Tuesday, July 29, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 59



ফুলকৌড়ি পর্ব-২২+২৩

0

#ফুলকৌড়ি
(২২)কপি করা নিষিদ্ধ
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

সেদিন ঝড়বর্ষনের রাত থেকে আজ ক’টা দিন ইভানকে বেশ ব্যস্ত দেখাচ্ছে।দিনরাতের অধিক সময়টা তাকে বাহিরের ব্যস্ততায় কাটাতে দেখে,নীহারিকা বেগম একটু চিন্তিত হলেন।সবসময় দুষ্টুমির ছলে মজে থাকা ছেলেটাকে হঠাৎ ক’দিন ধরে উদ্বিগ্ন দেখায়।ব্যাপারটা উনার চোখে লেগেছে।কি হয়েছে ছেলেটার?সবার সাথে ছেলেটা মনখোলা হলেও,নিজের বিষয়ে বেশ চাপা স্বভাবের।স্বভাবটা আগে ছিলো না, হঠাৎই পরিবর্তিত হয়েছে।সকালে খাবার টেবিলে ইভানকে পেতেই তিনি খাবার দিতেই, জিজ্ঞেস করলেন।

‘আজ কদিন ধরে তোকে চোখের নাগালে পাওয়া যাচ্ছে না।ব্যাপার কি বলতো?ঝড়বৃষ্টি বলেও কোনো বাঁধা বিঘ্নতা নেই,বাড়িতেই থাকছিস না।কোথায় ঘুরে-ঘুরে বেড়াচ্ছিস?সত্যি করে বলতো,ঠিক কি হয়েছে তোর?

একগাল হেসে দিলো ইভান,সেই হাসিটা কোনো কারনে যেনো উদাসীন দেখালো।যেটা নীহারিকা বেগমের মোটে-ও ভালো লাগলো না।সেই ভালো না লাগাতে আর-ও একটু ঘি ঢালার মতো কাজ করলো ইভানের কথাগুলো—আমাকে সন্দেহ করছো?যে আমি অলস মস্তিষ্কে থেকে থেকে খারাপ ছেলেদের সাথে মিশে সঙ্গ দোষী হয়ে যাচ্ছি কি-না?আমি তোমার বড় ছেলের মতো খুব ভালো নাহলে-ও একবারে মন্দ নই।আমাকে ওরকম সন্দেহ না করতে পারো।পুরোটা নাহলে-ও তোমার ছেলেতো একটু বিশ্বাস রাখতে পারো।

তরকারির বাটিতে চামচটা একটু জোরে শব্দ করে রাখলেন নীহারিকা বেগম।ফের রাগান্বিত স্বরে বললেন- ‘এই আমি কখন তোকে ওরকম ছেলেদের সাথে মেশার ইঙ্গিত দিলাম।আজ কয়দিন সেভাবে বাড়িতে দেখছিনা তাই জিজ্ঞেস করলাম কোথায়’কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছিস! আর তুই কেনো ও-কে নিয়ে সবসময় সকল কথার মধ্যে ঢুকিয়ে এভাবে খোঁচা দিয়ে কথা বলিস?তোর এটা কেনো মনেহয়,আমি শুধু নিভানকে বিশ্বাস করি ভরসা করি,ভালোবাসী,আদর করি, তোকে নয়।কেনো মনেহয় বল?এই তোদের মা আমি।একই পেটে লালিত-পালিত করে জন্ম দিয়েছি।আমি কিকরে তোদেরকে আলাদা আলাদা ভাবতে পারি! তোদের সবাইকে যে সমান ভালোবাসী,এটা কেনো বুঝিস না তোরা!কেনো মনে হয়না তোদের।কেনো মনে হয়না বল?কিজন্য মনেহয় ও-কে আমি বেশি ভালোবাসী,আর তোদেরকে কম।তবে কি এবাড়িতে পা রাখার আগে,সত্যিই কি ও-কে আমার ওবাড়িতে রেখে আসা উচিত ছিলো?

‘মা।

চেচিয়ে উঠলো ইভান।মায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মায়ের মুখের দিকে বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইলো কিয়ৎদক্ষন।আজ হঠাৎ মায়ের কি হলো?যে তার কথাগুলো সিরিয়াসলি নিয়ে নিলো।আশ্চর্য!মা তো কখনো এরকম সিরিয়াসলি নেয়না।তবে?তবে কি ফুপুমনি আবার উল্টাে পাল্টা কোনো কথা শুনিয়েছে?নিশ্চয় তাই হবে।তা নাহলে মা এতোটা সিরিয়াস হয়ে যাওয়ার কথা না।হয়ে যেতোও না।মায়ের আরও কাছাকাছি হলো ইভান।মমতভরা ছলছল চোখদুটো দিকে নজর দিতেই বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠলো ইভানের।মা কষ্ট পেয়েছে!কিন্তু সে তো মা’কে কষ্ট দেওয়ার জন্য কথাগুলো বলেনি।
দ্বিধাহীন হাতদুটো মায়ের কোমল মুখের দু-চোয়ালে রেখে আজলে নিলো ইভান।সহসা কেঁপে উঠলেন নীহারিকা বেগম।ইভানের এতো কোমল আচরনের সাথে তিনি পরিচিত নন।যদিও ছেলেটা সহসা উনার সাথে কখনো খারাপ আচারন করেনা। তিনি মনেমনে একটু বিচলিত হলেন।তবে মুখায়বে প্রকাশ করলেন না।মায়ের রাগান্বিত মুখ মিইয়ে মায়ামায়া করে চাওয়া নজরের দিকে তাকিয়ে বললো।

‘এতোটা রেগে যাচ্ছো কেনো,মা?আমি তো সিরিয়াসলি কথাগুলো বলিনি।তুমিতো খুবভালো করে জানো,আমি দাদাভাইকে ঠিক কি পরিমাণ ভালোবাসি।এটা নিশ্চয় বলে,চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে তোমাকে বোঝাতে হবেনা।তবে কেনো এসব আবোলতাবোল কথা বলে চলেছো মা!তুমি জানো না,পৃথিবীর সবাই এসব বিষয়ে উল্টোপাল্টা কথা বললে আমি সহ্য করতে পারলেও, তুমি বললে আমি সহ্য করতে পারি-না।আমার ভিষন কষ্ট হয়।খারাপ লাগে.. মা।তুমি যেমন মনেপ্রাণে বিশ্বাস করো,ভাবো।তোমার পেটেধরা সব সন্তানেরা তোমার কাছে সমান,কেউ উঁচুনিচু না।তেমন আমি-ও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি,ভাবি।আমার মায়ের পেটে লালিতপালিত হয়ে জন্ম নেওয়া,আমরা ভাইবোনেরা।কেউ আলাদা নই।প্রতিজন মায়েরই একেকটা অংশবিশেষ।মায়ের সন্তান।সেখানে তফাৎ বলে কিচ্ছু নেই।তবে তুমি আমাকে জেনেশুনে কিকরে একথা গুলো মুখে আনতে পারলে?সত্যি তুমি আমাকে দাদাভাইয়ের মতো ভালোবাসো না কমই ভালোবাসাে।না হলে দাদাভাইয়ের সামনে এই কথাগুলো বলার ক্ষমতা ছিলো তোমার?

ইভানের অভিমানী কথায় মমতাময়ী মন আর-ও গলে পড়লো।রাগান্বিত খোলসটা ছেড়ে এবার তিনি ঠান্ডা গলায় বললেন।

‘তবে কেনো উল্টো পাল্টা বলে আমাকে রাগিয়ে দিস?কোথায় যাস,কেনো যাস।আমাকে কেনো বলে যাস-না।
আমি মা না তোদের?তবে কেনো নিজের ভালোমন্দ তোরা মাকে একটু জানাতে পারিস না।কেনো এই বয়সে এসেও অন্যের কাছে আমাকে শুনতে হয়,আমি আমার নিজের পেটের ছেলেমেয়েদের একই নজরে দেখিনা।কে কখন বিপদ আপদ মাথায় নিয়ে কোথায় যাচ্ছে।খেয়াল রাখিনা।শুধু স্বার্থপরের মতো পরের বাড়ী থেকে নিয়ে আসা ছেলেটার প্রতি ভালোমন্দ নজর দেই,খবর রাখি।এসব কেনো শুনতে হয় আমাকে বল?

‘কেউ তোমাকে উল্টোপাল্টা কথা বলে উস্কানোর চেষ্টা করলো আর তুমিও বাচ্চা মেয়েদের মতো অভিমানী হয়ে আবোলতাবোল বলতে শুরু করলে।তবে তুমি-তো দেখি নাফিমের চেয়ে বাচ্চা হয়ে গেলে।তুমি অল্পস্বল্প নয়,উপযুক্ত বিবাহিত বয়স্ক তিন ছেলেমেয়ের মা।এখনকার যুগের ছেলেরা যেসব বয়সে বিয়ে করছে,
তোমার বড় ছেলেকে সেই বয়সে বিয়ে দিলে,এতোদিনে নাতী নানতীর বিয়েটাও তুমি খেতে পারতে।সেই তুমি বাচ্চা মেয়েদের মতো কান্ডকারখানা করছো?

কথাগুলো বলতে বলতে মায়ের সম্মুখ থেকে সরে গিয়ে ফের চেয়ারে বসলো ইভান।নীহারিকা বেগম হতাশ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।এই ছেলের জীবনে সিরিয়াস বিষয় বলে হয়তো কিছুই নেই।কখনো কোনো কিছু যেন
সিরিয়াসলি নিতেই পারেনা।পারেনা কি!নিতে চায়ই-না!নাহলে সিরিয়াস জিনিসটাকে মূহুর্তেই কচুরিপানার মতো ভাসিয়ে দিয়ে বিষয়টা কোনো ব্যাপার না টাইপ গাছাড়া ভাবটা নেয় কিকরে!এই দেখো আবার শুরু করে দিয়েছে।আর নড়েচড়ে সেই নিভানের পিছু লাগা।যদি-ও তিনিও বাচ্চামো করে ফেলেছেন।তবে ধৈর্য্য তো আর মানুষের সবসময় এক রকম থাকেনা।শুনতে শুনতে তিনিও অধৈর্য্য হয়ে পড়েছেন।আর গতকাল তো ইভানের এই বিষয়টা নিয়ে কতোকিছু শোনালেন উনাকে।এটাও শোনাতে বাদ রাখলেন না।-পরের বাড়ির ছেলে সব দখল করে নিয়ে বসে আছে অথচ নিজেদের বাড়ির ছেলের খোঁজ নেই।থাকবে কিকরে!যে মা নিজ সন্তানদের মধ্যে দুইদুই নজরে দেখে,তার কি আর খোঁজ রেখে লাভ আছে।

কালও ধৈর্য্য নিয়ে কথাগুলো শুনেছিলেন।কিছু বলেন নি।আজও ইভানকে এসব কথাগুলো বলতেন-না।তবে কেনো জানেননা ধৈর্যচ্যুত হয়ে গেলেন।আর সেই ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যবান থেকে কথাগুলো বেরই হয়ে গেলো।

‘কি হলো।খেতে দেবে-না নাকি?নাকি আবার-ও বড়ো ছেলের ভবিষ্যৎ ছেলেমেয়ে নিয়ে ভাবতে বসলে।

ইভানের পিঠে জোরে একখান চাপড় মারলেন তিনি।ফের মিছেমিছে রাগ দেখিয়ে বললেন-*আবারও শুরু করে দিয়েছিস?নড়েচড়ে তোর ওর পিছু লাগতে এতো ভালো লাগে কেনো?বলতো একটু?

‘কারনটা হলো,তোমার বড়ো ছেলে প্রচুর ঘাড়ত্যাড়া তাই।আর পিছু লেগেও কি,তাতে তার কোনো হেলদোল আছে!কাজ হয়!কার-ও কথা যেনো তার কানে ঢোকেই না!তাই তাকে তো বলতে পারিনা,তোমাকে বলে নিজের সাধ পূর্ণ করি।বুঝেছো,নিভান ইভানের মা।এবার খেতে দাও।কাজ আছে,যেতে হবে।

ইভানের বলার ভঙ্গিমা দেখে নীহারিকা বেগম সন্দিহান গলায় শুধালেন।–কি কাজ আছে?

‘তোমার বউমাকে উদ্ধার করা।

‘মানেটা কি?বউমা?

‘মা খেতে দাওনা।প্রচুর ক্ষুধা লেগেছে। ওসব মানে-টানে পরে উদ্ধার করো।আগে তোমার ক্ষুধার্ত ছেলের পেট উদ্ধার করো।

নীহারিকা বেগম আর দাড়ালেন না।রান্নাঘরে দিকে এগোলেন ছেলের জন্য খাবার আনতে।টেবিলের খাবার আপতত শেষ।সবাই খেয়েদেয়ে বেরিয়ে গেছে।ইভান এসেছে দেরীতে।নীহারিকা বেগম চলে যেতেই সেখানে হাজির হলো কৌড়ি।কলেজে যাওয়ার জন্য রেডি হয়েই বেরিয়েছে সে। নীহারিকা বেগমকে বলেই বের হবে বলে ডাইনিংয়ের দিকে আসতেই দেখলো ইভান বসা।কিন্তু চুপচাপ।মনেহয় গভীর কিছু নিয়ে চিন্তিত ভাবান্নিত।না হলে তাকে দেখে চুপ থাকার বান্দা তো নয় সে।তাই আজ নিজে থেকে খুঁচিয়ে কথা বললো।

‘কি ব্যাপার বলুন তো?কার বউ ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা ভাবনা করছেন বসেবসে?

মনের কথা যেনো পড়ে নিলো কৌড়ি।ভিতরে ভিতরে একটু চমকালো ইভান।ফের বললো—-নিজের বউকে, কিকরে অন্যের হাত থেকে ভাগিয়ে নিজের কাছে আনা যায় সেই প্লানিং করছি।

‘আপনার মতো ইতুড় মানুষেরও গার্লফ্রেন্ড আছে?

‘না-তো।আমার মতো ইতুড় মানুষের গার্লফ্রেন্ড টেকে, তুমি বলো?তবে তিন কবুল না বলা একটা বউ আছে।সেই না কবুল বলা বউটাকে অন্যের থেকে উদ্ধার করে কিকরে কবুল বলিয়ে নিজের করবো,সেটাই আপতত ভাবছি।

ইভানের প্যাচ লাগানো কথাগুলো সব কৌড়ির মাথার উপর দিয়ে গেলো।কি বলবে কথা পেলো না।তবে মনে মনে ভাবলো,ইভান মনেহয় ফাজলামো করছে।সে-ও আর দাড়লোনা,রান্নাঘরের দিকে যেতে উদ্যোক্ত হতেই ইভান দুষ্ট হেসে বললো—তা তোমাদের প্রেম-সেম কতোদূর এগোলো ফুলকৌড়ি।যদিও ব্যাপারটা প্রেমময় টাইপ নয়,তবে তুমি বললেই কবুল।

মূহুর্তেই সেদিনের হুমকিমুলক কথাগুলো মনে পড়ে গেলো কৌড়ির।হাসফাস করে উঠলো বুকের ভিতরটা।কিছু না বলে ফের চলে যেতে উদ্যোক্ত হতেই মজার ছলে ইভান ফের বললো।—সামথিং সামথিং মনেহচ্ছে?

সহসা উত্তর দিলো কৌড়ি।–সামথিং সামথিং না কচুর মাথা!আপনিতো দারুন খারাপ,সাথে আপনার ওই দাদাভাইটাও সাংঘাতিক খারাপ।

‘কেনো,ওর দাদাভাই তোমাকে কি করলো?

গম্ভীর কন্ঠটা কানে আসতেই বক্ষস্থল ভুমিকম্পের ন্যায় কেঁপে উঠলো।কলিজাটা লাফিয়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো।ইন্নালিল্লাহ,এই মানুষটা এখনও বাড়িতে।জানলে জীবনেও সে এই মানুষটার বিরুদ্ধে একটা শব্দও উচ্চারণ করতো না।এটাই বলে মহা-দূর্ভাগ্য।ভাগ্য কখনো তার ভালো কথা-কাজে সায় দেয়না কেনো?মূহুর্তেই নজর পাংশুটে ধারন করলো তার।মুখাবয়ব হলো ফ্যাকাশে।সেই নজরে ইভানের দিকে তাকাতেই দেখলো,সে মিটিমিটি হাসছে।অসভ্য ছেলেটা সবসময় এভাবেই তাকে ফাঁসানোর ধান্দায় ব্যস্ত থাকে।নিশ্চয় জানতো মানুষটার তার পিছনে।জেনে-বুঝেই তাকে ফাঁসিয়েছে!এখন কি বলবে সে?

‘তুই আবার বাড়িতে।কোনো সমস্যা?

নীহারিকা বেগমের গলা পেতেই হাফ ছেড়ে বাচলো কৌড়ি।বুকে হাত চেপে ঘনোঘনো শ্বাস ফেললো।যাক তবে তাকে আর উত্তর দিতে হবেনা।বাচলো সে।নিভান উত্তর দিলো—প্রয়োজন ছিলো একটু,তাই ব্যাক করতে হলো।

‘ওহ।

মায়ের ওহ শব্দটা শুনে নিভান আর দাঁড়ালো না।নিজের রুমে চলে গেলো।নীহারিকা বেগমও ইভানকে খাবার দিতে ব্যস্ত হলেন।তার ফাঁকে কৌড়িকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন–তুই রেডি হয়ে বেরিয়েছিস?আচ্ছা একটু দেরি কর,নিভান আসুক।আপতত আজ ওর সাথে যা,ও-ই পৌঁছে দেবে তোকে।

কৌড়ি তড়িঘড়ি করে বললো–না না বড়মা।উনাকে আমায় নিয়ে যেতে হবেনা।উনার কতো কাজ,উনাকে আর আামকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ফালতু ঝামেলায় জড়িওনা।আমি একা যাই-তো,আজ-ও
যেতে পারবো।কোনো সমস্যা হবেনা।

‘আমি জানি তুই পারবি।তবুও,ও যখন এসময়ে বের হচ্ছে।তখন আর অযথা রাস্তাঘাটের ঝামেলা পোহানোর দরকার কি?ওর সাথে চলে যা।ও পৌঁছে দিয়ে অফিস চলে যাবে,এটাতে ফালতু ঝামেলা কোথায় মনে হলো তোর?

‘ঠিকই তো বলেছে মা।অযথা রিকশা সিএনজির ঝামেলা না পোহায়ে,চলে যাও দাদাভাইয়ের সাথে।আর
তুমি নিজেকে দাদাভাইয়ের ফালতু ঝামেলা মনে করলেও, দাদাভাই কিন্তু একেবারেই সেটা মনে করেনা।

বলেই দুষ্ট হাসলো ইভান।সেটা দেখে মনেমনে কৌড়ির ভিষন রাগ হলো।মনেমনে ইভানকে ইচ্ছেমতো বকলোও সে।ওই লোকটা আশেপাশে থাকলে তার এমনিতেই অকারণে দম বন্ধ হয়ে যায়,আর সেখানে সে যাবে ওই লোকটার গাড়িতে।কখনো না।যদিও বড়মায়ের মুখের উপর কথা বলা অসভ্যতামী মনে করলো।তবুও নিচু গলায় উনাকে উদ্দেশ্য করে বললো-বড়মা,আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।আমি যেতে পারবো,আসছি।

‘চলো আমি এগিয়ে দিচ্ছি।

পিছে ফিরার আগেই ফের গম্ভীর গলার কথাটা শুনতেই
ফের বুকের ভিতর উথাল-পাতাল শুরু হলো।নজর ব্যথাতুরের ন্যায় অসহায় হলো মূহুর্তেই।সেই অসহায় নজরে ইভানের মুখের দিকে তাকালো।ছেলেটা এমন ভাবে খাচ্ছে,যেনো কতো বৎসরের অভুক্ত সে।আশেপাশে কোথায় কি ভেসে যাচ্ছে ডুবে যাচ্ছে কোনো দিকে খেয়াল ধ্যান নেই তার।

‘তুই এসেছিস।আমি আর-ও তোরসাথে যাওয়ার কথা বলছিলাম।তুইও যখন বলছিস,নিয়ে যা তো সাথে করে ও-কে।কলেজে পৌঁছে দিয়ে অফিসে যাস।

নিভানের উদ্দেশ্য কথা শেষ করে।ফের কৌড়িকে উদ্দেশ্য করে বললো–‘আরেহ দাঁড়িয়ে রইলি কেনো?ওর সাথে চলে যা।

দীর্ঘশ্বাস ফেললো কৌড়ি।উপায় না পেয়ে নিভানের পিছু পিছু এগোতে হলো তাকে।আজ যে কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছিলো!যে এমন একটা মানুষের সঙ্গ পেতে হলো তাকে।যাকে সর্বক্ষণ সর্ব অবস্থায় এড়িয়ে যায়,আজ তারই সঙ্গ।ভেবেই নিঃশ্বাসের চলার গতি ধীমে আসছে তার।ভাবনা সমেত লন এরিয়ায় পা রাখতেই দেখলো,কালো রঙের টয়োটা গাড়িটার ফ্রন্ট সিটের দরজাটা খোলো।অস্বস্তিতে দম বন্ধ হয়ে এলেও পা বাড়িয়ে,আশেপাশে না তাকিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো সে।সঙ্গে সঙে পরিচিত সেই মিষ্টি ঘ্রাণটা যেনো গাড়ীর ভিতরময় সর্বত্র ছড়িয়ে তীক্ষ্ণভাবে নাকে এসে ঠেকলো তার।বেশ কিছুদিন গাড়ীতে উঠার দরূন সিটবেল বাঁধাটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে তার।ত্রস্ত হাতে সেটা বেঁধে নিয়ে চুপচাপ বসে রইলো সে।বাড়ি ছেড়ে গাড়ী চললো তার নির্দিষ্ট গন্তব্যে।শহুরে রাস্তা ধরতেই ভিতরে ভিতরে করা হাসফাস অবস্থাটা কিছুটা কম হলো কৌড়ির।ব্যস্ত রাস্তা।ঘনোঘনো চলা বিভিন্ন যানবাহন।বহু মানুষের চলাচল।বিচিত্রময় দোকানপাট।রঙ বেরঙের বহুতল ভবন।সবকিছু হাসফাস করা মনকে কেমন স্বস্তি দিলো।সেদিকে তাকিয়ে পাশে কে আছে ভুলে যেতে চাইলো কৌড়ি।কিন্তু পাশের জন হয়তো সেই ভুলে যাওয়াটাকে মোটেই মেনে নিতে চাইলোনা।পাশের বসা রমনীটাকে একটু খোঁচাতে ইচ্ছে করলো তার।গম্ভীর নয় বরং স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করলো।

‘বললে না-তো,ইভানের দাদাভাই খারাপ কেনো?তা-ও আবার একটু আধটু নয়, সাংঘাতিক খারাপ!কেনো?সে তোমাকে কি করলো,যে এতো অভিযোগ?

বাহিরের পানে চেয়ে থাকা কৌড়ির,কথাগুলো কানে যেতেই চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো সে।কেনো,কথা না বললে চলছিলোনা তার।কথা না বলে ভালোই ভালো কলেজের সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলে তো পারতো।
তা না!উফফ,কথা বলাটা কি খুব প্রয়োজন ছিলো!আর বললো যখন,এই কথাটাই জিজ্ঞেস করতে হলো!তবে পাশে বসা মানুষটার কথার উত্তর না দেওয়াটা বেয়াদবি মনেহলো, তাই তড়িৎ করে উত্তর দিলো সে।

‘আমি কোনো অভিযোগ করিনি।

মৃদু হাসি ফুটলো নিভানের ঠোঁটে।শ্যামবর্ণ আদলে চমৎকার দৃশ্যমান হওয়া সেই হাসিটা নজরে পড়লো-না কৌড়ির।তবে কৌড়িকে ভৎসনা করতে ছাড়লো না নিভান।বললো।-তুমি হয়তো সত্যি বলছো।আমি হয়তো শুনতে ভুল করেছি।

ফের হাসফাস করে উঠলো কৌড়ির ভিতরের সর্বত্রটা।নড়নচড়ন যেনো ভুলে গেলো সে।খিঁচে বন্ধ রাখা চোখজোড়া খুলে,দুহাত কচলাতে থাকলো সে।গাড়ী চালানোর ফাঁকেও সেটা লক্ষ্য করলো নিভান।কৌড়ির অস্বস্তি আরও একটু বাড়িয়ে দিতে বললো।–তবে ইভানের দাদাভাইয়ের প্রতি অভিযোগ জানালে ইভানের দাদাভাই কিন্তু তোমার প্রতি একটু-ও কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া দেখতো না।বরং সে জানতো,নিশ্চয় সেই অভিযোগে অভিযোগী সে।না-হলে ইভানের শান্তশিষ্ট বউম….

‘সেদিন ছেলেগুলো ওভাবে আপনি মেরেছিলেন তাই না?

নিভানকে কথা শেষ না করতে দিয়ে হঠাৎই কথাটা বলে প্রসঙ্গ এড়িয়ে দিতে চাইলো কৌড়ি।যদিও কথা বলতে তার কঠিন অস্বস্তি হচ্ছিলো,তবুও কথা না এড়ালে নয়।এই মানুষটা যে ওই বেফাঁস মুখো ইতুড়ে ইভানের ভাইয়ার ভাই।এটা ভুলে গেলে তো চলবে না!তাই কখন কি বলে বসে,আর তার প্রতিনিয়ত চলা নিঃশ্বাসটা একেবারে বন্ধ করে দেয়।বলার উপায় আছে!মূহর্তেই গম্ভীর হয়ে উঠলো নিভানের মুখাবয়ব।তীক্ষ্ণ নজরটা পিচঢালা রাস্তায় রেখেই দৃঢ়কণ্ঠে বললো।

‘কেনো?মারাটা ভুল ছিলো নাকি?নাকি তুমি বলতে চাইছো ওরা যে বেঁচে আছে এখনো সেটা ভুল?

আন্দাজে ঢিল মারার মতো কথাটা বলেছিলো কৌড়ি।কিন্তু কথাটা সত্য হবে,এটা যেনো অভাবনীয় না হয়েও অভাবনীয়।সুস্থ হওয়ার পর যখন কলেজে গেলো সে।সেদিনই জানতে পেরেছিলো,ওখানের পরিচিত কিছু লাফাঙ্গা গুন্ডাপান্ডা ছেলেদের কেউ মেরে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছে।তারমধ্যে থেকে দু’জনের মরমর অবস্থা।আইসিইউতে লাইফ-সাপোর্টে রাখা হয়েছে তাদের।ছেলেদের নাম আর চেহারার বিবরণ শুনে কৌড়ি বুঝতে পেরেছিলো,সেদিন ঝড়বৃষ্টির দিনে তার সাথে ঘৃনিত কর্মকাণ্ড করা ছেলেগুলো।মুখে আলহামদুলিল্লাহ বলে মনেমনে সবার মতো সে-ও সেই মানুষটার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলো,যে ওই মানুষরূপে পিশাচগুলোকে মেরে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছে তাকে আল্লাহ হায়াত দান করুক।পরমূহর্তে হঠাৎই ,এই মানুষটার কথাও মনে পড়েছিলো তার।তবে বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি।অথচ সেই ভাবনা থেকে মুখ ফসকে বলে ফেলা কথাটা সত্যি হবে,এটা সত্যিই তার ভাবনাতিত ছিলো।ঘাড় ফিরিয়ে অবাক নজরে,নিভানকে দেখলো সে।একমনে পিচঢালা রাস্তায় নজর নিবিষ্ট রেখে গাড়ি চালিয়ে চলেছে মানুষটা।কতোটা স্বাভাবিক তার মুখাবয়ব। যেনো ছেলেগুলোকে মেরে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে দিয়েও কোনো আফসোস নেই!নেই কোনো অপরাধবোধ!আশ্চর্যতায় মুখ ফসকে কৌড়ি ফের বলে বসলো।

‘ওরকম নিষ্ঠুরভাবে কেউ মারে?কেনো মেরেছিলেন?

গাড়ি থেমে গেলো।রয়েসয়ে কৌড়ির দিকে ফিরলো নিভান।নিজের জায়গায় অবিচল থেকে শান্তকন্ঠে বললো।—কেনো মেরেছিলাম,জানো না তুমি?ওরা তোমার কোথায় ছুয়োছিলো বা ছুঁতে চেয়েছিলো জানা নেই আমার।জানতে চাইওনা আমি।শুধু একটু জেনেছি,ওরা তোমাকে ছুঁতে চেয়েছিলো।আর সেই ছুঁতে চাওয়াটাই ওদের পাপের পুকুরটা পূর্ন করে দিয়েছে।যার ফলসরূপ ভোগটা ওরা পাচ্ছে।আর সেটা তোমার কাছে নিষ্ঠুরতা মনে হলেও,আমার কাছে ওদের মৃতুটাই শ্রেয়!তোমার হয়তো জানা নেই,ওরা নিভানের কোথায় ছুঁতে চেয়েছিলো?

চলবে..

#ফুলকৌড়ি
পর্ব(২৩)কপি করা নিষিদ্ধ।
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

ঋতুতে সময়টা হেমন্তকাল।হালকা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব পড়েছে।রুমের পশ্চিমের জানালা দিয়ে বিকালের নিভে আসা স্বর্নালি রোদটা শরীরে কেমন মিঠামিঠা ভাব দিচ্ছে।নিজের রুমের ছোটোখাটো বেলকনির চেয়ারে বসে আছে কৌড়ি।মান্যতা আপু এখনো ভার্সিটি থেকে ফেরেনি।মৌনতা এই সময়টাতে আপতত ব্যাচে থাকে।আসার সময়টা অবশ্যই হয়ে গেছে।আর নাফিম, তাকে হয়তো বকে ধমকিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে ছোটো-মা।নাহলে বাড়িতে থাকাকালীন ছেলেটা তার রুমেই থাকে।আজ ছেলেটাকে কলেজ থেকে ফিরে এখনো দেখিনি কৌড়ি।খোঁজ নেওয়া উচিত ছিলো।যদিও কৌড়ি খোঁজ নেয়।তবে আজ মনটা তার কোনো কিছুতেই বসছে না। একজন নিজের গম্ভীর কথাকাজ দ্বারা তার মনমস্তিষ্কে জ্বালা বাঁধিয়ে দিয়েছে।বিধায় আজ কলেজের ক্লাসটাও ঠিকঠাক মতো করতে পারেনি সে।শুধু ওই মানুষটাকে আর তার কথাকাজগুলো ভেসে বেড়িয়েছে মন মস্তিস্কের অলিগলিতে।কিসব কথাবার্তা বলে তার ছোট্ট মনটাকে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলে দিলো মানুষটা!ওই গম্ভীর মানুষটাকে,ভাবলেই তার দম বন্ধ হয়ে আসে।সেখানে তাঁকে ঘিরে ওই মানুষটার শান্ত চাহুনি,কিসব আবোলতাবোল বার্তা!উফফ,কখনোই তা কি সম্ভব!কিভাবে সম্ভব!ওই মানুষটা আর সে!ওরে আল্লাহ, কখনোই সম্ভব’না।আর সে-সব কিভাবে ভাবতে পারে মানুষটা।ক্ষনে ক্ষনে এসব মনমস্তিস্কে ঘুরছে,আর বুকটা তার অস্বাভাবিকভাবে কেঁপে কেঁপে উঠছে।বিধায় মন স্থির বসাতে পারছেনা কোথাও।উফফ কি এক জ্বালা বাঁধিয়ে দিলো!অদৃশ্য ভঙ্গিতে মাথা ঝেড়ে মনেমনে বললো–সে আর ভাববে না এসব নিয়ে।আর না সহজে ওই মানুষটার সামনে পড়বে।ফের মনেমনে নিজের মনকে বুঝ দিলো,শহরের ছেলেরা মোটেই ভালো হয়না।আর বড়োলোকর বাপের ছেলেরা তো মোটেই নয়!

মূহর্তেই আবার মনমস্তিস্কের ভাবনা পাল্টে গেলো কৌড়ির।এবাড়ির ছেলেগুলো তো তেমনটা নয়।বিগত দু-মাসে কারও সেরকম কোনো অসংগত আচার ব্যবহার তো পায়নি সে।তবে অকপটে কিকরে বলতে পারে, শহরের ছেলেরা ভালো নয়।পৃথিবীতে ভালোমন্দ মিলে মানুষ।কে ভালো কে খারাপ তার যেনে-বুঝে লাভ আছে কি!দাদিআপা বারবার এসব বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলেছে।কখনো যেনো এসব বিষয়ে মন-কান না দেওয়া হয়।এমনকি যখনই উনার সাথে ফোনে কথা হয়,বরাবরই একটাই সতর্কতা।–খবরদার আপা,ওসব ফাঁদে কখনো পা দিসনা যেনো।পরের বাড়িতে বাপের মান রাখিস।ওসবে জড়িয়ে বাপ মায়ের সম্মান যেনো নষ্ট করিস না।কেউ কখনো যেনো তোর দিকে বা তোর মরা বাপ মায়ের দিকে আঙুল তুলে কথা বলতে না পারে,এমন কোনো কাজ করিসনা মনের ভুলেও।নিজের আচার ব্যবহার নম্র রেখে সবসময় সাবধানে চলাফেরা করবি।আর খবরদার ছেলেদের মন ভোলোনাে কথায় কখনো দূর্বল হবি-না।

হঠাৎ মন খারাপ হয়ে গেলো কৌড়ির।কেনো সে নিজেও যানে না।ফোনের আওয়াজে ভাবনা ছেঁদ হলো তার।উঠে দাঁড়ালো সে।রুমে গিয়ে ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো, তার বান্ধবী বিথী ফোন দিয়েছে।মেয়েটার সাথে যোগাযোগ করেছিল,মান্যতা আপুর ফোন দিয়ে।তারপর মাঝেমধ্যে কথা হতো।এই ফোনটা পাওয়ার পর বিথীকে জানিয়ে দিয়েছে।তারপর প্রায় বিকালে কথা হয় তাদের।কলটা রিসিভ করে সালাম দিয়ে ভালোমন্দ কথাবার্তা সারলো দু’জনে।ফের এটাওটা নিয়ে কথা বলতে থাকলো।কথার একপর্যায়ে বিথীর মনেহলো কোনো কারনে কৌড়ির মন খারাপ।মেয়েটা আজ হা হু ছাড়া সেভাবে কথাই বলছে না।বরং বিথীকে বারবার বলতে হচ্ছে,কৌড়ি শুনছিস?মেয়েটা তখন অমনোযোগীর মতো বলছে,কি বলেছিস আমি খেয়াল করিনি,বুঝতে পারিনি আবার বল।অথচ মেয়েটা এমন তো নয়।তবে আজ কি হলো।কথা প্রসঙ্গে বিথী বললো।

‘এই কৌড়ি কি হয়েছে তোর?,আজ কোনো কারনে কি মন খারাপ?

একটু চমকালো কৌড়ি।কথার মধ্যে নিজের অমনোযোগীতা টের পেলো।সহসা বললো।–আরেহ না।মন খারাপ কেনো থাকবে!

কৌড়ির সহসা উত্তরেও স্পষ্ট দ্বিধা।সেটা বুঝতে পেরে
ওপাশ থেকে বিথী কিছুটা অনুযোগী স্বরে বললো–আগে কিন্তু তুই আমার কাছ থেকে কিচ্ছু লুকােতিস না, আমাকে তোর সবটা বলতিস।একবারে এ টু জেট।আর এখন দূরে গিয়ে পর হয়ে গিয়েছিস,কিচ্ছু বলতে চাস না।

দীর্ঘশ্বাস ফেললো কৌড়ি।সত্যি বলতে বিথী আর তার বন্ধুত্ব শিশু বয়স থেকে,বলতে গেলে স্কুলে পড়ার আগে থেকে।স্কুল যাওয়ার আগ থেকেই মেয়েটা তার খেলার সঙ্গী ছিলো।তারপর একসাথে স্কুল পড়াকালীন গভীর বন্ধুত্ব তৈরী হয়।সেই বন্ধুত্বের জোরে,আলাদা আলাদা বিভাগে পড়া সত্ত্বেও একই কলেজ ভর্তি হয়েছিলো।দুজনের এমন কোনো খুটিনাটি বিষয় নেই।যে তারা দুজনে একে অপরেরটা জানেনা।দু’জনে একজায়গায় হলেই একে অপরের ভালো মন্দটা মন খুলে বলতো, জানাতো।প্রান খুলে গল্প করতো।দুজন দু’জনের যেনো একটা বিশ্বাস,একটা ভরসার জায়গা ছিলো।আর সেই বিশ্বাস ভরসার জায়গাটা সবসময়ের জন্য দু’জনেই অটুট রাখার চেষ্টা করেছে।রেখেছে-ও।তবে নিভানের কথাটা বিথীকে বলতে তার যেনো কেমন একটা অনুভব হচ্ছে। তাই ভিতর থেকে চেয়েও বলতে পারছে না।তবে প্রিয় বান্ধবীটাকে অনুযোগ তো করতে দেওয়া যায়না।তাই বললো।

‘আরেহ তেমন কিছুনা?এমনিতেই মনটা কেমন কেমন করছিলো।কেনো যানি কিচ্ছু ভালো লাগছে না।

‘কিন্তু কেনো?

বলবে না বলবেনা করে-ও কৌড়ি সময় নিয়ে রয়েসয়ে নিভানের ইদানীং তার-প্রতি করা আচার ব্যবহার এবং তার বলা কথাগুলো বিথীকে জানালো।বিথীও চুপচাপ শুনলো।যেদিন থেকে কৌড়ির সাথে যোগাযোগ হয়েছে, সেদিন থেকেই ওবাড়ির সবার কথা টুকটাক শুনছে সে।ইদানীং ওবাড়ির সবার বিষয়ে মোটামুটি ধারণা এসে গেছে তার। সবাই বেশ ভালো মনের মানুষ।তবে যে মানুষটার কথা আজ কৌড়ি বলছে,তারকথা এতোদিনে কোনোদিন কৌড়ির মুখে শোনেনি সে।কি জানি কেমন ছেলেটা।তবে কৌড়ি শান্তশিষ্ট হলেও অবুঝ নয়।যথেষ্ঠ বুঝদার মেয়ে।নিশ্চয় বুঝেশুনে পা এগোবে।তবুও প্রিয় মানুষটার ভালো বিবেচনা করে সর্তকতা সরূপ বললো।

‘তোর কথা শুনে-তো মনহচ্ছে উনি তোকে বেশ পছন্দ করেন।তবে কৌড়ি সাবধান।এটা যদিও আবেগের বয়স যারতার কথায় গলে যাস না যেনো।ওরা শহরের ছেলে।আর শুধু শহরের ছেলে বলে কথা নয়,কার মনে কি আছে বলা তো যায়-না।এখন কিন্তু প্রায়শই মেয়েরা ছেলেদের এমন কথায় দূর্বল হয়ে নিজেদের সবকিছু খুইয়ে চরিত্র হারাচ্ছে।তাই সাবধান।

নিভানকে তার কখনো খারাপ মনের ছেলে বলে মনে হয়নি কৌড়ির।এমনকি সারাক্ষণ তার পিছে লেগে থাকা ইভানকেও না।বিথীর সবকথা মানতে পারলে-ও, কেনো জানি উনি ভালো ছেলে নাও হতে পারে!এই কথাটা মন কিছুতেই মানতে চাইলো না।সেটা বিথীর কথার প্রেক্ষিতে বলেই ফেললো।

‘আমার মনে হয়না,উনি তেমন ছেলে।

আশ্চর্য হলো বিথী।তবে কি ছেলেটার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়লো কৌড়ি।আশ্চর্যতা গলায় জিজ্ঞেস করলো–তবে তুই কি তাকে প্রশ্রয় দিতে চাইছিস?

তড়িঘড়ি করে বললো কৌড়ি–আরেহ না।আমি প্রশ্রয় দেওয়ার কথা বললাম কখন!তবে আমার কেনো জানি মনে হয়-না,তিনি খারাপ মন- মানসিকতার ছেলে।

কথাটা বলে চোখ বুঁজে ফেললো কৌড়ি।সত্যিই কি সে প্রশ্রয় দিতে চাইছে?না-হলে সারাদিন সবকিছু ফেলে ওই মানুষটা মাথার প্রতিটি নিউরনে নিউরনে ঘুরছে কি করে! আর কেনোই বা সে ওই মানুষটার হয়ে সাফাই গাইছে?হোক ভালো বা মন্দ তাতে তার কি!সে তো ওসবে মনোযোগ দিতে চায়না।ডালিয়া ফুপির ভাস্যমতে লোভী হতে চায়না সে।তবে কেনো ওই মানুষটার বিরুদ্ধে উল্টো পাল্টা কথা শুনতে পারছে-না।চাইছেনা মন শুনতে।উফফ,এ কেমন জ্বালা বাঁধলো মনে।বিথীর কথায় ভাবনা কাটলো তার।

‘তুই যে উনার পক্ষ নিয়ে মন্দটা ভাবার আগে ভালো মনোভাবটা প্রকাশ করছিস ওটাইকেই প্রশ্রয় দেওয়া বলে কৌড়ি।তবে সাবধান।ভালো মন্দ বুঝেশুনে।যেমনটা নাহিদ ভাইয়ার ক্ষেত্রে বুঝশুনে চলতিস।তেমনভাবে চলিস,পাখি।আমি কখনো তোর খারাপ খবরটা শুনতে চাই না।এমনকি তুই কোনোপ্রকার পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছিস সেই খবরটা-ও না।তোকে আমি নিজের আপনজনের মতোই ভালোবাসি।এইটা অন্তত বিশ্বাস রাখিস পাখি।

‘আমি বিশ্বাস এবং ভরসা দুটোই করি তোকে।তুই আমার খারাপ চাইবিনা কখনো,এটাও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি।তোকে সেটা বলে বোঝাতে হবেনা।আর সত্যি বলতে,তুই আর দাদিআপা হলো আমার সহজ সরল পথের বন্ধু, সঙ্গীনি।তাদের কথা না মানি কি করে?আমি নিজেকে সাবধানে রাখার চেষ্টা করবো।প্রতিটি পদক্ষেপে পা বাড়ানোর আগে বুঝে-শুনে পা বাড়াবো।ভাবিস-না আমাকে নিয়ে।

‘লাভ ইউ সো মাচ্ পাখি।আমি সত্যি তোর খারাপ চাই না,আমার কথাগুলো তুই অন্যভাবে নিস না।

‘লাভ ইউ সো মাচ্ ট্যু বিথীরানি।আমি জানি সেটা।আর আমি মোটেও তোর কথাগুলো অন্যভাবে নেয়নি।নিচ্ছিও না।

কথার একপর্যায়ে দুই বান্ধবী আবার-ও বিভিন্ন কথায় মত্ত হলো।কথা শেষ হতেই ফোনটা চোখের সামনে নিতেই আবারও,সেই মানুষটার খেয়াল মনের নজরে ভেসে উঠলো।পশ্চিম আকাশে হেলে পড়া তপ্তহীন সূর্যের দিকে তাকিয়ে রইলো নির্বিশেষে।ফের চোখ বন্ধ করে নিতেই ভেসে উঠলো,সেই ধারালো স্থির শান্ত বাদামীবর্ন নজরজোড়া।সুডৌল কাটকাট শ্যামবর্ণ মুখাবয়ব।সেদিন বৃষ্টিভেজা দিনে,তাকে দেখে মানুষটার ক্ষীন হাসি।দুহাত হাটুতে ভর দিয়ে জোরেজোরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা।কাছে গিয়ে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করা,খুব ভয় পেয়েছো তাইনা?এইতো আমি এসে গেছি আর ভয় কিসের?তার নিজ চোখে দেখা সবটা কিকরে ছলনা হয়?তাকে হেনস্তা করার জন্য ওই ছেলেগুলােকে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে দেওয়ার মতো অবস্থা করা।সকালের সোজাসাপ্টা উত্তরটা,ওরা নিভানের ঠিক কেথায় ছুঁতে চেয়েছিলো তোমার হয়তো জানা নেই।এই ইঙ্গিতপূর্ন কথাগুলো তার মনমস্তিস্কে আজ সারাদিন পীড়া দিয়ে চলেছে।এখনো দিচ্ছে।তবে বিথীর বক্তব্য অনুযায়ী তার কেনো জানি মনেহয়,ওই মানুষটার ব্যাক্তিত্বের আড়ালে অন্য কোনো মানুষ নেই।আর যদিও থেকে থাকে তবে কৌড়ির জানি বিশ্বাস সেখানে কোনো ছলনা নেই।এমন বিশ্বাস ভরসা কেনো তৈরী হতে চাইছে?কেনো মনে হচ্ছে মানুষটা একটুও খারাপ নয়?

সৃষ্টিকর্তার ধরাবাঁধা নিয়মানুযায়ী আবারও একটা সকালের সূচনা হলো।নিয়ম অনুযায়ী খাওয়া দাওয়া সেরে যে যার মূখ্য গন্তব্য চলে গেলো।সকাল থেকেই কৌড়ির শরীরটা কেমন যেনো ভালো লাগছে না।ক্ষনে ক্ষনে অসম্ভব পেটব্যথা করছে সাথে পিরিয়ড হওয়ার পূর্বলক্ষণীয়।বিধায় আজ কলেজে যায়নি সে।যেতে মন চাইনি তার।বড়মা,আঙ্কেলের চেকআপে জন্য সকাল সকাল হসপিটালে ছুটেছেন।যাবার আগে তাকে দেখে বলে গিয়েছেন–বেশি শরীর খারাপ লাগলে যাওয়ার দরকার নেই।বাড়িতে পড়াশোনা কর।বিশ্রামও হয়ে যাবে সাথে পড়াশোনাও।

সকালের খাবারটা খেতে একটুও রুচি হচ্ছেনা কৌড়ির।তবুও ছোটোমা কয়েকবার ডাকতে পাঠিয়েছেন।তার না যাওয়াতে শেষমেশ নিজে-ও এসে ডেকে গিয়েছেন।বিধায় নিজের ভালো না লাগাটা একরকম একপাশে ফেলে রেখে ডায়িংয়ের উদ্দেশ্য ছুটলো সে।তবে খাবার উদ্দেশ্য নয় ছোটোমাকে বুঝিয়ে বলার উদ্দেশ্য।ডাইনিংয়ে এসে স্বান্তনা রহমাকে না পেয়ে রান্নাঘরে ঢুকল।কৌড়িকে ঢুকতে দেখেই স্বান্তনা রহমান তড়িঘড়ি করে বললেন।

‘কিচেনে কেনো তুই।ডায়নিংয়ে খাবার দিয়েছি খেয়ে নে।

মানুষ গুলোর ব্যবহার দেখলে মনেহয়,কতো চিরচেনা পরিচিতি তারা।কত-শত আপনজন।অথচ এবাড়িতে এসেছে সে মাস দুই হবে।কিন্তু নিজদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে আর তারমধ্যে কোনো বিষয়ে কখনো তফাৎ করে দেখেনি।কখনো তাদের আচার ব্যবহার তারপ্রতি বিরূপ দৃষ্টি ফেলেনি।কৌড়ির ইদানীং মনেইহয়না,সে এবাড়িতে এই মাস দুয়েক আগে এসেছিলো।তার মনেহয়,সে জন্ম থেকে এবাড়িতে থেকে আসছে।

‘কি হলো,দাঁড়িয়ে রইলি কেনো?কতো বেলা হয়েছে খেয়াল আছে?টেবিলে সব গুছানো,যা খেয়ে নে।

‘আমার খেতে ইচ্ছে করছেনা, ছোটোমা।

চুলায় নরম ডাল খিচুড়ি পাকাচ্ছিলেন স্বান্তনা রহমান।হুট করে শ্বাশুড়িমা খেতে চেয়েছেন।অসময়ে তারই বন্দবস্ত করছিলেন তিনি।কৌড়ি কথাটা বলতেই হাতের কাজ ফেলে রেখে,তার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালেন।সহসা কপালে গলায় হাত উল্টে পাল্টে রেখে বললেন।

‘কেনো ভালো লাগছে-না খেতে?হঠাৎ কোনো কারনে শরীর খারাপ লাগছে নাকি?

‘তেমন কিছুনা।এমনিতেই ভালো লাগছেনা খেতে।

কৌড়ির মুখের দিকে দৃষ্টি ফেললেন স্বান্তনা রহমান।শুভ্র মায়াভরা মুখটা আজ কেমন মলিন মলিন ভাব,সাথে ক্ষনে ক্ষনে কপাল কুঁচকে মেয়েটা ব্যাথা হজম করছে মনেহচ্ছে।ব্যাপার কি?কিছু আন্দাজ করতে পেরে বললেন–পেট ব্যাথা করছে নাকি?

দৃষ্টি নত রেখে কৌড়ি বললো —ওই একটু।

কৌড়ির কথার সুরেই যেনো বাকিটা বুঝে নিলেন স্বান্তনা রহমান।দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।প্রত্যেক মাসে এই সময়ের ব্যথা বেদনা দিয়ে বিভিন্ন সমস্যা পার করার থেকে একটা করে বাচ্চা প্রসব হয়ে যাওয়া ভালো। এটা উনার পিরিয়ড টাইমের জন্য মনে হয়।জানেন না মেয়েটার কি হয়।তবে নিজেরটা দিয়ে উপলব্ধি করে বললেন।

‘অন্যকিছু বানিয়ে দেবো?খাবি?না খেলে আরও খারাপ লাগবে তো!

‘আমার টোটাল খেতে ইচ্ছে করছেনা ছোটোমা।বিশ্বাস করো,খাবার গালে তুললেই বমি আসবে মনেহচ্ছে।

ফের বিড়বিড় করে বললো —বমি আসবে কি,এই সময়টাতে পেটব্যথা মাথাব্যথা হাতপা চিবানো।খাবারে অরুচি এমনকি বমিটাও বাদ যায়না তার।দুনিয়ায় শত অসহ্যতা সব এসে ভর করে শরীরে।

স্বান্তনা রহমান কিছু একটা ভাবলেন।ফের বললেন –আচ্ছা ঠিক আছে।আপতত খেতে হবেনা।তোর দাদুমার জন্য নরম খিচুড়ি রান্না করছি,হয়ে যাক।পাঠিয়ে দিচ্ছি তোর রুমে।খাবার চেষ্টা করিস,নাহলে আরও বেশি শরীর খারাপ লাগবে।মৌনতাকে দেখিস না,এসময়ে তিনদিন বিছানার সাথে লেগে থাকে।যা রুমে গিয়ে বিশ্রাম নে।

এই সময়টাতে তারপ্রতি দাদিআপার যত্ন ছিলেও অমায়িক।অথচ সেই যত্ন এখানেও পাবে আশা রাখেনি কৌড়ি।যদিও মানুষগুলো তার প্রচন্ড খেয়াল রাখে, ভালোবাসে।স্বান্তনা রহমানের কোমল গলার কথাগুলোতে আবেগপ্রবণ হলো সে।খিচুড়ি নাড়াচাড়া করা রান্নারত স্বান্তনা রহমানকে খুব কাছে দাঁড়ালো। দ্বিধান্বিত হয়েও,হঠাৎ পিছে থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে আবেগপ্রবণ গলায় বললো।—তুমি, বড়মা সবাই এতো ভালো কেনো ছোটোমা।

শান্তশিষ্ট মেয়েটা সহজে পাশ ঘেঁষে না।যদিও সম্পর্কটা তাদের অনেকটা আপনজন টাইপ নর্মাল হয়ে গিয়েছে।তবুও মেয়েটা তাদের দেওয়া নেওয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকে।আগ বাড়িয়ে নিজে থেকে কোনো কিছু চাওয়া পাওয়ার চেষ্টা করেনা। এমনকি উনাদের আদর যত্নটাও নয়।সেই মেয়ে আজ উনাকে নিজ ইচ্ছেতে জড়িয়ে ধরেছে।কাছে এসেছে।মমতাময়ী মন আরও নরম হলো উনার।হাতের খুন্তি ছেড়ে,নিজের কাঁধে রাখা কৌড়ির মুখে হাত দিয়ে বললেন।-মা যে তাই।তোদের ভালোমন্দ বোঝাটাই তো আমাদের মায়েদের দায়দায়িত্ব।আমরা না বুঝলে কে বুঝবে শুনি!এখানে মায়েদের বিশেষ ভালো হওয়া লাগেনা।প্রয়োজন পড়েনা। মায়েরা ভালো হোক বা মন্দ,সন্তানের সুখসুবিধা, ভালোমন্দতে তারা কোনো বেনিফিট ছাড়াই মমতাময়ী,স্নেহভাজন যত্নশীল,দরদী।বুঝলি?

‘হুমম।বুঝলাম।

স্বান্তনা রহমানকে জড়িয়ে থাকা অবস্থায় কিছু সময় কেটে গেলো।তিনিও সরতে বললেননা,কৌড়িও সরলো না।কিছুসময় যেতেই তিনি বললেন–এভাবে জড়িয়ে থাকলে আমি কাজ করবো কিভাবে?রুমে গিয়ে বিশ্রাম নে,যা।একটু পরে আমি খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।

রয়েসয়ে সরে দাঁড়ালো কৌড়ি।বললো–কি করতে হবে বলো?আমি তোমাকে করে দিচ্ছি।

‘তুই বললি না তোর খারাপ লাগছে,এখন আবার কাজ করতে মন চাইছে?আর এখানে আপতত কোনো কাজ বাকী নেই,শুধু এই রান্নাটুকু ছাড়া।আর কাজ থাকলেও করা লাগবেও না তোকে।আর যেটুকু আছে,রানি একটু বাহিরে গিয়েছে এসে করে নেবে।

‘আমার খারাপ লাগছে,খেতে ইচ্ছে করছেনা।তবে কাজ করার মতো অসুস্থতা আমি অনুভব করছিনা।

কৌড়ির পানে চাইলেন স্বান্তনা রহমান। কপাল কুঁচকে কিছুটা রাগ দেখিয়ে বললেন–এই তুই মৌনতার মতো মুখে মুখে তর্ক করতে শিখে গেছিস?শিখবি না কেনো, সঙ্গ দোষ বলে কথা।যাই হোক রুমে যেতে বলছি,রুমে যা।

কৌড়ি মুখ ছোটো করে ফেললো।বললো-আচ্ছা যাচ্ছি।

রান্নাঘর থেকে ধীরপায়ে বেরিয়ে এলো কৌড়ি।বেরিয়ে
ডায়নিং স্পেস।সেখানে নজর পড়তেই দেখলো,ইভান চুপচাপ খাবার খাচ্ছে।ছেলেটাক বেশ কয়দিন ধরে সেভাবে বাড়িতে দেখা যায় না।ইদানীং সকালে খাবার টেবিলে ছাড়া তাকে খুব একটা বাড়িতে দেখা যায় না।তবে আজ আর খুঁচিয়ে কথা শুনতে চাইলো না বলে নিজের রুমের দিকে চুপচাপ হাঁটা দিলো কৌড়ি।খেতে খেতে ইভানের নজরে সেটা পড়তেই তিরস্কারপূর্ন গলায় বললো।—বাড়ির বড় বউ।অথচ কোনো দিকে তার নজর নেই।কে খেলো,কে না খেলো।কোথায় কি আছে, কোথায় কি নেই।সেদিকে তার কোনো মন কান নেই।সে আছে নিজের খেয়ালে।বাড়িতে দেবর ননদের মেলা।তাদেরও তো খাতির যত্ন করা বড় বউয়ের দায়িত্ব অথচ তার সেদিকে মন নেই।এ-কেমন বড়ো বউ তুমি ফুলকৌড়ি?আমার দাদাভাইকে দেখো,সে কেমন সব দিকের দায়িত্ব পালন করে চলেছে।অথচ তুমি?সেই দাদাভাইয়ের ব….

কৌড়ির পা থেমে গিয়েছে অনেক আগেই।আর মুখ করুণ করে ইভানের কথাগুলো শুনছিলো।তবে ছেলেটা বলে যাচ্ছে লাগামহীন।যদিও লাগাম রেখে বলে কখন!তাই তাকে থামিয়ে দিতে বললো।

‘ইভান ভাইয়া।আপনার কি সারাদিন এসব উল্টো পাল্টা কথাবার্তা ছাড়া আর কোনো কথা মাথায় আসে-না?

‘এগুলো তোমার উল্টো পাল্টা কথাবার্তা মনেহলো?আশ্চর্য!আর বাড়ির বড় বউ হয়ে দায়িত্বে অবহেলা করলে তো অবশ্যই দেবর ননদের বেশি কথা শুনতেই হবে।এখন থেকে অভ্যাস করে নাও।যাই হোক আমাকে একজগ পানি এনে দাওতো বাড়ির বড় বউমা।

টেবিলের দিকে তাকালো কৌড়ি।সত্যিই জগে একফোঁটাও পানি নেই।সহজভাবে বললেই তো হতো।তারজন্য এতো উল্টো পাল্টা কথা বলার প্রয়োজন ছিলো?দীর্ঘশ্বাস ফেললো কৌড়ি।টেবিলে বসা ছেলেটা ইভান,মাথায় রাখা উচিত ছিলো তার।এগিয়ে যেতে যেতে বললো।

‘পানি লাগবে বললেই তো হতো।আবোলতাবোল বলার কি দরকার ছিলো?আমার না মাঝেমধ্যে আপনার উপর ভিষণ রাগ হয়,কিন্তু রাগটা কিভাবে দেখাবো সেটা বুঝে উঠতে পারিনা বলে রাগটাও আর দেখাতে পারি না।

চমৎকার হাসলো ইভান।কৌড়িকে আরও একটু ক্ষেপাতে বললো–তুমি রাগতেও জানো!এটা তো জানা ছিলোনা আমার।তা রেগে দেখাও দেখি একটু,ভবিষ্যতে আমার দাদাভাইয়ের কপালে কি আছে একটু বুঝে নেই।যদি-ও আমার দাদাভাইয়ের প্রচুর ধৈর্য্য,তোমার মতো শান্তশিষ্ট ফুলকৌড়ির রাগ সহ্য করাটা তার একটা তুড়ির ব্যাপার।যদি-ও আমার সেটা কোনো ব্যাপার বলেই মনে হয়না।

কৌড়ি কোনো জবাব দিলোনা।ডাইনিং টেবিলের কাছা- কাছি রাখা ফ্লিটার থেকে একজগ পানি এনে রেখে দিলো টেবিলে।ফের হুমকি সরূপ বললো–আপনি এই বিষয় নিয়ে আর একদিনও উল্টো পাল্টা কথা বললে আমি বড়মাকে বলে দেবো।

‘আরেহ,তুমি যে এবাড়ির বড় বউমা,এটা তোমার বড়মা ও জানেন।আর তোমার বড়মাকে থোড়াই না আমি ভয় পাই।তবে তুমি যদি দাদাভাইয়ের ভয় দেখাতে,যে দাদাভাইকে বলে দেবে তুমি তবে হয়তোবা কিছুটা ভয় পেতাম।যদিও তুমি বরের কান ভাঙানো টাইপ বউ নও এটা বুঝেই তো আমি তোমাকে আমার বউমনি আর দাদাভাইয়ের বউ বলে মেনে নিয়েছি।

‘আপনি আসলেই খুব খারাপ?

‘সত্যি তুমি রেগে যাচ্ছো দেখি!আচ্ছা রেগে যেও-না।তবে তোমাকে একটা কথা জানানোর আছে?শুনতে চাও?শুনতে না চাইলেও,বাড়ির বড়বউ হিসাবে শোনাটা দায়িত্ব তোমার।

ইভানের ফাজলামো সম্বোধন কানে না তুলে কৌতুহল বশত কৌড়ি বলে ফেললো। –কি?

‘আমার বউটার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছি আমার শ্বাশুড়ি আর শালাবাবু। এখন বলোতো উপায় হিসাবে,আমার কি বিয়েটা ভেঙে দেওয়া উচিত?নাকি তাকে বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে আসা উচিত?

‘সত্যি আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে?আর আপনি বিয়ে করবেন?

‘কেনো?আমি কি দেখতে শুনতে খারাপ, যে আমার গার্লফ্রেন্ড থাকতে পারেনা? নাকি আমার বিয়ে করতে মানা?

কৌড়ি বেজার মুখে বললো–আমি কিন্তু সেটা মোটেই বলিনি।আপনি শুধু শুধু কথা ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা বাড়ান।আমি বলতে চাইছি, আপনার সত্যি গার্লফ্রেন্ড আছে কি-না?

আবার-ও গাল ভরে হেসে দিলো ইভান।ফের বললো–‘আরেহ,মুখ ওরকম পেঁচার মতো করে ফেললে কেনো ফুলকৌড়ি।তুমি আমার বড় বউমনি না,মায়ের মতো ধৈর্য্য রাখবা সবসময়।আর সেদিন না বললাম আমার গার্লফ্রেন্ড নেই আর ও গার্লফ্রেন্ড নয়।বিয়ে না করা বউ,বুঝলে?আমি তাকে গার্লফ্রেন্ড নয় বউ বানাতে চেয়েছিলাম।এখন কি করা যায় সেটাই বলো?বিয়ে করে তোমার জা বানিয়ে নিয়ে আসি,কি বলো?

‘আপনি আপনার দাদাভাইয়ে আগে বিয়ে করবেন বলছেন?

‘কেনো,দাদাভাইয়ের আগে বিয়ে করলে সমস্যা কোথায়?মান ইজ্জত যাবে বলছো?সে যায় যাক,তবে যাকে বউ করবো বলে ভাবছি তাকে তো আর অন্য কারও হতে দেওয়া যায়-না।মানা মুশকিল হয়ে যাবে।
সেজন্য বিয়ে তো আমাকে করতেই হবে।আর দাদাভাইয়ের জন্য তুমি টেনশন নিও-না।তারজন্য তো তুমি কনফার্ম সিলেক্টেড।সে এখান থেকে দশসেকেন্ড পরে হোক বা দশবছর পরে,বউতো তুমি দাদাভাইয়েরই হবেই।

কৌড়ির যেনো সয়ে গেছে ইভানের এসব কথাবার্তা।তবে আর ভালো লাগছে না ঘুরেফিরে সেই মানুষটাকে নিয়ে তাঁকে পেঁচিয়ে কথা বলাগুলো শুনতে।কেনো জানেনা,মন খারাপ হয়ে যায় তার।বিথীর কথাগুলো মনে পড়ে যায়।তবে মন এটাও বলে আর যাই হোক,মানুষটা চারিত্রিক দিক দিয়ে মোটেই খারাপ নয়।
কৌড়ির ভাবনার মধ্যে নিভান এসে চেয়ার টেনে বসে পড়লো।চেয়ার টানার মৃদু শব্দ কানে যেতেই খেয়ালী হলো কৌড়ি।ইভানের সম্মুখীন অপরপাশের চেয়ারটাতে,পুরো ফর্মাল ড্রেসআপে সেই মানুষটাকে দেখে অযাচিত কারনে বক্ষস্থল কেঁপে উঠলো তার।সঙ্গে সঙ্গে নজর ফিরিয়ে নিয়ে,নিজের রুমের দিকে যাবার উদ্যোগ নিতেই ভারী কন্ঠের আওয়াজে থেকে গেলো পা।

‘কৌড়ি,আমার খাবারটা ছোটোমাকে দিতে বলো-তো?

আপনি আমার নাম ধরে কখনো ডাকবেন নাা।আপনার মুখে আমার নামটা নেওয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ!না-হলে অকালে আমার মৃত্যুর জন্য আপনি দ্বায়ী থাকবেন। কথাগুলো ওই মানুষটাকে উদ্দেশ্য করে খুবই বলতে ইচ্ছে করে কৌড়ির।তবে চাইলেই কি আর সব ইচ্ছেটা পূর্ণ হয়।যেমনটা সে মনেমনে ইচ্ছে পোষণ করেছিল,এই মানুষটার সামনে সহজেই পড়বেনা।অথচ পড়তেই তাকে হলো।উফফ..

পিছে ফিরলো না কৌড়ি।আবারও রান্নাঘরের দিকে হাঁটা দিলো।অন্যদিন গলা চড়িয়ে রানিসাহেবাকে ডেকে বলে আর আজ তাকে ঘটক ধরলো কেনো?ধরবে নাই বা কেনো!এদের দু-ভাইয়ের জন্মশত্রু তারসাথে।তাকে না জ্বালালে হয়!তাহলে শান্তিতে থাকবেন কিকরে উনারা।একজব জ্বালাতে জ্বালাতে সবে ক্ষান্ত দিয়েছে।তো আরেকজন এসে হাজির।মনেমনে কতশত প্রলাপ বকতে বকতে রান্নাঘরে গিয়ে স্বান্তনা রহমানকে জানালো,তাদের নবাবপুত্র এসেছে।ভাত রুটি বাদ দিয়ে তাহার স্পেশাল খাবার চাইছে।সকালের ভারী খাবারটা নাকি তাহার মুখে রোচে না।হালকা খাবারেই তিনি সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পার করে দেন।এই স্যান্ডউইচ জেলি আর একমগ কফি।এই সাধারণ অল্প খাবারেই নাকি তিনি অভ্যস্ত।কৌড়ির বুঝে আসেনা,এটুকুও খাওয়ার দরকারটা কি!না খেলেই তো পারে।যদিও উনার ইনকাম,তিনি খাবেন নাকি বাঁচাবেন সেটা তিনি বুঝবেন।তবে তাকে মাঝখানে ঘটক ধরে অস্বস্তিতে ফেলার প্রয়োজন কি?

‘ধর।

ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বে-ও খাবার ট্রেটা হাতে নিলো কৌড়ি।স্বান্তনা রহমান বললেন—ট্রে-তে পানির গ্লাস দেই-নি।পানিটা একটু কষ্ট করে ওকে ঢেলে দিস।ছেলেটা সহজে বাড়িতে খায়না।আর খেলেও সীমিত।সেখানে ত্রুটি রাখলে চলে?আর অন্যদের মতো সামনে পেলেই খেয়ে নেবে।এমনটা নয় ও।নিজে তো কিছু নিয়ে খাবে না, এমনকি পানিটুকু টেবিলে না পেলে সেটা না খেয়ে চলে যাবে।তাই ওর বেলায় একটু খেয়াল রাখতে হয়।

আশ্চর্য হলো কৌড়ি।-পানিটাও ঢেলে খেতে পারবে-না।যেখানে ইভান ভাইয়া,খাবার সামনে পেলেই চুপচাপ খেয়ে যায়।সেখানে ইনিতো দেখি নাফিমের চেয়ে আরও দুকাঠি উপরে।

‘যা।আবার দেরী হলে না খেয়ে চুপচাপ চলে যাবে!

মনের ভিতরে একগাদা অস্বস্তি নিয়ে আবার ডায়নিংয়ের দিকে পা বাড়ালো কৌড়ি।এই নবাব সাহেবের বউ যে হবে।তাকে তো সেবাযত্ন করতে করতে জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে যেতে হবে।খাবারের ট্রেটা কোনোমতে নিভানের সামনে টেবিলের উপর রেখে চলে যেতে উদ্যোগক্ত হতেই ফের নিভান বললো।

দাঁড়াও।

পুনরায় পা থেমে গেলো কৌড়ির।সামনে বসা ইভানের দিকে তাকালো সে।মিটিমিটি হাসছে আর খাচ্ছে ছেলেটা।সেই মিটিমিটি হাসিটা তাকে যেনো অদৃশ্য ভঙ্গিতে ভৎসনা করে বলছে–কি ব্যাপার ফুলকৌড়ি!দাদাভাইয়ের কথা দেখি অক্ষরে অক্ষরেই পালন করে চলছো।ব্যাপার স্যাপার কি বল-তো,ফেঁসে গেলে নাকি?নাকি ভিতরে ভিতরে কিছু-মিছু চলছে?হুমম?

মনেমনে ভাবলে-ও দুই ভাইয়ের ভাবসাব এমন যেনো কেউ করাও কথাকাজে নেই।ইভান খেয়ে উঠে চুপচাপ চলে গেলো।যাবার আগে কৌড়ির দিকে ফিরে একগাল হেসে দিয়ে গেলো।ইভান চলে যেতেই নিভান বললো।

‘বসো।

কথাটা স্পষ্ট শুনতে পেলেও কৌড়ি গাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।সেটা বুঝতে পেরে খাবারের ট্রে থেকে নজর হাঁটিয়ে কৌড়ির পানে চাইলো নিভান।সঙ্গে সঙ্গেই সামনের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো কৌড়ি।মনেমনে হাসলো নিভান।এইতো বাধ্য মেয়ে।ফের অতি স্বাভাবিক গলায় বললো।

‘যার দৌলতে শ্বশুর শ্বাশুড়ি ননদ দেবরের সেবাযত্ন করে চলেছো,তাকে সেবাযত্ন করতে সমস্যা কোথায়? আমার জানামতে আগে তাকে সেবাযত্ন করে সময় বাঁচলে তারপর,ননদ দেবর বা অন্যঅন্য পারিপার্শ্বিকতা।কিন্তু তুমি দেখি ভিন্ন পথের যাত্রী। আগে পারিপার্শ্বিকতা তারপর যার দৌতলে ননদ দেবর শ্বাশুর শ্বাশুড়ি পেলে,শেষে গিয়ে সে।তবে তুমি মানলেও,এটা কিন্তু সে মানতে নারাজ।প্রিয় মানুষটা বলতে সে কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে হিংসুক ছেলেটা।

কৌড়ির মনেহলো,সে মরে যাক।অবশ্যই বুকের যন্ত্রটা যে বেগে লাফাতে শুরু করছে,মরণ তার হতে সময় লাগবেনা।অথচ সামনের মানুষটা নির্বিকার খাবারের দিকে মনোযোগী।তারদিকে চেয়ে নেই।অথচ পৃথিবীর সমস্ত অস্বস্তি লজ্জা যেনো ঠেলে তার সমস্ত অঙ্গে মাখিয়ে দিয়েছে।কেনো বলছে এমন মানুষটা!কেনো বুঝতে পারছেনা,সে লোভী হতে চাইছেনা!

স্যান্ডউইচ খাওয়া শেষে কফির মগটা হাতে নিলো নিভান।মাথা উঁচু করে কফির মগটা ঠোঁটে ছোঁয়াতেই, অস্বস্তিতে গাট হশে বসে থাকা কৌড়ির পানে নজর স্থির করলো।সঙ্গে সঙ্গেই চোখ নামিয়ে নিলো কৌড়ি।
এখান থেকে উঠার জন্য হাত পায়ের কচলানো বাড়লো যেনো।সেটা দেখে,সময় নিয়ে নিভান বললো।

‘তোমার পরামর্শ দাতা খুবই অনেস্ট।সাথে বিশ্বাসযোগ্যও।আর তারপ্রতি তোমার বন্ধত্বের ভরসা ও বিশ্বস্ততা মুগ্ধকর।বিধায় আমার দিকে তোমাকে একধাপ বাড়িয়ে দেওয়ার বদৌলে পিছিয়ে দেওয়াটাকে কিছু বলছিনা,আর বলবোও আমি।তবে তুমি আমাকে বিশ্বাস করেছো, এটা তোমার দিকে আর-ও একধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে আমাকে।

বিস্মিত হলো কৌড়ি।একটু নয় অনেকখানি।অস্বস্তি লজ্জা ভুলে নিভানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো সে।
মানেটা কি?প্রথমে কথাগুলো না বুঝলেও,নিভান কথা এগোতেই বুঝতে পারলো।কালকে বিথী আর তার কথোপকথনের কথা বলছে মানুষটা।তবে তাদের কথা শুনলো কোথা থেকে?আর কিভাবে?আশ্চর্য! তার রুমে কখনো মানুষটা আসবে বা আসতে পারে এটা কখনোই বিশ্বাস করে না সে।আর আসিওনি যে।এটা নিজের চোখে দেখা।তবে কি করে?শত প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো কৌড়ির।তবে না সামনের ব্যক্তিটাকে প্রশ্ন করতে পারলো আর না তার সমাধান মিললো।কৌড়ির আশ্চর্য হওয়ার কারন বেশ বুঝলো নিভান।মৃদু হাসলো সে।কফি শেষ হতেই উঠে দাঁড়ালো।
তখনও কৌড়ি বিস্ময় নিয়ে হা হয়ে তাকিয়ে।সেই ডাগরডাগর কাজল কালো সচ্ছ চোখের পানি তাকিয়ে হঠাৎই তারদিকে ঝুকলো নিভান।সঙ্গে সঙ্গে চোখজোড়া বন্ধ করে পিছে সরে গেলো কৌড়ি।সেটা দেখে নিভানের মৃদু হাসি চওড়া হলো।চাপাস্বরে বললো।

‘তোমার ফ্রেন্ড ভুল কিছু বলেনি,শুধু ভুল মানুষের দিকে অবিশ্বাসের আঙুল তুলে দিয়েছে।তবে আমাকে বিশ্বাস করার জন্য,আমার পক্ষ থেকে তোমার পাওনা উপহারটা আপতত আমি সযত্নে আমার কাছেই গুচ্ছিত রাখলাম।তোলা রইলো।আমাদের কাছাকাছি আসাা যতো দেরী হবে, ততোই সুদের হারটা বাড়তে থাকবে।আর অপেক্ষার প্রহর যেদিন অস্তমিত হবে,সেদিন উপহারের আসলটাসহ শতগুনরূপে সুদটা ফেরত পাবে তুমি।খুব সযত্নে হালালরূপে ফিরিয়ে দেবো আমি।যতোই পিছু হাঁটো না কেনো,নিভানের দিকে এগোনো ছাড়া পিছাতে পারবেনা তুমি।

চলবে…..

ফুলকৌড়ি পর্ব-২০+২১

0

#ফুলকৌড়ি
(২০)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

সারাদিন তুমুল ঝড়-বর্ষনের পর রাতে গিয়ে নিস্তব্ধ হলো প্রকৃতি।যদি-ও রাত, তবু-ও বাহিরের পরিবেশটা ঘোর আমাবস্যা ন্যায় ঘুটঘুটে আঁধার।শীতল ভাবটা যেনো মাঘের কনকনে ঠান্ডাভাব!সেই ঠান্ডাভাবটা আর-ও বাড়িয়ে দিচ্ছে,মাঝেমধ্যে গ্রীল ভেদ করে আসা মৃদুমন্দ বাতাসে।অতি শীতল ঠান্ডাভাব আবহাওয়ার মধ্যে-ও বেলকনিতে সটান দাঁড়িয়ে আছে নিভান।গায়ে পাতলা টিশার্ট।বলিষ্ঠ দেহটা ক্ষনে ক্ষনে ছুঁয়ে যাচ্ছে শীতল বাতাসে তবু-ও নড়চড় নেই তার।ট্রাউজারের দু-পকটে দু-হাত গুঁজে স্থির পায়ে দাঁড়িয়ে আছে সে।পলকহীন শান্ত,সুগভীর নজরজোড়া তার ঘুটঘুটে আঁধারে আচ্ছন্ন প্রকৃতিতে।জানোয়ার গুলোকে ইচ্ছেমতো পিটিয়ে এসেছে সে।যদি তৃনয় না ঠেকাতো তবে আজ মৃতলাশে পরিনত করে আসতো সবকটাকে।যদি-ও নিঃশ্বাস নেওয়ার অবস্থায় ছেড়ে আসেনি।যদি কোনোক্রমে বেঁচে যায়,তবে ওদের হাত পা হাড়গোড় ঠিকঠাক হতে কতো মাস সময় লাগবে তারও ঠিক নেই।তবু-ও এতো মেরেও শান্তি মেটেনি নিভানের।মনে হচ্ছিলো,সবগুলোর আত্মা বের করে,মৃত লাশে পরিনত করে তারপর ছেড়ে আসতে।

কৌড়িকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তখন ওই অবস্থায় বের হয়ে,তৃনয়কে ফোন দিয়ে সাথে নিয়েছিলো সে।তারপর ছেলেগুলোর বিষয়ে তথ্য নিয়ে খুঁজে খুজে বের করতে যেটুকু সময় লেগেছে।কলেজের আশেপাশে একটা বদ্ধ ঘরে জুয়া খেলছিলো আর হাসি তামাশা করছিলো জানোয়ারগুলো।বিষয়টা কৌড়িকে নিয়েই ছিল।ওদের মধ্যে একজন লালসিত অঙ্গিভঙ্গি করে বলছিলো যে–ওই সিনজিওয়ালা যদি তখন মাঝখানে এসে সময়টা ওয়েস্ট না করাতো তবে ওমন সুন্দর চিকনাচামেলি ময়না পাখিটা আজ তাদের হাতের মুঠোয় থাকতো।হাতছাড়া হতোনা।আর হাত ছাড়া না হলে এই ওয়েদারে ময়নাটাকে ভোগ করতে কি মজাটাই না পেতো!ইশশ!তন্মধ্যে একটা ছেলের গলায় তখন-ও কৌড়ির ওড়নাটা ঝুলতে দেখে নিজেকে আর কন্ট্রোল রাখতে পারি-নি।ছেলেগুলো কিছু বুঝে উঠার আগেই,সাথে নিয়ে যাওয়া হকিস্টিক দিয়ে এলোপাতাড়ি ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে।তাদের আকুতি-মিনতি,জ্বালা-ব্যথা কোনোপ্রকার বাক্য কানে তোলেনি নিভান।শুধু মনের জ্বালা অনুযায়ী ইচ্ছেমতো ছেলেগুলোর যেখানে খুশি সেখানে মেরেছে।প্রথমে তৃনয় সাথে থাকলেও,যখন দেখলো নিভান, আউট অফ কন্ট্রোলে গিয়ে ছেলেগুলোকে পেটাচ্ছে।আধমরা হয়ে গেছে,নাকমুখ দিয়ে রক্ত ছুটছে তখন-ও ছাড়ছে-না।তখন গিয়ে নিজের হাতের হকিস্টিকটা ফেলে দিয়ে নিভানকে বাঁধা দিতে ব্যস্ত হলো তৃনয়।শক্তপোক্ত বলিষ্ঠ দেহের নিভানকে একা সামলিয়ে উঠতে পারা মুশকিল!পারছিলো না তৃনয়।কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছিলো,তবুও নিজের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে,বিভিন্ন কিছু বলেকয়ে তারপর তাকে ঠান্ডা করতে হয়েছে তাকে।না-হলে ওই জানোয়ার গুলোর দাফন করেই তারপর তবে বাড়ি ফিরতো!নিভানকে এতোটা উদভ্রান্ত হতে আগে কখনো দেখিনি তৃনয়।বিধায় আশ্চর্য হয়ে তখন তাকে থামাতে বলতে বাধ্য হয়েছে—পরের বাড়ির একটা মেয়ের জন্য তুই এভাবে নিজেকে কেনো খুনী প্রমান করার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছিস?বাড়ির মেয়েকে উত্যক্ত করেছে,অসম্মান করেছে!মারতে এসেছি,ব্যাস!মেরেছি!তারজন্য খুন করে ছাড়বি নাকি?

তৃনয়ের কথার উত্তর সরূপ মুখে কিচ্ছুটি বলতে পারিনি নিভান।শুধু অসহায়,পাগল পাগল নজরে তারদিকে তাকিয়ে ছিলো।সেই নজরে যেটা বুঝে নেওয়ার সেটা বুঝে নিয়েছিলো তৃনয়।বিস্মিতও হয়েছিলো,এটা ভেবে।যে তার সবসময়ে গম্ভীর হয়ে থাকা তীক্ষসম্পূর্ণ, বুদ্ধিমান বন্ধুটা একটা বাচ্চা মেয়েতে মন হারিয়েছে।সেই মেয়েটাকে উত্যক্ত করার জন্য এতোটা উদভ্রান্ত!এতোটা পাগল পাগল ভাব!তৃনয়ের সেই বিস্মিত ভাবটা আরও বাড়িয়ে তখন নিভান শক্তগলায় বলেছিলো।

‘ও শুধু পরের বাড়ির মেয়ে নয়,তৃনয়।ওর দিকে নজর দেওয়া তো অন্যায় ছিলো!আর সেই অন্যায়টা তো ওরা করেছেই!সাথে ওকে ছুঁতে চেয়ে সেই অন্যায়টা পাপে পরিনত করে ফেলেছে।তারজন্য আমার হাতে খুন হওয়া তো ওদের প্রযোজ্য।ওরা নিভানের ঠিক কোথায় ছুঁয়েছে,ওদের জানা নেই।যদি ওরা বেঁচে ফিরে,তবে রন্ধ্রে রন্ধ্রে টের পাবে।নিভান আওসাফ আহমদের ঠিক কোথায় হাত দিয়েছিলো ওরা।

তারপর আর তৃনয় একটা-ও কথা বাড়াইনি।নিভানের অনুভূতি মেয়েটাকে নিয়ে ঠিক কতোদূর গড়িয়েছে।সেটা নিভানের কথা কাজে বেশ ভালোভাবে অনুধাবন করতে পেরেছে।কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চোখ বুঁজে নিলো নিভান।মূহুর্তেই বদ্ধ নজরে ভেসে উঠলো,স্বপ্নে দেখা সেই ক্রন্দনরত চোখজোড়া।যা আজকের ক্রন্দনরত চোখজোড়ার সাথে মিলেমিশে একাকার।সেই স্বপ্নে দেখা ক্রন্দনরত চোখজোড়ার সাথে আজকের চোখজোড়ার নতুন করে মিল পেয়েছে, এমনটা নয়!মিল তো সে সেদিনই পেয়েছিলো যেদিন নাফিমের বাহুভেদ করে ভয়ার্ত চোখজোড়া উঁকি দিয়ে তাকে দেখেছিলো,সেদিনই।তবে সেবিষয়ে অবুঝ শিশুটি হতে চেয়েছিলো সে।পারলো কোথায়!বরং সেসব স্মৃতি তার হৃদয়ে মস্তিষ্কে জোকের মতো জেঁকে ধরে বসে আছে।স্মৃতিকে মধুরতা করতে,শীতল একদল বাতাস তখন সঙ্গী হয়ে ছুয়ে দিলো তাঁকে।নিজের অনুভূতি প্রকাশে বরাবরই সে অক্ষম হলেও,আজ তৃনয়ও খুব ভালোভাবে বুঝে গিয়েছে,কৌড়িকে নিয়ে তার অনুভব।এখন আর-ও একজন জানবে।যদি-ও তাতে তার সমস্যা নেই।তবে ইভানের ব্যাপারটাতে এখনো সে ক্লিয়ার নয়।তবু-ও নিজের মনকে তো শান্ত করতে হবে তাকে!ওই অসুস্থ মেয়েটাকে না দেখা পর্যন্ত তো ভিতরটাকে শান্ত রাখতে পারছেনা।আর না মিলছে নিজের শান্তি।আর না পারছে নিজের ক্লান্ত শরীরটাকে বিছানায় আরাম দিতে।

চোখ খুললো নিভান।আবার শান্ত নজর ফেললো বাহিরের নিকষ কালো আঁধারে!বাড়িতে আসার পর শুনেছে,কৌড়ির প্রচন্ড জ্বর!কড়া ডোজের ঔষধেও নাকি জ্বর নামেনি।ডাক্তারের কাছে না গেলেও,পরামর্শ নেওয়া হয়েছে। আপতত আজকের রাতটা দেখে কালকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে বলা হয়েছে। মা, এমনটা জানিয়েছেন তাঁকে।সেখান থেকেই নিজের দেহের বাহিরটাকে স্বাভাবিক আর শান্ত রাখতে পারলে-ও, ভেতরটাকে নিয়ে প্রচন্ডভাবে অশান্ত সে।দুদন্ড একজায়গায় বসে,শুয়ে,দাঁড়িয়ে শান্তিতে থাকতে পারছে না সে।না পেরে নিজের মনো-শান্তির জায়গা বেলকনিতে চলে এসেছে।তবু-ও শান্তি মিলছে কৈ!
ক্ষনিকের জন্য নিজেকে শান্ত রাখতে পারলে-ও মন মস্তিষ্কে চলছে তার,কৌড়ি কৌড়ি কৌড়ি!এই মেয়ে তাকে সত্যিই পাগল করে দেবে।

নিজেকে আর কতো দমিয়ে রাখবে!এতোযাবত সকল বিষয়ে নিজের ধারালো ব্যক্তিত্ব আর নিজের সিদ্ধান্তকে কঠিনরূপে গুরুত্ব দিয়ে এসেছে সে।সেখানে নিজের কাছের মানুষগুলো ছাড়া প্রধান্য পায়নি কেউ।অন্যের ভালোমন্দ মন অতোটাও গুরুত্ব দিয়ে দেখিনি। পায়-নি তার মন মস্তিকে গুরুত্ব। আর আজ,ওই মেয়েটার কাছে সেই কঠিন ব্যক্তিত্ব ঠুনকো হয়ে গেলো!মন মস্তিস্ক হয়ে গলো পরাজিত!সে, ওই মেয়েটার কাছে পরাজিত সৈনিক!দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিভান।নজরজোড়া ফের বন্ধ করে নিয়ে মৃদুস্বরে আওড়ালো।–তবে তার কাছে পরাজিত সৈনিক হতে ক্ষতি কোথায়!নেই ক্ষতি।

নিজের ব্যক্তিত্বের কঠিন্যত্ব বজায় রেখে নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে রাখতে পারলে-না নিভান।পা বাড়ালো, নিজের তোলপাড় হয়ে যাওয়া অশান্ত ভিতরটাকে পরম শান্তি দিতে।যাওয়ার সময় রুম থেকে নিজের ফোনটা নিতে ভুললো না।কৌড়ির রুমের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু একটা ভাবলো।হয়তো মন দোনো-মোনো করলো..এই এতো রাতে মান্যতার বিস্ময় বাড়িয়ে দিয়ে,মেয়েটার কাছে যাওয়া ঠিক হবে কি-না?এই ঠিক হবে কি-না,শব্দটা মস্তিষ্ক ভাবতেই।ভিতরটা আরও উতলা হলো।বুঝলো,মেয়েটাকে না দেখা পর্যন্ত আজ তার কোনোক্রমে নিস্তার নেই।দরজা বন্ধ।মান্যতাকে ফোন দিলো সে।আজ মান্যতা,কৌড়ির সাথে রয়েছে এটা সে জানে।প্রথমবার কল রিসিভ হলোনা।দ্বিতীয়বার আবারও কল দিলো নিভান।একটানা কল বেজে যাওয়ার পর শেষে গিয়ে রিসিভ হলো।ওপাশ থেকে মান্যতা কিছু বলার আগেই,এপাশ থেকে কিছুটা উদ্বিগ্ন গলায় নিভান বললো।

‘দরজাটা খোল মান্য।

বিস্ময়ের চুড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেলো মান্যতার ভাবনারা।এমনিতেই এতো রাতে দাদাভাই ফোন দেওয়াতে সে বেশ আশ্চর্য।তারউপর দাদাভাই যেটা বললো সেটা কি বাস্তব নাকি সে এখনো ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে চলেছে?নিজ হাতে চিমটি দিলো মান্যতা।ব্যথা পেতেই চোখমুখ কুঁচকে ফেললো।সত্যি জেগে আছে সে!তবে এতোরাতে কৌড়ির রুমে দাদাভাইয়ের কি দরকার?শত ভাবনা মনের মধ্যে ঘুরপাক খেলেও,উত্তর নেই।গায়ের কথাটা ফেলে উঠে দাঁড়ালো মান্যতা।দরজা খুলতেই তার দেখে আসা এতোযাবতকালের,উল্টো মানুষটাকে দেখলো সে। এরকম উদভ্রান্ত চেহারা,অসহায় নজর। এরআগে কখনো এই মানুষটার মধ্যে লক্ষ্য করেছে বলে মনে হয় না মান্যতার।অবাক হয়ে শুধু সামনে দাড়ানো মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো সে।সামনে দাড়ানো মানুষটাও বুঝি ছোট বোনটার চাহুনিতে একটু অপ্রস্তুত হলো।তবুও অন্তরের অশান্ততায় মুখ তাকে খুলতেই হলো।

‘আমি ভিতরে যেতে চাই মান্য।

বিস্ময় বাড়লো বৈ কমলোনা মান্যতার।তবে নিভান কথাটা বলতেই ফটাফট পা পিছে নিয়ে সরে দাঁড়ালো সে।ভিতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো নিভান।নিভানকে দরজা লাগাতে দেখেই মান্যতার যেনো হুঁশ ফিরলো।নারীমন চেনা-জানা ভাইটার অচেনা রূপ দেখে বুঝতে চাইলো বা বুঝে নিলো অনেক কিছু।নিভান দরজা লাগিয়ে পিছে মুড়ানোর আগেই,দ্রুত পা চালিয়ে বেলকনিতে চলে গেলো মান্যতা।দাদাভাইয়ের মনে কৌড়িকে নিয়ে কিছু চলছে,ভাবতেই সমস্ত শরীর শিরশির করে উঠলো তারও।না চাইতে-ও বেলকনির জানালায় নজর দিলো সে।বিস্ময়ে চোখ স্থির হয়ে গেল তার।এই মানুষটা তার দাদাভাই নিভান!কখনোই হতে পারে না!

দরজা লাগিয়ে সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো।মোটা কম্বল জড়িয়ে,শান্ত বাচ্চাটার মতো ঘুমিয়ে থাকা কৌড়িকে।বুকের স্পন্দন বেড়ে গেলো নিভানের।পৃথিবীর সব সুখ মনেহয় ওই মুখে লেপ্টে আছে,নাহলে তার অশান্ত মনটা মূহুর্তেই শান্ত হয়ে গেলো কি-করে!
নিষ্পলক মুগ্ধ নজরে এগিয়ে গিয়ে কৌড়ির পাশে বেডটায় বসলো।নিঃসংকোচে তার রুক্ষ ডান হাতটা ছুলো কৌড়ির কপাল।প্রচুর জ্বর মেয়েটার।হয়তো একারনেই এরকম বেহুঁশ হয়ে ঘুমাচ্ছে।নিথর দেহে পড়ে আছে।হাত সরিয়ে নিলো নিভান।কৌড়ির জ্বরে মলিন হয়ে থাকা মুখটা দেখে,খুবকরে একটা ইচ্ছে জাগলো মনে।কৌড়ির নিস্পাপ মুখটা যেনো বাধ্য করলো সেই ইচ্ছেটাকে প্রশ্রয় দিতে।মাথা নিচু করে নিজের ওষ্ঠ ছোঁয়ালো কৌড়ির তপ্ত কপালে।জ্বরের ঘোরে-ও কেঁপে উঠলো কৌড়ি।নড়েচড়ে ফের শান্ত বাচ্চাটি হয়ে গেলো।ঠোঁট ছোঁয়ানো অবস্থায় মৃদু হাসলো নিভান।ভিষন আদর-প্রিয় মেয়েটা!না-হলে অজানা অচেনা একজন পুরুষ তাকে ছুলো আর সে শান্ত বাচ্চাটার মতো আদর উপভোগ করলো।পরক্ষণে মনে পড়লো,মেয়েটা তো জ্বরের ঘোরে বেহুশ হয়ে আছে।না হলে কি তার এই ছোঁয়াটা মেনে নিতো?কখনোই নিতো-না।

ঠোঁট সরালো নিভান।এভাবে ছুঁতে চায়নি সে কৌড়কে।কিন্তু নিজের মনকে যে কিছুতেই মানাতে পারছিলো না।ঘুমান্ত কৌড়ির মুখের দিকে নিস্প্রভ নজরে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বললো।–আজ একজন পুরুষ তার অশান্ত মনকে শান্ত করার জন্য তোমাকে তার ছোঁয়ায় কলঙ্কিনী করে রাখলো।যদি কখনো আমার না হও, তবে তোমার অজানাতে একজন পুরুষের ছোঁয়ায় তুমি কলঙ্কীনি হয়ে থাকলে।

আর সময় ব্যয় করলোনা নিভান।যদি মেয়েটা একান্ত তার হতো,তবে ওই অসুস্থ মেয়েটাকে বেডে ওরকম নিথর দেহে পড়ে থাকতে দিতোনা।কখনোই দিতো না।
কতোকিছু ভুলভাল ভাবনা মনে এলো নিভানের।আর প্রশ্রয় দিতে চাইললনা,যদি কখনো প্রশ্রয় দেওয়ার সুযোগ আসে।তবে ওই মেয়েটাকে সবকিছু দিয়ে আগলে রাখবে,নিজের সর্বচ্চ সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসবে।হ্যা নিভান ভালোবাসবে তাঁকে।কাল ইভানের সাথে কথা বলা খুব প্রয়োজন তার।খুব প্রয়োজন।কেননা মেয়েটাকে যে তার হওয়া চাই।

দরজায় গিয়ে ফের দাঁড়িয়ে পড়লো নিভান।মান্যতা এখনো রুমে আসেনি।কৌড়ির দিকে আরও একপলক তাকিয়ে মৃদুস্বরে মান্যতাকে ডাক দিলো সে।তৃনয়ের মতো মান্যতাও আজ বুঝে গিয়েছে তার হাল। মনের বেহাল দশা।সেখানে লুকোচুরি করে লাভ আছে?নেই।আর এমনিতেই লুকোচুরি সে করতেও চায়-না।তার ধারনা মান্যতা তার মনের দশা জানার সাথেসাথে,একটু আগে কৌড়ির সাথে ঘটা নিজের আবেগ-ঘনো ঘটনাটা দেখেছে।মান্যতা রুমে আসতেই নিভান বললো।

‘আমি এসেছিলাম,আর ওকে ছুঁয়েছি।ও যেনো বিষয়টা না যানে।

মান্যতার আশ্চর্যতা হয়তো এখনো কাটেনি।সে সামনের মানুষটাকো এখনো ভুল দেখছে বলে তার মনেহলো।
সেই আশ্চর্যতা বহাল রেখে মাথা উপরনিচ করে সম্মতি জানালো।সেটা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিভান চলে গেল।বোনটা যে,তার কর্মকান্ডে ভিষন আশ্চর্যতা হয়েছে এটা মান্যতার চেহারায় প্রকাশ পেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে সে।এরা যে কেনো তাকে স্বাভাবিক ভাবে নেয় না বা নিতে পারে,বুঝে আসেনা নিভানের।না-হয় সে সবার সাথে খোলামেলা মিশতে পারে-না, বেশি-বেশি কথা বলতে পারে না।তাই বলে কি সে সবার মতো সাধারণ একজন মানুষ নয়?কথা কম বললে, মানুষের সাথে না মিশলে কেউ আশ্চর্য মানুষ হয়ে যায় কিকরে!এটাও বুঝে আসে না তার।

‘কোথায় গিয়েছিলি নিভান?

চেনা কন্ঠ শুনে মনেমনে মৃদুমন্দ হাসলো নিভান।ফের বললো–আমাকে প্রশ্ন করার তুই কে?যেখানে এবাড়ির বড়কর্তাও আমাকে প্রশ্ন করার সাহস করেনা, স্পর্ধা দেখায়না।সেখানে তুই কে?

নিভানের কথাগুলোয় কষ্ট পেলেও,কথাগুলো উপেক্ষা করে দীবা বললো।–কৌড়ির কাছে গিয়েছিলি তাই না?

বিরক্ত হলো নিভান।গম্ভীর গলায় বললো—তাতে তোর সমস্যা কোথায়?তোরতো সমস্যা হওয়ার কথা না?আর ইদানীং আমি কোথায় যাচ্ছি,কি করছি,না করছি।গোয়েন্দাগিরি করছিস?তবে পরমর্শ দিতে বাধ্য হচ্ছি,আমার পিছনে গোয়েন্দা গিরি না করে নিজের বরের পিছনে কর।কাজে দেবে, উপরন্তু সংসারটা টিকে যাবে।

চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো নিভান।সামনে এগোলোও ক-কদম।পিছন থেকে দীবা ফের বললো– যদি কৌড়িও আমার মতো অন্যায় করে।তখন কি করবি?

থামকালো নিভান।থমকে গেলো বুকের ভিতরের চলা হৃদস্পন্দন।রাগে চোয়ালদ্বয় কঠিন হয়ে এলো তার।তবে তার নিজের রাগটাও যে অপাত্রে দান করতে চায় না সে। দু’হাতের মুঠো শক্ত করে নিজের রাগটা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো।সময় নিয়ে পিছে ফিরে দীবার দিকে ফের দুকদম পা বাড়ালো।দীবাও একটু ভড়কে গেলো।যেটা তার সুন্দর চোখমুখে প্রকাশ পেলো।সেটা দেখে মৃদু হেসে তাচ্ছিল্যের সুরে নিভান বললো।

‘ও তোর মতো নিচু মানসিকতা বা লোভী প্রকৃতির মেয়ে নয়।আর যদি হয়ে-ও থাকে,তবে কৌড়ি মানে সাতখুন নয় সহস্রখুন মাফ,বুঝেছিস?তাহলে এটাও বুঝে-নে ওর স্থান নিভানের ঠিক কোথায়!কোন জায়গায়!

চলবে…..

#ফুলকৌড়ি
(২১)কপি করা নিষিদ্ধ
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

সেদিন যখন নিভানের অফিসকক্ষের স্পেশাল রুমটার একান্ত বেডটাতে কৌড়িকে খুব সুন্দর করে ঘুমাতে দেখেছিলো।সেদিনই দীবা বুঝে গিয়েছিলো,নিভানের মনের পরবর্তন!হালচাল!অফিসটা তো আজকের নয়।
কতোবার পদানত করেছে সেখানে।অথচ ওই স্পেশাল রুমটাতে বসার বা ঘুরে দেখার সৌভাগ্য হয়নি তার।অফিসকক্ষ থেকেই ফিরে আসতে হয়েছে।আর এমনিতেই খুব অতি প্রয়োজনীয় ছাড়া বাড়ির কোনো মেয়ের অফিসে অবাধ যাতায়াত,এটা নিভানের পছন্দ নয়।সেই নিয়ম আর তার বাধ্য হুকুম অনুযায়ী সহজে কেউ, প্রয়োজনেও অফিসে ঢুকতে চায়-না।আর সেই নিয়ম ভেঙেই মেয়েটাকে নিভান নিজেই অফিসে নিয়ে গেলো আবার তাকে নিজের একান্ত আরাম-আয়েশের জায়গায় খুবযত্নে স্থান দিলো।শুনেছিলো,মেয়েটা অফিস ঢুকতেই নাকি বমিটমি করে ভাসিয়ে দিয়েছিল।তাতে তো নিভানের মেজাজ চুড়ান্ত পর্যায়ে যাওয়ার কথা ছিলো!কৈ,সে বিষয়ে তো উফফ-তাক অব্দি টুঁশব্দ শোনে নি।রাগান্বিত, বিরক্ততা কোনো কিছুই তার চেহারায় বা ব্যবহারে প্রকাশ পায়নি।বরং মেয়েটার যত্ন নেওয়া হয়েছে নতুন পোশাক এনে,তাকে পরিয়ে!সেদিন অন্যরকম নিভানকে দেখে দীবা চরম আশ্চর্য হয়েছিল।কৌড়ির প্রতি নিভানের আচার-ব্যবহার,বাক্যবয়,দৃষ্টি সবকিছু সম্পূর্ণ আলাদা ছিলো।যা অন্য কোনো মেয়ের প্রতি কখনো সেসব হতে দেখেনি দীবা।সবসময় কমকথা বলা গম্ভীর একটা ছেলে।ছোটোবেলা থেকে নিভানকে এরকমটা দেখে এসেছে দীবা।সেই ছেলের
পরিবর্তন টের পাওয়া কি খুব মুশকিলের!মুশকিলের হলেও কৌড়ির প্রতি নিভানের দৃষ্টি সেটা বুঝতে সহজ করে দিয়েছে তাকে।সেদিন যখন কৌড়িকে নিয়ে আসার জন্য অফিস থেকে বের হচ্ছিলো সবাই।নিভানের শান্ত আর নিষ্পলক নজর ছিলো,কৌড়ির সদ্য ঘুমে উঠা ক্লান্ত মুখশ্রীততে।এটা দীবার চতুর নজর খেয়াল করেছিলো।তারপর নিচে এসে সবাই যখন গাড়িতে উঠলো।দীবার মনে হয়েছিল,নিভান অফিসের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।আর তার নজর নির্দিষ্ট সেই মেয়েটার উপর।সত্যিই তাইই দেখেছিলো।উফফ, সেটা দেখে ভিতরটা জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছিলো তার।মেয়েটার প্রতিও চরম হিংসা জেগেছিলো।কিন্তু কাকে কি বলবে সে?মেয়েটা তো নিজেই বেখবর, নিভানের সেই মুগ্ধ আচার ব্যবহার আর অনুভূতির প্রতি।

সেই থেকে নিভানের গিতিবিধির প্রতি লক্ষ্যে রেখেছে দীবা।নজরেও বিঁধেছে,সেই দৃঢ়চিত্তের গম্ভীর নিভানকে তবে কৌড়ির বেলায় সে নিভান আলাদা।তার আচার ব্যবহার দৃষ্টি সবকিছুই আলাদা।এটা মানতে কষ্ট হয় দীবার!কৌড়ির প্রতি সেই ব্যবহারের বিরূপ আচারন করতে গিয়েও বারবার ফিরে আসে সে।নিজের বিবেকে দংশিত হয়, বাঁধা পায়!যেখানে মেয়েটার কোনো দোষ নেই,সেখানে তাকে শাসিয়ে লাভ আছে।উপরন্তু নিভান যদি ক্ষুন্নাক্ষরেও টের পায়,কৌড়ির প্রতি দীবার বিরূপ আচারন।তবে তো সবকিছু নিঃশেষ করে দিতে ছাড়বে না।নিভানকে তার খুব ভালো করে চেনা!ঠান্ডা স্বভাবের হলেও রাগ ক্ষোভ জেদ তার খুব ভয়ংকর!যদি-ও মায়ের মতো স্বভাব দীবার নয়।যাকে-তাকে কারন ছাড়া উল্টো পাল্টা কথা সে বলতে পারেনা।আর না খারাপ আচারন বর্তাতে পারে।বিবেকহীন তো নয় সে!আর না হতে চায়।তবে কষ্ট হয়,যে কারনে সংসার ছাড়তে সংকোচ করিনি।আজ সেই কারনটাই হাতছাড়া। যদিও হাতের নাগালে কখনোই ছিলো-না।তবুও মনের কোণে আশার নিভুনিভু বাতিটা তো জ্বলছিলো।আজ সেই নিভুনিভু বাতিটা দমকা হাওয়ার মতো ফু দিয়ে নিভিয়ে দিয়ে গেলো নিভান নিজেই।

দৌড়ে নিজের ঘরে চলে গেলো দীবা।ঘুম আসছিলো না তাই হাটাহাটি করছিলো।রুম ছেড়ে সামনের লাগোয়া বারান্দায় আসতেই দেখলো নিভানকে নিচে যেতে।আর নিভান কোথায় যেতে পারে,সেটা আন্দাজ করে নিজেও নিচে এসেছিলো সে।কৌড়ির রুমে ঢুকতে দেখেই সেখানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো সে।নিভান বের হতেই
বেহায়া হয়ে প্রশ্নবিদ্ধও করেছে তাঁকে।আর যা সে শুনতেই চাই-নি,সেটাই শুনতে হলো তাকে।নিজের বেডে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে হুহু করে কেঁদে দিলো দীবা।জীবনটা নিজের সিদ্ধান্তহীনতার জন্য আজ এরূপ অবস্থা তার।না পারছে সিয়ামের ভালোমন্দ মেনে নিয়ে তারসাথে মানিয়ে সংসার করতে,আর না পারছে নিভানকে মন থেকে সরাতে।তার কিশোরী বয়সের ভালোলাগা ছিলো নিভান।সময়ের সাথে সাথে সেই ভালোলাগা বাড়তে থাকলে-ও নিভানের থেকে কোনোভাবেও প্রশ্রয় পায়নি কখনো।একই বাড়িতে বছর বছর থাকা সত্ত্বে-ও,নিয়ম করে দেখা সাক্ষাৎ হলেও সেভাবে কথাই হতোনা তারসাথে।শান্তশিষ্ঠ আর গম্ভীর ছেলেটা সবসময় পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো।সেই শান্তশিষ্ট ছেলেটার জন্য একটাসময় মামি তাকে পছন্দ করলো।তবে নিভানের গম্ভীর আচারনে আর সবসময়ে নির্লিপ্ত থাকার কারনে তন্মধ্যে সিয়াম তার জীবনে এসে গিয়েছিলো।

সিয়ামকে যে তার ভালোবাসা ছিলো বা সে সিয়ামকে ভালোবাসতো এমনটা-ও নয়।মামার বিজনেস পার্টনারের ছেলে ছিলো সে।একবার এবাড়িতে উনাদের পুরো ফ্যামিলিকে নিমন্ত্রণ করা হয়।সেখানে দীবাকে দেখে পছন্দ করে সিয়াম।নিজেথেকে যোগাযোগ করে নেয় দীবার সাথে।তারপর বিভিন্নভাবে যোগাযোগ, কথাবার্তা আদান-প্রদান।সিয়ামের কথাবার্তা চালচলনে এমনকি হুটহাট তার ভার্সিটির সামনে চলেআসা,কারনে অকারণে ফোন করা।সেসব বুঝিয়ে দিতো সিয়াম তাকে পছন্দ করে।এমনকি একদিন হাটুগেড়ে প্রপোজও করে দিলো যে,সে দীবাকে ভালোবাসে।সেদিন প্রপোজ গ্রহন করা নিয়ে দোনোমোনো করছিলো দীবা।কেননা সে তখন-ও নিভানকে নিয়ে কনফিউশানে ছিলো।তবুও কিভাবে কিকরে যেনো সিয়ামের সাথে জড়িয়ে গেলো।
আর সেই জড়ানোটায় তার মা কোনোভাবে টের পেয়ে এমন ইন্ধন যুগিয়েছিলেন,পিছু ফিরে তাকানোর কোনো যুক্তিতর্ক বাদ রাখেননি।মা হয়তো নিভানকে নিয়ে তার মনোভাবটা জানতেন!যা উনার পছন্দ ছিলো না।এমনিতেই ছোটো থেকে নিভানকে উনার কখনোই বিশেষ পছন্দ ছিলো না সেখানে নিজের মেয়ের ভালোলাগা অনুভূতিটা তাকে ঘিরে।তিনি মানতেই পারছিলেন না।আর যখন সিয়াম এলো মাঝখানে তখন তো তিনি মানার মতো কারনই খুঁজে পেলেন না।ভালোমন্দ কতোকিছু বোঝালেন তাকে।তারমধ্যে যখন হঠাৎই একদিন সিয়াম,বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে তার মা বাবা সমেত হাজির হলো।মা যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেলন।বড়মামি সেদিন মাকে তাদের আড়ালে প্রস্তাব রাখলেন যে,—–বাড়ির মেয়ে বাড়িতেই থাকুক।অনত্র দেওয়ার থেকে চোখের সামনে থাকা ভালো।মা সেদিন সরাসরি মামির প্রস্তাব নাকচ না করলে-ও,তাকে দিয়ে মতামত একপ্রকার না করাতে বাধ্য করেছিলেন।ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন।

‘নিভান এবাড়ির ছেলে নয়।বড়ভাই মন থেকে যদি চায় তবে নিভান সম্পত্তির ভাগ পাবে না-হলে নয়।সেখানে নিভানের সাথে সাংসার পেতে তোর লাভ আছে?আর কি আছে ওই ছেলের মধ্যে।যেখানে সিয়াম তার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। সেখানে রাজরানি হয়ে থাকবি তুই।দেখতেও কোথায় শ্যামকালো নিভান আর কোথায় রাজপুত্রের মতো দেখতে সিয়াম।নিজহাতে কেনো দূর্ভাগ্যকে কপালে টেনে এনে সৌভাগ্যকে ছেড়ে দিবি।সবকিছুর তফাৎ করার বা ভালো মন্দ বোঝার বয়সটা তো নিশ্চয় হয়েছে।সুতরাং আবেগে না ভেসে বাস্তবতায় ভাসো।কোথায় ভালো থাকতে পারবে,সেই বুঝজ্ঞানতো হয়েছে।

সত্যিই কি বয়স হলেও দেই জ্ঞানবুঝ তার হয়েছিলো?
সেদিন মা শুধু বাহিরের চাকচিক্য দেখেছিলো।ভিতরটা দেখেনি।দেখিনি ছেলের চরিত্র কেমন।সেই চাকচিক্যের মানুষ আর অর্থের মধ্যে উনার মেয়ে ভালো থাকবেন কি-না!দোষতো শুধু মায়ের একার ছিলোনা তার-ও তো ছিলো।নাহলে বুঝদার হওয়া সত্ত্বেও খাঁটি হিরা ছেড়ে কাচ কিকরে বেছে নিয়েছিলো সে?কেউ ইন্ধন দিলো,আর বুঝেশুনে সেই ইন্ধনের আগুনে ঝাপ দেওয়া তো,সম্পূর্ণ সেই ইন্ধন জোগানো মানুষটার দোষ নয়।সেখানে বুঝেশুনে সেই ইন্ধনে প্রশ্রিত হওয়া,নিজেরইতো দোষ।আর কোন বাবা মা কি সত্যিই চায় তার সন্তানের অমঙ্গল বা খারাপ?তবে মা কেনো বুঝেও বুঝলো-না,তার মন।তার ভালোটা।সেদিনও তো বাড়িতে আসার পর মামা কি বললো।তারউপরে এসে চোটপাট করলো, কতো কথা শোনালো।–ছেলেদের নাকি ওরকম একটু আধটু চারিত্রিক দোষ থেকেই থাকে।সেটা মানিয়ে গুছিয়ে নিয়ে সংসার করতে হয়।আরও কতো কথা।অথচ একবারও জানতে চাইলেননা সে কি চায়!সে সেই মানুষটার সাথে ভালো আছে কি-না?আগেও জানতে চাইনি আর এখনো জানতে চায়না,বুঝতে চায়না।মায়ের তারজন্য এ-কেমন ভালো চাওয়া,ঠিক বুঝে আসে-না দীবার।

হাটমুড়ে বসা দীবা,দুহাটুর ফাঁকে মুখ গুজে হুহু করে কেঁদে দিলো।জীবন এমন কেনো এলোমেলো হয়ে গেল তার!যেভাবেই হোক বিয়েটা যখন হয়ে গিয়েছিলো,সে মনের ভালোলাগাটাকে ভুলে সিয়ামের সাথে সংসারে মন দিতে চেয়েছিলো।সত্যি বলতে সে-ও তখন বাহিরের চাকচিক্যেরের মোহে ভুলে গিয়েছিলো তার পিছনের ভালোলাগাটা।তবে বিয়ের পর যখন সিয়ামের কাজিন বা বন্ধুবান্ধব থেকে একটু একটু করে জানতে পারলো, তারসাথে বিয়ে হওয়ার আগে সিয়ামের একাধিক মেয়েদের সাথে সম্পর্কের কথা।চারিত্রিক বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে তখন একটু একটু করে মন খারাপ হতে থাকলো।সম্পর্কের সুতোয় চির ধরতে শুরু করলো।তখন তার পুনরায় নিভানের কথা মনে হতে থাকলো।যে নিভান কখনো কোনো মেয়ের দিকে অযাচিত কারনে তাকায়নি,অপরিচিত মেয়েদের সাথে সহজে অহেতুক কথা বলতে দেখিনি।গম্ভীর্যভাব আর কথা কম বললেও, যে ছেলের সবদিক থেকে ছিলো পারফেক্ট।যারজন্য দীবার ভালো লাগাটা তৈরী হয়েছিলো।সেই ছেলেটাকে ভুলে ক্ষনিকের মোহে পড়ে বিয়ের মতো একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে তাতে জড়িয়েও পড়লো!সিয়ার আর নিভানের মধ্যের সবদিকের গুনাবলির কম্পেয়ার করতে করতে একটা সময় তাদের স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের এতোটা অবনতি হয়,সেই সম্পর্কে থাকাটা তিক্ততার হয়ে যাচ্ছিলো।বিধায় এবাড়িতে চলে এসেছে।আর আসার আরও একটা পাকাপোক্ত কারন ছিলো,পুরানো ভালোলাগার মানুষটাকে পুনরায় ফিরে পাওয়া।তবে আর ফিরে পাওয়া হলো কোথায়!সে মনে যে বাসা বেঁধেছে যে অন্য কেউ।তবে খড়কুটো দিয়ে যেন-তেন বাসা নয়,সে যে লোহার খাঁচার মতো পাকাপোক্ত ভাবে বাসা বেঁধে নিয়েছে সে মনে।যা আজ নিভানের কথায় ঢেড় টের পেয়েছে সে।

কান্নার গতি বাড়লো দীবার।যদি সেদিন আগেপিছে না ভেবে মামির সিদ্ধান্তে রাজি হতো সে।তবে নিভানের সেই একান্ত মনের জায়গাটা তার হতো।ওই পাগলকরা মুগ্ধকর ভালোবাসাটাও শুধুই একান্তে তারই হতো।তবে নিজেই সে-পথ রোধ করে দিয়েছে।সেই-পথে যে তার আর স্থান নেই______হঠাৎ ফোনের আওয়াজে কান্নার তীব্রতা কমে গেলো দীবার।তবে মাথা তুললো না সে।এতোরাতে কে ফোন দিতে পারে,সেটাও বেশ অনুধাবন করতে পারলো।সেদিকে আর মন দিলো-না।তবে ফোনের একের পর এক বেজে যাওয়া রিংটোনে বিরক্ত হলো সে।এটাও তার জানা ছিলো,সে ফোন না ধরা পর্যন্ত ওই অসভ্যটা কল দেওয়া বন্ধ করবেনা।আজ ঝগড়া করার মানসিকতায় নেই তার মন,তাই সে ফোন তুলতে চাচ্ছিলোনা।কিন্তু না তুলে উপায় আছে।বেড থেকে ফোনটা নিয়ে কল রিসিভ করে কানে তুললো দীবা।ওপাশ থেকে সিয়ামকে ত্যাড়াবেঁকা কিছু বলতে না দিয়ে কান্নাভেজা ক্লান্ত গলায় বললো।

‘আমাকে কি একটুও শান্তিতে থাকতে দেবেনা তুমি?কি চাইছো কি তুমি?আমি মরে যাই এটাই চাইছো!আচ্ছা মরে গেলে তুমি শান্তি পাবে! ঠিক আছে,তবে তোমাদের শান্তিরই ব্যবস্থা করি।

ওপাশ থেকে ধমকে উঠলো সিয়াম।–দীবা

সিয়ামের ধমকে এবার গলা ছেড়ে হুহু করে কেঁদে দিল দীবা।কান্নারত গলায় ফের বললো—তবে দাওনা আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে।দয়া করে আর ফোন দিয়ে জ্বালিওনা আমাকে।একটু শান্তিতে থাকতে দাও সিয়াম।প্লিজ থাকতে দাও আমার মতো আমাকে।তোমাদের কাওকে চাই-না আমার।

ওপাশ থেকে আর একটা শব্দও এলো-না।এপাশ থেকে দীবা তখন হুহু করে কেঁদে চলেছে।কিছুসময় পর কল কেটে যেতেই,ফোনটা বেডে ছুঁড়ে দিয়ে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়লো সে।সিয়ামের এই রোজ রোজ ফোন দিয়ে বিরক্তিরতার কারনটা হলো,সিয়াম তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। তাকে ছাড়তে চাইছেনা!

.

সময়টা রাত আটটার কাঁটায়।গম্ভীর মুখে সোফায় বসে আছে নাফিম।নানু অসুস্থ থাকায় কাল নানাবাড়ীতে গিয়েছিলো সে।একটু আগে সেখান থেকে ফিরেছে,সেই থেকে মন খারাপ তার।সাথে ফর্সা গোলুমোলু মুখটা অন্ধকারচ্ছন্ন রাতের ন্যায় অন্ধকার করে রেখেছে।কি হয়েছে কাওকে কিছুই বলছেনা।শুধু গুম মেরে বসে আছে।ইভান বাহির থেকে এসে নাফিমকে এমতাবস্থায় দেখে,তারপাশে ধপাৎ করে বসে বললো।

‘কিরে পিচ্চু,ওভাবে মুখ ভার করে বৈজ্ঞানিকদের মতো কি ভেবে চলেছিস?

আঁড়চোখে ইভানকে একপলক দেখে।ফের নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলো নাফিম।কিছুই বললোনা।সেটা কিছুসময় কপাল কুঁচকে দেখে ইভান ফের বললো–কি, গার্লফ্রেন্ড ভেগে গেছে নাকি?যে ওমন গুম মেরে বসে শোক পালন করছিস?

‘আমার গার্লফ্রেন্ড নেই।আর এই বয়সে গার্লফ্রেন্ড থাকা ভালো কথা নয়।

নাফিম গম্ভীর গলায় কথাটা বলতেই ইভান সোজা হয়ে বসলো।ফের মিছেমিছি মুখের ভাবে আশ্চর্যতা দেখিয়ে বললো—ওমা এতো সুন্দর নীতিবাক্য তোকে কে শেখালো শুনি?

‘ছোটোমামা বলেছে।

ইভান এবার সত্যি আশ্চর্য হলো।কারন নাফিমের ছোটমামা কিছুটা ইভানের কোয়ালিটির মানুষ।সেখানে তিনি আর নীতিবাক্য।মোটেই যাচে না। ইভান পের কিছু বলার আগেই নাফিম আবারও গম্ভীর গলায় বললো।

‘ছোটো মাাম জিজ্ঞেস করেছিলো ক্লাসে আমার কয়টা গার্লফ্রেন্ড আছে, আমি বলেছিলাম অনেক।কেননা আমার ক্লাসের মেয়েগুলো তো সবই আমার গার্লফ্রেন্ড হয়,তাই না।তখন ছোটো মামা এগুলো বলেছে।

নাফিমকে ক্ষেপানোর জন্য কথাগুলো যে বলেছে,এবার এটা বেশ বুঝলো ইভান।হেসেও ফেললো সে।নাফিমের মন খারাপের কারন যে তার ছোটো মামার উল্টোপাল্টা
কথা এটাও বেশ বুঝলো।হাসি ঠোঁটে বজায় বললো–তা মামা আর কি কি নীতিবাক্য শিখিয়েছে,বলে ফেল তো পিচ্চু।আমিও একটু জানি, শিখি।এবার নাফিমের মুখ কাঁদোকাঁদো হয়ে গেলো।আবেগে অবুঝমন বলে দিলো।–ছোটোমামা বলেছে,আমি নাকি আমার আম্মু আব্বুর ছেলে নই।আমাকে আব্বুআম্মু হসপিটাল থেকে চেয়ে নিয়ে এসেছিলো নাকি।

‘যাক বাবাহ।তোর ছোট মামাতো মোটেই সুবিধার মানুষ নন।সত্যি কথাটা আমরা এতোদিন চেপে রাখলাম,তুই কষ্ট পাবি বলে।সেটা তোকে বলেই দিলো।মামাকে তো এখন ফোন দিয়ে বকতেই হচ্ছে।

এবার সত্যিই নাফিম কেঁদে দিলো।ফর্সা চোয়াল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নোনাজল।ছোট্টো লাল টুকটুকে ঠোঁট দুটো ভেঙে উঠলো ফুপিয়ে।সেটা দেখে ইভান মুখটা মিছেমিছি আহত ভঙ্গিমা করে বললো।—কাঁদছিস কেনো পিচ্চু,কাদিসনা।তুই আমাদের চাচির পেটের ভাই না বলে,আমরা কি তোকে কম আদর করি?কম ভালোবাসি,বল?

‘তুমিও,ছোটোমামার মতো মিথ্যা বলছো?তাইনা ছোটো দাদাভাই?

নাফিম কান্নারত গলায় কথাটা বলতেই,ফের মিছেমিছে মুখটা করুণ করে ইভান বললো।—আমি তোদের একটু ক্ষেপালেও কখনো মিথ্যা বলি।তুই বল?আচ্ছা তুই যদি আমার কথা বিশ্বাস না করিস,তবে তুই নিজে ভেবে দেখ।সাধারনত নামের ক্ষেত্রে ভেবে দেখ,আমার নাম ইভান।বড়াে দাদাভাইয়ের নাম কি?নিভান।দেখেছিস আমাদের দু-ভাইয়ের মধ্যে নামের কতো মিল।মিল আছে কি-না বল?তারপর তোর বড়আপু ছোটোআপুর নামগুলো দেখ?মান্যতা আর মৌনতা।তাদের নামেরও কতো মিল।মিল থাকবেনা কেনো?মিলিয়েই তো রাখা হয়েছে।এখন তুই ভেবে বল আমাদের ভাই বোনদের নামের মিল আছে কি-না?আর সেখানে তোর নাম কি?নাফিম।আমাদের ভাইবোনদের নামের সাথে তোর নামের সেভাবে কোনো মিল আছে?তুই বল,আছে কি না?নেইতো।এই লজিক মানলেও তো…..

ইভানের কথা শেষ করতে দিলোনা নাফিম।গলা ছেড়ে হা হা করে কেঁদে দিলো। আর নাফিমের কান্না দেখে সিঁড়ির গোঁড়ায় দাঁড়ানো কৌড়ি খিলখিলিয়ে হেসে দিল।সে এতোসময় ধরে দু ভাইয়ের কথপোকথন শুনছিলো সে।দেখতে চাইছিলো,শেষ পর্যন্ত কি হয়!তবে সেটাই হলো।জুনায়েদ জাহিদ ইভান যার পিছু লাগে,ইতুড়ের মতো লাগে!তাকে কাদিয়ে ছেড়ে দেয়!নাফিকের কান্না দেখে খুব মন খারাপ করার বা দুঃখ পাওয়ার কথা থাকলেও,কেনো জানি খিলখিলিয়ে হাসি পেলো কৌড়ির।আর জ্বরে মিইয়ে যাওয়া সেই শুভ্র মুখের মায়াময় হাসির দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলো, দোতলায় দাঁড়িয়ে থাকা নিভান।আজ চারদিন অসম্ভব সর্দি-জ্বরের পালা চুকিয়ে মেয়েটা মনেহয় কিছুটা সুস্থ। ওই খিলখিলিয়ে উঠা হাসিটা তো সেরকমটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে।মনের কোণের স্বস্তির আর শান্তির জায়গাটায় যেনো একটু বিশ্রাম মিললো তার।সুগভীর সুস্থির নজরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো,হাসতে হাসতে নাফিমের দিকে এগিয়ে যাওয়া কৌড়িকে।

কৌড়ির খিলখিলিয়ে হাসি দেখে নাফিমে কান্নার জোর বড়লো বৈ কমলোনা।কাঁদলোও সে।সেই কান্না বসেবসে নিষ্ঠুর মানুষের মতো উপভোগ করছে ইভান।কৌড়ির এগিয়ে আসতে দেখেই ইভান বললো–তুমি বলো ফুলকৌড়ি আমার লজিক ঠিক কি-না।

‘মোটেই ঠিক না।পুরোই ইললজিক্যাল কথাবার্তা।নিভান আর ইভানের ভাই নাফিম।নাম মিলালো না কি-করে?আপনি সেটা বলুন আমাকে?

কথাটা বলতে বলতে নাফিমের পাশে বসলো কৌড়ি।ইভানের থেকে উত্তরের আশা না করে ফের নাফিমকে উদ্দেশ্য করে বললো।–তুমি এই সামন্য কথায় কাঁদছো নাফিম?তুমি কখনো নিজেকে আয়নায় দেখেছো,তুমি পুরো ছোটোমায়ের মতো দেখতে।চোখ কান নাক ঠোঁট, তোমার পুরো অবয়ব ছোটোমায়ের মতো।কে বলেছে তুমি হসপিটাল থেকে চেয়ে নিয়ে আসা ছেলে।পাগল ছেলে!ছোটো দাদাভাইতো এগুলো তোমাকে ক্ষেপানোর জন্য বলছে।আর তুমি কাঁদছো?বোকা!

‘তোমার কথাগুলো সত্যি ফুলকৌড়ি?

কান্না থেমে গিয়ে উৎফুল্ল গলায় কথাটা জিজ্ঞেস করতেই,কৌড়ির আগে ইভান উত্তর দিলো—একশো পার্সেন্ট মিথ্যা। ফুলকৌড়ি তোকে স্বান্তনা দেওয়ার জন্য কথাগুলো বলছে।

এবার কান্না বাদে রেগে গেলো নাফিম।গলা চড়িয়ে নীহারিকা বেগমে উদ্দেশ্য করে বললো–বড়মা,ছোটো দাদাভাই কিন্তু আমাকে আবার-ও..….

কথা শেষ করতে দিলো না তার আগেই নাফিমের মুখ চেপে ধরলো ইভান।ফের বললো–হসপিটাল থেকে চুরি করে নিয়ে আসা ছেলে, চুপ কর।

কথাটা বলতে বলতে প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করে নাফিমের হাতে দিয়ে বললো—একদম গলা দিয়ে সাউন্ড বের করবিনা,বড়মায়ের আদরে বাদর হওয়া মিনি।

ফোন পেতেই নাফিমও আর দাড়ালো-না।কান্নাকাটি সবকিছু ভুলে দৌড়ে চলে গেলো।কৌড়ি উঠে দাড়াতেই ইভান তাকে কথার ছলে থামিয়ে দিলো–তখন আমার নাম ধরলে ঠিকআছে,দেবরের নাম ধরাই যায়।তাই বলে বরের নাম ধরলে কেনো?পাপ হবেনা?

কপাল কুঁচকে গেলো কৌড়ির।সে কখন বরের নাম ধরলো।আরেহ ধেৎ,সে বিয়ে করলো কখন যে তার বর হবে!ইভান ভাইয়া নাফিমকে ছেড়ে এবার তার পিছনে লাগার ধান্দা করছে ভেবে বললো।—আমার বরের নাম আমি ধরেছি,তো বেশ করেছি।তাতে আপনার কি?

ইভান নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো।

‘বাহ বাহ,বিয়ে হতে পারলো-না,তারআগেই ভাইকে তার ভাইয়ের জীবন থেকে আউট করে দিয়ে বলছো।আপনি কে?একেই বলে বাড়ির যোগ্য বড় বউ!যাই হোক সেসব বাদ,তোমার বরের নাম নাহয় তুমি ধরতেই পারো, সত্যিতো আমি বলার কে?তবে তোমার বরতো বলার রাইট রাখে তাই-না?পিছনে দোতলায় তাকাও ফুলকৌড়ি?সেখানে তোমার বর অপেক্ষা করছে,উত্তর নেওয়ার জন্য।

বোকাবোকা নজরে সত্যিই পিছনে তাকালো কৌড়ি।দোতলার রেলিঙ ঘেঁষে তাদের দিকে স্থির আর শান্ত নজরে তাকিয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে বুক ধ্বক করে উঠলো তার।চোখ বড়োবড়ো হয়ে গেলো মূহুর্তেই।মনে পড়লো,সত্যিতো একটু আগে নাফিমকে বলার সময় ইভান ভাইয়ার সাথে ওই মানুষটার নাম-ও নিয়েছে সে।সেজন্যই তো নাম নিয়ে ইভান ভাইয়া ওরকমটা বললো।আর সে নাম নিয়েছে খেয়ালে না থাকার দরূন, না বুঝে কিসব বলে দিয়েছে।মানুষটা কি শুনে ফেলেছে তার বলা উল্টো পাল্টা কথাগুলো!মূহুর্তেই নজর ফিরিয়ে নিলো কৌড়ি।এখন তার হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।ইচ্ছে তো মিটাতে পারলোনা,তবে ইভানের উপর ক্ষোভ মিটাতে বললো।

‘আপনি খুব খারাপ, ইভান ভাইয়া।

একগাল হেসে ইভান বললো–সেটা আর নতুন কি বড়ো ভাইয়ের বউ।তা শুনলাম দুজন বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর সর্দি বাঁধিয়ে বসে আছো।তবে কি দু’জনের মধ্যে সামথিং সামথিং কিছু হলো?

মূহুর্তেই সেদিনের বৃষ্টিভেজা মূহর্তগুলো মনের গহীনে ভেসে উঠলো কৌড়ির।তাঁকে দেখে ওই মানুষটার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা,মনেহয় শত বছরের তৃষ্ণার্থ পাখি একফোঁটা পানির জোগান পেয়েছে।কাছে এসে কোমল গলায় শুধানো,খুব ভয় পেয়েছো তাইনা?কৈ সেদিন সেই গলায় তো কোথাও একফোঁটা গম্ভীর্যতা ছিলোনা?কতো নির্মল,কোমল ছিলো সে কন্ঠ।তারপর তাকে অভয় দিয়ে বলা,আমি তোমার কাছে এসে গেছিতো, তবে ভয় কিসের!কথাগুলো মনে পড়তেই ভিতরে ভিতরে কাটা দিয়ে উঠলো কৌড়ির।সর্দিতে এখনো ভার হয়ে থাকা নিঃশ্বাসটা আরও ভারী হয়ে উঠলো।ইভানের সাথে আর কথা না বাড়ালো না।

‘কি হলো?তোমার বরের প্রেমে পড়ে গেছো মনে হচ্ছে?

ভাবনা ভঙ্গ হলো কৌড়ির।কি বলবে কোনো কথা না খুঁজে পেয়ে বললো।–আপনি আসলেই খুব খুব খারাপ। আর আমি মোটেই কারও প্রেমে পড়িনি।

‘কিন্তু সে, তোমার প্রেমে পড়ে গেছে।

কথাগুলো বলে এদিক-ওদিক না তাকিয়ে যখন পা বাড়ালো চলে আসার জন্য।ইভানের কথায় পা থমকে গেলো তার।থমকে গেলো বুকের মধ্যে ধুকপুক করা চলা হৃদস্পন্দন-ও।তবে ইভানের কথায় সে নিজেকে দূর্বল করে চায়না।আর না নিজেকে দূর্বল দেখাতে চায়।আর সে নিশ্চিত ইতুড়ে ছেলেটা তারসাথে ফাজলামো করছে।তাই ঘাড় ফিরিয়ে সে বললো।

‘আপনাকে বলেছে তাই না?

‘বলবে কেনো?তার চোখে চোখ রেখে দেখো তবে নিজেই বুঝতে পারবে।

দাঁড়ালো না কৌড়ি।আরনা আশেপাশে তাকানোর প্রয়োজনবোধ করলো।কেনো জানিনা,তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে,ওই মানুষটা এখনো ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে।আর তার সূচালো আর শান্ত নজর তাদের দিকেই নিবন্ধিত।ইভানের শেষের কথার প্রতিত্তোর সরূপ মৃদুস্বরে আওড়ালো।

‘খেয়ে কাজ আছে!ওই চোখে চোখ রেখে সে নিজের দূর্বল হৃদয়ের মৃত্যু ডেকে আনবে।

আজ প্রায় পাঁচদিন পর পুরোপুরি সুস্থ কৌড়ি।কলেজে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হতেই মান্যতা তার সঙ্গ নিলো।দুজনেই গেটের বাহিরে পা রাখতেই মান্যতা বললো।—ফোন নিয়েছো কৌড়ি?

আজ সকাল সকাল কলেজে বের হওয়ার কিছু সময় আগে মান্যতা আপু,তাকে একটা ফোন ধরিয়ে দিয়েছে। ফোনটা যে নতুন এবং দামী,সেটা দেখেই বুঝতে পেরেছে কৌড়ি।এতোদামী ফোন নেবেনা নেবেনা করে-ও,মান্যতার বিভিন্ন যুক্তিতর্কে তাকে বাধ্য হয়ে নিতে হলো।কিন্তু ফোনটা কাছে নিতেই,একটা চেনা পরিচিত সুগন্ধ এসে ঠেকলো তার নাকে।অজানা কারনে বিভিন্ন প্রশ্ন মনে এলেও,মান্যতাকে তা জিজ্ঞেস করতে পারলো না সে।

‘কি হলো নিয়েছো?

‘হুম আপু।

দু’জনে একটা রিকশা ডেকে রিকশায় উঠলো।হঠাৎ ফোনের আওয়াজে বিভ্রান্ত হলো কৌড়ি।কার ফোন বাজছে বুঝে উঠতে পারলোনা,তবে এটা বুঝলো।এই টোন মান্যতা আপুর ফোনের নয়।তবে তার ফোনের।নতুন ফোন সকালে হাতে ধরিয়ে দিয়েছে মান্যতা আপু।তারমধ্যে কে নাম্বার জানলো আর কেই বা ফোন দিলো?

‘তোমার ফোন বাজছে কৌড়ি।

এতো নির্লিপ্ত কন্ঠে কথাটা বললো মান্যতা,যেনো সে জানতো কেউ ফোন দেবে।আর কে দিয়েছে এটাও মনে হয় মান্যতা আপুর জানা।নাহলে…..

‘ফোনটা ধরো কৌড়ি।

অদ্ভুত তরঙ্গে ভিতরের সকল অনুভূতি উথাল-পাতাল ঢেউয়ে দুলতে থাকলো কৌড়ির।অকারনে কাঁপলো হাত।সেইমৃদু কাঁপা হাতে ফোনটা ব্যাগের মধ্যে থেকে বের করলো সে।কল কেটে গিয়ে নিভে যাওয়া স্কিনটা ফের জ্বলে উঠতেই,স্কিনের উপরে জ্বলজ্বলে গোটাগোটা ইংরেজি অক্ষরে লেখা Nivan নামটা ভেসে উঠতেই সকল ইন্দ্রিয়ের কাজ করা বন্ধ করে দিলো কৌড়ির।চকিতে ঘাড় ফিরিয়ে একবার মান্যতার দিকে তাকালো সে।মেয়েটা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে নিজের ফোনের মধ্যে ডুবে আছে।যেনো আশেপাশে কোথায় কি ঘটে চলেছে,হয়ে চলেছে তাতে তার কোনো খেয়াল নেই।এমনকি যায়ও আসেনা।আশ্চর্য হলো কৌড়ি।নিজের ফোনের দিকে নজর রেখেই ফের মান্যতা বললো।

‘কলটা রিসিভ করো কৌড়ি।হয়তো দাদাভাই ইম্পর্ট্যান্ট কোনো কথা বলবেন।

তারসাথে ইম্পর্ট্যান্ট কথা।ওই মানুষটার সাথে তার কি ইম্পর্ট্যান্ট কথা থাকতে পারে?আর এরা ভাইবোনেরা শুরু করেছেটা কি?তাকে কি পাগল মেরে ফেলার ধান্ধায় নেমেছে।নাহলে ঠেলেঠুলে কোনো ওই মানুষটার দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে।তৃতীয়বার ফোনটা বাজতেই ফোনটা ধরলো কৌড়ি।তবে হ্যালো বলার সাহস পেলো-না।ওপাশের ধৈর্য্যশীল মানুষটা-ও হয়তো এই মেয়েটার বেলায় ধৈয্যহীনা হয়ে পড়লো।ফোন রিসিভ করতেই বললো।

‘ফোনটা তুলতে এতো সময় লাগে?তুমিতো বাধ্য মেয়ে তবে আমার বেলায় কেনো অবাধ্য হতে চাইছো?

প্রানটা যায়যায় অবস্থা কৌড়ির।মুখ ফুটে একটা রা শব্দও উচ্চারণ করলোনা সে।শুধু কঠিন পাথরের মতো নিথর হয়ে বসে রইলো।সেটা হয়তো বুঝতে পারলো ওপাশের মানুষটা।নিঃশব্দে শ্বাস ফেলে সময় নিয়ে বললো।

‘ভালোমন্দ যে-কোনো কারণেই হোক,প্রয়োজনে আগে আমাকেই ফোন দেবে।সুবিধা হোক বা অসুবিধা আগে আমাকেই জানাবে।সেটা ঝড়-তুফান বর্ষা-বাদল বা রাত-দিন,অ্যাট এ্যানি টাইম।যখন-তখন যেকোনো সময়ে অসময়ে,ভালোমন্দ প্রয়োজনটা আগে আমাকেই জানাবে।ভুলেও ভুল করো না কৌড়ি।তুমি তো বাধ্য মেয়ে,ভুলে-ও আমার কথার অবাধ্য হতে যেও না।আর আমার কথার অবাধ্য হতে গিয়ে যদি নিজের ক্ষতি ডেকে আনো বা তোমার কোনোরূপ ক্ষতি সাধিত হয়।মানা মুশকিল হয়ে যাবে।আর আমার কথা না মানলে কিন্তু মোটেই ভালো হবে-না।একদম ভালো হবে না কৌড়ি।

চলবে…

ফুলকৌড়ি পর্ব-১৮+১৯

0

#ফুলকৌড়ি
পর্ব (১৮) গল্প কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ
#লেখনীাতে_শারমীন_ইসলাম

কান্না থেমে গেল কৌড়ির।দরজার দৌড়গোড়ায় দাড়নো ছেলেটার উচ্ছ্বসিত কন্ঠের নির্বিকার কথায় কান্নাভেজা নজরজোড়া হয়ে উঠলো অসহায়।এই ছেলে তার মানসম্মান আর কিছুই রাখলো-না।সারাদিনে একদণ্ডও শান্তিতে থাকতে দেয়না।যখন তখন যেখানে সেখানে যারতার সামনে ওই লোকটাকে আর তাকে ঘিরে উল্টো পাল্টা কথা বলা শুরু হয়ে যায়।তার নরমাল প্রেশার বাড়িয়ে দেয়।এখন এমন একটা অবস্থা হয়েছে তার,এই ইতুড়ে ছেলেটা যেখানে থাকে ভুলেও সেখানের ছায়া মাড়ায় না কৌড়ি।কখন কার সামনে উল্টো পাল্টা কিছু বলে বসে,আর তার না অকালে আক্কা পাওয়ার টাইম চলে আসে।এই ছেলের জন্য না শান্তিতে কোথাও থাকা বসা যায়,আর না মনের দুঃখে শান্তি মতো কাঁদা যায়।এখন যদি ইভান ভাইয়ার কথার বর্ননা অনুযায়ী তার না হওয়া শ্বশুরবাড়ির,আর বরের ডিটেইলস সম্পর্কে জানতে চায় মান্যতা আপু।তবে কি’হবে?জানতে পারলে কি ভাববে মেয়েটা?আর তার কি লজ্জার শেষ থাকবে?
তারপর ওই ভয়ঙ্কর লোকটাকে আর তাকে ঘিরে এসব কথা যদি বাড়ির সবার কনে যায়,কেমন বিব্রতকর আর অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে

‘কৌড়ি শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে যেতে চায়-না মানেটা কি?আর ওর বরটা আবার কে?

গলায় আশ্চর্যতা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো মান্যতা।ইভান দরজার সামনে থেকে এগোতে এগোতে বললো।

‘তোকে বলবো কেনো?এটা ফুলকৌড়ির আর আমার সিক্রেট ব্যাপার স্যাপার।তোর মতো পেট পাতলা মেয়েকে বলে,আমার না হওয়া বউমনির আমি সর্বনাশ ডেকে আনি।অসম্ভব!যে-কোনো মূল্যে যুদ্ধ বিদ্রোহ করে হলে-ও তাকে আমার বউমনি বলে চাই।

ইভানের সতেরো প্যাচানো কথা শুনে মান্যতার কপাল কুঁচকে গেলো।নিজের নামের অপমানটাও গায়ে মাখানোর সময় পেলো না।কৌড়ির দিকে তাকালো সে।মান্যতা তাকাতেই কৌড়ির অসহায় মুখটা আর-ও ছোটো হয়ে গেলো।সন্দেহভাজন গলায় জিজ্ঞেস করল।

‘ছোটো দাদাভাই এসব কি বলছে কৌড়ি?তোমার আর ওরমধ্যে কি সিক্রেট চলছে?তোমার আবার হঠাৎ বর, শ্বশুরবাড়ি,এসব আসলো কোথা থেকে?

উত্তর দিতে পারলো না কৌড়ি।মুখটা আরও ছোটো করে ফেললো।ইভানের দিকে অদ্ভুত নজরে তাকাতেই চমৎকার হেসে দিলো সে।সেটাও অদ্ভুত নজরে দেখলো মান্যতা।ইভানের বলা কথাগুলো না ভেবেচিন্তে হুটকরে বলে বসলো।

‘তুই কি কোনোভাবে কৌড়িকে এ-বাড়ির ছোটো বউ বানানোর ইঙ্গিত দিচ্ছিস?

‘আস্তাগফিরুল্ল্যাহ,এসব কি কথাবার্তা!এই গর্দভ আমি একটু আগে কি বললাম।ফুলকৌড়িকে আমি আমার না হওয়া বউমনি বললাম না।আর তুই না ভেবেচিন্তে কি আস্তাগফিরুল্ল্যাহ মার্কা কথাবার্তা বলে দিলি!বুঝেছিস তবে কেনো আমি তোকে মাথামোটা বলি।ওমনি ওমনি তো আর বলিনা।কথাবার্তা কাজকর্ম যেমন নামও তার তেমন হওয়া উচিত?তাই নয়কি ফুলকৌড়ি?ওহ স্যরি স্যরি আমার বউমনি?

কৌড়িতো কথা বলতেই ভুলে গেলো।এই ছেলের কথার পাল্টা কথা বলা মানে।এক পুকুর ভরাডুবি জলের মধ্যে একটুকরো ঢিক ফেলা।মান্যতা আশ্চর্য হয়ে বললো।–তারমানে?

‘ইয়েস, ফুলকৌড়িকে আমি দাদাভাইয়ের বউ বানাবো বলে কনফার্ম করে ফেলেছি?কনফার্ম মানে বিয়ে হোক আর না হোক,আমার দাদাভাইয়ের বউ হবে ফুলকৌড়ি।
অন্য কাওকে আমি মানিনা,মানবোও না।

মান্যতা বিমূঢ় হয়ে ইভানের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো–দাদাভাই আর কৌড়ি!একজন পানির মতো সহজ তো অন্যজন পাহাড়ের মতো দৃঢ় কঠিন।কিভাবে সম্ভব?নাকি তুই সম্ভব বানিয়ে নিয়েছিস?

‘সম্ভব নয় কেনো?আমাদের সবার ফুলকৌড়িকে পছন্দ এমনকি দাদাভাইয়ের বউ হিসাবেও পছন্দ।সো দাদাভাই না মানলে,আমরা হরতালে নামবো।আমাদের একটাই দাবী হবে,ফুলকৌড়িকে আমাদের বউমনি হিসাবে চাই।দাদাভাই আমাদের দাবী না মানা পর্যন্ত এ-দাবী চলতে থাকবে।দাদাভাই মানতে বাধ্য!আর এমনিতে-ও দাদাভাই মানতে বাধ্য।শুধু দাদাভাইয়ের বউটার সুমতি আর সম্মতি হলেই হয়।

ওহ তারমানে ছোটোদাদাভাইয়ের এটা নিজস্ব ভাবনা, বড় দাদাভাই জানে না কিছু।তবে ভাবনাটা মন্দ নয়।কিন্তু তাদের ওই গুরুগম্ভীর দাদাভাই জীবনে এই দাবী মানবে বলে মন হয়না তার।

‘ইভান ভাইয়া থামুন’না প্লিজ।আমার মাথা কেমন কেমন করছে?আপনার এ্সব ভয়াবহ উল্টো পাল্টা কথার জ্বলায় ক’দিন পর দেখবেন,আমি রাস্তা রাস্তায় ঘুরছি।

‘ঘুরবে রাস্তায়,সমস্যাটা কোথায়?দাদাভাই আছেনা।বউ রাস্তায় ঘুরবে,আর সে বসেবডে দেখবে নাকি।ধরে নিয়ে আসবে।তবুও আমার দাবী মানতেই হবে তোমাকে।

কৌড়ি অযথা আর কথা বাড়ালোনা।প্রবাদে আছে না,বিচার মানতে পারি তবে তালগাছটা আমার।মায়ামায়া মুখটা ছোটো করেই মান্যতার দিকে তাকিয়ে রইলো।মান্যতা সেটা দেখে বললো–ওর মাথার নাটবোল্টু আগে থেকেই ঢিলা আছে,এটাতো তুমি-ও জানো।দেখোনা,সারাদিন এরওর পিছে লেগে থাকা ওর কাজ।আপতত পড়াশোনাতো নেই,এজন্য মাথার কলকব্জা গুলো আর-ও নড়বড়ে কাজ করছে।এবার তাই তোমাকে নিয়ে পড়েছে,তোমার পিছু লেগেছে।ওর কথা কানে নিওনা।এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দাও।

‘এই তুই ওকে কি পরামর্শ দিচ্ছিস?নিশ্চয় উল্টোপাল্টা কিছু!যদি-ও ননদীনিদের কাজ হচ্ছে কূটনামি করে বেড়ানো।দৃষ্টান্ত আমাদের ফুফুমনি…..

‘ওই কি বললি তুই?

বাজখাঁই গলার আওয়াজ শুনে তথাস্তু হলো সবাই।মূহুর্তেই সবার গোলগোল নজর,দরজায় দাঁড়ানো নারীর পানে পড়লো।মান্যতা মিটিমিটি হাসলেও, কৌড়ি চোখ নামিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইলো।এই মহিলাকে দেখলে কেনো জানেনা অকারণে তার কলিজায় কম্পন ধরে যায়।পরিস্থিতিতে না বুঝে কখন ছোটো বড় কথা শুনিয়ে দেয়!বেকুবের ন্যায় আগলা হাসলো ইভান
ফের টেনেটেনে বললো।

‘ওহ ফুফুমনি আপনি!আপনি তো কতো ভালো।আপনি কি আমার মা চাচিদেরকে জ্বালিয়েছেন নাকি?জ্বালান নি তো!আর না কখনো উনাদের সাথে কুটনামো করছেন!আমি তো মান্যতা-কে বলছিলাম,ও তো আর আপনার মতো নয়।আর বলতে গিয়ে কিভাবে জেনো আপনার নামটা মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো।ইশশ,এই মুখটা-ও না,ইদানীং টোটালি কন্ট্রোলে থাকতে চায়না।এতো কন্ট্রোল করার ট্রায় করি কন্ট্রোলই হয়না।আপনি তো মানুষ হোক বা তার মনমস্তিস্ক বেশ ভালোই কন্ট্রোল করতে পারেন।আমার মুখটা কিভাবে কন্ট্রোল করা যায় বলুন তো ফুপমনি?

জ্বলন্ত নজরে ইভানের দিকে তাকালেন ডালিয়া বেগম।কিভাবে ঘুরিয়ে পেচিয়ে বাহিরের একটা মেয়ের সামনে উনাকে চরম অপমানিত করলো ছেলেটা।একটা সময় ইভানের উপর কৃতিত্ব চলতো উনার।ছেলেটা উনার কথা সহজ সরল মনে বিশ্বাস করতো,মানতো।আর তারই প্রতিফলন অক্ষরে অক্ষরে ঘটাতো।সেই ছেলের হঠাৎই কি হলো!উনাকে তো মান্যই করে-না।কথায় কথায় ছোটোবড় কথা শুনিয়ে উনাকে উচিত জবাব দিতেও ছাড়েনা।বাপের মতো স্বভাব পেয়েছে কি-না! সারাজীবন রাস্তার লোক কুড়িয়ে কুড়িয়ে বাড়িতে নিয়ে এসে আশ্রয় দেবে।আবার তাদের নিয়ে যত্তসব মাতামাতি।পিরিত দেখানো।এখন এখানে দাঁড়িয়ে ইভানের সাথে তর্কবিতর্ক করলে আর-ও ছোটোবড়ো বেফাঁস কথা শুনিয়ে দিতে ছাড়বেনা ছেলেটা।বিধায় রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেলেন তিনি।যাওয়ার আগে অদৃশ্য কারনে কৌড়ির পানে বিরক্তিময় দৃষ্টি ফেলে তাকে ছোটোকরে কটু কথা শুনিয়ে যেতেও ভুললেন না।

‘পরের মেয়ে।চাচা ভাইরা নিতে এসেছে,দিয়ে দেবে।তা-না,আহ্লাদ করছেন।বাড়তি ঝামেলা বাড়িতে ফ্রীতে পুষে রাখতে খুব ভালো লাগে।যত্তসব আদিখ্যেতাপনা !

ইভান, মান্যতা জানতো ফুফুমনির হঠাৎ এখানে পদচারণের কারণ কৌড়িকে ছোটোবড় কথা শোনানো।
তিনি শুনেছেন এবং দেখেছেন,কৌড়িকে নিজের বাড়ি থেকে তার চাচা নিতে এসেছেন।আর তিনি এটাও বুঝতে পেরেছেন,এবাড়ির কেউ কৌড়িকে সহজে যেতে দেবে না।তিনি এসব বিষয় নিয়ে রান্নাঘরে বসে গজগজ করছিলেন মায়ের সাথে,শুনে এসেছে ইভান।সুযোগ পেলে কৌড়িকেও যে দু’কথা শোনাতে পিছুপা হবেন-না, এটাও জানা ছিল ইভানের।ফুফুমনিকে এখানে আসতে দেখে সেই সুযোগ দিতে চাইছিলো না ইভান।সেটা রোধ করার জন্য ফুফুমনিকে উল্টো পাল্টা কথার জালে ফাসিয়ে নিজের দিকে মনোযোগী করতে চাইছিলো।
তবুও নিজের স্বভাবের বহিঃপ্রকাশ তিনি ঘটিয়েই গেলেন।যার যা স্বভাব!মেজাজ খারাপ হলো ইভানের।মাথা নিচু করে থাকা কৌড়ির পানে একপলক তাকিয়ে শব্দকরে পা ফেলে চলে গেলো সে।পায়ের শব্দে কান ধরে গেলো মান্যতার।সেদিকে খেয়াল না দিয়ে কৌড়ির দিকে ফিরে বললো।

‘মন খারাপ করো-না।ফুফুমনির কাজই হচ্ছে সবাইকে খোঁচা দিয়ে কথা বলা।আম্মু ছোটোমা বা কাওকেই বাদ রাখেন না কথা শুনাতে।তাই উনার কথা কানে নি-ও না।আমরা কেউ নেইনা।

মাথা নিচু রাখা অবস্থায় মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলো কৌড়ি।সেটা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো মান্যতা।বুঝলো, মেয়েটার মন খারাপ তো ছিলো।আরও মন খারাপ হয়ে গেছে।ফুফুমনি যে কেনো এরকম স্বভাবের,বুঝে আসে না মান্যতার।


‘বাহ,বিয়ের কনে দেখি নিজেই এসেছে বিয়ের আমন্ত্রণ জানাতে।বিষয়টা মন্দ না।এখনকার যুগ,এখন তো আর ছেলেরা বিয়ে করতে যায়না, উল্টে মেয়েরা আসে বিয়ে করতে।সেই হিসাবে তোমার নিমন্ত্রণের বিষয়টা কোনো ব্যাপারই না।তা কেমন আছো তন্ময়ী?

মা তাহমিনা বেগমের সাথে এ-বাড়িতে নিজের বিয়ের আমন্ত্রিত কার্ডটা দিতে এসেছে তন্ময়ী।ভাই গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য আসতে পারিনি।আর সে-ও আসতে চাইনি।তবে মা জোর করে নিয়ে এসেছেন।জোর করার কারন ছিলো,কিছু কেনাকাটা বাকি আছে।যাবার রাস্তায় তা সম্পূর্ণ করা।আর এ-বাড়ির সাথে ভাইয়ের দারুন একটা সুসম্পর্ক থাাকায় আসতেও হলো তাকে।তবে এবাড়িতে তার না আসার মহা কারণটা হলো,সামনে দাড়ানো অসভ্য ফাজিল মানুষটা।মা,সবার সাথে ভিতরে কথা বললে-ও,এই লোকটাকে এড়াতে তন্ময়ী মান্যতার সাথে ছাঁদে এসেছে।মান্যতার ফোনে জরুরি কোনো কল আসায়,সে কথা বলছে ছাঁদের অন্যত্র দাঁড়িয়ে।আর তন্ময়ী, ছাঁদে লাগানো বিভিন্ন নাম জানা অজানা মনোমুগ্ধকর ফুলের ফলের গাছগুলো দেখছিলো।মনেমনে কিছু কারনবশত আতঙ্কিতগ্রস্থও ছিলো।আর স্বয়ং সেই আতঙ্ক হাজির।তবে ইভানের মজার ছলে বলা কথাগুলোর উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলোনা।বিধায় চুপ রইলো।

‘কি হলো বলছো না যে, কেমন আছো?তবে তোমার চোখমুখের এক্সপ্রেশন তো বলছে খুবই ভালো আছো।বিয়েতে-ও খুব খুশি?বর বুঝি দারুণ হ্যান্ডসাম?

শেষের প্রশ্নটা ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো সে।ইভানের কথার মাঝে নিজের জন্য অবজ্ঞতা টের পেলো তন্ময়ী।ভিতরে ভিতরে জ্বললো।তবে বাহিরে তা প্রকাশ করলো না।ঠান্ডা গলায় বললো।

‘হ্যা খুব খুশি।বুঝতেই যখন পারছেন জিজ্ঞেস করছেন কেনো?

বিকালের গোধূলি লগ্নে উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের মেয়েটার মুখের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো ইভান।শ্যামবর্ণের নারীরা সত্যিই মায়াবিনী হয়।না-হলে সেই মায়ার রূপে কোনো পুরুষের বুকে উতালপাতাল তরঙ্গ বয়ে যায় কি করে!চারপাশে এতো সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি থাকতে সেই শ্যামবর্ণ সৌন্দর্যে নজর মুগ্ধ হয় কিকরে!আর মেয়েটার ওই গোলগোল চোখ..উফফ!সেই চোখে নিজেকে অপরাধী হিসাবে বিবেচিত হতে দেখতেই শান্ত কন্ঠে বললো।

‘তুমি অকারণে আমাকে ভুল বুঝে,ভুল স্টেপ নিয়েছো
তন্ময়ী।

তন্ময়ীর কালোমনির গোলগোল সচ্চ চোখদুটো মূহুর্তেই জ্বলে উঠলো।গোল ফ্রেমের চশমার আড়ালে সেটাও লক্ষ্য করলো ইভান।তবে ইভানকে পাত্তা না দিয়ে শক্ত গলায় তন্ময়ী বললো।

‘আমি কখনো বুঝতেই চাই-না আপনার মতো বড়লোকদের ছেলেদের।সেখানে আপনাকে ভুল বোঝা তো অনেক দূরের কারন।

ট্রাউজারের দুপকেটে দু-হাত গুঁজে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো ইভান।তন্ময়ী কথাগুলো বলতেই রাগে হাতের মুঠো শক্ত হয়ে এলো তার।তবে সামনে রমনীকে সেটা বুঝতে দিলোনা।তন্ময়ীকে ভেদ করে সামনে নজর দিলো।মান্যতা সামনের অদূরে মনোযোগ দিয়ে ফোনে কথা বলছে।এবার তন্ময়ীতে মনোযোগী হলো ইভান।মৃদু ঝুকলো তারপানে।ফের বললো।

‘তুমি যেটা করলে,ভুল নয় অন্যায় করলে।একদম ঠিক করলে না।ইভানকে তো চেনো না।তোমার জিনিস যখন,এবার চিনবে।চার চোখ দিয়ে একটু বেশিই দেখে ফেলেছো কি-না!

সেকেন্ড দেরী করলো-না ইভান।বড়োবড়ো পা ফেলে চলে গেল নিচে।রাগে চোখমুখ লাল হয়ে গেল তন্ময়ীর।নিজে মেয়েদের সাথে ফূর্তি করে বেড়াবে আর তাকে কথা রাখতে হবে।আর না রাখলে, তুমি কাজটা ঠিক করলেনা।নিজের বেলার সব ঠিক।বিয়ে তো সে করেই ছাড়বে।সব ঠিকঠাক।এবার করবে কি?

রাগ ক্রোধ ছাড়িয়ে মনেমনে ইভানকে ভেঙালো সে।ফের মনেমনে বললো—আমি ইভান!দেখি এবার সেই ইভানে কি করতে পারে!

ড্রয়িংরুমে বসে আছেন তাহমিনা বেগম।অনেক্ক্ষণ যাবত একটা মেয়েকে দেখছেন।আর আগেও এবাড়িতে আসা হয়েছে উনার। কিন্তু মেয়েটাকে তিনি দেখেছেন বলে মনে হয়না।এখনকার যুগ হিসাবে মেয়েটা বেশ সুশৃঙ্খল।শালিন শান্ত চলাফেরা।কথাবার্তাও নিন্মগামী।আর সৌন্দর্য তো নজরে পড়ার মতোন।কে মেয়েটা?ছেলের বিয়ে দেবেন বলে মেয়ে খুঁজছেন। তবে যেরকম মেয়ে তিনি খুঁজছেন বা চাইছেন, সেরকমটা মিলছেইনা।
তবে মেয়েটা কে,জিজ্ঞেস করবেন না-কি?মেয়েটাকে এতো মনে ধরেছে কৌতুহল চেপে রাখতে পারলেন না।সামনে বসা নিহারীকা বেগমে জিজ্ঞেস করেই ফেললেন।

‘আপা,ওই মেয়েটা কে?আগে তো এ-বাড়িতে কখনো দেখিনি তাকে।আপনাদের আত্নীয় বুঝি?

মৌনতার সাথে অদূরে দাঁড়ানো কৌড়িকে দেখিয়ে তাহমিনা বেগম কথাগুলো বলতেই,নীহারিকা বেগম সেদিকে লক্ষ্য করলেন।ফের মৃদু হেসে কিছু বলতে যাবেন তারআগে পাশে বসদ ডালিয়া বেগম চোখমুখ কুঁচকে বললেন।—আরেহ না আপা আমাদের আত্মীয় টাত্নীয় কিছু নয়।ওই ভাইজানের কোনো এক বন্ধুর মেয়ে।বাপ মা মরে গেছে,তাই ভাইজান বাড়িতে এনে বাড়তি ঝামেলা পুষছে।

ডালিয়া বেগমের বলা কটুবাক্যগুলো তাহমিনা বেগমের মোটেই ভালো লাগলো না।আর নীহারিকা বেগমের তো ভালোই লাগলো-না।অন্তত বাহিরের মানুষের সামনে নিজের খোলাসা থেকে না বের হলেই কি হতো না!মনে মনে ননদকে প্রবোধন করে, তাহমিনা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বললো।

‘আসলে ব্যাপারটা তা নয়,আপা।মেয়েটা আমাদের রক্তের সম্পর্কিত কিছু না হলেও,এক-প্রকার আত্মার আত্মীয়।রক্তের সম্পর্ক না থেকে-ও কতো বন্ধন তো তৈরী হচ্ছে।আর সেসব সম্পর্ক আজীবন নিষ্ঠার সাথে চলে আসছে।এই দেখুন আপনাকে আমাকে,রক্তের সম্পর্ক ছেড়ে পড়ে আছি কোথায়।যেখানে রক্তের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই।অথচ সম্পর্কগুলো কতো কাছের, কতো আপন।ওই মেয়েটার সাথে আমাদের সম্পর্কও তেমনটাই।রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় নাহলে-ও আত্মার আত্মীয়,আপনজন।আপনার ভাই সাহেবের খুব ভালো একজন বন্ধুর মেয়ে।মেয়েটার মা মারা গিয়েছে জন্মের সময়,আর বাবা মারা গিয়েছেন এই কিছুদিন আগেই।
আপতত দাদিআপা ছাড়া কেউ নেই।নেই বলতে চাচা চাচিরা আছেন।তবে এখনকার যুগে নিজেরটা বাদে পরেরটা কে দেখে।তাই বলে মেয়েটা সম্বলহীন অসহায় নয়।তবে অর্থ সম্পদ, ঘরবাড়ি তো সবকিছু নয়।মাথার উপর একটা ছায়া সবার খুব প্রয়োজন। সেখানে মেয়ে মানুষের তো আরও প্রয়োজন। আর সেই প্রয়োজনটুকু শুধু আমরা করছি।অযথা না মেয়েটা এবাড়িতে থাকছে আর না আমরা পুষছি।

নিজের বিরুদ্ধে গিয়ে ভাবিকে কথা বলতে দেখেই ডালিয়া বেগম অসন্তুষ্ট হলেন। ভিতরে ভিতরে ক্ষুব্ধ হয়ে
বিরক্ত প্রকাশ করলেন, যত্তসব আদিখ্যেতা!প্রবোধন করে উঠে দাড়ালেন।মুখপ বিজবিজ করে চলে গেলেন।নীহারিকা বেগম দেখলেন,বুঝতে পারলেন। তবে কিছুই বললেন না।তাহমিনা বেগম সুশিক্ষিত নারী।নীহারিকা বেগমের বলা কথাগুলো বেশ বুঝলেন।আর মেয়ে মানুষের ছায়া হয়ে,তাদের পিতা ভাই স্বামীকে যে কি প্রয়োজন! সেটা তিনি খুব ভালো করে জানেন।তাদের লড়াইটা কেমন হয় এটাও উনার শিরায় শিরায় উপলব্ধি আছে।একটু আগের ভাবনাটা ফের মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো উনার।বাবা,মা নেই তো কি হয়েছে।মেয়েটা ভালো হলেই হলো।মনেমনে নিজের ভাবনা নিয়ে কিছুসময় তেনোমনো করলেন।সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে বেশ বিচক্ষণতার সহিত তাহমিনা বেগমকে লক্ষ্য করলো ইভান।বারবার কৌড়ির দিকে তাকাচ্ছে আর কিছু একটা ভাবছে।উনার মুগ্ধ নজর,আর ভাবান্নিত মুখাবয়ব।মোটেই সুবিধার ঠেকলোনা ইভানের কাছে।তার না হওয়া সংসারটা ভেঙে এবার তার ভাইয়ের না হওয়া সংসারটা ভাঙতে চাইছেন না তো উনি।উনার দৃষ্টিতো তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে। তার বউটা ছিনিয়ে নিয়ে এবার ভাইয়ের বউয়ের পানে কুদৃষ্টি! ছিনিয়ে নেওয়ার প্লান।নো ওয়ে।বড়বড় পা ফেলে তাহমিনা বেগমের পাশে এসে বসলো ইভানে।ফের মা’কে উদ্দেশ্য করে বললো।

‘আন্টির জন্য এখনো নাস্তাপানির ব্যবস্থা করো-নি আম্মু?টেবিল খালি কেনো?

ছেলের ব্যবহারে অপ্রস্তুত হলেন,নীহারিকা বেগম।আশ্চর্য ছেলে উনার।মেহমানের সামনে এভাবে বলতে আছে।তাতে নিজেদের ও লজ্জা পেতে হয়,সাথে মেহমানকেও।এই ছেলের সুবুদ্ধি হবে কবে থেকে কে জানে!তবুও মেহমানের সামনে অপ্রস্তুত যখন করেছে উত্তর তো দিতেই হবে।মৃদু হেঁসে তিনি বললেন।

‘রানি চা বানাচ্ছে, তাই হয়তো দেরী হচ্ছে।চা টা হয়ে গেলেই দিচ্ছি।

‘এসবের দরকার ছিলোনা কিন্তু আপা।আমিতো এখনই
উঠবো।

‘দরকার ছিলো না মানে কি?অবশ্যই দরকার আছে।আপনি দাদাভাইয়ের বেস্ট ফ্রেন্ডের মা বলে কথা।আর এই জোয়ার্দার বাড়িতে আপনার আপ্যায়ন হবে-না,তা কিকরে হয়!কতোদিকের আত্মীয় আপনি।আপনি তো নিজেও জানেন না।

কপাল কুঁচকে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন নীহারিকা বেগম। এই ছেলে বলছেটা কি?তবে বাহিরের একটা মানুষের সামনে ছেলেকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারলেন না।শুধু বললেন —দেখি,ওদিকে রানির কতোদূর হলো।

সেসবে খেয়াল নেই তাহমিনা বেগমের।তিনি নিজের ভাবনায় ডুবে আছেন।আর কিছুক্ষণ পরপর কৌড়ির মায়াময় মুখটার দিকে তাকাচ্ছেন।সেটা দেখে এবার নিশ্চিত হলো ইভান।ভদ্রমহিলা মনেমনে কি আশা পোষন করছেন।তবে তা হতে দেওয়ার নয়।ইভান তো কখনোই হতে দেবেনা সেটা।কন্ঠে উচ্ছলতা প্রকাশ করে ইভান,উনাকে উদ্দেশ্য বললো।

‘মেয়েটা সম্পর্কে শুনছেন নিশ্চয়।

বেখেয়ালিতে উত্তর দিলেন তাহমিনা বেগম।ছোটো করে উত্তর দিলেন– হুমম!

‘মেয়েটাকে দাদাভাইয়ের বউ বানাতে চাইছেন আম্মু আব্বু।কেমন হবে বলুনতো?দাদাভাইয়ের পাশে দারুণ মানাবে না?

চমকে ইভানের মুখের দিকে তাকালেন ভদ্রমহিলা।তিনি কি ভাবলেন,আর এই ছেলে কি শোনালো।ভ্যাগিস বলবে বলবে করেও মুখে বললেন না নিজের ভাবনার কথা।নাহলে লজ্জার শেষ থাকতোনা।তবে মনেমনে মন খারাপও হলো উনার।যদিও এরকম মেয়ে কে হাতছাড়া করতে চায়।ইভান হাসি মুখে ফের বললো।

‘মেয়েটাকে আমাদের ও দারুন পছন্দ। পছন্দ হওয়ার মতো মেয়ে।আমরাও চাই,দাদাভাইয়ের বউ হিসাবে তাকে এবাড়িতে আজীবন আমাদের বউমনি হিসাবে রেখে দেওয়া হোক।আন্টি..বললেন নাতো,কেমন হবে দাদাভাইয়ের বউ হিসাবে মেয়েটা?

‘খুবই ভালো।

সন্তুষ্ট হলো ইভান।ভদ্রমহিলা এবার নিরেট নজরে কৌড়ির পানে তাকিয়ে রইলেন।সেটা-ও লক্ষ্য করলো ইভান।বুঝলো,একদেখায় কৌড়িকে উনার বেশ মনে ধরেছে।মনে ধরলে কি হবে,কৌড়ি শুধু দাদাভাইয়ের।আর কার-ও সে হতে দেবেনা কৌড়িকে।মহিলার পাশ থেকে উঠলো না ইভান।সে চলে যাওয়ার পর,ভদ্রমহিলা যদি মা’কে জিজ্ঞেস করে বডেন।আর তার মিথ্যা ধরা পড়ে যায়।তখন আরেক বিপত্তি।সেটা না হতে দেওয়ায়, বসে থাকলো সে।ওই বিষয়ে প্রশ্ন করলে বা প্রসঙ্গ উঠলে,এলেবেলে কথা দিয়ে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিতে পারে যেনো বিধায় বসে থাকা।নাস্তা আসলো।খাওয়া দাওয়া হলো তবে তার কথার বিষয়ে কথা উঠলোনা।একপর্যায়ে উনারা সবাইকে নিমন্ত্রণ দিয়ে চলে গেলেন।সেই চলে যাওয়ার পানে তাকিয়ে ইভান নিজের জীবনের চক্রটা-ও সাজিয়ে গুছিয়ে নেওয়ার চিন্তা ভাবনা মশগুল হলো।


সময়টা শরতের শেষ বিদায়ের দিন।আকাশের সাদা মেঘের তুলোরাশি গুলো হঠাৎ কালো মেঘপুঞ্জে ছেয়ে গেছে।কালবৈশাখীর ন্যায় উতালপাতাল ঝড়ো হওয়ার ন্যায় বৈরী বাতাস শুরু হলো।সময়ের ব্যবধানে হঠাৎই দুপুর বেলার চারপাশটা মধ্যরাতের ন্যায় অন্ধকারাচ্ছন্নে ছেয়ে গেলো।কাল থেকেই শরতের মিঠে-মিঠে রোদের আবহাওয়াটা অল্পঅল্প করে খারাপের দিকে এগোচ্ছিলো।আজ সকালের দিকেও আকাশটা সেই অল্পঅল্প খারাপেই সীমাবদ্ধ ছিল।হঠাৎ বেলা গড়াতেই আবহাওয়ার চরম অবনতি পর্যায়ে চলে গেলো।কালবৈশাখীর ন্যায় ঝড় হাওয়া শুরু হলো,সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি।সেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টিটা এখন ঝুমঝমে কুলকুলে বন্যায় পরিনত হয়েছে।মান্যতা আজ ভার্সিটিতে যায়নি।মৌনতার স্কুলে বারোটায় ছুটি হয়।ছুটি হওয়ার সাথে সাথেই চলে এসেছে সে।ইভান বাড়িতে নেই,বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গেছে নাকি।ফোনটা-ও আপতত বন্ধ তার।এই ছেলেটাকে কখনো কাজের সময় পাওয়া যায় না,সবসময় অকাজের সময় তিনি পিছপিছে।দুপুর দুটো বাজতে গেলো কৌড়িটা এখনো বাড়িতে ফেরিনি।এই পরিস্থিতিতে ফেরারও কথা নয়।সেটা নিয়েই চিন্তিত নীহারিকা বেগম।এক জায়গায় স্থির হয়ে বসতে পারছেন না তিনি।মেয়েটার কলেজ ছুটি হয় একটায়।এখন বাজতে চললো দুটো,
অথচ মেয়েটা এখনো বাড়িতে ফিরলোনা।ঝড়বৃষ্টি নিয়ে তো এমনিতেই টেনশনে আছেন,মেয়েটা ফিরবে কি করে?আর তার থেকে-ও টেনশন হচ্ছে,উনার মমতাময়ী মন আজ অবিরত উল্টো পাল্টা গেয়ে চলছে।মেয়েটা কলেজের মধ্যে আছে নাকি এই পরিস্থিতিতে-ও বাহিরে বের হয়েছে!মেয়েটা ঠিকঠাক আছে তো,নাকি কোনো বিপদে পড়েছে!ঝড়বৃষ্টি থামার সাথে সাথে মেয়েটা ঠিকঠাক বাড়িতে ফিরতে পারবে তো!এরকম কতশত আবোলতাবোল গাইছে মন।কৌড়ি যে এখনো বাড়িতে ফেরেনি, এটা জাহিদ সাহেবকেও জানাননি তিনি এখনো।নাহলে মানুষটাও দুশ্চিন্তা করবেন।সাথে রাগ করবেন,আবহাওয়ার এমন অবনতি দেখেও মেয়েটাকে নিয়ে আসতে বাড়ির গাড়িটা কেনো পাঠানো হয়নি।বিষয়টা খেয়ালেই ছিলো-না উনার।এখন কি করবেন!হাফিজি তো আপতত বাড়িতে নেই।

ইভানের নাম্বারে আবারও ট্রায় করলেন। বারবার ট্রায় করতে থাকলেন।পেলেন না।মেজাজ চড়ে গেলো উনাার।মনেমনে হাজার বকাঝকা দিলেন ছেলেটাকে।সময় যতো ঘনাতে লাগলো, উনার অস্থিরতা ততোই বাড়তে থাকলো।একপর্যায়ে গিয়ে বাধ্য হয়ে নিভানকে ফোন দিলেন।নিভান ফোন উঠাতেই আতঙ্কিত গলায় ছেলেকে ডাকলেন।

‘ও নিভান।

চমকে উঠলো নিভান।মা তো কখনো এভাবে ডাকেনা তাকে।তবে আজ কি হলো?বাড়িতে কারও কিছু হয়নি তো।কিঞ্চিত বিচলিত হলো সে।বললো

‘কি হয়েছে মা?তোমার কন্ঠ এমন শোনাচ্ছ কেনো?বাড়িতে সবাই ঠিক আছে তো?

সময় নিলেন না নীহারিকা বেগম।বিচলিত গলায় বললেন—বাড়িতে সবাই ঠিক আছে।কার-ও কিচ্ছু হয় নি।তবে?

স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো নিভান।ফের বললো—তবে কি হয়েছে?

‘কৌড়িটা এখনো বাড়িতে ফেরেনি।বাহিরে কি অবস্থা দেখেছিস,মেয়েটাকে নিয়েতো আমার খুব টেনশন হচ্ছে বাবু।পরের বাড়ির মেয়ে কিছু হয়ে গেলে কি জবাব দেব।ইভান-ও বাড়িতে নেই,ফোনে-ও পাচ্ছি না ও-কে।বাড়ির গাড়িটা পাঠাবো,হাফিজও বাড়িতে নেই।ও বাবু তুই একটু ওর কলেজে গিয়ে দেখ না।আমি যে স্থির হতে পারছি-না।মনটা শুধু কু- গাইছে।

চলবে…..

#ফুলকৌড়ি
(১৯)কপি করা নিষিদ্ধ
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

শরতের কালবৈশাখীর ন্যায় বৈরী-হাওয়াটা প্রকৃতিতে আর তান্ডব চালালো কোথায়!তার থেকে দ্বিগুণ বৈরী হাওয়া শুরু হলো নিভানের মনে।বাহিরের ঝড়ো হওয়ার থেকেও দ্বিগুন তন্ডব লীলা চলতে থাকালো বুকের ভিতরের যন্ত্রণটায়।ছটফটিয়ে উঠলো মন।মা এসব বলছেটা কি?বাহিরের এই বৈরী ঘোর আমাবস্যার ন্যায় অন্ধকারচ্ছন্ন অবস্থা,ঝুম বৃষ্টি!তারমধ্যে মেয়েটা এখনো বাড়িতে ফেরে-নি।আর সেই কথাটা মা এখন তাকে বলছে!আশ্চর্য!ওপাশ থেকে অনবরত অপরাধী গলায় এটাওটা বলতেই থাকলেন নীহারিকা বেগম।সেসব যেনো কানের ভিতরে গেলেও,মন স্পর্শ করলোনা।ফোন কেটে দিলো নিভান।সেকেন্ড দেরী করলোনা।দ্রুত পায়ে অফিসকক্ষ থেকে বের হলো সে।আশেপাশে কোথায় কে আছে,খেয়াল করলো-না।বড়বড় পা ফেলে কিছুটা হন্তদন্ত হয়ে ব্যতিব্যস্ত পায়ে সামনে এগোলো।পথিমধ্যে দেখা হলো মৃদুলের সাথে।মিটিং রুমে ক্লায়েন্টের বসিয়ে সে আসছিলো নিভানের সাথে দেখা করতে।আজ একটা বিশেষ কনফারেন্স আছে।বড়ো একটা ডিল-ও সাবমিট করতে হবে।সেসব সব তদারকি করে,স্যারকে জানাতে আসছিলো।পথিমধ্যে নিভানকে ব্যতিব্যস্ত হয়ে বের হতে দেখে নিজেই দাঁড়িয়ে পড়লো।নিভানের গম্ভীর মুখাবয়বের প্রকাশভঙ্গি অদ্ভুত ঠেকলেও,দু’জনে সামনাসামনি হতেই মৃদুল বললো।

‘স্যার,কনফারেন্স রুমে আপতত সব কমপ্লিট।ক্লায়েন্টরা-ও এসে গেছে। আপনি গেলেই কনফারেন্স শুরু হবে।

তবুও থামলো না নিভান।আজ ডিলটা বিদেশি ব্যবসায়ীদের সাথে।নিজেদের কোম্পানির বিভিন্নরকম প্রডাক্ট শেয়ারে নিয়ে বিদেশিরা তাদের নিজেদের দেশে ব্যবসা করতে চান।জে এইস জে এর বিভিন্ন প্রডাক্ট, দেশে ছাড়া-ও বাহিরের দেশে নামডাক রয়েছে,চলে-ও প্রচুর।যার কারন ভিত্তিক বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীদের সাথে যুক্ত আছে তারা।আজ সেরকমই আর-ও একটা বিদেশি ব্যবসায়ীর সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার কথা।ডিলটা ইম্পর্ট্যান্ট।এই বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে-ও,উনারা হাজির।তবে সেসব এখন আর তার মাথায় ঘুরছেনা।কৌড়ির থেকে সেই ইম্পর্ট্যান্ট ডিলটাকে কিছুতেই গুরুত্ব দিতে পারছেনা।মুলত দিতে চাইছেনা না নিভান।তাতে যা হয় হোক।সামনে এগোতে এগোতে সে বললো।

‘আজ ছোটো চাচ্চুকে সামলিয়ে নিতে বলুন।না পারলে আপনি সামলিয়ে নিন।

বিস্মিত হলো কথাকাজে অনড় থাকা স্যারের অদ্ভুত কথাগুলো শুনে।এমন তো কখনোই হয়নি।আজ হঠাৎ কি হলো স্যারের?ভাবনার সাথে সাথে নিভানের পিছু নিলো সে।বললো।

‘আজকের কনফারেন্সটা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ,সেটাতো আপনি জানেনই।আর সেখানে আপনার ভুমিকা-ও যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ন।থাকাটা খুবই জরুরি।এটা-ও তো আপনার জানা।আপনি ছাড়া যে ডিলটা ক্যান্সেল হয়ে যেতে পারে।সেটাও তো আপনি জানেন!

‘তবে ক্যান্সেল করে দিন।এই ডিলটার থেকে-ও,সে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

নিভানের মুখের কথাগুলো আশ্চর্যের থেকেও আশ্চর্য লাগলো মৃদুলের কাছে।ডিলের থেকে-ও সে ইম্পর্ট্যান্ট।মানেটা কি?কে সে?থমকালো মৃদুল।তবে স্যারের মুখের উপরে জিজ্ঞেস তো করা সাঝে না।তাই বললো।

‘স্যার, এ্যানি প্রবলেম?

‘নো।

এই পর্যায়ে এসে আর কথা বাড়ানো উচিত নয়।নিজের সীমা জানে মৃদুল।তবুও মন কৌতুহলী হয়ে উঠলো।তার দেখা এতোদিনের মানুষটার সাথে আজকের মানুষটার এতো অমিল!মন মানলো না।কৌতুহলী করে তুললো তাকে।নিভানের পিছু হাঁটতে হাঁটতে বললো।

‘বাহিরের এই খারাপ পরিস্থিতি।এই পরিস্থিতিতে বাহিরে বের হওয়াটা ঠিক হবে বলে মনে হচ্ছে না,স্যার।যতোই ইম্পর্ট্যান্ট বিষয় হোক না কেনো,আপনার এখন বের হওয়াটা উচিত হবেন….

লিফটের দোরগোড়ায় এসে থামলো নিভান।মৃদুলের দিকে শীতল দৃষ্টিতে চাইল।এই ছেলে যদি জানতো,তার ভিতরের পরিস্থিতিটা সম্পর্কে।কৌড়ি কোথায় আছে,কিভাবে আছে?সর্বোপরি ঠিক আছে কিনা!এসব ভেবে তার ভিতরে কি অবস্থা হচ্ছে!তবে হয়তো এগুলো বলার সাহস দেখাতো না।এমনিতেই মৃদুলকে এতো কথা বলতে দেখে,নিজেই বিরক্ত হলো।এতো কথা তো বলেনা ছেলেটা।নিজের সীমার মধ্যে থেকে যেটুকু প্রয়োজন সেটুকুই বলে।তবে আজ এতো কথা বলছে কেনো!বিরক্ত হলেও সেটা প্রকাশ করলোনা নিভান।শুধু গম্ভীর গলায় বললো।

‘আমাকে নিয়ে আপতত না ভাবলে-ও চলবে।পারলে
আপনি ওদিকটা দেখুন,কিভাবে সবকিছু হ্যান্ডেল করা যায়,সেদিকে গুরুত্ব দিন।তবে আমার না থাকাটা যদি ডিলটা ক্যান্সেল হয়, সমস্যা নেই।

‘পাগল হলেন আপনি।

মৃদু শব্দে আওড়ানো কথাটাও নিভানের কান এড়ালো না।তবে সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে লিফটে ঢুকে গ্রান্ডফ্লোর বাটুন প্রেস করে চোখ বুঁজে নিলো।সঙ্গে সঙ্গে কৌড়ির মায়াময় সুন্দর মুখখানা ভেসে উঠলো বদ্ধ নজরে।তখন মৃদলের কথার প্রতিত্তোর সরূপ মৃদুস্বরে আওড়ালো।

‘পাগল হতে আর বাকি রেখেছে কোথায়,ওই মেয়েটা!পাগল তো বানিয়েছে সাথে স্বস্তির যে নিঃশ্বাসটা তার চলছিলো সেটা-ও যেনো মৃতু্প্রায় করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।

ভারী শ্বাস ফেললো নিভান।চোখ খুলে ফের বুঁজে ফেললো।মন অতিমাত্রায় ছটফট করছে তার।মনেহচ্ছে চোখের পলকে,মেয়েটার সামনে হাজির হতে পারলে মন শান্তি পেতো।তাকে সুস্থ অবস্থায় দেখতে পেলে,সব দুশ্চিন্তার অবসান ঘটাতো।নিজের নজর,মন,মস্তিষ্ক, পরাণ সব সুখ সুখ অনুভূত হতো।মনেমনে আবারও বিড়বিড়িয়ে বললো।

‘প্লিজ কৌড়ি,আমি তোমার কাছে আসা পর্যন্ত নিজেকে যেকোনো পরিস্থিতি থেকে যেভাবেই হোক আগলিয়ে রেখো।প্লিজ প্লিজ কৌড়ি।

ফের ঘনোঘনো শ্বাস ফেলে মনেমনে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা জানালো–ও প্রভু,সবদিক দিয়ে ঠিক রেখো ও-কে।

বাহিরের বৈরী হাওয়াটা কিছুটা কম হলে-ও,ঝুম বৃষ্টিতে চারপাশটা কুয়াশাচ্ছন্নের মতো ঢেকে আছে।শুনশান রাস্তা।বৃষ্টির ঝুমঝুম আওয়াজ ছাড়া কোনো আওয়াজ নেই।অনেক সময় পরপর দুই একটা করে সিএনজি আসছে যাচ্ছে। তাছাড়া কোনো যানবাহনের চিহ্নটুকো নেই।যদি-ও এই রাস্তায় ছোটো-খাটো যানবাহন ছাড়া, বড়োসড় কোনো যানবাহন চলেনা।রাস্তার ধারের বিভিন্ন দোকানপাটগুলো হয়তো বৈরী এই আবহাওয়ার কারনে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।অসময়ে বন্ধ দোকানের কপাটগুলো সেরকমই ইঙ্গিত দিচ্ছে। ছোটো খাটো শপিংমলগুলোও নিস্তব্ধ।মানুষের আনাগোনো নেই বললেই চলে।অথচ এই সময়টাতে প্রচুর লোকজনদের ভিড় থাকে সেখানে। পিচঢালা রাস্তার এপাশ থেকে ওপাশ যতোদূর নজর যাচ্ছে,শুনশান রাস্তা আর ঝুম বৃষ্টির বড়োবড়ো ফোঁটাগুলা ছাড়া সেভাবে কিছুই নজরে পড়ছে না।তবে মেয়েটা গেলো কোথায়?

কৌড়ির কলেজের সামনে এসে গাড়িটা থামিয়েছে প্রায় পনেরো মিনিটের মতো হবে।এখন বাজতে চলেছে প্রায় তিনটে।দুপুরে তিনটে হলেও,রাত তিনটের মতো দেখাচ্ছে চারপাশটা।ভয়ে ধ্বকধ্বক করে উঠলো বুকের ভিতরটা।মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো বিভিন্ন আজেবাজে চিম্তায়।ইতিমধ্যে,কৌড়ির কলেজে খোঁজ নিয়ে জেনেছে নিভান।সেখানে আপাতত কোনো স্টুডেন্ট অবশিষ্ট নেই।আবহাওয়া খারাপের দিকে যাওয়ার মতিগতি দেখতেই স্কুল এন্ড কলেজের সব স্টুডেন্টের ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।বৈরী হাওয়ায় আর বৃষ্টির তোপে দারোয়ান দুজন-ও আজ গেটের পাহারাদারে নেই।কি করবে নিভান এখন?কোথায় খুঁজবে মেয়েটাকে!কি পরিস্থিতিতে আর কোথায় আছে মেয়েটা!উফ, নিঃশ্বাস নিতেই যেনো অসহ্য লাগছে তার!অনর্গল বইতে থাকা ঝুপঝাপ বৃষ্টির মধ্যে-ও আকাশের দিকে তাকালো নিভান।মনেমনে ওই সাত আসমানের উপরে বসাবসরত মালিকের কাছে হাজারও সাহায্য প্রার্থনা করলো।

‘ও মাবুদ, তাকে একবার শুধু পাইয়ে দাও।শুধু একবার।

শুনশান রাস্তার একপাশে গাড়িটা রেখে আশেপাশে দৃষ্টি বোলাতে ব্যস্ত নজর।বৃষ্টিতে ভিজে জুবুথুবু অবস্থা! সেদিকে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখালো-না নিভান।তার শুধু একটাই ভাবনা,খেয়াল।কৌড়িকে সুস্থ সমেত পাওয়া।আর নিজের রয়েসয়ে ধীমেধীমে চলা নিঃশ্বাসটাকে একটু স্বস্তি দেওয়া,শান্তি দেওয়া।বৃষ্টির এই উগ্র তোপের মধ্যে-ও ব্যস্ত পায়ে প্রায় আশপাশের বিভিন্ন গলিপথ, দোকাপাটের আনাচকানাচ,বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিলো নিভান।তবে নিরাস হতে হলো তাকে।খুজতে খুঁজতে প্রায় মেইন সড়ক ছাড়িয়ে,কৌড়িদের কলেজের রাস্তার পিছনের সড়কে চলে এলো।যদি-ও এদিকের রাস্তায় আসার সম্ভবনা নেই মেয়েটার।কেননা এটা তাদের বাড়ির রাস্তাতো নয়,বরং আবাসিক লোকালয়ও নয়।দূর পাল্লার রাস্তা।যেখানের রাস্তার দু’পাশে শুধুই সারিবদ্ধ গাছ।কিছুদূর পরপর ঝোপঝাড় আছে।আর বিশাল চওড়া কালো পিচঢালা রাস্তাটায় ক্ষনে ক্ষনে ছয়চাকা আটচাকার বড়োবড়ো যানবাহনগুলো চোখের পলকে শোঁ-শোঁ করে ছুটে চলেছে।বৈরী অন্ধকারাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় আর বৃষ্টির তোপে,আজ সেসব যানবাহনের চলাচলও কম দেখাচ্ছে।শুধু নজর-ভর দেখাচ্ছে পিচঢালা ফাঁকা রাস্তা আর কুয়াশাচ্ছন্ন টুপটুপ বৃষ্টি।আশপাশে খেয়ালি নজর দিলো নিভান।কিছুই পড়লো না নজরে।তবে মেয়েটা কোথায়?কোথায় আর কি অবস্থায় আছে সে।ছটফটানি চঞ্চলা মন এবার উতলা,উদভ্রান্ত হয়ে উঠলো।সবসময়ের শান্ত নজরোজড়ো হয়ে উঠলো বিচলিত।ফাঁকা রাস্তায় দিশাহীন হয়ে বেশ কিছুসময় এদিকওদিক খুঁজলো,দেখলো, তবে দূর্ভাগ্যবশত কিছুই নজরে পড়ল না।আবেগি মন মনেমনে গেয় উঠলো,যদি আচমকা একটা ম্যাজিক হয়ে যেতো আর মূহুর্তেই কৌড়িকে সে পেয়ে যেতো।কতো সুখকর হতো তারজন্য বিষয়টা।সেটা শুধু সেই অনুভব করতে পারছে।

আশাহত নিভান,কলেজের পিছনের রাস্তাটা পার করে পুনরায় কলেজে মেইন সড়কে আসার জন্য উদ্বেগী হতেই,হঠাৎই পা থামকালো নিভানের।সিনেমাটিকভাবে থেমেথেমে কোনোমতে চলা হৃদস্পন্দনটা দ্বিগুনহারে বেড়ে গেলো তার।যেমনটা কৌড়ি আশে-পাশে থাকলে হয়।তাঁকে দেখলে অনুভব করে মন।ক্লান্ত হৃদয় তাকে দেখলে প্রশান্ত হয়।খারাপ মন,তাকে অনুভব করলে ম্যাজিকের মতো মন খারাপের মেঘগুলো কেটে যায়।
তবে কি মেয়েটা আশেপাশে কোথায় আছে?তড়িৎ গতিতে আশেপাশে তীক্ষ্ণ নজর ফেললো নিভান,নজরে কিছুই না পড়লেও মূহুর্তেই ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ পেলো সে।কৌড়ির গলার স্বর।ওই মেয়েটা আর তারমধ্যে কোনো প্রকার সম্পর্ক নেই।যেটুকু নিজের মন থেকে তৈরী হয়েছে সেই সম্পর্কের দূরত্বও অনেক!একই বাড়িতে থেকেও মাইল কি মালই সেই দূরত্বের গভীরতা!তবে ওই মেয়েটাকে অজানা কারনে নিভানের খুবচেনা।মেয়েটার নিজের মধ্যে থাকা চুপিচুপি চাওয়া পাওয়াগুলো চেনা।তাকে দেখে মেয়েটার লুকোচুরি খেলা দূরের স্পর্শগুলো চেনা।মেয়েটার নিঃশব্দে পায়ের চলাচল গুলো চেনা।মেয়েটার নীরবে হোক বা ফুপিয়ে কান্নার শব্দগুলোও তার চেনা।হঠাৎ কি কারনে,দূরে থেকেও মেয়েটা নিজের এতো কাছের চেনা মানুষ হয়ে উঠলো কিকরে?নিভানের জানা নেই।হয়তো নিজেই চেয়েছিলো,মেয়েটাকে চিনতে জানতে।সেকারনেই।তবে
এতো সময় তো আশেপাশে ছিলো সে,কৈ কোনো কান্নার শব্দ তো সে পায় নি।তবে কি কৌড়ি তাঁকে দেখেছে, আর দেখেই পাগল মেয়েটা কান্না শুরু করে দিয়েছে।

ক্ষীন হাসলো নিভান।দুহাটুতে দুহাত ভর দিয়ে মাথা নিচু করে এতোসময়ের বাধোবাধো হয়ে চলা নিঃশ্বাসটা স্বস্তিতে ত্যাগ করলো নিভান।পাথর ভর করে থাকা বুকের ভিতরটা হালকা হতে থাকলো।নিজের জানপাখিটা বুঝি জানের জায়গায় ধীরেধীরে অবস্থান করতে থাকলো।মাথার চুল বেয়ে চুইয়েচুইয়ে পড়তে থাকলো বৃষ্টির ঝমঝমে পানিগুলো,এমনকি সমস্ত শরীর বৃষ্টির পানিতে একাকার।ফুপিয়ে কান্নার রেশটা বেড়েছে।ওই অবস্থায় কিছুটা জোর গলায় কৌড়িকে ডাক দিলো নিভান।

‘কৌড়ি।

রাস্তার পাশের একটা পরিত্যক্ত ভাঙাচোরা দোকানের আড়ালে হাঁটু মুড়ে চুপচাপ বসে আছে কৌড়ি।এতোসময় নীরবে কাদলেও,এই ফাঁকা রাস্তায় পানির ঝপাৎ ঝপাৎ শব্দ কাওকে হাঁটতে দেখে পিছে ভয়ার্ত নজরে পিছে ফিরেছিলো সে। ক্ষনিকের জন্য মনে হয়েছিলো, ওই বুঝি সেই হায়েনারা আবার পিছু নিলো তার।খাবলেখুবলে খেতে এলো তাকে।কিন্তু না, পরিচিত মুখটাকে দেখে,ভরসা পেয়ে জোরেসোরে কেঁদে ফেলল সে।ফের নিভানের নরম কন্ঠের ডাকটা কর্ণগোচর হতেই আর-ও জোরে কেঁদে দিলো।সেই কান্না অনুসরণ করে পা বাড়ালো নিভান।বড়বড় কদম ফেলে ভিজে জুবুথুবু হয়ে হাটুমুড়ে বসে থাকা কৌড়ির সামনে গিয়ে নিজেও হাঁটু মুড়ে বসলো।বার কয়েকে জোরেজোরে ঘনোঘনো শ্বাস ছেড়ে,এলোমেলো হাসলো।কৌড়িকে এই অবস্থায় এখানে বসে থাকতে দেখে চতুর দৃষ্টি বুঝে নিলো অনেককিছু।তবে মেয়েটাকে পেয়েছে,এটাই শান্তি দিলো তাকে।শ্বাস ফেলে কোমল কন্ঠে সামনে বসা মেয়েটাকে শুধালো।

‘খুব ভয় পেয়েছো তাই-না?

ঝমঝমে বৃষ্টির মধ্যেও যেনো কৌড়ির ডগরডগর চোখের টলমলে নোনাজলগুলো দৃশ্যমান।সেদিকে শান্ত আর অটল নজরে তাকিয়ে রইলো নিভান।এভাবে কেউ কাঁদে!তাহলে কি নিজেকে স্থির রাখা যায়! আর না ওই ক্রন্দরত মায়ময় চোখজোড়া দিয়ে ওভাবে তাকিয়ে থাকলে নিজেকে সামলিয়ে রাখা যায়!বর্ষায় ভিজে জুবুথুবু ওই ছোট্টো দেহটা যে খুব করে নিজের দু’হাতের বাহুবন্ধনীতে শক্তকরে জড়িয়ে নিতে ইচ্ছে করছে।সাথে ওই কেঁদেকেটে লাল বানিয়ে ফেলা মুখশ্রীর আনাচে-কানাচেতে ভালোবাসার ছোঁয়ায় রাঙিয়ে তুলতে ইচ্ছে করছে।প্রবৃত্তি-গুলো মনে জাগতেই অদৃশ্যভঙ্গিতে মাথা ঝাড়া দিলো নিভান।নিজের আবেগ কন্ট্রোল করলো।অপেক্ষা করলো কৌড়ির উত্তরের।প্রশ্নবিদ্ধ হতেই আজ যেনো কৌড়ি কোনো দ্বিধা সংকোচ করলো না,তবে কান্নার তোপে কথাও বলতে পারলো-না।শুধু মাথা ঘনো-ঘনো উপর নিচ নাড়িয়ে হ্যা জনালো।তার মাথা নাড়ানোর ঘনত্ব দেখে,নিভান বুঝে নিলো।একটু নয় মেয়েটা অনেকটাই ভয় পেয়েছে।কৌড়ির উত্তর পেতেই মোলায়েম কন্ঠে

‘আমি এসে গেছি-তো তোমার কাছে।আর ভয় কিসের!উঠে এসো।চলো।

নিঃসংকোচে কৌড়ির বরফঠান্ডা হাতটা ধরলো নিভান।কেঁপে উঠলো কৌড়ি,সেটাও অনুভব করলো।কতক্ষণ ধরে এই ঝুম বৃষ্টির মধ্যে মেয়েটা ভিজে চলেছে কে জানে!হাতটা ধরে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে বাঁধা পেলো নিভান।মেয়েটা কঠিন পাথরের মতো অটল বসে আছে।মনের মধ্যে যে ধারণাগুলো একটু আগে ধরা দিলো,তা মূহুর্তেই মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠলো নিভানের।চোখ বুঁজে ফেললো সে।ফের কৌড়ির বলা শব্দগুলো কর্ণগোচর হতেই,বৃষ্টির ঠান্ডা ঠান্ডা পানির মধ্যেও কানমাথা গরম হয়ে এলো তার।ক্রোধিত হয়ে পড়লো মন মস্তিক।

‘আমার গায়ে ওড়না নেই।ওরা আমার মাথার হিজাব টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে।সাথে ওড়ানাটা-ও কেঁড়ে নিয়েছে।

কম্পনরত ফুঁপানো গলায় বাধোবাধো স্বরে কথাগুলো বললো কৌড়ি।রাগে হাতের মুঠো শক্ত হয়ে এলো নিভানের।মুঠোর তোপে পড়ে,ফুলেফেঁপে উঠলো হাতের শিরা-উপশিরাগুলো।টনটন হয়ে উঠলো শরীরের সমস্ত পেশী।সে কৌড়িকে এরকম একটা পরিত্যক্ত জায়গায় জুবুথুবু হয়ে বসে থাকতে দেখে আগেই বুঝে নিয়েছিলো,কিছু একটা তো হয়েছে!আর কি হয়েছে সেটাও কিছুটা অনুধাবন করতে পেরেছিলো।আর সেটাই শুনতে হলো!আবারও জোরেজোরে শ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করে নেওয়ার চেষ্টা করলো নিভান।এখন মেয়েটাকে সামলানো দরকার।তারপর সে দেখছে?কার-ও আত্মা ধরে টানাটানি করার ফলটা ঠিক কিরূপ হয়!আর এসব শোনার পরে তাদের আত্মাগুলো কিভাবে টেনে শরীর থেকে বের করতে হয় জানা আছে নিভানের।

কৌড়ির হাত ছেড়ে দিলো নিভান।গায়ে ভিজে চুপসে যাওয়া ব্লেজারটা খুলে ফের কৌড়ির সামনে হাঁটু মুড়ে বসলো।যে অবস্থায় মেয়েটা কলেজ আসে,সেই অবস্থায় নেই।সাদা ইউনিফর্ম হিজাব বোরকাটার,শুধু বোরকাটা পরা থাকলেও হিজাব নেই গায়ে মাথায়।কৌড়িকে বরাবরই দেখেছে,মাথায় ওড়না বা স্কাফ হিজাবের সাথেও আলাদা করে ওড়না পরতে।হয়তো সেই ওড়নাটার কথা বলছে।কৌড়ির হাত ধরে টেনে ব্লেজারটা গায়ে পরিয়ে দিলো নিভান।কৌড়ি সংকোচিত হলেও কিছু বললোনা,শুধু সামনে থাকা মাবুষটার থমথমে মুখের দিলে চেয়ে রইলো।বৃষ্টির তোপে চেয়ে থাকা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। তবু্ও চেয়ে থাকার চেষ্টা করলো সে।তার মনে হচ্ছে,একটু আগের স্বাভাবিক চোখমুখের মানুষটার সাথে এখনকার চোখমুখের মানুষটার মিল নেই।হঠাৎ শ্যামবর্ণ মুখটা থমথমে ভাব, চোয়ালদ্বয় লৌহকঠিন মূর্তি।একটু আগের শান্ত বাদামি বর্ন চোখজোড়ায় ছড়িয়ে পড়েছে রক্তিম আভা!

‘এখনো ভয় করছে?

খুব আদূরে গলায় জিজ্ঞেস করলো নিভান।প্রতিত্তোরে
কথা বললো-না কৌড়ি।শুধু মাথা নাড়িয়ে না জানালো।
সেটা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিভান।কৌড়ির কোমল ডান হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ফের বললো।

‘তবে কোনো কারনে আমাকে ভয় পাচ্ছো না তুমি?

ফের মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে না সম্মতি জানালো কৌড়ি।অশান্ত মনে শান্ত চোখে সেটা দেখলো নিভান।মেয়েটাকে তারদিকে অটল নজরে তাকিয়ে থাকতে দেখে মনেহলো,মেয়েটা এভাবে তাকিয়ে আছে কেনো!কোনোকারনে আবার তাকে ভয় পাচ্ছে না তো!বিধায় কথাটা জিজ্ঞেস করলো নিভান।উঠে দাঁড়ালো সে।কৌড়িকে বললো।

‘উঠো।চলো।

দাঁড়িয়ে পড়লো কৌড়ি।ঠান্ডায় পা হাত পা সব অচল হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা।উঠতে গিয়ে শরীরটা কেমন অচল অনুভব হলো।হেলে পড়ে যেতে নিলেই,নিভান তাকে দুহাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলো।ফের নিজেই সোজা হয়ে দাঁড়ালো কৌড়ি।পাশে ফেলে থাকা ব্যাগটা নিতে গেলেই বাঁধা দিলো নিভান।অন্য হাতে সেটা তুলে নিল।আবারও কৌড়ির ডান হাতটা নিজের শক্ত হাতের মুঠোয় নিয়ে বড়বড় পায়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো।মেয়েটার শরীর কম্পনরত।হয়তো অতিরিক্ত ভেজার ফলে আর মনের শঙ্কায় এই অবস্থা।ভিজে অবস্থায় দুজনে গাড়িতে গিয়ে বসলো।গাড়িটা বাড়ির পথ ধরতেই স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করলো।

‘তুমি,ছেলেগুলোকে এ-র আগে কখনো তোমাদের কলেজের আশেপাশে দেখেছো?

অতিরিক্ত বৃষ্টির পানিতে ভেজার কারনে ফর্সা মুখটা এমনিতেই ফ্যাকাসে বর্ন ধারণ করেছে।নিভানের মুখে হঠাৎ এমন কথা শুনতেই মুখটা আর-ও ফ্যাকাসে বর্ন হয়ে গেলো।মনে পড়ে গেলো সেই বিভৎস সময়ের কথা।আবহাওয়া খারাপের কারণে যখন কলেজ টাইম পার করার আগেই ছুটি ঘোষনা করা হলো,তখন সে কিছু নোটস নিজের খাতায় কালেক্ট করতে ব্যস্ত ছিলো।তারা কিছু মেয়েরা বাদে অধিকাংশ মেয়েরা তখন কলেজ থেকে বেরিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছিলো।অল্প সময়ের মধ্যে সংক্ষেপে নোটসগুলো কোনোমতে কালেক্ট করে, কলেজের বাহিরে বের হতেই ঝড়ের আনাগোনা শুরু।কৌড়ি মনে করেছিলো, সিএনজি পেলে আর তো কোনো সমস্যা নেই।তবে খালি সি এনজি পাওয়ায় মুশকিল হয়ে যাচ্ছিলো।পরিচিত দু-একজন বান্ধবী যারা তারসাথে দাঁড়িয়ে ছিলো,তাদের বাড়ি উল্টো পথে আর আশেপাশে হওয়ায়।তারা দ্রুত হেঁটে চলে গিয়েছিলো।ঝড়ের সাথেসাথে বৃষ্টির আনাগোনা যখন শুরু হলো, বিপদের শঙ্কায় কৌড়ি-ও কলেজের সড়ক রেখে,সামনের সড়কের দিকে হাঁটা দিল।যদি ওখান থেকে দ্রুত খালি সিএনজি বা রিকশা পায়।তবে সে পর্যন্ত যাওয়ার আগেই আকাশ ভেঙে ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি নামতে দেখেই একটা টঙ দোকানের ভিতরে আশ্রয় নিতে হলো তাকে।অতিমাত্রায় বৃষ্টির তোপে দোকনদারও তখন দোকানের ঝাঁপি লাগিয়ে দিয়েছে।তখনও ছাওনির নিচে একা দাঁড়িয়ে সিএনজির অপেক্ষা করছিলো কৌড়ি।কিছুসময় বাদে হঠাৎ দেখলো,তিনটে ছেলে তারপাশে ছাওনির নিচে এসে দাঁড়িয়েছে।গায়ে মাথায় বৃষ্টির পানি লাগায় সেগুলো ঝাড়ছে মুছছে।ছেলেগুলোকে এরআগে দেখেছে কৌড়ি।কলেজ থেকে মেয়েরা বের হলেই উল্টো পাল্টা গান ধরা,অভদ্রের মতো শিষ বাজানো।কলেজের এই রাস্তায় দাঁড়িয়ে যেখানে সেখানে আড্ডাবাজি করা।প্রতিনিয়ত এসবই কাজ এদের।তাদের চেহারায় প্রকাশ পায়,এরা অভদ্র বখাটে আর নেশাখোর!

রাস্তা তখন শুনশান।বাতাসের প্রকোপ আর ঝুম বৃষ্টির আনাগোনা। ভয়ে শঙ্কায় কলিজা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা!ইতিমধ্যে ছেলেগুলোও তাকে ইঙ্গিত করে উল্টো প্লাটা বাক্য ছোঁড়া শুরু করে দিয়েছে।সাথে সিগারেটের বাজে দুর্গন্ধ তো আছেই।দাঁড়িয়ে থাকা মুশকিল হয়ে যাচ্ছিলো, প্রান যায়যায় অবস্থা কৌড়ির!নিজের সাথে যখন তখন বাজে কিছু ঘটতে পারে ভেবেই সেই ঘনো বৃষ্টির মধ্যেও রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিলো কৌড়ি।আর তখনই ঘটলো বিপত্তি।একটা ছেলে তার গায়ের ওড়নাটা পিছন থেকে টেনে ধরলো।বোরকার সাথে ওড়নাটা পিনআপ না করে থাকায়,মূহুর্তেই সেটা ওদের হাতের মুঠোয় চলে গেলো।ভয়ে শঙ্কায় থরথরিয়ে কেঁপে চলছিলো কৌড়ি।কি করবে ভেবে উঠতে পারছিলো না।রাস্তা শুশশান, আশে পাশের দোকানপাট গুলো বন্ধ।চিৎকারে চেচামেচি আর ছেলেগুলোর অসভ্যতামীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেও তো কোনো লাভ হবেনা।বিধায় ভয় শঙ্কা নিয়ে আবারও সামনে এগোতে গেলে,তার মাথায় মুড়ানো হিজাবটাতে টান অনুভব করলো।ভয়ে কেঁদে ফেলেছিলো কৌড়ি।তবে ভয়ের সাথে সাথে এবার রাগ ক্ষোভও হয়েছিলো প্রচুর।পরিস্থিতিতে বুঝেও রাগ ক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে পিছনে ফিরে জোর গলায় প্রতিবাদও করেছিলো।

‘আপনারা কেনো আমার সাথে অসভ্যতামো করছেন? রাস্তায় মেয়েদের বিরক্ত করার আগে ঘরে মা বোনদের কথা মনে পড়েনা?

এমনিতেই কৌড়ি ভিতু টাইপের।তার উপর শঙ্কিত গলায় কথাগুলো বলতেই ছেলেগুলো বিশ্রীভাবে হাসতে শুরু করলো।ফের লালসিত গলায় বললো–মনে পড়ে তো মা বোনদের কথা।কিন্তু রাস্তার সব মেয়েকে যদি মা আর বোন ভাবি।তবে বউ পাবো কোথায়,সন্দুরী? আর তোমার মতো সুন্দরী মেয়েকে থোড়াই না মা বোন ভাবা যায়।তোমার মতো মেয়েকে নজরে পড়লে শুধু বউ বউ রকমের আসে।

আরও শত বিশ্রীরকমের কথা বলতে লাগলো একের পর এক।বাহিরে চোখমুখ শক্ত রাখলেও, ভিতরে ভিতরে ভয়ে শঙ্কায় নুইয়ে পড়েছিলো কৌড়ি।এই অসভ্য জানোয়ার গুলোর সাথে কথা বাড়ানো মানেই বিপদ!বুঝেই দ্রুত সামনে এগোতে গিয়েই আবারও বাঁধা পেলো। তবে দাঁড়ানোর মনোভাব দেখালোই না।হিজাবে টান পড়া সত্ত্বেও সামনের দিকে হাঁটা দিল সে।তবুও ছাড়িনি ওই অমানুষ গুলো।বরং আরও জোরে হিজাবের কোনাটা টেনে ধরতেই,চুল ছিড়েখুঁড়ে হিজাবটা নিয়ে নিলো তাদের হাতের মুঠোয়।সঙ্গে সঙ্গে চিতকার করে কেঁদে দিয়ে সামনের দিকে দৌড় দিয়েছিলো কৌড়ি।রাস্তায় তখন একটা মানুষ-ও নেই।
ঝড় আর বৃষ্টির প্রকোপ দ্বিগুণ তখন।চারপাশটা কেমন অন্ধকার!পিছন থেকে ছেলেগুলোও ছুটে আসছে দেখেই,দিশাহারার মতো যেদিকে নজর গেছে সেদিকে ছুটে গিয়েছে কৌড়ি।বেশ কিছুক্ষণ দিশাহীন ছুটে চলার পর হঠাৎই মনে হলো ছেলেগুলো তার পিছনে নেই।কারনটা কি জানা নেই কৌড়ির।কেনো ছেলেগুলো তার পিছু নেওয়া ছেড়েছিলো।তবে নিজের নিরাপদ রাখতে, ওই পরিত্যক্ত জায়গায়টার পিছনে গিয়ে লুকেছিলো সে।ঘন্টা পেরেয়ি যাওয়ার পর-ও সাহসে কুলায়নি সেখান থেকে বেরিয়ে আসার।তবে মনেমনে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইছিলো।

‘কৌড়ি।

হুঁশে ফিরলো কৌড়ি।ড্রাইভিং সিটে বসা মানুষটার দিকে উদভ্রান্তের ন্যায় ফিরলো সে।মানুষটার দৃঢ় নজর তখনও সামনের দিকে।তবে মনোযোগ তার দিকে এটা বেশ অনুভব করতে পারলো কৌড়ি।মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে,মুখে মৃদুশব্দে বললো।

‘মুখ চেনা।ওদেরকে প্রতিনিয়ত কলেজের আশেপাশেই দেখা যায়।

আর কথা বাড়ালোনা নিভান।বাড়ির কাছাকাছি গাড়িটা পৌঁছানোর আগেই,কাওকে ফোন দিলো সে।ওপাশ থেকে কলটা রিসিভ হতেই গম্ভীর গলায় বললো।

‘মান্য..একটা ওড়না নিয়ে বাড়ির বাহিরে আয়।

ওপাশ থেকে মুখে হাত চেপে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মান্যতা।কৌড়ি বাড়িতে না আসাতে সে-ও ছটফট করছে।বাড়ির অধিকাংশ লোকই এখনো জানে না, কৌড়ি বাড়িতে ফেরেনি।বিশেষভাবে মা আর সে ছাড়া।একটু আগে মায়ের কাছ থেকে জেনেছে,কৌড়ি বাড়িতে না আসায় দাদাভাইকে জানিয়েছেন তিনি।একটু নিশ্চিত হলেও টেনশন কমেনি।এখন দাদাভাই ওড়না নিয়ে বাহিরের যাওয়ার কথা বলছে কেনো? মেয়েটার সাথে খারাপ কিছু ঘটেনি তো!ও আল্লাহ।দ্রুত
ওয়ারড্রব থেকে একটা ওড়না বের করে নিয়ে দৌড় দিলো মান্যতা।বাড়িটা আপতত শুনশান।বৃষ্টির ঠান্ডার প্রকোপে যে যার রুমে অবস্থার করছে।হয়তো ঘুমিয়েও পড়েছে।কোনোরকম মেইন দরজা খুলে বৃষ্টির মধ্যেও লন এরিয়ায় পা রাখতে গিয়েও দেখলো,দাদাভাইয়ের গাড়িটা এদিকে আসছে।দাঁড়িয়ে পড়লো মান্যতা। গাড়ি এসে থামতেই দ্রুতবেগে গাড়ীর জানালার পাশে গিয়ে দাড়ালো সে।ততক্ষণে জানালার কাচ নামিয়ে দিয়েছে নিভান।বিধ্বস্ত কৌড়িকে দেখেই,পরাণ কেঁপে উঠলো তার।তারমধ্যে মান্যতাকে দেখেই কেঁদে ফেললো কৌড়ি।মূহুর্তেই গাড়ির দরজা খুলে, নিচু হয়ে কৌড়িকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরলো মান্যতা।ভিজে গেলো নিজে, তবুও সরলোনা।কৌড়ির মাথায় বরাংবার হাত বুলিয়ে, কপালে চুমু দিয়ে বললো

‘তুই ঠিক আছিসতো পাখি?আর কখনো তোকে এভাবে একা ছাড়বোনা।কাঁদিস না পাখি, চুপ কর।

অনর্গল এটাওটা বলে গেলো মান্যতা।মান্যতা আদূরে কথাগুলোয় কান্না যেনো বাড়লো কৌড়ির।সেটা বুঝে মান্যতা ফের বললো।–কিচ্ছু হয়নি।একদম কিচ্ছু হয় নি।

ছেড়ে দিলো কৌড়িকে।ভাইয়ের ব্লেজারটা কৌড়ির গায়ে দেখতেই আঁতকে উঠলো বুকের ভিতর।তবে মুখে তা প্রকাশ করলোনা।নিয়ে আসা ওড়না মেলে তারউপর গায়ে দিয়ে বললো।–তাড়াতাড়ি বাহিরে আয়।কতক্ষণ থেকে ভিজছিস তার ঠিক নেই।সর্দি-জ্বর বাঁধলো বলে!

কৌড়িকে ধরে বাহিরে নিয়ে আসলো মান্যতা।বাড়ির দিকে পা রাখবে এমন সময় মান্যতাকে ডাকলো নিভান।ফের বললো—ওকে এই অবস্থায় যেনো বাড়ির কেউ না দেখে!বিশেষ করে ফুপিমণি!আর ও ভয় পেয়েছে প্রচন্ড,ওকে আপতত একা ছাড়িস-না।খাবার শেষে জ্বরের একটা ঔষধ খাইয়ে দিস।

গাড়ি স্টার্ট দিলো নিভান।হঠাৎ কৌড়ির মন ছটফটিয়ে উঠলো।মানুষটাও তো তারমতো কাকভেজা।তবে জামাকাপড় চেন্জ না করে আবার-ও যাচ্ছে কোথায়? কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলোনা কৌড়ি।শুধু শা-শা বেগে গাড়ীর চলে যাওয়াটা দেখলো।মনেমনে আওড়ালো।

‘আজ কেনো ওই মানুষটার দিকে মনটা টানছে তার।ওই মানুষটার শক্তচোয়াল আর রক্তিম চক্ষুোদ্বয় তাকে যে ইঙ্গিত দিলো,তবে কি এই কাকভেজা অবস্থায় সেদিকে ছুটলো মানুষটা!কিন্তু কেনো?তারজন্য!এসব কি ভাবছে সে!নিজের সীমা-তো যানে কৌড়ি।সেই সীমা কখনো অতিক্রম করতে চায়-না সে।উচিত-ও নয় অতিক্রম করা।আর সেই অনুচিত কাজের ভাবানাটা-ও সীমার মধ্যে পড়ে।তাই সেটা নিয়ে ভাবনাও অনুচিত।

চলবে….

ফুলকৌড়ি পর্ব-১৬+১৭

0

#ফুলকৌড়ি
(১৬)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

‘বিশ্বাস করুন,আমি উনাকে কিছুই বলিনি বড়মা।আমি চুপচাপ কেনো বসে আছি,তাতেই নাকি উনি রেগে গেলেন।আর অত কথা শোনালেন।

কৌড়ির সহজ স্বীকারোক্তিতে কি বলবেন খুঁজে পেলেন না নীহারিকা বেগম।শুধু নিস্প্রভ নজরে কৌড়ির দিকে তাকিয়ে রইলেন।কাল কৌড়ির সাথে অকারণে ডালিয়া বাজে ব্যবহার করলো বলে তিনি কতোটা অসন্তুষ্ট হয়ে জাহিদ সাহেবকে কতো কথা শোনালেন। আজ ছেলের এই ব্যবহারে,তার হয়ে কাকে শোনাবেন কথা!নিভান তো এমন ধারার ছেলে নয়।তবে কেনো অকারণে মেয়েটার সাথে এমন ব্যবহার করল।নীহারিকা বেগমকে চুপ থাকতে দেখে কৌড়ি আবারও বললো।

‘উনি রেগে যাওয়ার মতো সত্যিই আমি কিছু করিনি বড়মা।

‘আমি বুঝতে পারছি,তারজন্য তোকে সাফাই দিতে হবে না।তবে হঠাৎ রেগে গেলো কেনো ছেলেটা,সেটাই বুঝতি পারছিনা।হঠাৎই কি এমন হলো,যে এতো রেগে গেলো!আর সেটা তোর উপরই ঝাড়লো।

কিছু সময় নীরব থেকে কৌড়ির মাথায় হাত রাখলেন নীহারিকা বেগম।ফের মুখ ছোটো করে অপরাধী কন্ঠে বললেন।–কিছু মনে করিস না, মা।ও যে ব্যবহারটা করলো,মোটেই ওরকম ছেলে নয় ও।হঠাৎ তোরসাথে ওরকম কেনো করলো বুঝতে পারছিনা।তবে এজন্য ও-কে আমি বকে দেবো।তবুও মন খারাপ করিস না।ঠিক আছে?

মৃদু হেসে মাথা নাড়ালো কৌড়ি।ফের মুখে বললো–ঠিক আছে।

নীহারিকা বেগম আবার’ও মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন। ‘তবে খেয়ে নে।

মন খারাপ করে রান্নাঘরের দিকে এগোলেন নীহারিকা বেগম।ছেলেটা খাবার চাইলো,অথচ খেলো-না।তাতে আবার কৌড়ির সাথে ওরকম আচারন করলো। মনটা উনার খারাপ হয়ে গেলো।কৌড়ি খাবারে মনোযোগী হওয়ার আগেই সেখানে উপস্থিত হলো ইভান।স্বভাব মতো চেয়ার টেনে ধপাত করে বসে পড়লো।ফের ভাবুক ব্যক্তির ন্যায় দুগালে হাত রেখ গলায় কৌতুক মিশিয়ে বললো — আসলে দাদাভাইতে তোমার সমস্যাটা কোথায় খুলে বলোতো,ফুলকৌড়ি?দাদাভাইয়ের মতো আমারও জানতে মন চাইছে,কেনো তাকে দেখলে, তোমার হাত পা থেমে যায়,নজর নুইয়ে পড়েে,লুকোচুরি লুকোচুরি খেলো?ব্যাপারটা কি?আমার মনেহয় দাদাভাইকে দেখলে তোমার সামথিং সামথিং ফিল হয়? ব্যপারটা কি খোলাখুলি তুমি বলোতো?আই প্রমিজ, আমি দাদাভাইকে কিচ্ছু বলে দেবোনা।

এসেছে দাদাভাই ভক্ত সাদা হনুমান।এই কতোদিন হলো এবাড়িতে এসেছে অথচ দুই ভাইকে কখনো এক জায়গায় বসতে দেখেনি,সেভাবে কথা বলতে দেখেনি।অথচ সারাদিন ভাইয়ের হয়ে উকালতি করে বেড়াচ্ছেন তিনি।মনেমনে কথাগুলো আওড়ে চললো,তবে মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের করলো না কৌড়ি। এই সামনে বসা ইতুড়ে ছেলেটাকে যদি মনের মধ্যে চেপে রাখা কথাগুলো বলে দেয়,তবে তো আর উপায় নেই।সেই কথা নিয়ে সারাক্ষণ পিছে লেগে থাকবে তার।

‘কি হলো?বোবা মানুষের মতো চুপ হয়ে আছো কেনো?ঝটপট উত্তর দাও দেখি।দাদাভাই ছেড়ে দিলেও,আজ আমি ছাড়ছিনা।উত্তর আমার লাগবেই।যেহেতু তোমাকে দাদাভাইয়ের বউ বানাবো বলে ঠিক করেছি।সেহেতু উত্তর তো আমার জানা দরকার।লাগবেই লাগবে।বিয়েতে মেয়েপক্ষের সম্পূর্ন সম্মতি থাকার জন্য খুব প্রয়োজনীয় উত্তর এটা।সো ফটাফট উত্তর দাও।

সামনে বসা ইতুড়ে মানুষটার কথায় নিজেকে কেমন এলেবেলে লাগলো কৌড়ির।যার ধারালো মুখের দিকে তাকানোর আগেই পুরো শরীর ঝিমিয়ে আসে।যে মানুষটা আশেপাশে থাকলে,তার গায়ের কড়া সুঘ্রাণে নিজের অনুভূতি সব অবশ অবশ মনেহয়।সেই অদ্ভুত মানুষটাকে ঘিরে তাকে নিয়ে সব অদ্ভুত ভাবনায় নিজের মধ্যে কেমন এলোমেলো ঠেকলো।উত্তর দেওয়ার বদৌলে আগের ন্যায় মুখ ভার করে ইভানকে বললো।

‘আপনি মোটেই ভালো ছেলে নন।

উচ্ছল হাসলো ইভান।ফের বললো–সেটা আমি জানি।আর তোমার দেবর হিসাবে আমার মনেহয় আমি মোটামুটি ঠিকই আছি,অতশত পারফেক্ট হওয়া লাগবে না।তোমার বর হিসাবে পারফেক্ট দাদাভাই হলেই চলবে।এখন তাড়াতাড়ি বলে ফেলোতো,দাদাভাইতে মূলত তোমার সমস্যাটা কোথায় আর কি?

‘আপনার দাদাভাইতে আমার কোনো সমস্যা নেই।

‘তবে একটু আগে অকারণেই দাদাভাই তোমাকে বকলো? আমার দাদাভাই অকারণে গালের থুতু পর্যন্ত ফেলে না।সেখানে তোমাকে বকবে,নো নেভার।আমি মানিনা।তাড়াতাড়ি বলো?

নাছোড়বান্দা কাকে বলে,কত প্রকার, কি কি?উদাহরণ সহ ব্যাখা করলে হয়তো এই মানুষটার মধ্যে সবটা পাওয়া যাবে।আল্লাহ,এ কেমন মানুষ!এতো এনার্জি পায় কোথায় এই মানুষটা?বাড়ির প্রতিটি মানুষ তার ইতুড়েপনার কাছে অতিষ্ঠ হয়ে যায়।অথচ এই মানুষটা নির্বিকার।কৌড়ি বুঝলো,উত্তর না নিয়ে এই বান্দা আজ তার পিছু ছাড়বে না।এখন উত্তরটা না দিয়ে এড়িয়ে গেলেও,আজ সারাদিন এই উত্তর পাওয়ার আশায় তাকে এক কথা নিয়ে জ্বালিয়ে মারবে।

‘কি হলো।তাড়াতাড়ি বলো,তোমার আবার কলেজের দেরী হয়ে যাচ্ছেনা!

মুখ সেই আগের ন্যায় ভার করে,কিছুটা ইতস্তত করে বললো।–জঙ্গলের বাঘের গর্জন শুনেছেন কখনো?শুনেছি তেনার গর্জন শুনলে নাকি মানুষের অর্ধমৃত অবস্থা হয়ে যায়।যাওয়ারই তো কথা।বনের রাজা মহাশয় বলে কথা।তার হুঙ্কারে তো রাজ্য কাপবেই!
আর সেই বনের রাজা মহাশয় যদি সাক্ষাৎ সামনে এসে সরাসরি দেখা দেয়,তখন সেই অর্ধমৃত হৃদয় কি বাঁচে?
আপনার দাদাভাইয়ের কন্ঠ আমার সেই বনের রাজা মহাশয়ের গর্জনের মতোই মনে হয়।আর উনার সাক্ষাৎ আমাকে…

থেমে গেলো কৌড়ি।শব্দ করে হেসে ফেললো ইভান।বললো–বাহ দারুণ উদাহরণ।তবে সেই মানুষটার সাথে সারাজীবন থাকা লাগলে,তখন কি করবে? কিভাবে থাকবে?

