অপ্রিয় প্রিয়জন পর্ব-০৩

0
328

#অপ্রিয়_প্রিয়জন
#Fiza siddique
#পর্ব-3

কেনো বৃষ্টিকে কষ্ট দিচ্ছিস তুই বলতো? তুই ওকে ভালবাসিস বলে দে না। আমি চাইলেও পারবোনা রে ওকে সবটা বলতে, এতে পরে ও বেশি কষ্ট পাবে, আর আমি যদি এখন ওকে ভালোবাসি বলি তাহলে ও যেটুকু পড়াশোনা করছে সেটাও করবেনা, চিনি ওকে ভালো করে। তাই যা হওয়ার এক্সামের পর হবে।

বাস শুরু করে নিজের গন্তব্য, আর সবাই পিছনে ফেলে যায় এই সুন্দর সময়টাকে, হাজারও স্মৃতি, ভালোলাগা আর মন খারাপ নিয়ে সবাইকে ফিরে যেতে হয়। ফেরার সময় অতিরিক্ত ক্লান্ত বৃষ্টি একটা ভরসার কাধ পেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, আর ফারহানের কোনো এক অজানা কারণে ঘুম আসেনা। কারনটা প্রেয়সীকে এত কাছ থেকে দেখার লোভ, নাকি অন্য কিছু তাকে ঘুমাতে দেয়না জানা নেই।

এভাবে দেখতে দেখতে সময় পার হতে থাকে, সামনে পরীক্ষা তাই সবাই পড়াশোনায় ব্যাস্ত, কেউ আর এখন স্কুলে যায়না। সারাদিন পড়াশোনার সাথে সাথেও চলতে থাকে ফারহান আর বৃষ্টির খুনসুটি। এরই মাঝে বৃষ্টির অ্যাক্সিডেন্ট হয় একবার, গুরুতর ভাবে আঘাত পায় পায়ে, সেসময়ে কখনও ফারহান একজন কেয়ারিং বন্ধু, তো কখনো আবার বড়দের মত শাসন করে সব কাজ করিয়েছে, ঠিকমতো ওষুধ খাওয়ানো, খাওয়া দাওয়া সময় মত করা সবকিছুতেই খেয়াল রেখেছে, এজন্য বৃষ্টিও খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে পড়ে। এক কথায় বৃষ্টি ফারহানের প্রতি আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে।

দেখতে দেখতে সবকটা পরীক্ষা শেষ হয়। এবার রেজাল্ট বেরোনোর আগে পর্যন্ত সবাই ফ্রী। ইদানিং ফারহান আর আগের মতো নেই, আগের মত ওদের আর কথাও হয়না। বৃষ্টি ভাবে হয়তো পরীক্ষার পর কিছুদিন রিলাক্স টাইম কাটাচ্ছে, তাই আর এবিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করেনা। এদিকে ফারহান এই কয়দিনে একদম স্বাভাবিক হয়ে যায়, বন্ধু হিসেবে যতটুকু খোঁজ নেওয়া দরকার ঠিক ততটুকুই বৃষ্টির খোঁজ রাখে। ফারহানের এই পরিবর্তন বৃষ্টি মেনে নিতে পারছেনা, সবসময় ভাবতে থাকে যে কি এমন হলো ফারহান ওর সাথে এমন ব্যবহার করছে? ও কি কিছু ভুল করেছে?

এরই মধ্যে কলেজে ভর্তির তোড়জোড় লেগে যায়, সবাই ব্যাস্ত হয়ে পড়ে কে কোন কলেজে ভরতি হবে সেটা নিয়ে। এদিকে বরাবরই ভালো রেজাল্ট করায় আশরাফ হোসেন মেয়েকে ভালো কলেজে ভর্তি করাতে চান। কিন্তু বৃষ্টি বারবার এখানের কলেজে ভর্তি হওয়ার কথা বলে, কারন দূরে চলে গেলে ফারহানের সাথে ওর আর দেখা হবেনা, আর ফারহান না চাইলে কথাও হবেনা। এমনিতেই ফারহানের এমন যোগাযোগ কমিয়ে দেওয়া নিয়ে দ্বিধাতে ভুগছে, তারউপর আব্বুর মুখের উপর কিছু বলতেও পারেনা তাই বাধ্য হয়ে ওকে আব্বুর পছন্দের কলেজেই ভর্তি হতে হয়।

এরপর একবার শুধু সৃজার সাথে কথা হয়েছিল আর ফারহান ব্যস্ততা দেখিয়ে দেখা করতে আসেনা একবারও, ভেতরে ভেতরে ভীষণ ভেঙে পড়ে বৃষ্টি। আর দুদিন পর চলে যেতে হবে, তাই চাইলেও এখন বৃষ্টি কিছু করতেও পারবেনা, তাই যেটা হচ্ছে চুপচাপ মেনে নেয়।

দেখতে দেখতে সময় পার হয়ে যায়, কেটে যায় দুটো বসন্ত। আজ বাড়ি ফিরছে বৃষ্টি, মনে মনে ভীষণ খুশি সে, কারণ এতগুলো দিন পর আবার ফারহানের সাথে দেখা হবে, ঠিকঠাকভাবে কথা হবে। কতদিন ওই মুখটা দেখেনি, একটু ছুঁয়ে দেয়নি, চুলগুলো এলোমেলো করে দেয়নি, দুষ্টুমি করেনি। ভাবতে ভাবতেই আপনমনে হেসে ওঠে, এতদিন মাঝে মধ্যে ফারহানের সাথে মেসেজে কথা হয়েছে, তাও খুব কম। একবার সৃজার কাছে শুনেছিল, ওর চলে আসার কয়েকদিন পর ফারহান বলেছিল, তুই সেদিন বলছিলিস আমি কেনো আমার ভালোবাসার কথা প্রকাশ করিনা, এখন দেখ প্রকাশ করলে আরো বেশি কষ্ট পেতাম। না পারতাম ওকে আটকাতে, না পারতাম ওকে ছেড়ে থাকতে, তাইতো কখনও কিছু বুঝতে দিয়নি। এগুলো শুনে বৃষ্টি ভাবে ফারহান ওর দূরে চলে আসতে খুব কষ্ট পেয়েছে তাই হয়তো শেষে দেখা করতে চাইতোনা। আর মনে মনে ঠিক করে যেভাবে হোক এবার ফারহানকে ওর মনের সব অনুভূতিগুলো বলবে, আর নিজের মাঝে চেপে রাখবেনা, বলে দেবে যে ফারহান যেটাকে আবেগ আর ভালোলাগা বলেছিলো সেটা ভালবাসা ছিল। তাইতো আজও এতগুলো দিনেও ওর মনে শুধুই ফারহান আছে, আর অন্য কেউ জায়গা করতে পারেনি।

আজ অনেকদিন পর বৃষ্টি সেই স্কুলের সামনে যায়, ঘুরে ঘুরে দেখে পুরো জায়গাটা, কত ছোট বড় স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই স্কুল, এই গাছতলা, এই ক্লাসরুমের সাথে। তারপর চলে যায় সেই পুরোনো পুকুর পাড়ে যেখানে মন খারাপ হলেই বৃষ্টি বসে থাকতো, আর ফারহান যখন সবজায়গায় খুজেও না পেতো তখন ঠিক বুঝে যেতো যে বৃষ্টি এখানেই আছে, ব্যাস চলে আসতো ওর মন ভালো করতে। এসব ভাবতে ভাবতে আপন মনেই হাসে আর ভাবে, আচ্ছা ফারহান নিশ্চই আগের থেকে আরো সুন্দর হয়ে গেছে তাইনা? এমনিতেই আমি এক বালতি ক্রাশ খেয়ে আছি ওর উপর, এবারে যদি এক পুকুর ক্রাশ খেয়ে যায়, তাহলে কি হবে? আর আমি তো সাঁতার জানিনা তাহলে উঠবো কিভাবে? যদি ডুবে মরে যাই তাহলে আমাদের হবু বাচ্চার কি হবে?

এসব ভাবনার মাঝে কেউ পিছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আর খুশিতে আটখানা হয়ে বলে, আমি ভাবতে পারছিনা কতগুলো দিন পর তোর সাথে আবার দেখা। কত বড় হয়ে গেছিস তুই, আর সুন্দরও। সৃজার এমন কথা শুনে আর না হেসে পারেনা। তুইও কি কম সুন্দরী হয়েছিস নাকি? আমাদের সোহেলের তো বিপদ বাড়ছে আরো। বৃষ্টির কথা শুনে ভ্র উচু করে তাকায় সৃজা, কেনো আমি আবার সোহেলের বিপদ কিভাবে বাড়ালাম? আরে এমন সুন্দরি গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরছে, বাকিরা আর কেউ যে চান্স পাচ্ছেনা, রাগ হবেনা বুঝি? তারপর দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে হু হা করে হেসে ওঠে।

বেশকিছুক্ষন দুজনে আড্ডা দেয়, তারপর বৃষ্টি ফারহানের কথা জিজ্ঞাসা করলে আমতা আমতা করে এড়িয়ে যায় সৃজা। ব্যাপারটা বৃষ্টি খেয়াল করে, আর এক অজানা ভয় কাজ করে ওর মধ্যে। দেখ সৃজা কি হয়েছে আমাকে বল সবটা, প্লিজ তুই অন্তত কিছু লুকাস না আমার থেকে।

ফারহান তন্নীর সাথে রিলেশনে আছে। ব্যাস এটুকুই যথেষ্ট ছিল বৃষ্টির হাসিমুখটা চুপসে দেওয়ার জন্য, ওর যেনো নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছেনা, এসব কি বলছে সৃজা? নিশ্চই মজা করছে, নাহলে ফারহান এমন করতে পারেনা আমার সাথে। দেখ আমার এমন মজা একদম ভালো লাগছেনা, তুই আর কখনো এই ধরনের মজা করবিনা আমার সাথে, তাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু। আমি জানতাম বৃষ্টি তুই মানতে পারবিনা এসব, আমি জানি তোর ভিতরে কি চলছে, কিন্তু বিশ্বাস কর আমি একটাও মিথ্যে কিছু বলিনি।

হটাৎ করেই দুনিয়াটা যেনো বড্ড স্বার্থপর বলে মনে হয় বৃষ্টির, সবকিছু এলোমেলো লাগে। তাহলে কি ফারহান ওকে ঠকালো? এই একটাই কথা মাথায় ঘুরতে থাকে। তাহলে ওর বলা সব কথা মিথ্যে ছিলো? এতো আবেগ, অনুভূতি সব মিথ্যে ছিল? কি করে পারলো ফারহান ওর সাথে এমন নাটক করতে? ও তো কখনো জোর করেনি ওকে ভালোবাসতে, তাহলে? কলেজে দুটো বছর যে কিভাবে পার করেছে সেটা শুধু সে নিজেই জানে। কলেজের সবাই জানত ফারহানের কথা, কেউ কখনো প্রোপোজ করলেই বলে দিতো ওর ভালবাসার মানুষটার কথা। ওর প্রতিটা ডাইরির পাতা, প্রতিটা নির্ঘুম রাত সাক্ষী ওর ভালোবাসার।

বৃষ্টি যেনো রিয়েক্ট করতে ভুলে গেছে, পাথরের মত বসে আছে দেখে সৃজা বৃষ্টির হাত ধরে একটা জায়গায় নিয়ে যায়, সেখানের দৃশ্য দেখে হুহু করে কেঁদে ওঠে বৃষ্টি। কলেজের পাশের পুকুর পাড়ে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ আছে, যেটা বরাবরই বৃষ্টির খুব পছন্দের ছিল, কিন্তু আজ হটাত করেই গাছটার উপর খুব রাগ হচ্ছে, সহ্য করতে পারছেনা গাছটাকে l কারণ ওই গাছের নিচেই তার ভালোবাসার মানুষটা নিজের ভালোবাসাতে মেতে আছে। তন্নীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে ফারহান, আর মাঝে মাঝে ওর পেটে কাতুকুতু দিচ্ছে, কখনও নাক ধরে টান দিচ্ছে, আর তন্নী কখনও ওর মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে, তো কখনো চুলগুল এলেমেলো করে আবার নিজেই গুছিয়ে দিচ্ছে। দুজনকে দেখে ভীষণ পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে, ঠিক এমন ভাবেই ত দেখতে চেয়েছিলো ও নিজেকে আর ফারহানকে। ওর কি দোষ ছিল যে আজ এতটা কষ্ট পেয়ে হচ্ছে? বাচ্চাদের মত নিচে হাঁটু মুড়ে বসে মুখে হাত দিয়ে কান্না করতে থাকে বৃষ্টি। আজ যেনো নিজের উপরই রাগ হচ্ছে এই জঘন্য মানুষটাকে ভালোবাসার জন্য। কিছু একটা ভেবে উঠে দাড়ায় বৃষ্টি আর এগিয়ে যায় ওই সুখি কপোত কপোতীর দিকে।

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে