তুই হবি শুধু আমার পর্ব-১৬

0
1271

#তুই হবি শুধু আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_ষোলো

আরশানের কাঁধে মাথা রেখে ওর এক হাত জড়িয়ে ধরে হাটছে অয়ন্তি। পেছনেই ফারহান কাউকে ফোন করছে অনবরত। ওরা তিনজন আজ ঘুরতে বেরিয়েছে। মূলত ফারহানের মন ভালো করতে বেরিয়েছে। কিন্তু বিবাহিত নতুন দম্পতি বিয়ের এই সময় অন্যকারোর মন ভালো করায় কতটুকু মনোযোগী থাকে? হাটতে হাটতে ওরা খেয়ালই করল না পেছনের মানুষটা গায়েব হয়ে গেছে। আরশানের দৃষ্টি নদীর মাঝ বরাবর থাকা মাছের ছোট নৌকাটার দিকে। হিম শীতল বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। ঠান্ডার আমেজে মনটা অতি প্রসন্ন। হঠাৎ ফারহানের কথা মনে পড়তেই আরশান পেছনে ফিরল,
-ফালাক কোথায়?
অয়ন্তি ত্বরিত গতিতে পেছনে ফেরে। এরপর আনমনেই বলল,
-পেছনে ছিল না? রোজের মত নিঁখোজ হয়ে গেলো নাকি?
-ধুর, না। নিঁখোজ হবে কেন? কোথাও গেছে হয়তো। কিন্তু না জানিয়ে যাওয়া ব্যাড ম্যানারস। বেয়াদবটাকে একা ছাড়া ঠিক হবে না ভেবেই তো সঙ্গে আনলাম।
-তাই তো!
-ফালাকের ওপর খারাপ প্রভাব পড়ছে কুসুম। অভিনয় জগৎ ছাড়া ও বাঁচতে পারেনা। বেবি সেটাই কেড়ে নিতে চাচ্ছে। কেড়ে নিচ্ছে ভালো কথা, কিন্তু চলে গেল কেন? ফালাকের কাছে থেকেই ওকে অভিনয়ের থেকে দূরে রাখতো। এভাবে তো ফালাকের জীবনটাও নষ্ট হচ্ছে। পাঁচটা বছর যে অনেক সময় তা কি বুঝতে পারছে না বেবি?
তখনই আরশানের ফোনে ম্যাসেজ আসল,
-দাদাই তোমরা ঘুরতে থাকো।আমি ঘন্টাখানেকের মধ্যে আসছি।
আরশান মুখ খিচে ফেলল। অয়ন্তি আরশানের প্রতিক্রিয়া দেখে হাসছে। আরশান রাগে দাঁতে দাঁত ঘসে বলে,
-দুটোকে টানিয়ে পেটানো উচিত। টেনশন ছাড়া কিছু দেয়না।
-ঠিক হয়েছে।
-তাই নাকি?
-হু।
-ওকে, তোমার আজ রাতে ঘুমানো বন্ধ। নিজের স্বামীর দুঃখ হেসে উড়িয়ে দেওয়ার শাস্তিস্বরূপ।
-গতকালও ঘুমাইনি। (দুঃখি মুখ করে)
-আজও ঘুম হবে না। (বাঁকা হেসে)
-এটা ঠিক না।
আরশান হাসলো। অয়ন্তির হাত শক্ত করে চেপে ধরে সামনে তাকালো।
-এখন কথা বলার সময় না। এঞ্জয় দ্য বিউটি মাই লাভ।

_____________

-তোমার বাবার মিশন সম্পর্কে শুধুমাত্র সে জানতো মা। আমরা কেউ ইনভলভ ছিলাম না। তিনি আমাদের কিছু বলেননি। টেরোরিস্ট’রা এখনও তোমার খোঁজ কেন করেছে বুঝতে পারছি না।তোমার বাবাও তোমাকে নিয়ে প্রচন্ড ভয়ে ছিলেন। কেন ছিলেন? তুমি কি কিছু জানো? মনে পড়ছে, বাবা কিছু বলেছেন কিনা? কোনো ক্লু! কোনো কোড, ডিজিট? তোমার কাছে নিশ্চই কিছু আছে, যা ওই টেরোরিস্ট’রা চায়। যা তোমাকে তোমার বাবা দিয়ে গেছে।

রোজ মুখটা ছোট করে বলে,
-না, স্যার। বাবা কিছু বলেনি আমাকে। আর বাবা তো সর্বদা আমাকে দূরে রাখতো এসবের থেকে।আপনারা সবটাই জানেন।

অতিরিক্ত ডি.আই.জি সাহেবের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।রোজ সত্য বলছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। রোজের প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক নিশ্চল হওয়া এখন সর্বনাশা হয়ে দাড়িয়েছে। মেয়েটার মনে কি চলছে বোঝা মুশকিল। রোজ হাতের ফোনটা নেড়ে চেড়ে বলল,
-আমি কি যাবো স্যার? কলেজের সময় হয়ে গেছে।

স্যার মাথা নেড়ে যেতে বলতেই রোজ ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। কেবিন থেকে বের হতেই রোজের চেহারায় ফুটে উঠল রাগের আভা। কপালের শিরাগুলো ফুলে উঠল মুহূর্তেই। হাতের ফোনটার দিকে তাকিয়ে সে মৃদু হেসে বলে,
-পৃথিবিতে হত্যাকারীর থেকেও বড় ঘাতক আছে। আর তা হচ্ছে বিশ্বাসঘাতক। হত্যাকারীকেও মাঝে মধ্যে মাফ করা যায়। তবে বিশ্বাসঘাতককে! কখনও না।

নতুন বাইক কিনেছে রোজ। আগের স্কুটার তো ফেলে এসেছিল। যাতায়াত কঠিন হয়ে যাচ্ছে বলে সে বাইকই কিনলো। স্কুটার ঠেলে মাঝে মাঝে সমস্যা হচ্ছে তাছাড়া হেলমেট আর স্টাইলেও সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বাইকে উঠে রোজ জিন্সের পকেট থেকে আরেকটি ফোন বের করল। ফোনটা কানে নিতেই রোজ শুনতে পেল,
-ওকে ফলো করো। কোথায় কখন যায় সব নজরে রাখবে।

রোজ ফোনটা পকেটে ভরে নিল আবার। এরপর ফুল স্পীডে বাইক চালিয়ে উধাও হয়ে গেল ইউনিটের সামনে থেকে। আনসারীর মেয়ে সে, এত কাঁচা কাজ সে নিশ্চই করবে না এটা বোঝা উচিত ছিল তাঁর। রোজের ঠোঁটে চওড়া হাসি।বাবার কথা মনে পড়ছে তাঁর। মায়ের হাতের রান্না খায়নি কতগুলো বছর কেটে গেল। রোজ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আর কখনও রোজকে ওর মা আদর করবে না, বাবা খাইয়ে দেবে না। ঘুরতে নিয়ে যাবে না। কিন্তু যার জন্য ওর বাবা-মা মা’রা গেল সেই কারনটার পেছনের উদ্দেশ্য রোজ পূরণ করবে। নরকের কীটগুলোকে তাদের স্বর্গীয় স্থান নরকে পাঠাতে হবে। হেলমেট দিয়ে পুরো মুখ ঢেকে ফেলল রোজ।পথে নেমে ড্রেসও পাল্টে নিল।ব্যাগে থাকা নম্বরপ্লেট দিয়ে বাইকের নম্বরপ্লেট বদলে নিল। ছেলেদের মত পোশাকে পড়ে সে বাইকে উঠে রওনা দিল সিলেটের বর্ডারের উদ্দেশ্যে। রাইড করেই যাবে সে। ম্যাপ তো আছেই, দুটো ফোনেই চার্জ আছে। এক্সট্রা একসেট জামা আছে। আপাতত এটুকুই প্রয়োজন। ঢাকা পার হতেই রোজ হেলমেট খুলে ফেলল। মেইন রোডের সিগন্যাল হয়ে যাওয়া যাবেনা। শর্টকাট রাস্তা ধরে গোপনে যেতে হবে নাহলে ওকে ধরে ফেলবে ওরা।

_______________

সিয়াম ভয়ে ভয়ে বলল,
-স্যার, ম্যামের খোঁজ পাওয়া যায়নি।ম্যামের মত কিছুটা দেখতে ছিলেন উনি। কিন্তু ম্যাম ছিলেন না।
-মাথামোটা। (বিরক্তমুখে)
-জি স্যার?
-তোমার মনে হয় আমার তোমার ম্যামের কথা শুনে এখানে এসেছি? ডাফার।
-তো কেন এসেছেন? আমি তো ভেবেছি ম্যামের জন্যই এসেছেন।
-সিরিয়াল কিলার মেহমেদকে চেনো?
-না স্যার, শুনেছি নাম। কিন্তু চিনি না। কেন স্যার? (আপনাকে দেখেই তো কূল পাচ্ছি না আবার নতুন কিলার।)
-মেহমেদ আসছে এখানে। ওকে আমি এ্যাপোয়েন্ট করেছি।
-কেন স্যার?
-তোমাকে মা’রতে।
সিয়াম এক লাফ দিয়ে দরজার কোনায় দাঁড়ালো। ভয়ে চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। প্রায় কেঁদে ফেলার মত চেহারা নিয়ে বলল,
-আমি কি করেছি স্যার?
-প্রশ্ন করে করে আমার মাথা খেয়ে ফেলছো। বাবার জন্য তোমাকে সঙ্গে রাখছি, নাহলে কবেই বাড়ির বাইরে ছুড়ে ফেলে দিতাম।
-আপনি এমন বলতে পারেন না। আমি না আপনার ছোট ভাইয়ের মত?
ল্যাপটপে চোখ রেখেই ফারহান জবাব দিল,
-ভাইয়ের মত। বাট ভাই না।
সিয়াম শুকনো ঢোক গিলল। সিয়াম তো রাগ হওয়ার মত কিছু বলেনি। ফারহানের চাঁদকে নিয়েও তো ভালো কথাই বলল। ম্যাম বলে ডাকলো। শুধুমাত্র দুটো কথা বেশি বলেছে বলে স্যার লোক ভাড়া করে ওকে মা’রবে? সিয়াম আবারও মিনমিনে কন্ঠে বলল,
-স্যার!
-কি?
-সত্যিই কি মেহমেদ আসবেন?
-বিরক্ত করবে না সিয়াম। যাও গিয়ে কফি বানাও। তুমি এককাপ নিবে আর আমার জন্য আনবে। যাও।
-জি স্যার। (খুশি হয়ে)
-মেহমেদ আসলে দরজা খুলে দেবে।
-কি(অবাক হয়ে) আপনি তো আমাকে মারবেন না। তাহলে উনি কেন আসবে। প্লিজ স্যার। ভুল করে কিছু বললে মাফ করে দেন। প্লিজ। প্লিজ!
-উফ! সিয়াম। বললাম তো বিরক্ত করো না। মেহমেদ অন্যকাজের জন্য আসবে।
-কি কাজ স্যার?
-গেট লস্ট সিয়াম, এ্যান্ড ডোন্ট ডিস্টার্ব মি। ড্যাম!

মেহমেদ আসার পর থেকে ফারহানের ঘর থেকে কোনো শব্দ আসছে না। সিয়াম বার কয়েক কান পেতে শোনার চেষ্টা করল ভেতরের কথা। কিন্তু কিছুই শোনা গেল না। হাল ছেড়ে সিয়াম বসার ঘরে গিয়ে টিভি ছেড়ে দিল। ফারহান ল্যাপটপে সিয়ামের কান্ডগুলো দেখে সামনে তাকালো। মেহমেদ কফি পান করছে আর বন্দুকে গুলি লোড করছে। ফারহান নিজেও কফিমগে চুঁমুক দিয়ে বলে,
-চাঁদের পেছনে তোর কি কাজ?
মেহমেদ ফিচেল হাসে। ফারহান ল্যাপটপে নজর রেখে বলল,
-কোথায় ও?
-খুজে দেখ। আমি কেন বলবো? তোর ক্ষমতা কম নাকি যে অন্য লোকের কাছে শুনতে হচ্ছে।
-ওসব ছেড়ে দিয়েছি আমি।
-বাহ, চমৎকার। একজন ছাড়ছে তো একজন ধরছে।
-মানে?চাঁদ কোথায় মেহমেদ?কি করছে ও? চুপ থাকিস না। তোর শত্রুতা আমার সাথে। দয়া করে চাঁদকে এর মধ্যে টানিস না।
-আমি টানছি না। ও নিজেই ওর প্রয়োজনের টানে চলে এসেছে। আর আমার কাছে যতটুকু খবর আছে তাতে ওর জীবন যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ওর বিপরীতে যে খেলোয়ার আছে তারা পাঁকাপোক্ত। রোজকে ছাড়বে না তারা।
-কারা?
-সাফোয়ান আনসারীর খু’নিরা। লাস্ট রংপুরে দেখেছি রোজকে।তাও মাস তিনেক আগে। এখন কোথায় আছে জানি না। আর তোর সঙ্গে আমার শত্রুতা ছিল, এখন নেই।
-চাঁদের খোঁজ দিতে পারলে তোকে পাঁচলাখ টাকা দেবো আমি।
-তোর চাঁদকে আমিও খুজছি। টাকা লাগবে না। ওর কাছে আমার বাবার খবর আছে। সেটা দরকার আমার।
-মানে?
-মানে আনসারী সাহেবের গুপ্তচর ছিল আমার বাবা। আনসারী সাহেব মা’রা যাওয়ার আগে রোজকে কিছু তথ্য ও কোড দিয়ে গেছে। আমার বাবা সেসব রক্ষার দায়িত্ব পালন করছিলেন। বাবা আমাকে পছন্দ করতেন না। আমার গুন্ডামির জন্য, তাই সেসব তথ্য টাকা নিয়ে উনি আমাকে না জানিয়েই অন্য কোথাও গিয়ে লুকিয়ে আছেন হয়তো। আর এসবের খবর তোর চাঁদ জানে। সেটা বলার জন্যই তোকে সকালে ফোন দিয়ে এখানে আসতে বললাম।
-কি তথ্য? কত টাকা?
-কালো টাকা, চোরাচালানজনিত তথ্য, ইউনিটের কিছু বিশ্বাসঘাতকের তথ্য, যারা দেশের সামনে দেশের রক্ষক, আর পেছনে ভক্ষক। তাই তোকে বলতে এসেছি তোর চাঁদকে খুজে বের কর। একা খেলাটা জিততে পারবে না ও। আমরা অবধি এখনও কিছু করতে পারি নি। আনসারী সাহেব কিছু করতে পারেননি। ওই বাচ্চা মেয়ে কি করবে?
-আমার গ্যাং নেই। বছর তিনেক আগে সব ছেড়েছুড়ে দিয়েছিলাম অভিনয়ের জন্য। তাই একা কিছু করা সম্ভব না।
-আমি হেল্প করতে রাজি কিন্তু বিনিময়ে আমার টাকা চাই।
-এই মাত্র না বললি তোর বাপ চাই?
-কালোটাকার একটা শেয়ারও চাই। যেটা তোর চাঁদ দেবে না। টাকাটা তুই দিবি।
-জাতে মাতাল, তালে ঠিক। ব্ল্যাং চেক এটা। কত লাগবে লিখে নিস। (চেকটা এগিয়ে দিয়ে)
-লাগবে না। দেখছিলাম চাঁদ তোর জীবনে কতটা গুরুত্ব রাখে। কার জন্য নিজের সবকিছু ছাড়ছিস। তা ও তোর বউ নাকি প্রেমিকা?(চেক ফেরত দিয়ে)
-দুটোই।
-তো ভাবির খোঁজ জানিস না কেন?
-অভিমান করে চলে গেছে। যাক, শুরু থেকে শুরু কর। চাঁদ কোথায় ছিল, কি করছিল, সবটা বল।

__________

হাত-পা বাঁধা অবস্থায় অন্ধকার ঘরটির মেঝেতে পড়ে আছে এক ব্যক্তি। কাঠের তৈরি বাড়িটির ভিত প্রচন্ড নড়বড়ে। যেকোনো সময় ভেঙে যেতে পারে। রোজ উঠে ধীরে সুস্থে লোকটার বাঁধন খুলে তাকে তুলে বাইরে এনে বসালো। ব্যাগ থেকে পানির বোতল খুলে তাকে পানি খাইয়ে বলল,
-ঠিক আছেন?
-কে তুমি? আমার খোঁজ পেলে কি করে? কার হয়ে কাজ করো?
-আমি সাফোয়ান আনসারীর মেয়ে কাকু। আমাকে কি চিনতে পারছেন না? আপনার সঙ্গে মিলে বাবাকে রাগাতাম আমরা। মনে নেই? আমি সেই রোজ।
-রোজ,,, তুমি এখানে কিভাবে আসলে? মা।
-পরে বলবো। এখন দ্রুত চলুন। ওরা এসে পড়বে। ব্যাথা আছে নাকি অনেক? ডাক্তারের কাছে যাবেন আগে?
-না, লাগবে না। এটুকুতে কি হবে? তুমি তোমার কথা বলো। আমি এখানে আছি জানলে কি করে?
-আসলে বাবা আমাকে একটা ডায়েরি দিয়েছিল। সেই ডায়েরিতে সব লেখা ছিল।
-ডায়েরিটা পেয়েছ তুমি? (অবাক হয়ে)ওরা সেটা হাতে পায়নি জেনেছিলাম। ভেবেছিলাম রেণু ভাবি লুকিয়ে ফেলেছে। পরে রেণু ভাবির মৃ’ত্যুর খবর শুনে সব আশা ধুলিশাত্ হয়ে গিয়েছিল।
-না, বাবা ওটা আমাদের ফার্মহাউজে রেখেছিল। বাড়ি ডায়েরি রাখার মত ভুল করেনি।
-আনসারী সাহেব মানুষটাই এমন! উনি জেনে গিয়েছিলেন ইউনিটের মানুষ ওনার সঙ্গে প্রতারণা করে ওনাকে মে’রে ফেলার চেষ্টা করবে তবুও নিজের কথা ভাবেননি।
-ওই সব প্রতারককে তাদের প্রতারণার ফল পেতে হবে কাকু। আমি কাউকে ছাড়বো না। কাউকে না।
-তুমি মেয়ে, তারওপর ওদের ছলচাতুরী বুঝবে না মা। এসবের মধ্যে ঢুকো না। ওরা ভয়ঙ্কর মানুষ। আনসারী সাহেব অবধি ওদের সঙ্গে পেরে ওঠেননি।
-কারন বাবা ভালো মানুষ ছিলেন। আমি ওতটাও ভালো নই কাকু। প্রতিটা কেউটেকে আমি গর্ত থেকে বের করে ওদের বিষদাঁত ভেঙে যন্ত্রণা দিয়ে শেষ করবো।
-পারবে না, ওরা মানুষের পর্যায়ে পড়ে না। ওদের কোনো দূর্বলতা নেই। ওরা একবার যদি জানে তোমার দূর্বলতা আছে,তাহলে তোমাকে শেষ করতে ওদের এক সেকেন্ডও লাগবে না। তোমার আঙ্কেলরা, আঙ্কেলদের পরিবার।
-ওরা জানবে না। কারন আঙ্কেলদের আমি কষ্ট দিয়ে চলে এসেছি। ফালাক ভাইয়ার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছি তাতে সবাই বুঝবে আমি ফালাক ভাইয়াকে ভালো বাসতাম। এখন বাসি না। আর ওদের প্রতি আমার দূর্বলতাও নেই।
-ওরা তোমার ওপর কখন থেকে নজর রেখেছে?
-আমি দেশে ফেরার পর থেকেই দেখছি কিছু মানুষ আমার চারপাশে ঘুরঘুর করে। প্রথমদিকে বুঝিনি পরে ডায়েরি পড়ে টের পেয়েছি। তখন থেকেই নানুবাড়িতে থেকেছি। নানু মা’রা গেলে ঢাকায় ফিরে সব খোজখবর রাখতে শুরু করি। আপনার ছেলে মেহমেদও অনেকটা ভালো হয়ে গেছে কাকু। এখন আর খু’নোখু’নি করেনা। আপনি ফিরে যান তাঁর কাছে। এই মিশনটা আবার বাবার। আমি চাইনা, এই মিশন কমপ্লিট করতে গিয়ে আমার মত আর কেউ বাবা মা’কে হারাক। আপনার ফেরার টিকিট কেটে রেখেছি। আজ রাতের ট্রেনেই ফিরে যাবেন। আপনার সঙ্গে এখানকার একটা দলও যাবে। ওদের সঙ্গে মিশে কোনোরকমে ঢাকায় পৌঁছালে মেহমেদ ভাই আপনাকে নিয়ে যাবে। টেক্সট করে দিয়েছি আমি। বাবার পরে এই মিশনটা শুধু আমার কাকু। জানিনা আমার পরিণতি বাবার মত হবে কিনা। কিন্তু বাবার মত ভুল করবো না আমি। দেশের সম্পদ ও আবর্জনার সব প্রমাণ ঠিক পৌঁছে যাবে, সেটা আমি বেঁচে থাকি অথবা না থাকি।

রোজ হাটতে হাটতে কিছুদূর যেতেই ওর চোখ পড়ল রাস্তার ধারের শিমুল গাছটার ওপর। শেষ যেবার রোজ এসেছিল সিলেটে, বাবার সঙ্গে। সেদিন এই গাছে সে উঠেছিল। গাছের ডালে বসেছিল। অনেক আবদারের পর বাবা উঠিয়ে দিয়েছিল। রোজের চোখ বেয়ে পানি পড়ল।রোজ চোখ বুজতেই ডায়েরির লেখাগুলো চোখে ভেসে উঠলো। ডায়েরিতে আনসারী সাহেব রোজকে লিখেছিলেন,

জীবন একটা জটিল সমীকরণ রোজ। তোমাকে এই সমীকরণের সমাধান নিজেকেই খুজে বের করতে হবে। তোমার প্রয়োজন তুমি নিজে বুঝবে। অন্যকেউ বুঝবে না। যেমন, তোমার তৃষ্ণা পেলে তুমি বুঝতে পারবে। বাকিরা ততক্ষণ বুঝবে না যতক্ষণ না তুমি বুঝতে দাও। কখনও হার মানবে না, রাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখবে। কারন ক্রোধ হচ্ছে ধ্বংস। রেগে গেলে তুমি যেকোনো কাজে হেরে যাবে। রাগ মানুষের মস্তিষ্ক অনলে জ্বালিয়ে দেয়, আর তাতে নিয়ন্ত্রণ না রাখলে দেখবে পরিস্থিতি সেই অনলে ঘি ঢালছে। সর্বদা মনে রাখবে তুমি পারবে। তুমি মেয়ে, কিন্তু দূর্বল নও। আমি না থাকলেও তুমি থাকবে, আমি জানি আমার মেয়ে একদম তাঁর বাবার মত। কখনও নিজেকে ছোট করে দেখবে না, অসহায় ভাববে না, ভালোবাসবে সবাইকে। আমি জানি তুমি বয়সের তুলনায় একটু বেশি ম্যাচিউর তাই বলছি। ফালাক তোমাকে চায়, ওকে কষ্ট দেবে না। আমি থাকছি না, আমার দায়িত্ব থাকছে। সে দায়িত্ব তুমি পালন করবে। জীবনে নানা বিপর্যয় আসবে, ভয় পাবে না। ভয়কে জয় করে সামনে এগিয়ে যাবে। তুমি ভাবতে পারো, তোমার জীবনের ঝুঁকি অনেক বেশি তাই ফালাকের থেকে দূরে যাবে। কিন্তু এটা সঠিক সিদ্ধান্ত না মা। আমিও তো অনেক রিস্কি কাজ করি। তবুও তোমার মা’কে ভালোবেসে বিয়ে করেছি।সংসার করেছি তাহলে তুমি কেন একা থাকার কথা ভাববে? তুমি ওকে চাও সেটাও জানি আমি। তোমাদের বন্ধুত্বের রূপ এমন থাকবে না। তাই সময়ের সঙ্গে আবেগ অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করতে শেখো। সর্বদা মাথায় রাখবে, তোমার জন্য যেন অন্যকেউ কষ্ট না পায়,অন্যকেউ বিপদে না পড়ে। মা’কে দেখে রাখবে। তুমি ছাড়া রেণুর কেউ থাকবে না। মায়ের অবলম্বন হবে। রেণু অল্পতে অনেক কষ্ট পায়, কাঁদে। আমার চলে যাওয়া ও মেনে নিতে পারবে না। তাই তুমি ওকে সামলাবে। আমি জানি আমার মেয়ে সেটা পারবে। তোমার বাবা তাঁর একমাত্র রাজকন্যাকে অনেক ভালোবাসে প্রিন্সেস। নিজের রেখাল রাখবে। আমাকে মনে করে কাঁদবে না, আমি কষ্ট পাবো তাহলে। ভালোবাসি আমার কলিজার টুকরা, আমার মেয়ে, আমার রাজকন্যা সাইরাহ্ আনসারী রোজা! ওহ স্যরি তোমার নাম তো কে’টে রোজ করা হয়েছে। আবারও বলছি রেণুর পাশাপাশি যে তোমার নাম কে’টেছে তাকে ভালোবাসবে।সবার সঙ্গে সাবধানে থাকবে। আমি জানি ফালাক তোমার কোনো ক্ষতি হতে দেবে না। তাই এখন নিশ্চিন্তে ম’রতেও পারবো।
তোমার বাবা….. সাফোয়ান আনসারী।

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে