কলঙ্ক পর্ব-০১

0
10302

#কলঙ্ক
#১ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক

গত দু মাস পর পর পিরিয়ড মিস্ করার পরই আমার সন্দেহ হলো।এরপর যখন খাওয়ায় অরুচি আর বমি শুরু হলো তখন বুঝতে আর বাকি রইল না যে কী ঘটতে যাচ্ছে। তবুও ফার্মেসি থেকে প্রেগন্যান্সি কীট এনে টেস্ট করলাম।কী সর্বনাশের কথা!যা ভেবেছি ঠিক তাই।কনসিভ করে ফেলেছি আমি!
এখন কী হবে আমার? বাসার কেউ জানে না আমার আর আমানের বিয়ের ব্যাপারে।গোপনে বিয়ে করেছি আমরা। শুধুমাত্র আমানের কাজিন (আমার বেস্ট ফ্রেন্ড)নিতু জানে বিষয়টা।ও নিজে সাক্ষীও ছিল আমাদের বিয়ের। আমানকে এই মুহূর্তে জানানো যাবে না।ওর বিসিএস পরীক্ষা।প্রিলিতে উত্তীর্ণ হয়েছে। কদিন পর রিটেন।আমান বলে রেখেছে কোন ভাবেই যেন ওকে ডিস্টার্ব করা না হয়। আমিও ডিস্টার্ব করতে চাই না কিছুতেই।কারণ এবার ওর বিসিএস টা হয়ে গেলেই সে বাসায় আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা জানাবে বলেছে। তখন আর তার পরিবার তাকে বাঁধা দিতে পারবে না।

আড়াই মাস আগে আমাদের দেখা হয়েছিল।আমরা তখন একসাথে ছিলাম ওর এক বন্ধুর বাসায়।সেদিনই সে এসব বলেছিল। বলেছিল,’তূর্ণা, তুমি কী চাও না আমাদের সম্পর্কটা দ্রুত সবাই মেনে নিক?’
আমি বললাম,’চাইবো না কেন?আমি তো চাই আজকেই যদি সবাই মেনে নিতো!’
আমান মৃদু হেসে তখন বললো,’অত সহজে কেউ মেনে নেবে না। আমার বাবা মাকে তো চেনো না।মেরে টেং গুঁড়ো করে দেবে।তেজ্য করে ছাড়বে একেবারে আমায়।’
‘তবে কী কোনদিনই আমরা আমাদের বিয়ের ব্যাপারে জানাতে পারবো না কাউকে?’
আমান আমায় তার কাছে টেনে বললো,’এই ব্যবস্থাইতো করছি জান। রাতদিন খাটা খাটুনি করছি। এবার প্রিলিতে টিকে গেছি। কদিন পর রিটেন। তুমি যদি দোয়া করো আর হেল্প করো তবে এসব রিটেন ফিটেনে টিকা কোন ব্যপার না!’
আমি ওর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
আমান এবার বললো,’আমায় সাহায্য করবে না তুমি?’
‘করবো। একশো বার করবো।তুমি আমার জন্য অতকিছু করছো আর আমি একটু সাহায্য করতে পারবো না তোমায়!’
‘হ্যা বেশি কিছু করতে হবে না। শুধু আমাদের যোগাযোগ বন্ধ থাকবে।আসলে তোমার সাথে কথা বললে আমার মন সব সময় তোমার কাছেই পড়ে থাকবে। তখন আর পড়াশোনায় মন বসাতে পারবো না!’
আমি হেসে বললাম,’এই কথা। কোন ব্যপার না। তোমার জন্য আমি এরচেয়ে বেশি ত্যাগও স্বীকার করতে পারি!’
আমান তখন আমায় কাছে টেনে নিলো।আর কপালে, চিবুকে চুমু খেতে খেতে বললো,’আমি জানি তুমি পারবে। এই জন্যই তোমায় ভালোবেসেছি। ভালোবেসে বিয়ে করেছি। আমার আপন মানুষ করেছি!’
কিন্তু এই মুহূর্তে আমার ভয় করছে।এতো বড়ো একটা ঘটনা ঘটে গেছে আর এই খবরটা ওকে না জানিয়ে পরে তো আবার বিপদে পড়বো না!
এর ভালো সমাধান দিতে পারবে নিতু।নিতুর সাথে কথা বললেই হবে।ও নিজেই তখন আমানের সাথে কথা বলবে। আমানকে বিষয়টা জানিয়ে রাখবে।জানানোর প্রয়োজন অনুভব না করলে জানাবে না!
সেদিন রাতেই আমি নিতুর নম্বরে ফোন করলাম।নিতুকে বললাম,’নিতু,তোর সাথে জরুরি কিছু কথা আছে।তুই কাল সকালেই আমার হোস্টেলে আয়।’
নিতু বললো,’আমার একটু সমস্যা আছে।আমি পড়শুদিন তোর ওখানে আসবো।’
নিতু পড়শুদিনও এলো না।এলো আরো সপ্তাহ খানেক পরে।সে এসে বললো পরিবারের অনেক ঝামেলা ছিলো এই জন্য আসতে পারেনি।
আমি বললাম সমস্যা নাই। তারপর শুরু করলাম আসল কথা।
নিতু কে ডেকে নিরালায় নিয়ে বললাম,’নিতু,একটা সর্বনাশ তো হয়ে গেছে!’
নিতু বললো,’কী হয়েছে?’
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,’আমি মা হতে যাচ্ছি!’
নিতু ফিক করে হেসে উঠলো। তারপর আমার মাথায় চাটি মেরে বললো,’সিরিয়াসলি?’
আমি বললাম,’তো কী?তোর সাথে আমি ফান করছি!’
‘আমান জানে এসব?’
নিতু মুখ শুকনো করে কথাটা বললো।
আমি বললাম,’না। ওকে তো জানানো নিষেধ।ওর উপর এমনিতেই প্রেশার। পড়াশোনা। পরীক্ষা।কত টেনশন!’
নিতু আবার হেসে উঠলো। তারপর বললো,’ভালো করেছিস।না জানানোই ভালো। পরীক্ষা দিয়ে ক্যাডার হয়ে রেজাল্ট শুনাতে এসে দেখবে বউ বাচ্চা কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।’
নিতু আবার হাসতে লাগলো।
আমি বললাম,’নিতু,তুই কী মনে করিস আমানকে এই বিষয়ে কিছু জানানো উচিৎ?’
নিতু শুকনো গলায় বললো,’এটা তুই ভেবে দেখ।কারণ ওর ভালো ফলাফলের উপর তোদের ভবিষ্যত নির্ভর করছে। তবুও তুই যদি চাস জানাতে তবে সমস্যা নাই। আমিও জানাতে পারি!’
আমি তখন বললাম,’না না। তবে আর এসব জানানোর প্রয়োজন নাই।সময় হলে এমনিই জেনে নিবে।’
নিতু আমার একটা হাত ধরে তখন আমার দিকে তাকালো। তারপর বললো,’তুই আসলেই লক্ষ্মী মেয়ে। লক্ষ্মী মেয়েরা সব সময় স্বামীদের মঙ্গল কামনা করে!’
তারপর বিকেল বেলা নিতু চলে যাওয়ার আগে আমায় সান্তনা দিয়ে গেল।বললো,’তুই টেনশন করিস না। অবশ্য একটা ভয় আছে। কনসিভ যেহেতু করেছিস পেটের ভেতর বাচ্চা বড় হবে।আর বিয়ের ব্যাপারে যেহেতু তোর পরিবার কিংবা আমি ছাড়া আর কোন বন্ধু বান্ধব কিছু জানে না এই জন্য তোকে একটু লুকিয়ে থাকতে হবে। সমস্যা নাই।আমি বাসার ব্যবস্থা করে দিবো।’
নিতু এই কথা বলে সেদিন চলে গেল। কিন্তু এরপর থেকে আর তার সাথে কোন ভাবেই যোগাযোগ করা গেলো না।সময় যাচ্ছে। আমার পেট বড় হয়ে উঠছে। এবার তো মহা বিপদে পড়েছি। মানুষ ইদানিং কেমন করে যেন আমার দিকে তাকাচ্ছে!না এখনও কেউ সরাসরি প্রশ্ন তুলেনি। কিন্তু তুলতে কতক্ষন! তাছাড়া বাড়িতেও কেউ জানে না। এবার যদি জেনে যায়!
আমার লুকোনো প্রয়োজন।নিতু বলেছিলো ও নিজে সবকিছু ব্যবস্থা করে দিবে। এখন তো তার নাগালও পাওয়া যাচ্ছে না। মোবাইল ফোনের সুইচও বন্ধ!
এখন আমার টেনশন হচ্ছে। ভীষণ রকম টেনশন।কী হবে আমার।এই বিপদ থেকে আমি উদ্ধার পাবো কী করে?

গতকাল দুপুর বেলা হঠাৎ করে আমার পাশের রুমের এক মেয়ে বললো,’এই শোন,তোর কী বিয়ে টিয়ে হয়ে গেছে নাকি?’
আমি শুকনো হাসি হেসে বললাম,’এমন মনে হলো কেন তোর?’
সে হেসে বললো,’তোকে না প্রেগন্যান্ট মেয়েদের মতো লাগছে!’
কথাটা বলে হাসতে হাসতে সে তার রুমের ভেতর ঢুকে গেল।
এবার তো আরও ভয়ংকর অবস্থার মধ্যে পড়েছি আমি।এই কথাটা একজন থেকে অন্যজনে ছড়াতে সময় লাগবে না।সময় লাগবে না দুশ্চরিত্রা উপাধি নিয়ে হোস্টেল থেকে বহিষ্কার হতেও!বাবা মার কাছ থেকে তো চিরদিনের জন্য তজ্য হতে হবেই!’
এবার আমি কোন উপায় না দেখেই আমানকে ফোন করলাম। পরপর দশবার ফোন করার পরেও সে ফোন রিসিভ করলো না। এগারো বারের সময় একজন বয়স্ক মহিলা ফোন রিসিভ করলো।আমি ভয় পেয়ে কেটে দিলাম।এর খানিক পর আবার ফোন দিলে ঠিক আগের মহিলাই ফোন রিসিভ করলো। আমি ভয় পেয়ে আবার ফোন কেটে দিলাম। তারপর আবার দিলে ঠিক একই মহিলা রিসিভ করলো।আমি এবার উপায়হীন হয়েই বললাম,’আন্টি,আমান আছে এখানে?’
মহিলা খসখসে গলায় বললো,’তুমি কে? আমানের কাছে কী প্রয়োজন?’
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,’আন্টি,আমি আমানের বন্ধু।ওর সাথে পড়ি। আমাদের তো বিসিএস পরীক্ষা। ও আমার নোটটা নিয়েছিল আর কি!ওর কাছ থেকে এটা ফেরত নিতে চেয়েছিলাম। এই জন্যই ওকে প্রয়োজন!’
ওই মহিলা তখন ওপাশ থেকে রাগমাখা গলায় বললো,’ফালতু কথা বলার আর জায়গা পাওনা মেয়ে। আমার আমান আজ থেকে তিনমাস আগে আমেরিকা চলে গেছে।আর তুমি বলছো তোমরা একসাথে বিসিএস দিবে। তোমার কাছ থেকে সে নোট ধার নিয়েছে!’
ওপাশ থেকে মহিলার মুখ থেকে এই কথাটা শোনার পর আমার মাথা প্রচন্ড রকম ঘুরতে লাগলো।সারা শরীর জুড়ে কেমন মর ঘাম দিয়ে উঠলো। এবং তৎক্ষণাত আমার বমি হলো।বমির পর আমি এলিয়ে পড়লাম বিছানায়। আমার পাশের রুমের এক মেয়ে সঙ্গে সঙ্গে আমায় হসপিটালে নিয়ে গেল।বাবা মাকেও সে ফোন করেছে।বাবা মা হসপিটালে আসছে।ডাক্তার আমায় দেখছে। টেস্ট দিয়েছে।আমি জানি একটু পর ডাক্তার কী বলবে। কিন্তু ভয় পাচ্ছি বাবা মার কথা ভেবে। তারা এসে যখন জানবে শহরে পড়াশোনা করতে এসে তাদের আদরের একমাত্র মেয়ে এখন প্রেগন্যান্ট হয়ে বসে আছে তখন কী অবস্থা হবে তাদের? কিংবা আমার সাথেই তাদের আচরণ কিরকম হবে? হোস্টেলের সব কজন যখন বিষয়টা জানবে তখন?

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে