Friday, July 18, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1372



দখিনা প্রেম পর্ব-১৫ + বোনাস পর্ব

0

#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ১৫ ||

—“রুবাই আপু কী ঠিকানা ভুল দিলো?”

—“এমন কেন মনে হচ্ছে তোর?”

—“না এখানে আরও একবার এসেছিলাম আর কী। সমস্যা নেই চলো সামনে এগোই, গাড়ি নিয়ে সেখানে যাওয়া সম্ভব না!”

—“কী বলিস! এখন প্রায় রাত হয়ে আছে, যদি কোনো সাপ-টাপ আসে?” ভয়ার্ত কন্ঠে বললো তানজীল।

—“আরে ধুর কিছু হবে না। চলো রাস্তার মোড়ে গিয়ে দাঁড়াই। সেখানে কাউকে পাঠাতে বলি!”

—“সে-ই ভালো। আমার এই রাত করে কেমন ভয় ভয় লাগছে, রাত বাজে মাত্র ৯টা তাও কেমন ভূতুড়ে, ভূতুড়ে পরিবেশ লাগছে!”

সা’দ কিছু বলে না। দুজন ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে রাস্তার মোড়ে গিয়ে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ পর পর ভোঁ করে বড় বড় ট্রাক, সিএনজি আর প্রাইভেট যাচ্ছে। এই রাস্তাটার ল্যাম্পপোস্টগুলো জ্বলছে না। হয়তো লোড শেডিং হয়েছে। গ্রামের কারেন্ট লাইন হয়তো এই সড়কের ল্যাম্পপোস্টেও বিদ্যমান। রাস্তার মোড়ে গিয়ে সা’দ রুবাইকে কল করলো। রুবাই ‘হ্যালো’ বলতেই সা’দ জানালো সে গ্রামে এসেছে তবে তানজীল যে এসেছে সেটা বলেনি। ওটা সারপ্রাইজ হিসেবে রেখেছে দুজন। রুবাই তো খুশিতে আত্মহারা। ভাবেনি তার ভাই এতো জলদি গ্রামে চলে আসবে। সা’দ রুবাইকে সবটা বুঝিয়ে কলটা কেটে অপেক্ষা করতে লাগলো।

রুবাই দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে চাচী জেঠু বলে চেঁচাতে থাকলো। রুবাইয়ের চেঁচামেচিতে সকলেই সিঁড়ির সামনে চলে আসে এবং জিজ্ঞেস করতে থাকে কী হয়েছে, এতো চেঁচামেচি করছে কেন? রুবাই ঠোঁটজোড়া প্রসারিত করে বলে,

—“ভাই আসছে। সে নাকি রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে। বলেছে কেউ যেন তাকে গিয়ে রিসিভ করে!”

—“আয়হায় সে কী বলিস রুবাই আগে বলবি না! আবিদ! আবিদ! যা গিয়ে সা’দ বাবাকে নিয়ে আয়। কতো কষ্ট করে আসলো আর এখন জায়গা চিনতে না পেরে নাকি রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে, এ কোনো কথা! হ্যাঁ গো,(বড় জেঠু) আপনি আর আবিদ মিলে ছেলেটাকে নিয়ে আসেন!”

—“আচ্ছা তুমি এতো উত্তেজিত হয়ে যেয়ো না, ছেলেটার জন্য ভালোমন্দ রান্নার ব্যবস্থা করো আমরা যাচ্ছি!”

বলেই জেঠু আর আবুদ বেরিয়ে গেলো। কবির সাহেব বাড়িতে নেই। কোনো এক কাজের চাপে আজ বাড়িতে ফিরবেন না। তাই জোহরা সকলের সাথে মানিয়ে চলার চেষ্টা করছে। সেহের এই দুইদিনে ফাতেমা খালার সেবায় প্রায় সুস্থ হয়ে গেছে। তবে হাঁটতে এখনো তার কিছুটা কষ্ট হয়। সে বহুবার চেয়েছিলো দাদীমাকে বিয়ের ব্যাপারটা বলতে কিন্তু কেন যেন সে বলে উঠতে পারছে না। আবার না বলতে পেরে অপরাধবোধে কঠোরভাবে ভুগছে সে। এমন একটা অবস্থা তার একূলও যেতে পারছে না আবার ওকূলও না! সেহের ধীর-পায়ে হাঁটার চেষ্টা করছে। কারণ, ফাতেমা খালা বলেছে হাঁটার চেষ্টা করছে নয়তো হাঁটুতে আরও রক্ত জমাট বাধার সম্ভাবনা আছে। এতে রক্ত চলাচলও সঠিকভাবে হবে না তাই হাঁটতে হবে৷ সেহের হাঁটতে হাঁটতে রান্নাঘরের দিকে যেয়ে দেখলো তার চাচীরা রান্নার ধুম লাগিয়েছে আর জোহরা কিছুটা দূরে বেসিনে কিছু শাক-সবজি ধুচ্ছে। সকলের তাড়াহুড়ো বুঝলো না সেহের। যদিও সে প্রশ্ন করতে চাইলো না তাও করেই বসলো,

—“কী হয়েছে তোমরা এভাবে তাড়াহুড়ো করছো কেন?”

আসিয়া সেহেরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,

—“আমার ছেলে আসছে ফুল! তার জন্য তার পছন্দের খাবারগুলো রান্না করছি। আর তুমি এখানে কেন যাও রুবাইয়ের সাথে গিয়ে বসো!”

সেহের মাথা নাড়িয়ে সোফার ঘরে চলে গেলো যেখানে রুবাই ফোন টিপছিলো। রিমন নিজের ঘরে পড়ছে আর তপা তো ঘর থেকে বের হয় না বললেই চলে। সেহেরকে দেখে রুয়াবি বিনয়ের সাথে হেসে সেহেরকে পাশে বসতে ইশারা করলো। সেহেরও মুচকি হেসে রুয়াবিয়ের পাশে গিয়ে বসলো। রুবাই মুচকি হেসে বলে,

—“জানো আমি কতো এক্সাইটেড, আমার ভাই এই গ্রামে আসবে! উফফ! তোমায় বলে বোঝাতে পারবো না। তবে হাসবেন্ডকে এতো ফোন করছি বারবার সুইচড অফ বলছে, চিন্তা লাগে না বলো?”

—“ভাইয়া ইতালিতে থাকে তাই না আপু?”

রুবাই মাথা নাড়ায়। এরপর সেহেরের কাঁধে মাথা রেখে আনমনে বলে,

—“কতোদিন তাকে দেখি না, কবে যে তাকে সরাসরি দেখবো, তাকে ছুঁতে পারবো!”

—“কেন ভাইয়া আসে না?”

—“হ্যাঁ আসে তবে খুব কম। জানো বড্ড অসহায় লাগে নিজের জন্য, আর কতো তার জন্য অপেক্ষা করবো!”

—“চিন্তা করিও না আপু, দেখবে আল্লাহ সুবহানাল্লাহ তায়ালা খুব শীঘ্রই তোমাদের দেখা করিয়ে দিবে!”

—“তাই যেন হয়। যাইহোক এখন কেমন আছো? হাঁটতে কী অসুবিধা হচ্ছে?”

—“না তেমন না ঠিক আছি আমি!”

তখনই সেহেরের দাদী আসলো আর সেহেরকে বিশ্রাম করার জন্য ঘরে পাঠিয়ে দিলো। দাদীমার ধারণা জোহরা সেহেরকে সামনে পেলেই কোনো না কোনো কাজে লাগিয়ে দিবেন। সে একদমই জোহরাকে ভরসা করেন না! সেহেরেরই বা কী করার সে রুমে চলে আসলো। একা থাকলেই সেহেরের বারংবার সা’দের কথা মনে পরছে। যদিও সেহের তার নাম জানে না, শুনেছিলো ‘স’ দিয়ে একটা নাম কিন্তু ঠিকভাবে শুনতে পায়নি। তবে সেহের তাকে বিদেশিই বলে। সেহের কখনো ভাবতেই পারেনি ওমন একটা পরিস্থিতিতে এই বিদেশিকে তার বিয়ে করতে হবে। সা’দের মতো এতো বড়ো মাপের মানুষকে ভাবাটাই তার জন্য বিলাসিতা ছিলো সেখানে কি না সা’দ তার স্বামী!! এখনো সেহের এই বিয়ের বিষয়টা বিশ্বাস করতে পারছে না। কেন যেন বিয়েটা মানতে পারছে না সেহের। মানবেই বা কী করে, সবটা যে তার মতামতের বাহিরে। কিন্তু বিয়ে তো বিয়েই হঠাৎ সেহেরের মনে পরলো তার দাদীমার কথা। তার দাদীমা গল্প শুনাতে গেলে সবসময় বলতো জম্ম, মৃত্যু, বিয়ে সবটাই আল্লাহ’র হাতে। আমরা তো উছিলামাত্র! এর মানে সেহেরের বিয়ে সা’দের সাথেই হতো? কিন্তু সা’দ তো তাকে বাঁচাতে এসেছিলো ওই অমানুষটার হাত থেকে, বাঁচাতে এসে নিজেই বিপদে পরে গেলো। ভাবতেই সেহের ভেতরে ভেতরে অনুতপ্ত হচ্ছে। নিশ্চয়ই সে বিয়েটা মানতে পারেনি, আর মানবেই বা কী করে? একটা অচেনা মেয়ের সাথে তার বিয়ে হয়েছে তাও গ্রামের সাধারণ একটা মেয়ের সাথে। এতে নিশ্চয়ই সে অসন্তুষ্ট! কিছুদিন পর ডিভোর্স পেপারও পাঠাতে পারে অথবা এই বিয়ে সারাজীবন ধামাচাপাই রয়ে যাবে। নাহ সেহের আর ভাবতে পারছে না, তার মাথায় ব্যথা উঠে যাচ্ছে। সেহের আর না দাঁড়িয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরলো। নানান কথা চিন্তা করতে করতে সে না খেয়েই ঘুমিয়ে গেলো।

সা’দের সাথে তানজীলকে দেখে রুবাইয়ের চোখের কোণে জল চিকচিক করে উঠলো। আশেপাশে মুরব্বিরা থাকায় সে তানজীলকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো না কারণ, ওনারা গ্রামের সংস্কৃতিতে বড় হয়েছে। তাদের সামনে জড়িয়ে ধরাটা খুবই লজ্জাকর পরিস্থিতি হবে। তাও রুবাই অভিমান করে বসে রইলো, তানজীল দেশে এসেছে তাকে আগে কেন জানালো না? তানজীল রুবাইয়ের গাল ফুলানো দেখে মৃদ্যু হাসলো! সে বুঝতে পেরেছে তার স্ত্রীর অভিমানের কারণ! আসিয়া রুবাইকে বললো,

—“রুবাই মা, জামাইকে ঘরে নিয়ে যা। কতো জার্নি করে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিবে!”

রুবাই মাথা নাড়ায়। রুবাই তানজীলকে আসতে বললে তানজীল রুবাইয়ের পিছে পিছে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো।
সা’দকে দেখে জোহরা হা হয়ে রইলো। এমন সুদর্শন সে আগে কোনোদিন দেখেনি। কী মনে করে সে খুব নম্র স্বরে বলে উঠলো,

—“বাবা উপরে গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে নাও, আমি তুমারে ঘর দেখিয়ে দেই!”

সা’দ জোহরাকে চিনতে পারলো না। সা’দ ভ্রু কুচকে আসিয়ার দিকে তাকাতেই আসিয়া বললো,

—“উনি তোর ছোট চাচী সা’দ আর ওইযে দেখছিস দাঁড়িয়ে আছেন, উনি তোর বড় চাচী!”

সা’দ বিনয়ের সাথে তাদের সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করলো। দাদীমা আশেপাশে তখন ছিলো না। জোহরা সা’দকে নিয়ে রিমনের ঘরে গেলো। রিমন নিজের ঘরে পড়তে বসায় সে সা’দকে দেখে ভ্রু কুচকে বললো,

—“উনি কে আম্মু?”

জোহরা হেসে বলে,
—“ও সা’দ, তোমার রুবাই আপুর ভাই। আর সা’দ, ও আমার ছোট ছেলে রিমন!”

সা’দ হেসে বলে,
—“হেই রিমন ভাই হোয়াট’স আপ!”

—“আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”

সা’দ রিমনের ব্যবহারে বেশ মুগ্ধ হলো সাথে জোহরার প্রতি সম্মানটা বাড়লো। জোহরা মা হিসেবে ভালো শিক্ষা দিয়েছে রিমনকে। কিন্তু সা’দ যে জানে না এসবের পেছনে কে আছে। জোহরা সা’দকে বাথরুম দেখিয়ে চলে গেলো। জোহরা ঘর থেকে বেরিয়ে তপার ঘরে গিয়ে তপার দরজায় নক করলো। তপা দরজা খুলে জোহরাকে দেখে বিরক্তির সাথে বললো,

—“কী হলো দরজা ধাক্কাচ্ছো কেন?”

—“তোর চাচাতো ভাইকে দেখেছিস?”

—“না কেন?”

—“দেখতে চাইলে জলদি নিচে আয়, কী সোনায় সোহাগা ছোঁকড়া! দেখলে পড়ান জুড়ায় যায়!”

তপা চোখ বড় বড় করে বলে,
—“সত্যি নাকি?”

—“হ্যাঁ। জলদি আয়।”

বলেই জোহরা চলে গেলো। তপা তার চুপ সুন্দরভাবে বেঁধে ওড়না একপাশে নিয়ে নিচে চলে গেলো। ওরা শহরের মানুষ, নিশ্চয়ই ওড়নায় আবৃত হয়ে ক্ষেত সাঁজা মানুষ পছন্দ করে না। আর করবেই বা কেন? তাদের তো বড় বড় স্টেটাস!
সা’দ নিজের লাগেজ রুমের একপাশে রেখে সেটা থেকে টি-শার্ট আর টাউজার নিয়ে ওয়াশরুম চলে গেলো। বাড়িটা কাঠের তৈরি হলেও ওয়াশরুমটার দেয়াল আর মেঝেটা টাইলসে আবৃত। এরকম কাঠের বাড়ি সা’দের বেশ পছন্দ হয়েছে। ফ্রেশ হয়ে হাত দিয়ে নিজের চুল পেছনের দিকে নিতে নিতে সা’দ ওয়াশরুম থেকে বের হলো। বের হয়ে দেখলো রিমন টেবিলে নেই। হয়তো নিচে গিয়েছে। সা’দ নিজের লাগেজের উপর তাওয়ালটা মেলে দিয়ে নিজের নিচে চলে গেলো। নিচে তো বিশাল আয়োজন। সকলেই আছে। সা’দ নিচে গিয়ে সকলের সাথে পরিচিত হলো। সা’দকে দেখে তপা তো হা হয়ে গেলো। এমন সুদর্শন সে নিজেও দেখেনি। একে হাতে নাগালে পেলে তো গ্রামের মেয়েদের বৃদ্ধাঙ্গুল দেখাবে। এ যে তার বড় সুযোগ! তবে সে সা’দকে একবার সে শুটিংয়েও দেখেছিলো। এতে তপার ইচ্ছা আরও বেড়ে গেলো সা’দকে নিজের করে নেয়ার! জোহরা মেয়ের ইচ্ছার কথা শুনে তো আরও খুশি। রাতারাতি বড়লোক হয়ে যাবে সে। আবারও তার রাজরানীর মতো থাকা হবে, এমনটাই ভাবছেন তিনি। সা’দ সকলকে পেলেও তার ছোট চাচাকে পেলো না। বড় জেঠু জানালো সে কিছু কাজে শহরে গিয়েছে। দাদীমা তো সা’দকে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে রুবাইকে বললো,

—“আমার নাতনি ঠিকই কইসে, মোর সা’দ তো পুরাই সেরা নায়ক! যা রুবাই বাজিতে হাইরা মোর সা’দের লগে লাইন মারা শুরু করলাম!”

দাদীমার কথায় ড্রইংরুমের সকলে অট্টহাসিতে ফেটে পরলো। সবাই কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে খেতে চলে গেলো। যেহেতু অনেক মানুষ সেহেতু নিচে পাটি বিছিয়ে খাবার খেতে বসলো সকলে। বড় চাচী, আসিয়া এবং জোহরা মিলে খাবার পরিবেশন করছে। সাথে তপাও যোগ দিয়েছে আজ। খাবারের মাঝে আবিদ বমে উঠলো,

—“ফুল খেয়েছে?”

—“না। ঘুমোচ্ছে ফুল। ডাকতে গিয়েও ডাকিনি ভাবলাম শরীর হয়তো খারাপ করছে।” বড় জেঠুর পাতে খাবার দিতে দিতে বললো বড় চাচী! এর মাঝে সা’দ এক লোকমা মুখে দিয়ে ভ্রু কুচকে বললো,

—“ফুল কে?”

কেউ কিছু বলার আগেই দাদীমা মুখ খুললো।
—“আমার নাতনি। আমার ছুডু পোলার প্রথম পক্ষের একমাত্র মাইয়া। ও(জোহরা) তো দ্বিতীয়পক্ষ। আর এই মাইয়াটারে(তপা) যে দেখতাসো ওয় জোহরার প্রথমপক্ষের মাইয়া!”

সকলের সামনে এভাবে বলায় জোহরা এবং তপা উভয়ই লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললো। দাদীমা মানুশজটাই এমন তার মুখের লাগাম নেই বললেই চলে। তপার তো রাগে মন চাচ্ছে দাদীমার মাথায় পাতিল দিয়ে জোরে মারতে। কিন্তু এতো মানুষ সাথে সা’দ উপস্থিত থাকায় না পারছে কিছু বলতে আর না পারছে সহ্য করতে। দাদীমা যেন এমন সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলো। সা’দ আর তানজীল এতক্ষণে বুঝলো বিষয়টা। বড় জেঠু চাচীকে উদ্দেশ্য করে বললো,

—“এ কী বলছো! মেয়েটা এমনিতেই অসুস্থ, না খেলে ওষুধ খাবে কী করে? যাও গিয়ে উঠাও ওকে আর খাইয়ে দাও।”
চাচী মাথা নাড়িয়ে সেহেরের জন্য কিছু খাবার আর পানি নিয়ে সেহেরের রুমে চলে গেলো। তানজীল নিজের কৌতুহল দমাতে না পেরে বললো,

—“কী হয়েছে ওনার? এনি প্রব্লেম?”

—“আর বলো না বাবা, জঙ্গলে পায়ে শিকল পেঁচিয়ে পড়ে ছোট বড় চট পেয়েছে। এর বেশি কিছু না!”

এই কথা শুনে সা’দ বিষম খেলো। তার মনে পরে গেলো সেই শিঁকল বাঁধার ঘটনাটা। আচ্ছা সা’দ তো তার মায়াবীনির গ্রামেই আছে। সে কী আবারও তার মায়াবীনিকে দেখতে পারবে? কেমন আছে সে? সুস্থ হয়েছে সে? এমন নানান চিন্তা সা’দের মাঝে ঘুরঘুর করছে। সা’দ জানে তার গ্রামের বাড়ি তার মায়াবীনির গ্রামেই কিন্তু তার মায়াবীনির বাড়িটা সে চিনে না। এটাও জানে না যে এটা সাবেক চেয়ারম্যানের বাড়ি।
খাওয়া-দাওয়া সেরে যে যার ঘরে চলে গেলো। যেহেতু এবাড়িতে মোট ৫ টা ঘরে সেহেতু সিদ্ধান্ত হলো সা’দ থাকবে রিমনের ঘরে, রুবাই এবং তানজীল থাকবে রুবাইয়ের ঘরে, তপার রুমে সেহের আর রিমন, জোহরার ঘরে তপা এবং জোহরা এবং সেহেরের ঘরে আসিয়া এবং জুবায়ের। দাদীমা জেঠুদের বাসায় থাকবে। এবং তাদের বাড়ি বেশ দূরেও নয়। শুধু এদিক থেকে সেদিক। এক লাফেই এ বাড়ি সে বাড়ি আসা-যাওয়া করা যায়। দাদীমাকে চেয়েছিলো সেহেরের সাথে তপার রুমে শোয়ানোর জন্য কিন্তু দাদীমা সাফ বলে দিয়েছেন সে উপরে উঠবে না, তার পায়ের ব্যথা বেড়েছে, সিঁড়ি বেয়ে ওঠা-নামা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আর কী করার তার সে বাড়িতেই যেতে হয়েছে। সেহেরকে খাইয়ে দিতেই সেহের চাচীর কথামতো নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে উপরে চলে গেলো। রিমনও তাকে সাহায্য করলো।
আশেপাশে সে কাউকে দেখেনি, তাই সুঁড়সুঁড় করে উপরে চলে গেলো। যাওয়ার সময় আস্তে আস্তে রিমনকে জিজ্ঞেস করলো,

—“আচ্ছা আজ নাকি কার আসার কথা ছিলো, সে এসেছে ভাই?”

—“হ্যাঁ আপু এসেছে। উনি তো আমার ঘরে তাই আমি তোমার সাথে শুচ্ছি!”

—“ওহ!”
সেহের আর কিছু না বলে তপার ঘরে চলে গেলো। সব গুছিয়ে রেখে রিমনকে নিয়ে সেহের বিছানায় শুয়ে পরলো।

চলবে!!!

#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| অতিরিক্ত অংশ ||

খুটখুট শব্দে সা’দের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। পিটপিট করে তাকিয়ে মুখের সামনে থেকে কাঁথাটা অল্প সরিয়ে দেখার চেষ্টা করলো কে শব্দ করছে। কাঁথা সরিয়ে টেবিলের দিকে তাকাতেই দেখলো একটা মেয়ে টেবিলে কী যেন করছে। মেয়েটার পিঠের অংশ দেখা যাচ্ছে সামনে থেকে তাকে দেখা যাচ্ছে না। আচমকা একটা মেয়েকে দেখে সা’দ অপ্রস্তুত হয়ে উঠে বসলো। সেহের রিমনের ব্যাগ গুছাতে এসেছিলো, হঠাৎ ধুরুম আওয়াজ শুনে সেহের চোখ বড়ো বড়ো করে পিছে ফিরে তাকালো এবং দুজন দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেলো। সেহের এবং সা’দ একে অপরকে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলো। তাদের মাঝে বিস্ময়ের শেষ নেই! সা’দ ঘুম থেকে উঠে সেহেরকে তারই ঘরে দেখবে তা সে কখনো কল্পনাও করেনি। মনের ভুল ভেবে চোখ কচলে সামনে তাকালো। নাহ সেহের নেই তো। শুধু সেহের কেন কোনো মেয়েই নেই। সা’দ কি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখলো? কিছুক্ষণ চিন্তা করে দেখলো আসলেই তার মনে ভুল। বিছানা থেকে নেমে হাই তুলতে তুলতে তাওয়াল নিয়ে সে ওয়াশরুম চলে গেলো। ওয়াশরুম ঢুকার আগে সময়টা দেখলো সা’দ। সকাল ৭ টা ১৩ মিনিট। সেহের ব্যাগ নিয়ে একপ্রকার দৌড়ে কোনোরকমে তপার ঘরে চলে আসলো। রিমন তখন স্কুলের ইউনিফর্ম পরছিলো। সেহেরকে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকতে দেখে রিমন অবাক হলো৷ সেহের ভারী নিঃশ্বাস ফেলছে অনবরত। কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ছে। সেহেরের এ অবস্থার কারণ সে বুঝতে পারলো না। রিমন নিজের ব্যাগ সেহেরের হাত থেকে নিতে নিতে বললো,

—“কী হয়েছে বুবু? এমন করছো কেন?”

সেহেরের সেদিকে খেয়াল নেই। তার চোখে বারবার সা’দের চেহারাটা ভাসছে। সে কী আসলেই সা’দকে দেখেছে? সা’দ কেন এবাড়িতে থাকবে? সা’দ তো সেদিনই চলে গেছে। নানান প্রশ্ন সেহেরকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। রিমন আরেকবার ডাকতেই সেহেরের ধ্যান ভাঙলো। সেহের অস্ফুট সুরে বলে,

—“তোর ঘরে কে ঘুমাচ্ছিলো ভাই?”

—“সা’দ ভাই। কেন গো বুবু?”

—“উনি দেখতে কী বিদেশিদের মতো?” শিওর হওয়ার জন্য রিমনকে প্রশ্নটা করলো সেহের।

—“হ্যাঁ কেন?”

সেহের যেন আকাশ থেকে পরলো। সে কিছুতেই তার হিসাব মেলাতে পারছে না। শেষ অবধি কি না সা’দ তারই চাচাতো ভাই? সেহের আবার প্রশ্ন করলো,

—“নাম কী যেন তার?”

—“আহা বুবু বললাম না সা’দ।”

সেহের ঠিক কেমন অভিব্যক্তি দেখাবে বুঝতে পারছে না। কেন বারংবার নিয়তি তাদের এভাবে মিলিয়ে দিচ্ছে তা সেহেরের জানা নেই। সেহের একটা শ্বাস ফেলে বললো,

—“চল ভাই খেতে বসবি!”

রিমন মাথা নাড়িয়ে সেহেরের সাথে নিচে নামলো। নিচে গিয়ে দেখলো দাদীমা সোফায় বসে পান চিবুচ্চে আর চাচী রান্নাঘরে রুটি বেলছে। তারা ফজরের নামাজের পরপরই চলে এসেছে। আজ রিমনের স্কুল হয়ে কাল থেকে ছুটি। রিমনকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে সেহের রান্নাঘরে গেলো রিমনের জন্য নাস্তা নিতে। চাচী দুইটা রুটি আর ভাজি সেখানে আগেই রেখেছিলো রিমনের জন্য। সেহের সেটা নিয়ে আবার রিমনের কাছে চলে আসলো। সেহেরকে এভাবে ছুটতে দেখে দাদীমা মুখ ভেংচিয়ে বলে,

—“মায়ের ঘুমের ঠ্যালায় পোলার খবর নাই আর এই মাইয়া দিনরাইত এই পোলার লেইগা খাইট্টা মরে!”

সা’দ সেই মুহূর্তে ফোন ইউস করতে করতে নিচে নামছিলো তাই সে দাদীমার কথাগুলো শুনে ফেললো। এমন কথায় সা’দ ভ্রু কুচকে দাদীর দিকে তাকাতে তাকাতে নিচে নামলো। দাদীমা সা’দকে দেখে হাসিমুখে পান চিবুতে চিবুতেই বললো,

—“আরে নায়ক সাহেব এত্তো সকালে ঘুম ভাইঙ্গা গেছে নাকি?”

“নায়ক সাহেব” শুনে সেহের পিছে তাকালো চোখ বড়ো বড়ো করে। সা’দ পকেটে ফোন রেখে দাদীমার পাশে বসে মুচকি হেসে বলে,

—“আমার এইসময়ে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস আছে দাদী!”

বলেই সা’দ সামনে তাকালো। আবারও দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেলো৷ সেহের চোখ সরিয়ে রিমনকে খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। না এবার সা’দ ভুল দেখেনি। অবাক হয়ে সে সেহেরকে দেখছে। সেহের তাদের বাড়িতে আর রিমনকেই বা খাইয়ে দিচ্ছে কেন? তখন তাহলে তার রুমে সেহেরই ছিলো। সা’দ অস্ফুট সুরে দাদীমাকে বলে উঠলো,

—“ও কে দাদী?” সেহেরের দিকে ইশারা করলো।

—“আরে ও-ই তো আমার ফুল, আমার নাতনি! জানোস না ভাই আমার ফুলডা কতো কষ্ট সইয্য করসে।” বলেই নিজের আঁচল মুখে রাখলো। এদিকে সা’দ কিছুটা ঘাবড়ে গেলো এই ভেবে সেদিনের ঘটনা কী তারা জেনে গেছে? তার চেয়েও বড় কথা এই সেহেরই ফুল? সা’দের ছোট চাচার মেয়ে? সা’দ যেন বিষম খেলো৷ কিছুতেই হজন করতে পারছে না এসব! কী থেকে কী হয়ে গেলো! শেষ অবধি তার চাচাতো বোনের সাথেই সা’দের বিয়েটা হলো? এই মেয়েটাই তার মায়াবীনি! সা’দের ভাবতে ভাবতে অবস্থা খারাপ। ঘুম থেকে উঠে এতোগুলা শক একসাথে পাবে কে জানতো?

—“তাহলে একটু আগের কথাগুলো কাকে বলছিলে?”

—“আর কারে আমার ফুলরে! মাইয়াটা সারাজীবন এই সংসারের লেইজ্ঞা খাইট্টা গেলো আর ওই কালসাপ(জোহরা) মরার মতো ঘুমায় গেলো। মাইয়াটাও বলি হারি, আমার ফুলের ছোড হইয়াও কী অত্যাচারটাই না করসে। বাপটার কথা তো বাদই দিলাম, গজবটায় ফুলের মায়রে খাইসে আর এহন আমার ফুলরে!”

হলেই বিলাপ করতে লাগলেন উনি। সেহের চুপ থাকতে ইশারা করলো কিন্তু দাদীমা ভাঙ্গা রেডিওর মতো বলেই গেলো। সেহের অসহায় দৃষ্টিতে একবার সা’দ তো আরেকবার দাদীমার দিকে তাকিয়ে রিমনকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। রিমনকে উঠোন অবধি এগিয়ে দিয়ে ফিরবে সে। সা’দ মনোযোগ দিয়ে সবটা শুনলো আর নিজেই আহত হলো। এতোটা কষ্ট সহ্য করেছে মেয়েটা! সা’দের মুহূর্তেই রাগ লাগলো, যাদের গতকাল এতো শ্রদ্ধা দিয়েছে তারাই তার মায়াবীনি, তার বউয়ের উপর এমন জুলুম করেছে! শাস্তি দেয়ার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে সা’দের গাঁয়ে। দাদীমা না বললে তো জানতেই পারতো না। সা’দ এবার দাদীকে জিজ্ঞেস করলো,

—“সুফিয়া চাচীকে কীভাবে মেরেছে চাচা?”

দাদীমা বলতে যাবে তখনই বাড়ির সকলে ঘুম থেকে উঠে সোফার রুমে চলে আসে। সকলের সামনে দাদীমা বললো না আর সা’দও জিজ্ঞেস করলো না। তপা এসে তার পাশে বসতে নিতেই সা’দ উঠে আসিয়ার কাছে গিয়ে বললো সে আর তানজীল হাঁটতে বের হবে। বলেই তানজীলকে নিয়ে সে বেরিয়ে গেলো। হনহন করে বের হওয়ার জন্য সা’দ সেহেরের সাথে ধাক্কা খেলো। আর এই দৃশ্য উপস্থিত সকলের চোখেই পরেছে। তপা এবং জোহরা তো তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো। জোহরা হুংকার ছেড়ে বললো,

—“সেহের বাহিরে কই গিয়েছিলি? যা রুমে গিয়ে বিশ্রাম কর!”

জোহরা কন্ঠ শুনে সেহের সা’দের সামনে থেকে সরে মাথা নাড়িয়ে ভেতরে চলে গেলো। সা’দ পিছে ফিরে জোহরার দিকে একপলক তাকালো। জোহরার চোখ দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছে। সা’দ কী যেন ভেবে রুবাইকে ডাকলো। রুবাই সা’দের সামনে গেলে রুবাইকে সা’দ ফুসুরফুসুর করে কিছু একটা বুঝিয়ে দিতেই রুবাই “ওকে ডান” বলে মাথা নাড়ালো। সা’দ আরেকবার সেহেরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বাইরে চলে গেলো। সা’দ যেতেই জোহরা এবং তপা গেলো সেহেরের কাছে। সেহের তখন নিজের ঘরে কাঁথা ভাঁজ করে বিছানা ঝেড়ে নিচ্ছে। জোহরা পেছন থেকে কেশে উঠলেই সেহের কাজ ছেড়ে পিছে ফিরলো।

—“মা, আপু তুমি?”

—“ভালোই রঙলিলা করতাছিস তুই তাই না? বড়লোক ছেলে পাইলি ওমনি নিজের রূপ দেখানো শুরু করলি তাই না?” অনেকটা রেগে কথাগুলো বললো তপা। তপার কথাগুলোর আগামাথা কিছুই বুঝতে পারেনি সেহের। সেহের কিছুটা অবাক হয়ে বলে,

—“কী বলছো তুমি আপু আমি ঠিক বুঝলাম না!”

—“হাহ ন্যাকা! এমন ভাব ধরসে যে সে নিষ্পাপ। দেখ সেহের একদম ন্যাকামি করবি না, সা’দরে আমি আমার তপার জন্য ঠিক করে রাখসি! তুই যদি আবার ওদের মাঝে গন্ডগোল পাকাস তাহলে তোরে আমি মেরে তোর লাশ নদীতে ভাসায় দিবো! দুইদিন ভালো ব্যবহার করেছি বলে মাথায় চড়ে বসবি নাকি!”

—“মা তোমরা ভুল বুঝছো আমি তো ওনাকে….”

—“ওই চুপ! কিসের ওনা-ওনি? আরেকবার যদি তোরে আমার সা’দের আশেপাশে দেখি তাহলে আমাএ চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না! মনে রাখিস।”
বলেই ওরা বেরিয়ে গেলো। ওরা বের হওয়ার আগেই দরজার সামনে আড়ি পাতা মানুষটা সরে গেলো।

—“ছিঃ এরা এতো নিচে কী করে নামতে পারে? এরা কী ভুলে যায় উপরেও একজন আছে তাদের এসব কর্মের হিসাব চুকানোর জন্য! জাস্ট ঘেন্না ধরে গেলো এদের প্রতি!” বলেই নাক সিটকালো রুবাই।

চলবে!!!

বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।

দখিনা প্রেম পর্ব-১৪

0

#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ১৪ ||

বাড়িতে নতুন মুখ খেয়াল করেছে সেহের কিন্তু তাদের পরিচয় জিজ্ঞেস করার মতো কাউকে আশেপাশে পাচ্ছে না। দাদীমাকেও যে জিজ্ঞেস করবে তাও করছে না কারণ, দাদীমা তার পাশে বসে কুরআন তিলওয়াত করছে। কিছুক্ষণ আগেই ফাতেমা খালা তার ক্ষতগুলোতে আবার লতাপাতার ওষুধটা দিয়ে বেরিয়ে গেছে। যাওয়ার আগে বলেছে বিকালে আবার আসবে। এইসব ওষুধি লতাবাটার মশলাটা অনেক কাজের। এই ধরণের লতাপাতার মাঝে কোনো কৃত্রিমতা নেই। সেহেরের ঘুমে চোখ বুজে আসছে তখনই আসিয়া ঘরে প্রবেশ করলো সাথে রুবাই। সেহের তাদের চিনতে পারলো না তবুও বিনয়ের হাসি তার ঠোঁটে বিদ্যমান। ওদের দেখে দাদীমা কুরআন বন্ধ করে বিছানা থেকে নেমে কুরআন সঠিক স্থানে রেখে আবার ফিরে আসলো। আসিয়া হাসিমুখে সেহের ডানপাশে বসে থুতনিতে হাত দিয়ে বলে,

—“এখন কেমন আছো?”

—“জ্বী আলহামদুলিল্লাহ ভালো!” বলেই সেহের দাদীমার দিকে তাকালো। দাদীমা সেহেরের দৃষ্টি বুঝতে পেরে বলে,

—“এ তোর মেজো চাচী। আর ওয় আমার আরেক নাতনি রুবাই!”

সেহের এতক্ষণে তাদের চিনতে পারলো। কোনো মেহমান আসলেই সেহেরকে রুমে বন্ধ করে রাখতো, রুম থেকে বের হলেই কঠিন সাঁজা পেতে হতো। তাই কে আসতো কে যেতো তা সেহেরের ধারণার বাইরে ছিলো। একবার তপাকে ছেলেপক্ষ দেখতে এসেছিলো, সেহের তখন কলেজ থেকে ফিরেছে। ছেলে তো সেহেরকে দেখে মুখের উপর বলে দেয় সে তপাকে নয় এই মেয়ে মানে সেহেরকে বিয়ে করবে। এ নিয়ে জোহরার সে কী রাগ, এমন বিত্তশালী ছেলেকে জন্য নিজের মেয়ের জন্য পছন্দ করে রেখেছিলো সেখানে কিনা এই ছেলে অন্যের মেয়েকে পছন্দ করলো! সেদিন হাজার বুঝিয়েও ছেলেপক্ষ রাজি হয়নি তপাকে বিয়ে করার জন্য, এরপর আর কী বিয়ে ভেঙ্গে গেলো। জোহরা তো রেগে সেদিন গরম খুন্তির ছ্যাঁক দিয়েছিলো সেহেরের পিঠে। যার ফলে সেহের ১৫ দিন ব্যথায় বিছানা থেকে উঠতে পারেনি। অথচ সেহের জানতোও না তার অপরাধ কী ছিলো। তখন সেহেরের পরীক্ষা চলছিলো, সেই পরীক্ষা দিতে না পারায় সেহেরের আরও এক ক্লাস গ্যাপ গেছে। অতীতের ঘটনা চিন্তা করে সেহের একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। রুবাই সেহেরের পায়ে কাছে বসে বলে,

—“তোমাকে সেহের বলবো নাকি ফুল?”

—“আপনার যেটা ডাকতে ইচ্ছা করে আপু!”

—“আপনি’ কী হ্যাঁ? তুমি বলবে! আমি তো তোমারই বোন। আচ্ছা তাহলে সেহের ডাকি? সকলেই তো ফুল ডাকে!” মিষ্টি হেসে বললো রুবাই! আসিয়া রুবাইয়ের কথার মাঝে বলে উঠে,

—“আমি কিন্তু ফুল ডাকবো। আমার তো ওকে গন্ধরাজ ফুল বলতে ইচ্ছে করে!!”

আসিয়ার বাচ্চামো দেখে দাদীমা হাসলো। সুফিয়াও এমন চঞ্চল ছিলো। তার মেজো বউমাও যে সোনার টুকরা তা আজ বুঝতে পেরেছে। চারজন অনেক কথা বললো, আড্ডা দিলো। এর মাঝে বড় চাচী নাস্তাও দিয়ে গেছে। আবিদ গেছে ভার্সিটি। আবিদের ভার্সিটিটা শহরে পরেছে। যেতে আসতে প্রায় এক ঘন্টার মতো লাগে। দাদীমার থেকে একে একে সবটা শুনলো রুবাই এবং আসিয়া, যে এতটাদিন কতোটা অবহেলা আর অত্যাচার সহ্য করেছে সেহের। সেহের বলতে না দিলে দাদীমা ধমক দিয়ে বলে,

—“চুপ কর, বেশি কুয়ারা করবি না, ওরা আমার আপনমানুষ, ওগো না কইলে কারে কমু!”

বলেই আবার সব ঘটনা খুলে বলা শুরু করে। সব শুনে আসিয়া এবং রুবাই বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। কতোটা পাষাণ হৃদয়ের হলে এরা এত নিকৃষ্টভাবে একটা অসহায় মেয়েকে অত্যাচার করতে পারে। দুজনের মনেই বেশ মায়া জম্মালো সেহেরের জন্য। মেয়েটা কতো নিখুঁত অভিনয়ে নিজের কষ্টগুলোকে চেপে রাখতে পারে তা-ই অবাক করার বিষয়! রুবাইয়ের হঠাৎ কী মনে হতেই মাকে বললো,

—“মা ভাইয়ের খবর কী কাল থেকে নিয়েছো?”

—“এই রে! পরিস্থিতির চাপে সা’দের কথা তো ভুলেই গেছি।”

—“সা’দটা কেডা আবার বউমা?”

—“আমার ছোট ছেলে মা। ও কাজের চাপে আসতে পারেনি। নাম সা’দ বিন সাবরান।”

—“মাহশাল্লাহ কী সুন্দর নাম আমার নাতিডার! ওরে আইতে কইয়ো জলদি, নাতিডারে তো হেই ছুডোবেলায় দেখসিলাম!”

—“হ্যাঁ দাদী দেখবাই তো। তোমার নাতি কিন্তু নায়কের মতো হয়েছে, লাইন টাইন আবার মারিও না।” টিপ্পনী কেটে বললো রুবাই। আসিয়া রুবাইয়ের হাঁটুতে হালকা চড় মেরে বললো,

—“এসব কোন ধরণের কথা রুবাই!”

—“আহা! মারো ক্যা! নাতনি তো আমারে সাবধান কইরা দিলো। আইচ্ছা দেহুম নে আমার নাতি কেমন নায়ক!”

রুবাই আর দাদীমা অট্টহাসিতে ফেটে পরলো। এদিকে সেহেরের অজানা আতঙ্কে বুকটা ঢিপঢিপ করছে। বারংবার গতরাতের ঘটনাগুলো তার চোখের সামনে ভাসছে৷ সেহের চোখ বুজে কয়েকবার লম্বা শ্বাস ফেললো।

—“তা নাতজামাই কই নাতনি। হেয় কী আহে নাই?”

—“দাদী উনি তো ইতালিতে থাকে। কীভাবে আসবে!”

দাদীমা বাচ্চার কথা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও জিজ্ঞেস করলো না কারণ, তার ছেলে আগেই দাদীমাকে রুবাইয়ের অবস্থা ব্যাখ্যা করেছে। সে একজন মা, সে নিজেও বুঝে সন্তান হারানোর কষ্ট কী পরিমাণ হতে পারে তাই কিছুই না বলে স্বাভাবিক কথা বলছে। এদিকে আসিয়া সা’দকে ফোন করে সা’দের খবরাখবর নিলো।

সা’দের অপজিট চেয়ারে গালে হাত দিয়ে তানজীল আনমনে বসে আছে। কারীব আরেকটা চেয়ারে চুপচাপ বসে আছে। তিনজনের মাঝেই নিরবতা বিরাজমান! নিরবতা ভেঙ্গে তানজীল বললো,

—“এখনো কিন্তু বলিসনি কীভাবে এবং কার সাথে বিয়ে হলো!”

সা’দ মুখ থেকে হাত সরিয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে মলিন কন্ঠে বলে উঠলো,

—“দুর্ঘটনাবশত বিয়েটা হয়ে গিয়েছে ব্রো!”

—“ক্লিয়ার করে বল!”

সা”দ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে থাকা গ্লাসের পানিটা পুরোটা শেষ করে গতরাতের ঘটনা বলা শুরু করলো,

ফ্যাশব্যাক,

সা’দ কারীবকে ফোনে পেতে বললো,
—“কারীব জলদি জঙ্গলের ভেতর আসো, জঙ্গলের শেষ পথেই একটা মাটির কুঁড়েঘর আছে সেখানে চলে আসো!”

—“কিন্তু স্যার আপনি সেদিকে কী করছেন?”

—“আহ! কাম ফাস্ট, বাকিটা পরে বোঝাবো!”

বলেই সা’দ ফোন কেটে তার মায়াবীনির দিকে এগিয়ে গিয়ে তার পাশে বসে। সা’দ বুঝতে পারছে না সেহেরকে কোলে নেয়াটা ঠিক হবে কি না! হাজারো দ্বিধাবোধ তাকে ঘিরে ধরলো। শেষে নিজের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছে সেহেরকে কোলে নিলো আর কুঁড়েঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। সেখান থেকে বেরিয়ে কিছুদূর যেতেই প্রায় অনেক মানুষ তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরলো। প্রায় অনেকের হাতে আগুনের মশাল ছিলো। সেই মশালের আলোতে সকলে চোখ বড় বড় করে সা’দ আর সেহেরকে দেখছিলো। সা’দের সামনে থাকা সেই মহিলাটা তার পাশের লোকটাকে উত্তেজিত হয়ে বললো,

—“দেহেন, দেহেন! আমি কইসিলাম না এরা কোনো নষ্টামি করসে, এহন মোর কতা বিশ্বাস হইসে তো? মাইয়াটারে কী অবস্থা করসে দেহেন!”

লোকটির চেহারায় মুহূর্তেই রাগ স্পষ্ট হলো। সা’দ মহিলাটির কথায় ভ্রু কুচকে বলে,

—“আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে আমি এই মেয়েটিকে বাঁচা..।”

—“এই চুপ! চোরের মায়ের বড় গলা। আমাগো গেরামে নষ্টামি করবা আবার এহন হালি হালি মিছা কথা কও। মাইয়াটারে এসব তুমি না করলে কী পশুপাখি আইয়া কইরা দিয়া গেছে? মিছা বলার জায়গা পাও না! দেইখা তো ভালা ঘরের মানুষই মনে হয় কিন্তু ভিত্রে ভিত্রে ছিঃ ছিঃ ছিঃ!” মহিলার পাশে থাকা লোকটি বললো। সা’দের তো মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই লোকেরা তাকে ধরে কোথায় নিয়ে গেলো। সকলে সা’দকে জোর করলে সা’দ সেহেরকে কোল থেকে নামিয়ে দিলো আর কোল থেকে নামাতেই কিছু মহিলা ধরে সেহেরকে কোথাও নিয়ে গেলো। এদিকে বিচার বসলো। সকলে সা’দকে যা পারছে বলেই চলেছে আর সা’দ প্রতিবাদ করতে গেলেই তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিচ্ছে। এদিকে এতো এতো অপমানে সা’দের চোখদুটো টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। কেউ কখনো তাকে কিছু বলার সাহস পায়নি সেখানে সামান্য ভুল বুঝাবুঝিতে তার চরিত্র নিয়ে এতো খারাপভাবে অপমান হতে হবে তা কখনো কল্পনাও করেনি।
সা’দকে বারবার জিজ্ঞেস করা হচ্ছে সে কেন এইসব নষ্টামি কেন করেছে কিন্তু সা’দ বারবার একই উত্তর দিয়েছে যে, সে কিছুই করেনি। একসময় এক মুরব্বি রেগে বলে,

—“এই তুর অভিভাবক ডাক! তারপর তোর ব্যবস্থা করতাসি!”

সা’দ তৎক্ষনাৎ তার মামাকে ফোন করে সব ঘটনা খুলে বললো। মামা তৎক্ষনাৎ রওনা হলো গ্রামের উদ্দেশ্যে। সা’দের মামা নরসিংদী শহরেই থাকে তাই ৪০ মিনিটের মতো লাগবে তার আসতে। ১০ মিনিট পেরিয়ে গেলেও যখন সা’দের অভিভাবক আসলো না তখন তারা আরও ক্ষেপে গেলো। তখনই এক মহিলা এসে খবর দিলো যে মেয়েটার মানে সেহেরের জ্ঞান ফিরেছে। সকলে সা’দকে ধরে নিয়েই সেহেরের কাছে গেলো। এক লোক বললো, “এবার তোর মিছা কথায় কোনো কাম হইবো না, যা বলার ওই মাইয়াই বলবে!”

সা’দ চুপচাপ শুনলো, উত্তরে কিছু বললো না। তার কিছু বলার ইচ্ছাও নেই আপাতত। সেহের এবং সা’দ সামনাসামনি বসে আছে। সেহেরকে নানান প্রশ্ন করলে সেহের অনেক কষ্টে বলে,

—“উনি আমার কো..কোনো ক্ষতি ক…করেননি!”

লোকটি কিছু বলার আগেই আরেক মহিলা বলে উঠলো,

—“দেহেন মাইয়াটা ভয় পাইয়া আছে। এই পোলায় কেমনে তাকায় আছে মাইয়াটার দিকে আর মাইয়াটা প্রাণের ভয়ে কিছু কইতাসে না। দেহো মা তুমি ভয় পাইয়ো না কও এই পোলায় তোমার কী ক্ষতি করসে?”

সেহেরের শরীরের যন্ত্রণায় কথাই বলতে পারছে না৷ তাই সে থেমে থেমে আবারও উত্তর দিলো সা’দ নির্দোষ। কিন্তু গ্রামের মানুষ বুঝলো না, সকলের ধারণা সেহের সা’দের ভয়ে মিথ্যা ভলছে তাইতো সেহের বারবার তোতলাচ্ছে। কেউ একবারের জন্যেও চিন্তা করছে না সেহের অসুস্থ সে কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। কেউ না বুঝলেও একজন বুঝলো সে আর কেউ না সা’দ। সা’দ সকলকে থামানোর চেষ্টা করে বললো,

—“এতো প্রশ্ন করা বন্ধ করুন, দেখছেন না সে অসুস্থ তাও কেন বারবার কথা বলার জন্য জোর করাছেন??? সবকিছুর একটা লিমিট আছে!”

—“এই পুলা তুমি চুপ থাকো, নিজের দোষ ঢাকার জন্য উইঠা পইরা লাগসো তাইনা? তবে তুমিও জাইনা রাখো এতো সহজে তুমারে আমরা ছাইড়া দিমু না।”

তখনই আরেকজন মহিলা নাক সিটকে বলে উঠলো,

—“আমার তো মনে হয় এরা শহরের পুলাপাইনগো মতো অবৈধভাবে মিলামেশা করসিলো!”

—“আমিও একমত, পুলা-মাইয়া দুইডায় সমান অপরাধী! ধইরা ওগো বিয়া দাও, নষ্টামি এক্কেবারে ছুইট্টা যাইবো!”

—“মানে কী পাগল আপনারা? বলছি না আমার মামা আসছেন সে আসলে সব তো হবেই নাকি!”

—“তুমার ওই মামা ফুমা দিয়া আমাগো কাজ নাই, তুমাগো আমরা বিয়া দিমুই ব্যাস! তখন নষ্টামীর ফল হারে হারে টের পাইবা বুজ্জো!”

বলে মুরব্বি কিছু লোককে কাজি ডাকানোর ব্যবস্থা করলো। সা’দের মামা আসার আগেই জোর-জবরদস্তি করে বিয়ে পড়ানো হলো। বিয়ে পড়ানোর জন্য দুজন লোক ইয়া মোটা গাছের ডাল আর গরম পেরেক হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সা’দ যদি কবুল না বলে তাহলে এগুলা দিয়ে তাকে মেরেই ফেলবে বলে হুমকি দেয়া হলো৷ আর সেহের যদি বিয়েতে রাজি না হয় তাহলে তাকে নগ্ন করে পুরুষদের মাঝে ছেড়ে দেয়ার হুমকি দেয়। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে দুজনের একজনও কখনো পড়েনি। আর একটা মেয়ের কাছে তার সম্মানটা বেশি জরুরি। তাই দুজনেই কঠিন পরিস্থিতির ফাঁদে পড়ে অবশেষে “কবুল” বললো। কবুল বলার পরপর সেহের হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো। এদিকে সা’দ কঠিন ক্রোধে ফেটে পরছে। এক লোক তো খুশিতে বলে উঠলো,

—“আলহামদুলিল্লাহ, আমরা আমাগো গেরামরে পাপমুক্ত করলাম।”

বিয়ের প্রায় ৫-৭ মিনিট পরে সেখানে গ্রামের মহিলা চিকিৎসক ফাতেমা খালাকে ডাকেন সেহেরের চিকিৎসার জন্য। ফাতেমা এসে সেহেরকে দেখেই চিনে ফেলে এবং সকলকে বলে সে সেহেরকে চিনে। এবং সেহেরের পুরো পরিচয়টাও সকলের কাছে বললো। কিন্তু সা’দের সেদিকে হেলদোল নেই, সে একমনে চিন্তা করেই চলেছে তার সাথে ঠিক কি কি হলো! সা’দ ভাবতেও পারেনি তার জীবনটা এভাবে মোড় নিবে। কিছুক্ষণ বাদে সা’দের মামা আসে সাথে কারীবও ছিলো। সা’দের মামা যখন নিজের পরিচয় দিলো তখন গ্রামের সকলেই চুপ ছিলো। সা’দ সেই সুযোগে সকলকে সবটা খুলে বলে এবং সেহেরের সাথে কী কী ঘটেছে সেটাও খুলে বলে। সবটা শুনে গ্রামের মানুষ বাকরুদ্ধ! তার চেয়েও বেশি অবাক হয় সা’দের পরিচয় জেনে। এতো বড় আর্টিস্টের সাথে এমন নিকৃষ্ট আচরণন করেছে ভাবতেই তারা ভয়ে কাচুমাচু হয়ে আছে। সাথে এও ভয় পাচ্ছে যদি তাদের পুলিশে ধরিয়ে দেয়। কিন্তু তাও তারা সে ভয় প্রকাশ না করে বলে,

—“এহন কিছুই করার নাই! বিয়া যেহেতু হইসে সেহেতু আমাগো হাতে আর কিছু নাই! এহন তুমার বউ নিয়া বিদায় হও, আর যাতে এমুখো না দেহি!”

—“সে তো যাবোই! আপনাদের মতো নিকৃষ্ট মানুষদের গ্রামে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। ”

বলেই ফাতেমা খালার সাহায্যে সেহেরকে নিয়ে সেই বিচার বসার জায়গাটি থেকে চলে আসে। ফাতেমা খালার বাসায় সেহেরকে রেখে সা’দ বলে,

—“আমি ঢাকায় রওনা হচ্ছি, আপনি দয়া করে এসব ঘটনা ওদের গ্রামে বলবেন না এমনকি তার পরিবারকেও না। আমি চাই বিয়ের ঘটনাটা সকলের কাছে গোপন থাকুক। আপনি সেহেরকে সুস্থ করে তার বাড়িতে পৌঁছে দিবেন। আর এই হলো আমার কার্ড যখন যা টাকা লাগে আমাকে ফোন করে জানাবেন আমি আপনাকে টাকা পাঠিয়ে দিবো। আর এখন সেহেরের চিকিৎসার জন্য টাকা দিয়ে যাচ্ছি আপনি রাখুন!”

ফাতেমা খালা মুগ্ধ হয়ে যায় সা’দের কথায়। এতক্ষণ এতো অপমানের পরেও সে তার সেহের মায়ের খেয়াল রাখছে ভাবতেই তার আনন্দ অনুভব হচ্ছে। ফাতেমা খালা শুধু কার্ডটা নিয়ে মলিন হেসে বলে,

—“টাকা-পয়সা লাগবো না বাবা। সেহের মা আমার মাইয়ারই মতো। আর তুমি চিন্তা কইরো না, তুমাগো বিয়ার কথা কেউ জানবো না এই ফাতেমা তুমারে কথা দিলাম!”

ফাতেমা খালা টাকা নিতে আপত্তি করলেও সা’দ জোর করে তার হাতে দুই হাজার টাকা গুজে দিয়ে চলে গেলো। যাওয়ার আগে সা’দ একবার সেহেরের দিকে তাকালো। সেহেরও তাকিয়ে ছিলো যার ফলে দুজনের চোখাচোখি হয়ে যায়। সেহের সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি নত করে ফেলে। “সেহের” নামটা কাজী সাহেবের মুখে শুনেছিলো সা’দ।
সারারাত সেহের ফাতেমা খালার সেবা পেলো। সেহের এখন অবধি জানে না ফাতেমা খালাকে যে সা’দ টাকা দিয়ে গেছে।

সব শুনে তানজীল বাকরুদ্ধ! তানজীল অবাক হয়ে বলে,

—“তাহলে কী এখন ডিভোর্সের চিন্তাভাবনা
করছিস?”

—“আরে না! আমার সময় চাই।”

তানজীল সেই মুহূর্তে গ্লাস থেকে পানি খাচ্ছিলো। সা’দের জবাব শুনে তার মুখের পানি গলায় আটকে সব ফ্রুত করে বেরিয়ে গেলো। কারীবও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সা’দের দিকে। সা’দ তাদের এরূপ দৃষ্টি লক্ষ্য করে বললো,

—“কী সমস্যা?”

—“মানে সিরিয়াসলি? যেই সা’দকে কোনোদিন কোনো মেয়ের পাশে দেখা গেলো না সে কিনা অচেনা একটা মেয়েকে বিয়ে করে এখন ডিভোর্সের জন্য না করছে? মেয়েটা কী সুন্দরী নাকি সা’দ? প্রেমে-ট্রেমে পড়লি নাকি?” শেষের কথাটা টিপ্পনী কেটে বললো তানজীল। সা’দ মুচকি হেসে বললো,

—“গভীরভাবে পড়েছি!”

সা’দের কথায় দুজন আরেকদফা বিষম খেলো। দুইজনের রিয়েকশন দেখে সা’দ হুঁ হাঁ করে হেসে দেয়। হাসি থামিয়ে সে নিজেই আবার বলা শুরু করলো,

—“প্রেমের ছন্দ লিখেও প্রেম-ভালোবাসাকে বরাবরই অবিশ্বাস করতাম। বিশ্বাস করতাম এইসব প্রেম-ভালোবাসা শুধু গল্প-উপন্যাস এবং সিনেমাতেই হয়, বাস্তব জীবনে এর আয়োজন খুবই ঠুনকো। প্রেম মানেই ধন-দৌলত, এক আকাশ কষ্ট এবং ধোঁকাবাজি যেগুলোর এক অংশকেও আমি সহ্য করি না। কিন্তু কে জানতো, আমিও কোনো একসময় এই প্রেম নামক জালে ভয়ংকরভাবে জড়িয়ে যাবো? আজ মন চাচ্ছে প্রেমিকপুরুষদের তালিকায় প্রথম নামটা যেন আমার থাকে। আজ খুব করে চাইছি, খুব!! গভীরভাবে প্রেমে পড়েছি ঠিক দখিনা হাওয়ার মতো। দখিনা হাওয়া যেমন মনকে প্রফুল্ল করে দেয় ঠিক তেমনই আমার “দখিনা প্রেম।”

—“হইসে ভাই থাম! আমাদের তোর এই বিষয় আর হজম হচ্ছে না!”

—“ঠিক! আমারও বিয়ের ব্যাপারটা একই রকমভাবে হজম হচ্ছে না। তাই আমার সময় চাই। সময়ের সাথে সাথে আমার সবটা হজম হয়ে যাবে আশা করছি।”

—“তো এখন আমি কী করবো? কোথায় যাবো? তোর বোনকে কল করলে তো বাংলাদেশি নম্বর দিয়ে কল দিতে হবে। যদি সে জানে আমি বাংলাদেশে থেকেও তার সাথে দেখা করিনি, বউ আমার সাথে কেলেঙ্কারি বাধিয়ে ফেলবে!”

—“তো যাও গ্রামে। সেখানে তোমার বউয়ের সাথে ইদ করিও এড্রেস আমার কাছে আছে, রুবাই আপু মেসেজ করে দিয়েছিলো!”

—“না চান্দু তোকে ছাড়া আমার যাওয়া চলবে না। তুই না গেলে আমিও যাচ্ছি না।” তানজীলের কথার মাঝে কারীব বলে উঠলো,

—“তাহলে স্যার, আমি ছুটিতে পরিবারের সঙ্গে ইদ কাটাই?”

—“ঠিক আছে। তোমার আজ থেকে ছুটি। সাব্বিরকে জানিয়ে দিবা আজকে শুটিং প্লেস দেখে কাল থেকে ওরও ছুটি। আমি নাহয় এখন আমার দুলাভাইয়ের ইচ্ছা পূরণ করি!”

—“আচ্ছা স্যার জানিয়ে দিবো। আসি!”

বলেই কারীব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেলো। সা’দ ফোন বের করে এড্রেস দেখতেই থম মেরে গেলো।

চলবে!!!

বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।

দখিনা প্রেম পর্ব-১৩

0

#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ১৩ ||

গত সন্ধ্যা থেকে সেহের নিখোঁজ। সকাল হয়ে গেলো এখন অবধি সেহের বাড়ি ফিরেনি। দাদীমা তো “ফুল” “ফুল” বলে মরণকান্না জুড়ে দিয়েছে। তাকে কেউ থামাতে পারছে না। আবিদ তার বন্ধুদের নিয়ে পুরো গ্রাম খুঁজেও সেহেরকে পায়নি। ওদিকে কবির জোহরার সাথে কথা কাটাকাটি চরম হয়েছে৷

—“কই থাকোস তুই হারাদিন? এই কয়টাদিনের লেইগা মাইয়াটারে আটকায় রাখতে পারলি না? তোর লেইগা আমার এক লাখ টেকা গাঙ্গে গেলো মা**!! ভাইরা বাড়িত থেইকা যাক তারপর দেহিস তোরে কী করি!”

—“বিশ্বাস করেন আমার ধারেকাছেই ছিলো সেহের। হঠাৎ কই চলে গেলো কি জানি। দয়া করে বিশ্বাস করেন আমি সত্যি কইতাসি!”

—“এই চুপ মা**!! আর একটা মিথ্যাও কবি না। ধারেকাছে থাকলে কী উইড়া উইড়া হারায় গেলো! আর একটা শব্দ করবি তো তোরে আমি মাইরা পাতালে পুঁইত্তা রাখমু।”

জুবায়ের আর তার পুরো পরিবার গ্রামে পৌঁছিয়েছে প্রায় ৭টা নাগাগ! এখানে এসে এসব কান্ড দেখে তাদের হুঁশই উড়ে গেছিলো৷ হ্যাঁ জুবায়ের জেঠু এবং কবিরের মেজো ভাই! অফিসের কাজের কারণে প্রায় অনেক বছরই আসেনি, তবে মাঝেমধ্যে মায়ের সাথে দেখা করে যেতেন জুবায়ের। তবে সা’দ বা রুবাই কোনোদিন গ্রামে আসেনি। জুবায়ের কে দেখে দাদীমা তাকে ধরেই অনেকক্ষণ কাঁদলো। আসিয়া(সা’দের মা) চাচীকে জিজ্ঞেস করেছিলো,

—“কে নিখোঁজ ভাবী?”

—“সুফিয়ার মেয়ে।”

—“সুফিয়ার মেয়ে মানে? সুফিয়ার মেয়েও ছিলো?” অনেকটা অবাক হয়ে বললো আসিয়া!

—“হ্যাঁ আছে।”

—“আমাদের কেন জানানো হয়নি?”

—“কবির ভাই চাইতো না ফুলের কথা কেউ জানুক!”

আসিয়া বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। কবির কেমন বাবা যে কিনা নিজের মেয়েকে আড়ালে রেখেছে। আসিয়ার কেমন রহস্য লাগছিলো। কবির তো মেজো ভাইকে দেখে খুশিতে আত্মহারা, গতকাল রাত থেকে আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি রাখেনি সে। রুবাইয়ের কেন যেন বিরক্ত লাগছে এই পরিবেশ। দাদী তো কান্নার চটে রুবাইকে খেয়ালই করেনি। তবে রুবাই বুঝতে পেরেছে এখানকার অবস্থা। তাও সে মাকে বলে নিজের ঘরেই আছে, বের হয় না। কান্নাকাটি তাকে কেমন যেন অস্থির করে দেয়। আসিয়াও বলেছে যেন রুবাই বের না হয়, পরিস্থিতি ঠিক হলে সে নিজেই ডেকে পাঠাবে। রুবাইও বেশি কিছু না বলে সেই যে খেয়ে দেয়ে ঘুম দিয়েছে এখনো উঠেনি। এদিকে জুবায়ের বা আসিয়ার চোখে ঘুম নেই। এই পরিস্থিতিতে কারই বা ঘুম আসবে? তারা কী ভেবে গ্রামে এসেছিলো আর এখন কী হচ্ছে৷ দাদীমা সেহেরের জামা-কাপড় জড়িয়ে কেঁদেউ চলেছে আর দাদীমার চারপাশে পুরো পরিবার দাঁড়িয়ে বা বসে আছে। জেঠু ভাঙ্গা গলায় জুবায়েরকে বললো,

—“তোর ছোট ছেলে আসেনি?”

—“না ভাই, আমাদের অনুপস্থিতিতে ও অফিস সামলাচ্ছে। তবে চিন্তা করিও না দু’দিন পর চলে আসবে!”

জেঠু আর কিছু বললো না, আনমনে সামনে তাকিয়ে রইলো। তার মনেও নানান দুশ্চিন্তা উঁকিঝুঁকি মারছে। আবিদ এখনো বাহিরেই আছে, বাসায় ফিরেনি। হঠাৎ কেউ বাইরে থেকে বলে উঠলো,

—“আরে আমাদের ফুল মামুনি আইসে সক্কলে দেইখা যাও!”

সেহেরের কথা শুনে দাদীমার কান্না থেমে গেলো। সে চাচীর সাহায্যে একপ্রকার ছুটে রুম থেকে বেরিয়ে সদর দরজার দিকে গেলো আর তার পিছে বাকিরা! সদর দরজার সামনে গিয়ে দেখলো ফাতেমা খালা সেহেরকে ধরে আছে। সেহেরকে বেশ দুর্বল দেখাচ্ছে, সাথে মুখটাও শুকিয়ে গেছে। আসিয়া তো মুগ্ধ হয়ে গেলো সেহেরকে। সেহের তার মায়ের চেয়েও সুন্দরী হয়েছে তবে চেহারাটা সুফিয়ার সাথে মিলেনি। সেহেরকে দেখে দাদীমা ছুটে গিয়ে সেহেরকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। কবির আর জোহরা দূরে দাঁড়িয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। হঠাৎ কী মনে হতেই কবির নিজের কপালে নিজেই চাপড় মারলো! জোহরা তা লক্ষ্য করে অবাক হয়ে বললো,

—“কী হলো আপনে কপালে চড় মারলেন কেন?”

—“আরে বলদি আমি তো এসব ঝামেলার মদ্দৈ ভুইলাই গেসিলাম জুব ভাই আর ভাবীরা এই মাইয়া সম্পর্কে জানতো না। এহন তো ভাই, ভাবী আমারে উল্টা পাল্টা ভাববো। যদি ঢাকায় লইয়া যায় তহন কী হইবো?”

—“আরে চিন্তা কইরেন না, উনি তো এহনো কিছুই কয় নাই। আর ঢাকায় কেমতে নিয়া যাইবো তার আগেই তো আপনে সেহেররে….”

—“ও হ ভুইলাই গেছিলাম। আইচ্ছা বাকিটা পরে দেখতাসি!”

সেহের আসার কিছুক্ষণ পর আবিদ খবর পেয়ে সেওও ফিরে এলো। আবিদ বোনকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে বসেছিলো। সকলে এক প্রশ্ন করেছিলো সেহের কোথায় নিখোঁজ হয়ে গেছিলো আর কীভাবেই বা তার এই অবস্থা হলো।? সেহের উত্তর দেয়ার আগেই তার পাশে থাকা গ্রামের চিকিৎসক ফাতেমা খালাই সকল জবাব দিয়েছেন।

—“ওর দাদীর জন্য আমার কাছে ওষুধ আনতে যাইয়াই জঙ্গলে পইরা গেছিলো তাই হাত-পায় এমন কাটাকাটি। কষ্ট টস্ট কইরা রাস্তায় আসতেই আমার এক লোক ওরে দেখে আর আমার কাছে নিয়া আসে। আমিই সারারাত ওর চিকিৎসা করি, কিন্তু তোমাগো খবর দেয়ার মতো কাউরে পাই নাই তাই খবরও দিতে পারি নাই। তবে চিন্তার কিছু নাই, দুইদিন বিশ্রাম করলেই ঠিক হইয়া যাইবো।”

এসব শুনে সকলেই ভালোভাবে শাসালো সেহেরকে যেন আর এভাবে বাসা থেকে বের না হয়। সেহেরকে পেয়ে সবাই খুশি। রিমন তো সেহেরের পাশেই বসে আছে। সেহেরের প্রতি সকলের আদিখ্যেতা দেখে তপা জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। কারো তাকে দেখার মতো সময় নেই। তপা ধপাধপ পা ফেলে মায়ের কাছে গিয়ে রাগান্বিত হয়ে মিনমিন করে বললো,

—“আর কতোক্ষণ এইসব তামাশা চলবে মা? আমার একদমই সহ্য হচ্ছে না!!”

—“তামাশা শেষ হতে আরও কিছুদিন বাকি তাই সবুড় কর। কথায় আছে না সঁবুড়ে নেওয়া ফলে। আর যদি সহ্য করতে না পারোস উপরে নিজের ঘরে যাইয়া বইয়া থাক! ভাল্লাগছে না তোর এসব ঘ্যানঘ্যানানি।”

তপা তাই করলো, কাউকে কিছু না বলে সে উপরে নিজের ঘরে চলে গেলো। সেহেরকে ধরে সেহেরের ঘরে নিয়ে আসলো ফাতেমা খালা। সেহের হাঁটতে হাঁটতে মিনমিন করে ফাতেমা খালাকে বললো,

—“আপনার মিথ্যা বলা উচিত হয়নি,খালা। সকলকে সত্যিটা জানানো উচিত ছিলো!”

ফাতেমা খালা চাপা স্বরে বলে,
—“কিছুই করার ছিলো না মা। সত্য জানলে আঙুল তুমার উপ্রে উঠবে যেখানে তুমার কোনো দোষই ছিলো না। আর আমরা গেরামের মানুষ, ওনারা ২-৪ লাইন বেশি বুঝবেই। তাই কিছু বলার সাহস হইলো না!”

সেহের আর কিছু বললো না। কান্নার কারণে তার গলা ধরে আসছে। অনেক কষ্টে সে নিজের কান্না থামিয়ে রেখেছে। গতরাতের ঘটনা সেহেরকে অনেকটা অশান্ত করে চলেছে।

—“মামা ওই ছেলেকে ধরতে পেরেছেন?”

—“হ্যাঁ মামু পেরেছি। ওরে এবার নরসিংদী নয় ঢাকার জেলখানায় নিয়া আসছি। আমার আদেশ ছাড়া ওই রাফসান কিছুতেই ছাড়া পাবে না। বেশ কড়াভাবেই কেস দিয়েছি। শালার দুই নম্বরি করার জায়গা নাই!!”

—“ঠিক আছে মামা। খেয়াল রাখবেন যাতে ধোলাইটা বেশি খায়! ওর জন্য আমার অবস্থা হেল হয়েছে।”

—“চিন্তা করিস না ভাগ্নে আমি গিয়ে সামলিয়ে এসেছি তো নাকি?”

—“কোথায় সামলালে? ঝামেলা লেগেছেই তো আগে!”

—“কিছু করার নেই। কিছু মাস পর ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিস!”

সা’দ কল কেটে দিলো। কেন জানি সে ডিভোর্সের কথাটা মাথায় আনতে পারছে না। সা’দ এখন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাচ্ছে। কারীব একদম চুপ হয়ে ড্রাইভ করছে। তার ভেতরেও অশান্তি চলছে। চেয়েছিলো কী আর হয়ে গেলো কী! কারীব নিজের মনে মনে একশোবার নিজেকে বকছে তো বকছেই। এদিকে সা’দের মনে অন্যকিছু চলছে।

১০ মিনিট হলো জ্যামে আছে সা’দ। তখনই সা’দের ফোনে কল এলো। কলটা তানজীলের। সা’দ রিসিভ করে “হ্যালো” বলতেই তানজীল বললো,

—“আর কতক্ষণ সা’দ, আমি তো ওয়েট করছি!”

—“জ্যামে আছি আর ১০ মিনিট লাগবে।”

—“ওকে। এখন তো অন্তত বল কী জন্য জোর করে আমায় দেশে আনালি?”

সা’দ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
—“আমি বিয়ে করেছি ভাইয়া!”

চলবে!!!

বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।

দখিনা প্রেম পর্ব-১১+১২

0

#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ১১ + ১২ ||

—“তোর মায়ের ওয়াদা কী ভুলে গেছিস সেহের?”

সেহের ছলছল দৃষ্টিতে জোহরার দিকে তাকালো। জোহরা অত্যন্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে সেহেরের দিকেই তাকিয়ে আছে। সেহের মাথা ডানে বামে নাড়িয়ে না জানালো!

—“তাহলে কোন সাহসে ওই বাড়ি ছেড়ে এই বাড়িতে আছিস? তোর নিজের ভাগও তো ওই বাড়িতে আছে তাই না?”

—“কিন্তু মা আমার তো কোনোকিছুরই ভাগ চাই না শুধু বাবার…”

—“ওটা কখনোই সম্ভব না। তোর মায়ের ওয়াদা ছিলো তুই তোর বিয়ের আগ অবধি ওই বাড়িতে থাকবি যতো কিছু হোক। এখন কিছু না বলে বাইরে গিয়ে সবাইকে বলবি তুই ওইবাড়ি যাবি! যদি না বলিস তোর মা তোকে অভিশাপ দিবে!”

সেহেরের চোখ বেয়ে পানি ঝড়ে গেলো। আবারও সেই নরকে তাকে যেতে হবে শুধুমাত্র মায়ের ওয়াদা রাখতে। আল্লাহ তার আর কতো পরীক্ষা নিবে সে জানে না। কোনো উপায় না পেয়ে সেহের বাইরে আসলো। দাদীমা অত্যন্ত রেগে কবিরকে বকেই চলেছে আর কবির! সে চুপচাপ মাথা নিচু করে শুনে যাচ্ছে! সেহের দাদীমার এগিয়ে আসতেই দাদীমা বললো,

—“দেখ ফুল চিন্তা করিস না এই যমগুলা তোরে এইহান থেইকা লইয়া যাইতে পারবো না! তোর এই দাদী থাকতে আমি জীবনেও তোরে আর রিমনরে নিতে দিমু না!”

—“কাকে কী বলছেন মা? সে তো আগেই যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে!”

বলতে বলতেই জোহরা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সকলে নির্বাক হয়ে তাকালো সেহেরের দিকে। সেহের চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কবির এই সুযোগে বলে উঠলো,

—“মা আমারে ক্ষমা কইরা দেও আমি অনেক ভুল করসি, তুমার লগে খারাপ কতা কইসি তার জন্য মাফ কইরা দাও। তাও দয়া কইরা আমার পুলা আর মাইয়াটারে আমাগো থেইকা দূরে রাইখো না। এই পুলাডারে যে অনেক কষ্টের পর ফল হিসাবে পাইসি। জোহরাও পুলাডারে ছাড়া ঘুমাইতে পারে না খালি কান্দে!”

—“তো তোর পোলারেই নিয়া যা আমার ফুলরে ক্যান নিবি?”

—“ফুলের বাড়ি যে ওইডা। ওরে না নিলে কেমনে হইবো! অনেক অন্যায় করিছি তার ফল পাইসি এতদিন। তুমি দয়া কইরা আটকাইয়ো না। পোলা মাইয়া ছাড়া আমার ঘর পুরাই অন্ধকার!”

দাদীমা চেহারায় রাগীভাব রেখেই চুপ করে রইলেন। জোহরা সেহেরকে হালকা ধাক্কা দিতেই সেহের বলে উঠলো,

—“যাই না দাদী! বাবা তো ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়েছেই!”

আবিদ রেগে সামনে যেতে নিতেই জেঠু আবিদের হাত ধরে আটকালো! দাদীমা কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত গলায় বললো,

—“বেশ! তইলে ওগো লগে আমারেও লইয়া যাবি! আমি না গেলে ফুল এই বাসা থেইক্কা কুথাও যাইবে না!”

—“আইচ্ছা মা তাই হইবো! যা ফুল মা সব গুছায় নে!”

কবিরের কথায় সেহের মাথা নেড়ে ভেতরে চলে গেলো। জোহরা এবং কবিরের চোখচোখি হতেই কবির চোখ দিয়ে আশ্বাস দিলো। অবশেষে দাদীমাকে নিয়ে সেহের এই বাড়িতে প্রবেশ করলো! সেহের যেদিকেই তাকাচ্ছে সেদিকেই তার মাকে দেখছে। তার মা যেন হাসিমুখে তাকে স্বাগতম করছে। দাদীমা কিছু না বলে সেহেরের হাত ধরে সেহেরের ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা ধুম করে বন্ধ করে দিলো। জোহরা রিমনকে আদর দিয়ে বলে,

—“বাবা যা উপরে গিয়ে রেস্ট কর!”

রিমন মাথা নাড়িয়ে উপরে নিজের ঘরে চলে গেলো। রিমন চলে যেতেই জোহরা কপট রেগে দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগলো,

—“সেহেরকে এনেছো ভালো কথা ওই বুড়িটাকে কেন এনেছো? বুড়ি যদি কোনোভাবে আমাদের পরিকল্পনা বুঝে যায় তখন কী করবে?”

—“আরে শান্ত হও, আমি সব ভাইবা চিন্তাই রাখসি! বিয়ার দিন নাহয় বুড়িরে ঘুমের ওষুধ খাওয়ায় দিমু! তহন তো টেরও পাইবো না।”

—“তা ঠিক বলেছো। সব ঠিকমতো হবে তো?”

—“অবশ্যই!”

বলেই কবির শয়তানি হাসি দিলো। সামনে তার যে টাকা কামানোর বড় কাজ আসছে! এদিকে খাবারের সময় ছাড়া দাদীমা আর সেহের রুম থেকে বের হয় না। বলা যায় দাদীমা বের হতে দেয় না। সে কোনোভাবেই নাতনিকে কাজ করতে দিবেন না। এদিকে সেহের ঘর থেকে বের হয় না দেখে জোহরারও যেন রাগের শেষ নেই! পুরো সংসারের কাজ এখন তার ঘাড়ে। সব করতে করতে সে ভিষণ ক্লান্ত। দাদীমা ঘর থেকে বের হলে তপাকে দেখলেই শুরু হয় কথা-কাটাকাটি! দাদী তো পুরো সাবান পানি ছাড়া ধুঁয়ে সাফ করে দেয়! সে যেহেতু বৃদ্ধ মানুষ সেহেতু তার ঝগড়া সম্পর্কে বেশি অভিজ্ঞতা! দাদীর সামনে তপা যেন ছোট পুঁটিমাছ। রিমন তো হাতে মুড়ি নিয়ে ওদের ঝগড়া দেখতে বসে। জোহরা চেয়েও তার শাশুড়ীকে থামাতে পারে না। শেষে সেহেরের কাছে গেলে সেহের দাদীমাকে টেনেটুনে রুমে নিয়ে আসে। এই রোজকার ঝগড়া-ঝাঁটি, সংসারের জন্য খেটে মরতে মরতে জোহরার অবস্থা খারাপ। প্রতিদিন এসব বিষয়ে নালিশ শুনতে শুনতে কবির সাহেব অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। শেষে খুব জোরে চেঁচিয়ে বলে,

—“থামাও তোমার এই ভাঙ্গা রেডিও! এতোদিন কাম না কইরা কইরা নাক টাইন্না ঘুমাইসোছ তাই তুরর এই অবস্থা! কয়বার কমু ১ লক্ষ টাকার বন্ধন এইডা তাই মুখ বুইজ্জা সইয্য কর! আরেকবার তোর এই বালের কতা হুনাইতে আইবি তো ওই প্রথম মহিলার মতো তোরেও মাইরা গাঙ্গে নিয়া ফালায় আমু! যত্তোসব!”

বলেই বিছানার অপর পাশে কাত হয়ে শুয়ে পরলো কবির। আর জোহরা সেখানেই অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। এই কাজের জন্য তার প্রথম স্বামী তালাক দিলো এখন তো তালাক নয় রীতিমতো একেবারে মেরে ফেলার হুমকি খেলো স্বামীর কাছে, চাইলেও কিছু বলতে পারবে না। সারাদিন কামলার মতো খাটো আর স্বামীসেবা করো। স্বামীসেবার কথা ভাবার সময়ই কবির বলে উঠলো,

—“পা ডা টিপ্পা দে ব্যথা করে!”

জোহরা সেখানেই থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। জোহরার উত্তর না পেয়ে কবির বিকট হাক ছাড়তেই জোহরা ভয়ে ভয়ে গিয়ে পা টিপতে মনোযোগী হলো!

—“মা প্লিজ! ইদের আরও ৫ দিন বাকি এতো আগে কেন যাচ্ছো?”

—“পাঁচদিন তো কী হয়েছে? আগে থেকেই যাবো ব্যাস! জানিস না এই ইদের সিজনে রাস্তায় কী পরিমাণ জ্যাম হবে? না বাবা আমার পক্ষে ওই জ্যামে বসে থাকা সম্ভব না। আগে যাওয়াই ভালো!”

—“আগে গেলে অফিস কে সামলাবে মা?”

—“কেন ভাই তুই তো আছিসই। আমি নাহয় কিছুদিন চিল মুডে থাকি। আর কতো দৌড়াবো!” রুবাই অসহায় সুরে বললো। রুবাইয়ের সাথে তাল মিলিয়ে সা’দের বাবা জুবায়েরও বলে উঠলো,

—“হ্যাঁ সেই তো। আর তোর তো এখন শুটিংও নেই ফ্রি আছিস! তাহলে তোর সামলাতে আপত্তি কোথায়?”

—“এই তোমরা বারবার ওকে অফিস সামলানোর কথা বলছো কেন? সা’দ যাবে না আমাদের সাথে?”

—“তোমার ছেলে যাবে বলে কী তোমার মনে হয়? সে তো গতকালই বাবাকে বলে দিয়েছে ইদের আগেরদিন সে গ্রামে পৌঁছাবে!”

এবার সা’দের মা উত্তেজিত হয়ে গেলো। অস্থির হয়ে প্রশ্ন করলো,

—“কী বলছিস বাবা? এতোদিন একা থাকবি কী করে? খাবি কী? তোর যদি কোনো সমস্যা হয় তখন তোকে কে সামলাবে?”

—“আহা মা এতো উতলা হচ্ছো কেন? আমার এই চারদিন কিছু শুটিং প্লেসে যেতে হবে। আর আপু তো বললো সে চিল করতে চায়, তাই আমি নাহয় আপুর জায়গায় কিছুদিন দেখি। আমার অফিস আর এখানে সেখানে দৌড়াদৌড়ি করতে করতেই সময় চলে যাবে। আর খাবার হোটেল বা নিজে রান্না করে খাবো!”

—“ওরে আমার লক্ষি ভাইটা! এতোদিন অফিস জয়েন করবে না বলে কতো কী করলো আর এখন সে অফিস জয়েন করবে এমডি হয়ে!”

—“নাহ। জাস্ট এই চারদিনের জন্য। আমার আর কাজ কী, ফাইল আদান-প্রদান আর সেই সামান্য সিগনেচার এইটুকুই তো!”

—“আচ্ছা আচ্ছা বুঝলাম, সাবধানে থাকিস। আমি কারীবকে ফোন করে আসতে বলছি, বাসায় একা থাকা লাগবে না!”

—“আমি বাচ্চা না মা, যে একা বাড়িতে থাকতে পারবো না। আর কারীবকে আগেই ফোন করে দিয়েছি আসছে সে। এখন তোমরা রওনা হও নয়তো আবার জ্যামে পড়বা! সাবধানে দেও আল্লাহ হাফেজ।”

—“হু, তোকে আমি এড্রেস মেসেজ করে দিবো নে, সঠিক সময়ে চলে আসিস আর নিজেও সাবধানে থাকিস!” বলেই রুবাই জুবায়ের এবং মায়ের সাথে বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে।

কারীব কতক্ষণ ধরে তার স্যারকে দেখছে। এদিকে সা’দ একমনে তার ফোনের দিকেই তাকিয়ে আছে। আশেপাশে কি হচ্ছে না হচ্ছে সেসব বিষয়ে তার যেন কোনো হেলদোল নেই। কারীব যে কখন এসেছে সা’দ তাকেও খেয়াল করেনি। খেয়াল করবে কী করে সে যে তার ফোনের স্ক্রিনে থাকা তার মায়াবীনিকে দেখছে। সেদিন থেকে তার ফোন এবং ল্যাপটপ মায়াবীনিময়। সেটা অবশ্য কারীব জানে তাও জেনে না জানার ভান ধরে থাকে। এখনও সে জানে স্যার সেই মেয়েটাকেই দেখছে। কারীবের মাথায় হঠাৎ-আসা একটা বুদ্ধি আসলো। সে সা’দের ধ্যান ভাঙাতে হালকা কাশলো। সা’দের ধ্যান ভাঙতেই সে ফোন রেখে কারীবের দিকে তাকালো। কারীব নড়েচড়ে দাঁড়িয়ে বলে,

—“স্যার কোথাও ঘুরতে যাবেন?”

—“সে সময় নেই, আমাদের তো এখুনি শুটিং প্লেস খুঁজতে বের হতে হবে নাকি?”

—“আমাদের হয়ে আমি সাব্বিরকে পাঠিয়েছি। সাব্বির ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে আপনাকে এড্রেস আর প্লেসের ছবিগুলাও পাঠাবে। তাহলে আমাদের ঘুরতে সমস্যা কী? মাঝেমধ্যে হুটহাট ঘুরাঘুরি করাটা কিন্তু খারাপ না!”

—“তা ঠিক বলেছো! কিন্তু যাবে কোথায়?”

—“নরসিংদী।”

—“সেখানে কেন?” চোখ বড়ো বড়ো করে বললো সা’দ। সা’দের প্রশ্নে কারীব আমতা আমতা করে বললো,

—“জায়গাটা আমার বেশ লেগেছে স্যার, তাই গ্রামে ঘুরার জন্য ওই জায়গাটাই পারফেক্ট। আর সেদিন বিকালে তো আপনি একা ঘুরেছিলেন আমি কাজের কারণে তো আর ঘুরতে পারিনি!”

সা’দ কী ভেবে চুপ হয়ে গেলো। হঠাৎ কিছু একটা ভাবতেই তার মন আনন্দে নেচে উঠলো। সেই গ্রামে গেলে তো সে তার মায়াবীনিকেও দেখতে পারবে৷ সা’দের যেন খুশির শেষ নেই। তবে খুশিটাকে বহিঃপ্রকাশ না করে শান্ত সুরেই বললো,

—“ঠিক আছে তোমার যেহেতু দেখার ইচ্ছে তাহলে চলো।”

—“উহু স্যার ভুল বললেন। ইচ্ছেটা আমার নয় আপনার। এতদিন পর নিজের প্রেয়সীর সাথে যে সাক্ষাৎ করবেনবসেই লোভটা ধরে রাখতে পারেননি আপনি। তবে নো চিন্তা স্যার, আপনাদের মিল করানোর শপথ এই কারীব আগেই নিয়েছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা!” কথাগুলো মনে মনে ভেবে কারীব মুচকি হাসি দিলো। সা’দ যাওয়ার আগে নিজের ডিএসএলআর এবং জুম ক্যামেরাওগুলো নিতেও ভুললো না।

সেহের নিজের ঘরে গিয়ে দেখলো তার দাদীমা বিছানায় শুয়ে কাঁতরাচ্ছে! সেহের এক চিৎকার দিয়ে দৌড়ে দাদীর কাছে গেলো।

—“দাদীমা এই দাদীমা কী হয়েছে তোমার এমন করছো কেন? ও দাদীমা বলো না তোমার কী হয়েছে?”

দাদীমা চোখমুখ কুচকে অনেক কষ্ট করে বললো,

—“বাতের ব্যথায় মইরা যাইতাসি রে ফুল! তুই কী আমার লেইগা ফাতেমার ওই বাটা ওষুধ টা আইন্না দিতে পারবি? সারা বাড়ি খুঁজ্জি! এই ওষু কোনোহানেই পাইলাম না!”

—“এ তুমি কী বলছো দাদীমা! চাচীর বাসায় নেই?”

দাদীমা মাথা নাড়ায় যার অর্থ নেই। এদিকে সেহের পরলো আরেক ঝামেলায়। এখন প্রায় শেষ বিকাল, কিছুক্ষণ পরেই সূর্য ডুববে। ফাতেমা খালার বাড়িও পাশের গ্রাম! সেহের যাবে কখন আর আসবে কখন? আর না গেলেই বা দাদী সুস্থ হবে কী করে? সেহের আবার জিজ্ঞেস করলো,

—“দাদীমা আবিদ ভাইকে বলেছো?”

—“না! হেই তো বাড়িতই নাই, হেরে কেমতে কমু!”

এবার সেহের মহা ক্যারা কলে পরলো। বাড়িতে তপা বা রিমন নেই। জোহরা গেছে পাশের বাড়িতে। এবার সেহেরের যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় রইলো না। সেহের মাথায় ওড়না পেঁচাতে পেঁচাতে দাদীকে বললো,

—“দাদী একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো আমি যাচ্ছি কিছু একটা ব্যবস্থা করতে।”
ব্যথায় দাদীমা উত্তরে কিছুই বলতে পারলো না। সেহের বাসা থেকে বের হয়ে দূরে যেতেই কেউ বলে কাউকে ফোন করে বলে উঠলো,

—“ভাই ফুলটুশি মাত্র বাসা থেইকা বাইর হইলো!”

—“কী বলিস! তাহলে পিছু নে আর আমাকে জানা কই যাচ্ছে। আমি বাসা থেকে বের হচ্ছি!”

—“আইচ্ছা ভাই তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।”

অপরজন উত্তরে কিছু না বলে কল কেটে শয়তানি হাসি দিয়ে বললো,

—“আজ তোরে আমার হাত থেকে কে বাঁচাইবো সেহের?”
বলেই পৈশাচিক হাসিতে মেতে উঠলো এবং বাসা থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেলো।

চলবে!!!

#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ১২ ||

কারীব আর সা’দ জঙ্গলটায় ঘুরাফেরা করছে। সা’দ ডিএসএলআর ক্যামেরা দিয়ে বিভিন্ন পোজে বিভিন্ন জায়গার ছবি তুলছে। সা’দের ফটোগ্রাফি ভিষণ পছন্দ। যখন ভার্সিটি অধ্যায়নরত ছিলো তখন এক প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে তার ছবিটি ম্যাগাজিনে গিয়েছিলো। সেই থেকে মূলত এই মুভী-ড্রামাতে তার আগ্রহ শুরু হয়। আজও সা’দ যেন সেই বয়সে চলে গেছে। খুব আগ্রহ নিয়ে সে ছবি তুলছে অনবরত। কারীবের হঠাৎ দূরে খেয়াল যেতেই দেখলো সেহের জঙ্গলে ঢুকছে। এ দেখে কারীবের খুশির রেশ রইলো না। সে তখনই সা’দকে বলে উঠলো,

—“স্যার! আমার ওই দিকটা থেকে ঘুরে আসি আপনি আপনার ফটো ক্লিক কন্টিনিউ করুন।”

বলেই সা’দকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কারীব সেই স্থান থেকে কেটে পরলো। সা’দ ডাকতে গিয়েও ডাকলো না। আবারও সে ছবি তোলায় মনোযোগী হলো। হঠাৎ তার ক্যামেরায় চলে আসলো সেই অনাকাঙ্ক্ষিত মুখটি! সা’দ আবার স্থির হয়ে গেলো, আবারও সেই অদ্ভুত অনুভূতি তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরলো। বুকের ভেতরের ধুকধুক শব্দটা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। এভাবে এই জায়গায় তার মায়াবীনিকে দেখতে সা’দ তা ভাবতেই পারেনি। কতোদিন পর তার মায়াবীনিলে সশরীরে দেখলো আহ! ভাবলে প্রাণটা যেন জুড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার মায়াবীনি প্রাণোচ্ছল দেখাচ্ছে না, মনে হচ্ছে সে কোনো কিছু নিয়ে বড্ড চিন্তিত। সেই চিন্তার রেশ তার চেহারা দৃশ্যমান! সেহের সা’দের প্রায় কিছুটা দূরে, তাইতো সা’দ সেহেরকে ক্যামেরা জুম করে দেখছে। আর এটাও ফলো করছে সেহের ঠিক কোথায় যাচ্ছে। হঠাৎ সা’দ খেয়াল করলো তার মায়াবীনির কেউ পিছু নিচ্ছে। এটা দেখে সা’দ ক্যামেরা নামিয়ে দেখলো। হ্যাঁ আসলেই কেউ ফলো করছে৷ ব্যাপারটা কেন যেন সা’দের ঠিক লাগলো না। সা’দ তৎক্ষনাৎ ক্যামেরা কাঁধে ঝুলিয়ে সে নিজেও পিছু নিলো।

সেহেরের তখন থেকে মনে হচ্ছে কেউ তার পিছু নিচ্ছে কিন্থ যতবার সে পেছনে ফিরছে ততবারই কাউকে দেখতে পায় না। পরে মনের ভুল ভাবলেও এখন নিস্তেজ জঙ্গলে শুকনো পাতায় পা পরার মতো খসখস শব্দ সে ঠিকই পাচ্ছে। তার ঠিকই অনুভব হচ্ছে সে ছাড়াও কেউ তার পিছে আছে। সেহের পিছে না ফুরে আল্লাহ’কে ডাকতে ডাকতে জঙ্গল থেকে জলদি বের হওয়ার দোয়া করছে। মাগরিবের আযান দিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। আস্তে আস্তে আঁধার নেমে আসছে। হঠাৎ একজায়গায় এসে থেমে গেলো সেহের। ভয়ে তার গলা বারবার শুকিয়ে আসছে কিন্তু কিছুই বলতে পারছে না। সেহের যেন নড়তে ভুলে গেছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে। সেই মানুষটা আর কেউ নয় রাফসান! সেই পুরানো বিশ্রী হাসি দিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সেহের ভয়ে এক ঢোক গিলে পিছে ফিরে দৌড় লাগাতেই কারো বুকে গিয়ে ধাক্কা খেলো। সেহের সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটার সামনে থেকে সরে ছেলেটার দিকে তাকালো। অচেনা একটা ছেলে যাকে সেহের কখনো দেখেনি। তবে এই ছেলেটার দৃষ্টিতেও নোংরামি স্পষ্ট! সেহের ভয়ে ভয়ে একবার পিছে তো আরেকবার সামনে তাকাচ্ছে। রাফসান পৈশাচিক হাসি দিয়ে বললো,

—“কী সুন্দরী ভয় লাগছে? চিন্তা করো না সোনা আজকের রাতটায় এমনিতেই একটু আকটু কষ্ট লাগবে, পরে আর লাগবে না। খুব আনন্দ পাবে তুমি জানেমান!”

রাফসানের এসব বিশ্রী কথাবার্তায় সেহেরের গা গুলিয়ে আসছে। সেহের নাক সিটকিয়ে কাঁপা গলায় বলে,

—“তোদের আমি কোনোদিন ধরা দিবো না!”

বলেই উত্তর দিকে দিলো দৌড়! কিন্তু সে বেশিদূর যেতে পারলো না তার আগেই রাফসান তার কাঁধের জামার অংশে ধরে আটকায়। কাঁধের অংশ এতো জোরেই টান দেয় যে কাঁধ থেকে ডানপাশের অর্ধেক হাতা ছিঁড়ে রাফসানের হাতে চলে আসে। আর সেহের ছিটকে দূরে পরে যার ফলে এক ধারালো গাছের ডালের সাথে তার ডানহাতের শিনা কেটে যায়! সেহের ব্যথায় কিছুটা শব্দ করে উঠলো। রাফসান জামার ছেঁড়া অংশ ফেলে সেহেরের দিকে এগিয়ে গিয়ে সেহেরের ওড়নাসহ চুল টেনে উঠে দাঁড় করালো! চুলের ব্যথায় সেহের গোঙ্গানি করে নিজের চুল থেকে রাফসানের হাত ছাড়ানোর প্রচেষ্টা করছে। কিন্তু ডানহাতে গভীর চট পাওয়ায় সেহের প্রায় নেতিয়ে আছে তার উপর চুল টেনে ধরার অসহ্য যন্ত্রণা! রাফসান আরও জোরে টেনে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

—“যতো যা-ই করিস আজ তুই আমার হাত থেকে বেঁচে ফিরতে পারবি না! চল আমার সাথে!”

বলেই রাফসান টেনে হিঁচড়ে সেহেরকে নিয়ে যেতে লাগলো। আর সেহের বারবার রাফসানকে অনুরোধ করছে ছেড়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু সেহেরের আকুতি ভরা কথাগুলো রাফসানের কান অবধি পৌঁছাচ্ছে না। সে এক ভয়ংকর খেলায় মেতে উঠেছে। রাফসানের সাথের ছেলেটাকে ইশারা করতেই ছেলেটা চলে গেলো আর রাফসান সেহেরকে নিয়ে একটা মাটির বানানো পুরানো কুড়েঘরে ঢুকলো। সেখানে কিছু নেই বললেই চলে৷ রাফসান সেহেরকে জোরে ধাক্কা দিয়ে সেই কুঁড়েঘরে ফেললো। এতে একটা শুকনো কাঠ সেহেরের হাঁটুতে লাগলো যার ফলে সেই কাঠ ভেঙ্গে দুই খন্ড হয়ে গেলো। সেই কাঠের চাপেও সেহেরের হাঁটুর অনেকখানি ছিলে যায় এবং গড়িয়ে গড়িয়ে রক্তও পরা শুরু হলো। সেহের চিল্লিয়ে “আল্লাহ গোহ” বলে উঠলো। রাফসান পৈশাচিক হাসি দিয়ে বলে,

—“কী সুন্দরী কষ্ট হচ্ছে? চিন্তা করিও না সোনা, আমি আদর দিয়ে দিয়ে তোমার সব কষ্ট ভুলিয়ে দিবো।”

বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পরলো। সেহের রাফসানের কন্ঠে নিজের আহত দেহ নিয়ে অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ালো আর পিছে দিকে যেতে যেতে বললো,

—“আমার ধারেকাছে আসবি না। আসলে আমি নিজেকে শেষ করে দিবো, তাও তোর মতো অমানুষের কাছে নিজের সতিত্ব বিসর্জন দিবো না!”

রাফসান উচ্চসরে হেসে বললো,

—“বাহ বেশ বুলি ফুটেছে আজ তোর! এই অবস্থা এতো তেজ আসে কোথা থেকে তোর? তবে আমিও দেখে ছাড়বো তুই তোর সতিত্ব কতক্ষণ আগলিয়ে রাখিস!”

সারাশরীরের অসম্ভব যন্ত্রণা এবং রক্তক্ষরণের ফলে বারংবার সেহেরের চোখ বুজে আসছে আর সব আবছা লাগছে। কিন্তু সেহের হার মানবে না, এর চেয়েও কষ্ট সহ্য করেছে সে। এই কষ্ট তার কাছে খুবই স্বল্প। তবুও সেহের নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। দুর্বল হয়ে কিছুদূর পিছু যেতেই সে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসে পরলো। রাফসান হাসতে হাসতে নিজের গাঁয়ে থাকা শার্টটা খুলে সেহেরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো। সেহেরের এখন আর কোনো উপায় নেই একমাত্র আল্লাহকে ডাকা ছাড়া। সেহের বারংবার আল্লাহকে ডাকছে আর অনেককিছু নিয়্যত করে চলেছে। রাফসান আর দুই ধাপ এগোতেই কেউ তার পিঠে জোরে লাথি দিলো। এতে রাফসান অন্যদিকে ছিটকে পরলো। বিকট শব্দে সেহেরের নিভু নিভু চোখ অটোমেটিক বড় হয়ে গেলো। সে এখন রাফসানকে স্পষ্ট পরে কাতরাতে দেখছে। এবার সেহের সামনের মানুষটাকে আবছা আলোয় দেখে একদম স্তব্ধ হয়ে গেলো। এ যে সেই বিদেশি যে ওই এক চেয়ারেই বসে থাকতো। তাকে এই মুহূর্তে এরকম একটা জায়গায় কল্পনায়ও আশা করেনি। সা’দ রক্তচক্ষু নিয়ে রাফসানের দিকে তাকিয়ে আছে। অনেক কষ্টে সে এই কুঁড়েঘরে পৌঁছিয়েছে। তখন পিছু নিতে নিতে সে একটা শিকলের সাথে পেঁচিয়ে পরে গিয়েছিলো। যা ছুটাতে ছুটাতে তার অবস্থা খারাপ। নেটওয়ার্ক না পাওয়ায় সে কারীবকেও সাহায্যের জন্য ডাকতে পারেনি। তবে মেসেজ করেছে।

সা’দ রাফসানের কাছে গিয়ে রাফসানকে সর্বশক্তি দিয়ে ইচ্ছা মতো পিটালো। সা’দ কপট রেগে চেঁচাতে চেঁচাতে বললো,

—“তোদের মতো জানোয়ারের জন্য আমাদের পুরুষজাতিকে আজ অবধি বেশিরভাগ মেয়ে বিশ্বাস করতে পারে না! তোর সাহস কী করে হলো এভাবে মেয়েটার উপর অত্যাচার চালিয়ে তার সর্বনামশ করার চেষ্টা করা? মেয়েরা ভোগবিলাসের বস্তু নয়! অন্য মেয়ের দিকে এমন বিশ্রী নজর দেয়ার আগে পারলে নিজের মা-বোনের দিকে নজর দিয়ে দেখ কেমন লাগে! শালা কুলাঙ্কারের বাচ্চা! তোকে তো মন চাচ্ছে কুপিয়ে মেরে ফেলি! এতো লালসা থাকলে নিষিদ্ধ পল্লিতে গিয়ে নিজের ভোগ-লালসা পূরণ কর না, ওদের মতো নিষ্পাপ মেয়েদের কেন নজর দিয়ে তাদের পরিবারকে ধ্বংস করে দিচ্ছি! সবার সামনে ভালো মানুষ আর ভেতরে ভেতরে কুত্তার মতো লেজ নাড়লেই তুই ভালো হিয়ে যাবি না!”

সা’দের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সেহের। কী এক মুগ্ধতা যেন তাকে ঘিরে ধরেছে। কিন্তু সে বেশিক্ষণ তাকাতে পারলো না, তার আগেই সেহের জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এদিকে সা’দের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে রাফসান নিজের শার্ট নিয়ে সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে গেলো। সা’দ নিজের হাত ঝাড়তে ঝাড়তে রাগ দমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে৷ তখনই তার সেহেরের দিকে নজর গেলো। কী করুণ অবস্থা সেহেরের। সা’দ নিজের গাঁয়ের কোর্ট খুলে সেহেরের গাঁয়ে জড়িয়ে দিলো। অজানা আতঙ্কে তার বুক কাঁপছে, আরেকটু দেরী করে ফেললে কী সর্বনাশটাই না করে ফেলতো ওই জানোয়ারটা। ভাবতেই সা’দের গাঁয়ে কাটা দিয়ে উঠছে। সা’দ এখন ভাবতে লাগলো কী করবে! শেষে উপায় না পেয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে নেটওয়ার্ক আনার জন্য হাত উঁচু করে আশেপাশে ঘুরছে সে। কারীবকে এখন তার ভিষণ প্রয়োজন।

এদিকে এক মহিলা সেই কুঁড়েঘরের সামনে দিয়ে যেতে নিতেই দুজনকে এক ঘরে দেখে ফেলে, সাথে সেহেরের করুণ অবস্থাও সে ভালোভাবে দেখলো। মহিলা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো। তার চেহারায় আতঙ্ক দৃশ্যমান! মহিলা আর এক মুহূর্ত দেরী না করে দৌড়ে গ্রামে ছুটে গেলো।

চলবে!!!

দখিনা প্রেম পর্ব-১০

0

#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ১০ ||

সা’দ দূর থেকে সেই ১ তলা বাড়িটার ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সেখানে তার মায়াবীনি রেলিংয়ের সাথে হেলান দিয়ে ভূবন ভুলানো হাসি দিয়েই চলেছে অনবরত। সমস্ত সুখ যেন এই হাসিটায় বিদ্যমান! মায়াবীনির ভূবন ভুলানো হাসিতে সা’দের মনে হচ্ছে তার মতো সুখী এই পৃথিবীতে কেউ নেই। সা’দের মনে হচ্ছে মায়াবীনির হাসিটা ধারালো ছুঁড়ির মতো তার বুকে গিয়ে বিঁধছে। এই হাসিটা দেখার সুযোগ দ্বিতীয়বার পাবে তো? ভাবতেই সা’দ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এই দুরত্ব যে তাকে হিম শীতল হাওয়ার মতো জমিয়ে দিচ্ছে। কে জানতো এই এক সপ্তাহের সফরে এমন এক মায়াবতীর মায়ায় পড়ে যাবে? ৭টা দিন যেন চোখের পলকে কেটে গেলো তার। নির্ঘুম রাত পার করলো মায়াবীনির কল্পনায় আর সারাদিন পার করলো নিজের কাজের ব্যস্ততায়, তবুও এক মুহূর্তের জন্য সে মায়াবীনিকে ভুলতে পারছে না। মাঝেমধ্যে মায়াবীনি শুটিং দেখতে আসতো সেটা তার ক্যামেরার ফুটেজেই বুঝেছে কিন্তু কাজের চাপে তার অন্যদিকে তাকানোর সময় ছিলো না। সা’দ সেহেরকে দেখার জন্য প্রতিটা ফুটেজ কালেক্ট করেছে পেনড্রাইভে। হয়তো এগুলো স্মৃতি হয়ে থাকবে আজীবন! আজ দুপুরেই শুটিংয়ের কাজ শেষ হয়, আগামী পরশু নাটক রিলিজ দেয়া হবে তাই আজ রাতেই সকলে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হবে। অভিনয়শিল্পীরা শুটিং করার ঘন্টাখানেক পরেই নিজেদের পার্সোনাল কারে করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে দিয়েছে কিন্তু সা’দ এবং তার পুরো টিম রাতে রওনা হবে। আজ চলে যাবে দেখে শেষ বিকালে সা’দ গ্রাম ঘুরে দেখিতে বেরিয়েছে। কারীব কাজে ব্যস্ত ছিলো বিধায় কারীবকে ফেলেই সে গ্রাম ঘুরতে বেরিয়ে গেছে। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে অট্টহাসির শব্দ পেতেই সা’দ সামনে তাকালো এবং দেখলো তার থেকে কিছুটা দূরত্বে একটা ১তলা বাড়ি। সেই হাসির মালিককে দেখে সা’দ এতক্ষণ আনমনেই সবটা ভাবছিলো। হঠাৎ সা’দের মনে হলো, আচ্ছা এই মায়াবীনির নাম কী? তার নাম কী তার মায়ার মতোই বিষাক্ত? কিন্তু আমার কাছে যে এই “মায়াবিনী” নাম ছাড়া কোনো নামেই তাকে মানায় না। নাহ থাক, নাম জেনে কাজ নেই, সে শুধুই “মায়াবীনি”। আমার “মায়াবীনি”!
সা’দ নিজের ভাবনায় নিজেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। কী ভাবছে সে এসব? এই মেয়েটি তার মায়াবীনি কেন হতে যাবে? অদ্ভুত! সা’দ তো প্রেম-ভালোবাসায় বিশ্বাসী নয়, তাহলে সে এরকম কেন বললো? সে যে সা’দের কেউ-ই না। সা’দ আরেক পলক সেহেরকে দেখে সড়াইখানায় ফিরে গেলো, সূর্য অলরেডি অস্ত নেমেছে!

এদিকে সেহের মানজু আর আবিদের ঝগড়া দেখছে আর সমানতালে হেসেই চলেছে। দুটোর মধ্যে সাপে নেউলেরর মতো সম্পর্ক। ওদের ঝগড়াগুলো এমন,

—“এই আবুল একদম আমাকে মগজের বেলপাতা বলবেন না আমার সুন্দর একটা নাম আছে!”

—“তাহলে তুমিও আমাকে আবুল বলা বন্ধ করো! নিজের ঢক দেখসো যে আমার এতো সুন্দর নামটার সম্মান ফালুদা বানিয়ে দাও!”

—“আবুল বলেছি বেশ করেছি! আপনি তো পুরাই আবুল! সারাদিন বখাটেগিরি করে এখন আমার সাথে লাগতে আসছেন!”

—“তাহলে আমিও বেশ করেছি তোমায় মগজের বেলপাতা নাম দিয়ে! সারাদিন হাঁসের কতো প্যাক প্যাক ছাড়া আর কী পারো?”

দুজনের ঝগড়াঝাঁটি যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যাচ্ছে তখন সেহের গিয়ে ওদের থামিয়ে অনেক কষ্টে হাসি চেপে বললো,

—“হয়েছে আমার বাপ-মা গণ! এবার অন্তত চুপ যাও, তোমাদের ঝগড়ায় আমার অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে।”

সেহেরের কথায় মানজু আর আবিদ আরও কিছু বলতে নিবে এমন সময়ই দাদীমা এসে হাজির হলো এবং হুংকারের সুরে বললো,

—“এই তোগো আর কোনো কাইজ কাম নাই? এতো চিল্লাস কেমতে হুনি? নামাজ পইড়া বিছানায় যাইয়া একটা শুইসিলাম কিন্তু তোদের মাইকের মতো ভ্যাঁ ভ্যাঁ হুনতে হুনতে আমার কান দুইটা ঝালাপালা হইয়া গেলো! বলি তোগো কী মাথা নষ্ট?”

দাদীমার ধমকে দুজনই চুপ হয়ে গেলো। সেহের কথা ঘুরিয়ে বললো,

—“আচ্ছা আচ্ছা হয়েছে এখন চলো নিচে, গরম গরম আলুর পাকোড়া খাবো!”

—“চাচী বানিয়েছে নাকি?”

—“সে তো জানি না। তবে আমি ঠিক করেছি আমি নিজেই বানাবো! জানিস ওই বাড়িতে রিমনের জন্য রোজ পাকোড়া বানাতাম। প্রিয় ভাইটা খুব পছন্দ করে খেতে আর তপাও….!”

—“এই হারামী মাইয়া চুপ! ওই কালসাপটার নাম এই বাড়িতে ভুল কইরাও নিবি না! তোর পুন্দে কী লজ্জা-শরম নাই? ওই মা-বেটি মিলে তোরে এতো অইত্যাচার করলো তাও তুই এই কালসাপগুলার নাম নিতাসোস! খবরদার এই বাড়িতে ওদের নিয়ে কথা বলছিস তো! এখিন চল নিচে নামাজ পড়বি! মাগরিবের আযানের সময় হইয়া গেছে!”

বলেই দাদীমা হনহন করে চলে গেলো। সেহের দাদীমার যাওয়ার দিক থেকে চোখ সরিয়ে মানজুর চোখের দিকে তাকাতেই দেখলো মানজু অসম্ভব রেগে আছে! সেহের একটা শুকনো ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললো,

—“চল নিচে এই সময় ছাদে থাকা ঠিক হবে না!”

—“তুই এমন কেন রে ফুল? ওই তপা মেয়েটা তো ওর বাপটার মতোই শয়তান হইসে তা কী তুই বুঝিস না? তুই বুঝিস না ওরা তোর মাকে মেরে ফেলেছে? তোর বাবাকে প্রভূলন দিয়ে এমন অমানুষ করেছে? ওই জোহরা ঠিক কেমন মহিলা তা তুই এখন অবধি বুঝতে পারলি না! এই মহিলা পারে না এমন কিছু নাই! হয়তো তার প্রথম স্বামী আর তার পরিবার সবটা জানতে পেরেছিলো তাইতো ওরে লাথি-উষ্টা মেরে ভাগিয়ে দিসে! এতো সহজ হস না রে বোন! এই পৃথিবীতে কাউকে সহজ হতে নেই, দুনিয়ার মানুষ যে তাকে কখনোই ভালো থাকতে দেয় না রে!”

আবিদের কথায় সেহের কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। কিছুক্ষণ নিরব থেকে ম্লান হেসে বলে,

—“কথায় আছে না,”যার জীবন সে-ই বুঝে।” আমিও আমার জীবনের প্রতিটা বিষয়ই বুঝি, জানি। কিন্তু আমার হাতে যে কিছুই নেই। আপনজন বলতে তুমি, মানজু, চাচী-জেঠু, রিমন আছে ভাইয়া। আমার আর কী লাগবে বলো তো? আমার ভেতর কী চলে সেটা আমি এবং আমার আল্লাহ জানি! তাইতো ওদের ভুলে থাকতে পারি না। আমি এমন পরিস্থিতির মাঝে আছি যেখান থেকে না সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছি আর না আশেপাশে তাকানোর ভরসা পাচ্ছি! আমার লড়াই যে আমার একার! জানি না আমার এই জীবন যুদ্ধের শেষ পরিণতি কী হবে, তবে একটা কথাকে আজীবন ভরসা করে এসেছি যে আল্লাহ সুবহানাল্লাহ তায়ালা যা করেন তা মঙ্গল এবং কল্যাণের জন্যই করেন। হয়তো তিনি আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন!”

বলেই সেহের বড়ো বড়ো পা ফেলে সিঁড়ির দিকে চলে গেলো। সেহেরের কথাগুলো দুজনের মধ্য থেকে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

সা’দ গাড়িতে উঠার আগে একবার আঁধারে আচ্ছন্ন মায়াবীনির গ্রামটায় ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিলো। এক সপ্তাহর স্মৃতি তাকে এভাবে ঝেঁকে ধরবে সেটা সা’দ কল্পনাও করতে পারেনি। এর মূল কারণটা হয়তো তার মায়াবীনি! এই মায়াবীনির মায়ায় যে সে গভীরভাবে পড়েছে, এখন দূরে চলে যাবে ভাবতেই তার বুকটা হুঁ হুঁ করে উঠলো। কয়েকবার লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো সা’দ কিন্তু কিছুতেই নিজের এই অস্থিরতা কাটাতে পারছে না। এ কেমন মোহ বা অদ্ভুত অনুভূতি যেটা সা’দকে এভাবে পুড়িয়ে মারছে?

—“স্যার কী হলো গাড়িতে আসুন হাইস তো রওনা দিয়ে ফেলেছে।”

কারীবের কথায় সা’দ ধ্যান ভাঙ্গলো। সা’দ আরেকবার অন্ধকারে গ্রামের দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে বললো,

—“বিদায় মায়াবীনি!”

বলেই সা’দ গাড়িতে উঠে বসলো এবং কারীবকে গাড়ি স্টার্ট দেয়ার নির্দেশ দিলো। নির্দেশ পেতেই কারীব গাড়ি চালানো শুরু করলো। মেইনরোডে গিয়ে উঠতেই অন্ধকার কেটে গিয়ে কৃত্রিম সোডিয়াম আলোয় চারপাশ আলোকিত হয়ে যায়। সা’দ আনমনে মুখে হাত হেলিয়ে বাইরের পানে তাকিয়ে রয়। কারীব কিছুক্ষণ পর পর লুকিং গ্লাসে তার স্যারের বিষন্ন চেহারাটা লক্ষ্য করছে কিন্তু কিছু বলছে না। কারণ, সে জানে তার স্যার এতো সহজে মুখ খুলবে না। তবে কারীব যে সা’দের মুখ খোলানোর ব্যবস্থাই করে এসেছে। ভাবতেই কারীবের ঠোঁটদুটি প্রসস্থ হয়ে যায়।

প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টার সফরে সা’দ বাড়িতে পৌঁছালো রাত সাড়ে বারোটায়। বাড়িতে ঢুকে সা’দ তার বোন এবং মাকে সোফায় হেলান দিয়ে বসে থাকতে দেখলো। রুবাই মায়ের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে কিন্তু মা এখনো জেগে আছে। সা’দের বাবা প্রতিদিন রাত ১১টায় কড়া ঘুমের মেডিসিন নিয়ে ঘুম দেয়। নাহলে সেও এখানে উপস্থিত থাকতো। কিন্তু এখন যে তার ঘুমে হুঁশ নেই!

চলবে!!

দখিনা প্রেম পর্ব-০৯+ বোনাস পর্ব

0

#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ০৯ ||

—“এইযে বিদেশি ভাইয়া একটু শুনবেন?”

সা’দ ফোনে রুবাইয়ের সাথে কথা বলছিলো এমন সময়ই পেছন থেকে কারো ডাক শুনে সা’দ থতমত খেয়ে পিছে ফিরলো। তার পিছে ঝোপঝাড় এবং সেটা হালকা হালকা নড়ছে। ঝোপের ফাঁকে ফাঁকে পোশাকের অংশ দেখা যাচ্ছে। সা’দ নিশ্চিত হলো ঝোপের পেছন থেকেই কেউ “বিদেশি ভাইয়া” বলেছে। সা’দ ভ্রু কুচকে কল কেটে বললো,

—“কে বিদেশি ভাইয়া?”

এবার ঝোপের পেছন থেকে একটা মেয়ে মাথা বের করে মৃদ্যু সুরে আমতা আমতা করে বললো,

—“আপনি! আমি তো আপনাকেই ডাকলাম।”

সা’দ বিস্মিত হয়ে মেয়েটির চোখের দিকে তাকায়। এই মেয়ে তো সেই মায়াবিনী! আজ মেয়েটার ডানগালের কিছু অংশও দেখা যাচ্ছে। কী ফর্সা মেয়েটা, ডানগালের মাঝামাঝি একটা ছোট্ট তিলও দেখা যাচ্ছে, এ তিলটা যেন হার্ট এট্যাকের জন্য যথেষ্ট। সামনের ক’গাছা চুল মেয়েটির ডান চোখ এবং ভ্রু স্বল্প ঢেকে রেখেছে। মেয়েটির বামপাশ দেখতে পেলো না কারণ সে একপাশ ঢেকে রাখলেও অপর পাশ ঢাকতে সক্ষম হয়নি। মেয়েটির চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ ঝামেলায় পরেছে সে। সা’দ আবারও ভ্রু কুচকে বললো,

—“আমাকে দেখতে কী বিদেশিদের মতো লাগে?”

—“হ্যাঁ! আপনি অনেকটা আরব দেশের বাসিন্দাদের মতো দেখতে তাই তো আপনি বিদেশি ভাইয়া!”

“ভাইয়া” শব্দটা যেন সা’দকে প্রচন্ড রাগিয়ে তুললো। তবে সে নিজের রাগ দমিয়ে শান্ত কন্ঠেই বললো,

—“কিসের সাহায্য লাগবে বলুন আমার তাড়া আছে। আই হ্যাভ টু গো!”

—“আরে দাঁড়ান! বেশি কিছু না ওইযে ওই গোলাপি রঙের কামিজ পরা মেয়েটিকে দেখতে পারছেন ওকে একটু এদিকে আসতে বলুন প্লিজ প্লিজ প্লিজ!”

সা’দ কেন যেন সেহেরের কথা না রেখে পারলো না। সেহেরের কোনো কথার উত্তর না দিয়ে সে চলে গেলো আর সেহের মনমরা হয়ে দাঁড়ালো। আপনমনে বিড়বিড় করে বললো,

—“এই বিদেশি এমন কেন? এই ছোট সাহায্য করলে কী হতো? আমি কী তার কাছে টাকা ধার চেয়েছি নাকি হুহ!”

এমন সময়ই মানজু আসলো সেহেরের কাছে। ঝোপের পিছে সেহেরকে কাঁদামাটিতে গোসল করতে দেখে ইয়া বড় হা করে সেহেরের দিকে তাকিয়ে রয়। বিস্ময়ের সাথে বলে,

—“কীরে ফুল কাঁদামাটি দিয়ে তোর এ কী অবস্থা? কীভাবে কী হলো?”

মানজুর কথায় সেহেরের ধ্যান ভাঙতেই সে চোখ বড় বড় করে তাকালো। সেহের আমতা আমতা করে বললো,

—“আবিদ ভাইকে দূর থেকে দেখে এখানে এসেছিলাম লুকাতে কিন্তু এখানে যে এমন অঘটন ঘটবে কে জানতো। পড়েছি তো পড়েছি-ই সাথে জুতোটাও ছিঁড়ে গেলো। এখন কী করি বলতো? তোকে কে বলেছিলো এই শুটিং দেখতে আসতে? এখন ঘটলো তো এই অঘটন!”

—“তোরে তো আমার কেলাতে মন চাচ্ছে, এই আবুলকে দেখে লুকানোর কী ছিলো হ্যাঁ? তোরে দেখলে কী খেয়ে ফেলতো?”

—“অনেকটা তা-ই করতো! দেখছিস না কতো লোকজন। আবুদ ভাই কখনো আমায় এতো লোকজনের মাঝে রাখেনি!”

—“হাহ ঢং! তোর ওই আবুল ভাইরে বলিস তোরে প্যাকেট করে আলমারিতে ঢুকিয়ে রাখতে, এতো ঢং কেমনে করে?”

—“ওই তোর সমস্যা কী, সারাদিন আমার ভাইয়ের পিক্সহে লেগে থাকিস কেন?”

—“তো কী করবো? আচ্ছা রাখ এসব কথা। আমার বাসা সামনেই, আমার বাসা থেকে গোসল করে আমার জামা পরিধান করে আপাতত বাড়ি যা পরে নাহয় ফেরত দিয়ে দিস!”

—“জুতা?”

—“খালি পায়ে যাবি সমস্যা কী? বাড়ি গিয়ে উঠোনে পা ধুঁয়ে নিবি!”

—“বুদ্ধি খারাপ না। আচ্ছা চল, এখানে থাকতে অসহ্য লাগছে। আরে হ্যাঁ আরেকটা কথা!” হাঁটতে গিয়ে থেমে শেষের কথা বললো সেহের। মানজু থেমে পিছে ফিরে সেহেরের দিকে তাকিয়ে বলে,

—“কিসের কথা?”

—“তোকে আমার এই স্থানের কথা কে বললো?”

—“একটা মেয়ে, কেন কী হয়েছে?”

সেহের কিছুটা চিন্তায় পরে গেলো। সে তো ওই বিদেশি ছেলেটাকে মানজুকে ডাকতে বলেছিলো মেয়ে আসলো কোথা থেকে?

—“কীরে কী হলো?”

—“না কিছু না চল!”

সেহের বাসায় গিয়ে আবিদের কাছে শুনলো, স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে নাকি ওই রাফসান পালিয়েছে। রাফসান সুস্থ হলে গ্রামের মানুষ তাকে ন্যাড়া করে মাথায় ঘোল ঢেলে গাধার পিঠে বসিয়ে গ্রাম থেকে বের করে দিত। কিন্তু রাফসান তার আগেই পালিয়ে গেছে। এদিকে আবিদ যেন নিজের রাগ সামলাতে পারছে না, যার তার সাথে ঝগড়াঝাটি লাগিয়েই রাখছে। শেষমেষ সেহেরের কাঁদামাটিতে ভূত সাজা অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে বসে পরেছে৷ সেহের তো গাল ফুলিয়ে আবিদকে হাসতে বারণ করছিলো কিন্তু আবিদ আরও হেসে দেয়। এরপর আর কী, দুই ভাইবোনের খুনশুটি শুরু।

এদিকে ফারুক হোসাইন স্ক্রিপ্ট দেখছে তখনই সা’দ তার পাশে এসে বসলো। সা’দকে দেখে ফারুক হোসাইন স্ক্রিপ্ট রেখে হেসে বললো,

—“কী ইয়াংমেন! এমন লাগছে কেন?”

—“আচ্ছা আঙ্কেল আমার মধ্যে বিদেশি বিদেশি ভাব আছে? আই মিন আমি কী আরাবিয়ানদের মতো দেখতে?” সা’দের বাচ্চা বাচ্চা কথায় ফারুক হোসাইন হুঁ হাঁ করে হেসে দিলো। হাসতে হাসতে বললো,

—“তা অবশ্য তুমি টুকটাক আরাবিয়ান তবে কার সাহস হলো তোমাকে এই চরম সত্যটা বলেছে?” রসিকতার সুরে বললো ফারুক হোসাইন।

—“সিরিয়াসলি আঙ্কেল? তাহলে তো আমায় আরাবিয়ান ফিল্মে চান্স নিতে হবে!”

সা’দের মশকরায় ফারুক হোসাইনও আবারও আরেকদফা হেসে নিলো। আবারও সে হাসতে হাসতে বললো,

—“আমারও এমন হয়েছে জানো। তোমার মনে আছে কাল এক মিষ্টি মেয়ের কথা বলেছিলাম? যেখানে গ্রাম শহর সকলেই আমার নাটক দেখে, আমাকে ভালোভাবে চিনে সেখানে সেই মেয়েটি আমাকে কাঁদা থেকে উঠানোর সময় আমার সাথে সহজ ব্যবহার করেছে, আমাকে “চাচা” বলে সম্বোধন করেছে। আমি সত্যিই অবাক হয়েছিলাম। এই গ্রামের প্রায় সকলের ঘরে ঘরে টিভি আছে বিভিন্ন জায়গায় আমার এডের পোস্টার আছে তাও ওই মেয়ে আমাকে চিনেনি। সত্যি আমার এই অভিনয় জগতে এমন মেয়ে প্রথম দেখলাম যে আমায় চিনে না!”

—“তা বুঝলাম, তবে মেয়েটার হয়তো টিভি দেখার মতো সামর্থ্য নেই!”

—“নাহ সেরকম মনে হয়নি, মেয়েটির পোশাক-আশাকে ভদ্র এবং বড়োঘরের মেয়েই লাগছিলো, ব্যবহারেও বেশ শালীনতা আছে!”
সা’দ অবাক হয়ে সবটা শুনলো উত্তরে আর কিছু বললো না। ফারুক হোসাইন আবার বলা শুরু করলো,

—“মেয়েটাকে কোনো পরী থেকে কম লাগে না। ও তো এই প্লাটফর্মে আসলে সিলেক্টও হয়ে যাবে, কী মায়াবী তার চেহারা। বারবার মনে হয়েছিলো আপনজন!”

শেষের কথায় সা’দের ধ্যান ভাঙলো আর ভ্রু কুচকে বললো,

—“আপনজন মনে হয় মানে?”

ফারুক হোসাইন ম্লান হেসে বলে,”আমার স্ত্রীর কথা মনে পরে এই আর কী!”

—“ওহ আচ্ছা। তা আঙ্কেল আপনি শুটিংয়ের জন্য রেডি?”

—“হ্যাঁ। শুরু করা যায়।” ঠোঁটদুটো প্রসারিত করে বললো ফারুক হোসাইন।

বিকালে সেহের মানজুর জামাকাপড় নিয়ে যেতেই মানজু যেন সেহেরকে খপ করে ধরলো। সেহের চোখ বড় বড় করে বললো,

—“না ভাই আমি ওই শুটিং স্পটে মোটেও যাবো না। দেখেছিস কতো লোকজন ছিলো সেখানে?”

—“আরে ধুর লোকজন থাকলে কী হবে হ্যাঁ? কিছুই হবে না তুই চল তো! দুপুরে তোর জন্য আমি শুটিংয়ের সেটের দিকে পৌঁছাতে পারিনি! আজ যেহেতু নিয়ত করেছি আমি শুটিং দেখবো, মানে দেখবোই! নো কথা তুই আমার সাথে যাবি মানে যাবি ব্যাস!”

—“দেখ মানজু পাগলামি করিস না! এতোদূর শুটিং দেখতে আমি যেতে পারবো না!”

—“কে বললো দূরে? ওই বিচ্ছু নুমকির থেকে জানতে পেরেছি আমাদের বাসা থেকে কিছুটা দূরের যে আমবাগানটা আছে, এখন সেখানে শুটিং হচ্ছে। প্লিজ বোন আমার চল! অনেকদিনের ইচ্ছে টিভির নায়ক-নায়িকাদের বাস্তবে দেখার! প্লিজ তুই আমার ইচ্ছাটারে ভাঙ্গিস না! যেতে তো বেশিসময় লাগবে না!”

সেহের কী করবে ভেবে পায় না। মানজুর জোরাজুরিতে অবশেষে হলো সেহের। সেহের থাকায় মানজুর মা মানজুকে আটকালো না। মানজু তো প্রায় লাফাচ্ছে তার এতো আনন্দ হচ্ছে সে বলে বোঝাতে পারবে না। এদিকে সেহেরের কেন যেন খুব ভয় লাগছে। ওই বিদেশিকে দেখলে তার কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হয়, বুকের ধুকপুকানি অধিক হারে বেড়ে যায়। মানজু সেহেরকে টানতে টানতে অবশেষে পৌঁছালো শুটিং স্পটে। শুটিং দেখার জন্য স্পটের চারপাশে গ্রামের মানুষের হালকা পাতলা ভীড় জমেছে। মানজু ভীড় ঠেলে সেহেরকে নিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ালো আর চোখ বুলিয়ে অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে নায়ক-নায়িকা এবং সকল অভিনতা-অভিনেত্রীদের দেখছে। এই আমবাগানটা অনেক সুন্দর। মাটিতে সবুজ ঘাসের সমোরোহ, শীতল পরিবেশ। বলা যায়, ফ্যামিলি পিকনিকের জন্য পারফেক্ট একটা জায়গা। এখন মূলত পিকনিকের সিনই চলছে। একটা বাচ্চা একজন মধ্যবয়সী লোকের সাথে বল খেলছে আর তার পিছে এক সুন্দরী নারী পাটি বিছিয়ে বসে হটপট থেকে খাবার বাড়ছে। মেয়েটির কোলে আবার একজন মাথা দিয়ে আকাশের পানে চেয়ে কিছু ডায়লগ দিচ্ছে। এ যেন এক বড়ই সুখী পরিবার। কোলে মাথা রাখা মানুষটাকে চিনতে সেহেরের সমস্যা হলো না কারণ এ ছেলেটিকে সে ভালো করে চিনে। এই ছেলেই তাকে গতকাল আজেবাজে কথা বলছিলো। হঠাৎ সেহেরের সামনে চোখ যেতেই সে থমকে গেলো। শুটিং স্পটের অপরদিকে সেই বিদেশি এক বড় ছাতার নিচে পায়ের উপর পা তুলে মাথা নিচু করে মনোযোগ সহকারে তার সামনে থাকা মিনি পিসিতে কিছু একটা দেখছে। তার পাশে আরেকজন লোক একইভাবে মনোযোগ দিয়ে দেখছে। সেহের না চাইতেই অবাক চাহনিতে সা’দকে দেখছে। কেন জানি না সেহেরের এই সা’দকে বড্ড ভালো লাগে যার ফলে সে বারংবার ছেলেটায় ভাবনায় হারিয়ে যায়। পরমুহূর্তে সেহের নিজের চোখ সরিয়ে মনে মনে বললো,

—“ছিঃ সেহের! তুই কেন সেই ছেলেটাকে দেখছিস? সে কতো বড়ো এবং উঁচু ঘরের মানুষ আর তুই কিনা তার ভাবনা নিয়ে বসে আছিস? না সেহের তাকে নিয়ে এতো ভাবিস না, সে বড়োমাপের মানুষ, নিশ্চয়ই তার অনেক মেয়েদের সাথে উঠাবসা। আর তুই ভাবলি কী করে এই বিদেশির সাথে তোর কথা হবে? ওরা সেলিব্রিটি মানুষ তাই ওদের দিক থেকে নিজের ফোকাস উঠা! হ্যাঁ নিজেকে শান্ত রাখ! আর তাকাবি না ওনার দিকে।” ভেবেই চোখ বন্ধ কয়েকবার লম্বা শ্বাস নিলো সেহের। হঠাৎ মানজু সেহেরকে জোরে ঝাকিয়ে উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলো,

—“ও আমার আল্লাহ! আমি কখনো ভাবতেই পারি নাই আমার ক্রাশ তুষারকে বাস্তবে দেখবো! দেখ ভাই কীভাবে নিজের সংলাপ বলছে। আমি তো পুরা মুগ্ধ ফুল! খাতা কলম আনলাম না কেন রে? অটোগ্রাফ নিতাম ধ্যাত!”

বলেই মুখ গোমড়া করে ফেললো মানজু। সেহের চোখ খুলে আশেপাশে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বললো,

—“কে তুষার?”

—“আরে ওইযে নায়িকা তারা আপুর কোল থেকে উঠে বাচ্চাটার কাছে যে ছেলেটা আসলো না, সেটাই তো তুষার। ওয়ি এই নাটকের হিরো!”

সেহের ভ্রু কুচকে সেদিকে তাকালো। হ্যাঁ কালকের ওই অভদ্র ছেলেটাকেই বলছে মানজু। সেহেরের মনে এখন প্রশ্ন জাগলো, এই তুষার যদি হিরো হয় তাহলে ওই বিদেশিটা কে? সেহেরের দৃষ্টিতে এই অভদ্র তো কোনো নায়কের কাতারেই পরে না। সেহের আনমনে বলে ফেললো,

—“এ ছেলে কোনো নায়ক হলো নাকি? নায়ক তো ওই ছাতার নিচের চেয়ারে বসা সুদর্শন ছেলেটাকেই মানায়। কোন চয়েসে এই অভদ্রকে নায়ক বানালো পরিচালকরা?”

—“তুই তো কোনোদিন টিভির ধারেকাছেও যাস নাই, ভালো খারাও বুঝবি কই থেকে? জানিস আমার তুষার ক্রাশ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কতোটা হাই লেভেলে আছে! এইসব মূর্খ ক্ষেতমার্কা পাবলিক কই থেকে যে আসে কে জানে?”

এসব শুনে সেহের তার বামপাশে তাকায়। তার কিছুটা দূরত্বে তপা বুকে হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মানজু রেগে তপার দিকে তেড়ে যাওয়ার আগেই সেহের মানজুকে আটকায় এবং বলে,

—“দয়া করে এখানে কোনো ঝামেলা করিস না!”

—“মানেহ! ওই বেয়াদব মেয়ে কিসব বললো শুনিসনি? মূর্খ সে নাকি তুই? বড়দের সাথে ভালো ব্যবহার করে না সে আবার কেমন ভদ্রতা! ছাড় আমাকে। এই বেয়াদবকে আজ আমি কোনো ছাড় দিবো না।”

তখনই শুটিংয়ের এক কর্মচারী “কিপ সাইলেন্ট’স” বলে চেঁচিয়ে উঠলো মানজুদের উপর! মানজু সাথে সাথেই মুখে তালা মারলো। কর্মচারীর চেঁচানো সা’দের কানে আসতেই সা’দ বিরক্তি নিয়ে সামনে তাকালো এবং আবারও থমকে গেলো। সেই মায়াবী চোখজোড়া! তবে আজ চোখজোড়ায় কিছু অস্বস্তি এবং ভয় ফুটে আছে। আজ সা’দের কেন যেন খুশিতে খুব জোরে “ইয়াহু” বলে চেঁচাতে ইচ্ছা করছে। তার একটাই কারণ আজ সেহেরের মুখে কোনোরকম মুখোশ নেই। সে আজ পুরো মুখমন্ডল দেখতে পেলো। মায়াবী চোখজোড়া দ্বারাই এই রূপসী মেয়েটাকে চিনতে পেরেছে। বড্ড আদুরে মেয়েটি। এই মুখটা দেখার জন্য সা’দ যেন কতোবছর এই মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিলো। অথচ গতকালই এই মেয়েটাকে প্রথম দেখেছে সে। যদিও কল্পনা করেছিলো কিন্তু তার কল্পনাকেও এই মুখমন্ডলের অপরূপ গঠন হার মানিয়ে দিলো। গতকাল শুটিং শেষে রাতে এই ল্যাপটপে এই মেয়েটাকেই বারবার দেখছিলো সে, তাই যেন এই মায়াবীনি তার বড্ড চেনা। তবে মেয়েটার ঠোঁটের বামদিকে কেমন ঝাপসা কালসিটে দাগ। দাগ থেকে সা’দ ভ্রু কুচকালো। যদিও দূর থেকে এই দাগ অস্পষ্ট তবুও সা’দ অল্প হলেও সে দাগটাকে লক্ষ্য করেছে।

সা’দ শুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে মেয়েটার ওড়না ঠিক করার ভঙ্গি, কপালের ঘাম মোছা, হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে তার পাশের মেয়েটির কানে কানে কথা বলা সবটাই লক্ষ্য করছে সে। এসব দেখে অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে সা’দের। জানে না সে এই অনুভূতির কোনো নাম, তবে চুপিচুপি মেয়েটাকে দেখতে তার ভিষণ ভালো লাগছে। কারীব অনেকক্ষণ থেকেই তার স্যারের ভাব-ভঙ্গি খেয়াল করছে। শেষে উপায় না পেয়ে সে সা’দের দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকালো আর নিজেই বিষম খেলো।

—“এ যে এক সুন্দরী মেয়ে, স্যার কেন এই মেয়ের দিকে বারবার তাকাচ্ছে? ওদের ভেতর কী কিছু চলছে? কিন্তু মেয়েটা তো একবারের জন্যেও স্যারের দিকে তাকায়নি এর মানে কী শুধু স্যারের মধ্যেই কিছু চলছে? হতে পারে। আমি যা ভাবছি তা যদি হয় তাহলে তো জিও বস! স্যারকে সিঙ্গেল থেকে মিঙ্গেল করার সুযোগ যে খুবই নিকটে!”

ভেবেই কারীব অন্যদিকে চলে গেলো।

চলবে!!!

#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| অতিরিক্ত অংশ ||

কারো উপস্থিতি টের পেয়ে মা নড়ে সদর দরজার দিকে তাকালো। মায়ের নড়াচড়ায় রুয়াবি লাফ দিয়ে উঠে বসলো আর এদিকে সেদিক তাকিয়ে অস্থিরতার সাথে বলতে লাগলো,

—“কী হলো মা? ভাই এসেছে? কোথায় সা’দ?”

বলতেই তার সদর দরজার দিকে নজর গেলো। সা’দকে দেখে রুবাইয়ের যেন প্রাণ ফিরে এলো। সে উঠে দাঁড়িয়ে বড়ো বড়ো পা ফেলে সা’দকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। সা’দও পরম আবেশে নিজের বোনকে জড়িয়ে ধরলো। পরিবারের প্রতিটা মানুষ সা’দকে এখনো সেই ছোটবেলার মতো করেই ভালোবাসে।

—“এতো দেরী হলো কেন ভাই? আমি তো অফিস থেকে ফিরে তোকে পেলাম না!”

—“আমি তো ন’টায় রওনা দিয়েছি আপু, তাই দেরী হলো আর কী!”

সা’দের মা দুই ভাইবোনের দিকে এগিয়ে এসে গাল ফুলিয়ে বললো,

—“বোনকে পেয়ে সবাই ভুলে যায় আর আমি যে ১২টা অবধি জেগে আছি সে খবর কেউ রেখেছে?”

মায়ের অভিমানী কথায় সা’দ কিঞ্চিৎ হাসলো। এরপর রুবাইয়ের সাথে নিজের মাকেও জড়িয়ে ধরলো। সা’দ চোখ বুজে মুচকু হেসে বলতে লাগলো,

—“তোমাদের ভুলবো কী করে বলো তোমরা যে আমার দুনিয়া মা! এখন বলো আমার চিন্তায় প্রেশার হাই করে ফেলোনি তো?”

সা’দের কথায় মা সা’দের বুকে হালকা চাপড় দিয়ে বললো,

—“তুই এতো ফাজিল হলি কেন?”

সা’দ দুজনকে ছেড়ে বুজে হাত বুলাতে বুলাতে মুখ গোমড়া করে বলে,

—“কিছু বললেই দোষ!”

—“না রে ভাই! তোর দোষ না মায়ের ব্লাডপ্রেশারের দোষ!” বলতেই লিভিংরুমে একদফা হাসির রোল চললো। কারীবকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সা’দ বললো,

—“এই তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন ভেতরে আসো! আজ ডিনার আমার সাথে করবে প্লাস আজ আমাদের বাড়িতেই থাকবে!”

—“আরে কী বলেন স্যার! তা তো হয় না!”

—“হওয়ার হলে ঠিকই হয়। এখন কোনো কথা না, চুপচাপ গেস্টরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেতে আসো! ইট’স মাই অর্ডার!”
বলেই সা’দ সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো। রুবাই হেসে কারীবকে বললো,

—“বসের অর্ডার না মানলে সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখবেন আপনার এই চাকরি ফুঁস করে উড়ে গেছে। তাই বেশি না বলে সা’দ যা বললো তাই করে ফেলুন, আমরা খাবার রেডি করছি!”

বলেই রুবাই তার মায়ের কাজে হাত লাগাতে রান্নাঘরে চলে গেলো। সা’দ উপরে যাওয়ার সময়ই মা কিচেনে ছুটেছিলেন। কারীবও আর কী করবে, কোনো উপায় না পেয়ে গেস্টরুমের দিকে চলে গেলো।

—“সেহের! তোরে আমি এতো সহজে ছাড়মু না। আমারও সময় আইবো! আমি কী জিনিস তোরে আমি হারে হারে বুঝায় দিবো। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। সেই সঠিক সময়ে তোকে আমার হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না কেউ না! তোর অপমানের শোধ আমি শুধে আসলে নিবো।”

বলেই অচেনা লোকটা হুংকারের সাথে হাতে থাকা স্টিলের গ্লাসটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো। রাগে তার সমস্ত শরীর যেন দাউদাউ করে জ্বলছে। প্রচন্ড জ্বলছে!

সেহের ব্যস্ত হয়ে পরলো নিজের পরীক্ষা নিয়ে। সারাদিন বইয়ে ডুবে থাকো পরীক্ষা দাও আর রাতে রিমনকে সময় দাও। এ যেন তার প্রতিদিনের রুটিন। জোহরা বা তপা এখনো কোনো ঝামেলা করেনি তবে জোহরা একবার এসেছিলো রিমনকে নিতে কিন্তু রিমন বরাবরই নাকোচ করে দেয় যে সে ওই বাড়িতে ফিরবে না। প্রতিবারের মতোই জোহরা খালি হাতে ফিরে যায়। তবে ফিরে যাওয়ার আগে সেহেরের দিকে ক্রোধের দৃষ্টি একবার হলেও নিক্ষেপ করবেই। সেই দৃষ্টি সেহের বুঝতে পারলেও কিছু বলে না। কবির এখনো জেলে আছে। এদিকে গ্রামের মানুষ নতুন একজন চেয়ারম্যান নিয়েছে। নতুন চেয়ারম্যান হলো রতন চাচা। উনি অত্যন্ত ভালো এবং ঠান্ডা স্বভাবের মানুষ৷ যেমন তার ব্যবহার তেমনই তার কাজের দক্ষতা। গ্রামের মানুষ বেশ খুশি এমন একজন চেয়ারম্যান পেয়ে। সময় যত এগোতে থাকলো সেহেরের পরীক্ষাও শেষ হয়ে আসলো। পরীক্ষার কারণে মানজুর সাথে কলেজ ছাড়া দেখাই হয় না। শেষ পরীক্ষার দিন মানজু আগেই কলেজ থেকে বাসায় চলে গেছে তাই সেহেরের আজ একাই যেতে হচ্ছে। সেহের প্রশ্নের এমসিকিউ দেখতে দেখতে আসছিলো তখনই তার পাশের ক্ষেত থেকে একটা শব্দ পেলো। সেই শব্দে সেহের ভ্রু কুচকে থামলো। ঘাড় ঘুরিয়ে পা উঁচু করে কিছু দেখার চেষ্টা করতেই যা দেখলো তাতে সেহেরের হাত-পা যেন অবশ হয়ে গেলো৷ এ যে তার বাবা কবির! এক ঢোকে মদ গিলছে সে। সেহের ভয়ে শ্বাস আটকে আসছে। মদ খাওয়া শেষে বোতল নামিয়ে কেমন পাগলের মতো কথা বলছে আর চিৎকার চেঁচামেচি করছে যা দেখে সেহেরের ভয় আরও বেড়ে গেলো। সে আর এক মুহূর্ত সেদিকে না দাঁড়িয়ে দ্রুত সেই স্থান ত্যাগ করলো। তার পক্ষে এই মানুষটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব না। বাসায় ফিরে কাউকে জিজ্ঞাসা করতে চেয়েও কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারলো না। আর আবিদ বা জেঠুও বাসাতে ছিলো না। আবিদ তার ভার্সিটি থেকে এখনো ফিরেনি আর জেঠু তার কাজে গেছে। সেহেরের অস্বস্তি যেন বেড়েই চলছে। কবির জেল থেকে ছাড়া কবে পেলো? আর কীভাবেই বা বের হলো? সে কী আবার সেহেরের কোনো ক্ষতি করবে? এরকম নানান প্রশ্ন সেহেরের মাথায় ঘুরঘুর করছে। চাচী সেহেরকে উঠোনে বসে থাকতে দেখে হাক ছেড়ে বললো,

—“ফুল রান্নায় এসে সাহায্য করতে পারবি? পুকুরে যাইয়া কাপড় ধুইতে হইবো আমার, তুই একটু ভাত টিকা দিস আর মাছ বসিয়েছি নুন লাগলে দেখিস একটু!”

—“আচ্ছা চাচী তুমি যাও, রান্না আমি সামলাচ্ছি!”

চাচীমা মুচকি হেসে রান্নাঘর থেকে ভেতরে চলে গেলো। সেহের নিজের সব চিন্তা পাশে ফেলে রান্নাঘরে চলে গেলো। আজ যেহেতু সেহেরের পরীক্ষা শেষ, সেহেতু সে এখন অবসরেই আছে।

পার্টিমুখর পরিবেশ! কিছুক্ষণ পরপর লাল, নীল লাইট বদলে চারপাশ দুই কালারের কলম্বিয়া তৈরি করছে। সাইড স্টেজে একটা ব্যান্ড এবং ফেমাস সিঙ্গার বসেছে। গায়ক কিছুক্ষণ পরপর বিভিন্ন মনভুলানো গান গাইছে। চারপাশে নানান মানুষের আনাগোনা। সকলেই পাবলিক ফিগার অথবা সেলিব্রিটি। এক প্রডিউসার তার নিউ মুভিতে ভালো রেসপন্সের জন্য এই বিশাল পার্টির আয়োজন করেছেন বিভিন্ন বড়ো বড়ো বিজন্যাসমেন এবং ফিল্মইন্ডাস্ট্রির সকল লোকদের। তুষার ড্রিংকস সাইডে হাতে ওয়াইন নিয়ে দুই-তিনজন মডেল মেয়ের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত এমন সময়ই সদর দরজার সামনের থেকে হালকা শোড়গোল শোনা গেলো। তিন মডেল সেদিকেই তাকালো। শুধু এই তিনজন নয় আশেপাশের সবার দৃষ্টি-ই সেদিকে। সকলের মতো তুষারও বিরক্তি নিয়ে সেদিকে তাকালো। প্রডিউসার সাহেব একপ্রকার ছুটে সদর দরজায় গেলেন আর কাউকে ওয়েলকাম ওয়েলকাম করে ভেতরে আসতে বলছেন। কিছু মানুষ সরে যেতেই দেখা গেলো সা’দ আর তার বোন রুবাই পার্টিতে প্রবেশ করছে। সা’দ পুরো ফর্মাল লুকে আর রুবাই একটা শাড়ি আর হিজাব পরেছে। সা’দকে দেখে তুষারের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। মেজাজ গরম হওয়ার মূল কারণ সা’দ কেন তার চেয়েও বেশি আকর্ষণীয় যার জন্য প্রায় সকল মডেল আর অভিনেত্রী তার দিকে নজর দেয়? কই তুষারের দিকে তো এভাবে তাকায় না? এই বিষয়গুলো পুরো বিরক্তি ধরিয়ে দেয় তুষারকে। অত্যন্ত বিরক্তির সুরে তার পাশে থাকা মেয়েটিকে বললো,

—“এরে নিয়ে এতো মাতামাতির কী আছে ভাই? সে তো সামান্য ডাইরেক্টর। শুধু সাদা হলেই যে ভালো হতে হবে এমন তো নয়! লুক এট মি অর লিভ হিম!”

মেয়েটা তুষারের দিকে না ফিরে কড়া কন্ঠে বললো,

—“সা’দ বিন সাবরানের মতো মানুষকে প্রায় প্রতিটা মেয়েই হাসবেন্ড হিসেবে আশা করে, যে মেয়েদের সাথে মিসবিহেভ করে না, রেসপেক্ট দেয় সাথে একজন ভালো মানুষ। ফেরেশতার মতো মানুষটাকে খারাপ বলার মতো কোনো ওয়ে নেই মিস্টার! বরং আমি এটা বলতে পারি, তোমার স্টার হওয়ার ২ বছরে বেশ অনেকবার ওয়াইন বা ড্রিংকস নিতে দেখেছি কিন্তু সা’দ স্যারকে গত সাড়ে চার বছরে কোনোদিন ড্রিংকস তো দূরে থাক স্মোকিংও করতে দেখিনি!”

বলেই মেয়েটি তার পাশের দুজন মেয়েকে নিয়ে অন্যদিকে চলে গেলো। তুষার রাগে গ্লাসের পুরোটা ওয়াইন এক দমে শেষ করে মৃদ্যু চিৎকার দিয়ে বললো,

—“সা’দ সা’দ এন্ড সা’দ! এই এক নাম আমার সবকিছু যেন শেষ করে দিচ্ছে। কে এই সা’দ! এ উপরে যা দেখায় তা তো সে একদমই না! এর ভেতরে কুটনৈতিক কাজ কেউ কেন ধরতে পারে না হোয়াই? কেন তার জন্য বারবার নিজেকে অপমান হতে হয়! এরে তো ইচ্ছা করে নিজ হাতে খুন করি একে!”

সা’দ কয়েকজনের সঙ্গে অল্পস্বল্প আলোচনা করছিলো তখনই সে দূর থেকে ফারুক হোসাইনকে দেখতে পেলো। তখনই সে “এক্সকিউজ মি” বলে ফারুক হোসাইনের দিকে এগিয়ে গেলো। এই একটা মানুষকে সা’দের বেশ পছন্দ। ফারুক হোসাইন যেমন রসিক তেমনই ভালো মানুষ। অল্পতেই মানুষের সাথে মিশে যান! সামান্য অহংকারবোধ নেই তার মধ্যে। ফারুক হোসাইন সা’দকে দেখে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললো,

—“আরে ইয়াংম্যান যে কী অবস্থা? তা নতুন কোনো শিডিউল আছে নাকি??”

—” আলহামদুলিল্লাহ আঙ্কেল ভালো আপনার কী অবস্থা? আর এক মাস শান্তিতেই আছি কোনো শিডিউল নেই। থাকলে তো আপনি জানতেনই!” মুচকি হেসে বললো সা’দ। ফারুক হোসাইন হেসে বললো,

—“হ্যাঁ তা তো অবশ্যই। আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তা কিছু খাবে কোলড্রিংকস অর স্নেকস?”

—“না আঙ্কেল ঠিকাছি। আন্টির কী অবস্থা আর আপনার মেয়ের?”

—“সকলেই আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে। আমার মেয়েকে তো এবার নিউইয়র্কে পাঠিয়েছি!”

—“ও আচ্ছা৷ এবার সে কোন ক্লাস?”

—“ইন্টার দিয়েছে, রেজাল্ট আসার পর নানান ঝামেলার পর অবশেষে নিউইয়র্কে পারি জমালো! তা শুনলাম তোমার বোনও নাকি এসেছে? সে কোথায় পরিচয়ই তো হলো না!”

—“ও হ্যাঁ ও ওদিকে আছে৷ চলুন সেদিকে যাই!”

—“হ্যাঁ চলো।

চলবে!!!

দখিনা প্রেম পর্ব-০৮

0

#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ০৮ ||

—“স্যার আপনাকে ইদানীং আনমনে লাগছে কেন? মনে হয় যেন কোনো গভীর ভাবনায় ডুবে আছেন!”

সা’দ থতমত খেয়ে কারীবের দিকে তাকালো। কারীব জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সা’দের পানেই তাকিয়ে আছে উত্তরের অপেক্ষায়! সা’দ নিজেকে সামলে হালকা হেসে বলে,

—“কবে দেখলে? আর এমন কেন মনে হলো?”

—“এই কয়েকদিন আপনাকে লক্ষ্য করছি, কিসের গভীর চিন্তা করেন স্যার? আমাকে কী বলা যাবে?”

—“তুষারের বিষয় নিয়ে কারীব! ছেলেটা বড্ড অমনোযোগী এবং খিটখিটে টাইপ। এর এসব অকাজের কারণে আমার শুটিংয়ের তো অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। যার তার সাথে আজেবাজে ব্যবহার আমার কথা তো বাদই দিলাম!”

—“এ আর নতুন কী? এর অবস্থা যা, প্রডিউসার, ডিরেক্টরের এর পিছে দৌড়াতে হয়। টাকায় কেনা গোলাম পাইসে নাকি? তবে যাই বলেন, আপনার ব্যবহার টা আমার সেই লাগে স্যার! তুষার ভিষণ নাকানিচুবানি খায়। আপনি যখন ওরে এভোয়েড করেন তখন ওর মুখটা দেখার মতো হয়! আমার তো ইচ্ছ্ব করে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়তে!”

—“ওকে বুঝলাম। এখন গিয়ে চেক করো শিমির মেক আপ ডান হয়েছে কিনা, নেক্সট শিডিউলে কিন্তু শিমির পার্ট আছে।”

—“ওকে স্যার দেখছি!”

তখনই আজের সা’দের জন্য কফি নিয়ে আসলো। সা’দ মুচকি হেসে কফিটা নিয়ে মুচকি হেসে ছোট্ট করে ‘ধন্যবাদ’ জানালো! আজের একটা তৃপ্তিময় হাসি দিয়ে সেস্থান প্রস্থান করলো! সা’দ কফিতে চুমুক দিতে দিতে কিছুক্ষণ আগের প্রতিটা ক্যামেরার রেকর্ড চেক করতে থাকলো! সা’দের যেই সাইট পছন্দ হবে সে সেই ক্লিপটুকুই কাট করে সঠিক জায়গা মতো বসিয়ে দিবে। এভাবে দেখতে দেখতে থমকে গেলো একটা রেকর্ডে। তুষার পেছনের দিকে যাচ্ছিলো তৎক্ষণাৎ এক মেয়ের সঙ্গে ধাক্কা খায় আর মেয়েটি নিচে পরে যায়। মেয়েটি আর কেউ নয় সেই মায়াবতী! পড়ে যাওয়ায় ভ্রু কুচকে চোখ বুজে খিচে রাখে। ক্যামেরাটা তুষারের দিকে ফোকাস করা ছিলো বিধায় সেহেরের ভাবভঙ্গি বেশ ভালোভাবে দেখছে সা’দ। অদ্ভুত মায়ায় জড়িয়ে গেছে সে এই মেয়েটার প্রতি। না চেয়েও পারে না মেয়েটিকে ভুলতে। সেই সময়ের পর থেকেই অনবরত মেয়েটার আঁখিজোড়া চোখের সামনে ভাসছে। হঠাৎ সা’দের কী হলো সে জানে না। পাশে থাকা ভিডিও এডিটরকে বলে সে মেয়েটির ক্লিপটা নিজের পেনড্রাইভে নিয়ে শুটিংয়ের রেকর্ড থেকে ডিলিট করিয়ে নেয়। এরপর সা’দ সবটা একে একে মার্ক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শিডিউল অনুযায়ী আবার তাদের শুটিং শুরু হলো।

সেহের বাসায় গিয়ে জানতে পারে তার বাবাকে নাকি পুলিশ এরেস্ট করেছে। ওদিকে নাকি জোহরা কেঁদেকেটে অবস্থা খারাপ করে ফেলছে। সেহের কিছুই বলছে না একদম চুপ। সেহেরের চোখে তার সেই নিকৃষ্ট দিনগুলো চোখে ভাসছে। আর কানে বাদ্যযন্ত্রের মতো বাজছে কবিরের অশালীন কথাগুলো। সেহের কিছু না বলে নিজের ঘরে গিয়ে ব্যাগ ট্যাগ রেখে বাথরুমে ঢুকে পরলো গোসলের জন্য। বাথরুম থেকে বেরিয়ে চুল মুছতে মুছতে র‍্যমে এসে দেখলো দাদীমা আর রিমন বিছানায় বসে আছে। হাতে দুই প্লেট খাবারও আছে। সেহেরকে দেখে দাদীমা মুচকি হাসি দিয়ে বলে,

—“আইজ তোগো এক পাঁত থেইকাই দুই ভাইবোনরে ভাত খাওয়ায় দিমু। গতকাল বরইয়ের আচারও বানাইসিলাম!”

আচারের কথা শুনে সেহেরে খুশির শেষ নেই। সে চটজলদি রিমনের পাশে গিয়ে বসে পরলো। দাদীমা এক প্লেট পাশে রেখে ভাত লোকমা করতে করতে একবার সেহেরকে তো একবার রিমনকে খাইয়ে দিচ্ছে। রিমন তো তার খেলা নিয়ে বকবক করতে ব্যস্ত। রিমনের কিছু কিছু কথায় সেহের আর দাদীমা একসাথে অটঠাসিতে ফেটে পরছে। চাচী আর জেঠু দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ওদের আনন্দ দেখছে। চাচী আনমনে বলে উঠলো,

—“মেয়েটাকে কতোদিন পর হাসতে দেখলাম তাই না আবিদের আব্বা?”

—“তা যা বলেছো! মা ঠিকই করেছে কসম দিয়ে সেহেরকে এই বাড়িতে এনে। নাহলে মেয়েটা কেমন শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেত, হাসিটা যেন কোথায় হারিয়ে যেত তার এই মায়ামাখা মুখ থেকে।”

—“হ্যাঁ গো! শুনলাম তোমার ভাইকে নাকি গতকাল পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে? আবার ছাড়া টাড়া পাবে না তো?”

—“সে জানি না। তবে বের হতে কতক্ষণ, আগেও তো কবির জেলে গেছে। বাটপারি করে, ঘুষ-টুষ দিয়ে বেরিয়ে গেছিলো। এবার কী হয় কে জানে। তবে কবির এখন আর চেয়ারম্যান নেই, গ্রামের মানুষ নতুন চেয়ারম্যানের খোঁজে আছে!”

—“তাহলে যদি নতুন চেয়ারম্যান আসার আগেই কবির ভাই ছাড়া পেয়ে যায় তখন?”

—“এমনটা হবে বলে মনে হচ্ছে না। গ্রামের মানুষ এখন সতর্ক হচ্ছে আগের চেয়ে, তাই তো হন্য হয়ে চেয়ারম্যানের খোঁজে আছে। তবে শুনেছি নির্বাচন করেই চেয়ারম্যান নেয়া হবে। দেখি এবারের নির্বাচনে কারা কারা দাঁড়ায়।”

—“তুমি দাঁড়াবে না?”

—“আরে না কী বলছো? আমাকে তো ওরা সরাসরি বারণ করে দিয়েছে। কবির আমার ভাই, তাই কবিরের পরিবার-বংশের উপর মুরব্বিরা খুব একটা ভরসা করতে পারছে না। সেই চাচা তো বলেছেন আমি সম্মানীয় ব্যক্তি আছি থাকবো তবে আগের মতো ভরসাটা থাকবে না!”

বলেই জেঠু চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। চাচী মুখ গোমড়া করে মাথা নিচু করলো। কবির যা করেছে তার জন্য তাদের পুরো পরিবারও ছোট হয়ে গিয়েছে। আর এমনিতেই গ্রামের মানুষ তিল কে তাল বানাতে অভিজ্ঞ। যেমনটা জেঠুকে পোহাতে হচ্ছে। দোষ করলো ভাই দোষী হয়ে গেলো পুরো পরিবার। জেঠু চেয়েও নিজের মাকে এসব বলতে পারছে না। বললে আবার বড়ো রকম অঘটন ঘটবে যা জেঠু বেশ ভালোভাবেই জানে। বিকালে সেহের উঠোনের একপাশে মুরগীদের খাবার ছিটিয়ে দিচ্ছিলো তখনই চাচী এসে বলে,

—“ফুল মা! আবিদটাকে একটু ডেকে নিয়ে আসতে পারবি? সেই কখন কাজ আছে বলে বাসা থেকে বের হলো এখনো তার খবর নেজ! নির্ঘাত জসিম চাচার টং দোকানে বসে আড্ডা মারছে। এই ছেলেকে নিয়ে আর পারি না!”

—“আরে চাচী। বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো দোষের কিছু না। যদি প্রয়োজন হয় আমি যাচ্ছি আবিদ ভাইয়াকে ডাকতে।”

—“যাবি?”

—“আরে হ্যাঁ সমস্যা কোথায়? এখান থেকে এখানে, এক গ্রাম পার করে তো যেতে হচ্ছে না!”

—“ঠিক আছে তাহলে সাবধানে যা। তবে হ্যাঁ মাথায় ওড়না বেঁধে মুখোশ ভালো করে পেঁচিয়ে নিবি, জানিস তো গ্রামের মহিলাগুলো কেমন ভয়ংকর! তোকে এই সময় বের হতে দেখলে কটুকথা ছড়াবে!”

—“আরে চাচী চিন্তা করিও না। ওদের মুখ আছে বলতে দাও আমার সমস্যা নেই। যাইহোক যাচ্ছি।”

বলেই ওড়না বাঁধতে বাঁধতে বেরিয়ে গেলো। আর চাচী সেহেরের জায়গায় মুরগীদের খাবার দিতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। রিমন গেছে বন্ধুদের সাথে ঘুড়ি উড়াতে। সেহেরেরও রিমনের সাথে খোলা মাঠে গিয়ে ঘুড়ি উড়ানোর ইচ্ছা হয় কিন্তু সে ইচ্ছা অপ্রকাশিত। বসন্তের প্রথম দিক থেকেই দখিনার শীতল হাওয়া সকলকে কাঁপিয়ে দেয়। গ্রামাঞ্চল বিধায় এর প্রকোপ যেন আরও বেশি! দুই ক্ষেতের চওড়া রাস্তা দিয়ে পা আলগিয়ে আলগিয়ে হাঁটছে সেহের। ফজরের পর ব্যাপক ঝড়বৃষ্টি হয়েছে বিধায় এখানে মাটি পানিতে চুপচুপ হয়ে কাঁদামাটিতে পরিণত হয়েছে। আর মাটি যা পিচ্ছিল, একবার পিছলিয়ে পরলে কোমড় নির্ঘাত যাবে। তবে সারাদিনের রোদের তাকে খুব একটা কাঁদা নেই তবুও পিছলিয়ে পড়ার মতো যথেষ্ট কাঁদা রয়েছে। সেহের সামনে তাকাতেই দেখলো একজন মধ্যবয়সী লোক ভুলবশত কাঁদাতে পা দিয়ে ফেলে যার ফলে সে পিছলিয়ে প্রায় পড়ে যায়। এতে তার পাজামা ঢোলাঢালা ফতুয়ায় কিছুটা কাঁদায় মাখামাখি হয়ে গেলো। সেহের জলদি করে লোকটির কাছে এগিয়ে লোকটিকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলো। লোকটিকে ধরে উঠানোর ফলে হাতে ওড়না টান লেগে মুখোশটা খুলে যায় কিন্তু সেহেরের সেদিকে খেয়াল নেই। লোকটি কাঁদামাখা হাত ক্ষেতের পানিতে ধুঁয়ে নিজের ফতুয়ায় হাতটা মুছে চোখের মোটা ফ্রেমের চশমাটা ফতুয়ার এক অংশ দিয়ে মুছলো। মোছা শেষ হতেই চশমাটা চোখে লাগিয়ে লোকটি সেহেরের দিকে তাকালো। সেহের কিছুটা মলিন সুরে বলে উঠলো,

—“আপনি ঠিক আছেন তো চাচা?”

সেহেরের কথায় লোকটি বেশ অবাক হয়। তাও নিজেকে সামলে কিঞ্চিৎ হেসে জবাব দিলো,

—“হ্যাঁ মা ঠিক আছি! আসলে হয়েছে কী এই জায়গাটা পার হওয়ার সময়ই চশমাটায় গাছের এক বিন্দু পানি পরে। এরপর যা অঘটন ঘটার ঘটে গেলো। ভাগ্যিস এসেছিলে নয়তো এই বুড়োকে সারাদিন এই কাঁদামাটিতে হাত-পা ছড়িয়ে বসে থাকতে হতো!”

লোকটির রসিকতায় সেহের মৃদ্যু হাসলো। সেহেরের হাসিতে লোকটিও তাল মেলালো! সেহের বুঝলো লোকটি বেশ রসিক মানুষ।

—“আচ্ছা তাহলে আজ আসি! তোমার উপকার আমি ভুলবো না!”

—“আপনার যেতে সমস্যা হবে না তো?”

—“না তেমন কিছু না, যেতে পারবো।”

—“ঠিক আছে চাচা, সাবধানে যাবেন আল্লাহ হাফেজ!”

লোকটি উত্তরে মুচকি হাসি দিয়ে চলে গেলো। সেহের সেখানে কিছুসময় দাঁড়িয়ে চলে গেলো জসিম দাদার টং দোকানে।

—“এ কী ফারুক আঙ্কেল, আপনার এ অবস্থা হলো কী করে?” সা’দ কিছুটা উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলো ফারুক হোসাইনকে।

—“আর বলো না চশমায় পানি পরায় পিছলিয়ে কাঁদায় পরে গেছিলাম। ভাগ্যিস একটা মিষ্টি মেয়ে এসে বাঁচিয়েছিলো নয়তো কী-ই না ঘটে যেত।”

সা’দ এবার অপরাধীর সুরে বলে উঠলো,

—“আই এম এক্সট্রেমলি সরি আঙ্কেল! আমার উচিত ছিলো মেইন রোড থেকে কারো মাধ্যমে আপনাকে রিসিভ করা। কে জানতো আপনি বিকালেই চলে আসবেন!”

—“আরে ব্যাপার না। গ্রামে শুটিং থাকলে আমি আগে পুরো গ্রাম ঘুরে দেখি এরপরই সেটে যাই। তাই এতে অপরাধীর মতো থেকো না। আমার কিছুই হয়নি জাস্ট কাঁদাতে পড়ে জামা-কাপড় নষ্ট হয়েছে এর বেশি কিছু না!”

—“তাও, উসমান! আঙ্কেলকে নিয়ে সড়াইখানা যা, ওনাকে ফ্রেশ করিয়ে চেকআপ করিয়ে নিবি!”

—“ওকে স্যার।”

উসমান পথ দেখিয়ে ফারুক হোসাইনকে অতি সাবধানে সড়াইখানায় নিয়ে যায়। সেখানে আগে থেকেই গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে একজন ডাক্তার এনে রাখা হয়েছে, যাতে করে যেকোনো সমস্যা হলেই আগে থেকে ট্রিটমেন্ট নিতে পারে! ফারুক হোসাইনের একবারের জন্যে তুষারের দিকে চোখ গিয়েছিলো। ফারুকের কাঁদামাখা অবস্থা দেখে মুখ সিঁটকালো। ফারুক সেদিকে পাত্তা না দিয়ে মুচকি হেসে উসমানের সাথে কথা বলতে বলতে চলে গেলো। হঠাৎ সা’দের মাথায় এলো ফারুক হোসাইন মিষ্টি মেয়ের কথা বলেছে। “মিষ্টি মেয়ে” শব্দটা মাথায় আসতেই সেই মায়াবীচোখ জোড়া তার তার চোখের সামনে আবারও ভেসে উঠলো। স’দ বিরক্ত হয়ে নিজের মাথায় হালকা চাপড় মেরে শুটিং সেটের দিকে চলে গেলো।

সেহের ঘন্টাখানেক ধরে এপাশ তো আরেকবার অন্যপাশ ফিরছে। ঘুম যেন তার জানালা দিয়ে পালিয়েছে। সেই ছেলেটার চেহারা একমনে তার চোখে ভেসেই চলেছে। সারাদিনের ব্যস্ততায় ছেলেটার কথা ভুলে থাকলেও আঁধার রাতের একাকীত্বে ছেলেটার চেহারা যেন তার ঘিরে ধরেছে। সেহের না চেয়েও বারবার সেই ছেলেটাকে ভেবে গভীর ভাবনায় ডুবে যাচ্ছে।
এদিকে সা’দেরও একই অবস্থা। হাজার চেয়েও এই এক মুহূর্তের চোখজোড়াকে সে ভুলতে পারছে না। বলা যায়, আঁখিজোড়া তাকে ঘুমোতেই দিচ্ছে না। কোন মায়ায় ঘায়েল হয়েছে সেটা সা’দ কিছুতেই বুঝতে পারছে না। না চাওয়া সত্ত্বেও বারংবার একজনকে নিয়ে ভাবনা। এই ভাবনায় যেন হাজারো অদ্ভুত অনুভূতির মেলা। দখিনার হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে সাদা পর্দাগুলো উড়ছে। সা’দ উঠে বসে বিছানা ছেড়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। শীতল হাওয়ায় লোম যেন দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। তাও প্রকৃতির এই হাওয়া যেন সা’দের সারাদিনের ক্লান্তি দূর করে দিচ্ছে। বাতাসে সা’দের টিশার্টের কলার এবং চুল একসাথে দুলছে।

দুজন দু-প্রান্তে থেকেও একই অনুভূতি যেন তাদের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। এ কিসের অনুভূতি? এই একটা প্রশ্নের উত্তর মেলাতে মেলাতে রাতের প্রহর শেষ হয়ে নতুন সকালের সূচনা হলো। তবুও যেন তাদের উত্তর মিললো না।

চলবে!!!

বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম আসসালামু আলাইকুম।

দখিনা প্রেম পর্ব-০৭

0

#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ০৭ ||

তুষার একের পর এক স্টেপ ভুল করছে তো আবার কড়া রোদে শুটিংয়ের জন্য বারংবার চেঁচিয়ে উঠছে। এদিকে সা’দ হাত দুটো মুঠিবদ্ধ করে চুপচাপ তুষারের আজারে কান্ড দেখছে। শেষ বিকালে রোদের তাপ দেয়ার জন্য কী সূর্যমামা বসে আছে? সা’দের যে তুষারকে কী করতে মন চাচ্ছে সে নিজেও জানে না। সা’দ চুপচাপ পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে আর এদিকে কারীবসহ প্রডিউসার নানানভাবে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু সা’দ একবারের জন্যেও তুষারের আশেপাশে ঘেঁষছে না। এদিকে তুষার যেন আরও রেগে আছে। এতক্ষণ এতকিছু করেও সে সা’দকে নিজের আশেপাশে আনতে পারলো না। শেষে ওদের জোরাজুরিতে আবার শুটিংয়ে মনোযোগ দিলো। শুটিং শেষ হলো রাত সাড়ে সাতটা নাগাদ। চা-কফির ব্রেক চলছে এখন। আটটা দশে আবার নেক্সট শিডিউল শুরু হবে। সা’দ কফিতে চুমুক দিতে দিতে গ্রামের রাতের সৌন্দর্য দেখছে তখনই তার পাশে চেয়ার নিয়ে বসলো তুষার। সা’দ তুষারের দিকে আড়চোখে তাকালেও টুশব্দও করলো না। তুষার সামনের দিকে তাকিয়েই বলতে লাগলো,

—“এতো কিসের দাপট তোমার মিয়া?”

সা’দ এবারও কিছু বললো না। সে একমনে কফি খেতেই ব্যস্ত। এবার রাগ চেপে বসলো তুষারের!

—“কী কথা কানে যায় না? হাউ ডেয়ার ইউ আমার মতো একজন সুপারস্টারকে এভোয়ড করো?”

—“সুপারস্টার বানানোর ক্রেডিট কার সেটা নাহয় আগে চেক করিও তারপর এসব কথা বলতে এসো!”

খুবই শান্ত গলায় কথাটা বললো সা’দ। সা’দের কথার মাঝে নেই কোনো রাগ আর না আছে কোনো ক্ষোভ! তুষার কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,

—“সে যারই ক্রেডিট হোক আমি সেসব বলছি না। আমাকে এভয়েড করার মানে কী? দাপটটা একটু কম করে দেখাইয়ো!”

সা’দ কফিতে এক লম্বা চুমুক দিয়ে মৃদ্যু হেসে বলে,

—“আমি দাপট দেখাই না। যে যেমন ব্যবহার পেতে যোগ্য আমি জাস্ট তাদের সেই ব্যবহারটাই উপহার দেই। তবে হ্যাঁ এতোটা বোকাও নই যে শেষ বিকালে কড়ারোদ বলবো!”

বলেই সা’দ কফির কাপটা নিয়ে উঠে সেটের দিকে চলে গেলো। আর তুষার? সে তো হাতদুটো মুঠিবদ্ধ করে রাগে ফুঁসছে।

—“এই লোকটার এত বড় স্পর্ধা আমার সাথে এমন বিহেভ করছে! ড্রামাটার ডিল না করতাম, তাহলে এরে উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়তাম। টাকার শর্ট ছিলো তাই এই নাটকটায় আসতে রাজি হয়েছি আবার কিছু বলতেও পারছি না। তবে মিস্টার সা’দ বিন সাবরান, আমায় দুর্বল ভেবো না! আমি হেরে যাইনি!”

শিডিউল শেষ হলো রাত সাড়ে এগারোটায়। সকলেই বেশ ক্লান্ত টানা শুটিংয়ের কাজ করে। সা’দ গ্রামের এক সড়াইখানা ঠিক করে রেখেছে সেখানেই এই ১ সপ্তাহ তাদের কাটাতে হবে। সকলে থাকলেও তুষার সেই রাতেই বাড়িতে যাওয়ার জন্য রওনা হলো। কাল তার শিডিউল দুপুরের দিকে তাই তার তেমন একটা সমস্যা হবে না। এদিকে সা’দ সড়াইখানায় পৌঁছাতেই তার মামার কল পেলো!

—“হ্যাঁ মামা বলো!”

—“বলছি তোর আশেপাশে আমি গোয়েন্দা ফিট করে রেখেছি!”

—“হোয়াট! বাট হুয়াই মামা? এসবের কী প্রয়োজন?”

—“প্রয়োজন আছে। কমিশনারের থেকে ওই লোকটার খবরা-খবর সব জেনেছি। লোকটা খুব একটা সুবিধার না আর গ্রামের মানুষ তো এদের ভরসা তো আমার একদম নেই। তুই সাবধানে থাকিস!”

—“তোমার যেমন হুকুম। আচ্ছা এখন রাখো আমাদের রাতের খাবারের সময় হয়েছে।”

—“ও আচ্ছা। তাহলে বাই আর বেস্ট অফ লাক তোর শুটিংয়ের জন্য!”

—“হুম মামা আল্লাহ হাফেজ।”

বলেই সা’দ ফোন রেখে দিলো। সা’দ ফোন রাখতেই কারীব সা’দের দিকে আসলো। সা’দ শান্তসুরেই প্রশ্ন করলো,

—“কিছু বলবে?”

—“হ্যাঁ। খাবারটা?”

—“সকলের সাথে খাবো আসো!” ম্লান হেসে বললো সা’দ। কারীব খুশি হয়ে তার স্যারকে নিয়ে সড়াইখানার পেছনের উঠোনে গেলো। সেখানে বাবুর্চি দিয়ে রান্না করা হচ্ছে আর বাকি কর্মচারীরা পাটি বিছিয়ে কথাবার্তা বলছে। অভিনেত্রী বা অভিনেতাদের দেখা যাচ্ছে না, তাদের খাবার রুমে রুমে দিয়ে আসা হবে।
সকল কর্মচারীরা সা’দ কে দেখে অত্যন্ত খুশি হলো। তাদের টিমে যে চা-কফির দায়িত্বে থাকে সা’দ তার পাশেই বসলো। সেই বেচারার তো আনন্দে চোখে জল চলে এসেছে। ছেলেটা বেশি বয়স না, কম করে হলেও তার বয়স ১৬-১৭ হবে। গরীব ঘরের ছেলেটা তবে সা’দই তার লেখাপড়া করাচ্ছে। লেখাপড়া করার মতো সামর্থ্য তার নেই। বাবা মারা গেছে অনেক আগেই। মা আর বোনের জন্যই এই ছোট বয়সে যুদ্ধ করতে নেমে পরা। ছেলেটার নাম আযের। আযের ছলছল দৃষ্টি নিয়ে বললো,

—“স্যার আপনি আমার পাশে বইসেন?”

–“হ্যাঁ বসলাম কেন কোনো সমস্যা হচ্ছে?”

—“না সাহেব কী যে বলেন না।”

এভাবে সকলের সাথে বেশ ভালোভাবে আড্ডা হলো, খাওয়া হলো।
পরেরদিন,

মানজু আর সেহের কথা বলতে বলতে আসছিলো হঠাৎ অদূরে সেহের একটা সুন্দর বেলী ফুকের চাড়া দেখতে পায়। সেহের মানজুকে সেখানে দাঁড়াতে বলে ছুটলো সেই চাড়ার দিকে তখনই সে সে ধাক্কা খেয়ে মাটুতে পরে গেলো। হাতের কবজি এবং হাঁটুর কিছু অংশ ছিলে গেছে। ছিলে যাওয়ার জায়গায় জ্বালা করায় সেহের চোখমুখ কুচকে ফেললো। কারো কথায় ধ্যান ভাঙতেই সেহের চোখ খুলে সামনে থাকা আগন্তকের দিকে তাকালো। শ্যাম বর্ণের লম্বা, সুঠাম দেহি ছেলেটা। তবে তার চেহারায় রাগ স্পষ্ট, রাগে তার কপালে একটা রগও দেখা যাচ্ছে। তুষার কিছুটা হুংকারের সুরে বললো,

—“ম্যানারলেস বলতে কিছু নাই? দেখো না এখানে শুটিং চলে? এখন ধাক্কা দিসো ক্ষমা না চেয়ে উলটা থম মেরে বসে আছো? এতো নাটক কেমনে করো হ্যাঁ? ডিসগাস্টিং! এসব গাঁইয়া মেয়ে যে কোন ক্ষেত থেকে উঠে আসে গড নোওস!”

সেহের তুষারের কথায় কোনোরকম অভিব্যক্তি না করে উঠে দাঁড়ালো। এরপর নিজের কামিজ ঝাড়তে ঝাড়তে বলে উঠলো,

—“দেখুন আমি আপনাকে ধাক্কা দেইনি, আমি তো শুধু আমার পথ ধরে এগোচ্ছিলাম, আপনি নিজেই আমাকে ধাক্কা দিয়েছেন!”

—“এই স্টুপিড মেয়ে! তুমি কী বলতে চাও আমি তোমাকে সেঁধে ধাক্কা দিয়েছি? এই ফিল্মস্টার তোমায় সেঁধে ধাক্কা দিবে হাউ ফানি! নিজেকে কখনো আয়নায় দেখেছো স্টুপিড মেয়ে? এই এক সেকেন্ড আই থিংক তুমি আগে থেকেই প্ল্যান করে আসছো এই ফিল্মস্টারকে নাকানিচুবানি খাওয়াবে বলে রাইট? দেখো গাঁইয়া মেয়ে আই হ্যাভ নো ইন্টারেস্টেড অন ইউ! জাস্ট লিভ!”

—“তুষার! পহোয়াট হ্যাপেন্ড? শুটিংয়ের মাঝে এভাবে অন্য একজনের সাথে ঝগড়া লাগলে কেন? সময় গড়িয়ে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল করেছো?”

সা’দের কথায় তুষার পিছে ফিরলো। তুষার পিছে ফেরার জন্য সা’দ এবং সেহের দুজন দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেলো। সেহেরের চোখদুটো দেখে সা’দ যেন স্তব্ধ হয়ে গেলো। তার সময়টা যেন থমকে গেছে কোনো একজোড়া ডাগর আঁখির মায়াতে। সা’দ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে কাজল ছাড়া চোখজোড়ার দিকে। চোখদুটোতে কৃত্রিমতার ছোঁয়া নেই তবে সা’দের এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে এই কাজলতা শুধু এই চোখজোড়াতেই মাধুর্যতা ফুটিয়ে তুললো, সাথে এক আকাশ মায়ার মেঘতুলো! মুখোশ বাঁধার কারণে সা’দ শুধু সেহেরের মায়াবী চোখজোড়াই দেখতে পাচ্ছে তবে তার জন্য এই চোখজোড়াই এনাফ, সা’দকে তার মায়ার মোহনজালে আবদ্ধ করে ফেলতে। নিজের অজান্তেই তার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেলো। সা’দ জানে না এ কেমন অনুভূতি! তবে বিষয়টা সত্যিই অদ্ভুত। হঠাৎ মেয়েটা দৌড়ে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর দেখা গেলো আরেকটা মেয়ে সেই মেয়েটির পিছে দৌড়ে চলছে। সেই মেয়েটির যাওয়ার পানে এখনো সা’দের দৃষ্টি স্থির। মায়ার বিষাক্ত জালে যে সে ফেঁসে গেলো তা একদমই ঠাহর করতে পারছে না। কারীবের কথায় ধ্যান ভাঙতেই সে আবার নিজের কাজে মনোযোগী হলো।

এদিকে সেহেরের বুকটা অগণিত ধুকপুক করেই চলেছে থামার নাম নেই। কয়েক মিনিটের জন্য সে সেই গাছের নিচে দাঁড়ানো পুরুষটার দিকে তাকিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলো! অত্যন্ত সুদর্শন সেই ছেলেটি। এমন সুদর্শন ছেলে সেহের এ জীবনে আগে কখনো দেখেনি। লম্বা, সুঠাম দেহি, চুল স্টাইল করে ব্রাশ করা। খোঁচা খোঁচা দাড়ি যেন তার সৌন্দর্য আরও বাড়িয়্ব তুলেছিলো। চাঁদের গাঁয়ে যেমন দাগ আছে, তার খোঁচা খোঁচা দাড়িতে যেন সেই কথাটাই ফুটিয়ে তুলে। তবে দাড়ির না থাকলে ছেলেটার চেহারাটিকে পানসে পানসে লাগলো। সানগ্লাসের জন্য চোখদুটো দেখতে পারেনি সে। সেহের কিছুদূর এসে হাঁপাতে লাগলো। মাঞ্জু সেহেরের কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,

—“আমালে ফেলে এভাবে দৌড়ে এলি কেন?”

—“ওখানে কী শুটিং চলছিলো?”

—“হ্যাঁ আশেপাশে তো ক্যামেরা ট্যামেরা দেখলাম!”

—“আগে কেন বলিসনি? বললে কী ওই ছেলে আমাকে অপমান করার সাহস পেতো না! আর ওরা রাস্তার মাঝে শুটিং করে কেন?”

—“আরে আরে! আমাকে কী বলতে দিয়েছিলি? নিজেই তো সেদিকে গেছিলি। তবে যাই বলিস, যে ছেলেটির সাথে ধাক্কা খেয়েছিলি সে তো ইয়া বড় ফেমাস হিরো! উফফ বইন আমার তো মন চাইছিলো ওনার অটোগ্রাফ নিতে!”

—“ফেমাস না কঁচু! এর ব্যবহার তো অত্যন্ত খারাপ। এরা টাকার সাথে মানুষকে তুলনা করে। কী বিচ্ছিরি মুখের ভাষা, আমি নাকি তার জন্য ইচ্ছা করে ধাক্কা মেরেছি! বড় বড় মানুষদের ব্যবহার যদি এমন নিচ স্বভাবের হয় তাহলে আমরাই বেশ আছি! এদের মতো উঠতে বসতে কাউকে কথা শুনাই না!”

—“বাহ তাহলে তো বেশ। তাহলে এতদিন যে নিজ বাড়িতে বাবা, সৎমা এবং ছোট বোনের অত্যাচার সহ্য করেছিস? সেগুলার বিষয়ে তো কোনোদিন প্রতিবাদ করিসনি?”

—“সে অন্য ব্যাপার! ওরা ঘরের মানুষ, আপনজন! আমতা আমতা করে বললো সেহের। এরপর কথা ঘুরিয়ে সেখান থেকে বাড়ির দিকে রওনা হলো।

চলবে!!!

দখিনা প্রেম পর্ব-০৬

0

#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ০৬ ||

—“কারীব ওই বটগাছের নিচে কিসের মিটিং বসেছে?”

—“জানি না তবে শুনেছি চেয়ারম্যানের মেয়েকে নাকি ধর্ষণ করার চেষ্টা করা হয়েছিলো। সেই অনুসারেই নাকি আজকে সভা বসেছে চেয়ারম্যানের সঙ্গে!”

—“বলছো কী! তাহলে তো অনেক সিরিয়াস বিষয়। আজ নির্ঘাত ওই রেপিষ্টের অবস্থা খারাপ হবে।”

—“স্যার আমার তো দেখতে মন চাইছে চলুন না প্লিজ চলুন!”

—“না কারীব আমাদের ফেরা লাগবে সেটে!”

—“স্যার প্লিজ চলুন না। ১ম শিডিউল তো বিকালে শুরু হবে। এখনো অনেক সময় আছে। প্লিজ চলুন! আমার অনেকদিনের ইচ্ছে গ্রামের মুরুব্বিদের এই ধরণের মিছিল-মিটিং দেখার।”

কারীবের জোরাজুরিতে সা’দ শেষ অবধি সেখানে যেতে রাজি হলো। এদিকে চেয়ারম্যান কবির মাথায় হাত দিয়ে চুপচাপ বসে আছে। চুপচাপ বললেও ভুল হবে, সে চুপ করে নিজের রাগ দমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। ওদিকে বাসায় স্ত্রী রাফসানের জন্য কান্নাকাটি লাগিয়ে রেখেছে আর এদিকে গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা রাফসানকে শাস্তি দেয়ার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে। কবির বুঝতে পারছে না সে কোনটা করবে? ঘর সামলাবে নাকি বাহির সামলাবে? একপ্রকার কোটান মধ্যে পরে আছে সে। তবে এবার রাগ লাগছে তার সেহেরের প্রতি! সেহেরের জন্যই সব হচ্ছে। আপাতত সে ভাবছে বাসায় গিয়ে সেহেরকে ঠিক কী করবে। এদিকে আরেক মুরব্বির কথায় কবিরের ধ্যান ভাঙলো যার ফলে রাগ সামলাতে না পেতে উচ্চসরে বলে উঠলো,

—“তো আমি কি করতাম এহন? পুলারে একলা দোষ দিলে হইবো নাকি মাইয়াও সমানভাবে অপরাধী! আমি না দেইক্ষা প্রমাণ ছাড়া কেমনে ওই পুলার বিচার করুম!”

কবিরের কথায় বড় জেঠু অত্যন্ত রেগে গেলো। কবিরের কথা সা’দ আর কারীব দূর থেকেই শুনতে পারলো। তারা জলদি পা চালিয়ে সেখানে উপস্থিত হলো এবং বোঝার চেষ্টা করলো আসল ঘটনাটা কী। বড় জেঠু হুংকারের সুরে বলে উঠলো,

—“কবির মুখ সামলে কথা বল! ওই মেয়েটা অসহায় হওয়ার আগে তোর রক্তেরই অংশ! আর আমরা এতক্ষণ কতোবার করে বললাম শুনিসনি? ওই রাফসান আমাদের মেয়েকে ধর্ষণের চেষ্টা করছিলো। আমরা যেই মুহূর্তে সেখানে পৌঁছিয়েছি সেই মুহূর্তে রাফসান দরজা ভাঙছিলো সাথে অকথ্য ভাষায় কথাও বলছিলো! তোর স্ত্রীর সাহস কী করে হলো এই মূর্খটার কাছে একা মেয়েটাকে ফেলে ঘুরতে যেতে? তোর নিজের স্ত্রী সমানভাবে দোষী, আমাদের ফুল নয়!”

—“ওই ভাই একদম আমার বউরে এইডিতে ঢুকাইবা না! ওই অপয়া মাইয়ারে নিয়া কী চৌদ্দগ্রাম ঘুরবো নাকি? বাসায় রাইখা গেছে, গেছে। এহন রাফসান আর ওই অপয়ায় কী করসে না করসে হেইডা আকরা কেমনে কমু? এহন যাইহোক রাফসান ধর্ষণ তো আর করে নাই! করলে এক কথা ছিলো, এই বিচারও ঠিক ছিলো কিন্তু মাইয়াটা তো জ্যান্তই আছে নাকি!”

কবিবের এমন নিচ বিচার-বিবেচনা দেখে উপস্থিত সকলের ঘৃণায় তারে থু থু মারতে ইচ্ছা করলো। মানুষ এতোটা পাষাণ এবং নির্দয় কী করে হতে পারে? কী করে বুক ফুলিয়ে মাথা উঁচু করে এসব বলছে? সা’দ এতক্ষণ তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মধ্যবয়সী লোকের থেকে সমস্ত ঘটনা শুনলো। কবিরের কথাগুলো তাকেও অত্যন্ত রাগিয়ে তুললো। সে সকলের মতো রাগ দমাতে পারলো না, ঘৃণিত কন্ঠে খুবই কড়া এবং শান্ত গলায় বলে উঠলো,

—“হয়তো ওই ছেলেটা কিছু করেনি তাই বলে ভবিষ্যতে অন্য মেয়ের জীবন নষ্ট করবে না তার গ্যারান্টি কী? এসব পুরুষ মানুষদের উচিত শিক্ষা না দিলে এরা কখনোই শোধরায় না। আর বর্তমানে যেকোনো মেয়ের বাবাই এসব বিষয় নিয়ে অনেক সিরিয়াসভাবে সবটা হ্যান্ডেল করে আর আপনার তো সেদিকে কোনো হেলদোলই নেই! উল্টো তখন থেকে নিজের মেয়েরই দোষ ঘাটছেন! বলি আপনি বাবা নাকি অন্যকিছু? আপনার দ্বারা যদি বিচারটাই ঠিকমতো না হয় তাহলে আপনি কোন কাজের চেয়ারম্যান যেখানে নিজের মেয়ের বিষয়েই এমন হেলাফেলা? এই ধরণের ফিউচার রেপিষ্টদের সুযোগ না দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরুন তাহলে এই সমাজে মেয়েদের সেফটি থাকবে!”

সা’দের বক্তব্যগুলো সকলের বেশ মনে ধরেছে কিন্তু কবির সাহেব সবসময়ই সত্যের ব্যতিক্রম! তিনি হুংকার ছেড়ে বললো,

—“শহরের পোলাপাইন শহরের পোলাপাইনের মতো থাকো। তুমারে কেউ আমাগো বিচারে নাক গলাইতে কয় নাই! আর তুমার এতো সাহস আমার বিচার নিয়া এসব বলো? তুমি গ্রাম চালাও নাকি আমি চালাই?”

—“গ্রাম আপনি চালান বা অন্যকেউ সেটা আমার দেখার বিষয় না। একজন চেয়ারম্যানের বড় কাজ হচ্ছে গ্রামের মানুষকে সুরক্ষা দেয়া, তাদের বিপদে-আপদে সঠিক পরামর্শ এবং বিচার করা। সেখানে আপনি গ্রাম তো দূর নিজের পরিবারের মেয়েকেই তো সুরক্ষা দিতে পারেন না। তাহলে আপনার এই চেয়ারম্যান পদের দরকার কী?”

—“এইসব জ্ঞান তুমার প্যান্টের পকেটে রাখোম আজাইরা কথা না কইয়া এইহান থেইকা বিদায় হও নয়তো পুলিশ দিয়া এমন ডান্ডাপিডান খাওয়ামু জম্মেও ভুলতে পারবা না।”

—“সেটা নাহয় ওই রেপিষ্টকে দিন শুধু শুধু আমার মতো নির্দোষ ছেলেকে এসব বলার মানেই হয় না!”

—“এইবার আইসো লাইনে এহন বিদায় হও!”

—“জ্বী না হবো না। তবে শুনুন আপনার এইসব ছোটখাটো হুমকিতে আমাকে দমাতে পারবেন না। হয় সঠিক বিচার করুন নয়তো উপরমহলের সাথে যোগাযোগ করে আপনার ব্যবস্থা করবো!”

—“আমারে ডর দেহাও তুমি?” কপট রেগে বললো কবির। কবিরের কথায় সা’দ হালকা হাসলো! এরপর হাসতে হাসতেই বললো,

—“জ্বী না। এই সাদ বিন সাবরান হুমকি বা ভয় দেখায় না। যা বলে সোজা তা-ই করে। এখন আপনার যদি আপত্তি না থাকে আমি যোগাযোগ করতে পারি। তাদের বলবো তো, দেখে যান কীভাবে এই চেয়ারম্যান পদের মানুষটা তাদের গ্রামের উন্নতি করার বদলে উল্টো বিপদে ঠেলছে। এর বিচারব্যবস্থার ঠিক নেই। যেখানে নিজের ঘরকেই সামলাতে পারে না পুরো গ্রামকে কী করে সামলাবে?”

কবির প্রথমে দমে গেলেও পরমুহূর্তে নিজের রাগকে দমাতে না পেরে সেই সবার সামনেই গালিগালাজ শুরু করলো। মুরব্বিরা এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার আর তারা চুপ থাকলেন না। সকলে মিলে সা’দকে বললো যেন এক্ষুনি উপরমহলের সাথে যোগাযোগ করে। এতদিন অনেক অত্যাচার সহ্য করেছে তারা এখন আর সম্ভব না। চুপ থাকা মানেই অপরাধীকে আরও উষ্কে দেয়া। সা’দও তাদের কথা ফেললো না। সা’দ নিজেও বিরক্ত হয়েছে এই লোকের প্রতি। আর এই লোকের ভাষার যা ছিঁড়ি এরে চেয়ারম্যান পদ থাকার চেয়ে না থাকা ভালো। সা’দ ফোন করলো তার মামা ইকবালকে। ইকবাল মামা একজন বড় পলিটিশিয়ান তাই এইসব বিষয় তাদের জন্য বা হাতের কাজ। ইকবাল মামাকে সবটা বুঝিয়ে বলতেই সে জানালো অতি দ্রুত সে জেলা প্রশাসকদের পাঠানোর ব্যবস্থা করবে। এদিকে কবিরকে এক ঘরে বন্দি করে রাখা হলো, যতক্ষণ না জেলা প্রশাসক আসছে ততক্ষণ অবধি তাকে বন্দিই রাখতে হবে। কারণ, কবিরকে খোলামেলা রাখা মানেই নিজের বিপদ ডেকে আনা।

সেহের চুপ করে উঠোনে মোড়া দিয়ে বসে আছে। গতকালের ঘটনা যেন তাকে পুড়িয়ে মারছে। গতকাল দাদীমা ওদের ইচ্ছেমতো অপমান করে সেহেরকে সাথে নিয়ে চাচীর বাসায় চলে এসেছে। স্বহের আসতে না চাইলে সেহেরকে তার কসম দেয়। তাই সেহের জীবন্ত মানুষটার জন্য মৃত মানুষটার ওয়াদা ভাঙতে বাধ্য হয়েছিলো। একবারের জন্যেই সে এখানে চলে আসে। তবে একা নয় সাথে রিমনও চলে এসেছে। রিমন নিজেও ওই নরকে থাকতে চায় না। ওয়াদা ভঙ্গের জন্য অপরাধবোধ সেহেরকে ক্ষণে ক্ষণে আঘাত করে ক্ষত করে দিচ্ছে। সেহেরের মন ভালো করার জন্য রিমন সেহেরের সামনে এসে দাঁড়ালো!

—“বুবু?”

—“হু?” রিমনের কথায় সেহেরের ধ্যান ভাঙতেই উত্তর দিলো।

—“বরই পারবো চলো না!”

—“কি এই ভরদুপুরে? আর চাচী যদি জানে তাহলে তো দুটোরই অবস্থা খারাও করবে!”

—“আরে জানবে না চলো তো। আমি গাছে উঠে ঢিল মারবো আর তুমি টোকিয়ে তোমার ওড়নাতে বাঁধবে। চলো না বুবু প্লিজ প্লিজ প্লিজ!”

—“ভাই এভাবে চুরি করে খাওয়া ঠিক হবে না প্লিজ জোর করিস না! এমনিতেই এই গাছে আগে বরই ধরেনি এই প্রথম বরই আসছে। প্রথম প্রথম চাচীর কন ভাঙ্গা কী ঠিক হবে?”

—“ক্যান হইবো না আইজ আমিও তোগো লগে বরই চুরি কইরা খামু!”

দাদীমার কথায় সেহের চোখ বড় বড় করে পিছে ফিরলো। অবাক হয়ে বললো,

—“কী বলো কী তুমি দাদী? মাথা ঠিকাছে? এই বুড়ো বয়সে বরই চুরি করবা?”

—“ওই মাইয়া চুপ! সারাক্ষণ বুড়ি বুড়ি বইল্লা চিল্লাইবি না। আমরা শহরের বুড়ি না যে আমাগো গাঁয়ে জোর থাকবো না। এহনো মনে মনে ৩০ বছরের জুয়ান ছোঁকড়ি। এহন বেশি প্যাঁচাল না পাইরা চল। বউমা এহন ইকটু হুইসে এ-ই সুযোগ!”

—“ইয়ে!! দাদী তুমি থাকলে তো নাচত্ব নাচতে গাছে উঠবো। বুবু চলো দাদী ঠিকই বলেছে এখনই সুযোগ।”

বলেই রিমন সেহেরকে টেনে উঠালো। এদিকে সেহের হাজার মানা করেও দাদী আর ভাইয়ের সাথে পারলো না। সেহের দাদীমার সাথে নিজের ওড়না হাতে বিছিয়ে সামনে দাঁড়ালো। আর দাদীমা নিজের সাদা সুতির আঁচলটা হাতে বিছিয়ে সামনে বাড়িয়ে রাখলো। এদিকে রিমন খুব সহজে গাছে উঠে গাছ কয়েকবার ঝাঁকি মারতেই বৃষ্টির বেগে বরই পরতে লাগলো। দাদীমা আঁচল বাড়িয়ে বাড়িয়ে নিচ্ছে আর সেহের টুকিয়ে তো আবার ওড়না বাড়িয়ে নিচ্ছে। ঝাঁকি দেয়া শেষে এবার রিমন ঢিল ছুঁড়া শুরু করলো। এতে বরই ঠুসঠাস করে মাটিতে পরতে শুরু করলো। একড়া বরই তো দাদীমার ডান চোখ গিয়ে লাগলো। দাদীমার হাতে থাকা বরই ফেলে চোখে দুইহাত দিয়ে “ওমাগো” “আল্লাহ গো” বলে চেঁচিয়ে উঠলো। দাদীমার চিৎকারে বাসার ভেতর থেকে শব্দ আসতেই রিমন জলদি করে গাছ থেকে নেমে সেহেরের সাহায্য নিয়ে বরইগুলো লুকিয়ে ফেললো। এদিকে দাদীমার চিৎকার চেঁচামেচিতে চাচীমা দৌড়ে আসলো দাদীর কাছে। চাচী অস্ফুট সুরে বলে উঠলো,

—“কী হয়েছে মা চিৎকার করছেন কেন? আর চোখে কী হয়েছে?”

দাদীমা চাচীর কথার উত্তর না দিয়ে রিমনকে ধমকানোর সুরে বলে উঠলো,

—“ওই হতভাগা, চোর! চোখ মেইল্লা দেহোস না ঢিল কই মারোস! এখন আমার হারাইয়া যাওয়া চোখ কী তুই ফিরায় দিবি?”

চাচীমা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো দাদীমার কথায়। অবাক হয়ে বলে,

—“এসব আপনি কী বলছেন মা? কে আপনার চোখে ঢিল মারলো?”

এবার দাদীমা এতক্ষণে বুঝলো সে ঠিক কী বলে ফেলেছে। জিবহায় সামান্য কামড় দিয়ে আমতা আমতা করে বললো,

—“আরে ওই বেয়াদব কাউয়ারে কইসি। বরই পারতে যাইয়া আমার চোখে ফেলাইয়া পালাইসে।”

চলবে!!!

বিঃদ্রঃ রিচেক দেয়ার সময় হয়ে উঠেনি তাই ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।

দখিনা প্রেম পর্ব-০৫

0

#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ০৫ ||

সেহের এদিক সেদিক তাকিয়ে জলদি তার মায়ের ঘরে চলে গেলো। কারণ, সৎমায়ের ঘরে একটা ল্যান্ডলাইন টেলিফোন আছে। সেহের দরজা লাগিয়ে ওয়ারড্রবের উপরে থাকা ল্যান্ডলাইনের নাম্বার টেপ করে কানে লাগালো।

—“হ্যালো?”

—“আবিদ ভাই!”

—“ফুল তুই?”

—“হ্যাঁ ভাইয়া আমি। ভাইয়া প্লিজ তুমি এবাসায় আসো প্লিজ!”

—“কেন কী হয়েছে? তোর কন্ঠ এমন কেন লাগছে? কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি ফুল?”

—“বেশী কিছু বলতে পারবো না ভাইয়া। তপা আপু আর মা বাসায় নেই। ওই রাফসান শয়তানটা বাসায় আছে। ভাইয়া দয়া আসো ওই ছেলে একদমই সুবিধার না!”

—“আচ্ছা আচ্ছা আসছি। তুই সাবধানে থাক আমি সবটা সামলাচ্ছি‌!”

আবিদের কথায় সেহেরের মনের উপর থেকে যেন বড় একটা পাথর সরে গেলো। রাফসান উপরে শুয়ে আছে, যেকোনো সময়েই আশেপাশে ঘেঁষবে তা সেহের বেশ জানে। সেহের টেলিফোনটা ঠিকভাবে রেখে দরজার সিটকিনি খুলে সাবধানে বের হলো। ঘর থেকে বের হতেই শুনতে পেলো রাফসান উপর থেকে “সেহের” বলে তাকে ডাকছে! সেহেরের গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো ভয়ে। সেহের রাফসানের ডাকে সাড়া না দিয়ে নিজের ঘরে দরজা লাগিয়ে থম মেরে বসে রইলো আর মনের মধ্যে আল্লাহর নাম জোপ করতে লাগলো৷ সেহের বাসা থেকে বের হতে পারছে না কারণ এই বিকাল সময়ে সেহেরের বাসার বাইরে যাওয়া একদম মানা। আর সৎমা যাওয়ার আগে কড়া করে বলে গেছে সেহের যেন তার অনুপস্থিতিতে বাড়ির বাইরে পা না রাখে। তাই সেহেরের নিজের ঘরটাই ভরসা। রাফসান চরম রেগে সিঁড়ি দিয়ে নামছে। এতক্ষণ এতো করে ডাকলো সেহের উপরে যাওয়া তো দূর সাড়াশব্দও করলো না। রাফসান এখন যা ভেবে রেখেছে তা করতে না পারলে তার মন শান্ত হবে না।
তাই সে দ্রুত পা চালিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলো কিন্তু সেহেরকে পেলো না। রাফসানের আবার মেজাজ খারাপ হলো। সে চেঁচিয়ে হাঁক ছাড়লো সেহেরের নাম ধরে। কিন্তু তাও সাড়াশব্দ মিললো না। এবার রাফসান রান্নাঘরের দিক থেকে এসে সেহেরের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো। দরজা খুলতে গিয়ে দেখলো দরজা বন্ধ। দরজায় জোরে জোরে নক করতে করতে শান্ত গলায় বললো,

—“সেহের! সেহের! দরজা খুলো! এই অসময়ে ঘরে দরজা লাগিয়ে বসে আছো কেন?”

সেহের টুশব্দও করলো না। এবার সেহেরের চোখে পানি চলে আসলো। রাফসান কী করতে চাইছে সেটা সেহের ভালোভাবে বুঝতে পারছে কিন্তু নিজেকে এর হাত থেকে বাঁচাবে কী করে? আবিদই বা কোথায়? এতো কেন দেরী করছে সেটা সেহের বুঝতে পারছে না। এদিকে রাফসান ডাকতে ডাকতে হয়রান হয়ে শেষ পর্যন্ত নিজের রাগ দমিয়ে রাখতে পারলো না। দরজা জোরে জোরে ধাক্কাতে ধাক্কাতে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করছে আর থ্রেড দিয়ে দরজা খুলতে বলছে নয়তো দরজা ভেঙ্গে সেহেরের অবস্থা খারাপ করে দিবে। এদিকে সেহের মুখে হাত দিয়ে নিশব্দে কেঁদেই চলেছে।

—“হে মাবুদ! আমাকে এই জানোয়ারটার হাত থেকে বাঁচান।”

—“মা*** এতিমের বাচ্চা দরজা খুল! তোর মা**বা***। আমি দরজা ভাঙলে তোরে গালতে গালতে মাইরাই ফেলমু দরজা খুল!!”

এদিকে আবিদ আর তার সাঙ্গপাঙ্গ তখনই দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। পিছে কিছু মুরব্বিরাও ছিলো। দরজা হালকা ভেঁজানো ছিলো বিধায় কলিংবেল বাজাতে হয়নি। তারা ভেতরে ঢুকতেই রাফসানের অকথ্য গালিগালাজ বেশ শুনতে পেলো। আবিদ এসব শুনে তো রেগে আগুন হয়ে গেলো। আবিদ তেড়ে গিয়ে রাফসানের কলার ধরে দরজার সামনে থেকে সরিয়ে আনলো। রাফসান হঠাৎ চুপ হয়ে যাওয়ায় সেহের নিজের কান্না কিছুটা কমালো। হঠাৎ বিকট থাপ্পড়ের শব্দ শুনতে পেলো। এবার সেহেরের কান্না পুরোপুরি থেমে গেলো। সে চোখ মুছে মাথায় ভালোভাবে ঘোমটা দিয়ে নাক টেনে উঠে দাঁড়ালো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো বাহিরে ঠিক কী হচ্ছে। আবিদের কন্ঠ শুনতে পেতেই সেহের তৎক্ষনাৎ দরজা খুলে সামনে তাকালো। বাইরে এতো মানুষ দেখে সেহের অস্বস্তিতে পরে গেলো। আবিদ সকলের সামনে রাফসানকে আচ্ছাভাবে কেলাচ্ছে।

—“আমার বোনকে রেপ করবি তুই না? এতো সাহস? যার সিংহের মতো ভাই আছে তারে রেপ করার স্পর্ধা দেখাতে আসছিস? তোরে তো আজ মাটিতে পুঁতে রাখবো জানোয়ার! আর তোরা দাঁড়িয়ে আছিস কেন মশলাপাতি দে আরও!”

আবিদের কথায় তার বন্ধু-বান্ধবরাও আবিদের সাথে যোগ দিলো। বেচারা রাফসানের তো পুরো আধমরা অবস্থা। মুরব্বিরা ক্ষীপ্ত দৃষ্টিতে রাফসানকে দেখছে। রাফসানের প্রতিটা কথাই সে শুনেছে। এই কয়েকটা কুলাঙ্কারের কারণেই গ্রামে দুদিন পর পর এই ধর্ষণের দুঃসংবাদ তারা শুনতে পায়! আর আজ তো নরখাদককে চোখের সামনে দেখলো। ভাগ্যিস তারা সময়মতো এসেছিলো নয়তো দরজা ভেঙ্গে আরও খারাপ কিছু করে ফেলতো। সেহের মুখে মুখোশ বেঁধে কাঁদতে কাঁদতে আবিদকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। আবিদ রাফসানকে ছেড়ে সেহেরের মাথায় হাত দিয়ে আশ্বাস দিয়ে বলে,

—“কাঁদিস না বোন! দেখ আমরা চলে এসেছি। এই কুলাঙ্কার তোর কিচ্ছু করতে পারবে না। কাঁদিস না বোন কাঁদিস না!”

এক চাচা সেহেরের দিকে এগিয়ে এসে বললো,

—“কেঁদো না মা। আমরা সবাই এই বিষয়টা সামলে নিবো!”

সেহের ছলছল চোখে মাথা নাড়ায়। তখনই সৎমা আর তপা হাতে বেশকিছু শপিং ব্যাগ নিয়ে বাসায় এসে হাজির হয়। বাসায় এতো মানুষ দেখে সৎমা জোহরা দৌড়ে ভেতরে এসে দেখলো তার আদরের ভাগনে আধমরা হয়ে পরে আছে। রাফসান আপাতত বেহুঁশ!এ দৃশ্য দেখে জোহরার মাথায় যেন বাজ পরলো। সে শপিংব্যাগ রেখে দৌড়ে রাফসানের কাছে এসে বলা শুরু করলো,

—“রাফসান এই রাফসান? কী হয়েছে তোর আর তোর এই অবস্থা কেন?”

—“তোমার এই ভাগনে আমাগো চেয়ারম্যানের মাইয়ারে ধর্ষণ করার তালে ছিলো হেই খবর জানো?”

এক মুরব্বি কথাগুলো বললো। জোহরা অবাক হয়ে মুরব্বির দিকে তাকালো। ভাঙ্গা গলায় বললো,

—“আপনার কথা ঠিক বুঝলাম না!”

—“তা কেন বুঝবেন আপনি? আমার বোনকে এইসব জানোয়ারের কাছে একা ফেলে এদিক সেদিক ঘুরতে বের হোন! সামান্য জ্ঞান বিবেচনা নেই আপনার যে একটা মেয়েকে একটা ছেলের কাছে একা ফেলে গেলে ঠিক কী পরিস্থিতি হতে পারে? সারাদিন কামলার মতো খাটান, অত্যাচার করেন তা দিয়ে কী পেট ভরে না? আপনারা কী মানুষ?” পাশ থেকে আবিদ কথাগুলো বললো। আবিদের কথা শুনে জোহরা রক্তচক্ষু দৃষ্টি নিয়ে আবিদের দিকে তাকালো। জোহরা এই আবিদকে একবিন্দুও সহ্য করতে পারে না। তখনই জেঠু, দাদীমা আর চাচী ছুটে আসলো বাড়িতে। দাদীমা তো সেহেরকে নিজের সাথে জড়িয়ে রাখলো। সেহের একদম চুপ হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। জোহরা চাইলো তার ভাগনের দোষটা কাটাতে তাই সে সেহেরের ঘাড়ে দোষটা চাপাতে নিজেকে প্রস্তুত করলো।

—“আমার রাফসান যে ওকে কিছু করেছে তার প্রমাণ কী? ওই হারামজাদী তো গিরিঙ্গিবাজ! এ তো ক্ষণে ক্ষণে নিজের রূপ বদলায়। নিশ্চয়ই এই মেয়ে আমার রাফসানরে কালাযাদু করে বশ করসিলো আর খারাপ কাজে আসার জন্য অনুপ্রেরণা দিছিলো নয়তো আমার এতো ভালো ভাগনেটা এমন মাইর খায়? এই মেয়ের চরিত্রে দোষ নাই তার কী গ্যারান্টি আছে? আমি কিছুতেই বিশ্বাস করি না আমার রাফসান এসব করতে পারে!”

জোহরা রাগে কী বলে ফেললো সে নিজেও ঠাহর করতে পারলো না। আবিদ এদিকে হাত মুঠিবদ্ধ করে রাগ দমানোর চেষ্টা করছে। এই মহিলা যে কতো নিচে নামতে পারে তা আবিদের জানা নেই। গিরিঙ্গিবাজ কে সেটা ভালোই বোঝা যাচ্ছে। সেহের ছলছল দৃষ্টিতে জোহরার দিকে তাকালো। শেষ অবধি নিজের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠবে সেটা যে সেহের ভাবতেই পারেনি। আপন মানুষগুলো ক্ষণে ক্ষণে কীভাবে রূপ পাল্টায় সেটা হয়তো সেহেরের চেয়ে বেশি আর কেউ জানে না। এক মুরব্বি তৎক্ষনাৎ জোহরার কথার প্রতিবাদ করে বলে,

—“আমরা না দেখে, যাচাই না করে কোনো কথা বলি না। নিজের চোখে দেখসি এই বেয়াদব, শুয়োর কীভাবে ফুলের মতো নিষ্পাপ মাইয়াটারে হুমকি দিয়াসে, অসভ্য ভাষায় কথা কইসে। এরে তো নাড়ু কইরা, মাথায় গোল ঢাইল্লা গাধার পিছে বসাইয়া গ্রাম থেকে বাইর করা উচিত। এদের মতো কীটের জন্য আমাগো ভালোবাসার গ্রাম আইজ ধ্বংসের পথে।”

এবার জোহরা মুরব্বিদের উপরে কথা বলার সাহস পেলো না। সে এক দৃষ্টিতে সেহেরের দিকে তাকিয়ে আছে। তার শরীর যেন দাউ দাউ করে জ্বলছে। মুরব্বিরা কিছু কথা বলে চলে গেলো। তাদের পেছনে আবিদের বন্ধুরা মিলে রাফসানকে আলগা করে ধরে নিয়ে গেলো। তপা তৎক্ষনাৎ এসে সেহেরের গালে চড় লাগিয়ে দিয়ে বললো,

—“এই অপয়া মেয়ে আর কতো আমাদের সংসারে আগুন লাগাবি? এই পরিবারটা ধ্বংস করার জন্যে তো দেখছি উঠে পরে লাগছিস! কী চাস তুই স্পষ্ট করে বল তো? আর কতো খাবি এই পরিবারকে?”

এবার দাদীমা তপার গালে চড় লাগিয়ে দিলো। এতোই জোরে দিলো যে তপা তাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে বসে পরলো। সেহের নিশ্চুপ হয়ে কেঁদেই চলেছে। দাদীমা হুংকার ছেড়ে বলে,

—“নাগিন মাইয়া!! অপয়া তুই নাকি আমার ফুল? তোরা দুই মা মেয়ে এসেই তো আমার সংসারটারে নষ্ট করে দিছোস! দুইটা তো একই রক্তের বিষাক্ত ছোবলময়ী নাগিন! সাহস তো কম না আমার সামনে দাড়াইয়া আমার ফুলরে থাপ্পড় দেস! এমন মাইর মারমু না তোর ওই গিরিঙ্গিবাজ মায়ের নামও ভুইল্লা গিল্লা ফেলবি!”

তপা গালে হাত দিয়ে রেগে দাদীমার দিকে তাকিয়ে রইলো। জোহরা ছুটে এসে মেয়েকে উঠিয়ে দাঁড় করালো আর চরম রেগে বললো,

—“মা আপনি আপনার সীমানা পার করবেন না! আমার বাড়িতে এসে আমার মেয়েকে মারার সাহস কী করে হয়?”

—“আর তোর সাহস কেমনে হয় আমার ফুলরে কামের বেটির মতো খাটানের। শুধু কী খাটাস? আধমরা কইরা বাসা থেকেও বের করে দেস! মনে রাখিস এই বাড়ি আমার স্বামী নিজ হাতে তৈরি কইরা দিয়া গেছে তাই আমার তোর থেইকাও বেশি অধিকার আছে এই বাড়িতে। আগেই উচিত ছিলো এই চড় থাপ্পড়ের থেরাপি শুরু করা তইলে তোরা বেকটিনে লাডির মতো সোজা হইতি!”

—“মুখ সামলে কথা বলো বুড়ি! এক পা অলরেডি কবরের তলায় চলে গেছে তাও দেখছি তোমার তেঁজের শেষ নাই! আল্লাহ এতো ভালো ভালো মানুষরে নিয়া যায় আর এই কুটনি বুড়িরে নেয় না কেন?”

তপার কথায় দাদীমা চুপ করে থাকলো না আরেক থাপ্পড় বসিয়ে দিলো তপার গালে। হয়তো চুপ থাকতো এই কথায় কিন্তু তপা যে তার রক্ত না তাই তপার তেজ সে নিজেই ঘুচাঁবে! অনেকদিন পর এই সুযোগ পেয়েছে সহজে হাতছাড়া করবে না।

সা’দ বারবার ঘড়ি দেখছে আর এদিক সেদিক তাকাচ্ছে৷ সকলেই বিরক্ত এখন। রাগে সা’দের চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। কারীব দূরে কারো সাথে ফোনে কথা বলছে। কথা বলা শেষ হতেই কারীব দৌড়ে সা’দের কাছে আসলো। কারীব হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,

—“তুষার নাকি নিজের গাড়িতে করে নরসিংদী যাবে আর আমাদের অপেক্ষা করতে না বলে চলে যেতে বলেছে!”

এবার সা’দ যেন আরও রেগে গেলো। কপট রেগে শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো,

—“সেটা আগে বলে দিলে কী হতো? আমাদের রওনা হওয়ার কথা ছিলো ভোর সাড়ে পাঁচটায় আর ওই রাস্কেলটার জন্য ফুল ওয়ান আওয়ার লেইট! ফেমাস পাবলিক ফিগার বলে যা ইচ্ছা তা করবে নাকি? আমাদের কী মানুষ বলে মনে করে না? কীসের এতো অহংকার এর? রাস্কেল একটা!”

—“রিলেক্স স্যার! ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এমন দু-একটা ক্যারেক্টার থাকেই যারা পাবলিকের কাছে সৎ আর আমাদের মতো কর্মচারীদের সামনে ত্যাড়া! আমরা তো জানি এই মুখোশ পড়া মানুষগুলা কেমন ফাজিল!”

—“হয়েছে এখন সকলকে বলো যার যার গাড়িতে উঠতে, ২ মিনিটের মধ্যেই গাড়ি ছাড়বে। গো ফাস্ট!”

বলেই চোখে সানগ্লাসটা দিয়ে গাড়ির পেছনের সিটে বসে পরলো। কারীব এক কর্মচারীকে সবটা বুঝিয়ে দিয়ে নিজে এসে সা’দের গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে সিটবেল্ট বেঁধে নিলো। সা’দ একমনে বাইরের ভোরের শহরটা দেখছে ব্যস্ত। তুষার একজন প্রখর অভিনেতা। তরুণ প্রজন্মে তুষারের নাম যেন সকলের মুখে মুখে। তুষার সকলের সামনে ভালো ব্যবহার করলেও সে অতিরিক্ত অহংকারী এবং ঘাড়ত্যাড়া। এই ধরণের লোক ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে না থাকলে যেন হয়-ই না। সা’দ তার বাবার মুখে শুনেছিলো তাদের সময়ে একজন আকবর নামের একজন অভিনেতা ছিলো। এর ভাষা এবং চরিত্র নাকি জঘন্য ছিলোম কিন্তু পাবলিকের সামনে সে ভালো মানুষ। প্রতিদিন স্মোকিং আর ড্রিংকস না করলে যেন তার হতোই না। তাও সে কীভাবে কীভাবে যেন অভিনিয় জগতে জায়গা করে নেয়। মাঝেমধ্যে মাতাল হয়ে অভিনয় করলেও কেউ ধরতে পারতো না সে আসলে স্বাভাবিক নাকি অস্বাভাবিক। আকবরের একমাত্র পাবলিসিটির জন্যেই প্রডিউসার, ডাইরেক্টররা তাকে ফিল্মে নিতে বাধ্য হতো। এদিকে আকবরের মতোই এই তুষার। যাকে সহজ ভাষায় বলে, “জাতে মাতাল তালে ঠিক!” এই তুষারকে যেমন সা’দ সহ্য করতে পারে না তেমনই তুষার সা’দকে পছন্দ করে না। তুষারের সা’দকে পছন্দ না করার কারণ অবশ্য আছে। তুষারের গার্লফ্রেন্ড ছিলো নাম তার রাজিয়া। সে পেশায় একজন মডেল। সে কীভাবে সা’দের প্রেমে পরে গিয়েছিলো যার ফলে রাজিয়া এবং তুষারের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এই একটা ঘটনার জন্যই তুষার সা’দকে সহ্য করতে পারে না। চাইলে বড়রকম শোধও নিতে পারতো কিন্তু পাবলিকের সিমপ্যাথির জন্য সে কিছুই করতে পারে না। তবে সে মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করেই স্টেপ ভুল করে। এতে করে সে পৈশাচিক আনন্দ পায়।

চলবে!!!