Friday, July 18, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1373



দখিনা প্রেম পর্ব-০৪

0

#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ০৪ ||

সেহের নিশব্দে মরিচা ধরা গ্রিলটা ধরে আকাশের পানে তাকিয়ে রয়েছে৷ মনে তার কালো মেঘের গর্জন দিচ্ছে, মেঘের অশ্রু তার চোখজোড়া বেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পরছে। কিছুক্ষণ আগেই তপা শুধু শুধু সৎমার হাতে চড় খাইয়েছে সাথে নিজের জম্ম পরিচয় নিয়েও অনেক বাজে কথা শুনেছে তাও নিজের জম্মদাতা বাবার সামনে যা সেহেরের সহ্যের সীমানার বাইরে। তপা কেন তাকে সহ্য করতে পারে না তা সেহের না। সেহের আকাশের পানে তাকিয়ে ভাঙ্গা গলায় বলে উঠলো,

—“মা! ও মা। আমার কষ্ট দেখতে পাচ্ছো মা? কেন আমায় এই নরকে ফেলে চলে গেলে? কেন মৃত্যুর আগে ওয়াদা করিয়ে গেলে বাবা এবং সৎমায়ের খেয়াল রাখ নিয়ে? কেন রিমনের জন্য এ বাড়িতে থাকার ওয়াদা দিলে মা? তোমার ওয়াদার কথা কাউকে মুখ ফুটে বলতেও যে পারি না মা। আমার অপরাধ কী মা? কেন সবাই আমার উপর এমন অত্যাচার করে?

মা তুমি বলেছিলে না আমি তোমার সুন্দর সকালের লাল টুকি ফুল। তাহলে তোমার এই ফুলটার কপালে সুখ কেন লেখা নাই মা? আর বাবা? আমার বাবা থাকতেও আমি এতিম, আমার জম্ম নিয়ে বাজে কথা শুনতে হয়!”
বলেই ডুঁকরে কেঁদে উঠলো সেহের। কিছুক্ষণ কেঁদে আপনমনে বলে উঠলো,

—“মা জানো আমার মাঝে মাঝে এই নরক ছেড়ে অনেক দূরে চলে যেতে ইচ্ছা হয়, অনেক দূর! কিন্তু পারি না গো মা! তুমি যেমন আমার কাছে প্রয়োজন ঠিক তেমনই তোমার কথা। তাইতো যেদিন সৎমা এসে তোমার ওয়াদার কথা বললো সেদিন থেকে চাইলেও এই বাড়ি আর বাবা, রিমনকে ফেলে চলে যেতে পারিনি।”

সেহেরের কান্নার মাঝেই সে রিমনের কন্ঠ শুনতে পেলো। দরজার ওপারে রিমন ধাক্কাচ্ছে আর বারবার আপু আপু বলে ডাকছে।

—“আপু আপু! কী হলো দরজা লাগালে কেন আপু? খাবে না তুমি?”

—“আর খাওয়া! ভাইরে কবে পেট পুড়ে খেয়েছি আমার কনে পরে না রে। এই জীবনটা যে আমার বড্ড কঠিন।” আপনমনে বিড়বিড় করে বললো সেহের।
রিমনের আবার হাক শুনতে পেতেই সেহের নিজেকে স্বাভাবিল করে ভাঙ্গা গলায় বললো,

—“ভাই আমি খেয়ে নিবো। তুই গিয়ে ঘুমিয়ে পড় ভাই কাল যে তোর স্কুল আছে!”

—“আচ্ছা আপু। তুমি তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যেও আর মনে করে খেয়ে নিও। আসছি।”

বলেই রিমন দরজার সামনে থেকে সরে নিজের ঘরে চলে গেলো। দূর থেকে তপা সবটা দেখতে পেলো। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে তপা আপনমনে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,

—“ঢং দেখলে বাঁচি না।”

—“কীরে তপা খাবি না মা?”

—“খেয়েছি মা তুমি গিয়ে ঘুমাও।”

বলেই একপ্রকার রাগ দেখিয়ে উপরে চলে গেলো। সৎমা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। বয়স যতো বাড়ছে তার আলসামো যেন সেই হারে বেড়েই চলেছে। ছেলে-মেয়ে, সংসার এসব সামলানোর সময় কই? সে নিজে বিশ্রাম নিতেই যে ব্যস্ত। স্বামী কি করছে না করছে সেটা নিয়েও চিন্তা করে না। সবটা সামলাতে আছে তো সেহের। এইজন্যই সৎমা কখনো সেহেরের বিয়ের কথা উঠায়নি। সেহের চলে গেলে যে সে রাজরানীর মতো শুয়ে-বসে কাটাতে পারবে না।

সা’দ একটা সুন্দর বাগানে বসে প্রকৃতি বিলাস করছে। কিছুক্ষণ আগেই শুটিং সেরে সবে বিশ্রাম করতে বসলো। নানান ফুলের সুঘ্রাণে চারিপাশটা মৌ মৌ করছে। কিছু কিছু ফুলের ওপর দিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতি উড়ছে নাহয় ফুলের উপর বসে খাদ্য পান করছে। নীল আকাশ তার মাঝে ভ্যালার মতো টুকরো টুকরো মেঘ। এ যেন বসন্তের সুখবর। হঠাৎ অদূরে সা’দ খেয়াল করলো এক অপরূপ হুরপরী আকাশ থেকে নামছে। চেহারা থেকে যেন রূপের ঝলকানি উপড়ে পরছে। সা’দ মুগ্ধ নয়নে সেই কন্যাটিকে দেখছে। কন্যাটির রূপের ঝলক যেন সা’দকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। মেয়েটির দীঘল রেশমি কেশ অবাধ্য হয়ে বাতাসের তালে উড়ছে। মেয়েটি অতি যত্নে নিজের অবাধ্য কেশ সামলাচ্ছে। সা’দের দেখা যেন শেষই হচ্ছে না। এই মুহূর্তে সা’দের ইচ্ছে করছে সময়টা থেমে যাক। এই মায়াবী আর স্নিগ্ধময়ী চেহারা দেখে প্রাণ জুড়াচ্ছে না তার। মনে হচ্ছে সারাজীবন সে এই মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকলেও তার দেখার তৃষ্ণা মিটবে না। মেয়েটি মাটিতে পাড়া দিতেই সব ফুল উড়ে তার চারপাশটা ঘিরে সুঘ্রাণ ছড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই সুঘ্রাণ সা’দের নাকেও এসেছে। হঠাৎ ফুলগুলো শুকনো পাতার মতো শুকিয়ে মাটিরে পড়ে গেলো। চারপাশে নীল আকাশ যেন অন্ধকারে ঢেকে গেলো আর বড়ো বড়ো বিজলি পরতে শুরু করলো। সাথে সাথে চারপাশের সকল ফুলগাছে মরে নেতিয়ে গেলো। বাজের বিকট শব্দে মেয়েটি কানে হাত দিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো। এবার সা’দ উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালো। চোখের পলকে এসব হলো কী করে সেটাই ভেবে চলেছে সে। পায়ে তরল কিছু অনুভব হতেই সা’দ পায়ের দিকে তাকালো। একি! এ যে রক্ত! সা’দ ভীতদৃষ্টিতে চারপাশে তাকালো। পুরো মাটি রক্তের পুকুরে পরিণত হয়েছে আর এই রক্ত সব মেয়েটির থেকেই আসছে। এবার মেয়েটি মাথা উঁচু করে সা’দের দিকে তাকালো। ছলছল দৃষ্টি নিয়ে চাপা গলায় বলে উঠলো,
—“আমায় এই নরক থেকে মুক্ত করুন সা’দ সাহেব! ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।”
বলেই মেয়েটি অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো।

সা’দ লাফ দিয়ে ঘুম থেকে উঠে বসলো। ভীষণ হাঁপাচ্ছে সা’দ। সা’দ আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সে তার ঘরে তারই বিছানায় শুয়ে। এসি চলছে তাও সা’দের খুব উষ্ণতা অনুভব হচ্ছে। কপাল থেকে চুল সরাতে যেতেই খেয়াল করলো সা’দ ঘেমেও গেছে অনেক। সা’দ চটজলদি বালিশের পাশে থেকে এসির রিমোটটা হাতে নিয়ে এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিলো। রিমোটটা রেখে পাশের বেডবক্স থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে ঢকঢক করে সবটা খেলো। সা’দের অস্থিরতা যেন কাটছে না। কে ছিলো সেই মেয়ে? সা’দ মেয়েটার চেহারা মনে করার চেষ্টা করলো কিন্তু সে ভুলে গেছে। সা’দ ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো। আবছা আলোয় বেশ বোঝা গেলো ঘড়ির কাটাটা ৩টার মাঝেই আছে। সা’দ এসব চিন্তা সাইডে ফেলার চেষ্টা করে আবার শুয়ে পরলো কিন্তু তার অনাকাঙ্ক্ষিত ঘুম সহজে ধরা দিলো না। ঘুম যেন স্বপ্নের সাথে পালিয়েছে। স্বপ্নের মেয়েটা কেন যেন সা’দকে বড্ড পোড়াচ্ছে। স্বপ্ন তো স্বপ্নই! তাও কেন তার এতো ছটফটানি? অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারলো না। তাই সে উঠে বেলকনি গিয়ে কিছুক্ষণ পায়চারী করলো। তাও তার ঘুম আসছে না। অবশেষে আযান দিলো। সা’দ বেলকনি থেকে ওউ করতে চলে গেলো। নামাজ পড়ে, জগিং শেষ করে বাসায় আসতেই দেখলো তার মা সবে ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরে যাচ্ছে। সা’দ ক্লান্তি সুরে বললো,

—“মা কফি পাঠিয়ে দিও তো সাত টার মধ্যে বেরোতে হবে, কারীবও সাড়ে ছ’টা নাগাদ চলে আসবে!”

—“আয়হায় সে কী বলিস? আমি তো এখনো রান্নাই করলাম না। আর এখন তো ছ’টা বাজছে।”

—“আরে মা এতো উতলা হওয়া লাগবে না। সার্ভেন্টকে দিয়ে রাঁধিয়ে নিয়েছি। এখন জলদি কফি পাঠাও।”

বলেই সা’দ উপরে চলে গেলো। রাতে না ঘুমানোর ফলে সা’দের মাথা ধরে আছে সাথে রয়েছে চোখের অসম্ভব জ্বালা। ঠিক সাড়ে ছ’টায় কারীব এসে হাজির হলো। সা’দ আর কারীব একসাথে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে গেলো। মা জেগে থাকলেও বাকিরা এখন ঘুম। রুবাই আর সা’দের বাবা ৮-৯ টায় উঠে। তাদের অফিস ১০ টায়। রুবাই অর্ধেক রাত নিজের হাসবেন্ডের সাথেই কথা বলে কাটিয়ে ফেলে। রুবাইয়ের বিয়ে হয়েছে আরও ৪ বছর আগে। রুবাইয়ের হাসবেন্ড তানজীল ইতালিতে বিজনেসে আছে আর সেখানেই তানজীল থাকে। সা’দের বাবার বিজনেস পার্টনার ছিলো তানজীল। একবার বাংলাদেশের এক পার্টিতে রুবাইকে দেখে পছন্দ করে বসে। এর কয়েকদিনের মাঝেই সে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। তানজীলের বাবা-মা নেই তবুও তানজীলের ব্যবহার খুবই ভালো ছিলো। তাই পরিবার থেকে সকলে রাজি হয়ে যায়। রুবাই তখন কোনো অমত করেনি কারণ তার পছন্দের মানুষ ছিলো। তাদের বিবাহিত জীবন ভালোই চলছিলো, তানজীল রুবাইকে ইতালিতে নিয়ে সেটেল হয়। এর কয়েকমাস পরেই জানতে পারে রুবাই কনসিভ। এই সুখবর শুনে সেদিনই সা’দের বাবা-মা ইতালির উদ্দেশ্যে রওনা হয় কিন্তু সা’দের শুটিংয়ের প্রেশার থাকায় যেতে পারেনি। তখন সা’দ একদমই নতুন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তাই নিজেকে প্রমাণ করতে তখন তার উপর দিয়ে বেশ চাপ যেতো। তবে বিপত্তি ঘটে আরেক জায়গায়।
রুবাইয়ের প্র‍্যাগন্যান্সির ৫ মাসে একটা এক্সিডেন্টে সে তার বাচ্চাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলে। সাথে হারিয়ে ফেলে নিজের মা হওয়ার আনন্দ। সেদিন ডক্টর বলেছিলো রুবাই আর কোনোদিন মা হতে পারবে না। একজন নারীর জন্য এর চেয়ে বড় জঘন্য যন্ত্রণা কী-ই বা হতে পারে? রুবাই তখনো ধৈর্য ধরে চুপ করে ছিলো। বিদেশের মাটিতে তানজীল নামক আপনজন ছাড়া যে তার আর কেউ নেই। সারাদিন রুবাই একা রুমে পরে থাকতো। তানজীল প্রথম কিছুদিন রুবাইকে সময় দিতে পারলেও পরে অফিসের কাজের জন্য তাকে রাত করে ফিরতে হয়। এই একাকিত্ব জীবনে তার দুঃখ যেন আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিলো। তাই রুবাই সিদ্ধান্ত নেয় সে বাংলাদেশ নিজের বাসায় থাকবে। আপনজন ছাড়া তার পক্ষে এখানে থাকা একদমই অসম্ভব। তানজীলও অমত করেনি। তানজীল এমন একটা মানুষ সে রুবাইকে বুঝে ফেলে। ১ সপ্তাহর মাঝেই রুবাই বাংলাদেশ আসে। আর তানজীল রুবাইকে কথা দেয় সে বাংলাদেশে সেটেল হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করবে। সেদিন থেকে তানজীল দিনরাত চেষ্টা করে গেছে নিজের অফিস এখান থেকে বাংলাদেশে ট্রান্সফার করার জন্য। কিন্তু ইতালির নানান ঝামেলা শেষ করতে করতেই তানজীলের চার বছর পেরিয়ে গেছে। অবশেষে সে ছ’মাস পরেই বাংলাদেশে সেটেল হতে পারবে। তবে মাঝেমধ্যেই প্রিয়তমার সাথে সময় কাটাতে তানজীল দেশে আসতো। রুবাই দেশে আসার পর থেকে বাবার সাথেই সে আবার তাদের বিজনেসের হাল ধরে। আর সা’দ! সে তো কোনোকালেই এমুখো হয়নি। সে সবসময় তার ইচ্ছাকেই প্রায়োরিটি দিয়ে এসেছে। ৩টা বছর এতো বুঝোনোর পরেও সা’দ রাজি হয়নি। সে নিজের কথা থেকে ১ ইঞ্চিও এদিক সেদিক হয়নি।

—“আর কতোদিন এসব অন্যায়-অবিচার সহ্য করবি তুই? তোর মাঝে কী রাগ নেই প্রতিবাদ করার মতো? কী করে পারিস কথায় কথায় ওইসব অমানুষগুলোকে ক্ষমা করে দিতে?” কপট রেগে কথাগুলো বললো মানজু। সেহের নিজের মুখের মুখোশ ঠিক করতে করতে ম্লান হেসে বলে,

—“চেরি কার্টার-স্কট কী বলে জানিস? উনি বলেছেন ‘রাগ আপনাকে আরও ছোট করে তোলে, এবং ক্ষমা, আপনি যা তার থেকেও বড় করে।’

—“হইসে তোর এইসব ভংচং উক্তি আমাকে শোনাতে আসবি না। ক্ষমা মহৎ গুণ সেটা সবাই জানে! কিন্তু সকলকে বারবার ক্ষমা করতে নেই। ক্ষমা তাকেই কর যে তোর ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য।”

—“উফ কী শুরু করলি বল তো? এমনিতেই গরমের তাপে অনবরত ঘামছি আর তুই বাবা আর মাকে বকছিস!!”

—“এই মেয়ে আমি কী শুধু শুধু চেঁচাই? তোর ওই মাতাল বাপরে তো আমার মাগুর মাছে খানা বানাইতে ইচ্ছা করে! ওই অমানুষটার জন্যই তো তোর মুখোশ বাঁধতে হইসে। গরম খুন্তির কালচে দাগ তো এখনো তোর মুখ, থুতনি আর ঠোঁটের চারপাশে রইসে। বিশ্বাস কর একবার সামনে পাই। এক্কেবারে স্যান্ডেল ফিক্কা মারমু!”

—“তোর বকবকানি হলে এখন আসতে পারিস আমার যেতে হবে!”

—“যাবি মানে কই যাবি?”

—“দাদীর কাছে। সেদিনের পর তো বাসা থেকে বের হতে পারি নাই, আজ কলেজ আসছি এই একটা সুযোগ!”

—“তোর বইন তপায় যদি তোর নামে বিচার দেয়?”

—“তপা আপু তো আজ কলেজ যায়-ই নি। সে তো মনে হয় এখনো ঘুমাচ্ছে।”

—“এক সেকেন্ড তুই ওরে আপু ডাকিস কেন? তুই না ওর বড়?তুই তো সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী আর ওই তপা তো সবে ম্যাট্রিক দিয়া ইন্টারে উঠসে।”

—“ওসব কিছু না। সে বলে দিয়েছে তাকে যেন আপু ডাকি। আর ডাকলেই বা সমস্যা কী? ছোট বড় সকলকেই আপু ডাকা যায়!”

সেহেরের কথায় মানজু যেন আরও রেগে বোম হয়ে গেলো। সে রেগে উচ্চসরে বলে উঠে,

—“তোর আপুর গুল্লি মারি! চ্যাঙ্গা মাইয়ারে আপু ডাকে! এই দুনিয়ার তোর মতো বলদ এই এক পিসই আছে। কেমন পারিস তুই ফুল? যেখানে তোরে কেউ রেসপেক্ট করে না সেখানে কি না তুই মরতে যাস! যা ইচ্ছা কর আমি তোর সাথে আর নাই? যা গিয়ে আরও ঝাটার বাড়ি খা।”

বলেই মানজু সেহেরকে রেখেই উল্টোদিকে হাঁটা ধরলো। সেহের নিশ্চুপ হয়ে মানজুর যাওয়া দেখছে। মানজু আগেও এমন রাগ দেখিয়ে কথা বলেছিলো তবে তার রাগ বরফের মতোই খুব জলদি-ই গলে যায়। রাগ যেতেই মানজু সেহেরের কাছে এসে তার গলা জড়িয়ে বসে কাঁদো কাঁদো গলায় কথা বলতে শুরু করে দেয়। সেহের আপাতত সেই মুহূর্তেরই অপেক্ষায় আছে। ভাবতেই সেহের মুখোশের আড়ালেই মিষ্টি হাসি দিলো। এই একজন সখী সেহের বেশ ভাগ্য করে পেয়েছে। এই একটা মানুষই তার সুখ দুঃখের ভাগীদার হয়। কিন্তু সবাইকে কী তার ভেতরের কষ্টটা বলা যায়? সেহের একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জেঠুর বাসার দিকে চলে গেলো।

দাদী সেহেরকে অনেক সময় নিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলো আর চাপাস্বরে কাঁদছিলো। সেহেরকে সে একবারের জন্যেও ছাড়েনি। এতো করে সেহের সামলানোর চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতেই সফল হলো না। দাদীমা বিলাপ করতে করতে শুধু কেঁদেই যাচ্ছিলেন। আবারও সেহেরের সুখাবারের দেখা মিললো। কারেন্ট না থাকায় চাচী সেহেরকে বাতাস করছিলো আর সেহের তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছিলো। হাঁসের মাংস, মিনি চিংড়ি মাছের ভর্তা, লাল শাক সাথে শশা, পেঁয়াজ, টমেটোর সালাদ। জম্পেশ খাওয়া হলো সেহেরের। খাওয়া শেষ হতেই সুখের ঢেকর তুললো সে। নাতনীর মুখে তৃপ্তির হাসি দেখে দাদীমার প্রাণ যেন জুড়িয়ে গেলো। হাত ধুঁয়ে বসে ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো দেরী হয়ে গেছে। সেহের তৎক্ষনাৎ গামছা দিয়ে হাত মুখ মুছে সকলকে বিদায় দিয়ে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পরলো। সেহের থাকাকালীন আবিদকে দেখতে পায়নি। হয়তো কোনো কাজে বাসার বাইরে ছিলো। সেহেরদের বাসা জেঠুর বাসা থেকে বেশি দূরে নয় জাস্ট ১৫ ধাপের পথ। তবে সেহের বাড়িতে না গিয়ে আগে পুকুরপাড়ে গেলো। পুকুরপাড় থেকে নরম কাঁদামাটি নিয়ে কোনোরকম নিজের জামার কিছু অংশে লাগিয়ে নিলো। লাগানো শেষ হতেই পুকুরের পানিতে হাত ধুঁয়ে আল্লাহর নাম নিতে নিতে বাসার দিকে গেলো।
বাসায় গিয়ে দেখে বাঁশের সোফায় পায়ের উপর পা তুলে টেলিভিশন দেখতে ব্যস্ত তার সৎমা। সেহের একটা শুকনো ঢেঁকুর তুলে বিড়বিড় করে “বিসমিল্লাহ” বলে বাসায় প্রবেশ করলো।

সৎমা কোণা চোখে সেহেরের দিকে তাকিয়ে আবার টেলিভিশিনের দিকে তাকালো। হঠাৎ কী মনে করে টিভি বন্ধ করে রিমোটটা রেখে সেহেরের দিকে ফিরলো। সেহের চুপচাপ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আজ আবার বোম ফাটবে যা সেহের বেশ ভালোভাবে বুঝতে পারছে।

—“কীরে নবাবের ঝিঁ! ভরদুপুরে কই গেছিলি? ঘরে যে কতোডি কাম আছে সেইগুলা দেখছিলি? ছাগলের বাচ্চা! আমার খাস আমার পড়োস আবার আমার টাকায় আনন্দ ফূর্তি করতে গেছিল! হারামজাদী!”

—“মা! বাবা ডেকে পাঠিয়েছিলো খালের দিকে। জালে পাথর বাঁধানোর জন্য। দেখো আমার জামাতেও কাঁদা লেগে আছে!” সৎমার কথা শেষ করতে না দিয়ে সেহের বললো। ছলছল দৃষ্টি নিয়ে জামার কাঁদা লাগা অংশটুকু দেখালো সৎমাকে।
কাঁদা দেখে উনি কিছুটা নরম হলেন। তাও গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন,

—“আচ্ছা বুঝলাম। এহন যা থালাবাসন আর জামা-কাপড় ধুঁয়ে দে। এগুলা শেষ হইলে উপর তলা মুছবি! আজ আমার ভাগনে আইতাসে! তার আপ্যায়নে যাতে কোনো ত্রুটি না থাকে।”

বলেই উঠে চলে গেলো। এদিকে ভাগনের শুনে সেহের কেঁপে উঠলো। সৎমায়ের ভাগনের নাম রাফসান। লুচ্চামিতে মাস্টার সে। সেহেরকে সে নানানভাবে উত্ত্যক্ত করার ধান্দায় থাকে আর সবার সামনে নিষ্পাপ বান্দার মতো থাকে। রাফসানকে সেহেরের দু’চোখে সহ্য হয় না। সৎমা যাওয়ার আগে বলে গেলো,
—“আর হ্যাঁ৷ বেসিনের ধারে পান্তাভাত রাখসি, কালকের বাঁশি তরকারির আলু পটল ছিলো সেগুলা দিয়া খাইয়া নিস!”

সেহের উত্তরে শুধু মাথা নেড়েছিলো। ব্যাগটা রুমে গিয়ে রেখে একটা লম্বা গোসল দিলো। গোসল শেষ করে রুম থেকে বেরিয়ে সৎমায়ের রুমের দিকে গেলো। রুমে গিয়ে দেখে সৎমা ঘুমে কুপোকাত। সেহের আস্তে করে দরজা ভিঁজিয়ে দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো। তার তো পেট পুরো ভরা এসব খাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। আবার এই পান্তাভাত পরে থাকলে আরও খারাপ কথা শোনা লাগবে। সেহের ভেবে পাচ্ছে না সে এখন কী করবে। পরমুহূর্তে কিছু একটা মনে হতেই একটা কড়াইয়ে পান্তাভাত নিয়ে বাড়ির পেছন দিকে চলে গেলো৷ দূরে একটা কুকুর দেখতে পেতেই কিছুটা ঝোঁপে গিয়ে পান্তাভাত ফেলে দিলো। পান্তাভাত ফেলা দেখে কুকুরটা দৌড়ে ঝোঁপের কাছে চলে আসলো। খাবার পেয়ে চটজলদি খাওয়া শুরু করলো। সেহের হাঁটু গেড়ে বসে কুকুরটার খাওয়া দেখছে। কুকুরটা তৃপ্তি নিয়ে খেয়ে লেজ নাড়তে নাড়তে জিহবা দিয়ে ফাস ফাস করে কিছুক্ষণ সেহেরের দিকে তাকিয়ে চলে গেলো। সেহেরও নাটিটা নিয়ে ভেতরে চলে এলো। থালাবাসন ধুঁয়ে উঠে দাঁড়াতেই রিমন এসে হাজির হলো,

—“বুবু বুবু একটা লোক কুলফির আইসক্রিম এনেছে?”

—“মানে?” অনেকটা অবাক হয়ে বললো সেহের।

—“আরেহ! মানে হলো ওইযে স্কুলের সামনে যে কুলফিওয়ালা কুলফি আইসক্রিম বিক্রি করতো উনি আমাদের বাসার এদিকে আসছে। চলো না কুলফি কিনে দাও ”

—“টাকা কই পাবো ভাই?”

—“আমার কাছে জমানো কিছু টাকা আছে তুমি চলো।”

—“না আরে ভাই তুই একা গিয়ে কিনে আন। মা একবার টের পেলে আমাকে আস্ত রাখবে না!”

—“আরে ধুর কিছু হবে না আসো!”

বলেই সেহেরের হাত ধরে টানতে টানতে বেরিয়ে গেলো। সেহের এতো বলেও রিমনকে থামাতে পারেনি। শেষে সেহেরকেই কিনে আনতে হলো রিমনের জন্য দুইটা কুলফির আইসক্রিম। রিমন একটা নিয়ে অপরটা নিলো না। সেহের ভ্রুজোড়া কুচকে বললো,

—“একটা নিলি কেন ভাই এটাও নে আর জলদি খা। যা কাঠফাটা রোদ গলে যাবে তো।”

—“ওটা তোমার জন্য আপু তুমি খাও!”

—“আমার জন্য মানে?”

—“আহ বুবু! এতো মানে মানে করো কেন? তুমি আর আমি মিলে খাবো দেখেই তো দুটো কিনেছি।”

সেহের আর কী বলবে। গরমে তারও আইসক্রিম খেতে ইচ্ছা করছিলো তাই সে নিজেও খেলো। খাওয়া শেষ করে পানির মটর ছেড়ে জামা-কাপড় ধোঁয়ার জন্য ছাদে গেলো। ছাদের এক কর্ণারে কল আর সাথে জামা+কাপড় ধোঁয়ার জায়গা করা আছে। সকালে অনেকটাই ধুঁয়ে ফেলেছিলো সে তাই এখন ২-৪টা জামার বেশি নেই। সেহের আধোঁয়া জামা-কাপড়সহ জরুরি সাবান বালতি মগ নিয়ে ছাদে চলে আসলো। ছাদের কর্ণারে বসে জামা-কাপড় কাচাকাচি করে শুকোতে দিয়ে দিলো। কাজ করতে করতে সেহের ক্লান্ত হয়ে বসে পরে। রোদের তাপ এখনো কমেনি। গরমে সেহের ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম মুছলো।

—“স্যার আপনার কফি!”

সা’দ ফোন থেকে চোখ সরিয়ে মাথা উঁচু করে কর্মচারীর দিকে তাকালো। কর্মচারীর হাতে কফি দেখে সা’দ ভ্রু কুচকে বললো,

—“আমি তো কফি চাইনি! তাহলে হঠাৎ?”

