Friday, July 18, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1371



শুরুটা অন্যরকম পর্ব-০১

0

#শুরুটা_অন্যরকম
#পর্ব_০১
#অধির_রায়

” আমাকে কি বাজারের মেয়ে মনে হয় আপনার? যে আপনার সাথে এক মাস রাত কাটাবো৷” নিয়তি বিদ্বেষের ভাব নিয়ে কাগজটি টেবিলে নিক্ষেপ করে বলে উঠে।

— সোফায় বসতে বসতে নির্বণ বলে উঠে, ” অ্যাজ ইউর ইউস৷ তোমার ইচ্ছা৷ তুমি যদি আমার শর্তে রাজি হও তাহলে তোমার বাবা এই যাত্রায় বেঁচে যাবে।”

— করুণ স্বরে বলে উঠে, ” স্যার আপনি কি আমার দুর্বলতার সুযোগ নিতে চাইছেন? আমি আপনার কাছে নিজেকে সুপে দিব! ”

— মিস নিয়তি তুমি হয়তো ভুল ভাবছো৷ আমি এমন কোন কথা বলি নি৷ আমার শর্তটা ঠিকভাবে পড়ে দেখো?

— আমি কি পড়ে দেখবো? সেখানে লেখা আছে এক মাস আপনার সাথে থাকতে হবে। আপনি যা বলবেন তাই করতে হবে। এক মাসের জন্য আপনি আমার হাসবেন্ড হবেন৷

— রাইট আমি যা বলবো তাই করতে হবে। আর হ্যাঁ আমি কখনো হাসবেন্ডের দাবী নিয়ে তোমার সামনে আসবো না৷ জাস্ট অভিনয়।

— হতদন্ত হয়ে বলে উঠে, ” আপনি কি বলতে চান? ”

— আমি বিয়ের কোন বন্ধন মানি না৷ আমি বিয়ের কোন বন্ধনে নিজেকে জড়াতে চাই না।

— তাহলে কেন আমাকে এক মাস আপনার ওয়াইফের অভিনয় করতে বলছেন?

— সেটা তোমার না জানলেও হবে৷ তোমার হাতে দুইটা সুযোগ আছে। এক আমাকে বিয়ে করা। দুই আমার সাথে এক বিছানায় রাত কাটানো। যদি বিয়ে কর তাহলে তোমাকে স্পর্শও করে দেখবো না৷ সিদ্ধান্ত তোমার৷

নির্বণ কথাগুলো বলে চলে যেতে নিলেই নিয়তি পিছন থেকে নির্বণকে ডাক দেয়৷ নিয়তির ডাক শুনে নির্বণ দাঁড়িয়ে যায়৷

— নিয়তি হাত কাচুমাচু করে বলে উঠে, ” স্যার আমি আপনার চুক্তি নামায় সাইন করতে রাজি। কিন্তু আমারও কিছু শর্ত আছে?

— নির্বণ প্যান্টের পকেটে হাত গুছে, ” কি শর্ত মিস নিয়তি?” তোমার শর্তটাও শুনি।

— আমার শর্ত হলো আমাকে দিনে দু’ঘন্টা সময় দিতে হবে। আমি এই দুই ঘন্টা আপনার কোন কথা শুনবো না৷ দুই ঘন্টা আমি আমার বাবাকে সময় দিব৷ কারণ তিনি…

— নিয়তিকে থামিয়ে দিয়ে, “ব্যাস আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি৷ তোমার কাছ থেকে আমি দুই ঘন্টা কেঁড়ে নিব না৷ চুক্তিনামায় সাইন করে তোমার বাবার চিকিৎসার টাকা নিয়ে যাও৷ ”

নিয়তি চুক্তিনামায় সাইন করে দেয়৷ সাইন করার সাথে সাথে নির্বণ চুক্তিনামাটা এক টানে নিয়ে নেয়৷ এমন ব্যবহারে নিয়তি অনেকটা ভয় পেয়ে যায়৷ নিয়তি ধরে নেয় নির্বণ তার বাবার খরচ দিবে না৷

— নিয়তি নরম স্বরে বলে উঠে, ” স্যার টাকা দেন প্লিজ! টাকা দিলে আমার বাবার অপারেশন হবে৷”

— নির্বণ চেয়ারে বসতে বসতে, ” ক্যাশ চাই নাকি ব্যাংক চেক।”

— “এই মুহুর্তে আমার ক্যাশ লাগবে।” আতঙ্কিত হয়ে বলে উঠে।

— নির্বণ এক লক্ষ টাকা নিয়তির সামনে ছুঁড়ে মারে। নিয়তি অন্য কোন সময় হলে এই টাকা নিত না৷ নিয়তি নিরুপায় হয়ে টাকাগুলো তুলে নেয়।

— এখানে এক লক্ষ টাকা আছে৷ কাল এক লক্ষ পেয়ে যাবে। আশা করি “এক লক্ষ টাকা দিয়ে তোমার বাবার অপারেশন হয়ে যাবে।” কাল যখন আমার সাথে আমার বউ হিসেবে আমার বাড়িতে প্রবেশ করবে ঠিক তখন তোমাকে এক লক্ষ টাকা দিয়ে দিব৷

— নিয়তি চোখের জল মুছে বলে উঠে, ” ওকে স্যার। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার এই ঋণ আমি কোনদিন ভুলবো না৷ ”

নিয়তি টাকা নিয়ে হসপিটালে চলে আসে৷ টাকা প্রি মেন্ট করার পর তার বাবার কিডনির অপারেশন শুরু করে দেয়৷
নিয়তি বাবার কিডনিতে চুনাপাথর ধরা দেয়। যার ফলে নিয়তির বাবা ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। নিয়তি তার বাবার জন্য অনেক চেষ্টা করে। মেডিসিন খাওয়ানোর মাধ্যমে কমেনি। বরং পাথরগুলো বৃদ্ধি পেয়েছে। নিয়তির বাবার অবস্থা বর্তমানে এমন অবস্থায় পৌঁছে গেছে যে, “অপারেশন না করলে নিয়তির বাবা মারা যাবে ৷” সে জন্য নিয়তি এমন বাজে চুক্তি নামায় সাইন করতে বাদ্য হয়েছে।

নিয়তির পৃথিবী বলতে নিয়তির বাবা৷ নিয়তির জন্মের ২ বছর পর নিয়তির মা নিয়তিকে ছেড়ে চলে যান৷ মা চলে যাওয়ার পর বাবাই নিয়তির সমস্ত দায়িত্ব নেন৷ দ্বিতীয় বিয়ে করেননি নিয়তির অবহেলা হতে পারে বলে। আজ দিন এসেছে নিয়তির তার প্রতিদান দেওয়ার৷ নিয়তি নিজের সর্বত্র দিয়ে নিজের বাবাকে বাঁচাতে চায়৷
______

নির্বণ অফিসের কাজ শেষ করে বাড়িতে পৌঁছে যায়।ফ্রেশ হয়ে নির্বণ তার প্যারালাইছিস মায়ের সাথে দেখা করতে যায়৷ নির্বণের মা হার্ট অ্যাটাক থেকে প্যারালাইছিস হয়৷ নির্বণের মায়ের অঙ্গ প্রতঙ্গের এক সাইট কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে৷

নির্বণ তার মায়ের মাথার পাশে বসে মাথায় হাত রাখতেই নির্বণের মা চোখ মেলে তাকায়৷ নির্বণকে দেখে ছোট বাচ্চার মতো মুখে ফুটে মিষ্টি হাসি।

— নির্বণ তুমি অফিস থেকে কখন ফিরলে? দুপুরে তুমি খাওনি৷ তোমার মুখটা শুকনো শুকনো লাগছে কেন?

— মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ” প্লিজ মা উত্তেজিত হবে না৷ আমি দুপুরে খেয়েছি৷ আর আমার মুখ কই শুকনো লাগছে। আমি তো একদম ভালো আছি৷”

— নির্বণের মা মুখ গোমড়া করে বলে উঠে, ” আমি যখন থাকবো না তখন দেখবি কেউ তোকে এসব কথা বলবে না৷ আর তো মাত্র ২৮ দিন বেঁচে থাকবো৷ প্লিজ একটা বউ নিয়ে আয় না৷ আমি আমার চোখের দেখা দেখে যেতে পারব না৷”

— মা তুমি সব সময় ইমোশনাল কথা কেন বল? তোমার কিছু হবে না। আমি তোমার কোন ক্ষতি হতে দিব না৷ তোমাকে আমি বিদেশের বড় ডক্টরের কাছে নিয়ে যাব৷

— আরে বোকা ছেলে আমাকে নিয়ে ভাবা বন্ধ কর। আমার জন্য একটা লাল টুকটুকে বউমা এনে দাও। আমি সুস্থ হয়ে যাব৷

— বুকের মাঝে কষ্ট চেপে ধরে দীর্ঘ একটা শ্বাস ছেড়ে বলে উঠে, ” মা কাল তোমার জন্য একটা লাল টুকটুকে বউ নিয়ে আসবো৷ ”

— মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে বলে উঠে, ” সত্যি তুমি কাল বিয়ে করবে৷ কিন্তু একদিনে কিভাবে সম্ভব? ”

— ডোন্ট ওরি মা৷ আমার বান্ধবী বিয়েতে রাজি হয়েছে৷ তাকে বলেছি দেশের অবস্থা ভালো না আমরা বরং মন্দিরে বিয়ে করে নিব৷ সে আমার কথামতো রাজি হয়ে গেছে। কাল সকালে আমরা বিয়ে করব৷

— আমি তোমাদের আশীর্বাদ করি তোমরা সব সময় সুখী থাকো৷ সৃষ্টি কর্তা তোমাদের সব আশা পূর্ণ করুক।

— মা এখন প্লিজ ঘুমিয়ে পড়। আর কোন কিছু নিয়ে চিন্তা করবে না৷ আমি আবার এসে যদি দেখতে পাই তুমি ঘুম আসোনি তাহলে কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে৷ এই আমি বলে রাখলাম।

— আচ্ছা বাবা৷ আর কোন চিন্তা করব না৷ তুমিও খেয়ে শুয়ে পড়৷ কাল তো তোমার অনেক কাজ৷

— হুম মা৷

নির্বণ তার মায়ের গায়ে কম্বল দিয়ে রুমের বাহিরে এসে কেঁদে ফেলে৷ মায়ের সামনে বুকের উপর পাথর রেখে নিজের কষ্ট গুলো লুকিয়ে রেখেছে।

— চোখের জল মুছে মনে মনে বলে উঠে, ” মা পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও৷ আমি তোমাকে অনেক মিথ্যা করা বলছি৷ ” আমি তোমার ভালোর জন্যই মিথ্যা কথা বলছি৷
_________

পরের দিন নির্বণ নিয়তিকে বউ সাজিয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে। নির্বণের কথামতো নিয়তি বাড়ির ভিতরে পা রাখতেই বাকি এক লক্ষ টাকা হাতে ধরিয়ে দেয়৷ নিয়তিকে নিজের রুমে নিয়ে যায়৷

— নির্বণ রুমের দরজা বন্ধ করে “মিস নিয়তি আমার কথাগুলো মন দিয়ে শুনবে। ”

— দরজা বন্ধ করাতে নিয়তি ভয় পেয়ে যায়৷ শুকনো গলায় ভয়ে ভয়ে বলে উঠে, ” আপনি কি বলতে চান? এভাবে দরজা বন্ধ করলেন কেন?”

— কোন ভয় নেই৷ আমি তোমার উপর হামলা করব না৷ শর্তগুলো হলো –
১.আমাকে স্যার ডাকা বন্ধ করতে হবে৷
২. আমার মা প্যারালাইছিস রোগী। তার উপর হার্টের রোগী৷ ডাক্তার বলে দিয়েছেন আর মাত্র ২৮ দিন বাঁচবেন । অলরেডি একদিন চলে গেছে। ২৭ দিন আমার মায়ের সামনে এমনভাবে অভিনয় করবে যেন মা মনে করে তুমি আমার সত্যিকারের বিবাহিত স্ত্রী।
৩.তুমি যখন বাহিরে যাবে তখন কোন সার্ভেন্টকে মার কাছে রেখে যাবে৷

— নিয়তি মাথা নিচু করে, ” ওকে স্যার৷ আপনি যেমনটা বলবেন ঠিক তেমনটাই হবে৷ আমি আমার সর্বত্র দিয়ে চেষ্টা করব৷ ”

— চল মার সাথে দেখা করে আসি৷

নির্বণ নিয়তির হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে তার মার রুমে। এই প্রথম নির্বণ নিয়তির হাত ধরে৷ নিয়তির কেমন জানি একটা একটা বিরক্ত লাগা অনুভব করছে। আবার কোথাও একটা ভালো লাগা কাজ করছে৷

— নিয়তি নির্বণের মাকে সালাম করে নির্বণের মায়ের পাশে দাঁড়ায়৷ নির্বণ চোখের ইশারায় তার মায়ের পাশে বসতে বলে। নির্বণের চোখের ইশারা বুঝতে পেয়ে নিয়তি তার মায়ের পাশে বসে।

— মা আমি তোমাকে সব সময় আশীর্বাদ করি তুমি সুখী হয়৷ তুমি আমার সোনা মা৷

— সোনা মা ডাকটা শুনে নিয়তি কেঁদে ফেলে৷ নিয়তি কান্না করে বলে উঠে, ” মা আপনি আমাকে কি বললেন?”

— নির্বণের মা কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে, ” কেন? আমি তোমাকে সুখী হওয়ার জন্য আশীর্বাদ করলাম৷ ”

— তারপর আমাকে কি মা বলে ডাকলেন?

— সোনা মা বলে ডেকেছি৷

— প্লিজ আমাকে আর একবার সোনা মা বলে ডাকেন!

— আমার সোনা মা৷

নিয়তি নির্বণের মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে বলে উঠে, ” জানেন মা৷ বাবা বলেছিল আমার মাও আমাকে সোনা মা বলে ডাকত৷ আজ তিনি বেঁচে নেই৷ আমাকে সোনা মা বলে ডাকত আমি জানতাম না ঠিক৷ বাবা সব সময় বলত মাকে আমাকে সোনা মা বলে ডাকত৷ ”

নির্বণের মা নিয়তির মাথায় এক হাত রেখে ভালোবাসার পরশ দিয়ে বলে উঠে, ” আজ থেকে আমিই তো তোমার মা৷ আমি তোমাকে সোনা মা বলেই ডাকব৷ ”

— নির্বণ বির বির করে বলে উঠে, ” এ তো দেখছি নাটকের মহারানী তুফান মে। ডিস্ট্রিক্টিং এত নাটক ভালো লাগে না৷ নির্বণ রুম থেকে নিজের রুমে চলে যায়৷

— নিয়তি চেখের জল মুছে বলে উঠে, ” মা আজ থেকে আপনার সব দায়িত্ব আমার৷ আপনাকে আমি সুস্থ করে তুলব। আপনি আবার আগের মতো হাঁটতে পারবেন৷ ”

— নির্বণের মা মুচকি হেঁসে, ” মা আমাকে মিথ্যা স্বপ্ন দেখিও না৷ আমার আয়ু আর বেশি দিন নেই৷ ”

— “রাখে হরি মারে কে” আপনার কিছু হবে না৷ ডক্টররা অনেক সময় তো ভুল করে। ডক্টরদের সব কথা সব সময় সত্যি হয় না৷ সৃষ্টি কর্তা চাইলে সব হবে৷

নিয়তি ভালোবাসা পেয়ে নির্বণের মায়ের চোখে জল এসে পড়ে। নির্বণের জন্য এমন একটা বউ চেয়েছিল নির্বণের মা৷

— টলমল চোখে “তোমার নাম কি মা? ”

— আমার নাম নিয়তি৷

— নিয়তি আমার আলমারিতে একটা বক্স আছে। একটু কষ্ট করে এনে দাও৷

নিয়তি আলমারি খুলে নির্বণের মায়ের কথা মতো বক্সটা নিয়ে আসে৷ তার পর নির্বণের মা যা বলে নিয়তি উত্তর দেওয়ার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না৷

চলবে…..

দখিনা প্রেম পর্ব-২৫ এবং শেষ পর্ব

0

#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| শেষাংশ ||

বিছানায় উবুড় হয়ে শুয়ে বিয়ের ছবিগুলো দেখছে সেহের। ফোনটা সা’দ সেহেরকে তার বাসরে উপহার হিসেবে দিয়েছিলো। তাদের বিয়ের আজ প্রায় কয়েকবছর কেটে গেছে। সেহের এবার অনার্স ২য় বর্ষে। অবসর সময়ে তাদের বিয়ের ছবি দেখা যেন সেহেরের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। রিসিপশনের সাঁজে সা’দ তাকে ফিসফিস করে বলেছিলো,

—“জানো আমি ঠিক তোমার এই সাঁজে তোমায় স্বপ্নে দেখেছিলাম। সেদিন আমার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছিলো স্বপ্নের হুরপরীর কথা চিন্তা করতে করতে। আমার সেই হুরপরীটা যে আমার বউ সেটা আজ তোমায় না দেখলে জানতামই না। কতোটা স্নিগ্ধময়ী লাগছে তোমায় জানো?” সা’দের কথাগুলোতে সেদিন সেহের ভিষণ লজ্জা পেয়েছিলো। সেহেরের মা এখন আলহামদুলিল্লাহ সুস্থ।
আজ সেহেরের ভার্সিটি বন্ধ। সা’দ গেছে তার শুট নিতে। বাড়িতে সার্ভেন্টরা আর সেহের ছাড়া কেউ-ই নেই। বরিং লাগছে সেহেরের কাছে সবকিছু। আসিয়াও নেই। সে গেছে রুবাইয়ের সাথে ফরেইনে। বেবির জন্য রুবাইয়ের দেশ-বিদেশে ছুটাছুটি করতে হচ্ছে বেশ, তানজীলও আছে তার সাথে। রুবাই একা থাকবে দেখে আসিয়াও সঙ্গে গিয়েছে। সেহের তার মায়ের সাথে মাঝেমধ্যে দেখা করতে গেলেও সা’দ ফেরার সময় সেহেরকে নিয়ে আসে। তবে আজ কেন যেন তার বাসায় যেতে ইচ্ছা করছে না। হঠাৎ কী চিন্তা হতেই সেহের উঠে বসলো এবং চুল খোপা করতে করতে নিচে চলে গেলো। রান্নাঘরে ঢুকতে ঢুকতে সেহেরের বড়ো বোন অধরাকে ফোন লাগালো। অধরা এবার মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে। দেশে ফিরেছে ছ’মাস আগেই। এখন তার বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে।

—“হ্যাঁ সেহের বল!”

—“তুই এখন কই আপু?”

—“এইতো ফ্রেন্ডের সাথে মিট করতে আসছিলাম, কেন? কিছু লাগবে?”

—“না। শুটিং স্পটে যাবি?”

—“যাওয়া তো যায়-ই কিন্তু হঠাৎ?”

—“এমনি বাবা আর ওনাকে সারপ্রাইজ দিবো। তুমি ঘন্টাখানেকের মধ্যে এসে আমাকে পিক করিও।”

—“ওকে। তাহলে এখন রাখি। বাই!”

—“আল্লাহ হাফেজ।”

বলেই সেহের কল কেটে রান্নায় মনোযোগ দিলো। আজ আকাশটা মেঘলা, কিছুক্ষণ আগে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিও হয়েছিলো। এমন সুন্দর একটা দিনে খিঁচুড়ি খাওয়ার মজাই আলাদা। রান্নার পুরোটা সময় সেহের তার দাদীর সাথে কথা বলে কাটিয়েছে। হয়তো ওরা তার রক্তের মানুষ না, তাতে কী? সেহের তাদের জান দিয়ে ভালোবাসে। রিমন স্কুলে গেছে তাই তাকে ফোনে পায়নি সেহের। রিমন এবার ক্লাস সিক্সের ছাত্র, সেহের চেয়েছিলো রিমনকে আর দাদীকে শহরে তাদের কাছে নিয়ে আসতে কিন্তু দাদী তার গ্রামকেই বেশি ভালোবাসে। দাদীমা না আসলে রিমনও আসতে পারবে না তাই সে দাদীমা চাচীদের সাথেই থাকে।গতবছর কবির মাদক পাঁচার করে ফেরার সময় রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়, জোহরা তো স্বামী এবং মেয়ের শোকে মানসিক রোগীতে পরিণত হয়েছে। সারাক্ষণ নিজেকে ঘর বন্দি করে রাখে। আর তপা! তার বিয়ের ১২ দিন বাদেই জানতে পারে সে প্রেগন্যান্ট! বাচ্চাটা কামালের না বরং আশরাবের। এ কথা শুনে কামাল তো তাকে শারীরিক নির্যাতন করতে আসছিলো, তার আগেই তপা নিজেকে বাঁচাতে ভারী কিছু দিয়ে কামালের মাথায় জোড়ে আঘাত করে। যার ফলে কামাল ঘটনাস্থলেই মারা যায়। তপা সেই ঘটনায় বেশ ভয় পেয়ে যায়, তাই সে ফুলদানিটা সঠিক জায়গায় রেখে নিজের আঙ্গুলের ছাপ মুছে নিজের ঘরে গিয়ে কাঁথা টেনে ঘুমিয়ে পড়েছিলো৷ আজ অবধি কেউ-ই জানতে পারেনি কামালের আসল খুনি কে। কামাল মারা যাওয়ার ১মাস পর যখন আশরাবের বিয়ের কথা চলে তখন তপা তাকে জানায় তাদের সন্তান তপার গর্ভে। বাচ্চার কথা শুনে আশরাব সেই মুহূর্তে তপাকে বিয়ে করে। এতে আশরাবের সাথে তার মায়ের ছাড়াছাড়ি হলেও আশরাব ঠিকই তার পরিবারের খেয়াল রেখেছে। বাচ্চার জন্যেও আশরাব তপাকে পূর্বের ভুলগুলো ক্ষমা করে দেয়। আশরাবকে পেয়ে তপার জীবনটা যেন বদলে যায়। আর কামালের সাথে বিয়ের দিন থেকে কঠিন অপরাধবোধে ভুগেছে সে বারংবার। আশরাবের সাথে বিয়ে হওয়ার পর তপা সেহেরের নাম্বার জোগাড় করে তাকে কল দিয়ে কান্নাকাটি করে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে। আর সেহের! সে তো কখনো ওদের শাস্তি দেয়ার কথা ভাবতেই পারেনি, তাই এবারও সেহের সকলকে ক্ষমা করে দেয়।

তপার দিনগুলো ভালোই কাটছিলো কিন্তু যখন তার প্র‍্যাগনেন্সির সাত মাস পেরিয়ে গেছে। তখন সে পুকুরপাড়ে হাত-মুখ ধুঁতে সিঁড়ি দিয়ে নামছিলো। আশরাব সেদিন বাড়িতে ছিলো না। তপা হঠাৎ বেসামাল হয়ে একটা সিঁড়িতে পা পিছলে পড়ে পানিতে পরে যায়। যদিও তপা সাঁতার জানতো কিন্তু ভারি এবং দুর্বল শরীর নিয়ে সে একেবারেই সাঁতার কাটতে পারেনি। শেষ রক্ষাও তার হলো না, পুকুরে ডুবে মারা গেলো। পুকুরঘাটের সিঁড়ি রক্তে মাখামাখি, পুকুরের এক অংশ পানিও।
আশরাব প্রায় একবছর নিজেকে না সামলাতে পারলেও এখন নিজেকে বেশ সামলিয়েছে কিন্তু ভেতরে তার আকাশ ছোঁয়া ক্ষত। সে এই ক্ষত না পারে কাউকে দেখাতে আর না পারে বলতে। জীবন্ত লাশ সে এখন, জীবন্ত লাশ! সুখ যেন তার হাতে কোনোদিনও ধরা দেয়নি।

আবিদ আর মানজুর বিয়েও হলো কয়েকমাস হলো। প্রথমে মানজুকে অন্যজায়গায় বিয়ে দিবে বলেছিলো। মানজু তো কেঁদেকেটে সেহেরের মাথা খারাপ করে দিচ্ছিলো৷ সেহেরের তখন পরীক্ষা চলছিলো বিধায় সে গ্রামে যেতে পারেনি তবে ব্যবস্থা ঠিকই করে দিয়েছে। সেহেরের দাদীর মতো একটা দাদী থাকলে আর কী লাগে? দাদীমা সব শুনে সেদিনই মানজুর বাড়িতে গিয়ে বিয়ের কথা পাকা করে আসে। আবিদ যেহেতু পড়াশোনা শেষ করে বাবার ব্যবসায় হাত লাগিয়েছিলো সেহেতু মানজুর বাবা-মা অমত করেনি। খুবই ভালোভাবে তাদের বিয়েটা সম্পূর্ণ হয়।

সেহের রান্না সেরে নিজ হাতে খাবারগুলো হটপটে ঢুকালো। অতঃপর রুমে গিয়ে শাওয়ার নিয়ে রেডি হয়ে গেলো। সা’দ তাকে বোরকা ছাড়া বের হতে নিষেধ করেছে তাই সেহের সবসময় বোরকা হিজাব পরেই বের হয়। রেডি হয়ে নিচে নামতেই দেখলো অধরা তার জন্য অপেক্ষা করছে। সেহের মুচকি হেসে অধরাকে এগোতে বলে সার্ভেন্টের হাত থেকে হটপটটা নিয়ে নিজেও বেরিয়ে গেলো।

—“কী কারীব তুমি বিয়ে কবে করবা? এতোদিন তো আমার বিয়ে বিয়ে করে সব মাথায় তুলেছিলে, আর এখন আমি বিয়ে করে সংসারীও হয়ে গেলাম অথচ তোমার খবর নেই। ব্যাপার কী হু?” সা’দের কথা কারীব হেসে লাজুক সুরে বলে,

—“বাবা-মা মেয়ে দেখছে স্যার, মনে হচ্ছে আমিও কিছুদিনের মধ্যে ডাবল হয়ে যাবো!” কারীবের কথায় সা’দ, কারীব উভয়ই হেসে উঠলো। ফারুক হোসাইন দূরে বসে চা খাচ্ছে এবং নিজের স্ক্রিপ্ট মনোযোগ সহকারে পড়ছে। সা’দ আর ফারুককে বিরক্ত করলো না। শ্বশুড়, জামাই এখন প্রায় শুটিং এই একসাথে থাকে। ফারুক হোসাইন তো গতবছর সেরা অভিনয়ের এওয়ার্ডও পেয়েছেন, সাথে সা’দও বেশ কিছু এওয়ার্ড পেয়েছেন তার নিখুঁত এবং বাস্তব জীবনের টেলিফিল্ম, নাটক এবং ফিল্মের জন্য।

তাদের ব্যস্ততার মাঝেই অধরা এবং সেহের স্পটে আসলো। কর্মচারীরা তো সেহেরকে ঠিক চিনে ফেলে, সকলে কি যে খুশি। সেহের এতো মানুষের মাঝে তার বিদেশিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। সা’দ তো এখনো খেয়াল করেনি সেহেরকে। সেহেরকে দেখে কিছুটা মুগ্ধ হলো টেলিফিল্মের একজন অভিনেতা জয়। জয় কাউকে সেহেরের বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেই সে জানালো সেহের সা’দের স্ত্রী। এ কথা শুনে জয় চোখ নামিয়ে ফেলে কারণ, সা’দকে সে অত্যন্ত সম্মান করে। সা’দ যদি না হতো তার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে আসা ইমপসিবল ছিলো, সা’দ এক বছর যাবত নবীনদের বড়ো একটা সুযোগ করে দিচ্ছে। জয়কেও সে-ই প্রতিষ্ঠিত করছে। সেহের সা’দের সামনে কোমড়ে দুই হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সা’দ কারো উপস্থিতি টের পেয়ে স্ক্রিপ্ট থেকে চোখ সরিয়ে মাথা উঁচু করে তাকালো। সেহেরকে দেখে সে হতবাক হয়ে গেলো এবং অস্ফুট সুরে বলে উঠলো,

—“তুমি এখানে?”

—“হু আমি৷ আপনার ওই বই-পত্র দেখা হলো?”

সেহেরের কথায় সা’দ ভ্রু কুচকে ফেলে। সেহের আবার বললো,

—“সারাজীবন তো এই স্ক্রিপ্টের মধ্যেই থাকেন, বলি ঢুকে যেতে পারেন না? ঢুকলে কী এমন ক্ষতি হয় হু?”

সেহেরের এমন রাগীমাখা কথাবার্তা শুনে কারীব তৎক্ষনাৎ কেটে পরলো।

—“আরে ধুর রেগে যাচ্ছো কেন? এটাই তো আমার কাজ! নইলে তোমার জামাই ডিরেক্টর কী করে হলো বলো তো? সবই তো তোমার জামাইর আর এইসব স্ক্রিপ্টের ক্রেডিট তাই না বলো?”

সেহের ভেংচি কেটে সা’দের পাশের চেয়ারে বসলো। এখনো বউ রেগে আছে তাই সা’দ তার বউয়ের রাগ ভাঙ্গাতে বললো,

—“বউ তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে!”

—“কিসের সারপ্রাইজ?”

সা’দ টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা সুন্দর রঙিন প্যাপারে মোড়ানো প্যাকেট নিলো। সেহের মুখ ঘুরিয়ে বসেছিলো। চোখের সামনে প্যাকেটটা ধরতেই সেহের অবাক হয়ে সেটার দিকে তাকিয়ে সা’দের দিকে তাকালো। প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে অস্ফুট সুরে বলে উঠে,

—“কী আছে এতে?” সা’দ সেহেরের হাতে প্যাকেটটা ধরিয়ে দিয়ে বলে,

—“নিজেই খুলে দেখো।”

সেহের কাগজ খুলে দেখলো একটা সাদা বইয়ের পেছন দিক। বইটা উল্টিয়ে সামনের কভার দেখতেই সেহের বিস্মিত হলো।
“বসন্তি ফুল” [স্ক্রিপ্ট]
“সেহের আশফির ফুল” লিখা।
সেহেরের চোখদুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো। সে দ্রুত ভেতরের কিছু পেজ পড়ে দেখলো। হ্যাঁ তারই লেখা। সেহের ছলছল নয়নে সা’দের পানে তাকালো। সা’দ সেহেরের দিকে তাকিয়ে আছে। সেহের তাকাতেই চোখ দিয়ে আশ্বাস দিলো। সেহের অস্ফুট সুরে বললো,

—“এটা তো আমি আমার ডায়েরীতে লিখেছিলাম, আপনি আমার ডায়েরী কই পেলেন?”

—“যেখান থেকেই পাই না কেন, পেয়েছি তো। আমি কী জানতাম নাকি আমার বউয়ের এতো গুণ! তাই এই সুযোগ হাতছাড়া করলাম না। ভাবছি সামনের শুটে এটা শুরু করবো। এখন বলো এই স্ক্রিপ্টার পেমেন্ট কতো নিবে তোমার জামাই’র থেকে?”

সা’দের কথায় সেহের ফিক করে হেসে ফেললো। দূর থেকে ফারুক হোসাইন এবং অধরা সেহেরের হাসিমাখা মুখটা দেখছে। সেহের হাসি থামিয়ে বলে,

—“সেটা পরে দেখা যাবে এখন আসুন, খিঁচুড়ি তো ঠান্ডা হয়ে যাবে। অনেক কষ্ট করে আপনার জন্য এবং বাবার জন্য নিজ হাতে রেঁধে এনেছি আপনাদের সারপ্রাইজ দিবো বলে।”

—“চলুন মহারাণী আমিও যে আপনার সুস্বাদু খাবারের অপেক্ষায় আছি!”
সা’দের নাটকীয় কথাবার্তায় সেহের নিশব্দে হাসলো।

~সমাপ্ত।

দখিনা প্রেম পর্ব-২৪

0

#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ২৪ ||

ফারুক হোসাইন সেহেরকে প্রথম দেখাতেই বেশ ভালো চিনতে পারলো ইভেন সেহেরও তাকে চিনেছে।দুজনের কী ভাব। তাদের ভাব দেখে সা’দ অল্প হলেও ভিষণ অবাক হয়েছিলো কারণ, সে এটাই ভেবে পায়নি তারা দুজন-দুজনকে কীভাবে চিনলো? পরে ফারুককে জিজ্ঞেস করলে সে নিজেই মুচকি হেসে বলে,

—“তোমাকে একটা মিষ্টি মেয়ের কথা বলেছিলাম মনে আছে? সেই মিষ্টি মেয়েটিই তোমার হবু বউ। একদম পারফেক্ট চয়েস করেছো তুমি সা’দ। আই প্রাউড অফ ইউ!”

সেদিন সা’দ নিজেও বেশ খুশি হয়েছিলো। তবে সা’দদের বাড়িতে এসে মিসেস ফারুক হোসাইন যবে থেকে সেহেরকে দেখেছে তবে থেকে সে সেহেরের পাশে বসে অপলক দৃষ্টিতে তাকে দেখেই চলেছে। মিসেস ফারুক মানসিকভাবে অসুস্থ প্রায় অনেক বছর ধরেই। এভাবে তার দৃষ্টিতে সেহের বারংবার ইতস্তত হয়ে পরেছে। মিসেস হোসাইনকে এরূপ বিষয়ে প্রশ্ন করলেও সে কোনো উত্তর দেয় না। একদম চুপ করে সেহেরের পাশে বসে থাকে। অনেকে এও বলাবলি করছে সেহের ফারুক হোসাইনের মেয়ে, তাদের চেহারার মিল আছে। এসব ফিসফিস ফারুক হোসাইন বা সেহেরের কানে না গেলেও সা’দ ঠিকই শুনতে পেলো। তাই সা’দ নিজেই পর্যবেক্ষণ করেছে দুজনের চেহারার দিকে তাকিয়ে। আসলেই অনেক মিল। কিন্তু ফারুক হোসাইন তো তাকে বলেছে তার একটাই মেয়ে। আর সেই মেয়েটি তো এখন লন্ডনে পড়াশোনা করতে গেছে। এক মিনিট, ফারুক হোসাইন বলেছিলো তার আরেকটা মেয়ে ছিলো যে কি-না জম্মের পরপরই মারা গেছে। বিষয়টা চরম খটকা লাগলো সা’দের কাছে। তাই সে কিছু একটা ভেবে হলুদের অনুষ্ঠানের পরপরই ফারুক হোসাইনের ঘরে চলে গেলেন। সেখানে চিরুনি না পেয়ে ওয়াশরুম থেকে তার ব্রাশ এবং সেহেরের চিরুনি নিয়ে কারীবের মাধ্যমে কোথাও পাঠিয়ে দিলো। পরেরদিন বিয়ে সুস্থভাবেই সম্পন্ন হলো। এরকম এক বিশেষদিনে সেহের তার পরিবারের সকলকেই বড্ড মিস করছে কিন্তু কেউ তার পাশে নেই। সেহেরকে মন খারাপ করতে দেখে মিসেস হোসাইন সেহেরকে আচমকা বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো আর বলতে লাগলো,

—“চিন্তা করিস না মা, তোর মা তোর পাশেই আছে। বিয়ে হয়েছে তো কী হয়েছে তোকে কেউই আমার থেকে আলাদা করতে পারবে না!”

মিসেস ফারুকের কথার আগা-মাথা কিছুই সেহের বুঝতে পারলো না। তবে সেহের তার থেকে অনেক প্রশান্তি পাচ্ছে যেমনটা তার মা তাকে জড়িয়ে ধরলে পেতো। সেহের কিছু না ভেবে নিজেও মিসেস ফারুকের সাথে লেগে রইলো। সা’দ ফারুকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে বলে উঠে,

—“আচ্ছা আঙ্কেল একটা কথা ছিলো!”

—“কী কথা বলো!”

—“আপনার ছোট মেয়ে কীভাবে মারা গেছে?”

ফারুকের চেহারা পাল্টে গেলো। চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

—“হঠাৎ-ই সে মারা যায়। তবে সে জম্মের পরপর সুস্থই ছিলো। জানি না কীভাবে কী হলো। আমার স্ত্রী তার শোকে মানসিক রোগীতে পরিণত হয়েছে, তার একই কথা তার মেয়ে জীবিত। অথচ আমরা দেখেছি মৃত! নিজ হাতে দাফন করেছি আমার সেই ছোট নিষ্পাপ মেয়েকে।”

বলেই সে হালকা চোখ মুছলো। সা’দ তখন আবারও বললো,

—“আপনার মেয়ের জম্মতারিখ?”

—“১৯শে ফেব্রুয়ারী!”

—“এ. এস হলি হসপিটালে?”

ফারুক বোকা বনে গেলো সা’দের কথায়। সা’দই বা কী করে জানলো হসপিটালের নাম? ফারুক হোসাইন তো কখনো তা জানায়নি তাকে।

—“তুমি কী করে জানলে?”

সা’দ মুচকি হেসে বলে,
—“ডিএনএ রিপোর্ট আসুক তারপর বোঝা যাবে, তবে তার আগে আরও কিছু খোঁজ নেয়া লাগবে।”

বলেই সা’দ পকেট থেকে ফোন বের করে ফোনে কিছু করতে করতে সেখান থেকে অন্যদিকে চলে গেলো। ফারুক সা’দের কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারছে না।
ওদিকে রুবাই সেহেরকে খুঁচিয়ে বলে,

—“কী সেহের সা’দ কই? বিয়ে করে হারিয়ে গেলো নাকি?”

বলেই হেসে উঠলো। এদিকে সেহের কিছুটা লজ্জা পেলেও কেন যেন সা’দের জন্য চিন্তা হলো। রুবাই সেহেরকে সা’দকে নিয়ে নানানভাবে খোচাঁচ্ছে আর সেহের লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। তখনই রুবাইয়ের ফোনে সা’দের কল আসলো।

—“হ্যাঁ ভাই বল!”

—“সেহেরকে দে।”

—“এই দেখো তোমার বর কলও করেছে, নেও কথা বলো আসছি।” বলেই মুচকি হেসে কিছুটা সরে গেল রুবাই। সেহের ফোনটা হাতে নিয়ে ‘হ্যালো’ বলতেই সা’দ বলে উঠলো,

—“কী বউ আমায় মিস করছো? সমস্যা নেই আমি তো এখন পার্মানেন্টলি তোমার হয়ে গেছি। এখন শুধু রাতটা আসার অপেক্ষা।”

—“এই, আপনার এইসব লাগামহীন কথাবার্তা ছাড়া আর কিছু কী মুখে আসে না?”

—“উহু! আসে না গো!”

—“রাখেন ফোন।”

বলেই সেহের কল কেটে দিলো আর সা’দ ফোনের দিকে তাকিয়ে হাসতে শুরু করলো। সেহেরকে জ্বালাতে তার বড্ড ভালো লাগে। আজ সা’দ খুশি অনেক বেশি খুশি। আজ থেকে সে তার প্রিয়তমাকেও খুশিতে দেখবে। এখন শুধু ডিএনএ রিপোর্ট আসার অপেক্ষা। কারীব কিছুক্ষণ আগেই বেরিয়েছে, সা’দ আপাতত তারই অপেক্ষায় আছে। প্রায় ৪০ মিনিট পর কারীব ফিরলো। সা’দ রিপোর্ট হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। অতঃপর রিপোর্ট খুলে দেখতে লাগে। রিপোর্ট দেখে সা’দের ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠলো। হ্যাঁ সে যা ভেবেছে তা-ই হয়েছে। সা’দ রিপোর্ট নিয়ে ড্রইংরুমে চলে যায়। সেখানে সকলে সন্ধ্যার নাস্তা করতে ব্যস্ত। সা’দ সকলের এটেনশন চাইতেই সকে সা’দের দিকে মনোযোগ হলো। এখানে সা’দের পরিবার এবং মি. এবং মিসেস ফারুকও উপস্থিত। সেহেরও তাদের মাঝে ছিলো। সেহেরের পাশে মিসেস ফারুকও আছে। সে তো সেহেরের পাশে থেকে সরতে নারাজ। তার এমন আচরণে সকলেই কমবেশী অবাক হলেও মিসেস ফারুকের জেদের কারণে কিছু বলতে পারেনি। সা’দ তখনই তার বাবা জুবায়েরকে বললো,

—“বাবা কবির চাচার মেয়ে তো সেহের না তাই না?” সা’দের এমন কথায় সেহেরের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরলো। কিসব যা-তা বলছে সা’দ? কবির কেন তার বাবা হবে না? সা’দ যেন সেহেরের মনের কথা বুঝতে পারলো। তাই সে সেহেরকে আশ্বাস দিয়ে বলে,

—“কী কী বলছি পুরোটা শুনো তারপর ভেবো!”

সা’দের মাঝেই জুবায়ের একনার সেহেরের দিকে তাকিয়ে নিচুস্বরে বলে,

—“হ্যাঁ তো?”

—“তো বোঝাচ্ছি। ফারুক আঙ্কেল আপনার সাথে কিছু কথা ছিলো!” সা’দের কথায় ফারুক হোসাইন নড়েচড়ে বসে। অতঃপর ঠান্ডা স্বরে বলে উঠে,

—“হ্যাঁ সা’দ বলো, আমি শুনছি!”

—“আপনার মেয়ে ১৯শে ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করে মারা যায়নি। এইযে আপনার স্ত্রীর সাথে যিনি বসে আছেন তিনি হলেন আপনার ছোট মেয়ে সেহের। আর যাকে আপনি নিজের মেয়ে বলে দাফন করেছেন তিনি আমারই চাচার মেয়ে।”

সকলে অবাক হয়ে গেলো সা’দের কথায়। হিসাবটা তারা ঠিক বুঝতে পারছে না। সা’দ আবার বলা শুরু করলো,

—“এ. এস হলি হসপিটালে সেদিন একই দিনে, একই সময়ে সুফিয়া মা এবং আন্টির ডেলিভারি হয়, দুজনেরই মেয়ে হয়ম তাদের চেকাপের জন্য চাইল্ড ক্লিনিকে নেয়া হয়। সেখানে একই বেডে দুজন শুয়েছিলো, এক সেহের এবং অন্যজন কবির চাচার মেয়ে। কবির চাচার ঠিকই তার মেয়েকেই মেরেছে। কিন্তু একজন নার্স ভুলবশত সেহেরকে নিয়ে সুফিয়া মায়ের কোলে দিয়েছে আর মৃত বাচ্চাকে ফারুক আঙ্কেলের কোলে দেয়। কী আঙ্কেল ঠিক বললাম তো?”
ফারুক হোসাইন নির্বাক হয়ে মাথা নাড়ালো।

—“সেই নার্সের গড়মিলের কারণে দুজন বাচ্চা আলাদা আলাদা মায়ের কোলে গেছিলো। একজন মৃত হয়ে আরেকজন জীবন্ত হয়ে। এটা আমার কথা না, আমি সেই হসপিটালে সব খবর নিয়েছি ইভেন ফারুক হোসাইন এবং সেহেরের ডিএনএ টেস্টও করিয়েছি। আপনারা চাইলে রিপোর্ট দেখতে পারেন, আমার হাতেই আছে রিপোর্ট।” বলেই সা’দ তার হাতে থাকা রিপোর্টটা ফারুক হোসাইনের হাতে দিলো। তিনি চোখে চশমা লাগিয়ে ভালোভাবে রিপোর্টটা পড়লেন।
যতোই পড়ছেন চোখের পানিতে তার চশমা ততোটাই ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। এদিকে সেহেরের চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি পরছে। যাকে এতদিন মা বলে এসেছে সে তার মা নয়, তার পাশে বসা মা-টাই তার আসল মা? সেহের এতক্ষণে বুঝলো মিসেস ফারুকের তখনকার কথাগুলোর মানে।
ফারুক হোসাইন রিপোর্টটা সোফায় রেখে সেহেরের পাশে বসে সেহেরকে বুকে জড়িয়ে হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো। সেহেরও নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না, সেও ফারুককে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। ফারুক হোসাইন প্রায় ১৯ বছর নিজের মনের মাঝে তার ছোট্ট মেয়েটাকে মৃত বলে লালন করে গেছে আর আজ তার ছোট্ট মেয়েটা তার বুকে। এর চেয়ে বড়ো সুখ আর কী হতে পারে? আল্লাহ সুবহানাল্লাহ তায়ালা চাইলে কি-ই না করতে পারেন। তার দ্বারা সব সম্ভব। তাইতো সেহের নিজেকে এতিম ভাবলেও আজ পুরো পরিবার ফিরে পেলো। তার দুঃখের দিন শেষ। সকলের এতক্ষণ এই চরম সত্যিটা মানতে কষ্ট হলেও বাবা-মেয়েকে একসাথে কাঁদতে দেখে তাদের চোখের কোণেও জল জমলো। সা’দ চোখে পানি নিয়েই মুচকি হেসে এদিক সেদিক তাকিয়ে চোখের পানি ঢাকার চেষ্টা করতে থাকলো। কারীব চোখের কোণ মুছে সা’দের পিছে দাঁড়িয়ে সা’দের কাঁধে হাত রেখে বললো,

—“স্যার আপনি পেরেছেন। সত্যি-ই আপনার বুদ্ধির তারিফ করতে বাধ্য হচ্ছি। আপনার যাচাই-বিবেচনার কারণেই আজ এমন সুখের সময় নিজ চোখে দেখতে পারছি। আপনার পা ধরে আমার সালাম করতে মন চাইছে।” কারীবের কথা সা’দ নিশব্দে হাসলো। অতঃপর সে পিছে ফিরে কারীবকে হালকা জড়য়ে ধরলো। হ্যাঁ আজ সা’দ সফল হয়েছে। তার চেয়ে বড়ো সুখী আর কে আছে?

—“বোকা ছেলে। এতো বড়ো হয়েছো তাও বুঝো না, তোমার স্থান আমার পায়ে নয় বুকে! এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার এন্ড লাভলী!”

ফারুক তার সেহেরকে বুকে নিয়ে মিসেস মালীনির দিকে তাকালো। সে এখনো একইভাবে সেহেরের দিকেই তাকিয়ে। এখানের কেউ তার মেয়েকে না চিনলেও এই মালীনি হোসাইন ঠিকই সেহেরকে চিনেছে। সন্তানের প্রতি মায়ের টান হয়তো এটাকেই বলে। শেষমেষ ফারুক হোসাইন স্বীকার করতে বাধ্য হলো,

—“মালীনি! আমার স্বীকার করতে বাধা নেই তুমি ঠিকই আমাদের মেয়েকে চিনেছো। কিন্তু দেখো আমি কেমন বাবা যে কি না আমার এই ছোট্ট মেয়েটাকে চিনতে পারলাম না। সত্যিই তুমি প্রসংশার যোগ্য।”

ফারুক হোসাইনের কথায় মালীনি হাসলো।
—“হয়েছে। এখন মেয়েকে আমার কাছে দিন তো!আমার বুকটা যে হাহাকার করছে। আমার মা তুই একদম কাঁদবি না, আমি আর তোর বাবা আছি তো।” সে খুবই স্বাভাবিক আচরণ করলো যা দেখে ফারুক হোসাইন বিস্মিত হলেন। ফারুক দেশ-বিদেশের কতো ডাক্তার দেখালেন তার স্ত্রীকে তবুও তার অবস্থার তেমন একটা উন্নতি হয়নি। সে যতোবারই ডাক্তার দেখাতে গেছে মালীনি মিনতির সুরে বারবার বলতো,

—“আমার মেয়েকে এনে দাও, দেখবা আমি একদম ঠিক হয়ে যাবো!”

হ্যাঁ, মালীনি বরাবরই ঠিক ছিলো এবং ফারুক হোসাইন ভুল। সত্যি সত্যিই মালীনি আবার স্বাভাবিক হয়ে আসছে। সেহেরকে দুজনই আগলে রাখলেন, একসময় ফারুক হোসাইন আবেগী সুরে বলে উঠলেন,

—“মা! মারে, একবার বাবা বলে ডাকবি? তোর মুখে বাবা ডাক না শুনে যে দম বন্ধ হয়েচ আসছে।”

সেহের অস্ফুট সুরে “বাবা” এবং “মা” বলে উঠলো। এবার ফারুক হোসাইনের সাথে মালীনিও কান্নায় যোগ দেয়। তাদের একান্ত কাটানো সময়গুলো ঘন্টাখানেক চললোই। কেউ-ই তাদের পরিবারে বিরক্ত করেনি। সা’দ দূরে পিলারের সাথে হেলান দিয়ে তার মায়াবীনির হাস্যোজ্জ্বল মুখটা দেখছে। দেখার তৃষ্ণা যেন মিটবার নয়।

চলবে!!!

দখিনা প্রেম পর্ব-২৩

0

#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ২৩ ||

সকাল সকাল কারীবের ডাক পরেছে। হাই দিতে দিতে সে ডাক্তার নিয়ে হাজির হলো তার স্যারের বাসায়। ভোর এখন সাড়ে ছ’টা বাজে। বেচারা কারীব গতকাল তার স্যারের সাথে সব করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে তো পড়েছিলোই কিন্তু তার ঘুম হওয়ার আগেই তার স্যারের ডাক। ডাক্তার চোখ কচলে চশমাটা ঠিক করে সা’দের রুমে প্রবেশ করলো। সা’দ তখন পায়চারি করছিলো রুমের মধ্যে। ডাক্তারকে দেখে সে বেডের পাশে এসে দাঁড়ালো। ডাক্তার সেহেরের চেকআপ করে কপালে ক্ষতটা ডেসিং করার কথা বললো। সা’দ সেহেরের পাশে বসে সুন্দরভাবে ডেসিং করে দিলো এবং বললো,

—“রাতে তীব্র জ্বর এলো কেন?”

—“আঘাতটার থেকেই জ্বরটা এসেছে। এতে চিন্তার কোনো কারণ নেই। তাকে বেশি বেশি খাওয়াতে হবে, অনেকটাই উইক উনি। আর আপনার স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে যেই ওষুধগুলো দিয়েছে সেগুলো আমাকে একটু দেখান আমি পারলে কিছু মেডিসিন বদলে দিবো।”

সা’দ কারীবকে ইশারা করতেই কারীব সেহেরের মেডিসিনের বক্সটা ডাক্তারের হাতে দিলো। ডাক্তার সব চেক করে নতুন মেডিসিন দিলো। এর মাঝে সেহেরের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। সামনে অন্য পুরুষকে দেখে সে লাফ দিয়ে উঠে বসলো। সেহের এভাবে ওঠায় সা’দ সেহেরের বাহু ধরে বলে,

—“কী হলো এভাবে উঠলে কেন?”

সেহের ঘাড় ঘুরিয়ে সা’দকে দেখে পুরো ঘরটা তাকালো। সে এক বিলাসবহুল ঘরে অবস্থান করছে। ডাক্তার সেহেরকে উঠতে দেখে মুচকি হেসে বলে,

—“এখন কেমন লাগছে?”

—“জ্বী ভালো।”

—“নিজের যত্ন নিবে এবং খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো করবে কেমন? মিস্টার সা’দ, আমি তাহলে আসি!”

সা’দ কোনো কথা বললো না, শুধু মাথা নাড়ালো। ডাক্তার চলে যেতেই সেহের পুরো ঘরটা হা করে দেখছে। এমন সুন্দর রুম সেহের কোনোদিনও দেখেনি। কতো আলিশান রুমটা, চোখ ধাঁধানো। সা’দকে অস্ফুট সুরে বলে উঠলো,

—“এটা কোথায়? আমি এখানে কী করে এলাম?”

—“তোমায় কিডন্যাপ করে এনেছি বউ, আর এইটা আমাদের ঘর। আর এই বাড়িটা তোমার শ্বশুরবাড়ি!” মুচকি হেসে বললো সা’দ। সা’দের কথা শুনে সেহের বিস্ময়ের দৃষ্টিতে সা’দের দিকে তাকালো।

—“এসব কী বলছেন। দেখুন একদম মশকরা করবেন না!”

—“আহা! মশকরা কেন করতে যাবো, সত্যিই এটা আমার বাড়ি। আমি তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি!”

—“কেউ জানে না?”

—“সবাই জানে। ইভেন আমাদের বিয়ের কথা এখন সকলেই জানে, তাইতো এই বাড়িতে তোমায় নিয়ে এসেছি।” মুচকি হেসেই বললো সা’দ। তবে সা’দ এটা বললো না, কবির বা সুফিয়া সেহেরের আসল বাবা-মা নয়। যতদিন না সেহের সুস্থ হচ্ছে ততদিনে এগুলা বলাও অসম্ভব।
সা’দ এই কয়েকদিনে খোঁজ জারি রাখবে। খোঁজ লাগাবে সেহেরের মাকে কোন হসপিটালে ভর্তি করা হয় এবং সেদিন সেখানে ক’জন রোগীর বাচ্চা হয়েছিলো।

—“কেউ কিছু বলেনি?”

—“বললে কী এখানে আনতে পারতাম? সকলের মত ছিলো দেখেই এনেছি।”

হঠাৎ সেহেরের মন খারাপ হয়ে গেলো। দাদীমা, রিমন, জেঠু, চাচী, আবিদ, মানজু সকলকে ছাড়া যে কী করে থাকবে বুঝতে পারছে না। বড্ড মনে পরছে তাদের। সা’দ এর মাঝে কিছু লোককে ফোন করে কিছু একটা বলে দিলো। কল কেটে সেহেরকে বললো,

—“ঘুম না আসলে ফ্রেশ হয়ে নাও, এরপর কিছু খাও!”

—“না কিছু খাবো না। বাথরুমটা কোনদিকে?”

—“রুমেই আছে। ওইতো!” ইশারা দিয়ে দেখালো। সেহের কথা না বলে চুপচাপ ওয়াশরুমে ঢুকলো। কিছুক্ষণ পর আবার বেরিয়ে উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলো,

—“আমার ড্রেস তো এটা ছিলো না। ড্রেস কে চেঞ্জ করেছে?”

—“সার্ভেন্ট। কী ভেবেছো আমি চেঞ্জ করবো?”

সেহের লজ্জায় আবারও ধপ করে দরজা লাগিয়ে দিলো। আর সা’দ সেহেরের লজ্জা দেখে হুঁ হাঁ করে হাসতে শুরু করলো। কারীব সা’দের ঘরে এসে সা’দকে হাসতে দেখে বেক্কল বনে গেলো।

—“স্যার হাসছেন কেন?”

—“কিছু না, এমনি। নাস্তা রেডি করেছো?”

—“হ্যাঁ আপনার মা মানে আন্টি রান্না শুরু করেছে আগেই।”

—“মা এতো সকালে উঠেছে কেন?”

—“সে তো বলতে পারছি না স্যার।”

—“আচ্ছা তুমি নিচে গিয়ে বসো আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি!”

—“জ্বী স্যার।”

বলেই কারীব চলে গেলো। বেশ কিছুদিন কেটে গেলো। সেহের এখন মোটামুটি সুস্থ৷ সা’দের কয়েকদিন কাজ ছিলো না বিধায় সে সবসময় সেহেরের পাশে পাশে ছিলো। সেহেরের জন্য একসেট শাড়ি এবং ড্রেসও এনেছে, সাথে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। সেহের তো ভেবেই পায় না, সা’দ এতো কেয়ার কীভাবে করতে পারে? রাতে সা’দ সেহেরের পাশেই ঘুমায় তবে দুরত্ব বজায় রেখে। এ দেখে সেহের যেন আরও মুগ্ধ হয়। দিনদিন বেশ ভালোই দুর্বল হয়েছে সে সা’দের প্রতি। অবশেষে সা’দ সিদ্ধান্ত নিলো তাদের বিয়েটা আবার নতুন করে হবে। হলুদ, বিয়ে ঘরোয়াভাবে হলেও রিসিপশন বেশ বড় করে হবে। সা’দের প্রস্তাবে সকলেই রাজি হয়। সেহেরও রাজি হলো। তবে এখানে কথা আছে। বিয়ের আগে থেকে সেহের এবং সা’দ আলাদা আলাদা ঘুমাবে। এতে সা’দ রাজি হয়েছে কারণ বিয়ে ছাড়া সে সেহেরের কাছে যেতে পারবে না। পারিবারিকভাবে বিয়ে করেই সে সেহেরকে আপন করে নিতে চায়। সেহের এবং রুবাই একসাথে ঘুমায়। দাদীমা, আবিদ, রিমন, মানজু, চাচী সকলের সাথে প্রতিদিন কথা হলেও জেঠু সেহেরের সাথে কথা বলেন না। এতে সেহের বেশ ব্যথিত।

অবশেষে হলুদের দিন এলো। সেহের হলুদ শাড়ি পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে সে। সেহের কখনো শাড়ি পরেনি, তার উপর আজ তার গায়ে হলুদ, ভাবতেই কেমন শিউরে শিউরে উঠছে। সা’দকে সেও যে চায়, ভিষণভাবে। সা’দ তাকে যতোটা ভালোবাসা দিয়েছে, কেউ কোনোদিন তাকে এতো ভালোবাসা দেয়নি, বুঝেওনি। সেহেরের বিয়ে মানা নিয়ে সময় প্রয়োজন ছিলো কিন্তু সা’দ সেটা মুখ থেকে না শুনেই যথেষ্ট সময় দিয়েছে সেহেরকে। সেহের এখন আগের মতো চুপচাপ নয়, খুবই প্রাণ্যোচ্ছ্বল সে। সে যেন নতুনভাবে, নতুনরূপে বাঁচতে শিখেছে। সেহের ভাবনায় মগ্ন ছিলো এই ফাঁকে সা’দ রুমে প্রবেশ করলো। আয়নায় সা’দকে আসতে দেখে সেহের আৎকে পিছে ফিরে তাকালো। সা’দ মুগ্ধ হয়ে সেহেরের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন হলুদ পরী দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। এতো সুন্দর কেন মেয়েটা? সেহের আমতা আমতা করে বলে,

—“কী হচ্ছে কী আপনি এখানে কেকেকেন!?”

—“বউকে হলুদ মাখাতে এসেছি।” বলেই সেহেরকে ইচ্ছামতো হলুদ লাগিয়ে দিলো। সেহের চোখ ছানাবড়া করে বলে,

—“হলুদের অনুষ্ঠান তো এখনো শুরুই হয়নি আর আপনি আমাকে হলুদ লাগিয়ে নাজেহাল অবস্থা করেছেন! আপনিও না!” বলেই সেহের টিস্যু দিয়ে হলুদ মুছতে শুরু করলো৷ মুছতে মুছতে আবার বললো,

—“কী হলো চুপ কেন? এখন সবাইকে কী বলবো এই হলুদের ব্যাপারে?”

সা’দ ঘোর লাগা দৃষ্টিতে সেহেরের দিকে এক পা এক পা করে এগিয়ে গিয়ে সেহেরকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। সেহের ভয়ে রীতিমতো কাঁপা কাঁপি শুরু করে দিয়েছে। সা’দ তার হাতদুটো সেহেরের কোমড়ে রাখতেই সেহের সাথে সাথে চোখমুখ খিঁচে জোরে জোরে শ্বাস নিতে শুরু করলো। সা’দ সেহেরের কোমড়ে হলুদ লাগাতে লাগাতে ঘোর লাগা কন্ঠে বলে উঠে,

—“বলবা তোমার জামাই তোমাকে প্রথম হলুদ ছুঁইয়েছে। আর তুমি সামান্যতে এই অবস্থা করছো কেন বলো তো? সামনের ডোজ তো আরও বেশি হবে! একবার বিয়েটা হতে দাও, এরপর বুঝবা এই সা’দ বিন সাবরান কী জিনিস!”

বলেই সেহেরের সামনে থেকে সরে আসলো। সেহের সেখানে দাঁড়িয়ে লজ্জায় মাথা নত করে আছে। সা’দ হেসে আবার সেহেরের সামনে গিয়ে সেহেরের থুঁতনি উঁচু করে বললো,

—“একবার বলেছি না মাথা নত করবা না! সা’দ বিন সাবরানের বউয়ের মাথা নত থাকাটা বেমানান। তুমি আমার বউ, সবসময় মাথা সোজা রাখবা ওকে?”

বলেই সেহেরের মাথায় টুপ করে কিস করে বেরিয়ে গেলো। আর সেহের সেখানে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর রুবাই আসলো। সেহেরকে হলুদ মাখা দেখে হেসে বললো,

—“নিশ্চয়ই আমার ভাইয়ের কাজ তাই না?”

সেহের লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললো। রুবাই আবারও হেসে সেহেরকে সাথে নিয়ে নিচে চলে গেলো। গ্রাম থেকে কেউই আসেনি, বলা যায় আসতে পারবে না। সেখানকার অবস্থা নাকি ভালো না। কবিরও নাকি কোথাও গাঁ ঢাকা দিয়ে বসে আছে, পুলিশ এখনো তাকে খুঁজছে। নিচে হলুদ নিয়ে কথা উঠলে রুবাই কিছু একটা বলে কাটিয়ে দেয়। সা’দ হলুদে ইনভাইট করেছেন একমাত্র ফারুক হোসাইনকে। ফারুক হোসাইনকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে সা’দ তাই সে একদিন কথা দিয়েছিলো তার বিয়ের সকল অনুষ্ঠানে সর্বপ্রথম তাকে ইনভাইট করবেন। সেই কথা অনুযায়ী সা’দ তা-ই করলো।

চলবে!!!

দখিনা প্রেম পর্ব-২২

0

#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ২২ ||

সা’দ সেহেরকে বুকে জড়িয়ে জানালা দিয়ে বাইরের শহর দেখছে। সেহেরের মাথায় ব্যান্ডেজ, তার কোনো জ্ঞান নেই। ডাক্তার ঘুমের ইঞ্জেকশন যে দিয়েছে এখনো তার ঘুম ভাঙ্গেনি। সেহেরের অপরপাশে রুবাই ফোন চাপছে আর ড্রাইভারের পাশের সিটে তানজীল বসে আছে। আজ তারা ঢাকায় ব্যাক করছে। সেখানের ঝামেলা মিটিয়ে সা’দসহ পুরো পরিবার সেহেরকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। সা’দ এবং সেহেরের বিয়ের খবর এখন সকলেই জেনে ফেলেছে। সা’দ চুপ করে ঘন্টাখানেক আগের ঘটনাগুলো ভাবতে শুরু করলো।
,
সেহেরের জায়গায় তপাকে দেখে জোহরা সেখানেই ধপ করে বসে পরলো মাথায় হাত দিয়ে। তপা তো এক চিৎকার দিয়ে কেঁদে দেয়। আশরাব রেগেমেগে তপার দিকে এগোতে যেতেই পেছন থেকে অন্যরা তাকে ধরে ফেলে। কামালের ১ম স্ত্রী আঁচলে মুখ গুঁজে বিলাপ করতে করতে বললো,

—“এ আমার কী সর্বনাশ হলো গো মাবুদ! জীবনে কোন পাপ করসিলাম যার ল্যাইগা তুমি আমারে এরম একখান দিন দেহাইলা। আমার পতি যে আবার একখান বিয়া করলো গো, আমি এহন কী করমু গো!”

এদিকে মুরব্বীসহ চেয়ারম্যানও কিছু বলতে পারলো না। যেহেতু বিয়ে হয়েই গিয়েছে সেহেতু তাদের আর কী বলার আছে? তবে সকলেই যা-তা বলে অপমান করলো তপা, কামাল, জোহরা এবং কবিরকে। একজন তো বলেই উঠলো,

—“এই বিবাহিত বুড়োর সাথে নিজের মেয়ের বিয়ে দিতে লজ্জা করলো না! এখন মেয়েটার জীবন নষ্টের দায়ভার কী আপনি নিবেন? এক সংসার পুরো তছনছ করে দিলেন!”

কবির নিজের রাগ দমাতে না পেরে হুংকার ছেড়ে বলে,

—“আমি তপারে না সেহেররে বিয়া দিতে চাইসিলাম, কিন্তু এইহানে হিসাব গোলমেলে হয়ে গেছে!”

তখনই পুরো পরিবার এসে হাজির হলো। তারা পাশের গ্রাম থেকে শুনেছে সেহের নাকি বিয়ে করেছে তাদের গ্রামে। এই কথা শুনেই সকলে ছুটে এসেছে সেহেরের থেকে জবাবদিহিতার নেয়ার জন্য। দাদীমা সেহেরের বিয়ের কথা শুনে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকলো! পরে যখন শুনলো সেহের নয় বরং তপার বিয়ে হয়েছে তার কান্না থেমে গেলো৷ আবিদ রেগে গিয়ে কবিরের কলার ধরে দিলো টান। অতঃপর চেঁচিয়ে বললো,

—“সেহের কী আপনার মেয়ে নয়? কী করে পারলেন আমার বোনকে নিয়ে এতো বড় খেলা খেলতে! আপনি বাবা নাকি অন্যকিছু!”

কবিরও রেগে আবিদের থেকে নিজের কলার ছেড়ে আবিদকে ধাক্কা দিয়ে আরও উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে বললো,

—“না আমি কোনো বাবা না কারণ, সেহের আমার মাইয়া না! আমার রক্তের সন্তান তপা! আমি তো এক লাখ টাকার বিনিময়ে সেহেররে বিয়া দিতাসিলাম এই ফকিন্নি সব লন্ডভন্ড কইরা দিলো।”

কবিরের কথায় উপস্থিত সকলে স্তব্ধ হয়ে গেলো। এমন একটা কথা কেউ-ই আশা করেনি। সকলের নিরবতায় কবির আবার বলে উঠলো,

—“জোহরার বিয়ার পরেও আমাগো ঘনিষ্ঠতা ছিলো। একবার ভুল কইরা অঘটন ঘইটা যায় কিন্তু আমি জানতাম না আমার আরেকটা মাইয়া আছে।”

—“তাহলে সেহের আপনার মাইয়া কেমনে হয় না? আপনার প্রথম বউয়ের তো মাইয়া হইসিলো!”

—“হ হইসিলো! কিন্তু মাইয়া দেইখা আমার রাগ উইঠা গেছিলো। এই নিয়া জোহরার লগেও আমার কথা কাডাকাডি হয় যার কারণে ওইদিন রাইতে মাতাল হইয়া মাইয়ারে বালিশ চাপা দিয়া মাইরা ফেলি। কিন্তু জানি না এই মাইয়া কইত্তে আইলো। জোহরার লগে ঘনিষ্ঠ ছিলাম ওর বাপের সম্পত্তির ল্যাইগা। তাই তপারেও আজ পর্যন্ত কিচু কইতে পারি নাই। আর সেহের, ওয় তো ভিখারির বাচ্চা। ওরে দিয়া আমি কয় টাকা পামু? জোহরা আমারে সুখ দিসে, আমার বংশের বাতিও দিসে!”

তখনই দাদীমা হুংকার ছেড়ে বলে,
—“তুই কী জানোছ গজব এই মাইয়ার সম্পত্তি বলতে কিষু নাই সব তার ভাইরা লাইট্টা লইয়া গেছে?”

কবির জোহরার দিকে রক্তচক্ষু নজরে তাকালো। জোহরা মেঝেতে বসে এমনিতেই মেয়ের জন্য কেঁদেই চলেছে। তখনই আরেকজন বলে উঠে,

—“এর মানে আপনিই আপনার প্রথম স্ত্রীকে মেরেছেন?”

—“হ, হ, হ! আমিই মারসি, ওই মা** বাইচ্চা থাকার কোনো অধিকার নাই। মরতে তো গেছিলোই আবার আমার ঘাড়ে বইতে আইসিলো। তাই দিসি…”

আর বলতে পারলো না তার আগেই দাদীমা গুণে গুণে ৪টা চড় দিলো কবিরকে। কবিরের এতক্ষণে হুঁশ হলো যে সে রাগের মাথায় কী কী বলে ফেলেছে। তখনই পুলিশ ভেতরে প্রবেশ করলো। পুলিশকে দেখে কবির দাদীমাকে ধাক্কা দিয়ে রান্নাঘরের দরজা দিয়ে গিয়ে পালালো। পুলিশও কবিরের পিছে ধাঁওয়া করলো। পুলিশ সব শুনেছে বাইরে থেকে। এদিকে দাদীমা পড়ার আগেই জুবায়ের এবং আবিদ এসে তাকে ধরে ফেললো। দাদীমা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো আবার। হঠাৎ কী মনে হতেই দাদীমা চোখ মুছে বললো,

—“আমার ফুলরে বাঁচাইতে হইবো। আমার ফুল কই! আমার ফুলরে এরা আমার নাতনি আর বউমার মতো আবার মেরে ফেলবে। কোথায় আমার ফুল! আবিদদা যা না আমার ফুলরে আমার কাছে আইনা দে৷ এরা মানুষ না! অমানুষ! ফাউ খাইতে এমন গজব জম্ম দিসি আমি! আল্লাহ! তুমি আমার পোলারে জাহান্নামের আগুনে পোড়াও! এ যে মহা খুনি, আমার নিষ্পাপ নাতনিডারেও ছাড়লো না!”

সকলে দাদীমাকে সামলানোর চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু দাদীমার এক কথা তার ফুলকে লাগবে। কামাল তপাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেলো। তপা বারবার বলেছে,”মা আমি যাবো না, এই বুড়োটা আমার বর হতেই পারে না।” কিন্তু না বাবার সাথে আশরাবও তাল মেলালো। বিয়ে যেহেতু হয়েই গেছে মুরব্বীরা আর কিছু না বলে চলে গেলো। দুইদিন পর আবার বিচার বসবে। কামাল দাঁতে দাঁত চেপে ভাবছে,

—“তোর বাপ আমার লগে এতো বড়ো চিটারি করসে তার শোধ তো আমি তোরে দিয়াই মিটামু!”

এদিকে আশরাবের না চাইতেও বারবার চোখ ভিঁজে আসছে কিন্তু সে নিজেকে শক্ত রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেই চলেছে। তপাকে সে সত্যিই ভালোবাসতো, তপা যদি বিয়ে করতে না চায় সেই ভয়ে সে তপার সাথে আগে থেকেই ঘনিষ্ঠ হওয়া শুরু করেছিলো। কিন্তু শেষমেষ কী হলো? তার ভুল সিদ্ধান্তের জন্য আজ কতোবড় শাস্তি আল্লাহ তায়ালা তাকে দিলো। নিজের বাবার বউ এখন তপা। যদি সে এসব পাপ না করে আগে থেকে তার বাবাকে বলে এই বাসায় তপাকে নিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিতো হয়তো তাদের জীবনটা সুন্দর হতো। আর তপা! তার অতিরিক্ত অহংকার, নোংরামী চিন্তা-ভাবনা এবং হিংসার জন্য আজ তার এই পরিণতি। জোহরা মেয়ের জন্য মেঝেতে বসে কাঁদতে কাঁদতেই জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।

এদিকে জোহরাকে গিয়ে ধরলো আসিয়া এবং বড়ো চাচী। এতো বড়ো ঝড়ের জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলো না। দাদীমা এদিকে ফুল বলে বিলাপ করেই চলেছে। একসময় আবিদ বাধ্য হয়ে বললো,

—“ফুল স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আছে। ওর মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়েছে তাই সা’দ ভাই তারে নিয়ে সেখানে গেছে।”

দাদীমা তখনই থেমে জলদি করে বললো,

—“ফুল নাকি বিয়া করসে?”

আবিদ চুপ হয়ে গেলো। আবিদকে চুপ হতে দেখে জেঠু বলে উঠলো,

—“কী হলো আবিদ চুপ করে গেলি কেন? তুই কী বিয়ের কথা জানিস? কার সাথে বিয়ে হয়েছে? আর ফুল আমাদের না জানিয়ে এতো বড়ো সিদ্ধান্ত কী করে নিলো?” শেষের কথাটা বেশ শক্ত গলায় বললেন তিনি! জেঠুর কথায় রুবাই আমতা আমতা করে বলে,

—“আসলে জেঠু, সেহেরের বিয়েটা এক্সিডেন্টলি হয়েছে। আর বিয়েটা,(কিছুক্ষণ থামলো) বিয়েটা আমার ভাই সা’দের সাথে হয়েছে।”

বলেই সেদিনের সকল ঘটনা খুলে বললো জেঠুকে। জেঠুসহ উপস্থিত সকলে আবারও শক খেলো। এতো কিছু ঘটে গেলো আর সেহের বা সা’দ কেউ কিছুই বললো না। সব শুনে জেঠু অত্যন্ত রাগ করলেন। তিনি কিছু না বলে বেরিয়ে গেলেন। সব শুনে দাদীমা মাথা নিচু করে চোখের জল ফেলতে লাগলো। মিনমিন করে বললো,

—“সব আমার দোষ! হেইদিন আমার ল্যাইগা ফুল বাইর হইসিলো। আর আমার ল্যাইগাই তার উপ্রে দিয়া এতো ঝড় গেছে।”

আসিয়া এবং জুবায়ের এখনো স্তব্ধ হয়ে আছে। তাদের কথাগুলো যেন হারিয়ে গেছে। বারবার একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে। দুজনেই মনে মনে ভাবছে তাই তো বলি সা’দ হুট করে কেন সেহেরের চারপাশে ঘুরঘুর করে। দাদীমার কথা শুনে রুবাই দাদীমার মাথা উঁচু করে তার চোখ মুছে দিয়ে মুচকি হেসে বলে,

—“না দাদী। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন, তাইতো উনি আমার ভাইয়ের মতো একজনকে স্বামী হিসেবে দিয়ে সেহেরের দুঃখের সমাপ্তি ঘটাতে এসেছে।তুমি চিন্তা করিও না দাদী, তোমার ফুলকে কেউ কিছু বলতে পারবে না, করতেও পারবে না। আমার ভাই যে আছে তার পাশে।”

তখনই রুবাইয়ের ফোনে কল আসে! রুবাই ফোনে তাকিয়ে দেখে সা’দ কল করেছে। রুবাই কল রিসিভ করে “হ্যালো” বলতেই সা’দ অপরপাশ থেকে বলে উঠে,

—“জলদি সব প্যাক করে নে। ঢাকার উদ্দেশ্যে দাদীমা সহ সবাই আজই রওনা হবো আমরা। সেহেরকে আমি আর এই বিপদে রাখতে পারবো না, অনেক সহ্য করেছে আর না। আমি ড্রাইভার নিয়ে মেইনরোডে উঠছি। বাবার ড্রাইভারকে অলরেডি কল করে দিয়েছি সে গাড়ি নিয়ে আসছে!”
বলেই সা’দ কল কেটে দিলো।
গোছগাছ করে সকলে বেরিয়ে গেলো। মেইন রোডে এসে সেহেরকে দেখতেই জুবায়ের বা আসিয়া সা’দকে কোনো প্রশ্ন করার সাহস পেলো না। সেহেরের অবস্থা দেখে তাদের আরও মায়া লাগলো। হয়তো তাদের ছেলেটা সেহেরকে মেনে নিয়েছে, ভেবেই তার আর কোনোরকম কথা বাড়ালো না। দাদীমা আসেনি তাদের সাথে তবে সেহেরকে শেষবারের মতো দেখার জন্য মেইন রোডে সকলের সাথে ছুটে এসেছিলো। সেহেরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে সা’দকে বললো,

—“আমার ফুলটা এখন তোর দায়িত্বে নাতি, আমার ফুলডার যত্ন নিস। জীবনে অনেক কষ্ট সইয্য করসে আমার ফুলে, এহন ওরে আর কষ্ট পাইতে দিস না, মাইয়াটার সুখের যে বড়ই অভাব। এই গেরাম থেইকা ওরে নিয়া যা বাপ, ওরা ওরে কোনোদিন ভালো থাকতে দিবে না, কোনোদিন না!”

সব ভাবতেই সা’দ একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেললো এবং সেহেরকে নিজের সাথে আরও গভীরভাবে জড়িয়ে ধরলো। সেহের পরম আবেশে চুপটি মেরে ঘুমিয়ে আছে। সে তো জানেই না তার অগোচরে কি-সব ঘটে গেছে। তার জীবন যে কোনদিকে মোড় নিলো সবটাই তার অজানা রয়ে গেলো। সা’দ গভীর দৃষ্টিতে সেহেরের মায়াবী মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো। সেহের আনমনে নিজের ঠোঁটজোড়া প্রসারিত করলো। তা দেখে সা’দ কিছুটা অবাক হলো। হয়তো সুন্দর স্বপ্ন দেখছে সেহের, তাইতো ঘুমের মধ্যেও মুচকি মুচকি হাসছে। সা’দ পাশে তাকালো। রুবাই কানে হেডফোন লাগিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। সা’দ হেসে সেহেরের মাথায় ডিপলি একটা কিস করে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে ভাবতে লাগলো,

—“তোমায় আমার রাজ্যের রাণী করবো মায়াবীনি, যেখানে থাকবে না কোনো দুঃখের এক চুল পরিমাণ চিহ্ন। তোমার সুখের সময়ের জন্য নিজেকে তৈরি করে নাও। আর আমিও তৈরি হবো তোমার হাসিমাখা মুখটা দেখার জন্য। তুমি যে আমার “দখিনা প্রেম”। যেখানে নেই কোনো কৃত্রিম হাওয়া, প্রেম। আছে শুধু আমাদের পবিত্রতার ভালোবাসা। ভালোবাসি, মায়াবীনি।”

রাত প্রায় সাড়ে আট’টা নাগাদ সকলে বাড়ি ফিরলো। সেহের এখনো ঘুমোচ্ছে। সেহেরকে ঘুমোতে দেখে আসিয়া কিছু বলবে তার আগেই সা’দ গাড়ি থেকে নেমে সেহেরকে কোলে নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেলো। সার্ভেন্টরা বাড়ির সকল লাইট জ্বালিয়ে রেখেছে এবং সা’দের রুমও পরিষ্কার করে রেখেছে। সা’দ আগেই ফোন করে সব ব্যবস্থা করে রেখেছে। একজন রাঁধুনীও এনেছে যিনি এখন রান্না করতে ব্যস্ত। অলরেডি কয়েক ধরণের ডিশ বানিয়েও ফেলেছে। সা’দ সেহেরকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে রুমের দিকে চলে গেলো। নিচে আসিয়া এবং জুবায়ের হা করে সা’দের কান্ড দেখছে। রুবাই তাদের কান্ডে মুচকি হেসে বলে,

—“দেখেছো মা, বাবা! এই ছেলেটা কতো বউ পাগল! এতদিনে তোমাদের সখ মিটে গেলো সাথে মায়ের শান্তশিষ্ট বউমাও মিললো। দেখিও মা সেহের সুস্থ হলেই তোমার আগে পিছে সব সময় ছায়ার মতো থাকবে।”

রুবাইয়ের কথায় আসিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কোনো কথা না বলে সে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো। আসিয়া যেতেই জুবায়ের বললো,

—“তোর মা মনে হয় বিয়েটা মানতে পারছে না। সা’দও আজ অবধি কখনো তোর মার থেকে কিছু লুকায়নি, কিন্তু এত বড়ো ঘটনায় নিশ্চয়ই তার অভিমান হয়েছে। চিন্তা করিস না, তোরা ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট কর আমি তোর মায়ের কাছে যাচ্ছি।”

বলে জুবায়েরও নিজের ঘরের দিকে হাঁটা দিলো। রুবাই এবং তানজীলও কিছু না বলে উপরে নিজেদের রুমে চলে গেলো। সা’দ সেহেরকে শুইয়ে দিতেই সার্ভেন্টকে ডেকে পাঠালো। সার্ভেন্ট ডেকে তাকে সেহেরের পাশে রেখে সে গেলো রুবাইয়ের ঘরে, সেহেরের জন্য রুবাইয়ের একটা ড্রেস নেয়ার জন্য। রুবাইকে বলতেই রুবাই কামিজ সেট দিয়ে দিলো আর সা’দকে এও বলেছে তাদের বিয়ের কথা না জানানোর কারণে তাদের মা বেশ অভিমান করেছে। সা’দ মুচকি হেসে বলে,

—“অভিমান করাটা স্বাভাবিক আপু, তোরা রেস্ট কর আমি সার্ভেন্টকে কাপড় দিয়ে মায়ের কাছে যাচ্ছি।”

বলেই সা’দ বেরিয়ে গেলো। সার্ভেন্টকে কামিজ সেট দিয়ে বলে দিলো যেন সেহেরের ড্রেস চেঞ্জ করে দেয়। অতঃপর আর দেরী না করে নিচে চলে গেলো তার মায়ের অভিমান ভাঙ্গাতে।

আধঘন্টা ধরে আসিয়া অন্যদিকে ফিরে আছে। সা’দ এতোকিছু বললো কিন্তু আসিয়া একটা প্রশ্নেরও উত্তর দিলো না। দূরের সোফায় বসে চা খেতে খেতে মা-ছেলের কান্ড দেখছে জুবায়ের। সা’দ আসিয়ার হাঁটুর সামনে বসেই আবার বললো,

—“তুমি যদি এবার কথা না বলো তাহলে আমি কিন্তু রাতে কিছু খাবো না আম্মা!”

এবার আসিয়ার টনক নড়লো। তিনি সা’দের দিকে না তাকিয়েই ঘাড় ঘুরিয়ে জুবায়েরের দিকে তাকিয়ে রাগাম্বিত স্বরে বলে উঠলো,

—“তাকে বলে দিন রুবাইয়ের বাবা, রাতে সে না খেলে তার এই বাড়িতে থাকার কোনো অধিকার নেই। কষ্ট করে আমার বাড়িতে রাঁধুনি বয়ে এনেছে, তার টাকা কী তার বাবা দিবে?”

শেষের কথা শুনে জুবায়েরের চা গলায় আটকে গেলো যার ফলস্বরূপ তিনি খুক খুক করে কাশতে শুরু করলো। সেন্টার টেবিল থেকে পানি ঢকঢক করে খেয়ে তবেই সে শান্ত হলো।

—“সেটা আমাকে বলছো তো বলছোই আবার তার বাপকে কেন টানছো হ্যাঁ?”

—“তো আপনাকে না টেনে কী আমার বাবাকে টানবো? আমার বাবা তো তাঁহার নানা হয় নানা!”

জুবায়ের করুণ দৃষ্টিতে সা’দের দিকে তাকালো। আসিয়া যখন রেগে থাকে তখন সে এই ধরণের অদ্ভুত কথাবার্তা বলে জুবায়ের এর অবস্থা খারাপ করে দেয়। সা’দ নিজের হাসি চেপে রেখে বাবাকে বললো,

—“বাবা ওনাকে বলে দিও আমি খাবো তখনই যখন তিনি আমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিবে!”

আসিয়া শুনেও না শোনার ভান ধরে বসে রইলো। সা’দ জানে তার মা তার প্রস্তাবে রাজি হবে না তাও সে বলেছে। তখনই সার্ভেন্ট এসে বললো,
—“ম্যাম খাবার তৈরি, আপনারা আসতে পারেন।”

বলেই সার্ভেন্ট চলে গেলো। সার্ভেন্ট চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ বাদেই সকলে বেরিয়ে এলো।
খাবার টেবিলে সা’দ খেতে খেতে রুবাইয়ের দিকে আড়চোখে তাকালো। রুবাই চোখ দিয়ে কিছু একটা ইশারা করলো। সা’দ সেই ইশারা বুঝতে পারলো। আসিয়া গম্ভীর হয়েই খাবার খাচ্ছে। সা’দ খেতে খেতেই বলে উঠলো,

—“যার কষ্টের জন্য রাঁধুনি আনলাম, বাসায় আসার আগে সার্ভেন্টদের খবর দিয়ে সব ব্যবস্থা করলাম, সে-ই কেমন অভিমান করে বসে আছে। কার জন্য করলাম এতসব? ঠিক আছে ব্যাপার না সে যেহেতু বিয়েটা মানছেই না আমার আর কী করার!”

বলেই হাত ধুঁয়ে অন্য রুমের দিকে যেতে লাগলো। রুবাই সা’দের পিছু ডেকে বললো,

—“কই যাচ্ছিস ভাই? তোর ঘর তো উপরে!”

সা’দ থেমে গিয়ে উত্তর দিলো,
—“আম্মা তো বিয়ে মানেনি তাহলে সেহেরের সাথে এক ঘরে থাকার প্রশ্নই উঠে না!”

সা’দের কথায় আসিয়া খাওয়া থামিয়ে হুংকার ছেড়ে জুবায়েরকে বললো,

—“তাকে বলে দেন, বিয়ে করে এখন বউ ছাড়া আলাদা কেন থাকবে? মেয়েটা যে অসুস্থ সেদিকে খেয়াল আছে? কখন বললাম আমি বিয়ে মানিনি? শুধু তো অভিমান করেছি, আর সে আমার অভিমান না ভাঙ্গিয়ে অসহায় মেয়েটাকে কষ্ট দেয়ার ফন্দি আঁটছে। তাকে কান খুলে শুনতে বলুন, আমার বউমাকে নিয়ে যদি কোনোরকম হেয়ালি করে, তার এই ২৯ বছর বয়সেও তাকে আমি ঝাটা পেটা করবো!”

আসিয়ার শেষের কথা শুনে সা’দ চোখগুলো বড় বড় করে আশেপাশে তাকালো। নাহ কোনো সার্ভেন্ট নেই। তার মায়ের এই ধরণের কথাবার্তা কেউ শুনলে তার এতদিনের গড়া সম্মান সব লাটে যাবে। সা’দ দ্রুত মায়ের দিকে এগিয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে বাচ্চা কন্ঠে বলে উঠে,

—“সরি আম্মা, মাফ করে দেও। সত্যিই তখন এমন পরিস্থিতি ছিলো না, কাউকে বলার মতো। ইভেন আমি নিজেও প্রথমে মানতে পারিনি বিয়েটা, পরে কী হলো আমি নিজেও জানি না। তবে তোমাকে বলবো বলবো করে আর বলতে পারিনি। যদি তুমি রিয়েক্ট করো সেই ভয়ে। প্লিজ আর অভিমান করে থেকো না, সকাল থেকে অনেক চাপে আছি এখন তুমিও যদি এমন করো তাহলে কীভাবে হবে বলো তো? এখন আবার তোমার বউমার সেবা করতে হবে।”

—“হুম। আমার বউমার সেবা করাটাই তোর শাস্তি। এখন বেশি পকপক না করে ফলের রস আর স্যুপ নিয়ে যা। ওরে উঠিয়ে খাইয়ে মেডিসিন দে। নয়তো মাথার চোটটা ভালো হবে কী করে?” আসিয়ার কথার মাঝে রুবাই বলে উঠলো,

—“আচ্ছা সেহের এমন গুরুতর আঘাত পেলো কী করে?”

—“সেহের প্রতিবাদ করেছে তাই জোহরা চাচী তার কপালে দেয়াল বরাবর আঘাত করেছে।”

অতি শান্ত সুরেই বললো সা’দ। সা’দের এই শান্ত স্বভাব সকলকেই অবাক করলো। এখন এমন এক পরিস্থিতি যেখানে কেউ-ই নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। আর এই সা’দ কি সুন্দর ঠান্ডা মাথায় সবটা গুছিয়ে হ্যান্ডেল করছে। এই সা’দের জন্যই রুবাই আবার নতুনভাবে বাঁচতে শিখেছে, যদিও তার সন্তান হারানোর ব্যথা এখনো হয় তবে সেটা স্বল্প সময়ের ব্যথা। তার ভরসা আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। নিশ্চয়ই তিনি উত্তম পরিকল্পনাকারী। সকল প্রসংশা শুধু তারই নামে।

সা’দ শুধু স্যুপ নিলো। ফলের রস এখন খাওয়াটা মোটেই উচিত হবে না তার উপর এখন বাসায় ফ্রেশ ফলও নেই। সা’দ স্যুপ নিয়ে উপরে চলে গেলো। উপরে গিয়ে দেখলো সেহের এখনো ঘুমাচ্ছে। সা’দ স্যুপের ট্রে-টা বেডবক্সে রেখে দরজা লক করে দিলো। এরপর সেহেরের পাশে বসে সেহেরকে ডাকতে লাগে। সেহের অল্প অল্প তাকিয়ে উঠে বসলো। মাথা এখনো তার প্রচুর ব্যথা করছে। সেহের মাথায় দু’হাত চেপে ধরলো ব্যথার। সেহের আধো আধো কন্ঠে বলে উঠে,

—“পা..পানি!”

সা’দ জলদি সেহেরকে পানি খাইয়ে দিলো। পানি খাইয়ে কোনোরকমে স্যুপটা খাইয়ে মেডিসিনও দিয়ে দিলো। সেহের এখনো ঘুমে ঢুলছে তাই সে ঘুমের ঘোরে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। সেহেরকে খাইয়ে আবার শুইয়ে দিয়ে সা’দ উঠে কাবার্ড থেকে টাউজার এবং টিশার্ট নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। আসার পর থেকে ফ্রেশ হওয়ার সময়টা অবধি সে পায়নি। ফ্রেশ হয়ে তাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বেরিয়ে এসে দেখলো সেহের ঘুমে কাত! সা’দ মুচকি হেসে সেহের অপরপাশে আধশোয়া হয়ে শুয়ে সেহেরকে মুগ্ধ নয়নে দেখতে লাগলো। বিয়ের পর এই প্রথম দুজন একই ঘরে, একই বিছানায়। এভাবে সেহেরকে দেখতে দেখতেই সা’দ সেহেরের পাশে ঘুমিয়ে গেলো। মাঝরাতে হঠাৎ সা’দের ঘুম ভেঙ্গে গেলো এবং দেখলো সেহের কেমন যেন কাঁপছে। সা’দ চটজলদি উঠে বসলো এবং সেহেরের কপালে হাত দিয়ে তার তাপমাত্রা চেক করলো। একি! জ্বরে তো গা পুড়ে যাচ্ছে। সা’দ এখন কী করবে ভেবে পায় না। জলদি বিছানা থেকে নেমে সে ওয়াশরুমে গেলো কাপড় আর বাটি আনতে। বাটিতে পানি ভরে আর একটা কাপড় এনে বেডবক্সে রাখলো। অতঃপর সেহের ব্যান্ডেজটা কিছুটা উঁচু করে জলপট্টি দিতে থাকলো। এসির টেম্পারেচারও কমিয়ে দিলো একদম। সা’দের ঘর যথেষ্ট ঠান্ডা আছে। তবুও সেহের কাঁপছেই। সা’দ উঠে কাবার্ড খুলে একদম শেষের তাক থেকে দুটো কম্বল এনে সেহেরকে জড়িয়ে দিলো। নাহ তাতেও সেহের কাঁপছে। হুট করে এতো জ্বরের মানে বুঝলো না সা’দ। এমন জ্বর তো হওয়ার কথা নয়। কিছুক্ষণ জলপট্টি দিয়ে সে নিজেও কম্বলের ভেতর ঢুকে সেহেরকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নিলো। সেহের জ্বরের ঘোরে বিড়বিড় করে কী যেন বলছে। সা’দ নিজের কান কিছুটা এগিয়ে দিতেই শুনতে পেলো সেহেরের কথা,

—“ওরা আমার মাকে মেরেছে, আমাকেও মারতে চায়। প্লিজ বাঁচান আমাকে, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। আমার মাকে খুব কষ্ট দিয়েছে ওরা, খুব!”

এরকম নানান বিলাপ বকছে সেহের। সা’দ সেহেরকে নিজের সাথে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অস্ফুট সুরে বলে,

—“তুমি এখন আমার কাছে মায়াবীনি। আমি থাকতে কারো সাহস নেই তোমার ক্ষতি করার। আমি সর্বদা তোমার পাশে আছি বউ, ভালোবাসি।”

বলেই সেহেরের কপাল থেকে ভেঁজা কাপড়টা সরিয়ে ভালোবাসার পরশ দিলো। সেহের অনেকক্ষণ পর গিয়ে স্বাভাবিক হয় এবং গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। সেহেরকে ঘুমাতে দেখে সা’দও ঘুমিয়ে যায়। বেচারা অনেক ক্লান্ত আজ।

চলবে!!

দখিনা প্রেম পর্ব-২১

0

#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ২১ ||

ইদের দিন সকালে সা’দ পাঞ্জাবির বোতাম লাগাতে লাগাতে ভুলবশত রুবাইয়ের ঘরের জায়গায় তপার ঘরে ঢুকে পরে। কিছু বলতে সা’দ সামনে তাকাতেই দেখলো সেহের কী সুন্দর করে ঘুমিয়ে আছে। ঘুমন্ত মুখে যেন আরও দশগুণ মায়াবী লাগছে। সা’দ জানে না এই মেয়েটিকে উপরওয়ালা এতো নিখুঁত সৌন্দর্য কীভাবে দিলো? যেমন রূপ তেমনই তার সৌন্দর্য। একদম চোখ ধাঁধানো। সা’দ যেন নেতিয়ে পরলো সেহেরের রূপে। কেমন ঘোর লেগে আসছে তার। তখনই নিচে ডাকাডাকির শব্দ শোনা গেলো আর সা’দের ঘোর কেটে গেলো। সেহেরকে একপলক দেখে সে নিচে চলে গেলো। অতঃপর সকল ছেলেরা ইদের জামাতের জন্য বেরিয়ে গেলো।

—“দাদী, পান খাচ্ছো?”

—“হ নায়ক, খাইতাসি। তবে এবারের পানগুলা কেমন জানি, এই কবিররায় ভালা পান কী পায় না ধুর ধুর!”

—“দাদী কিছু কথা জানার ছিলো!”

—“বল তুই নায়ক কী কবি?”

—“আসলে দাদীমা সেদিন বললে না সেহেরের মাকে ছোট চাচা মেরেছে। কাহীনি কী বলবে?” মুহূর্তেই দাদীমার হাস্যোজ্জ্বল চেহারা মলীন হয়ে গেলো। ধীরে ধীরে পান চিবুতে চিবুতে বলা শুরু করলো,

—“ফুলের জম্মের পর সুফিয়া ওরে নিয়া আলাদা সংসার করতো। তার কারণ আমি প্রথমে না জানলেও পরে জানসি যে আমার বইনের মাইয়া জোহরার লগে কবির পরকিয়ায় লিপ্ত। অথচ মাইয়াটা কখনো আমারে এই কথা জানায় নাই। সুফিয়ার বাপ-মা ছিলো না তাই সে পাশের গ্রামে সুফিয়ার এক কাকার বাড়িত থাকতো, একদিন ফুলরে কবির ধইরা নিজের কাছে আইন্না রাখসিলো। সুফিয়া খবর পাইয়া কবিরের কাছে গেছিলো। হেইদিন আমি ছিলাম আমার বড় পুঁতের বাড়ি। কবির আর সুফিয়ার ভিত্রে কথা কাটাকাটি হইতে হইতে একসময় কবির রাইজ্ঞা মাইডারে থ্রাপাইয়া হুতাইয়া লাইসে। তারপর গলায় পারা দিয়া!”

বলেই দাদীমা হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো। সা’দ চুপ করে বসে রইলো কিছু বলার মতো অবস্থা তার নেই। দাদীমা কিছুক্ষণ পর আবার বলে উঠে,

—“সুফিয়ার খুন আবিদ নিজ চোক্ষে দেখসে। দেইখা আমারে যাইয়া বলসে। আমি এইসব হুইন্না তহনই ছুইট্টা গেছি কিন্তু কবির বা সুফিয়ারে কোনোহানে পাইলাম না। রাইতে পুলিশরে খবর দিতেই আমাগো দীঘিতে সুফিয়ারে ভাইসসা থাকতে দেখসে। পুলিশরে সব ঘটনা খুইলা বললেও তারা কয় প্রমাণ ছাড়া কিছুই করতে পারবো না। তাই কিছুই হইলো না, সবাই ধইরা নিলো সুফিয়া নিজে মরসে। দুঃখের কথা আর কী কমু নাতনি! হেই থেইকা আমার ফুলডা কতো অত্যাচারিত হইসে। জম্মের পর থেইকা বহুত কষ্ট সইসে আমার ফুল। আমার ফুলরে আল্লাহ’য় কবে সুখ দিবো! ওর সুখ না দেখলে য্র মইরাও শান্তি পামু না।”

—“আজ যে তোমার ফুলের আরেক বিপদ দাদী, কিন্তু আফসোস তোমাদের বলতে পারলাম না। কিন্তু চিন্তা করিও না, তোমার ফুল আবার সুখী হবে, অনেক অনেক সুখী হবে। এখন শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা।”

এদিকে সেহের বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে। সেদিনের সা’দের সাথে কাটানো মুহূর্তটুকু সেহের এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলতেও পারছে না। সা’দ সেদিন সেহেরকে অনেক কিছু বুঝিয়েছে এবং সেহেএ বুঝেছেও৷ কারণ, তার মা তাকে কথা দিয়েছে এই বলে সে ততোদিন ওদের কিছু বলতে পারবে না যতোদিন না সেহেরের বিয়ে হচ্ছে। সেহের তো বিয়ে করেছে তার মানে সে নিশ্চয়ই তার মায়ের ওয়াদাভঙ্গ করবে না। এই কয়েকদিনে সেহের ভেতরে ভেতরে নিজেকে শক্ত করেছে এবং নিজের মনে সাহসও জুগিয়েছে। সেহের এখন আর অন্যায় সহ্য করবে না, সবার আগে প্রয়োজন নিজেকে ভালোবাসা, অন্যের স্বার্থে নিজেকে বিসর্জন দেয়ার মতো মেয়ে সেহের নয়। তাই এখন থেকে অন্যায় দেখলেই তার মুখ চলবে৷ ভেবেই সেহের একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো৷

—“আরে তপা যে!”

তপার রাস্তা আটকিয়ে কথাটা বললো মানজু। তপা বেশ বিরক্ত হলো মানজুকে দেখে। তপার বিরক্তিমাখা মুখ দেখে মানজু মনে মনে হাসলো। অতঃপর নিজেকে সামলে বললো,

—“কই যাওয়া হচ্ছে হু?”

—“তোমাকে বলবো কেন? আমি যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাবো!”

—“নিজের বাড়ির খবর রাখো?”

—“মানে?” ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করলো তপা। মানজু হাত দিয়ে ইশারা করে তপাকে কাছে ডাকলো৷ তপা মানজুর দিকে এগিয়ে যেতেই মানজু ফিসফিস করে কিছু বললো। এতে তপার চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেলো।

—“সত্যি?”

—“হ্যাঁ।”

—“কিন্তু মা যে বললো সা’দের সাথে আমার বিয়ে হবে?”

—“আরে মূর্খ মেয়ে, তোমার মা আর বাবা তো ফুলকে তাড়ানোর জন্য এসব করছে। এখন তুমি ভেবে দেখো তো ফুলের ইয়া বড় বাড়িতে থাকবে কিন্তু তুমি সাধারণ কাঠের বাড়িতে থাকবে৷ এটা কী কোনোদিন সম্ভব বলো? কই তুমি আর কই ফুল। ওর মতো মেয়ের যোগ্যতা আছে নাকি এতো বড়ো বাড়িতে থাকার? জলদি বাসায় যাও আর খেয়াল রাখো!”

—“তোমার কথায় যে বিশ্বাস করবো এটা তুমি ভাবলে কী করে?”

—“বিশ্বাস হলে নিজে গিয়ে দেখো। বিকালে শুনেছি সকলে আদিবা আপুর শ্বশুরবাড়িতে যাবে তখন সকলের ফাঁকে এসব করবে!”

—“না আমি কিছুতেই হতে দিবো না। মা আমার সাথে এতোবড়ো প্রতারণা করবো, এর ফল তো তাদের ভোগ করতেই হবে!”

বলেই তপা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে উল্টো দিকে হাঁটা দিলো। তপা চলে যেতেই মানজু ফিক করে হেসে দিলো। অতঃপর মানজু ফোনে কারো নাম্বার ডায়াল করে বললো,

—“কাজ হয়ে গেছে, এখন ফাইনাল খেলার পালা।”

জোহরা যেন রাগে ফুঁসেই চলেছে। এই কয়েকটা দিন অনেক অত্যাচার করেছে কবির তার উপর। জোহরা কবিরের দিক চিন্তা না করে সেহেরকে সবকিছুর জন্য দোষারোপ করছে। সে নিশ্চিত যে সেহেরই এসব করছে। বাড়িভর্তি মানুষের জন্য সেহেরকে না পারছে গিলতে, না পারছে ফেলে দিতে। ঘাড়ের উপর উঠে লাফাচ্ছে যেন। এই অপয়াকে যতো তাড়াতাড়ি তাড়ানো যায় ততোই মঙ্গল। তখনই কবির এসে জোহরাকে তার অনাকাঙ্ক্ষিত সংবাদটি জানালো। এতে জোহরা যেন মেঘ না চাইতেও জল পেয়ে গেলো। কবির জোহরাকে কিছু শপিং ব্যাগ দিয়ে বেরিয়ে গেলো। জোহরা প্যাকেটের জামা-কাপড় দেখতে দেখতে পৈশাচিক হাসি দিলো। এবার সেহেরকে কঠিন শাস্তি দেয়া যাবে।
তপা বাড়ি ফিরে চুপচাপ তার মায়ের উপর নজর রাখতে শুরু করলো। যতক্ষণ না প্রমাণ পাচ্ছে ততক্ষণে সে মুখ খুলবে না। বিকালে সকলে রেডি হলো, সেহেরের খাবারে কিছু মিশিয়ে দেয় যার ফলে সে ভিষণ ক্লান্তি এবং অসুস্থতা অনুভব করছে। এই অবস্থায় সেহের যেতে পারবে না বলে দিয়েছে। যেহেতু কবিরের পরিবার আগে থেকেই যাবে না তাই দাদীমার এই বাড়িতে একা সেহেরকে রেখে যেতে মন সায় দিলো না। তপাকে জিজ্ঞেস করলে সেও যাবে না বলে জানালো। দাদীমা থাকতে চাইলে সা’দ আবিদ মিলে তাকে জোর করে নিয়ে গেলো। দাদীমা যেতেই জোহরা এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তপা উপর থেকে মায়ের ভাব-গতি লক্ষ করে নিজের ঘরে চলে গেলো। অতঃপর জোহরা নিজের ঘর থেকে বেনারসিটা নিয়ে সেহেরের ঘরে চলে গেলো। সেহের তখন কিছুটা সুস্থবোধ করছিলো দেখে উঠে দাঁড়াবে এমন সময়ই জোহরা হাসিমুখে সেহেরের ঘরে হাজির হয়। সেহের কিছুটা ভ্রু কুচকালো।

—“কিছু বলবে মা?”

জোহরা হাসিমুখে বেনারসিটা এগিয়ে দিয়ে বলে,
—“এটা পরে তৈরি হয়ে নে মা!”

—“তৈরি হবো মানে!”

—“মানে আজ তোর বিয়ে। এখন কথা না বাড়িয়ে জলদি তৈরি হ, বরপক্ষ কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে!”

জোহরার কথায় সেহেরের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পরলো। সেহের সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালো আর চোখমুখে হালকা রাগ ফুটিয়ে তুলে বলে,

—“আমি বিয়ে করবো না, আপনি কী করে আমার অনুমতি ছাড়া আমার বিয়ে ঠিক করলেন? আমি কী একবারও বিয়ের কথা বলেছি!”

সেহেরের তেজি কথায় জোহরা চোখ গরম করে সেহেরের উদ্দশ্যে বলে,
—“এতো তেজ বাপরে! তাহলে তুইও শুইনা রাখা আজ তোরে আমি বিয়া দিমুই! তোর জন্য আমার সংসারে যতো অশান্তি। ভালোয় ভালোয় রাজি হ নয়তো তোরে যে কি করমু তুই ভাইবাও পাবি না। আমি চাই না এখন তোরে মার দিতে!”

—“আপনার চাওয়া না চাওয়ার মধ্যে কী আসে যায়? আমাকে কী খেলার পুতুল পেয়েছেন আপনারা? মানুষ মনে করেন না আমাকে? আমারও ইচ্ছা আছে, আমিও ভালো থাকতে চাই! এতোদিন কিছু বলিনি দেখে কোনোদিন বলবো না এমন কিছু ভুলেও মাথায় আনবেন না। আমার মাকে তো মেরেছেনই এখন আবার আমা…”

—“ওই বিয়াদপ মেয়ে চুপ! একদম চুপ। আর একটা কথা কইলে তোরে থাপ্রাইয়া কান লাল করে দিমু। যতো বড়ো মুখ নয় ততো বড় কথা! বিয়া হইবো মানে হইবোই৷ এই জোহরা কী জিনিস এখনো তুই বুঝোস নাউ! জলদি তৈরি হ! তোর মায়ের ওয়াদা কী ভুলে গেছোস!”

—“আমি জানি আপনি মাকে নিয়ে মিথ্যা বলছেন। আমার মা কোনো ওয়াদাই করেনি! কেন মিথায় বলে গেছেন এতোগুলা দিন?”

—“হা হা জেনে গেছিস যাক ভালো। তাহলে শুন, আমি শুধু চেয়েছি এখানের রানী হিয়ে বসবাস করতে। কিন্তু সংসার তো সামলাতে হবে? তাই সেই সংসার চালানোর ভয়ে আমি তোকে আমার কাছে রেখে দিয়েছি মিথ্যা ওয়াদার কথা বলে বলে আমার কাজ করিয়েছি তোকে। আর কিছু শুনতে চাস?”

বলেই বেনারসিটা সেহেরের হাতে ধরয়ে দিতেই সেহের সেটা জোহরার মুখে ছুঁড়ে মারলো। আজ কেন জানি না সেহের নিজের মধ্যে নেই, এদের প্রতি তার এতোটাই রাগ এবং ঘৃণা জমে আছে যা সেহের চিন্তাও করতে পারে না। সেহের তো অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়েছিলো মাত্র! সেখানে এতো বড় প্রতারণা তাও নিজের মৃত মাকে নিয়ে, সেহেরের যেন বুক ফেটে কান্না আসছে। কী করে পারলো সব বিবেচনা না করে সৎ মায়ের কথা শুনে। তার তো বোঝা উচিত ছিলো যারা তার মাকে খুন করতে পারে তারা নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সব করতে পারে সব!
সেহেরের এহেম কান্ডে জোহরা তো তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো। “সেহের” বলে চিৎকার দিয়ে সেহেরের গায়ে হাত তোলার আগেই সেহের তার হাত ধরে ফেলে।

—“এতোদিন আমার ভালো রূপ দেখেছেন এখন দেখবেন আমার নতুন রূপ! আমি কী জিনিস এখন আপনি বুঝবেন তাই ভুল করেও আমাকে থাপ্পড় কারার স্পর্ধা দেখাতে আসবেন না!”
জোহরা আরও দ্বিগুণ রেগে অকথ্য ভাষায় একটা গালি দিয়ে তার অপর হাত দিয়ে সেহেরের চুলের মুঠি ধরে দেয়ালে ধাক্কা দিলো যার ফলে অনেক জোরে সেহের কপালে আঘাত পেলো। সেহের আর্তচিৎকার দিয়ে কপালে হাত চেপে ধরলো৷ তরল কিছু অনুভব হতেই সেহের নিজের হাত কপাল থেকে সরিয়ে চোখের সামনে ধরে দেখলো, রক্ত! জোহরা বিশ্রী ভাষায় গালাগাল করে ঘর থেকে হনহন করে বেরিয়ে এলো। এদিকে কিছুক্ষণ পর সেহেরের মাথা কেমন ভার হয়ে আসছে। কপালে হাত রেখেও রক্ত পড়া বন্ধ করতে পারছে না। আস্তে আস্তে তার শরীরটা নিস্তেজ হয়ে আসছে৷ চারপাশটা কেমন ঝাপসা লাগছে। জ্ঞান হারানোর আগে তপাকে সে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। এরপর সেহেরের আর কিছু মনে নেই। এদিকে জোহরা রেগে বক্সার ঘরে আসতেই দেখলো কবির কালাম এবং কাজীসাহেব কে নিয়ে আসছে। ওদের দেখে জোহরার এতক্ষণে হুঁশ ফিরলো, সেহেরকে তো সে রাগের মাথায় মেরে এসেছে এখন কী জবাব দিবে তাদের? ভাবতেই জোহরার গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। ঝামেলা হলে তো কবির তাকে আস্ত রাখবে না। ভাবতেইভতার গলা শুকিয়ে আসলো।
কামাল নতুন বরের মতো মুখে রুমাল দিয়ে বসে আছে যেন জীবনে বিয়ে করেনি। কবির হাসিমুখে তাদের আপ্যায়ন করে জোহরার কাছে এসে বলে,

—“সব ঠিকাঠাক তো?”

জোহরা ভয়ের চোটে আনমনে মাথা নাড়ালো যার উত্তর “হ্যাঁ”। কবির এতে তৃপ্তির হাসি দিলো। হেসেই বললো,

—” তাহলে যাও ওরে লইয়া আইয়ো, কাজী কইসে দেরী করতে পারবো না!”

জোহরা এবার ভয়ে কুঁকড়ে উঠে। সেহের নিশ্চয়ই অচেতন হয়ে পরে আছে। এখন কী করবে সে কিছুই বুঝতে পারছে না। জোহরা রীতিমতো ঘেমে একাকার। জোহরাকে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কবির দিলো এক ধমক। ধমক শুনে সে উল্টো দিকে হাঁটা ধরতেই দেখলো সেহের বেনারসি পরিধান করে এক হাত ঘোমটা টেনে তাদের দিকেই আসছে। সেহেরকে এভাবে দেখে জোহরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। এর মানে সেহের জ্ঞান হারায়নি। ভাগ্যিস ঘোমটা টেনেছে নয়তো সেহেরের মাথার আঘাতটা দৃশ্যমান হতো। জোহরা জলদি সেহেরকে ধরে এনে কামালের পাশে বসিয়ে দিলো। সেহেরকে বসানোর পর জোহরা বিয়ের জন্য তাড়া দিতে থাকলো। যখন সেহেরকে কবুল বলতে বলা হলো তখন সেহের নড়েচড়ে উঠলো এবং কাজীকে হাত দিয়ে ইশারা করলো। কাজী সেহেরের ইশারায় কিছুটা এগিয়ে যেতেই সেহের কাজীর কানে কানে কবুল বললো। কাজী সেহেরের কবুলে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে উঠে। বিয়ে সম্পন্ন হতেই কামালের দুই ছেলে, বউ, চেয়ারম্যান রতম চাচা এবং গ্রামের প্রায় কিছু মুরব্বিরা এসে হাজির হলো। আশরাব তার বাবাকে সদ্য বরের পোশাকে এবং তার পাশে আরেকটি মেয়েকে দেখে চটে গেলো। দাঁতে দাঁত চেপে হুংকার ছেড়ে বললো,

—“তপা! তুমি এতোটা নিচ যে আমার সাথে এক বিছানায় কাটিয়ে শেষ অবধি আমার বাবাকে বিয়ে করলে ছিঃ!!”

আশরাবের এমন কথায় কামালসহ সকলে হকচকিয়ে সদর দরজায় তাকালো। পরিচিত কন্ঠে তপা ঘোমটা খুলে সদর দরজায় একবার তো আরেকবার নিজের পাশের মানুষটাকে দেখে ভয়ংকরভাবে চমকে উঠলো।

চলবে!!!

দখিনা প্রেম পর্ব-২০

0

#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ২০ ||

—“জোহরার কী হইসে রে? ঘর থেকে বাইর হয় না ক্যা? কতো কাম আছে দেহে না?”

—“আম্মা হের অসুখ তাই আইতে পারবো না। তুমরা যা করার করো!”

বলেই কবির বাহিরে চলে গেলো। কবিবের ভাব-ভঙ্গি সা’দের কেমন সন্দেহ হলো। সা’দ রুবাইকে ডেকে কিছু বুঝিয়ে বললো। রুবাই সেসব বুঝতে পেরে মাথা নাড়িয়ে জোহরার ঘরে চলে গেলো। বাকিরা কবিরের দিকে নজর না দিয়ে যে যার কাজে লেগে পরলো। আজ আবিদের বড়ো বোন আদিবা তার স্বামী রাজিব এবং সন্তানদের নিয়ে আসছে। এখানেই তারা এবার ইদ করবে। আদিবার দুই মেয়ে। বড়ো মেয়ে লাবনী ৮ম শ্রেণির ছাত্রী আর ছোট মেয়ের নাম কলি যার বয়স মাত্র ৪। এই খবর শুনতেই সকলে তাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত। সেহের তার বাবার হিংস্র চেহারা দেখে ভয়ে কাচুমাচু হয়ে আছে। কেউ তার হিংস্রতা বুঝতে না পারলেও সেহের ঠিকই বুঝেছে কারণ সেহের অনেকবার কবিরের এই হিংস্রতার খপ্পরে পড়েছে, তাই কবিরের এই হিংস্র চেহারা সেহের অনেক বেশি চেনা। রুবাই কিছুক্ষণ বাদে রুম থেকে বেরিয়ে সা’দের কাছে গেলো।

—“মেরে একেবারে আধমরা করে ফেলেছে। সারা শরীরে তার মারের চিহ্ন।”

রুবাইয়ের কথায় সা’দের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। দাঁতে দাঁত চেপে মিনমিন করে বলে,

—“এই অমানুষ কখনো শুধরাবে না! এর কিছু একটা ব্যবস্থা নিতেই হবে।”

বলেই সা’দ বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। আর রুবাই, সে তো আগা-মাথা কিছুই বুঝতে পারছে না। সে চুপচাপ তার মায়েদের সাথে কাজে সাহায্য করতে লাগলো, সেহেরও যোগ দিলো। তপা এখনো বাড়ি ফিরেনি, সেদিকে কারো খেয়াল নেই।

সা’দ এক ক্ষেত পেরুতেই ঘন্টাখানেক আগের সেই লোকটাকে কবিরের সাথে দেখলো৷ কবির কিছু একটা নিয়ে যেন তাকে বোঝাতে চেষ্টা করছে। সা’দ খুবই সাবধানে তাদের দিকে এগিয়ে আড়ালে তাদের কথা শুনতে শুরু করলো।

—“আর তো মাত্র কয়টা দিন ভাই! দয়া কইরা উল্টা পাল্টা কিছু কইরেন না। আপনার তো ঘরে বউ আছে আর আমার ঘরে এতোগুলা মানুষ, তাই যা করার সবই গোপনে করা লাগবো। কাইল ইদ তাই কিছুদিন পর সব পরিকল্পনা মাফিক হইবো দেইহেন!”

—“আবার কোনো চিটারি করবি না তো!”

—“আল্লাহ’র কসম আমি কোনো চিটারি করি নাই বিশ্বাস করেন। আপনে খালি আমার ট্যাকাডার কথা ঠিক রাইহেন তইলেই সব হইয়া যাইবো। সেহেরকে আপনের লগেই বিয়া দিমু যা কেউ জানতে পারবো না।”

—“আইচ্ছা যা তোরে আরেকবার সুযোগ দিলাম। এহন যদি তুই কোনো গোলমাল করোছ রে কবির, তোরে যে কি করুম তুই ভাবতেও পারবি না এই কামাইল্লা কী কী করতে পারে।”

—“আপনে চিন্তা কইরেন না কইলাম তো। যাহোক এহন আমরা যাই কেউ হুইন্না ফেললে বিপদ।”

—“আইচ্ছা যা তুই আমিও যাই আশরাবরে খুঁজতে। কুত্তাডায় কই যাইয়া মরসে আল্লাহ মালুম।”

বলেই কালাম সেই স্থান ত্যাগ করলো। কালাম চলে যেতেই কবির একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সেও সেই জায়গা প্রস্থান করলো। ওরা চলে যেতেই সা’দ মানজুর মুখ থেকে হাত সরিয়ে ফেললো। যখন সা’দ আড়ি পেতে শুনছিলো মানজু তাকে দেখে সা’দকে কিছু বলার আগেই সা’দ মানজুর মুখ চেপে ছিলো। ভাগ্যিস সা’দ মানজুকে চুপ করিয়ে দিয়েছিলো নয়তো ধরা দু’জন ভালো করেই পরতো। সা’দের সাথে সেও সবটা শুনে চোখ বড়ো করে ফেললো। সা’দ এবং মানজু উভয়ই ওদের পরিকল্পনা শুনেছে। মানজু অবাক হয়ে চেঁচিয়ে বললো,

—“এই লুইচ্চা বেডায় কিনা সেহেরকে বিয়া করবে? এতো সখ আইয়ে কইত্তে এই বেডার! আর কবিররা! এই বাল কেমন বাপ! সামান্য কিছু টাকার লোভে ফুলের জীবনটা নষ্ট করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে! ফুল কি খেলার পুতুল যে যা ইচ্ছা তাই করবে!”

বলে আরও গালমন্দ করতে থাকলো মানজু। মানজু এক মুহূর্তের জন্য ভুলে গেলো সে সা’দের সামনে। এদিকে সা’দের বুকটা ধুকধুক করছে। বারবার মনে হচ্ছে কিছু একটা হারিয়ে ফেলবে। নাহ সা’দ কিছু ভাবতে পারছে না। তাকে যা করার ঠান্ডা মাথায় করতে হবে। ভেবেই সা’দ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

—“তোমার বান্ধুবীকে সাহায্য করত্র চাও তো?”

—“বুঝলাম না, কেমন সাহায্য?”

—“এই বদ লোকের খপ্পর থেকে বাঁচানোর?”

—“হ্যাঁ, অবশ্যই।”

—“তাহলে আমি যা যা বলছি তা করবা। তার আগে এটা বলো আবিদ এখন কোথায়?”

—“বাজারের দিকে থাকবে মনে হয়, নয়তো ব্রিজের দিকে। চিন্তা করবেন না, ব্রিজ দিয়েই বাজারে যেতে হয়, যদি ব্রিজে না পান বাজারে অবশ্যই পাবেন।”

—“ঠিক আছে, তুমি এখন বাসায় যাও বাকিটা আমি সামলে নিচ্ছি!”

বলেই সা’দ চলে গেলো। সা’দের দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলো মানজু। সেহেরের প্রতি সা’দের ভাবনা দেখে মানজুর মনে আনন্দ কিছুটা দলা পাকালো৷ সে খুশিমনে নিজের বাড়ির দিকে হাঁটা দিলো। তবে মনের মধ্যে ওই কামালকে নিয়ে তার একটা থেকেই গেছে।

—“কামাল কে আবিদ?”

—“কোন কামাল ভাই?”

—“ওইযে সকালে এসেছিলো?”

—“ওহ ওই ফন ব্যবসায়ী?”

—“হ্যাঁ। ওর সম্পর্কে যা যা জানো সব আমায় ক্লিয়ার করো।”

—“ওর ব্যাপারে আর কী ক্লিয়ার করবো। হালারপো বিশ্বসেরা লুইচ্চা! কতো মহিলা, বোনদের দিকে কুনজর দিয়েছে! ফালতু লোক পুরা! আর কামালের বড় পোলার কথা কী বলবো, সারাদিন জুয়া, বিড়ি, গাঁজা নিয়া পরে থাকে। কিন্তু ভাই আপনি তার ব্যাপারে জেনে কী করবেন!”

—“সত্যটা তোমাকে জানাতে চাইছিলাম না কিন্তু আগাম বিপদের জন্য তোমার সাহায্য বেশি প্রয়োজন, তাহলে শুনো….”

বলেই সা’দ বিয়ের থেকে শুরু করে একে একে কামালের ঘটনাসহ সবটা খুলে বললো। এদিকে আবিদ বিয়ের কথা শুনে নির্বাক হয়ে তাকালেও শেষে কামাল এবং কবিরের পরিকল্পনা শুনে তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। আবিদ হুংকার ছেড়ে বললো,

—“ওই কুত্তার বাচ্চারে আমি এখনই মেরে পুঁতে রাখবো, শালা নিম্নহারামী! আমার বোনের জীবন নষ্ট করতে এরা উঠেপড়ে লাগসে!”

—“দেখো আবিদ কান্ট্রোল ইওরসেল্ফ। সেহেরকে বাঁচাতে হলে আমাদেরও কঠিন প্ল্যান করতে হবে তাই শান্ত হও। রাগ কখনো কোনোকিছুর সমাধান হয় না, এই রাগ হচ্ছে শয়তানের কুমন্ত্রণা যার ফলে রাগের মাথায় আমার ভুলপথে চলে যাই! তাই রাগ বর্জন করো। ঠান্ডা মাথা পরিকল্পনা করে ওদের উচিত শিক্ষা দিবো। তার আগে তোমার বোনকে প্রতিবাদ করাতে শিখতে হবে।”

—“ও কীভাবে শিখবে ভাই, ফুল তো কোনোদিনও ওদের মুখফুটে কিছু বলেনি, এখন বলবে কীভাবে?”

—“সেটা নাহয় আমার হাতে ছেড়ে দাও। আর প্রবাদ শুনেছো তো, ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে দুজন সমান অপরাধী’। এই প্রবাদটা তোমার বোনের মাথায় ভালোভাবে ঢুকাতে পারলেই ব্যাস! খেল খতম!”

আবিদ মুগ্ধ হয়ে সা’দের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ পর অনুনয় সুরে বলতে লাগলো,

—“বিশ্বাস করেন ভাইয়া, আপনাকে যেদিন থেকে চিনেছি সেদিন থেকে আপনাকে যেন চিনেই চলেছি এবং জীবনের নানান ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারছি। আপনার বিষয়ে যেন আমার জানার শেষ নেই, তবে আপনাকে যতটুকু চিনেছি এবং বুঝেছি আপনি খুবই নরম এবং সৎ মানুষ। এতো বড় মাপের মানুষ হয়েও আমাদের ফুলকে মেনে নিলেন। আসলেই আমাদের ফুলের কপাল ফুলের মতোই। আমার বিশ্বাস ছিলো আল্লাহ আমাদের ফুলের কষ্টের সমাপ্তি একজন ভালো মানুষ দ্বারাই করাবেন। দেখেন আমার বিশ্বাসটা কীভাবে মিলে যাচ্ছে। সেই অনাকাঙ্ক্ষিত সময় বেশি দূরে নয়।”

সা’দ আবিদের কাঁধে হাত দিয়ে বাঁকা হেসে বলে,

—“চিন্তা করিও না, রিলেক্স। তোমার বোনকে আমি ইনশাল্লাহ স-সম্মানে আমার ঘরে তুলবো। আমার রাজ্যের রাণী হবে সে, কথা দিলাম।”

—“আপনাকে আমি বিশ্বাস করি ভাই। আমি জানি আপনি কখনো আমার বোনকে কষ্টে রাখবেন না। এখন চলুন আপনার কী কী পরিকল্পনা সেসব অনুযায়ী কাজ তো করতে হবে!” সা’দ মাথা নাড়ালো।

বিকালের দিকে আদিবা আসলো। আদিবা সেহেরকে সুস্থ দেখে ভিষণ খুশি। আদিবা সেহেরকে অনেক ভালোবাসে একদম নিজের বোনের মতো। সেহেরের কষ্ট সহ্য হয় না দেখে সে খুবই কম আসতো বাবার বাড়িতে কিন্তু আজ সেহেরকে সহ পরিবারকে একসাথে দেখে সে ভিষণ খুশি। আদিবা এবং রুবাই সমবয়সী তাই দুজনে কথোপকথনে ব্যস্ত হয়ে পরলো। রিমন, কলি খেলছে আর তাদের পাহারা দিচ্ছে লাবণ্য। মাঝেমধ্যে সেও তাদের খেলায় যোগ দেয়। রাজীব এবং তানজীল টুকটাক আলোচনা করছে। তখনই তপা বাসায় ফিরলো। তপা ক্লান্ত থাকায় সোজা নিজের মায়ের ঘরে গেলো কারণ, এই কয়েকটা দিন সে সেখানেই থাকে। ঘরে গিয়ে জোহরাকে খেয়াল না করেই সে বিছানায় উবুড় হয়ে শুয়ে পরলো। জোহরা মেয়ের এই অবহেলা নিতে পারলেন না, আঁচলে মুখ চেপে কাঁদছে সে। এদিকে সেহের নিজের রুমে বসে আছে। মাগরিবের নামাজ শেষ করে উঠতেই দেখলো সা’দ দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সা’দকে দেখে সেহের জায়নামাজ ভাঁজ করতে করতে ইতস্তত হয়ে বললো,

—“কিছু বলবেন?”

—“হ্যাঁ। বলছি ছাদের চাবীটা আনতে পারবে?”

—“কেন?” চোখ বড় বড় করে বললো সেহের।

—“না মানে আজ তো চাঁদরাত। আকাশে সুন্দর চাঁদ উঠেছে। ছাদ থেকে পরিবেশ নিশ্চয়ই মনোমুগ্ধকর হবে।”

—“ও আচ্ছা। চাবীর দরকার নেই আপনি যেতে পারেন, ছাদ খোলাই আছে।”

—“ওহ তাহলে চলো!”

—“চলবো মানে? আমি আবার কোথায় যাবো?”

—“কেন ছাদে? বউ থাকলে একা কেন চাঁদবিলাস করবো? তুমিও যাবা।”

বলেই সেহেরের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। কেউই তাদের একসাথে দেখতে পেলো না কারণ, উপরে কেউ নেই তারা দুজন ছাড়া। সা’দ যেন সব বুঝে শুনেই মাঠে নেমেছে। এদিকে সেহের বারবার সা’দের থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু সা’দও নাছোড়বান্দা। ছাদে এসে রেলিংয়ে হাত রেখে দুজন চাঁদ দেখছে। চাঁদের আলো খুবই স্বল্প। কিছুক্ষণ পর পর শীতল হাওয়া গাঁ ছুঁয়ে যেতেই কেঁপে উঠে সেহের। পরিবেশটা ভালোই লাগছে সেহেরের তবে তার চেয়েও বেশি অস্বস্তি লাগছে সা’দ পাশে দাঁড়ানোর কারণে। সা’দ বিষয়টা বেশ উপলব্ধি করছে। তাদের মধ্যে কিছুক্ষণ নিরবতা বিরাজ করলো। নিরবতা ভেঙ্গে সা’দ বলে উঠলো,

—“কী জন্যে তুমি তোমার সৎমা আর বাবার অত্যাচার সহ্য করো?”

সেহের অপ্রস্তুত হয়ে সা’দের দিকে তাকালো। অতঃপর আমতা আমতা করে বললো,

—“মানে কারণ কই থেকে আসবে?”

—“কারণ তো নিশ্চয়ই আছে নয়তো তুমি এতোকিছু চুপচাপ সহ্য করতে না, অবশ্যই পরতিবাদ করতে!” সা’দের কথায় সেহের চুপ করে মাথা নিচু করে রইলো। সেহেরের মাথানত করতে দেখে সা’দ সেহেরকে নিজের দিকে ফেরালো অতঃপর সেহেরের থুঁতনি ছুঁয়ে মাথা উঁচু করে দিয়ে মাদকতা চাহনী দিয়ে বললো,

—“সা’দ বিন সাবরানের বউ কোনো কিছুতেই মাথা নত করবে না। তার দৃষ্টি থাকবে সামনে, নিচে তাকানোর অধিকার আমি তাকে দেইনি!”

সেহের মুগ্ধ হয়ে সা’দের ঘোরলাগা চাহনীর দিকে তাকিয়ে রইলো। সেহেরের অজান্তেই তার চোখের কোণা বেয়ে জল গড়িয়ে পরলো। সা’দ সেহেরের দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে চোখের জল মুছে দিয়ে আবেগীসুরে বললো,

—“এই বউ কাঁদছো কেন?”

—“ভালোবাসেন আমাকে?” সা’দের চোখের দিকে তাকিয়েই কাঁপা গলায় বলে উঠলো সেহের। সা’দ মুচকি হেসে সেহেরের কপালে নিজের কপাল ঠেকালো। এতে যেন সেহেরের দম উড়ে যাওয়ার মতো। সা’দের উষ্ণ নিঃশ্বাস তার মুখে পরছে। সা’দের প্রতিটা নিঃশ্বাস শুনতে পারছে সেহের। সা’দ মৃদ্যু মাথা নেড়ে বলে,

—“হ্যাঁ মায়াবীনি। ভালোবাসি তোমাকে, অনেক বেশি ভালোবাসি! তুমি কী জানো তোমার এই ডাগরআঁখি জোড়া আমায় কেমন মাতাল করে দিয়েছিলো? তোমার এই ভয়ংকর মায়ার জ্বালে সেই কবেই ফেঁসেছি, সেই ফেঁসে যাওয়ার পর আর ফিরতে পারিনি। ডুবে গেছি তোমার মায়ার গভীর সাগরে। হাতটা ধরে উঠাতে সাহায্য করবে না?”

সা’দের এমন উত্তর একদমই আশা করেনি সেহের। সা’দের উত্তরের বিপরীতে সে কী বলবে, তার বাকশক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছে সা’দের কথার মাঝে। সা’দ সেহেরের অস্বস্তি বুঝতে পেরে কথা ঘুরিয়ে বলে,

—“দেখো সেহের তোমায় আমার মনের কথা অলরেডি বলে ফেলেছি। এখন যদি রিমন, দাদীমা এবং আমার কষ্ট দেখতে না চাও তাহলে প্লিজ সবটা খুলে বলো আমি জানতে চাই। আমি সহ্য করতে পারছি না তোমার এই কষ্টগুলো।”

সা’দের আবেগীমাখা কথাগুলো শুনে সেহের নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। সে সা’দের বুকে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো। সা’দ পরম আবেশে তার প্রেয়সীকে জড়িয়ে ধরে সেহেরকে শান্ত হওয়ার সময় দিলো। সেহের কিছুক্ষণ কেঁদে থেমে থেমে বলতে লাগলো,

—“আমার মা ওয়াদা দিয়েছে আমাকে যেন আমি কখনো এই বাড়ি, এই সংসার ছেড়ে না যাই। আমি পারিনি আমার মায়ের শেষ ওয়াদার খেলাপ করতে। তাই আজ অবধি কখনো তাদের কিছু বলতে পারিনি।”

সা’দের এতক্ষণে সবটা ক্লিয়ার হলো। কিন্তু তার মনে খটকা লাগলো। সেদিন তার দাদীমার থেকে সব অতীত জেনেছিলো৷ এবং দাদীমা সা’দকে এও বলেছিলো সেহেরের মা সেহেরকে নিয়ে আলাদা এবং কবির আলাদা থাকতো, তাহলে সেহেরের মা কবিরের হাতে খুন হলো কী করে আর সেহেরের মা খুন হওয়ার কী করেই বা সেহেরকে এই নরকে থাকতে বললো। কোনো এক জায়গায় একটা প্যাঁচ তো নিশ্চয়ই আছে, তাই মনে হলো সা’দের। সেহেরকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে সেহের ভ্রু কুচকে বলে,

—“তোমার মা কী নিজের মুখে তোমাকে ওয়াদা দিয়ে গেছিলো?” সেহের মাথা নাড়ায় যার অর্থ “না”।

—“না। সৎমা আমাকে বলেছে।”

এবার যেন সা’দের সকল হিসাব মিলে গেলো। এই পরিবারটা যেমন খুনও করতে পারে তেমনই ছলনায় অভিজ্ঞ। আর সেহেরও সেই ছলনার ফাঁদে পা দিয়ে এসেছে বারংবার।

চলবে!!!

দখিনা প্রেম পর্ব-১৮+১৯

0

#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ১৮ + ১৯ ||

প্রতিদিনের মতো সেহের ফজরের সময় উঠে পরে। ওযু করে ঘরে ঢুকতে নেয়, তখন কী মনে করে সে রিমনের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। ধীরে ধীরে রিমনের ঘরের দিকে এগিয়ে দরজায় হাত দিতেই দেখলো দরজা ভেঁজানো। সেহেরের কী যেন হলো। সে ভেতরে ঢুকে পা টিপে টিপে বিছানার পাশে চলে গেলো। সা’দ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, ডানপাশে কাত হয়ে ঘুমোচ্ছে সে। সিলিংফ্যানের বাতাসে সা’দের কপালের চুলগুলো মৃদ্যু নড়ছে। ঘুমন্ত চেহারায় সা’দকে বড্ড নিষ্পাপ দেখাচ্ছে। একদম বাচ্চা বাচ্চা! কে বলবে এই ছেলেটাই গতকাল সারাটাদিন সেহেরকে জ্বালিয়ে মেরেছে? সেহেরের সা’দকে ডাকতে ইচ্ছা করলো না কিন্তু ফজরের ওয়াক্ত হয়ে গেছে বিধায় সেহেরের সা’দকে তুলতে হবে। ডাকতে গেলে সেহেরের অস্বস্তিও লাগছে। নিজের মনের সাথে কিছুক্ষণ যুদ্ধ করে অতি নম্র স্বরে সা’দকে ডাকলো,

—“এইযে শুনুন!”

সা’দের কোনো হুঁশ নেই, সে যে ঘুমে বেঁহুশ। সেহের আবার ডাকলো কিন্তু তাতেও সা’দের হেলদোল নেই৷ সেহের এবার সা’দের কাঁধে হাত দিয়ে ঝাঁকালো। এখানেই ঝামেলা হলো৷ সা’দ সেহেরের হাত শক্ত করে জড়িয়ে ঘুমিয়ে গেলো। সেহেরের সা’দ জড়ানোর সময় সেহের কিছুটা অপ্রস্তুত ছিলো যার ফলে সে গিয়ে পরলো সা’দের উপর, সেহের মাথাটা সরুয়ে ফেলার কারণে সা’দের মাথার সাথে বারি খায়নি। সেহের চোখ বড় বড় করে সা’দের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে ভাবছে,

“কী শক্তি এই বিদেশির, ঘুমের মাঝে এতো শক্তি আসে কোথা থেকে? কী এমন খায় যে হাতির মতো শক্তি তার, আল্লাহ মালুম!”

হঠাৎ কী মনে হতেই সেহের নিজের হাত মোচড়াতে থাকে সা’দের থেকে ছাড়ানোর জন্য। কেউ এভাবে দুজনকে দেখে ফেললে মিহা কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে। সা’দের উপকার করতে গিয়ে সে নিজে ফ্যাসাদে বেশ ভালোভাবেই পরেছে। এজন্যই বলে কারো ভালো করতে নেই নয়তো নিজেই মারা পরবে। সেহেরের হাত মোচড়া-মুচড়িতে সা’দের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায় তার ভ্রুজোড়া কুচকে গেলো। সা’দের চেহারা দেখে যে কেউই ধরতে পারবে সা’দ এখন অত্যন্ত বিরক্ত। সেহেরও সা’দের অভিব্যক্তি বুঝতে পারলো। সা’দ পিটপিটি করে চেয়ে দেখলো এক নারীমূর্তি কেমন ছটফট করছে। তার ঘরে মেয়ে ভাবতেই সা’দ লাফ দিয়ে উঠে বসলো। আবছা আলোয় সেহেরকে দেখে ভ্রু কুচকে বললো,

—“তুমি আমার ঘরে কি করছো?”

সেহের লজ্জায় মাথানত করে ফেললো আর উঠে দাঁড়ালো। সেহেরের লজ্জার কারণ বুঝতে পারলো না সা’দ, তাই একই প্রশ্ন আবারও করলো। সেহের আমতা আমতা করে বললো,

—“নামাজের জন্য ডাকতে এসেছিলাম আপনাকে কিন্তু আপনি…”

আরও কিছু বলতে গিয়ে সেহের মুখে হাত দিলো। সা’দ আবারও ভ্রু কুচকে বললো,

—“আমি কী? আমি তো ঘুমিয়ে ছিলাম আমার আবার অপরাধ কী?”

সেহের কিছু না বলে চলে যেতে নিলো কিন্তু সা’দ পেছন থেকে সেহেরের হাত ধরে সেহেরকে আটকালো। তারপর দুষ্টু হেসে বললো,

—“ও বুঝতে পেরেছি! বিয়ে হয়েছে কিন্তু আমরা আলাদা সেটাই বলতে এসেছো তাইতো? সমস্যা না চলো একসাথে ঘু….”

—“এই চুপ! মুখে লাগাম দিয়ে কথা বলবেন! এগুলো কী ধরণের অসভ্যতামি! বলেছি না আপনাকে নামাজের জন্য ডাকতে এসেছি, কিন্তু আপনি-ই তো আমার হাতকে কোলবালিশ বানিয়ে রেখেছিলেন।”

—“ও আচ্ছা এই ব্যাপার, আমি হাতকে কেন কোলবালিশ করলাম! তোমাকে করলে তো…”

—“আবার!” চোখ গরম করে কথা বললো সেহের। সেহেরের তেজ দেখে সা’দ হুঁ হাঁ করে হেসে দিলো। হাসতে হাসতেই বললো,

—“জানো আজ অবধি মা ছাড়া কারো সাহস হয়নি আমাকে এভাবে চোখ গরম দেখানোর। কিন্তু দেখো আজ তুমি করলে যেখানে সবাই তোমাকে নিষ্পাপ বলে অত্যাচার করে। তাই তো বলি তুমি আমার বউ হলা কীভাবে, নিশ্চয়ই তুমি আমার উপরে যাওয়ার মতো মেয়ে!”

বলেই আবার হাসতে থাকলো। এবার সেহের লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। সা’দের মুখে বারবার ‘বউ’ ডাকটা সেহেরকে অস্থির করে দেয়। সেহের কোনো কথার উত্তর না দিয়ে বলে,

—“ছাড়ুন, আমার যেতে হবে।”

—“উম… আচ্ছা ছাড়বো, তবে এক শর্তে!”

—“কী?” চোখ বড় করে বললো সেহের।

—“দু’জন একসাথে নামাজ আদায় করবো, জানো আমার খুব ইচ্ছা বউয়ের সাথে নামাজ পড়ার!”

সেহেরের গাল জ্বলে উঠলো। না চাইতেও সা’দের শর্তে সেহের রাজি হয়ে গেলো। কিন্তু বাসার মানুষকে নিয়ে সেহের খুব ভয়। সেহের আমতা আমতা করে বলে,

—“কেউ যদি রুমে চলে আসে তখন কী হবে?”

—“আরে কিচ্ছু হবে না, দাদীমা আর জেঠুরা তো ওই বাড়িতে আর এই বাড়ির কেউ-ই তো ফজরে উঠে না। চিন্তা করিও না কেউ কিছু বুঝবে না। আচ্ছা তুমি জায়নামাজের ব্যবস্থা করো আমি চট করে ওযুটা করে আসছি।”

বলেই সা’দ ওয়াশরুমের চলে গেলো। সা’দ যেতেই সেহের যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। সেহের এখনো জানে না সে বিয়েটাকে মানতে পেরেছে কি না, কিন্তু সা’দকে সে অত্যন্ত ভরসা করে কিন্তু কেন তা সে জানে না। সা’দের মাঝেই যেন তার সবচেয়ে নিরাপদ স্থান যেখানে তার কেউ ক্ষতি করতে পারবে না। সেহের তাদের বিয়ের কথা ভাবতে ভাবতেই তপার ঘরে গিয়ে দুইটা জায়নামাজ নিয়ে আসলো। জায়নামাজ দুইটা বিছিয়ে দিতেই সা’দ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো। তাওয়াল দিয়ে হাত আর মুখ মুছে, মাথায় টুপি দিয়ে সে সেহেরের পাশে জায়নামাজে দাঁড়ালো। দুইজন একসাথে নামাজ আদায় করলো। সেহের মোনাজাতে আল্লাহ তায়ালার কাছে বললো,

“হে মাবুদ আমি জানি না আপনি কী করতে চান, আমার ভাগ্যে কী লেখা আছে। তবে আমি আমার সুসময়ের অপেক্ষায় রইলাম। বিয়ে নিয়ে আপনি আমার মনের সকল দ্বিধাবোধ দূর করে দিন, আমার পাশের মানুষটাকে আপনি হেফাজতে রাখুন। তার মতো ভালো মানুষকে স্বামী হিসেবে পেয়ে আমি সত্যি-ই ভাগ্যবতি। আপনি বিদেশিকে ফেরেশতা হিসেবে আমার কাছে পাঠিয়েছেন, আমি ইনশাল্লাহ তার যত্ন করবো। আমার মাকে আপনি জান্নাতবাসী করুন, আমিন!” বলেই মোনাজাত শেষ করলো সেহের। এদিকে সা’দ মোনাজাতে আল্লাহ’র দরবারে লাখ লাখ শুকুরিয়া আদায় করছে,

“আপনার দরবারে লাখো লাখো শুকুরিয়া, জানি না আমি আমার জীবনে কোন মহাকাজ করেছিলাম যার জন্য আপনি আমার জন্য এমন উত্তম জীবনসঙ্গিনী দিয়েছেন। তাকে আমি ভালোবেসে ভুল করিনি, সে সত্যি-ই আমার স্ত্রী হওয়ার পূর্ণ যোগ্যতা রাখে। আপনি আমায় তৌফিক দান করুন মাবুদ যাতে আমি আমার স্ত্রীকে সুখে এবং সুরক্ষিত রাখতে পারি এবং অপরাধীদের শাস্তি দিতে পারি, আপনিই যে সকল কিছুর উর্ধ্বে। আমার জীবনসঙ্গিনীর হেফাজত করুন। আমি তার কল্যাণ কামনা করি, আমিন।” সা’দও তার মোনাজাত শেষ করলো।
দুজনের নামাজ শেষ হতেই সেহের জায়নামাজ দুটো গুছিয়ে নিলো। সা’দ মাথায় হাত দিয়ে বিছানায় বসে আছে। সারারাতে মাত্র ২ ঘন্টা ঘুমিয়েছে সে, প্রচুর মাথা ব্যথা হচ্ছে তার। সেহের জায়নামাজ নিয়ে রুম থেকে বের হতে নিবে তখনই সা’দ তাকে ডাকলো এবং মৃদ্যু সুরে বললো,

—“আমাকে এক কাপ কফি বানিয়ে দিতে পারবে?”

—“কফি তো নেই। চা আছে খাবেন।”

—“না থাক লাগবে না, তুমি যাও।” বলেই মাথা ধরে চোখ বুজে বসে রইলো। সা’দের ভাবভঙ্গি সেহেরের ভালো লাগলো না। সেহের কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বলে,

—“মাথা ব্যথা করছে আপনার?”

—“হু, ঠিকমতো ঘুম না হওয়ার কারণে ব্যথা করছে।”

—“তাহলে এখন ঘুমিয়ে পড়ুন, দেখবেন মাথা ব্যথাটা আর থাকবে না।”

—“তো জগিং কে যাবে?”

—“জগিং যেকোনো সময়ই যাওয়া যায়, শেষ বিকালেও জগিং করা যায়। আপনি ঘুমানোর চেষ্টা করুন, মাথা ব্যথা নিয়ে জগিং যাওয়াটা মোটেও ঠিক হবে না।”

সেহেরের কথায় সা’দ সম্মতি জানালো। সে একটা বালিশ কোলে নিয়ে শুয়ে পরলো চখ বুজে। সেহের কিছুক্ষণ সা’দের দিকে তাকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো এবং অতি সাবধানে দরজাটা ভিজিয়ে তপার ঘরের দিকে চলে গেলো৷ রিমন এখনো ঘুমোচ্ছে দেখে সেহের একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। ভাগ্যিস বাড়ির কেউ ঘুম থেকে জাগেনি। সেহের জায়নামাজ দুইটা ওয়ারড্রপে রেখে রুম থেকে বেরিয়ে ছাদে চলে গেলো। আধো আধো আলো ফুটেছে। পাখিদের কিঁচিরমিঁচির শব্দে জানান দিচ্ছে তাদের আনন্দের অনুভূতি। একটা মানুষ যেমন ফুরফুরে মেজাজে থাকলে গান ধরে তেমনই পাখিরাও তাদের আনন্দটাকে গান দিয়ে প্রকাশ করে৷ সেহেরের বড্ড ভালো লাগছে প্রকৃতির বন্ধুত্বপূর্ণ সকালটা। একেই তো সুন্দর স্নিগ্ধময়ী সকাল। শহরের মতো এখানে নেই কোনো দূষণভরা বায়ু, সবটাই প্রকৃত। সেহের ছাদে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলো। হঠাৎ তার মনে পরে গেলো কিছু কথা। সে কীভাবে সা’দের সাথে এতোটা স্বাভাবিক হয়ে যায় সেহের নিজেও জানে না। যেখানে বড়দের সাথে চোখ তুলে কথা বলার সাহস পায় না সেখানে সা’দের সাথে কীভাবে কী? কেন ভয় পায় না সে সা’দকে? এই প্রশ্নগুলো তার অজানাই রয়ে গেলো। সূর্য অনেকটা উঠতেই সেহের নিচে নেমে পরলো।

সকাল সকাল তিন ভাই মিলে গিয়েছে গরুর হাটে। আগামীকাল ইদ, তাই তারা আর দেরী করেনি। তিন ভাই মিলে বিরাট আয়োজন করবে। এদিকে বৃষ্টির দিন বিধায় চাচী আজ সকলের জন্য খিঁচুড়ী রাঁধছে। বৃষ্টির দিনে খিঁচুড়ি আর আঁচার পুরোই জমে খিড়! বাড়ির বড় ছেলেরা বের হতেই সকলেই টুকটাক কাজ করতে লেগে পরে। এদিকে সা’দ ঘুম থেকে উঠলো ১০ টা বাজে। প্রায় ৫ ঘন্টা ঘুমিয়েছে সে। ফ্রেশ হয়ে নিচে এসে দেখে রুবাই, তানজীল, সেহেরসহ আরেকটি মেয়ে আড্ডা বসিয়েছে। তাদের আড্ডায় আবিদও উপস্থিত। কিন্তু সেহেরের পাশে বসা মেয়েটিকে সা’দ চিনতে পারলো না। সেসব বিষয় না ভেবে সা’দ সিঁড়ি বেয়ে নিচে আসলো। দাদীমা দূর থেকে সা’দকে দেখতেই বলে উঠলো, “আমার নায়কের ঘুম ভাঙসেনি?”

দাদীমার কথায় সকলেই সিঁড়ির দিকে তাকালো। সা’দকে দেখে মানজু হা হয়ে গেলো আর সেহেরকে খুঁচিয়ে ফিসফিস করে বললো,

—“এই হ্যান্ডসাম ছেলেটা কে রে? কোন মুভীর হিরো?”

সেহের উত্তর দিলো না। কেন জানি না সা’দকে দেখলেই সেহেরের কথাগুলো গলায় এলোমেলো হয়ে আটকে যায়। সা’দ দাদীমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে তাদের আড্ডার দিকে গিয়ে বসলো। রুবাইয়ের পাশে সা’দ বসতেই সা’দকে কনুই দিয়ে গুতা মেরে বললো,

—“বউয়ের পাশে না বসে আমার পাশে বসলি কেন হু?”

—“তুমি কী ভুলে যাও আমাদের বিয়েটা গোপন?”

রুবাই জিবহায় কামড় দিয়ে বললো,”আসলেই তো। সরি!” পরমুহূর্তে দাদী চেঁচিয়ে বলে উঠলো, “কই গেলা মেজো বউ আমার নায়করে না খাওইয়া রাখবা নাকি?”

আসিয়া রান্নাঘর থেকে মৃদ্যু জোরে বলে উঠলো,

—“আনছি মা। আপনি আপনার নায়ককে ডাইনিং এ বসতে বলুন।”

সা’দ তার মায়ের কথা শুনে কোন কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে উঠে ডাইনিং এ চলে গেলো। এদিকে মানজু মুখটা ছোট করে ফেললো সা’দ চলে যাওয়াতে। সেহের মানজুর এরূপ অবস্থা দেখে ভ্রু কুচকে বলে,

—“কী হলো, মুখটাকে ওমন প্যাঁচার মতো করে রেখেছিস কেন?”

—“উনি চলে গেলো কেন? আর দাদী কী নায়ক নায়ক লাগিয়ে রেখেছে নামটা বললে কী হতো?”

—“কেন নাম জেনে কী করবি?”

—“মানুষ নাম জেনে কী করে? এই ছেলেটা এতো সুদর্শন আমার তো জান-প্রাণ হার্ট অ্যাটাক করে ফেলেছে রে সখি!”

—“তাহলে ওইযে তোর সিনেমার নায়ক, কী যেন নাম ও হ্যাঁ তুষার! সে তোরে হার্ট অ্যাটাক দেয়নি?”

—“আরে ধুর, ওর কথা বাদ। ওইদিন খবরে দেখলাম সে নাকি বেআইনিভাবে মাদক ব্যবসা চালাচ্ছে, আবার পুলিশ তাকে ধরাতে সে মাতাল হয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগালও করেছে। ইয়াক ছিঃ কী পরিমাণ ঘাউড়া আর বজ্জাত ওই তুষার, আমার তো ঘিন ধরে গেছে। সেদিন থেকে সে আমার মন থেকে উঠে গেছে বইন, ওই অপদার্থটাকে নিয়ে ভাবার সময় নাই!”

সেহের মুচকি মুচকি হাসলো। তার ধারণাই ঠিক, ওই ছেলেকে দেখেই তার কেমন মাতাল মাতাল মনে হয়েছিলো। ঠিক হয়েছে পুলিশ ধরেছে ওই অসভ্যকে। সেহের মনে মনে দোয়া করলো আল্লাহ যেন তুষারকে ভালো বোঝার তৌফিক দান করে। মানজু সা’দের বিষয়ে আরও কিছু বলে খোঁচাতেই সেহের বলে উঠলো,

—“তুই তো দেখছি দুই নৌকায় পা দিয়ে আছিস। তার তথ্য দিলে আমার বেচারা আবিদ ভাইটার কী হবে শুনি?”

মানজু যেন চমকে উঠলো৷ সে কিছুটা আমতা আমতা করে বললো,

—“মানে কী ববলতে চাচাচাইছিস?”

সেহের হেসে ফেললো। মানজু অনেকদিন পর সেহেরের কৃত্রিম হাসির পেছনে লুকিয়ে থাকা হাসিটা দেখলো। এই হাসিতে কৃত্রিমতা নেই, আজ সেহের প্রাণখুলে হাসছে। সেহের হাসতে হাসতেই বললো,

—“তুই কি মনে করিস আমি কিছুই বুঝি না? আবিদ ভাই আর তুই যতোই ঝগড়া করিস না কেন দিনশেষে ঠিকই একে অপরকে চিঠি আদান-প্রদান করিস। তুই কী ভেবেছিস আমি কিছু জানবো না? তোর দুটো চিঠি আমার হাতে কিন্তু পরেছে সখি!”

এবার মানজু লজ্জায় পরে গেলো। কিছুক্ষণ লজ্জায় লাল হয়ে মানজু আবার বললো,

—“প্লিজ বইন কাউকে কিছু বলিস না, মা একবার জানতে পারলে আমাকে মেরেই ফেলবে!”

—“ঠিক আছে জানাবো না। তুইও লুচুগিরি কম কর নয়তো আবিদ ভাই তোকে মেরে ভূত বানিয়ে দিবে!”

মানজু ভেঙচি কাটলো। সা’দ খেয়ে আসতেই সকলেএ আড্ডা আবার শুরু হলো। রিমন কিছুটা দূরে বসে আবিদের ফোনে মনোযোগ দিয়ে গেমস খেলছে। এদিকে তপা সকাল থেকেই বাড়িতে নেই। জোহরাকে বলে গেছে তপা তার এক বান্ধুবির বাসায় যাচ্ছে। সেই যে গেছে এখনো তার খবর নেই। হয়তো বিকালের দিকে ফিরবে। সাড়ে বারোটা নাগাদ গরু নিয়ে তিনভাই বাড়িতে ফিরলো। গরু দেখতে সকলেই বের হলো, সেহের যেতে চায়নি কিন্তু রুবাই তাকে জোর করে বাহিয়ে নিয়ে গেছে। উঠোনের একপাশের কলপাড়ে কবির, জেঠু এবং জোবায়ের হাত, মুখ ধুচ্ছেন। গ্রামের একটা ছোট ছেলে ক্লাস এইট পড়ুয়া বাচ্চা গরুকে ঘাস খাওয়াচ্ছে। বাড়ির সকলে গরুর আশেপাশে দাঁড়ালো। সেহের কিছুটা দূরে দাঁড়িয়েছে, কিছুক্ষণ পর কবিরের দুই-তিনজন বন্ধু এসেছে যাদের কেউই চিনতে পারেনি। তাদের মধ্যে একজনের চোখ সেহেরের দিকে পরলো। সেহেরের সেদিকে খেয়াল নেই, সেহের তো এদিক সেদিক বারবার তাকাচ্ছে। লোকটা চোখ দিয়ে সেহেরকে যেন গিলে খাচ্ছে। লোকটার সাথে দাঁড়ানো তার ছেলে মোতালেব বলে উঠলো,

—“আব্বা কবির কাকার সাথে দেখা না করে এখানে দাঁড়ায় রইসো কেন?”

—“কিশু না তুই বাড়ি যা বিকালে আসিছ আমার লগে।”

—“আইচ্ছা তুমি থাকো আমি তইলে গেলাম।”

বলেই মোতালেব চলে গেলো। মোতালেবের বাবা কামাল দাঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে সেহেরের দিকে এগোতে নিলেই সা’দ কামালের সাথে এসে দাঁড়ালো। সা’দ তার পথ আটকানোতে কামাল অনেকটা বিরক্ত হলো। বিরক্তির সাথে বলে উঠলো,

—“কী সমস্যা রাস্তা আটকাইসোস ক্যা? কেডা তুই, এইহানে কী করোস?”

সা’দ কামালের মাথা থেকে পা অবধি দেখে বলে,

—“বয়স তো মনে হয় পঞ্চাশের কাছাকাছি, তাও এই বুড়ো বয়সে মেয়েবাজি ছাড়েন না। ছেলেমেয়েও তো মনে হয় আছে, তা আপনার বাসায় কী বউ নেই? আপনার বউ জানলে তো আপনাকে ঝাটা দিয়ে পিটাবে!”

—“এই বিয়াদপ পোলা, মুখ সামলায় কথা বলো, কে কইসে তুমারে আমি মেয়েবাজি করি!”

—“সেটা আপনাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে আপনার ভেতর কী চলছে। যাইহোক, ঝামেলা এখানেই মিটিয়ে ফেলুন। উল্টোপাল্টা দেখলে আমি নিজে আপনার ঝাটা পেটা খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে দিবো, আল্লাহ হাফেজ।”

বলেই সা’দ সেহেরকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলো যা একমাত্র কামালই দেখলো। কামাল রাগে ফুঁসতে থাকলো সা’দের কথা শুনে। কবির হাত মুছতে মুছতে কামালের দিকে এগিয়ে আসতেই কামাল হুংকার ছেড়ে বললো,

—“শু*র জাত! তোরে কইসি না আমি সেহেররে আমি বিয়া করুম, তুই আবার কোন বালের কাছে বিক্রি করছোস! চিটারি করোছ আমার লগে, তোর এক লাখ আমি তোর পাছা দিয়া ভইরা দিমু। আমার ফ্রেশ মাল চাই মানে ফ্রেশ মালই চাই। যদি কোনোরকম চিটারি করার চেষ্টা করোস তো তোরে মাটিতে হোতায় দিমু!”

কবিরকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কালাম হনহন করে চলে গেলো। এদিকে কবির কালামের কোনো কথাই বুঝলো না তবে কালামের অপমান সে নিতে পারে না। কালামের ঝাল গিয়ে পরলো জোহরার উপর। জোহরাকে রুমে নিয়ে গিয়ে বেল্ট দিয়ে অনেক মারলো কবির। বাড়ির সকলে বাহিরে থাকায় জোহরার আর্তনাদ কেউ শুনতে পেলো না। তখন সা’দ সেহেরকে নিয়ে ছাদের গাছগুলো দেখছিলো।

চলবে!!!

দখিনা প্রেম পর্ব-১৭

0

#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ১৭ ||

সেহের বারবার খোচাচ্ছে সা’দকে সরানোর জন্য। এদিকে রিমন গেম খেলতে খেলতে সেহেরের সাথে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। বাকিরা যে যার মতো আছে। সা’দ এবার বিরক্তি নিয়ে সেহেরের দিকে তাকালো এবং বললো,

—“কী সমস্যা!”

সেহের ফিসফিস করে বললো,
—“আমার থেকে সরে বসুন, আমার অস্বস্তি হচ্ছে!”

সা’দ হেসে সেহেরের সাথে আরও লেগে বসলো। এবার সেহের নিজের চোখগুলোকে দ্বিগুণ বড় করে ফেলে। সা’দ আবারও মুচকি হেসে বলে,

—“এমন ভাবে চোখ বড়ো করেছো যেন চোখ খুলে হাতে চলে আসবে!”

এবার সেহের সা’দকে ধাক্কা দেয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু সা’দ এক চুল পরিমাণও সরলো না। সেহের এবার অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। সা’দ তো মুচকি মুচকি হেসেই চলেছে। সেহেরকে জ্বালাতে তার ভিষণ ভালো লাগছে।

—“প্লিজ বুঝুন!”

—“কী বুঝবো?”

—“আমার সত্যিই অস্বস্তি লাগছে!”

—“তো আমি কী করতে পারি?”

—“সরে বসুন!”

—“নো ওয়ে।” বলে সা’দ আবার ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলো। সেহের কী মনে করে রিমনকে আলগা করে মাঝে বসিয়ে দিয়ে জানালার পাশে চলে গেলো। রিমন ঘুমের ঘোরে কিছুটা নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে গেলো। সা’দ এটা দেখে অবাক হয়ে তাকালো। সেহেরের পেটে পেটে এই ছিলো ভাবতেই সা’দের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো আর কিছু না বলেই গাল ফুলিয়ে বসে রইলো। সেহের তাকিয়ে দেখলো রাগে সা’দের ফর্সা চেহারা লাল হয়ে আছে। এ দেখে কেন জানি না সেহেরের বেশ হাসি পেলো। সা’দ হঠাৎ তার সাথে এমন করে চিপকালো কেন? এই বিদেশির মতলব কী? আচ্ছা কোনোভাবে কী সা’দ এই বিয়েটা মেনে নিয়েছে? মেনে না নিলে এমন অধিকার তো দেখাতো না। ভাবতেই সেহেরের মনে শীতল হাওয়া বয়ে গেলো। পরক্ষণে আবার ভাবলো সা’দ তো একবারও মেনে নিয়েছে বলে স্বীকার করেনি! যদি তার ভাবনা ভুল হয় তো? আর সেহেরের জীবনটারই যে কোনো গ্যারান্টি নেই, তার মতো মেয়েকে সা’দ কেন মেনে নিবে? সেহেরের জীবন কাহীনি শুনে করুণা দেখাচ্ছে? নাহ সেহের আর ভাবতে চায় না তাকে নিয়ে। ভেবেই সেহের চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

প্রায় ৫০ মিনিট পর সকলে নরসিংদীর একটা শপিংমলে আসলো। রুবাই আর আসিয়া তো ধুমসে শপিং করছে, এদিক দিয়ে তপা আর জোহরাও কম না। তপা ওয়েস্টার্ন ড্রেস নিতে গেলে কবির বাঁধা দিয়ে রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠলো,

—“এইসব ছিঁড়া জামাকাপড় আমার টাকায় নিতে পারবি না ভিখারিনীর বাচ্চা!!”

কবিরের কথায় তপা মেজাজ দেখাতে গিয়েও পারলো না কারণ, কিছুটা সামনে সা’দ দাঁড়িয়ে এদিকে সেদিক তাকাচ্ছিলো। তপা সা’দকে দেখে কবিরের পাশ কাটিয়ে সরে এসে সা’দের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সা’দ সানগ্লাসের ভেতর দিয়ে তপাকে একবার দেখে অন্যদিকে সেহেরের দিকে তাকালো। সে আপাতত এক কোণায় রিমনকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তপা নিজে থেকে বলা শুরু করলো,

—“সা’দ দেখো আমার এই ড্রেসটা পছন্দ হিয়েছে প্লিজ কিনে দাও না।”

সা’দের মন চাচ্ছে তপাকে কয়েক ঘাঁ চড় মারতে। তার উপর কিসব ড্রেস দেখাচ্ছে যা সা’দের একদম অপছন্দ। সা’দ নিজের রাগ দমিয়ে বললো,

—“তোমার বাবা অথবা মাকে বলো!”

—“আরে বাবা তো কিনেই দিচ্ছে না তাইতো তোমাকে বললাম, প্লিজ সা’দ আমায় এটা কিনে দাও!”

—“কাউকে কিছু বলার আগে ম্যানারলেসটা শিখো! আমি তোমার থেকে প্রায় অনেক বড় তাও এইটুকুন একটা মেয়ে হয়ে আমার নাম ধরে ডাকছো তো ডাকছোই আবার ‘তুমি’ সম্বোধন করছো! লাজ-লজ্জা কী নেই নাকি তোমার মা বড়দের সম্মান কীভাবে দিতে হয় সেটা শিখায়নি! লজ্জা-শরম থাকলে এখুনি তোমার এই ডিজগাস্টিং ড্রেস থেকে সরে যাও নয়তো এই সা’দ কী জিনিস হারে হারে বুঝায় দিবো, ইডিয়েট!”

সা’দের ধমক তপা এই প্রথম শুনলো। সে ভয় পেয়ে অন্যদিকে চলে গেলো আর মনে মনে সেহেরকে গালি-গালাজ করতে লাগলো। সেহেরের আশেপাশে থাকলে কিছু না আবার সে কাছে গেলেই দোষ! এদিকে তপাকে দেখে সা’দের চ্যালেঞ্জের কথা মনে পরে গেলো। সে দ্রুত পায়ে হেঁটে সেহেরের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো এবং সেহেরের হাত ধরে সেহেরকে থ্রি-পিস দেখাতে লাগলো৷ জেঠু আর কবির বাইরে আছে তাই তারা সা’দের এহেম কান্ড দেখতে পারেনি। কিন্তু এখানে উপস্থিত সকলেই সা’দের কর্মকান্ড অবাক হয়ে দেখছে একমাত্র তানজীল বাদে। রুবাই তো ভাবতেই পারেনি তার ভাই এতো চালু হবে। জুবায়ের আসিয়ার সামনে এসে ফিসফিস করে বলতে লাগলো,

—“তোমার ছেলের কী হলো বলো তো? তুমি এতো করেও ওরে কোনো মেয়ের সাথে লাইন করিয়ে দিতে পারলা না আর এই ছেলে কি না সেহেরের হাত ধরেছে?”

—“বিষয়টা আমিও বুঝতে পারছি না গো। মনে হচ্ছে যেন স্বপ্ন দেখছি!” সা’দের দিকে তাকিয়ে বললো আসিয়া!

—“বাস্তবে ফিরে আসো এটা কোনো স্বপ্ন নয়৷ তোমার ছেলের পেটে পেটে কী চলছে দেখো গিয়ে আমার তো সুগার বেড়ে যাচ্ছে!”

—“আরে ধুর। হয়তো সেহেরের সম্পর্কে জানতে পেরেছে তাই হয়তো এমন করছে। চিন্তা করো না সব ঠিক আছে।”

ওদিকে তানজীল হেসে রুবাইকে বললো,

—“জান অবাক হলে?”

—“অনেকটা!” সা’দের দিকে তাকিয়েই বললো। এদিকে জোহরা আর তপা রেগে আগুন হয়ে আছে।

—“সকলে দেখছে হাত ছাড়ুন! এ কেমন অসভ্যতামি!”

সা’দ থ্রি-পিস দেখতে দেখতে বললো,
—“আমার ইচ্ছা আমি আমার বউয়ের হাত ধরেছি তাতে তোমার কী! চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো আর আমায় ড্রেস দেখতে দাও!”

সেহের নানানভাবে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু সা’দের শক্তির সাথে কিছুতেই পেরে উঠছে না। প্রতি রোজার ইদেই সেহেরের নতুন জামা কিনে দিতো কবির কিন্তু এবার কোরবানি ইদে একটা না দুইটা না একেবারে ৫টা দামী দামী থ্রি-পিস কিনে দিলো সা’দ। যদিও সা’দ গোপনে পেমেন্ট করেছে কিন্তু সকলে জানে রুবাই সেহেরকে এগুলো উপহার দিয়েছে। পাঁচটাই সা’দ নিজে পছন্দ করে দিয়েছে। নিজের পছন্দে প্রিয়জনকে উপহার দেয়াটা সত্যিই অনেক সুখ দেয়। যেমনটা সা’দ পাচ্ছে। সেহের একদমই নিতে চায়নি কিন্তু আসিয়া এবং জুবায়েরের জোরাজুরিতে সেহের এগুলা নিতে বাধ্য হলো। কিছুক্ষণ পর জেঠু এবং কবির আসলেন। তারা আসতেই সকলে বেরিয়ে গেলো। এতক্ষণ জোহরা এবং তপা সেহেরকে নিয়ে সকলের দরদ চুপচাপ দেখেছে আর লুচির মতো ফুলেছে। ভদ্রতার খাতিরে না কিছু বলতে পেরেছে আর না সহ্য করতে পেরেছে। তপার তো সেহেরকে একদম খুন করে দিতে ইচ্ছা করছিলো। যাওয়ার সময়ও সেহেরের গাঁ ঘেঁষেই সা’দ বসলো। এবার রিমন সেহেরের পাশে নেই। সে সামনে আবিদ ভাইয়ের সাথে বসেছে। এবার সেহের পরেছে বিপাকে। সেহের যতো সরে এসেছে ততোই সা’দ সেহেরের দিকে ঘেঁষে বসেছে। চাপতে চাপতে একসময় গাড়ির জানালার সাথে আটকে গেলো সেহের। পেছন সিটে সেহের এবং সা’দ ছাড়া কেউ নেই তাইতো সা’দের সাহস বেড়েছে। সেহের ফিসফিসিয়ে সা’দকে সরতে বললেই সা’দ বলে উঠে,

—“তুমি যতো তোমার থেকে সরতে বলবা আমি ততো তোমার কাছে চলে আসবো! এখনো তো দেখনি সা’দের খেল আস্তে আস্ত এসব বুঝবা!”

সেহের এবারও করুণ চোখে তাকালো সা’দের দিকে। সা’দ সেহেরের দৃষ্টি পাত্তা না দিয়ে ফোনের দিকে মনোযোগী হলো। সেহের বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে একসময় ঘুমিয়ে গেলো। সেহেরকে ঘুমোতে দেখে সা’স ফোন রেখে সেহেরের মাথাটা নিজের কাঁধে রেখে সামনে ফিরলো। গ্রামে ফিরতে ফিরতে মাগরিবের আযানও শেষ হয়ে গেলো। গ্রামে ফিরে রিকশা করে বাসাতে চলে আসলো।

—“দেখো এই সেহেরটারে আমার একদম সইয্য হইতাসে না। এই মাইয়া সবসময় ওই সা’দের লগে চিপকায় থাকে, আপনি জলদি ওরে কিছু করেন!”

—“এই মা*** চুপ করবি? এমনেই মন মেজাজ ভালা না আর তুই আসছোস আজাইরা কথা দিয়া কানের মাথা খাইতে! কয়বার কমু এইসব বালের কথা নিয়া আমার সামনে আসবি না! ওই মাইয়া জাহান্নামে যাক আমার কী! আমার এক লাখ পাইলেই হইলো! আর এই জোহইররা! আরেকবার যদি তুই বালের প্যানপ্যান করোস তইলে তোরেও ওই মাইয়ার ফকিন্নি মায়ের মতো মাইরা জবাই দিমু! আমারে চিনোস!”

বলেই হনহন করে কবির বাহিরে চলে গেলো আর জোহরা সেখানেই মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো।
রাতে সা’দের ঘুম আসছিলো না বিধায় রুম থেকে বেরিয়ে ক্যারিডোরে হাঁটাহাঁটি করছিলো আর একটা ফিল্ম নিয়ে ফোন ঘাটছিলো তখনই চেঁচামেচি শুনতে পায় সে। রেলিংয়ের ধারে আসতেই কবির এবং জোহরার সব কথা সে শুনতে পেলো। বেশ রাত হওয়ায় এখন প্রায় সকলেই ঘুমে কাত। সা’দ সব শুনে তার মাথায় অনেকগুলো প্রশ্ন ভনভন করতে লাগলো।
কবির কোন এক লাখের কথা বললো? আর কবির এও কেন বললো সে সেহেরের মাকে মেরে ফেলেছে?

—“নাহ এদের মধ্যে এখনো অনেক রহস্য লুকানো আছে।”

এইসব রহস্য ভাবতে ভাবতে সা’দের নির্ঘুম রাত কেটে গেলো, শেষরাতে গিয়ে সা’দ ঘুমিয়ে গেলো।

চলবে!!!

দখিনা প্রেম পর্ব-১৬

0

#দখিনা_প্রেম
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| পর্ব ১৬ ||

—“ও তাহলে এই ব্যাপার! এই মেয়েই তোর বউ! ও মাই গড ব্রো! আই জাস্ট কান্ট বিলিভ ইট। মেয়েটা আসলেই মাহশাল্লাহ।”

—“রুবাই শুনলে কিন্তু তোমার কপালে দুঃখ আছে ব্রো! তাই ভুল করেও ওসব বলিও না!”

সা’দ এবং তানজীল কথা বলতে বলতে হাঁটছিলো তখন দেখলো আবিদ এদিকেই আসছে। আবিদকে দেখে সা’দ হেসে ওকে সামনে আসতে ইশারা করলো। আবিদও মুচকি হেসে সা’দের দিকে গেলো।

—“এতো সাতসকালে তোমরা বাইরে যে?”

—“ও কিছু না, মর্নিং ওয়ার্কে বেরিয়েছিলাম তা তুমি কোথায় গিয়েছিলে?”

—“আর কোথায় বন্ধুদের সাথে টঙে বসে চা খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছিলাম। তো এখন চলো নাস্তার সময় হয়ে গেছে তো!”

—“হ্যাঁ চলো!”

আবিদ, সা’দ এবং তানজীল তিনজন মিলে সেহেরদের বাড়িতে চলে এলো। বাড়িতে এসে কবিরকে দেখে সা’দ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। ওনাকে সে চিনে কিন্তু এই চেয়ারম্যান এখানে কী করছে বুঝতে পারছে না সা’দ। তখনই আসিয়া সা’দের কাছে এসে সা’দকে দেখিয়ে বললো,

—“এইযে কবির ভাই ও আমার ছোট ছেলে সা’দ। আর পাশে যাকে দেখছেন, ও হলো আমার মেয়েজামাই তানজীল। আর সা’দ ও হলো তোমার ছোট চাচা!”

একথা শুনে সা’দ আরেকবার টাস্কি খেলো। তখনই সকালের দাদীমার বলা ঘটনাগুলো সা’দের মনে পরলো৷ সা’দ এবার স্বাভাবিক হলো এই ভেবে যে এই লোককে দ্বারা সব সম্ভব। কিন্তু এমন নিকৃষ্ট একজন মানুষ তার ছোট চাচা হবে সেটা সা’দ কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। সা’দ কবিরকে চিনতে পারলেও কবির সা’দকে চিনতে পারেনি কারণ, সেদিন সা’দ মাস্ক আর রোদের তাপ থেকে বাঁচকে চোখে সানগ্লাস পরা ছিলো। কবির হাসিমুখে কথা বলতে এলে সা’দ কবিরের সাথে কোনো কথাই বললো না। সে কবিরের পাশ কাটিয়ে পাটিতে খাওয়ার জন্য বসলো। সা’দ কোনোদিন তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে চলেনি এবং আজও তার ব্যতিক্রম নয়। সা’দের আচরণে কবির মুখটা গোমড়া করে রইলো আর বোঝার চেষ্টা করলো যে সা’দ তার সাথে এমন কেন করলো। বাকিরা নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে কেউ এই ব্যাপারটা খেয়াল করেনি। তবে আবিদ, তানজীল এবং আসিয়া ব্যাপারটা খেয়াল করেছে কিন্তু কেউ কিছু বলেনি। আসিয়া বুঝতে পেরেছে ছেলের এরূপ আচরণ কিন্তু তারও যে কিছুই করার নেই। ভেবেই চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্যদিকে চলে গেলেন। এদিকে আবিদ বেশ খুশি হলো সা’দ কবিরকে এড়িয়ে গেছে বলে। সা’দ খেতে বসলে রুবাই সা’দের পাশে বসলো আর খেতে খেতে ফুসুরফুসুর করে বলে,

—“সেহের তোর আশেপাশে ছিলো বলে জোহরা আর তার ওই মেয়ে তপা নাকি ধোপা কী যেন নাম, ওরা বেশ মিসবিহেভ করেছে। এও বলেছে তারা নাকি তোর গলায় ওই তপাকে ঝুলিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করছে তাই যেন সেহের তোর আশেপাশে না ঘেঁষে। সাহস কতো দেখেছিস?”

সা’দের মুহূর্তেই রেগে উঠলো। চামচটাকে এতো শক্ত করে ধরলো যে সেটা বাঁকা হয়ে গেলো। সা’দ দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

—“ওরা বলেছে না সেহের আমার আশেপাশে ঘেঁষলে ওরা সেহেরকে ছেড়ে কথা বলবে না। ওকে ডান চ্যালেঞ্জ এক্সেপ্টেড! সেহের না ঘেঁষলেও আমি সারাক্ষণ ওর সাথে আঠার মতো লেগে থাকবো, দেখি কার কেমন ব্যথা হয়।”

—“ধুর বাদ দে তো। শুধু শুধু ঝামেলায় জড়ানো উচিত হবে না!”

—“ঝামেলা? তুই বলছিস এই ঝামেলার কথা? ওদের সমস্যা কী সেহেরকে নিয়ে? পাইসে টা কী ওরা সেহেরকে? হাতের পুতুল নাকি শোপিজ যে যা ইচ্ছা সেভাবে ইউস করবে অত্যাচার করবে? একটারে যদি আমি শায়েস্তা না করতে পারি তাহলে আমার নামও সা’দ বিন সাবরান না মনে রাখিস!”

—“ভাই কোথায় যেন পুড়তাসে! এর মানে আমি যা ভাবছি তাই ঠিক হলো?” ভ্রু কুচকে কিছুটা খুঁচিয়ে প্রশ্নটা করলো রুবাই। রুবাইয়ের কথার মানে বুঝতে পেরে সা’দ আমতা আমতা করে কথা ঘুরিয়ে ফেললো। কথা ঘুরানোর আগেই রুবাই বলে উঠলো,

—“এবার আমি পুরোপুরি শিওর তোর আর সেহেরের মধ্যে কিছু একটা চলছে। একে তো তখন আমি ওভাবে বলায় এইরকম রিয়েক্ট করেছিস আবার এখন কথা ঘুরিয়েছিস। ভাই এতোটাও বোকা ভেবো না, বোকা হয়ে এতো বড় অফিস সামলাই না। তবে যাই বলো ভাবী মানতে আমার আপত্তি নেই। ক্যারি অন ব্রো, সবরকম হেল্প করতে প্রস্তুত আছি।” হেসে উত্তর দিলো রুবাই। সা’দও হাসলো। এর মাঝে তানজীল বলে উঠলো,

—“কী ব্যাপার দুই ভাইবোন মিলে কী এতো বলছো?”

—“আর কী ভাইয়ের প্রেমকাহিনী শুনি!”

—“ওহ রিয়েলি? কিরে সা’দ তোর আর সেহেরের বিয়ের কথাটা বলে দিলি?”

এবার সা’দ পরলো মহা মুশকিলে! রুবাই চোখ বড়ো বড়ো করে বললো,

—“বিয়ে মানে? ওদের বিয়ে হয়ে গেছে আর আমি জানি না? কীভাবে কী হলো?”

সা’দ এবার কপট রেগে তানজীলের দিকে তাকালো। সআ’দ চাইছিলো না রুবাই তাদের বিয়ের বিষয়টা জানুক কিন্তু শেষমেষ ফাঁস হয়েই গেলো! রুবাই তো এখন পুরো জ্বালিয়ে খাবে। সা’দ কপট রেগে বললো,

—“মুখটা না খুললে বেশি ভালো হতো!”

—“আমি কী জানতাম নাকি তুই বিয়ের কথা বলিস নি!”

—“এই তোমরা থামো আগে আমাকে সব হিস্ট্রি খুলে বলো। আর ভাই তুই কিনা বোনকে বাদ দিয়ে শেষমেষ এর সাথে সব শেয়ার করলি আর বোনটাকে পর করে দিলি?”

—“দেখ আপু যা জানিস না তা নিয়ে একদম কথা বলবি না!”

এরমাঝে আসিয়া ধমক দিয়ে বলে,”খাওয়া ছেড়ে কিসের এতো কথা বলিস তোরা? চুপচাপ খা!”

এবার কারো মাঝে কোনো কথা হলো না সকলে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। তপা তো বারবার সা’দের কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করছে। সা’দ বরাবরই তাকে এড়িয়ে চলছে। তপা খুবই উশৃংখল ভাবে চলাফেরা করে যা একদমই দৃষ্টি কটু। সা’দ তো ভাবছে রাগের মাথায় কখন কী বলে ফেলে। খাওয়ার পরপরই সা’দ রুবাইকে সবটা সুন্দরভাবে খুলে বলতেই রুবাই সা’দকে আশ্বাস দেয় সেহেরকে দ্রুত তারা এই নরক থেকে মুক্ত করবে। এদিকে সেহেরকে সা’দ একবারের জন্যেও রুম থেকে বের হতে দেখলো না। এতে সা’দের মনটা খারাপ হয়ে রইলো। উপায় না পেয়ে সা’দ রুবাইকে বলতেই রুবাই সা’দকে নিয়ে সেহেরের রুমে চলে গেলো। সেহের তখন একটা উপন্যাসের বই পড়ার চেষ্টা করছিলো কিন্তু কিছু কঠিন শব্দ তাকে বারংবার বিচলিত করে ফেলছিলো। কারো আসার উপস্থিতি টের পেতেই সেহের বই থেকে চোখ সরিয়ে রুবাইয়ের দিকে তাকায়। রুয়াবিয়ের পাশে থাকা মানুষটাকে দেখে সেহের অজানা কারণে শিউরে উঠলো। সেহের চটজলদি মাথা ওড়না পেঁচিয়ে পরিপাটি হয়ে বসলো। কোনো ছেলেমানুষ দেখে একটা মেয়ের এভাবে তাড়াহুড়ো করে মাথায় ঘোমটা পরার দৃশ্যটা সত্যিই মনোমুগ্ধকর যা সা’দকেও সমানভাবে মুগ্ধ করে ফেললো। সা’দ আপনমনে এলোমেলো ভাবে একটা ছন্দ বললো,

-“এই মায়াবীনি, আর কতো ভাসবো
তোমার ওই কাজল ভেলার আঁখিতে,
আর কতো মুগ্ধ হবো
তোমার মলিন হাসির রূপকথায়?”

রুবাই মুচকি হেসে বললো,
—“সামনে তো ইদ তাই আমরা আজ সকলে মিলে শপিং করতে শহরে যাবো! জলদি রেডি হয়ে নাও!”

—“আপনারা যান না আপু আমি যাবো না!”

সেহেরের জবাবে সা’দ মুহূর্তেই রেগে বললো,
—“কেন যাবে না?” সা’দের কন্ঠে রাগ স্পষ্ট। সা’দের এমন রূপে সেহের কিছুটা ভয় পেলো। সেহের আমতা আমতা করে বললো,

—“আসলে আমি বেশিদূর জার্নি করতে পারি না, আর আমি এমনিতেও অসু….”

সেহেরকে কিছু বলতে না দিয়ে সা’দ রুবাইয়ের উদ্দেশ্যে বললো,

—“আপু তুমি রুমের বাহিরে যাও আমি ওকে রাজি করাচ্ছি। আমিও দেখে ছাড়বো ওর এইসব এক্সকিউজ কই থেকে আসে।”

—“মামামানে? আপু কোথায় যাবে? আপু কোথাও যাবে না প্লিজ!”

কিন্তু আফসোস! সেহেরের কথাগুলো শোনার আগেই রুবাই বাইরে এসে দাঁড়িয়ে থাকলো। বাকিরা সবাই শপিং করার জন্য রেডি হচ্ছে তাই জোহরা বা তপার এদিকে আসার কোনো চান্স নেই। সা’দ পিছে তাকিয়ে বিছানায় হাত রেখে সেহেরের দিকে ঝুকতেই সেহের জলদি কিছুটা পিছে সরে গেলো। সেহেরের চোখেমুখে আতঙ্ক স্পষ্ট!

—“দে..দেখুন! আপনার মধ্যে উল্টো পাল্টা ভাবনা থাকলে আগেই বলে রাখছি এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন নয়তো…”

—“বাব্বাহ! এই তেঁজটা আমাকে না দেখিয়ে তোমার ওই বাপ সৎমা আর ছ্যাঁচড়া বোনটাকে দেখালে তো বেশি উপকার হতো!”

—“আমি যাকে ইচ্ছা তাকে তেঁজ দেখাবো আপনার কী?”

—“আমার অনেক কিছু বিকজ ইসলামের রীতিতে তোমায় আমি বিয়ে করেছি। সো নাও আই এম ইওর হাসবেন্ড কোনো পরপুরুষ না। তাই তোমার উপর আমার সম্পূর্ণ রাইট আছে।”

—“তো রাইট আছে দেখে কী যা ইচ্ছা তাই করবেন?”

—“ইয়েস! আমি সা’দ বিন সাবরান নিজের ইচ্ছাকে বেশি প্রায়োরিটি দেই৷ এখন থেকে যদি তোমার ওই বোন বা মা তোমাকে কিছু বলতে আসে, তুমি যদি তাদের কথা প্রতিবাদ না করো তাহলে,”

—“তাহলে কী?”

—“ব্যাখ্যা জানতে চেয়ো না! নিজেই ঝামেলায় ফাঁসবা। এখন যা বললাম তা করো, জলদি রেডি হও নয়তো…”

বলেই সা’দ সেহেরের দিলে আরও এগিয়ে গেলো। সেহের ভয়ে আরও পিছে গিয়ে অস্ফুট সুরে বললো,

—“আমি যাবো এখন আপনি ঘর থেকে বের হোন!”

সা’দ সোজা হয়ে দাঁড়ালো আর সেহের যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। সা’দ সেহেরের দিকে তাকিয়ে একটা চোখ টিপ মেরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। এই সা’দ যে কী জিনিস সেহের আজ হারে হারে টের পেয়েছে। কিন্তু এখন সেহের নিজেই অবাক হলো। কই আজ অবধি তো মানজু ছাড়া কারো সাথে সে এভাবে কথা বলেনি। সা’দের সাথে কী করে এমন স্বাভাবিকভাবে কথা বললো সেহের বুঝতে পারলো না। সা’দ সেহেরের স্বামী বলে নাকি সা’দকে আলাদা ভরসা করে বলে। কিন্তু তাদের বিয়েটা তো অস্বাভাবিকভাবে হয়েছিলো তাহলে সা’দ কী করে সবটা মেনে নিলো? সেহের তো ভেবেছিলো সা’দ তাকে ডিভোর্স দেয়ার কথা বলতে এসেছে কিন্তু এখন তো সা’দের কর্মকান্ডে তার সব ধারণা বদলে গেলো। নাহ সা’দ আসলেই এই বিয়ে মেনে নিয়েছে কি না তা সেহেরের জানতে হবে। সেহের সা’দকে তা জিজ্ঞেস করার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেডি হওয়া শুরু করলো। অবশেষে সকলে একসাথে বেরিয়ে রিকশায় চড়লো। গ্রামের ভেতর অটোরিকশা ছাড়া আর কিছুই চলে না। বাজারে এসেই ওরা রিকশা থেকে নেমে হেঁটে রাস্তার মোড়ের দিকে রওনা হলো। দাদীমা আর চাচী বাড়িতে থেকে গেছেন কারণ তাদের দুজনের একজনও জার্নি করতে পারে না আর দাদীমার পক্ষেও সম্ভব না এই শরীর নিয়ে জার্নি করার। রাস্তার মোড়ে আসতেই একটা বড় মাইক্রো দেখতে পেলো সবাই। সকলে যে যার সিটে বসতেই তপা একজায়গায় বসে পরলো সা’দের জন্য জায়গা খালি রেখে। কিন্তু সা’দ তপার পাশে না বসে একবারে পেছনে সেহেরের পাশে গিয়ে সেহেরের গাঁ ঘেঁষে বসলো। রিমন আবিদের ফোনে গেম খেলছিলো আর সেহের তা-ই দেখছিলো। পাশে কেউ গাঁ ঘেঁষে বসায় সেহের কিছুটা নয় বরং অনেকটা শিউরে উঠেই তার বামপাশে তাকালো। সা’দ এমন ভাব ধরে সামনে তাকিয়ে আছে যেন কিছুই জানে না। সেহের কিছু বলতে পারলো না কারণ তপা তাদের দিকেই অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। সেহের সা’দকে কী বলে সরাবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না সে। সেহেরের অস্বস্তিতে অবস্থা খারাপ৷ কে জানতো সা’দ এমন একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেলবে। সেহের আগে জানলে সে জানালার পাশে বসতো, রিমনকে বসাতো না। কিছুক্ষণের মাঝেই গাড়ি স্টার্ট দিলো। সা’দ সিটের সাথে হেলান দিয়ে একমনে ফোন টিপছে আর সেহের মূর্তির মতো বক্সে আছে।

চলবে!!!