Friday, June 27, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1066



তুমি নামক যন্ত্রনা পর্ব-০৭

0

#তুমি নামক যন্ত্রনা
#লেখনীতেঃহৃদিতা ইসলাম কথা
পর্বঃ৭

ভয়ে আমার কলিজার পানি শুকিয়ে গেছে।আমার হাত পা অস্বাভাবিক ভাবে থরথর করে কাঁপছে। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা।কিন্তু সামনের মানুষটার হুশ নেই।সে একইভাবে ছেলেগুলোকে পি*টি*য়ে যাচ্ছে। একেকটার অবস্থা ভিষন খারাপ।হাত, পা, মাথা,ঠোঁট কেটে র*ক্ত পড়ছে।কিন্তু সে মানুষটি নির্বিকারভাবে চারটে ছেলেকে পি*টা*চ্ছে।এতক্ষণ হাতে মারলে এখন ওদেরকে মাটিতে ফেলে ইচ্ছে মতো আঘাত করছে।ভয়ংকর দেখাচ্ছে তাকে।চোখদুটো ভিষন লাল বর্ন ধারন করেছে।যেন ওই চোখের আ*গু*নে ভ*স্ম করে দেবে সব।ছেলেগুলোর অবস্থা ভিষন খারাপ দুটো অলরেডি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।তারপরও মা*র*ছে।আমি কিছু বলতে পারছি না।বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছি।জীবনে কোনদিন এরকম কোন কিছুর সম্মুখীন হতে হয়নি।খুব বেশি ভযে মুখে হাত চেপে ফুপিয়ে কাঁদছি।যখন ওদের মারার পর র*ক্তা*র*ক্তি অবস্থা হয়েছিল।ছাড়াতে গিয়েছিলাম।তবে ওনার চোখ আর রাগের সামনে টিকতে পারিনি।ভিষন রাগে ছুড়ে মে*রে*ছিলেন আমায়।

এইতো ঘন্টাখানেক আগের কথা,
ভাইয়া হিরোদের মত গিটার বাজাতে বাজাতে এন্ট্রি নিল।তারপর সুন্দর একটা গান গাইলো আপুকে নিয়ে।
গানের মাধ্যমে তার মনের সকল অনুভূতি ব্যক্ত করলো।আপুর চারপাশে ঘুরে ঘুরে গান গাইলো।গান গাওয়া শেষে আপুর সামনে হাটু গেড়ে বসে তাকে প্রোপোজ করলো।আপু খুশি মনে হাত এগিয়ে দিল।তার চোখেমুখে খুশি উপচে পড়ছে। তারপর কেক কাটা হলো।আপুকে সবাইকে কেক খাইয়ে দিল। খাওয়া দাওয়ার পরে সবাই গিফট দিল আপুকে।এরপর শুরু হলো পার্টি।একজন এনাউন্স করলো আপু আর ভাইয়াকে কাপল ডান্স করতে হবে।তারা দুজন কাপল ডান্স করলো।আরো কয়েকজন কাপল এলো তাদের সাথে।স্রোত ভাইয়ার খালাতো বোন ও বোন জামাইরা ও আছে।মিউজিক শুরু হলো সবাই ডান্স করছে।আমি এককোনে দাড়িয়ে ডান্স দেখছি।হঠাৎ চোখ পড়লো স্রোত ভাইয়ার উপর। দেখলাম স্রোত ভাইয়া ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।ভয় পেলাম খানিকটা।এই লোকের এই ভয়ানক চাহনিই যথেষ্ট কারো প্রা*ন নেওয়ার জন্য। তার এমন দৃষ্টির মানে বোধগম্য হলো না আমার।না বুঝে চোখমুখ কুচকে তাকিয়ে আছি আমি।বোঝার চেষ্টা করছি।তবে ধুর! আমার মান্ধাতার আমলে ঢিলা মস্তিষ্ক যেন পন করেছে। আমি চাইলেও বুঝবো না।না বোঝার ভান করবো।তোকে ঝাড়ি খাওয়াতে আমার বেশ লাগেরে কথা! বেশ লাগে! হতাশ হলাম আমি।আমারই মস্তিষ্ক আমার সাথে বেইমানি করে। তখনই অনুভব করলাম এই মস্ত বড় পৃথিবীতে কেউ আমার না।আমি একা ভিষন একা।ঝুপ করেই মনে আষাঢ়ের মেঘেরা ভিড়ে করলো।

এই ঝাকঝমকপুর্ন পরিবেশ বিষাক্ত লাগতে লাগলো।একা থাকতে ইচ্ছে হলো।না জানে কোন বিপত্তি আবার আমার ঘাড়ে চড়লো বলে।বাগানের যে দিকটায় মানুষজন নেই সেখানে চলে এলাম।একটা বেঞ্চ পাতা আছে। তাতে ধপ করে বসে পড়লাম।ভাবছি! আমি এমন কি করলাম যার জন্য স্রোত ভাইয়া আমার উপর ক্ষেপে আছে।ঠিক সে সময় আমার পাশে এসে বসলো পিচ্চু।ও আজ স্রোত ভাইয়ার পাঞ্জাবির সাথে ম্যাচড পাঞ্জাবি পড়েছে।তবে রঙ ভিন্ন।কাঁচা হলুদ রঙের পাঞ্জাবিতে এই বজ্জাত পিচ্চুটাকে বেশ লাগছে। আমি একবার ওকে দেখে আবারো থুতনিতে হাত রেখে গভীর ভাবনায় মগ্ন হলাম।ও একটু ভাব নিয়ে বসে বললো,

— এখানে কি করছিস আপু? আম্মু তোকে ডাকছে।

আমি বিরক্ত হলাম বললাম,

— কই আমি তো শুনলাম না।

— কারন তুই কালা হয়ে গেছিস আপু ডাক্তার দেখা।নাহলে এমন হবে। বিয়েতে এসে বর তোর কালা হওয়ার নিউজ পেলে বিয়ে আর তোকে দুটো ফেলেই চম্পট মারবে।তাই আগে ভাগেই ডাক্তার দেখিয়ে নে।নইরে কপালে বর জুটবে না তোর।

বলেই হনহনিয়ে চলে গেল ও।আমি ওর যাওয়ার পানে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি।৯ বছরের একটা বাচ্চা সে কি ভাবটাই না নিলো আমার সাথে। আবার কথাও শুনিয়ে গেল।ওর কথার বিপরীতে আমি বলার কিছুই খুজে পাই না।ওর আর আমার সম্পর্ক আদায় কাচকলায়।এইটুকু পিচ্চি টা জন্মের পর থেকেই জ্বালিয়ে খায় আমায়।কারো কোলে ও হিসু করবে না।অথচ আমি কোলে তুললেই হিসু করে দিত।তখন থেকেই আমরা একে অপরের শত্রু। যাকে বলে অঘোষিত শত্রুতা আর অদৃশ্য যুদ্ধ চলে আমাদের মাঝে। পিচ্চুর উপর এক বালতি ভরতি রাগ নিয়েই মার কাছে গেলাম।

ফাংশনে তাকে খুঁজে যাওয়ার সময় আবার আমার বজ্জাত বিচ্ছু ভাইটার সাথে দেখা হলো ও বললো,

— কোথায় যাচ্ছিস তুই আপু? আম্মু তো বাড়ির ভিতরে।

ওর কথা বিশ্বাস স্টেজের ওইদিক না গিয়ে তাই বাড়ির ভিতরে গেলাম।সবজায়গা খুঁজতে লাগলাম।মনে হচ্ছে না বাড়ির ভিতরে কেউ আছে।পরে ভাবলাম হডতো আম্মু রুমে আছে তাই সেদিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই হঠাৎ আলো নিভে গেল।হতচকিত হয়ে গেলাম আমি। এরমধ্যেই কেউ আমার লেহেঙ্গার ওড়না মুঠোয় পুরে পেছন থেকে টান লাগালো।দুপা পিছিয়ে গেলাম তৎক্ষনাৎ। গিয়ে ঠেকলাম কারো প্রসস্থ বুকের মাঝে।বিদ্যুৎ খেলে গেল আমার সারা শরীরে।চট জলদি সেখান সরে আসতে চাইলে বুঝতে পারলাম সে আমার পেটের কোথাও তার এক আঙুল স্পর্শ করে রেখেছে।আর দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

— সবাইকে তোর ফর্সা পেট দেখানোর খুব ইচ্ছে তাই না।তাই এভাবে পেট দেখিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস।এসব সামলাতে না পারলে পরেছিস কেন? তোকে তো তখনই বলেছি যে এসব চেঞ্জ করে নিচে আসবি।আমার বারন কেন শুনলি না।

আস্তে অথচ ভিষন ভয়ানক আর ধারালো কন্ঠস্বর শুনে আমার বুঝতে বাকি নেই মানুষটি আসলে কে?এখন বুঝতে পারছি।ওই সময় ওভাবে ক্ষিপ্র দৃষ্টিতে কেন তাকিয়ো ছিল।তবে আমার তার এমন আচরনে বেশ রাগ হলো।তাই রাগ নিয়ে ঝাঝালো কন্ঠে বললাম,

— সবসময় কিছু না জেনে না বুঝেই বকাঝকা করেন আমায়।আমি ইচ্ছে করে করিনি ওটা অজান্তেই সরে গেছে।আর এসব ড্রেস আমি পরিনা।শুদুমাত্র আপু খুশি হয়ে পরতে বলেছিল বলেই পড়েছি।আমি ঠিকমতো আটকে বেরিয়েছি কিন্তু কখন এমন হলো বুঝতে পারিনি।

— বুঝতে পারিস নি মানে কি? নিজের খেয়াল রাখতে পারিস না।সব ঠিক আছে কিনা দেখে রাখতে পারিস না।

— আমি কি জানতাম এমন কিছু হবে।আমার চোখ কি ওদিকে গেছিলো।এক……এক মিনিট। আপনি কি করে দেখলেন ওটা।তারমানে আপনি আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আমাকে দেখছিলেন তাও ওভাবে…..
ছিহঃ ছিহঃ স্রোত ভাইয়া। আপনার নজর এত খারাপ।আপনি মেয়েদেরকে ওই নজরে ওভাবে দেখেন।ছিহঃ ছিহঃ আমি কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি আপনি এরকম একজন খারাপ মানুষ হবেন।দিদুন তো কত প্রশংসা করে আপনার।আপনি এই আপনি সেই! আপনি মেয়েদের দিকে তাকান না নম্র ভদ্র ছেলে।এই তার নমুনা। আপনি মেয়েদের শরীরের দিকে তাকিয়ে থাকেন।তাও আবার কোথায়….ছিহঃ বলতেও বাধছে আমার।

আমি একদমে গড়গড় করে সব বলে ফেললাম।এতগুলো কথা একসাথে বলে বেশ হাপিযে গেছি।একটু শ্বাস ছেড়ে নিশ্বাস নিতে যাবো তৎক্ষনাৎ স্রোত ভাইয়া হাত টেনে ঘুরিয়ে তার বুকের সাথে মিশিয়ে নিলেন।এবার দুহাত ভিষন শক্তভাবে ধরে আছে।ভিষন ব্যাথায় ” আহ” শব্দ করে উঠলাম।নিজেকে ছাড়ানোর জন্য মোড়ামুড়ি করছি।এভাবে এই অবস্থায় দম বন্ধ লাগছে আমার।স্রোত ভাইয়ার কাছে অনেকবার থাকলেও এবারের মত কখনোই ছিলাম না।আমার মাঝে নুন্যতম দুরত্ব নেই।একদম তার বুকের মাঝে আটকে আছি।এমন স্পর্শে চোখে জল চলে এলো আমার।উনি দাঁতে দাঁত চেপে তেজি গলায় বললো,

— তুই কি আমাকে দুশ্চরিত্র বলছিস নাকি প্রমান করতে চাইছিস।তোর যদি তাই মনে হয় তবে হ্যাঁ আমি দুশ্চরিত্র। মেয়েদের দিকে বাজে নজরে তাকাই তোর দিকেও ওই নজরে তাকিয়েছে।চাইলে আরও অনেক কিছুই করতে পারি।তবে তুই কিছুই করতে পারবি না।কিচ্ছু না! মাইন্ড ইট! আমি আমার কোন কাজের জন্য কাউকে সাফাই দেই না! তোকে তো একদমই না।

বলেই ছুড়ে মারলেন আমায়।আমার চোখ থেকে জল পড়ছে।উনি হনহনিয়ে প্রচন্ড রাগ নিয়ে চলে গেলেন।আর আমি কাঁদতে কাঁদতে বাইরে ছুটে এলাম।ছুটতে ছুটতে বাড়ির বাইরে রাস্তায় চলে এসেছি।ছুটেই চলেছি! ছুটেই চলেছি!থামার নাম নাই! কোথায় যাচ্ছি? কেন যাচ্ছি? জানি না! শুধু এইটুকু জানি আমি এখানে থাকবো না। কিছুতেই থাকবো না।কাঁদতে কাঁদতে এক পর্যায়ে রাস্তায় হাটু গেড়ে বসে পড়লাম।স্রোত ভাইয়া কি করে পারলেন আমাকে ওতগুলো কথা শোনাতে। তাও এত জঘন্য কথা। আমিতো ইচ্ছে করে কিছু করিনি।সবসময়! সবসময় আমার সাথে এমন করেন উনি।কেন করেন এমন? আমার বুঝি কষ্ট হয় না।এই মানুষটা আমার জীবনে আসার পর থেকে, পরিচয় হওয়ার পর থেকে পুরো জীবনটাই বদলে গেছে আমার।বিষিয়ে গেছে।বিষাক্ত অনুভূতিতে ছেয়ে গেছে শরীর মন।খানিকক্ষণ কাঁদার পর অনুভব করলাম আমার আশেপাশে কেউ আছে।চোখ তুলে তাকাতেই দেখলাম পেলাম। চারটা ছেলে।কুচকুচে কালো গায়ের রঙের। দেখতে পুরাই গাজাখোর। কেমন হেলেদুলে ঢলে পড়ছে।মনে হচ্ছে নেশা করেছে।গা থেকে বিশ্রী গন্ধ বেরচ্ছে। আমি নাকে হাত দিলাম।উঠে দাড়িয়ে ফিরে আসার জন্য পা বাড়াতেই দেখলাম। চারজন ঘিরে ধরেছে আমায়।আমার চারপাশে ঘুরছে।আমি মধ্যে খানে বন্দি।ভয়েরা ঝেকে বসলো মনে।আজ কি তবে কোন অঘটন ঘটে যাবে আমার সাথে! আমি তবুও সাহস হারালাম না।ভয় পেয়েছি তা প্রকাশ করলাম না।নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম।

আমি গলার স্বর খাদে ফেলে বললাম,
— যেতে দিন আমায়।

— কেন মামনি চলে যাবে কেন? আমরা আছি তো! একা একা কোথায় যাবে আমাদের সাথে চলো।

কথাটা বলেই বিদঘুটে হাসি হাসল।আরেকটা ছেলে বললো,

— তোমার সব কষ্ট দুর করে দেব।আমাদের সাথে চলো যা চাই তাই পাবা।অনেক মজা করবো তোমার সাথে।

বলেই বিশ্রী হাসলো। আমি কেঁদেই চলেছি।সবাই আমাকে খারাপ কথা বলে।আমি কি এতটাই খারাপ।কি এমন খারাপ করেছি আমি। সবাই আমাকে নিয়ে এত বাজে কথা বলছে।ভিতরে ভিতরে রাগ হলো আমার।তাদের এমন জঘন্য কথা শুনে রাগটাকে দমিয়ে রাখতে না পেরে উগড়ে দিলাম।তেজি কন্ঠে বললাম,

— একদম বাজে কথা বলেবে না আমাকে নিয়ে।

আমার কথা শুনে অন্য আরেকটা ছেলে বললো,

–সালা দেখছোস নি কি ঝাল মাইয়াডার। এইডারে দিয়া তো সেই মজা হইবো।

কথাটা বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো সবাই।আরেসজন বললো,
— হ রে। এরে তো লওয়া যাইতে হইবো।এই চল আমাগো সাথে।

বলেই আমার হাত ধরতে চাইছিলো তখনই কেউ এসে ওই হাতটা মুচড়ে দিলো।আমি একবার হাতের দিকে তাকিয়ে তারপর হাতের মালিকের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দৃষ্টিপাত করলাম। স্রোত ভাইয়া। ভিষনভাবে রেগে আছে।চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

উনি হাতটা মুচড়ে দিতেই ছেলেটা গগনবিদারী চিৎকার দিল।বাকিরা গর্জন দিয়ে উঠলো।

–ওই কে রে তুই,? আমাগো শিকার আর শিকারির মাঝখানে আইছোস! ভালোই ভালোই চইলা যা।নয়তো তোরে মা*ই*রা লা*শ পুইতা দিমু কেউ টের পাইবো না।বুঝলি।
যা ফুট এইখান থাইকা।

স্রোত ভাইয়া কিছু না বলেই লা*থি মা*র*লো কথা বলতে থাকা ছেলেটাকে ছিটকে গিয়ে দুরে পড়লো।
আর হাত ধরে থাকা ছেলেটার হাতটা শক্ত করে আবারো মুচড়ে দিল।মটমট করে উঠলো।সে চিৎকার করছে।অন্য হাত প্রতিহত করার চেষ্টা করতেই।সেটাকেও একই রকম ভাবে দুই- তিনটা মোচড় দিল।তার এমন মা* র দেখে বাকি দুজন বেশ ভয় পেল।ভয়ে শুকনো ঢোক গিললো।এ*টা*ক করবে কি করবে না দিদ্বাদন্দে ভুগছে।এক পর্যায়ে দিধাদন্দ্ব কাটিয়ে এ*টা*ক করলো।স্রোত ভাইয়া একহাতে ওই ছেলেটার দুহাত ধরে একটাকে লা*থি মা*রলো। অপরটাকে ঘু*ষি মা*রলো।দুটোই কুপোকাত।এরপর তিনজন একসাথে ছুটে এলো।ওটার দুহাত ধরে রেখেই বাকিগুলোকে আচ্ছামত মা* র লাগালো।এক সময় তাদের হাল বেহাল করে ছাড়লো।তারপর রাস্তার একপাশের থেকে একটা লোহার রড তুলে নিয়ে মা*রতে লাগলো।ভয় পেয়ে ঘাবড়ে গেলাম আমি।হডতো ছেলেগুলোকে মেরেই ফেলবে।আটকাতে গেলে আমাকেই ধাক্কা দিল।তবে নিজেকে সামলে নিয়েছি।

এই ছেলেগুলোর থেকেই বেশি ভয় এখন আমার স্রোত ভাইয়াকে লাগছে।মানুষ এতটা হিং*স্র আর নৃ*শং*স কি করে হতে পারে। আধঘন্টা একটানা মা*র খাবার পর সব কটা যখন জ্ঞান হারালো। উনি লোহার লম্বা রডটা ছুড়ে ফেললেন।মনে হচ্ছে উনার রাগ এখনো মেটেনি।পা দিয়ে দু চারটে লা*থি মারলেন।তারপর আমার দিকে ফিরে চাইলেন।তার চোখমুখ দেখে আমার আত্মা বেরিয়ে যাওয়ার অবস্থা। আমি উনাকে দেখে দুপা পিছিয়ে গেলাম।উনি তেড়ে এসে আমার হাত ভিষন শক্ত করে চেপে ধরে পিছনে মুড়িয়ে ধরলেন।ব্যাথায় প্রান ওষ্ঠাগত। মনে হচ্ছে হাড় মাংস সব আলাদা হয়ে যাবে।ভিষন যন্ত্রণায় বেশ জোরে কেদে দিলাম আমি।তবে তার কোন ভাবাবেগ নেই।তিনি সেভাবেই আমাকে ধরে নিজের কাছে এনে তেজি কন্ঠে বললেন,

— কেন এসেছিস এখানে বল?বাড়ি থেকে কেন বেরিয়েছিলি?কাউকে কিছু না বলে পার্টি থেকে হুট করে গায়েব হয়ে গেলি কেন?বল!

তার ভিষন ভয়ানক চিৎকার আর হাতের ব্যাথার কারনে চোখে মুখে অন্ধকার দেখছিলাম।এসব কিছু সহ্য করতে না পারে নিজের শরীরের ভর ছেড়ে দিলাম।গিয়ে পড়লাম স্রোত ভাইয়ার বুকে।আর কিছু মনে নেই আমার।

অপরদিকে কথার জ্ঞান হারানোর পর স্রোত কিয়দক্ষনের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। ও কি করছিলো বুঝতে পারে।হুশ ফিরে ওর।কথা যে ভিষন ভডে জ্ঞান হারিয়েছে তা বুঝতে পেরে নিজের ওপর রাগে ফেটে পরে ও।ভিষন রাগে ওর কোন জ্ঞান ছিল না যে ও কি করছে।ও কথাকে আঘাত করছে তা এতক্ষণে বুঝতে না পারলেও এখন ও বুঝতে পারছে।আর তা বোঝার সাথে সাথেই ও ওর ধরে রাখা হাতে কথাকে আগলে নেয়।অন্য হাতে ওর গালে হালকা বাড়ি মারে যাতে ওর জ্ঞান ফিরে।তবে না কাজ হচ্ছে না।ভিষন ভয় পেয়েছে মেয়েটা।এতক্ষণের সবকিছু নিজের চোখে দেখার পর ওর জ্ঞান হারানোটা অস্বাভাবিক কিছু না।তবে এতক্ষণ যে জ্ঞান হারায়নি সেটাই অস্বাভাবিক।ওকে একহাতে আগলে ছেলেগুলোর দিকে তাকালো।ছেলেগুলো ওভাবেই পড়ে আছে।একপলক ওদেরকে দেখে ও কাউকে একটা কল করে। তারপর কথাকে কোলে তুলে নেয়।আর ফিরে যায় নিজ গন্তব্যে।বাড়ির পিছন দিকের গেইট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে কথার রুমে চলে যায়। সেখানে গিয়ে ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ওর মাথার পাশে বসে পড়ে।ডক্টরকে কল করলে সে বলে যদি ভয় পেয়ে থাকে তবে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবে চিন্তার কিছু নেই।ও কথাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করে যে কথা কোথাও ব্যাথা পেয়েছে কিনা।কিন্তু না ব্যাথা পাইনি। ওকে বিশ্রাম নিতে দেওয়া প্রয়োজন।
ওর গায়ে ভালো করে কাথা টেনে দিয়ে বেরিয়ে গেল।বাইরে যাওয়া প্রয়োজন। দরজার কাছে এসে থমকে গেল।পিছন ফিরে একপলক দেখে নিল ওকে। এই মেয়েটার মাঝে এমন কি আছে? যা ওকে এতটা টানে।এি পিচ্চি মেয়েটার জন্য রাতারাতি ওর চোখের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। লুকিয়ে লুকিয়ে সারাক্ষণ ই দেখতে ইচ্ছে করে।ছুতে ইচ্ছে করে। কাছে থাকলে ভিষন ভালোলাগায় ছেয়ে যায় ওর মন।আর দুরে গেলে জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় হৃদয় নামক যন্ত্রটা।কেন এমন হয় ওর? কেন? তাহলে কি আপু ঠিকই বলে কারো মায়ায় জরিয়ে গেলে তাকে ছাড়া ভালো থাকা যায় না।তবে আমিও কি ওর মায়ায় জরিয়ে গেলাম।কারন ওর সাথে দেখা হবার পর থেকে ভালো থাকতে পারছি না আমি! কিছুতেই না! অস্থিরতা ঘিরে ধরেছে আমায়।ভিতরটা ভিষন ভাবে জ্বলে পুড়ে যখন ও নিজেকে আমার থেকে আড়াল করার চেষ্টা করে।দুরে থাকার চেষ্টা করে।রাগ আর ভালোলাগা দুটোই কাজ করে।ওর আমার প্রতি রাগ, অভিমান,অভিযোগ সব ভালো লাগে।বাচ্চাদের মত গাল ফুলানো,নাক ফুলানো, ঠোঁট কামড়ানো।ভয় পেলে মুখটা চুপসে যাওয়া।ওর বাচ্চামো! সবকিছুতে আটকে গেছি আমি।নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি ওর মাঝে।এতদিনে এতটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছি এই মেয়েটাকে আমার চাই! একান্তই নিজের করে চাই! ওকে ছাড়া ভালো থাকা বড় দায়! হঠাৎ ঝড়ের মত এসে আমার হাসিখুশি জীবনটাকে যন্ত্রণায় ভরিয়ে দিলে।যন্ত্রণা! #তুমি_নামক_যন্ত্রণায় আক্রান্ত আমি।

.
স্রোতের বাইরে যেতেই কথার মা প্রশ্ন করলো,

— স্রোত বাবা কথা কোথায়? দেখেছো ওকে? মেয়েটা খুব জ্বালাতন করে আমায়।পার্টিতে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না।কোথায় চলে গেল।

— কোথায় আর যাবে ছোট আম্মু বাড়িতেই আছে।হয়তো ভালো লাগছে না বলে নিজের ঘরে চলে গেছে রহিমা খালা বললো ওকে ওর ঘর যেতে দেখেছে।তুমি চিন্তা করছিলে বলে আমি ওর খোঁজ নিয়েছি। ও ঘরেই আছে। ঘুমোচ্ছে।

— হঠাৎ ঘুমোচ্ছে! ওর আবার কি হলো! এত জলদি তো ও ঘুমায় না।

— পার্টিতে ছিল এত লোকজনের ভিড়ে ।তাছাড়া সারাদিন এটা ওটা নিয়ে ছুটে বেরিয়ছে হয়তো ক্লান্ত তাই ঘুমোচ্ছে। তুমি চিন্তা করো না।একটু রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে।

ইনিয়ে বিনিয়ে কথাগুলো কোনরকমে বলে সামনের দিকে এগিয়ে গেল ও।কাউকে জানতে দেয়া যাবে না আজকের ঘটনার কথা।কেউ সঠিকটা বুঝতে চাইবে না উল্টো ঝামেলা বাড়বে। তাই বিষয়টা এগিয়ে গেল স্রোত।

#চলবে….

তুমি নামক যন্ত্রণা পর্ব-০৬

0

#তুমি নামক যন্ত্রণা
#লেখনীতেঃহৃদিতা ইসলাম কথা
পর্বঃ৬

সকাল ১০ টা বাজে। আম্মুর চেচামেচি আর বাইরের কোলাহলে ঘুম ভাঙলো আমার। ঘুম ঘুম চোখে টেনে তুললো আম্মু।ঢুলু ঢুলু হয়ে উঠে বসে ঝিমুতে লাগলাম।কাল অনেক রাত অবধি জাগার কারনে আজ যেন চোখের রাজ্যের ঘুম ভর করেছে।ছাড়ছেই না।ঘুম ঘুম চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসলাম।আম্মু বললো,

–তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিচে যা সবাই তোর খোঁজ করছে।

আমি কোনমতে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলাম।
আজ সকাল থেকেই বাড়িতে অনুষ্ঠানের তোরজোর চলছে।অনেক মানুষজনে গমগম করছে শান্তি নীড়। আমার দিদুনের নামে নামকরন করা হয়েছে বাড়ির। শান্তি! আমার দিদুনের নাম।
আজ সকাল থেকেই জনসমাগম বেড়ে চলেছে।তিশা আপুর নানু বাড়ির সবাই এসেছে।তারা অবশ্য আজ সকালে এসেছে।দিদুন,আব্বু, আম্মু কালকে এসেছে।আমার মামা বাড়িতেও দাওয়াত দেয়া হয়েছিল। তবে নীলার নানু নাকি একটু অসুস্থ তাই সবাই ও বাড়িতে গেছে।আসতে পারবে না বলে ভিষন দুঃখ প্রকাশ করেছে।

বড় আব্বু আম্মু ও দুঃখ প্রকাশ করেছে। নীলার নানুর সুস্থতা কামনা করছে।আমর্ সবাই এখানকার ফাংশন মিটে গেলেই ওখানে যাবো।হয়তো আজ না হলেও কাল যেতে হবে।

বাড়িতে ফাংশন এরেইঞ্জমেন্ট করা হবে বলে বাড়িটা খুব সুন্দর ভাবে সাজানো হয়েছে।বিজনেস ওয়ার্ল্ডে ওত বড় কেউ না হলে যথেষ্ট নাম ডাক আছে বড় আব্বুর।তার আদর্শ আর সততার জন্য।

বাগানের দিকে স্টেজ সাজানো হয়েছে।ডেকোরেশন ভিষন সুন্দর!চোখ ধাধানো!রাতে আরও বেশি সুন্দর লাগবে।সব জায়গা লাইটিং করা।আমি সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে এসব কিছু দেখছি। আমার পরনে একটা লেডিস টিশার্ট আর একটা লং স্কার্ট।গলায় ওড়না ঝুলানো।আমাকে দেখে তিশা আপুর দুইটা কাজিন ছুটে এলো।আমাকে ঘিরে ধরলো। বলতে লাগলো,

— আরে আরে তুমিই সেই কথা! তাই না।

আমি একটু অবাক হলাম।এরকম করে বলার কি আছে।আমি তো এমন স্পেশাল কেউ নই।আর তাছাড়া ওনাদেরকে আমি চিনি না।এনাদের আগে কখনো দেখিনি। আমি সহাস্যে মাথা নেড়ে ভদ্রতার সহিত বললাম,

— জ্বি আপু।আমিই কথা।

— দেখছো সত্যি দেখতে ভিষন মিষ্টি একটা মেয়ে। এমন মিষ্টি একটা লাখে একটা মেলে।খালামনি তোমার চয়েস….

আমি বুঝলাম এরা তিশা আপুর খালাতো বোন। কিন্তু এমন বলার ছিল যে বলতে বলতেই থেমে গেলেন উনি।তার কারন আমার কাছে অজানা।আমার আশে পাশে অনেকেই বসে। আম্মু নেই।তবে বড় আম্মু আর দিদুন আছে।সবার মুখে উৎফুল্লতা বিরাজমান।তবে তা যে আমাকে ঘিরে বোঝার বাকি রইলো না কিন্তু এমন কেন বুঝলাম না আমি। এরমাঝেই দেখতে পেলাম মাহিকে।মাহি তিশা আপুর মামাতো বোন।আমার এক বছরের জুনিয়র। তবে আমাদের মধ্যে খুব ভালো একটা সম্পর্ক আছে।ও এসেই কথাপু বলে জরিয়ে ধরলো আমায়। আমিও ওকে দুহাতে আগলে রেখে বললাম,

— কেমন আছো মাহি?অনেকদিন পর তোমাকে দেখলাম।

— আমি খুব ভালো আপ্পি। তুমি কেমন আছো?

— ভালো

— আমি তো তোমাকে খুব মিস করছিলাম আপু।কতবার কতবার করে বললাম তুমি ঢাকা বেরাতে এসো কিন্তু না তুমি আসতেই চাও না।তোমার নাকি তোমার প্রানের শহর ছাড়া কোথাও ভালো লাগে না।তা এখন কি করে এলে?

— না এসে উপায় আছে বলো। তিশা আপুর জীবনের এত বড় একটা দিন।কি করে মিস করি বলো তো।

— ওহ তাই বলো।শুনলাম স্রোত ভাইয়া নাকি তোমায় নিয়ে এসেছে।

আমি গম্ভীর মুখে শুধু “হুম ” বললাম।বুঝি না স্রোত ভাইয়ার আমাকে নিয়ে আসার পেছনে কারন কি? সেটা কি শুধুই আপুর এঙ্গেইজমেন্টের জন্য! নাকি অন্য কোন কারন আছে? সবাই এত অদ্ভুত ভাবে একই কথা কেন বলছে! আশ্চর্য!

.
সারা বিকাল তন্নতন্ন করার পর আপু আমার জন্য একটা লেহেঙ্গা সিলেক্ট করলো।বুঝলাম না আমি বার্থডে আর এঙ্গেজমেন্ট কি আমার নাকি উনার।অবাক করা বিষয়।আপু বরাবরাই আমাকে একটু বেশি ভালোবাসে। তাই তার এমন একটা স্পেশাল দিনে সে তার পছন্দ অনুযায়ী আমাকে সাজাতে চায়।আমি সায় দিলাম।
গাঢ় বেগুনি রঙের হালকা স্টোন বসানো একটা লেহেঙ্গা চুজ করলো। লেহেঙ্গাটা ভিষন সুন্দর! ওত হেবি না। তবে এটা তো শপিং এ ছিল না।কোথ্থকে এলো ভেবে পেলাম না আমি।যাই হোক লেহেঙ্গাটা কমফোর্টেবল বলে পড়ে নিলাম। সাথে হালকা সাজ।কানো ঝুমকো, হাতভর্তি ম্যাচিং চুড়ি।চুলগুলো মাজ বরাবর সিথি করে দুপাশে বেধে নিয়ে ছেড়ে দিলাম।ওড়নাটা গায়ের সাথে ভালোভাবে আটকে নিয়েছি।ওড়না সামলানো আমার জন্য বেশ মুশকিলের কাজ।তাই সবসময় ওটা সেফটিপিন দিয়ে আটকে রাখি।

যা হোক সবাই খুব জোর করছিলো পার্লারের জন্য তবে আমি যেতে চাইলাম না।আপু এ বিষয়ে কিছু বলেনি।আমি নিজেই তৈরি হয়েছি।

.
সন্ধ্যা ৮ টা। বাড়িতে রমরমা পরিবেশ। মানুষজনের আনাগোনা চলছে।আমি প্রায় রেডি তবে বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে না।ঘরে বসে আছি।সবাই পার্লারে।কিছুক্ষন পর বড় আম্মু এসে বললো আপু রেডি হয়ে চলে এসেছে।আমাকে তার রুমে যেতে বলেছে।আমি চলে গেলাম আপুর রুমে। সেখানে গিয়ে আরও অবাক হলাম।পুরো রুম আধারে ডুবে আছে।এত অন্ধকারে আপু কি করছে। সন্তপর্ণে ঘরে ঢুকে গেলাম।বেলকনির দরজা খোলা।সেখান থেকে এক টুকরো চাঁদের আলো এসে পড়াতে ঘরটা মৃদু আলোকিত।আমি ভাবলাম নিশ্চয়ই আপু বেলকনিতে।তবে পুরো ঘর অন্ধকার করে রাখার মানে কি! যত বেলকনির কাছে যাচ্ছি।ততই বুঝতে পারছি।আজ জোস্না রাত।চাঁদের উজ্জ্বলতা যেন উপচে পড়ছে।আমি বেলকনির ভিতরে গেলাম।বাইরের উজ্জ্বলতা চোখে পড়লো প্রথমেই।ঘুরে ওপাশে দেখতেই চোখে পড়লো এক বলিষ্ঠ দেহী পুরুষ।যে কিনা চাদের দিকে মুখ করে দাড়িয়ে আছে। তার গায়ে ও একই রঙের ডিজাইনার জামা।আমার ভ্রু কুঞ্চন হলো।এ সময় এখানে কে থাকবে?
আমার ভাবনার মাঝেই সে ব্যাক্তি পিছন ঘুরলো।মুখ দেখে খানিকটা ভড়কে গেলাম আমি।স্রোত ভাইয়া! উনি এখানে কি করছে? ভালো করে লক্ষ করে দেখলাম উনাকে।আজ উনাকে ভয়াবহ সুন্দর লাগছে।উনার এমন রুপে যেকোন নারী নির্ঘাত জ্ঞান হারাবে।যদি নীলা থাকতো তবে সে নিশ্চিত মুহূর্তে মুহূর্তে ক্রাশ নামক বাশ খেত।

শক্ত পোটানো শরীরে ফর্সা গড়নের বিশাল এই মানুষটার সৌন্দর্যের বর্ননা না দিয়ে পারলাম না।বেগুনি রঙের পাজামা পাঞ্জাবিতে বেশ মানিয়েছে। সাথে তার ঝাকড়া চুল মৃদু হাওয়ায় হেলছে দুলছে।মারাত্নক সুন্দর লাগছে।মনে হচ্ছে জ্ঞান হারাবো।এই প্রথম তাকে দেখে মনের ভিতর এক অজানা অনুভূতিরা নাড়া দিল।ক্রাশ নয়, অন্যরকম এক মুগ্ধতার সাথে পরিচিত হলাম আজ।আজ পর্যন্ত কোন পুরুষকে দেখে এতটা মুগ্ধ কখনো হই নি আমি।আচ্ছা! উনি কি সত্যি এত সুন্দর নাকি আমার কাছেই তাকে এত ভিষন সুন্দর লাগছে।বুঝতে পারছি না।তবে আবচেতন মন আমাকে অন্য কিছু জানান দিচ্ছে।

আমি ভাবনায় বিভের তখনই স্রোত ভাইয়া এলো আমার কাছে।তবে সচেতন দুরত্ব বজায় রেখেছেন উনি।নিষ্পলক দৃষ্টি বিনিময় হলো আমাদের।উনার চাহনিতে অস্বস্তি হলো আমার।এক পর্যায়ে উনি চোখ সরিয়ে আমাকে গম্ভির কন্টে শুধালেন,

— এত সেজেছিস কেন তুই?

আমি অপ্রতিভ।সেজেছি! কোথায় সেজেছি! কিছুই তো করেনি!শুধু অর্নামেন্টস পরেছি আর চোখে কাজল।এর বেশি তো আমি কখনোই সাজি না।
বিরক্ত কন্ঠে ভ্রুকুচকে বললাম,

— তো আজকের দিনে সাজবো না।তিশা আপুর জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন।আমি সেজেছি তাতে আপনার কোর সমস্যা?

— নাহ! আমার কোন সমস্যা নাই! তবে এই পুরো জাতির সমস্যার কারন তুই!

— মানেহ!

— এই যে তুই এত সেজেছিস, এখন তোকে দেখে যদি সবাই মাথা ঘুরে পড়ে যায়। তখন তার দায় কে নিবে বলতো?

আমি একটু লজ্জা পেলাম।কারো কাছে প্রশংসা শুনতে সবারই ভালো লাগে।আমারও লাগছে।একটু লজ্জা লজ্জা পেয়ে কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই উনি বলতে শুরু করলেন,

— নিজেকে নায়িকা ঐশ্বর্য রায় ভেবে মনে মনে এত জল্পনা কল্পনা করার কিছুই হয়নি।তোর মত ভিষন ভয়ংকর এক পেত্নীকে দেখলে সবার মাথা এমনি ঘুরে যাবে।

উনার এমন অপমান জনক কথায় গা রি রি করে উঠলো আমার।অপমানে জলে উঠলো পুরো শরীর। এই অসভ্য অভদ্র লোকটার সাথে কথা বলাই বেকার।যখন মুখ খুলবে আমায় অপমান করবে।এসব আর মেনে নেওয়া যায় না।রাগটাকে আরেকটু হাওয়া দিয়ে ভেতরের রাগটাকে আরো তীব্র করার চেষ্টা করলাম। কারন তাকে কিছু ভয়ংকর কঠিন কথা আজ শোনাতে না পারলেই নয়।

— কিহহ!আমি পেত্নী। আপনার আমাকে পেত্নী মনে হয়। চোখ কি আছে নাকি গেছে।চোখের ডাক্তার দেখান।লাগলে চারটা না দশটা চশমা লাগান বুঝলেন।এরকম চলতে থাকলে কপালে বউ জুটবে না।

উনি সহাস্যে বললেন,

— সত্যি বললে সবারই গায়ে লাগে।

— কোনটা সত্যি?

–এই যে তোকে সাজলে পুরো পেত্নীর মত লাগে। পুরাই বটগাছের ২০০ বছরের পুরনো পেত্নী।

বলেই উচ্চস্বরে হাসতে লাগলেন উনি।রেগে গেলাম ভিষন। যাকে বলে চরম রকমের রাগ।আর ভিষন রকম রেগে গেলে মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয় আমার।ভিষন রাগটা ঝাড়বো বলে তার দিকে তেড়ে এগুতে যাওয়ার সময় অসাবধানতা বশত লেহেঙ্গায় পা আটকে ছিটকে পড়লাম তার উপর।হটাৎ ঘটা আকস্মিক ঘটনায় উনি নিজেও ব্যালেন্স ধরে রাখতে পারলেন না।আমার পায়ের সাথে পা বেজে নিজেও পড়ে গেলেন।আর আমি ডিরেক্ট সিনেমার হিরোয়িনদের মত একেবারে উনার উপর গিয়ে পড়লাম।ধরাম করে আওয়াজ হলো।মনে হচ্ছে বেশ ব্যাথা পেয়েছেন উনি।
” আউচ!”শব্দ বের হলো উনার মুখ থেকে। তবে পড়ে যাওয়ার সময় আমাকে এমনভাবে দুহাতে আগলে নিলেন।যেন আমি আঘাত না পাই। চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করা আমার।ভয় কাটিয়ে উঠতে উঠতে কিছু মুহুর্ত কেটে গেল।চোখ মেলতেই ভয়াবহ ঘোরালো দুটো স্থির দৃষ্টির সম্মুখীন হলাম আমি।আমাদের মাঝে বিন্দুমাত্র দুরত্বের লেশ ও নেই।এমন বিষ্ময়কর ঘটনা আর অনাকাঙ্ক্ষিত চাহনিতে মিনিট কয়েক স্তব্ধ ছিলাম আমি।পুর মুহূর্তে উঠার চেষ্টা করতেই বুঝলাম।স্রোত ভাইয়ের দুহাত এখনো আমার কোমর শক্ত করে আকড়ে ধরে আছে।তার স্পর্শ অনুভব হতেই অন্য রকম এক শীতল অনুভুতিতে ছেয়ে গেল শরীর মন।লজ্জারা ঘিরে ধরলো আমায়।নুইয়ে গেলাম আমি।পেছনে দুহাত দিয়ে উনার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই উনি ঘোর ভেঙে বাস্তবিকতায় এলেন।সন্তপর্ণে সরিয়ে নিলেন দুহাত।আমি উঠে দাড়ালাম।তবে অপ্রীতিকর এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে কল্পনা অতীত ছিল।যার দরুন তাকে কিছু বলার সুযোগ দিলাম না আর না নিজে কিছু বললাম। ছুটে এলাম ও ঘর থেকে। মনে হচ্ছিলো দম আটকে মারা পরবো আমি।হাফ ছেড়ে বাচলাম।মনো হলো।বাইরে এসে জোরে জোরে শ্বাস নিলাম।তখনই হুট করে কাধে কারো স্পর্শ পেলাম।একটু ঘাবড়ে গেলাম আমি।
পিছনে ঘুরতেই চোখে পড়লো মাহিকে।ও বললো,

— আপু তুমি এভাবে হাঁপাচ্ছো কেন? কি হয়েছে? ভেতরে কে আছে?

মাহির চোখেমুখে উৎকন্ঠা। আমি শুকনো ঢোক গিলে বললাম,

— আরে না কেউ না।অন্ধকার ছিল বলে একটু ঘাবড়ে গেছিলাম।তেমন কিছু না।চল আমরা নিচে যাই।

— আরে দাড়াও আপু।আগে তোমাকে ভালো করে দেখতে দাও।
মাসাল্লাহ! আপু তোমাকে ভিষন ভিষন সুন্দর লাগছে। হালকা সাজে মানুষকে এতটা মায়াবি কি করে লাগে।আজ যে তোমাকে দেখবে সেই মুগ্ধ হয়ে যাবে।চোখ সরাতেই পারবে না।আমি তো ভাবছি ছেলেরা তো জ্ঞান হারাবে।উফফ! তুমি এত মারাত্মক কিউট কেন বলোতো!

— সত্যি!

— হুম আপু সত্যি বলছি।

— ওই বজ্জাত লোকটাকে সুযোগ বুঝে দেখে নিব।আমাকে পেত্নী বলা।মিথ্যাবাদী হারামি লোক।ব্যাটা খারুস! তোর কপালে বউ নেই! এটা আমার অভিশাপ। হুহ!

বিড়বিড় করলাম আমি।আমাকে বিড়বিড় করতে দেখে মাহি বললো,

— কিছু বলছো আপু?

— না, চলো আমরা নিচে যাই।বলেই নিচে চলে এলাম।
তবে আসার পথে প্রত্যেকে এমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিল যে ভিষন অস্বস্তি হচ্ছিল আমার দিকে।আশ্চর্য! আমি কি কোন ভিন গ্রহের প্রানী নাকি! নাকি কোন এলিয়েন! এভাবে দেখার কি আছে! নাকি স্রোত ভাইয়ার কথামত আমাকে সত্যি সত্যিই পেত্নী লাগছ! উফফ এসব কিছুই বিরক্তিকর। তার থেকেই বিরক্তিকর ওই মানুষটা। আর এক মুহূর্তের জন্য উনার চোখের সামনে যেতে চাই না আমি।উনার চোখেন আড়ালেই থাকবো।খাটাস লোক সুযোগ পেলেই আমার মান- সম্মান নিয়ে টানাটানি করবে।

#চলবে……..

তুমি নামক যন্ত্রণা পর্ব-০৫

0

#তুমি নামক যন্ত্রণা
#লেখনীতেঃ হৃদিতা ইসলাম কথা
পর্বঃ৫

— ভালোবাসা একটা সুক্ষ্ম অনুভূতি।যা প্রথমে মনের মাঝে ভালোলাগার সৃষ্টি করে।তারপর ধীরে ধীরে সে ভালোলাগা ভালোবাসায় রুপান্তর হয়।ওই মানুষটির ভালোবাসা, কেয়ারিং গুলো মনের মাঝে জায়গা করে নেও।অজান্তেই তার প্রতি একটা ভালোলাগাটা ভালোবাসা হয়ে ওঠে।সে মানুষটার প্রতি অনুভূতিটা সময়ের সাথে সাথে প্রগাঢ় হতে থাকে।

আমি ভালোবাসা মানে এটুকুই বুঝি।কারন এর বেশি তো উপলব্ধি করতে পারিনি।কিন্তু তোর ভাইয়াকে নিজের মত করেই ভিষন ভালোবাসি।তবে সবার কাছে ভালোবাসার বর্ননা বা ভালোবাসার মানে এক হয়না।একেক জন একেক ভাবে অনুভব করে। তোর ভাইয়ার প্রতি ভালোবাসাটা হুট করে আসেনি।ধীরে ধীরে এসেছে।তবে তার বর্ননা সে আমাকে প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ফেলেছে।

ভালোবাসা মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্য দিয়ে শুরু হলেও ধীরে ধীরে তা আত্মার সম্পর্কে সাথে জরিয়ে যায়।প্রিয় মানুষটির প্রতি তীব্র আসক্তি জন্মে।তাকে ছাড়া এক মুহূর্তে কাটানো মৃ*ত্যু সম যন্ত্রণা অনুভবের সমান হয়।সে আশেপাশে থাকলে সবকিছু ভালো লাগে।

— আপুইইইই গোঅঅঅ! তুমি তো দেখছি ভাইয়ার প্রেমে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে।বাহ! বাহ!

— পাকনি বুড়ি একটা।তুইও বুঝবি যেদিন তুই কাউকে ভালোবাসবি।ভালোবাসার অনুভুতি টা যেমন সুখের তেমন দুঃখের ও।একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ।তোর ভাইয়ার সাথে ঝগড়া কমই হয়।অবশ্য ঝগড়াটা আমিই শুরু করি।তবে রাগ করে যখন কথা না বলি।যখন তাকে অনুভব করি।তখন বুঝি আমি ঠিক কতটা তাকে ভালোবাসি।আসলে দুরত্ব ভালোবাসা বাড়ায়। প্রিয় মানুষটির অভাব বুঝতে শেখায়।তবে সময় থাকতে ভালোবাসাকে আকড়ে ধরতে হয়।সময় ফুরিয়ে গেলে হাজার হাতরে বেড়ালেও তা খুঁজে পাওয়া যায় না।সত্যি- কারের ভালোবাসা কখনো হারায় না!তবে চাপা পড়ে যায় তীব্র অভিমানের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে যায়!তাই তাকে চাপা পড়তে দিতে নেই! আবদ্ধ হতে দিতে নেই।তাকে নিজের মাঝে বিলীন করে নিতে হয় নতুবা তার মাঝে নিজেকে বিলীন করতে হয়।

— সত্যি আপু তোমার মত করে কখনো এভাবে ভাবিনি।আর ভাবতেই বা যাবো কেন? আমাকে তো কেউ ভালোই বাসে না।আচ্ছা আপু ভাইয়া যেমন তোমাকে ভিষন ভিষন ভালোবাসে! ঠিক তেমনভাবে আমাকে ভালোবাসার জন্য ও কি কেউ আসবে কখনো?

— কেন আসবে না ঠিক আসবে! তোর মতো মিষ্টি মেয়ে কোন খুউউব ভাগ্যবান পুরুষই পাবে।যে তোকে শুধু ভালোবাসবে না।যত্ন করে আগলে রাখবে তার বক্ষপিঞ্জিরায়।

— কে জানে কবে আসবে সে!

দুহাটু মুড়িয়ে মুখ গোমরা করে বললাম।তিশা আপু একগাল হেসে আমার গাল টেনে দিয়ে বললো,

— দেখবি সময় মতো ঠিক চলে আসবে।বা হয়তো এসেছে।তুই জানিস না।সময় হলে জানতি পারবি। বুঝতে পেরেছিস।তখন তাকে চিনে নিবি।

— সত্যি বলছো আপু! সে আসবে!

— অবশ্যই আসবে।

বলেই কথা তিশার আপুর বুকের মাঝে ঝাপিয়ে পড়ে শক্ত করে জরিয়ে ধরলাম ওকে। আমার মাঝে কেমন ভালোলাগা কাজ করছে।কখনো এসব নিয়ে ভাবিনি আমি।কারো সাথে কথা ও বলিনি।ভালোবাসা, অনুভূতি, প্রিয় মানুষটির প্রতি তীব্র অভিমান, অভিযোগ এসব সম্পর্কে আজ প্রথম কারো সাথে এত কথা বললাম।এখন আমার মাথায় শুধু একটাই কথা ঘুরছে।কবে? কখন? কিভাবে? সে মানুষটা আমার সামনে আসবে!আচ্ছা, আমি কি চিনে নিতে পারবে! নাকি না বুঝে হারিয়ে ফেলবো! কি করে চিনবো তাকে! আপু তো বললো সবার ভালোবাসা এক না! তাহলে!

.
কেটে গেছে ৬ দিন।এই ছদিন বেশ ভালোই দুরত্ব বজায় রেখেছি আমি।তবে যতসব উদ্ভট ঘটনার সময়ই তার সামনে পরতে হতো আমাকে।এইতো সেদিন গোধূলির ঠিক আগ মুহূর্তে আপু আর আমি ছাদে ছিলাম।আমি প্রকৃতিতে ডুব দিয়েছে সে অনেকক্ষণ। গোধুলির সময় টা আমার ভিষন প্রিয়।আলো আধারের মিলন সেতু এই গোধুলির। সুর্য অস্ত যাবে যাবে ভাব। পশ্চিমে হেলে পড়েছে বেশ অনেকটাই।নিভু নিভু হলুদরঙা আভা মিলিয়ে যাওয়ার জোগাড়।হঠাৎ দেখলাম ছাদে কেউ নেই।বুঝলাম আপু ফোনে কথা বলতে বলতে হয়তো নিচে চলে গেছে। এই সময়টা মন দিয়ে উপভোগ করছিলাম বলে হয়তো বিরক্ত করতে চায়নি।কি জানি কি হলো হঠাৎই দমকা হাওয়া এসে মন প্রান শীতল করে দিল।একটু জোরেই বাতাস বইছিলো।দুহাত মেলে তাকে প্রানপনে আপন করে নিজের মাঝে শুষে নিচ্ছিলাম। ঠিক তখনই ওড়না ফুরুৎ করে ওড়ে গেল।চেষ্টা করেও ধরতে পারিনি।ব্যাটা বজ্জাত ওড়নাটা ফাকি দিল আমায়।গিয়ে পড়লো একদম স্রোত ভাইয়ার বেলকনির রেলিং এর ওপর।এমনিতেই গায়ে ওড়না নেই তার উপর শীতল হাওয়া। গা হীম হয়ে আসার জোগাড়।রেলিং ধরে নিচের দিকে স্রোত ভাইয়ার বারান্দার রেলিং এ অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছি।এসময় ভাইয়া নিশ্চয় তার রুমে থাকবে না।এই ভর সন্ধ্যা বেলা তার বাড়িতে থাকার কথা নয়। সকালে ব্রেকফাস্ট করার পর তো তাকে আর দেখলাম না।হয়তো কাজে গেছে।এটাই মোক্ষম সুযোগ।যেই ভাবা সেই কাজ।ওড়না আনার উদ্দেশ্যে পিছন ঘুরতেই কারো বুকের সাথে বড়সড় একটা ধাক্কা খেলাম। আমার সামনে অবস্থানরত মানুষটি বিশাল দেহী একজন পুরুষ। তার কাছে আমি চুনোপুটি।তাই মাথাটা গিয়ে ঠেকলে ঠিক তার প্রসস্ত ইস্পাত দিয়ে গঠিত শক্ত বুকের মাঝে। আচমকা ঘটনাটি ঘটাতে ব্যাথা ও পেলাম খুব।মুখ থেকে “আহ” শব্দ উচ্চারন হলো।আমি দুপা পিছিয়ে কপাল ডলতে ডলতে মাথা তুলে তাকাতেই থমকালাম।স্রোত ভাইয়া স্বয়ং আমার সামনে পাথরের মুর্তির মত দাড়িয়ে।

স্রোত একদম অপলকে তাকিয়ে আছে কথার মুখের দিকে ।গোধূলির লালাভ আলো চোখেমুখে আচড়ে পড়ছে তার সাথে এলোকেশ। আরো মাতাল করা স্নিগ্ধ চোখ।খোলা চুলগুলো হাওয়ার বেগে উড়ে এসে চোখেমুখে পড়ছে।আর স্রোতের ভেতরে এক অদৃশ্য ভয়াবহ ঝড় তুলে দিচ্ছে।এই এলোকেশীর রুপের মুগ্ধতায় হারিয়ে যেতে চাইছে।ওর চোখে চোখ পড়তেই ওর মনে হলো ওই বাচ্চা বাচ্চা নিষ্পাপ মুখশ্রীতে রাজ্যের মায়া ছড়িয়ে আছে। ওই চোখে চোখ পড়তেই মনে হলো এ মুখে যেন সব লজ্জারা এসে ভর করছে।ওই লজ্জারাঙা মুখে হাজার বার খু*ন হতে চায় ও।লালচে রঙে কেমন রাঙা বতী মনে হচ্ছে ওর কাছে কথাকে।যেন কোন সদ্য ফুটন্ত রক্তজবা ওর সামনে তার প্রানবন্ত চমৎকার ঐশ্বর্য মন্ডিত রুপ নিয়ে দাড়িয়ে। চাক্ষুষ এমন গোধূলির রুপের আদলে অপরুপ রূপবতী তরুণীর দেখা যেন এই প্রথম বার পেল সে।স্রোত মহাশয়ের মনে হতে লাগলো। ও আজকের পুর্বে এমন রুপবতী নারী অনেক দেখেছে তবে এই তরুনীকে যেন পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা সুন্দরি রমনী বলে মনে হচ্ছে।

উনার চাহনি দেখে মনে হচ্ছে উনি বেশ গম্ভীর ভাবনায় মত্ত।মনে হয় কোনো ঘোরে আছেন উনি।তবে কেন জানি আমি ভিষন লজ্জা পেলাম। অকারনেই! এর কোনো মানে হয়! না হয় না!লজ্জা পাওয়ার কি আছে আমার! কিন্তু এভাবে একধ্যানে তাকিয়ে থাকার কি আছে?উনি কি এমন ভাবছেন? আচ্ছা আমাকে নিয়ে ভাবছেন নাতো? আমাকে নিয়েই বা কেন ভাববেন? কি ভাববেন?

মনের মাঝে হাজারো প্রশ্ন উকি দিল।নিজের ভাবনা চিন্তার ধরন দেখে আমি নিজেই বিস্মিত হলাম। তারপর সব চিন্তা ভাবনা ছুটিতে পাঠিয়ে উনার এভাবে আচমকা আমার সামনে প্রকট হবার দায়ে দু চারটে কঠিন কথা শোনাতে ইচ্ছে হলো। নিজের মন বাঞ্চনা পূর্ণ করার উদ্দেশ্য গলা খাকারি দিয়ে যেইনা কিছৃ বলবো।আচমকাই মনে হলো উনি ধ্যানচ্যুত হলেন।ভ্যাবাচেকা খেয়ে কিছুক্ষণ আমাকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত দেখলেন।তারপর হুট করেই দুপা এগোলো আমার দিকে।আমিও সয়ংক্রিয়ভাবে দুপা পিছিয়ে গেলাম।কড়া কথা শোনানোর চিন্তা ভাবনার ছুটে পালালো।মনের মাঝে ভয় যেন ভিড় জমালো।ভয়ে ভয়ে ভয়ার্ত কন্ঠে আটকে আটকে বললাম,

— আপনি এগোচ্ছেন কেন ভাইয়া?

— তুই পেছনে কেন যাচ্ছিস?

— আমি এগিয়ে আসছেন বলেই আমি পিছিয়ে যাচ্ছি।

— আমি এগিয়ে আসলেই তোকে পিছিয়ে যেতে হবে।

আমি এবার রেলিং এর কাছে চলে এসেছি।রেলিং এ আরেকটু পা পেছনে দিলেই হয়তো পড়ে যাবো।তার আগেই উনি আমার ডান হাতটা খপ করে ধরে একটানে তার কাছে নিয়ে এসে পিছন থেকে দুহাত বেধে দিলেন।সবকিছু এত তাড়াতাড়ি হলো কিচ্ছু বুঝে উঠতে পারলাম না।মান্ধাতার আমলো ঢিলা মস্তিষ্ক পরিস্থিতি বুঝতে সময় নিল।আমি পরিস্থিতি বুঝে উঠতেই ছোটাছুটি শুরু করলাম। তবে বিপরীত মানুষটা অপারগ! একচুলও নড়াতে পারলাম না।রাগ হলো আমার।মেজাজ টা মনে হলো একটু চটলো।আমার মনে হলো নিজেকে আরেকটু সাহসী প্রমান করা দরকার।তাই চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস নিলাম। ভেতরের ভয়টাকে কাটানোর চেষ্টা। তারপর একটু জোর গলায় বলেই ফেললাম।

— ভাইয়া দেখুন।

— যা দেখার তা তো দেখতেই পাচ্ছি। নতুন করে আর কি দেখাতে চাস।

চোখ আকস্মিক আকাড়ে বড় হয়ে গেল। নিজের দিকে চোখ পড়তে আমি নিজেই লজ্জায় চোখ বুঝে নিলাম।ইশশ! মনেই ছিল না।গায়ে ওড়না নেই।ছিহঃ ছিহঃ এই অবস্থায় ভাইয়ার সামনে ছিলাম আমি আর উনি আমাকে দেখছিলেন।তাও ওভাবে! ছিহঃ মান ইজ্জত সব জল ছাড়াই ধুয়ে গেল আমার।হুট করেই সেদিনের কথা মনে পড়লো। রাগে দুঃখে অপমানে সেদিন নিজের বিধ্বস্ত অবস্থার কথা মনেই ছিলনা।হয়তো সেজন্যই ভাইয়া ওভাবে বলেছিল।অখচ আমি তাকে কত বাজেই না ভেবেছি।সব কিছু বুঝে উঠতেই নিজের গালে নিজেকেই কষে দুটো চড় লাগাতে ইচ্ছে হলো।
ইচ্ছেটাকে দুর্দমনীয় রেখে কিছু বলবো তার আগে উনার রাগী কন্ঠে শুনতে পেলাম।

— এই অবস্থায় ছাদে কেন এসেছিস তুই?
উনার রাগী কন্ঠে অন্তরাত্মা কেপে উঠলো আমার।তবে ভুলটা আমারই।ভাবতেই ভিষন অনুশোচনা হলো আমার।অনুরোধী কন্ঠে বললাম,

— প্লিজ ভাইয়া আমাকে বকবেন না।আমি ইচ্ছে করে কিছুই করিনি।ওড়না ছাড়া ছাদেও আসেনি। আসলে ওই যে….ওই!

–কি ওই যে ওই যে করছিস?

আমি নিচু কন্ঠে শুধালাম।
— আমার ওড়নাটা হাওয়ার বেগে নিচে পড়ে গেছে।তাই ওটাকে আনার জন্যই যাচ্ছিলাম।

— কোথায় ওটা?

— আপনার বারান্দার রেলিং এর উপর।

উনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমাকে ছেড়ে দিলেন।কিন্তু পেছনে ঘুরার সাহস পাচ্ছি না।উনি বুঝতে পারলেন আমার অবস্থা। হয়তো সেজন্যই তার গায়ের জ্যাকেটা আমার গায়ে জরিয়ে দিলেন।আর পিছন থেকেই আমার ভিষন কাছে এসে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললেন,

— আর যেন কখনো ভুল করেই এভাবে আমার সামনে আসবি না।নাহলে নিশ্চিত কোন অঘটন ঘটে যাবে।তার জন্য সম্পুর্নভাবে কতৃপক্ষ দায়ী হবে। আমি নই।

বলেই আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন।আর আমার দুর্বল মস্তিষ্ক তার ভয়ানক কথার অর্থ খুজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।তবে কোন কুল কিনারা করতে পারলো বলে মনে হলো।এক পর্যায় তারা সচকিত হলো।স্নায়ুতন্ত্র সচল হলো।পিছনে ফিরে তার চলে যাওয়া দেখলাম।তারপর রুমে চলে গেলাম।

.
শুধু সেখানেই থেমে ছিলনা অঘটন গুলো। আপুর সাথে শপিং এ গিয়ে আমার একটা উইন্ড চাইম ভিষন পছন্দ হলো। তাই সেটা কিনে আনলাম। আমার জন্য বরাদ্দ করা ঘরটিতেই তা লাগানোর প্রচেষ্টায় চেয়ার নিয়ে উপরে উঠলাম। কখন যে ব্যালেন্স হারিয়ে ফেললাম বুঝতে পারলাম না।যখন তখন পড়ে গিয়ে যা তা একটা অবস্থার হওয়ার আগেই আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিলাম।পরমুহুর্তেই হাওয়ায় ভাসার আভাস পেলাম।একটা শক্ত পুরুষালি দেহের সাথে আটকে আছি আমি আর সে তার দুহাতের বাধনে আগলে রেখেছে।ভয় কাটিয়ে চোখ মেলতেই দেখতে পেলাম অনাকাঙ্ক্ষিত এক মুখ।সে কখনো আমার কাছে আকাঙ্ক্ষিত নয়।কিভাবে যেন সবসময় তার সামনেই এমন বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে যায় আমি।করুনা হয় আমার নিজের উপর।ভিষন মায়া হয় আমার। এই অদ্ভুত, গম্ভীর, রাগী মানুষটাই কেন এভাবে আমার এতোটা কাছে চলে আসে তার স্পর্শে অন্যরকম শিহরন অনুভব হয় কেন?
লজ্জা আর ভযে কুকড়ে গেলাম আমি। মাথা নিচু করে নিতেই তিনি ছেড়ে দিলেন আমায়।আগ্রাসী কন্ঠে বললেন,

— ছোটবেলার মত এখনও বুঝি আমার কোলে চড়ার ইচ্ছে জাগে।তা জাগতেই পারে।তুই বলতে পারিস আমাকে!আমি মাইন্ড করবো না!বরং আদর করে কোলে তুলে নেব।

উনার এমন খাপছাড়া কথায় গা শিরশির করে উঠলো।
রাগ নিয়ে নিজে নিজেই বিড়বিড় করলাম।

–এই লোক তো আচ্ছা বজ্জাত।সময় সুযোগ বুঝে ঠিক কথা শোনাতে ওস্তাদ।আর কিসব বললো, ছিছি! আমার উনার কোলে চড়ার শখ।হুহ! আমি ছোট থাকতে উনার কোলে চড়তাম।তাই বলে এখন তার কোলে চড়তে চাই। কি করে ভাবলেন উনি! উদ্ভট মানুষ আর তার উদ্ভট চিন্তাভাবনা।তার থেকেও ভয়ঙ্কর তার কথা বার্তা।একদম লাগাম ছাড়া।এই লোককে ব্ইরে থেকে দেখলে কেউ বলবে না।এই লোক এইরকম নস্টোলজি টাইপের কথাবার্তা বলতে পারে।এনার তো ঘাড় মটকে দেয়া দরকার।ইইই…
দাঁত কিড়মিড় করলাম।ইচ্ছে করছে বজ্জাতটার চুল টেনে ছিড়ে ফেলি।কোলে কেন চড়বো।একবারে তার ঘাড়ে চেপে বসে তার ঘাড় মটকে দেব।

এভাবেই কাটতে লাগলো দিন।তার থেকে যতই দিরে থাকতে চেয়েছি ততটাই তার কাছে চলে এসেছি।ইচ্ছাকৃত নয়। পরিস্থিতি এনে দিয়েছে। কিভাবে এই এক সপ্তাহ কেটে গেল টেরই পেলাম না।প্রিয় মানুষগুলোর সাথে সময় গুলো খুব দ্রুতই কেটে যায়।তাদের যেন ইয়ত্তা পাওয়া যায় না। তিশা আপুর সাথে এ কদিনে আরও ঘনিষ্ঠ হডে উঠলাম।আপু আমাকে তার লাভ স্টোরি বললো আমি আগ্রহ নিয়ে শুনলাম।ভাইয়া কখনো নাকি তাকে ভালোবাসি বলেনি।তবে তারা দুজনেই বুঝতে পেরেছিল। তারা একে অপরকে ভালোবাসে।তাই দুজনের সম্পর্কটা এভাবেই এগিয়েছে। আজ ওদের এঙ্গেইজমেন্ট আবার তার আগে আপুর বার্থডে সেলিব্রেশন হবে।এটা নাকি রোহান ভাইয়ের ইচ্ছে। সে তিশা আপুর এই পৃথিবীতে তার হয়ে যেদিন এসেছে সেই দিনই সে তাকে নিজের জীবনের সাথে জরিয়ে নিতে চায়।তবে এখন শুধু এঙ্গেইজমেন্ট হবে।বিয়ের জন্য আরও দুবছর অপেক্ষা করতে হবে।ভাইয়ার প্রজেক্টের কাজটা বিদেশি ক্লাইন্টদের সাথে যেখানে দুবছরের প্রজেক্ট। কাজটা মেষ হলে ভাইয়ার সফলতা আকাশচুম্বী হবে।তাই তারা দুজনেই অপেক্ষা করবে।এমনিতেই তারা নিজের মন প্রান একে অপরের নামে লিখে দিয়েছে।এখন শুধু শরিয়ত মোতাবেক আপন করে পাওয়া।ভালোবাসা থাকলে অপেক্ষা ম্যাটার করেনা।তীব্র ভালোবাসাটা কখনোই অপেক্ষার প্রহরে ফিকে হয়ে যায় না।তা বেড়ে যায় বহুগুনে।

আজ আপুর বার্থডে।আপু ঘুমিয়ে পড়েছে ১১ টা বাজেই।তবে আমার চোখে ঘুম নেই। আমি রাতভর পাইচারি করছি।ক কাপ কফি খেয়েছি জানা নেই।আপু ঘুমাতেই আমি আমার প্ল্যান মোতাবেক কাজ শুরু করলাম।আমার সাথে যোগ দিল।রোহান ভাইয়া।আপুকে ঠিক রাত বারোটায় বড়সড় একটা সারপ্রাইজ দেব।কারন ভাইয়ার কাল সকালে আসার কথা ছিল।তবে তার কাজ সম্পুর্ন হওয়ায় উনি আজই ব্যাক করেছেন।এটা তিশা আপুকে জানাতে বারন করেছি।প্ল্যানে স্রোত ভাইয়াকে নেওয়ার ইচ্ছে ছিল না।তবে পরে ভাবলাম।আপু সবাইকে একসাথে পেয়ে ভিষন খুশি হবে।তাই শুধু আমরাই না।আব্বু আম্মু দিদুন আর আপুর হবু শ্বশুড়বাড়ির সব লোকজন মিলে প্লযান মোতাবেক কাজ করলাম।ঠিক ঘড়িতে যখন বারোটা বেজেছে তখনই আপুকে সারপ্রাইজ দিলাম ।

আপু ভিষন অবাক।হঠাৎ করে এরকম কিছু আশা করেনি হয়তো।কেননা বারোটা পর্যন্ত আমাদের সাথেই ছিল।আমরা স্বাভাবিক ছিলাম। সবকিছু স্বাভাবিক ছিল।আপুর রুমটাকেও যতটুকু সম্ভব ডেকোরেট করেছি।অন্ধকার ঘরে আর কতটুকুই বা সম্ভব।
তবে আপু ভিষন খুশি ছিল।একদম কান্নাই করে দিয়েছে রোহান ভাইয়াকে দেখে। করবেই তো এতদিন পর তাদের দেখা। তাদের ভালোবাসা এরকমই একজন অপরজনকে ভালোভাবে বোঝে।আপুর রিলেশন পাঁচ বছরের।আর এর মধ্যে ভাইয়া বেশির ভাগ সময় দেশের বাইরেই ছিল।আউট অফ কান্ট্রি থাকার পরও তাদের ভালোবাসা কমেনি একবিন্দুও।

#চলবে…….

তুমি নামক যন্ত্রণা পর্ব-০৪

0

#তুমি নামক যন্ত্রণা
#লেখনীতেঃ হৃদিতা ইসলাম কথা
পর্বঃ৪

হঠাৎ করেই ব্রেক কষতেই আমি সামনের দিকে হেলে পড়লাম।অন্যমনস্ক থাকায় সামনের সিটের সাথে বেশ জব্বর একটা বাড়ি খেলাম।সেই চোট পাইছি মাগো।এই বজ্জাত লোকটা এত বজ্জাত কেনো? আমার জীবনে ঝড়ের মত উদয় হইয়া দুই দিনে জীবন ডারে একেবারে তছনছ কইরা ফালাইলো।ইচ্ছে করতাছে এক্ষনি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিই এই মাঝরাস্তায় গাড়ি থেকে। হুহ!

ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দুরত্ব ২৪৮ কিলোমিটার।গাড়িতো আর ট্রেনে আলাদা রকমের সময় লাগে।ট্রেনে ৬-৮ ঘন্টা আর গাড়ি বা বাসে যেতে সময় লাগে ৪-৬ ঘন্টা।যেহেতু আমরা নিজস্ব গাড়িতে যাচ্ছি তাই তুলনামূলক তাড়াতাড়িই পৌছানো যাবে বলে আশা করা যায়।এত লম্বা একটা জার্নি কি করে কাটবে।তাই ভাবছিলাম।আমি সচরাচর বাড়ি থেকে বের হইনা।আমার গন্ডির পরিসর তো ক্ষুদ্র। যেমন মোল্লার দৌড় মসজিদের অবধি আমার দৌড় মামা বাড়ি অবধি।মামা বাড়ি ছাড়া কোথাও যাই না আমি।তাই রাস্তা ঘাটের সৌন্দর্য ও দেখা হয় না।সবসময় মামা বাড়ির আশপাশের এলাকা আর আসা যাওয়ার রাস্তার সৌন্দর্য টুকু উপভোগ করার ভাগ্য মিলে।আজ পর্যন্ত কখনো ঢাকা যাওয়ার তেমন ইচ্ছে হয় নাই।যেহেতু আমি প্রকৃতি প্রেমী তাই প্রকৃতির সাথে মিশে থাকতে ভালোবাসি। ঢাকার মত ইট পাথরের শহরে আমার মন টিকবে না।এই ধারনাটা কেন যেন মনের মধ্যে বাসা বেধে আছে আমার। তাই আর সেমুখো হইনি আমি।আমাদের বাড়ি ও বাড়ির আশপাশটা গাছপালায় ভরপুর।যা আমার বেশ ভালো লাগে। আমার শ্রদ্ধেয় দাদা মশাই বেশ যত্ন করে বাড়িটা বানিয়েছেন।দিদুনের মুখে শুনেছি তিনিও নাকি আমার মত প্রকৃতিকে ভিষন ভালোবাসতেন।তাই চট্রগ্রাম শহর থেকে খানিকটা দুর এই নির্জন জায়গায় বাড়িটা বানান।তবে এখন এখানে আরো কয়েকটা বাড়ি তৈরি হয়েছে।মানুষজনের কোহাহলও মোটামুটি বাড়ছে।

মুলত এইসব ভাবনায় বিভোর ছিলাম।প্রকৃতির এই মোহময়ী রুপ আমাকে সবসময় টানে।তাদের মাঝে ডুবে থাকতে ভালোবাসি।আর সেই ভালোবাসায় ব্যাঘাত ঘটিয়েছে এই ধলা হনুমানটা।সহ্য হচ্ছে না লোকটাকে এই মুহুর্তে আমার।একদমই না।একটা রাগী শ্বাস ফেলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম তার উপর।সে ভাবলেশহীন। যেন এই পৃথিবীর কিছুই সে জানে না এতটা নিশ্বাপ সে। অথচ এক নাম্বারের বদেন হাড্ডি।আমি রেগে কিছু বলবো তার আগে উনি মিররে আমার দিকে শান্ত ও শীতল চাহনি নিক্ষেপ করে বললেন,

— তোর কি আমাকে ড্রাইভার বলে মনে হয়?

আমি ভ্রু কুচকালাম। মানে!
তবে উনি কে? ড্রাইভ যখন করছে নিশ্চয়ই ড্রাইভার সে।নিজেকে কি চিনতে পারছে না৷ নাকি উল্টোপাল্টা কিছু খেয়ে নিল।এসব ভাবনার ইতি টেনে বিরক্তি নিয়ে বললাম,

— মানে! মনে করার কি আছে! যেহেতু ড্রাইভ করছেন সেহেতু ড্রাইভার। আপনি জানেন না।চালককে ড্রাইভার বলা হয় নাকি কেউ বলে নি।ও আচ্ছা আপনি হয়তো বাংলা কম বোঝেন তাই তো।আচ্ছা সমস্যা নাই।আমি শিখিয়ে দিব।

উনার চোখে চোখে রেখে গড়গড় করে সব বলে ফেললাম। উনি চোখমুখ কুচকে নিয়েছেন ইতোমধ্যে।মনে হচ্ছে উনাকে বিরক্ত করতে পেরেছি।চরম ভাবে না হলেও খানিকটা হলেও বিরক্ত করতে পেরেছি।কাল থেকে যা শুরু করেছেন উনি।তার প্রতিশোধ তো নেওয়া হয় নাই।কাউকে বিরক্তির উপর বিরক্তি! মানে বিরক্তির চরম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া ও একটা আর্ট যা সবাই পারে না।আর এই গম্ভীর গোমরামুখো লোকটা ইঞ্চি পরিমান বিরক্ত করতে পারলেও কেল্লাফতে।এসব ভাবতেই নিজেকে কেমন সাহসী সাহসী মনে হচ্ছে।মনে মনে নিজেকে বাহবা দিলাম।

— গ্রেট কথা গ্রেট।তুই তো কামাল করে দিয়েছিস রে।তোকে তো নোবেল না থুরি অস্কার ছুড়ে দেওয়া উচিত।তারপর মিররে তাকিয়ে আবারো বললাম,

— আচ্ছা! আপনি কি ভুলে যাচ্ছেন যে আপনি কার ড্রাইভ করছেন উড়োজাহাজ নয়।যদিও উড়োজাহাজগুলো চালককে পাইলট বলা যায়। তবে কার ড্রাইভ কারীকে পাইলট বলার যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না।আপনি যেহেতু কারই ড্রাইভ করছেন সেহেতু আপনি ড্রাইভার। এবার বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়। একদম ক্লিয়ার করে বলে দিয়েছি।এবার একটু আপনি নিজের কাজে মন দিন আর গাড়িটা চালাতে শুরু করুন।কখন পৌছোবো কে জানে? ভালো লাগছে না। তাড়াতাড়ি করুন তো।বের হইলাম দশ মিনিট ও হলো না।আর আপনি গাড়ি থামায় রাখছেন।এটা কোন কথার মধ্যে পড়লো।

উনার চোখমুখ হুট করেই স্বাভাবিক হয়ে গেল।একদম শান্ত স্বাভাবিক।উনার এমন শান্ত আর স্বাভাবিক অবস্থা দেখে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এবার আমি চোখমুখ কুচকে তাকিয়ে আছে উনার দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে। আমার কেমন সন্দেহ সন্দেহ লাগছে। উনি একেবারে আচমকাই গাড়ির ফ্রন্ট সিট থেকে বেরিয়ে ব্যাক সিটে এসে বসে পড়লো।আমি অন্যপাশে বসে ছিলাম।উনাকে এমন হুট করেই কাছে আসতে দেখে বিচলিত হয়ে পড়লাম।পারলে গাড়ি থেকে পালাই। কিন্তু ডোর লক করা।ততক্ষণে মাথা অটোমেটিকলি পিছনে হেলিয়ে দিছি।আর ভয়ে চোখমুখ খিচে বন্ধ করে রাখছি।মনে মনে আল্লাহকে বলছি।

— হায় আল্লাহ! বাচাও আমারে। বাঘের খাঁচায় থেকে বাঘের সামনেও কেন এত বড় বড় বুলি আওড়াতে যাচ্ছিলাম কে জানে।আমার মাথায় কোন ভুত ভর করছে আল্লাহ।ওরে তাড়াতাড়ি নামায় দিবা না।এখন তো আমি শেষ! এই গরিলা তো আমারে কাঁচা চিবায় খাইয়া ফালাইবো।শেষ বার বাচাও আর বেশি বকবক করুম না।এই কান ধরছি।না নাক ও ধরমু।কে রাখছিলো আমার নাম কথা?😭
এত বেশি কথা কেন কই আমি?😭

মুখের উপর শীতল বাতাসের আভাস পেয়ে পিটিপিটিয়ে চোখ খুললাম।উনি একদম আমার মুখের সামনে।সামান্য দুরত্ব অবশিষ্ট নেই। সোস্যাল ডিস্টেন্সিং তো দুরের কথা। উনার দৃষ্টি এলোমেলো লাগছে।
কেমন ঘোর লাগা নেশাক্ত দৃষ্টি।যা অপলকে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।তার চাহনি দেখে অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম।একটু গলা ঝেড়ে নড়েচড়ে উঠতেই উনি দৃষ্টি পরিবর্তন করলেন।চোখ নামিয়ে নিলেন।কিছুক্ষন পর আবার চোখ তুলে শান্ত কন্ঠে বললেন,

— কি বলছিলি তুই? আবার বল আমিও শুনি।

আমি কাঁপছি রীতিমতো। কিছু না করেই লোকটা ভিষন ভয় পাইয়ে দিল।মনে মনে ভাবেলাম “এতক্ষণ এত কিছু বলার পর আবার জানতে চাইছে। কালা নাকি যে এতক্ষণ যা বললাম শুনতে পাইনি।যা বলেছি তা তো বলেছি এ কথা আর দ্বিতীয় বার মুখ ফুটে বের করা যাবে না।কালকের ধমক ভুলে যাইনি আমি।যে লোক আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমাকে এমন রামধমক দিতে পারে সে এই মাঝরাস্তায় আমার সাথে ঠিক কি করতে পারে আল্লাহ মালুম।বেশি কথা না বলে চুপ থাকাই শ্রেয়।”

আমার ভাবনাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে আমি একদম চুপ করেই রইলাম।যেন আমি কিচ্ছুটি জানি না।এক্কেবারেই না।ধোয়া তুলসি পাতা টাইপ।উনি আমাকে বললেন,

— ফ্রন্ট সিটে চলে আয়।

আমি মাথা নেড়ে সায় জানালাম।ইতোমধ্যে আমার সব সাহসিকতা জলে ধুয়ে গেছে।কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের অস্তিত্ব। আমি আর কথা না বাড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম।আমি সায় দিতেই উনি গাড়ির লক খুলে দিয়েছেন।

.
গাড়িতে বসে বাইরের পরিবেশের মুগ্ধতায় ডুবে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম জানি না।প্রায় একঘন্টা পর ঘুম ভাঙলো আমার। চোখ মেলেই দেখতে পেলাম গাড়িতে আমি একা।চোখ কচলে আশেপাশে তাকাতেই বুঝতে পারলাম উনি বাইরে দাড়িয়ে আছে।আমরা একটা ব্রিজের উপর।এখানে কোলাহল নেই একদমই শান্ত পরিবেশ। আর কি সুন্দর শীতল হাওয়া। শরীর মন শীতলতায় ভরিয়ে দিচ্ছে।আমি গাড়ি থেকে বাইরে বেরোলাম।উনার পাশে গিয়ে দাড়াতেই উনি আমার দিকে চাইলেন।বাতাসে আমার খোলাচুল গুলো আরও দুলতে লাগলো।এলোমেলো করে দিতে লাগলো। তবে এটা বেশ ভালো লাগছিলো আমার।কিছুক্ষণ ওভাবে থাকার পর উনি বললো,

–সামনেই রেস্টুরেন্ট আছে আমরা লান্চ করে তারপর বেরোবো।

আমি শুধু মাথা দুলালাম।তারপর আর কোন কথা হলো না।লান্চ করে বাড়িতে ফিরতে ফিরতে বিকেল ৪ টা বেজে গেল।বাড়িতে ঢুকতেই প্রথমে দেখতে পেলাম বড় আম্মুকে।আমব গিয়ে উনাকে সালাম দিলাম।উনি সালামেন জবাব দিয়ে আমাকে বুকো জরিয়ে বললো,

— আসার ইচ্ছে হলো তবে আমাদের রাজকন্যার। সে তো তার রাজ্য ছেড়ে কোথাও যায় না।

আমি আদুরে হয়ে বললাম,

— যদি নাই যাই তবে এখানে এলাম কি করে বলো?

— তা তো তুই তিশার জন্য এসেছিস।তাছাড়া নিজ থেকে তো এলি না।আমরা এতবার বলার পরও আসতে চাস না।

— এইতো এসেছি বড় আম্মু। তোমার অভিযোগের পালা এবার শেষ কর।

এরমধ্যেই তিশা আপু ছুটে এল।একছুটে তিশা আপু আমাকে জরিয়ে ধরলো শক্ত করে।তারপর ইচ্ছে মত গালগুলো টেনে দিল।সবার সাথে কুশল বিনিময় করলাম।দিদুন, আব্বু, আম্মুর,আর পিচ্চুর কথা জিজ্ঞেস করলো বড় আম্মু। স্রোত ভাইয়া আমাদের কথার মাঝেই চুপটি করে উপরে চলে গেলেন।বড় আব্বুর সাথে দেখা হলো না।উনি অফিসে ছিলেন।ভাইয়া থাকলে কাজের চাপ কম পড়ে।পড়াশোনার পাশাপাশি ভাইয়া বড় আব্বুর অফিসেও যায়। তাকে অনেকটাই সাহায্য করে।শুনে ভালো লাগলো।

তিশা আপু তার ঘরের দিকে যেতে যেতে বললো,

— তা আমাদের ঝাসিকি রানি।নিজের ঝাসি ছেড়ে বেরিয়ে এলো। আমি তো বিশ্বাস ই করতে পারছি না।

— কেন আমি তো এসেছি।

— তা এসেছিস তবে আমার মনে হচ্ছে ইচ্ছে করে আসিসনি।স্রোতের ধমক খেয়ে এসেছিস। তাই না!

— ইশশ! বললেই হলো,আমি তোমার ভাইয়ের ধমক খেয়েছি।শোন আমি কথা।যে কাউকেই ভয় পায় না।বুঝলে।আর তোমার ভাই! হাহ! তাকে কেন ভয় পেতে যাবো।এমনিতেই তো গোমরামুখো একটা। তাকে দেখে আবার কেউ ভয় পায়।সারাক্ষণ পেচার মত মুখটা করে রাখে।এমনিতেই দেখতে ধলু তারউপর আবার হোপ্ করে থাকে।এরকম মানুষকে দেখে আমি ভয় পাই না।আমি তো ইহজীবনে কোনদিন তাকে দেখে ভয় পাওয়ার প্রশ্নই উঠে না।আর ধমক! হাহাহা আমাকে ধমক দেয় কার সাধ্যি। তুমি তো জানো ইহজগতে আম্মু ছাড়া আর কাউকে ভয় পাই না আমি।

— হুম বেশ বুঝতে পারছি। কে কাকে কতটা ভয় পায়?

— মানে!

— কিছু না ফ্রেশ হবি চল।তারপর অনেক আড্ডা দেব।শপিং করবো।আর তো সময় বেশি নেই।দুটো ফাংশন একবারেই হবে।সবটাই সামলাবে স্রোত।বাবা ওর উপর দায়িত্ব দিয়েছে।আমার পছন্দ ও খুব ভালো করেই জানে।

আমি ফ্রেশ হয়ে নিলাম।বড় আম্মু খাবার খেতে বললে বললাম আমরা লান্চ করে এসেছি। এখন কিছু খাবো না।কিন্তু বড় আম্মু কার কথা শুনবে।উনাকে এটা বলতেই আদুরে গলায় ধমকে বললেন,

— একদম না।এখন খাবো না খাবো না বললে লাগাবো একটা।না খেয়ে খেয়ে কেমন শুকিয়ে যাচ্ছিস দেখেছিস! নিজের যত্ন তো একদমই নিস না।হেরে ছোট কি তোর খেয়াল রাখে না।ঠিকমতো খাবার খাস বলে তো মনে হচ্ছে না।

বড় আম্মুর বানী শুনে আমি বললাম,

— ঠিক বলেছো বড় আম্মু। তোমার ছোট আমার একটুও খেয়াল রাখে না। আদরও করে না।পিচ্চুকেই সব আদর করে।আমাকে খালি ধমকায়।

— হুম তাইতে বলি।আমার মেয়েটা দিন দিন এমন রোগা হয়ে যাচ্ছে কেন?

— দেখলে বড় আম্মু।তুমি আমাকে কত ভালোবাসো! তোমার ছোট আমাকে একদম ভালোবাসে না।আমি তোমার কাছেই থাকবো আম্মুর কাছে যাবো না।তুমি আম্মুকে আচ্ছা করে বকে দেবে কেমন?

বড় আম্মু কোল জরিয়ে আদুরে গলায় বললাম।
বড় আম্মু বললো,

— আচ্ছা বকে দিব।এখন কিছু খেয়ে নে।
তারপর নিজ হাতে আমায় আদর করে খাইয়ে দিল।

.
বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে উপুর হয়ে শুয়ে আছি আমি আর আপু।আপু তার ফাংশনে কি কি হবে সেসব নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা করছে।প্রথমেই বার্থডে সেলিব্রেশন আর তারপর এন্গেইজমেন্ট পার্টি।এরমাঝেই আমি বলে উঠলাম,

— আচ্ছা আপু।ভাইয়া তোমাকে খুব ভালোবাসে তাই না?

— হুম।তবে হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন? তুই তো কখনো এসব বিষয়ে প্রশ্ন করিস না।

— এমনিতেই।তোমার প্রতি উনার কেয়ারিং দেখলেই বোঝা যায়।

— আচ্ছা কথা তোর কোন বিএফ আছে? থাকলে বলতে পারিস। বাড়ির দিকটা আমি ম্যানেজ করে নিব।

— আরে না না! কি বলো আপু? আমার ওসব বফ টফ নেই।আমি এসবে ইন্টারেস্ট নেই।আমার তো আলাদা একটা জগৎ আছে। তুমি তো জানো প্রকৃতিতে মিশে থাকতে ভালো লাগে আমার।ওসব নিয়ে ভাবার বা টাইম পাস করার মত সময় নেই আমার হাতে।

–সত্যি বলছিস?

— একদম সত্যি।

— কিন্তু এ বয়সে মেয়েদের তো বফ থাকাটা স্বাভাবিক।

— থাকাটা স্বাভাবিক নয় আপু।না থাকাটাই স্বাভাবিক। জানো আমার সব বন্ধুদের বফ গফ আছে।সারাক্ষণ ফোনে প্যান প্যান।কি এসব ভালো লাগে না আমার।

— কখনো কাউকে ভালোবেসেছিস?

— নাতো! কেন আপু?

— তাহলে বুঝবি না।

— কেন বুঝবো না।বুঝিয়ে বললেই বুঝবো।

— আচ্ছা আপু তুমি কি করে বুঝলে যে তুমি রোহান ভাইয়াকে ভালোবাসো।
আচ্ছা আপু তুমি তো তোমার লাভ স্টোরিটা বললে না।আমি তো শুধু জানি তোমরা একে অপরকে পছন্দ করো।তো এই পছন্দের শুরুটা কোথা থেকে হলো? কিভাবে এগোলো কিছুই তো বললে না।

— কখনো জানতে চেয়েছিস যে বলবো।আর তাছাড়া তুই তো আমাকে ভালাই বাসিস না।তাই এত করে বলার পরও এলি না। আর এবার স্রোতকে পাঠাতেই সুরসুর করে চলে এলি।

— আরে আপু ছাড়ো তো তোমার বদরাগী গোমরামুখো হনুমান ভাইয়ের কথা।আমি তো তোমার জন্যই এলাম আর তুমি এভাবে বলছো।

— তো কিভাবে বলবো? তুই যা করেছিস তাই তো বলছি।আচ্ছা বলতো স্রোতের সাথে সারা রাস্তায় তোর ঝগড়া হয়নি।আই মিন টু সে, ও তোকে ধমক দেয় নি।ও যা রাগী। ওর রাগের সাথে তো পারা মুশকিল।আমি তো একবার ভয় পেয়েছি। যে ওকে তো পাঠিয়ে দিলাম।তুই যা ঘ্যাড়ত্যাড়া যদি না আসার জন্য জেদ করিস তবে ও তোর কি অবস্থা করবে সেই ভেবে দুঃখে ভেসে যাচ্ছিলাম একেবারে।

আপুর কথা শুনে কালকের রামধমক টা মনে পড়ে গেল।মুহুর্তেই মেজাজ বিগড়ে গেল আমার। তবে সেট্া অপ্রকাশিত রাখলাম।আর আপুকে মুখ কালো করে বললাম,
— এত দুঃখের সাগরে না ভেসে পাড়ে ফিরে আসো।আমি কারো ঝাড়ি বা ধমক খাই নাই। বারবার একথা মনে করাবা না।বলবা ও না।তোমার ভাই যে এই পৃথিবী না মহাবিশ্বের এক মাত্র অসভ্য ব্যাক্তি সেটা তার চেহারাতেই জ্বলজ্বল করে।

আপু উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। আর হাসতেই বললো,

— তাই বুঝি।তুই জানিস স্রোত যদি একথা জানতে পারে তবে তোর কি হাল করবে? আমার ভেবেই কলিজা কেঁপে উঠছে। তোর জন্য মায়া হচ্ছে।

–আপু। তুমি ওসব বাদ দাও আর আমাকে বলো আসলে এই ভালোবাসা কি? আমিও জানতে চাই।

#চলবে…..

তুমি নামক যন্ত্রণা পর্ব-০২ও০৩

0

#তুমি নামক যন্ত্রণা
#লেখনীতেঃ হৃদিতা ইসলাম কথা
পর্বঃ২ ও ৩

সেদিন ছিল,ভিষন আশ্চর্যের এক সুন্দর সকাল।কেন যেন সেদিন সকালটা একটু বেশিই সুন্দর মনে হচ্ছিলো আমার।

.
বসন্তের মিষ্টি সকাল।কোন এক অজানা পাখির মিষ্টি কন্ঠে ঘুম ভাঙলো আমার।আড়মোড়া ভেঙে উঠে বাবু হয়ে বসলাম আমি।একগাল হেসে লাফিয়ে নামলাম বিছানা থেকে।ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে মাত্রই রুমের সাথে লাগোয়া বেলকনির দিকে পা বাড়িয়েছে।বেলকনিতে পা রাখতেই শীতল হাওয়া গায়ে লাগলো।ভালো লাগা ছাড়িয়ে গেল শরীর মন জুড়ে।প্রকৃতির এই শীতলতা গায়ে মাখতেই।চোখে মুখে এক তৃপ্তির হাসি ছড়িয়ে পড়লো।এমন সকাল আমার প্রতিদিনই কাম্য। প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়ার এই এক সুযোগ।

বেলকনিটা আমার পছন্দের গাছ দিয়ে মন মত সাজিয়েছি।বেলকনির পুরোটাই সবুজে আবৃত। যেন ছোটখাটো একটা বাগান।বেলকনি ভর্তি গাছগুলোতে পানি দিলাম।তারা যেন সতেজতার ছোয়া পেল।তারপর বেলকনির চারপাশে বাধানো হাফ রেলিং এ হাত রেখে ঝুকে দাড়ালাম নিচের দিকে। চোখ গেল বাড়ির দুপাশের ফুলের গাছ গুলোর উপর।কেমন মুর্ছা গেছে ওগুলো।শুকিয়ে যাচ্ছে। আমি বাড়িতে না থাকায় কেউ ওগুলোর যত্ন করেনি বলে মনে হচ্ছে। আমি ছিলাম না বলেই হয়তো বাগানের ফুল গাছে পানি দেওয়া হয়নি।আমিও আর বিলম্ব না করে ছুটে গেলাম সেদিকে।মাকে দেখলাম রান্না ঘরে খুটিনাটি করছে। হয়তো নাস্তা বানানোর প্রস্তুতি করছে।শুক্রবার বলে সবাই আজ একটু লেট করেই উঠবে।পানি দেওয়ার জন্য পাইপ হাতে নিলাম।মনের সুখে গাছগুলোকে পানি খাওয়াতে লাগলাম।একসময় মনে হল ওরা যেন ভিষন খুশি।তেষ্টায় প্রান যেন তাদের বেরিয়ে যাচ্ছিলো।এখন সেই তেষ্টা মিটেছে।ঠোঁটের কোনে আলতো হাসি ফুটলো।হঠাৎ দেখলাম পানি আসা বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু বুঝে ওঠতো পারলাম না।তাই পিছনে ফিরলাম আমি।পিছনে ফিরে যা দেখলাম তাতে মাথা গরম হয়ে গেল আমার।আমার বিচ্ছু ভাইটা পাইপে পাড়া দিয়ে পানি আটকে রেখেছ। মেজাজটা বিগড়ে গেল মুহুর্তেই।চোখে মুখে ভয়াবহ রাগ নিয়ে এগিয়ে গেলাম ওর দিকে। পাইপটা আমার হাতেই বন্দী। দু কদম এগোতেই পানির পাইপ থেকে পা সরিয়ে নিল পিচ্চু। আর পানি ছিটকে আমি তৎক্ষনাৎ ভিজে গেলাম।বিস্মিত হলাম। মুখটা কিনঞ্চিত হা হয়ে গেল।হাত থেকে রীতিমত পাইপটা পড়ে গিয়ে জলগুলো মাটিতে ছড়িয়ে পড়ছে। স্লো মস্তিষ্কটা আকস্মিকতা বুঝে উঠতে না পেরে হ্যাঙ হয়ে গেল।কয়েক মুহুর্ত অতিবাহিত হতেই সে সচল অবস্থায় ফিরে এলো।পরিস্থিতি বুঝতে পেরে রেগে তাকালাম পিচ্চুর দিকে।ও খিলখিল করে হাসছে আর সে হাসি দেখে গায়ে জ্বালা ধরছে আমার।

আমি তেড়ে যেতে নিতেই ও মাটিতে থেকে পাইপটা তুলে আমার দিকে ধরলো।জলের পাইপটা মুখ বরাবর ধরে রেখেছে যার জন্য চোখে মুখে জল পড়ছে অবিরাম। চোখ তুলে তাকাতে পারছি না।দুহাতের তালু সামনের দিকে ধরে আড়াল করার চেষ্টা করছি নিজেকে।তবে খুব একটা লাভ হচ্ছে না।তারপর চেচিয়ে বলে উঠলাম,

— পিচ্চু সাত সকালে কি শুরু করেছিস? ভিজিয়ে দিলি কেন আমায়?পাইপটা ছেড়ে দে বলছি।না হলে ভালো হবে না কিন্তু। ধরতে পারলে মাথায় তুলে একটা আছাড় দেব।

— সকাল বেলা আমি শুরু করেছি নাকি রাত থেকে তুই শুরু করেছিস আপু।আমার সব চকলেট চুরি করে খেয়ে নিয়েছিস।

ওই অবস্থাতেই চোখমুখ খিচে নিলাম।এই রে ধরা খেয়ে গেলাম বলে মনে হচ্ছে।আমি তবুও না জানার ভান করে অবাক হওয়ার ভঙ্গিমায় বললাম,

— আমি!

ভোলাভোলা মুখ করে বললাম।যেন এই পৃথিবীতে যদি কোন ভোলাভালা মানুষ থেকে থাকে তবে সেটা আমি।আমি ছাড়া আর কেউ হতে পারে না।সে সত্বার অধিকারী। পিচ্চু পাইপ নিয়ে এগিয়ে আসছে আমার দিকে।পানির গতি বাড়ছে। এক পর্যায়ে ছুট লাগালাম আমি।পিচ্চু নিজেও আমার পিছনে ছুটছে।এই ১০ বছরের বিচ্ছু ছেলেটাকে সামলানো বেশ মুশকিল। মাযের আদরের রাজপুত্র বলে কথা। তবে যতই ও মায়ের আদরের রাজপুত্র হোক আমিও আমার বাবার আদরের রাজকন্যা।
ভেজা কাপড়ে ছুটে চলেছি আমি আর আমার পিছনে আমার বিচ্ছু ভাইটা পানির পাইপ হাতে দৌড়ে চলেছে।রাগ লাগছে ভিষন ধরতে পারলে একটা আছাড় দিব।পাজি ছেলে।দিনদিন বেদ্দপ হচ্ছে।এই ছেলের জন্য আজ আমার জীবনটা ফিস ফ্রাই এর থেকেও বেশি ভাজা ভাজা হয়ে গেছে।বাবার কাছে ভিষন আহ্লাদী রাজকন্যা হলেও মা আমাকে একদম ভালোবাসেন না।সারাক্ষণ বকাঝকা।সবসময় এক্সট্রা বকাঝকা।বুঝি না আমি কি সত্যিই আমার আম্মুর মেয়ে নাকি আমাকে কোথাও থেকে কুড়িয়ে এনেছে।হুহ!ভালো লাগে না।এখানে উনার ছেলে যে আমাকে এভাবে টর্চার করে তার বেলা। আজ আসুক আব্বু বলে দিব আমি।তবে তাহলে তো আমার কান্ডকারখানা ও ধরা পরে যাবে।

পিছন ফিরে বারকয়েক পিচ্চু কে শাষালাম।

— দেখ পিচ্চু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।আমি তোর চকলেট চুরি করেছি কে বলেছে তোকে।তুই যে তোর সিক্রেট ড্রয়ারে চকলেট রাখছিস তা আমি কি করে জানবো।

— হ্যাঁ,সেটাই তো কথা।আমি আমার সিক্রেট ডয়ারেই চকলেট রাখছি তা তুই কেমনে জানিস বল?

জিভ কাটলাম আমি।ইশশ মুখ ফসকে বলে ফেলেছি।আর এখন বাজেভাবে ধরাও পড়ে গেলাম।এটা কি ঠিক হলো বলো বাচ্চাপার্টি।আমি অসহায় মুখ করে বললাম,
–একটু চকলেট ই তো খেয়েছি তাতে এমন করার কি আছে।তোর বউকে তো আর খাইনি।আমি কাল এনে দিব।

— হু! একটু চকলেট খেয়েছিস! আমার পুরো বক্স খালি করে ফেলেছিস।জানিস এটা আমার জন্য কতটা স্পেশাল।আজ তোর খবর আছে আপু।তুই একদমই ঠিক করিস নাই।

— দেখ পিচ্চু এভাবে সাত সকালে আমাকে ভিজিয়ে কি লাভ তোর।আমার যদি সর্দি হয় না তো তোর গায়ে মুছবো বলে দিলাম।

— ছিহ! আপু তুই এত নোংরা। তবুও তোর এইসব ফালতু কথায় কাজ হচ্ছে না।রোজ আমার চকলেট খাওয়া আর আজ তো….

বলেও থেমে গেল। আমি ভ্রু কুচকে বোঝার চেষ্টা করছি ওর কথার মানে।কি এমন ভাবছে ও।পরক্ষণেই মনে পড়লো এটাই তো সঠিক সময়। যেই না ওর দিকে একপা এগিয়েছি ও পানির পাইপটা আমার দিকে ধরলো।পানির ঝাপটা মুখে পড়তেই চোখমুখ কুচকে ফেললাম। পিছনে ছুটতে ছুটতেই হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা খেলাম।পড়ে যেতে নিলেই সে আমাকে আকড়ে ধরলো দুহাতে শক্ত করে।আচমকাই এমন হওয়াতে চমকে ওঠে চোখ বন্ধ করেছি আমি। ওদিকের ব্যাক্তি অপলকে চেয়ে আছে বাচ্চা মেয়েটার মুখের দিকে। কি অপরুপ মায়াবি একটা মুখ।পানিতে ভিজে চোখমুখ আরও স্নিগ্ধ লাগছে ।পানির ছিটে মুখের উপর মুক্ত দানার মত চিকচিক করছে।চুলগুলো ভিজে লেপ্টে আছে মুখের উপর। তারউপর খিচে বন্ধ করে রাখা চোখ জোড়া।অসম্ভব দৃষ্টি নন্দন সে দৃশ্য।চোখের ঘন পাপড়িগুলো ভিজে আরও বেশি ঘন লাগছে। বড়বড় পাপড়ি গুলো সৌন্দর্যের শিখরে তাদের অবস্থান বর্ননা করছে।উজ্জ্বল শ্যাম বর্নের এই শ্যামময়ীর পানে দৃষ্টি যেন থমকে গেছে তার।

আমি নিজের কোমরে অচেনা কোন স্পর্ষ পেলাম।শক্ত হাতের বাধন অনুভব করলাম।চট করেই চোখ খুললাম আমি।অচেনা মুখ দেখে ভড়কে গেলাম আমি। চট করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম তার থেকে।সে অপলকে তাকিয়ে আছে।পলক ফেলছে না।তার ওই গভীর চোখের হিমশীতল চাহনিতে আমাকে অস্বাভাবিক অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে।অস্থিরতা আর অস্বস্তি যেন ঘিরে ধরেছে আমায়।

উনি মুখ খুলে বললেন,

— এই মেয়ে তুমি….

আর কিছু বললেন না থেমে গিয়ে আমার গায়ের দিকে নজর দিল।কয়েক সেকেন্ডের জন্য একদৃষ্টিতে চেয়ে থেকেই উনি পিছনে ঘুরে ভিষন রাগ নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

— এভাবে সং সেজে বাইরে কি করছো?যাও বাড়ির ভিতরে যাও।

রেগে গেলাম আমি। কেরে এ? আসছে কই থেকে?আমার বাড়িতে ঢুকে আমার সাথেই জোর গলায় কথা বলছে।আবার ধমকাচ্ছে।সাহস তো কম না।আমিও ঝাঝালো কন্ঠে বললাম,

— এইযে মিষ্টার ধলা হনুমান।ঠিক করে কথা বলুন।আমার বাড়িতে এসে আমাকেই ধমকাচ্ছেন। আমার বাড়ি আমি যেখানে খুশি সেখানে থাকবো। আপনার তাতে কি? দ্যাটস নান অফ ইউর বিজনেস।

আমার ঝাঝালো কথা শুনেই ভিষন ক্ষেপে গেছে বোঝাই যাচ্ছে। কিয়ৎক্ষন অপেক্ষা না করেই পিছন ঘুরলেন উনি।রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে তার। দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আমার কথা তার মোটেও পছন্দ হইনি। আমি ভালো করে দেখলাম তাকে।প্রথমেই দৃষ্টি পড়লো তার চোখের দিকে।নীল জলরাশির গভীর সমুদ্রের ন্যায় দুটি চোখ।তবে এখন তা হালকা লালচে বর্নের মনে হচ্ছে। গালো খোঁচা খোঁচা দাড়ি।সিল্কি চুলগুলো কপালের উপর এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।ঘন কালো ঝাকড়া চুল।যা উনার ফর্সা মুখের সাথে বেশ মানিয়েছে।চুলগুলো বেশ বড় হওয়ায় চোখ পর্যন্ত এসে ঠেকছে।পরনের সাদা রঙের শার্টটা আমার গায়ের পানিতে ভিজে লেপ্টে আছে। বুকের ভিতরের লোমগুলোও দৃশ্যবান।ফর্সা বুকে কালো ঘন লোমগুলো যেন ভয়াবহ ভাবে নজর কাড়লো আমার।তৎক্ষনাৎ আমার দুর্বল মস্তিষ্ক জানান দিলো সে ভয়ংকর সুন্দর একজন মানুষ। আমি আগে এত সুন্দর কোন ছেলে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না।আচ্ছা ছেলেটা কি সত্যি ই এত সুন্দর নাকি আমার চোখেই তাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুদর্শন যুবক বলে মনে হচ্ছে।২৪/২৫ বছরের এই যুবকের এমন ভয়ংকর রকমের রুপ দেখে হতবাক আমি।আচ্ছা আমি কি এই প্রথম ক্রাশ খেলাম নাকি এই অসভ্যটার উপর।যদি সত্যি তাই হয়,তাহলে ওহ মাই আল্লাহ! বাচাও মুঝে বাচাও! আজ এই তেরো বছর বয়সে আজ অবধি হিরো ছাড়া কোন ছেলেকে দেখে সরাসরি ক্রাশ না খাওয়া এই আমি কি তবে এই ধলা হনুমানটার উপর ক্রাশড।ভাবতেই নিজের গালে নিজ হাতে দুইটা চড় থাপ্পড় লাগানোর চরম ইচ্ছে প্রতিরোধ করে ভাবলাম। আমরা ফ্রেন্ড সার্কোলের সবাই ক্রাশ খায়।রোজ রোজ ক্রাশ খায়।যেন ক্রাশ কোন মেডিসিন যেটা ওদের খাওয়াই লাগবে।নয়তো ওরা সুস্থ স্বাভাবিক থাকতে পারবে না।তবে এতদিন আমি কি ভাবে সুস্থ ছিলাম।আচ্ছা এটা কি কোন ব্যাধি নাকি।যে ব্যাধিতে আজ আক্রান্ত হলাম আমি।

এই অল্প সময়ের মধ্যেই হাজার রকমের কথা ঘুরপাক খেল আমার মাথায়।এই মান্ধাতার আমলের ঢিলা মস্তিষ্ক। এত অল্প সময়ে এত কিছু ভাবতে পারে। ভেবেও অবাক হলাম আমি।আমার অবাকের রেশ আর অদ্ভুত চাওনি কাটাতেই ধমকে উঠলেন।সামনের অবস্থান রত ব্যাক্তিটি।আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম।
ঝাঁঝালো গলায় কিছু বলবো তার আগেই দৌড়ে এল পিচ্চু।আর ছুটে এসেই কোলে চড়ে গেল লোকটার। আমি হা হয়ে তাকিয়ে আছি।আমার এই দুষ্টু ভাইটা এই অসভ্য পাজি লোকটার কোলে কেন চড়লো? আমার অবাকের রেশ কাটাতেই পারছিলাম না যেন।তার আগেই লোকটি টুকুস করে চুমু খেল পিচ্ছু কে।আমি হতবাক! চেনা নেই জানা নেই একটা মানুষ কি করে আমার ভাইকে চুমু খেতে পারে।আমি এবার বেশ রাগ নিয়েই বললাম,

— এই আপনি,,,
আর বলতে দিল না আমায় চোখ গরম করে চাইলো।আমি বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। আমি কিছু বলার আগেই আবারো ঝাঝালো কন্ঠে বললো,

— ভিতরে যেতে বলেছি কথা কানে যায়নি।এখনো এখানে দাড়িয়ে আছো।যাও ভিতরে যাও।

ধুপ করেই মাথায় রাগ চড়ে বসলো আমার।রেগে গিয়ে বললাম,

— যাবো না ভেতরে।আমার ইচ্ছে।আপনি কে যে আমার আপনার কথা শুনতে হবে।

উনি কিছু না বলেই পিচ্চুকে কোল থেকে নামিয়ে দিল।আমার আরও খানিকটা কাছে এলো মুহুর্তেই।আমি মাথা পিছিয়ে নিলাম।উনি আমার উপর ঝুকে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললেন,

— শরীর দেখানোর এতই যদি ইচ্ছে হয় এখানে না দাড়িয়ে থেকে রাস্তায় গিয়ে দাড়াও।সবাই দেখবে।

তার এমন জঘন্য কথা শুনে গা গুলিয়ে এলো আমার।নিজের দিকে চোখ পড়তেই বিষিয়ে উঠলো মন।কালো রঙের টিশার্ট টা গায়ের সাথে একেবারে লেপ্টে আছে।ওড়নাটা ছোটাছুটিতে পড়ে গেছে।প্লাজুটার অবস্থা ও বাজে। টিশার্টটা বেশ খানিকটা লম্বা ছিল ভাগ্যিস। নাহলে আমার মান সম্মান সব এই মুহুর্তে নিলাম হতো।এখনো আর বাকি আছে কি! কতটা বাজে কথা বলে অপমান করলেন আমায়।ভাবতেই চোখের কোটর বেয়ে দুফোটা জল গরিয়ে পড়লো।মাথা নিচু করে ছিলাম আমি।ছুটে গেলাম বাড়ির ভিতর।সকাল আটটা বাজে।তাই সব কেমন নিশ্চুপ।মানুষজন নেই।সবাই হয়তো ঘুমোচ্ছে।আম্মুকেও দেখলাম না।যেতে যেতেই পিচ্চুর বলা কথা শুনলাম।

পিচ্চু বললো,
— স্রোত ভাইয়া তুমি এত সকালে কি করে এলে বলো তো।তোমার সাথে আর কেউ আসেনি।

ওর কথা কানে পৌছুলে আমার।তবে গুরুত্ব দিলাম না।সে যেই হোক না কেন এভাবে আমাকে অপমান না করলেও তো পারতো।দৌড়ে রুমে এসে দরজা আটকে দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে ট্যাব ছেড়ে দিলাম।অঝোরে কাদছি আমি।না চাইতেও জল গড়িয়ে পড়ছে দুচোখ দিয়ে । নিরবেই।কোন শব্দ হচ্ছে সে কান্নায়। স্রোত ভাইয়া এভাবে বাজে কথা বলতে পারলো আমায়।আমি কি ইচ্ছে করে ভিজেছি।পিচ্চুটাই তো ভিজিয়ে দিল আমায়।একটু বুঝিয়ে বললেই তো হতো।এভাবে অপমান করার কি দরকার ছিল।আচ্ছা, এতটুকু সম্মান কি প্রাপ্য ছিল না আমার।রাগ হলো, অভিমান হলো। ভিষন অভিমান।এক আকাশ সমান অভিমান।

.
প্রায় আধঘন্টা পর বেরিয়ে এলাম ওয়াশরুম থেকে। চোখমুখ ফুলে গোল আলু হয়ে গেছে। যেকেউ দেখলেই বুঝে যাবে আমি ভিষন কান্না করেছি।
কিছুক্ষণ পরই দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ পেলাম।আম্মু ডাকছে,

— কথা, এই কথা। কি করছিস তুই? বাইরে বের হ।সবাই বসে আছে ব্রেকফাস্ট করবে বলে।তুই কি করছিস? জলদি আয় তোর আব্বু বসে আছে।

— আম্মু আমার ভালো লাগছে না।এখন খাবো না ।বিরক্ত করো না।

— এক চড়ে সব দাঁত ফেলে দিব। বেয়াদব মেয়ে।এখনি খাবি তুই? বের হ বলছি।

বিরক্তিতে মনটা বিষিয়ে উঠলো আমার।মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে উঠলো।এক আকাশ সম বিরক্তি নিয়েই পা বাড়ালাম দরজার দিকে।দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলাম। বিরক্তিকর চেহারা নিয়েই খেতে বসলাম আমি।আমি আব্বুর সাথেই বসলাম। আব্বু পেপার পড়ছিলেন।পেপারটা রেখে আব্বু একপলক আমাকে দেখে বললো,

— আমার আম্মুটার কি হয়েছে? রেগে আছো মনে হচ্ছে।

— নাহ আব্বু কিছু হয়নি।ঠোঁটের কোনে আলতো হাসব টেনে বললাম।

— তাহলে চোখমুখ এমন ফুলে আছে কেন? কান্না করেছো?আম্মু কিছু বলেছে।

আম্মু কিচেনে কাজ করছিলো। আব্বুর কথায় বিরক্তিকর চেহারা নিয়েই ভ্রুকুচকে চেয়ে বললো,

–আমি আবার কি বলবো তোমার মেয়েকে! আর কেউ কিছু বললেই বা কেঁদে ভাসাতে হবে এটা কোন ধরনের কথা।
আম্মুর কথা শেষ হতেই আমি বললাম।
— আব্বু আমাকে কেউ কিছু বলেনি।

–তাহলে কি হয়েছে আমার প্রিন্সেস টার।

আব্বুর কথার প্রতিউত্তর দেওয়ার আগেই দেখলাম দিদুন, পিচ্চু আর স্রোত ভাইয়া আসছে টেবিলের দিকে।পিচ্চুটা কেমন একটা ভাব নিয়ে হাটছে।ঠিক স্রোত ভাইয়ার মত ওভার স্মার্ট হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা।হুহ! ঢং দেখলে আর বাচিনা টাইপ এক্সপ্রেসন দিলাম।তবে উনার দিকে দ্বিতীয় চোখ পড়তেই রাগে ড়া রি রি করে উঠলো আমার।দিদুন আমার ওপরপাশে বসলেন তারপাশে পিচ্চু। আর স্রোত ভাইয়া ড্যাঙ ড্যাঙ করতে করতে আমার পাশের চেয়ারটাতে বসলেন।রাগ,জেদ,ক্ষোভ সবটা তরতর করে বাড়তে লাগলো আমার।দিদুন পরিচয় করিয়ে দিলো।বললো,

— স্রোত চিনতে পারছিস। আমাদের কথা।যাকে সারাদিন তুই জ্বালাতি যে সারাক্ষন তোর ঘাড়ে চড়ে বসে থাকতো।

উনি ভিষন আশ্চর্যের মতন করে বললেন,
–কি বলো দিদুন!এই পিচ্চিটা। এত বড় হয়ে গেছে।

উনার মুখে পিচ্চি ডাকটা শুনেই যেন আগুনে ঘি ঢালার মত জ্বলে উঠলাম আমি। তবে কিছু বললাম না।চুপচাপ রইলাম।এখন ভেজাল না করাই ভালো।

— হুহ! বড় হয়ে গেছে।তুই তো এতবছরে ঠিক তেমনভাবে আসিস নি।এলও দু একদিনে আবার চলে গেছিস।আর ও তো মামু বাড়িতেই বেশি থাকতো তাই আর তেমন দেখা হয়নি বলেই চিনতে পারিস নাই।ও নিজেও তো কখনো তোদের বাড়িতে যায় নি তাই তোদের ঠিক দেখা হয় নাই।

সত্যি দেখা হবার কথা নয়।আমি দু একদিন ছুটি পেলেই ছুটে যাই মামার বাড়ি। আমাদের এখান থেকে দুঘন্টার পথ। গ্রাম্য অঞ্চল বলে বেশ ভালো লাগে আমার।তবে গ্রাম হলেও বেশ উন্নত। ওখানে সময় কিভাবে কাটে বুঝতেই পারি না।মামিরা বেশ আদর করে আমায়।কিছুদিন আগে সেখানেই ছিলাম।মামু আর নীলা এসে নিয়ে গেছে আমায়।কাল সন্ধ্যায় ফিরেছি আমি।তাই তার আসার কোন আগাম বার্তা ছিল না আমার কাছে।

আম্মু সবাইকে সার্ভ করছে আর আমাকে কথা শোনাচ্ছে।ভিষন বিরক্ত লাগছে।বিরক্তিতে সব ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করছে। এই বজ্জাত ছেলেটার সামনে এভাবে অপমান না করলে হয় না।আমি নাকি লেখাপড়ায় পুরাই ডাব্বা।কোনরকম টেনেটুনে পাস।আমার মায়ের কাছে ৮৫%নম্বর ও টেনেটুনে পাস মনে হয় বলে নিজের গালে সটান একটা চড় বসানোর ইচ্ছে হলো আমার।কেন টেনেটুনে পাস করলাম।ফেল করলেও ভালো হতো।আরও বললো সারাদিন শুয়ে বসে খাওয়া আর ফোন গুতোনো ছাড়া কোন কাজ নাই আমার।পড়ালেখা কেমনে হইবো।আর অনেক অপমান ই করলো।অন্য সময় হলে পাত্তা না দিলেও এখন বিশেষ রাগ হচ্ছে আমার।এই বজ্জাত ছেলেটাও বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনে চলেছে আর আড়চোখে আমানে দেখছি।বার কয়েক আম্মুর সাথে সায় দিচ্ছে।

চরম বিরক্তি নিয়ে কিছু না খেয়েই উঠে গেলাম।আম্মু বললো,

— কিরে কিছুই তো খেলি না।খাবার শেষ কর তার আগে উঠবি না।

–পেট ভরে গেছে আম্মু আর পারবো না।

— আমি কোন কথা শুনতে চাই না।

আব্বুর দিকে অসহায় চোখে চাইলাম।আব্বু চোখ দিয়ে সামলে নিচ্ছি বলে আশ্বাস দিল।

— থাক। ও যখন আর খেতে চাইছে না জোর করো না।মামুনি একটু পর আবার খেয়ে নিবে কেমন?

আমি মাথা নাড়ালাম।আজ আর গলা দিয়ে খাবার নামবে বলে মনে হয় না।যা মুখে দিয়েছি তাও গলায় আটকে আছে। আজকের মত এত ভিষন অপমানিত আমার জীবনে কখনোই হইনি।এই অসভ্য ছেলেটার সাথে সাথে আম্মুও রাজ্যের কথা শোনালো।এতদিন দেখা হইনি ভালোই ছিলাম।বড় আব্বু বড় আম্মু প্রায়ই আসে। সুযোগ পেলেই।তারা ভিষন আদর করে আমায়।তবে এই লোক আগে তো কখনোই আসে নাই তবে আজ কেন এলো? না এলেই ভালো ছিল।জীবনে এত অপমানিত হতে হতো না আমায়।

.
সারাদিনে ঘর থেকে বেরোলাম না।দুপুরে খেতে ডেকেছিল।যাইনি পড়ে খেয়ে নিব বলে। আম্মু বকাঝকা করেছে তবে কানে তুলিনি।রোজই করে তবে দিদুন তো আসে আমি না খেলে আমাকে নিতে।আজ এলো না কেন? এখন আর আমাকে কেউ ভালোবাসে না।সকালে আব্বুও আদর করে মুখে তুলে খাইয়ে দিল না।কেউ ঠিকভাবে বললো ও না।ভাবতেই মনটা ভিষন দুঃখে ভরে গেল আমার। তাই আর একবারও খেতে গেলাম না। সারাদিন মুখ ফুলিয়ে ছিলাম।

সারাদিন যেমন তেমন তবে রাতে আর থাকতে পারলাম না।ক্ষুধায় মরে যাবার মত অবস্থা। কি করবো? যাই হোক অন্যকারো উপর রাগ করে থেকে নিজের পেটকে অনশনে রাখার কোন মানেই হয় না।তাই সব ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলাম।সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছে এখন চুপিচুপি খাবার খেয়ে নিলে কেউ টের পাবে না আর না আমাকে নিয়ে মজা করবে। আর ওই বদমাইশ ব্যাটা তো মনে হয় এতক্ষণে ঘুমিয়ে গেছে।এই ব্যাটা এ বাড়িতে পা রাখার পর থেকেই কেউ আমায় আর ভালোবাসছে না। এটা কি মেনে নেওয়া যায়! নাহ যায় না! যাই হোক আগে পেটপুজো করে একে শান্ত করতে হবে।কি জোরে জোরে ডাকছে।

রাত প্রায় ১১ টা। আমাদের বাড়িতে ১০ঃ৩০ পর তো আর কেউ জেগে থাকে না।তাই চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে আশে পাশে উঁকিঝুঁকি দিলাম।নাহ সব জায়গায় ঘুটঘুটে অন্ধকার। মানে সবাই এতক্ষণে ঘুমিয়ে গেছে। আমি পা টিপে টিপে কিচেনের দিকে গেলাম।ফ্রিজ খুলতেই যাবো ওমনি কেউ আমার হাত ধরে ফেললো।আমার কলিজা ফাল দিয়ে উঠলো।আতকে উঠলাম আমি।এত রাতে ভুত টুত আবার নয়তো।ভাবতেই একটা শুকনো ঢোক গিললাম।ভয়ে ভয়ে পেছন ফিরলাম আমি। বাইরের আবছা হলদেটে আলো চোখে মুখে আছড়ে পড়ছে আর ওই হলদেটে আলোর আদলে আমি একটা ভয়ানক সুন্দর মুখের মানুষকে আবিষ্কার করলাম।যে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।আমি ভয় পেলাম আরো বেশি করে এই ভুত আবার স্রোত ভাইয়ার রুপ ধরে আসেনি তো।ভেবেই চোখ বড়বড় করলাম। নিজেকে বাঁচানোর উদ্দোশ্য যেই না চিৎকার করতে যাবো ওমনি উনি আমার মুখ চেপে ধরলো।চোখমুখ ভিষনভাবে কুচকে আছেন উনি।যার দ্বারা উনার বিরক্তি প্রকাশ হচ্ছে নাকি রাগ বুঝতে পারলাম না আমি।ভয়ার্ত মুখ নিয়ে প্রসারিত চোখে উনার দিকে চেয়ে আছি।

উনি আমার মুখের খানিকটা কাছে এসে বললো,

–চেচাচ্ছিস কেন?

— উম্ উম্ উম্….
আমি উম্ শব্দ করে চোখ দিয়ে আমার হাতের দিকে ইশারা করছি।উনি বুঝতে পেরে মুখ ছেড়ে দিলেন। কিন্তু দুরে সরলেন না।এমনিতেই উনি মুখ চেপে ধরায় শ্বাস আটকে আসছিলো আমার তারউপর আবার উনি আমার এত কাছে আছে।যা আমার ভিষন অস্বস্তি আর অস্থিরতা দুটোই সৃষ্টি করছে।উনার শরীরের অদ্ভুত রকমের ঘ্রানটা যেন আরো বেশি বাড়িয়ে দিচ্ছে আমার হৃৎস্পন্দন।এত জোরে জোরে বিট করছে যেন মনে হচ্ছে এখুনি লাফিয়ে বেরিয়ে আসবে ওটা।আমি মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছি।উনার দিকে তাকানোর সাহস নেই আমার।
তবুও বুঝতে পারছি উনি একধ্যানে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।আমি এবার একটু নড়েচড়ে উঠতেই উনি শুধালেন।

— এত রাতে কিচেনে কি করছিস তুই?

আমি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম।কি বলবো,

— আ্ আমি প্ পানি নিতে এসেছিলাম।

— তোর রুমে তো পানি আছে দেখলাম আমি।

আমি চমকে চাইলাম।উনি কি করে জানে আমার রুমে পানি আছে।তবে আমাকে মুখ খোলার সুযোগ দিলেন না উনি। বলে উঠলেন,

–এই এই এই! তুই এত রাতে চোরের মত কিচেনে ঢুকেছিস কেন বলতো? ধান্দাটা কি তোর? বাই এনি চান্স খাবার চুরি করতে নয়তো!

আমার মুখ এবার হা হয়ে গেল। সাথে কিঞ্চিৎ রাগও হলাম।চোখমুখ শক্ত করে বললাম,

— আমার বাড়িতে আমি খাবার চুরি করবো কেন?

— তাহলে এত রাতে কি চাই তোর?

— যা ইচ্ছে তাই।আপনাকে কেন বলবো! আপনি কেন কাউকেই বলবো না আমি।সরুন বলছি যেতে দিন আমায়।

বলতেই উনি আরো ঘেষে দাড়ালেন আমার সাথে। যেন আমার কথাটি তার কর্নপথে যায়নি।মিশে যেতে চাইলেন আমার সাথে। ঘাবড়ে গিয়ে চোখমুখ খিচে বুঝে ফেললাম।কিন্তু এমন কিছুই হলো না।আমি চোখ খুলে দেখলাম উনি একহাতের উপর আরেকহাত রেখে সে হাত থুতনিতে ঠেকিয়ে কেমন অদ্ভুদ চাহনীতে দেখছেন আমায়।আমি উনার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম।হুট করে উনি এসে একহাতে আমার কোমর জরিয়ে কাছে টানলেন।আমি স্তম্ভিত। হঠাৎ ঘটা এমন আকস্মিক ঘটনায়।অবাক চোখে তাকিয়ে আছি।আচমকাই গালে ঠান্ডা কিছুর আভাস পেলাম।এতক্ষণের কিছুর ধ্যান জ্ঞান ছিলনা বোধহয়। হঠাৎ হঠাৎ এমন সব কান্ড ঘটছে।আমার মস্তিষ্ক তা নিতে পারছে না।বারবার হ্যাঙ হয়ে যাচ্ছে।গালে ঠান্ডা আইসক্রিম গুলো কাতর স্পর্শে জিভ দিয়ে চেটে খেয়ে নিলেন। উনার এহেন স্পর্শে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট ব্যক্তির ন্যায় কাপছি আমি।পরমুহূর্তেই আমাকে ছেড়ে আইসক্রিম নিয়ে চলে গেলেন উনি।আমি এখনো আটকে আছি।যাওয়ার সময় পিছন না ঘুরেই বললেন,

— ফ্রিজে তোর পছন্দের ভুনা খিচুড়ি তোলা আছে। খেয়ে ঘুমিয়ে পড়।ওই ছোট্ট মাথায় ওতো বেশি প্রেসার দিস না।ফেটে যাবে।

আমি বোকার মত তার কথা শুনলাম।সাথে সায়ও দিলাম।এতক্ষণে ঘোরের মধ্যে ছিলাম।হঠাৎ কানে একটা আওয়াজ এলো।তাতেই ঘোর ভাঙলো আমার।এতক্ষণ কি হচ্ছিলো ভাবার চেষ্টা করলাম তবে কিছুই বুঝতে পারলাম না।উল্টো মাথাটা ভিষন ব্যাথা করছে।তাই ভাবনা চিন্তা বাদ দিয়ে ভুনা খিচুড়ি নিয়ে গরম করে ঘরে চলে এলাম।ইশশ! আফসোস হচ্ছে। আমার প্রিয় খাবার রেধেছিল আম্মু।আর আমি সারাদিন না খেয়ে ছিলাম।তবে আম্মু কেন বললো না যে আজ আমাে পছন্দের ভুনা খিচুড়ি রান্না হয়েছে জানলে তো সব রাগ ভেঙে চলে যেতাম আমি।

আর কিছু না ভেবেই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম আমি।কিন্তু ঘুম ভাঙতেই বাধলো আরেক বিপত্তি। ঘুমুঘুমু চোখ খুলতেই দেখলাম আমার চোখের সামনে আম্মু।উনি আমার বিছানার একপাশে উপুর হয়ে কিছু করছে। সকাল সকাল আম্মুকে আমার ঘরে দেখে উঠে বসলাম আমি।ঘুমুঘুমু চোখমুখ ডলে নিলাম।তারপর পরিষ্কার ভাবে দেখতে পেলাম। আম্মু আমার কাপর গুছিয়ে দিচ্ছে।আমি অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে আম্মুকো বললাম,

— আম্মু কি করছো তুমি সকাল সকাল? আমার কাপড় কেন গোছাচ্ছো?

আম্মু তাড়া দিয়ে বললো,
— বেশি কথা না বলে তাড়াতাড়ি ওঠ বলছি।ছেলেটা সেই কখন থেকে বসে আছে তোর জন্য। আর তুই কিসের ঘুম দিয়েছিস? সকাল থেকে ডেকে চলেছি।উঠার নাম নেই।এখন এগারোটা বাজে উঠেছিস।যা তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নে।

— কিন্তু আম্মু আমি রেডি কেন হবো? কোথায় যাচ্ছি? আর কে বসে আছে?

— আমি।আমার সাথে যাচ্ছিস আর তাই তুই এখন রেডি হবি।

গলা শুনে দরজার দিকে চাইতেই দেখলাম ওই অসভ্য ছেলেটাকে।সকাল সকাল এর মুখটাই দেখতে হলো দিনটাই খারাপ যাবে আমার।উফফ! তাকে দেখেই চরম বিরক্তিতে ছেয়ে গেল আমার মন।তবে আম্মু তো উনি আসার পর থেকেই বেশ খুশি।যেন আমি না ওইটাই ওনার আদরের ছেলে।আমার জন্য একটুও ভালোবাসা নেই।আমি রাগ নিয়েই বললাম,

— আমি রেডি হচ্ছি না।আপনার সাথে কোথাও যাচ্ছি না।আপনাকে বসে থাকতে কে বলেছে চলে যান আপনি যেখানে যাওয়ার।

আমার কথায় তার ভাবাবেগ হলো বলে মনে হলো না।তিনি কিছু বললেন না। তবে সঙ্গে সঙ্গে আম্মুর ধমকে প্রান ওষ্ঠাগত আমার।ভুবন কাপানো ধমক দিয়ে বললেন,

— এক চড় দেব বেয়াদব মেয়ে।বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানিস না তুই?নাকি তোকে শেখায় নি?একটা মাইরও মাটিতে পড়বে না তোর।আর যদি দেখেছি স্রোতের সাথে এরকম বেয়াদবি করতে।চুপচাপ গিয়ে রেডি হ। যা।

আম্মুর কথায় ভিষন মন খারাপ হলো।মুখটা লটকে গেল মুহুর্তেই।লটকানো মুখ নিয়েই একটা ড্রেস নিয়ে চলে গেলাম ওয়াশরুমে।একেবারে গোসল সেরে বেরিয়েছি।কোনরকম নাস্তা করলাম।ডাইনিং টেবিলে খেতে খেতে জানতে পারলাম উনি আমার জন্যই এখানে এসেছেন।আর এক সপ্তাহ পর তিশা আপুর বার্থডে + এঞ্জেমেইন্ট দুটোই।উনার জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন।তাই উনি এই সময় টা আমার সাথে কাটাতে চান বলে চলে এসেছেন আমাকে নিতে। এতক্ষন সব বিরক্তির মত মনে হলেও তিশা আপুর কথা ভেবে ভালো লাগলো।তবে রাগও হচ্ছে এই লোকটা তো ওখানে থাকবে৷ আবার আমাকে একা পেয়ে হুটহাট উল্টোপাল্টা কাজ করবে নাতো।ভাবতেই কেমন ভয়ে সিটিয়ে গেলাম।কালকের ঘটনাই তো এখনো মাথা থেকে বের করতে পারি নাই।তাইতো কাল সারারাত ঘুম হয় নাই।যতবার ঘুমাতে গেছি।এসবই চোখে ভেসেছি।সবাইকে বিদায় দিয়ে রওনা হলাম আমরা। উনার গাড়িতে করেই যাচ্ছি।তবে আমি পেছনে আর উনি সামনে।বাড়ি থেকে বের হবার সময় সবাই বারবার করে বলেছিল আমাকে সামনে বসতে।তবে আমি ভয় পাই বলে এড়িয়ে গেছিআমি অন্যদিকে মুখ ঘুড়িয়ে বসে আছি।ভাবখানা এমন যেন গাড়িতে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। হুট করেই গাড়ি……..

#চলবে………

তুমি নামক যন্ত্রণা পর্ব-০১

0

#তুমি নামক যন্ত্রণা
#লেখনীতেঃ হৃদিতা ইসলাম কথা
সুচনা পর্ব

–ঝলসে দেওয়ার মত উত্তাপ নিয়ে কেন প্রকট হলে!
যখন তোমার শীতলতা ভরা চাহনিতে খুনই করেছিলে!
কেন তবে এত লুকোচুরি, এত আড়াল।
যখন অনুভুতির আদলে বাধার ছিল রংমশাল।
দুরত্ব উত্তাপ বাড়ায়।যন্ত্রণা বাড়ায়।ভিষন পোড়ায়।
তুমি নামক যন্ত্রণার অনলে দগ্ধ প্রতিকাল।
তবুও কেন তুমি এত আড়াল।

কথাগুলো কর্নকুহুরে পৌছুতেই থমকে গেল পা।থমকে গেলাম আমি। আমার পিছনে অবস্থানরত মানুষটি তারা ভরা মহাকাশে তার গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই কথাগুলো মায়া জড়ানো কন্ঠে উগড়ে দিল।মানে বুঝতে না পারলেও স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে ছিলাম তার পিছনে।

রাতের তারা ভরা উজ্জ্বল আকাশের নক্ষত্রগুলো দেখার লোভ সামলাতে না পেরে তিশা আপুকে রেখে একাই ছুটে এলাম ছাদে।মনের সুখে এই বিশাল নক্ষত্রগুলোকে পর্যবেক্ষন করবো বলে।ছাদের দরজার ঠেলে ভেতরে ঢোকার আগেই তা আচমকা খুলে গেল আর ব্যাল্যান্স ধরে রাখতে পারিনি বলে আমি গিয়ে পড়লাম ঠিক কারো বক্ষ পিঞ্জিরায়।সযত্নে আগলে নিলে সে।ভয় তটস্থ হওয়ায় ইতোমধ্যে চক্ষুযুগল বন্ধ আমার।তবে যখন নিজের অবস্থান আর নিজেকে কোনো বলিষ্ঠ হাতের বাধনে আবিষ্কার করলাম ঠিক তখনই টনক নড়লো আমার।সামনে অবস্থানরত মানুষটি কে হতে পারে ধারনা না থাকায় পিটপিটিয়ে চোখ খুললাম আমি।ঠিক তখনই আমার সামনে এক ভিষন পরিচিত মুখ ভেসে উঠলো।তার শান্ত শীতল একঘেয়ে দৃষ্টি আমাতে নিবদ্ধ।তার দুহাতের বাধনে আমি।পড়ে যাওয়া থেকে বাচার জন্য তার মেরুন রঙের শার্টটার হাতের দিকটা খামচে ধরে আছি।তার একহাত আমার পিঠে ও অন্যহাতে আমার কোমর আকড়ে ধরে আছে।পরিস্থিতি আর অবস্থান বুঝতে পেরে বিদ্যুত বেগে সরে এলাম তার কাছ থেকে। মাথা নিচু করে দু হাত কচলাচ্ছি।অস্বস্তি আর অস্থিরতা ঘিরে ধরেছে আমায়। হাত- পা কাপছে।সাথে হৃদপিন্ডের ধুকপুকানি কয়েকগুন বেড়ে গেছে। সে যেন তান্ডব করছে।মনে হচ্ছে এখুনি দম বন্ধ হয়ে মারা পড়বো।
মনে মনে আল্লাহ ডাকছি।

–ইয়া আল্লাহ! এ কোন মসিবতে পড়লাম আমি।যার থেকে পালিয়ে বেড়াই আর আজ তার কাছেই এভাবে….
না, না এত বড় শাস্তি তুমি আমায় দিতে পারোনা।এই তো কান ধরছি আর জীবনেও নামাজ ছেড়ে দিব না।প্রমিস।যেভাবেই হোক আমাকে এই দুরবস্থা থেকে বাচাও আল্লাহ।প্লিজ প্লিজ প্লিজ।

নিজের দুরবস্থা দেখে নিজের ই নিজের উপর করুনা হলো আমার।পরক্ষনেই শুষ্ক ঠোটজোড়া জিভ দিয়ে ভিজিয়ে অতন্ত্য সুক্ষ্ম স্বরে বললাম।

— আ্ আ’ম সরি ভাইয়া।ভ্ ভুল করে…
আর বলতে পারলাম না।তার আগেই বুঝতে পারলাম আমার আরো খানিকটা কাছে চলে এসেছে উনি।আমি সঙ্গে সঙ্গে দুকদম পিছিয়ে গেলাম।উনি এগোচ্ছেন আমি পেছনে যাচ্ছি। এক পর্যায়ে ছাদের রেলিং ঘেষে দাড়ালাম।উনি আমার দু পাশে হাত রেখে বেশ খানিকটা ঝুকে গেলেন। আমি ভয়ে মাথা পিছন দিকে হেলিয়ে দিয়ে দুহাত পিছনে দিয়ে রেলিং চেপে ধরলাম।চোখমুখ খিচে বন্ধ করে আছি।
উনার গাড় নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমি।এই নিস্তব্ধ রাতে শুধু তার নিশ্বাসের শব্দই যেন কানে বাজে আমার।আমার গলায় ঘাড়ে আচড়ে পড়ছে সে ঘন শ্বাস প্রশ্বাস। রুদ্ধ হয়ে আসছে কন্ঠনালি।
কিন্তু উনার কোন ভাবান্তর নেই। গভীর চোখে চেয়ে আছেন আমার দিকে।তারপর ভেজানো গলায় বললেন,

–এত দহন কেন এ বুকে।ওই শীতলতা ভরা স্পর্শ কি এ দহনকে শীতলতা দিতে পারে না।ওই মায়াবি অক্ষিগোলক কি আমার অস্থিরতা বুঝতে পারে না।কেন সে বোঝে না।কেন প্রেমের বর্ষনে সিক্ত করে না এই হৃদয়ে জ্বলতে যন্ত্রণার অনল থেকে।

বিস্ময়ে থমকে না গিয়ে পারলাম না আমি।এত্ত বিশাল বিশাল কথার মানে কি? এর পরিসর কি? আর কি তার বিস্তৃতি!আমাকে এসব বলার মানে কি!হঠাৎ উনার এসব অদ্ভুত কথার মানে বুঝতে পারলাম না আমি।
ড্যাবড্যাব করে ঘাড় উচু করে তাকিয়ে আছি তার মুখে। আমি তার থেকে বেশ ছোট।সে বিশাল লম্বা।আর হবো নাই বা কেন? মাত্র অনার্সে সদ্য এডমিশন নিয়েছি।আর তিনি তো লেখাপড়া শেষ করার পর্যায়ে।মাসটার্স লাস্ট টার্ম।হয়তো কিছুদিন পরেই পরীক্ষা শেষ হবে তার।

এতক্ষণের তার ভেজা কন্ঠস্বর আমার বুকের ভিতর অদৃশ্য রক্তক্ষরন করছিলো যেন।আমার ভেতর কেমন এক যন্ত্রণা অনুভব করলাম।এই মানুষটার থেকে সবসময় দুরত্ব রেখেছি।ভয় পাই উনাকে। ভিষন!ভয়ে একবারে হার্ট অ্যাটাক করবো টাইপের ভয়।তবুও তার এমন জলভরা চোখ দেখে কিছু তো হচ্ছে আমার ভেতর বুঝতে পারছি না।হঠাৎ আমার গালে ঠান্ডা পানির অস্তিত্ব টের পেলাম।হ্যাঁ উনার চোখের জলে টুপ করেই আমার পড়লো।আমি কেপে উঠলাম।অসহায় চোখে তাকালাম তার মুখপানে।কিন্তু বেশিক্ষণ তা স্থির রাকতে পারলাম না।চোখ নামিয়ে নিতে হলো। তিনি আবারও বললেন,

— কাছে থেকেও দুরে থাকার যন্ত্রণা বুঝিছ কথা।ইচ্ছে করে দুরে সরে থাকার যন্ত্রণা। বুঝবি! একদিন ঠিক বুঝবি! যখন তোর একান্ত প্রিয় মানুষটিকে চাইলে কাছে পাবি না।চাইলেও তার থেকে দুরে সরে থাকতে পারবি না। অথচ থাকতে হবে তোকে। অবাধ্য কিছু অনুভুতি রোজ পোড়াবে রোজ পোড়াবে তোকে।তুই পুড়বি। যন্ত্রনার অনলে।মানসিক নয়।আত্মিক।ভালোবাসার দহনে ভিষন করে পুড়বি।বুঝবি ঠিক কতটা জ্বলন হয়!কতটা অসহনীয় হয়!যে অনলের দগ্ধতা।প্রকাশিত নয় তবে অপ্রকাশিত রয়।

এতটুকু বলেই দুরত্ব বাড়ালেন উনি।ততক্ষণে চোখের কোনে জল চিকচিক করছে আমার।নিজেকে সামলাতে না পেরে একসময় ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম।উনি আমার দিকে মুখ তুলে চাইলেন। উত্তেজিত হয়ে ছুটে এলেন।দুগাল তার হাতের তালুর মাঝে নিয়ে সন্তপর্ণে চোখ মুছিয়ে দিলেন।বললেন,

— কাদিস না প্লিজ।ও চোখের জল যে এ বুকে জলতে থাকা অগ্নিকে আগ্নেযগিরিতে রুপান্তর করে উত্তাপ বাড়িয়ে দেয় বহুগুন।উত্তলে উঠে ওরা।আরও বেশি করে জ্বালাতে!আরও বেশি পোড়াতে!আরও হাজার গুন বেশি ক্ষত বিক্ষত করতে।

আর পারছিলাম না নিতে তার এসব কথা। তাই এক ঝাড়া দিয়ে ছুটে এলাম আমি।তিনি শুধু শান্ত চোখে চেয়ে ছিলেন কিন্তু কিছু বললেন না।

ঠিক তখনই পেছন থেকে মেঘমন্দ্র কন্ঠে বলে ওঠলো উপরোক্ত বাক্যগুলো।

তাহলে আসুন এবার তার পরিচয়ে ফেরা যাক।আমি হৃদিতা ইসলাম কথা। আর ইনি হলেন আমার জেঠিমনির একমাত্র আদরের সুপুত্র ফয়সাল আহমেদ স্রোত।আর তিশা আপুর একমাত্র ভাই।আর আমার একমাত্র জেঠুর একমাত্র ছেলে।কেমন গম্ভীর একটা ছেলে।এই পৃথিবীতে মা ছাড়া আর কাউকে ভয় না পেলেও এই মানুষটাকে জমের মত ভয় পাই আমি।কারন জানা নেই তবে পাই বেশ ভয় পাই।কেন জানি উনি সামনে এলেই শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে। মনে হয় এই বুঝি আমার প্রানপাখিটা উড়াল দিবে।তাই সব সময়ের মতই তার কাছ থেকেই দুরে দুরে থেকেছি আমি।তবে মা বলতো ছোটবেলায় সারাক্ষণ উনার সাথেই থাকতাম।দুজন বেশ ঝগড়া করতাম।আমার পছন্দের সবকিছুই উনার চাই।এ নিয়ে খুব কাঁদতাম আমি।তবে সবটাই শোনা কথা।আমার তেমন কিছুই মনে নেই।আমার যখন পাঁচ বছর বয়স তখন কাজের জন্য জেঠুমনি ঢাকায় চলে যায়।আর আমরা অনেক আগেই আলাদা হয়ে গেছিলাম।তাই কৈশোর কালটা আমার তার সাথে কাটানো হয়নি।যার ফলে ছোটবেলার স্মৃতি আর সম্পর্ক দুটোই ফিকে হয়ে গেছে।

.
বাবা-মায়ের সাথে অন্য একটা শহরে থাকি আমরা।জেঠু তার কাজের সুত্র আর পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকে। আর আমরা চট্টগ্রাম। আমার প্রানের শহর।ভিষন ভালোবাসি এই শহরকে আমি।

এবারের গরমের ছুটিতে সবাই মিলে বেড়াতে এসেছে আমদের বাড়িতে। আমাদের নইরে বাবা দাদুর বাড়িতে। ফুপ্পিরাও এসেছে।আমার বাবারা দুই ভাই দুই বোন।বেশ ছোট পরিবার।জেঠুমনি বাবার বড়।আর তারপর দুবোন।আমার বাবা সবার ছোট।আর আমার পরিবারে আমি আর আমার ছোট ভাই।পিচ্চিটা ভিষন ঝগড়াটে সারাক্ষণ আমার পেছনে লেগে থাকাই যেন ওর কাজ।আর এখন তো খিটখিটে বদমেজাজি পাজি লোকটার সাথে হাত মিলিয়েছে। এবার এ দুটো মিলে আমার জীবন নামক রেলগাড়িটাকে যেন ঝাঝড়া করে দিচ্ছে।ওই নাটের গুরু পাজি লোকটাকে কিছু বলতে পারি না আর আমার হারামি মার্কা বদ নাম্বার ওয়ান ভাইটাকে সহ্য করতে পারি না।উফফ,জীবনটা বেদনার।এ আসার পর থেকেই জীবনটার বেদনায় ভরে গেছে আমার।কোনদিন যেন কোন উত্তাল সমুদ্রে এর ভরাডুবি হয়।ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে আমার ভিতর থেকে। আমি অসহায়!
অবলা নারী!
কিই বা করতে পারি!

তবে যতটুকু সম্ভব তাকে এড়িয়ে চলি।এড়িয়ে চললি বলে ভুল হবে নিজেকে লুকিয়ে রাখি।তার কাছ থেকে লুকিয়ে বাঁচি। তার অনুপস্থিতিতে নিজের মত করে বাঁচি।

আজ প্রায় সাতদিন হয়ে গেছে ওনারা এখানে এসেছে সবার সাথে চঞ্চল যুবতী হলেও এই মানুষটার সামনে ভিজে বিড়াল।সব দোষ এর চোখ নামক যন্ত্রের।এত তীব্র আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি কেন দেবে সে।হুহ! ভাবলেই রাগ হয় ভিষন রাগ।সবকিছু ধ্বংস করে দেওয়ার মত রাগ।
.
এই মুহুর্তে তার মুখ নিসৃত কথাগুলো নাড়িয়ে দিয়েছিল আমায়।থমকে ছিলাম আমি।হৃদপিন্ডে দুরুম দুরুম শব্দের তাল তুলেছে।পরমুহূর্তেই আবারো ভারি ঘোড়েল কন্ঠে সুধালেন,

— তুমি নামক যন্ত্রণা এতটা তীব্র কেন? যার তীব্রতার কাছে আমি বাজেভাবে হেরে গেছি।আজ পর্যন্ত কখনো কেউ আমাকে কোন কিছুতে বাধ্য করতে পারেনি।তবে তুমি পেরেছো! নিজেকে হারিয়েছে! যতবার খুঁজেছি তোমাকেই পেয়েছি! কেন এমন করলে বলতে পারো?

তার কথায় ভিষন চমকে যাচ্ছি আমি।এসব কি তিনি আমাকেই বলছে।তবে উনি তো আমার সাথে এইভাবে কথা বলে না।যাও দু- তিনবার মোটে কথা হয়েছে।তখন তো তুই করেই বলতো।এখন আবার এভাবে কেন বলছে!আমার মনে হচ্ছে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।তার এমন কথার আগাগোড়া বুঝতে না পারলেও যেন কষ্টটা সহ্য করতে পারছিলাম না।তার চোখের জল দেখে যেন ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিলো।তাই কিছু না ভেবেই ছুটে এলাম। একছুটে চলে এলাম।হয়তো তিনি ওভাবেই দাড়িয়ে। ওই বিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন।ওই বিশাল আকাশকে তার যন্ত্রণা উজার করে দিতে চাইছেন।তার বিশালতায় মিলিয়ে দিতে চাইছেন।

একছুটে নিজের রুমে চলে এলাম।ডান বাম কোথায় তাকায়নি।আর এত রাতে কেই বা জেগে থাকবে।সবাই ঘুমিয়ে গেছে।তিশা আপু আমার বেশ বড়।স্রোত ভাইয়ার ও বড় উনি।উনার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।এইতো সামনের মাসে জিজুর কাজ সেরে এব্রোড থেকে ফিরলেই বিয়ে।তাই উনার সাথে রাতের বিশালতার সাথে দুজনের মনের মাঝে জমা কথা উজার করতে চাইছিলাম।তাই সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আড়ালে চলে আসি।এমনিতেও রাতের তারা ভরা আকাশ আমার অসম্ভব প্রিয়।তারওপর প্রিয় মানুষটির সঙ্গ।আমার কাজিনদের মধ্যে কেন জানি তিশা আপুর সাথেই আমার ভাব বেশি।তবে এর কারন অজানা।

রুমে এসে দুম করে দরজা বন্ধ করে দিলাম।হাপাচ্ছি আমি। সাথে চোখের অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছি। তবে নিরবে,নিভুতে।কাঁদতে কাঁদতেই ভাবনার সাগরে ডুব দিলাম।মনে পড়ে গেল সেই প্রথম দিনের কথা যখন প্রথম বার স্রোত ভাইয়ার সাথে আমার দেখা হয়। কি অদ্ভুত সে ঘটনা!কি অদ্ভুত সে অনুভুতি!

চলবে,,

ভালোবাসা অন্যরকম পর্ব-১৮(শেষ পর্ব)

0

#ভালোবাসা অন্যরকম
[১৮ ও শেষ পর্ব ]
লেখক – আবির চৌধুরী

একটু পরে এম্বুল্যান্স চালাতে শুরু করে দিল।আমি আর আম্মুর রাইসার পাসে বসে আছি। আমি রাইসার একটা হাত খুব শক্ত করে ধরে বসে রইলাম। রাইসা একটু পর পর চিৎকার দিয়ে উঠছে।

— রাইসা আর একটু অপেক্ষা করো হাসপাতালের কাছে চলে আসছি আমরা।

কিন্তু রাইসাকে কোনো ভাবে সান্ত্বনা দেওয়া যাচ্ছেনা। আম্মু একটু পর পর রাইসার মাথায় হাত ভুলিয়ে দিচ্ছে। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা হাসপাতালে পৌছে গেলাম। তারপর রাইসা কে নিয়ে একটা কেবিনে চলে গেলাম। কিছুক্ষণ পরে ডাক্তার চলে আসল। ডাক্তার রাইসার সব কিছু চেক করে বলল — ওনার সিজার করতে হবে অবস্থা খুব খারাপ।

— যা ইচ্ছে করেন ডাক্তার আমার রাইসা যেনো সুস্থ হয়ে যায় আমি এটাই চাই।

ডাক্তার আমার দিকে তাকিয়ে বলল — বললেই তো আর হয়ে যাবে না অনেক রিক্স আছে হয়তো দুজনকে বাঁচাতে পারবো না রোগীর কন্ডিশন অনেক খারাপ। তবে আমরা চেষ্টা করবো দুজনকেই বাঁচানোর।

— ডাক্তার আপনি আমার রাইসাকে ঠিক করে দিন। রাইসার যেনো কিছু না হয় প্লিজ ডাক্তার।

তখন রাইসা বলে উঠলো — ডাক্তার আমার যা কিছু হয়ে যাক আপনি আমার সন্তান কে বাঁচিয়ে দিন। আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।

ডাক্তার — আমাদের হাতে সময় খুব কম আমি গিয়ে সব রেডি করছি আপনার কথা বলুন।

এই কথা বলে ডাক্তার বের হয়ে গেলো। এবার আম্মু রাইসার দিকে এগিয়ে আসলো।

আম্মু — মা তুই চিন্তা করিস না দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।

আম্মু রাইসার মাথায় হাত ভুলিয়ে দিয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম রাইসার দিকে তাকিয়ে। কেন জানি খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। এইবার আমি রাইসা আমাকে ইশারা করে তার দিকে ডাক দিল।আমি ধিরে ধিরে রাইসার দিকে এগিয়ে গেলাম। আমার চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে। আমি গিয়ে রাইসার পাসে বসলাম।

রাইসা আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল — ঈশান শোন! আমি যদি মারা যায় তা হলে কিন্তু তুমি আর বিয়ে করতে পারবেনা বলে দিলাম। তুমি শুধুই আমার এই পাড়েও আমার এপাড়েও আমার।

আমি রাইসার মুখে এমন কথা শুনে আমার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছেনা। শুধু চোখ থেকে অজড় ধারা পানি ঝড়ছে।

— রাইসা কিছু হবে না তোমার দেখবে তুমি ঠিক হয়ে যাবে আল্লাহর উপরে বিশ্বাস রাখো দেখবে তুমি ঠিক হয়ে যাবে। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি কি নিয়ে থাকব বলতে পারো?

— আমি জানি না ঈশান কেন জানি মনে হচ্ছে আমার সময় আর বেশি নাই।

— একদম চুপ কিছু হবে না তোমার তুমি ঠিক হয়ে যাবে।

— আমার বাচ্চাকে দেখে রেখো তুমি তাকে কখনও কষ্ট পেতে দিয়না। আমাকে শেষ বারের মতো একটু বুকে জড়িয়ে নিবে তোমার?

— এই ভাবে কেন বলছ তুমি। আমার যে অনেক কষ্ট হচ্ছে রাইসা। এই ভাবে বলবে না প্লিজ। কিছু হবে দেখো।

— আমাকে বুকে জড়িয়ে নাও তোমার। হয়তো আর কোনো দিন সেই সুযোগ আমি আর পাবো না।

এইবার আমি রাইসে খুব শক্ত করে আমার বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলাম। আমাদের দুজনের চোখ থেকে অশ্রু জুড়ছে। বুকের ভিতর টা আমার দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। এবার রাইসার কপালে একটা ভালো বাসার পরশ একে দিলাম। আর রাইসাকে শুইয়ে দিলাম। হঠাৎ করে আমার ফোন বেজে উঠল। আমি পকেট থেকে ফোন বের করে দেখি রাইসার আম্মু কল দিয়েছে। আমি সাথে সাথে ফোন রিসিভ করলাম। কান্না মাথা গলায় হ্যালো বললাম।

— বাবা কি হইছে এতো রাতে কল দিলে? আমরা ঘুমিয়ে ছিলাম। আর তোমার গলা এমন লাগছে কেন রাইসার কিছু হয়ে যায়নি তো?

— রাইসাকে নিয়ে কাল রাতে আমরা হাসপাতালে এসেছি৷ আপনার একটু তাড়াতাড়ি চলে আসুন।

— ঠিকানা পাঠিয়ে দাও আমি এক্ষনি আসছি।

তারপর আমি ঠিকানা দিয়ে দিলাম। রাইসার আম্মু কিছুক্ষণের মধ্যে চলে এলো। আমি তখনও রাইসার পাসে বসে ছিলাম।

রাইসার আম্মু ভিতরে এসেই রাইসার দিকে এগিয়ে আসল। আর রাইসাকে বলতে থাকল — এখন কেমন লাগছে মা তোর? আর চিন্তা করিস না কিছু হবে না তোর।

রাইসা কিছু না বলে কান্না করেই যাচ্ছে।

– ঈশান বাবা ডাক্তার কি বলছে?

তারপর ডাক্তার যা যা বলল আমি সব কিছুই বললাম। কিছুক্ষণ পরে ডাক্তার চলে আসলো।

ডাক্তার — সব কিছু রেডি করা আছে। এখানে আপনি সিগনেচার করুন।

আমি — কিসের সিগনেচার?

— আল্লাহ না করুক যদি রোগীর কিছু হয়ে যায়। তখন এর দ্বায় বার আমরা নিতে পারবোনা। কারণ রোগীর অবস্থা খুব খারাপ। বাচ্চা ঘুরে গেছে।

— ডাক্তার প্লিজ আমার রাইসার যেনো কিছু না হয়।

— আল্লাহ কাছে দোয়া করুন। আমরা আমাদের মতো চেষ্টা করব। মা ও সন্তান দুজনকেই যেনো বাঁচাতে পারি। বাকিটা আল্লাহর হাতে।

তারপর আমরা সবাই সিগনেচার করে দিলাম। একটু পরে রাইসাকে অপারেশন রুমে নিয়ে গেলো। আমরা সবাই গিয়ে অপারেশন রুমে সামে দাঁড়িয়ে রইলাম। আল্লাহ কাছে বললাম। হে আল্লাহ আমার রাইসাকে তুমি সুস্থ করে দিয়। ওর যেনো কিছু না হয়।আমি দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আর নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি বের হচ্ছে।

হঠাৎ অনুভব করলাম কেউ আমার ঘাড়ের ওপর হাত রেখেছে। তাকিয়ে দেখি আম্মু।

— ঈশান তুই একটু শক্ত হ বাবা তুই এমন করলে কি ভাবে হবে বল?

— আমি পারছিনা আম্মু।

এই কথা বলেই আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলাম। আম্মু আমার মাথায় হাত ভুলিয়ে দিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে৷

অনেক্ষন হয়ে গেলো ডাক্তার এখনও বের হচ্ছে-না। এখন খুব চিন্তা হচ্ছে। সবাই মাথা নিচু করে বসে আছে। অনেক্ষন পরে ডাক্তার বের হয়ে আসল।ডাক্তার কে বের হতে দেখে আমি তাড়াতাড়ি ডাক্তার রের দিকে এগিয়ে গেলাম।

— ডাক্তার আনার রাইসা কেমন আছে?

ডাক্তারে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।কিছু বলছেন না দেখে আমার খুব ভয় হচ্ছে।

— ডাক্তার কথা বলুন চুপ হয়ে আছেন কেন আপনি? কিছু তো বলুন আমার রাইসার কিছু হয়ে যায়নি তো?

এবার ডাক্তার একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল — কংগ্রাচুলেশনস মিস্টার ঈশান আপনি কন্যা সন্তানের বাবা হয়েছে। চিন্তার কোনো কারণ নেই মা ও সন্তান দুজনেই সুস্থ আছে।

ডাক্তারের কথা শুনে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠেছে ঠোঁটের কোণে ডাক্তার কে সাথে সাথে জড়িয়ে ধরে বললাম — আলহামদুলিল্লাহ। ধন্যবাদ ডাক্তার অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

— আমাকে ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই। আমি তো সামান্য উছিলা ধন্যবাদ উপর ওয়ালাকে দিন। তিনি না চাইলে কিছুই হতো না।

তারপর আমি আল্লাহ কাছে হাত তুলে কুক্রিয়া আদায় করলাম।

— ডাক্তার আমারা কখন দেখা করতে পারব?

— একটু পরেই পারবেন। রোগীকে একটু পরেই কেবিনে শিপ্ট করা হবে তখন দেখা করতে পারবেন

এই কথা বলেই ডাক্তার চলে গেলো। এবার আম্মু আমার দিকে এগিয়ে আসলো। এতক্ষণ পরে সবার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। আম্মু আমার কাছে আস্তেই আমি আম্মুকে জড়িয়ে ধরলাম। আর কান্না করে দিলাম। কান্নাটা কষ্টের নয় বরং সুখের কান্না।

— বোকা ছেলে আবার কান্না করছিস কেম তুই?

— জানি না আম্মু।

কিছুক্ষণ পরে রাইসাকে কেবিনে শিপ্ট করা হয়েছে। সবাই রাইসাকে দেখে বের হয়ে চলে আসছে। এবার আমি কেবিনের ভিতরে চলে গেলাম। দেখি রাইসা আর আমার বাচ্চা শুয়ে আছে। রাইসা আমাকে দেখে একটা মুচকি হাসি দিল। আমি রাইসার পাসে গিয়ে বসলাম। আর রাইসার কপালে একটা চুমু খেয়ে বললাম — এখন কেমন আছো তুমি?

— ভালো আছি।

তারপর পর চোখ পড়লো আমার বাচ্চা মেয়েটার দিকে। মেয়েটা দেখতে খুব সুন্দর হয়েছে ঠিক তার মায়ের মতো। আমি আমার মেয়েকে কোলে তুলে একটা চুমু খেলাম। তারপর আবার রাইসার পাসে শুইয়ে দিলাম।

–ঈশান জানো আমার খুব ভয় হচ্ছিল। মনে হচ্ছিলো আমি আর কোনো দিন তোমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে পারবনা।

— পাগলি একটা। আল্লাহর উপরে আমার বিশ্বাস ছিল আমি জানি আল্লাহ আমাদের সাথে এমন কিছুই করতে পারেনা।

আমি আবার রাইসার কপালে একটা চুমু খেলাম। তারপর থেকে শুরু হলো দুজনের মাঝে আবার ভালোবাসার এক নতুন অধ্যায়। তাদের ভালো বাসা টিকে থাকুক আজীবন। আর গল্পটা এখানেই শেষ করে দিলাম।

___________সমাপ্ত________

ভালোবাসা অন্যরকম পর্ব-১৭

0

#ভালোবাসা অন্যরকম
[পর্ব – ১৭]
লেখক – আবির চৌধুরী

আমি দিয়াকে নিয়ে একটা রুমের মধ্যে শুইয়ে দিলাম। দিয়ার জ্ঞান এখনও ফিরে আসেনি। দিয়াকে শুয়ে দিয়ে আমি রুম থেকে বের হবো তখনই আম্মু আমাকে ডাক দিয়ে বলল — ঈশান তুই এই মেয়েকে আবার আমাদের বাসায় নিয়ে আসলি কেন? তোর কি কিছুই মনে নেই এই মেয়ে তোর সাথে কি কি করছে?

— হুম সব মনে আছে।

— দেখ তুই এই মেয়েকে বাসা থেকে এক্ষুনি বের করে দে। রাইসা দেখলে অনেক কষ্ট পাবে।

এমন সময় রাইসাও চলে আসলো।

রাইসা — কি হইছে আম্মু? আমি আবার কি জন্য কষ্ট পাবো? কি হইছে?

আম্মু — ঈশান ওই মেয়েকে নিয়ে আবার বাসায় এসেছে।

রাইসা — কোন মেয়ে?

আম্মু — আরে দিয়ার কথা বলছি আমি।

আম্মুর মুখে দিয়া নামটা শুনে রাইসা এবার চুপ হয়ে গেলো। তারপর আমি সবাইকে সব ঘটনা খুলে বললাম।

আম্মু — যাই হোক আমি এই মেয়েকে বাসায় রাখা যাবেনা তুই এই মেয়েকে বাসা থেকে চলে যেতে বল।
এমন মেয়েকে আমাদের বাসায় রাখতে আমি চাইনা।

ঈশান — আম্মু আসতে কথা বলো ও শুনতে পাবে।

আম্মু — শুনলে আমার কিছু যায় আসেনা। তুই এই মেয়েকে বাসা থেকে বের করবি নাকি সেটা বল নাকি আমি বের করে দেবো?

— আম্মু তুমি একটু বুঝার চেষ্টা করো প্লিজ।

আমি এই কথা বলতেই রাইসা আমার সামনে থেকে চলে গেলো আমার রুমের দিকে।

আম্মু — দেখ আমি এই মেয়ের জন্য আর আমার সংসারে কোনো ঝামেলা চাইনা। তোকে আমি বলে দিলাম।

এই কথা বলে আম্মুও আমার সামনে থেকে চলে গেলো। এখন আমি কি করব বুঝতে পারছিনা। আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। আমি এইবার আমার রুমে দিকে চলে গেলাম। রুমে গিয়ে দেখি রাইসা খাটের উপরে শুয়ে কান্না করছে। আমি রাইসার দিকে এগিয়ে গেলাম।

— তুমি কান্না করছো কেন? কি হইছে তোমার?

— তুমি কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে? আবার ওই মেয়েকে মেনে নিবে?

— কি বলছ এসব? পাগল হলে নাকি! দিয়াকে আমি বাসায় নিয়ে আসছি তার মানে এটা নয় যে আমি ওঁকে আবার মেনে নেবো। আমার উপরে কি তোমার কোনো বিশ্বাস নেই?

— আছে৷

— আর আমি তোমাকে ভালোবাসি দিয়াকে না।

এই কথা বলতেই রাইসা আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল।

— আমি তোমাকে হারাতে চাইনা। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবোনা ঈশান। খুব ভালোবাসি তোমাকে আমি।

— আমিও তোমাকে ভালোবাসি।

এইটা বলে রাইসা আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে। এই ভাবে আমরা দু’জন দু’জনকে অনেক্ষন জড়িয়ে ধরে রাখলাম। তারপর আমি আমার রুম থেকে বের হয়ে চলে গেলাম দিয়ার রুমের দিকে। দিয়ার রুমের সামনে যেতেই আম্মু আমাকে আবার ডাক দিলেন।

— কিরে কই যাস তুই?

— দিয়ার রুমে দেখি ওর জ্ঞান ফিরছে কিনা।

— কোনো দরকার নেই। আর এই মেয়েকে আমি বলে দেবো ও যেনো আমার বাসা থেকে চলে যায়৷ তুই তোর রুমে যা এখন।

— আম্মু তোমার একটু বুঝার দরকার আছে এই মেয়েটা এখন কোথায় যাবে এই অবস্থায়?

— যেখানে ইচ্ছে যাক আমার বাসায় থাকতে পারবে না এটাই আমার শেষ কথা। আর কোনো কথা আমাকে বলতে আসবিনা। আর এই মেয়ে এই বাসায় থাকলে আমি চলে যাবো রাইসা কে নিয়ে তুই থাকিস এই বাসায়।

এই কথা বলেই আম্মু চলে গেলো। আমি আম্মুকে অনেক বার ডাকলাম তাও আম্মু তাকালো না। তারপর আমি দিয়ার রুমে গিয়ে দেখি দিয়া বসে আছে।

— দিয়া তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।

— আমি জানি আপনি কি বলবেন। আমি এমনি চলে যেতাম। আমি এখানে থাকতে চাইনা। আমি আর চাইনা আমার জন্য কারোর সংসারে ঝামেলা হোক। আমি তো একটা খারাপ মানুষ। আমাকে নিয়ে আপনার কোনো চিন্তা করতে হবে না।

— কিন্তু,,,

— আমাকে নিয়ে ভাবতে হবেনা। আপনি সত্যি অনেক ভালো মনের মানুষ। নিজের লোভের জন্যই এমন মানুষকে আমি হারিয়েছি। আমি চাইনা আমার জন্য আবার আপনার সংসারে কোনো অশান্তি নেমে আসুক।আমি চলে যাচ্ছি আমার পথে। ভালো থাকবেন আর পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন।

এই কথা বলে দিয়া বের হয়ে গেলো। আর সে বাসা থেকে চলে গেলো। তারপর থেকে আর দিয়ার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। এই ভাবে কেটে গেলো ৫ মাস। আমি আর রাইসা শুয়ে আছি হঠাৎ করে কারো কাতর মাখা গোলে শুনে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। পাসে তাকিয়ে দেখি রাইসা পেটে হাত দিয়ে কান্না করছে।

— রাইসা কি হইছে তোমার কান্না করছো কেন? খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার? কোথায় কষ্ট হচ্ছে?

কিন্তু রাইসা আমার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিলনা। সে বিছানার ছাদুর টা খামচে খামচে ধরেছে। বুঝতে পারছিনা কি করব আমি। সাথে সাথে আম্মুকে নিয়ে আমার রুমে চলে এলাম। আম্মু দিয়াকে দেখেই বুঝতে পারছে যে রাইসা সন্তান জন্মদানের সময় হয়ে আসছে।

আম্মু — ঈশান তাড়াতাড়ি ডাক্তার কে ফোন লাগা। আর একটা এম্বুল্যান্স পাঠাতে বল তাড়াতাড়ি।

এই দিকে রাইসার চিৎকারের শব্দ বেড়ে যাচ্ছে। ও মাগো বাবাগো বলে চিৎকার করছে। রাইসা এমন অবস্থা দেখে আমার শরীর থেকে ঘাম বের হতে শুরু করে দিল। আমি নিজের হাত দিয়ে ঘাম মুছে দিচ্ছি। তারপর হাসপাতালে ফোন দিয়ে বলে দিলাম তাড়াতাড়ি করে যেনো একটা এম্বুল্যান্স পাঠিয়ে দেয়।

আম্মু দিয়ার মাথায় হাত ভুলিয়ে দিচ্ছে আর দিয়াকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। আমি শুধু দিয়ার দিকে তাকিয়ে আছি আর ভাবছি একটা মেয়ে তার সন্তানকে দুনিয়াতে আনিতে কতটা কষ্ট করতে হয়। আর আমাদের মতো কিছু নরপশু আছে যারা স্ত্রীর গায়ে হাত তুলে। নারী দের সম্মান করেনা। সে ভুলে যায় যে সেও একজন নারীর পেট থেকে এসেছে। যাইহোক এসব কথা বাদ দিলাম। মুল গল্পে ফিরে আসি৷

দিয়া কিছুতেই সান্ত হতে পারছেনা। ধিরে ধিরে দিয়ার প্রশবের যন্ত্রণা বেড়ে যাচ্ছে।

আম্মু — মা আরেকটু অপেক্ষা কর এম্বুল্যান্স চলে আসবে এখনই। কিছু হবে না একটু অপেক্ষা করো।

রাইসা — আমি আর পারছিনা মা। আমি মরে যাচ্ছি কিছু একটা করুন প্লিজ।

এই দিকে আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি বের হচ্ছে। দিয়ার এমন অবস্থা দেখে আমার বুকের ভিতর টা পেটে যাচ্ছে। এবার আমি দিয়ার দিকে এগিয়ে গেলাম।

আমি — রাইসা কিছু হবেনা তোমার আমি আছি তোমার পাসে। তোমার কোনো কিছু হতে দেবোনা।

— ঈশান আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি আর পারছিনা এই যন্ত্রণা সহ্য করতে। আমি মনে হয় বাচব না।

— এই সব কথা মুখেও আনবে না আমি থাকতে তোমার কোনো কিছু হতে আমি দেবোনা।

আম্মু — ঈশান আবার ফোন দিয়ে দেখ বাবা এম্বুল্যান্স কি পাঠিয়ে নাকি?

আমি আবার হাসপাতালে কল দিলাম। ওখান থেকে কল রিসিভ করে বলছে অনেক আগেই তারা এম্বুল্যান্স পাঠিয়ে দিয়েছে। রাইসা একটু পর পর চিতকার দিয়ে উঠছে। মেয়েটার খুব কষ্ট হচ্ছে। কি করবো আমি কিছু বুঝতে পারছিনা। আমি গিয়ে আবার রাইসার পাসে বসে ওর একটা হাত খুব শক্ত করে ধরে বসে রইলাম। আর ওঁকে বলতে থাকলাম।

আম্মু — ঈশান তুই একটু রাইসার বাসায় ফোন দিয়ে বলেদে তারা যেনো হাসপাতালে চলে আসে।

তারপর আম্মু কথায় আমি রাইসার বাসায় কল দিতে থাকলাম কিন্তু কেউ কল রিসিভ করে নাই। এই দিকে অনেক রাত হয়ে গেছে সবাই হয়তো ঘুমাচ্ছে। তাও অনেক গুলা কল দিলাম।

— রাইসা আর একটু অপেক্ষা করো এম্বুল্যান্স চলে আসবে এক্ষনি।

রাইসাকে এই কথা বলতে বলতে এম্বুল্যান্স এর আওয়াজ আমার কানে ভেসে আসলো। এইবার আমি রাইসাকে কোলে তুলে তাড়াতাড়ি করে বাসা থেকে বের হয়ে ওঁকে গাড়িতে শুয়ে দিলাম।

চলবে,,,,

ভালোবাসা অন্যরকম পর্ব-১৬

0

#ভালোবাসা অন্যরকম
[পর্ব – ১৬]
লেখক – আবির চৌধুরী

এবার দিয়া আমাকে সব কিছু বলতে শুরু করে দিল।

— আমি যখন প্রথম অফিসে ইন্টারভিউ দিতে যাই। তখনই আমাদের অফিসের বস আমাকে দেখে তার ভালো লেগে যায়। তারপর থেকে আমি অফিস শুরু করে দেই। আমাকে তেমন কাজ করতে দিতেন না। একটু পর পর আমাকে ওনার কেবিনে নিয়ে যেতেন। আমি তখন তেমন কিছু বুঝতাম না। আমি তাকে জিগ্যেস করলে আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতেন না। হঠাৎ করে একদিন আমাকে প্রপোজ করে বসেন তারপর আমি তাকে বললাম আমি বিবাহিত আমার হাসবেন্ড আছে। কিন্তু তিনি আমার কোনো কথাই শুনতে চায়নি। আমি বস কে বল্লাম–

স্যার আপনি যেটা চাইছেন তা কখনও সম্ভব না আমাকে ক্ষমা করবেন।

বস — দিয়া আমি তোমার ব্যাপারে সব খবর নিয়েছি। তোমার হাসবেন্ড তো একটা কোম্পানির সামান্য একজন কর্মচারী তার আয় বা কতো টাকা? এই টাকা দিয়ে তো তোমাদের সংসার চালাতে কষ্টকর হয়ে যাবে। তুমি কি নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা কোরো না?

দিয়া — ভবিষ্যতের টা তখন দেখা যাবে। আমি এখন আসি স্যার।

এই কথা বলে আমি বস কে সব সময় এড়িয়ে চলতাম। কিন্তু উনি আমাকে সব সময় টাকার লোভ দেখাতেন। আর উনি কোথাও গেলে আমাকে নিয়ে যেতেন। তারপর আমি আঁচতে আঁচতে লোভে পড়ে যায়। তারপর থেকে আমি তোমার সাথে খারাপ আচরণ করা শুরু করি। কারণ আমি তখন অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আমি তোমার পাসে ঘুমিয়েও লাখ টাকার স্বপ্ন দেখতাম। একটা সময় আমি ভাবলাম যে তোমার সাথে থাকলে আমি ভবিষ্যতে কিছুই করতে পারবোনা। আমার সন্তান হলেও তারা তোমার মতই হবে। আমি তখন বুঝতে পারি নি যে লোভ মানুষ কে এতো টা খারাপ বানিয়ে দেয়। মনে আছে তোমার তুমি আমাকে রাস্তায় অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় দেখেছিলে? সেইটার পিছনেও আমার বস জড়িয়ে ছিলো। কিন্তু আমি এতোটাই বোকা ছিলাম যে আমি সেটা বুঝতেই পারিনি। যখন সব জানতে পারি তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। তখন আমি আমার সব কিছুই হারিয়ে ফেলছি। আমার বস আমাকে অনেকবার তার সাথে সহবাস করার জন্য প্রপোজাল করে। আমি বার বার না করেই দিতাম। আমাকে অনেক ভাবে চেষ্টা করতেন আমার সাথে রাত কাটানোর। কিন্তু আমি কখনও রাজি হতাম না। উনি আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়। আমি অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম তারপর আমি বিয়েতে রাজি হয়ে গেলাম। কিন্তু আমাদের পথের কাটা তুমি ছিলে। তারপর প্ল্যান করলাম আমরা তোমার থেকে কি ভাবে ডিভোর্স নেওয়া যায়। তারপর থেকে তোমাকে আমি ইগ্নোর করা শুরু করে দিলাম।

আমি দিয়াকে থামিয়ে দিয়ে বললাম — আমি রাস্তায় অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় তোমাকে দেখলাম সেই টা ঠিক বুঝতে পারলাম না। আর তুমি বা কি করে জানলে এটা তোমার স্যারের চক্রান্ত ছিল?

— আমার অফিস খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায় সেদিন। সবাইকে তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়ে দেয়। তারপর আমি অফিস থেকে বের হয়ে রাস্তায় এসে দাড়ালাম গাড়ির জন্য তখন আমাদের ম্যানেজার এসে আমাকে বলল — ম্যাম, আপনি কি ফ্রী আছেন?

— জ্বী, কেন কিছু বলবেন?

— আসলে ম্যাম আমি আপনার সাথে এক কাপ কফি খেতে চাই। প্লিজ না করবেন না।

তারপর আমি আর ম্যানেজার কে না করতে পারলাম না। অনার সাথে কফি খেতে চলে গেলাম। কিন্তু আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। তারপর আমার আর কিছুই মনে ছিলনা।তারপর যখন আমার জ্ঞান ফিরছে তখন আমি নিজেকে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। আমি তখন বুঝতে পারি আমার সাথে খুব খারাপ কিছুই হয়েছে। আমার কোনো কিছুই আমার গায়ে ছিলনা। যেটুকু হাতের কাছে পেলাম সে টুকু নিয়ে বের হয়ে গেলাম। তারপর তো তুমি সবি জানো।

এই কথা বলেই দিয়া কান্না করে দিল। আমি কিছুই বলতে পারছিনা আমি শুধুই দিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর বললাম — পরে তুমি কি ভাবে জানতে পারলে? আর তোমি নাকি আবার বিয়ে করেছিলে?

— হুম আমার বসের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। আমাদের বিয়ের সম্পর্ক ছিল মাত্র ৬ মাস।

— কেন? কি হইছে যে ডিভোর্স হয়ে গেলো আবার? নাকি অন্য কেউ আবার টাকার লোভ দেখিয়েছে?

দিয়া মাথা নিচু করে বলল — আসলে সেটা নয়। মানুষ একবার ধোকা খায় বার বার না। আমি বুঝতে পারিনি যে ছেলেটা ভালো না। আমার সাথে বিয়ে হওয়ার পরেই সে অন্য মেয়েদের উপরে আসক্ত ছিল।বাসায় মাঝে মাঝে মেয়ে দের নিয়ে আসতেন। আমি কিছু বললেই আমার গায়ে হাত তুলতেন। আমি চুপচাপ সব সহ্য করে যেতাম কিছুই বলতাম। তোমার কথা খুব মনে পড়ত। তারপর নিজেকে বোঝাতাম যে নিজের লোভে আজ এমন হলাম। ওখানে আমার কোনো কিছুরই অভাব ছিলনা। শুধু ভালোবাসার অভাব ছিল। আর আমাদের ডিভোর্স এর পরে সেই ম্যানেজারের সাথে আমার দেখা হয় আর ম্যানেজার আমাকে সব বলল যে তাকে দিয়ে সব করিয়েছে।

— আচ্ছা তুমি এই রাস্তায় কেন নেমে আসলে? কি এমন হলো যে তোমাকে এমন একটা পথ বেচে নিতে হয়েছে?

— আমাদের পরিবারের উপরে অনেক বড় একটা ঝড় নেমে আসে। আমি বাবাকে এসে সব বলার পরে বাবা স্টক করেন। আর সে এক বছর ধরে কোমায় আছে৷ বাবার চিকিৎসার খরচ। আমাদের খাওয়া দাওয়ার খবচ। সব আমাকে দেখতে হচ্ছে। বাবার চিকিৎসার জন্য আমাদের বাসা বিক্রি করে দিয়েছি। বাবার অপারেশন করতে হবে তার জন্য আরো অনেক টাকার প্রয়োজন। আমি অনেকের কাছে গিয়েছি টাকার জন্য কিন্তু কেউ আমাদের পাসে এসে দাঁড়ায়নি। সবার দরজা থেকে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে আমাকে। তাই বাদ্য হয়ে এই কাজে নেমেছি আমি।

এই সব বলে দিয়া কান্না করতে করতে বসে গেল। আমি দিয়াকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম — যা হইছে ভুলে যাও এসব।

— আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিয়। আমার জন্য তোমাকে অনেক কষ্ট পেতে হলো। আমার লোভের জন্য আমি তোমার ভালোবাসা হারিয়ে ফেলছি। তোমার কথা খুব মনে পড়ত আমার। তখন অনেক কান্না করতাম কিন্তু আমার কান্না শোনার মতো কেউ আমার পাসে ছিলনা।

আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না। দিয়ার কথা গুলা শুনে অনেক খারাপ লাগছে আমার। কি বলব আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এবার আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই দিয়া আমার পায়ের উপরে পড়ে গেলো।

— আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও ঈশান। আমি জানি আমি ক্ষমা পাওয়ার অযোগ্য তাও আমি ক্ষমা চাইছি আমাকে তুমি প্লিজ ক্ষমা করে দিয়৷

তারপর আমি দিয়াকে হাত দিয়ে তুলে বললাম — আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। তোমার রেস্ট এর দরকার তুমি রেস্ট নাও এখন।

— না আমার আম্মু হয়তো আমার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে আমাকে এখনই যেতে হবে।

— এই অবস্থায় কি ভাবে যাবে তুমি?

— আমি যেতে পারবো আমার কিছু হবেনা।

এই কথা বলেই দিয়া বাহিরের দিকে চলে যাবে এমন সময় দিয়া আবার মাথা ঘুরে পড়ে যাবে এমন সময় আমি দিকে ধরে কোলে তুলে বেডের উপরে শুয়ে দিয়ে ডাক্তার কে ডাক দিলাম। ডাক্তার দিয়াকে দেখে বলল — রোগী আপনার কি হয়?

আমি অনেক্ষন চুপ থেকে বললাম — আমার স্ত্রী।

তারপর ডাক্তার আমার কথা শুনে বললেন — ওনাকে বাসায় নিয়ে যান। এখানে না রেখে বাসায় নিয়ে গেলেই বেশি ভালো হবে। আর আমি ওষুধ লিখে দিচ্ছি তিন-চারদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।

এই কথা বলেই ডাক্তার চলে গেলো। আমি গিয়ে সব ওষুধ নিয়ে আসলাম। তারপর দিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি ও এখনও অজ্ঞান হয়ে আছে। বুঝতে পারছিনা ওঁকে নিয়ে এখন আমি কোথায় যাবো! ও তো আমাকে কিছুই বলল না। দিয়াকে কি আমাদের বাসায় নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে? যা হবার হবে আমি দিয়াকে আমার বাসায় নিয়ে যাবো। মেয়েটা এই অবস্থায় কোথায় যাবে তার কোনো ঠিক নাই পরে যদি আরও খারাপ কিছু হয়ে যায় তখন আমি নিজেকে কি ভাবে ক্ষমা করবো?

সব চিন্তা বাদ দিয়ে আমি দিয়াকে নিয়ে আমার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে বাসায় পৌছে গেলাম। বাসায় গিয়ে দরজার কলিং বেলে চাপ দিতেই আম্মু দরজা খুলে আমার দিকে একবার দিয়ার দিকে একবার তাকিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আম্মুকে দেখেই বুঝতে পারছি আম্মু আমাদের দেখে কিছুতেই খুশি হতে পারলো না।

চলবে,,,

ভালোবাসা অন্যরকম পর্ব-১৫

0

#ভালোবাসা অন্যরকম
[পর্ব – ১৫]
লেখক – আবির চৌধুরী

রাসেল এখনও আমাকে কোনো খোঁজ দিতে পারলোনা দিয়ার। কল ও দিলনা। এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি অফিসে চলে গেলাম। অফিসে গিয়ে কাজ করছি তখন হঠাৎ রাসেল আমাকে কল দিল।আমি খুব তাড়াতাড়ি করে কল রিসিভ করলাম।

— হ্যালো! রাসেল কিরে কোনো খোঁজ পেয়েছিস?

— হুম, তুই কখন ক্লাবে আসতে পারবি?

— কলে বল সমস্যা নেই।

— অনেক কথা আছে কলে এতো কিছু বলতে পারবোনা তুই কখন ফ্রী হবি সেটা বল আমাকে।

— আমি অফিস শেষ করে ক্লাবের দিকে চলে যাবো তুই ওই খানে থাকিস৷

— ঠিক আছে এখন তা হলে রাখি।

রাসেল কল কেটে দিলো। তারপর আমি আবার কাজ শুরু করে দিলাম। কাজে তেমন একটা মন দিতে পারছিনা। কোনো রকম ভাবে আমি কাজ শেষ করলাম। কাজ শেষ করে আমি ক্লাবের দিকে চলে গেলাম। ক্লাবে গিয়ে দেখি রাসেল আমার আগে এসে বসে আছে৷

— এতো লেট হলো কেন তোর? কখন থেকে এসে বসে আছি আমি।

— সরি দোস্ত।

— আর সরি বলতে হবেনা শোন।

— বল!

— দোস্ত তোর সাথে দিয়ার ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পরে দিয়ার আবার বিয়ে হয় একটা ছেলের সাথে। কিন্তু বিয়েটা বেশিদিন টিকে নাই। দিয়া ওই ছেলেকে বিয়ে করছে যার সাথে দিয়ার সম্পর্ক ছিল। আর ছেলেটা ছিলো দিয়ার অফিসের বস। আর কিছু আমি জানি না দিয়ার বাসা টা তারা বিক্রি করে দিয়েছে।এখন কোথায় আছে কেউ জানে না। আমি অনেকের কাছে ঠিকানা ছেয়েছি কিন্তু আমাকে কেউ দিয়ার বর্তমান ঠিকানা দিতে পারেনি।

— কি বলিস এসব!

— হুম আমি যেটা ধারণা করেছি সেটাই হয়েছে। মেয়েটা টাকার জন্য পতিতা মেয়ে দের দলে নাম লিখিয়াছে। তুই এই মেয়েকে নিয়ে অযথা চিন্তা করছিস বাদ দে ওর কথা।

— হুম কিন্তু আমার কেন জানি অন্য কিছু মনে হচ্ছে। যাইহোক ও আমাদের এই খানেই আছে আমি খুঁজে বের করবই।

— আমার আর কিছু বলার নাই, তুই যা ইচ্ছে কর। তুই তো আর আমার কথা রাখ বিনা তোর যেটা ভালো মনে হয় তুই সেটাই কর।

তারপর আমি আর কিছু বললাম না। আমি আর রাসেল অনেক্ষন চুপচাপ বসে রইলাম। কেউ কোনো কথা বলছেনা। হঠাৎ রাসেল বলল সে বাসায় চলে যাবে৷ তাই আমরা দুজনেই যে যার বাসায় চলে গেলাম। বাসায় গিয়ে আমি খাটের উপরে বসে রইলাম। তখন রাইসা আসলো আমার রুমে।

— কখন আসলে? আর এখনও ফ্রেশ হওনি কেন?

— একটু আগেই আসলাম। এখন ফ্রেশ হতে যাবো। তুমি আমার জন্য খাবার এখানে নিয়ে আসো।

— ঠিক আছে যাও।

তারপর আমি চলে গেলাম ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে দেখি রাইসা খাবার নিয়ে চলে আসছে। তাই খাবার খেয়ে নিলাম। তারপর খাটের উপরে নিজের শরীর হেলিয়ে দিলাম। বার বার কেন জানি মনে হচ্ছে দিয়া খুব বিপদে আছে। যে ভাবে হোক আমি দিয়াকে খুঁজে বের করতে হবে আর আমাকে জানতে হবে দিয়া কেন এই পথ বেচে নিল। মনে মনে ভাবছি রাতে দিয়াকে খুজতে বের হবো।দেখতে দেখতে রাত ১০ টা বেজে গেলো। তাই আমি উঠে বের হতে যাবো তখন রাইসা আমাকে ডাক দিল।

— এতো রাতে এখন তুমি কোথায় যাচ্ছ ঈশান?

— আমি একটু বের হবো কাজ আছে আমার।

— কি কাজ এতো রাতে?

— পরে বলব তোমাকে সব প্লিজ আমাকে এখন যেতে দাও তুমি। এখন আমাকে কোনো প্রশ্ন করোনা। আমি পরে তোমাকে সব বলব।

এই কথা বলে আমি বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। তারপর আমি গাড়ি নিয়ে পুরো শহর ঘুরতে থাকলাম। কিন্তু দিয়াকে কোথাও খুঁজে পেলাম না। গাড়ি ড্রাইভিং করছি আর আশেপাশে তাকে আমি খুজতে থাকলাম। হতাশ হয়ে বাসায় চলে গেলাম। বাসায় গিয়ে দেখি রাইসা এখনও ঘুমায় নি।

— কি হলো রাইসা তুমি এখনও জেগে আছো কেন? তোমার শরীর এখন ঠিক নেই আর এই অবস্থায় তুমি এখনও ঘুমাও নি।

— ঘুম আসছিলনা। বাদ দাও এবার বলো তুমি এতো রাত পর্যন্ত বাহিরে ছিলে কেন? কোথায় গিয়েছিলে?

— এখনও আমি তোমাকে কিছুই বলতে পারবোনা। এখনও সময় হয়নি।

— কিসের সময়?

— কিছুনা আসো ঘুমিয়ে যাই। আমার ঘুম পাচ্ছে খুব।

এই কথা বলেই আমি খাটের উপরে শুয়ে পড়লাম। রাইসা এসে আমার পাসে শুয়ে পড়ল। রাইসা আর কোনো কথা বললনা। রাইসা হয়তো আমার উপরে রাগ করে আছে৷ কিন্তু আমি রাইসাকে এখন কিছু বলতে চাইনা। আমি আগে ক্লিয়ার হবো তারপর রাইসাকে বলব। এসব ভাবতে ভাবতে আমি কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম নিজেও জানি না। ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে অফিসে চলে গেলাম। অফিসের কাজ শেষ করে বাসায় এসে আবার বের হয়ে গেলাম রাইসাকে খুজতে। অনেক্ষন ঘুরলাম কিন্তু তার দেখা আজও পেলাম না। অন্যমনস্ক হয়ে গাড়ি ড্রাইভিং করছি। হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখি একটা মেয়ে আমার গাড়ির সামনে এসে পড়ল। আমি গাড়ি ব্রেক করার চেষ্টা করলাম তাও মেয়েটা আমার গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। আমি তাড়াতাড়ি করে গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। দেখি মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে গেছে। আমি এখনও মেয়েটার মুখ দেখতে পেলাম না। তারপর মেয়েটাকে আমি কোলে তুলে মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতেই আমার পায়ের তোলা থেকে মাটি সরে গেলো। কারণ মেয়েটা যে দিয়া। আমি তাড়াতাড়ি করে দিয়াকে গাড়িতে শুইয়ে দিয়ে অকে নিয়ে একটা কাছের হাসপাতালে চলে গেলাম। হাসপাতালের সামনে গিয়ে আমি দিয়াকে কোলে তুলে হাসপাতালের ভিতরে চলে গেলাম। দিয়ার মাথা পেটে রক্ত বের হচ্ছে। দিয়াক নিয়ে হাসপাতালের ভিতরে যেতেই একটা ডাক্তার এগিয়ে আসলো। তারপর দিয়াকে একটা কেবিনে রাখা হলো। দিয়া অজ্ঞান অবস্থায় শুয়ে আছে। তারপর ডাক্তার ভালো করে দিয়ার মাথা ব্যান্ডেজ করে দিয়ে বলল — ভয় পাওয়ার কিছু নেই। হালকা মাথায় একটু চোট পেয়েছে ঠিক হয়ে যাবে। আর তাকে কয়েকদিন রেস্টে রাখতে হবে।

— ধন্যবাদ ডাক্তার।

তারপর ডাক্তার আমাকে ওয়েলকাম বলে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো। আমি দিয়ার জ্ঞান ফিরার অপেক্ষা করে বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পরে দিয়া চোখ খুলে তাকাল। দিয়া আমাকে দেখে চমকে উঠল হয়তো। হয়তো দিয়া এখানে আমাকে আসা করে নাই। আমাকে দেখে দিয়া বলে উঠল।

— আমি এখানে কি করে আসলাম? আর আমার কি হয়েছে?

— তেমন কিছুই হয়নি। একটু রেস্ট করেন ঠিক হয়ে যাবেন।

— না আমার রেস্ট করলে চলবেনা। আমি উঠি।

— আপনার শরীর তেমন একটা ভালো না। ডাক্তার বলছে আপনাকে রেস্ট করার জন্য।

— নাহ, আমার বের হতে হবে আমি এখানে থাকলে অন্যদিকে আমার,,,

এই কথা বলেই দিয়া থেমে গেল।

— আপনার কি হইছে আমাকে বলবেন? আর আপনাকে আমি ওই দিন ওখানে দেখে অবাক হলাম কিন্তু আপনি আমার কথা না শুনেই চলে গেলেন৷ কিছু তো একটা হইছে বলেন আমাকে।

— অনেক কথা বাদ দেন সেসব। আমি ওই দিন ওখান থেকে বের হয়ে চলে আসি। আর যায়নি কখনও।

— ওহ আচ্ছা। এখন আমাকে সব কিছু খুলে বলুন কি হইছে। আর আপনি কেন বা আমার সাথে এমন করছেন? আমি তো আপনার কোনো ক্ষতি করি নাই। তা হলে কেন আমার সাথে এমন করলে। আর আপনি আজকে এই যায়গায় এসে দাড়ালেন কেন?

— শুনবেন সব?

— হুম বলুন।

চলবে,,,,,