—“কারীব স্যারই তো পাঠালো।”

—“ওহ আচ্ছা। তাহলে সেন্টার টেবিলে রেখে চলে যাও।”

কর্মচারী মাথা নাড়িয়ে কফির মগটা রেখে নিজের কাজে চলে গেলো৷ সা’দ না চাইতেও কফিটা নিয়ে মুখে দিতে যেতেই তার হঠাৎ চোখ গেলো অদূরে দাঁড়ানো অভিনেত্রী সিনথিয়ার দিকে। সিনথিয়া রহস্যময় হাসি দিয়ে সা’দের দিকে তাকালো। সা’দ তার দিকে তাকাতেই সিনথিয়া জলদি হাসি থামিয়ে অন্যদিকে তাকালো আর এমন ভাব ধরলো যে সে খুব ব্যস্ত। সা’দের সন্দেহ হলো তাই সে সিনকথিয়ার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে সেন্টার টেবিলে একটা প্লেটে থাকা চামচ হাতে নিয়ে কফিতে ঢুকালো। কিছুক্ষণ আলতোভাবে নেড়ে চামচ উঠিয়ে দেখলো চামচে সাদা সাদা কিছু ছোট কণা। সা’দ ভ্রু কুচকে শব্দহীন হাসি দিলো। তখনই কারীব দৌড়ে এসে বললো,

—“স্যার কাল না আমাদের নরসিংদী শুটিং আছে! আজ রাতেই তো রওনা হতে হবে।”

কারীবের একটা কথাও সা’দের কানে ঢুকেছে বলে মনে হয় না। কারীবের আর কিছু বলার আগেই সা’দ এক কর্মচারীকে ডেকে কী যেন বললো। কর্মচারী মাথা নাড়িয়ে কফির মগটা নিয়ে চলে গেলো।

সিনথিয়া মেকাপ ঠিক করছিলো তখনই এক কর্মচারী তার সামনেই পা মচকে যায় যার ফলে সব কফি সিনথিয়ার ড্রেসে গিয়ে পরে। ভাগ্যিস কফিটা ঠান্ডা ছিলো। এই দৃশ্য দেখে সা’দ নিশব্দে হাসলো। সিনথিয়া সাংঘাতিক রেগে উঠে দাঁড়ালো। কর্মচারী তার ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়ে বারবার সরি বলতে লাগলো। অবস্থা খারাপের দিকে যাওয়া পূর্বেই সা’দ সেদিকে গিয়ে সিনথিয়া আর কর্মচারীর মাঝে ঢুকে বললো,

—“মিস সিনথিয়া আপনার নেক্সট শিডিউলে তো ড্রেস চেঞ্জ করার কথা আপনি তা না করে এখানে দাঁড়িয়েছেন কেন?”

—“মিস্টার সা’দ দেখুন আপনার কর্মচারী কীভাবে আমার ড্রেসটা নষ্ট করলো! এদের তো ম্যানারলেস বলতে কিছুই নেই! আপনি কী এমন ভেবে এই মূর্খগুলোকে কাজে রেখেছেন!”

—“ড্রেসে কফি ফেলেছে সো হোয়াট? আপনিও যেমন মানুষ ওরাও তেমন মানুষ! আপনি যদি শুটিং এ গিয়ে মিস্টেক করেন তো ওরা এখানে ছুটাছুটি করতে গিয়ে মিস্টেক হতেই পারে সিম্পল। মানুষ মাত্রই ভুল! আর আপনি সেখানে ভালোভাবে ইটস ওকে না বলে লেইম ওয়ার্ড ইউস করে চলেছেন। আপনার অভিনয় যেমন পেশা তেমনই ওদের পেশা আছে। সো সব পেশাকে উঁচু নিচু না দেখে সমানভাবে রেসপেক্ট দিন। আপনাদের দৃষ্টির ছোটখাটো কর্মচারীর জন্যই আপনারা এতো উঁচুতে গিয়ে পৌঁছতে পারেন সো রেসপেক্ট দেম! নাও নো মোর ওয়ার্ড গো ফাস্ট এন্ড লিভ দিস টপিক!”

কর্মচারীসহ সকলে যে যার কাজে গেলো। সিনথিয়া নিজের ড্রেস ঝাড়তে ঝাড়তে সা’দের পাশ কেটেই যাচ্ছিলো তখনই সা’দ হালকা সুরে বলে উঠলো,

—“কফিতে আরও ভালো করে স্লিপিং পিলটা মেশানো দরকার ছিলো আপনার!” বলেই বাঁকা হাসল্প সা’দ। সিনথিয়া থেমে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে সা’দের দিকে তাকালো! পরে সা’দের কথার মানে বুঝতে পেরে মন খারাপ করে বলে,

—“একটাবার বেডপার্টনার করলে কী হয় সা’দ? জাস্ট ওয়ান নাইট!”

আবারও হাসলো সা’দ। হাসতে হাসতেই বললো,

—“আপনাদের মতো নিচ মানুষদের বেড পার্টনার বানাবো? হা হা নো ওয়ে! আমার বেড পার্ট অনলি আমার ফিউচার ওয়াইফ হবে।”

—“আমাকে কী সুযোগ দেয়া যায় না?”

—“একদমই না। আপনার মতো লুজার আর চিফ মাইন্ডেড মেয়েদের না কোনোদিন পাত্তা দিয়েছি আর না কোনোদিন দিবো। মাই জার্নি ফর অনলি ওয়ান পার্সন যার পুরোটা মন জুড়ে থাকবো আমি শুধু আমি! যার মনে থাকবে না কোনো নোংরামির চিহ্ন! আন্ডার্স্ট্যান্ড?”
সিনথিয়া রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চেঞ্জিং রুমের দিকে হনহনিয়ে চলে গেলো।

রাফসান এসেছে মিনিট পাঁচেক হবে। সেহের কিচেনে হাতে চা আর বিস্কুটের ট্রে নিয়ে থরথর করে কাঁপছে। রাফসানের লালসার দৃষ্টি সেহেরের একদম পছন্দ নয়। রাফসান বারবার তাকে বিভিন্নভাবে বাজেভাবে ছোঁয়ার চেষ্টা করে কিন্তু সেহের বারবার তাকে এড়িয়ে চলে। সোফার ঘর থেকে সৎমার হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। তখনই বিকট চিৎকার দিয়ে সৎমা বলে উঠে,

—“কীরে সেহের এতক্ষণ লাগে নাকি চা-বিস্কুট নিয়া আইতে?”
সেহের একটা লম্বা শ্বাস ফেলে আল্লাহকে ডেকে কিচেন থেকে বেরিয়ে আসলো। সামনের রুমে এসে দেখে তপা মা এবং রাফসান বেশ হেসে হেসে কথা বলছে। সেহেরের দিকে চোখ যেতেই কেমন বিশ্রীভাবে সেহেরকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত দেখতে লাগলো। সেহের না তাকিয়ে বুঝতে পারছে রাফসান তার দিকেই তাকিয়ে। সেহেরের প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে তাই সে ট্রে-টা টি-টেবিলে রেখে চলে আসতে নিতেই রাফসান বলে উঠলো,

—“লেবুর শরবত হবে সুন্দরী?”

রাফসানের এমন কথায় সেহের থম মেরে দাঁড়িয়ে গেলো। সেহেরকে সুন্দরী বলায় তপা মুখ বাঁকা করে বিরক্তির সুরে বললো,

—“ওকেই তোমার সুন্দরী লাগে ভাইয়া। কই আমাকে তো কখনো সুন্দরী বললে না?”

রাফসান হেসে তপার গাল টেনে বললো,

—“তুই তো সুন্দরী বটেই তবে অল্প।”

—“কীরে সেহের এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ছেলেটা মুখ ফুটে শরবতের কথা বললো আর তুই দাঁড়িয়ে আছিস? যা গিয়ে শরবত বানা!”

—“জ্বী মা!”

বলেই দ্রুত সেই ঘর ত্যাগ করলো সেহের। ঘৃণায় সব কেমন তা গুলিয়ে যাচ্ছে। তার মন বারবার বলছে আজ খারাপ কিছু ঘটবে। সেহের মাথা উঁচু করে চোখ বুজে মনে মনে দোয়া করতে লাগলো,

—“হে মাবুদ আপনি আমার আগমন বিপদের হাত থেকে রক্ষা করুন। এই রাফসান ছেলেটার হাত থেকে আমায় বাঁচাও!”

চলবে!!!

দখিনা প্রেম পর্ব-২+৩

0

#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ০২ +০৩||

—“বসন্তী সুন্দর সকালে ফুল হয়ে নিজের অস্তিত্বের সুঘ্রাণ ছড়িয়ে দিয়েছিলি তুই সেহের। তাইতো তোর নাম রেখেছিলাম ‘সেহের’! সেহের শব্দের অর্থ সুন্দর সকাল ঠিক যেমন তুই। এভাবে সুন্দর সকালের মতো মিষ্টি আলো ছড়িয়ে দে মা। আমার দোয়া তোর সাথে সবসময় থাকবে। আসি রে…!”

বলেই সেহেরের মা অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো। আর সেহের অন্ধকারে হাঁতড়ে হাঁতড়ে তার মাকে ডাকছে আর কান্না করে যাচ্ছে।
একসময় “মা” বলে চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে উঠলো সেহের। সেহেরের পুরো শরীর ঘেমে একাকার। জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে বারংবার। চোখের কোণও অশ্রুতে ভিজে গেছে। সেহেরের চিৎকার শুনে দাদীমাও হুড়মুড় করে শোয়া থেকে উঠে বসলো আর উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলো,

—“কী হইলো ফুল এভাবে চিৎকার দিলি ক্যান? দুস্বপ্ন দেখছিস? থাক কিছু হইবো না আয় ঘুমানোর চেষ্টা কর আমি ঘুম পাড়ায় দেই।”

সেহের মাথা নেড়ে দাদীমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরলো আর তার দাদীমা পরম আদরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলেন। একসময় দাদীমা বালিশের সাথে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে গেলো কিন্তু সেহেরের ঘুম আসলো না। এক অজানা ব্যথায় ভেতরে ভেতরে কাতর হয়ে যাচ্ছে না। ব্যথাটা অচেনা নয় অবশ্যই চেনা কিন্তু বারংবার তার কাছে নতুন হয়ে ফিরে আসে। তার মায়ের সাথে কাটানোর সময়গুলো স্বপ্ন আকারে চলে আসে। হয়তোবা এটা সারাদিন এসব বিষয় নিয়ে চিন্তা করার ফল। সেহের মাথা উঠিয়ে দাদীমার দিকে তাকালো। তখনই চারপাশের আজানের ধ্বনি কানে আসলো। সেহের চোখ মুছে নিজের মাথা থেকে আলতো করে দাদীমার হাত সরিয়ে উঠে বসলো। অতঃপর অতি সাবধানে দাদীকে শুইয়ে কাঁথা টেনে দিলো। বসন্তকাল চললেও শেষরাতে ঠান্ডাকে আবরণ করে এই কাঁথা অথবা ল্যাপ। বেলার গড়িয়ে গেলে কাঁকফাটা রোদ আর আঁধার নামলেই গাঁয়ের লোম দাঁড়ানো শীতল হাওয়া।
সেহের দরকার ছিটকিনি খুলে বাইরে বেরিয়ে বাথরুমে ঢুকে পরলো। বড় জেঠুর বাসায় এই একটাই বাথরুম।
ওযু করে বেরিয়ে দেখলো তা চাচী গাঁয়ে শাল জড়িয়ে সামনের একটা চেয়ারে বসে এদিকেই তাকিয়ে আছে।
সেহেরকে দেখতে পেতেই চাচী এগিয়ে এসে বললো,

—“নামাজ পড়বি মা?”

—“হ্যাঁ চাচী। তুমি বসে আছো কেন?”

—“ওযু করার অপেক্ষায় ছিলাম। আর শুন ঘরে গিয়ে ওয়ারড্রবের উপরের ২য় ড্রয়ার খুললেই জায়নামাজ পাবি।”

—“আচ্ছা চাচী।”

বলেই সেহের ঘরে চলে এলো। চাচীর কথামতো জায়নামাজ নিয়ে নামাজ পড়া শুরু করলো। মোনাজাতে বসে নিজের মায়ের জন্য খুব কাঁদলো সেহের। মোনাজাত শেষে জায়নামাজ নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই সেহেরের সারা শরীরের যন্ত্রণা একসাথে হামলা করলো। এতক্ষণ অনেক কষ্ট করে সহ্য করেছে এখন আর পারছে না। জায়নামাজ ভাঁজ করে সঠিক জায়গায় রেখে কোনোরকমে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরলো। আজ ভোরবেলা হাঁটা তার পক্ষে সম্ভব নয়। ব্যথায় ছটফট করতে করতেই সেহের ঘুমিয়ে গেলো। ঘুম থেকে উঠলো সকাল দশটায়। দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে তার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। কখনোই সে এতো দেরী করে ঘুম থেকে উঠেনি। চাচী তখন হাতে শুকনো মরিচের ডালা নিয়ে উঠোনে যাচ্ছে। সেহের রুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কী মনে করে সেহেরের ঘরে উঁকি দিলো। উঁকি দিয়ে দেখলো সেহের জলদি উঠে দাঁড়াচ্ছে। চাচী ডালাটা রেখে রুমে ঢুকে বললো,

—“আরে আরে এভাবে তাড়াহুড়োর কী আছে চুপচাপ বস!”

—“না চাচী কী বলো? দশটা বেজে গেলো আর আমি পরে পরে ঘুমোচ্ছিলাম, কেমন দেখায় বলো তো? আর আমাকেও তো ডেকে দিতে পারতে।”

—“ডাকিনি কারণ আমি জানি তুই অকারণে দেরী করে ঘুম থেকে উঠিস না। এভাবে ঘুমোচ্ছিস তার মানে নিশ্চয়ই তোর শরীর খারাপ। তাইতো আমি বা মা তোরে ডাকি নাই। যাহোক আবিদ কলেজ যাওয়ার আগে তোর জন্য ব্যথার ওষুধ আর মলম কিনে দিয়ে গেছে। হাত-মুখ ধুঁয়ে আয়, খেয়ে তারপর ওষুধ নিবি।”

—“ওহ চাচী সামান্য বিষয় নিয়ে টাকা খরচের কি দরকার ছিলো?”

—“এই চুপ কর। এসব বলবি তো চড় খাবি যা নিয়ে হাতমুখ ধুঁয়ে আয়, আমি উঠানে যাচ্ছি।”

বলেই চাচী বেরিয়ে গেলো। সেহের কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বেরিয়ে গেলো। চাচী তাকে খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দিলো সাথে পরম যত্নে মলমও মালিশ করে দিলো। সেহেরের অবস্থার কারণে দাদীমা সেহেরকে কলেজ যেতে দেয়নি। ১২টা নাগাদ উঠোনে মোড়া দিয়ে বসে দাদীমা সেহেরের মাথায় তেল মালিশ করছে আর সেহের আরামে চোখ বুজে শান্তি উপভোগ করছে। দাদীমা তেল দিতে দিতে বলে,

—“হ্যাঁ রে ফুল! তুই আসলেই আমাগো ফুল রে, ফুলের মতো চেহারা আবার দীঘল রেশমি চুল। তোর নাম ফুল রাইক্ষা ভুল করি নাই।”

—“আচ্ছা দাদী আমার নাম ফুল রাখলে কেন?”

দাদীমা হেসে বলা শুরু করে,
—“আমার একখান গোলাপের চাড়া আছিলো। বছরখানেক যত্ন কইরাও ফুল ফুটাইতে পারি নাই। শেষে অনেক হতাশায় ভুগলাম কিন্তু যখন শুনলাম আমার ছোট নাতনি আইসে হেইদিন দৌড়ায় যাওয়ার সময়ই হঠাৎ গাছের দিকে চোখ যায় আর তা দেইখা আমি সেখানে থম মেরে দাঁড়াইয়া কাইন্দা দেই। দীর্ঘ কয়েকবছর পরে হেইদিনই প্রথম কই হইসিলো রে ফুল। সেই সুখে দুলতে দুলতে হাসপাতাল যাইয়া আরেক ফুল পাইলাম মানে তোরে। কী নিষ্পাপ এবং মাহশাল্লাহ চেহারা। তোর চেহারার লাল আভাটা যেন আমার লাল গোলাপের সংকেত ছিলো। গোলাপের পাঁপড়ির ন্যায় ছিলো তোর ঠোঁটজোড়া, সেই ঠোঁটের মৃদ্যু নড়াচড়া, ঠোঁটের কোণ বেয়ে লালা ঝড়া সব যেন আমারে আরও প্রাণোচ্ছল করে দিসিলো৷ তাইতো তো তোর নাম রাখলাম ফুল! জানোস না তোর সেই অবস্থায় তোর দাদারে দিয়া আঁকাআঁকির মাস্টার আনাইয়া তোর ছবি আঁকাইসিলাম। হেই ছবি এহনো আমার কাছে আছে।”

—“তোমার ওই গোলাপ চাড়া কই দাদী?”

—“তোর বাপের বাগানে কবেই তো মইরা পইরা আছে।” বলেই মুখ গোমড়া করে ফেললো দাদীমা। সেহের হতাশ হয়ে চুপ করে রইলো। তার বাবা সম্পর্কে কিছু বলতে পারবে না সে। কী বলবে সে? বলার মতো কি-ই বা আছে।

দুপুরের দিকে সেহের কিছুটা সুস্থ অনুভব করতেই সে রান্নাঘরে চলে গেলো তার চাচীকে রান্নার কাজে সাহায্য করতে। চাচী করতে দেয়নি, কিন্তু সেহের জোর করেই রান্না শুরু করে দিয়েছে। চাচী মাছ কাটছে আর সেহের মাছ ভাঁজছে। আজ ইলিশ ভাঁজা আর আলুর ভর্তা হবে। সেহের অনেকদিন পর তৃপ্তি সহকারে খাবে আজ। সেহেরের ইলিশ বড্ড পছন্দের তাইতো দাদীমা সক্কাল সক্কাল বড় জেঠুকে পাঠিয়েছে তাজা দেখে ইলিশমাছ আনাতে। বড় জেঠুও কোনোরকম কথা না বলে তার সেহের মায়ের জন্য বাজারে ছুটেছে। জেঠু আর চাচী সেহেরকে বড্ড ভালোবাসে নিজের মেয়ের মতোই। সেহেরের বাবাও এতোটা ভালোবাসেনি যতোটা ওনারা ভালোবেসেছে।
মাছ ভেঁজে ভাত বসাতেই দেখলো উঠোন দিয়ে রান্নাঘরের দিকেই আসছে আবিদ আর সেহেরের সখি একমাত্র প্রাণের বান্ধুবি মানজু। মানজুকে দেখে সেহের জলদি হাত ধুঁয়ে বেরিয়ে এলো। মানজুর কাছে এসে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরলো। মানজি তো কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে উঠলো,

—“এ তোর কি হলো সখি! ঠোঁটের আশেপাশে এমন কালো দাগ কেন? কী বিভৎস!”

সেহের ম্লান হেসে বলে, “আরে তেমন কিছু না। ভেতরে আয়, হঠাৎ আবিদ ভাইয়ের সাথে এখানে হাজির হলি?”

—“তো কী করতাম? কলেজ যাসনি তাই আবিদ ভাইয়ের সাথে দেখা করি। ওনার মুখে সব শুনে না এসে পারলাম না।”

পাশ থেকে আবিদ বলে উঠলো,”হ্যাঁ। আর তোর নাকি সামনে পরীক্ষা আসছে তাই কলেজের পড়ার জন্য হলেও নিয়ে আসলাম। মানজু আমার বোনকে সব দিয়ে দিস আমি একটু বাইরে গেলাম কাজ আছে।”

মানজু মুখ ভেঙচিয়ে বললো, “তোমার কাজ তো শুধু বখাটেগিরি করা!”

মানজুর কথায় আবিদ থেমে মানজুর দিকে তেড়ে আসলে মানজু চট করে সেহেরের পিছে দাঁড়িয়ে মুখটা কাঁচুমাচু করে বলে,

—“ফুল বাঁচা আমায়৷ তোর ওই বখাটে ভাই আমার সাথে বখাটেগিরি করতে আসছে! ”

—“ফুল তোর এই বাঁচাল বান্ধুবিকে চুপ থাকতে বল ওরে কিন্তু আমি বেলমাথা করে বাড়ি থেকে বের করে দিবো!”

—“এএহ! টাকমাথা করলে আপনার মাথায় বুঝি ডুগডুগি বাজাবো!”

—“আহ তোরা থামবি! আবিদ ভাই তুমি যাও তো আর মানজু থাম তুই! সারাক্ষণ লাগিস কেন? তোর মা আর চাচীর কানে গেলে দুটোকেই দেবে ধরে কেলানি!”

তখনই চাচী এসে হাজির হলো। কোমড়ে হাত দিয়ে ভ্রুজোড়া কুচকে বলে উঠলো,
—“কে কাকে মারবে রে? আর পুঁত এই ভরদুপুরে তুমি কই যাও? খাওয়া-দাওয়ার কী হবে শুনি?”

—“বাবা যেতে বলেছে মা আমি যাবো আর আসবো। কিসের কাগজপত্র দিয়ে দিবে নাকি আমার কাছে।”

—“ও আচ্ছা তাহলে যা। জলদি ফিরিস আমি ভাত বাড়ছি। আর ফুল মানজুকে নিয়ে ভেতরে যা এই কাঁকফাটা রোদে দাঁড়ানোর মানে হয় না।”

—“আচ্ছা চাচী।”

বলেই সেহের মানজুকে নিয়ে ভেতরে চলে আসলো। ভেতরে এসে দেখলো দাদী পানে চুন, সুপারি দিয়ে মশলা করছে। মানজু দাদীকে ডাকলো তখনই যখন দাদীমা মুখে পান পুরলো। পান চিবুতে চিবুতে ভ্রু কুচকে বলে উঠলো,

—“কী মানজি আজ কী মতলবে আসছোস হু?”

—“তোমার নাতনিরে আজকের পড়া বুঝাইতে গো দাদী!”

—“ও আচ্ছা। তাহলে তোরা গল্প কর আমি দেহি যাইয়া বড় বউর রান্দোন কদ্দুর!”

বলেই আস্তে ধীরে হেঁটে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো। এবাড়ির রান্নাঘরটা বাড়ির ভেতরে না বাহিরে করা হয়েছে। উঠোন পেরুলেই রান্নাঘর, যদিও বেশি দূরে না, অল্প। সেহের কী কাজে বাইরে এসেছিলো তখন একটা গাছ থেকে ছোট্ট বরই পরলো ঠিক সেহেরের সামনেই। সেহের ভ্রু কুচকে উপরে তাকালো। পাতাও কয়েকটা ঝরছে এর মানে নিশ্চয়ই কেউ বরইতে ঢিল মেরেছে। সেহের ছোট্ট বরই হাতে নিয়ে বাড়ির পেছনের দিকে গেলো। কারণ, বাড়ির সামনে উঁচু উঁচু দেয়াল হলেও বাড়ির পেছন দিকে লারকি আর লম্বা লম্বা গাছে ডাল দিয়ে বাঁধানো। যদিও বেশি উঁচু নয় তবে ঢিল মারার জন্য যথেষ্ট। সেহের পেছনে এসে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখতেই দেখলো তার ভাই রিমন হাতে একটা খেলনা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওই খেলনা দিয়েই রিমন ঢিল ছুঁড়েছে সেটা সেহের বেশ বুঝলো কারণ, এই ঢিল মারায় তার এই ছোট্ট ভাই খুব অভিজ্ঞ। সেহেরকে দেখতে পেতেই রিমনের চেহারা আনন্দে চিকচিক করে উঠলো। সে ঢিলের খেলনা তার প্যান্টের পকেটে ঝুলিয়ে পায়ের সামনে থাকা একটা প্লাস্টিকের ডিব্বাটা হাতে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
সেহের কিছু বলার আগেই রিমন বলে উঠলো,

—“আপু আজ জানিস বাসায় বিরিয়ানি রান্না হয়েছে কারণ আমি পরীক্ষায় ফাস্ট হয়েছি। আম্মু আমার ভাগে যেটুকু দিয়েছিলো সেগুলো তোমার জন্য লুকিয়ে নিয়ে এসেছি। এখন জলদি এই বক্সটা নেও তো!”

—“এ তুই কী করলি ভাই! কে বলেছে তোকে এগুলো আনতে। তোর খাবার তুই খাবি, এখন এগুলো নিয়ে যা বলছি। মা জানলে রক্ষা থাকবে না।”

রিমন মাথা ডানে বামে নাড়িয়ে বলে,”উহু! তোমার জন্য এনেছি তুমি খাবা ব্যাস! ছোট থেকে নিজের চোখে দেখেছি আমার ওই কেলেঙ্কারি মা আর বোন কি পরিমাণ অত্যাচার করেছে।”

—“এসব বলে না ভাই আমার। ওনারা আমাএ গুরুজন, গুরুজনদের এসব বলতে হয় না সোনা!”

—“গুরুজন বলে কী ঠিক-বেঠিক বুঝবে না? দেখো আপু আমি ওনাদের সম্পর্কে কিছু শুনতে চাই না। এখন তুমি এগুলা নিবে নাকি আমি না খেয়ে পুকুরপাড়ে গিয়ে বসে থাকবো? জানো আজ সকাল থেকে কিছু খাইনি। মা ঘুমিয়ে ছিলো এতো ডাকার পরেও উঠেনি। তাই না খেয়েই স্কুল গিয়েছি। এখন তুমি কী চাও আমার পেটে আরও কয়েকশো ইঁদুর দৌড়াক?”

সেহের হতাশ হলো। সে নেই দেখেই তার ভাইকে এমন না খেয়ে থাকতে হয়েছে। সেহের খুবই লজ্জিত। আর ক্ষুধার্ত ভাইকে কষ্ট না দিয়ে সে বক্সটি নিয়ে বললো,

—“দেখ নিয়েছি এবার খুশি? এখন যা গিয়ে খেয়ে নে।”

—“আচ্ছা আপু!” অনেকটা খুশি হয়ে বললো রিমন। যেতে গিয়েও থেমে বলে,

—“বুবু তুমি আমার কাছে কবে আসবে?”

রিমনের এই কথায় যেন সেহেরের ভেতরটা মেঘের গর্জনের তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো। করুণ চোখে অসহায় ভাইটার দিকে তাকিয়ে রইলো সে।

অভিনেত্রী সিনথিয়া বারংবার নিজের স্টেপ ভুল করছে সা’দের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে। আর সা’দ এতে চরম রেগে বারবার “কাট” “কাট” বলে উঠছে। এবার যেন সা’দের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলো!

—“মিস সিনথিয়া আপনি কী এখানে আমাকে দেখতে আসছেন নাকি কাজ করতে? নিজের কাজটার দিকে ফুল ফোকাস করুন! আপনার জন্য আমাদের নেক্সট শিডিউল মিস যাচ্ছে। আপনি একজন অভিনেত্রী বলে বারবার ভুল করবেন আর আমরা দেখে যাবো এমন কিছু ভাবার চেষ্টাও করবেন না। সকলের কাছেই সময়ের মূল্য আছে স্পেশালি মাইন! সো গো ফাস্ট আদারওয়াইজ আই উইল টেক একশন!”

সা’দ আরও কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না তার এসিস্ট্যান্ট কারীবের জন্য। অভিনেত্রী সিনথিয়া মুখটা কাচুমাচু করে মিনুতির সুরে বললো,

—“সরি স্যার। আমি আগে থেকে ফুল ফোকাস করবো প্রমিস!”

—“তো এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে গো এন্ড ডু ইউর ওয়ার্ক!”

বলেই সা’দ কিছু না বলে নিজের ডাইরেক্টর চেয়ারে বসলো। এখানের একটা কথাও সা’দ ঝাড়ি দিয়ে বলেনি পুরোটাই শান্ত এবং কড়া কন্ঠে কথাগুলো বলেছে। সা’দ কখনোই কারো সাথে দুর্ব্যবহার করে না সে যতো খামখেয়ালি-ই করুক না কেন। যা বলার শান্ত সুরেই বলবে। তাও সা’দকে সবাই বাঘের মতো ভয় পায়। সা’দ এমন একজন মানুষ তার মাঝে কখন কী চলে তা কেউই বুঝে উঠতে পারে না। তবে সা’দ ঠান্ডা ভাষায়ও মান-সম্মান খুয়ানোর মতো কড়া ধাঁচের কথা বলতেও জানে। তাই হয়তো সকলে ভয় পায়। আজ সা’দই শিডিউল নিচ্ছে কিন্তু এই সিনথিয়ার খামখেয়ালি তার একদমই সহ্য হচ্ছিলো না। সা’দ তার মতো কখনো গম্ভীর, কখনো রসিক মানুষ আবার কখনো নরম মানুষ। তবে আজ অবধি কেউ তার নামের সাথে “বদমেজাজি” ট্যাগ লাগাতে পারেনি ইনফেক্ট নিজের পরিবারের মানুষরাও না। সা’দের ভাষ্যমতে, “তুমি যা-ই করো তোমার রাগের বহিঃপ্রকাশ কখনোই তোমার জন্য সুফল নয়।”
হয়তো এই জন্যেই সা’দ এতো কম সময়ে নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পেরেছে। তার টিমের ওয়ার্কাররা যথেষ্ট সম্মান এবং ভালোবাসে সা’দকে। সা’দ দেখতে সুঠামদেহি, লম্বা এবং দুপুরুষ। অনেক অভিনেত্রী তো বলেই দেয় তাদের হিরো সা’দকেই হওয়া উচিত। কিন্তু সা’দ কোনোদিন অভিনয় করেনি। সে এই সিনেমা এবং নাট্য পরিচারলনাতেই সন্তুষ্ট। যদি তার পরিচালনার পাশাপাশি অভিনয়ও করতো তাহলে হয়তো তার আয় আরও বৃদ্ধি পেতো। কিন্তু ওইযে সা’দ বিন সাবরান তার ইচ্ছেকেই বেশি প্রায়োরিটি দেয়। তার ইচ্ছের উপর আজ অবধি কেউই উঠতে পারেনি। তবে একজন পারে, সে আর কেউ নয় তার একমাত্রে মা জননী আসিয়া খাতুন।

সা’দের কড়া কথায় এবার সিনথিয়া বেশ ভালো এক্ট করলো! সকলে মুগ্ধ নয়নে দেখেছে তার নিখুঁত অভিনয়। এই শিডিউল শেষ হতেই কারীব এসে সা’দের সামনে দাঁড়ালো! সা’দ বোতল থেকে পানি খেতে খেতে বললো,

—“কী বলবে বলো!”

—“স্যার আপনি বুঝেন কী করে আমি কখন কিছু বলতে আসি আর কখন কাজে।”

সা’দ আরেক ঢক পানি খেয়ে বললো,

—“তোমাকে আমি আজ থেকে চিনি না। সেই ভার্সিটি লাইফ থেকেই চিনি।”

—“বুঝলাম। তবে বলতে আসলাম, আপনি সিনথিয়া ম্যামকে ভালোই ডোজ দিয়েছেন।”

—“আরও আগে দেয়া উচিত ছিলো। তাহলে আজকের সেকেন্ড শিডিউলটার সময় বদলাতে হতো না।”

—“স্যার আমার কী মনে হয় জানেন?”

—“কী?”

—“সিনথিয়া ম্যাম আপনাকে পছন্দ করে!”

সা’দ এমন ভাব করলো যেন সে কিছুই শুনতে পেলো না। আপাতত কিছুক্ষণ আগের রেকর্ডটা মনোযোগ সহকারে দেখছে৷ আর কারীব হতাশার দৃষ্টি নিয়ে তার স্যারের দিকে তাকিয়ে আছে। এই প্রেম-ভালোবাসা আর পছন্দের কথা বললেই যেন সা’দের কানে যেন অটোমেটিক সুপারগ্লু লেগে থাকে। বরাবরই সা’দ এইসব প্রেম-ভালোবাসা খুব নিখুঁতভাবেই ইগনোর করে যেমনটা এখন করলো। কারীবকে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সা’দ মিনি টিভিটার দিকে তাকিয়েই বললো,

—“ব্ল্যাক কফি!”

—“আনছি স্যার।”

বলেই কারীব চললো কফির ব্যবস্থা করতে। সে আজ আবারও ভালোভাবে বুঝলো তার স্যারকে প্রেম করাতে খুব একটা সক্ষম হবে না।

চলবে!!!

বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।

#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ০৩ ||

—“পাগল নাকি তুই? তোরে আমি নরকে তোরে পাঠামু তুই চিন্তা করলি কি কইরা? কোনোদিনও তোরে ওই বাড়িত যাইতে দিমু না!” অত্যন্ত রেগে কথাগুলো বললো দাদীমা। সেহের দাদীমাকে বোঝানোর চেষ্টা করে বললো।

—“দাদী! আমার বই-খাতা সব ওই বাড়িতে দয়া করে বোঝার চেষ্টা করো। আর রিমনটাও ভালো নেই গো, আমার যে ওর এই অবস্থা একদমই ভালো লাগছে না।”

—“তো আমি কি করমু? আর তোর বই-খাতা আমি আবিদরে দিয়া আইন্না নিমু তাও তোরে ওই বাড়িত যাইতে দিমু না।”

—“ফুল দেখ বোঝার চেষ্টা কর। এবার তোর বাবা তোরে পাইলে সত্যি সত্যিই মেরে ফেলবে! তোর কী একটুও প্রাণের ভয় নেই?”

—“দুইদিনের দুনিয়ায় প্রাণের ভয় করে কী লাভ ভাইয়া? এরচেয়ে ভালো নয় কী উপর যিনি আছেন তার উপর ভরসা করে চলতে?”

আবিদ অসহায় দৃষ্টি নিয়ে সেহেরের দিকে তাকালো। সেহেরের চোখে মিনুতি। আজ অবধি কোনোদিন তারা সেহেরকে এই বাড়িতে রাখতে পারেনি এক অথবা দুইদিনের বেশি। কিসের টানে যে সেহের বারবার ওই বাড়িতে চলে যায় তা তাদের অজানা। কিন্তু কেউ-ই চায় না এই অসহায় মেয়েটাকে ওখানে রাখতে। সকলেই জানে সেহেরকে কতো অত্যাচার সহ্য করতে হয়। আবিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেহেরের সামনে থেকে সরে আসলো। দাদীমা হাজার তর্ক, বকাবকি করেও সেহেরের সিদ্ধান্ত বদলাতে পারলো না। তাই সেও আর কিছু বলতে পারলো না। সেহের রাতের খাবার খেয়েই চাচীর বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। নিস্তব্ধ পরিবেশ। ঝি ঝি পোকার ডাক শুনতে শুনতে সেহের সেই বাড়িতে চলে গেলো। দরজায় নক করার মিনিটখানেক পর সৎমা দরজা খুলে দিলো। সেহেরকে দেখে সে কোনোরকম রিয়েকশন করলো না, সৎমা যেন আগেই জানতো সেহের আসবে। সেহের ম্লান হেসে ভেতরে প্রবেশ করে বললো,

—“রিমন কোথায় মা?”

—“ঘুমিয়েছে।”

—“কোনো কাজ আছে? আর বাবা আসেনি?”

—“না আসেনি। থালাবাসনগুলো আছে সেগুলো পরিষ্কার কর গিয়ে। আমি গেলাম শুতে।”

বলেই হাত পা টানতে টানতে ভেতরের রুমের দিকে চলে গেলো। সেহের কিছু না ভেবে উপরে রিমনের ঘরে চলে গেলো। গাঁয়ে কাঁথা জড়িয়ে গুটিশুটি মেরে ঘুমোচ্ছে তার প্রিয় ভাই। সকালে উঠে বোনকে দেখতে পেয়ে রিমন কেমন রিয়েকশন করতে সেটাই ভাবছে সেহের। মুচকি হেসে ভাইয়ের রুমে গিয়ে ভাইয়ের মাথার পাশে বসলো। কিছুক্ষণ পরম যত্নে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কপালে ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। সৎমায়ের কথানুযায়ী চলে গেলো কাজ করতে৷ যদিও সেহের এখনো পুরোপুরি সুস্থ নয় তবুও কিছু বলেনি। গ্রামের প্রায় সকলেই জানে সেহের কী পরিমাণ অত্যাচারিত হয়। কিন্তু সেহের মুখে স্বীকার করে না দেখে কেউ কিছু করতে পারে না। সেহের স্বীকার করলে হয়তো তার বাবা এবং সৎমায়ের সকল কাড়সাজি একদিনেই ঘুঁচে যেতো৷ থালাবাসন মেজে ধুয়ে উঠতেই কিছু ভাঙার শব্দ পেতেই সেহেরের টনক নড়লো। ওড়না দিয়ে ভেজা হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দেখলো তার বাবা মাতাল হয়ে এদিক সেদিক হেঁটে বেড়াচ্ছে। সে নিজের মাঝে নেই। সেহেরের দিকে চোখ যেতেই কবির বিশ্রী হাসি দিয়ে বললো,

—“কিরে ফইন্নির ঝি! এতদিন কোন নাগরের লগে ছিলি হ্যাঁ? তোর আবুল না কী জানি নাম, ও হ্যাঁ আবিদ। ওর তো তোর লেইজ্ঞা দরদ এক্কেবারে উতলায় পরে। তা আর কতো নাগর আছে রে? মা** বাসায় যে কাজ পইরা ছিলো হেইডি দেখসিলি! আমার বউডা কত্তো কষ্ট করসে দুইডাদিন! তোর এই আবুইল্লা কারণে আমার বউডা কতহানি পালসে আমার পুলারে। খবরদার যদি আমার পুলার গাঁয়ে একটা আঁচড়ও কাডোস তোরে আমি এবার ছাদ থেইক্কা লাত্থি মাইরা ফেইলা দিম!” এমন নানান বিলাপ বকছে কবির। সেহের চুপচাপ শুনছে কিছু বলছে না। বাবার এসব কথায় কষ্ট লাগলেও কেন জানি কান্না পায় না। কান্নারাও ক্লান্ত এইসব শুনতে শুনতে। একসময় এসব বকর বকর থেমে গেলো। কবির সেখানেই লুটিয়ে পরে ঘুমে কাত। সেহের লাইট বন্ধ করে নিজের ঘরে চলে আসলো। দরজা লাগিয়ে সে চেয়ারে বসে গেলো পড়তে। সারাদিন কাজ করে সেহের এই রাতেই নিজের পড়ালেখা শেষ করতে পারে। সৎমা কখনোই চায় না সেহের পড়ুক তাই সে সারাদিন নানা কাজে সেহেরকে ব্যস্ত রাখে কিন্তু সেহের যে রাতে পড়ে সেটা তার অজানা। পড়াশোনার জন্য সেহের অনেক কষ্ট ভোগ করেছে কিন্তু কেউ তার লেখাপড়া দমাতে পারেনি। জেঠু সেহেরের পড়াশোনার খরচ বহন করে তাই কবির এই বিষয়ে কিছু বলে না। বলা যায়, প্রয়োজনবোধ করে না। সৎমা নানানভাবে সেহেরের পড়াশোনা বন্ধ করতে বললে কবির সবসময় এক কথাই বলে,
—“ওর লেহাপড়া দিয়া আমার কোনো কাম নাই। আমি তো ওর পড়ার খরচ দিতাসি না ভাই দিতাসে! তো খাক স্যারগো জুতার বাড়ি!”

এক কথা শুনতে শুনতে সেহেরের মা ক্লান্ত। তাই সে আর তার স্বামীকে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলে না। নিজে আর তার মেয়ে মিলে দমানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে।

—“উফফ মা বলো না তোমার কী হয়েছে? এভাবে মাথায় আইসব্যাগ দিয়ে বসে আছো কেন?”। উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠে সা’দ। সা’দের কথা পাত্তা না দিয়ে মা চোখ বুজে আগের মতোই মাথায় আইসব্যাগ ধরে বসে আছেন। রুবাই হাতে ফাইল নিয়ে ক্যারিডোরে পায়চারি করছে আর ফাইল দেখে দেখে ফোনে কাউকে কিছু বলেই চলেছে। সা’দ ফোনে যখন শুনলো তার মার এই অবস্থা তৎক্ষনাৎ ছুটে এসেছে। এদিকে তার মাও কিছু বলছে না। আচ্ছা ফ্যাসাদে পরেছে সা’দ৷ সা’দ লম্বা শ্বাস ফেলে খুবই দৃঢ় গলায় বললো,

—“মা তুমি বলবে নাকি আমি যাবো? আমার শিডিউল আছে মা প্লিজ চুপ করে থেকো না।”

এবার উনি চোখ মেলে তাকালেন আর কড়া কন্ঠে বলে উঠলেন,

—“সারাদিন এত শিডিউল শিডিউল করে তো ফ্যামিলিকেই ভুলে যাস! মনে থাকে না ফ্যামিলিকেও তোর সময় দিতে হয়?”

—“দেখো মা! আমি যথেষ্ট সময় দেই তোমাদের। কিন্তু হঠাৎ এসব বলছো কেন তুমি? নিশ্চয়ই ঘাবলা আছে!” ভ্রু কুচকে প্রশ্নটা করলো সা’দ। মা কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে,

—“সামনে কুরবানির ইদ। কতোদিন হলো গ্রামে যাই না, শাশুড়ীর সাথে আলাপ করতে পারি না। তোদের ব্যস্ততা কী এই জীবনে শেষ হবে না?”

—“আহ মা! ইদ আসতে আরও দেড় মাসের মতো বাকি। আর তুমি এই দেড় মাস আগে এসে বলছো ইদ করতে যাবে। এসব চিন্তা ছাড়া আর কিছু কী নেই?”

—“এই তুই চুপ কর। সারাদিন আজারে বসে থাকলে এসব চিন্তা আসবেই। এখন আমায় বল এবার গ্রামে ইদ করবি? বল!”

—” তুমি তাহলে জাস্ট এই কথাটা বলার জন্য আমায় ডেকে পাঠিয়েছো? পাক্কা ১ ঘন্টার জ্যাম সহ্য করে আমি এখানে আসছি তোমার এইসব কথা শোনার জন্য? হায় আল্লাহ!”

—“তাহলে তুই কী বলতে চাস? আমি তোকে ডিস্টার্ব করেছি? হায় আল্লাহ তুমি আমাকে এই দিন দেখালে! সন্তান তার মায়ের জন্য বিরক্ত!”

—“মা প্লিজ বাজে বকিও না। আমি অনেক টায়ার্ড রুমে যাচ্ছি।”

বলেই উঠে যেতে নিলো তখনই মা বলে উঠে,

—“খেয়েছিস?”

সা’দ থেমে পিছে ফিরে বলে,
—“নাহ খাইনি। তবে আপনার যদি এই অবলা পুত্রের উপর দয়া হয় তাহলে অতি দ্রুত আমার কক্ষে খাবার পাঠিয়ে দিয়ে আমায় ক্ষুদামুক্ত করতে পারেন।”

সা’দের কথায় মা আইসব্যাগ নামিয়ে হুঁ হাঁ করে হেসে দিলো। সা’দও মুচকি হেসে নিজের রুমে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে দেখলো সেন্টার টেবিলে খাবার এবং কফি রাখা। সা’দ আগে গিয়ে কফিটাই নিয়ে নিলো। কফিতে চুমুক দিতে দিতে কারীবকে ফোন করে জানিয়ে দিলো আজ আর সে বেরোবে না। একেবারে কাল ১১টা নাগাদ যেন সে চলে আসে। সা’দের কথায় ওকে বলে কারীবও কল রেখে দিলো। সা’দ কাজের সময় বেশি কথা পছন্দ করে না তাই কারীব কিছু বলে নি। কারণ সে তার স্যারকে ভার্সিটি লাইফ থেকেই চিনে। সা’দের থেকে ৩ বছরের জুনিয়র সে। একবার সা’দের ব্যবহারে কারীব তাকে বেশ পছন্দ করেছিলো। তাই সে দিনরাত লেগে থাকতো সা’দের মন জয় করার জন্য। একবার সা’দ বেখেয়ালিভাবে ফোন চালাতে চালাতে হাঁটছিলো। সেদিন কারীবের জন্যই আরেকটুর জন্যই ট্রাকের নিচে যায়নি সে। সেই থেকে সা’দের আলাদা মমতাবোধ জম্মায় কারীবের প্রতি। সা’দ এবার লক্ষ করলো কারীব তার আশেপাশে থাকার চেষ্টা করে তাই সা’দ কারীবের সাথেই মিশলো। সা’দের বন্ধু-বান্ধব ছিলো না বললেই চলে। যতো বন্ধু আছে কেউই তার ক্লোজ না। কিন্তু কারীব হয়ে উঠলো তার ভালো বন্ধু এবং ছোট ভাই। সা’দ তার প্রফেশনে কারীবকে নিয়েই শুরু করেছিলো। কেন জানি না সা’দ তাকে বড্ড ভালোবাসে, আর হয়তো এও জানে তার প্রফেশনে কারীবই তার প্রকৃত বন্ধু হয়ে পাশে থাকবে।

প্রতিদিনের মতো সেহেরের আযানের ধ্বনিতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। চোখ কচলাতে কচলাতে বাম হাতের দিকে তাকাতেই দেখলো সে বই হাতে নিয়েই ঘুমিয়ে গেছিলো। সেহের অসুস্থ বিধায় বেশিক্ষণ চেয়ারে বসে পড়তে পারেনি। তাই সে বইটা হাতে নিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়েই পড়ছিলো। পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলো তার জানা নেই। নামাজ পড়ে সে নাস্তা বানাতে চলে গেলো। নাস্তা বানানোর আগে এক কাপ চা খেয়ে নিলো। এতে যেন তার মন ফুরফুরে এবং সতেজ হয়ে গেলো। শরীরের ম্যাজম্যাজ ভাবটাও কেটে গেলো। রুটি ভেজে বেরিয়ে এসে দেখলো কবির মেঝেতে নেই। নিশ্চয়ই উঠে গেছে সে। সেহের একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছুটলো তার প্রিয় ভাই রিমনের কাছে। এখন বাজে সকাল ৭টা ১৫ মিনিট। রিমনকে হালকা ডাকতেই সে পিটপিট করে তাকালো। সেহেরের হাসিমুখটা দেখে রিমন লাফ দিয়ে উঠে বসলো। যখন দেখলো সত্যি সত্যিই সেহের বসে আছে তখন জাপটে ধরলো সেহেরকে। সেহেরও পরম সুখে ভাইকে জড়িয়ে ধরলো।

—“বুবু তুমি এসেছো! তুমি এসেছো আমার কাছে?”

—“হ্যাঁ ভাই আমার এসেছি। এখন উঠ দেখি ৮টায় স্কুল আছে তো। খাবে কে শুনি?”

স্কুলের কথা শুনে রিমন বিরক্তের সাথে সেহেরকে ছেড়ে দিলো। তারপর নাক ফুলিয়ে ঠোঁট উল্টে বলে উঠলো,

—“আমার খুশির সময় কেন স্কুলটা নামটা টেনে আনো বলো তো? যাও কথা নেই!”

সেহের হেসে দিলো রিমনের কথায়। এরপর রিমনের নাক টেনে মুচকি হেসে বলে,

—“ওরে আমার ভাইটা! বাস্তবজীবনে পড়াশোনা অনেক জরুরি সোনা, তাই এসব বলতে নেই। এখন উঠুন খেতে হবে তো নাকি?”

রিমন মাথা নেড়ে উঠে চলে গেলো ওয়াশরুমে। সেহের নিচে নেমে ডাইনিং টেবিলে খাবার বাড়তে থাকলো। কিছুক্ষণ পর রিমন স্কুলের ইউনিফর্ম পরে নিচে নামলো। রিমন চেয়ার টেনে বসতেই সেহের অতি যত্নে ভাইকে খাওয়াতে শুরু করলো। রিমনও মজার সাথে খাচ্ছে। রিমনের খাওয়ার মাঝেই সৎমা আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে ডাইনিং এ আসলো। জগ থেকে পানি ঢেলে ঢকঢক করে পানি খেয়ে রিমনের দিকে না তাকিয়েই আবার ঘরে চলে গেলো। তার চোখে এখনো ঘুম আছে। ঘুমোতে যাওয়ার আগে সেহেরকে বললো,

—“আমার ঘরের পানির জগটায় পানি নেই। পানি ভরে দিয়ে যাস তো!”

সেহের উত্তরে শুধু “আচ্ছা” বললো। কিন্তু সৎমা উত্তর শোনার আগেই রুমের দিকে হাঁটা ধরলো। তার যেন প্রয়োজনবোধ নেই সেহেরের উত্তর শোনার।

চলবে!!

দখিনা প্রেম পর্ব-০১

0

#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| সূচনা পর্ব ||

গলা বেয়ে রক্ত পড়ছে। ফ্লোরের কিছু জায়গায় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। সারা শরীরের যন্ত্রণায় বিছানায় গুটিশুটি মেরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সেহের। তার সারা গাঁয়ে মারের চিহ্ন। কিছুক্ষণ আগেই সেহেরের বাবা আর তার সৎমা বিনা অপরাধে মারধোর করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। সেহেরের মুখমন্ডলেও কাটা-ছেঁড়ার দাগ। সেহেরের চাচী তার গায়ে গরম পানির ছ্যাঁক দিয়ে যাচ্ছে আর সেহের বারংবার ব্যথায় চিৎকার করে উঠছে।
সেহেরের থেকে দু-হাত দূরত্বে বসে আছে সেহেরের দাদীমা।
দাদী আঁচলে মুখ গুঁজে কাঁদছে। অসহায় মেয়েটাকে কী করে তার নিজ জম্মদাতা পিতা মারতে পারে তা-ই ভাবতে পারছে না।
এই অসহায় মেয়েটার বাবাই যে নিজের গর্ভের সন্তান ভাবতেই তার ঘৃণায় গা ঘিনঘিন করছে।
কিছুটা দূরে আরামদায়ক চেয়ারে দুহাতের আঙুল একত্রিত করে মুখে হাত দিয়ে বসে আছে সেহেরের বড় জেঠু আর দরজার দিকে দাঁড়িয়ে আছে সেহেরের চাচাতো ভাই আবিদ।
সকলেই চুপচাপ আছে কারো কোনো কথা নেই।
নিস্তব্ধ ঘরটাতে সেহেরের গোঙানি ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না।
চাচী যখন সেহেরের থুঁতনিতে মলম লাগানোর সময়ই দাদীমা বলে উঠলো,

—“কোন গজব জম্ম দিসিলাম আমার পেটে। মাইয়াডার সোনার মতো মা ডারে খাইলো এহন মাইয়াডারে মাইরা ফেলতাসে! পুঁতরে(সেহেরের বাবা) মাইয়া মানে একটা জান্নাত! আর তুই তোর বংশের উত্তরাধিকারের ল্যাইগা এক মাইয়ারে মারসোস এহন আবার নিজের মাইয়ার পিছে লাগসোছ! আমার আজ অব্দি একখান মাইয়া হইলো না, হেই দুক্ষে কতোরাইত কানসি আর আমার পেডের পুঁত!”

বলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।
দাদীমার কান্না যেন সেহেরের কান অবধি পৌঁছাচ্ছে না।
সে একরকম ফোবিয়ায় আছে।
বারবার “মা” “মা” করছে।
দাদীর কান্নায় আবিদ এগিয়ে এসে দাদীকে সামলানোর চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না।
দাদীমা কাঁদতে কাঁদতে আবার বলা শুরু করলো,

—“মাইয়া ছিলো না হেই আফসোস আমার সুফিয়া(সেহেরের মা) ঘুঁচায় দিসিলো। আমার হেই পবিত্র ফুলটা দিনের পর দিন অত্যাচার মুখ চেপে সইয্য কইরাও হাসিমুখে কইতো “আমি ভালো আছি মা!” হেই ফুলের একটাই দোষ আছিলো হেয় পুঁত জম্ম দিতে পারে নাই দিসে এক মাইয়া। এতে আমারই বইনের মাইয়া আমার পুঁতের মাতা খাইয়া গিরিঙ্গি বাজের মতো আমার শান্তির সংসারে আগুন ধরায় দিয়া গেসে!”

—“আহ মা চুপ করবা! মান-সম্মান তো দেখছি সব খুইয়ে ছাড়বা।” বিরক্তির সুরে বললো জেঠু।

—“এই ছ্যাড়া চুপ কর তুই! গিরিঙ্গিবাজের চামচামি করতে আইবি না। এক গ্রাম কী আমি দশ গ্রামরে মাইকিং কইরা ওই গজবটার কুকীর্তি হুনামু! ভুইলা যাইস না ওই পোলায় তার মার গাঁয়ে হাত তুলতেও ভুলে নাই!”

জেঠু আর কোনো কথা না বলে আরামদায়ক সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
ওষুধ লাগানোর ঘন্টাখানেক অবধি সারা শরীরের জ্বালাতন না কমলেও আস্তে আস্তে কমে আসছে। এটাই হয়তো গ্রামের লতাপাতার চিকিৎসার ছোট নমুনা।
সেহের চোখদুটো ছোট ছোট করে আশেপাশে তাকালো। সে নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করতে পেরেছে।
দাদীমা সেহেরকে জিজ্ঞেস করলো,

—“ফুল, তোর কী এহন ভালা লাগতাসে?”

সেহের মাথা নাড়ায়। কিছুক্ষণ নিরব থেকে কাঁপা গলায় বলে,
—“দাদী, আমি মেয়ে বলে কী মানুষ না?”

সেহেরের এই নিষ্পার ভঙ্গির কথার শুনে দাদীর ভেতরটা হুঁ হুঁ করে উঠলো কিন্তু কিছুই বলতে পারলো না। কী বলবে সে? আর কী বলেই বা সান্ত্বনা দিবে? আর কতোদিন এই অন্যায়-অবিচার চলবে?
সেহের কিছুক্ষণ আনমনে থেকে হালকা হাতে চোখ মুছে দাদীকে বললো,

—“দাদী আমাকে ওই বাসায় যেতে হবে। কাল রিমনের স্কুল আছে আর রান্নাটাও তো বাকি!”

—“এই চুপ কর! যারা তোরে এই আধারাইতে মাইরা উঠানে ফালায় রাখসে তাদের লেইগা এতো দরদ একদম দেখাবি না!” দাদী পরমুহূর্তে আবার হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠে বলে,

—“এতো নরম ক্যান হস রে ফুল? তোর মারে তোর ওই বাপ মাইরা লাইসে এহন তোরেও মারতে উইঠা পইরা লাগসে। তোরে কতো কইরা কইলাম ওই বাড়িত থেইকা আইয়া পর আমাগো কাছে নয়তো ঢাকায় আমার মেজো পুঁতের কাছে চইলা না। হুনোস না তুই আমার কথা!!”

—“মাকে ফেলে আমি কোথাও যাবো না দাদী। আমার মায়ের স্মৃতি যে ওই বাসার আনাচে কানাচে লেপ্টে আছে। চাইলেও ওই বাড়ির মায়া কাটাইতে পারি না। তাইতো এই অত্যাচার মুখ বুজে মেনে নেই।”

তখনই চাচী পাশ থেকে বলে উঠলো,

—“ওইডা তোর স্বামীর বাড়ি না ফুল যে সব মুখ বুইজা সহ্য করবি। সবকিছুর সীমা আছে সেই সীমা তোর বাপ আর সৎমা অনেক আগেই পার কইরা ফেলসে।”

—“একটা মেয়ে যদি শশুড়বাড়িতে মুখ বুজে সব সহ্য করতে পারে তাহলে বাবার বাসায় কেন পারবে না? এ কেমন নিয়ম গো চাচী?”

—“দেখ ফুল তোর বুঝার বয়স হইসে, তাও ক্যান সব বুইঝাও না বুঝার ভান ধরে থাকোস? পড়ালেখাও তো তুই করোস তাও বুঝোস না?”

—“চাচী। তাদের প্রতি আমি ঋনি। আমাকে এতো বছর লালনপালন করেছে খাইয়েছে এই অবধি মানুষ করেছে, কী করে সব ভুলে যাই?”

চাচী আর দাদী এবার চটে গেলো সেহেরের কথায়। সেহের মেয়েটা অনেকটা বোকা এবং সৎ। কে বলে তাকে এতো সৎ হতে?

—“আর ছোট থেকে যেই অত্যাচারটা করতাসে সেটা? তোর বাপে তোর মায়ের খুনি জাইনাও কুত্তার মতো ওদিকে দৌড়াইতে লজ্জা করে না? আমি কোনো কথাই হুনুম না। তুই আমার বাড়িতেই থাকবি ব্যাস!”

বলেই দাদীমা কক্ষ ত্যাগ করলেন। চাচীও খাবার আনতে বেরিয়ে গেলো। সেহের একদম নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলো। সেহেরের বাবা কবির এলাকার চেয়ারম্যান। দো’তলা বাড়ি তার। তবে সেই বাড়িটা দাদাজানই তৈরি করে গিয়েছিলো, কিন্তু সেহেরের বাবা নানা কৌশলে হাতিয়ে নেয়। দাদীমা আগে সেই বাড়িতেই থাকতো কিন্তু সেহেরের সৎমা বাড়িতে আসার পর তাকে বের করে দেয়।
ওদের বাড়ি থেকে ১৫-১৭ হাত দূরেই সেহেরের বড় জেঠুর বাড়ি। একতলা বিশিষ্ট এই বাড়ি। বড় জেঠু তার কয়েক বিঘা জমির পর্যালোচনা ছাড়াও মাছ চাষ করেন, আলাদা সম্মান আছে তার গ্রামে কারণ সে কখনো লোক ঠকায়নি। কবিরের কাড়সাজি সম্পর্কে সকলেই অবগত। লোকটি যেমন অশিক্ষিত তেমনই ভয়ংকর লোভী এবং স্বার্থপর। স্বার্থের জন্য সে সব করতে প্রস্তুত।।
কবিরের এমন রূপের জন্য গ্রামের সকলে তাকে ভয় পায়। প্রতিবারই কীভাবে কীভাবে যেন কবিরই চেয়ারম্যানের পদ পায়, হয়তো দুই নম্বরি করে।

সেহেরের চকির পাশেই একটা জানালা। সে কষ্ট করেছে আলতো লেসড়িয়ে জানালার কাছে গিয়ে আকাশের পানে তাকিয়ে রইলো। আজ পূর্ণ গোলাকার চাঁদটা দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আলোতে চারপাশটা আলোকিত হয়ে আছে। ঝি ঝি পোকার ডাক খুব ভালোভাবেই শোনা যাচ্ছে। সেহের একমনে চাঁদটার দিকে তাকিয়ে আছে। আনমনেই সে একটা জগল ধরলো,

“আমি চাঁদকে বলি, তুমি সুন্দর নও
আমার মায়ের মতো!
গোলাপকে বলি, তুমি মিষ্টি নও
আমার মায়েরই মতো!”

এই জগলটা সে তার সখি মাঞ্জুর মোবাইলে শুনেছিলো। যদিও সেহের তার সৎবোন তোপার সঙ্গে এখনো মিশতে পারেনি। বলা চলে তার সৎবোনের জন্যই সে বেশি মার খায়। কিন্তু কথা হলো, তোপাকে কবির সেহেরের মতো মারে না আদর করে আগলে রাখে। এ নিয়ে সেহের কখনোই কোনোরকম অভিযোগ করে না। তার সৎভাইও আছে তবে বেশি বড় না ৮-৯ বছরের। তাও তার বিচার-বিবেচনা বিচক্ষণ। সে একদমই তার বোন বা মায়ের মতো নয়। রিমন সেহেরকে অনেক পছন্দ করে। কেনই বা করবে না, সেহের যে নিজ হাতে তাকে লালনপালন করেছে, সৎবোন হয়েও মাতৃস্নেহ দিয়েছে। আর সেহেরের সৎমা? সে তো কখনোই নিজের ছেলের খবর রাখতো না, তবুও যখন কবির সাহেব আসতো তখন ছেলেকে নিয়ে তার কতো দরদ! এমন ভাব করে যেন সে ছেলেকে সামলাতে সামলাতে ক্লান্ত। এমন নানান ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে সেহের।
সেহেরের সৎমার ১ম বিয়ে হয়েছিলো কিন্তু সে কিছু সামলাতে পারেনি দেখে শশুড়বাড়ি থেকে বের করে দেয় তার ২ মাসের মেয়ে তোপাকে নিয়ে। কবিরের সম্পত্তির প্রতি তার আগেভাগেই লোভ ছিলো বিধায় সে নানানভাবে সেহেরের মাকে নিয়ে কবিরের মনে হাজাররকম বিষ ঢেলেছে। এও বলেছে ছেলেসন্তান হচ্ছে বংশের বাতি।
সেহেরের চাচী খাবার দিয়ে গেলেও সেহেরের খেতে মন চাইলো না। সে একইভাবে এখনো চাঁদটার দিকে তাকিয়ে আছে।

—“স্যার ফাইভ হান্ড্রেড পুশ আপ অলরেডি ডান তাও কেন আপনি কন্টিনিউ করেই চলেছেন!”

কারীবের কথায় সাদ থামলো। হাত টান দিয়ে বসে উঠে দাঁড়ালো হাত ঝাড়তে ঝাড়তে।
সাদের চেহারা এবং গলা বেয়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝড়ছে।
সাদ হাতের রুমালটা খুলতে খুলতে কয়েকধাপ এগিয়ে গিয়ে পানির বোতলটা নিলো। বোতলের মুখ খুলে মুখের মধ্যে ঢেলে মুখ মুছতে মুছতে কারীবকে বললো,

—“আই থিংক আমার গণনায় কোনোরকম গোরবর হয়েছিলো।”

—“ইট’স ওকে স্যার। বাট স্যার নেক্সট শুটিং শিডিউলের সময় তো হয়ে আসছে আপনি জলদি চেঞ্জ করে হালকা খাবার খেয়ে নিন।”

সাদ নিজের গলা এবং হাতের ঘাম তোয়াল দিয়ে মুছতে মুছতে আবারও বললো,

—“শাওয়ার নিতে হবে তুমি আপাতত নিচে গিয়ে ওয়েট করো।”

বলেই হাতে থাকা তোয়ালটা গলায় ঝুলালো। এমন সময়ই সাদের বড় বোন রুবাই জিম কর্ণারে এসে হাজির হলো,

—“সাদ তুই আবারও কোথাও বের হবি নাকি?”

—“হ্যাঁ! সন্ধ্যার পর শুটিং আছে যেতে হবে।”

—“উফ! এই তোর এই শুটিং ফুটিং আর কতোদিন চলবে বলতো? আর কতো এই অফিস আমি আর বাবা সামলাবো? তোর অফিস তুই না সামলিয়ে আমি কেন সামলাচ্ছি হ্যাঁ?”

—“ভুল বললি। এই অফিস আমার কোনোদিনও ছিলো না। আর আমি একদমই অফিসের কাজে ইন্টারেস্টেড না আপু! তুই তো জানিসই এই সা’দ বিন সাবরান সবসময় নিজের ইচ্ছাকে প্রায়োরিটি দেয়। সো তুই সামলা আর নিজের ক্যারিয়ার গড়!”

বলেই তোয়াল দিয়ে চুলের ঘাম মুছতে মুছতে রুবাইয়ের পাশ কেটে বেরিয়ে গেলো। আর কারীব তো আহাম্মকের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কারীবকে এভাবে হ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রুবাই বললো,

—“হোয়াট! তোমার স্যার কী অর্ডার দিয়েছে তা গিয়ে পূরণ করো স্টুপিড!”
বলেই রেগে হনহন করে বেরিয়ে গেলো রুবাই।

চলবে!!!

Happily Married Part-16 And Last Part

0

#Happily_Married🥰
#Last_Part
Writer:: Shaanj Nahar Sanjida


দেখতে দেখতে তিন মাস হয়ে গেলো আমার আর আলিফের বিয়ের।হাসি খুশিতে কাটলো আমার এই তিন মাস।বাবা মায়ের সম্পর্কও খুব ভালো গতিতেই এগুচ্ছে।মা আমার সাথেও ভাব করার চেষ্টা করছে।আমি আমার যথা সম্ভব চেষ্টা করছি কিন্তু এতো বছরের জমে থাকা অভিমান ভাঙ্গা আমার পক্ষে একটু কঠিন।তবে সময় সব ঠিক করে দেবে এইটাই আমার মনে হয়।ভার্সিটিতেও আমার পড়াশুনা ভালো চলছে।এখন আর আলিফ আমাকে পড়ায় না আমি নিজে থেকেই পরি।আলিফ সত্যিই অনেক কেয়ারিং হাসব্যান্ড।আমার বা এই পরিবারের অনেক খেয়াল রাখে ও।সেদিন বৃষ্টিতে আমার কাছ থেকে ও প্রথম একটা জিনিস চেয়েছিল আর সেটা ছিলো আমি যেনো ওকে তুমি করে বলি।ভাবা যায়?আমার আর ওর মধ্যে এখনও কোনো শারীরিক সম্পর্ক তৈরি হয়নি।তবে এ নিয়ে আলিফ কোনো দিন আমাকে কোনো কথা বলেনি।উল্টো যদি আমি ওকে কিছু বলি ও আমাকে বলে সারাজীবন নাকি পরে আছে আমাদের। ও কোনো প্রকার জোর করবে না। তবে তা শুধু এই ছয় মাস পরে নাকি আমি চাইলেও উনি আমাকে নিজে থেকে দূরে রাখবে না।ভাবা যায় মানুষটা কেমন?
এখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল।আমি পড়ার টেবিলে বসে বসে আমার গত তিন মাসের কথা ভাবছি।
তখনই মামনি আমাকে ডেকে পাঠালো।আমিও তার কথা শুনে নিচে নেমে আসলাম।

মামনি আমাকে ডেকেছো?(আমি রান্না ঘরে গিয়ে)

হুম মা।সরি তোমার পড়ার সময় ডাক দিলাম।(আলেয়া বেগম)

না,মা।সমস্যা নেই।তুমি বলো তোমার কি সাহায্য লাগবে?(আমি)

একটু সবজি গুলো কাটতে হবে।আমি রান্না বসিয়ে দিয়েছি কিন্তু সবজি কাটাই হয়নি।(আলেয়া বেগম)

আচ্ছা।দাও আমি কেটে দেই।
বলেই আমি সবজি কাটতে লাগলাম।

মা। আলিশাকে দেখছি না?(আমি)

ওর কথা আর বলো না। ও যে সেই কলেজে থেকে এসেছে।এসেই রুমএর দরজা বন্ধ করে বসে আছে।আমি অনেক বার ডাক দিয়েছি।খুলেনি।বলেছে ওর সামনে HSC এক্সাম ওকে পড়তে হবে।(আলেয়া বেগম)

হুম।হতে পারে।সামনেই তো পরীক্ষা।তাই মনোযোগ দিয়ে পড়ছে হয়তো।(আমি)

তাই বলে খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে?(আলেয়া বেগম)

থাক।রাতের খাবারের সময় ডাক দেবো।(আমি)

হুম।(আলেয়া বেগম)


রাতের খাবারের সময়
আম্মু, আলিশা কোথায় ও খাবে না?(আলিফ)

আমি গিয়ে জিজ্ঞেস করছিলাম।খাবে না বলেছে।(আমি)

এই মেয়ের আবার কি হলো?(রামিম সাহেব)

বলছে পড়তে বসেছে।(আলেয়া বেগম)

তাই বলে খাবে না?(রামিম সাহেব ভ্রু কুঁচকে)

আমি তো তাই বলছিলাম!(আলেয়া বেগম হতাশ হয়ে)

চিন্তা করো না আম্মু। ক্ষুদা লাগলে এমনি খাবে!(আলিফ)

সবাই আর কিছু বললো না।চুপচাপ খেয়ে নিলো।


আমাদের রুমে
আলিফ।কিছু হয়েছে তোমার?অনেকক্ষন থেকে লক্ষ্য করছি তুমি বার বার চোখের পলক ফেলছো?(আমি ভ্রু কুঁচকে)

না আসলে আজকে অফিসে একটু বেশিই কম্পিউটারের সামনে বসে কাজ করেছিলাম।তাই মাথাটা একটু ব্যাথা করছে।(আলিফ মাথায় হাত দিয়ে)

অনেক কাজ করতে হয় তাই না?(আমি)

তুমি চিন্তা করো না।ঔষুধ খেয়ে ফেলেছি।ঠিক হয়ে যাবে।(আলিফ মুচকি হেসে)

এদিকে এসো।
বলেই আলিফকে টেনে বিছানার কাছে এনে ওর মাথা আমার কোলে দিয়ে দিলাম।আর সাথে হাতে তেল নিলাম।

কি করছো?(আলিফ আমার কোলে শুয়ে)

আমার বরটাকে একটু আরাম আয়েশ দিচ্ছি।তুমি আমার কোলে মাথা দাও।আমি তোমার চুলে আস্তে আস্তে তেল দিয়ে চুল গুলো টেনে দেই।মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে তুমি ঠিক ঘুমিয়ে যাবে।(আমি)

কিন্তু তোমার তো কষ্ট হবে।(আলিফ)

আমার কষ্টের কথা তোমার চিন্তা করতে হবে না।এখন চুপ করো তো।
বলেই আমি আলিফের মাথায় তেল দিয়ে চুল গুলো আস্তে আস্তে টেনে মাথায় হাত বুলাতে লাগলাম।

আলিফ চোখ বন্ধ করে বললো
আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না,হিয়া!

কি বিশ্বাস হচ্ছে না?(আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে)

তুমি আমার এতো যত্ন নিচ্ছ!তুমি তো সব সময়ই বলতে তুমি কোনোদিন কারো কেয়ার করো না।কিন্তু আজ আমার এভাবে যত্ন নিচ্ছ।সত্যিই বলতে আমার খুব ভালো লাগছে,হিয়া।তুমি আমার যত্ন নিচ্ছ বলে।(আলিফ)

বিয়ের দিন বাবা আমাকে বলেছিল।আমি মালিক হবো নাকি রানী।উনি বলেছিলো রানীরা নাকি নিজের জন্য না পরিবারের জন্য বাঁচে,পরিবারের খেয়াল রাখে,এইরকম আরো অনেক বলেছিলো।কিন্তু আমি সেদিন বলেছিলাম আমি রানী না মালিক হাওয়া পছন্দ করবো।কোনো দিন কারো কেয়ার আমি করিনি আর করবোও না।কিন্তু নিজের অজান্তেই,,,
কথাটা শেষ না করতেই আলিফ মাঝ পথে বলে মনে,,
কিন্তু নিজের অজান্তেই কখন যে এই বাড়ির রানী হয়ে গেছো খেয়ালই নেই,তাই না?(আলিফ চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে)

আমি মাথা নেড়ে হ্যা বললাম।

আলিফ মুচকি হেসে আমার পেটের দিকে মুখ ঘুরিয়ে আমাকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইল।আমিও আপন মনে ওর মাথায় হাত বুলাতে লাগলাম।


সকালে,,
আলিফ,,(আমি চিৎকার দিয়ে)

আলিফ চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বললো,,
কি হলো হিয়া?চিৎকার চেঁচামেচি করছো কেনো?

তুমি আবারও আমার পা বেঁধে রেখেছো?(আমি রেগে)

কি করবো?তুমি তো ফুটবল খেলো!(আলিফ)

এই নিয়ে এই সপ্তাহে তুমি চারবার আপনার পা বেঁধে রেখেছো।(আমি রেগে)

ওয়াও।খুব ভালো হিসেব রাখো তো দেখছি।(আলিফ ভ্রু কুঁচকে)

তোমার মত মানুষের সাথে হলে হিসেব রাখতেই হয়।এখন তোমারও অভ্যাস করতে হবে!(আমি)

আমি চাই তোমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর অভ্যাস করতে।তুমিই তো দাও না।(আলিফ বাচ্চাদের মত ঠোঁট ফুলিয়ে)

হয়েছে তোমার। যাও গিয়ে ফ্রেশ হও।আজকে আমার শেষ এক্সাম ভুলে গেছো?(আমি)

ও শিট।তাহলে তুমি আগে ওয়াশরুমে যাও।পড়ে আমি যাবো।(আলিফ আমাকে তাড়া দিয়ে)

আচ্ছা।যাচ্ছি।
বলেই আমি মুচকি হেসে ওয়াশরুমে ঢুকলাম।


ওয়াশরুম থেকে বের হতেই আলিফ বললো,,
আমি ফ্রেশ হয়ে আসতে আসতে সব কিছু রিভিশন দাও।আমি ধরবো।(আলিফ)

ঠিক আছে।এতো তাড়া দিও না তো।(আমি আলিফকে ঠেলে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে)


পরেই আমি আর আলিফ তৈরি হয়ে সবার কাছ থেকে দোয়া নিয়ে বের হলাম।


দুপুরের পর
রামিম সাহেব হন্তদন্ত হয়ে আলিফের রুমে ঢুকলো।

আলিফ চলো বাসায় যেতে হবে?(রামিম সাহেব)

কেনো বাবা?কিছু হয়েছে!(আলিফ চিন্তিত হয়ে)

চিন্তার কিছু না। গেলেই দেখতে পারবে।
বলেই রামিম সাহেব আলিফকে টেনে তুললো।আর সাথে নিয়েই যেতে শুরু করলো।


চৌধুরী বাড়িতে
আলিফ গিয়েই দেখলো সোফায় আলেয়া বেগম আর রিয়া বেগম বসে আছে তাদের মাঝখানে হিয়া বসে বসে আপেল খাচ্ছে।আর মুচকি মুচকি হাসছে। তা দেখেই আলিফ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো
কি হয়েছে?

আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোদের বৌভাত করতে?আর হিয়া মাও এতে শায় দিয়েছে।(রামিম সাহেব)

কি? কিন্তু বৌভাত তো ছয় মাস পরে করার কথা ছিল?(আলিফ অবাক হয়ে)

যে বৌভাত ছয় মাস পরে করার কথা বলেছে সেই বলেছে এখনই বৌভাত করতে।(মাঝখান থেকে আলিশা বলে উঠলো)

কিহ?(আলিফ আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে)

সারপ্রাইজ।(আমি এক গাল হেসে)

কিন্তু তোমার পরীক্ষা?(আলিফ)

ভুলে গেছো?আজকে আমার শেষ পরীক্ষা ছিলো!(আমি নাক ফুলিয়ে)

ও আচ্ছা।আমি তো ভুলেই গেছিলাম। তা তোমরা যখন এইটাই চাও তাহলে করো।(আলিফ মাথা চুলকাতে চুলকাতে)

তারমানে তুই চাস না ভাই?বাবা,মা,আংকেল,আন্টি বৌভাত করতে হবে না।উনি তো চায় না বৌভাত।তাহলে আর কি করার?তোমাদের কষ্ট করে করতে হবে না!(আলিশা মজা নিয়ে)

এই পাকা মেয়ে তোর না পরীক্ষা!কালকে না খেয়ে পড়তে বসে ছিলে এখন তা হাওয়া হয়ে গেছে যা পড়তে বস।(আলিফ আলিশাকে ধমক দিয়ে)

ভাবী কিছু বলো!(আলিশা আমার পেছনে লুকিয়ে)

আহা ছাড়ো না।বৌভাত করবে না?ওইটার প্রস্তুতি নাও।(আমি)

হুম।
বলেই আলিফ আবার মাথা চুলকাতে চুলকাতে শুরু করলো।


বৌভাতের দিন
আমি আজকে নিজে থেকেই সেজেছি।পিউ আপুর পার্লারের লোক গুলো আজ শান্তি মতো আমাকে সাজাতে পেরেছে।প্রথমে তো তারা আসতেই চাইনি।যখন শুনেছে আমাকে সাজাতে হবে।পড়ে তাদের অনেক বুঝিয়ে আনানো হয়েছে।আমি সেজে রুমে বসে আছি তখনই পিয়া রুমে ঢুকলো।

ও হিয়া!তোকে খুব সুন্দর লাগছে একদম পরির মত।(পিয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে)

থ্যাঙ্ক ইউ। তোকেও খুব সুন্দর লাগছে।পিয়াস ভাইয়া তোকে দেখে একদম ফিদা হয়ে যাবে।(আমি পিয়ার গাল টেনে)

হিয়া,আমি আর তোর পিয়াস ভাইয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছি বিয়ে করবো?(পিয়া নিচের দিকে তাকিয়ে)

আলহমদুলিল্লাহ।এইটা তো খুব ভালো খবর।আমি তোর জন্য অনেক খুশি।
বলেই আমি পিয়াকে জড়িয়ে ধরলাম।

কিছুক্ষণ পর আলিশা আসলো,,
ভাবী তোমাকে নিচে যেতে বলছে।

চলো।
বলেই আমি,পিয়া আর আলিশা নিচে নামলাম।


নিচে নামতেই দেখলাম
আলিফ গোল্ডেন কালার এর শেরওয়ানি পড়েছে।কোনো রাজকুমার থেকে কম না লাগছে না তাকে।

অন্যদিকে
আলিফ হা করে হিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।হিয়া গোল্ডেন কালার লেহেঙ্গা পড়েছে।যা ওর মা বানিয়ে দিয়েছে।খুবই হালকা সাজ দিয়েছে।মাথায় বেলী ফুল দিয়ে চুল গুলো ছেড়ে দিয়েছি।ওকে কোনো এক অপ্সরী লাগছে।

এইভাবে হা করে থাকলে লোকে খারাপ বলবে আলিফ রায়হান ভাই।(পিয়াস ভাইয়া টিটকারি মেরে)

আলিফ নিজেকে সংযু্ত করে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো।আমিও ওর হাত ধরে স্টেজে উঠলাম।
স্টেজে দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখলাম।সবাই সবার রঙের রঞ্জিত।মা বারবার বাবার কাছে কি মানা করছে এতো তেলযুক্ত খাবার না খেতে।আর বাবা তর্ক করে যাচ্ছে তার শরীর স্বাস্থ্য অনেক ভালো তাই এইসব খেলে তার করা কিছুই হবে না।
অন্যদিকে
পিয়াস ভাইয়া আমাদের লজ্জাবতী পিয়াকে আরো লজ্জা দিচ্ছে।মাঝে মধ্যে হাত ধরছে,সবার সামনে হটাৎ গালে বা হাতে চুমু খাচ্ছে।এইসব দেখে অজান্তেই মুখ থেকে হাসি বেরিয়ে গেলো আমার।

পাশেই আরেকটা কলির মত জুটি দেখতে পাচ্ছি।যেটা মাত্র ফুটার চেষ্টা করছে।আর সেই জুটিটা আকাশ আর আলিশার।

আকাশ কিছুক্ষণ পর পর গেন্দা ফুল ছুঁড়ে মারছে আলিশাকে অ্যাটেনশন পাওয়ার জন্য।কিন্তু কিছুই পাচ্ছে না।তাই আরো অনেক রকম ফুল ছুড়ে মারছে।আলিশা বিরক্ত দেখলেও মনে মনে খুশি হচ্ছে তা দেখাই যাচ্ছে।

আর আমার বাবাই আর মামনি।উনাদের ভালোবাসার তো কোনো কমতি কখনও ছিল না।সময় যেনো শুধু তাদের বয়স নয় ভালোবাসাকেও বাড়িয়ে দিয়েছে।তারাও আজ খুব খুশি।

আমি সবাইকে দাড়িয়ে দাড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করছি তখনই আলিফ বলে উঠলো।

হিয়া,বসো।(আলিফ)

হুম।
বলেই আমি আলিফের পাশে গিয়ে বসলাম।

আলিফের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম।সম্পর্কের কতো রঙ হয়,কতো রূপ হয়। তবে মানুষের উপর নির্ভর করে সে কোন রঙ বেছে নিতে চায়।আমি সম্পর্কের যেই রঙ বেছে নিয়েছিলাম।সে রঙ আমার জীবন বেরঙ করে দিত।কিন্তু আলিফ যেই রঙের আমার জীবনে এনেছে সেই রঙের কারণে আজ আমার জীবন রঙিন।আজ আমি বলতে পারি আমি Happily Married🥰

……………………………#THE_END………………………….
গল্পটা আরো বড়ো করতে পারতাম।কিন্তু অযথা কাহিনী টেনে সিরিয়াল বানাতে চাইনি।আলিফ আর হিয়ার লাভ স্টোরি এখানেই শেষ।
তারা Happily Married🤗
আল্লাহ হাফেজ,টাটা,bye bye, সায়োনারা🙋🏻‍♀️

Happily Married Part-15

0

#Happily_Married❣️
#Part_15
Writer:: Shaanj Nahar Sanjida


হিয়া,আমার রান্না হয়ে গেছে।তাড়াতাড়ি খেতে চলে আয়।
বলেই পিয়া হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকেই দেখে হিয়া আর আলিফ একে অপরের কপাল ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে।

পিয়া তাড়াতাড়ি চোখে হাত দিয়ে বললো
ওপস! সরি সরি।আমি আসলে বুঝতে পারিনি,যারা আমাকে খাবার বানানোর তাড়া দিচ্ছিলো সকালে।তারা তাদের ক্ষুদা ভুলে এখানে রোমাঞ্চ করছে। অবশ্য এমন রোমাঞ্চ পেলে ক্ষুদা আর থাকে বুঝি।

আলিফ তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে মাথা নিচু করে পাশ কাটিয়ে বাহিরে চলে গেল।

ভাইয়া মনে হয় অনেক লজ্জা পেয়েছে?(পিয়া হাসতে হাসতে)

একটু বেশিই মুখে বুলি আওড়ানো শুরু করেছো,মিস পিয়া?(আমি ভ্রু কুঁচকে)

এমন ভাবে বলছিস যেনো আমি কি না কি করে ফেলেছি!সরি বলছি তো।
বলেই পিয়া আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।

এখন কি করছিস?(আমি ভ্রু কুঁচকে)

তোর রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করছি! যাই হোক ভাইয়া লজ্জা পেয়েছে।তোকে দেখে তো বুঝাই যাচ্ছে তুই একটুও লজ্জা পাসনি!(পিয়া বাকা চোখে তাকিয়ে)

আমি কেনো লজ্জা পাবো।আমার বর,আমি যা ইচ্ছে করবো।লজ্জা তো তোর পাওয়া উচিত।কাবাবের হাড্ডি।(আমি)

সরি না!(পিয়া আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে)

আরে ছাড়।আমি পিয়াস ভাইয়া না।(আমি ছুটার চেষ্টা করে)

আমার এই কথা বলতেই পিয়া এক ঝটকায় আমাকে ছেড়ে পাশেই ঘুটিশুটি মেরে দাড়িয়ে রইলো।

হুহ!😒কি হলো?পিয়াস ভাইয়ার কথা শুনতেই আমাকে ছেড়ে দিলো।(আমি মনে মনে)

এখানে পিয়াস ভাইয়া আসলো কোথা থেকে?(পিয়া লজ্জায় লাল হয়ে)

আমি ভালো করে তাকিয়ে দেখি ও লজ্জায় টমেটোর মত লাল হয়ে গেছে।কান এতো লাল হয়ে আছে,মনে হচ্ছে ধোঁয়া বের হবে।

আবারও না।তুই আবারও লজ্জা পেতে শুরু করলি।তোর এই লজ্জা পাওয়া শুরু হলে আর থামতে চায় না।এখন এইসব রাখ।চল খেতে যাবো।
বলেই আমি লজ্জাবতী পিয়াকে নিয়ে বের হলাম।


বাহিরে বের হতেই দেখি আলিফ স্ট্যাচু হয়ে দাড়িয়ে আছে।

কি হলো আবার আপনার?এইভাবে স্ট্যাচু হয়ে আছেন কেনো?(আমি আলিফের দিকে তাকিয়ে)

সামনে দেখো?(আলিফ সামনের দিকে আঙুল দিয়ে)

আমি সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি পিয়াস ভাইয়া একটা পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরে দাড়িয়ে আছে।উনাকে পুরাই কাকাতুয়া লাগছে।

আমি আর আলিফ ফিক করে হেসে দিলাম।

দেখলেন কেনো আমি আমি আপনার জন্য পাঞ্জাবি আনি নি।কারণ বাবার পাঞ্জাবিতে আপনি পিয়াস ভাইয়ার মত কাকাতুয়া লাগবেন।(আমি হাসতে হাসতে)

ঠিক বলেছো!তোকে যে আজ কি লাগছে কি বলবো,পিয়াস?ফাটাফাটি।কে দিয়েছে তোকে এইসব?(আলিফ হাসতে হাসতে)

দেখেছো পিয়া,আমি বলেছিলাম আমাকে দেখে ওরা হাসবে।(পিয়াস ভাইয়া মাথায় হাত দিয়ে)

আমি কি করবো?পিয়াস ভাইয়া বলছিল উনার মাথা ব্যাথা করছে। আমি বলছি গোসল করলে ঠিক হয়ে যাবে।উনি বলছে কাপড় চোপড় কিছু আনে নি।গোসল করে আগের কাপড় পড়তে উনার ভালো লাগে না।তাই আমি বেলকনিতে গিয়ে দেখি আংকেলের লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি টানানো।সেখান থেকে আংকেল এর লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি এনে দিয়েছি।(পিয়া আঙ্গুল চুলকাতে চুলকাতে)

একদম ঠিক করেছো পিয়া।ধন্যবাদ তোমাকে।(আলিফ হাসতে হাসতে)

আর তুই উনাকে(পিয়াস) ভাই বলছিস কেনো?(আমি ভ্রু কুঁচকে)

জিজ্ঞেস করো হিয়ামনি।আমি কতো বলছি আমাকে ভাই বলো না।তুমি আমাকে ভাই বললে আমার হার্ট এ্যাটাক হবে।(পিয়াস মাঝখান থেকে)

তাই নাকি?(আমি আর আলিফ,পিয়াস ভাইয়ার দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে)

আসলে,,।আসলে আমার অনেক ক্ষুদা লাগছে।আমাকে খেতে দাও।
বলেই পিয়াস ভাইয়া টেবিলে বসলো।

দিচ্ছি।দিচ্ছি।বসুন।
বলেই পিয়াও টেবিলে খাবার বাড়তে গেলো।

আমি আলিফের কাছে গিয়ে বললাম,
দুইজন একসাথে কতো সুন্দর লাগছে তাই না।খুব ভালো মানাবে ওদের।

হুম।(আলিফ মুচকি হেসে)

হিয়া,আঙ্কেল আর আন্টির কি হবে?উনারা খাবে না।(পিয়া টেবিলে আমাদের জন্য খাবার বাড়তে বাড়তে)

আমি আর আলিফ একে অপরের দিকে তাকালাম।তারপরই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি দুটো বাজে।আমি উনাদের রুমে বন্ধ করেছিলাম সকাল দশটা নাগাদ।

উনাদের কথাবার্তা হয়েছে?(আমি আলিফের দিকে তাকিয়ে)

জানি না।খুলে দেখো!বন্ধ করার পর কোনো আওয়াজও তো পায়নি।(আলিফ)

হুম।
বলেই আমি দরজা খুললাম।


আমি দরজা খুলতেই দেখি
বাবা, হাত পেছনে বাজ করে জানালার কাছে দাড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।আর মা টেবিলে বসে মাথা নিচু করে কেঁদেই চলেছে।
আমার দরজা খুলার আওয়াজ শুনেই বাবা পেছনে তাকালো।
আমি বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি তার চোখ জোড়া খুবই নিষ্প্রাণ।আমি ভয় পেয়ে যাই।আসলে আমি কোনো দিন বাবার চোখ এত নিষ্প্রাণ দেখিনি।
বাবার চোখ জোড়া সব সময় উনার মনের কথা বলতো।রাগ,জেদ,আমার জন্য ভয়,ভালোবাসা,সবই আমি ওই চোখ জোড়ায় পড়তে পারতাম কিন্তু এখন কেনো জানি?কিছুই বুঝতে পারছিনা না।তবে কি বাবা মা নিজেদের মধ্যে কথা বলেছে?যার জন্য বাবার এমন অবস্থা।
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়েই আছি আর বাবা আমার কাছে এসে আমার কপালে চুমু দিয়ে মুচকি হেসে পাশ কাটিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।
আমি কিছুই বুঝলাম না কি হলো?

আমি এখন এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি।যেখান থেকে কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।আমি কি বাবার পিছু হটে যাবো?নাকি মার কাছে গিয়ে উনাকে শান্তনা দেবো?কি করবো?আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা না।

আমার এই দিশেহারা পরিস্থিতি দেখে আলিফ বললো,,
বাবার কাছে যাও।আমি জানি তোমার উনার কাছে যাওয়ার ইচ্ছেই বেশি!

আমি আর কিছু না বলে এক দৌড় দিয়ে বাবার কাছে গেলাম।


আমি গিয়ে দেখি বাবা বেডে বসে আছে মাথা নিচু করে।

আমি বাবার কাছে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসলাম।আমার মনে অনেক প্রশ্ন কিন্তু কেনো জানি সেই প্রশ্ন গুলো মুখ দিয়ে বের হতেই চাচ্ছে না।আমার ঠোট জোড়া যেনো খুব ভারী হয়ে আছে।তাই বাবার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।

বাবা আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,,
আমি সব সময় চাইতাম,তুই সম্পর্ক গুলোকে সম্মান দে,সম্পর্ক গুলোকে ভালোবাস,ওইগুলো বুঝ।কিন্তু দেখ আমিই আমার আর তোর মার সম্পর্ক গুলোকে সম্মান দেয়নি,ভালোবাসি নি,বুঝার চেষ্টা করেনি।সেদিন যদি তোর মার কথা বিশ্বাস করে একটু শুনতাম তাহলে তোর,আমার,তোর মার জীবন অন্য রকম হতো।আমরা মানুষ কেনো চাই,যে অপর মানুষটা একদম আমাদের মন মতো হবে?আমরা যা চাই উনি তাই করবে?আমি যদি তোর মাকে একটু বুঝতাম?তবে এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।তোর মাকে আমি বুঝতে পারিনি।এইটা আমার অসফলতা।কিন্তু ও আমাদের ছেড়ে চলে গেছে এই জন্য আমি ওকে ক্ষমা করবো না।তবে তোকে ধন্যবাদ।এখন আমি নিশ্চিত যে তোর আর আলিফের সম্পর্ক আমাদের মতো হবে না।

আমি বাবাকে আর কিছুই বললাম না।শুধু উনার হাঁটুর উপর মাথা রেখে শুয়ে রইলাম।


অন্যদিকে
ফুপি তুমি ঠিক আছো তো?(পিয়াস রিয়া বেগমের কাছে এসে)

পিয়াস আমি খুব বড়ো ভুল করে ফেলেছি।ও আমাকে ডিভোর্স দেয়নি।সেদিন যদি আমি জেদ ছেড়ে ওকে সব কিছু বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করতাম।সেদিন যদি ওই ডিভোর্স পেপারটা ছিঁড়ে ওকে বলতাম যে আমি তোমাদের ছেড়ে কোথাও যাবো না।তাহলে আজ আমায় এই পরিস্থিতে পড়তে হয় না।ও আমাকে কোনোদিন ক্ষমা করবে না।আমি এখন কি করবো?জেদ,রাগে আমি আমার সুখী পরিবার নিজের হাতে ধ্বংস করে দিয়েছি।এখন আমি কি করবো?কি করবো যে হিমেল আমাকে মাফ করে দেয়? ও কি আমায় মাফ করবে,পিয়াস?(রিয়া বেগম পিয়াসের হাত ধরে)

ওইটা তো আপনার উপর নির্ভরশীল।সেদিন আপনার কাছে পথ ছিলো নিজের পরিবারকে বেছে নেয়ার কিন্তু আপনি নেননি।নিজের জেদকে বেছে নিয়েছেন।তাই এখন নিজের পথ নিজে খুঁজে নিন,আন্টি।যে পথ দিয়ে আপনি আঙ্কেলের কাছ থেকে মাফ পাবেন আর হিয়ার মা হয়ে উঠার আরেকটা সুযোগ।(আলিফ)

রিয়া বেগম আলিফের দিকে তাকিয়ে আছে।

তুমি ঠিক বলেছো আলিফ।নিজের জেদের জন্য সব কিছু ছেড়েছি।এখন সব কিছু পাওয়ার জেদ ধরবো।আমি যে করেই হোক হিয়া আর হিমেলের মনে আবার নতুন করে নিজের জায়গা করবো।ওদের প্রতি করা অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করবো।(রিয়া বেগম)

এখন যেহেতু সব ঠিক হয়ে গেছে।তাহলে সবাই খেতে চলো খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে।(পিয়া মুচকি হেসে)

হুম।
বলেই পিয়াস রিয়া বেগমের হাত ধরে খাবার টেবিলে নিয়ে গেলো।

আলিফ হিমেল সাহেবের রুমে গিয়ে দেখলো হিয়া হিমেল সাহেবের হাঁটুর উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে।

আলিফ হিয়াকে ইশারা করলো আঙ্কেলকে খাবার টেবিলের নিয়ে আসতে,,

আমি আলিফের ইশারা পেয়েই বাবাকে বললাম,,
চলো খেতে চলো।

না আমার ভালো লাগছে।তুই গিয়ে খেয়ে নে।(হিমেল সাহেব)

আমি বাবার গালে হাত দিয়ে বললাম,,
তুমিই তো বলতে না,,যে বিয়েকে একটা সুযোগ দে।আমি দিয়েছি।তুমি না হয় মাকে আরেকটা সুযোগ দাও।

তুই দিতে পারবি আরেকটা সুযোগ?(হিমেল সাহেব)

বিয়েকে একটা সুযোগ দিয়েছি।পরিস্থিতে পরে উনাকেও আরেকটা সুযোগ দিয়েছি।তুমিও দাও।জীবন তো একটাই বাবা।রাগ,জেদ চেপে কেনো কষ্ট পাবে?আমি জানি তুমি মাকে ভালোবাসো।আর উনিও তোমাকে ভালোবাসে।তাই তো এতো বছরেও তোমাদের মনে অন্য কেউ জায়গা করতে পারে নি।(আমি)

তুই কবে থেকে এতো জ্ঞানী হয়ে গেলি।এই কয়দিন আগে নিজের ফালতু কাজ কর্ম দিয়ে আমার মান সম্মান ধূলায় মিশিয়ে দিতে নিয়েছিলি?আর এখন এতো পাকা পাকা কথা বলছিস?
বলেই বাবা আমার কানে ধরে টান দিতে লাগলো।

আহ্।বাবা।লাগছে।এখন চলো তো।(আমি নেকামি করে)

চল।
বলেই বাবা আর আমি চলতে শুরু করলাম।
আলিফ আমাদের কান্ড দেখে হাসতে শুরু করলো।

পরেই আমরা সবাই মিলে খাবার খেলাম।সারা বিকেল গল্প,লুডু,বালিশ পাস,চোর পুলিশ আর অনেক খেলা খেললাম।সবাই মিলে ভালোই মজা করলাম।


রাতে আমি আর আলিফ বাড়ি ফিরছি।পিয়াস ভাইয়া মাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছে।বাবার সাথে উনার একটু আকটু কথা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরো সময় লাগবে।আমরা বিদায় নিয়ে সবাই এক সাথেই বেরিয়ে গেছি।আমাদের আর পিয়াস ভাইয়ার বাড়ি দুটোই দুইদিকে।
আমাদের গাড়ি আপন চলছে।রাস্তা ঘাট পুরোই ফাঁকা।মাঝে মাঝে রাস্তার পাশে লাইট গুলো কয়েকটা অন হয়ে আছে।তো কয়েকটা অফ।এর মধ্যে নামলো বৃষ্টি।

আলিফ?এইটা বর্ষাকালের প্রথম বৃষ্টি না?(আমি এক্সসাইটেড হয়ে)

মনে তো হয়।(আলিফ গাড়ি চালাতে চালাতে)

গাড়িটা থামান।(আমি আলিফকে তারা দিয়ে)

কেনো?(আলিফ গাড়ি থামিয়ে)

চলুন বৃষ্টিতে ভিজবো।(আমি)

ঠান্ডা লাগবে।(আলিফ)

আপনিও না।প্লিজ চলুন।(আমি কিউট ফেস করে)

আচ্ছা বাবা চলো।
বলেই আলিফ গাড়ি থেকে নামলো।

আমিও গাড়ির সাউন্ড বক্সে গান ছেড়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম।

আলিফ আসুন।আমি আর আপনি নাচবো।(আমি আলিফের কাছে গিয়ে)

না।ভুলেও না।আমি নাচতে পারিনা।(আলিফ)

আরে আমরা কোথায় কম্পিশনে যাচ্ছি!চলুন।
বলেই আমি আলিফের কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে টেনে নাচতে শুরু করলাম।

প্রেমেরই সুর বাজে গুন গুন
আমার নয়ন তুমিই তো তুমি তো মন
আমার নয়ন তুমিই তো তুমিই তো মন

বুকেতে প্রাণ ধক ধক ধুম ধুম
বুকেতে প্রাণ ধক ধক ধুম ধুম
আমার নয়ন তুমিই তো তুমিই তো মন

মিউজিক,,,

অসীম আকাশে মন উড়ে যায়,,,,
অনেক মানে থাকে নীরব কথায়,,,,

চোখেরও আয়না তো আমারই এই মন
নতুন সাজে আমি সাজি এখন
কাজল না কাকন না কুমকুম
আমার নয়ন তুমিই তো তুমিই তো মন

বুকেতে প্রাণ ধক ধক ধুম ধুম
আমার নয়ন তুমিই তো তুমিই তো মন,,

(আমি আলিফকে জড়িয়ে ধরে)

অচেনা অতিথি হলো আপন
তোমায় ঘিরেই তো জীবন মরণ।

প্রেমেরই সুর করে গুন গুন
আমার নয়ন তুমিই তো তুমিই তো মন
আমার নয়ন তুমিই তো তুমিই তো মন


এই বৃষ্টিতে আমি আর আলিফ একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আছি। এ যেনো এক অন্যরকম প্রশান্তি।এই সম্পর্ক আমরা কোনোদিন ভাঙতে দেবো না।


চলবে,,,,

Happily Married Part-14

0

#Happily_Married❣️
#Part_14
Writer:: Shaanj Nahar Sanjida


আলিফ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েই দেখে হিয়া একটা বড়ো বাক্স এনে ঐটা ভ্রু কুঁচকে এক দৃষ্টিতে দেখেই যাচ্ছে।দেখছে তো দেখছে আবার একবার ঘাড় এদিকে ঘুরায় তো আর একবার ওদিকে।আলিফের সন্দেহ হলো হিয়া মনোযোগ দিয়ে যেহেতু বক্সটা দেখছে নিশ্চয়ই গন্ডগোল আছে বা এই মেয়ে গন্ডগোল লাগাবে।বক্সের চারপাশ ভালো করে দেখে হিয়া একটা হাতুড়ি দিয়ে যেই তার তালা ভাঙতে যাবে ওমনি পেছন থেকে আলিফ ধরে বললো,,
কি করছো?

বক্সের তালা খুলছি।(আমি)

তাতো আমিও দেখতে পাচ্ছি।কিন্তু কেনো?(আলিফ)

এইটার মধ্যে বাবার গুপ্তধন আছে।বাবা কোনো দিন এটাকে আমায় ছুঁতেও দিতো না।লুকিয়ে রাখতো।আজ বাবার ঘরের আলমারি খুলতেই এইটা পেলাম।আজ আর এইটা খোলার সুযোগ হাত ছাড়া করছি না।
বলেই আবার হাতুড়ি দিয়ে তালা ভাঙতে যাবো তখনই আবার আলিফ হাত ধরে বললো,,
অনুমতি ব্যতীত অন্যের জিনিস দেখা ভালো না হিয়া!

আমি কি অপরিচিত মানুষের জিনিস হাত দিচ্ছি নাকি?এইটা আমার বাবার উত্তরাধিকার সূত্রে এইটাতে আমারও অধিকার আছে।(আমি গর্ব করে)

তাও এইসব ঠিক না।হতে পারে এতে উনার পার্সোনাল জিনিস আছে!(আলিফ)

এই জন্যই তো আমার কৌতূহল।আরেকটা কথা এই সেন্টু গেঞ্জি আর লুঙ্গিতে আপনাকে পুরাই বাঙ্গালী জামাই লাগছে।(আমি চোখ টিপ মেরে)

ফর ইউর কাইন্ড ইনফর্মেশন।আমি বাঙালি জামাই।(আলিফ😒)

না কোনো দিন আপনাকে এই বেশে তো দেখিনি তাই বলছিলাম আর কি?শশুর মশাইয়ের লুঙ্গি পরে কেমন লাগছে!(আমি মজা নিয়ে)

খুবই ভালো। তবে এইসব কথা বলে আমাকে রাজি করাতে পারবে না।আমি তোমাকে অন্যর ব্যাক্তিগত জিনিসে হাত দিতে দেবো না।(আলিফ বুকে হাত বাজ করে দাঁড়ালো)

তাহলে দোষ আপনার!(আমি রেগে)

কেনো?আমি কি করেছি?(আলিফ অবাক হয়ে)

আপনিই তো বললেন বাবার আলমারি থেকে আপনার জন্য কাপড় চোপড় এনে দিতে আপনি ফ্রেশ হবেন।আমি যদি আপনার জন্য আলমারি না খুলতাম তাহলে এই বক্সটাও পেতাম না।আর আমার ইচ্ছেও জাগতো না এইটা খুলে দেখার।
বলেই আমি আলিফের দিকে কিউট ফেস করে তাকালাম।

আলিফ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো।

আলিফ,আমি জানি আপনারও ইচ্ছে করছে এইটার মধ্যে কি আছে খুলে দেখতে?(আমি বাকা চোখে আলিফের দিকে তাকিয়ে)

ভুলেও না।আমি তোমার মতো না।আমার কিছু আদর্শ আছে।(আলিফ ভ্রু কুঁচকে)

দূর আজকে আদর্শ গুলোকে গুলি মারেন তো।
বলেই আমি আলিফকে আমার পাশে বসিয়েই হাতুড়ি দিয়ে এক বারি মেরে তালা ভেঙ্গে ফেললাম।

তোমার জন্য আমাদের কোন দিন জেলে যেতে হয়!(আলিফ হতাশ হয়ে)

ব্যাপার না দুজন মিলে যেখানে যাবো সেখানেই খুশি থাকবো।
বলেই বক্স খুললাম।

আলিফ হিয়ার কথা শুনে মুচকি হেসে ভাবলো,,
সত্যিই তোমার সাথে আমি সব জায়গাতেই যেতে পারবো,হিয়া।

বক্স খুলে কৌতূহল নিয়ে আমি আর আলিফ তার ভিতরের জিনিস গুলো দেখে অনেক অবাক হয়ে গেলাম,,,

আলিফ দেখেন!এইটা বাবা আর পিয়াস ভাইয়ার ফুপির বিয়ের ছবি।আমি আগে কোনদিন দেখিনি।বাবা এখানে লুকিয়ে রেখেছিল!।(আমি আলিফকে ছবি দেখিয়ে)

উনি পিয়াস ভাইয়ার ফুপি আর সাথে তোমার মাও।(আলিফ আমার হাত থেকে ছবিটা নিয়ে)

আলিফ,আমি আপনার কথায় উনাকে একটা সুযোগ দিয়েছি।কিন্তু ক্ষমা এখনও করিনি। যাই কারণ থাকুক উনার এইসব করার পেছনে তা আমার কাছে কিছুই না।উনি আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল এইটাই আমার কাছে সব চেয়ে বড় বিষয়।আমি কোনো দিন ভাবি নি উনাকে সুযোগ দেবো।তবে যাই হোক সুযোগ দেয়ার কথা বলেছেন,দিয়েছি।কিন্তু এখন ক্ষমা করার কথা বলবেন না।আমি অতটাও মহান নেই যে উনার মত মানুষকে ক্ষমা করতে পারবো।(আমি নিচের দিকে তাকিয়ে)

যদি উনি সুযোগে তোমার মন গলাতে পারে তাহলে?(আলিফ আমার মাথায় হাত দিয়ে)

আপনি আমার সাথে এতো ভালো ব্যবহার করেন।এখনও কি আমার মন গলাতে পেরেছেন?আপনি আমাকে ভালোবাসেন,কিন্তু সত্যি করে বলুন তো,আপনি জানেন কি না আমার মনে আপনার জন্য কি আছে?(আমি আলিফের দিকে তাকিয়ে)

আলিফ আমার কথা শুনে চুপ হয়ে গেলো।

আমি আপনার মনে কষ্ট দিতে চাইনি।আপনি আমার অনেক খেয়াল রাখেন,আমার কথা বুঝতে পারেন,আমার সব কাজে আপনি সাহায্য করেন,আমাকে ভালোবাসেন।তাই আমি নিজেকে পরিবর্তন করে আপনার ওইসব জিনিস গুলোতে সাড়া দিতে চাই।কিন্তু পারি না।মনের কোণে যে ভয় এতো বছর ধরে জমেছে ওইসব এতো সহজে আমার পেছো ছাড়বে না।আর এই ভয় গুলো আমার মনে ঢুকিয়েছে উনি।তাহলে বলুন উনাকে কি এতো সহজে ক্ষমা করা যায়?আমার জীবন স্বাভাবিক হয়ে উঠুক তা আমিও চাই।কিন্তু আমি পারিনা।উনাকে আমিও ক্ষমা করতে পারবো না।আর সুযোগটা উনি কিভাবে কাজে লাগবে আমি জানি না।শুধু এইটা জানি আমার পক্ষে এখন অসম্ভব।হা, তবে এইটা বলতে পারি আমি উনাকে আগে যতটা ঘৃনা করি ততটাও ঘৃনা করবো না।(আমি মুচকি হেসে)

আর বাবার ক্ষেত্রে?(আলিফ)

বাবা!উনার প্রতি আমার আগে যতটুকু রাগ ছিল এখন তা আর নেই।কারণ উনি সব সময় আমার পাশে থেকেছেন।উনি কোনো দিনও চান নি আমার এরকম অবস্থা।তাই তো ধরে বেধে আপনার সাথে বিয়ে দিয়েছে।তবে যাই হোক উনি উনার রাগে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার জন্য একটু হলেও আমার কষ্ট পেতে হয়েছে।তাই উনাকেও একটু আমার রাগ সহ্য করতে হবে।বাবা মা হওয়া সহজ না।এইটা উনাদের বুঝতে হবে।যতক্ষণ না তারা এইটা বুঝতে পারছে ততক্ষণ আমিও হাল ছাড়ছি না।(আমি দীর্ঘ্য শ্বাস নিয়ে)

আমার কথা শেষ হতে না হতেই আলিফ আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,,
হিয়া প্রমিজ করো!তুমি আমাকে ভালো না বাসলেও, আমাকে তোমায় ভালোবাসা থেকে কখনও দূরে সরিয়ে রাখবে না।

আমিও উনাকে জড়িয়ে ধরে বললাম,,
ভুল বলছেন।আপনি প্রমিজ করুন।আমার মন থেকে এই সম্পর্কের ভয় দুর আপনি আমায় ভালোবাসতে বাধ্য করবেন।আমি আপনাকে ভালোবাসতে চাই।আমি ওইসব কিছু করতে রাজি আছি যা দিয়ে আমি আপনার ভালোবাসার মায়ায় পড়বো।

আলিফ আমার কপালে কপাল ঠেকিয়ে আস্তে করে বললো,,
তুমি ঠিক বলেছো।আমি প্রমিজ করছি এমনটাই হবে।

আচ্ছা চলুন অনেক হয়েছে ওইসব কথা এখন বাবার গুপ্তধনে দেখি কি কি আছে?
বলেই আমি আবার বক্সে হাত দিলাম।

আলিফও অনেক ইচ্ছা নিয়ে বক্সে ঘাটাঘাটি করছে।

আপনি না আদর্শ ছেলে?(আমি ভ্রু কুঁচকে)

যখন লাইফ পার্টনার হয়ে গেছি ক্রাইম পার্টনার হতে সমস্যা কি?(আলিফ চোখ টিপ মেরে)

আমি এক গাল হাসি দিলাম আলিফের দিকে তাকিয়ে।

আলিফ এই দেখুন।এইটা আমার পুতুল,বাবা নিজের হাতে কাপড় আর তুলো দিয়ে বানিয়ে দিয়েছিল।(পুতুল দেখিয়ে)আসলে আমার একটা দোকানের পুতুল দেখে খুব ভালো লেগেছিলো।কিন্তু ওই দোকানে একটাই ঐরকম পুতুল ছিলো।আর আমরা যাওয়ার আগেই কেউ একজন এসে পুতুলটা কিনে নিয়ে গেলো।তাই আমি অনেক কান্নাকাটি করেছিলাম।বাবা বলেছিলো অন্য রকম পুতুল কিনে নিতে কিন্তু আমি ছিলাম জেদী,ওই পুতুল আমার লাগবেই।তাই বাবাই কোনমতে আমার জন্য এমন একটা পুতুল বানিয়েছে।যদিও এই পুতুল ওই পুতুলের ধারের কাছেও যায়নি।তবুও এইটা আমার কাছে স্পেশাল কারণ বাবা এইটা আমার জন্য বানিয়েছে।ভাবছিলাম এইটা হয়তো আমি হারিয়ে ফেলেছি।কিন্তু ভাবতে পারিনি বাবা এইটা নিজের কাছে রেখে দিয়েছে।(আমি পুতুলটাকে জড়িয়ে ধরে)

বাহ!ভালো তো।কিন্তু আমি তার থেকে ভালো কিছু পেয়েছি।(আলিফ একটা ছবি দেখিয়ে ডেভিল হাসি দিয়ে)

কি এইটা!(আমি সন্দেহ দৃষ্টিতে)

কেউ একজন খালি গায়ে মাটিতে বসে ভে করে কান্না করছে,নাক গিয়ে সর্দিও পড়ছে।আর এমন স্বরনীয় দৃশ্যটাকে একটা ফ্রেমে বন্দী করে রাখা হয়েছে।আর এখন সেটা আমার হাতে।(আলিফ😎)

আলিফ খুব খারাপ হয়ে যাবে।এইটা তো ফেলে দিয়েছিলাম।এখানে আসলো কি করে?বাবাও না।যা খুশি এনে রেখে দিয়েছে।আলিফ দেন এইটা আমার কাছে!(আমি আলিফের কাছ থেকে ছবিটা নেয়ার চেষ্টা করে)

না না।ভুলেও দেবো না।আগেই বলছি অন্যর পার্সোনাল জিনিসে হাত দিতে না।এখন দেখলে নিজের পার্সোনাল জিনিস বেরিয়ে আসলো।এইটাকে তো আমি ফ্রেমে বন্দী করে বাঁধিয়ে রাখবো।(আলিফ হাসতে হাসতে)

আলিফ দিন বলছি।
বলেই আমি আর আলিফ ধস্তাধস্তি করতে লাগলাম।

ধস্তাধস্তি করতে করতে আমি গিয়ে আলিফের বুকে পড়লাম।আলিফ এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।আমিও উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম।উনার চোখে একটা নেশা রয়েছে।একবার তাকিয়ে থাকলে তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছে করে।আলিফ আসতে করে আমার কপালের চুল গুলো কানের পেছনে গুজে দিল।আর ঠোঁট জোড়া খুব কাছাকাছি নিয়ে আসলো আর তখনই আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম।চোখ বন্ধ করার পর বুঝতে পারলাম উনি আমার কপালে চুমু দিলো।আমি চোখ খুলতেই উনি কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,,
ভালোবাসার পরশ কপালেই সুন্দর।by the way তুমি কি অন্য কিছু ভাবছিলে? ইশ!কি লুচ্চু তুমি,হিয়া!

আমি তাড়াতাড়ি উনার উপর থেকে উঠে নাক ফুলিয়ে বললাম,,,
যার মনে যা লাফ দিয়ে উঠে তা।

আলিফও হাসতে হাসতে উঠলো।পরেই আলিফের চোখ গেলো বক্সে থাকা একটা সাদা কাগজে।

এইটা কি?(আলিফ কাগজটা হাতে নিয়ে)

আমিও কৌতূহল নিয়ে কাগজের দিকে তাকালাম।কাগজটা দেখেই আমাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো।
আমি আর আলিফ একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছি।


কিছুক্ষণ পর
আমি বেলকনিতে দাড়িয়ে আছি।আলিফ আমার পাশেই দাড়িয়ে আছে।

তাহলে তাদের ডিভোর্স হয়নি?(আলিফ আকাশের দিকে তাকিয়ে)

আমি চুপ করে আছি।
আসলে কাগজটা ছিলো বাবা আর মার ডিভোর্স পেপার।সেখানে মা স্বাক্ষর করেছে কিন্তু বাবা করেনি।বাবা হয়তো দেখতে চেয়েছিলো ডিভোর্স পেপার মার সামনে দিলে উনি কেমন রিয়েক্ট করে।যেহেতু উনি কিছু না বলেই স্বাক্ষর করে দিয়েছে এতে বাবাও হয়তো অবাক হয়ে গেছে।কিন্তু ভালোবাসার মানুষটাকে দূরে সরিয়ে দিলেও ডিভোর্স পেপার এ স্বাক্ষর করার শক্তি বাবার হয়ে উঠে নি।সবাইকে বাবা জানিয়েছে উনাদের ডিভোর্স হয়েছে।কিন্তু আসল কথা তাদের কোনোদিন ডিভোর্স হয়নি।কারণ বাবা তাতে স্বাক্ষর করে নি।

আমি স্থির দাড়িয়ে আছি।

আলিফ আমাকে ধাক্কা দিয়ে বললো,,
হিয়া কিছু বলো?

তারা একে অপরকে ভালোবাসে!তবুও তারা একে অপরের সাথে থাকতে পারলো না।এতই কষ্ট!ভালোবাসার মানুষের সাথে থাকা!মাঝে মধ্যে মনে হয় সম্পর্ক কতো সহজ আবার মাঝে মধ্যে মনে হয় এগুলো এতটাই ভারী যে বয়ে নেয়াই অসম্ভব।(আমি নিচের দিকে তাকিয়ে)

এখন তুমি কি করবে?(আলিফ)

আমি আলিফের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে,,,
তুমি চিন্তা করো না।ওইটা উনাদের মধ্যের কথা।আমি উনাদের মধ্যে পড়তে চাইনা।আমিও তোমার মত দর্শক।আমি শুধু দেখবো ভাগ্য আমার মা আর বাবাকে কোথায় নিয়ে যায়?(আমি আলিফের গালে হাত দিয়ে)
তবে একটা কথা!আর যাই হোক আমাদের সম্পর্ক আমি কিছুতেই উনাদের মত হতে দেবো না।ভালোবাসি কি বাসি না,জানি না।তবে আপনার থেকে কখনও দূরে যাবো না।আজকের পর থেকে না এই বিয়ে থেকে না আপনার থেকে, কারো থেকে পালাবো না।আমি কিছুতেই আমার বাবা মার মতো হবো না।আমার সম্পর্ক আর ভাঙবে না।তাই আলিফ?(আমি কাদতে কাদতে)

আলিফ আমার গালে হাত রেখে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,,
হুম।আমাদের সম্পর্ক কখনই উনাদের মত হবে না।


চলবে,,,

Happily Married Part-13

0

#Happily_Married❣️
#Part_13
Writer:: Shaanj Nahar Sanjida


সোফায় হিয়া ঘুমিয়ে আছে।আলিফ উঠে দরজায় হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আকাশের চাঁদ দেখছে।আজ চাঁদটা খুবই সুন্দর।হয়তো পূর্ণিমা,,হয়তো না আমি শিওর পূর্ণিমা।
কেনো জানি আজ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।কোনো দিন এইভাবে আকাশ দেখা হয়নি তবে আজ খুব ভালো লাগছে আকাশ দেখতে।হিয়া থাকলে আরো ভালো লাগতো।তবে যাই হোক আজ ওর উপর দিয়ে যা গেলো।মেয়েটা ছোটো থেকে কতো কিছু সহ্য করেছে।ভাবতে পারিনি ওর ওইসব কিছু করার পেছনে এতো বড় কারন হবে।তারউপর এতো বছর পর যার সাথে দেখা হয়েছে তাকে ও সারা জীবন ঘৃনা করে এসেছে।এইভাবে হুট করে দেখা হওয়াতেও ও অনেক ধাক্কা খেয়েছে।তবে যাই হোক দুই পক্ষের কথাটা শুনার জন্য ও নিজে থেকেই বলেছে বলে আমার চিন্তা মুক্ত হয়েছে।হিয়া,আমি জানতে চাই দুজনের কথা শুনে তুমি কি সিদ্ধান্ত নেও!
ভেবেই আলিফ হিয়ার দিকে তাকালো।হিয়া নিষ্পাপ শিশুর মত হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে।মাঝে মধ্যে ঠান্ডা লাগছে বলে কাচু মাচু হয়ে যায়।আলিফ নিজের কোটটা হিয়ার উপর জড়িয়ে দিলো।

কিছুক্ষণ পর পিয়াস ফোন করলো তখন মধ্য রাত।

হ্যালো পিয়াস!(আলিফ)

হুম।পেয়েছিস হিয়াকে?(পিয়াস)

হুম।পেয়েছি।(আলিফ হিয়ার দিকে তাকিয়ে)

ও কেমন আছে?(পিয়াস চিন্তিত সুরে)

ভালোই আছে।নিজেকে সামলে নেয়ার শক্তি আছে মেয়েটার।(আলিফ)

হুম।তবে কি রাজি হয়েছে?(পিয়াস)

হুম।রাজি হয়েছে।তোকে বলেছে রিয়া আন্টিকে নিয়ে সকালে ওদের বাড়িতে আসতে।আমিও ওকে নিয়ে ওর বাড়িতে যাবো।হিমেল আঙ্কেলকে এখনও কিছু বলি নি।তবে উনাকে ও বাড়িতে গিয়েই বলবো।(আলিফ)

আচ্ছা।আমি এখন হিমেল আংকেলের বাড়ি থেকে বাসায় আসলাম। ফুপিও আমার সাথে এসেছে।অনেক চিন্তিত মনে হচ্ছে।আমি ভাবতে পারিনি উনি ওভাবে হুট করে হিয়ার সামনে চলে যাবে। অবশ্য উনি তোর আর হিয়ার বিয়ের ছবি দেখে কেমন যেনো রিয়েক্ট করছিলো।তবে ভাবতে পারিনি ওই রিয়েক্ট করার পেছনে এতো বড় একটা কারণ থাকবে।এখন নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে।(পিয়াস মনমরা হয়ে)

তোর আবার নিজেকে অপরাধী কেনো মনে হবে?(আলিফ অবাক হয়ে)

আমার জন্যই ত ফুপি এইসব করেছে।আমিই এক প্রকার কারণ।যার কারণে ফুপি আর হিয়া আলাদা হয়েছে।(পিয়াস)

দেখ পিয়াস সব সময় তুই আমাকে জ্ঞান দিস!কিন্তু এইবার তুই নিজেই এমন জ্ঞানহীন কথা বলছিস।তোর এখানে কোনো দোষ নেই।এইটা উনাদের দোষ।উনারা নিজেদের অহংকার নিয়ে পরে ছিলো।(আলিফ)

হুম।তোর কি মনে হয় হিয়ামনি আমার উপর রেগে থাকবে?(পিয়াস)

ভুলেও না।আমার চড়ুই পাখির স্বভাব বাচ্চামো হলে কি হবে আমার চড়ুই পাখি অনেক জ্ঞানী।বুঝলি?তুই একদম চিন্তা করিস না।এখন একটা ঘুম দে কালকে অনেক কিছুর মুখমুখি হতে হবে,অনেক কিছু সামাল দিতে হবে।(আলিফ)

আচ্ছা।তাহলে রাখি তুইও রেস্ট নে।
বলেই পিয়াস ফোন কেটে দিলো।

এখন শুধু সকাল হওয়ার পালা।(আলিফ মনে মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে)


সকালে
ভোরে আমার ঘুম ভাঙলো আলিফের ডাক শুনে।

হিয়া উঠো!সকাল হয়ে গেছে।আমাদের যেতে হবে।(আলিফ)

আমি পিটপিট করে আলিফের তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম,,
আজকে অনেক বড়ো দিন তাই না আলিফ?

হুম।কিন্তু আমি জানি আমার চড়ুই পাখি সব কিছু সামলে নিতে পারবে।
বলেই আলিফ আমার কপালে চুমু দিলো।

আমিও মুচকি হেসে উঠে পড়লাম।


গাড়িতে বসে আছি,,
গাড়ির জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছি।বুকে ধুরফর আওয়াজ করছে।যতই এগুচ্ছি ততই হার্টবিট এতো বেড়ে যাচ্ছে যে বলে বোঝানো সম্ভব না।গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।প্রচুর চিন্তা হচ্ছে।কি হবে এই ভেবে!তারপর একটা দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করলাম।কিছুই হবে না।এইবার যা করার আমিই করব।


বাড়িতে
আমি ফ্রেশ হয়ে বের হতেই পিয়াস ভাইয়া উনার ফুপিকে নিয়ে আসলো।

ভালো করেছো পিয়াস ভাইয়া উনাকে নিয়ে এসেছো।আপনি(রিয়া)ওই রুমে গিয়ে বসুন আমি আসছি।(আমি)

উনি কিছু না বলে আমার দেখানো রুমে গিয়ে বসলো।

পিয়াস ভাইয়া বসার রুমে সোফায় বসে রইলো উনার পাশেই বসে আছে আলিফ।কিচেনে সবার জন্য নাস্তা বানাচ্ছে পিয়া।আমি সোজা গেলাম বাবার কাছে।


বাবার রুমে
আমি ঢুকেই দেখি উনি খুব চিন্তিত হয়ে পায়চারি করছে।

কি হলো?এমন পায়চারি করছো কেনো?(আমি ভ্রু কুঁচকে)

তুই আমাকে বলিস নি কেনো?ওই মহিলা আসবে?(হিমেল সাহেব রাগে)

তোমরা আমাকে জিজ্ঞেস করে ডিভোর্স নিয়েছো?তোমাদের জিজ্ঞেস করে আমি কাজ করবো!(আমি কড়া গলায়)

বাবা চুপ করে আছে।

ওই রুমে চলো।কথা আছে।
বলেই আমি যেতে লাগলাম তখনই বাবা বলে উঠলো,,

আমার ওর সাথে কোনো কথা নেই।

তোমাদের একে অপরের সাথে কোনো কথা নেই আমি তা ভালো করেই জানি।কিন্তু আমার তোমাদের দুজনের সাথে কথা আছে।এখন কি তুমি যাবে?(আমি রেগে)

বাবা আর কিছু না বলে সোজা হাটতে শুরু করলো রুমের দিকে।

চিল্লাচিল্লি না করলে এদের কথা শুনানো যায় না।
বলেই আমিও গেলাম বাবার সাথে।

রুমে ঢুকতে যাবো তখনই আলিফ বললো,,
হিয়া আমি যাবো তোমার সাথে?

আলিফ চিন্তা করো না।এইটা আমার উপর ছেড়ে দাও।আমার কথা শুনলে কিছুই করবো না।আর না হলে,,জানিনা কি করবো?
বলেই আমি রুমে ঢুকলাম।রুমে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিলাম।


পিয়া কিচেন থেকে এসে বললো
শুরু হয়ে গেছে বিশ্ব যুদ্ধ?

হুম।(পিয়াস জোরপূর্বক হাসি দিয়ে)

আচ্ছা।তোমরা বসো আমি চা নিয়ে আসছি।
বলেই পিয়া কিচেনে চলে গেলো।

আলিফ রুমের সামনে পায়চারি করছে।

আলিফ চিন্তা করিস না সব ঠিকই হবে!(পিয়াস)

জানি সব ঠিক হবে।কিন্তু হিয়ার রাগ উঠলে না জানি উনাদের কি হাল করে?আর উনাদের কথায় যদি হিয়া আরো কষ্ট পায়?(আলিফ পায়চারি করতে করতে)

কোনোদিন ভাবিনি তুই এমন করে কারো চিন্তা করবি?(পিয়াস বিড়বিড় করে)

কিছু বললি?(আলিফ)

না। শোন হিয়া ঠিক সামলে নিবে।আর যদি না হয় ওর চাকু তো আছেই।(পিয়াস রিলেক্স হয়ে)

কি?হিয়া কি চাকু নিয়ে ভিতরে গেছে?(আলিফ অবাক হয়ে)

এই দেখো তোমাদের চা এসে পড়েছে!(পিয়া চা আনতে আনতে)

Who knows? চিন্তা করে লাভ নেই।এসে বসে বসে চা খা।(পিয়াস চা খেতে খেতে)

তাও ঠিক চিন্তা করে লাভ নেই।চা খাওয়া যাক।
বলেই আলিফও চা খেতে লাগলো।


রুমে
হিমেল সাহেব রিয়া বেগমকে দেখেই অবাক হয়ে গেছে।
আজ কতো বছর পর এই মুখ দেখেছে ঠিক নেই। তবে রোজ এই মুখের স্বপ্নে উনি বিভোর হয়ে থাকতো।এখনও চেহারা থেকে সেই নূর সরেনি।আগের মতই মায়াবী চেহারা।যা দেখে এক দিন মন হারিয়েছিল সে।এখনও আগের মত গোছানো সব।তবে বয়সের ছাপ একটু হলেও মুখে দেখা যাচ্ছে।তবে তা মুখটাকে আরো সুন্দর করে তুলেছে।

অন্যদিকে রিয়া বেগমও যে কত বছর পর এই মুখটা দেখেছে হিসেব নেই।তবে এমন একটা দিন রাত নেই উনি এই মুখটাকে মিস করেনি।এখনও অগোছালো লোকটা,ঘুম থেকে উঠেই চুল আঁচড়ানোর কথা এখনও উনি ভুলে যায়।চোখে চশমা লেগেছে!বয়স শুধু আমাকে না উনাকেও ঘিরে ধরেছে।তবে দেখেই বোঝা যাচ্ছে নিজের একদম খেয়াল রাখে না।অবশ্য রাখবে কি করে জেদ থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে চোখ দিলি তো খেয়াল রাখবে!

আমি টেবিলে বসে আছি আর আমার এক পাশে বসে আছে বাবা আরেক পাশে পিয়াস ভাইয়ার ফুপি।এই রুমে এসেছি পনেরো মিনিটের বেশি হবে কিন্তু এই পনেরো বছর উনারা অপলক দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে।যা দেখে আমার কেমন লাগছে আমি বলে বুঝাতে পারবো না।

আমি কাশি দিয়ে বললাম
যদি দেখাদেখির পালা শেষ হয় তাহলে যেই জন্য এই রুমে আসা ওইটা করা যাক।

আমার কথা শুনেই তারা একে অপরের দিকে চাহুনি পরিবর্তন করে মুখ ভেংচিয়ে ঘুরিয়ে নিলো।

আমি একটা দীর্ঘ শ্বাস নিলাম😩

আপনাদের কিছু বলার আছে?
আমার মুখে থেকে এই কথা বের হতে না হতেই বাবা বলে উঠলো।

আমার এই মহিলার সাথে কিছু কথা বলার নেই।(হিমেল সাহেব রেগে)

থাকবে কি করে?তোমার কথা বলার মুখ আছে,হিমেল!(রিয়া বেগম রেগে)

আমার আছে।বলো তোমার নেই।অবশ্য যা করেছো তারপর কারোই কথা বলার সাহস থাকবে না।(হিমেল সাহেব)

তুমি আমাকে করতে বাধ্য করেছো হিমেল!তোমার ইগোর কারণে আমি যেতে বাধ্য হয়েছি।(রিয়া বেগম)

ও এখন আমার দোষ? দেবেই তো এখন আমার দোষ তখনও আমার দোষ ছিল এখনও আমার দোষ।(হিমেল সাহেব)

হ্যা তখনও তোমার দোষ ছিল এখনও তোমারই দোষ।তুমিই আমাকে ডিভোর্স দিয়েছো।আমি না!(রিয়া বেগম)

তাই?ডিভোর্স আমি দিয়ে ছিলাম।কিন্তু সেখানে সাক্ষর তো আর আমি জোর করে নেইনি।আর মেয়ের থেকে দূরে তো তুমি ইচ্ছে করে ছিলে।(হিমেল সাহেব)

তুমি যেখানে আমাকে ডিভোর্স দিয়েছো সেখানে আমার কথা বলার কোনো মানেই হয় না।আর মেয়ের থেকে দূরে আমি ইচ্ছে করে থাকিনি।আমাদের ডিভোর্স এর পরপরই তো তুমি মেয়েকে নিয়ে উধাও হয়ে গেছো।(রিয়া বেগম)

নিজের ভাইয়ের খুনিদের খুঁজে বের করতে পারো অথচ নিজের মেয়ে আর স্বামীকে খুজে বের করতে পারো না।(হিমেল সাহেব)

প্রথমত তুমি আমার স্বামী নও।প্রাক্তন স্বামী।দ্বিতীয়ত তোমার তো বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে আমি আমার ভাইদের খুনিদের বের করার জন্য এইসব করছি।(রিয়া বেগম)

কি করে হবে বিশ্বাস?তোমার কথা তো কোনো বাংলা সিনেমাকেও হার বানাবে!(হিমেল সাহেব)

আমি এতক্ষন উনাদের কথা শুনছিলাম।উনাদের কথা শুনে আমার রাগে ফেটে যেতে ইচ্ছে করছে।এতক্ষন ধৈর্য্য ধরে ধরার পরেও আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলো।আমি একটা চাকু টেবিলের মাঝ বরাবর গেঁথে দিলাম,,

তারা দুজনেই আমার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকালো,,

আমি তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বললাম,,
আপনাদের না এক জনের সাথে আরেকজনের কথা বলার কিছুই ছিলনা।এখন দেখি আপনাদের কথা থামছেই না।এখন সবাই চুপ।শুধু আমি কথা বলবো।শুধু আমি।আর আমি যাকে বলবো সেই কথা বলবে,,যাকে প্রশ্ন করবো সেই উত্তর দেবে।is that clear?(আমি দাত চেপে)

ইয়েস ম্যাম।(হিমেল সাহেব আর রিয়া বেগম)

Very good,,(শান্ত হয়ে)আপনি(রিয়া)বলুন আপনার কথা।কেনো আপনি এইসব করছেন?(আমি উনার দিকে তাকিয়ে)

পরেই উনি আমাকে উনার পক্ষের কথা গুলো বললেন।আমি শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম।বাবার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।আবারও একটা দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বললাম,,
বাবা,তোমার কথাগুলো বলো।

পরেই বাবা আমাকে তার কথা গুলো বললো।
আমি তার কথা গুলো শুনে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছি।

কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিনা?শুধু মাত্র তাদের জিদের জন্য আমার জীবন এমন।
আমি উপর দিকে মাথা তুলে একবার বাবার দিকে একবার পিয়াস ভাইয়ার ফুপির দিকে তাকালাম।

পরেই উঠে তাদের উদ্দেশ্য বললাম,,
আমি এখান থেকে যাচ্ছি।তোমরা এই রুমেই থাকবে,,কি করবে আমি জানি না। তবে হা এক জন আরেক জনের কথা শুনবে,যদি কেউ না শুনে তাহলে জোর করে শোনাও।নিজের মনের কথা বলো,আর যদি কেউ না বলে তাহলে তার মন থেকে কথা গুলো বের করো।আর হা একটা কথা মাথায় রেখো তোমাদের জেদের কারণে তোমাদের জীবন না আমার জীবন খারাপ হয়েছে।আমি এমন একজনে পরিণত হয়েছি যা আমার হওয়ার কথা ছিল না।আর এইসব কিছুর পেছনে দায়ী তোমরা দুজন।আমি কোনো দিন তোমাদের কাউকে ক্ষমা করবো না। তবে যেহেতু তোমরা আমার মা বাবা তাই তোমাদের ঘৃণাও করবো না।আগের হিয়া থাকলে তোমাদের এমন শাস্তি দিতাম তোমরা সারাজীবনের জন্য মনে রাখতে কিন্তু এখন আমি তা করবো না।কারণ যার সাথে বিয়ে হয়েছে তার সাথে থেকে এইটুকু শিখেছি যে সবাইকে একটা সুযোগ দেয়া উচিত।তাই আমিও তোমাদের একটা সুযোগ দেবো।এই সুযোগে তোমরা নিজেদের মধ্যে যা কিছু আছে সব কিছু ঠিক করো।আর না হয় তোমরা দুজনই আমাকে হারাবে!(আমি একদমে)

হিয়াকে হারানোর কথা শুনে দুজনই চমকে উঠলো।

এইবার যদি পালাই এমন জায়গায় যাবো। কেউ খুঁজে পাবে না।আরেকটা কথা।যতদিন না পর্যন্ত তোমাদের মধ্যে সব কিছু ঠিক হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত তোমরা কেউ আমার সাথে কোনো যোগাযোগ করবে না।আগে স্বামী স্ত্রী হয়ে উঠো তারপর না হয় বাবা মা।
বলেই রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম।


রুম থেকে বের হতেই রুমটা বাহিরে থেকে লক করে দিলাম।

কি হলো হিয়া?তুমি রুম বাহিরে থেকে লক করলে কেনো?(আলিফ অবাক হয়ে)

কিছুক্ষণ এভাবে উনাদের ভিতরে থাকতে দাও।আগে উনাদের নিজেদের মধ্যেকার সম্পর্ক ঠিক করুক।তারপর আমার সাথে উনাদের আমাদের সম্পর্ক নিয়ে কথা হবে।
বলেই সোফায় বসলাম।

আলিফও আমার পাশে বসলো।

পিয়া এক কাপ চা দে তো।তাদের কথা শুনে আমার মাথা ব্যাথা শুরু করছে।দুজনই এক রকম জেদী।(আমি)

একদম তোর মত।
বলেই পিয়া চা নিয়ে আসলো।

বলতে খারাপ লাগছে তবে তুই একদম ঠিক বলছিস আজ পিয়া।উনারা একদম আমার মত।(আমি চা খেতে খেতে)

উনারা তোমার মত না তুমি উনাদের মত।(পিয়াস হাসতে হাসতে)

ওই একই হলো।তবে যাই হোক।এখন আমি বুঝতে পারছি।(আমি)

কিহ?(আলিফ)

আমার এই পালিয়ে যাওয়ার অভ্যাস কোথা থেকে আসলো?আমার বাবা মা পালিয়ে বিয়ে করছে,,তারাও নিজেদের পরিস্থিতি থেকে পালায়,,নিজের কথা গুলো থেকে পালায়।(আমি হতাশ হয়ে)

আজ আমি তোমার সাথে এক মত।(আলিফ মজা নিয়ে)

আলিফের কথা শুনে সবাই হেসে উঠলো।

নাও নাও।সবাই মজা নাও।কি আর করার?(হতাশ হয়ে)পিয়া কি রান্না করেছিস?খুব খিদে পেয়েছে কিছুই খায়নি কাল দুপুর থেকে(আমি)

আমিও খায়নি।(আলিফ)

আরে কি বলছিস আমিও তো কালকে দুপুর থেকে কিছু খাইনি!পিয়া তাড়াতাড়ি কিছু একটা বানিয়ে দাও।(পিয়াস)

হ্যা আমি তো এই বাড়ির বাবুর্চি না?(পিয়া কড়া গলায়)

আমরা সবাই পিয়ার কোথায় ভয় পেয়ে গেলাম।

এতো রেগে যাচ্ছিস কেনো?আমি তো রান্না করতে পারি না তুই জানিসই!(আমি ঠোঁট ফুলিয়ে)

জানি জানি।সবার রান্না আমাকেই করতে হয়।
বলেই পিয়া রাগে গজগজ করতে করতে রান্নাঘরে গেলো।

যাই আমি গিয়ে ওকে সাহায্য করি।
বলেই পিয়াস ভাইয়া উঠলো।

তুমি রান্না করতে পারো।(আমি অবাক হয়ে)

হুম।বিভিন্ন জায়গায় ট্রেকিং করার সময় আমিই তো রান্না করি।আর আলিফও তো রান্না করতে পারে!(পিয়াস)

আমি আলিফের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে।

আলিফ হা বোধক মাথা নেড়ে।

এখানে আমিই অকর্মার ঢেঁকি।(আমি হতাশ হয়ে)

পরেই পিয়াস ভাইয়া হাসতে হাসতে রান্না ঘরে গেলো পিয়াকে সাহায্য করতে।

আমি আলিফের কাছকাছি গিয়ে ফিসফিস করে বললাম,,
ওরা দুজন কেমন ক্লোজ ক্লোজ মনে হচ্ছে না?

হুম।মনে হচ্ছে শীগ্রই আরেকটা বিয়ে খাবো।(আলিফও ফিস ফিস করে)

পরেই আমরা দুজনই দুজনকে দিকে তাকিয়ে হেসে দিলাম।


চলবে,,,,

Happily Married Part-12

0

#Happily_Married❣️
#Part_12
Writer:: Shaanj Nahar Sanjida


রিয়া, কাদিস না।হিয়া এমনটা ইচ্ছে করে নি।ও নিশ্চয়ই ভুল বুঝছে।(আলেয়া বেগম)

আমি জানি আমার মেয়েটা আমাকে খুব ঘৃনা করছে।(রিয়া বেগম কাদতে কাদতে)

তোর মেয়ে?তার মানে হিয়াকেই তুই ছেড়ে চলে এসেছিলি?(আলেয়া বেগম অবাক হয়ে)

হুম।হিয়া আমার সেই মেয়ে যাকে আমি ছেড়ে চলে এসেছি।কিন্তু আমার যে আর কোনো উপায় ছিল না।(রিয়া বেগম)

কেনো ফুপি?কি এমন হয়েছে যার জন্য তোমার কাছে কোনো উপায় ছিল না!(পিয়াস এসে)

পিয়াস তুমি কখন এলে?(রিয়া)

আমার মনে হচ্ছিলো কোথাও যেনো একটা গন্ডগোল আছে।যখন থেকে তুমি হিয়া আর আলিফের বিয়ের সময় হিমেল আংকেলের ছবি দেখেছো তখন থেকেই তোমাকে কেমন জানি অস্থির লাগছিলো।(পিয়াস ভ্রু কুঁচকে)

রিয়া বেগম চুপ করে আছে।

ফুপি চুপ করে থেকো না।আমি কিন্তু সবই দেখেছি হিয়া তোমাকে দেখে কীভাবে রিয়েক্ট করছে।ওইসব কিন্তু স্বাভাবিক না।(পিয়াস)

পরেই রিয়া বেগম আর উপায়নন্ত না পেয়ে সব কথা খুলে বললো পিয়াসকে।

কিন্তু ফুপি ওদের ছেড়ে আসাই কি তোমার কাছে একটা পথ মনে হয়েছে?(পিয়াস)

তাহলে আর কি করতাম?ও আমাকে সন্দেহ করতো।ভাইয়া মারা যাওয়ার আগে থেকেই কিছু মানুষের কুনজর পড়েছিল কোম্পানিতে।তখন কেউ কারো জান নিতেও পিছু পা হতো না।তোরা তো সবাই জানিস কোম্পানির জন্যই ভাইয়া আর ভাবীকে খুন করা হয়েছিল আর খুনটা ভাইয়ার বিজনেস পার্টনাররা করেছে।তারপর তাকে অ্যাকসিডেন্ট বানিয়ে দেয়া হয়েছে।ওদের কে ধরতে আমাকে একা কাজ করতে হতো।ওরা যদি হিয়ার খোজ পেয়ে যায় তাহলে আমাকে থামাতে হিয়ার ক্ষতি করতে পারতো।তাই আমি চাইলেও হিয়াকে নিজের সাথে কোম্পানিতে নিয়ে যেতে পারতাম না।(রিয়া বেগম)

কিন্তু তুমি হিমেল আঙ্কেলকে বলতে পারতে?(পিয়াস)

হ্যা(তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে)তোর হিমেল আঙ্কেল এইটা কোনো দিন চাইই নি যে আমি কোম্পানিতে যাই।মেয়েদের সফলতা সহ্য করতে পারে কজন পুরুষ?উনাকে আমি এতো করে বললাম আমার সাথে প্লিজ কোম্পানিতে যোগ দাও আমি একা পেরে উঠছি না।উনি দিলো না।উনার নাকি আত্মসম্মানে লাগবে।তাই আমিও উনার কাছ থেকে কোনো সাহায্য নিলাম না।আমারও তো আত্মসম্মানে লাগবে।তাই একটাই সব কিছু সামাল দিয়েছি।(রিয়া বেগম)

এখন বুঝতে পারলাম হিয়া মনি এতো জেদী কেনো?কারণ যার মা বাবাই এতো জেদী।তাদের এক মাত্র মেয়ে তো জেদী হবেই।(পিয়াস মনে মনে)

আমি রাত করে কেনো বাসায় ফিরতাম তা নিয়ে ওর সাথে আমার ঝগড়া হতো।পিয়াস তখন ছোটো। ও রাতে একা থাকতে ভয় পেতো।ভাইয়া ভাবীর পর ওদের টার্গেট ছিলো পিয়াস ওকে এমনি একা ছাড়তে আমার ভয় হতো।যতই হোক ছোটো থেকে ওকে লালন পালন করেছি।তাই রাতে বেশিরভাগ সময়টাই ওকে দেয়ার চেষ্টা করতাম।তোর হিমেল আঙ্কেলকে বলেছিলাম যে চলো আমরা ও বাড়িতে গিয়ে থাকি কিন্তু তাতেও নাকি উনার আত্মসম্মানে লাগবে।(রিয়া বেগম রেগে)

তাহলে আমাকে তোমাদের সাথে নিয়ে রাখতে?(পিয়াস)

কেনো রাখবো?আমারও তো আত্মসম্মান আছে!ও আমার সাথে ও বাড়িতে থাকবে না, ওর আত্মসম্মানে লাগবে বলে আমিও তোকে এই বাড়িতে আনি নি আমার আত্মসম্মানে লাগবে বলে।(রিয়া বেগম)

পিয়াস মাথায় হাত দিয়ে
কেউ কারো থেকে কম না।(মনে মনে)

সেদিন হিয়ার যখন খুব জ্বর ছিলো আমি কিছুই জানতাম না।সেদিনই আমাদের ওই হত্যাকারী গুলোকে ধরার কথা ছিলো।আমি আরেক অফিসার সেখানে as a couple সেই হোটেলে যাই।সেখানে সারারাত খোজার পর ওদের ধরতে পারে তারা।আমিও তাদের সাথেই ছিলাম আমার ভাইকে যারা মেরেছে তাদের আমি নিজের হাতে ধরতে চেয়েছিলাম।এই কারণে আমার ফোনও সাইলেন্ট ছিলো আমি কিছুই বুঝতে পারিনি।যখন ওই হত্যাকারী গুলো ধরা পড়লো।আমি ফোন হাতে নিতেই হিয়ার খবর শুনতে পাই।আমি তখন ছুটে গিয়েছিলাম হসপিটালে।তারপর সব কিছু ঠিকই চলছিলো কিন্তু তারা আমাকে বিভিন্ন ভাবে প্রেসার দিতো কেস তুলে নেয়ার জন্য।এইজন্যই আমার সংসার বরবাদ করতে ওরা আমাকে বিভিন্ন ম্যাসেজ দিতো কল করতো।অনেক নম্বর দিয়ে বিরক্ত করতো,হুমকি দিতো।তোর আঙ্কেল ছিলো অনেক সাদাসিধে আমি উনাকে এইসব কিছু বলে বিরক্ত করতে চাইনি।ভেবেছি ওরা যখন কোর্টে শাস্তি পাবে তখন বলবো।যখন কোর্টে আমি জিতে যাই তখন আমি তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসি তোর আঙ্কেলকে যা যা হয়েছে সব বলার জন্য।কিন্তু তোর আঙ্কেল আমার হাতে ডিভোর্স পেপার ধরিয়ে দিলো।জানতেও চাইলো না কিছু।তাই আমিও বলিনি।উনি যদি ডিভোর্স নিয়ে খুশি থাকে তবে থাকুক।(রিয়া বেগম)

আবারও জেদ!তোমরা বুঝতে পারছো না তোমরা নিজেদের জেদের স্বীকার হয়েছো!একজন জেদ ধরেছে কিছু জিজ্ঞেস করবে না,আরেকজন জেদ ধরেছে কিছু বলবে না!তোমরা বুঝতে পারো নি এই জেদ তোমাদের জীবনকে ধ্বংস করে দিয়েছে।আর তোমাদের এই জেদের স্বীকার শুধু তোমরা না ওই হিয়া মনিও হয়েছে।তোমরা শুধু নিজেদের জেদটাকে দেখলে আর ওইটা আজ তোমাদের এই অবস্থায় এনে দাড় করিয়ে ছাড়লো।শুনে রাখো এইসব যদি হিয়া শুনে তাহলে তোমাদের ওর হাত থেকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না।চাকু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তোমাদের অবস্থা নাজেহাল করে ঝাড়বে ওই মেয়ে।কারণ ওর জীবনের যতো কষ্ট হয়েছে শুধু মাত্র তোমাদের জেদের জন্য।
বলেই পিয়াস বেরিয়ে গেলো।

রিয়া বেগম সেখানে বসে পিয়াসের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।


হিয়াদের বাড়িতে
সব শুনলাম বাবা কিন্তু হিয়া এখন কোথায় থাকতে পারবে আপনি জানেন?(আলিফ)

আমাদের পুরনো বাড়িতে হতে পারে!(হিমেল সাহেব)

আচ্ছা তাহলে আমি আসি।
বলেই আলিফ বেরিয়ে আসতে লাগলো তখনই পিয়া বললো,,

ভাইয়া আমিও যাই আপনার সাথে।(পিয়া)

না।তুমি এখানে আংকেলের খেয়াল রাখো।
বলেই আলিফ বের হতে যাবে তখনই দেখলো পিয়াস।

পিয়াস কিছু বলবি?(আলিফ বের হতে হতে)

হিয়াকে যে করেই হোক দুই পক্ষের কথা শুনার জন্য রাজি করা!(পিয়াস)

আমি বুঝতে পারছি।
বলেই আলিফ গাড়িতে উঠে চলে গেলো।

পিয়াস একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেললো।


হিমেল সাহেব,পিয়াস আর পিয়া হিয়াদের বাড়িতে বসে আছে।একটু পরেই পিয়া হিয়ার রুমে গিয়ে হিয়াকে ফোন দিলো।দুইবার ফোন বেজে গেলো কেউ ধরলো না।পরেরবার রিং বাজতেই হিয়া ধরলো,,

আমি হেলো বলতেই ওপাশ থেকে কড়া গলায় পিয়া বললো,,

তোকে এখন হাতের কাছে পেলে কষে একটা থাপ্পর মারতম।(পিয়া রেগে)

কেনো?আমি কি করছি!(আমি)

তুই কি করেছিস?তুই ভাইয়ার সাথে ঝগড়া কেনো করেছিস?(পিয়া)

উনি আমাকে কষ্ট দিয়ে কথা বলেছে কেনো?(আমি)

কষ্ট?তুই জানিস কষ্ট কি?দেখ আমি আর আলিফ ভাইয়া হিমেল আংকেলের কাছ থেকে রিয়া আন্টির বেপারে সব শুনেছি।তাই এখন ওইসব বলে কিছু হবে না।(পিয়া)

উনি নাকি আমাকে সহ্য করেছে?এইটার কোনো কথা তোর কাছে হবে?(আমি)

সহ্য করেছেই তো।তুই ভাব এমন একটা দিন গেছে তুই উনার সাথে ভালো করে কথা বলেছিস।উনার জীবনে আসার পর থেকেই একটার পর একটা কান্ড করেই যাচ্ছিস।উনি কোনো দিন কিছু বলেনি।হাসি মুখে সব কিছু সহ্য করেছে।তোর সব ভুল ত্রুটি গুলো উনি ঠিক করে গেছে।কোনো কমপ্লেইন করেনি।আর আজ উনি না জেনে তোর করা কান্ডের উপর একটু কথা শুনিয়েছে বলে তুই এত রেগে আছিস উনার উপর।তাহলে ভাব তুই কি কি করেছিস উনার সাথে?উনি যদি ওইসব ধরতো তাহলে তো তোর কষ্টের সীমা থাকতো না।তুই উনার করা ভুল করে একটা ভুল ক্ষমা করতে পারছিস না,আর উনি তোর ভুলের উপর ভুল ক্ষমা করে আসছে।নিজের জেদ একটু ছাড়।ছেড়ে চোখ খুলে দেখ।না হলে পালাতে পালাতে এতো দূরে পালিয়ে যাবি যে ফিরে আসার কোনো পথ খোলা থাকবে না।আর আলিফ ভাইয়া তোকে ভালোবাসে।অন্তত উনার ভালোবাসার একটু সম্মান করিস।
বলেই পিয়া রাগে ফোনটা কেটে দিলো।

আমি ফ্লোরে ধপ করে বসে পড়লাম।কারণ পিয়ার প্রতিটা কথাই ঠিক।ভুলটা আমারই।আলিফ তো কিছুই জানতো না।না জেনে বলেছে।কিন্তু আমি তো সব জানতাম।আমি ওকে বলতে পারতাম আমার এমন করার কারণ। আলিফকে যদি আমি হারিয়ে ফেলি আমার অনেক কষ্ট হবে।দম বন্ধ হয়ে মরে যাবো আমি।এটা ভালোবাসা নাকি জানি না।


অন্যদিকে
পিয়া হিয়ার রুমে বসে কাদতে লাগলো।তখনই পিয়াস এসে ওর মাথায় হাত বুলাতে লাগলো।পিয়া পিয়াসকে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগলো,,

আমি কি ঠিক করেছি হিয়াকে এতগুলো কথা বলে?হিয়া তো এমনিই কতো কিছু ফেস করেছে ।ওর মনে এতো কষ্ট ছিলো।আমি জানতেই পারলাম না।আর এখন আমি ওকে আরো কথা শুনালাম।(পিয়া কাদতে কাদতে)

পিয়াস পিয়ার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,,
তুমি একদম ঠিক করেছ।তোমার এই কথা গুলো শুনে হিয়া মনিকে একটু হলেও ভাবতে হবে ওর আর আলিফের সম্পর্কটা।আর জেদের কারণে কোনো সম্পর্ক শেষ হতে দেয়া যাবে না।বিয়ে এমন একটা সম্পর্ক যাকে কথায় কথায় ভাঙ্গা যায় না।এইটা হিয়াকেও বুঝতে হবে আর ওদের বাবা মাকেও।


অন্যদিকে
আমি হাটু মুড়ে বসে বসে কাদছি।তখনই হিয়া হিয়া বলে ডাকতে ডাকতে রুমে ঢুকলো আলিফ।

আলিফ তাকিয়েই দেখলো হিয়া কাদঁছে।এই প্রথম ওকে কাদতে দেখেছে।কাদলে ওর মুখটা অনেক মায়াবী লাগে,চোখটা অসহায় লাগে।আলিফ তাড়াতাড়ি ফ্লোরে বসে হিয়াকে জড়িয়ে ধরলো।

আলিফ আমাকে জড়িয়ে ধরতেই আমি ওকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম

আলিফ তুমি এসেছো?আমি ভেবেছিলাম তুমি আসবে না।তুমি রাগ করে থাকবে।(আমি কাদতে কাদতে)

আমি কি করে আমার চড়ুই পাখির উপর রাগ করে থাকবো?তুমি কাদঁছ কেনো?আমি তো তোমাকে কোনদিন কাদতে দেখিনি।তুমিও তো বলেছো বুঝ হওয়ার পর তুমি কখনও কাদো নি।তাহলে এখন কেনো কাদঁছো?(আলিফ হিয়ার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে)

আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে।তাই আপনাআপনি আমার চোখে পানি চলে আসছিল।(আমি চোখ মুছতে মুছতে)

তারমানে আমাকে হারানোর ভয়?(আলিফ খুশি হয়ে)

এতো খুশি হয়ে লাভ নেই।আমি এখনও রেগে আছি।(আমি মুখ ফুলিয়ে)

আচ্ছা তাহলে আমি স,,,
আলিফ কিছু বলতে যাবে তার আগেই আমি ওর মুখ চেপে ধরে বললাম,,
আগে আমি বলবো,,
সরি।

আলিফ মুচকি হেসে আমার কপালে চুমু দিল।


কিছুক্ষণ পর
আলিফ সোফায় বসে আছে আর আমি চুপ করে ওর কোলে শুয়ে আছি।

আমাদের এই পুরনো বাড়ি একতলার।এখানে চারটা রুম আছে।একটা বড়ো বসার ঘর সেখানেই রয়েছে খাবার টেবিল।টেবিলের পাশেই একটা ছোট্ট রুমে রয়েছে রান্নাঘর।কয়েকবছর ধরে এখানে না থাকার কারণে সব জায়গাতে ধুলাবালি জমে আছে।আমি এসে সোফাটা পরিষ্কার করেছি।কেনো জানি ওই বাড়ি থেকে বের হয়ে এই বাড়িতেই আসতে ইচ্ছে করলো।তাই চলে আসলাম।

হিয়া?(আলিফ মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে)

হুম?(আমি)

দরজা খুললে কি করে?(আলিফ)

খুব রাগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিলাম।এখানে এসে দেখি মস্ত বড় এক তালা মারা।তাই রাগে একটা পাথর এনে তালা ভেঙ্গে দেই।(আমি)

তোমার দাড়াই সম্ভব।ভালো যে কারো মাথা ভাঙো নি।(আলিফ হাসতে হাসতে)

আমিও হাসতে লাগলাম,,


কিছুক্ষণ পর
আলিফ?(আমি)

হুম।(আলিফ)

আমি দুই পক্ষের কথা শুনবো।(আমি)

আমারও তাই মনে হয়।(আলিফ)

আজকের রাতটা এখানেই থাকি কালকে যাবো বাড়িতে।তুমি পিয়াস ভাইয়াকে বলবে উনার ফুপিকে যেনো কালকে সকালে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসে।(আমি)

আচ্ছা।এখন ঘুমাও।অনেক রাত হয়েছে।(আলিফ)

হুম।(আমিও গুটিশুটি মেরে আলিফের কোলে কথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম)


চলবে,,,

Happily Married Part-11

0

#Happily_Married🔥
#Part_11(#Surprise_Part)💥
Writer:: Shaanj Nahar Sanjida


আমি নিচে দিয়ে যাওয়ার সময় ওই মহিলার চোখের চোখ পড়লো।উনি লজ্জায় নিজের চোখ নিচে নামিয়ে নিলো।
অন্যদিকে আমি কিছু না বলেই চলে আসলাম।

হিয়া মা।(আলেয়া বেগম অবাক হয়ে)

কিছুক্ষণ পরেই আলিফ নিচে নেমে আসলো।

আলিফ হিয়া মা কোথায় গেলো?কিছু বলেছে ও কেনো রিয়ার সাথে এমন ব্যবহার করেছে?(আলেয়া বেগম)

আন্টি(রিয়ার দিকে তাকিয়ে)ও আমাকে কিছু বলেনি।আপনিই বলুন কেনো হিয়া এমন করেছে।আমি যতটুকু জানি ও কখনও কষ্ট দিয়ে কথা বলে না।কিন্তু আপনাকে ও সহ্য করতে পারে না।এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে।(আলিফ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে)

কি কারণ আছে! তা হিয়ার বাবাই আমার থেকে তোমাকে ভালো বলতে পারবে।(রিয়া বেগম মাথা নিচু করে)

আলিফ সেখানে এক মুহুর্তও দাড়িয়ে না থেকে বেরিয়ে গেলো।আলেয়া বেগম নির্বাক দৃষ্টিতে সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো।

রিয়া বেগম দাড়িয়ে থাকা থেকে ধপাস করে বসে পড়লো।

মেয়েটার মনে এতো ঘৃনা জমেছে। এ কি করলাম আমি?মেয়েটার মনে এতো ঘৃনা দিয়ে ভরিয়ে দিলাম।শুধু মাত্র আমার স্বার্থ রক্ষার জন্য।যেটাকে আমি আমার আত্মসম্মান ভেবেছিলাম সেটা ছিলো মিথ্যা অহংকার।আর এই মিথ্যা অহংকারটাই আমার মেয়েটার জীবনে বিষিয়ে তুলেছে।
ভেবেই রিয়া বেগম সেখানে বসে কাদতে থাকে।


অন্যদিকে
আলিফ ড্রাইভ করতে করতে হিমেলকে ফোন দিলো,,

আসসালমুআলাইকুম বাবা!আপনি এখন কোথায়!(হিমেল সাহেব)

অলাইকুম আসসালাম।আমি তো এখন অফিসে থেকে বাড়ি ফিরছি।কেনো বাবা কিছু হয়েছে?হিয়া কি আবার কিছু করেছে নাকি?(হিমেল সাহেব চিন্তিত হয়ে)

উনি জানেন না কিছু!তারমানে হিয়া উনাকে কিছুই বলেনি।(আলিফ মনে মনে)

আলিফ বাবা?(হিমেল সাহেব)

বাবা তেমন কিছু হয়নি।আমি বাসায় আসছি সেখানেই আপনার সাথে কথা হবে।(আলিফ)

আচ্ছা,বাবা।তুমি এসো।
বলেই হিমেল সাহেব ফোনটা কেটে দিলো।

হিয়া।কোথায় গেছে?(আলিফ মনে মনে)

পরেই আলিফ পিয়াকে ফোন দিলো।

হ্যাল্লো ভাইয়া কেমন আছেন?(পিয়া হাসিমুখে)

পিয়া এখন আমার একটা কাজ করতে হবে!(আলিফ)

জ্বি বলুন ভাইয়া!(পিয়া চিন্তিত হয়ে)

তুমি এক্ষুনি গিয়ে হিয়াদের বাড়িতে গিয়ে দেখবে হিয়া ওদের বাড়িতে নাকি!(আলিফ)

কেনো ভাইয়া?হিয়া কি কিছু করছে নাকি?(পিয়া চিন্তিত হয়ে)

পরেই আলিফ পিয়াকে সব কিছু খুলে বললো।পিয়া হিয়াকে কি করে সামলাতে হয় তা ভালো করেই জানেন।তাই এই সময় ওর থেকে সাহায্য নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ বলে আলিফ মনে করে।যতো হোক হিয়াকে পিয়া এখন পর্যন্ত আলিফ থেকে বেশি চিনে।

আমি এক্ষুনি হিমেল আঙ্কেলকে ফোন করে জিজ্ঞেস করছি।(পিয়া)

না না।পিয়া বাবাকে ফোন করো না।উনি এখন বাসায় নেই।অফিস থেকে ফিরছে মাত্র।আর উনি জানেও না হিয়ার কথা।আমি এসে উনাকে নিজে যা বলার বলবো।তাই তুমি নিজে গিয়ে একটু দেখো।আর যদি ওকে সেখানে পাও।সেখানেই রাখার চেষ্টা করো যতক্ষণ পর্যন্ত আমি না আসছি।আরেকটা কথা ওকে বলো না আমি আসছি না হলে আবার পালাবে।(আলিফ)

ভাইয়া আপনি একদম চিন্তা করবেন না। ও এখানে থাকলে আমি ঠিকই ওকে সামনে নিতে পারবো।(পিয়া)

এই জন্যই তুমিই আমার ভরসা।(আলিফ)

আচ্ছা,ভাইয়া রাখি।
বলেই পিয়া ফোন কেটে এক দৌড় দিয়ে হিয়ার বাড়িতে গেলো।


পাঁচ মিনিট পর পিয়া আবার ফোন করলো,,,
হ্যালো পিয়া পেয়েছো ওকে?(আলিফ)

না ভাইয়া।এতো বড়ো তালা দেয়া।আর আসে পাশেও খুঁজেছি কিন্তু ওকে পায়নি।এখন কি করবো?(পিয়া)

দেখো ওর ফোন এখনও অন আছে।আমি ফোন দিচ্ছি ধরছে না।তুমি ওকে ফোন দিয়ে দেখো ও কি বলে?কোথায় আছে?কেমন আছে।(আলিফ)

ঠিক আছে ভাইয়া।
বলেই পিয়া ফোন কেটে দিলো।


হিয়াদের বাড়িতে,,
তুমি কি বলছো?রিয়া?হিয়া রিয়া নামের এক মহিলাকে দেখে এমন রিয়েক্ট করছে?(হিমেল সাহেব অবাক হয়ে)

হুম।(আলিফ পানি খেতে খেতে)

পরেই হিমেল সাহেব আলমারি খুলে একটা ছবি বের করে আলিফকে দেখিয়ে বললো
দেখো তো বাবা।এইটা কি সেই মহিলা?

আলিফ দেখেই অবাক হয়ে গেলো,
এইটাই তো রিয়া আন্টির ছবি।আপনার কাছে কি করে?

কারণ তোমার রিয়া আন্টিই আমার প্রাক্তন স্ত্রী আর হিয়ার জন্মদাত্রী মা।(হিমেল সাহেব চশমা খুলে সোফায় বসলো)

পিয়া কিচেন থেকে তিনজনের জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে আসে পাশে বসলো।

হিমেল সাহেব বলতে শুরু করলো,,
রিয়া আর আমার বিয়েটা ভালবাসার ছিলো।(হিমেল)

তাহলে বিয়েটা ভাঙলো কি করে?(আলিফ)

আমি তোমাকে শুরু থেকে কাহিনীটা বলি।
রিয়া অনেক বড়লোক ঘরের এক মাত্র মেয়ে ছিলো।আর আমি ছিলাম অনাথ।ভার্সিটিতে পড়াকালীন আমাদের দেখা হয়।সেখান থেকে পরিচয়,পড়ে বন্ধুত্ব তারপর ভালোবাসা।আমার জীবনযাপন খুব সাধারণ।কিন্তু ওদের হাই সোসাইটিতে ফিট হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না।তাই আমি আর রিয়া মিলে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করি।আর এতে আমরা সফলও হই।এই শহর থেকে দূরে আমাদের একটা নতুন জগৎ তৈরি হয়।সব কিছু ঠিকমত চলতেছিল।আমি যতটুকু উপার্জন করতে পারতাম তা দিয়েই আমাদের ছোটো সংসার খুব সুন্দর ভাবে চলে যেত।আমাদের বিয়ের দুই বছর পর আমাদের ঘর আলো করে আসে হিয়া।আমাদের ভালোবাসার নিশানী আমাদের হিয়ামনি।অনেক আদরের মেয়ে ছিলো হিয়া আমার আর রিয়ার।কিন্তু হিয়ার যখন ছয় মাস বয়স তখন রিয়ার বড়ো ভাই আর ভাবী(পিয়াসের মা বাবা) ক্যার অ্যাকসিডেন্টে মারা যায়।তখন রিয়াদের কোম্পানি দেখাশুনা করার জন্য ছিলো না তারপর ওর ভাইয়ের ছেলেও ছোটো ছিল।আর ওর বাবাও কোম্পানি চালানোর মতো অবস্থায় ছিল না।নিজের একমাত্র ছেলে আর ছেলে বউকে হারিয়ে উনিও অনেক নির্জুর হয়ে পড়েছে।এইজন্যই কোনো উপায় না পেয়ে রিয়া কোম্পানির ভার নিজের কাধে নেয়।এতে আমার কোনো আপত্তি ছিলনা । ও আমাকে বলেছে ওদের বাড়িতে গিয়ে থাকতে কিন্তু আমি রাজি হইনি।আমার মান সম্মানে লাগবে বলে। ও আমাকে আর জোর করেনি।
তবে ও অনেক বলতো আমি যেনো ওর সাথে ওদের কোম্পানিতে যোগ দেই।কিন্তু আমি তা চাইনি।আমার আত্মসম্মানের কথা ভেবে।
ধীরে ধীরে আমাদের দূরত্ব বাড়তে লাগলো।আমাদের মধ্যে প্রায় ঝগড়া হতো।কারণ ও কোম্পানি নিয়ে এতই ব্যাস্ত থাকতো যে ওর যে একটা দুধের শিশু আছে ও তা ভুলেই যেতো।আমি সকালে চলে যেতাম, রিয়াও বেরিয়ে যেতো।হিয়াকে আয়ার আছে রেখে যেতো।মেয়েটা মা ছাড়া কিছু বুঝতো না।অনেক কাদত।আমি রিয়াকে বলেছি ওকে নিয়ে অফিসে যাও।তোমার কোম্পানীই তো কেউ কিছু বলার সাহস পাবে না।কিন্তু ও শুনত না।বলতো হিয়াকে নিয়ে গেলে নাকি ওর কাছে বেঘাট ঘটবে।আর কোম্পানিতে নাকি বাচ্চা নিয়ে যাওয়া নিয়ম নেই।এখন বসই নয়ম ভঙ্গ করে তাহলে কেমন দেখায়?এই কথা ভেবে ও আমার মেয়েটাকে রোজ কাদিয়ে অফিসে যেতো।
আমার হাত পা বাঁধা ছিল।আমি করি পরের চাকরি।মেয়েটাকে নিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না।তাই আমারও ওকে ছেড়ে চলে যেতে হতো।রিয়া প্রায় অনেক রাত করে বাসায় ফিরত।জিজ্ঞেস করলে বলতো ওর নাকি অনেক কাজ করতে হয়।ধীরে ধীরে আমাদের দূরত্ব আরো বেড়ে গেলো।ও আমার আর হিয়ার সাথে সময় কাটানো বন্ধ করে দিলো।তবুও ওকে ভালোবাসি বলে কিছু বলতাম না।মাঝে মধ্যে দুইতিন দিন হয়ে যেতো বাড়ি ফিরত না।তবুও কিছু বলতাম না।
কিন্তু যখন হিয়ার এক বছর তিন মাস তখন ওর অনেক জ্বর হয়। আয়া রিয়াকে এতো ফোন করেছিলো কিন্তু ওকে ফোনে পায়নি।তারপর আমাকে ফোন করলো।আমি সব কিছু ফেলে মেয়ের কাছে চলে আসি।সেদিন হসপিটালে আমার মেয়েটার ওই অসহায় মুখ দেখে আমার বুকটা কেঁপে উঠলো। আয়া কোনোদিন কি মায়ের মত যত্ন নিতে পারে?অযত্নে মেয়েটার চেহারা খুব খারাপ হয়ে গেছিলো।সেদিন সারারাত ফোন করেও রিয়াকে পায়নি।সকাল বেলা মেয়েটার অবস্থা একটু ভালো হয় তখনই রিয়া হন্তদন্ত হয়ে হসপিটালে আসে।ওর চেহারাতেও রয়েছে চিন্তার ছাপ। ও হসপিটালে এসেই মেয়ের অবস্থা দেখে কাদতে শুরু করলো।তাই আমি আর কিছু বললাম না।ওকে আশ্বস্ত করলাম মেয়েটা ভালো হয়ে যাবে।কিছুদিন সব ঠিক চলো।রিয়া আমাদের সাথে সময় কাটাতে শুরু করলো।ঠিক মত বাড়িতে আসতেও শুরু করলো।আমি ভাবলাম যাক সব কিছু ঠিক হয়ে গেছে।
একদিন রিয়ার ফোনে একটা ম্যাসেজ আসলো।
আবার কবে দেখা করছো?

আমি ম্যাসেজটা দেখতেই রিয়া আমার কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে গেলো।আমাকে ঝাড়ি দিয়ে বললো ওর ফোনে কেনো হাত দিয়েছি।কতো পার্সোনাল জিনিস থাকতে পারে।সেদিন যেনো আমি কোনো অপরিচিত মানুষকে নিজের সামনে পেয়েছি।
অবশেষে আমাদের সম্পর্ক ইতি ঘটল যেদিন আমি জানতে পারলাম আমার মেয়ের হসপিটালে ভর্তির সময় ও কারো সাথে হোটেলে ছিলো।আমার বিশ্বাস ভেঙ্গে গেলো।সেদিন অনেক ঝগড়া হলো আমাদের।ডিভোর্স হয়ে গেলো আমাদের।রিয়া আমাদের ছেড়ে চলে গেলো। অবশ্য ও হিয়াকে ওর সাথে নিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু আমিই দেইনি।কারণ আমি জানি ও আমার মেয়ের খেয়াল রাখতে পারবে না।ওকে নিয়ে ওই বাড়ি শহর ছেড়ে চলে গেলাম।হিয়া আমাকে প্রায়ই ওর মায়ের কথা জিজ্ঞেস করতো।যখন আমাদের ডিভোর্স হয় তখন ওর বয়স দেড় বছর ছিলো।যখন ওর বুঝ হয় তখন আমি ওকে সব কিছু বলি।কারণ ও যতো তাড়াতাড়ি জানবে ততই ওর জন্য ভালো হবে কিন্তু এইটাই আমার ভুল ছিল।সব কাহিনী শুনার পর ওর সম্পর্ক,ভালোবাসা গুলো থেকে বিশ্বাসই উঠে আসে। ও মানুষকে বিশ্বাস করাই বন্ধ করে দেয়। কারো সাথে কথা বলতেও চাইতো না।তাই ওকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি যদি ও কারো সাথে একটু মিশতে পারে।এইখানে এসেছি যখন হিয়ার পাঁচ বছর ছিলো।এখানে আসার পর হিয়া,পিয়া আর আকাশের সাথে মিশতে পেরেছে বলে এখানেই থেকে যাই।হিয়া ওর মার জন্য এতো রাগ পুষে রেখেছে যে এইসব কিছু জানার পর আমার কাছ থেকে ওর মায়ের নাম কি ছিল ও তাও জানতে চাইনি কোনো দিন।তবে ওর মার ছবি ও একদিন দেখে ছিলো আর বলেছিলো এই মহিলাকে ও অনেক ঘৃনা করে।আমি কোনো দিন চাইনি হিয়া ওর মাকে ঘৃনা করুক।কিন্তু পরিস্থিতির ওকে এমন বানিয়ে ফেলেছে।
তাই তো যখন বিয়ের কথা আসে তখন ওর মনে হয় ওর বিয়েটাও ভেঙ্গে যাবে। ওও ওর বাবার মতো একা হয়ে যাবে।আমার একাকীত্ব ওর উপর প্রভাব ফেলেছে।ও একা থাকতে ভয় পায়,একা হতে ভয় পায়,মিশতে ভয় পায়,সম্পর্ক তৈরিতে ভয় পায়,ওগুলো ভাঙার ভয় পায়।

ওর মনে সব সময় ভয় থাকতো আমিও হয়তো কোনো একদিন ওকে ছেড়ে চলে যাবো।অন্য কেউকে বিয়ে করবো আর ওকে ভুলে যাবো।তাই ও সব কিছুর জন্য আমার উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতো।আমি রান্না করে খাওয়ালে খাবে,আমি না রান্না করলে সারাদিন রাত না খেয়ে থাকবে।যদি বলতাম কিছু রান্না করে খেয়ে নিতে। ও খেতো না।না খেয়ে থাকবে তবুও রান্না করবে না।আজ পর্যন্ত একটা ডিম ভাজি করে খায়নি।বাড়িতে রান্নাঘর কোন দিকে জিজ্ঞেস করলে ও বলতে পারবে না।(হিমেল সাহেব)

হিমেল সাহেবের এই কথা শুনে আলিফ মুচকি হাসি দিল।
সেদিনও হিয়া কতো মজা করে সবার জন্য খাবার বানালো। কোনোদিনও আমি ভাবিনি হিয়ার ওই বাচ্চামী,জেদী চেহারার পেছনে এতো ভীতু আর ভয় পাওয়া একটা মেয়ের চেহারা দেখতে পারবো।কি কি ফেস করেছে মেয়েটা?একটা ভাঙ্গা পরিবার যে একটা বাচ্চার উপর কতটা প্রভাব ফেলে তা আর কারো অজানা না।মেয়েটা যতো হাসিখুশি থাকুক ওর মনের মধ্যে এক পাহাড় সমান কষ্ট।তার উপর আজকে আমি আবার ওকে কতো কিছু শুনিয়েছি।(আলিফ মনে মনে অনুতপ্ত হয়ে)

এমনকি আমি পড়তে বসালেই ও পড়তে বসতো,কোনো প্রাইভেট টিচারের কাছেও পড়তো না।ওর মনে হয় আমার প্রতি ও যদি সব কাজের জন্য নির্ভরশীল হয়ে থাকে তবে আমি ওকে ছেড়ে যাবো না।(হিমেল সাহেব মুচকি হেসে)

হুম।কারণ ও সম্পর্ক নিয়ে অনেক ভয় পায়।(আলিফ)


চলবে,,,

Happily Married Part-10

0

#Happily_Married🔥
#Part_10(#ধামাকা_স্পেশাল_1)💥
Writer:: Shaanj Nahar Sanjida


বাহ!কি সুন্দর দৃশ্য!(রামিম সাহেব বসতে বসতে)

তুমি কি সুন্দর দৃশ্য বলছো?আমি তো ভাবছি আজকে নাস্তা খাবো নাকি বিষ!কারণ যে নাস্তা বানাচ্ছে তার উপর আমার কোনো ভরসা নেই।(আলিফ আফসোস করে)

আপনার জন্য দুটোই অফার আছে নাস্তা খেতে পারেন আর না হয় আমি সাদরে আপনাকে নিজের হাতে বিষ খাইয়ে দেবো।কোনটা চান বলুন।মেনুতে সবকিছুই রয়েছে।(আমি হাতে খুন্তি নিয়ে)

তোমাকে এই রূপে দেখে আমার জীবন ধন্য হয়ে গেছে বুঝছো!এখন বিষ খাইলেও কোনো সমস্যা নেই।আর যদি নিজের হাতে খাওয়াও তাহলে আমি তো সাদরে গ্রহণ করবো।
বলেই আলিফ হা করলো।

আমি উনার কান্ড দেখে হেসে উঠলাম।

পরেই আমাদের কথার মাঝখানে বাবাই কাশি দিয়ে উঠলো।

হিয়া মা এসো সব কিছু নিয়ে টেবিলে সাজাও।(আলেয়া বেগম)

আসছি মামনি।
বলেই আমি রান্নাঘরে ঢুকলাম।

তোর এই রূপ আমার অজানা আলিফ!(রামিম সাহেব)

তাই নাকি?এখন থেকে রোজ এই রূপ দেখবে বাবা!(আলিফ হাসতে হাসতে)

আমি তো চাইই তুই খুশিতে থাক।(রামিম সাহেব মুচকি হেসে)

হুম বাবা।এখন থেকে খুশিই থাকবো।(আলিফ)

এইযে এসে পড়েছে সব খাবার।আজ সব গুলো ভাবী রান্না করেছে।যদিও আম্মু দেখিয়ে দিয়েছে।আর আমি সব কিছু টেস্ট করার বিভাগে ছিলাম।সো টেস্ট নিয়ে কোনো চিন্তা নেই।সব কিছু একদম ফাটাফাটি হয়েছে।(আলিশা)

আমিও ওর পাশে দাড়িয়ে সব কিছু শুনে হাসছি।

হিয়া মা। তুমিও আমাদের সাথে বসো।(রামিম সাহেব)

বাবাই তাহলে সার্ভ করবে কে?(আমি)

চিন্তা করো না ওইটা সার্ভেন্ট করে দেবে।আমাদের পরিবারের নিয়ম সবাই মিলে এক সাথে এক বেলা হলেও খাবার খায়।(রামিম সাহেব)

আচ্ছা।
বলেই আমিও বসে পড়লাম।

পরেই সার্ভেন্ট আমাদের খাবার বেরে দিলো।

ভাই কেমন হয়েছে ভাবীর রান্না?(আলিশা অনেক উৎসাহ নিয়ে তাকিয়ে)

আগে সব কিছু টেস্ট করতে তো দে।
বলেই আলিফ সব কিছু একটু একটু টেস্ট করছে আর খুদ ধরছে বলছে এইটার লবণ কম হয়েছে,তো ঐটাই নুন বেশি,আরেকটায় এই কম,তো ওইটা কম।
একটা খাবারের প্রশংসাও করছে না।

কি করছিস আলিফ?মেয়েটা কোতো কষ্ট করে আমাদের জন্য রান্না করেছে আর তুই খুদ বের করছিস?(আলেয়া বেগম)

মা আমি আর কি করলাম?সত্যিই কথাই বলছি।(আলিফ)

আমি আলিফের কাছ থেকে সব গুলো ডিস সরিয়ে বললাম
আপনাকে খেতে হবে না।তাই খাবার গুলো সরিয়ে নিলাম।

আরে কি করছো?আমি খাচ্ছি কই!আমি তো শুধু টেস্ট করছি।(আলিফ)

আলিফ তোর টেস্ট করতে হবে না।আমরাই টেস্ট করছি।হিয়া মা তুমি একদম ঠিক বলছো ওর খেতে হবে না।(রামিম সাহেব)

একদিনেই আমার পরিবারকে আমার শত্রু বানিয়ে ফেললে।এখন তো আমিই সব গুলো একাই খাবো।বলেই আলিফ আমার হাত থেকে খাবার নিয়ে খেতে শুরু করলো।

এইভাবেই হাসি দুষ্টামি করতে করতে আমাদের খাবার শেষ হলো।
আমি অযথাই এতো চিন্তা করছিলাম।উনাদের সাথে আমি হাসিখুশিই থাকবো।কষ্ট পেতে হবে না।এখন তো আমার তাই মনে হচ্ছে।উনারা আমাকে কতো তাড়াতাড়ি আমাকে আপন করে নিলো।আমি এতো তামসা করার পরেও আমাকে কিছু বললো না।আমার সাথে কতো তাড়াতাড়ি মিশে গেলো।আমিও কেমন জানি নিজের কথা ভুলে উনাদের সাথে মিশে যাচ্ছি।তবে কি ছয় মাস পর আমাদের এই সম্পর্ক আমার কাছে বোজা মনে হবে না।(আমি মনে মনে)


সকালে খাওয়া শেষ করে
আমি রুমে এসেই বাবাকে ফোন দিলাম।

আসসালমুআলাইকুম আব্বু।(আমি)

অলাইকুম আসসালাম।তুই কবে থেকে এত ভদ্র হলি। ফোনে প্রথমেই সালাম।(হিমেল সাহেব)

দেখো ভদ্র হয়েছি বলে যে অভদ্র হতে পারবো না এই চিন্তা কিন্তু করো না।আমার অভদ্র হতে কিন্তু এক সেকেন্ডেও লাগবে না।(আমি)

তাতো জানি এতো তাড়াতাড়ি তো ঠিক হওয়ার মেয়ে তুমি না।(হিমেল সাহেব)

তুমি কিন্তু গায়ে পরে ঝগড়া করছো আব্বু।(আমি)

ওপাশ চুপ হয়ে গেলো।তবুও যেনো আমার মনে হচ্ছে কেউ ফুফিয়ে কাদঁছে।

আব্বু।আমি তোমাকে একটুও মিস করি না।(আমারও গলা ধরে আসলো)

আমিও তোকে একটুও মিস করিনি।তাই তো এখন ঝগড়াটাও আমাকে ইমোশনাল করতে পারলো না।(হিমেল সাহেব কাদতে কাদতে)

আব্বু।আমি খুব সুখে আছি।(আমি)

আমি জানি।(হিমেল সাহেব)

তারা কেউ আমাকে তোমার মত বকে না।(আমি)

আমি জানি।(হিমেল সাহেব)

তুমি খুব খারাপ।উনারা অনেক ভালো।(আমি কাপা কাপা কণ্ঠে)

আমি জানি।(হিমেল সাহেব)

আব্বু তোমাকে খুব ভালোবাসি।(আমি মনমরা হয়ে)

আমি জানি।(হিমেল সাহেব)

তুমি কেনো জানো সব?(আমি)

কারণ আমি তোর আব্বু যে।যাক আর মন খারাপ করতে হবে না।আচ্ছা বল তুই সেখানে গিয়ে কি কি করলি?(হিমেল সাহেব)

পরেই আমি আর বাবা মিলে অনেকক্ষন গল্প করলাম।


বিকেলে
আলিফ রুমে বসে বসে খেলা দেখছে। আজ অফিসে যাবে না।কাল থেকে অফিসে যাবে।

আলিফ।তোমাকে কিছু বলার ছিলো।(আমি)

হুম। বলো।(আলিফ)

আমাদের বৌভাত এখন না ছয় মাস পরে করো।আসলে আমি দেখতে চাই এই ছয় মাস পরে আমার জীবন কি হয়?ছয় মাস পরে যদি আমি থাকি তাহলে আমি বৌভাতটা এনজয় করতে পারবো।এখন আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে।(আমি নিচের দিকে তাকিয়ে)

আলিফ মুচকি হেসে বললো
আমিও বাবাকে গিয়ে একটু আগেই বলেছি তোমার আর আমার বৌভাত ছয় মাস পরে হবে।আর এতে উনি সায় দিয়েছে।

আপনি কি করে আমার মনের কথা বুঝতে পারেন?(আমি অবাক হয়ে)

কারণ তুমি আমার কাছে একটা খোলা বইয়ের মত।খুব সহজে তোমাকে বোঝা যায়।
বলেই আলিফ আমার নাকে টান মেরে,
বাহিরে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললো।
আমি একটু পরেই আসছি তুমি তৈরি থাকো।

আপনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে উনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
উনি কিসের জন্য আমাকে তৈরি থাকতে বলেছে?


কিছুক্ষণ পর
আমি টেবিলে বসে আছি সামনে বসে আছে আলিফ,,
আপনি এইজন্যই আমাকে বলেছেন তৈরি থাকতে?(আমি দাত চেপে)

হুম।(আলিফ হা বোধক মাথা নেড়ে)

আমি আমার বামে তাকিয়ে দেখি সেখানে দাঁড়িয়ে আছে আকাশ আর ডানে দাড়িয়ে আছে পিয়া।আর ওদের হাতে ভার্সিটির নোটস।

এইনে বিয়ের আগের পনেরো দিনের নোটস।
বলেই টেবিলের বা দিকে খাতাটা রাখলো আকাশ।

আর এই নে বিয়ের পরের পনেরো দিনের নোটস।
বলেই টেবিলের ডান দিকে খাতাটা রাখলো পিয়া।

আমি একবার ডান তো একবার বাম দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে ওদের মুখে বিজয়ের হাসি।কারণ আমি যে এখন ফাঁদে পড়ছি।

আমি সামনে বসে থাকা আলিফের দিকে কিউট ফেস করে তাকালাম,,,

কিউট ফেস করে লাভ নেই!এই নোটস গুলো পাঁচ দিনের মধ্যে শেষ করবে!(আলিফ)

নাউজুবিল্লাহ।এই নোটস গুলো শেষ করতে আমার মিনিমাম ছয় মাস লাগবে।(আমি ঠোঁট ফুলিয়ে)

কয় মাস লাগবে?
বলেই আলিফ নিচে থেকে একটা বেতের লাঠি বের করলো।

আপনি এখন আমাকে মারবেন?(আমি ঠোঁট ফুলিয়ে)

তোমার বাবা মানে আমার শ্বশুর মশাই এর সাথে আমার কথা হয়েছে।উনি আমাকে বলেছে তুমি নাকি একদম পড়তে বসো না।(আলিফ)

আমি বসি তো। তা না হলে আমার এতো ভালো রেজাল্ট হয় কি করে?(আমি)

কারণ আঙ্কেল সারারাত তোকে নিয়ে বসে থাকে।তুই নিজে থেকে জীবনেও পড়তে বসিস না।জানেন ভাইয়া আংকেলের যদি চোখ এদিক থেকে ওদিক যায় তবেই ও ফাঁকি দেওয়া শুরু করে দেয়।(পিয়া)

ওই মীর জাফর।(আমি রেগে)

ও তো ঠিকই বলছে।তুই যে আঙ্কেলকে কতো জ্বালিয়েছিস আমরা নিজের চোখে দেখেছি।(আকাশ)

ওই,,,
আমি আকাশকে কিছু বলতে যাবো তার আগেই আলিফ জোরে টেবিলে একটা বারি দিয়ে বললো,,
চুপ।কোনো কথা না।বাবা(হিমেল) তোমাকে লাই দিয়ে মাথায় তুলেছে।

একমাত্র মেয়ে মাথায় তো তুলবেই!(আমি ঠোঁট ফুলিয়ে)

কিন্তু আমি তেমন কিছু করবো না।খালি একটু রেজাল্ট খারাপ আসুক।তারপর দেখো কি করি?(আলিফ)

কি শাস্তি দিবেন?(আমি ভ্রু কুঁচকে)

আলিফ আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,,
তোমাকে তো মারতে পারবো না।তবে রোমান্টিক শাস্তি দিবো।
বলেই আকাশ আর পিয়ার সামনেই কানে কিস করলো।

আর এইটা দেখেই আকাশ আর পিয়া হা হয়ে গেলো।কিন্তু আমি তো জানি ওই বদ দুটো আমার এই অবস্থা দেখে খুবই মজা নিচ্ছে।কারণ আমাকে অবশেষে কেউ জব্দ করতে পেরেছে।

আমি উনার থেকে দূরে সরে আসলাম,,,
এই দে সব নোটস।পাঁচ দিন না আমি তিন দিনেই সব শেষ করে দেবো।
বলেই মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করলাম।এই লোকের ভরসা নেই।এখন পিয়া আর আকাশ ছিলো।উনার কথা না শুনলে না জানি আর কার সামনে কি করে বসে!আমি নির্লজ্জ কিন্তু উনি আমাকেও ছড়িয়ে যাবে নির্লজ্জের দিক থেকে।

তোমরা বাহিরে যাও।বাগানে গিয়ে বসো।সেখানে আলিশা আর পিয়াস আছে।আমি ওকে পরিয়ে আসছি।(আলিফ)

জ্বি ভাইয়া।
বলেই আকাশ আর পিয়া নিচে চলে গেলো।
কিছুক্ষণ

আলিফ?(আমি)

কি হলো?(আলিফ)

আজকে এক জায়গা থেকে এসেছি।যদি না পরি।(আমি কিউট ফেস করে)

ভুলেও না।আজকে তুমি পড়বে।আর শুধু আজকে না প্রতিদিন পড়বে।আমি এসে তোমার পড়া নিবো।(আলিফ)

তার মানে আপনি পড়ানোর সময় আমার পাশে থাকবেন?(আমি অবাক হয়ে)

হুম।(আলিফ আমার নোটস গুলো দেখতে দেখতে)

আমি শুধু মুচকি হাসি দিলাম।কিন্তু আলিফের মুখ দেখে মনে হচ্ছে উনি আমার মুচকি হাসির কারণ এখনো বুঝতে পারলো না।কিন্তু আমি তো জানি আমার এমন বাচ্চামি ব্যবহার করার কারণ।


দুই ঘন্টা পর
আমি অর্ধেক শেষ করে ফেলেছি।(আমি)

হিয়া?(আলিফ)

হুম।(আমি)

তুমি এত ফাস্ট সব কিছু ধরতে পারো।তাহলে কেনো নিজে নিজে পড়ো না।তুমি তো বাচ্চা মেয়ে না যে তোমাকে বসে থেকে পড়াতে হবে।তুমি এখন ভার্সিটিতে।(আলিফ)

আজকেই আমার ব্যাপারে সব জেনে ফেলবেন!(আমি মুচকি হেসে)

তুমি যেমন দেখাও তুমি তেমনটা নও হিয়া।অনেক রহস্যময়ী তুমি।(আলিফ মনে মনে)

বাকি গুলো রেখে দাও।কালকে পড়বে।এখন তোমার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দাও।(আলিফ আমার মাথায় বুলাতে বুলাতে)

ওকে।
বলেই আমি নিচে নেমে গেলাম।আলিফ আসলো না ওর কি বলে একটা কাজ আছে।


বাগানে
আকাশ,পিয়া,আলিশা আর পিয়াস ভাইয়া বসে বসে আড্ডা দিচ্ছে।বাসায় আর কেউ নেই।বাবাই অফিসে গেছে।মামনি উনার কোনো এক ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে গেছে।

আরে তোরা এখানে বসে আছিস?দাড়া আমি চা নাস্তা নিয়ে আসি।(আমি ওদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে)

না ভাবী তুমি বসো।আমি যাই।আসলে আমি একদমই ভুলে গেছিলাম। সরি।
বলেই আলিশা উঠতে লাগলো তখন পায়ে পা লেগে আকাশের উপর পড়ে গেলো।

পিয়া হা হয়ে তাকিয়ে রইলো।পিয়াস ভাইয়া হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

আমি বুঝলাম না।আমার বিয়ের দিন থেকেই কেউ না কেউ পড়ছে।আর সাথে সাথে কেউ না কেউ ধরছে।কি হচ্ছে?(আমি অবাক হয়ে বসতে বসতে)

আমার কথা শুনে আবার পিয়া লজ্জা পেয়ে গেল।আর পিয়াস ভাইয়া মিটমিট করে হাসতে লাগলো।

আবার শুরু হয়েছে একজন লজ্জা পাচ্ছে আরেকজন মিটমিট করে হাসছে।সবার ভীমরতি হয়েছে।(আমি মনে মনে)

আলিশা তাড়াতাড়ি করে ভিতরে চলে গেলো।কিছুক্ষণ পর এখন সার্ভেন্ট এসে চা নাস্তা দিয়ে গেলো।কিন্তু আলিশা আর আসলো না।

পরেই আলিফ আসলো আর আমরা সবাই মিলে আড্ডা দিতে লাগলাম।


পরের দিন
আমি তোমাকে ভার্সিটিতে নিয়ে যাবো।আবার নিয়ে আসবো।(আলিফ তৈরি হতে হতে)

আপনার কোনো সমস্যা হবে না?(আমি)

না।এইটুকু তো আমি আমার চড়ুই পাখির জন্য করতেই পাড়ি।(আলিফ আমার গালে হাত রেখে)

এখন আপনি আমাকে লাই দিয়ে মাথায় তুলছেন!(আমি)

ব্যাপার না।চলো।
বলেই আমি আর আলিফ নেচে নামলাম।

পরেই সবাই মিলে একসাথে ব্রেক ফাস্ট করে করলাম।তারপর সবার থেকে বিদায় নিয়ে ভার্সিটিতে গেলাম।আলিফ আমাকে সেখানে পৌঁছে দিয়ে নিজে অফিসে চলে গেলো।


ভার্সিটি শেষ হতেই আমি বেরিয়ে দেখলাম আলিফ ওর গাড়ি নিয়ে দাড়িয়ে আছে বাহিরে,,
আলিফ।আপনি এসেছেন?(আমি মুচকি হাসি দিয়ে)

আমি প্রমিজ করেছিলাম।এখন গাড়িতে উঠো।(আলিফ)

হুম।
বলেই আমি গাড়িতে উঠে বসলাম।


বাড়িতে পৌঁছে
আমি বাড়িতে ঢুকতেই কারো আওয়াজ পেলাম।

বাড়িতে মনে হয় মেহমান এসেছে!(আমি গাড়ি থেকে নেমে)

আজকে রিয়া আন্টির আসার কথা!(আলিফ)

রিয়া আন্টি?(আমি অবাক হয়ে)

পিয়াসের ফুপি।আর আমার আম্মুর বেস্ট ফ্রেন্ড।তোমার লেহেঙ্গা আর জুয়েলারি সেই ডিজাইন করেছে।বিয়ের দিন ব্যবসার কাজে বাহিরে ছিলো।তাই আসতে পারেনি।উনি অনেক ট্যালেন্টেড।একদম বিজনেস ওম্যান।খুবই গোছানো।দেখলে খুবই অবাক হবে।(আলিফ)

এতো তারিফ করছেন দেখা তো করতেই হবে।আর উনাকে ধন্যবাদও দেয়া দরকার এতো সুন্দর একটা লেহেঙ্গা দেয়ার জন্য।(আমি বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে)

আচ্ছা।চলো।(আলিফ)


বাড়ির ভিতর ঢুকেই আমি ওই রিয়া নামের মহিলাকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।আলিফ সত্যিই বলেছে আমি উনাকে দেখেই অবাক হয়ে যাবো।আমি সত্যিই খুবই অবাক হয়ে গেছি।

আমি উনার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চলতে লাগলাম,,

হিয়া মা।আসো তোমার সাথে উনার পরিচয় করিয়ে দেই।(আলেয়া বেগম)

উনাকে চিনতে আমার কোনো পরিচয় লাগবে না।(আমি রিয়া আন্টির দিকে তাকিয়ে)

উনি আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

আপনার মত মানুষকে আমার থেকে ভালো আর কেউ চেনে না।আমার এখন ইচ্ছে করছে আপনাকে এই বাড়ি থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেই।কারণ এই বাড়ির মানুষ গুলো খুব ভালো।আপনার মত নোংরা মানুষ গুলো এসে এখানের পরিবেশটা আরো নোংরা করবে।
বলেই সেখানে আর এক মুহুর্ত না থেকে আমি চলে আসলাম রুমে।

রিয়া বেগম সেখানে স্থির দাড়িয়ে রইলো।

আলিফ হিয়া এইসব কি বলে গেলো?(আলেয়া বেগম অবাক হয়ে)

আমি দেখছি মা।
বলেই আলিফ রুমে হিয়ার পিছু পিছু গেলো।


রুমে,,
আলিফ গিয়ে দেখলো হিয়া,ওর বিয়ের লেহেঙ্গা আর জুয়েলারি বের করেছে।আর কেচি নিয়ে লেহেঙ্গা কাটার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

হোয়াট দা হেল হিয়া!কি করছো তুমি মাথা খারাপ হয়ে গেছে!
বলেই আলিফ আমার হাত থেকে লেহেঙ্গা আর কেচিটা নিয়ে গেলো।

আপনিই তো বলেছেন ওই মহিলা নাকি এই লেহেঙ্গা বানিয়েছে।তাই আমি এইটা এখন কুচি কুচি করে কাটবো।আগে জানলে জীবনেও এই লেহেঙ্গা পড়তাম না।
বলেই আমি আলিফের কাছ থেকে লেহেঙ্গাটা নিতে চাইলে আলিফ তা আরো দূরে সরিয়ে বললো,,,

তোমার সব কিছু সহ্য করি বলে।তুমি যা ইচ্ছে তাই করবে?তুমি জানো কতো যত্ন করে আন্টি এই লেহেঙ্গা বানিয়েছে?যাও এক্ষুনি গিয়ে আন্টিকে সরি বলবে।(আলিফ রেগে)

আলিফ দেখলো হিয়ার চোখ গুলো রাগে লাল হয়ে আছে।

কি বললেন?আপনি আমাকে সহ্য করেন?আমি ভাবছিলাম,,,না থাক আপনি যেহেতু ওই মহিলার কাছের জন আপনিও উনার মতই হবেন।ধন্যবাদ আপনাকে আমাকে এতো দিন সহ্য করার জন্য!আর আপনাকে কষ্ট করে আমাকে সহ্য করতে হবে না।
বলেই আমাকে বেরিয়ে যেতে লাগলাম।তখনই আলিফ আমাকে ধরে বললো,,

হিয়া আমি ঐভাবে বলতে চাইনি।তুমি যা করেছো ভুল।

প্রথম কথা আপনি কিভাবে বলেছেন আমি জানতে চাইনি।ছয় মাস থাকতে বলেছিলেন না?এক মাসও হয়নি আপনি অসহ্য হয়ে গেছেন।ছয় মাস তো পরেই আছে।আর দ্বিতীয় কথা আমি ভুল কিছু বলেনি।তাই আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই।ওই মহিলার সাথে যাদের সম্পর্ক তাদের আমি ঘৃনা করি আর এখন তার মধ্যে আপনিও আছেন।আজকের পর থেকে আপনি আপনার পথে আমি আমার পথে।আমাদের বিয়েটা কখনও Happily Married হওয়ার জন্য তৈরি হয়নি।

বলেই উনার হাত ছাড়িয়ে হাত ব্যাগটা নিয়ে সেখান থেকে চলে আসলাম।

আলিফ সেখানেই হিয়ার কথা শুনে স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছে।


চলবে,,,