Friday, June 27, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1070



কে তুমি পর্ব-০৬

0

গল্পঃ কে তুমি ( ষষ্ঠ পর্ব )
লেখাঃ ইমতিয়াজ আহমেদ চৌধুরী

নাবিলাকে ধরে নিজের বেডে শোয়ালো নিলয়, উদ্দেশ্য হাসিল করার এই তো মোক্ষম সময়, নাবিলার কোমরের ওপর সতর্কতার সাথে হাত রাখলো।

পাওয়ারফুল ঘুমের ওষুধ মিশ্রিত কফি খেয়ে খুব দ্রুত ঝিম মেরে এসেছিল নাবিলার মাথা, দুচোখ ঝাপসা হয়ে এসে কেমন ঢলে পড়েছিল।

আসলে নিলয় যখন হার্টের ওষুধ আনতে বলেছিল, কফি মেকারের পাশে হার্টের ওষুধ পেলেও প্রেসক্রিপশনে ঘুমের ওষুধ লেখা ছিল, সেটা পায়নি দেখেই ফিরে এসে বলেছিল ঘুমের ওষুধ পাইনি, এবং নিলয়কে বিশ্বাস করে বলেই ওটা নিয়ে তেমন সন্দেহ করেনি নাবিলা, কিন্তু সেই ওষুধ সরিয়ে এনে আগেভাগেই রেখে দিয়েছিল নিলয়।

নাবিলার কোমরের কাপড় সরাবে এমন সময় দরজার বাইরে থেকে আওয়াজ করে মীরা বললো,– ভাইয়া রাতের খাবার খেতে আসো, সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।

“ তুই যা আমি আসতেছি ” বলে নিলয় বেড থেকে নামলো।

সবাই অপেক্ষা করে বলতে নিলয়ের চাচা, তার স্ত্রী এবং দুই ছেলেমেয়ে মীরা ও রাকিব। নিলয়ের পুরো পরিবার সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাবার পর থেকে নিলয় নিজের বাড়ি ছেড়ে এখানেই থাকে চাচার বাসায়, এখানে থেকেই বাবার রেখে যাওয়া বিজনেস সামলায়। আসলে পরিবার হারিয়ে পরিবার সম্পর্কে ধারণা আরও স্পষ্ট নিলয়ের, তাই চাচার পরিবার নিজের পরিবার ভেবে নিজের আলিশান বাড়িঘর ছেড়ে এখানেই থাকে নিলয়।

ডাইনিং টেবিলে এসে বসলো নিলয়, চাঁচি খাবার সার্ভ করে নিজেও বসলো। মীরা নীরবতা ভেঙে সবার উদ্দেশ্যে বললো,– জানো, আজকে নিলয় ভাইয়ার রুমে হিমি ভাবীর আত্মা এসেছিল!

নিলয় বাদে বাকিরা ভীষণ অবাক হয়ে বললো,– এ্যা!

মীরা বললো,– এ্যা নয় হ্যাঁ, তারপর আবার গায়েব হয়ে গেল!

নিলয় বাদে সবাই সমস্বরে বললো,– বলিস কি!

মীরা মুখ গম্ভীর করে বললো,– তোমরা যা শুনছো সেটাই বলেছি।

মীরার বড়ো ভাই বললো,– মুখে মেকাপ ঘষতে গিয়ে চোখে ঘষে ফেলছিস মনে হয়, তাই ভুলভাল দেখছিস, কতবার বলছি মেকাপ কম করে মাখ, আমার কথা শুনলে আর আর তোর মুখে এসব আজগুবি গল্প শুনতে হতোনা!

মীরা ভেঙচি দিয়ে বললো,– তোর বউকে যেন কোনদিন মেকাপ ঘষতে না দেখি।

মীরার বড়ো ভাই রাকিব খুবই চালাক এবং উচ্ছনে যাওয়া যুবক, বাজে আড্ডা এবং নেশায় ডুবে থাকা ছাড়া তার আর কাজ নেই! রাকিব ও নিলয় সমবয়সী প্রায়।

খেতে খেতে রাকিব নিলয়কে বললো,– নিলয়, এতগুলো ফ্যাক্টরি পরিচালনা করতে নিশ্চয়ই তোর হিমশিম খেতে হয় মনে হচ্ছে, তাছাড়া হিমি ভাবীকে হারিয়ে তোর মানসিক অবস্থাও ভালো নেই বোধহয়, বলছিলাম আপাতত কেমিক্যাল ফ্যাক্টরিটা আমি দেখভাল করি, একটু হলেও তোর প্রেশার কমবে!

নিলয় সবার সামনেই রাকিবকে বললো,– তোর হাতে ফ্যাক্টরি ছাড়া মানেই কদিন পরে তোকে খুঁজে পাওয়া গেলেও ফ্যাক্টরি আর পাওয়া যাবেনা, সুতরাং আগে এই বিশ্বাস অর্জন করো যে তুমি পারফেক্ট, তারপর দেখা যাবে। অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করো, নেশাপানি ছাড়ো। কারণ আমি বেঁচে থাকতে আমার বাবার রেখে যাওয়া কোনকিছুরই বিন্দুমাত্র ক্ষতি হতে দেবোনা।

সবার সামনে এ কথা বলার কারণে রাকিব ভীষণ রেগে গিয়ে টেবিল ছেড়ে উঠে চলে গেল। রাকিবের বাবাও উঠে চলে গেল, তার ছেলেকে নিলয়ের বলা কথায় তারও খারাপ লেগেছে তাই।

নিলয়ের চাচি নিলয়কে বললো,– ওদের কথা বাদ দে তো বাবা, শোন বহুদিন তোকে একটা কথা বলবো বলবো করেও বলা হয়না, এটা আমার আর তোর চাচার ইচ্ছে, তুই পূর্ণ পূরণ করবি বল!

নিলয় বললো,– কি ইচ্ছে বলেন!

চাচি বললো,– তোর সাথে মীরার বিয়ে।

এই কথা শুনে নিলয় এবং মীরা দুজনেই হ্যাং হয়ে গেল। মীরা ভাবছে এরকম কিছু হলে তার ভালোবাসার মজনু তো ছ্যাঁকা খেয়ে দেবদাস হয়ে যাবে। এই দৃশ্য দেখার আগে হারপিক সেবন করে মরে যাওয়াও ভালো!

নিলয় বললো,– এসব কি বলেন চাচিমা, এটা কি করে সম্ভব! আমি মীরাকে নিজের ছোট বোনের মতো ভালোবাসি, এটা অসম্ভব! আপনাদের এই ইচ্ছেটা পূরণ করা আমার পক্ষে সম্ভব না।

মীরারও বললো,– বিষয়টি বেদনার মা, আমিও নিলয় ভাইয়াকে বড়ো ভাইয়ের মতো মানি।

মা চোখ গরম দিতেই মীরা চুপ হয়ে গেল।

চাচি আবার নিলয়কে বললো,– চাচাতো ভাই বোনের মধ্যে বিয়েসাদী হয়তো নিলয়, এটা দোষের কিছু না, তুই একটু ভেবে দেখিস, তা নাহলে আমার চেয়ে বেশি কষ্ট পাবে তোর চাচা।

নিলয় চুপচাপ উঠে বেসিনে গিয়ে হাত ধুয়ে প্রতিরাতের মতোই ড্রইং রুমে গিয়ে সোফায় বসে টিভি দেখতে লাগলো, ঘুমানোর আগে এটা নিলয়ের রোজকার অভ্যাস। নিলয়ের চাচি প্রতিরাতের মতোই দুধ গরম করে এক গ্লাস দুধ মীরাকে দিয়ে নিলয়ের জন্য পাঠালো। কিন্তু আজকের দুধ প্রতিদিনের মতো স্বাভাবিক নয়, ঘুমের ওষুধ মেশানো দুধ, সেটা মীরাও জানেনা।

ড্রইং রুমে এসে নিলয়ের হাতে দুধের গ্লাস দিয়ে মীরা বললো,– ভাই, বিয়ের আগে মজনুকে বিধবা করিসনা আব্বু আম্মুর কথায় প্লিজ, মজনুর প্রেমে অলরেডি লায়লা আমি!

: হা হা হা, কি বলিস এসব মীরা!

: হ্যাঁ ভাই, আব্বা আম্মার কথায় তুমি আবার রাজি হইয়ো না, তাইলে কিন্তু আমার নিরীহ নিষ্পাপ মজনু অকালে দেবদাস হইয়া ঝরিয়া পড়িবে ভাই!

: হা হা হা, তোর মাথা খারাপ! এমন কিছুই হবেনা।

মীরা আবার কিচেনে মায়ের কাছে চলে আসলো, মা মীরাকেও এক গ্লাস দুধ খেতে দিলো, এবং এই দুধেও ঘুমের ওষুধ মেশানো।

দুধ খেয়ে মীরা মায়ের সাথে কাজে হেল্প করছে এবং ধীরে ধীরে মীরারও ঘুম পাচ্ছে!

ওদিকে ঘুমের ওষুধ মেশানো দুধ খেয়ে নিলয় সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছে!

মীরাও চেয়ারে বসে ঘুম।

রাকিবকে ডেকে মা বললো,– শোন, নিলয়কে ধরে মীরার রুমে শুইয়ে দিয়ে আয়।

রাকিব অবাক হয়ে বললো,– কি বলছো এসব মা, মাথা ঠিক আছে তো!

রহস্যময় হাসি হেসে মা বললো,– তোর বাবার আর আমার প্ল্যানটা ব্যর্থ হবে মনে হয়, তাই ভিন্ন পদ্ধতি। তোকে খাবার টেবিলে অপমান করলো, আমি মা হয়ে সহ্য করবো বুঝি! নিলয়কে মীরার রুমে শুইয়ে দিয়ে আয়, তারপর সকালে এমন একটা ব্লাস্ট হবে,হয়তো নিলয় মীরাকে বিয়ে করবে, নয়তো জেলে যাবে, তারপর ওর সবকিছু তোর।

নিলয় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, রাকিব নিলয়কে নিয়ে গিয়ে মীরার রুমে মীরার বেডে শুইয়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে গেল।

মা মীরাকে নিয়ে নিলয়ের পাশে শুইয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়ে রহস্যমাখা হাসি হেসে চলে গেলো…

চলবে…

কে তুমি পর্ব-০৫

0

গল্পঃ কে তুমি (পঞ্চম পর্ব )
লেখাঃ ইমতিয়াজ আহমেদ চৌধুরী

নিলয়কে তার বেডরুমে শুইয়ে দিয়ে নাবিলা উঠতেই নিলয় নাবিলার হাত টেনে ধরলো। নাবিলা ভীষণ অবাক হয়ে বললো,– কী ব্যাপার!

নিলয় বললো,– আজ রাতটা নাহয় এখানে থেকে যাও।

চোখ বড়ো বড়ো করে নাবিলা বললো,– মনে আবার কু মতলব নেই তো আপনার। আমি কি আপনার বিয়ে করা বউ যে রাতে আপনার সাথে আপনার শয্যার সঙ্গী হবো!

নিলয় মুচকি হেসে বললো,– মতলব জিনিসটাই নেই, কু মতলব তো দুরের কথা!

নিলয় ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে ড্রয়ার থেকে ফ্রেমে বাঁধানো একটি ছবি এনে নাবিলার হাতে দিলো। ছবিটার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নাবিলা। ছবির মেয়েটি দেখতে হুবহু নাবিলার মতোই!

নাবিলা ছবিটা বেডের ওপর রেখে নিলয়কে বললো,– গোপনে আমার ছবি তুলে ফ্রেমে বাঁধাইলে কি আমি পটে যাবো ভাবছেন! অতটাও বোকা নই, আর আপনার মতলব ভালো মনে হচ্ছে না আমার।

নিলয় ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,– ঐ ছবিটা তার, যাকে হারিয়ে বেঁচে থেকে মৃত আমি!

: মানে?

: মানে যার মাঝে নিজেকে হারিয়েছি, তাকে হারিয়ে নিজেকে ঠিক খুঁজে পাচ্ছিনা!

: কিসব বলছেন এসব নিলয়, আপনার হার্টে সমস্যা মাথায় না, ভুলভাল কথা বন্ধ করুন!

: হা হা হা, ভুলভাল বলছিনা নাবিলা, ছবির ঐ মেয়েটি আমার স্ত্রী হিমি। যে আমার বুকের ওপর মাথা না রাখা পর্যন্ত আমার চোখে ঘুম আসতো না, যার কপালে হাজারটা চুমু না খেলে মনে শান্তি হতোনা, জানো আমরা কপালে কপাল, নাকে নাক, ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে ঘুমাতাম, দুজনের নিশ্বাস প্রতি মুহূর্তে দুজন অনুভব করে গভীর প্রেমে ডুবতাম। রাতে দুজনের শরীর অনাবৃত, দুজন দুজনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মিশে যেতাম দুজন দুজনায়। সেই মানুষটি আজ দূর থেকে বহুদূর, বাইরে থেকে আমাকে জীবন্ত মনে হলেও ভেতর থেকে মরে গেছি সেই কবে নাবিলা!

নিলয়ের কথা শুনতে শুনতে নাবিলা একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গেল।

নিলয় আবার বললো,– ছবির এই মেয়েটি তুমি নও, ও হিমি, আমার স্ত্রী।

হঠাৎ নিলয়ের রুমে ঢুকে নাবিলাকে দেখে হিমির আত্মা মনে করে ভূউউউউউত বলে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেল মীরা!

নিলয় হেসে ফেলে নাবিলাকে বললো,– হঠাৎ করে তোমাকে হিমি ভেবে মীরার এই দশা!

নাবিলা অবাক হয়ে বললো,– কিন্তু নাবিলা তো আমায় চেনে, আমাকে দেখতে হিমির মতো লাগে তা-ও নিশ্চয় সে জানে, তবু কেন!

নিলয় বললো,– হঠাৎ হঠাৎ আকস্মিক এমন হয়ে যায়, মানুষের সেন্স সবকিছু গুলিয়ে ফেলে!

নাবিলা বললো,– আচ্ছা, তাহলে একটা প্ল্যান করি, আমি লুকিয়ে পড়ি, আপনি মীরার হুশ ফিরলে বলবেন আপনার পাশে কেউ ছিলনা, তারপর শুরু হবে খেলা!

নিলয় অবাক হয়ে বললো,– কিন্তু কেন নাবিলা!

নাবিলা উঠে দাড়িয়ে বললো,– সুযোগ এড়িয়ে যেতে নেই, কাজে লাগাতে হয়, যা বলেছি তাই করেন!

নাবিলা গিয়ে আলমারির পেছনে লুকিয়ে পড়লো।

নিলয় উঠে মীরার মুখে জল ছিটিয়ে দিতেই হুশ ফিরলো, উঠে বসে নিলয়ের খাটের দিকে নজর বুলিয়ে মীরা বললো,– সে কই ভাইয়া?

: সে মানে কে মীরা?

: আরে তোমার পাশেই তো বসা ছিল, হিমি ভাবির মতো কেউ একটা, আচ্ছা তাহলে কি নাবিলা আপু এসেছিল?

: সে আমাদের বাসায় আসতে যাবে কেন, আর আসলে আবার গায়েব হয়ে যাবে কেন! কিসব ভুলভাল বকিস তুই?!

: ভাইয়া তোর রুমে মনে হয় হিমি ভাবীর আত্মা আছে!

: থাক্তেও পারে মীরা, অনেক বেশী ভালোবাসি তো, সেই ভালোবাসার টানে হিমির আত্মা ছুটে এসেছে, তা-ও ভালো, হিমি নেই কিন্তু হিমির আত্মা তো আছে। একেবারে কিছু না থাকার চেয়ে কিছু থাকা ভালো।

: ভাইয়া কিসব বলো!

: যেসব শুনছিস সেসব!

“বাবাগো আমি নাই” বলে মীরা উঠে দ্রুত পায়ে চলে গেল।

নিলয় উঠে রুমের দরজা বন্ধ করে এসে বিছানায় বসলো, নাবিলা আলমারির পেছন থেকে বেরিয়ে এসে নিলয়কে বললো,– এবার শুরু হবে আসল খেলা।

নিলয় অবাক হয়ে বললো,– তার মানে কি নাবিলা, তুমি কি করতে চাইছো?

নাবিলা বললো,– মৃত হিমি আপুকে আবার সবার চর্চায় আনতে চাইছি, মুখে মুখে তার নামের উপস্থিতি থাক।

এদিকে আজকে হার্টের সমস্যার যে অভিনয় করেছিল নিলয়, সেটার উদ্দেশ্য ছিল নাবিলাকে বাসা পর্যন্ত নিয়ে আসা, যেভাবে হোক নাবিলার কোমর চেক করতে হবে তার কোমরে জন্মদাগ আছে কি নেই!

নিলয়ের হার্টে সামান্য সমস্যা আছে, কিন্তু আজ আদৌ কোনো সমস্যা ছিলনা!

নিলয় নাবিলাকে বললো,– নাবিলা খুব কফি খেতে ইচ্ছে করছে, দুটো কফি করে আনবে! পাশের রুমে কফি মেকার আছে।

“জ্বি অবশ্যই” বলে নাবিলা উঠে রুমের দরজা খুলে পাশের রুমে চলে গেল নাবিলা।

নাবিলা চলে যেতেই উঠে গিয়ে একটা ঘুমের ওষুধ এনে আবার বিছানায় শুয়ে পড়লো নিলয়।

কিছুক্ষণ পরে দু’হাতে দুকাপ কফি নিয়ে ফিরলো নাবিলা, বেডের পাশে টেবিলে কফির কাপ রেখে মিষ্টি হেসে নাবিলা বললো,– নিন, খেয়ে দেখুন!

কফির কাপ হাতে নিয়ে নিলয় বললো,– ইশ! আর একটু কষ্ট করবে!

: কি বলুন!

: কফি মেকারের পাশেই আমার হার্টের ওষুধ রেখেছিলাম, যদি একটু নিয়ে আসতে!

: আচ্ছা যাচ্ছি!

নাবিলা আবার পাশের রুমে চলে যেতেই ঘুমের ওষুধ গুরো করে নাবিলার কফির সাথে গুলে দিলো নিলয়।

অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে কোথাও ওষুধ না পেয়ে ফিরে এসে নাবিলা বললো,– কই পেলাম না তো ঘুমের ওষুধ কোথাও!

নিলয় অবাক হবার ভান করে বললো,– ইশ! হয়তো অন্য কোথাও রেখেছি, মনে নেই ঠিক! আচ্ছা পরে দেখা যাবে, তুমি কফি খেয়ে নাও, ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো!

নাবিলা কফির কাপে চুমুক দিলো, নিলয়ের ঠোঁটে রহস্যময় হাসির রেখা ফুটে উঠলো এই ভেবে যে সফলতার দ্বারপ্রান্তে প্রায় পৌঁছে গেছে সে।…

চলবে…

কে তুমি পর্ব-০৪

0

গল্পঃ কে তুমি ( চতুর্থ পর্ব )
লেখাঃ ইমতিয়াজ আহমেদ চৌধুরী

নাবিলা চোখের পলকে মজনুর হাত থেকে চাকু কেড়ে নিয়ে মজনুর তলপেটে একটা কিক মারতেই মজনু কফিশপের চেয়ার টেবিল নিয়ে উল্টে পড়ে গেল। এই দৃশ্য দেখে মজনুর সাঙ্গপাঙ্গরা ফার্স্ট মোশনে গায়েব।

নাবিলা এগিয়ে গিয়ে মজনুর ঠ্যাং ধরে টেনে তুলে চেয়ারে বসিয়ে, আরও একটা চেয়ার টেনে নাবিলা মজনুর মুখোমুখি বসে বললো,– তোমরাই যদি মেয়েদের সন্মান না দাও, তাহলে পরের প্রজন্ম কি শিখবে, কাদের কাছ থেকে শিখবে? যে মেয়েটি তোমায় পাগলের মতো ভালোবাসে তার সাথে প্রতারণা করছো, আর তুমি ভুল কাউকে সিলেক্ট করে যখন সেখান থেকে প্রতারিত হবে, তখন তোমাদের কাছে পৃথিবীর সব মেয়েরা খারাপ! কি অদ্ভুত লজিক তোমাদের! মানে পজিটিভ থিংকিং ব্যাপারটা তোমাদের মাথায় আসেনা! সব মেয়েরাই তার প্রেমিককে প্রচন্ড ভালোবাসে বলেই একটু বেশী খেয়াল রাখে, কারণে অকারণে রাগ অভিমান করে, সন্দেহ করে, এসব ন্যাকামি নয়, প্রেমিকের প্রতি প্রবল ভালোবাসা এটা, বুঝতে পেরেছো?

মজনু কাতর গলায় বললো,– আপু আপনি কি ব্রুস-লি এর দূর সম্পর্কের আত্মীয় নাকি! কিকটা আর দুই ইঞ্চি নিচে লাগলেই আমার পিতৃত্বের সাধ গ্রহণ করা হইতো না আর এ জন্মে।

নাবিলা হেসে ফেলে বললো,– আত্মরক্ষার জন্য আমার স্পেশাল ট্রেনিং নেয়া আছে। যা-ই হোক, যে তোমায় পাগলের মতো ভালোবাসে তাকে ভালোবাসা দিয়ে বেঁধে রাখো, অবহেলা করে তার হৃদয় ভেঙে তুমি কখনও সুখী হতে পারবে না। বুঝছো?

মজনু মিনমিন করে বললো,– এভাবে এত সুন্দর করে ধোলাই দিয়ে বোঝালে কে না বোঝে আপু!

মজনু মীরার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলো।

নাবিলা মীরাকে বললো,– তোমার প্রেমিক মজনু এভাবে ট-ট করে ঘুরে আড্ডাবাজী করলে চলবে! তোমার ভাইয়ার অফিসে এইচ-আর ডিপার্টমেন্টে একজন ম্যানেজার প্রয়োজন, সেখানে মজনুকে জয়েন করাও। নয়তো আজীবন বাবার হোটেলে খাওয়াবে তোমায়, নিজের গর্ব করার মতো কিছু থাকবে না।

মজনু আবেগে নাবিলাকে বললো,– আপু আপনি মানুষ না।

নাবিলা অবাক হয়ে বললো,– মানুষ নই তো কি! এলিয়েন!

মজনু বললো,– মানুষের ওপরে যদি কিছু থাকে তাই, ধোলাই দিলেন, সঠিক বুঝ দিলেন, এখন আবার জব, একদিনে আপনার কাছ থেকে কত প্রাপ্তি!

নাবিলা মুচকি হেসে বললো,– তুমি আসলেই মজার লোক মজনু, আচ্ছা আমি যাচ্ছি, তোমরা আড্ডা দাও।

নাবিলা কফিশপ থেকে বেরিয়ে চলে গেল।

নাবিলা চলে যেতেই মজনু মীরাকে বললো,–এমন ডেঞ্জারাস মেয়ে তোমার আত্মীয় স্বজনের লিস্টে আছে আগে যদি জানতাম!

মীরা মুচকি হেসে বললো,– এবার জানলে তো, বিষয়টি মনে রাখলেই হবে।

সকালে অফিসে এসে নিলয় চেয়ারে বসে ভাবছে হিমির কোমরের সেই জন্মদাগের কথা। নাবিলার আচার-আচরণ হুবহু হিমির মতোই একদম, তাহলে কি হিমি মারা যায়নি! সেটা কীভাবে সম্ভব, হিমিকে যে নিজের চোখের সামনেই কবর বাসী হতে দেখেছে। সে যা-ই হোক, অন্তত যেকোনো উপায়ে এটা শিওর হতে হবে যে নাবিলার কোমরেও জন্মদাগ আছে কিনা। নিলয় নিজেও জানে এটা পাগলামি, কিন্তু নিজের মনকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না নিলয়। অবশেষে একটা ফন্দি আঁটতে সক্ষম নিলয়।

নাবিলাকে ডেকে সামনের চেয়ারে মুখোমুখি বসিয়ে আমতা আমতা করে বললো,– আচ্ছা নাবিলা, শাড়ী চেনো তো! নাকি?

নাবিলা ভীষন অবাক হয়ে বললো,– মিস্টার নিলয়, আপনার কি আমাকে এলিয়েন মনে হয়?!

: না মানে, ইয়ে নাবিলা সেরকম বলতে চাইনি!

: তো কি, শাড়ি চিনবো না মানে! একটা মেয়েকে তার সবচেয়ে পছন্দের বস্ত্রের কথা জিজ্ঞেস করছেন চেনে কিনা! হা হা হা, শরীরটা ঠিক আছে তো আপনার?

: হ্যা একদম নাবিলা, বিষয় হচ্ছে ড্রেস-ফেয়ার কাপড়ের ব্যবসার জন্য স্পেশালি শাড়িগুলো হাইলাইটস করার জন্য একজন মডেল দরকার ছিল। ভেবে দেখলাম এরার জন্য তুমি পারফেক্ট, মডেল হবে?

: মডেল হবার ইচ্ছে আমার নেই নিলয়!

: প্লিজ এবারের মতো, প্লিজ নাবিলা।

: আচ্ছা, তো কি করতে হবে?

: সুন্দর করে শাড়ি পরে ফটোশুট, এবং দুই তিনটা শর্ট স্লো-মোশন ভিডিও ক্লিপ। ভিডিও ক্লিপের জন্য অবশ্য কোমরের কাছের শাড়ী লুজ থাকবে, হালকা বাতাসে শাড়ী সরে যাবে এবং অল্প করে তোমার কোমরে সামান্য ওপরের অংশ দেখা যাবে।

: তাহলে তো এটা কোমরের বিজ্ঞাপন হয়ে যাবে মিস্টার নিলয়, আগে সিদ্ধান্ত নিন বিজ্ঞাপন ঠিক কোনটার দিতে চান, কোমরের নাকি শাড়ির!

নাবিলার কথায় থতমত খেয়ে চুপ হয়ে গেল নীলয়, নাবিলা মুচকি হেসে নিলয়ের সামনে থেকে উঠে গিয়ে নিজের ডেস্কে বসলো।

বিকেলে অফিসের কাজ শেষ করতে করতে দেরি হয়ে গেল। ঝুকে চেয়ারের নিচে পড়া কলমটা তুলতে গিয়ে বুক চেপে ধরে নিলয় হঠাৎ বসে পড়লো, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। নাবিলা ছুটে এসে নিলয়কে তুলে চেয়ারে বসিয়ে হার্ট সোজা বুকের বামপাসে হাত রেখে বললো,– একদম রিল্যাক্স, অস্থির হওয়া যাবেনা, স্বাভাবিক ভাবে নিশ্বাস নেবার চেষ্টা করুন।

নিলয় অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে নাবিলার দিকে, হিমিও ঠিক এভাবেই বুকে হাত রেখে এই কথাগুলো বলতো।

নাবিলা বললো,– এক্ষুনি ডাক্তারকে ফোন করছি।

নিলয় বললো,– আসলে মেডিসিনটা সঙ্গে করে আনতে ভুলে গেছি নাবিলা, ডাক্তার ডাকতে হবেনা, আমাকে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসলেই হবে যদি তোমার আপত্তি না থাকে!

“ওকে তাই হবে” বলে নিলয়কে ধরে ধীরে ধীরে অফিস থেকে বেরিয়ে এসে গাড়িতে বসিয়ে ড্রাইভ করছে নাবিলা। নিলয়ের ঠোঁটে রহস্যময় মুচকি হাসি…

চলবে…

কে তুমি পর্ব-০৩

0

গল্পঃ কে তুমি ( তৃতীয় পর্ব )
লেখাঃ ইমতিয়াজ আহমেদ চৌধুরী

হিমির কোমরের ঠিক সামান্য উপরে একটা জন্ম দাগ আছে, বিষয় হচ্ছে হিমি মারা গেছে এমনটা সবাই জানে, নাবিলাকে হুবহু হিমির মতো মনে লাগার কারণে নিলয়ের মনে কৌতূহল বেড়েই চলছে! এখন নাবিলার কোমরে ঐরকম জন্ম দাগ আছে কিনা সেটা শিওর হবার জন্য নিলয়ের মন ব্যস্ত সারাক্ষণ, কি এবং কোন উপায়ে সেটা সম্ভব ভেবে পাচ্ছে না নীলয়।

এই জন্মদাগ নিয়ে নানান কথা প্রচলিত, কিছু কুসংস্কার আবার এ নিয়ে গবেষনারও কম নেই, চলুন তেমন কিছু জানি–

অনেকেই হয়তো এমন তথ্যকে কুসংস্কার বলে অবজ্ঞা করতে পারেন। তবে এ নিয়ে গবেষণার শেষ নেই। তবে খুব বেশি তথ্য প্রকাশ্যে না এলেও, ১৯৬০ সালে চিকিৎসক ইয়ান স্টিভনসন এ নিয়ে নানা রহস্য ফাঁস করেছিলেন। সেই তথ্যের উপর ভিত্তি করেই এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হল জন্মদাগের কিছু গোপন কথা।
শরীরের আলাদা আলাদা জায়গার জন্মদাগের অর্থও আলাদা।

কারও পায়ে জন্মদাগ থাকলে সেই ব্যক্তি সাধারণত বিভ্রান্ত থাকেন। কোনও বিষয় নিয়ে চটপট সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও, তা সঠিকভাবে কাজে লাগানোর অভাবে বাকিদের থেকে পিছিয়ে পড়েন তিনি।

কাঁধে জন্মদাগ বলতে বোঝায় অর্থে টান। এই ব্যক্তিরা প্রায় সারাজীবনই টাকার অভাবে ভোগেন। তবে ডান কাঁধে জন্মদাগ থাকলে সেই ব্যক্তি অত্যন্ত ভাগ্যবান। ভাগ্যের জোরেই বহুদূর এগিয়ে যান তিনি।

লক্ষ্য করে দেখুন তো, বুকের বাঁ-দিকে জন্মদাগ রয়েছে কি না। তাহলে যাতেই হাত দেবেন তা সোনা হতে বাধ্য। প্রতিটি পদক্ষেপে মিলবে সাফল্য। পাশাপাশি আপনার মধ্যে যে রসবোধ রয়েছে, সে বিষয়েও সকলে অবগত।

বুকের ডান দিকের নিচে জন্মদাগ থাকলেও, আপনি সৌভাগ্যবান। সম্পদ ও সৌভাগ্যে পরিপূর্ণ আপনার জীবন।

ঘাড়ের ডান দিকে জন্মদাগ থাকার অর্থ সেই ব্যক্তি বেশিরভাগ সময় বাড়িতে থাকতেই ভালবাসেন। পরিবার ও বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটাতে তিনি পছন্দ করেন। এক কথায় সংসারে শান্তি বজায় রাখতে বড় ভূমিকা রয়েছে সেই ব্যক্তির।

কোনও ব্যক্তির হাতে অথবা হাতের আঙুলে জন্মদাগ থাকলে তিনি নিজের কাজ নিজে করতেই ভালবাসেন। অন্যের দয়া বা সাহায্য নেওয়ার পক্ষপাতী নন তিনি। পেটের কোনও অংশে জন্মদাগ রয়েছে এমন ব্যক্তিকে সমঝে চলবেন। কারণ, সেই ব্যক্তি কিন্তু অত্যন্ত লোভী এবং স্বার্থপর। এমনকী ভালবাসার মানুষকেও তিনি রেয়াত করেন না।

নাকে জন্মদাগের অর্থ আপনি একজন সৃজনশীল ব্যক্তি। যে কোনওরকম আর্টে আপনার প্রতিভা রয়েছে।

পায়ের নিচে জন্মদাগ। তাহলে নিঃসন্দেহে সেই ব্যক্তি ঘুরতে ভালবাসেন। ভবিষ্যতে ট্রাভেলকে পেশা হিসেবেও বেছে নিতে পারেন।

এটা ছিল জন্মদাগ নিয়ে সংগৃহীত কিছু কথা।

নিলয় এক ধ্যানে নাবিলার দিকে তাকিয়ে আছে, কিছুক্ষণ সেটা লক্ষ্য করে নাবিলা গলা খাখারি দিয়ে বললো,– এই যে, এভাবে তাকিয়ে থাকলে নজর লেগে যাবে তো!

নিলয় থতমত খেয়ে বললো,– ইয়ে না মানে বিষয়টা অন্য ভাবে নিয়ো না, তোমাকে দেখতে খুব কাছের কেউ একজনের মতো হুবহু, তাই তোমার মাঝে তাকে খুজে পাই, এবং নিজের অজান্তে তোমার মাঝে হারাই।

নাবিলা মুচকি হেসে বললো,– এভাবে অন্যের মাঝে হারালে, ডুবলে বিজনেস চলবে কি করে মিস্টার নিলয়! আর কে সেই কাছের কেউ জানতে পারি?

: নাবিলা সে খুব কাছের!

: তো আমি কি বলছি সে খুব দূরের?!

: হা হা হা, না সে হৃদয়ের খুব কাছের তো তাই।

: তো আপনার কাছের মানুষটার কাছে গিয়ে তার মাঝে ডুবলেই হয়, তাকে রেখে আমার দিকে নজর দিলে হবে!

নিলয়ের চোখে জল টলমল করে উঠলো, টেবিলের ওপর থেকে টিস্যু নিয়ে চোখ মুছে নিলয় বললো,– নাবিলা, কাছের মানুষটা আজ এতটাই দূরে যে চাইলেই দেখা যায়না, ধরা যায়না, ছোঁয়া যায়না। এটাই সবথেকে বড়ো কষ্টের কারণ! যে মানুষটা অস্তিত্বে মিশে আছে তার বিরহ ঠিক মারাত্মক শ্বাসকষ্টের মতো। শ্বাসকষ্টের রোগী অক্সিজেনের জন্য যেমন ছটফট করে, বাঁচার জন্য অক্সিজেন যেমন ভীষণ দরকার হয়ে পড়ে। কাছের মানুষটাও বেঁচে থাকার সেই অক্সিজেন, তাকে ছাড়া বেঁচে থাকা চব্বিশ ঘণ্টা মৃত্যু যন্ত্রণা বয়ে চলার মতো কষ্টকর।

নিলয়ের কথা শুনে নাবিলার চোখেও জল টলমল করে উঠলো।

কথা শেষে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাড়িয়ে নিলয় অফিস থেকে বের হয়ে গেল।

নাবিলাও বের হলো।

একটা কফিশপ অতিক্রম করে যাবার সময় নাবিলা খেয়াল করলো কফিশপের স্বচ্ছ কাচের দেয়ালের ওপাশে কয়েকজন যুবক যুবতী দাড়িয়ে সিরিয়াস কিছু নিয়ে বাগবিতণ্ডা হচ্ছে, সেখানে মীরাও আছে এবং মীরাকে খুব আপসেট দেখাচ্ছে!

নাবিলা কাচের দরজা ঠেলে কফিশপে ঠুকে মীরার কাছে গিয়ে বললো,– কি হয়েছে মীরা, কোনো সমস্যা হয়নি তো!

মীরা ইশারায় সামনে দাড়ানো যুবককে দেখিয়ে কান্না জড়িত কণ্ঠে বললো,– আমাকে এত এত ভালোবাসার স্বপ্ন দেখিয়ে সে অন্য কারো সাথে আবার সম্পর্কে জড়িত। এই যে আজ জানতে পারলাম, ওর পাশের ঐ মেয়েটির সাথে ওর সম্পর্ক চলে সেটা আজ হঠাৎ এই কফিশপে কফি খেতে এসে হাতেনাতে ধরে ফেলেছি বলে আমাকে যাচ্ছেতাই বলছে।

মীরার প্রেমিক তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,– তোর আবার প্রেম! তোর মতো বড়োলোকের মেয়েদের আছে টাকা আর অহংকার, কথায় কথায় ন্যাকামি, আর প্যারা ছাড়া কি দিতে পারিস!

নাবিলার মাথায় রাগ চেপেছে ভীষণ, মীরার প্রেমিককে বললো,– নাম কি তোমার?

মীরার প্রেমিক বললো,– আমি মজনু।

সবার সামনে টেনে মজনুর গালে একটা থাপ্পড় মেরে দিলো নাবিলা।

মজনুর মনে হলো গালের ওপর দিয়ে বড়সড় একটা ঝড় বয়ে গেল, মাথায় চক্কর, দুচোখ ঝাপসা। থাপ্পড়ের ঠেলায় ঘুরে গিয়ে নিজের সাথে আসা বন্ধুকে বললো,– আমাকে থাপ্পড় মারা, এতবড় সাহস!

মজনুর বন্ধু মজনুকে ধরে ঘুরিয়ে নাবিলার সামনে দাড় করিয়ে বললো,– থাপ্পড় আমি মারিনি, ইনি মেরেছে।

মজনু সাথে আসা বন্ধুদের বললো,– আমাকে থাপ্পড় মারলো আর তোরা চুপ, মেজাজ কিন্তু গরম হচ্ছে খুব।

মজনুর কথা শুনে এক বন্ধু বললো,– বাহ! দোস্ত বাহ! কি দারুণ ছন্দ।

মজনু বললো,– চুপকর, কানের উপ্রে একটা দিয়ে কোমায় পাঠালে বুঝবি কি ভালো কি মন্দ।

একটা ছুরি বের করে নাবিলার গলায় ধরে মজনু বললো,– মজনু নাম শুনকে লাভার সামঝা ক্যা, কুস মজনু ডেঞ্জারাস ভি হোতাহে!

মজনুর হাবভাব দেখে ভয়ের বদলে নাবিলার হাসি পাচ্ছে খুব।

নাবিলাকে হাসতে দেখে ছুরিটা নাবিলার গালে চেপে ধরে মজনু বললো,– আমার গালে থাপ্পড় মেরেছিস, তোর গালে এই ছুরি দিয়ে এমন দাগ বসিয়ে দেবো, আজীবন দেখবি আর মনে মনে ভাববি ভুল স্থানে বাহাদুরি দেখানোর ফল কত ভয়ংকর হয়…

চলবে..

কে তুমি পর্ব-০২

0

গল্পঃ কে তুমি ( ২য় পর্ব )
লেখাঃ ইমতিয়াজ আহমেদ চৌধুরী

সেদিন হন্যে হয়ে যাকে খুঁজছিল, আজ তাকে নিজের অফিসে দেখে দৌড়ে গিয়ে হাত ধরে, ‘কে তুমি’ জিজ্ঞেস করতেই মেয়েটি নিলয়ের গালে একটা থাপ্পড় মেরে বললো,–এটা কেমন অসভ্যতা! আপনি আমার হাত ধরলেন কেন?

সমস্ত অফিস স্টাফ এবং যারা চাকরির জন্য নিলয়ের কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিতে এসেছে, সবাই অবাক হয়ে হা করে তাকিয়ে আছে।

নিলয়ের অফিস স্টাফরা এই জন্য অবাক হয়নি যে মেয়েটি নিলয়কে থাপ্পড় মেরেছে। তারা এর জন্য অবাক হয়েছে যে মেয়েটি দেখতে হুবহু হিমির মতো।

হ্যাঁ, এই মেয়েকে দেখেই রাস্তায় থমকে গিয়েছিল নিলয়, হিতাহিত জ্ঞান ছিলনা যে রাস্তার মাঝখানে এভাবে দাড়িয়ে থাকলে গাড়ীর নিচে চাপা পড়ে প্রাণ যেতে পারে। নিলয়ের প্রাণ হিমির প্রতিচ্ছবি দেখেই নিজের প্রাণের প্রতি খেয়াল ছিলনা নিলয়ের। হৃদয় ভেবেছিল সেই ঘটনা তার মস্তিষ্কের ভ্রম, কিন্তু সেই মেয়েটিকে আজকে নিজের অফিসে দেখে আরও অবাক হয়ে যায় নিলয়। তাইতো থাপ্পড় খেয়েও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে।

মেয়েটির চেহারায় অস্বস্তির রেখা ফুটে উঠেছে। অফিস স্টাফদের দিকে তাকিয়ে মেয়েটি বললো,– এসব অসভ্য লোকদের কিভাবে এরা চাকরি দেয় আল্লাহ জানে!

একজন পিওন একটি চেয়ার টেনে এনে মেয়েটিকে বসতে দিয়ে বললো,– ম্যাডাম ইন্টারভিউয়ের টেনশনে হয়তো আপনি নার্ভাস, তার ওপর উনি এভাবে আপনার হাত ধরে ফেলল, প্লিজ উত্তেজিত হবেন না, মাথা ঠান্ডা করেন; কিছু খাবেন? কোল্ড ড্রিংকস, এনে দেই।

মেয়েটি পিওনকে বললো,– উনি যেভাবে দৌড়ে এসে আমার হাতটা ধরে বললো কে তুমি, মনে হচ্ছিল আমি কোনোকালে বোধ হয় ওনার বারা ভাতে ছাই দিয়ে এসেছিলাম, কি অদ্ভুত!

অফিস স্টাফরা খিলখিল করে হেসে উঠলো সবাই। নিলয় চোখের ইশারায় স্টাফদের মেয়েটির কাছে কোনকিছু বলতে বারণ করে তার রুমের দিকে হেটে চলে গেল।

অফিস স্টাফদের খাতিরযত্ন দেখে মেয়েটি ভীষণ অবাক, চাকরিতে জয়েন করার আগেই এত খাতির যত্ন।

নিলয়ের কোম্পানিতে নিয়োগ চলছে, কিছু সংখ্যক ফ্যাক্টরি শ্রমিক এবং নিলয়ের ব্যক্তিগত সহকারী পদে। মেয়েটি ব্যক্তিগত সহকারী পদে চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিতে এসেছে।

ফ্যাক্টরি শ্রমিকদের ইন্টারভিউ একপাশে, অন্যদিকে নিলয়ের অফিস রুমে সহকারী হিসেবে ইন্টারভিউ দিতে আসা অল্প কয়েকজনের ইন্টারভিউ নেবে নিলয়।

পিওনকে ফোন করে নিলয় বললো,– যে মেয়েটি থাপ্পড় মেরেছিল ওনাকে নিয়ে আমার রুমে আসো।

পিওন মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে নিলয়ের রুমে ঢুকলো, মেয়েটি নিলয়কে দেখে অবাক! কাচুমাচু করে বললো,– আপনার রিজেক্ট করতে হবেনা, আমিই চলে যাচ্ছি স্বসম্মানে।

নিলয় মুচকি হেসে পিওনকে বললো,– বাকি যারা ইন্টারভিউ দিতে বসে আছে তাদের গিয়ে চলে যেতে বলেন।

পিওন বেরিয়ে চলে গেল।

নিলয় মুচকি হেসে মেয়েটিকে বললো,– তো আপনি কিভাবে নিশ্চিত হলেন যে আপনাকে রিজেক্ট করা হবে?

: আপনাকে থাপ্পড় মারলাম যে।

: ওটা তো আমার প্রাপ্য ছিল, চিনিনা, জানিনা অথচ আপনার হাত ধরে ফেললাম। আপনার নামটাই তো জানা হলো না!

: সিভিতে তো লেখা আছে।

: তা আছে, তবে আপনার মুখে শুনলে আরও ভালো লাগতো।

: ওকে, আমি নাবিলা।

: সুন্দর নাম নাবিলা, আপনি চাইলে আজকে থেকেই জয়েন করতে পারেন, এবং করলে আমি খুশী হবো।

: অবশ্যই, অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে স্যার।

নিলয়ের অফিস রুমের ভেতরেই এক কর্ণারে থাকা চেয়ার টেবিল নাবিলাকে দেখিয়ে নিলয় বললো,– আপনি ওখানে বসবেন, তবে এখন কিছুক্ষণ এখানেই সামনাসামনি বসুন, আমরা কথা বলি।

আসলে নাবিলাকে যতই দেখছে যেন মন ভরছে না নিলয়ের। এ যেন হিমি নিজেই মৃত্যুর পরে আবার পূনরায় জন্ম নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে নিলয়ের ভালোবাসার টানে। নাবিলার কথা বলার ধরন, শারীরিক গঠন, হুবহু হিমির মতো। ভালোবাসার হিমি নেই কিন্তু হিমির প্রতিচ্ছি নাবিলাকে তাই চোখ ভরে দেখছে নিলয়। এরকম হুবহু দেখতে মানুষের মত মানুষ হয় এটা স্বাভাবিক, কিন্তু এতটা নিখুঁত মিল সত্যি রহস্যময়।

নিলয় এবং নাবিলা কথা বলছে এমন সময় দরজা খুলে নিলয়ের চাচাতো বোন মীরা অফিস কক্ষে ঢুকেই নাবিলাকে দেখে থমকে গেল। একটু সময় বিস্ফারিত চোখে নাবিলার দিকে তাকিয়ে থেকে, মুখ দিয়ে কাঁপা কণ্ঠে ‘ হি হি হি’ শব্দ করে ধড়াম করে ফ্লোরে পড়ে অজ্ঞান মীরা।

নাবিলা অবাক হয়ে নিলয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,– আমি কি এতটাই কুৎসিত যে আমাকে দেখে মেয়েটির জ্ঞান হারালো?!

নিলয় মুচকি হেসে বললো,– আমার চোখে তুমি স্রেষ্ঠ সুন্দরী। ও আমার চাচতো বোন মীরা, মৃগী রোগ আছে তাই প্রায় সময় এরকম হয়।

নাবিলা আমতা আমতা করে বললো,– ও আচ্ছা।

পানির বোতল হাতে নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে মীরার মুখমন্ডলে পানি ছিটিয়ে দিতেই মীরা চোখ খুলে ভ্রু কুচকে ফিসফিস করে নিলয়কে বললো,– মেয়েটি কে! হিমির ভূত নাকি আবার।

নিলয় ফিসফিস করে মীরাকে বললো,– আরে ও আমার সহকারী হিসেবে চাকরিতে জয়েন করেছে আজকে, ওর নাম নাবিলা। খবরদার ওকে কিছু বলিসনা আবার।

নিলয় মীরার হাত ধরে টেনে তুলে চেয়ারে বসতে বললো।

চেয়ারে বসে মীরা আড়চোখে নাবিলাকেই দেখছে।

নাবিলা গলা খাঁকারি দিয়ে মীরাকে বললো,– চোখদুটো এভাবে বারবার একশত আশি ডিগ্রিতে ঘোরালে চোখের বিয়ারিং ক্ষয়প্রাপ্ত হতে পারে, আমাকে দেখতে ইচ্ছে হলে সোজাসুজি তাকিয়ে থেকে দেখে নিন, ভিজিট দিতে হবেনা।

মীরা বললো,– স্মার্ট আছো খুব।

: এ-যুগে স্মার্ট না হলে হয় বলো মীরা? কিন্তু তোমাকে অতটা স্মার্ট মনে হচ্ছে না।

: মানে?

: মানে হলো তুমি যদি অতটা স্মার্ট হতে, তাহলে তোমার ভাইয়ার সহকারী নিয়োগ দিতে হতনা, এই পোস্ট তুমি সামলে নিতে পারতে।

: আমাদের কি টাকা পয়সার অভাব আছে নাকি! আমি কাজ করতে যাবো কেন?

: এই যে আনস্মার্ট লোকেরা এভাবেই চিন্তা করে, কাজ করা গর্বের বিষয়। তোমার ভাইয়া নিলয় স্যারের কি টাকার অভাব। তিনি কাজ করছেন কেন? আর বড়ো কথা হলো নিজের টাকা খরচা করার মজাটাই আলাদা।

নিলয় হা করে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছে নাবিলার কথা, হিমি ঠিক এভাবেই কথা বলতো।

মীরা একটু বিরক্ত হয়ে নাবিলাকে বললো,– তুমি আমাদের ভাইবোনের মাঝে কথা না বললেই বেটার, মনে রেখো তুমি সামান্য একজন কর্মচারী।

নাবিলা মুচকি হেসে বললো,– স্মার্ট লোকেরা কখনও কোনকিছুকে সামান্য মনে করেনা, যেমন আমার কাছে আমার চাকরিটা অসামান্য, ভেবে ভালো লাগছে আমি কিছু একটা করছি, যাতে আমার সময়ের মূল্যকে স্যালারি হিসেবে মাস শেষে পাবো, তার মানে আমার সময় মূল্যবান। আর তুমি ব্যাগ ভরে সপিং আর গাল ভরে মেকাপ ছাড়া আর কি করছো বলো। এতে সময় এবং টাকা দুটোই অপচয়।

নিলয় হা করে নাবিলার কথা গিলছে। মীরার মেজাজ গরম হয়ে উঠেছে দেখে নিলয় নাবিলাকে বললো,– নাবিলা আমাদের জন্য একটু চা করে আনবে!

নাবিলা রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই মীরা বললো,– ভাইয়া এই মেয়ে ঠোঁটকাটা, মানে যা মনে আসে মুখে গড়গড় করে বলে ফেলে; একে না রাখাই ভালো হবে। দেখতে হিমি ভাবীর মতো বলে গলে যেওনা।

: আহ! মিরা থাকনা, আজই তো সবে জয়েন করছে, কিছুদিন দেখি। তুই কেন এসেছিস বল।

: ভাইয়া শপিংয়ে যাবো বন্ধুদের নিয়ে, টাকা লাগবে।

: আচ্ছা একাউন্টসে বলে দিচ্ছি, যাবার সময় নিয়ে নিবি।

একটু পরেই নাবিলা এককাপ চা এনে নিলয়ের টেবিলে রাখলো। নিলয় অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,– মীরার জন্য আনোনি?

নাবিলা মীরার দিকে তাকিয়ে বললো,– নামী ব্র্যান্ডের দামী লিপস্টিপ মীরার ঠোঁটে চকচক করছে, তারমানে বাসা থেকে বেরিয়ে সোজা অফিসে এসেছে আপনার কাছে, এখান থেকে শপিং অথবা পার্টিতে যাবে। সুতরাং এখন মীরা কিছুতেই চায়ের কাপকে তার ঠোঁট স্পর্শ করতে দেবেনা এটাই স্বাভাবিক।

মীরা ভেংচি কেটে বললো,– থাক আর স্মার্টনেস দেখাতে হবেনা।

মীরা হনহন করে হেটে বেরিয়ে গেল।

নাবিলাকে যতই দেখছে, যতই তার কথাবার্তা শুনছে; নিলয় ভুলে যাচ্ছে যে তার হিমি মরে গেছে। নিলয়ের মনে হচ্ছে তার সামনে নাবিলা নয়, হিমি দাড়িয়ে আছে। কিন্তু সত্যিটা কি?

চলবে…

কে তুমি পর্ব-০১

0

গল্পঃ কে তুমি ( প্রথম পর্ব )
লেখাঃ ইমতিয়াজ আহমেদ চৌধুরী

মাঝরাতে হঠাৎ করে হিমিকে টেনে বুকের ওপর তুলে শক্ত করে বুকে চেপে ধরে নিলয়, তারপর পাগলের মতো কপালে ঠোঁটে গালে চুমু খেয়ে বলে,– তোমাকে হারানোর আগে আমি নিজে হারিয়ে যেতে চাই পৃথিবী থেকে, নয়তো তোমাকে হারিয়ে আমি বাঁচতে পারবো না।

হিমির ঘুম ভেঙে যায়, নিলয়ের কপালে চুমু খেয়ে ভাঙা গলায় মৃদু হেসে হিমি বলে,– নিশ্চয়ই আবার সেই দুঃস্বপ্ন দেখেছো! শোনো নিলয় স্বপ্ন স্বপ্নই হয়, আমি তোমায় ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না, তোমার ছিলাম, তোমার আছি, তোমার থাকবো।

আসলে কয়েকদিন ধরে খুব বাজে একটা দুঃস্বপ্ন দেখছে নিলয়, হিমির মৃত্যুর। তাই প্রতিক্ষণ অজানা আতঙ্কে কাটে তার।

হিমি আবারও নিলয়ের ঠোঁটে চুমু খেয়ে বললো,– স্বপ্নের কথা ভেবে ঘুম নষ্ট করে লাভ নেই, চলো দুজন দুজনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমাই।

তারপর দুজন দুজনকে জড়িয়ে আবার ঘুমের দেশে।

ঠিক তার দুদিন পরে–

ট্রাকের ধাক্কায় নিলয়ের গাড়ি ছিটকে গিয়ে গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে উল্টে যায়। সামনের গ্লাস ভেঙে বেশ বড়ো সাইজের একটা টুকরো হিমির মাথায় অনেকখানি ঢুকে যায়। রক্তাক্ত হাতে নিলয়ের মুখটা স্পর্শ করে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে অস্পষ্ট ভাবে হিমি বলে,– নিজের দিকে খেয়াল রেখো। তারপর হিমির শরীর নিথর হয়ে যায়।

মাস দুই আগে নিলয় এবং হিমি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। সপ্তাহ শেষে দুজনে লং ড্রাইভে বের হয় তারা। সুনসান নিরিবিলি রাতের রাস্তা, গাড়ির স্পিড একেবারে কম। একটু পরে পরে দুজনের চোখে চোখ, মুচকি হাসি। এই মুহূর্ত যেন বর্ননা করা যায়না, ভালোলাগা, ভালোবাসা, আনন্দের আবেশ।

হঠাৎই মালবাহী একটি ট্রাক প্রচন্ড গতিতে রং সাইডে এসে নিলয়ের গাড়িটা ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। নিলয়ের গাড়িটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ছুটে গিয়ে একটা গাছের সাথে প্রচন্ড জোরে ধাক্কা খেয়ে উল্টে যায়। ভাঙা গ্লাসের একটা টুকরো হিমির মাথায় অনেকখানি ঢুকে যায়, শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার আগেও রক্তাক্ত হাতে নিলয়ের মুখটা স্পর্শ করে কাঁপা কাঁপা অস্পষ্ট কণ্ঠে হিমি বলে,– নিজের দিকে খেয়াল রেখো। তারপর হিমির শরীর নিথর হয়ে যায়। ভালোবাসা বুঝি এমনই হয়, শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার আগেও ভালোবাসার মানুষটার কথা ভাবা, নিজের মৃত্যু জেনেও ভালোবাসার মানুষকে আগলে রাখার প্রবল চেষ্টা, ভালোবাসা যদি দৃশ্যমান হতো তবে মৃত্যুর আগেও ভালোবাসার মানুষটির জন্য একজন মানুষ কি পরিমাণ ভালোবাসা রেখে যায় সেটা দেখা যেতো।

কিছু বলতে পারছেনা নিলয়, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে, পৃথিবীটা অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। নিলয় অজ্ঞান।

নিলয়ের যখন জ্ঞান ফেরে তখন সে হাসপাতালের বেডে। হিমিকে না দেখে হন্তদন্ত হয়ে উঠতে গিয়ে খেয়াল করে তার হাত এবং পায়ে ব্যান্ডেজ করা। ‘ ডাক্তার আমার হিমি কোথায়,’ বলে গড়িয়ে বেড থেকে ফ্লোরে পড়ে নিলয়, স্যালাইনের পাইপ টেনে খুলে ফেলে হামাগুড়ি দিয়ে দরজার দিকে যেতে যেতে বলতে থাকে,– আমি আমার হিমির কাছে যাবো, হিমি একলা থাকতে ভীষণ ভয় পায়, কোথায় আমার হিমি।

ডাক্তার এবং কয়েকজন নার্স মিলে নিলয়কে ধরাধরি করে বেডে এনে শুইয়ে দেয়।

নিলয় ডাক্তারকে প্রশ্ন করে,– আমার হিমি কোথায় ডক্টর?

ডক্টর মাথা নিচু করে জবাব দেয়,– হিমি বেঁচে নেই।

‘হিমি’ বলে চিৎকার করে আবার নিলয় বেড থেকে ফ্লোরে গড়িয়ে পড়ে।

আবার ডাক্তার এবং নার্স মিলে নিলয়কে ধরে বেডে শুইয়ে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করে নিস্তেজ হয়ে পড়ে নিলয়।

এভাবে কয়েকমাস হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠে নিলয়।

নিলয় এবং হিমির প্রথম পরিচয় হয়েছিল কীভাবে চলুন জেনে নেই–

বছর খানেক আগে একটা রেলস্টেশনে মধ্যরাতে পরিচয় হয়েছিল নিলয় ও হিমির। নিলয় হেটে যাচ্ছিল এমন সময় পেছন থেকে হিমির কণ্ঠ ভেসে এলো,– মাতৃভূমিতে সামান্য হেল্প পাবার মতো একটা মানুষ নাই, কি অদ্ভুত!

ঘুরে দাড়িয়ে হিমিকে দেখে নিলয় চোখ ফেরাতে পারছিল না। মানুষ এত সুন্দর হতে পারে! শ্যামলা রঙ্গের মেয়েটির চেহারার সৌন্দর্য যেন স্বর্গের অপ্সরাদের হার মানাবে। চোখ, মুখ, নাক, কান যেন মায়ার সমুদ্র। তার মুখের হাসি যেন চৈত্রের খাঁখাঁ রোদ্দুরে পথিকের মাথার উপর উড়ে এসে ছায়া দেয়া এক খন্ড মেঘের মতো প্রশান্তির।

হিমি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,– হাই, আমি হিমি, জন্মস্থান বাংলাদেশ কিন্তু বেড়েওঠা লন্ডনে, প্রচুর ঘোরাঘুরি করতে ভালোবাসি, এডভেঞ্চার আমার নেশা বলতে পারেন। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিশ্বের সামনে তুলে ধরার ইচ্ছা, তাই সময় হলে ছুটে আসি। নিজের জন্মভূমির এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত যদি ঘুরতে না পারলাম, তবে বিশ্ব ভ্রমণের ছাড়পত্র আর পড়ালেখা না করে টাকা দিয়ে সার্টিফিকেট কিনে নেয়া বিষয়টি এক হয়ে গেল না! মানে পরিপূর্ণ জ্ঞানার্জন ছাড়াই সার্টিফিকেট।

নিলয় হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডসেক করে বললো,– আমি নিলয়, একজন ব্যবসায়ী। নিলয় গ্রুপের মালিক, কয়েকটা ফ্যাক্টরি আছে ওগুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়, তবুও সময় পেলে বেড়িয়ে পড়ি প্রকৃতির সান্নিধ্য পেতে। তবে আমার যেটা মনে হয়, আপনি ভীষণ স্মার্ট এবং উচ্চশিক্ষিত, আপনার সাথে পরিচিত হতে পেরে দারুণ লাগলো।

হিমি তার হাতের লাগেজটা নিলয়ের দিকে ঠেলে দিয়ে বললো,– আপাতত লাগেজটার দায়িত্ব আপনি নিলে আমার আরও দারুণ লাগবে।

হিমির চঞ্চলতা এবং চতুরতা দেখে নিলয় অবাক! মেয়েটির খুব সহজে কারো সাথে মিশে যাবার জাদুকরী ক্ষমতা আছে।

হিমি লং-স্লিভ শার্ট পরা, হাতা ভাজ করে কনুই পর্যন্ত ওঠাতে ওঠাতে বললো,– এদেশে হেল্পিং হ্যান্ড এখনও চিন্তার বাইরের বিষয়! কেউ কারো হেল্প করতে চায়না।

নিলয় বললো,– এই যে আমি হেল্প করছি।

হিমি শব্দ করে হেসে বললো,– তাও তো ঠ্যালায় পরে, জোর করে লাগেজটা দিয়েছি তাই সাহায্য করতে বাধ্য হলেন।

: হাহাহা, যেভাবেই হোক করলাম তো। থাকবেন কোথায়?

: এখনও ঠিক করিনি।

: কোনো হোটেল বুকিং না করে এসে ভুল করেছেন, রাতের বেলা একটা মেয়ের পায়ে পায়ে বিপদ।

: আচ্ছা, আপনি হোটেল বুক করেছেন?

: হ্যাঁ।

: আমি ওখানেই থাকবো আপনার সাথে, একটা মেয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আপনার দায়িত্ব, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে।

: এক রুমে তাও আবার একটি অপরিচিত মেয়ের সাথে।

: সমস্যা নেই, আমি ক্যারাটে জানি, আপনার মনে কুমতলব জাগলে পিটিয়ে পাটিসাপটা বানিয়ে ফেলবো।

হিমির কথা শুনে নিলয় হো-হো করে হেসে উঠে বলে,– সমস্যা নেই, রাত যেটুকু বাকী আছে গল্প করে কাটিয়ে দেবো।

এভাবেই পরিচয় হয়েছিল দুজনার, তারপর ভালোলাগা, ভালোবাসা। বছরখানেক হিমি নিলয়ের নিলয় গ্রুপের সিনিয়র একাউন্ট ম্যানেজার হিসেবেও কাজ করে। তারপর আবার লন্ডন চলে যায়। এবং বছর খানেক পরে আবার ফিরে আসে, তারপর বিয়ে।

এই বিয়েতে সম্মতি ছিলনা হিমির পরিবারের। লন্ডনে হিমির বাবার বিভিন্ন ব্যাবসার কছে নিলয়ের নিলয় গ্রুপ তুচ্ছ। নিলয়ের যা সম্পদ তা হিমির বাবার অর্থ সম্পদের কাছে কিছুই না। ভালোবাসার দেয়াল এখান থেকেই তৈরী হয়। সবাই অর্থবিত্তের প্রতি দূর্বল, দুটি হৃদয়ের ভালোবাসা নিঃশেষ হয় চাপা পড়ে এই অর্থবিত্তের নিচে, সেদিকে কজন খেয়াল রাখে! এই অবস্থায় হিমি সবাইকে ছেড়ে লন্ডন থেকে চলে এসেছিল নিলয়ের সাথে ঘর সংসার সাজানোর আশায়। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, বিয়ের মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই অসম্পূর্ণ স্বপ্ন নিয়ে পৃথিবী ছাড়তে হলো।

এবার বলতে পারেন মৃত্যু হয়েছে ভালো হয়েছে, মা-বাবার মনে কষ্ট দিয়ে কেন আসলো এভাবে!

আসলে হিমির চিন্তা ছিল অন্য রকম। তার বিশ্বাস মা-বাবা কোনদিন সন্তানকে দূরে ঠেলে দিয়ে থাকতে পারেনা, ঠিকই বুকে টেনে নেয়। কিন্তু ভালোবাসার মানুষকে হারালে তাকে না পাবার ক্ষতটা আজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। প্রত্যেকটা মানুষের নিজের সুখের পথটা বেছে নেয়ার অধিকার আছে, তবে ভেবেচিন্তে। নিলয়ের ভালোবাসা কখনও মিথ্যে মনে হয়নি হিমির, মনে হয়নি নিলয়ের ভালোবাসায় খুঁত আছে। মনে প্রাণে বিশ্বাস এবং ভালোবেসেছিল বলেই হিমি ছুটে এসেছিল নিলয়ের কাছে, তার স্বপ্নের রাজপুত্রের কাছে, তার সুখের ঠিকানায়। অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছে হিমি তার মা-বাবাকে, যখন কিছুতেই মানছিল না, তখন বাধ্য হয়ে হিমি চলে আসে। হিমির প্ল্যান ছিল বিয়ের কিছুদিন পরেই নিলয়কে নিয়ে লন্ডনে মা-বাবার সামনে উপস্থিত হবে। তারা মেনে নিতে না চাইলে দুজনেই ক্ষমা চাইবে, কিন্তু সেই সুযোগ আর পেলনা হিমি।

যা-ই হোক হিমিকে হারানোর ক্ষত নিয়ে বিধ্বস্ত নিলয় আজও দিশেহারা।

রাস্তার ওপাশের রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এপাশে আসতে আসতে কিছু একটা দেখে রাস্তার মাঝখানেই থমকে দাড়ায় নিলয়। সমস্ত খেয়াল যেন একত্র হয়ে নিক্ষিপ্ত ঐ এক দিকেই। প্রচন্ড স্পিডে ছুটে আসা একটি গাড়ী বারবার হর্ণ বাজিয়েও নিলয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পেরে কড়া ব্রেক করে গাড়ি থেকে একজন লোক নেমে এসে ধাক্কা দিয়ে নিলয়কে বলে,– মরতে হলে নদীতে ঝাপিয়ে মরো, এখানে মরলে নিজেও মরবে আমাদেরও মারবে।

নিলয়ের ধ্যান ভাঙে, ‘স্যরি’ বলে দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে অসংখ্য লোকের ভীড়ে কাউকে খুঁজতে থাকে পাগলের মতো। নিলয়ের ভীষণ ইচ্ছা তাকে একটিবার জিজ্ঞেস করা,– কে তুমি?
কিন্তু এত লোকের ভীড়ে কাঙ্খিত সেই মুখ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। তবু নিলয় অসংখ্য লোকের মাঝে পাগলের মতো খুঁজে চলছে। খুঁজে না পেলে হয়তো হিমিকে হারানোর ক্ষতটা আরও জীবন্ত হয়ে উঠে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিলয়ের বুকটা আরও ছারখার করে দেবে।

ডাক্তার বললো হিমি বেঁচে নেই, তাহলে এক ঝলক দেখে যাকে হুবহু হিমির মতো মনে হলো, সে কে?

চলবে…

ধূসর অনুভূতি পর্ব-১৭+১৮(শেষ পর্ব)

0

#ধূসর অনুভূতি
পর্ব:১৭+১৮(শেষ পর্ব)
লেখক: শাপলা

ঝিনুক আর যুথি ভেবেছে মালিহাকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মা খুব রিয়াক্ট করবে। কিন্তু, তাদের মা রিয়াক্ট করলো না একটুও।বললো,আসছো তুমি?আসো দেখে যাও আমার ছেলের কি অবস্থা করছো…আমি তো তোমাকে অনেক জ্বালাইছি, কষ্ট দিছি। এর জন্য শাস্তি ভোগ করছি খুশি হওনি তুমি? আমার কলিজা পুড়ে যাচ্ছে কষ্টে…..
মা কাঁদতে শুরু করলো।
যুথি এসে বললো,ভাবী তুমি আসবে আমরা জানতামই না।
মালিহা মাথা নিচু করে রইলো।তার খুব বলতে ইচ্ছা করছে,এতো কিছু হয়ে গেলো তোমরা আমাকে জানালে না? কিন্তু কোন অধিকারে সে এই কথা বলবে?
ঝিনুক মেহেদী-কে বললো বাসা থেকে তিতলিকে নিয়ে আসতে।তিতলি এখন আছে পরীদের বাসায়।
মেহেদী অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই তিতলিকে নিয়ে ফিরে এলো।
মালিহা তখন পিছন ঘুরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। তবুও মুখ না দেখেই তিতলি বুঝে ফেললো এটাই তার মা।
তিতলি প্রচন্ড অবাক হয়ে গেলো।সত্যিই তার মা এসেছে।
সে চিৎকার করে ডাকলো,মামণি…..
যদিও আওয়াজ টা বের হলো খুব আস্তে।তিতলির চোখে পানি টলমল করছে।
মালিহা পিছনে ফিরলো।তিতলিকে দেখে তার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো। মুহূর্তেই চোখের পানি গাল বেয়ে চিবুকে পৌঁছে গেলো।
তিতলি মেহেদীর কোল থেকে নেমে দৌড়ে মালিহার কাছে চলে গেলো।তার ছোট্ট শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে মালিহাকে জড়িয়ে ধরলো।
তার জড়িয়ে ধরার ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে তার মনের কথা।সে বলতে চাইছে,মামণি তোমাকে আমি আর কোথাও
যেতে দিবো না।আমি তোমার জন্য কত কাঁদছি তুমি জানো?
কিন্তু,মুখে সে কিছুই বলতে পারলো না। শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
মালিহা তিতলির কপালে আর গালে ইচ্ছা মতো চুমু খেতে লাগল।মেয়েটা শুকিয়ে গেছে।মুখটা বড় হয়ে গেছে শরীরের তুলনায়। কি মায়া লাগছে আহারে….
মালিহা নিজেকে সামলে নিলো।বললো,তিতলি তুমি তোমার ফুপিদের কাছে যাও।
তিতলি চোখ বড়বড় করে বললো,কেন তুমি আবার চলে যাবে?
তার চোখ ভর্তি পানি চিকচিক করছে।
মালিহা এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলো না।
তিতলি বললো, আমার বাবার সাথে দেখা করে যাও।বাবা তোমার ছবি নিয়ে রাত্রে বেলা কাঁদতো।তোমাকে দেখলে খুশি হবে…..
মালিহা তিতলির দিকে তাকিয়ে রইলো।এতো ছোট বাচ্চা অথচ কি সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতে পারে…মালিহা মনে মনে “মাশাআল্লাহ” বললো।মায়ের নজর না কি সন্তানের উপর বেশি লাগে. ।
মালিহা বললো,আচ্ছা তোমার বাবার সাথে দেখা করা যায় কি না দেখি। তুমি কান্না করো না মা আমি থাকবো।আর যাবো না।
তিতলি হাসার মতো করে খানিকটা ঠোঁট বাকালো।
মালিহা এগিয়ে গেল সামনে।সে আসলে বাদশার সাথে দেখা করতে চায় না। কিন্তু,তিতলির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আর সম্ভব হচ্ছিলো না।মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সব কষ্ট তার দিকে ধেয়ে আসছিল।
তিতলি মেহেদীর কাছে এলো। মেহেদী বললো,তিতলি তুমি আর কেঁদো না তো।এই যে তোমার মামণি চলে এসেছে,বাবাও সুস্থ হয়ে যাচ্ছে।এখন তো তোমার খুশি হওয়া উচিত তাই না মা?
তিতলি কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি জানি মামণি চলে যাবে।তোমরা সবাই এতো মিথ্যা কথা বলো কেন?জানো না মিথ্যা কথা বলা পাপ?আমি সব বুঝি। আমি বড় হয়ে গেছি।
মেহেদী চুপ থেকে কথা ঘুরিয়ে বললো,তাই না কি?তিতলি বড় হয়ে গেছে… আমার তো মনে হচ্ছে ছোটই আছে।
তিতলি চোখের পানি মুছে উৎসাহী হয়ে আবার বললো,আমি গল্প শোনা ছাড়াই একা ঘুমিয়ে যাই বুঝেছো?
– ওমা তাই?
– হুম।আমি একাই খেয়ে নেই।কেউ আমাকে খাইয়ে দিতে হয়না।নিজে নিজে জামা পরতে পারি।
– তাহলে তো তুমি আসলেই বড় হয়ে গেছো তিতলি…
– হুম হয়েছিই তো।দেখো না আমি মামণিকে ছাড়াই থাকি।কোনো ছোট বাচ্চা কি তার মামনিকে ছাড়া থাকতে পারে?বলো মেহেদী চাচু…
তিতলি কেঁদে উঠলো।সে আর বাবা মিলে তো প্ল্যান করেছিলো মামণির বার্থডে করবে। সারপ্রাইজ পেয়ে মামণি কত খুশি হবে। কিন্তু, কি এমন কাজ পরলো মামণির যে সে চলে গেলো।তিতলির কথা কি একবারও মনে পরলো না?কখনো ফোনও তো করলো না।মামণি কি জানে বাসায় কারো ফোন বেজে উঠলেই তিতলির বুক কেঁপে উঠতো। দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করতো,কে ফোন করেছে ফুপি?
তার মন কত ব্যাকুল হয়ে থাকতো এটা শোনার জন্য যে তার মা ফোন করেছে। কিন্তু,মা তো ফোন করতো না।প্রতিবারই ফুপি বলতো, আমার ফ্রেন্ড ফোন করেছে।তোর এতো জানার দরকার কি তিতলি?
কি ভাবে পারলো তিতলিকে একটা ফোন না করে থাকতে?দাদি যখন মায়ের সব শাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল তিতলি যে কি কান্না কেঁদেছে তখন মামনি তো জানেও না।তিতলি তো মায়ের শাড়িগুলো জড়িয়ে ধরে ভাবতো মাকে জড়িয়ে ধরেছে।
ঝিনুক ফুপি বা যুথি ফুপিকে জড়িয়ে ধরলে তো তার এতো শান্তি লাগে না যতটা মামণিকে জড়িয়ে ধরলে লাগতো।কেমন একটা মা…মা গন্ধ আসতো।মনে হতো আর কোনো ভূত-প্রেত,রাক্ষস এসে তিতলিকে মারতে পারবে না।মামণিকে জড়িয়ে ধরলে সব ভয় চলে যেতো।কই অন্যদের জড়িয়ে ধরলে তো এমন হয় না?
তাও মামণি চলে গেলো?মামণি তিতলিকে ভুলে গেলো?
তিতলির মনে কত শতশত অভিমান জমে আছে তা কেউ জানে না।কেউ বোঝেও না।
মেহেদী নিজেও তিতলিকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো।
ওদিকে ঝিনুক মালিহাকে বললো,আপনি ভাইয়াকে দেখে আসতে পারেন।ভাইয়া তো আপনার ভার্সিটি লাইফের খুব ভালো বন্ধু ছিল। ভাইয়ার সব বন্ধুরাই ভাইয়া কে এসে দেখে গেছে।আর, ভাইয়া এখন আগের চেয়ে ভালো আছে।
ঝিনুক হয়তো এ কথাটা বলছে কারণ মালিহার বাবা তাদের আর্থিক সাহায্য করেছেন।বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছেন।
ঝিনুক আরো বললো, ভাইয়ার অবশ্য সেন্স থাকে না।আপনাকে সে দেখতে পারবে না।আর,ভাইয়া তো কাউকে চিনেও না।
মালিহা বাদশাহ কে দেখতে গেলো।জ্ঞান না থাকলেই তার জন্য ভালো। বাদশাহ তাকে না চিনুক।
ডাক্তার বললো, বেশি ক্ষন যেন না থাকে।
মালিহা বেশিক্ষণ থাকবেই বা কি করে….তার কি সেই অধিকার আছে?
মালিহা বাদশার কেবিনে ঢুকলো। বাদশার পায়ের কাছে বসলো। অনেক দূর্বল আর শুকনো লাগছে বাদশার মুখটা।তবে এতোটা যে অসুস্থ সেটা বোঝা যাচ্ছে না।মনে হচ্ছে ভালোই আছে, ঘুমিয়ে আছে।
হঠাৎ বাদশাহ চোখ খুললো।মালিহার বুকটা কেঁপে উঠলো।মন চাইলো দৌড়ে পালিয়ে যেতে। বাদশার চোখে পরার মতো সাহস তার নেই।
বাদশাহ অস্পষ্ট,জড়ানো স্বরে বলে উঠলো,মালিহা…
ঝিনুক না বলেছিল বাদশাহ কাউকে চিনে না।মালিহা বরফের মতো জমে গেলো।
তার পায়ের সব শক্তি হারিয়ে গেলো।উঠে চলে যাওয়ার মতো শক্তি তার নেই।
খুব অস্ফুট স্বরে বাদশাহ কথা বলতে লাগলো।যদিও মালিহা সবই বুঝতে পারছিলো আর কথাগুলো তার কাছে অস্ত্রাঘাতের মতো লাগছিল।
বাদশাহ বললো,মালিহা আমাকে ক্ষমা করে দিও।আমি অনেক কষ্ট পাচ্ছি।
মালিহা তাকিয়ে রইলো।
হঠাৎ বাদশাহ বললো, তোমার কি বেবি হবে?
মালিহার বুকটা ধ্বক করে উঠলো। বাদশাহ বুঝলো কিভাবে?অন্য কেউ তো বুঝলো না।সে তো মোটা একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে এসেছে।বুঝাই তো যায় না।
বাদশাহ আবার বললো, তোমাকে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে,স্নিগ্ধ লাগছে।তিতলি যখন পেটে ছিল তখনকার মতো…মনে আছে?আমরা ভেবেছিলাম তিতলির কোনো ভাই-বোন হলে নাম রাখবো তিতাস?
মালিহা তাকিয়ে রইলো শুধু।সে মনে মনে প্রার্থনা করছিলো,খোদা তুমি আমার মরণ দাও এই মুহূর্তে।আমি আর সহ্য করতে পারছি না।
কিন্তু,খোদা তার কথা শুনলো না।তার মতো খারাপ মানুষের কথা সম্ভবত সৃষ্টিকর্তা শোনেন না।
বাদশাহ বললো,তোমরা ভালো থেকো মালিহা।তোমাকে আর ফারহানকে আমি অনেক বিশ্বাস করতাম। পৃথিবীতে মৃত্যু যন্ত্রনার পর সবচেয়ে বেশি কষ্ট মনে হয় বিশ্বাস ভাঙা।
মালিহা বাদশার পায়ে মাথা রাখলো। বললো,”তুমি আমাকে মাফ করে দাও।আমি নিজেও জানি না আমি এতো বড় ভুল কিভাবে করলাম।”
বাদশাহ বললো, তুমিও আমাকে মাফ করে দাও।আমি বুঝাতে পারি নি আমি তোমাকে কত ভালোবাসি। আমার নিজের চেয়েও বেশি। ঝিনুক,যুথির চেয়েও বেশি। এমনকি তিতলির চেয়েও বেশি তোমাকে ভালোবাসতাম। কিন্তু,লাভ কি তুমি তো বুঝো নি…এই ভালোবাসা মূল্যহীন। তুমি ফারহানের সাথে ভালো থেকো।
মালিহা কেঁদে উঠলো।
– না না আমি ভালো থাকতে চাই না।আমি মরে যেতে চাই। তুমি ভালো হয়ে যাবে দেখো। তুমি অনেক ভালো মেয়ে বিয়ে করে সুখে থাকবে।
বাদশাহ কিছু ক্ষন পর জিজ্ঞেস করলো,মালিহা তুমি তো বছরখানেকেরও বেশি সময় ফারহানের সাথে প্রেম করেছো তাই না?তাহলে সেই সময় গুলোতে যে আমাকে ভালোবাসি বলতে,বুকে মাথা রাখতে,হাসতে,কথা বলতে সব কি মিথ্যা অভিনয় ছিল? ভাবলেই আমার যে কি অসহ্য কষ্ট হয়…..সেই কষ্ট খানিকটা অনুভব করলেও তুমি বলতা বাদশাহ তুমি মরেই যাও,বেঁচে থেকে কষ্ট পেও না।
এরপর বাদশাহ একটু দম নিয়ে আবার বললো,মালিহা তুমি চলে যাও।তোমাকে দেখে আমার কষ্ট আরো বাড়ছে।

মালিহা বাইরে বেরিয়ে এলো।মনে হচ্ছে সে কিছুই চোখে দেখতে পাচ্ছে না।
চারপাশটা এতো প্রাণহীন কেন?কত মানুষ মরে যায় সে কেন মরে না?
মালিহা দেখলো ঝিনুক,যুথি, বাদশার মা,বাবা,তিতলি, মেহেদী সবাই কাঁদছে।
কিন্তু,সে কাঁদতে পারবে না।কান্না করার জন্য যে অধিকার লাগে সেটা তার নেই। কিন্তু,কষ্ট তো সেও পাচ্ছে।তার বুকটা তো পুড়ে যাচ্ছে।
ফারহান ফোনের উপর ফোন দিচ্ছে।কারো সাথে দেখা না করেই সে চলে এলো।তিতলির সাথেও দেখা করলো না আর।মালিহার মনে হলো পৃথিবীতে তার চেয়ে দুঃখী ,অভাগা মানুষ আর কেউ হয়না।যে কিনা বেঁচেও থাকবে মরণযন্ত্রনা নিয়ে।এর চেয়ে বড় শাস্তি কিছু হতে পারে? মালিহা আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,এতো কষ্ট না দিয়ে আমাকে মেরে ফেলো স্রষ্টা।আমাকে সব ভুলিয়ে দাও।আমি এতো কষ্ট সহ্য করতে পারছি না।আর,একটা সুযোগ যদি আমি পেতাম শুধু একটা সুযোগ।আমি বাদশাহ আর তিতলিকে ছাড়া কারো দিকে ফিরেও তাকাতাম না। সারাক্ষন ওদের জড়িয়ে ধরে রাখতাম।
মালিহা পাগলের মতো কাঁদতে লাগলো।

রাত পেরিয়ে ভোর হলো।ভোর বেলাতেই বাদশাহ মারা গেলো।
ডাক্তার শুধু মেহেদী কে খবরটা জানালো।
আর মেহেদী সর্বপ্রথম ঝিনুক কে। বাকিদের অবস্থা করুণ।সে ঝিনুক কে বললো,প্লিজ ঝিনুক তুমি কান্নাকাটি করো না। ভাইয়ার জন্য দুয়া করো।আল্লাহ উনাকে বেহেস্ত নসিব করুক। বেঁচে থাকলেই বরং উনি আরো কষ্ট পেতো।এখন উনার সব কষ্টের অবসান হয়েছে।
ঝিনুক ঘোলাটে চোখে মেহেদীর দিকে তাকালো। বললো, ভাইয়া যে এতো অসুস্থ ছিলো বাসার সবাই খুব কাঁদছে আমিই সবচেয়ে কম কাঁদছি।ভেবেছি কেঁদে সময় নষ্ট না করে ভাইয়াকে বাঁচাতে চেষ্টা করি।আজ আমার অফুরান সময়,আজ আমাকে কাঁদতে নিষেধ করো না।
– ঝিনুক তুমি তো তোমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছো ভাইয়াকে বাঁচাতে। এরপরেও যেহেতু উনি বাঁচেননি বুঝে নাও এটা স্রষ্টারই ইচ্ছা। তুমি প্লিজ কেঁদো না।নিজেকে শক্ত করো।
ঝিনুক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, তুমি জানো একদিন আমি আর ভাইয়া মেলায় গেছিলাম।ফিরার সময় হঠাৎ খুব বৃষ্টি শুরু হলো। আমাদের কাছে একটাই ছাতা ছিলো।ভাইয়া আর আমি সেই ছাতা দিয়ে কোনোমতে ফিরলাম।বৃষ্টি ছুঁতে পারলো না আমাদের। কিন্তু বাসায় এসে দেখি বৃষ্টি আমাকে না ছুঁলেও ভাইয়াকে ঠিকই ছুঁয়েছে।আমি খটখটে শুকনা থাকলেও ভাইয়া হয়ে গেছে কাকভেজা। বুঝলাম,ছাতাটা ভাইয়া শুধু আমার মাথার উপরই ধরেছিল।নিজে ভিজে আমাকে শুকনা রেখেছিল। জীবনের সব বিপদের বৃষ্টিতেই সে নিজে ভিজেছে আমাদের ভিজতে দেয়নি। ছাতার মতো থেকেছে।বড় ভাইয়েরা বুঝি এমনই হয়।আজ, আমার মাথার উপরে সেই ছাতা আর নাই।আজ আমি ভীষণ একা হয়ে গেছি। জীবনের সব ঝড়-বৃষ্টি,রোদ,ঘাত
প্রতিঘাতে আমার একাই থাকতে হবে।কেউ বলবে না,আমি আছিতো।তোর চিন্তা করতে হবে না।আহা… এরপরেও তুমি বলছো আমি যেন কান্না না করি?আমি কান্না না করে কি ভাবে থাকবো?
ঝিনুক চিৎকার করে কেঁদে উঠলো।
ঝিনুক কে কাঁদতে দেখে দূর থেকে বাকি সবাই ও বুঝে গেলো সবটা।
সবাই ছুটে এলো। কান্নার রোল পড়ে গেল।নার্স এসে সবাইকে ধমকাতে লাগলো।বের হয়ে যেতে বললো।
ওরা অবশেষে বেরিয়েই এলো। বাদশাহ কে আর একরাশ ধূসর অনুভূতি নিয়ে….
তিতলি শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।এও কি সম্ভব?তার মা-ও নাই।এখন আবার বাবাও চলে গেল!
.
১৮.

দেখতে দেখতে পাঁচ বছর কেটে গেছে। ঝিনুক আর মেহেদীর বিয়ে হয়েছে।তবে, মেহেদী খুব খামখেয়ালি। সারাক্ষন ছবি আঁকা নিয়ে থাকে। ঝিনুক নিজেও ছোট একটা জব করে।কারণ,কখনো মেহেদীর ছবি খুব ভালো বিক্রি হয় আবার কখনো হয়ই না। কিন্তু, সংসার তো চালাতে হবে। ঝিনুক খুব ঝগড়া করে এ নিয়ে মেহেদীর সাথে। মেহেদী শুধু হাসে।বলে,তাও তো তুমি একজন চিত্রশিল্পীর বউ। তোমার গর্ব করা উচিৎ। মেহেদীর কথা শুনে ঝিনুক আরো ঝগড়া করে। কিন্তু,যতোই ঝগড়া করুক মেহেদীকে ছাড়া সে এক সেকেন্ডও কল্পনা করতে পারেনা।তার কোনো দুঃখ নেই,একটা ছোট্ট বাড়ি তাদের। ছোট্ট একটা সংসার। কিন্তু, তবুও তারা ভীষন ভীষণ সুখী।
যুথিরও বিয়ে হয়ে গেছে।যুথির স্বামী বিশাল বড় ব্যবসায়ী,ধনী।স্বামী শ্বশুর, শ্বাশুড়ি,জা,ভাশুর সবাইকে নিয়ে বিশাল সংসার যুথির। সবচেয়ে ছোট ছেলের বউ হিসেবে সবাই ভীষণ আদর করে যুথিকে।যুথির স্বামীও ভীষণ ভালো মানুষ।বাড়িতে যতক্ষন থাকে ততক্ষণ খালি যুথি….যুথি করতে থাকে।
যুথি প্রায়ই ঝিনুকের কাছে ফোনে অভিযোগ করে ,আপু আমার খুব বিরক্ত লাগে জানো সারাক্ষন খালি সে আমার নাম জপ করবে।আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝে না।কি একটা অবস্থা….
ঝিনুক হাসে।বলে,হ্যাঁ এতে যে আপনি ঠিক কতটুকু বিরক্ত তা আপনার গলার স্বর শুনেই বুঝা যাচ্ছে মহারানী।
যুথিও হেসে ফেলে।একটা সময় সে মেহেদী ভাইয়াকে পছন্দ করতো।ভাবলেও এখন লজ্জা লাগে।মেহেদী ভাইয়ার সাথে ঝিনুক আপু ছাড়া অন্য কাউকে মানায়ই না।যেমনটা তাকে আর তার বরকে মানায়।
ঝিনুকের বাবা-মা তিতলিকে নিয়ে থাকে।মায়ের রাগী স্বভাব এখন আর নেই।বয়স বেড়েছে ধর্মকর্ম নিয়েই ব্যস্ত থাকে দুই স্বামী স্ত্রী।মাঝে মাঝে ঝিনুক আর যুথির বাসায় যায়। বাদশার কথা মনে পরলে স্রষ্টার কাছে হাত তোলে, দোয়া করে।
মালিহা আর ফারহানের সংসারও চলছে। ছোট একটা ছেলে আছে,যার নাম তিতাস।মালিহার মনে পাহাড়সম কষ্ট থাকলেও সে কাউকে বুঝতে দেয় না। ফারহান তো ব্যস্ত থাকে বন্ধু-বান্ধব আর মদ নিয়ে।কে জানে হয়তো মেয়ে নিয়েও।তবে,ফারহান তিতাসকে অনেক ভালোবাসে।মালিহাও তিতাসের দিকে তাকিয়ে বেঁচে আছে।নাহলে,এতো যন্ত্রনা নিয়ে কেউ বেঁচে থাকতে পারে না।
আর তিতলি?তিতলি এখন আসলেই বড় হয়ে গেছে।ক্লাস ফোরে উঠে গেছে। খুব হাসিখুশি থাকে সে….আসলেই কি তাই?তিতলির ক্লাসের সবার মা আছে,বাবা আছে। শুধু তার নেই।প্যারেন্টস মিট এ সবার বাবা মা আসে। টিচার রা সন্তানদের বিরুদ্ধে তাদের কাছে নালিশ করে,ভালো গুনগুলোও বলে। শুধু তিতলির বাবা মা আসে না।তিতলি ক্লাসে ফার্স্ট হয় কিন্তু সেই খবর বাবা মা শুনতে পারে না।ক্লাসের অনেকে আড়ালে মজা করে।বলে,জানিস তিতলির মা আরেক লোকের সাথে পালায় গেছিলো। কথাগুলো তিতলির কানে আসলে তার বুক ফেটে যায়। ঝিনুক ফুপি আর মেহেদী চাচু তাকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু,তারা তো সারাদিন বাইরে কাজ করে।তিতলি তো মন চাইলেও তাদের বাসায় যেতে পারে না।যুথি ফুপির বাসায় গেলেও দেখতে পায় যুথি ফুপি অনেক ব্যস্ত তার সংসার নিয়ে।তিতলির সাথে কথা বলার সময় খুব কমই পায় সে। কিন্তু,তিতলিকে আদর করে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু, মায়ের আর বাবার মতো কি কেউ হয়?তিতলি লক্ষ্য করেছে সে ভীষণ একা। অনেক আপনজন থাকলেও সে একা। মায়ের কাছে যেতে মন চায়। কিন্তু,মায়ের উপর রাগ হয় ভীষণ। আবার,বুঝতে পারে মায়ের তো আরেকটা সন্তান আছে।সেই সংসারে তো সে আগাছা।সেই সংসার এ তার উপস্থিতি কেউ পছন্দ করবে না। বিরক্ত হবে।
মামার বাড়ি তে যায় তিতলি মাঝে মাঝে।সেখানেও একই বিষয়।মামা,মামির সন্তান আছে।তারা তিতলিকে আদর করলেও নিজের সন্তানের মতো তো আর করে না।
বাবা মা না থাকলে বুঝি সব সন্তানই এমন আগাছা হয়ে যায়?তিতলির বাংলা মিস একবার কথায় কথায় ক্লাসের সবাইকে বলেছিল, পৃথিবীর সব মানুষের আদর-ভালোবাসাও যদি কেউ পায় তবুও জেনে রেখো তার চেয়েও মা-বাবার ভালোবাসা অনেক বেশি।
ক্লাসের সবাই জ্বি মিস…জ্বি মিস বলে চিৎকার করে উঠছিল। শুধু তিতলি কোনো শব্দ করেনি।তার বুকটা কেঁপে উঠেছিল।তিতলি রোজ রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে ডাইরিতে বাবা-মায়ের উদ্দেশ্যে চিঠি লিখে। সেই চিঠি আবার নিজেই কুটিকুটি করে ছিড়ে ফেলে দেয়।প্রিয়,মা-বাবা
মা…বাবা দেখো আমার রোল এক হয়েছে।আজকে বাংলার টিচার আমার হ্যান্ডরাইটিং এর প্রশংসা করেছে।আমি আর আমার বন্ধুরা গোল্লাছুট খেলেছি টিফিন পিরিয়ডে।জানো তোমরা, আমাকে আজকে ইংরেজি স্যার বকা দিয়েছে। আমার খুব কষ্ট হয়েছে।আমি কাউকে বলিনি।ফুপিদের বলে লাভ কি উনারা তো দূরে থাকে।দাদিকে বলেও লাভ নেই দাদি চিন্তা করবে।তোমরা থাকলে তোমাদের বলতাম।মা জানো বিকালে নিতু খেলতে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছিল তখন সে “মা” বলে চিৎকার দিয়েছিল।আর, সাথে সাথে ওর মা ঘর থেকে ছুটে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে ফেলেছিল।আমিও তো ব্যাথা পেলে তোমাকে ডাকি মা…কই তুমি তো আসো না। তোমার নাকি আরেকটা সন্তান আছে মা? কিন্তু, আমার তো মা নেই।
বাবা জানো কোথাও তোমার নাম লিখতে এত্তো বেশি আমার কষ্ট হয়।’মৃত: বাদশাহ রহমান’ এটা আবার কেমন নাম গো বাবা? আমি তো তোমার নামের পাশে মৃত লিখতে চাইনা…. স্কুল ছুটির পর সবার বাবা,মা সবাইকে নিতে আসে। শুধু তোমরা আসো না।আমি কি এতোই বড় হয়ে গেছি যে আমার বাবা-মায়ের আদর প্রয়োজন নেই। আমার কি তোমাদের জড়িয়ে ধরতে মন চায়না?আমি তো কোনো পাপ করিনা। মিথ্যা কথা বলিনা। দাদির সাথে নামাজও পড়ি তাও কেন আমার এতো কষ্ট? আমার সব বন্ধুরা বাবা-মায়ের সাথে কত জায়গায় ঘুরে ,ক্লাসে সেসব গল্প করে।আমি শুধু শুনি।আমাকে দাদা ,দাদী,নানি,নানা,ফুপি সবাই ভালোবাসে।তাও, আমি তোমাদের অনেক মিস করি বাবা-মা।আমি একা একা কাঁদি কাউকে বলি না। টিচার বলে ছোট বেলাটাই নাকি আনন্দের, বড়বেলায় অনেক কষ্ট সইতে হয়। কিন্তু, আমার তো ছোটবেলাতেই কষ্ট।জানো আগে আমি দুয়া করতাম তোমরা যেন ফিরে আসো। কিন্তু,তোমরা তো আসোনি। এখন আমি আর তোমাদের ফিরে আসার দুয়া করি না। এখন আমি প্রে করি, পৃথিবীর সব বাচ্চার বাবা,মা থাকুক।সব বাচ্চার বাবা ,মা থাকুক।
ইতি তোমাদের,তিতলি
তিতলি প্রায়ই মনে মনে বলে,মা তুমি না চলে গেলেও পারতে।
ছোট তিতলির মন জুড়ে থাকা অপূর্ণ অনুভূতি গুলোকেই বোধহয় বলে ধূসর অনুভূতি!
……………..(সমাপ্ত)…………..

ধূসর অনুভূতি পর্ব-১৫+১৬

0

#ধূসর অনুভূতি
পর্ব:১৫+১৬
লেখক- শাপলা

মালিহা রেস্টুরেন্টে বসে আছে।তার সামনে বসে আছে ঝিনুক আর যুথি… অনেক ক্ষন ধরেই নিশ্চুপ তিনজন।মালিহা তিনদিন ধরে তার বাবার বাসায় এসেছে। আজ সকালে সাহস করে যুথিকে ফোন করেই ফেলেছে।বলেছে তিতলির সাথে দেখা করতে চাই।
যদিও দেখা করতে ঝিনুক আর যুথি এসেছে শুধু।তিতলি আসেনি।
তিনজনের মধ্যে প্রথম কথা বললো ঝিনুক। খুব সুন্দর করে হেসে বললো,
– তো মিসেস ফারহান কেমন আছেন আপনি? আপনার স্বামী কেমন আছে?
মালিহা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।বললো, ঝিনুক আমার ক্ষমা চাওয়ার কোনো যোগ্যতা নেই তাই ক্ষমা চাইবোও না।আমি শুধু তিতলিকে একবার দেখতে চাই। এরপর আমি চলে যাবো।
ঝিনুক বললো,তিতলিকে কেন দেখতে চান ?আমরা তো তিতলিকে যার তার সাথে দেখা করাই না। বোঝেনই তো কত খারাপ মানুষ চারপাশে। এদের সাথে মিশে যদি তিতলির মনটা বিষিয়ে যায়…
মালিহা বললো, ঝিনুক আমি তিতলির মা হই।
ঝিনুক তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো।
বললো, ও আচ্ছা আপনি যে মা ভুলে গেছিলাম।তিনবছরের মেয়েকে ফেলে পালিয়ে যাওয়ার সময় কোথায় ছিল আপনার মাতৃত্ব?
মালিহা চোখের পানি মুছলো।”প্লিজ ঝিনুক একবার দেখা করে আমি চলে যাবো। দূর থেকে দেখবো একবার দয়া করো।”
– আমি বেঁচে থাকতে আপনার মতো অসৎ মহিলার ছায়াও আমার তিতলির গায়ে পরতে দিবো না।
মালিহা অসহায়ের মতো যুথির দিকে তাকালো।যুথিও মাথা নিচু করে ফেললো।
ঝিনুক আবার বললো,কোন সাহসে আপনি তিতলির সাথে দেখা করার কথা চিন্তা করলেন? আপনি এখনো আমাকে চিনেন নাই।আমি ভালোর সময় যেমন ভালো,তেমন খারাপের সময় আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ নাই।
যুথি ঝিনুক কে শান্ত হতে বললো। এরপর মালিহার দিকে তাকিয়ে বললো,ভাবী তিতলি এখন তোমাকে অনেকটাই ভুলে গেছে। তোমার জন্য আর কাঁদে না। এখন তুমি যদি আবার ওর সামনে যাও ওর পুরানো ক্ষতটা আরো বাড়বে। তুমি তো আর সবসময় ওর সাথে থাকতে পারবে না।মায়া বাড়িয়ে তো লাভ নেই।
মালিহা কেঁদে উঠলো।সে তিতলির জন্য তিতলির প্রিয় চকলেট এনেছে দুই বক্স,খেলনা এনেছে।
চোখের পানি মুছে যুথির হাতে বক্সগুলো ধরিয়ে দিয়ে বললো, দেখা যখন করতে দিবাই না তাহলে আর কি করার… এইগুলো তিতলিকে দিও।
যুথি বক্স গুলো হাতে নেওয়ার আগেই ঝিনুক সেগুলো ক্ষিপ্রভাবে নিজের হাতে নিয়ে ছুড়ে বাইরে ফেলে দিলো।
বললো, আপনাকে কিছু দিতে হবে না।তিতলির কিছু লাগলে আমরাই দিতে পারবো বুঝেছেন?
মালিহা বললো,আমি দোষ করছি আমি মানছি। কিন্তু তিতলি তো আমার মেয়ে।ওকে আমি কিছু দিতেও পারবো না?
যুথি বললো,আপু একবার দেখা করতে চাইছে দাও না…
ঝিনুক কোনো কথাই বললো না। অনেক ক্ষন আবার নীরবতা।
মালিহা আশা করে বসে আছে ঝিনুক এর হয়তো মন গলবে।
অনেক ক্ষন পর বাদশার প্রসঙ্গ উঠলো।
ঝিনুকের দু’চোখে পানি জমলো। বললো,ভাবী তুমি ভাইয়াকে ছেড়ে গেছিলা কিসের জন্য বলবা? আমার তো মনে হয় আজকালকার যুগে আমার ভাইয়ের মতো ছেলে পাওয়া মুশকিল। তুমি চলে যাওয়ার আগে যে চিঠি লিখে গেছিলা আমাদের সবার নামে একগাদা দোষ সেই চিঠিতে লিখে গেছিলা….
মালিহা বললো, পুরানো কথা কেন তুলছো?
– না ভাবী পুরানো কথা তুলতে হবে। তুমি আমাদের অনেক দোষ,ত্রুটি লিখছিলা সেটা পড়ার পর আমাদের নিজেদের কাছে নিজেদের খুব নিচু মনে হতো। আশেপাশের মানুষজন বলতো,বউটার উপর মনে হয় বাদশাহ অনেক টর্চার করছে এর জন্য না পেরে বউটা পালাইছে। আমার ভাই এইসব কথা শুনে শুনে মানসিক ভাবে চরম বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। তোমার চিঠিতে তার এতো দোষ পড়ে সে অবাক হয়ে গেছে যে তোমার তার প্রতি এতো বিতৃষ্ণা ছিল ,এতো ঘৃনা ছিল…সে সহ্য করতে পারে নাই।তো,ভাবী আমি জানতে চাই এখন কি তোমার মনের মতো স্বামী পাইছো?সেই স্বামী কি সর্ব গুণে গুণান্বিত?
ঝিনুকের চোখের পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পরছে।
মালিহা মাথা নিচু করে বসে রইলো। অনেক কষ্টে চোখের পানি আটকাচ্ছে সে।বললো,আমি ভুল করছি ঝিনুক কতবার বলবো…
ঝিনুক তার ব্যাগ থেকে মালিহার লিখে যাওয়া চিঠিটা বের করলো।সেটা মালিহার সামনে ধরলো।
হেসে বললো, ভুল না তুমি অন্যায় করছো অন্যায়,পাপ।ভাবী তুমি চিঠিতে লিখছো আমি আর যুথি নাকি তোমার জীবন অতিষ্ঠ করে দিচ্ছি। তোমার সব কিছুতে আমরা হাত দিই। তোমার শখের জিনিস নষ্ট করি। তোমার কোনো প্রাইভেসি নাই। আচ্ছা ভাবী প্রাইভেসি যদি নাই ছিল তুমি ফারহান ভাইয়ের সাথে প্রেম করছো কিভাবে? তোমার তো যথেষ্ট প্রাইভেসি এবং স্বাধীনতা ছিলো যার কারণে তুমি উনার সাথে পরকীয়া চালাতে পারছো বছরভর।রইলো বাকি আমরা তোমার সবকিছু তে ভাগ বসাতাম।আহারে ভাবী কসম করে বলতেছি বুঝতে পারি নাই তুমি আমাদের এইসব ব্যবহার অপছন্দ করো।তোমাকে বড় বোনের মতো মনে করছিলাম।তাই, তোমার কানের দুল, চুলের ফিতা নির্দ্বিধায় নিজের ভাবছি। কিন্তু,বুঝি নাই ভাবী তো বড় আপু হয় না।যদি ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারতাম তাহলে তোমার রুমেও যাইতাম না। শেষের দিকে এমনিতেও যেতাম না তোমার কাছে। বুঝতাম পছন্দ করো না। কিন্তু, শুরুতে বুঝতাম না। বুদ্ধি-শুদ্ধি কম ছিল তো তাই। তুমি তো মনে করো সব দোষ আমাদের। তুমি পরিস্থিতির চাপে পড়ে বাধ্য হইছো, কিন্তু তোমার ধারণা ভুল ভাবী। আমাদের দোষ আছে মানছি কিন্তু তোমার দোষ সবচেয়ে বেশি। আমার ভাইকে তুমি দোষী করছো ভাবী,আমি আমার ভাইয়ের চেয়ে ভালো ছেলে আর কোথাও কোনোদিন দেখি নাই। ছোট বেলার থেকে সে ছায়ার মতো আমাদের আগলে রাখছে।তার বিরুদ্ধে যখন তুমি এত্তোগুলো অভিযোগ করলা আমি মানতে পারি নাই ভাবী। আমার মায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুলো আমি মানছি, মায়ের দোষ আছে আমি জানি। কিন্তু, আমার ফেরেস্তার মতো ভাইরে তুমি অমানুষ বলছো, জানোয়ার বলছো।
ঝিনুক জোরে শ্বাস নিলো। এরপর আবার বলতে শুরু করল, ভাইয়ার অনেক দোষ তোমার চিঠি পড়ে জানছি এইবার আমি একটু তার গুণগুলো বলি কেমন…. তুমি ভাইয়ার বউ হয়ে যখন আসছো তখন ভাইয়ার কোনো চাকরি ছিল না, বেকার ছিলো। ভাইয়া বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে তবু তোমাকে বিয়ে করছে।কয়টা ছেলের এমন বুকের পাটা থাকে বলো তো…প্রেম করে, সর্বনাশ করে পরিবারের দোহাই দিয়ে চলে যায় ছেড়ে। আমার ভাই তো তা করেনি। আমার ভাই তো মদ-গাঁজা খায়না।এমনকি তোমার জন্য সিগারেট খাওয়াও বাদ দিয়ে দিছিলো।কোনো বাজে নেশা ছিল না।কোনো মেয়ের দিকে তাকাতোও না।কয়টা পুরুষ দেখাইতে পারবা এমন চরিত্রবান?তার কি দোষ ছিল বলবা?সে তার বোনদের ভালোবাসতো,মা-বাবাকে ভালোবাসতো এটা দোষ?তোমাকে কি ভালোবাসতো না?তোমাকে ফারহান ভাইয়ের সাথে নোংরামি করতে দেখে যুথি যখন ভাইয়াকে বিচার দিছিলো তখন ভাইয়া উল্টা যুথিকেই ধমকাইছিলো। বলেছিলো,ভাবলি কি করে মালিহার নামে এতো খারাপ একটা কথা বিশ্বাস করবো আমি?পরের বার এমন কথা বললে চড়িয়ে দাঁত ফেলে দিবো।’আহ খোদা কত বিশ্বাস ছিল তোমার উপর। তুমি পালিয়ে যাওয়ার পরেও বিশ্বাস করে নাই ভাবছিল বিপদে পরছো।সেই বিশ্বাস তুমি ভেঙে দিলা?মন ভাঙা তো মসজিদ ভাঙার সমান ভাবী। তোমার শাড়ি আমরা পছন্দ করলে ভাইয়া আমাদের দিয়ে দিতো? আচ্ছা, এরপর কি ভাইয়া তোমাকে কিনে দিতো না?আরে, আমাদের জন্য কিনে আনা কিছুও তুমি পছন্দ করে দেখতা ভাইয়া সাথে সাথে বলতো, তোদের ভাবীকে দিয়ে দে এটা তোদের জন্য আরেকটা কিনবো।ভাবী এইসব ছোট ছোট কারণে মানুষ সংসার ভাঙে? আমার মা তো আমাদের গায়েই হাত তুলতো কথায় কথায়। তুমি তো কোন ছাড়… শ্বাশুড়ির উপর জেদ করে সংসার ভাঙলা? সংসার কি শ্বাশুড়ির সাথে করতা নাকি স্বামীর সাথে?আমরা সবাই বুঝতাম ভাইয়া তোমাকে ভালোবাসে অনেক শুধু তুমি ই বুঝতা না।বুঝবা কেমনে তুমি তো ভালোবাসায় মগ্ন ছিলে পরপুরুষের সাথে। ফারহান ভাই কি আমার ভাইয়ের চেয়েও ভালো? অনেক সুখী এখন তুমি?
ঝিনুক কেঁদে উঠলো।মালিহা আর যুথিও কাঁদতে লাগলো।
ঝিনুক চোখের পানি মুছে বললো,ভাবী তুমি না হিংসা করছো ভাইয়া কেন আমাদের পিছনে টাকা খরচ করে…আজ দেখো ভাইয়ার বিপদে তুমি পাশে নেই, পালিয়ে গিয়ে সুখে আছো। কিন্তু,আমি তো পালায় যেতে পারছি না আমার ভাইকে ফেলে। আমার ভাই যে পাগল হয়ে গেলো। হাসপাতালে ভর্তি, তুমি কই এখন?আমার তো জান বেরিয়ে যাচ্ছে একা একা সংসার টা টানতে। এখন আসো হিংসা করতে…
মালিহা চোখের পানি ফেলে অবাক হয়ে বললো, বাদশার কি হইছে?
ঝিনুক বললো, তোমাকে বলতে চাচ্ছি না। তুমি তো কেউ না। তোমাকে বলে লাভ কি….চল যুথি।
ঝিনুক উঠে চলে গেল।
যুথি কি বলবে ভেবে পেলো না। তার ঝিনুক আপু ইদানীং এতো রাগী হয়ে গেছে।
যুথি বললো,ভাবী তিতলি ভালোই আছে। তুমি চিন্তা করো না।আমরা ওর খেয়াল রাখি।
মালিহা বললো, বাদশার কি হইছে?
যুথি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সব খুলে বললো।
মালিহা সব শুনে পাথরের মতো হয়ে গেল।
যুথি বললো,ভাবী আমাদেরও দোষ ছিল, শুধু তোমার একার না।আমরাও বুঝাতে পারিনি যে আমরা তোমাকে ভালোবাসি। ।
যুথি কাঁদতে লাগলো।
মালিহা যুথিকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বললো,আমি ভালো নাই যুথি আমি ভালো নাই।
যুথি কাঁদতে কাঁদতে বললো,আমরাও ভালো নাই।
মালিহা বললো,তিতলির এখনকার তোলা একটা ছবি দেখাবা?
যুথির ওয়ালপেপারেই তিতলির ছবি সেইভ করা ছিল।
যুথি দেখালো।মালিহা ফোনের মধ্যেই চুমু খেয়ে ফেললো।
পরদিন তিতলির সাথে দেখা না করেই সে ফিরে এলো একরাশ কষ্ট নিয়ে।

ঝিনুক-কে এখন কেমন যেন অদ্ভুত লাগে।যুথি চিনতে পারে না নিজের বোনকে।মাকেও চিনতে পারে না।সবাই বদলে গেছে।আর, বাদশাহর অবস্থা তো আরো খারাপ।সে তো তাদের কাউকেই চিনে না।এমনকি তিতলিকেও না…..
একটার পর একটা কষ্ট এসে সবাই কে বদলে দিয়েছে।
এখনো যে আরো একটা বড় কষ্ট পাওয়া বাকি তারা তো জানেও না।

আমি বারান্দায় বসে ছিলাম। ঝিনুক আপু হঠাৎ আমার পাশে এসে বসলো।আমি অবাক হলাম।আপু তো এতো তাড়াতাড়ি ফিরে না কখনো।কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আপু বললো,ডক্টরের রিপোর্ট। নে দেখ…
আমি বললাম,দেখে কি হবে,আমি তো বুঝবো না।ড.রবিউলের ওখানে গিয়েছিলে?
ঝিনুক আপু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। বাদশাহ ভাইয়াকে ইদানীং একজন নিউরোসার্জনও দেখছেন।কারণ,ডাক্তারদের ধারণা মানসিক সমস্যা ছাড়াও বাদশাহ ভাইয়ার আরো কোনো রোগ আছে। বাদশাহ ভাইয়া দৃষ্টিশক্তি কমে যাচ্ছে, ইদানীং অনেক বেশি দূর্বল হয়ে পরেছেন,জ্বর-মাথাব্যথা-বমি তো লেগেই আছে।আর কাউকে না চিনার বিষয়টা তো আগে থেকেই ছিল। মানসিক সমস্যা থেকে ভুলে যাওয়ার ব্যাপারটা হওয়া স্বাভাবিক কিন্তু সব মিলিয়ে দেখলে মনে হয় ব্যাপারটা শুধুমাত্র মানসিক আঘাতের কারণে হচ্ছে না। আগের থেকেই হয়তো কোনো সমস্যা ছিল আর মানসিক আঘাতের পর সেটা আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে। সাইকোলজিস্টের পরামর্শেই বাদশাহ ভাইয়াকে একজন নিউরোলজিস্ট দেখানো হয়েছে।
ঝিনুক আপুর হাতে তারই রিপোর্ট।
আপু নির্লিপ্ত ভাবে বললো,ডাক্তার বলেছে ভাইয়ার মাথায় টিউমার হয়েছে।ম্যালিগনেন্ট টিউমার।এটা ভীষণ ভয়ানক ব্যাধি বুঝেছিস। ভাইয়া মনে হয় বাঁচবে না।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।এতো বড় কষ্টদায়ক একটা খবর আমাকে শুনতে হলো।
ঝিনুক আপু বললো,আসলে ভাইয়ার বেঁচে থাকার মতো মানসিক জোরও নেই।মালিহা ভাবী যাওয়ার পর সে ভেবেছে এর জন্য সে-ই দায়ী।কোনো রোগ থেকে বেঁচে ফিরতে হলে সর্ব প্রথম যেই জিনিসটা লাগে তা হলো বেঁচে থাকার ইচ্ছাশক্তি।ভিতর থেকে মরে যাওয়া মানুষকে বাঁচিয়ে তোলা যায় না।যা আমার জন্য এক কাপ চা বানিয়ে আন।মাথা ব্যাথায় মরে যাচ্ছি।
আমি কাঁদতে কাঁদতে চা বানালাম।
বললাম,আপু ভাইয়াকে দেখতে যাবো।
আপু বললো,লাভ নাই রে। ভাইয়া কাউকে চিনে না।সেন্সও থাকে না ম্যাক্সিমাম টাইম।
– আমি তবুও ভাইয়াকে দেখতে চাই….
– কান্নাকাটি বন্ধ কর। ভাইয়া কি মরে গেছে? অপারেশন করতে হবে।
– অপারেশন করালে কি ভাইয়া ঠিক হয়ে যাবে?
– ভাগ্য ভালো থাকলে হবে।
– কয়টাকা লাগবে আপু?
– তিন লাখ।
টাকার পরিমাণ শুনে আমি আপুর দিকে তাকালাম।
– এতো টাকা কিভাবে যোগাড় করবে আপু?
– সেটা নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবে না। দরকার হলে আমার দুইটা কিডনি বিক্রি করে দিবো।
ঝিনুক আপু হাসলো।
আমি তাকিয়ে রইলাম।কি বলা উচিৎ জানি না।
এরপর আস্তে আস্তে ঝিনুক আপু কিছু টাকা যোগাড় করেও ফেললো,যদিও সেটার পরিমাণ বেশি না। শুরুতেই পুরো টাকা দিতে হবে না, সুতরাং কিছু সময় হাতে আছে।
ঝিনুক আপু হন্যে হয়ে টাকা জোগাড়ের চেষ্টা করছে। আমাকে নিয়ে এক দুঃসম্পর্কের মামার বাসায়ও গেলো একদিন, মোটকথা কোনো আত্মীয় বাদ নেই।মামা বাসায় ছিলেন না।তার স্ত্রী আর ছেলে ছিল।সব শুনে তারা বললো,অবশ্যই মামাকে জানানো হবে।
কিন্তু,আদৌ জানাবে কি না কে জানে।আর,জানালেই বা উনি আমাদের সাহায্য করবে এটা হওয়ার কোনো শিউরিটি নেই। আমার মনে হলো আমাদের ভাগ্য টা সবদিক দিয়েই খারাপ।অন্য মানুষেরা বিপদে পড়লে তাদের আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ঢাল হয়ে দাঁড়ায়।আর, আমাদের এক সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউই নেই।
হঠাৎ রাস্তায় মেহেদী ভাইয়াকে দেখলাম।
আমি ঝিনুক আপুকে বললাম, আপু দেখো মেহেদী ভাইয়া।
আপু বললো,তো?দেখতে হবে কিসের জন্য? এলিয়েন সে?
ঝিনুক আপু পা চালিয়ে হাঁটতে লাগলো। সাথে আমিও… কিন্তু মেহেদী ভাইয়া ততক্ষণে আমাদের দেখে ফেলেছে। তিনি দৌড়ে এলেন।
জিজ্ঞেস করলেন,কেমন আছো তোমরা?
আমি বললাম,জ্বি ভালো আছি।
মেহেদী ভাইয়া জিজ্ঞেস করলো, ঝিনুক তুমি তো এখন দেশে থাকার কথা না….
ঝিনুক আপু বললো,না আমার তো এখন মঙ্গল গ্রহে থাকার কথা।
মেহেদী ভাইয়া হাসলো।বললো, তুমি আগের মতোই আছো। তোমার স্বামী কেমন আছে?
আমি বললাম, ভাইয়া আপুর বিয়েটা হয়নি। বাদশাহ ভাইয়া ভেঙে দিয়েছিল।
মেহেদী ভাইয়ার চোখে হঠাৎ জল টলমল করে উঠলো।বললো, ঝিনুক তুমি আমাকে এতো বড় খবরটা দাও নি কেন?
ঝিনুক আপু বললো,আপনাকে খবর দিতে হবে কেন? আপনার জানার ইচ্ছা থাকলে আপনি নিজেই খবর নিতেন।
মেহেদী ভাইয়া বললো, আমি তো ভাবছি তোমার……….
এরপর থেমে বললো, আচ্ছা বাদ দেও সব দোষ আমার মেনে নিলাম।এর জন্য আমাকে যা শাস্তি দিবা মেনে নিবো। এখন প্লিজ আসো কোথাও বসি, কতদিন তোমার সাথে কথা হয়না।
ঝিনুক আপু বললো,সময় নেই বসতে পারবো না।তা, আপনার তো স্টাডি শেষ… এখন কি চাকরি খুঁজছেন?
মেহেদী ভাইয়া বললো,আসলে চাকরি খুঁজছি না।ওসব চাকরি বাকরি আমার দ্বারা হবে বলেও মনে হয় না।
– তাহলে এখানে যে?আমি তো খবর পাইছিলাম আপনি নিজের শহরে চলে গেছেন।
মেহেদী ভাইয়া বললো,হ্যাঁ বাড়িতেই থাকতাম। একটা আর্ট এক্সিবিশনের জন্য কিছু দিন হলো এসেছি।আমার কিছু ছবি আছে তো তাই।
আমি অবাক হয়ে গেলাম।-সত্যি?
মেহেদী ভাইয়া হেসে বললো, হুম সত্যি।দেখবা তোমরা?আসো।কয়েকটা সেল হয়ে গেছে ইতোমধ্যে।
আমি বললাম,তাহলে আর দেখবো কিভাবে?
– আরে বোকা এক্সিবিশন যতদিন চলবে ততদিন তো সব ছবিই থাকবে মানুষজন দেখার জন্য।যারা কিনেছে তারা এক্সিবিশন শেষ হওয়ার পর ছবি নিয়ে যাবে।
ঝিনুক আপু যেতে চাইলো না। আমার জোরাজুরিতে গেলো।যদিও আপুর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল আপু আসলে যেতে চায়। মেহেদী ভাইয়ার আঁকা ছবি দেখলে আপুর মনটা এমনিতেও একটু ভালো হবে। বাদশাহ ভাইয়ার অসুস্থতার পর থেকে তো আমাদের জীবন থেকে তো সব খুশি হারিয়ে গেছে।
আমরা মেহেদী ভাইয়ার সাথে আর্ট গ্যালারিতে গেলাম।কত সুন্দর সুন্দর ছবি চারপাশে।
এর মধ্যে মেহেদী ভাইয়া তার নিজের আঁকা ছবি গুলো দেখাতে লাগলো।তার একটা ছবি সবচেয়ে পছন্দ হলো আমার.. ছবিটার নাম”ঝিনুক”।উপরে নীল আকাশ আর নিচে সমুদ্রের নীল ঢেউ মিলেমিশে একাকার।সেই ঢেউয়ের মধ্যে একটা মেয়ে বসে আছে।মেয়েটার মাথার চুল উড়ছে। কিছু অবাধ্য চুল তার মুখের উপর পরে আছে।তাই, অর্ধেক টা চেহারা দেখা যাচ্ছে।সেই অর্ধেক টা চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটা আসলে ঝিনুক আপুকে ভেবেই আঁকা হয়েছে।ছবিতে মেয়েটার হাতে একটা ঝিনুক আছে…সবাই হয়তো ভাববে এর জন্যই ছবিটার নাম ঝিনুক কিন্তু…..কি জীবন্ত একটা ছবি। ছবিটার দিকে তাকালেই মনে হচ্ছে যেন আমিও ছবিতে থাকা মেয়েটার সাথে সমুদ্রের বেলাভূমিতে আছি। নীল ঢেউয়েরা এসে আমাকেও ছুঁয়ে দিচ্ছে। সমুদ্রের ঠান্ডা বাতাস যেন আমার গায়েও লাগছে…আর,ছবিতে থাকা মেয়েটা তো আরো জীবন্ত।মনে হচ্ছে সত্যিই সে মাত্র পাড়ে এই ঝিনুক টা কুড়িয়ে পেয়ে হাতে নিয়েছে।
আমি অবাক হলাম এতো সুন্দরও মানুষ আঁকতে পারে।কত পরিশ্রম না জানি হয়েছে।
তবে,আরো অবাক হলাম যখন শুনলাম এই ছবিটা দশ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে।
আমি চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে রইলাম। ঝিনুক আপু বললো,আপনি তো বড়লোক হয়ে গেছেন…
মেহেদী ভাইয়া হেসে বললো,আরে নাহ…কি যে বলো।আমি যদি আরেকটু বিখ্যাত হতাম তাহলে পঞ্চাশ হাজার টাকা হতো কমপক্ষে এটার দাম।
ঝিনুক আপু বললো,এতো টাকা দিয়ে ছবি কিনার মানুষ আমাদের দেশে আছে এটাই তো জানতাম না।
মেহেদী ভাইয়া হেসে বললো,আছে…আছে অনেক আছে।তবে এটা যিনি কিনেছেন তিনি অ্যামেরিকান।
ঝিনুক আপু দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুঃখ প্রকাশ করে বললো,এতো দাম দিয়ে এসব না কিনে কিছু টাকা আমাদের মতো অসহায়দের দিতে পারে না।
মেহেদী ভাইয়া হঠাৎ খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো।
বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলো, আমাদের কোনো সমস্যা কিনা……
ঝিনুক আপু কিছুতেই বললো না।আমাকে নিয়ে চলে এলো।পরে, মেহেদী ভাইয়া আমার ফোনে ম্যাসেজ পাঠালো।আমিই তাকে সবটা বলে দিলাম।
পরদিন হাসপাতালে গিয়ে দেখি মেহেদী ভাইয়া বসে আছে।
ঝিনুক আপু আমার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকালো।বললো, কেন ওকে জানাইছিস?
ঝিনুক আপু অনেক চেষ্টা করেও বেশি টাকা জোগাড় করতে পারলো না।আসলে, একবারে এতো গুলো টাকা জোগাড় করা কঠিন।তাই ভাইয়ার অপারেশনেও দেরী হচ্ছিল। এদিকে দ্রুত না করালে তো বিপদের আশংকা বাড়ছে।ডাক্তারকে অনেক রিকোয়েস্ট করার পর তিনি আপুকে বললো,আগে পঞ্চাশ হাজার টাকা জমা দেন।সেই সময়টা যে কি ভয়ানক কষ্টদায়ক ছিল। ঝিনুক আপু কেঁদে কেঁদে ডাক্তারকে রিকোয়েস্ট করছিল। আমার বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছিল।
কিন্তু, পঞ্চাশ হাজার টাকাও আমাদের কাছে অনেক টাকা। ঝিনুক আপু শুধু দশ হাজার টাকা যোগাড় করেছে।বাকি চল্লিশ হাজার টাকাই মেহেদী ভাইয়া দিলো। ঝিনুক আপু নিস্তেজ ভাবে জিজ্ঞেস করল, আপনি এতো টাকা কই পেলেন? আপনার সব গুলো ছবিই কি এতো দাম দিয়ে মানুষ কিনেছে?
মেহেদী ভাইয়া বললো,উহু।আমার জমানো টাকা ছিল কিছু,ছবিরও ছিল।তবে,সব ছবি তো বিক্রিও হয়নি।
ঝিনুক আপু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, আপনার টাকা ফেরত দিয়ে দিবো আমি।চিন্তা করবেন না।

ঝিনুক আপু আমাকে ডেকে নিয়ে বললো, আমাদের বাড়ি বিক্রি করে দিবো। এছাড়া তো আর বাকি টাকার কোনো পথ দেখছি না।
আমি তাকিয়ে রইলাম। বললাম,এই অল্প সময়ে তো বাড়ি বিক্রি করা সম্ভব না।
ঝিনুক আপু বললো,সবই সম্ভব।
সত্যি সত্যিই একটা ফ্ল্যাট বিক্রির চেষ্টা করছিল আপু।যদিও শেষমেশ আর তা করতে হয়নি।
কারণ,এক সন্ধ্যায় মালিহা ভাবীর বাবা আমাদের বাসায় আসলেন।
ঝিনুক আপুর হাতে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দিলেন তিনি। বললেন,এর মধ্যে কিছু টাকা আছে। বাদশার জন্য দিলাম।সে তো আমার সন্তানের মতোই।
আমি,মা আর ঝিনুক আপু অবাক হয়ে গিয়েছিলাম প্রচুর।
ঝিনুক আপু বললো, আপনার টাকা আমি ফেরত দিয়ে দিবো পরে ….
তিনি বললেন,দ্বিধা করো না।তোমাকে দিইও নি যে তুমি ফেরত দিবা ; আমি আমার নাতনির জন্যই দিলাম।তার তো মা নেই,বাবা অন্তত থাকুক।আর, আমি যে টাকা দিয়েছি সেটা তোমরা আর আমি ছাড়া কেউই জানে না।কেউ জানুক আমি চাইও না। এরপর তিনি উঠে চলে গেলেন। দরজার কাছে গিয়ে একটু থেমে বললেন,একটা কথা মালিহাকে তিতলির সাথে দেখা করতে দিও।সে তার ভুল বুঝতে পারছে যদিও শোধরানোর সুযোগ নেই তাও তিতলি তো তার সন্তান।
উনি চলে গেলেন। থামলেন না আর।
আমাদের তখনো বিশ্বাস হচ্ছিল না যে সত্যিই ঘটছে বিষয়টা।মা বাচ্চা মানুষের মতো খুশিতে চিৎকার করে উঠলেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলেন, আমার ছেলে ঠিক হয়ে যাবে?
আমি আর ঝিনুক আপু তাকিয়ে রইলাম মায়ের দিকে।
মা ছুটে গিয়ে তিতলিকে ঘুম থেকে জাগিয়ে ফেললেন।তিতলিকে কোলে নিয়ে ঘরময় ছোটাছুটি করতে লাগলেন।
…..
ভাইয়ার অপারেশন সাকসেসফুলি শেষ হলো।
ভাইয়ার জ্ঞানও ফিরলো।আমরা ভাইয়ার সাথে দেখা করতে গেলাম। ভাইয়া ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো শুধু। মায়ের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে দেখে চোখে না সূচক ইশারা করলো।যেন চোখের পানি না ফেলে।
এরপর আবার কি একটা ইঞ্জেকশন দেওয়া হলো। ভাইয়া ঘুমিয়ে পরলো।
পরদিন আবার একটু সমস্যা দেখা দিলো।ডাক্তারদের চিন্তিত দেখা গেলো।
আমরা কিছুই বুঝতে পারলাম না।
ডাক্তার বললো, হঠাৎ কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে আবার…
ঝিনুক আপু ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো, আমার ভাই বাঁচবে কিনা সেটা বলেন।
ডাক্তার বললো,আসলে এই টিউমার একবার অপারেশন করলে পুরোপুরি নির্মূল হয়না।এতে ক্যানসারের সেল আছে।ম্যাক্সিমাম ক্ষেত্রেই সমস্যা টা আবার ফিরে আসে।তবে,এতো দ্রুত যদিও না। কিন্তু, আপনার ভাইয়ের ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ্য করছি হঠাৎ করেই কমপ্লেক্স হয়ে যাচ্ছে বিষয়টা।আসলে…..
ঝিনুক আপু ডাক্তারের কথার মাঝখানে চেঁচিয়ে উঠলো,এতো কথা জানতে চাইছি? আমার ভাই বাঁচবে কিনা শুধু সেটা বলেন।
ঝিনুক আপু কান্না করে দিলো।
ডাক্তার বললো,আল্লাহকে ডাকুন।
মা বলতে লাগলেন,আমি তোদের বলছিলাম না আগেই? বাদশাহ বাঁচবে না… মায়ের মন সব জানে।আমার কপাল তো এতো ভালো না রে….
আমি আর ঝিনুক আপু মাকে জড়িয়ে ধরে ফেললাম।মা আর আমি কাঁদতে লাগলাম। ঝিনুক আপু কেমন পাথরের মত হয়ে গেলো। অনুভূতিহীন।
হঠাৎ, তাকিয়ে দেখি মালিহা ভাবী দাঁড়িয়ে আছে আমাদের থেকে খানিকটা দূরে।
এই গরমেও গায়ে একটা চাদর পেঁচিয়ে রেখেছে সে।

চলবে,,

ধূসর অনুভূতি পর্ব-১৩+১৪

0

#ধূসর অনুভূতি
পর্ব:১৩+১৪
লেখক: শাপলা

বড় চাচা রাগী চোখে বাবার দিকে তাকালো। বললো,এই ছেলে কে? এইভাবে ভদ্রলোকের ঘরের মধ্যে ঢুকে সিনক্রিয়েট করছে।
মেহেদী ভাইয়া কারো কথা পাত্তা না দিয়ে ভিতরের দিকে চলে গেল। মেহেদী ভাইয়ার চেঁচামেচির কারণেই শাহীন ভাইয়া দরজা খুললো। ঝিনুক আপুর চেহারা টা একদম ফ্যাকাশে রক্তশূন্য হয়ে আছে।ভয়ে রীতিমতো কাঁপছে সে।
মেহেদী ভাইয়া বললো, তুমি এতো ভয় পাচ্ছো কেন ঝিনুক? আমি আছি না?
ঝিনুক আপু হঠাৎ মেহেদী ভাইয়ার বুকে মাথা রেখে কাঁদতে লাগলো।
সেখানে তখন বাকিরাও সবাই চলে এসেছে।
চাচি চিৎকার করে উঠল মায়ের দিকে তাকিয়ে,ছিঃ ছিঃ তোমার মেয়ের স্বভাব-চরিত্রের এই দিকটা তো আমার জানা ছিল না।
মা পাথরের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
শাহীন ভাইয়া হুট করে মেহেদী ভাইয়ার গায়ে হাত তুলে ফেললো।আর,মুখে বিশ্রি একটা গালি দিলো।
মুহূর্তেই দুইজনের মধ্যে মারামারি শুরু হয়ে গেল।
শাহীন ভাইয়া ফ্লোরে পরার কারণে তার ঠোঁট খানিকটা কেটে গেল।
মা আর বাবা এসে দুইজন কে থামালো।
বড়চাচা চিৎকার করে বাড়ি মাথায় উঠিয়ে ফেললো।”কত বড় সাহস, আমার বাড়িতে থেকে আমার ছেলের গায়ে হাত তোলে।একে এখুনি বিদায় কর তুই মিজান।নয়তো আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না…”
শাহীন ভাইয়া দাঁত চেপে বললো, বিদায় পরে কইরেন আগে আমি ওর হাত-পা ভেঙে নিই।ও আমার গাঁয়ে হাত তোলে চিনে নাই এখনো আমি কে….
বাবা শাহীন ভাইয়া-কে শান্ত করার অনেক চেষ্টা করতে লাগলো।
মা বললো, মেহেদী তুমি এই মুহূর্তে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবা। দুধ দিয়ে যে আমি যে কালসাপ পুষছিলাম আগে তো বুঝি নাই।
মেহেদী ভাইয়া ঝিনুক আপুর দিকে তাকিয়ে বললো, ঝিনুক তুমিও আমার সাথে চলো। এখানে থাকার দরকার নেই।
শাহীন ভাইয়া বাঘের মতো গর্জন করে উঠলো,এই ছোটলোকের বাচ্চা কি বললি তুই? আমার বউ তোর সাথে যাবে কিসের জন্যে?এই ঝিনুক তুমি এই শয়তানকে বলো এখান থেকে যেতে।
মেহেদী ভাইয়া ঝিনুক আপুর দিকে তাকিয়ে রইলো।
ঝিনুক আপু বললো, আপনি কেন চলে যাচ্ছেন না? আপনি আল্লাহর ওয়াস্তে চলে যান। আপনার পায়ে ধরছি দয়া করে যান।
– তুমি আমার সাথে চলো,ভয় পেয়ো না।এই জাহান্নামে তোমার থাকার দরকার নেই।
ঝিনুক আপু বললো,আমি যাবো না।আমি যেতে চাই না। আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে এটা জানার পরেও আপনি কেন এখানে এসেছেন ঝামেলা বাঁধাতে?
মেহেদী ভাইয়া বললো,আমি জানি ঝিনুক তুমি এগুলো মন থেকে বলছো না। তোমার চোখের পানি ই বলে দিচ্ছে তুমি মিথ্যা বলছো।
– আমার চোখে পানি আসছে আপনার আচরণ দেখে। অভদ্রের মতো এসে আপনি মারামারি শুরু করে দিয়েছেন আমার হবু স্বামীর সাথে।
তর্কাতর্কি চলতেই থাকলো।
এক পর্যায়ে সত্যি সত্যিই মেহেদী ভাইয়াকে বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়।
মা মেহেদী ভাইয়ার বাবার কাছে ফোন করে বিচার দেয় যে, আপনার ছেলেকে আমি নিজের ছেলের মতো মনে করছিলাম।আর, আপনার ছেলে এখন আমাদের সর্বনাশ করতে চাচ্ছে।
সব শুনে মেহেদী ভাইয়ার বাবাও খুব রাগ করে। তিনি মেহেদী ভাইয়াকে বলেন এখুনি যেন চলে আসে।
এতোসব কিছুর পরও হয়তো মেহেদী ভাইয়া থাকতো। কিন্তু, ঝিনুক আপুর ব্যবহারেই সে যেতে বাধ্য হলো।
বড় চাচা বড় গলায় বলতে লাগলেন, আমার ছেলের চরিত্র নিয়ে তো অনেক কথা শুনাইছিস এখন তোর মেয়ে যে কেমন সেটাও তো স্বচক্ষেই দেখলাম।
বাবা কিছুই বললেন না। চুপ করে বসে রইলেন।মা দুঃখ প্রকাশ করে বললেন,সব দোষ ঐ ছোটলোকের বাচ্চার। আমার মেয়ের মাথাটা খাইছে ও…
বড়চাচা বললেন, আমি আর সময় দিতে পারবো না। ঝিনুক একটা ভুল করেছে,আমি মাফ করলাম।কারণ, আমি তার বাবার মতো। কালকেই কাজী ডাকিয়ে বিয়ে পড়ানো হবে।কোনো অনুষ্ঠানের দরকার নাই।ঐ ছেলে আবারো ঝামেলা করতে পারে। অবশ্য এ সব উটকো ঝামেলা উপড়াইতে আমার এক সেকেন্ডও লাগবে না তাও এখন ঝামেলা চাচ্ছি না..
বাবা কিছু বললেন না।তার নিরবতাকেই সম্মতি হিসেবে ধরা হলো।চাচি বারবার বলতে চেষ্টা করলেন, তিনি এই বিয়েতে রাজি না। কিন্তু, তার কথা শাহীন ভাইয়া পাত্তা দিলো না। তিনি ঝিনুক আপুকে বিয়ে করবেনই।কি থেকে কি হয়ে গেল আমরা কেউই কিছু বুঝতে পারছিলাম না।
সেদিন রাতে অনেক ঝামেলার পর রাত দুইটার সময় আমি নিজের ঘরে এলাম।
তিতলি বাদশাহ ভাইয়ার কাছে। খুব অদ্ভুত লাগছিল যে বাদশাহ ভাইয়া এতো বড় ঝামেলা দেখেও ঘর থেকে বের হলো না।
আপুকে বললাম, আপু তুমি কেন মেহেদী ভাইয়ার সাথে এমন করলা?উনি মনে কত কষ্ট পাইছে তুমি জানো?
ঝিনুক আপু বললো,আমিও যদি শাহীনের বিপক্ষে গিয়ে ওর পক্ষে কথা বলতাম। শাহীন ওকে খুনই করে ফেলতো।তুই তো জানিস ই শাহীন কত বড় শয়তান।এমন কাজ নাই যেটা ও করতে পারে না।আর,বড়চাচা তো অসৎ পথে অনেক টাকা ইনকাম করছে, যেকোনো কিছু ধামাচাপা দেয়া উনার বা হাতের ব্যাপার…
ঝিনুক আপু দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
আমি বললাম, আপু এখন অন্তত তুমি মেহেদী ভাইয়াকে একটা ম্যাসেজ পাঠিয়ে বলো সব সত্যিকথাগুলো।
ঝিনুক আপু বললো,ম্যাসেজ আমি পাঠাইছি।লিখছি, আমার কালকে বিয়ে।আর যেন আমার সাথে যোগাযোগ এর চেষ্টা না করে।
আমি ব্যথিত চোখে তাকিয়ে রইলাম।-‘তুমি এমন ব্যবহার কিভাবে করছো? তোমার কি মায়া লাগছে না? তুমি ই উনার সাথে যেচে মিশেছো শুরুতে।উনি তো তোমার সাথে নিজে থেকে মিশেনি। ‘
– শোন যুথি বিয়ের পর কি আমি ওর সাথে যোগাযোগ করতে পারবো?পারবো না। খামোখা ওর কষ্ট বাড়িয়ে লাভ কি? এখন আমার এমন ব্যবহার দেখে ও দ্রুতই আমাকে ভুলে যাবে।সেটাই ভালো।
– তুমি বিয়ে করতে চাও?
– চাওয়া ছাড়া কি কোনো উপায় আছে?
– ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়।
– দেখি উপায় বল।আমি তো কোনো উপায় দেখছি না।
– তুমি পালিয়ে যাও।
– পালাবো কিভাবে বোকা মেয়ে?আর আমি পালালে মা-বাবার কি হবে ভেবে দেখ…বড়চাচা তাদের কি পরিমান অপমান করবে ভাবতে পারিস…আর, ভাইয়ার চিকিৎসার টাকাও উনারা দিবে না।বাড়ির অর্ধেক যদি বেচে দেয়?আর, আমি পালালে যদি জেদ করে তোর সাথে বিয়ে দিয়ে দেয় শাহীন জানোয়ার টার তাহলে।আমি কষ্ট পেলে পাবো। কিন্তু,তুই আমার ছোট বোন।তোর কোনো কষ্ট তো আমি সহ্য করতে পারবো না।
ঝিনুক আপু কান্না করে দিলো।
আমিও আপুকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলাম।
ঝিনুক আপু বললো,তার চেয়ে ভালো আমার এখানেই বিয়ে হোক। তাহলে বাবা-মায়ের অনেক আর্থিক হেল্প হবে।ভাইয়াও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে।আর,আমি তো এতো ভালো মেয়ে না।মেহেদী কয়দিন পর ভালো একটা মেয়ে কে বিয়ে করে নিবে শেষ।
ঝিনুক আপু হাসলো।
আমি বললাম, আপু আর কি কোনো উপায় নেই?
– জানি না বোন।কোনো উপায় তো দেখছি না।
রাতে আমার একটুও ঘুম হলো না। ঘুমের ভাণ ধরে শুয়ে রইলাম।
ঝিনুক আপুও ঘুমালো না।সারারাত ই নিঃশব্দে কাঁদলো।কান্নার দমকে তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছিল।একসময় এই দীর্ঘ বিষাদের রাত পেরিয়ে ভোরের আলো ফুটলো।
মা আমাদের ডাকতে এলেন।যদিও আমরা ঘুমাই ই নি।
কাঁদার কারণে ঝিনুক আপুর চোখ-মুখ ফুলে আছে। চোখদুটো হয়ে আছে রক্তাভ।
মা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন,তোর আজকে বিয়ে আর তোরে লাগতাছে পেত্নীর মতো।এতো কানছিস কেন ?মনে হচ্ছে তোর বাপ মা মারা গেছে…
ঝিনুক আপু কিছুই বললো না।
মা বললেন,শোন ঝিনুক তুই আমারে ভুল বুঝিস না। আমার কিছুই করার নাই।
মায়ের দু’চোখে পানি জমলো।
তিনি ঝিনুক আপুর মাথায় হাত রাখলেন। বললেন, একবার চিন্তা কর তোর চাচাদের কত টাকা পয়সা,ক্ষমতা। তাদের সাথে সম্পর্ক খারাপ করে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরে লাভ আছে? তোর ভাইয়ের নাই চাকরি..আমরা চলবো কিভাবে?উনারা যদি টাকা পয়সা দিয়ে আমাদের হেল্প করে তাহলে তোর ভাইয়ের চিকিৎসা হবে।তিতলিটার তো বাবা ছাড়া কেউই নাই।তুই কি চাস তোর ভাই পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াক?একটা মাত্র ভাই তোর।সারা জীবন বটগাছের মতো ছায়া দিয়ে রাখছে… এখন শুধু নিজের কথাই ভাববি?আর, মেহেদী কি এতোই ভালো ছেলে? প্রেমের সময় সব ছেলেরাই ভালো বিয়ের পর যেই লাউ সেই কদু।ওর কোনো চাকরি নাই,এখনো পড়ালেখা ই শেষ হয়নি।আর্থিক অবস্থাও ততো ভালো না। মানে তুই কিভাবে এত নিশ্চিত যে ওর সাথে বিয়ে হইলে তুই সুখী হবি? শাহীন আগে খারাপ ছিল আমি মানলাম। কিন্তু,তাই বলে কি সারাজীবন ই খারাপ থাকবে বল… বিয়ের পর বাচ্চা কাচ্চা হইলে আরো ভালো হইয়া যাবে।কি সুন্দর তোকে তুমি করে বলছে।রাগও তো আগের মত নেই।কালকে মেহেদীর আচরণ দেখে আমার ই মন চাইছে ধরে পিটাইতে। কিন্তু, শাহীন তো সহ্য করলো।
আমি বললাম,প্লীজ মা শাহীন ভাইয়ের গুনগান কইরো না তো খামোখা।যাও….
মা বললো,কই যাবো আমি? এখন তোর বোনের সাজগোজ করা লাগবে না?
সকাল হতে না হতেই ফুপু তার পরিবারের সবাইকে নিয়ে চলে এলো।
আপুকে শাড়ি পরানো হলো।
ফুপা আসেন নি এখনো তিনি কাজী নিয়ে ফিরবেন।
সবাই বসে আছে বসার ঘরে।মা সবাইকে নাস্তা দিলো।
তখন হঠাৎ বাদশাহ ভাইয়া বসার ঘরে আসলো।
ভাইয়ার চোখ লাল হয়ে আছে। চুল গুলো এলোমেলো। মুখের মধ্যে খোঁচা খোঁচা দাড়ি।লাল চোখের জন্যই কেমন পাগল এর মতো লাগছে।
মা বললেন, বাদশাহ তোর শরীর ভালো না। তুই গিয়ে ঘুমিয়ে থাক।তোকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তুই ঘুমাস নি।
বাদশাহ ভাইয়া বললো,ঘুমাবো কিভাবে আমার বোনের এতো বড় সর্বনাশ এর দিন আজ।
মা অসহায় ভাবে আত্মীয় দের দিকে তাকালেন। এরপর ফ্যাকাশে ভাবে হেসে বললেন, ছেলেটার মাথার ঠিক নেই। চিকিৎসা চলছে সেটা তো জানেনই সবাই।ওর কথায় কিছু মনে করার দরকার নাই।
বাদশাহ ভাইয়া বললো, ঝিনুকের বিয়ে আমি বেঁচে থাকতে শাহীনের সাথে হবে না। তুমি যদি তবুও শাহীনকেই জামাই বানাতে চাও তাহলে আমাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলো।
মা চোখ বড়বড় করে বললেন, বাদশাহ তুই রুমে যা…হুট করে একটা কথা বলে ফেলিস কোন আক্কেলে?
বাদশাহ ভাইয়া বললো, রুমেই তো থাকি সারাক্ষন মা।বের তো হইনা।আর,হুট করে কিছু বলছি না তো,কাল সারারাত ধরে ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
বড় চাচা রাগত স্বরে বললো, সমস্যা কি তোদের?এ খানে আসার পর থেকেই অপমান আর অপমান করে যাচ্ছিস।আজকে বিয়ের দিন আবার নতুন নাটক শুরু…
এমন সময় ফুপা এলেন।বড়চাচা বিরক্ত হয়ে বললেন,কাজী কই? তুমি একলা কেন?
ফুপা বললেন, বাদশাহ তো ফোন করে আমাকে মানা করলো কাজী আনতে।
বড়চাচা চিৎকার করে উঠলেন।
মা বাদশাহ ভাইয়াকে বললেন,তুই কেন ঝামেলা করছিস বাবা?
বাদশাহ ভাইয়া শাহীন ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,তোরা খাওয়া দাওয়া করে যাস। ইচ্ছা করলে নিচতলায় থাকতে পারিস।অথবা তোদের যে আরেক টা বাড়ি আছে সেখানেও গিয়ে থাকতে পারিস, তোদের ইচ্ছা।তবে, খালি মুখে যাওয়া যাবে না।
শাহীন ভাইয়া হেসে বললো, খালি মুখেও যাবোনা,খালি হাতেও যাবো না।বউ নিয়ে তবেই যাবো।
– স্যরি শাহীন। তোর মতো নিকৃষ্ট কুত্তার কাছে আমার বোনকে বিয়ে দিবো না আমি।
শাহীন ভাইয়া আর বাদশাহ ভাইয়ার মধ্যে তর্কাতর্কি চলতে থাকলো।
বাদশাহ ভাইয়া বললো, আমি পুলিশ কে ফোন করবো।একটা প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে জোর করে বিয়ে দেয়া হবে , এতোই সোজা।
শাহীন ভাইয়ার মা চিৎকার করে বলতে লাগলেন, তোর বোনের যে কীর্তি দেখলাম রাতে,ঐ অসভ্য মেয়েরে ঘরে নেওয়ার ইচ্ছাও আমার বিন্দুমাত্র নাই। তবুও, তোদের দয়া করতেছি।
– ধন্যবাদ চাচি আপনারা কষ্ট করে দয়া না করলেই আমরা খুশি।
বড়চাচা বললেন, বিয়ে দিবি না?তোর বোন ছাড়া কি আর দুনিয়ায় মেয়ে নাই? তোর বোনকে তো এমনেও পছন্দ হয়নি আমার।
কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে বাদশাহ ভাইয়া টেবিলের উপর সাজানো সবগুলো প্লেট,গ্লাস ভেঙ্গে ফেললো। চিৎকার করে বলতে লাগল,এই বিয়ে হবে না…হবে না..হবে না।দয়া করে বিদায় হন আপনারা।নাহয় আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না…
বড়চাচা বাবার দিকে তাকালো।
বাবা বললো,যেহেতু আমার ছেলে চাইছে না।মেয়েও রাজি না। আবার, আপনাদেরও ঝিনুক কে বেশি পছন্দ হয়নি।এর থেকে ভালো মেয়ে পাবেন বলছেন তাহলে বিয়েটা মনে হয় না হওয়াই ভালো।
মা অসহায় ভাবে আপুর দিকে তাকালো।বললো, ঝিনুক তুই কিছু বল। তুই তো রাজি আছিস তাই না?
ঝিনুক আপু বললো,হ্যাঁ ভাইয়া আমি রাজি আছি। তুমি প্লিজ নিজের ঘরে যাও।
বাদশাহ ভাইয়া বললো,কি ব্যাপার বললাম না বিয়ে হবে না আপনারা শোনেন নাই?
বড় চাচা বললো,এতো বড় অপমান করলি আমাদের?এর পরিণতি কি হয় শুধু দেখ।
তারা সবাই চলে গেলো চিৎকার চেঁচামেচি করে।
আমি খুশি তো হলাম বিয়ে ভাঙায় আবার ভয়ও পেলাম।
মা কাঁদতে লাগলেন খুব। ঝিনুক আপু কে বকতে লাগলেন,এতো খারাপ তুই? নিজের পরিবারের ভালো চাস না?
বাদশাহ ভাইয়া বললো,মা তুমি ঝিনুক কে একটা গালিও দিবা না ‌যদি দাও…
– গালি দিলে কি করবি তুই?আরে তোর ভালোর জন্যই তো এরেই কয়,যার জন্য চুরি করি সেই কয় চোর।
বাদশাহ ভাইয়া বললো,মা তুমি আমার ভালোর জন্য ঝিনুক এর জীবন ধ্বংস করে দিচ্ছিলা?
মা কেঁদে উঠলেন, চুপ থাক তুই…কারোর ক্ষতি করছিলাম না আমি।বিয়ে হলে সবার ভালোই হতো। তোদের ভালোই চাই আমি…
বাদশাহ ভাইয়া বললো, তুমি হয়তো আমাদের ভালোই চাও মা। কিন্তু এই ভালো চাইতে গিয়ে অজান্তেই আমাদের খারাপ করে ফেলো।আমরা অনেক বড় হইছি মা এখন নিজের ভালো নিজেকে বুঝতে দাও।
মা আরো জোরে জোরে কাঁদতে লাগলেন। বললেন,
– ভালো চাইতে গিয়ে কি খারাপ করছি আমি তোর?
বাদশাহ ভাইয়া হাসলো।
– মা আমার সংসার ভেঙে গেছে মা। তুমি দেখছো না?দুঃখে কষ্টে, অপরাধবোধ এ আমি ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যাচ্ছি মা।
– ওহ আচ্ছা এইসব আমার দোষ?
– না মা… শুধু ঢালাও ভাবে সবটাই তোমার দোষ না।তবে, তোমারও দোষ আছে।মা বিয়েতো হয়েই গেছিলো আমাদের, মানলাম মালিহাকে তোমার পছন্দ হয়নি কিন্তু সারাক্ষন এটা তাকে বলার, কাজেকর্মে বুঝিয়ে দেওয়ার কি দরকার ছিল? শুরুতে তো সে পালিয়ে যাওয়ার মনোভাব নিয়ে এই বাড়িতে আসে নাই মা, সংসার করার ইচ্ছা নিয়েই আসছিল।তাহলে আমাকে ছেড়ে চলে গেলো কেন?ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলে তো বিয়ে করতো না কোনো দিন।
বাদশাহ ভাইয়ার চোখ বেয়ে পানি পড়লো।
মা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলো। চেঁচিয়ে বললো,
– জানোয়ারের বাচ্চা তুই এখনো ঐ বেশ্যার জন্য কাঁদিস?তুই নিজের মা’কে দোষারোপ করিস?
বাদশাহ ভাইয়া বললো,না মা সবচেয়ে বেশি দোষ আমার আর মালিহারই। কিন্তু, অভিভাবক হিসেবে তুমি কোনোদিন আমাদের দোষ গুলো শোধরাতে সাহায্য করোনি উল্টা দোষ ধরেই গেছো।আমি আগে মনে করতাম মালিহাই দোষী।ওকে অভিশাপ দিতাম। কিন্তু,যখন দেখলাম ঝিনুকও তোমার জন্য চোখের পানি ফেলছে তখন বুঝলাম…
– কি বুঝলি তখন?আমি ডাইনী?আমি জাঁদরেল?
ভাইয়া কিছু বললো না। ঝিনুক আপুর কাছে গিয়ে তার চোখের পানি মুছে দিলো।
বললো, আমার বোনের চোখের পানির বিনিময়ে আমি সুখী হতে চাই না…
ভাইয়া ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেলেন।
মা আমার দিকে তাকালেন।
বললেন,বল তুই বল আমার দোষ সম্পর্কে…আমি শুনি। তোদের মালিহা ভাবী তো নির্দোষ।
আমি বললাম,মা একটা কথা বলি।ভাবী নিঃসন্দেহে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করছে। কিন্তু,আমরাও নিরপরাধ না। ভাইয়া তোমার বিচার শুনে ভাবীর সাথে ঝগড়া করতো। তুমি কোনোদিন থামাতে না।আমি তোমাকে কতদিন বলেছি, ভাইয়া কে তুমি থামাও। তুমি উল্টা ভাইয়া কে বলতা,মালিহারে ধইরা দুইটা চড় লাগা…. এরপর, তুমি তিশির সাথে ভাইয়ার বিয়ে দিতে চাইলা।তিশি হলো একটা অকালপক্ক,ফালতু মেয়ে।ওর সাথে যদি ভাইয়ার বিয়ে হতো তাহলে ভাইয়ার জীবন টা পুরোপুরি ধ্বংস হতো। এখন আবার তুমি ঝিনুক আপুর সাথে..…..
মা হাত উঁচিয়ে আমাকে থামালেন। বললেন, এখন সংসার টা কিভাবে চলবে আমি শুধু ঐটাই দেখবো।আজ থেকে আমি এই ঘরে নিশ্চুপ হয়ে থাকবো।তাহলে কেমন সুখের বন্যা বয় সেটাই আমি দেখতে চাই।

দেখতে দেখতে একমাস হয়ে গেলো। আমাদের বাসায় যে কি চলছে নিজেও বুঝতে পারছি না।কখনো কখনো মন চায় সব ছেড়ে ছুড়ে চলে যাই।
বড়চাচা বাবার উপর ক্ষোভ থেকে বাড়ির অর্ধেক টা বিক্রি করে দিয়েছে এক অসৎ লোকের কাছে।যে প্রতিদিন মদ খেয়ে বাড়ি আসে। সারাক্ষন ই ছাদে বসে থাকে, আজেবাজে লোকের আড্ডা লেগেই থাকে। তার কারণে আমরা কেউই ছাদে উঠতে পারি না।তাকে কিছু বলাও যায়না কারণ সেও তো বাড়ির মালিক।এই লোকের আচরণে সবাই ত্যাক্ত-বিরক্ত;বড় চাচা ইচ্ছা করেই এমন একটা লোকের কাছে বাড়ি বিক্রি করেছে যেন আমাদের কষ্ট পেতে হয়।ইশিতা ভাবীরা বাসা ছেড়ে চলে গেছে।কারণ,এমন মাতাল যেই বাড়িতে থাকে সেখানে কি কোনো ভদ্রলোক থাকতে পারে?
বাবা তো এমনিতেও সংসারের কোনো বিষয়ে কথা বলেন না। আত্মভোলা মানুষ।ঠিক ভুল সব সিদ্ধান্ত মা-ই নিতো আগে। এখন তো সে-ও আমাদের উপর রাগ করে একদম চুপচাপ হয়ে গেছে।নিজে থেকে কিছু বলে না ,আমরা কিছু জিজ্ঞেস করলেও হ্যাঁ,না করে উত্তর দেয়।এই বাড়িতে বর্তমানে তিতলি ছাড়া কারো সাথেই মা কথা বলে না।
বাদশাহ ভাইয়া কিছু দিন ভালোই ছিল।জবের জন্য চেষ্টা করছিলো পাশাপাশি তার বন্ধুর দোকানে বসতো।
কিন্তু, সাতদিন ধরে বাদশাহ ভাইয়ার অবস্থা খুবই খারাপ।কাউকে চিনতে পারে না।ঘরের মধ্যে ভাঙচুর করে।তাই,তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।কলেজে পড়ার সময় মা আমাকে আর ঝিনুক আপু কে কিছু গয়না গড়িয়ে দিয়েছিল।নানিও কিছু দিয়েছিলেন। ঝিনুক আপু এখন সব বিক্রি করে দিয়েছে ভাইয়ার চিকিৎসার জন্য।
ঝিনুক আপু একদম অন্যরকম হয়ে গেছে। আগের মতো চঞ্চল, হাসিখুশি আর নেই। সারাক্ষন কপালে চিন্তার রেখা,সংসারের পুরো ভারটাই তার উপর। এখন আর ইউনিভার্সিটি তে ক্লাস করতে যায়ও না। সারাদিন বাইরে থাকে। বাসায় ফিরে রাত আটটায়।বাসা থেকে খানিকটা দূরে একটা কম্পিউটার টিচিং সেন্টারে ইন্সট্রাক্টর হিসেবে কাজ করছে দুপুর পর্যন্ত। এরপর টানা ৫ টা টিউশনি করছে। বাসায় ফিরেও ফুরসৎ নেই। আমাদের পাশের বিল্ডিং এ একজন ড্রেস ডিজাইনার থাকে।তার থেকে বিভিন্ন ড্রেস এনে সেলাই করা,স্টোন বসানো এইসব কাজ করে রাত ১২টা পর্যন্ত কমপক্ষে। অনেক সময়সাপেক্ষ কঠিন কাজ কিন্তু পারিশ্রমিক খুবই কম।তবুও,এই কম টাকাই বা কে কাকে দেয়।আমিও আপুকে রাত্রে বেলা সাহায্য করি।দু-একটা ছাত্রও পড়াই দিনে। ঝিনুক আপু বলে, প্রতিদিন ইউনিভার্সিটি যাবি।ক্লাস কামাই দেওয়া চলবে না।
ঝিনুক আপু-ই এখন বাজার সদাই করছে। বাবার ওষুধ কিনছে। আমার পরিক্ষার ফি দিচ্ছে।তিতলির জন্য দিনশেষে খেলনা নিয়ে ফিরছে। ভাইয়ার চিকিৎসার টাকা দিচ্ছে।
আপুর অনেক কষ্ট হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু,আপু সব সহ্য করে নিচ্ছে।কারণ,আজ যদি তার শাহীন ভাইয়ার সাথে বিয়ে হতো তাহলে হয়তো বড়চাচা আমাদের উপর রাগ করে মুখ ফিরিয়ে নিতেন না।
কোথাও না কোথাও আপু সব কিছুর জন্য নিজেকেই দোষী মনে করে।যদিও তার আসলে দোষ নেই,সব দোষ আমাদের কপালের।
আগে কি সুন্দর ছিল সবকিছু। এখন সেসব শুধু ই স্বপ্ন।
একটা জিনিস বুঝতে পারলাম, মানুষ যখন সুখে শান্তিতে থাকে তখন তার সঙ্গী-সাথির অভাব হয় না। কিন্তু,দুঃখের সময়টুকু বড়ই একাকী পার করতে হয়।
জীবনের সমস্ত গ্লানি,কষ্ট-দুঃখ,যন্ত্রনা,ব্যর্থতা অর্থাৎ সবচেয়ে কঠিন মূহুর্তগুলো কাটাতে হয় একা একাই।কেউ সাহায্য করবে,পাশে এসে দাঁড়াবে এই চিন্তা করা বোকামি।কত আত্মীয় স্বজন কিন্তু কেউই বলছে না ওদের পাশে দাঁড়াই।সবারই নিজ নিজ সংসার আছে,সবাই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত।
মেহেদী ভাইয়া আর ঝিনুক আপুর বিয়েটা হয়নি। পরিবারের সবাইকে এমন অনিশ্চয়তার সাগরে ফেলে নিজে বিয়ে নামক ভেলায় চড়ে তীরে চলে যাবে এমন কাজ আর যে-ই করতে পারুক ঝিনুক আপু তো পারবে না। মেহেদী ভাইয়ার সাথে আর কথাও হয়নি ঝিনুক আপুর…আমি বলেছি যোগাযোগ করো, তোমার যে বিয়ে হয়নি সেটা জানাও।
ঝিনুক আপু বলে,পারবো না রে।ওর যদি গরজ থাকে ও নিজেই খোঁজ নিবে। আমাদের বিয়ে হওয়ার কোনো দরকার নেই।বিয়ে করে আমি স্বার্থপরের মত স্বামী নিয়ে সুখে সংসার করতে পারবো না তোদের কষ্টে রেখে।আর, মেহেদীর বাবারও আমাকে পছন্দ না।উনি বলেছেন আমরা নাকি পাগলের বংশ। আমার ভাই পাগল,তাই আমিও পাগল হবো একদিন।এমন জায়গায় উনি ছেলেকে বিয়ে করাতে চানও না।
আমি অবাক হয়ে বললাম,আপু তোমাকে এইসব কে বলেছে?
ঝিনুক আপু বললো,শুনেছি একজনের কাছে।কি ব্যাপার মুখ গোমড়া করছিস কেন?তুই কি ফিউচারে তোর ছেলের বিয়ে কোনো মাথা খারাপ মেয়ের সাথে দিবি?দিবি না।সবাই নিজের টা ষোলো আনা বোঝে।তাই বলে,কেউ খারাপ না।
আমি বললাম, আপু তুমি মেহেদী ভাইয়ার সাথে একবার কথা বলো…
– কথা বলতে ইচ্ছা করে না।এই যে এতো সমস্যায় আছি এখন আর কাউকে বলতেও ইচ্ছা করে না। সেদিন এক ফ্রেন্ডকে বলছিলাম যে অনেক আর্থিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।ওমা.. আমার কথা শুনে দেখছি ওর চোখ মুখ কেমন হয়ে গেছে।হয়তো ভাবছে,আমি ওর থেকে ৫-৬ হাজার টাকা ধার চেয়ে বসবো।হাহা…
আমি বললাম, আপু মেহেদী ভাইয়া অন্যদের মতো না তুমি তো জানো।
– না রে বোন আমি এতো কিছু জানি না।ওর সাথে আমার তেমন কোনো সম্পর্কই ছিল না। শুধু একজনের আরেকজনকে ভালো লেগেছিল সেই কথা জানাতেও পারিনি মুখে।আমাকে ও এতো দিনে ভুলেও গেছে হয়তো… যাক ভুলে যাক…
ঝিনুক আপু দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
এইরকম রঙহীন-ধূসর জীবন কাটছিল আমাদের। ঝিনুক আপু প্রায় রাতেই কাঁদে ঘুমের মধ্যেও মেহেদী ভাইয়ার নাম নেয়। কিন্তু, সকাল হলে সব অন্যরকম। একজন কঠোর নারী আত্মপ্রকাশ করে সে।
একদিন ঝিনুক আপু হাসিমুখে এসে বললো,যুথি আমি একটা নতুন চাকরি পেয়েছি।
ঝিনুক আপুর নতুন চাকরি হলো একটা ছোট্ট বাচ্চা কে রাতের বেলায় রাখা। বাচ্চার মা ডাক্তার,সিঙ্গেল মাদার।সপ্তাহে তিনদিন নাইট ডিউটি করেন।ঐ তিনরাত বাচ্চাটাকে আপু রাখবে।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।”আপু তুমি এখন আয়ার কাজ করবা?”
ঝিনুক আপু বললো,শোন কোন কাজ ছোট করবি না।এটা তো কোনো পাপ কাজ না।কত বড় বড় অফিসার রা যে ঘুষ খায়, অবৈধ টাকা কামাই করে তাদের দেখলে তো স্যার..স্যার করিস।আর,আমি সৎপথে একটা কাজ করবো সেটা তোর ছোট মনে হয়।ঐ লেডি ডাক্তার বাচ্চা কে আমার কাছে রেখে রাতভর কত রোগীর সেরে ওঠার ওসিলা হবে, এখানে আমারও কৃতিত্ব আছে পরোক্ষভাবে বুঝলি?
আমি আর কিছুই বললাম না।
অনেক দিন পর মা আমাদের ঘরে এলেন, আমাদের সাথে কথা বললেন।
বললেন, ঝিনুক যদি বিয়েটা করতো তাহলে আর দিন রাত এতো কষ্ট করতে হতো না।
ঝিনুক আপু বললো, বিয়ের পর আরো কষ্ট করতে হতো মা। তুমিই বা কেমনে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে টাকা পয়সা পাওয়ার স্বপ্ন দেখো।উল্টা জামাই যৌতুকের আশা করে বসে থাকতো।হাহা।ঐ দেশে ওরা আমাকে শত কষ্ট দিলেও আমি চুপ করে সহ্য করতাম।এখন তো সারাদিন পরিশ্রম, কষ্ট করে এসেও নিজের কাছের মানুষদের মুখ দেখি। মায়ের মুখ দেখি।ঐ যে একটা কবিতা আছে না,দেখিলে মায়ের মুখ, দূরে যায় সব দুখ।
মা আর কিছু বললেন না।চলে গেলেন রুম থেকে।
মায়ের চোখে পানি টলটল করছিলো আমি দেখেছি।
…….
…….
মালিহা আজ ভোররাতে খুব অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখেছে।তার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠেছে স্বপ্নটা দেখে। আচ্ছা, ভোরের স্বপ্ন কি সত্যি হয়? কোথায় জানি শুনেছিল।স্বপ্নে দেখলো কি সুন্দর একটা সবুজ মাঠ, চারপাশে মৃদু বাতাস বইছে,পাখিরা গান গাইছে।আর, সবুজ ঘাসের উপর তারা তিনজন হাঁটছে।তিতলি মাঝখানে আর তিতলির দুই হাত ধরে সে আর বাদশাহ হাঁটছে‌।তিতলি কি মিষ্টি করে হাসছে। হঠাৎ,সে তিতলির হাত ছেড়ে দৌড়ে কোথায় একটা চলে গেল।তিতলি এদিক ওদিক তাকিয়ে তাকে খুঁজতে লাগলো।মামণি…মামণি বলে ডাকতে লাগলো। কিন্তু, কোথাও আর মালিহার চিহ্নটুকুও নেই। বাদশাহ একাই তিতলির হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ, বাদশাহও তিতলির হাত ছেড়ে চলে গেলো …তিতলি দিগন্ত বিস্তৃত পুরো মাঠটায় একা দাঁড়িয়ে রইলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে বাবা-মা বলে খানিক ক্ষন ডাকলো। এরপর, ঘাসের উপর বসে কাঁদতে লাগলো।
এই পর্যায়ে এসে স্বপ্নটা ভেঙে গেলো।মালিহা শুনতে পেলো ফজরের আজান হচ্ছে।মালিহার বুক কাঁপতে লাগলো।এ কেমন অলক্ষুনে স্বপ্ন! সাধারণত মালিহা ফজরের নামাজ পড়ে না। কিন্তু,আজ খুব সময় নিয়ে নামাজ পড়লো। দীর্ঘ সময় মোনাজাতে কাঁদলো।
কিন্তু, কিছুতেই তার মনের অস্থিরতা কমছে না।
তিতলিকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে তার….
সকাল বেলা ফারহান কে নাস্তা দিয়ে মালিহা সাহস করে বললো,তিতলিকে কিছু দিন এখানে এনে রাখতে পারলে…..
ফারহান একরাশ বিরক্তি নিয়ে মালিহার দিকে তাকালো।
মালিহা সবটুকু কথা শেষ করতে পারলো না আর।
ফারহান অফিসে যাওয়ার পর সে ঘরে একা একা বসে কাঁদলো কিছুক্ষণ।
আচ্ছা, বাদশাহ কি আবার বিয়ে করেছে?১৬ বছরের মেয়েটার সাথে তো বিয়ে টা হয়নি। এখন কি অন্য কাউকে করেছে? বিয়ের পর কি তিতলিকে ভুলে গেছে?এটাই কি স্বপ্নের মানে?
মালিহা ডুকরে কেঁদে উঠলো।”তিতলি মা আমার আমি তোমাকে ফেলে এসে অনেক বড় অপরাধ করেছি। তুমি আমাকে কোনোদিনও ক্ষমা করো না, কোনোদিনও না।”
মালিহা সিদ্ধান্ত নিলো সে তিতলিকে দেখতে যাবে।
কিন্তু, ফারহানকে তো বলতে হবে অন্যকথা। দুইদিন পর মালিহা ফারহানকে বললো,আমি মায়ের কাছে গিয়ে কয়েক দিন থাকতে চাই।
ফারহান প্রথমে রাজি হলো না।
কিন্তু,মালিহা তাকে বুঝালো সন্তানসম্ভবা অবস্থায় প্রতিটা মেয়েরই নিজের মায়ের কাছে থাকতে মন চায়।
কয়েকটা দিনের-ই তো ব্যাপার।সে গেলে কি তার মা তাকে তাড়িয়ে দিতে পারবে?
ফারহানকে অনেক অনুরোধ করে রাজি করালো মালিহা। ফারহান কে রাজি করাতেই লেগে গেল সাতদিন। ফারহান কাঁটা কাঁটা ভাবে বলে দিয়েছে ভুলেও যেন বাদশাহর ধারেকাছে না যায়।তার বউ এখন মালিহা,এটা যেন মনে রাখে।
ফারহানের অফিস খোলা তাই ফারহান এখানেই থাকবে।মালিহা মনে মনে খুশি হলো।সেটাই ভালো।
একাই রওয়ানা হলো সে।যদিও একা না, তার মধ্যে এখন আরো একটি সত্ত্বাও বেড়ে উঠছে।
মালিহা সারা শরীরে কাঁপুনি অনুভব করতে লাগলো।
কতদিন হয়ে গেছে তিতলির গোলগাল মুখটা সে দেখে না। কতগুলো মাস পেরিয়ে গেছে তিতলিকে সে জড়িয়ে ধরতে পারে না।
বাবার সামনে গিয়ে সে কিভাবে দাঁড়াবে? তিতলি কি তাকে দেখে ছুটে চলে আসবে কোলে উঠতে,মনে হয়না আসবে।তার শ্বশুর-শ্বাশুড়ির সাথেও কি দেখা হবে?না সে কিছুতেই পারবে না। ঝিনুক,যুথি ওরা তাকে দেখে কি বলবে?
আর, বাদশাহ??
বাদশার কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মালিহা।
তার চোখ বেয়ে পানি পড়ে।ইশ!এতো বড় ভুলটা না করলে কি হতো…..তার সংসারে যেতেই তার আজ এতো সংকীর্ণতায় ভুগতে হচ্ছে….
চলবে,,

ধূসর অনুভূতি পর্ব-১১+১২

0

#ধূসর অনুভূতি
পর্ব:১১+১২
লেখক: শাপলা

ঝিনুক মেহেদীর দিকে তাকালো।
বললো,কি বলতে চান খোলাখুলি ভাবে বলেন।এতো ঢং আমি পছন্দ করি না।
~কেন?ঢং করার অধিকার শুধু তোমারই আছে?
– আবার ঢঙের কথা। বিরক্তিকর।
~ আচ্ছা, এতোই যখন রিকোয়েস্ট করছো তাহলে বলি,আমি তোমাকে ভালোবাসি ঝিনুক!
– এই যে মেন্দিপাতা আপনাকে আমি মোটেও রিকোয়েস্ট করি নি ।আর,কি বললেন ভালোবাসেন?অমন ভালোবাসি বলতে বলতে কত ছেলের যে ভোকাল কর্ড নষ্ট হয়ে গেছে হিসাব নেই তাও এই ঝিনুক খান কারো দিকে ফিরেও তাকায়নি হুহ…
~ আর আমি এই মেহেদীকে দেখছো না ব্ল্যাক শার্ট পরে আছি।এই ব্ল্যাক শার্টের হাতা খানিকটা ফোল্ড করলে শ খানেক মেয়ে অজ্ঞান হয়ে যায় হুহ…
– জ্বি তাতো হবেই। আপনার হাতের পশম তো অ্যামাজনের জঙ্গলের টুইন।যেকোনো মেয়েই ভয় পেয়ে অজ্ঞান হবে স্বাভাবিক। অজ্ঞান হওয়ার আগে বলবে,এই গরিলা হাতওয়ালা আদমিকে কেউ চিড়িয়াখানায় নেও…
~ গরিলা বলো আর শিম্পাঞ্জি বলো তুমি তো আবার আমাকেই ভালোবাসো…
– আপনাকে আমি কেন ভালোবাসবো?আজব…
~ বাসোনা ভালো? আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলতো।
– হাহা. …. সিনেমার এসব ডায়লগ কপি করে ক্লাস নাইনের মেয়ে পটানো যায় ইউনিভার্সিটির না।
~ তাহলে তুমিই বলো ঝিনুকমালা তুমি কি করলে ইমপ্রেস হবা?
– হায়রে…সেটাও নাকি আমি বলে দিবো… গান শোনান একটা…
~ নরমালি গান তো পারি না সেরকম।তবে গোসলখানায় মাঝে মাঝে গাই।
– ওহ তাহলে আপনার গান শুনতে হলে গোসলখানায় ঢুকতে হবে?
~ছিঃ না।অন্য কিছু বলো।দেখি পারি কিনা..
-তাহলে একটু নেচে দেখান…
মেহেদী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, পারিনা।নেক্সট ..
ঝিনুক বললো,অন্তত কবিতা তো আবৃত্তি করতে পারেন?
~ ইয়ে চল চল চল,ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল এইটাই শুধু মনে আছে।তোমাকে এই মুহূর্তে যুদ্ধের কবিতা শোনানো তো ঠিক হবে না।
– আপনি তো দেখছি কিছুই পারেন না।
মেহেদী এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,উমম দুইটা কাটা সুতা যদি পাইতাম তাহলে তোমাকে একটা ম্যাজিক দেখাতাম।
ঝিনুক অনেক কষ্টে হাসি চেপে বললো,ঐ যে কাটা সুতা জোড়া লাগানোর ম্যাজিকটা?
~ হুম। কিভাবে বুঝলা?
– জনাব ঐটা আমিও পারি।আপনাকে একটা ফ্রি এডভাইস দিই। আপনি একটা ক্লাস নাইন-টেনের মেয়ের পিছনে ঘুরেন যান। তাহলে সেই মেয়ে আপনার এসব ছাতার মাথা ম্যাজিক দেখে পটে যাবে বলবে,ওএমজি ভাইয়া ইউ আর সো গ্রেট।ইউ আর জুয়েল আইচ। বুঝলেন?
~ হুম ঠিক ই বলছো। গার্লফ্রেন্ড হিসাবে অবশ্য নাইন টেনের মেয়েরাই পারফেক্ট।
ঝিনুক চোখ বড়বড় করে তাকালো। মেহেদী এটা বলবে সে ভাবে নি।
মেহেদী হেসে বললো, কিন্তু আমার পোড়া চোখে তো তুমি ছাড়া আর কাউকেই ভাল্লাগে না…..
ঝিনুক অন্যদিকে তাকিয়ে হাসলো।বললো,এই সস্তার বস্তাপচা ডায়লগ দিয়ে লাভ নাই।এখনো ইমপ্রেস হইনি। কিছুই পারেন না আপনি।
মেহেদী দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু ভাবলো। এরপর বললো, ঝিনুক আমি প্যারেড করতে পারি।কলেজে বিএনসিসি তে যুক্ত ছিলাম তো।
ঝিনুক অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
সত্যি সত্যিই মেহেদী খানিকটা দূরে সরে গিয়ে প্যারেড করতে করতে ঝিনুকের দিকে এগিয়ে আসলো। এরপর স্যালুট দিলো।
ঝিনুক আর হাসি আটকে রাখতে পারল না। জোরে হেসে ফেললো।বললো,এই লেফট রাইট দেখে আপনার প্রেমে পরবো আমি?সো ফানি… মেহেদী বললো,বাট আমার মনে হয় তুমি আরো আগে থেকেই আমার প্রেমে পরে আছো। ঝিনুক বললো,উহু ভুল ধারণা। আচ্ছা,চলেন ঐ পানির ফোয়ারা টার কাছে যাই।
খানিক টা দূরে একটা আধ ভাঙা পুরানো আমলের পানির ফোয়ারা।পানি নিচে পরে গ্রাউন্ড ভিজে আছে।
মেহেদী বললো, ওখানে কেন?
ঝিনুক বললো, আসেন তো।
ওরা দুইজন সেখানে গেলো। ঝিনুক বললো,আপনি হাঁটু গেড়ে বসে আমাকে প্রপোজ করেন।
মেহেদী বললো,যথা আজ্ঞা মহারানী।আমি বুঝতে পারছি আপনার মাথায় একটা ফাজলামি করার ফন্দি এসেছে।
ঝিনুক হাসতে হাসতে বললো, আচ্ছা আপনার হাত বাড়ান…আমি হাত ধরবো।
মেহেদী বললো, তুমি এতো ভালো মেয়ে না যে ভালোবেসে আমার হাত ধরবা।আমি এখন বুঝতে পারছি তোমার মাথায় কি প্ল্যান এসেছে, তুমি আমার হাত ধরে টেনে আমাকে ফোয়ারার পানিতে ফেলতে চাচ্ছো….আমাকে পানিতে ভিজিয়ে কষ্ট দিয়ে তুমি মজা পাবা….
ঝিনুক ব্যঙ্গ করে বললো,তাই?এতো কষ্ট বুঝে থাকলে আবার হাত বাড়িয়ে আছেন কেন?
মেহেদী বললো, তার আগে বলো পতঙ্গ কেন পুড়ে যাবে জেনেও আগুনের কাছে যায়?
ঝিনুক আবার হাসলো।”আপনি আমার সব প্ল্যান আগেভাগেই বুঝে ভেস্তে দিলেন।হইছে উঠে আসেন।”
খানিক ক্ষন পর ঝিনুক আবার বললো, আচ্ছা আপনার টোটাল কয়টা গার্লফ্রেন্ড ছিল বলেন তো…
মেহেদী চেঁচিয়ে উঠলো,কিহহ?? গার্লফ্রেন্ড??
ঝিনুক বললো, কেন ছিল না।এতো চমকানোর কি আছে আকাশ থেকে পরলেন মনে হয়?
মেহেদী মাথা নিচু করে বললো,যেই প্রশ্ন করেছো শুনে মনে হচ্ছে আকাশ থেকেই পরলাম…
ঝিনুক আবার ব্যাঙ্গাত্মক সূরে বললো,আহারে তাই?আকাশ থেকে পরে আবার হাত পা ভাঙেন নি তো?
মেহেদী হেসে বললো,ভাঙলে সমস্যা কি? তুমি আছো না সেবা করবা।বউ….
ঝিনুক নিজেও হাসলো।বললো,ভাই রে ভাই আপনাকে আমি কি ভাবছিলাম আর আপনি আসলে কি…কোন ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করছেন ফ্লার্ট করার উপরে?
~ কেন তুমি ভর্তি হতে চাও নাকি?
– প্লিজ ফাজলামি না আর…
~ ওকে সিরিয়াস বিষয়।তুমিও এখন আমাকে আই লাভ ইউ টু বলবে।বাট, তুমি তো মেয়ে নিশ্চয়ই লজ্জা পাবা বলতে, আমি বুঝি।একটা কাজ করো মুখে বলতে হবে না ঐ যে বাগানবিলাস ফুল গাছটা দেখছো তুমি যাও, গিয়ে ঐ গাছ থেকে একটা ফুল ছিড়ো।তাহলেই আমি বুঝবো তুমিও আমাকে ভালোবাসো।
ঝিনুক হেসে ছুটে গাছটার কাছে চলে গেলো। মেহেদী আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইলো।
ঝিনুক গাছটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ফুলগুলোর দিকে তাকালো। এরপর, মেহেদীর দিকে তাকিয়ে হাসলো এবং হাত বাড়িয়ে ফুল ছুঁলো,ছিড়ে ফেলার ভান করলো কিন্তু ছিড়লো না।
মেহেদী বিষন্ন হয়ে বললো,আমাকে কষ্ট দিয়ে তুমি এতো মজা পাও কেন? তোমার কি মায়া নাই?
হঠাৎ করে ঝিনুক ঘাসের উপর বসে পড়ল।
মেহেদী প্রথমে ভাবলো ও সবসময়কার মতো নাটক করছে। কিন্তু, পরক্ষনেই খেয়াল করলো ও কাঁদছে।
মেহেদী দৌড়ে এসে ঝিনুকের পাশে বসলো।বলতে লাগলো,এই ঝিনুক কাঁদছো কেন?
ঝিনুক আরো জোরে কেঁদে উঠলো।”আমি শুধু তোমার বউ হতে চাই আর কারো না।”
এই প্রথম মেহেদী কে তুমি করে বললো ঝিনুক।মেহেদীর বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে উঠল।
সে বললো,এর জন্য কাঁদতে হয় নাকি পাগল মেয়ে… তুমি যদি বলো আমি তোমাকে এখনই বিয়ে করে ফেলবো ‌।
ঝিনুক বললো,তাই?এখুনি?এই আকাশ,বাতাস সাক্ষী রেখে,আর এই গাছটাকে কাজী বানিয়ে?
ঝিনুক হেসে উঠলো চোখের পানি মুছে।”আপনি আসলে একটা পাগল মেহেদী গাছ”
মেহেদীর একটু মন খারাপ লাগলো।ও সত্যিই অনেক ইমোশনাল হয়ে পরেছিল ঝিনুকের কান্না দেখে। কিন্তু, ঝিনুকের কান্না হাসির কোনো ঠিক ঠিকানা নেই।এই কাঁদছে,এই হাসছে।
মেহেদী বললো,আসো অন্য কোথাও যাই।
ঝিনুক বললো, কোথায়?
মেহেদী বললো, আমার এক ফ্রেন্ডের বাসায়।
ঝিনুক চোখ বড়বড় করে বললো, আপনার ফ্রেন্ড কি ফ্ল্যাটে থাকে?
~ হুম।নয়তো কই থাকবে?
– আচ্ছা কিছু মনে করবেন না আপনার ফ্রেন্ডের নাম কি লিটন?হাহহা..
মেহেদী ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে পরলো।
~ ঝিনুক শোনো,আমার ফ্রেন্ডের নাম সামিরা..না যেতে চাইলে বলো অন্য কোথাও নিয়ে যাবো..লিটন,ফ্ল্যাট এসব কি শুরু করছো?
– রাগ করছেন কেন?আমি বুঝাতে চাইছি আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন আমি সেখানেই যাবো।এমনকি লিটনের ফ্ল্যাটেও যাবো।
ঝিনুক অপ্রকৃতিস্থের মতো হাসছে।
মেহেদী বললো,চলো বাড়ি যাই। তোমার জ্বর আসছে মেবি আবার..
– মেবি বলছেন কেন?একটু ছুঁয়ে দেখেন না জ্বর আসছে কিনা…নাকি আমাকে ছুঁলে আপনার জাত যাবে?
~ ঝিনুক তোমার কি হইছে বলবা?
– আমি পাগল হয়ে গেছি অধিক শোকে।একে তো ভাইয়া অসুস্থ তার উপর….
~ তার উপর কি?
– তার উপর আমি মেন্দিপাতা কে পাবো না এই দুঃখে পাগল হয়ে গেছি।
~ তোমার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না ঝিনুক।খুলে বলো তো কি হইছে…

– দুঃখের খবর যত দেরীতে শোনা যায় ততোই ভালো…
বলতে বলতে হঠাৎ ঝিনুক ঢলে পরে গেল ঘাসের উপর।
মেহেদী ঝিনুক কে ধরলো। মেয়েটার গায়ে কি ভীষণ জ্বর।পুড়ে যাচ্ছে একদম।
মেহেদীর মায়া লাগলো খুব।
মেহেদী সারাদিনের একটা প্ল্যান করে এসেছিল। এখান থেকে সামিরাদের বাসায় যাবে। সেখানে ঝিনুকের জন্য সারপ্রাইজ গিফট ছিলো।সামিরার বেকারি আছে। সেখান থেকেই মেহেদী ঝিনুক কে প্রপোজ করার জন্য কেক কিনেছিলো। ফুল, বেলুন এসব দিয়ে ঘর সাজিয়ে রাখবে সামিরা বলেছিল।
এরপর, ঝিনুক-কে নিয়ে মেহেদীর প্রিয় রেস্টুরেন্টে আর বিকালে শপিং করতে নিয়ে যাওয়ার প্ল্যান ছিলো।
মেহেদী ডাকলো,এই ঝিনুক… ঝিনুক…এতো জ্বর তোমার তুমি আমাকে বলবা না? এতোক্ষণ এই জ্বর নিয়েই এতো হাসাহাসি করেছো তুমি?
……
……
আপুর এতো জ্বর কিন্তু মায়ের তাতে কোনো বিকার নেই।মা বাদশাহ ভাইয়ার রুমে বসে বসে কাঁদছে আর মালিহা ভাবীকে দোষারোপ করছে।
আমি বললাম,মা ডাক্তার তো বলছে ভাইয়া তো ঠিকই আছে। তুমি খামোখা চিন্তা করছো কেন? ঝিনুক আপুর দিকেও একটু তাকাও….
মা বললো,ঐ মুখপুড়ির ঢং আমি সহ্য করতে পারবো না।ঢং করার জায়গা পায়না। স্বার্থপর কোথাকার… নিজের পরিবারের চিন্তা না করে ছেলে নিয়ে ঘুরতে যায় নির্লজ্জ মেয়ে…
আমি বললাম,মা তুমি এইভাবে কেন বলছো?
– তোর বোনের সব নাটক। বিয়ে ভাঙার জন্য।
আমি অবাক হয়ে গেলাম। বিয়ে মানে কার বিয়ে?
মা পরিষ্কার করে কিছু বললো না।আমি অনেক অনুরোধ করে সবটা জানতে পারলাম বাবার কাছে।
আসলে আমাদের বাড়িটা বাবা আর বড়চাচা মিলে করেছেন। তিনতলার মোট ছয় ইউনিটের তিনটি বাবার আর তিনটি বড়চাচার…তবে,বড় চাচারা অনেক বছর ধরেই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন।তাই,পুরো বাড়িটাই আমার বাবা দেখভাল করেন। বাড়িভাড়াও সবটাই বাবা রাখেন।বড়চাচা কখনো চান না। কিন্তু, এখন কিছু দিন আগে উনি উনার অংশের বাড়িভাড়া চেয়ে বসেছেন। এদিকে আমার ভাইয়ার ও জব চলে গেলো,তার উপর উনার চিকিৎসার জন্যেও টাকা লাগবে।এই মুহূর্তে এমনিতেই আমাদের চলতে হিমশিম খেতে হবে তার উপর যদি বাড়িভাড়াও পুরোটা না পাওয়া যায় তাহলে তো আর কথাই নেই।বাবা সবকিছু বড়চাচাকে বুঝিয়ে বলেছেন। উনি সব শুনে উনার ছেলের সাথে ঝিনুক আপুর বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন বাবার কাছে।
উনার আচরনে বুঝাই গেল উনি তখনই আমাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিবেন যখন বাবা উনার প্রস্তাবে রাজি হবেন।
আরো দুই বছর আগেও তিনি এই প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন।বাবা তখন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।কারণ উনার ছেলে শাহীন একটা নেশাগ্রস্ত….দেশে থাকতেও বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আজে বাজে কাজে মেতে থাকতো।বাবা খুব রাগ করেছিল বড়চাচার উপর যে সে কোন আক্কেলে এই প্রস্তাব টা দিলো।এখনো হয়তো উনি সেই রাগ পুষে রেখেছে।অবশ্য উনার দাবি উনার ছেলে এখন ভালো হয়ে গেছে বিদেশ এসে।
তবে, উনার কথায় সত্যতা আদৌ আছে কিনা আমি জানি না।
বাবা এইবার প্রস্তাবে রাজি হয়েছে।কারণ,বড়চাচা এও বলেছেন তিনি ভাইয়ার চিকিৎসার খরচ বহন করবেন।
এ ছাড়া বাবার কাছে হয়তো উপায়ও ছিল না।
আমার খুব কষ্ট লাগলো খুব….
ইচ্ছা করলো চিৎকার করে কাঁদি….
এই শাহীন ভাই লোকটা যে কতটা খারাপ সেটা আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না।উনি যখন ছাদের ঘরটায় থাকতেন আমি কখনো ছাদে উঠতাম না ভয়ে….
এই ছেলের সাথে ঝিনুক আপুর বিয়ে দিতে চায় বাবা-মা…
আমি আমাদের রুমে আসলাম।
ঝিনুক আপু শুয়ে ছিল।আমি আপুর পাশে শুয়ে পরলাম।আপুকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলাম।
আপু বললো, এমনিতেই আমি জ্বরে মরুভূমি হয়ে আছি তুই আবার ধরাধরি করে গরম টা আরো বাড়াচ্ছিস।
আমি বললাম,আপু তুমি কোনো চিন্তা করো না।আমি বিয়ে ভেঙে দিবো।
ঝিনুক আপু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।”এখনো ছোটই রয়ে গেলি যুথি। সবসময় বোকার মতো কথা বলিস…

চারদিন হাসপাতালে থাকার পর বাদশাহ ভাইয়া বাসায় এসেছে। তার মধ্যে,আর কোনো পাগলামির চিহ্ন দেখা যায় নি।যদিও ডাক্তার-রা ছাড়তে চায়নি। কিন্তু, বাদশাহ ভাইয়া এক প্রকার জোর করেই চলে এসেছে।
তবে, বাসায় আসার পর থেকে তেমন কারো সাথে কথা বলছে না।একা একা রুমে বসে থাকছে সারাক্ষন। মেহেদী ভাইয়া এসেছে আমাদের বাসায় বাদশাহ ভাইয়ার খোঁজ নিতে।আসলে সে ঝিনুক আপুকে দেখতেই এসেছে আমি বুঝতে পারছি।খালি এদিক ওদিক তাকিয়ে ঝিনুক আপুকে খুঁজছে।
একপর্যায়ে আমাকে জিজ্ঞেস ই করে ফেললো, ঝিনুক কই?
আমি কিছু বলার আগেই ঝিনুক আপু গোসলখানার দরজা খুলে মাথা বের করে বললো,বলে দে ঝিনুক সাগরে।
বলেই হাসলো। মেহেদী ভাইয়া জিজ্ঞেস করলো, তোমার মুখে কি হলুদ বাটা দিছো?
ঝিনুক আপু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। মেহেদী ভাইয়া বললো, কেন?
ঝিনুক আপু বললো, কেন আবার মা বললেন রূপ চর্চা করতে।
~তোমার না জ্বর , এখন এই সবের কি দরকার…
ঝিনুক আপু বললো,জ্বর বলে কি বিয়ের কনে-কে অসুন্দর লাগলে চলবে?
মেহেদী ভাইয়া কিছু বললো না।সম্ভবত সে ভেবেছে আপু তার স্বভাব মতো উল্টা পাল্টা কথা বলছে।
বিকালে আমি আর ঝিনুক আপু ছাদে গেলাম।
মেহেদী ভাইয়া আমাদের দেখেই এগিয়ে এলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,যুথি তোমার আপুর সাথে আমার একটু কথা আছে।
আমি লজ্জা পেয়ে খানিকটা দূরে সরে এলাম।
মেহেদী ভাইয়া বললো, ঝিনুক তুমি আর আমার রুমে আসো না কেন?আমি তো চাবি রেখেই যাই।
ঝিনুক আপু বললো, আপনার ঘরে আমি ঢুকবো কিসের জন্য?
মেহেদী ভাইয়া বললো,প্লিজ মজা করো না তো। তুমি আমার সাথে দেখা করছো না,ম্যাসেজ দিলে রিপ্লাই দিচ্ছো না।এমন করছো কেন?
ঝিনুক আপু বললো,আজব তো আপনার সাথে আমার এতো কথা বলতে হবে কেন?
মেহেদী ভাইয়া ঝিনুক আপুর হাত ধরে ফেলল। বললো, তুমি এমন করে কি মজা পাও?একটু সিরিয়াস হও দয়া করে।
ঝিনুক আপু ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো, আপনার তো সাহস কম না, আমার হাত ধরছেন কোন সাহসে? অসভ্য।
ঝিনুক আপু দ্রুত পায়ে হেঁটে ছাদ থেকে নেমে গেলো। মেহেদী ভাইয়া উদ্ভ্রান্তের মতো আমার দিকে তাকালো,বললো, তোমার আপু সারাক্ষন আমার সাথে মজা করে…
আমি বললাম, ভাইয়া আপুর কিন্তু সত্যিই বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।
মেহেদী ভাইয়া মনে হয় বুঝলো না আমার কথা।হেসে বললো, তোমার বোনের এসব ফাজলামির সাথে তুমিও যুক্ত আছো দেখছি।
আমি আর কিছু বললাম না।নেমে চলে এলাম।
ঘরে ঢুকে দেখি আপু একটা বই মুখের সামনে ধরে কাঁদছে।আমার এতো মায়া লাগলো।
আপু আমার দিকে তাকিয়ে বললো,স্যাড একটা উপন্যাস পড়ছি।প্রথম পেইজ পড়েই চোখে পানি চলে আসলো বুঝলি…
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।আপু বইটা উল্টা ধরে আছে।
এমন সময় মা প্রবেশ করলেন রুমে। আপুকে কাঁদতে দেখে বললেন,তোর চোখে পানি কেন?
ঝিনুক আপু বললো,তোমাকে বলে কোনো উপকার হবে না তাই বলতে চাইনা মা।
মা রাগী চোখে তাকালেন,কি উপকার চাস তুই শুনি? মেহেদীর সাথে বিয়ে দিতাম তোকে?বল না বল। জবাব দিচ্ছিস না কেন?
ঝিনুক আপু মাথা নিচু করে বললো,হ্যাঁ আমি ওকে বিয়ে করতে চাই।
মা অদ্ভুত ভাবে হাসলো, বিয়ের দরকার কি তোর? বিয়ের পরের কাজ তো আগেই সাইরা ফেলছিস ঐ ছোকড়ার সাথে।মনে করিস আমি কোনো খবর রাখি না? সারাদিন তুই যে ওর ঘরে থাকিস আমি কি জানি না মনে করছিস?
আমি চেঁচিয়ে উঠলাম,ছিঃ মা তুমি এসব কি বলছো?
মা আমার দিকে তাকালেন,তোর সাথে কথা বলছি আমি?তুই বের হ এখান থেকে….
ঝিনুক আপুর চোখে পানি টলমল করছে।
-কিরে জানোয়ার তোর চোখে পানি আসে কেন এত?
তোর সাত কপালের ভাগ্য তুই শাহীন কে বিয়ে করে উন্নত একটা দেশে থাকবি বুঝছিস? দুই দিনের পরিচয়ের ছেলের জন্য কান্দিস? মায়ের থেকেও বেশি হয়ে গেলো এই ছেলে?
ঝিনুক আপু বললো, তোমার আচরণ দেখে তো মাঝে মাঝে ভুলেই যাই তুমি আমার মা।
মা হঠাৎই খুব হিংস্র হয়ে উঠলো।
কিছু বুঝে উঠার আগেই আপুর চুল ধরে এলোপাথাড়ি কয়েকটা চড়-থাপ্পড় মারলো।
বাদশাহ ভাইয়া পাশের ঘর থেকে ছুটে এসে ঝিনুক আপুকে জড়িয়ে ধরলো।
নাহয় আজকে আপুর খবরই ছিলো।মা আপুর দিকে তাকিয়ে বললো, সুন্দর ভাবে সেজে গুজে হাসিমুখে থাকবি।কালকে তোর চাচারা আসবেন,কোনো ধরনের বেফাঁস কথা যদি তোর মুখ দিয়া বেরোয় আমি যে তোরে কি করবো ঝিনুক…
মা বের হয়ে গেলেন ঘর থেকে।
বাদশাহ ভাইয়া বললো,কি করছিস তুই?মা কেন তোকে মারলো?
ঝিনুক আপু বললো, কেন ভাইয়া?মা কিছু করতে পারে না? তোমার কেন মনে হয় আমিই কিছু করছি…আগেও তুমি সবসময় এমনই করতা।মালিহা ভাবী কিছু বললেই…….
আমি আপুকে চুপ করিয়ে দিলাম।
বাদশাহ ভাইয়া আর কিছুই বললো না। নিজের ঘরে চলে গেল।
.
পরদিন বাসায় তোড়জোড় চলতে লাগল।মা রান্না বান্না করছে।আমিও মাকে সাহায্য করছি।
বড় চাচা,চাচি আর শাহীন ভাইয়া এলেন সন্ধ্যায়।
ঝিনুক আপুকে পরী আপু এসে সাজিয়ে দিলো।
বাবা মন খারাপ করে বসে রইলো বারান্দায়।আমি আর মা বাবাকে ডাকতে গেলাম।দেখি বাবার চোখে পানি।বাবা বললো, শেষমেশ এ ছিলো আমার ঝিনুকের কপালে।একটা আস্ত লম্পট ও….
মা চেঁচিয়ে উঠলেন, তোমার মেয়ে কি ধোয়া তুলসী পাতা?কত বড়লোক ওরা তোমার ধারনা আছে? তোমার মতো তো ফকির না। ঝিনুকের ভাগ্য যে শাহীন ওকে পছন্দ করে।
বাবা মিনমিন করে বললো, আমার মেয়েটাকে বিদেশে নিয়ে মেরে ফেললেও তো আমি জানবো না।
হঠাৎ,শাহীন ভাইয়া বারান্দায় আসলো।
হাসি মুখে বললো,কি চাচা,এখন থেকেই কান্না শুরু করে দিয়েছেন…এখনো তো বিয়েই হয় নি।
আমি অবাক হলাম খুব…এতো বছর পরে কথা বলছে,না সালাম না কোনো কুশল বিনিময়।
শাহীন ভাইয়া তাকালো আমার দিকে।যেন বিষধর সাপের চাহনি।
হুট করে একটা ভয়াবহ স্মৃতি মনে পরলো আমার।তখন আমি অনেক ছোট। বাসার সবাই অর্থাৎ আমাদের আর শাহীন ভাইয়াদের পরিবার ফুপুর বাড়িতে গেছে। ফুপুর বাড়ি বেশি দূরে না। আমার বোরিং লাগছিল দেখে আমি চাবি নিয়ে বাসায় চলে আসি। হঠাৎ দেখি বড় চাচাদের ফ্ল্যাটে তালা নেই,ভিতর থেকে লক। উনাদের ফ্ল্যাট নিচ তলায় ছিলো।তাই, কৌতুহল বশত জানালার একটা ছোট ছিদ্র দিয়ে উঁকি দিই।দেখি শাহীন ভাই আর একটা মেয়ে ঘরের মধ্যে।বুঝাই যাচ্ছে মেয়েটাকে উনি জোর করে ধরে নিয়ে এসেছে।মেয়েটার মুখ বাঁধা ছিল।আর, শাহীন ভাইয়াকে দেখাচ্ছিলো একটা পশুর মতো।
সেই দৃশ্য আমার ছোট মনে কত প্রভাব ফেলেছিল আমি বলে বুঝাতে পারবো না। শাহীন ভাইয়ার কুকীর্তির অনেকখানি ই তার বাবা মা জানতো কিন্তু, কিছুই বলতো না। আবার,বললেও শাহীন ভাই পাত্তা দিতো না।কয়েক বার পুলিশের হাতেও পরতে হয়েছিল তাকে। ছাদের ঘরে প্রায়ই বন্ধু বান্ধব এনে মদ্যপানের প্রতিযোগিতা চলতো।এইসবই তো মা দেখেছেন। সবাই দেখেছে।তবুও, এখন নাকি বিদেশে গিয়ে শাহীন ভাই পুরো বদলে গেছেন। একদম খাঁটি মানুষ হয়ে গেছেন।আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কুকুরের লেজ কি সোজা হয় কখনো?
বড় চাচা,চাচি বসার ঘরে বাবা মায়ের সাথে কথা বলছেন। তাদের কি কি স্বয়-সম্পত্তি হয়েছে সেইসব শুনাচ্ছেন আরকি।
হঠাৎ দেখি শাহীন ভাইয়া আমাদের রুমে প্রবেশ করলো। আমার আর আপুর দু’জনের ই কলিজা কেঁপে উঠলো।
শাহীন ভাইয়া হাসলো।কি কুৎসিত সেই হাসি।
বললো,কি ব্যাপার তোরা দুই বোন আমাকে দেখে এমন চুপসে গেলি কেনো?
আমরা কিছুই বললাম না। শাহীন ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে বললো,যা তো আমার আর ঝিনুকের জন্য দুইকাপ কফি বানিয়ে আন…নাকি তোদের বাসায় কফি নাই?হাহাহ…
আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না উনি আমাকে এই ঘর থেকে সরাতে চাইছে। ঝিনুক আপুরও বুঝতে বাকি রইলো না।আপু আমার দিকে অসহায় ভাবে তাকালো।তার দৃষ্টি বলে দিচ্ছে আমাকে এঘর থেকে না যেতে।
শাহীন ভাইয়া অগ্নিগরম চোখে আমার দিকে তাকালো। কিন্তু,মুখে ঠিকই হাসি আছে।”কিরে যুথি কফি অনতে বললাম না।যা…”
আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেরিয়ে যেতে লাগলাম।
শাহীন ভাইয়া আমাকে পিছু ডেকে হেসে বললো,কফি নিয়ে আবার দুই মিনিটের মধ্যেই চলে আসিস না বোকার মতো কেমন?
আমি কিছু না বলে বেরিয়ে এলাম। দাঁড়িয়ে রইলাম দরজার কাছেই। কিচেন এ গেলাম না আপু কে ফেলে।
শাহীন ভাইয়া ঝিনুক আপুকে বললো,তো ঝিনুক তোকে তো আবার তুমি বলতে করে বলতে হবে রাইট?
আচ্ছা,ঠিকাছে বলো জান তোমার তেজ কি এখনো আছে?নাকি এখন নিস্তেজ হয়ে গেছো?অবশ্য মেয়ে মানুষের তেজ দেখতে আমার ভালোই লাগে।
ঝিনুক আপু বললো,মানে বুঝতে পারছি না।
– মানে না বুঝার তো কিছু নেই। আমার নামে পুলিশের কাছে সাক্ষী দিয়েছিলা আমি মেয়ে আনছি বাসায় ভুলে গেছো? আবার আমাকে বলছিলা আমি কুকুরের চেয়েও নিকৃষ্ট মনে নাই? এখন তো সেই কুকুরের বউ হবা তুমি… তোমার জন্য মায়াই লাগছে ঝিনুক। হাহা।
ঝিনুক আপু চুপ করে বসে রইলো। কোনো প্রতিউত্তর করলো না।
শাহীন ভাইয়া-ই আবার বলে উঠলো, এই গরমের মধ্যে ওড়না পেঁচিয়ে আছো কিসের জন্য?ওড়না সরিয়ে বসো আমার সামনে লজ্জা করে লাভ কি….
এরপর এমন একটা কুৎসিত কথা বললো যেটা আমার কানে আসার পর আমি আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। আমার সারা শরীর কেঁপে উঠলো।
আমি ছুটে বসার ঘরে চলে এলাম।
মা কে ডেকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললাম,মা শাহীন ভাইয়া আপুর রুমে বসে আছে কেন? বের হতে বলো।
মা নিস্পৃহ ভাব নিয়ে বলে উঠল, বিয়ের ডেট ফিক্সড হয়ে গেছে।এখন বসে থাকুক নাহয় শুয়ে থাকুক তুই দেখতে যাস কিসের জন্য?
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।”মা তুমি যে এমন আমি কল্পনাই করতে পারিনি।”
– কেমন আমি? খারাপ? তোর বোন ভালো? মেহেদীর সাথে রুমের মধ্যে ঢলাঢলি করছিল আর তুই বাইরে দাঁড়িয়ে পাহাড়া দিচ্ছিলি কই তখন তো এসে বলিস নি আমাকে….
আমি বললাম, চুপ করো মা। তোমার কন্ঠ শুনতেও আমার মন চাচ্ছে না।
– শোন যুথি। বিয়ের পর সুখে থাকতে হলে একটা জিনিস ই লাগে সেটা হলো টাকা।যেটা বিয়ের আগে তোদের বয়সী ছেলে মেয়েরা বোঝে না…
-প্লিজ তুমি যাও।
মা চলে গেলেন। হঠাৎ দেখি শাহীন ভাইয়া দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।
আমি অসহায় ভাবে তাকিয়ে থাকলাম।
বসার ঘরে সবাই কথা বলছিল ,সেখানে গিয়ে আমি দাঁড়ালাম। হঠাৎ করেই,দরজায় কে যেন পাগলের মতো বেল বাজাতে লাগলো।
মা গিয়ে দরজা খুললো। মেহেদী ভাইয়া হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলো।মা বিরক্ত হয়ে বলল,এখন যাও তুমি মেহেদী।পরে এসো…
আমি ই মেহেদী ভাইয়া কে ম্যাসেজ পাঠিয়েছিলাম।
মেহেদী ভাইয়া চেঁচিয়ে উঠলো,”ঝিনুক কই?কই আমার ঝিনুক?”
.
চলবে,,