Tuesday, June 24, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1062



তুই হবি শুধু আমার পর্ব-১৭

0

#তুই হবি শুধু আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_সতেরো

“আমি ফালাক ভাইয়াকে ভালোবাসি বাবা। সত্যিই খুব বেশি ভালোবাসি সেজন্যই তো তাকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করছি। তাকে ছেড়ে যেতে চাইনি আমি। সবসময় তাঁর কাছে থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে আমাকে ভুল বুঝে দূরে ঠেলে দিয়েছিল। জানো তখন প্রচন্ড অভিমান হয়েছিল আমার। পাঁচবছর যোগাযোগ করিনি। ভেবেছি সে যোগাযোগ করলেই তাকে বলে দেবো আমিও তাকে তাঁর চাঁদও তাকে ততটাই ভালোবাসে যতটা সে তাঁর চাঁদকে ভালোবাসে। কিন্তু তোমাদের ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়ে আমি কি জেনেছি জানো? ফালাক ভাইয়া একজন খু’নি। মেহমেদ ভাইয়ার সঙ্গে তাঁর শত্রুতা আছে। দুটো দলের মধ্যে যে ঝামেলা চলছে তার সমাধান একটা দলের ধ্বংস। আমি জানি ফালাক ভাইয়া অভিনয় করতে ভালোবাসে। তাঁর থেকেও বেশি আমি ভালোবাসি তাঁর অভিনয় দেখতে। মনে মনে কত সান্ত্বনা দিয়েছি নিজেকে, যে সেদিন যেটা হয়েছে সেটা ফালাক ভাইয়ার অভিনয়। নিজেকে সামলেও নিয়েছি। কিন্তু সে প্রচন্ড রাগি। তাঁর রাগ, জেদ অনেক। সে বড় হতে চায়, ঠিক আছে কিন্তু অহংকারিও হয়ে গেছে সেই বিকেলের পর থেকে। আমি তো তাকে ইচ্ছে করে কষ্ট দিতে চাইনি। সে আমার চরিত্র তুলে আমার আদর্শ তুলে কথা বলেছিল বলেই তো তাকে ওভাবে বলেছি। আমাকে সবাই ভালোবাসে। কিন্তু তোমাদের মত করে তো শুধু ফালাক ভাইয়া ভালোবাসতো।সে যদি আমাকে কষ্ট দেয়,আমি কি সহ্য করতে পারি? এরপর যখন জেনেছি ওরা আমার ওপর নজর রাখে, আমার প্রতিটা শক্তি ও দূর্বলতার খোঁজ রাখে তখন কিভাবে সবাইকে জানাতাম আমার মনের কথা? ফালাক ভাইয়া নিজের গ্যাং বাদ দিয়েছে অভিনয়ের জন্য। তাঁর কাছে অভিনয় জিনিসটা এতটা মূল্যবান জানার পরও তাকে আমি অভিনয় ছাড়তে বলেছি। আমার কি খারাপ লাগেনি? সবাই ভাবছে আমি নিজের জন্য সব করছি, করেছি। কিন্তু তোমরা তো জানো আমি নিজের জন্য কিছু করিনি। আমার নিজের আছে’টা কি? যে নিজের জন্য করবো। নিজের বলতে তো শুধু ওই মানুষগুলো। কুসুম নতুন মানুষ, আমার প্রিয়জনের তালিকায় নতুন যুক্ত হয়েছে আমি ওদের কাছে থাকলে ওরও তো ক্ষতি হতে পারে। দাদাই ওকে কত ভালোবাসে, ওর কিছু হলে কি দাদাই বাঁচবে? দাদাইয়ের কিছু হলে কি আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো? যে মানুষগুলো আমাকে এতটা আপন ভেবেছে, ভালোবেসেছে তাদের কষ্ট দিতে পারি না আমি।

ভালোবাসা, সেটা তো নিঃস্বার্থ হয়, কারনবিহীন হয়। অথচ দেখ সেই ভালোবাসার মামলাতেও আমি কত শত শর্ত জুড়ে দিলাম যেন ফালাক ভাইয়া আমার ওপর আবার রাগ করে। আর সে রাগ করলেই আমি অযুহাত দেখিয়ে চলে আসবো মিশনে। কিন্তু সে অভিনয়টাই ছেড়ে দিয়েছে।সবাই বলে ফালাক ভাইয়া আমার সব কথা শোনে, আমার সব শর্ত মানে। কিন্তু কেউ একবার ভাবে না আমি তাঁর জন্য কি করি? আমি যে তাঁর জন্য আজ অবধি কোনো ছেলেকে গুরুত্ব দেইনি, বন্ধু বানাইনি,কারোর সঙ্গে হেসে কথা বলিনি। এগুলো কেউ বোঝেনা।সবাই ভাবে আমি অস্বাভাবিক, প্রতিক্রিয়াহীন এটা তো সত্য নয়। তুমি তো জানো মামনি। আমারও মন চায় ছোটবেলার মত সবার আদরে থাকতে। মামনি আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, তোমরা কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেলে? আমাকে সাথে নিলে না।

তোমাদের থেকেই তো ত্যাগ করা শিখেছি। শিখেছি কি ভাবে অন্যের সুখের জন্য নিজের সুখ বিসর্জন দিতে হয়। তবুও সব সময় সব অপবাদ আমার গায়ে কেন লাগে? আমার কাজগুলো কি বড্ড খারাপ? আমি চাইনি ফালাক ভাইয়া পুনরায় নিজের হিং’স্র রূপে ফিরে আসুক। এটা কি খারাপ? তবুও কুসুম, দাদাই ভাবছে ফালাক ভাইয়ার জীবন আমি নষ্ট করছি। তাকে বদলে দিয়ে তাঁর ওপর বাজে প্রভাব ফেলছি। কষ্ট দিচ্ছি। কিন্তু কেউ বুঝতে চাচ্ছে না, আঠারো বছর বয়সে আমি ঠিক কতটা স্ট্রাগেল করেছি। কিভাবে থেকেছি, কিভাবে চলেছি। সবাই ভাবছে ফালাক ভাইয়াকে আমি মাফ করে দিচ্ছি না, সুযোগ দিচ্ছি না। কিন্তু একটাবারও ভাবে না, তেরো বছর বয়সে, ওই অল্প একটু বয়সে আমি কি কি ফেস করেছি।তখন কতটুকুই বা বুঝতাম? শুধু জানতাম ফালাক ভাইয়া আমার বন্ধু আর আমি তাকে ভালোবাসি। এই বন্ধুত্ব প্রেমে রূপান্তর হচ্ছে সেটা আমাকে কেউ বলেছে? বলেনি। দাদাইয়ের প্রেমের কথা শুনে বুঝেছি। তাহলে আমার দোষটা কোথায়? কেন সব খানে শুধু রোজের দোষ হয়? রোজ খারাপ হয়? রোজকে অপবাদ দেওয়া হয় জীবন নষ্টের। আমার কি সুন্দর জীবন আছে? আমি পেয়েছি সেটা? আমার কি কেউ সত্যিই ছিল? অভিমান আমি কেন করবো না? যখন ফালাক ভাইয়াকে আমার প্রয়োজন ছিল, একটা কাছের মানুষ, যে আমার ব্যক্তিগত মানুষ হবে তাঁর প্রয়োজন ছিল তখন ফালাক ভাইয়া কোথায় ছিল? সে তাঁর জেদ নিয়ে পড়ে থাকেনি?পাঁচটি বছর নষ্ট করেনি? কিন্তু না, এটা কারোর চোখে পড়বে না। সে মাফ চাইলো আর সবাই গলে পড়লো। সবার মনে হতে শুরু করল ভুল বোঝাবুঝি মিটে গেলেই মিলন সম্ভব। কিন্তু মনের ভেতর রাগ, অভিমান, কষ্ট জমা থাকলে মিলন হলেও সেটা তেমনই থাকে।এটা কেন বোঝে না? সেদিন দাদাই কুসুমকে বলল, আমি নাকি পাঁচবছর পর ফিরে আসতে চেয়ে অনেক সময় নিয়েছি। যদি মিশনে গিয়ে আর ফিরে না আসি তখন? ফালাক ভাইয়াকে মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে কেন রাখবো? সে জানুক আমি ফিরবো। যদি নাও ফিরি তাহলে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক তো হবে, রাগ মিটে গেলে সে নিজের মনকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। আর বাকি সবাই তো আছে ওকে সামলে রাখার জন্য। দেড়বছর হয়ে গেল। জার্নালিজমে আমি আরও একটি কারনে পড়ছি, সেটা তো জানো তোমরা। কুসুমকে সুস্থ করতে হবে, দাদাইয়ের কাছে পরিপূর্ন কুসুমকে ফিরিয়ে দিতে হবে। সবাই ভাবে দাদাইয়ের ওপর আমার ঝোঁক আছে। কেন ভাবে? কারন আমি দাদাইকে অনেক ভালোবাসি। কেন বাসি সেটা কেন কেউ জানতে চায়না? বুঝতে চায়না? কলকাতায় যখন ফালাক ভাইয়া আমাকে নানা কথা শোনাচ্ছিল তখন কে আমাকে আগলে রেখেছিল? কে আমার পাশে ছিল? মানছি দাদাই আর আমার কথাগুলো ফালাক ভাইয়াকে বুঝিয়ে বলা উচিত ছিল কিন্তু ফালাক ভাইয়া কি শুনেছিল? সেদিন চাইলেই তো দাদাই সবটা বলতে পারতো। বলেনি আমার কথা ভেবে, আমার ভালো চেয়ে। ফালাক ভাইয়ার বিপক্ষে গিয়ে আমার হয়ে যে মানুষটা লড়েছিল তাকে ভাই হিসেবে ভালোবাসা সম্মান করা কি ভুল? সে ভেবেছিল ফালাকের কাছে আমি নিরাপদ নই, যেখানে সে ফালাককে এতগুলো বছর ধরে চেনে। সে যদি আমার জন্য সবার সঙ্গে লড়াই করতে পারে তাঁর হয়ে কিছু কথা বলা কি অন্যায়?

কুসুমের পরিস্থিতি, কষ্ট বুঝি আমি। চোখের সামনে যদি সহসা কোনো দূর্ঘটনা ঘটে তা থেকে বের হওয়া কঠিন। আমি তো তোমাদের সাহসী মেয়ে তাই সবটা ওভার কাম করতে পেরেছি। কিন্তু কুসুম তো ভীতু, নরম মনের আহ্লাদি মেয়ে। ও পারেনি। ওর পরিস্থিতি ঠিক করা কি আমার কর্তব্য নয়? ও তো আমারই নতুন পরিবারের নতুন সদস্য।

আমি তবুও ফিরবো না বাবা, মামনি। ফিরে গিয়ে ওদের সামনে দাড়ানোর ক্ষমতা আমার নেই।তাই আমি এখানে থাকবো। যে কাজের সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটা করবো। যে দায়িত্ব বাবা আমার ওপর অর্পণ করেছে তা পালন করে যাবো শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। কিন্তু ফালাক ভাইয়ার স্বপ্ন কেড়ে নিয়ে তাকে যে কষ্ট দিচ্ছি তাঁর বদদোয়া আমার লাগবে না? স্বার্থপরের মত কাজ করছি? তাঁর কি এই কথা জানার অধিকার নেই যে আমি তাকে ভালোবাসি। যদি জানিয়ে দেই, উনি তো দুনিয়া ওলোট পালোট করে দেবে। তখন যদি টেরোটিস্টরা ওনার ক্ষতি করে? কি করবো আমি? তোমরাই বলো! ওনাকে কি বলে দেবো অভিনয় করার কথা? লিস্ট থেকে রাগ বাদে সব শর্ত কে’টে ফেলার কথা? এটাই ভালো হবে। ”

আকাশের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে ফারহানের নাম্বারে কল করল রোজ। দু বার বেজে বেজে বন্ধ হয়ে গেল। হয়তো আননোন নাম্বার বলে কল রিসিভ হচ্ছে না।

বারংবার কল আসায় প্রচন্ড বিরক্ত ফারহান। মুগ্ধতা ভেবে সে ফোনটা বালিশের নিচে চাপা দিয়ে রেখেছে। সকাল বিকাল ছ্যাছড়া হিরোইনটার প্যারা আর ভালো লাগছে না।হিপোক্রেট একটা।কিন্তু একটানা কয়েকবার ফোন বাজতেই ফারহান ফোন রিসিভ করেই দিল এক ঝারি,
-কি সমস্যা?স্লাট হতে চাইলে অন্যকোনো খোদ্দের খোজ, তোর মত বে’শ্যা আমার বিছানার আশেপাশে থাকারও যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনা। বালডা বিরক্ত করেই চলেছে। আর ফোন দিবি না।

এমন বাক্য শুনে রোজের চোখমুখ লাল হয়ে উঠল। হাত কেঁপে উঠল মুহূর্তেই। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
-ফালাক ভাইয়া!

ওপর পাশ থেকে কোনো শব্দ এলো না। রোজ বলল,
-কেমন আছো? আমি রোজ। কন্ঠ চিনতে পারছো না? কথা বলছো না কেন?

ওপাশ থেকে কিছু পড়ার শব্দ পেল রোজ। আতঙ্কিত কন্ঠে রোজ আবার বলে,
-বিরক্ত হচ্ছো? ফোন রেখে দেবো?

ফারহানের গলা ধরে আসলো। দম বন্ধ হয়ে আসছে। কিছু বলার মত শক্তিও যেন পাচ্ছে না সে। রোজ ফোন করেছে এটা বিশ্বাসই হচ্ছে না। ফারহানের ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠার আভাসে রোজ টলে উঠলো। পা দুলছে। ফালাক কাঁদছে এটা ভাবলেও রোজের দুনিয়া আঁধারে ঘনিয়ে আসে। সেখানে আজ ফালাকের কান্নার স্বর শুনছে। রোজ নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে বলে,

-শুনেছি পুরুষ মানুষরা নাকি কাঁদে না। তাদের কাঁদতে নেই। তারা কঠিন, আর কঠোরতায় তাদের বেশি মানায়।

-ফিরে আয় চাঁদ। আমি তোকে একটুও কষ্ট দেবো না। তোর সব কথা শুনছি, ভবিষ্যতেও শুনবো।

রোজেরও কান্না পেয়ে গেল ফারহানের কান্নাভেজা কোমল কন্ঠে। মানুষটার রাগ মিটে গেছে? আজ সে রোজকে একদম ধমক দেয়নি। বরং মিষ্টি করে কথা বলছে। তাঁর কন্ঠ জানান দিচ্ছে তাঁর তীব্র যন্ত্রণা। রোজ নাক টেনে বলে,

-ফিরবো তো। কিন্তু এখনও তোমার কষ্ট পাওয়া হয়নি। শোনো, অভিনয় জগতে তুমি ফিরে যাও। শুধু রাগটা বাদ দিলেই হবে।

-ভালোবাসি চাঁদ। তোকে কখনও বলা হয়নি। আঠারো বছর হলো তোকে ভালোবাসি আর আজ বলছি। তুই প্লিজ আমার কাছে আয়। ছোটবেলার মত আমার গলা জড়িয়ে ধরে অভিমান দেখা, তোর পা ধরে আমি স্যরি বলবো। তবুও ফিরে আয়।

রোজ এবার শব্দ করে কেঁদে ওঠে। ফারহানও কাঁদছে। দুজনের কথার সমাপ্তি ঘটে ক্রন্দনের প্রারাম্ভ ঘটেছে। কিন্তু রোজ তো এখন ফিরতে পারবে না। এটা সে কি করেরে বোঝাবে ফারহানকে? ফারহান আবার বলল,

-আসবি না?

-এই মুহূর্তে আসাটা কি জরুরি? যদি তোমার ভাগ্যে আমি থাকি। যদি তোমার হওয়া’টা আমার ভাগ্যে থাকে আমি নিশ্চই তোমার হবো ফালাক ভাইয়া। পৃথিবির দ্বিতীয় কোনো পুরুষ তোমার চাঁদকে পাবে না। তোমাকে পরীক্ষা দিতে হবে, এই দূরত্বের পরীক্ষা চালিয়ে যেতে হবে। অপেক্ষা করতে হবে। অপেক্ষার সুমিষ্ট ফলের প্রতীক্ষা করতে পারবে না? চাঁদকে পেতে হলে একুটু করা সামান্য বিষয়।

-আমার ম’রার পর আসবি? লাশ দেখতে আসবি? তবুও আসিস। আমার কবরে যেন তোর হাতের মাটি পড়ে।

-সৃষ্টিকর্তার কাছে বাবা আর মামনির জন্য দোয়া করার পর আমি নিজের জন্য সবসময় একটা জিনিস চাই। সেটা কি জানো? সেটা হচ্ছে আমার ফালাক ভাইয়ার সুখ, সমৃদ্ধি। আর তাঁর আগে আমার মৃ’ত্যু। বোঝার পর থেকে এই একটা চাওয়াই চেয়ে এসেছি। আর আমি মনে করি বিধাতা আমাকে নিরাশ করবেন না। যদি করে তাহলে জেনে রেখো তুমি, ফালাক বিহীন চাঁদ এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর প্রাণবায়ু গ্রহণ করবে না।

-ঠাটিয়ে মা’রবো এক চর। খুব কথা শিখেছিস তাইনা? সামনে পেলে তোকে মে’রেই ফেলতাম এমন কথা বলার দুঃসাহস পেলি কোথ থেকে?

-অপেক্ষা করো।পরীক্ষা দাও,যেদিন উত্তীর্ণ হবে, দেখবে তোমার চাঁদ তোমার সামনে দাড়িয়ে। আমাকে এবার দূরে ঠেলে দেবে না তো?

-একবার এসে দেখ।

-এভাবে বলবে না তুমি। তাহলে আমি নিজেকে সামলে রাখতে পারবো না। তোমার ওপর যত অভিমান আছে সব পুষে রাখছি। সামনে এলে তোমার ওপর ঝারবো।

-ভালোবাসিস আমায়?একবার বল চাঁদ! আঠারো বছর ধরে তোকে দেখছি, আমাকে বাদ দিয়ে তুই সবাইকে সম্মুখে ভালোবাসার কথা বলেছিস। প্রাণ থাকতে এক বার তোর মুখ থেকে শুনতে চাই। একবার বলবি?

-সবার সামনেই বলবো।

-এখন একবার বল না চাঁদ। প্লিজ চাঁদ।

-আমি তোমাকে ভা

-ভা? পুরোটুকু বল। আমি শুনতে চাই।

-লজ্জা লাগছে।

-তোকে মিস করছি চাঁদ। এবার আসলে তোকে আমি ছাড়বো না। কোথাও একা যেতে দেবো না, একমুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল হতে দেবো না তোকে।

-মেয়েদের সঙ্গে কথা বলা যাবে না এমন নিষেধাজ্ঞা তোমার ওপর থেকে তুলে নিলাম। অভিনয় করার, ও অসাধারণ থাকার নিষেধাজ্ঞাও তুলে নিলাম ফালাক ভাইয়া। জলদি রোম্যান্টিক একটা মুভি করে ফেলো। আমি ফিরে আসার আগে হলে তোমার মুভি দেখতে চাই।

-আমার হতে চাস না কেন?

-চাই তো।

-তাহলে নিষেধাজ্ঞা কেন তুলছিস? তোর মনে হয় তুই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে আমি অন্য নারীকে নিয়ে সামান্য একটা চিন্তাও মাথায় আনবো? আমি শুধু তোকে আর তোকেই ভালোবাসি চাঁদ। যেদিন প্রথম তোকে কোলে নিয়েছিলাম। বারো বছরের বাচ্চা ছিলাম আমি আর তুই দুধের শিশু। বোন পাওয়ার জেদ করেছিলাম বলে মা তোকে আমার কোলে দিয়েছিলো। কিন্তু তোকে প্রথম দেখার পর থেকে বোনের স্বপ্ন বাদ দিয়ে দিয়েছি। বন্ধুর স্বপ্ন দেখেছি আর তা মাত্র চারবছরে বদলে গেল। বুঝতে পারছিস কি বলতে চাচ্ছি? কৈশরে আমি এক দুধের শিশুকে বউরূপে দেখতাম। এটা কতটা জঘণ্য ও যন্ত্রণাদায়ক ছিল। তুই যতবার আমাকে ভাইয়া বলে ডাকতিস আমার বুকের ভেতরটা ততবার চিরে যেত। তবুও সব হাসিমুখে সহ্য করেছিলাম কারন তুই আমাকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝতিস না। জীবনের আঠারোটা বছর তোর জন্য আমি কারোর রূপে, গুণে মুগ্ধ হইনি। এমনকি আকর্ষনবোধও করিনি। আর এই আঠারো বছর পর তোর মনে হচ্ছে আমি কোনো হিরোইনের চক্করে পড়লেও পড়তে পারি? তোর মনে হয় কারোর রূপে আমি আটকাবো? বিছানায় তো অনেকে আসতে পারে চাঁদ কিন্তু মনে? তোকে ছাড়া মন নামক আমার বিষাক্ত দেহাংশে আর কারোর ঠাই নেই। কারোর না।

-আমি তোমার ভালোবাসা পাওয়ার আদৌ যোগ্য তো ফালাক ভাইয়া?

-যোগ্যতার হিসেব আমি করতে চাইনা। আমি শুধু জানি আমি তোকে চাই, আর তুই শুধু আমার হবি। ব্যাস।

-কয়েকটা মাস লেগে যেতে পারে। একটু ধৈর্য ধরো। আমি ফিরে আসবো।

-আমার থেকেও তোর মিশন বড় চাঁদ?

-তুমি জানো?

-মেহমেদ বলেছে। তুই ফিরে আয় চাঁদ। কি দরকার এই ঝুঁকি নেওয়ার? আমার সঙ্গে সারাটা জীবন কাটাতে পারবি না? ওসবে কি পাবি? যন্ত্রণা ছাড়া।

-বাবা আমার ওপর দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। যা পালন করা আমার কর্তব্য।

-ইশতিয়াক ইরফান ভালো না চাঁদ। তোকে ও বাঁচতে দেবে না। কোথায় আছিস তুই? আমাকে বল। আমি নিজে তোকে নিয়ে আসবো। তারপর দেখবি আমরা একসাথে থাকবো, আমাদের ছোট একটা সংসার হবে। তুই আমি আমাদের বাচ্চা…

-ডি.আই.জি স্যারের খেলাটা শেষ করে তবেই ফিরবো। উনি আমার বাবাকে মে’রেছেন, আমার মামনিকে মে’রেছেন। ওদেরকে আমি এত সহজে ছেড়ে দিতে পারবো না। কিছুতেই না। তোমার সঙ্গেও যোগাযোগ করবো না। কারন তুমি আমাকে আমার দায়িত্ব থেকে পিছিয়ে যেতে বলছো। এটা তুমি বলতে পারো না, ফালাক ভাইয়া। বাবা-মামনির শেষ ইচ্ছে ছিল এটা।

-আমি আমার সব ইচ্ছে বাদ দিচ্ছি, আমার পুরো জীবন তোর হাতে তুলে দিচ্ছি। তুই তার বদলে এটুকু করতে পারবি না?

-না। (কিছুটা থেমে) তুমি যদি আমাকে ভালোবাসো, তাহলে এমন অনুরোধ করবে না। আমার কসম ভাইয়া, তুমি অপেক্ষা করবে। আমাকে খুজতে আসবে না। পৃথিবির সামনে ততদিন কিছু বলবে না যতদিন না ইরফান মা’রা যায়। রাখছি।

ফোন রেখে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো রোজ। মেজাজ আবারও খারাপ হচ্ছে। কিন্তু পরক্ষণেই ঠোঁটের অদৃশ্য হাসি চওড়া হলো। কেন হাসলো রোজ? আর নিজের ভালোবাসার কথা স্বীকারই বা করলো কেন? সে তো এগুলো বলতে ফোন দেয়নি। তবুও ফারহানের কান্না দেখে গলে গিয়ে সব বলে দিলো? ভালোবাসা তো এমনই হয়! কিন্তু ফারহান? পাঁচবছর ধরে রোজের কান্না দেখার পর গলেনি। ভালোবাসার নতুন কোনো অধ্যায় ছিল নাকি ওটা? নাকি ভয়ের ছাঁপ? লুকানোর চেষ্টা অত্যন্ত গোপনীয় কিছু! রেলিঙ-য়ের পাশেই লম্বা রডটা বেরিয়ে আছে। রডের পাশে কিছু লম্বা লোহা। রোজ রেগে সেটা চেপে ধরতেই তালুর মধ্যে ঢুকে গেল লোহা। রোজ চোখ বুজে হাত টেনে নেয়। লালরঙা এই তরল পদার্থ অতিমূল্যবান জানা সত্ত্বেও তা দেহ থেকে বের করার মাঝে এক নিঃস্বার্থ সুখ খুজে পায় রোজ। মনে পড়ে প্রতারিত হওয়ার যন্ত্রণা, ঘাতকদের প্রতিটা আঘাত, অতিতের কষ্ট, বাবার ভালো মানুষ হওয়ার ভুল, তাঁর ঠকে যাওয়ার কথা, অতি আপনজনদের ভালোবেসে, বিশ্বাস করে মৃ’ত্যুকে বরণ করে নেওয়ার কথা। রোজ সে ভুল করবে না। রোজ মনে করে ভালো খারাপও একটি মুদ্রার দুটো পিঠ। কেউ সম্পূর্ণ ভালো হতে পারে না, আবার খারাপও হতে পারে না।রোজও তার ব্যতিক্রম নয়। রোজ ভালো হলে যতটা ভালো, খারাপ হলে তার থেকে শত গুন বেশি খারাপ। এটা সবাইকে বোঝানোর সময় দ্রুতই আসবে। রোজ শুধু সে সময়টুকুর অপেক্ষা করছে।

চলবে?

তুই হবি শুধু আমার পর্ব-১৬

0

#তুই হবি শুধু আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_ষোলো

আরশানের কাঁধে মাথা রেখে ওর এক হাত জড়িয়ে ধরে হাটছে অয়ন্তি। পেছনেই ফারহান কাউকে ফোন করছে অনবরত। ওরা তিনজন আজ ঘুরতে বেরিয়েছে। মূলত ফারহানের মন ভালো করতে বেরিয়েছে। কিন্তু বিবাহিত নতুন দম্পতি বিয়ের এই সময় অন্যকারোর মন ভালো করায় কতটুকু মনোযোগী থাকে? হাটতে হাটতে ওরা খেয়ালই করল না পেছনের মানুষটা গায়েব হয়ে গেছে। আরশানের দৃষ্টি নদীর মাঝ বরাবর থাকা মাছের ছোট নৌকাটার দিকে। হিম শীতল বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। ঠান্ডার আমেজে মনটা অতি প্রসন্ন। হঠাৎ ফারহানের কথা মনে পড়তেই আরশান পেছনে ফিরল,
-ফালাক কোথায়?
অয়ন্তি ত্বরিত গতিতে পেছনে ফেরে। এরপর আনমনেই বলল,
-পেছনে ছিল না? রোজের মত নিঁখোজ হয়ে গেলো নাকি?
-ধুর, না। নিঁখোজ হবে কেন? কোথাও গেছে হয়তো। কিন্তু না জানিয়ে যাওয়া ব্যাড ম্যানারস। বেয়াদবটাকে একা ছাড়া ঠিক হবে না ভেবেই তো সঙ্গে আনলাম।
-তাই তো!
-ফালাকের ওপর খারাপ প্রভাব পড়ছে কুসুম। অভিনয় জগৎ ছাড়া ও বাঁচতে পারেনা। বেবি সেটাই কেড়ে নিতে চাচ্ছে। কেড়ে নিচ্ছে ভালো কথা, কিন্তু চলে গেল কেন? ফালাকের কাছে থেকেই ওকে অভিনয়ের থেকে দূরে রাখতো। এভাবে তো ফালাকের জীবনটাও নষ্ট হচ্ছে। পাঁচটা বছর যে অনেক সময় তা কি বুঝতে পারছে না বেবি?
তখনই আরশানের ফোনে ম্যাসেজ আসল,
-দাদাই তোমরা ঘুরতে থাকো।আমি ঘন্টাখানেকের মধ্যে আসছি।
আরশান মুখ খিচে ফেলল। অয়ন্তি আরশানের প্রতিক্রিয়া দেখে হাসছে। আরশান রাগে দাঁতে দাঁত ঘসে বলে,
-দুটোকে টানিয়ে পেটানো উচিত। টেনশন ছাড়া কিছু দেয়না।
-ঠিক হয়েছে।
-তাই নাকি?
-হু।
-ওকে, তোমার আজ রাতে ঘুমানো বন্ধ। নিজের স্বামীর দুঃখ হেসে উড়িয়ে দেওয়ার শাস্তিস্বরূপ।
-গতকালও ঘুমাইনি। (দুঃখি মুখ করে)
-আজও ঘুম হবে না। (বাঁকা হেসে)
-এটা ঠিক না।
আরশান হাসলো। অয়ন্তির হাত শক্ত করে চেপে ধরে সামনে তাকালো।
-এখন কথা বলার সময় না। এঞ্জয় দ্য বিউটি মাই লাভ।

_____________

-তোমার বাবার মিশন সম্পর্কে শুধুমাত্র সে জানতো মা। আমরা কেউ ইনভলভ ছিলাম না। তিনি আমাদের কিছু বলেননি। টেরোরিস্ট’রা এখনও তোমার খোঁজ কেন করেছে বুঝতে পারছি না।তোমার বাবাও তোমাকে নিয়ে প্রচন্ড ভয়ে ছিলেন। কেন ছিলেন? তুমি কি কিছু জানো? মনে পড়ছে, বাবা কিছু বলেছেন কিনা? কোনো ক্লু! কোনো কোড, ডিজিট? তোমার কাছে নিশ্চই কিছু আছে, যা ওই টেরোরিস্ট’রা চায়। যা তোমাকে তোমার বাবা দিয়ে গেছে।

রোজ মুখটা ছোট করে বলে,
-না, স্যার। বাবা কিছু বলেনি আমাকে। আর বাবা তো সর্বদা আমাকে দূরে রাখতো এসবের থেকে।আপনারা সবটাই জানেন।

অতিরিক্ত ডি.আই.জি সাহেবের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।রোজ সত্য বলছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। রোজের প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক নিশ্চল হওয়া এখন সর্বনাশা হয়ে দাড়িয়েছে। মেয়েটার মনে কি চলছে বোঝা মুশকিল। রোজ হাতের ফোনটা নেড়ে চেড়ে বলল,
-আমি কি যাবো স্যার? কলেজের সময় হয়ে গেছে।

স্যার মাথা নেড়ে যেতে বলতেই রোজ ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। কেবিন থেকে বের হতেই রোজের চেহারায় ফুটে উঠল রাগের আভা। কপালের শিরাগুলো ফুলে উঠল মুহূর্তেই। হাতের ফোনটার দিকে তাকিয়ে সে মৃদু হেসে বলে,
-পৃথিবিতে হত্যাকারীর থেকেও বড় ঘাতক আছে। আর তা হচ্ছে বিশ্বাসঘাতক। হত্যাকারীকেও মাঝে মধ্যে মাফ করা যায়। তবে বিশ্বাসঘাতককে! কখনও না।

নতুন বাইক কিনেছে রোজ। আগের স্কুটার তো ফেলে এসেছিল। যাতায়াত কঠিন হয়ে যাচ্ছে বলে সে বাইকই কিনলো। স্কুটার ঠেলে মাঝে মাঝে সমস্যা হচ্ছে তাছাড়া হেলমেট আর স্টাইলেও সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বাইকে উঠে রোজ জিন্সের পকেট থেকে আরেকটি ফোন বের করল। ফোনটা কানে নিতেই রোজ শুনতে পেল,
-ওকে ফলো করো। কোথায় কখন যায় সব নজরে রাখবে।

রোজ ফোনটা পকেটে ভরে নিল আবার। এরপর ফুল স্পীডে বাইক চালিয়ে উধাও হয়ে গেল ইউনিটের সামনে থেকে। আনসারীর মেয়ে সে, এত কাঁচা কাজ সে নিশ্চই করবে না এটা বোঝা উচিত ছিল তাঁর। রোজের ঠোঁটে চওড়া হাসি।বাবার কথা মনে পড়ছে তাঁর। মায়ের হাতের রান্না খায়নি কতগুলো বছর কেটে গেল। রোজ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আর কখনও রোজকে ওর মা আদর করবে না, বাবা খাইয়ে দেবে না। ঘুরতে নিয়ে যাবে না। কিন্তু যার জন্য ওর বাবা-মা মা’রা গেল সেই কারনটার পেছনের উদ্দেশ্য রোজ পূরণ করবে। নরকের কীটগুলোকে তাদের স্বর্গীয় স্থান নরকে পাঠাতে হবে। হেলমেট দিয়ে পুরো মুখ ঢেকে ফেলল রোজ।পথে নেমে ড্রেসও পাল্টে নিল।ব্যাগে থাকা নম্বরপ্লেট দিয়ে বাইকের নম্বরপ্লেট বদলে নিল। ছেলেদের মত পোশাকে পড়ে সে বাইকে উঠে রওনা দিল সিলেটের বর্ডারের উদ্দেশ্যে। রাইড করেই যাবে সে। ম্যাপ তো আছেই, দুটো ফোনেই চার্জ আছে। এক্সট্রা একসেট জামা আছে। আপাতত এটুকুই প্রয়োজন। ঢাকা পার হতেই রোজ হেলমেট খুলে ফেলল। মেইন রোডের সিগন্যাল হয়ে যাওয়া যাবেনা। শর্টকাট রাস্তা ধরে গোপনে যেতে হবে নাহলে ওকে ধরে ফেলবে ওরা।

_______________

সিয়াম ভয়ে ভয়ে বলল,
-স্যার, ম্যামের খোঁজ পাওয়া যায়নি।ম্যামের মত কিছুটা দেখতে ছিলেন উনি। কিন্তু ম্যাম ছিলেন না।
-মাথামোটা। (বিরক্তমুখে)
-জি স্যার?
-তোমার মনে হয় আমার তোমার ম্যামের কথা শুনে এখানে এসেছি? ডাফার।
-তো কেন এসেছেন? আমি তো ভেবেছি ম্যামের জন্যই এসেছেন।
-সিরিয়াল কিলার মেহমেদকে চেনো?
-না স্যার, শুনেছি নাম। কিন্তু চিনি না। কেন স্যার? (আপনাকে দেখেই তো কূল পাচ্ছি না আবার নতুন কিলার।)
-মেহমেদ আসছে এখানে। ওকে আমি এ্যাপোয়েন্ট করেছি।
-কেন স্যার?
-তোমাকে মা’রতে।
সিয়াম এক লাফ দিয়ে দরজার কোনায় দাঁড়ালো। ভয়ে চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। প্রায় কেঁদে ফেলার মত চেহারা নিয়ে বলল,
-আমি কি করেছি স্যার?
-প্রশ্ন করে করে আমার মাথা খেয়ে ফেলছো। বাবার জন্য তোমাকে সঙ্গে রাখছি, নাহলে কবেই বাড়ির বাইরে ছুড়ে ফেলে দিতাম।
-আপনি এমন বলতে পারেন না। আমি না আপনার ছোট ভাইয়ের মত?
ল্যাপটপে চোখ রেখেই ফারহান জবাব দিল,
-ভাইয়ের মত। বাট ভাই না।
সিয়াম শুকনো ঢোক গিলল। সিয়াম তো রাগ হওয়ার মত কিছু বলেনি। ফারহানের চাঁদকে নিয়েও তো ভালো কথাই বলল। ম্যাম বলে ডাকলো। শুধুমাত্র দুটো কথা বেশি বলেছে বলে স্যার লোক ভাড়া করে ওকে মা’রবে? সিয়াম আবারও মিনমিনে কন্ঠে বলল,
-স্যার!
-কি?
-সত্যিই কি মেহমেদ আসবেন?
-বিরক্ত করবে না সিয়াম। যাও গিয়ে কফি বানাও। তুমি এককাপ নিবে আর আমার জন্য আনবে। যাও।
-জি স্যার। (খুশি হয়ে)
-মেহমেদ আসলে দরজা খুলে দেবে।
-কি(অবাক হয়ে) আপনি তো আমাকে মারবেন না। তাহলে উনি কেন আসবে। প্লিজ স্যার। ভুল করে কিছু বললে মাফ করে দেন। প্লিজ। প্লিজ!
-উফ! সিয়াম। বললাম তো বিরক্ত করো না। মেহমেদ অন্যকাজের জন্য আসবে।
-কি কাজ স্যার?
-গেট লস্ট সিয়াম, এ্যান্ড ডোন্ট ডিস্টার্ব মি। ড্যাম!

মেহমেদ আসার পর থেকে ফারহানের ঘর থেকে কোনো শব্দ আসছে না। সিয়াম বার কয়েক কান পেতে শোনার চেষ্টা করল ভেতরের কথা। কিন্তু কিছুই শোনা গেল না। হাল ছেড়ে সিয়াম বসার ঘরে গিয়ে টিভি ছেড়ে দিল। ফারহান ল্যাপটপে সিয়ামের কান্ডগুলো দেখে সামনে তাকালো। মেহমেদ কফি পান করছে আর বন্দুকে গুলি লোড করছে। ফারহান নিজেও কফিমগে চুঁমুক দিয়ে বলে,
-চাঁদের পেছনে তোর কি কাজ?
মেহমেদ ফিচেল হাসে। ফারহান ল্যাপটপে নজর রেখে বলল,
-কোথায় ও?
-খুজে দেখ। আমি কেন বলবো? তোর ক্ষমতা কম নাকি যে অন্য লোকের কাছে শুনতে হচ্ছে।
-ওসব ছেড়ে দিয়েছি আমি।
-বাহ, চমৎকার। একজন ছাড়ছে তো একজন ধরছে।
-মানে?চাঁদ কোথায় মেহমেদ?কি করছে ও? চুপ থাকিস না। তোর শত্রুতা আমার সাথে। দয়া করে চাঁদকে এর মধ্যে টানিস না।
-আমি টানছি না। ও নিজেই ওর প্রয়োজনের টানে চলে এসেছে। আর আমার কাছে যতটুকু খবর আছে তাতে ওর জীবন যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ওর বিপরীতে যে খেলোয়ার আছে তারা পাঁকাপোক্ত। রোজকে ছাড়বে না তারা।
-কারা?
-সাফোয়ান আনসারীর খু’নিরা। লাস্ট রংপুরে দেখেছি রোজকে।তাও মাস তিনেক আগে। এখন কোথায় আছে জানি না। আর তোর সঙ্গে আমার শত্রুতা ছিল, এখন নেই।
-চাঁদের খোঁজ দিতে পারলে তোকে পাঁচলাখ টাকা দেবো আমি।
-তোর চাঁদকে আমিও খুজছি। টাকা লাগবে না। ওর কাছে আমার বাবার খবর আছে। সেটা দরকার আমার।
-মানে?
-মানে আনসারী সাহেবের গুপ্তচর ছিল আমার বাবা। আনসারী সাহেব মা’রা যাওয়ার আগে রোজকে কিছু তথ্য ও কোড দিয়ে গেছে। আমার বাবা সেসব রক্ষার দায়িত্ব পালন করছিলেন। বাবা আমাকে পছন্দ করতেন না। আমার গুন্ডামির জন্য, তাই সেসব তথ্য টাকা নিয়ে উনি আমাকে না জানিয়েই অন্য কোথাও গিয়ে লুকিয়ে আছেন হয়তো। আর এসবের খবর তোর চাঁদ জানে। সেটা বলার জন্যই তোকে সকালে ফোন দিয়ে এখানে আসতে বললাম।
-কি তথ্য? কত টাকা?
-কালো টাকা, চোরাচালানজনিত তথ্য, ইউনিটের কিছু বিশ্বাসঘাতকের তথ্য, যারা দেশের সামনে দেশের রক্ষক, আর পেছনে ভক্ষক। তাই তোকে বলতে এসেছি তোর চাঁদকে খুজে বের কর। একা খেলাটা জিততে পারবে না ও। আমরা অবধি এখনও কিছু করতে পারি নি। আনসারী সাহেব কিছু করতে পারেননি। ওই বাচ্চা মেয়ে কি করবে?
-আমার গ্যাং নেই। বছর তিনেক আগে সব ছেড়েছুড়ে দিয়েছিলাম অভিনয়ের জন্য। তাই একা কিছু করা সম্ভব না।
-আমি হেল্প করতে রাজি কিন্তু বিনিময়ে আমার টাকা চাই।
-এই মাত্র না বললি তোর বাপ চাই?
-কালোটাকার একটা শেয়ারও চাই। যেটা তোর চাঁদ দেবে না। টাকাটা তুই দিবি।
-জাতে মাতাল, তালে ঠিক। ব্ল্যাং চেক এটা। কত লাগবে লিখে নিস। (চেকটা এগিয়ে দিয়ে)
-লাগবে না। দেখছিলাম চাঁদ তোর জীবনে কতটা গুরুত্ব রাখে। কার জন্য নিজের সবকিছু ছাড়ছিস। তা ও তোর বউ নাকি প্রেমিকা?(চেক ফেরত দিয়ে)
-দুটোই।
-তো ভাবির খোঁজ জানিস না কেন?
-অভিমান করে চলে গেছে। যাক, শুরু থেকে শুরু কর। চাঁদ কোথায় ছিল, কি করছিল, সবটা বল।

__________

হাত-পা বাঁধা অবস্থায় অন্ধকার ঘরটির মেঝেতে পড়ে আছে এক ব্যক্তি। কাঠের তৈরি বাড়িটির ভিত প্রচন্ড নড়বড়ে। যেকোনো সময় ভেঙে যেতে পারে। রোজ উঠে ধীরে সুস্থে লোকটার বাঁধন খুলে তাকে তুলে বাইরে এনে বসালো। ব্যাগ থেকে পানির বোতল খুলে তাকে পানি খাইয়ে বলল,
-ঠিক আছেন?
-কে তুমি? আমার খোঁজ পেলে কি করে? কার হয়ে কাজ করো?
-আমি সাফোয়ান আনসারীর মেয়ে কাকু। আমাকে কি চিনতে পারছেন না? আপনার সঙ্গে মিলে বাবাকে রাগাতাম আমরা। মনে নেই? আমি সেই রোজ।
-রোজ,,, তুমি এখানে কিভাবে আসলে? মা।
-পরে বলবো। এখন দ্রুত চলুন। ওরা এসে পড়বে। ব্যাথা আছে নাকি অনেক? ডাক্তারের কাছে যাবেন আগে?
-না, লাগবে না। এটুকুতে কি হবে? তুমি তোমার কথা বলো। আমি এখানে আছি জানলে কি করে?
-আসলে বাবা আমাকে একটা ডায়েরি দিয়েছিল। সেই ডায়েরিতে সব লেখা ছিল।
-ডায়েরিটা পেয়েছ তুমি? (অবাক হয়ে)ওরা সেটা হাতে পায়নি জেনেছিলাম। ভেবেছিলাম রেণু ভাবি লুকিয়ে ফেলেছে। পরে রেণু ভাবির মৃ’ত্যুর খবর শুনে সব আশা ধুলিশাত্ হয়ে গিয়েছিল।
-না, বাবা ওটা আমাদের ফার্মহাউজে রেখেছিল। বাড়ি ডায়েরি রাখার মত ভুল করেনি।
-আনসারী সাহেব মানুষটাই এমন! উনি জেনে গিয়েছিলেন ইউনিটের মানুষ ওনার সঙ্গে প্রতারণা করে ওনাকে মে’রে ফেলার চেষ্টা করবে তবুও নিজের কথা ভাবেননি।
-ওই সব প্রতারককে তাদের প্রতারণার ফল পেতে হবে কাকু। আমি কাউকে ছাড়বো না। কাউকে না।
-তুমি মেয়ে, তারওপর ওদের ছলচাতুরী বুঝবে না মা। এসবের মধ্যে ঢুকো না। ওরা ভয়ঙ্কর মানুষ। আনসারী সাহেব অবধি ওদের সঙ্গে পেরে ওঠেননি।
-কারন বাবা ভালো মানুষ ছিলেন। আমি ওতটাও ভালো নই কাকু। প্রতিটা কেউটেকে আমি গর্ত থেকে বের করে ওদের বিষদাঁত ভেঙে যন্ত্রণা দিয়ে শেষ করবো।
-পারবে না, ওরা মানুষের পর্যায়ে পড়ে না। ওদের কোনো দূর্বলতা নেই। ওরা একবার যদি জানে তোমার দূর্বলতা আছে,তাহলে তোমাকে শেষ করতে ওদের এক সেকেন্ডও লাগবে না। তোমার আঙ্কেলরা, আঙ্কেলদের পরিবার।
-ওরা জানবে না। কারন আঙ্কেলদের আমি কষ্ট দিয়ে চলে এসেছি। ফালাক ভাইয়ার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছি তাতে সবাই বুঝবে আমি ফালাক ভাইয়াকে ভালো বাসতাম। এখন বাসি না। আর ওদের প্রতি আমার দূর্বলতাও নেই।
-ওরা তোমার ওপর কখন থেকে নজর রেখেছে?
-আমি দেশে ফেরার পর থেকেই দেখছি কিছু মানুষ আমার চারপাশে ঘুরঘুর করে। প্রথমদিকে বুঝিনি পরে ডায়েরি পড়ে টের পেয়েছি। তখন থেকেই নানুবাড়িতে থেকেছি। নানু মা’রা গেলে ঢাকায় ফিরে সব খোজখবর রাখতে শুরু করি। আপনার ছেলে মেহমেদও অনেকটা ভালো হয়ে গেছে কাকু। এখন আর খু’নোখু’নি করেনা। আপনি ফিরে যান তাঁর কাছে। এই মিশনটা আবার বাবার। আমি চাইনা, এই মিশন কমপ্লিট করতে গিয়ে আমার মত আর কেউ বাবা মা’কে হারাক। আপনার ফেরার টিকিট কেটে রেখেছি। আজ রাতের ট্রেনেই ফিরে যাবেন। আপনার সঙ্গে এখানকার একটা দলও যাবে। ওদের সঙ্গে মিশে কোনোরকমে ঢাকায় পৌঁছালে মেহমেদ ভাই আপনাকে নিয়ে যাবে। টেক্সট করে দিয়েছি আমি। বাবার পরে এই মিশনটা শুধু আমার কাকু। জানিনা আমার পরিণতি বাবার মত হবে কিনা। কিন্তু বাবার মত ভুল করবো না আমি। দেশের সম্পদ ও আবর্জনার সব প্রমাণ ঠিক পৌঁছে যাবে, সেটা আমি বেঁচে থাকি অথবা না থাকি।

রোজ হাটতে হাটতে কিছুদূর যেতেই ওর চোখ পড়ল রাস্তার ধারের শিমুল গাছটার ওপর। শেষ যেবার রোজ এসেছিল সিলেটে, বাবার সঙ্গে। সেদিন এই গাছে সে উঠেছিল। গাছের ডালে বসেছিল। অনেক আবদারের পর বাবা উঠিয়ে দিয়েছিল। রোজের চোখ বেয়ে পানি পড়ল।রোজ চোখ বুজতেই ডায়েরির লেখাগুলো চোখে ভেসে উঠলো। ডায়েরিতে আনসারী সাহেব রোজকে লিখেছিলেন,

জীবন একটা জটিল সমীকরণ রোজ। তোমাকে এই সমীকরণের সমাধান নিজেকেই খুজে বের করতে হবে। তোমার প্রয়োজন তুমি নিজে বুঝবে। অন্যকেউ বুঝবে না। যেমন, তোমার তৃষ্ণা পেলে তুমি বুঝতে পারবে। বাকিরা ততক্ষণ বুঝবে না যতক্ষণ না তুমি বুঝতে দাও। কখনও হার মানবে না, রাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখবে। কারন ক্রোধ হচ্ছে ধ্বংস। রেগে গেলে তুমি যেকোনো কাজে হেরে যাবে। রাগ মানুষের মস্তিষ্ক অনলে জ্বালিয়ে দেয়, আর তাতে নিয়ন্ত্রণ না রাখলে দেখবে পরিস্থিতি সেই অনলে ঘি ঢালছে। সর্বদা মনে রাখবে তুমি পারবে। তুমি মেয়ে, কিন্তু দূর্বল নও। আমি না থাকলেও তুমি থাকবে, আমি জানি আমার মেয়ে একদম তাঁর বাবার মত। কখনও নিজেকে ছোট করে দেখবে না, অসহায় ভাববে না, ভালোবাসবে সবাইকে। আমি জানি তুমি বয়সের তুলনায় একটু বেশি ম্যাচিউর তাই বলছি। ফালাক তোমাকে চায়, ওকে কষ্ট দেবে না। আমি থাকছি না, আমার দায়িত্ব থাকছে। সে দায়িত্ব তুমি পালন করবে। জীবনে নানা বিপর্যয় আসবে, ভয় পাবে না। ভয়কে জয় করে সামনে এগিয়ে যাবে। তুমি ভাবতে পারো, তোমার জীবনের ঝুঁকি অনেক বেশি তাই ফালাকের থেকে দূরে যাবে। কিন্তু এটা সঠিক সিদ্ধান্ত না মা। আমিও তো অনেক রিস্কি কাজ করি। তবুও তোমার মা’কে ভালোবেসে বিয়ে করেছি।সংসার করেছি তাহলে তুমি কেন একা থাকার কথা ভাববে? তুমি ওকে চাও সেটাও জানি আমি। তোমাদের বন্ধুত্বের রূপ এমন থাকবে না। তাই সময়ের সঙ্গে আবেগ অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করতে শেখো। সর্বদা মাথায় রাখবে, তোমার জন্য যেন অন্যকেউ কষ্ট না পায়,অন্যকেউ বিপদে না পড়ে। মা’কে দেখে রাখবে। তুমি ছাড়া রেণুর কেউ থাকবে না। মায়ের অবলম্বন হবে। রেণু অল্পতে অনেক কষ্ট পায়, কাঁদে। আমার চলে যাওয়া ও মেনে নিতে পারবে না। তাই তুমি ওকে সামলাবে। আমি জানি আমার মেয়ে সেটা পারবে। তোমার বাবা তাঁর একমাত্র রাজকন্যাকে অনেক ভালোবাসে প্রিন্সেস। নিজের রেখাল রাখবে। আমাকে মনে করে কাঁদবে না, আমি কষ্ট পাবো তাহলে। ভালোবাসি আমার কলিজার টুকরা, আমার মেয়ে, আমার রাজকন্যা সাইরাহ্ আনসারী রোজা! ওহ স্যরি তোমার নাম তো কে’টে রোজ করা হয়েছে। আবারও বলছি রেণুর পাশাপাশি যে তোমার নাম কে’টেছে তাকে ভালোবাসবে।সবার সঙ্গে সাবধানে থাকবে। আমি জানি ফালাক তোমার কোনো ক্ষতি হতে দেবে না। তাই এখন নিশ্চিন্তে ম’রতেও পারবো।
তোমার বাবা….. সাফোয়ান আনসারী।

চলবে?

তুই হবি শুধু আমার পর্ব-১৫

0

#তুই হবি শুধু আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_পনেরো

আরশানদের বিয়ের তারিখ পুনরায় ঠিক করা হয়েছে। আজ ওদের পুনর্মিলনের একবছর পূর্ণ হলো। আর বিয়ের তারিখটাও আজ। গতবছর ঠিক এই তারিখেই আরশানের সঙ্গে অয়ন্তির ক্যাফেতে দেখা হয়েছিল। আর বিশ্রি একটা ঘটনাও ঘটেছিল ভেবেই লাজুক হাসে অয়ন্তি। অনার্সের প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শেষ। রেজাল্ট বের হওয়ার আগে অয়ন্তি বিয়ে করতে চায়নি কিন্তু না চাইতেও বিয়েটা করতে হচ্ছে শুধু অরুনির জন্য। কিছু একটা ঘাপলা আছে মেয়েটার মাঝে। রোজের কথাটা যাচাই করেও দেখেছে অয়ন্তি। কিন্তু মেয়েটা এতটা চালু যে ধরা যায়নি। আশরাফ সাহেবও বিষয়টা লক্ষ করে বিয়ের তারিখ ঠিক করলেন।

যথারীতি বিয়ের সকল অনুষ্ঠান পালন করা হলো। আজ রাতে অয়ন্তিরা এবাড়িতেই থাকবে। অয়ন্তিদের বাড়ির নিয়ম এটা। বিয়ের পর প্রথম দিন নাকি মেয়েরা বাবার বাড়িতেই থাকে। আরশান হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে নিয়ম দেখে। কিন্তু সে হাসি বেশিক্ষণ টিকলো না। রাতে খাবার টেবিলে বসতেই হাসি সারারাতের জন্য উবে গেল। বাড়ির নিয়ম অনুসারে জামাইয়ের পাতে যতটুকু খাবার দেওয়া হবে সব খেতে হবে। এটা কোন দেশের রীতি? আরশান উঠে যাবে তার আগেই অয়ন্তির বাকি ভাইবোন এসে চেপে ধরে আরশানকে বসিয়ে দিল। প্রায় দশ পনেরো পদের রান্না। এত খাবার খেলে তো পটলের তরকারি খেতে হবে না, বরং নিজেই পটল তুলবে। অয়ন্তি ঠোঁট টিপে হাসছে। আসলে এসব কোনো রীতি নয়। নতুন দুলাভাইকে পেয়ে ওর ভাইবোনেরা তাকে জব্দ করার চেষ্টা করছে। আর আজ এ বাড়িতে থাকবে কারন অয়ন্তির শরীর ভালো লাগছে না।

বাসরঘরটা দারুনভাবে সাজানো হয়েছে। হরেকরকম ফুল,মোমবাতি! অয়ন্তি খাটের মাঝ বরাবর বসে আছে। আরশান পেট নিয়ে হাটতেও পারছে না। যা যা গেলানো হয়েছে তা থোকা থোকা জমে আছে পেটের মধ্যে। কোনোরকম দেহটাকে টেনে এনেছে সে। দরজা লাগিয়ে বিছানার কাছে আসতেই অয়ন্তি সালাম দিল। আরশান উত্তর দিয়ে বিছানায় বসতে বসতে বলে,
-তোমার পরিবার আমার সঙ্গে দুর্নীতি করেছে কুসুম। মানুষ খায় এনার্জি পাওয়ার জন্য, আর অতিরিক্ত খায় তা খোয়ানোর জন্য। দেখো, খেতে খেতে ক্লান্ত আমি। নড়তেও পারছি না, আমার বাসররাত চাঁন্দে গেল।
-ফালাক ভাইয়াকে দেখলাম না কেন?
-তোমার স্বামী আমি, তুমি আমার কথা ভাববে। তা না আমার ভাইয়ের কথা ভাবছো। কাহিনি কি?
-রোজ আবারও উপহার পাঠিয়েছিল। তারপর থেকেই উনি নিঁখোজ তাই জিজ্ঞেস করছি। কিছু করে টরে বসে যদি?
-ও পাগল। কিন্তু ওতটাও না। নিজের ক্ষতি করবে না। রোজ কষ্ট পাবে তাহলে।
-এদের মিল কি হবে না? একবছর হয়ে গেল। রোজের পাত্তা নেই।
-আজকের রাতটা শুধু আমাদের হোক?
-কিন্তু,,, আচ্ছা।
-ওযু আছে তোমার? সালাত আদায় করতে হবে।
-হ্যাঁ।
-আসো।
সালাত আদায় করে আরশান বিছানায় বসে অয়ন্তিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-লাইটটা বন্ধ করে আসো।
-কেন?
-জ্বালিয়ে রাখতে চাইলে রাখো। তাতে আমারই লাভ। তুমি লজ্জা পাবে যখন তখন সেই চেহারা দেখতে আমার ভালো লাগবে।
অয়ন্তি লজ্জা পেল। গাল লাল হয়ে উঠলো। কান গরম হয়ে গেছে। আরশান খোঁচা মেরে বলে,
-এখনও তো কিছু করলাম না, তাতেই এই রিয়াক্শন? করার পর তো তোমার প্রতিক্রিয়া খুজেই পাওয়া যাবে না।
-অসভ্য।
-মানে টা এখনও বুঝিয়ে দেইনি। আজ সময় সুযোগ দুটোই আছে।
বলেই নিজে উঠে গিয়ে লাইট বন্ধ করে দিল আরশান। এরপর লাইটের সুইচের পাশে দাড়িয়ে থাকা অয়ন্তিকে পাঁজকোলা করে তুলে নিল। অয়ন্তির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
-আজ পালাবে কোথায়? সম্পর্কটাও বৈধ আর স্পর্শও। বৈধতার কারনে তোমার সম্মতিও আছে নিশ্চই।

_______________

ক্লাস শেষ অবিশ্রান্ত শরীর টেনে ফিরছিল রোজ। কাধে কলেজ ব্যাগ, হাতে বাজারের ব্যাগ। ঘামে জামা শরীরে সঙ্গে লেপ্টে আছে। এমন অবস্থায় কিছু ছেলেকে পেছনে আসতে দেখে বিচলিত হলো রোজ। নিজের জন্য নয়, ছেলেগুলোর জন্য। এমনিতেই ওর মেজাজ আজ প্রচন্ড খারাপ তার ওপর এরা। রাগ উঠে গেলে কি হবে তা রোজ নিজেও জানে না। কানে ব্লুটুথে অতিরিক্ত ডি.আই.জি সাহেবের সঙ্গে কথা বলছে ও। আনসারী সাহেবের কেসটা নিয়েই মূলত কথা বলছে। বাবা’মায়ের হত্যাকারীকে এত সহজে ছেড়ে দেবে? বাবার স্বপ্ন ছিল রোজ জার্নালিস্ট হবে, সে চেষ্টা তো করছে রোজ। আর নিজের স্বপ্ন? বাবা-মায়ের হত্যাকারীকে খুজে শেষ করা। তাই বাবার পেশার প্রতিও সমান গুরুত্ব দিচ্ছে সে। ছোট থেকে ওর মস্তিষ্ক বেশ প্রখর বলে এক সাথে দুটো দিকই মিলিয়ে চলতে পারছে। ডাক্তারি পড়লে এটা হত না। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর রোজকে যখন বলা হয় জার্নালিজমের চিন্তাও বাদ দিতে তখন রোজ সেটা পারেনি। যদিও কারোর মুখের ওপর না বলেনি। কিন্তু মনে মনে সে নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিল। আমীর আঙ্কেল, ফারদিন আঙ্কেল কখনও রোজকে জার্নালিজমে পড়তে দিতেন না। আরশানও লাইব্রেরিতে এসেছিলো রোজকে আটকাতে। ফালাকও নিশ্চই এখন সবটা জানার পর রোজকে বাঁধা দিত। এত মানুষের মন দুখিয়ে, রোজ তাদের সামনেই জার্নালিজমে পড়তে পারবে না বলে আজ একা অন্য শহরে চলে এসেছে। তাছাড়া ফালাকের ওপরও তো প্রচন্ড রাগ ও অভিমান জমা আছে।

প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। শর্টকাট রাস্তায় ঢুকে পড়ায় এদিকটায় মানুষজনও কম। ছেলেগুলোর হাটার গতি বৃদ্ধি পেল। রোজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই হাটছে। পনেরো দিন হলো সে বাবার পেশায় সরাসরি যুক্ত হওয়ার জন্য ক্যারাটে আর প্রতিরক্ষার কিছু কৌশল শিখেছে। সেগুলো এত তাড়াতাড়ি কাজে লাগবে? রোজের কি উচিত সেগুলো পরীক্ষা করা?কেমন শিখেছে সে? সেটা জানতে এখনও মাস তিনেক বাকি। এ্যান্টি টেরোরিজম ডিপার্টমেন্টে রোজকে তিনমাস প্রশিক্ষণ দিয়ে তারপর রোজের কাজ সম্পর্কে অবগত হবেন তারা। রোজের জন্যই শুধু ভিন্ন নিয়ম, কারন সে মেয়ে এবং আনসারী সাহেবের ক্ষমতার কারনে রোজকে অতিরিক্ত সুযোগ দেওয়া হবে। ছেলেগুলো কাছাকাছি চলে আসতেই রোজ হাসলো।ফালাক থাকলে কি করতো? এগুলোকে পিস পিস করে কে’টে ফেলতো। ভাগ্গিস সে নেই। রোজ হাতের ব্যাগগুলো রাস্তার ওপর রেখে পেছনে ফিরে তাকালো।
-অনেকক্ষণ ধরে দেখছি, শুধু ফলো করছেন। আর কিছু করার ইচ্ছে নেই নাকি? আপনারা আমাকে কিছু না করলে আমিও তো করতে পারছি না।

ছেলেগুলো রোজের কথার ভিন্ন মানে ধরে নিয়ে এগিয়ে আসলো। রোজ স্মিত হেসে ওরনা আড়াআড়ি বেঁধে নিল। জামার হাতা গুটিয়ে কনুইয়ের ওপর তুলতে না তুলতেই একজন অশ্লীল বাক্য ছুড়ে রোজের হাত ধরে টান দিতেই রোজ মৃদু হাসে। এরপর ‘স্যরি’ বলেই সে ছেলেটার পুরুষাঙ্গ বরাবর লাথি দিল। প্রথমেই এমন কাজ করতে চায়নি রোজ। হাতা গোটানোর সময় দেয়নি ওরা তাই রেগে গিয়ে প্রথমেই মেইন এ্যাটাক করে বসেছে। তার জন্য রোজ প্রচন্ড দুঃখিত বোধ করেছে। দুঃখিত বললেও ছেলেগুলো সে কথা পাত্তা না দিয়ে তেড়ে আসলো। রোজ ব্যাপক মুডে আসলো এবার। দুপক্ষই সমান চটে আছে। এবার গড়ে পেটানো সম্ভব। পাশ থেকে শুকনো ডাল তুলে নিয়ে রোজ ইচ্ছে মত পেটালো সবাইকে। বখাটে এরা, একটু আকটু বখাটেগিরিই করে বোধ হয়। তাই মা’রপিট তেমন জানে না। তা ওদের আনাড়ি হাতাহাতিতেই বোঝা গেল। ওদের মে’রে রোজ দাঁড়িয়েই থাকলো। অনুশোচনা হচ্ছে খুব। কলেজের রাগও এদের ওপর মিটিয়েছে। এতটা রাগ ঠিক ছিল না। এদের কি গাড়িতে তুলে দেবে? হাতে তো তেমন টাকাও নেই যে চিকিৎসার জন্য দেবে। রোজ এগিয়ে আসতেই ছেলেগুলো গড়িয়ে, দৌড়ে চলে গেল। রোজ হা করে চেয়ে আছে। মা’রটা বেশি হয়ে গেছে। ওরা ভয়ও পেয়েছে। রোজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যাগগুলো তুলে হাটা শুরু করল। বাড়ি পৌঁছাতে আর মিনিট দশেক লাগতে পারে।

______________

গোসল সেরে অয়ন্তি কলাপাতা রঙের একটা শাড়ি পড়েছে। ভেজা চুলগুলো ছেড়ে রেখেছে। আরশানের ঘুম ভাঙেনি এখনও। বরাবরই দেরিতে ওঠে সে। কিন্তু বিয়ের পর কিছু নিয়ম আপনাআপনি বদলে যায়। এই নিয়মটাও বদলাতে হবে। যথাসময়ে ঘুম এবং সজাগ হতে হবে। অয়ন্তি আরশানের ঘুমন্ত মুখের দিকে কিছু সময় চেয়ে থেকে ফালাকের মুভির কথা ভাবলো।চুলের পানিতে নায়কের ঘুম ভাঙানোর সীন। ওটা করলে কি অদ্ভুত দেখাবে? শাড়ির আঁচল গুজে নাকে সুড়সুড়ি দিলে কেমন হয়? না থাক! মানুষটা অতিমাত্রায় বউ সোহাগী! দিনের বেলায় ধরলে যদি না ছাড়ে? তাই এসব চিন্তাকে মাথা থেকে নামিয়ে অয়ন্তি ডাক দিল।আরশান ঘুমে বিভোর। সাড়া-শব্দ নেই। অয়ন্তি আবার ডাকে। না উঠছে না। সকাল আট’টা বাজে। এখনও ওঠে না কেন? অয়ন্তি দুষ্টু হেসে খানিকটা চেঁচিয়ে বলে, ‘আররে রোজ! তুমি? কখন এলে?’ ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো আরশান। বাসরঘরে বইন আসলে মানইজ্জত শেষ।ঘোরের মধ্যেই নাম শুনে যার এমন অবস্থা সামনে থাকলে সে কি করতো? অয়ন্তি হাসতে হাসতে টেবিলের ওপর উঠে বসেসে পড়ে। আরশান চোখ পিটপিট করে খুললো। তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত মানুষটিকে আজ বড্ড উৎফুল্ল ও প্রসন্ন দেখাচ্ছে। প্রাণোচ্ছল, প্রাণবন্ত লাগছে। আরশান উঠে বাথরুমে যেতে যেতে বলে,
-কাজটা ঠিক করলে না কুসুম। এর শাস্তি তোমাকে পেতে হবে।
-হু! যান আগে গোসল সেরে আসুন।
-বাহ, দারুন জ্ঞান আছে তোমার। একবছরে এতকিছু শিখে ফেলবে ভাবিনি।
-ভাবতে হবে না।
-ভাবলাম না, পরে যেন বলো না। ভেবে কাজ করতে পারেন না? (ব্যাঙ্গসুরে)
-আবার শুরু করলেন? সরুন, যান।
-যাচ্ছি।

খাবার টেবিলে ফারহানকেও দেখলো ওরা। ফারহান চুপচাপ খেয়ে চলেছে। পাশের ফোনটা অনবরত বেজে চলেছে আরশান ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো কে ফোন দিচ্ছে।প্রডিউসার আলম! আরশান বসতে বসতে বলে,
-ফোন রিসিভ কর।
-দরকার নেই।
-একেবারে বাদ দিচ্ছিস অভিনয়?
-হুম। চাঁদকে কষ্ট দেওয়ার তুলনায় স্বপ্ন বাদ দেওয়া নিতান্তই তুচ্ছ।
-সাবাশ বেবি!!
-সাবাশ বেবি, কেন?
-তোর মত সাইকোকে সিধে করে ফেলছে।
-কি করবো বলো? আগে জেদ করে, রাগ করে, সন্দেহ করে, ওকে ভুল বুঝে, ঘৃণা করে পাঁচবছর কাটিয়ে এসে যখন জানলাম আমার পুরোটাই ভুল ছিল। তখন বুঝতে পারলাম আমি মানুষটা ঠিক নই। তোমার কাছে ও ছিল ভেবে শান্তিতে ছিলাম। আর এখন? সবকিছু শূণ্য শূণ্য লাগছে। কোনো কাজে মন বসছে না। অভিনয় তো হচ্ছেই না।
-সব ঠিক হয়ে যাবে।
-চাঁদের অভিমান আমার রাগের চেয়েও ভয়ঙ্কর দাদাই। তুমি তো জানো এটা। এত সহজে সব ঠিক হবেনা। ও যদি আমাকে মে’রেও ফেলতো এত কষ্ট হত না।
-ফালতু কথা বলবি না। চুপচাপ খা। তবে হ্যাঁ, রোজের এভাবে চলে যাওয়া উচিত হয়নি। তুই পাঁচবছর নষ্ট করেছিস এবার ও পাঁচবছর নষ্ট করার চেষ্টা করছে। সময়ের মূল্য দিতে জানিস না তোরা।

খেতে খেতে ফারহান ডুব দিল অতিতে। রোজের তখন সাড়ে তিনের একটু বেশি বয়স। ফারহান আর ও হাটতে বেড়িয়েছিল। রাস্তায় ফারহানের ক্লাসের একটা মেয়ের সঙ্গে ফারহানের দেখা হলে সে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে যায়। বাচ্চা রোজ তখন একাকি বোধ করে বাড়ি ছুটে এসে কান্না জুড়ে দিল। ফারহান পিঁছু পিঁছু আসে। কিন্তু ততক্ষণে নালিশ ঠুকে দেওয়া সারা। ফারিয়া লাঠি হাতে দাঁড়ালেন, রেণু আন্টি গম্ভিরমুখে চেয়ে আছেন। বাড়িতে ঢুকতেই ফারিয়া সপাৎ করে বারি কষলেন ছেলের হাতে। ফারহান হতভম্বচোখে সামনের সোফার বসা গাল ফোলানো মেয়েটার দিকে তাকায়। সেও বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে। চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছে কেঁদে। ফারিয়া চেঁচিয়ে বললেন,
-এমন কেন করেছ ফালাক? তুমি জানো না তুমি ছাড়া রোজের কোনো বন্ধু নেই। তোমার জন্য রোজের বন্ধু হয়না। আর তুমি রোজকে রাস্তায় দাড় করিয়ে নিজের বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করো? যাও মাফ চাও ওর কাছে। (ফিসফিসিয়ে) কাঁদতে কাঁদতে দম আটকে যাচ্ছে ওর। ওকে চেতালি কেন? যা, রাগ ভাঙা।
-যাচ্ছি।

ফারহান রোজের কাছে যেতেই রোজ গাল ফুলিয়ে দু হাত সামনে বেঁধে বসে। ফারহান ওর পায়ের কাছে হাটু গেড়ে বসে বলল,
-স্যরি! আর এমন হবে না।
রোজ মুখ ঘুরিয়ে নিল।
-স্যরি বলছি তো। স্যরি, স্যরি, স্যরি, স্যরি স্যরি। অনেক গুলো স্যরি।
-পা ধরে।
-কি? তোর চেয়ে আমি কত বড় জানিস? আমাকে পা ধরতে বলছিস।
-পা ধরে। (একগুঁয়ে কন্ঠস্বর)
ফারহান নিরুপায় হয়ে রোজের পা ধরে ‘স্যরি’ বললেও সেই স্যরিতে মাফ করা হলো না।
-আবার কি?
-তুমি পঁচা। খুব পঁচা! তোমার সাথে কথা নেই।
রোজ উঠে দৌড়ে চলে গেল নিজের ঘরে। ফারহানও চলল সেদিকে। চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,
-আরে বাবা তোর পা ধরেই তো স্যরি বললাম। আবার কি হলো?
ঘরে ঢুকেই ফারহান দেখলো রোজ বিছানার ওপর বসে কেঁদেই চলেছে। বালিশের চাদরে নাকের সর্দি মুছতে মুছতে সে ফারহানের দিকে তাকালো। ফারহান ভ্রুকুটি করে চেয়ে আছে। রোজ বাবার ফোনের গেইম চালিয়ে খেলতে শুরু করে। ফারহান পাশে বসে টিস্যু এগিয়ে দেয়। রোজ নিল না।
-রাগ হয়েছে? রোজের তো রাগ হয়না। সে তো কখনও রাগ করেনা।
রোজ বা হাতের উল্টোপিঠে সর্দি লাগাতেই ফারহান হাত চেপে ধরে টিস্যু দিয়ে তা মুছে দিল। রোজ ব্যাথায় জোরে কেঁদে ওঠে। ফারহান রাগি কন্ঠে বলে,
-একদম কাঁদবি না। নাকের পানি চোখের পানি এক করার মত কি হয়েছে? স্যরি বললাম তো। মাফ করলে কর নাহলে করার দরকার নেই। কিন্তু এত কাঁদা যাবে না।
রোজ চুপ করে বসে রইলো। ফারহান উঠে রোজের পাশে বসে রোজকে কোলে নিতেই রোজ বলল,
-যাবো না। কোলে উঠবো না। তোমার বন্ধুকে ওঠাও। আমি তুরান ভাইয়ার কোলে উঠবো।
-তুরান কে?
-রাস্তার ওপারে বাড়ি।
-তোর বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ। তোকে বলেছি না? তোর বন্ধু আমি। আর কাউকে লাগবে না। তোর যা চাই সব আমি দেবো।
-না তোমার বন্ধুদের দাও। আমার লাগবে না।
-তাহলে চলে যাবো আমি? যাবো চলে?
রোজ আবারও কাঁদলো। পেটে মধ্যে গুড়গুড় শব্দ হচ্ছে।খিদে লেগেছে। ফারহান চকলেট কিনে এনেছিল। পকেট থেকে চকলেটগুলো বের করে সে রোজকে দিল। রোজ সেগুলো ছিনিয়ে নিয়ে খেতে শুরু করে। ফারহান রোজের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
-তোর চুলগুলো তো বেশ লম্বা হয়ে গেছে চাঁদ। গরম লাগে না? টাক হতে হবে।
-না।
-কেন?
-তুমি টাক হওনি, আমিও হবো না। তোমার বন্ধুও তো টাক না। আমি টাক হলে সবাই হাসবে।বলবে, টাক টাক চারানা চাবি দিলে ঘোরে না, টাকের কি অবস্থা আলুর দাম সস্তা। টাকবেল, কতবেল, কমলা বেল।
ফারহান হাসল,
-কমলা বেল কি জিনিস?
-ওই যে আঠা থাকে। শরবত খায়। কমলা কমলা।
-কিন্তু চুল না কাটলে তো ঘামাচি হবে। গরমে ঘেমে ঠান্ডা লেগে যাবে।
-লাগুক। তোমার কি? আমি তো তোমার বন্ধু না। তাই আমাকে ফেলে তুমি চলে গেছিলে। তোমার সঙ্গে কথা বলবো না।
-এত অভিমান?
-অভিমান? সেটা কি?
-কিছু না। আচ্ছা বল, কি দিলে কথা বলবি?
রোজ কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
-তুমি আমাকে ছাড়া কাউকে চকলেট দেবেনা। আমার বন্ধু থাকবে। আর কারোর না, আমারও তো বন্ধু নেই। কেউ আমার সাথে খেলে না। তাহলে তোমার সঙ্গে ওরা খেলবে কেন? ওত বড় বড় বন্ধু কেন তোমার? আমার তো তুমি ছাড়া বড় বন্ধু নেই।
-আচ্ছা আর কাউকে চকলেট দেবো না। কোনো বড় বন্ধু বানাবো না। ঠিক আছে?
-কাল আমি টাক হলে তুমিও টাক হবা তো?
ফারহান নিজের ঝাঁকড়া চুলগুলোর দিকে তাকাল।কত কষ্টে বড় করেছিল। সাইজ করে সেপে এনেছিল। কে’টে ফেলতে হবে বলে? এত সাধের চুলগুলো। না কাটলে তো রোজের অভিমানও কমবে না। কাঁদতে কাঁদতে কাঁদুনি রোগ বাঁধিয়ে ফেলবে। পরে বাড়ির সবাই ওকেই বকাবকি করবে।রোজ আবার বলে,
-হবা না?
-হতে হবে? আমার চুলগুলো দেখ কত সুন্দর।
-ঠিক আছে। টাক হতে হবে না। তুমি কেন টাক হবা? আমার কথা তো শুনবা না। আমিও শুনবো না। তোমার চকলেট খাবো না। থু, থু, ওয়াক। সব বমি করে ফেলে দেবো।
-উফ। ঠিক আছে কে’টে ফেলবো। টাক হয়ে ঘুরবো।
রোজ শুনলো না। টানা দশদিন কথাও বললো না। শেষে এগারো দিনের মাথায় যখন ফারহান চুল কে’টে টাক হয়ে আসলো রোজ সেদিন কথা বলেছিল। সারাবাড়ি দৌড়ে সবাইকে ডেকে ডেকে ফারহানের টাক হওয়ার কথা বলে শান্ত হয়েছিল। সামান্য একটা কারনে ওমন বাচ্চাবয়সে রোজ যদি এত অভিমান করতে পারে তা হলে এই মারাত্মক ঘটনায় রোজের এক আকাশসম অভিমান তো অনিবার্য ছিল। রোজের কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ভীষম লাগায় ফারহানের নাকে ভাত উঠে গেল। অয়ন্তি পানি এনে ফারহানকে দিতে দিতে বলে,
– কি করছ ভাইয়া? সাবধানে খাবে তো।কি ভাবছো এত?
-কিছু না।
আরশান খোঁচা মে’রে বলে,
-কি আবার? নিশ্চই বেবিকে গোসল করানোর ওই সীনটার কথা ভাবছিল। আরে বাচ্চার গোসলে কি আসে যায়, বড় হওয়ার পর করালে নাহয় কাজে…
ফারহান চোয়াল শক্ত করে আরশানের কথা থামিয়ে বলে,
-তুমি থামবে দাদাই? বউ পেয়ে অনেক উড়ছো। আমার কথা তো ভাবছোই না। সিঙ্গেল পুড়ে কয়লা হচ্ছি আর তুমি ওর কথা মনে করিয়ে দহন বাড়াচ্ছো?
-তোর দহন বাড়াতে আমার দারুন লাগে। বিয়ের পর তো তোকে ডেডিকেট করে একটা লাইনই সারাদিন বলতে ইচ্ছে করে।
-কি?
-”দেখ কেমন লাগে!!” সেদিন হাইপার হয়ে কান্ডখানা না ঘটালে তোর পাশের সীট ভরাই থাকতো।
-ধ্যাত খাবোই না।
অয়ন্তি বাধ সাধলো।
-না খেয়ে উঠতে নেই ভাইয়া। খেয়ে নাও, এমনিতেই তো পছন্দমত খেতে পারছো না।ডায়েটিংও বন্ধ!মনমেজাজ খারাপ। এত কম খেলে শরীর খারাপ করবে।
আরশান হা-হুতাশ করে বলে,
-কুসুমের কথা শোন। আমাকে তো বলেনা। তোকে তাও বলছে। আশ্চর্যবস্তুগুলো শুধু তোর আর বেবির কপালে থাকে। আমার কপাল তো,
-বকবক না করে খান। (ধমক দিয়ে বলে)
-তুমি আমাকে ধমকাচ্ছো কুসুম? আমাকে? (রেগে)
-হ্যাঁ। তো? (দ্বিগুণ রেগে)
-না কিছু না। খাচ্ছি।

চলবে?

তুই হবি শুধু আমার পর্ব-১৪

0

#তুই হবি শুধু আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_চৌদ্দ (বোনাস )

জানো ফালাক ভাইয়া আমার গল্পের হিরো হিরোইন কারা? তুমি তো বাস্তবিক জগতেও হিরো, তাই তোমার কথা বাদ। আমার গল্পের হিরো হিরোইন দাদাই আর তাঁর কুসুম। আমি জানি তুমি ভাবো এই গল্পের হিরোইন আমি। কিন্তু সেটা ঠিক নয়। আমি ডায়েরিতে সর্বদা নিজেকে হিরোইনের একটা দারুন আখ্যানে লিখেছি কিন্তু সত্য বলতে যে কল্পনা করে লেখে সে বাস্তবে কি হিরোইন হতে পারে? পারে না।তবে তোমার প্রতিটা কথা আমি মানি। তাই তুমি যখন বলেছিলে তুমি হিরো হলে আমি হিরোইন হবো। তখনই সেই ভাবনা আমার মনে গেঁথে গেছে সারাটা জীবনের জন্য। কিন্তু আমি বন্ধু হিসেবেই তো বেশ আছি তাইনা? প্রিয়মানুষ, আপনজন হিসেবেই আমি বেস্ট।তবুও এই হিরো হিরোইন হওয়ার চক্করে তোমাকে হারিয়ে ফেললাম আমি।
শুভ জন্মদিন নিজেকে! আজ আমার চৌদ্দ বছর পূর্ণ হলো। তুমি তো উইশ করলে না ফালাক ভাইয়া। তোমার ওপর প্রচন্ড রেগে আছি আমি।

ডায়েরির পাতাগুলো ছিড়ে পুড়িয়ে ফেললো রোজ। এসব স্মৃতি রাখা যাবে না। সে গল্পের বা উপন্যাসের প্রধান অভিনেত্রী নয়। নিজের প্রেমকাহিনি পূর্ণ করতে আসেনি রোজ। সে এসেছে সবার জীবনটা গুছিয়ে দিতে।
ফালাককে রোজ ভালোবাসে, এটা যেমন ঠিক তেমন ওর ভালোবাসাকে উপেক্ষা করতে পারবে না এটাও ঠিক। সেজন্যই ফালাকের থেকে দূরে চলে এসেছে সে। জার্নালিজমে ভর্তি হয়েছে। নিজেকে কঠিন করার সকল উপায় সে অবলম্বন করে চলবে। কখনও গলবে না, নরম হবে না। কারন ওকে শুধু বাবা-মায়ের ইচ্ছে নয়, নিজের ইচ্ছাটাও পূরণ করতে হবে।

__________

অভিনয় জগৎ ছেড়ে দিয়েছে ফারহান। ফারদিন সাহেব অবাক হলেও কিছু বললেন না। ফারহান সাধারণ হতে চাইছে বিষয়টা তাঁর ভালো লেগেছে। কিন্তু হঠাৎ করে নিজেকে পরিবর্তন করতে গিয়ে ফারহান যে পরিমানে কষ্ট পাচ্ছে তা সহ্য করা যাচ্ছে না। আরশান এসেছে ফারহানকে দেখতে। সেদিনের বিয়েটা পিছিয়ে গেছে। কারন রোজের এক্সিডেন্ট! রোজ এক্সিডেন্ট করেছে এমন একটা খবর পাওয়ার পর বিয়েটা সম্পন্ন হতে পারেনি। আরশান রাজিও হয়নি রোজকে ছাড়া বিয়েটা করতে। অয়ন্তির অবস্থাও এক। ফারহানের ঘর জুড়ে রোজের ছবি। অয়ন্তি সেগুলো ঘুরেফিরে দেখছে আর আরশানকে সেসব নিয়ে প্রশ্ন করছে। ফারহান খাটের কোনায় চুপচাপ বসে আছে। রোজের এক্সিডেন্ট হলেও হসপিটালে রোজ ছিল না। আরশান যদিও এটা বলেছে যে রোজের কেবিন, মেডিসিন ডিটেইলস আছে। কিন্তু অসুস্থ অবস্থায় ও যাবে কোথায়? অয়ন্তি রোজের ছোট বেলার গল্প শুনে হাসতে হাসতে বিছানায় বসে পড়ে। আরশানও বসলো ফারহানের পাশে। এরপর ঠান্ডা গলায় বলে,
-নিজেকে এভাবে হুট করে চেঞ্জ করা যায় না ফালাক। সময় লাগে। বেবি তোকে পাঁচ বছর সময় দিয়েছে তো। আস্তে আস্তে নিজেকে চেঞ্জ কর। অভিনয় জগৎ ছাড়া তুই থাকতে পারিস না, রাগও নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না বরং এক সময় রাগ কম দেখালে, অন্যসময় বেশি দেখাচ্ছিস।
অয়ন্তিও সায় দিয়ে বলল,
-হুম ভাইয়া। নিজেকে এভাবে বদলে ফেলা অসম্ভব।
ফারহান জবাব দিল না।আরশান উঠে দাঁড়ালো।অনেক সময় পার হয়ে গেছে এবার ফিরতে হবে ওদের। অয়ন্তি উঠতে উঠতে বলল,
-যে মেয়েটা সবার প্রবলেম সলভ করে, সে তোমার এই প্রবলেম ঝুলিয়ে রাখবে না ভাইয়া। ধৈর্য ধরো, ঠিক হবে সব।
-চলো কুসুম।
-হুম।

গাড়িতে উঠে অয়ন্তির সীটবেল্ট ঠিক করে দিল আরশান এরপর কোমল কন্ঠে বলল,
-বিয়ের দিন ওভাবে বিয়ের আসর ছেড়ে আমার যাওয়া ঠিক হয়নি কুসুম। মাফ করে দিও।
-এতদিন পর মাফ চাইছেন?
-ফালাকের অবস্থা দেখেছ? রোজ ওকে ভালোবাসলেও মাফ করেনি। আর তুমি তো সবে ভালোবাসতে শিখছো।
-ভয় পাচ্ছেন নাকি?
-একটু একটু।
-আমি আপনাকে ছেড়ে যাবো না আরশান।
-রোজও নাকি ফালাককে এমন বলতো। আমি নিজেও শুনেছি, দেখেছি। জ্বরের ঘোরে মেয়েটা ফালাকের নাম নিত। তবুও তো চলে গেল। শুধু ফালাকের জীবন থেকে নয়। আমাদের জীবন থেকেও।
-এমন কেন করল ও? ফালাক ভাইয়া তো নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে।রোজ তো নিজেই বলতো, যে ভুল বুঝতে পারে তাকে সংশোধনের একটা সুযোগ দেওয়া উচিত।আর ও নিজেই সেটা ভিত্তিহীন প্রমাণ করল।
-ভিত্তিহীন না, ও জেদের বশে সেটা নিজের জীবনে কার্যকর করেনি। বাক্যটার ভিত যথেষ্ট মজবুত।
-আগামীকাল থেকে ভার্সিটি শুরু। আমাকে ড্রপ করার দায়িত্ব নাকি আপনি নিয়েছেন?
-না, ওদিক দিয়েই রেডিও সেন্টারে যেতে হয়। তাই সেটা ভেবেই আঙ্কেলকে বলেছিলাম তোমাকে আমি ড্রপ করে দেব।
-একই কথা।
-খুব কথা শিখেছ?
-খুববববব!

আরশান হেসে গাড়ি স্টার্ট দিল। অয়ন্তি চকলেট খাচ্ছে আর আড়চোখে আরশানকে দেখছে। আরশান তা লক্ষ করে বলল,
-আমাকে কি আজ অনেক বেশি সুন্দর লাগছে? কেউ একজন চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে আমাকে।
অয়ন্তি ভীষম খেল। দ্রুত জানালার বাইরে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টে বলল,
-মানুষ গাড়ি চালানোর সময়ও এত ভাব নিলে চোখ তো যাবেই।
-কেমন ভাব?
-ঠোঁট কামড়ে সামনে দৃষ্টি স্থির,স্টিয়ারিং’য়ের ওপর হাত রেখে আঙ্গুল নাড়ানো, সাদা হাতের ওপর কালো ঘড়ি, খাড়া খাড়া চুলে বাতাসের বারি!
-প্রশংসাও ঠিক করে করতে পারো না। একমাস হয়ে গেল আমার সঙ্গে আছো। আমার থেকেও তো কিছু শিখতে পারো।
-ধমকিধামকি শিখবো? নাকি রাত-বিরেতে বাড়ির সামনে এসে হাজির হওয়া শিখবো?
-ভালোবাসতে শেখো। ওটা হলেই হবে।
-হুহ, তো কাকে ভালোবাসতে শিখবো?
-কাকে ভালোবাসতে চাও?
অয়ন্তি উত্তর দিল না। হুট করেই একরাশ লজ্জা ঘিরে ধরলো ওকে। আরশান মৃদু হেসে বলল,
-বলো।
-বাড়ি যাবো, আপনি গাড়ি উল্টোদিকে ঘুরালেন কেন?
-ভাবি তোমাকে দেখতে চেয়েছে। তাই আগে বাড়ি যাবো তারপর তোমাকে পৌঁছে দেবো।

বাড়ি ফিরেই ওরা দেখলো বসার ঘরে সবাই গম্ভির মুখ করে বসে আসে।আরসালানের হাতে নীল রঙের একটা ছোট কাগজের টুকরো। ভাবির হাতে গহনার বাক্স আর অভীদের হাত ভর্তি চকলেট। কিছু শপিংয়ের ব্যাগও আছে। সবাই শপিং’য়ে গিয়েছিল নাকি? তাহলে তো আনন্দে থাকবে। চেহারা বেজার করে বসে আছে কেন? আরশান অয়ন্তি ঢুকতেই আমীর সাহেব বললেন,
-এসেছ? বসো।
-কি হয়েছে বাবা?
কিছুসময় নিশ্চুপ থেকে আমীর সাহেব জবাব দিলেন,
-রোজ গিফট পাঠিয়েছে। আর বলেছে তোমাদের বিয়ে করে নিতে।
-কই দেখি।

নীলরঙা চিরকুটটি হাতে নিতেই আরশান দেখতে পেল গোটা অক্ষরে লেখা একটা হুমকি!
“বিয়েটা ভেঙে ঠিক করোনি দাদাই!!!
এত কষ্টে নিজের কুসুমকে পেয়েছ। বিয়ে ভাঙলে কেন? আমি কিন্তু রাগ করেছি অনেক।বিয়েটা করে নিও।আমার ফিরতে সময় লাগবে তাই অপেক্ষা করো না। আমাকে নিয়ে চিন্তাও করতে হবে না। বাবা আমার নামে ফিক্সড ডিপোজিট করে রেখেছিল। আমার বয়স আঠারো হয়েছে বলে টাকাগুলো পেয়ে গেছি। তাই আপাতত আগামী পথ চলতে আমার কোনো অসুবিধা হবে না। আর গিফটগুলো কুসুম ভাবিকে দিও। তাঁর একমাত্র ননদের পক্ষ থেকে।
ইতি রোজ! ”

আরশান দেখল অয়ন্তির জন্য একটা সুন্দর স্বর্ণের সেট পাঠিয়েছে রোজ। রজনী ভাবির জন্যও পাঠিয়েছে। বাড়ির সকলের জন্য জামা-কাপড় কিনেছে। সামনে ইদ সেই উপলক্ষে। আমীর সাহেব বললেন,
-ফালাকদের জন্যও গিফট পাঠিয়েছে।তুমি আর অয়ন্তি গিয়ে দিয়ে এসো।
-জি।

সবার সঙ্গে দেখা করে ফেরার পথে অয়ন্তি বলল,
-বিয়েটা কি তাড়াতাড়ি হবে?
-তুমি কি চাও? তাড়াতাড়ি নাকি দেরিতে?
-আপনি কি চান?
-এখন, এই মুহূর্তে।
-সব সময় মজা? এটা ঠিক না।
-ভাবছি, রোজ কি আমাদের ওপর নজর রাখছে? কি করছি না করছি তা কিভাবে জানতে পারছে? বুঝলে কুসুম! বাসর ঘর চেক করে ঢুকতে হবে। বোন আমার সুবিধার না। চিপায়-চাপায় ক্যামেরা ফিট করে দিতে পারে।অনার মত কূটবুদ্ধি মাথায় ভরা। আবার বলেছিল জার্নালিজমে পড়বে। সব ধান্দাবাজগুলো কি এমন হয়?
-জানেন আমিও ভেবেছি, জার্নালিজম নিয়ে অনাপি আর রোজের ধারণা প্রায় এক।
-তুমি যে ইকোনমিকস নিয়ে অনার্স করছো এজন্য খুশি আমি।
-কিন্তু আমি খুশি না।
-কেন?
-আপনার ব্যবসা কিসের সেটা তো বললেন না।
-ওহ, আমি ছোটখাট একটা কম্পানি খুলেছিলাম। সেটা তো চারবছর আগেই বাদ হয়ে গেল। এখন জকি হিসেবেই আছি।
-ব্যবসাটা কিসের?
-গাঁজার।
অয়ন্তি চোখ বড় বড় করে তাকালো। আরশান হেসে বলে,
-মজা করছি। আসলে আমি গ্রামের নারীদের হাতের তৈরি যেসব শিল্প আছে সেগুলোর রপ্তানির ব্যবসা করতাম।
– আপনি অত্যন্ত বাজে একটা মানুষ
আরশান শব্দ করে হাসে।এরপর বলে,
-তোমার বাবার সঙ্গে বাবা কথা বলবে। বিয়েটা যেই তারিখে ফিক্সড হবে সেদিনই বিয়ে করবো। এবার আর কোনো ছাড়াছাড়ি নেই।

_____________

ফারহানের দেখা না পাওয়ায় মুগ্ধতা নিজে বাড়িতে চলে এসেছে। সিয়ামও আটকাতে পারেনি তাকে। সিয়ামকে পাশ কাটিয়ে মুগ্ধতা যখন ঘরে ঢুকছিল সিয়াম চেহারা বিকৃত করে বলল ‘খাটাইশ্ঠা মহিলা’। মুগ্ধতা শুনলো না। সে সোজা ঘরে ঢুকে দেখলো ফারহান একটা তোয়ালে পড়ে আলমারির সামনে দাড়িয়ে কাপড় বের করছে। ফারহানের চুল ভেজা, চুলের পানি টপটপ করে ঘাড়ের ওপর পড়ছে। সারা শরীরে বিন্দু বিন্দু পানি! শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে বোধ হয়। সিয়াম দরজার পাশে এসে দাঁড়ালো। মুগ্ধতা ছুটে গিয়ে ফারহানকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে। সিয়াম হতবাক হয়ে চেয়ে রইল। মনে মনে আওড়ালো,
-কি ছ্যাছড়ার ছ্যাছড়া!কতবার মানা করলাম শুনলো না।এবার বুঝবে মজা।আমাকে জড়িয়ে ধরলে আমি কি মাইন্ড করতাম? জড়িয়ে ধরাটাই যখন ফ্যাক্ট আমাকে ধরতিস। আমাকে ইগনোর করার জন্য তোকে একদম সাহায্য করবো না আমি। বেয়াদব মহিলা।
ওদিকে মুগ্ধতা কেঁদেকেটে একাকার। ফারহানের হাত শক্ত হয়ে এসেছে। রাগে সারা শরীর ঘিনঘিন করছে। সে হাতে থাকা শার্টটা নিয়ে জোরে গা ঝারা দিতেই মুগ্ধতা ছিটকে পাশে পড়ে গেল। ফারহান কঠিন গলায় বলল,
-এটাকে ঘরে ঢুকতে দিয়েছো কেন সিয়াম? মুভি শেষ, এর সঙ্গে যোগাযোগও শেষ। এটা বলোনি ওকে?
মুগ্ধতা হিচকি তুলে কাঁদে,
-আমি তোমাকে ভালোবাসি ফারহান। তুমি যা করতে বলবে করবো। তবুও আমাকে ছেড়ে যেও না। তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না আমি।
-যা করতে বলব তাই করবে? (দুষ্টু হেসে)
-হ্যাঁ। (কান্না থামিয়ে)
-ম’রে যাও।
-ফারহান…. (হতাশ গলায়)
-সিয়াম আমি আবার শাওয়ার নিতে যাচ্ছি। রুম ক্লিয়ার করে রাখো।
-কিন্তু মুগ্ধতা ম্যাম তো যেতে চাচ্ছেন না।
-তুমি পুরুষ মানুষ না? সামান্য একটা মেয়েকে ঘর থেকে বের করতে পারছো না? আমার পি.এ হলে কোন যোগ্যতায়?
-ম্যাম বলেছেন সুইসাইড করবেন।
-তাতে তোমার কি? উনি তোমার কি হয় যে এত দরদ উতলে পড়ছে।
-ওকে স্যার। এই ম্যাম ওঠেন, ওঠেন। আপনি আমার কিছু লাগেননা। আপনি মরলেন কি বাঁচলেন তাতেও আমার কিছু আসে যায় না। দ্রুত ওঠেন, বের হন। কি ছ্যাছড়া মহিলা, যান না কেন? যান, দ্রুত ওঠেন!

মুগ্ধতা অপমানে চলে যেতেই সিয়াম তৃপ্তিময় হাসি দিল। চরম বদলা নেওয়া হয়েছে। ইগনোরের থেকেও বেশি। আহা! কি শান্তি। সিয়াম মিটিমিটি হাসছে দেখে ফারহান বুঝলো ওর তৃপ্তির কথা। তাই নিজেও হেসে গোসলে ঢুকলো। কি বিশ্রি পার্ফিউম মেখে এসেছে, গন্ধ গায়ে জড়িয়ে আছে। বমি আসছে ফারহানের! ওয়াক থু! অভিনেত্রী হয়ে সস্তা পার্ফিউম ইউজ করে কে? নাকি ভালো কিছুর ঘ্রাণও ফারহানের নাকে বিশ্রি লাগছে? রোজ তো এসব ব্যবহার করতো না, ও সর্বদা বকুল, বেলি, গোলাপ ও জুঁই ফুলের মালা রাখতো সঙ্গে। তাঁর ঘ্রাণটাই ওর কাছে সব থেকে বেশি ভালো লাগতো। আর ফারহানের ভালো লাগতো রোজের চুলের ঘ্রাণ, ঘামের ঘ্রাণ! ভেবেই ফারহান মাথা চাপড়ালো। কিসব ভালোলাগা সৃষ্টি করে রেখেছে মেয়েটা। যখন থাকবেই না তখন এসব অভ্যাস করানের কি দরকার ছিল?

চলবে?

তুই হবি শুধু আমার পর্ব-১৩

0

#তুই হবি শুধু আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_তেরো

রোজ যে মনে মনে কোনো গন্ডোগোল ঠিক পাঁকাচ্ছে তা ফারহান আগে থেকেই টের পেয়েছিল তাই সঙ্গে করে হ্যান্ডকাফও জোগাড় করে এনেছে। বলা যায়না মেয়েটা যদি পালিয়ে যায়? চমককে চমকে দিয়ে আজ থার্ড ডিগ্রি দেওয়ার সময় রোজকে তো সঙ্গে নেওয়া যাবে না। রোজ জানালার বাইরে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসছে। ফারহান তা লক্ষ করেও গাড়ি চালানোয় মন দিল। রাগে পা’র তলা থেকে মাথার চুল অবধি জ্বলছে। কোথাকার কোন ছেলেকে ভালোবাসে আজ সে দেখেই ছাড়বে। ফারহান রোজের হাতে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে তা স্টিয়ারিং’য়ের সাথে জুড়ে দিল। রোজ হতবাক দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে আছে। ফারহান গাড়ি লক করে চলে গেল রেডিও সেন্টারের ভিতরে। আরশান দারোয়ানকে বলে রেখেছিল তাই ফারহানকে দেখামাত্র দারোয়ান দরজা খুলে দেয়। ফারহান লিফটে উঠতেই রোজ হাই তুলে হাতের হ্যান্ডকাফ খুলে ফেললো। ছোট থেকে বাবার এসব হ্যান্ডকাফ নিয়ে খেলতে খেলতে বড় হয়েছে সে। এসবে তাকে আটকে রাখার মত বোকা বুদ্ধি ফারহানের মাথায় আসলো কি করে? হ্যান্ডকাফ খুলে রোজ বেশ লম্বা একটা চিঠি সাতমিনিটে লিখে, তিনমিনিটে পেছন থেকে রড এনে গাড়ির কাঁচ ভেঙে ফেললো। এরপর বের হয়ে সে ওরনা ঠিক করে স্টিয়ারিং’য়ে কাগজটা সেটে দিতে দিতে বলে,

-দুঃখিত জনাব! গাড়ির কাঁচটা ভাঙার জন্য। কিন্তু কি করবো বলুন? আমাকে আটকে রাখার মত সামর্থ্য আপনার নেই। আমাকে ভালোবাসতে হলে আপনাকেও সেই একই যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে যা আমি করেছি। আর আমি মানুষটা খাঁচায় বন্দি থাকা পছন্দ করিনা। তাই আমি তো যাচ্ছি, পারলে খুজে বের করুন আমাকে। টাটা!!!

ভেতরে এসে নামের তালিকা বের করে ”চমক” নামে কোনো নাম বা মানুষকে পেল না ফারহান। রাগে এবার মাথা ছিড়ে যাচ্ছে। রোজ এমন একটা বিষয় নিয়ে মজা করেছে? শুধু ওকে রাগানোর জন্য? মেজাজ চড়াও হতেই ফারহান চোখমুখ খিচে ফেলল। মনে পড়ল রোজ গাড়িতে।
-হোয়াট দ্যা…… তুই যদি পালাস চাঁদ। ট্রাস্ট মি তোকে খুজে আমি যাস্ট শেষ করে ফেলবো।

গাড়ির কাছে এসে গাড়ির ভা’ঙাচোরা অবস্থা দেখে ফারহান গাড়ির বাকি উইন্ডোগুলো ভেঙে ফেললো। কাঁচ শক্ত করে চেঁপে ধরতেই হাতের শিরা কেঁটে রক্ত গড়িয়ে পড়লো।ফারহান তা তোয়াক্কা না করে কাগজটা মেলে ধরে সামনে।

অপ্রিয় সাইকো,
প্রথমেই বলেছিলাম রাগ নিয়ন্ত্রণ করা শিখুন। রাগের সময় যে আপনার মাথা কাজ করে না তা খুব ভালো করেই জানি আমি। তাই এমন চমকের ব্যবস্থা করলাম। কেমন লাগলো চমকটা?
মন ভা’ঙলে কতটা কষ্ট হয় তা আমি জানি। আপনার রাগ তখন জায়েজ ছিল, কিন্তু আপনি আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে পারতেন আমি কেন ওসব বলেছি। বা কি হয়েছে? কিন্তু না। আপনি আমাকে টানতে টানতে নিয়ে ইচ্ছেমত ঝারলেন। আমার চরিত্র তুলে কথা বললেন। বলেছেন ভালো করেছেন। কিন্তু রাগ মিটে গেলে কেন ফিরলেন না? কেন আমাকে অবিশ্বাস করে এতগুলো বছর আমাকে একা করে রাখলেন? আমার কষ্ট, আপনাদের কাছে কষ্ট মনে হয় না তাইনা? কি ভাবেন? আমার কষ্ট হয় না, রাগ হয় না, অভিমান হয় না। যা হয় সব আপনার হয়? ভালোবাসলে বিশ্বাস করতে জানতে হয়। জেলাসি ভালো তবে যে মানুষটা আপনার, যেটা আপনি জানেন, নিশ্চিত। তাকে নিয়ে জেলাস ফিল করে ওই ঘটনা ওই কথাগুলো বলা ঠিক হয়নি আপনার। আমার আত্মসম্মানে আঘাত করেছেন আমাকে ছোট করেছেন, আমাকে বলেছেন আমি নাকি টাকার পেছনে ছুটি। কয়টা মেয়ে দেখেছেন? আপনার জীবনে কয়টা মেয়ে ছিল? যারা টাকার পেছনে ছুটে আপনাকে ফেলে গেছে? যাক সেটা আপনার ব্যক্তিগত জীবন। আমি জানি আপনি আপনার বাবার প্রথম প্রেমিকার কথা ভেবে ওসব রাগে দুঃখে কষ্টে বলেছেন। কিন্তু আমি এতটাও ভালো নই, আরশানের অয়ন্তির মত নরম নই যে আপনার ভালোবাসা দেখে গলে যাবো। এসব পরনারীর শরীর হাতানো ছেলে আমার পছন্দ ছিল না। আপনার স্বপ্ন অভিনয়, তাই তখন কিছু বলিনি কারন তখন আপনাকে আমি নিজের সবকিছু ভাবতাম। কিন্তু সময়ের সঙ্গে আমার ভাবনা পাল্টে গেছে। সবসময় আমি আপনার মন রাখার চেষ্টা করেছি কারন আমার প্রতিটা ইচ্ছে আপনি পূরণ করতেন। সব কথা শুনতেন। আমাকে ভালোবাসতেন। কিন্তু এটা কি সেই ভালোবাসা? আপনি আসলে আমাকে কোনোদিন ভালোই বাসেননি। শুধু আমাকে নিজের সম্পত্তি ভেবে এসেছেন। আমি পুতুল নই, আমাকে নিয়ে যখন ইচ্ছে খেলা করবেন, যখন ইচ্ছে সন্দেহ করে চলে যাবেন। এটা আমি কেন মানবো? আপনি যে অভিনয় করতেন। কত হিরোইনের সঙ্গে ইন্টিমেট সীন করতেন। আমি কি কখনও কিছু বলতাম? না! কারন আমি ভাবতাম ওই মানুষটা আমার। শুধু আমার। ভুল ভাবতাম। আপনাকে যখন আমার সবথেকে বেশি প্রয়োজন ছিল, আমার মা বাবার মৃ’ত্যুর পর। যখন ছোট্ট আমি ট্রমার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। সারাদিন সারারাত একা একা কাঁদতাম তখন কোথায় ছিলেন? কোথায় ছিল এই ভালোবাসা? উতলে পড়া ভালোবাসার বুঝি এখন দেখা মিলল। তার কারন কি? কারন হচ্ছে, আপনি বুঝেছেন আপনি ভুল করেছিলেন আমাকে অবিশ্বাস করে, আপনি বুঝেছেন রাগের মাথায় আপনার দ্বারা অন্যায় হয়ে গেছে। তো আমি কি করবো? আমি তো ভুলতে পারবো না। আমার সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছে তা ভুলবো কি করে? এখনও ওই ঘটনা মনে পড়লে আমার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে। আমার মনে হয় আমি আর বাঁচবো না, ম’রে যাবো। দিনের পর দিন নিরবে মৃ’ত্যুর যন্ত্রণা সহ্য করেছি। আর আপনি কি করেছেন? নিশ্চই এতদিন আমাকে ঘৃণা করেছেন। হু! জানেন একসময় ভাবতাম এভাবে পাগলের মত যে মানুষটা আমাকে ভালোবাসে তাকে ছাড়া এক মুহূর্তও চলবে না আমার। আর আজ ভাবি আপনি কেন আমার জীবনে আসলেন? কেন ভালোবাসি আপনাকে? কেন এত কষ্ট পাই? আমার জীবনের ভুল আপনি। আপনি হয়তো বলবেন রাগের মাথায় ওমন হয়েছে। সত্য কি জানেন?মানুষ রাগের মাথায় সম্পর্ক ভাঙে, রাগের বশে তালাক দেয়,রাগের বশেই সুস্থ স্বাভাবিক একটা সম্পর্ক ধ্বংস হয়। আপনার জীবনে রোজ ও চাঁদের ধ্বংস তো সেদিনই হয়েছিল।

আপনার প্রিয় ফুল গোলাপ। তাই আমার বয়স যখন ছ মাস তখনই আমার রোজা নামটা কে’টে রোজ করে দিয়েছিলেন। বাবা আপনার কথা শুনে আমার ডাকনাম রোজ চালু করে ভুল করেছিলেন। আমি রোজ নামটার জন্য আনন্দ অনুভব করতাম, ভাবতাম আপনার অতি প্রিয় বস্তুটা আমি। ভুল ছিলাম। আজ নিজের কাজের জন্য বড্ড রাগ হয় আমার।নিজের রোজ নামটাও আমি সহ্য করতে পারি না শুধু আপনার জন্য। আমাকে চাঁদ বলে কেন ডাকতেন? আপনার জীবনের একমাত্র উপগ্রহ হিসেবে তো! সেই উপগ্রহ মহাকাশে ভেসে গেল অথচ আপনি নির্বিকার, নির্লিপ্ত! এটাকে ভালোবাসা বলে? আমার তো মনে হয়না। আমি আপনাকে ছাড়া কোনো দ্বিতীয় পুরুষের কথা কল্পনাও করতে পারিনা এটা আমার জীবনের অন্যতম বাজে আবেগ, বাজে অভ্যাস, বাজে অনুরাগ। আমার জীবনে কেউ কখনও আসতে পারবে না। তবে এর মানে এই না যে আপনাকে গ্রহণ করবো। আমাকে ভালোবাসেন তাইনা? তাহলে সে ভালোবাসার প্রমাণ দিতে হবে। আমি দেখতে চাই চাঁদ আপনার জীবনে কি! আপনার স্বপ্ন অভিনয়, আপনার রাগ, আপনার লাইফস্টাইল সব বদলাতে হবে। সাধারন হতে হবে, লোকাল বাস, লোকাল সকল যানবাহন ব্যবহার করতে হবে। সাধারণ খাবার খেতে হবে, সাধারণ পোশাকে চলতে হবে। যেমনটা গত পাঁচ বছরে আমি ছিলাম।অসাধারণ ফারহান থেকে সাধারণ ফালাক হয়ে যেদিন আসবেন সেদিন পাবেন আমাকে। আমার মত পাঁচবছর কষ্ট সহ্য করুন। তারপর নাহয় ভেবে দেখি আপনার জীবনে ফিরবো? কি ফিরবো না? তবে আমি নিশ্চিত আপনি এসব পারবেন না। কারন আপনি আপনার পাঁচ বছর বয়স থেকে হিরো হবার স্বপ্ন দেখে এসেছেন। আর আপনার জন্মগত রোগ এই রাগ। এইদুটো ছাড়া আপনার পক্ষে কঠিন। তারওপর বড়লোক বাপের ছেলে, কখনও তো এসি কার,প্রাইভেট কার ছাড়া চলেন নাই। আমার মতে আপনার এবার একটু নিজের লাক্সরিয়াস জীবন থেকে বের হওয়া উচিত। যা বলার দরকার বলে দিলাম। কি করবেন সেটা আপনার ইচ্ছে।

ইতি আপনার জীবনের একমাত্র ভুল,,
সাইরাহ্ আনসারী রোজা।

কাগজটি মুচড়ে পকেটে ভরে রাখলো ফারহান। এরপর হাটতে শুরু করলো।দূরে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে রোজ এটা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ফারহানকে বুঝতে হবে ভালোবাসা শুধু স্বৈরাচারী অধিকারবোধ নয়। ভালোবাসায় দুটো মানুষ থাকে। দুজনেই সমান গুরুত্বপূর্ণ থাকে।শুধু একজনের জোর-জবরদস্তি চলবে না এখানে। একজন নিজের মর্জিমত কষ্ট দেবে তা কেন চলবে? তাকেও কিছুটা কষ্ট পেতে হবে। সব একমুহূর্তে ভুলে ফিরে আসবে,, এতটা মহান হতে পারবে না রোজ। তাছাড়া ফারদিন আঙ্কেল চান ওনার ছেলে স্বাভাবিক হোক। তেজ, জেদ রাগ, কমাক। রোজকে অনুরোধ করেছেন তিনি, যেন রোজও ওকে স্বাভাবিক করার একটু চেষ্টা করে। তাই রোজ নরম হলে ফারহানের রাগ দূর করা যাবে না। ওর সাইকিক চরিত্র দূর করতে রোজকে কঠিন হতে হবে।এভাবে কাজ হলে রোজ ফিরে আসার কথা ভাবলেও ভাবতে পারে। নাহলে এই মানুষটা বরং নিজের জেদ নিয়েই থাকুক। হুহ!!

_________________

গায়ে হলুদের দিন এলো।অয়ন্তিদের বাড়িতে হলুদ নিয়ে এসেছে রজনী ও ফারহান। ফারহানকে দেখে রীতিমত অয়ন্তির কয়েকডজন বন্ধু বেহুশ। ফারহান অস্বস্তিতে পড়ে গেল। এমন ঘটনা ঘটবে জানলে সে আসতোই না। নেহাৎ আরশান জোর করলো, বলল, ফারহান যদি না আসে তাহলে সে ভাববে ফারহান এখনও তাঁর ওপর রেগে আছে। বাধ্য হয়েই তাই ফারহানকে আসতে হলো। অয়ন্তি ফারহানকে একা দেখে ফারহানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলে,
-একা কেন?
-দোকা কোথায় পাবো?
-কেন তোমার চাঁদ।
-আমার কোনো চাঁদ নেই। ওর কথা তুলবে না তুমি। তাহলে কিন্তু চলে যাবো।
-এই না, না। তোমাকে দেখবে বলে অনেকে এসেছে। আমি বলেছি তুমি আমার জামাইয়ের বন্ধু। তুমি যদি চলে যাও আমি কালারিং হয়ে যাবো।
-তাহলে চুপচাপ গিয়ে নিজের কাজ করো। বিরক্ত করো না আমাকে।

অয়ন্তি গাল ফুলিয়ে রাগ দেখালো। মনে মনে বললো, ‘আসলেই খাঁটাশ, খচ্চর পোলা। রোজ একে সহ্য করে কিভাবে? বেয়াদব।’ ফারহান অয়ন্তিকে দেখলোও না। রোজকে কথা দেওয়ার পর থেকে প্রয়োজন ছাড়া ও মেয়েদের দিকে তাকায় না, কথাও বলে না। আর ওর সঙ্গে ঝামেলা হওয়ার পর থেকে তো মেয়েদের সহ্যই করতে পারে না। এটা নিয়ে হিরোইনদের সঙ্গেও মাঝে মাঝে গন্ডোগোল হয়। ফারহান তবুও নারীজাতি সহ্য করতে পারে না। একমাত্র ওর মা ছাড়া কোনো নারীর সঙ্গেই তার বনে না, সে যেই হোক না কেন। এখানে এসেও ওর স্বভাবের পরিবর্তন হয়নি। অয়ন্তি যে আরশানের বউ হতে চলেছে তাতেও কোনো প্রভাব পড়েনি ফারহানের ওপর।অয়ন্তি আরশানের বউ হচ্ছে, ফারহানের তো নয়। তাহলে ফারহান কেন মধুর বাক্য শোনাবে? বিরক্তিকর!

আরশান ফোন করেছে দেখে ফারহান চরম বিরক্ত। কি এত দেখবে অয়ন্তিকে? দুদিন পরেই তো বিয়ে। বিয়ের পর কোলে তুলে, ঘাড়ে তুলে দেখুক। কে দেখতে যাচ্ছে তখন?ফারহানের এমন মারাত্মক সময়ে সে ফারহানকে পিয়নের কাজ করাচ্ছে। অসহ্যকর। ফারহান ফোন রিসিভ করে বলে,
-বলো।
-তোর ভাবিকে কেমন লাগছে? একটা ছবি তুলে পাঠা।
-জানি না। দেখিনি, আর ছবিও তুলতে পারবো না। ওর বন্ধুরা সেন্সলেস হচ্ছে বারবার। ছবি তুলতে দেখলে যদি সেলফি তোলার আবদার করে বসে? ওসব ফালতু ঝামেলা সহ্য করা ইমপসিবেল। তার চেয়ে তুমি রজনী ভাবিকে কল দিয়ে বলো।
-তোর মাথা খারাপ? ভাবি জানলে পঁচানি দেবে।তুই দে, তুই না আমার ছোট্টভাই। বেবির সাথে তোর বিয়ের সব কাজ আমি করে দেবো। আমার কাজটা করে দে।
-লাগবে না। আমার বিয়েতে কোনো কাজ হবে না। তোমার বোনকে দেখামাত্র তুলে নিয়ে রেজিস্ট্রি করে কাজির সামনে কবুল বলে বিয়ে সেরে নেবো।খচম কম, ওর পালানোর সুযোগও কম এতে।
-কিপ্টামি করবি? ছি! তোর এত টাকা রাখবি কই?
-আমার একপাল বাচ্চার অনুষ্ঠান বড় করে করবো। ওখানে সব হিসেব সুদে আসলে মিটিয়ে নিও।
-বাচ্চা? তাও একপাল? তুই দেখি প্লেনের গতিতে দৌড়াচ্ছিস।
-তোমার বোনকে একবার পাই দাদাই, তারপর দেখো কি করি। রাতারাতি বাচ্চা হওয়ানোর প্রসেসিং কমপ্লিট করে ফেলবো। এরপর দেখি পালায় কোথায়।
-বড় ভাইয়ের সামনে এসব বলিস লজ্জা লাগে না?
-লজ্জা আমার কোনো কালেই ছিল না।
-ওকে।এবার একটা ছবি পাঠা প্লিজ। কোনো না শুনবো না। রাখছি।

ফারহান বিরক্তচোখে তাকালো। চারপাশের মানুষজন চোখ দিলে গিলে খাচ্ছে ওকে। সিয়ামকেও আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না। গেল কই কাজচোরটা? ফারহান উঠে দাঁড়ালো। অয়ন্তি কোথায়? কার কাছে শুনবে? রজনী ভাবিকেও ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। ফারহান এক মুরব্বি ভদ্রলোককে ডেকে অয়ন্তির খোঁজ করতেই বৃদ্ধ চটে গেলেন। ফারহানকে কয়েকটা কথাও শুনিয়ে দিলেন মুহুর্তেই। তাঁর কথার মর্ম ফরহান যা বুঝলো তা হচ্ছে লোকটা তাকে বখাটে ভাবছে। ফারহান অন্যদিকে ফিরে হাটা ধরলো। বকবক করে মাথা খেয়ে ফেলছে লোকটা। সিড়ির সামনে একটা মেয়েকে পেল ফারহান। তাকে জিজ্ঞেস করতেই সে লাজুক হাসলো, লজ্জায় চোখমুখ লাল করে ফেললো। ওরনার মাথা আঙ্গুলে পেঁচাতে লাগলো। ফারহান ভ্রু কুঁচকে ওখান থেকে চলে যেতে লাগলে মেয়েটি নাম্বার চেয়ে বসে। ফারহান মনে মনে একটা খুবই অভদ্র গালি দিয়ে এড়িয়ে গেল ওকে। সব মেয়েরা যেখানে ফারহানের জন্য পাগল সেখানে রোজ ফারহানকে চরকি ঘুল্লি দিচ্ছে। এই না হলে চাঁদ! ফালাকের চাঁদের সঙ্গে বাকি মেয়েদের পার্থক্য ঠিক এখানেই। অয়ন্তিকে পেতে প্রায় একঘন্টা লেগে গেলো ফারহানের। ছাদে মেয়েলী অনুষ্ঠানে আছে সে। ফারহান সরাসরি গিয়ে অয়ন্তিকে বলল,
-একটু দাড়াও, তোমার ছবি তুলবো।
-কেন?
-দাদাই চেয়েছে।
-তুলবো না ছবি। তখন আমাকে ইগনোর করে অপমান করেছো তুমি। স্যরি বলো।
-ফারহান কাউকে স্যরি বলে না।
-রিয়েলি? আমি তো শুনেছি রোজকে সকাল বিকাল স্যরি বলতে। এমনও নাকি হয়েছে, ও জেদ ধরে বসে থাকতো যে ওর পা ধরে ক্ষমা না চাইলে, স্যরি না বললে ও মাফ করবে না।
ফারহান বিব্রতভঙ্গিতে নড়েচড়ে দাঁড়ালো। দাদাই কি সব গোপন কথা ফাঁস করে দিয়েছে? এই অপরাধে ছবি তোলা’টা বন্ধ করে দেওয়া উচিত। ওর বিয়েটাও বয়কট করা উচিত। আস্ত জাঁদরেল ভাই। ফারহানকে অপ্রস্তুত হতে দেখে হেসে উঠল অয়ন্তি। বলল,
-সম্পর্কে আমি তোমার বড় ভাবি! সুতরাং মাফ না চাইলে ছবি তুলতে দেবো না।
-চাঁদ আর বাকি সবাই আলাদা। চাঁদকে কথা দিয়েছি অন্য মেয়েকে স্যরি বলা যাবে না, সুন্দর বলা যাবে না। প্রশংসা করা যাবে না, প্রয়োজন ছাড়া তাকানোও যাবে না।
-কত বছর আগে?
-চৌদ্দবছর আগে। যখন ওর বয়স চারবছর।
-দুধের শিশুর সঙ্গে লুতুপুতু করেছো নাকি?
-করলেও, তোমার কি? ছবি তুলতে দাও। আর এসব আলোচনা এখানেই থামাও।
-আবারও অপমান?
-নিজেই করালে। এত কথা বলো কেন?
-ওকে। স্যরি বলতে হবে না। রোজের প্রতি তোমার ফিলিং ফার্স্ট কখন কিভাবে আসলো সেটা বলো। কি দেখে পছন্দ হলো? বলো বলো!
-এক্সাক্টলি কি বলবো?
-রূপের কথাই বলো।
-ওর সাড়ে তিনবছর বয়স পর্যন্ত, ওকে গোসল করিয়ে আমি নিজে ওর কাপড় বদলে দিতাম।

কথাটুকু শুনেই স্তব্ধ অয়ন্তি।ভারি নির্লজ্জ তো নায়কটা। এক কথাতেই মুখ বন্ধ করে দিল। একেবারে টক্সিক! অয়ন্তি চোখমুখ খিচে দাড়াতেই ফারহান ফটাফট দুটো পিকচার তুলে আরশানের হোয়াট্স এ্যাপে পাঠিয়ে দিল। আরশান ছবিগুলো দেখে গালে হাত দিয়ে বসল। অয়ন্তির মুখ এমন লাগছে কেন? দুঃখি আর রাগি! কি হয়েছে? ফারহান মিসবিহেভ করেছে নাকি? আরশান দ্রুত অয়ন্তির বাবার ফোনে ফোন দিয়ে ডাহা মিথ্যে এক বাক্য বলে অয়ন্তিকে চাইলো। আশরাফ সাহেব দ্রুত ছুটে গেলেন অয়ন্তির কাছে। অয়ন্তির শশুড় অয়ন্তির সঙ্গে কথা বলতে চান, তাঁর চাওয়ার প্রাধান্যই এখন সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ আশরাফ মীর্জার কাছে। অয়ন্তি ফোন ধরতেই আরশান বলল,
-চিপায় যাও।
-মানে, কি? (থতমত খেয়ে)
-মানে মানুষজন থেকে একটু দূরে গিয়ে দাড়াও। কথা বলবো।
-ওহ, ওকে।
অয়ন্তি নেমে নিজের ঘরে চলে আসলো।
-বলুন।
-ফারহান কিছু বলেছে নাকি? তোমার চোখমুখ কালো হয়ে আছে। ওর কোনো কথায় মন খারাপ করো না। ও ওমনই।
-ওমনই মানে? এত নির্লজ্জ?
-নির্লজ্জ? কি বলেছে তোমাকে? কুসুম!

অয়ন্তি সবটা বলতেই হেসে উঠলো আরশান। অয়ন্তি এখনও লজ্জা পাচ্ছে। ফারহানের কথা মনে পড়লেই লজ্জায় নুইয়ে পড়ছে। আরশান হেসে বলে,
-আমি গিয়েও এটাই দেখেছি। তবে রোজকে আমাদের সামনে চেঞ্জ করাতো না। বুঝতে পারছো ফালাকের নজর কত আগে থেকে বেবির ওপর ছিল? ভাবতেই তো অদ্ভুত লাগে। বাচ্চা ছিল বেবি। আর বেবি নাকি ফারহানের ব্যক্তিগত বন্ধু। আমাদের সাথে তো মিশতেই দিত না বেবিকে। প্লাস বেবিও ওকে ছাড়া কিছু বুঝতো না।
-মানে, বন্ধুত্ব থেকে পরে প্রেম?
-হুম তেমনটাই। আমাকে যখন ও নিজের মনের কথা বলে তখন বেবির বয়স নয়-দশ ছিল হয়তো। তবে প্রথমে বন্ধুত্বও ছিল না। রেণু আর ফারিয়া আন্টির কাছে শুনেছিলাম, ফারদিন আঙ্কেল ও ফারিয়া আন্টি যখন বেবি জন্মানোর পর ওকে নিয়ে যায় তখন ফালাক বেবির ধারে কাছেও যায়নি।
-কেন?
-সাতদিনের বাচ্চার পেট খারাপ হয়েছিল। গন্ধে নাকি ওর বমি আসছিল।
-সেখান থেকে এখানে ক্যামনে আসলো?
-ফারিয়া আন্টি জোর করে ওর কোলে তুলে দিয়েছিল।
-তারপর?
-টানা চারঘন্টা কোলে নিয়েই বসেছিল। অতসময় কি করেছে জানি না। আন্টি নাকি পরে ওকে দিয়ে বেবির নষ্ট হয়ে যাওয়া কাঁথা ধুইয়েছিল। আসলে আন্টিরা দেখতে চেয়েছিল ফালাক কি করে। কিন্তু ব্যাটা নাকি চুপচাপ ধুয়ে দেয়।
-বুঝেছি।
-কি?
-মানে রোজের কাঁথা ধোয়ার সময় মনে হয় হিরো সাহেব মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলেন রোজের বাচ্চার কাঁথাও ধোবেন। আর সে বাচ্চা পয়দার দায়িত্বও নিজে নেবেন। হাহ!
-বাহ! তুমি দেখছি বড় হয়ে গেছ। আমার আর কোনো চিন্তাই থাকলো না। ফালাক আর রোজেরটা যেমন বুঝে গেছ, আমাদেরটাও দ্রুত বুঝলে খুশি হবো। রাখছি, কে যেন ডাকছে।
-হু।

চলবে?

তুই হবি শুধু আমার পর্ব-১২

0

#তুই হবি শুধু আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_বারো

-কি করছো?
-ঘুমাচ্ছি।
-নিচে নামো। আমি বাড়ির সামনে। দেখা করে চলে যাবো। তাই দ্রুত আসো।

অয়ন্তি এবার চোখ খুললো। ঘুম ঘুম ভাব নিমিষে কেটে যায়। এত রাতে আরশান বাড়ির সামনে কি করছে?এই মানুষটা এমন ক্যান? অয়ন্তি গায়ে ওরনা জড়িয়ে হেলে দুলে নিচে নামলো। আরশান গাড়িতে বসে গুনগুনিয়ে গান গাইছিলো। অয়ন্তিকে দেখে ওর গান বন্ধ হয়ে যায়। অয়ন্তির পরনে সাদামাটা থ্রিপিচ। ওরনা ঝুলছে, চুল খুলে ঘাড়ে আর কপালে কয়েক গোছা ঝুলছে। মেয়েটা ঘুম থেকে উঠেই চলে এসেছে? অন্য মেয়ে হলে নিশ্চই গুছিয়ে পরিপাটি হয়ে আসতো। অয়ন্তি গাড়ির সামনে এসে হাই তুলে বলে,
-বলুন।
-এভাবে এসেছো কেন?
-কিভাবে?
-এলোমেলো।
-রাত আড়াইটায় যদি কেউ ফোন দিয়ে দেখার করার তাড়া দেয় তখন এর থেকে বেশি টিপটপ হয়ে আসা সম্ভব না। দ্রুত বলুন, আমি ঘুমাবো। ঘুম আসছে।
-আমার ঘুম কেড়ে নিয়ে তোমার ঘুম খুব বেড়েছে তাই না?
-হু।
-খেয়েছো?
-হু।
-তুমি কি ঘুমিয়েই পড়েছিলে? রেডিও শোনোনি?
-হু।
-চলো বিয়ে করে ফেলি।
-হু।
-হু?ওকে গাড়িতে উঠে বসো। আজ বিয়েটা সেড়েই ফেলি। একা একা ঘুমাতে ভালো লাগে না আমার। দ্রুত ওঠো। কুইক! কুসুম।

অয়ন্তি পূর্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। আরশানের কথাগুলো মস্তিষ্ক ধরতেই লজ্জায় লাল থেকে নীল হয়ে উঠলো ও।আরশান হেসে ফেলল। অয়ন্তি মিনমিনে কন্ঠে বলে,
-আমি যাই?
-সেকি! বিয়ে করবে না?
-উহু!
-করতে হবে। আর মাত্র ছয়দিন। যাই হোক, যা বলতে এলাম। ফালাককে চেনো?
-ফালাক? অভিনেতা ফালাক? নেক্সট মান্থে যার মুভি রিলিজ হবে?আপনাদের গেস্ট নাকি? আসলে আমাকে বলবেন কিন্তু।আমি সেলফি তুলে আপলোড করবো।
-তুমি কি বেঁছে বেঁছে আমাকে বাদ দিয়ে সবার ফ্যান হও?
-মানে?
-ফালাকই সেই যাকে রোজ ভালোবাসে। আর সেদিনের ছবির তিন নাম্বার ছেলেটা। আমার বন্ধুদের বিরাট বড় পাঙখা আমার বউ আর আমার দিকে ফিরেও তাকায় না। এটা অন্যায় না? আমার প্রতি অবিচার করা হচ্ছে।
-ফালাক? এত বড় অভিনেতা! রোজকে ভালোবাসে ফালাক?
-আবার জিগায়! ব্যাটা পুরো পাগল। দেখলেই বুঝবে।
-কবে আসবে?
-পরশু।
-রোজরা তো নেই।
-ও যখন জেনেছে রোজ নিঁখোজ। তখন রোজকে খুজে সঙ্গে করেই আনবে।
-আপনাদের সব সমস্যা মিটে গেছে? আপনাকে ভুল বুঝেছিল।
-আমাকে না! আমি তো অযুহাত। ওরা নিজেরা নিজেরা ঝামেলা পাঁকিয়েছে।মান-অভিমান,রাগ-অনুরাগে জ্বলে এই অবস্থা। মাঝ থেকে আমি ফেঁসে গেছিলাম। আর আমরা বন্ধুরা অন্যদের মত না, যত রাগই থাকুক না কেন যাস্ট একটা ফোনকল, আর রাগ গলে জল। কেউ এতদিন ঝামেলা মেটানোর ট্রাই করেনি বলে ঝামেলা ঝুলে ছিল। আজ ও নিজে ফোন করেছে, ব্যাস সবকিছু ঠিক হয়ে গেল।
-উনি রেগে নেই?
-তা তো আছে।
-আপনার উপর?
-না। রোজের ওপর। আমাদের বন্ধুত্ব বাকি পাঁচটা বন্ধুত্ব যেমন তেমন না কুসুম। ওরা দুজন শুধু দুজনের ওপরই রাগ করে। সেই রাগের কারন অন্যকেউ হলেও বাইরের মানুষকে দোষী বানায় না। ওদের দুজনের মতামত হচ্ছে ‘উনি’ কেন আমাকে ভুল বুঝবে?আমাকে অবিশ্বাস করবে। ওদের ‘উনি’র চক্করে বাকিরা তলিয়ে যায়।
-উনি’টা কে?
-কে আবার? রোজ রাগলে ফালাককে ‘উনি’ বলে আর ফালাক রাগ হলে রোজকে ‘উনি’ বলে। তোমার আই কিউ দেখছি টোটাল জিরো কুসুম! এত বোকা কেন তুমি?
-আমি বোকা?তো চালাক মেয়ে খোজেন। আমার পিঁছে পড়ে আছেন কেন?
-কারন আমি বোকা নই। (বাঁকা হেসে)
অয়ন্তি গাল ফুলিয়ে তাকালো। আরশান হেসে বলে,
-যাও। আমাকেও ফিরতে হবে। টাটা,
-হু।
-ভালোবাসি কুসুম।
-হু।
-হু?
-ওকে।
-ওকে?
-পরে বলবো।
-কত পরে?তোমার তো মনে টনে পড়ছে না। রোজের মত তোমরও পরে পাল্টি খাওয়ার ইচ্ছে-টিচ্ছে আছে নাকি? সেসব থাকলে তা মাথা থেকে ঝেরে ফেলো।তুমি যখন একবার এই বিয়েতে সম্মতি দিয়েছো তখন আমাকে বিয়ে না করলে তুমি তোমার লাইফে স্বামী নামক ব্যক্তিটিকে কখনই পাবে না কুসুম।
-কেন?
-কারন তোমাকে বিয়ে করতে আসবে এমন বুকের পাটা কারোর নেই। থাকলে তা আমি ভে’ঙে গুড়ো গুড়ো করে দেবো। কথাটা মনে থাকে যেন, ঘরে যাও।

আরশান প্রচন্ড রেগে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যেতেই অয়ন্তি চোখ বড় বড় করে তাকালো।কি বললো লোকটা?উফ! লোকটা কেমন জানি! অয়ন্তি যেতে যেতে ফালাকের নতুন ছবির গান গুনগুনালো। কাল থেকে বিয়ের শপিং শুরু। কেনাকাটা কি অয়ন্তি একা করবে? আরশান কি যাবেনা? আচ্ছা আরশান কি করে? সায়নের কাছে শুনেছে অনাপি বলতো ওনার ব্যবসা আছে। কিসের ব্যবসা? কখনও সে ব্যাপারে বলে না কেন লোকটা? অনৈতিক কোনোকিছু? কি সাংঘাতিক! ক্রিমিনাল নয় তো? অয়ন্তি কল্পনার সাগরে মশগুল থাকায় সিড়ি বেয়ে যখন উঠছিল তখন তাঁর পাশে দাড়ানো মানুষটিকে দেখতে পারলো না।তাঁর রাগ, তিক্ত কথা আওড়ানো শুনতে পেল না।

______________

লেখিকা-সাইরাহ্ সীরাত।!
______________

ফার্মহাউজের সামনে এসে দাঁড়ালো ফারহান।সিয়ামকে চলে যেতে বলে সে ধীরে ধীরে প্রবেশ করল। টানা পাঁচ বছর পর এখানে আসলো ফারহান। রোজকে পেলে ও রোজকে ঠাটিয়ে দুটো চ’র আগে মা’রবে। তারপর বাকি কথা। কিন্তু রোজ এখানে এসেছে তো? আরশান নিশ্চই এখানেও খুজে গেছে। ফার্মহাউজের পেছনেই ওর বাবা মায়ের কবর। অতিরিক্ত ডিআইজি সাহেব জানতেন রোজের কথা তাই পরিকল্পনা করে এখানেই করবটা দিয়েছিলেন। যেন রোজ নিজের বাবা-মা’কে দেখতে পারে।যেটা ফারহান পরে জানতে পেরেছিলো। রোজের মন খারাপ হলে ও তিনটা মানুষের কাছে যায়, বাবা মা আর ফালাক! ফালাকের অনুপস্থিতিতে রোজ বাবা-মায়ের কাছেই আসবে। ফারহান ফার্মহাউজের ভেতরটা খুজে কবরের দিকে গেল।রোজ দাড়িয়ে আছে বুকের ওপর হাত গুজে। পরনে নীল পাড় সাদা শাড়ি! ফারহান ভ্রু কুঁচকে তাকায়। অন্ধকারে ঠিক ভুতের মত লাগছে বজ্জা’তটাকে। ফারহান পেছনে গিয়ে কিছুসময় দাড়িয়ে রোজকে দেখতে থাকলো। তের বছরের রোজ আর আঠারো বছরের রোজের মধ্যে আকাশপাতাল তফাৎ লক্ষ করা যায়।শারীরিক গঠন, পছন্দের ভিন্নতা, ভাবভঙ্গি সবকিছু বদলে গেছে।চাঁদের আলোয় রোজের চেহারার বাম পাশ দেখা যাচ্ছে। গাল বেয়ে অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ছে, চোখের নিচটা অতিমাত্রায় কালো তার মানে চোখের নিচে কালি পড়েছে। ঘুমায়না নাকি? নাক ফুলে আছে। শাড়ির আঁচল কোমরে গুজে রাখা। যার দরুন ওর ফর্সা পেট উন্মুক্ত হয়ে আছে। ফারহানের রাগ উঠে গেল। এভাবে এখানে কেউ দাড়ায়? দারোয়ান যদি চলে আসে? ওকে এভাবে দেখে? ফারহানের উপস্থিতি রোজ টের পেয়েছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। পূর্বের ন্যায় সে বা পা হালকা ভেঙে দাড়িয়ে আছে। ফারহান এগিয়ে গেল। জামার হাতা কনুইয়ের ওপর গোটাতে গোটাতে সে যখন রোজের একদম পেছনে গিয়ে দাড়ায় রোজ তখন নড়ে ওঠে। ফারহানের ঠোঁটে সূক্ষ্ম হাসির রেখা দেখা গেল। রোজ জানে ফারহান এসেছে, ফারহানের উপস্থিতি সে আগের মতই টের পায়। তাহলে সেদিনের নাটক করার কি দরকার ছিল? ফারহান রেগে যাচ্ছে দেখার পর জেদ দেখানোর কি দরকার ছিল? ও জানে না? ফারহানের রাগ অনেক। রাগ উঠলে মাথা ঠিক থাকে না। ফারহান কিছু না বলে রোজের কাছাকাছিই দাড়িয়ে রইল। পিনপতন নিরবতা চারিপাশে। ফারহান রোজের কোমরের আঁচল খুলে দিল। রোজ তবুও সাড়া দিল না। বরং তেজি কন্ঠে বলল,

-দূরে থাকুন।

ফারহান এবার রোজকে টান দিয়ে সামনে ঘোরালো। রোজ বরাবরের মতো স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়ায়। চোখে লেপ্টে থাকা পানিগুলো রোজ ডান হাতের উল্টোপিঠে মুছে নিয়ে ফারহানকে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে এমন সময় ফারহান ওর হাত ধরে বসল।

-চলে যাচ্ছিস কেন? যেতে বলেছি?

রোজ একবার ফারহানের হাতের দিকে আর একবার ওর চেহারার দিকে তাকিয়ে বলল,

-আপনার কথা শোনার মেয়ে বোধ হয় আমি নই। আমি রোজ হলেও পূর্বের রোজ নই।

-চাঁদ! (কোমল কন্ঠে ডাকল।)

-কে চাঁদ? আমি কারোর চাঁদ না। আমাকে এই নামে ডাকবে না ফালা,, ডাকবেন না ফারহান সাহেব।

-ফারহান? আর আপনি? আমাকে রাগাবি না চাঁদ।

-রাগ? আপনার মত সনামধন্য মানুষকে আমার মতো সাধারণ একজন কিভাবে রাগাতে পারে? আর ‘ফালাক ভাইয়া’ ডাকটা পাঁচবছর আগেই আমার জীবন থেকে মুছে গেছে। আপনাকে তুমি বলে ডাকার মত কোনো সম্পর্ক যেহেতু নেই তাই তুমি বলার অধিকারও মনে হয় নেই আমার। হাত ছাড়ুন! আমাকে যেতে হবে।

-কেন করছিস এমন?

– কি করেছি?

-সেদিন কেন বলিসনি কি হয়েছিল? তুই তো জানিস তোর পাশে আমি কারোর ছাঁয়াও সহ্য করতে পারিনা। সেখানে তুই একজনকে ভালোবাসার কথা বলেছিস, আবার এটা বললি যে তুই আমাকে ভালোবাসিস না। শুধু বন্ধু মনে করিস।

-ঠিকই তো বলেছি।

-ঠিক? তুই আমাকে শুধু বন্ধু মনে করিস?

-না। (থেমে বলল ) আপনি বন্ধু হওয়ারও যোগ্য নন।

-দাদাই বলে আমি সেদিন,

-আপনার জবাবদিহিতা চাইনি আমি। সেদিন কি হয়েছে তা স্বচক্ষে দেখেছি। এবং সবকিছু বোঝার মত ক্ষমতাও আমার আছে।একটা কথা বলুন তো, ভালোবাসা কাকে বলে? যাকে ভালোবাসা হয় তাকে কি নষ্টা বলা যায়? আপনি আমাকে নষ্টা বলেছেন, প্রস্টিটিউটের সঙ্গে দারুনভাবে তুলনা করেছেন। আমার ছেলে চাই কিনা জিজ্ঞেস করেছিলেন না? আজ বলছি! হ্যাঁ চাই। একটা দুটো না অনেকগুলো চাই। এবার কি করবেন? আমাকে মা’রবেন? কাটবেন? তাছাড়া পারেন’ই বা কি?
-কয়টা চাই?
-অনেকগুলো!
-আবার বল!
-………….
-কি হলো বল। আর একবার বল, তোর জিভ আমি টেনে ছিড়ে ফেলবো।
-আমার জিভ কি আপনার বাপের সম্পত্তি?
-না,আমার বাপের একমাত্র ছেলের সম্পত্তি!আর কিছু?
-হাত ছাড়ুন।
-ছাড়বো না।
-ছাড়বেন না? ওকে ধরে রাখুন! আমার ছেলেদের স্পর্শ ভালো লাগে।বাই দ্যা ওয়ে, আপনার নাকি চলছে?আই মিন হিরোইন মুগ্ধতার সাথে। তাকে এভাবে ছ্যাকা দিতে কষ্ট হবে না?ঘরে, বাইরে, রাস্তায়, বনে-জঙ্গলে আর কত প্রেমিকা চান?
-হোয়াট রাবিশ? ওরা আমার প্রেমিকা হতে যাবে কেন?ফালতু নিউজ পড়ে, রেডিওতে প্যাকপ্যাক করে অনেক কথা শিখেছিস। আর সেগুলো বলার জন্য আমাকেই পেলি? দেখ চাঁদ, ভালো ভালোয় বলছি বাড়িতে চল। সব যখন মিটে গেছে তখন এভাবে ঘুরবি না তুই।
-মিটে গেছে? কি মিটেছে? আপনি সেদিন আমাকে যে যে ভাবে অপমান করেছেন, যেভাবে গায়ে হাত তুলেছেন। ওসব ভুলে আপনার সঙ্গে যাবো এটা ভাবলেন কি করে মিস্টার মাহতাব!
-লাস্টবার বলছি চাঁদ। বাড়ি চল।
-যাবো না।
-ওকে ফাইন!

রোজকে টেনে রোজের অঁধরে অঁধর ছোঁয়ালো ফারহান। রোজ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ফারহান যে এমন কিছু আচমকা করে বসবে তা ভাবেনি রোজ। পাঁচ বছরেও মানুষটার এই দিকটায় বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আসেনি। আগে বাচ্চা ভেবে গালে চুঁমু দিত, সেটা মানা যেত। কিন্তু এখন? রোজ নড়ে উঠতেই ফারহান শক্ত করে চেপে ধরলো ওকে। বা হাতে আঁচল পেচিয়ে ধরে ডান হাতে কোমর জড়িয়ে ধরলো। রোজের দম বন্ধ হয়ে আসছে। ফারহান অতি হিং’স্রতার সঙ্গে ওর ঠোঁটের বেহাল দশা করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।বেয়াদব, অসভ্য, অভদ্র, বেহায়া, নির্লজ্জ, লু’চ্চা শব্দগুলোও ফারহানের জন্য অতি স্বল্প।এমন সাইকো রোজ পৃথিবিতে দুটো দেখেনি। ভালো তো আরশানও বাসে, সেও তাঁর থেকে অনেক ছোট একটা মেয়েকে ভালোবাসে। কই সে তো কখনও এমন করেনি অয়ন্তির সঙ্গে। ফারহানের থেকে নিজেকে ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে হাঁপিয়ে উঠে চেষ্টাটাই ছেড়ে দিল রোজ। এই হাতির মত বিশাল মানুষটার সামনে ও সামান্য একটা বিড়ালছানা। ওনাকে ঠেলে সরানো তো দূরে, সর্বশক্তি দিয়ে ঠেলেও সামান্য নড়ানো সম্ভব না। রোজ একদম শান্ত হয়ে যেতেই ফারহান ওর ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে বলল,
-এবার যাবি নাকি?

রোজ হাটতে শুরু করে। ফারহান মৃদু হেসে পেছন পেছন আসছে। এখনকার মত তো মেয়েটাকে ঠান্ডা করা গেল। কিন্তু পরে? ওদিকে রোজ মনে মনে বলল,
-ঝড় আসার পূর্বে সবকিছু শান্ত হয়ে যায় ফারহান মাহতাব ফালাক। বাক্যটা আপনি জানেন, তাই বাক্যের মর্মার্থ আমাকে বোঝাতে হবে না। মাত্র একঘন্টা, তারপর নিজেই বুঝে যাবেন। রোজকে এত সহজে পাবেন না আপনি। রোজ আপনার হবে না, সে আপনার হতে চায় না।

রোজ হাটতে হাটতে বলে,
-দাদাইকে আমি প্রেমিকের মত ভালো না বাসলেও আমার ভালোবাসার মানুষের অভাব নেই। এতক্ষণে এটা বুঝেছেন নিশ্চই। তাই এসব ফালতু ড্রামা করে কি লাভ? আমি আপনার নসিবে নেই। আপনার হতে আসি নি আমি।আর আমি না চাইলে আপনি আমাকে নিজের করতে পারবেনও না মিস্টার মাহতাব।

-তাহলে কার হবি তুই? নতুন দিওয়ানার নাম ঠিকানা দে আমিও একটু দেখি, সে কেমন? তোকে কিভাবে বশ করেছে।

-ওকে! শুনতে চান যখন তখন বলছি। আমার ওনাকে নিয়ে কথা বলতে আপত্তি নেই। তার আগে এটা বলুন দাদাইয়ের প্রেমের কথা শুনেছেন? দাদাইয়ের কুসুমের কথা?

-শুধু তোর কথা জানতে চাই, বাড়তি প্যাচাল পাড়বি না। ছেলের নাম কি?

-তাঁর নাম হচ্ছে চমক। রেডিও সেন্টারের আর’জের চমক। সে আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে, বিশ্বাস করে। আপনার মত নয় যে যখন তখন ছেড়ে চলে যাবে।আপনার কাছে তো শুধু আপনি নিজে গুরুত্বপূর্ণ, আপনার রাগ,ক্যারিয়ার, ইচ্ছে। রেডিও, আমি, আমার কথা, এগুলো তো ফালতু জিনিস। আপনি সর্বদা উঁচুতে উঠতে চেয়েছিলেন আজ উঠেছেনও। কিন্তু চরম সত্য হচ্ছে আমাকে পেতে হলে আমার মত হতে হবে। ওসব বাদ দিতে হবে। যেটা করা আপনার জন্য অসম্ভব। সো এসব নাটক অন্যকোথাও গিয়ে করুন। আমি চমককে ভালোবাসি, ওকেই বিয়ে করবো। আর ওর হয়েই সারাটা জীবন থাকবো।

কথাগুলো বলে একমুহূর্তও দাড়াতে পারলো না রোজ। ফারহান টেনে ওকে দেওয়ালের সঙ্গে মিশিয়ে গাল শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
-কি বললি? চমককে ভালোবাসিস? ওকে বিয়ে করবি? ওর হয়ে সারাজীবন থাকবি? তোর মনে হয় গতবারের মত তোকে ছেড়ে দেবো আমি? আমি আর অন্যসব প্রেমিকের মত না চাঁদ। যে শুধু প্রেমিকার কথা ভাববো, অতিতে ভেবে একবার ভুল করেছিলাম। সেই ভুল আর করবো না। তোকে আমি না পেলে কেউ পাবে না। প্রয়োজনে তোকে আগে শেষ করবো পরে নিজেকে আর তার আগে শেষ করবো ওই চমককে। তুই কারোর হতে পারবি না চাঁদ। কারোর না। আমি তোকে কারোর হতে দেবো না। তুই শুধু আমার হবি, বুঝেছিস? #তুই_হবি_শুধু_আমার।

রোজের ঠোঁট কে’টে গেছে। ফারহানের হাতের জোর বাড়ছে।গাল ব্যাথা করছে, সহ্যের সীমা পার হচ্ছে। তাই রোজ শক্ত গলায় বলে,
-সেটা তো সময় বলবে। তবে এটা নিশ্চিত থাকুন যদি নিজেকে বদলাতে না পারেন আমি কখনও আপনার নাগালের মধ্যে আসবো না। আপনার ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে রোজ। আর আপনি জানেন যে রোজ যেটা বলে সেটাই করে। রোজার বা চাঁদের মত কেঁদে ভাসায় না। কারোর ভালোবাসা পাবার আকাঙ্ক্ষা বা ইচ্ছে রোজের নেই। কারন এই বাজারে রোজকে ভালোবাসার মানুষের অভাব নেই। রোজ যাকে চাইবে তাকেই পাবে। সেজন্যই আপাতত চমককে চায় সে।

চলবে?

তুই হবি শুধু আমার পর্ব-১১

0

#তুই হবি শুধু আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_এগারো

অয়ন্তি এসেছে খাঁন ম্যানশনে। আমীর সাহেবকে দেখার কারনেই এসেছে মীর্জা বাড়ির সবাই। কিন্তু আরশানকে কোথাও দেখা গেল না। আমীর সাহেব কথা বলতে না পারায় আশরাফ মীর্জা নিজেই বলতে শুরু করলেন,
-অয়ন্তি বিয়েতে রাজি হয়েছে। তাই আমরা সবাই এটা চাচ্ছিলাম যে বিয়েটা আগামী মাসেই হয়ে যাক। আপনি তো সেটাই চেয়েছিলেন।

আরসালান এগিয়ে এসে বলল,
-হ্যাঁ! বাবা গতকালও আমাকে বলছিলেন এটা। বিয়েটা যদি আগামী মাসে না হয়ে এমাসের শেষে হয় তাহলে কি সমস্যা হবে আঙ্কেল? আসলে আরশানের বিয়েটা দেওয়া অনেক জরুরি।
-কেন বাবা? কোনো সমস্যা?

আরসালান থেমে থেমে বলে,
-আসলে পারিবারিক একটা সমস্যা চলছিল। আরশানের বিয়েটা তার সমাধান। ওর বিয়েতে একত্রিত হতে পারবে বাবার বন্ধুরা।
-আমার আপত্তি নেই। বিয়ে তো দিতেই হবে, সেটা আজ হোক বা কাল। আজ তো মাসের পনেরো তারিখ। শেষে বলতে ঠিক কত তারিখ বোঝাচ্ছো?
-শেষের শুক্রবার।
-আচ্ছা। কিন্তু তোমার বাবা? তিনি তো সুস্থ নন।
-সবাই আসলে সুস্থ হয়ে যাবে।চিন্তা করবেন না আপনি। আর ভাই একটা কাজে বাইরে আছে সেজন্য দেখা করতে পারলো না। কিছু মনে করবেন না।
-না, ঠিক আছে।

আরশান তিনদিন পর বাড়িতে ফিরলো। আরসালান বসার ঘরে বসে টিভি দেখছে। রজনী রান্না করছে, অভী আরসালানের পাশে বসে পড়া করছে। আরশানকে দেখে আরসালান গম্ভির কন্ঠে বলল,
-তোর রেডিওতে প্রচার করে দিস তোর বিয়ের নিউজ। বাবা আদেশ করেছেন!
-বিয়ে?
-রোজের আর ফালাকের কানে তোর বিয়ের খবরটা পৌঁছানোর দরকার। দেখা যাক পাগল দুটো কি করে। ফালাক না আসলেও রোজ নিশ্চই তোর বিয়েতে আসবে।
-আসবে না। আমি ভুল করেছি দাদাভাই। অনেক বড় ভুল।আমি বুঝিনি বেবি ফালাককে ভালোবাসে। আমার জন্য বেবির পাঁচটা বছর নষ্ট হয়েছে। ফালাক তাঁর চাঁদ আর রোজকে হারিয়েছে। সব দোষ্ আমার।
-দোষ গুণের হিসেব পরে করিস। আপাতত যা বলেছি সেটা কর। তাছাড়া ভুল তোরও ছিল না। পরিস্থিতিটাই ভুল ছিল। তোদের রাগ করা’টা ভুল ছিল। তোদের গরম মাথায় সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ভুল ছিল। রোজ জেদের বশে সেসব বলেছে, তুই রোজের কষ্ট দেখে ওসব বলেছিলি আর ওই সাইকো রোজকে তোর সঙ্গে দেখে জেলাসির ঠেলায় ওসব করেছে। সবটা ঠিক করার একটা সুযোগ এসেছে। সুযোগটা কাজে লাগা।
-ফালাকের কানে নিউজ পৌঁছাবে কি করে?
-রোজের শো’টায় কথা বলবি। খোঁজ পেয়েছি হিরো ফারহানের পি.এ রোজের ফ্যান! শো নিশ্চই শুনবে। ও ফালাকের কানে ঠিক কথাটা লাগাবে।
-আ’ইয়্যু শ্যর?
-হান্ড্রেড পার্সেন্ট। ফারদিন আঙ্কেলের সঙ্গে কথা হয়েছে আমার।উনি গ্যারান্টি দিয়ে বলেছেন। তাই এই শুক্রবার মানে আজ রাতের শো তুই করবি। আর নিজের বিয়ের এ্যানাউন্সটাও নিজে করবি।

____________

ফারহান আর সিয়াম সিলেট থেকে ঢাকায় ফিরছিল। ড্রাইভিং সীটে সিয়াম আর পাশে ফারহান। সিয়াম বার বার ফোন চেক করছে। বারো’টা বাজতেই সিয়াম গাড়ি থামিয়ে দিল। ফারহান ভাবলেশহীন হয়ে জানালার বাইরে চেয়ে আছে। গাড়ি থামতেই সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়।
-কি প্রবলেম?
-রেডিও চলছে না কেন স্যার? আমার ফোনেও চার্জ নেই। আপনার ফোনটা একটু দেবেন? প্লিজ!
-হোয়াট!
-মাত্র দেড়ঘন্টার জন্য স্যার। যাস্ট রেডিও অন করবো। আপনি করে দেন। আমি আপনার ফোন টাচও করবো না।
-রেডিও?
-না মানে একটা শো আমি রেগুলার শুনি স্যার। একটা মেয়ে হোস্ট করে, ভালোবাসার রংমহল নাম। আর ওই রেডিও জকির নাম
-এয়ারফোন আছে? এসব ফালতু জিনিস আমি পছন্দ করিনা।
-না স্যার! কিন্তু আমি শিউর, ওর গলা শুনলে আপনার ভালো লাগবে?
-হোয়াট? (রেগে বলল )
-কিছু না স্যার। (রেডিও গুতাতে গুতাতে )রেডিও ঠিক হয়ে গেছে। এরপর আস্তে বলল, “হোয়াটের প্রতিষ্ঠাতা!”

সিয়াম রেডিও চালিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিতেই আরশানের গলা শোনা গেল। “হ্যালো ডিয়ার লিসেনার, আমি আর জে আরশান, আজ আছি আপনাদের সঙ্গে। দুঃখিত আজ আর জে রোজ শো করতে পারছেন না। তাঁর হয়ে আমি এসেছি ভালোবাসার রংমহলকে রাঙাতে। জানি পারবো না, তবুও চেষ্টা করবো। তাঁর আগে একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর দিতে চাই, বেশ কিছুদিন ধরে আমার বিয়ে নিয়ে সবার মনে নানা প্রশ্ন ছিল। আজ সব প্রশ্নের উত্তর দিতে এসেছি আমি। আপনাদের দোয়ায় শীগ্রহই আমি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে চলেছি। ”

ফারহান আচমকা রেডিও বন্ধ করে দিল। এরপর রেগে বলল,
-আর অন করবে না।
সিয়াম দুঃখি মুখ করে বলে,
-কেন স্যার?
-আমি বলেছি তাই।
-প্লিজ স্যার একবার চালাই? রোজ মেয়েটার কি হয়েছে জানার দরকার। আই হ্যাভ অ্যা হিউজ ক্রাশ অন হার। মেয়েটার কি হলো কে জানে? দেখি কিছু বলে কিনা!
-নো।
-প্লিজ! স্যার। আপনার জন্য এত খাঁটি আমি। তবুও কি কখনও কিছু বলেছি? কোনো অনুরোধ করেছি? আজ একটা অনুরোধই তো করছি। দরকার পড়লে আমার এ মাসের স্যালারির টুয়েন্টি পার্সেন্ট কেটে রাখুন।
-নো।
-কি সমস্যা স্যার? চালাই না প্লিজ!
সিয়াম ফারহানের দুহাত চেপে ধরতেই ফারহান বিরক্ত হয়ে তাকালো। এরপর কঠিন গলায় ঝারি দিয়ে বলল,
-হাত ছাড়ো! ছাড়ো! এসব বাচ্চামির মানে কি? সামান্য একটা প্রোগ্রাম নিয়ে এত নাচানাচি কিসের?
-প্রোগ্রাম না তো, মেয়েটা!
-হোয়াট?
-কিছু না।
-ওকে। শোনো কিন্তু ভালিয়ম কম করে। আমার কানে যেন না পৌঁছায়।
সিয়াম বিরবির করে বলে,
-খাটাশ ব্যাটা।
-কি বললে?
-ন,না, ক,কিছু ন,না।

রেডিওতে এক কলার ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করেছে কে সেই ভাগ্যবতী যাকে আরশান বিয়ে করছে। আরশান হেসে বলল, ‘সে ভাগ্যবতী কিনা জানি না, তবে আমি ভাগ্যবান যে তাকে পাচ্ছি। তার নাম জেসমিন মীর্জা অয়ন্তি। ‘ ফারহান দ্রুত পাশ ফিরলো।
-সিয়াম ভলিয়ম বাড়াও তো। নামটা বোধ হয় ভুলভাল শুনলাম।
-কি শুনেছেন স্যার?
-জেসমিন টাইপ কিছু। নামটা তো সাইরাহ্ হবে।
-আমিও তো জেসমিন শুনলাম স্যার। সাইরাহ্ টাইপ কিছু তো বলেনি।
ফারহানের কপালে ভাঁজ পড়লো। রোজের বদলে কার নাম বলল আরশান? নাকি রেডিওর ফ্রিকোয়েন্সি তে প্রবলেম? ফারহানের হাত-পা-কপাল প্রচন্ড রকমেন ঘামছে। এটা কেমন মশকরা? সিয়াম ভলিয়ম বাড়াতেই ফারহান শুনলো আরশান বলছে,’ হ্যাঁ জেসমিন মানে জুঁই। আমি তাকে কুসুম ডাকি। জুঁই ফুলের পরিবর্তে কুসুম।’
-সিয়াম!
-জি স্যার।
-আর’জে আরশানের নাম্বার দ্রুত জোগাড় করে দাও আমাকে।
-কেন স্যার?
-তুমি এত প্রশ্ন কেন কর? আর একটা প্রশ্ন করলে এই রাতে, অন্ধকারে তোমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে চলে যাবো।
-নাম্বার তো আছে আমার কাছে। এই নিন।

ফারহান নাম্বার নিয়ে দ্রুত কল করলো। আরশান কল রিসিভ করলো না। ফোন তো সাইলেন্ট করে রাখা। ফারহান অনবরত কল করতে থাকলো।ওর চাঁদের সঙ্গে কি ঘটেছে কি ঘটছে জানা প্রয়োজন। চাঁদ কেমন আছে? ভালো আছে তো? ফারহান, ফারদিন সাহেবকে কল করলো। আরশানদের সঙ্গে ওনার যোগাযোগ ছিল এখনও আছে সেটা ফারহান ভালো করেই জানে। তাই সময় নষ্ট করলো না ফারহান। তিনবার রিং হতেই বাবা ফোন রিসিভ করে বিরক্তকন্ঠে বললেন,
-কি সমস্যা ফালাক? এত রাতে কল করছো কেন?
-চাঁদকে রেখে দাদাই কাকে বিয়ে করছে?
-যাকে করা উচিত, যাকে সে ভালোবাসে। তোমার এটা জেনে কি লাভ?
-ভালোবাসে মানে? সে চাঁদকে ভালোবাসে।
-হ্যাঁ, তবে বোন হিসাবে। প্রেমিকা বা বউ হিসেবে না।
-বাবা চাঁদ কোথায়?
-জানি না। তোমারও জানার দরকার নেই। হঠাৎ এতো বছর পর ওর খোঁজ নেওয়ার কি প্রয়োজন পড়লো?
-প্রয়োজন আছে বাবা,এতদিন জেনেছি দাদাই ওর সঙ্গে আছে। ও ভালো আছে।
-আজও সেটাই জানো। আর ফোন করবে না। ঘুমাচ্ছি আমি।
ফারদিন সাহেব ফোন রেখে আরসালানকে ফোন দিলেন। পরিকল্পনা তাহলে ঠিক দিকেই এগোচ্ছে।

ফারহান আবারও আরশানকে ফোন করতে শুরু করে। সিয়াম হা করে চেয়ে আছে। রাগি তেজি স্যারটা হঠাৎ বদলে গেল কি করে? রাগ দেখানোর বদলে নরম গলায় অনুরোধ করছে। হুকুম করা ভুলে গেছে নাকি? সিয়াম কি শিখিয়ে দেবে? তারপর ভাবে, না। কি দরকার ঘুমন্ত বাঘকে জাগানো? নিজেকে বাঘের খাদ্য বানানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। সিয়াম গাড়ির স্পীড কমিয়ে দিল। রাস্তাটা ভালো না, জায়গায় জায়গায় গর্ত। সিয়াম ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,
-আপনিও আর’জে রোজের ফ্যান নাকি স্যার? তাহলে তখন নাক সিটকালেন কেন?
-মানে? রোজের ফ্যান অনেক নাকি?
-মেল ফ্যান অনেক। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশতভাবে তাকে কেউ দেখতে পারেনি। উনি সামনে আসেননা। যদি আসতেন তাহলে
-তাহলে?
-তাহলে আমি টুপ করে ওনাকে বিয়ে করে ফেলতাম। তারপর সারাদিন ওনার মিষ্টি গলা শুনতাম। আহা!
-গুড!
-একটা আইডিয়া দেন তো স্যার, ওকে কিভাবে পাওয়া যায়। আপনার তো কদর অনেক, একটু ব্যবস্থা করে দেবেন?
-একটা পি’স্ত’ল হবে?
সিয়াম ব্রেক কষলো। পি’স্ত’ল কেন? এত রাতে পি’স্ত’ল দিয়ে কি হবে? সিয়াম থতমত খেয়ে বলে,
-পি’স্ত’ল কেন স্যার?
-তোমাকে খু’ন করবো আমি।
-আমি কি করলাম?
-ফারহানের জিনিস নিজের ভাবতে চাওয়ার মত ভুল আর অন্যায় ফারহান ক্ষমা করেনা।
-আপনার জিনিস? কোনটা স্যার? ফ্যান? না, না রেডিও? আপনার তো রেডিও নেই! তাহলে?
-আর একটা কথা বললে তোমাকে জানে মে’রে দেবো সিয়াম। আমার রাগ কিন্তু বাড়ছে বৈ কমছে না। আর তুমি জানো আমার খু’ন করতে হাত কাঁপে না।

সিয়াম এবার স্তব্ধ হয়ে গেল। এই কথাটা চিরন্তন সত্য। এই মানুষটা হাসতে হাসতে খু’ন করে। একপাশ থেকে খু’ন করে অন্যপাশে গিয়ে হাত ধুয়ে সাধুসন্ন্যাসী টাইপ রিয়াক্শন দিতে ওস্তাদ এই অভিনেতা। সিয়াম নিজেও তো সরাসরি দুইটা খু’ন দেখেছে। এনাকে বিশ্বাস নেই। দেখা গেলো সত্যিই সিয়ামকে মে’রেটেরে দিল। কিন্তু সিয়াম কি অন্যায় করেছে? কি ভুল বলেছে? ওনার জিনিসটাই’বা কি?

প্রায় দেড়শো কল করে ফেলেছে ফারহান। শো শেষ করে আরশান ফোন হাতে নিতেই দেখলো আননোন নাম্বার থেকে একশ সাতচল্লিশ মিস্ড কল। এতরাতে এভাবে কে ফোন করেছে? আরশান কল ব্যাক করল। একবার রিং হতেই ফোন রিসিভ হতেই ফারহান ক্লান্ত স্বরে বলে,
-ফোন কা’টবে না। চাঁদ কোথায়? কাকে বিয়ে করছো তুমি?

আরশান প্রথমবারেই গলা শুনে চিনে ফেলল ফারহানকে। ঔষধ এত দ্রুত কাজ করবে তা ধারনার বাইরে ছিল ওর। ও তো ভেবেছিল ফারহান রাগ নিয়েই থাকবে। ফারহান রোজকে ঘৃণা করে, আর সেটাই করে চলবে। কিন্তু পাগল ছেলে তো একটু শুনেই পাগলামি শুরু করে দিল। আগে পরে জানার প্রয়োজনবোধ করে নি নাকি? আরশান মুচকি হেসে গম্ভির গলায় বলে,
-কেন?
-আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নেবে না তুমি। চাঁদ কোথায় সেটা বলো।
-জানি না।
-জানো না মানে? চাঁদ তোমার কাছে ভালো থাকবে বলেই তো ওকে রেখে গিয়েছিলাম আমি। তুমি ওকে ভালবাসো, ও তোমাকে ভালোবাসে তাই রেখে গেছিলাম। ও ঘৃণা করে আমাকে,তাই চলে এসেছিলাম। যেন ও সুখে থাকে। ভালো থাকে । আর তুমি বলছো ও কোথায় তা তুমি জানো না!
-না জানলে কি করে বলবো? চলে গেছে রাগ করে।
-আর তুমি যেতে দিলে?
-আমাকে আটকে রেখে গেছে। ওকে চিনিস না?কেমন ফাজিল।
-সামলাতে পারো না, তাহলে দায়িত্ব নিতে গিয়েছিলে কেন? ওর কিছু হলে আমি তোমাকে ছাড়বো না দাদাই।
-আগে তো ধরে দেখা তারপর ছাড়াছাড়ির প্রশ্ন আসবে। গতবার একটা থা’প্পড় লাগিয়েছিলাম এবার গুনে গুনে বেশ কয়েকটা লাগাবো। আমার বেবিকে কষ্ট দেওয়ার ফল বুঝবি।
-ওকে আমি কষ্ট দিয়েছি? তোমরা কিছু করোনি?
-আরে ভাই, তুই তোর সাইকিক প্রেম আর পাগলামি যে ওভাবে প্রকাশ করবি তা কি আমরা বুঝেছি? তোরা দুজনেই যে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিলি তা কি জানতাম?ও অস্বীকার করলো বলেই তো আমি রেগে তোকে ওসব বললাম।
-তাহলে সত্যটা এতবছর বলোনি কেন? কি ভেবেছিলে? ওকেও ইউজ করে ছেড়ে দিয়েছ? নতুন করে কাকে,,
-ভাই, তুই এত সন্দেহ করিস ক্যান? তোর চাঁদ একদম ঠিকঠাক! কোনো ধরাধরি, ছাড়াছাড়ি নেই। সেদিন ওর বাবা-মায়ের মৃত্যুর খবর দেওয়ার পর ওকে সান্ত্বনা দিতে ভালোবাসার কথা বলেছিলাম, ও নিজেও সেজন্য বলেছে। তুই কোথ থেকে কতটুকু শুনে পাগলামি চালু করে ব্যাপারটা ঘেটে দিলি।
-আর এত ফ্যান?এত ছেলে? আমার পি.এ অবধি ওকে বিয়ে করতে চায়। ওকে এসব ফালতু রেডিও ফেডিও চালু করতে বলেছে কে?
-রোজকে দেখেছিস বড় হবার পর?
-না।
-তাইলে আর করলি কি? তোর বউ তো চাঁন্দের টুকরা। ফ্যানফলোয়ার বাড়বে, এটা স্বাভাবিক। আমার কয়েক ডজন ছোট ভাই তো স্বয়ংবরের অপেক্ষা করছে। মনে হয়ে বিয়ে’টিয়ে হয়ে যেতে পারে।
-বিয়ে করাচ্ছি আমি। নিঁখোজ হয়েছে কবে? এক্সাক্টলি কোনদিন কোন সময়?
-কেন?
-ওর কান টেনে নিয়ে আসবো। মা’র এখনও পাওনা আছে। হাত-পা ভে’ঙে ঘরে বসিয়ে রাখবো ওই বেয়াদব বদমাইশটাকে।
-সোমবার, সকাল সাড়ে এগারো’টা।
-ওকে! আমরা আসছি পরশু।
-কি?
-বললাম পরশু আসছি আমরা।
-তুই জানিস ও কোথায়? ক্যামনে ভাই?
-চাঁদের পাই টু পাই হিসেব রাখা ছিল আমার। জানিনা মিলবে কিনা, বাট ট্রাই করবো। বেয়াদবটা পাল্টে গেছে অনেক।
-ইউ ঠু! ওকে, কাম ফাস্ট। আ’ম ওয়েটিং।

ফারহান ফোন রেখে সিয়ামের দিকে তাকালো। সিয়াম হা করে চেয়ে আছে। নারীবিদ্বেষী মানুষটার প্রেমিকাও আছে? হিরোইন নাকি অন্যকিছু? চাঁদ বলে ডাকা হয় তাকে? এই ব্যাটা রোম্যান্টিক নাকি অত্যাচারী? টর্চার করার কথাই তো বললো। আবার কিছু কিছু কথায় রোম্যান্টিকতার আভাস! সিয়াম ফারহানের কথাগুলো পুনরায় মনে করেই লাফ দিয়ে উঠলো।
-স্যার! রোজ আপনার চাঁদ?
-ম্যাম ডাকবে।
-ও,ওকে স,স্যার! (সিয়াম রে আজ তোর কপাল ভালো ছিল। বড় বাঁচা বেঁচেছিস!)

চলবে?

তুই হবি শুধু আমার পর্ব-১০

0

#তুই হবি শুধু আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_দশ

“সাইরাহ্ আনসারী রোজা” সাফোয়ান আনসারী এবং মিফতাহুল মেহরিন রেণু’র একমাত্র কন্যা। সাফোয়ান আনসারী ছিলেন এ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের ডি. আই. জি। একটি গোপনীয় মিশন চলাকালীন পাঁচবছর আগে বো’মব্লাস্টে তিনি মা’রা যান। টেরোরিস্টদের কিছু গোপন তথ্য আনসারী সাহেবের কাছে ছিল বলে ওদের বাড়িতেও হা’মলা করা হয়েছিল। রোজ তখন কলকাতা অর্থাৎ আরশানের কাছে গিয়েছিল ঘুরতে। আরসালান, রজনী ভাবি, অভী, অয়ন, ফালাকসহ প্রায় সবাই এক সঙ্গেই গিয়েছিল। রোজের বাবা কাজের জন্য যেতে পারেননি আর রেণু আনসারী সাহেবের জন্য।সেই জঙ্গী ও টেরোরিস্ট বাড়িতে এসে ভাঙচুর করে, রেণু বাঁধা দিলে রেণুকেও মে’রে ফেলে। তাদের মৃত্যুর খবর দুদিন পর পৌঁছায় রোজের কাছে। রোজের বয়স তখন তেরো বছর। প্রচন্ড দুষ্টু ও চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে সে। সবাইকে জ্বালাতন করা ওর পেশা! দিনটি ছিল বৈখাশের প্রথম দিন। প্রচন্ড গরমে সে ছাদের কোনায় পা ঝুলিয়ে বসে সামনের আম গাছের থেকে আম ছিড়ে লবন দিয়ে খেতে খেতে গান গাইছিল। ফারহান শ্যুটিংয়ের কাজে দার্জিলিং গিয়েছিল। আজ কালের মধ্যেই ফিরবে। তাই তাঁর জন্যও কিছু আম গুছিয়ে রাখলো রোজ। এলে দুজনে মিলে মাখিয়ে খাবে। আরসালানের বড় ছেলে অভী রোজের পাশে বসেই গল্প করছে আর খাচ্ছে। ঠিক তখনই আরশান আসে ছাদে। রোজ খেতে খেতে পেছনে ফিরে বলে,
-দাদাই তোমার বাড়িতে সব ঘরে এসি নেই কেন? শুধু তোমার আর আঙ্কেলের ঘরে এসি। আমার গরম লাগে তো। এই অভী তোমার গরম লাগে না?

পাঁচ বছরের অভী খিলখিল করে হেসে উঠে বলে,
-লাগে তো। চাচ্চু আমার আর ফুপির ঘরে এসি দেবে। গরমে কালো হয়ে যাচ্ছি আমরা।

আরশানের গলা ধরে আসছে। রোজকে সে কিভাবে জানাবে ওর বাবা-মায়ের কথা?আমীর সাহেব অবধি সাহস পাচ্ছেন না এমন সংবাদ নিয়ে রোজের সামনে আসার। সেখানে আরশান এসেছে। না এসে উপায় নেই, রোজকে তো জানাতে হবে খবরটা।মেয়ে হিসেবে এটা জানার অধিকার আছে ওর। আমীর সাহেব নিজেকে ঘরবন্দি করে রেখেছেন। সপ্তাহখানেক আগে আনসারী সাহেব তাকে ফোন করে কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন,

-মেয়েটাকে তোদের সঙ্গে পাঠাচ্ছি আমীর। ওকে দেখে রাখিস। আমার পেশায় কখন কি হয় জানি না। আমার কিছু হলে রেণু আর রোজকে তুই নিজের কাছে রাখবি। রোজকে নিরাপদে রাখবি।পরিচয় গোপন রাখবি। কেউ যেন না জানে ও সাফোয়ান আনসারীর মেয়ে, আনসারী রক্ত ওর শরীরে।

-কি হয়েছে? এভাবে কথা বলছিস কেন? ফারদিনকে নাকি ফোন দিস না অনেকদিন হলো। কোথায় তুই?

-মিশনে আছি। বাড়িতেও তেমন যোগাযোগ রাখতে পারছি না। সকালে রেণুর ফোন পেয়ে রোজকে দেখতে এসেছিলাম। ওদের মাত্র গাড়িতে তুলে দিলাম। এবার আবার ফিরতে হবে। ওদের খেয়াল রাখিস। ফারদিন আর তুই ছাড়া আমি কাউকে বিশ্বাস করতে পারবো না।

-চিন্তা করিস না, আমি আছি তো। আমি কথা দিচ্ছি আমি ওদের খেয়াল রাখবো।রোজকে নিয়ে কলকাতায় যাচ্ছি, রেণু ভাবিকেও যেতে বললাম কিন্তু তোর জন্য যাবে না ভাবি। তুই রোজকে নিয়ে টেনশন করিস না। রোজের সকল দায়িত্ব আমার।

-রাখছি। জিপ চলে এসেছে।

-সাবধানে থাকবি। সময় পেলেই ফোন করবি। অপেক্ষা করবো আমরা।

একসপ্তাহ আগে যারা ছিল তারা আজ নেই। ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসছে আমীর সাহেবের। বাল্যকালের বন্ধু তারা। একসঙ্গে এক স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি থেকে এই বয়স অবধি একসঙ্গে ছিলেন। কিন্তু এখন এসবের থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে রোজ। আরশান রোজকে কাছে ডাকল,
-বেবি শোন।

রোজ আম কামড়ে টকে চোখমুখ খিঁচে ফেলেছে। ডাক শুনে সে একচোখ মেলে বলে,
-টাইম নেই। এখন ফালাক ভাইয়ার জন্য আম গোছাতে হবে। ফালাক ভাইয়া কবে আসবে?

-আমার কাছে আয়। তোকে একটা কথা বলতে হবে। জরুরি কথা। ওখান থেকে উঠে এখানে আয়।

রোজকে ডাকার অর্থ হচ্ছে, রোজ যেমন দুষ্টু তেমনই জেদি, রাগি, অভিমানি। যদি খবরটা শুনে লাফ দিয়ে বসে? রোজ উঠে অভীর জামার ওপর আমগুলো দিয়ে আরশানের কাছে আসলো। আরশান রোজের চুলগুলো ঠিক করে বলল,
-অনেক খেয়েছিস। আর খেলে পেট ব্যাথা করবে।
-ওকে। এবার বলো তোমার জরুরি কথা কি? কি বলবে যার জন্য আমাকে, রোজকে তুলে আনলে।

আরশান দম ফেলে বলল,
-তোর বাবা-মা নেই বেবি।

রোজ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। এটা নতুন কি? বাবা-মা তো এখানে আসেনি। তারা তো বাড়িতে। তাই এখানে তারা থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। আরশান বোকা বোকা কথা বলছে দেখে রোজ হেসে উঠলো,
-তো কি হয়েছে? তোমরা তো আছো। আর আমরাও তো দেশে ফিরবো কিছুদিন পরেই। এখন নেই তখন থাকবে।

আরশানের চোখে পানি চলে এসেছে। মেয়েটা এখনও ওর কথার অর্থ বোঝেনি। বুঝলে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে? আরশান কেঁদে উঠলো। বলল,
-তোর বাবা-মা মা’রা গেছে বেবি। আঙ্কেল বো’মব্লাস্টে আর আন্টিকে টেরোটিস্টরা খু’ন করেছে।

রোজের হাত আম ছিল। সে সেগুলো নেড়ে চেড়ে দেখে আরশানের হাতে দিতে যাচ্ছিলো। এমন বাক্য শুনে ওর হাত থেকে আমগুলো পড়ে যায়। সর্বাঙ্গ টলে ওঠে। কান কি ঠিকঠাক শুনতে পাচ্ছে নাকি ভুল কিছু শুনলে? হ্যাঁ ভুলই শুনেছে। এমন হতে পারে নাকি? ওর বাবা কত সাহসী বুদ্ধিমান,ব্লাস্টে কিভাবে তাঁর ক্ষতি হবে? আর মা তো বাড়িতে।রোজ আরশানের দিকে তাকিয়ে বলে,
-এমন বাজে কথা বলবে না দাদাই। আনসারীর মেয়ে আমি। এত সহজে ভয় পাবো না। আর তুমি কি ফালাক ভাইয়ার মত অভিনেতা হতে চাও? কাঁদছো কেন এমন করে? মেজাজ খারাপ করবে না একদম।

আরশান রোজকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে রোজের মাথা বুকের সঙ্গে মিশিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-আমি সত্যি বলছি। বিশ্বাস কর আমাকে।

রোজের চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসে। তাহলে এটাই সেই কথা যা আসার আগে রোজকে আনসারী সাহেব বুঝিয়েছিলেন। শিখিয়েছিলেন কঠিন পরিস্থিতে নিজেকে কিভাবে সামলাতে হয়। রোজকে বলেছিলেন সে যেন কখনও ভে’ঙে না পড়ে। সর্বদা মনে রাখে সে আনসারীর মেয়ে।আত্মসম্মান নষ্ট, মাথা নত করা, ছোট হওয়া, এগুলো আনসারীর মেয়ের জন্য শোভানীয় নয়। আনসারীর মেয়ে হবে, বাবার মত সাহসী, বুদ্ধিমতি, মায়ের মত কোমল, মমতাময়ী। রোজ আরশানের বুক থেকে মাথা তুলে দুহাতে চোখের পানি মুছে বলে,

-বাবাদের কবর কি দেওয়া হয়ে গেছে?

-হুম। তুই বাজে কিছু করার কথা ভাববি না বেবি। তুই একা নোস্ আমরা সবাই আছি তো। আমরা তোকে অনেক ভালোবাসি। আমি তোকে অনেক ভালোবাসি বেবি। অনেক!

– আমিও তোমাকে ভালোবাসি। আমি কষ্ট পাবো না। কারন তুমি, তোমরা আছো তো। তোমরা আমাকে কষ্ট পেতে দেবে না আমি জানি।

রোজের বুকের ভেতরটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে। ফালাক কোথায়? ওর যে ওর বন্ধু ফালাককে প্রয়োজন। ফালাককে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে চায় রোজ। কোথায় ফালাক? রোজের কাছে কেন আসছে না সে?

ফালাক শ্যুটিং শেষে সোজা ছাদে চলে এসেছিল। আর এসেই আরশান ও রোজের কথা শুনে সে স্তব্ধচোখে তাকাল। রোজ আরশান একে অপরকে ভালোবাসে? রোজ সেটা নিজ মুখে বলছে? ফালাক এসে রোজকে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে গেল। আরশান ওর এমন কাজে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাড়িয়ে রইলো। কি হলো ছেলেটার? আরশানও পিঁছু পিঁছু যেতেই দেখলো ফালাক দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। জানালার কাছে এসে সে তাকাল ওদের দিকে। ফালাক রোজের গালে চ’র বসিয়ে বলল,

-কি বললি তুই?কি বললি? তুই দাদাইকে ভালোবাসিস।দাদাইকে? আর আমি? আমাকে? তোকে আমি ভালো ভেবেছিলাম রোজ! কিন্তু তোরও তো সব মেয়েদের মত টাকা চাই তাইনা? আগে সবসময় আমাকে চিনতিস যেই দাদাই আসলো ওমনি পছন্দ পাল্টে গেল? এমন করতে পারলি তুই? কেন করলি এমন? কেন ঠকালি?

বলেই রোজের গলা টিপে ধরল ফালাক। আরশান এটা দেখে দরজা ধাক্কাতে থাকে। সবাই চলে আসে চিৎকার শুনে। রোজ হা করে তাকিয়ে আছে। আরশান জানে এই ধরনের ভালোবাসার মানে। আরশান নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছে কিন্তু ফালাক ছোট, ও তা পারছে না। রোজও কি ফালাককে ভালোবাসে? নাকি ফালাকের দিক থেকেই শুধু এই অনুভূতি জন্মেছে? ফালাক বলতে থাকে,

-মাত্র তিনদিন ছিলাম না এখানে।তারমধ্যেই ভালোবাসা হয়ে গেল? আর কি হয়েছে? কি দিয়েছে তোকে? বল কি পেয়েছিস? যে আমাকে ভুলতে সময় লাগলো না।

রোজ এবার শব্দ করে কেঁদে উঠলো। প্রথমে বাবা-মা আর এখন ফালাক। ফালাক ওকে বাজেভাবে অপমান করছে। রোজ বোঝে এসব কথার ধরন। ফালাক তো রোজের নিরাপত্তার জন্য ওকে সব বুঝিয়ে বলেছিলো। বলেছিল খারাপ ভালোর তফাৎ। তাই ফালাক ওকে সে সব ইঙ্গিত দিচ্ছে তাও বুঝতে পারছে রোজ। আনসারী কখনও নিজের আত্মসম্মান নষ্ট করতে দিতে পারেনা।সবকিছুর উর্ধ্বে তাদের আত্মসম্মান। বাবা তো এসবই বলেছিলেন। রোজের চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়তে থাকে। এই ফালাককে রোজ চেনে না। রোজের সম্মান নিয়ে যে কথা বলে, রোজকে যে অবিশ্বাস করে তাকে রোজ মাফ করবে না। কিছুতেই না। রোজ গলা থেকে হাত ছাড়িয়ে বলল,

-কি বলছো এসব? কেন বলছো?

আরশান দরজা ভেঙে ফেললো। রোজকে একহাতে আগলে ধরে বলল,
-কি করছিস ফালাক? বেবিকে মারছিস কেন? এসব কি কথা? ঠান্ডা হ। আমার সঙ্গে চল আমি সবটা বলে দিচ্ছি। তুই ভুল ভাবছিস।

-ভুল? তোমাদের প্রেমের কথা ভুল দাদাই? তুমি তো সব জানতে।তুমি জানতে এই মেয়েটাকে আমি ভালোবাসি। তবুও এমন করলে? কেন করলে? দাদাই কেন? আর তুই তোর কি দরকার ছিল? বয়সের আগে পেঁকে গিয়ে এই হাল করেছিস তাইনা? এখনই ছেলে লাগবে? থাকা লাগবে? আমাকে বলিসনি কেন? আমি থাকতাম।

আরশান সপাটে থাপ্পড় বসালো ফালাকের গালে।রোজ হিচকি তুলে কাঁদছে। আরশান রাগে থরথর করে কাঁপছে। চেঁচিয়ে বলে,

-এসব কি ফালাক? কি বলছিস, তার মানে জানিস? ও আমাদের বেবি, আমাদের প্রিন্সেস! তুই ওকে এভাবে, আর তুই ওকে ভালোবাসিস, ও কি বলেছে ও তোকে ভালোবাসে? রোজ, তুই ফালাককে ভালোবাসিস?

রোজের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। ফর্সা গাল লাল হয়ে রয়েছে। রোজ জোরে শ্বাস নিয়ে বলে,
-না! উনি শুধু আমার বন্ধু। আমি কাউকে ভালোবাসিনি ভালোবাসিনা। আর হ্যাঁ এটা সত্য আমি দাদাইকে ভালোবাসি। তবে সেটা ভাই হিসেবে।

ফালাক তাচ্ছিল্য হাসি হেসে বলল,
-সবার সামনে পাল্টি খেয়ে আমাকে খারাপ বানাতে চাইলি চাঁদ? ওকে! তোর এই চাওয়াটাও পূর্ণ করবে ফালাক। খারাপ হবে সে, প্রচন্ড খারাপ। যে খারাপের কল্পনাও কেউ করতে পারবে না।

আমীর সাহেব ফালাকের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
-ঠান্ডা হ, ফালাক।কি বাচ্চামি শুরু করেছিস? এধরনের কথা বলার সময় না এখন। রোজকে এভাবে বলিস না। ও সবে খবরটা পেল।

-তুমিও আমাকেই দোষারোপ করলে আঙ্কেল? তোমার ছেলে যেটা করেছে সেটা ঠিক?

-আরশান! ফালাক কি সত্য বলছে? তুই ভালোবাসিস রোজকে? এটা বলেছিস?

আরশানের জবাব,
-বলেছি। আর সেটা সজ্ঞানে বলেছি। ওর মত ছেলের হাতে বেবিকে তুলে দিতে পারবে তোমরা? যে এভাবে বেবিকে মা’রলো, বাজে কথা বললো। প্রয়োজনে বেবির দায়িত্ব আমি নেবো। কিন্তু এই বেয়াদবটাকে এখুনি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলো।

রোজ আমীর সাহেবের হাত জড়িয়ে ধরে বলল,
-যেতে বলো ওনাকে। আমি ওনাকে ঘৃণা করি আঙ্কেল। আমার সহ্য হচ্ছে না। কষ্ট হচ্ছে। যেতে বলো ওনাকে।

আমীর সাহেব কিছু বলবেন তার আগেই ফালাক বলে,
-আমিও চাঁদ! না চাঁদ না, আমার চাঁদ এমন হতেই পারে না। তুই রোজা, সাইরাহ্ আনসারী রোজা। আমার রোজ এমন ছিল না, আমার চাঁদ এমন ছিল না। সে প্রতারণা জানতো না। তোর মত প্রতারককে আমি ঘৃণা করি। তোর চেহারা আমি দেখতে চাইনা, কখনও না। আমাকে তুই কখনও ফালাক ভাইয়া বলে ডাকবি না। ফালাক নেই, ফালাক বলে কেউ থাকবে না। আমি চলে যাচ্ছি আঙ্কেল, তোমার ছেলের বাড়ি থেকে। তাঁর জীবন থেকে ভালো থাকিস রোজা! খুব ভালো থাকিস।

ফালাক চলে যেতেই আমীর সাহেব আরশানের দিকে তাকালো।এরপর আরশানকে প্রশ্ন করে সবটা জেনে বললেন,
-কেন করলে এমন? কেন বললে তুমি রোজকে ভালোবাসো? তুমি চেনো না ফালাককে? ওর রাগ জেদ জানো না? রোজ ওকে

রোজ কঠিন গলায় বলে,
-ভালোবাসিনা। বন্ধু ছিল। বন্ধুত্ব শেষ। আর ভালোবাসা কি? কাকে বলে? এসব কথা কেন আসলো? দাদাইকে তো আমি ভাইয়ের নজরের ভালোবাসার কথা বলেছি সেটাও দাদাই প্রথমে বললো সেজন্য। আমার মেজাজ ভালো নেই আঙ্কেল। ওই লোক আর এসব কথা বলা বন্ধ করো প্লিজ।

রোজ মুখে এটা বললেও আমীর সাহেব রোজের মনের কথা জানেন। কিন্তু পরিস্থির কথা ভেবে আরশানকে কিছু বললেন না। রজনী রোজকে নিয়ে চলে যেতেই আমীর সাহেব বললেন,
-ঠিক করোনি এটা। ফালাক ভুল করেছে, অন্যায় করেছে। তুমিও সমান ভুল করেছো আরশান।

-বেবি ওকে ভালোবাসে না। আর এমন ছেলে বেবিকে পাওয়ার যোগ্য নয়। আমি বেবিকে ভালোবাসি এটা শুধু ওকে শোনানোর জন্য বলেছি। ওকে বোঝানোর জন্য বলেছি।যেন ওর রাগ হয়, ওর এমন স্বভাব নিয়ে চলে যায় বেবির জীবন থেকে। তুমি ভাবতে পারছো বেবিকে মা’রতে চেয়েছে ও। ওর কাছে বেবি সেফ না। আর তুমি তো বেবির সেফটির দায়িত্ব নিয়েছো। তোমার উচিত ওর ভালো থাকার, নিরাপদ থাকার ব্যবস্থা করা। ওকে ওমন হিং’স্র, ছেলের কাছে রাখা নয়।

আরশানও রেগে বেরিয়ে গেল। আমীর সাহেব খাটের ওপর বসে পড়লেন। কি থেকে কি হয়ে গেল?ফারদিন ফোন করেছে। আমীর ফারদিনের সঙ্গে কথা বলে সব জানাতেই ফারদিন রেগে গেল। ফালাক রোজের গায়ে হাত তুলেছে? আমীর সাহেব সবটা বলে ওনাকে ঠান্ডা থাকতে বললেন। বাচ্চাদের মধ্যে সমস্যা হয়েছে, ওরা মিটিয়ে নেবে। কিন্তু মিটলো না কিছু। রোজ নিজের ব্যাগপত্র গুছিয়ে ফেললো। দেশে ফিরে সে চলে গেল নানাবাড়িতে। সবার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিল। আরশানও থেকে গেল ওই দেশেই। আমীর সাহেব সন্তানদের এমন বিচ্ছিন্ন বিচ্ছেদে দুঃখে কষ্টে জর্জরিত। সমস্যা মিটে যেত, কিন্তু আরশান রেগে বানোয়াট কথাগুলো বলে ব্যাপারটা মিটতে দিল না। সব ঝামেলার মূল এই ছেলে। রোজকে আনার জন্য গ্রামে যায় আমীর সাহেব। কিন্তু রোজ স্পষ্ট বলেছে সে ফিরবে না। কারোর সঙ্গে আপাতত সে যোগাযোগ রাখতে চায়না।

এরপর চারবছর পর রোজ শহরে আসে। নানার মৃ’ত্যুর পর গ্রামে থাকার অবস্থা ছিল না ওর। ট্রান্সফার নিয়ে এখানকার কলেজে ভর্তি হবার পর আরশানের সঙ্গে দেখা হয়। আরশান রোজকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলে রোজ সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। আমীর সাহেব নিজে ডেকে পাঠালে রোজ যায়। কিন্তু থাকার প্রস্তাবে রাজি হয়না। এখানে থাকলে পুরোনো ক্ষতে যন্ত্রনা হবে। তাই রোজ আমীর সাহেবের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে একটা ফ্লাট কেনে। আর রেডিওকে কাজ করে সেই টাকা পরিশোধ করার চেষ্টা করছিল। কারন ওর বাবা বলেছিল আনসারী বংশ কখনও কারোর করুনা, দয়ায় বাঁচেনি।রোজ বাবার সম্মান নষ্ট করতে চায়না। কারোর দয়ায় বাঁচতে চায়না। বৃত্তির টাকায় পড়াশোনা চালিয়ে গেছে। আর রেডিওর মাধ্যমে দিন। আরশানদের সঙ্গে স্বাভাবিক হতে পারলেও রোজ এখনও ভাবে ফালাককে নিয়ে। টিভিতে ফালাকের মুভিগুলো দেখে আর ভাবে মানুষটা কতটা বদলে গেল। আরশানের দোষ ছিলনা সেদিন। ফালাকের ব্যবহারে রেগে গিয়ে সে ওসব বলেছিল। রোজও রাগের মাথাতেই সেসব বলেছে, ফালাকও তাই। কিন্তু রোজের কষ্ট লেগেছে ফালাক ওকে অবিশ্বাস করেছে বলে। ভালোবাসলে বিশ্বাস থাকাটা জরুরি ছিল। যাক, অতিত ভাবতে থাকা মেয়ে নয় রোজ। সে অতিত ভাববে না। বাবার ইচ্ছে ছিল রোজ জার্নালিস্ট হবে, বাবার মত সাহসী! দেশের কাজ করবে। নরকের কীটগুলোকে টেনে বের করবে। আজ রোজের ধ্যানজ্ঞান শুধু সেটাই। বাবা-মা ও তাদের স্বপ্নগুলো। রোজ হার মানবে না, কারোর সামনে মাথা নত করে বাবার আদর্শ নষ্ট করবে না। সে বাঁচবে বাবা-মায়ের আদর্শে, সে হাটবে তাদের দেখানো পথে। ভালোবাসা! বাবা-মা ছাড়া কেউ তাকে আদৌ কি ভালোবেসেছে? আমীর আঙ্কেল, ফারদিন আঙ্কেল ও ফারিয়া আন্টি হয়তো বেসেছে। তাদের ভালোবাসাকে সম্মান করে রোজ। এজন্যই তো তাদের সঙ্গে এখনও যোগাযোগ রেখেছে। ফালাকের সঙ্গে যোগাযোগ না’ই বা থাকলো!

চলবে?

তুই হবি শুধু আমার পর্ব-০৯

0

#তুই হবি শুধু আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_নয়

রোজের ঘর থেকে কাঁদতে কাঁদতে বের হয় অয়ন্তি। আরশানের জন্য কষ্ট হচ্ছে ওর। যদি সবটা সত্যি হয়? আরশান এতগুলো বছর শুধু ওকে ভালোবেসেছে। ওর কথা ভেবেছে, ওর জন্য নিজে কষ্ট পেয়েছে। এমন এক মানুষকে ছেড়ে থাকা যায়? অয়ন্তি পারবে না আরশান কিংবা আরশানের ভালোবাসাকে উপেক্ষা করতে। তবে তার আগে সত্যতা যাচাই করতে হবে। আরশানকে সে ভালোবেসেছিল? ভালোবাসা দেখিয়েছিল? যদি এমন হয় তাহলে অয়ন্তি নিজেই নিজেকে শাস্তি দেবে। কঠিন শাস্তি! একজনের জীবনের বারো বছরের সুখ শান্তি কেড়ে নেওয়ার শাস্তি। আরশান বাইরের পাইচারি করছিল। অয়ন্তি ওকে রেখে চোখ মুছতে মুছতে যেতেই আরশান ছুটে আসে। কিন্তু ততক্ষণে অয়ন্তি লিফটে ঢুকে নেমে গেছে। আরশান নেমে সামনে তাকাতেই দেখে অয়ন্তি গাড়ি ধরে চলে গেছে। ওর কুসুম কাঁদছে কেন? রোজ কি বলেছে? আরশান দ্রুত ছুটে আসে রোজের ঘরে। রোজ এখানে নেই, শো শুরু হওয়ায় সে রেডিওতে কথা বলছে। আরশান গিয়ে দরজা খুলতেই রোজ সরু চোখে তাকায়। কথা থামিয়ে গান চালিয়ে দিয়ে সে আরশানের দিকে তাকালো। এরপর শান্ত কন্ঠে বলল,
-কি সমস্যা? দরজা বন্ধ করো। সাউন্ড আসছে তো।
-ওকে কি বলেছিস? ও কাঁদছে কেন?

রোজ চায়না আরশানকে বলতে, যে রোজ অয়ন্তিকে বলেছে সে চায় অয়ন্তি আরশানের জীবনে থাকুক। আরশান মানা করেছিল, যদি শোনে রোজ সে মানা শোনেনি তাহলে কষ্ট পেতে পারে। তাই গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলল,
-ওর কাছে গিয়ে শোনো।
-তুই বল, বেবি। কি বলেছিস ওকে? কেন কাঁদিয়েছিস কুসুমকে?
-কাউকে কৈফিয়ত দেয়না রোজ। নাও গেট লস্ট। কাজ করছি আমি।
-করতে হবে না। শো অন্যকেউ করবে। তুই আয়। আমি সবটা শুনতে চাই।
-আমি বলতে চাই না।
-কুসুমকে কাঁদিয়ে ঠিক করিসনি বেবি।
রোজের কঠিন জবাব,
-কে কাঁদবে, কে কাঁদবে না সেটা তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। এখানে আমার হাত নেই।
আরশানের মাথা ব্যাথা করছে। রোজ শনিবার মলম বিষয়ক যেমন কথা বলেছিল, রেগে গিয়ে তেমন কিছু বলেনি তো? রাগের সময় তো ওর মাথা ঠিক থাকেনা। কারোর মাথাই ঠিক থাকেনা।
-তুই কি নেগেটিভ কিছু বলেছিস ওকে? আমাকে নিয়ে কিছু? তুই সত্যি আমাকে ভালো-টালো!

রোজের কান জ্বালা করছে। আর শুনতে চায় না সে। যে মানুষটার জন্য ওর জীবন নষ্ট হলো তাকে সে আপন ভেবে ভালোবেসেছে এটা কি ভুল ছিল? আজ কি এটাই ওর প্রাপ্য ছিল? শেষে আরশানও রোজকে এটা মনে করাচ্ছে যে রোজ ওকে ভালোবাসে? রোজ উঠে দাঁড়ালো। রেডিও বন্ধ করে সে নিজের ব্যাগটা হাতে নিয়ে আরশানের দিকে এগিয়ে এসে বলে,

-””জানো দাদাই মানুষ খুব স্বার্থপর! আজ তুমি তোমার ভালোবাসার চোখে পানি দেখলে, কিন্তু তোমার মুখে দারুন এই কথাটা শুনে আমার হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ শুরু হলো তা দেখলে না। কারন কি জানো কারন সে তোমার ভালোবাসা, প্রেম, আর আমি বন্ধু! বোন বলো মুখে মুখে। যদি বোন ভাবতে তাহলে সেই মানুষটার মত এত বড় অপবাদ দিতে পারতে না। তোমরা সবাই জানো যে রোজ কখনও কাউকে ভালোবাসেনি, ভালোবাসে না। আজ বলছি, তোমরা ভুল জানো। আমার ব্যাপারে সবাই শুধু ভুল জানে। কেউ আমাকে জানে না, জানতে পারেনি। আমিও মানুষ! আমারও অনুভূতি আছে। আমিও ভালোবাসতে পারি। এটা তোমরা কখনও বোঝোনি। আমি ছোট থেকে বলে এসেছি আমি কাউকে ভালোবাসিনি, এটা ভুল। আমি কাউকে ভালোবাসি না, এটা ভুল। আমি কাউকে ভালো বাসবো না, এটাও ভুল। তোমাকে আরসালান দাদাভাই আর আঙ্কেলদের আমি অনেক ভালোবাসি। তার কারন কি জানো? আমি ভেবেছিলাম তোমরা আমাকে কিছুটা হলেও জানো, বোঝো। আমার ভাইবোন নেই, বাবা-মা নেই, তোমরা আমার ভাই। আঙ্কেল বাবা, তোমার দাদি আমারও দাদি। আমি মজা করি, মশকরা করি শুধু তোমাদের কষ্ট লাঘব করতে। এর পেছনে অন্য কোনো কারন নেই। কিন্তু তুমি আজ ভুলবশত হোক বা ইচ্ছে করে, যে কথাটা বলেছো তা আমার জন্য অপমানজক দাদাই। শতভাগ ভুলভ্রান্তিতে ডুবে থাকা এক মিথ্যা ধারণা। ভাবলে কি করে এসব? (চেঁচিয়ে বলে )

আজ শুনে ও জেনে রাখো দাদাই আমি আমার জীবনে একটিমাত্র পুরুষকে ভালোবেসেছি, ভালোবাসি আর সারাজীবন তাকেই ভালোবাসবো। তাঁর নাম ফালাক! ফারহান মাহতাব ফালাক। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আমার প্রথম ছেলে বন্ধু, আমার ছোটবেলা ও বেড়ে ওঠার সঙ্গী। যাকে আমি চাইলেও ঘৃণা করতে পারিনা। মুখে যতই বলি আমি তাকে ঘৃণা করি, কিন্তু যাকে ভালোবাসা যায় তাকে কখনও ঘৃণা করা যায়না। তোমার জন্য, শুধুমাত্র তোমার জন্য তাকে হারিয়েছিলাম আমি। তবুও তোমাকে আমি কখনও দোষ্ দেইনি। সর্বদা তাকে দোষ দিয়েছি কারন সে আমাকে ভুল বুঝেছে, বিশ্বাস করেনি, কষ্ট দিয়েছে। অথচ তুমি? যাক যা হয়েছে, ভালোই হয়েছে। এই নাও তোমার রেডিওর কেবিনের চাবি। আমি আর কখনও এই ঘরটাতে আসবো না। কখনও না। আজ থেকে আমি তোমাদের থেকে দূরে থাকবো। অনেক দূরে যেখানে তোমরা আমাকে খুজে পাবে না। ””’

কথাগুলো বলেই রোজ ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিল যেন আরশান ওর খোঁজ করতে না আসে। এমন একটা ঘটনার পর এখানে থাকা চলে না। রোজের আত্মসম্মান খুইয়ে সে এখানে চাকরি করতে পারবে না। কিছুতেই না। ওদিকে আরশান চেঁচাচ্ছে। রোজকে ডাকছে, কাঁদছে। রোজ ফিরেও তাকালো না পেছনে। স্কুটার নিয়ে বেরিয়ে পড়লো অজানা গন্তব্যে। কোথায় যাবে ও? কোথায় থাকবে? কিছু জানার ইচ্ছে আপাতত ওর নেই। ও শুধু জানে, এই মুহূর্তে ওকে এই শহর ছাড়তে হবে। অয়ন্তি সত্যটা জানলে আরশানের কাছে ফিরবে। রোজের দাদাই ভালো থাকবে এটাই তো অনেক। পৃথিবির সবাই ভালো থাকুক।

____________

অয়ন্তি বাড়ি ফিরে সব সত্য জানার পর হাউমাউ করে কাঁদলো। আরশান নামক মানুষটাকে সে কত কষ্ট দিল। কিন্তু আর না, আরশানকে আর কষ্ট দেবে না অয়ন্তি। মন ভালো করার জন্য অয়ন্তি রেডিও অন করে। রোজ নিশ্চই কথা বলছে, আজ থেকে রোজ ওর অনাপির জায়গায় থাকবে। হোক সে ছোট তবুও রোজ আজ বড় বোনের মত অয়ন্তিকে সামলেছে। তাই রোজকে সে আরশানের মতই ভালোবাসবে। বোনের শূণ্যস্থান পূরণ করবে। কিন্তু রেডিও অন করতেই ফ্রিকোয়েন্সির বন্ধ থাকা অয়ন্তিকে চিন্তিত করলো। রোজ তো কখনও বন্ধ রাখে না, আর এখনও তো রোজ শো করছে। আসার সময় তো অয়ন্তি দেখে আসলো রোজকে। তাহলে হলো কি রোজের? অয়ন্তি রোজের ব্যাপারটা গুরুত্ব দিলো না। হয়তো কোনো সমস্যা হয়েছে। তাহলে এখন কি করা যায়? আরশানকে ফোন করে বলবে? সে আরশান নামক বেয়াদব মানুষটার সঙ্গে থাকতে চায়? আরশানের ভালোবাসা পেতে চায়। ইশ! বলতে লজ্জা লাগবে তো। কিন্তু বলতে তো হবেই। অয়ন্তি ফোন বের করে আরশানের নাম্বারে ডায়াল করলো।ফোনটা বেজে বেজে কেটে যায়।
-এর আবার কি হলো?

অয়ন্তি অনবরত ফোন করেই চলেছে। আরশান তখন গাড়ি নিয়ে রোজের খোঁজে বেরিয়েছিল। রাগ হতাশার বশে সে যে বিরাট বড় একটা ভুল কথা বলে ফেলেছে সেটা বুঝতে পেরে রাগে মাথা ছিড়ে যাচ্ছে ওর। অয়ন্তি ফোন করছে দেখেও ওর রাগ ঠান্ডা হচ্ছে না। বারংবার ফোন বাজতে থাকায় আরশান ফোন রিসিভ করেই জোরে ধমক দিল,
-বিরক্ত করছো কেন? দেখছো তো ফোন ধরছি না।

অয়ন্তি ধমক শুনে কেঁদে ফেলল। অয়ন্তির কান্না শুনে আরশানের রাগ বেড়ে গেল। অয়ন্তি কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-জরুরি দরকার ছাড়া ফোন দেইনি। আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই, ভালোবাসতে চাই। সেটা বলার জন্য ফোন দিয়েছিলাম। আপনি খুব বাজে মিস্টার খাঁন। খুব বাজে।আপনার সঙ্গে আমি আর কথা বলবো না। রোজ ভুল বলেছে, আপনি আমাকে একটুও ভালোবাসেন না। বাসলে এভাবে বলতেন না।আমি রোজের কাছে নালিশ করবো। ওকে আপনি ভয় পান আমি জানি। হুহ!

অয়ন্তি ফোন কে’টে দিল। আরশান গাড়ি থামিয়েছে ততক্ষণে। অয়ন্তি কি বললো? সে আরশানকে বিয়ে করতে চায়? ভালোবাসতে চায়? রোজ তাহলে ওকে কনভেন্স করেই ফেলেছে? স্টিয়ারিং’য়ে জোরে ঘু’সি দিল আরশান। তখন আবারও কল বেজে ওঠে। আরশান রিসিভ করতেই অয়ন্তি নাক টেনে বলে,
-কথা বলতে ফোন দেইনি। রোজের নাম্বারটা দেন। ওর সঙ্গে কথা বলবো। রেডিও অন হচ্ছে না কেন?

-রোজ চলে গেছে। ওকে খুজতে বের হয়েছি। খোজ পেলে জানাবো। ওকে নিয়ে চিন্তা করো না। নিজের যত্ন নাও, কান্নাকা’টি করেছো। এখন ঘুমাও। মানসিক চাপ কমবে। রাখছি।

আরশান ফোন রেখে গাড়ি স্টার্ট দিল। কোথায় খুজবে রোজকে?কেউ নিঁখোজ হতে চাইলে তাঁর খোঁজ পাওয়া কি সহজ হবে? আমীর সাহেব বারবার ফোন দিচ্ছেন। যার অর্থ রেডিও বন্ধ হবার কারন জানতে চান তিনি। রোজের কথা জানতে চান। কি বলবে আরশান? কি আছে বলার? কিন্তু বাবার শারিরীক অবস্থা খারাপ তাই বাধ্য হয়ে ফোন রিসিভ করলো আরশান। আমীর সাহেব হুংকার দিয়ে উঠলেন,
-সমস্যা কি তোমার? ফোন ধরছো না কেন? রোজ কোথায়? শো অফ কেন? রোজ ঠিক আছে? মেয়েটা আবার অসুস্থ হয়ে গেল নাকি? জ্বর বেড়েছে অনেক? ডাক্তার ডেকেছো?
-একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে বাবা। রোজ চলে গেছে। আমি ওকে খুজতে বের হয়েছি। পেয়ে যাবো শীগ্রহই।
-ওর যেন কিছু না হয় আরশান। ওর বাবাকে আমি কথা দিয়েছিলাম ওকে সাবধানে রাখবো। ওকে নিরাপদে রাখবো। তোমার জন্য আমি সে কথার খেলাফ করতে পারবো না। ওকে খুজে আনো।
-হুম।
-তুমি ওকে না সঙ্গে না আনা অবধি বাড়িতে আসবে না। তোমার মুখ দেখতে চাইনা আমি।

ফোন রাখলেন আমীর সাহেব। বুকে ব্যাথা করছে তাঁর। ছেলের জন্য রোজকে তিনি বারংবার কষ্ট পেতে দেখে ক্লান্ত তিনি। হাত দিয়ে বুক চেপে ধরে তিনি নিজের ঘরে আসলেন।দেওয়ালে টানানো বড় ছবিটার দিকে চেয়ে বললেন,
-আমাকে মাফ করে দে সাফোয়ান! তোর মেয়েটাকে আমি সামলে রাখতে পারলা…

বাকিটুকু বলতে পারলেন না উনি। মেঝেতে শব্দ করে পড়ে গেলেন। রজনী ছুটে এসে দেখলো আমীর সাহেব মেঝেতে পড়ে আছেন। তাঁর গাল কিছুটা বাঁকা হয়ে আছে। রজনী চিৎকার দিয়ে বুয়াকে ডেকে বললেন,
-ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলো। বাবা স্টোক করেছেন।

পুরো শহর খুজেও রোজকে পেল না আরশান। রজনীর ফোন পেয়ে জানলো বাবার মিনি স্টোক হয়েছে। গাল বেঁকে গেছে, কথা বলতে পারছেন না। আরশানের পুরো পৃথিবি দুলে উঠলো। পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যেতে লাগলো। তিনজনের কলিজার টুকরো ছিল রোজ। তারা তিনজন হচ্ছেন, আমীর খাঁন, ফালাকের বাবা ফারদিন মাহতাব ও রোজের বাবা সাফোয়ান আনসারী। সেই সাথে আরসালান, ফালাক ও আরশানেরও প্রিয় মানুষ ছিল ওদের ছোট রাজকন্যা সাইরাহ্ আনসারী রোজা ওরফে রোজ। গোলাপ, যা ভালোবাসার প্রতীক। কি হবে এখন? রোজকে কোথায় পাবে ওরা?

______________

ফারহান পানি পান করছিলো। হঠাৎ ভীষম লাগায় নাক মুখে পানি উঠে গেল। দৃষ্টি গেল টেবিলের ওপর থাকা বাচ্চা একটা মেয়ের ছবির দিকে। চেহারায় ফুটে ওঠে তীব্র রাগ ও বিতৃষ্ণা। ছবিটা বাবার জন্য সড়াতে পারে নি ফারহান। নাহলে কবেই ছুড়ে মা’রতো ডাস্টবিনে। কোনো প্রতারকের ছবি সে নিজের সামনে রাখতে চায় না। পকেটের মুঠোফোন বেজে উঠলো, ‘ মুগ্ধতা ‘ ফোন দিচ্ছে। ফারহান ফোন রিসিভ করতেই মুগ্ধতা বিগলিত কন্ঠে বলল,
-কোথায় তুমি? শ্যুটিং শুরু হয়ে গেল। এখনও আসছো না। মুভিটার সমাপ্তি কি চাও না? রিলিজডেট ফিক্সড করতে হবে তো। ইডিটিং বাকি, গানের লাস্ট শ্যুট বাকি জলদি আসো।

-আসছি আমি। বাড়িতে আছি।

-দ্রুত আসুন, হিরো মহাশয়। আপনার ফিমেল ফ্যানে ভরে গেছে স্পট। এদের ক্লিয়ার করতে হবে আগে।

-ফারহান নিজের সময়ানুযায়ী কাজ করে। সো নিজের কথাগুলো সামলে বলবে মুগ্ধতা। ফারহানের ওপর কথা বলা ফারহান পছন্দ করে না।

ফোন রেখে ফারহান চেঁচিয়ে সিয়াম অর্থাৎ নিজের পার্সোনাল এ্যাসিস্টেন্টকে ডাকলো। গাড়ি বের করতে বলে শিডিউল মেলাতে বলল। সিয়াম সারাদিনের সব শিডিউল গড়গড় করে বলতেই ফারহান বিরক্তচোখে বলে,
-মিটিংগুলো ক্যান্সেল করো। মিটিং এ্যাটেন্ড করার মুড নেই আমার।

-কিন্তু স্যার, অনেকগুলো টাকা। আপনার নেক্সট মুভির এ্যাগ্রিমেন্ট সাইন করার ডেট ছিল আজ।

-টাকা জলে যাক, চুলোয় যাক আই ডোন্ট কেয়ার। আর না গেলে কি হবে? এ্যাগ্রিমেন্ট বাদ দিলে দিক।

-না মানে কিছুই না। ওনারা তো ফারহান ছাড়া আর কাউকে হিরো বানাবেন না বলে ঠিক করেছেন। আপনি না গেলে ওনারাই এখানে চলে আসবে।

-ওকে।

ফারহান বাথরুমে ঢুকে যেতেই সিয়াম ছুটে গিয়ে পানি পান করলো। হিরো ক্ষেপলো কেন আবার? স্যারকে নিয়ে সিয়াম পড়েছে মহাবিপদে। মাঝে মাঝে এত রাগ হয় মানুষটা। মার্কেটে এখন সুপারস্টার ফারহান মাহতাব ফালাকের কত দাম, কত ডিমান্ড তা কি সে বুঝতে পারেনা? চাইলেই তো রাতারাতি কোটিপতি থেকে মিলিওনার, বিলিওনার হওয়া যায়। অভিনয় জগতে বর্তমানে সব থেকে সফল অভিনেতা ফারহান। কিন্তু সে সবথেকে বেশি পরিচিত নিজের রাগের জন্য। অভিনেতাদের মধ্যে তাঁর রাগ সবার উর্ধ্বে। পরিচালক দিয়ে শুরু করে হিরোইনরা অবধি পাগল হয়ে আছে এর জন্য। আর একে দেখো? সিয়ামের মনে হতে লাগে ফারহান বোধ হয় টাকার গরমে ও চাহিদার দাপটেই এমন হয়ে গেছে। সফল এবং অহংকারি অভিনেতা।

চলবে?

তুই হবি শুধু আমার পর্ব-০৮

0

#তুই হবি শুধু আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_আট

সোমবারের সকালে মুষলধারায় বৃষ্টি পড়ছিল। অয়ন্তি তা দেখে মিটিমিটি হাসে।রোজের অনুষ্ঠান যেদিন থাকে সেদিনই কি বৃষ্টি হয়? আজ নীল রঙয়ের এটা থ্রিপিচ পড়েছে অয়ন্তি। কারন রোজ একদিন বলেছিল বেদনার রঙ নীল আর তাই রোজের পছন্দের রঙও নীল। কিন্তু এটা কেন বলেছিল রোজ? ওর কি কোনো কষ্ট আছে নাকি শো করতে করতেই বলেছে। ভাসা মেঘ বাতাসের সঙ্গে দিক পরিবর্তন করে চলে যেতে যেতে স্বচ্ছ করে দিল নীল আকাশটা। রোদের স্নিগ্ধ কোমল আলো এসে পড়ল অয়ন্তির চেহারার ওপর।অয়ন্তি চোখ বুজে রইল। রোদে ভিজতে তাঁর ভালো লাগে, বিশেষ করে এমন নরম কোমল রোদে।কানে ভেসে আসছে পাখির কূজন। হাতের ঘড়িটা ঠিক করে চুলগুলো বেঁধে নিল অয়ন্তি। সেদিন টেবিলে বসে কথাগুলো বলার পর থেকে আরশান আর কোনো কথা বলেনি, অয়ন্তিকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে চলে গিয়েছিল। একবার খোজও নেয়নি, ম্যাসেজ দেয়নি, কল করেনি। অয়ন্তি মনে মনে ভাবলো ঝামেলা মিটেছে। পরে আবারও ভাবলো যে ছেলে ওর বন্ধুকে মে’রে হাসপাতালে ভর্তি করল শুধু অয়ন্তি তাকে পছন্দ করে বলে। সে এত সহজে ওকে ছেড়ে দেবে?

আরশান আজ বাড়িতেই এসেছে। অরুনি আরশানের জন্য নাশতা বানিয়ে এনেছে। আশরাফ মীর্জা হেসে হেসে কথা বলছেন যা অয়ন্তির ভালো লাগলো না। এই মানুষটার সঙ্গে এত কথা কিসের? মেয়ের থেকেও উনি বেশি হলো? অয়ন্তি সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলল,
-খেতে দাও।

আরশান তাকাল না অয়ন্তির দিকে। অয়ন্তি অপমানিত হলো আরশানের এমন কাজে। তাই রেগে সোজা খাবার টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।কিছুক্ষণ পর আশরাফ সাহেব ও আরশানও এসে বসলো চেয়ার টেনে। অয়ন্তি খেতে খেতে আড়চোখে আরশানের দিকে তাকাল। সে কালো রঙয়ের শার্ট পড়েছে। চুলগুলো জেল দিয়ে সেট করেছে, হাতে কালো ঘড়ি, দাড়িগুলো সমান করে কেটে রেখেছে। মডেলিং করতে যাচ্ছে নাকি বিয়ে করতে? এত সাঁজ কেন? অয়ন্তি যে আরশানকে দেখছে তা বুঝে আরশান দীর্ঘশ্বাস ফেললো। চেহারায় কি আসে যায়? যদি মনই মানুষকে আকৃষ্ট করতে না পারে। আরশান না খেয়েই উঠে দাঁড়ালো। অয়ন্তির খাওয়া শেষ। হাত ধুয়ে সে হাত মুছছিল, আরশানকে এভাবে উঠে দাড়াতে দেখে সে থতমত খেয়ে তাকালো। আরশান তর্জনি দিয়ে ঘাড় ডলে বলে,
– শো এগারোটায় শুরু হবে। সাড়ে নয়টা বেজে গেছে। এখন না গেলে দেরি হয়ে যাবে।আমরা আসছি আঙ্কেল। চিন্তা করবেন না, অয়ন্তিকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যাবো।

আশরাফ সাহেব হেসে বললেন,
-আচ্ছা। আর তোমার বাবাকে বলবে আমি শীগ্রহই দেখা করতে যাবো তাঁর সঙ্গে।

– জি।

গাড়িতে বসেও আরশান অয়ন্তির সঙ্গে কথা বলেনি। সেদিনের কথাগুলোয় কি সে কষ্ট পেয়েছে? কষ্ট যদি পেয়েও থাকে তাহলে অয়ন্তি কি করবে? ও তো ভুল বলেনি। ওর অরুপির বিয়েটাও নড়বড়ে হয়ে গেছে এই বয়সের ব্যবধানের কারনে। ওরও তো তেমনই হবে। সে তো নিজের দিক থেকে ঠিক। বাকিটা রোজের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করবে। রোজ ভালো বুঝবে, সবার সব সমস্যা কি সুন্দর করে মেটায় সে, অয়ন্তির সমস্যাও নিশ্চই মিটিয়ে দেবে।

রেডিও সেন্টারটা পাঁচতলা ভবনের! আরশান গাড়ি পার্ক করে এই প্রথম মুখ খুলল,
-চলো।
-আপনি কি রেগে আছেন?
-না। তবে সেদিনের কথাগুলো ভাবছি। তুমি আমাকে না চাইলে, আমাদের আলাদা থাকাই উচিত। এক হওয়া সম্ভব না।
-আমি ওভাবে বলিনি। ডিফারেন্স’টা আসলেই অনেক বেশি। আপনিও ভাবুন একবার!
-রোজ এখনও আসেনি। রাস্তায় আছে বোধ হয়। এসে যাবে, তুমি গিয়ে আমার কেবিনে বসো। চারতলার দুই নাম্বার কেবিন, নেমপ্লেটে নাম আছে। লিফট ইউজ কর। আমি আসছি একটু।
-কোথায় যাচ্ছেন?
-রোজ আসলে ওকে তোমার কথা বলতে হবে। নাহলে ও শো শুরু করে ফেলবে, আর শো শেষ হতেই ফিরে যাবে।
-ওহ। ওকে।

রোজ এলো সাড়ে দশটায়। আরশান গেটের কাছে বসে আছে।সে চায়না অয়ন্তিকে রোজ কনভেন্স করুক। ওর কষ্ট রোজ সহ্য করতে পারবে না, যদি অয়ন্তিকে রোজ অনুরোধ করে আরশানের জীবনে থাকতে? এটা রোজ ও আরশান দুজনের জন্যই অপমানজনক হবে। অয়ন্তি তো সরাসরিই নাকোচ করে দেবে, তখন রোজ ছোট হবে। যা আরশান একেবারেই চায়না। আরশান চায় না ওর বেবি কারোর সামনে মাথা নত করতে শিখুক।রোজ স্কুটার থেকে নেমে হেলমেট খুলতেই আরশান এগিয়ে আসে।
-কোনো কথা না দাদাই, দেরি হয়ে গেছে। শো শুরু করে আবার শেষ করতে হবে।
-কুসুম এসেছে।
রোজ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আরশান অনুনয়ের সুরে বলে,
-আমার সাপোর্টে কথা বলবি না প্লিজ! অনেক ভেবেছি আর বুঝেছি ও আমাকে চায় না। কথা হয়েছিল ওর সম্মতিতে সব হবে। ও যখন রাজি না। আমি মেনে নিতে পারবো এটা।
-স্যরি? কি বললে?
-আমি সত্যিই মেনে নিতে পারবো বেবি। তুই প্লিজ এই ভুল সম্পর্ক জোড়াতালি দিতে যাস্ না।
-সেটা রোজের কাজ নয়। আর রোজের দাদাই কুসুমকে পাবে না এটাও রোজ চায়না।
-প্লিজ বেবি!
-আমি তোমার নিজের বোন নই, তাই এভাবে বলতে পারছো। কিন্তু তোমাকে আমি নিজের ভাই মনে করি। আমাদের ভাই-বোনের সম্পর্ককে দুনিয়ার মানুষ যা মনে করে করুক, তাতে আমার কিছু আসে-যায় না দাদাই। সে যখন ভুল বুঝে চলে গিয়েছে,তখন আমি কষ্ট পেয়েছিলাম। আর এই যন্ত্রণা কতটা অসহনীয় আমি জানি সেটা, তাই সেই কষ্ট আমি তোমাকে পেতে দেবো না। তোমার কুসুমকে আমি জোর করবো না তোমার জীবনে থাকার জন্য, কিন্তু কিছু তথ্য অবশ্যই দেবো। যেটা ওর জানা উচিত।
-তুই কিছু বলবি না বেবি।
-রোজ শুধু নিজের কথা শোনে দাদাই। তোমার বা অন্য কেউ আমাকে আমার মতের বিরুদ্ধে নিয়ে যেতে পারবে না। কারন রোজ সাইরাহ্’র নতুন পরিচয়, নতুন সত্ত্বা। সে কখনও পুরোনো সাইরাহ্ এ রোজায় পরিনত হবে না।

রোজ স্কুটারের চাবি নিয়ে চলে আসলো।পথিমধ্যে কিছু সংখ্যক আর’জে রোজের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে রোজ তা সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে। সবাই জানে এটা রোজের স্বভাব। তাই কিছু বললো না। পাঁচ তলার চার নম্বর রুমটায় রোজের কেবিন। রোজ সেখানে গিয়ে ঠান্ডা পানি পান করে চেয়ার টেনে বসলো। মেজাজটা গরম হয়ে আছে। রোজের ভাই কষ্ট পাচ্ছে! তাও সেই মেয়েটার জন্য যে ওর ভাইকে ঠকিয়েছে? মানুষ এতো বোকা কিভাবে হয়? রোজ বোকামি করেছিল সেটা দেখেও তো আরশান শিক্ষা নিতে পারতো। তা না করে একই ভুল করতে গিয়েছে। প্রেম ভালোবাসা জিনিসটাই বিষাক্ত। ঠিক তখনই দরজায় খটখট শব্দ হলো। রোজ চেয়ার ঘুরিয়ে বিপরীত পার্শ্বে মুখ করে বসলো। এরপর আর’জে রোজের চরিত্র অবলম্বন করে কঠোর গলায় বলল,
-কাম ইন।

আরশান অয়ন্তিকে নিয়ে প্রবেশ করে। অয়ন্তি আমোদে কেঁপে কেঁপে উঠছে। উত্তেজনায় অস্থিরচিত্তে চেয়ারের ওপর পাশ দেখার জন্য উঁকিঝুকি দিচ্ছে। আরশান ধরে আসা গলায় বলল,
-বেবি!
রোজ চেয়ার ঘুরিয়ে তিক্তকন্ঠে বলল,
-নো! নট বেবি আর’জে খাঁন! আমি রোজ, ফর নাও। হোয়াট হ্যাপেন্ড? আমার শো’টাইমে বিরক্ত করছেন কেন?
অয়ন্তি হা করে চেয়ে আছে। শনিবার তো ভারি মিষ্টি করে কথা বলেছিল মেয়েটা। এখন এমন রুক্ষ ব্যবহার কেন? আর রোজা এখানে কি করছে? রোজ কোথায়? রোজা নিজেকে রোজ বলছে কেন? আরশান হতাশ কন্ঠে বলল,
-কুসুম কথা বলবে আপনার সঙ্গে।
-ওকে! উনি কি আজকের গেস্ট? নমুনার প্রকারভেদ তো শিডিউলে রেখেছিলাম। দ্যেন উনি?
-পার্সোনাল মিটিং আর’জে রোজ।
-এ্যাজ?
-ইউর ব্রাদার্স ফ্রেন্ড!
রোজ শীতল চোখে তাকালো। এরপর কন্ঠ নরম করে বললো,
-বসো।দাদাই তুমি কি কিছু বলবে?বললে থাকো নাহলে বের হও।গ্যাদারিং পছন্দ না আমার। আর অয়ন্তি নাকি কুসুম? অয়ন্তি! কুসুম ডাকটা দাদাইয়ের জন্য থাক। কি নেবে তুমি? চা-কফি-কোল্ডড্রিংস? আই থিংক তোমার পানি প্রয়োজন। যাওয়ার সময় পানি পাঠিয়ে দিও দাদাই। নাও গো প্লিজ।

আরশান করুন চোখে চাইলো। রোজ রেগে আছে। কিছু বলে দেবে না তো? মেয়েটা রেগে গেলে তো রণচণ্ডী রূপ ধারণ করে। আরশান বেরিয়ে যেতে যেতে রোজকে টেক্সট করলো। রোজ ফোনের নোটিফিকেশন দেখেই ফোনটা বন্ধ করে দিল। সর্বনাশ! ম্যাসেজ তো দেখলোই না। নিরুপায় হয়ে আরশান বেরিয়ে যেতেই রোজ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অয়ন্তির দিকে তাকায়।
-বসবে না? কাজ না থাকলে যেতে পারো। আমার শো শুরু করার সময় হয়ে যাচ্ছে।

অয়ন্তি বসলো। একটা ছেলে এসে পানি দিয়ে যায়। রোজ পানির গ্লাসটা অয়ন্তির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
-পান করো। বুঝতে পারছি আমাকে এভাবে দেখে ভয় পেয়েছ। ভয় পাওয়ার দরকার নেই। আর’জে হিসেবে আমি এমনই। তো বলো কি করতে পারি তোমার জন্য।

-আ,,আ,,আসলে,

-পানি পান করো আগে। গলা ভিজিয়ে ঠান্ডা মাথায় বলো। তোমার গলা কাঁপছে।

রোজের এমন ক্রোধমিশ্রিত কন্ঠে অয়ন্তি ভয় পেয়ে যায়। রোজ বিরক্তচোখে তাকায়। এরপর উঠে গিয়ে অয়ন্তির পিঠে হাত রেখে নিজেই গ্লাসটা অয়ন্তির মুখের সামনে ধরল। অয়ন্তি পানি পান করেও শান্ত হতে পারল না। রোজ নিজের ওরনা দিয়ে অয়ন্তির কপালের ঘাম মুছে দিয়ে বলে,
-এত ভীতু কেন? একটু রেগে কথা বলেছি বলে এমন ব্যবহার করছো যেন তোমাকে শূলে চড়ানো হবে শুনেছো। বি ইজি! আমি বাঘ ভাল্লুক নই আপু।

অয়ন্তি ঠান্ডা হয়ে বসে বলল,
-আমি আসলে আরশান মানে তোমার দাদাই। আসলে, তোমার বন্ধু।
-আমার শো শোনো তুমি?
-হুম।
-কি মনে হয়? আমি কেমন? ভালো বুদ্ধি আদৌ দিতে জানি? যা বলি তা কাজে দেয়?
-দেয় তো।
-তাহলে আজ যা বলবো, আশা করি মন দিয়ে শুনবে। দাদাইকে তুমি ভালোবাসো না, এটা তোমার কেন মনে হয়?
-মানে?
-মানে, তুমি ওকে ভালোবাসো না এটা বুঝলে কি করে? সিনটম গুলো কি? ওকে দেখলে রাগ হয়? ওর চেহারা খারাপ লাগে? ওর কথাবার্তা খারাপ?কন্ঠ ব্যবহার?
-একটু শান্ত হয়ে কথা বলবে?

রোজ এবার নিজেকে শান্ত রাখতে পারলো না। কফির কাঁচের কাপটা মেঝেতে ছুড়ে দিয়ে বলল,
-পারছি না। তোমরা এমন কেন? ভালোবাসা পেলে তার মর্ম বোঝো না?

অয়ন্তি ভয়ে কেঁদে উঠলো। রোজ এমন করছে কেন? রোজ জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে। রাগা যাবে না, অয়ন্তি কাঁদছে। আরশানের ভীতুর ডিম কাঁদছে, একে কাঁদতে দেখলে ওটাও কাঁদবে। রোজ পানি পান করে বলল,
-কেঁদো না। আর রাগ করছি না আমি। শান্তভাবে কথা বলছি। কেঁদো না অয়ন্তি আপু। তোমাকে কান্নায় ঠিক মানায় না। হুস! চোখ মোছো, চোখ মুছে আমার কথাটা শোনো। তোমার এগুলো জানা প্রয়োজন। তোমার ছোট জীবনে যা যা ঘটেছে ঘটছে সবকিছু সম্পর্কে তোমার অবগত থাকা উচিত।

-ক,কি ব,বলতে চাইছো?

-সত্যটা। যেটা তুমি জানো না।
“”তুমি তখন ক্লাস টেনে পড় অয়ন্তি আপু! বয়স মাত্র ষোলো! আর দাদাই’য়ের বয়স তখন আটাশ, তোমাদের মাঝে তখন কিছু সুন্দর মুহুর্ত এসেছিল, তোমরা একে অন্যকে চেনার জানার চেষ্টা করেছিলে। তবে তোমার মনে তখনও দাদাইকে নিয়ে কোনো প্রেমের ভাবনা উঁকি দেয়নি। দাদাইকে তোমার ভালো লাগতো, দাদাইয়ের চালচলন তোমাকে মুগ্ধ করেছিল। ব্যাস এটুকুই, দাদাই চেয়েছিল তুমি নিজ থেকে যখন দাদাইকে চাইবে দাদাই তখন নিজের মনের কথা বলবে। কিন্তু এরপর তুমি চলে আসো দেশে, তোমার পরীক্ষার সময় আসে, অনা আপু ব্যস্ত হয় পড়ে নিজের সাংবাদিকতা নিয়ে। তোমার পরীক্ষার মাঝামাঝি সময়ে, হয়তো চার থেকে পাঁচটা পরীক্ষা দিয়েছিলে! তুমি যেবার লাস্ট পরীক্ষা দিচ্ছো মানে তোমার পাঁচ নম্বর পরীক্ষা সেদিন পুরো দেশে রাজনৈতিক অথবা ধর্মীয় কোনো বিষয় নিয়ে দাঙ্গাহাঙ্গামা চলছিল। অনা আপু সেটা স্যুট করছিল বেশ ভালো করে। তুমি পরীক্ষা দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে বের হয়েছিলে তখনই তুমি দেখতে পাও রাস্তায় জমে থাকা শতসহস্র মানুষের ভীড়। ভীড়ের মধ্যে তোমার অনাপিও ছিল। পুলিশ, র‍্যাব, কিছু মুখোশধারি ছাত্রনেতা, ভালো মন্দ মেশানো একটা দারুন ভীড়। গুলিবর্ষণ হওয়া দেখে তুমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলে, জনতা গিয়েছিল ক্ষেপে। ইট, পাটকেল, লাঠি, টায়ার পোড়ানো, কাঁদানে গ্যাস মা’রামা’রিতে যখন চারপাশ গরম তখন তোমার অনাপির এক্সিডেন্ট হয়, একটা মালবাহী ট্রাক পিসে দিয়ে যায় তাঁর শরীর। সবটা তোমার চোখের সামনেই হচ্ছিল, তুমি দেখছিলে কিন্তু স্বচক্ষে এমন দৃশ্য দেখার পর তুমি পাথরের ন্যায় হয়ে গিয়েছিলে। শরীরের সব ইন্দ্রিয় কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। তুমি চিৎকার দিয়ে সামনে এগোতেই একটা ইট এসে তোমার কপাল বরাবর লাগে। রক্ত গ’লগ’ল করে বেরিয়ে আসলেও তুমি থামো নি। ছুটে গিয়েছিলে অনা আপুর কাছে। ঠিক তখন একটা প্রাইভেট কার দ্রুতবেগে ওই স্থান থেকে সরে যাওয়ার সময় তোমারও এক্সিডেন্ট হয়। ভাগ্যক্রমে তুমি বেঁচে গেলেও অনা আপু বাঁচেনি। টানা পনেরোদিন তুমি অজ্ঞান ছিলে। দাদাই দেশে ফিরেছিল। অনা আপুর লাশ দেখতে না পারায় সে কতটা যন্ত্রনা পেয়েছিল তা আমি জানি। প্রথমে তোমার খবর কেউ দাদাইকে দেয়নি কিন্তু পরে যখন তোমার কথা জানলো দাদাই তখনই ছুটে গিয়েছিল তোমার কাছে। কিন্তু ততক্ষণে অনেকটা দেরি হয়ে যায়। অরুনি আপুর বিয়ে হওয়ার পাঁচ মাস চলছিল। সে চিনতো দাদাইকে। তাই সে নিজেই তোমার কথা বলেছিল। বলেছিল তুমি গত দেড়বছরের সকল কথা ও তার আগের কয়েকমাসের কিছু কিছু কথা ভুলে গিয়েছো। তুমি বিশ্বাস করবে না অয়ন্তি আপু, দাদাই তাঁর কুসুমের জন্য পাগলপ্রায় হয়ে ঘুরছিল। যাক দাদাই’য়ের কথা এখন বাদ। তুমি তোমার কথা শোনো। তুমি সব ভুলে যাওয়ার পর ডাক্তাররা বলেছিলেন তোমাকে এবং তোমার মাথায় যেন কোনো প্রেসার না পড়ে। তাই কেউ তোমাকে জানায়নি তোমার বয়স সতেরো পার হয়ে যাচ্ছে। ষোলো সতেরো পার হওয়ার সময় তুমি আবারও টেনে ভর্তি হও। পূর্বের ন্যায় আবারও সবকিছু চলতে থাকে। তুমিও জানতে থাকো তোমার বয়স ষোলো! এরপর তুমি আগের মত থাকতে শুরু করো।

তুমি শুধু জানতে একটা এক্সিডেন্টে তোমার অনাপি মা’রা গেছে। এর বেশি কিছুও তোমাকে জানানো হয়নি। তুমি ভাবতে জার্নালিজম অনাপির প্যাশান, আবেগ, ইচ্ছে। তাই সেটা পূরণ করার জন্য উঠে পড়ে লাগলে। ম্যাট্রিক দেওয়ার পরই যখন এসব কথা তুললে তখন সবাই আবারও ভয় পায়। দাদাইয়ের কানে আসে কথাটা, অনাপির মৃ’ত্যুর সময় মাহিন ভাই নিজেও হার্টএট্যাক করেছিল। অনাথ ছেলেটার বাঁচার কোনো কারন হয়তো ছিল না, আত্মহত্যা মহাপাপ বলে হয়তো বিধাতা ওনার কষ্ট দেখে নিজেই কাছে টেনে নিয়েছিলেন। এসব দেখে সায়ন ভাইয়া ঘাবড়ে গিয়ে তোমাদের বাড়িতে সবটা বলে দেয়। কারন মাহিন ভাই অনাপিকে যতটা ভালোবাসতো, আমার দাদাই তার থেকেও অনেকগুন বেশি ভালোবাসতো তোমাকে। যদি তোমার কিছু হত তাহলে আমার দাদাই বেঁচেও মরে থাকতো অয়ন্তি আপু।

শুধুমাত্র তোমার জন্য তোমার পরিবার লাখ লাখ টাকা খরচ করে ফেক সার্টিফিকেট, ফেক বার্থ সার্টিফিকেট বানায়, হিসেবে তোমার আসল নকল দুটো সার্টিফিকেটই আছে। নকলটা তোমাকে দেখানোর জন্য, তোমাকে অতিত থেকে দূরে রাখার জন্য, তোমার ব্রেনের চাপ কমানোর জন্য। আর আসলটা তোমার জীবনের সুন্দর মুহূর্তগুলো ধরে রাখার জন্য ছিল। তোমার অনাপি সবসময় চাইত দাদাইয়ের সঙ্গে তাঁর বোনের সুখের সংসার দেখবে। তা আর হলো কই? তোমাকে দাদাই এই ক’মাসে যে কম কাছে পেয়েছে তা নয়। তোমাকে লুকিয়ে দেখেছে, তোমার কাছে গিয়েছে।তোমাকে মনের কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তোমার সজ্ঞানে তোমার সামনে যেতেই ওর প্রচন্ড ভয় করতো।এই শুক্রবার রাতে সে চাইলেই তোমাকে কাছে পেতে পারতো। ছুঁয়ে দিতে পারতো। এতগুলো বছরের যন্ত্রণার বদলে তা কমই হতো। তাঁর হাতে সময় সুযোগ দুটোই ছিল।তবুও তোমাকে একটুও স্পর্শ করতে পারেনি, চুঁমুর বদলে যখন চর খেল তখন বুঝলো সে ভুল। সে তো এমন করতে পারবে না। এটা অন্যায় করা হবে তোমার সঙ্গে, তোমার অনাপির সঙ্গে। কারন সে তোমার অনাপিকে কথা দিয়েছিল বিয়ের আগে কিছু করবে না, তোমাকে ছোঁবে না।তোমার সম্মতি ছাড়া কিছু হবে না।

তোমার বয়স এখন কুড়ি অয়ন্তি আপু। আঠারো নয়। মিথ্যা আকড়ে বাঁচা কঠিন। সত্য জানার পর যতটা কষ্ট পাবে তা কাটিয়ে তোলা সম্ভব। কিন্তু দিনের পর দিন মিথ্যে নিয়ে কিভাবে থাকবে? দাদাই তোমার থেকে তেরো বছরের বড়, এটা তুমি সমস্যা মনে কর? যখন দাদাই শুনেছিল, মানে তোমার সার্টিফিকেটের বয়সটা শুনেছিল, ছয় বছরের একটা বাচ্চা ভেবে তোমাকে দেখেছিল তখন তাঁর কি হয়েছিল একবার ভাবো। সে নিজেকে ঘৃণা করতো, তোমাদের থেকে দূরে কলকাতা মানে তাঁর চাচার বাংলোয় থাকতো।সে কিন্তু নিজ থেকে আসেনি, তোমার অনাপি তাকে তোমার কাছে আসতে দিয়েছিল। তুমি তাকে এটা ফিল করিয়েছিলে যে তুমি তাকে পছন্দ করো। সে সবকিছু ভুলে শুধু তোমাকে নিয়ে থাকতে চেয়েছিল, তোমাকে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল এটা কি তাঁর ভুল? যদি ভুল হয় সে শাস্তির যোগ্য। তাকে ছেড়ে চলে যাও, এটাই তাঁর জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি হবে। কিন্তু এই চারটা বছর, তাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে? আটবছর ধরে সে নিজেকে যতটা সামলেছিল এই চার বছরে সেই সামালটুকু তো গুড়িয়ে গেছে।

ভুলে যাওয়া মানুষের হিউম্যান ন্যাচার অয়ন্তি আপু। সে ভুলে যাওয়া’টা হতে পারে কিছু দিনের জন্য, মাসের জন্য, বছরের জন্য, যুগের জন্য অথবা সারাজীবনের জন্য। কিন্তু যদি মনে পড়ে? তখন নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে তো? আমি তোমার ছোট তবে বেশি না মাত্র দু বছরের। আমার আঠারো চলছে, তোমার সঙ্গেই ইন্টার দিলাম। তোমার সম্পর্কে জেনেছি বছরখানেক হয়েছে। দাদাই নিজে সবটা বলেছে আমাকে।সবাই বলে আমি বয়সের তুলনায় বেশি ম্যাচিউর। অনেকটা বুঝি। তাই সেই বুঝ থেকে বলছি দাদাইকে ছেড়ে যেও না। তাঁর হাত একবার ধরলে সে তোমাকে কখনও ছাড়বে না।

তোমার ব্যাপারে বিশ্লেষণ করে যে তথ্যগুলো, তোমার রোগ ও সমস্যা জেনেছি তা হচ্ছে। তোমার সাময়িকের জন্য মেমরি লস হয়েছে। তোমার মেমরি ফেরার সম্ভাবনা আছে। তবে সেটা পঁচিশ পার্সেন্ট। তখন যদি তোমার ওপর প্রেসার দেওয়া হত তাহলে হয়তো অনেক প্রবলেম হতো। তুমি ঘুমের ঘোরে আবোল-তাবোল বলো না। সেই স্মৃতিগুলো তোমার চোখের সামনে অস্পষ্ট ভাসে। এটা যেমন ভালো লক্ষণ তেমনই আবার খারাপও। এক্সিডেন্টের সময় তোমার একটা মিনি অপারেশন করা হয়েছিল। তোমার মাথার পেছনে ছোট একটা কাঁচের টুকরো ঢুকে গিয়েছিল। তাই ডাক্তারদের ধারণা তোমার ব্রেনে চাপ পড়লে তোমার শর্টটার্ম মেমরি লস হতে পারে।এই মেমরি লস কতটা ভয়াবহ সেটা নিয়ে তোমার কোনো ধারনা নেই। এই মেমরি লস যাদের হয় তারা ১৫ মিনিট, কোনো কোনো সময় ৮০ মিনিট পর পর সব ভুলে যায়, কোনোকিছুই তাদের মনে থাকে না। নিজের পরিবার, ঠিকানা, এমনকি নাম অবধি সে মনে করতে পারে না। আর এগুলো হওয়ার কিছু কারন হলো, নির্ঘুম থেকে রাত জাগা, ক্লান্তি, অবসাদ, কিছু নিয়ে গভীর চিন্তা। যদিও তোমাকে নিয়ে তেমন কোনো চিন্তা নেই, তবে অতিরিক্ত মানসিক চাপে তোমার ক্ষতি হতে পারে। তাছাড়া যেকোনো মুহূর্তেই তোমার স্মৃতি ফিরে আসতে পারে। সবাই শুধু সেই শুভক্ষণের অপেক্ষায় আছে।

কথাগুলো তোমাকে আমি বলতাম না। শুধুমাত্র দাদাই আর তোমার ভালোর জন্য বললাম। তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে চাও, আমার কথা তোমার ভালো লাগে। বারবার দাদাইকে রিকোয়েস্ট করেছো আমার সঙ্গে দেখা করবে বলে, তাই আজ দাদাই তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। তোমার ধারণা আমি স্পেশাল, কিন্তু তা একদমই সত্য নয়। আমি খুবই সাধারণ, তোমাদের থেকেও সারাধণ, তোমাদের মত সৌভাগ্য আমার নেই। ওহ হ্যাঁ, তুমি আমাকে নিয়ে দাদাইকে সন্দেহ করছিলে, সন্দেহ করার কিছু নেই আপু। আমাদের বাবারা বন্ধু ছিলেন। সেই সূত্রে আমরাও বন্ধু। আমি ওদের থেকে অনেক ছোট তাই আরসালান দাদাভাই আর আরশান দাদাই আমাকে একটু বেশি ভালোবাসে। রজনী ভাবিও তো জানে এটা, তুমি ভাবি হয়ে আসলে তুমিও জানতে পারতে। আর আমার ওপর ওরা বেশি কেয়ার করে কারন প্রায় পাঁচবছর আগে আমার বাবা-মা মা’রা গিয়েছেন। আমি অনাথ, আপনজন কেউ নেই সেজন্য।

জানো, ডাক্তার বলেছিল অতিতের পুনরাবৃত্তি করলে তুমি ঠিক হয়ে যাবে। আর তা না হলে সারাজীবনের জন্য হারাবো তোমাকে। তোমার পরিবার একবার মত দিয়েছিল এই কাজে। কিন্তু দাদাই তোমার বাবার কাছে গিয়ে অনেক কান্নাকাটি করে। বুঝতে পারছ? ত্রিশ বছরের একজন কঠিন মনের পুরুষ তোমার বাবার হাত ধরে কেঁদেছিল। আমি বলছি না, তুমি অতিত মনে করো, বা অতিতের ব্যবহার পুনরায় করার চেষ্টা করো। তুমি যেমন আছো তেমনই থাকো। এভাবে যদি দাদাইকে ভালোবাসতে পারো, তাহলে ভালোবাসো। নাহলে আমাকে জানাও তোমার জীবনে দাদাইয়ের হস্তক্ষেপ বন্ধ করার ব্যবস্থা আমি নিজে করে দিচ্ছি।

কাউকে ভালোবাসলে অতিত বর্তমান ম্যাটার করেনা অয়ন্তি আপু। কিন্তু যদি ভালোই না বাসো তাহলে এই সম্পর্ক এগিয়ে তুমি ও দাদাই নিজেদের জীবন কেন নষ্ট করবে? যদি বয়সটা ফ্যাক্ট হয় তাহলে একটা ছোট গল্প বলি। আমার দাদা ও দাদির বয়সের তফাৎ আঠারো কুড়ি ছিল, গ্রামের সময় ছিল তো। অল্প বয়সে দাদির বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। আর দাদার আগের বিয়ে ছিলো। বড় দাদি মা’রা গেলে তিনি আমার দাদিকে বিয়ে করেন। তাঁর দুবছরের ছেলের জন্য। কিন্তু পরে তারা দিব্বি সংসার করেছে। আমার বাবা-মায়ের বয়সের গ্যাপ কম ছিল তবে সেই বড় চাচা ও চাচির বয়সের গ্যাপটাও ছিল পনেরো ষোলো। সবাই বলতো, বাবার ধারায় এমন করেছেন তিনি। তবুও তাদের সংসার সমান হিসেবেই চলেছিল। কারন কি জানো? তারা বয়সটাকে প্রাধান্য দেয়নি। তারা ভালোবেসেছিল। তারা অবশ্য দেখতে বুড়োও হয়ে গিয়েছিল। সেদিক থেকে তোমার কপাল তো বাঁধানো কপাল, যে দাদাইকে এখনও পঁচিশ’ছাব্বিশ বয়সের যুবকই লাগে। তুমি বাস্তবতা বোঝাতে চাইছ? বাস্তবে অনেকে সুখি হতে পারেনা বয়সের ব্যবধানে সেটা বলতে চাইছো। জীবন নষ্টও হয় এমন বিয়েতে সেটা বলতে চাচ্ছো!

বয়সের ব্যবধান কখনও সমস্যা হতে পারেনা যদি সেই মানুষ দুজনের মনের মিল থাকে। আমি আমার এই ছোট জীবনে অনেক ট্রাভেল করেছি। ছোট থেকে গ্রামে বেশি সময় কাটিয়েছি। তাই বয়সের ব্যবধানের সমস্যা সম্পর্কেও কিছুটা জানি। প্রধানত এখানে যদি কোনো সমস্যা হয় তা হচ্ছে চিন্তাধারা। জেনারেশনের ব্যবধান। স্বামীর বয়সের জেনারেশন বনাম স্ত্রীর জেনারেশন। যদি বয়স্ক কেউ বাচ্চাকে বিয়ে করে, অবশ্যই ভালো না বেসে, কিংবা এ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। তাহলে মনের মিল হতে সময় তো লাগবেই। যদি সম্পর্কটাকে সময় দেওয়া না হয়,একে অপরকে বোঝার চেষ্টা করা না হয়, একে অন্যকে হেয় করার চেষ্টা, কটাক্ষ করার চেষ্টা করা হয় তাহলে সুস্থ সম্পর্ক গড়ে ওঠা মুশকিল। আমাকে দিয়ে উদাহরণ দিচ্ছি। আশা করবো এটা তুমি কাউকে বলবে না। দাদাইকেও না। আমি একজনকে ভালোবাসি। সে আমার থেকে বারো বছরের বড়। সে আমাকে বোঝেনি, বোঝার চেষ্টা করেনি, আমার ভালোবাসাকে গুরুত্ব দেয়নি। আমাকে ফেলে চলে গেছে। বয়সের ব্যবধানকে দোষ্ দিতে পারি আমি। কিন্তু দেবো না, কারন কি জানো এখানে বয়সের দোষ্ নেই। দোষ্ মনের। আমি তাকে ভালোবেসেছি। সে বাসেনি। তাই সম্পর্ক টেকেনি।সে যদি আমাকে বুঝতো তাহলে ছেড়ে যেত না। তবে বয়সের ব্যবধানের একটা বেনিফিট হচ্ছে আন্ডার্স্টান্ডিং। তোমার স্বামী যদি তোমার থেকে বড় হয়, তাঁর অভিজ্ঞতা তোমার থেকে বেশি থাকবে, তাঁর বোঝার ক্ষমতা বেশি থাকবে। সে যদি তোমাকে বোঝে তাহলে তোমার কিছু বলার প্রয়োজন পড়বে না। সে তোমাকে দেখেই তোমার মনের কথা বুঝে ফেলতে পারবে। আর একটা কঠিন, বিশ্রি তিক্ত সত্য হচ্ছে, তুমি তোমার অরুপির জীবন দেখে প্রভাবিত হচ্ছো। তুমি কি সত্যিই জানো তোমার অরুপির সংসার ভাঙার কারন কি?সে বয়সের ব্যবধানকে সম্মুখে প্রকাশ করছে তাই তোমরা ধরে নিচ্ছো সে ব্যবধানজনিত কারনে সংসার করতে পারছে না। কিন্তু সত্যটা হচ্ছে, সে আমার দাদাইকে ভালোবাসে। তুমি হয়তো জানো না,তাঁর সঙ্গে দাদাইয়ের বিয়ের একটা কথা হয়েছিল যেটা দাদাই প্রথম বারেই নাকোচ করে দেয় শুধু তোমার জন্য। তোমাকে দাদাই প্রচন্ড ভালোবাসে বলে। দাদাইয়ের এমন ভালোবাসার সামনে বয়সের ব্যবধান নিতান্তই তুচ্ছ অয়ন্তি আপু।

একটা মানুষ বারো বছর ধরে তোমাকে ভালোবাসে। এটা সহজ বিষয় নয় অয়ন্তি আপু। কঠিনের থেকে কঠিন একটা পরিস্থিতি পার করে দাদাই আবারও তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে। তাঁর স্বপ্ন ভে’ঙে দেবে নাকি পূরণ করবে তা তুমি জানো।

আমি শুধু এটুকুই বলবো,ওকে ভালোবাসতে যদি তোমার সময়ের প্রয়োজন পড়ে, সময় নাও। তবুও ওকে ছেড়ে যেও না। ওকে বাঁচানো কঠিন হয়ে যাবে তখন। তোমার বাবা যখন নিজ থেকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় তখন আঙ্কেল সরাসরি সে প্রস্তাব নাকোচ করে দেয়। প্রাপ্ত ছেলেটার চক্করে পড়ে যাচ্ছিলে, তোমার সৌন্দর্যে সবাই মুগ্ধ হচ্ছিল, বখাটে বাজে মানুষের নজর পড়ছিল দেখে তোমার বাবা নিজেই অনুরোধ করেন দাদাইকে যেন সে তোমার জীবনে আসে। অনাপি তোমার বাবাকে দাদাই সম্পর্কে সব বলে রেখেছিল, অনাপির চাওয়া একসময় তোমার বাবার চাওয়ায়ও পূর্ণ হয়। তোমার বাবাও চায় তাঁর মেয়ে রাজরানী হয়ে থাকুক। আর তাঁর জন্য রাজা হিসেবে আরশানের থেকে বেটার কেউ নেই।
এখন বলো তুমি কি চাও? মানুষটাকে বেঁছে নিতে নাকি জার্নালিজম বেঁছে সবাইকে কষ্ট দিতে। তোমার অনাপি যদি থাকতো তাহলে সে হয়তো কখনই তোমাকে এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে দিত না। “”

কথাগুলো বলে রোজ ওর শো শুরু করার প্রস্তুতি নেয়। আড়চোখে কয়েকবার অয়ন্তিকেও দেখল সে। অয়ন্তির কপালে ঘামের বিন্দু বিন্দু ফোটা জমছে। চিন্তিত দেখাচ্ছে অয়ন্তিকে। ভেতরে কিছু একটা তালগোল পাঁকাচ্ছে কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারছে না সে। রোজও ওকে জোর করল না। রোজের প্রতিটা কথা সত্য এবং অয়ন্তি তা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছে। যতটুকু সন্দেহ আছে তা বাড়িতে গিয়ে সব সার্টিফিকেট চেক করলেই জানতে পারবে। রোজ কফি পান করে গলাকে আরাম প্রদান করে অয়ন্তির দিকে তাকালো। অয়ন্তির ঠোঁট কাঁপছে। কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে সে। অবশেষে জড়তায় ঘেরা কন্ঠে অয়ন্তি বলে ওঠে,

-সব যদি সত্য হয় তাহলে আমি আরশানকে সুযোগ দিতে চাই। ভালোবাসতে চাই, কিন্তু যদি মিথ্যে হয় তবে সারাজীবনের মত আমাকে হারাবে সে।

-পরখ করে দেখতে পারো।রোজ কখনও মিথ্যা বলেনি। কারন সাইরাহ্ এ রোজা মিথ্যা বলার শিক্ষা পায়নি।

চলবে?