অপ্রিয় প্রিয়জন পর্ব-১৬

0
319

#অপ্রিয়_প্রিয়জন
#Fiza siddique
#পর্ব-16

পিছন থেকে জড়িয়ে ধরা হাত দুটো টান দিয়ে সামনে আনতেই থ হয়ে যায় মেঘ। বৃষ্টিকে ছেড়ে কয়েক কদম পিছিয়ে যায়। তারপর তারাহুরো করে পাগলের মতো বৃষ্টির কাছে এসে পরনের শাড়ীটা খুলে ফেলে দিতে উদ্যত হলে বৃষ্টি শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মেঘকে। মেঘের খোলা বুকে বেশ কয়েকবার অধর ছুঁইয়ে শান্ত করে মেঘকে। তারপর ওভাবে থেকেই বলতে শুরু করে,

আমাদের ভালোবাসার শুরুটা এই রঙ দিয়েই হয়েছিল মেঘ। আর আমি জানি এটা তোমার প্রিয় রঙ। যেটা ঘটে গেছে সেটা ভুলে যাও প্লিজ। ওটা শুধু একটা অ্যাকসিডেন্ট ছিলো মাত্র। আজকের নতুন করে ভালোবাসার শুরুটা আমি আবারও এই রঙ দিয়ে করতে চাই। তোমার ভুল ধারনা ভেঙে দিতে চাই, সুধু মনে রাখবে ভালোবাসার জোর থাকলে সব অসম্ভব সম্ভব হয়। অতীত ঘেঁটে শুধু বেদনা পাবে, তাই অতীতকে পিছনে ফেলে একটা গিয়ে যেতে হয়। আমি চাই সেদিন যেমন তুমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমার দিকে তাকিয়ে ছিলে আজও সেভাবেই তাকাও। যেখানে থাকবেনা কোনো ভয়, আতঙ্ক। অনেক খুজে খুঁজে ঠিক একই শাড়ি কিনেছি আমি সেজন্য।

মেঘও শক্ত করে বৃস্তিকে জড়িয়ে ধরে বুকের মাঝে আর বৃষ্টির বলা সব কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনে। তারপরো কোথাও একটা বাঁধা পায় মন থেকে। কিন্তু আপাততো সব বাধা দূরে সরিয়ে প্রিয়তমার আবদারটা পুরন করে। ঠিক সেদিনের মতই অসম্ভব মায়াবী লাগছে আজও বৃষ্টিকে। বরং আরও বেশি সুন্দর লাগছে। মেঘের চোখের দিকে তাকাতেই ভীষণ লজ্জা পায় বৃষ্টি। কেমন ঘোর লেগে যাচ্ছে ওই চোখের দিকে তাকালে। তারপর মেঘের হাত ধরে সামনে থাকা কেকটা কতে দুজনে মিলে।

ব্যালকনিতে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে বৃষ্টি। আর তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে আছে মেঘ। হটাত মেঘ বৃষ্টিকে সামনে ঘুরিয়ে থুতনিতে আঙ্গুল দিয়ে বৃষ্টির মুখটা উঁচু করে ঘোর লাগা কন্ঠে বলে, মিসেস বৃষ্টি আমাকে জন্মদিনের গিফট তো আমাকে দিলেন না? তবে কি গিফটটা আমি নিজেই নিয়ে নেবো? বলেই বৃষ্টির দিকে এগিয়ে আসতে গেলে মেঘের ডান হাতটা নিয়ে নিজের পেটের উপর রাখে বৃষ্টি। তারপর মেঘের কনের কাছে গিয়ে লো ভয়েসে বলে, আপনার গিফট।

মেঘ পুরোপুরি ভাবে ফ্রিজড হয়ে দাড়িয়ে আছে। সবকিছু যেনো ওর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি কি বললো এটা? ওর পেট? আমার গিফট? ওর পেটে আমার গিফট? ও মাই গড। বলে অবাক হয়ে দুই হাত মুখে দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে বৃষ্টির সামনে। তারপর পেটের উপর থেকে শাড়ীটা সরিয়ে আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করে বলে, এই খানে? এখানে আছে আমাদের বাবু? কয়েকমাস পর আমাকে আব্বু বলে ডাকবে? আমি বাবা হয়ে গেছি? আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছেনা বৃষ্টি। আমাদের ভালোবাসার অংশ আস্তে চলেছে পৃথিবীতে।
তুমি আমাকে আমার জীবনের সবথেকে বড়ো আর মুল্যবান গিফট দিয়েছো বৃষ্টি। এটা আমার জীবনের সবথেকে স্পেশাল বার্থডে, যেখানে আমি তোমাকে পেয়েছি সাথে আমাদের সন্তানকেও। আমি যে আজ কতোটা খুশি সেটা তোমাকে ভাষায় প্রকাশ করতে পারবনা প্রাণপাখি। বৃষ্টির মুখ দুই হাতের মাঝে নিয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে মেঘ।
_____________________

সৃজা সবেমাত্র ফাতেহাকে খাবার খাইয়ে দিয়ে ওর সাথে দুষ্টুমি করছিল। তখনই দরজায় নক করার আওয়াজে ফাতেহাকে কোলে নিয়ে দরজা খুলে দেখে ফারহান দাড়িয়ে আছে। এটা নতুন নয়, সবকিছু ভুলে পাগল হয়ে গেলেও এই কাজটা ফারহান প্রায়ই করে। হয়ত এটাকেই বলে রক্তের টান। সব ভুলে গেলেও কিছু একটার টানে মাঝে মধ্যে আসে এখানে। মাঝে মাঝে শৃজার ভীষণ খারাপ লাগে ফারহানের জন্য। ওর জীবনটা এমন না হলেও তো পারতো। সব পেয়েও আজ ছন্নছাড়া ওর জীবন। এসব ভাবলেই শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস আসে আর মনে হয় হায় রে জীবন!

ফারহান হাত বাড়িয়ে দেয় ফাতেহাকে নেওয়ার জন্য। সৃজা কখনও না করেনা, কারণ ও খুব ভালো করে জানে ফাতেহার সবথেকে নিরাপদ স্থানে সে যাচ্ছে। বাবার পরিধানের কাপড় কিংবা মানসিক অবস্থা খারাপ হলে কি বাবা আর মেয়ের গভীর সম্পর্ক বদলে যাবে? নাহ যাবেনা। সৃজা ফাতেহাকে কোলে নিয়েই ফারহানকে ভেতরে আস্তে বলে। একটা শান্ত বাচ্চার মতোই আচরণ করে ফারহান ফাতেহাকে পেলে। বেশ কিছুক্ষন পরে ফারহান চলে যায়। কোথায় যায় সে নিজেও জানেনা। ফারহানের যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সৃজা বলে, আমার জীবনের #অপ্রিয়_প্রিয়জন তুমি, হোক সেটা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত। তোমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাকে তুমি আমাকে দিয়ে দিয়েছো, তাই তুমি আমার প্রিয়জন। কিন্তু তুমিতো আমার অপ্রিয় একজন মানুষ তাইতো #অপ্রিয়_প্রিয়জন তুমি।

তোমার জীবনের মূল্যবান সম্পদকে আমাকে সপে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ ফারহান। তোমার ফতেহাই এখন আমার বাঁচার কারন। নিজের থেকেও বেশি ভালবাসি আমি ফাতেহাকে। আমার মেয়ের পরিচয়ে বড়ো করবো আমি ফাতেহাকে, কখনও কোনো দুঃখ, কষ্ট ছুটে দেবোনা আমি ওকে। ফাতেহাকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে বিড়বিড় করে বলে ওঠে কথাগুলো সৃজা।
___________________

কেটে গেছে আরও আটটা মাস। এই তিনটে মাস ঠিক ছোটো বাচ্চার মতো করে খেয়াল রেখেছে মেঘ বৃষ্টির। সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেই ব্রেকফাস্ট বানায়, তারপর বৃষ্টিকে নিজের হাতে খাইয়ে দেয়, নিজে সাথে করে হসপিটালে নিয়ে যায়, কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটুও যত্ন নিতে ভিলেন বৃষ্টির। আবারও সাথে করে নিয়ে আসা, ডিনার বানানো সবটাই মেঘের কাজ। পারলে মেঘ বৃষ্টির ডিউটিটাও করে দেয় এমন অবস্থা। মেঘের বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা জারী হয়েছে বৃষ্টির উপর। এই যেমন কিচেনের ধারে কাছেও যাওয়া যাবেনা, সিড়ি দিয়ে ওঠানামা করা যাবেনা, বেশি লাফালাফি করা যাবেনা এমনই অনেক কিছু। বৃষ্টি মেঘের উপর ভীষণ বিরক্ত এসবের জন্য। যেনো এই প্রথম মা হচ্ছে। মাঝে মাঝেই এজন্য মুখ ফুলিয়ে বসে থাকে বৃষ্টি। মেঘও দায়িত্ত নিয়ে নিজের প্রাণপাখির রাগ ভাঙ্গায়। পেটটা বেশ উঁচু হওয়ায় হাঁটতে কষ্ট হয় বলে মেঘই কোলে করে রাখে বেশিরভাগ সময়।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চুল আঁচড়াচ্ছে বৃষ্টি। তখনই মেঘ এসে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে চিরুনিটা কেটে নিয়ে নিজেই আঁচড়ে দিতে থাকে। তারপর সুন্দর করে বিনুনি করে সেটা একদিকে করে কাঁধে একটা চুমু খায়। বৃষ্টিও বরাবরের মতোই কেঁপে ওঠে মেঘের ছোঁয়ায়। এরপর বৃষ্টিকে কোলে করে নিয়ে এসে বেডে শুইয়ে দেয়, তারপর পেটের থেকে জামাটা সরিয়ে নিজের অনাগত সন্তানের সাথে দুষ্টুমি করতে থাকে, সাথে বৃষ্টির সাথেও। এটা মেঘের রোজকার অভ্যাস, এখন আর হসপিটালে যায়না বৃষ্টি। তাই মেঘ রোজ হসপিটাল থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে বৃষ্টির কাছে এসে ওর অনাগত সন্তানের সাথে কথা বলে, অভিযোগ দেয়। এই যেমন এখন বলে,

জানো বাবু, তোমার আম্মু তোমার আব্বুকে একটুও ভালোবাসেনা। তোমার আব্বুকে ভুলেই গেছে এখন। সুন্দরি হয়ে গেছে তো আগের থেকে তাই এতো ভাব দেখায়। তোমার আব্বুর কষ্টটা একটুও বোঝেনা। তুমি আসো ত জলদি আমরা দুজন মিলে তোমার আম্মুর সাথে ফাইট করবো। মেঘের এমন বাচ্চামো দেখে শুধু ঠোঁট চেপে হাসে বৃষ্টি। এটা দেখে মিথ্যে রাগ দেখিয়ে বলে মেঘ, এখন হাসা হচ্ছে খুব তাইতো? ঠিক আছে যাও আমি আসবোনা আর তোমার কাছে। বলেই চলে যেতে নিলে বৃষ্টি মেঘকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে বলে, ভালোবাসিতো আমার বাবুর আব্বুকে। মেঘও আর দেরি না করে কোমল অধরে নিজের অধর যুগল চেপে ধরে। বেশকিছুসময় পর বৃষ্টির গলায় মুখ ডুবিয়ে ছোটো ছোটো চুমু এঁকে দুজনে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমায়।

ছুটির দিন হওয়ায় আজ মেঘ বৃষ্টিকে নিয়ে একটা পার্কে এসেছে। মেঘ বেশ বুঝতে পারছিলো বাড়িতে থাকতে থাকতে ভীষণ বোর ফিল করছে বৃষ্টি। তাইতো একটু ফ্রেশ ফিল করানোর জন্য এখানে নিয়ে এসেছে। বিকেলের সময় হওয়ায় বেশ লোকের সমাগম এখানে। কিছু বয়স্ক মানুষ হাঁটাচলা করছেন, আবার কিছু মারা তাদের বাচচাদের নিয়ে এসেছেন খেলা করানোর জন্য। মাঝে মাঝে কিছু কাপলস ও চোখে পড়ছে, যারা প্রিয়জনের সাথে এই সময়টা উপভোগ করছে। সবকিছু দেখে ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে বৃষ্টির। এখন বেশ ভালো লাগছে। সামনে আইসক্রিমের দোকান দেখে মেঘের কাছে বায়না ধরে খাওয়ার জন্য। কিন্তু মেঘ কিছুতেই এই অবস্থায় ঠান্ডা খেতে দেবেনা, এতে নাকি বাবুর আর বৃষ্টির দুজনের ক্ষত হবে। শেষে বৃষ্টির জেদের কাছে হার মেনে অল্প একটু খাওয়ার অনুমতি দেয়, তারপর চলে যায় আইসক্রিম আনতে।

বসে থাকতে ভালো না লাগায় বৃষ্টি আস্তে আসতে হাঁটাচলা করতে থাকে। হটাত করে ওর চোখ পড়ে সেদিনের সেই পাগলটার উপর। কিছু একটা নিয়ে কোলে।ধরে বসে আছে। বৃষ্টি আস্তে করে হেঁটে যায় সেখানে। গিয়ে দেখে একটা পুতুল রুমালে জড়িয়ে সেটাকে কোলে নিয়ে বসে আছে পাগলটা। দেখে মনে হচ্ছে কোনো বাচ্চার সাথে কথা বলছে, তাকে আদর করছে। এগুলো দেখে ভীষণ মায়া হয় বৃষ্টির ওই লোকটার প্রতি। লোকটার কাছে এগুতে হবে তখনই পাশ থেকে একটা কম বয়সী ছেলের গলার আওয়াজ পায়, কারোর সাথে ঝগড়া করছে বোধহয়। কৌতূহলবশত সেদিকে এগিয়ে গিয়ে দেখে, ছেলেটার সমবয়সী একটা মেয়ে হাঁটু মুরে বসে কান্না করছে। আর ছেলেটা বার বার করে বলছে আমি কি বলেছি আমি তোকে ভালোবাসি? কেনো আমাকে বিরক্ত করছিস তুই? মেয়েটা কাদতে কাদতে জবাব দেয়, তুই যদি আমাকে ভালোনাবাসিস তবে কেনো সবার ঠেকে বেশি আমার খেয়াল রাখতিস? আমার প্রতি তোর এক্সট্রা কেয়ার কেনো ছিলো?

ব্যাস আর শুনতে পারলোনা বৃষ্টি। মাথাটা ভীষণ যন্ত্রনা করা শুরু করলো, অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে একসময় অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়লো।

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে