কে তুমি পর্ব-০২

0
1189

গল্পঃ কে তুমি ( ২য় পর্ব )
লেখাঃ ইমতিয়াজ আহমেদ চৌধুরী

সেদিন হন্যে হয়ে যাকে খুঁজছিল, আজ তাকে নিজের অফিসে দেখে দৌড়ে গিয়ে হাত ধরে, ‘কে তুমি’ জিজ্ঞেস করতেই মেয়েটি নিলয়ের গালে একটা থাপ্পড় মেরে বললো,–এটা কেমন অসভ্যতা! আপনি আমার হাত ধরলেন কেন?

সমস্ত অফিস স্টাফ এবং যারা চাকরির জন্য নিলয়ের কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিতে এসেছে, সবাই অবাক হয়ে হা করে তাকিয়ে আছে।

নিলয়ের অফিস স্টাফরা এই জন্য অবাক হয়নি যে মেয়েটি নিলয়কে থাপ্পড় মেরেছে। তারা এর জন্য অবাক হয়েছে যে মেয়েটি দেখতে হুবহু হিমির মতো।

হ্যাঁ, এই মেয়েকে দেখেই রাস্তায় থমকে গিয়েছিল নিলয়, হিতাহিত জ্ঞান ছিলনা যে রাস্তার মাঝখানে এভাবে দাড়িয়ে থাকলে গাড়ীর নিচে চাপা পড়ে প্রাণ যেতে পারে। নিলয়ের প্রাণ হিমির প্রতিচ্ছবি দেখেই নিজের প্রাণের প্রতি খেয়াল ছিলনা নিলয়ের। হৃদয় ভেবেছিল সেই ঘটনা তার মস্তিষ্কের ভ্রম, কিন্তু সেই মেয়েটিকে আজকে নিজের অফিসে দেখে আরও অবাক হয়ে যায় নিলয়। তাইতো থাপ্পড় খেয়েও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে।

মেয়েটির চেহারায় অস্বস্তির রেখা ফুটে উঠেছে। অফিস স্টাফদের দিকে তাকিয়ে মেয়েটি বললো,– এসব অসভ্য লোকদের কিভাবে এরা চাকরি দেয় আল্লাহ জানে!

একজন পিওন একটি চেয়ার টেনে এনে মেয়েটিকে বসতে দিয়ে বললো,– ম্যাডাম ইন্টারভিউয়ের টেনশনে হয়তো আপনি নার্ভাস, তার ওপর উনি এভাবে আপনার হাত ধরে ফেলল, প্লিজ উত্তেজিত হবেন না, মাথা ঠান্ডা করেন; কিছু খাবেন? কোল্ড ড্রিংকস, এনে দেই।

মেয়েটি পিওনকে বললো,– উনি যেভাবে দৌড়ে এসে আমার হাতটা ধরে বললো কে তুমি, মনে হচ্ছিল আমি কোনোকালে বোধ হয় ওনার বারা ভাতে ছাই দিয়ে এসেছিলাম, কি অদ্ভুত!

অফিস স্টাফরা খিলখিল করে হেসে উঠলো সবাই। নিলয় চোখের ইশারায় স্টাফদের মেয়েটির কাছে কোনকিছু বলতে বারণ করে তার রুমের দিকে হেটে চলে গেল।

অফিস স্টাফদের খাতিরযত্ন দেখে মেয়েটি ভীষণ অবাক, চাকরিতে জয়েন করার আগেই এত খাতির যত্ন।

নিলয়ের কোম্পানিতে নিয়োগ চলছে, কিছু সংখ্যক ফ্যাক্টরি শ্রমিক এবং নিলয়ের ব্যক্তিগত সহকারী পদে। মেয়েটি ব্যক্তিগত সহকারী পদে চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিতে এসেছে।

ফ্যাক্টরি শ্রমিকদের ইন্টারভিউ একপাশে, অন্যদিকে নিলয়ের অফিস রুমে সহকারী হিসেবে ইন্টারভিউ দিতে আসা অল্প কয়েকজনের ইন্টারভিউ নেবে নিলয়।

পিওনকে ফোন করে নিলয় বললো,– যে মেয়েটি থাপ্পড় মেরেছিল ওনাকে নিয়ে আমার রুমে আসো।

পিওন মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে নিলয়ের রুমে ঢুকলো, মেয়েটি নিলয়কে দেখে অবাক! কাচুমাচু করে বললো,– আপনার রিজেক্ট করতে হবেনা, আমিই চলে যাচ্ছি স্বসম্মানে।

নিলয় মুচকি হেসে পিওনকে বললো,– বাকি যারা ইন্টারভিউ দিতে বসে আছে তাদের গিয়ে চলে যেতে বলেন।

পিওন বেরিয়ে চলে গেল।

নিলয় মুচকি হেসে মেয়েটিকে বললো,– তো আপনি কিভাবে নিশ্চিত হলেন যে আপনাকে রিজেক্ট করা হবে?

: আপনাকে থাপ্পড় মারলাম যে।

: ওটা তো আমার প্রাপ্য ছিল, চিনিনা, জানিনা অথচ আপনার হাত ধরে ফেললাম। আপনার নামটাই তো জানা হলো না!

: সিভিতে তো লেখা আছে।

: তা আছে, তবে আপনার মুখে শুনলে আরও ভালো লাগতো।

: ওকে, আমি নাবিলা।

: সুন্দর নাম নাবিলা, আপনি চাইলে আজকে থেকেই জয়েন করতে পারেন, এবং করলে আমি খুশী হবো।

: অবশ্যই, অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে স্যার।

নিলয়ের অফিস রুমের ভেতরেই এক কর্ণারে থাকা চেয়ার টেবিল নাবিলাকে দেখিয়ে নিলয় বললো,– আপনি ওখানে বসবেন, তবে এখন কিছুক্ষণ এখানেই সামনাসামনি বসুন, আমরা কথা বলি।

আসলে নাবিলাকে যতই দেখছে যেন মন ভরছে না নিলয়ের। এ যেন হিমি নিজেই মৃত্যুর পরে আবার পূনরায় জন্ম নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে নিলয়ের ভালোবাসার টানে। নাবিলার কথা বলার ধরন, শারীরিক গঠন, হুবহু হিমির মতো। ভালোবাসার হিমি নেই কিন্তু হিমির প্রতিচ্ছি নাবিলাকে তাই চোখ ভরে দেখছে নিলয়। এরকম হুবহু দেখতে মানুষের মত মানুষ হয় এটা স্বাভাবিক, কিন্তু এতটা নিখুঁত মিল সত্যি রহস্যময়।

নিলয় এবং নাবিলা কথা বলছে এমন সময় দরজা খুলে নিলয়ের চাচাতো বোন মীরা অফিস কক্ষে ঢুকেই নাবিলাকে দেখে থমকে গেল। একটু সময় বিস্ফারিত চোখে নাবিলার দিকে তাকিয়ে থেকে, মুখ দিয়ে কাঁপা কণ্ঠে ‘ হি হি হি’ শব্দ করে ধড়াম করে ফ্লোরে পড়ে অজ্ঞান মীরা।

নাবিলা অবাক হয়ে নিলয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,– আমি কি এতটাই কুৎসিত যে আমাকে দেখে মেয়েটির জ্ঞান হারালো?!

নিলয় মুচকি হেসে বললো,– আমার চোখে তুমি স্রেষ্ঠ সুন্দরী। ও আমার চাচতো বোন মীরা, মৃগী রোগ আছে তাই প্রায় সময় এরকম হয়।

নাবিলা আমতা আমতা করে বললো,– ও আচ্ছা।

পানির বোতল হাতে নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে মীরার মুখমন্ডলে পানি ছিটিয়ে দিতেই মীরা চোখ খুলে ভ্রু কুচকে ফিসফিস করে নিলয়কে বললো,– মেয়েটি কে! হিমির ভূত নাকি আবার।

নিলয় ফিসফিস করে মীরাকে বললো,– আরে ও আমার সহকারী হিসেবে চাকরিতে জয়েন করেছে আজকে, ওর নাম নাবিলা। খবরদার ওকে কিছু বলিসনা আবার।

নিলয় মীরার হাত ধরে টেনে তুলে চেয়ারে বসতে বললো।

চেয়ারে বসে মীরা আড়চোখে নাবিলাকেই দেখছে।

নাবিলা গলা খাঁকারি দিয়ে মীরাকে বললো,– চোখদুটো এভাবে বারবার একশত আশি ডিগ্রিতে ঘোরালে চোখের বিয়ারিং ক্ষয়প্রাপ্ত হতে পারে, আমাকে দেখতে ইচ্ছে হলে সোজাসুজি তাকিয়ে থেকে দেখে নিন, ভিজিট দিতে হবেনা।

মীরা বললো,– স্মার্ট আছো খুব।

: এ-যুগে স্মার্ট না হলে হয় বলো মীরা? কিন্তু তোমাকে অতটা স্মার্ট মনে হচ্ছে না।

: মানে?

: মানে হলো তুমি যদি অতটা স্মার্ট হতে, তাহলে তোমার ভাইয়ার সহকারী নিয়োগ দিতে হতনা, এই পোস্ট তুমি সামলে নিতে পারতে।

: আমাদের কি টাকা পয়সার অভাব আছে নাকি! আমি কাজ করতে যাবো কেন?

: এই যে আনস্মার্ট লোকেরা এভাবেই চিন্তা করে, কাজ করা গর্বের বিষয়। তোমার ভাইয়া নিলয় স্যারের কি টাকার অভাব। তিনি কাজ করছেন কেন? আর বড়ো কথা হলো নিজের টাকা খরচা করার মজাটাই আলাদা।

নিলয় হা করে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছে নাবিলার কথা, হিমি ঠিক এভাবেই কথা বলতো।

মীরা একটু বিরক্ত হয়ে নাবিলাকে বললো,– তুমি আমাদের ভাইবোনের মাঝে কথা না বললেই বেটার, মনে রেখো তুমি সামান্য একজন কর্মচারী।

নাবিলা মুচকি হেসে বললো,– স্মার্ট লোকেরা কখনও কোনকিছুকে সামান্য মনে করেনা, যেমন আমার কাছে আমার চাকরিটা অসামান্য, ভেবে ভালো লাগছে আমি কিছু একটা করছি, যাতে আমার সময়ের মূল্যকে স্যালারি হিসেবে মাস শেষে পাবো, তার মানে আমার সময় মূল্যবান। আর তুমি ব্যাগ ভরে সপিং আর গাল ভরে মেকাপ ছাড়া আর কি করছো বলো। এতে সময় এবং টাকা দুটোই অপচয়।

নিলয় হা করে নাবিলার কথা গিলছে। মীরার মেজাজ গরম হয়ে উঠেছে দেখে নিলয় নাবিলাকে বললো,– নাবিলা আমাদের জন্য একটু চা করে আনবে!

নাবিলা রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই মীরা বললো,– ভাইয়া এই মেয়ে ঠোঁটকাটা, মানে যা মনে আসে মুখে গড়গড় করে বলে ফেলে; একে না রাখাই ভালো হবে। দেখতে হিমি ভাবীর মতো বলে গলে যেওনা।

: আহ! মিরা থাকনা, আজই তো সবে জয়েন করছে, কিছুদিন দেখি। তুই কেন এসেছিস বল।

: ভাইয়া শপিংয়ে যাবো বন্ধুদের নিয়ে, টাকা লাগবে।

: আচ্ছা একাউন্টসে বলে দিচ্ছি, যাবার সময় নিয়ে নিবি।

একটু পরেই নাবিলা এককাপ চা এনে নিলয়ের টেবিলে রাখলো। নিলয় অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,– মীরার জন্য আনোনি?

নাবিলা মীরার দিকে তাকিয়ে বললো,– নামী ব্র্যান্ডের দামী লিপস্টিপ মীরার ঠোঁটে চকচক করছে, তারমানে বাসা থেকে বেরিয়ে সোজা অফিসে এসেছে আপনার কাছে, এখান থেকে শপিং অথবা পার্টিতে যাবে। সুতরাং এখন মীরা কিছুতেই চায়ের কাপকে তার ঠোঁট স্পর্শ করতে দেবেনা এটাই স্বাভাবিক।

মীরা ভেংচি কেটে বললো,– থাক আর স্মার্টনেস দেখাতে হবেনা।

মীরা হনহন করে হেটে বেরিয়ে গেল।

নাবিলাকে যতই দেখছে, যতই তার কথাবার্তা শুনছে; নিলয় ভুলে যাচ্ছে যে তার হিমি মরে গেছে। নিলয়ের মনে হচ্ছে তার সামনে নাবিলা নয়, হিমি দাড়িয়ে আছে। কিন্তু সত্যিটা কি?

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে