Friday, June 27, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1069



প্রণয় পর্ব-০৮

0

#প্রণয়
#৮ম পর্ব
#আবির হাসান নিলয়

সিফাত আর শেফা অর্নদের বাড়িতে এসে পৌছেছে। বাড়ির সবাই দাঁড়িয়ে আছে মেইন দরজার সামনে। শুধু একজনই নেই। সে হল অবনি। অর্নের মা তাকে ডেকেছে অনেক্ষণ হয়েছে। অবনি আসছি বলে এখনো আসেনি। সিফাত আর শেফা গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভিতরের দিকে এগিয়ে যায়। দরজার কাছে এসে, দাদুকে সালাম করে। তারপর অর্নের বাবাকে। সব শেষে অর্নের মাকে সালাম করার আগে তিনি জড়িয়ে ধরে বলে..

– তোরা বুকে আয়। কত বছর পর আসছিস বলতো? কত ছোট্ট দেখেছিলাম তোদের। মায়ের কথা ভুলে গিয়েছিস একদম তাইনা? (আরিনা বেগম)
– না বড় আম্মু। ভূলবো কেনো? চলে এসেছি। তোমার রান্না খাইনা কত বছর সেটা কি জানো? আনাফ ভাইয়া কোথায়? অর্নকেও তো দেখছিনা। (সিফাত)
– আছে সবাই। শেফা.. কিরে তুই এত মিষ্টি দেখতে হয়েছিস কবে হুম? দেখিস ছেলেগুলোকে আবার পাগল বানিয়ে দিয়ে যাস না।(আরিনা বেগম)

অর্নেরমা কথাটা বলে, শেফার গাল টেনে ধরে। শেফা সিফাতের থেকে তিন বছরের ছোট। শেফা বেশ আদুরী দেখতে। কথা বলার ধরনটাও অন্য সব মেয়েদের থেকে একটু আলাদা। প্রথমবারই শেফার কথা বলার ধরন দেখে তাকে মিষ্টি বলতে বাধ্য হবে যে কেউ। চুলগুলো তেমন বড় না। সোনালী রঙের চুল, বেশ গুছিয়েই রাখা। শেফা লজ্জা পেলো বড় মায়ের কথায়। অর্নের মাকে জড়িয়ে ধরে নেয় কিছু সময়। সবাই ভিতরে প্রবেশ করে। অর্নের মা ওদেরকে রুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজের লোককে ডাকে। কিন্তু সিফাত বলে..

– বড় আম্ম.. আমি তো চিনি সব। আমি একাই যাচ্ছি। ঐ শেফু আয়। (সিফাত)
– তুমি যাও। আমি বড়আম্মুর সাথে থাকবো একটু। (শেফা)
– আচ্ছা। (সিফাত)

সিফাত সিঁড়ি ডিঙিয়ে দৌড়ে এগিয়ে যাচ্ছে উপরের দিকে। শেষ সিঁড়ি পার হয়ে ডান পাশের ঘর গুলোতে তাকালো। ঠিক তখনি বাম পাশ থেকে কে যেন এসে সিফাতকে বেশ জোরে সরেই ধাক্কা দেয়। সিফাত পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই সিফাত লক্ষ্য করে যে এসে ধাক্কা দিয়েছে, সে নিজেই সিঁড়ির দিকে হেলে পড়ছে। সিফাত ক্যালকুলেশন করে নিল, যদি তিনি নিচে পড়ে তাহলে আর হাঁড়গুলো সোজা থাকবেনা। সিফাত আর দেরি করে না। সে নিজের ডান হাত বাঁড়িয়েই, পড়ে যাওয়া তাকে ধরলো। সিফাতের গায়ে কয়েকগুলো বালিশ হুড়মুড় করে এসে পড়া শুরু করে। মুখটা ভেসে ওঠে সিফাতের সামনে।

যে সিঁড়ি দিয়ে নিচে পড়তে যাচ্ছিল, সে হল অবনি। আর অবনি বেডসিট, আর কয়েকটা বালিশ একসাথে পাঁজকোলা করে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল পাশের রুমে। অবনি এতক্ষণ রুম পরিষ্কার করছিল সিফাতদের জন্য। সব রেডি, কেবল বালিশ এনে রাখলেই ফুলফিল হয়ে যাবে। এদিকে অর্নের মা তাকে বারবার ডাকছিল বিধায়, সে একসাথে তিনটে বালিশ পেঁচিয়ে ধরে বের হয়েছিল স্টোর রুম থেকে। কিন্তু দূর্ভাগ্যক্রমে একটা বালিশ হঠাৎ ওর চোখের সামনে চলে আসে। সরাতেই পারছিল না। তবে আন্দাজের ভারে এগিয়ে যাচ্ছিল অবনি। হঠাৎ কারো সাথে ওর ধাক্কা লেগে যায়।

সে সিঁড়ির দিকে হেলে পড়ছিল। কিন্তু তখনো বালিশ ধরেই রাখে বর্ষা। তাই যখন পড়ে যাবে, এমন সময় একটা হাত অবনিকে টেনে ধরে। সেই হাতটা হল সিফাতের। সিফাত হাত টেনে ধরতেই অবনির কোল থেকে বালিশগুলো ছুঁটে যেয়ে দুটো সিফাতের উপর এসে পড়ে। আরেকটা নিচের দিকে গড়িয়ে যেতে থাকে। সিফাত হাত ধরেই অবনির মুখের দিকে তাকায়। সিফাত অবনির চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে অনিমেষ ভাবে। এভাবে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে দুজন একে অপরের দিকে। অবনি বলে “আমি পড়ে যাচ্ছি।”

সিফাত কথাটা শুনেই এক ঝটকায় টেনে নেয় নিজের কাছে অবনিকে। অবনি টাল সামলাতে না পেরে সিফাতের বুকে এসে থামে। সিফাত ডান হাত দিয়ে অবনির কোমর পেঁচিয়ে ধরলো। ছোট্ট একটা খামছি দিয়ে ধরে রাখে অবনিকে। অবনি সিফাতের চোখের দিকে তাকায়। সিফাতও অবনির চোখের দিকে তাকালো। অনিমেষ দৃষ্টি। এ চাহনির বর্ণনা যেন নিমজ্জিত। অবনির হঠাৎ শুনতে পেলো নিচ থেকে অর্নের মা তাকে ডাকছে। সে স্তম্ভিত ফিরে পেয়ে নিজেকে সিফাতের থেকে ছাঁড়িয়ে নেয়। প্রশ্ন করে..

– কে আপনি? এখানে কি করেন?
– হ্যালো… আমি সিফাত। আর এটা আমাদের বাড়ি বলা যাই। কিন্তু আপনি কে? (সিফাত)
– ওহ, আপনিই সেই সিফাত? (অবনি)
– হুমম। কিন্তু আপনি কে? (সিফাত)
– আমি অ***

অবনি থেমে যায়। অর্নের কথা মনে পড়ে ওর। অর্ন তাকে বউ হিসেবে মানে না। অর্নের কাছে ঘেষতে বারণ তার। অর্নের বউ হিসেবে পরিচয় দিতে অর্নের খারাপ লাগে। এ জন্য অর্নের কোনো সম্মান নষ্ট না হয়, তাই অবনি অর্নের নাম নিতে যেয়েও থেমে গেলো। সে বলতে চেয়েছিল, অর্নের বউ। কিন্তু এখন এটা সে বলবে না। অবনি বলে..

– আমি অবনি। আর অর্ন ভাইয়ার আম্মুর বোনের মেয়ে।

অবনি কথাটা বলে বালিশগুলো হাতে তুলে নিল। রুমের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। পিছন থেকে সিফাত বলে..

– শুনুন…
– হুম। (অবনি)
– একটা প্রশ্নের উত্তর দিবেন? (সিফাত)
– কি প্রশ্ন বলুন। (অবনি)
– আপনার চোখ দুটো এত সুন্দর কেনো? এত মায়াবী কেনো? এত আকর্ষনীয় কেনো? সত্যিই বলছি, এত আকর্ষণীয় মায়াবী চোখ আমি কখনো দেখিনি। চোখের মায়াতে যেকোনো পুরুষ আটকাতে বাধ্য।

অবনি হা হয়ে গেলো সিফাতের থেকে কথাগুলো শুনে। এই প্রথমবার অবনিকে এই ভাবে কথা বললো। ওর গা কাঁপা শুরু করেছে। ওর পা যেন চলছেই না। অর্নের এতটা কাছে আসার পরও অর্ন কোনোদিন অবনিকে কিছু বলেনি। অথচ মাত্র পরিচিত হওয়া ছেলেটা অবনির চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে এতকিছু বলে ফেললো। যা অবনির গায়ের লোমগুলো যেন দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ উত্তরের একটা দমকা বাতাস অবনির মাথার চুলে এসে লাগে। ওর এলোমেলো করা চুলের খোঁপা খুলে যায়। দীঘল কালো চুল অবনির প্রায় পায়ের নিচে এসে ঠেঁকতে শুরু করেছে। সিফাদ নিস্তব্ধ, নীরব, নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অবনি আর দাঁড়ায় না। এক দৌড়ে গেষ্ট রুমে যেয়ে দরজা আটকে দিল।

দরজার সাথে হেলান দিয়ে, বালিশ একসাথে বুকের মধ্যে চেপে নিয়ে চোখ বন্ধ করলো অবনি। আয়নাতে তাকে দেখা যাচ্চে। সে বালিশগুলো বিছানায় ফেলে দৌড়ে আয়নার সামনে যেয়ে দাঁড়ায়। প্রথমবার আয়নার সামনে আগ্রহ নিয়ে দাঁড়ালো। নিজের চোখের দিকে তাকালো সে। মনে মনে বললো “এই ছেলেটা নিশ্চয় পাগল। আমার চোখ সুন্দর? মাথায় তার সমস্যা আছে। কিন্তু এভাবে তো কেউ বলেনি আমাকে। এত ভালো লাগছে কেন আমার? উফ.. এই ছেলে কি ম্যাজিশিয়ান নাকি? এক ঝটকায় আমার ভাবনাগুলো সব গোলমেলে করে দিয়েছে। দূরে থাকতে হবে ছেলেটার থেকে।”

অবনি দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পেলো। তাড়াতাড়ি আয়নার সামনে থেকে সরে এসে বিছানা গোছাতে শুরু করে। চুলগুলো খোলায় আছে তার। অবনি বিছানা গুছিয়ে দরজা খুললো। সিফাত দরজার পাশে হেলান দিয়েই দাঁড়িয়ে ছিল। অবনিকে দেখে বললো..

– এবার বলুন, আপনার চোখ দুটো এত সুন্দর কেনো? আর এত লম্বা চুল। আমি মনে হয় বাঙালী মেয়ের প্রেমে পড়বো বলে বিদেশি কারো প্রতি আকৃষ্ট হইনি। (সিফাত)
– এটা আপনার রুম। রেস্ট করেন। (অবনি)
– অবনি….শু.. (সিফাত)
– নাহ, কিছু শুনবো না। যান।

অবনি কথাটা বলেই সেখান থেকে দৌড়ে চলে আসে। অবনি সিফাতের কথা আরো শুনতে চাইছিল। কিন্তু কিনা কি হবে ভেবে দৌড়ে চলে আসে। নিচে এসে সোজা রান্না ঘরে যেয়ে, দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে হাফাতে থাকে। অর্নের মা আরিনা বেগম বলে..

– কি ব্যাপার কোথায় ছিলি? আমি তোকে এত ডাকাডাকি করেও পাচ্ছি না কেনো? আর হাফাচ্ছিস কেনো? (আরিনা বেগম)
– ঐ রুমগুলো পরিষ্কার করছিলাম। বিছানা সাজিয়ে তবেই এলাম। (অবনি)
– ওহ, সিফাত আর শেফা এসেছে দেখেছিস? (আরিনা বেগম)
– হুমম দেখলাম। কথা হয়েছে। (অবনি)
– ওহ, ভালো করেছিস। একটু রেস্ট নে যা। না হয় রান্নার কাজে হেল্প কর। (আরিনা বেগম)
– আচ্ছা করছি হেল্প। তুমি যাও। (অবনি)
– একসাথে করি আয়। অর্ন আসবে এখনি।

ওরা দুজন রান্না করতে থাকে। ও দিকে অর্ন ছোটনের মাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। সবকিছু ঝামেলা মেটাতে মেটাতে বিকেল হয়ে গেছে। অর্ন একটা রিকশা নিল। এই সময়ের রিকশায় অর্ন কখনো একা ঘোরেনি। পাশে ইরা থাকতো। ইরার কথা মনে পড়তেই ওর কেমন যেন কষ্ট হতে থাকে। অর্নের মুখে রোদ এসে পড়ছে। কেমন যেন জ্বর জ্বর অনুভব হচ্ছে ওর। সে হুডটা তোলার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ চোখ আটকে যায় দূরে একটা ফুসকার দোকানে। ইরা দাঁড়িয়ে আছে। অর্ন বলে..

– মামা.. ফুসকার দোকানের সামনে চলেন তো।
– আইচ্ছা।

অর্ন ইরার পিছনে এসে দাঁড়ালো। ইরা খেয়াল করেনি কে এসেছে। হঠাৎ পিছন থেকে অর্ন বললো..”আজ প্রথমবার একা ফুসকা খেতে চলে এলে যে?” ইরা পিছনে ঘুরে তাকায়। অর্ন দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। ইরা রাগ নিয়ে বললো..

– একা আসছি নাকি? আর আপনি এখানে কেনো? আমাদের ভাবীকে নিয়ে এসেছেন নাকি? (ইরা)
– ইরা, আমি অবনিকে ভালোবাসিনা। আমি তোমাকে এখনো ভালোবাসি। মানছি সে আমার বউ। কিন্তু আমি তোমাকেই চাই। আমাদের মধ্যে কিছু হয়নি। তাকে ডিভোর্স দিয়ে দেবো। তোমাকে চাই। (অর্ন)
– এক নাটক আর কতো? আমি তোমাকে ভালোবাসি না। (ইরা)
– আমাকে ভালোবাসো না? সত্যিই? (অর্ন)
– হুম, সত্যিই। সে তোর মত স্বার্থপরকে ভালোবাসবে কেনো? (শিহাব)
– ওহ। তার মানে ইরাকে সাথে নিয়ে তুই ফুসকা খেতে এসেছিস। বাহ ভালো। (অর্ন)
– হুমম। যা তুই এখান থেকে। আর ইরার পিছু ছেঁড়ে দে। (শিহাব)
– যদি না ছাঁড়ি? (অর্ন)
– ইরা বললে তোকে মেরে ফেলতেও পারি। (শিহাব)
– একটা মেয়ের জন্য বন্ধুকে মারবি? (অর্ন)
– এই একটা মেয়ের পিছনে কেনো পড়ে আছিস? আর দরকার হলে মারবোই। ইরা তুমি কি অর্নকে চাও? (শিহাব)
– নাহ, কখনো না। তাকে চিনিনা। আর ওর মত একটা ছেলেকে আমি কখনো ভালোবাসবো না। চাওয়াটা তো দুরের কথা। দেখুন মি. অর্ন। আপনার কাছে হাতজোড় করে মাফ চাচ্ছি, অনুরোধও করছি। আমাকে প্লিজ শান্তিতে থাকতে দেন। আমাকে আমার মত করে থাকতে দেন। আমার জীবন থেকে চলে যান। আমি আপনাকে চাইনা।

ইরার কথাগুলো শুনে অর্ন মাথা নিচু করে নিল। ইরা এগুলো বলবে, অর্ন তা কোনোদিন ভাবেইনি। ইরা তো এমন ছিল না। তাহলে কেনো এমন হয়ে গেছে? ইরা তো অর্নের সাথে ভালোবেসেই কথা বলতো। ইরা সত্যিই বদলে গেছে। অর্ন চলে আসার প্রস্তুতি নিল। পিছন থেকে শিহার বললো “শূনেছিস তো, ইরা তোকে চায়না। এরপর কখনো ইরার আশেপাশে যেন না দেখি তোকে। যা.. ভালোভাবে বললাম। এরপর আর বন্ধুত্ব দেখাবো না।” অর্ন চুপচাপ সেখান থেকে চলে আসলো।
.
অবনি আরিনা বেগমের পাশে যেয়ে দাঁড়ালো। অবনি মাথা নিচু করে বললো..

– খালামনি, একটা কথা রাখবে?
– হুম বল। রাখবো না কেনো? (আরিনা বেগম)
– আসলে, তুমি তো দেখলেই ঐ আনটিটা আমাকে কতকিছু বললো। শুনে অনেক খারাপ লাগছে। সিফাত আর শেফার কাছে আমার ব্যাপারে কিছু বললে ওরা যদি এমন করে? তাহলে আমি বাড়ি থেকে চলে যাবো। (অবনি)
– কি বলছিস? ওরা কেনো তোকে অপমান করবে? (আরিনা বেগম)
– আমি জানিনা। তবে বলবা না কিছু। আমি অর্নের বউ এই বাড়িতে, বাকিদের সামনে এটা প্রকাশ করবো না। তুমিও করবা না। প্লিজ.. যদি করো আমি চলে যাবো এখান থেকে। (অবনি)
– আচ্ছা ঠিক আছে। এখন মন খারাপ করিস না। (আরিনা বেগম)

দুজনে গল্প করতে থাকে। সিফাত আসে রান্না করে। আরিনা বেগম সিফাতকে দেখেই অবাক হয়। সিফাত রান্না ঘরে এই প্রথমবার আসলো। সিফাত আরিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো..

– বড়মা, একটু কফি খাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছিল। তাই ভাবলাম নিজে এসে বানিয়ে নিই। (সিফাত)
– আরে কি বলো.. তুমি কেনো বানাবা। আমি আছি, অবনি আছে। তোমার এত কষ্ট করতে হবে না। (আরিনা বেগম)
– তাহলে তো এক কাপ কফি পাচ্ছি। (সিফাত)
– বসো তুমি। আমি আসছি।

আরিনা বেগম কথাটা বলে কিচেন থেকে বের হলো। অবনি কফির মগ নিয়ে কফি বানাতে শুরু করেছে। সিফাত বসা থেকে উঠে অবনির পাশে, সামনের দিকে ফিরে দাঁড়ালো। অবনি তাকাচ্ছে না সিফাতের দিকে। কিন্তু সিফাত যে অবনির দিকে তাকিয়ে আছা, এটা অবনি জানে। অবনি প্রশ্ন করে..

– কি দেখছেন?
– বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ অনুভুতি জাগিয়ে তোলা মুখ..
দেখছি আমি, ঐ মুখে মায়াবী দুটি চোখ। (সিফাত)
– আমি দেখতে কালো। মজা নিচ্ছেন? (অবনি)
– আমেরিকাতে এটা কোনো ব্যাপার না। আর কথায় আছে তো, বাঙালী মেয়ে কালো মানে সে লক্ষী। আর আমার তো সবসময় মায়াবী জিনিসটাই পছন্দের ছিল। যা এখন হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাচ্ছি। (সিফাত)
– কি টের পাচ্ছেন? (অবনি)
– এই যে, আপনার এত সুন্দর ভ্রু যুগল, এত লম্বা কালো চুল, এত মায়াবী দুটি চোখ। আমাকে আকর্ষণ করছে অনেক। (সিফাত)
– আমি কে এতকিছু না জেনেই এত আকর্ষণ কিভাবে হচ্ছে? (অবনি)
– জানার আগে তৈরী হয় আকর্ষণ। জানার পর তৈরী হয় ভালোবাসা। যদিও অজানাতে ভালোবাসা আরো গাঢ় হয়। জানার দরকার কি? (সিফাত)

দুজন কথা বলছে। ও দিকে অর্ন রিকশা থেকে বাড়ির সামনে এসে নামলো। ভাড়া মিটিয়ে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করে। একটা অপরিচিত প্রাইভেট গাড়ি ওর চোখে পড়ে। কিন্তু এসব কিছু নিয়ে ভাবছে না। ভাবনাতে এখন অবনি। সে ভাবছে “এখনি কলিং বেল বাজাবো। অবনি আসবে দৌড়ে দরজা খুলতে। আমি বুঝিনা, এতকিছু বলার পরও সে কেনো এভাবে ভালোবাসে আমাকে? সে তো জানে আমি তাকে চাইনা। তাহলে কেনো এমন করে? কি অদ্ভুত নিয়ম, মানুষ যখন যাকে চায়, তাকে পাইনা। আবার যখন চাওয়া হয় তখন অপর পাশের মানুষটাও চায়না কিছু। চাওয়া আর না চাওয়ার এই পরিপ্রেক্ষিতে কত যে ভালোবাসা নষ্ট হয়। কিন্তু মানুষ কখনো মনের কথা শোনেই না। মানুষ শোনে মস্তিষ্কের কথা, মানুৃষ শোনে রাগের কথা, মানুষ শোনে অবিমানের কথা। মন কি চায় তা যদি মানুষ সঠিকভাবে বুঝতে পারতো। তাহলে মানুষ কখনো কষ্ট পেতো না।”

অর্ন কলিং বেলে চাপ দেয়। অবনি দরজা খুৃলবে এটা ভেবেই সে সামনের দিকে তাকালো। অবহেলায় ভালোবাসাগুলো কেমন যেন নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছে। অবনি কফি বানিয়ে সিফাতের দিকে বাড়িয়ে দিল। কলিং বেলের শব্দ কানে আসে ওর। অর্নের সাথে বিয়ে হওয়ার পর যত কলিংবেল হয়েছে। প্রতিবার অবনিই দরজা খুলেছে। সে অর্নের জন্যই এটা করতো। যদি অর্ন আসে, সে দৌড়ে ছুটে গিয়েছে দরজা খুৃলতে। কিন্তু আজ অবনির কানে কলিংবেলের শব্দ আসার পরও কোনো সাড়া নেই। সিফাতের দিকে কফির মগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সিফাত কফির মগ নিচ্ছে না। অবনির দিকে তাকিয়ে আছে। অবনি কালো হলেও, তার হেয়ার স্টাইল, তার হাঁটাচলা অন্য সব মেয়েদের থেকেও অনেক বেশি এগিয়ে। সে যদি দেখতে পরিষ্কার হতো, তাহলে এতদিনে যে কত ছেলে ওর পিছনে ঘুরতো এটার কোনো গননা থাকতো না।

সিফাত কফির মগ হাতে নিতে যেয়ে অবনির হাতের সাখে হাত এক করে মগটা ধরলো। অবনি প্রথমে ছাঁড়িয়ে নিতে যাচ্ছিল। কিন্তু সিফাতের হাত উপরে, কফির মগ শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে। অবনি ছাঁড়ানোর আর চেষ্টা করলো না। দুজনার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। ওদিকে অর্ন কলিং বেল বাজিয়েই চলেছে। শেফা এগিয়ে আসে। কলিংবেল বাজার শব্দে সে এগিয়ে এসে দরজা খুলে দিল। অর্ন জানতোই এটা অবনি হবে। কিন্তু শেফাকে দেখে চমকে যায়। কিছুটা অবাক হয়েই বললো..

– শেফা… তুমি? কখন আসছো? আমি জানতাম না। সারপ্রাইজ দিয়েছো নাকি? (অর্ন)
– জ্বি মি. সারপ্রাইজ। তা আপনি কোথায় থাকেন হু? সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুজে আপনার কোনো হদিস মিললো না। আজব… (শেফা)

অর্ন শেফার আদুরে আদুরে বাচ্চা স্টাইলের কথাগুলো শুনে চুপ হয়ে গেলো। অর্নের বাবার বন্ধু + ভাইয়ের মেয়ে শেফা। হঠাৎ করে দেশে এসেছে। অর্ন জানতোই না ব্যাপারটা। হয়ত অর্নের বউ দেখার জন্য নয়ত অন্য কিছু থাকতে পারে। আরিনা বেগমের থেকে না হয় জানা যাবে। অর্ন ভিতরে প্রবেশ করলো। বাড়িটা ফাঁকা লাগছে। অর্ন যে অবনিকে খুজছে, অর্ন নিজেই তা নিজের কাছে ধরা দিচ্ছে না।

– সিফাত কোথায়? আচ্ছা দাঁড়াও আমি একটু পানি খেয়ে আসি। গলা শুকিয়ে গেছে। খাবা নাকি? চলো রান্না ঘরে ফ্রিজ আছে। (অর্ন)
– মাত্র খেলাম কিছু। এখন এত পানি খেতে পারবো না। আপনি যান। আর রান্না ঘরে আমি কোনোদিনও যাইনি। রান্না ঘর কেমন দেখতে হয় তাও জানিনা। (শেফা)
– আচ্ছা বসো, আসছি।

অর্ন রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। দরজার কাছে আসতেই।

চলবে,,

প্রণয় পর্ব-০৭

0

#প্রণয়
#৭ম পর্ব
#Abir Hasan Niloy

অর্নের ঘুম ভাঙে। চোখ মেলে তাকায়। নিজের রুমেই আছে সে। পাশে তাকায়। কেউ নেই। সোফাতে চোখ যায় ওর। অবনি শুয়ে আছে। বালিশের পাশে অর্নের মোবাইল রাখা। মোবাইলে তখন পাঁচটা এ.এম। অর্ন একটা ঘুমেই রাত পার করে দিয়েছে। এখন বেশ হালকা লাগছে। জ্বর নেই বললেই চলে। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো অর্ন। অবনির মুখের দিকে তাকায়। ঘুমিয়ে আছে অবনি। অর্ন অজান্তেই কিছু সময় ধরে অবনির দিকে তাকিয়ে রইল। শীতের কারনে কাঁচুমাচু হয়ে আছে। ভোর রাতের দিকে শীত একটু লাগেই। অর্ন একবার ভাবলো, অবনির গায়ে একটা কাঁথা দিয়ে আসবে। পরক্ষণে ইরার কথা মনে পড়তেই সে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।

সাইকেল বের করলো ও। এই সাইকেলের সামনে ইরাকে নিয়ে এয়ারপোর্ট রোডে অনেক বার ঘুরেছে। সাইকেলের সামনে ইরা বসে থাকতো, হাতে থাকতো একগাদা ফুল। অর্ন সেগুলো কল্পনা করতে করতে ইরাদের বাড়ির সামনে চলে এসেছে। ফোন বের করে দেখে ৬ টা বেঁজেছে। অর্ন ফোন করলো ইরাকে। ইরা সারারাত ঘুমায়নি। অর্নের সাথে বিচ্ছেদ একদমই মেনে নিতে পারছে না ইরা। সে জন্য সারারাত চোখের পাতা একজায়গায় করতে পারেনি। হঠাৎ এত সকালে ফোন বাজছে দেখে কিছুটা বিরক্ত হয় ইরা। ফোন হাতে নিতেই দেখে অর্নের নাম্বার। ইরা অজানান্তেই রিসিভ করে ফেলেছে। অর্ন বলে…

– ইরা… আমি তোমার বাড়ির সামনে। একবার আসো। আমি তোমাকে দেখবো। খুব যে দেখতে ইচ্ছে করছে।
– তুই? কেনো এসেছিস? কালকের সকালের কথা তোর মনে নেই? জুতা এনে পিটিয়ে বের করবো তোকে? (ইরা)
– এভাবে বলছো কেনো ইরা? ভালোবাসি তোমাকে। (অর্ন)
– কিসের ভালোবাসা তোর? বেঈমান কোথাকার। এভাবে আমার ভালোবাসাটাকে নিয়ে খেলা করলি। এখনো খেলতে চাচ্ছিস। ধুর হো বাড়ির সামনে থেকে। (ইরা)
– ইরা যা খুশি আমাকে বলো। তবুও তুমি সামনে আসো। আমি তোমাকে দেখবো। (অর্ন)
– দেখ, তোকে খুব ভালোভাবেই বলছি। আমার বাড়ির সামনে থেকে তুই চলে যা। আমি তোর মুখ দেখতে চাইনা। অর্ন মরে গেছে। আমি তাকে মনেও করতে চাইনা। (ইরা)

ইরা ফোন কেঁটে দিল। অর্ন আর সেখানে দাঁড়ায় না। ক্লাবের দিকে যেতে থাকে। ইরাকে সে হারিয়ে ফেলেছে। যা কখনো অর্ন চায়নি। এমনটা হয়েছে কেবল অবনির জন্য। ক্লাবে আসতে আসতে আটটা বেজে গিয়েছে। অবনির ঘুম ভাঙে। রাতে সে না খেয়েই সোফাতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম থেকে উঠেই দেখে অর্ন নেই। অর্নকে কল দিল অবনি। একবার রিং হতেই, কেঁটে দিল অর্ন। অবনি আবারো ফোন দেয়। কিন্তু অর্ন এবার কাঁটে না, আবার রিসিভও করে না। অর্নকে ফোন দিতে শুরু করে। কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো রেসপন্স পায়না অবনি। বাইরে আসে সে। অর্নের মা দাঁড়িয়ে আছে। নতুন একটা মহিলাও দাঁড়িয়ে আছে। অবনি যেয়ে সামনে দাঁড়াতেই মহিলাটি প্রশ্ন করে..

– ভাবী.. এই কালো মেয়েটা কে?
– ওকে কালো মেয়ে কেনো বলছেন? জানেন ও কে? (অর্নের মা)
– কে ও? আর কালোই তো সে। আয়নাতে নিজেকে দেখলে সে নিজেই ভয় পাবে। (মহিলা)
– চুপ করেন। অর্ন শুনলে আপনাকে বকবে। (অর্নের মা)
– কেনো কেনো? অর্ন বকবে কেনো? (মহিলা)
– ও আমার বোনের মেয়ে, নাম অবনি। অর্নের বউ। (অর্নের মা)
– কিহ.. আমাদের অর্নের বউ অবনি? ছিহ ভাবী… অর্নের চয়েজ এত এত খারাপ? কমলা লেবুর মত দেখতে আপনার ছেলে। অথচ তার বউ দেখি কালো। অর্ন তাকে মেনে নিয়েছে ভাবী? আল্লাহ গো… হাসি পাচ্ছি। কোথায় আকাশের চাঁদ, আর কোথায় গবরের নাদ। কিভাবে সম্ভব? ঐ মেয়ে তোমার কি লজ্জা টজ্জা করেনা, অর্নের পাশে যখন দাঁড়াও তখন? (মহিলা)

অবনি মাথা নিচু করে নিল। কালো হলেই সমস্যা। সমাজের মানুষ আর কিছু পারুক বা না পারুক.. কোন বাড়ির মেয়ে বিয়ের বয়েসেও বিয়ে দিচ্ছে না কেনো তার পরিবার, এসব খবর রেখে, এমন এমন কথা শোনাবে। এসে বলবে ‘ও আপা, আপনাদের মেয়ে বিয়ে দিচ্ছেন না কেনো? কোথাও কি সম্পর্ক করেছে নাকি? বিয়ের বয়স পার হয়ে গেলে তো আর কোনো ছেলে বিয়ে করবে না। এত বড় মেয়েকে ঘরে রাইখা কি করছেন?’ আবার কালো মেয়ে হলে মা বাবাকে এসে কথা শুনিয়ে বলবে ‘ও ভাইসাব. এই কালো মেয়েকে কার কাছে বিয়ে দেবেন? নাকও ঠিকমত লম্বা না। পছন্দ করবে তো? ভালো করে ক্রিম ট্রিম মাখান।’ আবার সেই কালো মেয়ের বিয়ে হলে শ্বশুর শ্বাশুড়িকে সবাই বৌমাকে নিয়ে কথা শোনাবে।

তবে এদিকে ভূলেও কালো ছেলের বউ যদি সুন্দরী হয়েছে। সমাজের লোক তো আরো এক কাঠি উপরে কথা শোনানো শুরু করবে। ‘এইরাম একটা মেয়ের জামাই দেখো, একটুও মানায়নি। কি দেখে মেয়েটার সাথে এমন ছেলেকে বিয়ে দিয়েছে। কালো ছেলে তো না, যেন গান্জা খোর।’ সব বিবেচনা সমাজের মানুষই করে দেয়। আপনি কতজনকে থামাবেন? আপনি থামাতে গেলে হয় আপনি তাদের মত হয়ে যাবেন, না হয় আপনি খারাপ হয়ে যাবেন। সবাই শুধু চকচকা ছেলে মেয়েই খোজে। কিন্তু কখনো কয়লাতে যে সোনা থাকে, এটা বুঝতে পারেনা
.
– দেখুন, ভাবী.. আপনি আমার বুয়ার শ্বাশুড়ি। যতটুকু সম্মান দিয়ে আপনাকে এখানে আনছি। এটাও কিন্তু আর দেবো না। আমার অর্নের বউ কালো। কোনো সমস্যা আছে? আপনার ছেলের বউ তো সুন্দর। আপনি খুশি থাকুন। অসহ্য… (অর্নের মা)
– খালাআম্মু.. উনাকে কিছু বলবেন না। উনি তো ঠিকই বলেছে। অর্নের গায়ের রঙ, আর আমার গায়ের রঙ বিপরীত। অর্নকে আসলেই মানায় না আমার পাশে। (অবনি)
– চুপ থাক তুই। চলে আয়।

অর্নেন মা, অবনিকে হাত ধরে টেনে নিয়ে আসলো। অবনির খুব কান্না পাচ্ছে। সমাজের মানুষ যে যা ইচ্ছে বলুক। কিন্তু অর্ন যদি সামান্য ভালোবাসতো। তাহলে সে সব কিছু চোখ বন্ধ করে সহ্য করতে পারতো। কিন্তু সমাজের মানুষসহ, নিজের স্বামী অর্নও তাকে সহ্য করতে পারেনা। অবনি যতই নিজেকে শক্ত করুক না কেনো, বারবার কোনো না কোনো কারনে তার মনে হয় কালো হয়ে তার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই।

– অবনি মন খারাপ করিস না। অর্ন কোথায়? ওকে ডাকতো। (অর্নের মা)
– ও তো রুমে নেই। জগিং এ গিয়েছে হয়ত। (অবনি)
– সিফাত আর শেফা আসবে। তোদেরকে দেখতে আসবে। (অর্নের মা)
– এরা দুজন কে? (অবনি)
– তোর খালুর খুব কাছের বন্ধু। বিদেশে থাকে। আমার প্রথম যখন বিয়ে হয়। তখন ওনাদের সাথেই বছর খানিক ছিলাম। রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও তোর খালু মঈন ভাইকে নিজের ভাইয়ের মত দেখতো। মঈন ভাইয়ের ছেলে সিফাত। আর মেয়ে শেফা। অর্নের বন্ধু সিফাত। দুজনে বেশ ভালো বন্ধু। বিদেশ থেকে সোজা আমাদের বাড়িতেই আসছে। (অর্নের মা)
– খালাম্মু.. আমি কারো সামনে যাবো না আর। (অবনি)
– কেনো? (অর্নের মা)
– এমনি। ভালো লাগে না। (অবনি)
– চুপ কর। কালো বলে অপমান করবে? যারা সমাজে খাটো, লম্বা, কালো সুন্দর এসব নিয়ে বিচার করে বেঁড়ায়। তারা আসলে মানুষই না। তুই তো লক্ষী মেয়ে। যে তোকে একবার বুঝবে, সে তোকে কখনো ছাঁড়বে না। (অর্নের মা)

অবনি অর্নের মাকে জড়িয়ে ধরে। এই একটা মানুষের জন্যই অবনি পারেনা নিজেকে পুরোপুরিভাবে শেষ করতে। না হলে এতদিনে কবেই অপমান সহ্য করতে না পেরে নিজেকে মেরে ফেলতো।
.
অর্ন টেবিলের উপর পা দিয়ে বসে আছে। চা আর কেক এনে সামনে দাঁড়ালো ছোটন। অর্নের দিকে ছোটন কিছু সময় তাকিয়ে রইল। অর্ন প্রশ্ন করে..

– কিরে.. এভাবে তাকিয় আছিস কেনো? আজ স্কুল নেই?
– হো আছে তো ভাইজান। তই.. যামু না। (ছোটন)
– কেনো? রুস্তম আংকেল কি তোকে আবার বকাঝকা করেছে নাকি? (অর্ন)
– না ভাইজান। হেয় তো আমারে আর বকেই না। আপনে তো হেয়দিন বকা দিছিলেন, হের লেইগা আমারে আর কিছু কইতে পারে না। (ছোটন)
– তাহলে? স্কুল কেনো মিস করবি? (অর্ন)
– এমনিতে ভাইজান। পড়াশোনা কইরা কি হইব। বড় হইয়া কি হইবো? (ছোটন)
– মার খাবি তুই? বল কি হয়েছে?

ছোটন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। মাথাটা নিচু করেই নিল। রুস্তম চাচার ক্লাব এটা। রাতে ড্রিংকস চললেও দিনে চা বিস্কিট এসবই পাওয়া যায়। অর্ন ক্লাবে আসছিল একদিন। প্রথম যেদিন আসে, সেদিন রুস্তম দোকানদার ছোটনকে মারছিল। হাতে গরম চা ফেলে দিয়ে, ছোটনকে মারছিল। যা দেখে অর্ন থানা অবদি দৌড়ানি দিয়েছিল রুস্তমকে। ছোটন এখানেই কাজ করে। অর্ন তার সাথে আস্তে আস্তে সখ্যতা গড়ে নেয়। অর্ন আসলেই ছোটন দৌড়ে চলে আসে অর্নকে সব রকম সার্ভিস দিতে।

– ছোটু… যা বাবা ইসকুলে যা। মুরগীটা বাইচ্চা দিমুনে। ইসকুলের টেকা টা দিয়ে দিস।

ছোটনসহ অর্ন বাইরের দিকে তাকায়। একজন মহিলা এসে দাঁড়িয়েছে। ছোটু “মা..” বলে ডেকে দৌড়ে মহিলার দিকে চলে যায়। অর্ন সে দিকেই তাকিয়ে থাকে। ছোটন যেয়ে বলে..

– মা, তুমি উইঠা আইছো ক্যা? আর আইসা তুমি অর্ণ ভাইজানের সামনে কি কইলা? তুমি না কি যে করো। তুমি যাও, আমি বই নিয়া স্কুলে যামুনে। এখন যাও এহান থাইকা।
– অর্ন বাবা আইছে? আমার লগে দেখা করাস না ক্যা? আমি দেখা করুম।

ছোটনের মা কথাটা বলে। ক্লাবেল থেকে সামান্য দুরে ছোটনের বাড়ি। ওর মা অনেক অসুস্থ। বুকে একটা বিশাল টিউমার হয়েছে। অপারেশনের প্রয়োজন। কিন্তু ছোটনের বাবা নেই। তাই উনি অসুস্থতা নিয়েই পড়ে আছে। অর্নকে কোনোদিন ছোটন ওর মায়ের ব্যাপারে জানায়নি। অর্ন এসে পাশে দাঁড়ালো। বললো..

– ছোটন। আনটির সাথে আমাকে দেখা করিয়ে দিসনি কেনো? বেয়াদব কোথাকার..
– কেমন আছো বাবা? তোমার কথা ছোটু আমারে রোজ রোজ কয়। দেখো না,, ঐ আজকে কয় ইসকুলে যাইবো না। (কথাটা বলে তিনি কাঁশলেন)
– আচ্ছা আনটি আপনি বাসায় যান। আমি দেখছি। আর পরে আপনার সাথে দেখা করবো। আপরি যান। (অর্ন বুঝে যায় তিনি অসুস্থ)
– আইচ্চা…

উনি চলে যায় সেখান থেকে। অর্ন ছোটনের হাত ধরে ভিতরে নিয়ে আসলে। রুস্তম চাচাকে ডাক দেয় অর্ন। রুস্তম চাচা দৌড়ে আসলেন। কেননা, অর্নের কথা তিনিও শুনতে বাধ্য। কারন, অর্ন আছে বলেই অল্প করে ড্রিংকসের ব্যাবসা চালিয়ে যেতে পারছে। আর তাতে বেশ লাভও হচ্ছে অনেক। বড় কথা, অর্ন হল তার প্রধান কাস্টমার। ঢাকা শহরের মেইন জায়গাতে দোকানটা টিকে আছে অর্নের জন্যই। এ জন্য অর্ন যা বলে তিনি সব পালন করেন।

– জ্বি বাবা বলো।
– ছোটনের মায়ের কি হয়েছে? (অর্ন)
– জানো না তুমি? ওর মায়ের হার্টের সোজা একটা বিশাল টিউমার হয়েছে। অপারেশনের ডেট দিয়েছিল ডাক্তার। কিন্তু যেতে পারেনি। (রুস্তম চাচা)
– আচ্ছা আপনি যান। ছোটন.. এবার বল স্কুলে কেনো যাসনি? (অর্ন)
– পরশুদিন পরীক্ষা হইবো। পরীক্ষার ফিসের লাইগা চাচা টেকা দিছিল। ভাবছি হেয়ডা দিয়া ফিস দিমু। কিন্তু ঐ টেকা লিয়া আমি বাড়িত যাইয়া হুনি, মায়ের ঔষধ নাই। চাচার থাইকা কয়েকদিন আগেই টেকা লইছিলাম ঔষধের লাইগা। আবার চামু.. কেমনে? পরীক্ষার লাইগা এক হাজার টেকা লইছি। জানেন তো ঢাকার শহরে পরীক্ষার ফিস অনেক বেশি। ঐ টেকা দিয়া অল্প ঔষধ আইনা দিছি। এহন টেকা নাই। তাই স্কুলে যাইতেও ইচ্ছা করতাছে না। (ছোটন)
– তোর বয়েস কত রে? (অর্ন)
– বারো বছর। (ছোটন)
– কোন ক্লাসে পড়িস তুই? (অর্ন)
– কেলাস ফাইভে। (ছোটন)
– থাপ্পড়িয়ে তোর সবগুলো দাঁত ফেলে দেবো। এই বয়েসে খুব হিসেব শিখে গিয়েছিস? তোকে না বলেছিলাম, আমাকে সবকিছু এসে বলবি? বলেছিস? (ছোটন)
– তুমি তো সবকিছু করলা। ভর্তি কইরা দিলা। ব্যাগ কিনা দিছো, ড্রেস কিইনা দিছো। রুস্তম চাচারে বইলা দিছো যা লাগে দিয়া দিতে। খাতা কলম কিইনা দাও। স্কুলের বেতন দিয়া দাও। আর কি করবা? (ছোটন)
– অনেক কথা শিখেছিস দেখছি। যা স্কুলে যা। কালকে আনটির থেকে পরীক্ষার ফিস নিয়ে যাস। যা এখন সামনে থেকে যা। (অর্ন)
– আইচ্চা যাইতেছি। তই একটা কথা কয়.. শিহাব আছেনা আপনের বন্ধু। ওনার থাইকা দূরে থাইকেন। জানিনা কেনো বললাম। তয় মনে হইছে কইছি আমি। রাগ কইরেন না। যাচ্ছি স্কুলে।
– শোন। আমার সাইকেলটা নিয়ে যা। এখন থেকে এটা তোর। যার জন্য প্রয়োজন ছিল। তাকে আমি হারিয়ে ফেলেছি। তুই চালাবি এটা।

ছোটন চলে যায়। অর্ন চেয়ারে হেলান দিয়ে প্রায় শুয়ে পড়েছে। একটা গাড়ি এসে থামলো ক্লাবের সামনে। শিহাব নামলো। শিহাবের সাথে ইরাও নামলো। শুধু ওরা দুজন না। বাকি সব বন্ধুরা এসেছে ক্লাবে। মিহি দৌড়ে এসে অর্নের সামনের চেয়ারে বসলো।

– দোস্ত… তুর্জ তো বিয়ে করতে যাচ্ছে। তোকে দাওয়াত দেওয়ার জন্য ছুটে বেড়াচ্ছে সে। (মিহি)
– হুম। অর্ন.. এই সপ্তাহে বিয়ে করছি। (তুর্জ)
– শিহাব দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? ইরাকে নিয়ে বসে পড়। আরে এত প্যারা কেনো নিচ্ছিস তোরা বুঝলাম না। (সিমি)
– ইরা, কার সাথে এসেছো? (অর্ন)
– শিহাবের সাথে। শিহাব বললো বেচারারি মন খারাপ। ডেকে আনি। আড্ডা দিলে ভালো লাগবে। তাই ও যেয়ে নিয়ে আসছে। (মিহি)
– ওহ.. আমি ডাকলাম আসলে না। অথচ শিহাব ডাকার পর চলে আসলে। সত্যিই দারুন তো ব্যাপারটা। (অর্ন)
– আমি কারো বিয়ে করা বউ না যে, অন্য কেউ ডাকবে আর আমি আসবো। আমার ইচ্ছে আমি যার সাথে খুশি বেড়াবো, ঘুরবো, মিশবো। কেউ যদি এসব সহ্য করতে না পারে, বা দেখতে না পারে। সেটা তার সমস্যা। (ইরা)
– আরে বাদ দাও এসব। তুর্জ, মেয়েটা কেমন দেখতে? দেখিস তুই যেন আবার অর্নের মত কালো মেয়েকে বিয়ে করিস না। তাহলে কিন্তু আমরা আর তোর সাথে মিশবো না। পার্টিতেও আনতে পারবি না কোনোদিন বউকে। (সিমি)
– এহ.. আমি পাগল নাকি? কখনো ওমন বিশ্রি দেখতে কালো মেয়েকে আমি বিয়ে করবো? নো নেভার। আমার বউ দেখে তোদের জেলাস হবে। ছবি দেখেই তো আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। কোথায় অবনি, আর কোথায় আমার ফিয়ন্সি। (তুর্জ)
– এটা ঠিক বলেছিস। কার সাথে কার তুলনা করিস তোরা? অবনি চলে না। ফালুত দেখতে। আমি বুঝিনা অর্ন কিভাবে তাকে ভালোবাসে। (শিহাব)
– ঐ আমি অবনিকে ভালোবাসি না। (অর্ন)
– হাহাহা… বিনোদন। বুকের উপর কে মাথা দিয়ে থাকে? কে জড়িয়ে রাখে? নিজের চোখে দেখা। সে বলে নাকি অবনিকে ভালোবাসে না। ব্লাডি চিটার। (ইরা)
– ইরা.. আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি। (অর্ন)
– আমি চলে যাচ্ছি। এসব হাস্যকর কথা শোনার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। (ইরা)
– ইরা কোথাও**** (অর্ন)
– ইরা.. এসব বাদ দাও। বসো চুপচাপ। কি খাবে বলো। কারো কথায় কান দিও না। (শিহাব)
– আচ্ছা। কফি খাবো। (ইরা)

শিহাব ইরাকে নিয়ে পাশের টেবিলে গেলো। অর্ন কেবল অবাক হয়েই তাকিয়ে দেখছে। অর্নের গার্লফ্রেন্ড। কিন্তু ইরা সব শিহাবের কথা শুনছে। যা অর্ন মেনে নিতে পারছে না। অর্ন মিহিকে বলে..

– ইরা আমার গার্লফ্রেন্ড। কিন্তু সে শিহাবের কথা শুনছে।
– কি বলিস এগুলো? ইরা তোর গার্লফ্রেন্ড কবে থেকে হল আবার? আর লজ্জা শরম করে না? বউ আছে তোর বাড়িতে। ইরাকে কি তুই আবার বিয়ে করবি নাকি? তোর চয়েজ খারাপ হয়ে গেছে মানলাম। কিন্তু চিন্তা ভাবনাও এত খারাপ করলি কবে থেকে? (মিহি)
– আমি বাসায় যাচ্ছি। তোদেরকে সহ্য হচ্ছে না একদমই। (অর্ন)
– দোস্ত, আমার বিয়েতে আসিস প্লিজ। তবে একটা অনুরোধ। তোর কালো বউকে সাথে করে আনবি না। তাহলে পার্টিটাই নষ্ট হয়ে যাবে। আমি চাইনা, তোর বউকে দেখে সবাই অনুষ্ঠান থেকে চলে যাক। আর যদি আনিস, তাহলে কিন্তু বলবো তুই আমার বন্ধুনা। সবাই জানে আমার বন্ধুদের চয়েজ এত খারাপ হবেনা। আমার বউকে দেখলে তোর বউকেও সবাই দেখতে চাইবে। হাস্যকর পার্টি হোক এটা চাইনা।

তুর্জের কথা শুনে অর্ন আর সেখানে দাঁড়ালো না। অসহ্য লাগছে ওর। বারবার কালো বউ, কালো বউ শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গেছে। অবনির উপর আরো রাগ বেঁড়ে গেছে। আর বন্ধুগুলোও সব কেমন যেন। অর্ন ক্লাব থেকে বের হয়ে ছোটনদের বাড়ির দিকে যায়। ছোটনের মায়ের অপারেশনের ব্যবস্থা করতে হবে দ্রুত। তারপর…
চলবে,,

প্রণয় পর্ব-০৬

0

#প্রণয়
#৬ষ্ট পর্ব
#আবির হাসান নিলয়

ইরার কথা শুনে অবনি অনেকটাই রেগে যায়। অবনিকে কিছু বললে হয়ত অবনি মেনে নিতো। কিন্তু অর্নকে করা অপমান অবনি একদমই সহ্য করতে পারেনি। সে বসা থেকে উঠে আসে। ইরাকে বলা শুরু করে..

– কে তুমি? আমার অর্নকে কেনো বকছো? সে কি করেছে? তাকে বকার অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে? এটা ভদ্র লোকের বাড়ি। তোমার মত মেয়ে এসে চিৎকার করবে, তাও বাড়ির ছোট কর্তাকে, এটা তো হবে না। বেরিয়ে যাও। (অবনি)
– তুই আমাকে ভদ্রতা শেখাচ্ছিস? জানিস আমি কে? আমি কি হই অর্নের? অর্ন তুমি চুপ করে আছো কেনো? আমাকে কথা শোনাচ্ছে, তুমি দেখছো না? (ইরা)
– সে কি বলবে? সে অসুস্থ। সে কথা বলতে পারবে না। তুমি বেরিয়ে যাও। কে তুমি সেটা জানার কোনো দরকার নেই। আমার সামনে আমার অর্নকে কেউ কোনো বাজে কথা বলতে পারবে না। (অবনি)
– তোকে আমি…

ইরা অবনির দিকে এগিয়ে যায়। অবনির গালে চড় দিতে য়াচ্ছিল। অর্ন দ্রুত এসে ইরার হাত ধরে। ইরাসহ বাকি বন্ধুরা সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। ইরা হাত ছাঁড়িয়ে নিয়ে বলে..

– বাহ অর্ন বাহ.. এক রাতে এত পরির্তন? তোমার মত খারাপ ছেলে আমি আর দেখিনি। (ইরা)
– থামো ইরা। তুমি যা ভাবছো তা এমন কিছুই না। (অর্ন)
– লজ্জ্বা করছে তোমার? আমাদের সবার সামনে মিথ্যে কিভাবে বলতে পারো? (ইরা)
– বললাম তো, এমন কিছুই না। (অর্ন)
– তাহলে কেমন? (ইরা)
– আমি রাতে প্রচন্ড দূর্বল ছিলাম। বাড়িতে কেউ ছিল না। অবনি ডক্টর ডেকে আমাকে সুস্থ করার সব রকম চেষ্টা করে। আমি সোফাতে বসে ছিলাম। কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি জানিনা। তারপর উঠে দেখি তোমরা আসছো। (অর্ন)
– বাহ.. কি সুন্দর গল্প। জানতাম এটাই বলবি। আমার সামনে কখনো আসবি না তুই। (ইরা)

ইরা কথাটা বলে বের হয়ে যাচ্ছিল। অর্ন দৌড়ে ইরার হাত টেনে ধরে। ইরা জোরে হাত ঝটকা দিয়ে ছাঁড়িয়ে নিল। অর্ন পিছন থেকে ইরাকে ডাকাডাকি শুরু করে। কিন্তু ইরা আর সেখানে দাঁড়ায় না। অর্ন ওর বন্ধুদের কাছে আসে। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো..

– তোরা কিছু বল ইরাকে। আমি ইরাকে ভালোবাসি। অবনির সাথে আমি কিছুই করিনি। (অর্ন)
– চোখের সামনে এমন কিছু দেখেও কিভাবে ইরাকে আটকাবো? এখন তো মনে হচ্ছে, তুই তোর বউ পেয়ে বেশ আছিস। ইরাকে শুধু শুধু কেনো কষ্ট দিলি অর্ন। (সিমি)
– শিহাব, সিমি এসব কি বলে? ইরা চলে গেলো, প্লিজ আটকা ওরে। (অর্ন)
– থাম অর্ন। প্লিজ এবার ওকে একটু শান্তি দে। ইরাকে আর কত কষ্ট দিবি। ভালোবাসা দেখিয়ে ইরাকে কষ্ট দিয়ে, তুই অবনিকে বিয়ে করলি। ভাবছিস সে কষ্ট পাবেনা? ইরার কান্না আমরা দেখেছি। মাফ করে দে। আর যা করছিলি বউয়ের সাথে, সেটাই কর। (শিহাব)

সবাই চলে গেলো বাড়ি থেকে। অর্ন নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল ওদের চলে যাওয়ার দিকে। অর্নের পিছনে অবনি দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণ সে কোনো কথা বলেনি। কেবল চুপচাপ দাঁড়িয়ে এতকিছু দেখছিল। ইরাকে আজ প্রথমবার দেখলো অবনি। সত্যিই ইরা রূপবতী। ইরার উজ্জ্বল রূপের মাদকতায় অবনি কিছুই না। সে অতি তুচ্ছ এক মানবী। ইরার হাতের রঙ এর কোনো সৌন্দর্যও অবনির মধ্যে নেই। ইরা এটা ভেবেই কষ্ট পাচ্ছে যে… ‘ইশ..! ইরা মেয়েটা কতই না মিষ্টি রূপবতী। আমি যদি একটু ফর্সা হতাম। হায়! আফসোস। আমি কেনো কালো হলাম? উপরওয়ালা আমার তো রূপ নিয়ে কোনো অভিযোগ ছিল না। এভাবে পরীক্ষা কেনো নিচ্ছো? আমার সামনে হ্যান্ডস্যাম হাজবেন্ড। তার কতিপয় বান্ধবি নতুবা গার্লফ্রেন্ড এর এত সৌন্দর্য, যা দেখে আমার যে বড্ড হিংসে লাগছে, বড্ড বেশিই তুচ্ছ মনে হচ্ছে আমার নিজেকে। আমার কোনো যোগ্যতাই যে নেই অর্নের সামনে দাঁড়ানোর।’

অর্ন কাঁদছে। ইরাকে খুব বেশিই ভালোবেসেছে অর্ন। যথোচিত না হয়ে অনুচিত হয়েছে তার সাথে। বন্ধুরাও তাকে ছেঁড়ে চলে যাচ্ছে কালো মেয়েটি তার বউ বোলে। এত কষ্ট অর্ন কোথায় রাখবে? সে উঠে দাঁড়ায়। পিছনে ঘুরতেই অবনিকে দেখতে পায়। অর্ন কিছু না বলে ভিতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। অবনি বলে..

– অর্ন, আমি ইচ্ছে করে তোমার কাছে আসেনি। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তোমার পায়ের কাছে। তুমিই রাতে আমাকে…
– চুপ কর তুই। তোকে আমার এক মুহুর্তও সহ্য হইনা। কেনো বুঝিস না তুই? আর কি করলে তুই বুঝবি? আমার তো সব শেষ করে দিলি। দেখলি না, আমার ভালোবাসাটাও আজ হারিয়ে গেলো। (অর্ন)
– আমি বুঝিনি এতকিছু হবে। কেনো বিয়ের দিন সবকিছু বলোনি পরিবারকে? (অবনি)
– ফাজলামো করিস? কিভাবে বলতাম আমি? দেখিসনি সবাই আমার দিকে কিভাবে আশা নিয়ে তাকিয়ে ছিল? আমার দোষটা কোথায় বলতে পারিস? (অর্ন)
– তোমার কোনো দোষ নেই। সব দোষ আমার। আমি কেনো তোমার সাথে জড়িয়ে গেলাম। আমার মত মেয়ে তোমার সাথে জড়ানোর যোগ্যতা নেই। জড়ানো দূরে থাক, কথা বলারও যোগ্যতা নেই। ঠিক তো, তোমার কোনো দোষ নেই। (অবনি)
– চুপ কর, আমার কোনো কিছুই সহ্য হচ্ছে না। আমি হারিয়ে যাবো বহুদুরে। (অর্ন)
– না, তুমি কেনো হারাবে? আমিই তার আগে হারিয়ে যাবো। আমার জন্য তোমার অপমান হচ্ছে, এটা আমি কখনো চাইনি, আর না চাইবো। (অবনি)
– প্লিজ আমাকে একা থাকতে দে।

অর্ন কথাটা বলে রুমে চলে যায়। অবনি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সেখানেই। অবনি বালিশে মুখ গুজে কান্না করতে থাকে। একটা কালো মেয়েকে বিয়ে করে অর্ন না পারছে কারো সামনে যেতে, আর না পারছে বউকে প্রেজেন্ট করাতে। গর্ব করে কাউকে কিছুই বলতে পারছে না অবনির ব্যাপারে। সবকিছু ওর অসহ্য লাগছে।
.
ইরা গাড়িতে বসে আছে। পাশে শিহাব। শিহাব গাড়ি চালাচ্ছে। ইরা বসে বসে কাঁদছে। শিহাব ইরার দিকে তাকিয়ে বললো..

– মন খারাপ করো না। অর্ন এমন একটা কাজ করবে, কোনোদিস ভাবতেই পারিনি। বিয়ের আগে অনেকবার বারণ করেছিলাম। তোমার কথাও বলেছিলাম। সে তোমার কথা শুনে পাত্তায় দেয়নি। বারবার মনে করিয়েছিলাম অর্ন বিয়েটা করিস না, ইরা তোর ভালোবাসা। সবটা হারিয়ে যাবে। কিন্তু কে শুনলো কার কথা। সবসময় মানুষ ভুল মানুষকেই ভালোবাসে। অর্নকে ভালোবাসাটাই তোমার ভুল হয়েছিল। (শিহাব)
– আমার কি হবে? আমি কাকে নিয়ে থাকবো ভাইয়া? (ইরা)
– তোমার আবার কি হবে? তুমি জানো, তুমি কতটা সুন্দরী? তোমার চোখে এত বেশি মায়া যে, ছেলেরা পাগলের মত পড়ে আছে। তোমার হাসি দেখলে মনের মধ্যে সব কষ্ট কখন যে চলে যাবে সে টেরও পাবে না। তুমি কেনো কাঁদবে? আর ভাইয়া কি হা? যাইহোক, কেউ তোমার পাশে না থাকলে আমি আছি। তোমার যখন মস খারাপ হবে, আমাকে বলবে। আমি তোমাকে সাপোর্ট করবো, মন ভালো করার জন্য সবকিছু করবো। চিন্তা করো না। আমি আছি তো তোমার পাশে।

শিহাব কথাটা বলে ইরার দিকে টিস্যু পেপার বাড়িয়ে দিল। ইরা চোখ মুছতে থাকে। শিহাব মনে মনে অনেক খুশি। কোথায় ইরা, আর কোথায় অবনি। ইরার জন্য সব ছেলে উন্মাদ। আর সেই ইরাকে অবনির জন্য অর্ন ছেঁড়ে দিল। শিহাবের কাছে অর্ন বড্ড বোকা। সুন্দরী ললনা ছেঁড়ে অর্ন বিয়ে করেছে কয়লাময় এক নারীকে। হাস্যকর। শিহাব বললো..

– চলো কোথাও ঘুরতে যাই। তোমার মন ভালো হবে।
– কোথায় যাবো? কিছুই ভালো লাগছে না। আপনি শুধু শুধু এগিয়ে দিতে আসলেন। (ইরা)
– এটা আর এমন কি? ভাবছিলাম যদি কিছু হয় তোমার। টেনশন হচ্ছিল, এ জন্য এগিয়ে দিতে আসলাম। (শিহাব)
– অন্যদিন ঘুরবো। আজকে বাড়িতে যাবো। (ইরা)
– ওকে।

শিহাব আর কথা বাড়ায় না। ইরার বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামালো। তারপর নিজে নেমে দাঁড়ালো। ইরা বায় জানিয়ে ভিতরে চলে আসে। শিহাব মনে মনে হাসে। ইরাকে নিজের করে নেওয়ার একটা বিরাট সুযোগ তার কাছে ধরা দিচ্ছে। বন্ধুর গার্লফ্রেন্ড ইরা, তাকে এখন নিজের করে নিতে চাইছে শিহাব। এ জন্য অর্নকে কোনো ভাবেই ইরার ধারে কাঁচে ঘেষতে দেবে না সে।
.
অর্নের ঘুম ভাঙে। বাড়ি ভর্তি লোকজনের চিৎকার শুনতে পেলো সে। মা বাবারা বাড়ি এসেছে। অর্ন চোখ মেলে তাকায়। রুমের টেবিলের চেয়ারে বসে আছে অবনি। সামনে খাবারের প্লেট। টেবিলের উপরের ঔষধগুলো গুছিয়ে রাখা। অর্ন দেয়ার ঘড়ির দিকে তাকায়। বিকেল চারটা বাজতে গেছে। অর্ন আবার অবনির দিকে তাকালো। সকালে যে শাঁড়ি পরে ছিল, ওটা এখনো পরা। অর্ন প্রশ্ন করে..

– কি ব্যাপার তুই এখানে কেন?
– রুমটা তো আমার বরের, তাই কোথায় থাকবো আমি? (অবনি)
– মানে এখানে বসে কি করিস? (অর্ন)
– তোমার খাবার নিয়ে বসে আছি। রান্না অনেক আগেই শেষ হয়েছিল। (অবনি)
– তো, রেখে যাবি। তোকে কে বসে থাকতে বলেছে? (অর্ন)
– আসলে, তোমার হাতে ব্যান্ডেজ। রেখে গেলে খায়তা কিভাবো? এ জন্য বসে ছিলাম। (অর্ন)
– তোর কি আর শাঁড়ি, কাপড় নেই? অসহ্য। (অর্ন)
– হুম আছে তো। আসলে খাবার নিয়ে আমি তিন ঘন্টা ধরে বসে আছি। ১টার সময় এসে দেখি তুমি ঘুমাচ্ছো। ডাকিনি। যদি ঘুম ভাঙার পর তোমার কষ্ট হয়, বা রাগ হয়। আমাকে বকা দিতে যেয়ে যদি তোমার আবার কষ্ট হয়। তোমার মন খারাপ হবে ভেবে আর ডাকিনি। এ জন্য অপেক্ষা করছিলাম কখন তোমার ঘুম ভাঙবে। ভেবেছিলাম খাইয়ে, তারপর গোসল করবো। কিন্তু তোমার ঘুম ভাঙেনি। চারটার সময় ঘুম ভাঙলো। এভাবেই বসেছিলাম। এক মুহুর্তের জন্যও নড়িনি। দিনে খাওয়ার আগে যদি কেউ ঘুমায় তাহলে ঘুম ভাঙার পর তার অনেক খুধা লাগে আমি জানি। তোমারও লাগবে, আর তাছাড়া তোমার তো ঔষধও খেতে হবে। এ জন্য ঘুম ভাঙলে যদি খাবার না পাও, ঔষধ দিতে যদি দেরি করি তাহলে তো তুমি সুস্থ হবানা। এ জন্য বসেই ছিলাম। উঠিনি একবারো। সরি.. বকা দিও না এখন। পরে দিও। আগে খেয়ে নাও।

অবনির কথা শুনে অর্ন যেন হা হয়ে যায়। কিন্তু এত ভালোবাসার কথা ওর মাথায় ঢুকছে না। মাথাটা তখনো ইরার জন্য তালগোল পাকিয়ে চলেছে। তবে অবনি এতক্ষণ ধরে যে বকবক করলো, সেটা শোনেনি এমন নয়। অর্ন প্রথমে বিরক্তি নিয়ে শুনলেও পরে হা হয়ে গেছে সবটা শোনার পর। অর্ন প্রশ্ন করে..

– কেনো করছিস এগুলো? জানিস না তুই.. তোকে আমি বউ হিসেবে মানিনা। যতটুকু কথা বলি, তা ছোট বেলার বন্ধু হিসেবে। তাও অতটা আগ্রহ নেই। (অর্ন)
– আমি জানি তো সবটা। এ জন্য তোমার থেকে কোনো কিছুই চাওয়ার আমার নেই। তুমি অবহেলা দিলেও সেটা আমি গ্রহন করে নিতে পারবো, অবহেলাটাকে ভালোবেসে গুছিয়ে রাখতে পারবো। আমার এখন আফসোস নেই। আমি যে তোমার সাথে কথা বলছি এটাই তো বিশাল ভাগ্যের ব্যাপার স্যাপার। নাও হা করো। খাইয়ে দিই।

এরিই মধ্যে অবনির ভাত মাখানো শেষ। অর্ন হা করে। অবনি গালে স্পর্শ পেতেই দেখে অর্নের গায়ে অনেক জ্বর। অবনি খাবার এগিয়ে দিতে দিতে বলে..

– তোমার গায়ে এত জ্বর.. আমাকে কেনো বলোনি? (অবনি)
– তুই আমাকে টাচও করিস নি? (অর্ন)
– নাহ.. যেখানে কাছে আসা বারণ, সেখানে স্পর্শ করাটাই তো চাঁদ হাতে পাওয়ার মত খুশির ব্যাপার। তুমি আমার কাছে সত্যিই একটা চাঁদ। যাকে দূর থেকে দেখা যাবে, কিন্তু স্পর্শ করার ক্ষমতা আমার নেই। আমার কাছে এমন রকেটও নেই যে তুমি নামক চাঁদে যেয়ে তোমাকে আশ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখবো। সে ক্ষমতা আমার নেই। সে যোগ্যতাও আমার নেই। অনেক জ্বর তোমার।।তাড়াতাড়ি খাও। (অবনি)
– তুই এতক্ষণ এখানে কিভাবে বসেছিলি? আমি হলে তো দুই মিনিটেই চলে যেতাম। (অর্ন)
– হাহাহা.. রোগে পড়েছো কখনো? এটা একটা রোগ। যে রোগে আমি বহু বছর ধরে আক্রান্ত। রোগের নামটা তোমাকে বলবো না। যাইহোক, বললাম না তুমি সত্যিই একটা চাঁদ। আর চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতে কি কারো ক্লান্ত, অসহ্য, এসব হয়নাকি? হয়, যাদের চাঁদ দেখার সময় থাকেনা। আমার তো তোমার দিকে তাকিয়ে থাকতে যদি এমন দু তিনটে রাতের ন্যায় সময় এনে দেয় কেউ, তবুও আমি এভাবে বসে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবো। (অবনি)
– দু তিনদিন…! (অর্ন)
– কেনো কম হয়ে গেলো? আরে আমি এভাবে বসে মাসের পর মাস থাকতে পারবো। তোমাকে দেখবো শুধু, এতেই চলবে। কিন্তু দু তিনদিন বলেছি কারন মানুষ খাবার/পানি ছাড়া কতদিনই বা বেঁচে থাকবে? আমি তো সবকিছু ছেঁড়ে তোমাকে দেখবো বলেই বসেছিলাম। জানি বিশ্বাস করবে না, আমি এখনো অবদি কিছু না খেয়েই বসে আছি।

অর্ন চুপ হয়ে গেলো। অবনির মুখের দিকে তাকাচ্ছে না। অবনির তাতে কিছুই যায় আসেনা। সে অর্নকে ভালোবাসে। যতদিন বাঁচবে এমন অবহেলার ভালোবাসা নিয়েই অবনি বেঁচে থাকবে। করুক অর্ন যতখুশি অপমান। তবুও সে ভালোবাসা দেখিয়ে যাবে। খাবার খাওয়ানো শেষ হয়। অবনি বলে..

– দাঁড়াও জ্বরের ঔষধ আনি। তুমি একটু অপেক্ষা করো। (অবনি)
– হুম।

অবনি বাইরে চলে যায়। অর্ন বিছানা ছেঁড়ে উঠল। ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। কিন্তু প্রচন্ড জ্বর আর মাথাব্যাথার কারনে একপা আগালে টলে পড়ার জন্য ধীরে ধীরে পা ফেলতে শুরু করে। কিন্তু বেশিক্ষণ সে হাঁটায় মনোনিবেশ করতে পারেনি। একটু লম্বা পা ফেলতেই টলে পড়তে যাচ্ছিল। আর তার আগেই অবনি এসে শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরে অর্নকে। অর্ন অবনির শাঁড়ি খোলা পেটে হাত নিয়ে কোমর খাঁমচি দিয়ে ধরে। অবনি একটু কেঁপে উঠলো। এই প্রথমবার কোনো পুরুষ তার পেট স্পর্শ করে কোমর জড়িয়ে ধরেছে। অর্ন টাল সামলানোর জন্য কোথায় ধরেছে সে খেয়াল তাৎক্ষণিক তার নেই। অবনি বকা দেওয়া শুরু করে..

– আরে কি সমস্যা তোমার? বারণ করলাম না, উঠবে না। তবুও শুনলে না তো? সে সাইডে পড়তে যাচ্ছিল, সে সাইডে টেবিল। মাথাটা লাগলে কেঁটে যেতো। সবসময় বেশি বেশি করো তুমি। (অবনি)
– আমি বাথরুমে যাবো। (অর্ন)
– হুম চলো।

অর্নকে জড়িয়ে ধরে অবনি নিয়ে যায় ওয়াশরুমে। অর্ন যখন অবনিকে ছেঁড়ে দিয়ে প্যান্ট নামাতে যাচ্ছিল। তখনি অবনি বলে..

– ঐ থামো থামো.. এসব কি হা? আমি যে আছি সে খেয়াল আছে? (অবনি)
– ওহ, সরি.. উলটো দিকে তাকিয়ে থাক। তবে আমাকে ধরে রাখ।

অর্ন কথাটা বলে এক হাত পিছনে বাড়ায় কিছু ধরে সাপোর্ট পাওয়ার জন্য। কিন্তু তেমন কিছু নেই পিছনে। অবনি পিছনে তাকাচ্ছে না। সে ঘুরে রুমের দিকে তাকিয়ে আছে। অর্ন হাত আরেকটু লম্বা করে। কিছু একটা সাপোর্ট পায় অর্ন। কিন্তু অবনি সাথে সাথেই চমকে উঠে। অর্ন অবনির পেট থেকে কিছুটা উপরের কোমর হাতের মধ্যে খামচি দিয়ে ধরে। আরেকটু উপরে হাত তুললেই অর্ন অনেক কিছুর সন্ধান পাবে। অবনি নিজেকে ছাঁগানোর চেষ্টা করতে যাচ্ছিল, কিন্তু অর্ন আবার পড়ে যাওয়ার উপক্রম হওয়াতে ছাঁড়ায় না। অর্নের কাজ শেষ হলে বের হয়। অবনি বলে..

– ঘোরের মধ্যে আছো তাইনা?
– হুমম, জ্বরে কিছুই মনে পড়ছে না আমি কে? শুধু তোকে চিনতে পারছি। তুই অবনি। (অর্ন)
– তাই নাকি? ঢং.. বেয়াদব ছেলে, ঘরে বউ রেখে বাইরের মেয়ের জন্য কান্না করে। ইচ্ছে করছিল ছুঁরি এনে গলায় দিই একটান। খুন করবো একদিন তোমাকে। আমাকে তো চেনো না। মেয়েদের জন্য কান্না তাইনা? থাঁপড়িয়ে সব দাঁত ফেলবো বেয়াদব কোথাকার।
– কি বলছিস, তোর কথা আমি বুঝতে পারছিনা। (অর্ন)
– এ জন্য তো বলছি। এখন তো কিছুই বুঝবা না। তাই বকা দিলাম। (অবনি)
– ওহ, তাহলে আরো দে। মনে হচ্ছে আরো খুধা লাগছে। (অর্ন)
– এহ. বকা খাওয়ার জন্য নাকি তার খুধা বাড়ছে। ফাজিল..

অর্নকে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে ঔষধ খাওয়ালো অবনি। তারপর শুইয়ে দিয়ে দৌড়ে ওয়াশ রুমে আসলো। আয়নার সামনে নিজের কোমর রাখে। অর্ন যেখানে যেখানে ধরেছে, সেখানে নখের দাগ বসে কেঁটে গেছে। কিন্তু অবনির কোনো কষ্ট হচ্ছে না। সে এটা দেখে হাসতে থাকে। মনে মনে বলে “যাক ছেলেটা আমাকে স্পর্শও করতে পারে। হিহিহি…” তারপর…
চলবে,,

প্রণয় পর্ব-০৫

0

#প্রণয়
#৫ম পর্ব
#Abir Hasan Niloy

অবনি অর্নের কাঁটা হাতে তুলো দিয়ে স্যাভলন লাগাতে থাকে। একবার করে লাগাচ্ছে, তারপর আবার ফুঁ দিচ্ছে। অর্ন তাকিয়ে তাকিয়ে অবনির কাজগুলো দেখছে। অবনি ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে বলে..

– এভাবে নিজেকে কেনো কষ্ট দিয়েছো? দেখে শুনে কিছু করতে পারো না? বাচ্চাদের মত কাজ করো, কতটা ব্যাথা পেয়েছো। (অবনি)
– ঐ কান্না থামা। বাচ্চাদের মত কেনো কাঁদছিস? (ঝাড়ি দিয়ে বললো অর্ন)
– উহু…উহ….হু হু…. (আরো জোরে কান্না করে)
– ঐ কি শুরু করেছিস? বারণ করলে বেশি জোরে কাঁদছিস? ছাঁড় আমার, আমি ঠিক আছি। সর সামনে থেকে, যা ঘুমা। (অর্ন ঝাড়ি দিয়ে বলে)

অবনি কান্না থামিয়ে চুপচাপ হাত ধরে রাখে। নিজের কোলে হাত রেখে দিয়ে আস্তে আস্তে মলম লাগাতে থাকে। অর্ন যন্ত্রনায় চোখ বন্ধ করে নিল। অবনি মলম লাগাতে লাগাতে অর্নের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে দেখতে থাকে সে অর্নকে। অর্ন চোখ খুলে তাকায়। অবনিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে বললো…

– যা, খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়।
– তোমার ফোনটা আমাকে একটু দাও। (অবনি নরম গলায় বললো)
– কেন? (অর্ন গম্ভির হয়ে বলে)
– দাও তো একটু। (অবনি)
– নে.. তবে আম্মাকে কিছু বলিস না এখন। (অর্ন)
– দাও তো…

অর্নের থেকে ফোনটা কেঁড়ে নেয় অবনি। তারপর ডাক্তার সৈয়দ আংকেলকে কল দিতে থাকে। তখন ঘড়িতে রাত প্রায় দুইটা। একবার কল দিয়ে তিনি যখন রিসিভ করে না, অবনি অর্নের কাছে কান্না ভরা কণ্ঠে প্রশ্ন করে..

– ডাক্তার কাকু ফোন ধরে না কেনো?
– রাত কটা বাজে দেখেছিস? তোর মত কেউ জেগে আছে? আর তুই সামনে থেকে যা, আমার কিছু সহ্য হচ্ছে না। (অর্ন)
– ধুর। আমি ফোন দিবো, দরকার হলে মসজিদের মাইকে মাইকে বলে আসবো আমার বরের হাত কেঁটেছে কে কোথায় ডাক্তার আছো, সবাই চলে আসো। (অবনি)

অর্ন গম্ভীর চাহনি নিয়ে তাকিয়ে ছিল অবনির দিকে এতক্ষণে। কিন্তু হঠাৎ করে অবনির এমন পাগলামি মার্কা কথা শুনে অর্ন বুঝতে পারছে না হাসবে নাকি রাগ দেখাবে। সে চুপচাপ অবনির দিকে তাকিয়ে থাকে। অবনি ডাক্তারকে ফোন দিতে থাকে অটো। এক সময় রিসিভ করে..

– কি হয়েছে অর্ন, এত রাতে ফোন দিয়েছো কেনো? (ডাক্তার)
– কাকু… উহু… হু…হু…. আমি অবনি, ওর হাত কেঁটে গেছে অনেক। রক্ত বের হয়েছে দুই ব্যাগ। তাড়াতাড়ি আসেন, বাড়িতে আছে। (অবনি)
– অর্নের হাত কেঁটেছে? আচ্ছা আমি ১০ মিনিটের ভিতরে আসছি। (ডাক্তার)
– উহু… হু.. তাড়াতাড়ি..

অবনি কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলেছে। অর্ন এবার জোরে ঝাড়ি দেয়। অবনি লাফ দিয়ে ওঠে। চমকে যেতেই সে কান্না থামিয়ে মাথা নিচু করে নিল। অর্ন ঝাড়ি দিয়ে বললো…

– কাঁদবি না, অসহ্য লাগছে একদম। সামনে থেকে যা, আমাকে এখানে থাকতে দে। আম্মা কোথায় গেছে? ওহ, শিলা আপুর বিয়ের কথা ছিল আজ। তুই যা, ফোন দে। (অর্ন)
– ডাক্তার আসতে এত দেরি করে কেনো? আরো না ডাক্তারের নাম্বার আছে? দাঁড়াও কল দিই। (অবনি)
– ধুর…

অবনি অর্নের ঝাড়ি শোনেনা। যতগুলো ডাক্তার পরিচিত নাম্বার ছিল, সবাইকে ফোন দেয় অবনি। সবাই আসছে। অবনি ফোন দিয়ে অর্নের পায়ের কাছে বসে। অর্ন চোখ বন্ধ করে ইরার কথা ভাবছে।
.
“ছেলেটার অনেকখানি হাত কাঁটছে। রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছিল। আমার জন্য কতটাই না পাগলামি করছিল সে। সারাদিন আমার বাসার নিচে দাঁড়িয়ে ছিল। এতটা ভালোবাসে সে আমাকে? এখন কি তাকে দেখতে যাবো? না থাক, কাল সকালে একবার দেখতে যাবো। ভালোবাসি তো তাকে আমি। সেও বাসে। আমি আমার ভালোবাসা হারাতে দেবো না। অর্নের সাথে এসব নিয়ে কথা বলবো পরে।”

ইরা রুমে পায়চারী করতে করতে কথাগুলো ভাবছিল। অর্নের উপর রাগ জমেছিল ওর অনেক। সে জন্য সারাদিন যখন অর্ন ওর বাসার সামনে ছিল, তখন সে কিছুই অনুভব করেনি। আর রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। যাকে সে ভালোবাসতো, বা যে তাকে ভালোবাসতো, সে অন্যকে হুট করে বিয়ে করলে তো রাগ হবেই। তবে ইরা বুঝে গিয়েছে অর্ন তাকে সত্যিই ভালোবাসে। সে অর্নকে হারাতে চায়না আর। কালকে একবার দেখে আসবে, অবনির সাথে কথা বলবে না একদমই। এরাকমটা ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়ে পড়ে।

এদিকে দরজায় কলিং বেল এর শব্দে অর্ন আরো বিরক্ত হয়ে যায়। অবনি তাড়াতাড়ি দরজা খোলে। দেখে তিনজন ডাক্তার এসে হাজির। অবনি তাড়াতাড়ি ভিতরে নিয়ে আসে ওনাদের। অর্ন তিনজন পরিচিত ডাক্তার দেখে অবাক হয়ে গেলো। প্রশ্ন করে..

– আপনারা তিনজন এতো রাতে?
– তোমার বউ এত পাগলামি করে, আল্লাহ… আসছি বলেছি। তবুও ৩০ বার কল দিয়েছে। শুধু আমার একার না, বাকিদেরও একি অবস্থা হয়েছে। কি হয়েছে হাতে দেখি। (সৈয়দ সাহেব)

সৈয়দ ডাক্তার কথাটা বললো। অর্ন কথা শুনে অবনির দিকে তাকালো। অবনি অর্নের দিকে অপরাধীর মত একবার চাইলো। তারপর অর্নের কাছে এসে নিজেই অর্নের হাত ধরে কোলের মধ্যে নিয়ে ফু দিতে দিতে বলে..

– এই যে এই হাত, দেখেন কি পরিমানে কাঁটছে। একটুও নিজের খেয়াল রাখেনা। এতবার বলেছি সবসময় সাবধানে চলতে। আমার কথা শোনেই না। ভালো ঔষধ দিবেন, ইনজেকশন দেবেন, যেন ইনফেকশন না হয়। আজকে ব্যান্ডেজ করেন, ধুলাবালি যদি যায়? সকালে উঠেই খুলে দিবো। (অবনি)
– হা.. করছি করছি… এত টেনশন নিতে হবেনা। সব করছি.. তুমি বরং খাবার রেডি করো। খাবারের পর ঔষধ আছে। খেতে হবে। (সৈয়দ আংকেল)

ডাক্তার সাহেবেরা অর্নকে দেখতে থাকে। অর্ন শুধু অবনির পাগলামি দেখে অবাক হচ্ছে। এমনটা তো অবনি ছিলনা। বিয়ের আগে এমনিতে অর্নের জ্বর আসলে অবনিই বেশি কেয়ার নিত। মানে ঠিক সময়ে ঔষধ নিয়ে হাজির হতো। বাট এমন পাগলামি সে আগে কনোদিন করেনি। ডাক্তারেরা সবকিছু ঠিকভাবে করে। অবনি খাবার নিয়ে অর্নের সামনে এসে দাঁড়ায়। অর্নের হাতে ব্যান্ডেজ করা শেষে ডাক্তাররা উঠে দাঁড়িয়ে অর্নকে বলে..

– বাবা.. কপাল করে একটা বউ পাইছো। এতটা ভালোবাসা কেউ এই যুগে বাসবে না। অবনির ফোন পেয়ে পেয়ে বিরক্ত হয়ে গিয়েছি। যেভাবে কান্না করেছে, না জানি কি না কি হয়েছে ভেবে আরো তাড়াতাড়ি এসেছি। অবনি তোমাকে অনেক ভালোবাসে। দশ মিনিট ডাক্তার আসার সময় নিয়েছে, এর মধ্যে তিনজন ডাক্তাকে ডাকাও শেষ।

ডাক্তারেরা কথাগুলো বলে সেখান থেকে চলে গেলো। অবনি ঠাই দাঁড়িয়ে আছে খাবার নিয়ে। অর্নকে সাহসের অভাবে খাবার খেতে বলতেও পারছে না। সাহস নিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছিল অবনি। তখনি পিছন থেকে সৈয়দ আংকেল এসে বলে..

– এক মিনিট, আরেকটু কাজ বাকি আছে। অবনি দেখি তোমার পায়ের নখে কি হয়েছে? দরজা খোলার পর দেখলাম তুমি খোড়াতে খোড়াতে হাঁটছিলে।
– কিছু হয়নি তো আংকেল। (অবনি)
– আরে দেখি.. ইস কতখানি কাঁটছে। নখ তো প্রায় উঠে গিয়েছে। রক্তই এখনো বন্ধ হয়নি। দেখি দেখি ড্রেসিং করে দিই।

সৈয়দ আংকেল অবনির আংগুলে ভালোমত ট্রিটমেন্ট করে। সৈয়দ আংকেল সবকিছু চেকআপ করতে করতে বলে..

– কোথায় হোঁচট খাইছো বলো।
– ঐ যে চেয়ারের সাথে। (অবনি)
– কেনো? (সৈয়দ আংকেল)
– না মানে… (অবনি)
– চুপ.. বলো কিভাবে? (সৈয়দ আংকেল)
– আসলে, উনি এসে দরজায় কলিংবেল বাজিয়েছিল। তাড়াতাড়ি দরজা খুলতে যেয়ে হঠাৎ নখের সাথে চেয়ার লেগে হোঁচট খাই। সমস্যা নেই। আমি তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিয়েছিলাম। ওনার যেন কষ্ট না হয় সেটা দেখুন। হাতে অনেক ব্যাথা। আমি জানি সব। (অবনি)

অবনির মুখ থেকে কথাগুলো শুনে অর্ন আর ডাক্তার সাহেব দুজনেই অবাক হয়ে গেছে। সৈয়দ ডাক্তার আর কিছু বললো না। সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। অর্ন অবনির দিকে রাগি চোখে তাকায়।

– এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো? ভয় করে আমার। তবে তাকিয়েও লাভ নেই। এখন খাবার খেতেই হবে। না হলে হাত সারবে না। (অবনি)
– তোর পা কাঁটছে, সেটার খেয়াল না রেখে আমার হাত কাঁটছে, সেটা নিয়ে ছোঁটুছটি তোকে কে করতে বলেছে? তুই নিজের খেয়াল নিজে নিবি। আমি আমারটা। আমি কখনো বলিনা কাউকে আমার খেয়াল নিতে। অসহ্য লাগে। বিরক্তিকর তুই। (অর্ন)
– বকা দাও কেন তুমি? আমি ঠিক আছি। এখন খেয়ে নাও। (অবনি)
– খাবো না আমি। (অর্ন)
– ঔষধ খেতে হবে। (অবনি)
– আরে..দেখছিস না, আমার হাতে ব্যান্ডেজ। তুই যা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়। (অর্ন)
– আমি না খেয়ে আছি, তুমি কিভাবে জানো?

অর্ন কিছু বলতে যেয়েও থেমে গেলো। বুঝতে পারছে না এখন সে কি বলবে। অবনির দিকে তাকায়। অবনি সরু চোখে চেয়ে থাকে অর্নের দিকে। অর্ন ঝাড়ি দিয়ে বলে..

– আমি খাবো না। তুই যা খুশি কর।
– আমি খাইয়ে দিচ্ছি। তুমি চুপচাপ বসো। হাত ঠিক হয়ে গেলে না হয় আমাকে মেরো, রাগ প্রকাশ করিও। (অবনি)

অবনি সরলভাবে কথাটা বললো। অর্ন স্থির হয়ে বসে আছে। অবনি কোথা থেকে যেন সাহস পেয়ে যায়। ও এগিয়ে যায় অর্নের দিকে। ছোট টেবিলে খাবারের প্লেট রাখে। তারপর মাখিয়ে দিয়ে, অর্নের দিকে হাত বাড়ায়। এক লুকমা হাতে নিয়ে তাকিয়ে থাকে অর্নের দিকে। অর্ন গম্ভির চাহনি নিয়ে চায়লো। উপায় নেই, তাকে খেতে হবে। আর অবনি না খাওয়ানো অবদি ছাঁড়বেই না। অর্ন হা করে, অবনি দেরি করে না। সে খাবার মুখে পুরে দিয়ে অর্নের দিকে তাকায়। অর্ন চিবুতে শুরু করেছে। অবনি তার খাওয়া দেখছে। অর্ন অবনির দিকে না তাকিয়ে খেতে থাকে।

অর্নের খাবার শেষে অবনিও কিছু খেয়ে নেয়। অর্ন ঔষধ খেয়েই সোফাতে বসে ঘুমিয়ে গেলো। অবনি নিজেই অর্নকে ঔষধ দিয়েছে। অবনি আজকে খুশি। কৃষ্ণকলি রমনী সে। মুখে সবসময় কালো মেঘের ছড়াছড়ি। ঈষৎ কালো রঙ যেন অবনির ছোট থেকেই পিছু ছাঁড়েনি। জন্মের পর থেকে ঠিকমত মায়ের দুধ পায়নি অবনি। অর্নের মা ছিল বলেই হয়ত সে বেঁচে আছে। কালো বলে ছেলেরা তাকে পছন্দ করেনি কোনোদিন। অবনির কাছে ভালোবাসাটা ছিল অপ্রাপ্তিতে। শুধু সে দুর থেকেই ভালোবাসা খুজেছে।

সহপাঠী মেয়েদের জন্য কত কত ছেলে সামনে এসে হাত কাঁটতো। তাদেরকে পাওয়ার জন্য পাগলামি প্রকাশ করতো। অবনি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছে। তাকে কাছে পাওয়ার ব্যাকুলতা কেউ কোনোদিন প্রকাশ করেনি। কেউ এসে বলেনি ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ পৃথিবীর সবাই সুন্দরের পূজারি। কালো ছেলে হলেও কেবল টাকার জন্য সুন্দরী বউ পাওয়া যায়। আর কালো মেয়ে হলে বিয়ের জন্য টিভি, ফ্রিজ, বাইক প্রদান করতে হয়। পৃথিবীর কিছু নিয়ম বড়ই অদ্ভুত। যে যতই এই নিয়মগুলো পাল্টানোর চেষ্টা করুক না কেনো, কখনো সে সক্ষম হবেনা।

নিয়ম তৈরী হলে বদলানো যায়। কিন্তু আল্লাহ যে নিয়ম সৃষ্টি করে, সেটা মনুষ্য কখনো বদলাতে পারেনা। একটাই কথা পরিলক্ষিত হয়, তা হল আল্লাহর তৈরী নিয়ম। কালো ছেলে মেয়েদেরকে স্বাভাবিক ভাবে অন্য কোনো ছেলে মেয়ে পছন্দ করেনা। আবার গরীবদেরকে পছন্দ করেনা। যে ভালোবাসা দিতে চায়, তাকে আবার কেউ চায়না। এই নিয়ম বদলানো অসম্ভব।

অবনি দেখতে কালো। শুধু চেহারাটাই তার কালো। কালো বলেই নিজের পরিবারের মানুষ তাকে পছন্দ করেনি। সে অসিত, কৃষ্ণবর্ণ, শ্যাম, শ্যামল, কৃষ্ণ, শ্যামবর্ণ। সঠিকভাবে বলা যায় কালো হল সেসকল বস্তুর রঙ যা দৃশ্যমান বর্ণালীর মধ্যে কোন আলো বিকিরণ বা প্রতিফলন করে না। কালো রঙের বস্তু দৃশ্যমান বর্ণালীর সকল কম্পাঙ্ক বিশিষ্ট আলো শোষণ করে নেয়। যদিও কখন কখন বর্ণহীন বলতে কালো বলা হয়, তবে ব্যবহারিক অর্থে কালো একটি রঙ। কিন্তু অবনির মধ্যে শ্বেতের কোনো চিহ্ন নেই। শুধু গুন আছে। সমাজ তৈরী করা গুরুদের মতে একটা মানুষ তখনি পারফেক্ট হয়, যার মধ্যে সুন্দর চেহারাও থাকবে, অনেক গুন থাকবে। অথচ মানুষ কখনো কোনোকিছুতে কোনোদিন পারফেক্ট হয়না।

অবনি আবিরের পাশে বসে। সোফায় হেলান দিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে ওর খেয়াল নেই। ঘুমিয়ে পড়ে দুজন সোফাতে। ঘুমের ঘোরে অর্ন অবনির কাছে আসে। অবনিকে কোলবালিশের মত জড়িয়ে ধরতেই অবনির ঘুম ভেঙে যায়। সে চোখের পাতা মেলে তাকিয়ে দেখে অর্ন তাকে জাপটে ধরে, সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। অবনি ওঠার চেষ্টা করলো। কিন্তু অর্ন আরো শক্ত করে জড়িয়ে নেয়। অবনি মনে মনে বলে “ঘুমের ঘোরে হলেও কি.. সে তো আমার কাছে এসেছে, থাকুক এভাবে। না হয় সকালে একটু অপমানিত হবো, বকা শুনবো তবুও থাকুক। ঘুমটা আর ভাঙাবো না।”

অর্ন কষে ধরে রাখে। অবনি আবারো ঘুমিয়ে যায়। ঘুমের ঘোরে অবনি অনুভব করে, অর্ক তার পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে, এক হাত গলার পাশ দিয়ে রেখে পেটের উপর দিয়ে আরেকটা হাত নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। বেশ আরামেই দুজন ঘুমিয়ে যায় এখানে।
.
সকাল হয়ে গেছে। ইরা লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠল। সকাল আটটা বাজে। অর্নের কথা মনে পড়েই বুকটা কেমর ধুক করে উঠল। কালকে হাতে যন্ত্রনা নিয়ে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল অর্ন। ইরা তখন অর্নের ভালোবাসাটা বুঝতে পারেনি। কিন্তু রাত থেকে সে অর্নকে অনেক বেশি মিস করছে। তাই সে কোনোরকমে রেডি হয়ে নিল। অর্নকে দেখতে যাবে ইরা। সকালে ইরাকে দেখে অর্ন খুশিই হবে। ‘আমি আসছি অর্ন, আর কষ্ট পেতে হবেনা।’ ইরা অনেককিছু ভাবতে ভাবতে ত্রিশ মিনিটের ভিতরে রেডি হয়ে নিল। নিজের গাড়িতে করে ইরা অর্নের বাড়ির উদ্দেশ্যে আসতে থাকে। হঠাৎ শিহাবের ফোন আসলো। ইরা রিসিভ করে..

– জ্বি ভাইয়া বলুন… (ইরা)
– কোথায় আছো? (শিহাব)
– আসলে আমি অর্নের বাড়িতে যাচ্ছি। কিছু বলবেন? (ইরা)
– ওহ, আমরাও আসছি। চলো একসাথে যাবো। আসলে কালকে একটু বেশিই অর্নকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছিলাম। ফোন দিইনি আর। অবনিকে সে ভালোবাসে না। সে তোমাকেই ভালোবাসে। (শিহাব)
– জানি তো ভাইয়া। যেয়ে দেখবো অর্ন বাইরে বসে বসে ঘুমাচ্ছে। আর অবনি ভিতরে। আমার অর্নকে নিয়ে আসবো। আসুন আমি এগিয়ে যাচ্ছি।

ইরা কথাটা বলে ফোনে কেঁটে দেয়। অর্নদের বাড়ির গেটের কাছাকাছি আসতেই সবার সাথে দেখা হয় ইরার। বাড়ির দারোয়ান ওদের সবাইকে চেনেই। তাই সহজে ভিতরে প্রবেশ করে। বাড়ির মেইন দরজা হালকা খোলা আছে। ইরা আগে ভিতরে প্রবেশ করলো।

অর্ন আর অবনি রাত থেকে একসাথেই সোফাতে ছিল। রুমে যায়নি তারা। অর্ন ঘুমের ঘোরে অবনিকে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছিল। অর্নের ঘুম নষ্ট হবে, অর্নের কষ্ট হবে ভেবে আর অর্নকে ডাকেনি। ওভাবেই পাশে হেলান দিয়ে শুয়েছিল। কিন্তু অর্ন অবনিকে নিয়ে শেষ রাতে সমতল ভাবে শুয়ে পড়ে সোফায়। শুধু এতটুকু নয়, অর্ন তাকে জড়িয়েই ধরে ছিল সারাটা রাত। ইরা ভিতরে প্রবেশ করতেই ওর চোখ আটকে যায় অবনি আর অর্নের জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে। শিহাব অর্নকে ডাকতে যাচ্ছিল। কিন্তু ইরা থামিয়ে দেয়। ইরা খাবার টেবিল থেকে একটা কাঁচের গ্লাস হাতে তুলে নিয়ে সজোরে ফ্লোরে ছুঁড়ে মারলো।

দুজন ফ্লোরে কাঁচের গ্লাস পড়ার শব্দ শুনে লাফ দিয়ে ওঠলেও, অর্ন আর অবনি ওভাবেই জড়িয়ে শুয়ে ছিল। কাঁচের গ্লাসের শব্দের প্রতিধ্বনি চারপাশে বাজতে থাকে। অর্ন বুঝতে পারে অবনিকে সে জড়িয়েই ছিল। অর্ন তাড়াতাড়ি অবনিকে ছেঁড়ে দিয়েই সামনে তাকায়। ইরা দাঁড়িয়ে আছে। পিছনে অর্নের বন্ধুরাও আছে। অবনিও তাকালো সামনে। ইরার চোখ লাল হয়ে গেছে। সে ফ্লোরে আরো একটা গ্লাস ফেলে দিয়ে বলা শুরু করে..

– বাহ.. কি সুন্দর দৃশ্য। লজ্জা করেনা তোর…? আমার বাড়ির সামনে যেয়ে সারাদিন দাঁড়িয়ে ছিলি, কুকুরের মত তাঁড়িয়ে দিতে চেয়েছি। অথচ তুই সেখানে ছিলি। এখন বাড়িতে এসে বউ পেয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বেশ আরাম করেই ঘুমিয়ে ছিলি তাইনা? ছিহ.. তোকে বিশ্বাস করেছিলাম আমি। বিশ্বাস করেছিলাম অবনিকে কোনোদিন ভালোবাসবিনা। সব ভালোবাসা আমার জন্য থাকবে। এই তোর ভালোবাসা? না জানি বাসর ঘরে কি কি করছিস। ছিহ.. সরি কেনো ছি! ছি! করছি? তোর বউ, যা খুশি তাই করবি। আমার কি? জঘন্য মনের মানুষ তুই। লজ্জা করেনা আমাকে ভালোবাসি বলতে?

ইরা চিৎকার করে কথাগুলো বললো। ইরার কথা শুনে অবনি বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ইনোসেন্ট লুক দিয়ে অবনি প্রথমে কি হয়েছে বোঝার চেষ্টা করে। কিন্তু অর্নের এমন অপমান শুনে অবনি রেগে যায়। তারপর..
চলবে,,

প্রণয় পর্ব-০৪

0

#প্রণয়
#৪র্থ পর্ব
#Abir Hasan Niloy

অর্ন গাড়ির সামনের ডিগির উপর বসে আছে। গাড়ির ভিতর থেকে মিউজিক যন্ত্র থেকে মোহাম্মদ ইরফানের গাওয়া, এক ভিলেন মুভি থেকে ‘বানজারা’ গানটি বাজছে। অর্নের হাতে ড্রিংকসের বোতল। সামনে ওর বন্ধুরা গাছের গুড়ির উপর গোল হয়ে বসে আছে। ক্লাবের পরে তুর্জদের বাগান বাড়ির পিছনের দিকে এসে ওরা বসে থাকে।

– অর্নকে নিয়ে এখন হাসাহাসি চলছে। অর্নের বিয়ে এমন একটা মেয়ের সাথে হয়েছে, যা আমাদের সামনে সে কোনোদিন প্রেজেন্ট করতে পারবে না। পরিচয় দিতে পারবে না, যে অবনি অর্নের বউ। (মিহি)
– আমি বিয়ে করবো তোরা দেখিস। বউকে দেখে তোরা হা হয়ে যাবি। কোথায় অবনি আর কোথায় আমার বউ হবে। (তুর্জ)
– আস্তে বল, অর্ন শুনবে। (খেয়া)
– আরে কিসের আস্তে, অর্নের বউ অবনি এটা ভাবলেই তো হাসি পাচ্ছে। (সিমি)
– বাদ দে, ইরা কি করলো? সাফিনের সাথে মিশছে কেনো? ইরা তো ভালো করেই জানে সাফিন কতটা খারাপ ছেলে। (শিহাব)
– তো কি করবে? অর্ন কি ভার্জিন আছে নাকি? একটা মেয়ের সাথে রাত কাঁটিয়েছে সে। কি ভাবছিস, এখনো সে আগের অর্ন আছে? ইরাও তাই করবে? হয়ত দু একদিন পর সাফিনের সাথে এক রুমে পড়ে আছে। (তুর্জ)

অর্ন বেশ কিছু সময় ধরে ওর বন্ধুদের কথাগুলো শুনছিল। শেষের কথাটা আর সহ্য করতে পারেনি। কাঁচের বোঁতলটা ডান হাতেই ছিল। ওটা হাতের যত শক্তি ছিল, তা দিয়ে জোরে চাপ দেয়। সাথে সাথে বোতলটা ভেঙে অর্নের হাতে কাঁচের টুকরো লেগে যায়। এবং অনেকখানি কেঁটে, রক্ত বের হতে থাকে। শিহাব অর্নের দিকে তাকায়। হাত থেকে রক্ত ঝরতেই দৌড়ে এগিয়ে আসে সেদিকে।

– কি ব্যাপার অর্ন, তুই কি পাগল হয়ে গিয়েছিস? পাগলামি থামা।
– হুম, আমি পাগল হয়ে গিয়েছি। আর তোদের মত কিছু ভালো বন্ধু পেয়ে আরো পাগল হয়েছি। (অর্ন)
– আরে ওরা মজা করছিল। বাদ দে.. (শিহাব)
– হুম, বাদ তো দেবোই। থাক তোরা…

অর্ন আর কিছু বললো না। সে কারো দিকে না তাকিয়ে গাড়ি চালিয়ে সেখান থেকে চলে আসে। ইরাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। বাড়ির সামনে গাড়ি রেখে, গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে, উপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। ফোন বেজে ওঠে অর্নের। তাকিয়ে দেখে অবনি কল দিয়েছে। অর্ন ফোন কেঁটে দেয়। দুপুর ছাঁড়িয়ে বিকেল হয়েছে। অর্ন সকালে বের হয়ে আর ফেরেনি। অবনির অনেক চিন্তা হচ্ছে। জানে সে, অর্নকে কল দিলে অর্ন নিজেই তাকে ঝাড়ি দেবে। তবুও অর্ন দুপুরে খেতে আসেনি, এমনিতে সদ্ব্য বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পরেরদিন অর্ন বাহিরে সময় কাটাচ্ছে। অবনি আরো চিন্তিত হয়ে পড়ে। এ জন্য ফোন দিতে থাকে। অর্নের কোনো খোজ নেই।

অর্ন খাবার টেবিলেই বসে আছে দুপুর থেকে। কিন্তু অর্নের খোজ নেই। প্রথমবার ফোন কাঁটাতে অবনি আবারো অর্নকে ফোন দেয়। কিন্তু অর্ন আবারো কেঁটে দিল। অবনি এবার লাগাতার ফোন দিতে থাকে। অর্ন বিরক্ত হয়ে ফোন সাইলেন্ট করে দিতে যেয়ে থেমে যায়। দুইতলার ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে ইরা। ইরার দিকে তাকিয়ে থাকে অর্ন। ফোনটাও বাজতে থাকে। ইরা নিচে তাকায়। অর্নকে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। ইরা খুশিতে লাফ দিয়ে ওঠে। দৌড়ে অর্নের কাছে আসার জন্য পা বাড়ায়। পরক্ষনেই ইরা থেমে গেলো। মনে পড়ে তার অর্ন এখন অন্যের বর, সে আর তার নেই। সে অন্যের। আগে এমন হয়েছে,অর্ন বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াতো। ইরা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরতো অর্নকে। তারপর গাড়ি করে দুরে কোথাও ঘুরতে যেতো দুজন। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব নয়। অর্ন ইরার নয়, অর্ন অবনির। ইরা বিরক্ত হয়, বিরক্ত হয়ে ফোন দেয় অর্নকে।

অর্নের ফোনে আগে থেকেই কল আসছিল। ইরাকে ফোন কানে ধরতেই অর্ন, নিজের ফোনের দিকে না তাকিয়ে কল রিসিভ করে। অর্ন বলে…

– ইরা, আমাকে কেনো ভুল বুঝছো? আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি। অবনিকে আমি কখনো চাইনি। আর না কখনো চাইবো। আমার সবকিছুতে শুধু তুমিই আছো। আমি শুধু তোমাকেই চাই। চিন্তা করো না, আমি অবনিকে ছ মাসের মধ্যেই ডিভোর্স দিবো। প্লিজ ইরা আমাকে একটু বোঝার চেষ্টা করো। ইরা…

লাইনটা কেঁটে যায়। অর্ন ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে। ইরার কল আসলো। অর্ন আবার রিসিভ করে। অর্ন কিছু বলতেই যাচ্ছিল, তার আগে ইরা বলে..

– এখানে কুকুরের মত দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? চলে যান। ওহ আপনি তো এভাবে বললে যাবেন না। কেনো যাবেন? রাস্তার কুকুর কে জোরে হেয় বললেও চলে যাবে, আপনি তো যাবেন না। আপনার জাতটা একটু উচ্চপর্যায়ের। কিন্তু আপনাকে আমার সহ্য হচ্ছে না। চলে যান প্লিজ।
– ইরা আমার কথা তো শোনো। (অর্ন)
– কি শুনবো? বলতে চাইছেন অবনিকে টাচ অবদি করেন নি। তার সাথে বিছানায় রাত কাঁটান নি.. তাকে স্পর্শও করেন নি। এগুলোই তো বলবেন তাইনা? (ইরা)
– একদম ঠিক, অবনির থেকে দুরে ছিলাম আমি। (অর্ন)
– হাহাহা.. এসব কথা আগেই সাফিন আমাকে বুঝিয়েছে। এগুলোই তুমি বলবে সে আগে থেকেই আমাকে শুনিয়েছে। বোকা পেয়েছো আমাকে? আমি ভালোবাসতাম বোকার মত, আবার বোকার মত স্বপ্নও দেখতাম তোমাকে নিয়ে। অথচ আমাকে ঠকিয়ে তুমি অন্য কারো। চলে যাও আমার সামনে থেকে। (ইরা)
– ইরা প্লিজ.. সাফিনের কথা আমাকে বলবে না। (অর্ন)
– কেনো বলবো না? নিজে মাস্তি করতে পারো। আমি করলেই সেটা দোষ? (ইরা)
– চুপ.. একটা পুরুষ হাজারটা মেয়ের সাথে থাকতে পারে। কিন্তু একটা নারী সেটা পারবে না। (অর্ন)
– হাস্যকর, ভালোবাসা কখনো ভাগ হয়না অর্ন। প্লিজ, তোমার পায়ে পড়ি। আমাকে আমার মত করে থাকতে দাও। তোমার মত জঘন্য লোকের সাথে আমি কোনোভাবেই আর কথা বলতে চাইনা। (ইরা)
– বোঝার চেষ্টা করো, বিয়েটা আমি ইচ্ছে করে করতে চাইনি। (অর্ন)
– ইচ্ছে ছিল নাকি ছিলনা, সেটা দুরের ব্যাপার। বিয়ে করেছো মানে তুমি এখন অন্যের। আমি একা আছি, ভাবছো কষ্ট পাবো? না কষ্ট পাবো না। যে ছেলে ভালোবাসা নষ্ট করে অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারে, সে ছেলের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। সামনে থেকে যান আপনি। গেট লস… (ইরা)
– ইরা, ইরা… দেখো না আমার হাত কাঁটছে। কতখানি কাঁটছে জানো? দেখবানা? মনে আছে, একটুৃখানি কাঁটলে তুমি কতটা হাহাকার করতা… দেখো না ইরা। (অবনি)
– কি দেখবো? যা তোর বউকে দেখা। মর তুই। দুর হো সামনে থেকে।

ইরা ফোন কেঁটে দেয়। ব্যালকণি থেকে দৌড়ে নিজের রুমে এসে কাঁদতে থাকে ইরা। অর্ন ফোন গাড়ির ভিতর রেখে স্থির হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। সে বিড়বিড় করে বলে.. “আমি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো, তোমাকে না দেখা অবদি আমি যাচ্ছিনা।” অর্ন কষ্টের একটা হাসি দেয়। যে ইরা অর্নের জন্য কত কিছু ভাবছিল, সে ইরা অর্নের কাঁটা দেখলো না।
.
অবনি টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে বসে থাকে। চোখ দিয়ে বারিধারা যেন বর্ষণের ন্যায় পতিত হচ্ছে নিচের দিকে। এ অশ্রুজল যেন শেষ হবার নয়। নিঃশেষ হবেই বা কি করে। এ যে ভালোবাসায় সিক্ত, সুপ্ত বিচরন। অর্ন ভূল করে যার কল রিসিভ করেছিল প্রথমে, সেই কলটি ছিল অবনির। অর্ন ভেবেছিল, ইরা ফোন করেছে। এ জন্য সে অনেক কিছু শোনায়। আর সেগুলো সবটাই শুনেছে অবনি। ছয় মাস পর অবনিকে অর্ন ডিভোর্স দেবে। এ প্রণয় যেন শুধু আহতি নয় বরং নিহতি করে তুলছে অবনির। নতুন বউ যেমন হোক না কেনো, সে যদি নিজেই জানতে পারে তার বর বিয়ের পর অন্য মেয়ের জন্য কাঁদে, আবার ডিভোর্সের কথাও জানতে পারে। সে কতটুকু ঠিক থাকবে? তবুও অবনি নিজেকে সামলায়। কাউকে কিছু বুঝতে দেবে না ভেবে নেয়। অর্নের মা এসে দাঁড়ায় পাশে। চেয়ারে বসে, অবনির মাথায় হাত রাখলো। অবনির মাথা টেবিলে রাখা ছিল, তাড়াতাড়ি ওড়না দিয়ে চোখ মুছে নিল অবনি। অর্নের মা আরিনা বেগম বলে…

– কিরে মা. তুই কি এখনো না খেয়ে বসে আছিস? খেয়ে নে, সে মনে হয় ব্যস্ত।
– না মা সমস্যা নেই। আমি পরে খাবো। (অবনি)
– তাকা আমার দিকে। খেয়ে নে। (আরিনা বেগম)
– পরে খাবো। তোমাকে কি আবারো খেতে দেবো? বসো তাহলে তোমাকে খাইতে দিই। (অবনি)
– এহ, আমি কয়বার খাবো। থাক তোদের কারো খেতে হবেনা। এখনকার যুগে এমন ভালোবাসা দেখা যায়না। কেউ কারো জন্য না খেয়ে থাকে নাকি? আর তুই অর্ন ছাড়া খাবিইনা। থাক খেতে হবেনা। আমার আবার কি? এক বছর পর নাতি নাতনি হবে ওদেরকে সব গল্প শোনাবো। (আরিনা বেগম)
– হাহাহা.. ঠিক আছে মা, শুনিও।
– ওহ তোকে তো বলা হয়নি। আমাদের কাজের খালা আছে তার মেয়ের বিয়ে আজ রাতে, সেখানে যাবো সন্ধ্যায়। ভাবছিলাম তোকে নিয়ে যাবো। অর্ন এসে ঝামেলা করবে, তুই থাক। সকালের দিকে ফিরতে পারি। (আরিনা বেগম)
– আচ্ছা, চিন্তা করবানা। সব সামলে নিবো।

আরিনা বেগম চলে যায় সেখান থেকে। অবনি আবারো চুপিসারে কাঁদতে থাকে। আরিনা বেগমের কথা মনে করেই অবনি কাঁন্না থামাতে পারেনা। এক বছর পর নাতি নাতনির মুখ। অবনির কাছে কথাটা এখন হাস্যকর লাগছে। আরিনা বেগম তো জানেনা, তার ছেলে ছ মাস পরেই অবনিকে ডিভোর্স দেবে। যেটা অবনি জেনে গেছে। তবুও অবনি কাউকেই কিছু বললো না। সে খাবার টেবিলে বসে অর্নকে কল দেওয়া শুরু করে। কিন্তু অর্নের কানে এখন মোবাইলের রিংটোন এসে পৌছাচ্ছে না। সে ইরার নেশায় আসক্ত। বাকি সব কিছুতে সে বিরক্ত।
.
বিকেল গড়িয়ে রাত হয়। অর্ন গাড়ির সামনের ডিগিতে এসে বসেছে ঘন্টাখানিক আগে। পাশ দিয়ে একটা ভ্যান গাড়ি যাচ্ছিল। ভ্যানের সাথে ছোট্ট মাইক লাগানো। সেখান থেকে ভ্যানচালক গান শুনতে থাকে। সেই গান অর্নের কানে আসে।

“ও আমি পারি না… আর পারিনা…
আমি কেনো মরিনা..
আজরাইল কি চিনে না…….আমারে রে…?
আমি পারি না… আর পারিনা….”

অর্ন গানটা শুনে মুচকি হাসলো। সে কি করবে বুঝতে পারছে না। অবনিকে কোনো ভাবেই ওর মন মেনে নিচ্ছে না। মানবেই বা কি করে? ওর বন্ধুরা সবাই স্মার্ট, দেখতে বেশ। অর্নও সবার থেকে বেষ্ট। আর তার বউ হয়েছে কালো? এটা কি মেনে নেওয়া যায়? সময় বয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যা ছাঁড়িয়ে রাত। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে অর্ন। রাত এগারোটা বেজে গেছে। দুপুর থেকে সে এখানে ঠাই দাঁড়িয়ে আছে। ইরা আসেনি। ইরা সত্যিই একবারের জন্য অর্নকে দেখতে আসেনি। ইরা ভেবেছিল অর্ন হয়ত চলে গেছে। তাই সে বিছানা ছেঁড়ে উঠল। বাইরে উঁকি দিতেই দেখে অর্ন গাড়ির সামনের উপর শুয়ে আছে। ইরা আবারো বিছানায় যেয়ে বসলো। কি করবে বুঝতে পারছেনা। তবে এটা সে উপলব্ধি করতে পেরেছে, অর্ন অবনিকে বিয়ে করায় ইরা অর্নের প্রতি আগের মত টান অনুভব করছে না। হায়রে ভালোবাসা, একজন ভালোবাসার জন্য দুপুর থেকে লাগাতার ফোন দিয়ে যাচ্ছে, কখন অর্ন ফিরবে বলে অপেক্ষা করছে টেবিলের সামনে খাবার রেখে। আরেকজন দুপুর থেকে অন্যের জন্য গাড়ির উপর বসে আছে। কিন্তু ইরা… সেও তো ভালোবাসছিল। তাহলে এখন কি হল ওর? ভালোবাসা কি তাহলে শেষ? মুনিষীরা তো বলেছিলেন “প্রিয় মানুষ যদি পৃথিবীর সবচাইতে খারাপ হোক না কেনো, সে তোমার ভালোবাসা।”

অর্নের অনেক কষ্ট হতে থাকে। সারাদিন কিছু না খাওয়ার ফলে কেমন যেন ওর কাছে অন্ধকার লাগে। ইরার রুমের দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত স্বরে বললো “ইরা ভেবোনা, আমি চলে যাবো তোমার থেকে। আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি তোমারই ছিলাম, এখনো আছি। আজ যাচ্ছি, তবে আবার আসবো, রোজ আসবো।”

অর্ন গাড়ি স্টার্ট করে। ফোন হাতে নেয় ও। সাতশ বত্রিশটা কল। সবগুলোই অবনির নাম্বার থেকে। অর্ন ফোন চেক করে ভালোমত। সেখানে শুধু অবনিরই কল দেখতে পায়। এতক্ষণ ধরে ওর কোনো বন্ধুই ফোন করে খোজ নেয়নি। অর্ন অবাক হয়। বন্ধুদের জন্য কতকিছুই না করেছে সে। অথচ কেউ আজকে অর্নকে কল দিল না। অর্ন একটু মুচকি হাসলো। এরপর বাড়ির দিকে যেতে থাকে। ঠিকভাবে গাড়ি চালাতে পারেনা অর্ন। হাত কেঁটে গিয়েছিল অনেকখানি মদের বোতলে। এতক্ষণ মনেই হয়নি ব্যাথা, যন্ত্রনার কথা। গাড়ির স্ট্রাইং ধরতেই সে যন্ত্রনা আর অনেকটাই ব্যাথা অনুভব করে। কিন্তু ওর মনে যে ব্যাথা আর যন্ত্রনা হচ্ছে সেটা কেউ অনুভব করতে পারবে না।
.
অবনি ঘুমিয়ে পড়েছিল। সকাল থেকে বেশ অনেকটাই কাজ করেছিল অবনি। স্বামীর রুম পরিষ্কার থেকে শুরু করে, অর্নের কাঁপড় পরিষ্কার, অর্নের প্রিয় খাবার রান্না করে, প্লেট সাজিয়ে সবকিছু রেডি করেই টেবিলে এসে বসেছিল। বাড়িতে আজ কেউ নেই। অবনি আর টেবিল খেকে ওঠেনি। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল অবনি খেয়াল করেনি। হঠাৎ কলিংবেল বেঁজে ওঠে। অবনি লাফ দিয়ে চেয়ার ছেঁড়ে উঠল। দৌড়ে দরকার কাছে যাবে এমন সময় পা চেয়ারের সাথে বেধে পড়ে বড় রকমের হোঁচট খায় অবনি। পায়ের নখ যেন প্রায় উঠে যাওয়ার উপক্রম। অবনি আহ শব্দটুকুও করেনি। নিজেকে সামলে দরজার কাছে যেয়ে দাঁড়ায়। দরজা খুলে দিতেই দেখে অর্ন ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঢুলু ঢুলু চোখে অবনির দিকে তাকিয়ে আছে।

– দরজা খুলতে এত দেরি?

অর্ন ডান হাত দিয়ে ঠাস করে একটা চড় লাগিয়ে দেয় অবনির গালে। অবনি চিৎকার করেনি। কিন্তু অর্ন ঠিকিই চিৎকার করে ওঠে। হাতে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব হয়। অবনির গালে এতটুকুও চড় লাগেনি। কিন্তু অর্ন কেনো চিৎকার করলো সেটা না বুঝেই অবনি মুচকি হাসলো। অর্ন রেগে প্রশ্ন করে..

– কি ব্যাপার.. তোর হাসি পাচ্ছে?
– তুমি চড় দিয়েছো, আমার লাগেনি। জোরে মারোনি কেনো? (অবনি)
– আমার সামনে থেকে যা, দুর হো তুই। (অর্ন)
– এক মিনিট.. তোমার হাতে কি হয়েছে? রক্ত বের হচ্ছে? বিশ্বাস করো আমি মুখে কিছু দিইনি, যেটা তোমার হাতে লেগে কেঁটে যাবে। বিশ্বাস না হলে বাম হাত দিয়ে চড় মারো গালে, জোরে মারবা। দাঁড়াও আমি মারিয়ে নিচ্ছি।

অবনি পাগলের মত যেন ছটফট করতে থাকে অর্নের হাতে রক্ত দেখে। অর্নের বাম হাত ধরে গালের কাছে টেনে এনে কষে একটা চড় দেয়। অবনি আবার অর্নের হাত মেলে দেখে, বাম হাতে রক্ত নেই। অর্নের ডান হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে অবনি। এরপর দুই হাত দিয়ে অর্নের হাত আলতো করে ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে অবনি। অর্ন বোকার মত তাকিয়ে থাকে অবনির দিকে। মেয়েটার এমন পাগলামি দেখে অর্ন কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু এখন ওর মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয়না।

অবনি অর্নকে ধরে সোফাতে এনে বসায়। দৌড়ে রান্না করে যায় অবনি। স্যাভলন, তুলো মলম সবকিছু একসাথে নিয়ে আবারো দৌড়ে আসে অর্নের কাছে। অর্ন কেবল হা হয়েই অবনির ছোটাছুটি দেখছে। অবনি অর্নের পায়ের কাছে বসে। নিজের কোলে অর্নের হাত টেনে নিয়ে অনেক বেশি কেয়ার সহিত হাতে স্যাভলন লাগাতে থাকে। অর্ন যেন কেঁপে ওঠে। অবনি কাঁদতে কাঁদতে বলে..

– কিভাবে কাঁটছে তোমার হাতে? চারিদিকে কি করে কাঁটলো? একটু তো নিজের খেয়াল নিতে শেখো? ছোট বেলা থেকেই দেখে আসছি তুমি কেয়ারলেস। এমন করলে হবে? আজ যদি বড় কিছু হতো? তখন কে কষ্ট পেতো? বড়খালা মনি যে তোমাকে নিয়ে চিন্তা করে, দাদু যে তোমাকে নিয়ে ভাবে সেটা কি তুমি একটুও জানো?

অবনি কান্না থামায় না। অর্নকে কেয়ারের সাথে মিষ্টি বকা দিয়ে যাচ্ছে ও। আর অর্ন সোফাতে হেলান দিয়ে অবনির কান্ড হাবার মত হয়ে দেখতে থাকে। তারপর…

চলবে,,

প্রণয় পর্ব-০৩

0

#প্রণয়
#৩য় পর্ব
#Abir Hasan Niloy

অর্ন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। এতক্ষন সে বন্ধুদের সামনে অবনিকে নিয়ে অনেক কিছুই বলছিল। আর সেই অবনিকেই এখন ওর বিয়ে করতে হবে? অর্ন ওর বন্ধুদের দিকে তাকায়। বন্ধুরা ওর দিকে ইশারায় বিয়ে না করার সম্মতি জানালো। কিন্তু অর্নের যেন মুখ দিয়ে কথায় বের হচ্ছে না। শিহাব ইশারায় অর্নকে দৌড়াতে বলে। কিন্তু অর্ন যেন নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সেখানেই। শিহাব এগিয়ে আসে অর্নের মায়ের দিকে। অর্নের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে..

– আনটি.. অর্নের তো বিয়ের জন্য কোনো প্রস্তুতি নেই। হঠাৎ এভাবে বিয়েটা কি ঠিক হবে?
– ছেলেদের কিসেন প্রস্তুতি? অর্ন আমার আদরের ছেলে। ওকে আমি যা বলবো সে ওটাই শুনবে। ওর খারাপ চাইনা আমি। বড়ছেলের থেকে পাওয়া অপমান, সে সম্মানের সাথে ফিরিয়ে দেবে। (অর্নের মা)
– কিন্তু আনটি… অর্নের সময় দেওয়া উচিৎ। (মিহি)
– চুপ করো তোমরা। আমি জানি যে তোমরা এখনো বিয়ে করোনি। সে আগে করছে তাই এমন করছো? সমস্যা নেই। অর্নের ভালো আমি বুঝবো। বাবা… বাহিরে আসেন। আমাদের অর্নের সাথে অবনির বিয়ে দেবো। (আরিনা বেগম মানে অর্নের মা)

অর্নের চারপাশে বন্ধুরা ঘিরে দাঁড়ায়। অর্নকে বারবার বিয়ে না করার ইঙ্গিত দিতে থাকে ওরা। কিন্তু অর্ন স্থির হয়েই আছে। তার মনে এখন অনেকগুলো প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের দুটো উত্তর, অবনিকে ছেঁড়ে যাওয়া, না হয় বাড়ির মান সম্মান নষ্ট না করে তাকে বিয়ে করা। সে বুঝতে পারছে না কি করবে। ওর দাদু তাজুল সাহেব এগিয়ে আসে। দ্রুত হেঁটে অর্নকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন তিনি। অর্নকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে…

– কখনো ভাবিনি আনাফ এমন করবে। তোর বাবা চাচাদের ছোট থেকে কড়া শাষনে রেখেছি। কিন্তু কখনো স্বাধীনতা নষ্ট করিনি। সবাই আমাকে সম্মান করেছে। আনাফ এমন করে, আমার যে সম্মান ছিল এভাবে নষ্ট করবে, তা কল্পনাতেও ভাবিনি অর্ন। প্লিজ, আমাদের সম্মানটুকু রাখ। তোর জন্য আমি হাসতে পারবো। বল পারবিনা? (দাদু)
– পারবে, বাবা। আমাদের অর্ন সবার মত না। ঐ বিয়ের ব্যবস্থা করো। অর্ন স্টেজে ওঠ। (বাবা)

অর্নের বাবা এসে অর্নের হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে যায় অবনির পাশে। অর্ন এমনিতে সুন্দর। কালো পান্জাবি পরেছিল। বিয়ের টুপি এনে পরিয়ে দেওয়া হয় তার। অর্ন কোনো শব্দটুকুও করছে না। সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে। চোখের সামনে শুধু ইরার মুখটাই ভেসে উঠছে অর্নের। ইরার হাতে হাত রেখে সে এরাকম দিনের স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু আজ পাশে ইরা নেই। ইরার স্থানে আছে অন্য কেউ। যাকে অর্ন কোনোদিন সহ্য করেনি, কখনো তার মুখের দিকে তাকায়নি সে, বিশ্রি কালো দেখতে নিজের খালাতো বোনকেই অর্ন বিয়ে করতে যাচ্ছে। চোখের সামনে ইরার মুখ ভাঁসলেও, মাথার মধ্যে বাড়ির সম্মান, মা আর দাদুর বিশ্বাসটাই যেন ঘুরছে। শত অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অর্ন বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে। বন্ধুদের দিকেও তাকায়নি একবারো।

বিয়ের সব প্রসেস কম্পিলিট করা হয়। কাজী যখন অর্নকে কবুল বলতে বলে। তখন সে বন্ধুদের দিকে একবার তাকায়। তুর্জ তার ফোনে ইরার ছবি মেলে দুর থেকে অর্নকে দেখায়। অর্ন সাথে সাথেই মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে। চোখের পানি নিচের দিকে গড়িয়ে পড়তে থাকে। প্রথমবার কোনো ছেলে, বিয়ের সময় কবুল বলতে অনেকটা সময় নেয়। কবুল বলা মাধ্যমে বিয়ে কম্পিলিট। অর্ন তিনবার কবুল বলেই আসন ছেঁড়ে উঠে চলে আসে বাগানে। মানে এখন যেখানে অর্ন দাঁড়িয়ে আছে, এখানেই রাতে এসে দাঁড়ায়। রাতের শেষ সময়ে সে বাড়িতে প্রবেশ করে। কারো সাথে কথা বলেনি। ফোন অফ রেখে ওভাবেই গাছের নিচে বসে ছিল।

অর্ন ইরাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। ইরাও অর্নকে ভালোবাসে। দুজনে নতুন স্বপ্ন দেখেছিল, এক হবে। কিন্তু কোথা থেকে যে এমন কিছু ঘটে গেলো, কেউ বুঝে উঠতে পারেনি। অর্ন এখন ইরার নয়, অবনির হয়ে গেছে। কি একটা অদ্ভুত নিয়ম হয়েছে পৃথিবীর। যা, বা যাকে চাওয়া হয়, তাকে পাওয়াই হয়না। যাকে কখনো আপনি চাইবেন না, সেটাই পাওয়ার জন্য সুযোগ হবে অনেকবার। এ জন্য আমাদের উচিৎ, যাকে চাওয়া হবে বা যা চাওয়ার আগ্রহটা থাকবে সেটা কম করে চাইতে হবে। তাহলেই হয়ত পাওয়ার পথটা সহজ হয়ে উঠবে।

– অর্ন, বাহিরে কেনো? খেতে আয়। তোর জন্য খাবার রেডি করা আছে। (আরিনা বেগম)
– আচ্ছা।

অর্ন বাড়ির ভিতর চলে আসে। খাবার টেবিলে কেউ নেই। তবে খাবার সাজানো আছে। অর্ন টেবিলে বসে, মাংসের বাটির ঢাকনা তুলতেই নড়ার ফলে মাংসের ঝোল যেয়ে ওর সাদা টিশার্টে লাগে। অর্ন কিছুই বলেনা। সে খাবারের প্লেট সোজা করে। অবনি দৌড়ে চলে আসে সেখানে। কিছু না বলেই খাবার বেঁড়ে দিতে যায় অবনি। অর্ন রাগি গলায় বলে..

– আম্মাকে ডাক।
– মা, বাহিরেই আছে। তুমি তো বেঁড়ে খেতে পারো না। তাই বেঁড়ে দিতে এলাম। (অবনি)
– কি ব্যাপার, তুই আমাকে তুমি করে কেনো বলছিস? (অর্ন)
– বরকে, তুমি বা আপনি বলতে হয়। জানোনা এটা? আর এ কি? সাদা টিশার্টে মাংসের ঝোল, একটা কাজও ঠিকভাবে করতে পারোনা। আমাকে ডাকতে।

অবনি শাঁড়ির আঁচল দিয়ে টিশার্ট থেকে ঝোল মোছার জন্য হাত বাড়ায়। অর্ন সাথে সাথেই উঠে দাঁড়ালো। রাগি চোখে অবনির দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থাকে। এমনিতে কালকে রাতে কাছে আসার জন্য বারণ করেছে। কিন্তু অবনি সেটা মানছেই না। বারবার অর্নের কাছে চলে আসছে। যা অর্ন মোটেও গ্রহন করতে পারছে না। অবনি বলে..

– বসো, ঝোলটা পরিষ্কার করে দিই। নষ্ট হয়ে যাবে কাঁপড়।
– প্লিজ.. তুই আমার সামনে থেকে যা। (অর্ন)
– হুম যাবো, আগে বসো। ঠিকভাবে খাবার খাও। বেঁড়ে দিচ্ছি তো। যদি বলো, মাখিয়ে খাইয়ে দিই? (অবনি)

অর্ন তরকারীর বাটি হাতে তুলে নেয়। অবনির গায়ে তরকারী ঢেলে দিয়ে সেখান থেকে ভিতরে চলে আসে। ওয়াশ রুমে যেয়ে দরজা আটকে দেয়। পানির ঝরনা ছেঁড়ে দিয়ে কাঁদতে শুরু করে। ইরার স্মৃতি তাকে আরো কষ্ট দিচ্ছে। সে আনাফের বিয়েতে আসতে চাইছিল, কিন্তু আসতে পারেনি। সে আসলে হয়ত এমনটা হতো না। আবার বাড়ির সম্মান রাখতে অর্নও ইরাকে গ্রহন করতে পারতো না। কি করবে অর্ন? অবনিকে কিছুতেই মানতে পারছে না। যতবার অবনিকে দেখছে, ততবারই তার রাগ বেঁড়ে যাচ্ছে। বাড়ির কাজের ছেলেকে দিয়ে কাল রাতে ড্রিংকস আনিয়েছে। সেটা খেয়েই কষ্ট ভুলতে চেয়েছিল। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কি কষ্ট ভোলা যায়?

অবনির চোখে পানির রেখা। স্বামীর থেকে এত অবহেলা নির্যাতন পেয়ে জীবনে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই কার মরে যাচ্ছে। তবুও অবনি চুপচাপ। সে তরকারী বাটিটা গুছিয়ে টেবিলে রাখলো। তারপর সেখান থেকে চলে যায়। রুমে এসে কোমরে কাঁপড় পেঁচিয়ে, অর্নের জন্য শার্ট, কোর্ট ইস্ত্রী করে বিছানায় রাখলো। আঁতুরটাও সাজিয়ে রাখে ও। এরপর রুম থেকে বের হয়ে রান্না ঘরের দিকে যায় অবনি। অর্ন ওয়াশ রুম থেকে বের হয়। বিছানার উপর সুন্দরভাবে ওর ড্রেসগুলো সাজিয়ে রাখা। আগে ওর মা করতো। এখন কে করেছে সেটা অর্ন বুঝে যায়। এ জন্য কাঁপড়গুলো হাতে নিয়ে দরজার বাহিরে ছুঁড়ে মারতে যাচ্ছিল, তখনি অবনি এসে সেগুলো ক্যাচ ধরে।

– আমাকে তোমার পছন্দ না জানি। তবে এগুলো কি দোষ করেছে? (অবনি)
– জানিনা। (অর্ন)
– আমি দেখতে কালো বলে, এমন করছো? (অবনি)
– চুপ কর, তোর সাথে আমি কথা বলতে চাইনা। (অর্ন)
– অবহেলা করতে খুব মজা লাগছে? করো করো.. দেখি কত অবহেলা করো আমাকে। আমি সব সহ্য করবো। (অবনি)
– কেনো এমন করছিস? প্লিজ.. আমাকে আমার মত থাকতে দে। (অর্ন)
– আমি তো তোমার কিছু কেঁড়ে নিচ্ছিনা। (অবনি)
– আমার থেকে দুরে থাকবি। আমি এতকিছু জানিনা। (অর্ন)
– দুরেই তো ছিলাম। সৃষ্টিকর্তা কাছে এনে দিয়েছে। কখনো কাছে চাইনি। তিনি দিয়েছে। আমার কি দোষ? (অবনি)
– তোকে এক চড়ে…
– থামলে কেনো? চড় দাও। তোমার ভালোবাসা স্পর্শ না হয় না পেলাম। অবহেলা আর রাগের স্পর্শ তো পাচ্ছি।

অবনির দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অর্ন। এক ধাক্কা দিয়ে সামনে থেকে সরিয়ে দেয় তাকে। এরপর নিজের মত একটা শার্ট পরে অর্ন বাড়ি থেকে বের হয়। গাড়িতে যখন উঠতে যাবে, তখন অর্নের মা এসে বলে..

– অর্ন, তুই খুশি তো?
– হুম আম্মু। অনেক খুশি। কেনো কি হয়েছে? অবনি কিছু বলেছে তোমায়? (অর্ন)
– না না.. সে কি বলবে? সে তো তোকে পেয়ে আরো খুশি। মেয়েটাকে তো চিনিসই। ছোট থেকে কারো ভালোবাসা পায়নি। তুই একটু ভালোবাসা দিস, এতেই চলবে। আর বিয়ের পরের দিন গাড়ি নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস? অবনিকে সাথে নে। দাঁড়া ডেকে দিচ্ছি। (আরিনা বেগম)
– না আম্মু থাক, আমি এখনি চলে আসবো। ওকে বলেই বের হয়েছি। চিন্তা করোনা।

অর্ন তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বের হয়। ফোনটা অন করে ও। কয়েক মিনিট পরেই ফোন আসা শুরু করে। সবার নাম্বার থেকে কল আসলেও ইরার থেকে কোনো কল আসেনি। যে মেয়েটা প্রতি এক ঘন্টা পর পর অর্নকে ফোন দিয়ে জ্বালাতো, সে মেয়েটা এখন অর্নকে কল দিতেই যেন ভুলে গিয়েছে। অর্ন অনলাইন গ্রুপে মেসেজ করে, আড্ডার জায়গাতে সবাইকে আসতে বললো।
.
অবনি নিজের রুমে বসে আছে। নিজের বলতে অর্নের রুম এটা। বিছানা গোছাতে থাকে। ইস্ত্রি করা কাঁপড়গুলো সুন্দর করে ভাঁজ করলো ও। তারপর আলমারির ড্রয়ার খুলে রাখতে যাবে, তখনি কয়েকটা ছবি পায় অবনি। অর্নকে জড়িয়ে ধরে আছে একটি মেয়ে। যাকে কোনোদিন অবনি দেখেনি। অর্নের বন্ধুদের সাথে মেলানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ছবিগুলোতে অর্নের সাথে থাকা মেয়েটা অপরিচিত। মনে করার চেষ্টা করে অর্নের বলা রাতের কথাটা। মনে মনে বলে ‘এটাই কি তবে অর্নের ভালোবাসা? ইস কতই না সুন্দর মেয়েটা। আমি এত কালো কেনো? মেয়েটা দেখতেও তো অনেক সুইট। অর্নের সাথে কি সুন্দর মানিয়েছে। আমার সাথে মানাবে অর্নের? ধুর ওর পাশে দাঁড়ালেই তো বিশ্রি লাগবে। অর্ন ঠিক বলেছে, ওর থেকে দুরে থাকা উচিৎ। মানাবেই না আমাদের। কিন্তু আমার কষ্ট লাগছে কেনো? মেয়েটা অর্নের সাথে এভাবে কেনো আছে?’

“কি করছিস অবনি?” (আরিনা বেগম)

অবনি চমকে ওঠে। দরজার কাছে আরিনা বেগম এসে দাঁড়িয়েছে। তাড়াতাড়ি ছবিগুলো ড্রয়ারে রেখে দেয় ও। তারপর মাথায় কাঁপড় দিয়ে নিজের শ্বাশুড়ির সামনে যেয়ে দাঁড়ালো। অবনিকে দেখে তিনি হাসলেন।

– ভিতরে আসবো?
– এটা কি বলো মা? ভিতরে আসবা অনুমুতি নিচ্ছো কেনো? (অবনি)
– হুম, কি করছিলি? (মা)
– রুম গুছিয়ে রাখছিলাম। তোমার ছেলে এত অগোছালো। উফ তুমি বকা দাওনি কেন এতদিন? (অবনি)
– এই যে তোর মত একটা ভালো মেয়ে এসে আমার অগোছালো ছেলেটাকে শাষণ করবে। গুছিয়ে দেবে তো তাই করিনি। (অর্নের মা)
– হুম, চিন্তা করোনা। (অবনি)
– বলছি, তুই হ্যাপি তো? অর্ন একটু রাগি, আর জেদি। অনেক কিছু সামনে বলে ফেলে রাগ উঠলে। কিছু মনে করিস না। (অর্নের মা)
– কি যে বলো তুমি। আমি তো ছোট থেকেই চিনি। চিন্তা করো না। সব ঠিক আছে।

অর্নের মা হাসি মুখে রুম থেকে বের হতে যাচ্ছিল। এমন সময় অবনির বুক থেকে শাঁড়িটা একটু সরে যায়। তখনি একটা ক্ষতের চিহ্ন টের পান তিনি। সাথে সাথেই প্রশ্ন করে..

– তোর বুকের উপর ওটা কিসের দাগ?
– ক..কই কিসের দাগ? (অবনি)
– দেখলাম আমি। (অর্নের মা)
– আরে না। সকালে চুলা থেকে ভাত নামানোর সময় একটু কাঁপড়ে আগুন লেগে যায়। তোমার ছেলে মলম দিয়ে গেছে। জানো তোমার ছেলে আমাকে কত কেয়ার করে। (অবনি)
– আচ্ছা বুঝলাম, সাবধানে থাকিস।

উনি চলে যায়। অবনি তাড়াতাড়ি দরজা আটকে দিয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো। কাঁপড় সরিয়ে বুকের ক্ষত দেখতে থাকে। সিগারেটের আগুন চেপে ধরেছিল অর্ন এখানে। সেটার একটা বিশাল দাগ পড়ে গেছে। অর্নের মাকে মিথ্যে বলেছে। সে মোটেও ভালো নেই। কেঁদে ওঠে অবনি। এ কান্নায় কোনো শব্দ নেই। আছে কেবল তিক্ত নাক টানার হিস হিস শব্দ।
.
অর্ন বসে আছে। প্রতিদিন এই ক্লাবে বসে ওরা আড্ডা দেয়। অর্ন আজকে অসময়ে এসেছে। কিছু সময় পর তার বন্ধুগুলো একসাথে চলে আসে ক্লাবে। অর্নকে টেবিলে বসে থাকতে দেখলো। টেবিলের উপর কতগুলো ড্রিংকসের বোতল। অর্ন মাথা নিচু করে আছে। শিহাব বললো..

– কি মামা… বাসর রাত কেমন কাঁটালে?
– দোস্ত, বিড়াল কয়বার মারছিলি? (তুর্জ)
– তবে কি, তোর সাথে অবনি কখনো যায়না। দেখতে তো ভালোই না, কথা বলা, চলাফেরা সবকিছুর দিক দিয়ে সে ক্ষ্যাত। (সিমি)
– ক্ষ্যাতের ডিব্বা। অর্ন যে তুই সত্যিই বিয়ে করবি তাও আবার অবনিকে, আহা এটা কোনোদিনও আমরা ভাবিনি। (খেয়া)
– আমিও তো কখনো এমন কিছু ভাবিনি। কিন্তু অবনিকে বিয়ে করতে হলো। সমস্যা নেই। ইরাকে ভালোবাসি আমি। ইরা কো****

অর্ন থেমে যায়। ক্লাবের দরজার দিকে তাকালো ও। সাফিন নামের একটি ছেলের সাথে ইরা হাসতে হাসতে ক্লাবে ঢুকছে। অর্ন বসা থেকে উঠতে যায়। শিহার হাত চেপে ধরে বলে..

– কোথায় যাচ্ছিস? ইরার কাছে? কেনো যাচ্ছিস? বিয়ে হয়েছে না তোর? তাহলে?
– ইরাকে সাফিনের সাথে আমি মিশতে বারণ করেছিলাম। তবুও কেনো সে সাফিনের সাথে এখানে এসেছে। ছাঁড় আমার।

অর্ন ঝাড়ি দিয়ে ইরাদের টেবিলের সামনে যায়। ইরা সাফিনের হাত ধরে বসে আছে। অর্ন যেয়ে সোজা ইরার হাত ধরে। ইরা ঝটকা দিয়ে হাত ছাঁড়িয়ে নিতে নিতে বলে..

– আরে, কে আপনি? অভদ্রের মত অপরিচিত কারোর হাত ধরছেন? কি সমস্যা হা? (ইরা)
– ইরা, শোনো, আমি তোমাকে সবটা বুঝিয়ে বলছি। আমি… (অর্ন)
– কে আপনি? আমার নাম জানেন কি করে? (ইরা)
– ইরা প্লিজ.. আমার সাথে চলো। আমি তোমাকে সব বুঝিয়ে বলবো। (অর্ন)
– এ হ্যালো.. ইরার হাত ছাঁড়। কে তুই? ইরা না তোকে চিনেনা বললো? তাহলে ওর হাত ধরে আছিস কেনো? (সাফিন)
– ইরা, চলো আমার সাথে। আমি কিছুই করিনি। আমি তোমারই আছি। বিশ্বাস করো আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি। (অর্ন)
– শাট আপ.. আমার হাত ছাঁড়েন। আমি আপনাকে চিনিনা। (ইরা)
– হাত ছাঁড়বো না। আগে আমার সব কথা তোমার শুনতে হবে। (অর্ন)
– হাত ছাঁড় শালা..

সাফিন কথাটা বলে অর্নকে জোরে একটা ধাক্কা দেয়। অর্ন কিছুটা সরে গেলো পিছনের দিকে। অর্ন এগিয়ে আসে আবার। ইরার দিকে তাকিয়ে বলে..

– তোমাকে বারণ করেছিলাম, এই বেয়াদব ছেলে থেকে দুরে থাকতে। তুমি তো জানোই সে কতটা খারাপ। তারপরও কেনো তুমি ওর সাথে মিশছো? আমাকে তো কিছু বলার সুযোগ দাও। এক রাতেই এত পরিবর্তন? ভালোবাসতে না আমাকে তুমি? (অর্ন)
– ভালো তো আপনিও বাসতেন, কি হল? সেই তো অন্যকে বিয়ে করেছেন। আপনি রাত কাঁটাতে পারেন, আমি হাত ধরে ঘুরলেই দোষ? আপনি সারারাত মজা নিয়েছেন, আর আমি একটু মিশলেই দোষ?

ইরার কথা শেষ হতেই অর্ন কষে একটা চড় বসিয়ে দেয় ইরার গালে। ইরার গালে চড় দিতেই সাফিন এগিয়ে আসে সামনে। অর্নের গালে একটা ঘুসি দেয়। অর্ন টেবিল থেকে ড্রিংকসের বোতল তুলে সেটা ভেঙে ধারালো অস্ত্র বানিয়ে সাফিনের দিতে এগিয়ে আসতেই, বন্ধুরা ওকে জাপটে ধরে। অর্ন চিৎকার করে বলতে থাকে…

– আমার আর ইরার মাঝে যেই আসুক, আমি তাকে মেরে ফেলবো না হয় কখনো গ্রহন করবো না। ইরা বিশ্বাস করো, আমি অবনিকে স্পর্শও করিনি। ভালোবাসি আমি তোমাকে। তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে আমি কল্পনা করতে পারবো না। ইরা বোঝার চেষ্টা করো, আমি শুধু তোমার। আর তুমিও আমার। মাঝে খানে যে তোমাকে নিতে আসবে, আমি তাকে মেরে ফেলবো। ইরা….

অর্নকে টানতে টানতে বন্ধুরা ক্লাব থেকে বের করে নিয়ে যায়। সাফিন ইরার সামনে আসে। ইরার চোখে পানি টলমল করছে। সাফিন ইরার হাত ধরতে যাচ্ছিল। ইরা তার ভ্যানিটি ব্যাগ হাতে নিয়ে হনহন করে সেখান থেকে বের হয়ে যায়। অর্নকে বন্ধুরা গাড়িতে করে ক্লাব থেকে ততক্ষণে নিয়ে চলে আসে। তারপর…

চলবে,,

প্রণয় পর্ব-০২

0

#প্রণয়
#২য় পর্ব
#Abir Hasan Niloy

অবনি গোসল শেষ করে নিজের রুমের দিকে ফিরছিল। হঠাৎ ভেঁজা কাপড়টা ওর বুক থেকে সরে যায়। সে কাপড়টা গায়ে জড়িয়ে নেওয়ার জন্য নিচু হয়েছিল। আর তখনি আনাফ অবনির এমন দেহের সৌন্দর্য খুব কাছ থেকে দেখে নেয়। অবনি কাঁপড় টা তুলে ঠিক করতে করতে সামনে তাকিয়ে দেখে আনাফ হা করে অবনির ভেঁজা দেহের দিকে তাকিয়ে আছে। অবনি আনাফকে বলে…

– আনাফ ভাই, এভাবে কি দেখছো?
– দেখছি তোর জিনিসগুলো। (আনাফ)
– মানে?(অবনি)
– না মানে কিছু না। কোথায় যাচ্ছিস? (আনাফ)
– রুমে। চেন্জ করবো। (অবনি)
– ওহ আচ্ছা।

আনাফ আর কথা বাড়ায় না। অবনিও চুপচাপ নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। আনাফ আজ প্রথমবার অবনির দিকে এভাবে লোভাতুরের ন্যায় তাকিয়েছে। যেটা এর আগে কখনো হয়নি। আনাফ ফিরে আসছিল। কিন্তু মাথার মধ্যে অবনির ভাবনা। সাথে চোখের সামনে এখনো যেন অবনির শরীরের খাঁজ ভাসতে থাকে। সে নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারেনা। অবনির রুমের দিকে এগিয়ে যায়। অবনির রুমে কেউ কোনোদিন আসেনি। কারন অবনি এমনিতে কালো রঙ এর মেয়ে। তাই সবাই নিজ দায়িত্বে ওর থেকে দুরে থাকে। সে জন্য ড্রেস চেন্জ করার সময় দরজা হালকা খুলে রেখে রুমে এসে দাঁড়ায়। গা থেকে জামাটা সরাতেই অবনি দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেলো। অবনি ঘুরে তাকাতেই দেখে আনাফ দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি তোয়ালের সাথে নিজেকে পেঁচিয়ে ভয় আর লজ্জাবোধ নিয়ে বললো..

– আ..আনাফ ভাই তু…তুমি এখানে?
– হুমম। (আনাফ)
– কেনো এসেছো? (অবনি)
– তোকে দেখতে। (আনাফ)
– মানে? (অবনি)
– শোন.. তুই তো এমনিতে কালো দেখতে। কোনো ছেলে তোর কাছে আসবে না। তাই ফ্রিতে যদি আমি তোকে সার্ভিস দিই, তাহলে মজা পাবি বুঝেছিস? (আনাফ)
– কি বলেন আপনি? (অবনি)
– আহ, ন্যাকামি করিস কেনো? সরা কাঁপড়..

আনাফ এগিয়ে এসে অবনির হাত থেকে তোয়ালে টেনে খোলার চেষ্টা করে। অবনি আর নিজেকে সামলাতে পারেনা। ঠাস করে খুব জোরে অবনি, আনাফের গালে কষে চড় লাগিয়ে দেয়। আনাফ চড় খেয়ে অবনির দিকে ক্রোধের দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে কয়েক সেকেন্ড। আনাফ হিংস্র হয়ে যায় যেন। অবনির হাত শক্ত করে ধরে। অবনির দিকে তাকিয়ে বলে….

– শালী মা*** তোকে আমি আজকে…
– আমাকে ছেঁড়ে দাও। কে কোথায় আছো? আমাকে বাঁচাও… কেউ আসো…

অবনির এমন সরল আর জোর চিৎকার পুরো বাড়ির আনাচে কানাচে ছড়িয়ে যায়। বাড়িতে উপস্থিত মানুষের কান অবদি পৌছে। কেউ এক মুহুর্ত দেরি করে না, অবনির ঘরে আসতে। আর এসেই দেখে অবনির গায়ে আধাখোলা কাপড়, বাকি অংশ আনাফের হাতে। আনাফের মা এসে ঠাস ঠাস করে আনাফের গালে চড় বসিয়ে দেয়। অবনি তার বড় খালাকে জড়িয়ে ধরে। সবাই আনাফের দিকেই তাকিয়ে আছে। দাদু এগিয়ে এসে বলে..

– ছিহ, আনাফ.. শেষে কিনা তুই এমন করলি? এটা অন্যায়।
– দাদু, আমি আসলে… (আনাফ)
– চুপ কর তুই। তোকে ছেলে বলে ডাকতেই আমার লজ্জা করছে। কত ভালো একটা মেয়ে। আর তুই কিনা শেষ মেশ.. ছিহ আনাফ। লজ্জায় আমার… (আনাফের মা)
– কেউ কিছু বলবে না আনাফকে। ও যা করেছে, তার শাস্তি ওর পেতেই হবে। (দাদু)
– কি শাস্তি? ওর মুখটাও দেখতে চাইনা আমি। (মা)
– অবনির সাথেই ওর আগামী তিনদিনের মধ্যে বিয়ে দেবো। তাহলে সব ঠিক হবে। (দাদু)
– কিন্তু আমি অবনিকে বিয়ে…. (আনাফ)
– কি বললি তুই? তোকে আমি… (আনাফের মা)
– বউমা.. আমার সিদ্ধান্ত নড়চড় হবেনা। আনাফকে বিয়ে করতেই হবে অবনিকে। এটাই শেষ কথা। সবাই চলো এখন, আর ঘটনা যেন না ছড়ায়। বাড়ির খবর, যেন বাড়িতেই থাকে।

আনাফের দাদু মি. তাজুল সাহেব কথাটা বলে রুম থেকে বের হলেন। সবাই এক এক করে রুম থেকে বের হয়। আনাফ বের হওয়ার আগে অবনির দিকে তাকিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করে ‘তুই কাজটা ঠিক করলিনা। তোর কপালে খারাপ কিছু আছেই। এ বিয়ে আমি করছিনা।’ অবনিকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নেয় তার বড় খালামনি মানে আনাফের মা। অবনির কালো মুখে চোখের বারিধারা যেন সাদা পাথরের মত নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ছে। দুই হাত দিয়ে পানি মুছে দিয়ে ড্রেস এনে দেয় তাকে।

– কাঁদিস না। আমার ছেলে এমন কিছু করবে আমি ভাবতেই পারিনি। ও যে আমাকে কষ্ট দিয়েছে, আমি কখনো ভুলবো না। আমার ছেলেটাকে মাফ করে দে মা। তোর মাকে কি জবাব দেবো আমি বুঝতে পারছিনা। (আনাফের মা, আরিনা বেগম)
– না খালাআম্মু, তুমি কেনো মাফ চাচ্ছো? ঠিক আছি আমি। আর চিন্তা নেই, কেউ কিছু জানবে না। তোমার সম্মান নষ্ট হয় এরপর আর কোনো কাজ আমি করবো না। (অবনি)
– চিন্তা করিস না, তোর বিয়ে আনাফের সাথেই দেবো। তুই কষ্ট পাবি সারাজীবন এটা হতে দেবো না। ও একটু বদ, তবে আমি জানি তুই তাকে ঠিক করে নিতে পারবি। (আরিনা বেগম)
– আচ্ছা খালামনি।

অবনি যেন নিস্তব্ধ হয়ে যায়। এই বাড়ির মানুষ কে কেমন বিহেভ করে সেটা অবনি জানে। তবে সবার থেকে বেশি ভালোবাসে আরিনা বেগম। আর তিনি কষ্ট পাবে এমন কিছু কখনো অবনি করেনি। অবনি ভাবনা থেকে বের হয়। অর্নের দিকে তাকায়। অর্ন কপালের উপর হাত রেখে ঘুমাচ্ছে। অর্ন একটু নড়ে উঠল। নিজেকে আটোসাটো করে গুটিয়ে নিল। বোঝা যাচ্ছে, অর্নের শীত লাগছে অনেক। অবনি বিছানা ছেঁড়ে উঠল। রাত প্রায় শেষের দিকে। ফজরের আযানের জন্য আগে থেকে মসজিদের মাইকে সূরা, গজল পাঠ করছে মসজিদের মোয়াজ্জিনেরা। আযান দেবে একটু পরেই। অবনি বিছানা থেকে একটি কাঁধা নিয়ে অর্নের কাছে এসে দাঁড়ায়। অর্নের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে বেশ কিছু সময়। অর্নকে এমনিতে মনে মনে সে পছন্দ করতো। কিন্তু কখনো অর্নকে নিজের জন্য চায়নি অবনি। তবুও তাকে না চাওয়া শর্তেও বর হিসেবে পেয়েছে। কথায় আছে না, যা চাওয়া হয় তা পায়না মানুষ। আবার যা চায়না, সেটাই কাকতালীয়ভাবে নিজের কাছে চলে আসে।

অর্নের গায়ে কাঁথা জড়িয়ে দেয় অবনি। অর্ন কাঁথা পেয়ে গায়ে জড়িয়ে নিতে থাকে ঘুমের ঘোরে। আর ঘুমের ঘোরেই অর্ন অবনির হাত জড়িয়ে নেয়। অবনি চমকে ওঠে। হাত ছাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই অর্ন যেন আরো শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরে। অবনি হাঁটু ভাঁজ করে সোফার উপর বসে। অর্নের মাথায় চুলে হাত ডুবিয়ে দেয়। একজন নারীর কাছে সবচাইতে মূল্যবান জিনিস হলো তার প্রিয় স্বামী। প্রিয় নবী (স) নিজেই বলেছেন আল্লাহ ব্যতীত যদি কাউকে সিজদাহ করা যেতো তাহলে স্বামীকেই করা যেতো। অবনির মধ্যে অর্নের জন্য যে সম্মান, তা কেবল তাকে কাছে পাওয়ার নয়, এটা ভালোবাসার। অর্নের চুলে হাত বোলাতে বোলাতে কখন যে অবনি ঘুমিয়ে পড়ে খেয়ালই করেনি সে।
.
অর্নের ঘুম ভাঙে। জানালা থেকে রোদ ওর মুখে এসে পড়ছে। জানালা খোলায় ছিল। অর্নের কখনো এত তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙেনা। সে বিরক্ত হয়ে উঠতেই যাবে, অনুভব করে ওর গায়ে কাঁথা, সাথে আরো ভারী কিছু ওর বুকের উপর অনুভৃত হয়। অর্ন চোখ মেলে তাকালো। অবনি ওকে জড়িয়ে ধরে, বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। অর্নের মেজাজ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই রাগের চরম পর্যায় পৌছে যায়। কারন রাতেই অর্ন অবনিকে বেশ কড়া গলাতে জানিয়েছিল ‘তুই আমার থেকে সবসময় দুরে থাকবি। তোর মুখ আমাকে দেখাবিনা।’ এমন কড়া নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও অবনি অর্নকে জড়িয়ে ধরে থাকার যে দুঃসাহস দেখিয়েছে, এটা কল্পনা করেই অর্ন নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারছে না। সে অবনিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। অবনি ফ্লোরে পড়তেই ওর কনুইতে প্রচন্ড ব্যাথা লাগে। অবনি ঘুমের ঘোরে ছিল। এমনকে ধাক্কা লেগে নিচে পড়তেই সে প্রথমে বুঝতে পারেনি, এতক্ষণ কোথায় ছিল। সে হাতে ব্যাথা নিয়ে সামনে তাকায়। অর্ন বসে আছে।

– তোকে রাতেই বলেছিলাম আমার কাছে আসবি না। আমার থেকে দুরে থাকবি, এটাও বলেছিলাম। অথচ তুই তোর সাহস ছাঁড়িয়ে আমার কাছে নয়, আমার বুকের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়েছিস।

অর্ন কথাটা বলে অবনির দিকে এগিয়ে আসে। অবনির চোট পাওয়া হাত ধরে হেঁচকা টান দেয়। অবনি ও মা গো কেঁদে ওঠে। অর্ন এমন বিহেভ কেনো করছে সেটা অবনি এখনো ঠিকমত বুঝতে পারছেনা। অবনিকে সামনে এনে, ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দেয় অর্ন। অবনি ঠাই দাঁড়িয়ে আছে। অর্ন বলে..

– তোকে আমার সহ্য হয়না এটা কেনো বুঝিস না? তোকে দেখলেই আমি বিরক্ত হই। কেনো কাছে আসিস আমার? আমি কি তোকে চেয়েছিলাম? কেনো এমন হল আমার সাথে? আমি তো তোকে চাইনি। তাহলে কেনো আমার কাছে তুই এসেছিস? তুই জানিস, আমার এক হাত দুরুত্বে কোনো মেয়ে আসার সাহস করেনা। আর তুই আমার বুকে মাথা রেখে সারারাত ঘুমিয়েছিলি।
– আমি তোর বউ এখন। আমার তো অধিকার আছে তোর কাছে যাওয়ার। (অবনি)
– কিসের অধিকার? মন থেকে না মানা অবদি কখনো অধিকার খাটানো যায়না। সবকিছু তোর জন্য শেষ হয়ে গেছে। আমার ইচ্ছে, আমার ভালোবাসা সব, সব শেষ। আমি নিজেই শেষ হয়ে গিয়েছি।

অর্ন কাঁদতে কাঁদতে রুম থেকে বের হলো। অবনিও কাঁদতে থাকে। চেয়েছিল অর্নকে নিজের কাছে, তবে সেটা কল্পনায়। কিন্তু উপরওয়ালা অর্নকে ঠিকিই এনে দিয়েছে বাস্তবে। তবুও যেন শত অপূর্ণতা। এই অপূর্ণতার বেড়াজালে দুটো মানুষ কষ্টে বিভোর হয়ে যাচ্ছে। অবনি ড্রেস পাল্টে নেয়। শাঁড়ি ছেঁড়ে সালোয়ার কামিজ পরেছে। আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো ও। নিজের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো অবনি। ওর ডান গালে টোল পড়ে কথা বললে। ঠোঁটের নিচেও একটা তিল আছে। এসব দেখেই ও হাসছে। বিড় বিড় করে অবনি বলে ‘কালো মেয়ের আবার কিসের টোল পড়া গাল, কিসের কালো তীল? সবই বিলাসিতা ছাড়া কিছুই নয়।’

অর্ন বাড়ির উঠানে এসে দাঁড়ালো। খুব করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে ওর। অবনি আর অর্ন প্রায় সেম বয়েসের। অর্নের থেকে এক বছরের ছোট অবনি। অর্ন যদি ক্লাস টু তে পড়তো, অবনি পড়তো ওয়ানে। তবে ছোট থেকেই একসাথে ওদের বেড়ে ওঠা। অর্ন জানতো না, আনাফের সাথে অবনির কেনো বিয়ে হচ্ছে। কে ও সময়ে বাড়িতে ছিল না। আর দাদুর কড়া বারনে বাড়ির লোক ছাড়া কেউ কিছুই তেমন জানেনা। কিন্তু বিয়ে হবে ভেবে অনেক আত্বীয় ঠিকই দাওয়াত করানো হয়। অর্নও তার একগাদা বন্ধুদের দাওয়াত করে আনে তার বড় ভাইয়ের বিয়েতে।

অবনি বউ সেজে বসেছিল। অর্নের বন্ধুরা ভেবেছিল, আনাফের বউ হবে অনেক সুন্দরী। কারন আনাফ ভাই দেখতে বেশ স্মার্ট ছিল। আর আনাফ ভাই কখনো এমন কালো মেয়েকে বিয়ে করবে না। কিন্তু বিয়ে বাড়িতে এসে দেখে অবনির সাথে আনাফ ভাইয়ের বিয়ে হচ্ছে, অর্ন ছাড়া বাকি সবাই অবাক হয়ে যায়। অর্নের কানে কানে সিমি এসে বলে..

– দোস্ত, তোর ভাইয়ের কি চয়েজ রে। দেশে আর মেয়ে পেলো না। আমাকে অফার করতি, তোর ভাবি হতাম। আমি কি দেখতে খুব খারাপ নাকি? (সিমি)
– ভাইয়া নিজে থেকে বিয়ে করছে না। তাকে দাদুর কথা মত বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। (অর্ন)
– এটা বিয়ে না, কুরবানী বলে। আমি হলে বিষ খেয়ে মরে যেতাম। (তুর্জ)
– কেনো, অবনি কি খারাপ মেয়ে নাকি? একটু কালো। তবে ভালো মেয়ে। (অর্ন)
– আহারে বাবুটা.. এত অবনিে প্রশংসা করছো, তুমি যাও বিয়ে করো তাকে। (মিহি)
– এহ, আমি কেনো ওকে বিয়ে করবো। মেয়ে হিসেবে ভালো, তবে আমার বউ হিসেবে সে যোগ্যতা রাখে না। ওকে নিয়ে কল্পনাতেও কোনোদিন হাত ধরে হাঁটিনি। ছোট থেকে ওর সাথে রয়েছি। কখনো নিজ থেকে ওর হাত অবদি ধরিনি আমি। সাথে থাকা একটা ছেলে একটা মেয়ের প্রতি ভূল করেও একবার না একবার রোমান্টিক কল্পনা করে, কিন্তু আমিই প্রথম কোনো মানুষ, যে কিনা অবনিকে নিয়ে কোনোদিন কল্পনা করিনি। আর কি ভেবে কল্পনা করবো। চেহারাটা মনে পড়লেই তো সব বোরিং লাগতো। (অর্ন)
– হাহাহাহা… এটা ঠিক বলেছিস। অবনি মেয়ে ভালো তবে কারো বউ বা গার্লফ্রেন্ড হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। মিহি তুই যে কি বলিস, কোথায় আমাদের অর্ন, আর কোথায় কালো মেয়ে অবনি। আকাশ পাতাল তফাত বুঝিস? আপাতত বিয়ে খেতে আসছিস খা। (শিহাব)
– ঐ তোরা এখানে কি করিস? ওদিকে কি হয়েছে শুনেছিস? (খেয়া)

খেয়ার কথা শুনে সবাই তার দিকে কিছুটা কৌতুহলি দৃষ্টিতে তাকালো। বাড়ির ভিতর থেকে একটু চিৎকার চেঁচামেঁচি শোনা যাচ্ছে। তবে সবচাইতে বেশি যার চিৎকার শোনা যাচ্ছে সে হল তাজুল সাহেব। মানে অর্নদের দাদু। খেয়াকে প্রশ্ন করে শিহাব ‘কি হয়েছে? তুই না ভিতরে ছিলি? দাদু এভাবে বকছে কেনো?’ খেয়া জানায় “তোরা চল ভিতরে, বিয়েতে এসে তোরা অনুষ্ঠানে না থেকে বাড়ির বাহিরে এসে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিস। চল চল.. তোরা শুনবি কি হয়েছে।”

খেয়ার কথা শুনে, ওরা সবাই দৌড়ে ভিতরে আসে। অবনি বিয়ের পিঁড়িতে বসে আছে। সবাই নিরব, আর গম্ভীর হয়ে আছে। বরের আসনে তাজুল সাহেব বসা। অর্ন তার ভাই আনাফকে খুজছে। কিন্তু আনাফকে দেখা যাচ্ছে না। অর্ন গুটি গুটি পায়ে হেঁটে ওর মায়ের কাছে আসলো। আস্তে গলায় বললো..

– দাদু চিৎকার করছিল কেনো? কি হয়েছে? আর ভাইয়া কোথায়? (অর্ন)
– তোর কোনো ভাই নেই। ওর কথা কখনো আমার সামনে বলবি না। (অর্নের মা)
– কিন্তু কি হয়েছে? দাদু এমন ভাবে বসে আছে কেনো? (অর্ন)
– আনাফ যেন কখনো এ বাড়িতে আর না আসে। তাকে এ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলাম। কেউ যদি কখনো যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে, সে এই বাড়ি ছেড়ে যেনো চলে যায়।

তাজুল সাহেব কথাটা বলে বসা থেকে উঠে সেখান থেকে চলে যায়। অর্ন তার ছোট খালার সামনে এসে দাঁড়ালো। অর্ন যেন এখনো কিছুই বুঝতে পারছে না। তার খালার দিকে তাকিয়ে অর্ন জিজ্ঞাসা করলো..

– কি হয়েছে ছোট খালা? দাদু এভাবে কি বলে গেলো? (অর্ন)
– কি আর হবে, তোর ভাই আমার মেয়েকে বিয়ে করবে না, তাই পালিয়ে গেছে। কাগজে লিখে গেছে, ‘অবনির মত একটা মেয়েকে আমি কোনোদিন বিয়ে করবো না, তাই পালিয়ে যাচ্ছি।’ ঠিক করেছে। এমন বাজে দেখতে মেয়েকে কে বিয়ে করবে? ওর বাপ তো কালো না, আমিও তো কালো না। তাহলে ও কেনো কালো হলো? হওয়ার পর যদি ওরে গলা টিপে মেরে ফেলতে পারতাম, তাহলে আজ এই দিনটা দেখতে হতো না। এমনিতে সে কালো একটা মেয়ে, তার উপর বিয়ের আসর থেকে ছেলে নিজেই পালিয়ে গেছে। এখন তো কেউ ওকে ভৃলেও বিয়ে করবে না। বেঁচে আছে কেনো সে, মরে যেতে পারে না?

ছোট খালামনির কথা শুনে অর্ন নিজেই চুপ হয়ে গেছে। ও কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। এলাকার লোকজনও অবনিকে নিয়ে তার মায়ের মত করেই কথা শোনাচ্ছে। অর্ন ছোট আনটির থেকে চলে আসবে, তখন ওর মা এসে পাশে দাঁড়ায়। নিজের ছোট বোনের হাত ধরে বলে..

– তোকে না বলেছি অবনিকে কখনো কিছু বলবিনা? তোকে এখানে কে আসতে বলেছে? আর ওর বিয়ে হবেনা মানে? ওর জন্য রাজপুত্র আনবো আমি। রাজপুত্র বিয়ে করবে আমাদের অবনিকে। (অর্নের মা)
– কি বলিস আপা, হাসি পাচ্ছে। ওর মত বাজে দেখতে মেয়েকে কোনো রাজপুত্র না, মুচির ছেলেও বিয়ে করবে না। অসহ্য নিজের কাছেই লাগে, অন্য কোনো ছেলে কিভাবে তাকে সহ্য করবে? কি দেখে ওকে বিয়ে করবে? দাঁত, হাতের তলা ছাঁড়া অবনির কোনো সুন্দর জায়গা নেই। বলতেও কষ্ট লাগে, এটাই সত্য। আবার নাকি তাকে বিয়ে করবে কোনো রাজপুত্র। তা সেই রাজপুত্রটা কে? (অবনির মা)
– কে আবার, আমার এক ছেলে আমাদের অপমান করেছে, আরেক ছেলে করবে না। সেই রাজপুত্র আমার অর্ন। আমি অর্নের সাথেই অবনিকে বিয়ে দেবো। এবার খুশি তো তুই? অর্ন আমার কাছে রাজপুত্র বুঝেছিস? আনাফের মত না সে। সে জানে মাকে, পরিবারকে কিভাবে সম্মান করতে হয়। আমার অর্নের সাথে অবনির বিয়ে ঠিক এই মূহুর্তে এই আসরেই বিয়ে দেবো। অর্ন, তুই তো অবনিকে বিয়ে করবি তাই না?

অর্ন যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। ওর চারপাশ যেন থমকে গেছে। অবনিও হা করে তাকিয়ে থাকে এদিকে। অর্ন যেন নিজের কানকে বিশ্বাসই করতে পারছে না, অবনিকে বিয়ের কথাটা শুনে। তারপর..

চলবে,,

প্রণয় পর্ব-০১

0

#প্রণয়
#১ম পর্ব
#Abir Hasan Niloy

….
অর্ন রেড ওয়াইনের বোতলে তার নরম ঠোঁট রেখে, বোতলটা উঁচু করে ঢক ঢক করে ওয়াইন খেতে খেতে, রুমের মধ্যে প্রবেশ করে। অর্নের লোচনযুগল ঈষৎলাল হয়ে আছে। অর্নের নাকে ওয়াইনের কঁড়া গন্ধ লেগে থাকা সত্তেও, তার নাসিকাতে হলুদ গাঁদা, সাদা রজনীগন্ধা ফুলের সৌরভ এসে জানান দেয়, এটা সাধারন কোনো রুম না। এটা বাসর ঘর। আর অর্ন তার ভাইয়ের বাসর ঘরে সদ্ব্য আনা দামী মদের বোতল হাতে নিয়ে, তা খেতে খেতে রুমে প্রবেশ করেছে। রুমের চারপাশ ফূলে সমোরিত। মনোহরী, হৃদয় হরনী, সুকেশিনী, সুলভ সুহাশিনী নয়, বরং তিক্ত, বিরক্ত কৃষ্ণবর্ণ মহিয়সী, বিছানার মাঝে গুটিশুটি মেরে বসে আছে। অর্ন গম্ভীর হয়ে বিছানার দিকে তাকালো। অর্নের চোখে মুখে স্বচ্ছ ক্রোধের বিলাস। সেই বিলাসিতা প্রদানের সুবর্ণ সুযোগের অপেক্ষা অর্নের। অর্ন বলা শুরু করে..

“কেনো আমার জীবনটা তুই নষ্ট করলি? তোকে কে বিয়ে করতো? কেউ না? আমার কপালেই তুই এসে জুটলি? তোর কি লজ্জা করেনা? এত এত অপমান করার পরও আমার সাথে জড়িয়ে গিয়েছিস?”

ফুলে সজ্জিত বিছানার রংটা যেন ভালোবাসা প্রদানের আহ্বান জানায়। কিন্তু বিছানার উপর মাথা নিচু করে বসে থাকা অবনি যেন এট্রাকশনের মোনালিসা নয়। সে যেন সক্রেটিসের অনুরূপ রঙ এর গঢ়ন। অবনি কাঁদছে। শব্দহীন তবে ফোঁপানোর আওয়াজ মাঝে মাঝে বদ্ধ ঘরের কার্ণিশে ছড়িয়ে যাচ্ছে। অর্ন বোতলে আরো একবার চুমুক দিয়ে অবনির দিকে এগিয়ে যায়। অবনি তখনো চুপ হয়ে আছে। অর্ন কাছে যেয়ে বলে..

– তুই না ভাইয়ার বউ। আমার ভাবি তুই।
– আমি তোর বউ। (অবনি)
– চুপ কর.. শোন, আমার বউ হয়েছিস, খবরদার আমার কাছে আসবি না। আমার কাছে পৃথিবীর সবচাইতে বিরক্তিকর হচ্ছিস তুই। ঘোমটা কেনো দিয়ে আছিস? খোল ওটা.. তোর রুপ দেখার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। যে রুপে আকর্ষণতা নেই, সেই রূপে থুথু দিতেও লজ্জা করে।

অর্ন কথাটা বলেই, অবনির মুখের উপর থেকে বেনারসির ঘোমটা কাপড় তুলে ফেলে দেয়। অর্ন আর দেরি করে না। হাতে থাকা ওয়াইনের বোতলে, যতটুকু মদ ছিল সব ওর মাথায় ঢালা শুরু করে। কিছুটা মদের অংশ ক্ষীপ্র গতিতে অবনির মুখের উপর ছুঁড়ে মারে। অবনি চোখ বন্ধ করে নিল। কয়েক ন্যানো সেকেন্ড দেরি করলে হয়ত মদের পুরোটা চোখের মধ্যে চলে যেতো। তবুও অতি সামান্য তরল ওর চোখে যাওয়াতে জ্বালা করা শুরু হয়ে গেছে। অর্ন শব্দ করে হাসতে থাকে। অবনি নিরবে কেঁদে যাচ্ছে। হাসতে হাসতে বলে..

– কি ভাবছিস? আমার মত ছেলেকে বিয়ে করে, তুই সব পেয়ে গিয়েছিস? তুই জানিস না তুই কত বড় ভুল করেছিস।
– আমার কি দোষ? আমি তো.. (অবনি)
– চুপ কর তুই।

অর্ন কথাটা বলে অবনির গালে ঠাস করে একটা চড় লাগিয়ে দেয়। অবনির এমনিতে চোখ জ্বালা করছিল। তার উপর অর্নের থেকে খুব জোরে চড় খেয়ে সে যেন দিশেহারা, বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। অর্ন বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। অবনিকে টেনে, বিছানা থেকে নামিয়ে ফ্লোরে দাঁড় করালো। অবনি নিশ্চুপ। সে কিছুই বলতে পারছে না। কেবল কান্নায় করে যাচ্ছে। বাসর ঘরে স্বামীর থেকে মেয়েরা ভালোবাসা পেয়ে থাকে। কিন্তু অবনি যা পাচ্ছে সেটা ভালোবাসা নয়, বরং নির্যাতন।

এমনিতেই অবনি বিকেল থেকে কান্না করেছে। অর্নের ভাই আনাফ বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে যায়। সবাই বলাবলি করছিল, কালো মেয়ের জন্য এমনিতেই ছেলে পাচ্ছিল না। কাজিন ধরে বিয়ে করিয়ে দিচ্ছে, সেই ভেগে গিয়েছে। ছি ছি কি কান্ডটাই না ঘটেছে। কে করবে এর বিয়ে? অবনির কানে যখন অনুষ্ঠানে আসা মানুষের কথা আসে। তখন থেকেই কাঁদছিল। কান্নাটা যেনো এখনো থামছে না। অর্ন অবনির দিকে তাকিয়ে বলে..

– ঐ নেকা কান্না থামা বুঝেছিস? ওয়াশ রুম আছে। যা চোখে পানি দিয়ে আয়।

অবনি মাথা নিচু করে কোনোরকমে তাকিয়ে সামনে এগি যাওয়ার প্রস্তুত নেয়। অর্ন আবার থামিয়ে দিয়ে বলে..

– ঐ দাঁড়া। গা থেকে সব খোল।
– অর্ন… (অবনি)
– চুপ কর।

অবনির কোনো কথা শোনার মুডে অর্ন নেই। সে অবনির কাছে যেয়ে সজোরে টান দিয়ে, অবনির তনু থেকে কাঁপড় সরিয়ে ফেলে। অবনি আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। দৌড়ে ঔয়াশ রুমে চলে যায়। অবনি তাড়াতাড়ি ট্যাপ ছেঁড়ে দিয়ে, পানি হাতে নিয়ে মুখে ছেঁটাতে থাকে। কয়েকবার পানি ছিটিয়ে চোখ ঠান্ডা করে নিল। সে আয়নাতে তাকায়। নিজের চেহারা আজ সে বিগত ১০ বছর ধরে দেখেনি। দশ বছর পর আজ প্রথমবারের মত সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছে। আয়নাতে নিজের চেহারা দেখে চোখের পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে। কারন সে কালো এটার জন্য কাঁদছে না। কপোলের ডান পাশে স্পষ্ট থাপ্পড়ের দাগ। অবনি আরো ঢুকরে কেঁদে ওঠে। কারন, সে কালো বলে তার স্বামী এভাবে কথা শুনিয়েছে। সদ্ব্য বিয়ে করা স্বামী যেন বড়ই নিষ্ঠুর।

অবনি নিজের গায়ের দিকে তাকায়। শাঁড়িটা আধাখোলা হয়ে আছে। বুকের প্রস্বস্থ অধনা যেন দৃশ্যমানের বিলাসিতা বহন করলেও, অর্নের কাছে তা বড়ই তুচ্ছ। অবনির মনে নিসান্দ তৈরী করে তুলেছে। সে গায়ে শাঁড়ি পেঁচিয়ে নেয়। তারপর আবারো আয়নাতে চোখ দিল ও। বহু বছর ধরে না দেখা নিজের প্রতিভিম্ব অবলকন করতে থাকে ও।
.
অর্ন টেবিলের ড্রয়ার খুললো। নতুন সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটি সিগারেট বের করে তাতে আগুন জ্বালালো। হাতে সিগারেট নিয়ে সে রুমের সোফাতে যেয়ে বসে। দু ঘন্টা ধরে ও পাঁচ বোতল ওয়াইন শেষ করেছে। কিন্তু কিছুতেই যেন ওর নেশা হচ্ছে না। মাথার মধ্যে অবনির মুখটাই ভেসে উঠছে বারবার। আর যখনি ভাসছে তখনি সব নেশা ছুঁটে যেয়ে রাগ আবির্ভাবে মেঘের আড়ম্বর সৃষ্টি করছে। সে সিগারেটে টান দিয়ে চোখটা একটু বন্ধ করলো। সাথে সাথেই ইরার মুখ ভেঁসে ওঠে। সে চোখ মেলে তাকায়। ইরার হাসি মুখটা যেন ওর বুকে জমে থাকা রাগের ঘনঘটা উচ্চতর বানিয়ে দিয়েছে। অনুধাবনের শেষ অংশে প্রয়োগের মিমাংসাই ব্যস্ত হয়ে যার রাগের অনুভুতি।

অবনি নিজেকে কিছুটা সামলে নেয়। সে গায়ে ভালোমত শাঁড়িটা পেঁচিয়ে বাইরে বের হয়ে আসলো। লোচনযুগল যেন লাল তুরূপে ভর্তি। অর্ন সিগারেটে টান দিয়ে অবনিকে ডাকলো..

– দাঁড়া.. কোথায় যাচ্ছিস?
– বিছানায়। (অবনি)
– কেনো? কি ভাবছিস হা তোকে নিয়ে বাসর রাতের প্রমোদনা তৈরী করবো তাইনা?

অর্ন এগিয়ে আসে কাছে। আবারো শাঁড়ি ধরে হেঁচকা টান দেয়। শাঁড়িটা আগের মত খুলে গেলো। অর্ন এক হাতে শাঁড়ি ধরে থাকে। অবনি নিজেকে দুই হাত দিয়ে ঢেকে নেয়। অর্ন শব্দ করে হাসতে থাকে। অবনি অর্নের হাসির কারন বুঝতে পারে না। অর্ন হাসতে হাসতে বলে..

– শোন.. তোর এই শরীরের উপর আমার কোনো চাহিদা নেই। যার মাঝে কালোতে ভর্তি, তাকে ছুঁয়ে দেখার কোনো ইন্টারেস্ট আমার মধ্যে নেই। আফসোস, তোর জন্য ইরা আমার থেকে চিরজীবন হারিয়ে গেলো। (অর্ন)
– ইরা.. কে ইরা? (অবনি)
– আমার ভালোবাসা। যাকে আমি খুব করে ভালোবাসতাম। শুধু তোর জন্য সে আমার হলো না। (অর্ন)
– আমি কি করলাম? (অবনি)

অবনির মুখ থেকে এমন কথা শুনে, অর্ন আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে না। আবারো গালে একটা চড় বসিয়ে দেয়। অবনি ঘুরে যেতেই, শাঁড়ি দিয়ে অবনির মুখ বিহ্বর একটু চেপে ধরে। তারপর জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে অবনির খোলা পিঠের নিচ অংশে জোরে চেপে ধরে। অবনি চিৎকার দিতে যেয়েও শব্দ বের করতে পারে না। অর্ন ক্ষীপ্ত, ক্ষোভের চরম সীমায় পৌঁছে, সলাকায় যতক্ষণ আগুন ছিল, ততক্ষণ অবদি চেপে ধরে রাখলো। এরপর এক ধাক্কায় বিছানায় ফেলে দেয় অবনিকে। অবনি যেন একটু হাপ ছেঁড়ে বাঁচে। কিন্তু পিঠের উপরিভাগে সিগারেটের আগুন লাগায় যেন সে জ্বলন্ত পীড়ার এক ডোবায় পড়ে যায়। অবনি চিৎকার করতে পারেনা। চিৎকার কেনোই বা করবে? অবনিকে একমাত্র অর্নের মা ছাড়া এ বাড়িতে কেউ পছন্দ করে না। এমনকি অবনির নিজের মা’ও অবনিকে ঘেন্না করে। তার আত্বচিৎকার যে বৃথা যাবে এটা অবনি নিশ্চিত।

নতুন স্বামীর থেকে এমন নির্যাতিত ব্যবহার হয়ত এর আগে কোনো মেয়ে পায়নি। অবনি আজকে তার লোচনযুগলে বিশালবারিধারার এই ধারাপতনে চুপিসারে সব সহ্য করার অনুভবতা প্রকাশ করছে। যা অন্য কোনো মেয়ে হয়ত করবে না। অর্ন থেমে নেই। সে এক দু পা করে এগিয়ে আসছে অবনির দিকে। অবনি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকায় অর্নের চোখযুগলে। সেখানে রাগের অববাহিকায় এক জ্বলন্ত রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। অবনি থেমে থেমে বলতে থাকে..

-কি করছো? আমাকে ভালোবেসে চাও। আমি সবটাই তোমাকে দেবো। এভাবে কেনো আসছো?
– চুপ কর..

অর্ন কথাটা বলে অবনির আরো কাছে আসে। অবনি ভয়ে একটা ঢোক গিলল। অর্ন হাত উঠিয়ে, সোজা অবনির বুকের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। অবনি শঙ্কায় চুপসে যেতে থাকে। অর্ন তার বুকের কাছে হাত এনেই থেমে যায়। অবনি চোখ বড় বড় করে দেখতে থাকে। অর্ন হাসতে থাকে। অবনি ওর হাসির রহস্য বুঝতে পারে না। অর্ন হাসতে হাসতে বলতে থাকে..

– কি ভাবছিস? তোর মত একটা জঘন্য গায়ের রঙ এর মেয়েকে আমি স্পর্শ করবো? তোকে ভালোবেসে স্পর্শ করবো? কিভাবে ভেবেছিস তুই?

অর্ন কথাটা বলে অবনির পিছনে থাকা বালিশ হাতে তুলে নেয়। তারপর কিছু সময় অবনির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই তাকানোতে রাগের হিংস্রতা প্রকাশ পাচ্ছে। অবনি এমন চাহনিতে ভয় পাচ্ছে অনেক। একটা নারীর স্বামী মানেই সকল আশ্রয়স্থল হয়। কিন্তু অবনির কাছে এই অর্ন নামক স্বামীর কাছে থাকাটাও যেন বিশাল ভয়ের ব্যাপার। কিন্তু কোনো উপায় নেই তার। কোথায় যাবে সে? কার কাছে বলবে ও? অর্ন চলে আসার আগে অবনিকে বলে..

– শোন.. তোকে বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে আমার কোনোদিন ছিল না। তোকে নিয়ে কল্পনাতেও কোনোদিন এমন দিনের কথাও ভাবিনি। আমার থেকে দুরে থাকবি। এটা ভালো করেই জানিস, দাদু আমাকে কতটা ভালোবাসে। তাই ওনার সামনে কখনো ন্যাকা কান্না করবিনা। আমার মায়ের সামনেও কখনো মন খারাপ করে থাকবি না। আর বাইরে কারো সাথে আমি যে তোর বর, এটা ভুলেও বলবি না। যদি এসবের বাহিরে কিছু করেছিস, বুঝতেই পারছিস তোর জন্য কত খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে। আরেকটা কথা আমার থেকে সবসময় দুরে থাকার চেষ্টা করবি। স্বামীর অধিকার কখনো পাবিনা তুই। আমার জীবনটা আজ তোর জন্য নষ্ট হয়ে গেছে। আমার ভালোবাসাটাও শেষ। শুধু তোর মত একটা বাজে দেখতে মেয়েকে বিয়ে করেছি বোলে।

অর্ন কথাটা বলে সোফাতে যেয়ে বসে। অবনি বিছানার উপর পা উঠিয়ে গাটোসাটো হয়ে বসলো। গায়ে শাঁড়িটা কোনোরকমে জড়িয়ে নেয়। অর্ন সোফার উপর বালিশ রেখে শুয়ে পড়ে। অবনি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অর্নের মুখের দিকে। এই বাড়ির সবচাইতে হ্যান্ডস্যাম ছেলে অর্ন। ওর সাথে পরিচিত হওয়া মেয়েগুলো আঠার মত পড়ে থাকতে দেখেছে অবনি। বাড়িতেও কত মেয়ে নিয়ে এসে ফ্রেন্ড বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে অর্ন। সেই মেয়েগুলো একেকটা যেন অপ্সরা। অবনি কখনো কারো সামনে যায়নি। হয়ত তারা অপমান করবে ভেবে সে কখনো সামনে যেতো না। কিন্তু একদিন অর্নের মায়ের কারনে ওদের সামনে যায়। অর্ন অনেক বন্ধুদের বাড়িতে আনে। সেদিন ওদের জন্য নাস্তা রেডি করার পর অর্নের মা অবনিকে বলে..

– কিরে ওভাবে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখছিস? সব খাবার তো তুই নিজে বানাইছিস। এবার যা, ওদেরকে দিয়ে আয়।
– না খালাম্মু, আমি যাবো না। তুমি তো রোজ নিয়ে যাও। তুমি যাও এখন। (অবনি)
– আরে কি সমস্যা হা? যা তো নিয়ে যা। অর্ন আছে তো ওখানে সমস্যা কি? যা আমি কাজ করছি এখন।

সেদিন অবনি অর্নের মায়ের জোরাজুরিতে আসে ওদের সামনে। মাথার উপর লম্বা একটা কাঁপড় দিয়ে সে খাবারের ট্রে নিয়ে এগিয়ে আসে অবনি। অবনিকে দেখেই অর্নের বন্ধু শিহাব বলা শুরু করে..

– কিরে মামা.. এটা না তোর খালাতো বোন অবনি? এভাবে কেনো আসছে? (শিহাব)
– এমনিতে। (অর্ন)
– শিহাব তুই ওনার হাতের দিকে তাকা। হাতের কালার দেখছিস? কালো বিশ্রী দেখতে মেয়েটা। এ জন্য কি মাথা থেকে কাঁপড় সরায়? (মিহি)
– আরে হ্যা তো.. কই দেখি আপু তোমাকে একটু। (নিশি)

নিশি কথাটা বলেই অবনির মাথা থেকে কাঁপড়টা টেনে নামিয়ে দেয়। অবনির কালো চেহারাটা সবার চোখের সামনে। মেয়েটা দেখতে বেশ হলেও গায়ের রঙ টাই যত ঝামেলা। এ জন্য কেউ ওকে পছন্দ করেনা। আর পছন্দ করে না বলেই অবনি তার মায়ের থেকে দুরে থাকে। অবনি দৌড়ে চলে আসার প্রস্তুতি নিতেই মিহি বলা শুরু করে..

– ছিহ.. এত বিশ্রি দেখতে মেয়ের হাত থেকে আর কি খাবো? এত কালো কেনো তুমি? তোমার তো আমাদের সামনে খাবার আনার যোগ্যতাও নেই। বেঁচে আছো কেনো? নিজেকে কখনো দেখেছো? ভয় পাওনা তুমি?

মিহির কথা শুনে সবাই হো হো করে হাসতে থাকে। অবনি স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে। ওর পা যেন চলছে না। সে কি বলবে সেটাও বুঝতে পারছে না। সবকিছু যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। এত অপমান সে অনেক বছর হল হয়নি। কারন সে কখনো বাড়ি থেকে বের হতো না। বের হলেও হাত, চোখ মুখ সবকিছু ভালোভাবে বোরখার সাথে ঢেকে বের হয়েছে। যেন কেউ ওর কালো গায়ের রঙ না বুঝতে পারে। তবে আজ অর্নের মায়ের জোরাজুরিতে এখানে এসে সে অনেক বড় ভুল করেছে। যার জন্য অপমান সহ্য করতে হচ্ছে তার। চোখে পানি টলমল করছে অবনির। কেউ নেই ওর পাশে। এ বাড়িতে কখনো ওর সাপোর্ট নিয়ে কেউ কথা বলেনি। হঠাৎ অবনি শুনতে পায়.

– তোরা কি শুরু করেছিস? সে কি ইচ্ছে করে কালো হয়েছে? আজব ধরনের কথা বলছিস। তোরা আসছিস বেড়াতে, কেনো অবনির পিছনে পড়েছিস? অবনি, তুই যা। আর এসব কথায় মন খারাপ করিস না। (অর্ন)

অবনি দৌড়ে সেখান থেকে চলে আসে। আড়ালে এসে অর্নের দিকে তাকায়। অর্ন এই প্রথমবার অবনির সাপোর্ট নিয়ে কথা বলেছে। যা কখনো এর আগে হয়নি। তাই অর্নকে সে দেখতে থাকে। ছেলেটা সবার মধ্যে বেশি আকর্ষনীয়। তবে অবনিকে সাপোর্ট করার মাধ্যমে মেয়েটা অর্নির প্রতি এক অন্যরকম ভালোলাগা অনুভব করে।
.
অর্ন সোফা থেকে উঠে বসে। টেবিলের ড্রয়ারে সিগারেটের প্যাকেট। উঠে এসে সেখান থেকে একটা সিগারেট নিয়ে সে আগুন জ্বালায়। ধোয়াগুলো উপরের দিকে ছাঁড়তে থাকে। হঠাৎ সিগারেটের ধোয়ায় অবনি কেঁশে উঠল। কাঁশতে কাঁশতে বলে..

– সিগারেট খাচ্ছো কেনো? জানো না এটা ক্ষতিকর। আর আমার খুব কাশি হয় সিগারেটের ধোয়ায়। (অবনি)
– তো? তোর কাঁশি হলে হবে। তাতে আমার কি? (অর্ন)
– বাহিরে যেয়ে খাও। (অবনি)
– রুমটা আমার। তোকে থাকতে দিয়েছি এটাই অনেক। আমাকে বলছিস বাহিরে যেতে? তোকে আমি.. না থাক, তোকে স্পর্শ করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। তুই আমার থেকে দুরে দুরে থাকবি।

অর্ন কথাটা বলে সোফাতে চলে যায়। বদ্ধ ঘরে দুজন বিপরীত লিঙ্গের মানুষ। একজনের মনে অন্যজনের কাছ থেকে সামান্য ভালোবাসা পাওয়ার বাসনায় প্রহর গোনা হচ্ছে। আরেকজনের মনে বিকৃত গায়ের রঙে নিজেকে বিষাদগ্রস্ত করে তুৃলেছে। দুজনের মনেই কষ্ট। অর্ন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না অবনির সাথে বিয়ে হওয়ার ব্যাপারটা। বেশ তো হাসিখুশি ছিল ছেলেটা। হঠাৎ করে এভাবে যার সাথে অর্নের মানাবে না, যাকে অর্ন সবসময় অপছন্দ করে এসেছে। তার সাথেই বিয়ে দিয়েছে তাকে। ও যেন এখনো স্বপ্নের ঘোরে আছে। কিন্তু সবাই জানে, অর্নের সাথে অবনির বিয়েটা কোনো স্বপ্ন নয়। এটা বাস্তব।

অবনি লাইট অফ করে বালিশে মুখ গুজে কান্না করতে থাকে। সে যেন খেলার পুতুল। আনাফের সাথে বিয়ে হচ্ছিল ওর। কিন্তু হঠাৎ করে হাওয়া বদলে অর্নের বউ ও। যদিও অবনি অর্নকে আগে থেকেই পছন্দ করতো। কিন্তু অর্নের স্মার্টনেসের কাছে যোগ্যতার বিবেচনায় অবনির এই পছন্দবোধ হাসির খোরাক ছাড়া কিছুই নয়। সে মনে মনে আজ দিনের কথা ভাবতে থাকে। কিভাবে সে অর্নের বউ হল, সবকিছু কল্পনা করতে থাকে। আর তা হল…
চলবে,,

কে তুমি পর্ব-০৮(শেষ পর্ব)

0

গল্পঃ কে তুমি ( ৮ম বা শেষ পর্ব )
লেখাঃ ইমতিয়াজ আহমেদ চৌধুরী

নিলয়ের পাশে বেডে বসে নাবিলা তার ব্যাগ থেকে একটি সাদা শাড়ী বের করলো, সেটা দেখে নিলয় অবাক হয়ে বললো,– এই তুমি কি বিধবা নাকি?

নাবিলা ভ্রু কুচকে বললো,– বিয়ের আগে কেউ বিধবা হয় নাকি!

নিলয় আরও অবাক হয়ে বললো,– তাহলে অবিবাহিত বালিকার ব্যাগে বিধবা শাড়ী কেন শুনি?!

“ দরকার আছে ” বলে নাবিলা ব্যাগ থেকে লম্বা সাদা নকল চুল, পাউডার, এবং আলতা বের করলো!

সেসব দেখে নিলয় আবার বললো,– এগুলোর মানে কি নাবিলা! এসব দিয়ে কি হবে শুনি?

নাবিলা বললো,– শুনতে হবেনা, পরে জানবেন! এবার ঘুমানোর চেষ্টা করুন।

শাড়ী এবং বাকি সব টেবিলের ওপর রেখে নিলয়ের পাশেই শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে শুয়ে পড়লো নাবিলা।

রাত বারোটার জানান দিলো দেয়াল ঘড়ি, নাবিলা চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান ধরে আছে। নিলয়ের মাথায় ঘুরছে নাবিলার কোমরের সেই জন্মদাগ চেক করার বিষয়টি।

নিলয় ধীরে ধীরে নাবিলার কোমরে হাত রাখলো। নাবিলা তো ঘুমের ভান ধরে আছে, নিলয়ের হাতের স্পর্শে নাবিলার পুরো শরীরে কেমন একটা কামনার অনুভুতি খেলে গেল। নিলয় ঝুকে পড়ে নাবিলার কোমরের কাপড় সরালো, নিলয়ের গরম নিশ্বাস নাবিলার কোমর ছুয়ে দেহে কেমন এক অনুভূতি জাগিয়ে তুলছে, নাবিলার ইচ্ছে হচ্ছে এই স্পর্স আর নিশ্বাস দীর্ঘ সময় ঘিরে রাখুক তাকে।

নাবিলার কোমরে ভালো করে দেখলো নিলয়, কোনো জন্মদাগ নেই! তবুও একান্তে এভাবে নবযৌবনা একটা শরীর নিলয়ের মনে অন্য কিছু পাবার আকাঙ্খা প্রবল করে জাগিয়ে তুললো।

নিলয়ের কি হলো নিজেই জানেনা, আলতো করে নাবিলার পেটে হাত বুলোতে বুলোতে ধীরে ধীরে নিলয়ের হাত নাবিলার বুকে! অন্যরকম এক নেশায় এবং উত্তেজনায় দুজনেই বুদ হয়ে আছে। নাবিলার মন নিষেধ করলেও দেহ ভীষণ করে চাইছে নিলয়ের হাতের এই স্পর্শ অনুভব করুক তার সারা শরীর। এই স্পর্শে নাবিলা যেন বশীভূত হয়ে আছে। ধীরে ধীরে নিলয়ের ঠোঁট স্পর্শ করলো নাবিলার ঠোঁট। কিছুক্ষণ এভাবে চলার পরে বিষয়টি আরও গভীরে যাবার আগেই নাবিলা নিলয়কে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বললো,– কিছু সময় ভালোলাগার লোভে আজীবন দুজনের কাছে দুজন ছোট হয়ে থাকার চেয়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

নিলয়ও বিষয়টা বুঝতে পেরে আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

দেয়াল ঘড়ি রাত তিনটার জানান দিলো।

নাবিলা উঠে সেই সাদা শাড়ী পড়ে নকল চুল লাগিয়ে, পাউডার মেখে তার ওপর নাকে মুখে এবং বিভিন্ন স্থানে আলতা মেখে নিলো রক্তের মতো করে।

নিলয়ের রুম থেকে বেরিয়ে রাকিবের রুমে এসে ঢুকলো নাবিলা, রাকিব গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, রুমে ডিমলাইটের মৃদু আলো। খাট থেকে দূরে দরজার পাশে আরও একটু অন্ধকারে দাড়িয়ে গলার স্বর ভারী করে নাবিলা কয়েকবার রাকিবকে ডাকলো। হঠাৎ রাকিবের ঘুম ভেঙে গেল, ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে দরজার কাছে নাবিলার ভৌতিক অবয়ব দেখে ভীষণ ভড়কে গেল রাকিব, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে মস্তিষ্ক সম্পুর্ন অপ্রস্তুত থাকে এমন কিছু দেখার জন্য, কিন্তু এরকম কিছু দেখে ভয়ে রাকিবের গলা শুকিয়ে কাঠ, গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। রাকিবের হঠাৎ করে মনে পড়লো, মীরা বলেছিল হিমি ভাবীর আত্মার কথা। তাহলে এটা কি সেই মীরা ভাবীর আত্মা! রাকিব আরও ভীষণ ভড়কে গেল।

নাবিলা আবারও সেই ভারী কন্ঠে বললো,– আমি তোমাদের কি ক্ষতি করেছিলাম রাকিব যে আমাকে তোমরা বাঁচতে দিলেনা?

রাকিব ভীষণ ভয়ে আতঙ্কিত, গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না।

এবার নাবিলা ধীরে ধীরে রাকিবের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো, তাই দেখে ভয়ে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে রাকিব কোনমতে বললো,– আমাকে মেরো না হিমি ভাবী, বাবা মা প্ল্যান করেই তোমাকে আর নিলয় ভাইকে শেষ করে দিতে চেয়েছিল, কারণ তোমরা না থাকলেই নিলয় ভাইয়ের সবকিছু আমাদের হতো। প্ল্যান অনুযায়ী ট্রাকটা তোমাদের গাড়িতে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়, তুমি মারা যাও কিন্তু নিলয় ভাই ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়।

রাকিব ভয়ে গুটিশুটি মেরে চোখ বন্ধ করে আছে, এই ফাকে নাবিলা দ্রুত রাকিবের রুম থেকে বেরিয়ে চলে আসে। নাবিলার উদ্দেশ্য ছিল রাকিবের কথা রেকর্ড করার, সেটা কমপ্লিট।

ভোর হবার আগে আগে নাবিলা নিলয়কে জাগিয়ে বেরিয়ে পড়লো।

অফিসে বসে আছে নিলয়, গতরাতে করা রেকর্ড নিলয়ের সামনে প্লে করলো নাবিলা।

রেকর্ডের কথা শুনে থমকে গেছে নিলয়, চোখে জল টলমল। নিজেকে সামলে নিয়ে নাবিলাকে বললো,– যেটাকে সবাই এক্সিডেন্ট হিসেবে মেনে নিয়েছিলাম, তোমার সেটাকে মার্ডার কিভাবে মনে হলো, আর তার আগে প্রশ্ন আসলে কে তুমি।

নাবিলা রহস্যময় হাসি হেসে বললো,– আপনার স্ত্রী হিমি আগে থেকেই টের পেয়েছিল আপনার চাচা চাচী এবং চাচাতো ভাই এর ষড়যন্ত্রের আভাস, আর প্রতিদিনের ঘটনা সে সন্ধ্যায় লিখে আমাকে মেইল করে দিতো। ওর সন্দেহ সত্যি হলো, আপনার আত্মীয় স্বজনের লালসার শিকার হয়ে ওকে পৃথিবী ছাড়তে হলো।

নিলয় সাথে সাথে থানায় ফোন করে পুলিশ ঢেকে চাচা চাচী এবং চাচাতো ভাইকে এরেস্ট করালো।

খুব ভেঙে পড়েছে নিলয়, সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। নিলয়ের পাশে দাড়িয়ে নাবিলা বললো,– এবার সময় এসেছে আপনার সেই প্রশ্নের উত্তর দেবার, জানতে চান?

নিলয় ভাঙা ভাঙা গলায় বললো,– হ্যাঁ, এবার বলো কে তুমি?!

নাবিলা বললো,– আমি হিমির জমজ বোন। আপনাকে হঠাৎ কোনদিন সারপ্রাইজ দেবার জন্য হিমি কখনও আমার কথা জানায়নি, এবার পেয়েছেন উত্তর!

নিলয় অবাক চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে নাবিলার দিকে।

নাবিলা বললো,– এবার আমার ফেরার পালা, আমায় লন্ডনে ফিরে যেতে হবে। অবশ্য লাস্ট ইমেইলে হিমি লিখেছিল ওর যদি কিছু হয়ে যায় আমি যেন আপনার পাশে থাকি, ওর মতো করে আপনাকে আগলে রাখি। হিমির শেষ ইচ্ছা এবং আবদার পূর্ণ করতে আমার আপত্তি নেই। এবার আপনি বিদায় দিলে চলে যেতে পারি, আর আপনি চাইলে থেকে যেতে পারি।

নিলয় নাবিলার হাত ধরে বললো,– তুমি থেকে যাও,হিমির প্রতিচ্ছবি তুমি, তোমার মাঝেই হিমিকে খুঁজে পাই আমি। আর কিছু না হোক সম্পর্ক বৈধ করে দিনরাত দুচোখ ভরে তোমায় দেখতে চাই।

অবশেষে নিলয় ও নাবিলার বিয়ে হয়ে গেল।

সমাপ্ত।

কে তুমি পর্ব-০৭

0

গল্পঃ কে তুমি ( সপ্তম পর্ব )
লেখাঃ ইমতিয়াজ আহমেদ চৌধুরী

মীরার বেডে মীরা ও নিলয় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, নিলয় জানেনা কতবড় ষড়যন্ত্রের শিকার হতে যাচ্ছে সে।

ওদিকে নিলয়ের রুমে ঘুমিয়ে আছে নাবিলা। নিলয় নিজের রুম থেকে বেরিয়ে আসার সময় ফোনটা রেখে এসেছিল বেডে। রাত্রি দ্বিপ্রহরে নিলয়ের ফ্যাক্টরির নাইট সিফটে ডিউটিরত কোন এক স্টাফ সম্ভবত জরুরি প্রয়োজনে নিলয়ের ফোনে কল দিচ্ছে বারবার। বারবার কানের কাছে ফোনের রিং বাজায় ঘুম ভেঙে গেল নাবিলার, ঘুমঘুম চোখে ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কেউ বললো,– স্যার আমেরিকান বায়ারের দুপুরের পরে আসার কথা ছিল, কিন্তু হঠাৎ করে আবার জানালেন সকালেই আসবে, আপনাকে জানানো প্রয়োজন তাই এত রাতে বিরক্ত করলাম, সকাল সকাল চলে আসবেন অফিসে আজ।

নাবিলা কল কেটে দিয়ে খেয়াল করে দেখলো নিলয় তো রুমে নেই! তাহলে গেল কোথায় এত রাতে! দীর্ঘসময় অপেক্ষার পরে উঠে বসলো।

এখানে আসার পরে এবং নিলয়ের চাচা চাচী, মীরা রাকিব বাসায় ফেরার আগেই কয়েকটি ওয়্যারলেস মাইক্রোফোন বিভিন্ন যায়গায় সেট করে রেকর্ডিং চালু করে রেখেছিল নাবিলা, ডাইনিং টেবিলের নিচেও লাগিয়েছিল কারণ এখানেই সবাই জড়ো হয় একত্রে এবং বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়।

নাবিলা ফোনে ইয়ারফোন লাগিয়ে কানে দিয়ে রেকর্ড প্লে করলো। স্কিপ করে শুনতে শুনতে এক যায়গায় এসে থমকে গেল নাবিলা, যেখানে নিলয়ের চাচি এবং তার ছেলে নিলকে ফাঁসানোর ষড়যন্ত্রের আলোচনা করেছিল, নিলয়কে মীরার রুমে শুইয়ে দিয়ে। নাবিলা ভীষণ অবাক! যে পরিবারকে নিজের পরিবার ভাবে নিলয়, সেই পরিবার নিলয়কে নিয়ে এমন ষড়যন্ত্র কীভাবে করতে পারে! তাহলে কি নাবিলার সন্দেহ সঠিক!

যাই হোক নিলয়কে এই ষড়যন্ত্র থেকে বাঁচাতে হবে। রাত শেষের দিকে, নাবিলা উঠে দরজা খুলে পা টিপে মীরার রুমের সামনে গিয়ে ছিটকিনি খুলে নিলয়কে মীরার বেড থেকে কোনমতে নামিয়ে কাঁধে ভর করিয়ে নিলয়ের রুমে এসে বেডে শুইয়ে আবার গিয়ে সেরকম মীরার দরজার ছিটকিনি বাইরে থেকে লাগিয়ে দিয়ে আসলো।

নিলয়ের ঘুম ভেঙে গেল, এতকিছু ঘটে গেল তার কিছুই টের পায়নি নিলয়! নাবিলাকে সজাক দেখে অবাক হয়ে বললো,– তুমি এখনও সজাক নাবিলা!

নাবিলা বললো,– আমার ঘুম না ভাঙলে আপনার যে সর্বনাশ হয়ে যেত নিলয়!

: মানে! কি বলছো এসব নাবিলা!

: সকাল হলেই বুঝতে পারবেন সেটা, এবং সবাই জেগে ওঠার আগে আমার এখান থেকে চলে যেতে হবে।

: এখনও তো ভোর হতে বাকি নাবিলা!

: সমস্যা নেই, আমি চলে যেতে পারবো, আপনি নিজের দিকে খেয়াল রাখবেন!

: কিন্তু বিষয়টা কি একটু বুঝিয়ে বলবে!

: সকাল হলেই বুঝতে পারবেন!

নাবিলা তড়িঘড়ি করে চলে গেল।

সকাল হতেই নিলয়ের চাচি মীরার রুমের সামনে এসে জোরে জোরে বলতে লাগলো,– হায় সর্বনাশ! এটাও দেখার বাকি ছিল, দুধ কলা দিয়ে সাপ পুষছি এতদিন! নিলয় এমন সর্বনাশ করতে পারলো!

নিলয়ের চাচা এবং চাচাতো ভাই রাকিব মীরার রুমের সামনে আসলো।

রাকিব বললো,– কি হয়েছে মা, নিলয় কি করেছে?!

মা বললো,– কি করেছে আবার, মীরার সর্বনাশ করেছে, সারারাত ধরে মীরার রুমেই আছে!

মীরার বাবা বললো,– দরজা তো বন্ধ, তুমি কিকরে বুঝলে!

মীরার মা বললো,– আমি দুজনকে বেডে পাশাপাশি দেখেই বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছি, যাতে পালাতে না পারে।

নিলয় তার রুমের দরজা থেকে উঁকি দিয়ে সব দেখছে এবং মুচকি হাসছে! এতক্ষণে নাবিলার কথা বুঝে এসেছে নিলয়ের।

রাকিব মীরার রুমের দরজা খুললো, ভেতরে মীরা সটান হয়ে ঘুমাচ্ছে দিব্যি! সারা রুমে নিলয়ের কোনো অস্তিত্ব নেই।

পেছন থেকে নিলয় এসে চাচিকে চাচি বলে ডাক দিতেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো চাচি!

শান্ত মেজাজে নিলয় বললো,– আমাকে নিয়ে কি বলাবলি হচ্ছে চাচিআম্মা?

চাচি কি বলবে ভেবে না পেয়ে ইয়ে মানে ইয়ে মানে করতে লাগলো।

রাকিবও থ মেরে আছে, নিলয় কি করে মীরার রুম থেকে গায়েব হলো!

নিলয়ের চাচা তার স্ত্রীকে বললো,– কিসব বলছো, ঘাড়ে ভূত চেপেছে নাকি মতিভ্রম!

নিলয় কাউকে কিছু না বলে চুপচাপ অফিসে চলে এলো। নাবিলা এগিয়ে এসে হাসিমুখে বললো,– মিস্টার নিলয়, এবার সবকিছু ক্লিয়ার হলো তো! আমরা এমনই, তাদেরকেই বিশ্বাস করে মনে স্থান দেই, যারা ক্ষতি করার জন্য ব্যস্ত সর্বদা। আজও আপনার সাথে এমন কিছু ঘটতো যা আপনার জীবনটাকে আরও একবার ওলট-পালট করে দিতো!

নীলয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,– হ্যাঁ তাইতো, অথচ আমি তাদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং ভরসার ভেবেছি, কিন্তু ওরা এমনটা করবে কখনও ভাবিনি নাবিলা! এখন তো দেখছি নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে যাদের কাছে ভালো থাকার জন্য আশ্রয় নিলাম, তাঁরাই আমার বড়ো শত্রু!

নাবিলা বললো,– নিলয়, পানির অপর নাম জীবন, আবার এই পানিতে ডুবেই কত প্রাণের মৃত্যু ঘটে! বিশ্বাস হলেও এতটা ভরসা করতে নেই যেটাকে বলে অন্ধ বিশ্বাস। কে কখন বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে পিঠে ছুরি মারবে তারও বিশ্বাস নেই।

নাবিলা গত রাতের রেকর্ড তার মোবাইলে প্লে করে নিলয়ের সামনে রাখলো। সবকিছু শুনে ভীষণ অবাক নিলয়।

আরও বেশি অবাক নাবিলার এই বুদ্ধিমত্তায়। নিলয় জিজ্ঞেস করলো,– তুমি তো জানতেনা এমন কিছু ঘটবে নাবিলা, তাহলে রেকর্ড করার চিন্তা কীভাবে তোমার মাথায় আসলো, এবং রেকর্ডিং ডিভাইস তুমি আগেভাগেই সেট করে রেখেছিলে সম্ভবত, কিন্তু কেন? কি ভেবে?

নাবিলা বললো,– সে সবের উত্তর আরও পরে দেয়া হবে, আমার আরও একটি রাত আপনার চাচার বাসায় থাকতে হবে লুকিয়ে, ঠিক গত রাতের মতো, এবং এর জন্য আপনার সহযোগিতা দরকার! বলুন করবেন?

নিলয় বললো,– তুমি এতবড় বিপদ থেকে রক্ষা করলে আমাকে, অবশ্যই করবো, এবং তুমি চাইলে আবার আজ রাতেই হবে।

বিকেলে বাসায় ফিরে দরজা খোলা রেখে নিলয় চাচা, চাচী, মীরা এবং রাকিবকে ডেকে একটা রুমে নিয়ে গিয়ে বললো,– জরুরি কথা আছে।

এদিকে সেই সুযোগে দরজা দিয়ে ঢুকে নাবিলা নিলয়ের রুমে চলে গেল।

নিলয়ের চাচা বললো,– কি ব্যাপার নিলয়, কোনো সমস্যা?

নিলয় বললো,– চাচা দীর্ঘদিন আপনাদের এখানে থেকেছি, যদি ভুল ত্রুটি করে থাকি ক্ষমা করে দিবেন সবাই, আমার এখন নিজের ঘরবাড়ি ঠিক করে বসবাস করার সময় এসেছে!

সবাই চুপচাপ, সকালের বিষয়টি যে নিলয় বুঝতে পেরেছে সেটা বুঝেই আর কারো বলার মতো কোনো অপশন নেই!

নিলয় নিজের রুমে চলে আসলো।

দরজা বন্ধ করে গিয়ে বেডে বসলো নিলয়। নাবিলা সামনে এসে বললো,– প্রিয় মানুষদের মুখোশ উন্মোচিত হলে পৃথিবীটা ওলট-পালট হয়ে যায় তাইনা নিলয়? আর তারচেয়ে মারাত্মক কষ্টকর প্রিয় মানুষটাকে হারানো! আপনার মতোই প্রিয় মানুষকে হারানোর যন্ত্রনায় দিনরাত আমিও ছটফট করছি!

নিলয় অবাক হয়ে বললো,– কাকে হারানোর যন্ত্রণা তোমার নাবিলা, আর এবার অন্তত সত্যিটা বলো কে তুমি?!

নাবিলার ঠোঁটে রহস্যময় হাসি…

চলবে…