Tuesday, June 24, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1064



পিশাচ পুরুষ পর্ব-০৭

0

#পিশাচ_পুরুষ
৭ম পর্ব

ভয়ানক সুন্দর একটা রাত পার করেছে কিশোরী মেয়েটা গভীর জঙ্গলে। ক্লান্তিতে অবশ্য শরীর এখন অবশ হয়ে আসছে। মন তবুও চঞ্চল হয়ে রয়েছে, শিকরগুলোর রস বাবার দৃষ্টিশক্তি যতক্ষণ না ফিরিয়ে দিচ্ছে, মনে কিছুতেই শান্তি পাবে না সে। তাকে পরীক্ষা করে দেখতেই হবে অচেনা সেই যুবকের কথা কতটুকু সত্য, বিকট সেই বৃক্ষের ক্ষমতা কতদূর প্রসারিত, সত্যি! ভোরের হালকা আভায় আলোকিত হয়ে উঠছে চারপাশ। বাড়ির কাছে পৌঁছে গেছে সকিনা। ভয়ে ভয়ে ঘরে ঢুকলো, বাবা ঘুমিয়ে আছে দেখে হাপ ছেড়ে বাঁচলো। কেউ টের পায়নি তার এই অভিযান সম্পর্কে। শিকড়ের ঔষধটা কাজ না করলে জঙ্গলের এই রাতটার কথা সে কাউকে বলবে না প্রতিজ্ঞা করলো।

শিকরগুলো বেঁটে প্রায় ভর্তার মতো করে ফেলল সে। ধীরে ধীরে এসে বিছানায় বাবার মাথার পাশে বসলো। ভর্তার প্রলেপটা লেপ্টে দিতে লাগলো তার বন্ধ চোখজোড়ার উপরে। তার বাবা চমকে উঠলেন, ‘কে? কে?’ বলে। সকিনা তাকে শান্ত করলো। বলল, ‘একটা ঔষধ দিচ্ছি বাবা, তুমি এখন থেকে আবার আগের মতো দেখতে পাবে।’ হোসেন মিয়া মুচকি হাসলেন, ‘তোর মাথা খারাপ হইছে সকিনা! মরা জিনিস কী আবার বাঁচে! রাত কত হইছে? ঘুমা গিয়া মা।’

‘আহা আব্বা, চুপচাপ শুইয়া থাকো তো।’

প্রলেপ দিয়েই ঘর থেকে বের হয়ে গেল সে। বুক ধড়ফড় করছে। কী হবে এখন! একবার মনে হলো সমস্তটাই ছেলে মানুষী, এমন আবার হয় নাকি! পরমুহূর্তেই ভাবল, রাতে তার সঙ্গে যা ঘটে গেল, এরপর অলৌকিক শক্তির প্রভাবে তার বাবা দৃষ্টি শক্তি ফিরে পেলে আশ্চর্য্যের কী আছে!

বাইরে পুরোপুরি ফর্সা হয়ে উঠেছে। উঠানে একটা পিড়ি পেতে চুপচাপ বসে আছে সকিনা, মনে হাজার শঙ্কা। হঠাৎ ঘর থেকে ভেসে এলো বাবার চিৎকার। মনের ভুল নাকি! মনে হচ্ছে বাবা আনন্দে চিৎকার করে কাঁদছেন! ছুটে ঘরে গেল সে। হোসেন মিয়া বিছানা থেকে প্রায় লাফিয়ে নামলেন। টলতে টলতে এসে সকিনাকে জড়িয়ে ধরলো, ‘মারে! কত দিন পরে আমার মায়ের মুখটা দেখলাম। এই দেখ আমি সব দেখতাছি! কী ঔষধ দিলি তুই!’ আনন্দে কাঁদতে থাকে সকিনাও। সব তাহলে সত্যি! যুবকটা আর বিশাল গাছটার জন্য কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে উঠল।

মেয়েকে রেখে হোসেন মিয়া ছুটলেন গ্রামের রাস্তার দিকে। তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি আবার দেখতে পাচ্ছেন। পুরো গ্রাম বাচ্চা শিশুর মতো ছুটে বেড়ালেন তিনি। কতদিন পর দেখছেন এই সুন্দর দৃশ্যগুলো! গ্রামের সব মানুষ বিস্মিত হয়ে গেল হোসেন মিয়াকে দেখে। লোকটা দৃষ্টি শক্তি ফিরে পেল কী করে! হোসেন মিয়া সবাইকে বলে বেড়াতে লাগলো, সকিনা এক অদ্ভুত ঔষধ তার চোখে মাখিয়ে দিয়েছিল, ওটাই তার জ্যোতি আবার ফিরিয়ে দিয়েছে।

আস্তে আস্তে হোসেন মিয়ার অলৌকিক ভাবে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার গুঞ্জনটা পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো। সবাই হোসেন মিয়ার বাড়িতে এসে ভিড় জমালো। সকিনা বলল, হঠাৎ স্বপ্নাদেশ পায় সে জঙ্গলে যাওয়ার। স্বপ্নে পাওয়া পথ মোতাবেক রাতের আধারে একটা বড় গাছের নিচে হাজির হয় সে। হাটুমুরে গাছের কাছে প্রার্থনা করে বাবাকে নিয়ে। গাছটা তাকে শিকড়ের সন্ধান দেয় এবং তা দিয়েই তার বাবা দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায়।

গ্রামের মানুষেরা বিস্মিত হয়ে শোনে। অনেকেই বিশ্বাস করে ঘটনাটা। কেউ কেউ আবার বলে, পাগলের প্রলাপ। আপনা আপনিই সেরে উঠেছে হোসেন মিয়া। গাছ আবার ইচ্ছা পূরণ করে নাকি! সকিনা তাদের বলে , পৃথিবীর এমন কিছু নেই যা ওই গাছটা দিতে পারবে না। কিন্তু জঙ্গলের ওই অংশটা পুরুষদের জন্য বিপদজনক। শুধু নারীরাই সেখানে যেতে পারবে এবং যেতে হবে মধ্যরাতে। হাটুমুরে গাছটার কাছে জানাতে হবে প্রার্থনা। পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো ঘটনাটা।

জঙ্গলের খুব ভেতরে এই গ্রামের কেউই কোনোদিন যায়নি। যাওয়ার তেমন কোনো প্রয়োজনও পড়েনি। অনেকেই জানতো এই জঙ্গলের শেষ মাথায় একটা বড় নদী আছে, যা কিনা সাগরের সাথে মিশেছে। যারা অতি বয়স্ক তারাও তাদের ছোটবেলায় বড়দের কাছে শুনেছে জঙ্গল শেষের ওই নদীর পাড়ে নাকি একসময় প্রাচীন একটা গোষ্ঠী বাস করতো। নানান পিশাচ দেবতা পূজারী ছিল তারা । ভয়ানক ভয়ানক পিশাচের পুজো করতো তারা। আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসতো তাদের মাঝে। তাদের সাহায্যে পূর্ণ করতো নিজেদের মনসকামনা। লাভ করতো, দীর্ঘায়ু, অসীম শক্তি। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ বন্ধি করে এনে উৎসর্গ করতো পিশাচের উদ্দেশ্যে। কোনো এক পিশাচ বিরোধী নারীর ছলনায় পরে গোষ্ঠীর প্রধান মাতবর, এক শক্তিশালী পিশাচের পুজোয় অবহেলা করেছিল। পিশাচটা ক্রোধে, ক্ষোভে অভিশাপ দিয়ে গ্রাম প্রধান সহ তার সব সন্তানদের গাছ বানিয়ে ফেলে। অভিশপ্ত গাছ অনন্তকালের জন্য। গোষ্ঠীর বাকি লোকগুলোও তার রাগ দেখতে রক্ষা পায়নি।

গোষ্ঠীর বাকি মানুষদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে এক অচেনা অদ্ভুত রোগ। তাদের শরীরের ভেতর পোকা জন্মাতে শুরু করে। রক্ত শুষে ফুলতে থাকে আকারে ওগুলো। তারপর ধীরে ধীরে সংখ্যায় কয়েক হাজারে পরিণত হয় শরীরের ভেতরেই। মানুষের মাংস ছিদ্র করে বেরিয়ে আসতে থাকে বাইরে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিলবিল করতে থাকে সারা শরীরে। শরীর জুড়ে হাজার ফুটো তৈরি হয়, ওসব থেকে পুঁজ বের হয় অনর্গল আর পোকাগুলো ভেতরে ঢোকা এবং বের হওয়ায় ব্যাস্ত থাকে পথটা দিয়ে। শরীরে ঘা হয়ে যায়, পঁচা গন্ধে ছেয়ে যায় চারপাশ, তাদের মাংস গলেগলে পড়তে থাকে শরীর থেকে। ভয়ঙ্কর বীভৎস হয়ে ওঠে চারপাশ। কয়েকজন তখন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় শুধু।

এইসব কথাগুলো গল্প হিসেবেই গ্রামের সবাই শুনতো। তাও বহু বহু বছর আগে। বিশ্বাস করার মতো কিছুই ছিল না এতে। গোষ্ঠীর যেসব লোক পালিয়ে গিয়েছিল তাদের কেউ কেউ নাকি আশেপাশের গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের থেকেই এইসব গল্প ছড়িয়েছে। পিশাচ চর্চা যে কী ভয়ঙ্কর বিপদ বয়ে আনে তা বুঝতে পেরে পরবর্তী জীবন তারা এসব থেকে দূরে থাকে। এরপরে এসব কাহিনী প্রায় ভুলেই গিয়েছিল গ্রামের লোকেরা আজ পর্যন্ত।

সকিনার পিতার দৃষ্টি শক্তি ফিরে পাওয়া, সকিনার জঙ্গলের কাহিনী বর্ণনা, শক্তিশালী গাছটির আবির্ভাবের প্রসঙ্গে তাই গ্রামের বয়স্করা চঞ্চল হয়ে উঠলেন সেই ছেলেবেলার গল্পটার কথা মনে হতে। বললেন, ছোট বেলায় এমন গাছের কথা তারা শুনেছিলেন বড়দের কাছে। গাছটা একটা পিশাচের অভিশাপ। ওটা পিশাচ বৃক্ষ। ছোট উপকারের ফাঁদে ফেলে বড় ক্ষতি করে ফেলবে। কেউ যাতে ভুল করেও লোভে পরে জঙ্গলে না যায়। বয়স্ক মানুষের কথার তাৎপর্য কেউই অনুধাবন করে না। গ্রাম্য মানুষেরা কুসংস্কারচ্ছন্ন হলেও পিশাচ জিনিসটার সাথে পরিচিত নয়। অবশ্য গ্রামে বেশ শান্তি শান্তি একটা পরিবেশ বিরাজ করছিল। কারণ সেই রাতে কুকুর গুলোর সাথে সাদা জন্তুটার ভয়ানক লড়াই হওয়ার পর থেকে তারা আর ওটার দেখা পায়নি। ওটা নিয়ে তাই আতংক অনেকটাই কেটে গিয়েছিল।

গ্রামের কয়েকজন যুবক সকিনার বর্ণনায় কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল। সত্যিই যদি এমন এক গাছ থাকে যা তাদের মনের সব ইচ্ছা পূরণ করবে! তারা দলবেঁধে দিনের আলোতে জঙ্গলের ভেতর প্রবেশ করলো গাছটাকে খুঁজে বের করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু জঙ্গলের একটু গহীনে ঢুকতেই পথ হারিয়ে ফেলল, মুখোমুখি হতে লাগলো বন্য জন্তুর। কোনো রকমে দৌড়ে প্রাণ নিয়ে জঙ্গল থেকে পালিয়ে আসতে পারলো তারা। জঙ্গলে আবার ঢোকার সাহস নেই। সকিনার বলা পথ মতো অনেক পুরুষ লোকও জঙ্গলের ভেতর গভীর রাতে গিয়ে বৃক্ষের কাছে পৌঁছাতে চাইলো। কিন্তু অল্পখানি এগিয়েই পথ হারিয়ে ফেলে হতাশ হয়ে অনেক কষ্টে বাড়িতে ফিরে আসতে হল তাদের। মহিলারা এখনো কেউ সাহস করে উঠতে পারেনি। যেখানে পুরুষেরা পারছে না তারা কী করে মধ্যরাতে জঙ্গলে প্রবেশ করবে!

একজন মহিলা একদিন এসে সকিনার কাছে মনোযোগ দিয়ে সমস্ত বিবরণ শুনে নিল। মহিলাটি নিঃসন্তান ছিল। তার যৌবনের অন্তিমে পৌঁছে গিয়েছে। এখন বাঁচা-মরা তারপক্ষে বড় কিছু নয়। ভয়হীন মন। তাই একরাতে সে সাহস করে লুকিয়ে হারিকেন হাতে ঢুকে পড়লো জঙ্গলে। সোজা হাটতে লাগলো। এমন সময় জঙ্গলের ভেতর চোখে পড়লো একটি রাস্তা। যেন দীর্ঘদিন ধরে মানুষ চলতে চলতে এটা তৈরি হয়েছে। সেই পথ ধরে হাটতে হাটতে পৌঁছে গেল সে দানব আকৃতি বৃক্ষের কাছে। সমস্ত মন-প্রাণ ভয় আর আতঙ্কে টনটন করছে। হাটুমুরে প্রার্থনা করলো ওটার কাছে একটা সন্তান। এরপরেই বাড়ি ফিরে গেল। কোনো বিপদই হলো না পথে।

তার কিছুদিন পরই মহিলাটি আবিস্কার করলো সে সন্তান সম্ভবা। সে আর তার স্বামী উন্মাদ প্রায় হয়ে গেল। গ্রামের লোকেরাও অবাক হলো শেষ যৌবনে ফুলবাণুর জীবনে এই পরিবর্তন দেখে। আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়লো কথাটা। ফুলবাণু নাকি জঙ্গলে গিয়েছিল গভীর রাতে। সেই বৃক্ষের কাছে প্রার্থনা করায় সন্তান পাওয়ার আশা পূরণ হতে যাচ্ছে। গ্রামের নারীরা পুলকিত, শিহরিত হয়ে উঠলো। এটা সত্যি তাহলে! কোনো পুরুষ না পারলেও নারীর মনোবাসনা পূরণ করে গাছটি!

এরপর থেকে প্রায় রাতেই কখনো একা, কখনো দল বেঁধে নারীর দলকে আলো হাতে জঙ্গলে প্রবেশ করতে দেখা গেল। খুব সহজেই বৃক্ষের কাছে পৌঁছানোর পথ খুঁজে পাচ্ছে তারা ঢোকা মাত্রই, কোনো জন্তুর হামলারও শিকার হচ্ছে না। বৃহৎ আকার গাছটার দিকে তাকাতে এমনিই তাদের মনে ভক্তি জাগছে। জানাচ্ছে তাদের প্রার্থনা ওটার কাছে। সবার প্রার্থনাই পূরণ হতে থাকে। কেউ চায় সন্তান, কেউ চায় অধিক ফসল, কেউ চায় অর্থ, কারো রোগ থেকে মুক্তি।

দিন যত যেতে থাকে রাতে জঙ্গলের ভেতরে নারীদের আনাগোনা তত বাড়তে থাকে। সবার মুখে মুখে অনেক দূর ছড়িয়ে পড়েছে গাছটার মহত্ব।

এরপরেই ঘটতে থাকলো নিয়তির ভয়ংকর খেলা তাদের সঙ্গে। কেউ ছয় জনের দল নিয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করলো হঠাৎ দেখলো তাদের মধ্যে একজন উধাও হয়ে গিয়েছে। অনেক খুঁজেও আর তাকে পাওয়া গেল না। না জঙ্গলে না গ্রামে। কোনো এক গ্রামের বউ কাউকে না জানিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়লো বৃক্ষের কাছে যাবে বলে। কিন্তু সে আর ফিরলো না। কেউ জানতেও পারলো না সে কোথায় নিখোঁজ হলো। নারীগুলো এতই আলাদা সময়ে, আলাদা ভাবে নিখোঁজ হলো যে সাধারণ নারীরা তেমন আতঙ্কিত হলো না। ভাবল, হয়তো বন্য জন্তুর শিকার হয়েছে মেয়েগুলো। এত বড় সাহায্য পেতে গেলে একটু বিপদের ঝুঁকি তো নিতেই হবে!

কিন্তু দিন যত গড়াতে লাগলো। নারীদের নিখোঁজ হওয়ার সংখ্যাও বাড়তে লাগলো। যা চোখে পড়ার মতো। এখন আশেপাশের প্রায় অনেক নারীরাই এখানে রোজ রাতে আসেন। তাদের অধিকাংশই ফিরে যেতে পারে। শুধু নিখোঁজ হয়ে যায় কয়েকজন। কোথায় যায় ওরা?

বৃদ্ধ পিশাচ বৃক্ষ পুরুষ তার সন্তানের বুদ্ধিতে মুগ্ধ। এত দ্রুত কাজটা হয়ে যাবে সে আন্দাজও করেনি। ভাগ্যিস অর্ধেক মানুষের শরীর নিয়ে জন্মেছে জন্তুটা। কত যুগ পরে তার মনের আশা পূরণ হতে যাচ্ছে। অভিশাপ কাটিয়ে ওঠার পথ খুব কাছে চলে আসছে। তার কোটরে এখন নারী ঘুমিয়ে আছে ৬০জন। আর মাত্র ৪০টা শিকার লাগবে।

গাছের আড়ালে লুকিয়ে আছে সেই সুদর্শন যুবক। ঐতো একজন নারী হারিকেন হাতে এগিয়ে আসছে এদিকে, তার আশেপাশে আর কেউ নেই। যুবকটাকে দেখে থমকে গেল মেয়েটা। একটা গাছের আড়ালে চলে গেল যুবক। মেয়েটা নেশাগ্রস্থের মতো গাছের সারির কাছে চলে এলো। যুবকটার শরীরের সাথে জড়িয়ে নিল নিজেকে। মুহূর্তেই চমকে উঠলো বাহুতে লোমশ শরীরের অস্তিত্ব টের পেয়ে। তাকিয়ে দেখল একটা সাদা জন্তুকে জড়িয়ে রেখেছে সে। কিছু বোঝার আগেই কামড় বসিয়ে দিল জন্তুটা তার ঘাড়ে। যুবক , জন্তু বিষয়টাই অপরিস্কার। জন্তুটা টেনে নিয়ে যাচ্ছে তার ৬১ তম শিকার নারীকে গাছটার কোটরে। গাছটার ভেতর থেকে যেন এক আনন্দের জয়ধ্বনি বেরিয়ে এলো। কে জানবে এই গর্তের ভেতরে স্তুপ করে রাখা হয়েছে ৬১টি লাশ!……………………………………
.
.
. . . . চলবে . . . .
.
.
লেখা: #Masud_Rana

পিশাচ পুরুষ পর্ব-০৬

0

#পিশাচ_পুরুষ
৬ষ্ঠ পর্ব

গ্রাম যখন মধ্যরাতের ঘুমে স্তব্ধ তখন সকিনা এক অচেনা পুরুষের সাথে জ্যোৎস্নার আলোতে ঢুকে পড়লো গভীর জঙ্গলে। মনে আশা সেই বৃক্ষের সন্ধান যদি সত্যিই লোকটা দিতে পারে, তার বাবা হয়তো সত্যিই আবার তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবে। এই লোকটার সাথে গত দুই সপ্তাহ থেকে অন্তত এইটুকু বুঝতে পেরেছে সে লোকটার সাথে থাকলে তার কোনো ক্ষতি হবে না। বেশ অনেকক্ষণ শব্দহীন ভাবে চলল দুজনে। জঙ্গলের শুরুর দিকে গাছ-পালা, ঝোপ-যার কম থাকায় চলতে তেমন অসুবিধা হচ্ছে না। অবশ্য সে খেয়াল করলো না, জঙ্গলের ভেতরে ঢুকতেই যুবকের চেহারা কেমন যেন একটু কঠোর হয়ে এলো, শরীরের পেশীগুলোও শক্ত হয়ে আসছে,লোম কূপের ঘনত্বও বাড়ছে। সকিনা শুধু মুগ্ধ চোখে জঙ্গলের চারপাশ দেখতে দেখতে হাটছিল। ভেতর থেকে যে জঙ্গলটা এত সুন্দর আর ভয়ের তা বাইরে থেকে বোঝাই যায় না। নানান জন্তুর হাঁক ভেসে আসছে জঙ্গলের এদিক-সেদিক থেকে। ওগুলো কী রাতেও ঘুমায় না! ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ, পায়ের খসখস, এক সুদর্শন যুবকের সাথে পথ চলা তার মনকে রোমাঞ্চিত করে ফেলে।

সকিনা নিশ্চিত এই যুবক তার সাথে না থাকলে সে এতক্ষণে ভয়ে দৌড়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে যেত। অনেকটা পথ চলার পর ভাবলো, কোথায় যাচ্ছে তারা? আসলেই কী অমন কোনো গাছ আছে যার শিকড়ের রস মানুষকে দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দিতে পারে! চাঁদের মিহি আলোয় লোকটাকে কেমন অদ্ভুত লাগছে। ওর গায়ে যে এত লোম তা সে এতদিন খেয়াল করেনি কেন! তার থেকে কয়েক কদম সামনে মানুষটা, সকিনার ইচ্ছা করছে তার শরীরটা স্পর্শ করতে।

হঠাৎ একটা গাছের গোড়ার কাছে গিয়ে বসে পড়লো যুবকটি। সকিনা অবাক হয়ে গাছের দিকে তাকিয়ে দেখল এটা খুবই ছোট একটা গাছ, লোকটার দেওয়া বর্ণনার সাথে মিল নেই। যুবক তার দিকে তাকিয়ে হাসলো, ‘এটা সেই গাছ নয়, ওটা আরো ভেতরে। তুমি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছ, একটু বিশ্রাম নাও।’ আসলেই ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল সে। তারপাশে গিয়ে বসে পড়লো সেও।

যুবকটি তার দিকে তাকিয়ে আছে, কী অদ্ভুত সুন্দর চোখ লোকটার। যুবকের শরীর কেমন কম্পিত হচ্ছে, সকিনার মনে হচ্ছে তার চোখে কোনো ভ্রম হয়েছে। লোকটার চোখগুলো লাল হয়ে আসছে, শরীরের লোম আর ঘন হয়ে উঠছে। এটা কী করে সম্ভব! লোকটা তার একটু কাছে এসে দুই হাত চেপে ধরল। বলল, ‘বাকিটা পথ তোমাকে একা যেতে হবে। তুমি এদিক বরাবর সোজা চলতে থাকবে। এখানে দুজন মানুষ পাশাপাশি চললে বিপদ হতে পারে। আমি ঐ ঝোপের আড়ালে আড়ালে তোমার পাশাপাশি চলবো। দুজনের কেউই কোনো কথা বলবো না। চলো!’

এই বলেই লোকটা দ্রুত ছুটে ঝোপের আড়ালে চলে গেল। হতভম্ব হয়ে গেল সকিনা। এর জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। একা একা সে কী করে চলবে। দুজন একসঙ্গে চললে কী বিপদ! সামনের পথে তাকাতেই বুকটার কম্পন বেড়ে গেল। ঘন ঝোপ-যার, ঘন গাছের সারি। সে কয়েকবার লোকটাকে ডাকলো। সাড়া পেল না। তারপর ভয়ে ভয়ে সামনের দিকে চলতে লাগলো। গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে যে জোৎস্নার আলো প্রবেশ করছে সেই আলোতে কোনোরকম ভাবে পথ চলা যায়। তার ডানপাশে বিশাল ঝোপ। তার ওপাশ থেকেই অন্য কারো পথ চলার খসখস শব্দ শোনা যাচ্ছে। অর্থ্যাৎ সেই যুবকটি তার পাশাপাশি হাঁটছে আড়ালে কথামত। কিন্তু পদশব্দ এত ভারী মনে হচ্ছে কোনো চারপায়া জন্তু হাঁটছে, ফসফস করে এত জোরে লোকটা শ্বাস নিচ্ছে কী করে!

দানা পাকানো ভয় নিয়েই প্রায় এক ঘন্টা একা হেটে চললো সে। ক্লান্তিতে শরীর অবশ হয়ে আসছে, কিন্তু থামবে কিনা সে বুঝতে পারছে না। এদিকে গাছ কম। কিন্তু ওই ঝোপটা এখনো তার থেকে যুবকটাকে আলাদা করে রেখেছে। দ্রুত হাঁটছে সে আর ছটফট করছে মন। কী জানি বিপদের গন্ধ নাকে এসে আঘাত করছে। তার ডানদিকে বড় ঝোপ। বা দিকেও কিছু ছোট ছোট ঝোপ রয়েছে। সেদিকে একমুহূর্ত চোখ পড়তেই তার শিরদাঁড়া বেয়ে বরফ শীতল বাতাসের একটা স্রোত বয়ে গেল। ঝোপের পেছন থেকে এক জোড়া জ্বলজ্বলে চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। ওটা যে কোনো বন্য জন্তু তাতে আর কোনো সন্দেহ নেই। তারপাশ থেকে বেরিয়ে এলো আরো এক জোড়া চোখ, তারপাশ থেকে আরো এক জোড়া। মুহূর্তেই ঝোপের আড়াল থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে এলো তিনটি ভয়াল দর্শন বাঘ। হুঙ্কার ছাড়লো সকিনাকে উদ্দেশ্য করে।

পিছু ঘুরে দৌড় দেওয়ার শক্তিও তার মাঝে এখন অবশিষ্ট নেই। লোকটাকে উদ্দেশ্য করে শুধু বলল, ‘বাঁচাও!’ একটা বাঘ তাকে উদ্দেশ্য করে লাফ দিল, মুখ দিয়ে আর্তনাদ করে, দুই হাত দিয়ে মাথা ঢেকে চোখ বন্ধ করে মাটিতে বসে পড়লো সে। মৃত্যুর প্রস্তুতি। কিন্তু না, ওটা ওকে আঘাত করতে পারেনি। চোখ খুলে দেখল বিকট আকার একটা অদ্ভুত সাদা জন্তু বাঘটার ধড় কামড়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ দিয়েই আছাড় মেরেই বাঘটাকে দূরে ফেলে দিল ওটা। আরেকটা বাঘও হুংকার ছেড়ে লাফিয়ে পড়লো জন্তুটার উপর। জন্তুটা মাথা দিয়ে আঘাত করলো ওটার পেট বরাবর,মাটিতে পড়ে যেতেই দুই পা দিয়ে চেপে ধরলো ওটার শরীর। ওটাও জ্ঞান হারালো। তৃতীয় প্রাণীটা এদের তুলনায় বেশ ছোট বাঘ। সে জন্তুটার এই লড়ার ক্ষমতা দেখে আড়চোখে একবার তার শিকার মেয়েটার দিকে তাকালো।। তারপরেই উল্টো ঘুরে ছুটতে লাগলো। জন্তুটা এবার ঘুরে সকিনার দিকে তাকালো। সে বুঝতে পারছে বাঘ গুলোর কাছ থেকে এই জন্তুটাই তাকে বাঁচিয়েছে, কিন্তু কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে নয়। অন্যের শিকারকে শুধু নিজের খাদ্য বানানোর জন্য এই লড়াই। এমন বড় অদ্ভুত মাংসাশী জন্তুর সে জীবনে কখনো নাম শোনেনি। কিন্তু জন্তুটা তার উপর লাফিয়ে পড়ার কোনো লক্ষণ দেখালো না।

ওটা উল্টো ঘুরে হাটুমুড়ে বসে পড়লো। মুখ দিয়ে হালকা গড়ড়গড় আওয়াজ করলো। মাথা দিয়ে সকিনাকে ইশারা করে বলল যেন ওর পিঠে উঠে পড়তে। সকিনা ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকালো। সেই যুবকটিকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না, তার কী কোনো বিপদ হয়েছে! যুবককে কয়েকবার ডাকলো সে, কিন্তু ঝোপের ওপাশ থেকে কেউ সাড়া দিল না। জন্তুটা চোখ কেমন বাঁকা করে নাক কুঁচকে তার দিকে তাকালো, যেন মজার কিছু ঘটছে! সকিনা ধীরে ধীরে গিয়ে জন্তুটার পিঠের উপর উঠলো। শক্ত করে চেপে ধরলো ওটার পশম যাতে না পড়ে যায়। সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছে তার কাছে। যা কিছু তার সাথে ঘটছে এর কিছুই তো বাস্তবে ঘটা সম্ভব না। এত বিকট একটা জন্তু কী করে তাকে এমন কাছে টেনে নিচ্ছে, সকিনার এক মুহূর্তে মনে হলো এই জন্তুটার সাথে থাকলে তার আর কোনো বিপদ ঘটবে না। অবশ্য যুবকটার জন্য তার মন কেমন কেমন করছে, কোথায় আছে সে!

তাকে পিঠে নিয়েই ছুটে চললো জন্তুটা ঝোপঝাড় পেরিয়ে, নানান গর্ত উঁচু ঢাল পেরিয়ে। প্রায় আধ-ঘন্টা পর একটা বিকট আকৃতির গাছের নিচে ওকে এনে ফেলল জন্তুটা। বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে গাছটার দিকে তাকিয়ে রইলো সে।। এতবড় গাছ, অথচ গাছে কোনো পাতা নেই, ছাল গুলোও কেমন অদ্ভুত রঙের। ঐতো গোড়ার দিকে একটা খুপরি দেখা যাচ্ছে। তাকে পিঠ থেকে একরকম ছিটকেই মাটিতে ফেলে দিল জন্তুটা। এরপর ছুটতে ছুটতে অদৃশ্য হয়ে গেল জঙ্গলের ভেতরে। হতভম্ব হয়ে এই ভয়ানক সুন্দর প্রকৃতির মাঝে দাঁড়িয়ে রইলো এক কিশোরী মেয়ে। চোখমুখ ফুটে তার শুধু বিস্ময় , হাহাকার আর আতংক।

কয়েক মুহূর্ত পরেই পেছনে কারো পদধ্বনি শুনে ঘুরে তাকালো। ঐতো দাঁড়িয়ে আছে যুবকটি। দ্রুত ছুটে লোকটার কাছে চলে এলো সে, ‘কোথায় ছিলে তুমি? আমি ভাবলাম বড় কোনো বিপদ হয়ে গেছে। অদ্ভুত এক জন্তু আমাকে এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছে।’

‘আমি লুকিয়ে লুকিয়ে তোমাকে অনুসরণ করছিলাম জঙ্গলের নিয়মানুসারে। হঠাৎ বাঘ গুলোকে দেখে চমকে উঠি। তখনই দেখি ওই জন্তুটা তোমাকে বাঁচালো। আমি আর দেখা করিনি। হয়তো জন্তুটা আমাকে দেখে আক্রমণ করে বসতো। পরে তোমাদের অনুসরণ করে এখানে এসেছি।’

‘জন্তুটা এত গতিতে আমাকে নিয়ে ছুটে এলো, তুমি পায়ে হেটে কী করে একসঙ্গে, একই সময়ে এখানে পৌঁছালে?’

‘আমি শর্টকাট রাস্তায় এসেছি।’

‘তাহলে আমাকে শর্টকাট রাস্তা দিয়ে নিয়ে এলে না কেন?’

‘আহা! তুমি দেখি অনেক খুঁতখুঁতে। গাছটার দিকে ভালো করে তাকাও।’

গাছটার দিকে তাকাতেই মনে আবার সেই ভয় ফিরে এলো। এর সামনে নিজেকে ক্ষুদ্র, অসহায় একটা মানুষ মনে হচ্ছে তার। যেকোনো মুহূর্তে যেন গাছটা নড়ে উঠবে। গাছের গোড়ালির সেই গর্তের দিকে আঙুল ইশারা করে সকিনা জিজ্ঞেস করলো, ‘ওখানে কী?’ যুবক বিস্মিত হয়ে বলল, ‘আমিওতো বুঝতে পারছি না। যাবে ওটার ভেতরে?’

আৎকে উঠলো সকিনা, ‘কখনই না! কী ভয়ঙ্কর লাগছে!’

‘তাহলে হাটু গেড়ে বসে গাছটার কাছে চোখ বন্ধ করে মন থেকে প্রার্থনা করো। বল প্রভু আমার মনের ইচ্ছা পূরণ করে দিন।’

সকিনা ভয়ে ভয়ে গাছটার একটু কাছে এগিয়ে গেল। হাঁটুমুরে বসে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করতে লাগলো, ‘হ্যা প্রভু, মহা শক্তিশালী গাছ, আমার বাবার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিন।’ তার একদম ঘাড় ঘেষে দাঁড়িয়ে রয়েছে যুবকটি। চোখ জ্বলজ্বল করছে তার। যেন যেকোনো মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়বে সকিনার ঘাড়ে কামড় বসাতে। চোখ খুলে সকিনা পেছনে তাকালো, যুবক নিজেকে সামলে নিয়েছে। হাত ধরে সকিনাকে দাঁড় করালো। নিয়ে গেল বিশাল বৃক্ষের পেছনে। হাত ইশারায় দেখালো কয়েকটি কচি শিকড়। সকিনা ওগুলো তুলে নিল। যুবক এবার গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘এর রস তোমার পিতার চোখে দিলেই তিনি আবার দেখতে পাবেন।’

আনন্দে নেচে উঠলো সকিনার মন। বিশ্বাস করতে পারছে না মুহূর্তটাকে। যুবক বলল, ‘রাত প্রায় শেষের দিকে। যেই জন্তুটা তোমাকে এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছে তা এই বৃক্ষের সন্তান। বৃক্ষের গোলাম। বৃক্ষ তোমাকে পছন্দ করেছে বলেই জন্তুটাকে তোমাকে রক্ষা করে এখানে আনতে পাঠিয়েছিল। আমার বিশ্বাস আমি আড়ালে চলে গেলেই জন্তুটা এসে হাজির হবে এখানে। তোমাকে পৌঁছে দেবে গ্রামে।’

বিচলিত হয়ে সকিনা বলল, ‘আর তুমি?’

‘আমি ছোট পথ দিয়ে ছুটবো। জঙ্গলের শেষ মাথায় গিয়ে আবার দেখা হবে আমাদের। জন্তুটা পুরুষদের পছন্দ করে না। আমাকে দেখতে পেলে বিপদ হবে। আমি চললাম।’

এই বলেই মেয়েটিকে আবার নিঃসঙ্গ করে জঙ্গলের ভেতর চলে গেল লোকটা। আশ্চর্য্যের বিষয় সকিনার জন্য!যেই পথ দিয়ে যুবকটি অদৃশ্য হলো সেই পথ ধরেই মুহূর্ত পরেই এসে হাজির হলো অদ্ভুত বৃহৎ সেই সাদা জন্তুটি। হাটু গেড়ে বসে তাকে পিঠে উঠতে ইশারা করলো। সকিনা জন্তুটার পিঠে উঠলো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ওটার গলা। কোমরের কাছে গিট দিয়ে রেখেছে শিকরগুলো। বাতাসের বেগে ছুটতে লাগলো জন্তুটা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে।

জঙ্গলের শেষে এসে থামলো জন্তুটা। ঐতো দেখা যাচ্ছে গ্রাম। পিঠ থেকে ছিটকে পড়লো সকিনা। একবার সকিনার দিকে তাকালো জন্তুটা, তারপর মুহূর্তেই ঘুরে জঙ্গলের ভেতরে ছুটে চলে গেলো। তার একটু পরেই আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো সুদর্শন যুবকটি। সকিনার মাথায় কিছুতেই ঢুকে না লোকটা এত দ্রুত কী করে চলে এলো।

যুবকটি তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। সকিনার চিবুক স্পর্শ করলো তার হাত, ‘এবার আমাকে বিদায় নিতে হবে।’

সকিনা বিস্মিত হয়ে বলল, ‘মানে!’

‘তুমি আমার জন্য অনেক সেবা-যত্ন করেছ। আমি তোমার প্রতি সব সময় কৃতজ্ঞ থাকবো। কিন্তু আমাকেও আমার বাড়িতে ফিরে যেতে হবে। আমার মনে হয় এটাই সুন্দর সময়।’

চোখ ভিজে উঠলো মেয়েটার। কী বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। যুবকই বলল, ‘রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। তুমি বাড়ি চলে যাও। আমাদের আবার দেখা হবে। এই ঔষধেই তোমার বাবা সুস্থ হয়ে উঠবেন। তবে তোমাকে এর মূল্য দিতে হবে বৃক্ষের কাছে।’

‘কী! কী মূল্য? আগে বলো নি কেন?’

‘ভয় পেয় না। তোমার বাবা দৃষ্টি শক্তি ফিরে পেলে সবাই জানতে চাইবে কী করে এটা হলো! তুমি তখন সবাইকে সত্যিটা বলবে, গ্রামের সবার কাছে ক্ষমতাবান গাছটার মহত্ব প্রচার করবে। আর বলবে তাদের যেকোনো সাহায্যে, বিপদে গাছটা তাদের উপকার করার ক্ষমতা রাখে। তারা যাতে গাছটার কাছে এসে নিজেদের প্রয়োজন উপস্থাপন করে। তবে কোনো পুরুষ যাতে এই জঙ্গলে প্রবেশ না করে। গাছের কাছে প্রার্থনা করতে দলবদ্ধ ভাবে নারীরাই শুধু যাতে আসে। কারণ ওই অঞ্চলে পুরুষ অপ্রয়োজনীয়। প্রয়োজনে তুমি তাদের পথ নির্দেশনা দেবে। শুধু আমার সাথে যে তোমার দেখা হয়েছে এই কথাটুকু বলবে না।’

‘এমন কথা শুনলে তো গ্রামের প্রায় সব নারী ওই গাছটার কাছে গিয়ে হাজির হবে। ওদের তো সমস্যার শেষ নেই আগেই তোমাকে বলেছি।’

‘এটাইতো আমরা চাই!’

‘মানে?’

‘কিছুই না। তাদের অবশ্যই রাতে ওখানে যেতে বলবে। দিনের আলোতে গাছটাকে ওরা খুঁজে পাবে না। তোমার কাজ কিন্তু তোমাকে করতেই হবে। বলো করবে?’

‘করবো।’

‘যাও, তাহলে। আবার দেখা হবে।’

লোকটা ধীরে ধীরে জঙ্গলের ভেতর চলে গেল। কী যেন এক অশুভ আশংকায় মনটা কেঁপে উঠছে সকিনার। লোকটা চলে যাওয়ায় মনটাও বিষাদে ভরে উঠেছে। রাতের শেষ অংশে সে ধীরও পায়ে রওনা দিল নিজে বাড়ির উদ্দেশ্যে চিন্তিত মন নিয়ে।………………………………………….
.
.
. . . . চলবে . . . .
.
.
লেখা: #Masud_Rana

পিশাচ পুরুষ পর্ব-০৫

0

#পিশাচ_পুরুষ
৫ম পর্ব

সকিনা হতভম্ব হয়ে বিবস্ত্র যুবকটির দিকে ঝুঁকে আছে। যুবকের পুরো শরীর রক্তে চুপসে আছে। শরীরের নানান অংশে আঘাতের চিহ্নও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। লোকটার বুক ওঠা-নামা করতে দেখে বুঝলো এখনো বেঁচে আছে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখল কেউ নেই। সে কী লোকজনকে ডাকবে! হঠাৎ যুবকের মুখের দিকে তাকিয়ে কেমন একটা মায়া অনুভব করলো সে। এমন রূপের মোহে সে তার এই বয়সে আর কারো উপর মোহিত হয়নি। সেদিন ভোরে যুবকটিকে দেখার পর কয় রাত স্বপ্নে , কল্পনায় শুধু এই মুখটাই দেখেছে সে। এখন তাই কাছে পেয়ে ইচ্ছা করছে নিজেই সেবা করে ওকে সুস্থ করে তুলবে। হয়তো ছেলেটা বাকি জীবন তার উপর কৃতজ্ঞ হয়ে থাকবে। আরো কত কী ঘটতে পারে! কিন্তু তার তুলনায় লোকটা এত বিশাল যে তার পক্ষে ওকে ঘরে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। তবুও সে একহাত লোকটার মাথার পিছু নিয়ে মাথাটা উঁচু করার চেষ্টা করল। যুবক হঠাৎ করেই নড়ে উঠলো, মিটিমিটি করে তাকালো। সকিনার হৃদকম্পন বেড়ে যাচ্ছে। লোকটা এবার তার হাতে ভর দিয়ে দাঁড়াতে চাইছে বুঝতে পেরে শক্ত করে পেছন দিয়ে তার কাধটা চেপে ধরলো সে। যুবক এবং তার দুজনের চেষ্টায় দুজনেই দাঁড়াতে পারলো। লোকটার অর্ধেক ভর সকিনার শরীরে পড়ায় সকিনার পা অবশ হয়ে রইলো, চলতে পারছে না। লোকটার পুরোপুরি জ্ঞান নেই। তবুও ধীরে ধীরে যেন যুবকের শরীরে শক্তি ফিরে আসতে লাগলো। সে সকিনার গায়ে সামান্য ভর রেখে নিজ শক্তিতেই হাটতে লাগলো তন্দ্রাচ্ছন্নের মতো।

সকিনা বুঝতে পারলো ওর ঘরে লোকটাকে নিয়ে গেলে বাবা নানান প্রশ্ন করবেন। ছোট ছেলে-মেয়েরা কোনো মূল্যবান খেলনা কুড়িয়ে পেলে যেমন কাউকে না জানিয়ে আপন কোনো বাক্সে লুকিয়ে রাখে, ভাবে ওটা দেখলেই কেউ নিজের বলে দাবি করে নিয়ে যেতে পারে , তেমন ভাবেই যুবকটাকে নিজের একান্ত জিনিস বলে মনে হচ্ছে সকিনার কাছে। সে ছাড়া একজনও এই লোকটার কথা জানতে পারলেও যেন যুবকটা তার থেকে আলাদা হয়ে যাবে। কেড়ে নেবে কেউ। এমন অচেনা এক যুবকের জন্য এত টান অনূভব করা যে স্বাভাবিক কিছু নয় সেই বোধটাও তার নেই।

তাদের বাড়ির উল্টোপাশে একটা পরিত্যাক্ত ঘর আছে। বাবার চোখ যখন ভালো ছিল তখন কৃষির নানান সরঞ্জাম সেই ঘরটায় থাকতো। লোকটাকে সেই ঘরে নিয়ে গিয়েই মেঝেতে শুইয়ে দিল সে। দ্রুত ওখান থেকে বেরিয়ে বাবার ঘরে গেল, বাবা তখনো উদগ্রীব হয়ে আছেন কিসের শব্দ ছিল ওটা জানতে।সকিনা আমতা আমতা করে বলল, গাছই ভেঙে পড়েছিল। বাবা ঘুমিয়ে পড়লে বাবার একটা লুঙ্গি নিয়ে আবার লোকটার ঘরে পৌঁছল। বালতি আর মগ এনে একটা গামছায় ভিজিয়ে লোকটার সমস্ত শরীর মুছে দিল সে, রক্ত মুছতে গিয়ে বমি বমি লাগলো তার, তবুও পরিস্কার করতে লাগলো। এরপর পরিয়ে দিল লুঙ্গিটা। হতভম্ব হয়ে লক্ষ করলো লোকটার শরীরের ক্ষতগুলো আপনা-আপনিই সেরে উঠছে। নিজের ঘর থেকে চাদর বালিশ এনে সাধ্যমত লোকটার শোয়ার ব্যবস্থা সারলো। আর কী করবে বুঝতে পারছে না। লোকটার জ্ঞান এখনো ফেরেনি। সারারাত লোকটার পাশে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। বাবার চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর থেকেই সকিনার তার বাবার কাছ থেকে ফুরসৎ মেলে না। একটু পর পর ঘুম থেকে উঠে সকিনার কণ্ঠ শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেন তিনি। কিছুটা দ্বিধা নিয়েই সে ঘরটা বাইরে থেকে তালা দিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো। অনেকক্ষণ ছটফট করতে করতে এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়লো।

যখন ঘুম ভাঙলো তখন চমকে উঠে বিছানা থেকে নামলো সে। মনে পড়ে গেল গত রাতের লোকটার কথা। পুরোটাই কী স্বপ্নে ঘটেছে! নিজের জামার দিকে তাকিয়ে সংকুচিত হয়ে গেল। জায়গায় জায়গায় রক্ত লেগে রয়েছে। পাশের ঘরে গিয়ে দেখল বাবা ঘুমাচ্ছে এখনো। জামা পাল্টে বাইরে বেরিয়ে সেই তালাবদ্ধ ঘরের বাইরে এসে দাড়ালো। তালা খুলে ভেতরে যেতে যেতে বারবার মনে হচ্ছিলো ভেতরে গিয়ে দেখবে কিছুই নেই। কিন্তু না, ঐতো চাদরের উপর শুয়ে আছে সুদর্শন মানব মূর্তিটা। দিনের আলোয় তার সৌন্দর্য্য যেন হাজারগুণ বেড়ে গেছে। এত সুন্দর কোনো পুরুষ মানুষ হয়! ভাবে সে, ছোটবেলায় যেমন রূপকথা শুনতো ওসব কী সত্যি! ছেলেটা কী কোনো রাজপুত্র, পথ হারিয়ে এখানে চলে এসেছে!

লোকটাকে দেখে এখন পুরোপুরি সুস্থ মনে হচ্ছে। মিটিমিটি করে চোখ খুলে চাইলো লোকটা। সকিনার বুক ধক ধক করছে। যুবকের কণ্ঠ থেকে মিষ্টি মিহি আওয়াজ বেরিয়ে এলো, ‘কে তুমি? আমি এখানে কেন?’

কিছুটা শান্ত হয়ে সকিনা উত্তর দিল, ‘গতরাতে তুমি আমার ঘরের পেছনে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলে। আমি তোমার শরীর পরিস্কার করিয়ে এখানে নিয়ে আসি। তুমি কে? তোমার বাড়ি কোথায়?’

ছেলেটার মাথা ব্যাথায় কেঁপে উঠল যেন। দুই হাতে মাথা চেপে ধরলো নিজের, ‘ হ্যা আমার মনে পড়ছে সব। আমি জঙ্গলের ওপাশের একটা গ্রামে বাস করি। কাঠ কাটতে জঙ্গলে গিয়েছিলাম। কিন্তু একসময় ভেতরে চলতে চলতে পথ হারিয়ে ফেলি। সন্ধ্যা নেমে আসে, হঠাৎ মুখোমুখি হয়ে যাই একটা অদ্ভুত সাদা জন্তুর। ওটা আমার উপর আক্রমণ চালায়। আমি কুড়াল দিয়ে কোপ মারি। এরপর ছুটতে থাকি পাগলের মতো। ওটা তবুও পিছু নেয় আমার। ছুটতে ছুটতেই বোধহয় এখানে চলে এসেছিলাম।’

‘কিন্তু তোমাকে আমি এর আগে এক ভোরে দেখেছিলাম যে!’

‘আমাকে! আমি এই প্রথম এখানে আসলাম!’

‘হতে পারে! কিন্তু…. যাই হোক!’

সকিনার লজ্জায় মুখ লাল হয়ে এলো। সে যেন রূপকথার গরিব কাঠুরের এক রূপসী কন্যা, সত্যিই পথ হারিয়ে এক রাজপুত্র তার কাছে এসে হাজির হয়েছে। যুবকটা হঠাৎ বলল, ‘আমার না, খুব ক্ষুধা পেয়েছে!’

বাবার কথাও মনে পড়লো সকিনার। বাবাওতো খাবার চাইবেন একটু পরে। লজ্জা মাখানো মিষ্টি কণ্ঠে যুবকটিকে সে বলল, সে যাতে কোনো শব্দ না করে আর বাইরে না যায়। লোকজন তাকে এখানে দেখলে বিপদ হবে। একটু পরেই সে এসে খাবার দিয়ে যাব। যুবকটি বাচ্চার মতো সরল ভাবে জানালো সে যা বলবে তাই হবে, সে কোথাও যাবে না। এরপর খাবার তৈরি করতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল সে।

গ্রামবাসীরা সারারাত আতংক নিয়ে ঘরে লুকিয়ে থাকলেন। গতরাতে হিংস্র জন্তুটির সাথে কুকুরগুলোর লড়াইয়ের বীভৎস দৃশ্য মাথা থেকে বের করতে পারছে না কেউই। কিন্তু এরপর যা ঘটলো! যে ভূমিকম্পের নজির তারা দেখেছিলেন ভেবেছিলেন পুরো গ্রাম মাটি ফুঁড়ে তলিয়ে নিয়ে যাবে তা। জঙ্গল থেকে ছুটে আসবে অমন আরো ভয়ানক কিছু জন্তু। তেমন কিছুই যখন ঘটল না , তারা হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। সকাল বেলা ভয়ে ভয়ে গ্রামের শেষ মাথায় এসে পৌঁছুলেন কয়েকজন। অবাক হয়ে দেখলেন গত রাতের তাণ্ডবের বিন্দুমাত্র চিহ্নও নেই প্রান্তরের কোথাও। পুরো জায়গাটা থমথমে নীরবতা দিয়ে মেখে রয়েছে। একবিন্দু রক্ত কিংবা, মৃত কুকুরগুলোর কোনো অস্তিত্বই নেই এখানে। বড় জন্তুটার পরিণতি কী হয়েছে তাও তারা জানেন না। উত্তেজনা আর আতংক তাদের গিলে খাচ্ছে এখন অজানা ভয়ে। সব কিছু কে পরিষ্কার করলো, কিভাবে হলো এমন! রাত আবার নামবে এই গ্রামে। গ্রামের লোকদের ভাগ্যে কী বিপদ অপেক্ষা করছে তা তারা কেউ জানে না।

এরপর প্রায় সাতদিন কেটে গেল। গ্রামের লোকেরা জঙ্গল থেকে সেই জন্তুটার আর কোনো হুংকার শুনতে পায়নি, না তার উপস্থিতির কোনো চিহ্ন পেয়েছে। তাদের জীবন ধীরে ধীরে আবার স্বাভাবিক হতে লাগলো।

অবাক করার বিষয় হচ্ছে এই সাত দিন ধরে যে সকিনাদের বাড়ির একটা ঘরে একজন অচেনা যুবক বসবাস করছে তা সকিনা ছাড়া আর কেউই জানে না। এমনকি তার অন্ধ পিতা হোসেন মিয়াও না। সেই ঘরের থেকে যুবক কখনই বের হয় না। সকিনা শুধু তিনবেলা লোকটাকে খাবার দিতে ঘরটাতে যায়। আশেপাশের লোকজনও তেমন তাদের বাড়িতে আসে না। সকিনার যে কয়জন বান্ধবী ছিল তারা ওর সাথে দেখা করতে আসলে খারাপ ব্যবহার করে তাড়িয়ে দেয় সকিনা। ভাবে যুবককে দেখলে তারা সকলেই নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইবে। সে শুধু একা সব সময় লোকটার কাছে থাকতে চায়। রাতে বাবা ঘুমলেই সে চলে যায় লোকটার ঘরে। প্রায় সারারাত গল্প করে দুজনে। লোকটার কাছে তার জীবনের গল্প শোনে। নিজের গল্প বলে। লোকটা খুব আগ্রহ নিয়ে তার কাছে তার গ্রাম, গ্রামের মানুষের জীবনের বর্ণনা শোনে, তারা জঙ্গলে কেন যেতে চায় না , তাদের ভয় গুলো জানতে চায়, কিসের মোহ তাদের বেশি টানে তা নিয়ে আলোচনা করে।

একবার সকিনা লোকটাকে জিজ্ঞেস করেছিল এতদিন এখানে থাকা ঠিক হবে না, তুমি তোমার বাড়িতে ফিরে যাবে না! যুবক বলেছে তার শরীর বাইরে থেকে ঠিক লাগলেও ভেতর থেকে অনেক দুর্বল। যখন সে পুরোপুরি সুস্থ হবে সেদিন যাবে। আর সকিনাকে ছেড়ে যেতেও তার ইচ্ছা করে না। সকিনার খাবারের প্রশংসা করে। সকিনা লজ্জায় মুখ লাল করে ফেলে।

যুবক আরো বলে , তার গ্রামে তাকে ফিরে যেতে হলে প্রায় একদিন একরাত জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলতে হবে। সামনের পূর্ণিমার তিথিতেই সে রওনা হবে যদি সকিনা যেতে দেয়। এবং বলে এর ভেতর তার কথা গ্রামের কাউকেই না বলতে কেননা, গ্রামের মানুষেরা বিশ্বাস করে জঙ্গলের ওপারে যে গ্রাম আছে ওখানে পিশাচেরা বসবাস করে। তাকে পিশাচ ভেবে ক্ষতি করতে পারে সবাই। সকিনা এমনিতেও কাউকে বলতো না। এভাবেই চলতে থাকে।

আরো এক সপ্তাহ কেটে গেল। একদিন যুবকটি সকিনার কাছে জানতে চাইলো , তোমার বাবার চোখ অন্ধ হলো কী করে? সকিনা জানালো, হোসেন মিয়া একদিন ক্ষেতে কাজ করছিল। এমন সময় কয়েকটা পোকা নাকি তার দুই চোখে ঢুকে যায়। তার চোখ জ্বালা করতে থাকে। সে বাড়িতে চলে আসে। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ভয়ানক ফুলে যায় চোখজোড়া। অনেক ভেষজ ঔষধ, ঝাড়ফুঁক করেও কোনো কাজ হয়নি। তিনদিন চোখ অমন ফুলে থাকলো। তারপরে ফুলা ধীরে ধীরে কমে এলো। কিন্তু হোসেন মিয়ার চোখে আর দৃষ্টি ফিরে এলো না। হোসেন মিয়া ছাড়া সকিনার আর কোনো আত্মীয় বেঁচে নেই পৃথিবীতে। মায়ের, ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর কাহিনী তাকে শোনায়।

যুবকের মুখ দেখে বোঝা গেল যুবক কষ্ট পেয়েছে কথাগুলো শুনে। এরপরেই হাসিমুখে সে বলল, তোমার বাবার চোখ ভালো করার একটা উপায় আমার জানা আছে। সকিনা প্রায় লাফিয়ে উঠলো। যুবক বলল, ওই জঙ্গলে এমন একটা বড় মোটা ক্ষমতাবান গাছ আছে যেটার অসাধ্য কোনো কাজ নেই। সব রোগের ঔষধ আছে ওটার শিকড়ে। সেই গাছের শিকড়ের একটু রস তার বাবার চোখে দিলেই সে ঠিক হয়ে যাবে পুরোপুরি। সকিনা বিশ্বাস করতে চাইলো না প্রথমে। কিন্তু যুবক বলতে লাগলো সে নিজের চোখে কত মানুষকে ঠিক হতে দেখেছে তার গ্রামের। গাছটার কত ক্ষমতা! শুধু রোগের ঔষধ নয় ওই গাছটার কাছে চাইলে মুহূর্তেই ধন-দৌলত দিয়ে মানুষকে ধোনি করে দিতে পারে।

প্রথমে অবিশ্বাস করলেও ধীরে ধীরে তার মনে হলো লোকটা হয়তো সত্যি কথাই বলছে। কত অদ্ভুত জিনিস ইতো থাকতে পারে জঙ্গলে। অমন অদ্ভুত সাদা একটা জন্তুও যে ঐ জঙ্গলে থাকতে পারে তাও তো কেউ ভাবতে পারেনি। যুবকটি তাকে বলল, সে জঙ্গলের ওই গাছটা চেনে। এক রাতের মধ্যেই ওখানে গিয়ে শিকড় নিয়ে আসা সম্ভব। আজ পূর্ণিমা রাত , সকিনা যদি চায় ওকে সে ওই গাছটার কাছে নিয়ে যেতে পারে। সকিনা দ্বন্দ্বে পরে রইলো, লোকটা তাকে আশ্বাস দিল অনেক। বাবা আবার আগের মতো দেখতে পারবেন এটা ভেবেই সে পুলক অনুভব করছে। গ্রামের কেউই জানতে পারবে না তাদের যাওয়ার কথাটা। সকিনা সিদ্ধান্ত নিল আজ রাতেই জঙ্গলে যাবে এই যুবকের সাথে সে শিকড় জোগাড় করতে। মধ্যরাত হোসেন মিয়া সহ গ্রামের প্রায় সব লোক ঘুমিয়ে রয়েছেন। জোৎস্নার আলোয় সকিনা যুবকের পিছু পিছু গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করলো।………………………………….
.
.
. . . . চলবে . . . .
.
.
লেখা: #Masud_Rana

পিশাচ পুরুষ পর্ব-০৪

0

#পিশাচ_পুরুষ
৪র্থ পর্ব

গ্রামে মধ্যরাত। সময়টায় রোজকার মতো সকলে ঘুমিয়ে আছে। শুধু মাঝেমধ্যে কয়েকটা কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ শোনা যাচ্ছে। গ্রামে পালিত কুকুরের সংখ্যা যেহেতু এখন শতাধিক। এমন সময়েই জঙ্গলের ভেতর থেকে ভেসে এলো সেই চিরচেনা বিকট হুঙ্কারটা। যে সেই শব্দ শুনেছে সেই জানে এই ধ্বনি কতটা অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিতে পারে। জন্তুটার হুংকার কানে যাওয়া মাত্র সব কুকুরগুলো নানান জায়গা থেকে একসঙ্গে ‘ঘেউ ঘেউ’ করে উঠল। ‘কুঁঊঊঊঊঊ!’ করে শেয়ালের মতো ডাক বেরিয়ে এলো কয়েক জায়গা থেকে। কুকুরগুলো ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। তাদের ঘেউ ঘেউ এর শব্দ ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। কুকুর গুলো একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে, নিঃশ্বাসের গতি আর বুক ধকপকানি বেড়ে যাচ্ছে ওগুলোর, একই তালে নাচাচ্ছে লেজ। গ্রামের সবচেয়ে বড় কুকুরটা লিয়াকত ব্যাপারীর বাড়িতেই আছে। ওটা মাথা উঁচু করে ‘কুউউউউ!’ একটা ধ্বনি উচ্চারণ করলো। এরপরেই ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে এলো গ্রামের শেষ সীমায়, জঙ্গলের দিকে।

ওটার ডাকে সাড়া দিয়ে গ্রামের সমস্ত কুকুর ছুটলো ওটার পেছনে। গ্রামের শেষ সীমায় পৌঁছে জড়ো হয়েছে এখন শ’খানেক কুকুর। উত্তেজনায় ছুটোছুটি করছে এদিক, সেদিক। ঘেউ ঘেউ করে নিজেদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে মনে হচ্ছে। গ্রামের মানুষ গুলোও ভয়ে ভয়ে আড়ালে এসে লুকলো কী হয় দেখার জন্য, সকলের কাছেই আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র, লাঠি আছে। যদিও জানে জন্তুটা আক্রমন করলে ওসব কোনো কাজেই আসবে না। শুধু দেখা যাক এতগুলো কুকুরের সাথে জন্তুটা কী করে!

রক্তহীম করা হুঙ্কার ছেড়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলো জন্তুটা। হালকা চাঁদের আলোয় ওটার আকার এখন আগের চাইতে অনেক বড় মনে হচ্ছে। প্রায় ৪টা পূর্ণবয়স্ক বড় গরুর সমান হবে। কুকুরগুলো অদ্ভুত সাদা জন্তুটাকে দেখে কেমন দিশেহারা হয়ে গিয়েছে। গলার সর্বশক্তি দিয়ে জন্তুটাকে লক্ষ করে, ‘ঘেউ ঘেউ!’ করে যাচ্ছে। এতগুলো কুকুর একসঙ্গে দেখে জন্তুটাও কেমন ভড়কে গেল। কিন্তু পূর্ণ তেজ অনুভব করছে ওটা। জন্তুটা গজড়াতে গজড়াতে সামনের দিকে এগোতে লাগলো। কুকুরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় কুকুরটা সামনে চলে এলো। জন্তুটাকে উদ্দেশ্য করে গজড়াচ্ছে ওটাও। জন্তুটা তীব্র বেগে লাফিয়ে পড়লো কুকুরটার উপর, এক লাফেই কামড়ে ধরল ওটার গলার নরম অংশ, ক্রমশ ওটার দাঁত ডেবে যাচ্ছে নরম মাংসে। একটানে আলাদা করে ফেলল শরীর থেকে মাথা।

বড় কুকুরটার গলা ছিড়ে রক্ত ঝরছে একাধারে, মাথা ছিটকে গেছে দূরে। বাকি কুকুরগুলো এটা দেখেই মিউয়ে গেল হঠাৎ। কয়েকমুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইলো পরিবেশ।তারপরেই ঘেউ ঘেউ করতে করতে প্রায় একসাথে শতাধিক কুকুর লাফিয়ে পড়লো জন্তুটার উদ্দেশ্যে। ওটাও হুঙ্কার ছাড়লো। দ্রুত এদিক সেদিক ছুটছে, যেটার ধড় কামড়ে ধরতে পারছে ওটারই শরীর থেকে মাথা আলাদা করে ছুড়ে ফেলছে। গলা ফেটে ফিনিক দিয়ে রক্ত ঝরছে ওগুলোর। সেই রক্তেই গোসল হয়ে যাচ্ছে ওটার। চার পা দিয়েও সমানে আঘাত করে চলেছে ওগুলোর মাথা লক্ষ করে, ধারালো নখ দিয়ে আঁচড় কেটে ছিন্নভিন করে ফেলছে ওগুলোর চোখ-মুখ, বিশাল শরীর দিয়ে আঘাত ঠেকাচ্ছে।

কুকুরগুলো চেষ্টা করেও কামড় বসাতে পারছে না ওটার বিকট শরীরে। শরীরে উঠলেই ওটার শরীর ঝাড়ার বেগে ছিটকে পড়ছে, জন্তুটার শরীর অসম্ভব পিচ্ছিল। ওটাকে কামড়াতে গিয়ে উল্টো ওটার শরীরের চাপে দম আটকে মারা গেল কয়েকটা কুকুর। জন্তুটার গায়ে কিছু আচর বসাতে পারছে বড়জোর ওগুলো।

জন্তুটা একসময় ক্লান্ত হয়ে উঠল ওগুলোর আক্রমন ঠেকাতে ঠেকাতে আর মারতে মারতে। ওটার সাদা শরীর মৃত কুকুরগুলোর রক্তে লাল হয়ে উঠেছে অনেক আগেই। মৃত কুকুরগুলোকে দেখে বাকি কুকুরগুলোর ভয় পাওয়ার কথা। কিন্তু উল্টো ওগুলো যেন আরো বেশি ক্ষেপে উঠছে, স্বজাতি হত্যার প্রতিশোধ ওদের নিতেই হবে! প্রায় ঘন্টামতো যুদ্ধের পর পঞ্চাশের অধিক কুকুরকে হত্যা করেছে জন্তুটা। এখন ভয়ানক হাপাচ্ছে , বুঝতে পাড়ছে আর তারপক্ষে কিছু সম্ভব নয়। তার শক্তি অনেকটাই কমে গিয়েছে।

কিন্তু বাকি কুকুরগুলোর তেজ যেন বেড়েই চলেছে। এখন শিকার না করে জঙ্গলে পালিয়ে যাওয়াই শ্রেয়। উল্টো ঘুরে জঙ্গলের দিকে তাকালো। শরীর দমে গেল ওটার। পুরো জঙ্গল যেন তাকে দেখে বিদ্রুপ করছে। সেই পিশাচ পুরুষ, তার সন্তান সকলে যেন কটাক্ষ দৃষ্টি নিয়ে তাকে দেখছে। যে কুকুরের তারা খেয়ে জঙ্গলে ফিরে যায় ওকে তারা ত্যাজ্য করবে, জঙ্গলের সন্তান হিসেবে ওকে আর মেনে নেবে না। ফিরে যাওয়া মানেই মৃত্যু। এই বোধ জন্তুটার মন উলট পালট করে দেয়, ভয়ানক শরীর কাঁপানো এক হুঙ্কার বেরিয়ে আসে ওটার গলা ছিড়ে, তা শুনে কাঁপতে লাগলো মাটি আর গাছ। আজ সমস্ত কিছু তছনছ করে দেবে সে এই গ্রামের প্রতিজ্ঞা করলো। রক্ত টগবগ করে ছুটছে ওটার শরীর জুড়ে।

ওটার অন্যমনস্কতার এই সুযোগে ওটার উপর ঝাপিয়ে পড়লো একটা কালো কুকুর, পিঠ বেয়ে ঠিক গলার কাছে লাফিয়ে কামড়ে ধরলো জন্তুটার ধড়, কুকুরটার ধারালো দাঁত ঢুকে গেল চামড়া ভেদ করে মাংসে, পেছন থেকে লাফিয়ে আরেকটা কুকুর ওটার পায়ের নিচে চলে গেলো। লাফিয়ে কামড়ে ধরলো ওটার অন্ডকোষ। ভয়ানক , বীভৎস আর্তনাদ বেরিয়ে এলো জন্তুটার কণ্ঠ থেকে। শরীর ঝাড়া দিয়ে উঠতেই ওটার পা, লেজ, উদ্দেশ্য করে লাফিয়ে পড়ছে একটার পরে একটা কুকুর, কামড়ে ধরছে শরীরের নানান অংশ, ছিড়ে ফেলবে যেন জন্তুটাকে টুকরো টুকরো করে। ব্যথায় কাতর হওয়ায় আক্রমণ ঠেকানোর শক্তি হারিয়ে ফেলেছে ওটা।

কুকুরগুলোও ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। কাত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো, জন্তুটা। মাটি কেঁপে উঠল। ধুলো উড়ে অনেক আগেই এখানের পরিবেশ ঘোলা করে ফেলেছিল। জন্তুটা এবার আর ঘোলা দেখতে লাগলো চারপাশ, শরীরের সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে এসেছে। কুকুরগুলো অবিরাম কামড়ে চলেছে, নড়ার শক্তি পাচ্ছে না ওটা, মুখ দিয়ে শুধু গোঙানি ছাড়ছে।
বুঝতে পারছে জীবনের অন্তিম সময়ে পৌঁছে গেছে সে, এরমধ্যেই গ্রামের দিক থেকে অনেকগুলো জ্বলন্ত আগুনের শিখা ভেসে আসতে দেখলো জন্তুটা, শরীর একেবারে অসাড় হয়ে গেল, চোখ বন্ধ হয়ে গেছে ওটার।

বনের এই ভয়ানক, দানব আকৃতির হিংস্র জন্তু, যে কুকুর দেখে এতটা ভয় পাবে, কুকুররা দলবদ্ধ ভাবে মিলে ওটাকে এমন শক্তভাবে প্রতিরোধ করবে তা গ্রামের মানুষগুলোর কাছে অভাবনীয় ছিল। কিন্তু বন্য জন্তুরা যে হাজার বছর ধরে একটা জিনিসকে সবচেয়ে বেশি ভয় করে সেটা তারা এতদিন ভুলেই গিয়েছিল। আগুন! বন্য জন্তুর জন্য এরচেয়ে ভয়ঙ্কর আতংক আর কিছুই হতে পারে না। দীর্ঘক্ষণ ধরে আড়ালে লুকিয়ে ভয়ে ভয়ে কুকুরগুলোর অসীম সাহস আর জন্তুটার ভয়ানক শক্তির দ্বন্দ দেখছিল গ্রামের লোকজন। একটা সময় সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নেয় শুধু তামাশা দেখার দর্শক নয়, কুকুরগুলোকে সাহায্য করবে তারা জন্তুটাকে মারতে। জন্তুটাকে ভয় দেখাতে তাই সকলে মশালে আগুন জ্বালিয়ে অপেক্ষা করছিল, জন্তুটাকে কুপোকাত হতে দেখে তাই একে একে বেরিয়ে আসতে লাগলো সবাই।

একহাতে মশাল আর ওপর হাতে দাঁড়ালো অস্ত্র, লাঠি সবারই। চেঁচিয়ে একে অন্যের সাথে কথা বলছে, বুঝতে পারছে সকলেই আজই ওটাকে শেষ করে দিতে হবে, নাহলে আর সুযোগ পাবে না। ধারালো অস্ত্র দিয়ে ওটার গলা কেটে ফেলতে পারলেই সমস্ত ঝামেলা শেষ। কুকুরগুলোর উত্তেজনাও মানুষ দেখে কিছুটা কমে এলো, তারা ভয়ানক আহত জন্তুটা থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে লাগলো।

এমন সময় বিকট একটা হুঙ্কার ভেসে এলো জঙ্গলের ভেতর থেকে। ভয়ানক ক্রোধে যেন জঙ্গল পুরোটা কেঁপে উঠছে। আৎকে উঠলো গ্রামবাসীরা, জন্তুটাতো এখানে পড়ে আছে তাহলে আর্তনাদ এলো কোথা থেকে। আর এত জোরে হওয়া হুঙ্কার এর আগে কখনো শোনেনি তারা। তাহলে কী এই জন্তুটার পরিবারের আরো কেউ জঙ্গলে রয়েছে! সর্বনাশ তাহলে! এটাকে উদ্ধার করতে এমন আরেকটা জন্তু এখন এলে তাদের সব শেষ! সর্বনাশই হলো!

ভূমিকম্পের মতো মাটি কেঁপে উঠলো। কিছু জায়গার মাটি অস্বাভাবিক ভাবে কেঁপে উঠছে উপরের মাটিগুলো কেমন ঝুরঝুরে হয়ে আসছে, মাটি ফুঁড়ে বের হতে চাচ্ছে যেন অনেকগুলো প্রাণী! আর্তনাদ করতে করতে মশাল,অস্ত্র ফেলে উল্টো ঘুরে লোকজন সবাই ছুটতে লাগলো গ্রামের দিকে। ভয়ানক কিছু একটা ঘটবে এখন! তাই ঘটলো!

কুকুরগুলো ভড়কে গিয়েছিল, স্তম্ভিত হয়ে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। পালানোর কথা ভাবেনি, গলা দিয়ে চেষ্টা করেও যেন শব্দ বের করতে পারছে না ওগুলো। ওগুলোর শরীরও কাঁপছে মাটির সাথে। মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো একটা গাছের শিকড়, তার পাশে আরেকটা, তার পাশে আরেকটা, এমন করে প্রায় চারপাশ গিজগিজ করতে লাগলো মাটি ফুঁড়ে আসা শিকড়ে, কালো কুচকুচে রং ওগুলোর, সাপের মতো এঁকেবেঁকে ছুটছে এদিক সেদিক, সবগুলোর মাথাই সুচালো। কুকুরগুলোর চেহারায় এই প্রথম ভয় আর আতংক ফুটে উঠলো। শিকড়গুলো এবার ছুটতে লাগলো কুকুরগুলোকে লক্ষ্য করে ।

কাছের কুকুরটার গলা ফুঁড়ে একটা শিকড় এর মাথা ঢুকে ওটার পেট ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো। ছিন্নভিন হয়ে গেল ওটার শরীর। আরেকটা শিকড়ের মাথা পেট দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বের হয়ে আসলো আরেকটা কুকুরের, একটা কুকুরের হা করা মুখের ভেতর ঢুকে পেট ফুটো করে বের হলো, এফোর-ওফোর হয়ে যাচ্ছে ওগুলোর শরীর। রক্ত ছিটকে মেখে ফেলছে মাটি, পেট ফেটে হা হয়ে বেরিয়ে পড়লো নাড়িভুঁড়ি। ছুটে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো যেগুলো ওগুলোর পা পেঁচিয়ে ফেলল শরীর। এরপর দুই দিক থেকে টান দিয়ে শরীর ছিড়ে দুই ভাগ করে ফেলল।

কয়েক মিনিটের মধ্যে সবগুলো কুকুরের ছিন্নভিন্ন শরীর পরে রইলো শুধু ওখানে। গ্রামের লোকেরা কেউই এই দৃশ্য দেখার জন্য পিছু ফিরে তাকায়নি, এক ছুটে যে যার বাড়িতে চলে গিয়ে দরজা বন্ধ করে আতঙ্কে কাঁপতে লাগলো। ঘাম ঝরছে তাদের শরীর থেকে অনাকাঙ্খিত বিপদের গন্ধে। কী হলো এটা! এখন কী হবে!

খোলা প্রান্তরে এখন পরে রয়েছে শতাধিক মৃত কুকুরের ছিন্নভিন শরীরের অংশে, আর কিলবিল করে ছুটে বেড়াচ্ছে কুচকুচে শিকড়গুলো যেগুলোর পিতা কোনো প্রকৃত বৃক্ষ নয়। এক পিশাচ পুরুষ। ভয়ানক আহত জন্তুটা এবার একটু নড়ে উঠলো, তারপরেই শরীরে অবশিষ্ট থাকা কিছু শক্তির উৎস খুঁজে পেল। লাফিয়ে উঠে দাড়ালো ওটা। চারপাশের এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে চমকে উঠলো। পিশাচ পুরুষই তাকে রক্ষা করেছে! এর প্রতিদান তাকে দিতেই হবে। ওটার পুরো শরীর ব্যথায় জ্বলে যাচ্ছে, মাথা ঘুরাচ্ছে। জন্তুটা ছুটতে লাগলো। চোখে সব কিছু ঘোলা ঘোলা লাগছে। তার ফিরে যাওয়া উচিত জঙ্গলের দিকে। কিন্তু সে ছুটে যাচ্ছে গ্রামের ভেতরের দিকে। সে কী ভুল করে ব্যথার ঘোরে ছুটছে, নাকি কোনো হিংস্রক্রোধে জ্বলে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ছুটছে তা তার ছুটার গতি দেখে অনুমান করা যাচ্ছে না।

ঘরের বিছানায় গভীর ঘুমে শুয়ে আছে কিশোরী সকিনা। এই গ্রামের একেবারে শেষ মাথায় ওদের বাড়ি,জঙ্গল থেকে অনেক দূরে। তাই সেখানের গণ্ডগোলের কোনো শব্দই তাদের বাড়িতে এতক্ষণ এসে পৌঁছায়নি। ওখানে যে কী ঘটছে তার সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই তার। হঠাৎ করে তার ঘরের পেছনে ভারী কিছু একটা ধপাস করে পড়ার শব্দে বুকটা কেঁপে উঠলো তার। ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসলো সে। পাশের ঘর থেকে তার অন্ধ পিতা আতঙ্কে খেঁকিয়ে উঠলো, ‘কে? কে? কী হলো রে!’ সকিনা বলল, ‘যাই আমি, গাছ ভাঙছে মনে হয়!’ একটা গাছ সত্যিই বাড়ির পেছনে অর্ধেক হেলে পড়েছিল অনেক দিন।

তবুও ঘর থেকে বের হতে গিয়ে হঠাৎ সে অনুভব করলো, মনে কেমন একটা ভয় খেলা করছে তার। একটা ভয়ানক জন্তুর কথা সে গ্রামের লোকদের কাছে শুনেছে। একহাতে দা আর অন্য হাতে হারিকেন নিয়ে ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে এলো সে। বাড়ির পেছনে গিয়েই চমকে উঠলো। একজন মানুষ অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে, পরনে কোনো পোশাক নেই, সারা শরীর রক্তে ভিজে আছে। একটু কাছে গিয়েই চিনতে পারলো যুবকটাকে। সেদিন ভোরে যে অপরূপ সুন্দর যুবকটিকে সে দেখেছিল এই সে। পুলকে কেঁপে উঠলো তার শরীর। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল যুবকের কাছে। বোঝার চেষ্টা করছে কী ঘটছে! ……………………………………….
.
.
. . . চলবে . . . .
.
.
লেখা: #Masud_Rana

পিশাচ পুরুষ পর্ব-০৩

0

#পিশাচ_পুরুষ
৩য় পর্ব

সেরাতে লিয়াকত ব্যাপারীর বাড়িতে পাওয়া টমির ভয়ানক, বীভৎস ছিন্নভিন শরীর দেখে গ্রামের মানুষেরা একেবারে স্তম্ভিত হয়ে পড়লো। কী জানি কী হয় অনুভূতি তাদের গিলে খেতে লাগলো। জন্তুটা সব সময় হুংকার ছেড়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে গ্রামে প্রবেশ করে এবং শিকার করে। কিন্তু গত রাতে কোনো হুঙ্কার তারা শোনেনি বা অন্য কোনো পশুর উপর হামলাও চালায়নি ওই জন্তুটা। তাহলে কী প্রতিশোধ নিতে কেবল টমিকে মারতে এসেছিল! এত সতর্ক কী কোনো জন্তু হতে পারে! টমির ঘেউঘেউ কিংবা আর্তনাদের শব্দও ব্যাপারী বাড়ির কেউ পায়নি। মাথায় কিছুই ঢুকে না কারো ভেতর আতঙ্ক ছাড়া।

লিয়াকত ব্যাপারীর পরিবারের লোকদেরই ভয় সবচেয়ে বেশি বেড়ে গেল। না জানি ওটা সেই রাতের ক্ষোভে এবার এই বাড়ির মানুষের উপর আক্রমণ চালায় অন্য কোনো রাতে! কারো মাথাতেই এটা আসে না কোনো মানুষ এমন বীভৎস কিছু করতে পারে। গ্রামের মেয়ে সকিনা কুকুরটার মৃত্যুর খবর রাখে না। কিন্তু বারবার তার কল্পনায় ভেসে ওঠে সুদর্শন যুবকের মুখটা।

গ্রামের অনেকেই দূরের গ্রাম গুলোতে চলে যায়। সন্ধান করতে থাকে কুকুরের। যেখানেই কুকুর পায় পোষ মানিয়ে যানে করে তাদের এই গ্রামে নিয়ে আসে। তারা অন্তত এই টুকু বুঝতে পারলো ওই ভয়ানক জন্তুটার কুকুরভীতি রয়েছে এবং কুকুরও জন্তুটাকে দেখে অসাধারণ সাহসী হয়ে ওঠে। কয়টা কুকুর মারবে ওটা? তাই কুকুরের সান্নিধ্যে মনে অনেকটা সাহস যোগায় তাদের। পুরো গ্রাম জুড়ে প্রায় কয়েক’শ কুকুর আনা হলো। লিয়াকত ব্যাপারীর বাড়িতেই আছে ৮টা!

জঙ্গলের গভীর একটা অংশ। ভুল করেও এদিকে কোনো মানুষের পা পরেনা। বিশাল অদ্ভুত দেখতে ডাল আর পাতাবিহীন, লম্বা , মোটা একটা গাছের নিচের গোড়ার দিকে একটা বড় গর্ত দেখা যাচ্ছে। গর্তের এই পথ দিয়ে চললে যেন দেখা পাওয়া যাবে এক অন্য , অপরিচিত জগতের। নিয়ে যাবে ভিন্ন এক রাজত্বে। যেখানে মানুষ বলে কিছু নেই। ওটার ভেতর থেকে কেমন খচখচ একটা শব্দ বেরিয়ে এলো। পরমুহূর্তেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একজন বিবস্ত্র যুবক।

সূর্যের আলোয় এখন উত্তপ্ত দুপুর। এখানে গাছগুলো ও ঘন নয় এবং যে কয়টি গাছ আছে সেগুলোতেও তেমন ডালপালা বা পাতা নেই যে আলোর প্রবেশে বাধা পাবে। তবুও কোনো এক কারণে স্বচ্ছ আলো এখানে পৌছায় না। দিনেও কেমন একটা আঁধার ঘিরে রেখেছে জায়গাটা। গর্ত থেকে বেরিয়ে, উল্টো ঘুরে মাথা উঁচু করে যুবক একবার বিশাল আকৃতির গাছটার দিকে তাকালো। বুকটা তার কেঁপে উঠলো আতঙ্কে।

পুরো মন জুড়ে বাসা বেঁধে আছে ভয়। সে জানে এটা কোনো সাধারণ গাছ নয়। সন্ধ্যা হতেই জেগে উঠবে গাছটা। প্রশ্নে জর্জরিত করে ফেলবে তাকে। সে কী কৈফিয়ত দেবে! সে তার কথামতো কোনো কাজই করতে পারছে না। বৃক্ষের শিকড়ের সাথে যে গর্ত রয়েছে ওখানে দুজন নারীর মৃত শরীর পড়ে আছে। তাদের দুইজনকেই আমরা চিনি, একজন সেই বছর খানেক আগে যে মেয়েটি একটি জন্তু জন্ম দিয়েছিল সে অর্থ্যাৎ যুবকটির মা। সে যেদিন এখানে আশ্রয় নিয়েছিল লোকালয় থেকে পালিয়ে সেদিনই কোনো এক অশুভ শক্তির প্রভাবে দম বন্ধ হয়ে মারা যায় এই গর্তের ভেতর। জন্তুটাকে বড় করার দায়িত্বও নেয় সেই অশুভ শক্তি। অর্থাৎ এই বৃক্ষ পিশাচ। আরেকটা গ্রামের বৃদ্ধা নারী পরীমনির লাশ। কিছুদিন আগে যাকে মোহে আবৃত করে এই জঙ্গলে এনেছিল সে। তবে লাশ দুটোর শরীরে সামান্য পচনও ধরেনি। এই গর্তে কিছুরই পতন ধরে না।

মাত্র দুটো নারী শরীরে সন্তুষ্ট নয় পিশাচটা। যুবককে সেই দানবটি বলেছিল এই গর্তে শতাধিক নারীর শরীর থাকতে হবে। তবেই দানবটা তার সব শক্তি ফিরে পাবে। এবং লক্ষ্য পূরণ হবে। কিন্তু সে নিজের খাবার শিকারই ঠিকমতো করতে পারছে না আর শত নারীর লক্ষ্যত অনেক দূর। কাজটা করতে হবে ধীরে। গ্রামের মানুষ গুলো যদি একবার বুঝে যায় গ্রামের নারীদের নিখোঁজের পেছনে এই জন্তুটা দায়ী তাহলে তারা একেবারে সতর্ক হয়ে যাবে। যার ফলে তার একার পক্ষে শত নারীকে এখানে আনা অসম্ভব। আর সে যদি কাজটা না করতে পারে তবে পিশাচ দানবটার উপর থেকে নেমে আসবে ভয়ানক শাস্তি। তার ভেতরের জন্তু থেকে মানুষ, মানুষ থেকে জন্তু হওয়ার ক্ষমতাটা কেড়ে নেবে যা তাকে একই সাথে মানুষের মতো বুদ্ধিমান এবং জন্তুর মতো ক্ষিপ্রতা দান করেছে।

হয়তো যখন পিশাচটা বুঝতে পারবে তাকে দিয়ে কাজটা হবে না। তখন তাকে হত্যা করে ফেলবে। এবং গ্রামের অন্য একটা নারীকে ধরে এনে তার ভেতর তার আরেক সন্তানকে জন্ম দেবে এবং তাকে দিয়েই নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করাবে। হ্যা, সে নিজেও সেই দানব আকৃতির পিশাচ গাছটারই সন্তান!

সূর্য যখন অস্ত গেল তখন জঙ্গলের এই আধার অংশ আরো আধারে পরিণত হলো। জঙ্গলে প্রথমে শুরু হলো মৃদু বাতাস এরপর সেটার বেগ বাড়তে লাগলো। আশেপাশের সমস্ত গাছ দুলতে লাগলো। যুবক গর্তে ছিল। সেখান থেকে বেরিয়ে এলো। তার শরীর ক্রমশ লোমে আবৃত হয়ে উঠলো, নখগুলো সুচালো, দেখতে দেখতে বিশাল আকৃতির একটা সাদা জন্তুতে রূপান্তরিত হলো সে। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বিকট গাছটা এবার ভয়ানক ভাবে নড়াচড়া করতে লাগলো। আতঙ্কে পিছিয়ে গিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকলো সে। গাছটার ছাল খসে পড়তে লাগলো, ওটার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে বিকট আকৃতির কুৎসিত একটা শরীর। কালো কুচকুচে শরীর ভর্তি যেন ঘা হয়ে ফুলে আছে, জায়গায় জায়গায় পুচ জমছে, পঁচে গলে ঝরে পড়ছে মাংস, ভালো করে তাকালে বোঝা যায় ওটার পুরো শরীর জুড়ে কিলবিল করছে হাজার হাজার মাংসাশী পোকা, ওগুলোই ওটার পেশি আর কোষ ,ভয়ানক বাজে দুর্গন্ধে ভরে উঠছে চারপাশ। কয়েক মুহূর্তেই বিকট গাছটা একটা ভয়ানক দানব আকৃতির মাথাবিহীন পিশাচের শরীরে পরিণত হলো। পিশাচটার পাকস্থলির উপর কিলবিল করতে থাকা পোকা গুলো একদিকে সরে যেতে লাগলো। সেখানে উদয় হলো দুটো ক্ষুদ্র চোখ এবং একটি বৃহৎ মুখ।

জন্তুটার শরীর আতঙ্কে কাঁপছে দৃশ্যটা দেখে। এই সেই শক্তিশালী পিশাচ পুরুষ, যার হুকুম এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা একদিন এই পৃথিবীর কারো ছিল না! পিশাচটার মুখ দিয়ে ভয়ানক এক হুঙ্কার বেরিয়ে এলো। জন্তুটার দিকে তাকিয়ে চোখ কিছুটা হিংস্র করলো , এরপরেই ফু দিল জোরে। জন্তুটা বাতাসে ডিগবাজি খেয়ে পিছিয়ে গেল অনেকখানি। হো হো করে হেসে উঠলো পিশাচটা, ‘তুমি শুধু আকারেই বড় হচ্ছ, এইটুকু বাতাস সহ্য করতে পারো না! তুমি আমার সবচাইতে অপদার্থ ছেলে। এতদিনেও নিজের ক্ষমতা আন্দাজ করতে পারো নি, নিজের দক্ষতা , বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ সামলাতে পারো না! লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ! একবার তোমার ভাইদের দিকে তাকাও, নিজের সম্পর্কে জানতে পারবে!’

আশেপাশের সমস্ত ডাল আর পাতাহীন গাছগুলো কেঁপে উঠলো, জন্তুটা আতংক নিয়ে চারদিকে তাকাচ্ছে। গাছ গুলোর ছাল আর খোলসের ভেতর থেকে যেন বন্ধি অনেকগুলো দানব বেরিয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু কোনো একটা বাধার মুখে পারছে না। ওইসব গাছগুলো থেকে ভেসে আসছে পৈশাচিক গোঙানি।

বৃহৎ আকৃতির পিশাচটা পুনর্বার হুঙ্কার ছাড়লো। জন্তুটার কিছুটা কাছে এগিয়ে গিয়ে যেতে নিয়ে অনুভব করলো, সে চলতে অপারক। ছটফট করতে লাগলো। তার মুখটা বিকৃত হয়ে গেল। শরীরে থাকা পোকাগুলো ওটার মাংস পচেই জন্ম নিয়েছে আবার ওটার মাংস খেতে খেতেই চামড়ার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। এটার ব্যথার ছাপও ওটার মুখে স্পষ্ট। চেঁচিয়ে উঠলো ওটা, ‘দেখতে পারছো তোমার পিতার কষ্ট, তোমার ভাইদের কষ্ট! ওই জগতের মানুষের কুকর্মের ফল পাচ্ছি আমরা, আমাদের নিয়ন্ত্রণ এখন ওদের হাতে। এক নারীর ছলনা আমাদের এই দুর্দশা সৃষ্টি করেছে, এখন শত নারীর বিসর্জন আমাদের পুনরুত্থিত করবে। তোমার ক্ষমতার পরিচয় তুমি খোঁজ করো। মুক্ত করো পিতা এবং ভাইদের। যে পিতা তোমাকে এক বছরে এতটা শক্তিশালী করে দিয়েছে সে পিতার ক্ষমতা সম্পর্কে খোঁজ করো। লক্ষ্য থেকে সরে যেয় না। এগিয়ে আসো আমার দিকে।’

জন্তুটা ভয়ে সংকুচিত হয়ে ধীরে ধীরে বীভৎস পিশাচটার একদম কাছে পৌঁছে গেল। পিশাচটার মুখ বিকট হা হয়ে গেল, ওটার শরীরের যত পোকা ছিল সব ছুটে সেই বিকট মুখ ভর্তি করে ফেলছে, পিশাচটা চাবিয়ে খাচ্ছে যেন ওগুলো, ওগুলোর রস মুখে জমা করলো, বিশ্রী ভয়ানক গন্ধে পরিবেশ ভারী হয়ে আছে। পিশাচটা এবার তার মুখে জমে থাকা সব রস বমি করে ঢেলে দিল জন্তুটার গায়ে। এসিড পড়লে মানুষ যেমন ছটফট করে, জন্তুটাও ছটফট করতে করতে ডিগবাজি খেয়ে পেছাতে লাগলো, মাটিতে পড়ে ছটফট করতে লাগলো, ফসফস, গড়ড় গড় আওয়াজ বেরিয়ে আসছে ওটার গলা থেকে।

দেখতে দেখতে পিশাচ পুরুষটার পেট থেকে চোখ মুখ অদৃশ্য হয়ে গেল, ছাল মাটি থেকে উঠে ওটার পুরো শরীর আবৃত করে ফেললো আবার, থেমেগেলো ওটার নড়াচড়া। ওটা এখন আবার বিকট আকৃতির ডাল-পালা, পাতাবিহীন একটা বৃক্ষে রূপান্তরিত হয়েছে। জন্তুটা নড়েচড়ে ধীরে ধীরে উঠে বসলো। তার শরীরে বমির বিন্দুমাত্র আর অবশিষ্ট নেই। ওগুলো লোম, চামড়া ভেদ করে তার শরীরের একেবারে ভেতরে চলে গিয়েছে। জন্তুটা খেয়াল করলো তার আকৃতি আর শক্তি আগের থেকে আরো বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। বিকট একটা হুংকার ছেড়ে সে ছুটলো গ্রামের দিকে। আগে ক্ষুধা নিবারণ করতে হবে পরে ওই পিশাচটার আদেশ মতো কাজ করার কথা ভাববে সে। ওটাকে ওর মোটেও পছন্দ নয়। কিন্তু মনে হচ্ছে পিতার লক্ষ্য পূরণে তার ভূমিকা রাখতে হবে।……………………………………..
.
.
. . . . চলবে . . . .
.
.
লেখা: #Masud_Rana

পিশাচ পুরুষ পর্ব-০২

0

#পিশাচ_পুরুষ
২য় পর্ব

গ্রামীন সাধারণ জীবনের মধ্যে একটা মেয়ের চারপায়া অদ্ভুত এক জন্তুকে জন্ম দেয়া, মেয়েটার জন্তু সহ জঙ্গলে উধাও হয়ে যাওয়া, এর এক বছর পর সেই জঙ্গল থেকে একটা ভয়ানক মাংসাশী জন্তুর আগমন, গ্রামে বেশ আতঙ্কের আলোড়ন সৃষ্টি করে ফেলেছে। প্রত্যেকেই দিন-রাত থাকে এখন আতঙ্কের মাঝে। এরমধ্যেই হঠাৎ করে একদিন পরী নামের এক বৃদ্ধাও নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। অনেক খুঁজেও তাকে পাওয়া গেল না আর। বৃদ্ধার নিরুদ্দেশের পেছনে যে সেই সাদা জন্তুটার সম্পর্ক থাকতে পারে তা কেউ ধারণা করতে পারে নি। তাহলে তাদের আতংক সীমা ছাড়িয়ে যেত এবং এটারই প্রয়োজন ছিল।

এরমধ্যেই গ্রামে একরাতে ঘটে গেল ব্যতিক্রম এক ঘটনা। গ্রামের মাতবর লিয়াকত ব্যাপারীর এক নাতি শহরে থাকে। সে গ্রামে বেড়াতে আসার সময় তার দাদার জন্য একটা বিদেশি বড় আকারের কুকুর উপহার নিয়ে এসেছে। জঙ্গলের পাশে হওয়ায় শুধু এই গ্রামে নয় আশেপাশের দশ গ্রামের ভেতর কোনো কুকুর-বিড়াল ছিল না। লিয়াকত আলী খুব আগ্রহ নিয়েই কুকুরটাকে পোষ মানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। অদ্ভুত এক জন্তুর এই জঙ্গলে আগমন, গ্রামের পোষা প্রাণী শিকারের কথা লিয়াকত ব্যাপারীর কাছে তার নাতি শুনেছিল। কিন্তু যে কয়দিন সে গ্রামে ছিল ওটার কোনো আওয়াজ পাওয়া যায়নি। তাছাড়া জঙ্গলের পাশের অঞ্চলে বন্য প্রাণীর আক্রমণের ঘটনা অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়নি তার কাছে। ছুটি শেষ হলে সে আবার শহরে চলে যায়।

এরপর একদিন মধ্যরাতে গ্রামের অর্ধেক মানুষ জঙ্গল থেকে ভেসে আসা সেই সাদা জন্তুটির হুঙ্কারের আওয়াজ পেল। সবাই আতংক নিয়ে যার যার ঘরে অপেক্ষা করতে লাগলো। না জানি আজ কার বাড়ির গোয়ালে হামলা চালাবে!

লিয়াকত ব্যাপারীর বাড়ি গ্রামের মাঝামাঝি হওয়ায় এখন পর্যন্ত জন্তুটার হামলার শিকার হয়নি তার গোয়ালের পশুগুলো। লিয়াকত নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছিল, তার পাশে তার স্ত্রী। তাদের বাড়ির অদূরেই আরেকটা বাড়ি আছে যেটায় তার মেয়ে, মেয়ের জামাই আর দুই নাতি-নাতনি থাকে।

হঠাৎই খুব কাছে বিকট এক হুঙ্কারের আওয়াজে ধড়ফড় করে ঘুম থেকে জেগে উঠে বাড়ির সকলে। পরমুহূর্তেই শুনতে পায় গোয়ালের গরুগুলোর ভয়ানক আর্তনাদের শব্দ। কারো বুঝতে বাকি থাকে না , কী ঘটছে। জন্তুটা আজ এখানে হামলা চালাচ্ছে। লিয়াকত ব্যাপারীর মেয়ের জামাই বকুল ভয়ে ভয়ে জানলার খিলি সরিয়ে বাইরে তাকাল। সোলার লাইটে আলোকিত উঠানের একপাশে গোয়াল ঘরটা জানলা বরাবর হওয়াতে ওটার দিকেই চোখ আটকে গেল তার। শরীর শিরশির করে উঠলো হঠাৎ। ঐতো একটা বড় গাভীর ধর কামড়ে টেনে-হিঁচড়ে গোয়াল থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে ভয়ানক সেই জন্তুটা। মুখ দিয়ে বের হচ্ছে গোঙানি। চুইয়ে ঝরছে রক্ত। গাভিটাও এখনো মরেনি, ওটার গলা দিয়েও গড়গড় শব্দ বের হচ্ছে।

জন্তুটা গাভীর তিনগুন হবে। গাভিটাকে ভালোমতো কামড়ে ধরে উঁচু করার চেষ্টা করছে। এমন সময় ঘেউ ঘেউ করতে করতে ছুটে এলো লিয়াকত ব্যাপারীর পোষা কুকুর টমি। ভয়ানক জন্তুটাকে দেখে একটুও ভয় পাচ্ছে না ওটা। উল্টো আশ্চর্য্যের ঘটনা জন্তুটাই ভয় পেয়ে চমকে উঠে মুখ থেকে শিকারটা ফেলে দিল। টমি আরো জোরে ঘেউ ঘেউ করতে করতে ওটার দিকে এগিয়ে গেল। এবার জন্তুটাও রাগে ফুঁসছে। আকাশ ফাটিয়ে বিকট এক হুঙ্কার ছাড়লো। চোখ দিয়ে খুনের রক্ত ঝরছে যেন ওটার। লাফিয়ে পরে টমির ধর থেকে মাথা ছিন্ন করার প্রতিজ্ঞা করছে যেন। তবে তার আগে বেশ কয়েকবার হুংকার দিয়ে টমিকে ভয় দেখাতে চাইলো। বোঝাচ্ছে ঝামেলা চায় না সে।

টমি ভয় পেল না। একেবারে ঘেউ ঘেউ করতে করতে গাভীর আর জন্তুটার একদম কাছে চলে এলো। জন্তুটা এবার লাফ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো টমির উপরে। টমির তুলনায় আকারে ওটা বিকট। তবে ক্ষিপ্র গতিতে ছোট জন্তুটাই সেরা। টমি মুহূর্তেই সরে গেল একদিকে লাফিয়ে। মুহূর্তেই ভোঁ করে ঘুরে লাফিয়ে উঠে পড়লো জন্তুটার পিঠে ঠিক যেমন বন্য চিতা শিকার করে তার চেয়ে চারগুণ বড় মহিষকে। কামড় বসিয়ে দিতে চাইলো জন্তুটার পিঠে, আঁচড়াতে লাগলো সমানে। কিন্তু এক ঝাড়া দিয়েই টমিকে শরীর থেকে ফেলে দিলো ওটা। লাফিয়ে পড়লো আবার টমির উপর, কামড়ে ধরলো ওর গলা, টমি ছটফট করে পায়ের নখ দিয়ে সমানে আঁচড়াতে লাগলো ওটার শরীর। গুঙিয়ে উঠলো জন্তুটা। টমির কন্ঠদেশ থেকেও বেরিয়ে এলো গড়গড় শব্দ। ছুড়ে ফেলল টমিকে জন্তুটা উঠানের এক পাশে।

কয়েক মুহূর্ত নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে রইলো টমি। জন্তুটা জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। হুস ফিরতেই আবার উঠে পড়লো টমি, ঘেউ ঘেউ করতে করতে এগিয়ে গেল জন্তুটার দিকে। টমির শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি নেই। জন্তুটার তাই এবার টমিকে ধড় কামড়ে মারতে বেগ পেতে হবে না। হুংকার ছাড়লো ওটা। লাফিয়ে পড়বে টমির উপর। এমন সময় চেঁচাতে চেঁচাতে বড় একটা লাঠি হাতে ছুটে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলো লিয়াকত ব্যাপারী। তাকে এমন ভাবে ছুটে আসতে দেখে দা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলো তার মেয়ের জামাই ও।

আশেপাশের তিন বাড়ির অনেকেই আড়ালে লুকিয়ে থেকে ভয়ে জড়সড় হয়ে টমি আর জন্তুটার কর্মকাণ্ড দেখছিল। দুজন মানুষকে এভাবে জন্তুটার সামনে চলে আসতে দেখে আৎকে উঠলো তারা। হাতে মোটা লাঠি আগেই ছিল। এবার তারাও হৈ হৈ হুংকার দিতে দিতে এগিয়ে গিয়ে উঠানে হাজির হলো। মুহূর্তেই ভড়কে গেল যেন জন্তুটা। দিশেহারা হয়ে তাকালো এদিক সেদিক। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে গর্জে উঠলো কয়েকবার, কয় পা এগিয়ে পিছিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো গর্জাতে লাগলো। লোকগুলোও এবার আতঙ্কিত হলো। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ার কোনো মানে নেই। ওটা হামলা করলে ওরাও প্রতিরোধ হামলা করবে এই প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে জন্তুটা ধীরে ধীরে পিছিয়ে যাচ্ছে। একবার তাকালো তার মৃত শিকার পরে থাকা গাভিটার দিকে। মুহূর্তেই ওটার উপর উঠে দাঁড়ালো টমি। এতগুলো মানুষ দেখে তার সাহস আর মনোবল দুটোই বেড়ে গেছে। তার ঘেউ ঘেউ যেন বিভ্রান্ত করে দিল ভয়ানক জন্তুটাকে। শেষ একটা হিংস্র গর্জন দিয়ে উল্টো ঘুরে ছুট লাগালো ওটা জঙ্গলের দিকে।

একে অপরের দিকে তাকালো গ্রামবাসী লোকগুলো। চোখে-মুখে কিছুটা বিজয়ের গর্ব। এই একটা কুকুরের সাহস তাদের ভেতরে কতটা ভয়হীন সাহস জাগিয়ে তুলেছে বুঝে অবাক হলো। এক মুহূর্তে জন্তুটা সম্পর্কে তাদের মনে থাকা ভয় অর্ধেক হয়ে এলো। লিয়াকত ব্যাপারী ঝুকে গিয়ে টমিকে জড়িয়ে ধরলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। ওটার অনেক জায়গায় ছিলে গেছে। ওরও শুশ্রূষা প্রয়োজন। আনন্দে লেজ নাড়িয়ে, ঘনঘন নিশ্বাস নিয়ে ওটাও যেন সাধুবাদ জানাচ্ছে সবাইকে।

পরদিন সকালের মধ্যে পুরো গ্রামের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো রাতের এই ঘটনাটা। সবাই যেন একটা আশার আলো দেখতে পেল আতঙ্কের মাঝে। ওই জন্তুটাকে শায়েস্তা করতে পারবে এখন শুধু কুকুর। একটা নয়, প্রয়োজনে শতাধিক কুকুর এনে পুষবে তারা এই গ্রামে!

এরপর বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে। গ্রামে রাতের শেষ অংশ। আর আধ-ঘণ্টা পরেই সূর্য উঠে যাবে। গ্রামের সবাই এই সময়টাতে ঘুমিয়ে থাকে। এমন সময়েই জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো এক সুন্দর, লম্বা সুদর্শন যুবক। পিঠে আর বুকে কিছু আঁচড়ের দাগ, কালো চোখজোড়া কিসের এক নেশায় জ্বলছে। পরনে গাছের ছালের তৈরি ছোট একটা জামা আর সমস্ত শরীরই উদোম। ধীরে ধীরে পা ফেলে সতর্ক ভাবে চারদিকে তাকিয়ে গ্রামের ভেতরের দিকে চলছে সে। কোনো মানুষের পায়ের আওয়াজ পাওয়া মাত্রই সরে, অন্য পথ ঘুরে নির্জনতা খুঁজে হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে পৌছালো শেষ পর্যন্ত গন্তব্যে। বাড়িটা চিনতে পারলো সে। বাড়ির কেউ এখনো ওঠেনি।

বাড়ির একদম পেছনের দিকে চলে এলো সে , সে চলে নিঃশব্দে। লিয়াকত ব্যাপারীর বাড়ির পোষা কুকুর টমি একটা গাছের পাশে চুপচাপ শুয়ে আছে। নিঃশব্দে যুবক একদম ওটারর পিছু এসে দাড়ালো। ভন করে মাথা ঘোরালো টমি, চমকে উঠেছে। ‘ঘেউ ঘেউ’ করে উঠলো। যুবক শরীর ঝুঁকিয়ে আলতো করে স্পর্শ করলো টমির মাথা। হাত বুলিয়ে আদর করতে লাগলো ওটাকে। টমি চোখ বন্ধ করে ঘনঘন জিহ্বা বের করতে লাগলো, তার সাথে সমানে নাচছে তার লেজ। থেমে গেছে ঘেউ ঘেউ প্রতিবাদ। যুবক বসে আরেকটু গনিষ্ঠ হলো কুকুরটার। জড়িয়ে ধরলো ওটার শরীর। টমির শরীর কাঁপছে। সে প্রভু ভক্তিতে চোখ বন্ধ করে আছে।

যুবক তার ছালের তৈরি ন্যাংটির ভেতর থেকে সুচালো একটা পাথরের লম্বা ফলা বের করে আনলো। টমি কিছু বুঝে উঠার আগেই ফলাটা সজোরে চালিয়ে দিল ওটার গলায়। ফিনিক দিয়ে রক্ত পড়তে লাগলো, টমির গলা থেকে ফসফস, গররগরর শব্দ বের হতে লাগলো রক্তের স্রোত। যুবক শক্ত করে চেপে ধরে আছে ওটার শরীর। ছটফট করলেও একটুও নড়তে পারলো না ওটা। আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে এলো ওটার শরীর। যুবক এবার টমির ধর মুখ দিয়ে চেপে ধরলো, চুষতে লাগলো সমানে। রক্তে ভিজে উঠতে লাগলো তার মুখ। গলা নিয়ে টেনে পাকস্থলীতে নামাচ্ছে কুকুরটির রক্ত। রক্ত পান শেষে ধারালো ফলাটা ঢুকিয়ে দিল ওটার পেট বরাবর প্রচণ্ড আক্রোশে। একটানে পেট ফেড়ে দুভাগ হয়ে গেল। বেরিয়ে পড়লো নাড়িভুঁড়ি। সে এবার মুখ ঢুকিয়ে দিল ওখানে। সমানে কামড়াতে লাগলো জায়গাটা। দাঁত দিয়ে ছিন্নভিন্ন করছে খাবার।

পৈশাচিক কাজ শেষে চেটেপুটে, টমির শরীর থেকে ছিলা চামড়া দিয়ে নিজের শরীর পরিষ্কার করলো সে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো কেউ নেই। ঘুরে হাটা শুরু করলো সে ধীরও পায়ে সতর্কতার সাথে জঙ্গলের পথে। কিছুদূর যাওয়ার পরেই চমকে উঠলো । একজন ষোলবর্ষীয়া কিশোরী মেয়ে কাঁখে কলসি নিয়ে হেটে আসছে এদিকে। সে হতভম্ব হয়ে সরে যাওয়ার আগেই মেয়েটার সাথে তার চোখাচোখি হলো।

কিশোরী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে যুবকটির দিকে। ভোরের হালকা আভা ফুটছে কেবল। এত অপরূপ রূপবান পুরুষ সে তার পুরো জীবনে আর দেখেনি। কী অদ্ভুত জংলিদের মতো পোশাক পরে আছে। এ এই গ্রামে আসলো কী করে! কী মিষ্টি চেহারা, সুন্দর শরীর। কলসী তার হাত থেকে ছুটে পড়ে গেল। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সে ছেলেটির একদম কাছে। কিসের এক তীব্রতা টানছে তাকে। হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করে দেখল সে ছেলেটির শরীর, যেন এ স্বপ্ন নাকি বাস্তব বুঝতে চেষ্টা করছে। মুখ ফুটে বেরিয়ে এলো, ‘কে গো তুমি?’

যুবক এবার কয়েক পা পিছিয়ে গেল। উল্টো ঘুরে ছুটতে লাগলো জঙ্গলের দিকে। সেও যেন চমকে গেছে। কিশোরী সকিনা স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। কে এই যুবক?

সকালে উঠে টমির ছিন্নভিন্ন বীভৎস শরীর দেখে লিয়াকত ব্যাপারী সহ গ্রামের সকলেও একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেল। ভয়ানক সেই আতংক জুড়ে বসলো আবার তাদের মনে।……………………………
.
.
. . . . চলবে . . . .
.
.
লেখা: #Masud_Rana

পিশাচ পুরুষ পর্ব-০১

0

#পিশাচ_পুরুষ

১ম পর্ব

লেখা: #Masud_Rana

মেয়েটা যখন বলল এক মাস তাকে বন্ধি রেখে একটা দানব আকৃতি পিশাচ তার সাথে জোরপূর্বক শারীরিক অত্যাচার করেছে তখন কেউই ওকে পাত্তা দিল না, সবাই হাসলো। কিন্তু তার এক মাস পরেই যখন আবিষ্কৃত হলো মেয়েটার গর্ভে সন্তান এসেছে তখন সকলেই হতবাক হয়ে গেল। অনেকেই তাকে বলল গর্ভপাত করিয়ে ফেলতে। মেয়েটা বার বার কেঁদে কেঁদে শুধু বলল, বাচ্চাটার কোনো ক্ষতি হলে পিশাচটা এই গ্রামের সব মানুষদের খুন করে ফেলবে। গ্রামের সবাই একেবারেই বিস্মিত হয়ে গেল যখন ৯ মাস পর মেয়েটা গর্ভ থেকে একটা চার পায়া পশু প্রসব করলো।

চারপায়া অদ্ভুত জন্তুটাকে দেখে আতঙ্কিত হয়ে গুঞ্জন ঝুরে দিল প্রসবঘরের সবাই। এমন অদ্ভুত দবদবে সাদা জন্তু তারা জীবনে কখনো দেখেনি। মেয়েটা প্রসব করার পরেই অচেতন হয়ে গিয়েছিল। আচমকা চোখ খুলে উঠে বসলো। জন্তুটাও এবার নড়ে উঠে বসলো। চোখ খুলে একবার তাকালো লোকজনের দিকে। নাক কুঁচকে গন্ধ খুঁজল কিছুর। এরপর এক লাফে মা মেয়েটার কোলে গিয়ে উঠল, আচল সরিয়ে স্তনে মুখ দিল। দাই মহিলাটি ভয় পেয়ে ঘরের বাইরে চলে গেল। তাকে অনুসরণ করে বাকিরাও বাইরে বের হয়ে গেল। মেয়েটা একটা জন্তু প্রসব করেছে শুনে এরমধ্যেই বাড়িতে প্রচুর ভিড় হচ্ছে। পুরো গ্রামে উত্তেজনা। হঠাৎ মেয়েটা পাগলের মতো চেচাতে চেচাতে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলো। কোলে অদ্ভুত সেই সাদা জন্তু। চেঁচিয়ে বলতে লাগল, খবরদার! আমাদের সন্তানের যে ক্ষতি করতে আসবে তার পুরো বংশ নির্বংশ করে দেবে ওর বাবা। আমি এখন আর তোমাদের সাথে একসঙ্গে থাকতে পারবো না। আমি এখন থেকে জঙ্গলে থাকবো। কেউ আমায় খুঁজবে বা বিরক্ত করবে না। করলেই সর্বনাশ!

এই বলেই জন্তুটাকে কোলে নিয়ে গ্রামের পাশের এক ঘন জঙ্গলের দিকে ছুট লাগলো মেয়েটি। অনেকেই তার পিছু পিছু ছুটতে লাগলো। মেয়েটার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি! হবেই বা না কেন, এমন জন্তু জন্ম দেওয়া কার পক্ষে সম্ভব! মেয়েটার গায়ে এত শক্তি হলো কী করে। একদম ঝড়ের বেগে ছুটতে লাগলো সেদিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জঙ্গলের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল মেয়েটা। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এই জঙ্গলটা নিয়ে অনেক আতংক আছে গ্রামবাসীর ভেতর। তাই তারা কেউই ভেতরে যাওয়ার সাহস পেল না।

এরপর থেকে সেই গ্রামে মেয়েটাকে আর কেউ দেখতে পায়নি। জঙ্গলের ভেতরে কাঠ আনতে, পাখি ধরতে অনেকেই দল বেঁধে যেত। তাদের কেউও ওখানে কোনোদিন মেয়েটাকে দেখেনি। জঙ্গল যত পুব দিকে গেছে তত আর গভীর , ঘন হয়েছে। সেদিকে কেউই যায় না। তাই সেদিকের খবর কেউ রাখে না। মেয়েটার কোনো আপনজনও নেই যে তার খোঁজ করবে। এক সময় গ্রামের মানুষ গুলো মেয়েটাকে প্রায় ভুলেই গেল।

এক বছর পর হঠাৎ এক অমাবস্যার রাতে জঙ্গল থেকে ভয়ানক একটা জন্তুর হুংকার বেরিয়ে এলো। শব্দটা এতই বিকট ছিল যে অর্ধেক গ্রামের লোক সেটা শুনতে পেয়েছিল। যে ই শব্দটা শুনলো তারই হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠলো আতঙ্কে। কোনো এক ভয়ানক জন্তু রাগে যেন ফুঁসছে। এরপর থেকে জঙ্গলের পাশে গড়ে ওঠা বাড়িগুলোর মানুষ প্রায় রাতেই রক্তহীম করা সেই ভয়ানক হুংকার শুনতে পেত। যেটার উৎস সেই জঙ্গল। সন্ধ্যার পর জঙ্গলের আশেপাশে কেউ যেত না তাই। দিনে আতংক কিছুটা কম ছিল।

জঙ্গলের খুব কাছেই রইস আলীর বাড়ি। গভীর রাতে। স্ত্রী কন্যা নিয়ে শুয়ে ছিল সে। হঠাৎ গোয়াল ঘর থেকে পোষা গরু-ছাগলের ভয়ানক আর্তনাদের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় তার। দ্রুত একটা দা হাতে ছুটে যায় সেখানে। গিয়ে দেখতে পায় একটা গাভী উঠানে ছটফট করছে মাটিতে লুটিয়ে, গলার পাশ থেকে বের হওয়া রক্তে ভেসে যাচ্ছে উঠান। বাঘ বা শিয়াল! না, এমন সময় গোয়াল ঘর থেকে অদ্ভুত দর্শন বৃহৎ একটা চারপায়া সাদা জন্তু বেরিয়ে এলো, আকারে গাভীটির দ্বিগুন, জ্বলজ্বল করে জ্বলছে চোখ, নিঃশ্বাসের ফুসফুস আওয়াজ, চাঁদের আলোয় চারপাশ কাঁপিয়ে ভয়ানক এক হুংকার ছাড়লো ওটা ওর দিকে তাকিয়ে! ওটার মুখ চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে রক্ত। হাত থেকে দা টা পরে গেল রইস আলীর। আতঙ্কিত হয়ে পেছাতে গিয়ে পায়ের সংঘর্ষে উঠানে পরে গেল সে। অদ্ভুত ভয়ানক জন্তুটা লাফ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রইস আলী বুঝল তার বাঁচার আশা শেষ। এই অঞ্চলে বাঘ আসে না, এমন মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত। এটা কী জন্তু! জন্তুটা লাফ দিল কিন্তু রইসের উদ্দেশ্যে নয়। গাভিটার ধর চেপে ধরেছে। প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে উঁচু করে ফেলল ওটাকে। ওটাকে মুখে আটকে ঘুরে ছুট লাগলো জঙ্গলের দিকে। এরমধ্যেই গোয়াল ঘরে থাকা বাকি পশুগুলো গগনবিদারী চিৎকার জুড়ে দিল ভয়ে। আশেপাশের সব বাড়ির লোক ছুটে এলো এদিকে।

উঠানে রক্ত দেখে সবাই ভড়কে গেল। রইস মিয়া দৃশ্যটা ব্যাখ্যা করলো সবাইকে। আতঙ্কে তার শরীর বার বার কেঁপে উঠছে জন্তুটার শরীরের বর্ণনা দিতে দিতে। গ্রামের সবাই বুঝতে পারলো ভয়ানক এক জন্তুর প্রবেশ ঘটেছে জঙ্গলে। প্রায় রাতে ওটার হুংকার শুনেই আতঙ্কে থাকতো সবাই, এখন আবার ওটা শিকারে বের হতে শুরু করেছে!

এরপর থেকে এমন বীভৎস ঘটনা প্রায়ই ঘটতে লাগলো। জঙ্গল থেকে ভেসে আসে ভয়ানক হুঙ্কার। মাঝেমধ্যে মাঝরাতে বাড়ির গোয়ালঘর থেকে বোবা প্রাণীর আর্তনাদ বেরিয়ে আসে। ভয়ে ভয়ে বাড়ির মালিক উকি দিয়ে ভয়ানক দর্শন সাদা হিংস্র জন্তুটাকে দেখতে পায়। উন্মাদের মতো কামড়ে ছিড়ে খাচ্ছে একটা পশুকে, বাকিগুলো ভয়ে চেঁচাচ্ছে।কোনো কিছু করে বাধা দেওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারে না সে। কখনো বা কারো বাড়ি হতে একটা পশুকে হত্যা করে মুখে করে নিয়ে ছুট লাগায় জঙ্গলের দিকে। ওটার আকৃতি দিনকে দিন যেন বেড়েই চলেছে। মানুষের কোনো ক্ষতি করেনি এখন পর্যন্ত। অবশ্য ওটা রোজ রাতে শিকারে বের হয় না, হঠাৎ হঠাৎ ১০-১৫ দিন পর পর এক রাতে ওটা হুংকার ছাড়তে ছাড়তে শিকারের কাছে আসে। গ্রামের মানুষের আতঙ্কের সীমা রইলো না, প্রতিকারের উপায়ও খুঁজে পেল না। দল বেঁধে ওটাকে হামলা করে না জানি চটিয়ে দেওয়া হয়, এরপর হয়তো মানুষের উপর হামলা চালাবে রাগে ওটা। অন্তত ওটাকে মারার ক্ষমতা যে তাদের নেই তা তারা বেশ বুঝতে পারে। ধীরে ধীরে গ্রামের মানুষ এই ভয়ানক বিভীষিকাময় জন্তুর এই কর্মকাণ্ডে অভ্যস্থ হয়ে পড়ে।

একদিন ভোর ৫টা। গ্রামের ষাট উর্ধ বৃদ্ধা পরীমনি সকালে হাটতে হাটতে হাজির হলেন জঙ্গলের কাছে। আকাশ থেকে বিচ্ছুরিত আভা আশেপাশের পরিবেশ হালকা আলোকিত করে ফেলেছে। বৃদ্ধার উদ্দেশ্য জঙ্গলের কিনারায় একটা কামরাঙা গাছ , সকালে ওটার নীচে ফল পরে থাকতে পারে। সেখানে পৌঁছে দেখল গাছের নিচু একটা ডালে একটা সুদর্শন যুবক বসে আছে। বৃদ্ধার চোখের কোনো সমস্যা না থাকায় বুঝতে পারলো ছেলেটার পরনে কোনো কাপড় নেই। এত সুন্দর পুরুষ! মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে সে।

এক লাফে যুবকটা বৃদ্ধার কাছে এসে দাড়ালো। তার থেকে চোখ ফেরাতে পারে না বৃদ্ধা। কী মায়াবী মুখ, ঝাকড়া চুল, কালো চোখ জোড়া কিসের এক নেশায় জ্বলছে। যুবককে এভাবে নগ্ন দেখে বৃদ্ধা কিছুটা কুন্ঠিত বোধ করলো। যুবক ধীরে ধীরে তার মুখোমুখি এসে দাড়ালো। আলতো করে তার চিবুক স্পর্শ করলো। বৃদ্ধার পুরো শরীর কেঁপে উঠলো উন্মাদনায়। হঠাৎ বৃদ্ধা খেয়াল করলো নিজের শরীরের কুঁচকে যাওয়া চামড়া গুলো সব সমান, কোমল আকৃতি ধারণ করছে, পাকা চুলগুলো কালো হয়ে যাচ্ছে, কোমরের যে ব্যথার কারণে গুঁজ হয়ে চলতো তা উধাও হয়ে গিয়েছে, শরীরে পূর্ণাঙ্গ যৌবন ফিরে আসছে। বিস্ময়ের ধাক্কা খেল সে।

অবাক হয়ে সে নিজের দিকে তাকালো। পঁচিশ বছরের এক যুবতী নারী যেন সে। যুবক এবার উল্টো হয়ে ঘুরে জঙ্গলের দিকে হাটতে লাগলো। পুরো শরীরে ভয়ানক এক কাম উত্তেজনা অনুভব করছে পরী। ধীরে ধীরে আচ্ছন্নের মতো সেও অনুসরণ করতে লাগলো যুবকটিকে। প্রবেশ করলো জঙ্গলের ভেতর। জীবনে প্রথম এই জঙ্গলে ঢুকেছে সে। তবে তার বিস্মিত চোখ জোড়া এখনো আটকে আছে যুবকের শরীরের দিকে। এত সুন্দর কোনো মানুষ হতে পারে! ওকি! যুবকের সারা শরীর ভেদ করে বেরিয়ে আসছে যেন সাদা লোম। কোমরের নিচ থেকে গজাচ্ছে লেজ, নখগুলো হয়ে উঠছে তীক্ষ্ণ সুচালো! দেখতে দেখতে একটা সাদা অদ্ভুত জন্তুতে রূপান্তরিত হলো ওটা। পরীর কাছে মনে হচ্ছে ওটার সৌন্দর্য তবুও একটু কমে যায়নি। নেশাগ্রস্ত যুবতীর ন্যায় সে অনুসরণ করেই চলতে থাকে। চলে যাচ্ছে জঙ্গলের গভীর থেকে গভীরে।

সেদিনের পর থেকে গ্রামের কেউই বৃদ্ধা পরীমনিকে আর খুঁজে পেল না। জানতেও পারলো না সে কোথায় গেল, কী পরিণতি হয়েছিল তার!………..
………………….
.
.
. . . . . চলবে . . . . .
.

প্রাঙ্ক কাপল পর্ব-০৩(শেষ পর্ব)

0

#প্রাঙ্ক কাপল [শেষ পর্ব]
#রাকিব হাসান রাজ

মিম ভীত হয়ে চিৎকার দিলো। ‘‘রাকিব! শাঁকচু….রিমি! কেউ আছে বাহিরে?’’

কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে মিম প্রচণ্ড ঘাবড়ে গেল। আমার গত দুইদিনের ব্যবহারে মিম প্রচণ্ড ভীতিগ্রস্ত। সে নিজের ফোন খোঁজার চেষ্টা করল। কিন্তু ঘরে তার ফোন নেই। এমন সময় তার কানে দেওয়াল ঘড়ির ঘণ্টার শব্দ ভেসে এলো। সে দেওয়াল ঘড়ির দিকে নেত্রপাত করল। ইতোমধ্যে বারোটা বেজে গিয়েছে দেখে মিম খানিকটা স্তব্ধ হয়ে গেল। সে আজ অনেক দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছে।

এই সময় আমি ও রিমি অফিসে আছি, এটা ভাবতেই সে আঁতকে উঠল। মিম আশেপাশে তাকালো। তার নজর বিছানার পাশের টেবিলের উপর পড়ল। সেখানে সে একটি টিফিন বক্স দেখতে পেল।

মিম চটজলদি টিফিন বক্স খুলল। অনেক বেশি করে খাবার মজুদ করা রয়েছে। টিফিন বক্সের নিচে একটি চিরকুটও খুঁজে পেল সে। চিরকুটটা খুলে পড়া শুরু করল, ‘‘কোনো রকমের চালাকি করবে না। ব্রেকফাস্ট ও লান্সের ব্যবস্থা রুমেই করা আছে। সন্ধ্যায় অফিস থেকে এসে তোমাকে ঘর থেকে বের করে দেবো। ততক্ষণ নাহয় নিজের ব্যাগ গুছিয়ে রেখো।’’

চিঠিটা পড়া মাত্রই মিম স্তব্ধ হয়ে গেল। তার হাত থেকে চিঠিটা পড়ে গেল। সে নিজের এই মুমূর্ষ অবস্থার জন্য নিজেকে দায়ী করছে।

অগত্যা, মিম ব্রেকফাস্ট করে নিজের যাবতীয় জিনিসপত্র গোছগাছ করে নিলো। সে জানে না, কোথায় যাবে সে?

তবে একবার স্বামীর ছায়া মাথা থেকে উঠে গেলে এই সমাজে বেঁচে থাকাটা অসম্ভব হয়ে পড়ে একজন নারীর জন্য। তবুও মিম বেঁচে থাকবে। তার অনাগত বাচ্চার জন্য হলেও তাকে বেঁচে থাকতে হবে, নিজের কাছে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করল।

বিকাল পাঁচটা নাগাদ বাহিরে কিছুর শব্দ শুনতে পেল মিম। সে আবার দরজার কাছে গিয়ে জোরে জোরে দরজায় টোকা দিল।
‘‘হ্যালো, কেউ আছে বাহিরে?’’ এবারও কোনো প্রত্যুত্তর পেল না। আবারও নিরাশ হয়ে বসে পড়লাল। ইতঃপূর্বেই ব্যাগ গুছিয়ে ফেলেছে সে।

‘‘আচ্ছা, আমি যাবার পর কি রাকিব ওই রিমি নামের মেয়েটাকে নিয়ে ভালোভাবে সংসার করতে পারবে? না পারবে না। আমি যেভাবে রাকিবকে আগলে রেখেছিলাম, ওই শাঁকচুন্নিটা জীবনেও পারবে না। আচ্ছা, আমি কি সত্যিই রাকিবকে আগলে রেখেছিলাম?’’ নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করল মিম। কিন্তু এর উত্তর তার কাছে নেই।

সন্ধ্যা হতেই মিম ঘরের দরজা খোলার শব্দ পেল। সে চটজলদি দরজায় ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে এলো। কিন্তু বাহিরে অন্ধকার। কোথাও কোনো আলো নেই। চতুর্দিকে পিনপতন নীরবতা। এই আঁধার আর নীরবতা মিমের মনের ভয়ের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

আচমকা বাসার সকল বাতি একসাথে জ্বলে উঠে আর তার কানে একটি অতিপরিচিত কণ্ঠ ভেসে এলো। ‘‘হ্যাপি এনিভার্সি, মাই ডিয়ার রাগী বউ!’’

প্রথমে চারপাশটা আলোকিত হতেই তীব্র আলো সহ্য করতে না পেরে মিমের চোখ আপনা-আপনিই বন্ধ হয়ে গেল। আমার গলা শুনে চক্ষুদ্বয় খুলে ফেলল। আর চোখ খুলতেই মিম পুরো তাজ্জব হয়ে গেল।

পুরো হোলরুম সুসজ্জিত। এমন সময় মিম তার পেছনে কারও উপস্থিতি টের পেল। পিছনে ঘুরে তাকাতেই আমাকে জড়িয়ে ধরল মিম।

‘‘কোথায় গিয়েছিলে? আমি বড্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।’’ মিমের ক্রন্দনরত কণ্ঠ শুনে বেশ মায়া হলো।

‘‘শুভ বিবাহবার্ষিকী আমার রাগী বউ।’’ মিম আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। বিস্ময়ে তার ভ্রুকুটি কুঁচকে গিয়েছে। সে জিজ্ঞাসু গলায় বলল, ‘‘তোমার মনে ছিল, আজকে আমাদের বিবাহবার্ষিকী?

‘‘হুম!’’

‘‘কিন্তু মনে থাকলেও তোমার তাতে কী যায় আসে?’’ কণ্ঠে কোমল অভিমানতার ছাপ!

আমি এগিয়ে মিমের মুখে আঙুল রেখে বললাম, ‘‘চুপ! কোনো কথা নয়। আজকে আমাকে বলতে দাও। জানো মিম, যখনি তুমি আমাকে ঠেস দিয়ে কথা বলতে কিংবা অকারণে আমার উপর রাগ দেখাতে, তখন আমি অনেক কষ্ট পেতাম। ভেবেছিলাম আমি আমার ভালোবাসা দ্বারা তোমার কৃত্রিম রাগের সমাপ্তি ঘটাবো। কিন্তু ক্রমাগত তোমার রাগ নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে গিয়েছিল। আমিও সহ্য করে গিয়েছি কিন্তু এক পর্যায়ে আমিও নিজের ধৈর্যশক্তি হারিয়ে ফেলি। কারণ তুমি তোমার সব সীমানা পেরিয়ে গিয়েছিলে। তুমি কখনো বুঝতে চাওনি, ভালোবাসার মানুষের থেকে প্রাপ্ত ছোটো থেকে ছোটো আঘাত মনে অনেক গভীর প্রভাব ফেলে। তুমি কখনো অনুভব করতে চাওনি আমার কষ্ট। কখনো উপলব্ধি করতে চাওনি তোমার থেকে প্রাপ্ত অবহেলায় আমি কতটুকু কষ্ট পাই। কিন্তু সবশেষে যে, তুমি আমার স্ত্রী আর আমি তোমার স্বামী। আমরা একে-অপরকে ভালোবাসি। আর এটাই চিরন্তন সত্য।’’

আমার কথা শেষ হবার আগেই মিম আমাকে পুনরায় জড়িয়ে ধরল। অঝোরে অশ্রু বিসর্জন হচ্ছে তার গাল থেকে। তবে এই অশ্রু ভীষণ অপরাধবোধের। আমার চোখ থেকেও অশ্রুবিন্দুও পড়ল।

‘‘আজকের দিনও কাঁদবে? কেক কাটবে না?’’

মিম আমাকে ছেড়ে দিল। রান্নাঘর থেকে দুই পাউন্ডের কেক ও একটি চাকু নিয়ে এলাম। দুইজনে দুজনকে কেক খাইয়ে দিলাম। মিম কিছুটা শান্ত হয়ে বলল,

‘‘তাহলে রিমি, তোমার দ্বিতীয় বিয়ে, এতদিনের অবহেলা……’’

‘‘সব নাটক ছিল। অভিনয়! তোমাকে বুঝাতে চেয়েছি কাছের মানুষ যখন কারণে অকারণে কষ্ট দেয় তখন কতটা কষ্ট পায় অপরজন। আমি জানি না তুমি বুঝতে পেরেছ কি না, তবে গতকাল যখন আমি আমাদের মা-বাবা হবার খবরটা শুনলাম তখন আমার থেকে বেশি খুশি আর কেউ হয়নি।’’

মিম আড়চোখে তাকিয়ে বলল, ‘‘তাহলে ওই শাঁকচুন্নি থুক্কু মানে রিমি যে আমাকে এত খারাপ খারাপ কথা বলল তখন তো তুমি কিছু বললে না। আর এমনকি তুমিও আমাকে একজন পতি..তার সাথে তুলনা করেছ..।’’ শেষের কথাটা বলার সময় মিমের গলা আটকে গেল কষ্টের জন্য।

আমি অপরাধবোধমিশ্রিত ও শীতল গলায় বললাম, ‘‘আমি সব জেনে বুঝেই করেছি। এই কাজটা না করলে তুমি কখনো বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারতে না। আর রিমির ব্যাপারে এলে, সে আমার কলিগ। শুধু কলিগই না বরং বেস্টফ্রন্ড বলতে পারো। যখন তুমি আমাকে আরেকটি বিয়ে করার কথা বললে, তখনি আমার মাথায় এই পরিকল্পনা আসে। আমি সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে রিমির সাহায্য নেই।

‘‘আরে সেই বাসর রাতের ঘটনা। বেডরুম থেকে উত্তেজনাকর শব্দ ভেসে আসার ব্যাপারটা….’’ মিমের গলা আবারও আটকে যাচ্ছে।

আমি হেসে দিলাম। মিম বড্ড উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। আমাকে হাসতে দেখে সে আরও রেগে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই তার গাল লাল হয়ে গিয়েছে রাগের কারণে। আমি নিজেকে স্বাভাবিক করে বললাম, ‘‘আরে, সেটাও নাটক ছিল। আমি নিচে ফ্লোরে ঘুমিয়েছিলাম। আর রিমি বিছানায়। সেই শব্দগুলো তো শুধু মুখ দিয়ে বের করছিলাম আর কিছুই না।

‘‘আমি বিশ্বাস করি না।’’ অভিমানের সুরে কথাটা বলেই চলে যেতে উদ্যত হলো মিম।

তবে আমি মিমের হাত ধরে ফেললাম। মিম ঘাড় কাত করে পেছনে তাকালো।

আমি বাকা হাসি দিয়ে বললাম, ‘‘এই অবস্থায় এত রাগ করা ভালো না আমার রাগী বউ। পুরো কথাটা তো বলিইনি। তোমাকে ঘরের বাহিরে রাখাটা আমাদের পরিকল্পনার অংশ ছিল। তবে বিশ্বাস করো, তুমি যেমন নিচে ঘুমিয়েছ, তেমনি আমিও নিচে ঘুমিয়েছি। গতকাল যখন তোমাকে অচেতন অবস্থায় পাই, তখন আমার অবস্থা পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম তুমি নিজের ক্ষতি করে ফেলেছ। যখন ডাক্তার আংকেল খুশির খবরটা বলেন তখন আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম। বিশ্বাস করো, তখন এক মুহূর্তের জন্য তোমার প্রতি আমার সকল রাগ ভুলে গিয়েছিলাম আমি। নিজের বানানো পরিকল্পনা এক মুহূর্তের জন্য হলেও ভুলে গিয়েছিলাম। তবে রিমি সময়মতো আমার কাঁধে হাত না রাখলে আমাকে আমি তখনি তোমাকে জড়িয়ে ধরতাম। রিমিকে রাতে তোমার কাছে থাকতে বলেছিলাম কারণ তুমি অসুস্থ ছিলে। আজকে আমাদের বিবাহবার্ষিকী। আজকের দিনেই আমি আমার নিজ হাতে তৈরি করা সকল নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটানোর পরিকল্পনা করেছিলাম। তবে আল্লাহ তা’আলা আজকের দিনে আমাদের অনেক বড়ো একটা উপহার দিয়েছে।’’

ইতোমধ্যেই মিমের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তাকে আজ থামাবো না আমি। আরও বললাম, ‘‘সব নাটকের সমাপ্তি করার জন্যই সকাল ধরে এই পর্যন্ত তোমাকে ঘরবন্দি করে রাখি যাতে বাসা থেকে কোথাও না যেতে পারো। আজকে সারাটা দিন পুরো বাসা সাজিয়েছি। তোমার পছন্দমতো সবকিছুর এরেঞ্জ করেছি। আর এসব করতে আমাকে তোমার শাঁকচুন্নি মানে রিমিই সাহায্য করেছে। বলতে পারো এই অপদার্থ স্বামীর পক্ষ থেকে একটি ছোট্ট সারপ্রাইজ। এখনো কি আমার উপর রাগ করে থাকবে?’’

মিম মাথা নিচু করে কেঁদেই যাচ্ছে। আমার চোখাচোখি হতে পারছে না চক্ষুলজ্জায়। তবে আমিও তো ভুল করেছি। আমার স্ত্রীকে কষ্ট দিয়েছি আমি, যা আমার করা অনুচিত ছিল। তবে মাঝেমধ্যে কিছু কিছু কাজ অনিচ্ছাসত্ত্বেও করতে হয়।

আমি মিমের মাথা উঁচু করলাম। থুতনিতে হাত রেখে বললাম, ‘‘আরে পাগলি, কাঁদছো কেন? আমার রাগী বউটাকে এভাবে কাঁদতে ভালো দেখায় না। আর দেখো, তুমি যে ভুল করেছ, আমিও একই ভুল করেছি। তোমায় শিক্ষা দিতে গিয়ে আমি নিজেও কতটা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছি, তা শুধু আমিই জানি।’’

মিম অশ্রুমাখা কণ্ঠে বলল, ‘‘আমাকে মাফ করে দাও। বিয়ের আগে থেকেই সবার সাথে প্রাঙ্ক করতে করতে কবেই যে নিজের অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছি, নিজেও জানি না। আর এই জন্য কারণে-অকারণে সবার উপরে খারাপ ব্যবহার করেছি। সবকিছুর জন্য আমিই দায়ী। গত দুই দিনে আমার যা অবস্থা হয়েছিল, তার জন্যও আমিই দায়ী। আমার প্রাঙ্ক করার অভ্যাসটার জন্য সবাই অনেক দুঃখ পেয়েছে। কিন্তু আমি কখনো তা বুঝার চেষ্টা করিনি। তবে এখন থেকে করব। নিজের ভেতরকার সকল রাগ দূর করে ফেলব। আমার অনেক বান্ধবীদের কাছেই শুনতাম, কীভাবে তারা তাদের স্বামীদের থেকে অত্যাচারিত হচ্ছে, তাই আমি ঠিক ভরসা করে উঠতে পারছিলাম না। মূলত এটাও একটা কারণ, তোমার উপর নিজের আধিপত্য সৃষ্টি করার।’’

মিমের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম, ‘‘তোমাকেও বুঝতে হবে, সব স্বামী-স্ত্রী একরকম হয় না। সব সংসারেই অশান্তি থাকে। তবে সেই অশান্তির মাত্রা এতটাও উচিত না, যার কারণে দুজনের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটে। তবে আমি আমার পুরোনো রাগী বউটাকেই চাই। তবে হ্যাঁ, বেশি রাগী না, একটু রাগী হলেই চলবে।’’ আমার কথায় মিম হেসে দিল। সে হাসতে হাসতে বলল,
‘‘আমি তোমার সাথে প্রাঙ্ক করেছি, ঠিক আছে। তবে তুমি কিন্তু মাত্রারিক্ত করেছ আমার সাথে।’’

মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললাম, ‘‘মাত্রারিক্ত হয়েছে বলেই তো সেটা প্রাঙ্ক বলে বিবেচিত হবে, নাকি! আর তাছাড়া, যার স্ত্রীর এত প্রাঙ্ক করতে পারে, তার স্বামী হয়ে যদি আমি এতটুকু না করি, তাহলে ব্যাপারটা বেমানান লাগে না!’’ মিম আমাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। তারপর দুষ্টু গলায় বলল, ‘‘হয়েছে, আর সাফাই গাইতে হবে না নিজের। আমার প্রাঙ্ক বর!’’

আমিও নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে ফেললাম। জানি, মিম তার প্রাঙ্ক করার অভ্যাসটা ছাড়বে না। তবে এবার আমিও প্রাঙ্ক করতে শিখে গিয়েছি। দেখা যাক….কী হয়! তবে যাই হবে, ব্যাপারটা মঙ্গলজনকই হবে!

সমাপ্তি…..

প্রাঙ্ক কাপল পর্ব-০২

0

#প্রাঙ্ক কাপল [২য় পর্ব]
#রাকিব হাসান রাজ
________________
নিজের স্বামীকে অন্য নারীর সাথে বাসর করবে, এটা কোনো পতিব্রতা স্ত্রী মেনে নেবে না। নিজেকে দোষারোপ করতে করতেই মিম গভীর নিদ্রায় হেলিয়ে পড়ল ফ্লোরে।

সকাল বেলায় দরজা খোলার শব্দে মিম জেগে গেল। কারণ সে দরজার সাথে ঠেস দিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল।

এক রাতেই মিমের অবস্থা বেহাল হয়ে গিয়েছে। চুলগুলো রুক্ষ হয়ে গিয়েছে, চোখে নিচে কালশিটে পড়ে গিয়েছে। মিম ভেবেছিল তার এই দুর্দশা দেখে আমার মনে তার জন্য মায়া জন্মাবে। কিন্তু সে ভুল! মিমের প্রতি আর কোনো ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই আমার মনে। আমি ধমকের সুরে বললাম, ‘‘এখানে বসে আছিস কেন? তোকে না সকাল হতেই চলে যেতে বললাম। এই মুহূর্তেই তুই এই সংসার থেকে চলে যাবি। তোর মতো একজন অপয়ার কোনো স্থান নেই এই বাসায়। আগে তো সারাদিন আমার সংসার, আমার সংসার বলে বকবক করতি। কিন্তু এখন আর নয়। এখন আর এটা তোর সংসার নয়। এই মুহূর্তে তুই এই বাসা থেকে বের হয়ে যাবি।’’

মিম আমার ধমক শুনে প্রথমে ঘাবড়ে গেল। সে আমার পা ঝাপটে ধরল। অশ্রুরুদ্ধ হয়ে বলল, ‘‘দয়া করো আমার উপর। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না। আমাকে নিজের হৃদয়ের এক কোণে স্থান দিলেই হবে। বেশি জায়গা চাই না আমার।’’

আমি কিছু বলব তার আগেই পিছন থেকে রিমি আমাকে জড়িয়ে ধরল। সে বলল,
‘‘এই উটকো ঝামেলা এখনো দূর হয়নি? জান, এই ঝামেলাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দাও।’’

মিম শব্দ করে কেঁদে উঠল। ‘‘না, আমাকে বের করে দিয়ো না। এই শহরের থাকার মতো কোনো জায়গা নেই আমার। কোথায় যাব আমি?’’

‘‘কেন? তোর মতো মেয়েদের থাকার জন্য এই শহরের জায়গার অভাব হবে না। শহরের প্রতিটা অলিগলিতে তোর মতো মেয়ের জন্য পতিতালয় রয়েছে।’’

রিমির কথাশুনে মিম আরও প্রবল শব্দে কেঁদে উঠল। আমি রিমিকে বললাম, ‘‘আমার মাথায় একটি বুদ্ধি এসেছে। তুমি তো ঘরের কাজ করতে পারবে না। এই যেমন রান্নাবান্না, ঘর ধোয়া ইত্যাদি। এসব কাজ তো কাজের মেয়েদের জন্য বরাদ্দ। তোমার কোমল হাতে এসব করতে হবে না। এই মেয়েকে বরং রেখেই দেই কাজের বুয়া হিসেবে। ঘরের এক কোণে পড়ে থাকবে। থাকাখাওয়ার বিনিময়ে একজন কাজের মহিলা হিসেবেই নাহয় রেখে দিলাম।’’

আমি বাকা হাসি দিয়ে মিমের দিকে তাকালাম। সে স্তব্ধ ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এক রাতের ব্যবধানে আমার এই পরিবর্তন কিছুতেই তার বুঝে আসছে না।

‘‘যে রাকিব সর্বক্ষণ আমাকে মাথায় নিয়ে নাচতো, আজ সেই কি না আমাকে কাজের মহিলা বানাতে চাচ্ছে।’’ মিমের ক্লান্ত হৃদয় তাকে পুনঃপুন কথাগুলো বলছে।

রিমি কিঞ্চিত ভাবুক হয়ে বলল, ‘‘তুমি মন্দ বলোনি। এসব লো-ক্লাসের কাজকর্ম শুধু এই মেয়েকে দিয়েই সম্ভব। আমি তো শুধু তোমাকে ভালোবেসে যাব আর তুমি আমাকে।’’ রিমি মিমকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘‘যাহ্, আমাদের জন্য নাস্তা তৈরি কর। আমি আমার জানের সাথে প্রাতঃস্মান সেরে আসছি।’’ কথাটা বলেই রিমি আমার উদ্দেশ্যে দুষ্টুমির স্বরে বলল, ‘‘চলো জান, আজকে আমরা একসাথে গোসল করব।’’

আবার আমরা ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলাম। আজ মিমের সাথে যা কিছু হচ্ছে, সবই তার নিজের দোষ। নিজের আধিপত্য তৈরি করতে সব সময় সে আমার উপর তেজ দেখিয়েছে। কারণে-অকারণে আমার সাথে উচ্চস্বরে কথা বলেছে, আমাকে ঠেস দিয়ে কথা বলেছে। আর এজন্যই তার এই পরিণতি। তবে সে হার মানবো না। যত যাই হয়ে যাক না কেন, আমাকে পুনরায় নিজের ভালোবাসা দ্বারা ফিরিয়ে আনবে- নিজের কাছে নিজেই প্রতিজ্ঞা করে মিম রান্না ঘরে চলে গেল।

প্রাতঃস্মান সেরে আমি আর রিমি বেরিয়ে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসলাম। এখনো মিমের নাস্তা বানানো হয়নি দেখে রিমি বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে বলল,

‘‘এই বাসায় থাকতে হলে সময়মতো সব কাজ করতে হবে। কোনো অজুহাত দিলে চলবে না। জান, তুমি বলে দিবে সেই মেয়েকে, সে যদি এই বাসায় কাজ করে থাকতে চায়, তাহলে সে যেন নিজের কাজ যথাসময়ে সম্পন্ন করে।’’

রিমির কথা শেষ হতে না হতেই মিম নাস্তার ট্রে নিয়ে হাজির হলো। মিম বেশ বিনয়ী কণ্ঠে বলল, ‘‘আর এরকম ভুল হবে না। এবারের মতন ক্ষমা করে দিন। এটাই প্রথম আর এটাই শেষ।’’

ক্ষমা চেয়ে মিম আমার আর রিমির প্লেটে খাবার দিয়ে পাশের চেয়ারে বসে পড়ল। মিম খাবার খেতে বসতেই আমি ধমক দিয়ে উঠলাম, ‘‘এ কি! তুই একজন কাজের মেয়ে হয়ে মনিবদের সাথে বসার সাহস কোথা থেকে পেলি? আমাদের খাওয়া শেষ হওয়ার পর তুই নিচে বসে খাবি। আমার হুকুমের নড়চড় হলেই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবো।’’

আমার প্রত্যেকটা কথা মিমের হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে তুলল। ভাতের প্লেটটা নিয়ে সে রসুইঘরে চলে গেল। সেখানেই মাটিতে বসে বসে খেয়ে নিলো। আমি ও রিমি দুজনেই একসাথে অফিসের জন্য বের হলাম।

মিম আমাদের যাত্রাপথের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার বুঝতে বিলম্ব হলো না যে, আমরা একই অফিসে চাকরি করি আর সেখান থেকেই আমাদের প্রেমকাহিনী শুরু।

মিম তার বেডরুমে গেল। এখন অবশ্য তার বেডরুম নয় এটা। বিছানায় বসে চাদরের উপর হাত বুলালো সে। এই বিছানায় গতকাল আমি অন্য একটি মেয়ের সাথে…….ঘটনাটা ভাবতেই মিম ক্রোধিত হয়ে বিছানার চাদর টান দিয়ে নিচে ফেলে দিলো। আমার ও রিমির স্পর্শ যেসব বস্তুর উপর পড়েছে, সেসব সে ছুড়ে ফেলে দিলো ফ্লোরে। সবকিছু ছুড়ে ফেলে দিয়ে ফ্লোরে পাগলের মতো কাঁদতে লাগল। আচমকা তার বমি পেল। ছুটে ওয়াশরুমে গেল। ফ্রেশ হয়ে বাহিরে আসতেই কেমন যেন মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল তার।

সন্ধ্যা নাগাদ আমি আর রিমি বাসায় পৌঁছালাম। কয়েকবার কলিং বেল বাজানোর পরও যখন মিম দরজা খুলল না, তখন একটু চিন্তিত হয়ে পড়লাম। রিমি ব্যাকুল গলায় বলল,

‘‘মিমের ভালোমন্দ কিছু করে ফেলেনি তো!’’

রিমির কথায় আমারও চিন্তা বেড়ে গেল। ব্যাগ থেকে ডুপ্লিকেট চাবি বের করে লক খুললাম। বাসায় প্রবেশ করতেই দেখতে পেলাম চারপাশটা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে। মোবাইলের ফ্ল্যাশ চালু করে সুইচ বোর্ডের কাছে গিয়ে ঘরের সকল লাইট চালু করে দিলাম। চারপাশটা আলোকিত হতেই আমি আর রিমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। ঘরের সব জিনিসপাতি এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। মিমকে ঘরের কোনো জায়গায় দেখতে না পেয়ে বেডরুমে গেলাম। বাথরুমের সামনে মিমকে অজ্ঞান অবস্থায় দেখতে পেয়ে ছুটে তার কাছে গেলাম।

ধীরে ধীরে মিম নিজের চোখ খুলতেই আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল তীব্র মাথাব্যথার কারণে। হঠাৎ কানে কারও কোমল কণ্ঠ ভেসে এলো। পুনরায় চোখ খুলতেই চক্ষুগোচর হলো, আমি তার পাশে বসে আছি আর রিমি আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। আবারও সেই কণ্ঠ তার পাশ থেকে ভেসে এলো।

‘‘এখন কেমন আছো মিম?’’

মিম পাশে তাকাতেই ডাক্তার আংকেলকে দেখতে পেল। শহরে আসার পর উনার সাথে বেশ আত্মীয়তা গড়ে উঠে আমাদের।

‘‘মাথা ব্যথা করছে প্রচুর।’’

আমি বললাম, ‘‘আংকেল, আমরা মিমকে বাথরুমের সামনে অচেতন অবস্থায় পাই। ওর কিছু হয়নি তো?’’

অনেকদিন পর মিমের জন্য আমাকে ব্যাকুল হতে দেখে বেশ প্রশান্তি পেল মিম।

‘‘আরে তেমন কিছু হয়নি। এই অবস্থাতে অজ্ঞান হওয়াটা স্বাভাবিক।’’

আমি ভ্রু কুঁচকালাম। ‘‘এই অবস্থা মানে?’’

ডাক্তার আংকেল হাসিমুখে বললেন, ‘‘আরে তুমি বাবা হতে যাচ্ছ আর মিম মা হতে যাচ্ছে! মিষ্টি খাওয়াতে হবে কিন্তু। সেটা মিস করলে চলবে না।’’

[সবাই আমার গ্রুপ রাকিবের গল্প কুটির – মাফিয়া, ফ্যান্টাসি, ভৌতিক ও থ্রিলার গল্পের সমাহার এ এড হয়ে নিবেন]

ডাক্তার আংকেলের মুখ থেকে খবরটা শুনে আমার মুখটা বিষাদের আঁধার মেঘে ঢেকে গেল। মায়া আমার দিকে তাকালো। সে ভেবেছিল, এবার আমি অতীতের সকল কিছু ভুলে গিয়ে তাকে আবারও আপন করে নেবো। কিন্তু আমার চেহারায় খুশির ঝলক নেই। রিমি আমার কাঁধের উপর হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

আমি কৃত্রিম একটি হাসি দিয়ে বললাম, ‘‘মিষ্টি খাওয়াবো তো। আসুন, এগিয়ে দেই আপনাকে।’’ ডাক্তার আংকেলকে এগিয়ে দিয়ে আবার নিজের রুমে গেলাম। সেখানে গিয়ে মিমের উদ্দেশ্যে বেশ গম্ভীর ও শীতল গলায় বললাম, ‘‘এই বাচ্চাটা কার?’’

আমার মুখে এই প্রশ্ন শুনে মিমের অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল। বিস্মিত কণ্ঠে সে জবাব দিলো, ‘‘কার মানে? এটা আমাদের বাচ্চা। আমার আর তোমার ভালোবাসার স্মৃতি।’’

‘‘চুপ!’’ আমার ধমকে মিম কেঁপে উঠল। ‘‘এটা আমার বাচ্চা হতেই পারে না। যখনি তোর কাছে আসতে চাইতাম, তখনি তুই আমাকে দূরে ঠেলে দিতি। কখনো ভালোবেসে কাছে আসতে চাইলে তোর অবহেলাই পেয়েছি সবসময়। তাহলে এই বাচ্চা এলো কোথা থেকে?’’

রিমি বলল, ‘‘কোথা থেকে এলো, বুঝতে পারছ না? আরে বাহিরে ফ’ষ্টিন’ষ্টি করে এসেছে। এখন কার না কার বাচ্চা, তোমার ঘাড়ে চাপাতে চাচ্ছে। ’’

মিম কষ্টেসৃষ্টে নিজের অশ্রুকে থামালো।
রিমি মিমের উদ্দেশ্যে বলল, ‘‘রাকিব শান্ত মাথায় জিজ্ঞাসা করছে। বলে দেও , কে এই বাচ্চার বাবা? নাকি এতজনের সাথে রাত কাটিয়েছ যে এই বাচ্চার আসল বাবা কে, তুমি জানোই না?’’

মিম এবার আর সহ্য করল। সকল বাঁধ ভেঙে অশ্রুর ধারা বয়ে গেল গাল বেয়ে। তাএ নিজের উপরই ঘৃণা চলে আসছে। বিছানা থেকে উঠার চেষ্টা করতেই রাকিব আমি তাকে বিছানার সাথে চেপে ধরলাম।

‘‘খবরদার! বিছানা থেকে এক পা নামালে তোর পা ভেঙে ফেলে দিব। আগামীকালই তুই তোর পাপের ফসল নিয়ে চলে যাবি। তোর চেহারাও দর্শন করতে চাই না আমি।’’ প্রচণ্ডমূর্তি হয়ে কথাগুলো বললাম।
রিমির দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘‘রিমি, তুমি এর কাছে থাকো। যে-কোনো সময় পালিয়ে যেতে পারে। আগামীকাল সোজা ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবো। এখন বাহিরে গিয়ে সিনক্রিয়েট করতে পারে।’’

কথাগুলো বলেই আমি মিমকে ছেড়ে দিয়ে বাহিরে চলে গেলাম। রিমি মিমের পাশেই বসে রইল।

শরীরে ক্লান্তিভাব দূর করার জন্য বিশ্রামের প্রয়োজন মিমের। তাই অক্ষিযুগল বন্ধ করতেই নিদ্রাবিষ্ট হয়ে পড়ল সে। সকালে কিছু একটার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। শোয়া থেকে উঠে বসল সে। আশেপাশে তাকিয়ে আমাকেব কিংবা রিমিকে, কাউকেই দেখতে পেল না।

বিছানা ছেড়ে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। ফ্রেশ হয়ে যেই রুমের বাহিরে যাব, তখনি দেখতে পেল, দরজা বাহির থেকে বন্ধ।

মিম দরজায় ধাক্কা দিল, কিন্তু খুলল না। ভয়ে সে আঁতকে উঠল। পরবর্তীতে তার সাথে ঠিক কী হতে যাচ্ছে, ভাবার সাহসও পাচ্ছে না সে। শুধু জানে, ভয়াবহ কিছু হতে যাচ্ছে।

চলবে……

প্রাঙ্ক কাপল পর্ব-০১

0

#প্রাঙ্ক কাপল [সূচনা পর্ব]
#রাকিব হাসান রাজ

আজ আমি দ্বিতীয় বিয়ে করে আমার প্রথম স্ত্রী মিমের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। মিম একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে আরেক বার তাকাচ্ছে আমার দ্বিতীয় স্ত্রী রিমির দিকে। সে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। তবে আমি নিরুপায় ছিলাম। এই কাজটা আমাকে করতেই হতো। নিজের অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমাকে দ্বিতীয় বিয়েটা করতে হয়েছে।

||ঘটনার সূত্রপাত||

খাবার খেতে বসতে না বসতেই আমার স্ত্রী মিম ইচ্ছকৃতভাবে ধাক্কা দিয়ে খাবার থালাটা ফেলে দিলো। মিমের এমন অদ্ভুত কাজে আমি একটুও বিচলিত হলাম না। এসব তার নিত্যদিনের কর্মকাণ্ড। তবে আজ যা করল তা একটু বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে আমার কাছে।

‘‘মিম, তুমি করলে কী? খাবারের উপর কেন রাগ দেখালে?’’ খানিকটা উঁচু গলায় প্রশ্ন করলাম।

‘‘তো কী করব? তুমি বেশ ভালো করেই জানো যে, আমার হলুদ রঙ অপছন্দ। তবুও তুমি আমার জন্য হলুদ শাড়ি নিয়ে এসেছ।’’

মিমের রেগে যাওয়ার কারণটা এবার আমার বুঝে এলো। তবে এই সামান্য কারণের জন্য এতটা বাজে ব্যবহার আমি মানতে নারাজ।

‘‘তাই বলে তুমি খাবারের থালাটা ফেলে দেবে? খাবার হলো আল্লাহ তাআলার দেওয়া রিজিক। এই রিজিকের জন্যই বহির্বিশ্বে যুদ্ধ হয়ে থাকে। কত মানুষ অনাহারে দিন কাটায়। আর তুমি কি না সেই রিজিক নষ্ট করলে!’’

মিম বিরক্তিকর স্বরে বলল, ‘‘আবার শুরু করলে নিজের বকবক। এতই যখন দার্শনিকের মতো করে সবকিছু খেয়াল রাখো, তাহলে আমার কী পছন্দ আর কী অপছন্দ তার দিকে কেন খেয়াল রাখতে পারো না?’’

প্রশ্নটা করেই মিম শপিং ব্যাগ থেকে আমার নিয়ে আসা হলুদ শাড়িটা ফ্লোরে ফেলে দিল। তারপর সেই শাড়িটা দিয়ে ঘরের আবর্জনা পরিষ্কার করতে লাগল। আমার প্রতি ক্রমশ মিমের ব্যবহার নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছে।

মিমের উপর অভিমান করে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। দিনের পর দিন মিমের রাগের মাত্রা বেড়েই যাচ্ছে। মিমের অপছন্দের রঙ হলুদ, এটা সত্যি আমার জানা ছিল না। আর তাছাড়া আমার পছন্দের রঙ হলুদ। একজন পুরুষের পছন্দের রঙ হলুদ হবে, এটা কেউ আন্দাজ করতে পারবে না। ভেবেছিলাম আমার দেওয়া উপহার স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করবে মিম। কিন্তু হলো উলটোটা। তবে ক্রমাগত মিমের রাগের মাত্রা এভাবে বেড়ে গেলে ভবিষ্যতে বড়ো কোনো সমস্যাতে পড়তে হবে।

সেই সন্ধ্যার দিকে আমি বাসা থেকে বের হয়েছি। এখনও বাসায় ফেরার কোনো নামগন্ধ নেই। মিমের অহেতুক রাগের কারণে আমি বেশ দেরি করেই বাসায় ফিরি। আমার চাকরির সময়কাল বিকাল পর্যন্ত হলেও আমি সন্ধ্যার পরে বাসায় ফিরি। আর আজ তো আমি সন্ধ্যা নাগাদই বাসা থেকে বেরিয়েছি, না জানি কখন ফিরে যাই?

গভীর রাতে বাসায় ফিরলাম আমি। না চাইতেও বাসায় ফিরতে হলো আমাকে। দুই বছরের সাংসারিক জীবন আমাদের। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম মিমকে। বিয়ের আগে থেকেই মিমের ক্রোধ সব সময় তার নাকের ডগায় থাকত। ভেবেছিলাম বিয়ের পর আমার ভালোবাসা দ্বারা তার ক্রোধকে দমিয়ে ফেলব। কিন্তু পারিনি। বরঞ্চ ক্রমাগত তার ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যাচ্ছে।

বাসায় ফিরতেই নিজের রুমে চলে গেলাম। মোবাইলে ফ্ল্যাশ চালু করতেই কিঞ্চিত আলোকিত হলো চারপাশ। সেই আলোতেই দেখতে পেলাম মিম ঘুমোচ্ছে। আমিও চুপিসারে মিমের পাশে গিয়ে উলটো পাশ হয়ে শুয়ে পড়লাম। মিমের ক্রোধকে কীভাবে চিরতরে শেষ করা যায়, এসব ভাবতে ভাবতে আমি নিদ্রায়মাণ হয়ে গেলাম।

সকাল হতে না হতেই কারও উচ্চস্বরে আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমি নিজের চোখ খুলে সর্বপ্রথম মিমকে অগ্নিশর্মার বেশে দেখতে পেলাম। আমি কিছু বলব তার আগেই মিম বলে উঠল, ‘‘রাতে কার অনুমতি নিয়ে আমার রুমে ঢুকেছ? বাসার প্রবেশদ্বারের চাবি আছে বলেই যে বাসায় আসতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তোমার যখন ইচ্ছা হবে বাসায় আসবে আর যখন ইচ্ছা হবে বাসা থেকে চলে যাবে, এমন মনোবাসনা থাকলে মন থেকে তা মুছে ফেলো। কারণ, আমার সংসারে এসব বেহায়াপনা চলবে না।’’

মিমের কথা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। গতকালকের ক্রোধের কারণ নাহয় মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু আজকেরটা! পুরো বাসায় মাত্র এই একটা থাকার ঘর। মা-বাবা গ্রামে থাকে। শহরে ভালো বেতনের চাকরি করি। ভবিষ্যতে একটি ফ্লাট কেনার চিন্তাভাবনা আছে, যেখানে গ্রাম থেকে মা-বাবাকে এনে একসাথে বসবাস করব। তাই বর্তমানে ছোট একটি ভাড়া বাসায় থাকি।

মিমের কথাগুলো হজম করে দ্রুত বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। আমাকে এভাবে হুট করে উঠে আসতে দেখে মিম কিছুটা বিব্রত হলো। সে আরও কিছু বলবে তার আগেই আমি বললাম, ‘‘তুমি চাচ্ছো কী? আজকে শুক্রবার। ভেবেছিলাম শান্তিতে ঘুমাব। কিন্তু না, আজকেও তোমার বকবকানি শুনে আমার সকালটা শুরু হলো। নিজের বাসায় কখন আসবো, তার জন্য তোমার থেকে অনুমতি নিতে হবে নাকি?’’

আমাকে এভাবে উচ্চস্বরে কথা বলতে দেখে মিম উলটো বাজখাঁই গলায় বলল, ‘‘এটা যেমন তোমার বাসা, তেমনি আমারও। এতই যখন বিরক্তিকর ও অপ্রয়োজনীয় মনে হয় আমাকে, তাহলে যাও না, যাও! আরেকটা বিয়ে করে নিয়ে আসো। সে এসে এই সংসারের হাল ধরুক। কোন অপয়াক্ষণে যে তোমাকে পছন্দ হয়েছিল, জানি না আমি।’’

পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করার স্বভাবটা এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে মিমের। যথাসম্ভব এর চিকিৎসা না করলে মিম বড়ো কোনো কান্ড করে বসবে।

‘‘হ্যাঁ যাব। নতুন বউ নিয়ে আসব। তবুও তোমার মতো ঝগড়ুটে মেয়ের সাথে জীবনেও সংসার করব না। এই দুইটা বছর না একটু ভালোবাসলে আর না একটু কেয়ার করলে আমার। সব নিজেকেই করতে হয়। আমার জীবনের সবচে’ বড়ো ভুল ছিল তোমাকে ভালোবেসে বিয়ে করা। ডিভোর্সের জন্য তৈরি থেকো।’’

কথাটা বলেই আমি হনহন করে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে মিমকে চিন্তিত দেখলাম। আজ পর্যন্ত আমাকে এত রাগতে দেখেনি সে। বোধহয় আজ একটু বেশিই রাগ দেখিয়েছে আমার উপর, এটা ভেবে সে অনুতপ্ত। তবে আর কিছু করার নেই। বন্দুক থেকে গুলি ছোড়া হয়ে গিয়েছে।

সন্ধ্যা নাগাদ বাসার কলিং বেল বাজতেই মিম এসে দরজা খুলে দিলো। দরজা খুলতেই সে হতভম্ব হয়ে গেল। মিমের সামনে আমি আর আমার সদ্য বিয়ে করা নতুন বউ দাঁড়িয়ে আছি। অবশ্য তেমন সাজগোজ করা নেই আমাদের। তবে গলায় বিয়ের মালা দেখেই যে কেউ বুঝতে পারবে, আমরা সদ্য বিয়ে করেছি। মিম এখনো নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কর্কশ গলায় বললাম,

‘‘এভাবে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে না থেকে সরে যাও। নতুন বউ এসেছে ঘরে।’’

মিমকে ধাক্কা দিয়ে আমি আর রিমি অর্থাৎ আমার নতুন বউ প্রবেশ করলাম। রিমি সোফায় বসলো। আমি মিমকে উদ্দেশ্য করে আবার বললাম, ‘‘কী হলো? দাঁড়িয়ে আছো কেন? নতুন বউ বাসায় এসেছে। চা মিষ্টি নিয়ে আসো।’’

আমার কথায় মিমের ঘোর কাটে। অজান্তেই
তার চোখ থেকে দু-ফোঁটা অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ল। কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, ‘‘এ….সব কী?’’

নিজের কর্কশ কণ্ঠ বজায় রেখে বললাম, ‘‘কী মানে? তোমার চোখ নেই? নতুন বিয়ে করে এসেছি আমরা। তুমিই তো সকালে বলেছিলে আরেকটি বিয়ে করার জন্য। এখন থেকে রিমিই এই সংসারের হাল ধরবে। তোমাকে আর দরকার নেই। তুমি বিদায় নিতে পারো।’’

রিমি আমাকে শান্ত হতে বলল। সে বলল,
‘‘হা-হা রাকিব, এত হাইপার কেন হচ্ছো? সবে মাত্র বিয়ে করে বাসায় এলাম। আজ না আমাদের বাসর রাত। তা কোথায় হবে আমাদের বাসর?’’

‘‘হ্যাঁ, হবে তো। চলো, তোমাকে বেডরুমে নিয়ে যাই।’’

মিম এখনো নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কী হচ্ছে, সব তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। কিছুটা সময় লাগল তার, ব্যাপারটা হজম করতে। আমি দ্বিতীয় বিয়ে করেছি, ব্যাপারটা তার সহ্য হচ্ছে না। সকালে রাগের মাথায় কী না কী বলেছে, তার জন্য আমি সত্যি বিয়ে করে ফেলব, মিম অনুমানও করতে পারেনি? জলদি সে নিজের পা চালিয়ে বেডরুমে গেল।

আমি রিমিকে নিয়ে বেডরুমে আসতেই রিমি অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘‘এ কি! আজ আমাদের বাসর রাত। আর এদিকে ঘরে সাজসজ্জার কোনো চিহ্ন পর্যন্ত নেই।’’

আমি উত্তর দিব তার আগেই মিম আমার পিছন থেকে সামনে এসে বলল, ‘‘হ্যাঁ নেই। কারণ আজ কারও বাসর হবে না। এই শাঁকচুন্নি, তুই এক্ষুণি আমার বাসা থেকে বের হয়ে যাবি। নাহলে তোকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে বের করে দেবো।’’ কথাটা বলেই মিম রিমির হাত ধরে টানতে টানতে রুমের বাহিরে নিয়ে গেল।

মিম রিমিকে ধাক্কা দিবে এমন সময় আমি রিমিকে টান দিয়ে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ফেললাম। মিম এই ঘটনাতে আরও রেগে গেল। সে আমাদের কাছে আসতেই আমি মিমের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলাম। মিম গালে হাত দিয়ে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো।

‘‘তোর সাহস কীভাবে হয়, আমার স্ত্রীকে ধাক্কা দেওয়ার? কানে খুলে শোন, রিমিকে আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছি। আজ থেকে রিমিই আমার জীবন। তুই এই মুহূর্তেই আমার বাসা থেকে বের হয়ে যাবি। আমি আমার আর রিমির সংসারে কোনো তৃতীয় ব্যক্তিকে চাই না।’’

মিমে চেহারা দেখে বুঝা যাচ্ছে, তার শব্দ করে কাঁদতে মন চাচ্ছে। তবে কেন জানি তার চোখ থেকে অশ্রু বের হচ্ছে না। হয়ত তার পাষাণ হৃদয়ে অশ্রুর কোনো জায়গা নেই। আজ পর্যন্ত আমিন তার সাথে কখনো উচ্চস্বরে কথা বলিনি। কিন্তু আজ! আজ তার গায়ে হাত তুলেছি।

‘‘এসব উটকো ঝামেলা যথাসম্ভব বিদায় করাটা শ্রেয়। তবে এখন তো অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। তাই ওকে এখন বিদায় না করে আগামীকাল বিদায় করলে ভালো হবে। তোমার রাগ করে থাকতে হবে না। আজকে না আমাদের বাসর হবে? তাহলে চলো। আমার আর তর সইছে না।’’

রিমি মিমের চোখের সামনেই আমাকে নিয়ে বেডরুমে চলে গেল। মিম কিছুই করতে পারলাম না। ঘরের ভিতর থেকে দরজার ছিটকানি লাগিয়ে দিলাম আমি।

তবে দরজা লাগানোর আগে মিমের চেহারা দেখে মিমের ভেতরের তুফান অনুভব করতে পারলাম। সে নিশ্চই মনে মনে ভাবছে, ‘‘না, মিম। তুই এভাবে হেরে যেতে পারিস না। এসব তোর ভুলের জন্যই হয়েছে। তোর অতিমাত্রার রাগের জন্যই রাকিব দ্বিতীয় বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে। তুই আবার রাকিবকে ফিরিয়ে আনবি। তুই ওই শাঁকচুন্নির সাথে রাকিবের মিলন কখনো ঘটতে দিতে পারবি না।’’

মিম দরজার কাছে এসে জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগল। কিন্তু আমরা কেউ দরজা খুললাম না। সে ক্রমাগত দরজায় নক করতেই লাগল। এক পর্যায়ে সে ক্লান্ত হয়ে দরজার সাথে ঠেস দিয়ে বসে পড়ল।

সহসা রুমের ভিতর থেকে কিছু অতিপরিচিত শব্দ তার কানে ভেসে এলো।
শব্দগুলো মিমের অপরিচিত নয়। রুমের ভিতরে কী হচ্ছে, তা ভাবতেই মিমের ডুকরে কেঁদে উঠতে মন চাইছে। একজন নারীর চিৎকার শুধু একজন নারীই বুঝতে পারে। বিশেষ মুহূর্তের শব্দ এগুলো। আজ আমি অন্য একজন মেয়ের সাথে অন্তরঙ্গতায় মেতে উঠেছি, বিষয়টা মিমের বুঝে আসতেই সে ডুকরে কেঁদে উঠল। নিজের অশ্রুধারাকে আর বাধা দিতে পারল না সে। আজ নিজেকে শেষ করে দিতে মন চাইছে তার।
কিন্তু কীভাবে? এই পাষাণ হৃদয়ে এত সাহস নেই যে নিজের জীবন শেষ করে ফেলবে।
তাহলে কী করবে সে? আমাকে তার দিকে ফিরিয়ে আনতে নতুন কোন পদক্ষেপ অবলম্বন করবে সে?

চলবে……