Tuesday, June 24, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1063



তুই হবি শুধু আমার পর্ব-০৭

0

#তুই হবি শুধু আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_সাত

অয়ন্তির মুখের ওপর ঝুঁকে প্রায় পনেরো মিনিট দাঁড়িয়ে আছে আরশান। অস্বস্তিতে অয়ন্তি নড়তেও পারছে না। নড়লেই এই লোক বলেছে,ঘটনা একটা ঘটিয়ে ফেলবে। না জানি কি করে বসে লোকটা। কিন্তু এভাবে তাকায় কেন? পলকহীন নীলচোখগুলো ‘খেয়ে ফেলবো’ টাইপ দৃষ্টি দিয়ে গিলে ফেলছে অয়ন্তিকে। অয়ন্তির দুপাশে হাত রেখে বন্ধন তৈরি করে রেখেছে আরশান। কিন্তু তা বেশিক্ষণ টিকলো না। রোজ এসে, খুক খুক করে কেঁশে সংকেত দিল প্রিনসিপ্যাল স্যারের আগমনের। আরশান রোজকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে সরে দাঁড়ালো। অয়ন্তি ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আরশানকে ভীত দেখাচ্ছে, ঘাবড়ে সে শার্টের কলার ঠিক করছে। লোকটা ভয়ও পায় নাকি? রোজকে চেনে না অয়ন্তি তাই সেও কিছুটা বিব্রতবোধ করে বলল,
-তুমি কে?

রোজ অয়ন্তির দিকে ফিরল। মেয়েটা একদম পুতুলের মত সুন্দর। কি মিষ্টি আরশানের কুসুম। এজন্যই বোধ হয় আরশান সব ছেড়ে কুসুমের পেছনে পড়ে ছিল।ইশ! মেয়েটা দারুন ভাগ্যবতী। রোজ নিজের সূদর্শনা হাসি ঠোঁটে বজায় রেখে বলল,
-হাই, আমি সাইরাহ্ এ রোজা! আরশানের বন্ধু তবে বন্ধু কম বোন বেশি। তাই তুমি আমাকে ননদ ভাবতে পারো কুসুম। বাই দ্যা ওয়ে আমরা সেম ব্যাচ, সাইন্স থেকে এক্সাম দিলাম, তুমি তো হিউম্যানিটিস ছিলে। তাই না?

-হুম। তোমাকে কখনও দেখিনি কলেজে।

-আমি ট্রান্সফার নিয়ে সেকেন্ড ইয়ারে এসেছিলাম তাই দেখোনি। তোমাদের আর আমাদের ক্লাস টাইম আলাদা ছিল সেজন্য তো আরও কম দেখা হয়েছে। তুমি ভারি মিষ্টি ভাবি!

-তোমার কন্ঠ চেনা চেনা লাগছে! আগে শুনেছি বলে তো মনে পড়ছে না।

রোজ অপ্রস্তুত হয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করার উদ্দেশ্যে বলে,
-দাদাই আমি বাড়িতে ফিরছি। তুমি ভাবিকে নিয়ে কি ঘুরতে যাবে? অবশ্যই ফার্মহাউজ’টা ঘুরিয়ে দেখাবে। ওকে?

আরশান গলা পরিষ্কার করল। লজ্জায় কথা বলতে না পারায় রোজ বিজ্ঞ কন্ঠে বলল,
-লজ্জা পেতে হবে না। আমি কিছু দেখিনি। বাই ভাবি আবার দেখা হবে।

অয়ন্তি কিছু বলবে তার আগেই রোজ চলে গেল। ভারি অদ্ভুত মেয়ে তো অয়ন্তিকে কথা বলর সুযোগই দিলো না। আরশানের তো কোনো বোন নেই, ওরা তো দু ভাই। তাহলে এই বোন কোথ থেকে আসলো? পরে ভাবলো বোন নয় তো, বন্ধু। বন্ধুকে বোনের মত ভাবে আরশান। অয়ন্তি শুকনো ঢোক গিলে বলল,
-এবার বাড়ি যাই?

-না। ফার্মহাউজে যাবো। শুনলে না, বেবি যেতে বলল। আর বেবির কথা অমান্য করার সাধ্য নেই আমার। সো চলো মাই লাভ, চেনাজানার প্রথম ধাপ ফেলা যাক। তুমি আমাকে যতটা চাও চিনে নিতে পারবে এবার।

রোজের কথা শুনে অয়ন্তির মনে হুট করে হিংসার আবির্ভাব হলো। মেয়েটার মূল্য আরশানের জীবনে এত যে ওর সামান্য একটা বাক্যও অক্ষরে অক্ষরে পূরণ করতে হবে? কে ও? অয়ন্তির মনটা আবারও বিষিয়ে উঠল।মেয়ে যখন একটা হাতেই আছে তাহলে অয়ন্তির পেছনে পড়ে আছে কেন? ক্যারেক্টারলেস আরশান। অয়ন্তিকে ভাবনার সাগরে ডুব দিতে দেখে আরশান ওর নাকের সামনে তুরি মেরে বলল,
-আবার কোন ভাবনায় ডুব দিলে জান?
-রোজা কে আরশান?
-বেবি তো বলল’ই, আমার বন্ধু। কিন্তু বন্ধু কম বোন বেশি।
-বোন বা বন্ধুর কথা মানার জন্য এতটা ব্যাকুল হতে আমি তো কখনও কাউকে দেখিনি।
-আর ইয়্যু জেলাস?
-নো।
-ওকে। জেলাস না হলে জেলাসি মেটানোর কোনো প্রয়োজন নেই। আর পূর্বে যদি দেখে না থাকো এখন দেখে নাও।
-ক্যারেক্টারলেস!
-কে তুমি? জানি তো। নতুন করে বলতে না। যে মেয়ের হাজার হাজার বয়ফ্রেন্ড সে ক্যারেক্টারলেস হবে এটা স্বাভাবিক। আর আমার হৃদয়টা এতটাই সুবিশাল যে তোমার এই বড় অন্যায়টা’কেও মাফ করে দিয়েছি।

অয়ন্তি কথা বাড়ালো না। আরশান মৃদু স্বরে বলল,
-বেবি আমার বোনের থেকেও বেশি কুসুম। তুমি যেমন আমার প্রেমময়ী ভালোবাসা, বেবি হচ্ছে স্নেহময়ী ভালোবাসা। ওকে হিংসে করা মানে আমার ভালোবাসা অসম্মান করা। এটা তুমি করতে পারো না। বুঝেছো?

-আমার তো অন্যচক্কর মনে হচ্ছে।

আরশান চকিত দৃষ্টিতে তাকালো। মনে মনে বলল,’শুধু তুমি না, সবারই এমন মনে হয়। ‘ কিন্তু মুখে বলল,
-প্রেমের পড়ার কয়েকটা স্টেপের মধ্যে এটা একটা। সন্দেহ! ভালো ভালো, সন্দেহ না করলে মাঝে মাঝে সম্পর্ক নড়বড়ে হয়ে যায়। সম্পর্কে খুঁনসুটির প্রয়োজন আছে।

-যাবেন?

-যাওয়ার জন্য বেশি ব্যস্ত? কি মতলব আটছো বলো তো? দেখো আমি কিন্তু একদম পিউর ভোলাভালা এক অবুঝ পুরুষ। আড়ালে নিয়ে আমার সতীত্বহরণ করবে না তো?

-ছেলেদের সতীত্ব থাকে?

-মেয়েদের থাকলে ছেলেদের কেন থাকবে না? সবখানে বৈষম্য মেটানোর স্লোগান চলছে আর তুমি সেসব পাত্তা না দিয়ে ভেদাভেদ করার চিন্তায় আছো। এটা ঠিক না।

-গিরগিটি! আপনার মত এত রঙ গিরগিটিও পাল্টায় না।

-কারন গিরগিটির এত রঙ নেই। যতটা ভালোবাসায় আছে। আর ভালোবাসার রঙে যে রঙিন হয় তার রঙের হিসাব একমাত্র সে করতে পারে যে ভালোবাসে। তুমি তো ভালোবাসা কি জানোই না, রঙের হিসেব কি করে করবে? যাই হোক, চলো। আমার শো আছে দুপুরে।

__________________

ফার্মহাউজটা সুবিশাল দৈর্ঘ্যপ্রস্থে নির্মিত। জঙ্গলের বিপরীতে ছোটখাট মাঠের পাশে। গাড়ির হর্ন বাজাতেই দারোয়ান দরজা খুলে দিল। আরশান গাড়ি নিয়ে ঢুকে দারোয়ানের সঙ্গে হেসে কথা বলতে বলতে নামলো। অয়ন্তি চারপাশটা দেখছে। বাড়ির সামনে ঝরণার ফোয়ারা! ডান পাশে বাগানের মত, বাপাশে ফুলের রাজ্য মনে হচ্ছে। অয়ন্তি সেসব দেখতে দেখতে এগিয়ে গেল। আরশান দারোয়ানকে খাবার আনতে বলে পেছন পেছন আসলো।
-দারুন জায়গা তো।
-দারুন? বাসরের প্লানিং এখানে করলে কেমন হবে?
-একদম বাজে।
আরশান মুচকি হাসে।

বাড়ির ভেতরটা চকচক করছে। প্রতিনিয়ত পরিষ্কার করা হয়, তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আরশান বলতে শুরু করলো,
-আমার জীবনের অনেকটা সময় এখানেই কেটেছে। এখানে পিকনিকে আসতাম। এই ফার্মহাউজের প্রতিটা দেওয়ালে, মেঝেতে আমাদের চিত্রকর্ম আছে। আমার বাচ্চাদেরও এখানে আনবো আমি। তুমি আসবে তো?

-না।

-তুলে আনবো!আসবে না মানে, তুমি না আসলে আমার বাচ্চাদের দেখে রাখবে কে?(উচ্চস্বরে বলল)

অয়ন্তি ভয়ে কেঁপে উঠে বুকে থুতু দিল। আরশান সেটা দেখে হাসতে হাসতে কিচেনের দিকে চলে যায়। অয়ন্তি পুরো বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখছে। তিনতলার একটা ঘর খোলা। অয়ন্তি কৌতুহলী হয়ে ঘরে প্রবেশ করতেই ওর চোখ পড়লে ঘরের একটা দেওয়াল জুড়ে টানানো বিশাল একটা স্কেচ করা ছবিতে। লম্বা থেকে খাটো হয়ে আসা ছবিটা দারুন লাগছে দেখছে। চেহারা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে যেটুকু বোঝা যাচ্ছে তা হলো, বাম পাশে সবথেকে লম্বা ছেলেটা, তারপর আরেকটা ছেলে, তারপর আরেকটা ছেলে আর তিন নম্বর ছেলেটার হাত ধরে চোখ টিপে দাঁত বের করে হাসা এক বাচ্চা মেয়ে। তিনম্বর ছেলেটা মেয়েটার দিকেই তাকানো। স্কেচে ভারি মিষ্টি লাগছে দুজনকে। কারা ওরা? আরশান অয়ন্তিকে খুজতে খুজতে উপরে আসল। অয়ন্তি একধ্যানে ছবিটার দিকে চেয়ে আছে দেখে আরশান হেসে বলে,

-আমাদের ছোটবেলার ছবি। আন্টি স্কেচ করিয়েছিলেন। আরসালান ভাই, আমি, বেবি। বেবিকে কেমন দুষ্টু দুষ্টু লাগছে তাইনা? ছোট থেকে ভারি দুষ্টু ও। একবার কি হয়েছিল জানো? আমি যখন প্রথম ওদের বাড়িতে যাই, তখন কিছু চিনতাম না। বাবারা ওদের বাড়িতে ঢুকে পড়েছিল, আর আমি গাড়ি থেকে নামছিলাম। গাড়ি থেকে নামতেই ও আমার ওপর গোবরের পানি ছুড়ে মা’রলো। আমি তব্দা খেয়ে দাড়িয়ে ছিলাম। আরসালান ভাই হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। আমি তো রেগে মেগে একাকার। বাড়ি ঢুকবো না, চলে যাবো এমন জেদ ধরে গাড়ির ভেতর গিয়ে বসতেই ঝপাত করে আরসালান ভাইয়ের গায়ের ওপর পানি পড়ার শব্দ পেলাম। ভাই হাসি থামিয়ে আমার দিকে ভড়কে তাকালো। তাঁর ওই অদ্ভুত চেহারা দেখে আমি হাসতে হাসতে রাগের কথা ভুলেই গেলাম। তখন পিচ্চিটা এসে কোমরে হাত গুজে বলে, ‘তালা তোমলা?’ আড়াই বছরের পিচ্চি, আর তাঁর এহানো কাজে ভাই আমি দুজনেই কুপোকাত। পরে বুঝলাম পানিগুলো ও নয়। অন্য একজন মে’রেছে। যে একসময় বেবির প্রতিটা কথা শুনতো। কিন্তু বুদ্ধিগুলো তো বেবিরই।
-বেবির প্রশংসায় পঞ্চমুখ!
আরশান থেমে গেল। অয়ন্তি কৌতুহলী কন্ঠে বলল,
-রোজার হাত ধরে আছে ওটা আপনি? আরসালান ভাই বোধ হয় সবথেকে লম্বাজন।
-ওটা না, আমি আরসালান ভাইয়ের পাশেরজন।
-তাহলে ওটা কে? রোজার দিকে দারুনভাবে তাকিয়ে আছে। আপনাদের বন্ধু নাকি?
-হ্যাঁ।
-কি নাম?
-দুপুর হয়ে এলো। চলো খেতে হবে। তুমি এত বকবক করো কেন?

আরশানের এড়িয়ে যাওয়াটা বেশ বুঝলো অয়ন্তি। মনে প্রশ্নটা চাপা দিয়ে আরশানের পিঁছু পিঁছু আসলো সে। কারন আরশানের খপ্পর থেকে বাঁচা মুশকিল। বাড়ির যা অবস্থা তাতে বিয়েটাও ভা’ঙা অসম্ভব। তাই বিয়েটা যখন হবেই, অয়ন্তির উচিত আরশানের সম্পর্কে জানা। খাবার টেবিলে বসে অয়ন্তি প্রশ্ন করে,
-আপনার পুরো নাম?
-আরশান খাঁন তৈমুর।
-বয়স?
-তেত্রিশে পড়েছে।
-কি?
-কি?
-আমার থেকে পনেরো বছরের বড় আপনি? হোয়াট দ্যা! এত বয়স্ক মানুষের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করল কি করে বাবা? আজব তো!
-আমাকে দেখে বয়স্ক মনে হয়?
-মনে না হলেও, বয়স্ক তো। এইজ ডিফারেন্স এত নিয়ে কাউকে মানা যায় না। লজ্জা করে না নিজের থেকে এত ছোট একটা মেয়ের পেছনে হাত ধুয়ে পড়ে থাকতে।
-না।
-লজ্জা থাকলে তো লাগবে। নির্লজ্জ।
-বিয়ের প্রস্তাব তোমার বাবা পাঠিয়েছে। আমাকে এসব বলছো কেন? নিজের বাবাকে গিয়ে বলো।
-বলা যাবে না। তারপর বলুন আপনার ইনকাম কত?
-তোমার যত টাকা লাগবে তা তৎক্ষনাৎ পাবে। তাই এই হিসেব তোমাকে রাখতে হবে না।
-খাঁটাশ।
-ধন্যবাদ।
-কি করেন?
-বউয়ের সেবা। আর তাঁর কটুক্তি শোনাই আমার কাজ। পারিশ্রমিক পাইনা, তবে আশা করছি তাকে পরিশ্রমিক হিসেবে পাবো।
-সোজা কথা সোজা করে বলতে পারেন না?
-সোজা বললে বুঝবে না। নেক্সট কুয়েশ্চন?
-বাড়িতে কে কে আছে?
-বাবা, ভাই, রজনী ভাবি, ভাইয়ের তিন ছেলেমেয়ে অভী অয়ন আর রোশনি।
-কি পছন্দ করেন?
– লিস্ট করে তোমার বাড়িতে পাঠিয়ে দেবো।
-বেয়াবদ একটা।
-তোমার লজ্জা করেনা? পনেরো বছর বড় একজনকে বেয়াদব, অসভ্য, নির্লজ্জ, অভদ্র বলতে? এসব বলার উপযুক্ত কারন এখনও দেখাইনি আমি। যদি রেগে গিয়ে দেখাই? তখন কি করবে? আমার রাগ বাড়ছে কুসুম।
-সময় লাগবে ভাবতে।
-ওকে।
-আর’জে রোজের সঙ্গে আমার দেখা করিয়ে দেবেন? যাস্ট একবার, আর কখনও কোনো অনুরোধ করবো না। প্লিজ!
-কেন?
-কিছু প্রশ্নের উত্তর চাই আমার।
-সে তোমার প্রশ্নের উত্তর দেবে না। আর’জে রোজ অতি চুপচাপ থাকা একজন! প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেনা। তোমার সঙ্গে তো তাঁর অফিসিয়ালি পরিচয়ও নেই। তাই সে মিটিংটা এ্যাটেন্ড নাও করতে পারে।
-সেটা আমি বুঝে নেবো।
-ওকে। সোমবার সকাল ন’টায় তৈরি থেকো।

_______________

রোজের সামনে বসে কফিমগে চুঁমুক দিয়ে আরশান বলে উঠল,
-তুই গতকাল জ্বরের ঘোরে ওর নাম নিচ্ছিলি বেবি।
-কার নাম?
-ওনাকে এনে দাও, আই হেইট ইয়্যু, ইউ নেভার লাভ মি আই নেভার লাভ ইয়্যু! তোমার কাছে ফিরবো না।

রোজের মনে পড়লো ঘটনাটি। তারপর আলতো হেসে বলল,
-পুরোনো অভ্যাস। তাই হয়তো বলে ফেলেছি। সিরিয়াস কিছু না। কিছু কিছু মানুষ চলে গেলেও তাদের স্মৃতির রেশ রেখে যায়। উনি তেমনই একজন। আর আমি তো বলেছিই আমি কাউকে ভালোবাসিনা, বাসবো না।তাকে তো একদমই না। মায়া জমে ছিল বলে তার নাম জপ করেছি। নাথিং এল্স দাদাই।

-সিরিয়াসলি? তুই বলছিলি ওর জন্য তোর কষ্ট হয়। বাবা আমাকে এই নিয়ে অনেক কথা শোনালো। আমিও প্রথমে যখন গাড়িতে বসে শুনলাম, অপরাধবোধে তো প্রায় কেঁদেই ফেলেছিলাম।

-ধ্যাত! কিসের অপরাধবোধ?আঙ্কেলকে আমি বুঝিয়ে বলবো। আর তোমরা সবাই তো জানো জ্বর হলে আমি আধা মাতাল আর আধা পাগল থাকি। সব কথা ধরতে আছে নাকি? যা যা বলেছি, ভুলে যাও। আর উনি নয় ও, ওকে আমি ঘৃণা করি। বুঝেছ? যে আমার মর্ম বোঝে না তাঁর মর্ম বুঝে লাভ নেই আমার।

-বাঁচালি। কিন্তু কাল তোর অভিমান হয়েছিল কি নিয়ে? কুসুমের আরশান আছে, তোর কেউ নেই। এটার মানে কি হ্যাঁ? জামাই লাগলে বল, আমার ছোট ভাইব্রাদাররা তো তোর উপ্রে ফিদা! ইশারা দিলেই লাইন লেগে যাবে।

-আমার বয়স মাত্র আঠারো! একুশ পার হোক। লাইন তখন লাগিও। এখন লাগবে না।

-কুসুম তোকে সন্দেহ করছিল। সবাই করে, কাহিনি কি বুঝলাম না। আমাদের দেখলে কোন এঙ্গেলে প্রেমিক প্রেমিকা টাইপ লাগে?

-কি জানি! হয়তো আমরা দুজন দুজনকে গুরুত্ব দেই, কদর বুঝি, কেয়ার করি, এসবেই। বাট সেগুলো তো ভাই-বোন হিসেবে।শুধু কি প্রেমিক-প্রেমিকা’রাই ওভাবে কথা বলে? ভাইবোন’রা বলতে পারে না?

-গুড আন্সার।চলার মত! বাট সত্যি করে বল তো বেবি! আমার ওপর তুই ক্রাশড না? তোর উপ্রে কিন্তু আমি বাচ্চাকাল থেকে ক্রাশড। শুধু আমার ঘুড়ির নাটাই কুসুমের হাতে বলে,,

-ক্রাশ নয় ভালোবাসা। ভালোবাসা হলে হ্যাঁ! আমি তোমাকে ভালোবাসি। শুধু তোমাকে না পৃথিবির সকল কিছুকে ভালোবাসি। সকল সৃষ্টিকে। বাট তোমার কুসুমের যে হাল শুনলাম! তোমাকে বিয়ে করে কিনা দেখো। বুইড়া জামাই তো ওর পছন্দ না।

-বিয়ে না করে যাবে কই? তুলে আনবো না। আরশানকে বারো বছর ঘুরিয়ে যেতে পারবে?

রোজকে বোঝানোর জন্য এটা বললেও আরশান স্বস্তি পেলনা। কারন সে অয়ন্তির আজকের কথাগুলো সারা দিন ভেবেছে। সত্যিই কি ওদের এক হওয়া সম্ভব নয়? অয়ন্তি কি ওকে মেনে নিতে পারবে না? আরশানকে মুডে থাকতে দেখে রোজ রসিকতা করে বলে,

-সমস্যা নেই। যদি কুসুম না হয়, বেবি দিয়ে কাজ চালাবে। এমনিতেই তো সবাই ভাবে আমাদের মধ্যে চক্কর আছে। কুসুম ছ্যাকা দিলে আমি মলম লাগিয়ে দেবো। নো প্রবলেম। আমার মনটা আবার সমুদ্রসমান বড়।বুঝলে, নিজে কষ্ট পাবো, কিন্তু তোমাকে তোমাদের কষ্ট পেতে দেবো না।

-তুই আর মলম? তুই তো কা’টা ঘায়ে নুন, লঙ্কার ছিটে দিতে আসবি। বজ্জাত মেয়ে!

রোজ হেসে বলল,
-হতেও পারে! আমাকে দিয়ে নিশ্চয়তা নেই। এখন যাও, পড়তে দাও আমাকে। আর হ্যাঁ, যাওয়ার সময় গেট টেনে দিও। আমি বাইরে যাবো, তখন তালা দেবো।

আরশান যেতে যেতে ভাবলো রোজ কি ওকে সত্যিই মলমের কথা বলল? নাকি পুরোটাই মজা? রোজ তো এমন মজা করেনা। তারপরই ভাবে, ধুর কি ভাবছে ও? রোজ ওকে ভালোবাসবে কি করে? রোজ তো এসব বোঝেইনা। হয়তো আরশান ক্রাশের কথা তোলার জন্য রোজ মশকরা করেছে। হ্যাঁ! এটাই হবে।

ওদিকে রোজ আরশানের দিকে তাকিয়ে বলল,
-ভালোবাসা বুঝি আমি। ভালোওবাসি। কিন্তু বলার জো নেই বলে বলিনা। তোমাদের বুঝতে দেইনা। ওনার কথা তোমরা কেন মনে করিয়ে দাও? তোমরা কি একদমই বোঝো না?ওনার কথা শুনলে আমার কষ্ট হয়। বুকের ভেতরটা পুড়তে শুরু করে। জমে থাকা কয়লা জ্বলতে শুরু করে। আজ তো কথার জালে সবটা চাপা দিলাম। ভবিষ্যতে কি করবো? জ্বর আসলে তেমাদের সামনে যাবোই না, তাহলে ওনার কথা মা-বাবার কথাও ঘোরের মধ্যে বলবো না। তোমরাও তাহলে বুঝবে না দাদাই।

চলবে?

তুই হবি শুধু আমার পর্ব-০৬

0

#তুই হবি শুধু আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_ছয়

অয়ন্তিকে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরছিল আরশান। রাস্তায় রোজকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে সে দ্রুত গাড়ি থামালো। ওটা রোজ কিনা বোঝা যাচ্ছে না তাই সে গাড়ি থেকে নেমে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলো কালো থ্রিপিচের ওপর কালো লেদারের জ্যাকেট পড়া বাচ্চার মত দেখতে ছোটখাট মেয়েটিকে। মেয়েটি বিরক্তি নিয়ে ফোনে কাউকে অনবরত কল করছে। ওপর পাশ থেকে হয়ত রিসিভ হচ্ছে না। চট করে আরশান নিজের বাম পকেটে থাকা ফোনটা বের করল। সাইলেন্ট করা ফোনে বিশটারও বেশি মিস কল। উপরে জ্বলজ্বল করছে ‘বেবি’ নামটা। আরশান দ্রুত ফোন রিসিভ করে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপর পাশ থেকে ভারি দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল। আরশান দেখলো দূরে দাড়ানো মেয়েটাও কানে ফোন নিয়ে দাড়িয়ে আছে। আরশান আবারও ডাকে,
-বেবি! কোথায় তুই?
-রোডে! বৃষ্টির জন্য গাড়ি পাইনি। তুমি কি আমাকে একটু পৌঁছে দেবে দাদাই?
-কালো থ্রিপিচ পড়েছিস? আমার জ্যাকেটসহ!
-কোথায় তুমি?
-আরে তোর সামনেই।সামনের গাড়ির কাছে চলে আয়। আর স্যরি, রিয়েলি ভেরি স্যরি! ফোনটা সাইলেন্ট ছিল তাই রিসিভ করতে পারিনি।
-বুঝেছি। তোমার কুসুম সঙ্গে থাকলে তোমার কি আর কারোর কথা মনে থাকে? রাখো আসছি আমি।
-অভিমানি কন্ঠস্বর! হয়েছে কি?
-কিছু না।
-তোদের মেয়েদের এই ‘কিছু না’ শব্দের মধ্যে অনেক কিছু থাকে। আমাকে বোঝাতে আসিস না, কি হয়েছে সেটা বল।
-চলে যাবো? এত জেরা ভালো লাগছে না।
-এই না, না আয়। পাগলি!

গাড়ির সামনে এসে রোজ দাড়িয়ে রইল। আরশান মৃদু হেসে উঠে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে হাত মেলে রোজকে বসতে বলল। রোজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসে। মনটা আজ বড্ড বিক্ষিপ্ত। একশ দুই জ্বর নিয়ে টানা দেড় ঘন্টা শো করে, কিছু খারাপ ভালো গল্প শুনে বড্ড ক্লান্ত সে।চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। জানালার কাঁচ বন্ধ করে রোজ মাথা সীটে লাগিয়ে দিল। মৃদু ভলিয়মে এখনও রেডিও বেজে চলেছে। রোজ বিরক্ত হয়, কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু রেডিওর শব্দে মাথা ধরে যাচ্ছে। তাই অনেক কষ্টে ভগ্নস্বরে বলে,
-ওফ ইট দাদাই।

আরশান ভ্রু কুঁচকে তাকাল। রোজের ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত চেহারা দেখে বুকের ভেতর ছ্যাত করে উঠলো। রোজের যে জ্বর সেটা তো ওর খেয়ালই ছিল না। টেক্সটাও নিচে পড়ে গিয়েছিল বলে ভালো করে দেখা হয়নি। মেয়েটা কি সেজন্য দুঃখ পেয়েছে? আরশান গাড়ি থামিয়ে ডান হাত রোজের মাথায় ছোঁয়াতেই শিউরে উঠলো। উত্তাপে হাত জ্বলে উঠল মনে হয়। আরশান রোজের মাথায় পুরো হাত রেখে বলল,
-কষ্ট হচ্ছে অনেক?
রোজের সরল স্বীকারক্তি,
-হুম।আজ কেমন জানি মনে হচ্ছে, সত্যিই আমার কেউ নেই। পৃথিবিতে আমি একা। সবাই চলে গেল, তাহলে আমায় রেখে গেল কেন? দাদাই। কার ভরসায়?
-আমি স্যরি বললাম তো।
-স্যরি শুনতে চেয়েছি? আর যাকে তাকে স্যরি বলার অভ্যাস বদলাও।
-তার মানে শুধু অভিমান না, রাগও হয়েছিস আমার ওপর।
-না।
-বললেই হলো? আমি বুঝি না? জ্যাকেটটা খুলে রাখ।
-উহু ঠান্ডা।
-আরে জ্যাকেটে পানি জমেছে। ওতে ঠান্ডা বেশি লাগবে। কুসুমের ওরনা আছে ওটা পেঁচিয়ে নে।
-লাগবে না।
-আবার রাগ হচ্ছিস? তুই বড্ড জ্বালাচ্ছিস বেবি! এটা একদমই ঠিক না।
-ছুটি চেয়েছিলাম তোমার বাপ দেয়নি কেন? এটা ঠিক?
-তোর শো কে করবে? তোকে ছাড়া ওটা করা অসম্ভব। সবাই তোকে চায়, বুঝিস না কেন?
-তোমার মত একজন প্রয়োজন আমার। কুসুমের যেমন আরশান আছে, রোজের তেমন কোনো মানুষ নেই কেন দাদাই?
-চোখ বুজে রাখ। কথা বলবি না আর।

রোজ কথা বাড়ালো না। চোখ বুজে রইলো। আরশানের দৃষ্টি সামনে থাকলেও মন পড়ে রইল পাশের রমনীটির কাছে। যে মেয়েটা সবার সব সমস্যা মেটায়, সবাইকে হাসায় তাঁর মনের দুঃখ মেটানো এতটা কষ্টসাধ্য কেন? মাঝে মাঝে আরশানের নিজেকে অপরাধি মনে হয়। ওর জন্যই বোধ হয় রোজের আজ এমন অবস্থা। যদি সময় থাকতে মানুষ মূল্য দিতে জানতো, বুঝতে জানতো। তাহলে হয়তো আজ পরিস্থিতি অন্যরকম হত। বুক চিরে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতেই আরশান বুঝলো রোজ ঘুমিয়ে পড়েছে। ভারি নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে, হাত সীট থেকে নিচে পড়ে গেছে। এলোমেলো হয়ে সিটের মাঝে শুয়ে পড়ার চেষ্টা করছে। আরশান সীটবেল্ট খুলে রোজের মাথা নিজের কোলের ওপর রেখে অয়ন্তির ওরনা দিয়ে সীটের সঙ্গে ওর কোমর বেঁধে দিল যেন ধাক্কায় পড়ে না যায়। রোজ ঘুমের মধ্যেই বিরবির করে বলল,
-আই হেইট ইয়্যু! আই যাস্ট হেইট ইয়্যু। ইউ নেভার লাভ মি। আই নেভার লাভ ইয়্যু। আমি কখনও তোমার কাছে যাবো না। তুমি ভালোবাসা দেখালেও না। কারন আমি তোমাকে ঘৃণা করি, শুধু ঘৃণা।

আরশানের চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো রোজের চেহারার ওপর। উষ্ণ তরল পদার্থ টের পেতেই রোজ বা হাতে মুখ চুলকালো। আরশান তা দেখে সযত্নে সে পানি নিজের রুমাল দিয়ে মুছে দিল।রোজ চায়না ওর বিরুদ্ধে ওর অবচেতনায় কোনো পুরুষের ছোঁয়া পেতে। তাই আরশান রোজের সেই চাওয়ার বিরুদ্ধে যেতে পারে না। সজাগ থাকলে সে অবশ্যই হাত দিয়েই রোজের চেহারা মুছে দিত। আরশান নিজের বাড়িতেই রোজকে নিয়ে আসলো। গাড়ি গ্যারাজে রেখে সে রোজকে ডাক দিল। প্রথম ডাকে সাড়া পেল না, পরে আরও তিন-চারবার ডাকতেই রোজ উঠে বসলো। জ্বরের ঘোরে বাচ্চাদের মত করে বলল,
-স্যরি, কষ্ট হলো নাকি তোমার? পায়ে ব্যাথা পেয়েছ?
-থাপড়ে গাল লাল করে দেবো। নিজে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছিস, আর আমাকে নিয়ে চিন্তা! নিজের কথা ভাব। আমি নিজে স্যুপ বানিয়ে দেবো তোকে, ঘরে গিয়ে সেটা খেয়ে ঘুমাবি। বাড়তি কোনো কথা না, ওকে?
-তুমি আমাকে বকছো দাদাই?
-বকবো না? কোনো কথা শুনিস তুই? নাম, আমাকে ধরে হাট।
-আমি তো একা হাটতে পারবো।
-ধরে হাটবি নাকি কোলে নেবো?
-ধরে হাটছি। হাত কই তোমার? আমি দেখতে পাচ্ছিনা।
-চোখ তো খেয়ে ফেলেছিস। কাঁনা! এই নে ধর।

আরশান রোজের হাত ধরতেই রোজ আরশানের হাত চেপে ধরলো। বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই আরসালান ভাই ও তাঁর স্ত্রী রজনী ভাবি এগিয়ে আসলেন। রজনী ভাবি উতলা কন্ঠে শুধালেন,
-পিচ্চিটার হলো কি? টলছে কেন? আরশান ওকে ধরে সোফায় বসাও। জ্বর নাকি? মেয়েটা একদম কথা শোনে না। পঁচা মেয়ে।
রোজ অভিমানি গলায় বলে,
-দাদাই আমাকে আমার বাড়িতে রেখে আসো। আমি তো পঁচা। থাকবো না এখানে।
-থাকবো না বললেই হলো? আরশান পানি আনো। ওর গলা শুকিয়ে আসছে। অভীর বাবা ডাক্তারকে ডাকো। মেয়েটার গা তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।

আরসালান ফোন নিয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়লো। এত রাতে ডাক্তার বাড়িতে আসতে পারবে না, কিন্তু মেডিসিনের নাম নিশ্চই বলতে পারবে। ড্রইংরুমে চেঁচামিচি হতেই আরশানের বাবা আমীর সাহেব চোখে চশমা পড়তে পড়তে নিচে নামলেন। সবাইকে একসঙ্গে নিচে দেখে তিনি বিচলিত কন্ঠে প্রশ্ন করে,
-কি হয়েছে? লাইট জ্বালানো দেখে নামতে হলো।

রজনী জবাব দিল,
-রোজের অনেক জ্বর বাবা। আরশান নিয়ে আসলো।
-সেকি! জ্বর কমেনি? আমি যে আসার সময় মেডিসিন দিয়ে আসলাম। নিশ্চই খায়নি। এই মেয়েটা এত জেদি! আরসালান এ্যান্টিবায়োটিক আন। ওর সিম্পিলে কাজ হয় না।

বাবার আদেশ পেতে আরসালান নিজের ঘরে গিয়ে এ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে আসলো। আরশান স্যুপ বানিয়ে এনেছে। আমীর সাহেব নিজ হাতে রোজকে স্যুপ খাইয়ে দিলেন এরপর ঔষধ রোজের মুখের সামনে তুলতেই রোজ বমি করার ভাব নিয়ে বলে,
-ছি! তুমি তো জানো, এসব খাই না আমি। এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবো।
-খেতে হবে না। গিলতে হবে। চুপচাপ গিলে ফেল। মানা শুনবো না আমি।
-তুমি পঁচা। তোমরা সবাই পঁচা।
-ঠিক আছে। তুই একা ভালো। তাই ভালো মেয়ের মতো ঔষধটা খেয়ে নে মা।
-খেলে কি দিবা?
-কি চাই?
রোজ ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,
-ওনাকে ফিরিয়ে দাও। আমার একা খুব কষ্ট হয়। কষ্ট হয় অনেক। ফিরিয়ে দাও না ওনাকে।

আমীর সাহবে ছেলেদের দিকে তাকিয়ে রজনীর পানে চাইলেন। সবাই অসহায় দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে আছে। সব থেকে করুন চেহারা আরশানের। আমীর সাহেব হাসার চেষ্টা করে বললেন,
-আচ্ছা। আগে খেয়ে নে, তারপর তোর ওনাকে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি।
রোজ কাঁদো কাঁদো চেহারায় বলে,
-সত্যি তো?
-হুম।
-তিন সত্যি?
-আগে খেয়ে নে। না খেলে কোনো উনি টুনি আনবো না। আমার মেয়ে কি ফেলনা নাকি, যে ছেড়ে যায় তাকে ডেকে আনবো কেন? সে বুঝুক হীরার আর কাঁচের কি তফাৎ।
-আমি তো তাও না। পায়ের ধুলো, তাই পিসে মাড়িয়ে চলে গেল।
-রোজ! (ধমক দিলেন)
-খাচ্ছি তো। কিন্তু তিতা লাগবে।
-আরশান ফ্রিজ থেকে আইসক্রিম, ফালুদা, কাস্টার্ড, মিষ্টি সব এনে দে। এবার খা মা, আরশান চকলেটও আনছে। ঔষধ খেয়ে ওসব খা, দেখবি তিতা লাগবে না।
-ঠিক আছে।

রোজ ঔষধ খেতে খেতেই রজনীর কোলের ওপর শুয়ে পড়লো। আমীর সাহেব হতাশ চোখে চাইলেন। মেয়েটা কত আশা নিয়ে নিজের একটা ইচ্ছে প্রকাশ করল। আর তারা সেটাও পূরণ করতে পারবে কিনা জানেন না। আরশান বাবার দিকে ফিরে বলল,
-ওকে একা রাখা ঠিক হবেনা। কিছুদিন এখানে থাকুক।
-হ্যাঁ।
-তুমি কি আমার ওপর এখনও রেগে আছো বাবা?
-না।
-তাহলে এভাবে কথা বলছো কেন? সব তো স্বাভাবিক হয়ে গেছে। তবুও,
-কারন রোজের এমন অবস্থা হওয়ার পেছনে তোমারও হাত আছে। তুমিও অপরাধি, অন্যায় তুমিও করেছ।
-বাবাহ্!!
-যতদিন না রোজ ঠিক হয়। সুস্থ হয়, আমাকে বাবা ডাকবে না তুমি।
-ঠিক আছে। আমিও দেখবো বেবি কতদিন আমাকে অপরাধি বানিয়ে রাখে। আমার জন্য হলেও ওকে সুস্থ হতে হবে।
-কে তুমি? ওর জীবনে তোমার ভূমিকা কি যে তোমার জন্য ও সুস্থ হবে? পারলে নিজের ভুল শুধরাও। নাহলে,
-নাহলে?
-বলে কি লাভ?তুমি শোনার মত ছেলে? দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষ।
কথাগুলো বেশ রেগে বললেন আমীর সাহেব।যার দরুন রোজ ঘুমের ঘোরেও চিৎকার শুনে বলল,
-ঝগড়া করেনা। ঝগড়া ভালো না।
আমীর সাহেব রোজের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-তোর এত ভালো হওয়া উচিত ছিল না মা। তোর কঠিন হওয়া উচিত ছিল।

সকালে ঘুম ভাঙতেই কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে গেল রোজ। গন্তব্য লাইব্ররি। কিছু বই কালেক্ট করতে হবে। পড়া বাকি অনেক। অনেক কিছু জানা বাকি। সব জানতে হবে তো।

___________

খাবার টেবিলে অয়ন্তি আসামাত্র আশরাফ মীর্জা গলা পরিষ্কার করে কিছু একটা বলার প্রস্তুতি নিলেন। অয়ন্তি বুঝলো বিয়ের ব্যাপার এটা।তাই মেজাজ আগে থেকেই গরম হয়ে গেল। আশরাফ মীর্জা ভণিতা না করেই বলে উঠলেন,
-আমীর খাঁন বলছিলেন, আগামী মাসের শেষের দিকে যদি বিয়েটা।
-আরশানকে চিনি না আমি। চিনতে, জানতে সময় লাগবে। তারপর আলোচনা। অপরিচিত একজনকে হুট করে বিয়ে কিভাবে করবো?
-আচ্ছা।

খাওয়া শেষে অয়ন্তি তৈরি হয়ে নিল। প্রাপ্তকে একবার দেখতে যাওয়া উচিত। কিন্তু আরশান? সে যদি কোনো ভাবে ধরে ফেলে তাহলে তাঁর অদ্ভুত কাজের শুরু হয়ে যাবে। যেটা অয়ন্তি চায়না। লোকটা একটা মহাঅসভ্য। কখন কি করে বসে বলা যায়না। তার থেকে লাইব্ররিতে গিয়ে জার্নালিজমের কিছু বই এনে পড়লে কেমন হয়? কিছুদিন পরই রেজাল্ট দেবে। তারপর সে জার্নালিজমে ভর্তি হয়ে অনার স্বপ্ন পূরণ করবে।যেই ভাবা সেই কাজ। অয়ন্তি গুছিয়ে ড্রাইভারকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। লিস্টও করেছে কি কি বই আনবে। কিন্তু লাইব্রেরিতে এসে হতাশ হতে হলো।লিস্টের একটা বই’ও নেই। কেউ নিয়ে গেছে। এটা কোনো কথা? বিরক্ত, বিষাদগ্রস্ত চিত্তে বারান্দা দিয়ে হাটতেই অয়ন্তির নজর আটকালো সামনেই ধূসররঙা শার্ট পড়া পুরুষটির দিকে। অয়ন্তি ভালো করে চাইল। আরশানের মত লাগছে। কিন্তু আরশান এখানে কি করবে?তাছাড়া ওর তো শো চলছে এখন। অয়ন্তি মনের ভুল ভেবে পাশ কাটিয়ে যেতেই আরশান অয়ন্তিকে ডাক দিল,
-এই কুসুম তুমি এখানে?

অয়ন্তি দাঁড়ালো না। আরশান অয়ন্তির পেছনে পেছনে এসে গম্ভির কন্ঠে বলল,
-ডাকছি তো।
-আপনি? আমি তো হ্যালুসিনেশন ভেবেছিলাম।
-আমাকে নিয়ে তাহলে কল্পনাও হয়? ভালো ভালো। তা কি কি কল্পনা করেছো?বাচ্চা অবধি পৌঁছেছে কল্পনা?
-অসভ্য।
-ওহ হ্যাঁ। গতকাল তো এটার অর্থ বলতেই গিয়েছিলাম। বলা হয়নি। চলো আজ বলে দেই।
-কি?
-অসভ্যতার সংজ্ঞা। তাও প্রাকটিক্যালে।

বলেই অয়ন্তিকে টেনে লাইব্রেরির মধ্যে নিয়ে গেল আরশান। অয়ন্তি চিৎকার দিতে যাচ্ছিল তখনই ওর মুখ চেপে ধরলো আরশান। ফিসফিসিয়ে বলল,
-লাইব্রেরি এটা। চেঁচিয়ে সবাইকে বিরক্ত করবে না কুসুম।

রোজ গাড়িতে বই রেখে আবারও লাইব্রেরিতে আসে। ভুল করে লাইব্রেরি কার্ড ফেলে গেছে সে। সেটা নিতেই এসেছিল। কিন্তু আরশান আর অয়ন্তিকে দেখে সে দ্রুত চারপাশে নজর বুলালো। এটা প্রেম করার জায়গা?এরা আর বদলালো না। দরজার সামনে দিয়েই একজন স্যার আসছিলেন। রোজ চোখ বড় বড় করে একবার স্যারের দিকে আর একবার আরশানদের দিকে তাকাল। স্যার দরজার কাছে আসতেই রোজ একগাল হেসে এগিয়ে গেল,
-আসসালামু আলাইকুম স্যার। কেমন আছেন? শরীর ভালো তো?
-আরে রোজ! হ্যাঁ ভালো আছি। তোমার কি খবর?কতদিন পর এলে, তা হঠাৎ কি মনে করে?
-ভালো।কি মনে করে মানে? পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে গেছি বলে কলেজে আসা বারণ তা তো কোথাও লেখা দেখলাম না। আপনাদের ব্যানার বা পোস্টার লাগিয়ে নিষেধাজ্ঞা বলে দেওয়া উচিত ছিল।
-তাই? দুষ্টুমি দেখছি আগের থেকেও বেড়েছে।
-আমি দুষ্টু না।
-হুম, দুষ্টু না মহাদুষ্টু। তারপর বলো লাইব্রেরিতে কি মনে করে? এডমিশনের পড়া কেমন চলছে? মেডিকেল নেবে তো?
-চলছে মোটামুটি। আর মেডিকেল না, জার্নালিজম।
-সেকি! ব্রাইট স্টুডেন্ট তুমি। মেডিকেলের জন্য রাতদিন পরিশ্রম করলে। ওসব জার্নালিস্ট হতে হবে না। প্রচন্ড রিস্ক ওতে। পরিশ্রমও অনেক। তোমার স্যার হিসেবে বলছি, মেডিকেলে ট্রাই করো। সরকারিতে চান্স পেয়ে যাবে।
-জি স্যার! মাথায় রাখবো। তো কোথায় যাচ্ছিলেন?
-লাইব্রেরিতে। নোটস দিতে।
-আমিও যাচ্ছি। আমার কাছে দিন, জমা দিয়ে দেবো।
-আচ্ছা।

স্যার চলে যেতেই হাফ ছেড়ে বাঁচলো রোজ। উঁকি দিয়ে দেখলো আরশান অয়ন্তিকে জোর করে আটকে রেখেছে। অয়ন্তির লজ্জায় রক্তিম হয়ে যাওয়া মুখটা দেখে স্মিত হাসে রোজ। প্রয়োজনের অধিক কথা বলা রোজের পছন্দ নয়। আগে ছিল কিন্তু ইদানিং কথা বলতে ইচ্ছে করেনা। তবুও এদের জন্য কতকিছু বলতে হলো। নোটস অবধি বগলদাবা করে ছুটতে হচ্ছে। আর এদের দেখো। দিন-দুনিয়া ভুলে প্রেমে মশগুল।

চলবে?

তুই হবি শুধু আমার পর্ব-০৫

0

#তুই হবি শুধু আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_পাঁচ

অয়ন্তি যে ঘরে থাকার কথা ভেবেছে তার ডান পাশের ঘরটা আরশানের। বা’পাশে অনা’রা থাকবে। আর নিচে কিচেনের পাশের ঘরটায় থাকবে সায়ন ও সৌফি। অনা ল্যাগেজ থেকে অয়ন্তির জামা-কাপড় বের করে খাটের ওপর রেখেছে। অয়ন্তি সেগুলো তুলে ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
-আমরা কত দিন থাকবো এখানে?
-কেন কোনো সমস্যা হচ্ছে?
-না। কিন্তু অপরিচিত একটা মানুষের বাড়ি এভাবে না বলে এসে, থাকার পরিকল্পনা করা কি ঠিক অনাপি?
-অপরিচিত কে? আরশান হচ্ছে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। ওর বাড়ি মানে আমারও বাড়ি। আর তোরও বাড়ি!
-আমার বাড়ি? কিভাবে? উনি তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড না।
-ওত বুঝতে হবে না তোকে। আলমারিতে জামাগুলো তুলে রাখ। এক সপ্তাহ থাকবো এখানে।

অয়ন্তি আলমারিতে জামা-কাপড় তুলে রেখে অনার দিকে ফিরে চাইল। অনা বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলে। অয়ন্তি নিশ্চই এবার প্রশ্নে প্রশ্নে ওর মগজ খেয়ে ফেলবে।এই মেয়েটা এত প্রশ্ন কেন করে?বোকা একটা। অয়ন্তি প্রশ্ন না করে ঘরের জিনিসগুলো দেখতে থাকে। অনা নিজের কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়তেই অয়ন্তি গুনগুনিয়ে গান গাইতে শুরু করল। মন ভালো থাকলে অয়ন্তি গুনগুন করে। এটা ওর অনেক পুরোনো অভ্যাস। আরশান অনাকে খুজতে ওর ঘরে আসতেই অয়ন্তির গান ওর কানে ভেসে আসলো।আরশান থমকে দাঁড়ালো। অয়ন্তি বিছানার চাঁদর ঝারছে। মাঝে মাঝে খাটের ওপর থাকা থ্রিপিচের ওরনা শাড়ির মত পেঁচিয়ে আয়নার সামনে হেলেদুলে নাচছে। ঘোমটা দিচ্ছে, মুখ ঢাকছে, লাজুক হাসছে। আরশান ভ্রু কুঁচকে তাকালো। পাগল হয়ে গেল নাকি মেয়েটা? আরশান গলা খাঁকড়ি দিয়ে ঘরে প্রবেশ করল।
-এহেম!!

অয়ন্তি ত্বরিত গতিতে পেছনে ফেরে। আরশান গম্ভির কন্ঠে শুধাল,
-অনা কোথায়?
-গোসল করছে।
আরশান মেঝেতে চোখ বুলিয়ে অয়ন্তির দিকে তাকাতেই অয়ন্তি চোখ-মুখ খিচে ফেলল।
-আমি আসলে, আমি গুছিয়ে দিচ্ছি। হাত থেকে পড়ে গেছে সব। আমি ইচ্ছে করে করিনি। সত্যি!
-নিজের গায়ের ওরনা আগে খুলে তারপর গোছাও।

অয়ন্তি আরশানের কথাটা ঠিকঠাক শুনলো না। ব্যস্ততা নিয়ে এগোতেই ধপাস করে পড়ে গেল মেঝেতে। আরশান বুকের ওপর দু’হাত গুজে অয়ন্তির দিকে পলকহীন তাকিয়ে রইল। অয়ন্তি ব্যাথা পেয়েছে কিনা বোঝা গেল না। চেহারার ভীত চাহুনির অর্থ আরশানকে ভয় পাওয়া। মেয়েটা পড়ে ব্যাথা পেল অথচ ব্যাথার কথা না ভেবে অযথা আরশানকে ভয় পাচ্ছে ব্যাপারটা আরশানকে প্রচন্ড বিরক্ত করল। আরশান এগিয়ে এসে ওকে জিজ্ঞেস করতে চাইল, ও ব্যাথা পেয়েছে কিনা। তার আগেই অয়ন্তি ভ্যাভ্যা করে কেঁদে উঠলো।আরশান ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকাল। কোমল কন্ঠে বলল,
-ব্যাথা পেয়েছ? দেখি ওঠো!

অয়ন্তির দিকে এগিয়ে আসলো আরশান। তা দেখে অয়ন্তি আরও জোরে কেঁদে উঠল। কি অদ্ভুত! আরশান দূরে সরে দাড়ায়। অনা অয়ন্তির কান্না শুনে দ্রুত গোসল সেরে বের হতেই দেখল অয়ন্তি মেঝেতে বসে কাঁদছে আর আরশান ওর সামনেই দাড়িয়ে আছে। অনার কপালে ভাঁজ পড়ল।আরশানের দিকে তাকাতেই ওদের চোখাচোখি হলো। আরশান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-খাবার রেডি! নিচে আয়।
-আসছি।

খাবার টেবিলে আরশানকে দেখা গেল না। সায়নকে নিয়ে বেরিয়েছে সে। অয়ন্তির ভেজা চোখ দেখে মাহিন কৌতুহলী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে,
-কি হয়েছে আমার ছোট বউটার?
-পড়ে গেছি ওরনায় বেঁধে।
-ওহ। তা কিসের ওপর পড়েছ? নরম কিছু নাকি শক্ত!
অনা চোখ রাঙালো। মাহিন থেমে যেতেই অয়ন্তি নাক কুচকে বলে,
-মেঝেতে। কি শক্ত, হাটু ফুলে গেছে।অনাপি বরফ দিল তাও ফোলা কমেনি।
-আরশানের ঘরে বাম আছে। লাগিয়ে নিও, ফোলা আর ব্যাথা দুটোই কমে যাবে।

সন্ধ্যায় আরশান সিগারেট নিয়ে ছাদে উঠল। রোজকার অভ্যেস হয়েছে এটা। দিনে একটা আর রাতে একটা টান না দিলে মস্তিষ্ক কাজ করেনা। চারপাশ অন্ধকারে নিমজ্জিত। যৎকিঞ্চিৎ আবছা আলো আছে তবে তা না থাকার সমান। লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরাতেই একটা রিনরিনে কন্ঠস্বর ভেসে আসল আরশানের কানে,
-বাচ্চাদের সামনে সিগারেট খেতে হয়না।

আরশান সবে ঠোঁটের ভাজে সিগারেট রেখেছিল।কন্ঠটা শুনে সে ডানে বামে চোখ বুলালো। কাউকে দেখতে না পেয়ে সে পেছনেও ঘুরল। আজব! ছাদে তো কেউ নেই। ঠিক তখনই টাঙ্কির ওপর থেকে ধপ করে কিছু একটা পড়লো ওর সামনে। আচমকা এমন ঘটায় ভয়ে দুকদম পিছিয়ে গেল আরশান। আরশানকে ভয় পেতে দেখে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে অয়ন্তি। জামার ময়লা ঝেরে সে গম্ভির গলায় বলল,
-আমার দিকে ওভাবে তাকান কেন?
আরশান হকচকালো।
-কিভাবে?
-চোরদের মত।
-চোরদের মত? তুমি চোরদের দৃষ্টি জানো নাকি?
-অয়ন্তি সব জানে।
-কি জানে?
-সব জানে, সব।
-ওকে! তো বলো আজকে আকাশে কয়টা তারা দেখা যাচ্ছে।
-যে কয়টা উঠেছে সে কয়টা। যেমন প্রশ্ন তেমন উত্তর।
-বাহ!
-ধন্যবাদ। এবার বলুন, ওভাবে কেন তাকান? ওভাবে কারা তাকায় জানেন? বখাটে, ইভটিজার’রা।
-তাই?
আরশান অয়ন্তির দিকে এগিয়ে আসতেই অয়ন্তির ভরা কনফিডেন্স মিইয়ে গেল। পিঁছিয়ে গিয়ে সে থতমত খেয়ে বলে,
-একি এভাবে এগোচ্ছেন কেন?
-তুমি পিছিয়ে যাচ্ছো বলে।
-তো আপনি এগিয়ে আসলে আমি তো পিছিয়ে যাবোই। তাইনা?
-কেন?
-কারন…
-কারন?
-কারন বলতে পারবো না।
-বাচ্চা মেয়ে বাচ্চার মত থাকবা। এসব নাটক আমার সামনে করবা না। যাও, অনার কাছে গিয়ে চাঁদের বুড়ির গল্প শোনো।
-অভদ্র।
-কি বললে? (ধমকের সুরে।)
-অনাপি! অনাপির কাছে যাচ্ছি। (তোতলাতে তোতলাতে বলে।)
-গুড।
যেতে যেতে অয়ন্তি পেছনে ফিরে কাঁপা কন্ঠে শুধাল,
-আপনি কি বিদেশি? বিদেশিদের মত চোখ। আপনার গায়ের রঙও অনেক সাদা।কোন দেশে থাকতেন আগে? আপনার চোখের রঙ কি সত্যিই নীল?নাকি লেন্স দিয়ে,
-এই তুমি যাবে? ( বিরক্ত হয়ে চেঁচাল আরশান।)

অয়ন্তি দাঁড়ালো না আর। একছুটে নিচে চলে গেল। তা দেখে। মৃদু হাসে আরশান। যাক, অয়ন্তি তাঁর চেহারার ওপর অন্ততো নজর দিয়েছে, মনের খোজ না’ইবা নিল।



-এই বেয়াদব! এসব কি?

অয়ন্তির কন্ঠে আরশানের চেতনা ফিরলো। স্মৃতিচারণ থেকে বাস্তবে ফিরে সে নিজের চেহারা যথাসম্ভব গম্ভির করার চেষ্টা করল । এরপর অয়ন্তির দিকে তাকিয়ে বলল,

-বেয়াদব? আর আমি? গাড়ির ভেতর আসতে বলেছি দেখে কোলের ওপর এসে পড়লে তুমি। আর বেয়াদব হলাম আমি?

অয়ন্তি ভড়কে গেল। তবুও কন্ঠের তেজ কমলো না। সে কোলের ওপর এসে পড়েছে মানে? আরশানই তো ওকে টান দিল। ওভাবে কেউ হ্যাচকা টান দিলে ব্যালেন্স সামলে রাখা যায়? অয়ন্তি নিজের শরীরে লেপ্টে থাকা শার্টটা আরশানের গায়ে ছুড়ে দিয়ে বলে,

-এসব কি? কি করেছেন আমার সাথে?

আরশানের ভাবলেশহীন উত্তর,
-যাস্ট ঘাড়ে চুমু খেতে চেয়েছিলাম।তুমি তোমার লোহার মত হাত দিয়ে এমন চর মা’রলে যে চুঁমুর নেশা কর্পূরের মত উবে গেল। রোম্যান্টিক মোমেন্টে এমন টর্চার কিন্তু ভালো না মাই লাভ! তুমি এমন করলে আমিও এমন করতে বাধ্য হবো।

অয়ন্তি ভ্রু কুঁচকে তাকাল। লোকটা ওকে মা’রবে? কিন্তু ওসব ভাবার সময় নেই অয়ন্তির। লোকটাকে থা’প্প’ড় মে’রেছে এটা শুনে ওর নাচতে ইচ্ছে করছে। আহা! কি সীন! দ্যা গ্রেট রেডিও জকি আরশান খাঁনের গালে জেসমিন মীর্জা অয়ন্তির হাতের পাঁচ আঙ্গুলের ছাঁপ। জার্নালিস্ট হওয়ার পর অয়ন্তি নিশ্চই এমন একটা নিউজ ছবিসহ ছাঁপাবে। অয়ন্তি ভাবনাতে এত হারিয়ে গেল যে আনমনেই হেসে উঠলো। আরশান শার্ট পড়তে পড়তে বলে,

-এভাবে হাসবে না মাই লাভ! তোমাকে এভাবে হাসতে দেখলে আমার বাসর বাসর ফিলিং আসে।

অয়ন্তি মুখ ভেঙচি দিয়ে বলে,
-স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেবে না। তাই আমাকে পাওয়ার এই স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দিন।

-আফসোস!তুমিময় কোনো কিছুই ছাড়তে পারবো না। পারলে আগেই ছেড়ে দিতাম। এবার জলদি গুড নাইট কিস দাও, ঝড় থেমে গেছে। কিস দিয়ে দ্রুত বাড়ি যাও।

-হোয়াট?

-ইংলিশ বোঝোনি? ওকে বাংলায় বলছি। ওকে বালিকা স্যরি ওহে যুবতি আমাকে তুমি শুভরাত্রির মিষ্টিমধুর এক চুঁম্বন দিয়া দ্রুত পলায়ন করো। নাহলে তোমার পিতা আমাদের এই রাতে এভাবে ধরিতে পারিলে, ধরে বেঁধে বিবাহ করিয়া দিবেন। এর থেকে ভালো বাংলা আসে না আমার। সো ডু দ্যাট ফাস্ট, কিস মি!

-নেভার। আমি কিস করবো? তাও আপনাকে?অসম্ভব।

আরশান আগেই গাড়ি লক করে চাবি পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছিল। অয়ন্তি চারপাশে চোখ বুলিয়ে যখন চাবি খুজে পেল না তখন আরশানের দিকে করুনচোখে তাকাল। আরশান ঠোঁট চেপে হাসছে। অয়ন্তি আসফাস করে উঠে বলল,

-আমি আমার হাসবেন্ড ছাড়া অন্য কাউকে চুঁমু দেবো না।

আরশান ফ্রন্টসিটে এসে বসলো। এরপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে মিররে তাকিয়ে চুলগুলো ঠিক করলো। গাড়ি চলা আরম্ভ করতেই অয়ন্তি হতচকিত দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে। দ্রুততার সঙ্গে বলে,

-একি কোথায় যাচ্ছেন? গাড়ি থামান। থামান বলছি। আমি বাড়ি যাবো তো।

-না।

-না মানে? এই রাতে আমাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন? থামান গাড়ি। আমি কিন্তু চিৎকার করবো।

-করো। এমনিতেও এত রাতে তোমার চিৎকার শোনার অপেক্ষায় কেউ বসে নেই। তবে চাইলে গভীর রাতে আমাকে শোনাতে পারো। আমি শুনবো, শুধু চিৎকার না, গালি, হাসি, কান্না,ন্যাকামি গলা সব শুনবো। কিন্তু তোমার এতসব কিছু শুধু আমি এবং আমিই শুনবো। বুঝেছ?

-না। আপনাকে কেন শোনাবো? আপনি কে?

-কেউ না। কিন্তু দ্রুতই কেউ হবো।

-মানে?

-যাস্ট একটা কিস বলেছিলাম। দিলে না, বললে বিয়ের পর জামাইকে দেবে। বাট আমি যা চাই তা না পাওয়া পর্যন্ত আমার শান্তি হয়না। যখন বলেছি কিস নেবো তখন নেবোই। তার জন্য যদি এখন বিয়ে করতে হয়, করবো। তোমার পরিবার যদি কিছু জিজ্ঞেস করে দ্যান বলবো তুমি আমাকে নিয়ে পালাতে চেয়েছে কারন তুমি আমাকে দেখার পর থেকে স্থির থাকতে পারছো না। বিয়ের জন্য, বাসরের জন্য পাগল হয়ে গেছ তাই মাঝ রাতে আমাকে ডেকে কাজি অফিসে যাচ্ছো। আর এটা সবাই চোখবুজে বিশ্বাসও করবে। কারন তুমি আমার সঙ্গে সত্যিই যাচ্ছো। কোনো মতলব না থাকলে তুমি বাড়ির বাইরে, আমার গাড়িতে এত রাতে কেন আসবে জান?

অয়ন্তির চেহারা রাগে জ্বলে উঠলো। সাংঘাতিক মানুষ তো। এমন মানুষ অয়ন্তি জীবনেও দেখেনি। বানিয়ে বানিয়ে কি সব বলছে? এই ব্যাটাই তো ওকে ভয় দেখিয়ে নিয়ে আসলো। অয়ন্তি রেগে আরশানের বা’হাতে কামড় বসিয়ে দিল। মুহূর্তেই গাড়ি থেমে যায়। অয়ন্তির কাজে হতভম্ব আরশান। বিস্ময়ে যেন পাথর হয়ে গেছে সে। অয়ন্তি গাড়ির লক খুলেই দৌড় দিল। তা দেখে আরশানের মেজাজ তুঙ্গে। এটা কোন এরিয়া তা কি সে জানে? এমন বোকার মত কাজ করার চিন্তা ওর মাথায় আসলো কি করে? আরশান রেগে থম মেরে বসে রইল। কারন সে জানে কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর কুসুম নিজ থেকেই ফিরে আসবে।

গাড়ি থেকে বের হয়েই দিক বিবেচনা না করে ছুটতে থাকল অয়ন্তি। এই লোককে সে কিছুতেই বিয়ে করবে না। কিন্তু কিছুদূর এগোতেই কয়েক হালি কুকুরের সামনে পড়তে হলো। ভয়ে কলিজা শুকিয়ে আসলো। অয়ন্তির ভয় লাগে প্রাণী। বিড়াল দেখলেও সে ভয়ে দৌড় দেয়। আর এগুলো তো বাছুরের সাইজের কুকুর। এত বড় কুকুর কোথ থেকে আসল? এই রাতে বাইরে কি করে এরা? অদ্ভুত, বাড়ি থাকতে পারে না? তারপর আবার ভাবল অয়ন্তি, এদের তো বাড়ি নেই। ভয়ানক এই প্রাণীগুলোর অবশ্যই বাড়ি থাকা উচিত,কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে উঠতেই অয়ন্তির কেঁদে ফেলার জোগাড় হলো। এরা চেঁচায় কেন? কামড় দেবে নাকি? অয়ন্তি পেছন ফিরে জোরে হাটতেই বুঝলো কুকুরগুলোও আসছে।এরা আবার আসে কেন?অয়ন্তি ভয়ে আবারও চোখ বুজে দৌড় লাগালো। গাড়ির কাছে আসতেই আরশান গাড়ির দরজা খুলে দেয়। অয়ন্তি ভেতরে ঢুকে জোরে দরজা লাগিয়ে হাঁপাতে লাগলো, এরপর উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

-আরে গাড়ি চালাচ্ছেন না কেন? কুকুরগুলো কি বাড়ি নিয়ে যাবেন? ব্যাকসিটের দরজা খুলে দেবো? দ্রুত চলুন।

আরশান ভ্রু কুঁচকে তাকালো। অয়ন্তি রেগে তাকাতেই আরশান বলল,
-কামড়ে যে হাতের গোশত খেয়ে ফেললে সেই গোশত আগে ফেরত দাও। নাহলে গাড়ি নড়বে না। বরং আমি তোমাকে গাড়ি থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেবো। কুকুর আর তুমি সারারাত গল্পগুজব করে সকালে ঠিকানা চিনে একা একাই বাড়ি চলে যাবে।

-কি?

-বাংলাও বোঝো না?

অয়ন্তি কেঁদে ফেলল। বাইরে কুকুরের ডাকে ভয়ে ওর বুক কাঁপছে। ভয় পেলে অয়ন্তির মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। হাত পা কাঁপে, বুক ধড়ফড় করে, মাথা ঘুরে ওঠে। বাড়ির কেউ থাকলে অয়ন্তি তাঁর কোলে ঝাপিয়ে পড়ে ভয় মেটাতো। এখনও তো তারও উপায় নেই। ডান পাশে বসা নিষ্ঠুর মানুষ তো ওর ভয়, কষ্ট বুঝতেই পারে না। আরশান নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসে। দারুন জব্দ হয়েছে ওর কুসুম। আরেকটু জব্দ করা উচিত। সকালে মিথ্যা বলার শাস্তিস্বরূপ। বাচ্চা নিয়ে ওসব কিভাবে বলতে পারলো কুসুম? ওসব শুনে আরশানের ভেতরটা যে জ্বলছিল তার পরিবর্তে একটু ভয় দেখালে ক্ষতি কি? পরে না’হয় ভয়টাও ভেঙে দেওয়া যাবে। আরশান রাশভারি কন্ঠে বলল,

-আচ্ছা গোশত ফেরত দিকে হবে না। বিষে বিষে বিষক্ষয় করে দিলেই হয়।

-ম,মানে?

-যেটা নেওয়ার জন্য এতদূর আসলাম সেটা আমাকে দিলেই আমি গাড়ি ঘোরাবো।

অয়ন্তির কান্না থেমে গেল। স্তব্ধচোখে ক্ষণিক তাকিয়ে লাজুক ভঙ্গিতে হাসলো। পরক্ষণেই নিজের কাজে নিজে হতবাক হয়ে গেল অয়ন্তি। হাসলো কেন ও? হাসি পেল কেন এমন মুহূর্তে? আরশান কি ওর প্রেমিক? নাকি স্বামী যে এমন কথায় লজ্জা আসবে। লজ্জা পাবে না অয়ন্তি, কিছুতেই না। কিন্তু লজ্জা তো লাগছে, আর তা বেশ আয়োজনের সহিত ঘিরে ধরছে অয়ন্তিকে। মাথা নত করে বসে রইল অয়ন্তি। অচেনা এক অনুভূতি অয়ন্তির সর্বাঙ্গ কাঁপিয়ে তুললো। দুহাতের নখ ঘসে অয়ন্তি সামনে তাকায়। আরশান স্টিয়ারিং’য়ে আঙ্গুল রেখে গুনগুন করছে। রেডিও চালালে মন্দ হয়না। রোজ এখনও আছে? কয়টা বাজে? দেড়টা? আরশান রেডিও চালাতেই একটা গান বেজে উঠল, অন্য ফ্রিকোয়েন্সিতে তার মানে আড়াইটা বাজে, রোজের শো শেষ। আরশান মৃদু ভলিয়মে গানটা চালিয়ে রাখলো,

সার্দিকি রাতো’মে হাম শো’য়ে রাহে
এক চাঁদার মে
হাম দোনো, তানহা হো না কোই ভি রাহে
ইশ ঘার মে।
জারা জারা বেহেকতা হ্যায় মেহেকতা হ্যায়!!!

আরশান দুষ্টু হেসে বলে,
-রোম্যান্টিক ওয়েদার, রোম্যান্টিক সং, রোম্যান্টিক ফিল, আহা! সবকিছু বুঝি রোম্যান্টিক কিছু ঘটারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। তোমার কি মনে হয় কুসুম? রোম্যান্টিক কিছু হলে ভালো হবে না?

অয়ন্তির লজ্জা বেড়ে গেল। লোকটাকে আস্ত চিবিয়ে খাওয়ার চিন্তা মগজ থেকে বেরিয়ে গেল ঠিক কিন্তু রাগ বের হচ্ছে না। মাঝরাতে তুলে এনে এভাবে হেনস্থা করা কি ভদ্রলোকের কাজ?অয়ন্তিতে লজ্জায় নুইয়ে পড়তে দেখে আরশান অয়ন্তির দিকে ঝুঁকে বলে,

-একি তুমি লজ্জা পাচ্ছো নাকি? সকালে টেক্সট করে বলেছিলাম না? বাসর রাতে হিসেব চুকানোর মত ভদ্র জামাই আমি। এখন বেশি কিছু করবো না, তোমার এই লজ্জা দেখে কিছু করার মুডটাই নষ্ট হয়ে গেল। বুঝলে! আমার আবার লাজুক মেয়ে পছন্দ না। এরা রোম্যান্সে বাঁধার সৃষ্টি করে। যাও আজকের মত মাফ। তবে কিস তো তোমাকে দিতেই হবে। তুমি স্বেচ্ছায় দেবে নাকি?

-না। এসব হবেনা এখন। আমাকে ভালোবাসলে আমার মতামত নেওয়ার প্রয়োজন বোধ নিশ্চই করেন।

-সেজন্যই তো জিজ্ঞেস করছি।নাহলে চেপে ধরে কবেই চুঁমুটুমু খেয়ে ফেলতাম। তুমি তালপাতার সেপাই আমাকে আটকাতে পারতে না।

-আপনার সঙ্গে আমার মাত্র একদিনের পরিচয়।আপনি আমাকে হয়তো আগে থেকে চেনেন কিন্তু আমি তো চিনি না। পরিচয় হতেও তো সময় লাগে বলুন।

আরশান জবাব দিল না। পুরোনো ক্ষতে যেন নতুন করে ঘা লাগলো। গাড়ি স্টার্ট দিল আরশান। বুকের ভেতরে অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেল মুহূর্তেই। এত পরিচিত, এত কাছের কুসুম ওকে চিনতে পারছে না। ব্যাপারটা মাথায় আসতেই চোখ ভিজে আসে। কিছু সময় বাদে আরশান রুদ্ধ কন্ঠে বলে,

-হুম। সময় নাও, আমি বোধ হয় তাড়াহুড়ো করছি অনেক। কিন্তু সময় দিচ্ছি, এর মানে এই না যে তুমি তোমার নতুন প্রেমিকের কাছে যাওয়ার পরিকল্পনা করবে। তুমি শুধু আমার কুসুম। তুমি যদি কারোর হও সেটা শুধু আমার হবে। কথাটা মনে রেখো।

অয়ন্তি সন্দিগ্ধ চোখে তাকায়। আরশানের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে? কন্ঠ, শব্দ কেমন কাঁপাকাঁপা কেন? কাঁদছে নাকি? কিন্তু কাঁদছে কেন? অদ্ভুত মানুষ তো। অয়ন্তি ভাবলো একবার জিজ্ঞেস করবে কিন্তু তার আগেই আরশান ভেজা কন্ঠে বলে,

-নামো। বাড়ি চলে এসেছি। বেশি রাত জাগবে না। বেশি চিন্তাও করবে না। বেশি চিন্তা করলে তোমার মাথাব্যথা বাড়বে। গিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। ওকে?

অয়ন্তি মাথা নাড়লো। বাড়ির ভেতর ঢুকতে ঢুকতে অয়ন্তি আরশানের গাড়ির দিকে তাকায়। নীলচোখটা ভেজা। শুভ্র চেহারার মলিনতা অয়ন্তির ভালো লাগলো না। মানুষটা বেয়াদবই ভালো, এমন নরমশরম স্বভাবে তাকে একদমই মানায় না। অয়ন্তি বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেট লাগিয়ে নিজের ঘরে এসে খাটের ওপর বসতেই টের পেল ওর গায়ে ওরনা নেই, বরং আরশানের শার্ট আছে। তখন না শার্টটা ছুড়ে মা’রল? তাহলে এটা কোথ থেকে আসলো। পরক্ষণেই মনে পড়ে, টি-শার্ট দিয়েছিল শার্ট তো গায়েই ছিল, যেটা সে ওরনা ভেবে আগলে রেখেছিল। তখনই ফোনে একটা ম্যাসেজ আসল,

“ওরনা রেখে দিলাম। আমার শার্টের বদলে।তাই এখন ওসব নিয়ে চিন্তা না করে জামা-কাপড় বদলে ঘুমাও। জামা তো ভিজে গিয়েছিল।পাল্টে নিও, ”

আরেকটা ম্যাসেজ,
“ভালোবাসি কুসুম।”

অয়ন্তি বেখেয়ালে হাসে। কৌতুহলবশত শার্টটা নাকের কাছে টেনে ঘ্রাণ নেয়। বন্ধুদের প্রেমিককে গল্প বহুত শুনেছে সে। প্রেমিক না হলেও, জীবনে প্রথম কোনো প্রেমিকজাতের পুরষের শার্ট পেয়েছে সে। এটুকু সাধ পূরণ করা যেতেই পারে। ঘ্রাণ নিয়ে অয়ন্তি ভাব নিয়ে বলে,
-মন্দ না, ঘ্রাণটা বেশ। তবে মানুষটা, একদমই ভালো না।
বলেই উচ্চস্বরে হাসলো অয়ন্তি। ভাগ্গিস আরশান এটা শোনেনি। তাহলে এই হাসির অন্য মানে বের করে ফেলতো অদ্ভুত মানুষটা!

চলবে?

তুই হবি শুধু আমার পর্ব-০৪

0

#তুই হবি শুধু আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_চার

দরজার সামনে গিয়ে আরশান দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। অয়ন্তি এদিক সেদিক উঁকি দিয়ে আরশানের দিকে তাকায়।দেওয়ালে হেলান দিলেও দরজার অর্ধেক আরশানের শরীরে বন্ধ হয়ে আছে। বাকি অর্ধেকে উঁচু ল্যাগেজ ভর্তি। ঠেলেঠুলেও তা সরানোর উপায় নেই। ভেতর থেকে তপ্ত বাতাস আসছিল বলে, অয়ন্তি এখানে শীতল বাতাসের মাঝে দাড়িয়ে ছিল কিন্তু জার্নি করায় শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। গোসলের প্রয়োজন! সবাই ওকে ফেলে ঢুকে গেল কি করে? আরশানের নির্নিমেষ দৃষ্টি অয়ন্তিকে বরাবরের মত ভীত করে তুলল। ধমক দেওয়া লোকটা ওর দিকে এভাবে তাকায় কেন? তখন মা’রামা’রিই বা করছিল কেন? ভেতরের কথাগুলো স্পষ্ট শোনেনি অয়ন্তি। শোনার প্রয়োজনও নেই, ভেতরে ঢুকতে হবে। এটাই ওর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। আরশানের দিকে চেয়ে অয়ন্তি অস্ফুটকন্ঠে বলল,
-ভাইয়া একটু সরুন। আমি ভেতরে যাবো।

ভাইয়া ডাক শুনেই আরশানের চেহারার হাসি বিলিন হয়ে গেল। কালো মেঘের আনাগোনা দেখা দিল তাঁর শুভ্র মুখশ্রীতে। মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠলো। আরশান ভ্রু কুঁচকে সরে দাড়াতেই ভেতরে থাকা চারজন শব্দ করে হেসে ওঠে। তাদের হাসির কারন জানেনা অয়ন্তি। তাই চুপচাপ পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। অনা অয়ন্তিকে যে কোনো ঘরে যাওয়ার কথা বলে পাঠিয়ে দেয়। অয়ন্তিও পুরো বাড়িতে চোখ বুলিয়ে দো’তলার একটা ঘরে চলে গেল। মাহিন সকৌতুকে বলল,

-ওহে ভায়া! চিলিক মা’রে, অন্তরে?

আরশানের ঠোঁটের হাসি চওড়া হলো, বন্ধুদের সামনে হেরে যাওয়ার পাত্র নয় সে। নিজের ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে সে ভাব নিয়ে বলল,

-চিলিক মা’রবে কেন? ভাইয়া, ভাই যাই বলুক না কেন! তা থেকে সাইয়্যা, জামাই আমি বানিয়ে নিতে জানি। বয়স নিয়ে টেনশনে ছিলাম, এখন যখন গ্রিন সিগন্যাল পেয়েছি তখন আর থামাথামি কিসের?

অনা ভ্রু কুঁচকে তাকাল,
-থামাথামি কিসের মানে? তোর মত ই’তর’রে বিশ্বাস করবো আমি! তাই মনে হয়? খবরদার! ওর সঙ্গে কিছু করার কথা মাথাতেও আনবি না।নাহলে তোর বাপের রেডিও সেন্টার আর তোর ব্যাবসার নামে এমন রটনা ছড়াবো যে কাইন্দা কূল পাবা না চাঁন্দু!

সায়ন হেসে বলে,
-তা আর বলতে! জার্নালিস্ট ম্যাডাম কিন্তু মারাত্মক মহিলা হয়ে উঠেছেন আরশান। সাবধানে থাকিস, তাঁর ব্যাগে অলটাইম ক্যামেরা থাকে। সেটা কখন, কোথায় ফিট কইরা দেয়! আমরা তো বিবাহিত, বউ সব দেখে, জেনে নিয়েছে। তাই প্রবলেম নেই। কিন্তু তুই! তোরটা ভাইরাল হইলে তো লাভের ওপর লাভ।

সায়নের কথায় কেউ হাসলো না। সায়ন সিরিয়াস মুখ করে সবার দিকে একনজর তাকিয়ে বলে,
-হাসির কথা কইলেও তোগো হাসি আহে না। যা আমি একাই হাসমু! আরশান মাহিন যখন ই’ত’রামির লিস্টে আসে তখন কিছু হয় না, আর সায়ন কিছু বললেই সে লুচ্চা! যা, থাকুমই না তোগো লগে। সৌফি আসো বেবি আমরা ঘরে যাই, ঠান্ডা পানিতে গাত্র চুবানোর প্রয়োজন।

সায়ন চলে যেতে লাগলে সবাই হেসে দিল।মাহিনও চলে গেল উপরের একটা ঘরে। আরশান সোফায় বসে এখনও কাঁপছে। অনা পাশে বসে আরশানের কাঁধে হাত রাখে।

-জানিস সেদিন তোর কথা শোনার পর তোর ওপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছিল।বারবার ভাবছিলাম আট বছরের এক বাচ্চার প্রেমে পড়েছিস? আর সেই বাচ্চাটা কে? আমার অয়ন। রাগে মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছিল আমার। ভেবেছিলাম তোর সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখবো না। আমাদের ব্যাচের সবাই মাস্টার্সের পর চাকরি-বাকরি করে, এক একজন যখন বিয়ে করে নিচ্ছিল তখন সায়ন তোর কথা বলল। চার চার’টা বছর কে’টে গেল আরশান, তুই দেশে ফিরিস’নি। আঙ্কেলের সঙ্গে কথা বলে জানলাম তুই নাকি বলেছিস দেশে ফিরবি না।বিয়ের কথা দশবছরের আগে মাথাতেও আনবি না। তখন বুঝলাম তোর এহানো পরিবর্তনের কারন। কিন্তু তুই নিজে একটু হিসেব কর, অয়ন তোর থেকে তেরো বছর দু’মাসের ছোট। পাঁচ-ছয় বছর হয় তাহলে সেটা মানিয়ে নেওয়া যায়, কিন্তু এতটা গ্যাপ? অয়নের মন মস্তিষ্ক এখনও পরিপক্ক হয়নি। সবে ষোলো’তে পা দিয়েছে ও। জীবনের নতুন অধ্যায় সম্পর্কে জানতে শুরু করেছে। আর সেখানে তোর বয়স আটাশ! অয়ন যে একদম বাচ্চা তা নয়, বুঝতে শিখছে, হয়তো বোঝে। কিন্তু ভবিষ্যৎ? তুই ওর জন্য যেভাবে ডেসপারেট হচ্ছিস ও তো তেমন নাও হতে পারে।তোকে ভালোবাসা, তোর ভালোবাসা পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার আরশান। তোকে আমি কলেজের প্রথমদিন থেকে চিনি। আমি জানি অয়ন তোর কাছে কতটা ভালো থাকবে। কিন্তু অয়নের কথাটাও ভাব। ও তোকে মানবে না। দেশে চল, তোর বাবা-মা অপেক্ষা করছে তোর জন্য। প্রয়োজন হলে তোর জন্য আমি মেয়ে খুজবো। দরকার পড়লে মাহিনরে ছেড়ে আমি তোরে বিয়ে করে ফেলবো।

মাহিন সিড়ি দিয়ে নামছিল, অনার কথা শুনে সে চকিত দৃষ্টিতে নিচে তাকাল। এরপর ব্যস্তভঙ্গিতে বলল,
-এসব প্লানিং চলছে নাকি? বউ কিন্তু বাসি হইয়্যা গেছে আরশান। ভাইবা কাজ করিস। দেখা গেল রেডিমেড বাচ্চা পাচ্ছিস! নিজের বংশের বাত্তি নিভাইয়া আমার বাত্তি লইয়া টানাটানি ভালা না, বুঝলা মামা।

অনা চোখ রাঙালো। মাহিন তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে অনার পাশে শুয়ে অনার কোলে মাথা রাখলো। অনা মাহিনের চুল টেনে দিতে দিতে বলে,

-অয়নকে ভুলে যা আরশান। মুভ অন কর লাইফে। এভাবে আর কতদিন চলবে? আট বছর আগে তোর প্রেমের বয়স পার হচ্ছিল, এখন কি বিয়ের বয়স থেমে আছে? তোর ফ্যামিলি, তুই, তোদের রেপুটেশন এতো ভালো। যেকোনো মেয়ের বাবা তোকে তার মেয়ে দিতে প্রস্তুত। বাস্তবতায় চোখ না বুলিয়ে তুই মরিচিকার পেছনে কেন ছুটছিস? অয়নকে এখানে এনেছি শুধুমাত্র তোকে দেখাবো বলে। অয়ন নিজের জীবনে খুশি, তোকে সে মনেও রাখেনি। তাহলে তুই কেন ওকে ভালোবেসে কষ্ট পাবি? আমি তোকেও সমান ভালোবাসি আরশান তাই বলছি নিজের জীবন নষ্ট করিস না। আঙ্কেল বলছিলেন অরুনির সঙ্গে তোকে ভালো মানাবে।

আরশান মাথা নিচু করে সবটা শুনছিল। এবার মাথা তুলে তাকাল সে। এরপর কঠিন গলায় বলল,
-তোর চাচাতো বোন অরুনি? তোরা কি আমাকে সস্তা প্রডাক্ট পেয়েছিস অনা? যার তার ঘাড়ে গছিয়ে দিতে চাচ্ছিস। আরশান খাঁন এতটাও সস্তা না।কুসুম আমাকে ভালোবাসবে কি বাসবে না, তা জানি না। কিন্তু আরশান কুসুমকে ছাড়া আর কাউকে চায় না। কুসুম আমার না হোক, অন্যকারো হবে। আমি শুধু চাইবো ও যার’ই হোক, যার কাছেই থাকুক, ভালো থাকুক। সুখে থাকুক। কিন্তু আমি ওকে ছাড়া অন্য কোনো নারীকে বিয়ে করবো না। ভালোবাসতে পারবো না। ও ছাড়া আমি কাউকে চিন্তাতেও রাখতে পারি না অনা। ট্রাস্ট মি! আমার জন্য তোদের কারোর কোনো সমস্যা হবে না। তুই বাবাকে নিয়ে ভাবছিস তাই না? বাবা সত্যটা জানলে তোদের ভুল বুঝবে, কষ্ট পাবে সেটা নিয়ে ভাবছিস? আমি কাউকে বলবো না সত্যটা। শুধু তোরা চারজনই জানবি।তবুও আমার ওপর প্রেসার ক্রিয়েট করিস না। আমি কোনো বিয়ে-টিয়ে করতে পারবো না। আর রইল বাকি বংশরক্ষা। আরসালান ভাই তো বিয়ে করেছেন। দুটো ছেলেও আছে। ভাবি আবারও সন্তানসম্ভবা, মেয়ে হবে এবার। ব্যাস হয়ে গেল প্রবলেম সল্ভড।

-তার মানে তুই অয়নকে ছাড়বি না?

-না।

মাহিন হাই তুলে বলল,
-বাচ্চা বড় হতে দে। তারপর দেখ ওর মতামত কি হয়। দেন বিয়ের চিন্তা করিস। বাট আমার একটা ডাউব্ট থেকে যাচ্ছে। অয়ন বড় হতে হতে তুই বুড়ো হয়ে যাবি তখন তোর টাওয়ারে কারেন্ট থাকবে তো?

আরশান হতভম্ব চোখে চাইল। অনা মাহিনের চুলগুলো মুঠো করে জোরে টান দিতেই মাহিন ‘আহ’ করে উঠল। শব্দটা শুনে সায়ন সৌফি বেরিয়ে আসে। সায়ন কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,
-দিনে দুপুরে কিসব সাউন্ড করছিস ভাই! বাড়িতে যে দুইখান সিঙ্গেল পোলাপান থুরি একটা কচি মাইয়া আর একটা বুড়ো ভাম আছে সেদিকে নজর দিবি না?আমরা তো ঠান্ডা থাকুম ওরা কি করবে?

অনা পাশ থেকে কুশন তুলে ছুড়ে মারল সায়নের মুখে। এরপর কয়েকটা আঞ্চলিক গালি দিয়ে বলল,
-অয়নকে আনাই ভুল হইছে। তোদের মত অশ্লীল, অসভ্য, বেয়াদবগুলো আমার ছোটবোনটার কি হাল করবি তা বোঝা হয়ে গেছে। তাই আমি একটা কথা ক্লিয়ারলি বলতে চাই।

আরশানের দিকে ফিরলো অনা।
-অয়নকে পেতে হলে ওকে এসব অশ্লীলতা থেকে দূরে রাখতে হবে আরশান। আমাকে কথা দিতে হবে বিয়ের আগে অয়নের সঙ্গে কোনো কিছু করবি না। নট এ্যা সিঙ্গেল লাভ টাচ! এমন কি ওকে টেরও পেতে দিবি না তুই ওর ওপর এট্রাক্টেড।ও যদি স্বেচ্ছায় তোকে চায়, বাড়িতে কারোর কোনো আপত্তি থাকবে না। বাবার সঙ্গে কথা বলেই এসেছি আমি। অয়ন যা চাইবে তাই হবে, সেজন্য সবার বিশ্বাস রক্ষা করার দায়িত্ব তোর। আমি শুধু জানতে চেয়েছিলাম তুই ওকে কতটা চাস্। জানা হয়ে গেছে এবার মাহিন্না ও সায়ন্নার কি করবি তা তুই জানিস। মাথায় রাখিস আমার বোন যেন অকালে না পাঁকে। হুহ!

অনা গোসলের উদ্দেশ্যে উঠতেই, আরশান জামার হাতা ভাজ করতে লাগল। মাহিন, সায়ন হাসার চেষ্টা করে বলে,
-তোর জিগারের দোস্ত লাগি আমরা। আমাদের মা’রতে পারবি না তুই। তোর হাত কাঁপবে দোস্ত, তুই মনে মনে কষ্ট পাবি। আমরা জানি।

আরশান ভ্রু কুঁচকে বলে,
-রিয়েলি? তো আমারও জানা উচিত। আমি মনে মনে কতটা কষ্ট পাই! তোরা সবগুলো মজা নিছিস আমার প্যারা দেখে। এবার আমার পালা।

অয়ন্তি জানালার পাশে দাড়িয়ে আরশানদের হাতাহাতি দেখছে। অয়ন্তির আরশানকে মনে নেই। মনে থাকার কথাও না। যখন আরশান ওদের বাড়িতে গিয়েছিল তখন অয়ন্তির বয়স সার্টিফিকেট অনুযায়ী ছয় বছর এগারো মাস চলছিল। হাতে গোনা কয়েকটা দিন পরেই সাত বছরে পড়বে এবং বাস্তবিক বয়স আটে পড়বে। আর আরশান সবে একুশে পা দিয়েছিল। সেই হিসেবে স্মৃতিশক্তি প্রখর হলেও অয়ন্তির স্মৃতিতে আরশান নাম স্থায়ীত্ব লাভ করেনি। অনার অনেক বন্ধুই তো বাড়িতে এসেছে।সবার নাম মনে রাখার মত ইচ্ছে অয়ন্তির তখন জাগেনি। আর সবার নাম মুখস্থ করাও অসম্ভব ব্যাপার ছিল। আজও তো আরশানকে চিনতো না সে, যদি না অনা আসার আগে জানাতো। প্রথম আলাপ থেকেই আরশান অয়ন্তির অপছন্দের তালিকায় যুক্ত হলো। ছোটবেলার ধমকের গল্প, এখন মা’রামা’রি! অয়ন্তি তো ভয় পায় এসব। আর যা ভয় পাওয়া হয় তার সঙ্গে সহজ হওয়া কঠিন বিষয়। অয়ন্তি বিছানার ওপর বসে ভাবতে থাকে, এত বন্ধু থাকতে অনা’রা দেশ পাড়ি দিয়ে এই বাজে বন্ধুর কাছে কেন এসেছে? যে মানুষ কথায় কথায় ঝারি দেয়, কেমন মাদকতায় পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অপ্রস্তুত করে দেয় সে আসলেই একটা বাজে লোক। ভালো মানুষ কি এভাবে তাকায়? ব’খা’টেদের মত দৃষ্টি দেয়? একদমই না। কিন্তু তবুও অয়ন্তির চোখ বারংবার আরশানের ওপর গিয়ে আটকাচ্ছে। অনার সব বন্ধুদের থেকে আরশান দেখতে শুনতে ভালো। শুভ্র চেহারা, পেশিবহুল দেহ, উচ্চতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পরিবার, আর তাঁর চোখ। নীল চোখ এই প্রথম দেখেছে অয়ন্তি। পুরো বিদেশিদের মত চোখ আরশানের। আচ্ছা আরশান কি বিদেশি? বাজে মানুষটার প্রতি অয়ন্তির মনোভাব কি বদলাচ্ছে?কিছুসময় পূর্বে ভয়ে ভয়ে যাকে বাজে বলল, তাঁর কথাই এখন ভাবছে সে।কেন ভাবছে? অয়ন্তি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে মন খারাপ করে বসে রইল খাটের কোনায়। আরশান নামক জটিল ধাঁধাটা সমাধান না করা পর্যন্ত, স্বস্তি পাবে না সে। আরশানের দৃষ্টি, ব্যবহার, আর এমন স্বভাবের কারন কি? সেটা জেনেই ছাড়বে অয়ন্তি। জীবনে প্রথম কোনো ছেলের ব্যাপারে জানতে ইচ্ছে করছে, ইচ্ছেটাকে পূরণ করা অতি আবশ্যক। তাছাড়া আরশান তো বাইরের কেউ না, অয়ন্তির অনাপির বেস্টফ্রেন্ড। তাই সমস্যা হলে তা সামলানোর জন্য অনা তো আছেই।

চলবে?

তুই হবি শুধু আমার পর্ব-০২+০৩

0

#তুই হবি শুধু আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_দুই_তিন

‘স্লাং ইউজ করলাম না’ বাক্যটি প্রায় দশবার পড়েছে অয়ন্তি। রাগে সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে। সারাদিন ধরে যা যা বলেছা সেগুলো কি মধুর কথা ছিল? মধু দিয়ে সব ভেজানো ছিল? লিভ ইন টাইপ কথা কি মধুর সাগর ছিল? অয়ন্তির পাশেই ওর বোন অরুনি সবটা পড়ছে আর অয়ন্তির দিকে তাকাচ্ছে। অয়ন্তির হাতে রাবারের তৈরি একটা গোলাপী বল,সেটা অয়ন্তি চেপে চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। অরুনি বোনের ক্রোধ দেখে বিস্মিত হয়ে বলে,
-বাদ দে অয়ন্তি!

অয়ন্তি পাশে অরুনির দিকে ফিরে বলে,
-বাদ দেবো? কতকিছু সহ্য করেছি! শুধু বিয়েটা ভাঙবে বলে। আমাকে বলে আমি অত্যন্ত বাজে প্রকৃতির মেয়ে। সেই মেয়েকে বিয়ে করার জন্য দু পায়ে খাড়া কেন ওই লোক?আবার ম্যাসেজে পিরিতির কথা লিখছে। সামনে পেলে ওনাকে আমি পানি ছাড়া গিলে ফেলবো অরুপি। ট্রাস্ট মি! যাস্ট গিলে ফেলবো।

অরুনি ভ্রু কুঁচকে তাকাল। এটা বাদে আগের আটটা বিয়ে ভেঙেছে অয়ন্তি! তারা সবাই বেশ বড়লোক এবং প্রভাবশালী ছিল। সেখানে আরশান শুধু বিখ্যাত মানুষ। টাকা পয়সা কেমন তা জানা নেই ওদের। তবে মানুষ হিসেবে নাকি সে সেরা একজন। সেই সেরা একজনের নমুনা এমন? অরুনির কোলে ওর বছর তিনেকের মিষ্টি বাচ্চাটা ঘুমাচ্ছে। অরুনি হতাশ কন্ঠে বলে,

-বিয়ে করতে কি সমস্যা অয়ন? সে তো ভালো মানুষ। তোকে ভালোওবাসে।

-ভালোবাসে?ভালোবাসতে কি আমি বলেছি?অয়ন্তিকে ভালোবাসবে এটা তাঁর নিজস্ব অভিলাষ। আমি সেটা নিয়ে কিছু বলবো না। কিন্তু এভাবে? প্রাপ্তকে কিভাবে মে’রেছে তা তুমি জানো না অরুপি। প্রাপ্তর বন্ধু দিশান ফোন করেছিল। ছেলেটা নাকি ছমাসের আগে বিছানা থেকেই উঠতে পারব না। এটা কোনো মানুষের কাজ?

-চাচা,বাবা’র বিরুদ্ধে যাবি?

– এমন একটা মানুষকে আমি বিয়ে করতে পারবো না। যদি তার জন্য বাবার সঙ্গে কথা বলতে হয়, তাঁর বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু বলতে হয় বলবো আমি।

-আরশানকে তুই ওসব কেন বলতে গেলি? বাচ্চা না হওয়ার ব্যাপারটা শুনে হয়তো সে সত্যিই রেগে গিয়ে বলেছে ওসব।

-নুমা বলেছিল, এটা বলামাত্র বিয়ে ভা’ঙবে। ও নিজেও তো ওর প্রথম বিয়েটা এভাবে ভে’ঙেছিল।পরে নিজের প্রেমিককে বিয়ে করে।

-নুমার কথা শুনে তুই এত বড় একটা কাজ করে আসলি? তোর কোনো ধারনা আছে আরশান যদি এটা বাড়িতে বলে? তখন কি করবি?

-তুমি কি আমাকে আরও মানসিক চাপে ফেলতে চাচ্ছো অরুপি? ভালো কিছু বলো, ভালো কথা বলো! আমার রাগ হচ্ছে।

-ওকে। রেডিও অন কর। বারো’টা বাজতে গেল। তোর সেই আর’জের শো শুরু হবে।

অয়ন্তি এবার শান্ত হলো। অয়ন্তি হচ্ছে মীর্জা বাড়ির ছোট মেয়ে। পুরো নাম জেসমিন মীর্জা অয়ন্তি। এবার সে উচ্চমাধ্যমিকের ডিঙ্গি টপকিয়েছে। রেজাল্ট বের হবে কিছুদিন পরেই। ওর ইচ্ছে ও জার্নালিজমে পড়বে। তবে বাড়ি থেকে কেউ রাজি নয়।কিন্তু অয়ন্তি নিজের জেদে অটল থাকায়, অয়ন্তির জেদের সামনে বাড়ির কেউ আর দ্বিমত পোষণ করেনি। অয়ন্তি চায় মুক্ত পাখির মত জীবন। যেখানে সে শুধু উড়তে পারবে। যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে, কোথাও কোনো বাঁধা থাকবে না। কোথাও আটকে থাকার মত পরিস্থিতি তৈরি হবে না। নিজের বোনের প্রতিটা ইচ্ছে সে নিজে পূরণ করবে। অনামিকা যেমন তুখোড় জার্নালিস্ট ছিল অয়ন্তিও ঠিক তেমন হতে চায়।
এমন মুক্ত একটা জীবনে আবারও ঝড় বইয়ে আরশান নামক বিশ্রি তুফানকে আসতে হলো? এভাবে ওর স্বপ্নগুলো লন্ডভন্ড করতে তাঁর আগমন কি সত্যিই কাম্য ছিল? না। একদমই নয়। প্রাপ্ত জার্নালিজমে পড়ছে, ফোর্থ সেমিস্টার কমপ্লিট! কলেজেই ওদের প্রথম আলাপ আর তারপরেই বন্ধুত্ব। মূলত পেশার প্রেমে পড়ার পরই অয়ন্তি প্রাপ্তর সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিল।প্রাপ্ত বলেছিল অয়ন্তিকে সে সাহায্য করবে যেন জার্নালিজমে পড়ে সে নির্বিঘ্নে নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে। প্রাপ্তর সঙ্গে সদ্য প্রেমের ডানা মেলতে গিয়েছিল অয়ন্তি আর সেই প্রাপ্তকে,অয়ন্তির বন্ধুকে এক বে’য়াদব আর’জে মে’রে ফাটিয়ে দিল?

অয়ন্তি পাশ থেকে ডিজিটাল রেডিওটা অন করলো। সঙ্গে সঙ্গে এক সুস্পষ্ট কন্ঠস্বর ভেসে আসলো ওদের কানে।
“আসসালামু আলাইকুম! হ্যালো ডিয়ার লিসেনার! আপনারা শুনছেন ভালোবাসার রংমহল এবং আমি আর’জে রোজ আছি আপনাদের সঙ্গে। কেমন আছেন সবাই? নিশ্চই ভালো। আজকের এই মিষ্টি মধুর আবহাওয়ায় খারাপ থাকার কোনো কারন হয়তো নেই। তবুও যারা দুঃখি, যাদের মনে দুঃখ আছে, রাগ আছে, অভিমান আছে তারা তাদের এই দুঃখ কষ্ট আমার সঙ্গে শেয়ার করার জন্য কল করতে পারেন, *** এই নাম্বারে। আর যাদের মন ভালো আছে, বৃষ্টির আমেজে ফুরফুরে থাকা এবং তাদের ভালোলাগাও শেয়ার করতে পারেন। আজ আমরা কথা বলবো বৃষ্টি ও প্রকৃতি নিয়ে। সবাই বলে, বর্ষণ প্রেমের জন্য উপযুক্ত সময়! রোম্যান্টিক ওয়েদার! তাই বর্ষণপ্রেমিকদের জন্য শুরুতেই একটা মিষ্টি গান!
রিমঝিম এ ধারাতে, চায় মন হারাতে।
রিমঝিম এ ধারাতে, চায় মন হারাতে।
এই ভালোবাসাতে আমাকে ভাসাতে।
এলো মেঘ যে ঘিরে এলো
বৃষ্টি সুরে সুরে সোনায় রাগিনী।
মনে স্বপ্ন এলোমেলো
এই কি শুরু হলো প্রেমের কাহিনী।

গানের মতই আজ আমরা শুনত চলেছি কিছু প্রেমিক, না বর্ষণপ্রেমিকদের প্রেমের কাহিনি। আর আজ আমার সঙ্গে অতিথি হিসেবে আছেন আমাদেরই পরিচিত এক প্রতিভাবান কম্পোজার ও সিঙ্গার রোয়েন তালুকদার। ভাইয়া তো থাকবেনই, আমাদের আড্ডাও চলবে। তার আগে আমি শ্রোতাদের কিছু কল এ্যাটেন্ড করে নিচ্ছি। আমাদের আজকের ফার্স্ট কলার, (ফোন রিসিভ হতেই) হ্যাঁ, বলুন!
– হ্যালো, হ্যালো আমার আজ ব্রেক আপ হয়ে গেছে।

অকস্মাৎ বাক্যে হকচকালো সবাই কিন্তু রোজ নিজের মধুরহাসি বজায় রেখে বলে,
-জি! আপনার নাম বলে, আপনি যেটা বলতে চান সেটা বলুন।

-আকরাম! আপনি বললেন বর্ষণ প্রেমের জন্য উপযুক্ত কিন্তু এই বর্ষণ আমার প্রেমিকা কেড়ে নিল। কিছুক্ষণ আগে যখন ঝড়ে সারা দুনিয়ে কাঁপছিল তখন আমার প্রেমিকা আচার, আর মোড়ের হোটেলের বিরিয়ানি খেতে চাইলো।এনে দেইনি বলে রাগ দেখালো, তারপরই এক কথায় দু কথায় ব্রেকআপ! মেয়েদের স্বভাব এমন কেন? এটা জানতে চাই!

রোজ হাসতে হাসতে বলে,
-আপনার প্রেমিকা নিশ্চই এইট নাইনে পড়ে! কারন কোনো প্রাপ্ত বয়স্ক নারী এমন বাচ্চাসূলভ আবদার এই রাতে ঝড়ের মধ্যে করবে না। টেনে উঠলেই কমবেশি সকল নারীর মন পরিপক্ক হতে শুরু করে। তারা কখনও এমন আবদার করতেই পারে না। আর যদিও বা করে তবে সেটা পরিস্থিতি দেখে। বাচ্চাদের সঙ্গে প্রেম করলে তাদের বাচ্চামি সহ্য করার ক্ষমতা রেখেই করতে হবে প্রিয় ভাই। তাই এই পরিস্থিতির জন্য বর্ষণকে দোষ্ দিলে চলবে না।

পরবর্তী কলার,
-আপু আমার নাম ইলোরা, আমি নারায়ণগঞ্জে থাকি। আপনার কথাগুলো আমার অনেক ভালো লাগে। যদি কখনও নারায়ণগঞ্জে আসেন তাহলে রেডিওতে জানিয়ে দেবেন প্লিজ। আমি আর আমার বন্ধুরা দেখা করতে চাই আপনার সঙ্গে।

-ধন্যবাদ ইলোরা! নারায়ণগঞ্জ গেলে অবশ্যই জানাবো।

পরবর্তী কলার,
-হ্যালো! আমি পরিচয় দিতে পারবো না। আমি একটা কথা জানাতে চাই।

-জি! বলুন। সমস্যা হলে পরিচয় গোপন রাখতে পারবেন।

-আমার বিয়ে হয়েছে তিনবছর আগে। এমনই এক বৃষ্টি মুখর দিনে আমি আমার স্বামীকে আমি আপন করে পেয়েছিলাম। সৌভাগ্যবশত ভাবে আজ আমাদের বিয়ের তিনবছর পূর্ণ হয়েছে এবং আজও সেদিনের মত বৃষ্টিতে ধরণী ভিজে আছে। সেই সঙ্গে ভিজছে আমার নয়ন। বিয়ের সময় থেকে আজ অবধি আমি আমার শশুড়বাড়িতে কখনও উঁচু গলায় কথা বলিনি। কারোর সঙ্গে কোনো ঝামেলা করিনি। তবুও তারা আমাকে মেনে নিতে পারেন না। কারন আমরা গরীব। অথচ বিয়ের সময় আমার শাশুড়ি আমাকে বলেছিলেন তিনি আমার শাশুড়ি নন, বরং আপন মা। তাঁর মেয়ে এবং আমি সমান। সারাদিন বাড়ির সমস্ত কাজ আমাকে দিয়ে করান, অথচ তার পরিবর্তে সামান্যটুকু স্নেহ বা আদর আমার প্রাপ্য নয় এমন ব্যাবহার উপহার দেন। ননদ আমার রায়বাঘিনী! চুন থেকে পান খসলেই আমার বাবার বাড়ি নিয়ে কথা শোনায়। আবার যখন আমার স্বামী সামনে থাকে তখন ভালো ব্যবহার করে। আমার স্বামীকে যদি আমি এসব বলি উনি বিশ্বাস করবেন না। কারন তারা ওনার সামনে ভালো ব্যবহার করে। এই মানসিক চাপ আমি সহ্য করতে পারছি না। কি করবো বুঝতে পারছি না। ছয়মাস হয়েছে আমি জানতে পেরেছি আমি সন্তানসম্ভবা। বাচ্চার পুষ্টির জন্য যে আলাদা যত্ন পাবো তারও জো নেই। শাশুড়ি বলেই দিয়েছেন তাঁর নাতি চাই। নাতি না হলে তাঁর চলবে না। স্বামীর ভালোবাসা যেটুকু পাচ্ছি, তাদের অনাদর তার থেকেও দ্বিগুণ। প্রথম প্রথম বেশ ভালোবাসা দেখিয়েছিল। পরে যখন জানলেন মেয়ে হবে তখন সেই ভালোবাসার রেশটুকুও টিকলো না। আমার স্বামী কাজের জন্য বাইরে থাকেন। মাসে এক-দু বার আসেন। তখন মানসিক শক্তি পাই আমি। কিন্তু বাকি দিনগুলো! এ কথাগুলো আমি কাউকে জানাতে পারিনা। আমি বলছি না এসব মানসিক অশান্তি থেকে মুক্তির কারন বলতে। শুধু মনের কথাগুলো জানালাম, তুমিই একদিন বলেছিলে মনের কষ্ট ভাগ করে নিলে কমে যায়। আজ তোমাকে সবটা বলতে পেরে হালকা লাগছে। ভালো থেকো, তুমি খুব ভালো মেয়ে রোজ। আর দোয়া করো আমার মেয়েটাও যেন তোমার মত হয়।

কল কে’টে গেল। রোজের হাসি ক্ষণিকের জন্য থামল। পরক্ষণেই পূর্বের ন্যায় হাস্যজ্জ্বল মুখে বলল,
-একটা মেয়ে দুটি পরিবারের প্রদীপ হয়। তারা নিজেরা জ্বলে ঠিক কিন্তু আলো ছড়াতে কার্পণ্য করে না।
আপনার কথা শুনে প্রথমে ভেবেছিলাম বর্তমান যুগে আদৌও এমন ঘটনা এখন ঘটে? কিন্তু আপনার কন্ঠের কম্পন বলে দিল ‘হ্যাঁ’। চিন্তা করবেন না আপু, আপনার স্বামী যেহেতু আপনাকে ভালোবাসে, আর আপনার শাশুড়ির যেহেতু মেয়ে আছে। তাই তারা উভয়েই আপনার সন্তানের মর্ম বুঝবেন। হয়তো আপনাকে তারা পছন্দ করেন না, কিন্তু আপনার গর্ভে বেড়ে ওঠা সন্তান তাদের রক্ত! কোনো দাদী নিজের নাতি-নাতনিকে দূরে রাখতে পারেনা। আর রইল বাকি আপনার প্রতি তাদের উদাসিনতা। আপনার ব্যবহারেই, আপনার গুনেই আপনি তাদের মন জয় করতে পারবেন। বিধাতা, স্বামী এবং নিজের ওপর ভরসা রাখুন। দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।
এবার আমার এই অনুষ্ঠান যারা শুনছেন শিশু থেকে বৃদ্ধ নির্বিশেষে সবাইকে, বিশেষ করে নারীদের উদ্দেশ্যে যারা শাশুড়ি হয়েছেন, যারা হননি, যারা বউ হয়েছেন, যারা হননি। তাদের জন্য বলছি বিয়ের পর শাশুড়ি যেমন মায়ের হক নিয়ে আসেন বউমাও কিন্তু মেয়ে হয়েই আসে। মা হতে গেলে আগে বউমাকে মেয়ে বলে স্বীকার করতে হয়। আমি শাশুড়িমায়েদের দোষ্ দিচ্ছি না। অবশ্যই বউমা’কে আগে শাশুড়িকে মা ভাবতে হবে, মায়ের নজরে দেখতে হবে, নিজের মায়ের স্থান দিতে হবে।তারপর তারা সেই মায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার অধিকার পাবে তার আগে নয়। আর যারা শাশুড়িকে মা ভাবেন, মা মানেন মায়ের মত ভালোবাসেন তারা কখনই নিজের মায়ের নামে অভিযোগ করতে পারবে না। তাই সকল শাশুড়িমা চেষ্টা করবেন পুত্রবধুকে নিজের মেয়ের সমান ভালোবাসার। দোষেগুণে পূর্ণ মানুষ ভুল করবে, তাদের ভুলগুলো ধরিয়ে দিয়ে তাদের ভুল শোধরানোর চেষ্টা করবেন। গরীব ঘরের মেয়ে যদি পছন্দ না হয় তাহলে বাড়িতে না আনাই ভালো। কারন একটা মেয়ে নিজের পরিবার ও প্রিয়জন ছেড়ে আপনাদের বিশ্বাস করে, আপনাদের ভালোবেসে নতুন সংসারে আসে। সেখানে সে তার নিজের পরিবারের তুল্য ভালোবাসা আশা না করলেও কিছু পরিমান ভালোবাসা আশা করবেই। সেটুকু তাঁর অভিলাষ নয় বরং অধিকার। কোনো মেয়েকে তাঁর প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়। বাকিটা যার যার নিজস্ব মনোভাব। আমি কারোর ব্যক্তিগত মনোভাবে হস্তান্তর করতে চাইনা, কারন সেই মহা-মূল্যবান অধিকার আমার নেই।

তাই সংসার জীবনের কলহ থেকে বেরিয়ে আমরা আবারও এই সুন্দর প্রকৃতির রূপে ডুব দিতে চাই। আর তার আগে আপনারা শুনুন রোয়েন ভাইয়ার গলায় মিষ্টি এ’গানটি।

আকাশে রিমঝিম বাদল জমেছে
তোমাকে পাবার মাদল বেজেছে,
কিছু তো শোনা যায় না
তোমাকে ছাড়া।
প্রকৃতি নতুন সাজে সেজেছে
তোমার আমার দেখা হয়েছে,
কিছু তো ভেবে পাই না
মন যে আর মানে না।

স্পিকারের সামনে থেকে মুখ সরিয়ে চেয়ারে মাথা লাগিয়ে বসল রোজ। গুমোটভাব’টা এখনও কাটেনি। বর্ষণের ফলে শীতলভাব নেমেছে মেদিনীতে কিন্তু তার সেই শীতলতা রোজের শরীর ছুঁয়ে দিচ্ছে না। শরীরের তাপমাত্রা গাণিতিক হারে বাড়ছে। আজকের শো’টা বাদ দিতে চেয়েছিল সে। কিন্তু ওর পরিবর্তে কেউ এই শো করতে না চাওয়ায় বাধ্য হয়ে রোজকেই থাকতে হলো।রোয়েনের গান শেষ হতেই রোজ আবারও নিজের কায়দায় অনুষ্ঠান এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। ঠিক তখন আরও একটা কল আসে,

-হ্যালো! আমি প্রিয়া!

-জি বলুন প্রিয়া!

-আমার প্রেমের ব্যর্থ কাহিনি শোনাতে চাই আমি। আজ আমার সঙ্গে আমার বাড়ি থেকে ঠিক করা ছেলেটার প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছে। তাকে আমি ঠিক করে চিনিও না। তাকে বিয়েও করতে চাইনা। একথা তাকে জানানোর পরেও সে আঠার মত আমার পেছনে লেগে আছে। আমার বয়ফ্রেন্ডকে মে’রে হসপিটালে ভর্তি করিয়েছে। যেকোনো মূল্যে সে আমাকে বিয়ে করতে চায়। আমি এটা কিভাবে আটকা…

তখনই ফোন কেটে গেল। অয়ন্তি নিজের ফোনের দিকে তাকাল। আরশান বারবার ফোন দিচ্ছে বলে ভুল করে ফোন কে’টে গেল। অয়ন্তি আরশানের ফোন কে’টে রেডিও সেন্টারে ফোন করার চেষ্টা করল কিন্তু ফলাফল শূণ্য। রোজ বাকিটা শুনতে না পেয়ে ‘দুঃখিত’বলে বাকি কল এ্যাটেন্ড করছে। কি জ্বালা! বিরক্ত হয়ে অয়ন্তি ফোন রিসিভ করেই দিল ঝারি,

-কি সমস্যা?

-তুমি আর’জে রোজের কাছে আমাদের সম্পর্কের পুরো কাহিনি বলছ? বলতে চাইলে আলাদা করে বলতেই পারো। তাই বলে লাইভে, ফোন করে বলছ? আর ই্যয়ু এ্যান ইনশেইন?

-আমি পাগল? পাগল তো আপনি? শুধু পাগল না ইতর বেয়াদবও। প্রাপ্তকে মে’রে কি পেয়েছেন? কি ভেবেছেন এসব করলে আমি সুড়সুড় করে আপনাকে বিয়ে করে আপনার সংসার করব?

-এসব তোমাকে দেখানোর জন্য করিনি কুসুম। আমার নিজের মনের খোরাক মেটাতে করেছি। তোমার পেছনে কেউ ঘুরলে, তোমার দিকে বাজে নজরে তাকালেও তাকে শাস্তি পেতে হবে। কাউকে ছাড় দেবো না আমি। আর তুমি সুড়সুড় করে আমাকে বিয়েও করবে আমার বাচ্চাও পালবে। সে ব্যবস্থাও আরশান করে রেখেছে।

-পালবো না, কিচ্ছু পারবো না। পারলে এসব করে দেখান। আমিও দেখতে চাই আপনি কতটা খারাপ!

-এভাবে চ্যালেঞ্জ দিও না মাই লাভ। আরশান খাঁনের ডিকশোনারিতে ‘ডিফেট’ বলে কোনো শব্দ নেই। বিয়ে তুমি আমাকেই করবে। আর কাউকে না, কারন অন্য কোনো পুরুষকে বিয়ে করার মত অবস্থায় আমি তোমায় রাখবো না। প্রাপ্ত’র কেস’টা তার ডেমো মাত্র। আমি তার থেকেও ডেঞ্জারাস। তাই বাড়ি থেকে পালানো, আমার থেকে পালানোর চিন্তা মাথা থেকে ঝেরে ফেলে বিয়ের যাবতীয় স্বপ্ন মাথায় ঢোকাও। আর সেগুলোই চিন্তাতে রাখো, অবশ্যই চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে আরশান থাকবে।

-সকালের ওমন ব্যবহারের পর আপনি ভাবলেন কি করে আমি আপনাকে নিয়ে চিন্তা করবো? আর কুসুম কি?আমার নাম অয়ন্তি, কুসুম মীর্জা কাকে বলেছেন? সকালে কিছু বলিনি বলে এখনও বলবো না? ফারদার বিরক্ত করতে আসবেন না আমাকে। অসভ্য লোক।

-অসভ্য? এর মানে কি তা আদৌ জানো? নিশ্চই জানো না। তাই তোমার কোমল সহৃদয়বান হবু স্বামী তোমাকে এই শব্দের অর্থ জানাতে তোমার বাড়ির সামনে উপস্থিত হয়েছে। পাঁচ মিনিট সময় দিলাম। নিচে নামো নাহলে সকালে তুমি তোমার মাতৃত্ব নিয়ে যেসব বলেছ তা তোমার বাড়িতে বলতে বাধ্য হবো।

ফোনটা রেখে ঠোঁট কামড়ে হাসলো আরশান। অয়ন্তি যে আসবে এব্যাপারে নিশ্চিত আরশান। কারন কুসুমের হৃদয় অতি কোমল! কুসুমের বাইরের আবরণ সে শক্ত দেখানোর চেষ্টা করলেও আরশান জানে কুসুমের ভেতরটা এখনও নরম! সে নিজেকে বুদ্ধিমতি, রাগি, তেজি প্রকাশ করতে চায়। কিন্তু আসলে তাঁর কুসুম অভিমানি, বোকা ও ভীতু।একটুতে কেঁদে ফেলা মেয়েটা জার্নালিজমে ভর্তি হয়ে কি করতে চায়? শুধু বোকামি? নাকি বোনের মত মৃ’ত্যু? আরশানের চোখের সামনেটা ঝাপসা হয়ে আসলো। কুসুমকে সে হারাতে পারবে না। অনাকে যেভাবে হা’রিয়েছে সেভাবে তো একদমই না। অয়ন্তি ঠিক চার মিনিটের মাথায় গেটের কাছে এসে হাজির। ছাতাতেও বৃষ্টির ঝাপটা মানাচ্ছে না। অয়ন্তির একপাশ পুরো ভিজে গেছে। শরীরের সঙ্গে গোলাপী রঙয়ের জামাটা একদম মিশে গেছে। পাতলা কাপড়ের ওপর থেকে বোঝা যাচ্ছে অয়ন্তির শরীর। আরশান এক নজর তাকিয়ে অন্যপাশে ফিরে জোরে জোরে শ্বাস নিল। কিন্তু বেহায়া চোখজোড়া তাঁর এই নিয়ন্ত্রণ শুনলো না। আবারও দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করল অয়ন্তির পানে। অয়ন্তির ডান গালে বিন্দু বিন্দু পানির ফোটা লেগে আছে। আরশান নড়েচড়ে বসে। অয়ন্তিকে বলতে বলতে সে নিজেই না আজ ভুলেভালেই ভুল করে বসে। অয়ন্তি গাড়ির সামনে আসতেই আরশান দরজা খুলে একটানে অয়ন্তিকে গাড়ির ভেতর নিয়ে আসলো। টান দেওয়ার গতি এত বেশি ছিল যে অয়ন্তি ভয়ে চোখ বুজে ফেলেছে। দরজা খোলার সময় আরশান কিছু একটা বলেছিল,কিন্তু ঝড়ের ঝাপটার সঙ্গে মেঘের তীব্র গর্জনে সেটা শোনা গেল না। কি বলেছিল আরশান?

চলবে?

[এটা আমার লেখা প্রথম ধারাবাহিক গল্প। তাই আমিও জানি ভুলত্রুটি থাকবে। মানুষ মাত্রই ভুল হয়, তাই সেই ভুলগুলো গঠনমূলক মন্তব্যের মাধ্যমে ধরিয়ে দিলে খুশি হতাম।

বেতার বিষয়ক গল্পটা বোরিং লাগতে পারে আপনাদের কাছে। কিন্তু ওটা আমার পরিচিত একজনেরই জীবনে ঘটেছে তাই মনে পড়ায় লিখে দিলাম। রোজ মেয়েটির বিশেষ ও গুরুত্বপূৃৃর্ণ ভূমিকা থাকবে গল্পটিতে তাই তাকে হাইলাইট করতে পর্বটি বড় করা হয়েছে। প্রথম পর্ব থেকেই সে পরোক্ষভাবে গল্পের সঙ্গে সংযুক্ত।

আরশানের চরিত্র মানে একেক সময় একেক রকম নিয়ে আপত্তি যাদের তাদের বলছি, চরিত্রটিই এমন। আর কুসুম নামটি আরশান জেসমিনের পরিবর্তে ডাকে। প্রথম পর্বে কুসুম থাকলেও এখন অয়ন্তি থাকবে।

আমার যেকোনো ভুল ভদ্রতার সঙ্গে ধরিয়ে দেবেন। ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ!❤️❤️]

#তুই_হবি_শুধু_আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_তিন

অয়ন্তির ঘাড়ে আরশানের নিঃশ্বাস আছড়ে পড়তেই শিউরে উঠল অয়ন্তি। মৃদু কম্পনে কেঁপে উঠল ওর সর্বাঙ্গ। অচেতন অবস্থায় থাকা অয়ন্তিকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে আরশান। কিছু সময় পূর্বে, অয়ন্তি ভিজে যাচ্ছে দেখে আরশান ওকে টেনে গাড়ির ভেতর বসাতেই ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে অয়ন্তি। আরশান প্রথমে ভড়কালেও পরক্ষণেই আলতো হেসে অয়ন্তির মাথা নিজের কোলের ওপর রেখে ব্যাকসীট থেকে তোয়ালে এনে অয়ন্তির মাথার চুলগুলো সযত্নে মুছে দিল। বৃষ্টিতে ভেজার সম্ভাবনা ছিল বলে, আরশান তোয়ালেসহ এক্সট্রা জামা-কাপড়ও এনেছিল। সেটা যে এত দ্রুত কাজে লেগে যেতে পারে তা অকল্পনীয় ছিল। আরশানের এক হাত অয়ন্তির কোমর ছুঁয়ে উদর স্পর্শ করছে। আর অন্য হাতে রয়েছে জলন্ত সিগারেট। মাঝে মাঝে সেই সিগারেট ঠোঁটের ভাঁজে রেখে লম্বা টান দিয়ে অয়ন্তির দিকে তাকাচ্ছে সে। কয়েকমুহূর্ত চেয়ে থেকে যখন বুঝছে নিয়ত খারাপের দিকে যাচ্ছে তখনই বাইরে চোখ রাখছে।অয়ন্তি নড়ে উঠলো কিছুটা, শীত লাগছে। আরশান নিজের শার্ট’টা খুলে অয়ন্তির শরীরে জড়িয়ে ধরলো। আরশানের লাল শার্টের নিচে থাকা সাদা টিশার্ট’টি অয়ন্তির ভেজা জামা লেগে ভিজে গিয়েছে অনেকটা। আরশানের ঠান্ডার দোষ্ আছে, দেখে ও সেই টিশার্ট খুলে ফেলল। আরশানের উদাম শরীরের উষ্ণতা আর অয়ন্তির শরীরের শীতলতা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। উষ্ণতা পেয়ে অয়ন্তি আরশানের আরেকটু কাছে ঘেসে ওকে জড়িয়ে ধরে আরাম করে ঘুমালো। ওদিকে আরশানের চোখ লাল হয়ে এসেছে। হাতে থাকা সিগারেটটা কাঁপছে। আরশান দীর্ঘশ্বাস ফেলে অয়ন্তির চেহারায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। এরপর ধীরে ধীরে নিজের মুখ এগিয়ে নিল অয়ন্তির দিকে। অয়ন্তির ঘাড়ে মুখ গুজতেই ওর সদ্য বেড়ে ওঠা মাঝারি দাড়ির খোঁচায় অয়ন্তি চোখমুখ খিঁচে ফেললো। এরপর মশা ভেবে ঠা’স করে চর বসালো সেখানে। চর’টা আরশানের গালে পড়তেই আরশান থতমত খেয়ে বাচ্চাদের মত ভগ্নস্বরে বলে,
-থ্যাংকস কুসুম। তোমার থা’প্পড়ের জোরে ভুলটা করতে গিয়েও করা হলো না। এ্যান্ড অলসো স্যরি।

আরশান সরে আসতেই অয়ন্তি পিটপিট করে চোখ খুলল। আবছা আলোয় আরশানকে দেখতে পেল কিনা বোঝা গেল না। বিরবির করে কিছু একটা বলে সে চোখ বুজতেই আরশান ঝুকে শোনার চেষ্টা করল অয়ন্তি কি বলছে। অস্পষ্ট ভাবে যা শুনলো তা হচ্ছে, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি অনাপি। আমাকে ছেড়ে যেও না। মাথায় হাত বুলিয়ে দাও, আমার মাথায় অনেক ব্যাথা করে। ‘

আরশানের বুকের ভেতর মোচর দিয়ে উঠলো। অয়ন্তির চুলের মাঝে হাত রেখে সে বুলিয়ে দিতে দিতে চোখ বুজে অয়ন্তির চুলে নাক ডুবালো। শ্যাম্পুর নাকি তেলের ঘ্রাণ আসছে তা বোঝা যাচ্ছে না, তবে এই পরিচিত ঘ্রাণটা আরশানের বড্ড প্রিয়। ঘ্রাণ নিতে নিতে আরশান অধর ছোঁয়াল অয়ন্তির মাথায়, ধীরে ধীরে ঠোঁট কপালে নেমে আসে। অয়ন্তির দুগালে, ঠোঁট রাখার এক পর্যায়ে আরশানের চোখ খুলল। নিজের ওপরই চরম বিরক্ত সে। বারবার অয়ন্তিকে ছুঁয়ে দেখার প্রবৃত্তি থেকে নিজেকে সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ছে। কিন্তু এমন অবস্থায় অয়ন্তিকে নিয়ে বাড়ির ভেতর যাওয়াও তো সম্ভব না। ঝড়ের তান্ডবও বেড়েছে। বের হওয়ামাত্র ভিজে একাকার হয়ে যাবে দুজনে। কয়েক ঘন্টা বাদেই ঠান্ডা-জ্বর, সর্দি কাশি সব শুরু হবে। আরশান অয়ন্তিকে লম্বা করে সীটে শুইয়ে দিয়ে সীটবেল্ট লাগিয়ে ব্যাকসীটে এসে বসে। অয়ন্তির কাছে আর থাকা যাবে না। একটা ভুল হলে অয়ন্তি অনেকটা দূরে চলে যাবে যা আরশান চায় না। পেছনের সীটে বসে আরশান অতিতের কথা স্মরণ করল।



১২বছর আগে, আরশানের বয়স তখন একুশ। অনার সঙ্গে সে প্রথম মীর্জা বাড়িতে আসে। অয়ন্তির বয়স তখন ছয় বছর। বাড়ির সামনের উঠানে আরও দুটো বাচ্চার সঙ্গে খেলছিল অয়ন্তি। আরশান যখন গেট দিয়ে ঢুকছিল তখন অয়ন্তি খেলা বাদ দিয়ে আরশানের দিকে হা করে চেয়েছিল। আরশান মৃদু হেসে অয়ন্তির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-অনা এটা তোর বোন না? ভারি মিষ্টি তো! কি নাম পিচ্চির?

অনা হাসল। মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাল। কিন্তু অয়ন্তি হাসল না। বরং রেগে আগুণ হয়ে ছিটকে দূরে সরে দাড়াল। আরশান ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই অনা চোখ রাঙাল। অয়ন্তি গাল ফুলিয়ে বলে,
-আমি পিচ্চি না। মিমি পিচ্চি। রুনা পিচ্চি।আমি ওদের থেকেও বড়।

সেদিন অয়ন্তির বাচ্চামিতে হেসে উঠলেও আরশানের নজর অয়ন্তিতেই নিবদ্ধ থেকেছিল। আরশান বারংবার তাকাচ্ছিলো দেখে অয়ন্তি ভয় পেয়ে অনার পেছনে লুকিয়ে দাড়িয়ে চোরা দৃষ্টিতে আরশানকে লক্ষ করছিল। আরশান যখন অনার সঙ্গে অনার ঘরে আসে অয়ন্তিও পিঁছু পিঁছু এসেছিল। কিন্তু দরজার আড়ালে দাড়িয়েই আরশানকে দেখছিল, ভেতরে আসেনি। অনা ওয়াসরুমে যেতেই আরশান উঠে সমগ্রঘরে পাইচারি করে প্রতিটা জিনিস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। তখনই ওর চোখ পড়ে দরজার পাশে ছোট্ট একটা ছাঁয়ার ওপর যা রোদের আলোয় অনেকটা লম্বা হয়ে এসেছিল।আরশান গলার স্বর একটু উঁচু করে চেঁচিয়ে বলল,
-কে ওখানে?

সঙ্গে সঙ্গে অয়ন্তির গলা ফাটানো চিৎকার শোনা গেল। হিচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে এক দৌড়ে নিচে চলে যায় সে। আরশান বেকুবের মত তাকায়! এরপর গলা পরিষ্কার করে আয়নার সামনে দাড়িয়ে দু তিনটা বাক্য বলে চেক করে কন্ঠ ঠিক আছে কিনা। ঠিকই তো আছে তাহলে বাচ্চাটা ভয় পেল কেন? অনা বাথরুম থেকে বের হতেই আরশান অয়ন্তির কথা জিজ্ঞেস করল। অনা শব্দ করে হাসে,
-আর বলিস না, অয়নটা একটুতেই ভয় পায়। সবার আঁদরে আঁদরে বাঁদর তৈরি হয়েছে। কিছু হতে না হতেই ন্যাকাকান্না জুড়ে, এটা সেটা বায়না করে আবদারগুলো হাতানো ওর কাজ। এই যেন কান্না করল, নিচে গিয়ে দেখবি বাবাকে বলে একগাদা খেলনা আনিয়েছে, চাচা আর ভাইয়াদের সঙ্গে ঘোরার প্লানিং করেছে। তবে তোর ইমেজ’টা একটু কালারিং হবে, এই যা!

-আমার ইমেজ কালারিং? মানে?

-নিচে গিয়ে ও বলবে, তুই ওকে ধমক দিয়েছিস। গাল টেনেছিস।

-কখন করলাম এসব? তোর বাড়ির মানুষ বিশ্বাস করে নেবে নাকি তোর ছলনাময়ী বোনের কথা? মানইজ্জত সহিত বের হইতে পারুম তো?

-ধ্যাত! বিশ্বাস করবে কেন? সবাই জানে অয়ন এমন। সামনাসামনি তোকে একটু ঝারবে বাবা, নাহলে তাঁর আদরের দুলালি তো থামবে না। তারপর ঠিক হয়ে যাবে।

-ফাজিল মেয়ে! তোর স্বভাব পেয়েছে। তুই যেমন ব্লাকমেল করে কাজ হাতিয়ে নিস, তোর বোনটাও ঠিক তেমন।

-এবার আমার কম্পিউটার ঠিক কর দোস্ত! পরশু পরীক্ষা! ফেইল করলে তিন বছরের জার্নালিজম পড়ার সাধ মিটে যাবে। অর্নাসের দু বছর না চাইতেও পড়তে হচ্ছে, কি জ্বালা! ভাবলাম টুকে পাস করবো। বাট তোর সীট অনেক দূরে।

-জার্নালিজমে কি আছে? এতগুলো বছর নষ্ট করে ওতে পড়া লাগবে কেন? বিয়েশাদী কর, তোর ননদদের দেখে আমারও হোক! আর কতকাল সিঙ্গেল থাকবো? বয়স তো কম হলোনা, প্রেম করার উপযুক্ত সময় পর হয়ে যাচ্ছে।

-তুই ব্যাটা প্রেম নিয়াই থাক। বাই দ্যা ওয়ে সিনিওর আপু ট্রাই কর। তোর পিছে তো জোঁকের মত লেগে থাকে ফাইনাল ইয়ারের আপুরা।

-ধুর! বড় আপুরা আগে থেকেই বোঝে সব। আমার ওত বেশি বুঝা পাবলিক ভালো লাগে না। বাচ্চা-কাচ্চা দেখ। আমি ধৈর্যশীল মানুষ! বাচ্চা পালতে পছন্দ করি।

-বাচ্চা?বিয়ে কইরা একটা পয়দা করে নিলেই হয়।বাচ্চা বউ লাগবো ক্যান? আর বিয়ের পর কোন মাইয়া বাচ্চা থাকে?

-ঘসেটির নিউ ভার্সন! ওই বাচ্চা পালার মজা, আর বাপ হয়ে বাচ্চা পালার মজা আলাদা। এই বাচ্চা বউকে ধমকানো, গাল টিপে চুম্মানো, ভয় দেখানোর মজা তুই ক্যামনে বুঝবি? প্লাস, ইয়ে, মানে বুঝোসই তো! আমি মানুষটা এক্সট্রিম রোম্যান্টিক! ভীতু বাচ্চাদের আদর করতে গেলে রোম্যান্টিকতা বাড়বে বৈ কমবে না।

-ছি! তুই দেখি মহা শয়তান। কোন মাইয়্যার কপাল পুড়াবি বিধাতাই জানে। বেয়াদব। লুচ্চা প্রজাতির এমন বন্ধু আমার ফ্রেন্ডলিস্টে আছে জানতামই না। সায়নটা লুচ্চা জানতাম, কিন্তু ও’ও তোর মত এত না। সভ্য হ। আমার মত না হলেও, একটু হ। তোদের নিয়ে তো বের হওয়াই মুশকিল।

-রোম্যন্টিকতার অন্য মানে বের করছিস তো। কর! এই থাকল তোর কম্পিউটার, নিজে ঠিক করে নে। পারবো না আমি তোর এই ভা’ঙাচোরা কম্পিউটার ঠিক করতে। বালের সভ্যতার প্রতীক আসছে।

সেদিনও অয়ন্তির প্রতি আরশানের তেমন কোনো বিশেষ অনুভূতি জন্মায়নি। মীর্জা বাড়িতেও আরশানের তেমন যাওয়া হয়নি। তবে বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সুবাদে ছাদে বাচ্চা অয়ন্তিকে প্রায় দেখতো আরশান। ‘বাচ্চা হিসেবে সে চমৎকার! তাই তাঁর দিকে দৃষ্টি যায়।’ এমন বাক্য নিজেকে চড়া গলায় শুনিয়ে ধমকাতো সে। কিন্তু যখন অয়ন্তি ওরনা নেওয়া শুরু করলো। কিশোরী হওয়ার ছাঁপ প্রকাশ পেল তখন আরশান বুঝলো এটা শুধু বাচ্চার প্রতি ভালোলাগা ছিল না। অন্যকিছু ছিল। অনা জার্নালিজমে যখন দুই বছর কাটালো আরশান তখন হুট করেই দেশের বাইরে চলে যায়। অনা ভারি চমকায়। বেস্টফ্রেন্ডের এমন বিশ্রি কাজে ক্ষেপে গিয়ে ফোন করে ইচ্ছেমত ঝারে। আরশান প্রথমে কিছু বলতে চায়নি। কিন্তু অনার জোরাজুরিতে শেষে বলেই দিল সে অয়ন্তিকে পছন্দ করে। অনা স্তব্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ চার বছর আরশানের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রাখে। আরশান ভাবে ওর অন্যায়ের শাস্তি এটা। কিন্তু সেই ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করে কলকাতায় ওর বাড়িতেই এসে হাজির হলো অনা, অয়ন্তি, মাহিন,সায়ন ও সায়নের বউ। আরশান দরজা খুলতেই ওর ওপর অতর্কিত হামলা করে বসে সবাই।অয়ন্তি সবার পেছনে অস্বস্তিতে আসফাস করছে। আরশানের দৃষ্টি তখনও অয়ন্তির ওপর পড়েনি। অনা সবাইকে থামিয়ে কড়া কন্ঠে বলে,

-আরে থাম! দুমিনিট মা’রামা’রির কাজটা ওফ রাখ, আরশানের বাড়িতে নতুন মেহমান এসেছে তাকেও আপ্যায়ন করার সুযোগ দে ওকে।

আরশান সোফার ওপর থেকে উঠে দাড়াল। দরজার বাইরেই উঁকি মেরে দাড়ানো অয়ন্তিকে দেখে আরশানের চোখ ভিজে আসল। বেশ কিছু সময় স্তব্ধতা ঘিরে রাখল ওকে। যখন মস্তিষ্ক সচল হলো, বুঝতে পারলো অয়ন্তি এসেছে তখন ছুটে গিয়ে অনাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-থ্যাংক্স দোস্ত! আমি তো ভাবছিলাম ফ্রেন্ডশিপটাই বোধ হয় জলে গেল।

মাহিন তেড়ে এসে আরশানকে ছাড়িয়ে মুখটা বিকৃত করে বলে,
-ছাড় শালা! আমার বউরে চাইপ্পা ধরছোস ক্যান? ছাড় কইতাছি নাহলে আমিও কিন্তু অয়নরে…! আর তুই জানোস আমি কাউরে ধরলে ঘন্টাখানেকের আগে ছাড়ি না।

আরশান মাহিনের হাটু বরাবর লাথি মেরে বলে,
-টাচ কইরা দেখ, পিস পিস কইরা কা’ইট্টা বুড়িগঙ্গায় ভাসায় দিমু। আম্মার নজরে দেখবি ওরে। বোন, শালি আপু সব বাদ।

আরশান দরজার দিকে এগোতেই পেছন থেকে কয়েক কন্ঠের সমস্বর শোনা গেল,
-ফুল কিন্তু ছোঁয়ামাত্র নেতিয়ে পড়ে। লজ্জাবতী লতার মানবী প্রকাশ। দেখিস, চারবছরের প্রেম যেন একবারে উপচে না পড়ে। তুই তো মামা সুবিধার না।

মাহিন তেতে বলে,
-আমার শালির চোখে পানি আসে না যেন। লোহার থেকে আমার ফুল বেশি প্রিয়। মানে তোর থেকে আমার শালি বেশি প্রিয়। আর আমার বউয়ের চৌদ্দগুষ্টি ওর ব্যাপারে প্রচন্ড সেন্সিটিভ।

আরশান ঠোঁট কামড়ে হাসল। বা হাতে চুলগুলো ব্রাশ করে দুষ্টুমিতে ভরা কন্ঠে বলে,
-ফার্স্ট অফ অল আমারও প্লাস আমিও।

চলবে?

তুই হবি শুধু আমার পর্ব-০১

0

#তুই হবি শুধু আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#সূচনা_পর্ব

আমি কখনও মা হতে পারবো না আর’জে আরশান। এটা জানার পরও আমার পেছনে কেন আদাজল খেয়ে পড়ে আছেন? আপনার ক্যারিয়ার, আপনার পরিবারের মর্যাদা’র কথা ভাবুন এবং অন্য কোনো নারীতে আসক্ত হওয়ার চেষ্টা করুন।
কথাগুলো বলে কুসুম নিজের হ্যান্ড ব্যাগটা হাতে তুলে নিল।আরশান পানি পান করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। ক্যাফের ওয়েটার ছোট নোটপ্যাড এনে আরশান ও কুসুমকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করে,
-ম্যাম, স্যার! আপনাদের অর্ডার?

আরশান বিরক্ত দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে কুসুমকে বলল,
-কি নিবেন? আমি কফি আর স্যান্ডুইচ নিচ্ছি।

আরশানের ভাবলেশহীন প্রতিক্রিয়া ও স্বাভাবিক ভঙ্গির প্রশ্ন শুনে থমকাল কুসুম। চলে যাওয়ার জন্য উঠেছিল সে। আরশানের প্রশ্ন শুনে এবার তাঁর ললাটে দীর্ঘ ভাঁজ পড়ে। অনুভূতিশূণ্য মানুষটির এমন আচরণ ভাবাচ্ছে কুসুমকে। কুসুম যতদূর শুনেছিল মানুষটি প্রচন্ড ত্যাড়া, বদমেজাজি, বাস্তববাদী একজন। তাহলে তাঁর মাথায় কি বংশরক্ষা’র চিন্তা আসছে না? সন্তানলাভের কামনা আসছে না? কুসুমকে বসতে না দেখে আরশান আবারও ঠান্ডা গলায় বলল,
-বসুন। বসে কথা বলি। আপনার জন্য একটা শো বাদ দিয়ে এসেছি। সময় নষ্ট করেছি, এই গরমে রোদের তাপ সহ্য করেছি,তাপ লেগে আমার ফর্সা চামড়া পুড়ে গেল। আর আপনি এসেই নিজের মূল্যবান বক্তব্য শুনিয়ে চলে যাচ্ছেন?আমার কথা শুনবেন না? আর কে বলল আমি আপনার পেছনে আদাজল খেয়ে পড়ে আছি?আর ইয়্যু কিডিং উইদ্থ মি মিস কুসুম মীর্জা? আপনার মাঝে কি আছে? যার জন্য রেডিও জকি আরশান খাঁন আপনার পেছনে ঘুরবে?

অপমানে মুখটা থমথমে হয়ে আসল কুসুমের। আরশান তা দেখে বাঁকা হাসে। কুসুম চলে যাবে এমন ভাব নিয়ে সামনে তাকাতেই দেখল সবাই হা করে ওদের দিকে চেয়ে আছে। ওদের দিকে ঠিক নয়, মূলত আরশানের দিকে। পপুলার রেডিও জকি আরশানকে দেখার আগ্রহ তাদের কৌতুহল দমন করতে দেয়নি। আরশানের প্রতিটা বাক্য তাদের কানে পর্যাপ্ত আওয়াজেই পৌঁছেছে যার দরুন তাদের অদ্ভুত দৃষ্টির সম্মুখে পড়তে হলো কুসুমকে। দু-একজন ছবি তুলতে আসলো। আরশান বিরক্তি নিয়ে তাদের এড়িয়ে যায়। আরশান আবারও তাঁর শীতল কন্ঠে শুধাল,
-বসবেন? নাকি সিনক্রিয়েটের বাকি পর্যায়গুলো এপ্লাই করবো মিস কুসুম?

কুসুম ধপ বসে পড়ল।লোকটা মারাত্মক লেভেলের বদ। আরশান ওয়েটারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-ম্যাডামের জন্য এ্যাপেল জুস, কাস্টার্ড আর ফালুদা আনুন।

কুসুম আড়চোখে তাকাল। ওর প্রিয় খাবারের তালিকা জানে নাকি লোকটা? ওয়েটার চলে যেতেই কুসুম তিক্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
-কি সমস্যা? আমি তো বললাম আমি খাবো না। আমি বাড়ি যাবো।

-যেতে তো আটকাই নি।খালি পেটে আছেন,আগে খেয়ে নিন, তারপর যান।

-আপনার কি মানসিক প্রবলেম আছে? নাকি বড়লোক বাড়ির জামাই হওয়ার প্রবৃত্তিতে হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়েছে? কত টাকা চাই আপনার?আমাকে বলুন আমি দিচ্ছি।

আরশান জবাব না দিয়ে ফোনের দিকে চাইল। ওর শো একটা মেয়ে হোস্ট করছে। এবং দারুনভাবে হোস্ট করে শ্রোতাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করছে। আরশানের ভ্রু কুঁচকে থাকা দৃষ্টি ফোনের ওপর থেকে নড়ছেই না। এই মেয়ে তো এবার ওর শো’টাও হাতিয়ে ফেলবে। ওদিকে কুসুম রাগে কিড়মিড় করে উঠছে। এতক্ষণ ধরে কুসুম যে গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো বলেছে তা কি এই পাঠার মত মানুষটা শুনেছে? তখন থেকে ফোন গুতিয়েই চলেছে। কি এত দেখছে ফোনে? কুসুম টেবিলে মৃদু আ’ঘাত করে।
-এই যে মহামান্য রেডিও জকি মহাশয়! কি সমস্যা তা বলছেন না কেন? কত টাকা চাই?

আরশান মাথা তুলে তাকাল। কুসুমের চেহারায় চোখ বুলিয়ে কফিমগে চুঁমুক দেয়।
-টাকা দিয়ে কি হবে? আমার শান্তির প্রয়োজন। বাড়িতে আমার বিয়ে নিয়ে যে অশান্তি শুরু হয়েছে তা নির্মূলিত করতে আমার বিবাহের প্রয়োজন। এবং আপনার বাবা স্বয়ং বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন আমার বাবার কাছে। তাই এই বিয়ে ভাঙার বাহানাগুলো বাবার সামনে গিয়ে দেখালে খুশি হবো মিস কুসুম।

কুসুম স্তব্ধচোখে তাকাল। লোকটা বুঝে ফেলল কি করে কুসুমের অভিলাষ? কুসুম কন্ঠে দৃঢ়তা রেখে বলে,
-একটা মেয়ে সন্তান নিয়ে মিথ্যে বলবে বলে মনে হয় আপনার?

আরশানের স্পষ্ট জবাব,
-আগে মনে হত না। কিন্তু আপনাকে দেখার পর মনে হতে শুরু করেছে। এমন একটা কথা সত্যিই কি কোনো মেয়ে শুধুমাত্র বিয়ে ভাঙতে বলবে? বলতে পারে?

কুসুম অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল মুহূর্তেই। মিথ্যা বলার অভ্যাস নেই ওর। তবুও মিথ্যাগুলো বেশ চড়া গলায় বলেছিল। কিন্তু এই অতি চালাক লোকটা সব ধরে ফেলেছে। তাই কুসুম নিজের কপোট রাগ মিটিয়ে শান্ত দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করল আরশানের দিকে।
-বিয়েটা আমি করতে চাই না আরশান। প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্টান্ড। আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি।

আরশান কফির কানায় ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে,
-ওকে!

কুসুম আমোদে উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে এক প্রকার লাফিয়ে উঠে বলে,
-তার মানে আপনি বিয়েটা ভাঙবেন?ধন্যবাদ আরশান। অনেক অনেক ধন্যবাদ। শুনুন বাড়িতে গিয়ে আপনি না হয় এটা বলে দেবেন, যে আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি কারন আমি সিগারেট খাই। দুবার টেস্ট করতে গিয়ে ধরা খেয়েছিলাম, এই অযুহাত অবশ্যই কাজে লাগবে।

-রিয়েলি? মেয়েরাও সিগারেট টেস্ট করতে চায়? আর কি কি টেস্ট করেছেন? অ্যালকোহল? গাঁজা? ড্রাগের চক্কর? টেস্ট করার প্রশ্ন আসলে আমি এটাও সন্দেহ করছি যে আপনি ছেলেদেরও টেস্ট করেন নি তো?আই মিন লিভ ইন টাইপ কিছু?

আরশানের বাক্যে হতভম্ব চোখে চাইল কুসুম। প্রথম অপমানের ধাক্কা কা’টতে না কা’টতেই নতুন অপমানে জর্জরিত করে দিল কুসুমের হৃদয়টা। এমন ঠোঁটকা’টা লোকের সামনে পড়াটাই ওর ভুল হয়েছে। কুসুম এই বাজে অপমান মুখ বন্ধ করে সহ্য করে নিল।কার্যসিদ্ধির জন্য মানুষ কত কি করে? কুসুম একটু অপমান সহ্য করতে পারবে না? কুসুম অনুনয় করে বলে,
-প্লিজ! বিয়েটা ভা’ঙা নিয়ে কথা বলি? আর এসব টেস্ট করবো কেন? আমাকে দেখে কি আপনার এমন মেয়ে মনে হয়?

আরশানের সহজ সরল স্বীকারক্তি,
-মনে হবার কি আছে? গত আধঘন্টায় আপনাকে দেখে তো এমনই লাগে। আর আমি নির্দ্বিধায় বলছি, আপনি মেয়েটা এমনই। অত্যন্ত বাজে প্রকৃতির।

কুসুমের মাথা রাগে দপদপ করে জ্বলছে। মহাঅসভ্য প্রকৃতির এই ছেলের সঙ্গে আর কথা বলবে না । উঠে দাড়াতেই ওয়েটার খাবার নিয়ে আসলো। কুসুম বসে পড়ল। এতগুলো কথা হজম করার পরেও পেটের ক্ষুধা মেটেনি। কথা যখন গিলল তখন খাবার রেখে যাবে কেন? লোকটার পকেট খসিয়ে আরও কিছু অর্ডার দিয়ে সব খাবার শেষ করে তবেই উঠবে সে। কুসুম কিছু খাবার অর্ডার দিয়ে আরশানের দিকে তাকাল। ফোনের মধ্যে ঢুকে আছে। কুসুম সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিল,
-কি দেখছেন?

আরশান ফোনে দৃষ্টি রেখেই জবাব দিল,
-আপনি ভালোবাসার রংমহল শো’টা শুনেছেন কখনও? ফ্রিকোয়েন্সি ৯৮.০৪ এফ এম’য়ে তে হয়। রেডিও ফুর্তি আই মিন আমাদের রেডিও চ্যানেলে। ওই আরজে আমার শো হোস্ট করছে। কেমন করছে, সেটা দেখছি। আপনার জন্য তো আমাকে শো’টা ক্যান্সেল করে আসতে হলো।

কুসুমের চেহারা মুহূর্তেই বদলে গেল। এই শো সে শুরু থেকে শুনছে। প্রতি শুক্রবার রাত বারো’টায় হয়। এবং সোমবার সকাল এগারো’টায় হয়ে থাকে। এক মধুরকন্ঠী, সুমিষ্টভাষী মেয়ে হোস্ট করে। দারুন গলার সঙ্গে দারুন বুদ্ধির এই মেয়েটার জন্য রেডিও সেন্টারের নাম-ডাক তিনমাসেই দ্বিগুণ হয়েছে। কুসুম নিজেও তো মাঝে মাঝে কলার সেজে কথা বলে। মেয়েটির অনেক বড় ফ্যান কুসুম। আরশান কি তাকে চেনে? কুসুমের রাগ গলে গেল নিমিষে। সে প্রবল আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-আপনাদের চ্যানেল? যাই হোক আপনি কি চেনেন ওকে?মানে রংমহলের আর’জে’কে, আমার সঙ্গে একটু দেখা করিয়ে দেবেন? প্লিজ! প্লিজ!

আরশান ভ্রু কুঁচকে তাকাল। কুসুম এবার বাচ্চাদের মত বায়না ধরছে। কিছুক্ষণ আগের তেজ গেল কোথায়? আরশান হতাশ চোখে বিরবিরিয়ে বলে,
-তোর জ্বালায় শান্তি নেই রে! কুফা হয়ে এসেছিস এই মাসুম আরশানের জীবনে।দিস ইজ রিয়েলি ব্যাড বেবি, ঠু মাচ!

কুসুম আবারও বলে,
-ভাও খাচ্ছেন নাকি? আরে মিটিং ফিক্সড করার জন্য একটা বড় এ্যামাউন্টও পাবেন। কুড়ি পঁচিশ হাজারে হবে?

আরশান আনমনে জবাব দিল,
-আমার সঙ্গেই মাসে একবার দেখা হয়। আপনার সঙ্গে দেখা করাবো কি করে? তাছাড়া আমার ওত ঠেকা পড়েনি যে আপনার মত মেয়ের সঙ্গে ওর দেখা করিয়ে বদনাম কুড়োবো।

কুসুম কোনো কথা বলল না। না খেয়েই উঠে দাড়াল। এরপর গটগট করে বেরিয়ে গেল। যেতে যেতে আপন মনে আওড়াল,’দু’টাকার আরজে আমাকে কথা শুনিয়ে দিল? আমাকে? তোর কপালো দজ্জাল বউ জুটবে। যে তোকে দিনে দশবার দৌড়ানি দেবে বেয়াদব! তোর বউ একটা আকাইম্মা হবে, দেখে নিস্। সামান্য একটা কথা বললাম আর ভাব দেখ। আমি সিঙ্গেলই ম’রবো তাও একে বিয়ে করবো না। কখনও না ‘

ওদিকে কুসুম চলে যেতেই আরশান ফোনে নিজের বাবার নাম্বারে ডায়াল করে গম্ভীরকন্ঠে বলল,
-মেয়ে পছন্দ হয়েছে আমার। আগামী মাসের মধ্যে বিয়ের ডেট ফিক্সড করো। আমি একেই বিয়ে করবো। আর কাউকে না।

ওপর পাশ থেকে উত্তর আসার অপেক্ষা করল না সে। ফোন কে’টে কুসুমের রেখে যাওয়া কাস্টার্ডের বাটি’টা হাতে নিয়ে কুসুমের চামচ দিয়েই দু’চামচ খেল আরশান। এরপর ফোনে থাকা কুসুমের ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলে,
-যত ইচ্ছে ওড়ো, কিন্তু সেটা আরশানের গন্ডির মধ্যেই। তার বাইরে না কুসুম। বিকজ আমি তোমাকে ছাড়বো না। কিছুতেই না।

ঠিক তখনই ওর ফোনে কল আসল। ভালোবাসার রং মহলের আর’জে ফোন করেছে। ফোন রিসিভ করতেই আরশান শুনতে পেল,
-ভালোবাসা’কে খাঁচায় বন্দি করতে নেই। পাখিকে যত আটকে রাখবে সে তত উড়ে যেতে চাইবে। আর যদি মুক্ত রাখো, ভালোবাসা দাও তাহলে খাঁচা নয় আপন নীড়ে সে এমনিতেই ফিরবে।

এটুকু বলেই ফোন রেখে দিল সে। আরশান সন্দিগ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ফোনের ওপর। মেয়েটা কি অন্তর্যামী? আরশান মনে মনে কি পরিকল্পনা করে, এমনকি ওর সামনে দাড়িয়ে কে কি ভাবে তা বুঝে ফেলে কি করে? কুসুমকে কি ভালোবাসায় বাঁধতে বলল? আরশানের গন্ডির রেখা মুছে ফেলতে বলল? আরশান একগুঁয়ে অভিলাষ নিয়ে বলে,
-শুনবো না। তুই প্রেমে পড়িসনি কখনও, তাই বুঝিসনা বেবি। এভ্রিথিংক ইজ ফেয়ার ইন লাভ এ্যান্ড ওয়ার। যখন কাউকে ভালোবাসবি তখন বুঝবি একজনকে ঠিক কতটা চাইলে তাকে আটকে রাখার প্রবৃত্তি জাগে। তাকে খুব কাছে পাওয়ার, বুকের গহিনে লুকানোর, এই মনস্কামনা ভুল নয়। ভুল হতেই পারে না।

আরশান ফোন বের করে একজনকে কল করে সরল ভঙ্গিতে বলে,
– তোর ভাবির প্রেমিককে খুজে বের কর। হাত’পা ভে’ঙে আমার কাছে আনবি। আমার বউয়ের সঙ্গে প্রেম করার সাধ আমি পূরণ করে ছাড়বো!

ওদিকে কুসুমের ফোনে আসা একটা টেক্সট দেখে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। ভয় পাবে? আতঙ্কিত হবে নাকি চটজলদি পুলিশ স্টেশনে একটা কেস ঠুকে দেবে বুঝে উঠতে পারছে না সে। রেডিও জকি’রা তো ভালো চরিত্রের দারুন স্বভাবের মানুষ হয়।এমন ছ্যাছড়া,লু’চ্চা, বেশরম আর’জে কুসুম জীবনেও দেখেনি। কি বেয়াদব লোকটা! কুসুমকে ম্যাসেজ দিয়েছে,
– সন্তান না হওয়ার কারন তো জানিয়েছ!এবার সন্তান হওয়ানোর প্রসেসটা জেনে নাও। আমার দাদি, বছর ঘোরার আগে নাতনি বা নাতির চেহারা দেখতে চান। আর হ্যাঁ, স্যরি ফর দ্যাট সিনক্রিয়েট মাই কুসুম! ইয়্যু নো? হাও মাচ আই লাভ ইয়্যু!তোমাকে দেখলেই আমার তোমাকে চেপে ধরে ইয়ে করতে মন চায়। এবার তোমার মিথ্যা শুনে মাথায় রাগ চড়ে গিয়েছিল বলে কিছু করলাম না।পরের বার সামনে এলে এসব কন্ট্রোল আর রাগের ‘স্লাং’ ইউজ করলাম না। আমি চাইনা আমার ব্যাপারে তোমার ফার্স্ট ইমপ্রেশন খারাপ হোক। ওকে! এবার বাড়ি গিয়ে জেনে রাখার চেষ্টা করো স্বামীর মন ভালো করার বিশেষ কিছু টেকনিক। আ’ম ওয়েটিং। ওহ হ্যাঁ, টেকনিক গুলোয় অবশ্যই ‘আঁদর’ শব্দটা এ্যাড রাখবে। সেটা কিভাবে কি উপায়ে করবে সেটা তোমার ইচ্ছে, এটুকু ছাড় তোমাকে দেওয়া যেতেই পারে। আর তোমার বয়ফ্রেন্ড প্রাপ্ত না প্রান্ত, তাঁর হাড়গোড় জোড়া লাগবে কিনা ঠিক জানা যায়নি, তুমি চাইলে, তাকে না দেখেও দিন পার করতে পারবে। তাই ওকে দেখার ইচ্ছে মনে মনে থাকলেও তা আমার সামনে দেখানোর চেষ্টা করবে না। এর ফলাফল কঠিন ও বিশ্রি হবে তোমার জন্য। আমার চরিত্র, ইজ নট কুসুমের (ফুলের) মত পবিত্র মাই লাভ। তাই সাবধান। ভুলেও ভুল করার চেষ্টা করবে না। তাহলে বিয়ে ছাড়াই বাচ্চার মা হয়ে যাবে। অবশ্য বাচ্চার বাপের পরিচয়ে আমার নামই থাকবে। বাট বিয়ের আগে এসব ভালো নয় বুঝলে! আমার তো তোমার মত টেস্ট করার স্বভাব নেই। আমি বাসর রাতে সব হিসেব চুকানোর মত ভদ্র জামাই।
তোমার হবু স্বামী আরশান খাঁন।

চলবে?

পিশাচ পুরুষ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব

1

#পিশাচ_পুরুষ
১১তম এবং শেষ পর্ব

বর্তমান সময়। সকিনাদের পুরো গ্রামে এক ভয়ানক চঞ্চলতা সৃষ্টি হয়েছে। গত কয়েক মাসে শুধু তাদের গ্রামেরই ৩০জন নারী নিখোঁজ হয়েছে। গ্রামের কারো মনেই সন্দেহ নেই যে ঐ জঙ্গলে গিয়েই নিখোঁজ হয়েছে ওরা। দিনের আলোতে নিখোঁজ নারীদের খুঁজতে গিয়ে বন্য জন্তুর হামলার শিকার হয়ে মারা গিয়েছে আরও ২০ জনের উপর যুবক। কেউই সেই বিকট গাছটি খুঁজে পায়নি যেটার কথা নারীরা বলে বেড়ায়। যার খোঁজ শুধু নারীরা পায় এবং রাতে। যা তাদের সব ইচ্ছা পূরণ করে। যুবকদের লাশগুলো পাওয়া গেলেও নিখোঁজ নারীদের কোনো খবরই পাওয়া যাচ্ছে না। আশেপাশের গ্রাম গুলোতেও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। তাদেরও অনেক নারী নিখোঁজ হয়েছে এই কয়মাসে। সবাই উন্মাদের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছে নিখোঁজ মেয়েগুলোকে। সবখানে ওরা প্রচার করতে লাগলো আর যাতে লোভে পড়ে কেউ জঙ্গলে না যায়। এটা বুঝতে কারো অসুবিধা হলো না কোনো এক অদ্ভুত শক্তি মেয়েগুলোকে রাতের আধারে টেনে নিয়ে যায় জঙ্গলে।

সবাই তাই ঘরের নারীদের পাহারা দিতে লাগলো। জঙ্গলের কিনারে দল বেঁধে অবস্থান করতে লাগলো সন্ধ্যার পর থেকে। কোনো নারীকে জঙ্গলের দিকে আসতে দেখলেই জোর করে ধরে বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছে।

সেই যে শিকড় নিয়ে ফিরে এসেছিল সেই দিনের পর সকিনা আর একবারের জন্যও জঙ্গলে যায়নি। প্রথম কয়েকদিন অচেনা রূপবান যুবকের জন্য মনটা তার কেমন করে থাকতো। আশা করতো হয়তো হঠাৎ যুবকটা এসে তাকে দেখা দেবে। কিন্তু দিন বয়ে চলল, গ্রামের নারীরা গোপনে উদগ্রীব হয়ে উঠল নিজেদের মনোবাসনা গাছটার কাছে প্রার্থনা করে পূরণ করে নিতে। সফলও হতে লাগলো অনায়াসে। কিন্তু এরমধ্যেই নিখোঁজ নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগলো। সকিনার মনে কেমন একটা অনুশোচনা বোধ জন্মাতে লাগলো। তার জন্যইতো গ্রামের মহিলারা গাছটার কথা জানতে পারলো। যুবকটা কী কোনো অসৎ উদ্দেশ্য পূরণ করার লক্ষ্যে তাকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছে! হয়তো তার বাবা ভালো হয়ে উঠেছে, কিন্তু এর বিনিময়ে বিপদে পড়েছে পুরো গ্রাম।

তাছাড়া সেরাতে জঙ্গলের ভেতর জন্তুটা চলে যেতেই যুবকটার আবির্ভাব। যুবকের চলে যাওয়ার পরেই বিশাল সাদা জন্তুটার আগমন। সে গ্রামের মানুষের কাছে ভয়ঙ্কর একটা জন্তুর বর্ণনা শুনেছে যা তাদের পোষা প্রাণীগুলোকে হত্যা করতে রাতে এই গ্রামে প্রবেশ করতো। ওটার সাথেও তার দেখা জন্তুটার মিল রয়েছে! তবে কী ওই যুবকটাই বহুরূপী! কখনো জন্তু হয়ে যায় আবার কখনো পুরুষ! এও কী সম্ভব!

গ্রামের লোকেরাও আজকাল মনে করে তাদের সব ভোগান্তির পেছনে দায়ী সকিনা। তারা তাই তাকে তিরস্কার করতে প্রায়ই হোসেন মিয়ার বাড়িতে আসে। বিশেষ করে গ্রামের বয়স্করা। তাকে ডাইনি, প্রেত পূজারী বলে গালি দিতে থাকে। সকিনার কান্না পেয়ে যায়। সে বোঝে না, এর উত্তর কিভাবে দেয়া যায়!

অন্ধকার রাত্রি। জঙ্গলের মাঝামাঝি জায়গায়। এক মধ্যবয়স্ক নারীর ধড় কামড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে একটা সাদা বিকট জন্তু। জন্তুটার হিংস্র দৃষ্টি হতে বিচ্ছুরিত দ্যুতিতেই সে এগিয়ে গেল বিশাল আকৃতি বৃক্ষের মোটা শিকড়ের পাশের কোটরের ভেতর। বাইরে থেকে দেখে কারো আন্দাজ করবার সাধ্য নেই এর ভেতরটা কত বড় আর কত গভীর। নারীর লাশটা আরও ৯৮টি লাশের স্তুপের দিকে ছুড়ে দিল সে। দ্রুত কোটর থেকে বেরিয়ে এসেই বিকট একটা হুংকার ছাড়লো সে। এই হুংকার আনন্দের, গর্বের।

তখনই জঙ্গলের সমস্ত মাটি কম্পিত হয়ে উঠলো। আকাশ ফুঁড়ে কিছু আলো বিচ্ছুরিত হতে লাগলো জঙ্গলের এই অংশে। সেই আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বিকট প্রাণহীন পাতাহীন বৃক্ষটি কেঁপে কেঁপে উঠছে। তার বিকট ছাল খসে পড়লো শরীর থেকে। কিলবিল করতে করতে ওখান থেকে বেরিয়ে এলো অসংখ্য কোষ। অগুলো ফুঁড়ে বের হচ্ছে অসংখ্য ছোট চিকন লম্বা কালো পোকা। সেখানে থেকে বেরিয়ে এলো দুটি ছোট চোখ এবং একটি বৃহৎ আকৃতির মুখ। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। বিশাল একটা চিৎকার করলো সেটা, কম্পিত হলো পুরো জঙ্গল। এরপর তাকালো তার সামনে ঝুকে থাকা এক ক্ষুদ্র সৃষ্টি সাদা জন্তুটার দিকে। গমগম করে উঠলো ভারী কন্ঠটা। ‘তুমি দারুন খেল দেখিয়েছ পুত্র! আমি যখন সর্ব শক্তি আবার ফিরে পাবো তুমি হবে আমার সবচেয়ে ক্ষমতাবান সন্তান।’

আবার হুঙ্কার ছাড়লো ওটা। সাথে সাথেই আশেপাশে থাকা আরো কিছু মোটা, পাতা, প্রাণবিহীন বিকট গাছ কেঁপে উঠলো। ওরাও কিছু বলতে চায়।

‘তুমি ৯৯টি নারীর শরীর ওখানে জমা করেছ, আর প্রয়োজন একটা।’

এবার জন্তুটার সারা শরীর কাঁপতে লাগলো। শরীরে লোম, তীক্ষ্ণ নখ অদৃশ্য হলো। ওটা পরিণত হলো একজন সুদর্শন যুবকে। হাটুমুরে বসে পড়লো আবার। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বিকট গাছটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘প্রভু, মহান শক্তিধর! আমি সব রকম চেষ্টা করেছি। এত বিলম্ব হওয়ার জন্য ক্ষমা চাই। কিন্তু গ্রামের লোকেরা এখন বেশ সতর্ক। এখানে কাউকেই ঢুকতে দিচ্ছে না। আপনার আদেশে আমি সরাসরি তাদের বাঁধাও দিতে পারি না। এমন কী নিজের ক্ষুধাকেও বিসর্জন দিয়েছি। লোকালয়ে হামলা চালাইনি আর! কিন্তু মানুষ বড়ই লোভী! তারা কোনো না কোনো পথ বের করেই নেয় জঙ্গলে ঢুকতে। তাই আপনার উৎসর্গের জন্য নারীর কমতি পড়বে না। যদিও সময় লাগবে! কিন্তু আর একজন নারী হলেই সম্পূর্ণ হবে।’

‘হ্যা! কিন্তু আমি জঙ্গলের পথটা বন্ধ করে দিয়েছি। আর কোনো নারী জঙ্গলে প্রবেশ করলেও আমার কাছে পৌঁছাতে পারবে না। তোমারও এর শিকার করে আনতে হবে না কাউকে জন্তুর বেশে!’

‘মানে, প্রভু! বাকি একজন নারী!’

‘এখানে ৯৯টি লাশ রয়েছে! কিন্তু এদের একজনও কিশোরী নয়! শেষ নারী আমাদের একজন কিশোরী লাগবে। তুমিই তাকে নিয়ে আসবে লোকালয় থেকে।’

যুবকের মুখ একদম শুকিয়ে গেল। সে বুঝতে পারলো কার কথা বলছে। সে চুপসে সেভাবেই ঝুকে রইলো। দেখতে দেখতে ছাল আবার বিকট বৃক্ষটাকে ঢেকে ফেলল। ওটা পরিণত হলো একটি মরা গাছে। যুবক কয়েক মুহূর্ত স্থির, দ্বন্দ্বে দুলে থাকা মন নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এরপরেই ক্রোধে চিৎকার করে উঠলো। মুহূর্ত সময় নিয়ে পরিণত হলো সাদা জন্তুতে। ছুটতে লাগলো লোকালয়ে। সকিনার বাড়িতে তাকে যেতেই হবে। আদেশ লঙ্ঘণ করবে না সে এই শেষ মুহূর্তে।

গ্রামে মধ্যরাত। সকিনা চমকে ঘুম থেকে উঠলো কোনো একজনের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে।এই রাতে কে এল, ভাবল সে। দরজা খুলতেই চমকে উঠে পিছিয়ে গেল কয়েক পা। স্বপ্ন দেখছে নাকি সে! সেই যুবকটি দাঁড়িয়ে আছে যার মোহে একদিন পাগল হয়েছিল সে। পুনরায় তাকে দেখে আবার স্বীকার করতে হলো তাকে, এমন সুদর্শন পুরুষ দুনিয়াতে ২য়টি নেই। কী মায়া এই মুখে, এরচেয়ে পবিত্র আর কে হতে পারে! যুবক ইশারা করলো তাকে তার সঙ্গে যেতে। সকিনা সন্তর্পনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। একটু দূরে গিয়েই আড়াল হলো যুবক। কিশোরী সকিনা তার পাশে।

যুবক এগিয়ে গিয়ে আলতো করে সকিনার চিবুক স্পর্শ করলো। বলল, ‘আমাকে ক্ষমা করো, আমি এতদিন আসতে পারিনি। কিন্তু এখন তোমাকে আমার সাথে জঙ্গলে যেতে হবে। এক ভয়ানক খেলা শুরু করেছি আমরা দুজনে, এর শেষ আমাদেরই করতে হবে। যত জন নারী নিখোঁজ হয়েছে এই অঞ্চলে এর জন্য দায়ী ওই বিকট গাছটিই। একটি সাদা জন্তু ওটার সহায়তা করেছে। আরেকটা নারীকে ওরা আটক করতে পারলেই ওদের উদ্দেশ্য পূরণ হবে। জঙ্গলে পিশাচ শক্তি ফিরে পাবে তাদের পূর্ণ ক্ষমতা। তখন শুধু ধ্বংস আর ধ্বংস।’

‘তোমার কথার কিছুই আমি বুঝতে পারছি না!’ বিভ্রান্ত দেখাল সকিনাকে।

‘কিছুই বুঝতে হবে না, তুমি শুধু বিশ্বাস করো আমাকে। আমার সঙ্গে চলো। তুমিই পারবে এই গ্রাম সহ এই অঞ্চলের সবাইকে পিশাচের থেকে রক্ষা করতে।’

সকিনা দ্বন্দ্বে পড়ে গেল। তার কী উচিত হবে লোকটাকে আবার বিশ্বাস করা! কিন্তু এটিও সত্যি যে সে অনুভব করতে পারছে গ্রামে কোনো বড় বিপদ আসতে যাচ্ছে। তাছাড়া এই যুবকের মধ্যে এমন কিছু একটা আছে যা না করা যায় না। সে যেতে রাজি হলো। যুবক নিঃশব্দে তাকে নিয়ে গ্রামের শেষ মাথায় চলে এলো। এরপর জঙ্গল যেদিকে তার উল্টো দিকের পথ ধরে হাটতে লাগলো। সকিনা অবাক হয়ে জানতে চাইল, ‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমাকে এদিকে তো জঙ্গল নয়!’

‘এই পথ দিয়ে জঙ্গলে যাওয়া উচিত হবে না আমাদের। আমরা খালের পাড়ে যাব। ওখান থেকে নৌকা করে একটা নদীতে পড়বো, সেই নদী নিয়ে যাবে একটা বড় নদীতে, ওই নদী ঘুরে পৌঁছাব জঙ্গলে। আর কোনো প্রশ্ন করো না। আমি সবার ভালোই চাই।’

যুবক আবার চলতে লাগলো, সকিনা তার পিছু পিছু চলছে।

জঙ্গলের শেষ মাথায় গ্রামের শুরুতে এসে হাজির হলো বড় সাদা জন্তুটা। নিজের শরীরটাকে যুবকের শরীরে রূপান্তরিত করলো। কয়েকজন লোক আড়াল থেকে এই পথ পাহারা দিচ্ছিল। তাদের চোখের অলক্ষ্যে সে গ্রামে প্রবেশ করলো। সকিনা মেয়েটির প্রতি সে সামান্য মায়া অনুভব করেছিল ঠিক। কিন্তু তা এতটাও গাঢ় নয় যে এত দিনের সব পরিশ্রম বৃথা করে দেবে। মেয়েটাকে কিছু একটা বলে ভুলিয়ে জঙ্গলে নিয়ে যেতে হবে তাকে।

নিস্তব্ধ রাত। সকিনার ঘরের সামনে এসে হাজির হলো সে। অবাক হয়ে দেখল দরজা খোলা। ধীরও পায়ে ঘরের ভেতর ঢুকলো, কোথাও সকিনা নেই! এক ঘরে শুধু তার পিতা ঘুমিয়ে রয়েছে। কোথায় গেল সে এত রাতে? বাড়ির আশেপাশের সব জায়গায় খুঁজেও পেল না তাকে। তার ভেতর জন্তুর ক্ষমতা রয়েছে। সে সকিনার ব্যবহৃত একটি জামা শুকলো। এরপর ঝুকে মাটির দিকে তাকালো। এইতো পায়ের ছাপ পেয়েছে সে। ঐদিকে চলে গেছে ছাপগুলো। কিছুদূর এগোতেই অবাক হয়ে দেখল, দুজন মানুষের পায়ের ছাপ। একজন সকিনা, আরেকজন কে! ওপর পায়ের ছাপটা খুব পরিচিত মনে হচ্ছে।

পায়ের ছাপ অনুসরণ করে দ্রুত ছুটতে লাগলো সে। জন্তুর শরীরে ফিরে গেলে বিপদ হবে তাই মানুষ হয়েই ছুটছে সে। ছুটতে ছুটতে একটা খালের কিনারে এসে হাজির হলো যুবক। ঐতো কিছুটা দূরে একটা নৌকা দেখা যাচ্ছে, নৌকায় উঠছে দুজন নর-নারী। আড়াল থেকে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে যা দেখল তাতে পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে গেল সে।

সকিনার সাথে একটা যুবক নৌকা। সেই যুবক আর কেউ নয়। সে নিজেই! হ্যা, তার মতো অবিকল দেখতে একটা যুবক সকিনার সাথে নৌকায় বসে আছে। এ কী করে সম্ভব! পিশাচ পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী এই জঙ্গলে আর কে আছে যে তার পুত্রের রূপ ধরে এসে তার শিকারকেই কেড়ে নিয়ে যাবে ছলনা করে! নাকি তার উপর ভরসা নেই দেখে তার পিতা পিশাচ পুরুষ তার মতোই হুবহু আরেকটা মানুষ তৈরি করেছে! কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। নৌকার দিকে দৃষ্টি রাখলো সে।

নৌকার যুবকটা এবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সকিনাকে, সকিনা কিছু বুঝে ওঠার আগেই। জোরে চেপে ধরলো নিজের বুকের সাথে। জ্ঞান হারালো সকিনা। তাকে নৌকায় শুইয়ে দিয়ে বৈঠা হাতে তুলে নিল যুবক।

দূর থেকে যুবকটা ছুটে গেল খালের পাড়ে। নৌকায় বসে থাকা যুবকটাও বিস্মিত হয়ে পাড়ের দিকে তাকালো। সে চেচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কে তুমি? আমার রূপ ধরেছ কেন? সকিনাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছ? কে তোমার প্রভু?’

নৌকায় বসে থাকা একই চেহারার যুবক হাহা করে হেসে উঠল, বলল, ‘দেরি করে ফেলেছ বন্ধু, তোমার পিশাচ পিতাকে বলো তোমাদের ধ্বংস আবার হবে, ফিরে এসেছে জঙ্গলের মহান পবিত্র শক্তির সন্তান। বিদায়, ধ্বংসের জন্য প্রস্তুতি নাও।’ এই বলেই ছুটিয়ে দিল সে নৌকা। পাড়ে দাঁড়িয়ে ছটফট করতে লাগলো ওপর যুবক। পানিতে নামতে তার এত ভয় হচ্ছে কেন বুঝতে পারছে না। ক্রোধে আর্তনাদ করে উঠলো সে। পরিণত হলো সেই হিংস্র বিকট সাদা জন্তুতে।

দেখতে দেখতে নৌকায় বসে থাকা তার মতো যুবকটা একটা নারীতে রূপান্তরিত হলো। অপরূপ রূপবতী নারী যা দেখে জন্তুটাও বিস্মিত হয়ে গেল। এটা কী সেই ছলনা যার কারণে এত বছর ধরে অভিশপ্ত হয়ে আছে তার পিশাচ প্রভু! সে না অভিশপ্ত গাছ হয়ে গিয়েছিল! মুক্তি পেল কী করে! নিশ্চই তার প্রভু যেভাবে ধীরে ধীরে অভিশাপ থেকে মুক্ত হচ্ছিল ছলনাও একই ভাবে শতবর্ষে অভিশাপ মুক্ত হয়েছে।

নৌকা চলছে তার গতিতে। খালের কিনার দিয়ে ওটাকে অনুসরণ করে ছুটছে জন্তুটা। খাল পেরিয়ে ছোট নদীতে পড়লো নৌকা। এক মুহূর্তের জন্যও জন্তুটার চোখের আড়াল হয়নি নৌকা। নৌকাটি এবার এসে পড়লো খরতর বড় নদীটিতে। নদীটা জঙ্গলের দিকে গিয়েছে। জন্তুটা অবাক হলো নৌকার মেয়েটি সকিনাকে নিয়ে একবারও জন্তুটার আড়ালে যাওয়ার চেষ্টা করেনি। পাড় থেকে শুধু দূরত্ব রেখে চলছে নৌকাটা যেন জন্তুটা লাফিয়ে ওটার উপর উঠতে না পারে। সকিনার জ্ঞান এখনো ফেরেনি। বৈঠা হাতের মেয়েটা আড়চোখে মাঝেমধ্যে জন্তুটার দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপ ভরা মুচকি হাসি হাসছে যা জন্তুটার ক্রোধ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।

হঠাৎ করে জন্তুটা খেয়াল করলো সামনে নদীর আরেকটা বাক। যার ফলে সে নৌকাটাকে আর অনুসরণ করতে পারবে না। নৌকাটার সমানে আসতে হলে তাকে ঘুরে অন্য পথ দিয়ে বাকটা পাড় হতে হবে। পানিতে নামা অসম্ভব! তবে এতে নৌকাটা চোখের আড়াল হয়ে যাবে কিছুক্ষণের জন্য। সে সর্বশক্তি দিয়ে ডান দিকে নদীর বাক বরাবর পুরোটা ছুটে, বাক শেষের কিনার বরাবর সোজা ছুটে আবার বামে ঘুরে বাক বরাবর ছুটতে ছুটতে নদীর কিনারায় পৌঁছাল। হতাশ হয়ে চারদিকে চাইল। কোথায় গেল নৌকাটা! সে ছুটতে লাগলো সামনের দিকে বিরাম হীন ভাবে। ওটা লুকিয়ে থাকলে ওটাকে খোঁজা তার সাধ্যের বাইরে।

সকিনাকে নিয়ে ওটা কী করবে! তার পিশাচ প্রভুই কেন বা সকিনাকে শেষ নারী হিসেবে বিসর্জন দেয়ার জন্য তাকে চাপ দিল! বিরক্ত হচ্ছে সে। কিন্তু আর কিছুদূর গিয়েই প্রাণ ফিরে পেল যেন, ঐতো নৌকাটা দেখা যাচ্ছে। ছুটতে ছুটতে ওখানে গিয়ে হাজির হলো সে। নৌকায় পড়ে আছে সকিনা। ওই মেয়েটা নেই। কোথায় গেল সকিনাকে ফেলে সে! ধীরে ধীরে সে মানুষ রূপে ফিরে এলো। নৌকায় পৌঁছাতে হলে পানি দিয়ে সাঁতরে যেতে হবে ওকে। কিন্তু পানিতে নামবে না সে। সে ডাক দিতে লাগলো সকিনাকে। কয়েকবার ডাকতেই জ্ঞান ফিরে এলো মেয়েটার। তন্দ্রা মতো দৃষ্টিতে যুবকের দিকে তাকালো। বলল, ‘আমি কী ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম? আমার সারা শরীর ব্যথা করছে কেন! আমি নড়তে পারছি না! কোথায় নিয়ে এলে আমায়! পাড়ে নামাও!’

যুবক ব্যাকুল হয়ে উঠলো! বুঝল নৌকায় ওঠার পর থেকে আর কিছু মনে নেই সকিনার। কী একটা বিপদের গন্ধ নাকে আসছে। সে সকিনাকে বলল, ‘তুমি বৈঠা টা একটু ঐদিকে ঠেল! পাড়ে চলে আসবে নৌকা!’ সকিনা উঠতে গিয়ে গুঙিয়ে উঠল, অনেক কষ্টে বৈঠার নাগাল পেল। ওটা ঠেলতেই একদম পাড় ঘেষে চলে এলো নৌকা। যুবক লাফ দিয়ে নৌকায় উঠে বসলো। সকিনাকে ধরে উঠাতে গেল। সকিনার মুখটা একমুহূর্তে শক্ত হয়ে গেল। চোখে-মুখে অমানুষিক ক্রোধ। শক্ত করে যুবকের হাত চেপে ধরে তার সাথে নৌকায় বসিয়ে ফেলল।

যুবক ভড়কে গেল। কিছু বোঝার আগেই সকিনা নৌকাটার বৈঠা জোরে ধাক্কা দিল। এক ধাক্কাতেই নৌকাটা পাড় হতে অনেকটা দূরে নদীর পানিতে চলে এলো। চারদিকে পানি দেখে বুকটা কেঁপে উঠলো যুবকের। বুঝলো শরীরে এক ফোটাও শক্তি নেই তার। সকিনা এখনো শক্ত করে তার হাত ধরে আছে। এত শক্তি মেয়েটার হাতে! সকিনা তার চোখে চোখ রেখে বলল, ‘আমি সকিনা নই! ঐ যে সকিনা!’ যুবক আঙ্গুল লক্ষ করে একটা গাছের দিকে তাকালো, ঐতো নদীর পাড়েরই একটা ঝোপের আড়ালে অচেতন হয়ে পড়ে আছে সকিনা। তাহলে এ কে!

মুহূর্তেই সকিনার কিশোরী শরীর বদলে এক প্রাপ্ত বয়স্ক যুবতীর শরীরে রূপান্তরিত হলো। চেহারাও বদলে গেল। এই সেই মেয়ে যে সকিনাকে তার রূপ ধরে নৌকায় তুলে এখানে নিয়ে এসেছে। মেয়েটা বলল, ‘আমি ছলনা। মহান পবিত্র শক্তির শিষ্য। সকিনা মেয়েটা একটা ছল মাত্র। আমার উদ্দেশ্য ছিল তোমাকে এখানে নিয়ে আসা। তুমি সেই হিংস্র পিশাচের পুত্র। তুমি ৯৯জন নিরীহ নারী সহ অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী। পিশাচটা চতুরতা করেই তোমাকে জন্তু এবং মানুষের মিশ্রনে তৈরি করেছে। কেননা এই দুই শ্রেণীকে সরাসরি মহান পবিত্র শক্তি অভিশাপ দিতে পারে না। এই জগতে তুমি সৃষ্টি করেছ মহা বিশৃঙ্খলা। তাও তাই তোমাকে কিছু করা হয়নি। যদিও সবটাই করেছ পিশাচটার আদেশে! কিন্তু ওটা সরাসরি কিছু করেনি বলে ওটাকে অভিশাপ দেয়া যায় না। শুধু এই কিশোরী মেয়েটাকে যদি তুমি কোটরে ঢুকাও তবেই পিশাচ ফিরে পাবে আবার সব শক্তি।

এটা আমি কী করে হতে দেই! মহান শক্তি আমাকে এই কারণে অভিশাপ মুক্ত করেছে। না, সকিনা কোনো বিশেষ নারী নয়! তার বদলে যে কাউকে কোটরে আটকালেও সে শক্তিই পেত। কিন্তু সে তোমার আনুগত্য পরীক্ষা করতে সকিনাকেই শেষ নারী হিসেবে ঠিক করলো। আর এতেই তোমাকে ফাঁদে ফেলতে আমার সুবিধা হলো।

তুমি তার পুত্র। তুমি যদি এখন মারা যাও তবেই সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। ৯৯টি খুনের অভিযোগ যাবে সেই পিশাচ বৃক্ষের এবং তার বৃক্ষ সন্তানদের উপর। মহান পবিত্র শক্তির অভিশাপে ধ্বংস হয়ে যাবে সমস্ত পিশাচ শক্তি। হয়তো অনন্তকালের জন্য নয়, তবে দীর্ঘ একটা সময়ের জন্য। হ্যা আমিও আবার অভিশপ্ত হবো তোমাকে হত্যার অভিযোগে!’

চিৎকার করে উঠলো যুবক। তার চেহারা বদলাতে লাগলো জন্তুর মতো। কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেল। মেয়েটি লাফিয়ে নেমে শক্ত করে চেপে ধরলো নৌকার কিনার। একমুহূর্তে উল্টে গেল নৌকা। যুবকের মনে হলো তার পুরো শরীরে আগুন ধরে গেছে। নৌকা সহ দুজনেই তলিয়ে গেল পানিতে। ওখানকার পানি ঘুরতে লাগলো চক্রাকারে। সৃষ্ট হলো মহা গহ্বর।

জঙ্গল থেকে একই সময়ে ভেসে এলো মহা হুঙ্কার। আর্তনাদ করে কেঁদে উঠলো পুরো জঙ্গল যেন। নদীর মধ্যে সৃষ্ট গহ্বর থেকেও বেরিয়ে এলো আর্তনাদ। ভূমিকম্পে কেঁপে উঠলো চারপাশ। সকিনার জ্ঞান ফিরলো। এমন অদ্ভুত হুংকার, ঝড়ের বেগ, ঢেউয়ের গর্জন শুনে চমকে উঠলো সে। ভয়ে ছুটতে লাগলো অন্ধের মতো।

আকাশ ফেটে পড়তে লাগলো বজ্রপাত। বিশাল আকৃতির পাতা আর প্রাণবিহীন বৃক্ষে আঘাত করে ওটাকে করে ফেলল টুকরো টুকরো। তার আশেপাশের এরূপ ৬টি গাছ বজ্রপাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে আগুন ধরে গেল। বড় গাছটার বিশাল অগ্নিকুণ্ডে পুড়ে ছাই হয়ে গেল কোটরে থাকা ৯৯টি নারীর লাশ। যতক্ষণ না বৃষ্টি এলো পুড়তে থাকলো জঙ্গল।

ছুটতে ছুটতে গ্রামের ভেতর আসতে পারলো শুধু সকিনা। কিন্তু জঙ্গলে যে ভয়াবহ কাণ্ড ঘটে গেল তার কতটাই তার মাথায় রইলো, কতটাই বা যার ভবিষ্যত প্রজন্ম জানতে পারবে!

• * * * * সমাপ্ত * * * * *

লেখা: #Masud_Rana

পিশাচ পুরুষ পর্ব-১০

0

#পিশাচ_পুরুষ
১০ম পর্ব

পিশাচ পূজারী গোষ্ঠীর প্রধান আমন হঠাৎ তার কুঠিরে উপস্থিত হওয়া অপরূপ রূপবতী নারীর প্রতি এতটাই আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল কয়েক মুহূর্তে যে, তার এখন কোনো হিতাহিত জ্ঞান নেই। সে যে কী ভয়ানক একটা কাজ করতে যাচ্ছে তা সে নিজেও জানে না। সে হারিকেনের আলোতে অনেকক্ষণ পথ চলে হাজির হলো তাদের উপাসনের জায়গায়। ঐতো ৭টি মূর্তি রয়েছে ওখানে। আশেপাশে আবার ভালো করে তাকিয়ে দেখল কেউ নেই। এই প্রথম তার পুরো শরীর কেঁপে উঠল। অনুধাবন করতে পারছে অজানা এক শক্তির ক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্য কত বড় ঝুঁকি নিতে যাচ্ছে সে।

যে পিশাচ দেবতারা এতদিন তাদের উপকার করেছে, ক্ষমতা দান করেছে। তাদেরই একজনকে বিসর্জন দিতে যাচ্ছে সে। এমন ক্ষমতাবান পিশাচের সন্তানকে বিসর্জন দেয়ায় তাদের উপর কিরূপ শাস্তি, অভিশাপ নেমে আসতে পারে ভেবেই শরীরের রক্ত বরফ হয়ে যাচ্ছে। পা এগোতে অনিহা করছে। একবার নিজের গলার মালাটার দিকে তাকালো যেটা মেয়েটা পরিয়ে দিয়েছিল। মন শক্ত হলো তার। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল মূর্তিগুলোর কাছে। সবচেয়ে ছোট মুর্তিটাও প্রায় তার অর্ধেক সমান। সে জানে এটা কত ওজন! তবুও ভয়ে ভয়ে ওটাকে জড়িয়ে ধরে উঁচু করতে গেল সে। আশ্চর্য্যজনক ভাবে ওটাকে তার কাছে একটা শেয়ালের বাচ্চার মতো ওজন মনে হচ্ছে। কোনো বেগই পেতে হলো না উঁচু করতে। হারিকেন ফেলে দিয়ে দুই হাতে জড়িয়ে ধরলো মূর্তিটা। চারিদিকে নিঃসঙ্গ আধার।

হঠাৎই আলো বিচ্ছুরিত হতে লাগলো তার গলার মালা থেকে। পথ চলার জন্য তাই যথেষ্ট। সে ছুটতে ছুটতে চলে এলো নদীর পাড়ে। গোষ্ঠীর সবাই এখনো ঘুমিয়ে। নদীর কাছে আসতেই হৃদকম্পন আবার বেড়ে গেল তার। দ্বন্দ্বে ভুগছে কাজটা সে করবে কিনা! এমন সময়েই পেছন থেকে তার স্ত্রীর কণ্ঠ ভেসে এলো, ‘করছেন কী আই? থামুন!’ অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় ছুটতে অসুবিধা হচ্ছে তার। তবুও দ্রুতই আমনের কাছে চলে এলো। ‘ওটা, যেখান থেকে এনেছিলেন ওখানে রেখে আসুন। কী ভয়ানক বিপদ ডেকে আনছেন আপনি!’

‘তুমি কিছুই জানো না, বোকা মেয়ে! এই পিশাচগুলোর সাহায্যের কোনো প্রয়োজন নেই এখন আমাদের। এরচেয়ে মহাশক্তির খোঁজ পেয়ে গিয়েছি আমি। সেই শক্তিই আমাদের রক্ষা করবে।’ খেঁকিয়ে উঠে আমিন।

‘তুমি ছলনার কবলে পড়েছ। তুমি নিশ্চই সেই মেয়েটার কথায় এসব কাজ করছো! সে নিশ্চই ছলনা, কোনো নারীর রূপ ধরে আমাদের পথভ্রষ্ট করছে। সবাই আমরা বিপদে পড়বো!’

তাদের চেঁচামেচি এর সাথে হঠাৎ ঝড় হাওয়া বইতে লাগলো। আকাশে মেঘ ডাকছে। বৃষ্টির মৌসুম এটা নয়। গোষ্ঠীর লোকেরা ধীরে ধীরে বের হয়ে আসতে লাগলো কুঠির থেকে। নদীর ধারের কথাবার্তা কানে গেল। হারিকেন হাতে সকলে ছুটে গেল সেদিকে। গোষ্ঠী প্রধান কী করতে চলেছে বুঝতে পেরে আর্তনাদ করে উঠলো ওরা। বারবার অনুনয় করতে লাগলো মুর্তিটাকে পানিতে না ফেলতে।

আমনের শরীরে তখন অদ্ভুত এক অনুভূতি। একবার নিজের কুটিরের দিকে তাকালো। তার অদৃশ্য চোখ বলছে অপরূপ রূপবতী মেয়েটি তার অপেক্ষা করছে। মুর্তিটাকে বিসর্জন দিলেই ওর সঙ্গে তার মিলন ঘটবে। এই অঞ্চলের সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষ হবে সে। ধীরে ধীরে নদীর পানির দুই হাত কাছে চলে এসেছে সে। গোষ্ঠীর লোকেরা তাকে বাধা দিতে ছুটে আসছে। এক মুহূর্তে ঘুরে তাকালো নদীর দিকে। আর কোনো ভাবনা নয়! ছুড়ে ফেলল মুর্তিটাকে পানির মাঝে। এক মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল সবাই। শ্বাস নিতে ভুলে গেছে মানুষগুলো। সবাই একসাথে আর্তনাদ করে উঠলো, ‘হায়! হায়! আই! আই!’

মেঘের গর্জন আর বাতাস থেমে গেছে। নদীর যেখানটায় মূর্তিটা পড়েছে জায়গাটার পানি অস্বাভাবিক ভাবে নড়ছে। আমনকে কী একটা শক্তি টেনে নিতে চাচ্ছে। আমনের হুস হলো। সে গলার মালাটা একটানে ছিড়ে পানিতে ফেলে দিল।। তারপর দৌড়ে উঠে এলো তীরে। বিস্মিত হয়ে দেখছে নদীর কিনারের সেই জায়গাটার পানি চক্রাকারে ঘুরছে। ঘুরতে ঘুরতে ঐখানের পানি গুলো সরে গিয়ে সৃষ্টি হলো বিশাল এক গহ্বর।

আকাশ থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে আলো। এরমধ্যেই জঙ্গলের ভেতর থেকে ভেসে এলো ভয়ানক এক হুঙ্কার। পিশাচ গুলো জেগে উঠেছে নাকি! আবার ভেসে এলো হুংকার। নদীতে সৃষ্টি হওয়া গহ্বর থেকেও যেন প্রতিউত্তর হিসেবে বেরিয়ে এলো অদ্ভুত হুংকার! হচ্ছেটা কী! ভয়ানক ঝড় শুরু হয়ে গেল। ক্রোধে যেন ফুঁসছে প্রকৃতি।

সবাই ছুটে পালাতে লাগলো যার যার কুটিরের দিকে। আমনও তার স্ত্রীকে নিয়ে ছুটতে ছুটতে নিজের কুটিরে গিয়ে হাজির হলো। কুটিরের ভেতর ঢুকে দেখল সেই মেয়েটি নেই! কিন্তু একি! ঘরের ভেতর গুজো হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি মোটা খাটো মৃত গাছ! তার কুটিরে এই গাছ কোথা থেকে এলো! হারিকেনের ঝাপসা আলোয় আমন আর তার স্ত্রী দুজনেই বিস্মিত হয়ে গাছটার দিকে তাকিয়ে রইলো। হঠাৎ খেয়াল করলো গাছটার ছালের একটা অংশ কাঁপছে। সেখান থেকে ফুটো হয়ে বেরিয়ে এলো দুটি চোখ, তার একটু নিচেই বেরিয়ে এলো একটি বিকট মুখ। ভয়ে চিৎকার করে জ্ঞান হারালো আমনের স্ত্রী।

আমন ভয়ে মাটিতে বসে পড়লো। গাছের মুখ থেকে একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর বেরিয়ে এলো, ‘আমন! তুমি একজন খারাপ মানুষ! তবে আজ তুমি যে কাজ করেছ তার জন্য কখনো অনুতপ্ত হয়ো না। তুমি পুরো অঞ্চলকে রক্ষা করেছ ওই পিশাচটিকে বিসর্জন করে। তোমাদের উৎসর্গে পিশাচ গুলোর শক্তি ক্রমে ক্রমে বেড়ে যাচ্ছিল। আর কিছুদিন তোমরা এই পিশাচগুলোকে নতুন নতুন মানুষের রক্ত উৎসর্গ করে উপাসনা করতে থাকলে তারা তাদের হারানো সব শক্তি ফিরে পেত যা কিনা জঙ্গলের মহান শক্তি তাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল। ক্ষমতা পেয়ে গেলে সব অঞ্চলেই নিজেদের ক্ষমতা আর শক্তি বিস্তার করবে তারা। সবখানে ছড়িয়ে দিত হিংস্রা, ক্রোধ আর রক্তারক্তি খেলা। আমি ছলনা। কোনো নারী কিংবা পুরুষ নই আমি, নেই কোনো নির্দিষ্ট আকৃতি। মহান শক্তি আমাকে তৈরি করেছে আমি যেকোনো রূপ ধরে যাতে মানুষকে পথভ্রষ্ট করতে পারি ধোকা আর মিথ্যে দিয়ে।

দীর্ঘদিন আমি এই জঙ্গলে, নদীতে কত মানুষকে ভুল পথ দেখিয়ে এই অঞ্চলে আসা থেকে আটকেছি। ওই মূর্তি গুলো থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছি। শুধু ব্যার্থ হয়েছি তোমাদের গোষ্ঠীর লোকদের আটকাতে গিয়ে। তোমরা ওই পিশাচের শক্তি অনেক বাড়িয়ে দিয়েছ এতদিন পুজো করে। অনেক চেষ্টা করে ‘আমন’ তোমার সাথে আমি ছল করতে পেরেছি। না! তুমি মহান শক্তির ক্ষমতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করো না! কিন্তু তোমরা যা শুরু করেছ তা তোমাদেরই শেষ করতে হবে। ৭টি পিশাচের একটিকে বিসর্জন দিয়ে তুমি এবং তোমার গোষ্ঠীর লোকেরা ওদের ক্রোধের মুখে পড়লে। কারণ ওদের যেটা তুমি ফেললে নদীতে ওটা পিশাচ শক্তিরই সন্তান।

এখন ওই পিশাচ শক্তি ক্রোধে তোমাকে , তোমার স্ত্রীর গর্ভে থাকা সন্তান, স্ত্রী সহ গোষ্ঠীর সবাইকে পৈশাচিক শক্তির বলে ধ্বংস করবে, অভিশপ্ত করবে। আর সৃষ্টি হবে মহা বিশৃঙ্খলা। তখনই আবির্ভাব হবে আমার প্রভু, জঙ্গলের মহান পবিত্র শক্তির। সে তখন পুনরায় অভিশপ্ত করে দেবে ওই পিশাচ গুলোকে। আমি তোমাকে এই কাজ করতে আদেশ করেছি তাই আমিও অভিশাপের কবলে পড়েছি। এখন থেকে আমৃত্যু পর্যন্ত একটা গাছ হয়েই থাকতে হবে আমাকে। তোমাদেরকেও!’

এতটুকু কথা বলেই ওটার চোখ-মুখ আবার অদৃশ্য হয়ে গেল। চারদিকে ভয়ানক ভূমিকম্প হচ্ছে অনুভব করছে আমন। তার সাথে সমানে ঝড় বয়ে চলেছে, নদীর দিক থেকে আসছে তীব্র ঢেউ আর পানির শব্দ। জঙ্গলের ভেতর থেকে আসছে ভয়ানক রক্ত হীম করা হুংকার। আর গোষ্ঠীর লোকেদের আর্তনাদ আর গোঙানি শোনাতো যাচ্ছেই। কী ভয়ানক পরিণতি হতে চলেছে তাদের বুঝতে বাকি রইলো না আমনের। তার স্ত্রী এখনো অচেতন হয়ে পড়ে রয়েছে মেঝেতে। হঠাৎ কেঁপে উঠল সে। তার পেট ভয়ানক ভাবে কাঁপছে। জ্ঞান ফিরছে তার স্ত্রীর! ওকি! মেয়েটার পেট ছিদ্র করে বেরিয়ে এলো। কয়েকটি শিকড়! চিৎকার করে পিছিয়ে গেল আমন!

দেখতে দেখতে তার স্ত্রীর শরীরের সমস্ত চামড়া কালো হয়ে গেল,মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো ডাল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ঘরের চাল ফুটো করে একটা মোটা গাছে রূপান্তরিত হলো মেয়েটা। তারপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে আরেকটা ছোট গাছ। আমন অনুভব করলো তার শরীর গুলিয়ে উঠছে। তার পেটের ভেতর, গলায়, শরীরে, রক্তে, শিরায় শিরায় যেন ছুটে বেড়াচ্ছে হাজার হাজার পোকা! ভয়ানক ব্যথায় গুঙিয়ে উঠছে সে। ফুলে যাচ্ছে তার শরীর। জ্ঞান,দৃষ্টি শক্তি, বাক শক্তি হারালো সে। লম্বা,মোটা প্রাণহীন একটা গাছে পরিণত হলো সে।

পিশাচের অভিশাপে গোষ্ঠীর বাকি লোকেদের অনেকেই তৎক্ষণাৎ গাছে পরিণত হয়, কেউ কেউ ভয়ানক অসুখে আক্রান্ত হয়। শরীরের ভেতর বড় হতে থাকে তাদের মাংস খেকো পোকা। যা শরীরের ভেতর থেকে সব অঙ্গ-প্রতঙ্গ খেতে খেতে বাইরে বেরিয়ে আসে। মারা যায় তারা। বাকিরা নদী থেকে উঠে আসা ভয়ানক স্রোতের টানে ভেসে যায়। তাদের মধ্যে কয়েকজন হয়তো বেঁচে ছিল। দূর গ্রামে ভাসিয়ে নিয়ে যায় নদীর স্রোত।

এভাবেই ধ্বংস হয় পিশাচ পূজারী গোষ্ঠী। সরাসরি নিজেদের শক্তি, ক্রোধ মানুষের উপর ব্যবহার করায় পিশাচ হারায় তার ক্ষমতা। জঙ্গলের মহাশক্তি তখন অভিশাপ দিয়ে পিশাচ এবং তার ৬ পুত্রকে জঙ্গলের গভীর এক স্থানে এনে বৃক্ষে রূপান্তর করে। এরপর কেটে যায় শ’য়ের কাছাকাছি বছর। পিশাচ গুলো ধীরে ধীরে আবার ক্ষমতা ফিরে পেতে থাকে। জন্ম দেয় এক পিশাচ পুরুষ। যে কিনা সকিনাকে বোকা বানিয়ে পুরো গ্রামের সবাইকে ফাঁদে ফেলে এবং পিশাচ শক্তিকে মুক্ত করতে বিকট বৃক্ষের কোটরে জমা করে বেড়াচ্ছে শ’খানেক মৃত নারীর লাশ!……
………………………………………….
.
.
. . . . চলবে . . . .
.
.
লেখা: #Masud_Rana

পিশাচ পুরুষ পর্ব-০৯

0

#পিশাচ_পুরুষ
৯ম পর্ব

পিশাচ পূজারী গোষ্ঠীর প্রধান আমনের মনে তখন জন্ম নিয়েছে আরো বড় কোনো ক্ষমতার লোভ। তার নতুন স্ত্রীর সাথে প্রায়ই আলোচনা করে তারা যেসব পিশাচদের পুজো করে ওগুলো কোনোটাই সর্ব শক্তিমান নয়। তার স্ত্রীও তাকে সমর্থন করে এবং বলে জঙ্গল অনুসন্ধান করলেই হয়তো এরচেয়ে শক্তিশালী কোনো শক্তির খোঁজ পাওয়া যাবে। যা তাদের পুরো অঞ্চলের সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষ করে দেবে। জঙ্গলে গোপনে অনুসন্ধান চালিয়ে যায় আমন এমন কোনো শক্তির তার বিশ্বস্ত অনুগত কিছু লোক নিয়ে। দীর্ঘদিন এভাবে কাটতে থাকে। কোনো নতুন অলৌকিক কিছুর সন্ধানই পায় না সে। প্রতি মাসেই অবশ্য তিনটি করে নরবলি দিতে হয় তাদের পিশাচ মূর্তিগুলোকে উৎসর্গ করে। তবে আশেপাশের সব গ্রামের মানুষেরাই এখন অনেক সতর্ক। তবুও পিশাচ হতে প্রাপ্ত অলৌকিক সম্মোহন শক্তির প্রভাবে শিকার জোগাড় করতে তেমন বেগ পেতে হয় না ওদের।

তাদের গ্রামের পাশে যে নদী রয়েছে তা ভয়ানক খরতর। তাই নদীর ওপারে তারা তেমন একটা যায় না, আর ওপার থেকে কারো আসার প্রশ্নই উঠে না। গোষ্ঠীর কয়েকজন নারী নদীর পাড়ের দিকে বসে কিছু কাজ করছিল। এমন সময় অবাক হয়ে দেখল একটা ছোট নৌকা এসে ভিড় করলো নদীর পাড়ে। এই খরস্রোতা নদীতে এত ছোট নৌকা দিয়ে কে এল! নৌকায় কোনো মাঝি নেই। অপরূপ রূপবতী একজন নারী নেমে এলো নৌকা থেকে। পরনে চমৎকার শাড়ি কাপড়, গা ভর্তি স্বর্ণালংকার। ধীরে ধীরে মহিলাগুলোর দিকে এগিয়ে এলো সে। এই অপরিচিত রমণী তাদের ভাষাও জানেন।

রূপবতী রমণী তাদের অনুরোধ করলেন এখানকার গোষ্ঠী প্রধান আমনের কাছে তাকে নিয়ে যেতে। তারা কোনো উত্তর দিতে পারলেন না মুখ দিয়ে। রমণীকে নিয়ে আমনের কুঠিরের সামনে হাজির হলেন। আমনের স্ত্রী সন্তান সম্ভবা, তাই সে বর্তমানে ভিন্ন কুঠিরে রয়েছে। মেয়েগুলোর ডাকে আমন বেশ বিরক্ত হয়েই বাইরে বেরিয়ে এল। ভেতরে কারো সঙ্গ উপভোগ করছিল সে তা তার ভূষা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু বাইরে বেরিয়ে এক মুহূর্তের জন্য তার মুখায়ব বদলে গেল। সে যেন মুগ্ধতায় স্তব্ধ হয়ে এলো। রূপবতী মেয়েটার থেকে চোখ ফেরাতেই পারছে না। মেয়েটাই প্রথমে মুখ খুলল, ‘ আমার সম্মান জানবেন আমন। আমি ভেতরে আসতে পারি!’

আমন চোখ ইশারা করতেই গোষ্ঠীর মেয়েগুলো চলে গেল। একবার নিজের কুঠিরে উকি দিল, ওখান থেকে ছুটে বেরিয়ে এলো আরো দুজন মেয়ে। গায়ের পোশাক দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওরা কারা। একটু যেন লজ্জা পেল আমন। এরপর আমন্ত্রণ করলো সে, ‘আসো ভেতরে।’

মেয়েটা ধীরে ধীরে ঘরে প্রবেশ করলো। একটা আসন দেখতে পেয়ে উপবেশন করল। আমনের চোখ ঘুরে বেড়াচ্ছে মেয়েটার পুরো শরীরে। এরপর কিছুটা কাছে ঘেঁষে প্রশ্ন করলো, ‘কে তুমি?’

মেয়েটা লাজুক কণ্ঠে উত্তর দিল, ‘আমি শুনেছি আপনি নাকি এক মহান শক্তির অনুসন্ধান করছেন! আমি তারই দূত।’

চমকে উঠল আমন। এক মুহূর্তেই মোহ আর ঘোর কেটে গেল। এতক্ষণ থেকে মনে জমা কামনাও উবে গেল। মেয়েটা এটা জানলো কী করে! তার কন্ঠ কিছুটা কঠোর শুনালো, ‘তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না আমি!’

‘আমি এই জঙ্গলের মহান শক্তির আদেশে এখানে এসেছি। তিনি অন্তর্যামী। আপনার অনুসন্ধানের খবর তিনি রাখে। আপনার মত একজন স্বপ্নবাজ গোষ্ঠী প্রধানের প্রভু হওয়ার একমাত্র যোগ্য তিনি।’

আমন একটু বাইরে বেরিয়ে এদিক সেদিক খুঁজে দেখল কেউ আছে নাকি। সে যে তাদের এই পিশাচ দেবতাগুলোর পূজা আর করতে চায় না এই খবর কেউ জানলে বিপদ ঘটে যাবে। ঘরে আবার প্রবেশ করে সে মেয়েটাকে বলে, ‘তুমি আসলে কী চাও!’

‘আপনারা এক অশুভ শক্তির আরাধনা করছেন। যা কিনা জঙ্গলের প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে। যা কিনা আপনাদের হাতকে করে রক্তাক্ত। সামান্য শক্তি আর ক্ষমতার লোভে আপনারা নিজেরাও পিশাচে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছেন। ভবিষ্যতে আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে ভয়ানক বিপদ। দীর্ঘদিন আগে এই জঙ্গলের প্রাচীন পবিত্র শক্তি হত্যা করেছিল আশেপাশের সমস্ত অশুভ শক্তিকে। বন্ধি করে রেখেছিল মূর্তির ভেতরে। আপনারা তা আবার পুনরায় জাগ্রত করেছেন। আপনাদেরই আবার তাই এই পিশাচ শক্তিকে ধ্বংস করতে হবে। পুনরায় প্রাচীন পবিত্র শক্তির রাজত্ব চলবে এখানে।’

আমন বেশ বিরক্ত হলো এসব আজগুবি তত্ত্ব কথা শুনে। ‘ আমার তো মনে হয় না তোমার মতলব এত সাদা-সিধে। আমাদের কী লাভ হবে তোমার পবিত্র শক্তিকে পুজো করে, এই পিশাচ শক্তিকে ধ্বংস করে! আর তোমার পবিত্র শক্তি কেমন ক্ষমতাবান যে এই অশুভ শক্তিকে ধ্বংস করতে আমাদের সাহায্য লাগবে! সে আগে একবার পারলে এখন নিজেই কেন করছে না?’

‘শক্তির উৎস মানুষের ভক্তি। শক্তি আর শক্তির দ্বন্দ ভয়ানক বিপদ জনক। তাই মানুষ যেটা খুব সহজে করে তা পবিত্র শক্তির করতে বিশাল আয়োজন প্রয়োজন। যাই হোক এটা আপনার বিষয়। আমি শুধু তার দাসী, দূত। আমি এখন চলে যাব।’

‘তুমি কিভাবে এসেছ?’

‘নৌকায়।’

‘আশ্চর্য্য! এই নদীতে নৌকা! তুমি অপেক্ষা করো এখানে। তোমার যাওয়া হচ্ছে না কোথাও। তোমার পবিত্র শক্তির ক্ষমতা পরীক্ষা করবো আমি।’

এই বলেই আমন কুঠির থেকে বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরেই গোষ্ঠীর কয়েকজন লোক এসে মেয়েটিকে জানালো তার নৌকা নদীর ঢেউয়ের ধাক্কায় ভেঙে গিয়েছে। আমন তাকে এখানেই রাতে থাকতে বলেছেন। মেয়েটার বুঝতে বাকি রইলো না লোকটা তার যাওয়ার পথ রোধ করার চেষ্টা করছে। আশ্চর্য্য বোকাতো!

সেরাতে অপরিচিত এই রমণীকে থাকতে হলো গোষ্ঠীপ্রধান আমনের কুটিরে। গোষ্ঠীর সকলে কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল মেয়েটিকে নিয়ে। আমন তাদের কোনো কৌতূহলতা দূর করলো না এবং মেয়েটির সঙ্গে কাউকে দেখাও করতে দিল না। আমনের স্ত্রী রেগে প্রতিবাদ করতে এলো মেয়েটাকে আটকে রাখাতে। আমন হুমকি দিল সে বাড়াবাড়ি করলে আগের স্ত্রীর মতো তাকেও বিসর্জন দিতে সময় লাগবে না তার। রাতে এসে হাজির হলো আমন তার কুটিরে। জানালো সে যদি আমনকে বিয়ে করে তবেই সে পিশাচ দেবতাদের পুজো করা বন্ধ করবে, আর তার প্রভুর বলা কথা মতো কাজ করবে।

মেয়েটার চেহারায় ভয় বা শঙ্কার কোনো চিহ্নও ছিল না। শুধু সে স্পষ্ট ভাবে জানালো, সে প্রভুর শিষ্য পারিবারিক বন্ধনে জড়ানোর অনুমতি তার নেই। আমন পৈশাচিক হাসি হাসল। বলল, তার জন্য দুটো রাস্তা খোলা রয়েছে। একটা রাস্তাও অবশ্য তাকে মুক্তি দেবে না। হয় আমনকে বিয়ে করবে সে, নয়তো আগামী বিসর্জনে তার রক্ত উৎসর্গ করা হবে পিশাচ গুলোকে। এই প্রথম আমন মেয়েটার চোখে ভয় দেখল। মেয়েটা জানালো, এমন কিছু ঘটলে ভয়ানক বিপদ নেমে আসবে এই গোষ্ঠীর ভেতর। পবিত্র শক্তি মুখ ফিরিয়ে নেবে তাদের উপর থেকে।

আমনের চোখে মুখে কোনো ভয় নেই। শুধুই মেয়েটাকে পাওয়ার কামনা। তবে কোনো এক অজানা কারণে জোর করে মেয়েটাকে ভোগ করতে চাইছে না সে। চাইছে মেয়েটাই যাতে তাকে স্বাগত জানায়। অতিরিক্ত ক্ষমতা আর শক্তির লোভ, পিশাচ পুজো বন্ধ এসবের চিন্তা মাথা থেকে অনেকটাই উবে গেছে। মেয়েটা দীর্ঘক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। এরপর এগিয়ে এলো ধীরে ধীরে আমনের দিকে। চেহারায় অনেকটাই পরিবর্তন ঘটেছে। হালকা হারিকেনের আলোতে ঘরের পরিবেশ রহস্যময় হয়ে আছে। মেয়েটার শরীর থেকে রূপ যেন ঠিকরে বের হচ্ছে। নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে আমন। মেয়েটা একদম কাছে চলে এলো তার, বলল, ‘আমাকে ভালোবাসো তুমি?’

আমনের এমন লাজুক রূপ দেখলে গোষ্ঠীর যে কেউ জ্ঞান হারাবে। সে ভয়ে ভয়েই যেন বলল, ‘হ্যা’।

‘তবে পরীক্ষা দাও! তোমরা যে পিশাচ কে পুজো করো ওখানে ৭টি মূর্তি রয়েছে। একটি বড় এবং ৬টি ছোটো। তুমি যেটা জানো না বড় পিশাচটা পিতা আর বাকি গুলো তার সন্তান। তোমরা তাদের জন্যই এই রক্ত উৎসর্গ করো। পারলে লুকিয়ে গিয়ে ওখান থেকে একটা মূর্তি তুলে নিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দাও!’

আমন আৎকে উঠে পিছিয়ে গেল, ‘অসম্ভব! ওটার শক্তি সম্পর্কে দেখি কোনো ধারণাই রাখো না তুমি। আমার ভয় হচ্ছে আমার মনের ভেতরকার কথাও বোধ হয় ওটা জেনে গেছে। যেকোনো মুহূর্তে আমাকে মেরে ফেলবে ওই পিশাচ শক্তি!’

‘তোমারও আমার প্রভুর পবিত্র শক্তি সম্পর্কে ধারণা নেই। পরীক্ষা করে ফেল তাহলে আমার প্রভুর শক্তি।’ এই বলেই মেয়েটা তার শাড়ি খুলে ফেলল। বিস্মিত হয়ে মেয়েটার শরীরের দিকে তাকিয়ে রইলো আমন। মনের ভেতর জমে থাকা কাম ভাব এক মুহূর্তে চুপসে গেছে। যৌবনের ছিটেফোঁটাও নেই মেয়েটার শরীরে। সারা শরীর জুড়ে কিলবিল করে নড়ছে কালো কালো থোকা থোকা কোষ। ওগুলোর ভেতরে অসংখ্য ছোট ছোট ছিদ্র। এই মেয়ে কোনো নারী কিংবা মানুষ নয়! শরীর ফুঁড়ে অনেক গুলো গাছের ছোট শিকড় বেরিয়ে আছে পেট, স্তন আর গলার দিক দিয়ে।

টান দিয়ে সেখান থেকে কয়েকটা চিকন শিকড় ছিড়ে হাতে দিয়ে দলা পাকিয়ে দড়ির মতো করে একটা মালা বানালো। এরপর পরিয়ে দিল তা আমনকে। শরীরে কিলবিল করতে থাকা কোষগুলো হারিয়ে গেল শরীরের ভেতরে। সেখানে ফুটে উঠলো কামনাময়ী একটি শরীর। মেয়েটা নিজের শরীরে জড়িয়ে নিল আবার কাপড়। আমনকে বলল, ‘যাও যা বললাম করো। দেখবে আমার প্রভুর শক্তি। ‘

আমনের শরীর কাঁপছে ভয়ানক উত্তেজনায়। সে একটা হারিকেন নিয়ে বেরিয়ে পড়লো জঙ্গলের উদ্দেশ্যে যেখানে রাখা রয়েছে সাতটি পিশাচ মূর্তি। বার বার চারপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগলো কেউ তাকে দেখছে কিনা! না, কেউ নেই!

আমনের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রাগে ফুসছিল। তার জায়গা দখল করে নিচ্ছে আরেকটা মেয়ে।। সন্ধ্যার পর থেকেই তাই আমনের কুটিরের দিকে নজর ছিল তার। রাতে যখন আমন কুটিরে ঢুকলো তার পুরো শরীর পুড়ে যাচ্ছিল। ইচ্ছা করছিল কুটিরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে জীবন্ত অবস্থায় আমন আর ওই মেয়েটাকে পুড়িয়ে মারে। নিজেকে কিছুটা শান্ত করতে লাগলো সে। মধ্যরাতে আমনকে কুটির থেকে বেরিয়ে চোরের মতো হারিকেন নিয়ে জঙ্গলে ঢুকতে দেখে অবাক হয় সে। সে ভেবেছিল মেয়েটার সাথে সারারাত ফুর্তি না করে বের হবে না আমন। সেও একটা হারিকেন হাতে নিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে অনুসরণ করতে থাকলো স্বামীকে।……………………………………
.
.
. . . . চলবে . . . .
.
.
লেখা: #Masud_Rana

পিশাচ পুরুষ পর্ব-০৮

0

#পিশাচ_পুরুষ
৮ম পর্ব

দেখতে দেখতে জঙ্গলের সেই বিশাল বৃক্ষের কোটরে জমা হলো ৬১টি নারীর দেহ। শত গুলো পূরণ হলেই এমন কিছু একটা ঘটবে জঙ্গলে যা শত বর্ষ ধরে এই জঙ্গলের একটা শক্তি চাইছে ঘটুক। যে শক্তির উৎস, লক্ষ্য এখন পর্যন্ত কোনো মানুষ জানতে পারেনি। এমন কী কারো ধারণাও নেই, এখানে কী ঘটতে চলেছে।

আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগের সময়। এই জঙ্গলেরই শেষ মাথায় যে নদী রয়েছে তার পাড়ে একটি গ্রাম ছিল। যেখানে একটা গোষ্ঠীর বিশটির মতো পরিবার বসবাস করত। জঙ্গলে শিকার, বৃক্ষের ফল, উৎপাদিত সবজি দিয়ে খুব ভালো ভাবেই তাদের জীবন কেটে যাচ্ছিল। তাদের কাছ সৃষ্টিকর্তার আলাদা কোনো পরিচয় ছিল না। তাদের পূর্ব পুরুষ কারা, কবে থেকে এই নদীর তীরে তারা বসবাস করে কয়েকজন বৃদ্ধ লোক ছাড়া কেউই সে ইতিহাস জানতো, কারো মধ্যে এধরনের কৌতূহলতাও ছিল না বাইরের জগৎ সম্পর্কে। জঙ্গলকেই তারা প্রভু মানতো। নিজেদের গোষ্ঠীর লোকজন ছাড়া আর কাউকে তারা আপন ভাবতো না।

জঙ্গল খুঁজে যেসব বড়, অদ্ভুত গাছ দেখত সেসবের পুজো করতো তারা। বিপদে সহায়তা চাইতো, উৎসর্গ করতো নিজেদের খাবার। কিন্তু একটা সময় পর তারা বুঝতে পারে তাদের খারাপ সময় কিংবা বিপদে গাছগুলো কোনো সাহায্য করে না। তখনই গোষ্ঠীর মানুষেরা জঙ্গলের খুব ভেতরে একদিন শিকারে গিয়ে একটা বড় গাছের শিকড়ের পাশে সৃষ্টি হওয়া কোটরের মাঝে সন্ধান পায় কিছু বীভৎস, ভয়ঙ্কর মূর্তি। একবার ওগুলোর দিকে তাকাতেই ভয়ে তাদের বুক কেঁপে উঠে। অনুভব করে তারা এমন শক্তিশালী শক্তির উপলব্ধি তারা এর আগে কখনো করেনি।

মূর্তিগুলো এখানে কারা রেখে গিয়েছিল! তারা দল বেঁধে উপস্থিত হয় সেখানে, মূর্তিগুলো তাদের গ্রামের কাছাকাছি জঙ্গলের অংশে নিয়ে গিয়ে লুকায়িত, গুপ্ত এবং সুন্দর একটি জায়গায় মূর্তিগুলো স্থপিত করে। এক প্রকার ভয়েই নিজেদের গ্রামে নিয়ে যেতে পারেনি ওগুলোকে।

এরপর গোষ্ঠীর কেউ কেউ স্বপ্নে দেখতে লাগলো এসব মূর্তিগুলোকে। মূর্তিগুলোর পেছন থেকে এক গায়েবি কণ্ঠ তাদের নানান আদেশ, উপদেশ দিতে লাগলো। বলল, গোষ্ঠীর লোকেরা যাতে মূর্তিগুলোর পুজো করা আরম্ভ করে, তার প্রতিদানে পাবে তারা এমন কিছু যা তাদের কল্পনাতীত। মূর্তিগুলোর দিকে তাকালে এমনিতেও তাদের মনে ভয় আর ভক্তি কাজ করে। তাই দ্রুতই সবাই পিশাচ মূর্তিগুলোর উপাসনা করতে লাগলো। নিজেদের নানান চাহিদা ওগুলোর কাছে জানাতে লাগলো, রোগ বিপদের প্রতিকার চাইলো। এক অলৌকিক শক্তিতে ছেয়ে গেল গ্রাম। গোষ্ঠীর লোকেদের সব রকম সমস্যা দূর হতে লাগলো, অলৌকিক উপায়ে তাদের মনের সব ইচ্ছা পূরণ হতে লাগলো। বন্য হিংস্র জন্তুদের আক্রমনের শিকার, শিকার করতে গিয়ে কেউ না কেউ রোজই হতো। বন্য জন্তুর আদিপত্ত কমতে লাগলো।

তারা তখন এই মূর্তিগুলোর ক্ষমতায় স্তব্ধ মুগ্ধ। অবশ্য তখনো তারা পুরোপুরি পিশাচ পূজারী হয়নি। এরপরেই স্বপ্নাদেশ পেতে লাগলো তারা মূর্তিগুলোর তৃষ্ণা ও ক্ষুধা নিবারণ করতে হবে এই গোষ্ঠীর লোকগুলোকেই। কিভাবে করতে হবে সেই নির্দেশও পেল তারা। প্রথমে বিভিন্ন জন্তু এনে উৎসর্গ করতে লাগলো মূর্তিগুলোর কাছে। এরপরেই জানতে পারলো ওগুলোর উপাসনার জন্য মানুষের রক্ত প্রয়োজন। তারা আতঙ্কিত হয়ে উঠল নিজেদের কথা ভেবে। এরপরেই তারা প্রথম গ্রাম ছেড়ে বের হতে লাগলো। জঙ্গলের আশেপাশের অন্যান্য গ্রামের মানুষদের ফাঁদে ফেলে এখানে ধরে নিয়ে আসতো।

পিশাচ গুলো এরমধ্যেই গ্রামের লোকদের নানান অলৌকিক শক্তি দান করেছিল। শক্তির লোভ আর দাপটে পিশাচ গুলোকে সন্তুষ্ট রাখতে তারা পুরো দমে মানুষ শিকারে বের হয়। এবং উৎসর্গ করতে থাকে ওদের মূর্তির পায়ে। এক সময় এগুলো উপভোগ করতে থাকে তারা। বর্বর হিংস্র হয়ে ওঠে।দিন দিন গোষ্ঠীর লোকেরা আরো শক্তিশালী হয়ে উঠছে। প্রায় প্রতি মাসেই এখানে নরবলি হতে লাগলো। কখনো বাচ্চা, কখনো বৃদ্ধা, কিশোরী , যুবক যুবতী।

দেখতে দেখতে ভয়ানক পিশাচ সাধকের গ্রাম হয়ে উঠে এটা। স্বপ্নাদেশ পেয়ে আরো অনেক শক্তিশালী পিশাচ শক্তির সাধনা করে তারা। নিজেরাই কাঠ, মাটি দিয়ে ওগুলোর মূর্তি তৈরি করে , মানুষের রক্তে ভিজিয়ে পূর্ণতা দান করে বাকি পিশাচ মূর্তিগুলোর পাশে স্থাপিত করে। জঙ্গলের এপাশে একটি গ্রামের অস্তিত্ব আছে, কেউ কেউ জানলেও এখানে আসলে কী ঘটে কেউই জানতো না আশেপাশের গ্রামের। তাদের কিছু মানুষ নিখোঁজ হওয়ার পেছনে ওদের হাত থাকতে পারে এটা কল্পনাও আনতে পারেনি কেউ। জঙ্গলটা দুর্গম আর হিংস্র জন্তুতে ভরা ছিল বলে কোনো সাধারণ মানুষও এইদিকে আসতো না।

প্রায় দীর্ঘ একটি সময় কেটে যায়। জঙ্গলের ও মাথার এক কৃষক একদিন জঙ্গলে প্রবেশ করে পথ হারিয়ে ফেলে। হাটতে হাটতে অনেক রাতে চলে আসে জঙ্গলের যেই জায়গাটিতে পিশাচ মূর্তিগুলোর উপাসনা করে গ্রামের লোকেরা সেখানে। দূর থেকে সে আলো দেখে আর মানুষজনের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে সেদিকে এগিয়ে যায়। ভাবে জঙ্গলের এত ভেতরে রাতে কারা কী করছে!

লুকিয়ে লুকিয়ে সেখানে গিয়ে যা দেখল তা তাকে স্তব্ধ করে দিল। বিশাল আকৃতি কয়েকটা ভয়ঙ্কর মূর্তি। ওগুলোর সামনে হাত পা বাধা তিনজন মানুষ হাঁটুমুরে বসে আছে। অদ্ভুত পোশাক, মুখে , শরীরে নানারকম উল্কা আঁকা কয়েকজন মানুষ তাদের ঘিরে আছে। হাতে ধারাল অস্ত্র। বসে থাকা লোকগুলো নেশার ঘোরে গোঁঙাচ্ছে। হঠাৎ করে কেঁপে উঠলো মূর্তিগুলো। উল্কা আঁকা লোকগুলো কিছু একটা বলে চেঁচিয়ে উঠলো। এরপরই অস্ত্রগুলো নামিয়ে আনলো লোকগুলোর ঘাড় বরাবর। মাথা থেকে শরীর আলাদা হয়ে গেল তিনজনেরই। আনন্দে হৈ হৈ করে উঠলো লোকগুলো। বিস্ময়ে লোকটা স্তব্ধ হয়ে গেল। উল্টো ঘুরেই ছুটতে লাগলো লোকালয়ের দিকে।

রাত পেরিয়ে পরদিন রাতে সে গ্রামে ফিরল। তার অবস্থা তখন ভয়ানক কাহিল। গ্রামের লোকেদের কাছে সে বলল, জঙ্গলে কী দেখেছে সে। সবাই আতঙ্কিত হলো এবং অবিশ্বাস্যও লাগলো ঘটনাটা। কিন্তু তার কয়েক ঘন্টা পরেই সে মারা গেল। এরপরই চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো জঙ্গল নিয়ে এই গুঞ্জনটা। কিন্তু কেউই দিনে রাতে গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করে কথাটার সত্যতা নিশ্চিত করার সাহস পেল না।

পিশাচ গ্রামে তখন পুরোপুরি বর্বরতার যুগ। এক গ্রাম থেকে বেশি মানুষ তারা ধরে আনে না, জানে একবার আতংক সৃষ্টি হলে অন্য সব গ্রামের মানুষেরা মিলিত হবে একটি দলে। তখন তাদেরই বিপদ। তাই দূরের গ্রাম গুলো থেকে তারা মানুষ শিকার করে। আজ তেমনি তিনজন মানুষ ধরে আনা হয়েছে। দুই জন পুরুষ এবং একজন যুবতী। গোত্রপ্রধান আমন এলেন লোকগুলোকে দেখতে। যুবতী মেয়েটিকে দেখে একেবারেই স্তব্দ হয়ে গেলেন। এত রূপবতী মেয়ে সে এই প্রথম দেখল। মেয়েটার পরনেও ঠিকঠাক মতো পোশাক নেই। প্রবল আকর্ষণ বোধ করলো মেয়েটার প্রতি আমন। সে বলল, উৎসর্গের আগে মেয়েটাকে কিছুক্ষণের জন্য নিয়ে যাবে সে।

কেউ খুশি না হলেও গোত্রপ্রধানের সাথে ঝামেলা করলো না। আমন যুবক বয়সী, নতুন গোত্রপ্রধান। তার বড় ভাই গত এক মাস আগে ঘুমের ভেতর মারা গিয়েছে। আমন সবাইকে বলে, পিশাচ দেবতাদের সাথে বেঈমানি করতে চেয়েছিল তার বড় ভাই তাই তাকে অলৌকিক শক্তি হত্যা করেছে এবং এখন থেকে সেই গোষ্ঠী প্রধান। তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী অবশ্য অভিযোগ করেছিল আমনই নাকি কী এক শক্তি বলে ক্ষমতার লোভে তার বড় ভাইকে খুন করেছে। এরপর থেকে তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী এবং একমাত্র কন্যাকে আর কেউ খুঁজে পায়নি। হাজার হোক গোত্রপ্রধানের বিরোধিতা করা চলে না।

মেয়েটাকে তার ঘরে জোর করে টেনে নিয়ে যায় আমন। স্ত্রীকে ঘর থেকে বের করে দেয়, গভীর রাত পর্যন্ত আবদ্ধ থাকে সে মেয়েটিকে নিয়ে ঘরটিতে। আজ উৎসর্গের রাত। গোষ্ঠীর বাকি লোকেরা উৎসর্গের জন্য মেয়েটিকে নিতে আসলে এমন জানায় সে এই মেয়েটিকে বিয়ে করবে। ওকে কিছুতেই বলি দেয়া যাবে না। আমন নিজেও জানে আজ রাতে তিনজন লোককে বলি না দিলে পিশাচদের পক্ষ থেকে কঠিন বিপদ নেমে আসবে। সে নিজেই ক্ষমতার লোভে একাকী নিজের বড় ভাইয়ের স্ত্রী, কন্যা এবং এই গ্রামেরই তার বিরোধী এক লোককে কিছুদিন আগে গোপনে বলি দিয়েছে।

সে ঘোষণা করলো, উৎসর্গতে কোনো বাধা নেই। এই মেয়েটার বদলে সে তার আগের স্ত্রীকে উৎসর্গ করলো পিশাচের উদ্দেশ্যে। সকলেই হতভম্ব হয়ে গেল আমনের এমন নিষ্ঠুরতা দেখে। নিজেদের লোককে তারা এর আগে প্রকাশ্যে বলি দেয়নি। আমনের বড় ভাইয়ের সময়ে তা গুরুতর অন্যায় ছিল। আমনের স্ত্রী হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। সে রাতে এভাবেই উৎসর্গ সমাপ্ত হলো। যুবতী মেয়েটা নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়ে বিহ্বল হয়ে উঠল এবং আমনের মনোরঞ্জনে ব্যাস্ত হয়ে উঠলো।

আমন সেই মেয়েটিকে বিয়ে করলো। একই ভাবে কয়েক মাস অতিবাহিত হয়ে গেল। মেয়েটাও এরমধ্যে গোষ্ঠীর লোকদের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। সে খুব দরিদ্র পরিবারে আশ্রিতের মতো ছিল এতদিন গ্রামে। এখানে প্রায় মহারানীর মতো সম্মান আর মর্যাদা তার। সকলেই তাকে ভয় পায়। এই লোভে বশীভূত হলো সে।

আমন সম্প্রতি সময়ে বেশ হতাশায় ভুগতে লাগলো। তার মনে হতে লাগলো তারা শুধু শুধু কষ্ট করে মানুষ শিকার করে পিশাচগুলোকে উৎসর্গ করে বিপদের ঝুঁকি নিয়ে। সেই তুলনায় পিশাচ গুলো তাদের খুব কম উপকার করে। অলৌকিক শক্তিগুলোও এখন তার কাছে একঘেয়ে লাগে। সে ভাবে এরচেয়ে ক্ষমতাবান কোনো পিশাচ কী আছে! যার শক্তি তাকে আরো ক্ষমতাবান করবে। শুধু এই জঙ্গল নয়। আশেপাশের সব জায়গায় তার প্রভাব থাকবে। তার ভক্তি পিশাচ গুলো থেকে কমতে থাকে, প্রায়ই গোপনে অনুসন্ধান করে জঙ্গলের ভেতর লুকিয়ে থাকা কোনো মহান শক্তির। ………………………….
.
.
. . . . চলবে . . . .
.
.
লেখা: #Masud_Rana