আজ অনেক দিন পর দোয়েল বাবার বাসায় বেড়াতে এসেছে।দোয়েলের রুমটা এতদিনে পায়েল বেশ ভালোভাবেই দখল করে নিয়েছে।দোয়েলের সাজানো গোছানো রুমটা অনেকটাই বদলে গেছে।মিসেস সুমি মেয়ের পেছন পেছন আসেন।এসে দেখেন মেয়ে বুক সেলফে থাকা বই গুলোয় আলতো করে হাত বুলাচ্ছে।
” তোর পছন্দের জিনিস এটা।অন্য সব কিছু পায়েল দখল করলেও তোর বাবা এটায় ফুলের টোকা পর্যন্ত লাগতে দেয় নি।”
মিসেস সুমির কথা শুনে দোয়েল বুক সেল্ফের ডান পাশের পাল্লাটা খুলে বইয়ের পেছন থেকে একটা কাপড়ের ব্যাগ করে।ব্যাগের ভেতর একটা টি শার্ট ছিলো।বুক সেল্ফ কেউ ধরে না বলে এখানে টি শার্টটা রেখেছিলো দোয়েল।এতদিনে টি শার্টটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশংকা করেছিলো দোয়েল।কিন্তু না।টি-শার্টটা এখনো ভালোই আছে।টি-শার্টটা দেখে মিসেস সুমি মেয়েকে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারেন।
দোয়েল লাজুক হাসে।ফালাক ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে ছিলো।দোয়েল টি শার্টটা পেছনে লুকিয়ে ফালাকের পাশে গিয়ে বসে।মিষ্টি করে একটা ডাক দেয়।ফালাক অবাক কন্ঠে বলে,,,
” কিছু বলবে?”
” ছাদে যাবে?না করো না প্লিজ।”
” এত রাতে?”
” চাঁদ দেখতে তো রাতেই যেতে হবে।নাকি ভোর সকালে যাবো চাঁদ দেখতে।”
” বেলকনি দিয়ে দেখো চাঁদ।”
” তুই বেশি বুঝিস সব সময়।”
কথাটা বলে হ্যাঁচকা টান দিয়ে দোয়েল ফালাককে ছাদে নিয়ে যায়।চাঁদের দিকে ঘুরে ছাদের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে বসে দোয়েল।আনমনে এসে বলে,,,
” প্রেম করার সময় কত কাহিনিই না করতাম আমি তাই না?”
” হঠাৎ এই কথা?”
” আমি ত সব হঠাৎই বলি।”
” চেতার কি আছে?”
” আমিই তো চেতি।”
ফালাক বুঝতে পারে এখন দোয়েলকে সে যা বলবে তাতেই ঝগড়া লেগে যাবে।তাই এই মুহুর্তে চুপ থাকাই শ্রেয়।
ফালাক চুপ করে চাঁদের পানে চেয়ে থাকে।হঠাৎই দোয়েল পেছন থেকে ফালাকের ব্যবহৃত পুরানো টি-শার্টটা বের করে ফালাকের হাতে দেয়।ফালাক টিশার্টটা দেখে খানিকটা অবাক হয়।দোয়েল আবার মুচকী হেসে বলে,,,
” ফালাক তোমার মনে আছে?একবার আমি তোমার একটা টি শার্ট খুলে নিয়ে এসেছিলাম!”
দোয়েলের কথা শুনে ফালাকের মুখ কালো হয়ে যায়।দোয়েলের কাছে সেটা সোনালী স্মৃতি হলেও ফালাকের কাছে তা লজ্জাজনক স্মৃতি। দোয়েল তখন ক্লাস টেনের দুরন্ত কিশোরী।সম্পর্কের শুরু।কে যেন দোয়েলকে বলেছিলো প্রেমিকের ঘামের গন্ধে নাকি মানসিক চাপ কমে।সেখান থেকেই দোয়েলের জেদ চেপেছিলো সে ফালাকের ব্যবহৃত জামা যেমন করেই হোক নিবে।সেদিন প্রাইভেট ফাঁকি দিয়ে দোয়েল ফালাককে নিয়ে শপিংয়ে গিয়েছিলো।প্রায় চার-পাঁচ মাসের হাত খরচ জমিয়ে দোয়েল একটা টি-শার্ট কেনার টাকা জমায়।খালি গায়ে ফালাক যাবে।ব্যাপারটা কেমন হেলালেলা না?তাই এই বুদ্ধি বের করে দোয়েল। ফালাকের হাতে একটা হাল্কা বেগুনি রঙের টি-শার্ট ধরিয়ে দিয়ে ট্রায়াল রুমে যেতে বলে দোয়েল।ফালাক কোনো কথা বলে না।কারণ নিয়ে আসার সময়ই দোয়েল ফালাকে শর্ত দিয়েছিলো যাতে ফালাক কোনো কথা না বলে।ট্রায়াল রুম থেকে ফালাক বেরোতেই সে ট্রায়াল রুমে ঢুকে ফালাকের ব্যবহৃত পুরোনো জামাটা ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয়।ফালাক বেকুবের মতো চেয়ে থাকে।কিছু বলতে যাবে তার আগেই দোয়েল ফালাককে ধমক দিয়ে বলে,,
” একটাও কথা বলবি না তুই।”
দাম মিটিয়ে দিয়ে দোকান থেকে বের হতেই ফালাক দোয়েলকে প্রশ্ন করে,,,
” তুমি না বললে তুমি তোমার কাজিনের জন্য টি শার্ট কিনতে আসছো।তো আমায় টি শার্ট পরিয়ে রাখলে কেন?”
” আসলে তোমার জন্যই টি শার্ট কিনতে আসছি।এটা যদি বলতাম তাহলে তুমি কখনো আসতে না আমার সাথে।তাই একটু চালাকি করতে হলো।আর তাছাড়াও তোমার ব্যবহৃত জামা আমার দরকার ছিলো।কিন্তু আমি যদি তোমার গায়ের টি শার্ট নিয়ে আসি তাহলে তো অন্য মেয়েরা আমার সম্পদের অনেক কিছুই দেখে ফেলবে তাই….”
দোয়েল লজ্জায় নিজের হাত দিয়েই মুখ চেপে ধরে।ফালাক হতবিহ্বল।
” জানো ফালাক?তুমি যখন দূরে থাকতে না?আমি তখন তোমার এই টি-শার্টটা গায়ে জড়িয়ে তোমার গায়ের ঘ্রাণ নিতাম।আর তখন মনে হতো তুমি আমার পাশেই বসে আছো।প্রেমে পড়লে, ভালোবাসলে কারও গায়ের ঘামের দুর্গন্ধও কারও কাছে সুগন্ধ হয়ে যায়।”
” অনেক কষ্ট দিয়েছি না তোমায়?”
” অস্বীকার করবো না।দিয়েছো অনেক কষ্ট দিয়েছো।আমার সামনে যখন কেউ তার প্রিয় মানুষের হাত ধরে হাঁটতো তখন আমার প্রচুর খারাপ লাগতো।এক যদি কেউ না থাকতো তাহলে এক কথা ছিলো।কিন্তু থেকেও নেই।তাই রাগ হতো।ঝাড়তাম তোমার ওপর।তুমিও আমায় না বুঝে আমার সাথে উলটো রাগারাগি করতে।আবার আমরাই একেঅপরের সাথে কথা না বলে থাকতে পারতাম না।যাই হোক এখন তো তোমায় নিজের করে পেয়ে গেছি এখন আর কোনো আফসোস, রাগ,হারানোর ভয় নেই।”
” কিন্তু আমার আফসোস আছে।আমি আগের দোয়েলকে হারিয়েছি।যে এখন কিছু হলেই পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করে না।চিৎকার চেঁচিমেচি করে না।এখন সে চুপ চাপ হয়ে গেছে।”
” কারণ সে বড় হয়ে গেছে। ”
” আমার কাছে সেই দুরন্ত চঞ্চল কিশোরী দোয়েলেই ভালো।তোমার নামের সাথে নিস্তব্ধতা যায় না দোয়েল।কখনো দেখেছো দোয়েল পাখিকে চুপচাপ থাকতে?আগের দোয়েলকে খুব মিস করি আমি।”
” আগের দিন বাঘে খেয়েছে।আগের দোয়েল থাকলে প্যারার শেষ হতো না।”
” যতো যা ই ই হোক।সোনালী দিন সেগুলো।আজীবন সেগুলোর কথা ভেবে আফসোস করতে হবে।”
” আফসোস করা লাগবে কেন?মানুষকে একটা আল্লাহ আলাদা শক্তি দিয়েছে।ওই শক্তির সাহায্যে সহজেই আমরা আমাদের সোনালী দিন গুলোই ফিরে যেতে পারি।”
” ওই শক্তিটা কি শুনি?”
” কল্পনা শক্তি।”
কথাটা বলে ফিক করে হেসে দেয় দোয়েল।ফালাকও ওর হাসি দেখে হেসে দেয়।
” কাগজের ফুল দূর থেকে দেখতে একদম জীবন্ত।কিন্তু কাছে গেলে প্রাণহীণ।আপনাকেও ঠিক সেই রকম লাগছে।”
মেয়েটা লাজুক হাসে।
” হাও ক্যান আই হেল্প ইউ স্যার?”
” ইন্টারভিউ দিতে দিতে গলা শুকিয়ে গেছে।”
মেয়েটা একটা পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বলে,,,
” আপনি এটা থেকে পানি খেতে পারেন?”
” আপনার পার্সোনাল এটা?”
” জ্বী।”
” কোনো অসুবিধা হবে না তো?”
” না স্যার।আপনি খেতে পারেন।”
ফালাক পানি খেতে লাগে।হঠাৎই রিসিপশনের মেয়েটা অত্যন্ত বিনয়ের সাথে ফালাককে বলে,,,
” স্যার আপনার ইন্টারভিউ কেমন হলো?”
ফালাক মুখে পানি নিয়েই মেয়েটার দিকে কিছুক্ষণ বেকুবের মতো চেয়ে থাকে।পানি গিলে বোতলটা রেখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে,,,
” অতিমাত্রায় জঘন্য। ”
কথাটা বলেই ফালাক প্রস্থান করে।মেয়েটা বেকুবের মতো ফালাকের যাওয়ার পানে চেয়ে থাকে।
________
ফালাক বাইরে থেকে এসে ক্লান্ত শরীর দিয়ে ধুপ করে বিছানায় পরে।আজ সব টিউশন থেকে ছুটি নিয়েছিলো সে।দোয়েল বাসায় নেই।ক্লাস করতে গেছে।”বিলাই” এসে ফালাকের গালে পরম আয়েশে নিজের মাথা ঘষতে লাগে। ফালাক বিলাইকে সরিয়ে নিজে উঠে বসে।আলতো করে বিলাইয়ের গায়ে হাত বুলায় ফালাক।একসময় দুষ্টুমির জন্য বিলাইকে পছন্দ করতো না ফালাক কিন্তু এখন পছন্দ করে।দোয়েলের অনুপস্থিতিতে ফালাক বিলাইয়ের মধ্যে দোয়েলকে খুঁজে পায়।
বেশ অনেক সময়ই ফালাক বিলাইয়ের সাথে কাটায় কিন্তু দোয়েলের আসার নাম নেই।ফালাক দোয়েলকে ছাড়া এইটুকু সময়েই অস্থির হয়ে গেছে।না জানি দোয়েল কিভাবে ফালাককে ছাড়া একটা গোটা দিন কাটিয়ে দেয়।এখন তো তাও বিলাই আছে।আগে তো কেউ ছিলো না।একা ছিলো দোয়েল।ইন্ট্রোভার্ট হওয়ায় আশেপাশের ফ্ল্যাটের কারও সাথেই দোয়েল ফ্রীলি মিশতে পারে না।ফালাক বিলাইকে কোলে নিয়ে বলে,,,
” না জানি তোর আম্মু কিভাবে থাকে আমায় ছাড়া।আমি তো ঘন্টা দেড়েকেই অস্থির হয়ে গেছি।বড্ড কষ্ট দিই না তোর আম্মুকে?সব দিক দিয়ে আমি ব্যর্থ।একজন ব্যর্থ ছেলে,একজন ব্যর্থ প্রেমিক,একজন ব্যর্থ স্বামী।একজন ব্যর্থ মানুষ। ”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফালাক।পাশের র্যাকে একটা বয়ামে কিছু চানাচুর ছিলো।দোয়েলের চানাচুর খুব পছন্দ। বেশির ভাগ সময়ই দোয়েলের বিছানা বা স্টাডি টেবিলে কাটে।তাই বিছানা আর স্টাডি টেবিলের মধ্যে থাকা র্যাকে সব সময় চানাচুর থাকে।যাতে হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়।ফালাক সেখান থেকে চানাচুর নিয়ে খেতে লাগে।সাথে বিলাইকেও দেয়।কিছুক্ষণ বাদে দোয়েল আসে।
” কখন আসছো?”
ব্যাগটা ওয়ারড্রফের ওপর রাখতে রাখতে বলে দোয়েল।
” এইতো ঘন্টা দেড়েক হলো?”
” ইন্টারভিউ কেমন হলো?”
” জঘন্য। খালি বলে অভিজ্ঞ মানুষ দরকার তাদের।আমি স্টুডেন্ট লাইফে চাকরির এক্সপেরিয়েন্স পাবো কিভাবে?”
” প্যারা নাই চিল।হয়ে যাবে একটা দেখিয়ো।”
কথাটা বলে দোয়েল ওয়াশরুমে যায় শাওয়ার নিতে।বেশ তাড়াতাড়িই বের হয় দোয়েল।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছছিলো দোয়েল।হঠাৎ ফালাক ওর পেছনে এসে দাঁড়ায়।
” কিছু বলবে?”
” খুব কষ্ট দিই না তোমায় দোয়েল?”
” হঠাৎ এই কথা কেন?”
” আজ তুমি যখন ছিলে না তখন খেয়াল করলাম বাসায় একা একা কেমন লাগে!”
” বিলাই আছে তো।”
” বিলাই তো বিলাই ই।আর দোয়েল পাখি তো দোয়েল।দোয়েলের শূন্যতা কেউ পূরণ করতে পারে না।”
” আগে যখন দূরে থাকতাম তখন কেমন করতে?”
” তখনকার পরিস্থিতি আর এখনকার পরিস্থিতি এক নয় দোয়েল।”
দোয়েল হাল্কা করে ভেজা চুল গুলো বেঁধে রান্না ঘরের দিকে যায়।চারটা বাজে।অথচ দুপুরের খাবার খাওয়া হয় নি। ফালাকও দোয়েলের পেছন পেছন যায়।
” জানোই তো দোয়েল আমার বাবার অবস্থা ভালো না।বাবার টাকা থাকলে এই টিউশনও করতে হতো না চাকরির পেছনে এত ছুটতেও হতো না।তোমায় ঠিকই সময় দিতে পারতাম।”
ফালাক দোয়েলের পেছন পেছন ঘুরছে আর কথা গুলো বলছে।দোয়েল কোনো প্রত্যুত্তর করছে না।চালের ডাব্বা থেকে এক কাপ চাল নেয় পাতিলে।সেগুলো ভালো করে ধুয়ে চুলোয় বসিয়ে দেয়।ফালাক এখনো সেগুলো নিয়েই বকবক করছে।দোয়েল এইবার কিছুটা বিরক্তই হয়। তীব্র বিরক্তি চোখে মুখে নিয়ে সে ফালাকের দিকে তাকায়।ফালাক চুপ হয়ে যায়।
” আমি কি কখনো তোমার কাছে এগুলা নিয়ে অভিযোগ করছি?”
শান্ত গলায় বলে দোয়েল।ফালাক না বোধক মাথা নাড়ায়।
” তো কেন এত কথা বলতেছো তুমি?আমার বেশি কিছু লাগবে না ফালাক।দিন শেষে তোমায় পেলেই হবে।দিন শেষে রাত্রিতে তুমি আমায় যে এক দেড় ঘন্টা সময় দাও।আমার সাথে গল্প করো,আমরা দুজন যে বালিশ ছোড়াছুড়ি খেলি তাই আমার কাছে অনেক।হ্যাঁ একটা সময় ছিলো যখন তোমার এই সময় না দেওয়া নিয়েই আমি মনক্ষুণ্ম ছিলাম।আর তাই ব্রেকাপ করেছিলাম।কিন্তু বিধাতা আমাদের বিচ্ছেদ চাননি।তাই রাতেই সারাজীবনের জন্য আমাদের বেঁধে দেন।আর আমার টাকা পয়সা,গাড়ি বাড়ি কিছুই লাগবে না।শুধু তোমার সাথে ডাল-ভাত আর নুডলস খাওয়ার সামর্থ্যটুকু থাকলেই হবে যা ইতিমধ্যেই তোমার আছে।”
দোয়েল এক নাগারে কথা গুলো বলে।ফালাক অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।শুধু তারজন্য একটা মেয়ে কত স্যাক্রিফাইসই করছে।হাত পুড়িয়ে রান্না করছে।দোয়েলদের বাসায় প্রতিদিনই মাংসভাত খাওয়া হয়।আর এদিকে ফালাকের সামর্থ্য না থাকায় দোয়েল হাসি মুখে ঠিকই ডাল ভাত খাচ্ছে।মেয়েরা সত্যিই স্রষ্টার অবাক সৃষ্টি। হাসিমুখে সব পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
” ফ্রেশ হইছো?বাইরে থেকে যে আসছো ফ্রেশ হওয়া লাগবে না?”
ফালাক আর কোনো প্রত্যুত্তর করে না।ওয়াশরুমে যায়।আগে ফালাককে চুমুর লোভ দেখিয়ে দোয়েল কাজ করিয়ে নিতো।যদিও ফালাক সেগুলো বুঝতো।কিন্তু দোয়েলের দুষ্টুমি গুলো ফালাক খুব উপভোগ করতো।তাই সেও দোয়েলের সাথে তাল মেলাতো। এখন দোয়েলের মধ্যে কেমন যেন বাচ্চামি দুষ্টুমি গুলো নেই।বড় হয়ে গেছে দোয়েল।সাংসারিকও হয়ে গেছে।আগের মতো ফালাকের সাথে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করে না দোয়েল।বায়নাও ধরে না ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার।
ফালাক ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে আসে।দেখে দোয়েল খাবার সাজিয়ে বিছানায় আছে।পাশে বসে আছে বিলাই। ফালাক খেতে বসে।দোয়েল তখনও শুয়েই আছে।
” খাবে না?”
” শরীর টানছে না।তুমি খাও।আমি পরে খাবো নি।”
ফালাক কোনো কথা বলে না।প্লেটে খাবার নিয়ে বিছানায় গিয়ে বসে।
” ওঠো।”
” আমি পরে খাবো বললাম।”
” উঠতে বলছি।”
দোয়েল ওঠে বসে।ফালাক ভাত মাখতে মাখতে বলে,,,
” আংকেল পই পই করে বলে দিছেন তার মেয়ের ভাত খেতে আলসেমি লাগে।এখনো লাগতেছে।তাই দোয়েল পাখি বললো পরে খাবে সে।”
কথাটা বলে দোয়েলের সামনে খাবার ধরে ফালাক।দোয়েল মুখে তুলে নেয়।খেতে খেতে বলে,,,
” আমি বাচ্চা নাকি যে খাইয়ে দিতে হবে।বললামই তো একটু পরে খাবো।”
সেদিন শুক্রবারে আমার একটা আশা অন্তত পূরণ হয়েছিলো।বিকালের দিকে হঠাৎ আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে যায় সেদিন।হাল্কা শীতল ঝড়ো হাওয়া বইতে লাগে।আমি আর ফালাক তাড়াহুড়ো করে ছাদে যাই কাপড় আনতে।ঘরে এসে কাপড় গুলো রাখতে না রাখতেই ঝুম করে বৃষ্টি শুরু হয়।আমি ফালাকের দিকে করুণ চোখে তাকাই,,,
কথাটা বলেই আমি ওর হাত ধরে টানতে টানতে ছাদে নিয়ে যাই।ফোনটা ওর হাতে দিয়েই বৃষ্টিতে ভিজতে নেমে পড়ি।ও ছাদের প্রবেশদারে দাঁড়িয়ে আছে।আমি বৃষ্টিতে ভিজছি।চিৎকার করে ওকে বললাম ছবি তুলতে।ও ছবি তুলতে লাগে।হঠাৎই ডাক দিয়ে ইশারায় চুল খুলতে বলে।আমি বলদের মতো চিৎকার দিয়ে বলি,,,
” চুল তো খোলাই।”
ফালাক কপাল চাপড়ায়।আমি মাথায় হাত দিয়ে দেখি খোঁপা করা চুল।কাটা খুলে দিতেই খোঁপা আলগা হয়ে যায়।আমি হাত দিয়ে আলতো করে চুল গুলোকে ছাড়িয়ে নিই।তারপর ফালাক আবার ছবি তোলায় মন দেয়।পার্সোনাল ফটোগ্রাফার। শুধু শুধু কী বিয়ে করেছি? বৃষ্টি আরও তীব্র হচ্ছে।আমি ফালাকের কাছে গিয়ে ফোনটা সিঁড়ির এক কোণে রেখে ফালাককে নিয়ে আসি।
ফালাকের চোখে মুখে খানিক রাগ আর বিরক্তির ছাপ পাই আমি।আমি সেগুলো পাত্তা না দিয়ে লাফাতে লাগি ছাদের ওপর জমে থাকা পানির ওপর।হঠাৎই খেয়াল করি ফালাকের চোখে মুখে রাগ বিরক্তির ছাপ আরও তীব্র হয়েছে।এখনই যেন আমাকে চোখ দিয়ে ভস্ম করে দেবে।ওর রাগ কেমন আমি জানি।অনেকটা আকষ্মিক ঝড়ের মতো।সব লণ্ডভণ্ড করে দেয়।আমি ভীত বেড়ালের মতো থেমে যাই। আমার আচরণ দেখে ফালাক ফিক করে হেসে দেয়,,,
” থামলে যে!বৃষ্টিতে ভিজবা না?”
” না থাক।”
ভীত কন্ঠে বলি আমি।ও হেসে দিয়ে আমার মতো ছাদে জমে থাকা পানিতে লাফাতে থাকে।আমি অবাক চাহনিতে হেসে দিই।তারপর আমিও ওর সাথে লাফাতে লাগি। খুব ইচ্ছা ছিলো আমার।ফালাকের সঙ্গে এক সাথে বৃষ্টিতে ভিজবো।ঢাকায় আসার পর প্রতিবারই যখন বৃষ্টি হতো আমি আনমনে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকতাম।কবে সেই দিন আসবে।আমি আর ফালাক এক সাথে বৃষ্টিতে ভিজবো।ওপরওয়ালা অবশেষে আমার ইচ্ছাটা পূরণ করেই দিলেন।ছাদে থাকা গাছগুলো থেকে একটা অলকানন্দা ফুল ছিড়ে এনে ফালাক আমার কানে গুজে দেয়।আলতো করে চিবুকে ধরে হেসে বলে,,
” ফুলের সাথে আগাছা।”
আমার মুখ মলিন হয়ে যায়।অভিমানী কন্ঠে বলি,,,
“আমায় আগাছা বললা?”
ফালাক আবার কপাল চাপড়ায়,,
” আমি তোমায় আগাছা বলতে যাবো কোন দুঃখে?”
“ওইযে,তিনবেলা নুডলস ঠেলি।এই দুঃখে!”
“খাইতে খারাপ লাগে না তোমার নুডলসের নতুন নতুন রেসিপি।”
” হইছে তেল দিতে হবে না।”
” তেলই তো দাও।তাই তো আগাছা বললা।”
“ওরে! আমি তোমার কানে গুঁজে থাকা জিনিসটাকে আগাছা বলছি।তুমি তো আমার ফুল। তোমায় আগাছা বলবো কেন?”
” হাউ লুমান্টিক জামাই।”
আহ্লাদী কন্ঠে কথাটা বলেই আমি ফালাককে জড়িয়ে ধরি। আজকের দিনটা যেন ওপর ওয়ালা আমার জন্যই বানিয়েছিলেন।সন্ধ্যার আগ দিয়ে বৃষ্টি থামে আর পশ্মিমাকাশে সুর্য মামা দিনের শেষ দেখা দেওয়ার জন্য ঘন মেঘের পর্দা ঠেলে উঁকি দেন। ঠিক তার বিপরীতে দক্ষিণ পুর্বাকাশে অর্ধ বৃত্তের সাত রঙের রঙধনুর দেখা পাই আমরা।একই দিনে বৃষ্টিবিলাস আর রঙধনু দর্শন।
________
দুজনের ব্যস্ততায় ছোট ছোট খুশীর মুহুর্ত নিয়ে ভালোই যাচ্ছিলো আমারদের টোনাটুনির সংসার।আমার নিঃসঙ্গতা কাটাতে ফালাক আমায় একটা বেড়ালের বাচ্চা এনে দেয়।এনে দেয়ও বলা যায় না।ভাগ্যক্রমে রাস্তায় মুমূর্ষু অবস্থায় পরে থাকতে দেখে ফালাক।মায়া হয় আর বাসায় নিয়ে আসে।ও জানে আমার বিড়াল কত্তটা পছন্দের।বিড়ালের বাচ্চাটার তখনও চোখ ফোটেনি।গায়ে ছিলো অসংখ্য পোকা।নিয়ে আসার তিনদিন পর বাচ্চাটার চোখ ফোটে।ক্যাম্পাস কাছে থাকায় ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে এসে ওর যত্ন নিতাম।একদিন ক্লাস করে এসে দেখি কাটনের বাক্সে বসে মায়া ভরা চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আমি গিয়ে আলতো করে ওকে উঠিয়ে নিই।ও মিউ করে ডাক দেয়।বাচ্চাটা আনার পর অলস সময়গুলো আমার ওকে নিয়েই দিব্বি কেটে যায়।যেহেতু বুঝতে পারিনি বাচ্চাটা ছেলে নাকি মেয়ে তাই নাম রাখা নিয়ে বিড়ম্বনায় ছিলাম।অবশেষে আদর করে ওর নাম রাখি ‘বিলাই’।সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস নাম।
চড়ুই পাখির সাইজের বাচ্চাটা ধীরে ধীরে বড় হয়।ওর চাঞ্চল্যতা বাড়ে।বাসায় যতক্ষণ থাকি সর্বক্ষণ সে আমার পেছন পেছন ঘুরে। একদিন ও চেয়ারে জমে থাকা ফালাকের সারাসপ্তাহের কাপড়ের ওপর ও পটি করে দেয়।এমনিতে বিলাই বাথরুমে গিয়ে পি পটি কুরে।ফালাকের সাথে ঝগড়া হয়েছিলো সেদিন।তাই বোধহয় ফালাকের জামায় কাজ সেড়ে নিয়েছিলো সে।কিন্তু সেদিন কি নিয়ে যে বিড়াল প্রাণীটা কিউট হলেও এর পটি অনেক দুর্গন্ধ যুক্ত হয়।ফালাক সেদিন বাসায়ই ছিলো।কি একটা কাজে যেন বাইরে গিয়েছিলো।আমি রান্না ঘরে ছিলাম।ফালাক তো বাইরে এসেই দুর্গন্ধ পায়।গন্ধকে অনুসরণ করে দেখে ওর জামা কাপড়ে বিলাই পটি করে রেখেছে।সে তা দেখেই মুখ চেপে ওয়াশরুমে চলে যায়।বের হয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে সে বাসা মাথায় তুলে নেয়।আমি ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে রান্না ঘর থেকে বের হই।
” কি হয়েছে।এত চিৎকার চেঁচামেচির কি আছে?”
” চিৎকার চেঁচামেচির কি আছে মানে?তুমি কি নাকে তুলো গুজেছো?গন্ধ পাও না কিছুর?”
আমি লম্বা শ্বাস নিই।মুহুর্তেই আমার চেহারার ভাব ভঙ্গি পরিবর্তিত হয়ে হয়ে যায়।আমি মুখ বাংলার পাঁচের মতো করে বলি,,
” ছি ছি ছি। দুইদিন পরে বাচ্চার বাপ হবে এখনো এমন বিদঘুটে দুর্গন্ধ যুক্ত বায়ু ত্যাগ করো।শেষে সেই দুর্গন্ধে পাগল হয়ে আমায় ডাকো।”
পাশে তাকিয়ে দেখি ফালাক আমার দিকে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে।হাত ধরে টানতে টানতে কাপড়ের স্তুপটার পাশে নিয়ে যায়।গন্ধের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়।নাক মুখ ছেপে ফালাক আঙুল দিয়ে ইঙ্গিতে কাপড়ের স্তুপের ওপর কিউট বাদরটার কর্মকাণ্ড দেখায়।আমি বিলাইয়ের দোষ ফালাকের ওপর চাপাই।
” আল্লাহ! ফালাক তুমি এই খানে….ছি ছি ছি।ফালাক তুমি কি মীনা কার্টুন দেখো নাই?মীনা বলছে,স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার না করলে আমগো হজ্ঞলের ডায়রিয়া হইতে পারে!”
” দোয়েল দিস ইজ টু মাচ।”
হুংকার দিয়ে বলে ফালাক।আমি শুকনো ঢোক গিলে বলি,,,
” পরিষ্কার করতেছি।চিল্লাইয়ো না।”
” নেক্সট টাইম যদি তোমার পিরিতের বিলাই এই কাজ করে ওরে লাথি দিয়ে বের করে দিবো।”
আমি প্রত্যুত্তরে কিছু বলি না।পরে সুযোগ পেলে ঝাড়বো।
বাথরুমে কাপড় পরিষ্কার করছিলাম।হঠাৎই বিলাই এসে গা ঘেষতে লাগে।যদিও ও আমার কথার কোনো জবাব দেবে না।তারপরও ওকে জিজ্ঞেস করতে লাগি,,,
” এই কাজ কেন করলি?”
ও ভারী গলায় “মেও মাও মেও মাও” বলে ওঠে।আমি শুনে বলি,,,
” আব্বু আমার সাথে ঝগড়া করেছিলো বলে তুই পটি করে দিবি?এখন তো কষ্ট আমারই হচ্ছে।”
বিলাই আবার মেও মেও আওয়াজ করে। ফালাক আমার কথা শুনে ফেলেছিলো।ও ধমক দিয়ে আমায় বলে,,,
” আমি বিলাইয়ের আব্বু হইলাম কিভাবে?”
” ঠিক যেভাবে আমি আম্মু হলাম।”
” এহ,দুইদিন পর বাচ্চার মা হবে তাও বাচ্চামি যায় না।”
” মা হইছিই তো।বিলাইয়ের মা।আর তুমি বিলাইয়ের বাপ।”
প্রতিটা ওনারের কাছেই তার পেট অর্থাৎ পোষ্য তার সন্তান সমতুল্য। হাজারো মায়া মমতা জড়িয়ে থাকে পোষা প্রাণীটার প্রতি।পোষা প্রাণীর জন্য ভালোবাসা হলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভালোবাসা।
এ ভালোবাসা অভিমান আছে, খুনসুটি আছে, ভালোলাগা আছে, শুধু নেই আঘাত।
তারা ছেড়ে যায় আয়ু শেষে,তবে বিশ্বাসঘাতকতা করে না! আর বর্তমান পৃথিবীতে মানুষ সবচে স্বার্থপর প্রাণী।এরা প্রয়োজনে প্রিয়জন বানায়।স্বার্থ ফুরিয়ে গেলে,প্রয়োজন মিটে গেলে এদের চেনা মুখটা অচেনা হয়ে যায়।
মাঝখানে এইচএসসি পরীক্ষা এডমিশনের চাপের ফালাকের সাথে আমার যোগাযোগ প্রায় বন্ধই ছিলো।তার মধ্যে আমি যথেষ্ট আপসেট ছিলাম মেডিকেল এডমিশন নিয়ে।যথেষ্ট পয়েন্ট থাকার পরেও মাত্র দেড় মার্কের জন্য আমি মেডিকেলে চান্স পাই না।অথচ ছোট বেলা থেকেই এই লাইনে পড়ার জন্য কতই না পরিশ্রম করেছি।তীরে এসে নৌকা ডুবার মতো।পরে ডিসিশন নেওয়া হয় প্রাইভেটে এডমিশন নেবো।ধানমন্ডির একটা প্রাইভেট মেডিকেলে আমি এডমিশন নিই।ধানমন্ডিতেই একটা দুই রুমের ফ্ল্যাট নিয়ে আমি আর ফালাক থাকতে শুরু করি।যদিও ধানমন্ডি থেকে ওর ক্যাম্পাস বেশ দূরে হয়ে যায়!তারপরও ফালাক আমার জন্য ধানমন্ডিতেই থেকে যায়। ও বাসে ঝুলে ঝুলে যাক ওর সমস্যা নেই।কিন্তু আমায় যেন দুর্ভোগ পোহাতে না হয়।তাই আমাদের ধানমন্ডিতেই থাকা।তাছাড়া ঢাকায় প্রায়ই মেয়েরা রাস্তা-ঘাটে বাসে হ্যারাসমেন্টের শিকার হয়।সময় দিতে না পারলেও দায়িত্বে তার গাফিলতি নেই।অনার্স প্রায় ওর শেষের দিকে।অনার্স শেষ করেই ছোটখাটো জব করতে চাইছে। তারপর মাস্টার্স কমপ্লিট করে একটা ভালো জবে ঢুকার ইচ্ছা তার।যেহেতু বাংলাদেশে কোনো ভালো চাকরি করতে চাইলেই কর্তৃপক্ষ অভিজ্ঞ লোক চায় তাই অভিজ্ঞতার জন্য হলেও তার ছোটখাটো চাকরি করতে হবে। প্রতিদিন ভোর সকালে বেরিয়ে যায়।আসতে আসতে রাত এগারোটা-বারোটা বেজে যায়।কখনো কখনো ক্যাম্পাসের আশে পাশেই টিউশনগুলো প্রায় সারাদিন সেখানেই থাকতে হয় ওর।রাতে আমি তার জন্য খাবার নিয়ে বসে থাকি।সে আসে।একসাথে খেতে খেতে আমাদের সারাদিনের টুকটাক কথা হয়।আর দিন শেষে একেঅপরকে আলিঙ্গন করে শান্তির ঘুম।এভাবেই চলতে লাগে আমাদের সাদা-মাটা সাংসারিক জীবন।পড়াশোনার খরচ আব্বুর থেকেই নেই।আর টুকটাক হাত খরচের টাকা ফালাক দেয়।সেখান থেকেই টাকা জমিয়ে জমিয়ে আমি ওকে ছোট ছোট গিফট দেই।
কিন্তু একটা জিনিস আমার খুব খারাপ লাগে।ফালাক আমায় কখনো কোথাও ঘুরতে নিয়ে যায় না।এইতো সেদিনই বললাম।কাছেই ধানমন্ডি লেক।একটু ঘুরে আসি।ওমা!সে মুখের ওপর না বলে দিলো।খুব রাগ হয়েছিলো সেদিন।কয়েকদিন ভালো করে কথাই বলিনি জিদ ধরে।কিন্তু ব্যাটা তো বহুত সিয়ানা। যাইতে আসতে সালাম দেয়।ঠাস ঠুস ফোন দিয়ে সালাম দেয়।সওয়াব কামাইয়ের লোভে সালামের জবাব দিয়ে বারবার কথা বলে ফেলি।
আজও শুক্রবার। সাতটায় উঠে নাস্তা বানানোর কাজে লেগে পড়ি।আমি রান্নাবান্না অতটা ভালো পাই না।পেট ভরানোর জন্য নুডলসটা পাই ভালো।আজ ভিন্ন ভাবে নুডলস বানানোর ট্রাই করবো।মানে নুডলস দিয়ে নতুন রেসিপি আর কি!সয়া সেদ্ধ বসিয়ে দিই। এটা একটু টাইম লাগে সেদ্ধ হতে।ঝামেলারও লাগে জিনিসটা।সেদ্ধ করো।চেপে চেপে পানি বের কর।এই পানি বের করতে গিয়ে কত যে ছ্যাকা খেতে হয়েছে তার হিসাব নেই।টেস্ট অত ভালো লাগে না আমার।কিন্তু ফালাকের পছন্দ তাই ওর সাথে আমায়ও খেতে হয়।এমনিতেই খোটা দেয় রান্না পাই না বলে!
সয়া সেদ্ধ হয়ে গেলে পানি ঝড়িয়ে সেগুলো ঠান্ডা হওয়ার জন্য আবার ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে রাখি।তারপর নুডলস সেদ্ধ বসিয়ে দিই।
নতুন সংসার প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই কেনা হয়ে উঠেনি।পাশের ঝুড়িতে দেখি দুটো ছোট গাজর আর ডিম আছে।এগুলো বাদ যাবে কেন?এগুলোও কাজে লাগিয়ে দিই।গাজর গ্রেটারের সাহায্য কিচি কিচি করে সেগুলোও নুডলসের সাথে সেদ্ধ বসিয়ে দিই।
তারপর ময়দার সাথে স্বাদমতো লবণ মিশিয়ে খামি বানাই।এতক্ষণে সয়াও ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে।সেগুলো থেকে চিপে পানি বের করে নিই।
নুডলস গাজর সেদ্ধ হয়ে গেলে এজইউজুয়াল পেঁয়াজ,মরিচ,সয়া,ডিম,নুডলসের সাথে থাকা টেস্ট মেকার দিয়ে নুডলস রান্না করে নিই।সয়া অপছন্দের আরেক কারণ এটা মাত্রাতিরিক্ত তেল শুষে নেওয়া।সাশ্রয়ের জন্য সয়া বাদ দিতে বলি।তেলের যা দাম।তারমধ্যে এটা পুস করে তেল খেয়ে নেয়।আজকে স্পেশাল রেসিপি তো তাই একটু নাগা সস এড করি।
ময়দার খামি থেকে ছোট ছোট ল্যাচি কেটে নেই।তারপর সেগুলো বেলে ছোট সাইজের রুটি বানাই।রুটিগুলোর মাঝখানে নুডলস রেখে একটা মোমোর শেপ দিই।কাল এত করে দেখলাম মোমোর বিভিন্ন ডিজাইন।তাও হলো না।শেষে কোনো রকমে ভেতরে নুডলস পুরে আমি মোমো গুলো ভাপে বসিয়ে দিই।
নাস্তা রেডি হতে হতে সাড়ে আটটা বেজে যায়।গিয়ে দেখি ফালাক এখনো মরার মতো ঘুমাচ্ছে।আমি গিয়ে ওকে ডাকি।ও ওঠে না।বাম মাছের মতো মোচড়ামুচড়ি করতে লাগে।আমি ধমক দিই,,,
” ওই ব্যাটা ওঠ!নতুন রেসিপি বানালাম কষ্ট করে।ঠান্ডা হয়ে গেলে খেতে ভাল্লাগবে না।তখন আবার আমায় মেজাজ দেখাবি।”
আমার কথা শুনে ফালাকের চোখ কপালে ওঠে।ও ঝাল একদম খেতে পায় না।নাগা সসকে ও বিষের মতো ভয় পায়।আমি খাই বলেই ও এনে দিয়েছে।ওর গলার স্বর খানিকটা চিকন হয়ে যায়,,
” আল্লাহ,বলো কি?নাগা সস?আজ আমি শেষ দোয়েল।”
” কমায় দিছি ছাগল।আমি যে সস দিয়ে খাচ্ছি এটা ঠোঁটে ছোঁয়ালেই তো তুমি চিৎকার চেঁচামেচি করবে।এত ঝাল।”
” তাই কি?ঝালকে হারিয়ে দেওয়ার জন্য তুমি আছো না?”
” মানে?”
” মানে তুম….”
” প্লিজ স্টপ ফালাক।”
ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি কথাটা বলে ওকে থামিয়ে দিই।ফালাক লাজুক হাসি দেয়।আমিও লজ্জায় চোখ মাটিতে নামিয়ে খেতে লাগি।
খাওয়া হয়ে গেলে আমরা যে যার মতো বাসন ধুতে লাগি।ডিল হয়েছে আমাদের মধ্যে নিজের কাজ নিজের করতে হবে।ফালাক বাহিরে যাওয়ার জন্য রেডি হয়।শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বলে,,
” কিছু আনা লাগবে?”
” দুধ,আর ডিম আনিও।আজ পুডিং বানাবো নি।”
” এই একটা জিনিস তুমি ভালো বানাতে পারো।”
আমি চাপা হাসি দেই।ও বেরিয়ে যায়।আমি দরজা আটকে দিয়ে।বাথরুমে কাপড় ভেজাই।সারা সপ্তাহের কাপড় জমে রয়েছে।ফালাকেরই বেশি।ও একদিন ওই এক শার্টই পরবে।বাইরে থেকে এসেই ময়লা কাপড় রাখার চেয়ারে ঢেল দেবে সে।আর আমি একসেট জামা ঘাম শুকিয়ে এক সপ্তাহ পার করে ফেলি।তবে বৃষ্টির দিনে তা অন্য কথা! ভাবতেও অবাক লাগে সেদিনের অলস দোয়েল আজ কত্ত কাজ করে।ওপরওয়ালা যদি মেয়েদের সব পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা না দিতেন তাহলে সত্যিই, বিয়ের পরে মেয়েদের কষ্টের সীমা থাকতো না।
যুগের পর যুগ ধরে নারীরা স্যাক্রিফাইস আর এডজাস্ট করে আসছে।এই দুটো ওয়ার্ড যেন শুধু মেয়েদেরই জন্য।সংসারে সর্বস্ব দেওয়ার পরও,জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকে একটা শিশু ভূমিষ্ট করে একজন পুরুষকে পিতৃত্বের স্বাদ দেওয়ার পরও দিনশেষে নারীরাই কলঙ্কিনী, বে*শ্যা।নারীরাই ছলনাময়ী। বাংলা অভিধানে আশি ভাগ নেগেটিভ শব্দই নারীকে নিয়ে লেখা।
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পরে আমাদের ম্যারেজ রেজিস্ট্রি হয়।ফালাকের পরিবারের মোটামুটি সবাইকেই আমার ভালো লেগেছে।কিন্তু ওর দাদি আর বোনকে আমার একটু বেশিই ভাল্লাগে আমার।যদিও আমি দাদির কথা সঠিকভাবে বুঝি না।গ্রামের সহজ সরল মানুষ হওয়ায় কথা বার্তায় উনার খুলনার খাঁটি আঞ্চলিক ভাষার টান আছে।ফাইজা ফালাকের ছোট বোন।সেভেনে পড়ে।পায়েলের থেকে এক ইয়ার জুনিয়র।প্রায় সমবয়সী হওয়ায় অল্পসময়ের মধ্যেই ওদের মধ্যে একটা ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়।
আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন রাতেই রওনা দেন খুলনার উদ্দেশ্যে। তারা থাকার কারণে আমি অস্বস্তি সহ্য করেই শাড়ি পরে ছিলাম।তারা চলে যাওয়ার সাথে সাথে আমি আমার কমফোর্ট ড্রেস ঢিলেঢালা টি-শার্ট আর পালাজ্জো পরে নিই।
সাদ ভাইয়া,ফালাক বাহিরে গেছে।ড্রেস চ্যাঞ্জ করে মুখ ধুয়ে আমি চায়ের পানি গরম দিই।আমার কাছে এই চা টা এক ধরণের মাদক।যা ছাড়া আমি প্রায় পাগলের মতো হয়ে যাই।এই জিনিসটা না থাকলে কবেই যে আমি মাথাব্যথায় মারা যেতাম!তাছাড়াও আমার সকল মানসিক রোগের ওষুধ এই চা কেই লাগে।বিয়ের আগ দিয়ে প্রায়ই ফালাকের সাথে ঝামেলা হতো।আপসেট থাকতাম অনেক।তখন চা খাওয়ার মাত্রাটা বেরে যেত। আমি সাধারণত দিনে দুইবার চা খাই।সকাল আর বিকাল বা সন্ধ্যা।এটা শুনে অনেকেই বলে মেয়েটা মাত্র দু কাপ চা খেয়ে নিজেকে চাখোর দাবি করে।নাহ ভাই,আমার কাপে চা খাইতে মুখে সুড়সুড়ি লাগে।ইয়ায়া বড় একটা মগ কিনেছি।সেই মগ ভর্তি করে দু’বেলা চা খাই।কিন্তু কোনো বিষয় নিয়ে আপসেট থাকলে চা খাওয়ার মাথা অনেক বেড়ে যায়।তখন দিনে ১০-১২ মগ চা খাওয়ারও রেকর্ড আছে আমার।এতটাই আমি এই জিনিসটার প্রতি আসক্ত।আম্মুর মতে আমার এই ক্ষুধামন্দার মুলে নাকি রয়েছে আমার চা খাওয়া।মাঝে মাঝে চা পাতি আম্মু লুকিয়ে রাখে।কিন্তু আম্মু ভুলে যায় যে আমি আম্মুরই মেয়ে।রুমে সব সময় আমি ইমার্জেন্সি চা পাতি রাখি।তখন সেখান থেকে নিয়েই খাই।
সাদ ভাইয়া, ফালাক রাত সাড়ে দশটার দিকে ফেরে।ওরা বাসায় আসতে না আসতেই শুরু হয় আম্মুর রাতের খাওয়ার জন্য তাগাদা।দুপুরে আমার খাওয়া হয় নি।খিদেতে পেটে ছুঁচো ডাকছে।যার কারণে এইবার আর পরে খাবো,পরে খাবো বলে ঘ্যান ঘ্যান করি না।সবার আগে টেবলে ব,সে যাই।আমার খাওয়ার তোরজোর দেখে আপুনি টিটকারি মেরে বলে,,,
” দেখেছো?আজ আর খাওয়াতে তার আলসেমি নেই।খুব বলতো আমার বিয়েতে আমি আগে আগে খাবো।অতচ একটু আগে চা খেতে খেতে বললো জানিস আপুনি আজকে আমার দুপুরে খাওয়া হয় নি!”
” রিলেশন করেছো।জানো কি না জানি না।তারপরও বলছি,দোয়েলের চা ছাড়া সব খেতে রাজ্যের আলসেমি।না খেয়ে থেকে মরে যাবে তাও নিজে থেকে খাবে না।ওকে খাইয়ে দিতে হয়।তোমার হাতে তুলে দিয়েছি। তুমি দেখে রেখো ওকে।দেখো,মেয়েটা যেন কষ্ট না পায়।মুখ ফুটে সব বলে না।তাই তো তোমাদের ঘটনার কথা আমরা কেউ জানতে পারিনি।”
” আপনি চিন্তা করবেন না।দায়িত্ব যখন দিয়েছেন আমি সর্বস্ব দিয়ে তা পালনের চেষ্টা করবো।”
ফালাক বলে।খাওয়া শেষ হলে আব্বু-আম্মু নিজেদের রুমে ঘুমাতে যাই।আমরা সবাই ড্রয়িংরুমে বসি।আড্ডা দিতে।বাইরে থেকে আসার আগে ওরা কোকাকোলা এনেছে।আমি কোকাকোলা, গ্লাস নিয়ে আসি।ওত আদিখ্যেতা করে ঢেলে দিতে পারবো না।যার লাগবে নিয়ে নিয়ে খাবে।
আমি আপুনি একে অপরের লাভ স্টোরি বলি।পায়েল বিষন্ন মুখ নিয়ে গালে হাত দিয়ে সেগুলো শুনে।
” আজ যদি একটা প্রেম করতাম আমারও জামাই থাকতো।”
” এইটে পড়ে।মেয়ে নাকি প্রেম করবে!”
ভেঙচি কেটে বলি আমি।সবাই মৃদুস্বরে হেসে দেয়।দেড়টা পর্যন্ত আমাদের আড্ডা হয়।সাদ ভাইয়ার অফিস ধরতে হবে গিয়ে। তাই আপুনি, ভাইয়া ঘুমাতে যায়।আমি আর ফালাকও নিজেদের ঘরে যাই।পায়েল সাধারণত আমার সাথে থাকে।আজ ফালাক থাকায় তাকে গেস্ট রুমে ঘুমাতে দেওয়া হয়েছে।
ফালাক ঘরে ঢুকতেই আমি দরজা লাগিয়ে দেই।মুচকী হাসি দিয়ে বলি,,,
” আজ আমরা প্রথম এক সাথে রাত কাটাবো।”
আমার কথা শুনে ফালাক লাজুক হাসি দেয়।আমি দাঁতে দাঁত কামড়ে বলি,,,
” আর আজ তুই তোর সব কাজের কৈফিয়ত দিবি।”
ফালাক বেকুবের মতো আমার দিকে তাকায়।চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে ও ভেতর ভেতর আওড়াচ্ছে শা*লা কি ভাবলাম।আর কি হলো!আমি আবার বলি,,,
” যা যা জিজ্ঞাসা করবো ঠিক ঠিক উত্তর দিবি।”
ফালাক শুকনো ঢোক গিলে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।আমি ওকে সাইড দিতে বলি।আমি বসবো।ও সরে বসে।আমি বলা শুরু করি,,,
” নাম্বার ওয়ান,তুই সিগারেট খাওয়া ধরলি কবে থেকে?”
ও করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,,,
” একটা কথা বলি?”
” হুঁ,বল।”
” বুঝলা কিভাবে সিগারেট খাই আমি?”
” রাত্রে যখন খাইতে বসছিলাম তখন আপনার গা থেকে আমি সিগারেটের গন্ধ পেয়েছি ষ্যাড়।”
” আমি বা মিন্টের চুইংগাম খেয়েছি!সাদ ভাইয়া বললো মিন্ট জাতীয় কিছু খেলে নাকি সিগারেটের গন্ধ চলে যায়।”
” সাদ ভাইয়া জানলো কিভাবে?”
” উনিও তো খান।তোমার যেমন চা ছাড়া অস্থির লাগে আমাদের তেমন সিগারেট ছাড়া অস্থির লাগে।”
” আপুনিকে বলতেছি।”
” জানেন উনি।উনি ঘরে সিগারেট খাওয়ার পার্মিট দেন নাই শুধু।তাই ভাইয়া বাইরে খায়।”
ফালাকের সাথে আমি কথায় পাই না।বেশিই ফটরফটর করে ছেলেটা মনে হয়।আমায় চুপ থাকতে দেখে হাসতে লাগে ও।আমি ধমক দিয়ে বলি,,,
” এত হাসি কিসের?”
” হাসলে মানুষ বেশিদিন বাঁচে।বাঁচার জন্য হাসি।”
আমি একটু ওর দিকে এগিয়ে যাই।ও লজ্জায় কিছুটা সরে যায়।আমি শান্ত কন্ঠে বলি,,,,
” সত্যি করে বলো তো ফালাক!তুমি কি ভালো ছেলে?”
ও শার্টের কলারটা হাল্কা ঝাঁকিয়ে বলে,,
” হ্যাঁ,অবশ্যই।লাখে একটা।”
” ভালো ছেলেরা কখনো সিগারেট খায় না।কারণ ওরা জানে ঠোঁটজোড়া তাদের বউয়ের হক।”
কথাটা বলেই মুহুর্তে ওর অক্ষিজোড়া দুটো আমার হাত দিয়ে আড়াল করে ওর ঠোঁটে আমার ঠোঁটের আলতো ছোঁয়া দিয়ে দিই।
ও তাজ্জব।চোখের পলক পরছে না ওর।বড় বড় চোখ নিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।আমি লজ্জায় বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ি। মস্তিষ্ক কাজ করছে না আমার।কি করে ফেললাম আমি?হায় হায়!দোয়েল এতটা অসভ্য হয়ে গেছে?কিভাবে ঠাস করে….ছি ছি।আমার তো মনে হচ্ছে এখনই জমিন দু ভাগ করে তার ভেতরে ঢুকে যাই।নিজের কাছে নিজেরই লজ্জা লাগছে।
” দোয়েল! এই দোয়েল!”
ফালাক আমায় ডাকছে।কিন্তু আমার প্রচন্ড লজ্জা লাগছে।ঝোকের বশে কি না কি করে ফেলেছি।আমি কোনো সাড়া দিই না ওর ডাকে।
” দোয়েল ওঠে না!”
” উহু,আমার ঘুম পেয়েছে।ডোন্ট ডিস্টার্ব।”
” ঘুম পেয়েছে না লজ্জা?”
” যেটা ধরে নাও।”
” লজ্জাই ধরলাম।কিন্তু তুমি তো বলেছিলে আমার সব কাজের কৈফিয়ত নেবে।”
” আজ আর না।বেঁচে থাকলে কৈফিয়ত নেওয়ার অনেক সময় পাবো।”
ফালাক কোনো কথা বলে না।চুপ করে বসে মুচকী মুচকী হাসতে থাকে।আমি চুলের আড়াল দিয়ে সেগুলো দেখি।ওর চোখে মুখেও লজ্জা ফুটে ওঠেছে। ও উঠে গিয়ে লাইট অফ করে ড্রিম লাইট দিয়ে আবার বিছানায় আসে।আলতো ছোঁয়ায় আমার মুখের ওপর থেকে চুলগুলো সরায়।আমার অক্ষি যুগল তখন তার দিকে।
আমি লজ্জায় চোখজোড়া নামিয়ে দিই।ফালাক হেসে দিয়ে আমায় জড়িয়ে ধরে।আমি লজ্জায় আরও চুপসে যাই।কিজানি বাবা!আমার এত লজ্জা আজ হঠাৎ কোথা থেকে আসলো!আমি তো অত লাজুক মেয়ে না।ক্ষানিকবাদে আবার ও বলে,,,
” ট্রাস্ট মি দোয়েল।আমার কল্পনার বাইরে ছিলো যে তুমি এমনটা করতে পারো।আমার কাছে নেহাতই তুমি একটা নিরামিষ মেয়ে ছিলে।”
” হু,বুঝলাম।তাই ইগ্নোর করতা?”
” তা না।ব্যস্ততার জন্য সময় দিতে পাই নাই।জানোই তো আমার অবস্থান কেমন!তুমি বলেই আছো আমার সাথে।অন্য কেউ হলে কবেই ছেড়ে দিতো।”
কথাটা বলেই ও আমার কপালে আলতো করে চুমু দেয়।ভাই!আজ আমি লজ্জায় শেষই হয়ে যাবো।ওর জড়িয়ে ধরার মাত্রাটা আরও বাড়ে।আমায় নিজের বাহুডোরে শক্ত করে আবদ্ধ করে বলে,,,
বিয়েটা এক্সিডেন্টলি হয়ে যায় আমাদের।যার কারণে বিয়ের ব্যাপারে আমার বাবা-মা জানলেও ফালাকের বাবা-মা জানে না।আব্বু ফালাকের থেকে তাদের ফোন নাম্বার নিয়ে তাদের আমাদের বাসায় আসার আমন্ত্রণ জানান।আজ তারা আসছেন।বাসায় একটা উৎসব মুখর পরিবেশ বিরাজ করছে।আপুও এসেছে।আম্মুর সাথে আপু রান্না বান্নায় সাহায্য করছে।আমায় ঘর গুছানোর দায়িত্ব দিয়েছে। সাদ ভাইয়া আর পায়েল খুনশুটিতে ব্যস্ত।ট্রুথ ডেয়ার খেলছে তারা।সাদ ভাইয়া এই কিছুক্ষণ যখন ডেয়ার নেয় তখন বাদর পায়েলটা সাদ ভাইয়াকে ডেয়ার হিসাবে অনেক গুলো চকলেট আইসক্রিম আনতে বলে।ভাইয়া প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে পায়েলের চাপে ডেয়ার মানতে বাধ্য হয়।ডেয়ার অনুযায়ী ভাইয়া অনেক গুলো চকলেট আইসক্রিম আনে।আমি সেখান থেকে একটা চকলেট কোন আইসক্রিম নিয়ে খাই।
ফালাক এখনো আসে নি।সকালে রওনা দিয়েছে ফালাক।জ্যামে না পরলে যোহরের আজানের আগেই চলে আসবে আশা করা যায়।ফালাকের পরিবার ভোর রাতে রওনা দিয়েছে।সুদুর খুলনা থেকে আসছে তারা।আমি একটু বেশি নার্ভাস তাদের ভাষা নিয়ে। এক অঞ্চলের ভাষা তো অন্য অঞ্চলে বোধগম্য হয় না।হলেও তা অনেক হাস্যকর হয়।যেমন আমাদের এখানে পুরি এক ধরণের খাবারের নাম। কিন্তু সিলেটে গিয়ে যদি কেউ বলে সে পুরি খাবে তাহলে সে গেছে!
ঘর গোছানো শেষ হলে ড্রয়িংরুমে গিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিই।যা ভ্যাপসা গরম পরেছে।মনে হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমিতে আছি।আরেকটু গরম পরুক না!ইয়া হাবিবি বলে উট নিয়ে বের হবো। ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে আপুনি আসে।ওড়না দিয়ে হাত মুছতে মুছতে বলে,,,
” কি পরবি আজকে?”
” জামা।এমনিতে অন্যান্য দিন টিশার্ট পালাজ্জো পরি আজ কোনো এক থ্রীপিস পরবো।”
” ফালাকের বাবা মা তোকে কখনো দেখেছে?”
” থাকি দেশের দুই প্রান্তে।দেখবে কিভাবে?”
” প্রথম দেখতেছে তোকে।আজ শাড়ী পর।”
” আমি পরতে পাই না শাড়ি।”
” আমি পরিয়ে দেবো নি।এখন শাওয়ার নিয়ে আয় যা।তুই বের হলে আমি যাবো।”
আপুনির কথার পিঠে কোনো কথা বলি না আমি।গরম পরেছেও অনেক।চোখে মুখে তীব্র ক্লান্তিভাব।শাওয়ার নিলে হয়তো ভালো লাগবে।
শাওয়ার নিয়ে রুমে এসে দেখি ফালাক উপর হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে।আমি টাওয়েল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বলি,,,
” কখন এলে?”
” এই মাত্র।”
” ফ্রেশ হয়েছো?”
” একটু পরে।অস্থির লাগছে।”
” আপুনি গেলো কিন্তু তাহলে ওয়াশরুমে।”
” আচ্ছা যাক।”
আপু ওয়াশরুমে যাওয়ার আগে আমায় ডাক দিয়ে হাতে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে যায়।
” কি এইগুলো?”
” শাড়ি আর পাঞ্জাবী।আব্বু টাকা দিয়েছিলো তোদের জন্য কিনতে। দেখতো পছন্দ হয় কি না?”
আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিই।আপুনি মুচকী হেসে আমার গালে হাত দিয়ে বলে,,,
খাটের এক সাইটে সব মেকাপ প্রোডাক্ট ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছি।ফালাক সব গুলোই চোখ বুলিয়ে নেয়।অবাক দৃষ্টিতে বলে,,,
” এগুলা কি?”
” মেকাপ।”
” তুমি না বলতা মেকাপ করতে জানো না তুমি।”
” শিখে নিতে কতক্ষণ?মানুষকে দেখাতে হবে না ফালাক ভাই কত সুন্দর বউ পেয়েছে?”
” ফালাক ভাইয়ের বউ ন্যাচারালই অনেক সুন্দর। কাজল,লিপস্টিক দিলেই তাকে মাশাআল্লাহ লাগে।আটা ময়দা দেওয়ার দরকার নাই।”
আমি আড়চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে বলি,,,
” ডোন্ট ডিস্টার্ব। সাজতেছি।”
আপুনি বেরুতে বেরুতে আমার সাজা হয়ে যায়।কসমেটিকস গুলো শুধু শুধু কিনেছি।একটাও ভালোভাবে এপ্লাই করতে পারি না।টাকা নষ্ট।ছোট বড় সব অনুষ্ঠানে বিবি ক্রিম,লিপস্টিক, আইলাইনার, মাশকারা ই সব।বিয়ে বাড়ি গেকে শুধু ব্লাশন আর আইশ্যাডো দিই।সব সময় থ্রী পিস পরায় টিপটা আমার গেটাপের সাথে যায়।একসময় ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরতাম।কিন্তু বাদ দিয়েছি পরা।ফালাকের ভাষ্যমতে পশ্চিমা পোশাকে নাকি আমায় মানায় না।বাঙালি পোশাকেই নাকি আমায় অসম্ভব সুন্দর লাগে।আর কোন মেয়ে চাইবে না নিজেকে সুন্দর উপস্থাপন করতে!তাই বাঙালিয়ানার দিকে ঝুঁকি।ফালাকের কথাই সত্য হয়ে দাঁড়ায়।বাঙালি পোশাকে আমি নিজেকে আলাদা ভাবে খুঁজে পাই।তারপর থেকে থ্রীপিস,কুর্তাই আমি পরি।
আজ প্রথমবার শাড়ি পরতে যাচ্ছি।প্রথমবারও না।ছোট বেলায় অনেক পরা হয়েছে শাড়ি।কিন্তু মাঝখানে পশ্চিমা সংস্কৃতির খপ্পরে পরে শাড়ি কি জিনিসটাই ভুলে গেছিলাম।অনেকদিন পর পরা হচ্ছে তো তাই ফার্স্ট টাইম ফার্স্ট টাইম ফিলিং আসছে।
আপুনি শাওয়ার নিয়ে টাওয়েল দিয়ে চুল প্যাচাতে প্যাচাতে রুমে আসে।ফালাক আপুনিকে সালাম দেয়।আমি নতুন টাওয়েল বের করে দিই ফালাককে।ফালাক ওয়াশরুমে চলে যায়।
আপুনি শপিং ব্যাগ থেকে শাড়িটা বের করে মেলে।সাদা-কালো আমার প্রিয় রঙ।শাড়িটা জামদানী। সাদার মধ্যে লাল সুতোর কাজ রয়েছে।আর জমিন লাল।তখন ভালো করে না দেখেই বলেছিলাম শাড়িটা সুন্দর। এখন দেখি আসলেই সুন্দর।আপুনি বেশ পরিপাটি ভাবেই শাড়ি পরাতে পারে।আঁচল সুন্দর করে প্লেট প্লেট করে দেয়।
আমি রেডি হতে হতে ফালাক শাওয়ার নিয়ে বের হয়।ফালাকও সেইম পাঞ্জাবী পরেছে।সাদার মধ্যে লালের কাজ।পেছন পেছন সাদ ভাইয়াও আসে।
” সাদা নাকি শ্যালিকার পছন্দ?তাই তোমার আপু এই শাড়িটা কিনলো।আর পাঞ্জাবিটা তোমার আপু নিজ হাতে হ্যান্ড পেইন্ট করেছে।”
” আপুর গুণ আছে অনেক।আর আমি বে গুণ।শুধু বিছানা সোফায় গড়াগড়ি করি।”
সাদ ভাইয়ার কথার জবাবে বলি আমি।সবাই হেসে দেয়।পায়েল আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়। সেও শাটি পরেছে।প্যাচিয়েছে বলা যেতে পারে।ও তো তাও প্যাচিয়েছে।আমি তো তাও পাই না।
” আপুনি,শাড়ি পরিয়ে দে।আমি ছবি তুলার জন্য যেভাবে শাড়ি প্যাচাই সেভাবে প্যাচিয়েছি।তুই ভালো করে শাড়ি পরাতে পারিস।”
” পায়েলের সাথে আমিও শাড়ি পরে আসছে।তোমরা থাকো।সবাই শাড়ি পাঞ্জাবি পরে সেল্ফি তুলবো।”
” দোয়েল যা ইন্ট্রোভার্ট!ভাবতেই পারিনি ওর এভাবে বিয়ে হবে।”
” আপনারা সবাই ওকে কোন হিসাবে ইন্ট্রোভার্ট বলেন আমি ভেবে পাই না।সারাদিন আমার কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করে আমার মাথা খায়।”
সাদ ভাইয়ার কথার জবাবে বলে ফালাক।খানিকটা রাগ হয়।তোর কাছে যদি ইন্ট্রোভার্ট থাকতেই হয় তাহলে তুই কিসের প্রিয় মানুষ? প্রিয় মানুষের কাছে কিসের ম্যাচিউরিটি? খানিকটা অভিমানি কন্ঠে বলে,,,
” হু আমিই তো কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করি।আর অন্য মেয়েরা তো তোকে ফিসফিসিয়ে গান শোনায় তাই না?”
বেশ কিছুক্ষণ আমরা খোশগল্প করি।আপুনি পায়েল সেজে আসে।আমরা সেল্ফি তোলার প্রস্তুতি।সাদ ভাইয়া বেশ লম্বা।আপুনি মাঝে মাঝে তাকে খাম্বা বলে ডাকে,,,
” এই খাম্বা তুমি ফোন হাতে নেও।”
আমরা সবাই হেসে দিই।সেল্ফি তোলা হয়ে গেলে আমরা খাটে গোল হয়ে বসে ছবিগুলো দেখতে লাগি।ছবি গুলো দেখে পায়েল কিছুটা উদাসীন কন্ঠে বলে,,,
” দেখছিস আপুনি আপ্পি?তোদের সবার জামাই আছে।আজ আমারও যদি জামাই থাকতো তাহলে এই সেল্ফিটা পূর্ণতা পেতো।”
পায়েলের কথা শুনে আমরা সবাই এক যোগে হেসে উঠি।আপুনি পায়েলের মাথায় হাল্কা চড় দিয়ে বলে,,,
” বেশি পেকে গেছিস।”
” আচ্ছা ফালাক ভাইয়া!তোমার কি ছোট ভাই আছে?”
” কেন?”
আড়চোখে তাকিয়ে বলে ফালাক।পায়েল লাজুক কন্ঠে বলে,,,
” না মানে..আমারও একটা গতি হতো তো!তাই আর কি!”
আবার আমরা হেসে দেই।এরই মধ্যে কলিংবেলের আওয়াজ!পাশের ঘর থেকে আম্মু চিৎকার দিয়ে বলে,,,
” দোয়েল দরজাটা খুলে দে।”
” বিয়ের কনেকে বলছে দরজা খুলে দিতে।আমি যাচ্ছি।”
ভেংচি কেটে বলে আপুনি।আপুনি উঠে যায়।সাদ ভাইয়া ফালাককে বলে,,,
” তোমার বাবা- মা ই এসেছে হয়তো।”
বলতে না বলতেই আপুনির ডাক,,,,
” ফালাক আংকেল আন্টিরা আসছেন।”
ফালাক উঠে যায়।ফালাকের পেছন পেছন সাদ ভাইয়াও যায়।আমি উঠতে যাবো ঠিক তখনই পায়েল আমার পথ আটকে বলে,,,
” তুই বিয়ের কনে।তুই এক হাত লম্বা ঘোমটা দিয়ে বসে থাকবি।তুই কেন দৌড়ে শ্বশুরবাড়ির মানুষজনকে দেখতে যাবি?”
কলেজে যাই না বেশ কয়েকদিন হলো।বন্ধুবান্ধবরাও ফোনের পর ফোন দিচ্ছে।ওরা হয়তো জেনে গিয়েছে আমার আর ফালাকের বিয়ের কথা।কিছু খবর তো বাতাসে ভেসে যায় সেই হিসাবে আমাদের এক্সিডেন্টলি বিয়েটার ব্যাপারে মানুষের জেনে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু না।
কলেজে ঢুকতে কাওকে খুব একটা চোখে পরে নি।ওরা হয়তো ল্যাবের পাশে রুমটায় আড্ডায় ব্যস্ত।আমি চুপচাপ ক্লাসে গিয়ে বসে থাকি।আমায় দেখে
আযান এগিয়ে আসে।আযান আমার ক্লাসমেট।বেশ ভালো বন্ধুও বলা যেতে পারে।কিন্তু আমার ফ্রেন্ড সার্কেলের কেউ ওকে সহ্য করতে পায় না।ক্লাসে কয়েকটা গ্রুপ আছে।আযান আমাদের বিপরীত গ্রুপের সদস্য। যার কারণে দা কুমড়ো সম্পর্ক আমাদের।তবে সার্কেলের অন্যদের সাথে আযান খারাপ ব্যবহার করলেও আমার সাথে বেশ ভালো করেই কথা বলে।শুনেছিলাম আমায় সে পছন্দ করে।জোহা বলেছিলো।কলেজে আমি ইন্ট্রোভার্ট টাইপের।চুপচাপ থাকি। সবার সাথে কথা বলি না খুব একটা।নবীনবরণে আমায় দেখেছিলো আযান।তারপর জোহাকে বলেছিলো মেরুন রঙের শাড়ি পরা মেয়েটা কে?জোহাও সোজাসাপটা উত্তর দিয়ে দিয়েছিলো মেয়েটা দোয়েল।তারপর সে জোহার কাছে আমার নাম্বার চায়।জোহা হেসে বলে,,,,
” লাভ নাই ব্রো।ওর বয়ফ্রেন্ড আছে।”
” মিথ্যা বলছিস তুই।”
” ভাই তোর কসম।ওর বয়ফ্রেন্ড আছে।”
আযান কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলে,,,
” ব্রেকাপ হলে বলিস।দুলাভাই হয়ে যাবো তোর।”
” ওই আশায়ই থাক তুই।ওদের কখনো ব্রেকাপ হবেনা।”
আযানের আশা পুরণ হলো ঠিকই কিন্তু ব্রেকাপের রাতেই বিয়ে হয়ে গেলো।আযান আমার পাশের সিটটায় বসে।আমি একটু সরে বসি।
” শুনলাম তোমার নাকি তোমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে বিয়ে হয়ে গিয়েছে?”
” ভুল কিছু শুনোনি।”
” ম্যারিড লাইফ কেমন যাচ্ছে?”
” আলহামদুলিল্লাহ। ”
আযান হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে কেমন যেন দাঁতে দাঁত কামড়ে বসে থাকে।আমি জিজ্ঞাসাসূচক ভঙ্গিতে বলি,,,,
” কিছু বলবে?”
চমকে যায় আযান।চমকিত কন্ঠে বলে,,,
” না না কিছু না।শুভ কামনা রইলো নতুন জীবনের জন্য।”
আমি চাপা হাসি দিই।আযান উঠে চলে যায়।আমি ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে মেসেঞ্জারে যাই।সন্ধ্যার দিকে ফালাককে একটা মেসেজ দিয়েছিলাম।সীন পর্যন্ত করেনি এখনও।অথচ ওর প্রোফাইলে সবুজ রঙের বিন্দুটা জ্বল জ্বল করছে।
ডাটা অফ করি আমি।কিছুক্ষণের মধ্যেই জোহারা ক্লাসে আসে।জোহা এসেই আমার কাঁধে ওর কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দেয় ।
” কিরে?বিয়াইত্তা আফা, ম্যারিড লাইফ কেমন যাচ্ছে?”
” ভালোই।আগের মতোই আছে।”
” বলেছিলাম না?তোরা টম আর জেরির মতো।সারাদিন ঝগড়া করবি অথচ দিন শেষে একেঅপরকে না পেলে আপসেট হয়ে যাবি।”
কথা বলে।ইমন ইয়ার্কির হেসে ছলে বলে,,,
” জয় বাংলা।এবার বিয়ে করে একে অপরকে সামলা।”
ইমনের কথা শুনে আমরা সবাই অট্টোহাসিতে হেসে দিই। তুর্জ সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলে,,,
” ওরা তো বিয়ে করে ফেললো।কিন্তু আমরা তো আমাদের পাওনা জিনিস পেলাম না।”
” তোরা আবার কি পাস?”
গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলি আমি।আরুশি অবাক হয়ে বলে,,
” ওমা! বিয়ে করলি। আমরা ফালাক ভাইয়ার শালা শালি হিসাবে কিছু পাই না?”
” কি পাস তোরা?”
” আরেহ বোকা মেয়ে!বিয়েতে শালা শালিরা কি পায়?তুই কোয়েল আপুর বিয়েতে কি করেছিলি?”
” জুতা লুকিয়েছিলাম,দরজা ধরেছিলাম,গেট ধরেছিলাম।পরে ভাইয়ার কাছ থেকে নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা।”
” আমরাও ওরকম করবো।”
” যা পাবি ফিফটি পার্সেন্ট আমার।”
” এহ, দিবো তোমায়!”
ভেঙচি কেটে বলে আরুশি।এরই মধ্যে স্যার ক্লাসে প্রবেশ করেন।মুহুর্তেই সবাই যে যার আসনে বসে পড়ে।
________
” আপ্পি!”
কলেজ থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ড্রেস চ্যাঞ্জ করছিলাম।পায়েলের ডাকে পেছন ঘুরে তাকাই।
” কি হয়েছে?”
” একটা কথা জিজ্ঞেস করতাম।”
” কি কথা?”
” ফালাক ভাইয়া তো ঢাকা থাকে তাই না?”
” হু,তো কি হয়েছে?”
” তাহলে রাত্রি বেলা কিভাবে তোর সাথে দেখা করতে আসলো?”
ফালাকের কলেজ জীবন কেটেছে এখানে।কলেজে থাকতেই পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশন করতো ফালাক।সেখান থেকেই আমাদের পরিচয়। কলেজের গন্ডি পেরোনোর পর পড়াশোনার সুত্রে ফালাক ঢাকা পারি জমায়।শুরু হয় আমাদের লং ডিস্টেন্স রিলেশনশীপ।যার কারণে অন্যদের বয়ফ্রেন্ডের মতো ফালাক বাসার নিচে এসে রাগ ভাঙাতে পারেনি। রাগ ভাঙানোর জন্য ফোন কলই ছিলো ওর এক মাত্র ভরসা।আর আমিও রাগ করলে অপেক্ষায় থাকতাম ওর ফোন কলের।এভাবেই চলছিলো আমাদের লং ডিস্টেন্স রিলেশনশীপ।আব্বুর সাথে আমার বেশি ভালো সম্পর্ক।অনেকটা বন্ধুত্বের মতো।আব্বু কখনোই প্রেমের বিরোধী ছিলেন না।আপুর বিয়েটাও রিলেশনের। আমি আব্বুকে জানাতে চেয়েছিলাম কিন্তু ফালাকই না করে।বলে ওর মাস্টার্স কমপ্লিট না হওয়া পর্যন্ত না জানাতে।তাছাড়া আমাদের ফ্যামিলিতেও মেয়েদের একটু দেরি করেই বিয়ে দেওয়া হয়।
পায়েলের প্রশ্নটাও মোটেও ফেলে দেওয়ার নয়।জিজ্ঞেস করতে হবে ফালাককে।আমি মুচকী হেসে বলি,,,
” আমি জিজ্ঞাসা করে তোকে বলবো নি।”
পায়েল বেরিয়ে যায়।আমি বিছানায় গা এলিয়ে ফালাককে ফোন দিই।তিনবার কেটে দিয়ে তারপর ফালাক ফোন ধরে।প্রথম দিকে খুব রাগ উঠতো।কিন্তু এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।চতুর্থবারে ফালাক ফোন রিসিভ করে,,,
” কিছু বলবে?”
” নাহ!এমনিই ফোন দিছি।”
খানিকটা মেজাজ দেখিয়েই বলি আমি।ফালাক ফোনে ওপাশ থেকে হাসে।ওর হাসির শব্দ শুনে আমি জিজ্ঞাসা সূচক কন্ঠে বলি,,
” হাসলা কেন?”
” নাহ! এমনিই।”
” আমায় না ভেঙালে তোমার ভাত হজম হয় না নাহ?”
” এই জন্যই তো তুমি আমার পুচু বউ।”
” বউ বউ করবা না।”
” বিয়ে হইছে।এখনও বলো বউ বউ করবা না?আচ্ছা তোমার সাথে আর বউ বউ করবো না।অন্য কারও সাথে করবো।”
” ঠ্যাং ভেঙে হাতে ধরিয়ে দেবো।”
হেসে দিই আমি।ফোনের ওপাশ থেকে ও হাসে।আমি হাসি খানিকটা মলিন করে বলি,,,
” দেখেছো আমরা কত লাকি?বিয়ের পরেও প্রেম করছি।আচ্ছাহ,যেটার জন্য ফোন করেছিলাম!”
” কী?”
” থাকো তুমি ঢাকা।তো রাত্রে কিভাবে আসলা?”
” বিকালের দিকে ঝগড়া হলো না?তারপরই মেসে যাই আমি।ওয়ারড্রফে তোমার দেওয়া গিফট গুলা দেখে অনেক রাগ হয়।ডিসিশন নেই তোমার কোনো স্মৃতিই রাখবো না।রওনা দিই সন্ধ্যায়।রাত্রে গিয়ে উঠি ছোট ভাইয়ের মেসে।তারপর সেখান থেকে তোমাদের বাসায় যাই।দেয়াল টপকে তোমাদের বাসায় ঢুকি। তোমায় নিচে ডাকি।তুমি আসো আর বাকীটা ইতিহাস..”
অনর্গল কথাগুলো বলে হেসে দেয় ফালাক।ওর হাসি দেখে হাসি আটকে রাখতে পারিনি।হেসে দিই আমিও।সত্যিই ওপরওয়ালা যা করেন ভালোর জন্যই করেন।
প্রশ্ন ছুঁড়ে মারে আব্বু ফালাককে।ফালাক মাথা তুলে শীতল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়।মুচকী হেসে বলে,,,
” ওপরওয়ালা জোড়া বেঁধে রাখলে আজ হোক বা কাল হোক,দোয়েলের সাথেই বিয়ে হতো আমার।আর ওপরওয়ালাই উত্তম পরিকল্পনাকারী।উনি যা ভালো বুঝেন তাই করেন।”
ফালাকের কথা শুনে আমি ওর দিকে তাকিয়ে বিজয়ের হাসি দিই।ভাবনাচ্ছেদ ঘটে মানিক আংকেলের কথায়।লোকটা বড্ড খোঁচা মেরে কথা বলে।
” মেয়ে ন*ষ্টামি করতে গিয়ে ধরা পরেছে!কোথায় মেয়েকে শাসন করবে তা না।নাটক শুরু করেছে এরা! গণি ভাই,চলেন।এখানে থেকে সময় নষ্ট করার মানে হয় না।তাদের মেয়েকে তারাই বুঝে নিক।”
যা না যা। কে তোদের বেঁধে রেখেছে।অ*সভ্য লোক।নিজের ছেলের বাদ্রামি চোখে পরে না আসছে অন্যের মেয়ের দোষ ধরতে।আব্বু বরাবরই শান্ত স্বভাবের লোক।মানিক আংকেলের কথায় কোনো কর্ণপাত করেন না আব্বু।বেশ শান্ত গলায়ই আব্বু ইমাম সাহেবকে বলেন,,,
” ছেলে মেয়ের কোনো আপত্তি নেই।আপনি যে কাজটা করতে এসেছেন সেই কাজটা করতে পারেন।”
ফজরের আজানের আগ দিয়ে আমাদের বিয়ে পড়ানো হয়।তিনবার কবুল বলে আমরা একেঅপরকে গ্রহণ করি।ইমাম সাহেব আমাদের বিয়ে পড়িয়ে মসজিদের দিকে রওনা দেন।আর বাকীরা যে যার বাসার দিকে।আব্বু ওযু করতে যায়।আর আম্মু আমার পাশে ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন।পায়েল কিছুক্ষণ পর পর আমার আর ফালাকের দিকে তাকিয়ে মুচকী মুচকী হাসছে।আব্বু ওযু করে মসজিদে চলে যান।আম্মু আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে সেও আল্লাহর ডাকে সাড়া দিতে যান।পায়েল তখনও আমাদের সাথে বসে আছে।চোখ মেরে বলে,,,
” আপ্পি জিতে গেলি তো!”
” খুব বেশি পাকনামো বেড়েছে না তোমার?মারবো এক চড়।”
” দে না দে!আমিও আব্বুকে বলে দিবো তুই প্রেম করিস।”
পায়েলের কথা শুনে আমি আর ফালাক ফিক করে হেসে উঠি।পায়েল যখন আমার আর ফালাকের রিলেশনের কথা জানতে পারে তখন প্রায়ই আমায় এরকম ব্ল্যাকমেইল করে আমার থেকে টাকা আর এটা ওটা নিতো।আমার কাছে পায়েল বদের হাড্ডি হলেও ফালাকের কাছে সে ছিলো নিতান্তই শিশু।এক প্রকার গোয়েন্দা বলা যেতে পারে।ট্যাবে মেসেঞ্জার একাউন্ট খুলেছিলো ও।প্রায়ই ফালাককে আমার গতিবিধি সম্পর্কে খবরাখবর দিতো।এই কারণে সে ফালাকের চোখের মণি ছিলো।যদিও আমি আব্বুকে অতটা ভয় পাই না।কিন্তু আব্বু কষ্ট পাবে ভেবে বিষয়টা গোপন রাখতে চেয়েছিলাম সাময়িক সময়ের জন্য।
ফালাক আর আমার রিলেশন হয় চার বছর আগে।আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। ক্লাস নাইনে উঠলে নাকি সবার ডানা গজায়।আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।থ্রীতে পড়া ছোট বোনের প্রাইভেট টিচারকে দেখে আমার মন উড়ু উড়ু করতে লাগে।প্রায়ই এটা ওটার বাহানা দিয়ে দেখতে যেতাম ফালাক ভাইয়াকে।ভাইয়া!তাকে আমি ফালাক ভাইয়া বলেই ডাকতাম।ইভেন এখনো ডাকি।শুধু রাগ উঠলে নাম ধরে ডাকি।প্রপোজটা অবশ্য আমিই করি আগে!বেতনের খামের ভেতর একটা কাগজে I love you লিখে দিয়েছিলাম। বেতনের খামটা খুলে তিনি টাকার সাথে কাগজটা দেখতে পান।কাগজটা খুলে পড়তেই তিনি চিৎকার দিয়ে
বলে ওঠেন,,,
” আস্তাগফিরুল্লাহ, নাউজুবিল্লাহ।আপু এইগ্লা কি?”
আমি ভ্রু কুঁচকে বলি,,,
” কি হয়েছে ভাইয়া?”
” আন্টি কই?আন্টিরে ডাকেন।”
” আম্মু তো আপুনির সাথে শপিংয়ে গেছে।যাওয়ার আগে আপনার স্যালারির খামটা আপু আমার হাতে দিয়ে বললো আম্মু এটা আপনাকে দিতে বলেছে।”
ফালাক ভাইয়া গলা ঝেড়ে কেশে বলেন,,,,
” আপু একটু পানি হবে?”
” Why not?sure vaia.”
আমি রান্নাঘরে গিয়ে ট্রে বের করে সেখানে শরবত বানিয়ে আর ফ্রিজ থেকে পুডিং বের করে উনার জন্য নিয়ে যাই।ভেবেছিলাম বুঝতে পারবেন উনি।তাই মিষ্টিমুখ করানোর জন্য পুডিং বানিয়েছিলাম।শুধু তার জন্য।কিন্তু তা আর হলো কই?তাই বলে কি যার জন্য স্পেশালি পুডিংটা বানিয়েছি তাকে খাওয়াবো না?আমি ট্রেতে খাবার নিয়ে তার সামনে দিয়ে বলি,,,
উনি আমার দিকে কিছুক্ষণ সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন।আমি চাপা হাসি দিয়ে বলি,,,
” কি হলো ভাইয়া খান?খেয়ে বলেন কেমন হয়েছে!”
উনি কিছুডা পুডিং খেয়ে বলেন,,,
” জ্বী আপু অসাধারণ হয়েছে।”
আমি বোকা হাসি হেসে লাফাতে লাফাতে নিজের ঘরে চলে যাই।ঘরে গিয়ে লজ্জা মুখ খানা হাত দিয়ে আড়াল করে ঠাস করে বিছানায় শুয়ে পড়ি।গুণগুণ করে পরিনীতা মুভির “তোমাকে” গানটা গাইতে লাগি আর ঘরে একা একাই নাচতে লাগি।আয়হায়,ফালাক ভাইয়া আমার রান্নাকে অসাধারণ বলেছে!এমন সময় পায়েল আমার ঘরে আসে।
” আপ্পি?”
পায়েলের হঠাৎ ডাকে আমি ভড়কে যাই।তোতলাতে তোতলাতে বলি,,,
” কি..কি..কি হয়েছে?”
” তুই স্যাররে কিছু বলেছিস নাকি?আজ বেশিই তাড়াতাড়ি চলে গেলো।”
” আ..আ..আমি তোর স্যাররে কি বলবো।”
” না এমনি মনে হলো।তুই আসার পর স্যারের ব্যবহার অন্যরকম লাগলো তো!তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
” আর বলিস না।ছাত্রীর মেঝোবোন বেতনের খামে টাকা সাথে কাগজে আই লাভ ইউ লিখে দিয়েছে।আবার পুডিং,শরবত খাওয়ালো।”
” ভালো কথা তো!পুডিং শরবত খাওয়ালো ভালো কথা।”
ফালাক টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলে,,,
” কিভাবে ভালো কথা?”
” মেসে তো খালার হাতের সেই একই ভাত তরকারি খাওয়া লাগে।সে হিসাবে ছাত্রীর বাসায় গিয়ে যদি ভালো মন্দ খেতে পাস তো ভালো কথা হবে না?আমার কপাল দেখ!ছাত্রীর মা আমায় লবণ দিয়ে শশা মেখে সাথে চা খেতে দেয়।”
কথাটা বলে অর্ক ভেংচি কেটে চলে গেলো।ফালাক দোয়েলের আইডিতে ঢুকে পোস্ট গুলো দেখতে লাগলো।যদিও আইডি নতুন হওয়ায় বেশি পোস্ট নেই।তারপরেও রাতের নিদ্রাহীন অলস সময়ে এই পোস্টগুলোই ভালো লাগতে শুরু করলো ফালাকের।
” আমি মেয়ে না।আমি পরী।এড দিতে পারেন।আর কথায়।কথায় আপু বলবেন না।আমি আপনার থেকে ছোট।দোয়েল বলে ডাকবেন আমায়।এখন ফোনটা দিন।”
ফালাক অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে দেয়।দোয়েল পাসওয়ার্ড সেভ করে দিয়ে আইডিতে ঢুকে নিজের আইডিকে ফালাকের লিস্টে এড করে নেয়।ফোনটা ফালাকের হাতে দিয়ে বলে,,,
” ব্লক দেওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাববেন না।”
_______
“আপ্পি উঠ।এই আপ্পি।”
পায়েলের ডাকে ঘুম ঘুম চোখে চোখ মেলি।মোচড় দিয়ে লম্বা একটা হাই তুলে পায়েলকে বলি,,
” কি হয়েছে?”
” তুই ফালাক ভাইয়াকে বের করে দিয়েছিস তাই আব্বু রাগারাগি করছে।”
পায়েলের কথা শুনে মুহুর্তেই আমি আকাশ থেকে পড়ি।ভোর রাতের দিকে ফালাকের সাথে সেই আমার রাগারাগি ঝগড়া হয়। রাগের মাথায় বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে বলি।তারপর ও আর দেরি করে না।বেরিয়ে যায়।ও বেরিয়ে যাওয়ার পর ঘরে এসে সেই রাগে কান্নাকাটি করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়ালই নেই।
বালিশের পাশ থেকে ফোন বের করে দেখি মোবাইলের স্ক্রিনে সাড়ে তিনটা বাজে।দুপুর সাড়ে তিনটা। এতক্ষণ ঘুমালাম?তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে ফ্রেশ হতে যাই।ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িংরুমে যেতেই আম্মুর বকা শুনতে হয়,,,
আম্মুর কথার কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে আমি আমি বাটিতে দুধ আর কনফ্লেক্স নিয়ে খেতে লাগি।শুরু হয় আম্মুর আরেক দফা ভাষণ,,,
” তুই দুধ কনফ্লেক্স খাবি আগে বলতি।আমি কি ভাত রান্না করতাম তোর জন্য।শুধু শুধু ভাত গুলো নষ্ট হলো।”
আম্মুর এই ভাতের কথা শুনতে শুনতে আমি বিরক্ত হয়ে গেছি।মাঝে মাঝে তো আমার এইও মনে হয় আমি ম*রলে তখনও আমার আম্মু বলবে মা*রা যাবি আগে বলতি,শুধু শুধু ভাতগুলো নষ্ট হলো।
এরই মধ্যে আব্বু ঘর থেকে বের হয়।চোখে মুখে রাগ ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট।আমার দিকে কিছুক্ষণ আড়চোখে তাকিয়ে আব্বু সোফায় গিয়ে বসে।আমি আস্তে ধীরে খেতে লাগি।কারণ আমি জানি আব্বু আমায় খাওয়ার সময় কোনো বকাঝকা করবে না।উলটা রাগ করে যদি খাওয়া দাওয়া বাদ দিই! ধীরে ধীরে খেতে খেতে দুই বাটি দুধ কনফ্লেক্স শেষ করি আমি।আরেক বাটি খেতে যাবো কিন্তু পেটে কুলাচ্ছে না।চুপচাপ মাথা নিচু করে ঘরে আসতে যাবো ঠিক তখনই আব্বু পেছন থেকে ডাক দেয়,,,
” দোয়েল!”
” জ্বী আব্বু।”
” বসো তোমার সাথে কথা আছে।”
আমি শুকনো ঢোক গিলে বসি।আব্বু বলা শুরু করে,,,
” মসজিদ থেকে এসে ফালাককে না দেখে ভেবেছিলাম নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পরেছে।সকালে ডাকাডাকির পরও ফালাককে পাই না।তখন পায়েল বলে তুমি নাকি ওকে বের করে দিয়েছো।”
” জ্বী আব্বু।পায়েল ভুল কিছু বলেনি।”
” দেখো দোয়েল তুমি এখনো বাচ্চা নও।”
” জানি।”
” জানোই যখন এখন এত নাটক করার কি দরকার?ফালাককে ফোন দাও।আর ফোন দিয়ে ওকে বাসায় আসতে বলো।কথা আছে।কথাগুলো তোমায় খাওয়ার সময় বললাম না।কিছু বললেই তো রাগ করে খাওয়া বাদ দাও।”
আমি চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে ছিলাম।এমন সময় পাশ থেকে আম্মু বলে,,,
” কোয়েলের আব্বু,তুমি এখনই দোয়েলকে ফোন দিতে বলো।না হলে ও জীবনে ফালাককে ফোন দেবে না।বাপের মতোই হয়েছে।রাগ পুষে রাখে।”
আম্মুর কথা শুনে আমি পায়েল মুখ টিপে হেসে দিই।আব্বু আম্মুর দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকায়।তারপর আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলেন,,
” এখনই ফালাককে ফোন দাও।”
আমি চাপা হাসি নিয়ে ফালাককে ফোন দিই।কিন্তু ও ফোন রিসিভ করে না।আমি আব্বুর দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকাই।আব্বু বলে,,,
” দিতে থাকো।একবার না একবার ধরবেই।”
কল দেওয়াটা বড্ড আমার ইগোতে লাগছে।আমি সচারাচর কাওকে নিজে থেকে ফোন দিই না।সে আমার যতই দরকার থাকুক।নিজে থেকে ফোন দিলে আমার সেল্ফ রেস্পেক্টে লাগে যা অন্যদের কাছে ইগো নামে পরিচিত। পঞ্চমবার কল দেওয়ার পর ও কল রিসিভ করে।কন্ঠে তীব্র অভিমান নিয়ে ও সালামের জবাব দেয়।
” ফোন দিয়েছিস কেন?”
” ইচ্ছা হলো তাই।”
আমার কথা শুনে পাশ থেকে আম্মু বলে,,,
” এই মেয়ের ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বলার স্বভাব গেলো না।”
ফালাক বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে।তারপর শান্ত গলায় বলে,,,,
” ভালো।”
কথাটা বলেই সে ফোন রাখতে যাচ্ছিলো।ফোনের এ পাশ থেকে আমি বলি,,,
” আরে আরে আরেহ,ফোন রাখছিস কেন?”
” ইচ্ছা হলো তাই।”
” আমার ডায়লগ আমায়ই শোনাস?”
” এই মেয়ে আবার ঝামেলা পাকাবে। ”
কথাটা বলেই আম্মু আমার হাত থেকে ফোন কেড়ে নেয়।
” হ্যালো ফালাক!আমি দোয়েলের আম্মু বলছি।ওর কথায় কিছু মনে করো না।”
” আসসালামু আলাইকুম আন্টি।আর আমি ওর কথায় কখনো কিছু মনে করিনি।পাগলে কি না বলে ছাগলে কি না খায়।”
আম্মু হেসে দেয়,তারপর হাসতে হাসতে বলে,,
” ওয়ালাইকুম আস সালাম।দোয়েলের আব্বুর সাথে কথা বলো।সে কিছু বলতে চায় তোমাকে।”
কথাটা বলে আম্মু আব্বুর হাতে ফোন দেয়।আব্বু সালামের উত্তর দিয়ে মুল আলোচনায় আসে।
” দেখো ফালাক,কাল রাতে তো একটা বিরাট বড় এক্সিডেন্ট হয়ে গেলো!তোমায় চিনি জানি বলেই দোয়েলকে তোমার হাতে তুলে দিয়েছি।”
” জ্বী আংকেল বুঝতে পেরেছি।”
” এছাড়াও,তোমার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে।যদি কষ্ট করে আজ আসতে!আর দুপুরে আমাদের সাথে খেতে!”
” আংকেল আমি চেষ্টা করবো আপনার অনুরোধ রাখার।এখন রাখছি।টিউশনে আছি তো!আল্লাহ হাফেজ। ”
” আল্লাহ হাফেজ। ”
বাবা ফোন কেটে আমার হাতে দেয়।আমি আর কোনো কথা না বলেই সোজা আমার ঘরে চলে যাই।হঠাৎ টেবিলের পাশে থাকা ব্যাগটা চোখে পরে আমার।ফালাক কালকে এই ব্যাগ দিতেই রাত দুপুরে এসেছিলো আর…..।লাজুক হাসি আমি।কৌতুহল জাগে ব্যাগটার প্রতি।গিয়েই খুলেই ফেলি।ব্যাগটার ভেতরে থাকা জিনিসগুলোর প্রতি আমার এক আকাশ পরিমাণ আবেগ রয়েছে।হাত খরচের টাকা বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে ফালাকের জন্য গিফটগুলো কিনতাম।অজান্তেই হেসে ফেলি।কি পাগলামি গুলোই না করতাম।হাতে বানানো রঙিন কাগজের একটা কার্ড দেখতে পাই।আমিই বানিয়েছিলাম।কার্ডটা খুলে লেখাগুলো পড়তে লাগি।লেখা গুলো পড়ে মনে হচ্ছে লজ্জায় মাটি দু ভাগ করে তার ভেতর ঢুকে যাই।লজ্জায় দু হাত দিয়ে মুখ আড়াল করি আমি।
দিনে বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকাপ করেছিলাম।অথচ কপাল দেখো!রাতেই হারাম*জাদাটাকে আমার বিয়ে করতে হচ্ছে।ব্রেকাপের থেকেও দ্বিগুণ কষ্ট হচ্ছে আমার।কে বলেছিলো?কে বলেছিলো ছাগলটাকে গিফট ফেরত দিতে।দিবি তো দিবিই!মাঝরাতে কেন গিফট ফেরত দিবি?মন চাচ্ছে এখনই ছাগলটাকে মে*রে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দিই।
এলাকার মুরব্বিদের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি আমি।পাশে আমার সদ্য এক্স বয়ফ্রেন্ড ফালাক।চেহারা দেখে মনে হবে ভাজা মাছ উলটে খেতে পারে না।অথচ ফালাকই সব নষ্টের গোড়া।
” ছি ছি ছি! ইকবাল সাহেবের মেয়ে এমন করবে আমরা কল্পনাও করি নাই কখনো!শেষমেশ রাত দুপুরে ছেলে মানুষ নিয়ে ন’ষ্টামি?কি যুগ আসলো।”
গণি চাচার কথা শুনে ইচ্ছা করছে কুয়ার মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে ম*রে যাই।বেটা তুই আগে পুরো ঘটনাটা জেনে নে ভালো করে!তা না,চোখের সামনে যা দেখেছে তাই নিয়েই লাফাচ্ছে।চোখ যে সব সময় সঠিক জিনিস দেখে এর কোনো নিশ্চয়তা আছে?
” তাহলে সিদ্ধান্ত কি নিলেন ভাইজান?”
মিথিলার বাবা গণি চাচাকে বলেন।এলাকার গুন্যমান্য ব্যক্তি গণি চাচা।কোনো গন্ডগোল হলেই সে তা মিটিয়ে দেন।বয়স বেশি হওয়ায় জ্ঞান অভিজ্ঞতা বেশি।তাই সবাই উনাকে শ্রদ্ধা করে চলেন।কিন্তু এই মুহুর্তে লোকটাকে আমার পৃথিবীর সবচে বুদ্ধিহীন প্রাণী মনে হচ্ছে।আমাকে বা ফালাককে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ধমক দিয়ে আর এক গাদা কথা শুনিয়ে চুপ করে রাখলেন।গণি চাচা চশমাটা হাতে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,,,
” দেখো!দিন কাল ভালো না বেশি।তরুণ প্রজন্মটা ন *ষ্টামিতে ভরে গেছে।দোয়েলও হয়তো আবেগের বশে তাই ই করতে যাচ্ছিলো।আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন।ভাগ্যিস আমরা দেখে ফেলেছি।বড় ধরণের ক্ষতি হওয়ার আগেই আমার মনে হয় ওদের দুজনের বিয়ে দিয়ে দেওয়া উচিত।আপনার মতামত কি ইকবাল সাহেব?”
“আপনারা যা ভালো বুঝেন তাই ই করেন।”
ক্ষীণ কন্ঠে বলে বাবা।বুঝতে বাকী রইলো না বাবা আমার দ্বারা মনক্ষুণ্ম হয়েছেন।
” আপনারা যা ভালো বুঝেন মানে?পুরো ঘটনাটা আপনারা কেউ জানেন?একপলক দেখে মনগড়া কাহিনি করে বিয়ে দিয়ে আমার জীবনটা নষ্টের জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন!”
” দোয়েল..!”
হুংকার দিয়ে ওঠে বাবা।আমি বেশ চমকে যাই।আকষ্মিকতায় ভয় পেয়ে বাইরের মানুষ জনের সামনেই কেঁদে দিই।বাবা আমার সাথে কখনো উঁচু গলায় কথা বলেনি।অথচ আজ এই ছা*গল ফালাকের পাকনামির জন্য বাবা আমায় বাইরের মানুষের সামনে ধমক দিলেন।
গণি চাচার কথা শুনে রায়হান ভাইয়া বেরিয়ে যায়।রায়হান ভাইয়া আমাদের প্রতিবেশি মিথিলার বড় ভাই।অর্থাৎ মানিক আংকেলের বড় ছেলে।টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে বর্তমানে বেকার জীবন পার করছেন।অবসর কাটাতে মেয়েদের পেছনে ঘোরেন।মানুষের কাছে শুনেছি চৈতি আপুর সাথে উনার সম্পর্ক আছে।যদিও আমি নিশ্চিত নই তাতে।তার যদি রিলেশন থেকে থাকে তাহলে কেন সে আবার মেয়েদের পেছনে ঘুরবে? বিভিন্ন আকার ইঙ্গিতেও বুঝিয়ে দিয়েছেন আমাকেও তার ভালো লাগে।যদিও আমি বুঝেও না বুঝার ভান করেছি।এলাকার ছেলে ছোকরারাই মুলত তার আসল ক্যারেক্টর সম্পর্কে অবগত আছে।কিন্তু মুরব্বিদের কাছে তিনি নেহাৎই ধোয়া তুলসি পাতা।
এবার এই ঘটনার সূত্রপাতে আসা যাক।বেশ কয়েকদিন ধরেই ফালাকের সাথে আমার ঝামেলা হচ্ছিলো।ঝামেলাটা মুলত ছিলো ফালাকের আমাকে দেওয়া অবহেলা নিয়ে।অনেকের কাছেই এটা স্বাভাবিক বিষয় হতে পারে।তবে আমার কাছে এটি শুধুই অবহেলা।কোনো দামি গিফট চাইনি আমি ফালাকের কাছ থেকে।চেয়েছি শুধু একটু সময়।যা ও আমায় দিতে পারেনি।মন খারাপের সময় পাইনি ওকে আমি।যার কারণে ওর প্রতি আমার মনে তীব্র রাগ, ঘৃণা সৃষ্টি হয়। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত টানা এগুলো নিয়েই আমাদের ঝগড়া হয়।পরে বিকালের দিকে অবশেষে আমরা সম্পর্কের ইতি টানি। প্রথম প্রেম।অনেকটাই ইমোশন ছিলো সম্পর্কে।সাথে ওর প্রতিও ছিলো আমার তীব্র মায়া।যার কারণে ব্রেকাপের পর আমি অনেক আপসেট হয়ে পরি।কোনো কাজেই মন বসাতে পারছিলাম না।পড়াশোনায় তো না ই।এদিকে সামনে আমার এইচএসসি পরীক্ষা।রাত জেগে পড়া আমার বেশ পুরোনো দিনের অভ্যাস।কিন্তু সেদিন রাতে না আমি পেরেছি পড়তে আর না পেরেছি আমি ঘুমাতে।বইয়ের পাতা ভিজিয়েছি নোনা জলে।ঝগড়াঝাঁটি আমাদের রিলেশনে একটা কমন বিষয় ছিলো।পাঁচ বছরের সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও আমাদের আচরণ ছিলো সেইম এইজ কাপলদের মতো।ভালো কথা বলতে বলতেও ছোটখাটো ঝগড়া লেগে যেত।আর প্রতিবারই ঝগড়ার পর আমি কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলতাম।ঝগড়ার পর অভিমানের স্থায়িত্ব হতো সর্বোচ্চ দু-তিন ঘন্টা।তারপর সে ফোন দিয়ে সরি টরি বলে আমার অভিমান ভাঙাতো।এইবারও আশা রেখেছিলাম যে অক্ষর আমার অভিমান ভাঙিয়ে ঠিকই রিলেশনটা কন্টিনিউ করবে।কিন্তু বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে যাবার পরও যখন সে আমায় আর ফোন দেয় না। তখন বুঝতে পেরেছিলাম আমাদের একসঙ্গে পথ চলা এই পর্যন্তই ছিলো।রাত দেড়টার দিকে ফালাক আমায় ফোন দেয়।আমি কল রিসিভ করি।ভেবেছিলাম সরি বলে অভিমান ভাঙাবে।কিন্তু আমার ধারণা ভুল।ফালাক ফোন দিয়ে আমায় নিচে নামতে বলে।আমি এর কারণ জিজ্ঞাসা করি।জবাবে ও বলে,,,,,
” এত কারণ জিজ্ঞাসা করা লাগবে কেন তোর?নিচে আসতে বলছি নিচে আসবি।”
অগত্যা,ওর কথামতো নিচে যাই।ভেবেছিলাম সরি সারপ্রাইজ দেবে হয়তো।অনেকটা খুশী মনেই নিচে যাই।গিয়ে দেখি একটা বড় শপিং ব্যাগ নিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে।আমি ভাবলাম কোনো কিছু এনেছে হয়তো আমার রাগ ভাঙাতে।কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এইবারও আমি ভুল হই।ব্যাগটা আমার হাতে দেয় ফালাক।আমি ব্যাগের ভেতর পাঞ্জাবী,টি-শার্ট,ঘড়ি,পার্ফিউম দেখতে পাই।
” এগুলা কী?”
” দেখতে পারছিস না?আলো লাগবে?”
” দেখতে পারছি বলেই তো জিজ্ঞেস করছি!পাঞ্জাবি,টি-শার্ট,জেন্স ঘড়ি,জেন্স পার্ফিউম দিয়ে আমি কি করবো?”
” যা মনে চায় তাই কর গিয়ে।রিলেশন চলাকালীন এগুলো আমায় দিয়েছিলি তুই।তোর কোনো স্মৃতি রাখতে চাই না।তাই এগুলো দিয়ে গেলাম।”
” ভাই তুই কি কখনো শুনেছিস ভিক্ষা ফিরিয়ে নিতে?অনেকে হয়তো নেয়।বাট আমি ডিফ্রেন্ট।আমার লেভেল অনেক ওপরে।ভিক্ষা ফিরিয়ে নেওয়ার মেয়ে না আমি।”
” কি বললি আমি ভিক্ষুক?”
” কবে কখন বললাম।আমি কি তোকে মিন করে কোনো কিছু বলেছি?”
” এখানে তো তুই আমি ছাড়া কেউ নেই।তার মানে আমায়ই তুই কথা গুলো বলেছিস।”
” যতটা বল*দ ভেবেছিলাম অতটাও বল*দ না তুই।”
” দেখ আমি তোর থেকে পাঁচ বছরের বড়।সম্মান দে আমায়।”
” সম্মান বয়স দেখে না!আচরণ দেখে আসে আমার।”
” দোয়েল..!”
” গলা নিচে!এখন আমি তোর কেউ না। So আমার সাথে জোর গলায় কথা বলার কোনো রাইট নাই তোর।আগে গার্লফ্রেন্ড ছিলাম তখন ধমকাতি তাই কিছু বলতাম না।”
” তোর সাথে ফালতু কথা বলার কোনো ইচ্ছা নাই আমার।ব্যাগটা নে।”
” নিলাম না।কি করবি তুই?”
লেগে যায় আবার ঝগড়া!আমাদের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আশেপাশের মানুষজন উঠে যায়।আর তারপরে যা হয় তা সবারই জানা।
রায়হান ভাইয়া মসজিদের ইমাম সাহেবকে নিয়ে আসেন।আম্মু কাঁদছে।পায়েল চুপচাপ। মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকী হাসছে।ও আমাদের সম্পর্কের কথা জানতো।ব্রেকাপের কথা বলা হয় নি।বিয়ের কথা চলছে।সম্পর্কের পুর্ণতা পাবে এই ভেবেই ও হয়তো মুচকী হাসছে।
” কোয়েলের আব্বু,তুমি দোয়েলকে একটা সুযোগ দেও।ও এমন কাজ করার মেয়ে না।চিনি তো আমি মেয়েটাকে।”
আম্মু এমনিতে আমায় অত বেশি আদর করেন না।বড় মেয়ে ছোট মেয়েই তার চোখের মণি।ম্যাক্সিমাম সময়ই আম্মু আমায় ধমকের ওপরে রাখেন।আমি কিছু করতে গেলেই মা আমায় বাঁধা দিতেন।এই নিয়ে মায়ের প্রতি আমার শত অভিযোগ ছিলো।কিন্তু আজ আম্মুর মুখে এমন কথা শুনে আমার মায়ের প্রতি সমস্ত অভিযোগ মুহুর্তেই উধাও হয়ে গেলো।সত্যিই মা সন্তানের মন বোঝে।মিথিলার বাবা আমার কাছেই ছিলো।আম্মুর কথা শুনে মিথিলা বাবা বিড়বিড় করে বলে,,,
লোকটার কথা শুনে আমার মনে হলো লোকটাকে জ্যান্ত মাটিতে পুঁতে দিই।নিজের ছেলে যে সারা শহরের মেয়েদের পেছনে ঘুরে বেড়ায় তার খবর রাখে সে?আসতে আমার আম্মু আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলতে!লোকটার আর কি দোষ দেবো!সমাজটাই তো এমন।সন্তানেরা বিপথে গেলে বা কোনো ভুল করলে সব দোষ মায়ের।আর সন্তান কোনো ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করলে তার ক্রেডিট পায় বাবা।
” তুমি কি ছেলেটাকে ভালোবাসো দোয়েল?”
বাবা আকষ্মিক প্রশ্নে আমি চমকে যাই।কোনো কথা বের হচ্ছে না আমার মুখ থেকে।কেমন যেন গলায় এসে আটকে যাচ্ছে কথা গুলো।
” দোয়েল, আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি।”
” জ…জ…জ্বী আব্বু।”
মাথানিচু করে কাঁপা কন্ঠে উত্তর দিই আমি।আমার উত্তর শুনে ফালাক আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকায়।আব্বু আবার আমায় জিজ্ঞেস করেন।
” তুমি কি ছেলেটার সাথে কোনো সম্পর্কে আছো?”
” ছিলাম।আজ আমাদের বিচ্ছেদ হয়েছে।”
” বিচ্ছদেই যখন হয়েছে।তখন তুমি এত রাতে ছেলেটার সাথে কি করছিলে?”
” দরকার ছিলো আব্বু।কিছু বলার ছিলো ওকে।যা ফোনে বলা সম্ভব না।তাই আর কি ডেকেছিলাম।”
বাবা কিছুক্ষণের জন্য নিরব হয়ে যায়।তারপর ফালাককে একই প্রশ্ন গুলো জিজ্ঞেস করেন,,,
” তুমি কি দোয়েলকে ভালোবাসো?”
” জ্বী আংকেল।”
” বিচ্ছেদের কারণ ?”
” সেটা আপনার মেয়ে বলতে পারবে ভালো।সে যেতে চেয়েছে আমি আটকাই নি।”
ফালাকের কথা শুনে আমার খুব রাগ হয়।আসলেই কী ওর বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি?যাক ভালোই হয়েছে।কারও বিরক্তির কারণ হয়ে থাকার ইচ্ছা আমার কখনো ছিলো না আর হবেও না।
” দোয়েল ওর সাথে যদি তোর বিয়ে না দিই।যোগাযোগ করতে না দেই তাহলে কি তোর কোনো সমস্যা হবে?”
” মানুষ বলে না?ভালোবাসার মানুষ,প্রিয় মানুষকে না পেলে মারা যাবে!কিন্তু আমি তা বলবো না।আমি হয়তো তাকে না পেলে মারা যাবো না।কিন্তু তাকে না পাওয়ার এক আফসোস আমার মধ্যে থেকে যাবে।যা সারাজীবন আমায় বয়ে যেতে হবে।তারপরও আব্বু।তুমি যা ভালো বুঝো তাই করো।নিশ্চয়ই তুমি আমার খারাপ চাইবে না।আর এটাও চাবে না যে আমি আফসোস,হারানোর কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকি।”
#MEANINGLESS_LIFE_PARTNER (অর্থহীন জীবন সঙ্গী)
পর্ব:শেষ
#লেখিকা_Arshi_khan
(FULL FILLED OUR LIFE:আমাদের জীবন পরিপূর্ণ)
চলেই যাবে যখন,পিছু আর ডাকবোনা
স্মৃতিগুলোই থাকুক বরং আমার ভালোবাসার সান্তনা।আমরা অপেক্ষায় থাকব প্রিয়।(রুতবা আয়ান এর হাত ধরেই)
রুত পাখি প্লিজ এমন ভাবো বলোনা। আমার যে তোমার ও ছোট্ট বাবুই কে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভেবেই দম বন্ধ হয়ে আসছে।আমি সত্যি বুঝতে পারিনাই যে এসেই তোমার প্রতি আমার মনে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটবে।আর বিয়ের জন্য উতলা হয়ে উঠব।তাহলে আমি ভিসা নেওয়ার জন্য চেষ্টা করতাম না।এখন ভিসা যখন নিয়ে এসেছি তাই ফেরা বাধ্যতামূলক ।তাই আমি যাচ্ছি। তবে আমি কথা দিচ্ছি আমার বাবুই ভুমিতে পদার্পণ করার পূর্বেই আমি আবার ফিরে আসব।প্লিজ রুত যাওয়ার পারমিশন দাও আর কান্না থামাও নাহলে নিজেকে ঠিক রাখতে পারব না।(আয়ান রুতবার মাথায় হাত রেখেই)
আচ্ছা ভাল ভাবে যাও। গিয়ে কল কর নিজের খেয়াল রেখ। খুব বেশিই মিস করব। (রুতবা কান্না থামিয়ে)
এরপর আমি বাড়ির সবার থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকা এয়ারপোর্ট এর উদ্দেশ্য রওনা হলাম। পরিবারের সবাই কে ছেড়ে দূরে যাওয়ার মতো কষ্ট এ দুনিয়া তে আর নেই।আর প্রবাসীদের থেকে এ দুঃখ আর কে বাই বুঝবে।নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে রেখেছিলাম আমার রুত পাখির থেকে।কত্তটা কষ্ট পেয়েছে আমার রুত।ওর এই সময় সব চেয়ে বেশি দরকার আমাকেই।অথচ ওকে একা ফেলে আমি দূর দেশে চলে যাচ্ছি। প্লেনে চড়ে বসার কিছুক্ষণ পরেই প্লেন টেকঅফ করল।ছয় ঘন্টার মধ্যেই আমি আমার গন্তব্য স্থান এর পৌঁছে গেলাম। যাওয়ার পর কোন রকম ফ্রেস হয়ে বাড়িতে কল করলাম। আব্বু আম্মুর সাথে কথা বলার পর আমার রুত পাখিকে কল করলাম। সে কল ধরে অনেকক্ষন ফুফিয়ে কান্না করল।বুকটা চিড়ে আমার ও যে কান্না আসছে।কিন্ত পুরুষ দের যে কান্না করা নিষেধ।আমিও কিছুক্ষণ এ নিজেকে সামলে আমার রুত এর উদ্দেশ্য বলে উঠলাম।
অপেক্ষা হল শুদ্ধ ভালোবাসার একটি চিহ্ন।
সবাই ভালোবাসি বলতে পারে ।
কিন্ত সবাই অপেক্ষা করে,
সেই ভালোবাসার প্রমাণ করতে পারে না।
(হুমায়ূন
আহমেদ)
রুত পাখি মিস ইউ।(আয়ান)
হুম। (কান্না করে রুতবা)
আমার ছোট্ট পাখির কি খবর?(আয়ান খুশি মনে)
জানি না।(রাগি সুরে রুতবা)
কি জানে আমার পাখিটা?(আয়ান মজা করে)
আয়ান কে ভালোবাসতে আর তাকে খুব করে মিস করতে জানে।(রুতবা)
প্লিজ কয়েকটা মাস অপেক্ষা কর আমি ফিরে আসব। (আয়ান রুতবার উদ্দেশ্য)
অপেক্ষা জিনিস টা বড় এই বেদনার আয়ান। সাতটা বছর অপেক্ষার পর তোমার ভালোবাসার সাগরে ভাসতে চেয়েছিলাম। কিন্ত তুমি টাকার সাগরে ভাসার জন্য আমাদের ছেড়ে গেলে।আবার ও নিজের কথাই রাখলে।তোমার কাছে যেহেতু টাকাই সব।ঠিক আছে তুমি আরো টাকা কামাও আর আমাকে নানান ইমোশনাল কবিতা শুনিয়ে ভুলিয়ে রাখ।(রুতবা চোখ মুছে)
রুত প্লিজ এমন ভাবে বলো না।আমি আমাদের ভবিষ্যত এর কথা ভেবেই এখানে এসেছি।(আয়ান করুন কন্ঠে)
আমার যে তোমাকে এখন খুব বেশিই প্রয়োজন। তুমি এখানে থেকে কাজ করলেও ও আমরা খেয়ে পরে বেঁচে থাকতাম।কিন্ত না তোমার এখন আমাদের কে হাই লাইফ স্টাইল এ লিড করানোর ইচ্ছার কারণে আমাদের সবচেয়ে প্রয়োজন এর সময় এই তুমি পাশে থাকতে পারবেনা।কেন আয়ান আমাকে একবার জিজ্ঞেস করে টিকিট কাটা যেতনা।(রুতবা রাগি সুরে)
ওহে রুত পাখি রাগটা একটু শান্ত কর।এখানে এসে না খেয়েই তোমাকে কল করা।আমার কথা তো একটা বার ভাবতে। আমি তো আর নিজের শখ পূরণ করতে এখানে আসিনাই।অনেক তো বলছ দেশে থেকে কিছু করলেও সংসার চলত।কিন্ত যখন আমি কাজ না করতে পেরে বেকার ঘুরতাম তোমার মোটেও তা ভাল লাগতো না।হ্যা আমি বেবির কথা জানলে হয়তো টিকিট এখন কাটতাম না।তবে কি জানো প্রবাসে কেউ শখের বশে থাকেনা।এখানে খেটে যেই টাকা পাই তার এক গুন ওতো বাংলাদেশে পাওয়া মুশকিল তাহলে এখানে কষ্ট করে তোমাদের সুখে রাখার কথা ভাবা আমার কাছে অন্যায় নয়।যাইহোক কষ্ট দিতে চাইনি রুত। কষ্ট দিলে মাফ করো তোমার সন্তান এর পিতাকে।যে নিজের সংসার এর ভ্ররন পোষন এর জন্য তাকে আর তার মাকে একলা রেখেই প্রবাসে চলে এসেছে।এখন রাখছি রুত পাখি।পরে কল দিব। আই লাভ ইউ।
বলেই কল কেটে দিলাম। ভালোবাসি বলে কিছু বলিনা।কিন্ত ওর তো বোঝা উচিত ছিল আমি ওদের জন্য এই প্রবাসে এসেছি।(আয়ান হতাশ হয়ে)
আটমাস পর
দীর্ঘ আটমাস এর দূরত্বের পর দেশে ফেরার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি।
রুত পাখি আমার আয়াত পাখির কি খবর?(আয়ান রুতবার উদ্দেশ্য)
সে খুব দুষ্ট হয়েছে এখনি ফুটবল খেলে।আমি ভেবে পাইনা তার জন্মের পর সেযে কি করবে?(কপাল ধরে বসে)
পাখি ক্ষমা করেছ নাকি এখন ও রেগে আছ?(আয়ান হতাশ কন্ঠে)
ভেবে দেখলাম বুঝলে শুধু শুধু রাগ করে থেকে কি হবে।আর তাছাড়া আমার আয়ান আমার আর আমার ছোট্ট আয়াত বেবির জন্য এইতো এত্ত দূরে কষ্টে আছে।আর তাছাড়া
ভালোবাসা মানে তার পাশে শুয়ে তার আদরে থাকা নয়
ভালোবাসার মানে তার থেকে দূরে থেকেও তার আত্মাকে স্পর্শ করা।
আর তাই তোমার থেকে দুরে থেকে তোমার আত্মার সাথে জড়িয়ে আছি।তবে তুমি কথা দিয়েছিলে আমাদের আয়াত বাবুই ভুমিতে পদার্পণ করার পূর্বেই তুমি এখানে থাকবে।কথাটা মাথায় রেখ।(রুতবা আয়ান এর উদ্দেশ্য )
জ্বি মহারানী।আমি আমার রাজকন্যার পদার্পণ এর পূর্বেই তার কাছে থাকব।(আয়ান)
আচ্ছা তাহলে ঘুমাও কালকে কথা হবে।লাভ ইউ। (রুতবা মুচকি হেসে)
আল্লাহ হাফেজ। আই লাভ ইউ টু রুত পাখি।আর হ্যা তুমি ও জলদি ঘুমিয়ে পড়।
কল কেটে ঘুমিয়ে পড়লাম। আরো পনেরদিন পরে রুত এর ডেইট।তাই আমি দুইদিন পর এই রওনা দিব।কিছুদিন ওকে ও পেমপার করতে পারব।ওকে এখন ও জানাইনি ফেরার কথা।সারপ্রাইজ দিব তাই।
দুইদিন পর আমি চললাম বাংলাদেশের উদ্দেশ্য। দেশে ফিরে ঢাকার থেকে গ্রামে পৌঁছানোর পর জানতে পারলাম রুত সিরির থেকে পরে গেছে আর তাই ওকে ষোল ঘর হসপিটাল নিয়ে গেছে।আমি কিছুক্ষণ শকড হয়ে বসেই ছিলাম।তারপর সেই অবস্থাতেই দৌড়ে গাড়িতে উঠে ষোল ঘর সদর হসপিটাল এ পৌঁছানোর পর জানতে পারলাম কনডিশন সিরিয়াস হওয়ার কারণে ওকে ঢাকা হসপিটাল পাঠানো হয়েছে। আমি আবার গাড়ি নিয়ে ঢাকা হসপিটাল এর সাইটে রওনা হলাম আর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে লাগলাম। আর যাইহোক আমি আমার রুতকে চাই।ওকে ছাড়া নিজেকে কল্পনা করাও যেন ধোঁয়াশা। তাই প্রে করতে করতেই ঢাকা হসপিটাল এসে পৌঁছালাম।অনেক খুঁজে আব্বুর আর আমেনার দেখা পেলাম। আম্মুর এখানে আসতে আসতে শরীর খারাপ হয়ে গেছে।তাই সে পাশের কেভিন এ আছে।ক্যানোলা লাগানো হয়েছে। অপারেশন থিয়েটার এর সামনে আমাকে দেখে আব্বু যেন অবাক হয়ে গেল।আমেনা এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।আমার ও বুক ফেটে চিৎকার করে কান্না আসছে তবে আমি যে পুরুষ মানুষ ভুললে চলবেনা।কিন্ত কেন জানি আমার সমাজের তথাকথিত কথাটাকে একদম প্রাধান্য দিতে মন চাইল না।আমি সেখানে বসে চিৎকার করে কান্না করতে লাগলাম।
আমেনা এই আমেনা আমার রুত এর কি হয়েছে। ডাক্তারদের বল আমার কারো দরকার নেই রুত হলেই চলবে।আমার বাচ্চা বউ টার যে এখন ও অনেক অনেক ভালোবাসার দরকার ।ওদের বল আমার রুতকে আমাকে ফিরিয়ে দিতে।(আয়ান বসে কান্না করে)
রুত ভাবি ঠিক আছে ভাইয়া। ওকে ক্যাবিন এ দেওয়া হয়েছে । তবে তোমাদের বেবির!(কান্না করে আমেনা)
কোথায় আমার রুত?ওকে আমি দেখতে চাই। (আয়ান দাড়িয়ে)
ও ঘুমাচ্ছে। ওকে ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে। তবে সিরির থেকে পরার কারনে বেবির একটা সাইট এ সমস্যা হয়েছে।আর তাই ওর অপারেশন করানো হচ্ছে। (আমেনা আয়ান এর হাত ধরেই)
আমার নবাগত সন্তান কে আমি আল্লাহর ভরসাতে ঠিক ফিরে পাব।কিন্ত আমি রুতকে দেখতে চাই এখনি।আমার বিশ্বাস হচ্ছে না ওকে না দেখা অবধি।
আমেনা আমাকে যেই ক্যাবিন এ রুত ও আম্মু আছে সেখানে নিয়ে গেল। আমি আম্মুর মাথায় হাত রাখতেই আম্মু আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেল।আর কান্না করতে লাগল। আমি এর পর রুত এর পাশে বসে ওর কপালে হাত রাখলাম। ওর হাতে একি সাথে স্যালাইন ও রক্ত চলছে।আমি আস্তে করে ওর কপালে চুম্বন করলাম। আল্লাহ আমার প্রার্থনা শুনেছে।আমাকে সে নিরাশ করেনি।(আয়ান রুতবার দিকে তাকিয়েই)
দুইবছর পর
দেখুন ডাক্তার আমার মেয়ে যেমন এই হোক তাতেও সে আমার মেয়েই থাকবে।আর তার সব দোষ ত্রুটি ও আমরাই দেখব।যেহেতু সামান্য জ্বর আপনি দেখে ঔষধ দিয়ে দিন।ও কেমন তা বারবার বলার দরকার নেই।(আয়ান রেগে ডাক্তার এর উদ্দেশ্য)
ও প্রতিবন্ধী তাই ওকে স্পেশাল কেয়ার দিতে বলা কি ভূল। এত্ত রেগে যাওয়ার কি আছে?(ডাক্তার ভাব নিয়ে)
নেহাত আপনি মেয়ে মানুষ। নাহলে বারবার আমার মেয়েকে স্পেশাল কিড বলার জন্য আপনাকে মেরে দিতাম।যত্তসব ফালতু মানুষ।
বলেই উঠে চলে আসলাম। মেয়েটার জ্বর হয়েছে রাতে।সারারাত আমার রুত পাখি মেয়ের পেছনে খাটাখাটনি করেছে।এতে ওর শরীর একটু অসুস্থ হয়ে গেছে।ঐ ঘটনার কারণে ওকে স্ট্রেস নেওয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।আমার মেয়ে মাসাআল্লাহ অনেক সুন্দর, অনেক ভদ্র আর আল্লাহর রহমতে একটু অন্যরকম। সে আর সব বাচ্চাদের মত হাটা এখন ও শিখেনাই।কারণ তার পা টায় জন্মের সময় ভেঙ্গে গেছিল।ডাক্তার ওর ব্রেন ওপারেশন করেছিল।ওর ব্রেন থেকে পেটের ভেতরে একটা ছোট পাইপ দেওয়া আছে।আর পা এখন ও স্টাবেল হতে সময় লাগবে।তাই বলে কি আমি আমার আয়াত পাখির প্রতি রুড হব।ও যেমনি হোক ও আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার ।আমার আর আমার ছোট্ট রুত পাখির ছোট আয়াত পাখি ও।আমি আমার সোনা মনিকে কোলে নিয়ে বাড়ি ফিরতেই আম্মু ওকে কোলে নিয়ে তাদের রুমে চলে গেল ।আমার আয়াত এর প্রতি আমার ফেমেলির সবাই খুব সহনশীল। ওর প্রতি সবার ভালোবাসা নিখুঁত ও সার্থহীন।
ওকে ভালোবাসার জন্য সবাই যখন বিচলিত হয়ে উঠে আমার রুত পাখি তখন চোখের পানি লুকানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠে।এখন ও নিজেকে দোষি ভাবে সেইজন্য। আল্লাহ চাইছে তাই হয়তো এমন হয়েছে। এটা নিয়ে কষ্ট পাওয়ার তো কিছু নেই ।আমি উপরে চলে আসলাম। এসে দেখি রুত ঘুমিয়ে আছে।আমি তাই শাওয়ার নিতে গেলাম। শাওয়ার ছাড়া বাইরের থেকে বেডে বসলেও হাজার খানা ঝাড়ি শুনতে হয়।মেয়ে আমার তখন বেজায় খুশি মনে হাসতে থাকে।কারণ ও চলতে না পারলেও সব কিছুই বুঝে।অল্প বুলি ফুটেছে মুখে।যখন বা বা বলে মনটা জুড়িয়ে যায়।শাওয়ার নেওয়ার পর এসে আমার রুত পাখির পাশে শুয়ে পড়লাম। জাস্ট হাতটা পেটের উপর রেখেছি অমনি ওর ঘুম শেষ।উঠেই মেয়েকে খোঁজ করতে শুরু করল।
আছে তো আয়াত ওর দাদির কাছে।এদিকে যে আমার মনটা তোমাকে একটু আদর করার জন্য কেমন কেমন করছে তার খবর রেখেছ?(আয়ান রুতবার হাত ধরেই)
মেয়েটার জ্বর কত্ত হল,ডাক্তার কি বলল,ওকে ঔষধ কি কি দিল,নিচে রেখে আসলে খাবে কখন?(রুতবা অশান্ত কন্ঠে)
আরে মেরি দাদি থামেন থামেন।এত্ত প্রশ্নের তো কোন কারণ দেখছিনা।আমার মেয়েটার যত্ন নেওয়ার অনেক মানুষ আছে। আমার দিকে ও একটু নজর দাও রুত পাখি?(আয়ান হতাশ কন্ঠে)
এই যে মশাই এত্ত এটেনশন ক্রিয়েট করতে চাও কেন?জানতো ভালোবাসি।তাও ঢং করে ভালোবাসা লুফে নেওয়ার ধান্দা খোঁজ কেন?(আয়ান এর বুকে হাত দিয়ে রুতবা)
ভালোবাসা গুলো সর্বদাই বিলিন করে দিতে হয়।এভাবে লুকিয়ে রাখলে ঝং ধরবে তো।(আয়ান মুচকি হেসে)
আসছে।ও শোন বিকালে ঘুরতে যাব নিয়ে যাবে আমাদের?(রুতবা মুচকি হেসে)
তা আবার জিজ্ঞেস করা লাগে?অবশ্যই নিব।(রুতবার কোমরে হাত রেখে আয়ান)
কাজ করে কুল পাওনা।আসছে জিজ্ঞেস করা লাগে বলতে?(রুতবা মুখ ভেংচি কেটে)
আলুর ফলন ভাল হলে পরে ধানের ফলন শুরু হবে।একটু কাজের চাপ তো থাকবেই।(আয়ান রুতবার মাথায় হাত রেখেই)
হুম বিক্রমপুইরা আলু।(রুতবা মুচকি হেসে)
হুম
আমি তোমার আলু ভাজা।
তুমি আমার ডাল।
তোমার আমার
ভালো বাসা।
চিংড়ি মাছের ঝাল।(আয়ান হেসে)
আচ্ছা কবি মশাই আপনি থাকেন আমি কাজে যাই।(রুতবা)
দুপুর এর খাবার খাওয়ার পর আমি রুত আর আয়াত পদ্মার পাড়ে ঘুরতে গেলাম। অনেক দিন পর ফেমেলির সাথে একটু সময় কাটালাম। বেশ ফুরফুরে লাগছে আজকে।ভালোবাসার মানুষটির হাতে হাত রেখে কোলে ভালোবাসার চিহ্ন বহন করার মধ্যেই যে শান্তি তা পৃথিবীর সকল ধন সম্পদ দিয়ে কেনাও অসম্ভব ।পরিশেষে একটা কথাই বলব লাইফ এ কখন কি মিরাকল হয় বলা মুশকিল। তবে তাকে পজিটিভ ভাবে নেওয়ার চেষ্টা করবেন।এতে লাইফ হবে সুন্দর। যেমন ছোট্ট আট বছরের মেয়েটাকে বিয়ে করে মনে হয়েছিল ওর মতো #MEANINGLESS_LIFE_PARTNER আর হতেই পারেনা। কিন্ত বর্তমান এ ওর থেকে ভালো জীবন সঙ্গী পাব বলে মনে হয়না।সবার দোয়া ও ভালোবাসার পর একটা কথাই বলব।
ভালোবাসার প্রকৃত অর্থ হচ্ছে
কাউকে সম্পূর্ণরূপে বুঝতে পারা,
যদি তুমি কাউকে সম্পূর্ণরূপে বুঝতে না পারো
তাহলে সে ভালোবাসা সত্যি কারের নয়।(আয়ান)