অপ্রিয় প্রিয়জন পর্ব-০৪

0
351

#অপ্রিয়_প্রিয়জন
#Fiza siddique
#পর্ব-4

সামনে একজোড়া পা এর অবস্থান দেখে দুজনেই সেদিকে তাকিয়ে ভুত দেখার মতো চমকে গেলো, এমন ভাবে চমকানোর কারনটা দুজনের কাছেই অজানা। নিজেদেরকে যথাযথ স্বাভাবিক করে ফারহান বলে,
— কবে ফিরলি?
অপরদিক থেকে হাসিমুখে জবাব এলো,- এইতো কাল।
আবারও খাপছাড়া কণ্ঠে বলে ফারহান,
— কেমন আছিস? তুই ফিরবি বলিসনি তো?

বৃষ্টি এবার শান্ত কণ্ঠে উত্তর উত্তর দেয়, আগে থেকে জানিয়ে দিলে বুঝি এই খেলাটা আরো কিছুদিন খেলা যেতো? আরো কিছুদিন এই মনটা নিয়ে খেলতে পারতিস? আরো বেশী করে ভেঙ্গে, দুমড়ে মুচড়ে দেওয়ার সুযোগ পেতিস?
কিছুক্ষন থেমে আবারো বলা শুরু করে – কেন করলি আমার সাথে এমনটা ফারহান? আমি কি তোর কাছে কখনও ভালোবাসার দাবি নিয়ে এসেছিলাম? বলেছিলাম আমাকে তোর ভালোবাসতে হবে? কখনও কি বলেছিলাম যে আমার এত কাছে আয়, তবে কেনো এলি আমার এত কাছে? কেনো এতগুলো মিথ্যে বললি আমাকে? কেনো মিথ্যে স্বপ্ন দেখালি? কথা বলতে বলতে হেচকি তুলতে থাকে, আর জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়, বৃষ্টির এমন অবস্থা দেখে তন্নী পানি বের করে খাওয়ার জন্য দিলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আবারও বলতে শুরু করে,

তুই তো খুব ভালো করে জানতিস আমাকে ফারহান! আমি কখনো কোনো ছেলের সাথে এতটা ক্লোজ হয়নি যতটা তোর সাথে হয়েছি, ভালো না বাসতিস অন্তত এই অভিনয়টা না করলেই পারতিস। এটুকু ছাড় কি আমাকে দেওয়া যেতোনা? কেনো এভাবে আমাকে ভেঙ্গে দিলি কেন বল? তুই আমাকে তখনই বলতে পারতিস যে তুই তন্নী কে ভালবাসিস, আর কখনো তোদের মাঝে আসতাম না আমি, কিন্তু তুই আমার বিশ্বাস, ভরসা, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব সব নিয়ে খেলা করেছিস। এবার খুশী তো তুই? দেখ আমি তোর সামনে কেমন নিচে বসে কাদছি, আমার মনটাকে খুব যত্নসহকারে একটু আকটু করে ভেঙ্গেছিস, দেখ আমাকে ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছি তুই।

পুরোটা সময় ফারহান চুপ থাকলেও এখন আর চুপ থাকতে পারলোনা। দুকদম এগিয়ে বৃষ্টির মুখোমুখি বসে একটু জোরেই বলে উঠলো,
— আমি তোকে কখনও ভালোবাসি বলেছিলাম? তুই আমাকে কখনো ভালবাসিস বলেছিলিস? কখনও আমি তোকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম যে আমি তোকে ভালোবাসবো? তাহলে কিসের ভিত্তিতে তুই আজ আমাকে এতগুলো কথা বলছিস? আজ 2টো বছর পর তুই এসে বলছিস আমাকে ভালবাসিস, আমি তোকে ঠকিয়েছি? আমি তখন তোকে শুধু সান্ত্বনা দিয়েছিলাম, যাতে তুই স্বাভাবিক হতে পারিস, নিজের পড়াশোনায় ফোকাস করতে পারিস, কখনও তোকে ভালোবাসবো বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নই আমি।
কিছুটা নরম কন্ঠে আবারো বলে ওঠে, দেখ তুই আমার থেকে ভালো কাউকে………….

ফারহানকে হাত উঁচু করে থামিয়ে দিয়ে, yes, I know I deserve better than you. ( হ্যাঁ, আমি জানি তোর থেকে ভালো কেউ আমার উপযুক্ত)। তবে একটা কথা মাথায় রাখিস, পাপ বাপকেও ছাড়েনা, ভাবিসনা অভিশাপ দিলাম, কারন নিজের সবটুকু দিয়ে যে মানুষটাকে ভালোবেসেছি তার খারাপ কোনদিন চাওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। তবে হারানোর ব্যাথা তুইও একদিন বুঝবি, আর সেদিন টের পাবি আমার কষ্টটা। তবে কি বলতো আমি মনে প্রাণে চাই তুই যেনো সেই কষ্টটা না পাস, কারন তুই কষ্ট পেলে আমি দেখতে পারবোনা সেটা কারন তুই আমার #অপ্রিয়_প্রয়োজন। ভালো থাকিস তোরা, আর কখনো আমার মুখও তোদের দেখতে হবেনা।
__________________________

সেদিনের পর কেটে গেছে 3টা বছর, কেটেছে তিনটে বসন্ত। বৃষ্টি আজ মেডিকেল স্টুডেন্ট। সেদিন বাড়ি ফিরে কাউকে কিছু না বলে নিজের দরজা আটকে রাখে, হাজার রাতে খাওয়ার জন্য হাজার ডাকাডাকি করার পরও যখন বৃষ্টির কোনো সাড়াশব্দ না পায় তখন বাধ্য হয়ে দরজা খুজে যেটা দেখে সেটার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলেননা। মেয়েকে এমন অবস্থায় দেখে জ্ঞান হারান রাবেয়া বেগম। আশরাফ সাহেব অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নেন, কারণ এখন সবাই ভেঙে পড়লে মেয়েটাকে সামলাবে কে? বড়ো আদরের মেয়ে তার, একটা ফুলের টোকাও কখনও পড়তে দেননি মেয়ের গায়ে আর আজ সেখানে মেয়েটা র/ ক্তা /ক্ত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছে, ভেতরে ভেতরে ক্ষ/ত/বি/ক্ষ/ত হয়ে পড়েছেন উনি। তবুও অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে ডক্টরকে ফোন করে দ্রুত আস্তে বলেন।

ডক্টর জানান ক্ষ/ ত/ টা বেশি হয়নি, ব্লে/ ডে ধা/ র কম ছিলো বলে শিরা কা/ টে/ নি, পেশেন্ট এখন বিপদমুক্ত, অতিরিক্ত র/ ক্ত/ ক্ষ/ র/ ণে/ র ফলে জ্ঞান হারিয়েছিল।
তারপর জ্ঞান ফেরার পর রাবেয়া বেগম মেয়েকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্নাকাটি করেন। বৃষ্টি আম্মু আব্বুকে এইভাবে আর দেখতে পারছিলনা, তাই প্রথম থেকে ফারহানের সাথে হওয়া সব ঘটনা বলে দেয়, আর সেদিনই সিদ্ধান্ত নেয় যে সে অনেক দূরে চলে যাবে এখান থেকে। পরেরদিনই তারা ওই গ্রাম ছেড়ে দেন, আর অনেক দূরে চলে যান আর কাউকে তাদের ঠিকানা দেননা, যাতে কেউ আর ওনাদের সাথে যোগাযোগ না করতে পারে। বৃষ্টি প্রথম 6মাস কারোর সাথে ঠিকমতো কথা বলতনা, খাওয়া দাওয়া করতোনা, সবসময় নিজের ঘরে চুপচাপ শুয়ে থাকতো। আশরাফ সাহেব জানতেন ওনার মেয়ের ছোট থেকে স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার, যে বয়সে বাচ্চারা হাঁড়ি বাসন খেলনা কেনার জেড করতো বৃষ্টি তখন ডক্টর কিট খেলনা গুলো কিনতে চাইতো( বার্বি সেট এর মত এক ধরনের সেট পাওয়া যায় যেখানে stethoscope সহ আরো প্লাস্টিকের ডাক্তারি জিনিসপত্র থাকে, সেটার কথাই বলতে চাইলাম)। তাই তিনি মেয়েকে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির সিদ্ধান্ত নিলেন, কিন্তু তার আগে মেয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি তাই তিনি খাবার হতে নিয়ে বৃষ্টির ঘরে গেলেন।

পুরো ঘর অন্ধকার করে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে রাতের ব্যাস্ত শহরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বৃষ্টি, হটাৎ করে আশরাফ সাহেবের ডাকে ধ্যান ভাঙ্গে তার, তাই পলকহীন ভাবে তাকিয়ে থাকে আব্বুর দিকে।
আব্বু আজ তোকে খাইয়ে দেবে এদিকে এসে বস মা, কতোদিন তোকে আর খাইয়ে দেওয়া হয়না, আমার দুষ্টু মেয়েটা কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে, খুজে দেনা মা আমার মেয়েটাকে। আমার দুষ্টু মেয়েটাকে আমি একটু মন ভরে দেখতে চাই, ওর দুষ্টুমিগুলো উপভোগ করতে চাই, জানিনা আমার মেয়েটাকে আর কখনো আগের মত ফিরে পাবো কিনা।

শান্ত আর ছলছল চোখে আশরাফ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি বলে, আমিও তো স্বাভাবিক হতে চাই আব্বু। আব্বু আমি পড়াশোনা করতে চাই, আমার তো এস.এস.সি কমপ্লিট হয়ে গেছে আমি মেডিকেলে ভর্তি হয়ে চাই আব্বু, আমার সপ্ন পূরণ করতে চাই। মেয়ের কথা শুনে মনে মনে চিন্তা করেন কালই এই বিষয়ে কথা বলবেন, মেয়েটা যত ব্যাস্ত থাকবে ততই পুরোনো জিনিসগুলো ভুলতে পারবে আর আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হবে। তারপর দেখতে আজ তিনটে বছর পেরিয়ে গেলেও মেয়েটা আর আগের মত নেই, আগের বাচ্চা বৃষ্টিটা কোথাও হারিয়ে গেছে, এই বৃষ্টি হলো প্রাপ্তবয়স্ক, যার কাছে নিজের কাজ, পড়াশোনা টাই সব। ভালোবাসা, ইমোশান, ফিলিংস এসবের কোনো গুরুত্ব নেই।

কলেজ লাইফের তিনটে বছরেও কোনোদিন কোনো ছেলেকে বন্ধু বানানো তো দূরের কথা, কখনও কোনো ছেলের সাথে ঠিকভাবে কোথাও বলেনি। এই তিনটে বছরে অনেকগুলো প্রপোজাল পেয়েছে বৃষ্টি, কিন্তু কখনো কারোর দিকে ফিরেও তাকায়নি, এক কথায় ছেলেদের সহ্যই করতে পারেনা। কিন্তু হাজারও চেষ্টা করেও নিজের মনটাকে কঠোর করতে পারেনি বৃষ্টি, সেটা এখনো ততটাই সুন্দর আছে যতটা সেই ষোলো বছরের বৃষ্টির ছিল।

আজ এই হসপিটালে আসছেন একজন বিশিষ্ট সার্জেন, দেশে বিদেশে অনেক নাম তার। এখনও পর্যন্ত দুই একটা কেস ছাড়া সবগুলোই সাকসেসফুল। সবথেকে বড় ব্যাপার হলো বৃষ্টির আইডিয়াল মানুষ উনি, সবসময় এই মানুষটার মত হতে চেয়েছে বৃষ্টি আর আজ এই হসপিটালের লেকচারের হিসেবে আসছেন ড: আহাদ হোসেন মেঘ। মনে মনে ভীষণ খুশি হলো এই মানুষটার ব্যাক্তিত্ব এতদিন সোশ্যাল মিডিয়াতে পড়েছিল শুধু, আর আজ তার কাছ থেকে কিছু শিখতে পারবে এটা আসলেই অনেক বড় কিছু পাওয়া।

ড: আহাদকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য প্রিন্সিপাল, প্রফেসররা আর কিছু স্টুডেন্টস আসেন। ফুলের তোড়া দিয়ে বরন করে নেওয়া হয় ওনাকে।

হসপিটাল ক্যাম্পাস থেকে হেঁটে নিজের জন্য বরাদ্দ রুমে যাওয়ার সময় আহাদের চোখ পড়ে হসপিটাল ক্যান্টিনে বসা এক মেয়ের দিকে, যার দৃষ্টি শুধু বইয়ের দিকে, যেনো দুনিয়া উল্টে গেলেও তার কোনো যায় আসেনা। যেখানে বাকি মেয়েরা সেজেগুজে তাকে দেখতে, ইমপ্রেস করতে আর অভ্যর্থনা জানাতে ব্যাস্ত সেখানে এই নরমাল কুর্তির সাথে জিন্স আর মাথায় হিজাব পরা মেয়েটা বইয়ে কিছু বুঝতে অসুবিধে হওয়ায় কপালে ভাঁজ ফেলে সেটা রপ্ত করতে ব্যাস্ত। হটাৎ ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি ফুটে ওঠে তার। তারপর……………

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে