Monday, August 11, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1558



সংসার পর্ব-০৩

0

#সংসার
#পর্ব_০৩

#লেখিকা_সুরাইয়া_ইসলাম_সানজি

আর গল্পটায় মেইন চরিত্র মেঘ। তাই মেঘের সবদিকটা তুলে ধরেছি। অনেকেরই প্রশ্ন এটা মেঘের এতো কষ্ট কেনো?
শেষ পর্যন্ত পরলে সবটা বুঝতে পারবেন। আর এটা কোনো বাস্তব জীবন কাহিনী না, এটা গল্প শুধু বিনোদনের জন্য। আসা করি গল্পকে কেউ বাস্তব জীবনের সাথে গুলিয়ে ফেলবেন না। ভালোবাসা নিবেন।💚)
,,,,,,,

আমি রাকিব ভাইয়ের কথার জবাব না দিয়ে সেখান থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসি নয়তো রাকিব ভাইয়ার কথা আজ আর শেষ হবে না। লোকটা এমনই অদ্ভুত টাইপের। সবার সামনে গেলে গুলি মারলেও প্রয়োজন ছাড়া কথা বলবে না। কিন্তু আমাকে দেখলেই তার সব কথা পেট থেকে একসাথে বের হয়ে আসে।

আমি ফুপিকে সব কিছু গুছাতে সাহায্য করছি। বাবা আজও খুশি তবে মুখের সেই দীর্ঘ হাসিটা নেই। খারাপ হোক বা ভালো হোক দুটোই তার মেয়ে। একজনের বিয়ে ভেঙ্গে গেছে মনের ভিতর কষ্ট থাকলেও অন্য মেয়েটার ভালো জায়গায় বিয়ে হচ্ছে ভেবে বাবা খুশি।
বৃষ্টিকে আজ পরির মতো লাগছে। গা ভর্তি জিনিস দিয়ে সাজানো। আমি বৃষ্টির কাছে যেতে নিলে ফুপি পেছন থেকে হাত মুচড়ে আমাকে টেনে নিয়ে আসে আর কড়া গলায় বৃষ্টির কাছে যেতে নিষেধ করলো, অপয়া মেয়েদের নাকি সুন্দর জিনিসের কাছে যেতে নেই তাহলে সেখানেও খারাপের ছোঁয়া লাগে।

০৫.
সত্যিই কি অদ্ভুত সময়, আজ বৃষ্টির জায়গায় আমার থাকা উচিত ছিলো। কিন্তু আমি আজ বৃষ্টির কাছে যেতেও পারছি না। ফুপি ঠিকই বলে আসলেই আমি অপয়া।
আজ মা কে খুব মনে পরছে। মায়ের কাছে গিয়ে জানতে ইচ্ছে করছে সেও কি তার দুটি মেয়েকে আলাদা চোখে দেখতে পারতো? একজনকে লক্ষী আর অন্যজনকে অপয়া বলতে পারতো?

কিছুক্ষণ আগে রুদ্র স্যার বৃষ্টির হাতে আংটি পরিয়ে দিলো। ফুপি এতক্ষণ আমাকে সবার সামনে আসতে দেয়নি যদি কোনো অমঙ্গল হয় এটা ভেবে। কিন্তু এঙ্গেজমেন্ট শেষ হওয়ার পর রুমের দরজা খুলে দিছে। আমি দৌড়ে রুম থেকে নিচে নামি বৃষ্টিকে দূর থেকে দেখি। মেয়েটাকে রুদ্র স্যারের পাশে খুব সুন্দর লাগছে । দূর থেকেই ওকে মনে মনে দোয়া দিলাম যতোই হোক আমি ওর বড় বোন মায়ের মতো। আমার আপনজন বলতে তো বৃষ্টিই আছে।

আমাকে রাইমা ম্যাম দেখতেই কাছে এসে জিঙ্গেস করে-

“কিরে মেঘ এতখণ কোথায় ছিলে, সারা বাড়িতে তোমাকে খুজেছি কোথাও পাইনি। আসলে তোমাকে ধন্যবাদ দেওয়ার ছিলো। আজ যদি তুমি আমাকে ফোন না দিয়ে দেশে না নিয়ে আসতে, তবে আমি এতো আনন্দ কোথায় পেতাম বলো? তুমি আমার সব ভুল ধারনা দূর করে দিলে ধন্যবাদ তোমাকে। দেখো ওদের দুজন কে কতো সুন্দর লাগছে। বৃষ্টিও তোমারই মতো মিষ্টি একটা মেয়ে।
আরে মন খারাপ নাকি তোমার, এভাবে মুখ করে আছো কেনো? বলছিলাম না কখনো মন খারাপ করবেনা। তাহলে এর জন্য আমি নিজেকে দায়ী মনে করব।”

রাইমা ম্যামের কথা শুনে আমি হেসে দেয়। ইদানীং সব কথাতেই হাসিটা যেনো বাঝে অভ্যাস হয়ে গেছে। এই বাঝে অভ্যাসও বড্ড উপকার করে এর থেকে অনেক প্রশ্নের জবাব সহজেই ইগনোর করা যায়।

চারদিকে তাকিয়ে দেখছি কেউ কেউ খাবার খাচ্ছে আবার কেউ নাচছে এমন সময় রাকিব ভাই মাইকে আমাকে খান গাওয়ার জন্য ডাক দেয়। ছোট থেকেই গানের গলা ভালো হওয়ায় সব অনুষ্ঠানেই গান গাইতাম। আজ তারই সূএ ধরে রাকিব ভাই গান গাইতে সবার সামনে অনুরোধ করছে। চারপাশের লোকজন আমার দিকে তাকিয়ে আছে গান গাওয়ার জন্য অনুরোধ করছে। আমার হাত পা কাঁপছে এখান থেকে দৌড়ে রুমের ভিতর চলে যেতে ইচ্ছে করছে। মাহমুদের সাথে যেদিন থেকে কথা হয়নি তারপর আর গান গাওয়া হয়নি আজ এতোবছর পর গান প্রায় ভুলেই গেছি।

মাইক হাতে নিয়ে লম্বা করে একটা নিঃশ্বাস নিলাম, বাবা বলত এভাবে নিঃশ্বাস নিলে নিজেকে হালকা লাগে। চোখ বুঝে পরিচিত গানটি খাইতে শুরু করলাম। এই গানটা মাহমুদের খুব পছন্দের ছিলো। আগে মাঝে মাঝেই গাইতাম-

তুমি না ডাকলে আসবো না

কাছে না এসে ভালোবাসবো না

দূরত্ব কি ভালোবাসা বাড়ায়

নাকি চলে যাওয়ার বাহানা বানায়

দূরের আকাশ নীল থেকে লাল গল্পটা পুরোনো

ডুবে ডুবে ভালোবাসি

তুমি না বাসলেও আমি বাসি।
………………………………

গানের পুরোটা সময় চোখ বন্ধ করে ছিলাম। গান শেষ করে সবার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকালাম। আজ অনেক বছর পর গান গাইলাম কেমন হইছে জানার জন্য সবার দিকে তাকালাম। তখনই সবাই হাত তালি দিয়ে উঠলো। এতো এতো লোকের প্রশংসা পেয়ে আজ খারাপ লাগার ভিতরেও একটু খানি ভালো লাগা কাজ করছে।

এতক্ষণে আমার বৃষ্টির আর রুদ্র স্যারের দিকে চোখ গেলো। রুদ্র স্যার আমার দিকে এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হনহন করে বাহিরে চলে গেলো। সবাই হতবাকের মতো তাকিয়ে আছে হঠাৎ রুদ্র স্যারের চলে যাওয়ার কারন বুঝতে চেষ্টা করছে। স্যার খুবই রাগী তবে হঠাৎ হঠাৎ রাগের বদ স্বভাব তার নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে রুদ্র স্যারের মা সব মেহমানদের বুঝলো ‘রুদ্র স্যারের আগে থেকেই মাথা ব্যাথা ছিলো। হঠাৎ মাইকে এই রকম বেসুরো গলায় গান শুনে আরো মাথা ব্যাথা হওয়ায় রাগ করে চলে গেছে।’

সব মেহমান চলে গেছে, আর ১৫ দিন পরে বৃষ্টি আর রুদ্র স্যারের বিয়ে। ফুপি একের পর এক বকে যাচ্ছে কেনো আমি গান গাইলাম তাই। সারাদিনে কিছু খাইনি তাই আমি চুপচাপ বসে বসে খাচ্ছি। এখন আর ফুপির বকা গায়ে লাগে না ছোট বেলা থেকে বকা শুনতে শুনতে অভ্যাস হয়ে গেছে।

“বলি মেঘ তোর ভিতরে আল্লাহ লজ্জা দিতে কী ভুলে গেছিলো? নিজে তো অপয়া তার উপর নিজের বোনেরও ভালো চাস না তুই? এতো বড় বড় মানুষদের সামনে গান গেয়ে গাইকা হতে চেয়েছিলো। তোর ওই বেসুরো গান শুনে ভ্যাগিস তারা আমাদের কিছু বলেনি। আমারই ভুল হইছে তোকে রুম থেকে যেতে দেওয়া উচিত হয়নি।”

“আহ বড় মা, তুমি মেঘকে কেনো বকছো বলো তো? মেঘ কি ইচ্ছে করে গান গাইছে? বকলে আমাকে বকবে আমিই তো মেঘকে গান গাইতে জোর করলাম। আর কে বলছে মেঘ গান খারাপ গায়? গিয়ে দেখো তোমাদেরর আদুরে হবু জামাইয়ের হঠাৎ হঠাৎ মাথা ব্যাথার অসুখ আছে আর সেটা তার মা মেঘের গানের গলা খারাপ বলে কাটিয়ে নিছে। নয়তো মেঘের যা সুরলো গলা ওতে তো মাথা ব্যাথা ভয়ে পালানোর কথা।”

চুপচাপ একবার ফুপির দিকে তাকিয়ে তার কথা শুনছি আবার মুখের খাবার দিয়ে ঘাড় ঘুড়িয়ে রাকিব ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কথা শুনছি।
খাওয়া শেষ করে বাবার রুমে ওষুধ নিয়ে গেলাম। বাবা বিয়ের জন্য দেশের বাড়ির জমি বিক্রি করবে লোকও ঠিক হয়েছে। দুই দিনের ভিতরে জমি বিক্রি হয়ে যাবে। বিয়ের সব দায়িত্ব বাবা আমাকে আর রাকিব ভাইকে দিয়েছে। রাকিব ভাই এই ১৫ দিন বাড়িতে যাবে না এখানেই থাকবে। আমার এই বিষয়ে খুব বিরক্ত লাগছে রাকিব ভাইয়ের সাথে ১৫ দিন থাকলে নির্ঘাত তার কথা শুনতে শুনতে জ্ঞান হারাবো।

০৬.
আজ দুইদিন পর আবার অফিসে এসেছি। তবে এইবার আর বৃষ্টি আসেনি কেউ কী আর নিজের হবু স্বামীর অফিসে কাজ করে?
অফিসে ডুকতে নিবো তখনই কোথা থেকে রুদ্র স্যার এসে আমাকে টানতে টানতে তার গাড়িতে বাসায়। সবকিছু এতো দ্রুত হয় আমি আহাম্মকের মতো তার দিকে তাকিয়ে থাকি।

প্রায় দুইঘন্টা পর গাড়ি এসে নির্জন একটা জায়গা নদীর পাশে থামে। এই জায়গাটা আমার খুব পছন্দের আগে মাহমুদকে বার বার বলতাম তার সাথে দেখা করলে এই জায়গাতেই করবো।
কিন্তু রুদ্র স্যার কেন এখানে নিয়ে আসলো? মেরে গুম করে ফেলবে নাতো? আর এখানেই বা কেনো আসলো। নানা রকম প্রশ্ন মনের মাঝে উকি দিলেও আমি সব ভুলে প্রকৃতিকে অনুভব করি। এই জায়গা আমার আর বাবার খুব পছন্দের জায়গা। বাবা বলতো এই জায়গায় নাকি মায়ের সাথে প্রথম বাবার দেখা হয়েছিলো। ছোট বেলায় মাঝে মাঝে আমি আর বাবা দুজনে এখানে আসতাম কয়েক বছর থেকে পড়ালেখা আর কাজের ব্যস্ততায় এখানে আর আসা হয়নি। কিন্তু বৃষ্টি ছিলো এসবের ওল্টো আমি আর বাবা এখানে আসলে বৃষ্টি আর ফুপি যেতো শপিংমলে নয়তো কোনো মেলায়।
দুহাত মেলে পুরোনো শৃত্মি গুলো মনে করছিলাম। আমিই ভুলেই গেছি আজ আমার সাথে বাবা নয় রুদ্র স্যার এসেছেন।

হঠাৎ পিছন থেকে আমার গাওয়া সেই পুরোনো কন্ঠের কল রেকর্ড বেঝে ওঠে। এই গান গুলো আমি মাহমুদকে বলেছিলাম। তবে এগুলো রুদ্র স্যার কিভাবে পেলো।

আমি কাঁপা কাঁপা গলায় রুদ্র স্যার কে বললাম-
“এ এ এগুলো আপ আপনার কাছে কিভাবে আসলো, এসব তো আমার মাহমুদের_”

আমাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে, আমার কথার মাঝে রুদ্র স্যার বলতে শুরু করলো-
” আমায় চিনতে পারছো না সানু? আমিই তোমার মাহমুদ। এই শুনো আগের সেই ভয়েজ চিনতে পারছোনা তুমি?”

আমি সেই অাগের ভয়েজ, কথা বলার ভঙ্গি শুনে চিনতে পেরে কাঁদতে কাঁদতে ঘাসের উপর বসে অস্পষ্ট কন্ঠে বলি-
“আপনি আমার মাহমুদ? নাহ আপনি কী করে আমার মাহমুদ হবেন? আপনি তো রুদ্র স্যার। আপনি হতেই পারেন না আমার মাহমুদ।”

স্যার আমার সামনে হাটু গেড়ে বসে দু হাত দিয়ে গাল ধরে অভিমান ভরা কন্ঠে বলেন-
“কোথায় চলে গেছিলে সানু? জানো কত কত জায়গায় খুজেছি তোমায়। তোমার নাম্বার, ফেসবুক একাউন্ট সব বন্ধ পেয়ে পাগলের মতো হয়ে গেছিলাম। এই দেখো আজ সেই হাসিখুশি শান্ত ছেলেটা কতো কঠিন মনের হয়ে গেছে। সেদিন তোমাদের বাড়িতে এঙ্গেজমেন্টের সময় তোমার গানের প্রত্যেকটি সুর আমাকে এলোমেলো করে দিয়েছিলো, হৃদয়ে সেই পুরোনো ঝড় তুলেছিলো। তোমার এতোটা কাছে থেকেও আমি তোমাকে চিনতে পারেনি কতোটা হতভাগা আমি।”

আমি শব্দহীন ভাবে স্যারে দিক তাকিয়ে আছি। আজ বড্ড অপরিচিত লাগছে তাকে। স্যার পাগলের মতো করছে। পকেট থেকে ফোন বের করে আমার দিকে ফিরিয়ে বলে-

“এই দেখো আজো পাগলের মতো মেসেজ দেয় তোমাকে তুমি এসে মেসেজ দেখবে, উওর দিবে এই আশায়। তুমি জানো অফিসে যেদিন ইন্টারভিউ দিতে প্রথম এসেছিলে তখন তোমার নাম মেঘ দেখেই রাইমাকে চাকরি দিয়ে দিতে বলি। “সানজিদা সানজি মেঘ” এই নামটা যে আমার কলিজার সাথে মিশে আছে। যেখানেই এই নামের কাউকে দেখতাম সেখানেই তার ব্যাপারে সব জানতে চাইতাম। মনে আছে তোমার এই নামটা কেটে আমি ছোট করে তোমায় সানু নামে ডাকতাম? কেনো এমন করলে বলো তো কেনো না বলে চলে গেলে? কী ভুল ছিলো আমার,কী ভুল ছিলো?”

স্যার ওখানেই ঘাসের উপর বসে হাটু মুড়ে নিঃশব্দে কেঁদে ওঠে।

#চলবে…….

সংসার পর্ব-০২

0

#সংসার
#পর্ব_০২

#লেখিকা_সুরাইয়া_ইসলাম_সানজি

যখন জ্ঞান ফিরে তখন শুনি ডাক্তার বাবা আর ফুপিকে বলছে- “রোগী এখন সুস্থ তবে এক্সিডেন্ট কারনে পেটে ব্যাথা পাওয়ায় অপারেশন করতে হয়েছে। আমরা দুঃখিত আমাদের অপারেশনে একটু ভুলের জন্য রোগীর সন্তান হওয়ার ক্ষমতা একেবারে কমে গেছে। এই রকম রুগীর যদি বাচ্চা নেয় তবে কেউ একজন বেঁচে থাকবে। তাই আগেই সাবধান থাকবেন ভবিষ্যতে যেন এমন খারাপ কিছু না হয়।

ডাক্তারের কথাশুনে বাবা সেখানেই থম মেরে নিচের চেয়ারে বসে থাকে, ফুপি বাবাকে সান্তনা দেওয়ার জন্য কাধে হাত রাখতেই বাবা শব্দ করে কেঁদে ওঠে।
“বল তো রেনু (ফুপির নাম) কেন আমার মেয়েটার সাথেই বারবার এমন হয়। কি পাপ করছিলো মেঘ, ছোটবেলা থেকে একের পর এক কষ্ট পেয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। বলতে পারিস রেনু?”

“দাদা তুমি এমন করো না,শান্ত হও। হার্টের রুগী তুমি অসুস্থ হয়ে গেলে তোমার মেয়েদের কে দেখবে। আর তাছাড়া বৃষ্টির কি হবে। তোমার কিছু হলে মেয়েটা সামলাতে পারবেনা।”

“কি করে শান্ত হবো বল? রেনু তুই মেঘকে এসব ব্যাপারে কিছু জানতে দিস না আর বাহিরে কাউকে বলিস না এসব শুনলে কে নিবে আমার মা মরা মেয়েটাকে।”

বাবার চোখে জল দেখে আমার চোখ থেকে অজান্তেই জল গড়িয়ে পরতে থাকলো। অন্যের ভালো চাইতে গিয়ে নিজের এতো বড় ক্ষতি করে বাবাকে কষ্ট দিলাম। আজ বৃষ্টির পাপের শাস্তি আমি পাচ্ছি যা সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।

০৩.
আজ রাইমা ম্যাম আর আমাদের কোম্পানির মালিক নিজে এসেছেন আমাকে দেখতে। আগে কখনো দেখিনি এই ভদ্রলোক রুদ্র সাহেবকে।
ম্যাম অনেকক্ষণ থেকে আমার পাশে বসে আছেন।বড় স্যার কিছুক্ষণ থেকে চলে গেছে। তার বোনের প্রান বাঁচালাম তার পরিবর্তে একবারও জানতে চাইলোনা আমি কেমন আছি বা ঠিক আছি কিনা? বড়লোক বলে কথা এখানে সময় নষ্ট করে এসেছে এটাই তো অনেক। ভদ্রলোক অনেকগুলো ফলমূল আমার বেডের পাশে রেখে বাবার হাতে কতগুলো টাকা দিয়ে চলে গেলো কিন্তু রাইমা ম্যাম মাথা নিচু করে অপরাধি ভঙ্গিতে বসে আছে।

বাবার থেকে জানতে পারি রাইমা ম্যাম এই হাসপাতালের ডাক্তার। আজ সে যদি না থাকতো তাহলে যেভাবে আঘাত লাগছে তাতে আরো খারাপ কিছু হতে পারতো।
বাবা রাইমা ম্যামের কাছে গিয়ে অনুরোধ করে বলে কাউকে যেনো না বলে আমি কখনো সন্তান জন্ম দিতে পারবো না। ম্যাম তখন বাবার কান্না জড়িত অনুরোধ দেখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে-

“মেঘ তোমার কাছে কিছু চাইলে আমাকে দিবে প্রমিজ করো?”

“ম্যাম এভাবে বলছেন কেনো? আপনি চাইলে দিতে পারলে অবশ্যই দিবো।”

“আমি তোমাকে চাই, আমার ভাইয়ের বউ করে নিতে চাই। যাতে আজীবন আমার জন্য কষ্ট পেতে না হয়।”

“কি বলছেন ম্যাম! কোথায় আমি আর কোথায় আপনারা। এসব হয় না, আমরা সাধারণ মানুষ আপনাদের মতো না তাছাড়া স্যার আমাকে মানবে না। না আছে রূপ আর না আছে সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা। আপনার পরিবারের তারা কেউ এটা মানবে না ম্যাম।”

“মেঘ মানবেনা বা মানবে সেটা আমি বুঝবো। তুমি আমার অনুরোধটা রাখো প্লিজ নয়তো কখনো আমি নিজেকে নিজে ক্ষমা করতে পারবো না। ভাইয়া প্রথমে না মানলেও আমি জানি তুমি তোমার ধৈর্য দিয়ে মানিয়ে নিতে পারবে। তোমার মতো একজনই আমার ভাইয়ের যোগ্য। আর কি গ্যারান্টি আছে ভাইয়াকে অন্য কোথাও বিয়ে দিলে বাচ্চা হবে।”

সেদিন রাইমা ম্যামের কথা ফেলতে পারিনি। বাবাও এই বিয়েতে খুব খুশি ছিলো। কিছুদিনের ভীতর হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসি। তার দুইদিন পরে রাইমা ম্যামের পরিবার আমাকে দেখতে আসে। এক প্রকার জোর করেই রাইমা ম্যাম তাদের নিয়ে আসে । তাদের কথা শুনে বুঝতে পারি আমি যে বাচ্চা জন্ম দিতে পারবো না এটা তারা জানেনা। তখন রাইমা ম্যামকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে জিঙ্গেস করলে বলে-

“মেঘ এটা নিয়ে তুমি চিন্তা করো না। আমার ভাইয়ের সাথে একবার মানিয়ে নিতে পারলে বাচ্চা না হওয়াটা ব্যাপার না। দরকার হলে দওক নিবে। তবে এখন কাউকে বলবেনা।”

খুব বড় করে এগেন্জমেন্টের ব্যবস্থা করে। শহরের বড় বড় মানুষরা আসবে সেদিন যেখানে আমরা সামান্য একজন মানুষ। আমিও সব ভুলে নতুন করে আবার স্বপ্ন বুনতে শুরু করি। আজ কাল বাবার মুখের হাসি দীর্ঘ হয়েছে, এই হাসিটা দেখলে পুরোনো সব কষ্ট এমনিতেই ভুলে যাই।

০৪.
হঠাৎ একদিন কে জানি রাইমা ম্যামের মাকে আমার সব সত্যিটা বলে দেয়। তখন বড় ম্যাডাম আমাদের বাড়িতে এসে বিয়ে ভেঙ্গে দেয়। কিন্তু এতে তাদের সম্মানে আঘাত হানবে তাই আবার বিয়ে ঠিক করে তবে আমার সাথে না আমার ছোট বোন বৃষ্টির সাথে।

এবার রাইমা ম্যাম হাজার চেষ্টা করেও বিয়ে ভাঙ্গতে পারিনি। সেই রাগে সে বাড়ি থেকে বিদেশে চলে যায়। স্যারের একমাত্র ছোট বোন আমার কারনে বিদেশ চলে গেছে তাই সে আমার উপর আরো ক্ষেপে গেছে।
“নিজেকে খুব সুন্দরী মনে হয়? আপনার জন্য আমার বোন আজ আমার বিয়েতে থাকছে না। আপনি আমার সরল বোনটাকে ভুল বুঝিয়ে মন কেড়েছেন। আপনার থেকে বৃষ্টি অনেক ভালো। একই ফেমেলীতে দুটো বোন কিভাবে এতো পরিবর্তন হয়?
আজ যদি বৃষ্টি না থাকতো তবে আপনার ভালো মুখের আড়ালে লোভী চেহারাটা দেখতেই পারতাম না। বৃষ্টি অনেক ভালো মেয়ে ওকে বিয়ে করতে আমার আপত্তি নেই, তবে যদি আমার বোন আমার বিয়েতে না থাকে তাহলে আমিও এই বিয়ে করবোনা।”

তখন আমি রাইমা ম্যামকে ফোন করে দেশে নিয়ে আসি এটা বলে যে আপনার সেইদিন হাসপাতালে বসে অনুরোধ রেখেছিলাম আর আজ আপনি আমার অনুরোধ রাখতে দেশে আসবেন। আমি আজ আরো বেশি খুশি আমার বোন আপনাদের বাড়িতে যাচ্ছে। এখন আপনি না আসলে বড় স্যার বিয়ে করবেনা আর এবারও বিয়ে না হলে বাবা অসুস্থ হয়ে পরবে।

জানিনা ম্যাম সেদিন আমার হাসিমুখের আড়ালে চেহারাটা দেখতে পেয়েছিলো কিনা। সেদিন ম্যাম বলেছিলো “দেখো মেঘ তোমার জীবনে আরো ভালো কেউ আসবে, তুমি আসলেই খুব ভালো মেয়ে তবে ওয়াদা দাও তুমি সব সময় হাসিখুশি থাকবে। কখনো মন খারাপ করে থাকবে না তাহলে আমার মনে হবে এর জন্য আমি দায়ি।”

আস্তে আস্তে সময় এগিয়ে যায়। মনের ভিতর থাকা আবেগ আর ভালোবাসা দুটোই চাপা দিয়ে রাখি। আজ সন্ধ্যায় বৃষ্টি আর রুদ্র স্যারের এঙ্গেজমেন্ট বাড়িতে মেহমান ভরপুর। হঠাৎ মেহমানদের ভিতরে একজন দেখে চমকে ওঠি। রাকিব ভাই ফুপির দেবরের ছেলে। ফুপি কোনো ছেলে ছিলো না তাই রাকিব ভাইকে নিজের ছেলের মতোই দেখে। আমাদের কোনো সমস্যা হলে আগে রাকিব ভাইকেই বলতো ফুপি।
এই ছেলেটা আমাকে ছোট বেলা থেকে পাগলের মতো ভালোবাসে। মোটামুটি ভালো চাকরি করছে তবে তার এই ভালোবাসা আমার কেন জানি বিরক্ত লাগে। মাঝে মাঝে তার জন্য মায়া লাগলেও ভালোবাসা হয়ে ওঠিনি। মনের ভীতরে একজনকে যত্ন করে রাখলে বাকি সবাইকে তার জায়গায় বসাতে বিরক্ত লাগে।

“কেমন আছো ময়না, আজ কি বিরক্ত লাগছে না আমাকে? জানো তোমার মুখে ‘আপনাকে খুব বিরক্ত লাগছে’ শুনতেও খুব ভালো লাগে।”

“হ্যা ভাই আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছি। আপনি তো দেখি এই পাঁচ বছরে একটুও বদলে যান নি। দেখতে চেহারায় পরিবর্তন আসলেও মুখের ভাষা বদলেনি। এখনো একবারেই সব কথা বলে শেষ করার প্রতিযোগিতা করতে চান?”

রাকিব ভাই শব্দ করে হেসে ওঠলো-
“মেঘ তোমার মুখের সব কথাই বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হয়। তোমার বলা একটা শব্দ যদি শুনতে না পাই বা বাসাতে হারিয়ে যায় তবে মনে হয় বড় কোনো কিছু মিস করে ফেলেছি শুনতেই হবে।
আর তুমি না বলেছিলে তোমার সামনে না আসতে তাই তোমার কথা রাখতে এই পাঁচ বছর আসিনি। জানো এটাও বেশ মজার ব্যাপার। প্রত্যেকটি দিন কেটে যাওয়ার পর ভাবতাম তোমার কথা আমি আরো একদিন রাখতে পেরেছি।
চেহারায় পরিবর্তন তো উপর আল্লাহ দিয়েছে কিন্তু কথার পরিবর্তনটা আমার নিজের ভিতর যা কখনো করতে পারবো যতোদিন তুমি আছো। তোমাকে দেখলেই আমার সব কথা একসঙ্গে বলতে ইচ্ছে হয়।”

রাকিব ভাই চারদিকে তাকিয়ে এবার সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো-
“দেখো মেঘ কতো লাল নীল ফুলে ঘর সাজানো আচ্ছা তোমার ইচ্ছে হয়না তোমাকে কেন্দ্র করেও এমন করে সাজানো হোক? আমি তোমাকে বৃষ্টির হবু জামাইয়ের মতো এতোকিছু দিয়ে সাজাতে না পারলেও তার থেকেও বেশি ভালোবাসা দিয়ে সাজাতে পারবো?”

আমি রাকিব ভাইয়ের কথার জবাব না দিয়ে সেখান থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসি নয়তো রাকিব ভাইয়ার কথা আজ আর শেষ হবে না। লোকটা এমনই অদ্ভুত টাইপের। সবার সামনে গেলে গুলি মারলেও প্রয়োজন ছাড়া কথা বলবেনা। কিন্তু আমাকে দেখলেই তার সব কথা পেট থেকে একসাথে বের হয়ে আসে।

#চলবে,,,,,,,,,,

সংসার পর্ব-০১ | বাংলা রোমান্টিক ভালোবাসা গল্প

0

#সংসার
#পর্ব_০১

#লেখিকা_সুরাইয়া_ইসলাম_সানজি।

০১.কিছুক্ষণ আগে আমার বিয়ে হয়েছে ছোট বোনের জামাইয়ের সাথে। তিন মাসের ছোট মেয়ে পূর্ণতাকে কোলে নিয়ে বসে আছি বাসর নামের সাজানো ঘরটিতে।
আজ থেকে তিন মাস আগে যে ছিলো আমার ছোট বোনের স্বামী আজ সে আমার স্বামী।

প্রতিটা মেয়ের বাসররাত নিয়ে আলাদা স্বপ্ন থাকে, আলাদা করে ভাবনা থাকে। কিন্তু আমি মনেহয় এমন একজন মেয়ে যে কিনা একরাশ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বসে আছে।
এই মুহূর্তে আমার কিছুটা ভয় আর লজ্জা নিয়ে বসে থাকা উচিত কিন্তু অবাক করা বিষয় দুটোর একটি জিনিসও আমার ভিতরে নেই। সামনের দিনগুলোই কিভাবে এইলোক টার সাথে মানিয়ে নিবো, কিভাবে সারাটা জীবন একসঙ্গে থাকবো, আদৌও কি আমাকে মেনে নিবে? হাজার প্রশ্ন মনের মধ্যে চেপে রেখে কোলে ছোটবাবু নিয়ে বসে আছি বাসর ঘরে।

হঠাৎ দরজা খুলার শব্দে একটু নড়েচড়ে বসলাম। মৃদু আলোয় অন্ধকার রুমে পায়ের শব্দে বুঝলাম রুদ্র আমার দিকে এগিয়ে আসছে। ভয়ে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, এই ভয়টা আমার আজ হেরে যাওয়ার ভয়। ভাবছিলাম রুদ্র হয়তো সব গল্পের মতো আমার কাছে এসে ঘৃণা চোখে বলবে,
“কখনো আমার থেকে স্বামীর অধিকার চাইতে আসবেনা। তোমাকে আমার মেয়ের জন্য বিয়ে করেছি, তুমি আমার মেয়ের ঠিকভাবে যত্ন নিবে। আমি তোমার সব অভাব, স্বপ্ন পূরণ করব বিনিময়ে আমার মেয়েকে ভালোবাসবে। তুমি শুধু আমার মেয়ের সৎ মা তাছাড়া আর কিছুই না।”

রুদ্র আমার সব ভাবনায় জল ঠেলে, আমার কাছে এসে নিজের সাথে আমাকে মিলিয়ে নিলো। কাঁপা কাঁপা হাতে আমায় স্পর্শ করছে সম্পূর্ণ নিজের মতের বিরুদ্ধে।
আমার বাসররাত নিয়ে স্বপ্নটা এমন থাকলেও আজকে কখনো এমনটা হবে ভাবিনি। রুদ্র সব স্বামীর মতো ব্যবহার করলেও রুদ্রের ছোঁয়ায় দ্বায়িত্ব কর্তব্য ছাড়া ভালোবাসা খুজে পেলাম না।
অস্বস্তি সাথে রুদ্রকে মেনে নিলেও মনের মতো করে পাইনি। অসহ্য ব্যাথায় অচেতন হয়ে পরে রইলাম। রুদ্রের সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। সে স্বামীর কর্তব্য পূরণ করতে ব্যস্ত। কিছুখন পর রুদ্র রুম থেকে চলে গেলো। আমি অচেতন অবস্থায় সেখানেই পরে রইলাম।
,

আজানের সুর শুনে ঘুম ভেঙ্গে যায়। নিজের দিকে তাকাতেই রাতের কথা মনে পরে যায়। বিছানার চাদর গায়ে জড়িয়ে কোনো রকমে ওয়াশরুমে আসি। গোসল করে নামাজ পরে নেই। ছোট বেলা থেকে যতোই কষ্ট হতো না কেন, কারো কাছে অভিযোগ করতাম না। নামাজে বসে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করতাম আমার থেকেও খারাপ অবস্থায় আরো মানুষ আছে তাদের থেকে তো আমি ভালো আছি সুস্থ আছি এটাই শুকরিয়া।
কিন্তু আজ সৃষ্টিকর্তার কাছে খুব অভিযোগ করতে ইচ্ছে করছে। কেনো আমার জীবনটা এমন হলো?
,

পূর্ণতাকে আমি জন্ম না দিলেও আজ থেকে আমি ওর মা। আজ থেকে ওর সব আবদার আমার কাছে। দোলনা থেকে কোলে তুলে জানলার সামনে দাড়ালাম। হালকা রোদের আভা পেয়ে পূর্ণতা হাত পা ছড়িয়ে দিলো। এটাই প্রত্যেক মায়ের কাছে স্বর্গে দেখা শ্রেষ্ঠ দৃশ্য। আমি আমার মাকে কখনো দুচোখে দেখিনি। জন্ম হওয়ার পর থেকে ফুপির কাছে ছিলাম ফুপি অযত্নে না রাখলেও মায়ের ভালোবাসা কখনো পাইনি। তাই আজ পূর্ণতাকে ছুয়ে ওয়াদা করলাম পূর্নতাকে কখনো মায়ের অভাব বুঝতে দিবোনা। সব সময় আদরে বড় করবো। যে ভালোবাসা আমি পাইনি সে ভালোবাসা থেকে আমি পূর্ণতাকে বঞ্চিত করবো না।
,

সকাল ১২টা। রাত থেকে এখন পর্যন্ত রুদ্র একবারের জন্যও রুমে আসেনি, বাড়িতে তেমন কারো সাড়া নেই। সবাই নিজের কাছে ব্যস্ত। কিছুক্ষণ আগে রাইমা রুমে নাস্তা আর বাবুর ফিটার রেখে গেছে। নাস্তা খেয়ে কিছুটা ভয় আর সংকোচ নিয়ে বাবুর জন্য গরম পানি করতে রুমের বাহিরে বের হয়।
সোফায় বসে বসে রুদ্র ফোন টিপছে। শাশুড়ি মা নিজের মতো করে সোফায় বসে বসে কফি খাচ্ছে আর পেপার পরছে। বাসার এতো কাজের লোক থাকা সত্বেও কারো মুখে কোনো কথা নেই, সবাই সবার সাথে চুপচাপ কথা বলছে। আমাকে সবাই কেমন যেনো এড়িয়ে যাচ্ছে, কেউ আমাকে চিনে না এমন ভাব। শাশুড়ি মায়ের সামনে গিয়ে নিচু স্বরে সালাম দিলাম। শাশুড়ি মা আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার পেপার পড়ার মন দেয়। রুদ্র একবারের জন্য আমার দিকে তাকায়নি।
রান্নাঘরে একটা পাতিলে গরম পানি দিতে গেলে একটা বয়স্ক মহিলা চুপচাপ আমার হাত থেকে পানির পাতিল নিয়ে গরম পানি করা একটা ফ্লাক্স হাতে ধরিয়ে দেয়।
,

রামে এসেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠি। এমন পরিবার আমি চাইনি, যেখানে আমি সব পাবো কিন্তু মন খুলে কারো সাথে কথা বলতে পারবো না। চোখ থেকে অঝোরে জল পরছে, আজ চেষ্টা করেও কান্না ধামাতে পারছিনা। কেনো আমার সাথেই এমন হলো? যাকে পাবোই না তাকে তো ভুলেই গেছিলাম তাহলে সে কেন আবার আমার জীবনে আসলো? যে অতীত বার বার ভুলতে চাই সেই অতীত বার বার কেন সামনে আসে?
,

০২.অতীত,,,,,,
আমি আর বৃষ্টি জমজ হলেও বাবা বলতো আমি বৃষ্টির থেকে ১৫ মিনিটের বড় ছিলাম। বৃষ্টির গায়ের রং ছিলো ধবধবে ফর্সা আর চঞ্চল প্রকৃতির কিন্তু আমি ছিলাম ওল্টো উজ্জ্বল শ্যামলা মায়াবতী লাজুক স্বভাবের।

ফুপির কোনো সন্তান ছিলো না, একসঙ্গে বাবার দুটো মেয়ে হওয়ায় বাবার ছোট মেয়েকে ফুপিকে দিয়ে দেয়। তার প্রায় ছয় মাসের মাথায় বাবার সরকারি চাকরি চলে যায়, তার তিন মাস পরে সিড়ি থেকে পরে গিয়ে মা মারা যায়।
তারপর থেকে আমি আর বৃষ্টি একসাথে ফুপির কাছে থাকি। মা খুব শখ করে আমাদের দুই বোনের নাম রেখেছিলো মেঘ আর বৃষ্টি।

যখন আমাদের তিনবছর বয়স তখন ফুপির হাসবেন্ড গাড়ির সাথে এক্সিডেন্ট করে মারা যায় সেই থেকেই আমি ফুপির চোখের বিষ ছিলাম। ফুপির ধারনা আমি অলক্ষী। ফুপি সব সময় আমায় বলতো জন্মের পর বাবার চাকরি আর মাকে খেয়েছি এখানে এসে তার স্বামীকে মেরে ফেলেছি। আমার মতো অপয়া আর কোথায় আছে।

ছোট বেলা থেকেই অযত্নে বড় হই। বৃষ্টি আমার সব আদর কেড়ে নেয় তবুও কখনো হিংসা হয়নি ছোট বোন তো। বাবা সব সময় বলতো ছোটোরা যাই করে না তাদের বুঝিয়ে বলবে। তাদের বকতে হয় না ভালোবাসা দিয়ে পরিবর্তন করতে হয়।
বৃষ্টি ছোট থেকেই চালাক ছিলো, কোনো ভুল করলেও আমার নামে চালিয়ে দিতো যার ফলে ফুপি আমাকে আরো বকতো। ফুপি বাবাকে কিছু বলতো না কষ্ট পাবে তাই। কিন্তু বাবা তো সে, সবই বুঝতো। ফুপির কাছে আমার ভালোবাসার পরিমাণ কম থাকলেও বাবার কাছে ভালোবাসা আদর সব পেয়েছি।

এইচ এস সি শেষ হওয়ার পর বাবা বৃষ্টির অনুরোধে ওকে ফোন কিনে দেয় সেই সাথে আমাকেও। ফোনের ব্যপারে আমার একটুও আগ্রহ ছিলো না, ফোনের কিছুই জানতাম না। বাবা এক প্রকার জোর করে আমাকে ফোন দেয়। বৃষ্টির থেকে টুকটাক যতোটা শিখতে পারতাম ততো টাই চালাতাম।
একবার বৃষ্টির সাহায্যে ফেসবুক একাউন্ট খুলি সেখানে পরিচয় হয়েছিলো মাহমুদ চৌধুরী নামের একটা ছেলের সাথে। তারপর থেকে আমার যতো সমস্যা হতো মাহমুদ বললাম ও কেমন করেই যেনো সব ঠিক করে দিতো। আস্তে আস্তে আমি মাহমুদকে ভালোবেসে ফেলি। ততদিনেও আমরা দুজন দুজনকে দেখিনি শুধু মেসেজে কথা বলতাম। সে কখনো আমাকে ভালোবাসে কিনা বলেনি তবে মাহমুদের লুকানো কেয়ারিং দেখে মনে হতো ও আমাকে ভালোবাসে।

বৃষ্টিকে মাঝে মাঝে তার ব্যাপারে বললে ও তুচ্ছের ছলে বলত-
“আগে তো নিজের চেহারা দেখ, আর এই যুগে ছবি না দেখে ভালোবাসা হয় না। ছেলেটা তোকে ইউজ করছে নয়তো কি দেশে মেয়ের অভাব পরছিলো যে তোকে ভালোবাসবে?’

আসলেই তো বৃষ্টির কথাই ঠিক ছিলো দেশে কি মেয়ের অভাব যে আমাকে ভালোবাসবে। তবুও মন মানতো না লুকিয়ে লুকিয়ে ফোনে কথা বলতাম। মাঝে মাঝে ভয়েজে গান শুনাতাম। মাহমুদেরও যেনো আমার গান না শুনলে ঘুম আসতো না আর আমারো ওকে গান না বললে চোখে ঘুম আসতো না।
এভাবেই দিন কাটছিলো হঠাৎ একদিন বাবা অসুস্থ হয়ে পরে। হাতে কারো কাছে টাকা ছিলোনা তখন আমি আমার ফোন বিক্রি করে বাবার চিকিৎসা করাই সে সময়ও ফুপি বলেছিলো- “অপয়া অলক্ষি মেয়ে তোর জন্য আমার ভাইটার জীবন দেখবি একদিন শেষ হয়ে যাবে। এবার একটু আমাদের নিজেদের মতো বাঁচতে দে। কোথাও চলে যা এ বাড়ি ছেড়ে।”
আস্তে আস্তে মাহমুদ কে মনের গহিনে রেখে ওর কথা ভুলতে চেষ্টা করি।

পড়ালেখা শেষ করে আমি আর বৃষ্টি কাজের জন্য বিভিন্ন অফিসে যায় এমনই একদিন “মাহমুদ মাহ্দি রুদ্র চৌধুরী” কোম্পানির সন্ধান পাই।
সেখানে গিয়ে আমার উন্নত মানের চাকরি হলেও বৃষ্টির হয়েছিলো নিম্নমানের চাকরি। পড়ালেখায় বৃষ্টি কখনোই ভালো ছিলোনা তাই ভালো সার্টিফিকেট ছিলো না।
অফিসে ইন্টারভিউ জন্য যখন গিয়েছিলাম তখন অফিসের একজন রাইমা নামের লেডি বস বৃষ্টিকে বলেছিলো-
“এই তো সার্টিফিকেট তার উপর ভালো চাকরি খুজছেন, লজ্জা করছেনা? আপনার তো হাড়ি পাতিল ঘষার মতো সার্টিফিকেট এখানে কেনো এসেছেন? বেড়িয়ে যান।”

তখন আমি রাইমা ম্যামের হাতে পায়ে অনুরোধ করে বৃষ্টির জন্য চাকরি ভিক্ষা চাই। আমার সবকিছু সেদিন পজিটিভ দেখে আমার অনুরোধে বৃষ্টিকে সেদিন কাজ দেয় তবে খুব নিম্নমানের।

বৃষ্টি তখন থেকে রাইমার ম্যামের উপর প্রতিশোধ নিতে চাইছিলো। ছোট বেলা থেকেই কেউ ওকে অপমান করলে ও তার প্রতিশোধ নিতে নিতে এক প্রকার জেদ কাজ করতো ওর ভিতর। ভালো হোক বা খারাপ হোক নিজের ইগোকে কেউ ছোট করলে তাকে শাস্তি দিবেই।

একদিন অফিসের জন্য রেডি হচ্ছিলাম তখন দেখি বৃষ্টি ফুপির সাথে প্লান করেছিলো কিভাবে রাইমা ম্যামকে শিক্ষা দিবে। কিন্তু আমি গোপনে ওর প্লান সবটা শুনি। অফিসে পৌছে আমি ওর পিছন পিছন থাকতাম।
সেদিন অফিসের লিফট বন্ধ হওয়ায় সবাই সিড়ি দিয়ে যাওয়া আসা করতো। বৃষ্টি সেই সুযোগ কাজে লাগায়। রাইমা ম্যাম কে কেবিন থেকে বের হতে দেখে ও সিড়িতে তৈল ফেলে দেয়।
সিড়িতে তৈল থাকায় ম্যাম পা পিচলে সাত তলা থেকে গড়িয়ে পরতে থাকে। গড়িয়ে গড়িয়ে যখন নিচে পরছিলো সবাই তাকিয়ে ছিলো কিন্তু কেউ কাছে যায়নি। আমি দৌড়ে গিয়ে রাইমা ম্যামকে ধরি, কিন্তু তাল সামলাতে না পেরে আমি নিজে পরে যায়। সেদিন রাইমা ম্যাম ঠিক থাকলেও আমার মাথা ফেটে রক্ত বের হয় আর সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
যখন জ্ঞান ফিরে তখন শুনি ডাক্তার বাবা আর ফুপিকে বলছে-
“রোগী এখন সুস্থ তবে এক্সিডেন্টের কারনে পেটে ব্যাথা পাওয়ায় অপারেশন করতে হয়েছে। আমারা দুঃখিত আমাদের অপারেশনে একটু ভুলের জন্য রোগীর সন্তান হওয়ার ক্ষমতা একেবারে কমে গেছে। এই রকম রুগীর যদি বাচ্চা নেয় তবে কেউ একজন বেঁচে থাকবে। তাই আগে থেকেই সাবধান থাকবেন ভবিষ্যতে যেন এমন খারাপ কিছু না হয়।”

আগন্তুক পর্ব-১৫ এবং শেষ পর্ব

0

আগন্তুক
– সাবিহা বিনতে রইস

শেষ পর্ব

অন্তু ভেবেছিলো তনিমাকে বাসায় ছেড়ে তবে লাবণ্যদের বাসায় যাবে৷ তবে মাঝ পথে সে গোঁ ধরেছে, কিছুতেই বাড়ি ফিরবে না। সেও তার সাথে থেকে পুরো ব্যাপারটা জানতে চায়৷ এমনিতে অবশ্য বাড়িতে লাবণ্যদের পুরো পরিবার আছে। তাছাড়া এই বিষয়ের তদন্তে তনিমাও কম কষ্ট করেনি৷ তাই সাতপাঁচ ভেবে তাকে নিয়ে অন্তু লাবণ্যদের বাসার কাছাকাছি এসে পৌছুলো৷ আজ দুপুরে তনিমালা ফোন নিয়ে বেরিয়ে এসেছে শুনে, সাথে সাথেই লাবণ্যদের বাসায় সাদা পোশাকের ফোর্স পাঠিয়েছিলো সে। প্রায় ১৫ জনের একটা দল ছদ্মবেশে ঘিরে রেখেছে বাড়ি। শ্রাবনের আকাশে আজ পূর্ণিমা। মেঘলা অম্বরে চকচকে সুন্দর চাঁদটার মুখ কালিমাখা। অন্তু গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো লাবণ্যদের বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে। তনিমা তার পাশের সিটে বসা। প্রায় নিস্তব্ধ৷ বাক্যহীন। তার ফাঁকা দৃষ্টি কাচের ওপারে অন্ধকার দেখছে। অন্তু তার হাতে হাত রাখলো৷ চকিতে একটু কেঁপে উঠলো সে। পলকের চুল সরানোর ভঙ্গিমায় দুই হাতের আঙ্গুল ঘুরিয়ে মুছে নিল কান্না। এই চাপ চাপ অন্ধকারেও অন্তুর চোখ এড়ালো না বিষয়টা।

– স্যার!

অন্তু গাড়িজানালার কাঁচ নামিয়ে তাকালো৷ তার অফিসের জুনিয়র এক কর্মকর্তাকে আজকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সে স্যালুট ঠুঁকে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো। পলকে একবার তাকালো তনিমার দিকে। তারপর আবার দৃষ্টি ঘুরিয়েছে অন্তুর চোখে।

– সব ঠিক আছে?

– একদম স্যার! উনি একবার শুধু বাড়ি থেকে বের হয়ে লোকাল থানায় গিয়েছিলেন। ফোন চুরি গেছে বলে থানায় ডাইরি লিখিয়েছেন। তারপর ফিরে এসে আবার বাসায় ঢুকেছেন। শুধু মাত্র মাওলানা সাহেবারা ছাড়া, আর কেউ বাসা থেকে বের হয়নি।

– আর আসামী কে নিয়ে আসা হয়েছে?

– জ্বি স্যার। পুলিশসহ পেছনের গাড়িতে রাখা হয়েছে তাকে।

অন্তু মাথা ঝাঁকালো।

– ওকে, আমি ভেতরে যাচ্ছি৷ তোমরা রেডি থেকো। যখন তখন আমি সংকেত দিব।

– ওকে স্যার।

জুনিয়ার কর্মকর্তা স্যালুট দিতেই জানালার কাঁচ তুলে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে গেল অন্তু। গেটের কাছে বার দুয়েক হর্ণ দিতেই দারোয়ান বেরিয়ে এলো। তনিমাকে এক ঝলক দেখে, কোন কিছু চিন্তা না করে দৌড়ে গিয়ে গেট খুলে দিল। অন্তু গাড়ি নিয়ে সরাসরি গিয়ে দাড়ালো গাড়ি বারান্দায়। তনিমার ততক্ষণে বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়ে গেছে। বারবার মনে হচ্ছে যা হচ্ছে, তা কি ঠিক হচ্ছে? কোন ভুল হচ্ছে না তো? কাঁপা কাঁপা পায়ে সে দাড়ালো গেটের সামনে। এই জায়গাটা সকালের মতোই সাজানো আছে। কোন কিছু খোলা হয়নি। শুধু সকালের সেই লোকজন গুলো নেই৷ সব ফাঁকা। অন্ধকারে যেন এক মৃত্যুপুরী।

দরজাটা ভেজানো ছিলো৷ তনিমা প্রথমে পা রাখলো, তার পেছনে অন্তু। ভেতরে ঢোকা মাত্র, সামনে লাবণ্যর মা৷ তাকে দেখা মাত্র এগিয়ে এসেছে।

– কি ব্যাপার মামনি? হঠাৎ কোথায় চলে গিয়েছিলে? দুপুরে কতবার ফোন দিলাম, পেলাম না। এভাবে না বলে কেউ যায়?

তনিমার বড্ড বিব্রত লাগছিলো। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

– সরি আন্টি৷ আসলে একটা কাজ পড়ে গিয়েছিলো। দেখুন না, আমার সাথে কে এসেছে?

লাবণ্যর মা পেছনে তাকালেন। এতক্ষনে তিনি একবারও পেছনে খেয়াল করেননি। অন্তুর উপরে চোখ পড়তেই বেশ হাসিখুশি মুখে এগিয়ে গেলেন,

– আরে, অন্তু নাকি? অনেকদিন পরে দেখলাম৷ সেই কবে একবার এসেছিলে! আর আমরাও পরে এমন একটা অবস্থায় পড়লাম, তোমাকে আসতেও বলা হয়নি। এই দেখো। দাঁড়িয়ে রেখে কথা বলছি। এসো না, বসো!

– ব্যাপার না! ঠিক আছে আন্টি। আমি বসছি। চয়ন ভাই আছে?

– হ্যা, চয়ন তো বাসাতেই আছে। আজ আবার আরেক কাণ্ড ঘটেছে, জানো? চয়নের ফোনটা হারিয়ে গেছে। কি যে একটা অবস্থা!

তনিমা আড়চোখে তাকালো অন্তুর দিকে৷ সে ভাবলেশহীন মুখে কথা শুনছে আন্টির। শুধু তনিমা স্বাভাবিক হতে পারছে না৷ হার্টবিট বেড়ে গেছে মনে হচ্ছে। নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করে বললো,

– আন্টি, লাবন্য এখন কেমন আছে?

লাবণ্যর মায়ের মুখে সাথে সাথে চোখা বিষাদ।

– ঘুমাচ্ছে। শান্ত আছে এখন। তোমরা বসো৷ একটু চা খেয়ে যাও। আর আমি চয়নকে পাঠাচ্ছি।

সাথে সাথে থামিয়েছে অন্তু।

– আন্টি, এক মিনিট! চায়ের ব্যবস্থা করতে হবে না। আজ আমরা একটা অফিসিয়াল কাজে এসেছি।

লাবণ্যর মা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। তার চোখে জিজ্ঞাসা,

– অফিসিয়াল কাজ? ঠিক বুঝলাম না!

অন্তু উঠে দাড়ালো৷ মৃদু হেসে, স্বভাব সুলভ মিষ্টি স্বরে বললো,

– আপনি তো জানেন, আমি কি কাজ করি? বাসার সবাইকে ডাকুন। প্রত্যেকে যেন উপস্থিত থাকে। হাতে সময় কম আমাদের!

——————————————————

সচরাচর অন্তু কারো সামনে সিগারেট খায় না। আজ একদম ব্যতিক্রম। তনিমার মনে হচ্ছিলো সে নতুন কাউকে দেখছে। পুরোদস্তুর পেশাদার একজন মানুষ। সাজানো ড্রয়িং রুমে সবাই এসেছে বসেছে। লাবণ্যর বাবা, মামা, চাচা, চাচী, ফুপু, আর চয়ন। লাবণ্যকে আনা যায়নি৷ সে ঘুমাচ্ছে ঘরে। চয়নের পরনে সকালের সেই সাদা পাঞ্জাবী। চোখ মুখে ক্লান্তি। কেমন যেন বিপর্যস্ত ভাব। তনিমা দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্তু সিগারেটটা সামনের এ্যাশট্রে তে গুজে দিয়ে চয়নের দিকে ফিরলো।

– তা চয়ন ভাই, সব কিছু আপনি নিজের মুখে বলবেন? নাকি আমাকে দিয়ে কষ্ট করাবেন?

চয়ন পাশের ছোট টেবিলে রাখা টিস্যুবক্স থেকে একটা টিস্যু তুলে নিয়ে কপাল মুছলো৷ তারপর গম্ভীর গলায় বললো,

– আমি কিছুই বুঝতে পারছি না অন্তু। আমার স্ত্রী অসুস্থ। তোমরা সব কিছু জানো। তারপরও এইসবের মানে কি?

অন্তু হাসলো,

– মানে আমি কিভাবে বলব? খুন কি আমি করেছি? খুন তো করেছেন আপনি। আপনাকে বলতে দেওয়াটা যুক্তিসঙ্গত।

লাবণ্যর বাবা চমকে উঠেছে।

– খুন? কিসের খুন? চয়ন, ওরা কি সব বলছে?

চয়ন ঝট করে উঠে দাঁড়িয়েছে।

– আমি জানি না বাবা!! কি শুরু করেছে এরা? শোনো অন্তু, আমার সময়ের দাম আছে। আমি তোমাদের গাল গপ্প শুনতে ইন্টারেস্টেড নই।

– কুল ডাউন চয়ন ভাই। এত অল্পতে ক্ষেপে গেলে চলবে? দেখুন, আমি আপনাকে সুযোগ দিলাম একটা। আমি যখন বলা শুরু করব, তখন কিন্তু আর একটা বাক্য বলারও সুযোগ দেব না।

লাবণ্যর মা সরে এসে দাঁড়ালো তনিমার কাছে। কিছুটা রাগত স্বরে বললো,

– তোমরা কি শুরু করেছো এগুলো? আমাদের মানসিক অবস্থা জানো না? এর মধ্যে এইসব কি?

অন্তু আড়মোড়া ভাঙলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললো,

– তবে আমাকেই বলতে হচ্ছে সব! ঠিক আছে, ব্যাপার না! শুধু আমার কথা শেষ হওয়ার আগে, এখানে কেউ কিচ্ছু বলবে না। আংকেল, আপনার জামাই মহা ধুরন্ধর। মেয়ের বিয়ে দেবার আগে আরেকটু খোঁজ নেওয়া উচিৎ ছিলো৷

লাবণ্যর বাবা, মা, সহ প্রত্যেকের দৃষ্টি স্থির। চোখে মুখে জিজ্ঞাসা৷ অন্তু ফস করে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে সোফায় এসে বসলো, তারপর বললো,

– আপনাদের জামাই, মানে চয়ন ভাইয়ের প্রথম খুনটা ঘটেছিলো তার চৌদ্দ বছর বয়সে৷ কাকে খুন করেছিলো জানেন? নিজের বাবাকে।

সাথে সাথে ঘরের প্রত্যেকে আৎকে উঠেছে। তনিমা নিজেও চমকেছে অনেকখানি। চয়ন কিছু বলতে যাচ্ছিলো, অন্তু সুযোগ দিলো না।

– উহু! আমি বলেছিলাম, আমি কথা বলা শুরু করলে, আর কেউ বলবে না৷ আপনার বলার পালা শেষ। আপনি নিজের হাতে আপনার বাবাকে খুন করেছিলেন। কেন? কারণ তিনি অত্যাচারী ছিলেন। আপনার মায়ের উপর ক্রমাগত অত্যাচার করতেন। আপনার মা অপলা আনাম। যিনি বৃদ্ধাশ্রম থাকেন এখন, একসময় তিনি দারুণ লিখতেন। নিয়মিত পেপার পত্রিকায় তার লেখা বেরুতো। আর আপবার বাবা সেটা পছন্দ করত না। লেখা থামানোর জন্য অত্যাচার করত। এমনিতেও উনি ভালো মানুষ ছিলো না, যদ্দুর জেনেছি। নেশাগ্রস্ত ছিলেন। মেরে একদিক দিয়ে ভালোই করেছেন, নাকি? তবে কাজের কাজ কিছু হয়নি। আপনার মা এই ঘটনার পর বিকারগ্রস্ত হয়ে যান। আপনার ফুপু আপনাকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি ঘটনা ধামাচাপা দেন, ভাইয়ের মৃত্যুটা স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে চালিয়ে দেন। আর আপনাকে দত্তক নিয়ে বড় করে তোলেন নিজের সন্তান হিসেবে, ঠিক বলেছি?

চয়ন খানিকটা নড়েচড়ে উঠতেই অন্তু আবার বলে উঠেছে।

– সরি! সরি! আপনার কথা বলা যাবে না। আগে শেষ করে নিই। আপনার মায়ের অনেক গুন আপনি পেয়েছেন। তার মতো সুন্দর হয়েছেন। সেই সাথে মাশাআল্লাহ দারুণ লেখার হাতও! আর সমস্যাটা শুরু তখনই। আপনার মা বড় লেখক হতে পারেননি। তাই আপনি চেয়েছিলেন, সবাইকে টক্কর দিয়ে এক নাম্বার হতে। কিন্তু সেখানে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো লাবণ্য রহমান। একটুর জন্য বার বার তার থেকে পিছিয়ে যেতে থাকলেন। তাই রাগ টা সামলাতে পারলেন না। বিশাল একটা ফাঁদ পাতলেন। প্রথমে প্রেম, তারপর বিয়ে, তারপর তারই লেখার জালে তাকে ফাঁসাতে খুন করে ফেললেন অনিন্দিতা আর মল্লিকাকে। দারুণ, চমৎকার! আপনার প্ল্যানে কাজ হলো। লাবণ্য মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে গেল। আর আপনি তাকে সেবার নাম করে, আরো বেশি অসুস্থ করে দিলেন। তাকে তিলে তিলে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করালেন। আপনি সফলও হলেন, সেরার সেরা এওয়ার্ড পেলেন। দারুণ ছদ্মবেশ নিয়ে পৌছে গেলেন মঞ্চে। লোভ সামলাতে পারেননি পুরস্কার নেওয়ার, তাইনা? তবে গলার স্বরটা বোধহয় আরেকটু পরিবর্তন করতে হতো। নাহলে আমি সন্দেহ করতাম না৷ মেকআপ ভালো ছিলো।

লাবণ্যর বাবা এবার আর নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারলেন না। হৈ হৈ করে বলে উঠলেন,

– কি যা তা কথা বলছো? আমার জামাইকে আমরা চিনি না? তার মতো ছেলে হয় না।

সাথে সাথে লাবণ্যর চাচাও কথা বললেন,

– কিসের প্রমাণ আছে তোমার কাছে? কেন বিশ্বাস করব তোমার কথা?

অন্তু বুক পকেট থেকে খাম বের করে মেইলের রিপোর্ট টা রাখলো টেবিলের উপর। বললো,

– দেখে নিন, আপনার জামাইয়ের মেইলে পাওয়া গেছে এইগুলো। প্রকাশকদের সাথে সব কথাবার্তার ডিটেইল আছে। আর একবার খোঁজ নিয়ে দেখুম, সেরার সেরা এওয়ার্ডের দিন আপনার জামাই অফিসে ছিলো কি না? এ্যাম শিওর সেদিন সে বাসায় ছিলো না। কি চয়ন ভাই? বলবেন কিছু? আপনার বন্ধু প্রত্যয় গাড়িতে বসে আছে। সব স্বীকার করেছে সে। তাকেও নিয়ে আসা লাগবে?

লাবণ্যর বাবা, চাচা বাকরুদ্ধ। লাবণ্যর মা ধপ করে পড়ে গেলেন মেঝেতে। সাথে সাথে ফুপু আর চাচী ধরলেন তাকে। তনিমা চট করে জগ নিয়ে এগিয়ে গেল, পানি ছেটালো চোখে মুখে। লাবণ্যর বাবা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। চয়ন তখনও মাথায় হাত দিয়ে ঝুকে বসে আছে। অন্তু কথা বললো,

– কিছু বলবেন? নাহলে চলুন, যাওয়া যাক। অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট নিয়ে এসেছি আমি। এইসব করে কি হলো বলুন তো? আপনার আরেক বন্ধু রূপম, তার লাইফটাও হেল করে দিলেন। তার বাসাতেও গিয়েছিলাম। বেচারা! আপনার স্ত্রীর মতো শারিরীক ভাবে এতটা খারাপ না হলেও, মানসিক ভাবে একদম শেষ করে দিয়েছেন।

চয়ন উঠে দাড়ালো। একবার তাকালো সবার দিকে। কি ঘেন্না সকলের চোখে। মৃদু স্বরে সে বললো,

– আমার কিছু বলার আছে। তার আগে একবার লাবণ্যর সাথে দেখা করতে চাই।

– চয়ন ভাই, পালানোর পথ নেই৷ পুরো বাড়ি পুলিশ ঘিরে রেখেছে। খামোখা চেষ্টা করার কি দরকার। ক্রশ ফায়ারে মরা লাগবে। চলেন আমার সাথে। ভালো ভাবে নিয়ে যাব।

– পালাবো না অন্তু। আমার সত্যিই কিছু বলার আছে, দেখানোর আছে।

অন্তু মাথা নাড়লো, বললো,

– যান, অনুমতি দিলাম।

লাবণ্যর বাবা তখনও কাঁদছেন। নির্ভেজাল মানুষ তিনি। শিক্ষক। মানুষ গড়ার কারিগর। কোন উশৃংখলতা নেই, তেজ নেই। মানুষটাকে দেখে কষ্ট হচ্ছিলো ভিষণ। লাবণ্যর মায়ের জ্ঞান ফেরেনি। তনিমা তাকে নিয়ে ব্যস্ত। অন্তুর ঘড়ির দিকে তাকালো। স্টপ ওয়াচ চলছে। চয়নের ঘরে যাওয়ার পাঁচ মিনিট, সাত মিনিট, দশ মিনিট, বারো মিনিট। ও ঘর থেকে সাড়া শব্দ নেই। অন্তু এগিয়ে গেল লাবণ্যর ঘরের দিকে৷ আলো জ্বলছে ঘরে। ঘুমন্ত লাবণ্য বিছানায়৷ পাশের টেবলে চেয়ার নিয়ে বসে আছে চয়ন। মাথা রাখা টেবিলের উপর। কাছে যাওয়া মাত্রই অন্তু চমকে উঠলো! অস্ফুটে বললো,

– ওহ! শিট!

চিরকুটটা টেবিলের উপরেই রাখা ছিলো৷

” আমি স্বীকার করছি, সব কিছুর জন্য আমি দায়ী। ”

পাশেই নিথর দেহ পড়ে আছে। সায়ানাইড খেয়ে চয়ন আত্মহত্যা করেছে।

——————————————————

বছর ঘুরে আবার বসন্ত এসেছে পৃথিবীতে। ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে চারিদিক। শিমুল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়ার ডালে লেগেছে রঙের আগুন। প্রকৃতিতে ফুরফুরে হাওয়ার আনাগোনা। তনিমা আর অন্তুর বিয়ে হয়ে কয়েকমাস আগে। বেশ ভালো আছে তারা। প্রত্যয়ের জেল হয়েছে চয়নের সাথে খুনের সহযোগিতা করার জন্য। লাবণ্য ছেড়ে গেছে পৃথিবী, চয়নের মৃত্যুর মাসখানেকের মধ্যেই৷ রিপোর্ট অনুযায়ী, দীর্ঘদিনের রোগে ভোগা, ভঙ্গ স্বাস্থ্য, আর উচ্চ রক্তচাপের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে।

গভীর রাত। এক লেখক লিখছেন কম্পিউটারের সামনে বসে। সবে মাত্র নতুন উপন্যাস শেষ করলেন। এখন দরকার লেখকের একটা নাম। ছদ্মনাম। সবার কাছে আগন্তুক মারা গেছে। সুতরাং সেই নামে লেখা সম্ভব নয়। আচ্ছা, মৃত্যুঞ্জয় নামটা কেমন? মৃত্যুকে যে জয় করেছে, সেই তো মৃত্যুঞ্জয়। আর আগন্তুক তো মৃত্যু থেকেই জেগে উঠছে আবার।

পরিকল্পনাটা ভালো ছিলো ছিলো তার। চয়ন যেদিন গল্পে মগ্ন হয়ে তার সামনে নিজের বাবাকে হত্যা করার কথা বলে ফেলেছিলো, সেদিনই নিজের খেলাটা সাজিয়ে ফেলেছিলো সে। বুদ্ধির ছলে জেনে নিলো তার আসল মা এক বৃদ্ধাশ্রমে থাকে। পাগল। দুঃখের জীবন। তারপরই শুরু করলো ব্ল্যাকমেইল। যদি সে তার কথা মতো না চলে, তাহলে খুনের কথা ছড়িয়ে দিবে চারিদিকে। ফাঁসিতে ঝোলাবে চয়নকে। আর তার কথা যদি মেনে নেয়, তাহলে বিন্দাস লাইফ। তার লেখা থেকে পাওয়া সব টাকা চয়নের মায়ের জন্য ব্যয় করবে সে। পাগল মহিলার লাইফটা সুন্দর করে দিবে। চয়নের হাতে আর কোন অপশন ছিলো না৷ সব মেনে নিয়ে তার কথা মতোই লাবণ্যর সাথে প্রেম করেছিলো। বিয়েও হলো৷ কিন্তু ঝামেলা বাঁধলো তখন, যখন শালা চয়ন দুম করে ওই মেয়ের প্রেমে পড়ে গেল৷ তার হাত পা ধরে অনুনয় করলো, যেন লাবণ্যকে জানে না মারা হয়। সে চেষ্টা করবে লাবণ্যকে লেখা থেকে সরিয়ে দিতে! আহা প্রেম! তার কথা রাখতে গিয়ে পরিকল্পনা পালটে উল্টো দিক দিয়ে খেলা শুরু করতে হলো৷ নয়নতারা সেজে ভয় দেখিয়ে, বশে এনে জোর করে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করলো অনিন্দিতা আর মল্লিকাকে। জন্ম থেকে তার দারুণ একটা গুন আছে। মেয়েদের মতো গলার স্বরে কথা বলতে পারা। এই বিষয়টা দুজনকে ভয় দেখাতে দারুণ কাজে এসেছে। অবশেষে সফল হলো। সেরার সেরা এওয়ার্ড হাতে এলো৷ বুদ্ধি করে চয়নকে পাঠালো পুরস্কার নিতে। আরেকটা কাজও বুদ্ধিমানের মতো করেছে। তার যত দরকারি মেইল, সব চয়নের ফোন থেকে পাঠানো। চয়ন আসলে ছিলো সোনার ডিম পাড়া হাঁসের মতো। তাকে মেরে ফেরার একদম ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু উপায় কি? ফোন হারানোর খবর কানে যেতেই সে লুকিয়ে দেখা করতে এসেছিলো চয়নের সাথে। ঘাপটি মেরে বসে ছিলো লাবণ্যর ঘরে। চয়ন শেষ মুহুর্তে ঘরে এসে চাপা স্বরে বলেছিলো, সব জানিয়ে দিবে পুলিশকে। তাই উপায় না পেয়ে সায়ানাইড মুখে পুরে দিয়ে তাকে জোর করে মেরে ফেলতে হলো৷ আহারে বেচারা! লাবণ্য বাঁচবে না এটা সে আগেই জানতো। বোরখা পরে মেয়েদের বেশে একটু একটু করে নানা অছিলায় আর্সেনিক খাওয়াতো লাবণ্যকে। মেয়েটা অবশ্য চালাক ছিলো। শরীরের ওই দশা নিয়েও কিভাবে যেন বুঝে ফেলেছিলো সব। তবে বলার সুযোগ হলো না। আফসোস! নিজের মনে ভাবতে ভাবতে হাসলো লেখক। পানির বোতল হাতে নিয়ে জানালায় এসে দাঁড়ালো। বাইরের ল্যাম্পপোস্টের আলো তার মুখে এসে পড়ছে। হলুদ আলোয় চকচক করছে রূপমের মুখ।
রূপম। তার একটাই নেশা। জীবন নিয়ে খেলার নেশা। আর এই খেলায় জিততে খুন হাতের ময়লা। ইদানীং খেলার কাউকে পাচ্ছে না। তাই মন ভালো নেই। ফেসবুকে ঢুকে লেখক লিস্ট গুলো চেক করলো আনমনে। আগন্তুক নেই । লাবণ্য রহমানও নেই। তাদের স্থানে নতুন একটা নাম দেখা যাচ্ছে। পৃথুলা রায়। মেয়েটি ভালো করছে ইদানীং। এর সাথেই তো খেলতে নামা যায়, নাকি? আহা! আবার নতুন পরিকল্পনা, আবার সেই থ্রিল! আপাতত একটু ঘুমিয়ে নেয়া যাক। কাল সকালে উঠে নতুন খেলা সম্পর্কে ভাবা যাবে। রূপম খুশি মনে গড়িয়ে পড়লো বিছানায়, নতুন সকালের আশায়।

——– সমাপ্ত———

আগন্তুক পর্ব-১৪

0

আগন্তুক
– সাবিহা বিনতে রইস

#পর্ব – ১৪

বাইরে গোধূলি লগ্ন। লাল কমলা মেশানো গাঢ় রঙ মেখে আছে প্রকৃতিতে৷ গোলসূর্যটাকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না। তবুও পশ্চিম আকাশের কোন সীমানায় বসে এমন রঙ ছড়াচ্ছে, কে জানে! উত্তর আকাশে ছাইরঙা মেঘের দল অহেতুক উড়োউড়ি করছে। প্রকৃতির রঙিনতায় যেন তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। তনিমা ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ছিলো কাঁচের বাইরে। প্রকৃতি এত রঙ, এত রূপ কিচ্ছু তাকে ছুঁতে পারছে না। যেন সব ছোঁয়া বারণ। সব অচ্ছুত। তাদের কি করে বোঝাবে তনিমা, তার বুকে বাজছে যুদ্ধের দামামা? অকারণে কেঁপে উঠছে বার বার! হৃদয়ের আজ ভাঙচুর হচ্ছে না, যা হচ্ছে, তার উপমা পাওয়া যাচ্ছে না।

– কফি বলব? খাবে?

অন্তুর কথা শুনে জানালা থেকে সরে এলো তনিমা৷ বসলো সোফায়। বলল,

– তুমি খেলে খাও। আমার ইচ্ছে করছে না৷

– তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? রিপোর্ট পেতে দেরী হবে। বলো তো আমি ছেড়ে আসছি তোমাকে?

তনিমা ভ্রু কুচকে তাকালো।

– শরীর খারাপ কেন হবে? আমি ঠিক আছি। রিপোর্ট দেখেই যাব আজ, যতক্ষনই লাগুক!

অন্তু হাসলো৷

– তনি, একটা সত্যি কথা বলবে?

– কী?

– তুমি আসলে চয়ন ভাইয়ের নামে খারাপ কিছু সহ্য করতে পারো না, তাই না? তোমার চোখে ও বরাবরই অন্যরকম আমি জানি!

তনিমা গাঢ় চোখে তাকালো অন্তুর দিকে। তার মুখে হালকা একটা বিষাদের আভাষ। তার উচিৎ এখন অন্তুকে কিছু একটা বলা৷ তার বলা কথাটির বিপক্ষে যুক্তি দেখানো৷ কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, তনিমার মুখ দিয়ে একটা বাক্যও বের হতে চাচ্ছে না। অসহায় মুখ নিয়ে সে কেবল বসে রইল। উত্তর না পেয়ে অন্তুও সামনে খুলে রাখা ল্যাপটপে ব্যস্ত হয়ে পড়লো৷

তনিমা যে ঘরে বসে আছে, সেটা অন্তুর অফিস চেম্বার। গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়। অন্তুর পেছনে জাতির জনক এবং প্রধানমন্ত্রীর ছবি রাখা। সামনে সুন্দর কাঠের টেবিল। সাজানো গোছানো৷ একটা সাদা ফুলদানীতে এক গুচ্ছ রজনীগন্ধা ও গোলাপ রাখা। টেবিলের বাম পাশে বড় একটা পাতাবাহার গাছ। ঘরের এক পাশে গদিআটা সোফা। পায়ের নিচে পালকের মতো তুলতুলে কার্পেট। ডানপাশের দেওয়ালে বড় কাচের জানালা। ওপাশের প্রকৃতিতে গোধূলি ফুরিয়ে এসেছে। শেষ সময়ের মরা আলো গলে পড়ছে শান্তভাবে৷

আজ দুপুরে অন্তুর মেসেজ পেয়ে চয়নের ফোন হাতে নিয়ে ছুটে এসেছিলো তনিমা। যখন সে পৌছালো, তখন অন্তুও অফিসে এসে পৌছেছে। ফোনটা পাওয়া নাগাদ, তাদের এক্সপার্টের হাতে তথ্য সংগ্রহের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছে। আর তনিমাকে যা খুলে বলেছে, তার সারমর্মটি এইরকম।

শ্বেতমহল৷ যেখান থেকে এই গল্পের সূত্রপাত, সেখানে গিয়েই তনিমা বুঝেছিলো কোন একটা গন্ডগোল আছে। প্রত্বতাত্ত্বিক বিষয় সমূহে তার দারুন আগ্রহ। সেসব পড়াশুনা থেকেই সে জানে, প্রতিটি সময়ের নির্মানশৈলীর কমন কিছু বিষয় থাকে। সেসব নির্মাণশৈলী দেখলে অল্পতেই আঁচ করা যায়, এইসব দালান কোন সময়ের তৈরি। শুধুমাত্র তাজমহল ব্যতিক্রম। তাজমহলের বিশালত্বও অবশ্য আলাদা। তাই শ্বেতমহল দেখে সে কিছুটা হলেও দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলো। ওটা কখনোই দু’শ বছর আগের নির্মাণশৈলী নয়। প্রাচীন প্রাচীন একটা ভাব তৈরি করার চেষ্টা করেছে অবশ্য। কিন্তু আদলটা ঠিক আসেনি। সেসময়ের বাড়িগুলোর একটা কমন বিষয়, দালানের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় ঠাকুরঘর। এবাড়িতে কোন ঠাকুরঘর নেই। কোন অংশেই মন্দিরের চিহ্নমাত্র নেই। এত বড় জমিদারের বাড়ি, অথচ কোন মন্দির নেই, ঠাকুরঘর নেই, এটা খুবই অদ্ভুত ব্যাপার। দালানের তৈরি করা সিঁড়ি, ঘরগুলো দেখে সন্দেহ হয়েছিলো তার। পরে অন্তু আর তনিমা দুজনে একসাথে আবিষ্কার করে, ঠিক এই বাড়িটার পেছনেই জঙ্গলে ঢাকা একটা জমিদারবাড়ি আছে। প্রায় ধ্বংস স্তুপের মতন পড়ে থাকা এই বাড়িটি গায়ে নয়নতারার নাম খোদায় করা। সময়টাও উল্লেখ করা প্রায় তিনশত বছর আগের। অর্থাৎ শ্বেতমহল বা নয়নতারা ভবন আসলে এই বাড়িটি নয়। আসল বাড়িটি এই নকল দালানের পেছনে অবস্থিত। এই দালানটি তৈরি হয়েছে সাতচল্লিশের দেশ ভাগের পর। রূপমের পূর্বপুরুষেরা এই জমির দখল পাওয়ার পর বাগানবাড়ি হিসেবে এই ভবন নির্মান করে। তবে নয়নতারাকে নিয়ে ভৌতিক যে কথাগুলো শোনা গিয়েছিলো, তা প্রায়ই সত্যি। রূপমের বলা গল্পটাও সত্যি। কিন্তু মিথ্যা হলো, এর কোনটায় এ বাড়ির ঘটনা নয়। মূল বাড়িটি পেছনের জঙ্গলে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওই বাড়িটির ভয়েই গ্রামের লোক এ অংশটিকে এড়িয়ে চলে। বৃদ্ধাশ্রম থেকে ফেরার পর অন্তু প্রথমেই গিয়েছিলো প্রত্যয়ের অফিসে। সেখানে তাকে জিজ্ঞাসাবাদে অনেক কিছু জানা গেছে। প্রত্যয়ের কথা মতো, চয়ন চেয়েছিলো লাবণ্যকে সামান্য ভয় দেখাতে। তার ধারণা হন্টেড হাউজে বসে তার লেখার আসল সৌন্দর্য বেরিয়ে আসবে। বাস্তব অভিজ্ঞতার লেখা নিশ্চয় মন্দ হবার নয়?
আর তাই তাদের সকলের সামনেই চয়ন বলেছিলো, নয়নতারার ঘটনাটি উল্লেখ করার সময়, তারা যেন বলে এই ঘটনাটি শ্বেতমহলেই ঘটেছিলো। লাবণ্যকে বিশ্বাস করানোর জন্য চয়নের উদ্যোগেই বাড়ির সামনে নতুনভাবে ফলক তৈরি করে নয়নতারা নাম আর সালটা লেখা হয়েছিলো। যেন লাবণ্যর মনে না হয় যে বাড়িটি খুব একটা পুরোনো নয়। অনিন্দিতার মৃত্যুর আগের দিন চয়নই প্রত্যয়কে ফুলের ব্যবস্থা করতে বলে। যদিও প্রত্যয় কারণ জানতো না, এমনই জানিয়েছে৷ অনিন্দিতার মৃত্যুর পর প্রত্যয় চেয়েছিলো রূপমকে, সব জানিয়ে দিতে। কিন্তু চয়ন ভয় দেখিয়েছিলো, সে বলেছিলো প্রত্যয়ের যে আরেকজনের সাথে এফেয়ার চলছে এটা মল্লিকাকে জানিয়ে দিবে। আর সে যদি চুপ করে থাকে, তাহলে মল্লিকা যেন কখনো প্রত্যয়ের লাইফে ইন্টারফেয়ার না করে তারও ব্যবস্থা করে দিবে। ঠিক এই কারনেই সে চয়নের ব্যাপারে কাউকে কিছু জানায়নি। প্রত্যয় এখন পুলিশ কাস্টাডিতে আছে। তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

অন্তুর মুখ থেকে এইসব ঘটনা শোনার পর থেকে তনিমার মনে হচ্ছিলো পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেছে। বারবার শুধু চয়নের মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। কিভাবে এটা সত্য হতে পারে? হয়ত ভুল করছে তারা? হয়তো প্রত্যয় মিথ্যা বলেছে। নিশ্চয় কোন একটা বিষয় আছে। আজকের ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী পরা সুন্দর মুখের মানুষটাকে মাথা থেকে সরাতে পারছিলো না তনিমা। একটা সময় তার মনে হয়েছিলো সে আসলে চয়নকে ভুলে গেছে। তার জন্য আগের সেই ছেলেমানুষী অনুভূতির চিহ্ন মাত্র নেই। কিন্তু সে ভুল ভেবেছে। সব আছে, ষোলআনায় আছে। মুখে কিছু না বললেও অস্থিরতা আর চাপে বুক ফেটে যাচ্ছিলো তার।

– স্যার, আসতে পারি?

আওয়াজ শুনে মাথা উঠালো তনিমা। দরজা দিয়ে এক ব্যক্তি উঁকি দিচ্ছে। অন্তু মাথা নাড়তেই সে ঘরে ঢুকে খামে ভরা একটা কাগজ দিয়ে বেরিয়ে গেল। অন্তু আড়চোখে একবার তাকালো তনিমার দিকে৷ সেও সচকিত। অন্তু খাম খুলে রিপোর্ট বের করলো। চয়নের ফোনের কল লিস্ট, মেইল লিস্ট, সব আছে এই রিপোর্টে। অন্তু চোখ বুলিয়ে নিলো বার কয়েক। তারপর তনিমার দিকে ঘুরে বলল,

– ইন্টারেস্টিং! এসো দেখে যাও রিপোর্ট।

তনিমা উঠে এলো কাঁপা কাঁপা পায়ে। তারপর অন্তুর চেয়ার ঘেষে দাঁড়িয়ে কাগজটা হাতে নিয়ে চোখ বুলিয়ে নিলো। মেইলের ডিটেইলসে দারুণভাবে দুটো আইডি দেখা যাচ্ছে। একটি চয়ন নামে, অপরটি আগন্তুক। আগন্তুক নামের মেইলটি থেকে বিভিন্ন পাবলিশার্সদের সাথে কথা বলা হয়েছে। পান্ডুলিপির ফাইল, রয়্যালটির ব্যাপার স্যাপারে নানান আলোচনা এই মেইলে। আজ প্রথমবার তার নিজের চোখের উপর রাগ হচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে ভিষণ। তার মন সকল আবেগ দিয়ে চিৎকার করে বলছে, এইসব কিছু মিথ্যা। তনিমাকে চুপ থাকতে দেখে অন্তু মুখ খুললো,

– দেখো তনিমা, আমি জানি তুমি কষ্ট পাচ্ছ। হয়তো তোমার মনে হচ্ছে এই বিষয়টি নিয়ে না এগুলেই ভালো হত। কিন্তু কোন কিছুই আর আমার হাতে নেই। অপরাধের প্রমাণ যখন পেয়েছি, তাকে ছেড়ে দিতে পারি না আমি। ফোন হারিয়েছে দুপুরে, এবার সে নিজেই না হারিয়ে যায়! আমাকে বেরোতে হবে। প্রচন্ড ধুরন্ধর তোমার এই চয়ন ভাই। তাকে হাত ফসকে বেরুতে দেওয়া যাবে না। তুমি একা বাসায় যেতে পারবে?

অন্তু তাকালো তনিমার মুখের দিকে। তার চোখে পানি। ঠিক যেন একটা কাঠের পুতুল সে এখন। মুখে কোন আওয়াজ নেই। অন্তু শ্বাস ফেলে উঠে পড়লো৷ ঠিক তখনই তনিমা ঝাপিয়ে পড়লো তার বুকে। তারপর ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। অন্তু বুঝে উঠতে পারছিল না ঠিক কি করবে। সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গীতে সে হাত রাখলো তার পিঠে। তনিমা মুখ ওঠালো। বললো,

– আমি তোমার পাশে আছি অন্তু। সবসময়।

আগন্তুক পর্ব-১৩

0

আগন্তুক
– সাবিহা বিনতে রইস

পর্ব – ১৩

বিশাল এক গ্রাম৷ তবে তার পুরোটাই কৃত্রিম। দারুণ সুন্দর আম্রকানন, ছোট ছোট সবজির ক্ষেত, গোলাপ ফুলের বাগান, স্বচ্ছ পানির খাল, ডিঙি নৌকো, বাঁশঝাড় আর গোটা পঞ্চাশেক ছাউনি ঘেরা কাঁচাবাড়ি মিলিয়ে এই তৈরি এই গ্রামের নাম প্রত্যাশা বৃদ্ধাশ্রম। এর আগে অন্তু বৃদ্ধাশ্রমের নামটি শুনলেও, তার ভেতরটা এইরকম হতে পারে, কল্পনাও করেনি। গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে, প্রথমেই রয়েছে রিসেপশন রুম। সেটাও বাঁশের ছাউনি ঘেরা, একদম গ্রামীন পরিবেশের সাথে মানানসই। অন্তু ভেতরে ঢুকতেই একজন রিসেপশনিস্ট এগিয়ে এলো তার দিকে। ছাউনির তলে দর্শনার্থীদের জন্য সুন্দর এক ওয়েটিং রুম। থরে থরে সাজানো আছে নরম তুলতুলে সোফা। সেখানে বসতে না বসতেই বেয়ারা এসে কোমলপানীয় দিয়ে স্বাগত জানিয়ে গেল। অন্তু চোখ হতে রোদচশমা নামিয়ে ভালো করে তাকালো এদিক ওদিক। আকাশ এখনো গোমড়ামুখো। যখন তখন টুপটুপ করে কান্না শুরু করতে পারে৷ এইরকম আবহাওয়ায় রোদ চশমার দরকার নেই। কিন্তু এই চশমাটি অন্তুর ভিষণ প্রিয়। তনিমার তাকে দেওয়া প্রথম উপহার। তাই চশমাটি পরতে ভালোবাসে সে। মনে হয় যেন সবসময় তনিমার স্পর্শ সাথে নিয়ে ঘুরছে।

– হ্যালো স্যার, গুড আফটারনুন, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?

অন্তু সোজা হয়ে তাকালো সামনে দাঁড়ানো রিসেপশনিস্ট তরুণীর দিকে৷ হাসি হাসি মুখের চোখ ধাঁধানো সুন্দর মেয়েটি তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার চোখেমুখে পেশাদারিত্বের স্পষ্ট ছাপ। অন্তু তার বুক পকেট থেকে অফিসিয়াল আইডি বের করে ধরলো মেয়েটির সামনে।

– গুড আফটারনুন। আই হ্যাভ এ্যান এপয়েনমেন্ট উইথ ইউর ম্যানেজার। ক্যান আই মিট হিম?

– শিওর স্যার। লেট মি জাস্ট চেক দিস এপয়েনমেন্ট শিট।

– ওকে!

মেয়েটি চলে যাওয়ার মিনিট পাঁচেক পরই একজন ব্যক্তি এগিয়ে এলো৷ এই বৃদ্ধাশ্রমেরই কোন কর্মচারী হবে।

– স্যার, ম্যানেজার স্যারের চেম্বার ওদিকে। আপনাকে ডাকছেন। আসুন, প্লিজ!

অন্তু উঠে দাড়ালো৷ রিসেপশনের ছাওনি থেকে দূর পর্যন্ত দারুণ সুন্দর পথ। এঁকেবেঁকে ফাঁক ফোকর গলিয়ে অনেক দূর চলে গেছে। বৃদ্ধাশ্রম বলতে মানুষ যা বোঝে, এটা একদমই তেমন নয়। বরং যান্ত্রিক কোলাহল এড়িয়ে যেন এক টুকরো স্বর্গ। কিছু দূর পর পর গাছের তলে বাশের তৈরি বেঞ্চ রাখা হয়েছে। দুজন বৃদ্ধ ব্যক্তিকে দেখতে পেল অন্তু। এক হাতে কফির কাপ, আরেক হাতে খবরের কাগজ হাতে ভূ রাজনীতি নিয়ে চমৎকার আলাপে মেতেছে তারা। ম্যানেজারের চেম্বারটি এক কথায় অসাধারণ। কাঠের তৈরি দোতলা একটি ছোট বাড়ি। অনেকটা বিদেশী দালানের আদলে তৈরি। সামনের ঝুল বারান্দায় থরে থরে অর্কিডের টব সাজানো। উপরের ছাদ থেকে ঝুলছে বাগান বিলাস। একদম কাছাকাছি গিয়ে অন্তু বুঝতে পারলো, এতক্ষন যেগুলো কাঁচা আর কাঠের বাড়ি বলে মনে করেছে, সেগুলো সবই আসলে পাকা বাড়ি৷ আর্কিটেকচাররা দারুণ কাজ করেছে। এই বাড়ির নিচ তলাতে অফিস ঘর। অত্যাধুনিক জীবন যাপনের সব কিছুই বিদ্যমান ভেতরে৷ বাইরে থেকে যা বোঝার উপায় নেই৷ অন্তু অফিস ঘরে ঢুকতেই দেখলো গদিআঁটা চেয়ারে গুরুগম্ভীর চেহারার এক ভদ্রলোক বসে আছেন। মোটাসোটা, ফর্সা গোলগাল মুখ, চোখে চশমা। মাথার চুল প্রায় হালকা হয়ে এসেছে। টাকের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। পরনে আকাশি রঙের দামী শার্ট, সুন্দর একটি টাই পরেছে সাথে। তার চোখ সামনে রাখা ফাইলে নিবদ্ধ। কয়েকদিন ধরে টানা বৃষ্টিতে বাইরের আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা। তবে ঘরের তাপমাত্রা বেশ আরামদায়ক।

– “শতাব্দী লাঞ্ছিত আর্তের কান্না
প্রতি নিঃশ্বাসে আনে লজ্জা
মৃত্যুর ভয়ে ভীরু বসে থাকা, আর না—
পরো পরো যুদ্ধের সজ্জা।

প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
এসে গেছে ধ্বংসের বার্তা,
দুর্যোগে পথ হয় হোক দুর্বোধ্য
চিনে নেবে যৌবন-আত্মা”

সামনে বসা লোকটা চমকে তাকিয়েছে অন্তুর দিকে। তারপর চট করে গদি আটা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো,

– আরে করছিস কী! চুপ কর! কেউ শুনে ফেলবে তো?

অন্তু হেসে ফেললো৷

– আসিফ ভাই! সিরিয়াসলি আমার বিশ্বাস হচ্ছে না৷ এইটা তুমি? বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই বামপন্থী রাজনৈতিক নেতা, সুভাস মুখোপাধ্যায়ের অন্ধভক্ত কবি আসিফ অঞ্জন?

– আহা! তুই চুপ করবি? এখানে এইসব কেউ জানে না৷ এখানকার কর্পোরেট আসিফ অঞ্জন আর আগের সেই কবি আসিফ অঞ্জনের আকাশ পাতাল তফাৎ। তবে সুভাস কে ছেড়ে দিয়েছি, এটা কিন্তু বলা যাবে না। পড়ি এখনো, রক্ত গরমও হয়। তবে গোপনে। আয় বোস এখানে। এত বছর পর, তোর দেখা পাবো ভাবিনি।

অন্তু হাসল।

– আমিও কি ভেবেছিলাম বলো? সারাজীবন ভেবেছিলাম, পড়াশুনা শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হব৷ আর হয়ে গেলাম দেখো, পুলিশ। আর তুমি, যে কিনা সারাজীবন সমাজ পাল্টানোর স্বপ্ন দেখতে, সাম্যের কথা বলতে সেই তুমিই বিলাসবহুল আশ্রমের দায়িত্ব নিয়ে বসেছো।

আসিফ ভ্রু কুচকে তাকালো,

– হিংসা করছিস নাকি?

– হু, তা একটু করছিই বটে! চোর ডাকাতের পিছে ছুটতে কার ভালো লাগে বলো তো?

– আসলে, এই ব্যবসাটা মূলত ছিলো মামার। বড় মামার। যার বাসায় থেকে আমি মানুষ হয়েছি। ভার্সিটি থেকে বেরোনোর পরই মামা ব্রেইন স্টোক করে। লোয়ার পার্ট টা পড়ে গিয়েছিলো একদম। মামার সন্তান বলতে তো শুধু তৃষ্ণা। সো বুঝতেই পারছিস, দুম করে সব দায়িত্ব আমার ঘাড়ে এসে পড়ল। তৃষ্ণাকে ভালো লাগতো সবসময়। আর মামা মামীও চাইতো বিয়েটা হয়ে যাক আমাদের। বিয়ে হয়ে গেল। তারপর আর এই ব্যবসা বানিজ্য থেকে বেরুতে পারলাম না। প্রায় আট বছর হলো মামা চলে গেছেন। মামী আছে। আমার সাথেই থাকে৷ আমি, তৃষ্ণা, মামী আর আমার ছেলে অদৃক, এই তো সংসার। ভালোই চলছে। রাজনীতি যে টানে না, তা নয়। কিন্তু সংসার, ব্যবসা ফেলে ফুরসৎ পাইনা। ছেলেটার তো ভবিষ্যৎ আছে বল?

অন্তু অবাক হয়ে দেখছিলো। আসিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তুর ডিপার্টমেন্টেই ছিলো। তিন বছরের বড়। সে সময়ে ক্যাম্পাসের প্রতিবাদী চরিত্র। কি না করেছে সে তখন। অনেকেই বলতো, একসময় সে বড় নেতা হবে। দেশের হাল ধরবে। মানুষ ভাবে এক, আর হয় আরেক!

– এই অন্তু, কি খাবি বল? তারপর তোর গল্প শুনবো। বিয়ে টিয়ে তো করিসনি যদ্দুর জানি।

– করিনি, তবে করতে কতক্ষণ?

আসিফ হোহো করে হেসে উঠলো,

– তার মানে ম্যাচ সাজিয়ে রেখেছিস, তাই তো?

– হুম, তা একরকম বলতে পারো। সেসব কথায় আসছি। তার আগে কাজের কথা সারি। তোমাকে ফোনে বলেছিলাম, আমার এখানে আসার কারণটা।

আসিফের মুখটা গম্ভীর হলো খানিকটা।

– দেখ অন্তু, একটা কথা শোন। আমাদের কিছু নিয়মনীতি আছে। আমরা এখানে কাউকে রাখার আগে তার পরিবারের কাছে কিছু বিষয়ে কমিটেড থাকি৷ এভাবে ভেতরের তথ্য শেয়ার করার কোন নিয়ম আমাদের নেই৷

– আই নো আসিফ ভাই৷ সেজন্য আমি অফিসিয়াল নোটিশ নিয়ে এসেছি। কোনভাবে এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তুমি নোটিশ দেখিয়ে দিবে। আইনি কাজে বাঁধা দেওয়ার ক্ষমতা সসর্বসাধারণের নেই।

আসিফ ঠোঁটের নিচে কামড়ে ধরেছে। যেন ঠিক করতে পারছে না কী করবে৷ তারপর ধীর লয়ে ড্র‍য়ার টেনে একটা ফাইল বের করে এগিয়ে দিলো তার দিকে। অন্তু অভয় দিলো,

– আমি তো আছি আসিফ ভাই। কোন সমস্যা হবে না। আর হলেও তা আমি হ্যান্ডেল করব। তুমি রিলাক্সে থাকো৷

অন্তু ফাইলটি টেনে নিলো নিজের দিকে৷ সেটি খুলতেই নামটি ভেসে উঠলো৷ অপলা আমান। বয়স ৬৩। পাশে একটা ছবি দেওয়া। ছবিটি কয়েকবছর আগের তোলা বেশ বোঝা যায়, কারণ এই নারীর বয়স ছবিতে ৬৩ নয়। খুব জোর বায়ান্ন হতে পারে। চমৎকার সুন্দর চেহারা। মুখে কোন হাসি নেই৷ কিন্তু তবুও কিছু একটা আছে, চোখ আঁটকে থাকার মতো। অন্তুর বার বার মনে হচ্ছে কোথাও যেন দেখেছে তাকে। কিন্তু কোথায় দেখেছে? মনে পড়ছে না, একদম মনে পড়ছে না! অন্তু দ্রুত চোখ বুলাতে থাকলো তার ডিটেইল ঘটনায়। নাহ! কোন পরিচিত বিষয় চোখে পড়ছে না৷ বাবার নাম, মায়ের নাম, স্বামীর নাম, সব অচেনা। তারপরই থমকেছে অন্তু৷ ঠিকানাটা চেনা চেনা। গ্রামের নামটাও তো। সাথে সাথে তিড়িক করে চমকে উঠেছে মস্তিস্ক। অন্তু ফাইল থেকে মুখ তুললো। বললো,

– আসিফ ভাই, এনাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গেছেন কে?

– উনার ছেলে। পরের পৃষ্ঠায় দেখ। নাম আছে।

অন্তু দ্রুত গতিতে পৃষ্ঠা ওল্টালো। খুঁজছে নাম, ক্রমাগত খুঁজছে। এই তো এখানে। সাথে সাথে লক্ষ ভোল্টের শক খেয়েছে অন্তু। একসাথে দপদপ করেছে উঠেছে প্রতিটি নার্ভ। চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে একটি নাম।

– রওনক আনাম চয়ন।

লাবণ্য এখনো পড়ে আছে বিছানায়। চোখ বন্ধ। ঘুমিয়ে আছে নাকি জেগে, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তার পাশেই বসে আছে তনিমা। ক্রমাগত মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। লাবণ্যর মায়ের দেওয়া পোশাকটি পরেছে কিছুক্ষণ আগে। তারপর থেকেই মনটা কেমন যেন করছে তার। এই পোশাকটার পেছনে একটা লম্বা কাহিনী আছে। গতবছর লাবণ্যর জন্মদিনে চয়ন এটি উপহার দিয়েছিলো তাকে। অবশ্য উপহার দেওয়া এত সহজ ছিলো না৷ তার ইচ্ছে ছিলো লাবণ্যকে সারপ্রাইজ দেওয়া। কিভাবে সারপ্রাইজ দেওয়া যায় এ নিয়ে আগে থেকে তনিমার সাথে প্ল্যান করে রেখেছিলো সে৷ কথা ছিলো বাংলা সাহিত্যের সেরা ১০০ উপন্যাসের বই এক সাথে লাবণ্যকে গিফট করা হবে। লাবণ্য বইপাগল৷ বাড়ি ভর্তি তার বিশাল বিশাল বইয়ের আলমারি। কিন্তু শেষ মুহুর্তে প্ল্যান পাল্টাতে হলো। লাবণ্যর প্রচুর বই। এর মধ্যে কোনটি আছে, কোনটি নেই তার হিসাব কষা খুব কঠিন কাজ। তাই শেষে ঠিক হলো ওর জন্য ড্রেস কেনা হবে। জন্মদিনের আগের দিন তনিমাকে নিয়ে পুরো শহর চষে ফেললো চয়ন। কিন্তু কোনটায় তার পছন্দ হয় না। অবশেষে সিল্ক হাউজ থেকে দারুণ সুন্দর এই পোশাকটি কিনেছিলো সে। তনিমা পছন্দ করতে হেল্প করেছিলো। লাবণ্য সাদা রঙ পছন্দ করে। সাদা জমিনে মেটে সাদার দারুণ কাজকরা জামাটি। আজ এটা পরার পর থেকে অদ্ভুত একটা শিহরণ কাজ করছিলো তনিমার। পোশাকটি লাবণ্যর হলেও, কেমন যেন চয়ন চয়ন মিষ্টি ঘ্রাণ লেগে আছে এটিতে। ভাবনা গুলো মনে আসতেই নিজেকে ধিক্কার দিলো তনিমা। নিজের প্রিয় বান্ধবীর আজ এই হাল, আর সে কিনা তারই হাসবেন্ডকে নিয়ে চিন্তা করছে। নিজের ভেতরে মরমে মরে যাচ্ছিলো সে। তবুও চিন্তাগুলো যাচ্ছিলো না মাথা থেকে।

– লাবণ্য একবারো ওঠেনি?

তনিমা তাকালো দরজায়। দুজন বোরখাআবৃত ভদ্রমহিলাকে সঙ্গে নিয়ে দাড়িয়ে আছেন তনিমার মা।

– না আন্টি! ডেকেছিলাম বার কয়েক। কই আর উঠলো?

সামনে দাঁড়ানো ঘিয়ে রঙা বোরখা পরা মহিলাটি বললেন,

– থাক, ওকে ওঠানোর দরকার নেই। আমরা এখানে বসে কিছু আমল করব।

তনিমার মা তাড়াতাড়ি করে ফ্লোরে বসার জায়গা প্রস্তুত করে দিলেন। ঘিয়ে বোরখাপরা মহিলাটি সুমধুর সুরে তেলওয়াত শুরু করলো। পাশে হালকা গোলাপি রঙের বোরখাপরা মহিলাটি অবশ্য চুপ করে থাকলো। হয়তো মনে মনে কিছু পড়ছিলো৷ তার হাতে একটা বোতলে পানি। তিনি কয়েকবার পানিতে ফুঁ দিলেন। তনিমার হঠাৎ মনে হলো, লাবণ্য বোধহয় একটু নড়ে উঠলো। তনিমা তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,

– কিছু বলবি? উঠে বসবি একবার?

লাবণ্য চোখ খুললো। অনেকদিন পর দুই বন্ধুর চোখাচোখি হলো৷ সেই বুদ্ধিদীপ্ত চোখে আজ কেমন অসহায়ত্ব, দিশেহারা ভাব।

লাবণ্যর চোখ খোলা দেখতেই তেলওয়াত থামিয়েছে মহিলাটি৷ তিনি পাশের গোলাপি বোরখার মহিলাটিকে ইশারা করতেই তিনি উঠে দাড়ালেন। এসে বসলেন লাবণ্যর পাশে। বোতলের পানিটুকু ঢেলে দিতে চাইলেন মুখে৷ সাথে সাথে এক ধাক্কা দিয়ে বোতলটি ফেলে দিয়েছে লাবণ্য৷ তনিমা অবাক হয়ে তাকালো তার দিকে। এখন আর আগের মতো তার চোখে অসহায়ত্ব নেই। চোখ পাল্টে গেছে হিংস্রতায়। তেলওয়াত ছেড়ে ঘিয়ে বোরখা পরা মেয়েটি ছুটে এলো লাবণ্যর কাছে। তার হাত দুটো শক্ত করে ধরে জোরে জোরে দোয়া পড়া শুরু করলো। কিন্তু লাবণ্যকে শান্ত করা গেল না। বরং দ্বিগুন শক্তিতে সে নিজের হাত ছাড়িয়ে ঘিয়ে বোরকা পড়া মহিলাটির হাতে কামড় বসিয়ে দিলো। চিৎকার করে উঠলো মহিলাটি। লাবন্যর মা, বাবা, চয়ন ছুটে এসেছে সাথে সাথে। কোনভাবেই লাবণ্যকে শান্ত করা যাচ্ছে না। মুখ দিয়ে গোঁগোঁ আওয়াজ করছে সে। গড়িয়ে পড়ছে লালা। তনিমা ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব। হুশ ফিরতেই দৌড়ে ঘরের বাইরে এলো। ড্রয়িং রুমের টেবিলে চয়নের ফোন বাজছে। তনিমা সেদিকে না তাকিয়ে সোফায় বসে পড়লো। তারপর হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো৷ তার মনে হলো, এইমুহুর্তে কাউকে পাশে দরকার। খুব বেশি দরকার। ফোন বের করে অন্তুকে ডায়াল করার কথা ভাবলো। দ্রুত হাতের ফোন নিয়ে অন্তুকে ডায়াল করতে যাবে, কিন্তু তার আগেই থমকালো। ছোট্ট একটা টেক্সট এসেছে অন্তুর নাম্বার থেকে।

” যেভাবেই হোক, চয়নের ফোনটা লুকিয়ে নিয়ে ওই বাসা থেকে বেরিয়ে এসো। যত তাড়াতাড়ি পারো। ”

কান্না থেমে গেছে তনিমার। মাথা মনে হচ্ছে কাজ করছে না। কোথায় পাবে সে চয়নের ফোন? কিভাবে পাবে? অন্তুর কেনই বা ফোন দরকার?

এদিক ওদিক তাকালো তনিমা। তারপরই চোখ পড়লো টেবিলে রাখা ফোনটিতে। চয়নের ফোন। এদিকে এখন কেউ নেই। সবাই লাবণ্যকে নিয়ে ব্যস্ত। তনিমা কিছু ভাবার সময় নিলো না। চয়নের ফোনটি তুলে নিয়ে ব্যাগের ভেতরে রেখে দ্রুত বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো সে।

( চলবে)

আগন্তুক পর্ব-১২

0

#আগন্তুক
– সাবিহা বিনতে রইস

পর্ব – ১২

বর্ষা পেরিয়ে যাচ্ছে অল্প অল্প করে৷ শ্রাবনের শেষে প্রকৃতিতে কদমগন্ধা হাওয়ার দাপাদাপি। বেলা এগারোটার দিকেও আকাশে ভর সন্ধ্যে। গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলো তনিমা। পিচঢালা পরিচ্ছন্ন পথঘাট ভিজে, ঠিক যেন একটা আঁকাবাঁকা অজগরের মত দেখাচ্ছে। রাস্তা আজ ফাঁকা। নিতান্তই দরকার ছাড়া ঘরের বাইরে কেউ নেই৷ রাজশাহীর মানুষেরা বরাবরই শান্তি প্রিয়। অফিস আদালতের বাধ্যবাধকতার ভিড়ে জমে থাকা লোকগুলো ছাড়া, বাকিরা সুযোগ পেলেই ঘরে মুখ লুকাতে ভালোবাসে। তনিমাও তার ব্যতিক্রম নয়। আর অন্তুর ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। কি ঝড়, কি বৃষ্টি! কি দিন, অথবা রাত, সাদা পোশাকে তাকে চষে বেড়াতে হয় শহর। গত তিনদিন তার সাথে সঙ্গ দিয়ে এদিক ওদিক ছুটে বেড়িয়েছে তনিমা নিজেও৷ লাবণ্যর বিষয়টি কয়েক মাস ধরে ভয়ানক কষ্টে দিচ্ছে তাকে। কিন্তু গত দুই দিনে যা তথ্য পেয়েছে, তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না সে। কাল রাতে ঘুম হয়নি এক ফোঁটাও৷ শুধু মনে হয়েছে, এ সত্যটা না জানলেই বোধহয় ভালো হত। জীবন কি সত্যিই এত নিষ্ঠুর? স্বপ্ন মানেই কি মরিচীকা?

লাবণ্যদের বাড়ির সামনে গিয়ে হর্ণ দিতেই ড্রাইভার ছুটে এসে গেট খুলে দিলো। তারপর এগিয়ে এসে বললো,

– আপা, রাস্তায় গাড়ি সাইড করে রাইখেন। ভেতরে আজ জায়গা নাই। প্যান্ডেল হইসে।

তনিমা গাড়ি সাইড করে ভেতরে এসে ধাক্কা খেলো একটা৷ বিশাল ব্যাপার চারিদিকে। এলাহী কারবার যাকে বলে আর কি। গাড়ি বারান্দা থেকে বাগান পর্যন্ত বিশাল প্যান্ডেল করে মাদ্রাসার বাচ্চাদের বসানো হয়েছে। সবাই উচ্চস্বরে কোরআন তেলওয়াত করছে। বাগানের একপাশে মাটি খুঁড়ে চুলা বানোনো হয়েছে। বাবুর্চিরা বড় হাড়িতে নানান পদের রান্না করছে। বেশ কিছু লোকজন দূরে চেয়ার নিয়ে বসেছে। তাদের মাঝে চয়নের দিকে চোখ আটকে গেল তনিমার। তাকে দারুণ ঝরঝরে দেখাচ্ছে আজ। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী পরেছে সে। ছিপছিপে সুন্দর শরীর । চুল গুলো পরিপাটি করে আঁচড়ানো। ফর্সা সুন্দর মুখটা, আজ আরো বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে। ঠোঁটে তার হাসি নেই। কিন্তু গম্ভীরভাবটাও নেই। কেমন যেন নিষ্পাপ চোখ মুখ, টলটলে স্নিগ্ধতায় ভরা। ছেলেরা এত সুন্দর হয়, জানা ছিলো না তার। তবে তনিমার কাছে চয়ন বরাবরই আকর্ষণীয়। কিন্তু আজ যেন তার প্রতি অনেক বেশি দুর্দমনীয় আকর্ষনে চূর্ণ হয়ে যাচ্ছিলো সে। সেই সাথে বুকের মধ্যে অদ্ভুত এক ঢেউ খেলে যাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো যেন বিভ্রান্তিতে ডুবে যাচ্ছে। কিসের পিছে ছুটছে তনিমা? সত্য নাকি মিথ্যা? ভুল নাকি ঠিক? রহস্য উদঘাটনের নেশায় যদি ভুল কিছু করে বসে, নিজেকে কি কোনদিন ক্ষমা করতে পারবে?

– তনি মা, কখন এসেছো তুমি?

তনিমা চট করে চোখ ফেরালো৷ লাবণ্যর বাবা এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে। এই মানুষটা তনিমাকে ভিষণ ভালোবাসে। নিজের মেয়ের মতোই। সেই কোন ছোটবেলা থেকে পরিচয় লাবণ্যর সাথে। তখন থেকেই এই মানুষটার সাথে পরিচয়৷ আংকেল বলে ডাকা মাত্রই তিনিও হাসি মুখে ডেকে উঠতেন, “তনি মা”। আজ তাকে দেখে ভেতরে ভেতরে মুচড়ে উঠলো সে। কি অবস্থা মানুষটার। চোখ মুখ বসে গেছে একদম। বয়স যেন এক ধাক্কায় দশ বছর বেড়ে গেছে। ভিষণ বৃদ্ধ দেখাচ্ছে তাকে। সন্তানের শোকে একজন বাবার এমন রূপান্তর মেনে নেওয়া সহজ নয়।

– আমি এলাম এইমাত্র আংকেল। লাবণ্য কোথায় আছে?

– যাও, ঘরেই আছে। তোমার আন্টিও আছে। সকালে বোধহয় তোমাকে ফোন দিয়েছিলো তোমার আন্টি। আসলে লাবণ্যকে সামলানো খুব কঠিন হয়ে গেছে। সে কারো কাছে থাকে না। তোমার আন্টি একা একা পারছে না একদম। আজ তো অনেক কাজ বাসায়।

তনিমা অভয় দিলো,

– আমি আছি তো আংকেল। আমি দেখছি। আপনি চিন্তা করবেন না।

ঘরের ভেতরে ঢুকে একটু সচকিত হলো তনিমা। ৮-১০ জন মহিলা বসে আছে ড্রয়িং রুমে। প্রত্যেকের আপাদ মস্তক বোরখায় ঢাকা৷ কেউ কেউ বসে কোরআন তেলওয়াত করছে। কেউ কেউ দোয়া পড়ছে অনবরত৷ তাদের পাশ কাটিয়ে লাবণ্যর ঘরে ঢুকলো সে। ঘরটা আজ সুন্দর করে সাজানো। জানালা জুড়ে নতুন সাদা পর্দা। বেড কভার, কুশন কভার সব ধবধবে সাদা। ডান পাশের ছোট টেবিলে চিনামাটির ঘিয়ে রঙের ফুলদানি। তাতে এক আটি রজনীগন্ধা ফুল৷ ঘরময় সে ফুলের সুবাস। মিষ্টি স্নিগ্ধতা ভেসে বেড়াচ্ছে চারিদিকে। কিন্তু এই সুন্দর আবহাওয়া বেশিক্ষণ থাকলো না। লাবণ্যকে ধরে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন তার মা। চকিতে হতভম্ব তনিমা। কি অবস্থা হয়েছে তার। আজ যেন একটু বেশিই খারাপ দেখাচ্ছে। স্বাস্থ্য ভাঙছে অনেকদিন থেকেই৷ আজ চোয়াল থেকে গলার হাড় পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছে তার। চোখ দেখে মনে হচ্ছে, কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে এখুনি৷ তনিমা নিজের ব্যাগ ফেলে রেখে দৌড়ে গেল তার কাছে। বললো,

– আন্টি আমি ধরছি তনিমাকে৷ কি অবস্থা ওর আজ!

– না! না! তোমাকে ধরা লাগবে না। আমি পারব।

লাবণ্যর মা হাত নেড়ে থামালেন তাকে। তনিমা দাঁড়িয়ে পড়লো। তিনি একটু একটু করে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে লাবণ্যকে শুইয়ে দিলেন বিছানায়। তারপর তনিমার দিকে ঘুরে বললেন,

– মামনি, তোমাকে সকালে কল করেছিলাম। তুমি রিসিভ করোনি।

– আসলে আন্টি, আমি খেয়াল করিনি একদম। ফোন চার্জে দেওয়া ছিলো। আর আমিও একটু ব্যস্ত ছিলাম।

– আচ্ছা, সমস্যা নেই৷ ঘরটা খেয়াল করেছো?

তনিমা আরেকবার ঘরের চারিদিকে খেয়াল করলো। লাবণ্যর ঘর জুড়ে তার বইয়ের প্রচ্ছদগুলো বাঁধায় করে টাঙানো ছিলো৷ এখন একটাও নেই৷ দেওয়াল পুরো ফাঁকা৷

– ঘর সাজানো সুন্দর হয়েছে আন্টি।

– উহু! সুন্দরের কথা বলিনি। জানোই তো, আজ কেন এত আয়োজন। একটায় কারণ আমার বাড়ির উপর থেকে কালোছায়া দূর করা। ড্রইং রুমে যারা বসে আছে, তারা সব নাম করা মানুষ। সকলে কুরআনের হাফেজ। উনারা বলেছেন, আজ বাড়িতে, বিশেষ করে এই ঘরে কালোর কোন চিহ্ন রাখা যাবে না। তাই সব পালটে দিয়েছি।

তনিমা খানিকটা আড়ষ্ট হলো। নিজের পোশাকের দিকে তাকালো একবার। তার পরনে কালো-গোলাপির কম্বিনেশনের সিল্কের সালোয়ার কামিজ। কুচকুচে কালো ওড়নার উপর, দারুণ সুন্দর গোলাপি কাজ। যদিও সে একদম এইসব মানে না। বুঝতে পারছে, আন্টি যা বলছে তা সম্পূর্ণ কুসংস্কার। তবুও তাকে কষ্ট দিতে ইচ্ছা করছে না।

লাবণ্যর মা সাথে সাথে বুঝে নিয়েছে। বললো,

– সমস্যা নেই৷ আমি লাবণ্যর একটা ড্রেস আলমারি থেকে বের করে দিচ্ছি। এটা পালটে নাও কেমন? ও আর তোমার গড়ন তো প্রায় একই ছিলো। পোশাক ফিটিং হবে তোমার। এখন ওর পোশাক গুলো ওর নিজেরই হবে না৷ দেখছো, শরীরটা?

লাবণ্যর মা চোখ মুছতে মুছতে উঠে পড়লেন। লাবণ্য তখনও বিছানায় পড়ে আছে। ঝিম ধরে। চোখ বন্ধ। তনিমা যখনই আসে, তখনই ঝিম ধরে পড়ে থাকে সে৷ নাহলে ঘুমিয়ে থাকে। কতদিন যে কথা বলে না ওর সাথে। ভিষণ কান্না পাচ্ছিলো তনিমার। একটা সময় নিজের কথাগুলো লাবণ্যর সাথে শেয়ার না করলে তার খাবার হজম হতো না। সব কিছু তাকে বলা চায় ই চায়। আর এখন, কত কিছু বুকে চেপে রাখতে হয়। অন্তুর সাথে প্রায় সবই শেয়ার করে সে। কিন্তু তবুও মানুষের কিছু কথা থাকে, যা বেস্ট ফ্রেন্ড ছাড়া কাউকে বলা যায় না। না বলতে পারলে হাসফাস লাগে। বুকের উপর মনে হয় পাথর চাঁপা। যার জীবনে বেস্ট ফ্রেন্ড নেই, সে এই অনুভূতি বুঝবে না!

——————————————————

শহর ছাড়িয়ে অনেকটা দূরে এক নির্ঝঞ্ঝাট গ্রামে তৈরি হয়েছে প্রত্যাশা নামের প্রবীণ আশ্রম কেন্দ্র। এক কথায় যাকে বলে বৃদ্ধাশ্রম। কিছুক্ষণ আগেই আরেক পশলা বৃষ্টি ঝরে গেছে৷ আশ্রম কেন্দ্রটি গ্রামের এক কোনে অবস্থিত। দারুণ সুন্দর জায়গা। বিশাল এলাকার উপর গড়ে তোলা এই আশ্রমটি মূলত ধণী, বিলাসী, কিন্তু একাকী মানুষের আবাস স্থল। অন্তু গাড়ি নিয়ে গেটের কাছে এসে দাঁড়ালো৷ বিশাল এক সবুজ গেটের ফাঁকফোকর দিয়ে ভেতরের চমৎকার সৌন্দর্য চোখে পড়ছে। গেটের কাছে লেখা আছে নো স্মোকিং জোন। অন্তু গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে আয়েস করে ফুসফুস নিকোটিনের ধোঁয়া পূর্ণ করে নিলো৷ তনিমা পাশে থাকলে ভালো লাগে তার। তবে সমস্যা একটায়৷ সিগারেট সে সহ্য করতে পারে না৷ তার পাশে যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণ তাকে এক প্রকার উপোস করেই থাকতে হবে। সিগারেটের ধোয়া কুন্ডলী বানিয়ে ছাড়তে ছাড়তে অন্তু ফোন বের করে চেক করলো৷ অফিসের কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ বার্তার উত্তর পাঠালো। তারপর আজকের কাজের সিডিউলে চোখ বুলিয়ে নিলো একবার। এখানে কি কি করতে হবে, তার একটা লিস্ট তনিমা করে পাঠিয়েছে কাল রাতে। মেয়েটা আসলেই জিনিয়াস। এমন একটা মেয়েকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে চলেছে, এ নিয়ে সূক্ষ্ম একটা গর্ববোধ সবসময় কাজ করে তার। তনিমার কথা মতো লেখক আগন্তুক আর প্রত্যয় এদের দুইজনই তার সন্দেহের তালিকায়। প্রথমে সে আর তনিমা দুজনই ভেবেছিলো এই খুনের সাথে প্রত্যয় জড়িত। মোটিভ একটায়, তার নিজের এক্সট্রা ম্যারিটাল এফেয়ার। তবে ভাবনা থেকে পরে সরে এসেছে৷ শুধু মাত্র পরকীয়া প্রধান হলে প্রথম মৃত্যুটা মল্লিকার হতো। অনিন্দিতার না। আর দ্বিতীয়ত, মৃত্যুর জন্য এক গাদা নয়নতারা ফুলের দরকার পড়ত না। মৃত্যুর আরো অনেক সহজ পদ্ধতি আছে। এত ঝামেলায় কে যাবে? হুম, যেতে পারে সেই, যার এর পেছনে লাবণ্যকে ফাসানোর মোটিভ আছে। তনিমার কথা মতো সেটা লেখক আগন্তুক ছাড়া আর কেউ নয়। কয়েক বছর ধরে সামান্য তফাতে জনপ্রিয়তার রেটিং এ লাবণ্যর পেছনে তার অবস্থান। এই সামান্য তফাৎ টা ভাঙতে পারেনি সে৷ তাই যশ, খ্যাতির লোভে সে অন্য পথ অবলম্বন করেছে। প্রত্যয়ের মাধ্যমে সে ধ্বংস করতে চেয়েছে লাবণ্যর লেখক স্বত্তা। এক ঢিলে দুই পাখি আর কি! এখন মৃত্যুটা যদি শুধু মল্লিকার হতো, তাহলে পাবলিকের মনে সন্দেহ তৈরি করা কঠিন হতো৷ কিন্তু পর পর দুটো মৃত্যু পাবলিক খাবে ভালো, এই ছিলো তার পরিকল্পনা। কিন্তু এই আগন্তুক কে? সেখানেই বড় প্রশ্ন। আগন্তুককে সেরার সেরা এওয়ার্ড প্রোগ্রামে দেখে চমকে উঠেছিলো তারা দুজনই। কেন যেন মনে হয়েছে, একে তারা চেনে। আবার চেনেনা। কেমন যেন আলো আঁধারীর মতো এক মানুষ। সেই এওয়ার্ড প্রোগ্রামের পর কেউ তাকে আর দেখেনি। একজন মানুষও তার ঠিকানা জানে না। ফোন নাম্বার জানে না৷ সে শুধু মাত্র মেইলের মাধ্যমে প্রকাশকদের সাথে যোগাযোগ করে। তনিমার কথা হলো যেভাবেই হোক, আগন্তুকের এই রহস্য উদঘাটন করতেই হবে।

তারপর থেকে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে দুজনে। অন্তু পরের কয়েকদিন তার প্রতিটি প্রকাশকের সাথে যোগাযোগ করেছে। সাধারণত কেউই তার ব্যাপারে কথা বলতে চায়নি৷ লেখকের পক্ষ থেকে নাকি নিষেধ আছে। কিন্তু নিজের পুলিশি আইডি কার্ড দেখাতেই সুড়সুড় করে এক একজন যা জানে সব উগলে দিয়েছে। তাদের কথার সারমর্ম এই, আগন্তুকের সাথে তাদের কখনো ফোনে কথা হয়নি, কোনদিন দেখা হয়নি। একটা বইমেলাতেও তিনি কোন স্টলে সামান্য সময়ের জন্য উপস্থিত হননি। তিনি পান্ডুলিপি প্রকাশককে পাঠান মেইলে। আর নিজের রয়্যালটি নেন একাউন্টের মাধ্যমে। প্রকাশকরা একাউন্টে এমাউন্ট পাঠিয়ে দেন। ব্যাংকে সে একাউন্টের খোঁজ নিতে গিয়ে বিশাল এক ধাক্কা খেল অন্তু। অদ্ভুত ব্যাপার। আগন্তুকের ব্যাংক একাউন্ট কোন পুরুষের নামে নয়। সে একজন নারী। তেষট্টি বছর বয়সের সেই নারীর স্থায়ী ঠিকানা এই প্রত্যাশা বৃদ্ধাশ্রম।

(চলবে)

আগন্তুক পর্ব-১১

0

#আগন্তুক
– সাবিহা বিনতে রইস

পর্ব – ১১

– আমার কিন্তু মনে হচ্ছে, আমরা ঠিক দিকে এগুচ্ছি।

অন্তু মাথা নাড়লো৷

– আমার মতামত আংশিক হ্যা, আর আংশিক না!

তনিমা ভ্রু কুচকালো৷

– জানা গেল তো, প্রত্যয়ের একটা এফেয়ার ছিলো৷ সোজা বাংলায় পরকীয়া। মল্লিকা এটা জেনে নিতেই সে মল্লিকাকে খুন করেছে।

– উম, নাহ! তুমি মূল ঘটনা থেকে সরে গেছো।

তনিমা হাত ওল্টালো৷

– কি জানি বাবা! এই বিষয়টা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছি যখন থেকে, ঠিক তখন থেকেই আমার বুদ্ধি কমা শুরু হয়েছে। অনেক বিষয় ঠিক ধরতে পারছি না।

অন্তু হাসলো৷ তারপর তনিমার মাথায় হাত রেখে বললো,

– মাথাটাকে রেস্ট দাও একটু৷ এদিকের ঘটনা শুনেছো?

– কোনটা?

– মা বাবা আর থামতে চাইছেন না। লকডাউন শেষ, এবার উনারা বিয়ের তোড়জোড় শুরু করতে চান।

– শুধু বাবা মা তোড়জোড় শুরু করেছেন? আর কেউ না?

তনিমার চোখেমুখে স্পষ্ট দুষ্টুমি। অন্তু কিছু বলতে যাচ্ছিলো, তার আগেই ও ঘর থেকে ডাক এসেছে।

– এই তনি, সেরার সেরা এওয়ার্ড প্রোগ্রামটা দেখাচ্ছে। টিভি অন কর, দেখতে পাবি৷

তনিমা সাথে সাথে গলা ওঠানো,

– পুনঃপ্রচার হচ্ছে মা। আমি দেখেছিলাম সেদিন। তুমি দেখো৷

– এই টিভিটা অন করো। প্রোগ্রামটা দেখি।

– কেন? তুমি দেখোনি এর আগে? এবার এওয়ার্ড লাবণ্য পায়নি৷ আগন্তুক পেয়েছে।

– সেজন্যই তো দেখতে চাইছি আরেকবার।

তনিমা অবাক হয়ে তাকালো অন্তুর দিকে। তারপর অনিচ্ছা নিয়ে উঠে গিয়ে টিভি চালালো। প্রোগ্রামের অনেকটা দেখানো হয়ে গেছে৷ ঘোষণাও হয়েছে আগন্তুক পুরস্কার পাচ্ছে। সঞ্চালক সুমধুর কণ্ঠে পড়ে শোনাচ্ছে তার আত্মজীবনী৷ অন্তু টিভির সামনে এসে বসে মনোযোগ নিয়ে তাকিয়ে থাকলো পর্দায়। তনিমাও গিয়ে বসলো কিছু দূরে। ফোন হাতে নিয়ে অকারণে স্ক্রল করতে থাকলো নিউজফিড। সঞ্চালক তখনও পড়ছে,

” বর্তমান সময়ে তরুন পাঠকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করা মানুষটা নিজেকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যেতে পারেন যখন তখন। কিন্তু তিনি তা চাননি৷ তিনি শুধু চেয়েছেন লেখা দিয়ে পাঠকের মন ছুঁয়ে রাখতে। আর তাই গত দুই বছরের সেরার সেরা এওয়ার্ড প্রাপ্ত লেখক লাবণ্য রহমানকে পেছনে ফেলে তিনি জিতে নিয়েছেন সেরার স্থান। আমি আগন্তুকে স্বাগত জানাচ্ছি, মঞ্চে এসে পুরস্কার গ্রহনের জন্য৷

তনিমাও ততক্ষণে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়েছে টিভির দিকে। পর্দায় আগন্তুক উপস্থিত হচ্ছে। এই প্রথমবার আগন্তুকের দর্শন পাবে সে। আগেরবার সে পুরস্কার পাচ্ছে, এ খবর শুনেই উঠে পড়েছিলো তনিমা। বান্ধবীর জায়গায় অন্য কাউকে প্রায় সহ্যই হয়নি। লাবণ্যর বইয়ের পাশাপাশি, বুকসেলফ ভর্তি আগন্তুকের প্রচুর বই রয়েছে তার৷ নিঃসন্দেহে সে ভালো লেখে। তাকে এক নজর দেখা দরকার।

পর্দায় ঘোষণা চলছে, ” অবশেষে স্বেচ্ছা বন্দীত্ব কাটিয়ে হাজির হচ্ছেন তিনি”। হাত তালির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। তনিমা নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে আছে টিভির দিকে৷

মঞ্চে প্রবেশ তার। লম্বা গড়নের এক ব্যক্তি। পরনে ক্রীম রঙের শার্ট, কালো প্যান্ট। মাথা ভর্তি কাঁচাপাকা চুল দারুণ ভাবে আঁচড়ে রেখেছে। মুখেও চাপ দাড়ি৷ চোখে ক্রীম রঙের চশমা। দারুণ ব্যক্তিসম্পন্ন, আর তীক্ষ্ম চেহারা। পুরস্কার হাতে নিলেন তিনি, হাসলেন মৃদু। সেই হাসি দেখেই তনিমা ধাক্কা খেল৷ কেন লোকটাকে এত চেনা চেনা লাগছে তার? কোথায় দেখেছে একে? কোথায় দেখেছে? মাথায় ঘুরছে এক চিন্তা! পুরস্কার নিয়ে সে মাইকের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তারপর গলা তুলে বললো, আমি জনপ্রিয়তা চাই না। শুধু আপনাদের ভালোবাসা চাই৷ আজ আপনাদের ভালোবাসা পেয়েছি৷ এতেই আমি ধন্য। মাত্র কয়েকটা বাক্য যেন ঝংকার তুললো সকলের মস্তিষ্কে। সকলে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো তার কণ্ঠের জাদুতে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আগন্তুক আর কিছু বললো না। সামনের সকল শ্রোতা যেন বোবা হয়ে গেছে। মিনিট কয়েক চুপ থাকার পর সকলে একত্রে হাত তালি দিয়ে উঠলো। ততক্ষণে আগন্তুক মঞ্চ ছেড়ে মিলিয়ে গেছে। কোথাও নেই সে।

তনিমা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে টিভির দিকে৷ অনুষ্ঠানে বিরতি দিলো৷ অন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো ৷ তার চোখেও বিভ্রান্তি। আবার যেন কোন কিছু খুঁজে পাওয়ার অনিশ্চিত আনন্দ।

অন্তুই প্রথমে মুখ খুললো। বললো,

– পেলে কিছু?

তনিমার যেন সহসা ধ্যান ভঙ্গ হয়েছে। সে মুগ্ধ কন্ঠে বললো,

– দারুণ স্মার্ট, তাইনা?

অন্তু বাঁকা হাসি হাসলো।

– ঠিক বলেছো। তবে শুধু চেহারায় নয়, বুদ্ধিতেও স্মার্ট। দারুণ ঘোল খাওয়াচ্ছে আমাদের৷

তনিমা হাসলো৷ তবে এই হাসি প্রাণখোলা প্রেয়সীর হাসি নয়। এই হাসি এক সত্যান্বেষীর রহস্য উদঘাটনের। অন্তু তনিমার এই হাসিটা চেনে। তার বুদ্ধির ঝিলিক দেখেই একসময় প্রেমে পড়েছিলো তার।

– তাহলে এবার কি করব, বলো?

অন্তু দু হাত উপরে তুলে আড়মোড়া ভাঙলো। বললো,

– মাকে বলি, বিয়ের শপিং শুরু করতে, নাকি? দিন কয়েক পরে দারুণ একটা ব্রেক নিব। এই ঝামেলা সলভ করতে কয়দিন লাগবে? আর দিন দুয়েক, নাকি?

(চলবে)

আগন্তুক পর্ব-১০

0

আগন্তুক
– সাবিহা বিনতে রইস

পর্ব – ১০

সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে অনেক অনেকক্ষণ। বর্ষার আকাশে আজ মেঘ নেই। দুপুর গড়িয়ে আর বৃষ্টি আসেনি। আবার শুরু হয়েছে উত্তাপ। ফ্যানের নিচে বসেও ঘামছিলো অন্তু। বাসায় ফিরতে হবে। কিন্তু তনিমার দেখা নেই৷ সেই যে বাসায় ফিরে বেডরুমে ঢুকেছে, পাক্কা পয়তাল্লিশ মিনিট পরও সে নিখোঁজ। উডবি মাদার ইন ল এসে চা দিয়ে গেছে। হালকা পাতলা গল্পসল্প করে উঠে গেছেন। তারপর আর কতক্ষণ বসে থাকা যায়? নাহ! আর সম্ভব না! এবার যাওয়া দরকার ভেবে বসা থেকে উঠে দাড়াতেই, তনিমা দরজা খুলে বেরিয়ে এলো।

– কি হলো? দাঁড়িয়ে আছো যে?

অন্তু মুখ ফেরালো।

– আমাকে এখানে বসিয়ে রেখে কখন গিয়েছ খেয়াল আছে?

– সরি! গোসল সারতে দেরী হয়ে গেল! এত টায়ার্ড লাগছে! তুমিও যাও না, ফ্রেশ হয়ে আসো। রাতে খেয়ে ফিরবে।

অন্তু চোখ বড় বড় তাকালো।

– পাগল নাকি? টায়ার্ডনেস শুধু তোমার আছে, আমার নেই? কি বলবে বলে ফেলো তো। এই বসলাম আমি।

অন্তু ধপ করে সোফায় বসে পড়লো। তনিমাও এসে প্রায় তার গা ঘেঁষে বসলো। তারপর গভীর ভাবে তাকিয়ে বললো,

– তুমি না অন্তু, কেমন যেন!

তনিমার চুল থেকে ভুরভুর করে শ্যাম্পুর গন্ধ আসছে। খুব অচেনা একটা ঘ্রাণ । সহজাত কারো থেকে পাওয়া যায়না এই গন্ধটা। শুধু তনিমা ছাড়া! কেমন যেন নেশা নেশা লাগে এই ঘ্রাণটা পেলে৷ অন্তু একটু গা ঝাড়া দিয়ে উঠলো। তারপর ভ্রু কুচকে বললো,

– কেমন?

– কেমন! কেমন! রোমান্টিক না! রোবটিক! এই পুলিশের চাকরিটা তোমাকে দারুণ স্যুট করে! বয়ফ্রেন্ড হবে, আরেকটু অন্যরকম!

– ঠিক তোমার চয়ন ভাইয়ের মতো তাইনা?

অন্তুর চোখেমুখে দুষ্টুমি। তনিমা চট করে তা ধরে ফেললেও সেকেন্ডের জন্য বিব্রত হয়ে গিয়েছিলো। অন্তুর সাথে পরিচয়ের প্রথমদিকে, নানান কথায় তনিমা তাকে চয়নের কথা বলতো। চয়ন দারুণ হ্যান্ডসাম। যেমন লাভিং বয়ফ্রেন্ড ছিলো লাবণ্যর, এখন ঠিক তেমনই কেয়ারিং হাসবেন্ড, কতবার যে বলেছে কথা গুলো। সেই থেকে অন্তু মাঝে মাঝে সুযোগ পেলে তনিমাকে খোঁচাতে ভোলে না। যদিও তনিমা কখনো বলতে পারবে না, সে সত্যিই চয়নকে একসময় মন প্রাণ দিয়ে চাইতো।

– তুমিও না! সবসময়…কপট রাগ দেখালো সে। তারপরই সুর পাল্টেছে,
– শোনো তোমার কি মনে হচ্ছে, বলো তো?

– কি ব্যাপারে?

– এই যে প্রত্যয় ঠিক কতটুকু জড়িত এই মৃত্যু গুলোর সাথে?

অন্তু হাই তুললো৷ তারপর মুখে হাত চাপা দিয়ে বললো,

– তনি, আমার মনে হয় শুধু একটা ইনফরমেশনের উপর ভিত্তি করে প্রত্যয়কে সন্দেহ করা উচিৎ হবে না। তোমার যুক্তির খাতিরে ধরেই নিলাম, প্রত্যয় কোনভাবে এদের খুন করেছে। কিন্তু কেন খুন করবে? মোটিভ কি?

তনিমা সোফায় হেলান দিয়ে বসলো৷ এই একই প্রশ্ন তো তার মাথাতেও ঘুরছে। আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে যে এই মৃত্যু গুলোর পেছনে কারো হাত নেই, এইগুলো আসলেই আত্মহত্যা!

– আমি আজ উঠি। কোন কিছু জানানো লাগলে ফোন তো আছেই।

অন্তু উঠে দাড়াতেই চট করে তার হাত ধরে থামিয়েছে তনিমা৷

– শোনো, এই কেসটা তো আত্মহত্যা বলেই বন্ধ হয়ে গেছে। আবার রিওপেন করা যায় না?

– রিওপেন করতে হলে একটা হলেও ক্লু লাগবে। যেটা দেখিয়ে আমি রিওপেনের এপ্লাই করতে পারব। কিন্তু তেমন ক্লু পেলাম কোথায়?

– হুম!

অন্তুর হাত ছেড়ে দিলো তনিমা। এলিয়ে পড়লো সোফায় আবার। তার চোখে মুখে হতাশা! আজকের দিনটি খামোখা নষ্ট হলো৷ কাজের কাজ কিছুই করতে পারলো না। অন্তু তার মনের কথা আঁচ করতে পারছিলো। সে আলতো ভাবে হাত রাখলো তনিমার কাঁধে। তারপর বললো,

– আমি আছি তো৷ আপসেট হওয়ার কিছু নেই। নিশ্চয় একটা ব্যবস্থা হবে।

——————————————————

প্রায় পাঁচ মাস লকডাউন থাকার পর খুলে দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ। করোনার প্রকোপ প্রায় কমে এসেছে। বিশ্ব জুড়ে কমেছে মৃত্যুর হার। আক্রান্তের সংখ্যাও৷ মানুষ অনেকদিন পর যেন প্রাণ খুলে শ্বাস নেওয়ার সূযোগ পেয়েছে। বিকেলে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলো তনিমা। আজ রাজশাহী শহরেও জ্যাম বেঁধে গেছে। অনেকদিন পর খাঁচার পাখি যেন মুক্তি পেয়েছে। রাস্তায় শুধু মানুষ আর মানুষ। কারনে – অকারণে ঘুরছে এদিক ওদিক। অবশ্য এখনো সকলের মুখে মাস্ক, হাতে গ্লোবস। অর্থাৎ জানের ভয় ঠিকই আছে। কিন্তু তবুও ঘরের বাইরে বের হওয়া চায়। আজব পাবলিক সব! খানিকটা ভীড় ঠেলে অবশেষে গন্তব্যে পৌছালো তনিমা । অনেকদিন পর লাবণ্যকে দেখতে এসেছে সে। মাঝে কিছুদিন রাস্তায় এত কড়াকড়ি শুরু হয়েছিলো যে বের হবার উপায় ছিলো না। অবশ্য নিয়মিত সে চয়নকে ফোন করে খোঁজ খবর নিতো। আজ লাবণ্যকে দেখে বুকের ভেতরে ধক করে উঠলো। এ কোন চেহারা হয়েছে তার? চোখের নিচে কালি পড়েছে। ভেঙে গেছে শরীর। বিছানা ছেড়ে ওঠার অবস্থা প্রায় নেই। তনিমাকে দেখে লাবণ্যর মা তাকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠলো!

– দেখছো তনিমা, আমার মেয়েটার অবস্থা দেখছো? চিনতে পারছো, ও তোমার সেই বান্ধবী? কি হয়ে গেল এটা বলো তো? গত চার মাস এইভাবে পড়ে আছে, আমি আর সহ্য করতে পারছি না!

তনিমার কথা আটকে গেছে। কি বলে সান্ত্বনা দেবে সে? তার নিজেরই তো ভাষা হারিয়ে গেছে৷ এত বেশি অসুস্থ কিভাবে হওয়া সম্ভব? শেষ যেবার দেখেছিলো, তখনও তো এমন ছিলো না? অনেক কষ্টে মুখ খুললো,

– আন্টি চয়ন ভাই কোথায় থাকছে?

– চয়ন আসা যাওয়ার মধ্যে আছে। কখনো এখানে, কখনো ওর ফ্ল্যাটে। এখানেই বেশি থাকে। মাঝে মাঝে ও বাড়িতে যায়। একটু আগে অফিস থেকে ফিরলো। কথা বলবে? ওর উপর দিয়েও তো কম ঝড় যাচ্ছে না!

– হুম, আমি বুঝতে পারছি আন্টি। তবে ভাইয়ের সাথে একটু কথা ছিলো৷

– এসো, ওদিকের ঘরে থাকে চয়ন।

লাবণ্যর মায়ের পিছু পিছু এগিয়ে গেল তনিমা। দরজায় টোকা দিতেই চয়ন খুলে দিলো এসে৷

– আরেহ, তনিমা যে? কি খবর? কখন এলে?

তনিমা হাসলো৷

– এই তো চয়ন ভাই৷ আপনি ব্যস্ত? একটু কথা বলতাম।

– না! না! ফ্রি আছি৷ তুমি বসো, আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসছি৷

তনিমা মাথা নাড়লো৷ তারপর এসে বসলো ড্রইং রুমে। আসার পথে একবার উঁকি দিলো লাবণ্যর ঘরে। সে তখনও ঘুমাচ্ছে।

চয়ন ড্রয়িংরুমে এলো মিনিট পনেরো পর৷ এর মধ্যেই সে গোসল সেরেছে। বেশ চনমনে দেখাচ্ছে তাকে। তবে চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে বেশ অনেকদিন ঠিকমতো ঘুম হয়নি। কপালে দুশ্চিন্তার ছাপ। তনিমা প্রথমে কথা বললো,

– কি যাচ্ছে আপনার উপর দিয়ে, বুঝতে পারছি চয়ন ভাই! কিন্তু লাবণ্যর কোন উন্নতি নেই কেন? ওষুধে কাজ হচ্ছে না? এক ডাক্তারকে না দেখিয়ে, আমার মনে হয় এবার একটু অন্য ডাক্তার দেখানো উচিৎ৷

– ডাক্তার তো চেঞ্জ করেছি। মেডিসিন প্রফেসর দেখছিলেন প্রথমে। তারপর উনিই একজন সাইকোলজিস্টলে রেফার করলেন। তাকেও দেখালাম৷ কিন্তু কিছুই উন্নতি নেই।

– তনিমা, অতিপ্রাকৃত কিছু বিশ্বাস করো?

তনিমা চমকে তাকালো। লাবন্যর মা ট্রে হাতে নিয়ে ঢুকেছেন। তারপর কফির মগটা তনিমার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন,

– কোন ওষুধেই কাজ হবে না৷ আমি জানি, এখানে অন্যকোন ব্যাপার আছে। আমার মেয়েটার উপর কালোছায়া পড়েছে।

– আন্টি, কি বলছেন এইসব? সেসব কিচ্ছু না। লাবণ্য ঠিক হয়ে যাবে। চয়ন ভাই, আন্টিকে বোঝান একটু।

চয়ন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর বললো,

– তনিমা, আমার মনে হয় মা ঠিকই বলেছেন। লাবণ্যর এটা কোন রোগ নয়। আমিও বিশ্বাস করতাম না।এইসব। কিন্তু লাবণ্য যা সব করছে! আমাদের এবার অন্য পন্থা অবলম্বন করতে হবে।

– আপনি যদি এইসব বলেন, কিভাবে হবে চয়ন ভাই?

– তনিমা, আমরা শুধু লাবণ্যর ভালো চাই। সেটা যেভাবেই হোক!

—————————————————–

তনিমা যখন বাসায় ফিরলো, তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। বাসায় ঢুকতেই দেখলো সোফায় বসে পেপার পড়ছে অন্তু।

– কখন এসেছো? ফোন দাওনি যে।

– এই তো কিছুক্ষণ। তুমি নাকি লাবণ্যদের বাসায় গিয়েছিলে, আন্টি বললো। কি খবর ওদের?

– ওই আছে একরকম! তুমি বলো, নতুন কোন খবর আছে?

অন্তু হাই তুললো।

– আছে বইকি!

লাবণ্য সাথে সাথে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এসে বসেছে অন্তুর কাছে।

– কি খবর বলো তো?

– মনে আছে, শ্বেত মহলে গিয়ে একটা ঘড়ি পেয়েছিলাম, ওই যে ওখানে, তুমি যেখানে হোচট খেয়েছিলে।

– মনে আছে। কি হয়েছে ঘড়িটার?

– ঘড়িটা প্রত্যয়ের, জানা গেছে৷ আর দ্বিতীয় খবর হচ্ছে, সে বিয়ে করতে চলেছে। মানে প্রত্যয়।

তনিমা অবাক হয়ে তাকালো।

– বলো কি? বউ মারা যাওয়ার মাস তিনেক পার হতে না হতেই বিয়ে?

অন্তু শিষ দিয়ে উঠলো,

– তাহলে আর বলছি কি ডার্লিং! খোঁজ পেয়েছি মেয়েটার সাথে আগে থেকেই পরিচয় ছিলো প্রত্যয়ের৷

– বাহ! এবার তাহলে খুনের মোটিভ পরিস্কার। এক্সট্রা ম্যারিটাল এফেয়ার! আমরা তো এটা দেখিয়েই কেসটা রিওপেন করতে পারি তাইনা?

অন্তু মাথা নাড়লো৷

– তা তো পারিই। কিন্তু, সবকিছু কি এতই সহজ, মানে আমরা যা ভাবছি? নাকি অন্য কোন রহস্য আছে, যা আমরা ধরতে পারছি না?

( চলবে)

আগন্তুক পর্ব-০৯

0

আগন্তুক
– সাবিহা বিনতে রইস

পর্ব – ৯

– ভেতরে যাবে না? গেটে তো তালা দেওয়া!
– ওহ শিট! আমাকে মনে করাবে না যে গেটে তালা দেওয়া থাকবে?
– আমি কিভাবে জানবো, আজব তো?
– যেখানে দুটো অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে, সেটা কি এমনি খোলা রেখে দিবে?
– সেটা তো তোমার জানা উচিত। পুলিশে চাকরি আমি করি, না তুমি?

তনিমা বিরক্ত হয়ে তাকালো অন্তুর দিকে। তার চোখ দেখে হাত উঁচু করে হেসে ফেলল অন্তু৷

– ওকে বাবা! আমার ভুল ছিলো, হয়েছে? আমি থানায় ফোন করছি। দেখি ওরা খুলে দেয় কিনা!

অন্তু ফোন নিয়ে ডায়াল করলো থানায়। তনিমা সরে এলো গেটের কাছে। কারুকার্য করা গেটের বাইরে থেকে দেখতে থাকলো ভেতরের সৌন্দর্য। চমৎকার দুটো জলপরী ভেজা শরীর নিয়ে ফোয়ারায় বসে জলকেলি করছে৷ সামনে মার্বেল পাথর বিছানো রাস্তায় ঝরা পাতার মেলা৷ এ কদিন যে এখানে কারো পা পড়েনি, বেশ বোঝা যাচ্ছে। দূরে দাঁড়িয়ে আছে তেতলা সুউচ্চ প্রাসাদ৷ সামনে লম্বা ঝুল বারান্দা। দুপাশে সিঁড়ি না দেখা গেলেও আন্দাজ করা যাচ্ছে। পুরোটা মিলে অপূর্ব সুন্দর৷ বাড়ির মালিকের রুচির তারিফ করতে হয়! এই ধরনের বাড়ি তৈরি কম ব্যাপার নয়।

– এই তনি, কথা হলো থানায়।
তনিমা প্রাসাদ থেকে চোখ না ফিরিয়েই বললো,
– কি বললো ওরা?
– চাবি নিয়ে আসছে। তবে মিনিট তিরিশেক দেরী হবে।
তনিমা সাথে সাথে ফিরে তাকিয়েছে।

– ত্রিশ মিনিট! এতক্ষণ কি করব আমরা? গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবো?

– উহু! তা থাকবো কেন? চলো, আমরা একটু ঘোরাঘুরি করি। আশেপাশে লোকজনের সাথে কথা বলা দরকার।

– লোকজনের সাথে কথা বলতে হলে আবার উলটো পথে যেতে হবে। গ্রামের শেষ সীমানা ছেড়ে এসেছি, ভুলে গেছো নাকি? গ্রাম থেকে বেরুবার সময় ঘুরে নিব একবার।

– তাহলে আর কি! চলো, এই বাড়ির আশপাশটা দেখি, নাকি?

তনিমা অমত করলো না। অন্তুর সাথে বাড়ির সীমানা প্রাচীর ধরে হাঁটতে লাগলো। এদিকটায় তেমন কেউ আসে না বোধহয়। সাধারণত কোন মাঠ ধরে মানুষ নিয়মিত যাতায়াত করলে, সেখানে পথ তৈরি হয়। কিন্তু এখানে তেমন কিছু নেই। বর্ষার মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। ছায়া ছায়া চারিদিক। কেমন যেন অশরীরী ভাব। তনিমা ঘড়ি দেখলো। বারোটা বাজতে সাত মিনিট বাকি৷ এমন দিনের বেলায় লোকচক্ষুর সম্মুখে নিশ্চয় অশরীরী কেউ ঘুরে বেড়াবে না? তবুও কেন যেন তনিমার শরীর শিরশির করে উঠলো। কারণ না থাকলেও বার কয়েক পেছনে তাকালো৷ বারবার মনে হচ্ছে কেউ যেন আছে এখানে। তাদের অনুসরণ করে হাঁটছে মৃদু পায়ে। অন্তু ততক্ষণে এগিয়ে গেছে। সামনে কাদাপানির পথ। হঠাৎ তনিমা হোঁচট খেল। নিজেকে কোনরকমে বাঁচাতেই টুপটাপ বৃষ্টির শব্দ পেল সে ৷ তারপরই প্রায় ঝড়ের বেগে তার মাথার উপর থাকা জারুল গাছটি নড়ে উঠলো। পাতায় লেগে থাকা পানি এক নিমিষে ঝরে পড়লো গায়ে। চমকে উঠলো তনিমা। ভিজে গেছে অনেকখানি। শব্দ পেয়ে পেছনে ঘুরেছে অন্তু,

– এই কি হলো?

তনিমা দাঁড়িয়ে পড়েছে। বুক ধড়ফড় করছে। অন্তু দৌড়ে এলো তার কাছে!

– এই যা! ভিজে গেছো যে! এইভাবে কেউ গাছ ঝাকায়?
– গাছ আমি কখন ঝাকালাম?

অন্তু কোমরে হাত রেখে বললো,

– তুমি কিন্তু এখনো ডালটি ধরে আছো!

তনিমা খেয়াল করলো এবার। হাঁটতে হাঁটতে বেখেয়ালে কখন যেন জারুল গাছের চিকন ডালে হাত দিয়েছে। ঠিক তখনই হোঁচট খেয়েছিলো সে। নিজেকে বাঁচাতে কোনরকম ডাল আঁকড়ে ঝাকুনি খেয়ে থেমেছে। তবে গাছ নড়ে ওঠায়, পাতায় জমে থাকা পানি গায়ে ঝরে পড়েছে। নিজেকে একটু ধাতস্থ করে অন্তুর হাত ধরে এগুলো এবার। কিন্তু ভয়টা গেল না। অন্তুকে কিছু না বললেও, সে ঠিক জানে, হোঁচট এমনি এমনি খায়নি সে। বরং পেছন থেকে তাকে ধাক্কা দেওয়া হয়েছে।

অন্তু আর তনিমা এবার যে জায়গায় এসে থামলো, সেখানে বড় গাছপালার সংখ্যা বেশিই বলা চলে। এই মেঘাচ্ছন্ন দুপুরে পরিবেশটা ছমছমে। জায়গাটি থেকে শ্বেত মহলের উত্তর কোন দেখা যায়। এদিকে মহলের কোন জানালা নেই। অন্তু আর তনিমা দুজনই মহলের দিকে পেছন ফিরে দাড়িয়েছিলো। তাদের চোখে অবাক বিস্ময়। সামনে ভঙ্গ প্রায় লোহার গেট। তারপর কয়েক কদম এগুলে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, শেওলা ধরা, আগাছাপূর্ণ এক প্রাসাদ। গেটের পাশে থাকা ফলকে প্রাসাদের নাম খোদায় করা। সেটার অবস্থাও করুন। কি লেখা আছে, উদ্ধার করা ভিষণ মুশকিল। কিন্তু অবাক করা কাণ্ড, তনিমা লেখাটি উদ্ধার করতে পারলো৷ সেখানে লেখা,

নয়নতারা!
১১০৮ বঙ্গাব্দ।

– তাহলে এই হচ্ছে শ্বেতমহলের আসল রহস্য!

অন্তু হাসলো৷ বললো,

– যাবে নাকি ভেতরে?

তনিমা আঁৎকে উঠেছে সাথে সাথে।

– পাগল নাকি তুমি? এর মধ্যে দু-চার ডজন রাসেল ভাইপার ছাড়া আর কিছু পাবে না! খামোখা কামড় খেয়ে মরতে হবে। চলো ফেরা যাক! যা ধারণা করেছিলাম, তার বেশিরভাগই ঠিক! বিশাল দারুণ একটা নাটক সাজানো হয়েছে।

অন্তু মাথা নাড়লো,

– হুম, এবার খুঁজে বের কর‍তে হবে নাটকের পরিচালককে।

তনিমা মাথা নাড়লো৷

– আমি যদি ভুল না করি, এই নাটকের পরিচালক আসলে বিখ্যাত লেখক আগন্তুক। তিনি দারুণ লেখেন মানতেই হবে। কিন্তু পরিচালনা যে এত ভালো করেন, তা ভাবতে পারিনি।

– তনি, আমাদের সাবধান হওয়াটা জরুরি। যিনি এত কিছুর এরেঞ্জমেন্ট করতে পারেন, তিনি যে আমাদের কিছু করবে না, তা ভাবা যাবে না।

তনিমা মাথা নাড়লো৷ ফিরতি পথে আসার সময়, সেই জারুল গাছের নিচে একটা ঘড়ি চোখের পড়লো তার। অদ্ভুত! ঘড়ির ১১.৫৫ তে কাঁটা আটকে আছে! কোন কিছুতে আঘাত লেগে বন্ধ হয়ে গেছে। আর সেটা কিছুক্ষণ আগেই!

—————————————————-

থানা থেকে একজন এসে শ্বেত মহলের তালা খুলে দিল। ঘুরে দেখার সময় বেঁধে দিলো ২০ মিনিট। অন্তু আর তনিমার পক্ষে এর মধ্যে যতটুকু সম্ভব হলো, ঘুরে দেখলো। চয়নরা যাওয়ার সময় পোশাক বাদে আর কোন কিছু এই বাড়ি থেকে নিয়ে যায়নি৷ লাবণ্যর ব্যবহৃত ডায়রী পর্যন্ত পড়ে আছে। সাথে থাকা পুলিশের চোখ এড়িয়ে লাবণ্যর দুটো জিনিস ব্যাগে ভরে নিলো তনিমা। তারপর একে একে মল্লিকা আর অনিন্দিতার ঘরগুলো দেখে বেরিয়ে পড়লো তারা। ততক্ষণে দুপুর হয়ে এসেছে। অন্তু গ্রামের কয়েকজনের সাথে কথা বললো শ্বেত মহল আর নয়নতারার বিষয়ে। বিশেষ কোন কিছু জানতে পারলো না। তবে এতটুকু বোঝা গেল, তাদের সবারই বাড়িটির প্রতি ভীতি আছে। সবাই ভাবে এই বাড়িতে জমিদার কন্যা নয়নতারার অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে বেড়ায়। তাই তারা ওইদিকে খুব একটা যায় না৷

গ্রাম থেকে বেরিয়ে আসার আগে গাড়ী থামিয়ে একটা টঙের দোকানে বসে পড়লো দুজন। করোনা ভাইরাসের প্রকোপে গ্রাম জুড়েও কড়াকড়ি চলছে। লোকজন খুব একটা বাইরে নেই। অন্তু চা খাওয়ার ফাঁকে দেখলো, একটি বাচ্চাছেলে ফুলের ঝুড়ি হাতে নিয়ে এগিয়ে আসছে। ঝুড়িতে অল্প কিছু গাঁদা আর গোলাপ। অন্তু ডাকলো তাকে। ছেলেটি এগিয়ে এলো৷

– তোর বাড়ি এই গ্রামে?

ছেলেটি মাথা নাড়লো।

– ফুল বিক্রি করিস?

এবারও ছেলেটি নিঃশব্দে মাথা নাড়লো।

– কতদাম ফুলের?

এতক্ষণে ছেলেটি কথা বললো,

– গাঁদা ফুল ২০ টাকা শ, গোলাপ ৫ টাকা!

অন্তু চোখ কপালে তুলে বললো,

– বলিস কি! এত কমে ফুল বিক্রি করিস? সংসার চলে তোর?

সাথে সাথে ছেলেটির চটপট উত্তর,

– মাঝেসাঝে আপনাদের মতোন আপা- ভাই রা আইসা বেশি দামে ফুল কিনা নিয়া যায়! তখন লাভ করতে পারি!

অন্তু হেসে ফেললো!

– বাব্বাহ! বুদ্ধি তো ভালোই দেখছি। ইনডাইরেক্টলি বুঝিয়ে দিলি, আমার কাছেও বেশি দামে ফুল বিক্রি কর‍তে চাস, তাই তো?

ছেলেটা এবার ভারী সুন্দর করে হাসলো৷ পাশের বেঞ্চে চায়ে চুমুক দিতে দিতে দুজনের কথপোকথন উপভোগ করছিলো তনিমা। ঠিক তখনই একটা প্রশ্ন খেলে গেল তার মাথায়! ছেলেটিকে কাছে ডেকে ব্যাগ থেকে একশ টাকার নোট বের করে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

– নে, এটা আমি দিলাম তোকে। ফুল কিন্তু নিব না৷ ওগুলো ভাইয়ার কাছে বিক্রি কর।

অন্তু পলকে তাকিয়েছে তনিমার দিকে। সে অবশ্য কোনদিক তাকাচ্ছে না। তার চোখ ছেলেটির দিকে নিবদ্ধ।

– খেয়েছিস কিছু সকাল থেকে? চা বিস্কুট খাবি?

ছেলেটি মাথা নাড়লো৷ তনিমা তাকে পাশে বসালো। তারপর একটা বিস্কুট তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

– ক’ দিন আগে এই গ্রামে শহরের কিছু ভাই এসেছিলো, কয়েকটা আপাও ছিলো তাদের সাথে। ওই ভাইদের কেউ তোকে নয়নতারা ফুল এনে দিতে বলেছিলো?

ছেলেটি বিস্কুটে কামড় দিতে গিয়েও থেমে গেল। অবাক দৃষ্টিতে তাকালো তনিমার দিকে। তনিমা অভয় দিলো৷

– কোন ভয় নেই। তুই সত্যিটা বললে, আরো ১০০টাকা দিব।

ছেলেটা এইবার মুখ খুললো।

– এই গেরামে নয়নতারা ফুল নাই৷ আমি দূর থেকা আইনা দিয়াছিলাম, দুই বার! একটা ভাই বলসিলো আমারে।

তনিমা ঝটপট ফোন বের করলো। ফেসবুকে চয়নের আইডির ছবি গুলো দেখলো। এইবাড়িতে ঘুরতে এসে প্রথমদিন দারুণ সেলফি আপলোড দিয়েছিলো সে। চয়নের প্রায় কাঁধ ধরে ঝুকে আছে লাবণ্য। তার পাশে হাস্যজ্বল রূপম আর অনিন্দিতা। সব শেষে মল্লিকা। মল্লিকার ঘাড়ে হাত রেখে পেছনে দাড়িয়েছে প্রত্যয়। তিন মাস পর কত বদলে গেছে এই জীবনগুলো৷ অনিন্দিতা আর মল্লিকা পৃথিবীতেই নেই৷ লাবণ্যর থাকা না থাকা সমান। নরক কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছে বাকি তিনজন। তনিমা ছবিটা এগিয়ে ধরলো ছেলেটির দিকে। বললো,

– ভালো করে দেখে বল তো, এদের মধ্যে কেউ তোকে ফুল আনতে বলেছিলো কিনা?

ছেলেটি তাকিয়ে থাকলো ছবিটির দিকে। তারপর হাত দিয়ে ইশারা করলো। তনিমার মুখের ভাব পাল্টে গেছে সাথে সাথে। অবাক চাহনি তার। ততক্ষণে পিছে এসে দাড়িয়েছে অন্তু। সে অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,

– প্রত্যয়!!!!

(চলবে)