Tuesday, August 12, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1559



আগন্তুক পর্ব-০৮

0

আগন্তুক
– সাবিহা বিনতে রইস

পর্ব – ৮

গাড়িটা চলছিলো লাল মাটির মেঠো পথ ডিঙিয়ে। বৃষ্টি ভেজা গ্রামীণ পথের এখানে ওখানে পানি জমেছে। দুপাশে সুউচ্চ গগনচূড়া, শাল, জারুল, শিমুল গাছের মহা অরণ্য। কিছু দূর পর পর দু একটা করে কৃষ্ণচূড়া গাছও আছে। গাছগুলোতে ফুল নেই। বর্ষার মৌসুমে এইসব গাছে ফুল থাকার কোন কথাও নেই। কেবল লকলকে পাতা, হাওয়ায় তোড়ে দুলছে। সবুজ, স্নিগ্ধ সবুজ। চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছিলো তনিমার।

– শোনো, সামনে আর পথ নেই, এগুনো যাবে না গাড়ি নিয়ে। নামতে হবে

– এক সাইডে গাড়ি দাড় করাও, নেমে পড়ছি।
– হাঁটতে পারবে এই রাস্তা দিয়ে?
অন্তু ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করলো তনিমাকে।
– বেশ পারব। আর না পারলে তুমি তো আছই, কোলে করে পৌছে দিবে।

তনিমার কথা শুনে শিষ দিয়ে উঠলো অন্তু। হেসে বললো,

– ম্যাডাম আজ খুব খোশমেজাজে আছে বুঝতে পারছি।

গাড়ির দরজা খুলে সন্তর্পণে কাঁদাজল এড়িয়ে পা রাখলো তনিমা। তৎক্ষনাৎ ভেজা মাটির সেঁদো গন্ধ এসে লেগেছে নাকে। সাথে নাম না জানা মৃদু ফুলের ঘ্রাণ। তনিমা এগিয়ে এলো। অন্তুও ততক্ষণে নেমে পড়েছে গাড়ি থেকে। সে এসেই তনিমার হাত ধরলো, তারপর এগিয়ে গেল খানিকটা। তনিমাও তার হাত ধরে এগুলো ধীর পায়ে। অন্তুর সাথে তার পরিচয় মাস সাতেক আগে। পরিচয় থেকে একটু একটু প্রণয়। অন্তু পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছে। তনিমা মাসখানেক আগে বাড়িতে অন্তর বিষয়ে জানিয়েছে। অন্তুও তার পরিবারে বলেছে তনিমার কথা। দুই পরিবারের প্রাথমিক সম্মতিতে এগুচ্ছে বিয়ের আলোচনা। তবে এখন করোনা মহামারীর ভয়ে বিয়েও আপাতত স্থগিত।

– এই, কি সুন্দর একটা ঘ্রাণ, পাচ্ছো? কিসের বলো তো? লেবু ফুল নাকি?

তনিমার কথাশুনে অন্তু পেছনে ঘুরে তাকালো। তারপর নিজের নাকের দিকে নির্দেশ করে বললো,

– ঘ্রাণ নিয়ে মরব নাকি? এই বাতাসে যে ভাইরাস নেই, কে বলতে পারে? তোমাকে কতবার বললাম মাস্ক পরে নাও, শুনলে না তো।

– এই বাতাসে করোনা থাকবে না। এটা স্পর্শের মাধ্যমে ছড়ায়।

– সাবধান থাকলে ক্ষতি কি?

তনিমা শ্বাস ছাড়ল। সে ভুলেই গিয়েছিলো অন্তু মাস্কে নাক ঢেকে রেখেছে। সত্যিই তো চারিদিকে যা ভাইরাসের ভয়! সতর্ক না থেকে উপায় কি! এই মধ্যে তো বাসা থেকে বের হওয়ায় উচিৎ নয়। তিন মাস পেরিয়ে গেছে। তবুও করোনা থেকে রেহাই নেই। মানুষ অবশ্য এত কিছু মানছে না। অনুষ্ঠান, আয়োজনের শেষ নেই তাদের৷ এই তো সেদিন মিলনায়তনে হয়ে গেল সেরার সেরা লেখক এওয়ার্ড। এত মানা করছে এখন ভিড় না করার, শুনছে কে? অবশ্য এবছর অনুষ্টানে লোক সংখ্যা ছিলো নগন্য। প্রায় সবাই টিভিতে বসেই অনুষ্ঠান উপভোগ করেছে। তনিমা নিজেও। গত দুই বছরই সে লাবণ্যর সাথে নিজে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেছে। এইবার কি থেকে যে কি হয়ে গেল! লাবণ্য লেখালেখি বন্ধ করে দিয়েছে। শুধু লেখালেখি কেন, কোন কিছুই সে করছে না আর। বোঝা যায়, একদম স্বাভাবিক নেই সে। দিন রাত একটা ঘরে বন্দি হয়ে পড়ে থাকে, মাঝে মাঝেই বুক ফাটানো চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠে, কখনো অদ্ভুত ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। তনিমার বিশ্বাস হয় না এটাই তার সেই লাবণ্য। কতগুলো বছর পাশাপাশি কাটিয়েছে তারা। তবে লাবণ্যর থেকেও বেশি মায়া লাগে তার চয়নকে দেখে। মানুষটা ভিষণ ভেঙে পড়েছে। তনিমার সাথে শেষ যেদিন দেখা হলো, সেদিন দেখলো চোখের নিচে কালি, মুখটা শুকনো৷ চকিতে তনিমার মনে পড়ে গেল সেই হ্যান্ডসাম চয়নের কথা। কাউকে কোনদিন বলতে পারেনি, একসময় লাবণ্যর সাথে সাথে সেও চয়নের প্রেমে পড়েছিলো। প্রিয় বান্ধবীর ফিয়ন্সের প্রেমে পড়া নিশ্চয় সভ্য কোন ব্যাপার নয়! তাই মনের দুর্ণিবার প্রেম আর ভালোবাসাকে চাপা দিয়ে তাদের শুভ কামনা জানিয়েছিলো সে। নিজেও সব ভুলে নতুন করে জীবন শুরু করতে চলেছে। কিন্তু তবুও কেন যেন চয়নকে খারাপ থাকতে দেখলে তার বুকের ভেতর ঝড় ওঠে। সেদিনের চয়নের মিইয়ে পড়া মুখটা দেখে তার মনে হয়েছিলো লাবণ্যর পাশে এবার দাঁড়ানো দরকার। চয়নকে ভালো দেখতে চাইলে, লাবণ্যকে সুস্থ করতে হবে। আর এমনিতেও লাবণ্যর বিষয়টি নিয়ে প্রথম থেকেই প্রচণ্ড সন্দেহ ছিলো তনিমার। একটা অশরীরির এত ক্ষমতা, যে সুস্থ সুন্দর একটা জীবনকে নিমিষেই শেষ করে দিলো? তবে তাকে দেখতে হবে বিষয়টা, এই ভেবেই অন্তুকে নিয়ে তার বেরিয়ে পড়া। গাড়িতে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের লোক দেখলে ঝামেলায় পড়ার সুযোগ কম ভেবে, তাকে প্রস্তাব দিয়েছিলো তনিমা৷ অন্তুও রাজি হয়েছে তনিমার সাথে সময় কাটানোর লোভে।

– অবশেষে পৌছালাম তোমার অতি আকাঙ্ক্ষার শ্বেত মহলে। দারুণ, তাইনা?

হঠাৎ অন্তুর কথায় ঘোর ভাঙলো তনিমার৷ নিজের মনে ভাবতে ভাবতে গন্তব্যে পৌছে গেছে খেয়ালই করেনি সে। সামনে বড় গেট পেরিয়ে উঁকি দিচ্ছে তাজমহলের মতো ধবধবে দারুণ সুন্দর এক শ্বেত মহল৷

– আসো, ভেতরে যাই।

অন্তু যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই হাত টেনে ধরেছে তনিমা।

– এই, আমরা ঠিক জায়গায় এলাম? এটায় শ্বেত মহল?

অন্তু ভ্রু কুচকালো।

– এটা ছাড়া কোনটা হবে? তুমি যা বর্ননা দিয়েছিলে তার সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে। আর এই গ্রামের থানার দারোগাকে ফোন দিয়ে আমি ঠিকানা জেনে নিয়েছিলাম। তিনি নিজে বলেছেন, এই বাড়িতে কিছুদিন আগে শহর থেকে আসা দুই নারী আত্মহত্যা করেছে।

তনিমা তখনও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এতক্ষণ অন্তু তার হাত ধরে রেখেছিলো। তনিমা এবার হাত ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল মহলটির দিকে৷ সামনে বিশাল লোহার গেটে তালা ঝুলছে। সে ওদিকে না তাকিয়ে ডান পাশে ঘুরলো, যেখানে শ্বেত পাথরের শেওলাধরা ফলকের উপরে লেখা আছে “নয়নতারা”। সাথে ১২০৮ বঙ্গাব্দ। তার মানে প্রায় ২১৮ বছর আগে তৈরি।
তনিমা নিজের মনেই বলে উঠলো

– অসম্ভব। হতেই পারে না।

অন্তু অবাক হয়ে বললো,

– সমস্যা কি, তনি? কি হয়েছে?

তনিমা তাকালো অন্তুর দিকে। বললো,

– ফলকটা পড়ো, আর এই মহলটা দেখো। তারপর আমাকে বলো, কি বুঝলে!

অন্তু মিনিট তিনেক শ্বেত মহলের দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকলো। তারপর ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললো,

– ইন্টিলিজেন্ট। গোয়েন্দা কর্মকর্তার যোগ্য স্ত্রী বটে! কেউ লাবণ্যদের বোকা বানিয়েছে।

তনিমা এবার ভ্রু নাচালো, বললো

– কিংবা শুধু লাবণ্যকে।

( চলবে)

আগন্তুক পর্ব-০৭

0

আগন্তুক
– সাবিহা বিনতে রইস

#পর্ব – ৭

লাবণ্যকে কাঁপছে ঠিক মৃগীরোগীর মতো। কোনভাবেই তাকে ধরে রাখা যাচ্ছে না৷ মনে হচ্ছে যেন শরীরে ভর করেছে অন্য কিছু। এ ঠিক চেনা লাবণ্য নয়। এলোমেলো পিঠ ছড়ানো চুলের বেহাল দশা। চোখ টকটকে রক্ত জবা। গলা দিয়ে অদ্ভুত এক আওয়াজ বের হচ্ছে। দুজন নার্স শক্ত করে ধরে আছে তাকে। ডাক্তার ঘুমের ইঞ্জেকশন দেওয়ার প্রায় মিনিট দশেক পর আলগা হতে শুরু করলো তার হাতের কাঠিন্য। নার্স দুজন ছেড়ে দিতেই এলিয়ে পড়লো বিছানায়৷ এই দিনে গত দুই দিনে তিনবার এমন হলো। লাবণ্যর মা মেয়ের অবস্থা দেখে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছেন। তার বাবা স্তম্ভিত। চয়ন বাইরে বসে আছে। লাবণ্যর এমন অবস্থা সহ্য হচ্ছে না তার। সব কিছুর জন্য নিজেকে দায়ী মনে হচ্ছে। কেন যে নিয়ে গেল তাকে ওই বাড়িতে! ওখানে না নিয়ে গেলে কিচ্ছু হতো না। কি যে এক ভয়ঙ্কর বিপদে ফেসে গেল! নিজের হাত দুটো দিয়ে চোখ চাপা দিয়ে হাসপাতালের চেয়ারে হেলান দিলো সে৷ মল্লিকার লাশটা প্রথম লাবন্যই দেখেছিলো। চয়ন তখন ছাদে। ঘুমন্ত লাবণ্যকে ঘরে রেখে একটু সময় সময় কাটাতে এসেছিলো। অনিন্দিতার মৃত্যুর যক্কি সামলে রূপম তখন মৃত প্রায়। আর লাবণ্যকে ছেড়ে একা কোথাও যেতে পারছে না বলে থানা পুলিশ সব সামলাচ্ছে প্রত্যয়। মল্লিকা ব্যস্ত ভাইকে নিয়ে। ও বাড়ির বদ্ধ গুমোট আবহাওয়ায় হাপিয়ে উঠেছিলো চয়ন নিজেও। ছাদে ভরা দুপুরের রোদ্দুর সেদিন। তবুও ফাল্গুনী হাওয়া ছিলো। অজানা কিছু ফুলের ঘ্রাণ মাখানো সে বাতাসে কিছুক্ষণের জন্য যেন বুক ভরে শ্বাস নিতে পেরেছিলো সে। তখনই লাবণ্যর কানফাটানো চিৎকার। প্রথমে চয়ন বুঝে উঠতে পারেনি৷ তারপরই সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করেছে। ছাদ থেকে নেমে তিনতলায় পা দিতেই আরো অবাক৷ লাবণ্য পড়ে আছে একটা খোলা দরজার সামনে। তখনও চয়ন জানতো না তার জন্য কি অপেক্ষা করছে ওই ঘরের ভেতর। লাবণ্যকে ডাকাডাকি করতে করতেই চোখ গিয়েছিলো ঘরের ভেতর। সেই এক দৃশ্য, অনিন্দিতার মতো। মল্লিকা ঝুলছে কড়িকাঠ থেকে। পরনে বেনারসি। সেই শাড়িটাই কি, যেটা অনিন্দিতা পরেছিলো? চয়নের বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটানো শুরু করেছিলো। তারই ডাকাডাকিতে রান্নার লোক দুটি ছুটে আসে। খানিক পরে প্রত্যয়। উফ! কি একটা দিন গিয়েছিলো সেদিন। মল্লিকার লাশ দেখে প্রত্যয় সব ভুলে চড়াও হয়েছিলো লাবণ্যর উপর। তার এক কথা, মল্লিকা আত্মহত্যা করেনি৷ তাকে মেরেছে লাবণ্য৷ এখন লোকজন দেখে নিজেকে আড়াল করার জন্য অজ্ঞান হবার ভাব করছে! ভাগ্যিস চয়ন ছিলো, তা না হলে কি যে হত! নিজের বন্ধু এক নিমিষেই অচেনা হয়ে উঠেছিলো তার কাছে। থানার দারোগা যে এসেছিলো, তারও এক কথা! বারবার লাশ গুলো কেন শুধু লাবণ্যই আবিষ্কার করে? নাকি সে নিজেই কোন ভাবে এর থাকে জড়িত? কপাল ভালো যে মল্লিকার পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে সুইসাইড এসেছে৷ তা না হলে লাবণ্যকে হয়ত বাঁচানো যেত না পুলিশের হাত থেকে৷ চিন্তাগুলো আসার পর নিজের উপর নিজেই বিরক্ত হলো সে। খুব বেশি স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন! অনিন্দিতা আর মল্লিকা, জলজ্যান্ত দুটি মেয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে হারিয়ে গেছে চোখের সামনে থেকে, আর সে কিনা শুধু নিজেদের কথা ভাবছে!!

– চয়ন ভাই

ডাক শুনে চয়ন চোখ থেকে হাত সরালো। তাকালো সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে। লম্বা, পাতলা, ছিপছিপে শ্যাম বর্ণের মেয়েটির নাম তনিমা। লাবণ্যর বেস্ট ফ্রেন্ড। সেই স্কুল থেকে দুজনের বন্ধুত্বের সূত্রপাত। আজ এত বছর পরে এসেও অটুট বন্ধন তাদের। তনিমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো চয়ন৷ এগিয়ে এলো তার দিকে৷ মেয়েটির চোখ ভর্তি জিজ্ঞাসা। চয়নই প্রথম কথা বললো,

– দেখলে ওকে? কি থেকে কি যে হয়ে গেল! কিছুই বুঝতে পারলাম না।

তনিমা শুনলো। কথা বললো না কোন। সে এখনো তাকিয়েই আছে চয়নের দিকে। এক দৃষ্টিতে। কি যে দেখছে! ভিষণ অস্বস্তি লাগছিলো তার। ঠিক এমন অবস্থায় এই ধরনের পুরোনো স্মৃতি আওড়ানো উচিৎ নয় জেনেও চয়নের একটা কথা মনে পড়ে গেল৷ তখন প্রথম প্রথম লাবন্যর সাথে চয়নের পরিচয় হয়েছে। প্রেমের সবে দু মাস। একদিন বৈকালিক আড্ডায় বসেছিলো লাবণ্য, চয়ন আর তনিমা। এমনই কোন বসন্ত বিকেল ছিলো সেদিন। ক্যাম্পাসের চায়ের দোকান ছিলো তাদের আড্ডার কেন্দ্রস্থল। কথার ফাঁকে চায়ের অর্ডার দিতে লাবণ্য উঠে যেতেই হঠাৎ তনিমা প্রশ্ন করে বসল,

– আচ্ছা চয়ন ভাই, প্রেম করছেন ঠিক আছে, কিন্তু বিয়ের ব্যাপারে কিছু ভাবছেন না?

চয়ন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

– ভাবছি তো অনেক কিছুই৷ কিন্তু লাবণ্যর বাবা মা রাজি না হলে?

সাথে সাথে তনিমা চপল কণ্ঠে উত্তর দিলো,

– না হলে আর কি, লাবণ্যর বদলে আমি আপনার গলায় মালা দিয়ে দিব। এমন হ্যান্ডসাম ছেলেকে আমার ফ্যামিলি অন্তত রিজেক্ট করবে না!

চয়ন চকিতে বিমূঢ়। খানিকটা যেন হকচকিয়েও গিয়েছিলো। লাবণ্য আসার সাথে সাথে তনিমা প্রসঙ্গ পাল্টেছে। কথা বলছে অন্য বিষয় নিয়ে। কিন্তু তার এই একটা বাক্য অনেকদিন পর্যন্ত কানে বাজতো চয়নের। লাবণ্য কিছু না বুঝলেও পরে অনেক কাজে, কথায় তনিমা চয়নের প্রতি তার দূর্বলতা দেখিয়েছিলো। সে অবশ্য পাত্তা দেয়নি কখনো। আজ হঠাৎ তনিমার চাহনি দেখে পুরোনো অনুভূতিটি আবার জেগে উঠছিলো তার। তনিমা তার হাত দিয়ে চয়নের হাত ছুঁয়ে দিলো,

– এত চিন্তার কিছু নেই চয়ন ভাই! নিশ্চয় লাবণ্য সুস্থ হয়ে যাবে! ভেতরে আন্টি আংকেল আছেন। আসুন, একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়াই।

চয়ন মাথা ঝাঁকালো। তার নিজেও ভালো লাগছে না হাসপাতালের এই অবস্থা। বড়সড় আধুনিক হাসপাতালের পাঁচতলায় বিশাল খোলা বারান্দা। পুরোটা জুড়ে ফুলের বাগান। দূরে দেখা যাচ্ছে হাইওয়ে। ফাঁকা রাস্তা। মহামারীর ভয়ে লোকজন বাইরে বের হওয়া ছেড়ে দিয়েছে। সব সময় রাস্তায় টহল দিচ্ছে পুলিশ আর সেনাবাহিনীর লোকজন। দূরে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা রাস্তায় ল্যাম্পপোস্ট গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চয়ন বললো,

– সবটা আমার দোষ। আমার কারণেই এমন হলো৷ আমি কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না তনিমা।

– চয়ন ভাই, সামলান নিজেকে৷ ঘটনাটা কি ঘটেছে আমাকে বলুন তো৷ আর আপনি কেন নিজেকে দায়ী ভাবছেন? এখানে আপনার কি করার আছে?

– কারণ ওই বাড়িতে আমি ওকে নিয়ে গিয়েছিলাম! ওখানে না গেলে কিচ্ছু হতো না।

– চয়ন ভাই, আমি জানি আপনি ওখানে যেতে চাননি৷ পুরোনো বাড়ির প্রতি লাবন্যর সময়ই একটা ফ্যাসিনেশন কাজ করে। ও যে জোর করে আপনাকে নিয়ে ওই বাড়িতে গিয়েছিলো তা আমার জানা। ওই বাড়িতে আপনারা যেদিন গেলেন, তার আগের রাতে লাবণ্যর সাথে কথা হয়েছিলো আমার। সে যাই হোক, আরেকটা বিষয় হলো, বাড়ির কখনো কোন দোষ থাকে না।

– থাকে তনিমা! তুমি জানো, লাবণ্য আমাকে বলেছিলো, অনিন্দিতা মারা যাবার দিন ও কোন একজনকে দেখেছিলো ওই বাড়িতে৷ একটা মেয়েকে দেখেছিলো।

– এটা কি বিশ্বাসযোগ্য কোন কথা?

– হয়ত নয়৷ কিন্তু বিশ্বাস না করেও আমি কোন উপায় দেখছি না আর।

– দুটো মৃত্যুই কিন্তু আত্মহত্যা ছিলো, পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট নাকি তাই বলছে!

– এটাও কি বিশ্বাসযোগ্য? দুটো হাসিখুশি উচ্ছল মেয়ে বেড়াতে গিয়ে আত্মহত্যা করে বসলো?
একথা বলে নিজেই নিজের মুখ ঢাকলো চয়ন। মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে তার। সে গলা নামিয়ে বললো,

– আমি এ কথা জোর দিয়ে কিছু বলতেও চায় না। ব্যাপার যাই হোক না কেন, খুন নিয়ে প্রশ্ন উঠলে লাবন্য ফেসে যাবে। আমি কখনো চাই না তা হোক! তার থেকে বরং যা হয়েছে, হয়তো ভালোই হয়েছে। আমি শুধু চাই, লাবণ্য সুস্থ হয়ে উঠুক। স্বাভাবিক থাকুক।

——————————————————
তিন মাস পর

গত তিনধরে বর্ষা নেমেছে প্রকৃতিতে। দিন নেই, রাত নেই টাপুরটুপুর বর্ষাসংগীত বেজে চলেছে। এর মধ্যেই বিশাল এক আয়োজন। প্রতি বছরের মতো এবারও সেরার সেরা পুরস্কার নিয়ে চলে এসেছে দেশের সবচেয়ে বড় অনলাইন বইয়ের বাজার। গত দুবছর ধরে সেরার সেরা পুরস্কারে ছিলো একটিই নাম। আর তা হলো লাবণ্য রহমান। দুই বছরের চব্বিশ মাস, সবগুলো অনলাইন বুকশপে সবচেয়ে বেশি বিক্রিত বই ছিলো তারই। গতবছর গননা শুরুর পরও সে ছিলো সেরা অবস্থানে। তবে গত তিনমাসে সব উল্টেপাল্টে গেছে। সোস্যাল মিডিয়াতে হঠাৎ চাউর হয়েছে, লাবণ্য রহমানের বইয়ের পাঠকদের সাথে নাকি অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে। তার বইয়ের লেখা মৃত্যু গুলো নাকি কাকতালীয় ভাবে পাঠকদের জীবনে প্রবেশ করছে। অনেক পাঠক তার বই পড়ে, ঠিক বইয়ের চরিত্রের মতো ভাবে মারা যাচ্ছে। এই দেশে এইধরনের খবরের পাঠকের অভাব নেই। বাতাসের বেগে কথাটি ছড়িয়ে পড়েছে দেশ জুড়ে৷ অনেকেই জীবন বাঁচাতে বর্জন করছে তার বই। অবশ্য অদ্ভুত অলৌকিক এই খবরের নিন্দা জানিয়েছেন অনেকেই। যার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই বলে উড়িয়ে দিচ্ছে শিক্ষিত সমাজ। কিন্তু তারপরও লাবণ্য রহমানের বইয়ের বাজার হঠাৎ করেই পড়ে গেছে। অনেকেই বিক্রি করে দিচ্ছেন পছন্দের এই লেখকের বই। কেউ কেউ তো নিজের জীবন বাঁচাতে আগুনে ফেলে পুড়িয়ে ফেলেছে বইগুলো। বাধ্য হয়েই প্রকাশকরা তার বই বিক্রি একরকম গুটিয়েই ফেলেছে। তার ফেসবুক পেজটিতে রিপোর্ট করে বন্ধ করে দিয়েছে একদল উগ্রবাদী পাঠক। এই ঘটনাগুলোর পর লাবণ্য রহমানও অন্তরালে চলে গেছেন। জানা গেছে তিনি মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাই সেরার সেরা পুরস্কারের তালিকায় এবার তার নাম নেই। তাকে টপকে সেরার সেরা অবস্থানে এবার পাঠকের আরেক প্রিয় লেখকের নাম এসেছে। তিনি আগন্তুক।

( চলবে)

আগন্তুক পর্ব-০৬

0

#আগন্তুক
– সাবিহা বিনতে রইস

#পর্ব – ৬

দ্বিতীয় মৃত্যুটি ঘটে গেল অনিন্দিতা মারা যাওয়ার ঠিক দুদিন পর। তবে এবার ব্যতিক্রম সময়ের। বাইরে তখন মনোরম এক বসন্ত দুপুর। ঝুমঝুমে রোদ্দুর। লাবণ্য নিজের ঘরেই ছিলো, সেই শ্বেত পাথরের রাজবাড়িতে। গত দুইদিনে অনেক কিছু ঘটে গেছে। অনেক কিছু মানে, সত্যিই অনেক কিছু। ঠিক যেন একটা প্রলয় বয়ে গেছে। বিশ্ব জুড়ে থমথমে অবস্থা। করোনা ভাইরাস নামক এক প্রাণঘাতী যমদূত ঘুরে বেড়াচ্ছে বাইরে। তারা মানুষকে করেছে প্রকৃতি ছাড়া। সকলে চার দেয়ালের ভেতর বন্দি। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। সরকার কড়াকড়িভাবে ভাবে দেশে লক ডাউন করেছে। সকলের বাইরে যাওয়া বন্ধ। কোনভাবে বাইরে কাউকে দেখলেই শাস্তি। মৃত্যুর মিছিল যে এ দেশেও এড়ানো যাচ্ছে না কিছুতেই। লাবণ্য ভাবছিলো মৃত্যুটা এই ভাইরাসে হলে ভালোই হতো। মৃত্যু থেকে পালাতেই তো এখানে আসা। পরিবার ছেড়ে এত দূরে। একটু নিভৃতে সময় কাটাবে।বলে। কে জানতো এখানে ওঁত পেতে আছে ভয়ানক কিছু?

লাবণ্য চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করলো শেষ দুদিনে কি ঘটেছে। চয়ন থানায় খবর দিয়েছিলো। এই গ্রামের শুরুতেই থানা। বড় রাস্তার ঠিক নিচে। ওই থানা পেরিয়ে তারা গ্রামে ঢুকেছিলো। তারা এসে লাশ নিয়ে গিয়েছিলো। পোস্টমর্টেম শেষে ফেরত দিয়ে গেছে। পুরোটা স্বাভাবিক আত্মহত্যা, রিপোর্ট তাই বলছে। ঘর খুঁজে বিছানার তল থেকে একটা একটা চিরকুটও পাওয়া গেল৷ এলোমেলো কাটাকুটি পুরো কাগজ জুড়ে। তারই ভেতরে কয়েকটি লাইন।

তবু এ মৃতের গল্প; কোনো
নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই;
বিবাহিত জীবনের সাধ
কোথাও রাখেনি কোনো খাদ,
সময়ের উদ্বর্তনে উঠে এসে বধূ
মধু— আর মননের মধু
দিয়েছে জানিতে;
হাড়হাভাতের গ্রানি বেদনার শীতে
এ-জীবন কোনোদিন কেঁপে ওঠে নাই;
তাই
লাসকাটা ঘরে
চিৎ হ’য়ে শুয়ে আছে টেবিলের পরে।

কবিতার লাইনে নারী শব্দটি কেটে পুরুষ লেখা, বধূ কেটে স্বামী। থানার বড় বাবু রসিক মানুষ। গালের ফাঁকে একটা বড়সড় পান ঢুকিয়ে খানিক সময় চাবিয়ে নিয়ে রূপমের দিকে ফিরে বললেন,

– জীবনানন্দের ভক্ত ছিলেন নাকি আপনার ওয়াইফ? তা না হলে ঘুরতে এসে কেউ অকারণে সুইসাইড করতে পারে বলে জানা ছিলো না!

রূপম মুখে হাত চাপা দিয়ে কেঁদে উঠল
উঠলো। মল্লিকা জড়িয়ে ধরলো ভাইকে। সান্ত্বনা দিলো বারবার৷

প্রত্যয়ই জিজ্ঞাসা করলো,

– আপনারা কিভাবে এটাকে সুইসাইড বলেন, আমি তো বুঝতে পারছি না। বিছানার উপর ফুল গুলো খেয়াল করেছেন? কেউ যদি আত্মহত্যা করে, সে নিজের বিছানা সাজিয়ে তবে আত্মহত্যা করবে?

অফিসার এবার একটু গম্ভীর হলেন,

– আমি যা খেয়াল করার ভালো ভাবেই করেছি। এটাও দেখেছি, উনি সুইসাইডের আগে ঠিক নতুন কনের বেশে সেজেছিলেন। লাশটা ভুলে গেলেন এত তাড়াতাড়ি? বড্ড শৌখিন মৃত্যু!!

প্রত্যয় আর কিছু বললো না৷ ঘরের একদিকে সোফায় লাবণ্যকে জড়িয়ে ধরে বসেছিলো চয়ন৷ তারদিকে একবার তাকিয়ে অফিসার বেরিয়ে গেলেন। যাবার আগে বলে গেলেন,

– আপনারা কেউ এখান থেকে যাবেন না৷ যদিও এটা সুইসাইড কেস, তবুও সপ্তাহখানেক এবাড়িতেই থাকুন। বেশিরভাগই ঝামেলায় শুরু হয় তিনদিন পর। পোস্টমর্টেম হওয়ার পরও ঝামেলা হয়। আর দেশে এমনিতেই লক ডাউন৷ খামোখা ঝামেলায় পড়বেন৷ লাশ নিয়ে যেতেও সমস্যা হবে। এখানেই সৎকারের ব্যবস্থা করে দিন।

অনিচ্ছা সত্বেও লাবণ্যকে থেকে যেতে হলো এই বাড়িতে। সবাই প্রায় ধরে নিয়েছে মৃত্যুটা আসলেই সুইসাইড। শুধু লাবণ্য জানে এটা সুইসাইড না। অনিন্দিতার মৃত্যুর তৃতীয় দিন চয়নকে একান্তে পেয়ে লাবণ্য বললো,

– প্লিজ, এই বাড়ি থেকে চলো। এই বাড়িটা ভালো নয়। কোন একটা ঝামেলা আছে। আমি এখানে থাকতে চাই না।

চয়ন মাথায় হাত বুলিয়ে লাবণ্যকে শান্ত করার চেষ্টা করলো,

– আমি জানি তোমার ভালো লাগছে না! আমারই কি ভালো লাগছে? এসেছিলাম ছুটির সময়টা ভালোভাবে কাটাতে। কি থেকে যে কি হয়ে গেল!

– শোনো, তোমরা কেন বলছো, অনিন্দিতা ভাবী আত্মহত্যা করেছে? আমি জানি এটা আত্মহত্যা নয়। এ বাড়িতে সত্যি কেউ একজন আছে। নিশ্চিত আছে। তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করছো না৷ কেন করছো না বলো তো?

– লাবণ্য তোমার মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। তোমার একটু রেস্ট দরকার। তুমি একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো। আমি আছি তোমার পাশে।

– তুমিও আমাকে বিশ্বাস করবে না, তাইনা?

– আমি বুঝতে পারছি তোমার কথা। এই বিষয়ে আমরা পরে আলোচনা করব।

লাবণ্য শুয়ে পড়লো চয়নের গা ঘেষে। চয়ন তখন বিছানায় আধ শোয়া। কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলো জানে না লাবণ্য জানে না। যখন ঘুম ভাঙলো, তখনও দুপুর৷ ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে বাইরে। পাশে চয়ন নেই। লাবণ্যর মনে হলো কেউ যেন হাসছে। খিলখিলিয়ে। তারপরই মনে হলো কেউ একজন নুপুর পায়ে হাঁটছে। লাবণ্য ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। ডাকলো চয়নকে। না পেয়ে নেমে এলো বিছানা থেকে। মৃদু পায়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো৷ বাড়িটা আজ সুনশান, নিস্তব্ধ – নীরব। কোথায় গেল সব? দক্ষিনের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার জন্য পা বাড়ালো লাবণ্য। তার আগে হঠাৎ মনে হলো উত্তর দিকে সিঁড়িতে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। লাবণ্য ঘুরে দাঁড়ালো।

– কে ওখানে? কে?

উত্তর এলো না। কেবল ঝনমনে নূপুরের আওয়াজ কানে এলো। সেও ছুটলো ওদিকে। কেউ একজন সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে। তার টকটকে মেরুন রঙের পোশাক এক ঝলক দেখল লাবণ্য। ঠিক সেদিনের রাতের মতো পিছু নিলো সে। দৌড়ে ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো। তিনতলায় এসে থমকে গেছে। কেউ নেই এখানে। তিনতলার ঘরগুলো সব তালা বন্ধ থাকে। এর আগে একদিন ছাদে যাওয়ার পথে দেখেছিলো সে। মেঝেটাও অপরিষ্কার। ধুলো পড়া। সে কি তবে ভুল দেখলো? ফিরে যাবে নিচে? ফিরতে গিয়ে আবার থমকে দাড়ালো৷ কেউ একজন হেঁটে গেছে। ধুলোয় তার পায়ের ছাপ। ঠিক পায়ের ছাপ নয়। যেন পা ছেচড়ে গেছে। ছাপটা টানা দাগের মতো দেখাচ্ছে। লাবণ্য এগিয়ে গেল দুরুদুরু বুকে। কে আছে ওখানে? কাছে গিয়ে অবশ্য দেখলো দরজার তালা খোলা। কেবল ভেজানো আছে। ধাক্কা দিলো লাবণ্য। করকচ শব্দে খুলে গেল পুরানো দরজা। বিশাল এক জলসাঘর। ফাঁকা একদম। কোন আসবাব নেই। ঘরের ঠিক মাঝে, মেঝেতে দারুণ এক আলপনা। আলপনা জুড়ে কেউ ছড়িয়ে দিয়ে অজস্র নয়নতারা ফুল। ঠিক তার উপরে কড়িকাঠ থেকে ঝুলছে মল্লিকার লাশ। লাবণ্য গলা ফাটিয়ে একটা চিৎকার দিলো। তারপর জ্ঞান হারালো।

(চলবে)

আগন্তুক পর্ব-০৫

0

আগন্তুক
পর্ব – ৫

লাবণ্যর চিৎকার শুনে নিচে থেকে ছুটে এলো মল্লিকা আর প্রত্যয়। তার দৃশ্য অনুসরণ করে ঘরে তাকানো মাত্র মুখে হাত চাপা দিয়েছে সে৷ প্রত্যয়ের চোখ বিস্ফোরিত। ততক্ষণে কোমরে তোয়ালে পেচিয়ে চয়নও বেরিয়ে এসেছে। লাবণ্য আর দাঁড়াতে পারছিলো না। মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার আগ মুহুর্তে তাকে ধরলো চয়ন৷ প্রায় টেনে সরিয়ে নিয়ে এলো ঘরের দরজা থেকে। মল্লিকা ফুপিয়ে কেঁদে উঠেছে। বিড়বিড় করে বলে চলেছে, এটা কি হলো! কিভাবে হলো!
প্রত্যয় চট করে সামলে নিয়েছে নিজেকে। রূপমকে ফোন করা দরকার৷ ফোন অবশ্য দেওয়া লাগলো না৷ তার আগেই বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে রূপমকে ঢুকতে দেখা গেল। শিস দিতে দিতে মূল ফটক পেরিয়ে এগিয়ে এলো সে৷ প্রত্যয়কে রেলিঙের কাছে দাড়িয়ে থাকতে দেখে হাত নাড়লো৷ প্রত্যয় উত্তর করল না। আর আর কয়েকটা সেকেন্ড, তারপর অনিন্দিতাকে দেখে কি অবস্থা হবে তার ভাবতেই হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। রূপম ধীরে সুস্থে উপরে এলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,

– কি হয়েছে তোদের? সব দাঁড়িয়ে যে?

প্রত্যয় অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে হাত দিয়ে দেখালো ঘরের দিকে। ঘরের দরজায় তখনও মুখ ঢেকে বসে আছে মল্লিকা। রূপম এগিয়ে গেল,

– কি হয়েছে রে মল্লি…কথা শেষ হলো না। তার আগেই গগন বিদারী চিৎকার সকলের কানে পৌছেছে। রূপম ছুটে গেছে অনিন্দিতা কাছে। অনিন্দিতার পা দুটো নিজের কাঁধে নিয়ে হাউমাউ করে উঠেছে।

– এ কি সর্বনাশ হলো! কি ঘটে গেল এটা!! অনি! অনি! কি হয়েছে তোমার! অনি…
বলতে বলতে ঢলে পড়েছে৷ প্রত্যয় দৌড়ে এসে ধরলো রূপমকে৷ ছুটে এসেছে চয়নও। নাহ! জ্ঞান নেই। মূর্ছা গেছে রূপম। মল্লিকা ছুটে এলো পানির বোতল হাতে। মুখে পানি ছেটালো ছটাস ছটাস। মিনিট সাত- আট পরেই জ্ঞান ফিরলো রূপমের৷

বেলা এগারো বাজতে না বাজতেই ফাল্গুনের রোদ চড়া এখন। ফাল্গুন বোধহয় শেষ প্রায়। চৈত্র পড়েও যেতে পারে৷ হিসাব নেই লাবণ্যর৷ অনিন্দিতার লাশ নামানো হয়েছে৷ রূপম প্রায় অজ্ঞান। দুজনের প্রেমের বিয়ে ছিলো৷ বিয়ের আগে অনেক বছরের সম্পর্ক৷ ভালোবাসার মানুষের চলে যাওয়া মেনে নেওয়া কি এতই সহজ ব্যাপার? কখনো না। রূপমও এখনো কিছু বোঝার মতো অবস্থা নেই। ওর কথা মতো সব কিছু ঠিক ছিলো দুজনের। ভোরের আলো যখন কেবল ফুটতে শুরু করেছে, তখন উঠে রূপম বেরিয়েছিলো। এপাশে নাকি একটা বিল আছে। ভোর রাত থেকে জেলেরা মাছ ধরে। সকাল সকাল টাটকা মাছ নিয়ে আসা যাবে ভেবেই বেরিয়েছিলো। অনিন্দিতা তখনও গভীর ঘুমে৷ এর মধ্যে এটা কি হয়ে গেল, ভেবেই পাচ্ছে না কেউ। আরেকটা বিষয় চোখে পড়ার মতো। বিছানা জুড়ে অজস্র নয়নতারা ফুল। এত ফুল কে আনবে? আশেপাশে নয়নতারার বাগানও চোখে পড়েনি। চয়ন বলেছিলো পুলিশে খবর দিতে হবে৷ মৃত্যুটা অস্বাভাবিক। একসাথে মল্লিকা আর প্রত্যয় দুজনই বাঁধা দিয়েছে। এ বাড়িতে তারা ছাড়া আর কেউ আসেনি। কেউ নেইও সাথে। পুলিশ কি তাদের ছেড়ে দিবে? শেষে তো হাত কড়া পরবে তাদেরই হাতে। মল্লিকা আমতা আমতা করে বলেই ফেলেছে,

– তোমরা কি একটা বিষয় খেয়াল করেছো? ভাবীর মৃত্যুর সাথে অদ্ভুত ভাবে লাবণ্যর গল্পটা মিলে যায়। প্রায় সম্পূর্ণটায়।

– কোন গল্প?
চয়ন অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো।

– কেন? কাল রাতে অনিন্দিতা ভাবী বলেছিলো না, লাবণ্য একটা গল্প দিয়েছে ফেসবুকে? তোমরা কি ভাবছ জানি না, কিন্তু ওই গল্পের সাথে কিভাবে যেন ভাবীর মৃত্যুটা মিলে যাচ্ছে।

প্রত্যয় বললো,

– তাহলে কি এটা আত্মহত্যা? ভাবী গল্পটা থেকে কোনভাবে ইনফ্লুয়েন্স হয়ে আত্মহত্যা করেছে বলছো?

– আত্মহত্যা ছাড়া কি হবে? আমরা নিশ্চয় কেউ ভাবীকে খুন করব না?

চয়ন ঠোঁটের নিচটা কামড়ে ধরে আছে অনেকক্ষণ। ভাবছে কিছু৷ অনেকটা আনমনেই বললো,

– এই বাড়ির ছাদটা উঁচুতে অনেক। টেবিল চেয়ার ছাড়া কড়িকাঠে হাত পাওয়া সহজ নয়। আর যদি টেবিল চেয়ারের সাহয্য নেয়, বিছানার উপর তো থাকবে কিছু। কোথায় সেগুলো?

– তাহলে কি বলছো চয়ন ভাই? আমরা কেউ খুন করেছি ভাবীকে? কথাটা তো তোমার বউয়ের উপরেই বর্তায় তাহলে। ওরই মাথায় ওই দৃশ্যটা ঘুরছে। কারণ গল্পের দৃশ্যপট তার সৃষ্টি…

লাবণ্য ঘর থেকে সব শুনতে পাচ্ছিলো। হাত পা কাঁপছে তার। সত্যিই কি এর সাথে অন্য কিছু জড়িত। এ বাড়িতে অন্য কেউ আছে? কাল রাতে কাকে দেখেছিলো সে? কেউ বিশ্বাস করুক কিংবা না করুক। সে তো জানে। কেউ একজন ছিলো এখানে। নিশ্চয় কেউ ছিলো।

– ও আল্লাহ গো!! এই মাইয়াডার কি হইসে? ওমা! এইটা বউ না? মইরা গেসে? আল্লাহ গো! কি ভাবে মরলো? তোমরা সব বইসা রইসো ক্যান? কিছু করছ না ক্যান?

হঠাৎ এমন গগনবিদারী কণ্ঠের হাহাকারে সচকিত হয়ে উঠলো সবাই। সবার হতমান অবস্থার মধ্যে কখন যেন কালকের সেই বৃদ্ধ মহিলাটি উপরে উঠে এসেছে। গত কয়েকদিন ধরে তিন বেলার রান্নার দায়িত্বে তিনিই আছেন। চয়ন এবার উঠে দাড়িয়েছে।

– আমার মনে হয় পুলিশকে খবর দেওয়া উচিত। সে আসার পর যা সবার তাই হবে। প্রত্যয় আর মল্লিকা এবার আর বাঁধা দেওয়ার সুযোগ পেল না। তার আগেই চয়ন নেমে গেছে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে। মল্লিকা অনেক কষ্টে বৃদ্ধাকে শান্ত করেছে। সে এখনো বিড়বিড় করে কেঁদে চলেছে। রূপম আগের মতোই ঠাঁয় বসে আছে। বৃদ্ধা কাঁদতে কাঁদতে লাবণ্যর কাছে এলেন। মাথায় হাত রাখলেন, তারপর বিড়বিড় করে বললেন,

– বলসিলাম কাইল রাতে, সে দেখা দিব। তাই বইলা এমনে দেখা দিবে ভাবি নাই৷

লাবণ্য চমকে ফিরে তাকালো বৃদ্ধার দিকে। বললো,

– কার কথা বলছেন?

বৃদ্ধা চোখ মুছে বললো,

– ক্যান, নয়নতারা!!

(চলবে)

আগন্তুক পর্ব-০৪

0

#আগন্তুক
– সাবিহা বিনতে রইস

পর্ব – ৪

দরজা খুলে দেখবে একবার বাইরে কে ঘুরছে? চয়নকে ডাকবে নাকি? লাবণ্য নিজেকে অভয় দিলো। এত ভয় পাওয়ার কি আছে? বাইরে তো আলো জ্বলছে। লাবণ্য নিজেই দেখতে পারে। গুনগুন শব্দ এগিয়ে যাচ্ছে, বারান্দা ধরে ঠিক সিঁড়ির দিকে। লাবণ্য নিঃশব্দে দরজা খুললো। জোর করে পা দুটো টেনে নিয়ে বাইরে দাঁড়ালো। বাইরেটা ফাঁকা। কেউ নেই। বসন্তের মৃদু বাতাস আর লেবু ফুলের গন্ধে চারিদিক আচ্ছন্ন হয়ে আছে। সে ধীরে ধীরে পা বাড়িয়ে রেলিঙের কাছে এলো৷ নিচের গাড়ী বারান্দা আজ আঁধার। ঘুমাতে যাবার আগে ওখানে আলো জ্বলছিল না? জ্বলছিল তো। স্পষ্ট মনে আছে তার। আশ্চর্য! তাহলে নেভালো কে? যাকগে, কাল সকালে চিন্তা করা যাবে। এখন তাহলে ঘরে ফেরা যাক। খামোখাই ভয় পাচ্ছিলো। কিচ্ছু নেই বাইরে। ঘরের দিকে পা বাড়াতে যাবে, তার আগে আবার থমকে দাঁড়ালো। কোথায় যেন ধাস্তাধস্তির শব্দ হচ্ছে। চাপা ফিসফিসানি। ডান দিকের ঘর গুলো থেকে আসছে। কে হতে পারে? অনিন্দিতা আর রূপম ভাই? নাকি প্রত্যয় আর মল্লিকা? একবার ডেকে দেখবে? তার আগেই আবার গোঙ্গানির শব্দে দৃষ্টি ফিরলো তার। ওই তো বারান্দা ধরে হেঁটে যাচ্ছে মেয়েটি৷ শরীরে ভারী, পাথরের কাজ করা পোশাক। মেরুন ওড়না মেঝে ছুঁয়েছে। ভারী ওড়নার অংশ টেনে নিয়ে সে এগিয়ে যাচ্ছে। খুব ধীরে।মনে হচ্ছে কোন এক ছন্দের তালে তালে সে পা ফেলছে। লাবণ্যর সারা শরীর শিরশির করে উঠল। এগিয়ে গেল এসে এক পা, দুপা করে। মেয়েটি থামছে না। কে মেয়েটি? এত রাতে এখানে কি করছে? মেয়েটি কি নয়নতারা, যার কথা আজ শুনেছিলো? ধ্যাত! কি সব ভাবছে! ওটা গল্প ছিলো। তার কি হ্যালুসিনেশন হচ্ছে? আসলে এইসব কিছুই সে দেখতে পাচ্ছে না? সব মিথ্যা, হতেই পারে, তাইনা?

মেয়েটি সিঁড়ির মুখে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। এগুচ্ছে না আর। লাবণ্য পা বাড়ালো। তাকে দেখতেই হবে মেয়েটি কে। তার আগেই কে যেন তার কাঁধ ছুয়েছে৷ লাবণ্য চমকে ফিরে তাকালো।

– লাবণ্য, এত রাতে তুমি এখানে কি করছ? আমার হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল৷ পাশ ফিরে দেখি তুমি নেই। আর তুমি কিনা এখানে?

– আমি তো এসেছিলাম….

লাবণ্যর কথা থেমে গেল। সামনেটা পুরোপুরি ফাঁকা৷ কেউ নেই৷

– চয়ন, এখানে একজন ছিলো।

– কে ছিলো? কাকে দেখেছো?

– মুখ দেখতে পাইনি৷ কিন্তু কেউ যেন, রাজকীয় পোশাকে ছিলো এখানে। হাঁটছিলো৷

– লাবণ্য, কি সব বলছো? তুমি ঠিক আছো? এখানে কেউ নেয়, দেখো…

চয়ন আর লাবণ্যর কথা শুনে মল্লিকা আর প্রত্যয়ও বেরিয়ে এসেছে দরজা খুলে।

– কি ব্যাপার চয়ন? কি হয়েছে?

– দেখ না, লাবণ্য বলছে এখানে নাকি কাকে দেখেছে।

প্রত্যয় অবাক হয়ে তাকালো।

– এখানে? এত রাতে কে থাকবে? আমরা তো কিছু টের পাইনি৷

– লাবণ্য, আমার মনে হয় তোমার ঘুম দরকার। যাও, তুমি রেস্ট নাও৷ আমরা সকালে শুনবো বাকি কথা।

লাবণ্য মাথা নাড়লো৷ চয়ন তার হাত ধরে ঘরের দিকে নিয়ে গেল। ঘরে ঢোকার আগে লাবণ্য খেয়াল করলো, গাড়ি বারান্দাটা এখন আর আগের মতো অন্ধকার নেই৷ সবগুলো আলো জ্বলছে ওখানে।

লাবণ্যকে বিছানায় শোয়ায় পর অনেকক্ষণ পর্যন্ত মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো চয়ন। লাবণ্য অল্প কিছুক্ষণ পরই ঘুমিয়ে পড়লো৷ তারপর যখন ঘুম ভাঙলো তখন সূর্য বেশ উত্তাপ ছড়াচ্ছে৷ লাবণ্য উঠে আড়মোড়া ভাঙলো। চয়ন পাশে নেই৷ বাথরুমে কল ছাড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। তার মানে চয়ন বাথরুমে আছে। লাবণ্য বাইরে বেরিয়ে এলো। দারুণ এক সকালে দাঁড়িয়ে রাতের সব কিছু কেমন যেন অর্থহীন মনে হচ্ছে। কেন যে ভয় পেয়েছিল সে! আর কি সব দেখেছিলো রাতের আঁধারে! সবটাই স্বপ্ন ছিলো
বোধহয়। লাবণ্য রেলিঙের কাছে সরে এলো। নিচে ফোয়ারার কাছে বসে প্রত্যয় আর মল্লিকা সেলফি তুলছে। তাকে দেখে দুজনই হাত নেড়ে গুড মর্নিং জানালো।
লাবণ্য জিজ্ঞাসা করলো,

– অনিন্দিতা ভাবী আর রূপম ভাই কই?

মল্লিকা উত্তর দিলো,

– ভাইয়া তো হাঁটতে গেছে। আর ভাবীকে দেখো, ঘরেই আছে বোধহয়৷

– এখনো ঘুমাচ্ছে?

– জানি না। ডেকে দেখো একবার।

লাবণ্য পা বাড়ালো অনিন্দিতাদের ঘরের দিকে৷ দরজাটা ভেজানো ছিলো। আলতো ঠেলা দিতেই খুলে গেল পুরোটা। সাথে সাথে লাবণ্য গলা চিড়ে তীক্ষ্ণ চিৎকার বেরিয়ে এলো। অনিন্দিতা ঝুলছে ঘরের কড়িকাঠ থেকে। পরনে মেরুন রঙের একটা বেনারসি। নিচে বিছানা জুড়ে ছড়ানো অজস্র সাদা আর বেগুনি রঙের নয়নতারা ফুল।

( চলবে)

আগন্তুক পর্ব-০৩

0

আগন্তুক
#পর্ব : ৩

পর পর দুটো দিন দারুণ আনন্দে কাটলো লাবণ্যর। রূপমরা বেশ ব্যবস্থা করেছে। খাওয়া দাওয়া থেকে কোন কিছুরই কমতি নেই। শুধু বাড়িটা অদ্ভুত রকমের নিশ্চুপ। আশেপাশে অন্যকোন বাড়ি নেই বলে, লোকজনও তেমন চোখে পড়ে না। গতকাল বিকেলে মল্লিকার সাথে ছাদে গিয়েছিলো সে। ছাদ থেকে দূরের শিরিষ গাছগুলো কেমন ঢেউখেলানো জলাভূমির মতো মনে হলো। সন্ধ্যে হতে না হতেই অজস্র পাখির কুহুতানে কানে তালা লাগার জোগাড় হয়। তারপর রাত ঘন হতে হতে, আবার সব নীরব! আজ বিকেলে কিছুক্ষণ মা বাবার সাথে ফোনে গল্প করলো লাবণ্য৷ চয়ন, রূপম আর প্রত্যয় উত্তরের দীঘিতে ছিপ ফেলে মাছ ধরতে বসেছে। অনিন্দিতা আর মল্লিকা নিজেদের ঘরে আছে। লাবণ্যরও কোন কাজ নেই৷ ফেসবুক খুলে বসতেই সে তার নতুন বইয়ের রিভিউ এসেছে দেখলো। বইমেলার পরে তার বইয়ের চতুর্থ মুদ্রণ এসেছে। চারিদিকে লাবণ্য রহমানের জয়জয়কার। থ্রিলার পাঠকদের মধ্যে তার বই নিয়ে কাড়াকাড়ি লেগে গেছে। বেশ কয়েকজন পাঠক তাকে নিয়ে চমৎকার পোস্ট দিয়েছে৷ স্তুতি গুলো মনে মেখে নিয়ে টপ চার্টে চোখ বুলিয়ে নিলো সে। দেশের সবচেয়ে সম্মানের পুরস্কারের মধ্যে একটি সেরার সেরা পুরস্কার। যেটি দেশের সবগুলো অনলাইন বুক শপ মিলে একত্রে দেয়। পুরস্কারটি দেওয়া হবে জুনমাসের মাঝামাঝিতে। ততদিন পর্যন্ত সবগুলো বুকশপ মিলে যে সেরার অবস্থানটা ধরে রাখতে পারবে, সেই পাবে সেরার সেরা এওয়ার্ড। এখন পর্যন্ত সেরার তালিকার শীর্ষে লাবণ্য। তিন মাস ধরে এই পজিশনে সে প্রায় অনড়৷ তার ঠিক ঘাড়ের উপর নিশ্বাস ফেলছে আগন্তুক নামক একজন। ইনিও থ্রিলার জগতে বিখ্যাত লেখক। তবে তার সাথে কখনো লাবণ্যর দেখা হয়নি৷ ভদ্রলোকের বইতে কোন ছবি থাকে না৷ থাকে না কোন লেখক পরিচিতি৷ বইমেলার সারামাসে একদিনও তিনি মেলায় যান না। তবুও তার দারুণ লেখায় বুদ হয়ে থাকে পাঠকেরা৷ হাতে গোনা কিছু সংখ্যার হিসেবে উনি লাবণ্যর পেছনে, অর্থাৎ ২য় র‍্যাঙ্কিং এ অবস্থান করছেন। লাবণ্য নিজেও এই ভদ্রলোকের বই পড়ে৷ সাইকোলজিক্যাল পটভূমিতে বেশ সিদ্ধহস্ত তার। অবশ্য লাবণ্য বিনোদনের উপকরণ হিসেবে তার বই পড়েনা, সে পড়ে তাকে ছাড়িয়ে কিভাবে অন্য কিছু লেখা যায় সে জন্য। একটা প্রতিযোগিতাও বলা যেতে পারে৷ অদেখা প্রতিযোগিতা আর কি! লাবণ্য খেয়াল করলো, কেন যেন আগন্তুক নামটা শুনলেই লেখককে ভদ্রলোক বলে মনে হয়। আচ্ছা, তার সাথে তো লাবণ্যর কখনো দেখা হয়নি, হতে পারে সে একজন ভদ্রমহিলা? হতেই পারে!

অনলাইন থেকে বেরিয়ে লাবণ্য লেখায় মন দিল৷ প্রথমদিন এখানে এসে রূপমের মুখে নয়নতারার গল্পটা শোনার পর থেকে গল্পের প্লট তার মাথায় ঘুরছে। নতুন লেখার জন্য পাঠকের আবদারও বাড়ছে। এই প্লটের কয়েকটা পর্ব পাঠকের জন্য ছেড়ে দেওয়া যায়! দেখা যাক, কোন দিকে মোড় নেয় পাঠকের চিন্তা। কী- বোর্ডের উপর দ্রুত আঙ্গুল ঘুরতে থাকে লাবণ্যর। লেখায় ভরে ওঠে পাতা। গল্পের নাম দেয় নয়নতারা। নয়নতারার চরিত্রটা একটু নিজের মতো করে রাঙিয়ে নেয় সে। মেয়েটা দেখতে অপূর্ব সুন্দরী। বিশাল এক রাজবাড়ির একমাত্র মালকিন সে৷ রাজবাড়িটা জীর্ণ-শীর্ণ৷ অনেকদিন যেখানে কারো পা পড়ে না। এই রাজবাড়িতে নয়নতারা থাকে কিভাবে? আহা! থাকতে পারবে না কেন? সে যে শরীরী কোন অবয়ব নয়। একদম অশরীরী৷ ঘটনা চক্রে সে বাড়িতে বেড়াতে আসে তিন জোড়া দম্পতি। রাতের মধ্য সময়। চৈত্রের পূর্ণিমায় চারিদিক ভেসে যাচ্ছে আলোয়। সেই তিন দম্পতির একজন শুনতে পেল কে যেন ডাকছে তাকে। কি এক অপার্থিব মোহ-মায়ায় সে পাশের সঙ্গিনীকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ধীর পায়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো সে। দেখল, রাজকীয় সাজ পোশাকে এক অনিন্দ্য সুন্দরী নারী এগিয়ে চলেছে। ছেলেটাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো পিছু নিলো তার। বেশ খানিকটা পথ যাবার পর হঠাৎ তীক্ষ্ণ চিৎকার। ছেলেটা পেছনে ফিরলো। নাহ! কেউ নেই। সাথে সাথে সামনে ফিরে দেখলো সে পথও ফাঁকা। ছেলেটির ভ্রম ভাঙলো। মনে পড়লো ঘরে তার সঙ্গিনীকে একা রেখে এসেছে। দ্রুত পায়ে ছুটলো ঘরের দিকে! তারপরই গলা ফাটানো চিৎকার দিলো সে। ঘরের ঠিক মাঝ বরাবর কড়িকাঠে ঝুলছে তার সঙ্গিনীর দেহ! ঘরময় ছড়ানো অজস্র গন্ধহীন বেগুনী আর সাদা ফুল। নয়নতারা।

– সুযোগ পাওয়া মাত্র ল্যাপটপ হাতে বসে গেছ?

চয়নের কথায় ঘোর ভাঙলো লাবণ্যর। লেখাটি টুক করে তার ফেসবুক পেজে পোস্ট করে দিয়ে কোলের উপর থেকে ল্যাপটপটি নামিয়ে রাখলো।

– কি করব? তোমরা তো আমাদের না নিয়েই লাপাত্তা! মল্লিকা আর অনিন্দিতা ভাবীও যে যার ঘরে। আমার একা একা কি করার থাকতে পারে?

– বুঝলাম! এবার নিচে এসো। দেখো, কি বিশাল দুটো মাছ ধরেছি।

লাবণ্য চয়নের সাথে নিচে নেমে এলো। আসলেই তারা বেশ বড়সড় দুটো মাছ ধরেছে। মল্লিকা, অনিন্দিতা, প্রত্যয়, রূপম প্রত্যেকে নিচে আছে৷ গ্রাম থেকে রান্নার নতুন দুজন লোকও নিয়ে এসেছে। এত বড় মাছ, একা একা কেটে রান্না করা চাট্টিখানি কথা নয়। মল্লিকা জিজ্ঞাসা করলো,

– লাবণ্য মাছ রাঁধতে জানো?

– মাছের ঝোল পারি। ওই চলার মতো আর কি!

– ঝোল বাদে অন্য কিছু?

প্রত্যয় সাথে সাথে বলে উঠেছে,

– অনিন্দিতা ভাবীর রান্নার হাত চমৎকার। আজ বরং ভাবীর হাতের রান্না খাই আমরা। আর তোমরা তো আছই হেল্প করার জন্য।

– তাই হবে। আমিই আজ খাওয়াবো। রুইমাছের কালিয়া, আর মুগ ডাল দিয়ে মুরিঘণ্ট চলবে?

– চলবে মানে? বেশ চলবে! তোমরা তাহলে শুরু করো। আমরা বরং একটু আড্ডা দিই ঘরে বসে।

চয়ন, রূপম, আর প্রত্যয় চলে যেতেই ওখান থেকে সরে এলো লাবণ্য। বিশাল ডাইনিং স্পেসের শেষ মাথায় রান্নাঘর। রান্নার জন্য বড় বড় মাটির চুলার জায়গা করা আছে। নতুন দুজন রান্নার লোক মাছ কাটতে বসে পড়েছে৷ লাবণ্যরা আসার পর যিনি কাজ কর্ম তদারকির দায়িত্বে আছেন, তিনিও এসে পড়েছেন। কিছু পেয়াজ, রসুন নিয়ে খোসা ছাড়াতে তার পাশে বসলো তারা তিনজন। মহিলাটি বেশ বয়স্ক। কম করে হলেও ৬৮-৬৯ এর কম নয়। মল্লিকা বললো,

– লাবণ্য, আমাদের জন্ম থেকেই উনাকে দেখছি৷ যখনই এ বাসায় বেড়াতে এসেছি, উনি চলে এসেছেন তখনই। উনার বাসা এই গ্রামেই৷ আগে উনার শাশুড়ি এই বাসায় কাজ করতেন।

লাবণ্য মাথা নাড়লো।

– তাই নাকি? তাহলে তো এই বাড়ি আপনারা অনেকদিন থেকে দেখছেন। এই বাড়ির গল্প বলুন শুনি। এই যে এত বড় বাড়ি খালি পড়ে থাকে সারাবছর? চোর ডাকাতের উপদ্রব হয়না?

– চোর ডাকাত!

হাসলো বৃদ্ধা।

– কই থেকা আসবো চোর? জানের ভয় আছে না? তামাম দিকে সবলাই যখন ঘুমায় যায়, তখন সে আসে। এই বাড়ির চারিদিকে ঘুরঘুর করে, গান গাহে। আর তার চোখে যদি কেউ পইড়া যায়, তার তো জীবনডা ওইখানেই শেষ!

লাবণ্য অবাক চোখে তাকালো মল্লিকা আর অনিন্দিতার দিকে। কি বলছেন উনি! কার কথা বলছেন। অনিন্দিতা অবশ্য লাবণ্যর চোখে চোখ।পড়তেই উঠে পড়লো। বলল,

– তোমরা গল্প শোনো, আমি চুলা রেডি করি।

লাবণ্য দ্বিধা নিয়ে তাকালো বৃদ্ধার দিকে। চোখ কুচকে বললো,

– ঠিক বুঝলাম না! কার কথা বলছেন আপনি?
বৃদ্ধা মাথা ঝাকালো। তারপর বললো,

– নয়নতারা গো! নয়নতারার কথা বলি। ওই যে সেই জনম দুখী মাইয়া। বিয়া হইলো, কিন্তুক ঘর করবার পারলো না৷ তার আগেই গলায় দড়ি দিয়া মরলো। সে ঘুরে এখানে। সারা রাত বেবাক সময় ঘুইরা বেড়ায়।

লাবণ্য অবিশ্বাস নিয়ে বললো,

– আপনি দেখেছেন কখনো তাকে?

বৃদ্ধা হাসলো।

– সে সবালাইকে দেখা দেয়না। কাউরে কাউরে দেয়। যারে তার পছন্দ অয়।

লাবণ্য এবার মল্লিকার দিকে ফিরে বললো,

– তুমি কখনো এই ধরনের কিছু দেখেছো?

– আরেহ, পাগল নাকি? আমি দেখলে কি আর এখানে আসি! আর আমরা আগে যতবার এসেছি, বিকেল নাগাদ আবার ফিরে গেছি। থাকিনি কখনো। যাক গে, বাদ দাও তো৷ সব বুজরুকি! এইসব আবার সত্যি হয় নাকি?

লাবণ্য সরে আসার সময় শুনতে পেল বৃদ্ধা বিড়বিড় করে বলল,

– থাইকো ক’টা দিন! নিজেরাই হেরে ঠিক দেখবার পাবা!

রাতের খাওয়াটা জম্পেশ হলো তাদের। সত্যিই অনিন্দিতার হাতের রান্না চমৎকার। প্লেট চেটেপুটে খেয়েও যেন স্বাদ মেটেনা। খাওয়া দাওয়া শেষে দোতলার বেলকনিতে বসলো গানের আসর৷ প্রত্যয় আর মল্লিকা দুজনই দারুণ সুন্দর নজরুলগীতি গায়। তাদের গান শুনতে শুনতে রাত গড়ালো অনেক৷ ঘড়ির কাটা বারোটা জানান দেওয়ার কিছু আগে আসর ভাঙলো তাদের। বিছানো মাদুর গুছিয়ে তুলতে তুলতে অনিন্দিতা বললো,

– এই লাবণ্য, ফেসবুকে নতুন গল্প দিয়েছো, তাইনা? এই বাড়ি নিয়ে? খুব সুন্দর হয়েছে। ওয়েটিং ফর নেক্সট পার্ট।

চয়ন বললো,

– ও আচ্ছা, লেখা পোস্ট করাও সারা! বলেছিলাম না, ওখানে এসেছে শুধু নিভৃতে নতুন উপন্যাসের প্লট নিয়ে ভাববে বলে!

মল্লিকা সাথে সাথে উত্তর দিলো,

– আচ্ছা, চয়ন ভাই লাবণ্যর লেখার উপরে আপনার এত কিসের রাগ বলুন তো? ও ভালো লেখে। লিখতে দেন! ও না লিখলে আমরা দারুণ গল্প গুলো পাবো কোথায়?

চয়ন আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ ঘরে ঢুকে গেল। সকলকে বিদায় জানিয়ে লাবণ্যও এসে ঢুকলো ঘরে। সে ততক্ষণে বিছনায় চিৎপাট। লাবণ্য এসে বিছানার এক পাশে হেলান দিয়ে বসলো। তার মনটা ভালো নেই। ইদানীং সে খেয়াল করে, চয়ন তার লেখালেখিটা স্বাভাবিক ভাবে নিতে চায় না। সবসময় তাকে লেখা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়। কিন্তু লেখা ছাড়া সে বাঁচবে কিভাবে? আর কেনই বা চয়ন এমন করছে? সে কি গত দুবছর থেকে লাবন্যকে দেখছে না? সব কিছু জেনে শুনেই তো প্রেমে পড়েছিলো তার। এইসব নানান কথা ভাবতে ভাবতে ঘুম এসে গিয়েছিলো তার। যখন ঘুম ভাঙলো, তখন রাত ক’টা বাজে জানে না লাবণ্য। দক্ষিণের বড় জানালা হাট করে খোলা৷ পাশে চয়ন এলোমেলো ভঙ্গিতে ঘুমাচ্ছে৷ চারিদিক অদ্ভুত নিঝুম। লাবণ্য নেমে এলো। জানালাটা বন্ধ করা দরকার। এদিকে মৃদু ঠান্ডা হাওয়া বইছে। আকাশে গোল চাঁদটা নিশ্চুপ আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে চারিদিকে। লাবণ্য জানালাটা বন্ধ করে দিলো৷ সরে আলো আবার বিছানার কাছে। তখনই প্রথম শব্দটা কানে এলো। কেউ যেন গোঙ্গাচ্ছে, নাকি গুনগুন করছে ধীর সরে। সাথে সরসর আওয়াজ। ঠিক পাথরের কাজ করা শাড়ি মেঝে ফেলে টেনে নিয়ে গেলে যেমন হয়। লাবণ্যর হাত পা শিরশির করে উঠলো। কিসের আওয়াজ ওটা? এত রাতে কে ঘুরছে বাইরে?
(চলবে)

আগন্তুক পর্ব-০২

0

#আগন্তুক
– সাবিহা বিনতে রইস
পর্ব : ২

– কি সমস্যা? কিছু হয়েছে? ছুটে এলে যে?

লাবণ্য মুখ তুলে তাকালো চয়নের দিকে। তার চোখে এখনো ভয় খেলছে। নিজেকে খানিকটা ধাতস্থ করে বললো,

– মনে হলো, কাকে যেন দেখলাম জানালার বাইরে, মানে কারো যেন শাড়ির একটা অংশ উড়ে গেল।

চয়ন এগিয়ে এসে জানালার বাইরে তাকালো৷ দারুণ মনোরম এক বসন্ত দুপুর খেলা করছে বাইরে। চয়ন লাবণ্যর কাঁধে হাত রাখলো৷ আস্বস্ত করে বললো,

– সবসময় এক হরর আর থ্রিলার লিখতে লিখতে তোমার এই অবস্থা! কতবার বলি, এই জনরা থেকে বেরিয়ে এসো৷ তুমি ভালো লেখ, যা লিখবে তাই জনপ্রিয়তা পাবে।

– জনপ্রিয়তা সব কিছু নাকি? আমি তো আমার মনের আনন্দে লিখি!

– তাহলে আর কি? এখন আতঙ্কে ভোগো! যাগ গে, দেখছো তো, আমরা দোতলায় আছি। এখানে কোন কার্নিশও নেই৷ এখানে কে দাড়িয়ে তোমাকে ভয় দেখাবে বলো তো?

লাবণ্য মাথা নাড়লো।

– হয়তো ভুলই দেখেছি৷

– হুম, তুমি যাও, ফ্রেশ হয়ে নাও৷ চোখেমুখে পানি দিয়ে একটু রেস্ট নাও।

লাবণ্য দ্বিধা নিয়ে সরে এলো জানালা থেকে৷ তাদের রুমের সাথে লাগোয়া এটার্চ বাথ। বোঝা যাচ্ছে এটা পরে তৈরি করা। বাড়ির প্রতিটি ঘরে প্রাচীনত্বের ছোঁয়া পাওয়া গেলেও, বাথরুমগুলো বেশ আধুনিক। লাবণ্য গোসল সেরে নিলো৷ যখন বেরুলো, তখন চয়ন ঘুমে বিভোর। ওদিকে অনিন্দিতার হাঁক ডাক শোনা যাচ্ছে। মনে হয় দুপুরের খাবার তৈরি। লাবণ্য চয়নকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে ওয়াসরুমে পাঠালো। তারপর বেরিয়ে এলো ঘর থেকে৷ সামনে প্রসস্থ বারান্দায় দাড়ালে অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়। সামনে ফোয়ারার মাঝে মার্বেল পাথরের জলপরীটি দারুণ মোহময়। বাড়ির গাড়ি বারান্দায় রাখা আছে তাদের তিনটি গাড়ি। লাবণ্য কল্পনা করার চেষ্টা করলো, যখন এখানে জমিদার সাহেব তার পরিবার নিয়ে থাকতেন, কেমন এলাহী কারবার হতো তখন! তবে একটা বিষয় সে খেয়াল করলো, এ বাড়ির বহুদূর পর্যন্ত কোন জনবসতি নেই৷ গ্রামের শেষ হয়েছে অনেক আগেই৷ তারপর বহু পথ পাড়ি দিয়ে এসে এই বাড়ির অবস্থান। চয়ন ফ্রেশ হয়ে আসার পর তারা দুজনে নিচে নেমে এলো। বিশাল রাজসিক এক খাবার ঘর। পুরানো কাঠের লম্বা টেবিলের এমাথা থেকে ওমাথা অব্দি থরে থরে সাজানো চেয়ার৷ অনিন্দিতা, মল্লিকা, প্রত্যয়, রূপম ততক্ষনে বসে পড়েছে টেবিলে। তাদের দেখেই প্রত্যয় হাত তুললো,

– ওই যে, আমাদের হানিমুন কাপল অবশেষে এসেছে!

রূপমও সাথে সাথে গলা মেলালো,

– কি হে, কোথায় ছিলে এতক্ষন? অনিন্দিতা কতবার গিয়ে ফিরে এলো!

চয়ন হাসলো৷ তাদের সাথে গলা মিলিয়ে বললো,

– হানিমুনেই তো এসেছি বন্ধু! এত ডাকাডাকিরই কি দরকার?

– ইশ! চুপ করো না। খেতে বসো।

লাবণ্যর তাড়া খেয়ে বসে পড়লো চয়ন৷ অনিন্দিতা সকলের প্লেটে খাবার তুলে দিয়ে এক সাথেই খেতে বসলো। খেতে খেতে লাবণ্য প্রশ্ন করলো,

– একটা বিষয় খেয়াল করলাম, এই বাড়ির আশেপাশে এত বিশাল জায়গা পড়ে আছে, অথচ কারো বসতি নেই। আজব ব্যাপার, তাই না?

মল্লিকা সাথে সাথে বলে উঠলো,

– ও মা! থাকবে কিভাবে? এই পুরো জায়গাটা তো এই জমিদার বাড়িরই অংশ৷ জমিদার রাজ চন্দ্রের।

– আচ্ছা, এই জমিদার বাড়িতে কি যেন একটা ঘটনা ঘটেছিলো বলছিলি, কি হয়েছিলো?

চয়নের প্রশ্ন শুনে মাথা নাড়লো রূপম। বললো,

– সে বিশাল এক রক্তক্ষয়ী ঘটনা!

লাবণ্য সাথে সাথে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।

– তাই নাকি? কি ঘটনা? বলো শুনি।

খেতে খেতেই গল্প শুরু করলো রূপম।

– আমি ঘটনা টা শুনেছি আমার দাদুর কাছে থেকে। দাদু শুনেছিলেন, তার বাবার থেকে৷ তার আগে কে কিভাবে শুনেছে, জানা নেই আমার৷ তবে এই গ্রামে শত শত বছর ধরে লোকমুখে প্রচলিত এই কাহিনী৷ জমিদার রাজ চন্দ্রের এই অঞ্চলে বিশাল আধিপত্য ছিলো৷ টাকা পয়সার কমতি ছিলো না। জনদরদী শাসক ছিলেন। লোকমুখে তার দান দক্ষিনার কথা প্রচলিত ছিলো৷ উনার সন্তান বলতে ছিলো এক কন্যা। নাম তার নয়নতারা।

লাবণ্য বললো,

– যার নামে এই বাড়ির নাম?

– ঠিক ধরেছো। গেটের পাশে শ্বেত পাথরের ফলকে যার নাম খোঁদায় করা আছে। তো, নয়নতারা ছিলো দারুণ রূপবতী। গায়ের রঙ শ্যামলা হলেও, মুখশ্রী নাকি ভিষণ সুন্দর৷ সেই সাথে নাচ-গানে পারদর্শী। সেই আমলে জমিদার সাহেব দিল্লি থেকে মেয়েকে তালিম দেওয়ার জন্য শিক্ষক নিয়ে এসেছিলেন। নয়নতারা অশ্ব চালনা জানতেন। ঘোড়ার পিঠে চড়ে ধূলো উড়িয়ে তিনি ছুটে বেড়াতেন তার বিশাল সাম্রাজ্যে। নয়নতারার একুশ বছর বয়সে তার বাবা ঠিক করেন মেয়ের বিয়ে দিবেন। পাত্র ঠিক হয় আরেক জমিদার পুত্রের সাথে। তো নির্ধারিত সময়ে বিয়ে হয়ে যায় তাদের। নয়নতারার শ্বশুরবাড়ি ছিলো এই অঞ্চল থেকে বহু দূরে। পালকিতে করে পাড়ি দিতে হবে প্রায় ১৪-১৬ ঘন্টার হাঁটা পথ। এর মাঝে বিশাল এক জোড়া দীঘি পেরুতে হতো তাদের। কিছুদিন পর পর যেখানে ডাকাতের কবলে পড়তো যাত্রীরা। জমিদার ঠিক করলেন, নয়নতারা যাত্রা করবে রাতে। রাতে তাদের অঞ্চল পেরুতে পারলে জোড়া দীঘি যখন পৌছাবে, তখন ভোর হয়ে যাবে। দিনের আলোতে সেখানে কোন অসুবিধা নেই। ভাবনা মতো সন্ধ্যের পর পরই বরযাত্রী সমেত বেরিয়ে পড়ে নয়নতারা৷ পথিমধ্যে আরেক দল তীর্থযাত্রী তাদের সাথে যোগ দেয়। কিন্তু নয়নতারার কপাল পোড়া। সেই তীর্থযাত্রীরূপী দল ছিলো আসলে এক ঠগীর দল। রাতের শেষ প্রহরে তারা তাণ্ডব চালায় বরযাত্রীদের উপর। হত্যা করে নয়নতারার স্বামীসহ সকল পুরুষদের। ঠগীদের হাত থেকে বাঁচতে পারেনি নয়নতারা নিজেও৷ ঠগীরা নারীদের হত্যা করত না। নয়নতারাকে তারা মারেনি, কিন্তু সম্মান ছিনিয়ে নিয়েছিলো। আই মিন, তাদের হাতে রেপড হতে হয় নয়নতারা কে৷ নয়নতারার স্বামী পালকির পাশে ঘোড়ার পিঠে যাচ্ছিলো। সেই ঘোড়াতে চড়ে ভোরের আলো ফোটার আগ মুহুর্তে নিজের বাড়িতে ফিরে আসে নয়নতারা৷

– তারপর?

প্রত্যয়ের প্রশ্ন শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রূপম। এর পরের ঘটনা আরো মর্মান্তিক৷ নয়নতারা সে সময়ের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও, আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগের সমাজে তার বেঁচে থাকাটা অতটা সহজ ছিলো না। ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের সব আঁনাচে কাঁনাচে ছড়িয়ে পড়ে এই ঘটনা। নড়েচড়ে বসে ধর্মান্ধ সমাজ। নয়নতারাকে নিয়ে হাজারটা কু কথা ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। জমিদার সাহেবও লজ্জায় কুঁকড়ে যায়। ঠিক তার পরের দিন ভোরে বাড়ির চাকর বাকররা নয়নতারার ঘর থেকে তার ঝুলন্ত মৃতদেহ আবিষ্কার করে। সকলে ছুটে যায় জমিদার সাহেবকে খবর দিতে। কিন্তু হায়! জমিদার সাহেবের ঘরের কড়িকাঠে ঝুলছে তার আর গিন্নীমার দেহ। নয়নতারা মৃত্যুর আগে ঠিক বিয়ের দিনের মতোই সেজেছিলো৷ গ্রামবাসীরা চোখের জলে সৎকার করে তাদের৷

রূপম গল্প শেষ করার পরও অনেকক্ষণ পর্যন্ত তারা কেউ কোন কথা বলে না। অনিন্দিতা খাবার শেষ করার তাড়া দেয়। নিঃশব্দে সবাই খাবার মুখে তোলে৷ কেবল লাবণ্যর মাথায় হঠাৎ করে আবার নাড়া দিয়ে যায় দুপুরের ঘটনাটি। আচ্ছা, সে কি সত্যিই ভুল দেখেছিলো তখন? পুরোটি কি তার ভ্রম? নাকি এর পেছনেও লুকিয়ে আছে অন্য কোন গল্প?
(চলবে)

আগন্তুক পর্ব-০১

0

আগন্তুক
– সাবিহা বিনতে রইস

#পর্ব – ১

শ্বেত পাথরের বিশাল মহলটির সামনে দাঁড়িয়ে বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে ছিলো লাবণ্য। রাজশাহীর থেকে মাত্র ঘন্টা দেড়েকের দুরত্বে কোথাও এমন জায়গা লুকিয়ে থাকতে পারে, সে ভাবতেও পারেনি। মহলটির চারপাশে ঘন শালবন। তার ঠিক মধ্য দিয়ে আঁকাবাঁকা লাল মাটির পথ লোহার গেটে গিয়ে ঠেকেছে। কারুকার্যখচিত সেই গেটের ভেতর দিয়ে মহলটির সামনে অংশ কিছুটা দেখা যাচ্ছে। ভেতরে পাথরের জলপরীকে ঘিরে চমৎকার এক ফোয়ারা। চারিদিকে নয়নাভিরাম ফুলের বাগান। চয়ন তখন গাড়ী থেকে মালপত্র নামিয়ে লাবণ্যর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে৷ লাবণ্য কনুই দিয়ে তাকে খোঁচা মেরে বললো,

– দারুণ না জায়গাটা?

চয়ন ঠোঁট উল্টালো৷

– তোমার কাছে যখন দারুণ লেগেছে, তখন আর আমার মতামতে কিছু যায় আসে না।

লাবণ্য সরু চোখে চয়নের দিকে তাকালো৷ তার মুখে বিরক্তির ছাপ। এখানে আসতে সবচেয়ে বেশি যদি কারো আপত্তি থাকে, তবে নিঃসন্দেহে তা চয়নের।

চয়ন আর লাবণ্য৷ তাদের বিয়ে হয়েছে সবে দু মাস। তবে পরিচয় প্রায় বছর দুয়েকের। চয়ন একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকুরীজীবী। পরিবারে আছে বলতে মা আর বড় বোন। বোন দীর্ঘদিন যুক্তরাজ্য প্রবাসী। কয়েক বছর ধরে মা ও সেখানে স্থায়ী হয়েছেন। দেশে আছে শুধু চয়ন, একা। অন্যদিকে লাবণ্যর বিশাল পরিবার। বাবা – মা, ছোট ভাই, দীদা, চাচা-চাচী, চাচাতো ভাই-বোন সকলে মিলে একসাথে থাকে। বাবা-মা দুজনেই সরকারী কলেজের অধ্যাপক। লাবণ্য সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে। তবে তার সবচেয়ে বড় পরিচয়, সে একজন লেখক। গত কয়েক বছরে তার জনপ্রিয়তা দেশের গণ্ডি পেরিয়েছে। ওপার বাংলার উঠতি ছেলেমেয়েদের কাছেও সে ভিষণ জনপ্রিয়। দেশে সে থ্রিলার কুইন নামে সকল পাঠকের কাছে পরিচিত। দারুণ দারুণ সব হরর-থ্রিলার, সাসপেন্সে ভরা লেখা দিয়ে টানা তিন বছর সে বেস্টসেলার তালিকার প্রথম স্থানে অবস্থান করছে। দেশের সবচেয়ে বড় অনলাইন বুকশপ গুলোর টপ চার্টে প্রথম স্থানে তার নাম একপ্রকার অনড়। এ নিয়ে লাবণ্যর মনে সূক্ষ্ম গর্ববোধ আছে। তবে সে বিষয়টা চেপে রাখতে পছন্দ করে। গর্বের বিষয়টি কখনোই সে কারো কাছে প্রকাশ করে না৷

লাবণ্য চয়নের দিকে ঘুরে দু হাত দিয়ে তার ঘাড় জড়িয়ে ধরে বললো,

– আমরা কিন্তু হানিমুনে এসেছি ওকে? এখানে এসে এইরকম পেঁচার মতো মুখ কিন্তু আমি সহ্য করবো না!

– হানিমুন!! মানুষ হানিমুন করতে যায় সমুদ্রে, পাহাড়ে, আর আমরা হানিমুন করতে এসেছি কিনা এই জঙ্গলের মধ্যে, তাইনা? এইসব আজগুবি গপ্পো আমাকে দিও না। তুমি যে একটু পরই তোমার খাতা কলম নিয়ে নতুন উপন্যাসের কাজে বসে পড়বে, তা আমার ঠিক জানা আছে।

লাবণ্য হেসে ফেললো৷ চয়ন মাঝে মাঝে এমন করে, যেন ঠিক ছোট্ট একটা শিশু। চয়ন চেয়েছিলো হানিমুনে ইউরোপ ট্যুরে যেতে। কিন্তু হঠাৎ করে বিশ্ব জুড়ে মহামারী শুরু হয়েছে। করোনা ভাইরাস নামে এক ভাইরাসে বিশ্ব আজ বিপর্যস্ত। সব দেশ প্রায় লক ডাউন হয়ে যাচ্ছে। অফিস আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সব ছুটি৷ দেশের পর্যটন কেন্দ্র গুলো পর্যন্ত বন্ধ। কোথাও যাবার উপায় নেই। এই ফাঁকে ছোট্ট একটা হানিমুনের ব্যবস্থা করে ফেলেছে লাবণ্য। অবশ্য এই হানিমুনে তারা একা নয়। সাথে চয়নের দুজন বেস্ট ফ্রেন্ড রয়েছে। রূপম আর প্রত্যয়। সেই কলেজ লাইফ থেকে তাদের বন্ধুত্ব। তারা দুজনেই বিবাহিত৷ রূপমের স্ত্রী অনিন্দিতা, প্রত্যয়ের স্ত্রী মল্লিকা। বন্ধুত্বের বাইরে রূপম আর প্রত্যয়ের মাঝে একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। রূপম আর মল্লিকা দুই ভাই- বোন। রূপম নিজের বোনের বিয়ে প্রিয় বন্ধুর সাথে দিয়েছে, এই আর কি!

চয়ন আর লাবণ্যর বিয়ের কয়েকমাস আগে এক আড্ডায় মল্লিকা প্রথম এই বাড়ির কথা বলেছিলো৷ বাড়িটি নাকি প্রায় দুশো বছর আগের তৈরি। সেসময়ের জমিদার রাজ চন্দ্র চৌধুরী প্রায় চল্লিশ বিঘা জমির মাঝখানে এই বাড়িটি বানিয়েছিলেন। সে সময় এই শ্বেত মহলটি ছিলো দারুণ জমজমাট। কিন্তু এক রক্তক্ষয়ী ঘটনার ফাঁদে পড়ে এক রাতে, বাড়ির সকল লোক মারা যায়। তারপর অনেক বছর বাড়িটি পরিত্যক্ত ছিলো। তার দীর্ঘ দিন পর রূপম- মল্লিকার প্রপিতামহ বাড়িটি নিজের দখলে নেন। সেই থেকে তাদের তত্ত্বাবধানে আছে মহলটি। তবে কখনো এখানে রাত কাটানোর সুযোগ হয়নি তাদের৷ মল্লিকার মুখ থেকে এমন ইন্টারেস্টিং ঘটনা শোনার পর থেকে লাবণ্য একপ্রকার মুখিয়ে ছিলো বাড়িটি দেখার জন্য। কিন্তু নিজেদের ব্যক্তিগত কাজের চাপে সেভাবে এখানে আসার সুযোগ হয়ে ওঠেনি৷ অবশেষে সুযোগ আসে গত পরশু। করোনা ভাইরাসের কারণে সব প্রতিষ্ঠান যখন ছুটি, তখন এই তিন জুটির নিভৃতে সময় কাটানোর এর থেকে ভালো সুযোগ, আর কি বা হতে পারে? আর সরকার থেকে বার বার ঘোষণা আসছে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার। আল্লাহর রহমতে তারা সকলেই বেশ সুস্থ। গত দুমাসে প্রবাসী কারো সংস্পর্শে আসার রেকর্ডও নেই তাদের। তাই একরকম নিজ উদ্যোগে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে তারা।

গাড়ীর শব্দে চয়নকে ছেড়ে সরে দাড়ালো লাবণ্য। তাদের ঝকঝকে বিএমডব্লিউর পেছনে দুটো মারুতি এসে দাড়িয়েছে। প্রথম গাড়ী থেকে রূপম আর অনিন্দিতা নেমে এলো। পেছনের গাড়ি থেকে মল্লিকা নেমেছে। প্রত্যয় মালামাল নামাতে ব্যস্ত। রূপম তাদের দিকে এগিয়ে এসে চোখ টিপে বললো,

– কি বন্ধু, আসতে না আসতেই রোমান্স শুরু? একটু রয়ে সয়ে থাকো, এক-দুইদিন নয়, চৌদ্দ দিনের জন্য এসেছি। অনেক সময় আছে।

ইশ! রূপম ভাইটা কি সব যে বলে না!
লাবণ্য আড় চোখে তাকালো চয়নের দিকে। চয়নের কানও লাল হয়ে উঠেছে। বন্ধুদের মধ্যে চয়ন সামান্য লাজুক আর কি! অন্তত বন্ধুপত্নীদের সামনে কিছুটা বুঝেশুনে কথা বলে৷ কিন্তু রূপম আর প্রত্যয় ভাইয়ের কথা লাগাম ছাড়া।

অনিন্দিতা ভাবী এগিয়ে এসে বললো,

– কি গো? কোন সমস্যা হয়নি তো আসতে? পথ চিনে আসতে পারলে?

– এ আর এমন কি! হাইওয়ে দিয়ে আসতে তেমন সমস্যা হয়নি। আর গ্রামে ঢোকার পর গ্রামবাসী পথ দেখিয়ে দিয়েছে।

– তোরা সব দাঁড়িয়ে থাকবি? এতগুলো জিনিস আমাকে একা নিয়ে বাসা পর্যন্ত যেতে হবে নাকি?

প্রত্যয়ের কথায় সকলে পেছন ফিরে তাকালো। রূপম পকেট থেকে চাবিটা বের করে মল্লিকার দিকে ছুড়ে দিয়ে বললো,

– তুই গেটের তালা খুলে দে। আমরা প্রত্যয় কে হেল্প করছি। আর মোশাররফ চাচাকে ফোন দে। বল, আমরা চলে এসেছি৷ চাচার তো আগে থেকেই এখানে উপস্থিত থাকার কথা ছিলো,তাই না?

মল্লিকা মাথা নাড়লো৷ চয়ন আর রূপম, প্রত্যয় কে সাহায্য করতে এগুলো৷ অনিন্দিতা আর মল্লিকার সাথে মহলের দিকে পা বাড়ালো লাবণ্য। বড় লোহার গেটের কাছে পৌছে দাঁড়িয়ে পড়লো সে৷ ডানপাশে শেওলা জমা ফলকের উপর অবহেলায় খোদায় করা একটি নাম। নয়নতারা। তার নিচে খানিকটা ছোট অক্ষরে লেখা, ১২০৮ বঙ্গাব্দ।

গেট পেরিয়ে ভেতর ঢুকে লাবণ্যর শুধু অবাক হওয়ার পালা। ঠিক যেন রূপকথার কোন প্রসাদপুরিতে চলে।এসেছে সে৷ মূল ফটক থেকে অন্দরমহল প্রায় বিশ কদমের পথ। অন্দরে ঢোকার আগে প্রশস্ত বারান্দা, কারুকার্যখচিত কাঠের দরজা, দালানের দুপাশে ঘোরানো সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে। মনে মনে চনমনে হয়ে উঠছিলো লাবণ্য৷ নতুন গল্পের সূত্রপাত এখান থেকেই করা যাবে। অনিন্দিতা আর মল্লিকার সাথে পা বাড়িয়ে সে দোতলায় উঠে এলো। বাড়িটি এখনকার বাড়ির তুলনায় উচ্চতায় বেশি খানিকটা বেশি। নিচ তলা থেকে দোতলায় উঠার সময় প্রায় তেত্রিশটি সিঁড়ি ভাঙতে হয়েছে। নিচতলার তুলনায় উপরের ঘরগুলো বেশি পরিস্কার। মল্লিকা হাতে চাবির গোছা খুঁজে খুঁজে খুলতে থাকলো ঘর গুলো৷ বারান্দার চকচকে মেঝে দেখে বোঝা যাচ্ছে, দিন দুয়েকের মধ্যে কেউ ঘরগুলো পরিস্কার করে গেছে। অনিন্দিতা নিজেই বললো,

– বুঝলে লাবণ্য, গ্রামে আমাদের কয়েকজন লোক আছে। তাদের কাছে বাড়ির চাবি দেওয়া আছে। বছরে দু একবার এলে, তারা বাড়িঘর পরিস্কার করে দিয়ে যায়। এমনই শুনেছি আমি বাবার কাছে। কি মল্লিকা, ঠিক বলেছি তো?

– হুম, ঠিকই বলেছো৷ আসলে এত বড় বাড়ি সবসময় দেখাশোনার জন্য লোকজন রাখা খুবই কস্টলি। আর আমরা ছোটবেলা থেকে কেউ কখনো এখানে রাত কাটাইনি৷ বাবা-মা ও এখানে এসেছে কোনদিন একরাত থেকেছে বলে শুনিনি৷

লাবণ্য কৌতূহলী হয়ে বললো,

– তা বুঝলাম, কিন্তু ঘরে তো জিনিসপত্র ভালোই আছে দেখছি। চুরি হয়না এটাই তো বিশাল ব্যাপার।

অনিন্দিতা ফস করে বলে ফেললো,

– চুরি করবে, তাও আবার এই বাড়িতে? এত বড় সাহস কারো আছে?

– কেন? বাড়ির উপর বিশেষ কারো নজর আছে নাকি?

– তা আর বলছি কেন? এ বাড়িকে নিয়ে তো গল্পের শেষ নেই। গ্রামের লোকেরা বলে…

– আহ ভাবী! চুপ করো তো৷ এইসব কথা পরে বলা যাবে৷ শোনো লাবণ্য, তুমি ঠিক করো কোন ঘরে থাকবে! এখানে পাশাপাশি তিন ঘরই একইরকম। সব ঘরের সাথে এটার্চ বাথ।

লাবণ্য বেরিয়ে এলো। ফাল্গুনের মধ্য দুপুর। দূরে কয়েকটি শিমুল গাছ ফুলে ফুলে রক্তিম হয়ে আছে। বাতাসে অদ্ভুত রকমের স্নিগ্ধতা। চয়ন লাগেজ হাতে নিয়ে দোতলায় উঠে এলো, তার ঠিক পেছনে পেছনে এলো রূপম আর প্রত্যয়।

রূপম হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলো,

– কি হলো? ঘর ঠিক হলো তোমাদের? দেখা শেষ হয়েছে সব?

লাবণ্য হাসলো। বললো,

– সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব আমার উপর চাপিয়ে দিও না রূপম ভাই। কিছু দায়িত্ব তোমার বন্ধুর উপরে থাক, সে বলুক কোন ঘরে থাকবে!

– আহা! আবার আমার উপরে এই কঠিন দায়িত্ব কেন? তার থেকে বরং তোরা আগে ঠিক কর কোথায় থাকবি।

প্রত্যয় অবশ্য সাথে সাথে বাধ সেধেছে।

– তা বললে হবে না। আমি আর অনিন্দিতা ভাবী, দুইনজই শ্বশুরবাড়ির সূত্র ধরে হলেও এই বাড়ির আত্মীয়৷ কিন্তু তোরা দুজন অতিথি৷ তাই ফার্স্ট চয়েসের অধিকার তোদের উপরই দেওয়া উচিৎ।

লাবণ্য খানিকক্ষণ চিন্তা করলো। তারপর বললো,

– ওকে! আমাকে যদি বেছে নিতে বলো, তাহলে দক্ষিণ জানালাওয়ালা ঘরটি আমার চাই।

রূপম মাথা নাড়লো।

– ঠিক আছে, তাহলে মাঝের ঘরে আমরা থাকছি। আর উত্তরের ঘরে মল্লিকা প্রত্যয় থাকুক। সবাই ফ্রেশ হয়ে নে। দিন পনেরোর জন্য রান্নার দুজন কাজের লোক ঠিক করেছি৷ রান্না থেকে বাড়ির যাবতীয় কাজ তারা করবে। নিচতলার রান্নাঘরে কাজ শুরু হয়ে গেছে৷ কমপ্লিট হলে ওরা ডাক দিবে। আমি বরং কিছুক্ষণ গড়াগড়ি দিয়ে নিই।

লাবণ্য আর চয়নও নিজেদের লাগেজ টেনে নিয়ে ঘরে এসে ঢুকলো৷ ঘরদোর মোটামুটি পরিস্কারই আছে। আসবাব বলতে একটা প্রকান্ড খাট, বেড সাইড টেবিল, তার উপর একটা ল্যাম্প, এক পাশে কাঠের পুরানো আলমারি, আর ছোট একটা বুক সেলফ। ঘরের দক্ষিণ আর পশ্চিমে প্রকাণ্ড দুটি জানালা। বাইরে যতদূর চোখ যায় কেবল শাল গাছের ঘন বন।

লাবণ্য এগিয়ে এসে চয়নকে বললো,

– কেমন লাগছে এখন? খুব বেশি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি? এই হানিমুন পছন্দ হচ্ছে না?

চনয় লাবণ্যর কাছে এসে দাড়ালো।

– এখন আর অতটা খারাপ লাগছে না। তবে হানিমুনটা শুধু তুমি আর আমি হলে, আরো ভালো লাগতো।

– এখানেও তো তুমি আমি। যদিও তোমার বেস্ট ফ্রেন্ডরা আছে, তারা খুব একটা ডিস্টার্ব করবে বলে মনে হচ্ছে না। দেখলাম তো, কি দারুণ স্পেস দিয়ে গেল আমাদের!

লাবণ্যর চোখে মুখে দুষ্টুমি খেলছে। চয়ন আরো গাঢ় হয়ে দাড়ালো তার সামনে। লাবণ্যকে জড়িয়ে নিলো বুকের সাথে। সেও শিশুর মতো লেপ্টে গেল চয়নের সাথে। ঠিক তখনই মনে হলো, কারো একটা পাতলা শাড়ীর আঁচল উড়ে গেল দক্ষিনের জানালা দিয়ে। মুহুর্তে পিলে চমকে উঠলো লাবণ্য। কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে এক ঝটকায় চয়নের বাহু বন্ধন থেকে নিজেকে সরিয়ে ছুটে গেল সে জানালার কাছে।
নাহ! বাইরে কেউ নেই। নিস্তব্ধ নিঝুম দুপুরে কেবল একটানা ঘুঘুর ডাক। লাবণ্য নিচে তাকালো। এবাড়ির দোতলার ঘর সাধারণ দোতলা বাড়ির থেকে অনেক উঁচুতে। এখানে কে এসে দাঁড়াবে? কিভাবেই বা আসবে এখানে? লাবণ্য ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠলো। জানালার বাইরে তাহলে কি দেখলো সে?

(চলবে)

বৃষ্টি হয়ে নামবো পর্ব-৩১ এবং শেষ পর্ব | গল্প পোকা রোমান্টিক গল্প

0

#বৃষ্টি_হয়ে_নামবো
#Writer_Nondini_Nila
#Last_Part

তিথি আদনানদের বাসায় নিজের রুমে বসে রাগে ফুসফুস করছে। রাগে একবার রুমে এই কোনায় আসছে একবার ওই কোনায়।ওকি থেকে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না ওর ভাই কিনা ওই দোলার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। কোথায় ভাইকে দিয়ে দোলা রাস্তা ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এ তো তার প্রেমে মশগুল হয়ে আছে।
এখন সে তোর দোলার কোনো ক্ষতি করবে না। অল্টো ওর এই অবস্থা করেছি বলে আমাকে এতগুলো কথা শোনালো।
নিজের ভাই কিনা বোনের থেকে ওই মেয়েটাকে বেশি পার্টি দিচ্ছে।
রাগে ওর চোখ ফুলে যাচ্ছে। এই দোলা কিনা আমার ভাইকে বশ করে ফেলল। মেয়েটা আসলেই জাদু জানে। আদনানকে তো বশ করেই রেখেছে এখন আবার আমার ভাইকে।
কোথায় নিজের বোনকে সাহায্য করবে তা না নিজের প্রেমে পাগল হয়ে গেছে।
এখন যা করার আমাকেই করতে হবে তাহলে হয়ে গেছে দিপ আসতে দেওয়া যাবেনা। এসব ভাবছিল তখন কোথা থেকে আদনান এসে তিথির হাত শক্ত করে ধরে।
আচমকা শক্ত করে হাত ধরার ভয় পেয়ে দেখে আদনান।স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে হাত সরানোর চেষ্টা করে কারণ আদনান খুব শক্ত হাত ধরেছে মনে হয় হাত ভেঙে ফেলবে।

কী করছিস কী আদনান। আমার হাতে এতৈ শক্ত করে ধরেছিস কেন ভেঙে ফেলবি নাকি ছার হাত।
ছড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল।
আদনান ওর দিকে ফিরেও তাকাল না যেন ওর কোন কথা কানে যায় নি।
আদনান নিজের মত তিথির হাত ধরে টানতে টানতে ওকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে এলো। আর সবার সামনে এসে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল। তিথি মুখ থুবরে পড়ল ফ্লোরে। আদনানের বাবা-মা ও দোলার বাবা সোফায় বসে ছিল। দোলার মা এখন হসপিটালে আছে ওনার জ্ঞান এখনো ফিরে নি।
সবাই বসে শরবত খাচ্ছিল কারণ কাল থেকে কারও কিছু খাওয়া হয়নাই দোলার চিন্তায়। এমন সময় আচমকা এই ঘটনায় সবাই থমকে যায়। আর গ্লাস নামিয়ে রেখে দাঁড়িয়ে পড়ে।

তিথি ফ্লোরে পড়ে হাতে ও পায়ে ব্যথা পেয়েছে। ওইভাবে পড়ে থেকেই অবাক চোখে আদনানের দিকে তাকিয়ে বলল,
হোয়াট হ্যাপেনস আদনান এসব কি করছিস তুই আমাকে ফ্লোরে কেন ফেললি? অফ কত ব্যথা পেলাম।
বলে ওঠার চেষ্টা করতে লাগলো কিন্তু উঠতে পারল না ভালোই ব্যথা পেয়েছে।
তিথি বুঝতে পারছে না ওর সাথে এমন করছে কেন আদনান?
আদনান এগিয়ে এসে তিথি চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে দাঁড় করালো।
আর বলল,
তুই ইচ্ছে করে আমার দোলা কে আঘাত করেছিলি ওকে আমার কাছ থেকে আলাদা করতে চেয়েছিলে।
আদনান দাঁতে দাঁত চেপে চোখ রক্ত লাল করে বলল। তিথি আদনানের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে আদনান হিংস্র বাঘের মত হয়ে গেছে। ভয়ে তিথি চুপসে যায়। আদনান কিভাবে জানলো?
আমার চুল ছাড়া আমার লাগছে।
লাগুক লাগার জন্যই তো ধরেছি তুই যদি এখন মেয়ে না হতিস তাহলে তো আমি এখন মার্ডার করে ফেলতাম মারতে মারতে তোকে। মেয়ে বলে কম খাচ্ছিস।
আমি কিছু করিনি আমাকে ছেড়ে দে।
তিথি জানে এখন স্বীকার করলে আর রক্ষা নাই তাই মিথ্যা বলল।
কিন্তু তিথি তো আ্য জানে না আদনান সব জেনেই এসেছে। আদনান তিথির মিথ্যা কথা শুনে আরো শক্ত করার চুলের মুঠি ধরলো। তিথি ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠে,
ছেড়ে দে আমাকে আমি না তোর বন্ধু।
তুই আমার বন্ধু না তুই আমার চিরশত্রু। তোকে আমার বাসায় আনাই উচিত হয় নাই‌।খাল কেটে কুমির এনেছি আমি।
এর আগে আদনানের চোখ দিয়ে আগুন জ্বলছে পড়ছে যেন।
বাসার সবাই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেউ কিছু বুঝতে পারছেনা।কিন্তু আদনানের কথা শুনে বুঝতে পারছে দোলার এইসবের জন্য এই মেয়েটা দায়ী।
তাই সবাই এখন হিংস্র হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। তবুও আদনানের মা আদনান এর বাবাকে বলে আদনানকে তিথির থেকে সরিয়ে আনলো।
বাবা ছাড় আমাকে আর কত বড় সাহস আমার কলিজায় হাত দেয়। দোলাকে মারার প্ল্যান করে ছিল শুধুমাত্র আমার বউ হবে বলে। কিন্তু ও তো জানেনা দোলার কিছু হয়ে গেল ওআমি কখনই ওকে বিয়ে করতাম না। আমি শুধুমাত্র আমার দোলারানী কে ভালবাসি আমি আর কাউকে ভালবাসতে পারব না। দোল আমার প্রাণভোমরা আমার নিশ্বাস প্রশ্বাস আমার জীবন আর ও কিনা তাকে মারতে চেয়েছিল। ওকে আমি খুন করে ফেলবো।
আদনান মাই ডিয়ার সন্ শান্ত হও তুমি। এইসব করোনা মার্ডার কেস। ওকে আমরা পুলিশের কাছে দিয়ে দেব।
আদনান পাগলের মত ছটফট করছে সবাই মিলে ওকে শান্ত করলো।
তিথি ফ্লোরে পড়ে ব্যথায় কাঁদছে। তিথি হচ্ছে আদরের দুলালী এত আঘাত একদমই সহ্য করতে পারেনি মেয়েটা। কেঁদে কেঁদে নাকের জল চোখের জল এক করছে।
পুলিশের নাম শুনতে আঁতকে ওঠে। ওর পিল চমকে ওঠে। তাড়াতাড়ি এসে আদনানের পা জড়িয়ে বসে পড়ে।
আদনান আমাকে ক্ষমা করে দে আমি অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি। আমার দোলাএই অবস্থা করা উচিত হয় নাই। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দে।পুলিশের কাছে দিস না আমাকে আমার লাইফটা শেষ হয়ে যাবে। আমি তোর জীবন আর কখন আসব না।তোকে কথা দিচ্ছি আমি চলে যাব সিলেট ফিরে যাব। আমাকে পুলিশের কাছে দিস না বাবা-মা মরে যাবে পুলিশের কাছে দিলে আমাকে। প্লিজ ক্ষমা কর আমাকে।
বলেই কান্নায় ভেঙে পড়ল।ভাই এখন আর পাশে নাই আর বাবা-মা সত্যি যদি জানতে পারে আমাকে ত্যাজ্য করবে। আদনান এর জন্য আমি সবকিছু কেন হারাবো। তার থেকে আদনানকে ছেড়ে দেয়।
না তোকে আমি একটুও বিশ্বাস করিনা তোকে তোর প্রাপ্য শাস্তি পেতেই হবে। তোর জন্য আমার দোলা যে কষ্ট পেয়েছে তার সাথে তো তোকে শাস্তি পেতে হবে।
এইবারের মত শেষ বারের মত বিশ্বাস কর
আর কখনো তোর সামনে আসভো এই প্রতিজ্ঞা করছি। ক্ষমা করে দে।
বললাম তো তোকে পুলিশের কাছে দেবো। আর না হলে আমি নিজে তাকে শাস্তি দেবো।
আদনান কিছুতেই তিথিকে ছাড়বে না আর এদিকে তিথি কান্না করতে করতে অনেক কিছু বলছে কিন্তু আদনান শুনছে না।
আদনান ফোন বের করে পুলিশকে কল দিতে যাবে তখন দোলার বাবা এসে ফোন কেড়ে নেয়।
আদনান অবাক হয়ে দোলার বাবার দিকে তাকায়।
ওকে ছেড়ে দাও আর ভুল বুঝতে পেরেছে।আমার মনে হচ্ছে ওকে একটা সুযোগ দেওয়া উচিত।
ওকে যদি এখন আমরা পুলিশের কাছে দিয়ে দেই তাহলে ও আরো খারাপ হয়ে যাবে।হয়তোবা জেলে থেকে বের হয়ে আবার খারাপ কিছু করার চেষ্টা করবে।তা থেকে এতই যেহেতু সুযোগ চাইছে একটা সুযোগ দাও।

দোলার বাবার কথা শুনে আদনান আর কিছু বলার সাহস পেলো না তিথিকে একটা সুযোগ দিল।
তিথি খুশি হয় দোলার বাবাকে সালাম করল।নিজের ভুল কিছুটা হলেও বুঝতে পারল রাগে জেদেও সত্যিই খুব বড় অন্যায় করেছে।
আদনান বললো ও যেন আজকে সিলেট চলে যায় টিকিট কেটে এনে দেব। শেষে আদনান টিকিট কেটে নিয়ে আসে তিথি চলে যায়।
দোলাকে হসপিটাল একসাথে থাকতে হবে।
হসপিটালে একদিন সকালে,
দোলা কে সুপ খেতে হয় কিন্তু দোলা একদমই খাবে না তাই চুপ করে বসে আছে। প্রতিদিনই এমন করে একদিন মার কাছে খায় একদিন মামুনের কাছে। আজকে আদনান এসেছে
আদনান এসেদেখে ওর দোলা রানী সুপ ‌খাবে না বলে মন খারাপ করে বসে আছে।
এগিয়ে এসে দোলার পাশে বসে জিজ্ঞেস করে,
আমার দোলা রানীর এত মন খারাপ কেন?

দোলা খুশি হয়ে আদনান এর দিকে তাকিয়ে বলে,
ভাইয়া প্লিজ আমাকে বাইরে থেকে কিছু খাবার এনে দে আমি এটা খেতে পারছি না খুবই বাজে খেতে।
অনুরোধ করে বলল।
আদনান দোলার কপালে কিস করে বলে।
কয়দিন এটাই খেতে হবে। ডাক্তারের নিষেধ বাইরের খাবার খাওয়া যাবেনা। প্লিজ খেয়ে নে।
না ভাইয়া প্লিজ এটা খুবই বাজে তুমিএকটু ট্রাই করে দেখ। আমি এটা কিছুতেই খেতে পারব না আমার মুখ একদম বাজে হয়ে গেছে খেতে খেতে।
নাক মুখ ছিটকে বলল দোলা।
আদনান দোলা এমন বাচ্চা মো দেখে হেসে ফেললো আর নিজে স্যুপের বাটি হাতে নিয়ে বলল,
আমার কথা তো তুই সব শুনিস তাহলে আমার হাতে খা প্লিজ যা কালকে তোকে আমি বাইরে থেকে বিরানি খাওয়াবো।
বিরানির কথা শুনেই দোলা চোখ-মুখ চিকচিক করতে লাগলো।
সত্যি।
ইয়াহ মাই লাভ।
আদনানের হাতে দোলা কিছু টা খেলো তারপর আর খাওয়ানো গেলো না। তাই বাধ্য হয়ে আদনান বাকিটুকু রেখে দিল।
ভাইয়া বাসায় যাব কবে। এখানে আমার ভালো লাগেনা।
আর দুদিন তারপরে বাসায় চলে যাব।
আমাকে তোমার ফোনটা একটু দাও তো।
ফোন দিয়ে কি করবি?
দরকার আছে দাও সারাদিন আমার এখানে বোরিং হয়ে থাকতে হয় একা একা ভালো লাগেনা।
তাই তাহলে এখন থেকে আমি থাকি এখানে।
আচ্ছা থাকবে তাহলে থাকো তাহলে ফোন লাগবে না।
আমি তো থাকতে চাই কিন্তু।
কিন্তু আবার কি তুমিই থাকবে আজকে আমার সাথে।
তোর মা আছে তো তার সামনে আমি কিভাবে থাকবো।
তাহলে মাকে বাসায় চলে যেতে বল আর তুমি থাকো।
পাগল নাকি। তার বাবা-মাকে পিটিয়ে তক্তা বানাবো এখানে থাকতে চাইলে।
কেন তক্তা বানাবো কেন? আব্বু আম্মু তো জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো!
জানি এইটাই তো সমস্যা?
এটা সমস্যা কেন?
বুঝবি না তুই ঘুমা আমি তোর মাথা টিপে দিচ্ছি।
না আমি ঘুম আসবো না তোমার সাথে গল্প করবো।
চুপচাপ ঘুমাও মাথা ব্যথা করবে। গল্প যত পারো পরে কইরো।
মন খারাপ করে অন্য দিকে তাকালো দোলা।
দোলা তুই কিন্তু দিন দিন পাজি হচ্ছিস।
ভাইয়া তোমাকে জড়িয়ে ধরি।
আচমকা দোলার এমন কথা শুনে আদনান থতমত খেয়ে যায়।
দোলা উত্তরের অপেক্ষা না করে আদনানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।
তারপর নরম কন্ঠে বলল,
জানো ভাইয়া যখন আমি মাথায় আঘাত পেয়ে ছিলাম না আমার তোমার কথা খুব মনে পড়ছিল।আমার মনে হয়েছিল আমি আর তোমাকে বাবা-মাকে মামনি বাবাকে দেখতে পাবোনা তোমাকে আমার শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হচ্ছিল কিন্তু পারবো না আর মনে হচ্ছিল।তোমাকে বিয়ে করতে পারবোনা, সংসার করতে পারবও না প্রেম করতে পারবোনা। আমার না সত্যি খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমি যদি মরে যেতাম তুমি খুব কষ্ট পেতে তাইনা।
দোলার কথা শুনে চোখে জল চলে আসে। দুই হাত উঁচু করে দোলাকে শক্ত করে বুকের মাঝে চেপে ধরে আর বলে,
তোকে আমি মরতে দিতাম না কষ্ট কেন হবে? আদনান কে ছেড়ে তার দোলা রানী মরতে পারে না! এই পৃথিবীতে আমি থাকলে তুইও থাকবি আমার সাথে আর তুই না থাকলে আমিও থাকব না! খুব ভালোবাসি যে তোকে দোলার রানী।

দোলা মাথা উঠিয়ে আদনানের দিকে তাকিয়ে বলে, ভাইয়া বাসায় গিয়ে আমরা বিয়ে করে ফেলব তারপর আমাদের ছোট্ট একটা বেবি হবে ছেলে বাবু। আমি তার নাম রাখব আহান মুনতাসির।
আদনান দোলার বাচ্চা মো আর এতো সব ভাবনা দেখে বলল,
ওরে আমার বাবুর মা রে। তুই এসব কবে ভাবলি‌।
এই তো কালকেই ভাবছি।
এখানে থেকে এসব ভাবা হচ্ছে বুঝি।
হুম তাই তো হচ্ছে। এখন বলো বিয়ে করবে তো।
আদনান মুখ মলিন করে বলল,
আমি তো করতেই চাই কিন্তু সম্ভব না।
কেন? আহ্লাদী গলায়।
ওই যে আমার হিটলার শশুর মশাই।তোর বাবা তো আমাকে শর্ত দিয়ে রেখেছে আমার মেয়ে ইন্টার পাস না করলে মেয়ে আমি কিছুতেই বিয়ে দেবো না। আমার মেয়ে তো বাচ্চা আমি বাচ্চা মেয়ের উপর এত পেশার দিতে চাইনা।
এসব বাবা বলেছে তোমাকে।
হ্যাঁ এসব বলেই তো তোর থেকে আমাকে দূরে রেখেছে।এমনকি ভালোবাসার কথা বলতে মানা করেছে না হলে নাকি বিয়ে দেবে না।
বাবা তোমার সাথে এসব করেছে দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা বাবাকে।
না না কিছু করবিনা আমি আমার দোলা রানীকে আরো একবছর পরেই চাই। একদম নিজের করে। আপন ভাবে সবার সম্মতিতে।
বলে আদনান দোলার গালে হাত রেখে কপালে চুমু খায়।
দোলা চোখ বন্ধ করে আদনান এর স্পর্শ অনুভব করে। তারপরে চোখ খুলেই ফট করে আদনানের নাকের চুমু দেয় সাথে কামড়।
আদনান চমকে উঠে বলে, কি করলি তুই?
ঠিকই করেছি বাবার ভয়ে ভালবাসি বলতে পারো নাই এজন্য এটা তোমার শাস্তি। কথাটা বলে দোলা আবার আদনান এর গলায় কামড়ে ধরল।
রাক্ষসী হয়েগেছিস কামড়াচ্ছিস কেন?
এটা আরো এক বছর আমাকে নিজে থেকে দূরে রাখার জন্য।
এখন আমি দেই।
আচ্ছা দাও।
না এটা এক বছর পর সুদে-আসলে ফিরত পাবি।

(আরাফাতকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে! দোলাকে অপহরণ করতে চেয়েছিল সেই অপরাধে। দোলাকে কলেজ থেকে অপহরণ করতে চায়।তিথি ভালো হয়ে গেছে তারপর সত্যিই আর আদনানের জীবনে ফিরে আসেনি।)

এক বছর পর

দোলা আর আদনানের বিয়ে হয়ে গেছে শর্ত অনুযায়ী। সবার শর্ত মতো দোলা ইন্টার পরীক্ষা দেওয়ার পরই বড় অনুষ্ঠান করে বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।একটা বছর আদনানকে দোলায় কতভাবে যে টর্চার করেছে একমাত্র আদনান জানে। কিন্তু ভালোবাসার মানুষের থেকে সব টর্চার ই সুখের মনে হয় আর তা অতি আনন্দে নেওয়া যায়।
বধু বেশে দোলাকে অপ্সরার মতো লাগছে আদনান তার দোলা রাণীর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে বাসর ঘরে। দোলা লজ্জায় লাল নীল বেগুনী হচ্ছে নিচের দিকে তাকিয়ে থেকে এক হাত দিয়ে আরেক হাত মুচরামুচরি করছে।

দোলা রানী।
আদনানের জড়ানো কণ্ঠে দোলায় সারা শরীর হিম শীতল হাওয়া বয়ে গেল। পিট পিট আদনান এর দিকে তাকালো। তগন বাইরে ঝরঝর বৃষ্টি নামল।
শেষমেষ তুই আমার রানী হলি। এইবার সব কিছু সুদে-আসলে বুঝে নেব।

দোলা লজ্জায় লাল হয়ে গেল।
তারপর আচমকা বলল,
ভাইয়া দেখো বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। চল না আজকে আমরা বৃষ্টিতে ভিজি দুজন।
কি বললি তুই ভাইয়া আবার। এখন আমি তোর ভাইয়া না আমি তোর হাসবেন্ড। আমাকে একদম ভাইয়া ডাকবি না।
আচ্ছা তা নাহয় চেষ্টা করব এখন চলো ছাদে যাই‌। প্লিজ।
আচ্ছা চল আজকে তোর কোন আবদার ফেলবো না। আমাদের জীবনের নতুন অধ্যায় টা না হয় বৃষ্টিতে ভিজে শুরু করবো।
আমি খুশি হয়ে বিছানা থেকে নামতে যাব ভাইয়া ছুটে এসে আমাকে পাঁচকোলে তুলে নিল।
আমি বিশ্মিত হয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছি।
ভাইয়া আমার নাকের মাথা চুমু দিয়ে বলল,
চমকাচ্ছিস কেন? তোকে আজকে আমি হাটতে দেবো না তুই আমার কোলে চরছ ছাদে যাবি। বলে ভাইয়া হাঁটতে লাগলো আমি মুগ্ধ হয়ে ভাইয়া মুখের দিকে তাকিয়ে আছি আর শক্ত করে ভাইয়ার গলা জড়িয়ে ধরে আছি।
ছাদে পা রাখতেই ভাইয়ার কপাল বেয়ে জল গড়িয়ে আমার মুখে পড়ল। আমি চোখ বন্ধ করে পানির ফোটা অনুভব করলাম।
ভাইয়া আমাকে ছাদের মাঝখানে এনে দাঁড় করালো। আমাদের দুজনের শরীর গড়িয়ে ঠান্ডা পানি ফোটা ফোটা পরছে। দুজনকে ভিজিয়ে দিচ্ছে।আমি মুগ্ধ হয়ে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি ভাইয়া কপাল বেয়ে মুখ বেয়ে পানির বুকে নামছে।
ভাইয়া আমার দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। ভাইয়ের চোখে নেশা ভরা আমাকে পাবার নেশা। আমি চোখ বন্ধ করে পানির ফোটা অনুভব করছি।
আদনান মুগ্ধ হয়ে তার দোলা রাণীর দিকে তাকিয়ে আছে। দোলাকে যত দেখছি ততই কাছে পাবার তীব্র বাসনা মনে জাগছে। কত বছরের ভালোবাসা ওর আজকে নিজের করে পেয়েছে।
দোলা চোখ বন্ধ করে দুই হাত মেরে দাঁড়িয়ে আছে। আদানা দিকে একপা দু পা করে এগিয়ে কাছে যে ওকে স্পর্শ করবে। দোলা ছুটে চলে গেলো আর পুরো ছাদে লাফালাফি করতে লাগলো।
দোলার বাচ্চামো দেখছে আদনান আর ওর মুখে আনন্দের হাসি ফুটে উঠেছে।
আদনান ছুটে গিয়ে দোলাকে দুহাতে জাপটে ধরল। তারপর দোলার দু গালে হাত রেখে,
ভালোবাসি দোলা রানী।
দোলা চোখে চোখ রেখে এবার বললাম,
আমিও ভালবাসি।
আদনানের খুশি দেখে কে আদনান খুশিতে পাগল হবার উপক্রম। নিজের ভালোবাসার মানুষের মুখ থেকে ভালবাসি শুনার থেকে সুখ এই পৃথিবীতে আর কিছুই নেই।
নেশা দৃষ্টিতে আদনান দোলার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে দোলার কপালে ঠোঁট দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলো না আদনান। দোলার ঠোঁটের সাথে নিজের ঠোঁট মিলিয়ে দিল। পাগলের মত কিস করতে লাগল। ঠিক 10 মিনিট পর দোলাকে ছেড়ে দিল আর দুজনে হাঁপখতে লাগলো। দোলা লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে। এমন কিছু জন্য মটেও প্রস্তুত ছিলনা দোলা। আদনান দৌলা থুতনিতে হাত রেখে উঁচু করে ধরে বলল,
কিরে লজ্জা পাচ্ছিস? লজ্জায় তো লাল হয়ে গেছিস। এখন এত লজ্জা পেলে হবে এখনো তো শুরুই করলাম।
আদনানের কথায় দোলা লজ্জায় আরো মি‌ইয়ে গেল আদনান এর দিকে তাকাতে পারছে না তাই লজ্জায় লুকাতে আদনান এর বুকে জায়গা দখল করে নিল। শক্ত করে আদনান কে জরিয়ে ধরল।
আদনান দোলার কাছে বলল,
ওরে আমার লজ্জাবতিরে।
সব সময় আমার পাশে থাকিস দোলা কখনো ছেড়ে যাস না না হলে আদনান বাচতে পারবেনা।
এখানে ছেড়ে দাও না ভাইয়া। আমিও তো তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না।

(সমাপ্ত)

বৃষ্টি হয়ে নামবো পর্ব-৩০ | বাংলা রোমান্টিক গল্প

0

#বৃষ্টি_হয়ে_নামবো
#Writer_Nondini_Nila
#Part_30

12 ঘন্টা হতে আর মাত্র 10 মিনিট আছে। অথচ এখন অব্দি দোলার জ্ঞান ফেরেনি। ওটির রুম খুলে দেওয়া হয়েছে। ডাক্তাররা আশা ছেড়ে দিয়েছে। তাই তারা বলেছে আত্মীয়-স্বজন সবাই চাইলে এখনও ওর কাছে যেতে পারবে কারণ বেশী সময় নাই তারা ভাবছেন দোলার আর জ্ঞান ফিরবে না কারণ ফেরার হলে আগেই ফিরত।
এখন আর দোলার মাকে না জানিয়ে লাভ নেই তিনি এসে বুঝতে পেরেছেন কিছু একটা হয়েছে এখনতো তিনি তার মেয়ের পাশে বসে করে কেঁদে যাচ্ছে।

একটি মাত্র মেয়ে তার আর তার কিনা অবস্থা। চোখের জল কোনমতেই বাঁধ মানছে না। সবাইয়ের চোখ ভরা পানি নিয়ে ওটির ভেতরে দাঁড়িয়ে নীরব হয়ে দাঁড়ায় দোলার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। দোলার মা আচমকা আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন।
তাকে নিয়ে আবার ভর্তি করতে হলো।
এদিকে আদনান হসপিটালে নেই। দোলার সাথে পাগলামো করে দেখা করে আবার চলে গেছে কোথায় যেন।
ডাক্তাররাও চোখে পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাদেরও কষ্ট হচ্ছে তারা কখনোই চায়না কোন পেশেন তাদের কাছে এসে এভাবে সবাইকে ছেড়ে চলে যাক। কিন্তু সবাই কে তো বাঁচানোর সম্ভব না। যদি তার হায়াত না থাকে। কিন্তু তারাতো নিরুপায়।

চোখের চশমাটা খুলে চোখটা মুছে নিল তখনই হঠাৎ চোখে পরলো দোলার হাতের আংগুল নড়ছে। উনি চমকে উঠল তাড়াতারি দোলার কাছে গেলেন। সবাই ভেতরে দাঁড়িয়ে ছিলেন দোলার মা বাদে তাকে আরেকটা কেবিনে ভর্তি করা হয়েছে।সবাই আশা ছেড়ে দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন তখন হঠাৎ ডাক্তারকে দোলার কাছে দৌড়ে যাওয়া তে সবাই অবাক হয়ে তাকালো। ডাক্তার দোলার পালস চেক করছেন। তারপর নার্সকে দেখে অক্সিজেন দিতে বলল।আর অক্সিজেন দোলার নাকে দিতেই দোলা জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। আস্তে আস্তে নিঃশ্বাস নেওয়া টা স্বাভাবিক হলো। সবাই বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে সবার চোখে-মুখে আশার আলো ফুটে উঠল।
ডাক্তার দোলাকে একটা ইনজেকশন দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, আর মামনি দের কাছে গেল,
মামনিরা ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
ডঃ দোলা..
মিরাক্কেল আপনাদের দলা বেঁচে গেছে। আমি তো একদমে আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম তখন কিভাবে কি হলো সত্যি আই এম শকড।
কিন্তু ডঃ দোলা তাহলে কথা বলছো না কেন?
তাকে ঘুমের ইনজেকশন দেয়া হয়েছে। এখন আর কোন চিন্তা নেই যা ছিল সব কেটে গেছে। আপনারা একদম নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন উনি 4/5 দিনের ভেতরে ঠিক হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ আমরা তো আশা করছি।

সবার মুখে খুশি দেখা পাওয়া গেল
সবাইকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আমার দিকে রুম থেকে বেরিয়ে এলো,,
এবার সবার চিন্তা করতে লাগল আদনান ভাই কোথায় গেছে। অনেকক্ষণ ধরে তাকে দেখা যাচ্ছে না। আমার জন্য ভাইয়া কেমন পাগল সবাই তা জানে। তাই আমার এই খবরটা ভাইয়া এখন জানানো দরকার। না হলে ভাইয়া কি থেকে কি করে বসবে সন্দেহ আছে।
কিন্তু কোথায় ভাইয়া কোথায় সবাই পাগলের মতো ভাইয়াকে খুজতে লাগলো। তারপর ফোন করতে লাগলো, কিন্তু রিসিভ করছো না?

সবাই আমার চিন্তা বাদ দে এখন ভাইয়া চিন্তা করছে।এদিকে ভাইয়া মসজিদে চলে এসেছিল আমার জন্য দোয়া করার জন্য যাতে আমি সুস্থ হয়ে যায়। আর ডাক্তার কে নিজের নাম্বার দিয়ে সে বলেছিল আমার জ্ঞান ফিরলে যেন জানায় আর না হলে সে ওখান থেকে আসবেনা। ডক্টর আঙ্কেল বুদ্ধি করে আমার জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে কল করে জানিয়ে দিয়েছে। ভাইয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মসজিদ থেকে আমার এখানে আসতে নেয়। গাড়ি চালাচ্ছে তাড়াতাড়ি তখনই ভাইয়ের চোখ যায় রাস্তার বাম কর্নারে।

সেখানে দাঁড়িয়ে আছে তিথি আর একটা ছেলে।ভাইয়া গান্ড়িটা খুব সাবধানে থামিয়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে সে দিকে তাকায় ভাইয়া তাকানোর মাঝে সামনে ছেলেটির তিথির গালে ঠাস করে চড় মারে রেগে।
এটা দেখে ভাইয়া হকচকিয়ে যায় সাথে সন্দেহ হয়
তাই লুকিয়ে তিথিদের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে কথা শোনার চেষ্টা করে।
তিথি বলছে,
ভাইয়া তুই আমাকে মারলি?
হ্যাঁ মারলাম। তুই কোন সাহসে দোলা কে মারার প্ল্যান করেছিস?
আমি ওকে মারবো সেটা তো আগে থেকেই জানো।
না আমি জানিনা আমি জানি শুধু এটুকুই তুই দোলাকে আদনানের থেকে দোলা কে সরাতে বলেছিলি।
হ্যাঁ বলেছিলাম কিন্তু তুমি সেই সব পারছ না।আর আমি আদনানের থেকে দোলাকের সরাবো বলেছি সরাতে না পারলে আমি পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবো দোলাকে ওর জন্য আদনান আমাকে বারবার অপমানিত করে। ইগনোর করেছে।

আদনান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে দোলার এই অবস্থায় জন্য তিথি দায়ী। ও ইচ্ছে করে দোলার এই অবস্থা করেছে।রাগে ওর ফর্সা মুখ রক্ত বর্ণ ধারণ করছে।
ও আড়াল থেকে তিরিশের কাছে যাওয়ার জন্য এক পা এগিয়ে যায় ওমনি ওর ফোন বেজে উঠে আর ওইদিকে থেকে তিথিরা ও ফোনের আওয়াজ পেয়ে পেছনে তাকায় চমকে।
আদনান তাড়াতাড়ি ফোন বের করে রিং অফ করে লুকিয়ে পরে।
এদিকে আরাফাত বদে উঠে,
তুই কাজটা ভুল করেছিস যদি দোলার কিছু হয় আমি তোকে বোন বলে ক্ষমা করবো না মনে রাখিস।
তিথি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে ভাইয়ের দিকে ,
মানে এসব কি বলছো?
ঠিকই বলেছি। দোলাকে আমি ভালোবাসি ওকে আমার চাই।আর তুই কিনা ওকে মেরে হসপিটালে পাঠিয়েছিস।
হতদম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে ভাইয়ের দিকে তিথি তারপর বলল,
হোয়াট,
দোলার কিছু হলে আমি তোকে ক্ষমা করবো না।আমি চেয়েছিলাম দোলা আমার হবে আর আদনান তোর কিন্তু তুমি কি করলি।
আমি তো এসব জানতাম না। আর তুই ওই দোলাকে পছন্দ করিস কবে থেকে‌।
আরাফাত কিছু না বলে হনহনিয়ে চলে গেল।এদিকে আদনান বিষ্ময়ে হতদম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের সমস্ত কথায় ও শুনেছে।
আদনান কি যেন ভেবে নিজের গাড়িতে ওঠে হসপিটালে চলে এলো। তারপর ধরে দোলার কেবিনে এলো সবাই চিন্তিত হয়ে দোলার কেবিনের বাইরে বসে ছিল। তখন ছুটে আদনান কে আসতে দেখে সবাই দাঁড়িয়ে পরে ওর কাছে আসে।
নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে লাগে। আদনান কোনমতে কাটিয়ে দোলার কাছে আসে।
দোলার অক্সিজেন খুলে দেয়া হয়েছে হাতে স্যালাইন চলছে। নিষ্পলক ভাবে দোলা দিকে তাকিয়ে থেকে আদনান পাশে গিয়ে বসে। দোলা ইনজেকশনে খুব ভয় পায় আর এখন কিনা ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। দেওয়া হবে কতটা ভয় পাবে ঘুম ভাঙলে।আদনান নিজের কাঁপা হাতটা আস্তে করে দোলার শুকনো গালে স্পর্শ করে। নিজের ভুলের জন্য দোলার এই অবস্থা। তিথিকে আমার আনা উচিত হয়নি ও ভালো হবার মানুষ না আমার আগে বোঝা উচিত ছিলো। ওর জন্য আমার দোলা রানী কত কষ্ট পাচ্ছে। আদনানের চোখের কোনে পানি জমে ওঠে। তিথিকে ও ওর ভাইকে এর চরম শাস্তি দিয়েই ছাড়বে। আদনানের চোখের পানি গাল বেয়ে দোলার হাতে পড়ে। আর তখনই দোলা পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। আদনান কে নিয়ে যে সামনে বসে থাকতে দেখে আমার চোখ ছল ছল করে ওঠে।আমার চোখ কেম গোলা হয়ে আসছে আমি আবার চোখ বুজে চোখ মেলে ভাইয়া দিকে তাকায়।
ভাইয়া আমার দিকে নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে আছে তার চোখের কোনে পানি জমে আছে। আমি দুর্বল গলায় ভাইয়াকে ডেকে উঠি,
ভা–ই–য়া
ভাই আমার মুখে কথা শুনে আমার আরেক পাশে এসে বসেছে যে পাশে স্যালান দেওয়া হয় নাই।
তারপর হাত শক্ত করে ধরে তিন-চারটা চুমু খেয়ে বলে,
কথা বলিস না তোর কষ্ট হবে দোলা রানী।
আমি আবার কিছু বলতে গেলে ভাইয়া হাত দিয়ে আমাকে চুপ করে থাকতে ইশারা করে।
একদম কথা বলিস না তুই আমাকে কত ভয় পায় দিছিলি জানিস।আমার মনে হচ্ছিল আমি আমার প্রাণ ভোমরা হারিয়ে ফেলছি।বুকের ভেতরটা কত ব্যথা করছিল জানিস আর কখনো এমন ভয় পাওয়াবি না আমাকে। না হলে কিন্তু সত্যিই তোর সাথে প্রেম করবো না।
কষ্টের মাঝেও ভাই আর এই কথা শুনে আমি মৃদু হাসলাম। আর ভাইয়ার বারণ সত্তেও বললাম,
আমি তো প্রেম করবই না আমি তো এবার বিয়ে করবো।
ভাই আমার কথা শুনে শকড হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
তারপর ভাইয়া বলল, পাগলি। বলে ভাইয়া মাথা উচু করে আমার সারা মুখে চুমুতে ভরিয়ে দিল। আমি চোখ বন্ধ করে ভাইয়ার স্পর্শ অনুভব করছি।কেমন যেন মাথা যন্ত্রণা করছে আমি নিজের মধ্যে থাকতে পারছিনা আসতে আসতে আমি ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলাম।

#চলবে