Tuesday, June 24, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1065



তুমি নামক যন্ত্রণা পর্ব-১৭(অন্তিম পর্ব)

0

#তুমি নামক যন্ত্রণা
#লেখনীতেঃ হৃদিতা ইসলাম কথা
অন্তিম পর্ব

দীর্ঘ আটমাস পর।অনেক কিছু বদলে গেছে। সময় প্রবাহমান।নদীর স্রোতের মত প্রবাহিত সে।কারো জন্য থেমে থাকে না।সে তার নিজ গতিতেই চলে। যেন চোখের পলকেই অতিবাহিত হলো দীর্ঘ আটটি মাস। ভালোবাসার, ভালোলাগার মুহুর্তগুলো বুঝি এভাবেই কেটে যায়। এই আটমাসে স্বামী নামক মানুষটার ভালোবাসাগুলোই উপলব্ধি করেছি।তার প্রতিটা পাগলামি মেনে নিয়েছে।তার ভালোবাসায় ঘেরা মুহূর্তগুলোকে স্মৃতির পাতায় বন্দী করেছি।

বেলকনিতে রাখা চেয়ারটাতে বসে আনমনেই কথাগুলো ভেবে চলেছি আমি। এখন সময় বিকাল ৫ টা।খুব সুন্দর একটি সময়।মাথার উপর সাদা মেঘ পেজা তুলোর মত উড়ে বেড়াচ্ছে।রোদ প্রায় নেই বললেই চলে।পাখিরা উড়ে বেড়াচ্ছে আপনমনে।মৃদু বাতাসে শীতলতার ছোয়া।ভালো লাগছে। সব মিলিয়ে মনোমুগ্ধকর একটা পরিবেশ।মানুষের মন ভালো থাকলে সব কিছুই ভালো লাগে।আর আজকে আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন, খুশির দিন। প্রতিটি মেয়ের জীবনেই এই দিনটা আসে।সবাই নিশ্চয় এতটাই আনন্দিত হয় যখন সে জানতে পারে তার ভিতরেও একটা সত্তা বেড়ে উঠছে।তারই রক্তমাংসে খেয়ে একটু একটু করে নিজের অস্তিত্বের জানা দিচ্ছে।ভাবতেই চোখের কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো।আমি নিজে এতটা খুশি উনি ঠিক কিভাবে রিয়েক্ট করবেন।কথাটা জানার পর আমি নিজেই বাকহারা হয়ে গেলাম।সেক্ষেত্রে উনার কথা কল্পনা করতে পারছি না।ঠিক কতটা খুশি হবেন উনি।
পেটের উপর আলতো হাত রেখে অনুভব করলাম আমার অনাগত সন্তানকে।মুচকি হেসে বললাম,

— তোর বাবাইকে আমরা সারপ্রাইজ দিব।বল তো কি করা যায় বেবি? কি এমন করবো যাতে সে অবাক হবে।হঠাৎ করে তোর আগমনের সুমধুর বার্তা শুনে।নিশ্চয় আনন্দে আত্মহারা হবে সে!

বিকালের এই স্নিগ্ধ মোহনীয় রুপ দর্শনের সাথে সাথেই পরিকল্পনা করলাম তাকে চমকে দেওয়ার।পুরো ঘর সুন্দর করে সাজালাম।আমাদের রুমটাকে একটা ছোট্টখাটো বেবি নার্সারী বানিয়ে ফেললাম।
তার আসার সময় হলে আমি বেলকনিতে চলে গেলাম।উনার ক্যান্ডেলের ডেকোরেশন ভিষন পছন্দ। তাই সেভাবেই করলাম সবটা।

অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘরে ঢুকতেই তিনি ডেকোরেশন দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।হঠাৎ এতকিছু বুঝে উঠতে পারলেন না তিনি।বাড়িতে কেউ এবিষয়ে কিছুই জানে না।জানানো হয়নি কাউকে। আমি চাই এত বড় খুশির সংবাদ সবার আগে উনি জানুক।উনি আস্তেধীরে এগিয়ে আসছেন ঘরের ভিতর ভ্রু যুগল ঈষৎ কুচকানো।এত সাজানো দেখে চমকে গেছেন বেশ।পরপর তিনটে টেবিলে তিনটা চিরকুট সাথে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখা সারপ্রাইজ। উনি ঘরে ঢুকেই প্রথম চিরকুটটা হাতে নিলেন।
তাতে লেখা”আপনার বহু আকাঙ্খিত উপহারটি খুব শ্রীঘ্রই পাবেন আপনি”
উনি হয়তো বুঝতে পারলেন না।কৌতূহল চোখে এদিক ওদিক তাকালেন।আমি জানি আমাকে খোঁজার প্রচেষ্টা।
উনি ঢাকনা সরাতেই এক জোড়া ছোট্ট জুতো দেখতে পেল।তখনও উনার মস্তিষ্ক আসল ব্যাপারটা ধরতে পারলো না।আর এ সবটাই বেলকনির আড়াল থেকে দেখে চলেছি আর মিটিমিটি করে হাসছি।উনি আবারো একটু এগিয়ে দ্বিতীয় চিরকুটটা হাতে নিলেন।সেখানে লেখা ” আপনার কথিত আপনার জীবনের সবচেয়ে সুন্দরতম দ্বিতীয় উপহারটি দিতে চলেছি আপনাকে”
উনি ঢাকনা সরাতেই সেখানে একটা কিউট কাপলের কোলে একটা ছোট্ট বেবিসহ কাচের সোপিচ।ওখানে ছোট্ট করে লেখা হ্যাপি ফ্যামিলি।উনার মুখভঙ্গি দেখে এখন কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তবে আমার মুখের হাসি সরেনি।এবার উনি তৃতীয় টেবিলের কাছে এসে পরতেই আমি চলে গেলাম রেলিং এর কাছে।জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছি। উনি কিন রিয়েকশন দেবে সে কথা ভেবে উত্তেজনায় পাগল হয়ে যাচ্ছি।নিজেকে সামলে সামনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম।অপরদিকে উনি শেষ চিরকুট হাতে নিতেই বিস্মিত হয়ে দাড়িয়ে রইলেন,

সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ” ইউ আর গোয়িং টু বি ফাদার ভেরি সুন।”

স্রোতের চোখের কোনে জ্বল চিকচিক করছে।এত বড় সারপ্রাইজ এমন আচমকাই পাবে। ভাবনার বাহিরে ছিল স্রোতের।ও এবার শেষ ঢাকনাটা সরাতেই প্রেগন্যান্সি কিটটা পেল।সেখানে দুটো দাগ স্পষ্ট প্রমান হয়ে জলজল করছে।এবার আর চোখের পানি বাধ মানলো না খুশিতে আত্মহারা হয়ে একেবারে কেঁদেই দিল ও। মন মস্তিষ্ক শুধু একটা কথাই বিরাজমান।
“তুই বাবা হতে চলেছিস স্রোত! খুব শ্রীঘ্রই তুই বাবা হতে চলেছিস!তোর একান্ত নিজস্ব অস্তিত্ব বেড়ে উঠছে কথার কোল জুড়ে।”

আনন্দে আপ্লূত হয়ে জলভরা চোখে বেলকনির দিকে চোখ দিল।দরজা খোলা দেখেই বুঝে গেছে।আমি এখানেই আছি।তিনি বড় বড় পা ফেলে বেলকনির দরজা অবধি ছুটে গেলেন।দরজায় পৌছে থেমে গেল তার পা।অস্থিরতায় বুদ আমি পেছনে ফিরলাম।তিনি আমার দিকে পূর্ন দৃষ্টিতে তাকালেন।তারপর পেটের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। একটু একটু করে এগিয়ে আমার সামনে এলেন।পেটের উপর আলতো হাতে স্পর্শ করলেন।তিনি আবেগপ্রবন হয়ে নিশ্বাস ছাড়লেন।যেন এতক্ষন তার নিশ্বাস আটকে ছিল।আঁখিতে এখনও জলকনা বিদ্যমান।আমার চোখের দিকে একপলক তাকিয়ে বসে পড়লেন হাটুমুড়ে।পেটের উপর আলতো করে চুমু খেলেন।তারপর পেটে মুখ গুজে রইলেন।আজও তার স্পর্শে প্রথম দিনের মত কেঁপে উঠলাম ।তার এমন পাগলামি আর উল্লাসিত মুখশ্রী আগে দেখেনি আমি।হয়তো তার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহারটাই আজ পেল সে।সে খুশি ধরে রাখতে পারছে না।উঠে দাড়িয়ে আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে বললেন,

— আজকে আমাকে তুমি ঠিক কতটা খুশির জোয়ারে ভাসিয়েছো তা বলে বোঝাতে পারবো না কথা।আমাদের দুজনের অংশ তোমার গর্ভে লালিত হচ্ছে। আমি বাবা হচ্ছি।বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। উত্তেজনায় হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে আমার।

— আপনি খুশি হয়েছেন।

— আমি খুশির পরিমান যদি আমার জানা থাকত তবে অবশ্যই তোমাকে বলতাম।তবে আমি তা জানি না।আমার খুশি তো সীমাহীন।তাই তোমাকে বোঝাতে পারবো না।আমাদের ছোট্ট বেবি আসবে।সে আধো আধো স্বরে আমাকে বাবা বলে ডাকবে আর তোমাকে মাম্মাম।ভাবতে পারছে কথা।তার ছোট্ট ছোট্ট হাত।এই ঘরটাতে তার ছোট ছোট পায়ের বিচরন চলবে।সবাইকে মাতিয়ে রাখবে সে।আমাদের পরিবারের পূর্নতা এনে দিবে সে।

আমি হেসে তাকে শক্ত করে জরিয়ে ধরে বললাম,

— খুব যত্ন করে আগলে রাখবো তাকে।পরম আদরে লালন করবো।

এভাবেই কাটলো অপার আনন্দের মিষ্টি মুহূর্তগুলো।
সকাল হতেও সারা বাড়িতে ছড়িয়ে গেল কথা।সবাই ভিষন খুশি।আহ্লাদে আটখানা হয়ে গেল।আবেগ প্রবন হলো সবাই।আমাদের একসাথে সুখী হতে দেখে।বাবা মায়ের কথা আর কি বলবো।বড় আব্বু বড় আম্মুকে বিয়ের পর থেকেই বাবা মা বলেই ডাকি।তাদের কড়া আদেশ বড় আব্বু বড় আম্মু বলা যাবে না।নয়তো কান মুলে দেবে।বাড়িতে ছোট্ট বেবি আসবে সে নিয়ে কত আয়োজন তাদের। মা তো ছেলে মেয়ে উভয়ের জন্য এখন থেকেই কেনাকাটা করছে।বলা তো যায় না কোন বেবি আসলো।বাবাও কম নয়।ও বাড়িতে খবর পৌছে গেল।সবাই অভিনন্দন জানাচ্ছে।খুশির খবর শুনে তিশা আপুও ছুটে এলো শ্বশুর বাড়ি থেকে।দুমাস হলো তার বিয়ের।দুমাস আগে জিজু আসাতে ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন করেছে স্রোত।নীলা আর আহান ভাইয়ার বিয়ের কথা চলছে।তবে নীলা তাকে একদমই সহ্য করতে পারে না।কেমন হবে তাদের পরবর্তী জীবন। তাদের বিবাহিত জীবন কি পাবে প্রনয়ের স্বাদ।যা আমরা পেয়েছি।অন্যদিকে মৃদুল ভাই আর তন্নি চুটিয়ে প্রেম করছে।সবাই ভালো আছে ভিষন ভালো।আমার খুশির সংবাদ পেয়ে সবাই ছুটে এলো। সবাই একসাথে ভালো সময় কাটালাম।এখন থেকেই রান্নাঘরের ছায়া মাড়ানো নিষিদ্ধ হলো আমার।উনার যত্নও হাজার গুন বেড়ে গেল।আমাদের দিনগুলো সুখেই কাটছে।আর কি চাই? একটা মেয়ের জীবনে সব চাওয়া পাওয়ার থেকেও সবচেয়ে বড় পাওয়া হলো খুব করে ভালোবাসতে আর যত্ন করে আগলে রাখতে পারবে এমন একজন মানুষ।এমন একজন স্বামী। মহান আল্লাহ আমার প্রতি সদয় হয়ে তা আমাকে দান করেছেন।আর কি চাই আমার।চাওয়া পাওয়ার সবটাই পেয়েছি।এতেই শুকরিয়া।আলহামদুলিল্লাহ। বাকি জীবনে এইভাবেই তার ভালোবাসার বন্ধনে বেধে থাকতে চাই।তার ভালোবাসা অনুভব করতে চাই ।

.
সময়ের স্নোতধারায় অতিবাহিত হলো আরও দুবছর।আমাদের একটা রাজপুত্রের মত ছেলে হয়েছে। স্রোত ভিষন ভালোবেসে নাম রেখেছে তানভীর আহমেদ কল্প। কল্প আসার পর এবাড়িতে রমরমা ভাব চলে এলো।সবাই তাকে নিয়ে মেতে থাকতো।ছেলের বাবার অভিযোগ ছেলে তার ভাগের আদর কেড়ে নিচ্ছে।তার আদর কম পড়ে যাচ্ছে। বাবুর আম্মু এখন আর তাকে ভালোবাসে না। কাছে আসে না।মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় না।সময় দেয় না।আরো কত বাহানা।অথচ তিনি যে সারাক্ষণ ছেলেকে মাথায় করে রাখছে তার বেলা কিচ্ছু
না।তবে তার আদর নামক পানিসমেন্টের চুড়ান্ত প্রতিশোধ নিয়েছে আমি।খুব জ্বালিয়েছে এতদিন আমাকে।আমিও ছাড় দেয়নি।রাত বেরাতে বাইরে পাঠাতাম। দুর্লভ খাবারের আবদার করতাম।সে খানিক বিরক্ত হলেও প্রকাশ করত না।রাত দুটো তিনটে বাজে ঘুম থেকে উঠিয়ে বসিয়ে রাখতাম।ঘুম আসছে না গল্প করবো।তার কিছু বলার সাধ্য ছিল না। একেতো আমার ইনোসেন্ট ফেস উপরন্তু বাবা মায়ের কড়া নির্দেশ আমার মেয়ের যেন কোন কষ্ট না হয়।ইতোমধ্যে আব্বু আম্মুও কয়েকবার এসেছে।লং জার্নিতে অনুমতি ছিল না কারোরই।তাই অতি পরিচিত আর ভালোবাসার শহরটিতে যাওয়া হয়ে উঠেনি।

.
দেখতে দেখতে সময়গুলো কেটে গেছে।তবে প্রতিটি মুহুর্তে স্রোতের ভালোবাসা আমাকে নতুনত্যের ছোয়া দিয়েছে।কল্পের এখন একবছর চলছে।বেশ দুষ্টু সে।বাবার আদরের রাজপুত্র বাবা এলে একদম শান্ত।অথচ মাকে সারাদিন জ্বালাবে।আধো আধো স্বরে কথা বলে। আমাকে মাম,স্রোতকে অস্পষ্ট স্বরে বাবাই,আর বাবাকে দাদাই,মাকে এখনো ভালো করে ডাকতে শেখেনি।ওর মিষ্টি স্বরে সবার হৃদয় জুড়িয়ে যায়। ভালো করে হাটতে শেখেনি এখনো।সবার চোখের মনি।সবাই তাকে চোখে হারায়। আজ আমাদের রাজপুত্রের জন্মদিন ছিল।সারাদিন পার্টিতে সবাইকে এটেন্ড করে বেশ ক্লান্ত।তাই তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি।তিশা আপুও প্রেগন্যান্ট। যা কালই আমরা জানতে পেরেছি। সবাই আনন্দিত এমন খুশির সংবাদে।দুটো সেলিব্রেশনই একসাথে হলো।নীলা আর আহান ভাইয়ার বিয়ে দেড়মাস চলছে।তাদের সম্পর্কও ভালোই চলছে।একে অপরকে ভালোবাসতে শিখে গেছে।চোখে হারায় দুজন – দুজনকে।

কল্পকে শুইয়ে দিয়ে বেলকনিতে এসে দাড়াতেই হু হু করে ছুটে আসা তীব্র বাতাসের ঝাপটা গায়ে লাগতেই শরীর হীম হয়ে এলো।ঠান্ডা বাতাসের দাপটে মৃদু কাপছি আমি।ঠিক সেসময়ই পেছন থেকে জরিয়ে ধরলো আমার স্বামী মহাশয়। আমার ভালোবাসা।আমার প্রান।তার কাধে পেছন থেকেই মাথা হেলিয়ে দিলাম।আকাশে কালো মেঘ জমেছে।বাতাসের তীব্রতা জানান দিচ্ছে আজ ঝড় হবে।ঝুম বৃষ্টিতে মেতে উঠবে ধরনী।স্মৃতির পাতায় উঁকি দিতেই দেখা মিললো এমনই একটি মনোমুগ্ধকর রাতে একে অপরের কাছে আসা,একে অপরকে আপন করে পাওয়ার চিত্র ফুটে উঠলো।

ঠোঁট যুগলে মিহি হাসির চিহ্ন ফুটে উঠলো। উনি আমাকে সেভাবেই জরিয়ে রেখে আমার কানের কাছে এসে নেশাক্ত গলায় বললো,

— মনে পড়ে কথা। এমনই একটি রাত।এমনই এক বর্ষনময় রাতে আমরা দুজন – দুজনকে পেয়েছিলাম।আমার বৃষ্টিবিলাসীনির বৃষ্টি বিলাসের সেই স্নিগ্ধ রুপের
সম্মোহিত রুপে নেশাক্ত হয়েছিলাম।

–হু।মনে আছে। আজও বর্ষনের রাত।আর আজও আপনার বৃষ্টিবিলাসীনি তার প্রিয়তম মানুষটিকে নিয়ে বৃষ্টি বিলাসে মগ্ন হতে চায়।

— সো লেটস গো মেরি জান।অপেক্ষা কিসের! তোমার সাথে বৃষ্টি ভেজা মুহূর্ত উপলব্ধি করতে এই অধম সদা তৎপর।

উনার কথায় হেসে উঠলাম আমি।উনি হুট করেই কোলে তুলে নিলেন।অপ্রস্তুত ছিলাম আমি।হেসে গলা জড়িয়ে ধরতেই পা চালালেন উনি।গন্তব্যে পৌঁছাতেই উনি নামিয়ে দিলেন।দুহাত মেলে প্রানভরে নিশ্বাস নিচ্ছি।ঝড়ো হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যাওয়া কেশ মনোমুগ্ধকর পরিবেশ, প্রেয়সীর মাতাল করা হাসি।আবহাওয়াটাই এত রোমান্টিক বলে বোঝানো যাবে না।সেই উচ্ছ্বাসিত,প্রনোচ্ছল চঞ্চলা অপরুপ নারীর দিকে মুগ্ধতা ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো স্রোত।এই বাচ্চা মেয়েটিতে ভয়াবহভাবে আসক্ত সে।এই তীব্র আসক্তি থেকে মুক্তির কোন উপায় নেই আর না ও চায়। শুধুমাত্র হৃৎস্পন্দনের থেমে যাওয়ায় এই আসক্তি থেকে মুক্তি দিতে পারে।ঘোর লাগানো চোখে প্রিয়তমা স্ত্রীর চঞ্চলা রুপে সম্মোহীত হয়ে নিনির্মেষে পা বাড়ালো স্রোত।ততক্ষণে ঝুম বৃষ্টি পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়ছে।খুশিতে একপ্রকার নাচতে শুরু করে দিলাম আমি। মুগ্ধ হয়ে ঘোরের মাঝেই হাতে টান লাগালো স্রোত।একবারে তার বুকের মধ্যে খানে স্থান পেলাম।গুটিসুটি মেরে পরে রইলাম সেখানে।ইশশ! কি শান্তি! প্রিয় মানুষটির বুকে বুঝি এতই শান্তি অনুভব হয়! আমিও কি বোকার মত করে বলছি। পৃথিবীর সবথেকে প্রশান্তি তো তার বুকের মাঝে।এতগুলো দিন তো সেখানেই পার করলাম।তার বুকে মাথা না রাখলে ঘুম হয় না আমার।ছটফট করতে থাকি।বাড়িতে ফিরতে একটু দেরি হলে অস্থির হয়ে উঠি আমি।একেই ভালোবাসা বলে।আমার অবাধ্য অনুভূতিকে প্রশয়ের নামই ভালোবাসা।

উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে মোহময় কন্ঠে বললেন,

— বাতাসে আজ সুবাস পেয়ে
মন হয়েছে চঞ্চল
আসলে বুঝি আমার শহরে
থামিয়ে সব কোলাহল।
চলো না আজ হারিয়ে যায়
বৃষ্টিভেজা এই মুহূর্তে
আজ তোমাকে রাঙাই
আবারো আমার প্রেমের রঙে।

উনি আমার দুগার ধরে কপালে কপাল ঠেকিয়ে প্রগাঢ় কন্ঠে বললেন,

— তুমি শুধু আমার।কেবলই আমার।আমি #তুমি_নামক_যন্ত্রণায় অনলে পুড়তে চাই।ঝলসে যেতে চাই। যেন তোমার ভালোবাসার গভীরতম স্পর্শে সে ক্ষত সেরে উঠার সুযোগ পায়।তোমার ভালোবাসা পাবার তরে বারবার #তুমি_নামক_যন্ত্রণায়! তীব্র যন্ত্রণায় কাতর হতে চাই।

সমাপ্ত

তুমি নামক যন্ত্রণা পর্ব-১৬

0

#তুমি নামক যন্ত্রণা
#লেখনীতেঃ হৃদিতা ইসলাম কথা
পর্বঃ১৬ ও বোনাস পার্ট

স্নিগ্ধ, মায়াবী একটা ভোর।কাল রাতের বৃষ্টির জন্য চারপাশটা একটু বেশিই সিক্ত লাগছে।প্রায় দুটোর দিকে বৃষ্টি হয়েছে কাল। মুষলধারে বৃষ্টি। বৃষ্টির আঁচ পেতেই সোয়া থেকে উঠে বসলাম আমি।উদ্দেশ্য বৃষ্টিবিলাস।মনটা নেচে উঠলো।তবে বিছানার বাইরে পা রাখার আগেই মোবাইলে টুং টাং মেসেজের শব্দ এলো।সেখানে স্পষ্ট লেখা আছে” এখন যদি একপা ঘরের বাইরে গেছে তো ঠ্যাং ভেঙে রেখে দেব।অসময়ের বৃষ্টিতে ভিজে অসুখ বাধিয়ে বিয়ে পেছনের ধান্দা। তুই খুব ধুরন্ধর মহিলা দেখছি।বেশ ভালোই ফন্দি এটেছিস। বিয়ে পেছনের তবে তা কোনোভাবেই হতে দিচ্ছি না আমি।আমার শাস্তিগুলোর জন্য আর একটু সময় ও নষ্ট করতে চাই না আমি।সো যদি নিজের ঠ্যাং গুলোকে আস্ত দেখতে চাস তবে চুপচাপ শুয়ে পড়।”
মনটা ঝুপ করেই খারাপ হয়ে গেল। বজ্জাত লোকটা টের পেল কি করে? মুখটা লটকে ঠোঁট উল্টে বসে রইলাম আমি।

মিনিট দুয়েকের মধ্যে আবারো টুং করে একটা শব্দ হলো।ফোন হাতে নিতেই মেসেজ পেলাম।”ও আমার বৃষ্টিবিলাসীনি! আর একটু অপেক্ষা! এ বৃষ্টি শুধু তোমার আমার ভালোবাসার,আমাদের অব্যক্ত প্রনয়ের সাক্ষী! আমাদের মিলনের প্রহর।তোমার উষ্ণতায় তপ্ত হৃদয়কে সিক্ত করতেই তার আগমন।অপেক্ষা শুধু একটুখানি অপেক্ষা! এ সময় তোমাকে এভাবে বৃষ্টিবিলাস করতে দেখলে যে আমার পক্ষে নিজেকে বোঝানো দায় হয়ে পরবে! ভিষন কঠিন হবে নিজেকে সামলে নেয়া।আমার অপেক্ষার প্রহর খুব শ্রীঘ্রই শেষ হতে চলেছে।এমনই এক বর্ষনময় রাতে শুরু হবে ভালোবাসার নতুন অধ্যায়, নতুন প্রহর। হয়তো কখনো ঘটা করে বলা হয় নি না বলা কথা,মনের ব্যাথা! অব্যক্ত অনুভুতিগুলোকে ভাষায় ব্যক্ত করা হয়নি।আমিও প্রকাশ চাই! আমিও আমার বৃষ্টিবিলাসিনীকে আমার না বলা মনের কোনে জমানো হাজরো অনুভুতির কথা তাকে জানাতে চাই! সে মুগ্ধ হয়ে শুনবে,মুগ্ধতা নিয়ে দেখবে।সে অপেক্ষায় দিন কাটাতে চাই।”

ব্যাস এটুকু পড়েই মনের মাঝে ঝড়ো হাওয়া বইতে লাগলো।অনুভুতিরা আনন্দে নেচে উঠলো।আমিও চাই! সে প্রকাশ করুক।তার অব্যক্ত অনুভূতির! আমিও চাই তাকে দুচোখ ভরে মুগ্ধতা নিয়ে দেখতে! আমিও চাই আমার শুধুই তাকে শুনতে! তাকে অনুভব করতে! মনের গহীন থেকে! হারাতে চাই তার মাঝে! ডুবে যেতে চাই ওই নীল জলরাশির ধারায়!

.
আমি ঘুম থেকে উঠেই সৃষ্টিকর্তার ইবাদত করলাম।( এখানে আরাধনা বলতে ইবাদত বোঝানো হয়েছে।শব্দের ভিন্নতা। কেউ উল্টোপাল্টা ভাববেন না।)
ভিজে মাটির স্যাঁতস্যাতে মিষ্টি গন্ধ নাকে লাগতেই ভালো লাগায় ছেয়ে গেল মন।মনের কোনে স্নিগ্ধতারা উকি দিল।মনটা ফ্রেশ লাগছে।শীতল হাওয়া, লাল টকটকে বৃত্তটা গাছপালার ফাঁক- ফোঁকর দিয়ে উকি দিয়ে ধরনীতে আলো বিকিরন করছে,ডালপালার একটু আকটু নড়েচড়ে ওঠা,পাখিদের কলকাকলি সবকিছু মিলিয়ে মনোমুগ্ধকর পরিবেশ।মাঝে মাঝেই মনে প্রশ্ন জাগে!
আচ্ছা প্রকৃতি এত সুন্দর কেন হবে? আমাকে এত কাছে কেন টানবে? মাঝে মাঝে তো ইচ্ছে হয় প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যায়। বিলীন করে দেই নিজেকে।

প্রকৃতির এই মুগ্ধতার মোহজাল ভেঙে বেরিয়ে এলাম আমি।রান্নাঘর থেকে দু কাপ চা নিয়ে চলে এলাম রুমের দিকে।দিদুন নামাজ পড়ে নিয়েছে। দুজনে মিলে কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম।দিদুন তার আর দাদুর বিয়ের পরে প্রেমের গল্প বললেন।তারা একে অপরকে কতটা ভালোবাসতেন।দাদু ভাই রাগী হলেও কখনো গায়ে হাত তোলেনি।দিদুনকে নাকি ভিষন ভালোবাসতেন
দিদুন একটু রেগে গেলেই খুব করে আদর করে দিতেন।দিদুন আর রেগে থাকতে পারত না।এসবই বলছিলেন। আমি মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম আর কল্পনা করছিলাম সে সব গল্পের মাঝে আমাদের দুজনকে।আমাদের ভালোবাসা ঘন মুহূর্তকে।হারিয়ে যেতাম।হুটহাট দু- তিনবার ফিক করে হেসে উঠেছিলাম।দিদুন অনেক ঠাট্টা করলো এই নিয়ে।পিন্চ করলো।আমি শুধু লাজুক হেসেছি।একসময় ধ্যাৎ বলে ছুটে এলাম নিজ ঘরে।এসে দেখি নীলা আর তিশা আপু বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। সবটাই বৃষ্টির কামাল।বৃষ্টি এলেই ঘুম কাতুরে হয়ে ওঠা এরা দুজন। তিশা আপুর মত নীলাও বৃষ্টিকে পছন্দ করেন না।তাদের মতে বৃষ্টির কোন সৌন্দর্য নেই।বৃষ্টি শুধু ঘুমের আরেক নাম।বৃষ্টি এলেই জমিয়ে ঘুমোনো যায়।রাস্তা ঘাট কাঁদায় স্যাঁত – স্যাঁতে হয়ে যাওয়া,কোথাও বেরোতে না পারা,জামা- কাপরের বিঘীস্তি অবস্থা। কাঁদায় মাখামাখি সবকিছুই বৃষ্টির ফলাফল। তাই বৃষ্টি- বাদল থেকে দুরে থাকাই শ্রেয়। তাদের এসব বক্তব্য শুধু বিরক্তিকর মনে হয় আমার।বৃষ্টি আবার অসুন্দর হয় কি করে? বৃষ্টির পূর্বে উড়ে আসা এক দল মেঘের আগমনে বিশাল আকাশের বুকে শুভ্রতার ছোয়া পেতে পৃথিবী শুভ্রতার রঙে ছেয়ে যায়।বৃষ্টির সৌন্দর্য তো অপরুপ।ঝিরঝিরি বৃষ্টিতে ছোট্ট ছোট্ট ফোটায় গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির রুপের বর্ননা না করলেই নয়।মুষলধারে বড় বড় ফোটায় টপটপ করে ঝড়ে ধুপধাপ আওয়াজ সৃষ্টি করে সে আওয়াজও কত শ্রুতিমধুর শোনায়।বৃষ্টির শেষে গাছপালা থেকে শিশির বিন্দুর মত গড়িয়ে পড়া দু- এক ফোঁটা বৃষ্টির পানি।আঙ্গুলে ছুয়ে দিতেই শরীর-ময় শীতল স্রোত বয়ে চলে। ভেজা মাটির মিষ্টি গন্ধ নাকে শুষে নিতেই অন্য রকম ভালোলাগা কাজ করে। আর এসবকিছু সুন্দরের প্রতীক।অবাধ সৌন্দর্যের আগমনী বার্তা নিয়ে আসে বৃষ্টি। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেলকনিতে গেলাম।রেলিং এ দুহাত রেখে দাড়াতেই চোখে পড়লো বেলকনির ছোট্ট টেবিলের উপর একটা নীল রঙের চিরকুট। এগিয়ে গিয়ে চিরকুটটা হাতে নিয়ে ভাজ খুলতেই চোখে পড়লো অপরুপ সুন্দর হাতের লেখনী। মুখে হাসি ফুটলো আমার তার অবুঝ বায়না শুনে।
চিরকুটে গোটা গোটা অক্ষর লেখা আছে ” শ্যামাঙ্গিনী! এভাবে মুগ্ধ চোখে ওই প্রকৃতির দিকে তাকিয়ো না।আমার ভিষন হিংসে হয় তাদের। তোমার ওই চাওনি আমাকে দিশেহারা করে দেয়।তোমার ওই হাসি আমার বুকে ব্যাথার জন্ম দেয়।জানোতো খুব করে জানতে ইচ্ছে করে ওই প্রকৃতির কাছে তার সৌন্দর্যের রহস্য। আমার শ্যামাঙ্গিনীর হৃদয় কেড়ে নেওয়ার মত সৌন্দর্য যার আছে সেতো আমার জন্য হিংসের কারন হবেই তাই না।আমার তো ইচ্ছে করে ওই প্রকৃতির মাঝে মিশে।ওগো বর্ষনময়ী! তোমার নামের বর্ষন হতে চাই। আমার প্রতিটি ফোটা তোমায় ভেজাতে চাই।সিক্ত করতে চাই।অনুভব করতে চায় তোমায় নিবিড়ভাবে। মিশিয়ে নিতে চায় আমার মাঝে। তুমি তো আমার! শুধুই আমার!তবে তোমার মুগ্ধতা, স্নিগ্ধতা সবটা জুড়ে আমার অধিকার! কেবল আমার! এখন নিশ্চয় তোমার আমাকে পাগল বলে মনে হচ্ছে। জানোতো মাঝে মাঝে আমারও মনে হয়, আমি পাগল! তোমার জন্য পাগল!”

চিরকুটটা পড়ে চোখের কোনে জল চিকচিক করছে।বুকের ভিতর চিনচিনে ব্যাথা হচ্ছে। এই মানুষটাকে শুধুমাত্র ভুল বোঝে অনেক কষ্ট, অনেক আঘাত দিয়েছি।তার এই নিবিড় ভালোবাসাগুলো চোখে কেন পড়লো না আমার। কেন অনুভব করিনি তাকে! কেন পড়তে পারিনি তার চোখের ভাষা! কেন আড়াল করেছি নিজেকে! কেন তাকে এভাবে পুড়িয়েছি অবাধ যন্ত্রণায়।সত্যি মাঝে মাঝে খুব অপরাধবোধ কাজ করে।একটা মানুষকে প্রায় মৃত্যুর দৌড়গোড়ায় পাঠিয়ে দিয়েছিলাম আমি। সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া তিনি আমাকে সঠিক বুঝ দান করেছে।

.
উনার কথা অনুযায়ী এখানকার খুব নামী দামি একটা ইভেন্ট মেনেজমেন্টের মেনেজারের সাথে কন্টাক্ট করলেন উনি।উনারা আগেই সব এরেন্জমেন্টস করে রেখেছে।সবার থাকা এবং তৈরি হওয়ার দায়িত্ব উনাদের উপর।এখানে এসে পৌছাতেই আমাকে রেডি করে আমার জন্য বরাদ্দকৃত রুমে বসিয়ে রাখা হলো।যেহেতু দুটো পরিবার একসাথে তাই দুটো স্টেজই একসাথে সাজানো হয়েছে।তবে দুটো স্টেজের মাঝেই বিস্তর ফারাক। মাঝখানে পর্দা টানানো।সবকিছু হলুদ আর সাদা ফুলে সজ্জিত। সাথে লাইটিং করা।ড্রেসকোড ও সেম।হলুদ সাদা।বরের সেরওয়ানি হলুদ রঙের আর পাজামা সফেদ রঙের।কনের লেহেঙ্গার উপরের অংশ হলুদ আর নিচের অংশ সফেদ রঙের। আর বাকিদেরটাও সেম।অনুষ্ঠানের শুরুতেই আমাকে মাস্ক পরিয়ে আনা হলো।সল্প সময়ের মধ্যেই সাঙ্গীত,মেহেন্দি আর হলুদের আয়োজন করেছে।রুবি আর অলি আমার বন্ধু। ওদেরকে সবটা সেভাবে জানানো হয়নি।তবে ওরা খুব খুশি। নীলা,মাহি তন্নি, অলি আর রুবি এলো আমার ঘরে।ওরা এসে মাস্ক পরিয়ে দিল আমায়। আমি কিছু জিজ্ঞেস করতেই ওরা বললো,
— এত সহজে কি তোকে তুলে দেব ভাইয়ের হাতে।সে তোকে চিনে নেবে।খুঁজে নেবে সবার মাঝে তবেই সে পাবে তোকর বুঝলি।এবার তুই কোন চিটিং করবি না।কাপল হিসেবে যার সাথে পড়বি তার সাথেই ডান্স করতে হবে তোকে।

সবাই লাইন ধরে দাড়িয়ে।আগে সব মেয়েরা দাড়িয়েছে তারপর তাদের ডাকা হয়েছে। সবার ড্রেসের ডিজাইন ও সেম।তাই খুঁজে পাওয়াটা বেশ মুশকিল।ওদের সবার কথা শোনার পর আমিও খুব ইন্টারেস্ট পাচ্ছি।আমিও দেখতে চাই উনি আমায় সবার ভিড়ে খুঁজে পান কিনা।

প্রথমেই উনাকে পাঠানো হলো।উনি আসার পর প্রথমেই সবাইকে না দেখে আমার চোখের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিলেন।চোখাচোখি হতেই আমার অস্বস্তি হতে লাগলো।তবুও নিজেকে শক্ত রাখলাম।প্রথমেই হুট করে আমার সামনে দাড়ালেন উনি।বুকের ভিতর ঢিপঢিপ করছে।পরমুহূর্তেই আমাকে ছেড়ে দুপা এগিতো দেখেই আশাহত হলাম আমি।তবে মন খারাপ হওয়ার পূর্বেই তিনি আচমকা সবার মাঝে আমার হাত টেনে ধরলেন।আর তার কাছে টেনে নিলেন।আমার একহাত তার কাধে। উনি একহাতে কোমর আকড়ে কানের কাছে মুখ এনে সবার সামনে ফিসফিসিয়ে বলতে লাগলেন,

— “ওই চোখের মায়ায় পরেছি আমি
যা আর কোথায় নাই,,,,
,,,,,,,হাজার জনের ভিড়ে আমি
শুধু তোমাকেই খুঁজে পাই।”

তার কথা শুন মাথা নিচু করে মুচকি হাসলাম।ভিষন লজ্জা পেলাম।কিন্তু তার এমন ভালোবাসাময় কবিতায় মুগ্ধ হলাম।লোকটার পাগলামির অন্ত নেই।আমি সারাজীবন তার এই পাগলামি গুলোকেই ভালোবেসে যেতে চাই।

শুরু হলো কাপল ডান্স।আমার পরে আহান ভাইয়ার সুযোগ এলো।তবে এখানে অন্য ব্যবস্থা।কয়েকটা চিরকুটে নাম লেখা আছে।যে যার নামের চিরকিট তুলবে তাকে তার সাথেই ডান্স করতে হবে।আহান ভাই নীলার নামের চিরকুট উঠালো তাই কথামত তারা কাপল হিসেবে তার পার্টনারের সাথে নাচ করবে।তন্নির সাথে নাম উঠলো মৃদুল ভাইয়ার।দুজনেই ঝগড়ুটে পার্টি। মৃদুল ভাই আমার ফুফাতো ভাই।স্নোত ভাইয়ের দু বছরের ছোট।আর তন্নি আমার ছ মাসের ছোট।দুই ফুপ্পিদের মাঝে ভিষন ভাব।ছোট ফুপ্পির একটাই মেয়ে তন্নি।আর বড় ফুপ্পির এক মেয়ে এক ছেলে। মৃদুল ভাই আর মিতু।মিতু নবম শ্রেনীর ছাত্রী। বেশ চুপচাপ ধরনের মেয়ে।কথা কম বলে।তবে আমাকে বেশ পছন্দ করে।ভালো স্টুডেন্ট ও বটে।

প্রথমে কাপল ডান্স।তারপর বয়েজ / গার্লস ডান্স প্রতিযোগিতা। যেখানে মেয়েরা জয়ী হলো।একে একে মেহেন্দি আর হলুদের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলো।সবাই ক্লান্ত শরীর নিয়ে রেস্ট করতে গেল।সব কিছুর ঝামেলায় বেশ টায়ার্ড থাকায় বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই একপ্রকার ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালাম।উনি আমার সমস্যা বুঝেই তাড়াতাড়ি করে সব মিটিয়ে ফেলতে বললেন।বাড়ির বড়রা এদিকটায় তেমন ছিল না।হলুদের ফাংশনের পর তারা তাদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।হুট করেই বিয়ের মত বিশাল এক দায়িত্বের কাজ সামলানো ভিষন মুশকিলের।খু্ব বেশি মানুষের আয়োজন না হলেও আত্মীয় স্বজন পাড়া- পড়শী অনেকেই ছিল।এত অল্প সময়ে কার্ড বিতরন যতটুকু সম্ভব হয়েছে সবটাই করেছে।বেশিরভাগ কাজ স্রোত ভাইয়াই সামলেছে।তার এমন পাগলামি কান্ড কারখানা দেখে বড়রা তেমন কিছু না বললেও মিটিমিটি হাসছিল সবাই।তবে তার খুশিই যেন সবার কাছে সবথেকে মুল্যবান।তাই কেউ অমত করেনি। তবে আব্বুর মন খারাপটা আমার চোখে ঠিকই পড়েছে।তাই একান্তে আব্বুর সাথে সময় কাটিয়েছি।

.
সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই আব্বু আম্মুকে আমার বিছানায় দেখতে পেলাম।আমি ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে বললাম,

— কি হইছে আম্মু? সব ঠিকাছে তো তোমরা এভাবে এখানে?

— সব ঠিকাছে আম্মু।চিন্তা করো না তুমি।আজ তো আমরা ভিষন খুশি। এতদিন মনের মধ্যে সংশয় ছিল।কিন্তু এখন তোমার চোখেমুখে যে খুশির ঝলক দেখতে পাচ্ছি তা আমাদের বলে দিচ্ছে আমরা কোন ভুল করিনি। তুমি খুশি থাকলেই আমরা খুশি।

আব্বুর ভেজা কন্ঠ।হয়তো আমি চলে যাব।সে জন্য ভিতরে কষ্ট পাচ্ছেন। তবে প্রকাশ করতে পারছেন না।পুরুষদের মন পাথর হয় না।তাদেরও কষ্ট হয়।শুধু তারা প্রকাশ করতে পারে না।নিজেকে শক্ত একটা কঠিন খোলসের মাঝ৷ আবৃত রাখে।আমি আব্বুকে জরিয়ে ধরলাম। এই মানুষটাকে খুব ভালোবাসি আমি! খুব! আমার না বলা মনের কথা গুলো কি করে বুঝে যান উনি।এবার আম্মুর চোখদুটো ছলছল করছে।আব্বুর আবারও কাতর কন্ঠে বললো,

–দেখছো কবিতা।আমাদের মেয়ে আজ কত বড় হয়ে গেছে। তার আজ বিয়ে।পর করে দিয়ে চলে যাবে আমাদের। এত তাড়াতাড়ি কেন বড় হয়ে গেলি মা।আমি যে তোকে ছাড়া থাকতে পারবো না।কষ্ট হবে তো তোর আব্বুর।

আমি এবার ফুপিয়ে কেঁদে উঠে বললাম,

— আমিও যেতে চাই না আব্বু। তোমাদের সাথেই থাকতে চাই।প্লিজ আমাকে ও বাড়ি পাঠিয়ে দিও না।বড় আব্বুকে বল না তারা যেন এবাড়িতেই থেকে যায়।আমরা সবাই একসাথে থাকবো।

— তা বললে হয় না মা।তুমি এখন ও বাড়ির আমানত।ও বাড়ির লক্ষী।ও বাড়িতে যেতে হবে তো মা।তাছাড়া সবসময় তো আর সেখানো থাকছো না তুমি।আমরা যাবো আর তোমরাও তো আসবে।দুটোই তো তোমার বাড়ি।তুমি জানো তোমার বড় আব্বুর বিজনেস ওখানে।সবটা ছেড়ে এখানে আসা যায় না মা।

— তুমি চিন্তা কেন করছো বলোতো।আমাদের মেয়ে বড় হয়ে গেছে না।এখন সে তার নিজ সংসার সামলাবে। সবাইকে আগলে রাখবে।কি মা পারবি না বল?

আমি এবার আম্মুকে জরিয়ে ধরে বললাম,

— তোমাদের ছেড়ে কি করে থাকবো? কষ্ট হবে না আমার।

— পাগলি মেয়ে আমার। কষ্ট কেন হবে? তোর বড় আব্বু আছে আম্মু আছে।তাদের এখন থেকে বাবা মা বলে ডাকবি।আগের সম্পর্ক ছেড়ে এখন থেকে নতুন সম্পর্কের বাধনে বাধতে চলেছিস তুই।সবাইকে ভালোবেসে আগলে রাখবি।সবার যত্ন করবি।ও বাড়ির সবার ভালো থাকার দায়িত্বটা এখন তোর হাতে।স্রোতকে কখনো আঘাত দিস না মা।ছেলেটা যে বড্ড ভালোবাসে তোকে।লাখে খুঁজলেও ওর মত এত ভালোবাসবে তোকে এমন কাউকে খুঁজে পেতাম না আমরা।ওর খেয়াল রাখবি।

–স্রোত আছে বলেই আমি চিন্তামুক্ত। বুঝেছিস সে জানে আমার আমানত আমি তার হাতে তুলে দিব।আর সে সেই আমানতকে অতি যত্নে আগলে রাখবে।কখনো তার চোখে জল আসতে দেবে না ও।

বাবার স্রোত ভাইয়ার প্রতি এত বিশ্বাস আর ভালোবাসা দেখে ভিষন খুশি হলাম আমি।সে মানুষটাই হয়তো এমন।যাকে ভালো না বেসে পারা যায় না।একটু রাগী তবে আমি মেনেজ করে নেব।

আমাদের মাঝেই পিচ্চু এলো।বললো,

— সব আদর আপিকে দিয়ে দিলে আমার জন্য কি রাখব বল? ওকে তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বিদেয় কর তারপর সব রাজত্ব আমার একার।বুঝলে।তাড়াতাড়ি শ্বশুর বাড়ি যাও।আব্বু আম্মুর আদর আমি একাই খাব।

আমি ওর কান টেনে দিয়ে বললাম,

— হাহ! আসছে কই থেকে? আমি দেব তোকে রাজত্ব করতে।এ বাড়িতে আমার রাজত্ব সবসময় থাকবে বুঝলি পিচ্চু।

ও মেকি রাগ দেখিয়ে ঠোঁট উল্টে বললো,

— আবার পিচ্চু

আমরা সবাই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলাম।এভাবে অতিবাহিত হলো কিছুক্ষন।তারা চলে গেল।সব নিয়ম নীতি মেনে বিয়ের আসরে তিন কবুল বলে বিয়ে হলো আমাদের। সামাজিকভাবেভাবে স্বীকৃতি পেল আমাদের সম্পর্ক। সবাই খুব খুশি।বিয়ে শেষ হলে সেখান থেকেই বিদায় দেয়া হয় আমায়।স্রোত ভাইয়াদের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ে সবাই।কাজিন গুষ্ঠি আগেই চলে গেছে ও বাড়ি।নীলা আমার সাথেই আছে।বিদায়ের সময় অনেক কান্নাকাটি হলো।খুব কষ্ট হচ্ছিল তাদের ছেড়ে আসতে।আমার কান্নাকাটির জোরে দিদুনও আমার সাথে এলো।ও বাড়িতে বড়রা সবাই।বড় আব্বু আমাদের সাথে এলো।আর বড় আম্মু আগেই চলে গেছে।বাড়ির বউকে বরন করবে বলে।ঘটা করে বরনের আয়োজন করবে বলে।ছোট ফুপ্পিকেও সাথে নিয়ে গেছে।

বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত ১০ টা বেজে যায়। বরনের সব নিয়ম নীতি মেনে ঘরে তোলা হয় আমাকে।বড় আম্মু জোর করে নিজ হাতে তুলে খাইয়ে দেয়।১১ টার দিকে উনার ঘরে রেখে এলো আমার বজ্জাত কাজিনরা।আমাকে বসিয়ে অনেক হাসি তামাশা করলো ওরা।এদিকে আমি ভিষন ক্লান্ত।অস্বস্তিতে হাসফাস করছি আমি।ভালো লাগছে না কিছু।তবে ওদের আনন্দটা নষ্ট করতে পারি না।তাই মুখ বুজে রয়েছি।কিছুক্ষণ পর দিদুন এসে ওদের ধমকে পাঠিয়ে দিল।কিন্তু ওরা বাইরে দাড়িয়ে রইলো গেল না। উনি আসলে উনার থেকে টাকা আদায় করবে।টাকা ছাড়া বাসরে কিছুতেই ঢুকতে দেওয়া হবে না তাকে। বাইরে হট্টগোল শোনা যাচ্ছে। হয়তো উনি এসে পরেছে।আমি নড়েচড়ে বসলাম।অস্থিরতা ঘীরে ধরেছে আমায়।অস্বস্তিতে ভিতর ভিতর কাঁদা হয়ে যাচ্ছি আমি।টেনশনে হাত-পা মৃদু কাঁপছে। বাইরে থেকে কিছু একটা শোনা যাচ্ছে। ওরা পঞ্চাশ হাজার চাইছে।সকালেও নাকি পঞ্চাশ হাজার নিয়েছে।এরা একেকটা কসাই।আমার জামাইর পকেট খালি করে দিল। এত চিন্তার মাঝেও এই চিন্তা ঢুকে গেল আমার ছোট্ট মস্তিষ্কে।

কিছুক্ষন পর সব শান্ত হয়ে গেল। ব্যাপারটা কি! কি হলো? উনি কে টাকা দিয়ে দিয়েছেন? এখনি ঘরে ঢুকবেন নিশ্চয়।আমি ঘাবড়ে গেলাম। ভিষন লজ্জা লাগছে।উনার সাথে এক ঘরে একা রাত কাটানো। সবটাই কেমন লজ্জাজনক।লজ্জায় লাল নীল চেহারা নিয়েই আমি ভারি লেহেঙ্গা নিয়ে আস্তেধীরে উঠে বিছানা ছেড়ে নেমে দাড়ালাম। তারপর বেলকনিতে চলে গেলাম।উনার সামনে থাকার সাধ্যি আমার নেই।বেলকনিতে যেতেই চোখ আটকে গেল আমার।বেলকনিটা খুব সুন্দর করে সাজানো।বিভিন্ন রকমের গাছ আছে এখানে।গাছগুলোতে ছোট ছোট মরিচবাতি লাগানো।মাথার উপরে ও জানালার গ্রীলে লতাপাতায় ঘেরা।এবং সবটাই লাইটিং করা।খুব সুন্দর ঝলমলে আলো।একপাশে দুটো বেতের চেয়ার।সাথে ছোট্ট একটা টি- টেবিল।অবসর সময়ে কোন এক বিকালে এখানে বসে বই পড়া আর চা খাওয়াতে খুব সুন্দর একটা সময় কাপানো যাবে।সুন্দর করে ডেকোরেট করা একটা বেলকনি।মন খারাপ হলে এত সুন্দর একটা জায়গায় এলে নিমিষেই মন ভালো হয়ে যাবে। এখানকার সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতেই রাতের কালো মেঘে ঢাকা আকাশ চোখে পড়লো।ওই বিশাল আকাশটা ওই মেঘেদের আয়ত্তে। তার দল বেধে ভেসে বেড়াচ্ছ। আমি মুগ্ধ চোখে দেখলাম নিস্তব্ধতায় ঘেরা আধারের নির্মল রুপ।শীতল বাতাস গায়ে মেখে নিলাম।পেছন থেকে কেউ যে ভিষন মুগ্ধতা নিয়ে আমাকে দেখছে সেদিকে কোন খেয়াল নেই আমার।আমি নিজেকে এই নিশি রাতের মায়াবী আলোতে ডুবিয়ে রেখেছি।হঠাৎ আমার পাশে আমি কারো অস্তিত্ব অনুভব করলাম।ফট করেই চোখ খুলে খানিকটা স্তম্ভিত হলাম।এসব কিছুর মাঝে এতটাই ডুবে ছিলাম যে আর কিছুই মনে ছিল না আমার।উনার চোখে চোখ পড়তেই দেখলাম উনি একদৃষ্টে দেখছেন আমাকে।আমি চোখ নামিয়ে নিলাম।লজ্জায় নত হলাম।উনি এগিয়ে এসে আমার কোমড় জরিয়ে ধরে কাছে টানলেন।তার স্পর্শে কেঁপে উঠলাম আমি।শরীর মৃদু কাঁপছে।তিনি ললাটে অধর ছোয়ালেন।উনার উষ্ণ স্পর্শ বন্ধ চোখে অনুভব করলাম আমি। উনার দিকে চোখের দিকে তাকাতেই কেমন এক ঘোর লাগানো চাওনি দৃষ্টিগোচর হলো আমার। আমি লজ্জায় মাথা নত করলাম।তিনি ছেড়ে দিলেন আমায়। দুপা পিছিয়ে গেলেন।ওই নেশাক্ত চাওনি আমার উপরই নিবদ্ধ।ঠোঁটের কোনে মিহি অথচ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম হাসিটি হাসলেন।আমি মুগ্ধতা নিয়ে চেয়ে রইলাম ওই হাসির পানে।পৃথিবীতে আর কখনো এত সুন্দর হাসি দেখেছি বলে মনে হলো না।
উনি বললেন,
–বর্ষা! এ কেবল বর্ষনের মৌসুম নয়।এতো ভালোবাসার মৌসুম।প্রেমবক হৃদয়ের জ্বলন্ত দাবানলকে শান্ত করার মৌসুম।আমাদের ভালোবাসার সাক্ষী এ মৌসুম।তোমার প্রিয় এক মৌসুম।বর্ষনের এ সময় বহু প্রতিক্ষার প্রিয় মানুষটিকে কাছে পাওয়ার সময়।যেমন ধরনী বর্ষনের ছোয়ায় নিজেকে সিক্ত করতে তৎপর তেমনি আমিও বর্ষনের প্রতিটি ছোয়ার মতই তাকে আমার মাঝে অনুভব করতে চাই। সিক্ত হতে চাই তার ছোয়ায়।তার ভালোবাসাময় স্পর্শে।
জানো আজ আমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর উপহার পেয়েছি।দ্বিতীয়টি পেতে অবশ্য সময়ের প্রয়োজন।আমার চোখে দেখা পৃথিবীর সবথেকে রুপসী নারী আজ আমার ঘরে।তার সিক্ততায় শীতল ছোয়া পাবে আমার উত্তপ্ত হৃদয়। তার স্নিগ্ধতা আমার জীবন থেকে সকল ঘন কালো মেঘকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে।তার থেকে দুরত্বের অনলে ঝলসে যাওয়া এই আমিটাকে তার ভালোবাসার স্পর্শে আবারো রাঙিয়ে দেবে।আবারো সজীবতা এনে দেবে এই মুর্ছা যাওয়া জীবনে।

উনার প্রতিটি কথায় এতদিনের জমিয়ে রাখা প্রগাঢ় অনুভূতির কথা স্পষ্ট প্রমান দিল।উনার কণ্ঠে কেমন এক মায়া।হাজার অনুভূতির মিশ্রনে মিশ্রিত এক মায়া।
তার প্রতিটা কথা বুকে তোলপাড় করলো আমার।পারলাম না নিজেকে ধরে রাখতে।হৃদপদ্মের ছোট্ট খাচায় ধরাস ধরাস করে লাফিয়ে চলা হৃদয় নিয়ে দুপা এগোলাম তার দিকে। আলতো করে তার বুকে মাথা ঠেকালাম।না দেখেও বুঝতে পারলাম তিনি চোখ বন্ধ করে অনুভব করছেন আমাকে।কিছুক্ষন পরেই দুহাতের বন্ধনে পেলাম নিজেকে।ঠোটের কোনে মিহি হাসি ফুটলো।আরেকটু শক্ত করে তাকে জরিয়ে ধরে বললাম,

— ভালোবাসি আপনাকে।ভিষন ভালোবাসি।আমি জানি আপনি বলেননি আর বলবেন ও না তবে আমি বলতে চাই।প্রকাশ করতে চাই।আপনাকে ঘীরে আমার সকল অনুভুতি। অনুভব করতে চাই আপনাকে।আমার অস্তত্বি মিশিয়ে নিতে চাই আপনাকে।

উনি গভীরভাবে জরিয়ে ধরলেন আমায়।আমার মাথায় চুমু খেলেন।তারপর আমার দুগাল তার হাতের মাঝে নিয়ে বললেন,

— বলবোনা ভালোবাসি।শুধুই প্রকাশ করবো।আমার প্রতিটি উষ্ণ স্পর্শ জানান দেবে ঠিক কতটা ভালোবাসি তোমায়।ঠিক কতটা চাই।তোমার অস্তিত্বে নিজেকে বিলীন করতে চাই।আমার আমিকে তোমার মাঝে খুঁজে পেতে চাই।তোমার প্রতিটি নিশ্বাস প্রশ্বাস অনুভব করতে চাই।তোমাকে একান্তই নিজের করে পেতে চাই।সব দুরত্বের অবসান ঘটাতে চাই।মে আই শ্যামাপরী।

উত্তরে কিছুই বলার ছিল না।সবসময় বলে বোঝাতে হয় না।তার ভালোবাসার পরিধি সীমিত নয়।যা কেবলই চারটে অক্ষর ধারন করতে পারে।তার ভালোবাসা তো ব্যাপক, বিস্তৃত। মানুষটা একটু আলাদা।
তবুও আমি তো তার।শুধুই তার! কখনো কখনো মনের কথা মুখে বলতে হয় না চোখই মনের কথা বুঝিয়ে দেয়। আমি মুচকি হাসলাম শুধু। উনি উনার উত্তর পেয়ে গেলেন। পাজোকোলে তুলে নিলেন আমায়।আমি গলা জরিয়ে ধরে মুখ লুকালাম উনার বুকে।বিছানায় বসিয়ে দিলেন আমায়।একে একে গা থেকে গয়না খুলে নিলেন।চুল খুলে দিলেন।তারপর আবারো কোলে তুলে নিলেন আমায়।সোজা চলে গেলেন।ছাদের দিকে।একেকটা সিড়ি বেয়ে উঠছেন আর আমার বুক দুরুদুরু করছে।ছাদে পৌছানোর কিছুক্ষনের মধ্যেই ঝুম বৃষ্টি নামলো।ভিজে গেলাম দুজনে।খুশিতে নেচে উঠলো আমার মন।তাকে ছেড়ে চঞ্চল কিশোরীর মত দুহাত মেলে ঝুমতে লাগলাম।লাফিয়ে লাফিয়ে বৃষ্টিবিলাস করছি।আর উনি কিছুটা দুরে দাড়িয়ে সেই মুহুর্ত উপভোগ করছেন।উনি আমার দিকে দুপা এগিয়ে এলেন।দুহাতে কোমড় টেনে কাছে আনলেন তার।একদম কাছকাছি আছি দুজনে।দুজনে বিশাল আকাশের দিকে মুখ করে বৃষ্টির প্রতিটি ফোটাকে অনুভব করছি হৃদয় দিয়ে। একে অপরের কপালে কপাল ঠেকালাম।বৃষ্টির ঝড়ে পড়ার শব্দের সাথে দুজনের নিশ্বাস প্রশ্বাসরের শব্দও শুনতে পাচ্ছি।একে অপরে অনুভব করছি। সে সুর তালহীন মোহনীয় শব্দ।হঠাৎ ভিষন বর্জ্রপাতের শব্দে মিশে গেলাম তার বুকের সাথে।উনিও জরিয়ে ধরলেন আমায়।
তার শীতল হাতের শীতলতা কাপিয়ে তুললো আমায়।থরথর করে কাঁপছি আমি।উনি আবারো কোলে তুলে নিলেন।ওয়াশরুমে গিয়ে নামিয়ে দিলেন।হাতে একটা জামা ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

— চেঞ্জ করে নাও। নয়তো ঠান্ডা লেগে যাবে।

বলেই বেরিয়ে গেলেন।বাইরে তখন ঝুম বৃষ্টি।আমি কালে রঙের জামা পড়ে ভেজা চুলে বেরিয়ে এলাম।আড়চোখে একবার উনাকে দেখলাম। উনিও কালো রঙের জামা পড়েছেন।ভেজা চুল কপালে পড়ে আছে।শার্টের দুটো বোতাম খোলা বিধায় উন্মুক্ত বুক দৃশ্যমান।লজ্জা পেলাম একটু তবে খুব স্নিগ্ধ লাগছে উনাকে।বাইরে এসে নতমুখে দাড়িয়ে রইলাম।উনি আমার সামনে দাড়িয়ে আমার মুখের সামনে থাকা চুলগুলো কানের পিছে গুজে দিয়ে গালে ঠোঁট ছুইয়ে কাছর আসতে চাইলেই আমি একটু দুরে সরে গেলাম। হেসে উঠলাম।উনিও হেসে এগিয়ে আসছেন আর আমি সমানতালে পিছিয়ে যাচ্ছি।এভাবেই ছোটাছুটি করলাম কিছুক্ষন।একমময়ে আমার হাত আটকে দিলেন পেছন থেকে । হাত টেনে উনার কাছে টেনে নিলেন।উনার বুকের মাঝে পিঠ ঠেকলো আমার।আমি জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছি।বুক উঠানামা করছে।উনি কানের লতিতে ঠোঁট ছুইয়ে গলায় ঠোঁট ছোয়ালেন।ছোট ছোট চুমুতে ভরিয়ে দিলেন।অন্যরকম শিহরনে হারিয়ে যেতে লাগলাম আমি।উনি প্রায় উন্মাদ।
আমাকে শুইয়ে দিয়ে আমার মুখের উপর ঝুকে রইলেন। গলায় মুখ ডোবাতেই বিছানার চাদর খামচে ধরলাম আমি।উনার পাগলামি বেড়ে চলেছে সময়ের সাথে সাথে।তার প্রতিটি ভালোবাসা আর পাগলামিগুলোতে তাল মেলালাম আমি।সাদরে গ্রহন করলাম তার ছোয়া।এভাবেই পুর্নতা পেল আমাদের ভালোবাসা।স্রোতের #তুমি_নামক_যন্ত্রণা আজ শীতলতার স্পর্শে ছেয়ে গেল।

.
রোদেল ঝিলিক চোখেমুখে পড়তেই চোখমুখ কুচকে এলো বিরক্তিতে।হালকা নড়াচড়া করতেই আটকে গেলাম আমি। বুঝতে পারলাম কারো শক্ত বাধনে আবদ্ধ আমি।আর মানুষটা কে সেটাও ভালো করেই জানি আমি।ঘুমের মাঝেও আলতো হাসলাম।অনুভব করলাম ঘুমের মাঝেও কত শক্ত বাধনে বেধে রেখেছেন উনি।মাথা উপরে তুলতেই উদোম শরীরে সুঠাম দেহী সুদর্শন পুরুষের দিকে চোখ আটকে গেল আমার।তার বন্ধ চোখজোড়ার ফর্সা মুখে ছোট ছোট চাপ দাড়ি তার সৌন্দর্যকে হাজারগুন বাড়িয়ে দিল।কপালের উপর লেপ্টে থাকা চুলগুলোতে ফু দিলাম। উদোম শরীরের লোমহীন বুক নজর কেড়ে নিল আমার।তার বুকের মাঝেই আকিবুকি করতে লাগলাম।আনমনেই হেসে উঠলাম।একটু নড়েচড়ে উঠতেই উনি ঘুম ঘুম মোহনীয় কন্ঠে বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন,

— ঘুমোতে দাও বিরক্ত করো না। অনেকদিন পর শান্তির ঘুম ঘুমোচ্ছি।

বলেই আরো আষ্টেপৃষ্টে জরিয়ে ধরলো আমায়। আমি এবার কৌতুক করে বললাম,

— এবার উঠুন মহারাজ অনেক বেলা হলো।

উনি বিরক্তিতে চ শব্দ করলো। তারপর মুখ কুচকে বললো,

— হোক বেলা।আই ডোন্ট কেয়ার।আমি এখন ঘুমোবো আর তুমিও।একদম নড়াচড়া করবে না।নাহলে পানিসমেন্ট হিসেবে খুব করে আদর করে দিব।

উনার কথায় আমি বিস্মিত। ওষ্ঠদ্বয়ের মাঝে কিঞ্চিৎ ফাক।মন শুধু একটাই কথা বলছে,

— কথা এ তো তার আদর নামক ভয়ঙ্কর পানিসমেন্টে জর্জরিত করতে চাইছে তোকে।এবার তোর কি হবে!

#চলবে……

তুমি নামক যন্ত্রণা পর্ব-১৫

0

#তুমি নামক যন্ত্রণা
# লেখনীতেঃ হৃদিতা ইসলাম কথা
পর্বঃ১৫

— তখন কি ছিল? কেন ছিল? আমি জানতে চাইনি।আমি শুধু অসম্পূর্ণ কাজটা সম্পূর্ণ করতে এসেছি।

— সো বেবি লেটস ডু ইট।

উনার কথা শুনে উনাকে দুহাতে ধাক্কা দিয়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই উনি একহাতে আমার কোমর আকড়ে ধরলেন আর অন্যহাত আমার দুহাতে আটকে দিলেন।একদম উনার বুকের মধ্যেখানে আবব্ধ করে নিলেন আমায় সময় বিলম্ব না করে অতিশয় দ্রুত আমার অধর জোড়ন উনার অধরে মিশিয়ে দিলেন।গভীরভাবে ছুয়ে দিলেন আমায় । আমার পৃথিবী প্রায় থমকে গেল।প্রথমবার উনার এমন স্পর্শ পেয়ে আমার ভেতর এক অদ্ভুদ অনুভুতির জন্ম নিল।দুহাতে উনার শার্ট খামচে ধরলাম ।চুপচাপ উনার গহীন স্পর্শকে অনুভব করতে লাগলাম। মিনিট কয়েক পরে উনি আমাকে আলতো করে ছাড়লেন।আমার গাল দুটে টমেটোর মত লাল হয়ে গেছে। নাকের ডগা লাল। লজ্জায় মুখ তুলে তাকাতে পারছি না। চোখজোড়া এখন বন্ধ। খোলার সাহস নেই।আমি মাথা নিচু করে ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছি।উনি এবার কোমরে গভীর স্পর্শ করে আরেকটু কাছে টেনে নিলেন আমাকে।আমার দুহাত উনার বুকের মাঝে অবস্থিত। উনি আমার কাছে এসে কানের লতিতে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললেন,

–লজ্জা পেলে আরও বেশি মায়াবী আর অপরুপ লাগে তোমায়।আরো বেশি কাছে টানতে ইচ্ছে করে। টমেটোর মত লাল লাল গাল দু’টোকে ইচ্ছে করে কামড়ে কুমড়ে খেয়ে ফেলি।

উনার এমন চরম অসভ্যের মতো কথাবার্তা আমার চারদিকে লজ্জামিশ্রিত কোন বলয় তৈরি করলো।তবে নিজেকে না গুটিয়ে কিছুটা রাগ নিয়ে বলার চেষ্টা করলাম।

— আপনি দিন দিন চরম মাত্রার অসভ্য হয়ে যাচ্ছেন।পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অসভ্যের উপাধি দেয়া উচিত আপনাকে।লাজ – লজ্জার মাথা খেয়েছেন।

— বউয়ের কাছে লজ্জা পেলে কি করে হবে বলো তো দেখি।বউ তো আদর করার জিনিস লজ্জা পাওয়ার জিনিস।

— ছিহঃ এসব কথা কোত্থেকে শিখছেন।এত অশ্লীল কথা কি করে বলতে পারেন আপনি।

— বউ কাছে থাকলে অশ্লীল কথারা মুখ ফসকে বেড়িয়ে আসে।প্রেম প্রেম ভাব অটোমেটিকলি চলে আসে।বউকে খুব করে আদর করতে ইচ্ছে করে।রিসেন্টলি আদর করার ইচ্ছেটাকে চেপে রাখতে হচ্ছে তবে আর বেশি সময় নেই। খুব শ্রীঘ্রই আমার অপেক্ষা শেষ হতে চলেছে।আর মাত্র ৪৮ ঘন্টার এই দুরত্ব।আমার পাগলামিরা তোমাকে জানিয়ে দিবে ঠিক কতটা! ঠিক কতটা চাই তোমায় আমি।আমার মন গহীনে শুধুই তোমার বসবাস।আমার অস্তিত্বের সবটা জুড়ে শুধু তুমি আর তুমি।আমার ভালোবাসার প্রতিটি স্পর্শকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার জন্য প্রস্তুত হন মিসেস ফয়সাল আহমেদ স্রোত।

তার প্রতিটি কথার মাঝে কেমন এক অদ্ভুত নেশা কেমন এক ঘোর কাজ করছে।মনের মাঝে তোলপাড় করা কোন এক অদৃশ্য ঝড় বইছে।তার প্রতিটি বাক্যের মাঝে কিছু তো আছে।উনি এখনও ওভাবে কোমর আকড়ে দাড়িয়ে আছেন।মাঝে মাঝে নিস্তব্ধ রাতের হিমশীতল আবহাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে দুলে উঠছেন।এই রাতের শীতলতা যেমন আমাকে কাপিয়ে তুলছে।ঠিক তেমনি তার ওই শীতল নেশা জড়ানো কণ্ঠ আমার হৃৎস্পন্দনের গতি বিধি বাড়িয়ে তুলেছে। তিনি এবার আমাকে পিছন থেকে জরিয়ে আমার খোলা এলোমেলো চুলে নাক ডুবিয়ে দিলেন।পুনরায় কাপন ধরলো পুরো শরীর জুড়ে। বুকের ভিতর ধুকপুক ধুকপুক শব্দ হচ্ছে। অনুভব করতে পারছি সে শব্দ। মনে হচ্ছে এখুনি বেরিয়ে আসবে আমার হৃদপিণ্ডটা।তার প্রতিটি কথা,প্রতিটি শব্দ বারবার কানে বাজছে। শেষ বাক্যটি প্রতিধ্বনিত হয়ে বারবার কর্নকুহুরে ফিরে ফিরে আসছে।”আমার ভালোবাসায় প্রতিটি স্পর্শকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার জন্য প্রস্তুত হন মিসেস ফয়সাল আহমেদ স্রোত। ” মিসেস ফয়সাল আহমেদ স্রোত! সত্যি আমি মিসেস ফয়সাল আহমেদ স্রোত! তার অর্ধাঙ্গিনীরুপে এই প্রথমবার! এই প্রথমবার এমন উক্তি! এমন উপাধি প্রাপ্ত এই আমি! আমার মনের মাঝে ভালোবাসারা হুহু করে জানান দিচ্ছে আমি তার একমাত্রই তার! সে কেবলই আমার! আর কারো নয়! কারো না! কখনো না! কিছু কিছু আনন্দ প্রকাশের বাহিরে।ভাষা থাকে প্রকাশের।তার প্রকাশ জানান দেয় শুধুমাত্র অশ্রু! আনন্দ অশ্রু। ভালোবাসার মানুষটিকে একান্তই নিজের করে পাওয়ার আনন্দ, ভালোবাসার প্রাপ্তি ঠিক কতটা সুখকর অনুভূতির সংমিশ্রন সে শুধু তারাই বোঝে যারা সেটা অনুভব করতে পেরেছে।যারা পেরেছে তারা ভাগ্যবান! ভিষন ভাগ্যবান!সে আনন্দে যে দুটো অশ্রু অজান্তেই অক্ষিকোটর থেকে ঝড়ে পড়ে তাই আনন্দ অশ্রু। এই চোখের জল ও ভিশন কনফিউশন ক্যাটাগরির। খুশিতেও টপটপ করে ঝড়ে আর দুঃখেও।স্রোত ভাইয়ের থেকে প্রাপ্ত প্রতিটি আঘাতেও ঝড়েছে আর আজ তার ভালোবাসার প্রাপ্তি হয়েও ঝড়ছে।আমার চোখের কোনের দুফোটা অশ্রু তার আড়ালে সন্তপর্ণে মুছে নিলাম।

আমি আমার সকল অনুভূতিকে আড়াল করার চেষ্টা করলাম।নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,

— এত রাতে আপনি এখানে কেন এসেছেন? আর কিভাবে এলেন?

— কেন এসেছি তা বোঝার বাকি থাকলে সমস্যা নাই।আমি দ্বিতীয় বার বোঝাতে প্রস্তুত।ইনফ্যাক্ট দ্বিতীয় বার বোঝানোর সুযোগ পেলে আমি বেশ খুশি হব।মে আই?

বলেই উনি দুষ্টু হাসলেন।উনার ঠোঁটের কোনে লেগে থাকা বাঁকা হাসি দেখে টনক নড়লো আমার।বুঝতে পারলাম যে অস্বস্তি কাটাতে গিয়ে মাথা ঘেটে গেছে। নিজেকে এলোমেলো করে ফেলছি।নিজেই যদি এলোমেলো হয়ে যাই তবে এনার পাগলামিগুলো সামলাবো কি করে! উনার দুষ্টুমি বুঝতে দেরি তার থেকে ছিটকে আসতে দেরি নেই।আমার এভাবে আচমকা তার থেকে দুরে সরে যেতে দেখে ঠোঁট টিপে হাসলেন তিনি।

— আপনি না ভিশন বাজে হয়ে গেছেন।আর একটাও বাজে কথা না।এবার ঘরে ফিরে যান।কেউ দেখলে কি ভাববে বলুন তো।কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।সবার কাছে লজ্জায় পড়তে হবে। সবাই এটা সেটা বলবে আমায়।এমনিতেও আপনার জন্য বিকালে ভয়াবহ বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে আমাকে।কেউ এভাবে বলে? এত ভয়ংকর কথা বলতে একবারও বুক কাপলো না আপনার! আপনি ভিশন নির্লজ্জ একজন বাজে লোক।

— এই ভয়াবহ বিড়ম্বনায় পড়ার দায় সম্পূর্ণ আপনার মিসেস।দুপুরবেলা আমাকে বিবস্ত্র অবস্থায় পেয়ে যা ভয়ংকর কান্ড ঘটিয়েছেন তার ছোট্ট একটা ডেমো ছিল।আপনার এরকম ভয়ংকর কার্যকলাপে আমার জীবন অতিষ্ট। আমার মত শান্ত ভদ্র মানুষটাকে চরম অসভ্য, নির্লজ্জ, বেহায়া হতে বাধ্য আপনি করেছেন।আর এখন আমি বেহায়া হলেই দোষ।বউকে একটু আদর করতে চাইলেই আমি নির্লজ্জ আর তুমি যে আমাকে একা পেয়ে আমার ইজ্জত লুটে নিলে তার বেলায়।

তার এমন অদ্ভুত কথা আর যুক্তির ফলে আমি জাস্ট বাকহারা।তাকে ঠিক কি বলবো খুঁজে পাচ্ছি না।আমি কি এমন করেছি শুধু একটা চুমুই তো খেয়েছি। তার জন্য তিনি এরুপ বেহায়ার মত আচরন করবেন।সোজা দিদুনের কাছে গিয়ে বলে দিলেন দুদিনের মধ্যেই বিয়ে হবে।লোকটি কি পাগল নাকি? সরু চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকে কিছু বলার পূর্বেই সে বললো,

— আমাকে পাগল বানিয়ে এখন খুব মনোযোগ সহকারে ভাবা হচ্ছে আমি পাগল কিনা।তাহলে জেনে রাখো জানপাখি! তোমার বর পাগল।তোমার জন্য পাগল।তোমার এসব পাগলামিতে নিজেকে সামিল করবো বলে আমি পাগল।

আমি তার কথা শুনে আলতো হাসলাম।
— এখন আপনার পাগলামির চ্যাপ্টার ক্লোজ করুন আর এখান থেকে যান।নয়তো ভিষন বিপদে পড়বো।দিদুন উঠে যেতে পারে।

— উঠলে উঠবে।একসাথে দুজনকে হ্যান্ডেল করার মত এবিলিটি আছে আমার।

— হুম।বুঝলাম।তবে এখন আপনি যান প্লিজ।

— উহু। এখন তো যেতে পারবো না।আমার তো রিটার্ন গিফট চাই।আর সেটা ছাড়া একপাও নড়ছি না আমি।এমনিতেই তোমার দুপুরের ডোজ আমার সারাদিনটাকে এলোমেলো করে দিছে।আমার মত গুছালো শান্ত- শিষ্ট ভদ্রছেলের হাল বেহাল করে ছেড়েছে।আমার উচিত আমার এমন করুন দশার জন্য তোমাকে শাস্তি দেওয়া। তবে এখন সেটা দিব না।সব শাস্তি সময়মত পেয়ে যাবেন আপনি।দুবছরের প্রতিটি মুহূর্তের দুরত্বের শাস্তি। আর সেই শাস্তি হবে পৃথিবীর সবথেকে রোমান্টিক শাস্তি।সে শাস্তির প্রতিটি স্পর্শে পাবে শুধুই ভালোবাসা! আমার ভালোবাসা মোড়ানো শাস্তি উপহার দিব তোমায়।

তার নেশাক্ত কথায় কাপন ধরলো আমার।হাত – পা রীতিমতো কাঁপা- কাঁপি অবস্থা। নিশ্বাস আটকে আসছে। এই লোকটার এই মোহময়ী কথাই যে আমাকে দিশেহারা করতে যথেষ্ট। তার কথিত ভালোবাসায় মোড়ানো শাস্তি কি করে সইবো আমি! কি করে!

চারপাশ নিসর্গতায় ছেয়ে আছে।কোথাও থেকে ভেসে আসছে আষাঢ়িয়া মেঘের দল।গ্রীষ্মের শেষ। বর্ষার শুরু।এসময় মৃদুমন্দ বাতাসে ছাপিয়ে থাকে প্রকৃতিতে।হুটহাট ভেসে আসা আষাঢ়িয়া মেঘ ঝাপিয়ে নামে ঝপঝপে বৃষ্টি। কখনো মুষলধারে। পথঘাট ডুবে জলে থইথই।তবে কাল বৈশাখির পর এখন অবধি ঝাপিয়ে বৃষ্টি হয়নি।গ্রীষ্মের প্রখরতায় অতিষ্ঠ মানব- মানবি। এমন সময় ধেয়ে আসা হুটহাট মেঘের আগমন মনে প্রশান্তির ছোয়া জাগায়।শীতল বাতাস গায়ে হিম ধরায়।শরীরে কাটা দেওয়া হিম শীতল হাওয়ায় হেলে দুলে ওঠা আমার অবাধ্য চুলগুলো কানের পিছে গুজে দিলেন।তার স্পর্শে আবেশে চোখ বুজে নিলাম।সে শান্ত – শীতল অথচ মাদকমিশ্রিত চাহনি নিক্ষেপ করলো।আমিও মুগ্ধতা নিয়ে খানিকক্ষণ তার গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম।তার পর আনমনেই দুপা এগিয়ে তার মুখোমুখি দাড়ালাম।আমার থেকে বেশ লম্বা হওয়ায় পা দুটো উঁচু করে তার ললাটে চোখ বুজে গভীরভাবে অধর ছোয়ালাম।উনি ভিষন ভাবে চমকে গেলেন।চমকালাম আমিও।তিনি হয়তো ভাবতেও পারেননি আমি এমন কিছু করবো! আসলে আমি নিজেও জানি না আজকাল হুটহাট কি হয় আমার।যত ভয়ংকর ঘটনা অনায়াসেই ঘটিয়ে ফেলি আমি।আশাবিহীন অপ্রাপ্তির ভিড়ে এ যেন এক বিশাল প্রাপ্তি।লজ্জা,সংকোচ আর অস্বস্তি নিয়েই ছুট লাগালাম। তবে এগোতে পারলাম না।তার আগেই শক্ত হাতের নরম স্পর্শে আটকে গেলাম।উনি একটানে আবারো তার কাছে আনলেন। দুগালো হাত রেখে মুখে ফু দিলেন।পাপড়িগুলো আলতো করে পিটপিটিয়ে আবারো স্নিগ্ধ চাহনিতে তাকালাম তার মায়াবী মুখ খানায়।উনি নিচু স্বরে বললেন,

— আঘাত যখন দিয়েছো সারিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব ও তোমার।হয়তো সহজে সারবে না।তবে তোমার ছোয়ায় সে ক্ষত বিক্ষত স্থান দ্রুত আরোগ্য লাভ করবে।যেভাবে আমার উষ্ণ হৃদয়কে শীতল করেছো সেভাবেই এই ক্ষতকেও শীতলতা দিয়ে যাও।বলেই উনি আঘাত প্রাপ্ত হাতটা এগিয়ে আনলেন।ক্ষতটা দেখেই বুকের ভিতরটা মোচড় দিল।তীব্র অনুশোচনা আর আত্মগ্লানিতে বিষাক্ত হয়ে উঠলো হৃদয়।এসব কিছুর চক্করে ক্ষতর কথা বেমালুম ভুলেই গেছিলাম।অস্থির হয়ে তার ক্ষতটাকে নিজের কাছে টেনে দেখতে লাগলাম।রাগ,ক্ষোভ ভিড় করলো মনে। কি করে ভুলে গেলাম? এতটা কেয়ারলেস কেন আমি? অস্থির কন্ঠে সুধালাম,

— আপনি এতটা কেয়ারলেস কেন বলুনতো? কতটা কেটে গেছে আর তখন থেকে একটু উফফ পর্যন্ত না করেননি।

— যার কেয়ার করার কথা সে নিজেই তো ভুলে গেছে।আমি আর কি মনে রাখবো।

আমি অসহায় করুন চাহনি দিলাম।উনি হাসলেন।তারপর বললেন,

— আমি জানি তুমি ইচ্ছে করে করোনি।ভুলে গেছো।ইটস ওকে।তোমার জন্য যেখানে মর……

আর বেশিকিছু উচ্চারন করার আগেই মুখ চেপে ধরি তার।আর শোনার সাধ্য আমার নেই।সবটা শোনার আগে যেন আমার মরন হয়।এই প্রার্থনাই করি রোজ মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে।আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে তৎক্ষনাৎ জরিয়ে ধরি তাকে।তিনি আলতো করে হাত বুলিয়ে দেন আমার মাথায়। কিয়ৎক্ষন অতিবাহিত হবার পর দ্রুত ওড়না টেনে ছেড়ার চেষ্টা করলাম।কাজ হচ্ছে না।আমার কাজ দেখে উনার ঠোঁট যুগলে হাসি ফুটলো। প্রাপ্তির হাসি! আমি দাঁত দিয়ে কাপড়ে একাংশ ছিড়ে নিলাম।তারপর টেনে কতখানি ছিড়ে তার বাহুতে বেধে দিলাম।খুব বেশি না হলেও কম রক্তক্ষরণ হয়নি।অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে।আমার খেয়াল রাখা উচিত ছিল।

ওড়না বাধতে বাধতে উনার চোখের দিকে দৃষ্টি দিলাম কেমন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে।আর ঠোঁটে মুদু হাসির রেখা। যার তার মোহময় রুপকে আরো মোহিত করছে।প্রেয়সী যখন তার প্রেমিক পুরুষের ক্ষত স্থান যত্ন নেই তখন সেটা হয় অমায়িক এক মুহুর্ত। এমন মুহুর্তগুলো স্মৃতির পাতায় রয়ে যাবে আজন্ম কাল।কখনো বিচ্যুত হবে না। কখনো কোনো বৃষ্টিভেজা মুহূর্তে কিংবা কোন পড়ন্ত বিকালে বেলকনির রেলিং ঘেষে বসে সেই মুহুর্তগুলোর স্মৃতিচারন হবে।কখনো বা গোধূলির রুপের আলোর সংমিশ্রনে গড়ে ওঠা প্রেমিক – প্রেমিকার সাক্ষী হয়ে থাকবে।

বাধা শেষ হতেই উনি আমাকে দুহাতে গাল আগলে মাথার চুলে ভালোবাসার পরম আবেশ দিলেন।

–অনেক রাত হলো ঘুমিয়ে পড়ো।আমি আসছি।
বলেই যেইনা উনি বারান্দার রেলিং এ হাত রেখেছে ওমনি তার হাত ধরে আটকে দিলাম।মাথা নাড়িয়ে ইশারায় না বোঝালাম তারপর হাত ধরে টেনে পা টিপে টিপে ঘরে এনে দরজা খুলে দিলাম।তিনি মুচকি হেসে চলে গেলেন।

আমি দরজা বন্ধ করে পা টিপে টিপে সুয়ে পড়লাম।অল্প সময়ের মধ্যেই ঘুমের দেশে পাড়ি দিলাম।

#চলবে……

তুমি নামক যন্ত্রণা পর্ব-১৪

0

#তুমি নামক যন্ত্রণা
#লেখনীতেঃ হৃদিতা ইসলাম কথা
#পর্বঃ১৪

— দিদুন বিয়েটা আগামী সপ্তাহে নয় এই সপ্তাহে হবে।কালকে হলুদ আর পরশু বিয়ে। রিসেপশন ঢাকা হবে।সে অনুযায়ী সব ব্যবস্থা করছি আমি।

স্রোত ভাইয়ার হঠাৎ এ কথা শুনে সবাই তব্দা মেরে বসে আছে।মুহুর্তের মাঝেই হাসির রোল পড়ে গেল।ভুবন কাপানো হাসি যাকে বলে।সবাই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।আমার সব কাজিন সমাজ একসাথে। তারা আমার দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে অদ্ভুত সব ইশারা করছে। আর আমি লজ্জায় শেষ।মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে তবে উনার কোন ভাবান্তর নেই।উনি নির্বিকার ভাবে দাড়িয়ে।নীলা তো আমাকে বসে থেকেই ধাক্কা মেরে হিসহিসিয়ে ঠাট্টার সুরে বললো,

— দেখ তো স্রোত ভাইয়ার আর তর সইছে না।তাই বলে তো কাল- পরশুর মধ্যেই তোকে নিয়ে যেতে চাইছে।বুঝতে পারছিস জানু স্রোত ভাই তোকে কতটা ভালো্াসে। ইশশ! আমার ক্রাশ তোকে এতটা ভালোবাসে ভাবতেই বুকে চিনচিন ব্যাথা হচ্ছে।
আমি ওর দিকে কটমট করে তাকালাম।

ও মিটমিটিয়ে হাসছে । শুধু ও না প্রায় সবাই মিটমিটিযে হাসছে। আমি এবার না পেরে উনার দিকে চোখ গরম করে তাকালাম।উনি আমার দৃষ্টিকে পাত্তা দিলেন।তা দেখে গা জ্বলে উঠলো আমার।চোখমুখ শক্ত করে মনে মনে ঝেড়ে দিলাম উনাকে।

— নির্লজ্জ বেহায়া লোক।এক্কিবারে লজ্জা শরম নেই।অসভ্য পাজি লোক একটা।সবাই কি ভাবলো।ইশশ! আমাকে এভাবে লজ্জায় ফেলবে বলে ইচ্ছে করে সবার সামনে এরকম নির্লজ্জের মত কথাটা বলে ফেললো।

সবার এমন হাসি মুহুর্তেই উবে গেল উনার শান্ত, শীতল অথচ তীক্ষ্ণ চাহনির কবলে পড়ে।উনি আর সময় ব্যয় না করে স্থান ত্যাগ করলেন।আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।তবে উনারা যেতেই শুরু হলো সবার মশকরা। সবাই ফাজলামো করছে উনাকে নিয়ে। এমন সব কথা বলছে চোখ তুলে তাকাতে পারছি না।গাল দুটো ইতোমধ্যে টমেটো হয়ে গেছে।ওদের কথার প্রতিত্তোরে কিছু বলতে পারছি না। আসলে আড্ডার আসর বসেছে আমাকে ঘীরে। যেহেতু বিয়ের কনে তাই।আজ সকালেই দিদুন নাস্তার টেবিলে আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা তুলে ধরে। সামাজিকভাবে সবটা মিটিয়ে নিতে চান উনি।সেখানে কারো কোন আপত্তি নেই।ফুপ্পিরা আমার আর স্রোতের বিয়ের ব্যাপারে সবটা জানলেও কাজিন সমাজ কোন হই- হুল্লোড় করেনি।পরিস্থিতি অনুকুলে ছিল না।তার ঘোর নিষেধ এসব বিয়ের বিষয় নিয়ে যেন কোনমতেই বাড়াবাড়ি না হয়।আর তার আদেশ যেন কোন মহান ঋষির বানী তার একচুলও নড়চড় চলে দুনিয়া এদিক ওদিক করতেই পরোয়া করবেন না তিনি।মানুষটা বড়ই অদ্ভুদ তার থেকেও বেশি অদ্ভুদ তার আচার আচরন।এই ঠান্ডা তো এই গরম।উনার আচার আচরন আবহাওয়ার পূর্বাভাসের থেকেও বেশি দ্রুত পরিবর্তন হয়।এই ঝড় এই বৃষ্টি এই তুফান তো এই স্লাইকোন।এই মানুষটা জীবন ঝালাপালা করে দেবে আমার।

সবার মতে বিয়ের সমস্ত নিয়ম- কানুন মেনে বিয়ে সম্পন্ন করা হবে।তাই মেহেন্দি, সঙ্গীত ও হলুদের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ উনার এমন বক্তব্য সবাইকে বাক্য হারা করে দিয়েছে। এমনিতেও উনি মুডি মানুষ কখন মুড চেঞ্জ হয় বলা যায় না।তখন তো কোন আপত্তি করেননি।আজ হঠাৎ কি হলো কাল মেহেন্দির ফাংশন করার ছিল।তবে উনার কথায় মনে হচ্ছে কিছুই হবে না।ধ্যাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেল আমার।কতকিছু করবো বলে ভেবেছিলাম। কত সাজগোজ করবো? কত মজা করব?ধুর! এখন আর কিছুই করা যাবে না।আমার সাথে সাথে পুরো কাজিন গুষ্ঠির মন খারাপ। তবে সেটা প্রকাশ করার সাহস নেই কারো।স্রোত ভাইয়ের উপর কথা বলার মত কলিজা কোন প্রানীর মধ্যেই নেই।

.
মন খারাপ নিয়েই রাতের খাবার শেষ করে নিজ ঘরে ফিরে যাচ্ছিলাম। নীলা কিছুক্ষণ আগেই আমার ঘরে গিয়ে সুয়ে পড়েছে।তিশা আপুর ঘর দখল করেছে সবাই। তাই নীলা আর তিশা আপু আমার ঘর দখল করেছে।তখনই দিদুন স্মরন করলো আমায়। আমিও দিদুনের ঘরে চলে গেলাম। দিদুন বললো,

— শোন বুড়ি যতদিন তুই এবাড়িতে আছিস আমার কাছে থাকবি।আর তাছাড়া বিয়ের কনের একটু আলাদা থাকা দরকার।

কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

— আলাদা থাকা কেন দরকার?

— ওতকিছু তোর জানার দরকার নেই।তুই এঘরেই থাকবি আমার সাথে বুঝতে পারছিস।

আমি শুধু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোঝালাম।

দিদুনের সাথে কিছুক্ষন আড্ডা দিয়ে দুজনেই চুপ করে সুয়ে পড়লাম।কিন্তু ঘুম আসছে না।কিছুতেই না! ভিষন বিরক্ত লাগছে আমার।সকল বিরক্তির অন্ত ঘটলো বারান্দার থেকে কিছু একটা পড়ার আওয়াজে। আমি ধপ করে উঠে বসলাম।বারান্দার দিকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছি।আজ পূর্নিমা তাই চাঁদের উজ্জল আলোয় আবছা আলোকিত চারিপাশ। হঠাৎ করেই কারো একটা ছায়া দেখতে পেলাম।আমার ভেতর কেমন যেন একটা ভয় অনুভব হতে লাগলো।বসে থেকেই শুকনো গলাটা ঢোক গিলে ভেজানোর চেষ্টা করলাম।ধীরে ধীরে ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলার চেষ্টা করলাম,

ভয়ে ভয়ে বললাম,

— ক্ কে ওখানে? কে আছে?

ওপাশ থেকে কোন উত্তর এলো না।আমার এবার ভয় হতে শুরু করলো।আমি আলগোছে দিদুনকে হাত দিয়ে আলতো নেড়ে চড়ে দীর কণ্ঠে ডাকতে থাকলাম।

— দিদুন!দিদুন!তুমি ঘুমিয়ে গেছ দিদুন! ও্ ওঠ দিদুন।বা্ বারান্দায় কেউ একটা আছে। দিদুন!

দিদুনের কোন সাড়াশব্দ নেই।সে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। শান্তির ঘুম! আর এদিকে আমার ঘুম হারাম হয়ে গেছে। ওখানে কে আছে? কেন আছে? চোর টোর নয়তো! ভাবতেই বুকটা কেঁপে উঠলো।কিন্তু চোর হলেও তো তাকে ধরা প্রয়োজন। যদি সে কারো ক্ষতি করতে এসে থাকে। মনের ভিতর কিঞ্চিত সাহস জুগিয়ে বিছানা থেকে পা দুটো নিচে নামিয়ে সন্তপর্নে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলাম।যাওয়ার সময় তীক্ষ্ণ ধারালো একটা অস্ত্র হাতে নিলাম।যা দিয়ে বিপদ হলে নিজেকে রক্ষা এবং অপর ব্যাক্তিকে ঘায়েল করতে পারি।

বারান্দার দরজা খুলে দুপা আগতেই কেউ একটা পরছন থেকে মুখ চেপে ধরলো। আমি অন্যহাতে প্রতিকারের চেষ্টা করছি।তবে বারবার ব্যর্থ হচ্ছি।এক পর্যায়ে ধস্তাধস্তির সময় তার গায়ে আচড় লেগে গেল।সে “আউচ ” শব্দ করে উঠলো।আমি ভয় পেলাম খানিকটা। আমার ধরে রাখা হাতটা ছেড়ে দিল সে।তারপর সে যেহাতে আমার মুখ চেপে ধরেছিল সে হাতটা ছেড়ে দিয়ে তার আঘাত প্রাপ্ত হাতটাকে আকড়ে ধরলো।আমি ছাড়া পেয়ে তার থেকে দুরে সরে এলাম।অতঃপর কোন দিকে খেয়াল না করে চোখ বন্ধ করে সর্ব শক্তি দিয়ে চিৎকার করার জন্য উদ্যত হতেই সে সামনে থেকে আমার মুখ চেপে ধরলো আর তার ধারালো দৃষ্টি আমার উপর নিবব্ধ করলো।ভয়ার্ত চোখ দুটো তার উপর পরতেই তা অস্বাভাবিক আকাড়ে প্রসারিত হলো।বড় বড় চোখে সামনের মানুষটির মুখের দিকর তাকিয়ে । আকাশে শুল্কপক্ষের চাঁদ। জোৎস্নার উজ্জ্বলতা ছাড়িয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। পুরো পৃথিবী ছেয়ে আছে দুধসাদা জোৎস্নায়। বাইরে হিমেল বাতাস হু হু করে প্রবেশ করছে বারান্দায়। শরীর শীলতায় ছেয়ে দিতেই।হাড় কাপাতেও যথেষ্ট।
তারউপর শিহরন জাগানো স্পর্শ। স্রোতের মুখে জোৎস্নালোকিত স্বর্গীয় লালিত্য যেন উপচে পড়ছে।আর সেই উপচে পড়া জোৎস্নার উজ্জ্বলতা যেন তার সৌন্দর্যকে হাজার গুন বৃদ্ধি করছে।আমি একপলকে তার মুখের দিকে তাকিয়ে। তার গভীর নীল জলরাশির মত দুটো গহীন চোখ।যার গহীনে যেকোন রমনী হারিয়ে যেতে বাধ্য। এক দেখাতেই প্রেমে পড়তে বাধ্য। গৌর বর্নের মুখটিতে সৌন্দর্যের বাহার নেমেছে বলে মনে হয়।চিকন পাতলা ঠোঁট দুটি লালচে রঙের। মনে হয় ঠোঁটে লিপি স্টিক লাগিয়েছে।উনার ছোট ছোট ঘন চাপদাড়ি গুলো উনার সুদর্শন হওয়ার পরিচয় বহন করছে বলে মনে হয়।উনাকে এতটা নিখুত আর খুঁতিয়ে খুঁতিয়ে পর্যবেক্ষন করার পর মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন ছুড়লাম!

— আচ্ছা উনি এত সুন্দর কেন? উনি কি সত্যি এত সুন্দর নাকি আমার চোখেই শুধু তাকে অধীক সুদর্শন পুরুষ বলে মনে হচ্ছে।পুরুষদের অতি সুদর্শন হতে নেই। সৌন্দর্যের সীমা থাকা প্রয়োজন। তা সীমা পেরিয়ে গেলেই অঘটন ঘটতে দেরি হবে না।

.
যেমনটা আজ সকালের ঘটনা।উনার ঘুম থেকে উঠতে দেরি হওয়ার ফলে আম্মু আমাকে জোর করে পাঠিয়েছে স্রোত ভাইয়ার রুমে।অন্যদিকে উনার আমার প্রতি এত অবহেলা সহ্য হচ্ছে না আমার।তাই কালকেি নীলা ফোন করে এবাড়িতে ডেকেছি।এই মেয়ে ভিষন বিচ্ছু। ছেলেদের ঘোল খাওয়াতে এক্সপার্ট। আজ পর্যন্ত ঠিক কতজন ওর বয়ফ্রেন্ড ছিল তা হয়তো ওর নিজের ও অজানা! অথবা যদি কাউন্ট করতে বসে তবে হয়তো কয়েকদুন পেরিয়ে যাবে।এমনও বয়ফ্রেন্ড ছিল যাদের মেয়াদ কেবল মাত্র কয়েক ঘন্টা।নীলার ভাষ্যমতে, ওর মুড সুয়িং যে ছেলে হ্যান্ডেল করতে পারবে একমাত্র সেই ছেলে ই ওর বপেন হওয়ার যোগ্যতা রাখে।ওর এসব আজব আজব যৃক্তি আর যুক্তিখন্ডন দেখে রীতিমতো কয়েকবার কোমায় যেতে যেতে বেঁচে গেছি।মেয়েটা বড্ড ফাজিল আর দুষ্টু। তবে ভিষন মিষ্টি। আমাকে ভিষন ভালোবাসে সেখানে কোন সন্দেহ নেই।কেউ আমাকে জোরে ধমকে দিলেও যেন ওর চোখ দিয়ে জল গরিয়ে পড়ে। সকাল থেকেই নানা বুদ্ধি সুদ্ধি প্রয়োগ করতে উদ্যত সে।তবে কোনভাবেই মনমত কোন কিছু পাচ্ছি না।যাতে করে ব্যাটাকে আচ্ছামত জব্দ করা যেতে পারে।আমাকে ইগনোর করার সাধ মেটাবো বলেই পণ করেছি আমি।আর সে পণ পুরন করতেই একটা অশ্লীল পন্থা অবলম্বনের কথা বলেছে নীলা।তবে আমি তা মানতে নারাজ।আমার পক্ষে এত বড় কার্য ইহ জীবনেও সিদ্ধ হবে না।উল্টো দেখা গেল দু- চারটে চড় লাগিয়ে দিল।না বাবা না।মোটেও না।স্রোত ভাইকে কিস করার মত মহাপাপ আমি ইহজীবনেও করতে পারব না।যদিও সে আমার স্বামী তবুও এত অশ্লীল কাজ আমার দ্বারা অসম্ভব।

খাবারের ট্রে নিয়ে উপরের আসার সময় হাজারো জল্পনা কল্পনা করছিলাম।তবে সেসবের ইতি টেনে প্রবেশ করলাম স্রোত ভাইয়ার রুমে। সেখানে এসে কোথাও মহাশয়ের দেখা মিললো না।ওয়াশরুম থেকে পানির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছর।আমি খাবারের ট্রে টা টেবিলে রেখে পিছনে ঘুরতেই আমার চোখ ছানাবড়া। স্রোত ভাই শুধুমাত্র টাওয়ার কোমরে জরিয়ে দুহাতে ভেজা চুল ঝাড়তে ঝাড়তে এগিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েছে।আমি একবার মাথা থেকে পা পর্যন্ত তাকে পুরোটা স্ক্যান করি।অতঃপর হুট করেই তার দিকে এগিয়ে যেতে থাকি।বুকের ভিতরটা তার এমন ঘায়েল করা চোখের চাহনিতে ধরাস ধরাস করছে।হৃদপিণ্ড তার গতিবিধীর হাড় বাড়িয়ে দিয়েছে।আমার হার্ট অস্বাভাবিক গতিতে বিট করছে।আমি মনে হয় হারিয়ে গেছি কোন একটা ঘোরে।ঘোরের মাঝেই তার দিকে সমান্তরালে এগিয়ে যাচ্ছি।তিনি আমাকে এভাব এগিয়ে আসতে দেখে একটু অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে। সত্যি ব্যাপারটা ভিষন অদ্ভুত! তার ভেজা শরীরে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি জমে আছে।তার ভেজা চুল থেকে টুপটাপ করে পানি গরিয়ে পড়ছে।তার চোখমুখ সিক্ত।সিক্ততা মিশ্রিত এই সুঠাম দেহী সুদর্শন পুরুষকে দেখে কি হলো আমার জানি না। তবে তার দিকে ভিষনভাবে আকৃষ্ট হয়ে গেছিলাম। তার সামনাসামনি দাড়িয়ে পা দুটো একটু উঁচু করে একদম আচমকাই তার ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ছুইযে দিলাম।আমার এহেন কান্ডে স্রোত মহাশয় যেন জমে বরফ হয়ে গেল। তার মুখে শব্দ নেই।চোখদুটো বড় বড় হয়েছে ইতোমধ্যে। এমন একটা ঘটনায় সে রীতিমতো শকড! সে শকড কাটিয়ে উঠতে পারছে না।তাকে ভয়াবহ এক চুমু খাওয়ার পর অকস্মাৎ আমার ঘোর কাটলো।পরিস্থিতি বুঝতে দেরি হলেও আমার পালাতে দেরি হলো না।ছুট লাগালাম নিজ ঘরের উদ্দেশ্য। আর পৌছেও গেলাম।ঘরে এসে দরজা দিয়ে হাপাতে লাগলাম।পরক্ষনেই সেই মুহুর্তের কথা মনে পড়তেই দুহাতে মুখ লুকালাম।ইশশ!কি লজ্জার ব্যাপার! আমি কিনা স্রোত ভাইকে চুমু খেলাম।তাও আবার লিপ টু লিপ।যদিও সেটা একটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চুমু ছিল।তবুও চুমু তো ছিল।

.
আমার ভাবনার মাঝেই উনি আমার সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললো,

— সকালের ঘটনার ভয়াবহতা মনে পড়ছে নিশ্চয়।

আমার সম্বিৎ ফিরলো। সকালের ঘটনার ভয়াবহতা বলতে উনি ঠিক কি বুঝিয়েছেন।মুহুর্তেই আমার ভিতরে ভয় আর লজ্জারা গ্রাস করলো।আমি লজ্জাটাকে ছাপিয়ে ভয়ার্ত চোখে উনাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম।

–আ্ আসলে ত্ তখন….

— তখন কি ছিল? কেন ছিল? আমি জানতে চাইনি। আমি অসম্পূর্ণ কাজটা সম্পূর্ণ……

#চলবে…..

তুমি নামক যন্ত্রণা পর্ব-১৩

0

#তুমি নামক যন্ত্রণা
#লেখনীতেঃ হৃদিতা ইসলাম কথা
পর্বঃ১৩

ঘরে এসে বিষ্ফোরিত নয়নে থমকে তাকিয়ে আছে স্রোত।তারই বিছানায় ঘুমন্ত এলোমেলো রুপসীর ঘুমন্ত মায়াবি মুখের দিকে।বিস্ফোরিত দৃষ্টি মুগ্ধতায় আটকে গেলো।ঠোটের কোনে মুচকি হাসিরা খেলা করতে লাগলো।মেয়েটা বড্ড অগোছালো আর একদমই বাচ্চাদের মত কাজকর্ম করে। হয়তো ওর এই বাচ্চামোতেই মন হারিয়েছে স্রোত।বারবার হারাতে চায়! হাজার বার! ওর অস্তিত্ব ওর নিজস্বতা সবকিছুকে ঘীরে শুধু ওই একটা নাম।ওই একটা মুখ।ওই একটা মানুষ।যার কাছে বারবার হেরে যেতে চায় প্রাপ্ত। যার অভিমানে হৃদয় পুড়ে।যার দুরে সরে থাকা তিল তিল করে যন্ত্রণা দেয়।অসম্ভব যন্ত্রণা! বলে বোঝানো দায়!
মৃদু হাসি ঠোঁটের কোনে ধরে রেখেই এক পা দুপা করে এগিয়ে এলো স্রোত।হাটু মুড়ে বিছানার পাশে মেঝেতে বসে পড়লো।কথার এলোমেলো কেশরাশি মুখের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।হাত দিয়ে না সরিয়ে মুখে ফু দিতেই তারা উড়ে গেল।মুচকি হাসি ফুটলো ঘুমের ঘোরে তার স্রোতস্বীনির ঠোঁট যুগলে।হ্যাঁ! স্রোতস্বীনি! স্রোতের স্রোতস্বীনি! যে স্রোতের প্রবাহে গা ভাসিয়েছে ও!ওর সেই চঞ্চলা, চটপটে রমনিকে একমনে দেখতে লাগলো! মুগ্ধতায় ঘেরা চাহনিতে তার ঘুমন্ত মায়াবীনিকে আরও মায়াবি লাগছে । যার মায়ার জালে আটকে গেছে ও! যেখান থেকে ছাড়া পাওয়া মুশকিল! পারবে না ও! আর না এখন থেকে চেষ্টা করবে! আটকে রাখবে! আগলে রাখবে! নিজের সাথে বেধে রাখবে! কখনোই ওর থেকে দুরত্ব রাখবে না! মন গহীনে বন্দী করে রাখবে।

হঠাৎ করেই ওই ঘন পাপড়ি বিশিষ্ট গভীর চোখের অধিকারিণীকে ছুয়ে দিতে ইচ্ছে হলো ওর।ও নিজের ইচ্ছেকে সংবরন করল না বরং ইচ্ছেকে পুর্নতা দিয়ে পরম আবেশে ভালোবাসার স্পর্শ দিল।ওই ঘুমন্ত এলোমেলো মায়াবী নারীর মায়াবি দু নয়নে।তার পর ললাটে তার উষ্ণ ঠোঁটের ছোয়া দিল।ঘুমের মাঝেই মৃদু কেঁপে উঠলাম আমি। শরীরে এক শীতল শিহরন বইলো।তবে চোখজুড়ে রাজ্যের ঘুম। খোলার সুযোগ নেই।ওর ঘুমন্ত মুখের উপর ঝুঁকে ওর নিশ্বাসের শব্দকে অনুভব করছিলো স্রোত। দেখতে দেখতে ভোর হয়ে গেল।তবে স্রোতের দৃষ্টি সরলো না।একভাবে সারারাত দেখেছিল ওর স্রোতস্বীনিকে।ওর স্রোতস্বীনি ও ওকে ভালোবাসতে চাইছে।ওর স্রোতেই গা ভাসাতে চলেছে ভাবতেই মনের ভিতর আনন্দের জোয়ার বইতে লাগলো।ঠোঁট যুগলের মুচকি হাসিটা প্রসারিত হলো।তবে নিশব্দ! হে হাসির কোন শব্দ নেই।না আছে কোন আওয়াজ।হুট করেই মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এলো।কথাকে আরেকটু জ্বালানো যাবে।আজ ওর চোখে মুখে যে ভয় ছিল তা দেখে বেশ মজা পেয়েছি ও! তবে এ ভয় স্রোতের কাছে আসা নিয়ে নয়! স্রোতের সাথে নতুন এক সম্পর্কে আরো নিবিড়ভাবে জরিয়ে যাওয়ার। তাইতো ওকে বাধা দেয়নি কথা! তবে হুট করেই স্রোতের বদলে যাওয়া আচরনে অনেকটা হতবাক হয়েছিল তা ও বেশ বুঝতে পেরেছিল।

আজানের ধ্বনি কানে বাজতেই নড়ে চড়ে উঠলো কথা।স্রোত দ্রুত স্থান ত্যাগ করলো।এভাবে ওর সামনে পরতে চায় না ও।ওকে আরও কিছুদিন কথাকে ওর পিছনে ছুটাবে।যাতে করে ওদের ভালোবাসা আরও মজবুত।আসলে ভালোবাসায় ডত আঘাত যত যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতা থাকবে তার ভালোবাসা ততটাই গভীর হবে।যেমনটা স্রোতের ক্ষেত্রে! কথার থেকে ওর এই দুরত্ব যেভাবে ওকে পুড়িয়েছে সেভাবেই আরও গভীর ভাবে কথাকে অনুভব করতে পেরেছে।স্রোত চায় ওর প্রেয়সীও যেন ওকে ততটাই গভীরভাবে ভালোবাসতে পারে! অনুভব করতে পারে! তবেই না ওদের ভালোবাসা স্বার্থক। একটা পুর্নাঙ্গ ভালোবাসাময় পৃথিবী গড়তে চাইলে ভালোবাসায় অনেক আঘাত সহ্য করতে হয়।আর প্রিয় মানুষটির থেকে দুরে থাকার তীব্রতর কষ্টগুলোই একসময় গভীরতম ভালোবাসায় রুপ নেয়।আর তখনই একটা ভালোবাসাময় পৃথিবী গড়ে ওঠে।যার স্থায়ীত্ব অনন্তকাল! মৃত্যু অবধি! প্রিয় মানুষটি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেও তার প্রতি ভালোবাসাটা কেড়ে নিতে পারে না।আমরা বেঁচে থাকি তার ভালোবাসায়! তারাই বাচিয়ে রাখে আমাদের এই বিশাল পৃথিবীতে! একাকিত্বে তার সাথে কাটানো সুমধুর স্মৃতিচারনে মনে প্রশান্তি অনুভব হয়।

স্রোত নিঃশব্দে রুম থেকে বেরিয়ে ছাদে চলে এলো।বিশালতর আকাশের বুকে তার ভালোবাসার ক্ষতগুলোকে কর্পুরের ন্যায় বিলীন করে দিল।আজ তার হৃদয়ের সকল ক্ষত সেড়ে গেছে।তার মন খারাপগুলো কালো মেঘের মত ওই আবছা অন্ধকারে ঢাকা আকাশের বিশালতায় মিলিয়ে গেছে।কেন জানি আজ বড্ড খুশি লাগছে ওর! মুখে ভালোবাসার কথা না বলেও কথাকে ওকে ওর ভালোবাসা অনুভব করিয়েছে।ইচ্ছে করে নিজ থেকে ওর কাছে এসেছে! ধরা দিয়েছে! কিছু ঘন্টা আগেও এর বিপরীত চিন্তা ভাবনায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো ওর মাথায়।তাই তো তখন বাসা থেকে বেরিয়ে গেছিল ও।প্রকৃতির কাছে গিয়ে প্রশ্ন করেছিল।তারা ওকে জবাব দিয়ে দিয়েছে।তাই এখন ও যা অনুভব করতে পারছে সেই অনুভুতিগুলোকে হারাতে চায় না।কথাকে আর কষ্ট দিতে চায় না! আধার আর আলোর মিলনমেলার এই অপুর্ব মুহুর্তের সাক্ষী হয়ে ওই নীল আকাশের আধারকে কাটিয়ে আলোর দিশা খুঁজে পাওয়ার মত সমীকরন পেল ও।ডুবে রইলো তাতে।স্মৃতিচারন করতে লাগলো সন্ধ্যে বেলার কথা বাচ্চামোগুলোকে।ওর ভয়ার্ত মুখটাকে।তখন কতটা স্নিগ্ধ লাগছিলো ওর স্নিগ্ধপরীকে।ওর মায়াবীনির নানা৷ রুপের বর্ননায় নানান নামের নামকরন করেছে ও।স্রোতস্বিনী, মায়াবীনি,স্নিগ্ধপরী আরও কত কি! ভাবতেই আবারো একগাল হাসলো ও। বিভোর রইলো ভাবনায়! যে ভাবনা! যার ভাবনা ওকে প্রশান্তি দেয়! ওর মনকে শান্ত করে! আজ দুবছর পর আবারও নিজেকে তার মাঝে ফিরে পেয়ে ভালো লাগছে ওর! ভিষন ভালো লাগছে!

.
আমার ঘুম ভাঙতেই আড়মোড়া ভেঙে অলস ভঙিতে উঠে বসলাম আমি।মুলত নামাজ আদায়ের জন্যই ওঠা।তবে এখনো চোখে ঘুম ঘুম ভাব বিদ্যমান। ঘুম ঘুম ভাবটা কাটাতেই চোখদুটো ভালো করে ডলে তাকালো ও চারদিকে। প্রথমত ঘরের পরিবেশ দেখে কপালের বলিরেখায় ভাজ পড়লো ওর।এটা তো ওর রুম নয় তবে কোথায় ও।ও জেগে গেলেই ওর অলস মস্তিষ্কটা জাগতে একটু সময় নিল।ও একটু ঝাড়া মাড়তেই সে যেন বিরক্ত ভঙ্গিতে আড়মোড় ভেঙ্গে বলে উঠলো,

— আরে মাইয়্যা! একটু শান্তিতে ঘুমায় ছিলাম সমস্যা কি তোর! একটু শান্তি তো দিবি!রহম তো করবি! সারাদিন খাটাছ আমারে! এখনো এত কিসের চিন্তাভাবনা তোর! আর চিন্তাভাবনা থাকলেও চিন্তাভাবনা ভাবার মত সময় তো দিবি! কাল রাত যে অধিকার অধিকার করে ভয়ানক আন্দোলন জুড়ে দিল তারই পরিনামের ফল।এর বেশি তোরে বুঝ দেওয়ার সাধ্য আমার নাই। বাকিটা বুঝে নে।

আমার বুঝতে সময় লাগলো না যে আমি কার ঘরেই কাল সারারাত ঘুমিয়েছিলাম। বুঝে ওঠার সাথে সাথেই চমকে উঠলাম আমি। আমি যদি এই ঘরেই ঘুমিয়েছে তবে সে কোথায়?ঘুমিয়েছে নাকি ঘুমোয়নি? ঘুমিয়ে যদি থাকে তবে কোথায়? সবাই তো সবার ঘরে! গেস্ট রুম ফাকা আছে। ওইখানে ঘুমিয়েছে।চটপট করে উঠে পড়ে গেস্ট রুমে খুঁজে এলাম।কিন্তু না মহারাজ তো সেখানেও নেই।তবে কোথায় গেল।বাইরে ছিল সারারাত।ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। আজকাল ওনার অভিমান ভাঙাতে গিয়ে আরও বেশি আঘাত করে ফেলছি নাতো! কষ্ট দিচ্ছি নাতো! বিষন্নতায় ভরা মন নিয়েই পা বাড়ালাম নিজের ঘরে। নামাজ আদায় করে আল্লাহর কাছে দোয়া করলাম আমাদরের আগামী ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য। তাড়াতাড়ি যেন তার মান ভাঙাতে পারি আমি।সে দোয়া ও করলাম। অতঃপর চলে এলাম বেলকনিতে। ভোরের শীতল হাওয়া গায়ে মাখলাম।শরীর মন সতেজ হয়ে উঠলো।কিছুক্ষণ একমনে অনুভব করলাম।এই ভোরের স্নিগ্ধতাকে।পাখির কলকাকলীতে মুখরিত পরিবেশকে।পাখিরা নিজ নিজ গন্তব্যে ছুটে চলছে।আহারের খোঁজে! প্রিয় মানুষগুলোর মুখে আহার তুলে দিতে তারাও পরিশ্রম করে।আম্তে আস্তে পুরো আকাশ পরিষ্কার হলো।অন্ধকার কেটে নতুন সুর্য উঁকি দিল মেদিনীতে।তারই মিষ্টি আলো ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। লালাভ সেই আলো প্রকৃতিকে করে তুললো আরো মোহনীয়। মুগ্ধ নয়নে কিছুক্ষন সেখানে তাকিয়ে থেকে গেলাম দিদুনের রুমের দিকে।দিদুনের ঘুম মাত্রই ভাঙলো।আমি উনার ঘরে উঁকি দিয়ে মিষ্টি সুরে বললাম,

— সুপ্রভাত দিদুন।

— সুপ্রভাত বুড়ি।

— কি করছো?

— এইতো নামাজ পড়লাম। বসে আছি। তজবি গুনছি।

— আচ্ছা চল।একটু হেঁটে আসি।তোমার শরীরের জন্য উপযোগী আর মনটাও সতেজ হবে।

— আচ্ছা চল বুড়ি।

আমি মিষ্টি করে হেসে দিদুনকে নিয়ে বেরোলাম।সেদিন আমাদের বিয়ের পর থেকেই তার সুস্থতা ব্যাপক হারে বাড়ছে।মাত্র দু দিনেই তিনি প্রায় পুরো সুস্থ। বাসায় আসার পর আমি তার সাথেই বেশি সময় কাটাই।তিনি আমাকে নানান বুদ্ধি দেন।তবে তিনি নিজের সকল কাজ নিজে করতেই পছন্দ করেন।আমরা হাটতে হাটতে প্রায় বিশ মিনিট এসেছি।ভোর হওয়াতে রাস্তা প্রায় ফাকা।লোকজন তেমন নেই।দু – চারজনকে দেখা যাচ্ছে। তারা নিজ কর্মস্থলে যেতে উদ্যত বোঝাই যাচ্ছে।একটু নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশ আমার আর দিদুন দুজনেরই বেশ পছন্দ। তাই আমরা নির্জন কোলাহল নেই এমন রাস্তায় চলতে শুরু করলাম।

— একটা গল্প শুনবি বুড়ি।( দিদুন সবসময় আমাকে বুড়ি বলেই ডাকে। মাঝেমধ্যে নাম ধরে বলে)

— শোনাও দিদুন।অনেকদিন হয় তোমার কাছে গল্প শুনি না।

— আজকের গল্প বাস্তবিক! প্রেমের গল্প! প্রেমে আচ্ছাদিত দুটি মনের গল্প! ওই তোরা কি যেন বলিস না ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ওইটা!

— ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি কোথায় ঘটলো দিদুন?

— কেন তোর আর স্রোতের মাঝে।

আমি অবুঝের মতো তাকিয়ে বললাম,

— মানে!…

— মানে! তোর আর স্রোতের প্রেমকাহিনী আমার আর তোর দাদুর প্রেমকাহিনীর পুনরাবৃত্তি ঘটালো যে!

আমি উৎসাহিত হয়ে বললাম,

— কি বলছো দিদুন। সত্যি!

— হুম। সত্যি!

— কিভাবে দিদুন? আর আগে কেন বলো নাই তোমার আর দাদুর প্রেমকাহিনী? তোমরা প্রেম করে বিয়ে করেছিলে মানে তোমাদের প্রেমের বিয়ে ছিল।

— হুম।

— তাহলে আগে কখনো বলোনি কেন?

— কারন কখনো এই বিষয়ে তোর আর আমার কথা হয়নি তাই।তুই তো কখনো প্রেম ভালোবাসা নিয়ে কথা বলিসনি।কিছু জানতেও চাসনি।তাই বলা হয়নি।

— ঠিকাছে এখন বলো তো কিভাবে কি?

— তোর দাদু আর আমি সম্পর্কে ভাই বোন ছিলাম। আপন না।আমি সম্পর্কে উনার ফুফাতো বোন ছিলাম।তার বাবা আর আমার মা দু ভাই বোন। তবে আমরা দুবোন ছিলাম।তোর দাদু একাই ছিল। ছেলের ঘরের একমাত্র ছেলে হওয়ায় বড় আদরের ছিল সে। বাবা যখনই অকালেই গত হয় আমার জন্মের পাঁচ বছরে। তখন থেকেই আমরা এ বাড়িতে থাকি। আমাদের কোন ভাই ছিল না।তবে আমি তাকে কখনো ভাই মনে করিনি।তার সাথে ভিষন ঝগড়া হতো আমার।দুচোখে সহ্য করতে পারতাম না।অনেক রাগী ছিল তোর দাদু।তবে আমার উপর কখনো দেখাতো না।ভিষন আদুরে ছিলাম তার কাছে। সব আবদার সেই পুরন করত আমার অজান্তে।আমাদের মধ্যে সাপে নেউলের সম্পর্ক ছিল।

বলেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো দিদুন।আমার বেশ ভালো লাগছে শুনতে।আমি আগ্রহ ভরে বললাম,

— তারপর!

— তারপর।এভাবেই বড় হলাম দুজন।তিনি আমার চেয়ে আট বছরের বড় হওয়ার পরও।পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করত।বড় আপুকে অনেক সম্মান করত।তবে আমাকে সবকিছুতেই খেপাতো।ভালো লেখাপড়ার জন্য মামা তাকে দুরে পাঠিয়ে দেয়।তখন থেকে তার প্রতি শুন্যতা অনুভব করি।ভিষন মন খারাপ থাকতো।কিছুই ভালো লাগতো না।দুরত্ব বাড়ার সাথে সাথে মনের কোথাও অন্যকিছু অনুভব করতে শুরু করি।তখন ও বুঝিনি আসলে আমি তাকে ভালোবাসি।আসলে আমাদের সময়ে এসব ভালোবাসা ছিল না।পরিবার দেখে শুনে বিয়ে দিত আর সেখানেই মেয়েরা মানিয়ে নিত।তবে তোর দাদু যখনই ছুটিতে বাড়িতে আসতো আমার মনটা আনন্দে ভরে উঠতো।আমাদের মাঝে ঝগড়া তখনো হতো তাতেই যেন শান্তি মিলতো।এর মাঝে আপার বিয়ে হয়।মামাই সব দেখে শুনে ভালো ছেলের কাছে বিয়ে দেয়।সবকিছু ভালোই ছিল।হঠাৎ একদিন মামা আম্মারে বললো আমারে বিয়ে দিবে।কোথাকার কোন বনেদি ঘরের পাত্রর নাকি আমাকে পছন্দ হইছে।আমি আবার উড়নচণ্ডী ধরনের মেয়ে ছিলাম কিনা।সারাক্ষণ বাচ্চাদের সাথে খেলাধুলায় মেতে থাকতাম।সময় কাটাতাম।জানিস তোর দাদুর ভাষ্যমতে আমাকে নাকি আমার বাচ্চা বাচ্চা স্বভাবের জন্যই এত ভালোবাসত সে।

— তারপর!

— তারপর। তখন তোর দাদুর পড়ালেখা শেষে খুব ভালো চাকরি হইছে।তাও আবার সরকারি।সে খুশির খবর সবাইরে দিতে বাড়িতে আসছে। যখনই জানতে পারছে তখন বাড়ির পরিস্থিতি গমগমে।আমার আম্মা তার ভাতিজারে ভিষন ভালোবাসতো।ছেলে ছিল না বলেই হইতো।পরিবারের সবার কাছেই সে বড্ড আদুরে।তার জেদ সে আমাকেই বিয়ে করবে।সবাই মেনে নিল।কারন মামি সহ সবার ভিষন আদুরে ছিলাম।তাই কেউ অমত করেনি হয়তো তারাও এটাই চাইতো।আমিও খুশি ছিলাম কারন তাকে ভালোবাসতাম।ভালোবাসা কি না বুঝলেও তার প্রতি গভীর টান ছিল, মায়া ছিল।সেবারই আমাদের বিয়ে হয়।আর বিয়ের পর আমাকে সাথে করেই নিয়ে আসেন তিনি আর তার কাজে যোগ দেন।এইভাবে ঝগড়া, খুনসুটি আর ভালোবাসায় সংসার করছিলাম আমরা।

আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সবটা শুনলাম।সত্যি অসাধারণ প্রেমকাহিনী ভালোবাসা না বুঝে ও একে অপরের প্রতি এত টান এত মায়া তাদের একটা সুন্দর সম্পর্কে জরিয়েছে। দিদুন না বুঝলেও দাদু নিশ্চয় বুঝতো সবটা।তাইতো ভালোবাসার মানুষটাকে হারাতে চায়নি।বেধে নিয়েছে নিজের সাথে। আগলে রেখেছে এতটা বছর।আসলেই ভালোবাসা মরে না।সে প্রেমিক হৃদয়ে বেঁচে থাকে হাজারো বছর।আজও দিদুনকে হুটহাট হাসতে দেখি, একা একাই বিড়বিড় করতে দেখি।আবার কখনো বিষন্ন মনে নেত্রকোনের অশ্রুও দেখা যায়। হয়তো প্রিয় মানুষটার শুন্যতা কাঁদায়। যে কান্নায় শব্দ নেই।যে কান্না ভিতরটাকে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে পারে না।নিঃশব্দে কান্না অনেক যন্ত্রণার হয়।সবাই অনুভব করতে পারে না।শুধু তারাই পারে যারা সে যন্ত্রণার অনলে প্রতিনিয়ত পুড়ছে।প্রিয় মানুষটির অনুপস্থিতি যাকে কাঁদায়।এক তরফা ভালোবাসায় মগ্ন মানুষের কান্না সে নিরব নিস্তব্ধতায় দগ্ধ হৃদয়ের আর্তনাত।সে আর্তনাত কেউ শুনতে পায় না,কাউকে বোঝানো যায় না।শুধুই পোড়ায়! অনেক পোড়ায়!

আমার ভাবনার মাঝেই দিদুন ঝাকি দিলো আমায়।

— কিরে বুড়ি কোন ভাবনায় ডুবে গেলি? আমার আদরের নাতিটারে নিয়ে ভাবিস বুঝি।

আমি কপালে ভাজ ফেলে বললাম,

— তোমার ওই গোমরামুখো,পাঙসুটে, ঢেড়স মার্কা নাতনির ভাবনায় আমি বিভোর হমু।মোটেও না।হুহ! ব্যাটা উজবুক কি মনে করে নিজেরে? আমারে পাত্তা দেয় না।আমি দেখবো কি করে পাত্তা না দিয়ে থাকে। আমিও ছাড়ছি না ব্যাটা খাটাশকে।আমারে ভয় দেখায় বলে কি….

— কি বলে?

— আরে ওই যে বলে আগে আমি আমার অধ্….

— কি হলো বল না বুড়ি কি বলছে তোরে? আদর করছে মনে হয়? চুমু খাইছে নাকি!

আমার আটকে থাকা কথা আর বেরোলো না। তার আগে এই পাকনা বুড়িটার এসব অদ্ভুত আর লজ্জাজনক কথা শুনে পা দুটো যেন জমে গেল।মস্তিষ্ক সেখানেই আটকে আচে। টাস্কি খেয়ে চোখ বড়বড় করে রোবটের মত অনুভুতিশুন্য হয়ে ফিরলাম তার দিকে।বিষ্ফোরিত চোখে তাকালাম তার দিকে।তার কোন ভাবান্তর নেই।মানে লজ্জা পাবে বুড়ি।তার ছিটে ফোটাও নেই।মানে! এত ভয়ংকর কথা এক লহমায় সে কি করে গড়গড় করে বলে দিল।সে ভাবনায় টাস্কি খাওয়া ভাবটা এড়ালো না আমার।আমি যেন জমে গেছি। এমন কথায়।এই মুহুর্তে কথাটা ঝংকারের ন্যায় কানে বাজছে আমার।রিপিট হয়ে বারবারই বেজে চলছে।” আদর করছে মনে হয়।চুমু খাইছে নাকি!”
এই মুহূর্তে আমার কাছে পৃথিবীর সবথেকে অশ্লীল কথা বলে মনে হচ্ছে এটা।আমি স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে থাকাতে দিদুন কপালে বিরক্তি প্রকাশ করে বললো,

— কিরে বুড়ি কি হইছে তোর? জ্বিনে টিনে ধরলো নাকি।নড়ছ না ক্যান!

#চলবে…..

তুমি নামক যন্ত্রণা পর্ব-১২

0

#তুমি নামক যন্ত্রণা
#লেখনীতেঃহৃদিতা_ইসলাম_কথা
পর্বঃ১২

–অধিকার চাই তোর তাই তো!

বলেই আমার দিকে দুপা এগিয়ে এলো স্রোত । আমি শুকনো ঢোক গিলে দুপা পিছিয়ে যেতে যেতেই উনি আবারো স্বাভাবিক ভাবেই বললেন,

— পাবি তুই তোর অধিকার। তার আগে…. (কিছুক্ষণ চুপ থেকে)
আমি আমার অধিকারটুকু বুঝে নেই।

উনার এই শান্ত শীতল কন্ঠের ভয়ংকর অস্বাভাবিক কথাটা কর্নপথে প্রবেশ করতেই পুরো শরীর হিম হডে এলো।স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। ততক্ষণে স্রোত আমার একদম কাছে এসে দাড়িয়েছে।আমি নিস্তব্ধতা কাটিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় শুধালাম,

— মা্ মানে…

— মানে!
উনার বলার সাথে সাথেই বেডের সাথে পা বেজে একবারে বিছানার উপর ধপাশ করে পড়লাম আমি।উনি আমার উপর অনেকটা ঝুকে একেবারে আমার মুখের কাছে তার মুখ নিয়ে আসতে ভয়ে চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে ফেলি।উনি আমার কানের কাছে মুখ এনে ধীর কন্ঠে ফিসফিসিয়ে বলে,

— স্বামী হিসেবে আমারও তো আমার স্ত্রীর উপর কিছু অধিকার আছে।আমি আমারটা বুঝে নেই তারপর নাহয়….

এর থেকে বেশি কিছু শোনার সাধ্য ছিল না আমার।মেরুদণ্ড দিয়ে এক শীতল হাওয়া প্রবাহিত হলো।শিহরন বইলো শরীর মন জুড়ে।সাথেই মনের মাঝে ভয়ও ঝেকে ধরলো।মানে… উনি চাইছেন টা কি আসলে….তাহলে কি উনি! ছিঃ ছিঃ ভাবতেও কেমন লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে।

কথার ভয়ার্ত মুখ দেখে ভিষন মজা পাচ্ছে স্রোত।ঠোঁট টিপে নিজের হাসি আটকানোর চেষ্টা করলো।মায়াবি মুখটিতে তাকিয়ে মনে মনেই বিড়বিড় করলো,

— এ কোন মায়ায় জড়ালে আমায় মায়াবতী! আমকর চারপাশ যে তুমি হীনা শুন্য! ভিষন অসহায়!নিঃস্ব আমি! ইচ্ছে করে পলকহীন ওই মায়াবি মুখশ্রীতে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকি।এ দেখাতেই জনম জনম পার করে দেই।তবুও তো ক্লান্ত হবে না আমি আঁখি জোড়া।

কথার ওই ভয় পাওয়া মায়াবী মুখের আদলে হারিয়ে যাওয়ার আগেই নিজেকে সামলে নিল স্রোত।প্রেয়সীর কপালে ভালোবাসার স্নিগ্ধ মায়াময় পরশ একে দেওয়ার তীব্র ইচ্ছেকেও সংযত করলো । আচমকাই চোখ চলে গেল কথার গলার নিচে বুকের উপরে কুচকুচে কালো তিলটার দিকে। সেখানে চোখ যেতেই কোন এক নেশায় নেশাগ্রস্ত হয়ে গেল স্রোত।নেশাক্ত চাহনিতে কিছু মুহুর্তের চাহনির পরই ঘোর কাটলো ওর।নিজেকে ধাতস্থ করে যতদ্রুত সম্ভব উঠে এলো কথার উপর থেকে। একপ্রকার হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।কিছু মুহূর্তের জন্যে হলেও কথাকে কাছে পেতে ইচ্ছে করছিলো।কিন্তু ও তো শুধুমাত্র কথাকে ভয় দেখাবে বলেই এসব কিছু বলেছিল তবে।নাহ! নিজেকে সংযত করতে হবে! পাগলামি করলে চলবে না! ওর সাথে আমিও অবুঝ হতে পারি না! আমার ছোট্ট একটা ভুলের জন্য ওর সুন্দর জীবনটা বিষিয়ে তুলতে পারি না।আমি জানি কথা আমাকে ভালোবাসে না।ভালোবেসে এই বিয়েতে রাজি হইনি।শুধুমাত্র দিদুন আর কাকাইয়ের জন্য এই বিয়েতে রাজি হয়েছে ও।আমি এভাবে ওর জীবন থেকে ওর স্বাচ্ছন্দ্য কেড়ে নিতে পারিনা।ওকে মুক্ত করে দেব। এই বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধন থেকে।

এসব ভাবনার মাঝে বিভোর থেকেই সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো স্রোত।আর আমি কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পরও কোন কিছু না ঘটাতেই আস্তে আস্তে চোখ মেলে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করি।যেইনা একটু চোখ খুলে স্রোতকে দেখতে পেলাম না।অমনি ফট করে চক্ষু যুগল খুলে গেল নিস্ক্রিয় ভাবে।সামনে উনাকে না দেখে অবাক হলাম।

— কোথায় চলে গেলো রে বাবা…..!ধ্যাত, উনাকে আমি জব্দ করতে চেয়েছিলাম।উল্টো উনি আমাকে জব্দ করে চলে গেল।

কথাগুলো বলেই মুখ দিয়ে বিরক্তিকর শব্দ করলো।ওর এখন ভিষন বিরক্ত লাগছে।নিজের উপরই। ওই মানুষটাকে এত ভয় পেলে চলবে! কই সাহস করে বাঘিনীর মত এসেছিল তাকে ভয় দেখাবে আশ্চর্য করবে তা না উল্টো ওর প্ল্যানে জল ঢেলে দিল পাজি লোকটা।

.
আমাদের বিয়ে হয়েছে আজ দুদিন হতে চললো।তবে এ ঘটনা কারো মনে ভাবান্তর সৃষ্টি করলো না।সবাইকে দিদুনকে নিয়ে ব্যস্ত।আমি আর স্রোত ও।সিদ্ধান্ত নিয়েছি সে এখন আমার স্বামী তাই তাকে ভাই বলার মত দুর্দান্ত পাপ আমি ইহকালে করতে পারি না।এমনিতেও তাকে ভাই বলে ডেকেছি কতবার ঠিক মনে নেই।হাতে গোনা চার পাঁচ বার হবে।আর সবসময়ই তার থেকে দুরত্ব বজায় রেখেছি।আজ এই দুরত্বই আমার কাল হলো।এতদিন সে এই দুরত্বের আগুনে পুড়েছে আর আজ আমি পুড়ছি।সেদিন তার অনুভুতির বহিঃপ্রকাশ হওয়ার পর থেকেই মন শুধু তার কথাই বলে, তার কথাই ভাবে,সারাক্ষন প্রতি মুহুর্ত শুধু তাকেই দেখতে উদগ্রীব হয়ে থাকে আমার দুটি নয়ন।যখন যেখানেই দেখি অপলকে দেখতে থাকি।আশেপাশে কি হচ্ছে ভুলে তাতে মগ্ন হয়ে পড়ি।বেহায়া চোখদুটো বাধা মানে না।নিজেদের সীমা ছাড়িয়েই যায়।এভাবেই একবার তিশা আপুর চোখে পড়েছিল।তাকে মুগ্ধ নয়নে দুচোখ ভরে দেখছিলাম।ঠিক তখনই আপু বলে ওঠে,

— আমার ভোলাভালা ভাইটাকে এভাবে চোখ দিয়েই গিলে খাবি।

তার এমন লজ্জাজনক কথায় ভিষন অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিলাম আমি।ভিষন অস্থিরতায় ছুটে পালিয়েছিলাম।তবে আজ আপুর চোখে আমার জন্য অজস্র ভালোবাসা, স্নেহ আর মায়া দেখতে পেলাম যা সেদিন ছিল না।তবে বেশ ভালো লাগছে আমার।এ দুদিন উনার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছি, উনার কাছে যাওয়ারও চেষ্টা করেছি।তবে উনি সবসময় ইগনোর করেছেন আমাকে।রাগ হচ্ছিলো খুব।ইগোতে বাধছিল তার একাই কি রাগ আছে নাকি! আমারও আছে আমি এত অপমান সহ্য করবো না! আমি তো পরনারী নই তার স্ত্রী আমি।এতোটা হেলা করার কোন মানেই হয় না চোখের পলকে তুলতুলে নরম মনটা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।ভিষন তেজে জ্বলে উঠে তার ঘরে যেতেই দেখলাম কেউ নেই।আমি এদিক ওদিক হাটাহাটি করে এটা ওটা ঠিক করছিলাম।আগ্রাসী স্রোতকে জব্দ করার তীব্র ইচ্ছেকে মনের মধ্যে লালন করে এক প্রকার উচ্ছলিত হয়েই এসেছি এ ঘরে।
কারন আমি জানতো একটু পরে এ ঘরেই আসবে স্রোত।তাই আগেই এখানে ঘাপটি মেরে বসে রইলাম।আমার খুটিনাটি নেড়ে চেড়ে দেখার মাঝেই ঘরে ঢুকলেন উনি।দৃষ্টি ফোনের মাঝে নিবন্ধ।তার আশেপাশে কে আছে? কি হচ্ছে? কিছুই তার দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না।মনে হচ্ছে একেবারে ফোনের মধ্যে ঢুকে যাবে।আমি তার সামনে গিয়ে দাড়ালাম।তবে তার ভাবনন্তর নেই।মনে হচ্ছে তিনি আমাকে দেখতেই পান নি।দেখবেন কি করে ফোনের মধ্যেই তো ঢুকে আছে।রাগ হলো আমার। প্রচন্ড রাগ! রাগটা যেন তার এই অবহেলায় আরো তিরতির করে বাড়তে লাগলো।চোখমুখ শক্ত করে তাকে কিছু বলতে যাবো।তিনি চোখ তুলে না তাকিয়েই বললেন,

— এখানে কি?

— এখানে কি আবার? এখানে আসা যাবে না।

— না! আসা যাবে না!আমার পার্সোনাল স্পেসে আমি কাউকে এলাউ করি না। গো গেট লস্ট ফ্রম হেয়ার!

অপমানে রি রি করে উঠলো শরীর।রাগে গা কাঁপতে শুরু করলো অস্বাভাবিকভাবে।রাগ,ক্ষোভ আর অপমানে চোখ ছলছল হয়ে উঠলো।তিনি এখনও একবারের জন্যও তাকায়নি আমার দিকে।আমি মুহুর্তেই নিজেকে শক্ত করে নিলাম।দুর্বল হলে চলবে না! হাল ছাড়া যাবে না! আমার ভুলের মাশুল গুনতে হচ্ছে আমাকে!তাই যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা কররাম।

— কোথাও যাবো না আমি! এখানেই থাকবো।এটা এখন থেকে আমারও ঘর ভুলে যাবেন।আর আপনার পার্সোনাল স্পেস বলতে আমি।কারন আমি এখন আপনার সাথে জরিয়ে সেটা ভুলে যাবেন না।

তিনি ফোনটা পকেটে পুরে বুকে দুহাত গুজে সরু চোখে তাকিয়ে বললো,
— কি বলতে চাইছিস তুই

— বলতে চাইছি না করতে চাইছি।আমার অধিকার বুঝে নিতে চাইছি।বিয়েটা আপনার ইচ্ছেতে হোক বা না হোক তা জানার আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নাই। আমাকে এভাবে ইগনোর করতে পারেন না।আর নাই বা অপমান করতে পারেন।আমি আপনার স্ত্রী।আপনার উপর, আপনার ঘরের উপর, আপনার সবকিছুর উপর একমাত্র আমার অধিকার আর কারো নয়। একথাটা মাথায় রাখবেন।

— তুই তোর অধিকার আদায় করতে চাইছিস?

সন্দিহান কন্ঠে প্রশ্ন করেন।আমি মাথা ঝাকিয়ে জবাব দেই।

— হু।

তারপরই তার সেই ভয়াবহ উক্তি যা শোনা মাত্রই কান গরম হয়ে গিয়েছিল আমার।তবে এত সবকিছুর মাঝে আপনাকে একটা কথা ভিষন ভাবাচ্ছে, যেখানে উনি আমাকে এতটা ভালোবাসেন সেখানে হঠাৎ উনি কেন আমাকে নিজের থেকে দুরে রাখছেন অবহেলা করছেন।কারন কি? কিছুই বুঝতে পারছি না।মাথা ব্যাথা করছে উল্টো। সকালেই দিদুনকে রিলিজ করেছে।সারাদিন তার সাথেই সময় কাটিয়েছে।দিদুনই বলেছে তার মান ভাঙাতে। স্বামীরা রাগ করলে স্ত্রীদের উচিত তাদের মানিয়ে নেওয়া।সেই চেষ্টাতেই এতসব কিছু করা।কিন্তু তিনি তো কোনকিছুকেই গুরুত্ব দিলেন না।শুধু কিছু ভয়ানক অসভ্য কথা বলে গেলেন।হুট করেই কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে।দুহাতে মুখ ডেকে নিলাম।সত্যি ভিষন লজ্জাজনক কথা। তবে লোকটা লাগামহীন বেপরোয়া মানুষ।এত ভয়ংকর কথা অকপটে বলে ফেললেন কেমন।একটু বাধলোও না।হঠাৎ অনুভব হলো মাথা ব্যাথা একটু বেশিই হচ্ছে।তাই ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।উনার ঘরেই। উনার বিছানায়।

রাত বারোটা। চারপাশের সবকিছু নিরব নিস্তব্ধ।রাতের এই নিস্তব্ধতায় নিজেকে মিশিয়ে নিতেই এসেছে ও। নিজের সাথে! একান্তই নিজের সাথে একা কিছুটা সময় পার করবে বলে দুরের একটা পাহাড়ে এসেছে ও।পাহাড়টা ওতোটা উঁচু নয় আর।লোকালয়ের থেকে তেমন দুরেও নয়।এখান থেকে প্রায় আধঘন্টা পরই মুল সড়ক।যখন ও এখানে আসে তখন রাত ১০ টা। তবে কোন জনমানব ছিল না।একটা সিগারেট নিয়ে তাতে আগুন ধরালো।সিগারেটে সুখটান দিতে দিতে ভাবলো কি করছে ও! কেন করছে? এরকমটা করা কি খুব দরকার! মেয়েটা হয়তো কষ্ট পেয়েছে! বাচ্চা মেয়ে ওর অনুভূতিগুলোর প্রকাশ না করার ফল ভোগ করেছে ও।এখানে ওর তো কোন দোষ নেই।ওর রাগের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই যার ফলে ভয় পেয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল ও! তবে ও তো স্রোতকে ঘৃনা করে! আসলে কি তাই করে! নাকি এসব ও ভাবছে! যদি ঘৃনা করে তবে চুপচাপ বিয়েটা কেন করলো? ছোট আব্বুকে কেন বললো না ও আমাকে বিয়ে করতে পারবে না। পছন্দ করে না ও আমাকে।ছোট আব্বু তো ভিষন ভালোবাসে ওকে।একবার বললে নিশ্চয় ওর কথা শুনতো। হতোনা এই বিয়েটা!দিদুনের জন্য করেছে এই বিয়েটা! হ্যাঁ, হবে হয়তো! ও তো দিদুনকে খুব ভালোবাসে তাই হয়তে দিদুনের কথা ভেবে স্ক্রাক্রিফাইজ করলো ও।ও তো চলেই গিয়েছিল কথার জীবন থেকে। আর কখনো ফিরবে না।ওকে বিরক্ত করবে না বলেই তো সেদিনের রাতের পর আর ওর কাছে যাওয়ার কথা মাথায় আনেনি।ওর থেকে দুরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

রেজিস্ট্র পেপারে সাইন করার পর থেকে কেমন পাল্টে গেছে কথা।অদ্ভুত সব আচরন করছে।ওর সাথে যেচে কথা বলতে চাইছে।যে মেয়ে কিনা আদোতে ওর সামনে কখনো আসতো সে ওর কাছে ঘেষতে চাইছি।অবশ্য সেদিন হসপিটাল থেকে বাড়ি ফেরার পরেই কিছু বলতে চাইছিলো ও।কিন্তু স্রোত শোনেনি।উপেক্ষা করেছে।নিজের সিদ্ধান্তর অটল থেকেছে।তবে আজকাল বড্ড বেশি জ্বালাতন করছে মেয়েটা।সারাক্ষন চোখের সামনে ঘুরঘুর করছে।আজতো ওর ভাবনার সম্পুর্ন বিপরীতে কাজ করেছে।ওর ই ঘরে ঢুকে ওকে শাসাচ্ছে, ওর সাথে জোর গলায় কথা বলছে,নিজের অধিকার চাইছে! হলো কি হঠাৎ তরে ওর? তাহলে কি ও সম্পর্কটাকে এগিয়ে নিতে চাইছে।সেচ্ছায় নাকি পরিবার আর দিদুনের সুস্থতার কথা চিন্তা করে।আর ভাবতে পারছে না স্রোত কেমন গুলিয়ে যাচ্ছর এলোমেলো হচ্ছে চারিপাশ।ও সিগারেটটা শেষ করে ঘাসের উপর ধপাস করে শুয়ে পড়লো।দুরে কোথাও জোনাকির ঝাঁকের ঝলমল করা আলো দেখা যাচ্ছে। তবে তা স্পষ্ট নয়।আকাশে বড় থালার মতো উজ্জ্বল চন্দ্র।জোস্নাৎর আলোয় আলোকিত ভুবন।চারদিকে মৃদু মন্দ শীতল বাতাস বারবার গা ছুয়ে দিচ্ছে।মনের মাঝের বিষন্নতারা হারিয়ে গেল ওই ঘন কালো আধারের মাঝে৷ প্রায় অনেক্ষন সময় অতিবাহিত হওয়ার পর উঠে চলে ওলো ও।রাত প্রায় ১ টার কাছাকাছি সময়।বাড়ি ফেরা উচিত বলেই স্থান ত্যাগ করলো ও।

মাঝে মাঝে বড্ড আফসোস হয় স্রোতের কেন ও নিজের অনুভুতি প্রকাশ করতে পারে না।ভিতরটা কাউকে দেখাতে বা বোঝাতে না পারলেও প্রিয় মানুষগুলো ওর কষ্টটা ঠিক আন্দাজ করতে পেরেছে।স্রোত জানে দিদুন কেন এভাবে ওদের বিয়েটা দিল।দিদুন তো সবটাই জানতো।এই একটা মানুষকে স্রোত নিজের মনের সব কথা বলে।দিদুন ও চাইতো কথা যেন স্রোতকে ভালোবাসে।তবে কথার স্রোতকে এড়িয়ে চলা।অবহেরা অবমাননা এসব কিছুর ফলে স্রোতের মনের মাঝে যে কষ্ট জমেছে তার আন্দাজ তিনিও কিছুটা করেছিলেন।কারন তিনিও লক্ষ করতেন স্রোত এ বাড়িতে আসলে কথা দরজা বন্ধ করে রাখে।ঘর থেকে বেরোয় না।ওর সামনে আসে না।যখন ও না থাকে তখন সবার সাথে হেসেখেলে আনন্দ করে।যতক্ষণ স্রোত বাড়ির বাইরে ততক্ষণই কথার আচরন স্বাভাবিক থাকে।তিনি ভেবেছিলেন হয়তো লজ্জায় কথা স্রোতের মুখোমুখি হদে চাই না।তাই তিনি বেশি ঘাটেন নাই কিন্তু কিছুদিন ধরেই উনার কোনকিছু ঠিক মনে হচ্ছিল না।স্রোতের মন মেজাজ ভালো দেখতে না।কেমন যেন এলোমেলো আর অগোছালো লাগতো ওকে।স্রোত কথাকে নিয়ে ওর মনের সুপ্ত অনুভুতিগুলো নিয়ে কখনো কারো সাথে খোলামেলা আলোচনা করেন নি।এমনকি বন্ধুরা কেউ জানে না ওর মনে পুষে রাখা কথার জন্য ওর তীব্র ভালোবামার কথা! ওর শ্যামাঙ্গীনির ওকে অবহেলায় ওর বুকের মাঝে তিলে তিলে গড়ে ওঠা কষ্টের কথা।তার থেকে দুরত্বে থেকে সেই দুরত্বের আগুনে পুড়ে একটু একটু করে ছাই হওয়ার কথা! কাউকে বলতে পারেনি ও! তবে যেদিন দিদুন ওকে চেপে ধরেছিল সেদিন স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল।কারন ওর শ্যামাঙ্গিনীকে ওর ভাবনাগুলোকে ও অন্যকারো কাছে প্রকাশ করতে চাইনি।ও চেয়েছিল ওর ভাবনায় ওর শ্যামাঙ্গিনীর সৌন্দর্য তার রুপ লাবণ্য তার লজ্জা রাঙা রুপ।যাকে ও কল্পনায় সাজিয়েছে তাকে ওর ভাবনার প্রেক্ষিতে ওর বর্ননায় অন্য কেউ দেখুক! ওর শ্যামাঙ্গিনী কেবল ওর! তাকে নিয়ে ভাবার অধিকারও কেবল ওর! কল্পনা করার অধিকারও ওর! আর কারোর নেই! কারোর না!

ওদের মাঝে আসলে কি চলছে মান অভিমান নাকি অন্যকিছু সেটা জানার উদ্দেশ্যেই সেদিন কথার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলেন । তবে সেদিন রাতে যখন কথাকে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে নিজের ঘরের দরজা দিতে দেখেছিল সেদিন তিনি বুঝেছিলেন।নিশ্চয় কিছু হয়েছে। ছাদে তখন স্রোত একাই মেঝেতে হাঁটু মুড়ে কাঁদতে কাঁদতে নিজের অব্যক্ত অনুভূতিকে ব্যক্ত করছিলো তখনই সবটা বুঝতে পারেন তিনি।তাই তো এভাবেই ওদের বিয়েটা দেন উনি।স্রোত আর কথা দুজনকেই ভিষন ভালোবাসেন তিনি।তাদের জীবনের এই বিপর্যয় তাও আবার একে অপরকে কেন্দ্র করে মানতে পারেন নি উনি।কষ্টগুলো ভিতর ভিতর আরো পীড়া দিচ্ছিলো।কি করবেন? কি করে এদেরকে এক করবেন এই দুশ্চিন্তা ঘীরে ধরেছিল তাকে।স্রোতের অবস্থা তো দিনদিন বেগতিক হচ্ছে।এভাবে ছেলেটাকে কষ্টে দেখতে পারছেন না উনি।এত শত চিন্তা হতাশা আর অস্থিরতার ফলে তার শারীরিক অবস্থা বেগতিক হয়। যার দরুন তিনি হার্ট অ্যাটাকের শিকার হন।তবে তা ততোটা প্রানঘাতি ছিল না বিধায় এ যাত্রায় বেঁচে গেছেন উনি।তবে বয়স হয়েছে উনার কখন আল্লাহ তাকে ডেকে নিবেন জানা নেই।তাই এদুটোর চারহাত এক করে দিতে চেয়েছিলেন।যাতে জীবিত থাকা অবস্থায় অন্তত ওদের সুখে দেখতে পারেন।কারন এক সাথে থাকলে আর পবিত্র সম্পর্কের জোরে ওদের মাঝের মান অভিমান শেষ হবে।

রাত প্রায় দুটো।বাড়ি ফিরে সোজা নিজের ঘরে এলো ও।ঘরে এসেই চমকে গেল।বিষ্ফোরিত নয়নে…..

# চলবে……

তুমি নামক যন্ত্রনা পর্ব-১১

0

#তুমি নামক যন্ত্রনা
#লেখনীতেঃহৃদিতা ইসলাম কথা
পর্বঃ১১

শুধুমাত্র দুটো সাক্ষরের মাধ্যমে বিয়ের মত এক পবিত্র বন্ধনে আবব্ধ হলাম আমরা।দিদুনের ইচ্ছেকে সম্মান জানিয়ে উকিল,দিদুন, বড় আব্বু আর আব্বুর উপস্থিতিতে বিয়ে সম্পন্ন হলো আমাদের।রেজিষ্ট্রি পেপারটি প্রথমেই দেয়া হলো আমার হাতে।একপলক সামনের মানুষটির মুখের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ সাইন করে এগিয়ে দিলাম।উনি পেপারে সাইন করেই একমুহূর্ত বিলম্ব না করেই গটগট পায়ে বেরিয়ে গেলেন।আমি সবার অগোচরে একটা ছোট্ট শ্বাস ফেললাম।জানি তার অভিমানের পাল্লা ভারি।তবে তা আমি আমার ভালোবাসার আদলে মুড়িয়ে দেব।নিজের জমিয়ে রাখা সবটুকো ভালোবাসায় শুধু তার অধিকার হবে।আমার ভালোবাসার স্পর্শে তার অভিমান, অভিযোগকে মুছে দেব।তার এহেন আচরনে বড় আব্বু মনঃক্ষুণ্ন হলেন।আব্বু কিছু না বলেই চুপচাপ রইলেন।আমি দিদুনের কাছে গিয়ে বসলাম তার হাত দুটো আকড়ে ধরে।দিদুন অপরহাতে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বললেন,

— স্বামী সোহাগী হবি তুই। অনেক সুখী হবি।
দিদুনের করা আশির্বাদে আমি লজ্জা পেলাম। লজ্জায় নুইয়ে গেলাম।ইতোমধ্যে বাবা আর বড় আব্বু উকিলের সাথে বাইরে বেরিয়ে গেছে কিছুক্ষন আগেই।দিদুন এবার আমার হাতের উপর হাত রেখে বললো,

— ওর অভিমান শুধু তুই ভাঙাতে পারবি।খুব অভিমানী ও।পারবি ওকে আগলে রাখতে সামলে রাখতে।তোর চঞ্চলতায়, প্রাণোচ্ছলতায় আবার ভরিয়ে তুলবি ওকে।তোর ভালোবাসায় মুড়িয়ে দিবি ওকে।যেন এতদিনের দুরত্বে জ্বলতে থাকা পুড়তে থাকা হৃদয় প্রেমের বর্ষনে সিক্ত হতে পারে।শীতলতা ছড়িয়ে দিবি ওর অনলে দগ্ধ হওয়া মনটাকে।পারবি না বল! আমি জানি তুই! একমাত্র তুই – ই পারবি।

আমি বেশ অবাক হলাম।তারমানে কি দিদুনও জানে উনার অবাধ্য, অব্যক্ত, অপ্রকাশিত অনুভুতির কথা।হবে হয়তো! তাইতো সে তার হৃদডে জ্বলতে থাকা যন্ত্রনার কথা জানে।আমি কিছুক্ষন ভাবনায় মগ্ন রইলাম।দিদুন অন্যহাতে হাত চেপে ধরে বললেন,

— কি হল বল? পারবিনা তুই?

আমি ভাবনা থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলাম।তার পর ঠোটের কোনে মুচকি হাসি বিদ্যামান রেখে চোখের পলক ফেলে আমি তাকে আশ্বাস দিলাম। মনে মনে ভাবলাম।”হ্যাঁ,পারবো আমি! আমাকে পারতেই হবে!তার দগ্ধ হৃদয়কে শীতল স্রোতের জোয়ারে ভাসাবো! ভরে দেব যত ক্ষত।আমার ভালোবাসার স্পর্শে।মুড়িয়ে দেব সকল সুখ।গুচিয়ে দেব সকল দুঃখ”

মুখে বললাম,
— চিন্তা করো না দিদুন! সব ঠিক হয়ে যাবে।

দিদুন তৃপ্তির হাসি হাসলেন।তার হাসিতে যেন মুক্ত ঝড়ে।বুড়ি এককালে ভিষন সুন্দরী ও মায়াময়ী ছিলেন।তার রেশ এখনো কাটেনি।হঠাৎ হঠাৎ তার রুপ লাবণ্য উকি দেয়। তার অদ্ভুত সুন্দর হাসিতে।আচ্ছা সুন্দর মনের মানুষগুলোর হাসিও বুঝি সুন্দর।এত ভাবনার মাঝেই মনটা খারাপ ভিষন খারাপ।মিথ্যে হাসির আড়ালে মন খারাপটা লুকিয়ে রাখতে চাইলেও পারছিনা।হুট করেই বিষন্নতায় ছেয়ে গেল অবুঝ মনটা।নার্স এসে বললেন,

— আপনি একটু বাইরে যান।এখন উনার রেস্টের প্রয়োজন।

আমি দিদুনকে একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে চলে এলাম কেবিনের বাইরে।আমার দুচোখ শুধুই আমার প্রিয় মানুষটিকে খুঁজছে। আমি জানি সে বড্ড অভিমানী। আমার সাথে বড্ড অভিমান তার।সবটাুকো মানলেও একটা বিষয়ে আমি ভিষন কষ্ট পেয়েছি। দুঘন্টার আগের কথা,,,
বাড়ি পৌছেতেই স্রোত ভাই গটগট পায়ে উপরে চলে যান।আমাকে কথা বলার সুযোগ দেন না।গাড়িতে কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করেছি তখনও ইগনোর করেছে উনি আমায়।ভিষন জোরে রেডিও চালিযে দিয়েছিল।কান ঝালাপালা হওয়ার জোগার।আচ্ছা উনি কি বোঝেন না আমার মনের কথা। উনার চোখে কি আটকায় না আমার করুন নিঃস্ব অসহায় চাহনি।আমার অনুতপ্ত মনের ব্যাথা কি তার হৃদয়কে ব্যথিত করেন না।আমি তপ্ত শ্বাস ফেলে ব্যথিত হৃদয় নিয়ে উপরে চলে এলাম।মন খারাপের রেশ নিয়েই ফ্রেশ হতেই ক্লান্তিতে চোখ বুজে এলো আমার।অনেক বেশি কান্না করলে মাইগ্রেনের ব্যাথাটা তীব্রভাবে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।মস্তিষ্ক ঝাঝড়া করার মত মাথা ব্যাথা। ব্যাথায় মাথার সবগুলো রগ দপদপ করে উঠলো।মেডিসিন নিয়ে শরীরটা এলিয়ে দিতেই রাজ্যের ঘুম নেমে এলো চোখে।ঘুমিয়ে পড়লাম চোখের পলকে।ঘুম ভাঙল আব্বুর মায়াময় কন্ঠে আম্মু বলে ডেকে ওঠাতে।ঘুমের মাঝেই টের পাচ্ছিলাম।আব্বু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।ঘুমের মাঝেই মুচকি হাসলাম।আব্বুর দুবার ডেকে ওঠাতেই পিটপিটিয়ে চোখ খোলার চেষ্টা করলাম।ঘুমে জুবুথুবু আমি।তারপরও চোখ খুলে মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিলাম।আব্বু আলতো হাসলেন।আমি উঠে বসলাম।আমি আদুরে কন্ঠে শুধালেন,

— ঘুম হয়েছে আমার আম্মুর?

— হু আব্বু।তুমি কখন এলে?আর দিদুন এখন কেমন আছে?

— আলহামদুলিল্লাহ ভালো আম্মু।তুমি একটু ফ্রেশ হয়ে এসো।আব্বু কিছু জরুরি কথা বলবো।

আমি বুঝতে না পেরে কপাল কুচকে চাইলাম।আব্বুকে প্রশ্ন করলাম,

— কি জরুরি কথা আব্বু?

— আগে তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো বলছি।

— ঠিকাছে।তুমি পাঁচ মিনিট বসো আমি দশ মিনিটে আসছি।

বলেই উঠে চলে গেলাম ফ্রেশ হতে।ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আব্বুর কাছে আসতেই আব্বু বিনয়ী স্বরে বললো,

— তোমার কাছে আজ আব্বু কিছু চাইবো দিবে আমায়?

— আব্বুর হঠাৎ এরকম প্রশ্নে চমকে উঠলাম আমি।বুঝতে পারলাম না কি এমন চাইবে আব্বু যে এভাবে অনুমতি চাইছে!আমি চমকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষনের জন্য আব্বুর নিমীলিত মুখ পানে।তারপর আব্বুর হাত ধরে বললাম,

— এভাবে বলো না আব্বু। আমার ভিষন কষ্ট হয়।

— আচ্ছা বলবোনা! তুমি আমাকে বলো তো আম্মু তোমার জীবনে কেউ আছে? তুমি কি কাউকে পছন্দ করো।যদি এমন কেউ থেকে থাকে তবে নিসংকোচে আমাকে বলতে পারো।আব্বু তো তোমার বন্ধু তাই না।

আব্বুর আচমকা কাউকে আমার জীবনে থাকার কাউকে পছন্দ করার বিষয়ে জিজ্ঞেস করায় কিছু নয় বেশ অনেকটাই অবাক হলাম।কারন এখনো অবধি এ বিষয়ে কখনো কথা হয়নি আমাদের।আমি চুপ থেকে মাথা নাড়ালাম।আব্বু তার জবাব পেয়ে গেলেন।তারপর সবচেয়ে অবাক করা এক কথা বলে ফেললেন।আমি তাতে খুশি হবো নাকি অবাক হবো বুঝতে পারছিলাম না।

— স্রোত আর তোমার বিয়ে দিতে চায় তোমার দিদুন।আমি আর ভাইয়াও তাতে একমত।আমাদের কোন সমস্যা নেই।তোমার কি এই বিয়েতে মত আছে?

বিস্ফোরিত হলো চক্ষুযুগল।আব্বুর করা প্রশ্নে আকাশসম বিস্ময় নিয়ে আব্বুর মুখপানে নিরুত্তর স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষন আটকে ছিলাম।পরপরই শুন্য মস্তিষ্ক নাড়া দিল আমায়।আব্বু আমার হাত দুটো আকড়ে ধরায় ঘোর কাটল।তিনি করুন চাহনি নিয়ে ভেজা কন্ঠে বললেন,

— না করো না আম্মু।আমি জানি তুমি তোমার দিদুনকে খুব ভালোবাসো।আব্বুর জন্য না হলেও দিদুনের জন্য মেনে নাও। ডক্টর কি বলেছে তুমি তো শুনেছো, তাকে এখন কোন রকম স্ট্রেস দেওয়া যাবে না।

একটু থেমে তারপর আবার বললেন,

— আর মা চাইছেন আজ আর এখুনি তোমার আর স্রোতের বিয়েটা দিতে।যাতে তিনি বেঁচে থাকতে তোমাদের দুজনকে একসাথে দেখতে পায়। তুমি তো জানোই তোমার বড় আব্বু সহ তার পরিবার তোমাকে কতটা ভালোবাসে! তারাও চায় তোমাকে নিজের কাছে রাখতে।আমি কখনো চাইনি আমার মতামত তোমার উপর চাপিয়ে দিতে।চেয়েছি তুমি নিজের লেখাপড়া শেষ করে নিজের একটা পরিচয় তৈরি কর।তবে এই বিয়েটা তোমার উপর প্রভাব পড়বে না তুমি চাইলে স্বাধীনভাবে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে পারো।আমি সবসময় তোমাকে বেস্টটাই দিতে চেয়েছি।আর আমার মতে স্রোতের থেকে ভালো জীবন সঙ্গী আমি হাজার খুঁজলেও পাবো না।তাই আমার মনে হয় স্রোতই তোমার জন্য বেস্ট।

আমি চুপ করে শুধুই শুনছি।তবে কি বলবো বুঝতে পারছি না।তাই চুপ করেই আছি।আব্বু আবারো বললো,

— তবে তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমি আমার মতামত চাপিয়ে দিতে চাই না।তুমি কি বলো?

আমি এবারো চুপ রইলাম ।আমি জানি আব্বুকে আমাকে ভিষন ভিষন ভালোবাসেন।তিনি সবসময় আমাকে বেস্টাটাই দিতে চেয়েছেন।আজও সেটাই চাইছেন।আমিও জানি তিনিই আমার জন্য বেস্ট।আমিও তো তাকে চাই। একান্তই নিজের করেই চাই।তার প্রতি আমার অনুভুতিগুলোকে এতদিন চিনতে না পারলেও আজ আমি আমার অনুভুতির বহিঃপ্রকাশ করতে চাই।তাকে বোঝাতে চাই শুধু তিনি একাই নয় আমিও তার ভালোবাসা নামক যন্ত্রণার অনলে দগ্ধ। ভয়- ভীতি কাটিয়ে তাকে জানাতে চাই আমার মনের কথা।তাই তার সাথে বিয়ের মতো পবিত্র বন্ধনে আবব্ধ হওয়াতে আমার আপত্তি থাকার কথা নয়।কিছুতেই নয়! মোটেও না! আব্বু আমার মুখপানে ভিষন আশা ভরসা নিয়ে তাকিয়ে রইলেন।আমি এবার গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললাম,

–আমি জানি আব্বু আপনি আমাকে ভিষন ভালোবাসেন।আপনার ভালোবাসায় উপর আঙুল তোলার অধিকার আমি কাউকে দিই না।এমনকি নিজেকেও না।আপনি যা ভালো মনে করেন তাই করবেন আমার এতে কোন আপত্তি নেই।

— আমাকে খুশি করার জন্য বলছে নাকি মন থেকে বলছো?

— মন থেকেই বলছি কারন আমি জানি আমার ভালো থাকায় আপনার ঠিক কতটা ম্যাটার করে।আর আমি আপনাকে কখনো সামান্যতম কষ্ট দিতে চাই না।

মাথা নিচু করেই কথা বলছিলাম। মাথা তুলে আব্বুর দিকে চাইতেই দেখলাম আব্বুর চোখে জল।তিনি সে জল আড়াল করতেই ঘুরে দাড়ালেন।সন্তপর্নে চোখের জল মুছে নিলেন।তবে তা আমার চোখের আড়াল হলো না।আমি জানি আব্বুর চোখের এই জল দুঃখের নয় এ জল আনন্দের। সন্তানের তার প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ তাকে আবেগী করে তুলেছে।সেই আবেগ থেকেই নিরবে ঝড়ছে সে জল।তিনি প্রাপ্তির হাসি হাসলেন।আমার কপালে স্নেহের পরশ একে দিয়ে বললেন,

— তৈরি হয়ে নাও মা।তোমার জীবনের নতুন পদার্পনের জন্য।

আমি মুচকি হেসে তাকে আশ্বাস দিলাম।তিনি খুশিমনে চোখের জল মুছতে মুছতে চলে গেলেন। আমি সত্যি ভিষন খুশি।মনটা আমার আনন্দে আত্মহারা।তবে সেই খুশি বেশিক্ষন বহাল রইলো না।মুহুর্তেই মিলিয়ে গেল।যখন জানতে পারলাম স্রোত ভাইয়া বিয়েতে অমত করছেন তখন আর বলার মত কিছুই রইলো না।ভাষা হারিয়ে ফেললাম।নির্বাক আমি।আব্বুর কথামত আমি নিজেকে গুছিয়ে বেরিয়ে এলাম।আসার সময় বড় আব্বুর ঘরের ভিতর থেকে শুনতে পেলাম তার অবরুদ্ধ কন্ঠস্বর। মুহুর্তেই মনের ভিতর জমে থাকা কষ্টগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।

— আব্বু প্লিজ আমি পারবো না।

— কেন পারবে না স্রোত।কিসের তোমার বাধা? তুমি কথাকে পছন্দ করো না নাকি তাকে বিয়ে করতে চাও না।এখন এটা একদমই বলবে না যে তুমি কথাকে বিয়ে করতে চাও না।কারন আমরা সবাই জানি যে তুমি কথার প্রতি দুর্বল। তুমি আমার ছেলে, যতই তুমি নিজেকে আড়াল রাখার চেষ্টা করো, নিজেকে অপ্রকাশিত রাখো।আমি জানি তুমি কি চাও।তাছাড়া এখানে তোমার বা আমার চাওয়া গুরুত্বপূর্ণ নয় স্রোত।তুমি তোমার দিদুনের কথাটা কেন ভাবছো না।তুমি তো সবটাই জানো।তার ইচ্ছে! তিনি তোমাদের দুজনকে একসাথে দেখতে চায! অন্তত তার কথাটা ভাবো।

— দিদুন আমার জন্য কি সেটা আমিও জানি আর তুমিও। তবে আমি জানি আব্বু দিদুন কেন এসব চাইছে।তবে আমি কথার জীবনটা নষ্ট করতে চাই না। আমার জীবনের সাথে জরিয়ে ওর কাছ থেকে ওর সকল খুশি কেড়ে নিতে চাই না।আমার জন্য বা কারো জন্য ও নিজের সাথে সেক্রিফাইজ করুক আমি চাই না।ওকে ওর মত ভালো থাকতে দাও।ও আমার সাথে সুখি হবে না।এটা বোঝার চেষ্টা করো।

— কে বলেছে তোমাকে এইসব বাজে কথা।আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না। আমি যা বলছি তাই হবে।মায়ের ইচ্ছে আমার কাছে আদেশস্বরুপ।তাই আর কোন কথা না বলে চলে এসো।

আমি দ্রুত দরজা থেকে সরে দাড়ালাম।আড়াল করলাম নিজেকে।তারা বেরিয়ে গেল।আমি হুট করেই কেমন জ্বলে উঠলো।ভিষন রাগ হলো গোমরা মুখোটার উপর।একটু বেশিই বোঝেন উনি।ব্যাটা বজ্জাত হোক না।শুধু একবার বিয়েটা হোক তারপর তোকে বোঝাবো মজা।আমার ভালো আর আমার সুখের চিন্তা করতে তাকে কে বলেছে? আমি বলেছি! আমি আমার সুখ ঠিক খুঁজে নেব।আর তাকে জব্বর শায়েস্তা করবো।রাগী বদমেজাজি রাক্ষস একটা।নিজের অনুভুতি প্রকাশে অপারগ থেকে সবসময় শুধু ধমকা- ধমকা আর রাগ দেখিয়েছে আমার উপর। উজবুক একটা! রাগ না দেখিয়ে নিজের ভালোবাসাটা প্রকাশ করলেও তো পারতো তাহলে তো আর এতকিছু হতো না।একবার হোক বিয়েটা তারপর আমি দেখবো কিভাবে সে আমাকে ইগনোর করে।হুহ! পাজি রাক্ষস!

তারা চলে যাওয়ার পর একা একাই বিড়বিড় করে জোরে জোরে পা ফেলে চলে এলাম।তখন প্রচন্ড রাগ হলেও এখন মনটা কেমন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এসব কিছু আমারই বোকামোর জন্য হচ্ছে ভেবে অনুতপ্ত হলাম আমি।তবে অনুতপ্ত হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিলে চলবে না তার রাগের সামনে আমাকে টিকে থাকতে হবে।তার রাগী চোখমুখ দেখে ভয় পেলে একদম চলবে না।তার অভিমানকে আমার প্রনয়ের স্রোতে ভাসিয়েই ছাড়বো নয়তো আমার নামও কথা নয়।ভেবেই একটু ভাব নিয়ে খোলা চুলগুলোকে পেছনে ঠেলে দিলাম।

# চলবে…..

তুমি নামক যন্ত্রনা পর্ব-১০

0

#তুমি নামক যন্ত্রনা
#লেখনীতেঃ হৃদিতা ইসলাম কথা
পর্বঃ ১০

— আমার এই শেষ যাত্রার শেষ ইচ্ছেটা পুরন কর বাবা!তোদের দুজনের কাছেই আমার অনুরোধ! আমি সবসময় চাইতাম আমার স্রোতের জন্য আমাদের কথাকেই রেখে দিতে।ওকে চোখের আড়াল করতে চাই না।ওকে স্রোতের সাথে বেধে রাখার জন্য হলেও এই বিয়েটা দরকার।

হাসপাতালের বিছানায় শয্যাশায়ী মায়ের মুখে এমন কথা শুনে বেশ অনেকটাই চমকে যায় দুইভাই।তারা হয়তো ভাবে নি এমন একটা বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতে মা এমন কিছু আবদার করে বসবে।
এইতো আজ সকালের ঘটনা,,,,,
স্রোত ভাইয়ার বিরহে ক্লান্ত মন কখন যে নোনাজলে ভাসতে ভাসতে চোখের পাতা ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছে বুঝতে পারিনি।তবে তিশা আপুর চিৎকারে ধরফরিয়ে উঠে বসি।হঠাত তার এমন আর্তনাত তাও আবার দিদুনের ঘর থেকে। যা মুহুর্তের মাঝেই সবকিছু স্থবির করে দিয়েছিল।আমি তৎক্ষনাৎ ছুটে যাই দিদুনের ঘরে।মা আর বড় আম্মু আমার আগেই ছুটে এসেছে।তারা দিদুনের এমন অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেছে।কি করবে বুঝতে পারছে না। অস্থির হয়ে উঠেছে।আম্মু বাবাকে কল করার চেষ্টা করছে।আমি দিদুনের কাছে ছুটে যাই। দিদুন বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস টেনে নিচ্ছে।মনে হচ্ছে তার শ্বাস যেন ফুরিডে আসছে। দম আটকে আসছে।অনেক ঘামতে শুরু করেছে।কিছুই বলতে পারছে না।হাপিয়ে উঠছে। এক পর্যায়ে দেখা গেল দিদুনের শ্বাস ছোট হয়ে আসছে আর চোখ বুজে আসছে। দিদুনের অবস্থায় সবাই কান্নায় ভেসে যাচ্ছে।দিশেহারা হডে দিদুনকে দুহাতে আগলে কান্না ভেজা কন্ঠে তাকে উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করি,

— কোথায় কষ্ট হচ্ছে তোমার দিদুন।কিছু বল দিদুন। কিছু হবে না তোমার। কিচ্ছু হবে না।

এরমাঝেই হন্তদন্ত হয়ে বাবা আর বড় আব্বু ছুটে আসে।তারা বাড়িতেই ফিরছিলো।আম্মুর ফোন পেয়ে দিশেহারা হয়ে যায়। দিকবেদিক না ভেবে বাবা এসেই দিদুন পাজোকোলে তুলে নেয়।হসপিটালের উদ্দেশ্য রওনা হয়।পিছন পিছন আমরা সবাই ছুটে আসি। কান্নায় ভেঙে পড়া অবস্থায় আমাকে দুহাতে আগলে রাখে তিশা আপু।তার চোখ ভরা অশ্রু। আম্মু আর বড় আম্মুর চোখের কোনে অশ্রুকনারা ভিড় করেছে।তারাও কেদেছে তবে নিরবে।শাশুড়ি মাকে তার দুই ছেলের বউ ভিষন ভালোবাসে।তিনি যেমন সন্তানের মত ভালোবেসেছেন স্নেহ করেছেন।পুত্রবধুরাও তাকে মায়ের স্থান দিয়েছে।শ্রদ্ধা সম্মান আর ভালোবাসায় ভরিয়ে রেখেছে।বড় আম্মু মাকে সামলে নিচ্ছেন সাথে নিজেকেও।দুজনেরই বাবা মা নেই।শ্বশুড় মশাইকে হারিয়েছেন।বিগত পনেরো বছর আগে।তাই শাশুড়ি মাকেই মায়ের স্থান দিয়েছেন। কষ্ট তো হবেই।বড় আব্বু আর বাবার অবস্থা আরও কাতর তবে হয়তো পুরুষ হওয়ার দরুন।তারা তাদের ভিতরের যন্ত্রনা প্রকাশ করতে পারছে না।আমরা মেয়েরা কেঁদে ভাসিয়ে মন হালকা করি।তারা তো তাও পারে না।দুজনের চোখের জল। বাবা দিদুনকে ভিষন ভালোবাসে। মায়ের এমন অবস্থা সহ্য করতে পারলেন।অবাধ্য অশ্রুকনার দুফোটা টুপ করে গাল বেয়ে গরিয়ে পড়লো।বড় আব্বু ছোট ভাইকে বুকে জরিয়ে ভরসা দিলেন।বড়রা এভাবেই ছোটদের আগলে রাখে।নিজেরা শক্ত থেকে ছোটদের মনে সাহস জোগায়।অথচ তাদের ভিতরেও ঠিক ততটাই কষ্টেরা ভিড় জমিয়ে রাখে।তারা শুধু একটা শক্ত আবরনে আবৃত থাকে। আমাদের বাড়িটি যেন আস্ত একটা স্বপ্ন পুরী।যেখানে সবাই ভিষন খুশি।তবে হঠাৎ করেই এই স্বপ্ন পুরীতে কান্নার রোল পড়ে গেল।বাড়ির সবচেয়ে বয়জেষ্ঠা মানুষটির এমন দুর্ঘটনায় সবাই ভেঙে পড়লো।

ডাক্তার ভিতরে চিকিৎসা করছেন। আমরা সবাই হসপিটালের কড়িডোরে অপেক্ষা করছি।প্রায় একঘন্টা পরে ডাক্তার বাইরে বেরিয়ে এলেন।চট্রগ্রামের একটি প্রাইভেট হসপিটালে এসেছি আমরা।হসপিটালের কার্ডিওলোজি ডিপার্টমেন্টের দায়িত্বরত ডক্টরকে দেখে ছুটে গেলেন বড় আব্বু, বাবা, আমি ও তিশাসহ বাকি সবাই।বড় আব্বু কাতর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

— মায়ের কি অবস্থা ডক্টর?

— মেসিভ হার্ট অ্যাটাক ছিল।অনেক বেশি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ায় হঠাৎ করেই অ্যাটাক হয়।বয়সে হয়েছে উনার বুঝতে হবে।কোন বিষয়েই দুশ্চিন্তা করা তার জন্য ভালো লক্ষন নয়।এই বয়সে অস্থিরতা আর দুশ্চিন্তা প্রান ঝুঁকির কারন হতে পারে।যার ফলে হুট করেই তিনি হার্ট অ্যাটাকের শিকার হন। বাট সি ইজ ফাইন নাও। আপনাদের আরও বেশি যত্নশীল হতে হবে। তিনি যেন কোন বিষয়েই দুশ্চিন্তা না করে মাথায় রাখবেন।

— আমরা কি মায়ের সাথে দেখা করতে পারি ডক্টর?
আব্বু করুন চাহনিতে জিজ্ঞেস করলেন।

ডক্টর আব্বুর কাধে হাত রেখে আশ্বাস দিয়ে বললেন,

— হ্যাঁ,অবশ্যই দেখা করবেন।তবে এখন নয়।এখান ওনার রেস্টের প্রয়োজন।ঘুমের ওষুধ দেয়া হয়েছে ঘুমোচ্ছে উনি।আপনারা পরে দেখা করে নিবেন।এখন
উনাকে বিরক্ত না করাই ভালো।

–আপনাকে ধন্যবাদ ডক্টর।

— প্লিজ ডোন্ট সে থ্যাংক্স! ইট’স মাই ডিউটি।

— উনার টেক কেয়ার করবেন।আপাতত দুদিন ওভজার্ভেশনে রাখার পর ডিসচার্জ করে দেওয়া হবে।

ডক্টরের কথা শুনে সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো।তবে দিদুনের হঠাৎ দুশ্চিন্তার কারন নিয়ে সবাই ভিষন চিন্তিত।ছেলেরা মাকে চেনে।সদা হাসি খুশি প্রানোচ্ছোল তাদের মা কিসের জন্য দুশ্চিন্তায় ভুগবেন।কোন কিছুর অভাব তো নেই।তাছাড়া এমন কোন দুশ্চিন্তার রেখা কখনো চোখেও পড়েনি। মাকে দেখে তো তাদের কখনো মনে হয়নি।

আমরা সবাই বাইরে অপেক্ষা করছি।প্রায় অনেকক্ষন হলো তবে দিদুনের কক্ষে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া গেল না।এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন স্রোত ভাই।তিনি এসেই বড় আব্বুকে জিজ্হেস করলেন দিদুনের অবস্থার কথা।বড় আব্বুকে তাকে সব কিছু বললে তিনি কিছুটা শান্ত হন।এতক্ষন ভিষন অস্থির লাগছিলো তাকে। প্রিয় মানুষটির সামান্য তম আঘাতে আমরা ভিষন অস্থির ও উত্তেজিত হয়ে পড়ি।আমি একপলক তাকে দেখলাম।মলিন মুখে এক ঝাক দাড়ি গজিয়েছ। ভিষন অবহেলায় তা স্বাভাবিকের তুলনায় কিছুটা বড় হয়েছে।মাথা ভরা ঝাকড়া চুলগুলো উসকো খুসকো।জোখের নিচে কালচে দাগ।কেমন শুকিয়ে গেছেন তিনি।মনো হয় ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করেন না।রাতের আধারে তার এমন করুন অবস্থা আমার দৃষ্টি এড়ালেও আজ এড়াতে পারলো না।তার এমন উদ্ভান্ত্র অবস্থা দেখে বুকের ভিতর কোথায় চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করলাম।তবে ভিষন অভিমান আর মন খারাপের অন্ধকারে ডুবে গেল আমার মন।কারন তিনি একবার ও চোখ তুলে আমার দিকে তাকান নি।কষ্ট পেল আমার ছোট্ট মোলায়েম মনটা! ভিষন কষ্ট! বাধভাঙা কষ্ট!

.
স্রোত ভাইয়ার আসার কিছুক্ষনের মধ্যেই দিদুন জেগে উঠলেন।প্রথমে বড় আব্বু আর আব্বু ভিতরে গেলেন।দুজনের বেশি যাওয়ার অনুমতি নেই।ঠিক সেসময়ই অবাক করা এক আবদার করে বসলেন তাদের মা জননী। তবে মায়ের কথা ফেলে দেওয়ার ছেলে তারা নয়।মায়ের চাওয়া পুরন করতে পৃথিবী উলোটপালোট করতেও তারা দুবার ভাববে না। তাছাড়া মা যা চায় যা করে ভালোর জন্যই করে।এটা জানে তার দুই ছেলে।তাই মায়ের কথার অমত তারা করবে না। মা তো ভুল কিছু বলেনি।ফারদিন তো নিজেও চায় ওই চঞ্চলা মিষ্টি মেয়েটাকে নিজের কাছে রাখতে। সে তো লক্ষ করেছে,এই দুই বছরে স্নোতের মত ইন্ট্রোভার্ট ছেলেটাও কতটা বদলে গেছে।সদা গম্ভীর, একঘুয়ে, জেদি ছেলেটাও কেমন বদলে নিতে চাইছে নিজেকে।যদিও চুপচাপ স্বভাবের রাগী ছেলে তবুও বড়দের সম্মান আর শ্রদ্ধায় এতটুকু অবহেলা নেই তার।তার জেদ, রাগ, সবটাই কেমন যেন কৌশলে হাসিল করতে জানে সে।ইদানীং ছেলের আচরনে পরিবর্তন লক্ষ করছেন তিনি।কিছুমাস হলো তিনি পর্যবেক্ষন করছে, তার ছেলে আগের থেকেও নিজেকে একাকী রাখছে।প্রায়শই ঘর বন্দি হয়ে থাকছে।উদাসিন জীবন যাপন করছে।কাজে মন নেই।কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকা ছেলেটিও আজকাল আর অফিসে যাচ্ছে না।বাবার কাজে সহায়তা করছে না।পড়ালেখায় মন দিচ্ছে না।বন্ধুদের সাথে আড্ডার পাহাড় জমাচ্ছে না।সদা প্রিয় বন্ধুদের থেকেও দুরত্ব বাড়িয়েছে।একা একা কোথায় থাকছে কেউ জানছে না।প্রশ্ন করলে উত্তর দিচ্ছে না।ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া নেই।ছেলেকে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না তার কাছে।সে আর তার স্ত্রী অনেক আগে থেকেই কথাকে ছেলের বউ করে ঘরে আনবে বলে ভেবে রেখেছে।মেেয়েটার বাচ্চামো স্বভাব মায়া মায়া দৃষ্টি সবটাই যে কারো মন কাড়তে সদাপ্রস্তুত।এমন একটা মিষ্টি মেয়েই পারবে তার এই হঠাৎ বদলে যাওয়া গম্ভীর ছেলেটাকে স্বাভাবিক করতে। বাবা ছেলের বাহ্যিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত হলেও মনের দিকটা তার আড়ালেই রয়ে গেল।তবুও অজান্তেই ছেলের জন্য তার ভালোর জন্য সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন তিনি।এখানে আসা, সবার সাথে সময় কাটানো,কথা আর স্রোতের কাছাকাছি থাকা এবং ছোট ভাইকে নিজের মনের কথা বলবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েই এসেছেন তিনি।তবে তার মা যে এমন কিছু ভেবেছেন কল্পানাতীত ছিল তার কাছে।
যাইহোক, মা যখন চায় তাই হবে।আপাতত ভাইয়ের সিদ্ধান্ত জানার পালা।

— আমার কোন আপত্তি নেই মা।বরং আমি নিজে ফারহানের সাথে ওদের বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাইছিলাম।স্রোতের জন্য কথা মামনির চেয়ে ভালো মেয়ে কোটিতে খুঁজলেও পাবো না আমি।
তবে এখন সবটাই ফারহানের সিদ্ধান্ত।কথা ওর মেয়ে। মেয়ের ভালো মন্দ বিচারের অধিকার ওর আছে।কেবল দায়িত্বের ভারে আমি চাই না ও কোন সিদ্ধান্ত নিক।

— এসব তুমি কি বলছো ভাইয়া। ও যেমন আমার মেয়ে তেমন তোমারও।আমি জানি তোমরা সবাই ওকে ঠিক কতোটা ভালোবাসো।তোমাদের থেকে বেশি ভালো ও আর কোথাও থাকতে পারে না।স্রোত আমার নিজরে ছেলে।ওর মত ছেলে হাজারটা খুঁজলেও পাবো না আমি।মা যখন চায় তোমার যখন ইচ্ছে তখন এই বিয়েতে আমার অমত নেই।

— তাহলে আজই ওদের বিয়ের ব্যবস্থা কর আর এখুনি।আমি কখন আছি কখন নেই জানি না।ওদের বিডেটা দেখে যেতে চাই।আমার পরিবারের এইটাই প্রথম বিয়ে। তোদের ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেখলে শান্তিতে মরতে পারবো।

–কিন্তু মা! এখনি এত তাড়াতাড়ি কি প্রয়োজন!তুমি আগে সুস্থ হও।আমরা বাড়ি যাই তারপর এসব নিয়ে আলোচনা হবে।ওরা তো আর কোথাও পালিয়ে যাচ্ছে না।তাছাড়া ডাক্তার বলেছে দুদিন অভজার্ভেশনের পরে রিলিজ দিয়ে দিবে।ততদিন পর্যন্ত না হয় আমরা সব আয়োজন করবো।বাচ্চাদের সাথেও তো কথা বলতে হবে।ওরা কি চায় জানতে হবে।

মায়ের দুহাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো স্রোতের বাবা।

— কথাকে নিয়ে চিন্তার কারন নেই ভাইয়া।ও আমাদের অমত হবে না।তবুও স্রোতের সাথে এ বিষয়ে কথা বলে নিলে ভালো হয়।

মায়ের অন্যপাশে মাথার কাছে বসা অবস্থায় বললো বাবা।

— ওকে নিয়ে চিন্তা করিস না ভাই।আমি যা করবো ওর ভালোর জন্য। ও কখনো অমত করবে না আমি জানি।

— তাহলে তো হলোই! তোমরা সব ব্যবস্থা কর।আজ আর এখুনি ওদের রেজিস্ট্রে মেরেজ হবে।বাকি যা কিছু করতে চাও সেটা তোমরা পরে করবে আমার কোন সমস্যা নেই।

একটু কঠিন কন্ঠেই কথা গুলো বলার চেষ্টা করলেন দিদুন।দুভাই মায়ের জেদের কাছে হার মানল।ডাক্তারদের মতে তাকে এখন কিছুতেই উত্তেজিত করা যাবে না!আর না দুশ্চিন্তাগ্রস্থ! এমনিতেও ওরা পরিবারের লোক।কোন সমস্যা হবার কথা নয়।মা যখন রেজিস্ট্র মেরেজ করতে চাইছেন সেটা এই মুহূর্তে করতে কোন সমস্যা নেই।তাই তারা দুজনেই সিদ্ধান্ত নিল মায়ের কথা মতোই কাজ করবে।

অন্যদিকে তিশার ভাবনার বিষয় তার ভাব।একটা মাত্র ভাই যাকে সে ভিষন ভালোবাসে।ভাই তার প্রান।তাই ভাইযের মন বুঝতেও তেমন সময় লাগে না তিশার।প্রথমবার যখন কথা ওদের বাড়ি গিয়েছিল।তখন থেকেই পরিবর্তন লক্ষ করছে ও স্রোতের মাঝে।তারপর যখন স্রোত ওদের শপিং এর মাঝে নিজের করা শপিং গুলো চুপিসারে রেখেছিল।তখন ও শিউর হলো।ও নিজেই ভিষন খুশি এতে।তবে কিছুমাস ধরেই ভাইডের মাঝের আমুল পরিবর্তন চোখে পরলো ওর।ভাবলো হয়তো ওদের মাঝে কোন সমস্যা। বা এতদিনে হয়তো ওরা কোন সম্পর্কে জরিয়েছে।মাঝখানের কোন কিছুই তার জানা ছিল না।ওর ভাই যে নিজের অনুভূতি প্রকাশে অপটু তা মাথা থেকেই বেরিয়ে গেছিলো ওর।তবে কাল রাতের ছাদে স্রোতের কথোপকথন শুনে সম্ভিত হয়ে গেছিল ও।আড়ালেই ছিল! সবটা বোঝার চেষ্টা করছিলো!ওদের মাঝে আসতে চায়নি।সবটা স্রোতের থেকে শোনার পর ওর আর বুঝতে বাকি থাকে না।আসল কাহিনি কি! স্রোতের মনের অনুভুতিগুলো ওর কাছে স্পষ্ট হলেও কথার অনুভূতি সম্পর্কে অনভিজ্ঞ। ভেবে দেখেনি ও আর না জিজ্ঞেস করেছে।তবে ভাইয়ের কথা শুনে মনে হচ্ছে কথা সবসময় ভাইকে এড়িয়ে চলে।কিন্তু কেন! কি এর কারন! তবে কি স্রোতের জন্য কথার মনে ভালোবাসার মত কোন অনুভূতি নেই! নাকি ওর জীবনে অন্য কেউ আছে! আচ্ছা ও কি অন্য কাউকে ভালোবাসে! বুকের ভিতর ভিষন ভয় অনুভব হলো।ভাইয়ের সব কথা শুনে এতটুকু বুঝতে পেরেছে।তার ভাই কথার পররতি কতোটা দুর্বল।সে আর আগের মতো নেই এখন সে কারো কাছে দায়বদ্ধ করেছে। নিজের মন মর্জি ভালোলাগা জেদকে হেয় করে ওই বাচ্চা মেয়েটার কাছে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে।
এমন একজন কি সহজেই মেনে নিতে পারে প্রিয় মানুষটির অবহেলা।না পারে না! ভাইয়ের জন্য প্রচন্ড কষ্ট অনুভব হলো।সবকিছু শোনার পর আস্তে করেই নিজ ঘরে চলে গেল।ভাবনায় ডুবে গেল।

সবাই দেখা করলো দিদুনের সাথে।বেশ হাসি খুশি প্রনোচ্ছল মনে হচ্ছিলো তাকে।কাঙ্খিত কোন কিছু পেলে মানুষ যতটা খুশি হয় তার থেকেও বেশি খুশি।ভিষন কান্নাকাটির জন্য মাইগ্রেন নামক উপসর্গটি তীব্রভাবে হানা দিলে বাবা আমাকে বাড়িতে চলে যেতে বললেন।তাও আবার স্রোত ভাইয়ার সাথে।তবে তার মাঝে কোন ভাবাবেগ দেখা গেল না।এমনিতেও দিদুন সুস্থ তাই এত মানুষের ভিড় না করাই ভালো।তাই অগত্যা চলে আসতে হলো আমাকে স্রোত ভাইয়ার সাথে । তবে এখনো অবধি তিনি একবার ও আমাকে দেখেন নি।নিজ দায়িত্বে নিজ কাজে মনোনিবেশ করছেন।আশেপাশে কেউ আছে কি নেই সেই খেয়াল নেই।তারদিকে একমনে চেয়ে থেকে ভাবনায় ডুবে ছিলাম।গাড়ি চলতে শুরু করলে হঠাৎ ই ধাক্কা খেলাম।উনি বুঝতে পেরেই সাথে সাথে গাড়ি থামিয়ে বেরিয়ে এলেন।আমি শুধুই তার দিকে তাকিয়ে।বিনাবাক্যে কেবল আমার সিটবেল্ট লাগিয়ে আবারো নিজ স্থানে গমন করলেন।গাড়ি স্টার্ট দিলেন আর সে স্থান প্রস্থান করলেন।

দুই ভাই মায়ের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে পরিবারের বাকি সদস্যদের সাথে আলোচনা করলেন।তবে তা স্রোত আর কথাকে ছাড়া।ওরা চলে যাওয়ার পর।সবাই সিদ্ধান্তে বেশ খুশি।এমনকি তিশাও।তবে ওর মনে ভয় কাজ করছে।যদি কথা না মানে তাহলে কি হবে?

অনুভূতি প্রকাশে অপটু ছেলেটার আচার আচরনও কেমন অদ্ভুত ঠেকছে সবার কাছে।বন্ধুদের আড্ডার মধ্যমনি হয়েও কখনো কোথায় অতি উল্লাসীত দেখায়নি তাকে। সর্বদা মেপে মেপে কথা বলার মত অদ্ভুত স্বভাবের এক ভিষন পরিচিত মানুষটি যখন বদলাতে শুরু করে তখন তা সবার নজর একটু আধটু কাড়ে।স্রোতের কথার প্রতি এক্সট্রা কেয়ার সবার চোখেই পড়েছে।এমনকি কথার বাবা মায়ের।তারা কখনো দুই ভাইয়ের সন্তানদের মধ্যে পার্থক্য করেনি যার ফলে তাদের সুখে থাকার প্রাধান্য টাই বেশি তাদের কাছে।স্রোতের কথার প্রতি দুর্বলতা কথার মত বাচ্চামো মন না বুঝলেও বাকিরা বোঝে। তাই সবাই বিয়েতে একমত পোষন করলেন।

#চলবে….

তুমি নামক যন্ত্রণা পর্ব-০৯

0

#তুমি নামক যন্ত্রণা
#লেখনীতেঃহৃদিতা ইসলাম কথা
পর্বঃ৯

সেদিনের পর কেটে গেছে আরও দুটো বছর।স্রোত ভাইয়ার চট্টগ্রাম আসার পরিমানটাও বেড়ে গেছে।তবে তাকে এড়িয়ে চলার প্রবনতা বেড়ে গেছে।তিনি যখনই আসতেন খবর পেতাম।আমি মামা বাড়ি চলে যেতাম।তিনিও দুএকবার কৌশল করে এসেছিলেন তবে আমি নিজেকে যথেষ্ট আড়াল রাখার চেষ্টা করতাম।তাকে তুমুলভাবে এড়িয়ে চলতাম।

এমনই একদিন তিনি বাড়িতে এসেছিলেন। আমি খবরটা জানতাম না।তাই বাড়িতেই ছিলাম।ওইদিন বাড়িতে কেউ ছিল না।আমি আর দিদুন ছিলাম।আব্বু আম্মু গেছিল মামা বাড়ি। জরুরি প্রয়োজনে সাথে ছিল পিচ্চু(আমার ভাই ইমন)।যেহেতু বাড়িতে আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না।কলিং বেল পাওয়ায় ভেবেছিলাম আমার বন্ধু মারিয়া এসেছে।আম্মুই বলেছিল একা লাগলে ওকে ডেকে নিতে।দিদুন ঘরে ছিলেন।আর আমি কিচেনে।ওর জন্য নাস্তা রেডি করছিলাম।যেহেতু ওর আসার সময় হয়ে গেছে তাই উল্লাসে ছুটে গেলাম দরজা খুলতে। কিন্তু দরজার ওপাশে দাড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে আমি হতচকিত, হতবিহ্বল হয়ে গেলাম।স্রোত ভাইয়া স্বয়ং আমার সামনে দাড়িয়ে। চোখ মুখের অবস্থা করুন,মলিন।চোখমুখ কেমন গর্তে চলে গেছে।চুলগুলো এলোমেলো। চোখজোড়া লালচে হয়ে আছে।মনে হয় সারারাত ঘুমোয় নি।দরজা খোলার পর আমাকে দেখে এক করুন চাহনি নিক্ষেপ করলো।তার ওই করুন চাহনিতে কেমন অস্থির লাগছিলো আমার।বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিলো।কেন জানি না তবে তাকে এড়িয়ে চললেও তার কোন কষ্ট সহ্য হয় না আমার।দৃষ্টি নামিয়ে নিলাম।কোন কথা না বলে সরে এলাম দরজার কাছ থেকে। তিনি ভেতরে ঢুকলেন।আমি ওড়নাটা নিয়েই ছুট লাগাচ্ছিলাম নিজের ঘরের উদ্দেশ্য তবে আটকে দিলেন।হাত শক্ত করে ধরে দাড়িয়ে আছেন।থমকে গেল পা।অস্বাভাবিকভাবে হাত পা কাপতে লাগলো।বুকের ভিতর ভয়ংকর শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে প্রানটা বেরিয়ে যাবে।এতদিন তিনি আমার সাথে কথা বলতে চাইলেও কখনো এরকম ভাবে স্পর্শ করেন নি।তার স্পর্শে আঘাত পেলাম।বেশ শক্ত করে ধরে আছে হাতখানা।আমি ভয়ে দুটো ঢোক গিলে পেছনে ফিরলাম।উনি হাত টেনে তার সামনে দাড় করালেন।ভরাট গম্ভীর অথচ কত যন্ত্রণা মিশ্রিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

— কি এমন করেছি আমি যে তুই এভাবে আমাকে এড়িয়ে চলিস? এভাবে লুকিয়ে চুরিয়ে থাকিস! নিজেকে কেন আড়াল করিস আমার থেকে বল!

— আ্ আমি কিছু করিনি।হাত ছেড়ে দিন ভাইয়া আমি ঘরে যাব।

— যাবি না! কোথাও যাবি না! আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তারপর যাবি।বল কেন? কেন এমন করছিস তুই?
অপরাধ কি আমার? কোন দোষের শাস্তি দিচ্ছিস তুই আমাকে!

— ছ্ ছাড়ুণ ভাইয়া।

বলেই ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম।উনি আমায় আরো কাছে টেনে নিলেন।হাতের বাধন শক্ত করলেন।উনার করুন চাহনি আমার উপর নিবদ্ধ করে প্রগাঢ় কন্ঠে শুধালেন,

— ছেড়ে দিব!কি করে ছেড়ে দিব!পারছিনা আমি!

— আমার হাত ছাড়ুন ভাইয়া।ল্ লাগছে আমার!

কথাটা বলতেই ছেড়ে দিলেন আমার হাত।ফুপিয়ে কাঁদছি আমি।উনি আমার দুগাল ধরতে যাচ্ছিলেন।তখনই একটা পরিচিত এক কন্ঠস্বর কানে ভেসে এলো।তিনি মাথা উপরে তুললেন।আমি মাথা নিচদিক দিয়ে দাড়িয়ে ছিলাম।তার কন্ঠ শুনেই ছুটে উপরে চলে গেলাম।নিজ ঘরে গিয়ে দরজা দিয়ে দিলাম।আটকে নিলাম নিজেকে বদ্ধ ঘরে।

ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিলাম।হাতের দিকে চেয়ে দেখলাম।জায়গাটা কেমন নিলচে হয়ে গেছে।ব্যাথা করছে।অভিযোগ হলো তার প্রতি।কেন এভাবে আঘাত করেন উনি আমায়।যখনই তার সামনে থাকি আঘাত করেন।আমাকে এভাবে কষ্ট দিয়ে কি পান উনি।অভিমান হলো।অভিমানের মাত্রাটা হুরহুর করে বেড়ে গেল।আজকের করা কার্যকলাপে।মন ভারি হলো! ভিষন দুঃখ হলো।আবারো প্রতিজ্ঞা করলাম।কখনো যাবো না তার সামনে।ভুল করেও না।কিন্তু তখনও হানা ছিল না আমার এই সামান্য আঘাতের যন্ত্রনা তার যন্ত্রনার কাছে কিছুই না যা আমি তাকে দিয়েছি।রাগ হলো নিজের প্রতি।কেন বুঝলাম না তাকে! তার অনুভুতিকে! কেন তাকে সুযোগ দিলাম না! কেন আড়াল করলাম নিজেকে! তাকে এত অবহেলা অবমাননা করলাম! হয়তো আমাকে দেয়া আঘাতের জন্য তিনি নিজেও তার দ্বিগুন আঘাত পেয়েছেন।বুক চিরে কান্নার বেরিয়ে আসতে চাইছে।আটকালাম না তাদের কাঁদতে দিলাম।চোখের বর্ষন হতে দিলাম।সবকিছু ঠিক করার সিদ্ধান্ত নিলাম।কান্নার মাধ্যমে কষ্ট কমানোর চেষ্টা করলাম।তবে আদৌ কি এই কষ্ট কম হবে।হবে না! তাকে দেয়া এই তুমুল যন্ত্রনার রেশ কাটাতে অনেক সময় লাগবে আমার।এসব ভাবনা আর কান্নার মাঝেই চোখ লেগে এল।সারারাত অঝোড় বর্ষনের পর চোখ বুজে এল।কখন ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলাম জানা নেই।

.
কড়া রোদের তীক্ষ্ণ আচড় চোখের উপর পরতেই।বিরক্তে কপালে ভাজ পরলো।কুচকানো চোখমুখ নিয়েই বিরক্তিতে থিতিয়ে গেল মন।মেঝেতে বসে বেড়ের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে ছিলাম।বিরক্তি ভাবটা কাটিয়ে চোখ খুললাম।কাল ভোরের দিকে ঘুমিয়েছি বলে হয়তো এত দেরি হলো।রাতের কথা মনে পরতেই মনটা বিষন্ন হলো।তবে আজ তার এই #আমি_ নামক_যন্ত্রনার শেষ দিন।আজকের পর থেকে আর কখনোই তাকে কোনো কষ্ট দেব না।তার থেকে নিজেকে আড়াল করবো না।তাকে নিজের সাথে বেধে নেব।ভাবনার অবসান ঘটিয়ে ঘরির দিকে চোখ রাখতেই দেখলাম সকাল নয়টা বাজে। অনেক বেলা হয়েছে কিন্তু কেউ আমাকে ডাকলো না কেন?উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম। নিচে গিয়ে দেখলাম বড় আম্মু আর আম্মু কিচেনে কাজ করছে।আম্মু বারবার বলছে ” আপা আমি করে নিব তুমি যাও কিন্তু বড় আম্মু শুনছে না উনি সবজি কাটতে ব্যস্ত।বাড়িটা হালকা মনে হলো।জনমানব নেই।আমার দুচোখ বেহায়া নির্লজ্জের মত শুধুমাত্র একজনকেই খুজে বেড়াচ্ছে।তাই আমি নিচে নেমে একটা আপেল নিয়ে কিচেনের দিকে গিয়ে আম্মুকে জিজ্ঞেস করলাম।

— আচ্ছা আম্মু বাড়িটা এমন ফাকা ফাকা লাগছে কেন? সবাই কোথায়?

— সবাই চলে গেছে।কেন তুই জানতি না আজ সবাই চলে যাবে।তারপরও এমন মরার মত ঘুমোলি।তিশা তো তোকে ডাকতেও দিলো না।বললো,

— কাল নাকি অনেক রাত করে গল্প করে ঘুমিয়েছিস দুটোয় তাই।ওরাও বললো পরে কথা বলে নেবে।দেরি হচ্ছিলো তাই বেরিয়ে গেছে সবাই।

–ওহ! আচ্ছাতিশা আপুকে দেখলাম না। দিদুন ও নেই।কোথায় সবাই?

— তিশা তো ঘরে মা।আর তোর দিদুনও ঘরে।

আমি আমতা আমতা করছি।আসলে যার কথা জিজ্ঞেস করতে চাইছি।তার কথা জিজ্ঞেস করবো কিভাবে? বড় আম্মু কি ভাববে! আর আম্মুই বা ব্যাপারটা কিভাবে নেবে?অস্থিরতা ঘীরে ধরেছে আমায়।নিচে তো কোথাও উনাকে দেখলাম না।আচ্ছা উনার ঘরে আছে।আমাকে উসখুস করতে দেখে বড় আম্মু জিজ্ঞেস করলো,

— কিরে কিছু বলবি?
অপ্রস্তুত হলাম আমি।কি বলবো বুঝতে পারলাম না।তাই বললাম,

–ও ওই তো বড় আম্মু বলছিলাম কি যে, আচ্ছা বড় আম্মু আজ কি তুমি রান্না করবে?

— হ্যাঁ।তুই কি খাবি বল।

— ঠিকাছে তাহলে ভুনা খিচুড়ি কর।তোমার হাতের ভুনা খিচুড়ি উইথ কষা মাংস। উফফ! কি জোশ যে হয় বলে বোঝানো যাবে না।

— আচ্ছা করছি।

সেখান থেকে এক প্রকার হড়বড়িয়ে চলে এলাম।গেলাম স্রোত ভাইয়ার রুমের দিকে। দিদুনের ঘরের পাশের ঘরটায় তার।এবাড়িতে সবার জন্য আলাদা ঘর আছে।দিদুনের ঘর পেরিয়ে যাওযার সময় দেখলাম দিদুন শুয়ে আছে।এই অবেলায় বুড়ি ঘুমিয়ে আছে কেন? মনে প্রশ্ন জাগলেও আজ সেটাকে গুরুত্ব দিলাম না। ঘরের দরজার কাছে আসতেই বুকে দ্রিম দ্রিম শব্দ হতে শুরু করলো।হার্টবিট এত দ্রুত ছুটছে বোঝানো দায়।আমি বড়বড় দুটো নিশ্বাস নিলাম। নিজের ভিতর একটু সাহস সঞ্চয় করলাম।তারপর পা টিপে টিপে ঘরের দরজাটা একটু ফাক করে দেখলাম ঘরে কেউ নেই।ভ্রুযগল কুঞ্চন হলো।তারপর পুরো দরজাটা পুরোটা খুললাম।নাহ কেউ নেই।ভিতরে গেলাম।তারপর সবজায়গায় খুঁজেও পেলাম না।কোথায় গেল মানুষটা।হাওয়া হয়ে গেল।কাকে জিজ্ঞেস করবো।হ্যাঁ, দিদুন! দিদুনকে জিজ্ঞেস করতে হবে।কিন্তু পরমুহুর্তে মনে পরলো দিদুন তো ঘুমোচ্ছে। এখন যদি ঘুম ভাঙি তো বুড়ি খেপে যাবে আমার উপর।তারউপর আবার হঠাৎ করে স্রোত ভাইয়ার খোঁজ করায় যদি জেরা কনে পুরো বাড়ি মাথায় তোলে তখন। নাহ! তাকে বিরক্ত করা মানে বিপদ! মহাবিপদ যাকে বলে!তবে আর কি করবো? তাকে জিজ্ঞেস করবো! তিশা আপু! হ্যাঁ, তিশা আপুকে ঘুরিয়ে পেচিয়ে জিজ্ঞেস করা যেতেই পারে।একছুটে পৌছে গেলাম তিশা আপুর ঘরে।ঘরে গিয়ে দেখি আপু ঘরে নেই।বারান্দায় কারো ছায়া দেখে সেখানে গেলাম।গিয়ে দেখলাম আপু উদাসীন হয়ে রেলিং এ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আনমনে।দৃষ্টি বাইরের প্রকৃতিতে নিবদ্ধ। তবে মনে প্রশান্তি নেই।ভারাক্রান্ত মনে বিষন্নতা ঘীরে রেখেছে।আমি গিয়ে পিছন থেকে তাকে জরিয়ে ধরলাম।উনার ধ্যান ভাঙলো।নড়েচড়ে উঠলো।অন্যদিন আমাকে দেখলে যেমন একগাল হাসতো।আজ সেই হাসিটা নেই।বুঝলাম ভিষন মন খারাপ আপুর।আষাঢ়ের কালো মেঘের ন্যায় ছেয়ে আছে শীতল মুখখানা।বললাম,

–কি হয়েছে আপু? মন খারাপ তোমার?

— হুম!

ছোট প্রতিত্তুর।আমি মৃদু হেসে বললাম,

— কারন কি জানতে পারি?

— একটা কথা বলবি সত্যি করে।

— কি কথা আপু বলনা।তার জন্য আবার জিজ্ঞেস করতে হয়।আর আমি তোমাকে মিথ্যে বলবো ভাবলে কি করে?

মৃদু হাসলো আপু।তারপর অনাকাঙ্ক্ষিত এক কথা বলে ফেললো যার উত্তর আমার কাছে নেই।আদৌ কি নেই নাকি বুঝতে পারছি না জানি না।

— ভালোবাসিস কাউকে?

অনাকাঙ্ক্ষিত এমন প্রশ্নে যে কারো থমকে যাবার কথা আমিও থমকে গেলাম।ভাবনায় ডুবে গেলাম।আচ্ছা সত্যি কি আমি কাউকে ভালোবাসি! নাতো আপুর সেদিনের বলা বক্তব্যের মত অনুভূতি কখনো হইনি আমার। তবে স্রোত ভাইয়ার কষ্ট হলে যে কস্ট আমি অনুভব করি।সেটা কি তবে! আচ্ছা সেটাই কি ভালোবাসা! তবে কি স্রোত ভাইয়া আমাকে ভালোবাসে! আমিও কি বাসি! যদি নাই বাসি তাহলে তার কান্নায় কাল রাতে এত কষ্ট কেন হলো।কেন তার দুবছরের প্রনয় যন্ত্রনার কাছে আমার শারীরিক আর মানসিক আঘাতকে তুচ্ছ মনে হল।কেন ভুলে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে সবকিছু।কেন তাকে আগলে রাখতে ইচ্ছে হচ্ছে?কেন তার স্রোতের মোহনায় গা ভাসাতে ইচ্ছে হচ্ছে?কেন? কেন? কেন?
এত কেনর উত্তর কি একটাই! তিনি তার না বলা অনুভূতি ব্যক্ত করার মাধ্যমে অপ্রকাশিত রেখেই তার ভালোবাসা আমাকে জাহির করেছে আর আমিও অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে তার ভালোবাসার জোয়ারে গা ভাসাতে চাইছি।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে আপু আমার কাধে হাত রেখে বললো,

— কি ভাবছিস কথা!
আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম বললাম,

— ক্ কই? কিছু নাতো! কিছু না! এমনি!
আপু আবারো সামনের খোলা আকাশে দৃষ্টি রেখে বললো,

— বললি না যে।

— কি বলবো?

— কাউকে ভালোবাসিস!

আপু কাকে ভালোবাসার কথা জিজ্ঞেস করছে।স্রোত ভাইয়ের প্রতি আমার অনুভূতি তাকে জানানো ঠিক হবে।নাহ! না! ছিঃ কি করে বলবো আমি।সম্ভব না! একেবারেই না।
তাই চুপ করেই রইলাম।

— কই কিছু বল।

এবার আমতা আমতা করে বললাম,

— ন্ না!

— ওহ।

তারপর বেশ অনেকক্ষণ চুপ ছিলাম।কি বলবো ভেবে পাচ্ছি না।স্রোত ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করবো! না থাক আপুর মন ভালো নেই।কি ভাবতে কি ভাববে।তাই মুচকি হেসে আপুকে জিজ্ঞেস করলাম,

— নাস্তা করেছো আপু?

— হুম।তুই করেছিস?

— নাহ!

— তাহলে করে নে।
আবারো সেই মলিনতা। আপুকে কখনো এভাবে দেখেনি।হাসিখুশি একটা মেয়ে আজকে কি হলো তার? বুঝতে পারছি না।কিছু না বলেই মন খারাপ করে চলে এলাম।আসার সময় দেখলাম পিচ্চু বাগানে খেলছে।আমাদের এখানকার ওর সমবয়সী কয়েকটা বাচ্চা ছেলের সাথে।ওকে দেখো আসার আলো জেগে উঠলো।ছুটে গেলাম ওর কাছে বললাম,

— পিচ্চু তোর মহারাজ কইরে?

— কোন মহারাজ?

— যার মাথায় চড়ে বসে থাকিস তুই?

— কার মাথায় চড়ে বসে থাকি?

আমার করা প্রশ্নে ওর ফিরতি প্রশ্ন মেজাজটা খিটখিটে করে দিল।দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,

— স্রোত ভাইয়া কই?

— ওহ! তুই স্রোত ভাইয়ার কথা জিজ্ঞেস করছিলি? তাই বল।এত ঢং করার কি আছে।

— কিহহহ!আমি ঢং করি।

— হ্যাঁ, করিসই তো। একটু বেশিই ঢং করিস।

— দেখ পিচ্চু ভালো হবে না বলে দিচ্ছি। উল্টো পাল্টা কথা একদম বলবি না।

— তুই বলতে পারলে আমি কেন পারবো না।

— এই বেয়াদব ছেলে আমি না তোর বড় তুই তুই করে বলছিস। আবার মুখে মুখে তর্ক করছিস।

— তুই আগে আমাকে পিচ্চু বলা বন্ধ কর।তাহলে আমিও আর তুই করে বলবোনা।

— কেন পিচ্চু ডাকে কি আছে?

— আমি কি পিচ্চি যে পিচ্চু বলে ডাকবি।

— হ্যাঁ, তুই তো বুড়ো বুড়ো বলেই ডাকবো।হয়েছে শান্তি!

— না হয়নি।

— আবার কি হলো?

— আগে আমাকে পিচ্চু বলা বন্ধ কর আর আমাকে দশটা ইয়া বড় বড় ডেইরি মিল্ক কিনে দে আর বিশটা আইসক্রিম কিনে দে তারপর বলবো।( আমার বিচ্ছু ভাইটা আমারে এইভাবে ব্ল্যাকমেইল করে☹️।কিছু বলতেও পারি না।হুমকি দেয়। স্ক্রিক্রেট ফাস করার)

— কিহহহ! এত কিছু।পারবো না।

— না পারলে আমিও বলবো না। এমনিতেও খুব কম চাইছি আমি।তুই তো আরো অনেক কিছু চুরি করেছিস আমার।সেই তুলনায় এগুলো কিচ্ছু না।

বিরক্তিতে রি রি করে ওঠা মেজাজ নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,

— আচ্ছা দেব।এবার বল কোথায়?

— ভাইয়া তো চলে গেছে।

— কবে? কখন? কোথায়?

— আস্তে আস্তে এত কথা এক সাথে জিজ্ঞেস করলে কেমনে বলমু?

— একটা একটা করে বল।

— ভাইয়া বাড়ি চলে গেছে।কি এক জরুরি কাজ আছে তাই।

শুনেই মনটা বিষন্নতায় ডুব দিল।সেই অথৈ জলের উত্তাল স্রোতে ভেসে চললো।কান্না পেল খুব।কোনমতে কান্না আটকে ঘরে এসে দরজা দিতেই টুপটাপ করে পরতে শুরু করলো নোনা পানি।এত নিষ্ঠুর মানুষ হয়।আমাকে একবার বললোও না।দেখা করা তো দুরের কথা। কালকে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করে আমার অনুভূতি না জেনেই চলে গেল।অভিমান হলো খুব।বুকের ভিতরটা জ্বলছে খুব।পুড়ছে তার নামের উত্তাপে।যন্ত্রণায় ছটফট করছে।ভিষন চিৎকার করে আর্তনাত করছে।আচ্ছা কাছের মানুষ থেকে প্রাপ্ত অবহেলা আর এড়িয়ে চলা বুঝি এতটাই কষ্টদায়ক হয়।যন্ত্রনাদায়ক হয়।তবে তিনিও কি এতটাই কষ্ট পেয়েছেন।যন্ত্রনার অনলে এভাবেই পুড়েছেন! ছটফট করেছেন! আমি একদিনে সহ্য করতে পারছি না।তিনি দুবছর কি করে সহ্য করেছেন।ভাবতেই বুকফাটা আর্তনাত বেরিয়ে এলো।দুহাটুতে মুখ গুজে নোনা জলের স্রোতে ভেসে যেতে লাগলাম।তার ভালোবাসার স্রোতে গা ভাসানোর আগে তার #তুমি_নামক_যন্ত্রনার স্রোতে চোখের জলে ভেসে যাচ্ছি আমি।

#চলবে……

তুমি নামক যন্ত্রণা পর্ব-০৮

0

#তুমি নামক যন্ত্রণা
#লেখনীতেঃহৃদিতা ইসলাম কথা
পর্বঃ৮

রাত দুটো।নিস্তব্ধ প্রহরে আধারে ডোবা ঘরটি চাঁদের আবছা আলোয় নিয়ন আলোকিত।আকাশে পুর্ন চাদের সমাহার।দুধ সাদা জোৎস্নায় ছেয়ে আছে বিশাল মহাকাশ। বেলকনির পর্দা সরিয়ে দেওয়া। মৃদু বাতাস বইছে আর সেই সাথে জোস্নামাখা আলোয় স্বর্গীয় লালিত্য ছাপিয়ে পড়ছে মেয়েটার চোখেমুখে।জোৎস্না প্রতিচ্ছবিতে এক মায়াবন বিহারিনী নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে।আর ওই মায়ারানীর মায়াবি মুখশ্রীতে অপলকে দৃষ্টি স্থির রেখেছে এক প্রেমিক পুরুষ। যে তার প্রেয়সীর ঘুমন্ত মায়াবী মুখটার অপরুপ সৌন্দর্যের সাগরে গা ভাসিয়েছে।খুঁটিয়ে খুটিয়ে দেখছে রুপ লাবণ্যের ভরপুর এই শ্যামাকন্যাকে।শ্যামা রঙটাতে এক অনবদ্য মায়া যেন ভিড় করে থাকে।যেমনটা এখন স্রোতের মনে হচ্ছে। তার শ্যামাঙ্গিনীর মুখশ্রীতে যেন পৃথিবীর সকল মায়ারা ভিড় জমিয়েছি।এক মুহুর্তের জন্যও পলক ফেলার মত শাস্তিযোগ্য অপরাধ করার মত অপরাধ করকে চায় না।ওই মুখটির মায়া আর ওই নিষ্পাপ শিশুর মন সাদামাটা মনের মেয়েটার কাছে যে ও বাধা পড়ে গেছে।খুব বাজেভাবে বাধা পড়ে গেছে। সেখান থেকে আদৌ ফিরে আসা সম্ভব! না সম্ভব না! এই সপ্তাহ খানেকের মধ্যে এইটুকুন বাচ্চা মেয়ের প্রতি এতটা আসক্তি। সত্যিই বিশাল এক অপরাধ।অপ্রতিরোধ্য এক মস্ত বড় ভুল।যে ভুল করা হয়ে গেছে স্রোতের।

কথার বিছানার একপাশে ফ্লোরে বসে দুহাত বিছানায় ঠেকিয়ে নিরব নিস্তব্ধতায় তার প্রেয়সীর রুপের মুগ্ধতা হারিয়ে গেছে স্রোত।এই বাচ্চা মেয়েটা ওকে পাগল করে দিয়েছে।ও ছাড়া আর অন্য কোন কিছুই চোখে ধরা দেয় না।যেখানে সেখানে যখন তখন এই মায়াবীনির প্রতিচ্ছবি ধরা দেয়।ঘুমন্ত অবস্থায় যেন তার মায়াবী মুখটার স্নিগ্ধতা আরো বাড়িয়ে দেয়।ওই চাদের আলোয় ওই মুখটা আরো মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিচ্ছে যেন।কেন যেন ওই চাঁদের থেকেও ভিষন সুন্দর আর রুপসী প্রতিত হচ্ছে এই রমনীর রুপের সৌন্দর্য। আচ্ছা ওকে এত সুন্দর কেন হতে হবে! কেন? আমাকে পাগল করার জন্য! ঘায়েল করার জন্য! এভাবে তার রুপের জাদুতে বশ করার জন্য! আমার হৃদয়কে অসম্ভব যন্ত্রণায় ছটফট করতে বাধ্য করার জন্য।
নিজের মনের মাঝে জমে থাকা অব্যক্ত অনুভূতিকে প্রকাশ করে স্বাচ্ছন্দ্যে, নিরানন্দে।

— তোমার ওই মায়াবী চোখের ভয়ার্ত দৃষ্টিতে প্রতিমুহূর্তে তোমার প্রেমে পড়ে যাই।আমার প্রতিটা নিশ্বাসে শুধুই তুমি।শুধু তুমি। কি এমন জাদু করেছো বলো তো।তুমি ছাড়া আমার চারপাশটা বিষন্নতায় ছেয়ে।খুব অস্থিরতা কাজ করে।দম বন্ধকর পরিস্থিতি তৈরি হয়।কেন হয় এমন? একেই কি তবে ভালোবাসা বলে! আমি কি তবে সত্যি তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি!

.
সেই একঘন্টা ধরে একভাবে এক ঘোর জড়ানো চাওনিতে চেয়ে আছে স্রোত।ওর চোখ দুটো যেন ক্লান্ত হয় না।ক্লান্তিতে নুইয়ে পড়ে না।অসম্ভব মুগ্ধতায় ছাড়িয়ে যায় মনপ্রান।
সেই যে জ্ঞান হারিয়েছে কথা এখনো হুশ ফেরেনি ওর।স্রোত বুঝতে পারছে ভিষন ভয়ে আতঙ্কিত ওর মন।তাই ওর জ্ঞান ফেরার পর ওকে পরিস্থিতি বুঝিয়ে শান্ত করতে হবে।তাই এখানে এসেছে ও।কিন্তু এখনো জ্ঞান ফেরেনি বলে ডাক্তারকে কল করেছিল।তিনি বলেছে পার্লস চেক করতে।যদি নরমাল মনে হয় তাহলে সব ঠিকাছে চিন্তার কিছু নেই।যখন কথা জ্ঞান রাত তখনও বেশ হয়েছে।১২ টার কাছাকাছি এত রাতে ডাক্তার বাড়িতে আনলে সবাই জেনে যাবে।বিষয়টা ধামা চাপা দেওয়ার লক্ষ্যেই বাড়িতে ডাক্তার ডাকা নিয়ে ভিষন চিন্তায় ছিল স্রোত।পরমুহূর্তে নিজেই সবটা সামলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।তারপর থেকে সারাক্ষণ কথার ঘরের আশেপাশেই ছিল।কথার মা এসেছিল ওকে দেখতে। যেই না দেখলো মেয়ে আরামসে ঘুমাচ্ছে। ওকে আর ডাকেনি।এমনিতেই ও ভিড় থেকে দুরে থাকতেই পছন্দ করে বেশি।তাই আর তিনি তেমন ঘাটলেন না।

সবাই যখন ঘুমাতে চলে গেছে তখনই এ ঘরে আসে স্রোত।অন্য সময় আসাটা সবাই ভালো চোখে দেখবে না।ওর পরিবারের সবাই তবুও। কি দরকার সবার কাছে ব্যাপারটাকে বিশ্রী করে তোলা।
স্রোত পার্লস চেক করতে গিয়ে দেখলো তখন হাত চেপে ধরায় হাতে রক্তে জমে কালসিটে পড়ে গেছে।বিরক্ত হলো নিজের উপর।ক্ষোভ জমলো।নিজেকে নিয়ন্ত্রন করা উচিত ছিল ওর।তাহলেই মেডেটাকে এত কষ্ট পেতে হতো না।এত সব কিছুতেই হতো না।উজ্জ্বল শ্যামবর্নের হওয়াতে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।ও গিয়ে ওষুধ নিয়ে এলো তারপর আদুরে হাত ওষুধ লাগিয়ে দিল।গায়ের তাপমাত্রা পরিমাপ করে স্বাভাবিক অনুভব করলো।ফুস করে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো।এরপর হাটু গেড়ে মেঝেতে বসে পড়লো।অনেক সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর স্রোত নিজেকে আর সামলাতে পারলো না।ভয়ংকর এক কান্ড ঘটিয়ে বসলো।প্রেয়সীকে একটু ছুয়ে দেয়ার। একটু ভালোবাসার স্পর্শ দেয়ার মত লোভকে সংযত করতে না পেরে।টুপ করে কথার কপালে ভালোবাসার ছোয়া দিল।উনার উষ্ণ ঠোঁটের গভীর ছোঁয়ায় নড়েচড়ে উঠলাম আমি। পিটপিটিয়ে চোখ খুলতেই দৃষ্টি স্থির হলো স্রোত ভাইয়ের মুখে।স্রোত ভাই ঠিক আমার মুখের উপর ই ঝুকে আছে।হুট করে ঘুম ভাঙাতে নিস্তেজ মস্তিষ্ক কিছুটা সময় নিল সচল হতে।যখনই সে সচকিত হলো পরিস্থিতি বুঝতে পারলো।প্রতিক্রিয়া বিহীন একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলাম।কিছুক্ষনের মধ্যেই তখনকার বাজে ঘটনাটা মনে পড়ে গেল।লাফিয়ে ওঠে আমার উপর ঝুকে থাকা স্রোতের বুকে দুহাতে জেরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলাম।অপ্রস্তুত ছিল স্রোত। তাই ছিটকে নিচে পড়ে গেল।আমি গায়ের কাথা টেনে নিজের সাথে জরিয়ে নিলাম।হকচকিয়ে যাওয়া দৃষ্টি নিয়ে কিছুক্ষন চুপচাপ তাকিয়ে ছিল স্রোত ভাই।আচমকাই আমার চোখ খোলা আর তাকে এভাবে আমার মুখের উপর ঝুকে থাকতে দেখবে বা এভাবেই ভীত গ্রস্ত হয়ে এত ভয়ংকর কান্ড করবো হয়তো ধারনা ছিল না উনার।সবটাই হঠাৎ করে হয়েছে।অপ্রতিভ হলো স্রোত ভাই।দৃষ্টি নত হলো।নিচ দিক তাকিয়ে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে ছেড়ে দিল।ভিতরের বিরক্ত আর অস্থিরতাকে কাটানোর চেষ্টা।

আমি ভয়ে কাপছে। চোখমুখে আতঙ্ক। শঙ্কিত অজানা কোন কারনে।স্রোত ভাই ভাবলো হয়তো তখনকার জন্য ভয় পেয়ে আছি।তবে আমার মনে ভয় এই কারনে যে স্রোত ভাই কি আমাকেও ওভাবে শাস্তি দিবে।যেভাবে ছেলেগুলোকে দিল।আমার দিকে উনার একহাত এগিয়ে শান্তনা দেওয়ার প্রচেষ্টা করতেই ভয়ে বেডের সাথে আরো সিটিয়ে গেলাম আমি।লেপ্টে গেলাম একদম।স্রোতকে আমার ভয় করছে।প্রচন্ড রকমের ভয়।যে ভয়ের কারন সেই নাকি ভয় কাটাতে এসেছে ভাবা যায়।অদ্ভুত না।স্রোত শ্বাস ছাড়লো।নিজেকে যথা সম্ভব শান্ত করে বললো,

— ভয় পাস না।তুই এখন বাড়িতে আছিস।সেইফ আছিস।কেউ নেই ওরা।ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

আমি তবুও ভয়াবহ ভাবে ভয়ার্ত।আমার কাছে স্রোত ভাইকে যমদূত মনে হচ্ছে। যেন আমার প্রানপাখি ছিনিয়ে নিতে এসেছে।আমাকে সামলাতে ডানহাতটা আবারো বাড়াতেই আটকে আসা ভয়ার্ত কণ্ঠেই বললাম,

— ক্..কাছে আ্..আসবেন না।ছ্..ছোবেন ন্ না আমায়।
দ্..দুরে থাকুন প্লিজ।

প্রেয়সীর কান্নামিশ্রিত অসহায় কন্ঠস্বর যেন প্রেমিক পুরুষের হৃদয়ে গভীর ক্ষত একে দিল।অদৃশ্য ঝড় বইতে শুরু করলো। ভয়াবহ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করলো হৃদয়ের অন্তস্তল। ওই ছেলেগুলোকে এই মুহুর্তে শেস করে দিতে ইচ্ছে করছে ওর।রাগটাকে কন্ট্রোল করলো স্রোত।

তারপর গলার স্বর নরম করে বললো,

–আচ্ছা! ছোব না তোকে। আর না কাছে যাব।দুরেই আছি আমি।তুই শুধু একটু শান্ত হ।কিছ্ছু হয়নি। তখন যা কিছু হয়েছিল ভুলে যা।মন থেকে মুছে ফেল।

— আ্.. আপনি ও্.. ছেলেগুলোকে মেরে ফেলেছেন তাই না।বলুন! আমাকেও মেরে ফেলবেন তাই না!

— না ওদেরকে একেবারে মেরে ফেলেনি হাসপাতালে পাঠিয়েছি। সুস্থ আছে এখন।যেটা তোর সাথে করতে চাইছিল সেটা যেন অন্য কারো সাথে না করতে পারে তাই শাস্তি দিয়েছি শুধু।

বলেই থামলো স্রোত।ইশারায় ওকে কাছে ডাকলো কথা গেল না।ও আরেকটু এগিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

— ভয় পাস না প্লিজ।আমি তোকে কিছুই বলবো না।বকবো না।তখন বকাঝকা করেছি বলে সরি।এইযে কান ধরছি। সরি!সরি! সরি!

তার এমন বাচ্চামোতে যেখানে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাওয়ার কথা সেখানে আমার কোন রেসপন্স নেই।আমি চুপ করে আছি।আমার ভয়টা একটু কমলো।তবে পুরোটা নয়।তবুও স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলাম। সোজা হয়ে বসলাম।স্রোত ভাই বললো,

— তুই ফ্রেশ হয়ে নে।আমি খাবার নিয়ে আসছি।

বলেই চলে গেল।আমি নেমে ওয়াশরুমে গিয়ে চোখেমুখে পানি দিলাম।ভয়টা একটু কমলেও পুরোটা কাটেনি।স্রোত ভাইয়ের ওমন ভয়ানক রুপ নিজ চোখে দেখেছি।প্রভাব তো একটু পড়বেই।স্রোত ভাই নিজ হাতে খাবার এনে মুখে তুলে খাইয়ে দিল।তারপর ওকে বিছানায় ঘুম পাড়িয়ে চলে গেল।

.
নিজের ভুলগুলো ভিষনভাবে উপলব্ধি করে ভিসন রেগে ফেটে গেল সে।নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হলো ওর
কেন তখন ওরকম করলো কথার সাথে। বাচ্চা মেয়ে না বুঝে বলে ফেলেছে ওর উচিত ছিল পরিস্থিতি সামলে নেওয়া তা না করে ওর উল্টো রেগে যাওয়া উচিত হয়নি।তবে রাগবে না তো কি করবে।পার্টির কয়েকটা ছেলে বাজে নজরে তাকিয়ে ছিল ওর পেটের কাছের কালো তিলটার দিকে।সহ্য হচ্ছিল না স্রোতের।তাই নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি।রেগে গেছে ওর উপর।কিন্তু ও তো কম কথা শোনাইনি।যা না তাই বলেছে।চরিত্র নিয়ে কথা বলেছে।তবুও তার জন্য রাগ হয়নি ওর।ছেলেগুলোর দৃষ্টি ওর গায়ে কাটার মত বিধছিলো।কথার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিল।রাগী চোখে বোঝানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু বোঝেনি।তাই কৌশলে পিচ্চুকে দিয়ে ওকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে এসেছিল।

তবে সবকিছু এত বাজে পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে সেটা ধারনাতেও ছিল না ওর।বরাবরাই রাগের পারদটা দু কাঠি উপরে তবে সবসময় নিজেকে সামলে নেয় স্রোত।সিন ক্রিয়েট হওয়ার মত কিছুই করে না।নিজের কাজ কৌশলে হাসিল করে আর কেউ তা টেরও পায় না। ওই ছেলেগুলোর চাওনির জন্য ও শাস্তি দিয়েছে নিজ হাতে তবে কেউ সেটা টেরও পায়নি। ছেলেগুলো পার্টি থেকে বেরোতেই ও চাপড়ে ওদের গাল লাল করে দেয়।সবাই বেকুবের মত শুধু তাকিয়ে ছিল।বুঝতে পারেনি হঠাৎ তাদের ওপর আক্রমনের কারন।কাউকে পাল্টা কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উরাধুরা থাপড়ালো শুধু।কয়েক মিনিটের মধ্যে তাদের তিনজনের গাল গরম হয়ে গেল।তিনজন গালে হাত দিয়ে প্রশ্ন করলো,

— ভাই কিসের অপরাধে এভাবে মারলেন আমাদের।কি করেছি আমরা?
ওদের গাল গুলো টমেটোর মত লাল করে দিয়ে শুধু এতটুকুই বলেছিল,

–ভদ্রতার পোশাক গায়ে জরিয়ে নিলেই শুধু ভদ্র হওয়া যায় না।আচরনেও তা ফুটিয়ে তোলা উচিত। পরবর্তীতে মেয়েদের দিকে চোখ পড়লে সম্মানের সাথে তাকাবি।হয়তো সে তোর বোন নয়।তবে সে অন্য কারো বোন।হয়তো সে তোর প্রেমিকা বা স্ত্রী নয়।কিন্তু অন্য কারো প্রেমিকা বা স্ত্রী।তাই মেয়েদের সবসময় সম্মানের দৃষ্টিতে দেখবি।ভবিষতে যদি কখনো কোন মেয়ের দিকে বাজে নজর দিতে দেখেছি।তাহলে যে চোখ দিয়ে দেখবি সেই চোখ আর থাকবে না।গট ইট।

বলেই হনহন করে বেরিয়ে এলো।কথার উপর ভিষন ভাবে রেগে যাওয়া একটু অনুশোচনা হলো।নিজেকে অপরাধী মনে হলে।দোষটা ওর ও কম নয়।তি দরকার ছিল এই পোশাক গুলো কথাকে পড়তে দেওয়ার জন্য। ও যদি না দিত তবে তিশাও কথাকে জোর করত না। আর না কথা ওটা পড়তো।তবে স্রোত তো ওকে পড়ে বলেই দিয়েছিল চেঞ্জ করে নিতে।ওই ঘাড়ত্যাড়া মেয়েটা চেঞ্জ করলো না।তাই তো এতসব হলো।যখন পার্টিতে ফিরে কথাতে পেল না।আর বাড়ির ভিতরেও পেল না তখন পিচ্চুকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে ও বলে,

–আপুকে তো ছুটে বাইরে যেতে দেখেছি।মনে হচ্ছিলো আপু কাঁদছে। আমি ডাকলাম তবু শুনলো না।কি হলো বলো তো ভাইয়া।

— তেমন কিছু না।তুমি কাউকে কিছু বলবে না প্রমিস কর।তাহলে তেমাকে অনেক চকলেট দেব।

–আচ্ছা।কাউকে বলবো না।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে এলো।তখন প্রায় ভোরের প্রথম প্রহর।তবে বাইরে আলোর ছটা দেখা যাচ্ছে না।বিছানায় শুয়ে এসব ভাবছিল।

.
এদিকে তার যাওয়ার পর উঠে বসি আমি।ঘুমোনো সম্ভব না।এই লোক স্বাভাবিক নয়।অস্বাভাবিক! কালকে কেমন হিংস্র হয়ে উঠেছিল।এখানে আর থাকা যাবে না।আর এই মানুষটার থেকে নিজেকে যথাসম্ভব আড়াল রাখবো।উনার কোন আচরনের মানে নেই।এই আষাঢ়ের মত বিশাল কালো মেঘে ছেয়ে থাকা মুখ,তো কখনো কাল বৈশাখি ঝড়ের মত তীব্র ভয়ংকর আবার কখনো ভিষন শান্ত।নমনীয়! উনার রাগের কারন খুঁজে পাই না আর না নমনীয়তার। যাই হোক আপাত দৃষ্টিতে এত চিন্তা ভাবনার পর আমার সিদ্ধান্তে আমি অটল।আজকের পর থেকে এই লোকের দৃষ্টিসীমার বাইরে থাকবো আমি।
আমার এই সামান্য সিদ্ধান্ত যে এই দুই বছরে কারো জীবনে চরমভাবে আঘাত আনবে ভাবিনি আমি।আমার ভয় পেয়ে ভুল করে নেয়া একটা সিদ্ধান্তের পরিনতি ঠিক কতটা ভয়াবহ আকাড় ধারনা করবে সেটা ধারনাই ছিল না আমার।

#চলবে…..