রক্তে আমার পুরো শরীর ভিজে যাচ্ছে। আমি চিৎকার করার চেষ্টা করছি কিন্তু আমার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে-না। শরীরে কোনো শক্তি পাচ্ছিনা। দেখালাম অনেক মানুষ এসে জোড় হয়ে গেছে। আমি আর তাকাতে পারছিনা। আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। তারপর আমি সেখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। তারপর কি হলো আমার আর কিছুই মনে পড়ছেনা। চোখ খুলে নিজেকে হাসপাতালের বেডের উপরে আবিষ্কার করলাম। দেখি আম্মু আর রাসেল আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আম্মু আমার চোখ খোলা দেখে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিল।
— বাবা কেমন আছিস তুই?
আমি কথা বলতে চাইছি কিন্তু কথা বলতে পারছিনা। আমার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছেনা। আমি দুচোখ দিয়ে দুফোটা পানি ছেড়ে দিলাম।
আম্মু আমার এই অবস্থা দেখে আরো বেশি কান্না করা শুরু করে দিল।
আমি আম্মুকে থামানোর চেষ্টা করবো কিন্তু আমি নিজের শরীর নড়াচড়া করতে পারছিনা। আমার পুরো শরীর অবশ হয়ে গেছে। মুখ দিয়ে কোনো কথা বলতে পারছিনা। সবার কথা শুনেতে পারছি। আমি শুধু তাকিয়ে রইলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে ডাক্তার চলে আসলো আম্মুর কান্নার শব্দ শুনে।
— তাহলে রোগীর জ্ঞান ফিরছে! আলহামদুলিল্লাহ আমি তো ভয় পেয়ে গেছি।
আম্মু — ডাক্তার ঈশান কোনো কথা বলছেনা কেন? ও শুধু তাকিয়ে আছে কেন?
ডাক্তার — ও আজকে ১৯ দিন ধরে কোমায় ছিল। তাই এমন হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্য আবার সব ঠিক হয়ে যাবে চিন্তার কোনো কারণ নেই।
ডাক্তারের কথা শুনে আমি একটা শর্খ খেলাম। আজকের ১৯ দিন ধরে আমি হাসপাতালে!এতো দিন আমি কোমায় ছিলাম! দিয়াকি আমার এক্সিডেন্ট এর কথা শুনে নাই? নাকি শুনেও আমাকে আমাকে দেখতেও আসে নাই। আর আসবেই বা কেন? আমি তো গরীব।
— আম্মু খাবার খাবি তুই?
আমি মুখ দিয়ে কথা বলতে পারছিনা। আম্মু আমাকে খাবার খাইয়ে দিল। ওষুধ খাইয়ে দিল। তারপর আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। এই ভাবে হাসপাতালে দুই দিন পার হয়ে গেলো। এখন আমি ধিরে ধিরে সুস্থ হয়ে যাচ্ছি। ৫ দিন পরে আমাকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হলো। বাসায় নিয়ে আমাকে খাটের উপরে শুইয়ে দিল। আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম কিছুক্ষণ পরে কারো কান্নার শব্দ শুনে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। তাকিয়ে দেখি রাইসা কান্না করছে। ওহ রাইসার পরিচয় টা দিয়ে দেই এবার! রাইসা আমার খালাতো বোন হয়। রাইসা আমাকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করতো কিন্তু আমি তাকে সব সময় ছোট বোনের মতোই দেখতাম। কখনও অন্য কিছু ভাবতাম না। রাইসা এইবার ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়াশোনা করে। রাইসা তার মা বাবার এক মাত্র মেয়ে। দেখতে খুব সুন্দরী। যে কোনো ছেলে দেখলেই ক্রাশ খাবে। রাইসা উচ্চতা ৫পিট ৭ ইঞ্চি। যে কোনো ছেলেই প্রেমে পড়তে বাধ্য।
রাইসার কান্না শুনে আমি চোখ খুলে তাকালাম।
— এই ভাবে কান্না করছিস কেন তুই?
— তোকে এতো কিছু জানতে হবে না। তোর এই অবস্থা কি করে হলো? আর ভাবি কোথায় তাকে তো দেখতে পারছিনা! এই সময় সে তোর পাসে নাই কেন?
আমি কিছুই বললাম না চুপ হয়ে রইলাম। একটু পরে আম্মু আমার রুমে এসে আমাকে যা বলল আমি সেটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
— বাবা তুই আমার থেকে এতো বড় একটা কথা কি ভাবে গোপন করতে পারলি?
— কি কথা গোপন কলাম আমি?
— দিয়া তোর সাথে এমন একটা অন্যায় করছে অথচ তুই আমাকে বললিনা কিছুই।
আমার আর বুঝতে বাকি রইল না রাসেল আম্মুকে দিয়ার ব্যাপারে সব বলে দিছে।
— আমি ভাবতেও পারিনি দিয়া তোর সাথে এমন করবে৷ দিয়ার জন্য আজ তোকে এতো কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে ওই মেয়েকে আমি কোনো দিন ক্ষমা করবো না। ও কোনো দিন ও সুখী হতে পারবেনা।
রাইসা — খালামনী কি হইছে? ভাবি কোথায়?
আমি — কিছু হয়নি। তুই কি একা আসলি নাকি?
— না,আম্মুও আসছে। আম্মু তোকে দেখে আবার চলে গেছে।
— ওহ আচ্ছা,
— এখন বলেন কি হইছে?
আম্মু — আমি বলছি।
তারপর আম্মু রাইসাকে সব কিছুই বলে দিল। তারপর আম্মু কান্না করতে করতে আমার রুম থেকে বের হয়ে গেলো। জানি কোনো মা তার সন্তানের এতো কষ্ট সহ্য করতে পারবেনা। কোনো মা চায়না তার ছেলেটা কষ্ট করুক। কিন্তু আমার ভাগ্যটাই খারাপ যাকে এতো ভালো বাসলাম সে আমাকে একটি বারের জন্য দেখতে আসে নাই।
— যা হইছে ভুলে যা, তুই এখন কেমন আছিস?
— আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।
— আমার খুব কষ্ট হচ্ছে তোকে এই অবস্থায় দেখে। কেন জানি আমি সহ্য করতে পারছিনা। তুই আমাকে ভালো না বাসলেও আমি তো বাসি। কিন্তু সেটা তুই কোনো দিন বুঝতে পারলিনা। যদি আমাকে একটু ভালোবাসতিস আমি তোকে কখনও কোনো ভাবে কষ্ট পেতে দিতাম না। বুকের মাঝে আগলে রাখতাম সব সময়।
রাইসার কথা গুলা শুনে খুব হাস্যকর মনে হচ্ছে। দিয়াও তো আমাকে কতো স্বপ্ন দেখিয়েছে সে কি আছে? সে তো আমাকে ছেড়ে খুব ভালোই আছে।
এখন রাইসার কথা গুলো শুনে খুব হাসি পাচ্ছে।
— রাইসা এসব বাদ দে তুই যা খাবার খেয়ে নে। অনেক রাত হয়ে গেছে আমি ঘুমাব।
রাইসা আর কিছু না বলে চলে গেলো। আমি ঘুমিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু আমার চোখ থেকে ঘুম হারিয়ে গেছে। কিছু তেই চোখে ঘুম আসছেনা। দিয়ার সাথে কাটানো সময় গুলি বড্ড বেশি মিস করছি৷ আজকে কতো দিন হয়ে গেলো দিয়ার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। দিয়াকি আমাকে সত্যি ভুলে গেছে! দিয়া কি আমার কথা একটি বার ও ভাবেনা? এসব ভাবতে ভাবতে আমার চোখের পাতা ভিজে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে ঘুম ভেঙে গেলো বুকের উপরে ভারি কিছু অনুভব করতে পেরে। চোখ খুলে দেখি রাইসা আমার বুকের উপরে শুয়ে আছে। আমি একটা ধাক্কা দিয়ে রাইসাকে সরিয়ে দিলাম।
— রাইসা এসব কি? আমার রুম তুই কি করিস?
— এটা তোর একার রুম না ওকে আজকের পর থেকে এই রুম আমার ও।
— মানে কি? কি বলতে চাস?
— কিছু না। আমার ভালোবাসার উপরে আমার বিশ্বাস ছিল আমি জানতাম তুই আমার কাছে ফিরে আসবি।
— একদম চুপ থাক, আর আমার রুম থেকে বের হয়ে যা। আমাকে না বলে আর আমার রুমে আসবি না বলে দিলাম তোকে।
— তুই ফ্রেশ হয়ে নে৷ আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।
— আম্মুকে নিয়ে আসিতে বলিস তোকে আসতে হবেনা। তুই এখন আমার সামনে থেকে যা।
তারপর রাইসা আমার রুম থেকে বের হয়ে গেলো। মনে করছি ও আর আসবেনা। আমি ফ্রেশ হতে চলে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি রাইসা নাস্তা নিয়ে এসে বসে আছে।
— তোকে না বলছি আম্মুকে নাস্তা নিয়ে আনতে? তুই আবার নিয়ে আনতে গেলি কেন?
— আমার ইচ্ছে হইছে তাতে তোর কি চুপচাপ খাবার খেয়ে নে কোনো কথা বলবি না।
এই মেয়ে দেখি আমাকে ধমক দিচ্ছে! এবার রাইসা আমার মুখের সামনে খাবার তুলে ধরলো। কি আর করার খাওয়া শুরু করে দিলাম। খাওয়া শেষ করে রাইসা আমাকে ওষুধ খাইয়ে দিল।
— গুড বয়। এখন ভালো ছেলের মতো ঘুমিয়ে থাকো।
— হুম, এখন তুই আমার রুম থেকে বের হয়ে যা।
— ঈশান তুই এমন কেনরে?
— আমি এমনই। এখন যা আমি ঘুমাব।
তারপর রাইসা রাগ দেখিয়ে আমার রুম থেকে বের হয়ে চলে গেলো। এখন একটু ভালো লাগছে। এবার আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
আমি গাড়িটিকে ফলো করতে শুরু করে দিলাম। একটু পরে দেখি দিয়ার গাড়ি একটা হাসপাতালের সামনে গিয়ে দাড়ালো। আমি তাড়াতাড়ি করে নেমে হাসপাতালের ভিতরে চলে গেলাম। গিয়ে দেখি দিয়া একটা মহিলা ডাক্তারের সাথে কথা বলছে। আমি দিয়ার কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে আমার দিকে ফিরিয়ে আনলাম তখনই দিয়া আমার গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় মেরে দিল সবার সামনে। দিয়ার থাপ্পড়ের শব্দ শুনে সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি গালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলাম।
— তোর সাহস কি করে হয় আমার গায়ে হাত দেওয়ার? তোর কি যোগ্যতা আছে আমাকে স্পর্শ করার?
আমি মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলছি।
হঠাৎ করে একটা ছেলে এসে বলল — দিয়া কি হয়েছে? (ছেলেটার নাম মিরাজ)
— এই ছোটলোক টার কতো বড় সাহস আমার হাত ধরেছে।
— এই ছেলেকে চেনো তুমি?
— হুম এই সেই ছেলে যার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। আর আমি তারপর সাথে ভালোবাসার নাটক করেছি।
মিরাজ একটা হাসি দিয়ে হলল — ওহ আচ্ছা এই সেই ছেলে? ছেলেটা কতটা বোকা বুঝতেই পারেনি।
— এই ছোটলোকের বাচ্চাটাকে এখান থেকে যেতে বলে বল।
তারপর দিয়া ডাক্তার কে বলল — ডাক্তার এই বাচ্চা নষ্ট করার ব্যবস্থা করুন।
আমি — দিয়া প্লিজ এমন করোনা তুমি। আমি তোমার কাছে কিছু চাইনা শুধু আমার বাচ্চাটাকে নষ্ট করোনা। আমি এই বাচ্চা নিয়েই বাকি জীবন কাটিয়ে দেবো। কোনো দিন আমি তোমার সামনে আসবো না। প্লিজ দিয়া তোমার কাছে এটা আমার অনুরোধ। দিয়ার হাত ধরে কথাটা বললাম।
দিয়া এক জটকা দিয়ে আমার হাত সরিয়ে নিল।তারপর মিরাজ আমার কলার চেপে দরে বলল
— তুই দিয়াকে স্পর্শ করার সাহস ফেলি কোথা থেকে?
এই কথা বলে মিরাজ আমার নাকে একটা ঘুসি দিল। সাথে সাথে আমার নাক দিয়ে রক্ত বের হতে শুরু করে দিল। আমি দিয়ার দিকে তাকালাম কিন্তু দিয়া কিছুই বলল না। যে দিয়া আমার হালকা হাত কেটে গেলেও সহ্য করতে পারতো না আজ সেই দিয়া আমার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। তারপর ডাক্তার দিয়াকে নিয়ে ভিতরে চলে যাবে এমন সময় আমি আবার দিয়ার সামনে গিয়ে দাড়িয়ে গেলাম। আমার নাকের রক্ত টপটপ করে পড়ছে।
— দিয়া আমি তোমার পায়ে পড়চি আমার বাচ্চাটাকে তুমি নষ্ট করে দিয় না। আমি এই বাচ্চা কে নিয়ে এই শহর ছেড়ে চলে যাবো কখনও তোমার মুখোমুখি হবোনা। শুধু আমার বাচ্চাটাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও।
কিন্তু দিয়া আমার কোনো কথা শুনল না। মিরাজ কয়েকজন লোক নিয়ে এসে আমাকে হাসপাতালে থেকে বাহিরে ফেলে দিল। রক্তে আমার কোট লাল হয়ে গেলো। আমি হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু পরে দিয়া মিরাজের হাত ধরে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে এসে গাড়িতে উঠে চলে গেলো। আমি দিয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আর চোখের পানি ফেললাম৷ এখন চোখে পানি ফেলা ছাড়া যা আমার আর কিছুই করার নাই। হাসপাতালে পাসের একটা দোকানে গিয়ে এক লিটার পানি নিয়ে রক্ত পরিষ্কার করছি এমন সময় আমার বন্ধু রাসেল এসে হাজির।
— ঈশান তোর এই অবস্থা কি ভাবে হলো? কে তোর এই অবস্থা করছে?
— কেউ না এমনি নাক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিলো।
— তুই তো হাসপাতালে যেতে পারতি। তুই আমার সাথে হাসপাতালে আই।
— লাগবেনা এমনি ঠিক হয়ে যাবো৷
— কোনো কথা বলবি না তুই আমার সাথে চল।
রাসেল আমার কথার গুরুত্ব না দিয়ে আমাকে টেনে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। হাসপাতালের সেই মহিলা ডাক্তারের কাছে আমাকে নিয়ে গেলো রাসেল। ডাক্তার আমাকে দেখেই বলে ফেলল,
— ওই মহিলা টা আপনার কে ছিল? আর ছেলেটা কে যে আপনার গায়ে হাত তুলল?
রাসেল — কি! কোন ছেলে ঈশানের গায়ে হাত তুলছে? ঈশান তুই আমাকে বল্লিনা কেন? ছেলেটার নাম বল কে সেই ছেলে?
আমি — আরে ভাই বাদ দে এসব।
ডাক্তার — আপনি তো আমার কথার উত্তর দিলেন না মেয়েটা কে?
— মেয়েটা আমার স্ত্রী।
— তা হলে যে সন্তান,,,
এই কথা বলতেই আমি ডাক্তার কে থামিয়ে দিয়ে বললাম — আমার চিকিৎসা করুন।
তারপর ডাক্তার আর কিছু না বলে আমার নাকের রক্ত বন্ধ করে কিছু ওষুধ দিয়ে দিল। রাসেল কিছু না বলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর আমি আর রাসেল বের হয়ে গেলাম। রাসেল আমাকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে চলে গেলো।
— ঈশান এই বার সব আমাকে বল কি হইছে? আর তোকে ও কেমন জানি লাগছে আমাকে সব বল তুই।
তারপর আমি রাসেল কে সব কিছুই খুলে বললাম। রাসেল আমার সব কথা শুনে চোখের পানি ছেড়ে দিল।
— তোর আম্মু যানে এসব?
— না আমি আম্মুকে কিছু বলিনি। আম্মু জানতে পারলে অনেক কষ্ট পাবে আম্মুকে কিছু বলি নাই।
— ওহ, কিন্তু ভাবি এমন করছে কেন? ভাবি তো তোকে অনেক ভালোবাসতেন তা হলে?
— হয়ত আমার টাকা পয়সা নাই তাই এমন করছে।আর আগে যা ছিলো তা হয়তো দেখানো ভালোবাসা ছিল। কিন্তু এটা আমি কখনও ভাবি নি দিয়া আমার সন্তান টাকে নষ্ট করে ফেলবে। জানিস আমার খুব কষ্ট হচ্ছে ভাই। দিয়া এমনটা কি করে করতে পারল!
রাসেল কে এসব বলছি আর চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে। এবার রাসেল আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
— চিন্তা করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমি কিছু না বলে শব্দ বিহীন কান্না করছি। ছেলেরা যে চাইলেও চিৎকার করে কান্না করতে পারে না। কারণ ছেলেদের কান্নাতে মানায় না। একটা ছেলে কখনও চিৎকার করে কান্না করতে পারে না শত কষ্ট বুকে নিয়েও তাদের হাসতে হয় এই সমাজের মানুষের সামনে।
কিছুক্ষণ পরে রাসেল আমাদের জন্য খাবার অর্ডার করল। একটু পরে খাবার আমাদের সামনে চলে আসলো। কি খাবার খাবো খাবার আমার ঘোলা দিয়ে নামছে না।
— কিরে খাচ্ছিস না কেন? খেয়ে নে এই খাবার। দেখে তো মনে হচ্ছে সকাল থেকে না খাওয়া তুই!
— দোস্ত খাবার আমার ঘোলা দিয়ে নামছে না। আমি খাবো না তুই খেয়ে নে।
— এতো কথা শুনতে চাই না তুই এই সব খাবার খেয়ে নে।
তারপর আমি কোনো ভাবে হালকা করে খাবার খেয়ে নিলাম।
— ঈশান চল আমি তোকে বাসায় দিয়ে আসি।
— না আমি একাই যেতে পারবো। সমস্যা হবে না আমার।
— ঠিক আছে সাবধানে যাবি কিন্তু৷ আর এসব নিয়ে চিন্তা করিস না। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।
তারপর রাসেল রেস্টুরেন্টের বিল মিটিয়ে দিয়ে আমার বের হয়ে গেলাম। রাসেল তার নিজের বাসার দিকে চলে গেলো। আমি গিয়ে আমার গাড়ি তে উঠে বসলাম। শরীর টা কেমন জানি খারাপ লাগছে। তাও আমি গাড়ি ড্রাইভিং করা শুরু করে দিলাম। চোখের সামনে বার বার দিয়ার মুখ ভেসে উঠছে আমার চোখের সামনে। আর চোখ দিয়ে অজস্র ভাবে পানি পড়ছে। এক হাতে ড্রাইভিং করছি অন্য হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে দিচ্ছি। গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলাম। রাস্তা জেনো কোনো ভাবেই শেষ হচ্ছেনা। হঠাৎ করে লক্ষ্য করলাম সামনে থেকে একটা বড় গাড়ি আমার দিকে এগিয়ে আসছে। গাড়িতা আমার থেকে তেমন একটা বেশি দুরে না। গাড়ি টি অনেক জোরে এগিয়ে এসে আমাকে একটা ধাক্কা মেরে দিলো সাথে সাথে আমার গাড়ি উল্টে পড়ে দুমড়েমুচড়ে গেলো । আমার শরীর রক্তে লাল হয়ে গেলো।
দিয়া রুমে এসে আমার সাথে কোনো কথা না বলে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। আমি না খেয়ে শুয়ে আছি। দিয়া ফ্রেশ হয়ে এসে খাবার খেতে চলে গেলো। খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ পরে দিয়া রুমে এসে খাটের উপরে শুয়ে পড়ল।
— দিয়া তুমি খেয়ে এলে এই দিকে যে আমি না খেয়ে আছি সেই দিকে খেয়াল আছে?
— আমি কি আপনাকে খেতে নিষেধ করছি নাকি? খেয়ে নিলেই তো পারতেন!
— আমাদের মধ্যে কথা ছিল তুমি এসে আমাকে তোমার হাতে,খাইয়ে দিবে।
— আপনি কি বাচ্চা নাকি যে আপনাকে খাইয়ে দিতে হবে?
দিয়ার মুখে এমন কথা শুনে খুব কষ্ট লাগলো। আমি দিয়াকে আর কিছুই বললাম না। না খেয়েই শুয়ে পড়লাম। দিয়ার কথা ভেবে অনেক খারাপ লাগছে৷ দিয়া কি ভাবে এতোটা পরিবর্তন হয়ে গেল?
ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং
মোবাইল ফোন বেজে উঠতেই আমি বর্তমানে ফিরে আসলাম। ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখি আম্মু কল দিছে৷ আমি তাড়াতাড়ি করে ফোন রিসিভ করলাম।
— হ্যালো আম্মু কি হইছে?
— বাবা তুই কই তাড়াতাড়ি হাসপাতালে আয় দিয়া কে কোথাও খুঁজে পাচ্ছিনা।
আম্মুর কথাটা শুনেই বুকের ভিতর টা নড়ে উঠল।
— কি বলছো দিয়া আবার কোথায় চলে গেছে? তুমি কই ছিলে?
— তুই আগে হাসপাতালে আয় তারপর তোকে সব বলছি।
এবার আমি ফোন রেখে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেলাম। দিয়ার জন্য খুন চিন্তা হচ্ছে এই শরীর নিয়ে মেয়েটা আবার কই চলে গেলো? আমি খুব জোরে গাড়ি ড্রাইভিং করছি। কিছুক্ষণের মধ্যে আমি হাসপাতালে পৌছে গেলাম। হাসপাতালে পৌছে আম্মুর কাছে চলে গেলাম।
— আম্মু দিয়ার কোনো খোঁজ পেয়েছ?
— না বাবা।
— তুমি দিয়ার সাথে থাকতে ও আবার কই চলে গেলো?
— আমি দিয়ার পাসে বসে ছিলাম কিন্তু হঠাৎ আমি ঘুমিয়ে গেলাম। চোখ খুলে দেখি দিয়া নাই। হাসপাতালের সব কিছুই খুঁজে দেখলাম কিন্তু কোথাও পেলাম না।
— কাওকে জিগ্যেস করোনি? কেউ তো দেখবে ও হাসপাতাল থেকে বের হলে!
— আমি জিগ্যেস করছি কিন্তু কেউ নাকি ওঁকে হাসপাতাল থেকে বের হতে দেখে নাই।
— এটা কেমন কথা? ও কি হাওয়া হয়ে গেছে নাকি?
— আমি কিছু জানিনা তুই গিয়ে দেখ ও কোথায় চলে গেছে।
— ঠিক আছে তুমি বাসায় চলে যাও আমি দেখছি।
আম্মুকে এই কথা বলে আমি হাসপাতাল থেকে বের হয়ে গেলাম গাড়ি নিয়ে। আশেপাশে ভালো করে দেখতে থাকলাম কিন্তু দিয়াকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছিনা। দিয়ার ছবি আমার মোবাইলে আছে। ছবি দেখিয়ে অনেক জনকে জিগ্যেস করছি কিন্তু কেউ দিয়ার কোনো খোঁজ দিতে পারলোনা। এই দিকে আমার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমার শরীর দিয়ে ঘাম বের হতে শুরু করে দিল৷ আমি এক হার দিয়ে ঘাম মুছে ড্রাইভিং করছি। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো এখনও দিয়াকে পেলাম না। আমার পুরো শহর ঘুরলাম কিন্তু দিয়ার কোনো খোঁজ মিলল না। হতাশ হয়ে বাসায় চলে গেলাম। বাসায় গিয়ে দরজার কলিং বেলে চাপ দিতেই আম্মু এসে দরজা খুলে দিলো।
— কিরে তুই একা কেন দিয়া কই? ওঁকে কি খুঁজে পেলিনা?
আমি মাথা নিচু করে না বললাম।
— মেয়েটা কোথায় চলে গেলো এই ভাবে? আমার খুব চিন্তা হচ্ছে মেয়েটা আবার কিছু করে বসে নাইতো?
— এসব কি বলছ আম্মু! দিয়ার কিছু হতে পারেনা ও যেখানেই থাকুক না কেন,আমি দিয়াকে খুঁজে বের করবই।
— বাবা তুই একটু পুলিশ কে খবর দে। যদি আবার খারাপ কিছু হয়ে যায়!
— আজকে রাত টা অন্তত দেখি যদি দিয়া ফিরে আসে৷ না আসলে কাল পুলিশ কে খবর দেব।
তারপর আমি আম্মুর সামনে থেকে চলে আসলাম। দিয়ার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে মেয়েটা এই অবস্থায় কোথায় যেতে পারে। এসব ভাবতে ভাবতে চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গেলো। তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম নিজে ও জানিনা। হঠাৎ করে মধ্য রাতে ঘুম ভেঙে গেলো কারো কল এর শব্দ শুনে। ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখি অচেনা নাম্বার। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি রাত ৩ টা বাজে। আমি ফোন রিসিভ করলাম। ফোন রিসিভ করে ওপাশের ভয়েস শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। কারণ কলটা আর কেউ না দিয়াই কল দিয়েছে।
— হ্যালো তুমি হাসপাতাল থেকে কোথায় চলে গেলে কাওকে কিছু না জানিয়ে? তোমার জন্য খুব চিন্তা হচ্ছিলো তুমি এখন কোথায় আছো?
— আমার জন্য চিন্তা করার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি যেখানে আছি ঠিক আছি। আর অনেক ভালো আছি।
— কিন্তু তুমি হাসপাতাল থেকে এই ভাবে কেন চলে গেলে?
— সেটা কি তোকে বলতে হবে?
দিয়ার মুখে তুই শব্দটা শুনে আমি থমকে গেলাম। যে দিয়া আমাকে আপনি ছাড়া কথা বলে না সে দিয়া আমাকে তুই করে বলল! আমি ওই সব নিয়ে না ভেবে দিয়াকে বললাম — তোমার কি হয়েছে? তুমি এমন কেন করছো? তুমি এই অসুস্থ শরীর নিয়ে কোথায় চলে গেলে?
— আমি তোকে এতোকিছু বলার জন্য বাধ্য নই। আর শোন আজকের পর থেকে তুই তোর মতো থাকবি আমি আমার মতো থাকব। কিছুদিনের মধ্যে ডিভোর্স পেপার চলে যাবে তোর বাসায়।
দিয়ার মুখে এসব কথা শুনে আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিনা। মনে হচ্ছে আমি কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখছি একটু পরে আমার ঘুম ভেঙে যাবে আর সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে।
— দিয়া এসব কি বলছ তুমি? আমি তো তোমাকে খুব ভালোবাসি। তুমিও তো আমাকে ভালোবাস!
দিয়া একটা হাসি দিয়ে বলল — ভালোবাসা! হাহাহা। তোর থেকে আমি কখনো কিছু পাইনি। আরে তুই তো নিজেই ঠিক ভাবে চলতে পারিস না। শোন আমি এখন অন্য একজন কে ভালোবাসি আর তার অনেক টাকা। সে আমাদের অফিসের বস উনি আমাকে পছন্দ করে। ভালো ও বাসে। তোর সাথে থাকলে আমি কোনো দিন কিছুই করতে পারবোনা। সে আমাকে নিয়ে সিংগাপুর যাবে ঘুরতে। আর তুই আমাকে কখনও কোথাও ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিলি? তুই তো আমার জন্য রোজ ৫ টাকার ফুল নিয়ে আসতি। আর ও আমাকে ফুলের দোকান দিয়ে দিছে। আর শোন আমার পেটে যে সন্তান আছে। ওটা তোরই সন্তান। ওটা আমি নষ্ট করে দেবো। তোর কোনো কিছুই আমার কাছে থাকবেনা।
দিয়ার কথা শুনে আমার বুক পেটে কান্না আসছে। নিজেকে অনেক কষ্ট করে কন্ট্রোল করলাম।
দিয়া — আমার সন্তানকে নষ্ট করোনা প্লিজ। আমার নিষ্পাপ বাচ্চাটা কি দোষ করছে তাকে কেনো তুমি দুনিয়ায় আলো দেখতে দিবেনা। তুমি আমাকে যা ইচ্ছে বল, আমার সন্তান কে নষ্ট করোনা প্লিজ দিয়া, তোমাকে হাত জোর করে বলছি।
— আমি তোর এতো কথা শুনতে চাইনা। আমি কাল ডাক্তারের কাছে যাবো।
এই কথা বলে দিয়া কল কেটে দিল। আমি সাথে সাথে আবার কল দিলাম কিন্তু ফোন অফ। আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। দিয়া আমার সাথে এমনটা কি করে করতে পারলো? (আমার বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আমি এই সংসারের হাল ধরলাম) দিয়া টাকার জন্য আমার সাথে এমন করলো! এসব ভাবতে ভাবতে আমার চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পরে আমি ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে আম্মুর ডাকে ঘুম ভেঙে গেলো।
— ঈশান বউমার কোনো খোঁজ ফেলি বাবা?
— হুম কাল রাতে কল দিয়েছে।
— দিয়া এখন কোথায় আছে?
— দিয়া ওর বান্ধুবীর বাসায় আছে।
আম্মুকে এই প্রথম মিথ্যে কথা বললাম। কারণ আম্মু যদি সত্যি টা জানতে পারে কখনও সহ্য করতে পারবেনা।
— ওহ, এই ভাবে চলে গেলো কেন? আমাকে না বলেই এই অসুস্থ শরীর নিয়ে চলে গেলো!
— তোমাকে ডেকে ছিল কিন্তু তুমি নাকি ঘুমিয়ে চিলে তাই না বলেই চলে গেছে৷ ও ঠিক আছে বাদ দাও আমি অফিসে যাবো।
— আচ্ছা ঠিক আছে আমি নাস্তা রেডি করে দিচ্ছি৷
— না,আম্মু আমি খাবনা তুমি খেয়ে নিয়।
তারপর আমি ফ্রেশ হতে চলে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আমি গাড়ি ড্রাইভিং করছি হঠাৎ রাস্তায় ট্রাফিক সিগনাল পড়ে গেল। আমি পাসের গাড়িতে তাকিয়ে দেখি দিয়া একটা ছেলের সাথে গাড়িতে বসে আছে। আমি দিয়াকে ডাকতে যাবো তখনই ট্রাফিক সিগনাল ছেড়ে দিল।
সকালে বুকের উপরে ভারি কিছু অনুভব করতে পারলাম। চোখ খুলে দেখি দিয়া আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। চোখে অনেক ঘুম, অনেক রাতে ঘুমিয়েছি তাই আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পরে চোখের উপরে টপটপ করে পানি পড়তেই তাকিয়ে দেখি দিয়া তার চুলের পানি আমার চোখের উপরে ফেলছে।
— আর কতো ঘুমাবেন? অনেক বেলা হইছে উঠুন। উঠে ফ্রেশ হয়ে নিন।
ঘুমঘুম চোখে দিয়াকে একটা টান মেরে নিজের কাছে নিয়ে আসলাম।
— কি করছেন এসব? মাত্র গোসল করে আসছি ছাড়ুন।
— একদম চুপ দরকার হলে আবার গোসল করবে।
— ইসসসস সখ কতো!
এবার দিয়াকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে আসলাম। তারপর দিয়ার কপালে একটা চুমু খেলাম।
— উঠুন তো ফ্রেশ হয়ে নিন নাস্তা করে নিন।
এই কথা বলে দিয়া আমার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। আমিও উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করতে চলে গেলাম। গিয়ে দেখি সবাই আমার জন্য নাস্তা নিয়ে বসে আছে। তারপর সবার সাথে নাস্তা করে আবার রুমে চলে এলাম। এই ভাবে দুই দিন কেটে গেলো। দুই দিক পরে আমি বাসায় বসে বসে ফোন টিপছি হটাৎ আমার বন্ধু রাসেল আমকে কল দিয়ে বলল আমাদের ক্লাবে যেতে। আমি বের হব তখন দিয়া রুমে আসলো।
— কোথায় যাচ্ছেন আপনি?
— একটু বের হব আমার ফ্রেন্ড এর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।
— ঠিক আছে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন কিন্তু।
— আচ্ছা।
তারপর আমি রুম থেকে বেরিয়ে ক্লাবের দিকে এগিয়ে গেলাম। ক্লাবে গিয়ে দেখি আমার সব বন্ধুরা এসে বসে আছে৷
— দোস্ত বিয়ে করলি আমাদের ট্রিট দিবি না?
তারপর আমি সবার জন্য খাবার অর্ডার দিলাম। কিছুক্ষণ পরে খাবার চলে আসলো। সবাই খাবার খেয়ে নিলাম। তারপর আড্ডা দিতে থাকলাম। আড্ডা দিতে দিতে কখন যে রাত ১১ টা বেজে গেলো বুঝতেই পারি নি। তারপর সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় চলে গেলাম। বাসায় গিয়ে দরজার কলিং বেলে চাপ দিতেই আম্মু এসে দরজা খুলে দিলো।
— কিরে এতোক্ষণ কই ছিলি তুই?
— বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে কখন যে এতো রাত হয়ে গেলো বুঝতেই পারি নি।
— এই দিকে নতুন বউ না খেয়ে তোর জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে। আর তুই এতো রাত করে বাসায় ফিরলি!
— তোমরা খেয়ে নিলেই তো পারতে।
— আমি বউমা কে অনেক বার বলছি খেয়ে নিতে কিন্তু ও তোকে ছাড়া খাবেনা বলছে।
— আচ্ছা ঠিক আছে তুমি খাবার রেডি করে রাখো আমি ওঁকে নিয়ে আসছি।
তারপর আমি রুমে চলে গেলাম রুমে গিয়ে দেখি দিয়া খাটের এক কোণে বসে আছে। আমি গিয়ে ওর পাসে এসে বসতেই ও অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে থাকলো।
— আমার বউটা আমার উপরে রাগ করে আছে কেন? কি হইছে?
দিয়া কোনো কথা বললনা এবার আমি দিয়াকে জড়িয়ে ধরে বললাম — সরি দিয়া বুঝতে পারিনি কখন এতো রাত হয়ে গেলো। আর এমন হবে না।
দিয়া এবার কান্না করে দিল।
— আরে কান্না করার কি হয়েছে? কান্না করছ কেন তুমি?
— আপনার ফোন কোথায়?
— এই তো কেন কি হইছে।
এই কথা বলে ফোন পকেট থেকে বের করে দেখি ফোন বন্ধ হয়ে আছে।
— ওহ সিট সরি খেয়াল করি নাই ফোন কখন বন্ধ হয়ে গেছে।
— জানেন আমার খুব চিন্তা হচ্ছিলো আপনার জন্য।
— আর এমন হবে না এবার চলো আমরা খেয়ে নি।
দিয়া কিছু না বলে চুপ হয়ে রইল। এবার আমি নিচে গিয়ে খাবার নিয়ে আসলাম। তারপর নিজ হাতে দিয়াকে খাইয়ে দিতে থাকলাম। দিয়া ও আমাকে খাইয়ে দিতে থাকল। খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমরা শুয়ে পড়লাম।
দিয়া হঠাৎ করে বলে উঠল — আমি আপনার বুকে মাথা রেখে সারাজীবন ঘুমাতে চাই।
— ঠিক আছে।
— আপনি কি কাল থেকে অফিসে যাবেন?
— হুম কাল থেকে অফিসে যাবো।
— হুম। একটা কথা!
— কি কথা?
— অফিসে যাওয়ার সময় কিংবা অফিসে গিয়ে কোনো মেয়ের দিকে আপনি তাকাতে পারবেন না একদম।
— যার ঘরে এমন সুন্দরী বউ আছে সে কি অন্য কারো দিকে তাকাতে পারে?
— হুম, মনে থাকে যেন!
এবার আমি দিয়ার কপালে একটা চুমু খেয়াল। তারপর দুজনে হারিয়ে গেলাম ভালোবাসার ভুবনে।
তারপর আমরা দুজনেই ঘুমিয়ে পড়লাম। দিয়া আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেলো। সকালে ঘুম ভেঙে গেলো দিয়া ধাক্কা খেয়ে।
— আরে কি হয়েছে? এই ভাবে ধাক্কা দিচ্ছ কেন?
— আপনি ইচ্ছে করে আমাকে আপনার বুক থেকে নামিয়ে দিলেন কেন?
— আমি কখন নামালাম?
— আপনি নামিয়ে না দিলে আমি বালিশের উপরে কি ভাবে চলে গেলাম?
— মনে হয় ঘুমের মধ্যে চলে গেছো।
তারপর দুজনে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। আজকে অফিসে যাবো তাই নাস্তা খেয়ে রেডি হয়ে নিলাম একটা ব্লাক কোট পড়লাম।
দিয়া এসে বলল — আপনাকে অফিসে যেতে হবে না।
দিয়া কথা শুনে আমি অবাক হয়ে বললাম — কেন কি হইছে?
— আপনি এই কালো কোট পড়ে অফিসে যেতে পারবেনা।
— কেন? এই কোটের সমস্যা কি?
–সমস্যা আছে যদি কোনো মেয়ে আপনার প্রেমে পড়ে যায়! তখন তো আমাকে ভুলে যাবেন।
দিয়া কথা শুনে খুব হাসি পাচ্ছে। আমি দিয়াকে বসলাম — পাগলি বউ একটা।
এই কথা বলে দিয়ার কপালে একটা ভালোবাসার পরশ একে দিয়ে অফিসে চলে গেলাম।
এই ভাবে অফিস বাসা করতে করতে কেটে গেলো ৪ মাস এর মধ্যে আমাদের ভালোবাসা আরো বেড়ে গেলো। আমি বাসা না আসা অব্দি দিয়া আমার জন্য সব সময় না খেয়ে বসে থাকে। একদিন রাতে আমি আর দিয়া খাবার খেয়ে এসে খাটের উপরে এসে শুয়ে থাকলাম তখন দিয়া আমাকে বলল,
— আমার বাসায় এই ভাবে থাকতে খুব বোরিং লাগছে। সারাক্ষণ শুয়ে বসে থাকতে ভালো লাগছে না আর।
— তো!
— ভাবছি আমিও একটা চাকরি করবো। এতে আমাদের জন্য ভালো হবে। তোমাকে একাই এই পরিবার দেখতে হয় আমি যদি একটা চাকরি করি এতে আমাদের ভবিষ্যতের জন্য ভালো হবে।
— তোমাকে কষ্ট করে চাকরি করতে হবে না। তুমি বাসায় থাকো।
দিয়া অনেক জোরাজোরি করতে থাকলো এক সময় আমি দিয়ার কথায় রাজি হয়ে গেলাম।
— দিয়া তুমি চাকরি করবে ঠিক আছে কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে সেটা তোমাকে মেনে নিতে হবে!
— ঠিক আছে বলো কি শর্ত?
— তুমি প্রতিদিন আমার আগে বাসায় ফিরে আসতে হবে। আর রোজ রাতে আমি তোমার হাতে খাবার খাবো।
— ঠিক আছে।
তারপর আমরা দুজনেই দুজনকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লাম। তারপর পর দিন থেকে আমি আর দিয়া এক সাথে বের হয়ে যাই দিয়া আমার আগেই বাসায় ফিরে আসে সব সময় আর আমাকে দিয়া নিজ হাতে খাইয়ে দেয়। এই ভাবেই চলছিলো আমাদের দিন কাল এই ভাবে কেটে গেলো আরো ৬ মাস। হঠাৎ করে দিয়া কেমন জানি হয়ে গেলো। এখন সব সময় আমার পরে বাসায় ফিরে আসে৷ আমার সাথে আগের মতো কোনো কথা বলে না। এসেই ঘুমিয়ে যায়৷ আগের মতো আমার কেয়ার করেনা। এখন দিয়াকে দেখলে খুব খুব খারাপ লাগে। যে মেয়ে আমার সাথে কথা না বললে তার ঘুম আসে না সে এখন আমার আগেই ঘুমিয়ে যায়।
পরের দিন রাতে আমি অফিস থেকে এসে খাটের উপরে শুয়ে আছি। তখন রুমে দিয়া আসলো।
আমি জোরে জোরে দরজা ধাক্কা দিতে থাকলাম কিন্তু দরজা খুলছেনা দিয়া। খুব ভয় লাগছে মেয়েটা যে পরিমাণ রাগি কি থেকে কি হয়ে যায়।
আম্মু — বউমা দরজা খুলো কি হইছে তোমার দরজা বন্ধ করে দিলে কেন?
দিয়া কোনো কথা বলছে না। দিয়ার থেকে উত্তর না পেয়ে আম্মু বলল — ঈশান দরজা ভেঙে পেল।
তারপর আমি জোরে জোরে দরজা ধাক্কা দিতে থাকলাম এক সময় দরজা খুলে দেখি দিয়া অজ্ঞান হয়ে ফ্লোরে পড়ে আছে৷ দিয়া হাতে বিষের বলত দেখে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। দিয়ার মুখ থেকে পেনা ছেড়ে দিছে।
আম্মু — বউমা কে নিয়ে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যেতে হবে। কিন্তু ও এমন করলো কেন?
আমি — জানি না আম্মু।
আমি দিয়াকে কোলে তুলে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। একটা টেকসি থামিয়ে ওকে নিয়ে হাসপাতালে চলে গেলাম। হাসপাতালে ঢুকতেই একজন ডাক্তার এগিয়ে আসলো।
— কি হইছে ওনার?
— বিষ খেয়েছে তাড়াতাড়ি কিছু একটা করুন ডাক্তার।
— পুলিশ কেচ আগে পুলিশে খবর দিন তারপর আমরা অপারেশন শুরু করব। না হলে আমরা কিছু করতে পারবোনা।
— ডাক্তার প্লিজ আগে অপারেশন শুরু করুন তারপর সব করবো দেরি হয়ে গেলে বিপদ হয়ে যেতে পারে প্লিজ৷
— সরি আমরা কিছুই করতে পারবোনা।
ডাক্তারের কথা শুনে আমার রাগ বেড়ে গেলো। ডাক্তারের কলার ধরে বললাম — তুই আগে ওর অপারেশন কর ভালো ভাবে বলছি যদি ওর কিছু হয়ে যায় তুই আর দুনিয়ায় আলো দেখতে পারবিনা।
ডাক্তার আমার কথা শুনে ভয় পেয়ে গেলো। ডাক্তার নার্সকে ডাক দিয়ে বলল — ওনাকে তাড়াতাড়ি অপারেশন রুমে মিয়ে যাও।
তারপর কয়েকজন নার্স এসে দিয়াকে নিয়ে অপারেশন রুমে নিয়ে গেলো। আমিও অপারেশন রুমের সামনে চলে গেলাম। অপারেশন রুমের দরজার মধ্যে ছোট একটা গ্লাস লাগানো আছে। আমি গ্লাস দিয়ে দেখতে থাকলাম। দিয়ার মুখে একটা পাইপের নল ঢুকিয়ে দিয়ে বিষ বের করছে। দিয়ার এমন করুন অবস্থা দেখে খুব খারাপ লাগছে। অনেক কষ্ট হচ্ছে মেয়েটা। কিন্তু ও কেন এমন করছে কিছুই বুঝতে পারছিনা। কেনো জানি সব কিছুর জন্য নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে ডাক্তার বের হয়ে আসলো।
— সব বিষ বের করা হয়েছে। এখন ওনাকে রেস্টে রাখতে হবে। ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।
— সরি ডাক্তার, তখন এমন ব্যবহার করা ঠিক হয়নি আপনার সাথে।
— ঠিকি আছে। আসলে আমি ভুল ছিলাম সব কিছুর আগে রোগীকে দেখা উচিৎ।
এই কথা বলে ডাক্তার চলে গেলো। একটু পরে দিয়াকে কেবিনে শিপ্ট করা হলো। আমি গিয়ে দিয়ার পাশে বসে রইলাম। অনেক্ষন পরে দিয়া চোখ খুলে তাকাল। দিয়া আমার দিকে তাকিয়ে তার চোখ থেকে পানি পড়ে গেল।
— দিয়া এমন পাগলামি করার মানে কি? তোমার যদি কিছু হয়ে যেতো তখন আমার কি হতো?
দিয়া কিছু না বলে আমার দিকে তাকিয়ে শুধু কান্না করেই যাচ্ছে। আমি দিয়ার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললাম — রেস্ট নাও তুমি আর এমন পাগলামি কখনও করবে না।
তারপর আমি কেবিন থেকে বের হয়ে গেলাম। আম্মু দিয়ার পাশে বসে রইল। আমি বাসায় গিয়ে ভাবতে থাকলাম দিয়ার কি হয়েছে। দিয়া কেন এমন করছে? তাহলে কি এই বাচ্চা অন্য কারো! দিয়া আমার সাথে এমন টা কি করে করতে পারলো? দিয়া তো আমাকে অনেক ভালো বাসতো হঠাৎ কি হয়ে গেলো? যে ওর অন্য পুরুষের সঙ্গ নিতে হলো আমি কি অকে খুশি করতে পারতাম না? আমার ভালোবাসায় কি কোনো কমতি ছিল? দিয়ার সাথে কাটানো কথা গুলা খুব মনে পড়ছে।
চলুন ফ্ল্যাশব্যাক থেকে ঘুরে আসি।
ফ্ল্যাশব্যাক
______________________
আজ আমার আর দিয়ার বাসর রাত। আমি বাসর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। বাসর ঘরে ঢুকতে খুব ভয় লাগছে৷ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি দিয়া আমাকে কি ভাবে নিবে। সব ভাবনার অবসান কাটিয়ে বাসর ঘরে ডুকে গেলাম। বাসর ঘরে ঢুকতেই দিয়া উঠে এসে আমাকে সালাম করে আবার খাটের উপরে গিয়ে বসে পড়লো বড় একটা ঘোমটা দিয়ে। আমি খাটের দিকে এগিয়ে গেলাম। গিয়ে দিয়ার পাশে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম।
হঠাৎ করে দিয়ার প্রথম বাক্য ছিল – আপনি কি কখনও প্রেম করছেন কারো সাথে?
দিয়ার মুখে এমন প্রশ্ন শুনে আমি অবাক হয়ে বললাম — না, কেন?
— তা হলে ঠিক আছে। এমনি জিজ্ঞেস করলাম কিছু মনে করবেন না।
— তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
— জ্বী বলুন।
— চলো ছাদের উপরে গিয়ে বসি। আজকে আকাশে খুব সুন্দর চাঁদ উঠেছে।
— আচ্ছা চলুন।
তারপর দিয়াকে নিয়ে ছাদের উপরে চলে গেলাম। ছাদের উপরে গিয়ে ছাদের এক কোণে গিয়ে আমরা বসলাম। ছাদের উপরে গিয়ে খুব ভালো লাগছে। হালকা হালকা বাতাস ভয়ে যাচ্ছে পুরো শরীর শীতল হয়ে আসছে। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে রইলাম।
— চাঁদ আপনার খুব ভালো লাগে বুঝি?
— হুম। খুব ভালো লাগে। আমার যখন খুব কষ্ট হয় তখন আমি একা একা চাঁদের সাথে কথা বলি।
— চাঁদের সাথে কথা বলেন মানি? চাঁদ কি আপনার কথা শুনতে পায় নাকি?
— হুম শুনতে পায়। যখন আমার খুব করে মন খারাপ হয় তখন চাঁদ টাও কেমন যেনো হয়ে যায়। চাঁদ আমার কষ্ট বুঝতে পারে।
— আপনি তো খুব অদ্ভুত মানুষ!
— কেমন আমি?
— জানি নাহ।
— আচ্ছা তোমাকে আমার কিছু কথা বলার আছে।
— জ্বী বলুন!
— তুমি আমাকে স্বামী হিসেবে মেমে দিয়েছো? নাকি মা বাবার চাপে আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছ? আমাকে তোমার বন্ধু মনে করতে পারো। আমি তোমার স্বামী নয় বন্ধু হয়ে থাকতে চাই। কাওকে যদি ভালোবেসে থাকো আমাকে বলতে পারো আমি তার হাতে তোমাকে তুলে দেবো। কারণ আমি জোর করে কারো ভালোবাসা নিতে চাইনা।
— আমি নিজের ইচ্ছেতেই রাজি হয়েছি। আর আমার এমন কেউ নেই। আমি কখনও রিলেশন করি নাই। আমি আপনার ভালোবাসা নিয়ে বেচে থাকতে চাই। পৃথিবীতে স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসাই সব থেকে বড় ভালোবাসা। এই ভালোসায় কখনো হারাম কিছুই থাকেনা।
দিয়ার কথা শুনে খুশিতে আমার মন ভরে গেলো। এবার চাঁদের থেকে চোখ সরিয়ে আমার পাশের চাঁদ এর দিকে তাকালাম৷ পুরো চাঁদের আলো যেনো দিয়ার মুখের উপরে এসে পড়ছে। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।
আমি দিয়াকে বললাম — দিয়া তোমার চুল গুলো ছেড়ে দাও।
দিয়া আমার দিকে লজ্জা মাখা চোখে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে তার চুল গুলো ছেড়ে দিল। হালকা হাওয়াতে দিয়ার চুল গুলো হাওয়ায় ভাসতে থাকলো। খুব অপরুপ সুন্দরী লাগছে দিকে। যেনো আমার চোখের সামনে দুটি চাঁদ। কোনটা রেখে কোন চাঁদ দেখবো! আমি দিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
— এই ভাবে কি দেখছেন?
— চাঁদ,
— কিন্তু চাঁদ তো আকাশে থাকে আপনি তো আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
— তুমি চাঁদের থেকে কম কিসে বলতে পারো?
আমার কথা শুনে দিয়া লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। দিয়া আর কিছু না বলে আমার কাধের উপরে তার মাথা রাখল। দিয়ার চুলের ঘ্রাণ আমার নাকে ভেসে আসলো। দিয়ার চুল থেকে খুব সুন্দর একটা ঘ্রাণ বের হচ্ছে।
— দিয়া অনেক রাত হইছে এবার চলো আমরা রুমে চলে যাই।
— ঠিক আছে কিন্তু আমি হেটে যেতে পারবোনা।
আমি দিয়ার কথা শুনে খানিকটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম — তো কি ভাবে যাবে?
— আমাকে কোলে করে নিয়ে যান।
এবার আমি একটা মুচকি হাসি দিয়ে দিয়াকে কোলে তুলে নিলাম। ওঁকে কোলে তুলে নিজের রুমে চলে গেলাম৷ দিয়াকে খাটের উপরে বসিয়ে দিয়ে আমি দরজা বন্ধ করে দিয়ে দিয়ার পাশে এসে বসলাম।
— অনেক রাত হইছে ঘুমিয়ে যাও।
— হুম, আর আপনাকে ধন্যবাদ।
— ধন্যবাদ কেন?
— আপনি আমার স্বপ্ন টা পুরোন করছেন। বাসর রাত নিয়ে আমার এমন একটা স্বপ্ন ছিল। যে আমি আমার স্বামী সাথে বসে আকাশের চাঁদ দেখবো।
— আচ্ছা ঠিক আছে এবার ঘুমিয়ে যাও।
— ঠিক আছে আপনিও ঘুমিয়ে যান।
এবার আমরা দুজনেই ঘুমিয়ে পড়লাম সকালে ঘুম থেকে উঠে বুকের উপরে ভারি কিছু অনুভব করতে পারলাম।
#ভালোবাসা অন্যরকম
[সূচনা পর্ব ]
লেখক – আবির চৌধুরী
হঠাৎ করে রাস্তায় আমার স্ত্রীকে অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় দেখে আমি থমকে গেলাম। ওর শরীরের দিকে তাকিয়ে দেখি অনেক যায়গায় রক্ত লেগে আছে। গলায় নখের দাগ স্পষ্ট দেখতে পারছি। আমার শরীর থেকে ঘাম ঝাড়তে শুরু করে দিল। আমার স্ত্রীকে এই ভাবে দেখিব তা আমি কখনও কল্পনাও করিনি। নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছিনা। আমার স্ত্রী বুকের উপরে হাত দিয়ে তার বুক ডেকে রেখেছে। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। এসব দেখে আমার চোখ দিয়ে নিজের অজান্তেই কয়েক ফোটা পানি বের হয়ে পড়লো। আমি আমার স্ত্রীর দিকে এগিয়ে গিয়ে নিজের গায়ের কোট খুলে তার গায়ে পড়িয়ে দিলাম। সে আমার দিকে করুনার দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছে।
— দিয়া এসব কি করে হলো?
দিয়া আমার কথার উত্তর না দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল। সবাই খারাপ দৃষ্টিতে দিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি পরিস্থিতি বুঝতে পেরে দিয়াকে গাড়িতে তুলে বাসার দিকে রওনা দিলাম। আমি নিজে গাড়ি ড্রাইভিং করছি দিয়া আমার পাশে বসে কান্না করেই যাচ্ছে। আমি বুঝতে পারছিনা এসব কি করে হলো। দিয়াকে নিয়ে বাসায় চলে গেলাম। বাসার সামনে গিয়ে দরজার কলিং বেলে চাপ দিতেই আম্মু এসে দরজা খুলে দিলো। আম্মু দিয়ার এমন অবস্থা দেখে অবাক হয়ে দিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল।
আম্মু — বউমা তোমার এই অবস্থা কি করে হলো? কি হইছে তোমার?
আমি — আম্মু এখন কোনো প্রশ্ন করতে হবে না। আগে আমি ওঁকে নিয়ে আমার রুমে যাই।
আম্মু — ঠিক আছে যা তাড়াতাড়ি।
তারপর আমি দিয়াকে নিয়ে আমার রুমে চলে গেলাম। রুমে গিয়ে দিয়াকে ফ্রেশ হতে পাঠিয়ে দিলাম।
অন্যদিকে দিয়া ওয়াশরুমের ভিতরে গিয়ে ঝরনা ছেড়ে দিল। আর দিয়া তার পুরো শরীর ভিজিয়ে নিচ্ছে আর কান্না করছে। দিয়া প্রায় একঘন্টা পরে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো।
— দিয়া এবার বলো এসব কি? তোমার এই অবস্থা কি করে হলো?
দিয়া কিছু না বলে চুপ হয়ে রইল। এই দিকে রাগে আমার শরীর জ্বলতে শুরু করে দিল।
— দিয়া চুপ করে থেকোনা আমার কথার উত্তর দাও। এসব কি করে হলো আর তোমার এই অবস্থা কি করে হলো?
— এখন আমার খুব খারাপ লাগছে পরে সব কথা বলব।
এই কথা বলে দিয়া খাটের উপরে শুয়ে পড়লো। কিছুদিন ধরে দিয়ার মধ্যে কেমন যেনো একটা হতাশা দেখতে পাচ্ছিলাম। সব সময় কিছু নিয়ে ভাবত আমি জিজ্ঞেস করলে কোনো উত্তর দিত না। সব সময় আমাকে এড়িয়ে চলত। ওর মধ্যে অন্য রকম কিছু একটা অনুভব করতে পারতাম। রাতে আমার সাথে ঠিক করে কথা বলতোনা। আমার আগেই ঘুমিয়ে যেতো। দিয়া আগে এমন ছিলনা আমাকে রেখে কখনোই একা খাবার খেতো না। সেই দিয়া আমাকে রেখে খাবার খেয়ে নেয় কয়েকদিন ধরে। ঘুমানোর আগে আমার সাথে গল্প না করলে নাকি তার চোখে ঘুম আসতো না আর সেই দিয়া আমার সাথে কথা না বলে ঘুমিয়ে যায়। এসব এর কারণ টা আমি বুঝতে পারিনি। আজকে আবার এমন একটা ঘটনা ঘটছে যেটা দেখার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম। দিয়া আমার থেকে কেন এসব লোকাচ্ছে বুঝতে পারছিনা। আজকে দিয়ার এমন অবস্থা দেখে খুব কষ্ট হচ্ছিলো। সবাই কি ভাবে আমার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ছিল। এসব ভাবতে ভাবতে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি দিয়া আমার পাশে নাই। তাড়াতাড়ি করে ঘুম থেকে উঠে দিয়াকে খুজতে শুরু করে দিলাম। কিন্তু পুরো বাসা খুজে দিয়াকে কোথাও পেলাম না। পরে ছাদের উপরে গিয়ে দেখি দিয়া ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। দিয়াকে দেখে একটু ভালো লাগছে। আমি গিয়ে দিয়ার পাশে দাড়ালাম।
— দিয়া তুমি এখানে আর আমি তোমাকে পুরো বাড়ি খুঁজে কোথাও পেলাম না।
— আপনি অফিসে যাবেন না?
— যাবো তার জন্য তো তোমার খোঁজ করছি। তোমার হাতের চা না খেলে তো আমার সারাদিন ভালো যায়না।
দিয়া আমাকে কিছু না বলে সামনের দিকে এগিয়ে গেল, একটু সামনে যেতেই আবার দাড়িয়ে গেলো।
— আসেন আমি চা করে দিচ্ছি।
দিয়া এই কথা বলে আবার হাঁটা শুরু করে দিল।আমি দিয়ার পিছু পিছু হাটা শুরু করে দিলাম। তারপর নিজের রুমে গিয়ে চায়ের জন্য অপেক্ষা করে বসে রইলাম। একটু পরে দিয়া এক কাপ চা নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিল। চা দিয়ে রিয়া চুপ করে আমার পাশে বসে রইল। আমি চা খেয়ে অফিসের দিকে রওনা দিলাম।
এবার আমার পরিচয় দিয়ে দেই অফিসে যেতে যেতে। আমি ঈশান আহামেদ। মা বাবার এক মাত্র ছেলে। বাবা অনেক বছর আগেই মারা গেছেন। তারপর থেকে আমি আর আমার আম্মু এক সাথে থাকি। আমি পড়াশোনা শেষ করে একটা অফিসে জব নিলাম। চাকরি পাওয়ার কিছুদিন পরেই দিয়ার সাথে আমার বিয়ে হয়ে যায়। দিয়ার সাতে আমার বিয়ে হয়েছে মাত্র এক বছর পার হলো। আমাদের বিয়েটা পারিবারিক ভাবেই হয়েছে। তবে আমাদের মধ্যে ভালোবাসার কমতি কখনোই ছিলনা। দিয়া আমকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু হঠাৎ কি হয়ে গেলো দিয়ার আমি বুঝতে পারিনি দিয়া ও আমাকে কিছুই বলছেনা।
আপনাদের আমার পরিচয় দিতে দিতে আমি অফিসের সামনে চলে এলাম। অফিসে গিয়ে নিজের কেবিনে গিয়ে বসলাম আর কাজে মন দিলাম। হঠাৎ করে আমার কেবিনে আসলো রাজ। রাজ আমার সাথেই কাজ করে আমার পাশের কেবিনে।
— ঈশান সাহেব কি অবস্থা কাল রাত কেমন কাটলো আপনার?
রাজের মুখে এমন প্রশ্ন শুনে আমি অবাক হয়ে বললাম — কাল রাত কেমন কাটছে মানে কি?
— মনে হয় আপনি কিছুই জানেনা আমি কাল সব দেখেছি।
— কি দেখেছেন আপনি?
— কাল যে একটা মেয়েকে নিয়ে বাসায় গেলেন আমি কিন্তু ওখানেই চিলাম। খুব মজা করছেন তাইনা? পতিতা মেয়েটা কিন্তু সেই ছিল। যদি আপনার যায়গায় আমি থাকতাম ভাবতেই কেমন লাগছে।
রাজের কথা শুনে আমার গায়ে আগুন ধরে গেলো।
আমি — Talk to you soon and keep up the good content. She is my wife. Don’t talk nonsense about him ok.
রাজ — What?
— যেটা বললাম সেটাই। ওই মেয়েটা আমার স্ত্রী ছিল। কোনো পতিতা মেয়ে না।
— i am sorry but এই মেয়েকে আমি কালকে একটা ছেলের সাথে দেখছি।
— একটা ছেলের সাথে মানে কি? আর কোথায় দেখেছেন?
— আমি কাল অফিস থেকে বের হয়ে একটা রেস্টুরেন্টে লান্স করতে গিয়ে দেখলাম একটা ছেলের সাথে আপনার স্ত্রী কি নিয়ে কথা বলছে। দেখে মনে হচ্ছিলো আপনার স্ত্রী খুব রেগে ছিল। কিন্তু যে ছেলের সাথে ছিলো ছেলেটা কেমন যেনো ব্যাবহার করছিল।
— আপনি কি ছেলেটাকে চেনেন?
— নাহ। আমার কথায় কিছু মনে করবেন না। আমি না বুঝেই এসব বলে ফেললাম।
এই কথা বলে রাজ আমার কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো। রাজের কথা শুনে আমার মাথা হ্যাং হয়ে গেলো। মাথায় কোনো কিছুই কাজ করছেনা। দিয়া আমার সাথে এমন করতে পারলো? এসব ভেবে আমার রাগ চরমে ওঠে গেল। আমি কাজে মনযোগ দিতে পারছিনা। নিজের মনের ভিতর অনেক প্রশ্ন জমা হয়ে আছে৷ সব প্রশ্নের উত্তর আমার চাই৷ এসব ভেবে আমি অফিস থেকে বেরিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে বাসায় পৌছে গেলাম। নিজের রুমে গিয়ে দেখি দিয়া খাটের উপরে বসে আছে। আমি দিয়ার কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে টেনে দাড় করালাম। দিয়া আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
— দিয়া এসব কি শুনি আমি তুমি কাল কোন ছেলের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলে আর ছেলেটা কে? আমার সব প্রশ্নের উত্তর চাই আমি।
দিয়া কিছু না বলে হঠাৎ করে মাথা ঘুরে পড়ে গেল। আমি দিয়াকে কোলে তুলে খাটের উপরে শুইয়ে দিয়ে আম্মু কে ডেকে নিয়ে আসলাম।
আম্মুর কথায় আমি ডাক্তার কে কল দিলাম। ডাক্তার কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসলো। ডাক্তার দিয়াকে চেকাফ করলো। দিয়ার জ্ঞান ফিরছে।
আমি — ডাক্তার কি হইছে দিয়ার?
ডাক্তার — তেমন কিছুই না মিষ্টি খাওয়ান আপনি বাবা হতে চলছেন।
ডাক্তারের কথা শুনে আমি খুশি হতে পারলাম না। কারণ এই সন্তান আদোও আমার কিনা আমি জানিনা। এসব ভাবতেই খুব খারাপ লাগছে। আমি দিয়ার দিকে তাকিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। বের হয়ে আসতেই দিয়া রুমের দরজা বন্ধ করে দিল। দরজা বন্ধ করার শব্দ শুনে আমি দরজা ধাক্কা দিতে শুরু করে দিলাম। এই মেয়ে যে পরিমাণ রাগি কি করে বসে আল্লায় ভালো যানে।
#প্রণয়
#১৪তম
#শেষ পর্ব
#Abir Hasan Niloy
…
পুলিশ অফিসার নিজের ফোনে নাম্বারটি পাতাতে থাকে। কল দিতে দিতে বলে “এখনো বেঁচে আছে। হাসপাতালে নিয়ে যাও জলদি। জেলা হসপিটাল কাছেই আছে। আমি দেখি কার নাম্বার এগুলো। যাও।” অফিসার কথাগুলো দুজন পুলিশকে বললো। ওদিকে আরিনা বেগমসহ বাসার সবাই কান্না করছে। হঠাৎ আরিনা বেগমের ফোন বেজে উঠল। দৌড়ে যায় অবনি। রিসিভ করে সে। ওপাশ থেকে একজন পুরুষ কণ্ঠে বলে..
– আপনি কি আরিনা বেগম বলছেন? (পুলিশ)
– আমি ওনার ছেলের বউ। আপনি কে? (অবনি)
– ওনার ছেলের নাম? (পুলিশ)
– অর্ন, আবিদ হাসান অর্ন। কিন্তু আপনি কে? (অবনি)
– ওহ.. মানে আপনি কি ওনার স্ত্রী? (পুলিশ)
– জ্বি। উনি কোথায়? (অবনি)
– আমি পুলিশ আকরাম খান। সদর থানার অফিসার। সদর থানার এরিয়াতে একটা বিরাট এক্সিডেন্ট হয়েছে। অর্ন সাহেব রাস্তার পাশে পড়ে ছিল। দেখে যতদূর মনে হয়েছে কন্ডিশন ভালো না। হয়ত মারা যেতে পারে। হসপিটালে পাঠানো হয়েছে। আপনাদের কেউ আমাদের থানায় এসে যোগাযোগ করবেন। আর জেলা হাসপাতালে আসুন দ্রুত। (পুলিশ অফিসার)
– অর্ন…
পুলিশ অফিসার ফোন কেঁটে দিল। অবনি ফোন হাতে নিয়ে দৌড়ে সবার সামনে আসলো। হাপাতে হাপাতে বললো “অর্ন হাসপাতালে। এক্সিডেন্ট করেছে। পুলিশ বলছে কন্ডিশন ভালো না। কাউকে থানায় যেয়ে কথা বলতে বলেছে আর হাসপাতালে যেতে বলেছে।”
.
এক ঘন্টার ভিতর বাড়ির সবাই হাসপাতালে এসে পৌছেছে। ইমার্জেন্সির সামনে এসে দাঁড়ায়। পুলিশদের সাথে আনাফ, আর তার বাবার কথা হয়েছে। পুলিশি সব ঝামেলা শেষ করে তারাও ইমার্জেন্সির কেবিনের সামনে এসে অপেক্ষা করে। কিছু সময় পর একজন নার্স এসে দাঁড়ালো। অবনি ছুটে যায়। নার্সকে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই নার্স বলে “এ পজেটিভ রক্তের প্রয়োজন। ছিল তবে ফুরিয়ে গেছে। আপনাদের কারো এ পজেটিভ রক্ত আছে?”
অবনি বলে “আমার আছে। আমি রক্ত দেবো।” নার্স একটা কেবিনে নিয়ে যায় তাকে। অর্নের অনেক রক্ত বের হয়েছে। মাথায় হেলমেট না থাকায় পিছনের অংশ ফেঁটে গিয়েছে। রক্তের প্রয়োজন এখন। নার্স অবনির থেকে রক্ত নিয়ে চলে যায়। অবনি একটি চেয়ারে এসে বসলো। সিফাত এসে তার পাশে বসে। অবনির দিকে তাকিয়ে আস্তে গলায় বললো..
– আমি কখনো ভাবিনি এমনটা হবে। অর্ন এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেবে জানতামই না। ইরার থেকে কষ্ট পেয়েছে। আমাদের থেকে কষ্ট পেয়েছে। সব মিলিয়ে সে হয়ত নিজেকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। হয়ত উপর ওয়ালা তা চায়নি। তিনি ঠিকিই একটা এক্সিডেন্টের মাধ্যমে অর্নকে সুসাইড থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। বাকিটা তারই ইচ্ছে। তবে আমি সরি অবনি। আমি বুঝিনি এতকিছু ঘটে যাবে অর্নের মধ্যে। (সিফাত)
অবনি কাঁদতেই থাকে। সে কোনো কথা বলেনা। আরিনা বেগম অবনিকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে নিল। অবনির চোখে মুখে ভয় আর চিন্তার ছাপ অনেক বেশি। ভোর রাত হয়ে গেছে। ভোর রাতে ছোটন আনাফের সাথে হাসপাতালে আসলো। ছোটন দৌড়ে আরিনা বেগমের কাছে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলে..
– ভাইয়ার কি হয়েছে? ভাইয়া চলে গেলে আমি মরেই যাবো। আমার মা মারা গিয়েছে। আমার পাশে একমাত্র তিনিই ছিলেন। আমার কিছু লাগবে না। আমার তাকেই চাই। অবনি ভাবী.. জানেন আপনি? ভাইয়া আপনাকে এখন কতখানী চায়? আমি সব জানি। আমার ভাইয়াকে এনে দেন।
– ছোটন, চিন্তা করিস না। তোর ভাইয়া ঠিক আছে। দোয়া কর।(আনাফ)
কেবিনের সামনে সবাই অপেক্ষা করতে থাকে। ভিতরে ডাক্তাররা অর্নের মাথা সেলাই করেছে। ব্যান্ডেজ করেছে। এখন অর্নের জ্ঞান ফেরা বাকি। ভোরের দিকে ডক্টর বের হল। বাইরে আসতেই সবাই ঘিরে ধরে তাকে। ডাক্তার জানায় “চিন্তা করার কারণ নেই। উনি সুস্থ তো আছেই। বাকিটা উপরওয়ালার ইচ্ছে। জ্ঞান ফেরার জন্য অপেক্ষা করুন। হাত ভেঙে গেছে। আমরা সবকিছু ঠিকঠাক ভাবে চেক করেছি। ট্রিটমেন্টও করেছি। আপনারা জ্ঞান ফিরলে দেখা করতে পারবেন।” ডাক্তার কথাগুলো বলে চলে যায়।
.
অর্ন আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালো। উপরে ফ্যান ঘুরছে। হাতে পায়ে আর মাথায় ব্যান্ডেজ করা। ঠিকমত নড়ার উপায় যেন নেই। অর্ন চোখ খুলে মনে মনে বলে “আমি এখানে কিভাবে এলাম। জ্ঞান হারানোর আগে অবনির কথা ভাবছিলাম। চেয়েছিলাম তো মরতে। কিন্তু বেঁচে আছি এখনো? যদিও এক্সিডেন্টটা হঠাৎ করেই হয়ে গেছে।” ছোটন অর্নের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। অর্ন চোখ মেলতেই ছোটন দেখে আনন্দের সাথে চিৎকার দিয়ে বলে “ভাবি… ভাইয়ার জ্ঞান ফিরেছে। চোখ মেলে তাকিয়েছে।” সবাই ছুটে আসে অর্নের চারপাশে। নার্স এসে সবাইকে একটু দূরে সরিয়ে দিল। অর্ন ধীর গলায় ছোটনকে উদ্দেশ্য করে বললো..
– ছোটন.. তুই এখানে? আমি কোথায়? (অর্ন)
– তুমি, হাসপাতালে আছো। পুলিশ নিয়ে আসছে। এখন কেমন আছো? (অবনি)
অর্ন অবনির কথা শুনে চমকে গেলো। নার্সের উদ্দেশ্যে বলে “আমাকে একটু উঠাবেন? আমি হেলান দিয়ে বসবো।” নার্স সাবধানতার সাথে অর্নকে বসালো। সবাইকে দেখতে পায় অর্ন। সবার সাথে কথা বলে নিল। আরিনা বেগম এসে অর্নের কপালে চুমু দিলেন। সবাই অর্নকে পেয়ে যেন খুশি হয়েছে। বেশ কিছু সময় অর্নের সাথে টুকটাক সবাই কথা বলে। কিন্তু অর্ন এখনো অবনির সাথে কথা বলেনি। ডাক্তার এসে জানালো.. “উনি এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ নন। আপনারা ভীড় করলে, সমস্যা আছে। আপনারা একজন করে দেখতে আসুন।”
ডাক্তারের কথা শুনে আরিনা বেগম বলে “সবাই তো অর্নকে দেখলে। চলো সবাই বাহিরে থাকি। অনেক কাজ আছে। অবনি থাকুক এখানে। ওদের একটু আলাদা কথা বলার প্রয়োজন আছে।” আরিনা বেগমের কথা শুনে সবাই রুম থেকে বের হলো। অবনি একা রুমে বসে আছে। অর্নের সামনে, টুলের উপর বসা সে। অবনি কোনো কথা বলছে না। একাধারে কেঁদেই যাচ্ছে। অর্ন চুপচাপ অবনির কান্না দেখছে। কাঁদলেও যে মানুষের সুন্দর দেখায় হয়ত অর্নের এর আগে দেখার চোখ ছিল না। অর্ন বেশ কিছু সময় পর বলে..
– সরি… (অর্ন)
– সরি? সরি কেনো বলছো? (অবনি)
– তোদের মাঝে ফিরে এলাম। আমি আসলেই চাইনি এমনটা। একবারে হারিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। বাট হলো না। সরি..(অর্ন)
– চুপ করো তো তুমি? এত বেশি কেনো বোঝো? আর আমাকে তুই করে কেনো বলছো? (অবনি)
– হিহিহি… তুই তো আমার কাজিন। আর তুমি বলার জন্য আমার কাছে একটা সুনির্ধারিত সম্পর্কের প্রয়োজন। যেটা নেই। (অর্ন)
– হা কাজিন। সাথে তোমার বউও আমি। বেশি বোঝে। (অবনি)
– হুম, বুঝি বলেই তো সবাইকে মুক্তি দিতে চাইছিলাম। (অর্ন)
– কিসের মুক্তি হ্যা? কি ভাবোটা কি আমাকে? এত সহজে ভালোবাসা শেষ হয়ে যাবে? নিজেকে বড্ড মহৎ ভাবো তাইনা? ঐ তুমি দেখেছো আমি কখনো সিফাতকে ভালোবাসি বলেছি? আজাইরা চিন্তা ভাবনা করো খালি। (অবনি)
– সবকিছু মুখে বলতে নেই। বোঝা যাই। (অর্ন)
– সেটাই তো, বেশি বোঝো।
অবনিকে রাগতে দেখে অর্নের বেশ হাসি পাচ্ছে। হাসিটা ভালোবাসার। তাচ্ছিল্যের নয়। কিন্তু অবনি কেনো রাগছে? অর্ন রাগের মানে খোজার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু যুক্তিগত কোনো কারণও পাচ্ছে না অর্ন। অবনি আবার কাঁদতে কাঁদতে বলে..
– আমি তোমাকে জেলাস ফিল করানোর জন্য সিফাতের সাথে মিশেছিলাম। ইরার কথা শুনে আমার যেমন রাগ হতো, তেমনি তোমাকে ইগ্নোর করে সিফাতের সাথে মিশে রাগ ওঠানোর চেষ্টা করেছি। আর রইল সিফাতের কথা.. সে আর খালামনি মানে তোমার মা প্ল্যান করেই আমার সাথে মিশিয়েছে সিফাতকে। যেন আমার মাঝে তোমার প্রতি অনূভূতিটা কেমন, আর আদৌ আমাদের মধ্যে সম্পর্ক ঠিক আছে কিনা তা দেখার জন্য সিফাতকে পাঠায়।
সত্য বলতে আমি একটা সময় ভাবছিলাম তোমাকে ছেঁড়ে সিফাতের সাথে থাকবো। কিন্তু তোমার কল্পনা আমি কখনো মাথা থেকে ফেলতে পারিনি। সবসময় তুমি আমার ভাবনাতে এসে ভিড় জমিয়েছো। তোমাকে ইগ্নোরেন্স দেখাতে গিয়ে নিজেই আরো তোমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি। সিফাতেন কথা যতটুকু মনে পড়েছে, তার থেকে শতগুন তোমার কথা মনে পড়েছে আমার। বিশ্বাস করতে হবেনা আমাকে। তবে তুমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে, তা খুবিই জঘন্য। (অবনি)
– হুম ভাইয়া.. অবনি তোমাকে ভালোবাসে। শুনলাম তিনি রক্তও দিয়েছে। সারারাত ঘুমায়নি। দেখো সকাল দশটাই তুমি চোখ খুলেছো। অবনি ঘুমায়নি একটুও। সারারাত কেঁদেছে। সব শুনে বুঝলাম তুমি একটা বোকাসোকা লোক। মেয়েদের মন বোঝার মত তোমার ক্ষমতা নেই। (ছোটন)
– এহ, তুই খুব বুঝিস? আর এখানে কি তোর? যা বাইরে যা। (অর্ন)
– ওকে বস। এখন তো তোমাদের সময়। হয়ে গেলো ডাক দিও। (ছোটন)
– ফাজিল। (অর্ন)
ছোটন রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। অর্ন আর অবনি মুচকি হাসছে। অবনির দিকে তাকালো অর্ন। কালো মেয়েটার মুখে এত মায়া জড়িয়ে আছে। সে মায়াতে কেবল একজনের জন্য আকাশ বিশাল ভালোবাসা লুকিয়ে আছে। আসলে সত্য বলতে কিছু মানুষ বা কালো মানুষ আছে যারা ভালোবাসে, একজনেই পৃৃথিবীর সমান ভালোবাসে। সেই ভালোবাসা কেবল তার জন্যই জমা থাকে সবসময়। কালো ছেলে বা কালো মেয়ে সঙ্গী পাওয়াটাও ভাগ্যের ব্যাপার। আবার অগাধ ভালোবাসা পাওয়াটাও ভাগ্যের ব্যাপার।
– তুই আমাকে কষ্ট দিয়েছিস। (অর্ন)
– এখনো তুই করে বলছো? আর আমি কষ্ট দিছি? তুমি দাওনি আমাকে? (অবনি)
– আচ্ছা, কষ্ট বিয়োগ কষ্ট। কাটাকাটি। (অর্ন)
– তুমি কেনো এমন করলা? যদি সত্যিই মরে যেতা? কি হতো আমার? (অবনি)
– কি আর হতো, সিফাতকে নিয়ে থাকতা। (অর্ন)
– কখনো ওর প্রতি ভালোবাসা আসতো না। আর তুমি বারবার সিফাতকে কেনো টানছো। আজব.. ইরার কথা বলেছি একবারো?(অবনি)
– তুমি কেন ইরার কথা তুলেছো? আজব.. (অর্ন)
– এই তুমি আগে সিফাতের কথা বলেছো। (অবনি)
– তুমি ইরার কথা বলেছো। (অর্ন)
– উফ… তুমি এমন ঝগড়াটে ছিলা না তো। ইরা কি ঝগড়া শিখিয়েছে তোমার? (অবনি)
– আবার ইরার কথা? তুমি তো আগে এত কথা বলতে না। সিফাত কি কথা শিখিয়ে তোমার? (অর্ন)
– আরে… কিসের সিফাত? চুপ করো তো। (অবনি)
– হু…
দুজনে রাগি দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকায়। কিছু সময় তাকিয়ে থেকে দুজনেই হেঁসে ওঠে। অবনি আরো অর্নের দিকে এগিয়ে গেলো। ভাঙা হাত একটু মেলে দিতেই অবনি অর্নের বুকে মাথা রাখলো। অর্ন অবনিকে জড়িয়ে ধরে। অবনি কাঁদতে কাঁদতে বলে..
– তোমার বন্ধুগুলো ভালো না। দেখো, তোমাকে একবারো দেখতে আসেনি। (অবনি)
– ওদের আর প্রয়োজন নেই। তুমি আছো তো আমার পাশে। (অর্ন)
– হুম, আমি আছি সবসময়। তোমাকে হারাতে দেবো না একদমই। (অবনি)
– আমিও না। বাচ্চা কাচ্চা নিতে হবে তো, হারিয়ে আর কি করবো? (অর্ন)
– ফাজিল… হাত পা, মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে শুয়ে আছে। এখন বাচ্চার চিন্তা শুরু করে দিয়েছে। (অবনি)
– বুঝবানা এসব। (অর্ন)
– চুপ, বকো কেন এত? এই প্রথম তোমার বুকে মাথা রাখছি। আহ কি শান্তি। (অবনি)
অর্ন আর কিছু বললো না। সে অবনিকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে নিল। আসলেই প্রিয় মানুষদের বুকে মাথা রাখার যে শান্তি, সেটা কেবল যার আছে, সেই জানে। সবার ভালোবাসার পূর্ণতা পাক। এখন অর্নকে অবনি সেবা, ভালোবাসা দিয়ে সুস্থ করে তুলবে। অর্নও এখন অবনিকে নিজের প্রিয় মানুষ হিসেবে গ্রহন করে নিয়েছে। ওদের ভালোবাসা ভালো থাকুক। সবার ভালোবাসা এভাবেই ভালো থাকুক।
——<সমাপ্ত>—–
#প্রণয়
#১৩তম পর্ব
#Abir Hasan Niloy
…
অবনি অর্নের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এই প্রথম বিয়ের পর অবনির জন্য হয়ত অর্ন কিছু করতে যাচ্ছে। অর্ন তুর্জের সামনে এসে দাঁড়ায়। তুর্জের দিকে তাকিয়ে বলে..
– অবনি আমার বউ। আমার সামনে তার গায়ে টাচ করাটা তোর অনেক বড় ভুল হবে। আরেকটা কথা, অনেক পরে অনুধাবন করেছি, সাদা চাঁমড়া হলেই যে ভালোবাসা তৈরী হবে, ভালো মনের মানুষ হবে এমনটা না। ভালো মানুষ হতে হলে, বাহিরের সৌন্দর্য কোনো ফ্যাক্ট না। তার জন্য প্রয়োজন ভালো ব্যবহার। একটা কথা কি জানিস.. উচ্চ সিজিপিএ ওয়ালা বন্ধুকে পরীক্ষার ৩ দিন আগে লয়্যাল বন্ধু, একটা চ্যাপ্টার বুঝার জন্য কল দিয়ে তার বাসায় যেতে চেয়েছিলো। সে জবাবে বলছিলো ‘তুই এখন আসিস না, তুই আসলে আমার পড়ালেখার ক্ষতি হবে। ‘সেদিন এক কম সিজিপিএ ওয়ালা বন্ধুর বাসায় গিয়ে তার অতিথেয়তায় সত্যিই মুগ্ধ হয়েছিলো লয়্যল বন্ধু।
বাসার গলিতে ঢুকবার পথে গেইটের সামনে থাকা গার্ড মামাকে প্রথমদিন একটা সালাম দিয়েছিলো একটা ছেলে, আর তাকে জিজ্ঞাসা করছিলো “মামা ভাল আছেন?” যাস্ট এতুটুকুই…….
এরপর থেকে দারোয়ান, ঐ ছেলেটাকে যতবার দেখে ততবারই দাঁড়িয়ে সামনে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করে “ভাইয়া ভাল আছেন?”
ভার্সিটিতে পা রেখে প্রথম যেদিন একটা ছেলে বন্ধুদের নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে যায়, সেদিন এক ওয়েটারের সাথে পরিচয়। এরপর থেকে সেখানে গেলেই তার টেবিলে বসে ওরা, সুখ দুঃখের গল্প করতো ওয়েটারের সাথে। পরের ঈদে বন্ধুরা কয়েকজন মিলে, ওয়েটারকে ভাল অংকের একটা বকশিশ দিয়েছিল।
সেই ছেলে পরে ওমানে যায়। প্রায়ই ওখান থেকে ফোন দিয়ে, তাদের বলে ‘আপনাদের কিছু লাগলে বলেন পাঠাইয়া দেই।’ কিছুই না, ঈদের আগে অল্প কয়টা টাকা যাস্ট সবাই মিলে দিয়ে বলছিল “বাড়ি যা, ভাল করে ঈদ করিস।”
টং দোকানে একটা কালো কুচকুচে কুকুর সব সময় বসে থাকতো। একদিন চা খাওয়ার সময়, একজন ছেলের সামনে এসে লেজ নাড়ায় আর ঘুর ঘুর করতে থাকে। শুধু পাঁচ টাকার একটা পাউরুটি কিনে খেতে দেয়। এখন প্রায়ই মাঝ রাতে চা রুটি খেতে বের হওয়া ছেলেটা, আগে ওই সময়টাতে চা খেয়ে সামনের গলি দিকে ফিরতে ভয় পেত। যদি ছিনতাই হয়। এখন মাঝরাতেও কানে হেড ফোন লাগিয়ে হাঁটে ছেলেটা। ভয় হয় না তার। কারন ওই কালো কুকুরটা ছেলেটার সাথেই থাকে। অন্য কাউকে দেখলেই তেড়ে যায়। সাথে পা মিলিয়ে হাটে। দুইটা হাত থাকলে হয়তো জড়িয়েও ধরত। তার চোখের ভাষা বলে দেয় ” কেউ এই ছেলেটাকে ধরতে আসলে কইলজা খুইল্লা ফালামু ”
উচু শ্রেনীর মানুষদের ডিকশনারিতে কৃতজ্ঞতা শব্দটা প্রায়ই নাই বললেই চলে। অনেক রুই কাতলার জন্য জীবনে অনেক কিছু করে মানুষ। নেগেটিভ গ্রুপের এক ব্যাগ ব্লাড ম্যানেজ করতে সারারাত দৌড়াতে হয়। কিন্তু পরদিন ভোরে জানতেও চায়না ব্লাডটি কার, কোথা থেকে ম্যানেজ করা হয়েছে। কিন্তু সামান্য একটা গার্ড, রাস্তার মুচি, ক্যান্টিনের মামা এমনকি টং দোকানের কুকুরটাকেও যদি একটু এহসান করা হয় তখন পারলে পুরা হার্টটা খুলে দিবে। মানুষ হতে টাকা লাগে না, মানুষ হতে সুন্দর চেহারা লাগে না। বিশাল আকাশের মত বড় একটা মন লাগে। যেটা তোর বউয়ের মধ্যে, তোদের কারো মধ্যে নেই। অবনির মধ্যেই আছে।
.
অর্ন কথাগুলো বলে সেখান থেকে চলে যায়। তুর্জদের বাড়ির সামনে এসে বাইকে বসলো। অবনি দৌড়ে আসে অর্নের সামনে। অর্নের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছু সময়। অর্ন কোনো কথা বলেনা। সে বাইক স্টার্ট করলো। অবনি বলে..
– তুই, আমার জন্য ফাইট করলি?
– আমি তোকে আসতে বলেছিলাম। আমাকে না বলেই চলে এসেছিস যে। (অর্ন)
– সিফাত জোর করলো, তাই ওর সাথে চলে এলাম। সিফাত জানে তুই বিয়েতে আসবি। আর খালামনির সাথে কেমন করে কথা বলে এসেছিস। চিন্তা করছে। (অবনি)
– ওহ.. সিফাত বললো বলেই চলে এসেছিস। (অর্ন)
– আরে না.. শোন..(অবনি)
– হয়ত কিছু সময় পর তুই ডিভোর্স লেটার পাবি। ভালো থাকিস।
অর্ন আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ালো না। বাইক স্টার্ট দিয়ে অবনির সামনে থেকে চলে আসে। অবনি স্থির দৃষ্টিতে অর্নের চলে যাওয়া দেখতে থাকে।
.
অর্ন ঢাকা শহর ছেঁড়ে বেশ অনেকটাই দুরে চলে এসেছে। বাইকের স্পিড ৭০+। এক হাত দিয়ে মাথা থেকে হেলমেট খুলে নিল। তারপর ছু্ড়ে ফেলে দিল রাস্তার পাশে। বাইকের স্পিড আরো তোলা শুরু করে। ৭৫, ৭৬, ৮০, ৮৫, ৯০, ৯৫। ঝড়ের বেগে গাড়ি চলা শুরু করেছে। হাত ঘড়ির দিকে একটু তাকালো। রাত ১০ টার বেশি বেজে গেছে। অবনির কথা খুব মনে পড়ছে ওর। অবনি এখন সিফাতের। অর্ন সেটা ভাবতে ভাবতেই মনে মনে বলে “ভালোবাসা চাইলেই ধরে রাখা যাইনা। ভালোবাসা ধরে রাখতে হলে মেহনত করতে হয়। কষ্ট পেয়ে ভালোবাসা চাইতে হয়, কষ্ট দিয়ে ভালোবাসা খুজতে নেই। পৃথিবীর সবাই ভালোবাসা চায়। আমি না হয় না পাওয়া ভালোবাসা নিয়েই হারিয়ে যাবো।” কথাগুলো ভাবতে ভাবতে স্পিড আরেকটু তুললো। সামনে একটা পিকআপ যাচ্ছে। অর্ন স্পিড একটু একটু করে তোলা শুরু করলো আবার। পিকআপটাকে ক্রস করার জন্য ডানে বাইক ঘোরাতেই সামনে থেকে, অনেকটা গতিতে ঢাকা পরিবহন আসে।
অর্ন পরিবহনটাকে দেখে বামে বাইক ঘোরাতেই, পিকআপের সামনে বাইকের পিছনের অংশ বাড়ি খায়। সাথে সাথেই অর্নের বাইক স্পিডের কারনে রাস্তার উপর পড়েই, গড়াতে শুরু করলো। অর্ন সিটকে পড়ে রাস্তার উপর। মাথাটা রাস্তার উপরে যেয়েই পড়ে। পিছনে থেঁতলে যায় ওর। রাস্তার উপর পড়তেই অর্ন গড়াতে গড়াতে আরো অনেকটা দূরে সরে যায়। পিকআপ যেয়ে রাস্তার পাশের পিলারের সাথে ধাক্কা দিল। পরিবহনটাও রাস্তার পাশের গাছে যেয়ে ধাক্কা খায়। বেশ বড় রকমের একটা এক্সিডেন্ট হয় সেখানে। অর্নের মাথা একদমই থেঁতলে গিয়েছে।
.
অবনি ছাঁদে দাঁড়িয়ে আছে। সিফাত এসে পিছনে দাঁড়ালো। অবনি সিফাতকে ডেকেছিল। তাই সিফাত এসেছে। অবনির পিছনে এসে সিফাত দাঁড়িয়ে বললো..
– কিছু বলবা তুমি? (সিফাত)
– হুম, অনেক কিছুই বলার আছে। (অবনি)
– আমি তো শুনতে প্রস্তুত। কিন্তু আমারও কিছু কথা আছে। তুমি বলো, তারপর আমি বলবো। (সিফাত)
অবনি সিফাতের মুখের দিকে তাকালো। সিফাতের মুখে এক আকর্ষনীয় আশাময় মুখের আলোড়ন। সিফাত খুশি হওয়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অবনি জোরে একটা শ্বাস নিল। তারপর বলল..
– আমি অর্নের বউ। আর আমি অর্নকে ভালোবাসি খুব। সত্য বলতে, অর্নকে ছেড়ে তোমাকে ভালোবাসতে চেয়েছিলাম। মনের বিরুদ্ধে যেয়েও চেষ্টা করেছিলাম অনেকবার। কিন্তু এতটা সহজ নয়, ভালোবাসা পরিবর্তন করতে। ঘুরে ফিরে বারবার আমি অর্নের কাছে নিজের অনুভুতি খুজে পেয়েছি। অর্ন খারাপ, আমাকে ভালোবাসে না। তাতে কি? এখন কোনো আফসোস নেই। আমি তবুও অর্নকে ভালোবাসি খুব। অর্ন ছাড়া আমি কোনো কিছুই কল্পনা করতে পারিনি, পারবোও না। অর্নই আমার সবকিছু।
তোমার সাথে ক্লোজলি মিশেছিলাম অর্নকে একটু বোঝাবো, যে ভালোবাসায় অবহেলা রাখতে নেই। আজ ওর চোখে মুখে আমার জন্য অনেক কিছুই দেখেছি। আমি সাকসেস। আমি ব্যস এতটুকুই বোঝাতে চেয়েছিলাম অর্নকে। আমি পেরেছি। আমি অর্নকে ভালোবাসি। অর্নও আমাকে ভালোবাসে। আমি এখন অর্নকে চাই। সরি সিফাত, তোমার থেকে অনেক কিছুই লুকিয়েছি। তোমাকে অনেক কিছুই বলিনি। হয়ত তুমি আমাকে নিয়ে বেশি কিছু ভেবেছিলে। সরি সিফাত।
.
সিফাত অবনির দিকে অপলক হয়ে তাকিয়ে আছে। অবনি মাথা নিচু করে নিল। অবনির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ সিফাত হেসে দেয়। অবনি সিফাতের হাসি দেখে বোকার মত তাকিয়ে থাকে। যেখানে সিফাত অবাক হওয়ার কথা, সেখানে অবনি অনেকটাই অবাক হয়ে গেছে। সিফাত হাসতে হাসতে বলে..
– আরে গাধি নাকি তুমি? শোনো তাহলে তোমাকে বলি সবটা। আমি যেদিন ফোন করেছিলাম বড়মাকে। সেদিন জানতে পারি তুমি অর্নের বউ। বড়মা নিজেই আমাকে বলে অবনি আর অর্নকে দেখে যেতে। এখন অবনিকে দেখিনি আমি। তাই দেখতে এসেছিলাম। যেদিন আসি সেদিন বড়মা আমাকে অনেক কিছুই বলে। আর তোমার এবং অর্নের মধ্যে মনের যে অমিলটা ছিল, তা বড়মা আগে থেকেই জানতো। আমাকে যেভাবে তিনি করতে বলেছে, সেভাবেই করেছি। বড় মায়ের প্ল্যান ছিল, যেন আমি তোমার সাথে মিশি। এর পিছনে দুটো কারন ছিল। প্রথমটা হল, তুমি অর্নকে আসলেই কতটুকু ভালোবাসো, বা বিয়ে নিয়ে তুমি কতটুকু খুশি কিংবা অর্নকে পেয়ে তোমার ভিতরে কি চলছে না চলছে সবটা জানা ছিল প্রথম কারণ। আর বড় মা যেটা জানতো মানে তোমার আর অর্নের মিল নেই। সেই মিলটা যেন আমি করিয়ে দিই। এটাই আরেকটা কারণ।
আচ্ছা একটা বলো তো। তোমার কি মনে হয়, আমি এতদিনে কি একবারো জিজ্ঞাসা করবো না অর্নের বউ কে? কারণ আমি তো অর্নের বউকেই দেখতে এসেছিলাম। যাইহোক, সবাই ভালো অভিনয় করেছে। শেফাও ভালো অভিনয় করেছে। সেদিন তোমাকে রুমে জড়িয়ে ধরেছিলাম। শেফা ওটা দেখেছিল। তাকে বলেছিলাম আড়ালে থাকতে। যেন আমি যা করি, তা অর্নকে বলতে। আমরা কেবল রাস্তাটা তৈরী করেছে। হেঁটেছে অর্ন। অর্ন তোমাকে এখন অনুভব করে। কিন্তু তোমার মনে অর্নকে নিয়ে কি আছে, সেটা তুমিই জানো। আমি আসলে আজকে এটাই বলতে চাইছিলাম।
দুজনে ছাঁদে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। দুজনেই দুজনার কথা শুনে অবাক। কি বলবে আর কেউ খুজে পাচ্ছে না। ভালোবাসা এত সহজে কারো উপর তৈরী হয়না। ভালোবাসার জন্য অন্তত ভালোলাগাটা থাকা দরকার। আর আমরা মানুষেরা সামান্য ভালো লাগাটাকেই অনেক সময় ভালোবাসা ধরে নিই। ইরা হয়ত সামান্য ভালোলাগা থেকে অর্নকে ভালোবাসছিল। সে জন্য এত তাড়াতাড়ি বিশ্বাসটা হারিয়েছে। অর্নকে বোঝেনি। আর অর্ন…
.
“তোরা এখানে? নিচে আয় তো.. উকিল এসেছে। অবনিকে খুজছে।”
আরিনা বেগম ছাঁদের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। সিফাত আর অবনিকে সে দিকে তাকায়। তাড়াতাড়ি দুজন ছাঁদ থেকে নিচে নেমে এলো। উঁকিল সাহেব বসে আছে সোফায়। অবনি সামনে যেতেই, তিনি ব্রিটকেস হাতে নিয়ে দাঁড়ালো। তারপর সেখান থেকে কয়েকটা পেপারস বের করে। প্রথম পেপারটা উকিল সাহেব হাতে নিয়ে বললো…
– আপনি অবনি আমি জানি। এখানে সাঈন করুন। আপনার জন্য কয়েকটা পেপারস আছে। আর ছোটনকে চিনেন আপনারা? (উকিল সাহেব)
– ছোটনকে আমি চিনি। কিন্তু অবনিকে কেনো সাঈন করতে হবে? (আরিনা বেগম)
– এটা হল, ডিভোর্স লেটার। অর্ন সাহেব রাতের এই সময়ে এসে দিতে বলেছিল। (উকিল সাহেব)
– ডিভোর্স লেটার? মানে? অর্ন কোথায়? আর সে কেনো অবনিকে ডিভোর্স লেটার দিয়েছে? মানেটা কি উকিল? (দাদু)
– আমি তো জানিনা। আমার যতটুকু দরকার, আর কাজ ছিল সবটাই করেছি। বাকিটা তো অর্ন সাহেব বলতে পারবে। (উকিল)
অবনি অনিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পেপারটার দিকে। চোখের কোণে পানি জমা শুরু করেছে। পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেছে। কেমন যেন অসার অনুৃভব হচ্ছে তার কাছে। একটা মেয়ের ডিভোর্স হওয়া মানে দ্বিতীয় মৃত্যু। অবনির যেন এটাই হচ্ছে। করুণ দৃষ্টিতে পেপারটার দিকে তাকিয়ে আছে। উকিল সাহেব বলে..
– দেখুন আমি এতকিছু তো জানিনা। তবে আরো কয়েকটা পেপারস আছে। অর্ন সাহেবের নামে যতটুকু সম্পত্তি ছিল, টাকা ছিল। তা দুজনের জন্য লিথে গেছে। (উকিল)
– লিখে গেছে মানে? কি বলছেন আপনি? (সিফাত)
– হুমম, ঠিক বলছি। একজন হল অবনি। আরেকজন হল ছোটন। ছোটনে মা যেদিন মারা যায়, সেদিন রাতে কথা হয়েছিল ফোনে অর্ন সাহেবের সাথে। জলদি সাঈন করুন বাকি পেপারসগুলোতে। ডিভোর্স লেটারে কবে করবেন, আপনার ব্যাপার। রেখে যাচ্ছি। (উকিল)
– সব পেপার রেথে যান উকিল সাহেব। (দাদু)
– ওকে। (উকিল)
– ছোটনের মা কবে মারা গিয়েছিল? (আনাফ)
– এই তো কয়েকদিন আগে। সেদিন উনি হয়ত রাতে বের হয়েছিল। আমি জানিনা। ছোটনকে জিজ্ঞাসা করবেন। আসি। (উকিল)
– অর্ন কোথায়? ফোন করো তাকে। (আরিনা বেগম)
– ওহ,সরি আরেকচা পেপার আছে। এটা অবনিকেই দিতে হবে। চিঠি আছে।
উকিল সাহেব কথাটা বলে পকেট থেকে একটা চিঠি বের করলেন। অবনির দিকে বাড়িয়ে, তিনি সেখান থেকে প্রস্থান করল। অবনি চিঠিটা বের করে। অর্নের দেওয়া চিঠি। সেখানে যা লেখা আছে.. “ভালোবাসি অবনি। অবাক হচ্ছো? অবাক হওয়ারই কথা। প্রথম আমার থেকে কথাটা শুনলে তো অবাক হওয়ার কথা। যাইহোক.. যখন চিঠিটা পাবে তুমি। তখন আর আমি দুনিয়াতে নেই। মানে চলে যাবো ওপারে। আমার মৃত্যুর জন্য আমি নিজেই দায়ী। ইরাকে ভালোবেসেছিলাম। ইরাকে পেয়ে বুঝেছিলাম হয়ত জীবনে আর কিছুই চাওয়ার নেই। কিন্তু কি হল.. ইরা আমাকে ভূল বুঝলো। লজিক আর অনুভুতি দিয়ে যদি ভাবা হয়, তাহলে আমার জীবনের সাথে তুমি জড়িয়ে ছিলে। আমি যখন একটু একটু করে তোমাকে ফিল করা শুরু করেছি। তখনি আরো একটা ঝড় শুরু। ঝড়ের নাম সিফাত।
আমি জেলাস হতাম, কষ্ট পেতাম। সেদিন রাতে ছোটনের মায়ের লাশ দাফন করছিলাম। ইরার সাথে না। সেদিন তোমার ফোন কলের আগে ইরা ফোন করেছিল। তাকে তুমি ভেবে বলেছিলাম ভালোবাসি অবনি। কিন্তু সে ছিল ইরা। ইরার পর তুমি ফোন করেছিলে। ভেবেছিলাম ইরা করেছে। তাই ইরার নামটা বলেছিলাম। বাকি কথা না শুনেই কেঁটে দিয়েছিলে। বোঝাতে চেয়েছিলাম অনেক কিছু। কিন্তু আমাকে তুমি অনেকটাই অপমান করেছিলে। এতটা অপমান আমি কখনো শুনিনি, সহ্যও করিনি। কেনো তুমি আমার সাথে এমন করছো, তার কারণ খুজতে যেয়ে বুঝলাম, আমি তোমার ভালোবাসার মূল্য দিইনি। আর আসল কথা, সিফাত এসেছে তোমার জীবনে। যাইহোক… ভালো থেকো সবাই। তোমাদের জন্য সব রেখে গেলাম। মাফ করে দিও।
.
অবনি চিঠি পড়ে ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লো। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়া শুরু করেছে। আরিনা বেগস এগিয়ে এলেন। অবনিকে দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে.. “কি হয়েছে অবনি? এভাবে বসলি যে?” অবনি হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে। কাঁদতে কাঁদতে বলে..
– অর্ন আর নেই। সে সুসাইড করেছে। সে আমার আর সিফাতের মধ্যে অনেক কিছু ভেবে, আমাদের ভালোর জন্য নিজেকে মেরে ফেলেছে। আমিও মরে যাবো। অর্নকে এনে দাও তোমরা। (অবনি)
– কিহ? অর্ন সুসাইড করেছে মানে? (আনাফ)
চিঠিটা আনাফ পড়ে। তারপর সেও একি কথা জানায়। আরিনা বেগমও পড়েন। উনিও অবনির মত করে কাঁন্না শুরু করে দিয়েছে। তারপর.
.
অর্ন রাস্তার পাশে পড়ে আছে। সে সুসাইড করতেই যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই বড় রকমের একটা এক্সিডেন্ট ঘটে গেছে। এক্সিডেন্টে অনেক মানুৃষ নিহতও হয়েছে। পুৃলিশ এসেছে সেখানে। আশেপাশে সবকিছু চেক করতে থাকে। একটা পিকআপ, একটা বাস পড়ে আছে। পুলিশেরা রাস্তা ব্লক করে চেক করতে থাকে সবকিছু। একজন পুলিশ টর্চ হাতে নিয়ে এগিয়ে আসে দূরে। একটা বাইক পড়ে থাকতে দেখে তিনি। দৌড়ে সেদিকে যায়। বাইকের অবস্থা অনেক খারাপ। বাইকের কাছে দাঁড়িয়ে আশেপাশে টর্চ মারে। অনেক রক্ত পড়ে আছে রাস্তার উপর। রক্ত অনুসরণ করে টর্চ মারতেই বাইক থেকে আরো বেশ খানিকটা দূরে মেইন রাস্তার পাশে, ঝোপের দিকে সাদা শার্ট পরা একজন পড়ে আছে। পুলিশটা জোরে বড় পুলিশদের ডাক দেয়। সবাই এসে দেখে একজন পড়ে আছে। আর সে হল অর্ন।
অর্নের কাছে আসে তারা। রক্ত একজায়গায় হয়ে আছে। অনেক বেশিই রক্ত বের হয়েছে। পুৃলিশ একজন, অর্নের প্যান্টের পকেটে হাত দিল। মোবাইল, মানিব্যাগ বের করলেন। মানিব্যাগে আইডি কার্ড। নাম্বার বুক রাখা আছে। অর্নের ফোন ভেঙে গেছে একদমই। আইডি কার্ডে নাম দেখলো তারা “আবিদ হাসান অর্ন।” নাম্বার বুকটা বের করলো। প্রথমেই আরিনা বেগম নামে একটি নাম্বার লেখা। তারপর…
#প্রণয়
#১২তম পর্ব
#Abir Hasan Niloy
…
অর্ন শেফার দিকে তাকিয়ে আছে। শেফা অর্নের সামনে এসে দাঁড়ালো। গম্ভীর হয়ে বললো..
– অবনি তোমার বউ তাইনা? আমি এখন সব জানি। (শেফা)
– হুমম।
– আমি দেখেছি সিফাত ভাইয়া অবনিকে ধাক্কা দিয়ে নিজের বিছানায় ফেলে দিতে। তারপর ভাইয়া অবনিকে তার খোলা পেট ধরে নিজের কাছে টেনে নেয়। তারপর.. (শেফা)
– থাক। কিছু বলতে হবেনা। আমি বুঝতে পেরেছি। কাউকে কিছু বলো না। (অর্ন)
– শোনো আগে। (শেফা)
– আর কিছু শোনারর প্রয়োজন নেই।
অর্ন তাড়াতাড়ি রুম থেকে বের হল। আজকে অর্নের অনেকটা কান্না পাচ্ছে। অর্ন এবার ইরার জন্য কাঁদছে না। অর্ন কাঁদছে অবনির জন্য। বিয়ের কয়েকদিনে অনেক কিছুই ঘটে গেছে। বিয়েটা কাঁকতালীয়ভাবে হয়েছে। প্রথমে অর্ন ভেবেছিল, অবনিকে ছেঁড়ে সে ইরার সাথে থাকবে। আর অবনি ভেবেছিল, ভালোবাসা দিয়ে অর্নকে ভরিয়ে দেবে। কিন্তু অর্ন না পেয়েছে ইরাকে, আবার অবনি না পেয়েছে অর্নকে। বরং তার বদলে একজন ভালোবাসা হারিয়েছে। আরেকজন পেয়েছে অনেক অবহেলা। আর এই অবহেলা অপমান তীলে তীলে মানূষকে পরিবর্তন বা শেষ করে দেয়। অর্ন অবনিকে স্পর্শ না করলেও অর্নের দেওয়া প্রতিদিনের অবহেলা, কষ্টগুলো অবনির মনের অর্নের প্রতি আলাদা ভাব সৃষ্টি হয়েছে। অবনি অর্নের কথা মনে করলেই, অর্নের দেওয়া অপমান, অবহেলাগুলো বেশি মনে করে।
আর অবনির মনের অবস্থা তখন শোচনীয় হয়ে যায়। ঠিক এমন সময় অবনির মনে নতুনকরে ভালোবাসা জন্ম নেওয়ার মত অনুভুতি সৃষ্টিকারী একজন মানুষ এসেছে। যে কিনা অবনিকে বুঝতে পারে। অবনি কালো বলে তার জন্য কোনো অবহেলা নয়, বরং ভালোবাসা দেখিয়েছে। আর অবনি এতদিন এই ভালোবাসাটাই অর্নের কাছে চেয়েছে। অর্ন তা দেয়নি। অবনি কারো ভালোবাসা তো কখনো আশা করেনি। আসলে মেয়েরা সবার ভালোবাসা আশাও করেনা। বিশেষ একজনের ভালোবাসা সবার থেকে বেশি করে আশা করে। সে হল তার প্রিয় মানুষ। অবনির প্রিয় মানুষ অর্ণ। অর্নের থেকে সামান্য ভালোবাসা চেয়েছিল অবনি। কিন্তু অর্ন তা কখনো দেয়নি। অবনি এই ভালোবাসাটা সিফাতের থেকেই পাচ্ছে। মানুষ অপমান অবহেলার দাস নয়। মানুষ ভালোবাসার দাস। ভালোবাসা পেলেই মানুষ নতুন করে বাঁচার আশা খুজে পায়।
সেখানে অবনি তো ছোট বেলা থেকেই ভালোবাসাহীন জীবন কাঁটিয়েছে। তাই সিফাতের থেকে এতটা ইম্পরটেন্স, একটা আগ্রহ, এতটা ভালোবাসা পাচ্ছে। তখন তারই বা কি দোষ। ভালোবাসার জন্য মানুষ কত কিছুই না করে। অবনি কি অর্নকে ছাঁড়তে পারবে না? ও দিকে ইরার প্রতি ছিল অর্নের অগাধ বিশ্বাস। অর্নকে কখনো ভূল বুঝবে না ইরা। অথচ ইরা অর্নের থেকে কিছুই শুনলো না। ইরা ঠিকিই অর্নের বিরুদ্ধে বন্ধুদের কাছে কতকিছু শুনে অর্নকে ঘৃণা করতে শুরু করেছে। আর অর্ন যতবার ভালোবাসার দাবি নিয়ে ইরাকে বোঝাতে গিয়েছে। ততবারই ইরা অপমান করে অর্নকে ফিরিয়েছে। কি অদ্ভুত পৃথিবীর নিয়ম। কেউ অন্যকাউকে অবহেলা করলে, সেই আবার আরেকজনের কাছে অবহেলিত হয়। যাকে ভালোবাসা হয়, সে বাসে অন্যকে। আবার তাকেও অন্য একজন ভালোবাসে। অথচ আমরা বুৃঝিনা। আমরা সবসময় আমাদের নিজেদের ভালোবাসাটাকে প্রাধান্য দিই বেশি। অথচ অন্যকেউ যে আমাকে ভালোবাসছে, সেটা বুঝিইনা।
অর্ন ঠিক এটাই অনুভব করেছে। অর্নও ভালোবাসার দাস। ইরার থেকে অপমান পেয়ে, সে যখন বুঝলো তার জন্য অবনিই পারফেক্ট। অর্ন যেন দেরি করে ফেলেছে। অবনির ভালোবাসাগুলো অনুধাবন করেছে অর্ন। অবনির প্রতি টান সৃষ্টি হয়েছে। ভালোবাসা সহজে তৈরী না হলেও অবনিকে সে আর কষ্ট দেবে না ভেবেই কাছে আসার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কিছু মানুষ থাকে, অনেক অনেক বেশি ভালোবাসার পরও স্বীকার করতে পারেনা। অর্নও যেন ঠিক এমন। অবনিকে এখন যে সে চায়, এটাই প্রকাশ করার সাহস নেই অর্নের। করলেও অবনি সেটা হাস্যকর ভাবেই নেবে। এটাই একটা বিভৎস নিয়ম। যখন অগাধ ভালোবাসা প্রকাশ করা হয়, তখন সেটা তেতো না হয় হাস্যকর হয়ে যায়। অর্ন এখন অবনিকে চায়। আর অবনি ভালোবাসা চায়। যা সিফাতের কাছেই সে পেয়ে এসেছে এ কয়েকদিন।
অর্ন পকেটে হাত গুজে ক্যান্টিনে আসলো। শেফার কথাগুলো মাথা থেকেই ফেলতে পারছে না অর্ন। একটা টেবিলে এসে বসলো সে। ছোটন এসে পাশে দাঁড়ায়। ছোটনের দিকে খেয়াল নেই অর্নের। ছোটন বলে..
– ভাইয়া.. মন খারাপ কইরা আছো কেন?
– ভালো লাগছে না। এমনি, কোনো কারণও খুজে পাচ্ছিনা। (অর্ন)
– মন খারাপের পিছনে থাকা একটা ছোট বা বড় কারণ, কেউ প্রকাশ করতে লজ্জা বা ভয় পায়, কেউ অনায়াসে মন খারাপের কারণ বলে দেয়। তবে বেশিরভাগ মন খারাপের কারণ আমরা ‘কিছুনা, এমনি’ বলে চালিয়ে দিই। (ছোটন)
– তুই অনেক গুছিয়ে কথা বলা শিখেছিস। (অর্ন)
– পড়াশোনা করছি তো। তোমার দেখা আমাকে নিয়ে স্বপ্ন পূরণ তো করতেই হবে। (ছোটন)
– ভালো চিন্তা করেছিস তুই। এ জন্য তোকে ভালো লাগে অনেক। ওহ, একটা কথা। একটা না, দুটো কথা আছে। (অর্ন)
– বলো।
– প্রথমটা হল, আমার বন্ধু তুর্জ আছে না? ওর বিয়ের অনুষ্ঠান আজ। তুই আর আমি যাবো। সন্ধ্যায় রেডি থাকিস। (অর্ন)
– কিন্ত সেখানে তো ভাবি আর তুমি যাবে। (ছোটন)
– নাহ, তোর ভাবি কেউ নেই। (অর্ন)
– হুম, বুঝছি এবার মন খারাপের কারণ। যাইহোক, আরেকটা কি কথা বলো। (ছোটন)
– দাঁড়া..
অর্ন দোকানী মামার দিকে তাকিয়ে একটা কাগজ আনতে বললো। সাদা পৃষ্টা আনে সে। অর্ন কলম দিয়ে সাদা পৃষ্টায় কিছু লিখলো। তারপর সেটা ভাঁজ করে ছোটনের শার্টের পকেটে ঢুকিয়ে দেয়। ছোটন প্রশ্ন করে..
– কি এটা?
– এই কাগজটা আমার বাবার কাছে নিয়ে যাবি। তোকে উনি চেনে। আমার মায়ের কাছে নিয়ে গেলেও হবে। আমার যা কিছু আছে তা প্রায় সবটা তোকে দিয়ে দিলাম। মানে প্রায় এক কোটি টাকার মত হবে। এটা তোর জন্য দিয়ে যাচ্ছি। আর কখনো তোর সাথে দেখা হবেনা। (অর্ন)
– মানে? (ছোটন)
– কোনো মানে নেই। হারিয়ে যেতে চাই বহুদুর। হয়ত দুনিয়া ছেঁড়ে নয়ত দেশ ছেঁড়ে। আমি চাইনা, আমার জন্য ইরার সমস্যা হোক, আমি চাইনা আমার জন্য শিহাবের সমস্যা হোক। আমি এটাও চাইনা, আমার জন্য সিফাতের কোনো সমস্যা হোক। আমি চাইনা আমার কারণে সবার সমস্যা সৃষ্টি হোক। বিশেষ করে… বিশেষ করে অবনির যেন সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা না হয়। আমি এ জন্য সবার থেকে দূরে চলে যাচ্ছি। ভালো থাকিস ছোটন। সরি, সন্ধ্যায় দেখা হবে। কথা দিয়েছিলাম তুর্জকে, তার বিয়েতে আমি যাবো। কিছু সময় থাকবো। তারপর চলে আসবো। রেডি থাকিস।
অর্ন ক্যান্টিন থেকে বের হলো। কিছু ভালো লাগছে না ওর। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। সে আলাদা একা কোথাও দাঁড়িয়ে খুব করে কাঁদবে।
.
বাড়ির কলিংবেল বেজে উঠল। আরিনা বেগম এসে দরজা খুলতেই, দুজন মানুষ আরিনা বেগমের পা জড়িয়ে ধরে। আরিনা বেগম নিচের দিকে তাকায়। পা জড়িয়ে ধরা ব্যক্তিকে আরিনা বেগমর চিনতে অসুবিধা হয়নি। আনাফ এসেছে। আর সাথে ওর স্ত্রী। সেদিন বিয়ের আসর থেতে পালিয়ে যায় আনাফ। অবনিকে বিয়ে না করে, সেদিন রাতেই আনাফ তার প্রেমিকাকে নিয়ে পালিয়ে যায়। বিয়ে করে দুজন আবার ফিরে এসেছে। আনাফ পা জড়িয়ে ধরে আরিনা বেগমকে বলে..
– মা, আমি অবনিকে বিয়ে করতে চাইনি। আমার পছন্দ না। তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিতেও পারিনি। এ জন্য পালিয়ে গিয়েছিলাম। আমি এই মেয়েটাকে ভালোবাসি ভীষণ। আমাকে মাফ করে দাও। আমি চলে এসেছি তোমার কাছে থাকবো বলে।
আনাফের কথা শুনে বাড়ির অনেকে দৌড়ে এসেছে। অবনি, সিফাতসহ সবাই এসেছে। আনাফ আরিনা বেগমের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। মা যতই সন্তানের জন্য অপমানিত হোক না কেনো। একটা মা নিজেই জানে সন্তান মায়ের কাছে কতটা প্রিয়। তাই সন্তান যতই ভূল করুক না কেনো, মায়ের কাছে যেন সে নির্দোষ থাকবেই। আনাফ পা জড়িয়ে ধরতেই আরিনা বেগমের মনে আনাফের প্রতি জমা রাগ নিমিষেই চলে গেছে। আনাফকে টেনে তুললো। আনাফ তার মাকে জড়িয়ে ধরে।
– মা, আমাকে মাফ করে দাও। আমি আর কখনো ভূল করবো না। (আনাফ)
– আচ্ছা হয়েছে। তোর দাদুর সাথে কথা বলে নিস। (আরিনা বেগম)
– দাদু কোথায়? (আনাফ)
– ওনার রুমে আছে।
আনাফ দৌড়ে তার দাদুর রুমে চলে যায়। তারপর অনেকটা সময় পর বের হয়। দাদুর সাথেই আনাফ বের হয়। সবাই বুঝতে পারে আনাফ দাদুকে মানিয়ে নিয়েছে। সবার সাথে আনাফ কথা বলে। আবারো মায়ের কাছে আসে। আস্তে গলায় বলে..
– অবনির বিয়ে হয়নি আমার জন্য। খুব খারাপ লাগছে। (আনাফ)
– কে বললো বিয়ে হয়নি? (আরিনা বেগম)
– হয়েছে? কে বিয়ে করেছে অবনিকে? (আনাফ)
– অর্ন। অবনি এখন অর্নের বউ। (আরিনা বেগম)
– অর্নের বউ সে? অর্ন তাকে বিয়ে করেছে? তাহলে ইরা? (আনাফ)
– ইরা? ইরাটা আবার কে? (আরিনা বেগম)
– ইরাকে চেনো না? তোমাকে বলেনি অর্ন? ইরাকে তো অর্ন নিজের চাইতে বেশি ভালোবাসতো। ওদের রিলেশনশীপ প্রায় তিন বছরের। জানো না তুমি? (আনাফ)
– কিহ? আমাকে কেনো বলেনি সে? আর ওর ভালোবাসা সেক্রিফাইস করে অবনিকে বিয়ে করেছে? (আরিনা বেগম)
– সব দোষ আমার। হয়ত তোমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে, তোমাদের সম্মানের কথা চিন্তা করে অর্ন তার ভালোবাসার কথা ভাবেনি। সে অবনিকে বিয়ে করেছে। (আনাফ)
– কি বলছিস তুই? অর্নের সাথে তাহলে আমরাও অন্যায় করেছি। ওর কথাটা শোনা দরকার ছিল। (আরিনা বেগম)
– বাদ দাও। ওরা হ্যাপি থাকলেই হবে। অর্ন কোথায়? (আনাফ)
– তুর্জের আজ বিয়ে হয়ত, এ জন্য বাইরে গেছে কিছু কেনাকাটা করতে। বিকেল হয়েছে। আসবে হয়ত এখনি। (আরিনা বেগম)
বাড়ির সবাই একসাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে। সিফাত আর অবনি সামনা সামনি বসা। সিফাত একটু একটু করে অবনির দিকে তাকাচ্ছে। অবনি মনে মনে অনেক কিছুই ভাবছে। সেই ভাবনাতে কখনো সিফাত, আবার কখনো অর্ন আসছে। তবে ভাবনাতে অর্নই বেশি ঘুরছে। অবনির কাছে যেন এখন অপশন ভালোবাসার কথাটি এসে গেছে। বারবার নিজেকে প্রশ্ন করছে, কোন ভালোবাসাটা তার গ্রহন করা উচিৎ। যে, সে যাকে ভালোবাসে তাকে গ্রহন করা নাকি তাকে যে ভালোবাসে, তাকে গ্রহন করা উচিৎ?
.
সন্ধ্যার কিছু সময় আগে অর্ন এসেছে। আনাফ এসেছে সে জানেনা। দেখা হয়নি এখনো। আনাফ ওর দাদুর রুমে বসে গল্প করছে। অর্ন সোজা নিজের রুমে প্রবেশ করে। ওয়াশ রুমে যেয়ে টিশার্ট খুলে ফ্লোরে ছু্ঁড়ে দেয়। তারপর মুখে পানির ছিঁটা, আর ফেসওয়াশ দিয়ে ধুয়ে নিল। মুখ মুছে বাইরে বের হল অর্ন। প্যান্ট চেন্জ করে কি পরবে তা খোজার জন্য কাপড়ের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। এ সময় অবনি রুমে আসলো। বিছানায় এসে বসলো। আড়চোখে তাকালো অর্নের দিকে। খালি গায়ে দাঁড়ানো অর্ন। কোনো জায়গাতে একটুও লোম নেই। অবনি অর্নের খোলা পিঠের দিকে তাকিয়ে থাকে। অর্ন সাদা শার্ট বের করলো। কোনোদিক না তাকিয়ে গায়ের উপর পরে নিল ও। শার্টের বোতাম লাগিয়ে প্যান্টের সাথে ইন করে, সামনে ঘুরলো। অবনি তাকিয়ে ছিল সেদিকে। অর্ন ফিরতেই চোখ সরিয়ে নেয়।
টেবিলের কাছে এসে, বডি স্প্রে হাতে নিয়ে দুই হাতের নিচে লাগাতে লাগাতে অবনিকে বলে.. “আপনার জন্য গুড নিউজ আছে। অনেক খরচ হয়েছে, তবে আপনার জন্য এতটুকু করার দরকার ছিল। আমি প্রেমিক হতে না পারলেও দুশমনও হতে পারবো না। এটার কোনো রাইট আমার নেই। কারো অসুবিধা যেন আমার কারণে না হয়। তার জন্য অর্ন সবকিছু করতে প্রস্তুত। যাইহোক.. বিয়েতে আপনি যাবেন না। রাতের মধ্যে ডিভোর্স লেটার চলে আসবে। ধন্যবাদ আপনাকে, অনেক কিছু শেখানোর, বোঝানোর আর জানানোর জন্য।”
অর্নের কথা শুনে অবনি অবাক হয়। এত তাড়াতাড়ি ডিভোর্স? মানে টা কি? কি পেয়েছে অর্ন অবনিকে? যা খুশি তাই করবে? অবনির খুব রাগ হতে থাকে। সত্যিই ভিডোর্সের কথা শুনে ওর বুকটা কেঁপে উঠল। কিন্তু মনে মনে বলে “স্বার্থপর মানুষের থেকে দূরে থাকা ভালো।” অর্ন কালো কোর্ট পরে নিল। তারপর লোফার পরে বের হতে যাচ্ছিল, দরজার কাছে থেমে যেয়ে বলে..
– আমি ইরাকে চাইনা। ইরাকে চাইতাম। কিন্তু আমি জড়িয়ে গিয়েছিলাম কারো লাইফে। সেটা এক্সিডেন্টলি হয়েছিল। ইরাকে তা বোঝাতে পারিনি বিষয়টা। সে ঠিকিই দুদিন পর শিহাবের সাথে জড়িয়ে গেছে। হাস্যকর। যাইহোক, সে পারলে আমিও পারবো না কেনো? জড়াতে চেয়েছিলাম কোনো এক ধোয়াশার সাথে। কিন্তু সে আসলেই ধোয়াশা। আর ধোয়াশা ছোঁয়া যায়না, কাছে টেনে নেওয়া যায়না। কেবল দূর থেকে ধোয়াশাকে অবলকন করতে হয়। তাতেই সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। তবে এবার দূর থেকেও দেখা হবেনা। আমি… থাক। বাদ দিই এসব কথা। টেক কেয়ার।
অর্ন কথাগুলো বলে আর দাঁড়ায়নি। সে নিচে নেমে আসে। আরিনা বেগম দাঁড়িয়ে ছিল। অর্ন এসে মায়ের সামনে দাঁড়ায়। আরিনা বেগম বলে
– বাব্বাহ.. আমার ছেলেকে তো রাজকুমারের মত লাগছে।
অর্ন মুচকি হাসলো। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে, নিচু হল। পায়ে সালাম করে, অর্ন ওঠে দাঁড়ায়। মায়ের দিকে না তাকিয়ে বলে “নিজের যত্ন নিও।” অর্ন ঘুরে চলে আসার জন্য পা বাড়ায়। আরিনা বেগমের বুকের ভিতর কেমন যেন চিনচিন অনুভব হয়। মায়ের মন অনেক কিছুই অনুভব করতে পারে। তিনি বলেন..
– কি হয়েছে অর্ন। হঠাৎ এভাবে কথা বলছিস কেনো?
– এমনিতে। যাচ্ছি। (অর্ন)
– যাচ্ছি মানে? বল আসছি। কি হয়েছে তোর? (আরিনা বেগম)
অর্ন মুচকি হাসলো। সে আর ফিরবে না। নিজেকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে অর্ন। তাই এমন করেই কথা বলছে। অর্ন আর দাঁড়ালো না। তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বের হল। বাইকের উপর বসে, মাথায় হেলমেট পরে নেয়। বাইক স্টার্ট দিয়ে বের হল ও। উদ্দেশ্য আপাতত তুর্জদের সাথে দেখা করা।
.
অর্ন বিয়ের আসরে উপস্থিত হল। তুর্জদের সামনে এসে দাঁড়ালো। তুর্জের পাশে ওর বউ দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা আসলেই সুন্দর। অপরুপ দেখতে। সত্যিই তুর্জের চয়েজ আছে। তুর্জ এগিয়ে আসলো। অর্নের হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় স্টেজের উপর। মাইক হাতে নিয়ে তুর্জ বলে..
– হ্যালো এভরিয়ান। আমার বন্ধু অর্ন। তার পরিচয় এতটুকুই থাকুক। সে এসেছে আমার বউ দেখতে। কেনো জানেন? অর্নের বউ একটা ক্ষ্যাত আর কালো। বিচ্ছিরি দেখতে সে। জঘন্য দেখতে। ভয়ে আমার বন্ধু তার বউকে সাথেই আনেনি। (তুর্জ)
– কিরে, এসব কি হচ্ছে? অবনিকে নিয়ে কেনো কথা বলছিস? (আস্তে গলায় অর্ন বলে)
– কালো মেয়ে অর্নের বউ। আর আমার বউ দেখুন সবাই। হাসি লাগে অর্নের বউকে দেখলে। (তুর্জ)
– তুর্জ.. অবনিকে নিয়ে আর একবার বাজে কথা বললে, আমি কিন্তু তোকে মেরে ফেলবো। (অর্ন)
– কি করবি রে? (তুর্জ)
ঠিক তখনি ঠাস করে একটা চড়ের শব্দ শুনতে পায় সবাই। ঘুরে তাকিয়ে দেখে তুর্জের বউ, একটা ওয়েটারের গালে কষে চড় বসিয়ে দিয়েছে। ওয়েটার ছেলেটা গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সামনে। তুর্জের বউ বলে..
– কুত্তার বাচ্চা, চোখে দেখিস না? তুই জানিস, আমার ড্রেসের দাম কত? তোর পাঁচ মাসের বেতনের থেকেও বেশি। কি সাহসে আমার ড্রেসে তুই পানি ফেলেছিস?
– ম্যাম, আমি দেখতে পাইনি। আমি পরিষ্কার করে দিচ্ছি। আর অতি সামান্যই ম্যাম। (ওয়েটার)
– কিহ? আমার মুখের উপর কথা বলিস? বেয়াদব কোথাকার। তোর যোগ্যতাও নেই আমার ড্রেসে হাত লাগানোর।
তুর্জের বউ কথাটা বলেই ছেলেটাকে ধাক্কা দেয়। কিন্তু কে যেন এসে ছেলেটার হাত ধরে টেনে তুললো। সবাই ও দিকেই তাকিয়ে আছে। অর্নও তাকিয়ে আছে। অবনি এসেছে। কিন্তু পিছনে কে? সিফাত? সিফাত কেনো এসেছে অবনির সাথে? অবনি ছেলেটার হাত ধরে টেনে তুলে বলে..
– কিছু মানুষ আছে, যারা জানোয়ার হয়। মানুষ হতে পারেনা তারা। তুমি এমন কাজ ছেঁড়ে দাও ভাই। এসব অহংকারী জানোয়ার সেন্চ মানুষদের থেকে দূরে থাকবে। (অবনি)
– ঐ, জানোয়ার বললি আমাকে? নিজের দিকে তাকিয়েছিস কোনোদিন? কালো দেখতে, আমার সামনে দাঁড়িয়ে তোর কথা বলার যোগ্যতা নেই বুঝেছিস? (তুর্জের বউ)
– দেখুন ম্যাম.. সৌন্দর্য দিয়ে আপনি পানি খাবেন বুঝলেন? আপনার মত মেয়ে বাইরের দেশে ফকিরের মতই আছে। সৌন্দর্য কেবল কালোদের সামনেই দেখাতে পারেন। হাস্যকর। (সিফাত)
– তোরা এখানে কেনো? (অর্ন)
– দেখতে এসেছিলাম, সুন্দর ছেলের বউটা কেমন সুন্দর। হা সুন্দর তিনি। তবে গায়ের রঙে। ভিতরে একটা জানোয়ার আছে। (অবনি)
অবনি কথাটা বলে দাঁড়াতেই তুর্জ এসে অবনির গালে চড় দিতে যায়। আর তখনি…..
#প্রণয়
#১১তম পর্ব
#Abir Hasan Niloy
…
দরজার ওপাশ থেকে অর্ন তোয়ালে ধরে রেখেছে। এপাশে অবনি। কেউ টানছেও না। অবনি কর্কশ গলায় বললো..
– কি হচ্ছে তোর? সমস্যা টা কি? এমন কেনো করছিস? (অবনি)
– কেমন করছি? (অর্ন)
– আমাকে কেনো জ্বালাচ্ছিস? (অবনি)
– ভালো লাগছে তাই। (অর্ন)
– ঢং করছিস কেনো? এগুলো একদমই অসহ্য লাগছে। এত ঢং কিসের তোর? দুইদিন আগেও তো ঠিক ছিলি। এখন এত ঢং আসছে কোথা থেকে? বিরক্ত হচ্ছি আমি। তুই যা তো এখান থেকে ভালো লাগছে না আমার। অসহ্য লাগছে সব। (অবনি)
অর্ন নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দরজার দিকে। ভিতরে থাকা অবনির কথাগুলো ওর বুকে এসে লাগে যেন। দুই কান লাল হতে শুরু করেছে। অর্ন রেগে নেই, তবে অপমানে লজ্জায় তার কান আর নাক লাল হওয়া শুরু করেছে। কিছু মানুষ থাকে, যারা কখনো অপমান হয়নি, এমনকি তারা অতিব সামান্য অপমান সহ্যও করতে পারেনা, তারা কখনো অপমানিত হলে, তাদের চোখ কান নাক লাল হওয়া শুরু করে। অর্ন তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বললো…
– এহ, চুপ কর। তুই আমার এখন বউ। আমি যা খুৃশি করার অধিকার রাখি। (অর্ন)
– হাহাহা.. হাসাচ্ছিস অর্ন। তুই আমার বর? আমি তোর বউ? বলি প্লিজ.. এভাবে হাসাবি না। জোকসটা শুনে হাসি থামাতে কষ্ট হচ্ছে। কিসের বউ আমি তোর? বউ বলতে আসছিস। তোর থেকে রাস্তার খারাপ ছেলেরা অনেক ভালো। ওদের সামনে একটু ওড়না সরিয়ে হাঁটলেও ফিরে তাকাবে। আর তুই? কখনো তাকিয়ে দেখেছিস আমাকে? আসছিস বউ বলতে। আর অধিকারের কথা বলছিস? অধিকার তো আমার ছিল। আমি ভালোবাসতাম বলে। তুই কিসের অধিকার দেখাবি? তোর মত ছেলে অধিকারের কথা বললে তা মানায় না। কিভাবে বললি তুই? অনেক অপমান সহ্য করেছি। আত্বমর্যাদা হারিয়েছি। এখন তুই প্লিজ মজা করিস না।
অর্ন একদম চুপ হয়ে গেলো। সে তোয়ালে ছেঁড়ে দেয়। আর কিছু বলার সাহস পায়না অর্ন। এত অপমান সে কখনো হয়নি। অবনির থেকে এমনটা আশাও করেনি কোনোদিন। অবনি এতকিছু বলতে পারে, অর্ন ম্বপ্নেও ভাবেনি। অর্ন তোয়ালে ছেঁড়ে কাপড়ের শোকেজে আসে। অবনির জন্য ড্রেস পেঁড়ে এনে দরজার কাছে রেখে দেয়। ফিরে আসতে যাবে,তার আগে বললো “সন্ধ্যায় আমার বন্ধুর বিয়ের পার্টি। রেডি থাকিস।” অর্ন কথাটা বলে ফিরে আসতে যায়। কিন্তু অবনি তার আগেই বলে “হাসির পাত্রী বানাতে নিয়ে যাবি? বন্ধুরা তো কম অপমান করেনি। চুপচাপ শুনেছিস। এখনো স্বাদ মেটেনি? আমি যাবো না।”
অর্ন আর কথা বাড়ায় না। সে বাড়ি থেকে বের হয়। অবনি আরো কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকে ভিতরে। অর্নের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজা খুললো। দরজার পাশে অবনির পছন্দের ড্রেস রাখা। অর্ন ছাড়া কেউ রুমে ছিল না। অবনি অবাক হয়। মনে মনে বলে ‘অর্ন আবার কবে আমার পছন্দগুলো খেয়াল করেছে? যত্তসব ঢং।’ অবনি ড্রেস পরে নিল।
.
অর্ন অফিসে এসেছে। বাবারই অফিস। আনাফ থাকতো আগে এখানে। আনাফ নেই, সে জন্য অর্ন না চাইলেও নিজ থেকে করতে হচ্ছে অফিসের কাজ। অফিসে বসে আছে। কিছুই ভালো লাগছে না ওর। বারবার অবনির কথা মনে পড়ছে। অর্ন রুমের মধ্যে পায়চারি করছে আর ভাবছে “আচ্ছা আমি কি অবনিকে একবার কল দেবো? না. থাক। কল দিয়ে কি বলবো? কখনো তো কল করিনি। আর সে যদি ভাবে আবার ঢং করছি তাহলে? ধুর আমার কি হল? অবনির কথা আমি কেনই বা এত ভাবছি? সে আমাকে কত অপমান করলো, তবুও যেন আমার ওর কথা ভাবতেই বেশি ভালো লাগছে। অবনি কি যে করলো আমাকে। আমার না কিছু একটা হয়েছে। সিফাতের সাখে অবনির কিসের এত গাঢ় সম্পর্ক? রাগ কেনো হয় আমার, ওদের একসাথে দেখলে? ইরার কথাও এখন ঠিকমত মনে পড়ছে না আমার। উফ, কি যে অসহ্য লাগছে।”
অর্ন ভাবতে ভাবতে ফোন হাতে নিল। কল দিয়েও ফেলেছে অবনিকে। প্রথমবার রিং ঢুকতেই সে কল কেঁটে দেয়। বুকের ভিতর ঢিপ ঢিপ শুরু হয়ে গেছে। কি বলবে সে, অবনিও কি বলবে এটা ভেবে ফোন আর দেওয়ার সাহস পায়না অর্ন। কিন্তু ঠিকিই অবনির কলের অপেক্ষা করতে থাকে। অবনি রুমের মধ্যেই ছিল। ফোন হাতে নিয়ে দেখে অর্নের কল। প্রথমে অবাক হলেও ফোন হাতে নিয়ে বিড়বিড় করে বলে “হয়ত, কোনো দরকারে ফোন দিয়েছে। না হলে সে ভুলেও আমাকে কখনো কল করবে না।” কথাগুলো ভাবতে থাকে ফোনের দিকে তাকিয়ে।
ওদিকে ফোন হাতে নিয়ে থাকা অর্ন, অবনির থেকে কল না পেয়ে ফোন পকেটে রেখে দিল। সাথে সাথেই ফোন বেজে ওঠে। হাতে নিয়ে না দেখেই রিসিভ করে বলে.. “আমি জানি অবনি, তুমি আমাকে কল করবে। আমি অপেক্ষাতে ছিলাম তোমার ফোনের। আমার কি হয়েছে বুঝতে পারছিনা। সবসময় তোমার কথা মনে পড়ছে।” ওপাশ থেকে কিছু শোনার জন্য অর্ন প্রস্তুত হয়। তখনি সে শোনে “গুড… ভাবছিলাম তোকে নিজের করে নেওয়ার একটা শেষ সুযোগ দেবো। আমার কেনো জানি মনে হচ্ছিল, তুই শুধু আমারই। কিন্তু না, আমি ভুল। আমি সত্যিই বোকা, তোর মত একটা খারাপ ছেলেকে ভালোবেসেছিলাম। শোন, আমি শিহাবকেই বিয়ে করবো। ভালো থাকিস তুই।”
ওপাশ থেকে ফোন কেঁটে দেয়। অবনি স্ক্রীনে থাকা নামটা দেখে।ইরার নাম্বার থেকে কল এসেছে। অর্ন বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু এখন একটুও খারাপ লাগছে না ওর। তবে বুকের ভিতর হালকা চিনচিনে ব্যাথা অনুভব তো হবেই। হাজার হোক, সত্যিকার ভাবে ইরাকে অর্ন চাইতো। কিন্তু পরিস্থিতি এমন হয়ে গেছে, হাজার ভালোবাসা, চাওয়ার উন্মাদনা থাকলেও দুজনের মধ্যে বিরাট ব্যাবধান হয়ে গেছে। এখন যতই কাছে আসার ট্রাই করুক না কেনো কেউ। কাছে আসা তো দূরে থাক, দুজনে আরো দূরে সরে যাচ্ছে। এ জন্য প্রেমিক প্রেমিকার কোনো সম্পর্ক, একবার ভেঙে গেলে, দ্বিতীয়বার সেটা জোড়া লাগানো উচিৎ নয়। প্রথমবার যা হয়েছে, দ্বিতীয় বার তা হবেনা। প্রথমবার যেভাবে দুজন দুজনকে ভালোবেসেছিল, দ্বিতীয়বার ফিরে আসার পর সেইভাবে ভালোবাসা গড়ে উঠবে না। দুজনেই পরিবর্তন হয়ে যাবে। ছেঁড়ে যাওয়ার ভয় থাকবে না। আর কোনো সম্পর্কে যদি হারানো কিংবা ছেঁড়ে যাওয়ার ভয় না থাকে, তাহলে সেই সম্পর্ক বেশিদিন টিকে না। দায়সাড়া ভাব চলে আসে সম্পর্কের নিয়মে।
.
অর্ন ইরার কথা ভাবছে। হঠাৎ আবার ফোন বেজে ওঠে। সে আবারো ফোনের দিকে না তাকিয়ে রিসিভ করে। মন খারাপ করে অর্ন বলে। “ইরা.. আমি এখন তোমাকে…।” অর্ন পুরো কথা বলতে পারেনা। তার আগেই ওপাশ থেকে বলে “এখনো ইরাকেই ভালোবাসিস তুই তাইনা? জানতাম এটাই সত্য কথা। আমাকে ডিভোর্স দিতে পারিস তুই। আমি জানি তোর মধ্যে যে ভালোবাসা আছে, তা সবটা ইরার জন্য। সকালে কত নাটক করলি। তোর মত নাটকবাজ আর দেখিনি। আরে বাবা, ভালোবাসবি না আমাকে সেটা নিয়ে তোকে কখনো অভিযোগ রেখেছি? যা ইরা তোর জন্য অপেক্ষা করছে।”
ফোন কেঁটে দেয়। এবার অবনিই কল করেছিল। আর ইরা মনে করে অর্ন বলতে চাচ্ছিল ‘সে এখন তাকে রেখে অবনিকে স্মরণ করে সবসময়।’ কিন্তু অর্ন তা বলার আগেউ অবনি ফোন কেঁটে দেয়। দুইবার ফোন না দেখে রিসিভ করায় এটা হয়েছে। দুজন মানুষ ভুলটাই বুঝলো। অর্ন বোকার মত বসে থাকে ফোন হাতে নিয়ে। অবনিকে কিছু জানানোর আগেই সে আবার অর্নকে ভুল বুঝলো। অর্ন এখন যা করছে তা সবটাই যেন অবনি বিরোধী। ধুর আর অফিস করতে ওর ভালো লাগছে না। সে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়।
.
অবনিরও বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না। সে উঠে সিফাতকে খুজতে থাকে। সিফাতের রুমের সামনে এসে কয়েকবার পায়চারি করলো অবনি। সিফাতকে দেখতে পাচ্ছে না। সাহস করে রুমের মধ্যে প্রবেশ করে অবনি। রুমে কেউ নেই। কিন্তু বিছানা পত্র অগোছালো হয়ে আছে। অবনি বিড়বিড় করে বলে “উফ এই ছেলেগুলো এত অগোছালো কেনো হয়? রুম সবসময় ডাস্টবিন বানিয়ে রাখবে। কেউ নেই, গুছিয়ে রাখি।”
অবনি বিছানা গোছাতে শুরু করে। বালিশ দুটো ঠিকভাবে রাখতে যাবি, তখনি কে যেন পিছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরে অবনিকে। অবনি চমকে যায়। কখনো এমন স্পর্শ সে পায়নি। পিছনে ঘুরতেও পারছে না। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে পিছন থেকে কেউ একজন। অবনি বলে..
– কে.. ছাঁড়ো বলছি। কে তুমি?
পিছনে থাকা কেউ একজন অবনিকে সোজা করে, জোরে একটা ধাক্কা দেয়। বিছানায় ছিটকে পড়ে অবনি। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা হল সিফাত। অবনি অবাক হয়। সিফাত অবনির পাশে যেয়ে শুয়ে পড়ে। এক হাত দিয়ে অবনির খোলা পেট পেঁচিয়ে ধরে সিফাত। জোরে একটা খামচি দিয়ে অবনিকে নিজের কাছে টেনে নেয় সে। অবনি সাথে সাথেই বিছানা থেকে উঠে বসলো। সিফাত কিছু সময় অবনির দিকে বোকা দৃষ্টিতে তাকালো। অবনি বলে..
– কি হচ্ছে এসব সিফাত?
– জানিনা। আমার তোমার মায়াতে মিশতে ইচ্ছে করে খুব। (সিফাত)
– কিন্তু… কেনো? আমি তোমার চেহারার সাথে বিপরীত। (অবনি)
– কিন্তু আমার তো এতে কোনো সমস্যা নেই। আচ্ছা আমার কাছে আসতে হবেনা। তুমি এমনিতেই ভাবো অনেক সময় নিয়ে। তাহলেই বুঝতে পারবা। আর আমি এসব সমাজের নিয়ম কানুনও মানিনা। মানি তবে যেগুলো বেমানান, তা কখনো না। তাই তুমি একটু সময় নাও, ভাবো। আমার চাওয়াটাকে উপলব্ধি করো। তবেই এসো আমার কাছে। আমি সর্বদা আছি তোমার জন্য অপেক্ষায়। (সিফাত)
অবনি কিছু বললো না। দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো অবনি। মাথার মধ্যে এখন অনেকটা চিন্তা ঘুরছে। সিফাতের সাথে কথা বলাটা হয়ত ওর ঠিক হচ্ছে না। সিফাতকে সব জানানো দরকার। সে অর্নের বউ। কিন্তু অর্ন যদি এসবে রাগ করে? অর্ন যদি রিএক্ট করে? না না অর্নের কোনো সমস্যা হোক এমন কিছু অবনি করবে না। কিন্তু সিফাতের কথা কেনো অবনির বারবার মনে আসছে? এতটা প্রায়োরিটি কেউ কখনো অবনিকে দেয়নি। হঠাৎ করে একটা অচেনা মানুষের এতটা গুরুত্ব, এতটা আকর্ষনতা দেখাচ্ছে, যা অবনির মনকে বারবার অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে। অবনি বুঝতেই পারছে না, সিফাতের নিয়ে সে ঠিক কি ভাববে। সিফাতকেই বা সে কেনো অপশন হিসেবে দেখছে? তার তো হাজবেন্ড আছে। কিন্তু অর্ন? যে কিনা অবনিকে কোনোদিন বোঝেইনি। অবনি এতটা ভালোবাসা দেওয়ার পরও অবনিকে গুরুত্ব দেয়নি অর্ন। তাহলে কি কেবল কাগজ কলমের সম্পর্কটাই বড়, মনের সম্পর্ক কি কিছুই না?
অবনি আর বেশি কিছু ভাবতে পারেনা। কেমন যেন মাথা চিনচিন অনুভব হচ্ছে। রুমের দরজা হালকা আটকে, সে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ে। অর্ন যেখানে ঘুমায়, সেখানেই সে শুয়ে পড়ে। কখন যে চোখ লেগে আসে অবনির খেয়াল নেই।
.
একটু আড়ামোটা ছাঁড়তেই অবনির ঘুম ভেঙে গেছে। চোখ বন্ধ করে সে মনে করার চেষ্টা করে কোথায় আছে। কেনো আছে। মনে পড়ে সে অর্নের জায়গাতে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিল। অবনি উঠতে যাচ্ছিল, তখনি সে অনুভব করে গায়ে কাঁথা দেওয়া। এসিটাও অন করা আছে। কিন্তু অবনির খুব ভালো করেই মনে আছে, সে এসি অন করেনি। ফ্যান ছাড়া ছিল, বিছানায় কাঁথাও ছিল না। তাহলে কে দিয়েছে? সিফাত? ঘুম জড়ানো কণ্ঠে অবনি বলে “উফ সিফাত.. এত কেয়ার কেনো নিচ্ছো তুমি? এতকিছু খেয়াল করতে বলিনি তো। আমার সবদিক তোমার নজরে থাকে।”
অবনির গায়ে কাঁথা সিফাত দেয়নি। এসিটাও অন সিফাত করেনি। সবকিছু করেছে অর্ন। অর্ন সোফাতে বসে ছিল। পাশে রাখা ছিল অবনির প্রিয় বেলী ফুল। অর্ন অনেক কষ্টে অবনির জন্য বেলীফুল, চকলেট নিয়ে বাড়িতে এসেছিল। রুমে এসে দেখে অবনি ঘুমিয়ে পড়েছে। অবনিকে ডাকেনি অর্ন। অবনিকে নিয়ে অর্ন ভেবেছে অনেক। মনে মনে নিজেকে বলেছে “অবনির প্রতি এখন ওভাবে ভালোবাসা না আসলেও একটা নাম না জানা অনুভুতি ওর প্রতি টান সৃষ্টি করছে। আস্তে আস্তে অবনিকে ভালোবেসে ফেলবো আমি। পারতেই হবে। অবনিকে ঠকানো ঠিক হবেনা। যাইহোক, সে তো আমাকে ভালোবাসে। আমার উচিৎ, তার ভালোবাসাটাকে মেনে নেওয়া। অবনির প্রতি আস্তে আস্তে আমি আসক্ত হতে চাই। আমি পারবোই।”
অর্ন এসব ভেবে বেশ খুশিই ছিল। তাই সে অনেক কষ্টে ফুলগুলো ম্যানেজ করে। তারপর বড় একটি চকলেট বক্স নিয়ে বাড়িতে আসে। রুমে এসেই দেখে অবনি ঘুমিয়ে আছে। গরম লাগবে ভেবে, সে অবনির জন্য এসি ছেঁড়ে দেয়। তারপর একটা পাতলা কাঁথা অবনির গায়ের উপর দিয়ে কিছুটা দুরে রুমের সোফাতে এসে বসে থাকে। অবনির ঘুম ভাঙার সাথে সাথেই দেখবে টেবিলে চকলেট বক্স রাখা। সে অবাক হয়ে দেখবে অর্ন বসে আছে। অর্ন ঘুম ভাঙতেই অবনির দিকে বেলীফুলগুলো ছু্ঁড়ে দেবে, চুলের মধ্যে দিয়ে দেবে। একটু খুনশুটি করবে। তাই সে প্রস্তুত হয়েই ছিল। অবনির ঘুম ভাঙতেই অর্ন এগিয়ে যায় সেদিকে। কাছে যেতেই অবনির মুখে সিফাতের কথা শুনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।
অবনির চোখ খোলার আগেই টেবিলে ফুলগুলো রেখে দিয়ে তাড়াতাড়ি রুম থেকে বের হয়ে গেলো। রুম থেকে বেরিয়ে দেখে সিফাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি সিফাতের কাছে যেয়ে বলে.. “অবনি হয়ত তোকে খুজছিল। দেখ সে কোথায় আছে।” অবনির কথা শুনতেই সিফাতের মুখে একটা সুখকর হাসি ফুটে উঠল। সে ওখান থেকে দ্রুত চলে আসে। অবনি বিছানা ছেঁড়ে উঠে দাঁড়ালো। টেবিলের উপর প্রিয় বেলী ফুল দেখেই কয়েক মিনিট চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল অবনি। চকলেট বক্সও রাখা। সে অবাক আর খুশিতে বোবা হয়ে গেছে যেন। সিফাতের কথায় মনের ভিতর উঁকি দিতে শুরু করেছে। ঠিক তখনি সিফাতের গলা শুনতে পায় অবনি।
রুম থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসলো অবনি। সিফাতের সাথেই দেখা হয়ে গেলো। সিফাত বলে “তুমি কি আমাকে…” সিফাত কথাটা শেষ করতে পারেনা। তার আগেই অবনি সিফাতকে জড়িয়ে ধরে। খুশিতে অবনির চোখে পানি এসে পড়েছে। কারন কেউ এতটাও গুরুত্ব অবনিকে দেয়নি। অবনি কয়েক সেকেন্ড সিফাতকে জড়িয়ে ধরে, রেখে আবার ছেঁড়ে দেয়। হাসি হাসি মুখে বলে..
– ধন্যবাদ সিফাত। আমি সত্যিই ভাবিনি, আমি এতটা গুরুত্বপূর্ণ কারো কাছে। তুমি না থাকলে হয়ত জীবনের মানেটা কি তা জানতে পারতাম না।
অবনি কথাটা বলেই আবারো দৌড়ে রুমে প্রবেশ করে। সিফাত নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আঁড়াল থেকে অর্ন সবটা দেখছিল। অর্ন দ্রুত হেঁটে এসে দাঁড়ায় সিফাতের পাশে। কাধে হাত দিয়ে বলে…
– অবাক হচ্ছিস? মেয়েটা ওরাকমই। ছোট থেকে কেউ যদি একটু আদর করে, মানে অতি সামান্য আদর করে ডাকলে সে অনেক খুশি হতো। আর তুই তো অনেক কিছু মোটিভেট করে বলেছিস। তাকে গুরুত্ব দিয়েছিস। সে অনেক খুশি। আমিও চাই সে সবসময় এমন খুশি থাকুক। ছোট থাকে অবনিকে মজা করে ডাকতাম অবন বলে। অবন বলে বলে লবণ বানিয়ে দিয়েছিলাম। সে এতেই খুশি হয়ে বলেছিল ‘আমার এমন নাম ধরে ডাকলে খুব ভালো লাগে, খুশি খুশি লাগে, কেউ তো আমাকে অন্য নামে ডাকছে, এটাই তো অনেক বড় পাওয়া।’ যাইহোক, তোরা দুজনেই অনেক খুশি দেখছি।
– থ্যাংকস দোস্ত…
সিফাত অর্নকে জড়িয়ে ধরে, সেখান থেকে চলে যায়। অর্ন জোরে একটা নিঃশ্বাস নিল। ওর চোখের কোণে পানি জমা শুরু করেছে। বুকের ভিতরটা কেমন মোঁচড় দিয়ে উঠল। অর্ন এখন পুরোপুরি অবনির জন্য মনের মধ্যে ভালোবাসা অনুভব করা শুরু করেছে। সে রুমের মধ্যে যাওযার জন্য পা বাড়ায়। তখনি কে যেন পিছন থেকে হাত টেনে ধরে অর্নের। ঘুরে তাকিয়ে দেখে শেফা দাঁড়িয়ে আছে। শেফা অর্নের হাত ধরে, নিজের রুমে নিয়ে যায়। শেফা দরজা আটকে দিয়ে, অর্নের সামনে এসে দাঁড়ালো। অর্ন অবাক হয়ে শেফার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর..