Monday, June 23, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1061



প্রেমপ্রলয় পর্ব-০৩

0

#তাসনিম_তামান্না
#প্রেমপ্রলয়
পর্ব-৩

রাতের নিস্তব্ধতা ঘিরে রেখেছে চারিদিকে রাস্তার পাশের ঝোপঝাড় থেকে ঝিঁঝি পোকারা ডেকে চলেছে সমান তালে ল্যামপোস্টের আলোয় দুই মানব-মানবী দু’জনের দিকে ক্রোধনল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস নিচ্ছে যেনো এখনি দুজন দু’জনকে ভর্স করে দিবে। নিরবতা কাচ ভাঙ্গার মতো ঝনঝনিয়ে শব্দ তুলে সামি ক্রোদ নিয়ে বলল

-‘ সাহস তো কম না আমার গাড়ির লাইটের কাজ ভেঙ্গে দিলেন? বাইক চালাতে পারেন না তো চালান কেনো? ডিজগাস্টিং’

জিমি চুপ করে রাগ নিয়ন্ত্রণের প্রয়াশ চালাছে। জিমি দাঁতে দাঁত চেপে বলল

-‘আপনি বুঝি ভালো গাড়ি চালাতে পারেন? তাই তো এসেই আমার বাইকের সাথে লাগিয়ে দিলেন। আমার বাইকেরও তো মিরর ভেঙে গিয়েছে আমি কি আপনাকে সেটা নিয়ে কিছু বলছি? পায়ে পা লাগিয়ে ঝামেলা বাড়াছেন কেনো?’

-‘দোষটা আপনার আপনি মাঝ রাতে মাঝ রাস্তায় বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন কেনো? এখানে আমি না এসে অন্য কেউ আসলে লাগিয়ে দিতো’

-‘আজ্ঞে জী না। আসলে আপনার চোখ থাকতেও চোখ নাই তাই মাঝ রাস্তায় জলজেন্ত মানুষ দেখেও আপনি দেখতে পান নি’

-‘আপনি আমাকে ইনডিরেক্টলি ঝগরুটে আর অন্ধ বলছেন? তাহলে আপনি নিজে কি হ্যাঁ দেখছিলেন গাড়ি আসছে সরে যেতে পারলেন না আপনি অন্ধ’

-‘এই শুনুন আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন নিজে হাইস্পিডে গাড়ি চালিয়ে আসছিলেন তো আমি কেমনে সরতাম’

-‘হ্যাঁ হ্যাঁ আপনাদের মতো মানুষদের না আমার খুব ভালো করেই চেনা আছে’

জিমি ভ্রু কুচকে বলল

-‘হোয়াট ডু ইউ মিন বাই আমাদের মতো মানুষ?’

-‘এই যে এখন ক্ষতিপূরণের জন্য টাকা চাইবেন আপনার হাতে লাগছে, পায়ে লাগছে, গাড়ি ভাংঙ্গে কি চাইবেন না? ওকে চাওয়া লাগবে না আমি-ই দিচ্ছি’

কথাটা বলে সামি জিমির হাতে একহাজারের পাঁচটা নোট ধরিয়ে দিলো। জিমি দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস টেনে নিয়ে চোখ খুলে সামি’কে টাকাগুলো রিটার্ন ফেরত দিয়ে শান্ত গলায় বলল

-‘আমরা মধ্যবিত্ত হতে পারি। কিন্তু আপনার মতো নিচ মনমানসিকতা আমাদের নাই। টাকা কিন্তু আমাদেরও আছে হতে পারে আপনাদের থেকে কম কিন্তু টাকা আছে গাড়ি ঠিক করার সামর্থ্যও আছে আর না থাকলেও আপনার কাছে অনন্ত চাইতাম না। নেক্সট টাইম আপনার এই টাকার গরম আমাকে দেখাতে আসবে না’

কথাটা বলে সবাইকে ইশরা করতেই যে যার বাইকে উঠে গেলো জিমিও বাইক তুলে স্টার্ট দিয়ে তিনটে বাইক সো করে চলে গেলো চোখের সামনে থেকে। অপমানে সামির চোখ মুখ লাল হয়ে উঠেছে গাড়িতে ড্রাইভিং সিটে উঠেতে নিলেই সামির ফেন্ড রানা সামিকে আঁটকে দিয়ে বলল

-‘ভাই থাম আমি ড্রাইভ করছি তুই ড্রাইভ করলে আজ নিশ্চিত ইননাল্লিলা হয়ে যাবো’

সামি রক্তিম চোখে রানার দিকে তাকালো। রানা সেটা পাত্তা না দিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে গেলো। সামিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল

-‘আরে ওঠ দেরি হচ্ছে আমাদের তোকে বাসায় পৌঁছে আমিও বাসায় যাবো’

সামি রাগে গজগজ করতে করতে গাড়িতে উঠে বসলো। রানাও ড্রাইভ করতে লাগলো।
.
সামিদের পারিবারিক বিজনেস আছে যেটা সামির বাবা শহিদ খান নিজের হাতে গড়ে তুলেছেন সেটাতেই সামি আর সামির বড়ভাই জাকি সবসামলাচ্ছে জাকি পুরনো হলেও সামি নতুন জয়েন্ট করেছে। রানা সামির ফেন্ড বলতে গেলে বেষ্ট ফেন্ড রানা সামির পিএ। অফিসের কাজ শেষে বাড়ি ফিরতে দেরি হওয়ায় গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দেয় সামি। জিমি আর ওর বন্ধুরাও জিমির জন্য প্রতিযোগিতার সব কাজ শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায় আর রাস্তা ফাঁকা থাকায় বল্টু জিমিকে স্ট্যাড করে দেখাতে বলতেই জিমিও রাজি হয়ে যায়। প্রস্তুতি নিয়ে সবে শুরু করতে যাবে তখনি সামির গাড়ি ঝড়ের বেগে আসে।
.
রানা মধ্যবিত্ত বলে জিমির ব্যপাটা বুঝতে পেরছে এটা কতটা অপমানজনক। রানা বলল

-‘দোস্ত মেয়েটাকে ওভাবে তোর বলা উচিত হয়নি।’

সামি রেগে গজগজিয়ে বলে উঠলো

-‘তুই ঔ মেয়ের হয়ে সাফার গাইছিস? তুই আমার ফেন্ড নাকি ওর ফেন্ড’

-‘দেখ আমি কারোর হয়ে কথা বলছি না যেটা আমার কাছে খারাপ লাগছে আমি সেটাই বলছি। মেয়েটাকে এভাবে টাকা দেখানোর কি ছিলো? মেয়েটা তো টাকা চাই নি’

-‘টাকা চাইতো না তার কি গ্যারান্টি আছে?’

-‘সবাই তার এক না যদি চাইতো তখন দিতি আগ বাড়িয়ে দিতে গেলি কেনো? আর দোষটা কিন্তু দু’পক্ষেরই আমাদের ও তাড়া ছিলো বলে জোরে গাড়ি চালাছিলি আর মেয়েটাও বুঝে উঠতে পারি নাই এভাবে হুট করে গাড়ি চলে আসবে। আর তুই তো এমন ছিলি না কি হলো তোর এমন বিহেভিয়ার করছিস কেনো? জানি তুই রাগি। তাই বলে এভাবে মাঝ রাস্তায় দাড়িয়ে একটা মেয়ের সাথে তর্ক?আসলেই কি তুই এটা?’

সামির চুপ মুখে কোনো উত্তর নাই। কি-ই বা উত্তর দিবে নিজেই তো জানে না। একদিনেই দুইবার দেখা হলো তাও ঝগড়া। ব্যাপারটা অদ্ভুত না?

_________________________________

জিমি বাসার কাছে আসতেই। দেখলো বাসার মেনডোর খোলা সাথে সাথে ভ্রু কুচকে এলো। কিছু না ভেবেই বাসায় ডুকে পড়লো। এসেই ঘাবড়ে গেলো রাগের চোটে ভুলেই গেছিলো। এতো রাত করে ফিরলে লিলি লাঠি নিয়ে জিমি জন্য বসে থাকে। ঔ বলে না যেখানেই বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না লিলি লাঠি নিয়ে জিমির সামনে দাঁড়িয়ে আছে জিমি ড্রায়ইং রুমে চোখ বুলাললো না কেউ নেই হয়ত মা-ই থাকতে দেয় নি ধমকে সবাইকে ঘুমাতে পাঠিয়েছে। কিন্তু কেউই ঘুমাইলি লিমন ছাড়া।

-‘কখন বেড়িয়েছিস?’

-‘৬টা’

-‘আর এখন কয়টা বাজে?’

-‘২টো’

-‘বাহ ভালো না ব্যাপারটা। তো বাসায় ফিরলি কেনো? আর কয়েকঘন্টা বাকি মাত্র সকাল হওয়ার ফেরার দরকার ছিলো না’

-‘আম্মু আসলে…..’

-‘হাত পাত’

জিমি দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করে দু-হাত বাড়িয়ে দিলো। বেশিক্ষণ যেতেই কিছু হলো না জিমি চোখ খুলে দেখলো লিলি মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। এমন-ই হয় লিলি কখনো মা*রে আবার কখনো না মে*রে চলে যায় না হলে বসে থাকে জিমি দরজা লাগিয়ে দিয়ে হাত মুখ ধুয়ে প্লেটে করে খাবার এনে লিলির পাশে বসে একলোকমা মুখের কাছে ধরে বলল

-‘আম্মু হা করো খাইয়ে দি’

লিলি কথা না বলে মুখে নিয়ে নিলো। খাওয়া শেষ হতেই লিলি বলল

-‘এমন করে রাত করে ফিরিস কেনো বলতো টেনশন হয় আমার তোর যদি কেউ ক্ষতি করে দেয়? বুঝিস না তুই ছেলে না মেয়ে ছেলেদের মতো জামা প্যান্ট আর চুল লাগালেই সে ছেলে হয়ে যায় না’

-‘আমি জানি আম্মু আমি মেয়ে কিন্তু আমার এভাবে থাকতে ভালো লাগে আর আমি যদি নরম হই তাহলে সবাই চেপে ধরবে আমরা এখানে ঠিকতে পারবো না। সমাজের অনেকে আছে আম্মু আমাদের সামনেই থাকে ভালোর মুখশ পড়ে আসলেই কি তারা ভালো? সবাইকে এতো বিশ্বাস করো না আম্মু’

-‘জানি আমি তাই বলে পড়াশোনাও করবি না? সারাদিন রাত ই তো টো টো করে ঘুরে ব্যরাস আমাদের নিয়ে ভাবিস কখনো নিজেকে নিয়ে ভেবেছিস তোর কি হবে?’

-‘আমার কিছু হবে না এভাবেই চলে যাবে। আর পড়ছি তো এক্সাম আসলে একটু পড়লে হয়ে যাবে আমার পাশ নম্বর উঠলেই হবে আমার ওতো পড়ে কি করবো বলো তো?’

-‘পড়াশোনা, টাকা ছাড়া এখানে তোকে কেউ চিনবে না সবাই ভুলে যাবে’

-‘যাক চাই না কেউ আমাকে মনে রাখুক’

চলবে

প্রেমপ্রলয় পর্ব-০২

0

#তাসনিম_তামান্না
#প্রেমপ্রলয়
পর্ব-২

জিমি পিটপিট করে চোখ খুলে চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো কোথাও কোনো আলোর ছিটে ফোটাও নাই। হাতে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব হলো প্রচন্ড ব্যথায় চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। কিন্তু উঠে বসতে পারছে না। মুখ কিছু দিয়ে বাঁধা কথাও বলতে পারছে না শুধু উহু্ উহু্ শব্দ ছাড়া কিছুই পারছে। হঠাৎ আলোর ঝলকানি এসে চোখে লাগলো চোখ বন্ধ করে আস্তে আস্তে চোখ খুললো জিমি। চোখ খুলে সামি’কে শয়তানি হাসি দিয়ে দাড়িয়ে থাকা অবস্থায় দেখলো। নিজের অবস্থান দেখে আর-ও হতভম্ব হয়ে গেলো জিমি চেয়ারে বসা হাত দুইটা সামনের টেবিলে পেরেক দিয়ে বাঁধা আটকানো তা দিয়ে রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। সামি জিমির সামনে টেবিল বরাবর চেয়ার টেনে বসলো। হাতে পেরেক আর হাতুড়ি জিমি ভয় পেয়ে যায়। মাথা নাড়িয়ে বারবার বাঁধা দিয়ে না না ইশারা করতে লাগলো। সামি শুনলো না বলল

-‘বলেছিলাম না হাত গুড়ো করে দিবো এই হাত দিয়ে তুই সামির কলোয়ার টেনে ধরছিলি তাই না? দেখ তোর হাতে কি অবস্থা করি’

সামি জিমির হাতের ওপর একটা পেরেক রেখে হাতুড়ির বারি দিতেই। জিমি গলা ফাটানো চিৎকার দিয়ে উঠে বসলো জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে নিজের হাতের এপিট ওপিট দেখে বুকে জড়িয়ে ধরলো। জিমির চিৎকার শুনে বাসার সবাই দৌড়ে জিমির বদ্ধ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে মিলি বলল

-‘জিমি কি হয়েছে? এভাবে চিৎকার করলি কেনো? জিমি দরজা খোল’

জিমির মা চিন্তিত গলায় বললেন

-‘জিমি কি হলো দরজা খুলছিস না কেনো? কথা বলছিস না কেনো? জিমি, এই জিমি, কি হলো দরজা খোল’

-‘এই জিমিআপু কই তুই দরজা খোল’

সবাই ডাকাডাকি করতে লাগলো। জিমি এদিকে ঘেমে নেয়ে একাকার কথা বলার অবস্থা তেই নেই যেনো। বিরবিরিয়ে বলতে লাগলো ‘কি ভয়ংকর স্বপ্নটা’

জিমি নিজেকে সামলিয়ে গ্লাসে থাকা পানিটা ঢকঢক করে খেয়ে বলল ‘আমার কিছু হয় নি আমি ঠিক আছি যাও তোমরা’

জিমির মা বলল ‘ঠিক আছিস মানে? ঠিক থাকলে কেউ এমন চিৎকার দেয়? দরজা খোল আমি দেখবো তোকে’

জিমি কথা না বাড়িয়ে দরজা খুলে দেয়। ও জানে দরজা না খুললে জিমির মা-ও নড়বে না ওখান থেকে। দরজা খুলে দিতেই সবাই হুড়মুড়িয়ে রুমে ডুকে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে সন্দেহজনক কিছু না দেখতে পেয়ে জিমির মা চোখ ছোট ছোট করে বলল

-‘ওমন করে চিৎকার দিলি কেন?’

জিমির দাদি ফোড়ন কেটে বলল

-‘ওর আবার কি হইবো দেখতাছনা এই ছেরি ঠিক ঔ আছে খালি আমাগো চিন্তায় ফ্যালোন যায় কেমনে সেই ফন্দি আঁটে হেরে আমি খুব ভালা কইরা চিনি’

জিমিও ওর দাদির মতো করে বলল

-‘হ হ বুড়ি তুমি আমারে চিইনয়া উল্টায় ফ্যালছো খালি উল্টাফাল্টা কথা কও ক্যান’

-‘এই ছেরি তুই আমারে একদম কফি করবি না কইয়া দিলাম ভালা হইবো না কইয়া দিলাম’

-‘ক্যান বুড়ি ঠুমি আমারে আবার কি করবা? আর তোমারে কফি করতে আমার বইয়ায় গেছে’

জিমি মা রেগে বললেন

-‘আহ জিমি কি হচ্ছেটা কি?’

জিমি আফসোস সুরে হেয়ালি করে বলল

-‘আমার কি আবার হইবো আমার মরণ হইবো তোমাগো জ্বালায়’

লিমন, মিলি এতোক্ষণ জিমির কাজে মজা নিলেও মরার কথা শুনতেই মুখ থেকে হাসি উড়ে গিয়ে আঁধার নেমে আসে। জিমির দাদিও মুখ গম্ভীর করে বলল

-‘এই ছেরি মরণের কথা কস কেন? আমার বুক খান কেমন কইরা ওঠে’

-‘ক্যান আমি মরলে তো তোমাগো ভালা হইবো আমার জন্য কত কি শুননো লোকের কাছে আমি না থাকলে তো আর কারোর কাছে কথা শুনোন লাগবো না’

জিমির মা লিলি জিমিকে হঠাৎ বুকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে বলল

-‘মা’রে তুই কি আমার ওপরে রাগ করে কথাগুলা বলছিস? তোকে বকি বলে তুই এসব বলবি? আমার কষ্ট হই জানিস না তোরা এই ক’জন ছাড়া আমার আর কে আছে বলতো তোরাই তো আমার সব’

জিমি মায়ের বুকে গুটিগুটি হয়ে বলল

-‘আম্মু আমি তো মজা করে বলেছি ডোন্ট বি সিরিয়াস আম্মু আমি আছি আর থাকবো, মরে গিয়েও ভুত হয়ে থাকবো কোথাও যাবো না’

মিলি জিমির বাহুতে চাপড় মেরে বলল

-‘সবসময় ফাইজলামি তাই না বিয়াদপ একটা’

-‘হু আর ইউ? ও হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে আপনি তো জামান সাহেবের প্রথম বড় কন্যা সন্তান কনেবউ কেমন আছেন আপনি?’

-‘আম্মু দেখেছ তুমি সবসময় ভাল্লাগে না আমাকে পর করে দিচ্ছো থাকো তোমরা আমি আর আসবোই না তোমাদের কাছে’

কথাটা বলে রাগে গজগজ করতে করতে দুপদাপ পা ফেলে চলে গেলো মিলি। মিলি যেতেই জিমির মা লিলি বলে উঠলো

-‘ওর পিছনে না লাগলে হয় না তোদের আর ক’দিন পরে চলে যাবে মেয়েটা’

জিমিরও মন খারাপ হয়ে গেলো। লিলি টেবিলের ওপর খাবারগুলা দেখে রেগে বলল

-‘দুপুরের খাস নাই এখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে না খেয়ে খেয়ে কি অবস্থা করছিস নিজের দেখেছিস একবার আয়নায়?’

-‘আম্মু যাও আপুকে খাইয়ে দিয়ে আসো আমি ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিচ্ছি এতো টেনশন করা লাগবে না আমাকে নিয়ে’

_________________________

জিমি ফ্রেশ হয়ে টেবিলে এসে দেখলো লিলি ভাত মেখে জিমির জন্য অপেক্ষা করছে জিমি মুচকি হেসে খেতে বসলো মিলিও লিলির অন্য পাশে বসে আছে। লিমন আর দাদি বসে টিভি দেখছে।
জিমি খেতে খেতে ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো বন্ধুমহল থেকে কতগুলো ফোন। জিমির ভ্রু কুচকে গেলে সাথে সাথে কল ব্যাক করতেই ওপাশ থেকে সবুজ চিল্লিয়ে বলল

-‘ঔ হা/রা/মি মাইয়া তোর কাছে কতবার ফোন দিয়েছি সে খেয়াল আছে তোর? আবার তোর বাসায়ও যেতে পারছি না এসব ফেলে’

জিমি ভাতগুলো পানি দিয়ে গিলে বলল

-‘কেনো? কি হয়েছে? এতো জরুরি তলব যে’

-‘আরে বস কি হইনি সেটা বলল লটারি লেগে গেছে বইন তুই তাড়াতাড়ি বানানিতে চলে আয়’

-‘ওখানে কেনো? তাও আবার এখন? আগে বল হয়েছেটা কি?’

-‘বাইক আর সাইকেল স্ট্যান্ড/রেস প্রতিযোগিতা জিততে পারলেই ১ লক্ষ টাকা পুরস্কার যেহেতু তোর টাকার প্রয়োজন আর আজ-ই কাগজ পত্র জমা দেওয়ার লাস্ট ডেট আমি সব জমা দিয়ে দিছি তোর শুধু একটা সই লাগবে তারাতাড়ি চলে আই ১০ টার মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে’

জিমি তড়িৎ গতিতে লাফিয়ে উঠে বলল

-‘বলিস কি দোস্ত আমি এখনি আসছি এখন সন্ধ্যা ৬টা বাজে আমি ঠিক পৌঁছে যেতে পারবো’

লিলি প্রশ্ন করলো

-‘কি হয়েছে এখন আবার কোথায় যাবি?’

-‘আম্মু আমাকে এখনি বের হতে হবে আমার আসতে রাত দেরি হবে আমাকে নিয়ে টেনশন করো না আমি ঠিক থাকবো’

লিলিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঝড়ের বেগে রেডি হয়ে বাইক নিয়ে বেড়িয়ে গেলো লিলি বাঁধা দিলেও শুনলো না।

চলবে

প্রেমপ্রলয় পর্ব-০১

0

#তাসনিম_তামান্না
#প্রেমপ্রলয়
সূচনা পর্ব

শার্টের প্রথম দু’টো বোতাম খুলতেই ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দের জিমি পিছন ফিরে নিজের রুমে অপরিচিত সুদর্শন পুরুষকে দেখে ঘাবড়ে গেলো। জিমি নিজের দিকে তাকিয়ে শার্টের কলার দু’হাত দিয়ে চেপে ধরে আবার ও সুদর্শন পুরুষটির দিকে ভীতু দৃষ্টিতে তাকালো। সুদর্শন পুরুষটিও জিমির দিকে বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। জিমি যেই না গলা ফাটানো চিৎকার দিতে যাবে ওমনি ছেলেটি এসে জিমি’র মুখ চেপে ধরে শ্বাস টেনে বলল

-‘আর ইউ ম্যাড? কোনো কমন সেন্স নাই আপনার এই ভরা বাড়িতে আপনি চিৎকার দিতে যাচ্ছিলেন? কি হতো এখন সবাই ছোট জিনিসটাকে তিল থেকে তাল বানাতো!’

জিমি ছেলেটার স্পর্শে বরফের মতো স্থির হয়ে জমে যায়। ছেলেটার কথা শুনে জ্ঞান আসতেই ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে পিছন ফিরে ঝটপট বোতাম লাগিয়ে ছেলেটার সোজাসোজি হয়ে দাড়িয়ে রেগে বলল

-‘আপনার কমন সেন্স নাই কারোর রুমে আসতে গেলে তার পারমিশন নিতে হয়। তা-ও একটা মেয়ের রুম!’

-‘ও হ্যালো মিস ওয়াট? কি বললেন আপনি?’

জিমিকে পা থেকে মাথা অব্দি স্ক্যান করে ঠোঁট বাঁকিয়ে আবারও বলল

-‘আপনি মেয়ে? কই আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে না’

জিমি রেগে জোরে বলল

-‘You Shurtup! আপনার সাহস তো কম না আমার রুমে দাঁড়িয়ে আমাকেই উল্টো পাল্টা কথা বলছেন?’

-‘এই! You Just shurtup! ওকে তোমার মতো ফালতু মেয়ে আমাকে এই সামি’কে চোখ রাঙিয়ে গলা উঁচু করে কথা বলছো? হাও? I kill…!’

সামির কথা শেষ হওয়ার আগে দরজায় আস্তে আস্তে টোকা পড়লো। জিমি রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে নিলেই সামি জিমির হাত ধরে আটকে দিয়ে বলল

-‘এই stupid! আ..!

জিমি এবার ভয়ানক রেগে গেলো। রেগে সামির কলোয়ার টেনে ধরে বলল

-‘সেই First থেকে দেখে আসছি আপনি আমাকে। ম্যাড, স্টুপিট বলেই যাচ্ছেন কিছু বলছি না দেখে আর-ও বলছেন’

জিমি সামির কলোয়ার টেনে ধরায় সামিও রেগে গেলো। এক ঝটকায় জিমির হাত কলোয়ার থেকে সরিয়ে হাত মুচড়ে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল

-‘এই হাত আমি ভেঙ্গে গুঁড়ো করে ফেলবো। আর আপনি যা আমি সেটাই বলছি কোন সেন্স নিয়ে আপনি দরজা খুলতে যাচ্ছিলেন?’

জিমি নিভলো। মনে মনে বলল ‘সত্যিও এখন যদি আমাদের দু’জনকে একসাথে একরুমে বাইরের লোক দেখে ব্যপারটা খারাপ দেখায়’

আবারও দরজায় টোকা পড়লো। দরজার ওপাশ থেকে জিমির ছোট ভাই লিমন ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো।

-‘আপু দরজা খোল তোর রুমের ওয়াসরুমে সামি ভাইয়া আছে মিলিপুর দেবর’

লিমনের কথাটা কানে শ্রবন হতেই জিমির রাগী দৃষ্টি আস্তে আস্তে ভীতি দৃষ্টিতে পরিনত হলো। সামির দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পড়ে যায় দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে চারিদিকে এলোমেলো দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজের হাত বলিষ্ঠ হাত থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো কিন্তু সফল হলো না সামি তীক্ষ্ণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জিমির দিকে জোরে জিমির হাত ধরে রাখছে যেনো নিজের সব রাগ জিমির হাতের ওপর ঝাড়ছে। জিমি হাতে তীব্র ব্যথায় টনটন করছে কিন্তু সেটাকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে না দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নিলো কেননা এমন ব্যথা সে প্রতিনিয়ত পেয়ে থাকে তার মাথায় চলছে অন্য চিন্তা মনে মনে বলল ‘আপুর বিয়েটা যদি আবারও আমার জন্য ভেঙে যায় তবে কি হবে? সবাই কষ্ট পাবে না না কিছুতেই এটা হতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই না’

জিমি এবার চোখ ছলছল করে তাকিয়ে বলল ”Sorry!’

সামি জিমির মুখে সরি শব্দ শুনে দমে গেলো। জিমির দৃষ্টি নত করে আছে। নিজের দূর্বলতা কাউকে দেখাতে চাই না। সামি জিমির হাত ছেড়ে দিয়ে বলল

-‘ Next time আমার সাথে লাগতে আসবে না। ব্যাপারটা খুব একটা শুভকর্ম হবে না তোমার প্রাণটাও যেতে পারে।’

সামির কথার প্রেক্ষিতে জিমি কিছুই বলল না কেননা এখানে আপুর হবু দেবর না থেকে যদি অন্য কেউ থাকতো তাহলে জিমি তাকে এতোক্ষণে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে ফেলতো।

সামি দরজা খুলে বেরিয়ে এলো লিমন দরজার সামনেই দারিয়ে ছিল। লিমন সামিকে দেখে সৌজন্যে মূলক হাসি দিলো। কিন্তু সামির মুখ গম্ভীর লিমন কিছু মনে করলো না কেননা সামি আসার পর থেকেই মুখ এমন গম্ভীর করে আছে। সামি ভাবলো সব ঠিক আছে এখনো জিমি আসে নি নিজের মনে কথা সাজিয়ে ড্রাইংরুমের উদ্দেশ্য পা এগিয়ে নিতেই। রুমে ভিতর থেকে জিমির কন্ঠ ভেসে আসলো লিমন থমকালো দৌড়ে রুমে ভিতরে চলে আসলো জিমিকে দেখে বলল

-‘আপু তুই? কখন আসলি?’

জিমি রেগে বলল

-‘যখন আপনি আমার রুমে ছেলেটাকে রেখে চলে গেছিলেন তখন’

লিমন ভীতু গলায় নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য বলল

-‘আপু আসলে সামি ভাইয়ার গায়ে জুস পড়েছিল আর আম্মু আমাকে ডেকেছিলো তাই…’

-‘তাই কি? হ্যাঁ? আর কোনো ওয়াশরুম ছিলো না? এবার যদি এই ছেলে কাউকে কিছু বলে দেয় তাহলে তো আপুর বিয়ে ভেঙে যাবে!’

জিমির কথায় লিমনও বেশিক্ষণ ভয় পেলো। এটা প্রথমবার নয় এর আগের বারও জিমিকে দেখে পাত্রপক্ষ বিয়ে ভেঙে দিয়ে চলে গেছে। আজ ছিল জিমির বড়বোন মিলির পাকাদেখা এনংঙ্গেজমেন্ট বাংলায় যাকে বলে আংটি বদল। জিমি লিমন বেশি কিছুক্ষণ নিরব হয়ে বসে রইলো ড্রায়ংইনরুম থেকে চিল্লাপাল্লা আওয়াজের অপেক্ষায় কিন্তু বেশিক্ষণ যাওয়ার পর ও তেমন কিছুই হলো না। জিমি লিমন মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। নিরবতা ভেঙে জিমি বলল

-‘যা দেখে আয় তো সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি-না’

লিমন বিনাবাক্যে এদিক-ওদিক মাথা নাড়িয়ে জায়গা থেকে প্রস্থান করলো। জিমির আজ বড্ড ক্লান্ত লাগছে। মাথা ব্যথা করছে, চোখ দু’টো ঘুমে ভেঙ্গে আসছে। জিমি আর কিছু ভাবতে পারছে না ওয়াশরুমে গিয়ে চোখ-মুখে পানি দিলো তা-ও ক্লান্তি কমছে না। শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে পানির নিচে দাঁড়িয়ে পড়লো। মাথায় ঠান্ডা পানির স্পর্শ পেতেই যেনো শান্তি পেলো।

মাথায় তোয়ালে পেচিয়ে রুমে আসতেই। লিমনকে খাটের ওপর পা দুলিয়ে রিল্যাক্সে আংঙ্গুর খেতে দেখে জিমি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল

-‘কি হয়েছে সব ঠিকঠাক তো’

-‘ইয়েস বস। আমার মনে হয় সামি ভাইয়া ব্যপারটা ধরতে পারি নাই যে তুই মিলি আপুর বোন’

জিমি সস্থির শ্বাস নিলো। রুমের জানালার পর্দা গুলা টেনে দিতে দিতে বলল

-‘তা আমার রুমে কি করিস ঢ়া দূর হ আমি এখন ঘুমাবো কেউ যেনো ডিস্টার্ব না করে’

লিমন উঠে দাড়িয়ে যেতে যেতে বলল

-‘যাচ্ছি যাচ্ছি সবসময় দূর দূর করে তাড়িয়ে দিস কেন? তোর রুমে আসছি কি স্বাদে আম্মু তোর জন্য খাবার পাঠিয়েছে খেয়ে নে’

লিমন রুম থেকে যেতেই জিমি ধড়াম করে রুমের দরজা আটকে দিলো। এতে লিমন লাফিয়ে উঠলো।

জিমি খেলো না খাবারটা ডেকে রেখে শুয়ে পড়লো। মাথায় চিন্তারা এলোমেলো হয়ে হানা দিলো। জিমি মনের সাথে এলোমেলো হয়ে কথা বলতে লাগলো ‘এই কষ্টের অবসান কবে হবে? আদেও কি হবে? সুখের সন্ধান কি মিলবে কখনো? আপুর বিয়ের এতো খরচ কিভাবে জোগাড় হবে? আমি তো আপুর বিয়েতে থাকতে পারবো না। ইশশ কত ইচ্ছে ছিল আপুকে ধুমধামে বিয়ে দিবো বিয়েতে সবকাজ নিজের হাতে করবো। কিন্তু সেসব কিছুই হবে না।’

জিমি ঘুর্নিয়মান ফ্যানের দিকে তাকিয়ে বলল ‘তুমি আমার ওপর সব দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্তে চলে যেতে পারলে? আমার বুঝি ক্লান্তি, কষ্ট, মান-অভিমান কিছুই নাই? আমাকে কি যন্ত্রমানব মনে করে সবাই? আমিও তো মানুষ না-কি! আমার ও অভিমান রাগ কষ্ট হয়?’

চলবে

তুই হবি শুধু আমার পর্ব-২৫(শেষ পর্ব)

0

#তুই হবি শুধু আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#শেষ_পর্ব

ফারহান ফোনটা রিসিভ করতেই অয়ন্তির গলা শোনা গেল। চেঁচামিচিতে অস্থির করে তুলেছে বাড়ি। ফারহান হ্যালো বলতেই অয়ন্তি দ্রুততার সঙ্গে বলে,

-দ্রুত ডাক্তার নিয়ে আসো ভাইয়া। রোজের পা বোধ হয় ভে’ঙেই গেছে। এখন কথা বলতে পারছি না, ফোনে চার্জ নেই, রাখছি।

ফারহান হতভম্ব চোখে চাইলো।শ্রবণেন্দ্রিয় কি ঠিকঠাক কাজ করছে না? কি শুনতে কি শুনল? রোজের পা কি করে ভা’ঙবে? আর রোজকে পেলোই বা কোথায় ওরা? ফারহান কল ব্যাক করল, কিন্তু সিম বন্ধ। মেজাজ চটে গেল মুহূর্তেই। এত রাতে কি ইয়ার্কি করার সময়? সত্য না জেনে ডাক্তার ডেকে নিয়ে যাবে? কিন্তু অয়ন্তি মিথ্যা বলবে কেন? তাহলে কি রোজ সত্যিই ফিরেছে? ফিরেই ঠ্যাঙ ভা’ঙলো? নাকি মজা করল? উত্তেজিত হয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়লো ফারহান। ডাক্তার ডাকেনি কারন সে সর্বপ্রথম অয়ন্তির হাসির শব্দ পেয়েছে তারপর চিন্তিত কন্ঠস্বর।

খাঁন ম্যানশনে পৌঁছাতেই ফারহানের নজর গেল ছাদের দিকে। রোজ ঝুঁকে তাকিয়ে আছে। দুজনের নজর স্থির ও নিবদ্ধ হতেই ফারহানের বুকের ভেতর ধক করে ওঠে। রোজ এসেছে? ফিরে এসেছে? রোজ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। গাড়ি থেকে নামছে না কেন লোকটা? রোজ আরও একটু ঝুঁকে তাকাতেই দেখলো ফারহান গাড়ি থেকে নেমে দৌড়াচ্ছে। রোজ হা করে চেয়ে রইল। লোকটা কি ম্যারাথন দৌড়ের প্রতিযোগিতায় নাম লেখাচ্ছে?

ভাবতে ভাবতেই ছাদের দরজা শব্দ করে খুলে ফেললো ফারহান।রোজ পেছনে ঘুরে তাকায়। ফারহান হাঁপাচ্ছে। রোজ মৃদু হাসে।ফারহান এগিয়ে এসে রোজকে জড়িয়ে ধরতে গেলে রোজ পিঁছিয়ে যায়।ফারহানের চোখে জল, এই লোকটা শুধু কাঁদে। ছিঁছকাদুনে একটা। ফারহানের হাত রোজের হাত স্পর্শ করতেই রোজ রুদ্ধকন্ঠে বলে,

-বিয়ে করবো। আজ, এখনই। তারপর ছোঁবে আমাকে। আমি চাই না অনিশ্চিত কারোর ছোঁয়া পেতে। যখন জানবো তুমি শুধু আমার। আমাদের মধ্যে কেউ থাকবে না। তখনই পরিপূর্ণ চাঁদকে পাবে ফালাক। তার আগে না।

-এখন?

-হ্যাঁ। এখনই। কাজি নিচে অপেক্ষা করছে। তুমি বলো দেনমোহর, কাবিন এসবের খরচ এখনই বহন করতে পারবে? নাকি গিয়ে আনবে? ওসব ছাড়া তো একসাথে থাকা যায় না।

-তুই সত্যিই আমাকে বিয়ে করবি চাঁদ?

-করবো না? কি চাও তুমি? এবার তুলিকে ঘাড়ে ঝুলিয়ে দেবো?তোমার আশিকাদের জন্য আমার বাঁচা মুশকিল হয়ে পড়ছে। আমাকে কি মা’রতে চাও তোমরা? বলো!

-মানে? তুলি কে? নামটাই তো প্রথম শুনলাম।

-আমার সহকর্মী। যে তোমার জন্য জান দেওয়ার মতো ফ্যান। সাইমুনের বন্ধু ছিল। তোমাকে অন্ধের মতো ভালোবাসে। মুগ্ধতার কারনে সে ভালোবাসা এক্সপোজ করেনি। বাট আমাকে ঠিকই মহাকাশে পাঠানোর দারুন ব্যবস্থা করেছিলো। বিফল হওয়ার পর আবারও ট্রাই করছে।

-কি বলছিস? এসব তুলি ফুলি তো জীবনেও শুনিনি। মুগ্ধতা বা সাইমুনের মুখেও এর নাম শুনিনি।

-সেদিন লরির কাহিনি তুলি ঘটিয়েছিল। শিওর হওয়ার জন্যই জোর করে আমার সঙ্গে এসেছিলো। মুগ্ধতাকে তুমি মেনে নেবে না কখনও, সেটা জানতো ও।ভেবেছিল আমার পেশা, আমার মত হলে ও তোমার মনে জায়গা করতে পারবে। কারন সাইমুনের বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল সে আর তুমি সাইমুনের চাচাতো ভাই। আজও আমাকে ও নিজের স্কুটি দিয়ে ধাক্কা মে’রেছে।

-আর তুই ছেড়ে দিলি?

-এমনি এমনি ছেড়ে দেবো কেন? কোমরে আরিফিন ও ইরফানের বন্দুক ছিল। দুটো গুলি চাকায় করতেই ও মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়ে হাত পা ভে’ঙে ল্যাঙড়া খোড়া হয়ে গেছে। হসপিটালে পাঠিয়েছি, প্লাস্টার করা হচ্ছে। ব্যাস আমার কোনো দোষ নেই, গুলি পেলে ওদের গুলি পাবে।

-কেমন আছিস চাঁদ? (কোমল কন্ঠে)

ফারহানের এমন প্রশ্নে ভড়কে গেল রোজ। এতক্ষণ ধরে সে কি বলল আর ফারহান কি বলছে? রাগে মাথায় আগুন দপদপ করে জ্বলছে।কোথায় বিয়েটা তাড়াতাড়ি করে নেবে তা না। রোজ বুকের সামনে হাত গুজে যেতে যেতে বলে,

-টাকা পয়সা নিয়ে দ্রুত আসো। আমি শাড়ি পড়তে যাচ্ছি।বিয়েটা আজ রাতেই হবেই। আর রেডিওতে তুমি তুলির সঙ্গে কথা বলেছো কেন? আমার মোটেও ভালো লাগেনি ওটা।তুলি তোমাকে ইনডিরেক্টলি আমায় ছেড়ে দিতে বলল।তুমি কি সেসব ভাবছো?ভেবে থাকলে বলে দাও, আমি ফেলনা না। যে ছেলের অভাব হবে। আমি চাইলেই তুরি মে’রে ছেলে জোগাড় করতে পারি । হুহ! তোমার প্রতি আমার কোনো ইন্টেরেস্ট নেই। বুঝেছো?

রোজ একা একাই কথা বলতে বলতে চলে গেলো। ফারহান তখনও নিশ্চুপ দাড়িয়ে। রোজের শো একটা সিজনাল শো। বছরে দুবার শো’টি চালু হয়। বসন্তে ও শরৎ কালে। রোজ প্রথম শুরু করেছিল বসন্তে তাই তিনমাস পুরো চলেছিল শো। কিন্তু এরপর থেকে দুমাস করে চলতো। অর্থাৎ বছরে চারমাস। গত একবছরে ফারহান চারমাস শো করেই কাটিয়েছে। আজ শেষদিন ছিল বসন্তের শো’টির। আপাতত রেডিওতে সে আর যাবে না। বাবা দীর্ঘদিন ধরে তাঁর ব্যবসার কাজে হাত লাগাতে বলেছেন। রোজ ছিল না বলে ওটাতেও মন বসে নি। কিন্তু বিয়ের পর নতুন জীবন নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে গেলে ব্যাবসা’টা জরুরি। রোজ কি সেজন্যই এতটা চাপ দিচ্ছে? নিশ্চই বাবা ওকে বলেছে। ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল ফারহান। বাবার কথা রাখতে বিয়ে করছে রোজ? ওকে ভালোবেসে, ওর জন্য নয়? এতটা অভিমান মেয়েটার? নয় বছর ধরে শুধু অভিমান করেই কাটিয়ে দিল। ভালোবাসাটা দেখলো না।যাক, যে কারনেই হোক! রোজ রাজি হয়েছে এটাই অনেক।

বিয়েটা সম্পন্ন হতেই রোজ সবার সামনে ফারহানের হাত টেনে ছাদে নিয়ে গেল। সবাই ব্যাপারটা পুরো উপেক্ষা করল। কিন্তু কাজি সাহেব ও মৌলবি সাহেব বিস্মিত চোখে চেয়ে রইলেন। মনে মনে নিশ্চই বলছেন, ‘এ কেমন নির্লজ্জ মেয়ে রে বাবা ‘ আরশান পড়েছে মহা বিপদে। রোজের বাসর ঘর সাজানোর দায়িত্ব পড়েছে ওর আর অয়ন্তির ওপর। কিন্তু অননকে সামলানো কষ্টকর হয়ে উঠেছে। আগে কাঁদতো না বলে সবাই অস্থির হত। আর এখন কেঁদেকেটে বাড়ি মাথায় করে ফেলছে। রজনী রোশনিকে সামলেই পারছে না, অয়ন অভীও আজ প্রচন্ড চঞ্চলতা দেখাচ্ছে। এদের সামলাবে নাকি অননকে নেবে? ফারিয়া আর ফারদিন ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমীর সাহেবও ঘুমাচ্ছেন। নিরুপায় হয়ে অয়ন্তি অননকে নিয়ে ছাদে চলে আসে।

ছাদের দুপ্রান্তে দুজন দাড়িয়ে আছে। রোজ রাগি চোখে তাকানো আর ফারহান ভীত চোখে।অয়ন্তির হাসি পেয়ে যায় এদের বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখে। অয়ন্তি সর্বদা ফারহানকে ক্রোধান্বিত আর রোজকে ঠান্ডা দেখেছে। অথচ আজ ভিন্ন। বিয়ের পর ব্যবহার চক্রটাই ঘুরে গেছে। অয়ন্তি কেঁশে সংকেত দিতেই ওদের চেহারা স্বাভাবিক হলো। অয়ন্তি অননকে এনে রোজের কোলে দিতে দিতে বলে,

-একে রাখো। একঘন্টা পর এসে নিয়ে যাবো।

-ওর ঠান্ডা লেগে যাবে হীরামন। বাতাস হচ্ছে অনেক। দেখছ না?

-কাঁথা দিয়ে চাপা দিয়ে রাখো। তোমাদের ঘর সাজাতে হবে না। ওকে নিয়ে সেসব পারছি না।

-চাপা দিয়ে রাখবো? আর ঘর সাজাতে হবে না। নতুন করে কি সাজাবে?

-বাসর ঘর সাজানো থাকা উচিত। তুমি বুঝবে না। তুমি শুধু অননকে রাখো।

অয়ন্তি চলে যেতেই রোজ হেসে বলে,
-আমার গল্পের একটা বোকা চরিত্র কুসুম। বাচ্চাকে চাপা দিতে বলে কোন বুদ্ধিমান? একে নিয়ে যে আমার দাদাই কি করবে! এটাকে বড় না করে আবার আরেক বাচ্চা নিয়ে আসলো। (অননের দিকে তাকিয়ে) তাই না আব্বু? তোমার আম্মুটা বড্ড সহজ-সরল। না? বলে কিনা তোমাকে চাপা দিতে। তোমাকে কি চাপা দেওয়া যায়?

ফারহানও খুকখুক করে কাঁশলো। রোজ ধাঁরালো কন্ঠে শুধায়,
-কি?

-গলার স্বর নরম কর। এখন তোর হাসবেন্ড আমি।

-তো? তোমার কাছে মাথা বেঁচে বসে নেই আমি। হিসেব করো, আমাকে কত কষ্ট দিয়েছো। সেগুলো উসুল করে নেবো এবার।

-মানে?

-আমাদের বাসর, আগামী একমাসের আগে হবে না। সেপারেট থাকবো আমরা।

-হোয়াট? এটা কেমন কথা?এটা কি ধরনের অস্বাভবিক কৌতুক? চাঁদ। এটা সম্ভব না।

-ওকে ফাইন। একমাস সম্ভব না হলে ছ’মাস। এবার ভেবে দেখো একমাস ভালো নাকি ছ’মাস। যা বলবে তাই হবে।

ফারহান এগিয়ে আসতেই রোজ গম্ভির স্বরে বললো,
-চেপে ধরে চুঁমু খাওয়ার স্বভাব বাদ দাও। নাহলে কিন্তু আমিও আমার রাগের বহিঃপ্রকাশ করবো। এবার গেলে ফিরে আসবো না।

-ব্লাকমেল করছিস? এবার এক পা বাড়ির বাইরে রেখে দেখা। ঠ্যাঙ ভে’ঙে বাড়িতে বসিয়ে রাখবো। (স্বল্পস্বরে)

-কি বললে তুমি? (চেঁচিয়ে)

-কিছু না। অননকে দে। তোর হাতে ব্যাথা না? আরও ব্যাথা লাগবে। (ভীত কন্ঠে)

রোজ অননকে ফারহানের কোলে তুলে দিলো।অননকে কোলে নিয়ে রোজের নামে নালিশ করতে শুরু করে ফারহান। অননের ভাব-ভঙ্গি এমন যে সে তা মনোযোগ দিয়ে শুনছে। মাঝে মাঝে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসছে। রোজ ভ্রু কুঁচকে বলে,

-কি বলছো ওকে?

ফারহান ব্যাঙ্গসুরে বলে,
-তোকে বলা লাগবে? আমাদের পার্সোনাল কথা এসব। তুই দূরে গিয়ে দাড়া। যা!

-একমাসের বাচ্চার সাথে পার্সোনাল কথা? আমাকে ভুগোল বোঝাও? আমি কেমিস্ট্রির স্টুডেন্ট ভুলে যেও না। হ্যাঁ হয়তো অফিসিয়ালি পড়া হয়নি, বাট কেমিস্ট্রি আমার প্রিয় বিষয়। আর কেমিস্টও!

-কেমিস্ট? আমাকে বললি চাঁদ?

-কেমিস্ট হতে যোগ্যতা লাগে তোমার তা নেই।

-ঘরটা সাজানো হোক, কি আছে কি নেই তা তোকে প্রাকটিক্যালে বোঝাবো। অনেক জ্বালিয়েছিস। একবার সুযোগ পেয়েছি, সে সুযোগ এত দ্রুত হাতছাড়া করবো না আমি।

-তুমি আমাকে জোর করতে পারবে না।

ফারহান এগিয়ে আসলো। রোজ দু কদম পিঁছিয়ে যায়। ফারহান রোজের মুখের ওপর খানিকটা ঝুঁকে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

-তোর সঙ্গে আমি সবকিছু করতে পারি চাঁদ। সবকিছু! আর আমি একবার অন হলে, আমাকে অফ করার সুইচ তুই খুজে পাবি না। বাধ্য হয়ে হোক বা স্বেচ্ছায়, তোকেও আমার তালে তাল দিতেই হবে। আজ কোনো ছাড়াছাড়ি নেই।

ফারহানের কন্ঠস্বর রোজের কানে বারি খেলো। ঠোঁট কানের লতি ছুঁয়ে দিতেই রোজ শিউড়ে উঠে জামা চেপে ধরে।ফারহান হেসে সরে যেতেই রোজ ফারহানের হাত টেনে ধরে। ফারহান ভ্রু কুঁচকে তাকায়। এরপর ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করে ‘কি?’। রোজের মুখশ্রীতে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়লো। গরম হয়ে আসছে কান ও গাল। রোজ জোরে শ্বাস নিয়ে বলে,
-আমি
-তুই?

-তোমাকে
-আমাকে?

-আমি তোমাকে ভালোবাসি ফালাক। (একদমে বলে শ্বাস নিল)

-নতুন কিছু বল। এটা জানি আমি। (কৌতুকের স্বরে)
-ওকে ফাইন। (গম্ভির স্বরে)

-আবার রাগ, বুঝিস না কেন চাঁদ! কোলে অনন আর এমন পরিবেশ ভালোবাসা প্রকাশের জন্য উপযুক্ত না। ঘরে ঢুকে তোর ভালোবাসার সঠিক প্রত্যুত্তর দেবো। আর আমি তোকে ভালোবাসি এটা সারা দুনিয়ার মানুষ জানে। তোকে নতুন করে, নতুন ভাবে না বললে মজা পাবি না। সুতরাং সবুর কর, সবুরে ভালোবাসার নতুন অধ্যায় উপহার পাবি।

-আমাকে ‘ তুই ‘ সম্বোধন করা যাবে।

-তুমি ডাকা অসম্ভব, আপাতত। এত বছরের অভ্যাস,,

রোজ চোখ রাঙালো,
-ওকে তুমি ডাকবো। তুমি ঘরে চল তারপর তোমার ভালোবাসা পাবি।

-কি বলছো এসব? তুমি তোমার সম্বোধনের সাথে চল, পাবি?

-প্রনাউন্স দেখ। তুমি তোমার ঠিকঠাক আছে। বাকিসব গোল্লায় যাক।

-তুমি একটা এলিয়েন টাইপ প্রাণী।

-থ্যাংক ইয়্যু।

ফারহান রোজের কাধে হাত রেখে ওকে কাছে টেনে নেয়। রোজও ফারহানের সঙ্গে মিশে দাড়ায়। অনন ঘুমিয়ে গেছে। রোজ আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। একবছর আগে চাঁদের যে অভিমান দেখেছিল সেটা আজ নেই। চাঁদের শুভ্র স্নিগ্ধ কোমল এসে পড়ছে ওদের ওপর। রোজের মনে হলো আজ ফালাকের চাঁদের মত আকাশের চাঁদও তৃপ্ত, সন্তুষ্ট! ফারহানের শার্ট খামচে ধরে রোজ নাক টেনে বলে,

-আমাকে কখনও মিথ্যে বলবে না।

-বলবো না।

-কোনো কিছু লুকাবে না।

-লুকাবো না।

-শুধু আমাকে ভালোবাসবে।

-শুধু তোকে ভালোবাসবো। তোকে ছাড়া ভালোবাসার মত আর আছে কে আমার?

-আমাকে একা ফেলে কোথাও যাবে না।

-যাবো না।

-ঠিক আছে।

-কি ঠিক আছে? শুধু আমি কেন সব শর্ত মানবে? তুই মানবি না?

-কি মানবো? সবই তো মেনে চলি।

-কাঁদবি না আর।

-তুমিও তো কাঁদো।

-তোকে পাওয়ার জন্য কেঁদেছি। কারন তোর মতিগতি ভালো না। আমাকে পাওয়ার জন্য তোকে কাঁদতে হবে না। ফালাক শুধুমাত্র তোর, আর তোরই থাকবে। বুঝেছিস?

রোজ মাথা দুলালো। ফারহান মুচকি হেসে বলে,
-ভালোবাসি তোকে চাঁদ।সবার তুলনায় বেশি! সবথেকে বেশি। আমাকে আর কখনও ছেড়ে যাস না। কোনো ভুল করলে সরাসরি আমাকে বলবি। তবুও ছেড়ে যাবি না। কথা দে আমায়।

-যাবো না। কথা দিচ্ছি!

_____

বিছানার চাদর উল্টে পাল্টে দেখছে অয়ন্তি। বুঝতে পারছে না ঠিক কোন রঙের চাদর বিছাবে। অবশেষে আরশান নীল রঙের একটা ফুলের চিত্রের মিশেলী চাদর এগিয়ে দেয়। আরশান ফুল দিয়ে ঘর ডেকোরেট করছে। মেঝেতে লাভ সেপের মোমবাতি রেখেছে। অয়ন্তি মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে দেখে আরশান হা হুতাশ করে বলে,

-আমাদের বাসরে কি হয়েছিল মনে আছে? তোমার ওই দ’জ্জাল বোনেরা আমাকে আধমরা বানিয়ে দিয়েছিল গিলিয়ে গিলিয়ে।

-বেশ হয়েছে। আপনি যেমন, ওরাও তেমন। ওদের পাওনা টাকা ঘুরিয়েছিলেন বলেই তো ওমন করেছে।

-তাই নাকি? আমি কি জানতাম তোমার বোনেরা সব টাকার কুমির। প্রতি কাজে দশ পনেরো হাজার করে টাকা চাইলে দেওয়া সম্ভব? বিয়ে করতে গিয়েছিলাম নাকি আমার সব টাকা ঢালতে? সামান্য হাত ধুইয়ে দিয়ে পিচ্চি একটা মেয়ে পাঁচ হাজার টাকা চায়। এতো টাকা করবে কি?

-এটা শালিদের হক।

-অতিরিক্ত।

-আমার বোনদের নিয়ে কিছু বলবেন না। খবরদার!

-সে আর বলতে, তোমার অরুপি যে খেলা দেখালো। তোমার সব বোনের নজর খারাপ। পরের জামাইয়ের দিকে নজর দেওয়া স্বভাব। তুমিও ফালাকের দিকে নজর দাও, কি ভেবেছো আমি বুঝিনা?

-বেশ করি! উনি দেখতে সুন্দর তাই নজর দেই। আপনি ওনার মত সুন্দর না তাই আপনার দিকে নজর দেইনা। বুঝেছেন?

-খুব বুঝতে পারছি। এক অননে আটকানো যাবে না।আরও দু একটা লাগবে।

-অসভ্য লোক।

রোজ আর ফারহান সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে ওদের কথা শুনে থম মে’রে দাঁড়াল। পরক্ষণেই হেসে উঠলো দুজন। অনন ঘুমিয়ে পড়েছে এবার ওদেরও ঘুমানোর প্রয়োজন। আরশানের আবার সকালে শো আছে। অয়ন্তির কলেজ আছে। রোজ ঘরে ঢুকে বলল,

-অনেক সাজানো হয়েছে। এবার নিজেদের বাচ্চা নিয়ে ঘরে যাও।

অয়ন্তি সকৌতুকে বলে,
-আজ নেবো না। ওকে বরং রেখেই যাই। কি বলো?

ফালাক কৌতুক বুঝতে পেরে বলল,
-শুধু ওকে রাখবে? তুমিও থেকে যাও। কি দাদাই, তোমার কি মত? চাঁদ তোমার বাচ্চাকে সামলাবে আর আমি তোমার কুসুমকে।

– কি সাংঘাতিক মানুষ। রোজ দেখলে তো, এভাবেই আমাকে সবসময় হ্যারাস করে। তুমি কিছু বলবে না?

রোজ কিছুসময় ভেবে বলে,
-অনন থাকুক। আমরা দুজনেই টায়ার্ড! ঘুমাবো। দাদাই নিজের বউকে নিয়ে যাও। তবে রয়েসয়ে, মাত্রই অনন আসলো। এত দ্রুত আরেকজন আসলে সামলাতে পারবে না।

আরশান লজ্জায় পড়ে যায়। রোজ’রা সবটা শুনে ফেলেছে। অয়ন্তিরও লজ্জায় মরি মরি অবস্থা। অয়ন্তি দ্রুত অননকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে যেতেই আরশান মাথা চুলকে লাজুক হেসে চলে গেল। রোজ নিজের ডায়েরি খুলে লিখল,

“অসমাপ্ত কাহিনিটি পরিশেষে সমাপ্ত হলো। শুধু জাদুর জুটি নয়, আমার জীবনটাও পরিপূর্ণ আজ।”

ফারহান উঁকি দিয়ে ডায়েরি দেখার চেষ্টা করে। রোজ মুখ ভেঙচি দিয়ে বলে,
-এটা আমার পার্সোনাল ডায়েরি।

ফারহান সে কথা পাত্তা না দিয়ে ডায়েরি কেড়ে নিয়ে পড়লো। রোজ গাল ফুলিয়ে বসে আছে চেয়ারে। হাতে কলম, কলমের খাপটা রোজের ঠোঁটের ভাজে। রোজ সেটা টেবিলের ওপর রাখতেই ফারহান আচমকা এসে রোজকে পাঁজকোলা করে তুলে নিয়ে রোজের ঘাড়ে মুখ গুজে ঘ্রাণ নিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলে,

-আর এটা আমার পার্সোনাল ওয়াইফ! একান্তই আমার। শুধুমাত্র আমার। তোকে বলেছিলাম না চাঁদ? #তুই_হবি_শুধু_আমার। দেখ, আজ তুই শুধু আমার। আমি তোকে আর একমুহূর্তও ছেড়ে থাকতে পারবো না। কিছুতেই না। ভালোবাসি চাঁদ, তোকে প্রচন্ড ভালোবাসি আমি।

ফারহানের অঁধরের বিচরণ রোজের সমস্ত মুখে চলতেই রোজও অস্ফুটকন্ঠে বলে,
-আমিও।

সমাপ্ত।

তুই হবি শুধু আমার পর্ব-২৪

0

#তুই হবি শুধু আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_চব্বিশ

‘ অয়ন্তি প্রেগনেন্ট ‘ বাক্যটি খাঁন ম্যানশনে খুশির জোয়ার নিয়ে আসলো। ফারহানের পরিবারও এসেছে অয়ন্তিকে উপহার দিতে ও শুভেচ্ছা জানাতে। অয়ন্তির চোখজোড়া ভিজে আছে। এখনও ওর বিশ্বাস হচ্ছে না ওর পেটে ছোট্ট একটা প্রাণ আছে। ওর ভেতরে কারোর অস্তিত্ব আছে, ওর বেবি আছে। রেডিও সেন্টারে এক বেলার খাবারের ট্রিট দিয়ে আরশান সবেমাত্র বাড়িতে ঢুকেছিলো। এমন সময় ডেলিভেরি বয় এসে একটা নীল রঙা পার্সেল ধরিয় দিলো ওর হাতে। প্রেরকের নামটা পড়তেই আরশানের দৃষ্টি প্রখর হলো ‘রোজ’। রোজ পাঠিয়েছে? তার মানে রোজ বেঁচে আছে। খুশিতে আটখানা হয়ে আরশান বাড়ির ভেতর ঢুকেই রোজের কথা জানালো। ফারহান নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে রইলো। এ সংবাদ নতুন নয়, যদি রোজ নিজে আসতো তাহলে খুশিটা প্রকাশ করা যেত।

অয়ন্তি পার্সেল খুললো। একটা স্বর্নের বর্ডার দেওয়া আয়না ও চামচ। নীলরঙা চিরকুটে লেখা, “স্বর্ণের চামচ মুখে দিয়েই জন্মাবে সে।তাঁর যেন কোনো অযত্ন না হয়। আমার জাদুর জুটির প্রাণ সে। তাঁর খেয়াল রাখবে। দাদাই কাজ কাম বাদ দিয়ে বউয়ের সেবা করবে। তাকে একা রাখবে না। এ সময় মুড সুইং চলে, কখনও বিরক্ত হবে না হীরামনের ওপর। হীরামন যা চাইবে তাকে তাই দেবে। হীরামন, তোমাকে ধন্যবাদ মিষ্টি জান’টাকে আনার জন্য। ”

ফারহান সরুচোখে তাকালো। আরশান হেসে বলল,
-কি হয়েছে?

-রোজের শো, আমি করবো। আর কোনো কাজ নেই আমার। অভিনয়, দল সব তো বাদ দিয়ে দিলাম।

-রিয়েলি? তুই কথা বলতে পারিস? রোজের শো’য়ের তো বারোটা বাজায় দিবি। তুই বরং তোর এগ্রেশন কি করে কমবে তার উপায় খুজে সেটা প্রাকটিস কর।

-জোক্স ছিল?

-হু! কবে থেকে করবি বল? আজ বুধবার। পরশু রাতে আছে।

-পরশু না। দু একদিন অবজার্ভ করবো তারপর। এটায় কিভাবে কথা বলতে হয়, গান চালানো কিছুই তো জানি না।

-আর ইয়্যু শিওর?অভিনয় একেবারে ছাড়ছিস?গতবার তো না, না করে আবার ঢুকলি।

-এবার কনফার্ম।প্রডিউসারের লস হয়েছে। সেই টাকাটা দিয়ে একেবারে বিরতি নিয়েছি এই জগৎ থেকে।

-গুড!

___________

ডিভানে বসে গান শুনছিল রোজ। পাশেই আগুণ জ্বলছে। আরও একটা বছর পার হয়েছে। রোজের মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। জার্নালিজমে এটাই ওর লাস্ট ইয়ার। পড়া শেষ করে সে দেশের বাইরে চলে যাবে। মুগ্ধতা বা ফারহানের খোঁজ সে রাখেনি। এমনকি ফারহান অভিনয় ছেড়েছে কিনা সেটাও জানে না সে। এতদিন সে শুধু নিজের পড়াশোনায় মনোযোগ দিয়েছে। চাঁদের কথাও তাকে প্রভাবিত করেনি। ফারহানের কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু মুগ্ধতার কথা মনে পড়লে সেই প্রবৃত্তি অন্তরেই চাপা পড়ে যায়। মেয়েটা ভালোবেসে ভুল করেনি তাহলে রোজের জন্য সে কেন নিজের ভালোবাসা পাবেনা?

রিমোটটা চিবুকে স্পর্শ করে চ্যানেল পাল্টাচ্ছে রোজ। হঠাৎ ওর চোখে পড়ে একটা নিউজ। মূলত ফারহানের ইন্টারভিউ। যেখানের সারমর্ম হচ্ছে সে আর অভিনয়ের জগতে ফিরবে না। কারন হিসেবে দাঁড় করিয়েছে ইচ্ছে। ওর আর ইচ্ছে নেই অভিনয় করার তাই গত একবছর ধরে সে নতুন কোনো প্রজেক্টে কাজ করেনি। রোজের কপালে ভাঁজ পড়লো। দৃষ্টি প্রখর হলো। অভিনয় ছেড়ে দিয়েছে ফারহান? আর দল? রোজ সিয়ামকে ফোন করল তৎক্ষণাৎ। সিয়াম ফোন রিসিভ করতেই রোজ কোমল কন্ঠে বলে,

-হ্যালো,আনসারী স্পিকিং, মানে রোজ বলছি। তোমার স্যার কোথায়?

-ম্যাম আপনি? কেমন আছেন? কোথায় আছেন?

-পরে বলছি। আগে বলো তোমার স্যার কোথায়? তাকে দাও ফোনটা।

-আজ সোমবার! স্যার তো রেডিও সেন্টারে।

-রেডিওতে কি করে?

-আপনার শো এখন স্যার করছেন।

-হোয়াট?

-জি ম্যাম। ফারদিন আঙ্কেল বারবার করে বলেছিলেন ওনার ব্যবসায় হাত লাগাতে কিন্তু স্যার ব্যবসা বাদ দিয়ে আপনার শো করার কথা ভেবেছেন।

-হোয়াট দ্যা… অভিনয় ছেড়েছে কেন? অভিনয় ছাড়লে কষ্ট পাবে জানো না?

-আমি কি করবো? স্যারই তো করতে চান না।

-কোথায় তুমি?

-বাড়িতে। ফারদিন আঙ্কেলের সামনে। স্যার তাঁর একটা কাজের জন্য ডেকেছিলেন।

-ফোন দাও বাবাকে।

সিয়াম ফারদিন সাহেবে হাতে ফোনটা দিতেই রোজ বলে ওঠে,
-কি হয়েছে? হঠাৎ উনি সব ছেড়ে দিলেন কেন? মুগ্ধতা কেমন আছে? ওকেও দেখছি না কোনো মুভিতে।

-আমার কথা জিজ্ঞেস কর। আমি কেমন আছি আগে শোন। সব ম্যানারস ভুলে গেছিস?

-ওহ! কেমন আছো?

-ভালো। তুই?

-আমি তো ভালোই থাকি। কিন্তু ওখানে কি হচ্ছে সেটা বলবে?আমি ফিল্ম নিয়ে গবেষণা করিনি এতদিন। তার মধ্যেই এতকিছু হয়ে গেলো? মুগ্ধতাও অভিনয় ছেড়ে দিল কেন? প্লিজ বলো বাবা।

-মুগ্ধতা বেঁচে নেই। তোর সঙ্গে শত্রুতা করেছিল বলে ফালাক ওকে মে’রে ফেলেছে। তুই সব ভুল জানতিস মা। ফালাকের সঙ্গে ওর তেমন কিছু হয়নি। মুগ্ধতা সব বানোয়াট কথা রটিয়েছিল। ছেলেটা একদম বদলে গেছে। অভিনয় ছেড়েছে, ওর কালো দুনিয়াও ছেড়েছে। তোর মতই একাকিত্বকে সঙ্গী হিসেবে বেঁছে নিয়েছে। ওর দিকে তাকানো যায় না। খায় না, ঘুমায় না, ছেলেটা আমার শেষ হয়ে যাচ্ছে। ফিরে আয় না, তুই এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আর কতদিনই বা বাঁচবো? ম’রার আগে অন্ততো তোদের একসাথে দেখে ম’রতে চাই। আসবি তুই?

-উনি সব ছেড়েছে?

-বিশ্বাস না হলে, তুই নিজে চেক করে দেখ।

-ছাড়লে আমি ফিরবো বাবা। তোমাদের ছেড়ে আমিও ভালো নেই। তবে কবে ফিরবো সেটা বলতে পারছি না। ভালো থেকো।

_________

অয়ন্তি আর আরশানের ছেলে ‘আরহান খাঁন অনন’। আজ একমাস পূর্ণ হলো ওর বয়স। বাচ্চা হিসেবে কিছু দিক থেকে আলাদা সে। হাসে না, কাঁদে না, সবসময় একটা গম্ভির মুখ করে রাখে। যেন মাত্রই কেঁদে এসেছে বা পেটের গন্ডোগোল হয়েছে। অনেকটা ফারহানের মত স্বভাব। তা নিয়ে সবার হাসিহাসির শেষ নেই। আরশান প্রায়ই অয়ন্তিকে খোঁচায় এটা বলে, ‘আমার বাচ্চা ওর চাচার মত কি করে হল? ‘ অয়ন্তি বরাবরের মতই চটে যায়। ফারহান মাঝে মাঝে আসে, আর অননকে দেখে। রোজ থাকলে ওদেরও হয়তো এমন একটি বেবি থাকত। ফারহান সর্বদা তাকে কোলে কোলে রাখতো। রোজের কাছে একদম দিত না। রাতে সে কেঁদে উঠলে ফারহান নিজে ওর ডাইপার বদলে দিত, ওকে খাইয়ে দিত। রোজকে একদম জ্বালাতো না। কিন্তু রোজ তো সেটুকু করার সুযোগও দিলো না। একা করে দিয়ে চলে গেলো। আগামীকাল শুক্রবার। রোজের জন্মদিনও। সকালে রোজ ফোন দিয়েছিল শোনার পর থেকে সবাই অস্থির হয়ে আছে। ফারহান মনে মনে ঠিক করলো আজ রাতে রেডিওতে সে রোজের কথা বলবে। রোজ নিশ্চই রেডিও শুনবে। এসব ভাবনার মাঝেই অয়ন্তি ডেকে উঠলো,

-ভাইয়া অননকে একটু ধরো না। আমি ছাদে যাচ্ছি। কাপড় তুলতে।

ফারহান অননকে কোলে নিতে চাইলো। কিন্তু বাচ্চাটা এত নরম যে ফারহানের হাত কাঁপছে। যদি পড়ে টরে যায়? অয়ন্তি হেসে বলে,

-তোমার বাচ্চা হলে কি করবে? পড়ে যাওয়ার ভয়ে কোলে নেবে না? নাও, কোলে নাও। ও পড়বে না।

-অনেক নরম অয়ন্তি। আমি ধরতেও পারছি না। তুমি রজনী ভাবির কাছে দিয়ে যাও।

-ভাবি বাড়িতে নেই। অয়নকে নিয়ে স্কুলে গেছে। বুষ্টি পড়ছে আমাকে কাপড় তুলতে যেতে হবে। ওকে একটু নাও না।

-দাদাই কোথায়?

-বাথরুমে। উফ এত কথা বলো না তো। ধরো। আমার ছেলে যেন ব্যাথা না পায়, ওকে বিছানায় শোয়াবে না। কোলেই রাখবা। বুঝেছ?

অননকে ফারহানের কোলে শুইয়ে অয়ন্তি চলে গেলো। ফারহান অননের ছোট্ট ছোট্ট আঙ্গুলের মাঝে নিজের তর্জনি ঢুকিয়ে দিতেই অনন তা শক্ত করে চেপে ধরল। কেঁপে উঠলো ফারহান। এই অনুভূতিটা এত ভালো লাগে কেন ওর? ফারহানের মনে পড়ে রোজও এমন করতো। নিশ্চই ওদের বাচ্চারাও এমন করবে। ফারহান অননকে উঁচু করে ওর কপালে চুঁমু খেলো। বুকের সঙ্গে মিশিয়ে চুপচাপ বসে রইলো।


রাত এগারোটা বেজে পঞ্চাশ মিনিট। রেডিও চালু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে ফারহান। বারোটা বাজতে যখন দুইমিনিট বাকি তখন ফারহান শো চালু করে।

“হ্যালো ডিয়ার লিসেনার! আপনারা শুনছেন ভালোবাসার রং মহল। এবং আমি ফালাক আছি আপনাদের সঙ্গে। কেমন আছেন সবাই? নিশ্চই ভালো। আমিও ভালো আছি। আজ আমি আপনাদের একটা গল্প শোনাতে চাই। গল্পটা কার? কেন শোনাচ্ছি এটা নিশ্চই জানতে চান আপনারা,গল্পটা আমার খুব কাছের একজন মানুষের। যার আজ জন্মদিন। বারোটা বাজতে এখনও ত্রিশ সেকেন্ড বাকি। তাই তাকে উইশ করার পূর্বে তাঁর নাম জানিয়ে দেওয়া উচিত। যে নামে আমি তাকে ডাকি সেই ডাকনামটা হচ্ছে চাঁদ। এক অভিশপ্ত রাজকুমারের ভালোবাসার নাম চাঁদ। এই ভালোবাসার রাজ্যের একমাত্র রাজকন্যার নাম চাঁদ। শুভ জন্মদিন চাঁদ! যেখানেই থাকিস, ভালো থাকিস।

ফার্স্ট কলার ‘চাঁদ? ইন্টারেস্টিং নাম। কিন্তু শেষের কথার অর্থ কি? চাঁদ কি আপনার সঙ্গে নেই? ‘

‘আমার পৃথিবি যতদিন থাকবে চাঁদও ঠিক ততদিনই থাকবে। হয়তো কাছে, নয়তো দূরে। ‘

সেকেন্ড কলার ‘গল্পটা বলুন।’

‘গল্পের শুরুটা অনেক বছর আগের। এক রাজার ঘরে এক ছোট্ট, দুষ্টু, মিষ্টি রাজকন্যার জন্ম হয়েছিল। রাজার মিত্র নতুন অতিথিকে দেখার জন্য তাঁর দরবারে হাজির হয় নিজের রানি ও রাজপুত্রের সঙ্গে। ধীরে ধীরে সেই রাজকন্যা আর রাজপুত্রের বন্ধুত্ব হয়। রাজপুত্র বুঝতে পারে এটা শুধু বন্ধুত্ব নয়, তার থেকেও বেশি কিছু। কিন্তু রাজকন্যা তা বুঝতে পারেনা। রাজকুমারের জেদ ও রাগ অনেক বেশি ছিলো। রাজকন্যাকে নিয়ে অনেক পসেসিভ ছিল। রাজকন্যা যদি কারোর সামনে দাড়িয়ে একটু হেসেও কথা বলতো, সেই রাজকুমার তা সহ্য করতে পারতো না। রাজকন্যাকে শাস্তি দিত, ধমকাতো। অথচ রাজকন্যা রাজকন্যা তা বুঝতো না।রাজকুমারের মায়ের কাছে গিয়ে নালিশ করত। রাজকুমারকে শাস্তি দেওয়াতো। কিন্তু বড় হওয়ার পর রাজকন্যাও বোঝে যে সেও রাজকুমারকে চায়। কিন্তু একটা দূর্ঘটনায় ওদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। রাজকুমার নিজের মাত্রার থেকে অতিরিক্ত রাগ জেদ নিয়ে রাজকন্যাকে ছেড়ে চলে যায়। খারাপ হয়ে যায়, অভিশপ্ত হয়ে যায়। কয়েক বছর পর রাজকন্যার সঙ্গে তাঁর আবার দেখা হয়। সব ভুল বোঝাবুঝি মেটানোর আগেই নতুন করে ঝামেলা সৃষ্টি হলো। রাজকন্যার আগের অভিমানের সঙ্গে নতুন অভিমান যুক্ত হয়ে তা পাহাড়সম গড়ে উঠলো। সেই এক পাহাড় অভিমান নিয়ে রাজকন্যা পুনরায় ছেড়ে চলে যায় এই অভিশপ্ত রাজকুমারকে। রাজকুমার তাঁর রাগ ভা’ঙানোর সুযোগটুকুও পায়না। কারন সে আগে যেসব ভুল করেছিল তাতে রাজকন্যা কষ্ট পেয়ে ওর সঙ্গে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছিল। অবশেষে যখন সেই রাজকন্যা রাজকুমারকে ছেড়ে চলে যায় তখন রাজকুমার বুঝতে পারে জীবনের সবথেকে মূল্যবান জিনিসটাই হারিয়ে গেছে। সেটা হচ্ছে অনুভূতি, আর অনুভূতিটা হচ্ছে ভালোবাসা।সে জানে না রাজকুমারের জীবনে তাঁর ভূমিকা কি? রাজকুমার তাকে কতটা চায়, কতটা ভালোবাসে। তাঁর জন্য এখন রাজকুমার নিজের জীবনটাও দিয়ে দিতে পারে। তাকে একনজর দেখার জন্য সবকিছু করতে পারে।নিজের স্বপ্ন-ইচ্ছে জলাঞ্জলি দিতে পারে। রাজকন্যা রাজকুমারের কোনো খবরই রাখে না। রাখলে জানতো তাঁর ভালোবাসার জন্য সেই রাজকুমার কি কি করতে পারে। কি কি করেছে। কি কি বদলেছে। রাজকুমারের এখন বড্ড একা লাগে। সে শুধু রাজকন্যার শূণ্যতা অনুভব করে। রাজকন্যার অভিমান ভা’ঙানোর সময়টার অভাব বোধ করে। রাজকন্যাকে দেখার তৃষ্ণা রাজকুমারের নয়নের কখনও ফুরাবে না। তাঁর মুচকি হাসি, গাল ফুলিয়ে অভিমান জাহির করা, রাগ হলেই জেদ করে বলা, ‘পা ধরে স্যরি বলতে হবে’, কষ্ট পেলে গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদা। সবকিছুর শূণ্যতা অনুভব করছে রাজকুমার। অপেক্ষা করছে তাঁর ফিরে আসার। রাজকুমার জানে না সে ফিরবে কিনা, কিন্তু সে জীবনের শেষ সময়পর্যন্ত অপেক্ষা করে যাবে।’

থার্ড কলার ‘অনেক ভালোবাসেন তাকে তাইনা? সে নিশ্চই ফিরবে। তাঁর জন্মদিন উপলক্ষ্যে তাকে বিশেষ কোনো সার্প্রাইজ দিন। মেয়েরা উপহার পেলে খুশি হয়।’

‘তাঁর ঠিকানা জানা নেই আমার। তবে আমার গলার গান তাঁর বড্ড প্রিয়। সে সবসময় বলত অভিনেতা ফারহান মাহতাব থেকে বেরিয়ে যেদিন সাধারণ এক ফালাক হয়ে আসবে আমি সেদিন ফিরবো। ‘

ফোর্থ কলার, ‘আপনি ফারহান মাহতাব? ফারহান মাহতাব ফালাক? সুপারস্টার ফারহান? আই কান্ট বিলিভ ইট। আপনি আপনার ক্যারিয়ার বাদ দিয়ে এই রেডিও শো হোস্ট করছেন?’

‘হুম। চাঁদের ইচ্ছে ছিল এটা।’

ফিফ্থ কলার, ‘মেয়েটা নিঃসন্দেহে ভাগ্যবতী যে সে আপনার মত একজনের ভালোবাসা পেয়েছে। তবুও সে চলে গেল কেন? তাঁর আসল পরিচয় কি? কি করে সে?’

‘সে আরজে। ‘

‘আর’জে? সামান্য একটা আর’জের জন্য নিজের সমগ্র ক্যারিয়ার বাদ দিলেন? এটা বোকামি। যে ছেড়ে যায় তাকে ভুলে যাওয়া উচিত। আমাদের পুরাতন আর’জে রোজ বলতো এটা। যে পাখি ভালোবাসে সে নীড়ে ঠিক ফিরে আসে। আর যে বাসে না সে ঠিক মুক্ত আকাশ খুজে চলে যায়। আজ রোজ থাকলে সে এটাই বলতো। ‘

‘আপনাদের রোজ যথার্থই বলে। কিন্তু তাঁর মত একজন খুজে পাওয়া দূর্লভ। এজন্যই তাকে পাওয়ার জন্য এই কষ্টটুকু সহ্য করা যায়। পৃথিবিতে কোনো জিনিসই সহজে পাওয়া যায়না। সেখানে ভালোবাসার মত এক জটিল অনুভূতির মানুষ সহজে পাওয়া যাবে? ‘

‘সে আপনাকে ভালোবাসে?’

‘হ্যাঁ।

‘তাহলে চলে গেল কেন? কি নাম তাঁর? নাম বলতে কি অনেক সমস্যা? তাঁর কি বিয়ে হয়ে গেছে? তাই তাঁর নাম নিচ্ছেন না।’

সিক্সথ কলার, ‘তাঁর নাম কি? সে কেন চলে গেছে? ‘

‘তাঁর নাম সাইরাহ্ আনসারী রোজা ওরফে রোজ। যে ভালোবাসার রংমহলের আর’জে। আর সে অভিমানের কারনে আমাকে ছেড়ে গেছে। ফিরবে বলেছে। কিন্তু যখন আমি বদলে যাবো। আজ হয়তো রোজও শুনছে শো’টা। তাই বলছি।তুই ঠিক যে যে পরিবর্তন চেয়েছিলি সবটা করেছি চাঁদ। যেমন ফালাককে চেয়েছিলি তেমন ফালাক হয়েছি। আমার গান তোর প্রিয় ছিল তাই আজ তোর বার্থডে গিফট হিসেবে গানটাই দিলাম। তোকে বিশেষ কিছু দেওয়ার মত সামর্থ্য আজ সত্যিই আমার নেই। হয়তো তুই নেই বলে মনে হয় আমার কিছু নেই, আমার আমিত্ব নেই, কোনো অনুভূতি নেই, কোনো ভালোলাগা নেই। শুধু এটুকুই বলবো। ফিরে আয়, সব কিছু ছেড়ে শুধু আমার হতে আয়। রাগ, জেদ, অভিমান ভুলে আমার হয়ে যা প্লিজ! শুধু আমার।

♪♪♪♪♪তুই ছাড়া লাগে, শূন্য এ জীবন।
আমার বেঁচে থাকার, শুধু তুই কারণ।
কত চাইলে তোকে বল,
ফিরে আসবি তুই আবার।
কত বাসলে ভালো বল,
#তুই_হবি_শুধু_আমার।

অভিমান যত আছে,
করে নিস ভালোবাসা।
দূরত্ব সব’ই ভুলে,
শুরু হোক কাছে আসা।

তুই বিহীন ভালো নেই,
প্রহরগুলো লাগে একা।
এ মনে তোর তরে,
কত প্রেম আছে যে রাখা।

কত চাইলে তোকে বল,
ফিরে আসবি তুই আবার।
কত বাসলে ভালো বল,
#তুই_হবি_শুধু_আমার♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪

নিজের গলায় গানটুকু গেয়ে থামল ফারহান। চোখজোড়া ভিজে উঠলো। ঠিক তখনই ফোন বেজে ওঠে। আননোন নাম্বারের কল। প্রায় দশবার কল দিয়েছে। মিসড কল নোটিফিকেশন জ্বলছে। কে এত বার ফোন দিয়েছে? তাও এত রাতে?

চলবে?

তুই হবি শুধু আমার পর্ব-২৩

0

#তুই হবি শুধু আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_তেইশ

-সি ইজ নো মোর আমীর খাঁন। ওর লা’শটা পাওয়া যায়নি, তবে ওর জামা কাপড় জিনিসপত্র পাওয়া গেছে। চাইলে অফিসে এসে সেগুলো দেখে নিশ্চিত হয়ে যেতে পারেন।

আরিফিনের ফোনটা রেখে আমীর সাহেব বিছানার ওপর বসে পড়লেন। সমগ্র শরীর কাঁপছে। চোখের বাঁধ ভে’ঙে গেছে। রোজ আর নেই, বাক্যটা কল্পনা করতেই তো জান যায় যায় অবস্থা হয়ে যায় সকলের। সেখানে এটা সত্য মানতে কেমন লাগবে? আমীর সাহেবের সামনে সবাই রোজের সংবাদ শোনার জন্য প্রবল আগ্রহ নিয়ে দাড়িয়ে আছে। আমীর সবার দিকে তাকিয়ে বললেন,

-রোজ নেই।

সবাই সচকিত দৃষ্টিতে ফারহানের দিকে তাকালো। চোখ মুখ শুকিয়ে যাওয়া ছেলেটা নির্নিমেষে আমীরের দিকে চেয়ে আছে। অনিশ্চয়তার ছাঁপ চেহারায়, অবিশ্বাসী দৃষ্টি। সবার চোখে পানি সেখানে ফারহানের চোখ শুষ্ক। আরসালান এগিয়ে এসে ফারহানের কাঁধে হাত রেখে বলে,

-পাথরের মত দাড়িয়ে থাকিস না। কেঁদে নে। মন হালকা হবে।

ফারহান ফিচেল হেসে জবাব দেয়।
-তোমাদের মনে হয় চাঁদ মা’রা গেছে? ও নিজেকে দূরে রাখছে আমাকে শাস্তি দিতে। আমি জানি ওর কিছু হয় নি।হতে পারে না। কারন আনসারীর মেয়ে প্লান বি রেডি রেখেই কাজ করে। ও নিশ্চই অন্য কোনো কারনে এই মৃ’ত্যুর সংবাদ ছড়িয়েছে। ও ফিরে আসবে দাদাভাই। আমি জানি, ও ফিরবে। আমাকে কষ্ট দিতে চায় তো। পাচ্ছি আমি কষ্ট। দেখি আর কত কষ্ট দেখতে চায় ও। আমিও দেখতে চাই আরও কত ভালোবাসলে ও শুধু আমার হবে। ওর জীবনের সকল বেদনাদায়ক অনুভূতি ও ত্যাগ করবে।

আমীর সাহেব ইশারায় সবাইকে বললেন, ফারহানকে ওর অবস্থাতেই ছেড়ে দিতে। মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে সে। বাস্তবতা ও কল্পনার এক ঈন্দ্রজাল বুনে রেখেছে সে। যেটা ভা’ঙতে সময় লাগবে। আপাতত তা ভা’ঙার প্রয়োজন নেই। রাতারাতি, অভিনয়, দল বাদ দেওয়ার পর রোজের এমন খবর ও মেনে নিতে পারছে না। সবাই আমীর সাহেবের সঙ্গে সহমত পোষণ করল।

_______

বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে আছে অয়ন্তি ও আরশান। জেগে আছে দুজনেই, কিন্তু কারোর মুখে কোনো শব্দ নেই। আরশানের ফুঁপিয়ে কাঁদার শব্দ কানে আসতেই অয়ন্তি উঠে বসলো। সারাদিন কাঁদেনি ছেলেটা তাহলে এখন কাঁদছে কেন? অয়ন্তি লাইট জ্বালিয়ে আরশানের কাছে আসলো। আরশান চোখ বুজে আছে। অয়ন্তি ওর মাথায় হাত রাখতেই আরশান অয়ন্তির হাতে হাত রেখে শক্ত করে চেপে ধরে বলে,

-জানো কুসুম। রোজ কখনও রাগ করে না। ও তো রাগ করতেই জানে না। ওর রাগের অর্থ অভিমান। ফালাক আর আমার ওপরই ওর বেশি অভিমান হয়। কারন ও আমাকে দাদাভাইয়ের থেকেও বেশি আপন ভাবে। ও ভাবে ওর ভাইয়া থাকলে সে হুবহু আমার মত হতো। আর ফালাককে তো ভালোবাসে। সেই ভালোবাসার মানুষ আর ভাইয়ের কাছ থেকে কষ্ট পেয়ে ও আর ফিরে আসবে?

-শান্ত হন। এত কাঁদলে শরীর খারাপ করবে তো।

-ও আর ফিরবে না কুসুম। বেঁচে থাকলেও না। ফালাকই একমাত্র ওকে ফেরাতে পারতো কিন্তু ফালাক তো চায় না বেবিকে জোর করতে।

-জোর করে কাউকে পাওয়া যায়না। ফালাক ভাইয়া এটা জানে।আর রোজকে বন্দি করে রাখা তো অসম্ভব। আপনি চিন্তা করবেন না ওদের মান-অভিমান ঠিক মিটে যাবে। রোজ বেঁচে থাকলো নিশ্চই ফিরবে।

-বেঁচে থাকলে না, বেঁচে আছে। আনসারীর মেয়ে এতো সহজে মরবে না। ঘটনা যা শুনলাম, পানিতে ও পড়েনি। নিজেই ঝাঁপ দিয়েছে। এর কারন কি? কি হতে পারে?

-তার মানে ফালাক ভাইয়া আর আপনি নিশ্চিত রোজ বেঁচে আছে?

-হুম। কিন্তু ওর অভিমান বড্ড খারাপ। একটি সর্বনাশা অনুভূতি। ওর অভিমান হলে ও সবার থেকে দূরে চলে যায়। কারোর সঙ্গে যোগাযোগ করে না। তুমি এতদিনে এটুকু বোধ হয় জেনেছো।

-হুম।

-ঘুমাও। তোমার শরীর ভালো নেই। কাল ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবো তোমাকে। তোমার মাথা ঘুরছে কেন সেটা পরীক্ষা করতে হবে। আচ্ছা তোমার পিরিয়ড হচ্ছে তো?

অয়ন্তি এবার লজ্জায় নুইয়ে গেল। এটা কেমন প্রশ্ন? হুট করে এমন প্রশ্ন করলে উত্তর দেওয়া যায়? আরশান ভ্রু কুঁচকে আবারও প্রশ্ন করে,

-লজ্জা পাচ্ছো কেন? দুই বছর হয়ে গেল বিয়ের। এখন তো স্বাভাবিক হও। তোমারই স্বামী আমি, পরপুরুষ না। আর এটা স্বাভাবিক একটা প্রশ্ন, এত লজ্জা পাওয়ার কি আছে? হচ্ছে নাকি হচ্ছে না?

-হচ্ছে না।

-কতদিন?

-মাসখানেক হলো।

আরশানের কপালের ভাঁজ দৃঢ় হলো। ঠোঁট কামড়ে সে হেসে ওঠে। অয়ন্তি চোখ-মুখ খিচে তাকায়। কাঁদার মাঝে আবার হাসে কেন লোকটা? অধিক শোকে পাগল হয়ে গেল নাকি? আরশান চোখের পানি মুছে বলল,

-ঘুমাও। কাল সকালে যাবো হসপিটালে।

-হাসছেন কেন?

-তুমি বুঝবে না। এখনও তেমন পাঁকোনি তুমি। তা বুঝে হাসছি। গুড নাইট কুসুম।

-আমি পাঁকিনি?

-পাঁকলে মানে বুঝতে। বুঝেছো মানে?

-না তো।

-ঘুমাও। চিন্তা বাদ দাও।

অয়ন্তি শুয়ে পড়লো। আরশান লাইট অফ করে এসে অয়ন্তির কোমর পেঁচিয়ে ওর কাঁধে মুখ গুজে শুয়ে পড়ে। বাড়ির নতুন অতিথির আগমনে নিশ্চই পুরাতন প্রিয় মানুষটা ফিরবে। এই সুখ থেকে নিজেকে সে বঞ্চিত করবে না।

___________

আরিফিন রোজের বাবার ডায়েরিটার কপি নেড়েচেড়ে দেখছে।কোড টা বোঝাই যাচ্ছে না। কিভাবে সেটা নিয়ে এ্যাকাউন্টের টাকাগুলো তুলবে? রোজ কেমন জানি প্রহেলিকা ছেড়ে গেছে। আরিফিনের রাগ হচ্ছে। টাকাটা না পাওয়া অবধি শান্তি পাচ্ছে না। এখানে শুধু টাকার কথা, ব্যাংকের কথা, পেনড্রাইভ আর বিশ্বাসঘা’ত’কের কথাই বলা আছে। কিন্তু পিন কোড? আরিফিন কাগজ মুচড়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিলো।

রোজের লা’শটা পাওয়া যায়নি কেন? ইরফানের মৃ’ত্যুর সঙ্গে ওর কাহিনিও তো শেষ হওয়ার কথা ছিল। তাহলে নতুন কোন খেলা শুরু হলো?আরিফিন নিজের কেবিনে বসে কফি পান করছে। এমন সময় ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেল। আরিফিন খেয়াল করলো চারিদিকে পিনপতন নিরবতা। নিরব থাকারই কথা, কারন ইউনিটের অর্ধেক বিশ্বাসঘা’ত’ক গতকাল মা’রা গেছে। আর এখন রাত তিনটে বাজে বলে সবাই চলে গেছে। আরিফিন এখানে ছিল শুধুমাত্র টাকা তোলার কোডটা বের করার জন্য।

থাই গ্লাসের সামনের গ্রিল ভেদ করে শো শো করে বায়ু প্রবাহিত হচ্ছে। আরিফিন কফিমগ তুলে সেখানে গিয়ে দাড়ায়। শীতল শুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নিয়ে সে কফিকাপে আবারও চুঁমুক দিলো। মনে মনে নিজেকে বাহবাও জানায় নিজের চতুর মস্তিষ্কের জন্য। এতদিন ভালো মানুষ সেজে থাকার কি দারুন অভিনয়টাই না সে চালিয়ে গেছে। রোজ টেরও পায়নি। ওর পিঠের গুলিটা ইরফান নয় ও করেছিলো। ভাবতেই আরিফিনের ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে। ডুবুরি পাঠানোর পরিকল্পনা সে এমনি এমনি করেনি। আর্মিরা চলে আসায় ওটা করতে বাধ্য হয়েছিল। অথচ সেখানেও সব কৃতিত্ব সেই পেলো। সব পরিকল্পনা ও সাহসিকতার কৃতিত্ব শুধু আরিফিনের।

আরিফিনের চোখ হঠাৎ গ্রিলের ওপর পাশে নিচের দেওয়ালের ওপর যায়। কেউ দেওয়াল টপকে ভেতরে আসছে। কে? চোর? আরিফিন নিজের বন্দুক খুজতে থাকে। কিন্তু অন্ধকারে পায়না। সে দ্রুত ডাস্টবিন থেকে কাগজগুলো কুড়িয়ে নিলো। এগুলোর জন্য আসেনি তো চোর? সব দিলেও এই একশ কোটি টাকার খোজ সে কাউকে দেবে না। কাউকে না।

আরিফিন কাগজগুলো পকেটে গুজতেই ওর কেবিনের দরজা খুলে যায়। ভেতরে প্রবেশ করে একটা অবয়ব। আরিফিন কঠিন গলায় বলে,

-কে তুমি? কি চাও?

অবয়বটি জবাব দিল না। কফি মেকার থেকে কফি বানিয়ে আয়েশ করে চেয়ার টেনে বসে, চুঁমুক দিয়ে সরু চোখে আরিফিনের দিকে তাকালো। পকেটে হাত শক্ত করে চেপে দাড়িয়ে আছে সে। চৈতালি পূর্নিমার বড় রুপোর চাঁদের আলোয় সবটা আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। অবয়বটি কফি পান করে কাপটা নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল। যাওয়ার পথে সেটা কোনো ড্রেনে ফেলতে হবে। ও যে এখানে এসেছিল তার প্রমাণ রাখা যাবেনা।

-কে তুমি?

অবয়বটি এবার শব্দ করে হাসে। সেই হাসির ঝংকার শুনে আরিফিনের পা টলে উঠলো। কোনোরকমে সে চেয়ার ধরে বসে পড়লো। আরিফিন অস্পষ্ট স্বরে বলে,

-রোজ। তুমি?

রোজ হাসি থামিয়ে গম্ভির কন্ঠে বলে,
-বাবাকে বলতে শুনেছিলাম, ‘ টাকা দেখলে কাঠের পুতুলও হা করে। ‘ বাস্তবে বাক্যটির উপযুক্ত দর্শন করানোর জন্য ধন্যবাদ আরিফিন সাহেব। আপনাকে বিশ্বাস করে নিজের জীবন দিতে যাচ্ছিলাম। আর সেই আপনিই কিনা আমাকে উপরে পাঠাতে চাচ্ছিলেন? এটি কি ঠিক করেছেন?

-তুমি আমার কথা শোনো। আমি ওসব..

-আর একটা কথা বললে, গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেবো আপনার হৃদপিন্ড। আপনার চৌদ্দগুষ্টির কথা এবার, একবারও ভাববো না। কারন আমাকে ধোকা দেওয়ার শাস্তি শুধু মৃ’ত্যু।

আরিফিন চুপ হয়ে যেতেই রোজ বলতে শুরু করে,
-সেদিন কেন আপনার এ্যাকাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করি নি জানেন? কারন আপনাকে হাতে রাখতে চেয়েছিলাম আমি। আপনাকে হাতে না রাখলে এদের ধরা যেত না। পাশাপাশি টাকা এমন একটা বস্তু যা লোভের সৃষ্টি করে। কথায় বলে, লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। আপনি লোভ করেছেন, পাপ করেছেন এবার মৃ’ত্যুর স্বাদটাও গ্রহণ করবেন। তার আগে ব্যাংকের কোডটা জেনে নিন। আমার বাবা কাঁচা খেলোয়ার ছিলেন না। তিনি সব জানতেন, তিনি যদি সবটা তখনই ফাঁস করতেন তাহলে আমার আর মামনির জীবন ঝুঁকিতে পড়তো বলে নিজে মৃ’ত্যুকে বরণ করেছিলেন। তিনি ভালো মানুষ ছিলেন। ভালোবাসার মত মানুষ ছিলেন। আমি ওতটাও ভালো নই বলেই হয়তো একে একে বাবার সব বিশ্বাসঘা’ত’ককে মা’রতে পেরেছি। এবার আসি পিনে! বাবার লিখে গেছে, ‘বিশ্বাসে বিষ’ এটা পিনকোড ছিল। তবে এর অর্থ কি জানেন? মূল যে বিশ্বাসঘা’ত’ক তাঁর নাম। অর্থাৎ ব্যাংকের পিনকোড হচ্ছে আরিফিন আদ্র। আপনার কৌতুহল মিটেছে?

-তাহলে আমি ছাড়া তোমার ব্যাংকের কাজ?

-ওটা?ওটা হয়ে যাবে।বাবার টাকা নিজের করতে বেশি সময় লাগবে না আমার। এতোদিনের সব গেমপ্লান তো শুধু আপনার জন্য ছিল। আমার বা হাতে আ’ঘাত লাগার পর সেখানে যে ব্যান্ডেজটা করা হয়েছিল, সেই চামড়ার ভেতরে আপনি মাইক্রোফোন রেখেছিলেন। এজন্যই তো আপনাকে শুনিয়ে শুনিয়ে এত কাহিনি করতে হলো।

-তুমি জানতে সব?

-প্রথম দিকে জানতাম না। পরে হাতে ব্যাথা পাচ্ছিলাম বলে নিজেই চামড়া কে’টে ফেলেছিলাম। জানেনই তো আমার কা’টাছেড়া করতে ভালো লাগে। (বিদ্রুপ হেসে)

-এখন কি চাও?

-সংশোধন। নিজের ভুলের। শেষ বিশ্বাসঘা’ত’ককে বাঁচিয়ে রেখে যে ভুলটা করেছি তার সংশোধন করতে এসেছি। গুড বাই আরিফিন সাহেব।

বলে আরিফিনের বন্দুক দিয়েই আরিফিনের কান বরাবর শ্যুট করলো। হাতে গ্লাভস পড়া ছিল যার দরুন রোজের হাতের ছাঁপ বন্দুকে পড়েনি। আরিফিন সাহেব মা’রা গেলে রোজ বন্দুকটা ওনার হাতে সুন্দর করে সাজিয়ে দেয়। এরপর আরিফিনের হাতের লেখা নকল করে একটা কিউট সুইসাইড নোট লিখে সেটা চাপা দিল ওনার কেসের ফাইলের ওপর। সেটা সবার আগে মানুষের নজরে পড়ে।

শেষ অপরাধির মৃ’ত্যুর শেষে সে বেরিয়ে আসলো এই ইউনিট থেকে। বিক্ষিপ্ত মন শান্তির খোঁজে বের হয়। রোজের বরাবরই শান্ত নিরব রাত প্রিয়। ওর ইচ্ছে ছিল প্রতিরাতে ফারহানের সঙ্গে সে হাটতে বের হবে, ঘুরবে, আইসক্রিম খাবে। এখন যেহেতু ফারহান নেই তাই সে নিজের ইচ্ছেগুলো নিজেই পূরণ করবে।

যেতে যেতে রোজ আকাশের দিকে তাকায়। মেঘে ঢাকা নিষ্প্রভ চাঁদটাকে দেখে ওর মনে হলো এই চাঁদের মনেও হাজার অভিযোগ, অভিমান জমা আছে। রোজ চাঁদকে প্রশ্ন করে,

-কি হয়েছে তোমার?

চাঁদের রাগান্বিত জবাব, ‘কিছু না।’

-না বললে তো জানতে পারবো না। যদি বলতে না চাও তাহলে শুনবো না।

-তা কেন শুনবে? তুমি তো কারোর কথাই শোনো না।

-হতে পারে। কিন্তু কেউ কি আমার কথা শোনে?

-শোনে কিনা জানো না?

-জানতে গেলে, তাকেও যে জানাতে হবে। সে যদি ঠিক করে আমায় জানাতে না পারে আমি কি করে জানবো?

-মানুষটা তোমাকে ভালোবাসে। আমার সঙ্গে কতবার তোমার তুলনা করেছে। আমার সামনে তুমি নিতান্তই তুচ্ছ এক মানবী। আমার সৌন্দর্যের সামনে তুমি ক্ষুদ্র। অথচ সে আমার সৌন্দর্যকে অবহেলা করে তোমাতে মুগ্ধ হয়েছে। কতবার এই চাঁদ অপমানিত হয়েছে তোমার তাঁর চাঁদের সামনে।

-আমি ফিরে গেলে মুগ্ধতার কি হবে? ভালোবাসায় সব জায়েজ! আমার মতে ও ভুল করেনি। ফালাকেরই উচিত ছিল সাবধান থাকা, সতর্ক থাকার। সে বিয়েতে সায় দেওয়ামাত্র তাঁর জীবন থেকে রোজ নামক চাঁদ নির্বাসিত হয়েছে।

-কেউ যদি সন্তান নিয়ে মিথ্যে কথা বলে কাউকে জোর করে তখন তার কি করার থাকে? তোমার ফালাক অসহায় হয়ে বিয়েতে মত দিয়েছিল। তুমি ফিরে যাও ওর কাছে।

-যে তোমাকে অপমানিত করেছে, অবহেলা করেছে তাঁর হয়ে সাফাই গাইছো কেন? আত্মসম্মানবোধ নেই তোমার?

চাঁদের পাশে কয়েকটা তারা মিটিমিটি জ্বলে উঠলো। রোজের মনে হলো ওরাও রোজকে দেখে হাসছে। রাস্তার পাশেই বসে ছিল রোজ। আগে থেকেই যে ও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পড়ে ছিল তা কেউ টের পায়নি। এই নাটকের উদ্দেশ্য ছিল সবার সামনে নিজেকে মৃ’ত প্রমাণ করা যেন ফারহান মুগ্ধতাকে বিয়ে করে নেয়। আর আরিফিনের ম’রার সম্পূর্ণ দোষ গিয়ে বর্তায় আরিফিনেরই উপর। নাহলে নতুন করে প্রতিশোধের অনল জ্বলে উঠতো। রোজ আবারও চাঁদের দিকে তাকালে চাঁদ জবাব দেয়।

-সে তোমাকে ভালোবাসে।তাঁর ভালোবাসার কাছে দুটো মিথ্যে কথা স্বীকার্য নয়।

-তাঁর পেশা?

-যদি ছেড়ে দেয়?

-তার কালো জগৎ?

-সেটাও যদি ছেড়ে দেয়?

-আমার মত সাধারণ জীবন?

-যদি সেও তোমার মত সাধারণ জীবন অতিবাহিত করে? তোমাকে নিয়ে থাকে? তোমার সকল অনুভূতির সম্মান দেয়? তোমাকে আর মিথ্যা না বলে, তোমাকে আর দূরে ঠেলে না দেয়? তোমার থেকে কিছু না লুকায় তাহলে?

-ফিরে যাবো।

চলবে?

তুই হবি শুধু আমার পর্ব-২২

0

#তুই হবি শুধু আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_বাইশ

💙ফালাক💙
আমি ভাবতাম পৃথিবিতে তিনজন আমাকে সব থেকে বেশি ভালোবাসে।তারা হচ্ছে, বাবা মামনি আর তুমি। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। জানো তুমি প্রথমে দাদাই আর আমাকে নিয়ে যেটা করেছিল সেটা ভুলে গিয়েছিলাম। কারন তোমাকে ভালোবাসি আমি। তুমি আমায় ততটাই ভালোবাসো ভেবেছিলাম। কিন্তু আমাকে ভালোবাসলে মুগ্ধতার কাছে কেন গিয়েছিলে?আমি জানি তুমি ওকে ছুঁতে চাওনি, ওর কাছে যেতে চাওনি। ও নিজেই ধরা দিয়েছিল। রাগের বশে হয়তো তাঁর সঙ্গে চুঁম্বনে লিপ্ত হয়েছো। কিন্তু তখন একবারও কি ভেবেছো আমার কথা? তোমার কাছে নিজের জেদ, রাগ অভিমানটাই বড় ছিল। কেন?

আমি কখনও চাইনি তুমি অভিনয় করো। কারন, ওখানে বিভিন্ন নারী থাকবে যাদের তুমি অনিচ্ছাকৃত ভাবে হলেও ছোঁবে। আমি চাইনি আমার প্রিয় মানুষটা আমাকে ছাড়া অন্যকারোর সঙ্গে থাকুক। তবুও সবটা সহ্য করেছি। এই আড়াই বছর তোমাকে সুযোগ দিয়েছি আমায় সত্যগুলো বলার। তুমি বলোনি। বলতে চাওনি। মুগ্ধতা তোমার চাচার মেয়ে, তোমার কাজের সঙ্গী! তোমাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু সেটা বিয়ে অবধি গড়াবে? বিয়ের দিন একটা মেয়েকে প্রত্যাখ্যান করা কতটা ভয়ঙ্কর জানো? মেয়েটা বধুর সাঁজে অপেক্ষা করছিল তোমার জন্য আর তুমি ওকে ছেড়ে দিলে? ভুল ওর বাবা করেছে ও করেনি। ভুল তুমি করেছো, মুগ্ধতা করেনি। আমি সর্বদা সত্যের পথে থেকেছি। আজও থাকবো। তোমার কাজ আমি সমর্থন করিনা, এটা বলতে আমার গলা কিংবা লিখতে হাত কোনোটাই কাঁপবে না।

আমি তোমার জেদের কারণ? রাগের কারণ? সেদিন বিকেলে তুমি বলেছিলে আমার জন্য তুমি খারাপ হবে। প্রচন্ড খারাপ হবে। এটা তার নমুনা ছিল? পাতালের সদর দরজা খুলে তাতে প্রবেশ করার সময় আমার কথা মনে পড়েনি? এখন কেন মনে পড়ছে? ভালোবাসা কিন্তু সময়, দিন কাল ক্ষণ মেনে চলে না। রাগের বশে নিয়ন্ত্রণ হারায় না। আমার বাবাদের কথা তুমি জানতে অথচ আমাকে জানালে না। যদি আমাকে নিয়ে তোমার একটুও চিন্তা থাকতো, আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা থাকতো তাহলে আমার থেকে কথা লুকাতে না। তোমার কাছে ভালোবাসার সংজ্ঞা কি? আমার পেছনে লোক লাগিয়েছো,আমাকে নজরবন্দি করেছো। কেন? বিশ্বাস করোনি আমাকে তাইনা? পালিয়ে গিয়েছিলাম, এবং আমি বলেছিলাম আমাকে চাওয়ার মানুষের অভাব নেই তাই?

ভালোবাসা এটাকে বলে না,ভালোবাসায় পাওয়ার ইচ্ছে আকাঙ্ক্ষা থাকে না। শুধু ভালোবাসার মানুষটির সুখ, শান্তিটাই স্পৃহা হয়, অভিলাষ হয়। অঁধরচুঁম্বন তো সবাই করতে চায় কিন্তু সেই অঁধরে হাসি ফুটিয়ে রাখতে ও ধরে রাখতে চায় ক’জন? তুমি বলেছিলে বিছানায় তো অনেকে আসতে পারে, মনে ক’জন আসতে পারে? ইয়্যু নো হোয়াট! মনে কেউ থাকলে বিছানায় অন্যকারোর আসার কোনো সম্ভবনাই নেই। সেখানে মুগ্ধতা তোমার বিছানায় শুয়েছে, তোমাকে ছুঁয়েছে! মানছি তোমাকে সে বেহুশ করে ফায়দা লুটতে চেয়েছে, তোমার এখানে কোনো দোষ নেই, তুমি জানতে না এসব, কিন্তু নিজের ওপর কি তোমার একটুও ভরসা নেই? তোমাকে আমি তোমার চাইতেও বেশি বিশ্বাস করি, এর প্রমাণ কি চাও তুমি? তাহলে শুনে রাখো, পৃথিবির সবাই, যখন তোমার বাবাও তোমাকে অবিশ্বাস করেছিল। ভেবেছিল তুমি সত্যিই মুগ্ধতার সঙ্গে থেকেছো, তখন আমি এটা বিশ্বাস করিনি। কারন আমি জানি আমার ফালাক ভাইয়া এটা করতেই পারেনা। কিন্তু তুমি নিজে যখন অনিশ্চিত হয়ে বিয়েতে সায় দিলে তখন আমার কেমন লেগেছিল? ভাবতে পারবে? পারবে না!

অভিনয় তোমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো আমার থেকেও বেশি! কারন অভিনয় তোমার জীবনে আগে এসেছে। আমি তো আরও দশ-বারো বছর পর এসেছি। তাই আমি চাইনি আমার আগে যা, যে তোমার জীবনে এসেছে তাকে ভুলে তুমি আমাকে নিয়ে থাকো।কারন যদি এমন হত তাহলে এটা হওয়ার সম্ভাবনাও কম নয় যে আমার পরে তোমার জীবনে আরও কিছু আসতে পারে। তখন তুমি আমাকে ভুলে সেটা গ্রহণ করবে। মানুষ পরিবর্তনশীল। তাই আমি সর্বদা ভেবেছি, চেয়েছি তুমি পরিবর্তন হবে। সবকিছু ছেড়ে আমাকে নিয়ে থাকবে। কিন্তু আরও একটা চলিত কথা আছে, সেটা হচ্ছে ‘মানুষ অভ্যাসের দাস’ তোমার অভ্যাস এত সহজে পাল্টাবে না। আমি অপেক্ষা করেছি, সহ্য করেছি, ধৈর্য ধরেছি। তোমার মুখ থেকে তোমার জীবনের ইতিহাস শুনতে চেয়েছি। অনেক বেশি চেয়েছি তাইনা?

যে আ’ঘা’ত করে সে ঘা’ত’ক হলে যে বিশ্বাসে আ’ঘা’ত করে সে নিশ্চই বিশ্বাসঘা’ত’ক। তুমি আমার বিশ্বাসে চরমভাবে আ’ঘা’ত করেছ। তুমি বলেছিলে তুমি শুধু অভিনয় নিয়ে আছো, আমি বিশ্বাস করেছিলাম এটা। কিন্তু আমি ভুল। তুমি কালো জগতের মোহতে পড়ে গেছো। তুমি বলেছিলে ওসব তুমি ছেড়ে দিয়েছ। আমি বিশ্বাস করেছিলাম, কিন্তু ফলাফল আবারও শূণ্য। তুমি বলেছিলে আমি ছাড়া তুমি কারোর মোহতে পড়বে না। কেউ তোমার জীবনে আসবে না । বিশ্বাস করেছিলাম আমি, কিন্তু আবারও ঠ’কে গেলাম। সারাটাজীবন কি এভাবেই কা’টবে আমার? তাহলে এই জীবন চাই না আমার।

দাদাই আমাকে কষ্ট দিয়েছে, তোমার বাবা কষ্ট দিয়েছে,আমীর আঙ্কেলও সবসময় নিজের কষ্ট লুকিয়ে মিথ্যে বলে কষ্ট দিয়েছে। সবার দেওয়া কষ্ট আমি ভুলে যেতে পারি। কিন্তু তোমার দেওয়া কষ্ট? সেটা কিভাবে ভুলবো ফালাক ভাইয়া? খুব কষ্ট হয় যে, যখন তোমার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে তোমার বিশ্বাসঘা’ত’কতার কথা। মনে পড়ে তোমার ওয়াদা ভা’ঙার কথা। বুকের ভেতরটা পুড়ে যায়। যন্ত্রণায় ছটফট করি। দম বন্ধ হয়ে আসে। দুচোখের পানি শুকিয়ে যায় পড়তে পড়তে। কি ভুল করেছিলাম আমি? কি পাপ করেছিলাম যে বিধাতা আমার ভাগ্যে এমনটা লিখে রেখেছিল। আমি বাঁচবো না এটা জানি। তাই আমার বাবা-মামনিকে যে মে’রেছে তাকেও বাঁচতে দেবো না আমি।

আমার একটা কথা রাখবে? আমি যদি ম’রে যাই তুমি মুগ্ধতাকে বিয়ে করবে। অনাথের জীবন কেমন আমার থেকে ভালো কেউ বুঝবে না। মেয়েটা তোমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। ওকে ভালো রাখবে। ভাববে ওর মাঝেই তোমার চাঁদ নতুন করে এসেছে। তোমার এসব কাজকে আমি মন থেকে মানতে পারবো না। তোমার কাছে ফিরে আসতেও মন চায় না। যদি বেঁচেও থাকি তোমার এসব কাজ দেখলে তোমার কাছে আমি ফিরে আসবো না। মুগ্ধতা তোমার পেশার সঙ্গে যুক্ত। ওকে জীবনে নিয়ে আসলে তোমার ভালোবাসা ও অভিনয় দুটোই থাকবে। তবে গ্যাংস্টার হওয়ার নেশা কেন? কি হবে ওসব করে? ওসব বাদ দিতেও বলবো না। কারন আমি চাইনা আমার চাওয়া মানতে গিয়ে তুমি নিজের চাওয়া পাওয়া ভুলে যাও। তোমাকে বেশি কিছু বলতে চাইনা কারন ইচ্ছে করেনা। তোমাকে লিখতে গিয়ে দু দফা চোখ ভিজলো। এত হালকা কথাগুলো লিখতেও কষ্ট হচ্ছে। অদ্ভুত না?

জানো! মাঝে মাঝে ভাবি, আমি চাইলেই তো তোমার কাছে ফিরে যেতে পারি। কিন্তু আমার আত্মসম্মান বলে ওঠে, তোকে যে ঠকালো তাঁর কাছে যাবি রোজ? তখন আমার উত্তর থাকে না। মিথ্যেবাদী রাখালের গল্প মনে আছে নিশ্চই। তোমাকে আমার তেমন মনে হয়। এখন তুমি সত্য বললেও আমার বিশ্বাস হয়না। কারন পেছনে পেছনে কি করছ তা তো জানি না আমি।তোমার একটা লোককে পিটিয়ে সত্য বের করেছি তাই দুঃখিত। ওকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। হসপিটালে আছে, আজকালের মধ্যেই ফিরে যাবে তোমার কাছে। তোমার,আমার ওপর নজর রাখার সকল উপায় বন্ধ করে দিয়েছি। চাইলেও আমাকে খুজে পাবে না। তবে যদি নিজেকে বদলাও, আমি ফিরে আসতে চাইবো। (যদি বেঁচে থাকি) নতুবা আমার একাকিত্বই আমার সর্বকালের সঙ্গী হবে। আমি তোমাকে ভালোবাসি! আজীবন ভালোবেসে যাবো। তবে ভালোবাসা পাওয়ার ইচ্ছেটা আর নেই। একটা সময় যাকে কাছে পাওয়ার ইচ্ছে জাগতো তাকে আজ দূরে ঠেলে দেওয়া ছাড়া গতি নেই আমার। ইশ! কতটা বেদনায় ভরা এই মুহূর্ত তা কেউ বুঝবে না।

তোমাকে ভালোবাসি ফালাক! নাম ধরে ডাকছি বলে অবাক হয়ো না। অনেকদিনের ইচ্ছে আমার। আমি তোমাকে নাম ধরে ডাকবো। ভাইয়া ডাকটা এখন প্রচন্ড বিরক্তিকর লাগে। তাই বলছি অনেক বেশি ভালোবাসি তোমায় ফালাক, কিন্তু ভালোবাসলেও তোমার কাছে ফিরতে চাইনা। চলে যেতে চাই এই অতিতে ঘেরা জীবন থেকে। বেঁচে থাকলে নতুন করে বাঁচতে চাই, আর ম’রে গেলে যতটুকু ছিল আমার জীবনে ততটুকুর তৃপ্তি নিয়েই যেতে চাই।

আমি ছোট থেকে একটা কথা তোমার মুখে সবসময় শুনতাম,’ ভালোবাসা ভালোবাসে, শুধুই তাকে।ভালোবেসে ভালোবাসা বেঁধে যে রাখে। ‘ আমাকে তুমি বেঁধে রাখতে পারলে না। আমি স্বেচ্ছায় বন্ধন গ্রহণ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু তোমার মিথ্যেগুলো আমাকে সেটা করতে দেয়নি। আজ চলে যাচ্ছি সব বন্ধন ছেড়ে। মুক্ত পাখির মত ডানা মেলে। ভালো থেকো, ভালোবেসো। কখনও এমন মিথ্যে বলো না যা কারোর মন ভা’ঙে, যা কারোর স্বপ্ন ভা’ঙে, যা কারোর জীবনটাই ত’ছ’ন’ছ করে দেয়। সত্য বলার পর মন ভা’ঙলে তা দোষের নয়। কারন সত্য, সত্যই হয়। আর সত্যের থেকে মূল্যবান কিছু নয়।

আর লিখতে ইচ্ছে করছে না। সবার কাছ থেকে এভাবে আলাদা আলাদা করে বিদায় নিতে ভালো লাগছে না।
ইতি
তোমার চাঁদ!!!

ডায়েরিটা বন্ধ করে পাশের টেবিলের ওপর তাকালো ফারহান। রোজের সাদা-কালো একটা ছবি ফ্রেম করে রাখা আছে সেখানে। ফারহান ফ্রেমটা হাতে নিয়ে তাতে হাত বুলিয়ে বলে,

-আ’ম স্যরি চাঁদ!আমি বুঝিনি তুই এতটা কষ্ট পেয়েছিস। আমি সত্যিই বুঝিনি। তুই ঠিক বলেছিস তোর গল্পের সবগুলো হিরোই স্বার্থপর। শুধু নিজেদের কথা ভাবে। কিন্তু আর ভাববে না চাঁদ। তোকে ফিরতে হবে। তোর এই গল্পের সমাপ্তি তোকে ছাড়া কিভাবে সম্ভব? দাদাই আর কুসুম সমাপ্তি টানলেও শেষ পর্যন্ত তোকে থাকতে হবে। আজ বুঝতে পারছি আমার স্বপ্ন দেখাটা আসলে ভুল ছিল। তোর নেশার কাছে অন্যসব নেশা অতি তুচ্ছ। মুগ্ধতাকে আমি ছুঁয়েছি কিনা জানি না, কিন্তু যদি না ছুঁয়ে থাকি। তাহলে ফিরবি তো? অভিনয় করেছি, নানা রকম ইন্টিমেট সীন করেছি! অন্যায় করেছি! আমি সব ছেড়ে দেবো চাঁদ! একদম সিম্পিল হয়ে যাবো। ট্রাস্ট মি এবার ওগুলো ছাড়লেও আমার কষ্ট হবে না। কারন সব কষ্ট তোকে ঘিরে রয়েছে। এসবের থেকে উর্ধ্বে তুই। সব স্বপ্ন ভালোলাগার উর্ধ্বে!আমার তোকে বুঝতে সময় লেগে গেল চাঁদ। আমাকে শাস্তি দে, যা ইচ্ছে তাই কর। তবুও ফিরে আয় চাঁদ! প্লিজ ফিরে আয়।

ফারহান সিয়ামকে ফোন দিল। কয়েকবার ফোন বেজে বেজে থেমে যায়। অবশেষে সিয়াম যখন ফোন রিসিভ করে তখন শুনতে পায়, ফারহানের ভগ্নস্বর!
-মুগ্ধতাকে নিয়ে আমীর আঙ্কেলদের বাড়িতে এসো।

_________

-তোমার সঙ্গে সেদিন রাতে আমার কি হয়েছিল মুগ্ধতা? সত্যটা বলবে। কি করেছিলাম আমি? আর তুমিই বা কি করেছিলে?

মুগ্ধতা থতমত খেয়ে তাকালো।ফারহান এখনও কাঁদছে আর ওর হাতে একটা বাচ্চা মেয়ের ছবি।মুগ্ধতা বুঝলো এটা রোজের ছবি। কিন্তু এভাবে কান্নাকাটি করছে কেন ফারহান? মুগ্ধতার উত্তর না পেয়ে ফারহান আবার প্রশ্ন করে,

-বলো।

-নতুন করে কি বলবো? সেদিন তো সব বললাম। তুমি তো সবটাই শুনেছো।

-তুমি আবার বলো। আমার চাঁদকে আমি শোনাতে চাই সবটা। তোমার মুখ থেকে শুনলে ও বিশ্বাস করবে। তুমি যদি সব সত্য বলো, আমি তোমাকে আবার বন্ধু বানাবো মুগ্ধতা। প্লিজ!

-চাঁদকে এত ভালোবাসো? আমার ভালোবাসায় কিসের কমতি ফারহান?

-আত্মমর্যাদার!আত্মসম্মান নেই তোমার।থাকলে সেদিন নিজেকে আমার সামনে বিলিয়ে দিতে চাইতে না। চাঁদ আর বাকি মেয়েরা আলাদা মুগ্ধতা!বোঝার চেষ্টা করো। তোমার জন্য, তোমার সুখের জন্য ও আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাচ্ছে।

-তাহলে ওর ত্যাগকে সম্মান দাও। আমাকে আপন করে নাও। আমিও তো তোমাকে ভালোবাসি। তোমার চাঁদের মত ছেড়ে চলে যাওয়া ভালোবাসা নয়। আমি তোমাকে কখনও ছেড়ে যাবো না।

-ঠান্ডা মাথায় তোমাকে অনুরোধ করছি মুগ্ধতা। আমার সঙ্গে কোঅপারেট করো। নাহলে তোমাকে শেষ করতে আমার দুসেকেন্ডও সময় লাগবে না। তোমাদের বাপ মেয়ের খেলা আমার চাঁদকে ঘিরে। চাঁদের নিরাপত্তার জন্য চুপ ছিলাম। চাঁদই যখন চলে যাচ্ছে তখন আমার চুপ থাকার কোনো প্রয়োজন দেখছি না।

-মানে? কি করবে তুমি? আমাকে মা’রবে? পারবে না।

ফারহান বাঁকা হেসে বলে, ‘দেখতে চাও, পারি কিনা? ‘

-ওকে, বলছি। সেদিন তোমার খাবারে ড্রাগ দিয়েছিলাম আমি। তুমি নেশায় বুদ হয়ে গিয়ে রোজের ওপর রাগ দেখিয়ে আমাকে কিস করেছিলে। আমি ভেবেছি তুমি আমাকে চাও, তাই তোমার সঙ্গে ইন্টিমেট হওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ততক্ষণে তোমার জ্ঞান পুরোপুরি হারিয়ে যায়। তোমাকে অজ্ঞান দেখে আমি নিজের দেহে নিজেই কলঙ্ক লেপ্টে নেই। ব্যাস এটুকু।

-এটুকু?

-আর কি?

-চাঁদের কানে সেদিন রাতের কথাগুলো পৌঁছালো কি করে?

-জানি না। হয়তো সাইমুন বলেছে। সাইমুনকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না তাই শিওর না ও বলেছে কিনা।

ফারহান চেঁচালো, ‘সিয়াম! ‘ সিয়াম ছুটে আসে। ফারহান স্পষ্ট গলায় বলে,
-মেহমেদ এসেছে?

-জি স্যার।

-ম্যাডামকে নিয়ে মেহমেদের হাতে হস্তান্তর করো। মেহমেদকে বলে দেবে, সে যেন মুগ্ধতাকে একটি যন্ত্রণাদায়ক মৃ’ত্যু উপহার দেয়।

-রোজ ম্যামের খোঁজ?

-ও নিজেই আমাকে খুজে নেবে।চাঁদকে খোজার কোনো প্রয়োজন নেই। তুমি এই স্লাটটাকে নিয়ে যাও।

-ওকে স্যার।

মুগ্ধতা ফারহানের দিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকাতেই ফারহান অত্যন্ত দুঃখি মুখে বলল,

-তোমাদের জন্য আমার জীবনের অনেকগুলো বছর নষ্ট হয়েছে। তোমরা বেঁচে থাকলে আরও নষ্ট হবে। শুধু আমার না, অনেকের। তাই নিজেদের জীবনটা ত্যাগ করে সবাইকে সুখ শান্তিতি দাও, মুগ্ধতা। জানো তো? একটা প্রবাদ, চলিত বাক্য আছে। “ভোগে নয়, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ”
তোমার জীবনের সমাপ্তি সুখকর হোক। সিয়াম নিয়ে যাও এটাকে।

মুগ্ধতাকে নিয়ে সিয়াম চলে যেতেই ফারহান অস্ফুট কন্ঠে আওড়ালো,

-কালো জগৎটাও ছেড়ে দিলাম চাঁদ। এটাই হবে তোর ফালাকের জীবনের শেষ হত্যাকান্ড! অভিনয়ের জগৎ থেকে কাল অফিসিয়ালি বেরিয়ে আসবো। প্রডিউসারের টাকাটা ফেরত দিতে হবে। নাহলে আজই অতিত জীবনের পরিসমাপ্তি হত। সাবধানে থাকিস চাঁদ! তোকে আমার কাছে আসতেই হবে। তাই আশা করি নিজের খেয়াল রাখবি!

_________

ইরফানের সামনে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে রোজ। রোজের ঠোঁটের কোনায় এক চিলতে হাসি। ইরফান সাহেব কিছুসময় পূর্বেই নিজের ছেলের মৃ’ত্যুর সংবাদ শুনেছেন। যার দরুন রোজকে এভাবে আটকে রেখেছেন। শীগ্রহই রোজকেও তিনি শেষ করবেন। শুধু টাকাগুলো হাতে পাওয়া অবধি তিনি সময় দিয়েছেন রোজকে।

বর্ডারের পাশেই নদীর তীরে তাবু টানানো হয়েছে। রোজ সেখানের একটা তাবুতেই আছে। আরিফিন স্যার সতর্ক দৃষ্টিতে পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করছেন। এখনও অবধি কেউ জানে না রোজের সঙ্গে আরিফিন সাহেবও মিলিত আছেন। পূর্বের ন্যায় মাইন পোঁতা হয়েছে মাটির নিচে। বিস্ফোরণের স্থানও ঠিক করা হয়েছে।আরিফিন সাহেব সেটাই লক্ষ করছেন যেন নির্দোষ কেউ ওদিকটায় না যায়। বিকেলবেলা টাকা না পেয়ে যখন ইরফান রাগে অগ্নিশর্মা রূপ ধারণ করেছে তখনও ক্ষতবিক্ষত রোজ মৃদু মৃদু হাসছে। ইরফানের লোক এসে রোজকে নদীর পাড়ে নিয়ে যায়। রোজের হাত পায়ের বাঁধন খুলে দেয়। রোজের শরীরে এতটা ক্ষত তৈরি হয়েছে যে হাত পা নাড়ানও যাচ্ছে না। ধাঁরালো অস্ত্রে রোজের শরীর ফালা ফালা করা হয়েছে। তাতে আবার নুনও ছেটানো হয়েছে রোজের মত এক অপরাধির শাস্তি হিসেবে। আরিফিন সাহেবের চোখাচোখি হতেই তিনি রোজকে ইশারায় বোঝালেন সব ঠিক আছে। রোজ হেসে ইরফানকে উস্কে দেওয়া উদ্দেশ্যে বলে,

-আপনার ছেলেকে মা’রার সময় আমি তাকে শূকর, স্যরি শুয়ো** বাচ্চা বলেছিলাম। কিন্তু আপনি তাঁর থেকেও নিকৃষ্ট। কি ভেবেছেন আমাকে মা’রলে টাকাগুলো উড়ে উড়ে আসবে? আপনার গলা অবধি গেলানোর জন্য টাকা সরাইনি আমি। সরিয়েছি নিজের নিজের কার্যসিদ্ধির জন্য। সেই টাকার হদিশ আপনারা ইহকালে পাবেন না।

ইরফান রেগে এগিয়ে যেতেই পায়ের নিচে কিছু্র আভাস পেল। শুধু ও নয়। আরও তিন-চারজন সেটা বুঝেছে। ইরফান নিচে তাকিয়ে পায়ের তলায় মাইন দেখে ভয়ে, রেগে রোজের দিকে তাকালো। রোজের পরিকল্পনা বুঝতে সময় লাগেনি ওর। আনসারীর সেই মৃ’ত্যুর খেলার পুনরাবৃত্তি করেছে আনসারীর মেয়ে। পা তোলামাত্র বিস্ফোরণ ঘটবে। আজ জীবনের শেষপ্রান্তে এসেও হারতে চায়না ইরফান। তাই বন্দুক বের করে রোজের দিকে তাক করে বললেন,

-সত্যিই আনসারীর কন্যা তুমি। কিন্তু আমি তোমার বাবার মত ভালো নই। তাই শত্রু ও বিশ্বাসঘা’ত’ককে পৃথিবির বুকে রেখে যাবো না। আরিফিনকেও শেষ করে যাবো।

বন্দুক আরিফিনের দিকে ঘোরাতেই রোজের চোখের সামনে আরিফিনের আঠারো বছরের মেয়ে আর বাইশ বছরের ছেলেটার চেহারা ভেসে উঠলো। তাদের পরিণতি রোজের মত হবে? রোজ উঠে দাড়ানোর চেষ্টা করে। একটা মাইন ব্লাস্ট হয়। লোকটার বন্দুক ছিটকে রোজের পাশে পড়তেই রোজ সেটা তুলে নিলো। ইরফান বন্দুকের ট্রিগার টান দিতেই রোজ হাটতে শুরু করে। আরিফিন সাহেবের নজর তখন তাবুর ভেতর। তিনি আর্মিদের উপর নজর রাখছিলেন। এত দ্রুত এসব ঘটতে পারে তা অনুমানও করেননি তিনি। রোজ হাটছে দেখে ইরফান কাউন্ট ডাউন শুরু করে। দশ, নয়, আট, সাত, ছয়… ইরফান শ্যুট করতেই রোজ লাফিয়ে পড়লো আরিফিন সাহেবের ওপর। গুলিটা গিয়ে ঠিক রোজের পেট বরাবর লাগে। ইরফান আবারও শ্যুট করে, রোজের পিঠে লাগলো এটা। রোজ ইরফানের পা বরাবর শ্যুট করলো, যেন পা সরে গেলে ব্লাস্ট হয়। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পেরে গুলি করার পর পরই নদীতে পড়ে যায় রোজ। পানিতে পড়ার আগ মুহূর্তে সে দেখলো বিস্ফোরণের দৃশ্যটি। ইরফানের দেহ খন্ডবিখন্ড হয়ে ছড়িয়ে গেল। রোজের মাথা গিয়ে লাগে পানির নিচের পাথরে। চোখ বন্ধ হয়ে আসে রোজের। রোজ অস্পষ্ট কন্ঠে বলে,

-তোমার কাজ সম্পন্ন করেছি আমি বাবা। টাকাগুলো ও বিশ্বাসঘা’ত’ককে তাদের উপযুক্ত স্থানে পৌঁছে দিয়েছি। আর আমিও আসছি তোমাদের কাছে। ফালাক, তোমাকে বলেছিলাম আমি সবসময় তোমাকে ভালোবাসবো। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তোমাকে ভালোবাসবো। আমার কথা আমি রেখেছি। ভালোবাসা নিয়েই চলে যাচ্ছি। ভালো থেকো তোমরা।

আরিফিন সঙ্গে সঙ্গে ডুবুরি পাঠালো। কিন্তু নদীর স্রোত এত বেশি ছিল যে রোজের শরীর কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল তা ডুবুরিরাও বলতে পারলো না। আরিফিন জানে উপযুক্ত চিকিৎসা না পেলে মাত্র কয়েকটা মিনিট বাঁচবে রোজ। আর সে সময়টুকুও অতিবাহিত হয়ে গেছে। যার অর্থ রোজ আর নেই। লা’শটাও হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই খুজে পাওয়া যাবে। এভাবে এত কম সময় নিয়ে মেয়েটা এসেছিলো ভাবতেই আরিফিনের চোখ ভিজে আসে। কোথাও না কোথাও আরিফিনও দায়ী রোজের মৃ’ত্যুর জন্য।

চলবে?

তুই হবি শুধু আমার পর্ব-২১

0

#তুই হবি শুধু আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_একুশ

সবার সামনে হাসিমুখে দাড়িয়ে আছে রোজ। আজ সে অফিসিয়ালি মিশনের উদ্দেশ্যে রওনা দেবে। ফিরে আসতে পারবে কিনা জানে না ও, তাই সবার সঙ্গে দেখা করে যেতে চায়। আরশানদের বাড়িতেই এসেছে সবাই। আরশান, আরসালান, ফারহানসহ ফারদিন, আমীর ও ফারিয়া আন্টি সোফায় বসে আছেন। বাকিরা দাড়িয়ে আছে এদিক সেদিক। সবার একটাই কথা রোজ যেন থেকে যায়। রোজকে সুন্দর জীবন এরা উপহার দেবে। নষ্ট হয়ে যাওয়া বছর ও সবার সব ভুলের মাশুলও দেবে সবাই। রোজ সবার বক্তব্য শুনে ফিচেল হাসে। ফারহান এই হাসি আগেও দেখেছে। পরিচিত এই হাসিটা বিদ্রুপ করে হাসে রোজ। যখন মনে অনেক কষ্ট থাকে কিন্তু সে কষ্ট হেসে উড়িয়ে দিতে হয় তখন এভাবে হাসে রোজ। ফারহানের ভয় শুরু হয়ে গেলো। একজন চামচা যে সেবার নিখোঁজ হলো সে রোজের কাছে নয় তো? সব বলে দেয়নি তো? রোজ নিজেও সোফায় বসে বলতে শুরু করল,

-সবাই আমাকে কেন অনুরোধ করছো? এই কাজটা তো বাবা আমাকে দিয়ে গিয়েছেন। তাঁর অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করার দায়িত্ব তাঁর মেয়ের নয়?

ফারদিন সাহেব কোমল কন্ঠে বলল,
-সব বুঝতে পারছি। কিন্তু তুমি এভাবে যাবে না রোজ। দরকার হলে ফালাককে সঙ্গে নিয়ে যাও।

-কেন? ফালাক ভাইয়ার এ ব্যাপারে অনেক বেশি জ্ঞান আছে নাকি? গ্যাংস্টার, টেরোরিস্ট, ডিটেক্টিভ এগুলোর ওপর সে কি পি.এইচ.ডি করেছে?

-না করলেও নিয়ে যাও।তুমি একা গেলে আমাদের চিন্তা হবে।

-নিজের ছেলেকে কেন মৃ’ত্যুর মুখে ঠেলে দিতে চাচ্ছো আঙ্কেল? অপরাধবোধ, অনুশোচনা থেকে? তাহলে বাদ দাও সেসব। তোমাদের ওপর আমার কোনো অভিযোগ নেই।

ফারদিন সাহেব কেঁপে উঠলেন।রোজ ঠিক কি বোঝাতে চাইলো? ফারহানের চোখাচোখি হতেই বাবাছেলের দশা বেহাল হলো। দুজনেই ঘামছে। আরশান নিজেও কেমন নড়েচড়ে বসলো। অতিত বর্তমান জীবনের সকল কথা মনে পড়লো। অনুধাবন করতে পারলো সেই মেয়েটির কথা সে ছোট থেকেই ত্যাগ করা শিখেছে, অন্যকে কি ভাবে ভালো রাখতে হয়, ভালোবাসতে হয় শিখেছে। কি ভাবে সবাইকে এতগুলো বছর এক সুতোয় বেঁধে রেখে নিজেকে দূরে রেখেছে। আরশানের মনে পড়লো রোজ সবসময় ডায়েরি লিখতো আর বলতো,

”””’এই গল্পটা আমার দাদাই। কারন যে লেখে, যে সৃষ্টি করে সেটা তো তাঁরই হয়। তাইনা?কিন্তু গল্পটার হিরোইন বোধ হয় আমি নই। আমার গল্পে সর্বদা তুমি ও কুসুম লিড রোলে থাকবে। ফালাক ভাইয়া তো আমার সঙ্গে থাকার মানুষ। আমি হিরোইন না হলে সে এই গল্পের হিরো কিভাবে হবে? বাস্তবে সে অভিনেতা হলেও এই অসমাপ্ত গল্পের হিরো সে হবে না। কিছু না পাওয়া হিসেবের পাওনা পূর্ণতা পাবে তোমার জীবনে। আমার বা ওর জীবনে না। আমি না থাকলে তুমি আর কুসুম এই গল্পটা চলমান করে রাখবে। গড়িয়ে চলতে থাকবে গল্পটা যেমন গড়িয়ে যায় সময়। তোমার কুসুমকে আমি চিনি না। কিন্তু তোমাকে চিনি খাঁটি স্বর্ণ চিনতে ভুল হবে না তোমার। তাই আবারও বলছি আমাকে গুরুত্ব দিতে হবে না। এই গল্পের হিরোইন কুসুম, তাকে গুরুত্ব দাও। আমি নাহয় বিশেষ এক চরিত্রে থাকবো। বোন, বন্ধু, আনসারী ও রেণুর মেয়ে, ফালাকের চাঁদ, আঙ্কেলদের মেয়ে, অভীদের ফুপি হিসেবে। এতগুলো সম্পর্ক পেয়েছি আমি। এসবের সামনে সামান্য হিরোইন হতে চাইবে কে? আমি এটা ভেবেই শান্তি পাবো আমি না থাকলেও আমার রেখে যাওয়া গল্পটা থাকবে। তাঁর মূল চরিত্রগুলো থাকবে। তাদের স্মৃতি থাকবে, তাদের সকল কথা থাকবে। কিন্তু আমার এই গল্পে আমার, একান্তই আমার কাহিনিগুলো কি গ্রহণযোগ্যতা পাবে? যদি গল্পটা আমার হয় নিশ্চই পাবে। এই গল্পের শুরুটা যেমন তোমাকে, তোমাদের দিয়ে শুরু হবে তেমন শেষও তোমাদের দিয়ে হবে। আমি ডায়েরিতে লিখতে শুরু করেছি। শেষ হলে সবাইকে দেবো সেটা পড়তে। পড়বে তো তোমরা? নাকি ভুলে যাবে আমাকে? ‘হিরোইন ও হিরো পেলে কারোর তো এই রোজ বা ফালাককে মনে থাকবে না তাইনা? তাই ভাবছি আমি আমার ঘটনাও লিখবো। সবটা হিসেব করে লিখবো। পড়লে পড়বে না হলে রেখে দেবে স্মৃতি হিসেবে।”””

রোজের হাতে সেই ডায়েরিটা রয়েছে এখন। আরশান অয়ন্তির কানে ফিসফিসিয়ে ঘটনা’টা বলতেই অয়ন্তি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে। নীল রঙয়ের কভার এই ডায়েরিটির। তার ওপরে গোটা অক্ষরে লেখা “আনসারী”। সম্ভবত এটা রোজের বাবার ডায়েরি যেটা আনসারী সাহেবের পর রোজ লিখতো। রোজ মৃদু হেসে বলে,

-আমাকে কি এমন দুঃখি মুখে বিদায় জানাবে তোমরা? তোমাদের এমন কষ্টে জর্জারিত মুখ দেখে গেলে আমার ফেরার ইচ্ছেটাই যে থাকবে না। তোমরা কি এটাই চাও? যদি চাও, রোজের ফেরার দরকার নেই। রোজ ফিরবে না।

ফারহান উঠে দাঁড়ালো। রোজ ভ্রুকুটি করে তাকায়। এই পাগল মানুষটাকে সামলানো কঠিন। আরশানের মতো সে হিসেব করে চলতে পারে না, ভদ্রতা, নম্রতা জানে না। লজ্জাশরমও নেই। সবার সামনে জড়িয়ে টড়িয়ে ধরলে ওর থেকে নিজেকে কিভাবে ছাড়াবে রোজ? যে অভিমানগুলো সবার জন্য জমা হয়ে আছে তা সে সঙ্গে নিয়েই যেতে চায়। মনে কষ্ট থাকলে মনোবলটাও বাড়ে। ফারহান রোজের পায়ের কাছে মেঝেতে বসে পড়লো শব্দ করে। আরশান আরসালান শব্দে উঠে পড়ে। এগিয়ে এসে ফারহানকে ধরারও ঝোঁক নেয়। কিন্তু তা ফারহান উপেক্ষা করে রোজের পা ধরতে যায়। রোজ দ্রুত পা টেনে নিলো। ফারহানের চোখ ভিজে আসে। সে কেঁদে উঠে বলে,

-তুই আমার ওপর অভিমান করে আছিস চাঁদ। আমি জানি, তুই আমি আমরা সবাই বদলে গেছি।কিন্তু এতটাও বদলে যাইনি যতটা বদল হলে তুই আমাকে তোর পা ধরতে দিবি না। তোর পা আমি এমনিও ধরতে পারি চাঁদ, এতে পাপ হবে না। তুই জেদ করে বলতিস তোর পা ধরে যেন মাফ চাই আমি। তখন আমি বলতাম, এতে পাপ হবে। আজ বলছি, পাপ হবে না। আমি নিজ থেকে তোর কাছে মাফ চাচ্ছি। তোর পা ধরছি, ছেড়ে যাস্ না আমাকে। আমি বাঁচবো না। তোর কিছু হলে আমি সহ্য করতে পারবো না। তোর ওপর রাগ অভিমান করে ভুল করেছি আমি। সব ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করবো। যা বলবি তাই করবো। অভিনয় ছেড়ে দেবো। সকল প্রকার বিলাসিতা ছেড়ে দেবো। আমি শুধু তোকে নিয়ে থাকবো, তোকে নিয়ে থাকতে চাই। দেখ আমি আগের মত রাগ করিনা, রাগ করার মানুষটা তো থাকেইনা রাগ করবো কার ওপর? বাবা তুমি ওকে বলো না, আমার কাছে থাকতে। ও তোমার কথা ঠিক শুনবে।

রোজের চোখে পানি চলে আসলো। মানুষটা এভাবে কথা বললে রোজের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। সব রাগ, অভিমান মিটে যায়। কিন্তু এবার তা হবে না। অভিমান জমা হতে হতে তা পাহাড় সমান হয়ে গেছে। এত সহজে তা মিটবে না। রোজ কানের ব্লুটুথ অন করে কাঠ কাঠ গলায় বলল,

-জি চাচ্চু। আসছি আমি, জিপ পাঠিয়ে দিয়েছেন তো? ওকে। না, আসেনি এখনও চলে আসবে, হয়তো রাস্তায় আছে। উহু, চিন্তা করবেন না, আমি টাইমেই চলে আসবো।

আমীর সাহেব নিজেও রোজের পাশে এসে বসলেন। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-আমাদের ওপর তোর এত অভিমান? কি করেছি সেটা তো বল। কোন কাজে কষ্ট পেয়েছিস? যে সবাইকে ছেড়ে যেতে চাচ্ছিস।

-আমি কাউকে ছেড়ে যেতে চাইনি আঙ্কেল। এমনও সময় এসেছে যখন সব ভুলে তোমাদের কাছে থাকতে চেয়েছি। ভেবেছি আমার বাবা-মামনি নেই তাতে কি? তোমরা আছো। কিন্তু সেখানেও আমি ব্যর্থ! আমার জীবন ব্যর্থতায় পূর্ণ আঙ্কেল। সুখ আমার জন্য যতটুকু বরাদ্দ ছিল আমি তা পেয়ে গেছি।এবার অসুখের ডাকে সাড়া দিতে হবে। তোমরা জানো আমি ভিন্নস্বাদের অনুভূতি ভালোবাসি। এটুকু ভালোবাসা নিয়ে যেতে দাও।

-আমরা কি তোকে ভালোবাসি না?

-ভালোবাসলে বিশ্বাস করতে হয়। ভরসা করতে হয়। আফসোস! আমি সবাইকে বিশ্বাস, ভরসা করলেও কেউ আমাকে করেনি। পৃথিবিতে প্রতিটা মানুষ স্বার্থপর এটা মানো বা না মানো। আমিও স্বার্থপর তাই তো শুধু নিজের সুখের জন্য চলে যাচ্ছি।

জিপগাড়ির আওয়াজ আসতেই রোজ ফোন ও পি’স্ত’ল হাতে উঠে দাড়ালো। চোখের পানি মুছে ডায়েরিটা সে আমীর সাহেবের হাতে তুলে দেয়। ফারহানের দিকে সে একনজর তাকিয়ে বলে,

-আমাকে যদি ভালো রাখতে চাও, তাহলে তোমার ওই আঁধারে নিমজ্জিত দুনিয়া ছাড়তে হবে। আমার কসম ভাইয়া! তুমি কখনও হাতে অস্ত্র তুলে নেবে না। কখনও না। জানি কসম দিতে হয়না, কিন্তু এটাও জানি আমার কসম তুমি অগ্রাহ্য করবে না। আমি ফিরে আসবো কিনা জানি না, তবে তোমরা যদি আমাকে দেওয়া কথা রাখো তাহলে ফিরে আসার চেষ্টা অন্ততো করবো। বিধাতাকে বলবো সে যেন আমাকে তোমাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়। নতুবা মৃ’ত্যুই সই।

রোজ চলে যেতে থাকলে ফারহান বার কয়েক চেঁচাল। রোজ পেছনে ফিরলো না।কারন যদি পেছনে একবারও তাকায় তাহলে সে যেতে পারবে না। রোজ জিপে উঠে চলে গেল। ফারহান মূর্তির ন্যায় বসে রইলো । আমীর সাহেব ডায়েরি খুললেন। কিন্তু কৌতুহলী অয়ন্তি ধৈর্য ধরে রাখতে না পেরে নিজেই নিয়ে পড়তে শুরু করে।

”বাবার প্রিন্সেসের জন্য বাবার তরফ থেকে ছোট্ট একটা গিফট”

”’ব্যাংকের কোড, টাকার হদিশ, মিশনের বর্ণনা, কে কেমন তাঁর বর্ণণা।”’

”’কখনও মন খারাপ করবে না। সর্বদা জানবে তোমার তিনটে বাবা, তিনটে মামনি। আমি যাচ্ছি তাতে কি? ওরা তো থাকবে। ওরা তোমাকে নিজের মেয়ের চেয়েও ভালোবাসে। ওদের কষ্ট দেবে না।ছোট থাকতে তুমি কত ভুল করেছো, অন্যায় করেছো। ওরা তা আপন ভেবে নিয়েছে তাই কখনও ওদের কাছ থেকে কষ্ট পেলে তা মনে রাখবে না। ওরা যা বলবে তাই শুনবে। ওকে?”’
‘ঠিক আছে বাবা’—রোজ💙

”’কষ্ট পেলে প্রকাশ করবে না। কারন কেউ একবার তোমার দূর্বলতা জানলে তোমাকে নিঙড়ে ফেলতেও দু বার ভাববে না। এ জগৎ ভীষণ অদ্ভুত! তাই সর্বদা সচেতন থাকবে। কষ্ট পেলে রেণুকে অথবা ফালাককে বলবে। কষ্ট ভাগ করে নিলে তা কমে যায়। ”’
‘কেউ তো নেই বাবা। আমি তো বড্ড একা।’—-রোজ💙

”’বড় হয়েছো। সময় পাল্টাচ্ছে। চোখের সামনে যেসব ভাসমান আবেগ, রঙিন দুনিয়া দেখতে পাচ্ছো তার ঠিক ভুল বুঝতে শেখো। কারো দুটো মিষ্টি কথা শুনেই গলে যাবে না।রেণু অবশ্য এসব বলতো তোমাকে। কিন্তু আমি নিজেই বলে রাখছি, তুমি তো জেদি অনেক যদি মামনির কথা না শোনো? আমার কথা তুমি ফেলতে পারবে না আমি জানি। ”’
‘জেদ নেই বাবা। আমি এখন খুব করে মামনিকে চাই। তাঁর বকা খেতে চাই, দুষ্টুমি করতে চাই। কিন্তু দায়িত্ব ও একাকিত্বের বেড়াজালে আমার সেসব ইচ্ছে চাপা পড়ে গেছে। আমি খাঁচার বন্দি পাখি হয়ে গেছি যেটা আমি কখনও চাইতাম না। ‘—-রোজ💙

এমন আরও ছোট ছোট কথোপকথন আছে আনসারী সাহেব ও রোজের। কয়েকপৃষ্ঠা সামনে যেতেই ছেড়া পাতার আভাস পাওয়া গেলো। এই কাগজগুলো রোজ ছিড়ে ফেলেছে। শেষের দিকে আবারও লেখা।

💙আমীর আঙ্কেল💙
তোমার ব্যাপারে যত বলবো ততই কম। শুধু এটুকুই বলবো, ইউ আর দ্যা বেস্ট চাচ্চু! তোমাকে কখনও চাচ্চু বলে ডাকিনি । ভেবেছিলাম ফিরে এসে ডাকবো। কিন্তু আমার ভাগ্য মনে হয় ওতটাও ভালো নয়। যাই হোক লাভ ইয়্যু চাচ্চু!

💙দাদাভাই💙
তুমি বড্ড খারাপ দাদাভাই। ভাবিকে শুধু রাগিয়ে দাও। জানো না, ভাবি তোমার থেকে কষ্ট পেলে কাঁদে। আমার মিষ্টি ভাবিটাকে কাঁদিয়ে তুমি অন্যায় করো। তাকে আর রাগাবে না। আজই অতিতের সকল ভুলের জন্য মাফ চাইবে। ঠিক আছে? অভী অয়নকে একদম বকবে না। ওরা এখন দুষ্টুমি করবে না তো কখন করবে? আমি চাই না আমার মত কেউ ছেলেবেলার আনন্দ হারাক। ওদের পড়া ওরা ঠিক করবে। ওদের সঙ্গে তেমন ডিল হয়েছে আমার। তাই ওদের বকাবকি করবে না, আমি দেখেছি তুমি ওদের খুব বকা দাও, এভাবে বকলে বাচ্চাদের মানসিক বিকাশে অসুবিধা হয়। ওদের সঙ্গে ঠান্ডাভাবে কথা বলবে। অফিসের কাজ অফিসে ফেলে আসবে। সেটা টেনে বাড়িতে আনবে না। চাচ্চুর খেয়াল রাখবে, চাচ্চু রাতে অতিতের কথা মনে করে কাঁদে, আমি প্রায়ই রাতেই চাচ্চুর ঘরে উঁকি দিয়ে দেখেছি। তাকে কখনও একা রাখবে না, একাকিত্ব মানুষের সকল অনুভূতিকে গ্রাস করে ফেলে। অসহায় করে তোলে। রজনী ভাবির ফুল পছন্দ। রোজ রাতে ফেরার পথে তাকে রোজ দেবে উপহার স্বরূপ। তিন বাচ্চার বাপ হয়েছো বলে স্বামীর রোল থেকে বেড়িয়ে গেলে চলবে না। বুঝেছ? তোমাকে মিস করবো খুব দাদাভাই। লাভ ইয়্যু!

💙রজনী ভাবি💙
আমার বোনের থেকেও বেশি তুমি। মামনির পরে তুমি আমাকে যতটা স্নেহ দিয়েছো তেমনটা সবাই পারেনা। অনেকে ননদকে পছন্দ করে না। চোখের বালি ভাবে। সেখানে তুমি সর্বদা দাদাই, ফালাকের থেকে আমাকে বেশি ভালোবেসেছো। এমন অনেক সময়ও দেখেছি তুমি নিজের সন্তানদের থেকে আমাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছো। কিভাবে মায়ের ভূমিকা পালন করতে হয় তা তোমার থেকে শেখা উচিত। আমার গল্পে তুমি একটা দায়িত্বশীল, মমতায় ঘেরা চরিত্র! তোমার তেমন কথা লেখা নেই গল্পে তবে জ্বরের রাতের আবছা ঘটনাগুলো লিখেছি। অভীকে ধমকানোর মুহূর্তটুকুও লিখেছি।মূলত তোমাদের সবার কথাই কিছু কিছু লিখে রাখলাম।যখন পড়বে তখন আমার কথাও মনে পড়বে। পড়বে তো? তোমার স্নেহময় ভালোবাসার কথা মনে পড়বে আমার। সবাইকে নিয়ে ভালো থেকো, ভালোবাসি ভাবি।

💙ফারিয়া আন্টি💙
তোমাকে অনেক জ্বালিয়েছি তাইনা? তবুও মুখ বুজে আমার সব জ্বালাতন সহ্য করেছো। ভেবেছিলাম মামনি ডাকটা তোমার জন্যই বরাদ্দ। কিন্তু সময় সুযোগ হলো না। তোমার ছেলের বউ না হয়ে কি তোমাকে মামনি ডাকা যাবে না? আমি জানি তোমার উত্তর। তুমি মেয়ে হিসেবেই চাও আমাকে। ছেলের বউ হিসেবে না। তাই মেয়ে হয়েই বলছি। মামনি হিসেবে তোমাকে পেয়ে তৃপ্ত আমি। লাভ ইয়্যু মামনি।

💙দাদাইয়ের কুসুম💙
তোমার সঙ্গে আমার পরিচয়ের সময়কাল অতিস্বল্প। তবুও তোমার সঙ্গে আমার ভালো একটা সম্পর্ক হয়েছে সাধারনত সবার সঙ্গে আমি মিশতে পারিনা। ভালো লাগে না। তবে তোমার সঙ্গ আমার ভালো লাগতো। আমাকে তুমি তোমার অনাপির জায়গা দিয়েছো তার জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। জানো আমি ছোটবেলায় বলতাম আমার শুধু ভাই (দাদাই, দাদাভাই) আর বন্ধু আছে। কোনো আপু নেই। আমার আপু থাকলে তাকে আমি হীরামন বলে ডাকতাম। রূপকথার হীরামনকে জানো? যে সুখের সংবাদ নিয়ে আসতো, বিপদ থেকে রক্ষা করতো। অবশ্য তুমি তেমনটাই, আমার দাদাইয়ের বিপদের ঢাল। তার সুখ, ভালোবাসা। আমার গল্পের প্রধান চরিত্রের একটা ডাকনাম থাকা উচিত। দাদাই তো তোমাকে কুসুম ডাকে। আমি না’হয় হীরামন দিলাম। মিস ইয়্যু হীরামন। অল্পদিনেই ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে। সাবধানে থাকবে, নিজের যত্ন নেবে আর আমর দাদাইকে অনেক অনেক ভালোবাসবে।

💙দাদাই💙
তোমাকে কি লিখবো? বউ পেয়ে যে বোনকে ভুলে যায় তাঁর মত মানুষকে নিয়ে রোজ লিখতে পছন্দ করে না। তবে পুরো দোষটা তোমারও না। কুসুমকে এতো কষ্টে পেয়েছো তাই ওকে নিয়ে তোমার বেশি ভয় থাকবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমার গল্পের হিরোগুলো কেন এত স্বার্থপর? ফালাকের কথায় পরে আসছি। আগে তুমি বলো, সেদিন এক্সিডেন্টে যদি আমি টপকে যেতাম? তোমার বউয়ের জন্য, তোমার বউকে সুস্থ করার জন্য এত বড় একটা রিস্ক নিলাম আর তুমি? শেষে কিনা আমাকেই দোষারোপ করলে? খুব খারাপ এটা। আমি তোমার আর কুসুমের সব কথা শুনতে পাই কারন কি জানো?কুসুমের কানের দুল আর তোমার ঘড়ি যেগুলো আমি গিফট দিয়েছিলাম, যেগুলো তোমরা সারাক্ষণ পড়ে থাকো তাতে ছোট্ট ছোট্ট দুটো চিপ আছে যার শব্দতরঙ্গ আমার ফোনে প্রতিটা মুহূর্তে সাপ্লাই হতো। ওর মাধ্যমেই তোমাদের ভালো মন্দের খোঁজ রাখতাম আমি। দূরে গিয়ে একা থাকলেও তোমাদের চিন্তা বেশি বৈ কম হতো না। তাই স্যরি! গোপন অনেক কথা জেনে গেছি। সেগুলো আমার গল্পে আছে। ডায়েরি পড়লে জানবে। তোমাদের ক্যাফের দেখা, বাসর ঘরের ফার্স্ট সীন, গাড়িঘোড়ার সিন, বাথরুমের সিন! তোমরা যখন অনেক বছর পর এগুলো কিছু কিছু ভুলে যাবে তখন সবটা মনে করানোর জন্য লিখে রাখলাম। তোমাদের কথাগুলো ভোলা যাবে না, ভুলতে দেওয়া যাবে না। কারন তো জানোই, আমার গল্পের সবথেকে প্রিয় ও জাদুর জুটি তোমরা। প্রণয়ের পূর্ণতার দর্শন তোমরা। আমার অসমাপ্ত জীবনের পরিপূর্ণ কাহিনি তোমরা। তবে তোমার কিছু কিছু কথা আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছে, যেমন রেডিও সেন্টারের ঘটনা, হসপিটালের ঘটনা। তবে সেটা ধরার মধ্যে পড়ে না। সব প্রিয়দের ওপর অভিমান করতে নেই। লাভ ইয়্যু দাদাই, সবাইকে বিশেষ করে কুসুমকে ভালো রেখো। ভালোবেসো।

💙বাচ্চারা💙
আমি যে ফ্লাটটা কিনেছি সেটা আর আমার স্কুটার, বাইক অভী অয়নকে দেবে। অভীরা ট্রাভেল পছন্দ করে।
বাবা আমার জন্য প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ টাকা জমিয়ে রেখে দিয়েছিলেন ব্যাংকে। আমি না থাকলে টাকাগুলো শুধু ইন্টারেস্ট পেয়ে বৃদ্ধি পাবে। আমি চাই ট্রাভেলের খরচ ওখান থেকে হোক। আর বাকি টাকা দাদাইয়ের বেবি ও রোশনির জন্য।
আমার আমানতগুলো ওদের বুঝিয়ে দেবে।

💙ফারদিন আঙ্কেল💙
তোমার কথা মনে পড়লে কেন জানি না বুক চিরে এক বিশ্রি দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে আঙ্কেল। তুমি আমাকে কখনও মেয়ে মনে করোনি। আমাকে ঠকিয়েছো তুমি। তোমাকে আমি বাবা মনে করতাম। ইভেন বাবা বলেও ডেকেছি। সেই তুমি আমাকে বিশ্বাস করলে না, ভরসা করলে না।তোমার মনে হয়? আমি তোমাকে খু’নি ভাববো? যে যা বোঝাবে তাই বুঝবো? তুমি দিনের পর দিন ফালাকের মত অভিনয় করে গেছো। এসব করে কি পেয়েছো? যদি একবার আমাকে কাছে ডেকে সবটা বলতে আমি টু-শব্দ করতাম না। সেই তুমি আমার থেকে সত্য গোপন করে দিনের পর দিন নতুন নতুন মিথ্যে বলেছো। একটা মিথ্যে ঢাকতে কতগুলো মিথ্যে বলেছো, এটা ঠিক না। তুমি জানো আমি সব সহ্য করতে পারি, কিন্তু মিথ্যে? বাবা আমাকে মিথ্যে বলার বা প্রশ্রয় দেওয়ার শিক্ষা দেয়নি। তোমার ওপর আমি রাগও করতে পারিনা। তবে দূরে যেতে নিশ্চই পারবো। নিজেকে অপরাধি মনে করে চলাটা তোমার বোকামি। আমি জানি আমার বাবা আমার পরিবার কাউকে তুমি সামান্য কষ্টটুকুও দিতে পারবে না। এজন্যই মিথ্যে বলেছো। ইরফান তোমার ভাই সেজন্য কথা লুকিয়েছো। ইরফান বাবাকে মে’রেছে জানার পরও তুমি আমার সুরক্ষার জন্য আমার থেকে দূরে থেকেছো। এটা কতটুকু যুক্তিসংগত? আমার নিরাপত্তা তোমাদের কাছে ছিল, তোমাদের থেকে দূরে নয়। যাক বিষয়টা জটিল নয়, তাই আমি এটা পেঁচিয়ে জটিল করতে চাইনা। ইরফান আমার বাবাকে মে’রে ভুল করেছে সেই ভুল আমি সংশোধন করবো। তোমার ওপর আমার কোনো রাগ, অভিমান বা অভিযোগ নেই। তোমাকে আগে যেমনটা ভালোবাসতাম এখনও তেমন ভাবেই ভালোবাসি। শুধু একটু মন খারাপ ছিল কিন্তু তোমার পয়েন্ট অফ ভিউ বুঝতে পেরে সেটাও মিটে গেছে। তোমরা খুব ভালো বাবা! খুব ভালো! আমাকে মিস করবে না, ফালাক ভাইয়ার ওপর নজর রাখবে সে যেন কোনো খারাপ কাজ আর না করে। বুঝেছ? মনে রাখবে,রোজ কিন্তু বড্ড জেদি আর অভিমানি। রোজের কথা না শুনলে রোজ কষ্ট পাবে।

💙সবার উদ্দেশ্যে💙
আমি ছোট, অনেক জ্বালিয়েছি তোমাদের। অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমার ভুলগুলো, আমার দেওয়া কষ্টগুলো মনে রেখো না। আমি নিজের কথা ভেবেই চলে যাচ্ছি। স্বার্থপরের মত কাজ করছি। এছাড়া উপায় ছিল না। ইরফান আমাকে চায়,আমি ধরা না দিলে ওরাও সামনে আসবে না।আর ওরা সামনে না আসলে আমি নিজেকে তিল তিল করে যে উদ্দেশ্য পূরণের জন্য তৈরি করেছি তা পূর্ণতা পাবে না। সবাই যেমন আমাকে ভালোবাসো আমিও তোমাদের ভালোবাসি, বড্ড বেশি ভালোবাসি। নিজেদের খেয়াল রাখবে, শরীরের যত্ন নেবে। আমি যদি বাবার মত পরিণতি পাই তাহলে আমার লা’শটা বাবা আর মামনির মাঝে দেবে। আমি জায়গা ঠিক করে রেখেছি।

অয়ন্তি পড়া থামালো। আরশান রুদ্ধ কন্ঠে বলল,
-এরপর?

অয়ন্তি ডায়েরি বন্ধ করে ফারহানের হাতে দিল। মুখে বলল,
-“এবার শুধু ফালাকের উদ্দেশ্যে লিখছি।এটা শুধু তাকে পড়তে দিও। এটা শুধুমাত্র তাঁর জন্য। অন্যকেউ এটা পড়ুক সেটা চাইনা আমি। নিজের একান্ত কথাগুলো শুধু তাকেই জানাতে চাই।”

💙ফালাক💙

চলবে?

তুই হবি শুধু আমার পর্ব-২০

0

#তুই হবি শুধু আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_বিশ

গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন রোজ। চোখের পাপড়ি ভার হয়ে আছে। পায়ের ব্যাথাটা সকাল থেকে বেড়েছে। ফোনের চার্জ শেষ। তবুও এলার্মের শব্দ কানে বাজছে। বিরক্তি ও রাগে রোজের মস্তিষ্ক সজাগ হতে থাকলো। চোখ খুলে গেল মুহূর্তেই। রোজ উঠে সোজা হয়ে বসে। চোখ ডলে। এরপর ঘুম ঘুম নজরেই পাশে তাকায়। একটা বাটন ফোন অনবরত বাজছে। কার ফোন এটা? ওর ঘরে কোথ থেকে আসলো? রোজ পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

-কাম আউট সিয়াম!

খাটের নিচে লুকিয়ে থাকা সিয়াম কেঁপে উঠলো। রোজ জানলো কি করে সিয়ামই এসেছে?রোজ তো সিয়ামকে আগে দেখেনি ইভেন সিয়াম নিজেই তো রোজকে এই প্রথম দেখলো। তাহলে চিনলো কি করে? রোজ উঠে ড্রয়ার থেকে নিজের লাইসেন্স করা পি’স্ত’ল বের করে পি’স্ত’লের অগ্রভাগ দিয়ে গলা চুলকিয়ে বলে,

-তুমি নিজে বের হবে? নাকি আমি বের করবো? সকাল সকাল র’ক্ত ভালো লাগবে না আমার। সো কাম আউট ফাস্ট সিয়াম।

সিয়াম বেরিয়ে আসলো। ধুলোবালির সাগরে ডুব দিয়ে উঠেছে যেন। রোজ কঠিন গলায় বলে,

-ফালাক ভাইয়া ফোন দিচ্ছে? রিসিভ করো। কিন্তু এটা বলবে না যে আমি জেগে আছি প্লাস তোমার সামনেই দাড়িয়ে আছি। যদি কোনো চালাকি করতে যাও তাহলে এই পি’স্ত’লের একটা বুলেটই তোমার হৃদয়ের কৌতুহল মেটানোর জন্য যথেষ্ট।

-ম্যাম!

-নো মোর ওয়ার্ড সিয়াম, রিসিভ দ্যা কল। এ্যান্ড অন দ্যা স্পিকার।

সিয়াম স্পিকার অন করে হ্যালো বলতেই ফালাকের কন্ঠ শোনা গেল।
-কোথায় তুমি? চাঁদ ঘুমাচ্ছে তো? ওকে যে ঔষধটা দিতে বলেছিলাম দিয়েছো?

-জ,,জি স্যার।

-ওকে নজরে রাখবে। কোথাও যেন একা না যায়। শ্যুটিং অলমোস্ট শেষ। আমি ফিরে আসবো, যতদিন না আসছি ততদিন ওর খবরাখবর তুমি আমাকে দেবে। তুমি সামনাসামনি থাকলে ও সন্দেহ করবে না। আর যে ছেলেগুলোকে বলেছিলাম চাঁদের ওপর নজর রাখতে তাদের মধ্যে একজনকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। কি হয়েছে ওর? জেনে আমাকে ইনফর্ম করো।

-আসলে স্যার ম্যাম তো,,

রোজ পি’স্ত’ল তাক করতেই সিয়াম কাঠ কাঠ গলায় বলে,
-জি স্যার। আমি জেনেই বলছি।

-ওকে। ও যেন টের না পায় ওর ওপর নজর রাখছি আমি। সো বি কেয়ারফুল।

ফারহান ফোন রাখতেই রোজ পি’স্ত’ল কোমরে গুজে ফেলল।সিয়াম ভয়ে কাচুমাচু হয়ে দাড়িয়ে আছে। রোজ হেসে বলে,

-নজর রাখছো আমার ওপর? গুড, ভেরি গুড। কিন্তু ও তো গাঁধা না, তাহলে তোমার মত গাঁধাকে আমার খোজ রাখতে বলল কেন? লোকের অভাবে? ও এখানে নেই তাই? ইশ! সব প্লান ভেস্তে গেল তাইনা?

-ম্যাম!!

-যা জিজ্ঞেস করবো সব টা সত্য এবং সরাসরি বলবে সিয়াম। কারন, আমার কাছে এখন শুধু সত্য জানাটা জরুরি। মানুষ নয়। (কঠিন গলায়)

-জি বলুন ম্যাম, কি জানতে চান? স্যার লাস্ট নাইটে চা বাগানের একটা শ্যুটে গেছে। মাসের শেষে ফিরবে তাই তিনি চাচ্ছিলেন আমি যেন আপনার খেয়াল রাখি, ঔষধের ওপর নজর রাখি, আপনি টাইম টু টাইম খাচ্ছেন কিনা। বিশ্বাস করুন আর কিছু না।

-ওহ প্লিজ! সিয়াম। মিথ্যা বলে না, মিথ্যা বললে পাপ হয় জানো না? আমি চাইনা তুমি পাপ করো। সুতরাং যা যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দাও। বাড়তি একটা কথা না। অতিরিক্ত কিছু পছন্দ না আমার।

-কিন্তু ম্যাম,

-মুগ্ধতার সঙ্গে ফালাকের বিয়ে ঠিক হয়েছিল?

-ওটা ম্যাম

-হ্যাঁ, কি না। (চেঁচিয়ে)

-হ্যাঁ।

-গুড। মুগ্ধতার বাবা কে? ইশতিয়াক ইরফান? খোজ খবর নিশ্চই রেখেছো। বিয়ের মত কথা যেহেতু চলেছে সেহেতু এসব তুমি জানো।

-জি ম্যাম।

-ভেরি গুড। এভাবেই ভালো মানুষের মত উত্তর দেবে। সাইমুন কি মুগ্ধতার ভাই? দেখো আমি জানি তুমি সব জানো, আমিও সব জানি। শুধু কনফার্ম হতে চাই। তাই ভণিতা না করে জবাব দেবে।

-হ্যাঁ, সাইমুন মুগ্ধতার ভাই। কিন্তু এটা কেউ জানে না। পারিবারিক ব্যাপার তো তাই।

রোজ স্মিত হেসে বলে,
-পারিবারিক? পরিবারেরও কানেকশন আছে, তা ঠিক কি কানেকশন সিয়াম?

-আমি জানি না ম্যাম।

রোজ সিয়ামের পায়ের ঠিক পাশের চেয়ারটায় গু’লি করতেই সিয়াম ভয়ে লাফ দিয়ে ওঠে। রোজ কৌতুকের স্বরে বলে,
-বললাম না, মিথ্যা বলতে হয়না।

-আপনি আমার সঙ্গে এমন কেন করছেন?

-কারন তুমি আমাকে কোনো মেডিসিন দিচ্ছিলে। আমার হাতে কি পুশ করেছ? যার জন্য আমার মাথা ঝিমঝিম করছে। যাক সেসব পরে জানা যাবে, আগে এটা বলো ইরফান কি হয় ফালাকের? চাচা?

সিয়াম বাকরুদ্ধ দাড়িয়ে রইলো। রোজ সবকিছু জানে? তাও জিজ্ঞেস করছে কেন? দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে? সিয়াম যদি সব বলে দেয় ফারহান প্রচন্ড রেগে যাবে।এমনিতেই ভুল করে ধরা খেল। এখন যদি সব বলে দেয় ফারহান সহ ফারদিন সাহেবও রেগে যাবেন। সিয়ামকে কিছু বলতে না দেখে রোজ নিশ্চিত হলো ওর কানে যেসব খবর এসে তা পুরো সত্য। রোজের হাত পা জ্বলে উঠল রাগে। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে সে সামনে তাকায়। এরপর কঠিন গলায় বলে,

-তোমার স্যার স’ন্ত্রাস ছাড়েনি?

-ছেড়ে দিয়েছে ম্যাম।

-মেহমেদকে চেনো?

-জি ম্যাম। মারাত্মক কিলার।

-তোমার স্যার তাঁর থেকেও বেশি মারাত্মক সিয়াম। ফালাকের জীবনে ওর মা বাবা ছাড়া আর একটা মানুষ সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তুমি জানো, সেটা কে? সেটা সাফোয়ান আনসারীর মেয়ে সাইরাহ্ আনসারী রোজা। কিন্তু তোমার স্যার তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘা’ত’কতা করে এটা সুনিশ্চিত করেছে যে সে বিশ্বাসের যোগ্য নয়। আমার বিশ্বাস নিয়ে যে খেলতে পারে সে তোমাকে ভাই মনে করে কোলে তুলে রাখবে?

-স্যার ভালো হয়ে গেছেন ম্যাম। বিশ্বাস করেন উনি আর ওসব করেন না। শুধু অভিনয় করেন।

-হতে পারে। কিন্তু আমি ওকে বিশ্বাস করিনা। তোমাকে গাঁধা পেয়ে আমার ওপর নজরদারির আদেশ দিয়েছে। সে ভেবেছে তুমি বোকা তাই তোমার ওপর আমার সন্দেহ হবে না। আসলেই হত না। তোমার মত ভীতুর ডিম যে আমাকে ঘুমের ঔষধ দিতে পারে তা ভাবিওনি। কিন্তু দিন কে দিন তোমার সাহসের উন্নতি হয়েছে। সেটা ভালো লক্ষণ। তবে আমার সঙ্গে এমনটা না করলেও পারতে ডিয়ার!

-স্যার আপনাকে ভালোবাসেন ম্যাম।

-জানি সেটা। নতুন কিছু শুনতে চাচ্ছি। ফালাকের গ্যাং কোথায়? সে কি এখনও যুক্ত আছে? ইরফানের কাছে ও মাথা বেঁচে বসে আছে কেন? কিসের জন্য?

-আপনার জন্য।

-আমার জন্য?

-আর কিছু বলতে পারবো না ম্যাম। কিছু জিজ্ঞেস করবেন না প্লিজ।

রোজ মৃদু হেসে বলে,
-ওকে করলাম না। ফিরে গিয়ে তোমার স্যারকে বলবে তুমি সব কাজ ঠিক ঠিক করেছো। আর আজকের এই কথাগুলো বলার দরকার নেই, সময় সুযোগ বুঝে আমি নিজেই জানিয়ে দেবো। মনে থাকবে?

-জ..জি ম..ম্যাম।

সিয়াম চলে যেতেই রোজ আইডি কার্ড নিয়ে বেরিয়ে গেল। সাইমুন কল দিচ্ছে। ছেলেটার কাজে প্রচন্ড রাগ হচ্ছে রোজের। এত বিরক্তি সহ্য করা যাচ্ছে না। একটা ক্যাফে রোজকে ডেকেছে সাইমুন।রোজ উপস্থিত হতেই দেখলো ক্যাফ পুরো ফাঁকা।সাইমুন একা একটি চেয়ারে বসে কফি পান করছে। রোজকে দেখে সে এগিয়ে এসে কুর্নিশ করে স্বাগত জানালো। রোজ গায়ের জ্যাকেট খুলে সাইমুনের হাতে দেয়। বাইরে ঠান্ডা পড়লেও ভেতরে বেশ গরম। রোজ বসতে বসতে বলল,

-কফি উইথআউট সুগার। হট চকলেট এ্যান্ড পেস্ট্রি।

সাইমুন অর্ডার কনফার্ম করে সামনে বসলো। রোজের ঠোঁটের কোনায় সূক্ষ্ম হাসি ঝুলে আছে। সাইমুন হেসে বলে,

-চিনি ছাড়া কফি? গলা মিষ্টি করার নতুন ট্রিক নাকি?

-হতে পারে। তুমি তোমার কথা বলো। কেন ডেকেছ?

-তুমি কি ফারহানকে ভালোবাসো?সত্যিটা বলবে প্লিজ। বাসো কি বাসো না?

-কি মনে হয়?

-জানি না। তুমি বলো।

-তোমার ফ্যামিলি সম্পর্কে বলো। ইউ নো হোয়াট, আ’ম কোয়াইট ইন্টারেস্টেড টু ইয়্যু।

-আমারও ফ্যামিলি নেই। একা একাই বড় হয়েছি।

-তাই? (সন্দিহান কন্ঠে)

-হ, হ্যা। তা ছাড়া কি? তুমি জানো না? সবাই তো জানে। (তোতলানো কন্ঠে) এবার বলো ফারহানকে কি তুমি এখনও ভালোবাসো?

-এক্চুয়ালি হ্যাঁ। বাসি, আজীবন বাসার চিন্তাও করে রেখেছি। ওর কোনো ফল্ট না পেলে তো ওকে ছাড়তে পারবো না। যেহেতু ও এত ভালোবাসে আমাকে।

-তুমি অপছন্দ করো কি?

-অপছন্দ! প্রতারণা, ধোকা, বিশ্বাসঘা’ত’কতা। কিন্তু তুমি জানো,আমি এগুলোও ভালোবাসি। কারন এগুলো ভিন্নস্বাদের অনুভূতি।

-যদি কখনও জানো ফারহান তোমার সঙ্গে বিশ্বাসঘা’ত’কতা করেছে? আর একজন তোমাকে নিঃস্বার্থে ভালোবেসেছে। তখন কাকে বেঁছে নেবে?

-সেকেন্ড অপশন। যে নিঃস্বার্থে ভালোবেসেছে। কিন্তু সে যে নিঃস্বার্থ হয়ে ভালোবেসেছে এটার কি প্রমাণ? আর আমি তা মানবো কিভাবে?

-ফারহান তোমাকে আঠারো বছর ধরে চেনে।তুমি তাকে ছাড়তে পারবে তো?

-আমাকে তুমি ঠিক চেনো নি সাইমুন। আমি মানুষটা কিছুটা হলেও স্বার্থপর। আমি যা চাই তা পেয়েই ছাড়ি। জেদের কমতি নেই আমার মাঝে। তাই যদি টের পাই এমন কিছু হয়েছে, আমি ফালাক কেন? তোমাকেও ছেড়ে দিতে পারি। সো বি কেয়ারফুল। আমার জীবনে আসার আগে এসব জেনেই আসবে।

-আমি রাজি।

-রাজি? আমাকে পাওয়া কিন্তু এতটা সহজ হবে না।

-যেটা সহজেই পাওয়া যায় মানুষ তাঁর মর্ম বোঝেনা। তুমি বলেছিলে এটা।

-আমি তো অনেককিছুই বলি। সবটা সিরিয়াসলি নিতে হবে নাকি?তাছাড়া আমি তোমার কেন হবো? কি আছে তোমার? না ফ্যামিলি, না ফেম!

-তুমি আমার হবে কারন আমার কাছে সেসব আছে যা তোমার চাই।

-কি?

-সত্য!

-বলে ফেলো। শোনার পর ভেবে দেখবো তোমার হতে চাইবো কিনা।

-আমি তোমাকে ভালোবাসি রোজ।

রোজ বিরক্তি নিয়ে তাকালো। সাইমুন বলতে শুরু করে।
-আশা করবো তোমাকে না ঠকালে তুমিও আমাকে ঠকাবে না। তোমাকে ভালোবাসি তাই বিশ্বাস করে সব বলছি।

-তোমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবো আমি।

-আমার সঙ্গে চলো। এখানে এসব বলা যাবেনা।

-কপালের ব্যান্ডেজটায় ব্যাথা করছে অনেক। পাল্টানো হয়েছে একটু আগে। বুঝতে পারছি না কি হয়েছে। খুলে দেবে একটু। যন্ত্রণা হচ্ছে খুব।

-দিচ্ছি।

রোজের ব্যান্ডেজ খুলে সাইমুন তা ড্রেনে ফেলে দিলো। রোজ মৃদু হেসে বাইকে উঠলো। সাইমুন রোজকে নিয়ে ওর অতি পরিচিত ও গোপনীয় একটি জায়গায় এলো।রোজ চারপাশে চোখ বুলিয়ে যা বুঝলো তা হচ্ছে এটা জঙ্গলের মধ্যে এক শিকারির বাসা। সাইমুন রোজকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে রোজের জন্য খাবার তৈরি করে। তখন কিছু খাওয়া হয়নি। এখন খাওয়া প্রয়োজন তার ওপর রোজ অসুস্থ। রোজ খেতে শুরু করলো। সাইমুন আতঙ্কিত চোখে চেয়ে আছে। সত্যাটা কিভাবে বলবে সে? খাওয়া শেষ হতেই রোজ কৌতুহলী কন্ঠে বলে,

-এবার বলো। ফালাক কি করেছে? তোমার কি আছে?

-আমার মা আর ভাই বাদে সবাই আছে।

-কি?

-এ্যন্টি টেরোরিজম ইউনিটের অতিরিক্ত ডিআইজি ইশতিয়াক ইরফান আমার বাবা। আর মুগ্ধতা মেহরীম আমার আপু। ফারহান আমার চাচাতো ভাই।

-কি বলছো এসব? (অবাক কন্ঠে)

সাইমুন রোজের কাছে এসে রোজের হাত জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। রোজ অগোচরে স্মিত হাসে। সাইমুন বলতে শুরু করে।

-ঠিক সাত বছর আগে থেকে তোমাকে চিনি আমি।তবে তোমাকে ভালোবাসি তোমার পরিচয় না জেনেই। আমি আর’জে রোজকে ভালোবাসি। আমি জানতাম না তুমি সাফোয়ান আনসারীর মেয়ে। ট্রাস্ট মি রোজ, আমি কিছু জানতাম না।

-মজা করছো তাইনা?

-না। আজ তোমাকে আমি সব সত্য বলবো। বাবা বোন সবার বিপক্ষে গিয়ে সবটা বলবো আশা করবো তুমিও আমার পক্ষে থাকবে।

-বলো।

-আমার বাবার চোরাচালানের ব্যবসা ছিল। ইউনিটের আরও কিছু সদস্য এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। তোমার বাবা সব জানতেন। ফারদিন চাচ্চুও জানতেন। চাচ্চুর সঙ্গে তোমার বাবার ঝগড়াও হয়েছিল কারন চাচ্চু তাকে নিষেধ করেছিলেন আমার বাবার সঙ্গে ঝামেলা করতে। কিন্তু তোমার বাবা সৎ ছিলেন তাই তিনি সে বারণ শোনেননি। ফারহান তখন সবে সবে আন্ডারওয়ার্ল্ডে ঢুকছে। বাবার কথাতেই আগ্রহবোধ করে সে এসেছিল এই কালো দুনিয়ায়। ফারহান জানতো বাবা সাফোয়ান সাহেবকে মা’রার পরিকল্পনা করছে। চাচ্চুও জানতো। তারা চেষ্টা করেছিলো তোমার বাবাকে বাঁচানোর কিন্তু বিষয়টা গোপন ছিল বলে কেউ জানে না। সবাই জানে তারা জেনেও তাকে আটকায়নি। এমনকি চাচ্চু স্পটেও চলে গিয়েছিল। কিন্তু বাবা তাকে দেখে নিজের প্লান বদলে চাচ্চুর হাতেই তোমার বাবাকে মা’রে। আর বলে তোমাকেও মে’রে ফেলবে যদি তুমি বুঝে যাও এসবের পেছনে বাবা আছে। তারপর তোমার আর ফারহানের ঝামেলা হয়। ফারহান তখন তোমার বাবার কথা জানতো না। তাই আন্ডারওয়ার্ল্ডে নিজের আধিপত্য বিস্তারের নেশায় বুদ হয়ে গেল।চাচ্চু ধুকে ধুকে ম’রতে থাকলো অপরাধবোধে। ফারহান সবটা জানার পরও তোমার কাছে আসেনি কারন ও তোমাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছিল। ও ভেবেছিল তুমি ওকে ঠকিয়েছো। তাই পাঁচবছর সে জমিয়ে রাজত্ব করলেও সবার সামনে বলেছে দুবছর সে ওসব করতো। আসলে তা ঠিক নয়। ফারহান এখনও এই জগতে আছে। এই জগতে একবার ঢুকলে ফেরা কঠিন, অন্ততো বেঁচে ফেরা। কেউ ভালো হতে চাইলেও এই জগত তাকে ভালো হতে দেবে না। ফারহানও আড়াইবছর ধরে চেষ্টা করছে এই জগত ছাড়তে কিন্তু পারবে না । কারন ওর দল বিপদে পড়ে যাবে যদি ও এসব ছেড়ে দেয়। তাই ও তোমাকে কালোজগত ছাড়ার যে কথা বলেছে তা মিথ্যা। তোমার পেছনে ও সর্বদা নজর রেখেছে কারন তোমাকে পাওয়ার নেশা ওর জেদ, ওর স্পৃহা। তোমাকে ও নিজের করেই ছাড়বে। অথচ সবার সামনে দেখাচ্ছে সে তোমার খোঁজও জানে না। চারবছর আগে আমার আপুকে বিয়ে করার প্রস্তাবে সায় দিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যায়ে আপুকে ছেড়ে দেয়। আমার আপু ওর জন্য কি করেনি? পাগলের মত ভালোবেসেছে, ফারহান ওকে ছুঁয়ে দেখেছে আর বিয়ের সময় আসতেই পাল্টি খেল। বিয়ের দিন ওর তোমার কথা মনে পড়লো, আর আগের দিনগুলো? আমার আপু তবুও ওকে ভালোবেসেছে।

তোমার বাবার নামে যে একশ কোটি টাকা আছে সেটা চায় সবাই। আমার বাবা, তাঁর দল। আর ফারহান চায় তোমাকে নিজের করতে।

রোজ হাই তুলে বলে,
-মেইন পয়েন্ট বলো।ফালাক ও তাঁর বাবা কেন কিভাবে দোষী সেসব কারন শোনায় আমার আগ্রহ নেই, তোমার খু’নি বাবার কথা বলো তুমি।

-বললাম তো। আর জানি না।

-প্লিজ বলো সাইমুন। আমার মা’কে কেন মা’রলো তোমার বাবা? তাঁর তো কোনো দোষ্ ছিল না। আমাকে প্লিজ সবটা বলো। তোমার বাবা এখন কি চায়? আমার পেছনে পড়ে আছে কেন?

-জানি না আমি।

রোজ কোমরে গুজে রাখা পি’স্ত’ল বের করে সাইমুনের বুক বরাবর দুটো গু’লি করে বলে,
-শু***** বাচ্চা! কোনো কিছুই যখন বলবি না তখন আমাকে নিয়ে আসলি কেন? তোর বাপটা দেখছি তোর জীবনেরও তোয়াক্কা করেনা। তো আমার কি এমন ঠেকা পড়ছে তোকে বাঁচানোর?

রোজ সাইমুনের ফোনটা বের করে কললিস্ট চেক করে সেটা আইজি সাহেবের অফিসে পাঠিয়ে দিলো।আইজি সাহেব সবটা শুনে বললেন,
-ওদের দুজনের কল রেকর্ডিং পেয়েছি। ইরফান প্লান করে তোমার টাকার খবর জানার জন্য সাইমুনকে তোমার কাছে পাঠিয়েছে। তুমি এখন কোথায়? সাইমুন কোথায়? ঠিক আছো তো?

-সাইমুন, আমার সামনেই মেঝেতে পড়ে আছে।

-জীবিত?

-না।

-চলে আসো। লা’শের ব্যবস্থা আমি করছি। কিন্তু আমি ভাবছিলাম তোমার নিরাপত্তার জন্য,,

-ইউনিটে বাবার পরে আপনি আছেন। আমি চাইনা বাবার প্রিয় ইউনিট অসৎ লোকে পূর্ণ হোক। ওরা যে আপনার ওপর আমার থেকেও বেশি নজর রাখছে এটা আপনার অজানা নয়। আর আপনার কিছু হলে আমি একা সবটা সামলাতে পারবো না চাচ্চু। আপনার ওপর ভরসা করেই তো এত বড় একটা পদক্ষেপ নিলাম।

-তাহলে তৈরি হও, ওদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য। আমি খুব দ্রুতই ওদের এ্যাগাইন্সটে এ্যাকশান নিবো। ওদের ঠিক সেভাবেই শেষ করতে হবে যেভাবে আনসারী শেষ হয়েছে। তখন না থাকবে বাঁশ না বাজবে বাঁশুরি।

-শুভকাজটা আমি নিজহাতে করতে চাই। তার আগে টাকাগুলো আপনি ইউনিটের ইউনিট এাকাউন্টে ট্রান্সফার করে নিন। কারোর পার্সোনাল এ্যাকাউন্টে যাবে না টাকা। আগামীকাল বা পরশু এসে অফিসিয়াল কাজগুলো করে দিয়ে যাবো।

__________

রোজের জন্য সার্প্রাইজ পার্টি এ্যারেঞ্জ করছে অয়ন্তি। ওর জন্মদিন ও সুস্থতা উপলক্ষে। অয়ন্তির বেলাতেও অনুষ্ঠান করা হয়েছিল। রোজ মানা করেনি বলে এবার ওর জন্যও করা হচ্ছে। অয়ন্তি নিজে কেক বেক করছে। বাড়িতে আজ কেউ নেই, ওরা দুজন বাদে। সবাই গ্রামে গিয়েছে। আরশান রান্নাঘরের দরজার কোনায় দাড়িয়ে আছে। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে অয়ন্তিকে দেখার পর ও এগিয়ে আসে। অয়ন্তি আটা গুলাচ্ছিল রুটি বানানোর জন্য। আরশানকে আসতে দেখে সে দ্রুত সরে দাঁড়াল।
-একদম আসবেন না। এখন কিছু হবে না। কোনো চুঁমু টুমুও না।

আরশান পানি পান করার জন্য গ্লাস নিতে নিতে বলে,
-তোমার মনে দেখছি সবসময় ওসব নাচছে। মনটাকে পবিত্র করো।

-আমার মন ঠিকই আছে। আপনি আমাকে জ্ঞান না দিয়ে নিজের স্বভাব বদলান।

-বদলাবো না। কি করবে কুসুম?

-আটায় গোসল করাবো। করবেন নাকি?

-না।

অয়ন্তি ঠোঁট টিপে হাসে।
-আজকে তাহলে আটাতেই গোসল সাড়তে হবে মাই ডিয়ার হাসবেন্ড। আপনার অত্যাচার অনেক সহ্য করেছি আজ আমার পালা।

অয়ন্তি দুহাতে আটা নিয়ে তেড়ে আসতেই আরশান ভ্রু কুচকে তাকালো। অয়ন্তি সত্যি সত্যি আসছে নাকি? আরশান দূরে সরে দাঁড়ালো।
-এমন করবে না কুসুম। ঠান্ডা লেগেছে আমার।

-লাগুক।

-ওকে। আমিও আটায় ডুবাবো তোমাকে।

অয়ন্তি আরশানের মুখের ওপর আটা ছুড়ে দিতেই আরশানও আটা এনে অয়ন্তির চুলে ঢেলে দিলো। রোজ এসে ওদের রান্নাঘরে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখে সোজা নিজের জন্য বরাদ্দ ঘরটাতে চলে গেলো।দরজা আটকে দিয়ে সে ইয়ারফোনে গান শুনছে। দরজা সে সন্ধ্যার আগে খুলবে না। বলা যায় না এরা ওকেও আটার ভুত বানিয়ে দিতে পারে।

অয়ন্তি দৌড়ে হাঁপিয়ে গেছে। পুরো রান্নাঘর আটায় মাখামাখি। আরশান মেজাজ দেখিয়ে বলে,
-চলো। গোসল করে নেবে। এভাবে থাকলে এলার্জি হবে তোমার।

-এগুলো কে ঠিক করবে?

-পরে দেখছি। তুমি চলো।

-কিন্তু,,

-কোনো কথা না কুসুম। চলো।

আলামারি থেকে জামা বের করে বিছানার ওপর রাখে অয়ন্তি। আরশান আগে গোসলে ঢুকেছে। অয়ন্তি চুলের শুকনো আটাগুলো ঝেরে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। একেবারে ভুত বানিয়ে দিয়েছে। চুলের আটা ছাড়াবে কি করে?
-ইশ! চুলগুলো বোধ হয় গেল এবার। অত্যাচারী বর!

আরশান বাথরুমের ভেতর থেকে ডাকে,
-কুসুম আমার তোয়ালে দাও। নিতে ভুলে গেছি।

-পারবো না। আমার কি হাল করেছেন? নিজের তো কদমছাট চুল। একটু শ্যাম্পুতেই উঠে যাবে। আমার তো এক বোতলেও কাজ হবে না। বোতল বোতল ঢাললেও আমার চুল ঠিক হবে না। চুল থেকে এসব ছাড়াবে না।

-আসো ছাড়িয়ে দেই।

-থাক, অসংখ্য ধন্যবাদ।আপনার ছাড়ানোর মানে ভিন্ন। দরকার পড়লে এই চুল নিয়েই থাকবো। তবুও আপনার কাছে গিয়ে চুল থেকে আটা ছাড়ানোর প্রয়োজন নেই।

আরশান শব্দ করে হেসে বলে,
-আনরোম্যান্টিক বউ! ভালো হয়ে যাও।

রোজ আইজি আরিফিনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আবারও বাইরে যাচ্ছিলো। অয়ন্তি আর আরশানের কথা শুনে সে মুচকি হাসে। ঘরে ঢুকে অয়ন্তিকে টানতে টানতে সে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিলো। তোয়ালে কাপড়ও অয়ন্তির হাতে করে পাঠিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বলল,

-দাদাই, তোমার বউ তোয়ালে সব দিয়ে গেলাম। জমিয়ে রোম্যান্স করো। আমার টিমে রোশনির মত আরও কিছু সৈন্য চাই। তাদের আনার ব্যবস্থা করো জলদি। আমি কলেজে যাচ্ছি। ফিরতে সাত-আটটা বেজে যাবে। চিন্তা করো না।

-আমারটা তো চলে আসবে। তোর নিজের দায়িত্ব নেই? বিয়েশাদী করে মামা ডাক শোনা। কতদিন চাচ্চু আর আব্বু ডাক শুনবো?

সর্বনাশ! মুখ ফসকে কি বলল আরশান? রোজ যদি এটা মজার ছলে নিয়ে ফেলে? নির্ঘাত ফাঁসিয়ে দেবে।রোজ যেতে যেতে দুষ্টু হেসে বলে,

-ভাবি, তোমার জামাইকে আব্বু ডাকে কার বাচ্চারা? ভালো করে জেনে নিও। কোথাও কিছু ঘটিয়ে ফেলেছে কিনা। ইদানিং রেডিও সেন্টারেও তাকে খুব একটা দেখা যায়না। সারাদিন, রাতের অর্ধেক সময় সে থাকে কোথায়?

অয়ন্তি চোখ রাঙিয়ে আরশানের দিকে তাকালো।পায়ের আওয়াজ মিলিয়ে যেতেই আরশান বুঝলো সে ফাঁসিয়ে দিয়ে কে’টে পড়েছে। আরশান সামাল দেওয়ার জন্য বলে,

-স্লিপ অফ টাং কুসুম। আমি ওটা মিন করিনি। আমি তো রোজকে বিয়েতে রাজি করানোর জন্য বলছিলাম। ট্রাস্ট মি আমি ঠিক টাইমে অফিসে যাই।

-এমনি এমনি এত বড় একটা কথা বলবেন? নিশ্চই কিছু আছে। আপনি আমাকে বাদ দিয়ে,

-একদম না। ট্রাস্ট মি, রোজ আমাকে ফাঁসানোর জন্য বলেছে। তুমি বিশ্বাস করলে ওটা?

-করলাম।

-কি জ্বালা।

-পানিশমেন্ট স্বরূপ আমার চুলের আটা ছাড়িয়ে দেন। তবে শর্ত আছে। শর্ত হচ্ছে চুল ছাড়া আপনার হাত আর কোথাও যাবে না। না ঘাড়ে, না গলায়, না গালে।

-তোমরা দুটোই ব’জ্জা’ত। রোম্যান্টিক মুডটাই খারাপ করে দিলা। (বিরবির করে)

-কি বললেন?

-বলছি কি, রোজের টিমমেম্বার আনার প্রয়োজন আছে তো। বোন’টা আমার কত করে চাচ্ছে। আমার একদম ইচ্ছে নেই, শুধু ওর জন্য? তুমি তো ওকে অনার স্থান দিয়েছো। অনা যদি চাইতো খালা ডাক শুনতে তুমি শোনাতে না?

-ওসব চালাকি আমার সামনে না।

-খ’চ্চ’র।

-কে?

-আমি। আবার কে? আসো আটা ছাড়িয়ে দেই।

রাতে ছাদে ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের আয়োজন করল রোজ। আরশানদের একান্ত কিছু সময় কাটানো দরকার। ঝামেলা দিয়েই বিয়ের দেড়বছর কাটিয়ে দিল। এখন যখন কুসুম সুস্থ তখন ওদের বৈবাহিক জীবনটাও স্বাভাবিক হওয়া প্রয়োজন। রোজ ছাদ ডেকোরেট করে ছাদের দরজায় তালা দিয়ে নিচে নেমে আসে। অয়ন্তি কেক সাজিয়ে রেখেছে। রোজ দ্রুত কেক কে’টে খাওয়া সম্পন্ন করলো। এরপর ওদের দুজনকে টেনে ছাদে নিয়ে আসলো। ছাদ পুরো অন্ধকার করে রাখা হয়েছে। রোজ লাইট অন করে মোমগুলো জ্বালিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখলো আরশান অয়ন্তি হা করে চেয়ে আছে। রোজ এগুলো কখন করলো? সফেদ টেবিল, রেলিঙ-য়ে ফুলের সাঁজ, রঙবেরঙয়ের মরিচবাতি। আবার টেবিলের ওপর চাইনিজ ডিশ। রান্নাঘরও ক্লিন ছিল বিকেলে। তার মানে রোজ রান্নাঘর পরিষ্কার করে নিজে রান্না করেছে? অয়ন্তি টেবিলের সামনে আসতেই রোজ কঠিন গলায় বলে,

-ছোঁবে না। আমার হাতের সুস্বাদু খাবার তুমি ততক্ষণ খেতে পারবে না যতক্ষণ না তুমি দাদাইকে ভালোবাসার কথা বলো। তাও তুমি সম্বোধনে। আমার সামনে তুমিতে বলতে হবে। বাকি সময় নিজেদের ইচ্ছেমত ডাকবে। আমার আপত্তি নেই। কি দাদাই? তোমার আপত্তি আছে?

-না, না আমার আপত্তি কিসের। আমার হৃদয় কত বড় তা তো তোদের জানাই আছে। তোদের যা ইচ্ছে বল, আমি না শুনেই সব মেনে নেবো। তোদের সুখই আমার সুখ।

-মেলোড্রামাটিক দাদাই! বেয়াদব। এখানে আমার সুখ কোথায়? নিজের কথা নিজের মত করে বলবে। তোমারই তো বউ, নাকি পরের বউ? যে সরাসরি কথা বলতে পারো না।

-বুঝিস না ক্যান? রাত হচ্ছে। চেতালে বালিশ বিছানা আলাদা করে ফেলবে রাগে।

-তুলে আনবা। আমার ফুল সাপোর্ট আছে। তবে বালিশ আমার ভাইয়ের বক্ষস্থল হলে অন্য হিসেব। এবার দ্রুত বলো ভাবি।

ওদের কথা শুনে অয়ন্তি ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে। রোজ অস্থিরচিত্তে উত্তেজিত হয়ে বলে,
-বলো ভাবি। আমি টয়লেটে যাবো। ইট্স আর্জেন্ট। কুইক ভাবি।

রোজ পেট ধরে দাড়িয়ে ছটফটানি শুরু করতেই অয়ন্তি চিন্তিত হয়ে আরশানের সামনে গিয়ে রোজের দিকে তাকিয়ে বলল,
-আমি তোমাকে ভালোবাসি। এবার যাও তুমি।তোমার কষ্ট হচ্ছে।

-উফ! আমার দিকে না। দাদাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলো। আমি তোমার ভালোবাসা দিয়ে কি করতাম? আমার জামাই ফিক্সড আছে। আমি সুদর্শন এক যুবক না মানে অভিনেতার ভালোবাসা অলরেডি পেয়ে গেছি। তাই সামনে তাকাও, দাদাইয়ের চোখে চোখ রেখে বলো, আমি তোমাকে ভালোবাসি আরশান। কুইক বলো। আমাকে যেতে হবে। কুইক ভাবি, জোর চেপেছে!

অয়ন্তি আরশানের চোখে চোখ রাখলো। নীলচোখে এই প্রথম দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে। আরশানের চোখমুখ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। মাঝে মাঝে রঙবেরঙ আলোর ঝলকানিতে আরও মোহনীয় হয়ে উঠছে সে হাস্যজ্জ্বল চেহারা। অয়ন্তি ধীর কন্ঠে বলে,
-আমি তোমাকে ভালোবাসি আরশান!

রোজ মৃদু হেসে বলে,
-ওয়ান মোর টাইম।

অয়ন্তি ঘোর লাগা কন্ঠে আবারও বললো। আরশান জবাবে নিজের ভালোবাসার কথা বলে অয়ন্তির কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। রোজ পুরোটা ভিডিও করে খাবারগুলো বেড়ে দিল। অয়ন্তি লজ্জা পেয়ে দ্রুত সরে দাঁড়ালো। আরশান বা’হাতে মাথা চুলকে লাজুক হাসে।অয়ন্তি প্রশ্ন করে,
-আমি করে নেবো। তুমি টয়লেটে যাও।

অয়ন্তির কথা শুনে আরশান রোজ দুজনেই শব্দ করে হেসে ওঠে। রোজ আরশানের ফোনে ভিডিও সেভ করে টেবিলের ওপর রেখে বলে,
-ওহ হ্যাঁ মনে ছিল না। যাচ্ছি আমি। খেয়ে নিও অনেক কষ্টে বানিয়েছি। কেমন হয়েছে জানি না, তবে একটু কম্প্রোমাইজ করো। নতুন নতুন চাইনিজ রান্না শিখছি তো। ওকে টাটা।

রোজ চলে যেতেই অয়ন্তি ভাবুকদৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
-এই না, ওর জোরে চেপেছিল? তাহলে সেটা ভুলে গেল কি করে?

আরশান বাঁকা হেসে বলে,
-বেবিও টের পেয়ে গেছে তুমি মহা বিরল জাতের বোকা। তাই তোমাকে বোকা বানিয়ে অভিনেতার প্রিয় নতুন অভিনেত্রী বউ ড্রামা করে তোমার মুখ দিয়ে এই দূর্ভাগা প্রেমিক বরটাকে ভালোবাসার কথা শোনার সৌভাগ্য করে দিল। এর জন্য ওকে দুটো সৈণ্য প্রদান করবো। এটা আমার প্রমিজ!

অয়ন্তি এবার বুঝলো রোজের নাটক। মেয়েটা এতো ফাঁজিল? আরশানের কথা শুনে সে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আরশান তা দেখে আবারও বাঁকা হেসে বলে,

-অবশ্যই তা তোমার সম্মতিতে কুসুম। সো ডোন্ট ওয়ারি মাই লাভ।

চলবে?

তুই হবি শুধু আমার পর্ব-১৮+১৯

0

#তুই হবি শুধু আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_আঠারো_ও_উনিশ

-কুসুম আমার টাই কোথায়? ওয়ালেট পাচ্ছি না। আমার মোজা কোথায়?

চেঁচামিচিতে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলল আরশান। নিচে রান্নাঘরে রান্না করছিল অয়ন্তি। আরশানের চেঁচামিচি শুনে সবাই মিটিমিটি হাসছে। অয়ন্তি তো সব খাটের ওপরই গুছিয়ে রেখে এসেছে। তাও চেঁচাচ্ছে কেন? ভারি অদ্ভুত তো। রজনী ঠোঁট টিপে হেসে বলল,

-দেবর আমার ভারি অলস অয়ন্তি। তাকে শুধু দেখিয়ে দিলে হয় না। পড়িয়েও দিতে হয়। তুমি যাও আমি বাকি রান্নাগুলো করে নিচ্ছি।

অয়ন্তি চোখ বড় করে তাকাল। কথার অর্থ বুঝতে ওর কিছুটা সময় লেগে গেলো। লোকটা ভারি অসভ্য। কি মনে করল সবাই? লজ্জায় অয়ন্তি নড়তেও পারছে না। বুয়ারাও হাসছে। এমন সময় অভি এসে দরজার পাশে দাড়িয়ে বিজ্ঞ গলায় বলে,
-চাচ্চু ডাকছে। তাঁর বোধ হয় মন টাও খুজে পাওয়া যাচ্ছে না।

কি সাংঘাতিক বাচ্চা। দশ বছরের বাচ্চা এত পাঁকা হয়? রজনী চোখ রাঙালো ছেলেকে। কিন্তু অভী তা পাত্তা না দিয়ে বলে,
-চিল মামনি! ফুপি আমাকে গ্রুম করেছে। এসব বোঝা আমার কাছে ডালভাত।

-ফুপি গ্রুম করেছে? ভুগোল বোঝাচ্ছিস? মেরে পিঠের ছাল তুলে ফেলবো। আজ থেকে তোর টিভি দেখা বন্ধ। পড়া শোনায় তো পাওয়া যায় না, অথচ পাঁকা পাঁকা কথায় ঠিক আগে চলে আসিস। যা টেবিলে গিয়ে বস।

-ছোটমা লজ্জা পাচ্ছে বলে আমাকে ঝারছো? ইটস নট ফেয়ার মামনি।

-যাবি নাকি খুন্তিপেটা করবো?

-যাচ্ছি, যাচ্ছি। কিন্তু ছোটমা তুমি যেন চাচ্চুর ঘরে যেতে ভুলে যেওনা।

অভী চলে যাওয়ার পর অয়ন্তি লজ্জায় আরও নুইয়ে পড়লো। রজনী হেসে বলে,
-অয়ন্তি রোশনির ফিডারটাও নিয়ে যাও। ওর গালে তুলে দিলেই ও একা একা খেতে পারবে।
-জি ভাবি।
-লজ্জা পেতে হবে না। আমি তোমার বড়বোনের মত। বাঁদরটা তোমাকে অনেক জ্বালাচ্ছে তাইনা? ও কিছু ভুল করলে আমাকে বলবে। আম্মা আমাকে ওর দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছেন। প্রয়জনে মে’রে সিধে করে দেবো।
-আচ্ছা।
-যাও।

রোশনিকে ফিডার দিয়ে ঘরে আসলো অয়ন্তি। আরশান আয়নার সামনে চুল ঠিক করছিল। অয়ন্তিকে আয়নার মাঝে দেখে সে দুষ্টু হাসে। অয়ন্তির চেহারায় কপোট রাগ ফুটে আছে। অয়ন্তি তেড়ে এসে আঙ্গুল তুলে শাসিয়ে বলল, ‘এই, কি সমস্যা আপনার? সব তো গুছিয়ে রেখে গিয়েছিলাম। তবুও চেঁচালেন। সবাই কিসব ভাবছে। অভিটাও ‘ আরশান অয়ন্তির আঙ্গুলে টুপ করে চুঁমু খেয়ে বলে,
-অভীকে তো আমিই পাঠালাম। যাক, ছেলে কাজের আছে।
-আপনি?
-হ্যাঁ।
-মহাঅসভ্য।
-ধন্যবাদ। এবার টাই বাঁধো জলদি।
-এতদিন কে বেঁধেছে?
-আমি। কেন?
-তো আজও নিজে বেঁধে নিন।
আরশান অয়ন্তির কোমর পেঁচিয়ে ধরে ফিসফিসিয়ে কলল,
-এতদিন বউ ছিল না বলে নিজে বেঁধেছি। এখন বউ আছে। তাহলে কষ্ট করতে যাবো কেন?
-কখন ফিরবেন?
-কেন মিস করবে? তুমি বললে আমি আজ বাড়িতেই থাকতে পারি। যাওয়ার মুড নেই।
-মোটেও না, আমি একটু বাড়িতে যাবো। বিকেলে ফিরে আসলে ভালো হয়।
-চলে আসবো। রেডি হয়ে থেকো।
-বলছি, অরুপির মেয়ের জন্মদিন। গিফট নিতে হবে।
-কি আনবো?
-খেলনা, জামা-কাপড়, চকলেট।
-ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি তুমি গিয়ে নিয়ে এসো। ওসব পছন্দ করতে পারিনা আমি। আর হ্যাঁ সাবধানে যাবে। ওকে?
-হুম।
আরশান এগিয়ে এসে অয়ন্তির কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে,
-আসার সময় ডক্টরের সঙ্গে মিট করে আসতে হবে।ফ্যামিলি প্লানিং , তোমার হেলথ কান্ডিশন নিয়ে কথা বলতে হবে। হসপিটালে চলে যেও।
-আপনি আসবেন না? আমি একা যাবো?
-তুমি গিফট কিনতে কিনতে চলে আসবো আমি।
-ঠিক আছে।

_________

সোনালী ব্যাংকের সামনে দাড়িয়ে আছে রোজ। লকারে বাবার গুরুত্বপূর্ণ কাগজ আছে সেগুলো নিতেই এসেছে ও। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো অন্য জায়গায়, ডি.আই.জি ইরফানের চামচাগুলো রোজকে খুজে বের করে নজর রাখতে শুরু করেছে। ব্যাংকে ঢুকলেই বুঝে যাবে কিছু একটা আছে ব্যাংকে। রোজ ব্যাংকের সামনে বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। ফারহানের সঙ্গে সেদিনের পর আর কথা হয়নি। সাতমাস হয়ে গেল। ফারহানের নতুন মুভির শ্যুটিং শুরু হয়েছে। রোজ ফোন বের করে সেলফি তুললো বেশ কয়েকটা। যারা ওর ওপর নজর রাখছিল তারা থতমত খেয়ে একে অন্যের দিকে তাকায়। কি করছে রোজ? সেলফি তুলে রোজ পকেট থেকে টাকা বের করে পথের ভিখারিদের দিয়ে চলে গেল। চামচাগুলো ভাবল ওদের সঙ্গে রোজের লিংক আছে। তাই ছুটে এসে ওদের জেরা করতে থাকে। কিন্তু কিছু জানতে পারলনা। জানবে কি করে? রোজের সঙ্গে তো ওদের কোনো সংযোগ নেই। রোজের সংযোগ তো ব্যাংকের সাথে। তাই সামনের গেটে গন্ডোগোল করে রোজ পেছনের গেট দিয়ে ঢুকে গেলো। লকারের পাসওয়ার্ড জানে রোজ। তাই ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলেই সে লকার থেকে সকল জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার পথে সে দেখলো, চামচাগুলো এখনও ভিখারিদের মা’রছে। রোজ পুনরায় গিয়ে ধমকিধামকি দিয়ে উঠতেই ভিখারিরা বলে দিল ওরা রোজের খোঁজ করছে। রোজ ভ্রু কুঁচকে বলে,
-আমার খোঁজ করছিলেন কেন? আর ওনার সঙ্গে কি কাজ থাকবে আমার? আমি তো যাস্ট টাকা দিলাম। কিন্তু কথা সেটা না,কথা হচ্ছে আপনারা আমাকে ফলো করছেন কেন? কিসের জন্য? কার কথায়?

-স্যার আপনার নিরাপত্তার জন্য আপনার ওপর নজর রাখতে বলেছে ম্যাডাম।

-নিরাপত্তা? তাহলে এদের জেরা করছেন কেন? কাহিনি কি? কোন স্যার?

-স্যরি ম্যাডাম।

লোকগুলো দ্রুত বাইকে উঠে পড়তেই রোজ অসহায় ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে ডাকে,
-আরে কি অদ্ভুত! বলে যাবেন তো কোন স্যার? কে আমার নিরাপত্তার জন্য পাঠিয়েছে? এই যে…

ওরা দ্রুতবেগে চলে যেতেই রোজ স্মিত হাসে। পাশের ভিখারিদের সামনে গিয়ে দশ হাজার টাকার দুটো বান্ডিল দিয়ে বলে,
-ধন্যবাদ। আপনাদের জন্য আমার কাজটা হয়ে গেছে। এটা রাখুন, ভালো পোশাক কিনবেন, জুতো কিনবেন, খাবেন। ঠিক আছে?

-আল্লাহ তোমার ভালো করুক মা। তুমি যা চাও তিনি যেন তোমাকে তাই দেয়।

-দোয়া করবেন চাচা।

রোজ উঠে পকেটে হাত গুজে দাড়ায়। পেনড্রাইভটা সে পকেটে রেখেছে। এটা খুব শীগ্রহই আই.জি সাহেবের কাছে পাঠাতে হবে। উনি ডিপার্টমেন্টের একজন সৎ ও বিশ্বস্ত মানুষ। বাবার মুখে তাঁর প্রশংসা অনেক শুনেছে রোজ। কিন্তু এখনই পেনড্রাইভটা পাঠালে টাকাগুলো তোলা কঠিন হয়ে যাবে।যে একশকোটি টাকা আনসারী সাহেবের নামে আছে সেই টাকার হদিশ এই পেনড্রাইভে আছে। রোজকে সেটা খুজে টাকাগুলো ট্রান্সফার করে নিতে হবে নিজের এ্যাকাউন্টে তাহলে টাকাগুলো অন্য হস্তে চালান হতে পারবে না। কিন্তু এতগুলো টাকা তো ট্রান্সফার করাও কঠিন। যেহেতু রোজের ব্যাকগ্রাউন্ড নেই, তাই ট্রান্সফারের সময় কাজে বিঘ্ন ঘটবে। রোজ নিজের পরিচয়ে আনবে টাকা? না, তাতে ইরফান সাহেবের নজরে পড়ে যাবে টাকা। আর উনি তো লালা ফেলে টাকার প্রত্যাশায় আছেন। টাকাগুলো রোজ বেহাত হতে দেবে না।

আড়াই বছর হতে চললো রোজের এই গোপনীয় জীবনের। টাকাগুলোর জন্য হলেও এবার ওকে সামনে আসতে হবে। কিন্তু জকি হিসেবে নয়, নতুন কোনো পরিচয়ে। আর পরিচয়টা জনপ্রিয় হতে হবে। কি পরিচয়? অভিনয় রোজের দ্বারা হবে না, হলে ফারহানের সাহায্য নেওয়া যেতো। রেডিও সেন্টারে রোয়েন তালুকদার এসেছিল, উনি রোজের কন্ঠ শুনে প্রশংসা করেছিলেন। বলেছিলেন অনুশীলন করলে সে গান গাইতে পারবে। রোজের কি এটা ভাবা উচিত? কিন্তু পরিচিতি পেতেও তো সময় লাগবে। রোজের কন্ঠ সুস্পষ্ট, টিউন, কথাগুলোও দারুন। এজন্যই তো জকি হিসেবে দারুন পাবলিসিটি পেয়েছিল। রোজের কি উচিত হবে এই প্রফেশনে আসা? রোজ রাগে থরথর করে কাঁপছে। এই প্রফেশনে আসলেও তো দশকোটির উপরে ইনকাম হবেনা তাহলে বাকি নব্বই কোটির হিসেব কিভাবে মেলাবে? হাতে তো বেশি সময়ও নেই। আর রোজের দ্বারা গান হবে কিনা সে ব্যাপারেও তো রোজ নিশ্চিত না। যদি গান না হয়? প্লান বি রেডি করে রাখতে হবে। নাকি কোনো হ্যাকার এ্যাপোয়েন্ট করবে। কিন্তু এটা তো বেআইনি! ধরা খেলে টাকাও যাবে, আর ওরাও।

রোজ বাড়ি ফিরে দেখলো সোফার কোনায় রাখা ছোট এ্যাসিডের শিশিটা পড়ে সোফা পুড়ে গেছে। রোজ হাতে গ্লাভস পড়ে পড়ে শিশিটা উঠিয়ে বন্ধ করল। এমনিতেই ওর মাথা কাজ করছে না টেনশনে, তার ওপর এমন বিরক্তিকর ঘটনা। রোজ ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল বের করে গ্লাসে পানি ঢালে। পানি খেতে খেতে সে ভাবছে কি করা যায়। টার্ম এক্সাম সামনে মাসে। পড়া সব শেষ হলেও চিন্তা একটা থেকেই যাচ্ছে। পাঁচ বছরের কোর্স শেষ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে ওকে। তিনবছরের কোর্সটা করতে পারলো না স্নাতক পাশ না করার জন্য। একদিক থেকে ভালোই হয়েছে অনার্সে চার বছর প্লাস জার্নালিজমে তিন বছর, মোট সাত বছরের চেয়ে পাঁচ বছরের কোর্স বেশি উপোযোগী। রোজ ফোন ঘাটতে ঘাটতে টিভির দিকে তাকালো। দেশে নির্বাচন নিয়ে ঘটা সমাবেশের আয়োজন চলছে।রোজের সব চিন্তা নিমিষে মিটে গেল। পত্রিকা থেকে রোজকে রিপোর্ট তৈরি করতে বলা হয়েছিল। সেটা তৈরির করার সময় এসেছে। রোজ আজই ফিরবে ঢাকায়। আড়াই বছরের অপেক্ষার ফল যে মিষ্টি হতে চলেছে।

_______________

হসপিটালের সকল চেক আপ শেষ করে বাড়ি ফিরছে আরশান’রা। অয়ন্তি ঘুমাচ্ছে ওর কাঁধে মাথা রেখে। আরশান ওকে একহাতে জড়িয়ে ধরে গাড়ি চালাচ্ছে। হঠাৎ গাড়ির ধাক্কায় অয়ন্তির ঘুম ভেঙে যায়। খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখেছে সে। অস্পষ্ট পুরোনো স্বপ্নটা। যেটা মনে পড়লে অয়ন্তির শরীর খারাপ করে। মাথা যন্ত্রণায় ছিড়ে যায়। অয়ন্তি হাউমাউ করে কেঁদে উঠতেই গাড়ি থামাল আরশান। অয়ন্তির সমস্যা বুঝতে পেরে সে অয়ন্তিকে জড়িয়ে ধরে অয়ন্তির মাথায় হাত বুলাতে থাকে।
-কিচ্ছু হয়নি কুসুম, দেখো কোনো র’ক্ত নেই। কেউ নেই। আমি আছি তো। ভয় পায় না, কাঁদে না। কান্না থামাও কুসুম। কষ্ট হবে পরে।

-অনাপি, অনাপি।

-হু, হু।কথা না। চুপ করো। কিচ্ছু হবে না তোমার। কিচ্ছু না। আমি আছি না? তোমার কিছু হতে দেবো না আমি।

অয়ন্তি আরশানের শার্ট খামচে ধরে। আরশান এসি অন করে দিল। গরমে, ভয়ে ঘামে-নেয়ে একাকার মেয়েটা। আরশানের ফোনে ম্যাসেজ আসে। ম্যাসেজটা চেক করতেই শুনলো পরিচিত কন্ঠটি। রোজের কন্ঠ। অয়ন্তি কান খাড়া করে শোনে,
-কেমন আছো? ভাবি কেমন আছে? বাড়ির সবার কি খবর? রোশনির ঠান্ডা কমেছে? ভাবির পরীক্ষার প্রস্তুতি কেমন? কাল থেকে পরীক্ষা শুরু না?তাকে আমার হয়ে অল দ্যা বেস্ট বলে দিও দাদাই। টাটা!

আরশান ম্যাসেজের রিপ্লাই দিয়ে যখন নতুন ম্যাসেজ লিখবে তখনই দেখলো ম্যাসেজ সেন্ট হচ্ছে না। যার অর্থ রোজ সিম বন্ধ করে ফেলেছে।কিন্তু রোজ জানলো কি করে রোশনির ঠান্ডা লেগেছে? এমনকি ওদের প্রতিটা খবর রোজের কাছে যায়। কিভাবে? অয়ন্তির কান্না থেমে গেল। প্রশ্নসূচক দৃষ্টিপাত করে সে বলে উঠল,

-রোজ সব খবর পাচ্ছে কি করে? আমাদের আশেপাশে কি থাকে ও? আমরা পাইনা কেন ওকে?

আরশান নিজেও জানে না এই প্রশ্নের উত্তর। কিন্তু এই মুহূর্তে এসবের থেকে অয়ন্তি বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাই সে উদ্বিগ্ন কন্ঠে প্রশ্ন করে,
-এখনও কষ্ট হচ্ছে? শ্বাস নাও। কথা বোলো না। (বেবির টাইম সেন্স এত ভালো? ঠিক টাইমে ম্যাসেজ পাঠিয়েছে নাহলে কুসুমকে সামলানো কঠিন হতো। কিন্তু সবকিছু টের পাচ্ছে কিভাবে ও? আমাদের বৈবাহিক জীবন থেকে শুরু করে, আশাপাশের সকল ঘটনা সম্পর্কে ও অবগত। কে দিচ্ছে খবরাখবর?)

অয়ন্তি চুপচাপ আরশানের বুকের মাঝে ঘাপটি মে’রে পড়ে রইলো। কিন্তু রোজের কাহিনিগুলো একটু অদ্ভুত ধাঁচের। অয়ন্তির মাঝে মাঝে রোজকে প্রহেলিকা মনে হয়। কেমন জটিল ধাঁধার মত! ওদিকে আরশানের মনে অয়ন্তির চিন্তা। অয়ন্তির মাথার স্কান পাওয়া গেছে। সেখানে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হচ্ছে ওর স্মৃতিতে। অয়ন্তির মন মস্তিষ্কে দূর্ঘটনার স্মৃতি চেপে বসেছে। সেটা দূর করতে হবে। কিন্তু এর প্রপার সলুশনও তো নেই। ডাক্তাররা যা বলছে তা করা অসম্ভব। দ্বিধা-দোটানা নিয়ে আরশান অয়ন্তির প্রাণের ঝুঁকি নেবে না। বাড়ির সবারও একই মত। কেউ সাহস পাচ্ছে না, কারোর সাহস নেই অয়ন্তিকে নিয়ে ভয়ঙ্কর কাজটা পরীক্ষা করা।

___________

শ্যুটিং শেষ করে বিশ্রাম নিচ্ছিলো ফারহান। ঠিক তখন রোজের ভয়েস ম্যাসেজ আসলো। ফারহান ম্যাসেজ চেক না করেই সরাসরি কল দিল। রোজ রিসিভ করে মুচকি হাসে। মানুষটা অতিমাত্রায় চালাক। ও জানে যে ম্যাসেজের সিন করা আর রিপ্লাই দেখলে রোজ সিম চেঞ্জ করে ফেলবে। তাই সময় নষ্ট না করে কল দিয়ে বসেছে। ফারহান বলল,
-কেমন আছিস?
-ভালো। তুমি দেখছি পুরোদমে অভিনয়ে লেগে পড়েছ।গুড, ভেরি গুড। তুমি কেমন আছো?
-ভালো। তুই’ই তো বললি অভিনয়ে ফিরতে। তাই তো।
-হুম। তবে সাধারণ হওয়ার কাজগুলো কি করেছ? কি কি করেছ বলো তো একটু।
-এই প্রফেশনে থেকে মুখ খোলা রেখে বাসে ট্রেনে চলা অসম্ভব চাঁদ।গতকাল রাস্তায় বের হয়েছিলাম। আর সব হুমড়ি খেয়ে পড়লো। পাবলিকের হাত থেকে ওভাবে বাঁচা মুশকিল।
-জামা-কাপড়? (কৌতুক করে।)
-শ্যুটিং টাইম বাদে, সিম্পিল। খাওয়াও সিম্পিল।
রোজ হেসে ফেললো। ফারহান রোজের হাসি শুনে বলে,
-ভিডিও কলে আয়। তোকে একটু দেখি।
-না।
-সাত মাস কোনো কল নেই ম্যাসেজ নেই। আমার কথা কি তোর মনে পড়ে না চাঁদ?
-যারা আমার কথা শোনেনা তাদের কথা মনে পড়বে কেন?
-কোনটা শুনিনি?
-ভেবে পরে বলবো। তুমি একটা গান শোনাও, আমার মুড অফ এখন।
-সামনে আয়। নেচেও দেখাই।
-হু, যা নাচো! শুধু ধরাধরি। রিসেন্ট তোমার যে গানের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে তা দেখেছি আমি।
-রিয়েলি? কেমন লাগলো? রিভিউ দে একটা।
-সত্যি করে বলো তো, ওদের ছোঁয়ার সময় কেমন লাগে তোমার? সত্যি বলবে কিন্তু।
-সত্যি বললে তোর খারাপ লাগবে না তো? (দুষ্টু হেসে)
-জানতাম! ক্যারেক্টারলেস হিরো! (রেগে)
-তুই কি আমাকে পুরুষ ভাবিস না চাঁদ? এটা সিম্পিল একটা ম্যাটার।
-সিম্পিল? তুমি অন্য মেয়েকে চুঁমু খাবে, পেটে ধরবে, যেখানে সেখানে টাচ করবে। মোট কথা ওসব উপভোগ করবে। এটা সিম্পিল? আমিও করে দেখাবো?
-আয়। করে দেখা, ওসব ফিবিং এক্সপ্রেশনের বদলে আমার সত্যিকারের এক্সপ্রেশন দেখতে পাবি।
-যাবো না। তোমার চরিত্র ভালো না।
-সেটা তো একমাত্র তুই জানিস। বাকিরা জানে আমার চরিত্র একদম ফুলের মত পবিত্র। সামান্য একাটা দাগও লাগেনি।
-রেকর্ড করে রাখলাম। ভাইরাল করে সেলিব্রিটি হয়ে যাবো।
-খুব শখ?
-বহুতততত!
-আমাকে বিয়ে করলেই হয়ে যাবি।
-ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজের ফায়দা আদায়! শেয়ানা লোক।এবার গান শোনাও, কুইক। আমার ঘুম আসছে না।

♪♪কেন! কাছে তুই এলি, যদি আবার চলে যাবি!
বল কেন! তাহলে স্বপ্ন দেখালি।
আমি জানি কোনো একদিন,
কোনো এক নতুন ভোরে।
দেখা হবে আমাদের আবার এক স্বপ্নের শহরে।

তোর সাথে ছিল বাকি,
কত কথা বলব একদিন।
একাকি নিজের সাথে,
করেছি তোর গল্প সারাদিন।
তোর কথা আসে ফিরে ফিরে,
পথ হারানোর সব কবিতায়।
আমি তোকে নিয়ে যাব আবার।
রূপকথার সেই বাড়িতে,, আয় ফিরে!!♪♪

গানের শেষটুকু গেয়ে ফারহান রোজকে ডাকলো। কিন্তু সাড়া পেলনা। মেয়েটা কি ঘুমিয়ে পড়ল? ক্লান্ত থাকলে ওর ঘুম আসেনা, আবার ঘুমিয়ে পড়লে সহজে ভা’ঙেনা তাই ফোন রেখে দিল ফারহান। ঘুমাক মেয়েটা। আজ নিশ্চই বড্ড বেশি ক্লান্ত সে। ফারহান ফোন রাখতেই রোজ ফোনটা পকেটে ভরে রাখলো।ঠোঁটে বিস্তর হাসির রেখা।

#পর্ব_উনিশ

পরীক্ষা দিয়ে সবেমাত্র বের হয়েছে অয়ন্তি। কলেজের আনাচে কাঁনাচে মিছিলের ছাঁপ। কোথায়, কিভাবে, কে কাকে ভোট দেবে, কার পক্ষে কতজন? কে কি মার্কায় দাড়িয়েছে এসবেরই গুঞ্জন। অয়ন্তির বিরক্ত লাগলো ব্যাপারটা। এসব নির্বাচনে ওর তেমন আগ্রহ নেই। এই রাজনীতি বিষয়টা ওর দু চক্ষের বিষ। কোনো এক অজ্ঞাত কারনেই সে রাজনীতি পছন্দ করেনা। কলেজ গেটের বাইরে হট্টগোলের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কি হয়েছে বাইরে? ভাবতে না ভাবতেই অয়ন্তির পাশ ঘেসে কয়েকটা ছেলে লাঠিসোটা নিয়ে দৌড়ে যেতেই ভয়ে ঘেমে উঠলো অয়ন্তি।পরিবেশ গরম হয়ে উঠছে। অয়ন্তি দ্রুতপায়ে বেরিয়ে এসে গাড়ির খোঁজ করতে থাকে। ওর গাড়ি কোথায়? ড্রাইভার কোথায়? চিৎকার চেঁচামিচিতে রাস্তা ভরে উঠলো। কোনো এক প্রতিনিধির মাথায় ঢিল মা’রা হয়েছে, তাকে হ’ত্যার চেষ্টা করা হয়েছে এমন কাহিনি ছড়িয়ে পড়েছে। পাশাপাশি কয়েকজনকে চরম ভাবে আঘাত করা হয়েছে। কয়েকজনের হাতে ছু’রি, রাম দা। অয়ন্তির মাথা ঘুরছে। রাস্তার ওপর পাশে চলে এসেছে পুলিশের গাড়ি, সাংবাদিক।

গাড়ির ভেতর চুপ করে বসে আছে রোজ। ওর সহকর্মী তুলি আর সাইমুন বের হওয়ার কথা ভাবছে। এই গরম মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি করাটা জরুরি। কিন্তু রোজের অনুমতি ছাড়া বের হওয়াও সম্ভব না। কারন স্যার রোজকে লিড করতে বলেছেন। রোজ নিজে এই দায়িত্ব যেচে নিয়েছে। তাহলে বের হচ্ছে না কেন? ওদিকে স্যার বারংবার কল করছেন পরিস্থিতি জানার জন্য। গন্ডোগোল বিরাট আকার ধারন করতেই রোজ বলল,

-নাও গো। তুলি তুমি পেছনের দিক কভার করবে আর সাইমুন সামনে। বাকিরা তোমাদের সঙ্গে থাকবে।

সাইমুন বলে, ‘আর তুমি?’

-আমি এখানে কাজের সূত্রে আসিনি। ব্যক্তিগত কারনে এসেছি। তোমাদের তো বলেছিলাম, এখানে আমি আসবো ঠিকই তবে কোনো কাজ করতে পারবো না।যা করার সব তোমাদেরই করতে হবে। সবটা জেনেই তোমরা আমার সঙ্গে আসতে চেয়েছিলে। আমি কিন্তু তোমাদের ডাকিনি।

সাইমুন রেগে কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু তুলি সাইমুনের হাত চেপে ধরে ওকে চুপ থাকতে বললো। রোজ সেটা স্পষ্ট দেখে। সাইমুন চুপ হয়ে গেলে তুলি বলে,
-আমরা তোমার সঙ্গে কাজ করতে চেয়েছি কারন তুমি সবার থেকে কিছুটা আলাদা। আর স্যারদের গুডবুকে আছো। তোমার সঙ্গে থাকলে আমাদের সুবিধা হবে।

-যখন নিজেদের প্রয়োজনেই এসেছো, তখন প্রয়োজন মিটিয়ে নাও। আমিও আমার কাজে যাচ্ছি। বেস্ট অফ লাক, অল অফ ইয়্যু। আর হ্যাঁ, আমি গুডবুকে আছি এটা কিছুটা ভুল, আমি কাজের কদর করি, সময়ের মূল্য দেই বলে স্যার আমাকে পছন্দ করেন। তোমরা লেট করে আসো, মাঝে মাঝে প্রেজেন্টেশন দাও না, অনেক সময় তাদের কথা অমান্য করো সেজন্য স্যার তোমাদের বকাবকি করে। তোমরা নিয়ম মেনে চললে তোমাদেরও সমান গুরুত্ব দেবে।

তুলি হাসার চেষ্টা করে বলে ‘হুম, বুঝেছি। সাইমুনটাই একটু ইয়ে। ‘

-ওকে। থাকো তোমরা।

রোজ গাড়ি থেকে নেমে যেতেই সাইমুন রাগে চেঁচিয়ে ওঠে। তুলি থতমত খেয়ে তাকায়। সাইমুন রাগ নিয়েই বলল,
-দেখলি, দেখলি কি ভাব? আমি তো ভালোভাবেই প্রশ্ন করেছিলাম। ভাব জমানোর চেষ্টা করছিলাম আর দেখ, এই মেয়ের এ্যাটিটিউড। ঘাউড়া, দজ্জাল। যার কপালে পড়বে সে তো মনে কর, শ্যাষ!

-কার ব্যাপারে বলছিস জানিস?

-কার ব্যাপারে?

-আরে ভাই এটা তোরই ক্রাশ! আমি সকালেই নিউজটা শুনলাম। এটা সেই আর’জে। আড়াইবছর আগে যার উপ্রে ক্রাশ খাইয়া মুখ থুবড়ে পড়ছিলি।এটা সেই রোজ।

-ওরে আল্লাহ! কি শুনাইলি? মিথ্যা কথা কইস না দোস্ত। মিষ্টি আর’জের ওপর নাহয় আমার দূর্বলতা আছে তাই বলে এই জাঁদরেল মেয়ের সঙ্গে মিলিয়ে ক্রাশ দূর করার চেষ্টা করবি? কোথায় ভালোবাসার রংমহলের মিষ্টি ভালোবাসাময় আর’জে। আর কোথায় এই খাঁটাশ মেয়ে। ওর কথা শুনছোস? কি সুন্দর, আর এর কথা? বাপ রে!

-সত্যি বলছি। এটা সেই রোজ। স্যার নিজে বলেছেন।

তুলি সাইমুনসহ আরও চারপাঁচজন খবর তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেই রোজ ফোন বের করে কাউকে কল দিল। এরপর মাথার স্কার্ফ টেনে হাতে ক্যামেরা নিয়ে এগিয়ে গেল সামনে। রোজের ঠিক পেছন বরাবর দুটো ছেলে যারা রোজের দিকে একধ্যানে চেয়ে আছে। রোজ মৃদু হাসে। অয়ন্তি রাস্তার ওপরেই বসে পড়েছে ভয়ে। নড়ার ক্ষমতা নেই। দেখার ক্ষমতা নেই। শুনতেও যেন পাচ্ছে না সে। রোজ জোরে কথা বলতে বলতে ওর সামনে দিয়ে যেতেই অয়ন্তি চোখ তুলে তাকায়।রোজকে দেখে, হঠাৎ একটা ছোট ইটের টুকরো রোজের কপাল বরাবর লাগতেই অয়ন্তি আতকে ওঠে। চিৎকার করে রোজকে ডাকে। রোজ ডাক শুনেও না শোনার ভান করে নিজের কাজ করতে থাকে। পেছনের ছেলেদুটোর একজন লরি নিয়ে আসলো। রোজ মানুষজন দেখে সাইড হয়ে দাড়ায়। অন্যছেলেটা অয়ন্তির পেছনে দাঁড়ালো। রোজ ইশারা করতেই লরিটা এসে ধাক্কা দিল রোজের শরীরে। অয়ন্তি উঠে কোনো দিকে না তাকিয়েই রোজের দিকে ছুটলো। রাস্তার ওপর র’ক্তাক্ত শরীর নিয়ে পড়ে আছে রোজ। চোখে বিস্ময়, ঠোঁটে হাসি! লরি নিয়ে যে ছেলেটা এসেছিল সে থামেনি। চলে গেছে। আর বাকি একজন দ্রুত এগিয়ে আসে। অয়ন্তির গাড়িটাই সে ব্যস্ত হয়ে চালিয়ে অয়ন্তির ঠিক সামনে নিয়ে আসতেই অয়ন্তি আবার চেঁচালো।কাঁদতে কাঁদতে সে আরশানকে ফোন দিল। বেজে বেজে বন্ধ হয়ে যায় ফোনটা। রোজ স্বল্পস্বরে বলে,

-কিছু হয়নি আমার ভাবি।

-কিছু হয়নি মানে? অনাপিকে হারিয়েছি আমি। কিন্তু তোমাকে হারাতে পারবো না রোজ। ঠিক এমন করেই অনাপি চলে গিয়েছিল। ঠিক তোমার মত স্কার্ফ, এমন পরিবেশ, এমন দৃশ্যপট।

-তোমার সব মনে পড়েছে তাইনা ভাবি?

অয়ন্তি আতঙ্কিত চোখে তাকালো। হ্যাঁ, সব মনে পড়ছে। সেদিনের এক্সিডেন্টের পুরো ঘটনা মনে পড়েছে। কিন্তু রোজের চিন্তায় সেসব স্মৃতির প্রভাব অয়ন্তির মগজে পড়লো না। ঠাই পেল না স্মৃৃতিচারণ। সে এখন শুধুমাত্র রোজকে নিয়ে ব্যস্ত। রোজ শ্লেষাত্মক হেসে ছেলেটিকে দূর্বল কন্ঠে বলে,

-টাকা তোমাদের এ্যাকাউন্টে,,

বাকিটুকু বলার আগেই চোখজোড়া বন্ধ হয়ে আসলো। গাড়ির গতি পরিকল্পনা অনুসারে আসেনি। বেগ বেশি ছিল যার দরুন রোজ আ’ঘা’তটাও বেশি পেয়েছে। ছিটকে রাস্তার ধারে পড়ে, ইটে বারি খেয়েছে মাথায়। র’ক্তক্ষরণ হচ্ছে। হাতে পায়েও বেকায়দা চোট লেগেছে। এমন হওয়ার তো কথা ছিল না। তাহলে কি এখানেও প্রতারণা করা হলো? আর কিছু ভাবতে পারলো না রোজ।নিস্ক্রিয় হয়ে আসলো মস্তিষ্ক।অসার হয়ে আসলো শরীর। কানে অয়ন্তির অস্পষ্ট কন্ঠস্বর ভাঁসা ভাঁসা এসে ধাক্কা খাচ্ছে। কিন্তু যতটুকু বুঝতে পেরেছে তা হচ্ছে রোজের পরিকল্পনা সফল হয়েছে।

অপারেশন থিয়েটারে প্রায় আধঘন্টা কেটে গেল। কিন্তু এখনও কোনো ডাক্তার বা নার্সের খোঁজ নেই। আরশান এসেছে মিনিট দশেক হলো। ড্রাইভারের সাহায্যেই অয়ন্তি রোজকে নিয়ে এসেছে এখানে। অয়ন্তির ভাব ও বচনভঙ্গিতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সে রোজের অতিমাত্রায় চিন্তা করছে। অনার কথাগুলো আওড়ে চলেছে। কিন্তু অনার ড্রেসআপ আর পরিস্থিতির বর্ণনা এত সূক্ষ্ম করে দিচ্ছে কিভাবে অয়ন্তি? তবে কি ওর সব মনে পড়ে গেছে? সেই দূর্ঘটনার রিক্রিয়েট করেছে রোজ? নাকি সবটাই কাকতালীয়? আরশান অয়ন্তিকে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে চেপে ধরে দাড়িয়ে আছে। অয়ন্তি ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে। প্রায় পনেরো মিনিট পর নার্স এসে জানালেন,

-পেশেন্টের বাড়ির মানুষ কে?

আরশান এগিয়ে গিয়ে বলে,
-আমি।

-অনেক র’ক্তক্ষরণ হয়েছে। তাই Ab- র’ক্তের প্রয়োজন। আপনাদের কারোর কি এই গ্রুপের র’ক্ত আছে? রেয়ার ব্লাডগ্রুপ হওয়ার কারনে আশেপাশের কোনো ব্লাড ব্যাংকেও এই র’ক্ত নেই।

আরশান হা করে চাইলো।এবি নেগেটিভ ব্লাডগ্রুপ নাকি রোজের?সবথেকে রেয়ার ব্লাডগ্রুপ। এই র’ক্ত তো হাতে গোনা কয়েকজনের হতে দেখেছে। এই সময় র’ক্ত পাবে কোথায়? যার তার র’ক্তও তো দেওয়া যাবে না। আগে তো শুনেছিল রোজের A+ ব্লাডগ্রুপ। সেটা ভুল ছিল? এদিকে অয়ন্তিরও ভয়ে জ্ঞান যায় যায় অবস্থা। একেই বা কোথায় রেখে যাবে আরশান? র’ক্তের ব্যবস্থা করার জন্য যেতে হলে আরশানকে তো একাই যেতে হবে। নার্সকে অন্য এক নার্স ডেকে বললেন,

-র’ক্ত পাওয়া গেছে।

নার্স চলে যেতেই আরশান অয়ন্তিকে নিয়ে বেঞ্চে বসে। অয়ন্তি অতিতের কথাগুলো আওড়াচ্ছে। আরশানের দৃষ্টি শিথিল হয়ে আসে। এতদিন ডাক্তাররা বলছিলেন পাস্ট রিক্রিয়েট করতে। কিন্তু কেউ সাহস পায়নি। আর রোজ সেটা এমন সময় হুট করে করল? নাকি অয়ন্তির যন্ত্রণা সে শুনেছে? কোথ থেকে? কার কাছ থেকে শুনেছে? আর রিক্রিয়েট করবে ভালো কথা। কিন্তু এই ভাবে? নিজেকে মৃ’ত্যুর মুখে ঠেলে দেয় কোন পাগল?

ফারহান এসেছে রাত একটার পর। আরশান বলেছিল আগামীকাল আসতে কিন্তু রোজের কথা শোনার পর সে কোনোকিছু না ভেবেই ফ্লাইট ধরে চলে এসেছে। রোজকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে, হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ, কপালের সফেদ ব্যান্ডেজটা রোজের চেহারার সঙ্গে মিলে গেছে নিদারুণভাবে। ফারহান রোজের পাশে চেয়ার টেনে বসলো। আরশান অয়ন্তি বাইরে চলে যায়। ফারহান স্তব্ধচোখে চেয়ে আছে। রোজকে আড়াইবছর পর এভাবে দেখবে ভাবেনি ও। হঠাৎ রোজ চোখ মেলে তাকালো। ফারহান হতবিহ্বল দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই রোজ বলল,

-মনোযোগ দিয়ে শুনবে।আমাকে কে র’ক্ত দিয়েছে আর লরিতে কে ছিল সেটা জানতে হবে। ইরফান এমন কাঁচা কাজ করবে না। আমাকে মা’রতে হলে সে অনেক আগেই মা’রতো। এটা অন্যকেউ। তাকে খুজতে আমার মেহমেদ ভাইয়াকে প্রয়োজন। তুমি এসবে জড়াবে না। সো ওনাকে বলো খোঁজ লাগাতে।

ফারহান নিশ্চুপ থেকে তাকিয়ে রইলো। রোজ বিরক্তি নিয়ে বলে,
-তুমি কি বলবে ভাইয়া? না বললে আমার ফোনটা দাও আমি ফোন করে বলছি।

-ব্যাথা কেমন?

-নেই। হাত-পা একদম ঠিক শুধু মাথায় একটু ব্যাথা। মানে ঘুরে উঠছে, প্রপার রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে।

-কেন করতে গেলি এমন? অয়ন্তির জন্য? ওরাই তোর সব তাইনা? একবারও আমার কথা ভাবলি না। তোর কিছু হলে আমি কি করতাম চাঁদ?

-কিছু হত না। তেমনভাবেই প্লানিং করেছিলাম। কিন্তু ওদের মধ্যেও একজন বিশ্বাসঘা’ত’কতা করেছে।

-এসবের থেকে ফিরে আয় চাঁদ। এসবের কি দরকার? কেন করছিস এমন? আঙ্কেল তোকে ঝুঁকি নিতে বলেছে এমন কপটতা কেন? এসবে একবার কেউ জড়িয়ে গেলে ফিরে আসার পথ থাকে না। তুই এখনও পুরোটা জানিস না। তাই ওদের সঙ্গে শত্রুতা করিস না চাঁদ, প্লিজ! তোর অভিমান আমার ওপর তো? আমি তো সব ছেড়েই দিচ্ছি। তবুও জেদ পুষে রাখছিস কেন?

-যদি বলি,সবাই আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘা’ত’কতা করেছে, সেজন্য।

ফারহান কম্পিত কন্ঠে বলল,
-ম..মানে?

-নিজে খুজে বের করো মানে। বাই দ্যা ওয়ে কল করবে নাকি?

ফারহান কল করে রোজের হাতে ফোন দিয়ে দিল। ঘাম কপাল গড়িয়ে শার্টের ওপর পড়ছে। বুক কাঁপছে ভয়ে। রোজ কিসের ইঙ্গিত দিল? সবাই বিশ্বাসঘাতকতা করেছে মানে? ও কার কথা বলছে? কি কি জেনেছে? রোজ কি ওর কথাও জেনে গেছে? ফারহান কি করেছে সেটাও? ফারহান শার্টের হাতা দিয়ে কপাল মুছতেই রোজ তা দেখে তাচ্ছিল্য হাসে। ভুল করলে অটোমেটিক ভয় চলে আসে, চিন্তা হয়, ছটফটানি ভাব আসে। এই মুহূর্তে ফারহানের সেই ভীত দশা রোজকে চিন্তিত করল না, কষ্টও দিল না। বরং ওকে উপহাস করার সুযোগ তৈরি দিল। কিন্তু রোজ এখন সেটাও করতে চায়না। কি লাভ ফারহানকে উপহাস করে? মানুষটাকে তো নিজের মনে করে রোজ।আর রোজ নিজের মানুষ বা অন্যকেউ কাউকে তাঁর দুর্বলতা নিয়ে উপহাস করতে শেখেনি।

______________

অয়ন্তিকে খাইয়ে দিয়ে ওকে বসিয়ে রেখেছে আরশান। ডাক্তারের সঙ্গে একটু আগেই কথা বলে এসেছে সে। কিছুদিন রেস্ট নিলে অয়ন্তি একদম সুস্থ হয়ে যাবে।মগজের চাপ কমে যাবে। শক্ডের কারনে সব স্মৃতি ফিরে এসেছে ঠিক তবে এসব হৃদয় বিদারক স্মৃতিগুলো ভুলতে ও মানিয়ে নিতে একটু সমস্যা হবেই। অয়ন্তি আরশানের দিকে চেয়ে বলে,

-আমার সব মনে পড়ে গেছে। আ’ম স্যরি!

-কেন?

-আসলে, আপনার সঙ্গে আমি মজা করেছিলাম। মানে, দেখতে চেয়েছিলাম নীলচোখের মানুষটা আমাকে দেখলে অদ্ভুত ব্যবহার কেন করে। তাই আরকি ওমন বিহেভ করেছি। আর আপনি ভেবেছেন আমি আপনার ভালোবাসায় সায় দিয়েছি।

-এখন এসব বলার সময়?

-না, কিন্তু বলে রাখা ভালো। ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা হবে না।

-হুম তা ঠিক।কিন্তু অতিতে কি করেছো তা নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ বা আপত্তি নেই কুসুম। আমি বর্তমান নিয়েই খুশি। আর তোমাকেও খুশি রাখতে চাই।

-আমিও খুশি। এভাবেই থাকতে চাই সারাজীবন। এখন রোজকে থ্যাংকস বলবেন না?

-সুস্থ হলে ওকে নতুন করে পেটাবো। এমন কাজ কেউ করে? যদি উনিশ বিশ হত তাহলে তোমাদের দুজনের জীবন ঝুঁকিতে পড়তো। এসব ভাবলোও না? এই ধাক্কাটা তুমি সহ্য করতে না পারলে তোমা,,, (রেগে)

-কিছু তো হয়নি! রাগ হচ্ছেন কেন?

-কিন্তু ওর অবস্থা দেখেছ? পায়ের হাড় নড়ে গেছে। হাত ছি’লে অবস্থা খারাপ। মাথার আ’ঘা’তের কথা না’হয় বাদই দিলাম।

-ও সুস্থ হয়ে যাবে। চিন্তা করবেন না। ফালাক ভাইয়া ওর পাশে আছে। ভালোবাসার মানুষ পাশে থাকলে সুস্থ হওয়ার ঔষধ বেশি কাজ করে।

-ফিলোসফিক্যাল কথাবার্তা কোথ থেকে শিখেছো? আমি তো শেখাইনি।

অয়ন্তি মুখ বাঁকিয়ে অন্যপাশে তাকাতেই আরশান হেসে ফেললো। অয়ন্তির জন্য আলাদা কেবিন নেওয়া হয়েছে তাই অয়ন্তিকে বেডে ঘুমাতে বলে আরশান কফি নিতে চলে গেল।

__________

আসসালামু আলাইকুম। হ্যালো ডিয়ার লিসেনার আপনারা শুনছেন ভালোবাসার রংমহল, এবং আমি আর’জে রোজ আছি আপনাদের সঙ্গে। প্রায় আড়াই বছর পর আবারও আপনাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে যাচ্ছি। একটু নার্ভাস লাগছে। আপনাদের প্রশ্নের বাণে ঝাঝড়া হওয়ার জন্য। সোশাল মিডিয়ায় বেতারের কথাটা পাবলিশ হওয়ার পর সবার একটাই প্রশ্ন ‘রোজ কোথায় ছিল এতদিন?’ আসলে আমার পড়াশোনার জন্য হুট করেই চলে যেতে হয়েছিল। কি পড়াশোনা তা না হয় ধীরেসুস্থে জানলেন। কিন্তু এত শত কথার মাঝে যে কথাটা চাপা পড়ে গেছে সেটা হচ্ছে ‘কেমন আছেন সবাই?’

প্রথম কলার ‘আলহামদুলিল্লাহ। উই মিস ইয়্যু রোজ ‘

‘আই অলসো মিস অল অফ ইয়্যু। ‘

দ্বিতীয় কলার, ‘আবার হারিয়ে যাবে না তো? ‘

‘সেটা তো এখন বলতে পারছি না। তবে চেষ্টা করবো যেন হারিয়ে যেতে না হয়। ‘ মৃদু হেসে।

তৃতীয় কলার, ‘ঠকে যাওয়ার পরও কি বিশ্বাস করতে হয়? তোমার কি মতামত? ‘

‘মতামত! বেশ কঠিন প্রশ্ন করেছেন। ঠকে গেলে আবার বিশ্বাস করা কঠিন, তবে কার কাছে কিভাবে ঠকছেন সেটা বিবেচনা করে পুনরায় বিশ্বাস করার ভাবনায় আসতে হয়। যেমন ধরুন, কোনো দোকানদার একবার ঠকালো, আপনি নিশ্চই পরবর্তীতে ওই দোকানে যেতে চাইবেন না। কিন্তু পরে দেখা গেল সে আর ঠকালো না। আপনাকে ঠিক মূল্যে ঠিক জিনিসটা দিল। এখন হিসেব করলে দেখবেন দোকানদার আসলে নিজের মুনাফার কথা চিন্তা করেছে। প্রত্যেক দোকানদার সেটাই করে। যদি কেউ ভালো কোনো ক্রেতা পায় তাহলে বিক্রেতা চাইবে নিজের মুনাফা বাড়াতে, তাই এ ব্যাপারে কৌশল অর্থাৎ ঠকানোর পথ অবলম্বন করা তেমন খারাপ নয়। সেও নিশ্চই এমন পরিস্থিতি পার করেই এসেছে। তাই কে কিভাবে ঠকাচ্ছে সে সম্পর্ক হিসেব করে বিশ্বাসের ভিত ঠিক করতে হবে।
তবে মানুষটা যদি খুব কাছের হয় তাহলে সেটা একান্তই নিজের ব্যাপার হবে। কারন মানুষের মন বোঝা বেশ কঠিন। যদি আপনার মন চায় তাকে বিশ্বাস করতে, করবেন। আর যদি মনে হয় সে বিশ্বাসের অযোগ্য তাহলে করবেন না।’

চতুর্থ কলার, ‘আচ্ছা তুমি কখনও কাউকে ভালোবাসো নি কেন? ‘

‘কে বলেছে ভালোবাসিনি? ভালোবাসা কি শুধুমাত্র নর-নারীর মধ্যে হয়? ভালোবাসতে জানলে সবকিছুই ভালোবাসা যায়। আমিও সেভাবেই ভালোবাসি। ‘

‘কি ভালোবাসো? ‘

‘আমি যেগুলো ভালোবাসি সেগুলো একটু অদ্ভুত! এই ধরুন আমি ধরণী কাঁপিয়ে তোলা নীরদগর্জন, আঁধার, সকল প্রকার অনুভূতি, । ‘

‘সকল প্রকার অনুভূতি বলতে?’

‘সকল প্রকার অনুভূতি বলতে, শুধু আবেগ, অনুরাগ, ভালো লাগা নয়। রাগ, জেদ, প্রতারিত হওয়া, বিশ্বাস ঘা’ত’কতা, কষ্ট, খারাপ সময়, ভয়, একাকিত্ব, শত্রুতা বলতে চেয়েছি।’

‘তোমার জীবনে এসেছে এগুলো? তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি এগুলো ফেস করেছো। ‘

‘অনুভূতি জানতে হলে ফেস করা কি জরুরি? জরুরি হলে আমার উত্তর, হতে পারে আবার নাও হতে পারে। ‘

নেক্সট কলার, ‘আই লাভ ইয়্যু রোজ।’

‘থ্যাংকইউ। ‘

‘থ্যাংকইউ,কেন?তুমি তো বললে সবাইকে ভালোবাসো তাহলে। ‘

বোকা বাচ্চাসূলভ প্রশ্নটা শুনে তাজ্জব বনে গেল রোজ।
‘ভালোবাসা হয়তো জাহির করে বেড়ানো বা লোক দেখানোর কোনো জিনিস না। আর মানুষ হিসেবে তো সবাইকে ভালোবাসি, কিন্তু আপনার এই ভালোবাসা প্রকাশের মূল কারন জানি না, কোন সম্পর্ক হিসেবে ভালোবাসেন সেটাও জানি না। সেজন্য ধন্যবাদ! ‘

‘বন্ধু হিসেবে।’

‘বন্ধু? তাহলে হ্যাঁ বলা যেতেই পারে। কিন্তু বন্ধুর থেকে আমি শত্রুকে বেশি ভালোবাসি, হেটার্সদের ভালোবাসি। কারন তারা চোখ বন্ধ করে শুধু আমাকে ভালোবেসে যায় না। আমার মন্দগুলোও প্রকাশ করে, যার সাহায্যে আমি নিজের ব্যর্থতা বা ভুলোগুলো সংশোধন করার সুযোগ পাই। ‘

‘ধন্যবাদ রোজ।’ (বুঝতে পেরে।)

রোজ মৃদু হাসে। সাইমুনের কন্ঠ সে চেনে। কিন্তু সাইমুন হঠাৎ রেডিওতে এভাবে এমন কথা বলে বসবে সেটা ভাবেনি। ও একই রোজকে দুটো কিভাবে ভাবছে? খারাপ চাইছে আবার ভালোবাসাও দেখাচ্ছে।

চলবে?