Saturday, June 28, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1071



ধূসর অনুভূতি পর্ব-০৯+১০

0

#ধূসর অনুভূতি
পর্ব:০৯+১০
লেখক-শাপলা

মালিহা সবকিছু ভুলে নতুন করে জীবন শুরু করতে চাইছে। তার মা তাকে বুঝিয়েছে,কোনো কিছুর জন্যই জীবন থেমে থাকেনা।মালিহাও ভাবে একটা ভুল করে সেটার জন্য যদি সারাজীবন আফসোস করে কাটে তাহলে আর জীবনের কি বাকি থাকে।
ফারহান যদিও তার সাথে তেমন ভালো ব্যবহার করে না। তবুও মালিহা সবটা মেনে নিয়েছে। মেনে না নেওয়া ছাড়া আসলে তার করার কিছু ছিলও না।সকালে আর বিকালে রান্না-বান্না করে।ঘরের মেঝে পরিষ্কার থাকলেও আবার মোছে। অর্থাৎ,কোনো কাজ করে নিজেকে ব্যস্ত রাখা আরকি। সবশেষে বারান্দায় বসে থাকে।অলস-ক্লান্তিকর একেকটা দিন।কথা বলার কেউ নেই।মালিহার ফোন নষ্ট হয়ে গেছে।একটা ফোন কিনবে;এই কথা সে ফারহানকে বলতে পারে না ভয়ে।
দিনের বেলা তার ঘুমও আসে না। ফারহান অনেক রাত করে বাড়িতে আসে।এতো রাত পর্যন্ত তো অফিস থাকে না।ও কোথায় থাকে কে জানে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয় হয়তো।মালিহা জিজ্ঞেসও করে না। ফারহান বলেও না।তবে,কোনো কোনো দিন বাসায় এসে গল্প করে মন ভালো থাকলে।মালিহার ভীষণ ভালো লাগে।
আর, বেশিরভাগ দিনই কোনো কথা বলে না দরকার ছাড়া।
এইতো এভাবেই একটা অদ্ভুত জীবন কাটাচ্ছে মালিহা।
ইদানিং মালিহা একটা জিনিস লক্ষ্য করেছে,কারো কাছাকাছি থাকলে সেই মানুষটার দোষগুলোই শুধু আমাদের চোখে পড়ে। কিন্তু,যখন দূরত্ব সৃষ্টি হয় তখন অনেক সুন্দর স্মৃতি মনে পড়ে,গুন গুলো মনে পড়ে।মনে হয়,মানুষটা তো এতোটাও খারাপ ছিল না।
যেমন: ইদানীং যেই ঝিনুক,যুথিকে মালিহার অনেক অসহ্য লাগতো তাদের কথাও খুব মনে পড়ে।ওরা, ক্লাস থেকে এসেই ভাবী ভাবী করে মাথা ব্যথা বানিয়ে ফেলতো। সারাদিন কলেজে কি কি করেছে সব তার সাথে গল্প করতো। কোনো কোনো দিন হয়তো মালিহার মন থাকতো না এইসব গল্প শোনার।তাই,মালিহা বলতো, এখন ভাল্লাগছে না।পরে শুনবো।
ওরা বলতো,না…না দুই লাইন শোনো আর।
এইভাবে কত কথাই না বলে ফেলতো।কেমন অদ্ভুত ধরণের ছিল ওরা।কিছু কিনলেই ভাগ বসাতো।আমাকে দাও-বলার জন্য এক মূহুর্ত ভাবতে হতো না ওদের।
যখন তিতলি হবে তখন তার শ্বাশুড়ি আরো কয়েকজন বয়স্ক মহিলাকে নিয়ে আসলো,বললো,ঘরেই বাচ্চা হবে কোনো হাসপাতাল যাওয়া যাওয়ির দরকার নেই। আমাদের সব বাচ্চা তো ঘরেই হইছে।আমরা কি মরে গেছি।মালিহার তখন কি অসহ্য যন্ত্রনা।মনে মনে ভয়ও লাগছে;মৃত্যুভয়…. কিন্তু, তার শ্বাশুড়ি তো হাসপাতালে যাওয়ার ঘোর বিরোধী।গেলেই বস্তা বস্তা টাকা দিতে হবে।
তখন, ঝিনুক আর যুথির সেকি কান্না।ভাবীকে হাসপাতালে নিতেই হবে।নাহলে ভাবী মরে যাবে।
ওদের কান্নাকাটির জন্য অবশেষে হাসপাতালেই তিতলি হলো।
ওরা সম্ভবত খারাপ ছিল না। হিংসুটে তো আরো আগে ছিল না। তবুও ওদের তখন কেনো ভালো লাগতো না?মালিহা ভালো লাগা-না লাগার কারণগুলো বের করে ঘরে বসে বসে।তার তো অফুরান সময় এখন,ভাবনা-চিন্তা ছাড়া কিইবা করার আছে।
যুথি মেয়েটা অনেক ভালো ছিল।মালিহা কত বার যে যুথির কাছে, বাদশার নামে আজেবাজে কথা বলেছে।বলেছে, তোমার ভাই অমানুষ, জানোয়ার আরো কত দূর্নাম। কিন্তু,যুথি কখনোই এসব কথা তার ভাই বা মাকে বলে ঝগড়া বাঁধাতো না। চুপ করে শুনতো।
ঝিনুক অবশ্য এতোটাও সহনশীল ছিল না।খালি কথায় কথায় ভুল ধরতো,ভাবী তোমার এই কাজটা ভুল….
তবে,মালিহা ঘুরিয়ে জবাব দিলে ঝগড়া করতো না।
এটা ভালো অভ্যাস ছিল। ওদের ভালো না লাগার কারণ হলো,ওরা মালিহার সব জিনিস নিজের ভাবতো।মালিহার কত শখের জিনিস যে ওরা নষ্ট করে ফেলেছে হিসাব নেই।এতো সুন্দর আয়না যেটা মালিহার মামা মালদ্বীপ থেকে এনে দিয়েছে সেটা দুই দিনের মধ্যে ওরা ভেঙে ফেললো।”কি সুন্দর..কি সুন্দর”- বলে দেখতে গিয়ে হাত থেকে ফেলে দিলো।
ইচ্ছা করে তো আর ভাঙে নি তাই কিছু বলাও যায় না। ভেঙেই স্যরি স্যরি বলতে লাগলো।মালিহা দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল,স্যরি বললেই কি এখন আমার জিনিস টা ফেরত আসবে?
ওরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে অবাক হয়ে বললো,ভাবী তুমি কি রাগ করেছো?
যেন রাগ করাটাই অনুচিত।মালিহা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলেছিল,নাহ করিনি।
এরপর, ওদের মধ্যে একজন বলে উঠল, চিন্তা করো না ভাবী… তোমাকে নিউ মার্কেট থেকে এর চেয়ে সুন্দর একটা এনে দিবো।
মালিহার যে কি রাগ লেগেছিল তখন।এরা এমন নির্বোধ কেন?মন চাইছিল চড় মেরে দাঁত ফেলে দিতে।
কি পরিমান অধিকার যে এরা ফলাতো।রাত ১২টার সময় বলতো,ভাবী একটু চা বানিয়ে দেও তো।
মালিহা বিরক্ত হয়ে বাদশাহকে বলতো, তোমার বোন কি সামান্য একটু চা-ও বানিয়ে খেতে পারেনা?
বাদশাহ বলতো, সামান্য চা ইতো।বানিয়ে দিলেই পারো।আর নাহয় বলে দেও নিজেই যেন বানায়।এটা নিয়ে এতো কথা বাড়াও কেন?
মালিহা বলতো,কোন আক্কেলে এতো রাতে চা বানাতে বলে?
বাদশাহ বলতো,ওরা এমনই। ছোট তো ,বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে।
মালিহার কি প্রচন্ড বিরক্তি লাগতো।এরা নাকি ছোট….
অবশ্য মালিহা না বানিয়ে দিলে কোনো অভিযোগ করতো না। কিন্তু,বানাতে বলবেই বা কেন? নিজের কি হাত নেই….
মালিহা পুরানো কথা আর ভাবতে চায় না। কিন্তু, তবুও মনে পরে।মালিহার শ্বশুর অবশ্য ভালোই ছিল। মাটির মানুষ।কোনো কিছুতেই থাকতেন না।
মালিহাকে তুই করে বলতো।ঠিক যেভাবে ঝিনুক,যুথিকে বলে সেভাবে।”এই মালিহা এদিকে আয়।” “তোর মা কই? জাঁদরেল মহিলাকে কোথাও দেখছি না যে আজ..” “একটু পত্রিকা টা পড়ে শোনাবি? ঝিনুক কে বললাম, ফাজিল মেয়ে বলে, তুমি কি নিরক্ষর?নিজে পড়ো।”
লোকটা একদম সহজ সরল ছিলো। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হতো শ্বাশুড়ি কে নিয়ে।এই মহিলা সর্বক্ষন শুধু ভুল ধরতো। ভুল ধরে যে কি আনন্দ পেতো।খালি কথা শোনাতো।এটা করোনা,ওটা করোনা। এখানে যেও না, সেখানে যেও না।
আর, বাদশাহ কে বললে তো কোনো লাভ নেই। তার বউ আরো অপমানিত হলেও সে বলবে,মা একটু এমনই।রাগ বেশি।দেখো না, আমাকে,ঝিনুক-যুথিকেই সারাক্ষন ধোলাই এর উপর রাখে।তাও তো তোমাকে কমই বলে।আমাকে কলেজে পড়াকালীনও ঝাড়ুর বারি দিতো…হাহা!
মালিহার রাগে শরীর জ্বালা করতো।এ কেমন কথা… তিনি রাগী বলে যা নয় তাই বলবে,আর সেটাকে সহ্য করতে হবে?
বাদশাহ বলতো, তোমাদের বউ, শ্বাশুড়ির বিষয় তোমরা মিটাও।আমি যদি ইন্টারফেয়ার করি মা ভুল বুঝবে।ভাববে,ছেলে তাকে পছন্দ করে না।বউয়ের পক্ষ নেয়। মায়েরা এইসব বিষয়ে খুব সেন্সিটিভ। তুমি ই ভালোর সময় বুঝিয়ে বইলো যে,মা আপনি যে আমাকে এতো কথা শোনান, আমার কষ্ট হয়।
মালিহা বিরক্ত হতো।এই কথা বললে তার শ্বাশুড়ি আরো বেশি কথা শোনায় দিবে।
অন্য সবাই যেমনই ছিল এই মহিলা একটু বেশি ই ছিল।
কিন্তু,সবার কথা ভুলা গেলেও তিতলিকে তো ভোলা যায় না কিছুতেই। গোলগাল মুখ,নরম তুলতুলে গাল। সবসময় গালে আঙুল দিয়ে ইশারা করে বুঝাতো তাকে চুমু খাওয়ার জন্য।
ইশ কতদিন মেয়েটাকে চুমু খাওয়া হয় না! গল্প বলার সময় চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে থাকতো।কি তার মনোযোগ….
ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে মাকে ঝাপটে ধরে রাখতো।একটা পুতুলের মতোই লাগতো মেয়েটাকে।
মালিহা চলে আসার দশ-পনেরো দিন আগে তিতলি একদিন রাতে জেগে ওঠে।তাকে ডেকে বলে,মা আমি স্বপ্নে দেখলাম তুমি আমাকে ফেলে চলে গেলা।
সেকি কান্না মেয়েটার। এরপর, ঘুমানোর সময়ও মায়ের লম্বা চুল ধরে ঘুমায়।তার ধারণা, চুল ধরে থাকলে মা আর যেতে পারবে না। ঘুম ভেঙে সকালে উঠেই মাকে খুঁজতো।
মালিহার বুকটা ফেটে যায়।ইশ! সে কিভাবে পারলো তিতলিকে ফেলে চলে আসতে।
মালিহা চিৎকার করে কেঁদে ওঠে।তিতলি রে….তিতলি। তুই কই মা?
তিতলি কিছু কিছু শব্দ ঠিক ভাবে বলতে পারতো না।আঙুর কে বলতো আংগুল।বলতো,মামনি আংগুল খাবা?
মালিহার খুব হাসি আসতো।সে সত্যিই আস্তে করে তিতলির ছোট্ট আঙুলে কামড় দিয়ে দিতো।
তিতলি চেঁচিয়ে উঠতো,আরে এই আংগুল না গাছের আংগুল।
আর, মোমবাতি কে বলতো বোমবাতি।এমনি ম উচ্চারণ করতে পারতো। শুধু মোমবাতি পারতো না। অন্ধকার খুব ভয় পেতো। কারেন্ট গেলেই চেঁচাতো,বোম জ্বালাও….বোম জ্বালাও।
বাদশাও অন্ধকার ভয় পেতো। ওদের রুমে রাতেও বাতি জ্বলতো।একটু কম পাওয়ারের।মালিহার ভালো লাগতো না।সে সবসময় নিকষ অন্ধকারে ঘুমিয়েছে।
গরম কালে ঘনঘন ইলেকট্রিসিটি চলে যেতো, বিশেষ করে রাতে।এই প্রচুর গরমের মধ্যেও বাদশাহ তাকে জড়িয়ে ধরে রাখতো।মালিহা বিরক্ত হলে বলতো, ইলেকট্রিসিটি আসুক। আমার অন্ধকার ভয় লাগে।
এক সাইড দিয়ে বাদশাহ আরেক সাইড দিয়ে তিতলি জড়িয়ে ধরে রাখতো। কাউকেই ছাড়ানো যেতো না এমন শক্ত করে ধরতো….!!
এখন কই সেই শক্ত বাঁধন?

……..
……..
আমি ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে দেখি ঝিনুক আপু কোথাও নেই।
মা কেমন থমথমে মুখে ঘরের কাজ করছে ‌।
মাকে জিজ্ঞেস করায় মা বললো, ঝিনুক আপুর নাকি এক্সট্রা ক্লাস আছে,যাওয়ার সময় বলে গেছে।
মা অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো,কেন তুই জানিস না।ও তো তোর গুরু…
আমি বললাম,ইয়ে মানে জানতাম, ভুলে গেছি।
এরপর ভাবতে লাগলাম আপু কই গেল? বাসায় যদি না আসে। হঠাৎ মনে পড়ল,ছাদে?এই রোদের মধ্যে।
ছাদে উঠে মেহেদী ভাইয়ার রুমের জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি আপু উনার রুমে। খাটের উপর বসে বসে কি যেন খাচ্ছে।
আমি বললাম,আপু তুমি এইখানে?
ঝিনুক আপু বললো, ভালো লাগছে না রে তাই এসে বসে আছি।গাধাটা এখন ঘরের চাবি ঐ গাছটার টবের নিচে রেখে যায়।
আমি বললাম, কিন্তু তুমি এখন এখানে বসে আছো কেন?
ঝিনুক আপু বললো,ঘরে গিয়ে মায়ের চেঁচামেচি শুনতে ভাল্লাগে না।
আমিও রুমে ঢুকে আপুর পাশে বসলাম।আপুকে কেমন বিষন্ন দেখাচ্ছে।
আমি বললাম,কি হইছে তোমার আপু?
আপু কোনো উত্তর না দিয়ে বললো,আচার খাবি?
বলেই তার হাতে থাকা কাঁচের শিশিটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলো।
আমি বললাম,আপু তুমি এটা মেহেদী ভাইয়ার ঘর থেকে নিছো?উনি তো বুঝে যাবে কেউ উনার ঘরে ঢুকছে।
ঝিনুক আপু বললো,জানিস আমি ওকে অনেক গুলো চিঠি দিয়েছি ডাকিনী সেজে।ঐ যে ও আমার স্কেচ আঁকলো।এরপর আমি ওকে আরেকটা চিঠি দিছিলাম। তোদের কে বলিনি।ঐ চিঠিতে লিখছিলাম,আমি আসলেই ভূত… কেন সে এই শামুক-ঝিনুক মেয়ের ছবি আঁকছে এর জন্য আমি রাগ করছি।
এরপর,ও আমাকে একটা চিঠি লিখছে।আর, অনেক গুলো চকলেট ঘরে রেখে গেছে আমার জন্য।আর,লিখছে এরপর থেকে রুমের চাবি গোলাপ গাছের টবের নিচে রাখবে। খাটের উপর চাবি রাখা সেইফ না।
আর, আমি প্রতিদিন এই রুমে আসি। তোদের কে বলিনি।
আমি অবাক হয়ে বললাম,কি করতে আসো আপু?
আপু যেন আমার প্রশ্ন শুনতেই পেলো না।বলতে লাগলো,
– আমি প্রতিদিন ওকে ডাকিনী সেজে চিঠি লেখি….লিখি, আঁমাঁর জঁন্য চকঁলেটঁ আনঁবিঁ….
আর,ও সত্যি সত্যি আমি যা লিখি তাই এনে ঘরে রেখে যায়। যেমন,কালকে লিখেছি আচার আনতে।ও এই আচারের শিশিগুলো কই থেকে যোগাড় করেছে কে জানে?
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। বললাম, রুমে আসো আপু।
ঝিনুক আপু বললো,দাড়া যাওয়ার আগে ওর রুমটা অগোছালো করে দিয়ে যাই।তাহলে ভাববে আমি আসলেই ভূত।
সত্যি সত্যিই আপু বিছানাটা অগোছালো করে ফেললো।বইগুলো এনে খাটের উপর রেখে দিলো।
আমি বললাম,আপু তুমি কেন এসব করো? তুমি নিজেও বুঝছো মেহেদী ভাইয়া জানে তুমি ই ভূত সেজেছিলে ‌।আর,এখনো যে তুমি উনার ঘরে আসো সেটাও উনি জানে।এবং, উনি যে সব জানে সেটা তুমিও জানো।তাহলে, কেন সবকিছু অগোছালো করলে?
ঝিনুক আপু হেসে ফেললো।বললো,ওকে জ্বালাতে আমার ভাল্লাগে…
এরপর, রুম থেকে বের হওয়ার সময় হঠাৎ পরে যাচ্ছিল।
আমি আপুকে ধরলাম। দেখলাম আপুর গায়ে জ্বর।
আমি বললাম , তোমার কি হইছে আপু?
আপু বললো, আমাদের অনেক দুঃখ রে!
– কি হয়েছে বলো না…
– জানবি সবই। দুঃখের খবর যত দেরীতে জানা যায় ততই ভালো। একটা কাজ করতে পারবি যুথি…
– কি আপু?
– তুই তোর মেহেদী ভাইয়া কে বলবি কাল যেন ও ক্লাস না করে আর আমাকে নিয়ে ঘুরে সারাদিন। আমার বলতে লজ্জা লাগে। তুই বলিস। আবার,এটা বলে দিস না যে আমি তোকে শিখিয়ে দিছি।এমন ভাবে বলবি যেন আমার মন খারাপ দেখে তুই নিজে থেকেই উনাকে বলছিস কেমন?ক্লাস তো সারাজীবন করতে পারবে,আমাকে নিয়ে কি আর সারাজীবন ঘুরতে পারবে বল…..
বাসায় ফিরে আপু ঘুমিয়ে পরলো।
মা আজকে একদম চেঁচামেচি করছে না।কেমন যেন হয়ে আছে। হঠাৎ বললো,জানিস যুথি বাদশার চাকরিটা চলে গেছে।

মা বললো, বাদশাহ ভাইয়ার চাকরি চলে গেছে।কথাটা আমার কানে পৌঁছেও যেন পৌঁছালো না।ভাইয়াই আমাদের সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।বাবা আগে ছোট খাটো ব্যবসা করতো কিন্তু,ভাইয়া চাকরি পাওয়ার পর থেকে আর কিছু করে না। শারীরিক ভাবেও তিনি ততো সুস্থ নন। ভাইয়া মোটামুটি একটা ভালো অঙ্কের টাকাই বেতন পেতো।যদিও চাকরি টা সরকারি নয়।তবে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হলেও হুটহাট করে কর্মীদের ঝেড়ে ফেলা হয় না সেখানে।আর, ভাইয়া তো ভালো পোস্টে ছিল,কাজের প্রতিও তার যথেষ্ট সিনসিয়ারিটি ছিল।
আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু ভাইয়ার দোষ টা কি মা?
মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, তোর ভাইয়া নাকি পাগল হয়ে গেছে।ডাক্তার বলেছে। অফিসে বেশ কয়েকটা কম্পিউটার ভেঙে ফেলেছে সে। ডিসথমনিয়া না কি যেন বললো একটা মেন্টাল ডিসঅর্ডার….
আমার বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটছেই না।আমি বললাম, ভাইয়া কোথায় এখন মা?
মা বললো,ক্লিনিকে আছে।অফিস থেকে পাঠাইছে।
আমি অবাক হয়ে রইলাম। ভাইয়ার একি অবস্থা।না চাইতেও চোখের জল গড়িয়ে পরলো।
আমি বললাম,মা..আমি ভাইয়ার কাছে যাবো।
মা বললেন,যা।আমি কি ধরে রাখছি?
কি নির্লিপ্ত ভাবে কথা বলছে মা।যেন আমি কোন বান্ধবীর বাসায় যেতে চাইছি।
মায়ের থেকে জেনে আমি চলে গেলাম হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে দেখি বাবা আছে, মেহেদী ভাইয়া আর আরমান আংকেলও আছে।বাবা কাঁদছে আস্তে আস্তে। মেহেদী ভাইয়া বাবাকে শান্তনা দিচ্ছে।
আমাকে দেখে বাবা আরো জোরে কান্না করে ফেললো।উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
আমি বললাম,বাবা ভাইয়ার কিছুই হবে না।
ভাইয়াকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে।ডাক্তার বলেছেন, ভাইয়া অত্যাধিক মানসিক কষ্ট পেয়েছে যেটা সহ্য করা তার পক্ষে সম্ভব হয় নি। এরপর, তিনি ঠিকমতো না ঘুমিয়ে, নিজের যত্ন না নিয়ে রোগটাকে ডাল-পালা গজাতে সাহায্য করেছে।
যখন কেউ মানসিক কষ্টের মাঝে দিয়ে যায় তখন সবার উচিৎ সেই মানুষটাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করা,সময় দেওয়া।বড় কষ্ট পাওয়ার পরও যখন মানুষ হাসে, স্বাভাবিক জীবন যাপন করে নিজে থেকেই তখনি বুঝতে হবে ঘাপলা আছে। শরীরের যেমন যত্ন নিতে হয় মনেরও তেমন যত্ন নিতে হয়।
আমি ডাক্তারকে থামিয়ে বললাম, আমার ভাই কি পাগল হয়ে গেছে?
ডাক্তার বললো,হয়নি। তবে,কিছুদিন ভর্তি থাকতে হবে। পর্যবেক্ষনে রাখা হবে তার আচার আচরণ সবকিছু।
আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন চারপাশ অন্ধকার দেখছি। দরজার উপরে থাকা কাঁচের অংশ দিয়ে তাকালাম। দেখলাম, ভাইয়া নিষ্পাপ শিশুর মতো ঘুমিয়ে আছে।
রুমের মধ্যে ঢুকতে আর মন চাইলো না।
ক্লিনিকের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
একসময় দেখি মেহেদী ভাইয়া এসে দাঁড়িয়েছে আমার পাশে।
মাথা নিচু করে বললো,মন খারাপ করো না যুথি। বাদশাহ ভাইয়া ঠিক হয়ে যাবে।
আমি বললাম,ঠিক যদি হয়েই যাবে তাহলে চাকরি চলে গেল কেন?
মেহেদী ভাইয়া বললো,কারণ ঠিক হওয়াটা একটু সময়ের ব্যাপার তাই। প্রাইভেট কোম্পানির কি এতো সময় আছে…তবে ঠিক যে হবে এইটা শিওর।
আমি বললাম,একটু সময় বলতে কত সময় সত্যি করে বলবেন প্লীজ….
মেহেদী ভাইয়া করুন চোখে তাকালো।বললো,হয়তো একমাস হয়তো বা একবছর।
আমি মুচকি হেসে বললাম, ধন্যবাদ ভাইয়া।সত্যিটা বলার জন্য।
এরপর বললাম, ঝিনুক আপু বলেছে আপনি যেন তার সাথে কালকে একটু ঘুরতে যান। তিনি খুশি হবে।
লক্ষ্য করলাম, ঝিনুক আপুর নাম শুনে মেহেদী ভাইয়ার বিষন্ন মুখে এক মুহুর্তের জন্য আনন্দের রেখা ঝিলিক দিলো।
পরক্ষনেই বললো, কিন্তু বাদশাহ ভাইয়ের এই অবস্থা….
আমি বললাম,এক ঘন্টার জন্য যাইয়েন। আপুর মনটাও খারাপ।মনটা ফুরফুরে হবে একটু।
মেহেদী ভাইয়া হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।হ্যা ঠিকই বলেছো।
জানি না কেন একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আমার বুক থেকে।
কিছুক্ষণ পর ডাক্তার এলো।খানিকটা ধমকের স্বরে বললো, মানসিক রোগীর সাথে আত্মীয়দের দেখা করানো হয় না।তাই, দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই।
আমরা যেন বাসায় যাই। তিনদিন পর আসি।উনারা তিন দিন রোগীর কাছে কাউকে এলাউ করবেন না।
আমি বাড়ি ফিরে এলাম ভগ্ন হৃদয় নিয়ে।
বাবা ক্লিনিকের বাইরে বসেই রইলো।আসলো না কিছুতেই। মেহেদী ভাইয়া তার সাথে রইলো।
আমি চলে এলাম। হাসপাতাল আমার দোজখের মতো লাগে।উফ কি কষ্ট…কি ভীষন অসহ্য আহাজারি-আর্তনাদ মানুষের।ডাক্তার-নার্স গুলো কি হৃদয়হীন। আমাদের মতো ভাঙা হৃদয়ের মানুষদের ধমক দিয়ে কথা বলে…
বাসে করে বাসায় ফিরছি।এক উগ্র ধরণের লোক আমার পাশের সিটে বসলো। চুল খানিকটা বড়, হাতের দশ আঙুলে দশটা আংটি।লাল চোখ আর পরণে কেমন ধরণের ছিড়াফাড়া পোশাক। এইগুলো তো আবার আজকালকার যুগের ফ্যাশন।লোকটা সিগারেট ফুঁকছে আর ফোনে কার সাথে যেন ঝগড়া করছে।
আমি বললাম,ভাই পিছনের সিট খালি ওখানে বসেন।
লোকটা প্রচুর বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকালো। তার,লাল চোখ দু’টো যেন বলছে,এতো সমস্যা হলে প্রাইভেট কারে চলাফেরা করবেন।আমি উঠবো না।
কত ধরণের হ্যারাসমেন্টের স্বিকার হয়েছি এইরকম বাসে।আহ!এতো কষ্ট কেন আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের জীবনে? সিটের আরো কোনায় চলে গেলাম আমি।
এসব ভাবার সময় না এখন। আমার ভাইয়াকে নিয়ে ভাববো শুধু। আমাদের সব আবদারের কথা ভাইয়াকে বলতাম নির্দ্বিধায়। তখন ভাইয়া চাকরিও করতো না।টিউশনি করতো।সেই টিউশনির এক টাকাও নিজের জন্য খরচ করে নি।সব আমার আর ঝিনুক আপুর পিছনে খরচ করেছে।যা খেতে মন চাইতো,যা কিনতে মন চাইতো,যেখানে যেতে মন চাইতো সব বলতাম ভাইয়ার কাছে।আর,ভাইয়াও সব ইচ্ছা পূরণ করে দিতো।আর,কার কাছে আমরা আবদার করবো?
কে আমাকে আগলে রাখবে?কে বলবে,যুথি কাউকে ভয় পাবি না। রাস্তাঘাটে কোনো পোলাপান কিছু বললে আমারে বলবি একদম ঠ্যাঙ ভেঙে দিবো ঐ পোলাপানের। নিজের অজান্তেই ডুকরে কেঁদে উঠলাম। অনেক চেষ্টা করলাম কান্না থামানোর। কিন্তু, পারলাম না।
আমার পাশে বসা অসভ্য লোকটা হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে খুব উতলা হয়ে গেলো।”কি হইছে আপা কাঁন্দেন কেনো? আইচ্ছা আমি উইঠা যাইতাছি কান্দা থামান”…
উনি উঠে গেলেন সিট থেকে। চলন্ত বাসে দাঁড়িয়েই গেলেন বাকিটা পথ।
আমি বললাম বসতে। কিন্তু,উনি আর বসলেন না।
বলতে লাগলো, সমস্যা নাই বইন সমস্যা নাই।দশমিনিটের রাস্তা।
আমি মন থেকে উনাকে ভাইয়া ডাকলাম। বললাম, ভাইয়া আপনি অনেক ভালো মানুষ।
উনি হেসে বললেন,আরে না..না।আমি ভালা না।

বাসায় ফিরে দেখি মা চিৎকার করে কাঁদছে। কিছুক্ষণ আবার চুপ রইলো। আবার চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। আর মালিহা ভাবীকে গালিগালাজ করতে লাগলো। আবার কিছু ক্ষন চুপ থাকেন আবার চেঁচামেচি করেন। চক্রাকারে এটাই চলছে।
আমি মাকে বললাম,মা ভাইয়া কি মরে গেছে? তুমি এমন করছো কেন?ডাক্তার তো বলেইছে ঠিক হয়ে যাবে।
মা বললো,তুই বুঝবি না.. বাদশাহ আর ঠিক হইতো না।মা’র মনের চেয়ে কি ডাক্তার বেশি জানে? মায়ের মনে যেইটা বারি খায় ঐটাই হয়।
ঝিনুক আপু পাশের ঘর থেকে বললো,মা তোমার মন কোন মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করছে?

আমি পাশের ঘরে গেলাম। গিয়ে দেখি ঝিনুক আপু শুয়ে আছে তখনো। চোখ গুলো ছোট হয়ে গেছে কান্নার কারণে।তবুও আমার সামনে হাসি দেওয়ার ভাণ করে আছে।
কপালে হাত দিয়ে দেখি গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে।
নিজের শরীরেও কোনো রকম শক্তি পাচ্ছি না।
কিন্তু, কিছু রান্নাবান্না তো করতে হবে।সবাই খাবে কি… কিচেনে যেতে যেতেই মেহেদী ভাইয়া বাবাকে নিয়ে ফিরে এলো।
মেহেদী ভাইয়া রেস্টুরেন্ট থেকে খাওয়ার জন্য অনেক কিছু কিনে নিয়ে এসেছে।
কিন্তু, কারোরই খাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। মেহেদী ভাইয়া জোর করে আমাকে আর বাবাকে খাওয়ালো।
মাকে অনেক জোর করতে লাগলো খাওয়ার জন্য।মা তো কিছুই খাবে না।আমি বললাম,থাক ভাইয়া জোর কইরেন না।মা যেটা না করে সেটা সবসময় না ই থাকে।
মেহেদী ভাইয়া তবুও মাকে জোর করতে লাগলো।বলতে লাগলো, আপনি তো আমার মায়ের মতোই, আমার একটা কথাও কি শুনবেন না? বাদশাহ ভাইয়া বললেও কি আপনি না খেয়ে থাকতেন? আমিও আজ সকাল থেকে কিছুই খাইনি। আপনি যদি না খান এখনো আমার খাওয়া হবে না।
মা বললো, তোমার খাওয়া তুমি খাও.. আমার সাথে তোমার কি সম্পর্ক?আমি খাবো না বলছি না।
মেহেদী ভাইয়া বললো,প্লীজ খেয়ে নেন না মা!
মা অবাক চোখে মেহেদী ভাইয়ার দিকে তাকালো। মেহেদী ভাইয়া বললো,আমার মা নেই আন্টি। আমি কাউকে মা ডাকলাম দীর্ঘ একযুগ পর। আপনি আমার কথা শুনবেন না?
মেহেদী ভাইয়া চোখের পানি মুছলো। মায়ের চোখেও পানি চলে আসলো।
মা খেতে রাজি হলেন। খাওয়া দাওয়া করে বাদশাহ ভাইয়ার রুমে গিয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে রইলেন।
আমি তিতলিকে খাওয়ালাম। হঠাৎ মনে পরলো,আপু তো খায়নি।
তিতলিকে ওর দাদার রুমে রেখে আমি আমাদের রুমে গেলাম।দরজায় দাঁড়িয়ে দেখি মেহেদী ভাইয়া খাবার নিয়ে বসে আছে আপুর মাথার কাছে।
– ওঠো খেয়ে ওষুধ খাও ঝিনুক। একজন অসুস্থ হইছে ঐটাই যথেষ্ট। আবার, তুমি কেন অসুখ বাঁধাতে চাইছো?
ঝিনুক আপু বললো, চুপ থাক গাধা ভূত কোথাকার। আমাকে খাইয়ে দিতে বললাম ঐটা শুনছিস না কেন?
কান নেই তোর?
– তুমি আমাকে তুই তুকারি করছো কেন?
– তো?এই ডাকিনী কি তোর মতো গাধা ভূত কে আপনি আজ্ঞে করবে?শখ কত হুহ….
– তাহলে স্বীকার করছো তো তুমি ই ডাকিনী?
আমি দরজার আড়াল থেকে ওদের দুজনকে দেখছিলাম। মেহেদী ভাইয়া ঝিনুক আপুকে খাইয়ে দিচ্ছিলো।কি সুন্দর লাগছে দুইজনকে… আমার ভাল্লাগলো,কেন জানি একটু কষ্টও হলো।
খাওয়ার পর আপুকে ওষুধ খাইয়ে মেহেদী ভাইয়া চলে যেতে লাগলো।আপু উনার হাত ধরে বললো,যাইস না রে প্লিইজ…
মেহেদী ভাইয়া বললো, কেন?
আপু বললো,কারণ একবার যেতে দিলে এমন মেন্দি পাতা আরতো পাবো না।
বলেই আপু হাসলো।
মেহেদী ভাইয়াও হেসে ফেললো। আবার, ঝিনুক আপুর পাশে বসলো।
ঝিনুক আপু মেহেদী ভাইয়ার কোলে মুখ গুঁজে ফেললো।
মেহেদী ভাইয়া বললো, ঝিনুক জ্বরের ঘোরে কি করছো?কেউ যদি এই খানে এখন আসে?
ঝিনুক আপু বললো, চুপ গাধা ভূত…আমি কালকে ঘুরতে যাবো ঠিকাছে…
– তোমার তো অনেক জ্বর ঝিনুক..
-আমার হলো ভালুকের জ্বর।কাল সকালেই গায়েব হয়ে যাবে।
আমি হঠাৎ আমার ঘাড়ে কারো নিঃশ্বাস অনুভব করলাম। তাকিয়ে দেখি,মা….
আমার হৃৎপিণ্ড থেমে যাওয়ার উপক্রম হলো।আজকে মা তান্ডব বইয়ে দিবেন।
মা ঠান্ডা চোখে কিছু ক্ষন দেখে চলে গেলো। কিছুই বললো না।এ যেন অষ্টম আশ্চর্য।
পরদিন সকালে খুব ভালো একটা ঘটনা ঘটলো।ক্লিনিক থেকে ফোন আসলো।আমি ধরলাম। একজন নার্স বিরস মুখে বললো,নিন রোগীর সাথে কথা বলুন।
হঠাৎ, বাদশাহ ভাইয়ার গলা শুনতে পেলাম।
– কিরে যুথি আমাকে এখানে রেখে গেছিস কেন?
আমি ভাইয়ার সাথে কথা বললাম। মা-বাবাও বললো। ভাইয়া একদমই স্বাভাবিক।
পরে,ডাক্তার বললো, চিন্তা করবেন না। তিন-চার দিনের মধ্যেই উনি ঠিক হয়ে যাবে।
নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।সত্যিই আমাদের ভাগ্য এতো ভালো?নাকি…….
……..
……..
ঝিনুক ঠিকই বলেছে।ওর জ্বর আসলেই ভালুক জ্বর।রাতে কি ভীষণ জ্বর ছিল, এখন আর নেই।
মেহেদী আর ঝিনুক ঘুরতে এসেছে।কি সুন্দর ছবির মতো একটা জায়গা….আসলে এটা একটা নার্সারি। শহরের সবচেয়ে বড় নার্সারি এটা। চারপাশে শুধু গাছ গাছ আর গাছ। ফুল,ফল,ঔষধি,মশলা,কাঠ সব ধরনের গাছই আছে।
লাল রঙের জামা পরেছে বলেই ঝিনুক কে কেমন বউ বউ মনে হচ্ছে। বিশেষ করে, মাথায় ঘোমটা দেয়ার কারণে।
মেহেদী তাকিয়ে থাকে ঝিনুকের দিকে।একদিনের জ্বরেই কেমন রোগা আর দূর্বল লাগছে মেয়েটাকে।অবশ্য এর জন্য আরো বেশি মায়াবী লাগছে….
ঝিনুক হঠাৎ বললো, তাকিয়ে আছেন কেন? জীবনে মেয়ে দেখেন নি?
মেহেদী কি বলবে ভেবে পেলো না।
ঝিনুক বললো, আপনি আমাকে নিয়ে ঘুরতে এসেছেন কোন মতলবে বলবেন?
– তুমি ই তো আসতে চাইছো।
– কখন?জ্বরের ঘোরে কি না কি বলেছি আপনি সত্যি ধরে বসে আছেন?জ্বর এলে আগে আমি আমার মাকে ভাবী ডাকতাম। আমার মাথা আউলায় যায় বুঝলেন?
– কিন্তু,আমাকে তো যুথি বললো তুমি নাকি আমার সাথে ঘুরতে যেতে চাও।
ঝিনুক বিরক্ত হয়ে যায়।এই গাধা যুথিটাও না….
নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,আমি বললেই আমাকে নিয়ে আপনি আসবেন কেনো?কোনো মেয়ে বললেই আপনি তাকে নিয়ে ঘুরতে যান?
– কোনো মেয়ে আর তুমি কি এক?
– ওমা আলাদা হবো কেন? আমার মাথায় কি শিং আছে?
মেহেদী হাসলো।
~তুমি নিজেই বুঝো ঝিনুক কেন তুমি আলাদা?
– না তো আমি তো বুঝি না। বলেন কেনো?
~তুমি যে বুঝো সবকিছু আমি জানি।স্বিকার করলেই হয়, আমার মুখ থেকে শুনতে চাও….
……….
চলবে,,

ধূসর অনুভূতি পর্ব-০৭+০৮

0

#ধূসর অনুভূতি
পর্ব:০৭+০৮
লেখক-শাপলা

অনেক ক্ষন ধরে ঝিম মেরে বসে আছি আমরা তিনজন। ঝিনুক আপু বললো,ও কি তাহলে গাধা নয়?
পরী আপু বললো,আরে গাধাই।তবে,আমরা যতটা ভাবছি তার চেয়ে একটু কম। ঐদিন চিঠি না দিলে বুঝতেই পারতো না যে এই কাজ তোর।চিঠি দিয়ে বাড়াবাড়ি টা করছিস।
ঝিনুক আপু দীর্ঘশ্বাস ফেললো। পরী আপু বললো,ঐ স্কেচ ওর ঘরেই থাকুক।আমরা এমন একটা ভাব করবো যেন আমরা ওর ঘরে ঢুকিই নি।জানবো কি করে ও কি ছাতার মাথা আঁকছে।
ঝিনুক আপু বললো, হুম। একটু থেমে বললো, কিন্তু ছবিটা অনেক সুন্দর আঁকছে তাই না?
পরী আপু হেসে বললো, মনের মাধুরী মিশিয়ে এঁকেছে সুন্দর তো হবেই।
ঝিনুক আপু হাসতে লাগলো। বললো, চুপ থাক। বেশি ফালতু কথা বলবি না!
এরপর হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বললো,কিরে যুথি কি হইছে?মেন্দি পাতার রুমে চিঠি পাওয়ার পর থেকেই দেখছি তুই কেমন মন মরা হয়ে আছিস..
আমি মৃদু হেসে বললাম ,কই না তো।মনমরা হইনি তো, ভীষণ অবাক হয়েছি।
ঝিনুক আপু বললো, আসলেই অবাক হওয়ার মতোই বিষয়।গাধাটা আমাদের সবাইকে চমকে দিলো।
কিছুক্ষণ পর আমরা ছাদ থেকে নেমে পরলাম।
বাসায় ফিরে দেখি মা পোলাও রাঁধছে।
আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম কারণ মায়ের মেজাজ সবসময়ই তেঁতে থাকে,মা হঠাৎ পোলাও করছো কেন?
মা আমাকে অবাক করে দিয়ে হাসলো।হেসে বললো,তিশি মনি আসবে তো তাই।
আমি অবাক হয়ে গেলাম।তিশিমনি মানেটা কি….
আপু বললো, তুই জানিস না? আমাদের মাতা তিশিকে ডাকে তিশিমণি আর তিশি তাকে ডাকে মামণি।
মা ঝিনুক আপুকে একটা ধমক দিলেন। বললেন,সর ভাগ তো…
তিশি আর মা বসে বসে খুব হাসাহাসি করে গল্প করছে।তিশি দেখছি আবার মায়ের সাথে পানও খাচ্ছে।
এমন সময় ভাইয়া বাসায় এলো।
ভাইয়া বিরক্ত হয়ে বলল,সেই মেয়ে আবার এসেছে?
আমি বললাম, আসবেই তো। তোমার বউ হয়েই ছাড়বে সে।
ভাইয়া দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এরপর,মায়ের রুমে ঢুকলো।
আমিও পিছুপিছু ঢুকলাম। ভাইয়ার চাহনি হঠাৎ বদলে গেল। সেইদিন অফিসে যেমন লাগছিল ঠিক তেমন লাগছে ভাইয়াকে আবার। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ভাইয়া কি আবার সব ভুলে গেলো?
মাও আমার মতো ভয় পেয়ে গেল।
বললো, বাদশাহ তুই এখন এখান থেকে যা।
ভাইয়া বললো,কাকে যেতে বলছেন? এখানে তো কোনো রাজা-বাদশাহ দেখছি না।
মা চোখ বড়বড় করে বললো,যুথি ওকে নিয়ে যা এখান থেকে।
তিশি আবাক হয়ে বললো,উনার কি হয়েছে মামণি?
বাদশাহ ভাইয়া বললো,এই যে খুঁকি তুমি সব কিছু তে এতো নাক গলাও কেন?নাক গলাতে গলাতে একদিন দেখবা তোমার নাক গায়েব হয়ে গেছে বুঝছো?যাও বাসায় গিয়ে বই নিয়ে বসো।সামনে এসএসসি না?পরে তো ১১ বিষয়ের মধ্যে ১০ টাতেই ফেইল করবা।
তিশি উঠে দাঁড়িয়ে পরলো।
মা বললো,তিশি ওর কথায় কিছু মনে করো না।ও মজা করছে।
বাদশাহ ভাইয়া বললো,না মজা করছি না তো।এই খুঁকি তোমার কি মনে হয় আমি মজা করছি?
আমি বললাম, ভাইয়া চলো।
ভাইয়া বললো, আপনি কে ইয়ং লেডি?একটু পরিচয় বলুন।অপিরিচিত মানুষের সাথে কোথাও গেলে আমার মা বকবে।
তিশি ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে রইলো। এরপর ছুটে বেরিয়ে চলে গেল।মা পিছু পিছু গেলো।
আমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি ভাইয়া হাসছে স্বাভাবিক মানুষের মতো।
আমি বললাম, ভাইয়া তার মানে তুমি এতক্ষণ অভিনয় করেছো?
ভাইয়া হেসে বললো,বড় ঝামেলা থেকে মুক্তির শর্টকাট টেকনিক।তোরা তো বলিস আমি নাকি হঠাৎ হঠাৎ সব ভুলে যাই। আমার তো সেসব মনে থাকে না।তাই,আজ সজ্ঞানে সব ভুলে গিয়ে দেখলাম কেমন লাগে।
ভাইয়া নিজের রুমে চলে গেল।
মা ফিরে এল একটু পর ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে।
আমি বললাম,কি হয়েছে মা?
মা বললো,তিশি সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে বাদশাহ বদ্ধ পাগল।এর জন্যই নাকি বাদশার বউ পালিয়ে গেছে।
মায়ের করুণ মুখটা দেখে আমার মায়াই হলো।
মা বললো, বাদশাহ কই?
আমি বললাম, ঘুমিয়ে পড়েছে।
-ঘুমিয়ে পড়েছে না?এত বড় প্যাঁচ লাগিয়ে নাক ডাকছে হারামজাদা।
আমি বললাম, তোমার ছেলে অসুস্থ সেই চিন্তা না করে তুমি কি বলছো এইসব?
মা চোখের পানি ফেলতে লাগলেন।
কিছুক্ষণ এর মধ্যেই ইশু ভাবী আমাদের বাসায় এলেন।
বললেন,আন্টি আপনি মন খারাপ কইরেন না। একবার তো আমাকে বলতে পারতেন বাদশাহ ভাইয়ের সমস্যার কথা।তাহলে,এতো বড় ঝামেলা হতো না।যাকগে তিশি গেছে যাক।এর চেয়েও ভালো মেয়ে আমার হাতে আছে।আর শোনেন বাদশাহ ভাইকে ঘরে লুকিয়ে না রেখে পাবনা পাঠিয়ে দেন। আমার পরিচিত একজন ডাক্তার আছে পাবনা মেন্টাল হসপিটালে। পাগল হওয়াটা দোষের কিছু না।
মা চিৎকার করে বললো,যাও তো তুমি। বেরিয়ে যাও।
রাত্রে বেলা আমি আপুকে জিজ্ঞেস করলাম,আপু মেহেদী ভাইয়াকে কি তুমিও ভালোবাসো?
আপু আমার দিকে অবাক হয়ে তাকালো।বললো,তুই এতো করুন গলায় কথা বলছিস কেন?
আমি বললাম,তাই নাকি? খেয়াল করি নি তো!
বলেই হাসলাম।আপু বললো,ঐ হাবলাকে ভালোবাসার জন্য কি আমার দায় পরেছে?
– না তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে…….
– আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে?
– তুমি উনাকে একটু হলেও পছন্দ করো।
-ছাই করি।দেখ না আমি ওর কেমন বারোটা বাজাই।কি করি শুধু দেখ…
আমি বললাম,আপু আবার?
– তো?তুই কি মনে করেছিস আমি একবার ব্যর্থ হয়েছি দেখে থেমে যাবো। একবার না পারিলে শত বার চেষ্টা করিতে হয় জানিস না?

……..
…….
ফারহান হাসি হাসি মুখ করে ঘরে ঢুকলো।বললো,শুনছো মালিহা খবর শুনছো?
মালিহা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,কিসের খবর?
ফারহান হাসিটাকে আরো বিস্তৃত করে বললো, তোমার প্রাণপতি বাদশাহ সাহেব আবার বিবাহ করছেন এই কয়েকদিনের মধ্যেই খবর পেলাম।হা…হা।
মালিহার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো।সে বললো,এই খবর আমাকে শোনাচ্ছো কেন তুমি?যাও গিয়ে ফ্রেশ হও।
– তোমাকে শোনাবো না তো কাকে শোনাবো? তুমি তো বাদশার কথা ভেবে সারাক্ষন অশ্রুবিসর্জন করো।হাহা।
মালিহার বিরক্ত লাগছে খুব।সে উঠে চলে যেতে চাইলো।
ফারহান বললো,পাত্রীটা কে শুনে যাও।পাত্রীর বয়স সবে ষোলো। একদম কচি মেয়ে। বাদশার ই তো সময় এখন হাহা…
-ফারহান তুমি মদ খেয়ে এসছো?
– না তো খাইনি তো।পান করেছি।হা…হা….
মালিহা দ্রুত পায়ে হেঁটে অন্য রুমে চলে গেল।দরজা আটকে কাঁদলো কিছু ক্ষন।তার কোনো কিছুই শান্তি লাগছে না।বুকের মধ্যে সাগরসম কষ্ট।
পরদিন শুক্রবার ছিল।মালিহা ঘুম থেকে উঠে দেখে ফারহান নেই।ও তো এতো সকালে কখনো ঘুম থেকে ওঠে না…
মালিহা ড্রইং রুমে এসে দেখে ফারহান কোথাও যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে আছে।
মালিহা বললো, কোথায় যাচ্ছো ফারহান?
ফারহান বললো, বাড়িতে যাচ্ছি। বাবা অসুস্থ।
মালিহা বললো,আমি কি এই অপরিচিত জায়গায় একা থাকবো?আমাকেও তোমার সাথে নিয়ে চলো…
ফারহান মালিহার দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকালো। বললো,মালিহা তোমার একেকটা কথা শুনলে আমার গা জ্বলে যায়। আমার বাবা অসুস্থ হয়েছে তো তোমার জন্যেই।এখন আবার তোমাকেই যদি সাথে নিয়ে যাই তাহলে তো কথাই নেই।
– আমার জন্য অসুস্থ হয়েছে মানে?
– এই যে আমি অবিবাহিত হয়ে বিবাহিত এক মেয়ের সাথে পালিয়ে গেলাম।এই খবর কি কোনো বাবা-মা সহ্য করতে পারে?বাবা আমার জন্য মেয়ে পছন্দ করে রেখেছিলেন।মেয়ে অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে ছিলো।নাম সারাহ। আমার দুঃসম্পর্কের ফুপুর মেয়ে। বাবার মনের সমস্ত ইচ্ছায় আমি জল ঢেলে দিয়েছি।বাবাকে সবাই অপমান করছে ,তার ছেলে আরেক জনের বউ নিয়ে পালিয়ে গেছে।এই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে বাবা অসুস্থ হয়ে গেছে। আমার নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে মালিহা। আমার বাবা খুব কষ্ট করে আমাকে আর আমার ছোট ভাইকে পড়াশোনা করিয়েছে।দিনে কৃষিকাজ করেছে,রাতে নাইট গার্ডের চাকরি করেছে। আমাদের কথা ভেবে তিনি নিজের সব আনন্দ বিসর্জন দিয়েছে।আর, আমি বাবার রক্ত পানি করা টাকায় বড় হয়ে নিজের সুখের কথা ভেবে বাবার মনে কষ্ট দিয়েছি… বাবা স্ট্রোক করেছে।যদি মারা যায় আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবোনা।
মালিহা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।সে চাইলেই জবাব দিতে পারে কড়া ভাষায়।কারণ, ভালোবাসার কথাটা সর্বপ্রথম ফারহান ই বলেছে,সে নয়।ক্ষতি ফারহানের চেয়েও তার বেশি হয়েছে। এখন ফারহান তার ঘাড়েই দোষ দিচ্ছে। কিন্তু,মালিহা কিছুই বলতে পারলো না।
ফারহান কাঁদছে।মালিহা বললো,যাও চিন্তা করো না।বাবার কিছুই হবে না।
ফারহান চলে গেলো। পিছন ফিরে তাকালো না।
মালিহার কেন জানি মনে হলো ফারহান আর ফিরবে না।যত সুখ স্বপ্ন নিয়ে ফারহান এর হাত ধরেছিল সে তার কিছু ই বাস্তবিকই হয় নি।
নরকের মতো মনে হতো যেই বাড়িটাকে ,ছেড়ে আসার পর সেখানেই মনটা পরে ছিল মালিহার।খালি তিতলির কথা মনে পরে কান্না পাচ্ছিল।তিতলিকে যে এতো ভালোবাসে আগে কখনোই বুঝতে পারেনি। তখন মনে হচ্ছিল তিতলির জন্য জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডেও সে হাসিমুখে থাকতে পারবে। ফারহানকে বলেছিল,তিতলি কে কবে আনবে আমাদের কাছে?
ফারহান খুব রেগে গিয়েছিল। ফারহানের দোষ দিয়ে লাভ নেই। ফারহানের সাথে মন খুলে কথা বলতেও মালিহার ভালো লাগতো না।কিভাবে লাগবে;তার তো পিছুটান রয়ে গেছে। ফারহান সারাক্ষন রাগারাগী করতো। গালাগালি করতো কুৎসিত ভাবে।বলতো, বাদশার জন্য এতো টান হলে ওখানেই থাকতি।আর মেয়ের জন্য এতো দরদ হইলে পালাইছিস কেন?তুই যদি এতোই ভালো মেয়ে হতিস তাহলে পালিয়ে আসতি না। এখন আমি কেন তোর মেয়েকে পালবো? দুইদিন পর তো বলবি তিতলির সাথে বাদশাহ কেও নিয়ে আসতে এই বাড়িতে।
মালিহা চোখের পানি মোছে। কিছু মানুষের জন্মই হয় বোধহয় কষ্ট পেতে। আচ্ছা, তার জীবনটা তো এমন হওয়ার কথা ছিল না। বাবা-মা যথেষ্ট ধনী ছিল।না চাইতেই সব ইচ্ছা পূরণ করে দিতো বাবা।কত আদরে মা রেখেছেন,চুলার কাছেও যেতে দেননি। বলতেন, আমার মেয়ের হাত পুড়ে যাবে। খুব ফীল করতো মালিহার কষ্ট মা।
মালিহার বুকটা যে এখন পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে মা কি ফীল করে না?
আচ্ছা, ফারহান কি সেই সারাহ নামের তার কাজিনকে বিয়ে করবে? ফারহানের বাবা নিশ্চয়ই মৃত্যুশয্যায় শুয়ে বলবে মালিহাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য।
আর বাদশা?সে কি সত্যিই ষোলো বছরের একটা মেয়ে কে বিয়ে করছে? বিচিত্র কিছু নয়। করতেই পারে।
তিতলি কি সেই মেয়েটিকেই মা ডাকবে? বাদশাহ আর তার পরিবার কি বলবে ,তিতলি তোর মা ডাইনী ছিল। তোর মায়ের কথা মনেও আনিস না। কষ্ট পাস না।
একসময় তিতলি তাকে ভুলে যাবে?তিতলি সত্যিই ভাববে তার মা একটা ডাইনী?
মালিহা আর ভাবতে পারে না।
চিৎকার করে বলে,আল্লাহ তুমি আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দাও।আর,কিছুই আমি চাইনা।
মালিহা অনেক ক্ষন কান্নাকাটি করে।
এরপর, কাঁপা কাঁপা হাতে তার মায়ের নম্বরে ডায়াল করে।
দুইবার রিং হওয়ার পর মা ফোন উঠায়। জিজ্ঞেস করে,কে?
মালিহা নিজেকে সামলাতে পারে না। বাঁধভাঙা কান্না থামতেই চায় না।
মালিহার মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,কেন আমাকে ফোন করেছিস? লজ্জা করে না তোর?কি দোষ করেছিলাম আমি আর তোর বাবা?তোকে জন্ম দিয়েছি এটাই সবচেয়ে বড় দোষ? তোর বাবা কতটা সৎ মানুষ তার দিকে চোখ তোলার সাহস কোনোদিন কেউ পায়নি।আজ, তোর কর্মকান্ডের জন্য সবাই আঙুল তুলছে আমাদের দিকে।বলছে,কি শিক্ষা দিয়েছেন মেয়েকে,মেয়ে এতো বড় চরিত্রহীন হলো কিভাবে?যেদিন তুই বাদশাহ কে বিয়ে করতে চেয়েছিলি সেদিনও আমি মানা করেছিলাম তুই শুনিস নি।কত ভালো পাত্র হাতছাড়া করেছি।সবাই সেদিনও কথা শুনিয়েছিলো,কেন একটা বেকার ছেলের সাথে মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছি।তবুও, তোর কথা ভেবে সব হজম করেছি।স্বামী-সংসার,সন্তান সব হয়েছে। এরপর তুই এমন একটা কাজ কিভাবে করলি?এতো বড় একটা পাপ কাজ করার আগে তো মাকে ফোন করিস নি… তাহলে আজ করেছিস কেন? আমার কোনো মেয়ে নেই মালিহা।আশা করি,এতো ক্ষন যা বলেছি তার সারমর্ম বুঝেছিস।আমাকে আর ফোন করবি না।
মালিহা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে,মা…. কোনো মানুষ যখন অসহনীয় কষ্টের মধ্য দিয়ে যায় তখন সবার আগে তার যে মানুষটার কথা মনে পরে সে হলো মা।কারণ,সে জানে তার দুঃখের সময়, বিপদের সময় সুসময়ের সঙ্গীরা কেউ পাশে দাড়াবে না শুধু মা ছাড়া।
মা বললেন,হ্যাঁ কিন্তু যে বারবার নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনে তার পাশে মায়েরও দাঁড়ানো উচিৎ না।
ফোন রেখে মালিহা সারারাত কাঁদলো।
ভোরের দিকে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরলো।
দেখতে দেখতে চারদিন হয়ে গেল। ফারহান ফিরে এলো না।কোনো ফোনকল-ও করেনি।মালিহাও করেনি।কি দরকার যে আসতে চায় না তাকে বিরক্ত করেই। ফারহান হয়তো বুঝতে পেরেছে আবেগের বসে সে অনেক বড় ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
মালিহা অনেক সময় নিয়ে গোসল করলো।তারপর, বারান্দায় বসে রইলো।কি করতে চায় সে?সে কি নিজেকে শেষ করে দিতে চায়?
নাহ!এতো অসীম সাহসী তো সে নয়। হঠাৎ কলিং বেল বেজে ওঠে।
মালিহা দরজা খুলে দেখে ফারহান দাঁড়িয়ে আছে।
মালিহা কেমন অনুভূতি শূন্য হয়ে যায়। তার কি খুশি হওয়া উচিত ছিল না ফারহানকে দেখে?
ফারহানের চোখ টকটকে লাল।
মালিহা বললো, তুমি মদ খেয়েছো? চোখ এতো লাল কেন?
মালিহা প্রস্তুত হয়েই ছিল ফারহানের ধমক শোনার জন্য। কিন্তু, ফারহান ধমক দিলো না।
খুব নিচু গলায় বললো, আমার বাবা মারা গেছে মালিহা।
ফারহান মালিহাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে থাকে।
মালিহা যন্ত্রের মতো দাঁড়িয়ে থাকে।
ফারহান কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে, বাদশাহ মনে হয় অভিশাপ দিয়েছে তাই না?
মালিহা ভাবলেশহীন ভাবে বলে,না ফারহান বাদশাহ অভিশাপ দেয়ার মতো ছেলেই না।ও কারো খারাপ চায় না,কাউকে ও অভিশাপ দেয় না।
ফারহান হঠাৎ হিংস্র হয়ে ওঠে।মালিহার গালে সজোরে একটা থাপ্পর দেয়। চেঁচিয়ে বলে, বাদশার মতো ভালো মানুষ দুনিয়ায় নাই তাই না? তাইলে বাদশাহকে ছেড়ে আসছিস কেন? সারাক্ষন কেন ওর গুনগান করে আমাকে কষ্ট দিস?কেন?
মালিহা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো,তার চোখে পানি আসছে
আজ মায়ের জন্মদিন।আমরা মাকে সারপ্রাইজ দিতে চাচ্ছি। মায়ের মন এমনিতেই খারাপ তিশির জন্য।আর,বাবাও বললো তোর মা ইদানীং বেশি খ্যাটখ্যাট করে।ওকে কোনো উপহার-টুপহার দেওয়া উচিৎ। তখন, ঝিনুক আপু বললো, মায়ের তো সামনে জন্মদিন আসো আমরা মাকে সারপ্রাইজ দিই।প্রথমে কেউ রাজি না হলেও পরে সবাই রাজি হলো। একটা উপলক্ষ্য আসলেই দরকার।যাতে সবাই আনন্দ করতে পারি।তিতলির মতো ছোট একটা বাচ্চা গম্ভীর ভাবে ঘুরে বেড়ালে ভালো লাগে না।ওর দাদির জন্মদিন দেখলে ও হয়তো অনেক মজা পাবে।
তিতলি আমাকে এসে বললো,দাদির জন্মদিনে তো সবাই আসবে।ফুপি আজ কি আমার মামনি আসবে?
কথাটা বলেই ও এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।সেই দৃষ্টিতে মিশে আছে ভয়; আমি “না” বলবো এই ভয়। আমার খুবই মায়া লাগলো।আমি বললাম,হ্যাঁ আসবে তো।
তিতলি খুব সুন্দর করে হেসে দিলো।এরপর প্রজাপতির মতো উড়তে লাগলো ঘরময়।কি আনন্দ ওর চোখে মুখে। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বিকালের দিকে সারাঘর সাজানো হয়ে গেছে।আর্টিফিশিয়াল ফুল,লতা-পাতা দিয়ে।বাসার সবাই কে দাওয়াত করা হয়েছে।মায়ের থেকে বিষয়টা বেশি ক্ষন লুকিয়ে রাখা গেলো না।বাবাই বলে দিলো সব,বাবার পেটে কোনো কথা থাকে না।মা এমন ভাণ করছে যেন তিনি খুবই অখুশি। কিন্তু,আসলে তিনি অনেক খুশি। রান্নাঘরে এসে আমাদের বলতে লাগলেন,কি ছেলেমানুষী শুরু করেছিস তোরা?এই বুড়ি বয়সে জন্মদিন… লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে।
ঝিনুক আপু বললো,মাথা কাটা গেলে সুপার গ্লু দিয়ে জোরা লাগাও যাও। এখন কিচেনে এসো না।বার্থডে গার্লের কিচেনে আসা বারণ।মা বললো,তাহলে আমি কি করবো?আপু বললো, গিয়ে সাজগোজ করো।
মা বিরক্ত হয়ে বললেন, চুপ থাক ছাগল। কিন্তু,সত্যি সত্যিই মা একটা নতুন শাড়ি পরলেন।একটু বোধহয় সেজেওছেন।কেমন অন্যরকম লাগছে…বাবা বললেন, তোর মাকে আজকে মায়াবী লাগছে খেয়াল করেছিস?আমি কিছু বলার আগেই মা বললো, কেন আগে কেমন লাগতো?বাবা বললো, জাঁদরেল জাঁদরেল লাগতো।
মা রাগী চোখে বাবার দিকে তাকালো।
আমি হেসে প্রস্থান করলাম। কিছুক্ষণ পর মেহেদী ভাইয়া এলো।আমি দরজা খুলে দেখি তার হাত ভর্তি টকটকে লাল গোলাপফুল এর তোড়া। মেহেদী ভাইয়াকে দেখেই ঝিনুক আপু ছুটে এলো দরজার সামনে। কিন্তু,ভাব করতে লাগলো অন্য কারণে এসেছে। আমার দিকে তাকিয়ে বললো,নীল রঙের ফ্রাই প্যান টা দেখছিস?
নীল রঙের কোনো ফ্রাইপ্যান আমাদের বাসায় আছে বলে তো আমার মনে হয় না। কাজেই, আমি চুপ করে রইলাম।
মেহেদী ভাইয়া বললো, ঝিনুক…
আপুর চোখে মুখে হাসির রেখা ঝলমল করছে তবুও সে হাসি চেপে রেখে গম্ভীর হয়ে বললো,কি?
মেহেদী ভাইয়া বললো, তোমাদের সারা ঘর তো নকল ফুল দিয়ে ভরিয়ে ফেলছো।এই নাও কয়েকটা আসল ফুলও রাখো। জন্মদিনের মতো শুভ দিনে কিছু আসল ফুল রাখা উচিৎ।
ঝিনুক আপু বললো,আমার বয়েই গেছে আপনার আসল ফুল রাখতে।
এটা বলেই চলে গেল দৌড়ে। দৌড়ে যাওয়ার কি আছে বুঝলাম না।অগ্যতা মেহেদী ভাইয়ার আমার হাতেই ফুল গুলো দিতে হলো।
আমি রুমে এসে দেখি আপু গান গাচ্ছে গুনগুন করে।
আমি বললাম,আপু তুমি সাজবা না?
আপু বললো,আমি পরে সাজবো।তুই আগে সাজ।
এর মধ্যে পরী আপু এসে পরেছে।ইশিতা ভাবী আর তার দুই ছেলে-মেয়েও চলে এসেছে।ইশু ভাবীর বাচ্চারা তিতলির থেকে ২-ত বছরের বড় হবে। কিন্তু,ওরাই তিতলির খেলার সাথী।আমি লক্ষ্য করলাম তিতলি ওদের কাছেও বলছে,জানো আজকে আমার মা আসবে।
আমার খুবই মায়া লাগলো।চোখে পানি চলে আসলো।
পরী আপু বলতে লাগলো,কিরে তুই সাজবি না ঝিনুক?
ঝিনুক আপু বললো,সাজবো তো ঘোড়ার ডিম।
আমি বললাম, আসলেই আপু তুমি দেরী করছো কেন?
সবাই তো চলে এসেছে।
আপু আমার দিকে তাকিয়ে বললো,সবাই এসেছে?
আমি বললাম, হুম।
পরী আপু বললো, শুধু মেহেদী গাধাটা আসে নাই।
ঝিনুক আপু বিচলিত হয়ে বললো,আসে নাই কেন?
পরী আপু বললো,কিরে তুই এতো বিচলিত হচ্ছিস কেন?বাই এনি চান্স তুই কি ওর সাথে ম্যাচ করে ড্রেস পরতে চাইছিস?এর জন্য রেডি হতে দেরী করছিস?
আপু খুব রেগে গেলো।বললো,কেন যে ওর জন্য অপেক্ষা করছি সেটা পরে বুঝবি।
এরপর, আমাদের পীড়াপীড়িতে রেডি হলো।একটা হলুদ রঙের শাড়ি পরলো।মাথায় মেহেদী ভাইয়ার দেয়া গোলাপ ফুল লাগালো।
এরপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বললো, আবার ওর গোলাপ ফুল চুলে দিছি দেখে নেগেটিভ ভাবে নিস না।
পরী আপু হাসলো।বললো,দেখলি যুথি একেই বলে চোরের মন পুলিশ পুলিশ।আমরা কি ওকে এই বিষয়ে কিছু বলছি?
আমরা তিনজন রেডি হয়ে বাইরে এসে দেখি সবাই চলে এসেছে হাতে গিফট বক্স নিয়ে।সবাই বলতে আমাদের বিল্ডিং এর সবাই। কিন্তু,মা এখনো আসেননি।
আমি মায়ের রুমে গেলাম।দেখি মা চুপ করে বসে আছে।আমি বললাম,চলো মা।
মা বললো,সরতো। আমার লজ্জা লাগছে।
বলেই মা হেসে ফেললো। অনেক দিন পর মাকে এইভাবে হাসতে দেখলাম।
মাকে নিয়ে বাইরে আসতেই সবাই সমস্বরে বলে উঠলো,হ্যাপি বার্থডে টু ইউ…..
মা লজ্জায় নিচের দিকে তাকিয়ে সবাইকে ধন্যবাদ জানালো। আমাদের পাশের বাসায় আরমান আংকেল আর তার টেনে পড়ুয়া ছেলে আকাশ থাকে। আকাশ বলে উঠলো,আন্টি আপনার জন্মদিন হচ্ছে শুনে যে কি খুশি লাগছে। আপনার জন্যই আমার মাথায় সুন্দর একটা আইডিয়া এসেছে। সামনের মাসে আমার বাবার জন্মদিনটাও সেলিব্রেট করবো।
মা হেসে ফেললো।কেইকের উপর ৫২ লেখা মোমবাতি দেখে বাবার দিকে কটমট করে তাকালো।আস্তে আস্তে রাগী কন্ঠে বললো, তোর বাপ আমার বয়স কেমন ২ বছর বাড়ায় দিছে দেখছিস?নিজে বুড়া দেখে আমারেও বুড়ি বানাতে চায়।
এরপর কেইক কাটা হলো।সবাই হাসাহাসি করলেও মেহেদী ভাইয়ার মুখটা একদম চুপসানো বেলুনের মতো হয়ে আছে।আমি অবাক হয়ে গেলাম। মেহেদী ভাইয়া এতো মনমরা হয়ে আছে কেন? ঝিনুক আপু বললো,আরে নীল পাঞ্জাবী পরেছে দেখে এমন লাগছে। নীল হলো বিষন্নতার রঙ।
পরী আপু বললো,হইছে ফিলোসফি কপচাবি না। নিশ্চয়ই তুই কিছু একটা করছিস….
ঝিনুক আপু বললো, ভুলে যাস কেন আমি দর্শনের স্টুডেন্ট।
আমি বললাম, বলোনা আপু কি করছো?
ঝিনুক আপু বিরক্ত হয়ে বলল,ধুর ছাই।কিছু একটা হলেই বলবে আমার দোষ।ট্রাম্প কেন হারছে বাইডেন কেন জিতছে সেইখানেও আমার হাত আছে।
পরী আপু বললো, আচ্ছা বাদ দে।একটা ব্যাপার দেখে হাসি পাচ্ছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম,কি আপু?
পরী আপু বললো,সবার বেলায় হয় হলুদ হিমু, নীল রূপা।আর আমাদের ঝিনুক এর বেলায় নীল হিমু, হলুদ রূপা।হা..হা।
ঝিনুক আপু নিজের হলুদ শাড়ির দিকে তাকালো এরপর মেহেদী ভাইয়ার নীল পাঞ্জাবীর দিকে তাকালো।
তাকানোতেই মেহেদী ভাইয়া কেমন করুন চোখে আপুর দিকে তাকালো।
এরপর, এগিয়ে এলো আমাদের দিকে।
ঝিনুক আপুর দিকে তাকিয়ে বললো, ঝিনুক তুমি অনেক বড় অন্যায় করেছো। তোমার শাস্তি পাওয়া উচিৎ।
ঝিনুক আপু বললো,জ্বি।শাস্তি স্বরূপ আমাকে ফাঁসিতে ঝোলানো উচিত কচুগাছে।
পরী আপু বললো,না… মেহেদী গাছে।
এরপর হাসতে লাগলো।
মেহেদী ভাইয়া সরু চোখে তাকিয়ে চলে গেল।
আমি বললাম,কি করেছো আপু তুমি?
ঝিনুক আপু বললো,দেখবি একটু পরে।অতি চালাকি করার জন্য ছোট্ট শাস্তি। আমার স্কেচ বানানো না?
আমি ভাবতে লাগলাম,আপু কি এমন করতে পারে।
খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হবার পর ইশু ভাবী বললো,আন্টি গিফট গুলো খোলেন।
মা রাজি হলেন না।
ঝিনুক আপুও রিকুয়েস্ট করতে লাগলো।
এরপর সবার সামনেই মা গিফট খুলতে বসলো। মেহেদী ভাইয়া বললো,আমি আসি আন্টি।
মা বললো, কেন বাবা। গিয়ে কি করবে?ঐ যুথি ওকে আরেক গ্লাস শরবত দে। ছেলেটা এতো ঘামছে কেন?
মা গিফট খুলতে লাগলেন।সবাই শাড়ি,টিপট-কাপ এর সেট অথবা অন্যান্য গৃহস্থালি জিনিস পত্র এসবই দিয়েছে।
সবার শেষে মা মেহেদী ভাইয়ার গিফট টা হাতে নিলেন।
সেটা খুলে মায়ের চোখ ছানাবড়া।বেশ কয়েকটা পুতুল,আর বাচ্চাদের রান্নাবাটি খেলার সেট। ছোট চুলা,হাড়ি-পাতিল এইসব।
মা চোখ বড়বড় করে মেহেদী ভাইয়ার দিকে তাকালো।ঘর ভর্তি সবাই অট্ট হাসিতে মেতে উঠলো।
মা নিজেও হেসে ফেললো। আকাশ বললো,আন্টি মেহেদী ভাইয়ের গিফটের মধ্যে একটা চিরকুটও আছে দেখেন। নিশ্চয়ই ভাইয়া কারণ টা লিখেছে সেখানে এই উপহার দেয়ার।
মা হাসি মুখে চিঠি হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলো,প্রিয়:টুনটুন মা, জন্মদিনে তোমাকে অনেক আদর। তুমি কি জানো তুমি একটা টুনটুনি, ঝুমঝুমি,ময়না পাখি?একটা কিউট বার্বি ডল।
সবাই আরো জোরে জোরে হাসতে লাগলো। সবচেয়ে বেশি হাসছে ঝিনুক আপু।
মেহেদী ভাইয়া মাথানিচু করে বললো, আমি ভেবেছিলাম তিতলির জন্মদিন।
আমি বললাম,সেকি ভাইয়া?আমি না নিজে গিয়ে আপনাকে বলে আসলাম মায়ের জন্মদিন।
মা এসে মেহেদী ভাইয়ার হাত ধরলেন। বললেন, তুমি মন খারাপ করছো কেন বাবা? তোমার গিফট ই আমার সবচেয়ে পছন্দ হয়েছে। ছোট বেলার কথা মনে পরে গেছে।
মেহেদী ভাইয়া বললো,স্যরি আন্টি।
এরপর, ঝিনুক আপুর দিকে তাকিয়ে চলে গেলো।
আমি বুঝতে পারলাম,আপুই মেহেদী ভাইয়া কে বলছে আজকে তিতলির জন্মদিন।আপু সবসময় এমন প্যাচ লাগিয়ে কি মজা পায় কে জানে..
আস্তে আস্তে সবাই চলে গেলো।আমি ভাবলাম,মা হয়তো এখন মেহেদী ভাইয়া সম্পর্কে কিছু বলবে।যে ছেলেটা একটা বোকার হর্দ।
কিন্তু,মা বললো, জানিস যুথি। ছোট বেলায় আমাদের পাশের বাড়ির একটা মেয়ের বাবা অনেক বড়লোক ছিল।আমরা তো ছিলাম দিন আনি দিন খাই।তো,ঐ মেয়ের বাবা মেয়েটার এভাবে জন্মদিন করতো। একবার আমি গিয়েছিলাম ওর জন্মদিনে, ওদের বাসায়,ওকে ওর বাবা এমন একটা গিফট বক্স দেয়।ও খুলে দেখে এমনি পুতুল, কিচেন সেট।
আমার এতো মন চাইছিল সেদিন যে,ইশ আমাকেও যদি কেউ এমন দিতো। ছোট মানুষ ছিলাম,খেলার জিনিস এর প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল। অনেক দুয়া করতাম। কিন্তু,বাবাকে ভয়ে বলতাম না।যেখানে খাওয়া ই পাই না ঠিক মতো। আবার, জন্মদিন.. উপহার।
এরপর,আশা করতে করতে একসময় ভুলেও গেলাম।আজ হঠাৎ মনে হলো, আমার সেই ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। চোখের পলকেই সময় চলে যায় দেখছিস…মনে হচ্ছে এইতো সেদিনের কথা সব…
মা থেমে বললো,যা মেহেদী কে বলে আয় তো।৯ টার সময় আমাদের বাসায় এসে যেন খাওয়া দাওয়া করে যায়।
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম।
তিতলি বেচারি সবচেয়ে মনমরা হয়ে রয়েছে।তার মা এলো না।আহারে!আমি বললাম, সোনামনি তোমার মা একটা কাজে আটকে গেছে।
তিতলি ব্যথিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার ছলছল চোখ দুটো যেন বলছে,ফুপি তোমরা বড়রা এতো নিষ্ঠুর কিভাবে হও?
……….
মালিহার মা মালিহাদের বাসায় এসেছে।একথা মালিহার বাবা জানে না। তিনি বলেছেন,তার বোনের বাসায় যাবেন।মিথ্যা কথা না বললে আসাই হতো না।
মালিহার মা বললেন, এখানে এসেছি বলে ভাবিস না,তোকে আমি মাফ করে দিয়েছি।তোর মতো কুলাঙ্গার কে মাফ করা অসম্ভব।
মালিহা মাথা নিচু করে বসে রইলো।
মা বললো,তোকে কয়েক টা উপদেশ দিতে এসেছি। হাজার হোক আমি তো মা।মা তো খুনী সন্তানের জেল হলে সেটাও সইতে পারে না।
মালিহা চোখ তুলে তাকালো।মা বললেন,যেহেতু পালিয়ে চলে এসেছিস। বাদশাহর সাথে ছাড়াছাড়িও হয়ে গেছে তাহলে সেই অধ্যায় ভুলে যা।তিতলিকে যেহেতু ফেলে আসতেই পেরেছিস সেহেতু ওকে নিয়ে তোর আর ভাবতে হবে না।তিতলিকে ওর বাবা-দাদারাই দেখবে। বুঝেছিস? এখন আগের সংসারের কথা ভেবে কাঁদলে দেখবি এই সংসারও টিকবে না। এরপর কই যাবি?তোর বাবা তো তোকে বাড়ি ঢুকতে দিবে না।
মালিহা কেঁদে উঠলো। বললো,মা আমি ভুল করে ফেলেছি। অনেক বড় ভুল। ফারহান নেশা করে, আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে অনেক। সারাক্ষন বলে, আমার জন্য নাকি তার বাবা মারা গেছে।আমি ওকে যেমন দেখেছিলাম ও আর তেমন নেই।ওর সাথে কথা বলতেও আমার ভয় লাগে।কথায় কথায় খালি খোঁটা দেয়,মনে করিয়ে দেয় আমার আগেও বিয়ে হইছে, বাচ্চা আছে।
মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,মালিহা তুই এতো বোকামি কিভাবে করলি? আমাদের জানাতি বাদশাহর সাথে তোর কি সমস্যা হচ্ছে..আমরা বাদশাহ আর তার পরিবারের সাথে বসতাম। বলতাম তাদের যে আমাদের মেয়ে আপনাদের এই এই ব্যবহারে কষ্ট পাচ্ছে। আপনারা এমন করবেন না।এরপরেও তারা তোকে অতিমাত্রায় কষ্ট দিলে আমরাই তোকে নিয়ে আসতাম। তখন তো বাদশাহ নিজের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চেয়ে তোকে ফিরিয়ে নিতো।অথবা, দরকার পরলে আমরা উপস্থিত থেকেই তোদের ডিভোর্স করাতাম। এরপর,তুই যা করার করতি। বাদশাহ যে যে অন্যায় গুলো করছে তোর সাথে সেগুলো ক্ষমার যোগ্য এবং চাইলে শোধরানো যায়। কিন্তু,তুই যেই অন্যায়টা করছিস এটা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ, কখনোই শোধরানো যাবে না।কখনো না।
মালিহা তাকিয়ে রইলো মায়ের দিকে…..

চলবে,,

ধূসর অনুভূতি পর্ব-০৬

0

#ধূসর অনুভূতি
পর্ব:০৬
লেখক- শাপলা

মালিহার একেকটা দিন ছিল বিভীষিকাময়।তার কষ্ট কেউই বুঝতো না। বাদশার মা খালি কথায় কথায় বলতো,আমার যখন বিয়ে হয়েছে তখন মাত্র ১৪ বছরের ছিলাম।সেই বয়স থেকে আজানের সময় উঠে মাটির চুলায় চার-পাঁচ আইটেম রান্না করতাম। শ্বশুর-শ্বাশুরি,জা,ননদ,দেবর নিয়ে কত বড় সংসার ছিলো।গরু, ছাগল,হাঁস,মুরগি, কবুতর কি ছিল না সেই সংসারে। আবার ধান ভানা, সিদ্ধ করা কতশত কাজ।নিঃশ্বাস ফেলার সময় পেতাম না।জীবনের বিশ-পঁচিশটা বছর এইভাবেই কাটাইছি।কই আমি তো কোনোদিন বিরক্ত হইনি এতো কাজ করার পরও। নিজের সংসার,আমিই তো করবো। কিন্তু, তোমার তো কোনো কাজ ই নাই।গ্যাসের চুলায় দুইটা ভাত রাঁনবা এইতো কাজ। এইটা করতে গিয়েই সারাদিন পাতিল বাইড়া-বাইড়ি করো। তোমার নাকি বিতৃষ্ণা লাগে সবকিছু।এতো বিতৃষ্ণা লাগলে বিয়ে করছো কেন?একটা এতিম ছেলে কে বিয়ে করতা,তাইলেই তো শ্বশুর-শ্বাশুরি,ননদের জ্বালা তোমাকে পোহাতে হতো না।
মালিহা কোনো প্রতিউত্তর করতো না।কি বলবে সে?সে কিছু বললে বাদশাহ উল্টা তাকেই ভুল বুঝবে।
বাদশাদের বাসায় প্রায়ই ফারহান আসতো। বাদশার জানে-জিগার দোস্ত।
সেই সুবাদেই মালিহার সাথে পরিচয়।
একদিন ফারহান একটা শাড়ি কিনে দেয় মালিহাকে।বলে,ভাবী দোকান এ এই শাড়িটা দেখেই আপনার কথা মনে পরলো।এই রঙটা আপনাকে খুব মানাবে। আপনি রাখলে আমি খুব খুশি হবো।
মালিহাকে এক প্রকার জোর করেই শাড়িটা ধরিয়ে দেয় বাদশাহ।মালিহা দেখে, আসলেই শাড়িটা খুব সুন্দর। বাদশাহর পছন্দ ভালো না।কেমন বয়স্ক মানুষের শাড়ি কিনে নিয়ে আসে।
প্রায়ই ফারহান ফোন করতো। খোঁজ খবর নিতো। একপ্রকার বন্ধুত্ব হয়ে যায় ফারহানের সাথে। ফারহান আর তার মন-মানসিকতা একদম সেইম। ফারহানের শখ হলো,সারা বাংলাদেশ ঘুরে দেখা।মালিহা অবাক হয়।তারও তো এই শখ।তার, পছন্দ-অপছন্দ সবই ফারহানের সাথে মিলে। তার সব দুঃখের কথাও সে ফারহানকে বলতো। ফারহান শুনে খুব বিচলিত হতো। অনেক সময় ঘুরতে নিয়ে যেতো।যতক্ষন বাড়ি থেকে বাইরে থাকতে পারতো ততক্ষনই শান্তি লাগতো।
সে বুঝতে পারতো।সে বিবাহিত; ফারহানের সাথে কথা বলা তার উচিত নয়। কিন্তু, তবুও মনের বিরুদ্ধে যেতে পারতো না।এক পর্যায়ে ফারহানের সাথে না চাইতেও একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। ফারহান প্রচন্ড কেয়ারিং ছিল।কত সহজেই ছোট ছোট ইচ্ছা গুলো পূরণ করে খুশি করতে পারতো তাকে। ফারহান বলতো,চলো আমরা দূরে কোথাও চলে যাই।তিতলিকে আমি নিজের মেয়ের মতোই দেখবো।
মালিহার একবার মনে হতো চলে যাওয়াই উচিত। পরক্ষনেই বাদশার জন্য মায়া লাগতো।একটা দোটানার মধ্যে ছিল সে। কিন্তু,বাদশাই সেই দোটানা দূর করে দেয়।
খুব সামান্য একটা বিষয় নিয়ে ঝগড়া করে বলে, বেরিয়ে যাও বাড়ি থেকে। তোমার মুখ দেখতে চাই না। তুমি আসার আগে তো এতো ঝামেলা হতো না বাসায়। তুমি আসার পর থেকেই খালি ঝগড়া-ঝাটি।
সেদিন এই কথাটা খুব গায়ে লেগেছিল মালিহার।হয়তো চলে যাওয়ার অপশন আছে বিধায়ই।সে মনস্থির করে ফেলে সে থাকবে না।তারা সবাই ভালো থাকুক,সেও এবার ভালো থাকতে চায়।
সারারাত বাদশাহ অন্য পাশে ফিরে শুয়ে থাকে।মালিহা রাগ ভাঙানোর চেষ্টাও করে না। পরদিনই সে চলে যায়।তিতলিকে ফেলে যেতে খারাপ লাগছিল। কিন্তু, ফারহান বলেছিল কিছু দিন পর তিতলিকে নিয়ে আসবো আমাদের কাছে!
∆∆∆
আমি আর আপু অনেক দিন পর ছাদে উঠেছি আজকে। বাসায় আজ সকালে যা একটা ঘটনা ঘটলো তিশিকে নিয়ে।আজই ভাইয়া জানতে পেরেছে তিশির সাথে মা ভাইয়ার বিয়ের কথা ভাবছে।এতে, ভাইয়া খুব রাগ করেছে।বলেছে,এই মেয়েকে আমি নিজের ছোট বোনের মতো দেখেছি। তুমি ভাবলেও কিভাবে আমি একে বিয়ে করবো।এর এখন পড়াশোনার বয়স, খেলাধুলার বয়স।আর, তুমি চাইছো আমার সাথে বিয়ে দিতে?মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার?
মা ভাইয়ার উপর ভীষণ রাগ করেছে।বলেছে,ভাইয়া বিয়েতে রাজি না হওয়া পর্যন্ত সে জলস্পর্শ করবে না।মালিহা যদি বিয়ে করে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারে তাহলে তার ছেলে কেন পারবে না?
সত্যি সত্যিই মা দুপুরে কিছুই খায়নি। ঝিনুক আপু বলেছে, দুপুরে খেয়ে নেও। ভাইয়া তো অফিসেই জানবে না।রাতে খাবার টেবিলে আইসো না। তাহলেই হলো।
মা আপুকে ধমকে বিদায় করেছেন। বলেছে,এই বাড়ি থেকে যেন বেরিয়ে যায়।আপু আমাকে গম্ভীর ভাবে বলল,চল বেরিয়ে যাই বাড়ি থেকে।
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,বাড়ি থেকে বেরিয়ে কই যাবা?
আপু বললো,ছাদে।
এরপর থেকে আমরা ছাদে এসে বসে আছি।
ছাদে অনেক গুলো নতুন ফুলের টব, মেহেদী ভাইয়া এনেছে।গোলাপি রঙের গোলাপ ফুল গাছ যেটা আগে ছিল না।বেশ কয়েকটা নয়নতারা গাছ, হলুদ-কমলা গাঁদা ফুল,কার্নেশন ফুল আরো কতগুলো গাছ যেগুলোর নাম জানি না।মরিচ গাছ, ধনেপাতা গাছও লাগিয়েছে অনেক গুলো।মা ছাদ থেকে মরিচ, ধনেপাতা নিয়ে যায়।এই একটা কারনে ইদানিং মেহেদী ভাইয়াকে মা একটু একটু পছন্দ করে। মেহেদী ভাইয়া বলেছে,সব তরকারি,ফলের গাছ সে ছাদে লাগিয়ে দিবে,যেন মা টাটকা জিনিস খেতে পারে।সে নাকি খুব ভালো গাছের যত্ন নিতে পারে।মা বলে, পারবেই তো।ও তো নিজেই একটা গাছ।ছেলেটা একেবারে বলদের হাড্ডি তবে ভালোই।
মেহেদী ভাইয়া এখন বাইরে গেছেন।হয়তো ক্লাসে আছেন।তার ঘরে তালা ঝুলানো আছে।
আপু বললো,ধুরর কিছু ভাল্লাগে না।
আমি বললাম, আসলেই।
আপু উৎসাহ নিয়ে বললো,আয় মেহেদী গাধাকে ভয় দেখাই।
আমি বললাম,প্লীজ আপু এমনটা করো না। বেচারা সহজ সরল মানুষ। কেন তুমি খামোখা উনার পিছনে লাগো?
আপু ষড়যন্ত্রীর মতো হেসে বলল,মজা লাগে তাই।যা একটা কলম আর খাতার পেইজ নিয়ে আয়।
আমি প্রথমে আনতে না চাইলেও আপুর জোরাজুরিতে নিয়ে আসলাম।
আপু বসে বসে মেহেদী ভাইয়াকে পত্র লিখছে।
বঁরাবঁর,
মেঁন্দি পাঁতাঁ
প্রিঁয়তঁম জঁনাবঁ,আঁমি তোঁমাকেঁ মনঁ-প্রাঁণ দিয়েঁ ভালোঁবাসিঁ। তোঁমার বধূঁ হতেঁ চাঁই। তুঁমি আঁর আঁমি মাঝঁরাঁতে তাঁলগাঁছে ঠ্যাঙঁ ঝুঁলিঁয়ে বসেঁ ভালোঁবাসারঁ কঁথা বলঁবো।তোঁমাকে আঁমি পুঁকুঁর থেঁকে কাঁচা মাছঁ ধঁরে নিঁজেরঁ হাঁতে খাঁইয়ে দিঁবো।তঁবে শুঁনে রাঁখো তুঁমি যঁদি কোঁনো বিঁবাহিতঁ মাঁনুষঁ কেঁ এঁই চিঠিঁখাস্তঁ দেঁখাও তাঁহলেঁ তোঁমাকেঁ আমিঁ চুঁবিয়ে মাঁরবোঁ।
বিঁনীতঁ নিঁবেদঁক,
ইতিঁ ডাঁকিনীঁ
আমি করুন মুখে বললাম,আপু এসব কি লিখছো? তোমার কি মাথায় সমস্যা আছে?
আপু হাসির চোটে কথা বলতে পারছে না।
আমি বললাম,এসব কি আবোল-তাবোল লিখেছো?
আপু বললো, মেহেদী ভাইয়া নাকি এটা পড়ে ভাববে ডাকিনী ভূতের পত্র।আর,ভূতেরা নাকি স্বরে কথা বলে,তাই এতো গুলো চন্দ্রবিন্দু দেয়া হয়েছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, বিবাহিত মানুষ কে এই চিঠির কথা বলা যাবে না এটা কেন লিখছো?
আপু বললো,যেন চিঠি পাওয়া মাত্রই ঐ হাবলা আমার মা,বাবা বা অন্য কোনো বড় মানুষকে দেখাতে না পারে।
আমি বললাম,আপু উনি ভার্সিটি তে পড়ে।এতোটাও হাবা ভেবো না যে এই হাস্যকর লেখা পড়ে ভাববে ভূত লিখেছে।পরে, আরেক ঝামেলা বাঁধবে।
আপু বললো, চুপ থাক।ওর বুদ্ধির দৌড় আমার জানা আছে।
আপু গিয়ে জানালা দিয়ে চিঠিটা ভাইয়ার ঘরে ফেললো।
এর কিছুক্ষণ এর মধ্যেই মেহেদী ভাইয়া চলে আসলো। আমাদের ছাদে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
এরপর,তালা খুলে ঘরে ঢুকে দরজা দিয়ে ফেললো।
আপু বললো,দেখছিস শালা কত খারাপ?মনে করছে আমরা তার ঘরে ঢুকবো এর জন্য দরজাটা দিয়ে ফেললো।
আপুর কথা শেষ না হতেই ভিতর থেকে মেহেদী ভাইয়ার চিৎকার শোনা গেলো।
খানিকক্ষণ এর মধ্যেই উনি উদ্ভ্রান্তের মতো বেরিয়ে এলেন।হাতে আপুর চিঠিটা। তিনি ভয়ার্ত চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।
আপু ভালো মানুষ এর মতো জিজ্ঞেস করল,কি হয়েছে মেহেদী ভাই?
উনি আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, তোমাদের কি বিয়ে হইছে?
আপু বললো,না না।কি বলেন এসব?
এরপর,চিঠিটা আপুর হাতে দেয়।বলে,দেখো আমাকে সে চিঠি দিছে।
আপু বললো, কে?
মেহেদী ভাইয়া বললো,ঐ যে ড দিয়ে যার নাম।যে আমাকে বিয়ে করতে চায়।
আপু চিঠিটা পড়ার ভাণ করলো।আপু বললো, দেখছেন আপনি ভূতেরও তন্দ্রাহরণ করে ফেলেছেন। এরপর একটু থেমে, চিন্তিত ভাবে তাকিয়ে বললো,তবে শুনেন এই চিঠি ভুলেও বিবাহিত কাউকে দেখাইয়েন না।বড় বিপদে পড়বেন।
মেহেদী ভাইয়া চিন্তিত হয়ে বললো,কি করবো আমি এখন বলোতো।
ঝিনুক আপু বললো, আপনি একটা কাজ করেন। আপনার রুমের চাবিটা খাটের উপর রেখে যাবেন।যেন ভূত আপনার রুমে আসতে পারে।
– এতে কি লাভ হবে?
– আরে, মানুষরা যেমন সুন্দর জিনিস পছন্দ করে তেমন ভূতেরা অসুন্দর জিনিস পছন্দ করে। ধরেন,বিয়ের জন্য একটা মেয়ে দেখতে গিয়ে যদি দেখেন সেই মেয়ের ঘর অগোছালো ডাস্টবিনের মতো আপনি কি সেই মেয়েকে জীবনেও বিয়ে করবেন?
– আস্তাগফিরুল্লাহ না।
-তাইলে ভূতও যখন আপনার রুমে ঢুকে দেখবে আপনার রুম অনেক গোছানো তখন ভূতও বলবে আস্তাগফিরুল্লাহ কি রুচিশীল মানুষ।কি গোছানো, সুন্দর রুম ছিঃ ছিঃ ওয়াক থু।
এরপর আপনাকে আর সে পছন্দ করবে না।
মেহেদী ভাইয়া বললো, ধন্যবাদ ঝিনুক। তুমি অনেক বুদ্ধিমতী। কিন্তু, আমার ঘরে যদি কেউ ঢুকে?
– ওমা কে ঢুকবে?আমরা তো জীবনেও ঢুকবো না ।আর,অন্যকেউ তো জানবেও না যে আপনি চাবি জানালার কাছে খাটের উপর রেখে যান।

এরপর, ওহ তাইতো বলে মেহেদী ভাইয়া চলে গেল নিজের রুমে।
ঝিনুক আপু অনেক কষ্টে নিঃশব্দে হাসার চেষ্টা করছে।
আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ভার্সিটি তে পড়া ছেলে। এতোটাও বোকা না তাইনা যুথি?বলদামির উপর পিএইচডি করে রেখেছে এই ছেলে।
আমি আসলেই অবাক হলাম।একটা মানুষ এতোটাও বোকা হতে পারে। একবার ভাবলোও না ভূতের ঘরে ঢুকতে চাবি লাগবে কেন?
আমি আপুকে বললাম, আপু তুমি উনার ঘরের চাবি দিয়ে কি করবে?
– কি আর করবো…ওর ঘরটা একটু এক্সপ্লোর করবো।হি…হি।।
হঠাৎ এমন সময় মা ছাদে আসলো হন্তদন্ত হয়ে।বলতে লাগলো, ঝিনুক..যুথি বাদশার অফিস থেকে ফোন এসেছিল।ও অজ্ঞান হয়ে গেছে।
মা কাঁদতে লাগলো।আমরা দুইজন অবাক হয়ে গেলাম। মায়ের কান্নার শব্দে মেহেদী ভাইয়াও বের হয়ে এলো।
আমি,মা,আপু দ্রুত ভাইয়ার অফিসে গেলাম। সাথে মেহেদী ভাইয়াও গেল।
আমরা গিয়ে দেখি ভাইয়ার জ্ঞান ফিরেছে। একজন ডাক্তার ভাইয়াকে দেখছে। ভাইয়ার দৃষ্টি কেমন ঘোলাটে লাগছে।
মা কাঁদতে লাগলেন, বাদশাহ… বাদশাহ বলে।
আমি বললাম, ভাইয়া তোমার কি হইছে?
ভাইয়া বললো,কে আপনি?
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।মা চেঁচাতে লাগলেন।ডাইনী,শয়তানি পরপুরুষের সাথে পালায় গিয়ে খুব আনন্দে আছস। আমার ছেলের জীবন তছনছ করে। তোর উপর ঠাডা পরবো অসভ্যের বাচ্চা।
আমি মাকে অনেক কষ্টে থামালাম।সবাই মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে।ডাক্তার বললো, উনার এখন পর্যাপ্ত ঘুম এবং বিশ্রাম দরকার। উনি অনেক দিন ধরেই ঠিক মতো ঘুমায় না।স্ট্রেসের কারনে সাময়িক বিস্মরণ ঘটে থাকে।ঠিক মতো বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবে।আমি কিছু ওষুধও লিখে দিচ্ছি। চিন্তার কারণ নেই।
ভাইয়া তখনো শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চাহনি দেখেই বোঝা যাচ্ছে আমাদের কাউকেই চিনতে পারছে না।আমরা ভাইয়াকে নিয়ে বাসায় ফিরলাম।
মেহেদী ভাইয়া গেলো ওষুধ কিনতে।
গাড়ির মধ্যেই ভাইয়া ঘুমিয়ে পরলো।
বাসার সামনে গাড়ি থামায় আমি ভাইয়াকে ডেকে তুললাম।
ভাইয়া বললো,কিরে যুথি আমি এখানে কেন?আর তোরা সবাই?
ভাইয়া একদম স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলছিলো।
যেন কিছুই ঘটেনি।
ভাইয়া কে অফিস থেকে বেশকিছু দিন ছুটি দেয়া হলো।
তবে, বাসায় ফিরার পর থেকে ভাইয়া একদমই স্বাভাবিক।
এইভাবে দুইদিন কাটলো কোন সমস্যা ই হলো না।
তাই,আমরা চিন্তামুক্ত হলাম।
………
ভাইয়াকে নিয়ে চিন্তিত থাকার কারণে দুইদিন ঝিনুক আপু কোনো কান্ড ঘটায় নি। কিন্তু,আজকে বিকালেই আবার বলছে ,এই যুথি হাবাটাকে যে বলছিলাম চাবি রেখে যেতে।আয় তো দেখি ও চাবি রাখছে কি না…
আমি বললাম,কি দরকার আপু।বাদ দাও তো।
কিন্তু,আপু বাদ দিলো না। আমাকে আর পরী আপু কে নিয়ে ছাদে এলো। মেহেদী ভাইয়া এখন বাসায় নেই।অবশ্য,আমারও একটু একটু মন চাইছিল উনার ঘরটা দেখতে।
সত্যি সত্যিই উনি জানালার কাছে চাবি রেখে গেছেন।
আপুর চোখ উত্তেজনায় চকচক করে উঠলো। পরী আপু কে পাহাড়ায় রেখে আমরা দুইজন মেহেদী ভাইয়ার রুমে ঢুকলাম।কি সুন্দর ছিমছাম, গোছানো রুম। দেখলেই কেমন আপন আপন লাগে,শান্তি লাগে। ছেলেদের এতো গোছানো হতে আমি আগে দেখিনি।মা প্রায়ই বলে, মেহেদীর পা ধুয়ে পানি খাইতে পারছ না।তোরা মেয়ে হয়েও এতো অগোছালো কিসের জন্য?
যাইহোক, ঝিনুক আপু মেহেদী ভাইয়ার রং গুলো দেখছিলো।কত ধরনের রং উনার! আমি
দেখলাম, উনি একটা নতুন আয়নাও লাগিয়েছে রুমে।কি সুন্দর ডিজাইন করা কাঠের আয়না।
হঠাৎ আয়নার পাশে থাকা টেবিলে চোখ পরলো। দেখলাম একটা ছেড়া পৃষ্ঠা বই দিয়ে চাপা দিয়ে রাখা আছে।খানিকটা বেরিয়ে আছে।মনে হচ্ছিল যেন চিঠি।
আমি আপুকে ডেকে দেখালাম।আপু সেই পেইজটা হাতে নিয়ে পড়তে লাগলো।আমিও আপুর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে লাগলাম।
লেখাগুলো পড়ে আমরা দুইজনেই অবাক। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। পেইজটাতে লেখা ছিল:
“প্রিয়:ডাকিনী
শোনো,আমিও তোমাকে ভালোবাসি।আমি জানি তুমি আমার রুমে আসবা। তাই তোমাকে খুশি করতে তোমার একটা স্কেচ বানিয়েছি। টেবিলের ড্রয়ার টা খুলে দেখো পছন্দ হয় কি না…পছন্দ না হলে আবার আমাকে পানিতে ডুবিয়ে মেরে ফেলো না কেমন..আমি মরে গেলে তুমি কার সাথে তালগাছে ঠ্যাঙ ঝুলিয়ে বসে গল্প করবা বলো….
ইতি তোমার,মেন্দি পাতা”
ঝিনুক আপু আমার দিকে তাকালো, আমিও আপুর দিকে তাকালাম। আমাদের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।আপু বললো,কেইসটা কি বলতো।
আমি বললাম, জানি না আপু।ড্রয়ারটা খুলে দেখছি।
টেবিলের ড্রয়ার খুলে মেহেদী ভাইয়ার আঁকা ডাকিনীর স্কেচ টা আমি হাতে নিলাম। আমার হাত রীতিমতো কাঁপতে লাগলো।কারণ স্কেচটা ঝিনুক আপুর….
ঝিনুক আপু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।
আমি বললাম, তোমার ছবি এঁকেছে।

চলবে,,

ধূসর অনুভূতি পর্ব-০৫

0

#ধূসর অনুভূতি
পর্ব:০৫
লেখক: শাপলা

অনেক গুলো দিন পার হয়ে গেছে।মালিহা আর বাদশার ডিভোর্স হয়ে গেছে।মালিহা এখন ফারহানের বউ।এটাই তো সে চেয়েছিল। তবুও সারাক্ষন মনের মধ্যে অশান্তি।মালিহা সারাক্ষনই ভাবে,সে কি আসলেই ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে?এর মাশুল দিতে হবে না তো…
যখন বাদশাদের বাড়িতে থাকতো তখন মনে হতো বাদশাহ আর তার পরিবারের মতো টক্সিক মানুষ এই দুনিয়ায় আর নেই।মালিহা ওদের সহ্যই করতে পারতো না… পুরানো সময়ে ডুব দেয় মালিহা। ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন বাদশাহ তাকে একটা চিঠি দেয়।চিঠির সারমর্ম এই,বাদশা তাকে সেই কলেজের প্রথম দিন থেকে ভালোবাসে। কিন্তু,প্রত্যাখানের ভয়ে বলেনি। আজ,আর না বলে থাকতে পারছে না।
এমনিতেই সেদিন মালিহার মেজাজ খারাপ ছিল।তার উপর এই নেকা মার্কা ভালোবাসার চিঠি পড়ে
কেন জানি মালিহার খুব রাগ হয়।সে বাদশাকে ডেকে যা নয় তাই বলে অপমান করে।
বাদশাহ সেদিন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। তার চোখে পানি টলমল করছিল।
সেদিন বাসায় ফিরে মালিহার কোনো কিছুতেই মন বসছিল না।বাদশার অশ্রুসজল চোখ দুটোর কথা মনে পড়ে মায়া লাগছিল।মনে হচ্ছিল, ধুর এইভাবে না বলে ভদ্রভাবে রিজেক্ট করলেই হতো।
সে ঠিক করে বাদশাকে স্যরি বলবে। কিন্তু, ভার্সিটি আবার পরপর দুই দিন বন্ধ ছিল। তিন নম্বর দিন ক্লাসে গিয়ে সে জানতে পারে বাদশা গতকাল এক্সিডেন্ট করেছে।কি মনে করে সে হাসপাতালে যায় বাদশাকে দেখতে।সাথে আপেল কিনে নিয়ে যায়।
বাদশার ভয়াবহ তেমন কিছু হয় নি। শুধু একটা হাত ভেঙেছে আর মাথায় চোট পেয়েছে।মাথার চোটের জন্যই ভর্তি হয়েছে।
মালিহা যখন গিয়েছিল তখন বাদশাহ ঘুমে ছিলো।
ঝিনুক আর যুথি তার উপর হামলে পড়ে।বলতে থাকে,আপু তুমি মালিহা না?
মালিহা অবাক হয়ে যায়।তাকে ওরা কিভাবে চিনে?
ওরা বলে,ভাইয়া তোমাকে নিয়ে আমাদের কাছে অনেক গল্প করে,তাই দেখেই বুঝে গেছি। তোমাকে অনেক পছন্দ করে তো তাই।
মালিহা অবাক হয়ে বলে,আমাকে নিয়ে কি গল্প করে?আমি তো ওর সাথে কোনো দিন কথাই বলিনি।চিনিও না তত একটা।
ঝিনুক বলে,এই যে তুমি কোনদিন কি ড্রেস পরে ক্লাসে আসো।কত নম্বর বেঞ্চে বসো।কোন ক্লাসে স্যার তোমার প্রশংসা করে।কোন দিন বেশি হাসো,কোন দিন মনমরা থাকো। তোমার কয়টা বান্ধবী এইসব।
মালিহা দারুন অবাক হয়।ভাবে মেয়ে গুলো মিথ্যা বলছে। কিন্তু,যুথি বলে গত রবিবারে তুমি বেগুনি একটা জামা আর নীল ওড়না পরে আসছিলা।চুলে তেল দিয়ে বেনি করছিলা তাই না?আর সিড়ি দিয়ে উঠার সময় হোঁচট খেয়েছিলা।
বলেই হাসতে থাকে।মালিহা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। জিজ্ঞেস করে, তোমাদের ভাইয়া এইসব তোমাদের কেন বলে?
যুথি হেসে বলে, ভাইয়ার মাথার তার ছিড়া তো তাই।আমরা রোজ বলি, তোমার এই ঘোড়ার ডিমের কাহিনী শুনবো না।পারলে প্রপোজ করে এসো।দ্যান শুনবো।
ভাইয়া রোজই বলে,আজকে প্রপোজ করবোই। কিন্তু, তোমাকে দেখলেই তার সাহস হাওয়া হয়ে যায়।
মালিহার খুব হাসি পায়।বিষয়টা তার কাছে মজাই লাগে। ঝিনুক,যুথিকেও খুব পছন্দ হয়। অনেক মিশুক দুইবোন।
একদিনেই অনেক ভাব জমে যায়। অনেক ক্ষন পরেও বাদশাহ ঘুম থেকে না উঠলে মালিহা চলে যায়। ঝিনুক আর যুথি দুইজন মালিহার দুই হাত ধরে এগিয়ে দিয়ে আসে।
পরের দিন ক্লাসে একটা ছেলে বলে,বাদশাকে আজ সকালে দেখতে গেছিলাম।দেখি আপেলের প্যাকেট জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। বললাম,খাবি?তাহলে ছিলে দেই?
আমাকে এমন ধমক দিলো।বললো,ঐ শালা এই আপেল কি খাওয়ার জিনিস? মাথায় আঘাত পেয়ে মাথায় গন্ডগোল দেখা দিছে নাকি কে জানে?
মালিহার প্রচন্ড হাসি আসে,মনে মনে নিজেকে ভাগ্যবতী ও মনে হয়। তাকে কেউ এতো ভালোবাসে?
এরপর বাদশাহ ক্লাসে এলো।মালিহা বাদশার দিকে তাকালেই সে চোখ নামিয়ে নেয়।
মালিহার খুব হাসি পায়।এমনিতে তো খুব সাহসী। তাদের এক সবচেয়ে বদরাগী,ক্ষমতাধর স্যারের বিরুদ্ধে একাই প্রতিবাদ করেছিল একবার। আর, এখন মালিহা তাকালেও নার্ভাস হয়ে যায়।মালিহা একদিন বাদশাকে ডেকে তার নম্বর টা দেয়।বলে,পঞ্চাশ টাকা পাঠিও আমার নম্বরে।
বাদশাহ বিনা বাক্যে রাজি হয়।মালিহা ইচ্ছা করেই দিয়েছিল।নাহলে, বাদশাহ নিজে এসে কোনোদিন চাইবে না। ততদিনে মালিহারও বাদশাকে ভালো লাগতে শুরু করেছে।
যাইহোক,মালিহা ভেবেছিলো বাদশাহ তাকে রাতে ফোন করবে।তাই,সে হাতের কাছেই ফোন টা রাখে। কিন্তু,কোনো ফোন আসে না। অবশেষে, অনেক ক্ষন পরে একটা আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসে।মালিহা দ্রুত ফোন উঠায়।তার বুকে অন্যরকম একটা শিহরণ বয়। কিন্তু, ফোন ধরার পর ওপাশ থেকে একটা মেয়েলী কন্ঠ শোনা যায়।মেয়েটা বলে,মালিহাপু আমি ঝিনুক। বাথরুম থেকে বলছি।
মালিহা বলে,ওমা কেন?
ঝিনুক বলে,আরে লুকিয়ে ফোন করছি তোমাকে। আমার ভাই হাবাদশাহকে তুমি নম্বর দিয়েছো?
-হাবাদশাহ মানে?
– আরে হাবা যোগ বাদশাহ আরকি।
মালিহা হেসে কুটিকুটি হয়।
– দিয়েছো না আপু?
– হুম দিয়েছি তো।
– ভাইয়ার মন মানছে না তোমাকে ফোন করার জন্য। কিন্তু,ভয়ে করতে পারছে না।ভাবছে তুমি রেগে যাবা।আমরা অনেক বুঝাচ্ছি যে নম্বর দিয়েছে তো ফোন করার জন্যই। কিন্তু,সে বুঝছে না।বলছে, তুমি নাকি ফ্লেক্সিলোড করতে নম্বর দিয়েছো।কত বড় হাবদশাহ!
মালিহা হাসি থামাতে পারেনা কিছুতেই।বলে, এখন কি করা যায় বলোতো।
ঝিনুক বলে,আপু তুমি ফোন দেও।ভড়কে যাবে আর অনেক খুশিও হবে।
সত্যি সত্যিই মালিহা একটু পর ফোন করে।
আর,সে রাতে তাদের দুইঘন্টার মতো কথা হয়। বাদশাকে তার দারুন লাগতো তখন। কথাবার্তা,চালচলন,হাসি সবকিছুই ভালো লাগতো। একদিন দেখা না হলে অস্থির অস্থির লাগতো।সেই সময়গুলো খুবই সুন্দর ছিল। একেবারে স্বপ্নের মতো।
এইভাবে তিন বছর কেটে যায়।মালিহার বাবা তার অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক করে।বাদশার কি কান্নাকাটি তখন! অনেক কষ্টে বাবাকে মানাতে হয়েছে মালিহার।কারণ,বাদশারা আর্থিকভাবে তাদের চেয়ে নিচু পর্যায়ের,আর বাদশা তখনো চাকরি পায়নি। খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে, কান্নাকাটি করে, অনুরোধ করে বাবাকে রাজি করিয়ে ছিলো মালিহা।মা বলেছিলো,তুই মানিয়ে নিতে পারবি না ওদের সাথে।বিয়ে আর প্রেম আলাদা। প্রেমের সময় মনে হয় গাছতলায়ও থাকতে পারবো, কিন্তু বিয়ের পর সেটা করা যায় না।মালিহাও পাল্টা জবাব দিয়েছিল। বলেছিল, তাদের ভালোবাসা এতো ঠুনকো নয়।
এরপর, দুইজনের বিয়ে হয়। ঘরোয়া ভাবে কোনোরকম।মালিহার অনেক স্বপ্ন ছিল অনুষ্ঠান করে বিয়ে হবে,সে পরীর মতো সাজবে। ফটোশুট করবে স্বামীকে নিয়ে। খুব ধুমধাম হবে।
তবে,সেসব না হওয়াতে কষ্ট ছিল না মালিহার। ভালোবাসার মানুষটাকে তো পেয়েছে!
কিন্তু, বিয়ের পরদিনই তার শ্বাশুড়ি তাকে ডেকে বলে, তোমার কি লজ্জা নাই? বেকার একটা ছেলে কে বিয়ে করে ফেলছো।ও তো নিজেই বাপের হোটেলে খায় তোমাকে পালবে কিভাবে?
মালিহার চোখে পানি চলে এসেছিল সেদিন। বাদশার মা সারাক্ষণ ই মালিহাকে কথা শোনাতো। মালিহা তেমন রান্না-বান্না পারতো না। তিনি বলতেন,বিয়ে তো লাফ দিয়ে করে ফেলছো। তখন তো পারি না বলো নাই। রান্নার বেলায় পারি না বলো কোন মুখে?
তিনি অনেক সময় এটাও বলতেন যে তোমরা না বড়লোক। তোমার বাবা তো দশটা টাকাও দিলো না বিয়েতে। আমার বেকার ছেলের ঘাড়ের উপর বসে খাচ্ছো।মালিহা খুব খুব কষ্ট পেতো। অবশেষে, বিয়ের ২২ দিনের মাথায় বাদশার খুব ভালো একটা চাকরি হয়।মালিহা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
বাদশাহকে একদিন সব খুলে বলে যে তার মা সারাক্ষণ ই যা নয় তাই ব্যবহার করে। বাদশাহ সব শুনে বলে, মায়ের কথায় কিছু মনে করো না।মায়ের একটু রাগ বেশি।দেখো না আমাদের তিন ভাইবোনকেও সারাক্ষন বকে দেখো না।
মালিহা অবাক হয়।বলে, তুমি মাকে কিছু বলবা না?
বাদশাহ দ্বিগুণ অবাক হয়ে বলে,মাকে আমি কি বলবো?
মালিহা আর কিছু বলে না। ততদিনে সংসারের সব কাজ মোটামুটি সেই করে।আর, তার শ্বাশুড়ি সারাক্ষন ভুল ধরে।এটা হয় নাই,ওটা হয় নাই।
সারা জীবন কুটোটি না নাড়া মালিহা যেন সংসার করতে এসে অথৈ সমুদ্রে পরে।মালিহার সব বান্ধবীদের বিয়ে হয়েছে অত্যন্ত ধনী পরিবারে।তারা মালদ্বীপ যায়,বালি যায়।কত দামি দামি উপহার পায় স্বামীদের থেকে। ফেসবুকে ঢুকা যায় না তাদের পোস্ট এর জন্য।
মালিহার না চাইতেও একটু মন খারাপ হয়।মালিহা তো এতো কিছু চায়না। শুধু একটু ভালোবাসা, সম্মান আর প্রশংসা চায়।সেটাও পায় না ঠিকমতো। বাদশাহ কখনো কিছুর প্রশংসা করে না।যেচে যদি মালিহা জিজ্ঞেস করে, রান্না কেমন হইছে? তখন বলে, হুম ভালো। ব্যাস এইটুকুই।মালিহার বান্ধবীরা একদিন আসে তার বাসায়।সেটা বাদশার মা ঠিক পছন্দ করে না।বলতে থাকে,এইসব উশৃঙ্খল মেয়েদের সাথে তোমার মেলামেশার দরকার নেই।কি পোশাক আশাকের ছিরি একেকজনের।
মালিহা সেদিন পাল্টা জবাব দেয়।
এতেই দুইজনের ঝগড়া হয়ে যায়। বাদশাহ বাসায় ফিরে মালিহাকেই দোষারোপ করে।বলে, তুমি কেন মায়ের মুখে মুখে জবাব দিতে গেলা?
মালিহা অবাক হয়।যা বলবে সব সহ্য করতে হবে?
বাদশাহ বলে, নিজের মা ভেবে মেনে নাও না।এমন করো কেন?
মালিহা বলে,আমার মা কোনো দিনও এমন কথা বলতো না।আমাকে দিয়ে এভাবে কলুর বলদ খাটাতো না।কাজেই আমার মায়ের সাথে তোমার মায়ের তুলনা করবা না।
সারাক্ষন কিছু না কিছু নিয়ে ঝামেলা হতোই।চার রুমের একটা বাসা।মালিহাদের কোনো প্রাইভেসিই ছিল না।মালিহা শখ করে শাড়ি,চুড়ি, প্রসাধনী কিছু কিনলেও সেটায় এসে ঝিনুক,যুথি ভাগ বসাতো।ভাবী এটা দেও,সেটা দেও নির্দ্বিধায় আবদার।
মালিহার কাছে ওদের বিরক্ত লাগতো।আর, সারাক্ষন ভাইয়া এটা আইনো,ওটা আইনো।
কয়টাকাই বা বেতন পায়। প্রতিদিন যদি এতো কিছু আনতে হয়। তাদের ভবিষ্যৎ এর জন্যেও তো কিছু টাকা বাঁচাতে হবে।এইসব বাদশাহকে কে বুঝাবে?
এরপর, আবার বাদশাহ পীড়াপীড়ি করতে লাগলো বাচ্চা নেয়ার জন্য।মালিহা প্রচুর বিরক্ত হয়।সে চাইতো বিয়ের কয়েকটা বছর যাক। দুইজন কিছু সময় একসাথে কাটিয়ে তারপর অন্য চিন্তা।
কিন্তু,না। বাদশাহ বলে, তুমি কি আমার সাথে সংসার করতে চাও না?অন্য কোথাও চলে যাওয়ার প্ল্যান আছে?নাকি আমি ছাড়াও তোমার কেউ আরো আছে? কিসের জন্য বাচ্চা নিতে চাও না?
মালিহার বিরক্ত লাগে খুব।মা বলে, বাচ্চা হলে নাকি সব ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু,তিতলি হওয়ার পরেও কিছু ঠিক হয় না। দিনদিন মালিহার সব অসহ্য লাগতো। বাচ্চা পালা, আবার রান্না করা, তার উপর শ্বাশুড়ির কথা শোনা।
সে চাইতো আলাদা হয়ে যেতে।কিশোর বয়স থেকে স্বপ্ন দেখেছে তার আর তার বরের ছোট একটা সংসার হবে। দুইজনের ছিমছাম সংসার।সে রান্না করার সময় বর পাশে বসে থাকবে, জোছনা হলে দুইজন ছাদে উঠবে। নানান জায়গায় ঘুরতে যাবে।সে শাড়ি পরে সাজবে; তার বর মুগ্ধ চোখে তাকে দেখবে।
এসবের কিছুই বাস্তব জীবনে হয় না।
বাদশাহ কে আলাদা বাসার কথা বলায় সে বলে,আর দ্বিতীয় বার এই কথা উচ্চারণ করবে না।
বাসায় ফিরার পর সে তিতলিকে রাখতো।তার বাবার রুমে যেয়ে কিছু ক্ষন বসতো, বোনদের সাথে কথা বলতো। এরপর,ঘুমিয়ে যেতো। আবার, সকালে অফিস। সারাদিন বাইরে থাকা।ফিরে এসেও সেইম রুটিন।মালিহার সাথে আলাদা কিছু সুন্দর সময় কাটানো তার হতোই না।
কেমন যেন ধূসর মনে হতো জীবনটা।কোনো রঙ নেই।

চলবে,,

ধূসর অনুভূতি পর্ব-০৪

0

#ধূসর অনুভূতি
পর্ব:০৪
লেখক-শাপলা

ভাইয়া আজ অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়িই ফিরলো।তিশি তখনো যায় নি। ভাইয়া তিশির ব্যাপারে কিছুই জানেনা।মা ভাইয়াকে না জানিয়েই বিয়ে-শাদির মতো বড় ব্যাপার নিয়ে ভাবছে। মায়ের স্বভাব এমন বিচিত্র টাইপেরই। ভাইয়া আসার কিছুক্ষন পর মা বললো,যা তো বাদশাহ তিশিকে একটু দিয়ে আয়।একা একা ওর যাওয়া ঠিক হবে না।রাস্তা-ঘাট ভালো না।
ভাইয়া সহজ মনেই রাজি হলো। ভাইয়া হয়তো ভেবেছে এই মেয়ে আমাদের কারো বান্ধবী হবে। মায়ের ধারণা তিশির মতো বুঝদার, ভালো,লক্ষ্মী মেয়ে এই জগত সংসারে একটিও নেই। ভাইয়া যদি ওর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে তাহলেই ভাইয়ার ওকে মনে ধরে যাবে।তিশি খুব লাজুক ভঙ্গিতে ভাইয়ার সাথে যেতে রাজি হলো। ভাইয়া বললেন,কি ব্যাপার খুঁকি? তুমি এতো লজ্জা পাচ্ছো কেন?এসো।
মা বিরক্ত হয়ে বললো,ওকে খুঁকি বলছিস কেন?
ভাইয়া খানিকটা অবাক হলেও আর কথা বাড়ালো না।চলে গেল তিশিকে নিয়ে।মা আমার দিকে ফিরে বললো,দেখলি গাধাটার কান্ড? দুইদিন পর যার সাথে বিয়ে হবে তাকে বলছে খুঁকি….
আমি সাহস করে বলেই ফেললাম,মা ভাইয়া বিয়ে করতে রাজি হবে না কখনোই।
মা আমার দিকে শীতল চোখে তাকালো।বললো,রাজি হবে না?
আমি নাসূচক মাথা নাড়লাম।
মা বললো,জানতে পারি কি কারণে?
আমি মাথা নিচু করে রইলাম। ভাইয়া আর মালিহা ভাবীর পরিচয় সেই কলেজ লাইফ থেকেই। তখন থেকেই ভাইয়া ভাবীকে ভালোবাসতো একতরফা ভাবে।পরে অবশ্য ভাবী জানতে পেরেছিলো। তারপর,তিন বছর প্রণয়ের পরে চার বছরের সংসার।এতো দ্রুতই কি ভোলা যায়? মাকে এই জিনিস বুঝাবে কে?
মা বললেন,ঐ জারজের বাচ্চার জন্য আমার ছেলে সারাজীবন কাঁদবে নাকি?
আমি বললাম,আমি জানি তুমি এখন গালাগালি শুরু করবা।প্লিজ এটা করোনা।ভাবী যদি খারাপও হয় তুমিতো ভালো তাহলে কেন একজন খারাপ মানুষের জন্য মুখ খারাপ করবে?
মা বললেন,আচ্ছা গালি দিবো না। খুব সম্মান করবো মহারানীকে।
মা একা একাই বলতে লাগলো,কত বলছিলাম বাদশাহ রে এমন আধুনিক,অহংকারী মেয়ে বিয়ে করার দরকার নাই।এর সাথে তুই মানায় নিতে পারবি না। সারাক্ষন বাপের সহায়-সম্পত্তি নিয়ে বড়াই করে তোরে জ্বালিয়ে মারবে।কে শোনে কার কথা? তখন তো মায়ের কথা বিষের মতো লাগে।যত মধু সব ঐ ডাইনীর কথায়। এখন তো হারে হারে বুঝলি।
মা চোখের পানি মুছলেন। চিন্তা করছিস,মেয়ে মানুষ এমন হয়?তিন বছরের বাচ্চা ফালায় যায়গা?এ কেমন মেয়ে?আরে এরে কি আমি স্বাধে ডাইনী বলি?
আমি কি বলবো খুঁজে পেলাম না।
মা বললেন, আমার ছেলের আমি আবার বিয়ে দিবোই। এইবার ও অনেক সুখে থাকবে।ওর সুখ দেখে আমার চোখ জুড়াবে।বিয়ে করতে চাইবো না মানে ,করতেই হবে।নয়তো আমি এই বাড়িতে আর থাকবো না।
আমি আর মা কথা বলছি এমন সময় কে যেন বেল বাজালো। দরজা খুলে দেখি মেহেদী ভাইয়া।আমি অবাক হয়ে বললাম, ভাইয়া আপনি এই সময়ে?
মা তৎক্ষণাৎ কে এসেছে বলতে বলতে চলে এলেন। এসেই ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন,কি দরকার?
মেহেদী ভাইয়া বললো,আসলে ঝিনুককে একটা জিনিস দিতে এসেছিলাম ‌।
মায়ের ভ্রু আরো কুঁচকে গেল।বললো, কি জিনিস? আমার হাতে দেও।
মেহেদী ভাইয়া তার আঁকা ছবিটা মায়ের হাতে দিলো।মুখে বললো,ওকে বলবেন পরে আমি সময় নিয়ে আরো সুন্দর করে এঁকে দিবো।
মেহেদী ভাইয়া চলে গেলেন।মা তখনো হতবম্ভ হয়ে রইলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,কি চক্কর চলতেছে? এখন কি বলবি এমনি এমনিই ছবি এঁকে দেয়।
আমি বললাম,আমাকে বলছো কেন?আপুর ছবি আপুকে বইলো।
মনে মনে আপুর জন্য দুঃখ হতে লাগলো।আজ, আপুর কপালে দুঃখ আছে।
আপু ফিরলো সন্ধ্যায়।মা গিয়ে হামলে পড়লো আপুর উপর।যা মুখে আসে তাই বলতে লাগলো।
ঝিনুক আপু বললো, চুপ করো মা। তোমার এমন অসংলগ্ন কথাবার্তার জন্যেই মালিহা ভাবী চলে গেছে। কোনদিন দেখবা আমিও চলে গেছি।
মা নিমিষেই চুপ হয়ে গেল। তবে, তার চোখ দিয়ে আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে।
– আমার জন্য চলে গেছে?আমি ওকে বলছি ঘরে স্বামী রেখে পরপুরুষের সাথে ভাগতে?আর,তুই কই যাবি?ছাদে থাকা চাল-চুলোহীন ছেলের সাথে যাবি?
– উফ মা আমার ছবি এঁকে দিছে কি এমনি এমনি নাকি?আমি টাকা দিছি তাই দিছে। সে একজন পার্টটাইম চিত্রশিল্পী। টাকার বিনিময়ে মানুষের ছবি আঁকে।এই সামান্য বিষয়টাকে তুমি এতো বড় বানাচ্ছো কেন?যদি অন্য কোনো ব্যাপার থাকতো তাহলে কি সে তোমার হাতে ছবি দিতো?
মা বললেন,এই কথা বাদ দে। একটু আগে কি বললি আমার জন্য মালিহা ডাইনী চলে গেছে?
– না মা, তোমার জন্য যায়নি। তার চরিত্র খারাপ এর জন্যই গেছে। কিন্তু, তোমার কথা শুনতে মেয়ে হয়েও আমারই কষ্ট হয় তাহলে বুঝো ভাবীর কেমন লাগতো?
-ভাবী বলছিস কাকে?
– মোটকথা,তুমি কথায় কথায় গালাগালি একটু কম করবা। তোমার গালাগালি শুনে তিতলি অনেক ভয় পায়।আর, তোমার আদরের তিশি যদি তোমার এই রূপ দেখে তাহলে বিয়ের নামও নিবে না।
– তোর থেকে আমার জ্ঞান শুনতে হবে?যে ভালো তার সাথে আমি ভালো ব্যবহারই করি।
মা আর আপুর ঠান্ডা যুদ্ধ চলেই যাচ্ছে।
আমি আর সেসবে কান দিচ্ছি না। তিতলির সাথে খেলছি।
অনেক ক্ষন পর আপু রুমে আসলো।বললো,দেখলি যুথি গাধাটার কান্ড দেখলি? আমার ছবি এনে মায়ের হাতে দিলো?ওর গাধামি জন্মের মতো ছুটাবো আমি।
আমি বললাম,কি করবা আপু?
– দেখ না কি করি।এমন শাস্তি দিবো যে ও জন্মের মতো মনে রাখবে।
…….
ঝিনুক আপু আর তার সঙ্গী পরী আপু মিলে প্ল্যান করেছে তারা মেহেদী ভাইয়াকে ভূতের ভয় দেখাবে।আমি অনেক বার বুঝেয়েছি যে এমন করা টা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। কিন্তু,কে শোনে কার কথা।তারা এই বিষয় নিয়ে খুবই মজা পাচ্ছে।
যথারীতি এরপর দিন পরী আপু পরিক্ষার পড়া পড়বে আপুর সাথে এই বাহানায় কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে আমাদের বাসায় চলে এলো। তার ব্যাগে যদিও বইয়ের বদলে আছে সাদা শাড়ি।রাতে একটা সাদা শাড়ি পরে ভূত সাজার প্রক্রিয়া শুরু করে দিলো ঝিনুক আপু। মুখের মধ্যে লিপস্টিক দিয়ে রক্ত বানানো হলো,কাজল দিয়ে চোখ এর নিচটা কালো কুচকুচে করা হলো। এরপর দরজা বন্ধ করে শুধু বাসার সবার ঘুমানোর অপেক্ষা।
আমার মনে মনে খুব চিন্তা হচ্ছিল কি যে হবে!
সত্যিই রাত ১২:৪৫ এ আমরা তিনজন ছাদে গেলাম। প্ল্যান হলো, আমি দরজায় আর পরী আপু জানালায় টোকা দিতে থাকবো। মেহেদী ভাইয়া তখন ঘর থেকে বের হবে।আর, তখনই সাদা শাড়ি পরা, চুল ছাড়া ঝিনুক আপু কে দেখবে।আপু যদিও হাতে একটা মোমবাতি নিয়ে এসেছে। কিন্তু,সেটার আর দরকার পরবে না।কারণ,আকাশে যথেষ্ট চাঁদের আলো আছে।
প্ল্যান মোতাবেক কাজ শুরু হলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও দরজায় নক করতে লাগলাম।
মেহেদী ভাইয়া মনে হয় জেগেই ছিলো। জিজ্ঞেস করতে লাগলো, কে…কে….
ওদিকে পরী আপু জানালায় নক করছে।এক পর্যায়ে ভাইয়া দরজা খুললো।আমি তখন দরজার আড়ালে চলে গেছি।আর, ঝিনুক আপু দরজা বরাবর ছাদের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে আছে।
মেহেদী ভাইয়া প্রথম দেখাতেই ভয়ে একটা চিৎকার দিয়ে উঠলো। এরপর কাঁপতে লাগলো থরথর করে। দরজার আড়াল থেকে আমি তার দুয়া পড়ার শব্দ পাচ্ছি। ঝিনুক আপুকে মোটেও ভূতের মতো লাগছে না।হাস্যকর জোকারের মতো লাগছে।ভূতের মতো ধীর পায়ে না হেঁটে আপু জোরে জোরে হেঁটে সামনে আসছে।পরী আপু আড়াল থেকে ঝুমঝুমি বাজাচ্ছে।সেই আওয়াজও হাস্যকর। কিন্তু, মেহেদী ভাইয়া প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেছে।অতি মাত্রায় ভয় পেয়ে জমে গেছে পুরোই।তাই, নড়াচড়াও করছে না। ঝিনুক আপু খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে একটু ভারী গলায় বললো,এই মেহেদী আজকেই তোর শেষ দিন।
ভয়ে মেহেদী ভাইয়া আবার প্রচুর জোরে একটা চিৎকার করলো।এবং, এরপর যা করলো তার জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না।সে ভূতের ভয়ে ভূতকেই জড়িয়ে ধরে ফেললো।বলতে লাগলো,প্লিজ আমাকে বাঁচান।
হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকতেও পারলাম না বেশি ক্ষন।কার যেন পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম।
আপু মেহেদী ভাইয়াকে বললো,ছাড় আমাকে ছাড়।
তবুও কাজ হচ্ছে না,সে কিছুতেই ছাড়ছে না।খালি বলছে,আমাকে বাঁচান। এরপর,ধাক্কা দিয়ে,খামচি দিয়ে,পা দিয়ে লাথি মেরে মেহেদী ভাইয়াকে সরিয়ে আপু দৌড়ে পানির ট্যাংকের পিছনে লুকালো। ততক্ষণে মেহেদী ভাইয়া অজ্ঞান হয়ে গেছে।আমরাও লুকিয়ে পরেছি। ঝিনুক আপু বললো,দেখছিস কত বড় মহা গাধা হলে কোনো মানুষ ভয় পেয়ে ভূতের কাছেই সাহায্য চাইতে পারে। ততক্ষণে, আমাদের পাশের বাসার আরমান আংকেল তার ছেলে কে নিয়ে ছাদে এসেছে।সম্ভবত মেহেদী ভাইয়ার বিকট চিৎকার শুনতে পেয়েছে।পরী আপু খুব আস্তে আস্তে বললো, তোর সাদা শাড়ি টা খোল।নয়তো আজকে ধরা খাবো।আপু প্লাজো আর একটা টি-শার্টের উপর দিয়ে শাড়িটা পেঁচিয়েছে।তাই,শাড়ি খুলে ফেলল। ততক্ষণে বাবা-মাও ছাদে এসেছে। আরমান আংকেল কল করে বাসার আরো অনেক কে আনিয়ে ফেলেছে।পরী আপু বললো,সবাই মেহেদী গাধাকে নিয়ে ব্যস্ত এই সুযোগে আমরাও ওদের পিছনে যেয়ে দাড়াই।সবাই ভাববে আমরাও চিৎকার শুনে এসেছি।আর, ঝিনুক তুই আমার পিছনে মাথা নিচু করে থাকবি যেন তোর মুখ কেউ না দেখে। এরপর,আস্তে নিচে নেমে যাবি। গিয়ে মুখ-টুখ ধুয়ে ফেলবি।
যেই বলা সেই কাজ।
আপু চলে গেল নিচে।মা একফাঁকে আমাকে জিজ্ঞেস করলো দরজা খোলা ছিল কেন?
আমি বললাম, চিৎকার শুনে আরমান আংকেল এর সাথে ছাদে এসেছি।।
মা আর কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না।পানি ছিটিয়ে মেহেদী ভাইয়ার জ্ঞান ফিরানো হলো।সে জ্ঞান ফিরার পর থেকেই ভূত ভূত বলে চেঁচাচ্ছে।

তার এতো ভয় পাওয়া দেখে বাবা বললেন,আজকে এইখানে থাকতে হবে না। তুমি বরং বাসায় চলো। বাদশার রুমে থেকো আজ।
পরদিন সকালে কোথা থেকে বাবা একটা ওঝা ধরে নিয়ে আসলো।সে নাকি মহা-ক্ষমতাধর। পকেটে ভূত নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
আমার একটু ভয়ভয় করতে লাগলো।যদি সত্যি বুঝে ফেলে উনি যে আমরা করেছি এই কাজ।আপু বললো, চুপ থাক গাধা।তুই মুখ না খুললেই হয়,কেউ জানবে না।
ওঝা মেহেদী ভাইয়াকে পরিক্ষা-নিরিক্ষা করে বললো,ডাকিনী এসেছিল মেহেদী ভাইয়ার কাছে।
ডাকিনী না কি ভূতেদের মধ্যে অত্যন্ত শক্তিশালী নারী ভূতের জাত।
বাবা জিজ্ঞেস করল, কেন এসেছিল ওর কাছে?
ওঝা বললো,ওকে পছন্দ করছে।বিয়ে করতে চায়। অনেক ভূত ই মানুষের প্রেমে পরে জীবন অতিষ্ঠ করে দেয়,বিয়ে করার জন্য।
ঝিনুক আপু আর আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
বাবা বললো,এর হাত থেকে বাঁচতে কি করতে হবে?
ওঝা বললো,ঘর বন্ধ করতে হবে।আর, তাবিজ পরতে হবে।আমি সব ই দিবো। মূল্য মাত্র ৫ হাজার।
মেহেদী ভাইয়া তখন বললো,না না লাগবে না।আমি মনে হয় ভুল দেখেছি।
ওঝা বললো,আরে কি বলো তুমি? কিসের ভুল?এখনো তোমার আশেপাশে ঐ ডাকিনীর অস্তিত্ব টের পাচ্ছি আমি।ও তোমার জীবন নরক করে দিবে। তোমার এতো বড় ক্ষতি আমি হতে দিতে পারি না। তুমি আমার ছেলের সমান।যাও,টাকা দরকার পরলে একটু কম রাখবো।
বাবা বললো,টাকা নিয়ে চিন্তা করবেন না।ওর সাথে যেন আর এমন না হয় সেই ব্যবস্থা করুন।
– করবো তো বটেই।তবে ডাকিনী খুব বেশি শক্তিশালী।এটাই চিন্তার বিষয়। এখন তুমি একটু দূরে যাও বাবা।
মেহেদী ভাইয়া উঠে এসে আমাদের পাশে দাঁড়ালেন। করুন ভাবে বলতে লাগলেন,কি হয়ে গেল না? আমার জন্য তোমাদের অনেক বিপদে পরতে হলো।
আপু বললো, শোনেন এইসব ভূত-টুত কিছুই না।সব আপনার চোখের ভুল।ওঝা টা হলো মিথ্যুক। আপনি বাবাকে বলে একে বিদায় করান।৫ হাজার কি কম টাকা?
মেহেদী ভাইয়া বললো, আমিও তাই ভাবছিলাম চোখের ভুল, মনের কল্পনা। কিন্তু, ভূতটা ধাক্কা দিলো,খামচি দিলো।তার নখের দাগ আমার গায়ে এখনও আছে।তাহলে চোখের ভুল হয় কেমনে?তবে,ওঝা স্যার যে মিথ্যুক সেটা আমিও বুঝতে পারছি।ওঝা স্যার বারবার বলছে,ডাকিনী অনেক শক্তিশালী। কিন্তু,এটা মিথ্যা। মোটেই শক্তিশালী না। আমার হাত থেকেই ছুটতে পারছিলো না। আমার মনে হয় দূর্বল ভূত,৫০ টাকার তাবিজ হলেই একে তাড়ানো যাবে।উনি মিথ্যা বলে ৫০০০ নিতে চাইছে।
আমি অবাক হয়ে বললাম,ওঝা স্যার বলছেন কেন?
মেহেদী ভাইয়া বললো,উনি বললেন উনি কামাখ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূত-পেত্নী বিষয়ে পড়াশোনা করে এসেছেন।উনি অন্যান্য অশিক্ষিত ওঝাদের মত নয় তাই স্যার বলছি।
আমি কিছুই বললাম না।
আপু একটু চুপ থেকে বললো,আপনি ছাগল দেখছেন?
মেহেদী ভাইয়া বললো,জ্বি দেখেছি।
আপু এরপর বললো,রামছাগল দেখছেন কোনোদিন?
মেহেদী ভাইয়া নাসূচক মাথা নাড়লো।সে দেখেনি।
আপু বললো,আয়নার সামনে যেয়ে দাঁড়ান।রামছাগল দেখতে পাবেন।
আমি মনে মনে ভাবছি, আমার সহজ-সরল বাবা এতো গুলো টাকা খামোখা এই ফ্রডটাকে দিচ্ছে। কিন্তু,সত্যিটা আমরা জেনেও বলতে পারছি না।একেই বোধহয় বলে,পরের জন্য গর্ত করলে নিজেই সেই গর্তে পরতে হয়।

চলবে,,

ধূসর অনুভূতি পর্ব-০৩

0

#ধূসর অনুভূতি
পর্ব:০৩
লেখক- শাপলা

মা আমার ঘরে এসে দরজা আটকালো।আমি বললাম,দরজা আটকাচ্ছো কেন খামোখা?মা রাগী চোখে আমার দিকে তাকালেন। বললেন, লজ্জা করে না তোর? আবার বড় গলায় কথা বলিস…ছিঃ ছিঃ।
আমি বললাম,উফ মা।বলছি তো উনাকে ফুলদানি তে রাখার জন্য আমি ফুল দিয়েছি।
মা ব্যাঙ্গ করে বললেন,ও আচ্ছা তাই নাকি?ঐ ছেলে কি পঙ্গু?হাত নাই?তুই ছিঁড়ে দিতে হবে ক্যান?এক প্লেইট খাবার দিয়ে আসতে কয় মিনিট লাগে? বড়জোর একমিনিট। কিন্তু,২০ মিনিট ধরে ঐ ছেলের সাথে কি করছিলি?জবাব দে….আমি কি ঘাসে মুখ দিয়ে চলি।আজ তোর বাবা আসুক।এই ছেলেকে আমি কালকের মধ্যেই বিদায় করবো।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।মাকে বোঝানো অসম্ভব।
নিজের ঘরে চলে এলাম।মা চেঁচাতে লাগলেন।”আল্লাহ রে আমি কই যাবো?ছেলে একটা বউ পাগল,এক মেয়ে তার ছিড়া ছাগল। আরেক মেয়ে লাইলি বেগম।
চেঁচামেচি শেষ করে মা কাঁদতে লাগলেন।
আমার খুব খারাপ লাগছিল এটা ভেবে বেচারা ভালো মানুষ ছেলেটাকে এই অপবাদ দিয়ে বাসা থেকে বের করে দেয় যদি সত্যি?
এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পরলাম।রাতে বাবা ফিরে আসায় আমি নিজেই আগে গিয়ে বাবাকে সবকিছু বললাম।বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন, তোর মায়ের সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি।
রাতে অবশ্যি মা নিজেই খাবার নিয়ে গেলেন।আমাকে আর পাঠালেন না।
আমি ঝিনুক আপুকে বললাম, আপু জানো মেহেদী ভাইয়া রুমটা এতো সুন্দর করে সাজিয়েছে। তুমি দেখলে অবাক হয়ে যাবা।
আপু বললো, আচ্ছা কালকে দেখবো।
পরের দিন সকালে আমি ,আপু আর দোতলার আসমত আংকেলের মেয়ে পরী আপু মিলে ছাদে গেলাম।পরী আপুর সাথে ঝিনুক আপুর অনেক ভাব।উনারা দুইজন মিলে প্ল্যান করছে মেহেদী ভাইয়াকে কিভাবে জব্দ করা যায়।আমি অনেক বার বুঝানোর চেষ্টা করেছি।কি দরকার বেচারার পিছনে লাগার।সহজ-সরল একটা মানুষ। আমার কথা শুনে ঝিনুক আপু ঠোঁট উল্টিয়ে ব্যাঙ্গ করে বলেছে,তোর কি প্রাণের স্বামী লাগে এই হাবলা?তোর এতো দরদ কেন?
যাই হোক, উনাদের সাথে আমিও ছাদে এসেছি।ছাদে এসে আরেক দফায় অবাক হলাম। আমাদের ছাদে অনেক গুলো নতুন ফুলের টব। নিশ্চিত এইগুলো মেহেদী ভাইয়াই এনেছেন।
আমরা তিনজন উনার রুমে প্রবেশ করলাম। ঝিনুক আপু বললো, আপনার সাথে গল্প করতে এসেছি।
মেহেদী ভাইয়া দাঁড়িয়ে পরলো।বললো,আ.. আমার সাথে কিসের আ.. আবার গল্প? আপনারা বাইরে যান রুম থেকে।
ঝিনুক আপু বললো, এইভাবে বের করে দিলেন আমাকে?
এটা বলে কান্না শুরু করে দিলো মিথ্যামিথ্যি।
ঝিনুক আপুর এই এক বিচিত্র স্বভাব।কোনো কারণ ছাড়াই চোখে পানি নিয়ে আসতে পারে।পরী আপুও খুব সুন্দর শান্তনা দেওয়ার একটিং করছে।
মেহেদী ভাই প্রচন্ড ভড়কে গেছে।সে কাতরস্বরে বলছে,প্লীজ আপনি কাঁদবেন না।আসলে আন্টিই আমাকে বারণ করেছে আপনাদের সাথে কথা বলতে।
আমি খুবই স্যরি।
ঝিনুক আপু বললো, শুধু স্যরি বললে কাজ হবে না।আমি বাবার কাছে বিচার দিবো আপনি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছেন।পরী আর যুথি সাক্ষী দিবে।
মেহেদী ভাইয়া আরো ভয় পেয়ে গেলো। বেচারার মুখটা দেখে মায়াই লাগছিল আমার।
বলতে লাগলো,প্লীজ বিচার দিবেন না। আংকেল মনে খুব কষ্ট পাবে।উনি আমাকে খুবই পছন্দ করে।আর, আমি তো কোনো অন্যায়ও করি নি।
ঝিনুক আপু বললো,অতোশতো বুঝি না।আমি বিচার দিবোই আর বাবা আমাদের কথাই বিশ্বাস করবে।
মেহেদী ভাইয়া মলিন ভাবে তাকিয়ে রইলো।
আপু বললো,এক শর্তে মাফ করতে পারি।আপনি নাকি অনেক বড় চিত্রশিল্পী। আমার একটা ছবি এঁকে দিবেন।তাহলে,আর বিচার দিবো না।
মেহেদী ভাইয়া বললো, দেখুন এখন আমার অনেক পড়ার চাপ।পরে,এঁকে দিবো।
– না…না বাকির নাম ফাঁকি। একদিন সময় দিলাম।
কথাটা বলেই আপু,পরী আপু আর আমি চলে যেতে লাগলাম।আপু এই কথাটা নিতান্তই মজা করে বলেছে। কিন্তু, মেহেদী ভাইয়া সেটা বুঝলো না।সে বললো,একটু দাঁড়ান।আপু অবাক হয়ে দাঁড়ালো। মেহেদী ভাইয়া আপুর দিকে তাকিয়ে রইলো এক দৃষ্টিতে।
আপু অস্বস্তিতে পরে গেলো।বললো, এইভাবে দেখছেন কেন?
মেহেদী ভাইয়া বললো,ওমা না ভালো করে দেখলে আঁকবো কি করে?
ঝিনুক আপু হেসে ফেললো।এক পা সামনে এগিয়ে গিয়ে বললো,নেন একটু ভালো করে দেখে নেন।নয়তো দেখা যাবে ছবিতে আমাকে নাক বোঁচা বানিয়ে ফেলবেন।
…..
রাত্রে বেলা মা আমাকে আর আপুকে ডাকলেন তার ঘরে। আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর।ইশু ভাবী নাকি ছাদে কাপড় মেলতে গিয়ে আমাদের মেহেদী ভাইয়ার রুমে দেখেছে। ঝিনুক আপু নাকি মেহেদী ভাইয়ার সাথে গা ঘেঁষাঘেষি করে দাঁড়িয়েছিল।
মা দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,তোরা এতো বেহায়া আমি কল্পনাই করি নি। শুরুতে মনে করছি ছেলেটা হয়তো তোদের কাউকে ডিস্টার্ব করবে। এখন তো দেখছি উল্টা।মুরগিরাই দল বেঁধে শিয়ালের কাছে যাচ্ছে।
ঝিনুক আপু খুব খানিকটা চেঁচিয়ে উঠলো,কি সব আজেবাজে কথা বলছো?আমি তো আজকে একবারো ছাদেই উঠিনি।
ঝিনুক আপু খুব ভালো মিথ্যা কথাও বলতে পারে একদম সত্য কথার মতো।
মা বললো ,তাহলে কি ইশু মিথ্যা বলেছে?
ঝিনুক আপু বসা থেকে উঠে চেঁচাতে লাগলো।”ইশিতা ভাবী বলছে না?এতো বড় মিথ্যাবাদী মহিলা চিন্তা করছিস যুথি?কত্ত বড় মিথ্যুক।এই ঘষেটি বেগমকে আজকে সাইজ করবো আমি। আমার নামে মিথ্যা অপবাদ না?
বলতে বলতে আপু উঠে গিয়ে দরজা খুলতে লাগলো।ভাবটা এমন যেন এখুনি ইশু ভাবীদের ফ্ল্যাটে যাবে।
মা ছুটে গিয়ে আপুকে আটকালো। বললো,দাঁড়া যাস না মা। ঝামেলা করিস না।ইশু তো এমন বানোয়াট কথা বলে তুই জানিস ই।আমি ওকে ধমকাবো পরে।তুই প্লিজ ঝগড়া করিস না।
আপু তাও কিছু ক্ষন অভিনয় চালিয়ে অবশেষে নিজের রুমে গেলো। আমিও রুমে ঢুকলাম।
আপু বই নিয়ে বসলো।একটু আগের ঘটনা নিয়ে কোনো বিকার নেই আপুর।

মালিহা চা বানিয়ে ফারহানের সামনে রাখলো।চায়ে চুমুক দিয়েই ফারহানের ভ্রু কুঁচকে গেল বিরক্তিতে। বললো,
মালিহা তোমাকে না কতবার বলেছি চায়ে চিনি কম দিবা। তুমি তো প্রতিবারই শরবত বানিয়ে ফেলছো।
মালিহা মাথা নিচু করে বললো,আসলে ও অনেক বেশি চিনি খেতো চায়ে। অনেক দিনের অভ্যাস বেশি চিনি দিয়ে চা বানানো তাই…….
মালিহার কথা শেষ না হতেই ফারহান তার হাতে থাকা চায়ের কাপটা ছুড়ে ফেললো ফ্লোরে।
মালিহা চমকে উঠলো খুব।
ফারহান বললো, সারাক্ষন ও ও মারাস কেনো?ওর জন্য এতোই দরদ হইলে পালায় আসছিস কেন? আরেক দিন যদি দেখি কোনো কথায় বাদশার নাম তুলিস তাহলে তোকে আমি……
ফারহান উঠে চলে গেল।মালিহা নিজের ঘরে গিয়ে খানিকক্ষণ কাঁদলো।মালিহারা সিলেট এসেছে। ফারহান চা বাগানে একটা চাকরি পেয়েছে।শুরুতে ফারহানের ব্যবহার যতটা মধুর ছিল এখন তার ছিটেফোঁটাও নেই।পালিয়ে আসার আগে ফারহান বলেছিল,তিতলি মালিহার কাছেই থাকবে। কিন্তু, এখন তিতলির নামও সে সহ্য করতে পারে না।মালিহা তিতলির কথা মনে করে কিছু ক্ষন কাঁদলো….তিতলি কি এখন খুব খুঁজছে তার মামণিকে??
মালিহার পুরানো কথা মনে পরে গেলো। বিয়ের দুইমাস পরের কথা।মালিহা খুবই ঘুরা ঘুরি করতে পছন্দ করতো। কিন্তু, বাদশাহ একদমই ঘুরতে পছন্দ করতো না। একদিন কি হলো কে জানে এসে বললো, কক্সবাজার ঘুরতে যাবে।মালিহা তো প্রচুর খুশি হলো। সমুদ্র মালিহার খুবই পছন্দ।সে তোড়জোড় করে ব্যাগ গুছাতে লাগলো।যুথি এসে জিজ্ঞেস করল,কই যাবা ভাবী?মালিহা খুশি খুশি গলায় বললো,আমি আর বাদশা কক্সবাজার যাবো।অমনি যুথি বললো, ওয়াও।আমি সমুদ্র কখনো দেখিনি আমিও যাবো।
মালিহার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়।মালিহা বলে,যুথি আমি আর তোমার ভাইয়া একসাথে একবার ঘুরে আসি। পরেরবার তুমিও যেও। কিন্তু,যুথি নাছোড়বান্দা।সে যাবেই।মালিহার শ্বাশুড়ি কে বলায়, তিনি বললেন, তোমাদের ঘরে যেয়ে তো ও বসে থাকবে না।যেতে চাইছে যাক।যাওয়ার দুইদিন আগে ঝিনুক বললো। সেও যাবে।আর, বাদশাহ এতে খুব খুশি। ঝিনুক,যুথিকে তো সাথে নিবেই আবার বাবা-মাকেও সাথে যাওয়ার জন্য বলছে।মালিহা বাদশাহ কে বললো,আমরা নিউলি ম্যারিড কাপল। আমাদের সাথে সবার দল বেঁধে যাওয়ার কি দরকার?
বাদশা অবাক হয়ে বললো,সবাই গেলেই তো মজা বেশি হবে।আমরা দুইজন একা একা স্বার্থপরের মত ঘুরে আসবো তা কি করে হয়?
মালিহা রেগে যায়, স্বার্থপরের কি আছে? নতুন স্বামী-স্ত্রী ঘুরতে যাবে,একান্তে কিছু সময় কাটাবে এটা স্বার্থপরতা?যারা সাথে যেতে চাইবে তারাই বরং কান্ডজ্ঞানহীন।
বাদশাহ এই কথা শুনে খুব রেগে যায়।বলে,সবাই যাবে।এটাই ফাইনাল। তোমার এতো সমস্যা হলে তুমি যেও না।
মালিহা সত্যিই যায়নি অবশ্য কারোরই আর যাওয়া হয়নি সেবার। বাদশাহ খুব পরিবারঘেষা ছিল।খালি বলতো, আমার মায়ের খেয়াল রেখো মালিহা। ঝিনুক-যুথি কিছু বললেও প্রতিউত্তর করো না।ওরা তো ছোট।
আরেক বার মালিহা গেছে তার বাবার বাসায়। না বলেই গিয়েছিল সেদিন।এক-দেড় ঘন্টার জন্যে। গিয়ে দেখে তার মা ক্ষীর বানিয়েছে।মালিহাকে সেই ক্ষীর খেতে দিলো মা।মালিহা অনেক লজ্জা মিশ্রিত গলায় মাকে বললো,মা ওর জন্য একটু দিয়ে দিও।মা হেসে বললেন,তুই আসবি জানলে তো আমি বেশি করে বানাতাম।যাওয়ার সময় খানিকটা একটা বক্সে ভরে বাদশার জন্য নিয়ে আসলো সে।কারণ, বাদশাহ ক্ষীর অনেক পছন্দ করে। কিন্তু, বাদশাহ সেই ক্ষীর খেলো না।উল্টা তাকে কথা শোনালো।বললো,”এতো কম আনছো কেন?আনলে বেশি ই আনতা না আনলে নাই।আমি একা একা খাবো ঘরে আমার ছোট দুইটা বোন আছে ওদের না দিয়ে? তোমার ক্ষীর তুমিই খাও।
মালিহার খুব মন খারাপ হয়েছিল সেদিন। ঝিনুক আর যুথি তো প্রায়ই স্কুল-কলেজ থেকে আসার সময় কত খাবার-দাবার নিয়ে আসে।এইতো দুইদিন আগেও ঝিনুক দুই প্যাকেট বিরিয়ানি নিয়ে ফিরলো কলেজ থেকে।সব তো একা একাই খেলো।কই ভাইয়ের নামটাও তো মনে করলো না।মালিহা এই কথাটাই বাদশাহকে বললো।শুনে বাদশার সে কি রাগ-চেঁচামেচি।মালিহা কেন এসব বলে তাদের ভাই বোনের সম্পর্ক নষ্ট করার চেষ্টা করে?
মালিহা খুবই কষ্ট পেয়েছিলো সেদিন।বুঝেছিলো বাদশার কাছে তার কোনো দাম নেই। বাদশার সব প্রাধান্য মা-বোনদের প্রতি।ঈদে হয়তো বাদশা মালিহার জন্য একটা শাড়ি কিনে এনেছে। শাড়িটা মালিহার খুব পছন্দ হয়েছে। তখনই যুথি এসে বলছে,ভাবী অনেক সুন্দর তো শাড়িটা।অমনি বাদশাহ তখন বলে উঠত, তোর পছন্দ হলে নিয়ে যা।
মালিহার প্রচন্ড বিরক্ত লাগতো। বাদশাহ কেমন যেন ছিল। খুব সাজগোজ করে বাদশার জন্য বসে থাকলেও সে ফিরে এসে বলতো,এতো সেজে সময় নষ্ট না করে এই সময়টাতে ডিস গুলো ওয়াস করলেই পারতা। ঝিনুক কে দেখলাম পড়া বাদ দিয়ে কিচেনে কাজ করছে। বাদশার এমন আচরণের জন্যই দিনদিন মালিহার সব কিছু বিতৃষ্ণা লাগতো।সেই সময় ফারহানের সাথে পরিচয়। ফারহান কত প্রশংসা করতো মালিহার।বলতো,ভাবী বাদশার অনেক রাজকপাল।তাই আপনার মতো রূপবতী,গুণবতী বউ পেয়েছে।এই অধমের জন্যেও দোয়া করবেন যেন আপনারই মতো কাউকে পাই।মালিহা মনে মনে হাসতো। ফারহানের কাছে সে অলরাউন্ডার হলেও বাদশার কাছে কিছুই না।
পুরানো কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মালিহা। বাদশাহ দোষী অবশ্যই। কিন্তু,তারও কি কম দোষ ছিল?আগে সবসময় বাদশাকে অসম্ভব খারাপ মনে হলেও এখন অনেক সুন্দর সুন্দর স্মৃতি মনে পড়ে। একবার,একটু মনমালিন্য হওয়ার কারণে সে বাবার বাড়ি চলে এসেছিল। সন্ধ্যা নাহতেই বাদশাহ ফোনের উপর ফোন করছিলো। বিরক্ত হয়ে ফোন ধরার পর বাদশাহ রাগী গলায় বলেছিল, তোমার কি আক্কেল নেই?এই সময়ে বাপের বাড়ি গিয়ে বসে আছো।ঘরের মধ্যে কত কাজ।মা কি অসুস্থ শরীর নিয়ে করবে? এখুনি ফিরে আসো। ঝিনুক-যুথির কাজ করতে অনেক সমস্যা হচ্ছে।
মালিহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, আমি সব রান্না বান্না করে দিয়েই এসেছি।আর কিছু বাকি থাকলে ঝিনুক কে করতে বলো।আমি একদিন না থাকলে ওদের এতো বড় কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
তখন বাদশা হঠাৎ বললো,আসলে ওদের কারোরই সমস্যা হচ্ছে না। সমস্যা হচ্ছে আমার। আমার তোমাকে ছাড়া ঘরটা খালি খালি লাগছে। আমাদের মধ্যে যতই ঝগড়া হোক না কেন অফিস থেকে ফিরে তোমাকে দেখলে শান্তি লাগে।আজ,সেই শান্তিটা পাচ্ছি না।
মালিহার মনটা গলে গিয়েছিল ওর কথায়। তবুও মিথ্যা কাঠিন্য বজায় রেখে বললো,পারবো না আসতে।রাত হয়ে গেছে এখন।
বাদশাহ বললো, তুমি বের হয়ে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই আমাকে পাবে।আমি তোমাদের এলাকাতেই আছি।
ভাবনার খাতা বন্ধ করে মালিহা উঠলো। রান্না চড়াতে হবে।
…….
…….
তিতলি আমার কোলে এসে বসলো।বললো,যুথি ফুপি আমার মামণি আর কোনোদিন আসবে না তাই না?
আমি দীর্ঘশ্বাস গোপন করলাম। বললাম,আসবে। তুমি বড় হলে তোমার জন্য সারপ্রাইজ নিয়ে আসবে। তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাও তো তুমি।
তিশি এসেছে আমাদের বাসায়। টিফিন বক্সে করে বিরিয়ানী নিয়ে।মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করে বলতে লাগল, বিরিয়ানি রান্না করেছিলাম মা।খেতে গিয়ে গলা দিয়ে নামলো না। আপনার কথা মনে পরলো।তাই,চলে এলাম। আপনি নিশ্চয়ই ভাববেন আমার লজ্জা নাই। ভাবলে ভাবেন আমার কিছু যায়ে আসবে না। আমার তো একটাই শান্তি আমি আপনাকে অন্তত দেখতে তো পারলাম।
মা তিশির এইসব মনভোলানো কথায় আসলেই পটে গেলেন।বলতে লাগলেন, তুমি এসেছো আমি কি যে খুশি হয়েছি মা।এসো বসো।
তিশির রান্না করা বিরিয়ানির টেস্ট পুরো হাজীর বিরিয়ানির মতো।আমি আগেও খেয়েছি। আমার মনে হচ্ছিল তিশি বিরিয়ানি দোকান থেকে কিনে এনেছে রান্না করে নি……

চলবে,,

ধূসর অনুভূতি পর্ব-০২

0

#ধূসর অনুভূতি
পর্ব:০২
লেখক:-শাপলা

পরদিন সকাল সাতটার সময়ই ইশু ভাবী আমাদের বাসায় এসে হাজির।তিনি তার বোন তিশিদের বাসায় যাচ্ছে তিশিকে আনতে।এই খবরটাই মাকে দিতে এসেছেন।মা বললেন, আচ্ছা যাও। সাবধানে যেও। ঝিনুক আপু বললো,মা সত্যিই তোমার মাথার স্ক্রু ঢিলা? এইটুকু মেয়ের সাথে তুমি ভাইয়ার বিয়ে দেয়ার কথা ভাবছো?মেয়ে মাত্র টেনে পড়ে। বাচ্চা একেবারে।টেনে থাকতে তো আমি বিছানায় হিসু করতাম।
মা প্রচন্ড রেগে গেলেন। বললেন, চুপ থাক গাধার বাচ্চা।এরপর মা রান্নাঘরে গিয়ে তার হবু পুত্রবধূর জন্য পায়েস চড়ালেন।আমরা দুইবোন জল্পনা-কল্পনা করছি মেয়েটিকে নিয়ে।মেয়েটা নিশ্চয়ই গরিব আর তাই এই ছোট বয়সে বিয়ে দিয়ে দিবে বাবা-মা। মেয়েটার মনে নিশ্চিত কত দুঃখ জমে থাকবে।আহা!
সকাল তখন এগারোটা।ইশু ভাবী আমাদের বাসায় আবার আসলেন।এসে ফিসফিস করে বলতে লাগলেন,মেয়েকে ভুংভাং বুঝিয়ে নিয়ে এসছি।আপনি আসেন আন্টি দেখে যান।বিয়ের পাত্রী হিসাবে দেখাতে এনেছি এটাকি আর বলা যায়,লজ্জা পাবে ছোট মেয়ে।
মা বললেন,ভালো করেছো ইশিতা।এখন চলো।
মা চলে গেলেন তিশি নামক বালিকা কে দেখতে।
কিছু ক্ষন পর আবার বেল বাজলো।আমরা ভাবলাম মা বোধহয় ফিরে এসেছে। আমি দরজা খুলে দেখি একটা অপরিচিত ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।পরনে নীল পাঞ্জাবী।চোখে সরু ফ্রেমের চশমা। খুব সুন্দর আর ভদ্র একটা ছেলে। আমার প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে গেলো।
এদিকে আমার গায়ে একটা ওড়নাও নেই আছে একটা গামছা।এর জন্য খুব অস্বস্তি লাগছিল।ছেলেটা মাথা নিচু করে সালাম দিলো।বললো, মিজান আংকেল আমাকে আসতে বলেছে।
মিজান আমার বাবার নাম।কাজেই আমি ছেলেটিকে বসার ঘরে এনে বসালাম।
এমন সময় ঝিনুক আপু তিতলিকে কোলে নিয়ে বসার ঘরে প্রবেশ করল। আমাকে ধমক দিয়ে বলতে লাগলো,ঐ গাধা যাকে তাকে ঘরে ঢুকাস কেন?চোর না ডাকাত কোনো গ্যারান্টি আছে?
আমার আপুর উপর খুব রাগ হতে লাগলো। আপুর কোনো কান্ডজ্ঞান নেই। এইভাবে সামনাসামনি কেউ বলে?ছেলেটা খুব মলিন ভাবে বললো,আমাকে মিজান আংকেল এই সময়ে আসতে বলেছে।
আপু ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ভিতরের রুমে চলে গেল।
একটু পরেই তিশি আমাদের ঘরে ঢুকলো।আমি তিশিকে দেখে পুরোই হা হয়ে গেলাম।পার্লার থেকে সেজে এসেছে সে।ব্রাইড-ও মনে হয় এতো ভারী সাজ দেয় না।পরনে লাল জামদানি শাড়ি। মাথায় আবার ফুল লাগিয়েছে।সে স্বাভাবিক ভাবেই হেসে বললো, তুমি যুথি না ঝিনুক? আমার চোয়াল ঝুলে পরলো।এই মেয়ে নাম ধরে বলছে কেন আমাদের?
তিশি আবারো বললো,আন্টি ইশু আপুর সাথে গল্প করছে।আমাকে বললো,বাড়িটা ঘুরে-টুরে দেখতে।
আমি চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে রইলাম। কোনো রকম কাঁপা গলায় বললাম,জ্বি আ…আচ্ছা আপু আপনি ভি…ভিতরে আসেন।
তিশি বললো, তুমি কি তোতলা নাকি?
আমি চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে রইলাম।এই মেয়ে আসলেই টেনে পড়ে?একটু ডর-ভয়,জড়তা, লজ্জা কিছুই নেই এর মধ্যে।
ঘরে ঢুকেই মেয়েটা তাকালো সোফার দিকে। সেখানে একটু আগে আসা নীল পাঞ্জাবী পরা আগন্তুক বসে আছে।তিশি গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করলো,এইটা কি তোমার ভাইয়া?
আমি এমনিতেই তিশির আচরনে যথেষ্ট ভড়কে আছি।তাই বেখেয়ালি ভাবে হুম বলে ফেললাম।
এরপর, শোবার ঘরে চলে গেলাম আপুকে ডাকতে।
আপু ,তিতলি আর আমি এসে দরজার ধারে দাঁড়িয়েছি।ওমা,দেখি তিশি সোফার মধ্যে বসে নীল পাঞ্জাবী ওয়ালার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে।
আমরা দুইজন দাঁড়িয়ে রইলাম এক রাশ বিস্ময় নিয়ে।
তিশি আর সেই ছেলের কথোপকথন এইরকম:
তিশি জিজ্ঞেস করছে,কেমন আছেন?
ছেলেটা দাঁড়িয়ে পরলো।তিশি বললো,আরে বসেন না লজ্জার কিছু নাই। ছেলেটা অনিচ্ছা নিয়েই বসলো। এরপর ঢোক গিলে বললো,জ্বি ভালো আছি।
তিশি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,আর ভালো…আপনি যে কতটা ভালো আছেন তা কি আর আমার অজানা? আপনি যে কতটা কষ্ট বুকে চেপে রেখেছেন আমি জানি।
ছেলেটা বললো,কি বলছেন এইসব? আমার বুকে কষ্ট চেপে রাখবো কিসের জন্য?
তিশি হাসলো। বললো,এই যে আপনার বউ পালিয়ে গেলো তাও আপনার প্রিয় বন্ধুর সাথেই এই কষ্ট কি যেনতেন কষ্ট।বউ পালানো টা একটা পুরুষ মানুষের কাছে যে কি অপমানের বিষয়!
ছেলেটার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল।সে আতংকিত হয়ে বলতে লাগলো,কি…ইই বলছেন এ..এসব?আন্দাজে ক কথা?
তিশি ভ্রু কুঁচকে বললো,ইয়া আল্লাহ বোনের মতো ভাইও দেখি তোতলা।এই পরিবারের সবাই কি তোতলা না কি?
হঠাৎ,তিতলি চেঁচিয়ে বলে উঠলো,না আমি তো তিতলি।
এইবার তিশি আমাদের দিকে তাকালো।
ঝিনুক আপু এগিয়ে গিয়ে বললো,এই মেয়ে এই… একটা নতুন জায়গায় এসে যে ভদ্রতা মেইনটেইন করতে হয় জানো না?
তিশি বললো,আমি অভদ্রতা করলাম কখন?কি বলছো এসব?
ঝিনুক আপু বললো, তুমি আমাকে তুমি করে বলছো কোন সাহসে? এইটুকু মেয়ে।
তিশি বললো,আমি বয়সে ছোট হতে পারি কিন্তু সম্পর্কে তো বড় নাকি?
– কিসের সম্পর্ক?
তিশি মাথা নিচু করে লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গী করলো। এরপর বললো,আমার আর আপনার ভাইয়ের বিয়ে তো ধরতে গেলে হয়েই গেছে। শুধু কাজি ডেকে কবুল পড়ানো টা বাকি….
আমি বোকার মত তাকিয়ে রইলাম।কাজী ডেকে কবুল পড়ানো যদি বাকিই থাকে তাহলে বিয়েটা ধরতে গেলে হয় কেমনে?
তিশি তার হাত ছড়িয়ে ধরলো আমার সামনে।একি তিশির আঙুলে আমার মায়ের আংটি কেন?
তিশি লাজুক স্বরে বলল,মা আমাকে পছন্দ করে আংটি পরিয়ে দিয়েছেন।
ঝিনুক আপু বললো, তুমি তো আচ্ছা মেয়ে। আমার ভাইকে এখনো দেখোই নি কিন্তু আংটি পরে বসে আছো।
তিশি বললো,প্রথমে একটু মনটা খচখচ করেছিলো কিন্তু এখন আপনার ভাইকে দেখে সব খচখচানি দূর হয়ে গেছে।
আপু বললো,কই আমার ভাই?
তিশি নীল পাঞ্জাবী ওয়ালার দিকে তাকিয়ে বললো,এইযে আপনি বাদশাহ না?
বেচারা ছেলেটা ভয়ে ভয়ে মাথা নেড়ে বললো,না আমি তো ছাত্র।
…….
রাতের বেলা পরিবারের সবাই ডিনার করতে বসেছি। শুধু ভাইয়া নেই। ভাইয়া তার কোন এক কলিগের বাসায় গেছে কি একটা দরকারে।তিশি বিদায় হয়েছে সন্ধ্যায়।মা তো তখনো যেতে দিতে চাচ্ছিল না। এতোই তার মনে ধরেছে এই অকালপক্ক মেয়েকে।
মা বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,কাজটা কি তুমি ঠিক করলা?ঘরের মধ্যে দুইটা বড় বড় মেয়ে আছে,দোতলার আসমত সাহেবেরও একটা মেয়ে আছে।এমন বাসায় তুমি ব্যাচেলর ১টা ছেলেকে থাকতে দেও কোন আক্কেলে? মেয়েগুলো একটু ছাদেও উঠতে পারবে না এই ছোকরার জ্বালায়।
বাবা নির্বিকার ভাবে বললেন,এই ছেলের মতো ভদ্র-নম্র ছেলে আর হয় না বুঝেছো? মেয়েদের জ্বালানো তো দূর তাকাবেও না।
মা মুখ অন্ধকার করে বসে রইলো।
কথা হচ্ছিলো সকাল বেলার সেই নীল পাঞ্জাবী ওয়ালাকে নিয়ে। ছেলেটার নাম মেহেদী। আমার বাবার পুরানো কোন বন্ধুর ছেলে যেন। পড়াশোনার সুবাদে আমাদের শহরে থাকছে অনেক দিন ধরেই।হলের খাবার নাকি তার মুখে রোচে না।তাই, তার বাবা আমার বাবাকে বলেছেন সবটা।আর, আমাদের বাড়িতে থাকতে বলেছেন বাবা।বাবা আরো বলেছে, খাবার-দাবার আমরা যা খাই সেই ছেলেও আমাদের সাথেই খাবে।আর থাকবে হলো ছাদের ঘরে। আমাদের ছাদে বাড়তি দুইটা রুম বানানো হয়েছিল। সেগুলো সবসময় খালিই থাকতো।আগে সেই রুমে আমার বড় চাচার ছেলে শাহীন ভাই থাকতো। কিন্তু, এখন উনারা স্বপরিবারে বিদেশে চলে গেছে অনেক বছর।
যাইহোক, খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমি আর আপু আমাদের ঘরে এলাম।তিতলি গেছে তার দাদার রুমে ভূতের গল্প শুনতে।
আমি আপুকে বললাম,আপু শুনলা বাবা কি বললো?ঐ মেহেদী ছেলেটা নাকি এতোই ভদ্র যে মেয়েদের দিকে তাকায়ও না।
আপু বললো, মেয়েদের দিকে তাকানোর মতো সাহস আছে ঐ হাবলার?দেখিস নি আজ সকালে তিশির ভয়ে হিসি করে দিতে নিছিলো।
আমি আর আপু হাসতে লাগলাম।আপু বললো,ভালোই হইছে মেহেদী পাতা আমাদের বাড়ি থাকতে আসছে।ওরে মুরগি বানিয়ে মজা নিবো। অনেক দিন ধরেই জীবনে কোনো ভিন্নতা নাই। গড়পরতা জীবন।
আমি উৎসাহিত হয়ে বললাম,কি করবা আপু?
আপু হেসে কি যেন বলতে গিয়েও থেমে গেলো।কারণ, পাশের ঘর থেকে মায়ের চেঁচামেচির আওয়াজ আসছে।
আমরা তেমন বিচলিত হলাম না।মায়ের অল্পতেই চেঁচামেচি করার স্বভাব।তাই, নিজেদের মতো করে কথা বলতে লাগলাম।এমন সময় হঠাৎ ভাইয়া আমাদের রুমে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলো।বললো,এই যে আপা আপনারা একটু সাহায্য করবেন?মালিহার সব ড্রেস মা পুড়িয়ে ফেলছে।প্লিজ আপনারা একটু এসে মানা করেন।মালিহা কি পরবে বলেন তো!
আমি আর আপু তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলাম ভাইয়া কি মজা করে আমাদের সাথে এভাবে কথা বলছে?
কিন্তু, ভাইয়ার চেহারাটা তো খুব করুন হয়ে আছে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে,ভাইয়া যেন আমাদের চিনতে পারছে না।
ঝিনুক আপু উঠে ভাইয়াকে ধরলো।আমি রুম থেকে বেরিয়ে বসার ঘরে গেলাম।দেখি মা সত্যিই মালিহা ভাবীর সব শাড়ি,ব্লাউজ,জামাতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন।তিতলি ভয়ে কান্না করে দিয়েছে আগুন দেখে।আমি দ্রুত জগ ভর্তি পানি এনে এনে আগুনে ঢাললাম। মায়ের চোখে তখনো রাগের চিহ্ন।মা চেঁচাতে লাগলেন, কু**র বাচ্ছা তুই কেইক আনছ কার জন্য হ্যাঁ?মুখপুড়ি যে আরেক বেডার লগে ভাগছে তুই মনে হয় জানছ না?সব জ্বালায় দিবো আমি।ঐ ডাইনীর কোনো চিহ্ন এইবাড়িতে থাকবে না।
দেখলাম ফ্লোরের মধ্যে একটা বার্থডে কেইকও পরে আছে। হঠাৎ মনে পরলো,আজ ভাবীর জন্মদিন ছিল।
আমি তিতলিকে কোলে নিয়ে মায়ের সামনে থেকে চলে এলাম।তিতলি বেচারি খুবই ভয় পেয়েছে।
রুমে এসে দেখি ভাইয়া মাথানিচু করে বসে আছে।আমাকে দেখে বললো,কি লজ্জার ঘটনা। আমার এক ফোঁটাও মনে নেই যে মালিহা চলে গেছে।আমি কেইক কিনে নাম নাম টাম লিখিয়ে বাসায় এসে পরেছি।
আপু বললো, ভাইয়া তোমার উচিৎ কিছু দিন ছুটি নিয়ে বিশ্রাম নেয়া। তোমার মনের উপর দিয়ে অনেক ঝড় গেছে।এর জন্য এমন হয়েছে।
ভাইয়া লজ্জিত ভঙ্গীতে উঠে চলে গেলো।
আমরা তিনজন শুয়ে পরলাম। মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে দেখি,তিতলি বিছানায় নেই।
আমি উঠে ভাইয়ার ঘরের দিকে গেলাম।হ্যাঁ যা ভেবেছি তাই তিতলি এখানেই।ডীম লাইটের আলোয় দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট,ভাইয়া ঘুমিয়ে আছে।আর তিতলি বুড়ি ভাইয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
আমি খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম।এর চেয়ে পবিত্র আর সুন্দরতম দৃশ্য কি আর হতে পারে। এইটুকু বয়সেই তিতলি অনেক খানি বড় হয়ে গেছে।অন্য বাচ্চাদের মতো একদমই নয় সে।কিছু ক্ষন হাত বুলিয়ে দিয়ে আবার ভাইয়ার কপালে চুমু দিয়ে দিলো।যেন ভাইয়াই ছোট একটা ছেলে আর সে মা।আমি না হেসে পারলাম না। কেন জানি চোখের কোণে পানিও জমলো।
……
সকালবেলা আবার ভাইয়া একদমই স্বাভাবিক।নাস্তা টাস্তা করলো। আমার পড়াশোনার খোঁজ নিলো।তিতলিকে আদর করলো কিছুক্ষণ। এরপর অফিস এ চলে গেল।
মা বললো,বাদশাকে তো এখনও তিশির ব্যাপারে কিছুই বলা হলো না। ভেবেছিলাম রাতে বলবো।আর,রাতে ও যা কান্ডটা করলো।রাগে আমার …..
আমি মাকে বললাম,বাদ দেও মা। ভাইয়ার উপর দিয়ে অনেক স্ট্রেস গেছে তো…..
একটু পর ঝিনুক আপু ইউনিভার্সিটি তে চলে গেল। আমার আজকে ক্লাস নেই তাই আমি বিছানায় গড়াগড়ি করতে লাগলাম।এমন সময় মা এসে বললো,যা মেহেদী কে খাবার দিয়ে আয়।ঐ ছেলেও তো নিশ্চয়ই ক্লাসে যাবে।
আমি মায়ের কথা মতো খাবারের ট্রে নিয়ে ছাদে উঠলাম। মেহেদী ভাইয়ার রুমে ঢুকে তো আমি অবাক।পুরো ঘরটাকে লাগছে এক টুকরো স্বর্গের মতো।বুঝাই যাচ্ছে উনি অনেক ঘষা-মাজা করে ফ্লোর ধুয়েছে।একদম চকচক করছে।ঘরের দেয়াল জুড়ে তিনটা বড় বড় পেইন্টিং। যেগুলো তে সমুদ্র আর নীল আকাশ মিশে আছে একসাথে। জানালায় হালকা নীল পর্দা। বিছানার চাদরেও সাদার মধ্যে নীল ফুলের কাজ।ঘরে ফার্ণিচার বলতে একটা খাট,পড়ার টেবিল-চেয়ার, ছোট একটা বুক সেলফ।কি সুন্দর ছিমছাম গুছানো সবকিছু।উনি মাথানিচু করে বললো,আমার আসলে ঘর-দোর গুছানো না থাকলে ভাল্লাগে না।
আমি বললাম,এই ছবি গুলো কি আপনি এঁকেছেন?
– হুম আমিই এঁকেছি। বিছানার চাদরের ফুলগুলোও আমার আঁকা।শখ আরকি আঁকাআঁকি টা।
আমি নিজের অজান্তেই বলে ফেললাম, অসাধারণ!
খাবারের ট্রে নিয়ে টেবিলের উপর রাখলাম। দেখলাম, টেবিলে একটা খালি কাঁচের ফুলদানি।
তাই আমি বললাম, ভাইয়া ছাদে তো ফুলের টব আছেই। আপনি চাইলে ফুল এনে ফুলদানি তে রাখতে পারেন। এমনিতেও ফুল গুলো একদিন পর ঝরেই যায়।
উনি বললো,তুলিনি ফুল।পারমিশন ছাড়া অন্যের জিনিস নষ্ট করবো কেন?একটু থেমে আবার বলল,জানো বাড়িতে আমার পড়ার টেবিলের জানালার সামনে একটা হাসনাহেনার গাছ আছে।এতো ঘ্রান হয় তুমি ভাবতেই পারবা না বিশেষ করে মাঝরাতে।
খুব সহজভাবেই আমি উনার বাড়িতে থাকা ফুল বাগানের গল্প শুনলাম কিছুক্ষণ। ভালোই লাগছিলো উনার কথা শুনতে।
এরপর,চলে আসার সময় কি মনে করে টব থেকে দুইটা গোলাপ ছিড়ে উনার হাতে দিলাম। ফুলদানি তে রাখার জন্য। গোলাপ দুটো দিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি মা দাঁড়িয়ে আছে। আমার বুক কেঁপে উঠলো।মা নিশ্চিত অন্য কিছু ভাববে…মা যা সন্দেহপ্রবন।
চলবে,,

ধূসর অনুভূতি পর্ব-০১

0

#ধূসর অনুভূতি
পর্ব:০১
লেখক:শাপলা

রাত তিনটার সময় তিতলি আমার ঘুম ভাঙিয়ে বললো,ফুপি আমার বাবা মামণির ছবি নিয়ে কাঁদছে।আমি তিতলিকে জড়িয়ে ধরলাম।তিতলির বয়স মাত্র তিন।ভাইয়া আর ভাবীর একমাত্র সন্তান সে।বিয়ের পরপরই ভাবী সন্তানসম্ভবা হয়।সবাই অনেক খুশি হলেও ভাবী আমাকে আড়ালে ডেকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে,আমি এখনই বাচ্চা নিতে চাই না।সবটাই তোমার ভাইয়ার জোড়াজুড়িতে হয়েছে। তোমার ভাই একটা অমানুষ।তোমার ভাই খালি আমাকে সন্দেহ করে।মনে করে আমি অন্য পুরুষের সঙ্গে পালিয়ে যাবো।ছিঃ কেমন নোংরা মানসিকতার মানুষের সাথে বাস করছি।
ভাবী খুব কান্নাকাটি করছিলো সেদিন।আমি তখন মাত্র নাইনে পড়ি।কি বলা উচিৎ এমন পরিস্থিতিতে আমি জানতাম না।তাই চুপই ছিলাম। চার বছর পর আজও আমি চুপ করেই আছি।তিতলি আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।ওকে কি বলবো আমি?
ভাবী বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে আজ তিন দিন হলো।যাওয়ার সময় একটা চিঠি রেখে গেছে।চিঠির সারমর্ম এই, তিনি ভাইয়ার মতো ছোটলোক মানুষের সাথে সংসার করে হাঁপিয়ে উঠেছেন। তার পক্ষে আর সম্ভব না। তবুও ভাইয়া তাকে পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছে এখানে-সেখানে।থানা-পুলিশের উপর নাকি তার বিশ্বাস নেই।মাকে চিঠিটা দেখিয়েছি।মা দাঁতে দাঁত চেপে অশ্লীল কিছু গালি দিয়েছেন ভাবীকে।আসলে ভাবী কার সাথে পালিয়ে গেছে আমি জানি। ফারহান ভাইয়ের সাথে। ফারহান ভাই হলো আমার ভাইয়ার বন্ধু। সবচেয়ে ভালো বন্ধু। তিনি প্রায় প্রতিদিনই আমাদের বাড়ি আসতেন। ভাইয়ার সাথে গল্প করতেন,দাবা খেলতেন। কিন্তু,এই তিনদিন ধরে তিনি আসছে না এই বাড়িতে, তার ফোনও বন্ধ। শুধু এইটুকুতে কাউকে সন্দেহ করা বোকামি। কিন্তু, আমি একদিন ভাবীকে আর ফারহান ভাইকে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখে ফেলেছিলাম। সেদিন আব্বু-আম্মু সহ সবাই খালামনির বাসায় ছিল। পরিক্ষা থাকার কারণে আমি যেতে পারিনি আর ভাবী আমার সঙ্গে ছিলো। যাইহোক,এই ঘটনা ভাইয়াকে বলায় ভাইয়া বিশ্বাস করে নি।আমাকে উল্টা বকাবকি করেছে কেন এতো বড় মিথ্যা বলেছি তাই। এখনো ভাইয়া বিশ্বাস করছে না যে ভাবী ফারহান ভাইয়ার সাথে পালিয়ে গেছে।
আমি তিতলিকে ডাকলাম। বললাম, তুমি এতো রাতে একা একা বাবার রুমে কেনো গিয়েছো যদি তোমাকে ভূত এসে খেয়ে ফেলতো।
তিতলির তার ছোট্ট হাত দুটো দিয়ে চোখ মুছলো।বললো,যুথি ফুপি আমার বাবার জন্য অনেক মায়া লাগছে।আমি আর বাবা মিলে ঠিক করেছিলাম মায়ের জন্মদিনে কি কি সারপ্রাইজ দিবো। কিন্তু,মামণি কোথায় গেলো?
আমি বললাম, তোমার মা-ও তোমাদের জন্য সারপ্রাইজ আনতে গেছে। এখন ঘুমিয়ে পরো।
তিতলি এরপরেও খানিকক্ষণ কাঁদলো।কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পরলো। কিন্তু, আমার চোখে ঘুম আসলো না আর।ভোরের আলো ফুটলো ধীরে ধীরে।আমি বিছানা ছেড়ে উঠলাম। বারান্দায় এসে দেখি ভাইয়া বারান্দায় বসে সিগারেট খাচ্ছে। ভাইয়ার সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস টা কি আবার ফিরে এলো?মা এসে দাঁড়ালো আমার পাশে। ভাইয়া কে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে বললো,ঐ জানোয়ারের বাচ্চা তুই আবার সিগারেট খাওয়া ধরছিস?সাথে গাঞ্জা-মদও ধর। বেহাইয়া ছোটলোক কোনখানের বউয়ের জন্য কান্দে।তোর বউ তো আছিলো আস্তা বেশ্যা।ঐ বেশ্যার জন্য আরেক ফোঁটা চোখের পানি ফেললে তোরে আমি খুন করমু।মা চেঁচাতে চেঁচাতে চলে গেলেন। এখন তিনি রুমে গিয়ে কাঁদবেন আমি জানি।
মায়ের এতোগুলো কথা ভাইয়ার কান পর্যন্ত পৌঁছেছে বলে মনে হলো না। হঠাৎ, ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললো,যা তো যুথী আমার জন্য এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে আয়।আমি গোসলখানায় ঢুকলাম।
আমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। এরপর চা বানাতে গেলাম।
চা খেতে খেতে ভাইয়া বললো,বুঝলি যুথি ফারহান ফোন করেছিল।বললো,মালিহা তার সাথেই আছে এবং ভালো আছে।আমি যেন আর খোঁজাখুঁজি না করি।ডিভোর্স লেটার সময় মতো পৌঁছে যাবে।
আমিও ভেবে দেখলাম মালিহা যেহেতু ভালো আছে তাহলে আমার ঝামেলা করে লাভ কি?তাকে আর তিতলিকে ভালো রাখার চেষ্টা ই সবসময় করেছি।
কথাগুলো বলেই ভাইয়া ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলো যেন খুব হাসির কথা বলেছে সে।
হাসি থামিয়ে বললো,আজকে তিতলির জন্য অনেক বড় সারপ্রাইজ গিফট আনবো বলিস ওকে।
আমি বললাম,ভাইয়া তুমি কোথায় যাবে?
ভাইয়া চোখ বড়বড় করে বললো,ওমা অফিস যেতে হবে না? এমনিতেই তিন দিন কামাই হয়ে গেছে। আচ্ছা, তোর কিছু লাগবে?
আমি নাবোধক উত্তর দিয়ে চলে এলাম।
মাকে সব বললাম।মা রেগে গেলেন খুব। বললেন,তোর শফিক মামারে কল দিতেছি এখুনি।ঐ কালসাপের বাচ্চারে জেলের ভাত ঠিকই খাওয়ামু।বলমু,পালায় যাওয়ার সময় দশ ভরী স্বর্ণ আর ৩ লাখ টাকা সঙ্গে নিয়ে গেছে চুরি করে।
শফিক মামা অনেক বড় পুলিশ অফিসার।
মা তাকে ফোন করতে যাচ্ছিলেন এমন সময় ভাইয়া আমাদের রুমে আসলো।বললো,মা তুমি কাউকে ফোন করবে না।কোনো পুলিশ কেইস হবে না।আমি ওকে মাফ করে দিলাম।
মা ভাইয়ার দিকে রাগী চোখে তাকালেন।”তোর নাম বাদশা রাখছিলাম কিন্তু তুইতো আসলে একটা নেড়ীকুত্তা।বউ লাত্থি মেরে গেছেগা এখনো বউয়ের পক্ষ ছাড়ছ না।”
বাদশাহ ভাইয়া মুচকি হেসে বললো,আমি সৃষ্টিকর্তার বিচার দেখতে চাই মা।এতো যত্ন, ভালোবাসার দেয়ার পরও যে ঠকাতে পারে সৃষ্টিকর্তা তাকে কি শাস্তি দেন আমি দেখতে চাই।
আমার ভাইয়া এমনি।তার জীবনের সবচেয়ে বড় ক্ষতিও যে করবে তার প্রতিও সম্ভবত ভাইয়া কোনো প্রতিশোধ নিবে না।সব স্রষ্টার উপর চাপিয়ে দিবে।বলবে,স্রষ্টাই বিচার করবে।
আমরা তিন ভাইবোন।প্রথমে ভাইয়া তারপর ঝিনুক আপু আর তারপর আমি। ঝিনুক আপুও অনেক অদ্ভুত ধরনের।এইযে বাড়িতে এতো বড় ঘটনা ঘটলো তাতে তার কোনো হেলদোল নেই।দিব্যি খাচ্ছে-দাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে।যেন বাড়ির বউ পালিয়ে যাওয়াটা একটা স্বাভাবিক বিষয়।
কথায় কথায় আমি ঝিনুক আপুকে বললাম,ভাইয়া আজকে তিতলির জন্য সারপ্রাইজ গিফট আনবে।
অমনি ঝিনুক আপু লাফিয়ে উঠলো।বললো,চল তাহলে আজকে মজার কিছু রান্না করি।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।এই পরিস্থিতিতে? ঝিনুক আপু বললো,কেন কি সমস্যা?
এরপর সত্যি সত্যিই আপু আমাকে নিয়ে বাসার সবার পছন্দের খাবার রান্না করলো। বাবার প্রিয় সরষে ইলিশ,মায়ের জন্য গরুর মাংস ভূনা। বাদশাহ ভাইয়ার জন্য ছাদ থেকে কবুতর ধরা হলো।সেই কবুতর ঝিনুক আপু-ই জবাই করলো;রান্না করলো।তিতলির জন্য বানানো হলো আইসক্রিম আর পুডিং।সব মিলিয়ে হুলস্থুল ব্যাপার।
মা প্রথমে খুব গালিগালাজ করলেন। বিলাপ করে বললেন,ছেলে একটা বউ পাগল আর মেয়ে একটা আরেক ছাগল।কখন কি করতে হয় বোঝেনা। আল্লাহ আমি কই যাই?
তবে কিছু ক্ষন পর মা নিজেও এসে আমাদের সাথে হাত লাগালেন। রান্নাবান্না শেষ হওয়ার পর শুরু হলো ঘর সাজানো।তিতলির জন্মদিনের জন্য কিনা সব বেলুন, রঙিন কাগজের ফুল এইসব দিয়ে ঘর সাজানো হলো। এরপর,আপু নিজেও শাড়ি পরে সাজলেন।তিতলিকে সাজালেন,আমাকেও জোর করে সাজতে বাধ্য করলেন।হুট করেই ঘরের পরিবেশ বদলে গেলো।তিতলি বেলুন ফুটানোর জন্য বায়না করতে লাগলো।ঝিনুক আপু গম্ভীর হয়ে বললো, এইগুলো বেলুন না এগুলো হলো ভূতের পেট। এইগুলো ফুটালে ভূতেরা তোকে মেরে ফেলবে।তিতলি খিলখিল করে হেসে ওঠে।বাবাও এসে যোগ দেয় ওদের সাথে। শুধু মা মুখ কালো করে তাকিয়ে থাকে। এককথায়,পুরো বাড়ি জুড়ে উৎসবের আমেজ দেখা গেলো।
সন্ধ্যা বেলায় ভাইয়া বড় বড় দুইটা টেডিবিয়ার আর একটা সুন্দর সাদা জামা নিয়ে ফিরলো। ঝিনুক আপু মুখ গম্ভীর করে বললো,এই তিতলি এটা কিন্তু পরীর মেয়ের জামা।তোর বাবা চুরি করে নিয়ে এসেছে।
তিতলি আবার হাসতে লাগলো।এই ছোট্ট বয়সেই সে ভূত-পরীর গল্প যে বানানো তা বুঝতে শিখে গেছে।
আচ্ছা, ভাবীর কি এই নিষ্পাপ শিশুর মিষ্টি হাসি মাখা মুখটা মনে পরবে না?
ফারহান ভাইয়ার সাথে কি সে সত্যিই সুখে ঘর করতে পারবে?
এমন সময় আমাদের নিচতলার ভাড়াটিয়া ইশু ভাবী এলেন আমাদের বাসায়।ইশু ভাবী হলেন এই বাড়ির সাংবাদিক।সবার খবর তার কাছে থাকে,কার ছেলে ফেইল করলো,কার মেয়ে প্রেম করে,কার বাড়িতে ঝগড়া হয়েছে সব। তিনি এসে যখন দেখলেন,ঘরময় আনন্দের ছড়াছড়ি তার চোখ ছানা বড়া হয়ে গেলো।বললো,একি যুথি এতো হাসাহাসি করছো কেন তোমরা সবাই?
আমি কিছু বলার আগেই মা জবাব দিলেন, বললেন,এক চরিত্রহীন আপদ বিদায় হইছে সেজন্য কি আমরা সারাক্ষণ কাঁদবো?
ইশু ভাবী থতমত খেয়ে গেলেন। বললেন,না আন্টি কি যে বলেন। আপনাদের দেখে আমার অনেক খুশি লাগছে।বাদশাহ ভাইয়ের উচিৎ বিয়ে করে ফেলা।
মা বললেন,তা তো করবেই। আমার ছেলে কি দেবদাস হয়ে থাকবে না কি?ওর চেয়ে হাজার গুণ সুন্দর মেয়ে আমি বাদশার বউ করে আনবো।
ইশু ভাবী বললেন,আন্টি আমার কাছে পাত্রীর অভাব নেই। আমার দুঃসম্পর্কের বোন তিশি।অসম্ভব সুন্দর। এক্কেবারে পরী।আপনি ছবি দেখবেন?
মা হ্যাঁ না কিছুই বললো না।ইশু ভাবী ফোন থেকে ছবি বের করে দেখালেন।
ছবি দেখে মায়ের মন গললো মনে হয়।মা বললো,মেয়ে সুন্দর হলে তো হবে না।বাপ-মা কি করে?
ইশু ভাবী বললেন,আন্টি মেয়েরা হলো জমিদার বংশ বুঝলেন।আদি পুরুষ জমিদার ছিলো। কিন্তু, এখন টাকা পয়সা বিশেষ নাই,তবে খুব সৎ লোক উনারা ।
মা জানতে চাইল, মেয়ের বয়স কত?
ইশু ভাবী বললেন,১৬ তে পরলো এবার।
আমরা সবাই চমকে উঠলাম,কিহ?এটা তো বাচ্চা মেয়ে।ছবিতে শাড়ি পরেছে বলে বড় লাগছে।
ইশু ভাবী বললো, ছোট ই ভালো।যেমনে বলবা তেমনে চলবে।ঠিক না আন্টি? আপনি বললে ওকে আমার বাসায় আনি।আপনি সামনাসামনি দেখেন। এরপর দরকার পরলে ওদের বাড়ি যাবেন।
মা ঝিম মেরে রইলো। ঝিনুক আপু বললো, আপনি যান তো ভাবী।এই দুধের বাচ্চার জন্য প্রস্তাব আপনি কোন আক্কেলে দেন? আমার ভাইয়ের বয়স ৩২। বুঝলেন?ঐ মেয়ের ডাবল। আমাদের যুথিও ঐ মেয়ের চেয়ে তিন বছরের বড়। আপনার বিবেক দেখে আমি হতবাক।
মা ঝিনুক আপুকে থামিয়ে বললো,ঐ মেয়েটাকে এনো তোমার বাসায় আমি দেখতে চাই।
আমি আর ঝিনুক আপু দুইজনই মায়ের কথা শুনে থ হয়ে গেলাম।
চলবে,,

তুমি আমার পর্ব-১৮(শেষ পর্ব)

0

#তুমি আমার (সমাপ্তি পর্ব ১৮)
#মেঘা আফরোজ
·
·
·
মেঘা রেহানের দিনগুলো বেশ ভালোই কাটছে প্রতিদিন ফোনে কথা বলা দেখা করা এভাবেই কাটছে। ওদিকে রাফিন মিতুর বিয়ে হয়ে গিয়েছে। সেদিন রাফিন আর মিতুর ব্যাপারে সবাই রাজি হয়ে যায় মিতুর বাবাও কোনো অমত করে নি। রাফিনের মা চেয়েছিলো অনুষ্ঠান করে ছেলের বিয়ে দিতে কিন্তু রাফিন না করে দিয়ে বলেছে বিয়েটা ঘরোয়া ভাবে সেরে ফেলতে। অবশেষে ওদের বিয়েটা খুবই সাধারণ ভাবে হয়ে গিয়েছে।
রাফিন এখন রেহানের বাবার অফিসে জয়েন করেছে। রাফিন এখন আগের মতই হাসিখুশিতে থাকে,তবে মাঝে মাঝে মন খারাপ হলেও তা কাউকে বুঝতে দেয় না নিজেকে সামলে রাখে।

সময় তার আপন গতিতে ছুটছে। দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে অনেকগুলো দিন। রেহান ও নিজের লেখাপড়া শেষ করে বিজনেসের কাজে মন দিয়েছে। মেঘার ইন্টার পরীক্ষার আর মাত্র ১৫ দিন বাকী। মেঘা যতটা পারছে পড়াশোনা করছে মন দিয়ে। রেহান মেঘাকে তেমন ফোন দেয় না এখন। রেহান চায় না মেঘার রেজাল্ট খারাপ হোক।
কেটে গেলো আরো ১৫ টি দিন। আজ মেঘার পরীক্ষা শুরু মেঘা রেডি হচ্ছে তন্ময় দরজার কাছে দাড়িয়ে বললো
– আপু তাড়াতাড়ি রেডি হও রেহান ভাইয়া এসেছে তোমাকে পরীক্ষা সেন্টারে নিয়ে যাবে।
– ৫ মিনিটে আসছি।
তন্ময় চলে গেলো মেঘা জলদি হিজাবটা পড়ে প্রয়োজনীয় যা যা আছে সব নিয়ে বেড়িয়ে আসলো রুম থেকে। বসার রুমে সোফায় রেহান ওর বাবা আর তন্ময় বসে কথা বলছিলো। মেঘা আসতেই রেহান তারা দিয়ে বললো
– মেঘা আধ ঘন্টা আগে এক্সাম হলে ঢুকে যেতে হবে। তুমি কিছু খেয়েছো?
মেঘা কিছু বলার আগেই ওর বাবা বললো
– রেহান ওকে আজ ধরে বেধেও খাওয়াতে পারবেনা।
– সেকি কথা! মেঘা যাও খেয়ে এসো।
– তুমিও তো খাও নি চলো তুমি কিছু খেয়ে নেবে আমি খাবো না।
– আমি নিজের নয় তোমার খাওয়ার কথা বলেছি।
– আমি খাবো না প্লিজ জোর করো না পরীক্ষার মধ্য সকালে খেলে সে খাবার আমার হজম হয় না। তারচেয়ে বরং তুমি….
– আমি খাবো না। না খেলে তুমি চলো বের হতে হবে।
মেঘা মাথা নাড়িয়ে বাবার থেকে দোয়া নিয়ে বেড়িয়ে গেলো।
.
🌿
.
একে একে মেঘার পরীক্ষা গুলো ভালো ভাবেই শেষ হলো। মেঘা এখন সম্পুর্ণ ফ্রী, পরীক্ষা শেষ হবার ৩ দিন পরে রেহানের বড়মা রেহানের মা মেঘাদের বাড়িতে এসে ওর বাবার সাথে কথা বলে গেলো তারা চায় এখন মেঘাকে রেহানের বউ করে ঘরে তুলতে। বিয়ের দিনটা ঠিক করা হয়েছে ৭ দিনের মধ্য।

আজ মেঘা রেহানের বিয়ে সকাল থেকেই বিয়ের আনন্দে মেতে উঠেছে দুটো বাড়ি।
মেঘাকে একটু আগে পার্লার থেকে মেয়েরা এসে সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছে। বউয়ের সাজে লাল বেনারসিতে অপরুপ সুন্দর লাগছে মেঘাকে। মেঘা ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে নিজেকে দেখছে,আশা মেঘার গলা জড়িয়ে মিষ্টি হেসে বললো
– আপুনি তোমাকে খুব খুব খুব কিউট দেখাচ্ছে। উফ আমারি তো মাথা ঘুড়ে যাচ্ছে না জানি রেহান ভাইয়ার কি হাল হবে!
– আশা তুই না সব সময় এক লাইন বেশি বলিস।
– আপুনি কি যে বলনা আমার তো ইচ্ছে করছে এক লাইন নয় সাথে আরে দু লাইন বাড়িয়ে বলি।
– হয়েছে আর বলতে হবে না।
মেঘাকে ঘিরে আশা আরো অন্য সব কাজিনরা বসে আছে একটু পর বাইরে থেকে কেউ বললো বড় এসেছে। মেঘাকে একা রেখেই সবাই বেড়িয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর মিথিলা মিতু রাইসা মেঘার রুমে এসে ওর সাথে দেখা করে গেলো।
অবশেষে ওদের বিয়ে পড়ানোর সময় আসলো মেঘাকে প্রথমে কবুল বলতে বলা হলো কিছুটা সময় নিয়ে মেঘা কবুল বলেছে। রেহানকে কবুল বলতে বললে ও গটগট করে কবুল বলে দিয়েছে। তানভির দুষ্টু হসে রেহানে বললো
– বউকে নেওয়ার এত তারা তোর! কবুল বলতে একটুও সময় নিলি না!
– বলতে তো হতোই তাই তাড়াতাড়ি বলে দিলাম শুধু শুধু সময় নষ্ট করে লাভ কি বল।
– হুমম বুঝি আমি।
– তোর যে বুঝ আমার জানা আছে। এই তানভির মেঘাকে দেখেছিস তুই?
– আর দেখা,মেয়েদের ভীরে তোর বউকে খুজেই পাইনি।
রেহান হেসে বললো
– ভালো হয়েছে আমার বউকে আমি দেখতে পেলাম না তুই কেনো দেখবি আগেই।

রেহানের বাবা মেঘার বাবাকে বললো
– বেয়াই এখন তো আমাদের যেতে হবে রাত হয়ে এলো প্রায়।
মেঘার বাবা কাউকে ডেকে বললো মেঘাকে নিয়ে আসতে মেঘার মামি আশা সহ কয়েকজন মিলে ওকে এনে রেহানের পাশে দাড় করালো। মেঘার বাবা রেহানের হাতে মেঘাকে তুলে দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো।
মেঘা ও নিজেকে সামলাতে পারলো না বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। কেঁদে কেঁদে তন্ময়কে বললো বাবাকে দেখে রাখতে সময় মত ওষুধ খাওয়াতে। মেঘার খুব কষ্ট হচ্ছে বাবা ভাইকে ছাড়া কখনো একা কোথাও থাকে নি কিন্তু আজ থেকে ওদেরকে ছেড়েই থাকতে হবে।
মিথিলা মেঘাকে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দিলো পাশে রেহান বসেছে সামনে ড্রাইভার। মেঘা এখনো কেঁদে চলেছে বাবা আর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে। গাড়িটা ছেড়ে দিতেই আর কাউকে দেখতে পেলো না।
.
🌿
.
মেঘা মাথায় বড় ঘোমটা টেনে বসে আছে বাসর ঘরে। পুরো রুম জুরে ফুলের মাতাল করা ঘ্রাণ মৌ মৌ করছে। লাল গোলাপ সাদা গোলাপ বেলিফুলে সাজানো হয়েছে রুম। হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে মেঘা চমকে উঠে তাকালো রেহানকে দেখে চোখ নামিয়ে নিলো। রেহান দরজা লক করে মেঘার পাশে এসে বসে মেঘার ডান হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো
– মেঘা আজ আমি অনেক অনেক হ্যাপি,তোমাকে আমার লাইফে সারাজীবনের জন্য পেয়েছি। এখন আমি জোর গলায় বলতে পারবো”””তুমি আমার””” ভালোবাসি বউ অনেক ভালোবাসি তোমাকে।
রেহান মেঘার হাতের উল্টো পাশে চুমু খেলো
– এখনো কি ঘোমটার আড়ালে থাকবে হুম?
মেঘা কিছু না বলে একই ভাবে বসে আছে
– ঠিকআছে আমার কাজটা আমি করে নিচ্ছি।
রেহান মেঘার মুখের উপর থেকে কাপরটা সড়িয়ে নিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার মেঘপরীর দিকে। রেহান ঘোর লাগা কন্ঠে বললো
– তোমার সৌন্দর্যের উপমা যে আমি কি বলে প্রকাশ করবো বুঝতে পারছি না!! তোমাকে ন্যাচারাল ভাবে দেখেছি সব সময় এমন ভারী সাজে কখনো দেখিনি তোমায়। আজ যেনো এক অন্য মেঘাকে দেখছি আমি। তোমার ওই টানা চোখে এখন থেকে সব সময় কাজল পড়বে বুঝেছো উহু তুমি নয় আমি নিজেই রোজ পড়িয়ে দেবো। এই মেঘা চুপ করে আছো কেনো তুমি?
রেহান মেঘার দুগালে হাত দিয়ে বললো
– মেঘা তাকাও আমার দিকে
মেঘা চোখ তুলে তাকালো রেহানের চোখে চোখ রাখতেই এক অন্য রকম অনুভূতি বয়ে গেলো। রেহানের চোখে আজ শুধুই খুশির ঝিলিক দেখছে মেঘা। রেহান মেঘার কপালে পরম আবেশে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিলো। মেঘা রেহানের দিকে তাকিয়ে বললো
– আমি সত্যি খুব খুশি আজ তোমার মত জীবনসঙ্গী পেয়েছি। আজ থেকে যেমন আমি তোমার, তেমনি””তুমি আমার””শুধুই আমার। রেহান মুচকি হেসে মেঘাকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিলো।
– মেঘা এভাবে থাকতে তোমার আনইজি লাগছে তাইনা,যাও ফ্রেস হয়ে এসো।
মেঘা ওয়াশরুমে গিয়ে ভারী গহনাগুলো খুলে শাড়িটা চেন্জ করে স্কাই ব্লু কালারের একটা সিল্কের শাড়ি পড়ে নিলো। ওয়াশরুমের দরজা খুলতেই চোখ পড়লো রেহানের উপর রেহান খাটে বসে ফোন দেখছিলো। রেহান আওয়াজ পেয়ে চোখ তুলে তাকিয়ে হা করে তাকিয়ে রইলো মেঘার দিকে। উঠে গিয়ে মেঘার কাধে দুহাত রেখে বললো
– এই মেঘপরী তুমি কি চাইছো আমাকে আজ মেরে ফেলতে!!
– এসব কি বলছো তোমাকে মারবো কেনো??
– একটু আগে দেখেছি এক রুপে তখন ছিলে মিষ্টি বউয়ের সাজে আর এখন একদম স্নিগ্ধ লাগছে তোমায়। শাড়ির কালারটা তোমার সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। আমার দেওয়া নামটা আজ সার্থক হলো,আমার মেঘপরী তুমি।
মেঘা কিছু বললো না মুচকি হাসলো।
রেহান মেঘা দুজনে একসাথে নফল নামাজ আদায় করে নিলো। তারপর ওরা এক নতুন অধ্যায় পা রাখলো,যে অধ্যায় শুধু ওদের ভালোবাসা দিয়ে রচনা করা হবে।

দুজনের সপ্ন গুলো পূরণ হয়েছে আজ। নতুন এক জীবনে পা রাখলো রেহান-মেঘা। ভালোবাসা সত্যি বড় অদ্ভুত! শত কষ্ট হলেও একটুখানি ভালোবাসাই পারে সে কষ্টকে দূর করে দিতে।

—(সমাপ্ত)—

তুমি আমার পর্ব-১৭

0

#তুমি আমার (পর্ব ১৭)
#মেঘা আফরোজ
·
·
·
রাফিন প্রতিদিনের মত আজও ছাঁদে দাড়িয়ে সিগারেটের ধোয়া উড়াচ্ছে। মিতু এসে রাফিনের পাশে দাড়ালো। রাফিন সামনে তাকিয়েই বললো
– মিতু এখানে কেনো এসেছো?
– আমি এসেছি আপনি বুঝলেন কি করে! আপনি তো সামনে তাকিয়ে আছেন।
– আমি এতটাও অন্যমনা হয়ে ছিলাম না,যে কেউ পাশে এসে দাড়ালে বুঝতে পারবো না।
– ও আচ্ছা।
দুজনেই চুপচাপ দাড়িয়ে আছে মিতু কিছু বলতে চেয়েও পারছে না রাফিন নিজেই বলে উঠলো
– কি বলতে চাইছো বলে ফেলো।
মিতু অবাক হয়ে বললো
– আপনি এটাও বুঝে গিয়েছেন আমি কিছু বলতে চাই!!
– বেশি কথা না বলে কি বলতে চাও বলো আর না বললে যাও এখান থেকে।
– ওকে বলছি। আপনি যে এভাবে সব সময় মন খারাপ করে থাকেন,এতে যে আপনার মায়ের কষ্ট হয় সেটা কি বুঝেন আপনি?
– আমার মাকে নিয়ে তোমার না ভাবলেও চলবে।
– কেনো ভাববো না হুম,আপনি যে মেঘাকে ভালোবেসে সবসময় কষ্ট পাচ্ছেন নিজের মাকে কষ্ট দিচ্ছেন সে মেঘা তো ভালোই আছে নতুন সম্পর্কে ও জড়িয়ে গিয়েছে। তাহলে আপনি কেনো পারছেন না নিজেকে স্বাভাবিক করতে?
– আমি এ নিয়ে কোনো কথা বলতে চাইছি না,যাও এখান থেকে।
– দেখুন আমার কথাটা একটু…..
মিতুকে আর কিছু না বলতে দিয়ে রাফিন রেগে ধমক দিয়ে বললো
– এই মেয়ে তোমাকে যেতে বলেছি না,কেনো বিরক্ত করছো আমাকে?
মিতু কিছুটা কেঁপে উঠলো চোখের কোনে পানি জমে গিয়েছে আর কিছু না বলে দৌড়ে নেমে গেলো ছাঁদ থেকে। মিতু চলে যাওয়ার পর রাফিন নিজেকে একটু শান্ত করে মনে মনে ভাবছে
– আমি মেয়েটির সাথে এমন ব্যবহার না করলেও পারতাম,ও তো ভুল কিছু বলেনি। ধুর আমিও না নিজের রাগটা কনট্রোল করতে পারি না।
.
🌿
.
মিতু নিজের রুমে এসে সোজা ব্যালকনিতে চলে এলো,নিরবে চোখের জল ফেলে তাকালো দূর আকাশের দিকে। আকাশটাও আজ মেঘাচ্ছন্ন,মিতুর চোখের জলের মত আকাশের বুক থেকে যখন তখন বৃষ্টির ফোটা গড়িয়ে পড়বে। মিতু নিজে নিজেই বলতে লাগলো
– ভালোবাসা সত্যি বড় যন্ত্রণাদায়ক। এ যন্ত্রণা যে কোনো ভাবেই কমার নয়। আজ বুঝতে পারছি রাফিন মেঘাকে ভালোবেসে কতটা কষ্ট পাচ্ছে।রাফিন তো আমাকে সহ্যই করতে পারে না কিন্তু আমি যে চাই খুব করে চাই রাফিনের পাশে থাকতে ওর কষ্টগুলো নিজের করে নিতে। এ কটা দিনে খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছি ওকে বার বার আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে তারপরেও ওর সামনে গিয়েছি একটু আশায়। তবে আজ একটু বেশি কষ্ট হচ্ছে আমার বড্ড অসহায় লাগছে নিজেকে।আমি কখনো কি বলতে পারবো না রাফিন””””তুমি আমার””””।

রাফিন ভুল করেছে বুঝতে পেরে মিতুর কাছে সরি বলতে এসেছিলো। দরজা খোলা ছিলো নক করে কোনো সারা না পেয়ে রুমে এসে মিতুকে না পেয়ে ব্যালকনির কাছে এসে মিতুর কান্নাজরিত কন্ঠ শুনে দাড়িয়ে পড়েছিলো। মিতুর বলা কথাগুলো শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে রাফিন। মিতু ওকে ভালোবাসে এটা যেনো ও মানতেই পারছে না। কি করে মানবে মিতুর সাথে এ পর্যন্ত খারাপ ব্যবহার ছাড়া ভালো ব্যবহার করেনি। তাহলে মিতু কেনো ভালোবাসলো ওকে!!
.
🌿
.
রাফিন ধীর পায়ে এগিয়ে মিতুর কাধে হাত রাখলো,মিতু চমকে তাকালো পেছনে। রাফিনকে দেখে চরম পর্যায় অবাক হলো মিতু,তাড়াতাড়ি চোখের পানিটা মুছে মৃদু হেসে বললো
– আপনি আমার রুমে! কোনো দরকার?
– ভালোবাসো আমাকে?
রাফিনের এমন কথায় মিতু বিষ্ময় চোখে তাকালো,রাফিন হঠাৎ এ কথা কেনো বললো মিতু বুঝতে পারছে না। মিতুকে চুপ থাকতে দেখে রাফিন আবার বললো
– কি হলো বলো ভালোবাসো আমাকে?
– হুম। মাথা নিচু করে বললো।
– কি দেখে ভালোবাসলে? আমি তো ভালো ছেলে নই তোমার সাথে অলটাইম বাজে ব্যবহার করি এমনকি সিগারেট ও খাই তাহলে??
মিতু মাথা নিচু করেই বললো
– কি দেখে ভালোবেসেছি জানিনা তাছাড়া মানুষের ওপরের রুপটা সবসময় তার আসল ব্যক্তিত্বর পরিচয় দেয়না। আপনার মনটা খুবই ভালো আমি মনে করি আর সে মনটাকেই আমি ভালোবেসেছি।
রাফিন কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে মিতুর দিকে তাকিয়ে থাকলো তারপর মিতুর দিকে একটু এগিয়ে বললো
– বিয়ে করবে আমায়?
মিতু মুখ তুলে অবাক চোখে তাকালো রাফিনের দিকে,রাফিন মৃদু হেসে মিতুর গালে হাত রেখে বললো
– কি হলো বিয়ে করবে না? এটাই কিন্তু সুযোগ পরে কিন্তু আর সুযোগ দিবো না।
মিতুর চোখ থেকে অঝরে পানি পরতে লাগলো ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে বললো
– ভালোবাসিতো তাহলে সুযোগটা কেনো হাতছাড়া করবো। কিন্তু আপনার হঠাৎ কি হলো??কিছুক্ষণ আগেও তো আমাকে সহ্য করতে পারছিলেন না!!
– কি হলো জানি না,তবে এখন থেকে এই মুহুর্ত থেকে জানবো অতীতকে মনে করে বর্তমান আর ভবিষ্যৎ কে অন্ধকারে ঠেলে দেবো না।
রাফিন মিতুর হাত ধরে বললো
– দূরে সরিয়ে দিও না কখনো তাহলে হয়তো নিজেকে আর গড়তে পারবো না।
মিতু মুচকি হেসে বললো
– প্রান থাকতে কখনো দূরে সরিয়ে দিবো না।
.
🌿
.
পরের দিন সকালে রাফিন ওর মাকে নিজে গিয়ে বলেছে ও মিতুকে বিয়ে করতে চায় ওর মা কিছুটা অবাক হলেও খুব খুশি হয়েছে । অবশেষে তার ছেলেটা আবারো আগের মত হয়ে উঠছে। সব মা চায় তার সন্তান হাসি আনন্দের মাঝে বাচুক। রাফিন ওনার ছেলে নয় সেটা রাফিনকে কখনো বুঝতে দেয় না নিজের ছেলের মতই ভালোবাসে ওকে। আজ অনেক দিন পর রাফিনের মুখে হাসি দেখে ওনার চোখেও পানি চলে এসেছে। রাফিন মায়ের চোখ মুছে দিয়ে বললো
– মা কাঁদছো কেনো তুমি!!
– সুখে কাঁদছি। তুই যে সব ভুলে নতুন করে সব শুরু করতে চাইছিস এ খুশিতে কাঁদছি আমি। মিতু তোকে ভালোবাসে জানিস তো?
– হ্যা জানি সবটা জেনেই তো ওকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
– ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছিস,মিতুকে আমারো খুব ভালো লাগে। তাহলে এখন মিথিলাকে সবটা বলি ওর বাবার সাথেও তো কথা বলতে হবে।
– হুম দেখো কি করবে। আমি রুমে যাচ্ছি।

রেহান বড়মার রুমে এসে ওদের সব কথা শুনে নিজেও খুব আনন্দিত। রাফিনের জীবনটা আবারো স্বাভাবিক হয়ে উঠবে এটাই চেয়েছিলো রেহান।
রাফিন বেরনোর সময় রেহানকে দেখে দাড়িয়ে পড়লো,রেহান মুচকি হেসে বললো
– আমি অনেক খুশি হয়েছি রাফিন,তুই যে নিজেকে অন্ধকার লাইফ থেকে বের করতে পেরেছিস এটাই অনেক।মিতু খুব ভালো মেয়ে আর ও তোকে অনেক ভালোবাসে।
– হুম,কিন্তু মিতু আমাকে ভালোবাসে তুই জানলি কি করে?
– তুই তো ওকে সহ্য করতে পারতি না মিতু মনে মনে খুব কষ্ট পেতো একদিন রাতে আমি ভাবিকে খুজতে ওর রুমে ঢুকতেই শুনতে পেলাম ও কারো কাছে কেঁদে কেঁদে ফোনে বলছিলো তোকে খুব ভালোবাসে। আর ও যেভাবে তোকে চোখে হারাতো আমি সবই খেয়াল করতাম। যাই হোক আল্লাহ যেনো তোদের ভালো রাখেন,দোয়া রইলো।
রাফিন মৃদু হেসে বললো
– হুমম। আচ্ছা রেহান ভাবি কেমন আছে?
রেহান ভ্রু কুঁচকে বললো
– ভাবি কে?
– কে আবার তোর হবু বউ মেঘা,আর আমার ভাবি।
রেহান হেসে দিয়ে বললো
– হুম ও ভালো আছে। ভাই তুই এভাবেই হাসি মজা করবি এতেই মানায় তোকে।
বড়মা ওদের সামনে এসে বললো
– রেহান একদম ঠিক বলেছে। রাফিন আমি তোর মুখে সব সময় হাসিটা দেখতে চাই।
– হুম হাসবো তোমার জন্য হাসবো।
রেহান বলে উঠলো
– শুধু বড়মার কথা ভাবলি মিতুর কথা কে ভাববে হুম?
রাফিন হেসে বললো
– ওর জন্যই তো আজ আমি নিজেকে বদলাতে পারছি ওকে তো হ্যাপি রাখতেই হবে।
·
·
·
চলবে………………….