অজান্তেই শরীর শিরশির করে,গায়ের সমস্ত লোম কাটা দিয়ে উঠলো।ওই মানুষটা আর সে!অদৃশ্য ভঙ্গিতে শরীর ঝাড়া দিয়ে উঠলো।কখনোই না।ভাবতে গেলেও, নিজেকে কেমন নিজের নিঃশ্বাস নিজহাতে বন্ধ করে ফেলার মতো মরমর অনুভূতি হয়।ভাবনা মতোই তড়িৎ গতিতে মাতা নাড়িয়ে গড়গড় করে বললো।

‘কখনোই থাকা লাগবেনা আমার।ওই মানুষটার যেদিকে পথ হয়,আমি জেনো সেই পথের উল্টো দিকের যাত্রী হই।সবসময় আমার পথটা জেনো উল্টো পথেয় হয়।সৃষ্টিকর্তার কাছে সবসময় এই দোয়া আমার।

মুখ করুনদশা করে ফেললো ইভান।গলা খাদে নামিয়ে বললো–তুমি এভাবে আমার আশা ভরসা,মন ভেঙে দিতে পারো না ফুলকৌড়ি। আমি কনফার্ম করে ফেলেছি,তোমাকেই আমি দাদাভাইয়ের বউ বানাবো।আর তুমি তাতে অসম্মতি জানাতে পারো না কখনোই।

আবারও সেই জলদগম্ভীর মানুষটাকে একবার ভাবলো কৌড়ি।তার গম্ভীর কাটাকাট মুখের আদল,সেই আদলে কখনো সে হেসে কার-ও সাথে কথা বলেছে কি-না সন্দেহ?তার চিহ্ন মাত্রা অবলোকন কখনো চেহারায় প্রকাশ পায়না।ওই ধারালো দৃঢ় চোখ,সবসময় কেমন সু-গভীর নজরে তাকিয়ে থাকে?কৌড়ির যে-ক’বার ওই নজরে নজর পড়েছে,মস্তিষ্কের রক্ত ছলকে পায়ে নেমে গিয়েছে।আর ওই কন্ঠস্বর,যেখানে মিষ্টান্নতা বলে কোনো জিনিসই নেই।সেই মানুষ আর সে!রক্ষা করা প্রভু।তড়তড়িয়ে বললো।

‘অবশ্যই পারি।আর আপনার ওই ভাইয়ের বউ টিকবে না কখনো।কেমন অদ্ভুত মানুষ!

আবারও হাসলো ইভান।হাসি মুখে প্রানউচ্ছল কন্ঠে বললো—তুমি হলে গ্যারান্টিসহ হান্ড্রেড পার্সেন্ট টিকে যাবে,ফুলকৌড়ি।

এমনিতেই ভিতরে ভিতরে তুফান বয়ে যাচ্ছে। তারমধ্যে এই ছেলেটার থামার নাম নেই।বিরক্ত হয়ে ভয় দেখিয়ে বললো।

‘এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে ইভান ভাইয়া।আমি কিন্তু বড়মাকে বলে দেবো।

চুপসে গেলো ইভান।মনও ভিষণ খারাপ হয়ে গেলো।এই মেয়ে না গললে হবে কিকরে?তার দাদাভাইয়ের জীবনে ফুলকৌড়ির মতো একটা শান্তশিষ্ট কোমল মনের মেয়ে যে খুব দরকার।কি হবে এখন?পাত্রী বেঁকে গেলে তো সবশেষ!অনেকক্ষণ চুপ থাকলো ইভান।তারমধ্যে কৌড়ির খাওয়া প্রায়ই শেষ।হঠাৎই কিছু ভেবে মুখে দুষ্ট হাসি ফুটলো ইভানের।আশেপাশের মানুষ শুনে ফেলবে এমনকরে কিছুটা হিসহিসিয়ে বললো।

‘আমি একটা সিক্রেট জানি ফুলকৌড়ি।শুনবে?

ইভানের বলার ধরন দেখে আশ্চর্য হয়ে মুখ ফসকে বলে ফেললো।–কি?

‘দাদাভাই তোমাকে চুরি করে-করে দেখে।

নিভান নামক আস্ত লোকটা মানে তারজন্য মারাত্মক বিষম।যেদিন থেকে এই লোকটার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে সেদিন থেকেই তার এই মরমর বিষম লাগা শুরু হয়েছে।ইভানের কথা শুনেই খালি গলায়ও বিষম খেলো কৌড়ি।পানি এগিয়ে দিলো ইভান।সেটা খেয়েই অল্পের উপর দিয়ে ছেড়ে গেলো।তবে ইভানের কথা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো, মানুষটা তাকে চুরি করে দেখে!তাকে চুরি করে দেখার কি হলো?তবে চুরি করে আর কোথায় দেখে,ওই মানুষটার পানে যে কয়বার তাকিয়েছে।সরাসরি মানুষটার ওই ত্রিশূল নজরে বিদ্ধ হয়েছে সে।আর সেই নজরটা যে স্থির তার উপরেই থাকে,এটাও অনুভব করেছে।তবে?ভাবনা আর এগোতে পারলোনা।তার আগেই ইভান ফের বললো।

‘যেদিন তুমি আমাদের বাড়িতে এসেছিলে,ওইদিন প্রথম আমি দাদাভাইকে দেখলাম নিষ্পলক কারও দিকে মুগ্ধ নজরে তাকিয়ে থাকতে।তোমার দরজার সামনে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলো দাদাভাই।দেখেছিলাম আমি দাঁড়িয়ে থাকতে,তবে এতোটাও গায়ে মাখইনি।ক্লান্ত হয়ে পরিক্ষা শেষে বাড়িতে ফিরেছিলাম,বিষয়টা ওতোটাও গুরুত্ব দেই নি।ভেবেছিলাম,হয়তো কোনো কারনে দাদাভাই ওখানে ওভাবে দাঁড়িয়ে আছে।তবে তার মুগ্ধ নিষ্পলক নজরটা আমাকে খটকা লাগিয়ে দিয়েছিলো।তবে ক্লান্ত থাকায় বিষয়টা উপেক্ষা করে চলে গিয়েছিলাম আমি।তুমি ও-রুমে জায়গা করে নিয়েছো বিষয়টা তখন আমি জানতাম না।পরে নাফিমের কাছ থেকে জেনেছি।যে আমাদের বাড়িতে ফুলকৌড়ি নামক একটা শান্তশিষ্ট সুন্দর মেয়ে এসেছে,আর সেই মেয়েটার জায়গা হয়েছে ওই রুমে।
তখন আমি দুইয়ে দুইয়ে এক করতে পারলাম।তবে
সত্যি বলছি,এরআগে দাদাভাইকে ওভাবে কখনো কোনো মেয়ের দিকে তাকাতে দেখিনি আমি।বিলিভ্ মি ফুলকৌড়ি।

ঝড় উঠে গেলো কৌড়ির দেহ মনে।উথাল-পাতাল করে দেওয়া কালবৈশাখী ঝড়!তবে সেদিন যখন নামাজের বিছানায় চুপ হয়ে বসেছিলো,তখন মনে হয়েছিলো কেউ তাকে নিরোট নজরে দেখছে।তারপর আশেপাশে, দরজার সম্মুখে তাকাতেই দেখলো কেউ নেই।কৌড়ি মনে করেছিলো, তার মনের ভ্রম।তবে ইভান ভাইয়া যে বর্ননা দিলেন,বর্ননা অনুযায়ী মনে হচ্ছে তো ওই মানুষটা দাড়িয়ে ছিলো সেখানে।রন্ধ্রে রন্ধ্রে টগবগিয়ে উঠলো রক্ত।তোলপাড় শুরু হলো বুকের খাঁচাটার মধ্যে।
গোলগোল নজরে ইভানের মুখের দিকে তাকাতেই দেখলো,সিরিয়াস মুখাভঙ্গিমা করে বসে আছে ছেলেটা।
সবসময়ের সেই দুষ্টুমি মুখাভঙ্গিটা তার নেই।তবে কি কথাগুলো….আর ভাবতে পারলোনা।এদিকে কলেজে যাবার সময়টা গড়িয়ে যাচ্ছে সেদিকেও তার খেয়াল, হুঁশ,কিছুই নেই।

ড্রয়িংরুমে মধ্যে স্থলে দাঁড়িয়ে ডায়নিং টেবিলে বসা ছেলে মেয়ে দু’টোকে শান্ত নজরে কিছুসময় অবলোকন করলো নিভান।তখন রেগেমেগে বের হয়ে গাড়িতে গিয়ে বসতেই দেখলো,গাড়ির চাবি আনিনি সে, সাথে ফোনটাও।আগে কখনো প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো সঙ্গে নিতে ভুলেও ভুলতো-না সে।কিন্তু এখন অনায়সে ভুলে যায়।ইদানীং ভুলে যাওয়ার রোগ হয়েছে তার মন মস্তিষ্কের।মন মস্তিষ্কে তো আগে শুধু সে আর তার নিজের প্রয়োজনীয় ভাবনাগুলাে ছিলো,এখন সেখানে বাসা বেঁধেছে অন্যকেউ।মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে ডালপালা গজিয়ে ছড়িয়ে বাসা বেঁধেছেন এক যাদুকারিনী,না ভুলে উপায় আছে কি।অথচ সেই যাদুকারিনী তার যাদু ছড়িয়ে,বেখবর।তপ্ত শ্বাস ফেললো নিভান।সেই চাবি আর ফোন নিতে এসে দেখলো,কি সুন্দর গল্পে মেতে আছে ডায়নিং টেবিলে বসা দু-জন।অথচ সে সামনে গেলেই যতো সমস্যা শুরু হয়ে যায় সেই যাদুকারিনীর।কৌড়ির উপর রাগ তিরতির করে বেড় গেলো নিভানের।রাগে হনহনিয়ে চলে গেলো সে।

ডালিয়া বেগমকে ডেকে পাঠালেন জাহিদ সাহেব।চার ভাইয়ের একমাত্র বোন ডালিয়া বেগম।মা বাবা ছাড়াও সেই সুবাধে ছোটো থেকেই সবার ভিষণ আদরের তিনি। ভাইদের তো অতি আদরের।এই অতি আদরে আদরে মানুষ হওয়ায় ছোটো থেকেই কিছুটা গৌরবি স্বভাবের তিনি।নিজের ভুলত্রুটি আমলে নেন-না,অন্যের ত্রুটিগুলো খুঁজেখুঁজে বের করার চেষ্টা করেন।আর ত্রুটি পেলে খোঁটা দিয়ে কথা বলতে দু’বার ভাবেন-না।শুধু নিজে আর নিজের মেয়ে বাদে আপন পরও ছাড়েন না।জাহিদ সাহেব ডাকতেই চটজলদি পায়ে না এগোলেও ধীরে ধীরে ভাবুক মনে ভাইয়ের ঘরের দিকে এগোলেন।অনুমতি নিয়ে রুমে প্রবেশ করতেই দেখলেন সেখানে ভাই ভাবি দু’জনেই আছে।রুমে ঢুকতেই পরিস্থিতি বুঝে ভাইয়ের পাশে গিয়ে বসলেন।ফের আহ্লাদী গলায় শুধালেন।

‘আপনার শরীর কেমন আছে ভাইজান?

জাহিদ সাহেব বরাবরই গম্ভীর স্বভাবেরই মানুষ। স্বভাব মতো গম্ভীর গলায় বললেন।–আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তোমার ওদিকের কি খবর?

যদি-ও প্রশ্নটা করতে চাননি জাহিদ সাহেব।তবে বাধ্য হয়ে প্রশ্নটা করলেন।বোন তো,সে যেমনই হোক তার ভালোমন্দের খোঁজখবর রাখাতো উনার কর্তব্য দায়িত্ব।

‘আলহামদুলিল্লাহ,সব ঝামেলা মিটিয়ে এসেছি।আমার ছেলে সন্তান নেই, শুধু মেয়ে বলে, জমিজায়গার হিসাব নিকাশে কম দিতে চেয়েছিলো ওরা।আমি ডালিয়া ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নাকি,দিবার বাপে যে সম্পত্তির ভাগিদার।সব হিসাবকিতাব করে গুছিয়ে নিয়েছি সাথে এক চাচা শ্বশুরের ছেলের কাছে বিক্রি করার ব্যবস্থাও করে এসেছি।

‘এসবের কোনো দরকার ছিলো না কিন্তু।তুমি অযথা ঝামেলা করলে।আর ছেলে সন্তান না থাকলে,শুধু মেয়ে সন্তান থাকলে নিজের ভাইয়ানা সম্পত্তির ভাগিদার হয়ে যায় অন্য ভাইয়ে-রা।সেই সূত্রে মেয়ে-রা সম্পত্তি কমই পায়।

‘তাই বলে ওরা আমার এতিম মেয়েকে বঞ্চিত করবে।তা আমি হতে দেই কিকরে?আমার মেয়েরটা ভাগ আমি কড়ায়গণ্ডায় বুঝে নিয়ে এসেছি।একতিল ছাড় দেইনি কাওকে।

বোনের এই খেয়ালিপনায় মনেমনে বিরক্ত হলেও চোখে মুখে সেটা প্রকাশ করলেন না জাহিদ সাহেব।সেদিকে আর কথাও বাড়ালেন না।অযথা যুক্তিতর্ক বাড়বে।যতোই বোঝান না কেনো কাজ হবেনা।নিজে যা বুঝবে সেটাই করবে।তাই যেটা বলার জন্য বোনকে এখানে ডাকলেন।সেটা বলার জন্য মনস্থির করলেন।একপলক দেখে নিলেন,নিজ মনে আলমারির মধ্যে কিছু ঘাঁটতে থাকা নীহারিকা বেগমকে।ফের বললেন।

‘যে মেয়েটাকে এবাড়িতে দেখছো, সে এবাড়ির আশ্রিতা নয়।আমার খুব কাছের একজন শুভাকাঙ্ক্ষীর মেয়ে।যার সাহায্যে তোমার ভাইজান সসম্মানে আবারও মাথা উচু করে দাঁড়াতে পেরেছে।তাই তাকে কখনো ছোটো করে কথা বলো-না।বাঁকা নজরে দেখো না।আমি কিন্তু সেটা কখনো মেনে নেবো-না।মেয়েটা আমার কাছে একপ্রকার আমানত সরূপ।সেই আমানতের শারীরিক বা মানসিক কোনো খেয়ানত আমি বরদাস্ত করবো-না।
বিষয়টা খেয়ালে রেখো।

অনাকাঙ্ক্ষিত অপমানে মুখাবয়ব থমথমে হয়ে গেলো ডালিয়া বেগমের।রোষানল নজরে একবার নীহারিকা বেগমকে দেখলেন।তিনি একমনে আলমারি খুলে কিছু একটা করছেন। আলমারির সামনে দাঁড়ানোতে দেখা যাচ্ছে না,মুলত তিনি কি করছেন।তবে ডালিয়া বেগম
বুঝে ফেললেন,ভাইজানের কানে কথা কে ঢেলেছে।মনেমনে ভিষণ ক্ষুব্ধ হলেন নীহারিকা বেগমের উপর।তবে চেয়েও মুখে কিছু প্রকাশ করতে পারলেন না।ভাবীর কান ভাঙাতে ভাইজান ডেকে এনে ঠান্ডা মাথায় অপমান করলেন,বিষয়টা আরও গায়ে লাগলো উনার।জাহিদ সাহেব ফের বললেন।

তোমার ‘মেয়ের কথা ভাবো।তার সংসার কিকরে টিকিয়ে রাখা যায়,সেটার চেষ্টা করো।অযথা অন্যের খাওয়া,পরার, থাকার,হিসাবে প্রেশার না নিয়ে মেয়ের বিষয়ে প্রেশার নাও।সংসার ছাড়া মেয়েটা কতোদিন এখানে পড়ে আছে,তার ভালোমন্দের খোঁজখবর নাও। কতো মানুষ কতোকিছু বলছে,সেটা থেকে মেয়েটাকে বাঁচাতে তার জীবনের একটা ভালোমন্দ সিদ্ধান্তে যাও।
অন্যের বিষয়ে খেয়ালি না হয়ে মেয়ের বিষয়ে খেয়ালি হও।তাতে আখের তোমারী ভালো হবে।সিয়ামের বাবা মা আসতে চেয়েছিলো,তাদের বৌমাকে নিয়ে যেতে।
তোমার মেয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে সেখানে থাকবে না।
তুমি থাকতে, তোমার মেয়ের সিদ্ধান্তে আমি মতামত রাখবো।সেটাতো ভালো দেখায় না, উচিতও নয়।তুমিও অসন্তুষ্ট হতে পারো।বিধায়,তুমি বাড়িতে নেই জানিয়ে তাদের আসাটা আঁটকে রেখেছি।এসেছো।মেয়ের সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নাও।সে-ও প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে,নিজের ভালোমন্দ সব বুঝ তার আছে।আর তুমিও তার মা।ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত জানাও,আমি তাদেরকে আসতে বলি।একটা মিমাংসে তো যাওয়া উচিত।এভাবে ঝুলন্ত অবস্থায় সম্পর্ক রাখা ঠিক নয়।আর এভাবে তো জীবনও চলতে পরে না।

ডালিয়া বেগম নিজের অপমানিত হওয়া বিষয়টা বাদ দিয়ে এবার মেয়ের জন্য ভাবতে বসলেন।মেয়েকে এতো করে বোঝালেন অথচ কাজ দিলো-না।পুরুষ মানুষের ওরকম একটু আধটু চারিত্রিক সমস্যা থেকেই থাকে তাই বলে, রাজপুত্রের মতো বর,প্রাচুর্যে ঘেরা সংসার ছাড়তে হবে!নাকি নিভানের ভুত আবার চেপেছে মাথায়।যেটা মেয়ে উনার কাছে প্রকাশ করতে চাইছে না।মনেমনে এবার মেয়ের প্রতি ভিষন ক্ষুব্ধ হলেন।নিভানকে ভেবে যদি মেয়ে নিজের পাহাড় সমতুল অর্থ বিত্তের সংসার ছাড়তে চায় তা কখনোই হতে দেবেননা।

সময় গড়াতে থাকলো,আর আস্তে আস্তে নিজেকেও সেই সময়ের সাথে সাথে মানিয়ে নিতে থাকলো কৌড়ি।এখন এই বাড়িটা তার খুবই পরিচিত জায়গা সাথে বাড়ির মানুষগুলোও।আর সবাই তাঁকে প্রচন্ড ভালোও বাসে।বিধায় এতো তাড়াতাড়ি বাড়ির মানুষগুলোর সাথে সহজ হতে পেরেছে সে,মিশতে পেরেছে।আর নিজেকেও মানিয়ে নিতে পেরেছে।সময়টা শুক্রবার বিকাল।শুক্রবার মানেই বাড়িতে একটা আলাদা হৈচৈ থাকে।তবে এবাড়িতে বিশেষ কিছু মানুষের জন্য সেই হৈচৈ আড্ডা দুষ্টমি না থাকলেও শুক্রবারের দিনটা বিশেষ ভাবেই কেটে যায় এবাড়ির বাচ্চাপাটিগুলোর।তারা নিজেদের মতো স্পেশাল করে নেয় শুক্রবারের দিনটা।

ছাঁদে দাঁড়িয়ে নাচের প্রিপ্রারেশন নিচ্ছে মৌনতা আর মান্যতা।দু-বোন বেশ ভালোই নাচে।এর-আগে কৌড়ি দেখেছে একবার।দর্শক হিসাবে আছে, সে আর নাফিম। দর্শক হিসাবে নাফিম শুধু দাঁড়িয়ে নেই।ইভানের কাছ থেকে ফোন এনে ভিডিও এর কাজে লেগে পড়েছে।আজ ছোটো দাদাভাইয়ের ফোনটা বাগে পেয়েছে,কতো ইনিয়ে বিনিয়ে ফোনটা নিয়েছে গেম খেলার জন্য।অথচ গেম খেলাই তার হলোনা। ছাঁদে এসে দেখলো, বোনেরা সব সেজেগুজে নাচের জন্য রেডি হচ্ছে।আর কি!মান্যতা আপুর ফোনে গান চলছে, তার হাতে ছোটো দাদাভাইয়ের ফোনটা দেখেই ঘ্যানঘ্যান শুরু করলো ভিডিও করার জন্য।নাফিমও বাধ্য হয়ে গেম খেলা বাদ দিয়ে ভিডিও এর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।নাহলে অন্যসময় মান্যতা আপুর ফোন চাইলেও তাকে দেবেনা।

‘আকাশে বাতাসে চল সাথি উড়ে যাই চল ডানা মেলে রে।
ময়নারে ময়নারে যাবো তোর পিছু পিছু ডানা মেলে রে।
আকাশে ভেসে চল,রুপকথার চল।
ওই দেশে বাঁধবো ঘর।
পার হয়ে তেপান্তর।
সাত সাগর তেরো নদী পিছনে ফেলে।

গানটার সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে মেয়ে দুটো দারুন নাচতে থাকলো।মুগ্ধ হয়ে তা দেখলো কৌড়ি।মনে পড়ে গেলো প্রিয় বান্ধবীটার কথা।তার স্কুল এন্ড কলেজে জীবনের ঘনিষ্ট বান্ধবী ছিলো বিথী।মেয়েটার বাড়িটা তাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে।বিথীও খুব সুন্দর করে নাচতে পারতো।কৌড়ি কলেজ ছাড়া-তো সেভাবে বাড়ির বাহিরে বের হতো না।দাদিআপার-ও বিশেষ নিষেধাজ্ঞা ছিলো।তাই মেয়েটা সময় পেলেই তার কাছে চলে আসতো।দু’জনে মাতিয়ে গল্প করতো আড্ডা দিত।মাঝেমধ্যে গান ছেড়ে,রুমের মধ্যে নাচতো।মেয়েটার কাছ থেকেই মোটামুটি নাচটা শেখা কৌড়ির।তবে মেয়েটা নাচতে পারতো প্রফেশনালদের মতো।বান্ধবীটা তার এখন কেমন আছে কে জানে।এখানে আসার পর আর কখনো তো কথা হয়নি।হয়নি বলতে সুযোগ হয়নি।যদি একটা নিজস্ব ফোন থাকতো তার,তবে অবশ্যই সে খোঁজখবর নিতো,রাখতো।

‘কি ভাবছো?

গান শেষ হতেই নাচ থামিয়ে, কিছুটা হাঁপিয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করলো মান্যতা। কৌড়ি জেনো হুঁশে এলো।মৃদু হেসে বললো।—তেমন কিছু না আপু।আপনি কিন্তু দারুণ নাচতে পারেন।আমার একটা বেষ্টফ্রেন্ড ছিলো, জানেন সে-ও আপনার মতো দারুণ নাচতে পারতো।

ছোটো বেলায় শখ করে নাচ শিখছিলো।স্কুল প্রগামও করেছে বেশ।তবে বড় হওয়ার পর,বাড়ির কড়া নিষেধাজ্ঞা আছে।বাহিরে কোথা-ও নাচের পারমিশন নেই।বিশেষ করে দাদাভাই আর মায়ের।একগাল হাসল মান্যতা। হাসিটা জেনো অমায়িক মানায় ওই ফর্সা মুখে।বললো–তাই।আমাকে দেখে তবে বান্ধবীর কথা মনে পড়ে গেলো।

‘হুম আপু।স্বভাবেও আপনার মতো মিশুকে আর ভারী মিষ্টি সে।

‘নাম কি তোমার বেষ্টফ্রেন্ডের?

উচ্ছল গলায় কৌড়ি বললো।’নাজিয়া বীথি।

‘খুব সুন্দর নাম।কথা বলতে ইচ্ছে করেনা তারসাথে?নিশ্চয় তাকে মিস করছো খুব?

হঠাৎই হাস্যোজ্জ্বল মুখে আধার নেমে এলো কৌড়ির।
মন খারাপ হয়ে গেলো।বললো–খুব মিস করি।আর কথাও বলতে ইচ্ছে করে খুব খুব।

ছাঁদের একপাশ ঘেঁষে করা সিমেন্টর তৈরী বসার স্থান। সেখানে বসা কৌড়ি।কৌড়ির পাশে গিয়ে বসলো মান্যতা।কোমল গলায় বললো–মন খারাপ করো-না। তার নাম্বার জানা থাকলে,আমার ফোন থেকে কথা বলে নিও।অথবা তার কোনো ফেসবুক আইডি থাকলে
আমার আইডি থেকে রিকুয়েষ্ট দিয়ে,যোগাযোগ করো।আর মা’কে বলে আমি তোমার ফোনের ব্যবস্থা করে দেবো।

হুট করে মান্যতাকে জড়িয়ে ধরলো কৌড়ি।ফের বললো–আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আপু।আর আমার ফোন লাগবেনা।আপনার ফোন থেকে মাঝে মাঝে একটু কথা বলতে দিলেই হবে।

খুশি হলো মান্যতা।এই মিষ্টি মেয়েটার মুখের দিকে তাকালে,তার ভীষন মায়া হয়।কি আদূরে একখান মিষ্টি সুন্দর মুখ,চালচলন আদব কায়দায় ভারী সভ্য মেয়েটা।কোনো কিছুতে উগ্রতা নেই,বাড়াবাড়ি নেই।অথচ এই বয়সে সে কতো জেদ,কতো বাড়াবাড়ি করেছে।অবশ্যই এখন অনুতপ্ত হয় সেগুলোর জন্য।আর মনেমনে দাদাভাইকে ধন্যবাদ জানায়, তখন যদি দাদাভাই কড়া হাতে শাসন না করতো।কতোটা বিগড়ে যেতো,সেটা সেই কলেজ জীবনের কিছু বন্ধুবান্ধবদের এখনকার পরিস্থিতি জানলে বোঝা যায়।যাই হোক,আল্লাহ যেটা করেন ভালোর জন্য করেন।

‘এভাবে কাজ হবেনা।আমরা নাচছি তোমাকেও আমাদের সাথে নাচতে হবে।তোমার প্রিয় বান্ধবী যখন নাচতে পারে,নিশ্চয় তোমাকেও শিখিয়েছে।অল্পস্বল্প হলেও তুমিও নিশ্চয় জানো।তাতেই চলবে।চলো আমরা একসাথে নাচবো।

মান্যতা উঠে দাড়িয়ে কৌড়ির হাত চেপে ধরতেই কৌড়ি বললো—আপু,আমি আপনাদের মতো নাচতে পারিনা। প্লিজ আপু।

মান্যতা কিছু বলতে যাবে,তা আগেই মৌনতা বললো– আপু,কৌড়ি আপু নাচতে না পারলে-ও খুব ভালো গান গাইতে পারে।উনার গানের গলা বেশ,আমি শুনাছি।

লজ্জা পেলো কৌড়ি।লজ্জালু গলায় প্রতিবাদ করে বললোো।–মোটেই না।আমি মোটেই ভালো গাইতে পারিনা।ওরকম গুনগুন করে গান সবাই গাইতে পারে।

মান্যতা, মৌনতা কেউই ছাড়লো না।এমনকি নাফিম-ও নাছোড়বান্দার মতো চেপে ধরলো ও-কে।গান গাইতে স্বীকার না করা পর্যন্ত,কেউই ছাড়লোই না।বাধ্য হয়েই গান গাইতে স্বীকারোক্তি জানাতে হলো তাকে।কৌড়িকে গান গাইতে স্বীকার হতে দেখেই,সবাই চুপচাপ বসে পড়লো।লজ্জা পেলো কৌড়ি।তবে বিমুখ করলো না।চোখ বন্ধ করে গলায় সুর তুললো।আর সেটাও ভিডিও করলো নাফিম।

কার্নিশে ভুল,অবেলা বকুল,
থাকো ছুয়ে,একুল ওকুল।
থাকো ছুয়ে শহুরে বাতাস,
ছুঁয়ে থাকো নিয়ন আকাশ।
আবছায়া চলে যায় হিজলের দিন,
অভিমান জমে জমে আমি ব্যথাহীন।
আহারে জীবন, আহারে জীবন,
জলেভাসা পদ্মা জীবন… !!

আহা পারতাম,যদি পারতাম,
আঙুলগুলো ছুঁয়ে থাকতাম।
বিষাদের জাল টালমাটাল,
একোন দেয়াল,একোন আড়াল।
ছাই হয় গোধুলী কারে যে বলি,
একোন শ্রাবন আজ বয়ে চলি।
আহারে জীবন,আহারে জীবন
জলে ভাসা পদ্ম জীবন…!!

চোখের কার্নিশ বেয়ে নোনোজল বয়ে গেলো কৌড়ির।দেখলো সবাই।তবে কি বলবে ভুলে গেলো।মেয়েটার গানের গলা সত্যিই বেশ।ধীরেসুস্থে চোখ খুলে হাসলো কৌড়ি।দু’হাতে ফটাফট চোখ মুছে নিলো।সেটা দেখে পরিস্থিতি সহজ করতে মান্যতা কৌড়ির হাত চেপে ধরে বললো —চলো একসাথে তিনজনে মিলে একটা নাচ দেই।যেমনই হয় হোক।

কৌড়ি বারবার না স্বীকার করলো,এবারেও কাজ হলো না।বাধ্য হয়ে কোমরে ওড়না বেধে,গানের সাথে তাল মিলিয়ে, মৌনতা আর মান্যতার সাথে পায়ে পা মিলিয়ে নাচতে হলো তাঁকে।

রাতের খাবারের পর,নিজের আরামদায়ক বিছানায় হাত পা এলিয়ে দিয়ে ফোন নিয়ে বসলো ইভান।গ্যালারিতে ঢুকতেই দেখলো,অসংখ্য ভিডিও আর পিক।এটা নিশ্চিত নাফিমের কাজ।বিকাল বেলা কতো ইনিয়েবিনিয়ে ফোন নিয়ে কিসব আলতু ফালতু ভিডিও করেছে।সাথে ছাদের ফুলগাছ ফুলগাছ কোনো কিছুর পিক তুলতে বাকী নেই।সাথে মৌনতা আর মান্যতার ছবিতে ভরা।বিরক্ত নিয়ে একের পর এক পিক ডিলিট করতে গিয়ে দেখলো,দুই একটা কৌড়ির পিকও আছে।
কৌড়ির পিকগুলোও ডিলিট করতে থাকলো।দুটো পিক থাকতেই হঠাৎ মনেহলো কৌড়ির পিক তার ফোনে!তারপর মনেহলো,নাফিম কি ভিডিও করেছে?ভিডি-ও গুলো দেখতেই মন মস্তিষ্কে দুষ্টমী খেলে গেলো তার,অধোর কোণ প্রসারিত হলো বাঁকা হাসিতে।মূহুর্তেই হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকলো সে।কাঙ্ক্ষিত নাম, নাম্বারটা নজরে পড়তেই বেছেবেছে দুটো ভিডিও সঙ্গেসঙ্গে সেন্ড করে দিলো,সাথে একটা পিকও।টিকচিহ্নের গোলাকার চিহ্নটা মূহুর্তেই হালকা কালো রঙে ভরাট হয়ে যেতেই মুখের হাসি চওড়া হলো তার।দাদাভাই লাইনে আছে।একটু পরে পিক আর ভিডিও ডিলিট করে দিয়ে।মেসেজ দেবে সে।–স্যরি দাদাভাই,ভুল করে চলে গেছে।

ল্যাপটপে অফিসিয়াল কাজ করছিলো নিভান।হঠাৎ ল্যাপটপের পাশে রাখা ফোনটা,মেসেজ নোটিফিকেশন আসতেই জ্বলে উঠলো।গুরুত্ব দিলোনা।একমনে কাজ করে চললো।ফোনের আলো নিভে গেলো।বেশ কিছুক্ষণ পরে ফোনে একটা আননোন নাম্বার থেকে লম্বা মিসড্ কল আসায়,মনোযোগ ফোনে দিতে বাধ্য হলো নিভান।।ফোনটা হাতে তুলে নাম্বার দেখলো।চেনা পরিচিত নয়।তবে কে দিলো?কিছুসময় অপেক্ষা করে দেখলো,আর কল দিচ্ছনা।হবে হয়তো রং নাম্বার!ফোনটা রেখে দিতে গিয়ে দেখলো ইভানের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে মেসেজ। ইভান তো কখনো তাকে নক বা কল করেনা।নম্বরটা সেভ থাকায় হোয়াটসঅ্যাপে এড হয়ে আছে।তবে বিশেষ কথা হয়না কখনো।তবে আজ,কি কারনে মেসেজ দিলো।আর কি মেসেজ?কৌতুহল বশত হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকলো নিভান।

বিকালের নরম আলোতে,হাঁটু সমান চুল ছেড়ে রাখা এক মায়াহরিনী এলোকেশী কন্যা।দুধে আলতা গায়ে হালকা কলাপাতা রঙের ড্রেসটা,সোনালী আদ্রের মতো জ্যোতি ছড়িয়েছে।মায়ামায়া মিষ্টি একখান লাবন্যময়ী মুখ।ডাগরডাগর আঁখি জোড়া দিয়ে দুরের কিছু জেনো একমনে দেখে চলেছে সে।রক্তিম চিকন ঠোঁটের কোণে ঝুলে আছে মিষ্টি হাসি।সুগভীর নজর স্থির হয়ে গেলো পিকটায়।সাধারণ একটা পিক।অথচ নিভানের নজর মুগ্ধতায় ছেয়ে গেলো।মন শান্তি পেলো।ছবির দিকে নির্মিশেষে তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎই হাত লেগে ভিডিও অন হয়ে গেলো।মূহুর্তেই মিষ্টি স্বরের গানের ভিডিওটা চলতে শুরু করলো।গানের অর্ধ পর্যন্ত শুনতে পারলো না,তারমধ্যে ভিডিও ডিলিট।সঙ্গে পিক-ও।মূহুর্তেই এলোমেলো হয়ে গেলো নজর,তোলপাড় শুরু হলো শক্তপোক্ত বুকটার ভিতরটায়।ত্রস্ত হাতে বারবার ইভানের হোয়াটসঅ্যাপ আইডির ভিতর বাহির করতে থাকলো।কাজ হলো না।ক্ষন বাদেই ইভানের মেসেজ এলো–স্যরি দাদাভাই ভুলে তোমাী আইডিতে ওগুলো চলে গেছে।

মেজাজ অকারণেই প্রচন্ড খারাপ হলো নিভানের।
না চাইতেও ইভানের প্রতি মনেমনে বেশ ক্ষুব্ধ হলো সে।
এগুলো আজ বিকালের ভিডিও আর পিক।সেটা বেশ বুঝতে পারলো।তবে সারা বিকাল ইভান ঘুমে কাটিয়ে সন্ধ্যার পরে গিয়ে উঠলো।মা এই নিয়ে কতো চেচামেচি করলো।সারা সপ্তাহে শুক্রবারের জুমার নামাজ ছাড়া আর কোনো নামাজ নেই।নামাজ নিয়ে কতো কথা শোনালো।সেই ছেলে তার ফোনে এসব ভিডিও করলো কখন?আর কাকেই বা দিতে গিয়ে তার আইডিতে এলো?ফাজলামো করছে ছেলেটা তারসাথে।তবে কি ইভান বুঝে গিয়েছে তার দূর্বলতা?নাকি সে যেটা বলছে সেটাই ঠিক।

মনের হাজার ভাবনা,জলে ফেলার মতো ডুবিয়ে দিলো নিভান।ওই পিকটা তার চাই!সাথে ভিডিও গুলো।একটা অর্ধ দেখলো আরেকটাতো দেখতেই পেলোনা।সবগুলো তার চাই!চাই মানে লাগবেই।নাহলে এই ভিতরে বয়ে যাওয়া ঝড় শান্ত করবে কিকরে?তব এখন যদি ফর্মালিটি বাদ দিয়ে ইভানকে বলে,ভিডিওসহ পিকটা দিতে।ওই ফাজিল ছেলেটা তার পিছু লাগতেও ছাড়বে না।আবার যদি ইভান সত্যিসত্যি কৌড়িকে পছন্দ করে থাকে,তবে বিষয়টা কেমন দেখাবে?ভিষন বাজে!এখন কি করবে সে?জোরেজোরে কয়েকবার শ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করলো।বাহিরে নিজেকে ধাতস্থ করতে পারলেও,ভিতরটাকে কিছুতেই শান্ত করতে পারলোনা।মন বসালো ল্যাপটপে।কিন্তু কাজ পাগল ছেলেটা তাতেও মন বশিভূত করতে পারলোনা।মন মেজাজ হঠাৎই উগ্র হয়ে গেলো তার।ইভানের রাগ দেখালো ল্যাপটপের উপর।ছুঁড়ে মারলো সেটা বেডের অন্যত্রে।বেডের নিচে গিয়ে পড়লে,জিনিসটা হয়তো গুড়িয়ে যেতো এতোক্ষণ।উঠে দাঁড়ালো সে।বেশ কিছুসময় হাসফাস করে,কিছু একটা ভেবে রুমের বাহিরের পানে পা বাড়ালো সে।থামলো,মান্যতার রুমের সামনে গিয়ে। দ্বিধান্বিত হয়েও,দরজায় নক করলো দু’বার। তৃতীয়বার নক করার আগেই দরজা খুলে গেলো।এইসময়ে দাদাভাইকে নিজের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হলো।প্রশ্ন করলো।

‘কিছু বলবে দাদাভাই?

‘ফোনটা কোথায় তোমার?ফাইভ মিনিট,ফোনটা আমার কাছে দাও তো।প্রয়োজন আছে,আমি আবার একটু পরেই দিয়ে যাচ্ছি তোমাকে।

ফোনটা মোটেই দিতে চায়না মান্যতা।কারন তো অনেক।তবে এমন একজন ব্যক্তি চেয়েছে,না তো তার মুখ দিয়ে কখনো বের হবেনা।ভিষণ কান্না পেলো মান্যতার।সবকিছু বাদ,ফ্রেন্ডদের সাথে চ্যাটিং গুলো যদি দেখে দাদাভাই।তাহলে তো ইন্না-লিল্লাহ।তবে এতো রাতে তার ফোনের কি প্রয়োজন পড়লো, এটা বুঁজে আসলোনা তার।মন খারাপ করেও,হাতের ফোনটা বাড়িয়ে দিলো দাদাভাইয়ের দিকে।ফোনটা হাতে নিয়ে নিভান বললো।

‘পাচ মিনিট পরে দিয়ে যাচ্ছি।

মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলেও,মন বললো ফোনটা এখন দিয়ে যেতে তবে মুখ দিয়ে তা কখনো বলা হবেনা।নিভান নিজের ঘরে চলে এলো।নিভান রুমে ঢুকতেই, পাশের রুমের পর্দার ফাঁক থেকে বেরিয়ে এলো ইভান।
মুখ তার দুষ্ট মিষ্টি হাসি।মান্যতার রুমের সামনে এগিয়ে গেলো সে।মান্যতাকে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো।

‘কি ব্যাপার।এমন মুখ করে দাঁড়িয়ে আছিস যে,তোর সাত রাজার ধনদৌলত দাদাভাইয়ের হাতে তুলে দিয়েছিস মনে হচ্ছে!

মান্যতা মন খারাপ করে বললো–‘সেরকমই তো।

‘নিশ্চিত থাক।আজ দাদাভাইয়ের তোর সাত রাজার ধনদৌলত চেইক করার সময় নেই।তার কাজ সামাধান হয়ে গেলে,তুই ফোন পেয়ে যাবি।

কপাল কুঁচকে ইভানের মুখের দিকে তাকলো মান্যতা। সেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে নিচে ড্রয়িংরুমের দিকে এগোলো ইভান।একটু পরে দাদাভাই বের হবে,মান্যতার ফোন দিতে।তাকে আরও একটু না জ্বালালে হয়!ড্রয়িংরুম থেকে নজর রাখলো,ইভান।কখন দাদাভাই বের হয়।নিজের কাজটা যতসম্ভব কমপ্লিট করে নিয়ে মান্যতাকে গিয়ে ফের ফোনটা দিয়ে আসলো নিভান।নিভানকে নিজের রুম থেকে বের হতে দেখেই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকলো ইভান।রাত বিরাতেও গলা ছেড়ে গান ধরলো।

‘জ্বলে পুড়ে মরার মতো যদি কোনো সুখ থাকে তার নাম ভালোবাসা।তার নাম প্রেম।

একই লাইন বারবার গাইতে গাইতে নিজের রুমে চলে গেলো ইভান।নিজের কাজের জন্য ভিতরে ভিতরে এমনিতেই কেমন দ্বিধবোধ, অপ্রস্তুত কাজ করছিলো নিভানের।তার উপর ইভানের এই গানের কলি তাকে আরও অপ্রস্তুত করে দিলো।মান্যতার হাতে কোনো রকম ফোনটা দিয়ে চলে গেলো সে।দু-ভাইয়ের এই অদ্ভুত কথাকাজে কেমন কেমন লাগলো মান্যতার।তবে প্রশ্ন করবে কাকে সে?

মান্যতার রুমে ছিলো কৌড়ি।সেখান থেকেই নামছিলো।
সিঁড়ির মাথায় এসে হঠাৎ ড্রায়িংরুমের দিকে নজর যেতেই থমকে গেলো সে। সিঁড়ির প্রথম ধাপে ফেলা পা জোড়া তড়িৎ গতিতে উঠিয়ে, পিছে সরতে গিয়ে বলিষ্ঠ শক্তপোক্ত একটা বুকের সাথে ধাক্কা খেলো।সামনে হুমড়ে পড়ার আগেই পিছনের মানুষটার হাতজোড়া আঁকড়ে ধরলো তার কোমর।সেদিকে জেনো তার খেয়াল নেই,ড্রয়িংরুমে বসা মানুষ দুটোকে সে স্থির নজরে দেখতে থাকলো।এরা দুজন এখানে কি করছে?

নিজের সাথে আঁকড়ে নেওয়ার পর-ও যখন কৌড়ির কোনো প্রতিক্রিয়া অনুভব করলোনা।তখন কৌড়ির নজর লক্ষ্য করলো নিভান।ড্রয়িংরুমে বসা মানুষ দুটোকে কেমন চেনা চেনা লাগছে তার,কোথাও জেনো দেখেছে!হ্যা মনে পড়েছে।কৌড়ির চাচা আর চাচাতো সেই ভাই।যে কৌড়িকে সেদিন এখানে আসতে না দেওয়ার জন্য খুবই উগ্র আচারন করেছিলো।সেদিন ছেলেটার আচারনে নিভান বেশ বুঝেছিলো,কৌড়ির প্রতি ছেলেটার দূর্বলতা আছে।না-হলে আর-ও অনেক কাজিন ভাইবোন থাকতেও,ওই ছেলেটা কেনো এতোটা ডেস্পারেট আচারন করেছিলো।আজ আরও ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারছে।কিসের জেনো একটা রাগ,যেটা কৌড়ির প্রতি ভিতরে ভিতরে একটু একটু করে জন্মেছে।সেটা জেনো ড্রয়িংরুমে বসা ছেলেটাকে দেখে আর-ও চড়াও হলো নিভানের।গম্ভীর গলায় বললো।

‘নিজের মায়ার যাদুতে আর কাকে কাকে বশিভূত করে রেখেছো?আর কে কে বলি হয়েছে সেই যাদুতে?

চলবে….

#ফুলকৌড়ি
(১৭)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

সেই আতঙ্কিত জলদগম্ভীর গলার আওয়াজ কর্ণগোচর হতেই, সম্বিৎ ফিরলো কৌড়ির।নিজের কোমল শরীরের অবস্থানটা ঠিক কোথায় ঠেকে রয়েছে, বুঝে উঠতেই ভূমিকম্প বয়ে গেলো সর্বাঙ্গে।মূহুর্তেই বিদ্যুৎ গতিতে ছিটকে সরে গেল সে।বিস্মিত নজর,নিভানের দৃঢ় মুখের পানে ফেললো।মানুষটা তাকে আঁকড়ে ধরে ছিলো আর সে বুঝে উঠতেই পারিনি,এমন বেখেয়ালিতে ছিলো সে!আশ্চর্য! এটাও হওয়ার ছিলো!আর ওসব কি বললো মানুষটা?সে তার মায়ায় যাদু করেছে!তাও আবার কাকে কাকে।মানেটা কি?নিভানের স্থির,শান্ত নজরে নজর পড়তেই ইভানের বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেলো তার।মূহুর্তেই অস্বস্তিতে নজর এলোমেলো হয়ে পড়লো।নজর নামিয়ে নিলো।কার সামনে দাঁড়িয়ে আছে খেয়াল হতেই,বুকের ভিতরের যন্ত্রণাটার ধুকপুকানি দ্বিগুণ হারে লাফাতে থাকলো তার।নিঃশ্বাস ঘনো হলো।পা ছটফটিয়ে উঠলো,জায়গা ত্যাগ করার জন্য।হঠাৎ মন পড়লো,ড্রয়িংরুমে বসা খুব চেনা মুখদুটো।চোখের ভ্রম নয়তো,নাকি দিনে দুপুরে চোখ মেলেও স্বপ্ন দেখছে সে?না-হলে তারা আসবে কোথা থেকে?ভাবতেই সামনের মানুষটাকে ভুলে ড্রয়িংরুমের দিকে ফের তাকালো।নাহ,তার চোখের ভ্রম নয়।আর না দিবালকে দাড়িয়ে সে সপ্ন দেখছে।সত্যিই তারা এসেছে। কেনো এসেছে?তাঁকে নিয়ে যেতে।

ড্রয়িংরুমে বসা সুঠামদেহের ছেলেটার এলোমেলো নজর উপরে দিকে পড়তেই,মূহর্তেই কয়েক কদম পিছে সরে গিয়ে নিজেকে আড়াল করে নিলো কৌড়ি।আগে পিছে না তাকিয়ে এলোমেলো কদমে দ্রুত এগোলো মান্যতার রুমের পানে।ওই ড্রয়িংরুমে বসা লোকটা সম্পর্কে তার আপন চাচাতো ভাই।বাপের এক ছেলে হওয়ার সুবাধে ছোটোবেলা থেকে অতিরিক্ত রাগী,জেদী আর একগুঁয়ে স্বভাবের।যেটা বলবে সেটাই হতে হবে।নাহলে কে মা কে বোন কে আপনজন সব ভুলে,ব্যবহার হয়ে যায় হিংস্র পশুর ন্যায়।স্বভাবে লোকটার চরিত্র খারাপ না-থাকলেও,ব্যবহারে সে অমানুষ।বাজে ছেলেদের সঙ্গ পেয়ে সেই ব্যবহারের সাথে সাথে চরিত্রটাও নষ্ট হয়ে গিয়েছে।বাপের এক ছেলে হওয়ায়,যখন যেটা চেয়েছে।সেটাই পেয়ে পেয়ে বিগড়ে গেছে এমন।তেমন বাপও, কখনো শাসনবারন করেন নি।বংশের প্রদীপ,তাতে আবার পুত্র সন্তান।আহ্লাদ দিয়ে দিয়ে এখন পরিনতি,ভরাডুবি নৌকা।আগে রাগ জেদ ব্যবহার খারাপ থাকলে-ও।চারিত্রিক বিষয়টা খারাপ ছিল না।এখন তো মদ গাঁজা আসক্ত হয়ে চারিত্রটাও নষ্ট করে ফেলেছে।আর সেই বাজে চরিত্রের প্রতিফলন ঘটিয়েছে তারসাথে।

কবে থেকে ওই উগ্র মস্তিষ্কের নাহিদ ভাই নামক ছেলেটা তাকে পছন্দ করে,এটা কৌড়ির জানা নেই।জন্মসূত্রে চাচাতো ভাই বোন হিসাবে জানা-বোঝা তাদের।সেই ভাইবোনের সম্পর্কের উর্ধ্বে গিয়ে কখনো কিছু ভাবতে হবে এটা কখনো আশা করেনি বাা ভাবিনি কৌড়ি।তবে জ্ঞানবুদ্ধি হওয়ার সাথে সাথে সেই ভাবনা তাদের ভাই বোনের সম্পর্কে দেয়াল উঠিয়ে, সেখানে জন্ম দিয়েছে একরাশ ঘৃনিত অনুভূতি।পাশাপাশি বাড়ি তাদের।কৌড়ি বুদ্ধি হওয়ার পর দেখেছে।সব চাচাদের সীমানা ভাগ করে নিয়ে আলাদা আলাদা বাড়ি করা।সব বাড়িতে কমবেশি যাতায়াত থাকলেও,মেজো চাচাদের বাড়িতে যাওয়ার বিশেষ নিষেধাজ্ঞা ছিলো কৌড়ির।নিষেধাজ্ঞা বাবা এবং দাদির দু’জনের পক্ষ থেকে ছিলো।মেজোমা ও পছন্দ করতোনা,ওবাড়িতে যাওয়া।বিধায় কৌড়ি-ও যেতো না।তবে যখন আস্তে আস্তে বড় হতে থাকলো,নাহিদের উগ্র আচারন সম্পর্কে জানতে বুঝতে থাকলো তখন কৌড়ি বুঝলো কেনো ওবাড়িতে তাকে যেতে দেওয়া হতো না। হয়না।

কারনে অকারণে মা বোনদের সাথে তুই তুকারি করে বাজে আচারন করা।এমনকি গায়ে হাত তোলা।মুখে অশালীন বাজে ভাষা ব্যবহার করা।বড়ছোটো কাওকে মান্য করে কথা না বলা।বখাটে ছেলেপুলেদের সঙ্গে মেলামেশা।পড়ালেখা বাদ দিয়ে রাত নেই বিরাত নেই,সারাক্ষণ এই মোড়ে সেই মোড়ে আড্ডাবাজি করা।তা নিয়ে কেউ কথা বললে,তারসাথে উগ্র আচারন করা।ছোটো বেলা থেকে এগুলো করে এসেছে ছেলেটা।কখনো মুরুব্বি মানিনি।বাড়িতে অবাধ নালিশ এসেছে।রাস্তা ঘাটে বাবা,চাচাদের দেখলে চেনা পরিচিত বিভিন্ন ময়মুরুব্বিরা বলতো, ভালো বংশের ছেলে হয়ে এতো উগ্র মস্তিষ্কের কেনো ছেলেটা?কাওকে মান্য করে কথা বলেনা।আর যে ছেলে মুরব্বি মানেনা, সে ছেলে মানুষ হওয়ায় নয়।আর কতো কথা।আর সেই ছেলেকে কেই বা পছন্দ করবে?কৌড়ির বাবাতো নাহিদ বলতে ভিষণ অপছন্দ ছিলো!বিধায় ওবাড়িতে যাওয়াও বিশেষ নিষেধাজ্ঞা ছিলো।মেয়ে দেখতে শুনতে মন্দ নয়,কখন আবার নিজের মেয়ের প্রতি নজর চলে যায়।আর সর্বনাশী কি কান্ড ঘটে বসে!এই আশঙ্কায় ওবাড়িতে যাওয়াটা আরও বিশেষ নিষেধাজ্ঞা ছিলো।যেটা দাদীআপাও সরাসরি দিনে দু’বেলা মুখে আওড়াতেন।
আর তাই-ই ঘটেছিলো।কৌড়ি যখন ক্লাস এইটে পড়ে,তখন কৌড়ির বাবার কাছে হঠাৎই একদিন বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসে নাহিদ।প্রস্তাব তো নয়,সে চড়াও গলায় জানিয়ে দিয়েছিলো।কৌড়িকে সে বিয়ে করতে চায়,তাকে জেনো অন্যত্রে বিয়ে দেওয়া না-হয়?কারন সে জানতো,তার সাধারন কথায় কখনো কৌড়ির বাবা মানবেন না।এমনিতেই মানতোনা এটাও জানতো।বিধায় হুমকিধামকি দিয়েছিল।আর এই হুমকিধামকির প্রস্তাবে কৌড়ির বাবা ভিষণ রেগে গিয়ে বাজে ব্যবহার করেছিলো নাহিদের সাথে।এমনকি গায়ে হাতও তুলেছিলো পর্যন্ত।ভাইকে ডেকেও,ছেলের হয়ে নানাবিধ কথা শুনিয়েছিলেেন।ছেলেকে উনার মেয়ের থেকে সাবধান থাকতে বলেছিলেন।নিজের বংশের ছেলে হলে কি হবে,যে ছেলের আচার ব্যবহার,ওঠবস ভালো নয়।সেই ছেলে,উনার মেয়েকে বিয়ে করার স্পর্ধা দেখিয়েছে।আবার উনাকেই হুমকিধামকি দিচ্ছে।এটা কখনোই মানবেনা তিনি।দরকার হলে মেয়েকে ফকির ভিখারির হাতে তুলে দেবেন,তা নাহলে মেয়ের পাত্র হিসাবে যদি কাওকে না পান নদীতে ভাসিয়ে দেবেন।তবুও ভাইয়ের ওই উগ্র মস্তিস্কের ছেলের হাতে কখনোই তুলে দেবেন না।একটা সময় গিয়ে এবিষয় নিয়ে দুই-পরিবারের মধ্যে ভিষণ মনোমিলন্য হয়।দুই পরিবার বলতে কৌড়ি বাবা ও চাচার মধ্যে।তারপর থেকে শুরু হয়,কৌড়ির জীবনে স্বাধীনভাবে চলাচলের প্রতিবন্ধকতা।

সেই ঝামেলা শেষ হওয়ার পর,কিছুদিন চুপচাপ ছিলো নাহিদ।তবে কৌড়ির ক্লাস নাইনে উঠার পর আবারও শুরু হয়ে যায়।তাকে কনভিন্স করার চেষ্টা করে।কনভিন্স তো নয়,সেই উগ্র মেজাজের হুমকি-ধামকি! কোনো মেয়ে কি আর সেই হুমকি-ধামকিতে কনভিন্স হয়?হওয়ার কথা নয়।কৌড়ির-ও সেসব হুমকি ধামকির আচারনে নাহিদের প্রতি কনভিন্স হওয়া তো দূর, আরও তীব্র ঘৃণা জন্মাতে থাকে।বাড়িতেতো বাবা আর দাদিআপার কারনে ঢুকতে পারতোনা ওই অমানুষটা।তাই স্কুল-কলেজে যাতায়াতের রাস্তায় উল্টোপাল্টা কথাবার্তা বলে হুমকিধামকি দিতো।বখাটে ছেলেদের মতো আচারন করতো।উঠিয়ে নিয়ে বিয়ে করার হুমকি ধামকি-ও দিয়েছে।সেসব দাদিআপাকে বাড়ি এসে বলতো কৌড়ি।তা নিয়ে আবার অশান্তি, ঝামেলা শুরু হয়।আর সেই ঝামেলার নতুন উৎপত্তি শুরু হয়, কৌড়ির বাবার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার হুমকি ধামকিতে।কৌড়ির বাবা সেবার প্রচন্ড রেগে গিয়ে ভাইকে ডেকে বলে বসলেন,ছেলেকে সোজা করতে না-হলে এরপর যদি নাহিদ আর একবার-ও কৌড়িকে নিয়ে উগ্রতা দেখায় তবে তিনি আইনে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবেন।

কৌড়ির বাবা একজন হাইস্কুলের টিচার ছিলেন।ভালো
টিচার হিসাবে সবাই উনাকে বেশ সম্মান করতেন,মান্য করেও কথা বলতেন।বংশ পরিচয়েও সমাজে উনার একটা উঁচুস্তরের সম্মান ছিলো।গ্রামের চেয়ারম্যান মেম্বারদের সাথেও স্বাভাবিক ওঠবস ছিলো।বিধায় কৌড়ির বাবা আইনগত ব্যবস্থা নিতে চাওয়ায়,উগ্র মেজাজের ছেলে হুমকিতে না দুললে-ও ছেলের বাবা হয়তো সেই হুমকিতে কিছুটা দুলেছিলেন।কিভাবে কি-করে জেনো ছেলেকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ঠান্ডা রাখতে পেরেছিলেন।তবে নাহিদের বাজে নজর যে তখনও কৌড়ির পানে ছিলো,এটা কৌড়িও বেশ জানতো।সবসময় দাদিআপার আদেশ নিষেধ অনুযায়ী সাবধানে চলাফেরা করতো।তবুও কি কাজ হয়েছিলো?হয়নি!সেদিন যদি দাদিআপা সময় মতো না আসতো তবে আজ কি আর এখানে থাকা হতো।ওই অমানুষের বাজে স্পর্শের জন্য হয়তো ধর্ষিতা তকমা গায়ে লাগিয়ে ওই অমানুষটাকেই বাধ্য হয় বিয়ে করা লাগতো।যেমনটা ওই অমানুষটা প্লান করেছিলো,আর খালি বাড়িতে তাকে একা পেয়ে তার ঘরে ঢুকে মাতলামি করে কথাগুলো বলেছিলো তাকে।-তোর বাপের তোকে নিয়ে খুব দেমাগ তাইনা!হবেনা কেনো,বুড়ো বয়সের ফূর্তির সন্তান বলে কথা।দরদ তো উথলে উথলে থাকবেই।তবে আমি কি বলেছিলাম,তার ওই ফূর্তির সন্তানকে আমি আদর দেবো না!শয়তান বদমাশ হতে পারি,তাই বলে বউকে আদর করবোনা!এাটা হয়?আর এটা তোর বাপে বুঝলোনা কেনো,তাইআজ বুঝিয়ে দিতে আসছি আমি। তোকে আজ ভরপুর আদর সোহাগ দিয়ে তোর আর তোর ওই দেমাগধারী বাবাকে বুঝিয়ে দেবো যে,তোকে বিয়ে করার পর ঠিক কতোটা আদর ভালোবাসায় রাখতাম আমি।আর এমনিতেই আজ যদি তোকে একটু আদর সোহাগ দেই,কাল নির্দ্বিধায় তোর দেমাগিওয়ালা বাপ নিজ থেকে আমার হাতে তোকে তুলে দিতে বাধ্য হবেন।

সময়টা ছিলো ডুবডুব সন্ধ্যা।দাদিআপা পাশের বাড়িতে কোথায় একটা গিয়েছিলেন।আর বাবা আসরের নামাজ পড়তে গিয়ে বাড়িতে তখনও ফেরেননি। ফেরার কথাও ছিলোনা,কেননা তিনি আসরের নামাজ পড়ে বাহিরে উনার সমবয়সী মানুষদের সাথে দেখাসাক্ষাৎ কথাবার্তা বলে একেবারে মাগরিবের নামাজ পড়ে ফেরেন।পাশাপাশি চাচাচাচিদের বাড়ি থাকতেও,সেদিন নাহিদের ড্রাগ নিয়ে চোখমুখ লাল-লাল করা মাতাল অবস্থা দেখে,আর ওসব নোংরামো আবোলতাবোল কথা শুনে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলো কৌড়ি।চিৎকার চেচামেচি করবে,গলা দিয়ে জেনো আওয়াজ বের করতেও সেদিন ভুলে গিয়েছিলো।মন হয়েছিলো,সে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নিত্যদিনের ন্যায় ওই অমানুষটাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু নাহ!নিজের গায়ের ওড়নায় যেই টান পড়েছিলো,গলা ছেড়ে চেচিয়ে উঠেছিলো সে।তারপর তার গলা ছেড়ে চিল্লাপাল্লা কান্নাকাটিতে,পাশের বাড়ি থেকে দাদিআপা সহ চাচীরা ছুটে এসেছিলেন।তখন ওই অমানুষটা তাঁকে হুমকিধামকি করে বাঘের থাবার ন্যায় গাল চেপে ধরে তার কান্না চেঁচামেচি বন্ধ করাতে ব্যস্ত!কি বিভৎস সন্ধ্যাটা ছিলো সেদিন!মনে উঠতেই গা শিহরে উঠে।

নিজের সাথে করা ওই অমানুষটার আচার ব্যবহারগুলো মনের দুয়ারে ভেসে উঠতেই তিক্ততায় ভরে উঠলো মন।রাগে ঘৃনায় রিরি করে উঠলো শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিচরিত রক্ত।ওই অমানুষটার জন্য বাড়ি ছাড়া হতে হলো,চলে এসেছে নিজের চেনা- পরিচিত সবকিছু ছেড়ে তারপরও পিছু ছাড়লোনা জানোয়ারটা।এলোমেলো পদচারণে মান্যতার রুমে ঢুকেই শব্দ করেই দরজা লাগিয়ে দিলো সে।সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে স্তব্ধ নজরে শুধু কৌড়িকে অবলোকন করে গেলো নিভান।মেয়েটাকে আজ অসম্ভব অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে।লজ্জা, ভয়,জড়তামুলক আচারন প্রয়াসই কৌড়ির মধ্যে খেয়াল করেছ নিভান।তাই বলে এরকম অস্বাভাবিক আচরন তো করতে কখনো দেখিনি মেয়েটাকে।তবে আজ হঠাৎ কি হলো মেয়েটার?সামনে তাকালো নিভান।ড্রয়িংরুমে বসা ভদ্রসভ্য হয়ে বসা ছেলেটার পানে গিয়েই বিধলো নজর।তবে কি,কৌড়িকে এখানে পাঠিয়ে দেওয়ার কারন,ড্রয়িংরুমে বসা ওই ভদ্রসভ্য ছেলেটা!

বিশাল বড় ড্রয়িংরুমটা নামীদামী জিনিস দিয়ে বেশ আভিজাত্যপূর্ণ সাজে পরিপাটি করে সাজানো গোছানো।যে কারও নজর বলে দেবে রুচিশীল হাতের কারুকায।অবশ্যই টাকা থাকলে কি-না করা যায়,যেখানে বাঘের চোখ মেলে।বড়ো ভাই আহসান হাবীবের কয়েকজন শহরে বন্ধু আছেন।তন্মধ্যে একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছেনএটা আরশাদ হাসান জানতেন আর জাহিদ সাহেবকে দেখেছেনও।লোকটার অর্থ সম্পদ আছে,শহরে বাড়িগাড়িও আছে,এটাও জানতেন।তবে লোকটা এতো বিত্তশালী,এটা জানা ছিলো না উনার।ড্রয়িংরুমের সিঙ্গেল সোফায় বসে আছেন আরশাদ হাসান।ভিতরে ভিতরে অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে বসে আছেন তিনি।কি দিয়ে কথা শুরু করবেন বুঝতে পারছেন না।ছেলের জেদ মেনে একপ্রকার বাধ্য হয়ে এখানে আসতে হয়েছে উনার।যেটা মোটেও উচিত হয়নি,সেটা এখন বেশ বুঝতে পারছেন।কিন্তু কি করবেন?ছেলের একটাই জেদ।কৌড়িকে তার চাই!যে কোনো মূল্যেই চাই।হাতের নাগালে থাকলে নাহয় ছেলের বাসনা পূরণ করতে অসুবিধা হতোনা,রাজ্যসহ রাজকন্যা যেকোনো মূল্যে উশুল করা যেতো। কোনো ব্যাপার ছিলোনা।কিন্তু উনার মা বুদ্ধিমানের মতো কাজ করে মেয়েটার বাপ মরতে না মরতেই উনাদের নাগাল থেকে বের করে দিয়েছেন।এখন এই ক্ষমতাধারী বৃত্তশীল পরিবার থেকে মেয়েটাকে বের করা সহজ হবেনা।বেশ বুঝতে পারছেন তিনি।তবুও মেয়ে যখন তাদের চেষ্টা করে দেখা যাক।আখেরি লাভ তো উনারই।রাজকন্যা পাবে ছেলে।আর রাজকন্যার বাপের রেখে যাওয়া রাজ্য হবে উনার।তবে চেষ্টা করতে ক্ষতি কোথায়!

‘আসলে আমরা এখানে এসেছি,আমাদের মেয়েটাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।নিজের সবকিছু থাকতে,পরের বাড়িতে এভাবে আর কতোদিন পড়ে থাকবে মেয়েটা?আত্মীয় স্বজন পাড়াপ্রতিবেশি সবাই জানতে ইচ্ছুক,বিয়ে নেই সাদী নেই হঠাৎ মেয়েটা কোথায় গায়েব হয়ে গেলো?না জেনে না বুঝে আমাদের প্রতি মেয়েটার প্রতি সবার একটা বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি!যার কোনো উত্তর দেওয়া যায়-না।আমরা চাচা চাচি থাকতে আম্মা কি বুঝে কৌড়িকে এখানে পাঠালেন,বুঝলাম না।

ড্রয়িংরুমের চার আসনের বসার সোফাটার মধ্যেবর্তী আসনে বসে আছেন জাহিদ সাহেব।খবর পেয়েছেন, সকাল সকাল উনার সাথে দেখা করতে কৌড়ির বাড়ি থেকে লোক এসেছেন।কারা আসতে পারেন বুঝতে সমস্যা হয়নি উনার।তবে সেদিন ফোনে কথাবার্তা বলার পরও যখন এবাড়িতে আসার স্পর্ধা দেখিয়েছেন, তখন তাে কথা বলাই দরকার।কথার প্রেক্ষিতে কথা বলতে যাবেন তিনি। তার আগেই সেখানে উপস্থিত হলো ইভান।বাবার বাঁপাশের খালি জায়গাটায় বসতে বসতে বললো।

‘তা আপনার আম্ম কৌড়িকে এখানে কেনো পাঠিয়েছেন,বুঝতে যখন পারছেনই না।তখন কিন্তু আপনাকে আপনার আম্মার কাছ থেকে সুন্দর করে শুনে বুঝে তারপর এখানে আসা উচিত ছিলো।আর তার থেকেও ভালো হতো,যখন আপনার ভাই মারা গিয়ে কবরে শুতে পারলেন না,তার আগেই তড়িঘড়ি করে উনার মেয়েটাকে কেনো একটা অচেনা অজানা জায়গায় পাঠানো হচ্ছে?সেটা জানাটা।তখন আপনি এতো আদরের চাচা সাহেব কোথায় ছিলেন?

জাহিদ সাহেব সোজাসাপ্টা কথাবার্তা বলতে চেয়েছিলেন।কৌড়িকে নিতে এসেছে তার চাচা,আর তিনি জেনেশুনে মেয়েটটাকে নরকে ঠেলে দেবেন না।কিন্তু ইভান যেভাবে কথা শুরু করলো,উনার চিন্তা ভাবনার থেকে আরও একধাপ উপরে।নীরবে হাসলেন। ইভানকে শাসন বারন না করে আরশাদ হাসানের মুখের দিকে তাকালেন।নজর অপ্রস্তুত হয়ে গেলো আরশাদ হাসানের।কে এই ছেলে না জানলেও,ছেলেটা যে মহা সেয়ানা সেটা বেশ বুঝতে পারলেন।কেমন উড়ে এসেই কথার মুখ মেরে দিলো।এখন তিনি উত্তর সরূপ কি বলবেন?ইভানের বা পাশের সিঙ্গেল সোফাটায় নাহিদ বসেছে।অল্পতে এমনিতেই মাথা গরম হয়ে যায় ছেলেটার।কারও ভালো কথা তার সহ্য হয়না।বরাবরই উগ্র মেজাজে আখ্যা পাওয়া ছেলেটা,ইভানের ইনিয়েবিনিয়ে বলা কথাগুলো শুনতেই মাথা গরম হয়ে গেলো।রাগে চোখমুখ কঠিন হয়ে এলো।হাতও মুষ্টিবদ্ধ হলো।দরদের লোকের দেখি অভাব নেই।এখানে এসেও রূপের জালে ফাঁসিয়ে দরদী লোকজন বানিয়ে নিয়েছে।এখানে আসার আগে বারবার বাবার দেওয়া সাবধানতা বানী মনে করে,নিজেকে আর নিজের তিরিক্ষি মেজাজ কে ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করলো।নাহিদকে লক্ষ্য করে ইভান একটু তারদিকে হেলে গিয়ে ফের বললো।

‘ফুলকৌড়ির বড়োভাই হিসাবে বোনকে নিতে এসেছেন?নাকি ব্যাপার অন্য কিছু ব্রো?আমার নজর তো বলছে,আপনি ঠিক সুবিধার মানুষ-নন।আর এই অসুবিধার মানুষজনদের কাছ থেকে ফুলকৌড়িকে ঠিকঠাক রাখার জন্য, তাকে এখানে পাঠানো হয়েছে! আমার নজরের ধারণা ট্রু নাকি ফলস্?

ইভান শেষের কথাটার উত্তর চাইলো চোখের ইশারায়।
রাগে মাথা দপদপ করতে লাগলো নাহিদের।দাতে দাঁত চেপে যতোসম্ভব নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো।তবে ইভানের কথার উত্তর সরূপ ইভানের দিকে লাল লাল নজরে একবার তাকাতে ভুললো-না।সেটা দেখে কৃত্রিম অমায়িক হেসে ইভান ফিসফিসিয়ে বললো।

‘আরেহ কুল ব্রো।তবে ভুল জায়গায় চলে এসেছেন!যাকে পাওয়ার চিন্তা করে এখানে এসেছেন।ভুলে-ও আর তাকে পাওয়া তো দূর,চোখের দেখা দেখতে পাবেন বলে তো আমার অন্তত মনেহচ্ছে না।কোনোরূপ আশা দেখছিনা আমি।আপনি-ও আল্লাহর ওয়াস্তে আশা ছেড়ে দিন।তাতে আমার মনেহয় আপনারই ভালো হবে।

ঠান্ডার মাথার ঠান্ডা গলার হুমকি!তাতে অপর পক্ষের মানুষটা ভয় পেলো কি-না বোঝা গেলোনা।ঠাই যেভাবে বসে ছিলো সেভাবেই বসে আছে।উপর থেকে ইভানের আর নাহিদের আলাপন কপাল কুঁচকে দেখলো নিভান।
ইভান হাজির হতেই মন কৌতুহলী হয়ে উঠলো।সামনে নজর রেখেই একে একে প্রতিটি সিঁড়ির ধাপ পার করে ড্রয়িংরুমে এসে জাহিদ সাহেবের অন্যত্র পাশে বসলো।
তবে মনোযোগ বা আগ্রহ সামনের দু’জনের পানে মোটেও রাখলোনা।সামনের টেবিল থেকে পেপার হাতে নিয়ে সেটাতে মনোযোগ দিলো।মনেহলো,সে বিশেষ ভাবে এখানে পেপার পড়তে এসেছে এবং বসেছে।কিন্তু বিষয়টা মোটেই তা নয়,নজর পেপারে থাকলেও কান সজাগ পাশের মানুষগুলোকে ঘীরে।সেটা বুঝে হাসলো ইভান।তার কোলাহলমুক্ত শান্তি প্রিয় দাদাভাই,নিজের শান্ত পরিবেশের রুম রেখে,স্টাডি রুম রেখে এখানে মানুষের কথাবার্তার মধ্যে এসেছেন পেপার পড়তে!মহা আশ্চর্যের বিষয়!আর এই মহা আশ্চর্যের বিষয়টা ঠিক কি সেটা ইভানের ভালো রকম জনা আছে।আরশাদ হাসান এবং নাহিদ দুজনে দেখেই চিনতে পারলো,এই সেই ছেলেটা সেই ছেলে।সেদিন কৌড়িকে এখানে নিয়ে এসেছিলো।নাহিদের সুক্ষ নজর নিভানকে পর্যবেক্ষণ করলো।কারনটা সেদিনেরই,সে যখন কৌড়িকে এখানে আসতে দেবেনা বলে হুমকিধামকি মাতলামো শুরু করেছিলো,লম্বা চওড়া পেটানো শরীরের ছেলেটা তীক্ষ্ণ নজরে তারদিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলেছিলো–

‘কোথায় আর কার সামনে দাঁড়িয়ে হুমকিধামকি দিতে হয়,মাতলামো করতে হয়।এরপর জেনে-বুঝে করবেন।মৃতবাড়ি না হলে আপনি কে আর আমি কে আর কার সামনে দাঁড়িয়ে হুমকিধামকি দিয়ে কথা বলে চলেছেন, ঠিকঠাক জানিয়ে বুঝিয়ে দিতাম।বাবা যখন মেয়েটাকে নিয়ে যেতে বলেছেন,দ্বিতীয়বার জেনা আমার সামনে আর আপনার ফালতু চিল্লাপাল্লা না শুনি।তবে মৃতবাড়ি বলেও কিন্তু ধৈর্য্য সহ্যশক্তি সহবৎ বলে কিছু আছে,মনে রাখবো না।

নিভানের দিকে সূচালো তীক্ষ্ণ নজরে নাহিদকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছু একটা বুঝে,তাকে উদ্দেশ্য করে ফের ফিসফিসিয়ে ইভান বললো।

‘আপনি ফুলকৌড়ির যেই হোন-না কেনো,আমি ইন্টারস্টেড নই।তবুও বলছি,তাকে নিয়ে ভালো-মন্দ যে ভাবনাটা মনের মধ্যে চলছে বা আছে অথবা ভাবছেন,সেই ভাবনাটা এখানেই বন্ধ করে দিন।ওই সদ্য এসে বসা পেপার হাতে নেওয়া মানুষটাকে দেখছেন না।সম্পর্কে উনি আমার দাদাভাই।ফুলকৌড়িকে নিয়ে ভালোমন্দ ভাবনার জন্য আপতত উনিই যথেষ্ঠ।আমার মনে হয়-না,এখন আর তাকে টপকিয়ে যে কেউ ফুলকৌড়ির ধরাছোঁয়ার কাছে ঘেঁষতে পারবে বা ফুলকৌড়িকে নিয়ে ভাবতে পারবে।আপনি যেই হোন না কেনো,মনেহয় আপনিও পারবেন না,ব্রো।সো ফুলকৌড়ি বলে আপনার লাইফে বোন অথবা বোনের বাহিরে কেউ ছিলো,এই ভাবনাটা মাইন্ড আউট করে ফেলুন।বুঝছেন কিছু?

আগুনে ঝলছে যাওয়ার মতো সমস্ত শরীর জ্বলে গেলো নাহিদের।ইভানের কথার অর্থ বুঝতে তার সময় লাগলো না।মাথার মধ্যের শিরা উপশিরা গুলো দপদপ করে উঠলো,কৌড়ির প্রতি রাগে।কাছে পেলে হয়তো মেয়েটাকে এতো সময় নিজের রূপ দেখিয়ে দিতো।আছড়ে মেরে ফেলতেও দ্বিধা করতোনা।ভীতু,লাজুক, ঘরকুনো মেয়েটার বড়লোক ছেলে দেখেই মাথা ঘুরে গেলো।নিজের সৌন্দর্য দিয়ে পটিয়ে ফেললো তাকে।অথচ সে কতোকিছু করলো তাকে নিজের করার জন্য। কিন্তু তাকে শুধু ঘৃনার নজরেই দেখলো।আর সেই ঘৃনা নিয়ে তারসাথে সারাজীবন রেখে দেওয়ার জেদ চেপেছিলো একসময় নাহিদের।আর সেই জেদ বজায় রেখেই এখনো পিছে লেগে থাকা।মেয়ের দেমাগ ভেঙে দেওয়ার প্রয়াস।তবে এখানে বসে হুমকিধামকি দিলে নিজের পিঠ বাঁচনো যাবে না,এটা এবাড়ির ঐশ্বর্য আর ছেলেদের হাবভাবেই বোঝা যাচ্ছে।কৌড়িকে এখানে নিয়ে আসার দিনও বুঝেছিলো,ছেলেটার ওই শান্ত তীক্ষ্ণ চাহুনির কথাগুলো তার পষান্ড হৃদয় আর শরীরকেও কাঁপিয়ে তুলেছিলো।তবে এতো সহজে তো সে-ও ছাড়বেনা!

ছেলেটাকে শাসাতে পেরে মনেমনে বেশ মজা পেলো ইভান।সেদিন মা আর বাবাকে কৌড়ির বিষয়ে কথা বলতে শুনেছিলো।মেয়েটাকে এখানে কেনো পাঠানো হয়েছে।আর কৌড়ির বাড়ি থেকে লোক এসেছে শুনতেই এখানে এসে ছেলেটাকে দেখে বেশ বুঝেছে,এই খবিশ নেশাখোর ব্যাটার জন্য মেয়েটাকে বাড়ি ছাড়তে হয়েছে।তবে খবিশ ব্যাটাকে একটা ধন্যবাদ দেওয়া দরকার।ব্যাটার জন্য কৌড়ি যদি বাড়ি ছেড়ে এখানে না আসতো।তবে সে দাদাভাইয়ের জন্য ওমন সুন্দর একটা শান্তশিষ্ট ফুলকৌড়ি নামক বউমনি পেতো কোথায়।দাদাভাই আর ফুলকৌড়ির বিয়ে হয়ে যাক।তারপর না-হয় একদিন যেচে গিয়ে মিষ্টি মিঠাই নিয়ে ধন্যবাদ দিয়ে আসবে খবিশটাকে।এখন ধন্যবাদ জানালে ব্যাটার দেমাগ বেড়ে যেতে পারে।

‘আপনি মেয়েটাকে নিতে এসেছেন,তবে আমি দিতে চাইছি না তাকে।আপনার পাড়াপ্রতিবেশি আশেপাশের লোক, আত্মীয় স্বজনরা কে কি বলছে আমার জানার দরকার নেই।তবে এই আত্নীয় স্বজনের কথা নিয়ে যদি আপনি চিন্তিত থাকেন,মেয়েটার ভবিষ্যতের চিন্তা করে থাকেন। বিয়ে দেবেন কিকরে?তবুও বলছি কৌড়ির চিন্তা আপনাদের কারও করা লাগবেনা,ওর সবকিছুর দায়িত্ব আমার।এমনকি বিয়ে দেওয়ার দায়িত্বও।তবুও আমি আপনাদের সাথে ওকে পাঠাতে চাইনা।এটাই ফাইনাল।

এতোসময় পর জাহিদ সাহেবের স্ট্রেইট কথায় নিজের গ্রাম দাপিয়ে কথা বলা আরশাদ হাসান আরও মিইয়ে গেলেন। উনার দু’পাশে বসা সামর্থ্য দুই ছেলেকে দেখে আর কোনো কথা বলার স্কোপ খুঁজে পেলেননা।মেয়ে উনাদের অথচ কথা বলার জোর পেলেননা।বরং উনার ছেলের সম্পর্কে জেনেশুনেও ঠান্ডা মাথায় কথা বলছেন এটাতে জেনো কথার প্রতিত্তোর করতে আরও দ্বিধা করলেন উনি।তবে আরশাদ হাসানকে প্রতিত্তোর করতে না দেখে মনেমনে বাবার প্রতি বেশ ক্ষুব্ধ হলো নাহিদ।নিজেই এবার মুখ খুললো।গমগমে গলায় বললো।

‘কৌড়ি আমাদের সাথে যেতে চায় কি-না, সেটা একবার ওর থেকেই জানতে চাই আমি।আপনি না বললে তো হবে না,ওর সিদ্ধান্ত নেওয়ার বয়স হয়েছে।আমি ওর নিজের মুখ থেকে সিদ্ধান্ত জানতে চাই।

নাহিদের বিশ্বাস কৌড়ি তার চোখের দিকে তাকালে কখনো হ্যা না কথা বলতে পারবে-না।বাধ্য হবে তাদের সাথে যেতে।সেই মনস্কামনাতে কথাটা বললো।কপাল কুঁচকে ফেললো ইভান।ঘাড় কাত করে বাবার ওপাশে বসা ভাইয়ের দিকে তাকালো।একটু আগের সাবলীলভাবে ধরা পেপারটা এখন খামচে ধরার মতো করে ধরে আছে।নিশ্চয় মনেমনে নাহিদের কলিজাটা খামচে ধরেছে।হাসলো ইভান।ঠোঁটে প্রকাশ পেলো-না হাসিটা।তবে মনেমনে নাহিদকে উস্কিয়ে দিলো,আরও দুটো একটা বেফাস কথা বলার জন্য।জাহিদ সাহবকে চুপ থাকতে দেখে নাহিদ ফের বললো।

‘ওকে ডাকুন,আমি ওর থেকে জানতে চাই।ও যেতে চায় কি না,ওর মুখ থেকে শুনতে চাই….

জাহিদ সাহেব নিজের সামনে বসা ছেলেটার স্পর্ধা দেখে অবাক না হয়ে পারলেন না।যারজন্য মেয়েটাকে এখানে পাঠিয়ে দেওয়া হলো,তারমধ্যে ভয় লাজলজ্জা, অনুতাপ কোনো কিছুই নেই।বরং লেজ উঠিয়ে মেয়েটাকে নিতে এসেছে।আবার উনার সামনে বসে গলা চড়িয়ে কথা বলার স্পর্ধাও দেখাচ্ছে।সবকিছু জেনেশুনেও ভদ্রভাবে কথা বলছেন বলে সাপের পাঁচ পা দেখেছে।তাই যদি হয় তবে সামনে বসা দুজনের ধারণা খুবই ভুল।তিনি ভালোরও ভালো। খারাপের আবার খুব খারাপ!কিছু বলতে যাবেন তারআগে চোখের ইশারায় নিভান থামিয়ে দিলো উনাকে।হাতে রাখা পেপারটা খুব সাধারণ ভঙ্গিতে টেবিলে উপর রাখলো ।সবার নজরে সাধারণ মনে হলে-ও ইভানের নজরে কিছুতেই সেটা সাধারণ মনে হলো-না।দাদাভাই সহজে রাগে-না।আর রেগে গেলে ভয়ংকর হয়ে যায়।মনেমনে একটু আতঙ্কিত হলো ইভান।তন্মধ্যে
ইভানকে উদ্দেশ্য করে গম্ভীর গলায় নিভান বললো—ইভান,বাবকে উনার রুমে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো।উনি অসুস্থ, এতোসময় বসে থাকতে পারেন না।সেটা বাহিরের লোকজন না জানলেও,আমাদের মনে রাখা উচিত।ভিতরে নিয়ে যাও বাবাকে।

ফের জাহিদ সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললো–আপনি নিজের রুমে গিয়ে বিশ্রাম নিন।আমি উনাদের সাথে কথা বলে নিচ্ছি।বিষয়টা আমি দেখছি।

নিভান মানেই যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটা চোখ বুজে মেনে নিতে বাধ্য জাহিদ সাহেব।তাই আর না করলেন না।
প্রশ্নই উঠলো না,না করার।এখানে বসে থাকতেও উনার কষ্ট হচ্ছে।ছেলের কথা শুনে হুট করে উঠে যাওয়াটা কেমন দেখায়,তাই নিজের অসুস্থতার বিষয়টা জানিয়ে, ইভানের সাহায্যে হুইলচেয়ারে বসে চলে গেলেন।যাওয়ার আগে বলে গেলেন মেহমানদের নাস্তাপানির ব্যবস্থা করতে।জাহিদ সাহেব চলে যেতেই রাজকীয় ভঙ্গিতে গা এলিয়ে পায়ের উপর পা তুলে সোফায় বসলো নিভান।ফের ঠান্ডা গলায় শুধালো।

‘তো কি বলছিলেন যেনো,এবার বলুন।

নিভানের এই দায়সারা ভাবসাব মোটেই পছন্দ হলোনা নাহিদের।আরশাদ হাসান তো সেই থেকে চুপ।পাঙ্গা এমন মানুষের সাথে নেওয়া দরকার, যার সাথে পেরে উঠা যায়।হয়তো সমানে সমানে নয়তো নিজের ক্ষমতা অর্থসম্পদের থেকে নিচুস্তরের লোকের সাথে।নিজের ক্ষমতা আর দৌলতের উর্ধ্বে গিয়ে উঁচু স্তরের লোকের সঙ্গে পাঙ্গা নিলে তা হয়তো কখনো জেতা যায়না।আশা করাও বোকামি।তিনি বুদ্ধিমান অতি চতুর ব্যক্তি সেই বোকামীটা করলেন না।সাথে সামনে বসা ছেলেটার বাজপদখির ন্যায় তীক্ষ্ণ নজর!গমগমে গম্ভীর দৃঢ় গলার স্বর!রাজকীয় বসার ভাবভঙ্গিমা।এমনিতেই রুদ্ধ করে দিয়েছে উনার শ্বাসনালী।নিভান প্রশ্ন করলেও উত্তরের আশা করেনি।তবুও কিছুসময় চুপ থেকে দেখতে চেয়েছিলো,তার সামনে বসা মানুষের দুজনের ঠিক সাহস কতটুকু। তারপর মুখ খুললো সে।গমগমে গলায় বললো।

‘ওর মুখ থেকে উত্তর চাই, তাই তো?মনে করুন আমি নই ওই-ই বলছে,ও আসবে না এখানে।আর যাবেও-না আপনাদের সাথে।যদি বলেন ওর হয়ে উত্তর দেওয়ার আমি কে?আমি কেউ না!তবুও ওর হয়ে আমি যে সিদ্ধান্তটা নেবো সেটাই ওর জীবনের লাস্ট এন্ড ফাইনাল ডিভিশন হবে।শেষ কথা যাকে বলে।প্রশ্ন যদি হয় কেনো এবং কিসের জন্য!তবে তার উত্তর আমি আপনাদেরকে দেওয়ার বিশেষ প্রয়োজন বোধ করছি না।আর কোনো প্রশ্ন বা উত্তর চাই?

আরশাদ হাসান তো কোনো কথাই বলতে পারলেন না।
তবে এটা বুঝতে পারলেন,কৌড়ি তাদের নাগালের বহুত দুরে চলে গেছে। সাথে এই ছেলের নজরেও পড়ে গেছে মেয়েটা।তার সেখান থেকে মেয়েটাকে বের করা সহজলভ্য হবে না।ছেলের পানে চাইলেন।কাঠ হয়ে চুপচাপ বসে আছে সে।হয়তো সেও বুঝে গেছে,মেয়েটার নাগাল পাওয়া আর সম্ভব নয়।তবে ছেলের অহামিকায় আঘাত লেগেছে।এর যের ঠিক কিভাবে পোহাতে,প্রভুই জানেন।হঠাৎ টেবিলের উপর কিছু রাখার শব্দে খেয়াল ভঙ্গ হলো উনার।দেখলেন এক ভদ্রমহিলা চা কফির ট্রে-টা টেবিলে রাখায় মৃদু শব্দ হয়েছে।

‘রানীসাহেবা,উনাদেরকে ডায়নিংয়ে নিয়ে যান।খাবারের ব্যবস্থা করুন।কৌড়ির আপনজন বলে কথা,সে যেমনই হোক আপ্যায়ন তো এমনিতেও হোক আর ওমনিতে-ও।করতেই হবে।

কি উদ্দেশ্য করে কথাটা বলা হয়েছে বিশেষ না বুঝলেও নড়েচড়ে বসলেন আরশাদ হাসান।ছেলেকে গাঁট হয়ে বসে থাকতে দেখে,উঠতে চেয়েও উঠতে পারলেন না।
তন্মধ্যে রানী বললো।

‘আসুন,এমনিতেই আপনাদের খাবারের ব্যবস্থা টেবিলে গোছানো হয়েছে। তবে এখানে কথা চলছিলো বলে,ভাবী সাহেবা চা নাস্তা পাঠালেন।

উঠলেন আরশাদ হাসান।এমনিতেই সামনে বসা ছেলেটার সামনে বসে থাকতে কেমন অদ্ভুত লাগছে উনার।উঠলেই বাঁচেন এমন একটা অবস্থা। সেই হেতুই উঠে দাঁড়ানো।ছেলেকে ডাকলেন।তবে সাড়া না পেয়ে রানীসাহেবাকে অনুসরণ করলেন।তিনি আলে যেতেই কফির মগটা হাতে নিলো নিভান।চুমুক দিলো খুবই আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে।ফের সামনে বসা একগুঁয়ে তেজস্বী ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে শীতল গলায় বললো

‘আমাকে দেখলে সবাই খুবই চুপচাপ আর শান্ত মাইন্ডের ছেলে বলে মনে করে।তেমনটাই নাকি আমার ব্যবহারে আর চেহারায় প্রকাশ পায়।আপনারও কি আমাকে তাই বলে মনেহয় যে,আমি খুবই ভদ্রসভ্য আর শান্ত স্বভাবের ছেলে?

কথার উত্তর দিলো-না নাহিদ।তবে অনুধাবন করতে পারল,তার সামনে আছে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ধূর্ত একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। যাকে নিজের সহজ হোক বা দূর্লভ কথায় বশ করানো বা ভয় দেখনো সহজ হবে না।তাই কথা বলার প্রয়োজন মনে করলোনা।আর এটাও অনুধাবন করতে পারলো,তার সামনে বসা মানুষটা তাকে উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেও উত্তর নেওয়ার অপেক্ষায় নেই।নিশ্চুপ থাকা প্রতিপক্ষ ছেলেটা নিজের থেকে কম বুদ্ধিমান, এটা ভুলেও ভাবলো না নিভান।মনেমনে হাসলো।ফের বলতে শুরু করলো।

‘তবে আমি ছেলেটা মোটেও তেমনটা নই।শান্তশিষ্টতা আমার বাহিরের রূপ,যা দেখে সবাই সেভাবেই বিবেচিত করে আমাকে।আমার ভিতরের রূপটা বাহিরের রূপের প্রকাশভঙ্গির পুরো বিপরীত।অতিরিক্ত বাজে,খুবই ভয়ঙ্কর,নিন্মমানেরও বলা চলে।তবে সেটার বহিঃপ্রকাশের পরিচিতি আমি আবার সবার সাথে পরিচয় করাই-না।পরিচয় করাই শুধু তাদের সাথে,যারা আমার অতি অপছন্দের মানুষ।সেটাও মাত্রারূপ ছাড়িয়ে গেলে।বিশেষ করে আমার প্রিয় মানুষগুলোকে কেউ আঘাত করার চেষ্টা করলে।বলতে পারেন,তাদের কোনোরূপ ক্ষতি আমার ওই অতিরিক্ত বাজে নিন্মমানের ভয়ঙ্কর হিংস্র আত্মাটাকে জাগিয়ে দেয়।সেখানে কাকে আপনার প্রশ্নের কাঠগড়ায় এনে দাঁড় করাতে চাইছেন,আপনার ধারনাও নেই।সুতারাং কোথায় বসে আছেন আর কার সামনে বসে আছেন, ভেবেচিন্তে একটু বুঝেশুনে কথা বলার চেষ্টা করবেন।

নাহিদের অপমানে রক্তিম হয়ে উঠা ক্রোধিত মুখাবয়বের দিকে আরও একপলক তাকিয়ে,কফির মগটা টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়ালো নিভান।সামনে এগোতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো হঠাৎই ।ফের গম্ভীর কন্ঠে বললো।

‘আর দ্বিতীয়বার এবাড়িতে ও-কে নিয়ে যাওয়ার কথা ভেবে পা রাখবেনও একটু সাবধানে!গভীর ভেবেচিন্তে!
মনে রাখবেন আমি মানুষটা যেমনটা সবাই দেখে ভাবে ঠিক তেমনটা নই।

মান্যতাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে কৌড়ি।আর ওই নাহিদ নামক অমানুষটার আচারনগুলো বিবরণ করে চলেছে।মান্যতারও মন খারাপ হলো খুব,ছোট্টো মেয়েটা, তার এতটুকু বয়সে কি-না কি দেখে চলেছে।এতটুকু বয়সে মা চলে গেলো তারপর বাবা নামক ছায়াটা।তারপরও কতোকিছু সয়ে গেছে এইটুকু জীবনে। কান্না থামানোর জন্য এটাওটা বলে স্বান্তনা দিতে থাকলো কৌড়িকে।
ফের বললো –মন খারাপ করোনা,দেখবে বাবা কিছুতেই উনাদের সাথে তোমাকে যেতে দেবেন না।

‘আমার যেতে মানা নেই আপু।বরং আমার বাড়িতে যেতে খুব ইচ্ছে করে।ওখানে থাকতে খুব মন চায়।তবে ওই অমানুষটার জন্য উপায়হীন আমি।

ফুপিয়ে কেঁদে কথাগুলো বললো কৌড়ি।দীর্ঘশ্বাস ফেললো মান্যতা।কি বলে আর স্বান্তনা দেবে মেয়েটাকে বুঝে আসলোনা।হঠাৎ প্রানউচ্ছল কন্ঠটা কানে আসতেই সেদিকে ফিরলো মান্যতা।কান্না থেমে গেলো কৌড়িরও।

‘আরেহ.. শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে যেতে চাওনা।সেটা বললেই হয়।এরকম ভ্যা ভ্যা করে কান্নার কি দরকার!আর যে কেউ তোমাকে নিতে চলে আসলে তোমার বর,সহজেই হোক বা যুদ্ধ বিদ্রোহ করে,তাকে তোমাকে দিয়ে দেবে ভাবছো কিকরে,?

চলবে…

ফুলকৌড়ি পর্ব-১৪+১৫

0

#ফুলকৌড়ি
(১৪)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

আগুনের একটুকরো ফুলকি জেনো ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ ছুঁড়ে দিলো মুখের উপরে।ঠিক এমনটা অনুভব করলেন ডালিয়া বেগম।আর-ও ব্যথিত হলেন,নিজের প্রিয় ভাইপো ইভানকে কথাটা বলতে দেখে।নিভান হলে নাহয় মানতে পারতেন কিন্তু ইভান!যদি-ও ইভান গালকাটা স্বভাবের।তাই বলে উনাকে এমন ধারার কথা বলতে পারলো?একটু-ও মুখে বাঁধলো না!আর কার সাথেই বা কার তুলনা করলো!নিজের আপন ফুপুর সাথে বাহিরের মানুষের তুলনা!অঙ্গারের ন্যায় শরীর জ্বলে উঠলো উনার।আলস্য ভঙ্গিতে এগিয়ে আসা ইভানের দিকে মূহুর্তেই কর্কশ কন্ঠে শব্দ ছুড়লেন।

‘তুই কার সাথে কার তুলনা করছিস ইভান?

সহসা উত্তর দিলো ইভান।—কেনো?মানুষের সাথে মানুষের তুলনা করছি।আপনি মনেহয় আপনার লেভেলের মানুষকে ছাড়া আর কাউকে মানুষ ভাবতে পারেন না।নাকি ইদানীং আপনার লেভেলের নিচের মানুষগুলোকে মানুষ ভাবা বন্ধই করে দিয়েছেন?যেখানে একই সৃষ্টিকর্তার (আল্লাহ) সৃষ্টি আপনি,আমি, তারা সবাই।

মুখাবয়ব কঠিন্য করে ফেললেন ডালিয়া বেগম।ইভান এভাবে তারসাথে কথা বলতে পারেনা!মূহুর্তেই অগ্নিশর্মা ধূর্ত নজর ঘুরিয়ে আনলেন নিজের চারপাশটাজুড়ে। রান্নাঘরে চোখমুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে উনার দুই ভাবি।বুঝলেন উপস্থিত ব্যক্তিগুলো কেউ উনার পক্ষ নিয়ে কথা বলবেন না।তাই নিজের হয়ে নিজেই কঠিন গলায় প্রতিবাদ জানালেন।

‘আমি কিন্তু এবাড়ির হকদার।একমাত্র মেয়ে।বাহিরের মানুষের সাথে কিন্তু এভাবে আমার তুলনা চলেনা।আর তুলনা দিতে পারিসও না তুই!

ফুপুমনির সামনে সটান এসে দাড়ালো ইভান।নিস্প্রভ চোখে উনার দিকে চেয়ে বললো।-পারিনা বলছেন!কিন্তু কেনো? আপনি যদি এবাড়ির হকদার হয়ে থাকেন,তবে যাদের উদ্দেশ্য করে বিষাক্ত বানী গুলো বললেন,তারাও কোনো না কোনোভাবে এবাড়ির হকদার।রক্ত সম্পর্কিত না-হলেও,এবাড়ির আপনজন।তা না-হলে আপনার শ্রদ্ধেয় মৃত বাবা,ভাইজান,এবাড়িতে তাদেরকে থাকতে দিতেন না। রাখতেন না অযথা।

‘তুই এভাবে আমার সাথে কথা বলতে পারিসনা ইভান।

ফুপিমণির সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো ইভান।ধপ করে গিয়ে বসলো নাফিমের পাশের চেয়ারটায়।নাফিম খাওয়া বাদ দিয়ে মুখ ভার করে বসে আছে।নজর পড়লো সামনে বসা কৌড়ির পানে।মেয়েটা খাচ্ছেনা।শুধু হাত দিয়ে ভাত নেড়ে যাচ্ছে নীরবে।টুপ করে কয়েক ফোঁটা চোখের পানি প্লেটে পড়তেই,চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।চেয়ার সমেত ফুপুমনির দিকে ঘুরে বসলো সে।শক্ত গলায় বললো।

‘আমি যেমন পারিনা,আপনার সাথে এভাবে কথা বলতে।তেমন আপনিও পারেন না এভাবে কাউকে ছোট করে কথা বলতে।সম্মান দিতে শিখুন,তবে সম্মাননা এমনিতেই পেয়ে যাবেন।এভাবে রাগ দেখিয়ে হুঙ্কার ছেড়ে চেয়ে পেতে হবেনা সম্মান।

কথাগুলো বলে ফুপুমনিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে মা’কে উদ্দেশ্য করে বললো—মা খেতে দাও আমাকে।

সুক্ষ অপমানে শুভ্র মুখখানা রক্তিম আভায় ছেয়ে গেল ডালিয়া বেগমের।আগুন ঝরা নজর দিয়ে আশপাশটা একবার দেখে নিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে গটগট করে চলে গেলেন তিনি।

দোতলার খোলা বারান্দার দাঁড়িয়ে আছে নিভান।সুগভীর,স্থির নজরটা তার ড্রয়িংরুম পেরিয়ে ডায়নিং স্পেসটায়।ফুফুমনির বলা তীর্যক বাক্য সে না শুনলেও,মেয়েটার হয়ে ইভানের বলা প্রতিটি বাক্য সে শুনেছে।অচেনা মেয়েটাকে যে ফুপুমনি তার চরিত্র বোঝাতে নিজের জবানের কটুবাক্য গুলো শুনাতে দ্বিধাবোধ করেন নি এটাও বেশ বুঝলো।তবে ফুপুমনিকে তার নখদর্পে।তাই সেসব বাদ দিয়ে আবার-ও ইভানকে বোঝার চেষ্টা করলো সে।মেয়েটার হয়ে ফুপুমনির বিরুদ্ধে গিয়ে,উনাকে কথা শোনানো!ইভান কি মেয়েটার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছে?তবে কি মেয়েটাকে তার সত্যিই পছন্দ?নাহলে ফুপুমনিকে এতো কথা শোনালো কেনো?একটা সময় এই ফুপুমনির কুটনৈতিক বাক্যগুলো ঘিরে তাদের দু-ভাইয়ের মধ্যে সম্পর্কের ফাটল তৈরী হয়।দুই ভাইয়ের মধ্যে সম্পর্কের এই জড়তা,এই দুরত্ব সবকিছু ঘিরে ওই ফুপুমনি।যদিও ইভানের তখন অপরিপক্ক বয়স ছিলো।আর সেই বয়সে ফুপুমনি ব্রেনওয়াশ করার জন্য যে ছলাবলা কথাগুলো বলতো,ছেলেটার ব্রেন তা ভয়ঙ্করভাবে জড়িয়ে নিতো।তারপর শুরু হতে থাকলো,সম্পর্কের টানাপোড়েন।দুই ভাইয়ের মধ্যে কতো মধুর একটা সম্পর্ক,একটা নৈকট্য বন্ধন ছিলো।সেটা আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যায়।যখন নিজ থেকে ইভান বুঝতে শুরু করলো,তখন সম্পর্কে এতো অবনতি এতো দুরত্ব চলে এসেছে,চেয়েও আর ইগোর খাতিরে কেউ আর সেই আগের মধুর বন্ধটাতে এগোতে পারিনি।সেই ইভান এখন নিজের সাথে সাথে,নিজের আপনজনদের ভালোমন্দটা-ও বুঝতে শিখেছে।তাদের হয়ে ভালোমন্দ স্ট্রেইট স্টেপ নেয় এবং নিচ্ছেও।

হঠাৎ নিভানের মস্তিষ্ক খেয়ালী হলো।তখন যে ইভান বললো,মেয়েটা তার আপনজনদের মধ্যে-ও একজন।তবে কি,তার মন ইভান আর ওই মেয়েটাকে ঘিরে যেটা ভাবছে।সেটারই ইঙ্গিত দিলো ইভান তার কথা-কাজে।
হঠাৎ আবার মনেহলো,এসব কি ভাবছে সে!যদি তাই হয়ে থাকে তবে তারও বা সমস্যা কোথায়?যদি সমস্যাই বা না থেকে থাকে তবে এমন আবোলতাবোল ভাবনা বারবার মন মস্তিষ্কে ঘুরছে,ভাবছেই বা কেনো?আর সেই ভাবনাতে ডুবে আছেই বা কেনো সে?কি হলো তার মনের,এমন অদ্ভুত অহেতুক ভাবনাতো কখনো ভাবনাতে আসিনি তার!এমন ভাবনা কখনো ভাবিওনি তার মন মস্তিষ্ক।তবে আজ কেনো?শুধু আজ তো নয়, ইদানীং মস্তিষ্কে ভাবনাগুলো কিলবিল করছে।সে তো প্রশ্রয় দিতে চাইছেনা,তবুও জবরদস্তি করে ভাবনাগুলো যেনো সেখানে নিজের জায়গা পোক্ত করে নিয়েছে।কি এক জ্বালা!কি এক যন্ত্রণায় নিভৃতে ভুগছে সে !কি নাম এ-জ্বালার, এই নিভৃতে পাওয়া যন্ত্রণার!

নজর আরও দৃঢ় হলো নিভানের।সেই দৃঢ় নজর পড়লো কৌড়ির মাথা নিচু করে খাওয়ার পানে।মেয়েটার মাথায় ওড়না টানা।বিধায় মুখ দেখাচ্ছে না।আর ওখানে যে তাকে ঘিরে,অতশত কতা হলো তবু্ও মেয়েটা মাথা উঁচু করে তাকায়নি।মেয়েটার কি খুব মন খারাপ?হঠাৎ মস্তিষ্ক সজাগ হলো,বললো।তুই আবারও মেয়েটার কথা ভাবছিস!উফফ!মস্তিষ্কের উপহাসের বানীতে ভাবনা সেখানেই ক্ষান্ত রাখল নিভান।মৃদুস্বরে মুখে আওড়ালো।

‘কেনো এলো এই যাদুময়ী তার জীবনে।

খাবার টেবিলে বসা মানুষগুলো চুপচাপ।মায়ের কাছে খাবার চাইলেও তিনি এখনো এখানে আসেননি। গুমোট পরিবেশ চনমনে করতে ইভাননাফিমকে উদ্দেশ্য করে বললো—এই পিচ্চু তুই এরকম না খেয়ে হুতুম পেঁচার মতো মুখ করে বসে আছিস কেনো?নাকি ছোটো-মা আজ খাইয়ে দিচ্ছে না বলে এরকম মুখ বানিয়ে বসে আছিস?

কোনো অভিব্যক্তি দিলো”না নাফিম।সে যতোই দুষ্ট থাকুক,কারও মন খারাপ দেখতে পারেনা।এমনি সময় মা বোনকে মহাবিরক্ত করলে বা জ্বালালেও,মা যখন মন খারাপ করে কোনো কিছু বলে,তখন সে কতো ভালো বাচ্চা হয়েযায়।তখন বিনাবাক্যবয়ে মায়ের সমস্ত কথা মানে।সেখান ফুপুমনির কথায় তার সামনে বসা মেয়েটাকে মন খারাপ করতে দেখে।তার মোটেও ভালো লাগিনি।এমনকি ফুলকৌড়িকে নীরবে কাঁদতে দেখে তার আরও বেশি খারাপ লেগেছে।তাই খাবার না খেয়ে চুপ হয়ে বসে আছে।এখন কারও কথা তার ভালো লাগছেনা।বাচ্চা ছেলেটার মনে বেশ ইফেক্ট পড়েছে কৌড়ির কান্না দেখে এটা বুঝতে পারলো ইভান।তার নিজেরই খাবাপ লেগেছে, খাবারের প্লেটে মেয়েটার চোখের পানি পড়তে দেখে,সেখানে নাফিমতো বাচ্চা ছেলে।মন তো খারাপ হওয়ারই কথা।নাফিম আর কৌড়ির মন থেকে ফুপুমনির কদর্য ব্যবহারটা দূরীভূত করতে সে বললো।

‘আমার কি মনে হয় জানিস!ভাবছি আজ ছোটোমাকেও বলবো আমার ভাবনার কথা?যে আমাদের তিন ভাইয়ের মধ্যে সিরিয়ালে আগে দাদাভাইকে বিয়ে না দিয়ে তোকে আগে বিয়ে দেওয়া হোক।আমার মনেহয় তোর আগে বিয়ে প্রয়োজন।ভেবে দেখ দাদাভাই আর আমাকেতো কাওকে খাইয়ে দেওয়া লাগেনা,গোসল করিয়ে দেওয়া লাগেনা,ড্রেস পরিয়ে দেওয়া লাগেনা,ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া লাগেনা।অথচ এতো বড় দেড়ি ছেলে হয়ে তোকে সব করিয়ে দেওয়া লাগে।এখন বল কার বউয়ের প্রয়োজন?বিয়ে করার পর তো সেই ছোটোমাকে ভুলে বউয়ের উকালতি করবি।সেই বউ এসে পারলে,কষ্টসাধ্য করে এখন থেকে তোকে মানুষ বানিয়ে নিক।তোর পিছনে ছোটোমার এই অক্লান্ত পরিশ্রমের সুরাহাটা,আমি কতো ভেবেচিন্তে তারপর বের করেছি।দারুন আইডিনা না বলো ছোটোমা।

গলা চড়াও করে শেষের কথাটা স্বান্তনা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বললো ইভান।এতোসময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলেও,ইভানের গলা পেতেই নড়েচড়ে দাঁড়ালেন তিনি।নীহারিকা বেগমকে থমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনিও চাইলেন ইভানের মতো পরিবেশ চনমনে হোক।যদিও জানেন,এই ঘটনা নিয়ে আরও ঘটনা ঘটবে তারপর ঝামেলা মিটবে।আদৌও মিটবে কিনা উনার জানা নেই।যা একখান ননদ উনার।তপ্ত শ্বাস ফেলে তিনিও গলা চড়াও করে বললেন।–তা যা বলেছিস?

এবার মুখ খুললো নাফিম।চেঁচিয়ে ডেকে উঠলো নীহারিকা বেগমকে উদ্দেশ্য করে-বড়মা।ছোট দাদাভাই কিন্তু জ্বালাচ্ছে আমাকে।

‘ইভান চুপচাপ খেতে বোস।আমার মেজাজ কিন্তু বহুত খারাপ আছে! আর একটুও খারাপ করিস না?

ভদ্র ছেলে হয়ে গেলো ইভান।তবে সামনে বসা কৌড়িকে চুপচাপ দেখতেই মুখটা আর স্থির রাখতে পারলো-না। মায়ের তীক্ষ্ণ মেজাজের বানী ভুলে গিয়ে ফিসফিসানি গলায় বললো—এই ফুলকৌড়ি, তুমি খাবার না মুখে তুলে শুধু ঘেঁটে যাচ্ছো কেনো?তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও।তোমার জন্য দাদাভাইও খেতে আসতে পারছে-না,যদি সে আসাতে তুমি আবার বিষম খেয়ে বসো।

তড়িৎ বিস্ময় নিয়ে মুখ তুলে চাইলো কৌড়ি।নিজেকে অনেক আগেই স্বাভাবিক করে নিয়েছে সে।তারজন্য সেই মানুষটা খেতে আসতে পারছেনা।মানেটা কি?আশেপাশে নজর দিলো কৌড়ি।কৈ,কোথাও তো কেউ নেই।তবে কি তারসাথেও ফাজলামো করছে ছেলেটা।নাফিমকে ক্ষেপিয়ে এবার তারপিছনে লেগেছে মানুষটা।কৌড়ির আশেপাশে চাওয়াচাওয়ি করতে দেখে বিষয়টা বুঝে ইভান ফের ফিসফিসিয়ে বললো।

‘দোতলার দিকে তাকাও,তোমার চাওয়াচাওয়ির উত্তর সেখানে মিলে যাবে।

সেকেন্ড দেরী করলোনা কৌড়ি।মূহুর্তেই ঘাড় উঁচিয়ে দোতলার দিকে তাকালো।সুগভীর,তীক্ষ্ণ নজরজোড়ায় আঁটকে গেলো নজর।লম্বা চওড়া মানুষটাকে সটান হয়ে স্থির নজরে তারদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বুকের মধ্যে থাকা যন্ত্রটা মূহুর্তেই ছলকে উঠলো,শিরশিরানি দিয়ে গায়ের সমস্ত লোমকূপ কাটা দিয়ে সজাগ হলো।এদিকেই তাকিয়ে ছিলো মানুষটা!কৌড়িকে তাকাতে দেখেও নজর কিঞ্চিত সরালোনা নিভান।সেভাবেই ত্রিশূল নজরে তারদিকে তাকিয়ে রইলো।নজর নামিয়ে নিলো কৌড়ি।খেতে মোটেই ইচ্ছে করছেনা তার।তবে একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার পর খাবার ফেলে চলে যাওয়া শোভনীয় দেখাবেনা।তাই না চাইতেও প্লেটে থাকা অল্প খাবারগুলো টপাটপ গালে তুললো।সেটা দেখে মৃদু হাসলো ইভান।এই মেয়েকে যে সে দাদাভাইয়ের বউ করবে বলে ভাবছে।এতো ভয় পেলে এই মেয়ে দাদাভাইয়ের সাথে সংসার করবে কি-করে?তবে আর যাই হোক,বউকে ভালোবাসবে দাদাভাই ভিষন।আর সেই ভালোবাসায় এই ভয়,এই দ্বিধাবোধ কোথায় পালিয়ে যাবে।কৌড়িকে নিয়ে দাদাভাইকে সে ভাবতো না।তবে দু-ভাইয়ের মধ্যে সম্পর্ক মধুর না হলেও, দাদাভাইয়ের নজর পড়তে যে তার ভুল হয়নি।আর এখন পিছনে না তাকিয়েও বুঝতে পারছে,ওই দোতলার বারান্দায় দাঁড়ানো মানুষটার ভিতরে চলছেটা কি?চলুক একটু।সারাজীবন নিজেকে আর নিজের অনুভূতিগুলোকে, আপনজনদের থেকে আড়াল করে এসেছে।এবার দেখা যাক কতোসময় আড়ালে রাখতে পারে নিজের অনুভূতি।সব সম্পর্কের অনুভূতি একই রকম হয়না।কিছু সম্পর্কের অনুভূতি নিজেকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেয়।ইভান,দেখতে চায় সেই জ্বালানো পোড়ানো অনুভূতি কতক্ষণ দমিয়ে, চাপিয়ে রাখতে পারে তার ওই সহনশীল ধৈয্যধারী দাদাভাই।সাবজেক্ট ফর ফুলকৌড়ি।

তাড়াহুড়ো করে খেয়ে,কোনোরূপ এদিক ওদিক না তাকিয়ে মাথা নিচু করে চলে গেছে কৌড়ি।ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে সেটা নীরবে অবলোকন করলো নিভান।মা ডাকা সত্ত্বেও খেতে যায়নি সে।ক্ষুধা লাগা সত্ত্বেও ডায়নিং টেবিলে গিয়ে কেনো বসতে ইচ্ছে করেনি,জানা থাকলে-ও মানতে রাজী নয় সে।তাই ড্রয়িংরুমে বসে মায়ের কাছে চাওয়া কফির অপেক্ষা করছিলো।তন্মধ্যে কৌড়িকে মাথানিচু করে শব্দহীন পায়ে চলে যেতে দেখলো।সোফায় হেলান দিয়ে বসে নজর হাতের নিউজপেপারে হলেও মনোযোগ তার সেই শব্দহীন চলে যাওয়া রমনীর পানে ছিলো।এখনো নজর নিউজপেপারে হলেও,মনোযোগ পড়ে আছে অন্যকোথাও।সেখান থেকে কিছু সময় পরে ইভানের খাওয়া শেষ হলো।খাওয়া শেষ হতেই উঠে দাঁড়ালো সে।
দুষ্ট হেসে ড্রয়িংরুমের দিকে এগোতে এগোতে,গলাছেড়ে গান ধরলো।

‘তোমাকেই চাই শুধু তোমাকেই চাই।আর কিছু জীবনে পাই বা না পাই।

গানের কলিটা আওড়াতে আওড়াতে ড্রয়িংরুমের মধ্যে দিয়ে ধীরপায়ে এগোচ্ছিলো ইভান।সিঁড়ির গোড়া পর্যন্ত যেতে পারলোনা,জলদগম্ভীর গলায় পিছে থেকে ডাক এলো তার।মূহুর্তেই গলার স্বর ধীর হয়ে এলো।দাঁড়িয়ে পড়লো সে।মুখে ফুটলো দুষ্টমিষ্টি হাসি।সেই গলার ফের ডাকে পিছে ফিরলো সে।

‘তোমার সাথে প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ন কথা আছে আমার,ইভান।

চলবে….

#ফুলকৌড়ি
(১৫)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

ইভানের হাসিখুশি সুদর্শন মুখখানা দেখতেই,যে কথাগুলো বলবে বলে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছিলো,সেই সাজানো গোছানো কথাগুলো ভিতরের গিলে ফেললো নিভান।কন্ঠস্বর ভেদ করে ঠোঁট অব্দি নিয়ে আসলো না।হঠাৎই মন বলে উঠলো,তবে কি সে ইভানকে হিংসা করছে?সঙ্গেসঙ্গে মস্তিষ্ক বলে উঠলো,কখনোইনা।বাবার রক্ত আলাদা হলেও,ইভান মান্যতা তার জীবনের ভালো থাকার একেকটা অংশবিশেষ।তাদেরকে কোনোকিছুর বিনিময়ে কখনোই সে হিংসা করতে পারেনা।যে যতো প্রিয় জিনিসের বিনিময়ে হোক না কেনো,তাদের ভালো থাকার কাছে সেই প্রিয় জিনিস কিছুই না।হঠাৎই বুকের বা-পাশের যন্ত্রটায় ব্যথার টান অনুভব করলো।নতুনত্ব অনুভূতি।এই ব্যথার অনুভূতিটা জানা থাকলেও,নিজের মধ্যে কখনো অনুভব করেনি।সম্পর্কের কতো টানাপোড়েন চললো।নিজের কাছের মানুষগুলো থেকে কতো ব্যথার অনুভূতি পেলো।আপন মানুষ বিদায় নিলো।সেসবে ভীষন কষ্ট পেয়েছে সে কিন্তু এমন ব্যথার অনুুভব অনুভূতি হয়নি বুকের এই যন্ত্রটায়!তাহলে আজ কেনো এই ব্যথার উৎপত্তি!তবে কি?অদৃশ্য ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে নিজের মস্তিষ্কে যা ভাবতে চাইলো,সেই ভাবনাটা দূরীভূত করার চেষ্টা করলো নিভান।যেটা তার মন মস্তিষ্কজুড়ে শক্তপোক্তভাবে বাসা বাঁধতে চাইছে,তা হওয়ার নয়!এ কি টানাপোড়ন শুরু করলো তার মন মস্তিষ্ক!না চাইতেও তার সব ভাবনার শেষটা গিয়ে,সেই তাকেই জুড়ে ভাবতে বসে মন।যাকে সে ভাবতেই চাইছে না।তবুও কেনো তাঁকেই ঘিরে এই অনুভব, অনুভূতি, ভাবনা?

‘কিছু বলবে কি দাদাভাই?

ইভানের কথায় মূহুর্তেই নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো নিভান।মুখের আদলে সেই দৃঢ়তার ছাপ বজায় রেখেই বললো।

‘বিভিন্ন দেশের ভার্সিটিগুলোতে স্কলারশিপের আবেদন পত্র ছেড়েছে।তুমি এপ্লিকেশন করোনি?সময়তো আর বেশি নেই আবেদন করে ফেলা উচিত নয়-কি?

‘আমি তো দেশের বাহিরে পড়তে যেতে চাই-না।যেটা নিজের যোগ্যতায় হয়নি,সেখানে বাবা ভাইয়ের শত পরিশ্রমের টাকা নষ্ট করে নামীদামী ডিগ্রী নিতে চাইওনা আমি।আর এমনিতেও দেশের বাহিরে যেতে চাই-না আমি।সামনে বি-সি-এস পরিক্ষার জন্য প্রিপ্রারেশন নিচ্ছি।সেটাতেই সমস্ত মনোযোগ দেওয়ার ট্রাই করছি।

‘বাবার টাকা তোমার টাকা নয়-কি?তবে এরকম হেঁয়ালিপনা কথা কেনো বলছো?

দুর্বোধ্য হাসলো ইভান।বাবার টাকা!যেখানে সে নিজে উল্লেখ করলো,বাবা ভাইয়ের পরিশ্রমের অর্থ। সেখানে শুধু বাবার টাকা উল্লেখ করলো!দাদাভাই নিজেকে এখনো এতোটা পর ভাবে।হয়তো এবাড়ির কিছু মানুষের খোঁটা তার কঠিন মনকে আরও কঠিন করে দিয়েছে।মলিন হেসে সে বললো।

‘তবে কি সেই বাবার টাকা তোমার ছিলোনা?তুমি কেনো নাওনি।স্কার্লারশিপ পেয়েও,সুযোগ পায়ে ঠেলে দিলে।নিজের ক্যারিয়ার নষ্ট করলে যারজন্য?সেই ব্যবসাটা নিজে শ্রম দিয়ে পুনারায় দাঁড় করালে,সেই শ্রমের টাকা যদি তোমার নিজের না মনে হয়!তবে ভাইয়ের ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের অর্থ কিকরে আমার অর্থ মনেহয়?সেই অর্থ কি শুধু আমার বাবার ভাবা উচিত?আর উচিত হলে-ও,আমি চাইনা সেই অর্থের ভাগিদার হতে।

শক্তপোক্ত চোয়াল আরও কঠিন্য রূপ নিলো নিভানের।
ইভানের যুক্তিসঙ্গত কথা তার মোটেও ভালো লাগিনি।দৃঢ় গলায় বললো।

‘নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ছেলেখেলা করোনা ইভান।সুযোগ বারবার আসেনা।আর সুযোগ হাতছাড়া করলে, সেটার জন্য আফসোস সারাজীবন আওড়াতে হয়।ফালতু ভিত্তিহীন লজিক দেখিয়ে নিজের ক্যারিয়ার বরবাদ করারা চেষ্টা করো-না।এটা আমার নয়,সেটা ওর।এসব বাচ্চামি খেয়ালীপনা ছেড়ে নিজের ক্যারিয়ার কিভাবে ঠিকঠাক জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়,কিভাবে সফলতার চূড়ায় উঠা যায়,সেটা নিয়ে ভাবো।সেদিকেই ধ্যান দাও।তুমি এখন আর সেই অবুঝ বাচ্চা ছেলেটা নও।

‘আমার ক্যারিয়ার নিয়ে মোটেই ছেলেখেলা করছিনা আমি।যেটা তুমি করেছো!আর দ্বিতীয় কথা হলো,আমি দেশের বাহিরে যেতে চাইনা।এটাই ফাইনাল।সেটাতে যদি সামনে আমার দ্বারা কিছু না-হয় না-হলো।আমার আফসোস থাকবেনা।বাবা ভাইয়ের পরিশ্রমের অংশ না নিলেও,বসেবসে নাহয় সারাজীবন খেয়েই ধ্বংস করলাম।সারাজীবন খাবারটুকু দিয়ে এই ভাইকে পুষতে পারবেনা?

নিভানের কঠিন মুখাবয়ব দেখে শেষের বাক্যগুলো মজার ছলে বললো ইভান।মূহুর্তেই কপাল কুঁচকে গেল নিভানের।এই ছেলে কি তারসাথে ফাজলামো করছে?
সিরিয়াস কথার মধ্যে ফাজলামো শুরু করলো?যদিও এটা ইভান,কখন কোন মুডে থাকে বলাবাহুল্য।সেটা শুধু সেইই জানে আর তার মর্জির উপর ডিপেন্ড করে।নিভানকে কপাল কুঁচকে শান্ত নজরে তারদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মনেমনে দুর্বোধ্য হাসলো ইভান।তার চিন্তা মাথা থেকে দূরীভূত করে ভাইয়ের মাথায় অন্য চিন্তা ঢোকাতে মুখে মৃদু হাসি টেনে ফের বললো।

‘আমার ক্যারিয়ার নিয়ে কি আর বাচ্চামো করবো বলো?আমার ইচ্ছে অনুযায়ী ক্যারিয়ারে যদি সাফল্য না আসে।সাফল্য অর্জনে যদি আমি দূর্ভাগা হই,আমার বাপ ভাইয়ের কি আর কম আছে নাকি?যেটুকু আছে তাতেই আমার আর ফুলকৌড়ির খেয়ে-পরে দিব্যি চলে যাবে।আমরা দু’জনেই কিন্তু খুব একটা বেশি চাহিদার মানুষ নই।যে আমার বাপের আর ভাইয়ের আমাদের দুজনকে পুষতে খুব একটা কষ্ট হবে।সো আমার ক্যারিয়ার নিয়ে অযথা টেনশন নিও-না,যেটা নিয়ে টেনশন করার,সেটা নিয়ে খুব ভাবো।আর ভেবেচিন্তে সমাধানের ব্যবস্থা করো।বলা যায় না এটা হারিয়ে গেলে,তোমার জীবনে নিজের চাওয়া পাওয়া বলে আর কিছুই না থাকলো।

মুড়ে দাঁড়িয়ে দুষ্ট হেসে আবারও গলা ছেড়ে গান ধরলো ইভান।সিঁড়ির ধাপে ধাপে পা ফেলে নিজের গন্তব্যে চলে গেলো।তবে পিছনের মানুষটাকে তার বলা বাক্যে বিমূঢ় করে রেখে গেলো।এগুলো কি বলে গেলো ইভান?ইভান এক কথার ছেলে।বলেছে যখন এপ্লিকেশন সে করবে না।সেটা নিয়ে না ভাবলেও,ইভানের শেষের কথাগুলো ভাবালো নিভানকে।বিমূঢ় করে দিলো একটা কথায়,তার আর ফুলকৌড়ির দিব্যি চলে যাবে মানে?
মানেটা কি তবে আজ খোলাসা করে বুঝিয়ে দিয়ে গেল ইভান!বুঝিয়েই দিয়ে গেলো তবে?খোলা হাত মুঠো হয়ে এলো নিভানের।হাতের তালুতে শক্ত আঙুলের চাপে মূহুর্তেই চামড়ার রগগুলো ফুলেফেঁপে টনটনে হয়ে উঠলো।নিজের অনুভূতি গুলোকে ভিতরে মাটি চাপা দেওয়ার প্রয়াসে শক্ত হয়ে এলো লম্বা চওড়া দেহ।তবে মন,তাকে মানাবে কিকরে?তবে সত্যিই কি তার নিজের চাওয়া পাওয়া বলে আর কিছুই থাকলো না।হঠাৎই মস্তিষ্ক বলে উঠলো,একেমন অদ্ভুত অবুঝ ভাবনা তোর!


মেয়ের নালিশ শুনেও চুপচাপ বসে আছেন ফাতেমা বেগম।এবাড়ির ছেলে বলতে উনার দূর্বলতার জায়গা।বিশেষ করে নাতীদের ক্ষেত্রে।সেখানে সেই নাতীর বিরুদ্ধে অভিযোগ।তিনি আমলে নিলেন না। একমাত্র মেয়ে হওয়ার সুধাবে,মেয়েকে প্রচন্ড ভালোবাসেন।মেয়ের ভালোমন্দ কথা কাজে সঙ্গে দিতে বাধ্য হন।তাই
বলে নাতী আর মেয়ের মধ্যে হওয়া মলিন্যতার পক্ষ-বিপক্ষ করে কথা বলতে পারলেন না।বরংচ মেয়ের প্রতিই মনেমনে একটু অসন্তুষ্ট হলেন।কেনো ওই মেয়েটাকে সে এরকম খোঁটা দিয়ে কথা বলতে গেলো?এই একমাস যাবত মেয়েটা এবাড়িতে।কখনো তার অশোভন আচারন দেখেননি,চলাবলায় অশালীনতা পান-নি।নিজের নাতনিদের মতো হৈহৈ রৈরৈ করে কথাবার্তা বলতে শোনেননি।সবসময় শান্ত পদচারণে চলতে ফিরতে দেখেছেন।গায়ে মাথায় কি সুন্দর করে ওড়না দিয়ে ঢেকে ঢুকে চলাফেরা করে মেয়েটা।দেখলেই উনার কেমন ভালো লাগে।সেই মেয়েটার বিরুদ্ধে কথা বলতে যাওয়ার মানে হয়!দরকার ছিলো কি!আর-ও একটা সময় নিজের ছেলের দুরবস্থায় ওই মেয়েটার বাবা পরমআত্মীয়ের মতো সাহায্য করেছে।সেখানে সেই মেয়েটার সাথে কটু আচরন!এটা উনিও কাম্য করেন না।মেয়ের এই আচারন একটু-ও ভালো লাগলোনা উনার।যেকোনো কথাকাজে মেয়ের হয়ে সবসময় কথা বলেন তিনি।তবে এক্ষেত্রে কেনো জেনো মেয়ের সঙ্গ দিতে পারলেন না। বরং মেয়ের আচারনেই রুষ্ট হলেন তিনি।

‘তোমার কাজটা করা একদম ঠিক হয়নি।তোমার বড়ভাই জানলে কতোটা অসন্তুষ্ট হবেন বুঝতে পারছো?

আগুনের ঝলকানির ন্যায় ফুসে উঠলেন ডালিয়া বেগম।মা-ও এ-কথা বলছে।–আমি ভুল কি বলেছি?হ্যাঁ বলো?প্রথম রানী,তারপর নিভা….

ডালিয়া বেগমের কথা শেষ করতে দিলেন না ফাতেমা বেগম।কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বললেন।

‘ভুলে-ও নিভানের নাম মুখে নিও-না।অন্তত ওর বেলায় লাগাম টানো মুখে।নাহলে পরবর্তীতে কেউ ছোটো বড়ো কথা শুনালে,আমাকে বলতে পারবেনা।যার অগাধ পরিশ্রমের টাকায় এতো বিলাস-বহুল জীবনযাপন করছো,অন্তত তার বিরুদ্ধে কোনো কথাবলা অভিযোগ সাঝে না,না তোমার আর না এবাড়ির কার-ও।বিবেক বুদ্ধি জাগ্রত করো ডালিয়া।আর কতোকাল অবুঝপনা করে চলবে,মেয়ে বিয়ে দিয়ে শ্বাশুড়ি হয়ে গেছো।এমন বিবেচনাহীন কথাকাজ আর তোমায় মানায় না।এবার একটু ভেবেচিন্তে কথাবার্তা বলা শেখো।

রাগ তো হলেন বিরক্ত হয়েও কথাগুলো মেয়ের বিরুদ্ধে বলতে বাধ্য হলেন ফাতেমা বেগম।ভিতরে ভিতরে জ্বললেও,আর কথা বাড়ালেন না ডালিয়া বেগম।আজ মা-ও উনাকে ছোটোবড় কথা শোনাচ্ছেন,বিষয়টাতে মনেমনে তিনি বেশ ক্ষুব্ধ হলেন।

নিজের রুমে চুপচাপ বসে আছে কৌড়ি।হঠাৎই একটু আগের ঘটনা ঘিরে মন খারাপ তার।সব সহ্য হলেও কারও খোঁটা সে সহ্য করতে পারেনা।সহ্য হয়-না তার।অথচ তার জীবটা এমন একটা পরিস্থিতিতে এসে ঠেকেছে সেখানে হয়তো খোঁটা ছাড়া সামনের দিনগুলো পার হবেনা তার।হঠাৎ মনেহলো, সে বাড়িতে থাকলে তো আর এসব শুনতে হতোনা,হবেওনা।আর না অন্যের ঝামেলা বা বাড়তি বোঝা হয়ে থাকতে হবে।নড়েচড়ে বসলো কৌড়ি।দাদীআপার সাথে কথা বলতে হবে।কথা বলার জন্য উদ্যোক্ত হতেই,মনে পড়লো।তার তো নিজস্ব কোনো ফোন নেই,তবে কার ফোন দিয়ে কথা বলবে সে?মান্যতা আপুতো তার রুমে এখনো ঘুমে।
আর মান্যতা আপু ছাড়া সহজে কার-ও ফোনে হাত দেয় না সে।দেওয়া হয়-না তার।দাদিআপার সাথে মাঝেমধ্যে কথা হয়,সেটা বড়মার ফোন থেকে।আর এখন যদি বড়মার কাছে ফোন চায়,দাদিআপার সাথে কথা বলার জন্য। নিশ্চয় তিনি বুঝে যাবেন।সে নিজ থেকে কেনো দাদিআপার সাথে কেনো কথা বলতে চাইছে।আর দাদিআপারও বিশেষ নিষেধাজ্ঞা আছে,যখন তখন ফোন দেওয়া।

ভাগ্য সুসম্পন্ন হওয়ায়,কৌড়ির ভাবনার মাঝে হঠাৎই ফোন হাতে প্রবেশ করলেন নীহারিকা বেগম।ব্যস্ত হাতে কৌড়ির দিকে ফোন এগিয়ে দিয়ে বললেন।

‘কথা বল দাদিআপা ফোন দিয়েছে।

কৌড়ি হাতে ফোন নিতেই,নীহারিকা বেগম ব্যস্ত পায়ে সামনে এগোতেই থেমে গেলেন।কৌড়ি কানে ফোন চেপে ধরেছে দেখে চোখের দ্বারা কিছু ঈশারা করলেন।কৌড়ি বুঝে ফেললো সেই ঈশারা।অর্থাৎ তিনি নিষেধ করছেন একটু আগে ঘটা ঘটনাটা দাদিআপাকে না জানাতে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে কৌড়িও মাথা নাড়িয়ে আশ্বস্ত করলো,সে জানাবে বা।এমনিতেই সে কখনো জানাতো না।চলে গেলেন নীহারিকা বেগম।ফোনে মনোযোগ দিলো কৌ্ড়ি।

‘ও আপা কথা কইস না ক্যান?ভালো আছিস তুই?

নড়েচড়ে বসলো কৌড়ি।মনোযোগ দিল ফোনের অপর প্রান্তের মানুষটার কথায়।–‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।তুমি কেমন আছো দাদিআপা?

কৌড়ির আলাপনের জবাব দিয়ে আরও ভালোমন্দ কথা বলতে,জানতে থাকলেন তিনি।যা প্রায়সই ফোন দিলে তিনি জেনে থাকেন কৌড়ির থেকে। মা বাবা হারা এতিম নাতনী উনার।সব থাকতেও যে কারনে অন্যের আশ্রয়ে পাঠালেন।অন্যের আশ্রয়ে আশ্রিত হলো নাতনীটা।সেখানে মেয়েটা ভালো আছে কিনা সেটার বিষয়ে তো খেয়ালী থাকতেই হবে উনার।শুনেছেন ওবাড়িতেও নাকি উপযুক্ত দু’দুটো ছেলে আছে।যে ভয়ে মেয়েটাকে ওখানে পাঠালেন।সেখানে সেই জাতীয় সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে কিনা নাতনীটা।তাদের চালচলন স্বভাব ব্যবহার কেমন?সেখানে উনার নাতনীটা ঠিকঠাক ভালো আছে কি-না,জানাটা যে দ্বায় উনার।না-হলে পরকালে ছেলের কাছে গিয়ে জবাব দিবেন কি-করে!আর এমনিতেই কৌড়ি উনার পরাণ।যে পরাণটাকে একটু স্বস্তি শান্তিতে বাঁচতে দেওয়ার জন্য, নিজের কাছ থেকে দূরে পাঠানো।পাঠাতে বাধ্য হলেন তিনি।তবে দূরে পাঠানোটা উনার মনেহয় স্বার্থক হয়েছে।ওবাড়ির মানুষগুলোর সম্পর্কে কৌড়ির থেকে তো সেই ধারণা হয়েছে উনার।মেয়েটা বরাবর ওবাড়ির মানুষগুলো সম্পর্কে ভালো ছাড়া খারাপ বলেনি।আর কৌড়ি যে সহজে উনাকে মিথ্যা বলবেনা,এটা উনি জানেন।আর নাতনী মিথ্যা বললে তিনি ধরতে পারেন।সেই শূন্য বয়স থেকে যে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন কি-না।

‘ও দাদিআপা,আমার না তোমার কাছে যেতে খুব মনে চাইছে।নিয়ে যাওনা আমারে।এমনিতেই তো সামনে পরিক্ষা তখন তো যেতেই হবে।আমাকে নিয়ে যাওনা তোমার কাছে,আমার না এখানে থাকতে একটুও ভালো লাগেনা।সবকিছু কেমন পরপর মনেহয়।এমনিতেই তো এখানে আমার কিছু বলে নেই।

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মাজেদা খাতুন।বললেন–আমার কাছে রাখার সুযোগ,নিরাপত্তা থাকলে,আমার ছেলেডা মরতে না মরতে তোরে কি আর আমি অন্যের আশ্রয়ে পাঠাইতামরে আপা।কেনো বুঝোস না,আমার ছেলেহীন তুই এখানে থাকলে ওই অমানুষটা তোর মতো ফুলকে ছিড়েখুঁড়ে নষ্ট কইরা দিতো।তোর বাপ মরছে তা কি আর মানতো,ওই রাতেই তোরে জোরজবরদস্তি করে বিয়া করতো।আমি পারতাম ওদের ঠেকাইতে?আর না ও মানুষ হইলে আমি তোরে আমার থাইকা দূরে রাখতাম?অন্যের আশ্রিতা হতে দিতাম কখনো?তুই চলে যাওয়ার পর ওই অমানুষটা আরও ক্ষেপেছে,বলেছে যেভাবে হোক ও তোরে তুলে নিয়ে আসবে।তারপর নিজের স্বাদ পূর্ণ করবে।কতোবড় জানোয়ার হইলে আমার সামনে দাড়াইয়ে চোখ রাঙিয়ে এসব কথা বলে।তারপরও তোরে আমার কাছে রাখার সাহস করি কিকরে আপা?আমি পারতাম ওই অমানুষটা থেকে তোরে আগলে রাখতে?হয়তো পারতাম,যদি তাের চাচা আমার ছেলেডা মানুষ হইতো।কি যে পেটে ধরছিলাম, অমানুষের ঘরে আরেকখান অমানুষ হইছে।এবার বল,
আমি কি আর ইচ্ছে করে আমার থাইকা দূরে পাঠাইছি তোরে আপা?ইচ্ছে করে পাঠাইনি।

শেষের বাক্যগুলোয় হাহুতাশ করে আওড়াতে থাকলেন মাজেদা খাতুন।কথাগুলো নীরবে শুনলো কৌড়ি।সে চলে আসার পর কি হয়েছে তার জানা নেই।তবে কি হতে পারে, কিছুটা হলেও আন্দাজ আছে।আর দাদিআপা যে তাঁকে সব খুলে বলবেনা,এটা-ও তার জানা।সে আদরের নাতনি হওয়ার সাথে সাথে ওই অমানুষটাও যে তার নাতী।কৌড়িকে চুপ থাকতে দেখে হঠাৎই মাজেদা খাতুন শুধালেন।

‘ও আপা,তুই হঠাৎ আমার কাছে আসবার জন্য পাগল হইলি ক্যান? ওবাড়িতে কেউ তোরে কিছু কইসে?

নিজের ভবিতব্যের উপর আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেললো কৌড়ি।জবাব দিলো–না দাদিআপা।কে কি বলবে আমাকে।এবাড়ির সবাই খুব ভালো।আর আমাকে-ও সবাই খুব ভালোবাসে।আমার এমনিতেই তোমার কাছে যেতে মন চাইছিলো,তাই বলছিলাম।তোমাকে কতোদিন দেখিনা বলোতো?যে তুমি আমার মাথায় হাত না বুলিয়ে দিলে রাতে ঘুম আসতো না।গালে তুলে না খাওয়ালে আমার খাওয়া হতোনা।চুল না আঁচড়িয়ে দিলে ওভাবেই এলোমেলো জটবেধে পড়ে থাকতো সব।সেই তোমাকে ছাড়া কতোদিন পেরিয়ে গেলো বলো তো?এখন আমাকে একা সব করতে হয়।তখন তোমাকে খুব মনে পড়ে,তোমার কাছে চলে যেতে ইচ্ছে হয়।

কৌড়ির ভাঙা ভাঙা গলার কথাগুলো শুনে মাজদা খাতুন মন খারাপ করলেন।বৃদ্ধ মন কেঁদে উঠলো।তবে মেয়েটার কথায় ভেঙে পড়লে, দূর্বল হলে চলবে না।না হলেও মেয়েটা আর-ও দূর্বল হয়ে পড়বে।কৌড়ি ফের বললো।—ও দাদিআপা,আমাকে যেতে নিষেধ করছো।তবে তুমি আমার কাছে চলে এসো।আমরা দু’জন ছোটো একটা বাসা নিয়ে সেখানে দুজনে সংসার পাতবো।তবে আর কোনো সমস্যা থাকবেনা, ঝামেলা হবেনা।

এটা তিনি-ও ভেবেছিলেন মেয়েটার কাছাকাছি থাকার জন্য। কিন্তু পরবর্তীতে নিজের অমানুষ নাতীর কথা ভেবেচিন্তে দমে রয়েছেন।কৌড়িকে আশ্বস্ত সরূপ বললেন।—আমারে আরও একটু সময় দে আপা।আমি নিশ্চয় তোর কাছে আইসা থাকবো।এখন একটু মানাইয়া গোছাইয়া থাক।যদিও পরের বাড়ী, নিজের বাড়ির মতোন থাকোন যায় না।তবুও।তুই আমার শান্তশিষ্ট খুব ভালো ফুলকৌড়ি না। মন খারাপ করে না আপা।সব ভালো হইবো দেখিস।

কৌড়ি আর কিছু বললোনা।নিঃশব্দে চোখের পানি পড়ে গেলো শুধু,তবে গলা স্বাভাবিক রেখে কথা বলার চেষ্টা করলো।নাহলে,তাকে ভালো রাখতে চাওয়া ফোনের ওপাশের বৃদ্ধা মানুষটা যে আরও মন খারাপ করবে।দুজনের মধ্যে আরও কিছুসময় কথা চললো।একটা সময় গিয়ে কথা শেষ হলো দু’জনের।ফোন রেখে এবার হুহু করে কেদে ফেললো কৌড়ি।তার একটা সুষ্ঠু সুন্দর পূর্ণ পরিবার থাকলে কি ক্ষতি হতো?কেনো এমন অভাগা হলো সে?আর এমনও কেনো হলো তার ভবিতব্য?কেনো?


সকাল থেকে নীহারিকা বেগমের মুখটা গম্ভীর হয়ে আছে।হাতে দুরন্তপনায় কাজ চললেও,কথা পরিমানের তুলনায় কম বলছেন তিনি।বিষয়টা লক্ষ্য করলেন জাহিদ সাহেব।বুঝতে পারলেন,বিশেষ কোনো বিষয় নিয়ে স্ত্রীর মুড খারাপ হয়ে আছে।সারাদিনে কিছু না বললেও,রাতে খাবারের সময় তিনি জিজ্ঞেস করেই ফেললেন।—কি হয়েছে নীহারিকা?শরীর খারাপ নাকি অন্যকিছু হয়েছে তোমার?মুড এতোটা বিগড়ে আছে কেনো?

সারাদিনের ধৈর্যের বাঁধ বুঝি মূহুর্তেই চূর্ণ হলে উনার।গলায় ক্ষোভ নিয়ে বললেন– আপনার বোনকে আচার ব্যবহারে সাবধান হতে বলুন।মুখে লাগাম টেনে কথা বলতে বলবেন।সারাটাজীবন তার কটুবাক্য সবাই শুধু শুনে যাবে,আর তার এলেবেলে আচরণ সহ্য করবে!এমনটা কিন্তু আর চলবে না।এতোকাল সব মেনে নিয়ে চলতে দিয়ে আসলেও এবার কিন্তু তা আর আমি চলতে দেবো-না।মেনে নেবো না।আমার সংসারে এসব কিন্তু আমি আর সহ্য করবোনা।বহুত হয়েছে আর নয়।
আমাকে-সহ আমার ছেলেকে কম বলেনি।নীরবে সব সহ্য করেছি,কখনো ওর মতো হয়ে খারাপ কথা শোনাতে পারিনি।নীরবে সহ্য করতে হয়েছে আমাকে।এখন আবার ওই মেয়েটার পিছে লেগেছে।বয়স হয়েছে অথচ জ্ঞান বিবেক বুদ্ধি সেই আগের মতোই রয়ে গেছে।লোপ পেয়েছে ছাড়া বৃদ্ধি পায়নি।সবকিছুর একটা সীমা থাকা উচিত।সীমা লঙ্ঘন হয়ে গেলে,পাপ কিন্তু বাপকেও ছাড়েনা।অন্যের পিছে লাগা বাদ দিয়ে নিজের মেয়ের কথা ভাবতে বলুন।

খাবার মুখে তুলতে ভুলে গেলেন জাহিদ সাহেব।নীহারিকা বেগমের তেজস্বী মুখের দিকে নির্বাক নজরে তাকিয়ে রইলেন।ডালিয়া এসেই শুরু করে দিয়েছে।এই মেয়ের স্বভাব ব্যবহার কি আর কখনো ভালো হবেনা।মনেমনে খুবই বিরক্ত হলেন বোনের আচারনে।নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে ঠান্ডা গলায় শুধালেন।—ডালিয়া কি বলেছে কৌড়িকে।

যদিও আন্দাজ করতে পারলেন,ডালিয়া কটুবাক্য হিসাবে কৌড়িকে কি বলেছে।তবুও শুধালেন।নীহারিকা বেগমও ক্ষুব্ধ হয়ে একে একে বর্ননা করলেন সকালের ঘটনা।তিনি বলতেন না,তবে সবকিছুর একটা সীমাবদ্ধ বলে জিনিস আছে তাইনা?সারাটাজীবন একটা মানুষ একই আচারন স্বভাবে কি-করে অটল থাকতে পারে!
সহ্য তিনিও কম করেননি।তবে সংসারে অশান্তির ভয়ে আর নিভানের মুখ চেয়ে সয়ে গেছেন সব।বিয়ের পর যে মেয়েদের বাপের বাড়িও পর হয়ে যায়,সেখানে তিনি ছিলেন বিধবা! আবার এক ছেলের মা।বাধ্য হয়ে সইতে হয়েছে উনাকে।তবে আর কতো!মুখ তো একটা সময় গিয়ে খুলতেই হতো।যদিও তিনি সেই স্বভাবের নন।বরং ছোটোজাকে আরও বেফাঁস বলা থেকে আঁটকে রাখেন, রাখার চেষ্টা করেন বরাবর।সেই উনারও ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে।

‘তুমি শান্ত হও।অযথা প্রেশার বাড়িও না,আমি দেখছি।এখন আর নয় কাল ওরসাথে কথা বলে নিচ্ছি আমি।

‘কথা বলার সাথে সাথে,ওই মেয়েটার দাদি আপার পাঠানো কাগজপত্রগুলোও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখিয়ে দেবেন।আর বলবেন সবাই তোমার মতো মন মানসিকতার হয়না।বিবেচনাবোধও তোমার মতো নয় সবার।মেয়েটাকে এখানে শুধু শুধু অন্যের অন্ন,অর্থ ধ্বংস করার জন্য আশ্রিতা সরূপ পাঠানো হয়নি।ওই মেয়েটাকে দ্বায়ে পড়ে এখানে থাকলেও,অনাথ নয়।

মনের মধ্যে জন্মানো এতোদিনের কিছু ক্ষোভ ক্রোধ মিশিয়ে আরও কিছু কথা বললেন নীহারিকা বেগম।তা নীরবে শুনে গেলেন জাহিদ সাহেব।কি বলবেন তিনি, বোনের স্বভাব সম্পর্কে তিনি অবগত।আর এই নারীটা, এই সংসারে এসে তো কম সহ্য করেনি।সহজে কখনো মুখ খোলেনি,উনার কাছে নালিশ জানায়নি,কোনোকিছু প্রকাশ করেনি।নীরবে সয়ে গেছেন। তবে তিনিতো জানেন বোনের সম্পর্কে।কিছু কিছু সময় সেসব কথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, কিছু কিছু সময় নীহারিকার কথা শুনে চুপ থেকেছেন।আজ সেই নারীটা ক্ষুব্ধ হয়েছে।নিশ্চয় বিষয়টা অধৈর্য্যর পর্যায়ে চলে গিয়েছে ব্যাপারটা।নাহলে এতোটা ক্ষুব্ধ তো কখনো হয়না এই ধৈর্য্যশীল শান্ত নারীটা।

রোজকার মতো সকালের এই সময়টা বাড়িটা ফাঁকা।খাবার খাচ্ছিলো কৌড়ি।মৌনতার স্কুল এন্ড কলেজের প্রিন্সিপালের সঙ্গে কথা বলে তাকে কলেজে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে।বিগত সপ্তাহ ধরে কলেজ যাওয়া আসা করছে সে,কলেজে কিছু চেনা পরিচিত সল্প সংখ্যক মুখ হয়েছে।তবে মৌনতার সাথে কলেজে যাওয়ার আসার সুযোগ সুবিধা থাকলেও, যাওয়া আসা হয়না তার।কেননা,মৌনতার ক্লাস হয় দুই শিফটে।সকাল সাড়ে আটটা থেকে বারোটা অব্দি একটা শিফট।তারপর থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত একটা শিফট।মৌনতা সকালের শিফটে ক্লাস করে।বিধায় তাকে স্কুলে বের হতে হয় সাড়ে সাতটার দিকে।আর কৌড়ির কলেজ শুরু হয় দশটায়।বিধায় অত সকালে মৌনতার সাথে যাবার কোনো মানেই হয়না।তাই সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও মৌনতার সাথে যাওয়া আসা কোনোটাই হয় না।এই নিয়ে মেয়েটার মন খারাপের শেষ নেই।মন খারাপ তারও হয়,তবে কি আর করার।

প্রথম কয়েকদিন কলেজে যাওয়া আসায় একটু অসুবিধা হলেও এখন আর সমস্যা হয়-না।রাস্তাটা খুব ভালোভাবে আয়ত্ত করে নিতে পেরেছে সে।সোজা রাস্তা।কলেজের সামনে থেকে সিএনজিতে উঠলে সোজা মোড়ের মাথায় এসে নামিয়ে দেয়।আর সেখান থেকে বাড়ি দু’মিনিটের রাস্তা।বিগত সপ্তাহে যাবার সময়টা মান্যতা আপুর সাথে গেলেও,আসার সময়টা প্রায় ইভান ভাইয়া নিয়ে এসেছে তাকে।আবার ছুটির আগের দিন সে একা এসেছে।আজ মান্যতা আপুর সকালের দিকে একটা ক্লাস থাকায়, আজ সকাল সকাল চলে গিয়েছে সে।যাবার আগে অবশ্যই জিজ্ঞেস করে গিয়েছে,কৌড়ি একা-একা যেতে পারবে কি-না? কৌড়ি বলেছে পারবে।আর না পারলে নীহারিকা বেগম বলেছে, বাড়ির গাড়িতো আছে।কৌড়িকে পৌঁছে দেবে।
তাই আজ কলেজে যাবার জন্য সবার শেষে পড়ে গিয়েছে সে।

‘মা,আমাকে খেতে দাও।

ভারিক্কী পরিচিত গলার স্বরটা শুনতেই প্লেটে হাত থেমে গেলো কৌড়ির।মূহুর্তেই জড়তা অস্বস্তি ঘিরে ধরলো তাকে।সেদিনের পর থেকে মানুষটাকে সেভাবে আর ভয় পায়না সে।তবে সংকোচ দ্বিধা রয়েই গেছে।মানুষটা আশেপাশে থাকলে সেটা খুবই গাঢ়ভাবে কাজ করে।হয়তো ইভান ভাইয়ার মতো মানুষটা খোলামেলা মনের হলে,এই জড়তা-সংকোচ কাজ করতোনা।দেখা সাক্ষাৎ বা কথা হয়না বললেই চলে।আর এই ধরনের গম্ভীর মানুষের সামনে সত্যি বলতে,কৌড়ির চলতে ফিরতে, কথা বলতে ভিষণ দ্বিধা হয়।এবাড়িতে আসার
প্রথম প্রথম তো ইভান ভাইয়ার সামনেও আড়ষ্টতা কাজ করতো,কিন্তু তার যেচে যেচে কথা বলা, চাঞ্চল্যে স্বভাব সেই আড়ষ্টতা দূর করে দিয়েছে।

‘কি হলো!থেমে আছো কেনো,খাচ্ছো না কেনো?

ভারিক্কী গলার বাক্যগুলো তাকে ঘিরে বুঝতেই চোখ বন্ধ করে মাথা আরও নুইয়ে ফেললো কৌড়ি।হা পায়ের নড়নচড়ন থেমে গলো মূহুর্তেই,পুরো শরীর জেনো অবশ অবশ লাগলো।হৃৎস্পন্দন জেনো তার গতিধারা ছেড়ে আরও দ্বিগুণ হারে লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে থাকলো।নিজের বেহালদশা অনুধাবন করে নিভানকে মনেমনে প্রবোধন করতে লাগলো,কৌড়ি।জিজ্ঞেস করার কি দরকার ছিলো?তিনি এখানে এসেছেন এটা কি কম পড়েছিলো!

কৌড়ির নীরবতা,তাকে দেখে অকারণে এই নুইয়ে পড়া হঠাৎই নিভানকে রাগিয়ে দিলো।বুঝে আসেনা,তাকে দেখলে মেয়েটা এরকম অদ্ভুত আচারন করে কেনো?অথচ নাফিম আর ইভানের সাথে কি চমৎকার বন্ডিং তার।ইভানের নামটা মস্তিষ্কে ধরা দিতেই,কৌড়ির উপর অকারণে রাগ জেনো দ্বিগুণ চড়াও হলো নিভানের।কারণ ছাড়া ধমকে উঠে বললো।

‘এই সমস্যা কি তোমার,আমি সামনে এলেই তোমার কি হয়?সবার সামনে তো ঠিকঠাকই থাকো।আমি কি অদ্ভুত প্রানী,যে আমি দেখা দিলেই তোমার শুরু হয়ে যায়।হয়তো নুইয়ে পড়ো না-হলে লুকোচুরি খেলা শুরু করো।হোয়াই?টেল মি?হোয়াট ইজ ইয়োর প্রবলেম?

আচমকা ঘাড় উঁচু করে নিভানের মুখের দিকে তাকালো কৌড়ি।কাটকাট আদলের পরিপাটি শ্যামবর্ণ গম্ভীর মুখখানা দেখতেই বুক ধুকপুক করে উঠলো তার।হঠাৎ মানুষটা তার উপর রেখে গেলো কেনো বুঁজে আসলো না।বিধায় সব অনুভূতির উর্ধ্বে গিয়ে আচমকা মাথা উঁচু করে তাকিয়ে পড়েছে সে।ভারা দিঘির টলটলে সচ্চ জলের ন্যায়,ডগর ডগর নয়নজোড়া,নিজের নয়নে বাঁধা পড়তেই ক্ষোভিত গলার স্বর থেমে গেলো তার।ক্রোধিত নজর হয়ে গেলো শীতল।হৃদস্পন্দন থেমে গেলো নিভানের।জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাওয়ার মতো নেশাধরানো দু’টো নজর।

‘কি হলো,হঠাৎ ওর উপর রেগে গেলি কি কারনে?কি করেছে ও?এভাবে বকছিস কেনো?

নিভানের চড়াও গলা শুনতেই রান্নাঘর থেকে ছুটে একপ্রকার ছুটে এসে কথাগুলো বলবেন নীহারিকা বেগম।হঠাৎ ছেলে কৌড়ির উপর রেগে গেলো কেনো?মেয়েটা তো চুপচাপ খাচ্ছিলো,তবে নিভানের কি হলো?কৌড়ি আগেই মাথা নিচু করে নিয়েছিলো।মায়ের কথার উত্তর না দিয়ে বড়বড় কদম ফেলে সামনে এগিয়ে গেলো নিভান।খোলা চোখে-ও ভেসে বেড়াতে থাকলো একটু আগের ডাগরডাগর সচ্চ টলটলে আঁখি যুগল।রাগমিশ্রিত মৃদুস্বরে মুখে বিড়বিড়ালো সে।

‘উফ,এই মেয়ে তাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিবে।

অথচ নীহারিকা বেগম পিছে থেকে ডাকতেই থাকলেন কিন্তু কানে তুললো না নিভান।বড়বড় পা ফেলে চলে গেলো সে।ড্রয়িংরুম পার করতেই ইভানের সাথে দেখা হলো তার।মিটমিটিয়ে হাসছে ছেলেটা।হাসিটা জেনো কোনো ক্রমেই সহ্য হলোনা।দিল, কলিজা,সব জ্বালিয়ে দিলো।মনেহলো তাকে কেউ উত্তাপ্ত আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে তার সবকিছু ছারখার করে দিচ্ছে।নিঃশেষ করে দিচ্ছে তাকে।

চলবে….

ফুলকৌড়ি পর্ব-১২+১৩

0

#ফুলকৌড়ি
(১২)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

নীহারিকা বেগম চোখ মোটামোটা করে ছোটো ছেলের দিকে চাইলেন।ইভানের এই একগাল ভুবনভুলানো হাসি মোটেও সুবিধার ঠেকছে না উনার কাছে।মোটামোটা চোখজোড়া হঠাৎই স্বাভাবিক হয়ে এলো উনার।নিটোল কপাল কিছুটা কুঞ্চিত হলো।ভারী গলায় শুধালেন।

‘তুই ইন্ডাইরেক্টলি বলতে চাইছিস কৌড়িকে তোর পছন্দ হয়েছে।তুই তাকে বিয়ে করতে চাস?

‘ছিঃ মা এসব কি ভাবো,কি বলো।তোমার ঘরে এতবড় একখান সাবালক ছেলে থাকতে,তুমি এই নাবালক ছেলের দিকে নজর দাও কেনো!ইট’স নট ফেয়ার মা।আর কোনো মেয়েকে ভালো লাগলে বা পছন্দ হলে যে, তাকে শুধুই নিজের জন্য পছন্দ করতে হবে এটা তোমাকে কে বললো,আর কোথায় বা লেখা আছে শুনি?এজন্য তোমরা স্ত্রীগন বোঝার ক্ষেত্রে পুরুষের থেকে একধাপ এগিয়ে।এটাকেই বলে মাত্রা-অতিরিক্ত বোঝা।

ইভানের শেষ কথাগুলো শুনে চোখ রাঙিয়ে তাকালেন নীহারিকা বেগম।তা মোটেও পাত্তা না দিয়ে বিচক্ষণ ব্যক্তির মতো মুখের ভঙ্গিমা করে ইভান ফের বললো।

‘আমি পর্যবেক্ষণ করে দেখলাম,তোমার বড়ো ছেলের জন্য পারফেক্ট বউ হলো ফুলকৌড়ি।দেখতে,শুনতে শান্তশিষ্ট,নম্রভদ্র,কথাবার্তা,চালচলন,আদব লেহাজ।
যেসব গুনগুলো একটা মেয়ের মধ্যে থাকলে তোমরা মহিলাগন মনে করো তোমাদের ছেলের জন্য পারফেক্ট।মেয়ে দেখতে গেলেও তোমারা মহিলাগন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যেসব গুনগুলো খুঁজে বের করতে থাকো।তার দুই একটা মিসিং হলেও,অধিকাংশ গুনই খুঁজে পাবে ফুলকৌড়ির মধ্যে।একদম বাড়ির পারফেক্ট বড়ো বউ।

নীহারিকা বেগমের মনহলো তিনি মেয়ে দেখতে এসেছেন আর মেয়ের বাপ ভাই,মেয়েকে পার করার জন্য তার গুনগান গেয়ে চলেছে।আশ্চর্য হতে গিয়েও নিরাস হলেন তিনি।এটা উনার ছোটো ছেলে ইভান।যে, কোনো বিষয়ে কখনো সিরিয়াস নয়।হাতাশার নিঃশ্বাস ছেড়ে রান্নায় মনোযোগ দিলেন তিনি।ইভানের অযথা কথায় মনােবেশিত করতে চাইলেন-না।সেটা বুঝতে পেরে ইভান ফের খোঁচালো।

‘ও আম্মু,শুনছো আমার কথা?

‘মেয়েটা অনেকটাই ছোটো।আজেবাজে কথা না বলে এখান থেকে যা।আমার কাজ আছে। তোর অযথা উল্টো পাল্টা কথা আমার এখন শুনতে মোটে-ও ইচ্ছে করছেনা ইভান।

‘আমি সিরিয়াস আম্মু।

‘সিরিয়াস নিজের জন্য হ।ওর জন্য না ভেবে তোরজন্য গিয়ে ভাব,যা।

‘আমার জন্য ভেবে রেখেছি তো।

অদ্ভুত নজরে আবারও ইভানের দিকে তাকালেন নীহারিকা বেগম।সেটা দেখে অপ্রস্তুত হাসলো ইভান।
নীহারিকা বেগম আবারও রান্নায় মনোবেশিত করলেন।
বুঝলেন ছেলে ফাজলামো করছে।তবুও কাটকাট গলায় বললেন।

‘কোনো উদ্ভট,উশৃংখল,মেয়েকে বাড়িতে বউ করে আনলে ,আমি কিন্তু কখনোই মানবো না।বলে দিলাম।

‘কেনো মানবেনা।সেই উশৃংখল উদ্ভট মেয়ের সাথে তোমার ছেলে সংসার করতে পারলে,তুমি কেনো মানবে না।তুমি শ্বাশুড়ি হবে,তোমার কাজ হলো সেই উশৃংখল উদ্ভট মেয়েটাকে কিকরে সুশৃঙ্খলায় আবদ্ধ করে রাখা যায়।সংসারের কাজকর্ম করিয়ে তাকে কিভাবে নিজের আয়ত্তধীন করা যায়।আর সেখানে তোমার ছেলের কাজ হলো ,সেই উশৃংখল মেয়েটাকে শুধু ভালোবাসা, ভালোরাখা।তবে কেনো মানবে না তুমি?

ছেলের মুখের দিকে বিস্ময় নজর নিয়ে তাকিয়ে রইলেন নীহারিকা বেগম।এই ছেলের মনেহয়, তিনি এরকম দজ্জাল শ্বাশুড়ি হয়ে,ছেলের বউ পরিচালনা করবেন।যে উনাকেই এরকম ইন্সট্রাকশন দিচ্ছেন,উনার ছেলে।আশ্চর্য!মায়ের বিস্ময় নজর পড়তে,বুঝতে,বিশেষ জ্ঞান অভিজ্ঞতার প্রয়োজন পড়লোনা। সময়ও লাগলোনা ইভানের।মায়ের মুখের এক্সপ্রেশন বলে দিচ্ছে সে,একটু বেশিই বলে ফেলেছে।তাই কথা ঘুরাতে বললো।

‘আচ্ছা আমার প্রসঙ্গ বাদ দাও।তোমার নাবালক ছেলে সাবালক হতে অনেক বাকী।সে সাবালক হবে তারপর তো বিয়ে!সে এখানো হাজার বছর বাকী।যাই হোক যা বলছিলাম,সেটাতে মনোযোগ দাও।তুমি বলো তোমার ফুলকৌড়িকে পছন্দ নয়?

এরকম নজরকাঁড়া মেয়ে নজরে পড়তেই,মেয়ের চৌদ্দ গুষ্ঠির ডিটেইলস নিয়ে বংশবৃত্তান্তের গুনাগুন ভালো হলেই সেই প্রস্তাব নিভানের সামনে তুলে ধরেছেন তিনি।বরাবরই ছেলেটা নাকচ করে এসেছে।আর কৌড়িকে তার মনে ধরবে,আর-ও মেয়েটার বয়স কম।কখনোই মানবে না নিভান।নিজে বয়সে পরিনত হওয়া সত্ত্বে-ও যখন বিয়ে করতে চাইছেনা,তখন অপরিণত একটা মেয়েকে নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে মেনে নেবে।জড়াবে নিজের জীবনে।কখনো মনেহয়না নীহারিকা বেগমের।
ছেলে,নিজে জীবনসঙ্গী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে শুধুই সুন্দরীর কাঙালি নয়,এটা তিনি বেশ বুঝেছেন।তবে বিয়ে করতে চাইছে না,এটাই উনার বুঁজে আসছেনা।দীবাকে কি খুব মনে ধরেছিলো ছেলেটার?সেই কারনেই কি বিয়ে করতে নাকচ সে?তাহলে কেনো দীবার বিষয়ে কথা এলেই এতো মহাবিরক্ত হয়।আর যদি দীবার বিষয়ে আপসেট নাই থেকে থাকবে তবে সেবার বিয়ে করতে রাজী হলেও,তারপর আর কেনো বিয়ে করতে রাজী হচ্ছেনা ছেলেটা?

‘কি হলো কথা বলছো না কেনো?

‘ভাইয়ের জন্য মেয়ে দেখেছিস,প্রস্তাব তার কাছ গিয়ে রাখ।আমাকে বলছিস কেনো?ছেলেরা বড়ো হয়ে গেলে কি আর মায়ের কথা শোনে,নাকি মানে?

‘ছেলে বড় হয়ে গেছে তো কি হয়েছে, কান চেপে ধরে কথা শোনাবে,মানবে না আবার।আর তোমার যা ছেলে আমার কথা শোনার জন্য বসে আছে।আমি প্রস্তাব রাখবো,আর সে নির্দ্বিধায় মেনে নেবে!তাহলেই হয়েছে।ঠিকই বলেছো,তোমার বড় ছেলেটা একটু অবাধ্য বেশিই।

চালন বলছে সুইয়ের।তোর পিছে কেনো একটি ছিদ্র! যেখানে তার নিজের পিছনে হাজার ছিদ্র, তার কোনো খোঁজনামা নেই।তেমনটা হয়েছে উনার ছোটো ছেলের।তবে কথা বাড়ালে,ইভানের অযথা বকবকানিতে মাথা ধরে যাবে উনার।তাই ইভানকে রান্নাঘর থেকে তাড়াতে বললেন।

‘আয় আগে তোর কান চেপে ধরি।

কথাটা বলে ইভানের দিকে এগোতেই সরে বসলো সে।থেমে গেলেন নীহারিকা বেগম। এমনিতেই ছেলে লম্বা। তারউপর বসে আছে উঁচুতে,ধরতে তো এমনিতেই পারবেন না।সহসা শুধু তেড়ে এলেন।ফের সরে রান্নায় মনোযোগ দিয়ে ইভানকে উদ্দেশ্য করে বকতে থাকলেন।

‘সারাদিন কাজকর্ম নেই,শুধু আবোলতাবোল ভাবনা।আর এরওর পিছে লেগে থাকা।সকালবেলা কতো করে বললাম, ওদের সাথে একটু যা,গেলিনা।মেয়েটা বাড়ি থেকে অসুস্থ অথচ আমাকে জানালো না,তা হলে কি কখনোই আমি যেতে দিতাম।সেই অসুস্থ অবস্থায় মেয়েটাকে নিয়ে ,রাস্তায় গিয়ে বমি-টমি করে একাকার অবস্থা করে ফেলেছে।না পেরে তাকে অফিসে রেখে ওরা জিনিসপত্র কিনেছে।দেখলি মেয়েটা অসুস্থ, তাকে নিয়ে বাড়ি চলে আসবি।নাহ,মার্কেটের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে যখন সেই অসুস্থ মেয়েটাকে ফেলে রেখে চলে গেলো ওরা।অফিসে গিয়েও নাকি বমি করেছে মেয়েটা।তখন বাড়িতে ফিরলো চোখমুখের কি নাজেহাল অবস্থা।সারাদিন এরকম আজুড়ে কথাকাজ না ভেবে,একটু তো বাড়ির বিভিন্ন কাজকামের দিকে খেয়াল দেওয়া যায়।নাহ…তা না করে সারাদিন মাথায় আজুড়ে চিন্তা নিয়ে ঘুরা।

‘অফিসে বমিটমি করে দিলো অথচ তোমার সাংঘাতিক ছেলে কিছু বললো না?

আশ্চর্য হয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করলো ইভান।নীহারিকা বেগম এবার অতিষ্ট হয়ে গেলেন।এতো কথা শোনালেন তবুও এই ছেলের কানে ঢুকলোই না।এ কেমন ইতুড়ে ছেলে হয়েছে উনার।দিনদিন ইতুড়েপনা বাড়ছে বৈ কমছেইনা।এবার কিছুটা রাগান্বিত হয়ে বললেন।

‘ইভান,এখান থেকে যা।আর একটা উল্টোপাল্টা বকলে কিন্তু সত্যিই ভালো হবেনা বল দিলাম।

মায়ের শান্ত মেজাজ বেশ কায়দা মতো বিগড়ে দিয়েছে সেটা বেশ বুঝতে পারলো ইভান।আর রাগানোটা ঠিক হবেনা ভেবে,কেবিনেট থেকে নেমে দাঁড়ালো সে।বাহিরে যাবার জন্য পা বাড়াতেই ফের দাড়িয়ে পড়লো।মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো।

‘আমি ফাজলামো করে বলছিনা মা।আমি সিরিয়াসলি বলছি,দাদা-ভাইয়ের জন্য ফুলকৌড়িকে আমার ভিষণ পছন্দনীয়।মেয়েটার গুনাগুন তোমার মতো।তাই বলছিলাম।আমার কথা ফাজলামো মনে হলে-ও, তুমি মেয়েটাকে সিরিয়াসলি নিয়ে নাহয় একটু ভেবে দেখো।

চলে গেলো ইভান।সেদিকে তাকিয়ে রইলেন নীহারিকা বেগম।একটা মানুষের বলাচলা একদিন দেখলেই বোঝা যায় মানুষটা কেমন।সেই হিসাবে তিনি কৌড়ি দেখছেন,প্রায় মাসের কাছাকাছি সময়। নিঃসন্দেহে মেয়েটা খুবই ভালো।মনে ধরার মতোন।তবে উনার মনে ধরলে তো আর হবেনা।ছেলের ও মনে ধরতে হবে।আর এরকম দেখতে শুনতে মাশাআল্লাহ মেয়ের প্রস্তাব তো এ-র আগেও ছেলের সামনে উপস্থাপন করেছেন তিনি।মনে ধরেছে কই ছেলের। সেখানে কি কৌড়িকে মন ধরবে তার?মন হয়না নীহারিকা বেগমের।দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজে মনোযোগ দিলেন তিনি।ইভান সিরিয়াসলি বললেও এবার তিনিই সিরিয়াসলি নিলেন না।

সকালবেলা খাবার খাচ্ছিলো কৌড়ি।আজ থেকে তার কলেজে যাওয়ার কথা থাকলেও বড়মা তাকে যেতে দিলেন না।কাল অসুস্থ হয়ে পড়ায়,আজও শরীরটা দূর্বল।অতিরিক্ত ঘুমে চোখমুখ ফুলেফেঁপে মুখটা ঢোল হয়ে আছে।মায়ের নজর,সেটা দেখে বড়মা তাকে আর কলেজে যেতে দিলেন না।বললেন,আরও একটা দিন কলেজে না গেলে কিছুই হবেনা।কিন্তু শরীর খারাপ হলে সবকিছুই বৃথা।তাই আর যাওয়া হয়নি।সত্যিই শরীর ভালো না থাকলে কিছুই ভালো লাগেনা। তার-ও যেতে ইচ্ছে করেনি।

‘কি ফুলকৌড়ি,কাল থেকে তোমার দেখা-সেখা নেই?ব্যাপার স্যাপার কি বলোতো একটু শুনি।শুনালাম,বমি-টমি করে দাদাভাইয়ের অফিস ভাসিয়ে দিয়ে এসেছো। ভালোই করেছো,তাকে জ্বালানোর লোক নেই।তুমি একটু জ্বালিয়ে এসে ভালোই করেছো।তবে ইচ্ছে করে ভাসিয়েছো নাকি দাদাভাইয়ের ভয়ে?কোনটা?

ডায়নিং টেবিলে বসতে বসতে কথাগুলো বললো ইভান।শেষের কথাগুলো গালে হাত চেপে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো।এতোসময় মাথা নিচু করে খেলেও এবার মাথা উঁচু করলো কৌড়ি।এতোদিন এই লোকটাকে সে ভালোভাবে চিনে ফেলেছে,এবাড়ির সবার পিছু লেগে থাকা হচ্ছে এই লোকটার কাজ।আর তার পিছনে এক্সট্রা গোয়েন্দাগিরি করা হচ্ছে এই লোকটার আরও বড় মহাকাজ।বরাবরের মতো কণ্ঠের কোমলতা বজায় রেখে কৌড়ি বললো।

‘কেউ ইচ্ছে করে বমি করতে পারে?আমি ইচ্ছে করে করেছি বলে আপনার মনে হয়?

‘দারুন যুক্তি।তবে কি বরাবরই মতো দাদাভাইয়ের ভয়ে করে ফেলেছো?

এবার মুখটা ছোটো করে ফেললো কৌড়ি।এখন তাকে কালকের ঘটে যাওয়া বিব্রতকর পরিস্থিতির বর্ননা দিতে হবে!যদিও মানুষটাকে সে ভয় পায়।তাই বলে ভয়ে তো সে করেনি,পরিস্থিতিতে পড়ে করতে বাধ্য হয়েছে।তবে ইভানকে সে বর্ননা দিতে চাইলোনা।নাহলে লোকটা আরও ক্ষেপাবে।কৌড়ির মনে কথা তো আর ইভান বুঝলো না,সে তার স্বভাবমতো অমায়িক হেসে বললো।

‘তোমার ভয় কাটানোর একটা দারুণ আইডিয়া পেয়েছি ফুলকৌড়ি।তবে খাওয়া শেষ করে নাও,না-হলে দাদাভাই তোমার সামনে না থাকস সত্ত্বেও তুমি বিষম খাবে।এবং সেই বিষম না ছাড়ার সম্ভাবনায় বেশি।

একটা মানুষের দূর্বল বিষয় পেলে হয়।এই ছেলে সেটা নিয়ে তার পিছনে ইতুড়ের মতো লেগে থাকে।এখন আবার,তার ওই ইতুড়ে মাথা থেকে কি আইডিয়া বের করলো, কে জানে?

‘কি হলো,তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও।নাকি বলবো?

‘বলুন।

তাহলে গালে ভাত, পানি কিছুই দিওনা।না-হলে আমার ভাবা আইডিয়া শুনে সত্যিই তোমার বিষম লাগতে পারে।

এবার অসন্তুষ্ট মুখে ইভানের দিকে তাকালো কৌড়ি।তা দেখে হেসে ফেললো ইভান।বললোে–আচ্ছা তুমি যখন শুনতে আগ্রহী তবে বলি।তবে বিষম-ফিষম খেলে কিন্তু আমার দোষনা।দোষ না তো?

না চাইতেও মাথা নাড়িয়ে না সম্মতি জানাতে হলো কৌড়িকে।কৌড়ির মাথা নাড়ানো দেখেই ইভান বিজ্ঞ ব্যক্তিদের ন্যায় বলতে শুরু করলো—আমি ভেবে দেখালাম,যে জিনিসটাতে আমাদের ভয় বেশি। সেই জিনিসটার কাছাকাছি থাকলে আমাদের ভয় ততোটাও করেনা।যেমন মনেকরো,কাল তোমাকে বাধ্য হয়ে দাদাভাইয়ের কাছে থাকতে হয়েছে।যতোটা ভয় তুমি দাদাভাইকে দূর থেকে পাও,কাছাকাছি গিয়ে ততোটা অনুভব করেছিলে?

কৌড়ি কি বলবে বুঝে পেলোনা।কি বলতে চাইছে সামনে বসা ছেলেটা সেটাও বুঁজে আসলোনা তার।তবে সত্যি বলতে দূর থেকে মানুষটাকে যতোটা ভয়ংকর মানুষ বলে মনে হয়েছিলো, মানুষটা ততোটাও না।আর ভয়টাও সেভাবে অনুভব করেনি।বরং মানুষটা সবদিক দিয়ে ভিষন কেয়ারিং বলেও মনেহলো তার।তাই ইভানের ভিতরে কি চলছে,সেটা না বুঝে নিজে যা বুঝলো সেই ভিত্তিতে মাথা নাড়িয়ে না জানালো।অর্থাৎ সে ততোটাও ভয় অনুভব করেনি। সেটা দেখে ইভান জেনো যুদ্ধ জয়লাভ করলো,এমনভাবে খুশি হলো।তা দেখে প্রশ্নে কপাল কুঁচকে গেলেও কিছু বললোনা কৌড়ি।

‘পাওনি তাইতো।তাই তোমার ভয় কাটানোর উত্তম ব্যবস্থা হচ্ছে দাদাভাইয়ের সান্নিধ্যে থেকে যাওয়া।অর্থাৎ দাদাভাইকে বিয়ে করে দাদাভাইয়ের বউ হয়ে থেকে যাওয়া।তোমার ভয় কাটানোর দারূন আইডিয়া না বলো?

হতবাক,আশ্চর্য,বিস্ময়,অবাক কোনটা হলো না কৌড়ি। সব অনুভূতি মিলিয়ে ইভানের দিকে মুখ হা করে তাকিয়ে রইলো।বিষম লাগার থেকে-ও বাজে অবস্থা হয়ে গেছে তার।সে, বাঘ ভাল্লুক সিংহ,এরকম হাজারও প্রানী বাদে কতশত মানুষকেও ভয় পায়।তাই বলে তাকে ভয় কাটানোর জন্য,সেসকল প্রানিদের সাথে-ও বিয়ে করতে হবে!এটা কোনো কথা হলো।আর মানুষও খুঁজে পেলোনা।শিরশিরানি দিয়ে উঠলো সমস্ত শরীর।আজ একটুখানি মানুষটার আশেপাশে থেকেছে,তাই দম লেগে মরে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে।সংকোচে অশান্তি অশান্তি অনুভব হয়েছে তার।শুধু মনে হয়েছিলো,কখন মানুষটার থেকে ছুটকারা মিলবে তার।সেখানে এই ছেলে,ওই মানুষটার সাথে একেবারে থাকার বুদ্ধি দিয়ে বলছে,ভয় কাটানোর জন্য একটা গুড আইডিয়া বের করেছে!ইভানকে তার এবার পাগল মনেহলো।আর পাগলের আইডিয়া কোনোমতেও গ্রহনযোগ্য নয়।

‘বললে না-তো,কেমন আইডিয়া দিলাম তোমাকে?একেবারে ফাস্টক্লাস আইডিয়া না!

অসন্তুষ্ট গলায় কৌড়ি বললো–সবচেয়ে বাজে আইডিয়া।

ইভানের উচ্ছাস মুখটা নিমিষেই চুপসে গেলো।বললো —কোন এঙ্গেলে তোমার মনেহলো আইডিয়া বাজে?দাদাভাই একটু গম্ভীর টাইপের মানুষ। কম কথা বলে। কিন্তু দাদাভাই কতো ভালো ছেলে তুমি জানো?আমার দেখা সেরা ছেলে আমার দাদাভাই।

‘আপনার দাদাভাই ভালো ছেলে হলেও আপনি মোটেই ভালো নন।

‘আরেহ দেবর হিসাবে আমি খারাপ হলে-ও তোমার চলবে।কিন্তু বর হিসাবে আমার দাদাভাইতো খারাপ নয় খুব গুড বয়।তবে তাকে কেনো রিজেক্ট করছো?দেবর হিসাবে ভালো না হওয়ায় আমাকে রিজেক্ট করো।সমস্যা নেই।কিন্তু তুমিতো বলছো দাদাভাই ভালো ছেলে তবে তাকে কেনো বর হিসাবে মানতে চাইছোনা?

কৌড়ির মাথার মধ্যে সব তালগোল পাকিয়ে নাজেহাল অবস্থা।নজর অসহায় হয়ে পড়লো।কি বলবে খুঁজে পেলোনা।আশেপাশে নজর দিলো,নীহারিকা বেগমকে এদিকে আসতে দেখে,আশা নিয়ে উনার দিকেই চেয়ে রইলো সে।কাছে আসতেই কৌড়ির চাহুনি দেখে ডায়নিং টেবিলের পাশে থেমে গেলেন তিনি।ইভানকে ভদ্র ছেলের মতো বসে থাকতে দেখে খটকা বাড়লো।বললেন।

‘তুই নিশ্চয় আবোলতাবোল বলে ওর খাওয়া বন্ধ করে রেখেছিস?আল্লাহ,ইভান তোর সারাদিন এগুলো করতে ভালো লাগে?বড় হয়েছিস অথচ অবুঝপনা বাড়লো বৈ কমলোই না।আর তুই?ভাত না খেয়ে ওর আলতুফালতু কথা গিলছিস কেনো?ও যেখানে থাকবে সেখানে একটাও থাকবিনা।বলেছিনা আমি।

কৌড়িকে উদ্দেশ্য করে শেষের কথাগুলো বলতেই ইভান প্রতিবাদ জানালো—মা এটা কিন্তু মোটেই ঠিক না।আমি মোটেই আলতু ফালতু কথা বলছিলাম না।আমি ওকে ভালো আইডিয়া দিচ্ছিলাম।আমি সবসময় ফালতু কথা বলিনা।

‘কি আইডিয়া দিচ্ছিলি?

‘তোমার বড় ছেলের বউ হওয়ার।কিন্তু ও তোমার মতো রাজী হচ্ছে না।

মানেটা কি?এটা বড়মাকেও বলেছে।অসহায় নজরটা এবার ইভানের মুখের দিকে ফেললো কৌড়ি।সেটা দেখে ইভান ফিচাল হেসে বললো—তোমাকে আইডিয়া দেওয়ার আগে মায়ের সাথে তোমাকে তার বড় বউমা হওয়ার পরামর্শ করে নিয়েছি।তবে সবাই ওই একজায়গায় আঁটকে আছি,আমার গম্ভীর দাদাভাই।

মূহুর্তেই চোখ ঘুরিয়ে নীহারিকা বেগমের দিকে তাকালো কৌড়ি।এসব কি হচ্ছে, বলছে এই ছেলে।নিশ্চিত এই ছেলের মাথায় সমস্যা হয়েছে।নীহারিকা বেগমের দিকে তাকাতেই দেখলো,তিনি-ও নিরাশ ভঙ্গিমায় তারদিকে চেয়ে আছেন।হয়তো ছোটো ছেলের কান্ডতে তিনিও নিরাশিত।তেমনটা মুখেও বললেন।

ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে কৌড়ি।ও কথা বললে কানে তুলবিনা।চুপচাপ খেয়ে রুমে চলে যা।

কথাগুলো বলে নীহারিকা বেগম চলে গেলেন।কৌড়ি মাথা নিচু করে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।সেটা দেখে অসন্তুষ্ট গলায় মা’কে উদ্দেশ্য করে ইভান চেঁচিয়ে বললো।

‘এটা ঠিক নয় মা।এজন্য কারও ভালো করতে নেই।

কৌড়ির খিলখিলিয়ে হাসি পেলো।তবে পরিস্থিতি যা হাসলে সামনে বসা মানুষটাকে অসম্মান করা হবে তাই হাসি চেপে রেখে খাবারে মনোযোগ দিলো।

গোটা দেড় কিলোমিটার রাস্তা দৌড়ে এসে,বাড়ির গেটের সম্মুখীন হয়েই দাড়িয়ে পড়লো নিভান।গায়ের সাদা টিশার্টটা ঘামে ভিজে প্রায় জুবুথুবু।পেশিবহুল হাতদুটো দুহাটুতে ভরক দিয়ে মাথা নিচু করে নিয়ে শ্বাস ছেড়ে নিলো কয়েকবার।ফের মাথা উঁচু করে বাড়ির ভিতরের দিকে তাকাতেই স্নিগ্ধ একটা মায়াবী মুখের দেখা মিললো,বাড়ির গার্ডেন এরিয়ার বেঞ্চতে।হালকা গোালপী আর সাদা রঙের মিশ্রনে সাদামাটা একটা থ্রিপিস পরা।মাথায় ওড়না নেই।লম্বা বেনুনিটা,বসে থাকায় পিঠ বেয়ে জমিনে গিয়ে ঠিকেছে।মাথা নিচু করে একমনে কি জানো করে চলেছে মেয়েটা।আনমনে কদম বাড়ালো নিভান।যতো সামনে এগোলো ততো সেই স্নিগ্ধ মুখটা আর-ও স্নিগ্ধ দেখালো।

সকালের বাগানে ফোঁটা শতশত স্নিগ্ধ ফুলের মাঝে বসা মেয়েটার সকালের মায়বী রূপের স্নিগ্ধতা আজ শতশত ফুলের স্নিগ্ধতাকেও হার মানাচ্ছে।জীবন্ত একটা মায়াবী স্নিগ্ধ সাদা গোলাপ।একমনে মেয়েটা ফুল গেথে চলেছে।হাঁটা থেমে গেলো নিভানের।নজর স্থির রাখলো সেই জীবন্ত সাদা গোলাপের পানে।হঠাৎ কৌড়ির মনেহলো কেউ তাঁকে খুব খেয়ালি নজরে দেখছে।আশেপাশে নজর দিতেই দেখলো,কোথাও কেই নেই।তবে এরকম কেনো মনেহলো?বিশেষ ভাবলোনা কৌড়ি।আবারও মনোযোগ দিলো ফুল গাঁথুনিতে।আনমনে হেসে বাড়ির ভিতরে ঢুকলো নিভান।দ্রতপায়ে ছাঁদে চলে গেলো, যাবার আগে রানি সাহেবাকে রান্নাঘরে দেখে কফির অর্ডারও দিয়ে গেলো।ছাঁদে এসে রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়ালো নিভান।নজর স্থির রাখলো সেই জীবন্ত সাদা গোলাপের পানে।কি হলো নিজের মন মস্তিষ্কের,ভেবে পেলো-না নিভান।তবে সকালের ওই বাগানভর্তি ফুলের মধ্যে বসা জীবন্ত গোলাপটা তার মন মস্তিষ্ক এলোমেলো করে দিয়েছে।তাকে দেখার নজরের তৃষ্ণা জেগেছে প্রবল।একই দৃশ্য_____মেয়েটা নিজের কোমল হাতদ্বারা একমনে ফুল গেঁথে চলেছে।

প্রেমে পড়েছে মন প্রেমে পড়েছে।
অচেনা এক মানুষ আমায় পাগল করেছে।

সকাল সকাল গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে কফির মগটা এনে রেলিঙের উপর রাখলো নিভান।কপাল একটু নয় অনেকখানি কুঁচকে পাশে দাঁড়ানো ছেলেটার দিকে চাইলো নিভান।ইভানের এরকম একটা গান গাওয়ার মানেটা কি?আর আজ ব্যাপার কি?বাহিরে দিগন্তে সূর্য উঠার আগেই তাদের বাড়ির সূর্যটা উঠে গেছে।যার সকাল হয় মধ্যেদুপুরে।সেই তিনি সূর্য উঠার আগেই দেখা দিলেন!

‘কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।

কফির মগটা হাতে নিলো নিভান।মগটা ঠোঁটে ছুঁতেই সেই দূরপ্রান্তে বাগানে বসা মেয়েটার পানে নজর গেলো।অদ্ভুতভাবে নজরজোড়াকে টানছে মেয়েটা।এই মেয়ে চাইছেটা কি?হঠাৎই মন বলে উঠলো,মেয়েটা চাইছে কোথায়?চাইছে তো সে!হঠাৎ মস্তিষ্ক বলে উঠলো,সে কখন চাইলো!তবে কেনো মেয়েটা তাকে এতো অদ্ভুতভাবে টানছে?

‘এই ফুলকৌড়ি…

হঠাৎ ইভানের এমন ডাকে ঘাড় ফিরিয়ে তার মুখের দিকে তাকালো নিভান।মানেটা কি,মেয়েটাকে এভাবে ডাকার কি প্রয়োজন?কতোবড় ফাজিল ছেলে।তাকে যে অপ্রস্তুত ফেলার জন্য ফাযিলটা কাজটা করেছে বেশ বুঝলো নিভান।তবে অপ্রস্তুত তাকে দেখালো না।বরং নির্বিকার চাহুনিতে চেয়ে রইলো সেই দূরপ্রান্তের নারীটির দিকে।ইভানের ডাকে কৌড় উপরের দিকে চাইতেই নজর অপ্রস্তুত হয়ে গেলো তার।নজর ফিরিয়ে নেওয়ার আগেই ইভান ফের বললো।

‘আজকে যা তোমাকে লাগছে-না!কুয়াশাচ্ছন্ন স্নিগ্ধময় সকালের স্নিগ্ধতম জীবন্ত ফুলকৌড়ি।বাগানের শত ফুল-ও আজ তোমার স্নিগ্ধতায় হার মেনে যাচ্ছে….

পছন্দের কফিটা হঠাৎই স্বাদহীন মনেহলো নিভানের।কেনো?কোনো উপকরণ তো কফিতে কম নেই,সবকিছু তো পরিমাপ মতোই।খুব মনোযোগ দিয়েও তো খাচ্ছিলো এতোসময়।তবে হঠাৎ কেনো বিস্বাদে পরিনত হলো?ভালো লাগছে না কেনো কফিটা আর খেতে!কফির মগটা ঠোঁটে চেপে থাকলেও,মগের ভিতরের অসমাপ্ত তরল পদার্থটা দাঁতের ফাঁক দিয়ে আর কেনো গলাতে নামতে চাইছে-না?এতো বিস্বাদ!

চলবে…

#ফুলকৌড়ি
(১৩)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

কফির মগটা শক্তহাতে চেপে রেখেছে নিভান।মোটাসোটা পরিপুষ্ট সিরামিকের কফিমগ না হয়ে যদি সাধারণ প্লাস্টিক বা কাঁচের কোনো মগ হতো,হয়তো এতোসময় জিনিসটা দুমড়েমুচড়ে হাতের মুঠোয় চলে আসতো।হঠাৎই এমন অনুভূতি হওয়ার কারনটা কি,বুঝেও বুঝতে চাইলো না সে।তবে মেয়েটার সাথে ইভানের ফ্লাটিং এর ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করলো।যে মধুময় বাক্যগুলো মেয়েটাকে উল্লেখ্য করে আওড়ালো ইভান। তা কি শুধুই ফ্লাটিং নাকি তারমতো মনোভাব নিয়েই,নিজের প্রিয় ঘুমটা বিসর্জন দিয়ে ছাঁদে এসেছে ইভান?তাহলে তখনকার গাওয়া গানটা কি মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করেই ছিলো?তবে কি মেয়েটার প্রেমে পড়েছে ইভান?মূহুর্তেই ঘাড় ফিরিয়ে ইভানের হাসি-হাসি মুখের দিকে তাকালো নিভান।নিরেট চোখে সেই হাসি হাসি সুদর্শন মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পর্যবেক্ষণ করলো তাকে।ছেলেটা তো এমন স্বভাবেরই,তাই তাকে দেখে বিশেষ কিছু অনুধাবন করতে পারলো না।তবে কেনো এই সাতসকালে ইভান এখানে?জিজ্ঞেস করবে কি?কি বলেই বা জিজ্ঞেস করবে!সামনে তাকালো নিভান।নজর গিয়ে পড়লো সেই কাঙ্ক্ষিত জায়গাটাতে গিয়ে তবে মেয়েটা সেখানে নেই।পুরো লন এরিয়ায় চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে আসলো নিভান।কোথায় নেই মেয়েটা।চোখ ঘুরিয়ে সেই শূন্য বেঞ্চেটাতে এনে স্থির রাখলো।মূহুর্তেই কানে এলো ইভানের সুরেলা গলার প্রতিধ্বনি।

‘এইতো ক’দিন আগে-ও তুমি ছিলে অচেনা।
আজ যে চোখের আড়াল হলে প্রানে বাঁচি-না।

তড়িৎ গতিতে পাশে ফিরলো নিভান।ইভান পাশে নেই।পিছে ফিরে দেখলো,ছাঁদের গেট পেরিয়ে সিঁড়িপথে হাঁটা দিয়েছে সে।তবে কাঁটার মতো বিঁধে দিয়ে গেছে নিভানের মস্তিষ্কে গানের বার্তাগুলো।সেদিকে শান্ত নজরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে,সামনে ফিরলো নিভান।
নজর রাখলো সেই একই শুন্যস্থানে।তবে কি তখনের আর এখনের গাওয়া গানের বাক্যগুলো মেয়েটাকেই উদ্দেশ্য করেই গাইলো ইভান!সেরকমই তো ইঙ্গিত দিলো।কি মনে করে শক্ত হাতে চেপে রাখা কফিমগটা ছুঁড়ে মারলো,সেই শুন্যস্থানটিতে।নিশানা এতো তীক্ষ্ণ ছিলো, ঠিক জায়গামতো গিয়েই পড়লো কফিমগটা।হয়তো কৌড়ি সেখানে বসে থাকলে,তার শরীরের কোথাও লেগে এতোসময় ক্ষত হয়ে যতো।সে-রকমই হয়তো দূর থেকে ছুঁড়ে দেওয়ায় ক্ষত হয়ে ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে মগটা।তবে শব্দ ফিরত আসেনি।কার উপরে এই অযথা রাগ?আর কি কারনে বা এই খেয়ালিপনা?চোখ বুঁজে ফেললো নিভান।মূহুর্তেই বদ্ধ দুয়ারে ভেসে উঠলো,স্বপ্নে-দেখা ক্রন্দনরত সেই একজোড়া চোখ।তারপর নাফিমের মোটাসোটা বাহু-ভেদ করে একজোড়া ডগরডগর ভয়ার্ত নজর।সেদিন শেষ বিকালের লাল কমলারঙা গোধুলী আলোয় শান্ত শোভিত সেই সুন্দর মুখাবয়ব।অফিসে নিজের স্পেশাল বেডে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত মায়াবীনি এক রমনী।আরও আরও কতশত স্মৃতি জোগাড় করে ফেলেছে এই নজর!কেনো?সারাদিনে কত নারী নজরে পড়ছে,আশেপাশে শত সুন্দরীর ভীড়।তাদের সকলকে উপেক্ষা করে এই নারীটার চলাবলা কেনো স্মৃতিচারিত করে জড়িয়ে নিয়েছে মন মস্তিষ্কে?সে কি নিজ থেকে চেয়েছিলো স্মৃতিরোমন্থন করতে?চাইনি তো!সাধারণ সব নারীদের মতোই উপেক্ষিতোই তো করেছিলো।তবে কেনো আচমকা দখল করলো সে নারী তার হৃদয়!মন, মস্তিষ্কে!কতোশত সৌন্দর্যময়ীকে এ-নজর উপেক্ষিত করলো।তবে কেনো ওই মায়াহরিনীটাকে উপেক্ষিত করতে পারলোনা মন মস্তিষ্ক?আর না উপেক্ষিত করতে চাইছে।কেনো….?এতোসময় মন হাজারও প্রশ্ন আওড়ালেও,মুখ বললো।

‘ও নারী সত্যিই যাদুকারীনি।

সূর্যের এলোমেলো রশ্মি দিগন্তে মিটিমিটি ছড়িয়ে পড়তে শুধু করেছে।লৌহ কঠিন যন্ত্রের ন্যায় শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নিভান,সেই উদায়িত সূর্যের পানে তাকলো।শক্ত চোয়ালে,কঠিন মুখাবয়ব করে সেদিকে নিরেট নজরে চেয়ে রইলো।সকালের উদিত হওয়া সূর্যের রশ্মির তীক্ষ্ণতার চেয়েও তার মুখাবয়বের তীক্ষ্ণতা,চাহুনি জেনো ভারী ঠেকলো।অকারণে কেনো এই কঠিনভাবমূর্তি,এই তীক্ষ্ণতা ভর করলো নিজের ভিতর-বাহিরে জুড়ে,বুঝতে পেরে আরও শক্ত হয়ে এলো নিজের মুখাবয়ব।মুখ নয় এবার মন বললো–যদি সে সত্যিই যাদুকারিনী হয়ে থাকে,তবে সেই যাদুবলে শুধু তাকেই রেখে কেনো ক্ষান্ত হচ্ছে না?অন্যকে-ও কেনো সেই যাদুতে মোহাবিষ্ট করছে?কেনো?

সূর্যের রশ্মি বাড়তেই ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেলো।ললাট,চিবুক গলা বেয়ে দরদরিয়ে নোনাজল নামতে থাকলো,তবুও সেদিকে কালক্ষেপণ করলো না।কি কারনে নিজের প্রতি এই শাস্তি মন বুঝলে-ও, শরীর বুঝলোনা।শরীর চাইলো ছায়াস্থল তবে মন ভ্রুক্ষেপহীন।

আজ পুরো একমাস কৌড়ি এবাড়িতে।বাড়ির মানুষগুলো বিভিন্ন স্বভাব চরিত্রের হলেও বেশ ভলো, আর অমায়িক।এই ত্রিশদিনে কাছের মানুষ হয়েছে প্রায়সই,তবে কথা কম হয়েছে, দাদুমা, দীবাআপু আর ওই চোখমুখ শক্তকরে থাকা মানুষটার সাথে।তবে কাছের মানুষগুলো বাদেও ওই তিনজন মানুষের থেকেও এতোদিনে কোনো খারাপ আচরন কৌড়ি পায় নি।বাহিরের মানুষ বলে তীক্ষ্ণ কোনো বাক্যও শুনতে হয়নি তাকে।তবে কাল সন্ধ্যা থেকে জাহিদ আঙ্কেলর বোন ডালিয়া বেগম,এবাড়িতে পদার্পণ করার পর থেকে কেমন কপাল কুঁচকে অদ্ভুত নজরে তাকিয়ে থাকছে তারদিকে।কিছু তীক্ষ্ণ ছোটোছোটো কটুবাক্যের শিকারও হতে হয়েছে তাকে।সেখান থেকেই মন খারাপ কৌড়ির।দাদািআপার কাছে বাড়ি চলে যেতে ইচ্ছে করছে।একটুও থাকতে ইচ্ছে করছেনা এবাড়িতে।হঠাৎ কাল থেকে মনেহচ্ছে, এতোবড় আলিশান বাড়ি হওয়া সত্ত্বেও এবাড়িতে শান্তি নেই।তার সুখ তার শান্তি, স্বস্তির নিঃশ্বাস সব ওই ছোট্টো বাড়িটায়।যেখানে কেউ তাকে ছোটো করে খোঁটা দিয়ে কথা বলার সাহস পায়না।খেয়ে থাকুক না খেয়ে থাকুক,কারও কটুবাক্য শুনতে হয়না।কেনো দাদিআপা তাকে এখানে পাঠালো?যা ছিলো কপালে,তাইই না-হয় হতো।সইতো।তবু-ও পরাধীনতার শিকলে এভাবে জড়বস্তুর ন্যায় থাকতে হতোনা।

বিগত দুদিন ধরে কলেজে যাচ্ছে কৌড়ি।আজ শুক্রবার।কলেজ না যাওয়ার কারনে,নিজের জন্য বরাদ্দ করে দেওয়া রুমটায় বসে একমনে কথাগুলো ভেবে চলেছে সে।রুমের বাহিরে কেনো জানি পা রাখতে মোটেও ইচ্ছে করছেনা তার।নিজেকে কেমন ছোটো মনেহচ্ছে।বাহিরের মানুষ,আশ্রিতা!যদি-ও সে আশ্রিতা তবে এই একমাসে এই বাড়ির কারও ব্যবহারে সেটা মনে হয়নি যেটা আজ খুবকরে মনেহচ্ছে।

‘মন খারাপ তোমার, ফুলকৌড়ি।

নাফিমের কথায় তাকালো তারদিকে।মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললো–মন কেনো খারাপ থাকবে?

‘তাহলে আমি এতোবার ডাকলাম,শুনলে না কেনো?

ডেকেছে নাফিম!ভাবনায় এতো ডুবে ছিলো খেয়াল হয় নি হয়তো।কন্ঠের উচ্ছলতা বজায় রেখে বললো—তুমি ডেকেছিলে,আমি-তো খেয়ালই করিনি।স্যরি!

কৌড়ির পাশঘেঁষে বসলো ছেলেটা।মুখ ভারকরে গম্ভীর কন্ঠে বললো।—আমি জানি তুমি কি ভাবছিলে।

অবাক হলো কৌড়ি।কিছু বলতে নেবে তার আগেই ফের গম্ভীর কন্ঠে বললো–ফুপিমনির কথায় তুমি কষ্ট পেয়েছো,তাই না?জানো, উনাকে না আমারও একটু-ও ভালো লাগেনা।সবসময় কেমন করে কথা বলে।আম্মু সিরিয়াল দেখে না,ওই সিরিয়ালের খারাপ কুটনি মহিলাদের মতোই উনার কথা,আচারন।যা আমার একটুও ভালো লাগেনা।এজন্য আমার ফুপিমণিকেও আমার একটুও পছন্দ নয়।

‘এসব কি কথা নাফিম।এভাবে বলতে নেই।উনি তোমার গুরুজন হন-না।আর গুরুজনদের নিয়ে এভাবে বলতে আছে?বলতে নেই।নাফিমতো গুড বয়।আর গুড বয়-রা কখনো ব্যাড বয়দের মতো কথা বলেনা।

নাফিমের মাথায় হাত বুলিয়ে কথাগুলো বললো কৌড়ি।চোখ তুলে তাকালো নাফিম।মুখ এখনো তার ভারাক্রান্ত।বললো–ফুপিমণি ভালোভাবে কথা বলতে পারেন না!ভালো করে কথা বললে তো হয়ে যায়।তবে কেনো বলেন না?তিনি ভালো করে কথা বলেন না এজন্য তো উনাকে আমার ভালো লাগেনা।আর আমার ফুপিমণিকে ভালো না লাগলে,তো আমি কি করবো?

‘তবুও ওভাবে বলতে নেই।আর কখনো বলবেনা। ঠিক আছে?

অনেক্ক্ষণ বাদে হালকা মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো নাফিম।ফের বললো—বড়মা তোমায় খেতে ডাকছে।চলো।

খেতে যেতে কৌড়ির একটু-ও ইচ্ছে করছেনা।তবু-ও ডাকতে পাঠানো মানুষটাকে সে অসম্মান করতে চায়না।মানুষটা তাকে এই একমাসে এতো আপন করে নিয়েছে,এতো ভালোবাসা দিয়েছে।মায়ের মতো করে কাওকে পাওয়া এবং তার মমতা ভালোবাসার,আদর শাসনের ছায়াতলে থাকা সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার।সারাদিনে মানুষটা প্রচুর ব্যস্ত থাকে, তারমধ্যও নিয়ম করে কৌড়ির ভালোমন্দের খোঁজখবর নিয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত।তাই উনার ডাকতে পাঠানোটা উপেক্ষা করা সমুচিত মনে করলো না।না যাওয়াটা অভদ্রতাও মনে হলো।হাত টান পড়তেই দেখলো,নাফিম হাতের আঙুল আঁকড়ে ধরে টানছে।

‘চলো।

ইচ্ছের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়ালো কৌড়ি।নাফিমের ডাককে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে সামনে এগোলো।

রোজ এই সময়টায় বাড়িটা থাকে নিস্তব্ধ। কেউ বাড়ি থাকেনা।খেয়েদেয়ে যেযার কর্মস্থল বা স্কুল কলেজ চলে যায়।আর আজ বাড়িতে থাাক সত্ত্বেও সবাই এখনো ঘুমে।দশটার বেশি বাজতে চললো অথচ কারও খাওয়া দাওয়ার কোনো হদিশ নেই।বাপ ছেলেদের সাথে পাল্লা করে মেয়ে দুটো আজ ঘুমিয়ে। কতোবার ডাকতে পাঠালেন,নিজেও ডেকে এলেন।অথচ এখনো তাদের খোঁজ নেই।এসব নিয়েই ছোটো জায়ের সাথে টুকিটাকি বকেই চলেছেন নীহারিকা বেগম।বড় জায়ের মৃদুস্বরের বকা শুনে স্বান্তনা রহমান দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।তিনিও একদফা বকে ধমকিয়ে ছেলেটাকে তুলতে পারলে-ও, ছেলের বাবা আর মেয়েটাকে এখনো তুলতে পারলেন না।প্রতি শুক্রবারের দিনটা এলেই এরকম এলোমেলো সকালটা পার হয়ে যায়।কৌড়িকে আসতে দেখেই নীহারিকা বেগম বকা থামিয়ে বললেন।

‘এসেছিস?তবে বোস।তুই আর নাফিম আপতত খেয়ে নে।ওরা যে যখন উঠবে,পারলে যেযার মতো সে তখন খেয়ে নেবে।ওদের আশায় বসে থাকলে,সকালে আর কারও খাওয়া হবেনা। না খেয়ে বসে থাকতে হবে।

অন্য দিন হাজার বাহানা করলেও আজ নাফিম চুপচাপ খেতে বসলো।বিষয়টা স্বান্তনা রহমানের হজম না হলেও,কিছু বললেন না।কৌড়ি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে নাফিমের পাশের চেয়ারটায় খেতে বসলো।নীহারিকা বেগম খাবার বেড়ে দিলেন দু’জনকে।ফের কিছু লাগলে,নিজেদের নিয়ে নিতে বলে রান্নাঘরে ঢুকলেন।কিছুসময় বাদে সেখানে হাজির হলেন ডালিয়া বেগম।কৌড়িকে দেখেই নাকমুখ কুঁচকে গেলো উনার।
বাড়িটা কি আশ্রম বানিয়ে রেখেছে,যার যখন বাপ মা মরে যাবে।এবাড়িতেই তাকে এনে সমাদর করতে হবে!আর এই বাড়ির মানুষগুলোও হয়েছে সেরকম।বিশেষ করে উনার ভাই আর ভাবি।একেবারে দয়ার সাগর।যা উনার একটুও পছন্দ নয়।ডায়নিংয়ে এসে বসতে বসতে গলা চড়াও করে নীহারিকা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বললেন।

‘বুঝলে ভাবী।বড়ভাইয়ের না বাড়িটার নাম বেলা শেষে রাখা উচিত হয়নি।বাড়িটার নাম রাখা উচিত ছিলো, আশ্রিতাদের আশ্রম।এটাই এ-বাড়ির যোগ্য নাম বলে মনেহয় আমার।

রান্নাঘরে বেসিনে থালাবাসনের টুংটাং শব্দতুলে কাজ করছিলো রানী।হাত থেমে এলো তার।এরকম খোঁটা এবাড়িতে কতো শুনেছে সে।তবে নিজের আশ্রয় না থাকায় আর কতোগুলো ভালো মানুষের জন্য এখনো টিকে আছে এখানে।বিয়ের পর একটা সময় মনে হয়েছিলো,এবার বুঝি নিজের বলে একটা জগত হলো।সেটাও একটা সন্তানের অভাবে কপালে সইলো না।দীর্ঘশ্বাস ফেলে টুংটাং শব্দ তুলে আবার-ও কাজে মনোযোগ দিলো সে।খাওয়া থেমে গেলো কৌড়ির-ও।নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো।কটাক্ষ করে বলা কথাগুলো কাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে বুঝতে বাকী রইলোনা তার।গালের মধ্যে থাকা খাবার গলায় কাঁটার মতো বিঁধে রইলো।অজান্তে দু’চোখের কোল ভরে এলো।
নীহারিকা বেগম হতবাক হয়ে চেয়ে রইলেন।শেষ পর্যন্ত এই মেয়েটাকে-ও কটাক্ষ করতে ছাড়লোনা।নিজের মেয়ের জায়গায় বসিয়ে এই মেয়েটাকে একবার ভাবতে পারলোনা।প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হলো উনার।স্বান্তনা রহমান নাকমুখ কুঁচকে ফেললেন।কিছু বলতে যাবেন তারআগে পুরুষালী গলার আওয়াজে তিনি চুপ হয়ে গেলেন।

‘ঠিকই বলেছেন ফুপুমনি।নাহলে আপনিই বা থাকতেন কোথায়?আপনিও তো এবাড়ির আশ্রিতা।শুনেছি মেয়েরা বিয়ের পর নাকি বাপের বাড়ির আশ্রিতা হয়ে যায়।

চলবে…..

ফুলকৌড়ি পর্ব-১০+১১

0

#ফুলকৌড়ি
(১০)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

কাঁচের দেয়াল বেষ্টিত সৌন্দর্যবর্ধনে সজ্জিত- গচ্ছিত নিজ অফিসকক্ষের চেয়ারে বসে আছে নিভান।রুমটা শুধুই তারজন্য স্পেশাল।জাহিদ সাহেব এবং শাহেদ সাহেব অফিসে আসলে তাদের জন্য-ও স্পেশাল নিজ নিজ অফিসকক্ষ রয়েছে।যে যারমতো করে নিজেদের অফিসকক্ষটা সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে।শীততাপনিয়ন্ত্রণ রুমটার চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে সে।ইদানীং চোখ বন্ধ করলে সেই ক্রন্দনরত চোখজাড়ার সাথে সাথে আর-ও একটি দৃশ্য বদ্ধ নজরে ভেসে বেড়ায় তার।সেদিন বিকালের সেই ফিকে পড়া সূর্যের আলোতে কালোপোশাকে আবৃত এক মায়াহরিনীর গোলগাল কোমল লাবন্যময়ী মুখশ্রী ।কি অদ্ভুত!যে কারনে বিহানকে সে ঠান্ডা গলায় শাসালো,সেই একই নজরে সে-ও তাে দেখেছে মেয়েটাকে।তবে তাকে শাসাবে কে?আর মেয়েটা তো তার-ও কেউ নয় তবে কোনোই বা বিহানকে শাসালো সে?বিহানের মতো সেই মায়াহরিনীকে মুগ্ধ চোখে দেখার জন্য,তারও কি শাসন প্রাপ্য নয়?হবেনা কেনো?একই অপরাধে অপরাধী দুজন,তবে কেনো একজন শাসিত হবে।কিন্তু ভিতরটা কেনো বলছে ভিন্ন কথা!বিহানতো খারাপ নজরে মেয়েটাকে দেখেনি,তবে কেনো সেই মুগ্ধ নজরে তাকানোটা ঠিকঠাক লাগেনি তার?শান্ত থাকতে চেয়ে-ও মানতে পারিনি সে।হঠাৎ কি শুরু হলো এগুলো তার সাথে?কি?

‘আসবো?

কোনো সাড়া এলোনা ভিতর থেকে।কপাল কুঞ্চিত হলো তৃনয়ের।এতো কি ভাবনাতে ডুবে আছে ছেলেটা,যে তার ডাকটা অব্দি কান পর্যন্ত পৌঁছালো না।নিভান এত মনোযোগী হয়ে কি ভাবনায় ডুবে আছে।আশ্চর্য!

‘এই নিভান আসবো?

সচকিত হলো নিভান।চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলো চেয়ারে।—তোকে বারবার কেনো উহ্য করে বলতে হয়, আমার কেবিনে আসার জন্য তোর অনুমতি প্রয়োজন নেই।

‘অফিসিয়াল রুলস বলে কথা।সেটাতো আর অগ্রাহ্যতা করা যায়না।রুলস্ তো সবার জন্য সমান।তাই না?

‘সেই অফিসের কোনো স্টাফ নোস তুই।আর না কোনো কোম্পানির কন্ট্রাক্ট ডিলার।আমার কাছের মানুষগুলোর আমার কাছে আসার জন্য কখনো তাদের অনুমতির প্রয়োজন নেই।

‘তা এমন কোন কাছের মানুষের কথা ভাবছিলি,যে আমার ডাকটা পর্যন্ত নিভান আওসাফ আহমেদ এর সেই ভাবনা ভেদ করে তার কর্নদ্বয় অব্দি পৌছালো না?

দুষ্ট হেঁসে কৌতুক গলায় কথাটা বলে চেয়ারে গা এলিয়ে
দিয়ে নিভানের মুখের দিকে উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইলো তৃনয়।যদিও অপরপক্ষের ছেলেটার থেকে উত্তর পাবে এই আশাটা রাখে-না সে।তৃনয়ের ভাবানমতো সত্যিই উত্তর দিলো না নিভান।বরং অফিসের পিয়নকে ডেকে কফির অর্ডার করলো।পিয়ন চলে যেতেই তৃনয়কে উদ্দেশ্য করে বললো।

‘হঠাৎ আমার অফিসে?সহজে তো পা পড়ে-না এখানে?কিজন্য এসেছিস?

তৃনয় জানতো উত্তর পাবেনা। তাই সেদিকে সে-ও আর এগোলা না।তবে নিভানের বলা কথাগুলো কানে যেতেই চেয়ারের হেডে মাথা এলিয়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো— তন্ময়ীর বিয়ে ঠিক হয়েছে।সেটাই বলতে আসলাম তোকে?

‘হঠাৎ?অনার্সটা তো কমপ্লিট করতে দে।তারপর না-হয় ওর বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবিস।

‘জানিসইতো,আম্মা আমাদের দুভাইবোনের অভিভাবক সম্বল।সবকিছু।হয়তো প্রতিটি সন্তানের ক্ষেত্রে মায়ের অবদান অতুলনীয়।তবে বাবা মারা যাওয়ার পর সেই মা,বাবা মায়ের দুজনেরই অবদান রেখেছেন বর্ননাহীন।নিজে চোখে দেখে এসেছি তো,বাবা মারা যাওয়ার পর আমাদের দুই-ভাইবোন-কে আঁকড়ে কিভাবে বেঁচে আছেন আম্মা।আমাদের সবদিকের যথাযথ খেয়াল রেখে প্রয়োজন অপ্রয়োজন সকল আশা আকাঙ্খা মিটিয়ে কি-করে মানুষের মতো মানুষ করার চেষ্টা করেছেন।মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখিয়েছেন।সেই মায়ের সিদ্ধান্ত কখনো অমান্য করার চেষ্টা করেনি।তন্ময়ী-ও কখনো করিনি।হঠাৎ বিয়ের এই সিদ্ধান্তে ওর একটু মন খারাপ হলে-ও,মায়ের সিদ্ধান্তে অমত পোষন করেনি।তন্ময়ীকে আমি ঠিক কিরূপ ভালোবাসী।সেটা তো তুইও জানিস।আমিও তোর মতো চেয়েছিলাম,আর ভেবেছিলামও,এতো তাড়াতাড়ি ও-কে পর কর দেবো না।তবে মা যখন চাইছেন আমি-ও না করবো কিকরে বল?যদি-ও আমি না করেছিলাম।আম্মাকে বললাম– এতো তাড়াহুড়োর কি দরকার?পড়াশোনাটা আপতত কমপ্লিট করে নিক।তারপর না হয় ওর বিয়ের কথা ভেবে দেখা যাবে।মা আমার কথাতে রাজী হতে চাইছে না।বলছে,ভালো পাত্র,হাতছাড়া করা ঠিক হবে-না।আর এখনকার যুগে খুঁজে খুঁজে যোগ্য পাত্র মেলাও ভার।তা বাদেও মেয়েদের বয়স হয়ে গেলে,সঠিক পাত্র পাওয়াও মুশকিল হয়ে যায়।সঠিক বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া উচিত।এই কতশত কথা।মায়েদের ভাবনা বুঝিসই তো।
আর ছেলের ডিটেইলস সম্পর্কে খোঁজ খবর তো নিলাম।সবদিকে থেকে ভালোই তো মনেহলো।

‘আন্টি যখন ভালো ভেবেছেন,তবে নিশ্চয় চিন্তা ভাবনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।আর তন্ময়ী অ্যাডাল্ট, ও যখন মতামত দিয়েছে।তবে আর না করার কি আছে!যদি-ও খোঁজখবর নিয়েছিস,তবু-ও আর-ও একটু ভালোভাবে খোঁজখবর নিয়ে তারপর বিয়ের মতো সিদ্ধান্তে যাবার চিন্তাভাবনা করিস।এটা কিন্তু শুধু একটা মেয়ের ভবিষ্যতের চিন্তা নয়।তোর আমার একেকটা জান কলিজার ভবিষ্যত।সেখানে ওরা ভালো থাকলেই তবে আমাদের শান্তি।

তৃনয় কথা বললো-না।শুধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।ফের চেয়ারে এলানো মাথাটা আরও শক্তকরে চেয়ারে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে নিলো।ওই শান্তশিষ্ট মায়াবী মিষ্টি চেহারার আদরের বোনটাকে তার পর করে দিতে হবে?ভাবতেই ক্ষনে ক্ষনে বুকের ভিতরটা ছলাৎ করে উঠছে তার।বাবা ছিলো না বিধায় ছোটো থেকে ওই বোনটাকে যে খুব যত্নে আগলে মানুষ করেছে সে।

‘এই তৃন?

ছেলেটার মন খারাপ হলেই নিভানের সঙ্গ খোঁজে।আজ হয়তো সেই সঙ্গটাও মন খারাপটাকে বিতাড়িত করতে পারছে-না।সেটা বুঝে তৃনয়কে ডাকতেই চোখ মেলালো সে।তন্ময়ীর জন্য যে ছেলে দেখা হয়েছে তার সম্পর্কে এবং তার ফ্যামিলি সম্পর্কে ডিটেইলসে জানতে কথা বাড়ালো নিভান।কথার মধ্যে থাকলে হয়তো ছেলেটার মন খারাপটা দীর্ঘ হবে-না।সেটা ভেবেই মুলত কথা বাড়ানো নিভানপর।একপর্যায়ে কফি নিয়ে এলো পিয়ন।কফিটা পান করতেকরতে দুই-বন্ধুর কথা আরও জমে উঠলো।

বেডে হেলান দিয়ে খুব মনোযোগ সহকারে বই পড়ছেন জাহিদ সাহেব।বই পড়ার অভ্যাসটা উনার আগে খুব বেশি একটা ছিলো না।বলতে গেলে,ব্যবসায়ী কাজের জন্য পড়ার সময়ই পেতেন না।অসুস্থ হওয়ার পর থেকে এই পড়ার অভ্যাসটা হয়েছে উনার।এখন সারাদিন নামাজ কালাম তসবিহ তাহলীল ছাড়া সারাদিনের সঙ্গী হলো বই।আসরের নামাজটা পড়ে বিকালের চা নাস্তা নিয়ে স্বামীর খেদমতে হাজির হলেন নীহারিকা বেগম।নীহারিকা বেগমের উপস্থিতি বুঝতে পেরে বইটা হাত থেকে বেডের একপাশে রাখলেন জাহিদ সাহেব।যতো প্রয়োজনীয় কাজ আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হোক এই নারাীটাকে তিনি কেনো জানি উপেক্ষা করতে পারেন না।কতো বছরের সংসার উনাদের।অথচ যতোবার স্ত্রী নামক নারীটার পদচারণ এই রুমে পড়ে তিনি সব উপেক্ষা করে নারীটাতেই মন দেন।

‘নিন,আপনার চা।

চায়ের কাপটা হাতে নিলেন জাহিদ সাহেব।চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার আগে জিজ্ঞেস করলেন।

‘আজ এক কাপ চা?তোমারটা কোথায়?

‘দুপুরের খাবারটা আজ অসময়ে খাওয়া হয়েছে।তাই চা টা আর এসময়ে খেতে ইচ্ছে করলোনা।

কথা বাড়ালেন না জাহিদ সাহেব।চায়ের কাপে ছোটো ছোটো চুমুর দিতে থাকলেন।সাথে একটুকরো বিস্কিট ও নিলেন।সেদিকে কিছুসময় নীরবে তাকিয়ে থেকে কথা পাড়লেন। বললেন–মেয়েটার দু’মাস বাদে ফাইনাল পরিক্ষা।কলেজ যাওয়ার একটা ব্যবস্থা করা উচিত নয় কি?

‘কার কথা বলছো?কৌড়ির?

‘হুমম।

জাহিদ সাহেব ভাবান্বিত হলেন।সময় নিয়ে কিছুসময় ভাবলেনও।ফের বললেন—ব্যবস্থা তো করা উচিত।তবে এই পরীক্ষার দু’মাস আগে কলেজ কতৃপক্ষ কোনো বহিরাগত স্টুডেন্ট এলাও করবে কি-না।এটাও চিন্তার বিষয়।

ফের জাহিদ সাহেব কিছু ভাবলেন।বললেন–তবে আমি দেখছি।রাতে শাহেদ বাড়িতে আসলে আমার সাথে একবার জরুরীভাবে দেখা করতে বোলো তাকে।

‘ঠিক আছে।

সম্মতি জানিয়ে ফের নীহারিকা বেগম বললেন।-আমিও তাই ভাবছিলাম।মৌনতার স্কুল এন্ড কলেজের যে প্রিন্সিপাল,উনার সাথে শাহেদের তো বেশ সখ্যতা আছে।সম্পর্কে মৌনতার নানুবাড়ির দিক থেকে আত্নীয় ও হয়।আপতত পরিক্ষার আগ অব্দি মেয়েটাকে একটু ক্লাস করার ব্যবস্থা করে দিলেই হচ্ছে।মেয়েটা মনেহয় আবার সাইন্সের স্টুডেন্ট।

‘হুম।আহসান বলেছিলো মেয়েকে ডাক্তারী পড়াবে।সেই হিসাবেই এগিয়েছে।আর সেদিন ওর কাগজপত্রগুলো তো দেখলাম।ক্লাস ফাইভ, এইট,এস এস সি।হাই কোয়ালিটি রেজাল্ট।সবগুলোতে গোল্ডেন এ প্লাস।

‘হুমম।

দু’জনে মিলে কৌড়িকে নিয়ে ভালোমন্দ বেশ টুকিটাকি আলোচনা করতে থাকলেন।কীভাবে বাাবা মা মরা মেয়েটাকে নিজের সন্তানদের মতো, তার স্বপ্নের পথের দিকে এগিয়ে দেওয়া যায়।

রাতে শাহেদ সাহেব বাড়িতে এলে কৌড়ির বিষয়ে উনার সাথে আলোচনা করলেন জাহিদ সাহেব।আলোচনার একপর্যায়ে শাহেদ সাহেব বললেন।তিনি মৌনতার স্কুলের প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলে কৌড়িকে কলেজে ক্লাস করার জন্য ব্যবস্থা করে দেবেন।নিশ্চিত হলেন জাহিদ সাহেব।সেখান থেকে দু’দিন বাদেই কৌড়িকে নিয়ে কলেজে গিয়ে,ওর বিষয়ে কথা বলে আপতত ক্লাস করার ব্যবস্থাটা করে দিয়ে আসলেন শাহেদ সাহেব।তবে পরিক্ষাটা মেয়েটা এখানে দিতে পারবে-না।
পরিক্ষাটা, তার নিজ কলেজের রেজিষ্ট্রেশন অনুযায়ী সেখানেই দিতে হবে।


নিজের অফিস কক্ষের কাঁচের বেষ্টনীতে ঘেরা ওয়ালের সম্মুখে,দু-পকেটে হাত গুঁজে সটান দাঁড়িয়ে আছে নিভান।নজরটা তার ব্যস্ত শহরের অলিতে-গলিতে স্থির। সাততলা ভবনের উপর থেকে ব্যস্ত নগরীর ব্যস্ত যানযট আর তারচেয়ে ব্যস্ত মানুষের চলাচলের আনাগোনা দেখে চলেছে সে।বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রের বিভিন্ন পোশাকের মানুষের আনাগোনা চলছে,বাকী নেই স্কুল, কলেজ ভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের ব্যস্ত চলাচল সেখানে।এমনকি বিভিন্ন পোশাকে ভিন্ন ভিন্ন নারীর পদচারণাও। হঠাৎ নিভানের মনেহলো বাড়ির গাড়িটাও সেই ব্যস্ত চলাচলের রাস্তায় ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে।গাড়িতে কে বা কারা?আর এই অসময়ে কোথায় চলেছে?হঠাৎই আবার মনেহলো গাড়ীটা তার অফিসের পার্কিং এরিয়ার দিকে টার্ন নিচ্ছে।ব্যাপার কি?চাচ্চু আর সেতো সেই কখন অফিস চলে এসেছে।তবে অফিসে আবার কে আসলো।ইভান নাকি অন্যকেউ?ইভান তো সহজেই অফিসে পা মাড়ায় না।আর অন্য কেউ।কে?হয়তোবা প্রয়োজনে কেউ এসেছে।তবে অনেক্ক্ষণ যাবত অপেক্ষা করার পরও যখন মনেহলো,অফিসে কেউ আসেনি।ব্যাপার অন্যকিছু। নাহলে এতো সময় বাড়ি থেকে কেউ এসেছে,এটা তার কাছে ইনফর্ম হয়ে যেতো।

নিভান যে পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো,সেপাশ থেকে গাড়িটার কিছু অংশ দেখা গেলেও,গাড়ির সামনের অংশ আর গাড়িতে কারা?এটা দেখা যাচ্ছিলো না।দ্রুত পা চালিয়ে নিজের অফিস রুমের সাথে নিজস্ব কেবিনটায় চলে গেলো নিভান।সেখানে মাঝেমধ্যে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য থাকার সুব্যবস্থা করা আছে।সুব্যবস্থা করে রেখেছে নিভান।মাঝেমধ্যে এর প্রয়োজনীতা সুফল দেয় খুব।কেবিনের বিশাল বড় কাচের জানালাটার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই নিচের পার্কিং-এরিয়ার দৃশ্যবলী নজরবন্ধিতে স্পষ্ট হতেই কপাল কুঁচকে গেলো তার।গাড়ির দরজা খোলা,সেখান স্পষ্ট একটা মেয়েকে মাথা এলিয়ে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে।মেয়টা কে বুঝতে অসুবিধা হলোনা
নিভানের।প্রায় মাসের কাছাকাছি হতে চলেছে,মেয়েটা তাদের বাড়িতে এসেছে।সামনাসামনি দেখাসাক্ষাৎ কম হলেও,মেয়েটা শত দূর থেকে তার নজরে পড়লেও সে চিহ্নিত করতে পারবে মেয়েটা কে?তবে মেয়েটার কি হলো,ওভাবে বসে আছে কেনো?আর এরা এই অসময়ে এখানেই বা কি করছে?মান্যতা আর দীবা গাড়ির বাহিরে দাড়ানো।মান্যতা চিন্তিত মুখে কিছু ভেবে চলেছে আর দীবা তাকে কিছু বলে চলেছে। হাফিজ ভাই তাদের পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে কান্ড দেখছে।কোনো কারনে মন একটু বিচলিত হলো নিভানের।দ্রুত পায়ে অফিসকক্ষে গিয়ে টেবিলের উপর থেকে ফোনটা এনে পুনরায় জানালার পাশে দাঁড়ালো।কাঙ্ক্ষিত নম্বরটাতে ফোন দিতেই ওপাশের মানুষটা তথাস্তু হয়ে কিছুটা ভয়েভয়ে ফোনটা রিসিভ করলো। সে নিশ্চিত স্যার নিশ্চয় উনাদের দেখেছেন বলেই তাকেই ফোন দিচ্ছেন।
মান্যতাদের কাছ থেকে কিছুটা সরে দাঁড়ালো হাফিজ।ফের ফোন রিসিভ করেই সালাম দিলো।সালামের উত্তর দিয়েই নিভান স্বভাবমত গম্ভীর গলায় শুধালো।

‘এ্যনি প্রবলেম,হাফিজ ভাই।অফিসের নিচে কেনো আপনারা?

কি বলবে হাফিজ খুঁজে পেলোনা।এই মহিলাদের কান্ড-কারখানা তার বুঁজে আসেনা।কি যে করবে এরাই ভেবে পাচ্ছেনা তো সে কি বলবে!

‘হাফিজ ভাই।

গম্ভীর গলার ডাকটা শুনতেই মান্যতাদের দিকে একপলক তাকিয়ে তড়তড়িয়ে উত্তর দিলো।–আসলে হয়েছে কি স্যার।ওই যে নতুন মেয়েটা এসেছে না,উনার জন্য কিছু বই আর কিসব শপিংয়ের জন্য বড়ো ম্যাডাম পাঠিয়েছেন।মান্যতা ম্যাডাম আর মেয়েটা আসছিলেন। দীবা ম্যাডাম বললেন তিনিও শপিংয়ে যাবেন তাই তিনিও তাদের সাথে এসেছেন।আর..

‘আমি সবার ডিটেইলস সম্পর্কে জানতে চাইনি হাফিজ ভাই।অফিসের নিচে এতো সময় দাঁড়িয়ে আছেন কেনো সমস্যাটা কি সেটাই বলুন।

নিভানের থমথমে গলায় আওয়াজ কানে আসতেই থতমত খেয়ে সংক্ষেপে কথা ধরলো হাফিজ।বললো–

‘মেয়েটা মনেহয় আগে থেকে কোনো-কারনে অসুস্থ ছিলো।গাড়িতে উঠার পর,মাঝ রাস্তায় এসে হড়বড়িয়ে কয়েকবার বমি করে দিলো।এখন আবার এখান থেকে বাড়ি ফিরতে তো সময় লাগবে,আমারাও শপিংমলের কাছাকাছি চলে এসেছি।তাই মান্যতা ম্যাডাম চাইছিলেন,সেই কাছাকাছি এসে গেছি যখন মেয়েটাকে আপনার অফিসের শীলা ম্যাডামের কাছে আপতত রেস্টে রেখে,জিনিসগুলো কেনাকাটা করে নিতে।মেয়েটার এই অসুস্থ অবস্থায় নিয়ে শপিংয়ে তো আর ঘোরাঘোরি করা ঠিক হবেনা।আর গাড়িতে একা রেখে যাওয়াতো রিস্ক হবে, তাই।কিন্তু…

‘কিন্তু কি?

মুখটা ছোটো হয়ে এলো হাফিজের।আমতাআমতা করে বললো–দীবা ম্যাডাম চাইছেন না আপনার অফিসে মেয়েটাকে রেখে যেতে।বলছেন আপনি এসব উল্টো পাল্টা কাজের জন্য রেগে যেতে পারেন।আমাকে বলছেন উনাদের শপিংমলে রেখে মেয়েটাকে বাড়িতে দিয়ে আবার আসতে।সেটাতে তো প্রচুর দেরী হবে।আর বড় ম্যাডাম আবার বারবার করে বলে দিয়েছেন, তাদেরকে একা না ছাড়তে।মেয়েটারও যা অবস্থা!তার আপতত বিশ্রামের প্রয়োজন।খুবই ক্লান্ত মনেহচ্ছে তাকে।

দীবার বিষয়টা আমলে নিলোনা নিভান।সে যে কি কারনে মেয়েটাকে অফিসে রাখতে দিতে চাইছেনা।এটা নিভানের থেকে ভালো কে জানে।তবে মেয়েটার যা পরিস্থিতি শুনছে,মেয়েটার তো আপতত রেস্টের প্রয়োজন।তবে শিলাও তো অফিসে নেই।

‘কিন্তু শীলা তো আজ আসেনি।সে ছুটিতে আছে।

হাফিজের সাথে কথা বললেও নিভানের দৃঢ় নজর স্থির গাড়ির সিটে নির্জীব ভঙ্গিতে মাথা এলিয়ে রাখা মেয়েটার পানে।সেদিকে লক্ষ্য রেখেই গম্ভীর কন্ঠে বললো।

‘আমি নিচে আসছি।

নিচে যেতে সময় নিলোনা নিভান।হাফিজের নজরে পড়তেই সে তথাস্তু হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।স্যার নিচে আসতে চেয়েছে এ খবর সে কাওকে দেয়নি।তাই নিভানকে নজরে পড়তেই মান্যতার মুখ শুকিয়ে গেলো।
উল্টো পাল্টা কাজকর্ম দাদাভাইয়ের সহ্য হয়না,এখন কি না কি বলে বসে?যদিও দাদাভাই পরিস্থিতি বুঝে রাগারাগি করে।তবুও দাদাভাইয়ের এই দৃঢ় চোয়ালের কঠিন মুখাবয়ব নজরে পড়লেই অযথা কারনে বুক কাপে তাঁর।

নিভানকে নিচে দেখে দীবাও অবাক হলো।কিছু বলতে নেবে তার আগেই শক্ত গলায় মান্যতাকে প্রশ্ন করলো।

‘সমস্যা কি?

দৃঢ়চিত্তে এসে সটদন সামনে দাঁড়ালো শক্ত চোয়ালের মানুষটাকে একবার দেখে নিয়ে নমনীয় স্বরে মান্যতা বললো।

‘ওর হালকা মাথা ব্যথা ছিলো।মনে করেছিলাম বাহিরে আসলে ঠিক হয়ে যাবে।তাই ও না আসতে চাওয়া সত্ত্বেও,ও-কে নিয়ে এসেছি।ওর সামনে ফাইনাল পরিক্ষা তাই বইসহ ওর কিছু পোশাকও কেনা লাগতো।ও সাথে থাকলে বই পোশাক,দুটোই কিনতে সুবিধা হতো তাই মুলত নিয়ে আসা।কিন্তু ও এতো অসুস্থ হয়ে পড়বে আমি বুঝতে পারিনি।

‘ও অসুস্থ জেনেও ওকে নিয়ে আসা তোমার ঠিক হয়নি মান্য।

বিস্ময় চোখে নিভানের দিকে তাকিয়ে আছে দীবা।এ- কোন নিভানকে দেখছে সে! কৌড়ির হয়ে কথা বলছে নিভান!সম্ভব!এটা নিভানইতো?সে ভুল কাওকে দেখছে না তো?দীবার বিস্ময় আরও কঠিন রূপে বাড়িয়ে দিয়ে নিভান গমগমে গলায় মান্যতাকে আদেশ দিলো।

‘ও-কে বাহিরে আসতে বলো?

এবার মান্যতাও চোখ বড়বড় করে নিভানের দিকে তাকালো।পরপর চোখ নামিয়ে নিয়ে কৌড়ির কাছেই এগোলো।বিভিন্ন প্রশ্ন জাগলো মনে,তবে ভুলেও করলো না।গাড়ীর সিটে চোখ বুঁজে মাথা এলিয়ে রাখা মেয়েটার ক্লান্ত মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে তার ভিষন মায়া হলো।খুব করে মনেহলো,মেয়েটাকে জোর করে আনা তার একদম ঠিক হয়নি।কৌড়িকে ডাক দিতেই চোখ খুললো।একটু আগের কথোপকথোন কথন শুনেছে সে।এমনিতেই মানুষটাতে তার ভয় এবার ভয়ের সাথে সংকোচও কাজ করলো।বাহিরে গিয়ে সে ওই মানুষটার সামনে দাঁড়াবে কি করে?তাই মান্যতাকে উদ্দেশ্য করে নিচু গলায় বললো।

‘আমি আপতত ঠিক আছি আপু।উনার সামনে যেতে চাইনা,প্লিজ আপু।আমি উনাকে খারাপ ভেবে বলছি-না আপু।

কৌড়ির ভয় সংকোচের কারনটা জানে মান্যতা।সে আগেও খেয়াল করেছে দাদাভাই যেখানে থাকে কৌড়ি সহজে সেখানে যায়না।কারনটা,তাদের মতোই।ওই কঠিন মুখাবয়বের মানুষটার সামনে সহজে তারা ভয়ে কেউ পড়তে চায়না।জানে দাদাভাই ওরকম কঠিন মুখাবয়ব করে থাকলে-ও সহজে বকা রাগদ্বেষ করবে না।তবুও ওই মানুষটাকে দেখলে একটা ভয় কাজ করে।কেনো এটা তারা কেউ জানেনা!হয়তো তার কম বলা আর গম্ভীর স্বভাবের জন্য।কিন্তু এখন উপায় নেই।কথা না শুনলে দু’দিকেই বিপদ।

‘না বলো না।প্লিজ নেমে এসো কৌড়ি।তোমার আপতত বিশ্রামের প্রয়োজন।এই অবস্থায় তোমাকে নিয়ে ঘোরাঘুরি একদম ঠিক হবেনা।আম্মু জানলেও বকবে।আর দাদাভাই জেনে গিয়েছে যখন,উপায়ও নেই।তাই প্লিজ লক্ষী বোন আমার,না বলো না।এবারের মতো বাচিয়ে দাও আমাকে।

তারজন্য কেনাকাটা করতে আসা।আবার তারজন্যই তারকাছে অনুনয়। একটুও ভালো লাগলোনা কৌড়ির।সবার জন্য কেমন একটা গলায় বিঁধে থাকা কাটার মতো হয়ে গেছে সে।অন্তত নিজেকে তাই মনেহচ্ছে ইদানীং তার।দূর্বল পায়ে গাড়ি থেকে বের হলো সে।বের হতেই সামনে দাঁড়ানো উঁচু লম্বা বলিষ্ঠ দেহের কঠিন মুখাবয়বের মানুষটাকে দেখেই মুখ নিচু করে নিলো সে।

‘হাফিজ ভাই গাড়িতে উঠুন।তাড়াতাড়ি কেনাকাটা শেষ করে ওদের নিয়ে ফেরার চেষ্টা করবেন।

নিভানের গলার আদেশ পেতেই,দ্রুত পায়ে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলো হাফিজ।সেটা লক্ষ্য করেই মান্যতাকে উদ্দেশ্য করে নিভান ফের বললো।

‘মান্য গাড়িতে উঠে বসো।শপিং শেষ হলে,যাবার সময় ওকে এখান থেকে নিয়ে যেও।যাও।

কৌড়ি তড়িৎ গতিতে মুখ উচু করে মান্যতার দিকে তাকালো।মান্যতা তারদিকেই অসহায় ভঙ্গিতে আগে থেকেই তাকিয়ে ছিলো।তার মুখাবয়ব বলে দিচ্ছে, পড়েছি যমের হাতে,এখন যা বলবে তাই শুনতে হবে।দূর্বল শরীরের পা থেকে মাথা পর্যন্ত রোমে রোমে কাটা দিয়ে উঠলো কৌড়ির।তাকে এই জলদগম্ভীর ভয়ংকর মানুষটার সাথে আপতত কিছু সময়ের জন্য থাকতে হবে!এরথেকে মান্যতা আপু তাকে, এই অজানা অচেনা শহরের অলিতে-গলিতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে যেতো বা নিজে হস্তে কোনো ক্ষুধার্ত বাঘের মুখের আহার বানিয়ে দিতো।তবুও ভালো ছিলো।আল্লাহ।

গাড়ি ছাড়তেই ভাবনা কাটলো কৌড়ির।গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বের করা মান্যতার মুখটা দেখে ভিষণ কান্না পেলো তার।সত্যিই রেখে যাচ্ছে তাঁকে?গাড়িটা কিছুদূর যেতেই নিভানের কন্ঠে চমকে তার দিকে তাকিয়ে ফের মুখ নিচু করে নিলো।

‘আমি কোনো ভয়ংকর জীব নই,যে আমার সামনে এলে তোমাকে গিলে ফেলবো।চলে এসো।

চলবে….

#ফুলকৌড়ি
(১১)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

তখন মান্যতা আপুকে বলা নিচু গলায় কথাগুলো শুনে ফেলেছে লোকটা!শ্রবণশক্তি কি তুখোড়!এবার থেকে এই লোকটা আশে-পাশে থাকলে ভুলেও কথা বলবেনা কৌড়ি।না-হলে এই জলদ-গম্ভীর গলার আওয়াজে তার রূহ,শরীর ছেড়ে চিরতরে বিদায় নিতে সময় লাগবেনা।যেমনটা এখন অনুভব করছে।ওই অদ্ভুত গলার খোঁচা মারা কথা-গুলো শুনে তার হৃদপিণ্ড নিজ গতির সীমা ছাড়িয়ে চৌগুন হারে লাফালাফি করে চলেছে।লাফালাফির হারের গতিবেগ মাঝেমধ্যে এতো দ্রুত অনুভব হচ্ছে কৌড়ির,এই বুঝি বুকেরপাটা ভেঙে হৃদপিণ্ড নামক যন্ত্রটা জমিনে ছিটকে পড়লো।অবান্তর অনুভূতিতে ক্লান্ত শরীরটা আরও দূর্বল অনুভব হচ্ছে।অহেতুক ভাবনাগুলো মন মস্তিষ্ক-জুড়ে কিলবিলিয়ে বুকের ভিতরের ভয় আর শরীরের কাঁপুনিটা বাড়িয়ে দিতে চাইছে। তবু্-ও লোকটাকে অনুসরণ করেই তার পিছন পিছন যেতে হচ্ছে তাকে।আশেপাশে অনেক মানুষের পদচারণরা চোখে পড়লে-ও মাথা উঁচু করে দেখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে পোষন করলো না কৌড়ি।শরীর মন আপাতত দুটোই দূর্বল, কিছুই ভালো লাগছে না তার।শরীর চাইছে বিছানা আর মন চাইছে এই সামনে চলা ভয়ংকর মানুষটার সঙ্গ ত্যাগ করতে।তারউপর অদ্ভুত অদ্ভুত চিন্তাভাবনা,ভয়,সংকোচ মিশ্রিত মাথা-ঘোরানো অনুভূতি।সেসবের জন্য আশেপাশে তাকাতেই তার ইচ্ছে করছেনা।তাই বাধ্য হয়ে একমনে ফ্লোরের ঝকঝকা সাদা টাইলসকৃত মেঝের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধন করে তার সামনে চলা মানুষটাকে অনুসরণ করে চলেছে সে।তবে তার সামনে চলা মানুষটাকে যে,সেসব পথচারীরা বিনয়ের সাথে সালাম বিনিময় করে চলেছে।সেটা চোখে না দেখলেও কানে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে।

হঠাৎ সামনের মানুষটা থেমে যাওয়ায় তাকেও থেমে যেতে হলো।মাথা উচু করে তাকাতেই, সেই দৃঢ় চোয়ালর মানুষটাকে স্থির নজরে তারদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নজর মূহুর্তেই সরিয়ে নিলো কৌড়ি।লিফট!লিফট তার কাছে অপরিচিত কিছু নয়।চড়া হয়েছে।তবে….

‘এসো।

পা চালালো কৌড়ি।লিফটের ভিতরে গিয়েই মোটামুটি দুরত্ব বজায় রেখে শক্ত হয়ে দাঁড়ালো সে।লিফট চলতেই পুনরায় মাথাটা ঘুরে এলো তার।বমি বমি ভাবটা আবার শুরু হলো।এখন কি করবে সে?এই ভয়টাই পাচ্ছিলো! ক্লাস এইট থেকেই মাইগ্রেনের সমস্যা তার।মাথা ব্যথা শুরু হলে,কড়া পেইনকিলারেও কাজ হতে চায় না।আগে মোটামুটি হতো,তবে ইদানীং কড়া পেইনকিলারেও কাজ হয়না।একবার কোনো কারনে মাথা ব্যথা শুরু হলে,একটানা দুই -তিনদিন মাথা ব্যথায় ভুগতে হয়।তারপর গিয়ে সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে আস্তেআস্তে ব্যথা স্বাভাবিক হয়ে যায়।কড়া ঘুমের ঔষধ ছাড়া,এই ব্যথা সাধারণ ব্যাথার ঔষধে এখন আর নিষ্পত্তি হয়না।যদি-ও এই ব্যথা সহ্য পেয়ে গেছে তার।তবুও ব্যথার প্রতিক্রিয়াতো আছেই।কাল ভেজা চুল নিয়ে দুপুরে ঘুমিয়ে পড়েছিলো কৌড়ি।আর তার ফলস্বরূপ এই মাথা ব্যথার উৎপত্তি।মনে করেছিলো রাতে ঘুমের পরে ঠিক হয়ে যাবে।তবে ঠিক না হয়ে বরং সারারাত মাথা ব্যথায় ছটফট করেছে সে।মৃদু ধাক্কা দিয়ে লিফটা থেমে যেতেই আগের থেকে দ্বিগুণ হারে গা গুলিয়ে আসলো কৌড়ির।মাথা ঝিমঝিম করে উঠলো।এখন যদি আবারও বমি হয়।কি বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হবে তাঁকে?ভেবেই কান্না পেলো।দাঁতে দাত চেপে যতসম্ভব নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করলো কৌড়ি।লিফটের থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে আগে দু’জনে আগেপিছে হাঁটলেও এবার নিভানের সাথেসাথে সামনে এগোলো সে।বিশাল বড় কাঁচের দরজাটা ভেদ করে সাততলা ভবনের ভিতরে প্রবেশ করতেই মূহুর্তেই মাথা নিচু করে নিলো কৌড়ি।আচমকা কতোগুলো নজর তাদের দিকে পড়তেই আড়ষ্টতা সংকোচ আর-ও দ্বিগুণ হারে ঘীরে ধরলো তাকে।সাথে বমিবমি ভাবটা জেনো তীব্র হলো।অথচ পাশের মানুষটা কতো সাবলীল-ভাবে বড়বড় পা ফেলে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলেছে।

আর পারলো না কৌড়ি।স্টাফ রুমগুলো পার করতে না করতেই, নিভানের অফিসকক্ষের সামনে এসেই হড়হড় করে বমি করে দিলো।পা থেমে গেলো নিভানের।কপাল কিছুটা কুঞ্চিত হলো অস্বস্তিতে।ফের কৌড়ির খিঁচে নেওয়া চোখ মুখের দিকে তাকাতেই সেই কুঞ্চিত কপাল মূহুর্তেই সহজ হয়ে গেলো তার।যে জিনসটায় তার প্রচুর অস্বস্তি হয়।পারল না সেই জিনাসটা চোখের সামনে দেখে-ও মেয়েটা থেকে দূরে সরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে।দ্রুত বেগে কৌড়ির খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ালো সে।দ্বিধা সংকোচ ছাড়াই বাম হাত দিয়ে শালীনতার সাথে তাকে আঁকড়ে ধরে, ডান হাতটা তার কপালে রেখে মাথা চেপে ধরলো।রুক্ষ স্পর্শ পেতেই কেঁপে উঠলো কৌড়ির সর্বাঙ্গ।বমির মধ্যে-ও ভয়ে কেঁদে ফেললো সে।ক্লান্ত অসহায় শঙ্কিত নজরজোড়া নিয়ে তাকালো,মাথা চেপে রাখা মানুষটার পানে।যা কখনো সে আশা করে নি।সেই লজ্জাজনক পরিস্থিতিতেই পড়তে হলো তাকে।আর এতোগুলা মানুষের সামনে লজ্জিত করলো এই মানুষটাকেও।এখন মানুষটা তাকে বকবে নাকি কঠিন ধমকাবে?সেই শঙ্কা নিয়ে না চাইতেও ভয়েভয়ে তাকালো সে।কৌড়িকে তাকাতে দেখেই চোখের পলক ফেলে আশ্বস্ত করলো নিভান।মেয়েটার শরীরে কাঁপুনি বলে দিচ্ছে,নিজের কর্মকান্ডের জন্য মেয়েটা ভয়ে শঙ্কায় আছে।তাই চোখের ইশারা দ্বারা আশ্বস্ত করলো ভয় নেই, সংকোচ করো-না।যেটা হচ্ছে হতে দাও।

নিভানের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার সময় পেলো-না কৌড়ি।পেটের মধ্যে যা ছিলো,তা আর গলা দিয়ে উগরে তুলতে বাকী নেই।শেষ সম্বল হিসাবে সবুজ পিতুনিগুলোও উঠছে।মেয়েটার গলা টানা দেখে কৌড়ি কে ধরে রাখা বাম হাতের বাঁধনটা আর-ও জোরালো হলো নিভানের।পানি প্রয়োজন।পিছনে তাকাতে নজরে পড়লো কয়েকজোড়া বিস্ময়কর,অবাককরা, আশ্চর্যজনক নজর।নজরগুলো সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ভরাট গলায় হাঁক ছাড়লো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে উদ্দেশ্যে।

‘অহিদ সাহেব,কোথায় আপনি।তাড়াতাড়ি পানি নিয়ে আসুন।

অফিসের পিয়ন।তিনি কৌড়িকে বমি করতে দেখেই পানি আনতে ছুটে ছিলেন।নিভান হাক ছাড়তেই দৌড়ে পানি নিয়ে হাজির হলেন।কৌড়ির মাথা থেকে হাত সরিয়ে,হাত পাতলেন অহিদ সাহেবের সামনে।ইশারা করলেন হাতে পানি ঢালতে।ইশারা পেতেই হাতে পানি ঢলালে অহিদ সাহেব।মুঠোভর্তি পানি কৌড়ির হিজাবে এঁটে থাকা মাথায় দিয়ে, ফের আরেকমুঠো পানি নিয়ে কৌড়ির চোখমুখে ছিটিয়ে দিতেই মেয়েটা একটু স্বস্তি পেলো।গলা টানাও কমে এলো।শরীর কঠিন দূর্বলতায় ছেড়ে দিতে শুধু করলো।তবুও নিজেকে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে রাখার কঠিন প্রয়াস করলো।

‘এখন ঠিক লাগছে?

কথা বলতে পারলোনা।শুধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো কৌড়ি।সেটা দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো নিভান।ফের বললো –এটুকু হেঁটে ভিতরে যেতে পারবে?

নিভানের চোখের ইশারায় দু-কদম সামনের রুমটার দিকে তাকালো কৌড়ি।আবার-ও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো,পারবে।কৌড়ি সম্মতি জানাতেই বমিকৃত অপরিচ্ছন্ন জায়গা থেকে কৌড়িকে নিয়ে সরে দাড়ালো নিভান।সামনে এগোনোর আগে,অফিসের পিয়নকে আদেশ করলো। —জায়গাটা পরিস্কার করার ব্যবস্থা করুন, অহিদ সাহেব।

স্বভাবমত গম্ভীর গলায় কথাটা বলে সামনে এগোতে গিয়ে,কৌড়ির দিকে নজর পড়তেই কিছু একটা ভেবে ফের আদেশ ছুড়লো—আর মিস রাইসাকে একবার আমার কেবিনে জলদি আসতে বলুন।

‘জ্বি স্যার।

সম্মতি জানিয়ে সরে দাঁড়ালো অহিদ।নিভানও কৌড়িকে নিয়ে তার নিজস্ব অফিসকক্ষের ভিতরে চলে গেলো।নিভান ভেতরে ঢুকতেই বিভিন্ন বয়সী অফিস স্টাফদের চোখ ঘুরেফিরে এলো সেই,স্পেশাল অফিসকক্ষের বিশাল বড় ঘোটালে থাই গ্লাসের কাঁচের দরজা থেকে।স্যার যখন অতি সুন্দরী একটা মেয়েকে পাশাপাশি নিয়ে অফিসে ঢুকলেন,তখনই সবার নজর কেড়েছে।বেশ আশ্চর্যও হয়েছে সবাই।যে যার চাকরির বয়স অনুযায়ী কখনো দেখেনি তাদের এই দৃঢ় ব্যাক্তিত্বের স্যারের সাথে কোনো মেয়ে সঙ্গ।অফিস অথবা অফিসের বাহিরে কোথাও দেখেনি।এমনকি কানাঘুঁষা-ও কখনো শোনেনি কোনো মেয়ে সম্পর্কিত বিষয়।যেমন স্যারের গার্লফ্রেন্ড বা এই ধরনের ধনী ব্যক্তিদের যেসব বিভিন্ন মেয়ে-ঘটিত বিষয় সম্পর্কিত জানা যায়,শোনা যায়।কখনো শোনেনি কেউ।এজন্য অফিসের যে ক’জন মেয়ে স্টাফ আছে,সবাই এম-ডি স্যার মানেই ফিদা।সেই দৃঢ় ব্যাক্তিত্বের মানুষটার সাথে হঠাৎ কোনো মেয়েসঙ্গ।সবাইকে তো একটু চমকে দিলো বটেই।আর- ও চমকে দিলো,ভরা অফিসে মেয়েটাকে বমি করতে দেখেও একটুও বিরক্ত হলেন না স্যার।বরং শালীনতা সাথে আগলে নিলেন,এবং ধৈর্য্য নিয়ে শান্ত হয়ে মেয়েটার পাশে থাকলেন।নিশ্চয় মেয়েটা, স্যারের স্পেশাল কেউ।নাহলে এতো যত্ন,এতো মায়া।কৈ এরকম মায়া করে,যত্ন করে কথা বলতে তো অফিসের নারী স্টাফদের সাথে কখনো দেখা যায়নি বা যায়না স্যারকে।সবাই তো স্যারের কঠিন ব্যাক্তিত্বে আর জলদগম্ভীর গলার আদেশে তথাস্তু থাকে।

সবার জল্পনা কল্পনা শেষ হলো মিস রাইসাকে,স্যারের রুমের দিকে ছুটে যেতে দেখে।অফিসে যে ক’জন মেয়ে স্টাফ আছে,তাদের বসার জন্য আলাদা জায়গা নির্বাচন করা।অফিসে ঢুকেই সরাসরি পুরুষ স্টাফদের নজরে পড়লেও,নারী স্টাফদের সহজে নজরে পড়বে না।তাদের কেবিনগুলো আলাদা ভাবে,অফিসে ঢুকতেই উত্তর সাইডে একটু ভিতরের পানে।বিধায় এতো সময়ের কান্ড তাদের নজরে পড়েনি।তবে মিস রাইসা যখন স্যারের কেবিনে যাচ্ছেন, মেয়েটা স্যারের কে।ঠিক জানা যাবে।

নিভানের অফিস কক্ষের সামনে আসতেই নাকমুখ কুঁচকে ফেললো রাইসা।একজন ওয়ার্ডবয় অপরিচ্ছন্ন জায়গাটা পরিস্কার করছে।তবে অকাজটা করলো কে? আশেপাশে কাওকে জিজ্ঞেস করারও সময় পেলো-না।স্যার হঠাৎ কেনো ডেকেছেন?অহিদ ভাইকে জিজ্ঞেস করাও সময় পায়নি।সেখানে একসেকেন্ড দেরী হলে ওই গম্ভীর গলার ঠান্ডা হুমকি।

‘যতসম্ভব টাইম মেইনটেইন করে চলার চেষ্টা করবেন।

স্যারের উপরে ফিদা হলে-ও, তার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস তার এখনো হয়ে উঠেনি।আর হবে বলেও মন হয়না।ভাবনা স্থির রেখে দরজায় নক দিলো সে।

‘মে আই কা’মিন স্যার।

‘ইয়েস।

ভিতরে ঢুকতেই চোখজোড়া বিস্ময়ে চড়কগাছ।স্যারের রুমে মেয়ে মানুষ।ও আল্লাহ এ-কি দেখছে সে।মাথা চেপে চেয়ারে বসা মেয়েটাকে লক্ষ্য করলো রাইসা।গাঢ় নেভিব্লু কালারের সাথে সাদা মিশ্রনে একটা গোল ফ্রক জাতীয় জামা পরা।সাথে চুড়িদার।নেভিব্লু ওড়নাটা, দুকাধে সেফটিপিন দিয়ে আটকে গায়ে জড়ানো।মাথাটা সাদা হিজাবে মুড়ানো।মাথায় হাত চেপে রাখায় মেয়েটার মুখটা দেখা যাচ্ছে না।তবে হাতের খোলা অংশ বলে দিচ্ছে মেয়েটার গায়ের রঙটা মারাত্মক চকচকে ফর্সা।

‘আশেপাশের কোনো শপিং কর্নার থেকে ওনার একটা রেডিমেট যেকোনো ড্রেসের ব্যবস্থা করুন।

হুঁশে ফিরলো রাইসা।মেয়েটার কাছাকাছি দাড়ানো নিভানের মুখের দিকে তাকিয়ে ফের কৌড়ির দিকে তাকালো সে।মাথায় প্রশ্নেরা ভিড় করেছে,মনে কৌতুহল জমেছে গাদাখানিক।তবে প্রশ্ন করাতো তাকে সাঝেনা।তাই চাইলেও করতে পারলো না।প্রশ্ন,কৌতুহল সব চেপে সম্মতি জানালো সে।মুখে বললো–জ্বি স্যার,আমি ব্যবস্থা করছি।

পা ঘুরিয়ে-ও কৌতুহলী নজরে কৌড়ির পানে একবার চাইলো সে।মুখ ঘুরিয়ে যেতে নিতেই শুনতে পেলো, মেয়েটাকে ঘীরে স্যারের নম্র আচারন।

‘চোখেমুখে পানি দিলে একটু বেটার ফিল করতে।আর এমনতেই তোমার ওয়াশরুমে যাওয়া উচিত,জামা চুড়িদার নষ্ট হয়ে গেছে।

মেয়েটাকে ঘীরে তাদের দেখা দৃঢ় স্বভাবের ব্যাক্তিটার এতে নম্র আচারন।আরও কৌতুহলী করে তুললো রইসাকে।মেয়েটা স্যারের কে খুব জানতে ইচ্ছে করলো।তবে পারলো না।এমডি স্যারের অফিসকক্ষ থেকে বের হতেই অনেকেই কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেসও করে ফেললো।মেয়েটা স্যারের কে?আর তাকে কিজন্য ডাকা হয়েছিলো?তাকে কিজন্য ডাকা হয়েছিলো,এটা বলতে পারলেও, মেয়েটা স্যারের কে?এটা বলতে পারলো না।তবে রাইসার মন বলছে,মেয়েটা স্যারের বিশেষ কেউ।নাহলে এতো মুগ্ধ চাহুনি নিয়ে,তাদের দেখা দৃঢ় স্বভাবের মানুষটা কিকরে একটা মেয়ে মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে!সে মেয়ে মানুষ, পুরুষ মানুষের চাহুনির তফাৎটা বোঝে।স্যার যেভাবে গাঢ় দৃষ্টি ফেলে মেয়েটার দিকে মায়ামায়া নজরে তাকিয়ে ছিলো।নিশ্চিত মেয়েটা স্যারের অতি কাছের কেউ।


মাথাটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে কৌড়ির।আশেপাশে
কে আছে,কি হচ্ছে দেখতে, শুনতে,জানতে কিছুই ইচ্ছে করলো না।তবে মেয়েটার সাথে নিভানের কথপোকথন সে শুনেছে।মেয়েটা চলে যেতেই, তাকে উদ্দেশ্যে বলা কথাগুলো শুনতেই এবার অস্বস্তিতে গা ঝাড়া দিয়ে উঠলো তার।কি একটা পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে সে,না পারছে সহ্য করতে আর না পারছে এই অস্বস্তিকর পরিবেশ ছেড়ে পালাতে।নিজের উপর চরম বিরক্তিতে চোখমুখ তেঁতো হয়ে এলো তার।এমনিতেই পাশে দাড়িয়ে থাকা মানুষটা মানেই আতঙ্ক ভয়,তারউপর বদ্ধ একই রুমে দু’জনে।ভয় লজ্জা সংকোচ সবমিলে কি যে দাবানল হচ্ছে তারমধ্য শুধু সেইই জানে।।নিভান হয়তো বুঝলো।

‘এভাবে থাকলে তোমারই অস্বস্তি বাড়বে।তখন আবার-ও বমিভাব পুনরাবৃত্তি হতে পারে।

এমনিতেই প্রচন্ড অস্বস্তি লাগছে।ওয়াশরুমে যাওয়া খুব প্রয়োজন।তবে ভয়ে লজ্জায় কিছুতেই জড়তা কাটিয়ে উঠতে পারছেনা কৌড়ি।তবে আর কতো মানুষের জ্বালা আর বিরক্তর কারন হবে সে?সবার কাছে জেনো না চাইতে-ও কাঁধে নেওয়া বাড়তি ঝামেলা আর বিরক্ততা সে।উঠে দাড়ালো কৌড়ি।সে উঠে দাঁড়াতেই ওয়াশরুম দেখিয়ে দিলো নিভান।মাথা নিচুকরে সেদিকে এগোলো সে।বেশ কিছুসময় সেদিকে নীরব চেয়ে থেকে নিজের দিকে তাকালো নিভান।মেয়েটা মাথা নিচু করে বমি করায় তার প্যান্টের নিচের দিকে-ও কিছুটা ছিটকে লেগেছে।চেঞ্জ না করলে নিজেরই অস্বস্তিতে ভুগতে হবে।অফিসকক্ষ সাথে লাগোয়া কেবিনের দিকে এগোলো নিভান।সেখানে রাখা কেবিনেট থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে, নিজেকে চেঞ্জ করে নিলো।বাহির এসে দেখলো কৌড়ি এখনো বের হয়নি।নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলো নিভান।সেখান থেকে কিছুসময় বাদেই ফের দরজায় নক পড়লো।

‘আসুন

রাইসা ভিতরে ঢুকলো।হাতে তার একটা শপিং ব্যাগ।রাইসাকে দেখে নিভান উঠে দাঁড়ালো।রাইসাকে উদ্দেশ্য করে বললো–আমি বাহিরে যাচ্ছি।ও ওয়াশরুমে আছে, ওকে একটু হেল্প করুন।

আদেশ পেতেই সম্মতি জানিয়ে, ওয়াশরুমের দিকে এগোলো রাইসা।মেয়েটাকে দেখার জানার আরেকটা সুযোগ পেয়েছে সে,সুযোগ পেতেই সম্মতি জানালো।এতো আকর্ষণ সে দেখাতোনা,তবে কঠিন ব্যাক্তিত্বের ক্র্যাশিত বসের জন্য মেয়েটাকে জানায়,দেখার আকর্ষণ মনে ভরপুর দোলা খাচ্ছে।ওয়াশরুমের দরজায় নক করতে গিয়ে,মনেহলো কি বলে নক করবে?নিভান বড়বড় পা ফেলে বাহিরে চলে যেতে গিয়েও দরজায় দাঁড়িয়ে পড়লো।পিছে ফিরে তাকাতেই তার ধারনা ঠিক হলো।রাইসা ওয়াশরুমের দরজা নক করতে গিয়েও থেমে দাঁড়িয়ে আছে।

‘ওর নাম কাশফিয়া।

ইচ্ছে করেই কৌড়ি নামটা বললোনা নিভান।চলে গেলো।মনেমনে দু’বার নামটা আওড়িয়ে ওয়াশরুমের দরজার নামধরে নক করলো রাইসা।সময় নিয়ে দরজা খুলতেই নজরে পড়লো কৌড়ির শোভিত সুন্দর মুখখানা।মুগ্ধ নয়নে চেয়ে রইলো কিয়াদক্ষন।নিঃসন্দেহে অতি সুন্দরী মেয়েটা।একনজরে যে কারও নজর মুগ্ধ হতে বাধ্য হবে।রাইসা নিজে-ও কম সুন্দরী নয়।তবে সামনে দাঁড়ানো লাবন্যময়ী নারী চেহারার কাছে সেই সৌন্দর্য কম মনেহলো।অথচ মেয়েটা ক্লান্ত, অসুস্থ দেখা যাচ্ছে।সেই মলিন মুখেও অদ্ভুত মায়ামায়া ভাব।স্যারের কি হতে পারে মেয়টা?গার্লফ্রেন্ড!এতো ছোটো মেয়ে।বয়সে তার তুলনায় বেশ ছোটো বলে মনেহচ্চে।যাই হোক,পরে জেনে নেওয়া যাবে।তবে মেয়েটাকে কি বলে সম্বোধন করবে।স্যারের স্পেশাল কেউ বলেই তো মনেহচ্ছে,তুমি করে বললে আবার কিছু মনে করে কি-না? আবার আপনি বলতেও দ্বিধা হচ্ছে।মেয়েটা তার অনেক ছোটো বলে। অতশত ভেবে যখন উত্তর মিললোনা,ভাবনা সেখানে ক্ষান্ত রেখে রাইসা বললো।

‘বয়সে আমার তুলনায় বেশ ছোটো মনেহচ্ছে।তুমি করে বলি।

ঘনঘন কয়েকবার বমি করায় গলা চিরে গেছে কৌড়ির।কথা বলতে ভিষন কষ্ট হচ্ছে।তবুও নমনীয় গলায় বললো–জ্বি।আপনি আমাকে তুমি করেই বলুন।আমি আপনার বয়সের ছোটোই হবো।

কৌড়ির ব্যবহারে খুশিই হলো রাইসা।শপিং ব্যাগটা কৌড়ির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো–এটাতে ড্রেস আছে তোমার।পারফেক্ট ফিট না হতে পারে।তবুও মানিয়ে নিও।

‘আচ্ছা।

মিষ্টি হাসালো রাইসা।মেয়েটা শান্তশিষ্ট স্বভাবের মনে হলো তার।এখনকার মেয়েদের মতো অতি চঞ্চল আর বাঁচাল নয়।বললো।

‘আমি ভিতরে আসবো?হেল্প লাগবে তোমার?

একটু ইতঃস্তত হয়ে কৌড়ি বললো-আমি পারবো আপু। আপনি শুধু একটু বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকলেই হবে।

মিষ্টি হেসে ফের রাইসা বললো–আচ্ছা ঠিক আছে।

শরীর প্রচন্ড দূর্বল লাগছে।চোখেমুখে ঘনঘন পানি দেওয়ার পর একটু ভালো লাগছে।তবুও ক্লান্ত দেহটা জেনো বিছানা চাইছে।জামাকাপড় পাল্টাতে ইচ্ছে করলো না, সত্যি বলতে হাত চলতে চাইছে-না।তবু-ও নোংরা জামাকাপড় বদলাতে তো হবেই।বদলানোর সুযোগ করে দিয়েছে মানুষটা এটাইতো অনেক।নাহলে তো নিজেকেই অস্বস্তিতে থাকতে হতো আর নিজের জন্য অন্যকেও অস্বস্তির মধ্যে পড়তে হতো।আর-ও এখানে কতক্ষণ থাকতে হবে কে জানে।দূর্বল হাতে কোনোরকম জামাকাপড় পাল্টে নিলো কৌড়ি।নতুন পরিহিত পোশাকগুলো শরীরে বেশ ঢোলাঢুলাই হয়েছে। তবু-ও চলবে।এখন আর এসব ভালো লাগছেনা তার।তবে নিজের পোশাকগুলো কি করবে এখন?ভেবে কুল না পেয়ে দরজা খুললো।বাহিরেও একজন তারজন্য দাড়িয়ে অপেক্ষা করছে,সেটা ভেবেই বাহিরে আসতে বাধ্য হলো।কৌড়ি বাহিরে বের হতেই আবারও মিষ্টি হাসলো রাইসা।তখন যে অফিসকক্ষের সামনে মেয়েটা বমি করে ভাসিয়েছে এটা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। বুঝলো রাইসা।বললো।

‘এখন ঠিক লাগছে?

ঠিক তো মোটেই লাগছেনা।তবুও মাথা নাড়িয়ে হ্যা সম্মতি জানিয়ে।মুখে বললো–লাগছে।

‘তুমি কিছু বলবে?

কৌড়ির বারবার ওয়াশরুমের দিকে তাকাতে দেখে কথাটা বললো রাইসা।মেয়েটা বুঝতে পেরেছে দেখেই কৌড়িও বললো।—আমার জামাকাপড়গুলো ভিতরে সেগুলো কি করবো তাই বলছিলাম…

‘ওগুলো অহিদ ভাই নিয়ে গিয়ে লন্ড্রিতে দিয়ে দেবে।তারপর তোমার কাছে পৌঁছে যাবে ভেবো-না।

নিজের পছন্দমতো গাঢ় সবুজরঙা ঢিলাঢালা ড্রেসটাতে মেয়েটার বেশ লাগছে।গাঢ় সবুজের মধ্যে গায়ের ফর্সা রঙটা,রৌদ্দুরে জ্বলজ্বল করা বালির ন্যায় চিকচিক করছে।ওড়নায় মুড়িয়ে রাখা মুখটা কি সুন্দর শোভিত একখানা মুখ।মেয়েটার সৌন্দর্যে রাইসা নিজেই জেনো মুগ্ধ হয়ে গেলো।তবে তাদের স্যার কি এই সৌন্দর্যে…ভাবতে গিয়েই মনেহলো।সে কিসব উল্টাপাল্টা ভেবে চলেছে?তবে স্যারের দুটো বোনকে তো সে দেখেছে,চেনে ।এমন কি স্যারের ফুফুর মেয়ে দীবাকেও চেনে।তবে এই মেয়েটা কে?কৌতুহল আর নিজের মধ্যে দমন রাখতে পারলোনা রাইসা।প্রশ্ন করেই ফেললো।

‘তুমি স্যারের কি সম্পর্কিত হও?

দূর্বল শরীর আরও জেনো দূর্বল অনুভূত হলো এই প্রশ্নটার কারনে।আসলে তো,সে কি সম্পর্কিত হয় ওই মানুষটার?কি বলবে এখন সে?মান্যতা আপুকে সে আপু বলে ডাকে।নীহারিকা আন্টিকে বড়মা আর আঙ্কেলকে আঙ্কেল।ইভানকেও ভাইয়া বলে ডাকে।তবে ওই মানুষটাকে কখনো কিছু বলে ডাকা হয়নি।তবুও ওদের সম্পর্কিত ডাকটার খাতিরে, মানুষটাকে কি তার ভাই বলে ডাকা উচিত?ভাই!কেমন একটা বিশ্রী ভাবনা বলে মনেহলো কৌড়ির।তবে ভাই সম্পর্কিতোই তো হয়।তবে ভাবনা কেনো বিশ্রী বলে মনেহলো তার।মানুষটাকে ভয় পায় বলে তাকে ডাকতে চাইছেনা মন?নাকি….দরজায় নক পড়তেই আর ভাবা হলোনা কৌড়ির।তবে স্বস্তি পেলো সামনে দাঁড়ানো মেয়েটাকে উত্তর দিতে হলো না বলে।রাইসা-ও উত্তর না পাওয়ায় হতাশ হলো।নিভান ঢুকতেই রাইসা বের হয়ে গেলো।রাইসা বের হওয়ার আগমুহূর্তে নিভান ফের আদেশ জারী করলো।

‘অহিদ সাহেব কে আমার কেবিনে একবার আসতে বলুন।

সম্মতি জানিয়ে রাইসা বের হতেই আবার-ও অস্বস্তি ঘিরে ধরলো কৌড়িকে।কি এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে পড়েছে সে!মাবূদ, কখন যে বের হবে এই পরিস্থিতি থেকে।জীবনে শিক্ষা হয়ে গেছে,সামন্য অসুস্থ অবস্থায়ও আর কোথাও কখনো বের হবেনা।হবেই না।

‘ওপাশে একটা রুম আছে, তুমি আপতত ওখানে গিয়ে রেস্ট নিতে পারো।

নিভানের আঙুলের ইশারা পেতেই সেদিকে যাওয়ার জন্য দ্রুত পা চালালো কৌড়ি।মানুষটার সামনে থেকে দূরে থাকতে পারলে স্বস্তি,শান্তি তার।কেবিনের দোরগোড়ায় পর্দার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াতেই পিছন থেকে নিজের নামের ডাকটা শুনেই কলিজা কেঁপে উঠলো।হাত পায়ে মৃদু কম্পন ছড়িয়ে গিয়ে কাটা দিয়ে উঠলো সর্বশরীরে।এ কেমন ডাক?

কৌড়ি?

কৌড়ি থমকে যেতেই নিভান বললো।–কিছু খাবে?

তড়িৎ গতিতে মাথা নাড়িয়ে না জানিয়ে ভিতরে ঢুকলো সে।খাবার আগেই অর্ডার করে দিয়েছে নিভান।তবুও জিজ্ঞেস করলো সে।জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলো অন্য কিছু কিন্তু বলতে হলো আরেক কথা।নিজের চেয়ারে বসে পড়লো নিভান।গা এলিয়ে মাথাটা চেয়ারের হেডে রাখতেই চোখ বন্ধ করে নিলো।সেই ক্রন্দনজোড়া নজর হারিয়ে সেখানে দখল করেছে একজোড়া ডগরডগর সচ্চ চোখ,একটা মায়াবী মুখ।কি কারনে?

কেবিনের ফ্লোর কম্ফোর্ট আরামদায়ক বিছানাটায় শুতে প্রথমে কৌড়ির দ্বিধা হলেও,শরীরিক দূর্বলতায় বাধ্য হয়ে শুতে হলো তাকে।সংকোচ হয়েছিলো,তবে শরীরের দূর্বলতা,ক্লান্তি সেই সংকোচ বেশিসময় টিকিয়ে রাখতে পারিনি।আর নরম বিছানাতে,হাত পা গুটিয়ে গা এলাতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো সে।কোথায় ঘুমাচ্ছে, জায়গা যাচাই-বাছাই না করে ঘুমানো উচিত হবে কি-না।এগুলো আর মাথায় কাজ করলোনা তার।অপরিচিত মানুষ অপরিচিত জায়গা,কার উপর ভরসা রেখে ঘুমালো।এটাও চিন্তা করলো না।শুধু ক্লান্ত শরীরটা বিছানাতে দিতেই ঘুমে বিভাোর হয়ে গেলো।

সেই হাত পা গুটিয়ে গায়ে মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে ঘুমিয়ে থাকা মেয়েটাকে,নজর স্থির রেখে দেখে চলেছে নিভান।
দূর থেকে মুখটা আচ্ছন্ন।তবু-ও নিভানের সুক্ষ নজর,সেদিকে স্থির। ক্লান্ত মুখটা কি নিস্পাপ দেখাচ্ছে। এতো মুগ্ধ নজরে এরআগে কাওকে দেখেছে সে?মন বলে উঠলো।না!তবে এই মেয়েটাকে কেনো দেখে চলেছে?কতো ঘেন্না ছিলো বমি জিনিসটাতে তার।অথচ আজ একটু অস্বস্তি লাগলেও,ঘেন্না করেনি।কেনো?তার হৃদয় দখল করতে চাইছে?হৃদয়ের রানী হতে চাইছে মায়াহরিনীটা?

‘মে আই কা’মিন স্যার?

ভাবনা কাটলো।মূহুর্তেই সটান হয়ে বসলো সে।নিজের ব্যাক্তিত্বের নিদর্শন বজায় রেখে গম্ভীর গলায় বললো।

‘ইয়েস,কাম’ইন।

ভিতরে ঢুকতেই মূহুর্তেই চারিদিকে নজর ঘুরিয়ে নিয়ে এলো রাইসা।মেয়েটা কোথাও নেই।তারমানে স্যারের স্পেশাল কেবিনে।নারীমন বুঝে নিলো,মেয়েটা স্যারের বিশেষ কেউ।স্যারের পার্সোনাল এ্যাসিস্ট্যান্ট মৃদুল ভাই আপতত ক্লায়েন্টদের নিয়ে ব্যস্ত।বিধায় ফাইল পত্রের সই সাক্ষর নিয়ে তাকেই দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে।যদি-ও এই কাজ তার নয়,।মৃদুল ভাইয়ের।তিনি ব্যস্ত থাকায় তাকেই করতে হচ্ছে।ফাইলগুলো টেবিলের উপর রেখে বললো।

‘স্যার,ফাইলগুলোতে সাক্ষর দরকার।

রাইসার বিশেষ কৌতুহলী নজর খেয়াল করলেও,সেদিকে বিশেষ গুরুত্ব দিলো-না নিভান।স্বভাবমতো দৃঢ় গলায় বললো–ঠিক আছে।আমি চেইক করে সাক্ষর করে দেবো।আপনি আসুন।

এরমধ্যে আবারও দরজায় নক পড়লো।নিভানের পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট এসেছে।ছেলেটা সকাল থেকেই ব্যস্ত,নতুন ক্লায়েন্টের তদারকিতে।

‘স্যার সবকিছু কমপ্লিট।এবার উনারা আপনার সাথেই মিট করতে চাইছেন।

‘ওকে।উনাদেরকে আমার অফিস-রুমে নিয়ে আসুন।

মৃদুল চলে যেতেই রাইসাও অফিস কক্ষের বাহিরে যাবার জন্য পা বাড়ালো।কৌতুহল বশত পিছে ফিরতেই দেখতে পেলো,স্যার বড়বড় কদম ফেলে কেবিনের দিকে যাচ্ছেন।কেবিনের দরজার সামনে গিয়ে বিশাল কাঁচের দরজাটা টেনে দিয়েছেন।সাথে ভারী পর্দাগুলোও।আশ্চর্য!এতো পজেসিভ মেয়েটাকে নিয়ে স্যার।এবার নিশ্চয় নয় নিশ্চিত মেয়েটা স্যারের বিশেষই কেউ।নিভান পিছু ফেরার আগেই দ্রুত পায়ে অফিসকক্ষের দরজা খুলে বাহিরে চলে এলো সে।

রাইসা চলে গেছে বুঝতে পেরেই নিজেকে কাচের দেয়ালের সামনে স্থির করলো নিভান। ঘোলাটে কাঁচের দেয়াল ভেদ করে ওপাশের শয়নরত আবাছা নারীমূর্তিটির দিকে অবিচল নজরে চেয়ে রইলো কিছু মূহুর্ত।ফের মৃদুস্বরে আওড়ালো।

‘নারী,তুমি শুধুই ছলনাময়ী নও।যাদুকারিনী-ও বটেই।


রান্নাঘরে সন্ধ্যার চা নাস্তা বানাচ্ছিলেন নীহারিকা বেগম একাই।আপাতত সেখানে কেউ নেই।শ্বাশুড়ি মায়ের পায়ের ব্যথাটা বেড়েছ, তাই আজ্ঞা পেতেই তেল গরম করে নিয়ে রানী গেছে মালিশ করতে।স্বান্তনা আপতত বাড়িতে নেই,মা অসুস্থ তাই ছেলেকে সাথে নিয়ে বাবার বাড়িতে গেছে।বিধায় একাই রান্নাঘরে ব্যস্ত কাজে মত্ত তিনি।সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই মা’কে রান্নাঘরে দেখে সেখানে ঢুকলো ইভান।নীহারিকা বেগম দেখলেন তবে কিছু বললেন না।ইভান আরও একটু এগিয়ে গিয়ে চুলোর পাশাপাশি কেবিনেটটার উপর ঝপাৎ করে উঠে বসলো।বিরক্ততে চোখমুখ কুঁচকে ফেললেন নীহারিকা বেগম।কিঞ্চিত রাগ দেখিয়ে বললেন।

‘আমি রান্না করছি চোখে দেখিস না।শুধু নামেই বড়ো হয়েছিস।

একগাল হেসে মা’কে ভোলানোর চেষ্টা করলো ইভান।ফের বললো—আমার না তোমার সাথে খুব ইম্পর্ট্যান্ট একটা কথা আছে।

ছোটো ছেলের ইম্পর্ট্যান্ট কথা বলতে কি উনার জানা আছে।সারাদিনে মা,চাচি,ভাই বোনের পিছে লেগে থাকা যার গুরুত্বপূর্ন কাজ,তারই আবার গুরুত্বপূর্ণ কথা।তবুও তিনি শুধালেন–কি?

সেই একগাল হাসি বজায় রেখে ইভান বললো।

‘আমার না ফুলকৌড়িকে বেশ ভালোই লাগে।বলতে পারো খুব পছন্দ।

চলবে…

ফুলকৌড়ি পর্ব-৮+৯

0

#ফুলকৌড়ি
পর্ব(৮)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

নীহারিকা বেগমের দ্বিতীয় স্বামী হলেন জাহিদ সাহেব।একই শহরের একই গলির বাসিন্দা হওয়ায় চেনা পরিচিত ছিলেন উনারা।দু’জনেই বাবারা আদিসূত্রে বাসিন্দা,এই শহরের।চালচলনের শালীনতা আর স্বভাবে শান্ত থাকায়।নীহারিকাকে বেশ পছন্দ করতেন।শুধু যে স্বভাব, চালচলনে ভালো লাগতো এমনটাও নয়।নীহারিকা সেই কিশোরী বয়সে ছিলো,অনিন্দ্য সুন্দরী। তার সৌন্দর্যতাও মুগ্ধ করতো জাহিদ সাহেবকে।তবে কালভেদে নিজের অনুভূতিরগুলো কখনো, না নিজের পরিবারের কাছে প্রকাশ করতে পেরেছিলেন আর না নীহারিকাকে জানাতে পেরেছিলেন।যদিও তিনি চেয়েছিলেন পড়াশোনা শেষ করে,নীহারিকার পরিবারের কাছে বিয়ের প্রস্তাব রাখবেন।কিন্তু ভাগ্য সু-সম্পূর্ন ছিলো-না উনার।পড়াশোনার খাতিরে বাড়ির থেকে দূরে থাকায় হঠাৎ একদিন জানতে পারলেন,নীহারিকার বিয়ে হয়ে গেছে।ভালো সুশিক্ষিত উচ্চবংশীয় পাত্র পাওয়ায় অল্প বয়সে মেয়েকে পাত্রস্থ করেছেন নীহারিকার বাবা।জীবনের প্রথম ভালোলাগা মেয়েটা অন্যের জীবনসঙ্গিনী হয়ে গেছে জানতে পেরে খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন সেদিন।ব্যথিত হয়েছিলো নিজের মন।পরবর্তীতে ভাগ্য হিসাবে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।তবে উনার চাওয়ায় হয়তো পবিত্রতা ছিল।
তাই ভাগ্যক্রমে নীহারিকা আবারও উনার কাছে ফিরে এলো।দ্বিতীয়বার সুযোগ পেলেন নীহারিকাকে নিজের করে নেওয়ার।আর সেই সুযোগটা বিভিন্ন সংঘাতের মধ্যেও কোনোমতেও হাতছাড়া করেননি তিনি।

নীহারিকার বিয়ের সাতবছর পর হঠাৎই তার প্রথম স্বামী এক্সিডেন্টে মারা যান।সংসারের বিভিন্ন সংঘাত আর ঝামেলার কারনে,ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি ফিরতে হয় তাকে।বিষয়টা জানার পর জাহিদ সাহেব আর দেরী করেননি।চার ভাইয়ের মধ্যে, তিনি সবার বড় হওয়া সত্ত্বেও তখনও বিয়ে করেননি।যদিও অন্যন্য ভাইরা বিয়ে করে নিয়েছিলো।তিনি যখন ছেলেসহ- নীহারিকা বিয়ে করতে চাইলেন,বাড়ির কেউই প্রস্তাবে রাজী হলেন না।বিশেষভাবে উনার মা।সুদর্শন ছেলে উনার,কোনো দিক থেকে কম নয়।বাবার বিরাট ব্যবসাও একহাতে সামলে চলেছে।সেই ছেলের জন্য বাচ্চাসহ বিধবা বউ।তিনি মানতে নারাজ ছিলেন।তবে এক সময় ছেলের জেদের কাছে হার মেনে নীহারিকাকে মানতে রাজী হলেও,তার ছেলেকে মানতে নারাজ। কিছুতেই রাজী হলেন না।তবে জাহিদ সাহেব বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে শুনিয়ে মা’কে মানান।তবুও মায়ের নজরভঙ্গি না নীহারিকার প্রতি সন্তুষ্ট ছিলো আর না নিভানের প্রতি।পরে আস্তে আস্তে সবটা ঠিক হয়েছে।তবে কতোটা ঠিক হয়েছে এটা বিশেষ জানা নেই জাহিদ সাহেবের।হয়তো আছে,তবে প্রকাশ করতে চান-না।দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।

নীহারিকাও,উনাকে এক কথায় বিয়ে করতে রাজী হয়েছিলেন এমনটাও নয়।তাকেও বিভিন্নভাবে মানাতে হয়েছিলো।শেষমেশ বাবা ভাইদের কথায় বাধ্য হয়ে জাহিদ সাহেবকে বিয়ে করতে রাজী হয়।তবে বাধ্য হয়ে বিয়ে করলেও,পরবর্তীতে নিজেকে মানিয়ে নেয়।মেনে নিতে শুরু করেন নিজের নতুন সংসার।নীহারিকার সাথে বিয়ের বছরের মাথায় নীহারিকা অন্তঃসত্ত্বা হয়।তারপর ইভানের জন্ম।নিভান শান্ত, গম্ভীর ধরনের ছেলে বরাবর।তবে ইভানের জন্মের পর,ভাই অন্ত প্রান ছিলো তার।সময়ের সাথে সাথে সেই অন্তরঙ্গ ভাইভাই সম্পর্কটায় হঠাৎই দুরত্ব তৈরী হলো।ইভানের ক্লাস সিক্স সেভেন উঠা পর্যন্ত দু’ভাইয়ের সম্পর্ক মোটামুটি ঠিকই ছিলো।তারপর যে কি হলো,দু’ভাই হঠাৎ দু’জনের থেকে নিজেদের দূরত্ব তৈরী করে চলতে শুরু করলো।নিভান চুপচাপ থাকলেও, ইভানের কথা ছিলো।নিভানকে বাবা মা সবকাজে সবসময় প্রায়োরিটি বেশি দেয়।তাকে বেশি ভালোবাসে।শত চেয়েও, বুঝিয়েও আর সেই দুরত্ব ঘুচানো গেলোনা।তবে আগে ইভানের অভিযোগের মাত্রা সীমাহীন থাকলেও,এখন আর তাকে অভিযোগ করতে দেখা যায়না।তবু-ও, দুভাইয়ের মধ্যে সম্পর্কটায় আর উন্নতি হলো না।

‘বাবা ডেকেছিলে আমায়? আসবো?

ইভানকে ডাকতে পাঠিয়ে অতীতের ভাবনায় ডুব দিয়েছিলেন জাহিদ সাহেব।ইভানের ডাকে সেই ঘোর কাটতেই বললেন।–এসো।

‘ইভান এসে বেডের পাশে রাখা টুলটা টেনে বসলো।বাবার দিকে শান্ত দৃষ্টি বুলিয়ে বললো–শরীর কেমন যাচ্ছে তোমার?পরিক্ষার চাপে এ-কদিন খোঁজ নেওয়া হয়নি।

‘আলহামদুলিল্লাহ, এই যাচ্ছে ভালো।

কিছুসময় দু’দিকেই নীরবতা চললো।ইভানের নীরবতা বুঝে জাহিদ সাহেব মুখ খুললেন– পড়াশোনা তো আপতত শেষ।এখন কি করতে চাইছো?এবার অফিসে বসার চিন্তা ভাবনা করলে ভালো হয়-না?

জানা ছিলো ইভানের।বাবা এমনই বিষয় নিয়ে কথা বলবেন বলে,তাকে জরুরী তলবটা করেছেন।ইভানের শান্ত নজরটা এবার দৃঢ় নজরে পরিনত হলো।নির্বিকার গলায় বললো।

‘যাকে দায়িত্বটা দিয়েছো তাকেই সেই দায়িত্বটা সামলিয়ে নিতে দাও।আমি মনে করি অফিসে বিশেষ প্রয়োজন নেই আমার।প্রয়োজন যার,সে-তো সবটা সামলিয়ে আসছে,সামলিয়ে চলছে তো।নিচ্ছে-ও।তবে সেখানে আমার বিশেষ প্রয়োজনটা কোথায়?দেখছি না-তো আমি!

ইভানের কথাগুলো খারাপ নয়।তবে যাকে নিয়ে ইভান বাক্যগুলো ব্যবহার করলো,সেই সম্বোধনহীন বাক্যগুলো ঠিক মেনে নিতে পারলেন না জাহিদ সাহেব। কিছুটা কঠিন গলায় বললেন।

‘ছেলেটাতে,তোমার সমস্যা কোথায় ইভান?কেনো তার বিষয় এলে সবসময় এহেন কথাবার্তা বলে চলো?দু’ভাই তোমরা,অথচ বড় ভাইয়ের বিষয়ে আচারন কথাবার্তায় এ-কি বিরূপ ভঙ্গিমা ইভান!আমি তো ভেবেছিলাম সেই বয়সে বুদ্ধি বিবেক বিবেচনায় অপরিপক্বতা ছিলে বলে অবুঝপনা করেছো।তবে আশা রেখেছিলাম, বয়সের সাথে সাথে ম্যাচুরিটি বাড়বে,সেই অপরিপক্ক বুদ্ধি বিবেচনার পরিপক্কতা আসবে।কিন্তু তুমি-তো সবকিছু দেখেও,তোমার বিবেক বিবেচনার দুয়ার নিজ ইচ্ছেতেই বন্ধ করে রাখলে।কেনো ইভান?

‘কারনটা তো তোমাদের জানা,তোমাদের প্রায়োরিটির প্রথমে সবসময় সে।আর ভালোও বাসো বেশি তোমরা তাকে।মা হওয়ার প্রথম অনুভূতিটা নাহয় তার মধ্যেমে অনুভব করেছিলো,মা। মাকে না-হয় মা সেই প্রথম ডেকেছিলো তাই মায়ের তাকে প্রায়োরিটি দেওয়া, বেশি ভালোবাসার কারন রয়েছে।কিন্তু তোমাকে তো বাবা বলে প্রথম ডেকেছিলাম আমি। তবে কেনো মায়ের মতো তুমিও দাদাভাইকে বেশি প্রায়োরিটি দাও,বেশি ভালোবাসো।আমাকেও দাদাভাইয়ের মতো ভালোবাসাে না,কেনো?

‘এটা তোমার অত্যন্ত খুব-বাজে ভুল ধারনা ইভান।যা আমি মনে করেছিলাম,বয়স বাড়ার সাথে সাথে শুধরে যাবে।কিন্তু তুমি সেই বাজে ধারণাই মনে পুষে রেখেছো।তবে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি।তোমাদের যদি তাই মনেহয়,যে আমি নিভানকে তোমাদের সবার চেয়ে বেশি প্রায়োরিটি দেই,বেশি ভালোবাসী।তবে হ্যা তাই।প্রথম কারনটা,সে আমাকে বাবা না ডাকলেও,আমার প্রথম সন্তান।আর দ্বিতীয় কারনটা চোখে দেখা এবং জানা সত্বে-ও যদি বাবার মুখ থেকে শোনার ইচ্ছে হয় তোমার, তবে শোনো।

‘তোমার দাদি চাচাদের আর ফুফুর ভস্যমতে আমি আমার স্ত্রীর প্রথম ঘরের সন্তানকে নিয়ে বেশি মাতামাতি করি।আর আমার সন্তানদের দাবি হলো, তাদের বড়ভাইকে আমি সবসময় প্রায়োরিটি বেশি দেই।বেশি ভালোবাসি।কেনো?অর্ধাঙ্গিনীর সন্তানকে যদি নিজের ভাবা,যদি মাতামাতি হয়।তবে সেটা মাতামাতি।এই কথাগুলো কখনো আমি আমলে নেইনি।গুরুত্বপূর্ণ মনে করিনি,তাই তা নিয়ে অযথা তর্কবিতর্কে জড়াইনি।কিন্তু নিভান,ওর দোষটা কোথায় বলো-তো? বাচ্চা বয়সে বাবা হারা হয়ে যাওয়া?নাকি তার স্বভাব ব্যববহারে,তার প্রতি টান ভালোবাসা অনুভব করা?নিভান যখন এবাড়িতে এলো,তুমি ছিলেনা তখন।তবে শুনে দেখোতো,ওর কোনোপ্রকার অসংগতি আচার ব্যবহার কারও নজরে কখনো পড়েছে কি-না?ওইটুকু ছেলে কখনো এবাড়ির কারও কাছে কোনো জিনিসের আবদার,অযথা বাহানা করেছে কি-না?এমনকি আমার কাছেও না,আর না তোমার মায়ের কাছে।তোমার মা বরাবরই তার প্রয়োজন বুঝতে পেরে তবে তাকে প্রয়োজনীয় জিনিস দিতেন।সেই ছেলেটাকে ভালো না বেসে থাকতে বলছো।তোমার মা’কে বিয়ে করার পর,নিভানকে কিন্তু তোমার নানুমনিরা নিজেদের কাছে রাখতে চেয়েছিলেন।তার মাথার উপর ছাঁদের কিন্তু অভাব ছিলো-না।কিন্তু আমি চাইনি,ওরকম একটা শান্ত নিস্পাপ বাচ্চা মা ছাড়া থাকুক।মা ছাড়া বেড়ে উঠুক।মা থেকে দুরে থাকুক।তাতে যদি তোমাদেরকে আমার তোমাদের প্রাপ্য ভালোবাসা না দেওয়ার অপরাধী মনেহয়,আমি তবে অপরাধী!শাস্তি দিয়ো বাবাকে, বাবা মাথা পেতে নিবে।কি করারা আছে।

‘আর তাকে প্রায়োরিটি দেওয়ার কথা বলছো!আমি যখন সুস্থ ছিলাম,সবাই আমাকে গ্রাহ্য করতো,মানতো।কিন্তু যেই আমি এক্সিডেন্টে অসুস্থ হয়ে পড়লাম।আমার ব্যবসা ধসে পড়তে শুধু করলো।তোমার চাচারা নিজেদের তল্পি তল্পা গুছিয়ে নিয়ে কেটে পড়লেন।পিছে ফিরে তাকিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করলেন-না,আমি তাদের রক্তের সম্পর্কিত ভাই বেঁচে আছি নাকি মরে গেছি!অথচ বাবা মারা যাওয়া ভাইবোনদের নিজ শরীরকে যত্ন নেওয়ার মতো লালিত পালিত করেছি।যদিও সেটা আমার তাদের প্রতি হক ছিলো,কথাগুলো বলা উচিত নয়।তবে আমিও একজন রক্তে-মাংসে মানুষ!তাদের গুছিয়ে নেওয়া সম্পদ সব আমার পরিশ্রমের ছিলো।যদিও পিতার সম্পত্তির অধিকার সবার সমান,তবুও সেখানের কঠিন হাড়ভাঙা শ্রমটা ছিলো আমার।কোনো কিছু থেকে তাদেরতো আমি চুল পরিমাণ বঞ্চিত করিনি।তবে তারা কি করলো বিবেকহীন আর মনুষ্যত্বহীনের পরিচয় দিলো।আমি অসুস্থ দেখেও,স্বার্থপরের মতো নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত হলো।রক্তের টানটা পর্যন্ত দেখালো না।সেই ধসে পড়া ব্যবসাটা,নিজের ক্যারিয়ারের কথা বাদ দিয়ে হাল ধরলো কে?তোমার বাবার ছেলে নয় শুধু তোমার ওই মায়ের ছেলেটা।তোমাদের চিন্তা ধারায় যে তোমাদের সৎভাই।আর তাকেই প্রায়োরিটির লিস্টে প্রথম রাখা আমার অন্যায় বলছো?

‘বাবা।

ছোটোবেলায় অন্যের কথায় প্রভাবিত হয়ে আবেগপ্রবন হয়ে যে বিবেকহীন কথাগুলো বলেছে বলেছে।যতো বড় হতে শুরু করলো,নজর খুললোা।বিবেক পাল্টাতে শুরু করলো।ইভান বুঝতে পারলো,সে এতোদিন কার বিরুদ্ধে অহেতুক অভিযোগ নামা করে এসেছে।তবে তখন দু-ভাইয়ের সম্পর্কে এতো দূরত্ব চলে এসেছিলো।ইগোর কারনে,সেই দুরত্বটা আর ঘুচিয়ে উঠা হয়নি।তাই বলে,বাবার মুখে উচ্চারিত সৎভাই নামক সম্পর্কটার নাম দিয়ে দাদাভাইকে কখনো ভাবিনি,দেখিনি সে।এতো নিচু মানসিকতা তার আগে-ও ছিলোনা,আর এখন….।মাথা নিচু করে নিলো ইভান।ফের বললো।

‘আমি কিন্তু কখনো দাদাভাইকে সেই নজরে দেখিনি বাবা।আমার বরাবর অভিযোগ ছিলো,তোমাদের দাদাভাইকে বেশি ভালোবাসা নিয়ে।প্রায়োরিটি দেওয়া নিয়ে।তাই বলে এরকম কথা বলতে পারো তুমি।

‘তুমি বলোনি।কিন্তু তোমার আগের আচার ব্যবহার আর এখনের বলা কথাবার্তা গুলোতো সেরকমই ইঙ্গিত দিচ্ছে।তা না হলে একটা বিবেকবান সুশিক্ষিত ছেলে হয়ে এখনো ওসব উল্টো পাল্টা কথাবার্তা বলো কিকরে?চোখে দেখেশুনেও ভাবনাতে আসে কিকরে তোমার?তার আচারনে কখনো মনে হয়েছে,যে তোমারা তার আপন ভাইবোন নও।এবাড়ির কেউ তার রক্তের সম্পর্কিত কেউ নয়।সেই ধসে পড়া ব্যবসাটা পুনরায় দাঁড় করাতে কি পরিমান ধৈর্য্য কষ্টসাধ্য করা লেগেছে, তুমি জানো?ব্যবসায় ঢুকে দেখো,এখন সাজানো গোছানো সব।তবুও বুঝতে পারবে,কতো নিষ্ঠার সাথে কাজ করলে যে সম্মান পরিচিয়ের সাথে চলতে ফিরতে পারছো তা কতো কষ্টে অর্জিত করতে হয়।আর সেখানে নিজের পরিশ্রমটা কি পরিমান ঢালতে হয়।তা নাহলে নিজের ছোটো চাচ্চুকে জিজ্ঞেস করে দেখো,কেনো সে নিভানের সিদ্ধান্তের উপরে একটা কথা-ও বাড়ায় না।কেনো আমাদের প্রায়োরিটিতে সে প্রথম থাকে।কেনো তার সিদ্ধান্তকে বিনাবাক্যবয়ে মেনে নেওয়া হয়।

কথা শেষ করতেই বেডের হেডে মাথা এলিয়ে দিলেন জাহিদ সাহেব।ছেলেমেয়েদের সাথে কখনো জোর গলায় বা উত্তেজিত হয়ে কথা বলেননা তিনি।বরাবরই শান্তভাবে বুঝিয়ে কথা বলতে পছন্দ করেন।তবে আজ পারলেন না।কারনটা হয়তো নিজের অসুস্থতা।সময় নিয়ে নিজেকে শান্ত করলেন।ফের ধীরকন্ঠে বললেন।

‘আমার ছেলে হয়ে,তোমাকে এই কথাগুলো কখনো বোঝাতে হবে এটা তোমার থেকে আশা করেনি ইভান।আমি ভেবেছিলাম,সব ঠিক হয়ে যাবে।তবে কি বলতো আমার সন্তান হলে কিহবে,গুনটা হয়তো চাচাদের মতো….

কথা শেষ করতে চাইলেন না জাহিদ সাহেব। চোখ বুঁজে নিলেন।ইভানও এবার আশ্চর্য হয়ে বাবার মুখের দিকে চাইলো।তাকে নিয়ে বাবার ধারণা এতোটাও নিন্মে চলে গেছে।কথা বাড়ালোনা ইভান।রাগ হলো,ক্ষোভ হলো।তবে কার প্রতি তার জানা নেই।উঠে দাড়ালো সে।দরজা মুখো হতে গিয়ে দেখলো,অসহায় নজরে একজন মা দাঁড়িয়ে আছে।হয়তো তাদের বাবা ছেলের আলাপনটা শুনেছে।ভালোমন্দ কথা বলতে চেয়েও হয়তো পক্ষ নেওয়ার ভয়ে কথা বলেনি।সেই পক্ষপাতে বড় ছেলে অভিযোগ না জানালেও,ছোটো ছেলে অভিযোগ জানাতে ভুলবেনা।নজর সরিয়ে ফের বাবার বন্ধ হয়ে চোখমুখের দুই তাকালো ইভান।দৃঢ় গলায় বললো।

‘আমি ভালো ছেলে হতে চাই- না।তাই আমার পক্ষে-ও অফিসে বসা সম্ভব নয়।আর মনে হয়না সেই দক্ষতা আছে আমার,দক্ষতা অর্জন করতে চাই-ও না আমি।তাতে যদি আমাকে সেখানের সকল অর্থের অধিকার ভোগ বিলাশ থেকে বঞ্চিত হতে হয়,অসুবিধা নেই আমার।যাদের সাথে মানসিকতার তুলনা করলে এতটা নিচু মানসিকতাও আমার নয়,যদিও আমি ভালো ছেলে নয়,তবুও।বাবার রক্ত আলাদা হলেও,একই মায়ের পেট থেকে আমাদের জন্ম।দুজন মানুষ আলাদা হতেই পারি।তবে মানসিকতার শিক্ষাটা দুজনেই মায়ের থেকে পাওয়া।আর আমার মায়ের মানসিকতার শিক্ষা কখনো নিচু নয়।হতে পারেনা।

চুপ হলো ইভান।ফের বললো—আমি সামনে বি-সি-এস এর জন্য প্রিপ্রারেশন নিচ্ছি।আমি জব করতে চাই।আর তুমি আমাকে যাই বলো,আমি কখনো অফিসে বসবোনা।সেখানের কোনো লেনাদেনা বা সিদ্ধান্তে আমি কখনো নিজেকে জাহির করতে চাইনা।করবোও না।

নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়ে চলে গেলো ইভান।দরজা মাড়ানোর আগে মায়ের শান্ত মুখের দিকে একবার তাকিয়ে যেতে ভুললো-না।বাবার বুঁজে নেওয়া নজর,আর মায়ের শান্ত চাহুনি বুকের ভিতরে তীব্র ব্যথায় ছড়িয়ে দিয়েছে।সেটা মনের মধ্যে সংবরন করেই বড়বড় পা ফেলে চলে গেলো সে।


সুন্দর একটা ঝলমলে বিকাল।অথচ ইভানের মনটা সেই সুন্দর বিকালটার মতো ঝলমলে নেই,সেখানে হয়ে আছে আমাবস্যার রাতের মতো ঘুটঘুটে অন্ধকার।বাবা এখনো এরূপ আচারনে এরআগে কখনো তারসাথে কথা বলেনি।কিন্তু আজে! মন খারাপ নিয়ে ছাঁদ উঠলো ইভান।আকাশের দিকে তাকিয়ে ঘনোঘনো দীর্ঘশ্বাসই ফেললো সে।মন যেটা চায় মুখ কেনো সেটা প্রকাশে অক্ষম জানায়। এ কেমন স্বভাবে পুরুষ জাতিকে সৃষ্টি করেছেন প্রভু।অতি খুশিতে খিলখিলিয়ে হাসতে নেই।অতি দুঃখ কষ্ট শোকেতাপেও কাঁদতে নেই।পকেটে দু’হাত গুজে স্থির নজরে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম নিভান।পাশে এসে কাওকে দাঁড়াতেই সেদিকে একনজর তাকিয়ে মৃদু হাসলো।বুঝলো,ছেলেটাকে কে পাঠিয়েছে।হঠাৎ মন চঞ্চল হয়ে উঠলো।

‘ছোটো দাদাভাই তোমার মন খুব খারাপ?

নাফিমের উত্তর না দিয়ে, ঘুরে দাঁড়িয়ে হঠাৎই ওয়ালে উঠে বসলো ইভান।সেটা দেখে চোখ মোটামোটা করে নাফিম বললো—এই কি করছো,দাদাভাই? পড়ে যাবে তো!আর বড়ো দাদাভাই দেখলে কিন্তু খুব বকে দেবে।

‘তোর বড়ো দাদাভাইকে আমি ভয় পাই নাকি।তোকে এখানে কে পাঠিয়েছে বল-তো?তোর বড় দাদাভাই নয় তো?

কি উত্তর দেবে?তাকে যে পাঠিয়েছে সে তো বারবার করে তার নামটা বলতে নিষেধ করে দিয়ছে।আর তার নিষেধ তো মানতেই হবে। তবে কি বলবে এখন?নাফিম কে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বারবার ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস সরূপ ইশারা করলো ইভান।সেটা দেখে আমতা আমতা করলো নাফিম।তা দেখে হেসে দিয়ে ইভান বললো।

‘যা তো পিচ্চু,আমার গিটারটা নিয়ে আয়তো।একটু গান গাই।তোর প্রশ্ন মতে সত্যিই আমার মনটা একটু একটু খারাপ,তাই মনটা একটু ভালো করি।যা নিয়ে আয়।

ছোটো দাদাভাইয়ের গলা দুর্দান্ত।ছুট লাগালো নাফিম।মিনিট পার হলোনা,গিটার এনে হাজির হলো সে।গিটার হাতে পেতেই ধপ করে নিচে নামলো ইভান।পশ্চিম আকাশে তাকালো।সূর্যের তীর্যক রশ্মিটা কমে গিয়ে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে।তার নিভে আসা রূপটা প্রকৃতিকে অপরূপ সৌন্দর্য্যে মনোহারিত করেছে।গিটারে টুংটাং শব্দ তুললো ইভান।ফের চোখ বন্ধ করে গলা ছেড়ে গাইতে শুরু করলো।

‘এক মুঠো স্বপ্ন এসে ছুঁয়ে যায় সারাক্ষণ, চেয়ে থাকি আমি তার আশায়’
একমুঠো ইচ্ছে লুকিয়ে রাখি অন্তরে,হয়না সাজানো ভালোবাসায়।
কখনো মন হয় রোদেলা কখনো হয় মেঘলা যায় না তারে ভোলা।
কাটেনা যে বেলা একাকি একেলা, ভালোবাসার একি জ্বালা…।।

ও-হো,,, আধো আলো আধু ছায়া।বুঝিনা এ কেমন মায়া।।
কখনো মন রোদেলা কখনো হয় মেঘলা।যায় না তারে ভোলা।
কাটেনা যে বেলা একাকি একেলা ভালোবাসার এ-কি জ্বালা…।।

গানের মধ্যও,চোখবুঁজে ইভান অনুভব করতে পারলো। নাফিম বাদেও তার অন্যপাশে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে।
হাতে কফির মগ।কফির গন্ধে ঠোঁটের কোণ প্রসারিত হলো। মুখের হাসিটা আর-ও একটু চওড়া করে গলার স্বরটা এবার আরও উগরে দিলো।

খুঁজে ফিরি তারি ছবি অন্ধ মোহে ভাসি ডুবি….।।

গানের কলিটা শুরু করতেই, আপনাআপনি চোখ বন্ধ হয়ে গেলো নিভানের।বদ্ধ চোখে ভেসে উঠলো সেই ক্রন্দনরত মায়াবী আঁখি জোড়া। ভুলতে চেয়েও আরও জেনো জেঁকে ধরেছে এই চোখজোড়া তাঁকে।চোখ বন্ধ করলেই জেনো,ক্রন্দনরত চোখজোড়া তাকে ভর্ৎসনা কর বলছে,যতো যাই করো আমার থেকে তোমার ছুটকারা নেই,নেই নিস্তার।নেই মানেই কোনোমতেও নেই।চোখ খুললো নিভান।ইভানের মুখের দিকে তাকালো।ছেলেটা এখনো চোখ বন্ধ করে গেয়ে চলেছে।কি দুর্দান্ত তার গলার স্বর।চোখ ঘুরিয়ে ওয়ালের উপরে রাখা কফিটার উপর নজর ফেললো সে।কফিটা ঠান্ডা হতে বসেছে,খাবে না না-কি?আর ঠান্ডা হলেও কি,বাসি হলেও ইভান ঠিকই খেয়ে নেবে।

এক মুঠু সপ্ন এসে ছুয়ে যায় সারাক্ষণ,চেয়ে থাকি আমি তার আশায়
এক মুঠো ইচ্ছে লুকিয়ে রাখি হৃদয়ে,হয়না সাজানো ভালোবাসা।
কখনো মন রোদেলা কখনো হয় মেঘলা, যায় না তারে ভোলা।
কাটেনা যে বেলা, একাকি একেলা ভালোবাসার এ কি জ্বালা…!!

গান শেষ করেও,চোখ খুললো না ইভান।তারপাশে দাঁড়ানো মানুষটার সাথে গলায়গলায় ভাব না থাকলেও, মন খুলে কথা না বললেও,মানুষটা পাশে এসে দাঁড়ালে অদ্ভুত মনোশান্তি অনুভব হয়।অনুভব হয়,বাবার পরে তার আরও আরেকটা ছায়া দেওয়ার জন্য বটবৃক্ষ আছে।যতোই তারসাথে আড়ষ্টতার সম্পর্ক থাকুক না কেনো,সেই মানুষটা সবসময় তার ছায়া হয়ে রয়েছে, থাকবেও।চোখ খুললো ইভান।তবে ভুলেও আশেপাশে তাকালো না।ঠান্ডা হয়ে যাওয়া কফির মগটা হাতে নিয়েই এক চুমুকে সেটা শেষ করে ফেললো।কপাল কুঁচকে সেটা দেখে আবার সামনের দিকে নজর দিলো নিভান।কন্ঠে স্বাভাবিকতা বজায় রেখে বললো।

‘লাইফটা তোমার।বয়সের ম্যাচুরিটিটা-ও হয়তো এসে গেছে,তাই তোমার লাইফের বিশেষ বিশেষ সিদ্ধান্তঃগুলোও তোমার নেওয়া যথার্থ।বাবা মা কখনো তার সন্তানদের জন্য ভুল ডিসিশন নিতে পারেন না,হয়তো সময়ের চক্রে কিছুসময় সেই ডিসিশন ভুল হয়ে যায়।এটা আমার একান্ত ধারনা।তবে তোমার নেওয়া ডিসিশন যে ভুল,এটাও আমি বলছি-না।শুধু বলতে চাইছি তাদের দিকটাও একবার ভেবে দেখা উচিত।আমি তোমার স্বপ্নপূরণ বা ইচ্ছের সাথে কোনো কম্প্রোমাইজ করতে বলছিনা।তবে তাদেরকে শান্তভাবে বুঝিয়েও সবকিছুর ডিসিশন নেওয়া, তোমার ডিসিশন এর মতোই যথার্থ উচিত।

সামনের দিকে নিটোল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইভান।তবে তার কান সজাগ বড় দাদাভাইয়ের উপদেশ মুলক বানীতে।সেদিকে একপলক তাকিয়ে নিচে যাওয়ার জন্য পিছে মুড়ালো নিভান। দুকদম সামনে এগিয়ে ফের দাড়ালো সে।এবার দৃঢ় নজর ফেললো ইভানের স্বশরীরে।তখনও ইভানের নজর সামনে স্থির ।নিভান সেটা খেয়াল করে বললো।

‘আর নিজের লাইফের অর্ধাঙ্গিনী পছন্দ করাও একান্তে তোমার ডিসিশন। তাই বলে যেকোনো মেয়ে আর
যেন-তেন মেয়ে নয়।যে মেয়েটার সাথে সম্পর্কে আছো, সে মেয়েটা ভালো,মেয়ে নয়।তার একাধিক বয়ফ্রেন্ড আছে।বড়াে দাদাভাই হিসাবে সতর্ক করলাম, সিদ্ধান্ত এখন একান্ত তোমার।

তড়িৎ গতিতে পিছে ফিরলো ইভান।ততক্ষণে পা চালিয়ে সামনে এগিয়ে চলেছে নিভান।ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো ইভানের।গলা চড়িয়ে নিভানকে উদ্দেশ্য করে বললো—আই হেইট ইউ দাদাভাই।

‘আই হেইট ইউ টুহ্।

ছাঁদের দরজা পানে যেতেই ইভানের বলা বাক্যগুলো কানে পৌঁছালো নিভানের।তবু-ও পিছে মুড়লোনা সে।তবে উত্তর সরূপ একই বাক্যগুলো ইভানের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে যেতে মোটেও কার্পণ্য করলো’না সে।

.

মেয়েটার সাথে লোক দেখানো সম্পর্কে জড়িয়েছিলো ইভান।কারন যেটা ছিলো,সেটাতে সাকসেসফুল হয়েছে সে।মুখের হাসি চওড়া হলো তার।সেই খুশিতে হঠাৎই ছাঁদের কোণায় লুকিয়ে থাকা মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বললো।

‘গান শুনবে ফুলকৌড়ি।

চমকে উঠলো কৌড়ি।নাফিমকে ছাঁদের দিকে আসতে দেখে সে ছাঁদে এসেছিলো।এসে দেখে ইভানও আছে।তাই চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াচ্ছিলো।হঠাৎই সেই ভয়ংকর গলার মানুষটার ছায়া,ছাঁদের দরজায় পড়তে দেখেই ছেলেমানুষী করে ফেলেছে সে।উনাকে পাশ কাটিয়ে ভদ্র মেয়ের মতো চলে যাওয়া যেতো।কেননা কোনো কারন ছাড়াতেো আর কিছু বলতেন না তিনি।তবে পা বাড়িয়েও,মনের শঙ্কায় যেতে পারিনি সে।গা কেমন কাটা দিয়ে উঠেছিলো তার।তাই ছাঁদের অন্য পাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিলো।দরজা মুখো হয়ে মানুষটা ছাদের রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকার কারনে পরবর্তীতেও যেতে পারিনি।তবে সেই মানুষটার নজরে পড়লোনা, এই মানুষটার নজরে পড়ে গেলো স।লোকটা তো সাংঘাতিক।কৌড়ির ভাবনার মাঝেই তার সামনে এসে দাঁড়ালো ইভান।ফের উচ্ছল কন্ঠে বললো।

‘আমার মনটা আজ খুব খুব ভালো।চলো তোমাকে আরেকটা গান শোনাই।

কৌড়ি কিছু বলতে যাবে।তার আগেই ছাঁদের অন্য প্রান্ত থেকে নাফিম দৌড়ে এসে ইভানকে উদ্দেশ্যে বললো।

‘একটু আগে তুমি-না বললে তোমার মন খারাপ। এখন বলছো মনটা খুব খুব ভালো?

‘একটু আগে খারাপ ছিলো।কিন্তু এখন মনটা ওই ঝকঝকা আকাশের মতো রিফ্রেশ হয়ে গেছেরে পিচ্চু।

একটা মানুষ তাকে তার গার্লফ্রেন্ড থেকে ব্রেকাপের নিমন্ত্রণ দিয়ে গেলো।অথচ সেই মানুষটা বলছে তার মন ভিষণ ভালো এখন।একটু আগে দু-ভাই যে শব্দগুলো একে অপরের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলো।তারপরও ছেলেটা বলছে তার মন ভিষণ ভালো।কি অদ্ভুত ছেলেরে বাবাহ।দুভাই একে অপরের থেকে কেউ কম না।দু’টোই অদ্ভুত!কৌড়ির ফের ভাবনার মাঝে নাফিম বললো।

‘বড়ো দাদাভাই তোমাকে কতোগুলো বকা দেওয়া কথা শুনিয়ে গেলো তারপরও তোমার মন ভালো হয়ে গেছে বলছো?

‘তারপর তো মনটা ভালো হয়ে গেলো রে পিচ্চু।ও তুই বুঝবিনা।

সত্যিই নাফিম বুঝলো না।তবে ইভানের কঠিন কঠিন কথার মধ্যে আর যেতে চাইলোনা।তাই কৌড়িকে উদ্দেশ্য করে বললো–এই ফুলকৌড়ি তুমি কখন ছাঁদে এলে?চলো বাগানের ওদিকে যাই।

সুযোগটা চাইছিলো কৌড়ি।ইতিমধ্যে নাফিম কৌড়ির হাত ধরেছে।নাফিমের সাথে যেতে উদ্যোক্ত হতেই ইভান বললো।

‘কি ব্যাপার বলোতো ফুলকৌড়ি।তুমি দাদাভাইকে দেখে এরকম পালাই পালাই খেলছো কেনো?সকালেও দেখলাম দাদাভাইকে দেখে পালাতে,এখনো।ভয়ে নাকি সামথিং সামথিং,কোনটা?

শেষের কথাগুলো ঘনোঘনো ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল ইভান।কৌড়ি আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইলো ইভানের মুখের দিকে।এই ছেলে কিকরে বুঝলো,সে ওই লোকটা কে দেখে পালাই পালাই করছে।আর তার গতিবিধি-ও লক্ষ্য করছে ছেলেটা?তবে ভয় তো অবশ্যই।কিন্তু সামথিং সামথিং মানেটা কি?অচেনা একটা ছেলের সাথে তর্কবিতর্ক করা ঠিক মনে হলোনা বলে,পাল্টা প্রশ্ন করতে পারলোনা কৌড়ি।ইভান ফের ভ্রু নাচাতেই বললো।

‘তুমিও দাদাভাইকে ভয় পেতে শুরু করলে?

নাফিমের কথায় অসহায় নজরে তারপানে চাইলো কৌড়ি।সেটা দেখে নাফিম একগাল হেসে দিয়ে বললো- এটা কোনো ব্যাপার না।সবাই দাদাভাইকে একটু আধটু ভয় পায়।তাতে তোমার ভয় পাওয়াটা মোটেই দোষের নয়।চলো….

কৌড়ির হাত ধরে চলে নিয়ে গেল নাফিম।ইভানও আর কথা বাড়াতে চাইলো-না বলে।তবে কৌড়ির যাবার পথে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মনেমনে বললো- মাকে একটা সুপরামর্শ দেওয়া উচিত।

সময়টা সকালবেলা।বাড়ির ছেলেমেয়েগুলো খেয়েদেয়ে যে যার সময় মতো স্কুলে চলে গেছে।আজকে জাহিদ সাহেবের সপ্তাহে চেকাপ করার দিন তাই নীহারিকা বেগম উনাকে নিয়ে হসপিটালে গেছেন।ফাতেমা বেগম খাবারটা আজ রুমে খেয়েছেন।স্বান্তনা রহমানের শরীরটা খারাপ থাকায়,এখনো শুয়ে আছেন। বাড়িটা আপতত নিরিবিলি।ডায়নিং টেবিলের মধ্যেবর্তী একটা চেয়ারে বসে চুপচাপ খাবার খাচ্ছে কৌড়ি।সে আর রানীসাহেবা ছাড়া আপতত নিচে কেউ নেই।সে ডাইনিংয়ে খাচ্ছে আর রানীসাহেবা রান্নাঘরে টুকটাক কাজ করে চলেছে।খাবার মধ্যে কৌড়ির হঠাৎই মনে হলো তার অপর পাশের সামনের চেয়াটায় এসে কেউ বসেছে।একটা কড়া মিষ্টি সুবাস নাকে এসে ঠেকতেই,কিছুটা হলেও অনুভব করতে পারলো মানুষটা কে।হঠাৎই খাবার গলায় আঁটকে গেলো কৌড়ির।ভুলেও মুখ উঁচু করে তাকালো না সে।তবে গলায় আটকে থাকা খাবারটা বিষমে পরনিত হলো সামনে বসা মানুষটার গম্ভীর গলার স্বরে।

‘রানীসাহেবা আমাকে এককাপ কফি দিয়েন তো।

ব্যাস।সামন্য এক লাইনের স্বাভাবিক কথা।কৌড়ির বিষম লাগার কারন নাহলেও,ভয়ে হোক বা সংকোচে বিষম লেগে গেলো তার।তবু্ও মাথা উঁচু করলোনা,মাথা নিচু রেখেই কেশে গেলো।আশ্চর্য হয়ে মাথানিচু করে থাকা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলো নিভান।ড্রয়িংরুম থেকে ডায়নিং টেবিল ফাঁকা দেখে সে ডায়নিংয়ের দিকে এসেছিলো।তখন কৌড়িকে খেয়াল না করলেও কাছে আসতেই বুঝতে পেরেছিলো।চুপচাপ নিঃশব্দে একটা মেয়ে ডায়নিংয়ে বসে খাচ্ছে।সেটা দেখে চলে যেতে চেয়েছিলো,তবে বিষয়টা কেমন দেখায় তাই আর চলে যায়নি।নিঃশব্দে এসে ডায়নিংয়ে বসেছে।আর মেয়েটাও তো স্বাভাবিক ভাবে খাচ্ছিলো।তবে হঠাৎ কি এমন হলো,যে বিষম খেতে হলো?খাওয়ার ধরনও তো তাড়াহুড়ো নয়।আস্তেআস্তে।তবে বিষম খাওয়ার কারন কি?

‘রানিসাহেবা।জলদি এদিকে আসুন।

কৌড়ির বিষম কানে যেতেই ডায়নিংয়ে আসছিলো রানী।শুধু ভীমের ফ্যানাতে ভরা হাতটা ধুতে যেটুকু সময় লেগেছে।তার আগেই নিভানের ডাকে ছুটে এলো সে।রানী কাছে আসতেই, পানি ভর্তি গ্লাসটা তার দিকে এগিয়ে দিলো নিভান।ফের বললো।—পানি খেতে দিন তাকে।

আগের দিনের মতো হয়নি।অল্পতে বিষম ছেড়ে গেলো কৌড়ির।তবে বিষম লাগায় গলাবুক জ্বলে যাওয়ার সাথে সাথে চোখ দিয়ে অনর্গল পানিও বের হয়ে গেলো তার।মুখ উচু করে পানি খেতে গিয়ে সেই নজরে একবার নজর পড়লো নিভানের।সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে নিলো কৌড়ি।পানি খেয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো।সঙ্গে মনেমনে নিজের প্রতি নিজেই বিরক্ত হলো।কারও গলার স্বর গম্ভীর হতেই পারে,তারজন্য বিষম খাওয়ার কোনো মানে হয়!গম্ভীর গলার স্বরতো তো তার বাবারও ছিলো,তবে এতোটাও ভয়ংকর নয়।কৌড়ির বিষম ছেড়ে দিতেই রানীসাহেবা ফের রান্নাঘরে যেতে উদ্যোগী হলেন।

‘নিভান বাবা,আমি চুলোয় দুধ বসিয়ে দিয়ে এসেছি।এক মিনিট দেরী করো,তোমার কফি দিচ্ছি।

হঠাৎই কফি খাওয়ার মুডটা জেনো নষ্ট হয়ে গেলো নিভানের।বললো–আপতত লাগবে না।আপনি কি জেন করছিলেন,সেটাই মনোযোগ দিন।

কৌড়ি মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছো।সেদিকে একপলক শান্ত নজর ফেলে চলে গেল নিভান।সেদিকে আঁড়চোখে একবার তাকিয়ে এতোক্ষণের চেপে রাখা শ্বাস,বুকে হাত দিয়ে জোরে-শোরে ছেড়ে দিলো কৌড়ি।
খেতে আর ইচ্ছে করলোনা।হঠাৎ করে ডায়নিংয়ে উদয় হলো ইভান।সে এতো সময় সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে ডায়নিংয়ের চিত্র দেখেছে।তাই বসতে বসতে বললো।

‘আজ বিষম-ও উঠে গেলো দাদাভাইকে দেখে!লক্ষ্মণ কিন্তু মোটেও ভালো বলছে না ফুলকৌড়ি।আমার কালকের প্রশ্নের উত্তর দিলে না তো।এইযে দাদাভাইকে দেখে তোমার পালাই পাালই,বিষম উঠে যাওয়া।ভয়ে নাকি সামথিং সামথিং।

এই লোকটা তার পিছনে গোয়েন্দাগিরি করছে?এ কি অদ্ভুত ঝামেলায় ফেঁসে গেলো সে।কালকের মতো ইভানকে ভ্রুু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করতে দেখে মিনমিন স্বরে মুখ খুললো কৌড়ি।

‘উনার গলার স্বর শুনলেই আমার কলিজা কেঁপে যায়।কেমন অদ্ভুত মানুষ উনি।তাই….

কথা শেষ করলোনা কৌড়ি।তবে কৌড়ির না বলা কথার অংবিশেষ বুঝে নিতে পারল ইভান।আর কৌড়ি অদ্ভুত মানুষ উনি বলতে কি বোঝালো।সেটাতে বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে,নিজের দু-হাতের কনুই সঁপে দিলো টেবিলে।ফের দুগালে দুহাত রেখে বিজ্ঞ ব্যাক্তির মতো করে বললো।

‘দেখো,আবার ওই অদ্ভুত মানুষটার প্রেমে পড়ে যেওনা জেনো।উনার আশেপাশের মেয়েরা কিন্তু ওই অদ্ভুত মানুষটাতেই পিছলে যায়।এই দেখো আমার গায়ের রঙ কতো ফর্সা অথচ ওই শ্যামবর্ণ অদ্ভুত ছেলেটাতেই সবাই মুগ্ধ হয়।ভালোবেসে ফেলে।তুমি আবার ভয় পেতে গিয়ে ডুব দিও-না জেনো,সেই অদ্ভুত মানুষটার প্রেমে।সাবধান ফুলকৌড়ি!

চলবে….

#ফুলকৌড়ি
পর্ব(৯)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

বাবার মৃত্যুর আজ পনেরো দিন পার হয়ে গেলো। কৌড়ি-ও এবাড়িতে এসেছে আজ প্রায় পনেরো দিনের মতো।নারী মানুষের জীবন কেমন অদ্ভুতময় হয়,তাই না?নির্দিষ্ট কোনো স্থানে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তাদের জীবনটা স্থায়ীত্ব হয়-না।জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নির্দিষ্ট বয়সের কিছু বছর বাবার সংসারে কাটাতে হয়।তারপর ভাগ্যের পালাক্রমে শুরু হয় স্বামীর সংসার।সেই
পর-মহলটা আপন করতে করতে,সময় এসে যায় নিজের সংসারটা ছেড়ে দেওয়ার।তারপর বৃদ্ধ বয়সে কিছুদিন এই ছেলের সংসারে তো কিছুদিন ওই ছেলের সংসারে।তবে মেয়ে মানুষের জীবনটাও একটা সময় গিয়ে একটা নির্দিষ্ট স্থানে স্থায়ীত্ব হয়,সেই স্থায়ীত্বটা কবরে গিয়েই।হয়তো সবার স্থায়ী বা শেষ ঠিকনা কবর। তবে মেয়ে মানুষেরটা বিশেষ।

সেই মেয়ে মানুষ হয়ে পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছে কৌড়ি।তার জীবনটা অন্য মেয়ে মানুষের থেকে আলাদা হয় কি করে!তবে মেয়ে মানুষের বিয়ের পর বাবার সংসার ছাড়তে হয়,কিন্তু তার তো সেই সময়টা আসার আগেই বাবা-র আশ্রয়টা ছাড়তে হলো।কি অদ্ভুত ভাগ্য।আর সেই ভাগ্য মেনে নেওয়া ছাড়া তার উপায়-ও নেই।নিতে হচ্ছে তাঁকে।এই পনেরো দিনে এবাড়িটার প্রতিটি মানুষের সাথে মিশে যেতে শুরু করেছে সে।মানুষগুলাও তেমন,ভিন্ন চরিত্র ভিন্ন স্বভাবের হলেও খুবই অমায়িক ব্যবহার।আর ভালো তো বটেই।হয়তো সে কারনেই বাবা হারিয়ে যাওয়ার শোকটা কিছুটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে সে।

তবে কৌড়ির আজ ভীষন মন খারাপ।এবাড়ির ছেলেমেয়ে গুলোকে রোজ স্কুল কলেজে যেতে দেখলেই তার ভীষন মন খারাপ হয়ে যায়।সে-ও তো বাড়িতে থাকলে,কলেজে যেতো।কলেজ অনিয়মিত করা,পড়াশোনায় হেলা করা।কৌড়ির বাবার মোটেও পছন্দ ছিলোনা।আর সেই হিসাবে কৌড়ি নিজেও কলেজ অনিয়মিত বা পড়াশোনায় হেলা করতো না।কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে আজ করতে হচ্ছে।এইস এস সি
পরিক্ষার তিনমাস বাকী থেকে, আর-ও পনেরোটা দিন কেটে গেলো।বাকী আছে মাত্র আড়াইটা মাস।অথচ সে পড়ালেখা থেকে দূরে।আদৌও তার আর পরিক্ষাটা দেওয়া হবে কি-না কে জানে!তবে বাবার সাথে সাথে তার ও যে স্বপ্ন ছিলো, সে ডাক্তার হবে।তবে?মন খারাপটা আর-ও তীব্র রূপ নিলো।সারাদিন সেই মন খারাপেই কেটে গেলো তার।মৌনতা আর মান্যতা সেটা বুঝতে বিভিন্ন প্রশ্ন করেও উত্তর মেলেনি।কৌড়ির মুখ থেকে মন খারাপের কথাটা কিছুতেই বের করতে পারি নি।না পেরে মান্যতা,মাকে গিয়ে কৌড়ির কথা বিবরণ দিয়ে ডেকে আনলো।নীহারিকা বেগম এসে ভালোমন্দ কথা বলতে থাকলেন।কৌড়ির ভিতরে কি চলছে সেটা জানার জন্য তাকে সহজ করতে লাগলেন।মা বাবা মরা মেয়ে,ভালোমন্দ বলতে,উনারাইতো এখন সব।তাছাড়া কৌড়িকে দেখে তিনি প্রথমদিনই বুঝতে পেরেছিলেন,মেয়েটা চাপা স্বভাবের।অতি প্রয়োজন ছাড়া কখনো নিজের সুবিধা অসুবিধার কথা কাওকে জানাবে না।

‘কৌড়ি,আমার মনেহচ্ছে তোমার মন খারাপ।কি হয়েছে মা?

নীহারিকা বেগমের অমায়িক আচারনে কৌড়ি নিজের ভিতরের কথাগুলো আর চাপিয়ে রাখতে পারলো না।
চাপা স্বভাবটা সরে গিয়ে,মন গলে গেলো।আবেগপ্রবণ হয়ে বলে ফেললো।

‘আন্টি, আমি পরিক্ষা দিতে চাই।

আশ্চর্য হয়ে নীহারিকা বেগম বললেন।–দেবে।এটাতে বাঁধা কে দিচ্ছে।আর অবশ্যই তুমি পরিক্ষা দেবে।এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

‘আমার পরিক্ষার আর কিছুদিন বাকি আছে আন্টি।কলেজে যাওয়া দরকার।আর কলেজ না গেলেও পড়টা তো খুবই দরকার।কিন্তু আমার তো বইখাতা বলতে আপাতত কিছুই নেই।কিভাবে পড়বো আমি?

বইখাতা কিছুই নেই,এই কথাগুলো বলতে হবে বিধায় লজ্জা পাচ্ছিলো কৌড়ি।মান্যতা মৌনতাকেও বলতে পারিনি ।এবাড়ির মানুষগুলো তাকে খেতে পরতে দিচ্ছে এটাই তো অনেক।তার উপর নিজের জন্য নিজ থেকে কিছু চাওয়া সত্যিই কৌড়ির জন্য লজ্জাকর।তাই-তো বিষয়টা নিয়ে গুমরে মরলেও কাওকে বলতে পারছিলো না।তবে নীহারিকা বেগমের কোমল আচারনের জন্য বলতে হলো তাকে।আর না বলেও উপায়!পড়াশোনাটা ছাড়া জীবনে আর কি হারাতে বাকী আছে তার।সেই পড়াশোনাটার জন্য নাহয় একটু চেষ্টা করল।নীহারিকা বেগম নিস্প্রভ নজরে কিছুসময় কৌড়ির দিকে তাকিয়ে থেকে তার সংকোচটা বুঝতে চেষ্টা করলেন।হঠাৎ নিভানের এবাড়িতে কাটানো ছোটো-বেলার কথা মনে পড়ে গেলো।উনার নিভানটাও এমন ছিলো।প্রয়োজনেও জিনিস চাইতোনা।বুঝতে পারতো সংসারটা মায়ের হলেও,সেই সংসারের আপনজন সে নয়।এতো বুঝদার ছিলো ছেলেটা।কখনো তাকে নিয়ে অহেতুক কটু কথা শুনতে হয়নি,পড়তে হয়নি কখনো কোনো দ্বিধা লজ্জায়।দীর্ঘশ্বাস ফেললেন নীহারিকা বেগম।এই মেয়েটাও সেই একই স্বভাবের বলে মনে হলো উনার।মৃদু হাসলেন।কৌড়ির মাথায় গালে নরম স্পর্শে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন।

‘এজন্য মন খারাপ?এটা কোনো বিষয় হলো,মন খারাপ করার জন্য?পাগল মেয়ে। আজতো আর সময় হবেনা, কাল কাওকে দিয়ে তোমার বই আনিয়ে নেবো।আর কলেজে যাওয়ার ব্যবস্থাটা দেখি কি করা যায়।এবিষয়ে তোমার আঙ্কেল ভালো বুঝবেন।আমি উনার সাথে জরুরি কথা বলছি।আর মন খারাপ করে থেকো-না, ঠিক আছে?

কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেলো কৌড়ির।নীহারিকা বেগমের কথায় মুখে কিছু না বলে মাথা নিচু করে ফেললো।ফের মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো।

‘এরকম ছোটো খাটো বিষয়ে কখনো মন খারাপ করবে না।মনে প্রবল আস্থা রাখবে,মন খারাপ করে সেই আস্থা নষ্ট করে ফেলবেনা।তাহলে শত চেষ্টা সব বিফলে যাবে।

মাথা উঁচু করে নিলো কৌড়ি।কৃতজ্ঞতায় ভরা জ্বলজ্বলে চোখদুটো নীহারিকা বেগমের মুখের দিকে নিষ্পলক দিয়ে বললো।–আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আন্টি।

‘ধন্যবাদ দেওয়ার মতো কিচ্ছু করিনি।আর না এটা ধন্যবাদ দেওয়ার মতো বিষয়।এটা তোমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়,তোমার প্রাপ্য।যেটা আমাদের গুরুজন হিসাবে গুছিয়ে দেওয়া দায়িত্ব।আর মা হিসাবে সেই দায়িত্বটা পালন করছি বা করতে চাইছি আমি।

আচমকা নীহারিকা বেগমকে জড়িয়ে ধরলো কৌড়ি।মায়ের আদর তার কখনো ভাগ্যে জুটিনি।তিন তিনজন চাচী থাকতেও সেই অভাবটা থেকে গেছে তার।তবে মেজো চাচী কিছুটা মমতা দেখাতে চাইলেও,উনার ওই কুকুর ছেলেটার জন্য কাছে টানতে পারতেন না।বলতেন, –তোর চাচা মানুষ না।আর তার মতো হয়েছে আমার পেটের ছেলে।দেখিসনা,কি অমানুষ হয়েছে।সারাদিন মদ গাঁজা নিয়ে পড়ে আছে।মন মেজাজ হয়ে থাকে কুকুরের মতো।আর সেরকমই ব্যবহার করে মা বোনের সাথে।আর তাতে আবার তোকে বউ বানানোর জন্য উৎ পেতে বসে আছে।তুই আমার কাছে আসলে সুযোগ পাবে বেশি।তাই আমার কাছে আসবিনা।এবাড়িতে ঢুকবিনা সহজে।আমি চাইনা আমার মতো তোর কপালটা পুড়ুক।নিজের সন্তান হয়েও বলতে বাধ্য হচ্ছি,ওই জানোয়রটা ভুলেও তোর মতো ফুলকে কখনো না ছুঁতে পারুক।তাই এটা তোর চাচীর পক্ষথেকে দূরে থেকেও আগলে রাখা।চাচীযে মা মরা তোকে খুব আদর দিতে চায়,ভালোবাসতে চায়।তবে পারেনা।তাই চাচীর জন্য কখনো মনে দোষ পুষে রাখিস না।অন্য চাচিদের মতো মনে করে ভুল বুঝে থাকিস না।

তবে সত্যি বলতে দূরে থেকেও এটুকু আগলে রেখেছিল চাচি তাকে।তবে সেই ছোট্টোটা থেকে মায়ের অপূর্ণ মমতা ভালোবাসাটা পেয়েছিলো,দাদির কাছথেকে।বৃদ্ধা মানুষ নিজের যথাসাধ্য দিয়ে চেষ্টা করে যেতেন, তার মায়ের অভাবটা পূর্ণ করার।আজ সেই দাদিআপা থেকেও দূরে।নীহারিকা বেগমের মমতা সেই মৃতু মা’কে মনে করিয়ে দিলো।কেমন হতো সেই মমমতাময়ী মায়ের স্পর্শ ভালোবাসা,শাসন-বারন জানা নেই কৌড়ির।তবে যে দাদিআপার থেকে কিছুটা হলেও অনুভব করেছিলো সেই মমতা ভালোবাসা।তা নীহারিকা বেগমের কথায় ব্যবহার নিজের জন্য অনুভাবিত হতেই,প্রকাশ পেতেই আবেগপ্রবণ হলো কৌড়ি।নীহারিকা বেগমও তিন সন্তানের মা। সন্তানের দরদ তিনি বোঝেন।তাই পরম মমতায় কৌড়িকে আগলে নিলেন নিজের বুকে।মাথায় চুমু দিয়ে বললেন।

‘নিজেকে সহজ কর মা।অন্য কাওকে বলতে না পারিস, নিজের প্রয়োজনীয়তা অপ্রয়োজনীতা যা মন চাই এই বড়মাকে অন্তত বলার চেষ্টা করিস,বলিস।মান্যতা আমার নিজের পেটের মেয়ে হলেও,মৌনতাকে আমি মান্যতার থেকে তিল পরিমান কম ভালোবাসিনা।তুইও আমার মান্যতা মৌনতার মতো আরেক মেয়ে।ওদের মতোই মায়ের কাছে আবদার করিস।মা যথাসাধ্য চেষ্টা করবে তোদের আবদার পূরণ করতে, ভালো রাখতে।শুনছিস আমি কি বলছি।বলবি তো?

নিঃশব্দে কেঁদে চললো কৌড়ি। মুখে কিছু বললো-না। শুধু মাথা নাড়িয়ে হ্যা জানালো।সেটা বুঝে মৃদু হেসে কৌড়ির মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে নীহারিকা বেগম ফের বললেন—আর আজ থেকে ওসব আন্টি সান্টি বলবি না।হয়তো মান্যতার মতো মা বলে ডাকবি নয়তো মৌনতার মতো বড়মা বলে।কেমন?ডাকবি তো?

একটু সময় নিয়ে ফের মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো কৌড়ি।সেটা বুঝে আর কথা বাড়ালেন না নীহারিকা বেগম।মেয়েটা এখন তো সম্মতি জানিয়েছে ঠিকই তবে নিজের অপ্রয়োজনীয় তো দূর,প্রয়োজনীয়টা পর্যন্ত বলবে কি উনার সন্ধান। এরকম স্বভাবের একজনকে যে পেলেপুষে বড়ো করেছেন তিনি।তাই এসব স্বভাবের মানুষ সম্পর্কে বেশ আবগত উনি।

এবাড়িতে সবার সাথে মোটামুটি কৌড়ির সখ্যতা গড়ে উঠলেও,সখ্যতা সেভাবে গড়ে উঠেনি দীবার সাথে।মেয়েটার হাবভাব বুঝে পায়না কৌড়ি।এবাড়িতে আসা এই পর্যন্ত কখনো তারসাথে সেভাবে কথা বলেনি।বলিনি বললেই চলে।অথচ কি অদ্ভুত নজরে মাঝেমধ্যে তারদিকে তাকিয়ে থাকে।নিজেরই কেমন এলেবেলে লাগে কৌড়ির।মনেহয়,গ্রামের অদ্ভুত মেয়ে সে।তাদের মতো স্মার্ট চালচলন নয় বলে কি এভাবে তাকিয়ে থাকে?নাকি অন্যকিছু?সেদিন কাশফুল বাগানে ঘুরতে গেলো,সারাটা সময় একসাথে কাটালো অথচ একটা শব্দও তার হয়ে ব্যয় করলোনা।তবে সেই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে ভুল করেনি।তাকে ওই অদ্ভুত দৃষ্টিতে কি দেখে বুঝে আসেনা কৌড়ির।কি যে অস্বস্তি অনুভব হয় তখন।কি করে বোঝাই ওই মেয়েটাকে।এইযে খাওয়া বাদ দিয়ে তারদিকে সেই তীক্ষ্ণ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে,যারজন্য ঠিকঠাক ভাবে খেতে পারছেনা কৌড়ি।কেউ এভাবে তাকিয়ে থাকলে খাওয়া যায়।তবে সকালের এই সময়টাতে তো মেয়েটা খেতে আসেনা।আজ পনেরো দিনেও বেশি,কখনো দেখিনি কৌড়ি।তবে আজ কেনো?

‘কিরে খাবার সামনে রেখে এভাবে বসে আছিস কেনো?
খেয়ে নে?

নীহারিকা বেগমের কথায় খাবারে মনোযোগ দিলো দীবা।তবে খাবার গলা দিয়ে নামতে চাইলো-না তার।কি এক যন্ত্রণার মধ্যে আছে সে।সেই যন্ত্রণার সাথে সাথে দ্বিধায়ও আছে।যন্ত্রনাটা হলো,অসুস্থ একটা বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছেন না সে।আর দ্বিধা হলো সেই সম্পর্ক থেকে নিজেকে মুক্ত করার পর,যাকে সে মনে-প্রাণে চাইছে তাকে সে পাবে তো?হয়তো বা।যারজন্য সিয়ামের সাথে সম্পর্কটায় তার ইতি টানতে হবে তাড়াতাড়ি না-হলে বিয়ে হয়েছে অথচ শ্বশুর বাড়িতে না থেকে বাপের বাড়িতে পড়ে আছে।আশেপাশে পরিচিত কতো মানুষের কতো কথা শুনতে হচ্ছে রোজ তাকে।তাদেরকে তো আর খুলে বলা যায়না সে কি পরিস্থিতির মধ্যে আছে।যারা অন্যের পরিবার সংসার নিয়ে সমোলচনা করে তারা-তো আর জানেনা,সেই পরিবারের সেই সংসারের ভিতরের খবর।তারা শুধু জানে মেয়েটার একটা ভালো বিত্তশালী ফ্যামিলিতে বিয়ে হয়েছিল,ছেলেটাও তো দেখতেশুনতে ভালো। তবে মেয়েটা কেনো বাপের সারক্ষন বাড়িতে পড়ে থাকে?

‘মা কবে আসবে বলেছে নাকি?সেদিন আমার সাথে একবার কথা হলো,সেভাবে তো কিছুই বললো না।

নীহারিকা বেগমের প্রশ্ন মুখ তুলে চাইলো দীবা।বললো- দুই একদিনের মধ্যে আসবে বললো।

‘বাড়িটা একটু শান্ত পরিবেশে আছে সেটা বুঝি ভালো লাগছেনা তোমার?ডেকে ডেকে ঝড় তুফান নিয়ে আসছো কেনো?

মা’কে উদ্দেশ্যে কথাটা বলেই কৌড়ির পাশাপাশি চেয়ারটায় বসে পড়লো ইভান।মায়ের চোখ রাঙানোকে সম্পূর্ণ ইগ্নোর করে বললো।-তোমার বেকার ছেলেটাকে একমুঠো খাবার দাও।

‘তুই কাকাে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বললি?নিশ্চয় মা-কে?

দীবা কথাটা বলতেই চমৎকার হেসে দিলো ইভান।মুখে হাসি রেখেই পুরো ৩৬০ডিগ্রী এঙ্গেলো কথা ঘুরিয়ে বললো।—বাবা আর চাচ্চু,তোমাকে ড্রয়িংরুমে ডাকছেন।আামকে বললেন তোমার খাওয়া হলে ডেকে দিতে।ওবাড়ি থেকে সিয়াম ভাইয়ার বাবা মা নাকি ফোন দিয়েছেন।

দীবার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।একপলক উপস্থিত সবার মুখের থেকে চোখ ঘুরিয়ে এনে, উঠে পড়ল সে।আপতত তার খাওয়া আর গলা দিয়ে নামবেনা।হাত ধুয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে পা বাড়ালো সে।সেদিকে তাকিয়ে নীহারিকা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইভানকে উদ্দেশ্য করে বিরক্ত হয়ে বললেন।—কথাটা মেয়েটার খাওয়া শেষ হলে বলা যেতোনা।এতোবড় ছেলে হয়ে গেছিস,এখনো বুঝে শুনে কথা বলতে শিখলি না।মেয়েটা অর্ধেক খাওয়া ছেড়ে উঠে গেলো।

‘বুঝেশুনেই তো বললাম।আর যার মেয়ের এই অবস্থা, তিনি মেয়ের চিন্তা না করে জমিজায়গার হিসাব নিয়ে সেই না সংসার করা শ্বশুর বাড়িতে পড়ে আছেন।আর তুমি মরে যাচ্ছো,তার মেয়ের চিন্তায়।

ছেলের সাথে তর্কে গেলেন না নীহারিকা বেগম।এই ছেলের সাথে যতো তর্ক যাবেন।উল্টোপাল্টা কথা ছাড়া এই ছেলের মুখ থেকে একটা কথাও বের হবেনা।মা চুপ হয়ে যাওয়ায় ইভানও আর কথা বাড়ালোনা।তবে সে যে চুপচাপ থাকার ছেলে নয়।পাশে থাকা কৌড়ির দিকে নজর দিলো।মেয়েটা সংকোচ নিয়ে বসে প্লেটের খাবার নেড়ে যাচ্ছে শুধু।গালে তুলছে কম। কি কারনে বুঝতে অসুবিধা হলো না ইভানের।তড়িৎ উঠে কৌড়ির অপর পাশের সামনাসামনি চেয়ারে গিয়ে বসলো সে।ফের কালকের মতো টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে দু’হাত দুগালে চেপে কৌড়িকে উদ্দেশ্য করে বললো।

‘কি ব্যাপার ফুলকৌড়ি আশেপাশে তো কোথাও দাদাভাইকে দেখছিনা,তবে কেনোএতো ভয়ে ভয়ে সংকোচে খাবার খাচ্ছো? তবে তুমি মোটেও চিন্তা করো না,দাদাভাই নিচে নামলো বলে কথা ।তাই বলছি বিষম লাগার আগেই খাবারটা খেয়ে নাও।নাহলে আজকের বিষম লাগাটা কিন্তু তুমি কিছুতেই হজম করতে পারবে না।

বাবা সহজে নিজের অসুস্থতার কারনে রুমের বাহিরে খুব একটা আসেন না।প্রয়োজন ছাড়া।তবে আজ এসেছে।ইভান,ড্রয়িংরুমে দেখে এসেছে বাবা আর চাচ্চু কি বিষয় নিয়ে আলাপআলোচনা করছে।সেখানে ইতিমধ্যে স্বয়ং ঝামেলাকে-ও পাঠিয়ে দিয়েছে ইভান।এখন দাদাভাই নিচে নামবে।আর বাবা সেই ঝামেলার সমাধান সরূপ দাদাভাইয়ের কাছে পরামর্শ চাইবে।আর দাদাভাই তার ওই জলদগম্ভীর গলা দিয়ে পরামর্শ সরূপ কি বানী ছাড়তে পারে,এটা এখানে বসে মুখস্থ বলে দিতে পারে ইভান।আর সামনে বসা এই ভীতু মেয়ে যদি সেই গলার স্বরের কথাগুলো শোনে।তাহলে বিষম কনফার্ম হতে সময় লাগবেনা।কৌড়ির বোকা চাহুনীর দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে খাবারের প্লেটের দিকে ইশারা করলো ইভান।ফের মুখে বললো।

‘বসে আছো কেনো,জলদি খেয়ে নাও।

অসহায় নজরটা প্লেটে দিকে দিলো কৌড়ি।আজ পনেরো দিনে এই ছেলেটাকে সে খুব ভালোকরে চিনে ফেলেছে।কারও একটা দূর্বল পয়েন্ট পেলেই হয়,সেটা নিয়ে তাকে সামনে পেলেই শুরু হয়ে যাবে তাকে ক্ষপানো।এরজন্য এতো বড় ছেলে বড়মার কাছে বকা কম খায়না।তবুও ইতোড়ের মতো পিছনে লেগে থাকবে।এমন একটা ভাব,কে কি বললো বা বলছে এরা থোড়াই না তার যায় আসে।তবে ইভানের কথা সত্যিয়িত করে ড্রয়িং রুম থেকে গম্ভীর গলার স্বরটা আসতেই খাওয়া থেমে গেলো কৌড়ির।ইভানের মুখের দিকে চকিতে তাকাতেই দেখলো,মনোযোগ দিয়ে ভদ্রসভ্য ছেলের মতো খাচ্ছে।অথচ কৌড়ির তাকানোটা মাথা নিচু রেখেই বেশ বুঝতে পারলো ইভান।উপহাসের স্বরে বললো।

‘বলেছিলাম শোনোনি,এখন বিষম লাগার ভয়ে না খেয়ে বসে থাকো।

সকালে অফিস যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়েই নজরে পড়লো সোফায় বসা জাহিদ সাহেবকে।পাশাপাশি সিঙ্গেল সোফায় বসে আছেন, শাহেদ সাহেব।বিগত পনেরো দিনের বিজনেস ট্যুর সেরে গতকাল রাতে বাড়ি ফিরেছেন তিনি।আর তাদের মধ্যেমনি হয়ে মাথা নিচুকরে বসে আছে দীবা।নিভানের তীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক আর বুদ্ধিদীপ্ত নজর মূহুর্তেই বুঝে নিতে পারলো,এখানে কি আলাপআলোচনা চলছে।সেদিকে মোটেই গুরুত্ব দিলো না নিভান।ধাপেধাপে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো সে।বড়বড় পা ফেলে ড্রয়িংরুম পার হতেই জাহিদ সাহেব ডাকলেন তাকে।

‘নিভান।তোমার সাথে জরুরি একটা বিষয় নিয়ে কথা বলার ছিলো।

জরুরি বিষয়টা কি?জানা সত্ত্বেও ডাক উপেক্ষা করলো না নিভান।পিছে ফিরে সরাসরি জাহিদ সাহেবের মুখের দিকে তাকালো।বুঝতে পারা সত্ত্বেও গম্ভীর কন্ঠে বললো।

‘বলুন।

জাহিদ সাহেব এবং শাহেদ সাহেব দু’জনের মুখ গম্ভীর। তবে দীবার আশাবাদী মুখটা উৎসাহিত হয়ে আছে,নিভানের মুখপানে চেয়ে।সেদিকে নিজের নজর ভুলেও ফেললোনা নিভান।নিজের দৃঢ় নজর শুধু স্থির রাখলো জাহিদ সাহেবের মুখপানে। জাহিদ সাহেব বললেন।

‘সিয়ামের বাবা মা ফোন দিয়েছিলেন,উনারা দীবাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন।কিন্তু আমার মনে-হচ্ছে, এতো কিছু হওয়ার পর সেখানে মেয়েটার না যাওয়াই উচিত।আর দীবাও চাইছেনা,সিয়ামের সাথে সম্পর্ক রাখতে। ওদিকে উনারাও অনুনয়বিনয় করছেন।ছেলে মানুষ ভুল করে ফেলেছে,তাই বলে সম্পর্কচ্ছেদ করার মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়।বিভিন্ন কথা অনুনয়-বিনয় করে বলছেন।উনাদের অনুনয়-বিনয় শুনে তোমার ছোটো চাচ্চুও বলছিলেন সবাই মিলে একজায়গায় বসে উভয়পক্ষের কথা দ্বারা একটা সিদ্ধান্ত নিতে, সমাধান বের করতে।কি করা যায় বলো তো?

‘এখানে আমি কি বলতে পারি?আমি মনে করছিনা,ওর বিষয়ে আমার সিদ্ধান্ত জানানোটা যথাযথ।সেটা আমি আগেও মনে করেনি,এখনো-ও মনে করছি-না।আর দ্বিতীয়ত ও একটা অ্যাডাল্ট মেয়ে।বিয়ের মতামতটা ও নিজেই নিয়েছিলো,আপনারা সেই মতামতের গুরুত্ব দিয়েছিলেন।এখন সেই সম্পর্কে ও সুখে নেই,ভালো নেই বা সেই সম্পর্কটা এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেনা।সেটারও যথাযথ কারন দিয়ে ওকেই সিদ্ধান্ত নিতে দিন।ও যথেষ্ঠ বুদ্ধিমতি একটা মেয়ে এবং অ্যাডাল্ট পারসন।তাই ওর সিদ্ধান্তটা আপতত ওকেই নিতে দিন।তবে বুঝে এবং অন্যের দোষ ত্রুটিগুলোর সাথে সাথে নিজের দোষত্রুটি গুলোও খুঁজে।সেখানে ও থাকতে চায় নাকি না।আর
এখানে আমার সিদ্ধান্ত প্রকাশ করার মতো প্রয়োজন বা গুরুত্ব কোনোটাই আমি দেখছিনা।

দৃঢ়কণ্ঠে কথাগুলো বলে একটু থামলো নিভান।তবে নজরের নড়চড় হলোনা।জাহিদ সাহেবের ভাবান্তর মুখের দিকে চেয়ে ফের বললো–আর একান্ত আপনারা ওর গার্ডিয়ান হয়ে যদি ভালোমন্দ মতামত গ্রহন করতে চান,তবে ওর কাছে জিজ্ঞেস করে নিন।সেই সিদ্ধান্ত ও খুশি মনে মেনে নেবে কি-না?যদি নেয়,তবে ছোটো চাচ্চুর পরামর্শ অনুযায়ী দুই পরিবার একসাথে হয়ে,দুজনের ভালোমন্দ কথা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিন।এখানে আমার সিদ্ধান্তের একান্ত প্রয়োজনীতা নেই।জীবন-টা ওদের তাই সামনের পথটাও ওদেরকেই বেছে নিতে বলুন।

বড়বড় পা ফেলে চলে গেলো নিভান।সেদিকে ভারাক্রান্ত নজরে তাকিয়ে রইলো দীবা।নিভান এতোটা অবজ্ঞা করে তাকে।অথচ আগেও তারসাথে কম কথা হলেও এতোটা অবজ্ঞা করে কথা বলতোনা সে।নিভান বরাবরই প্রয়োজন ছাড়া কম কথা বলে,তাই বলে এতো রুক্ষ ভাষা!কতো সাবলীলভাবে কথাগুলো বলে গেলো সে।তারদিকে একবারও ফিরে চেয়ে দেখারও প্রয়োজন মনে করলোনা।তবে কি সত্যিই নিভানের ফেলে দেওয়া থুথু হয়ে গেলো।যার দিকে দ্বিতীয়বার চর ফিরে তাকাতে চায়না নিভান।অথচ সেই নিভানকে নিয়েই তাদের স্বামী স্ত্রীর মধ্য ঝগড়ার উৎপত্তি শুরু হয়।যদিও দোষ নিভানের নয়,তার জাগ্রত হওয়া ভুল সময়ের অনুভূতির।

একটা বিজনেস কন্ট্রাক্ট সাইন করার জন্য জাহিদ সাহেবের সিগনেচার দরকার।কারন জে এইস জে এর চেয়ারম্যান এখনো উনি।যদি-ও কোম্পানির নির্দেশনায় পরিচালনায় নিভানের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হয়।তবুও যেকোনো কোম্পানির সাথে কন্ট্রাক্ট সাইন করার আগে ডিলকৃত কোম্পানি সম্পর্কে উনাকে বিস্তারিত জানানো এবং কন্ট্রাক্ট সাইন করার জন্য অনুমতি নেওয়া প্রযোজ্য মনেহয় নিভানের।এবারও তাই করা হলো।তবে ডিল-কৃত কোম্পানি জাহিদ সাহেবের পুরানো।উনারা জাহিদ সাহেবের সাথে আগেও ব্যবসায় লেনাদেনা করেছেন।তখন জাহিদ সাহেবের ব্যবসার নীতি,উনার সদাচরণ বেশ ভালো লেগেছিলো।উনি অসুস্থ শুনে তাই সরাসরি উনার সঙ্গে একবার দেখা করতে চান।এবং কথাও বলতে চান।বিকালের সময়টাতে উনাদের,বাড়িতে আসার ইনভাইটেশন দিলো নিভান।সেটা বাড়িতে জানিয়েও দিলো।বিকাল গড়াতেই হাজির হলেন উনারা।

উনাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হলো বাড়ির অন্দরে নয়,বিভিন্ন ফুলে আচ্ছাদিত সাজোনো গার্ডেন এরিয়াতে।গোল চেয়ার টেবিলে বসার আয়োজন হলো।চা নাস্তা সহ বিভিন্ন খাবারে টেবিল ভরে উঠলো।মুখোমুখি বসে দু’পক্ষ কথাতে মশগুল।কোম্পানির বিভিন্ন কার্যক্রম এবং নিজদের ব্যাক্তিগত কথাও চললো সেখানে।তবে চারজন ব্যাক্তির মধ্যে, একজনের মুগ্ধ নজর গার্ডেন এরিয়ার অপরপাশে।যেখানে দুটো মেয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।তারমধ্য কালো সাধারণ একটা প্লাজু পরা সাথে কালো মিশালে সাধারণ চেইকের জামার সঙ্গে সুন্দর করে গায়ে মাথায় কালো উড়না জড়ানো মেয়েটার সৌন্দর্যে বিভোর হলো সে।বিকালের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য জেনো ফিকে পড়েছে মেয়েটার ওই সৌন্দর্যে।কালো ড্রেসআপে গোলগাল ফর্সা মুখটা নজর কেড়েছে বেশি।সাথে মেয়েটার মাথার ওড়না ভেদ করে কোমর ছাড়া হাঁটু ছুঁইছুঁই চুলগুলো।এই অধুনিক শহরের মেয়েদের কৃত্রিম সজ্জা চেহারা দেখতে দেখতে হঠাৎই এরকম সাদামাটা সৌন্দর্য দেখে নজর মুগ্ধ হতে বাধ্য হলো ছেলেটা।

তীক্ষ্ণ নজরে নিজের মুখোমুখি বসা ছেলেটাকে লক্ষ্য করলো নিভান।ছেলেটার মুগ্ধ নিষ্পলক নজরও তার এড়ালোনা।ছেলেটা,তাদের কোম্পানির সাথে ডিলকৃত কোম্পানির কর্ণধার নওশাদ চৌধুরীর ছেলে বিহান চৌধুরী।তবে ছেলেটা তার পিছনে এরকম নিস্পলক নজরে তাকিয়ে কি দেখছে?ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরতেই, নিজেও কয়েক সেকেন্ড সেদিকে তাকিয়ে পুনরায় সোজা নজর ফেললো বিহানের সুদর্শন মুখের দিকে।গলা জোরেশোরে ঝাড়লো নিভান।গলার স্বরের তীক্ষ্ণতায় হুঁশ ফিরলো বিহানের।মনেমনে লজ্জিত হয়ে নড়েচড়ে বসলো সে।তবে চেহারায় সেটা প্রকাশ পেতে দিলোনা।তবে নিভানের তীক্ষ্ণ নজর সেটা ঠিকই অনুধাবন করলো।পায়ের উপর পা তুলে,চেয়ারে গা ছেড়ে দিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে বসার ভঙ্গিমা চেঞ্জ করে সামনে বসা মানুষটার দিকে ঝুঁকে বসলো সে।গম্ভীর কন্ঠের তীক্ষ্ণতা বজায় রেখেই বললো।

‘ব্যাবসার নীতি কি জানেন?সততা।আর সততার নীতি কি জানেন?চরিত্র।আর চরিত্রের নীতি হলো ব্যক্তিত্ব।আর একজন পুরুষ মানুষের ব্যক্তিত্ব ঠিক না থাকলে তাকে সুপুরুষ বলা যায়না।আর একজন ব্যক্তিত্বহীন পুরুষ না ব্যবসায়ের কর্ণধার হতে পারে।আর না সেই পুরুষটা কোনো স্পেশাল নারীর কাম্য।

লজ্জায় কান মাথা গরম হয়ে উঠলো বিহানের।মুখের বহির্ভাগ ধারন করলো রক্তিম। সামনে বসা অতি চতুর লোকটা যে তাঁকে বেশ লক্ষ্য করেছে বুঝতে পারলো বিহান।যদিও অল্প বয়সে নিজের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা আর চতুরতা দিয়ে বাবার ব্যবসায় বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে লোকটা,এটা জানা সত্ত্বেও তারই সামনে বসে লজ্জাজনক কাজটা করে ফেললো কিকরে বুঝতে পারলোনা বিহান।তবে সত্যি বলতে মেয়েটার সাদামাটা সৌন্দর্য তাকে বিমোহিত করেছে।বিধায় কার সামনে বসে আছে অনুধাবনে ছিলোনা।ফের নিভানের তীক্ষ্ণ বাক্যে, বিহানের মুখাবয়ব কঠিন হয়ে এলো।

‘আমার বাড়ির প্রতিটি নারীই স্পেশাল।আমরা আশা রাখি,এবাড়িতে যত অপরিচিত ব্যক্তি প্রবেশ করবে আমাদের বাড়ির নারীদের নজরে পড়তেই তারা নজর নিচু করে নেবে।আমরা বরাবরই এমনই মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরী করি,করে আসছি।ব্যবসায়ী ক্ষেত্রেও এই নীতি শিরোধার্য মানা হয়।সো বি কেয়ারফুল মিস্টার বিহান।যেদিকে ভুলে নজর দিয়ে ফেলেছেন, সেদিকে জেনো আর ভুলে-ও নজর না যায়।মনের ভুলে-ও না।

চলবে…

ফুলকৌড়ি পর্ব-৬+৭

0

#ফুলকৌড়ি
(৬)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

মায়ের কাছ থেকে হাজার বাহানা আর জোরাবাদী করে তারপর ফোনটা নিতে হলো মৌনতাকে।সেটার জন্যই ফিরে আসতে দেরী হলো তার।ছাঁদে দরজায় পা রাখতেই দেখতে পেল,ছোটোদাদাভাই কিছু বলে চলেছে আর তার সামনে তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কৌড়ি।

‘ছোটো দাদাভাই, তুমি এখানে?

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো কৌড়ি।ইভানও পিছনে ফিরল।পকেটে হাত গোঁজা অবস্থায় সেভাবেই সটান হয়ে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো–কেনো?ছাঁদটা কি তুই তোর নামে লিখে নিয়েছিস নাকি আছাড়ি বিবি?যে এখানে অন্য কার-ও প্রবেশ নিষেধ।

চঞ্চল পাজোড়া সহসা এগোলো মৌনতার।ফের গলায় তীক্ষ্ণতা ভর করে বললো।–ওসব বাজে নামে ডাকবেনা তুমি, আমায়।বলে দিলাম দাদাভাই।

মৌনতার বাজখাঁই গলায় কপাল আরও কুঁচকে ফেলল ইভান।ফের মৌনতাকে রাগাতে আবারও বললো–‘তোর ওই আছাড়ি বিবি নামটাই পারফেক্ট।কিন্তু ছোটো চাচা চাচিতো আর,তোর ওই বাচ্চা বেলার ভোলাভালা মুখটা দেখে বুঝে উঠতে পারেননি।তাই নাম রেখে ফেলেছিলেন মৌনতা।তুই নিজে বল, তোর সাথে তোর নামটা ঠিকঠাক যায়?নাকি আমি যে নামটা দিয়েছি, সেটা যায়?

ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো ইভান।সেটা দেখে আরও ক্ষেপে গেলো মৌনতা।কিছু বলবে তার আগে আবারও ইভান বললো।–সেজন্য চাচ্চু আর চাচির ভুলটা শুধরে দিলাম আমি,নাম দিলাম আছড়েবিবি।কিন্তু তোর আছাড় খাওয়ার সাথে সাথে গলার যা জোর বেড়েছে।নাম আবারও চেঞ্জ করতে হবে বলে মনে হচ্ছে।

‘দাদাভাই ভালো হচ্ছে না বলে দিলাম।এবার কিন্তু আমি বড়মাকে গিয়ে বলবো।

মৌনতার কাঁদোকাঁদো গলার কথাগুলো শুনে বেশ মজা পেলো ইভান।মেয়েটা ক্ষেপাতে তার যা লাগে না।আর তার কথায় ক্ষেপে যায়-ও মেয়েটা,এটাতে আর-ও বেশি মজা লাগে তার।ঠোঁটে তীক্ষ্ণ হাসি ফুটালো ইভান।ফের বললো।–বাবাহ,তা তোর বড়মার ভয়ে আমি কোথায় গিয়ে লুকাবো সেটা তো বলে দে।তাহলে আমার সুবিধা হয়।

‘দাদাভাই…

এবার কেঁদে ফেললো মেয়েটা।আর মৌনতার কান্না দেখে ইভান এবার হো হো করে হেসে দিলো।আশ্চর্য হয়ে দুই ভাইবোনের ঝগড়া দেখে গেল কৌড়ি।এতোবড় একটা ছেলে হয়ে এক পুচকি মেয়ের সাথে কিভাবে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করলো!আশ্চর্য! এখন আবার মেয়েটাকে কাঁদিয়ে হো হো করে হেসে চলেছে।কি অদ্ভুত।

মৌনতার দিকে পা বাড়ালো ইভান।সামনাসামনি গিয়ে দাঁড়িয়ে মৌনতার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললো।–আচ্ছা ঠিক আছে তোর নামটা নাহয় আছাড়ি বিবিই রইলো।চেঞ্জ নাহয় নাই করলাম।তবুও তুই এরকম গলা বাজিয়ে কাঁদিস না।লোকে দেখলে আমার আর নাম চেঞ্জ করা লাগবেনা।তারাই তোর নামের বদৌলে কাঁদুনিবিবি বলে ডাকবে।

অতিরিক্ত রাগে এবার ইভানের পেটে ধাক্কা দিয়ে দুরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো মৌনতা।যদিও শক্তপোক্ত বলিষ্ঠ দেহের ইভানকে এক ইঞ্চিও নড়াতে পারলোনা।সেটা দেখে ইভানের পেটে দু-হাত চেপে দিয়ে ছাঁদের দরজার সম্মুখে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে গেলো মৌনতা। যদিও ইভান সেটা নিজ ইচ্ছেতই এগোলো।নাহলে চিকনাচাকনা মৌনতার ক্ষমতা নেই তাকে এক ইঞ্চিও নড়ানোর। ঠেলেঠুলে দরজা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার পর মৌনতা অভিমানি স্বরে বললো।

‘তুমি খুব খারাপ।তুমি আমার দাদাভাই নও।তোমার চেয়ে বড় দাদাভাই ভালো।সে আমাকে কত সুন্দর করে ডাকে।তোমার মতো বাজে নামে ডাকে-না।

হঠাৎই নিভে গেলো ইভান।মৌনতার কথার উত্তর দিলো না।কিছু সময় মৌনতার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে চুপচাপ সিঁড়ির পথ ধরলো।যদিও সে জানে, মেয়েটা এমনি এমনিই কথাগুলো বলেছে,তবুও।ওদের বড়দাদাভাই যে ওদের কাছে খুবই প্রিয়,এটাতো ইভান জানে।তবুও উহ্য করে বারবার কেনো বলে তার সামনে।

দুপুরে স্কুল থেকে ফেরার পর মায়ের ধমকের জন্য বাধ্য ছেলের মতো খেয়েদেয়ে ঘুমাতে হয়েছিলো নাফিমকে।সেই ঘুম থেকে সন্ধ্যার পর উঠেছে সে।মুলত উঠেনি সে,তাকে ডেকেডেকে উঠানো হয়েছে।কারনটা টিচার এসেছে,পড়তে হবে তাই।কোনোমতে পড়াটা কমপ্লিট করে কৌড়ির রুমে চলে এসেছে সে।ফুলকৌড়িকে তার কতো পছন্দ অথচ সারাদিনে একবার-ও তার সাথে দেখা করতে পারিনি সে।স্যারের কাছে কতো বাহানা দিয়ে তারপর আসতে পেরেছে।

‘ফুলকৌড়ি আজও কি তোমার মন খারাপ?

বিকালের তোলা ফুলের পিকগুলো কৌড়িকে দেখাচ্ছিল মৌনতা।হঠাৎ নাফিমের গলার স্বরে দুজনেই মাথা উঁচু করে তাকালো।কৌড়ি কিছু বলার আগে মৌনতা বললো।–ওই ফুলকৌড়ি কি!ওর নাম শুধু কৌড়ি।কতবার বলেছি তোকে?আর কৌড়ি আপু তোর বয়সের কতো বড় হয় তুই জানিস?নাম ধরে ডাকছিস কেনো?

‘ওর নাম যাই থাকুক,আমি তাকে ফুলকৌড়ি বলেই ডাকবো। তাতে তোর কি?

‘আমার কি মানে,আম্মুকে বলবো।বেশি পাক-না হয়ে গেছো তাইনা?

‘থাকনা মৌনতা।ওকে বকছো কেনো?ও যে নামে ডাকে ডাকুক না আমাকে।ও ফুলকৌড়ি বলে ডাকলে আমার নিজের আপন মানুষগুলোর কথা মনে পড়ে যায়।দাদিআপা তো প্রায়সই এই নামেই ডাকতো আমাকে।আর মাঝে-মাঝে বাবা-ও ডাকতেন।ও ডাকলে আমার ভালোই লাগে।মনেহয় আপন কেউ ডাকছে।

কথাগুলো বলতে বলতে নাফিমকে কাছে টেনে নিলো কাৌড়ি।গোলুমোলু দেখতে ছেলেটা ভারী মিষ্টি।গোল ফ্রেমের চশমাটায় আরও দুষ্টমিষ্টি লাগে তাকে দেখতে।একদিনে, এবাড়ির ছেলেমেয়ে গুলো কি সুন্দর তাকে আপন করে নিয়েছে।নাফিম কে কাছে টেনে কোলের মধ্যে এনে বসাতেই,লজ্জা পেলো নাফিম।মাঝেমাঝে মায়ের কোলে বসার আবদার করলে,আপুরা তাকে বলে।তুই কোলে বসলে আম্মা ফেটে যাবে।রাগে ক্ষোভে সে আর মায়ের কোলে বসতে চায় না।এখন যদি ফুলকৌড়ি-ও সেই কথা বলে।তবে যে আর-ও লজ্জা পাবে।

‘ওকে কোলে নিয়েছো কেনো,চেপ্টা হয়ে যাবে তো তুমি!

‘বাজে কথা বলবিনা মৌনতার বাচ্চা।তুই আমাকে মোটু বলছিস,আমি যদি মোটু হই।তুই পাতলুর বউ বাতাসী।আমার চকলেট চুরি করে খাস আবার আমারই নিন্দা করিস।পাতলুর বউ কেথাকার।

‘কি বললি তুই?আর আমি তোর চকলেট খাইনা,তোর চকলেট ইঁদুর-বাদরে খায়।

‘সেই ইঁদুরটা- বাঁদরটা কে আমার জানা আছে।

দুজনের ঝগড়াটা সেই বিকালের ঝগড়ার মতো আশ্চর্য হয়ে দেখতে লাগলো।বিকালেরটা থামাতে না পারলেও, এবারের ঝগড়াটা থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো কৌড়ি।তবুও দু’জনে কিছুতেই থামলো গেল না।মান্যতা এতোসময় বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিলো,ওদের ঝগড়াতে বিরক্ত হয়ে ফোনটা কেটে দিয়ে রুমে এলো।দুজনকে বকে ধমকিয়ে থামানোর চেষ্টা করলো,কাজই হলো-না।হঠাৎ জলদগম্ভীর বজ্রকন্ঠের আওয়াজে পুরো পরিবেশ মূহুর্তেই বরফ শীতল আবহাওয়ার মতো ঠান্ডা হয়ে গেলো।

‘এখানে হচ্ছেটা কি?পড়ালেখা বাদ দিয়ে এখানে এতো চিল্লাপাল্লা কিসের তোমাদের?হোয়াট ইজ রং উই….

নাফিমের মোটাতাজা শরীরের বাহুভেদ করে একজোড়া ডগরডগর ভয়ার্ত কম্পিত চোখ উঁকি দিতেই তীক্ষ্ণ বাক্যদ্বয় সেখানেই থেমে গেলো নিভানের।নজরে নজর পড়তেই তড়িৎ গতিতে নজর আবারও নাফিমের মোটাতাজা শরীরের পিছনে লুকিয়ে নিলো কৌড়ি।কাল আসার সময় একপলক দেখেছিলো শ্যামবর্ণ লম্বা চওড়া সুঠাম দেহী এই মানুষটাকে।আজ আরও একপল দেখে কৌড়ির মনেহলো,মানুষটা যেমন তেমন থাক।এই ভয়ংকর গলার স্বরের জন্য একদিনও তার বউ টিকবেনা।আর বিয়ের আগে যদি সেই মেয়ে এনার গলার স্বর শোনে তবে বিয়েতেও জীবনে রাজী হবেনা।মরে গেলেও না।

ডগর ডগর নজরজোড়া নাফিমের পিছনে লুকিয়ে যেতেই নিভানের মনেহলো,এঘরে তার ভাইবোন ছাড়া অন্য কারও বাস আছে।এ রুমে যে বাহিরের একটা মেয়ে আছে,হঠাৎই খেয়াল ছিলোনা নিভানের।বাড়িতে ঢোকার পর,সিঁড়িতে উঠতে গিয়ে ড্রয়িংরুমের পাশ ঘেঁষে রুমটা থেকে তিনটা মানুষের এতোএতো হযবরল তর্কবিতর্ক ভেসে আসছিলো,মেজাজ শান্ত রেখে উপরে হয়ে উঠা হয়নি আর।তবে এটাও খেয়াল ছিলো না, তার অপরিচিত একজন মেয়ে এই রুমে আছে।পরিবেশ একদম শুনশান। পিছে মুড়ে গটাগট পা চালিয়ে চলে গেলো নিভান।পায়ের শব্দ মিলিয়ে যেতেই সশব্দে শ্বাস ফেললো সবাই।মান্যতা এবার দাঁতে দাঁত চেপে মৌনতাকে উদ্দেশ্য করে বললো।

‘তোকে কতোবার বলছি নাফিম আর ছোটো দাদাভাই যেখানে থাকবে সেখানে তুই,থাকবি-না। যাবি-না।এখন হয়েছে তো!

‘আমি যাইনি তো,ও এসেছে।

‘আবার তর্ক করিস মুখেমুখে,ও এসেছেতো কি হয়েছে?ওকে খোঁচালি ক্যান তুই?

‘আমি খোঁচাই নি।আমি ভালো কথা বলেছিলাম,ও অযথা তর্ক শুরু…..

‘মৌন….

অতিরিক্ত রাগে মৌনতাকে ডেকে উঠায় আর কথা বাড়ালো না সে।চুপ হয়ে গেলো।সবাই শুধু তার দোষ দেখে,সবাই যে অকারণে তার পিছে লাগে এটা দেখেনা।
নিভানের গলার স্বর শুনে স্বান্তনা রহমান আর নীহারিকা বেগমও সেখানে হাজির হলেন।তবে নিভান চলে যাওয়ার পর।স্বান্তনা রহমান শঙ্কিত হয়ে প্রশ্ন করলেন।

‘কি হয়েছে এখানে।নিভান চিল্লালো কেনো?নিশ্চয় এই দুটোতে আবার ঝগড়া বাধিয়েছে।

মান্যতা কিছু বলতে যাবে।তাকে বলতে না দিয়ে বিলাপ করে ফের স্বান্তনা রহমান নললেন।

‘আল্লাহ, একই মা’র পেটের ভাইবোন তোরা।কোনো সৎ ভাইবোন নোস।তবুও এক জায়গায় হতে পারিসনা ঝগড়াঝাঁটি মারামারি শুরু হয়ে যায়।তবে একজায়গায় হোস কেনো?এ কেমন ছেলেমেয়ে আমার।নতুন একটা মেয়ে এসেছে,তার সামনেও ঝগড়া।তাকেও মান্য করলো না।একি ছেলেমেয়ে হয়েছে আমার।

‘তুমি আবার কিসব বলা শুরু করলে ছোটোমা।

‘কিছু হয়নি তো নিভান চিল্লালো কেনো?অতিরিক্ত কিছু না হলে তো ছেলেটা উফফ তাক শব্দ করেনা?আর এই দুটোকে তুই এখন আমাকে নতুন করে চেনাচ্ছিস!আমি চিনিনা বুঝি এদের।

মান্যতা এবার পড়লো মহাবিপদে।এই দুটো ছোটোমাকে জ্বালিয়ে পড়িয়ে তার মাথা নষ্ট করে দিয়েছে।আগের ছোটমা কতো শান্ত ছিলো,এখন বকতে শুরু করলে আর থামে-না।মায়ের দিকে অসহায় নজরে তাকালো মান্যতা।সেটা বুঝে নীহারিকা বেগম,স্বান্তনা রহমানকে বুঝিয়ে শুনিয়ে নিয়ে গেলেন।তবুও স্বান্তনা রহমান মৃদুস্বরে নীহারিকা বেগমকে উদ্দেশ্য করে আওড়ালেন।

‘এই দুটোর জ্বালায় দেখবে একদিন আমি পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবো।বাপটা সারা বছর এদেশ সেদেশ আরাম করে ঘুরে বেড়াবে,আর আমার হয়েছে যতোসব জ্বালা।

নীহারিকা বেগম জানেন,এবার স্বান্তনা রহমান ছেলেমেয়ে ঝাঁঝ,ছেলেমেয়ের বাপের উপরে উঠাবে। মুখে বকেবকে শান্ত হতে না পারলে, ফোন দিয়ে শাহেদকে ইচ্ছেমতো বকেবকে তার চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করবে।

নীহারিকা বেগম আর স্বান্তনা রহমান চলে যেতেই নাফিম কৌড়ির দিকে ফিরে মুখটা অসহায় ভঙ্গিমাকরে বললো।—বিশ্বাস করো ফুলকৌড়ি আমি মোটেই দুষ্ট ছেলে নই।ও সারাক্ষণ আমাকে মোটু বলে ক্ষেপায়।আমার রাগ হয়না বলো?আর আমার চকলেট গুলোও চুরি করে নিয়ে নেয়।আমার চকলেট গুলো ফেরত চাইলে,ইচ্ছেকরে আমার সাথে ঝগড়া বাধায়।আমি ওর কোনো কিছুতে হাত দিলে আম্মুকে বলে আমাকে বকা শোনায়।তবে আমি কোনো ওকে ভালো বলবো।ওর কথা শুনবো?তুমি বলো আমি দুষ্ট ছেলে?

মান্যতা আবার-ও বেলকনিতে চলে গিয়েছে। মৌনতা চুপচাপ বসে ছিলো,নাফিমের কথাগুলো শুনতেই ফোঁস করে উঠলো সে।কিন্তু কৌড়ির নজরে নজর পড়তেই থেমে গেল।চুপচাপ উঠে রুম থেকে চলে গেলো।নিজের কোনো ভাইবোন ছিলোনা বিধায় এসব ঝগড়াঝাঁটির ঝামেলা হয়নি।নাফিমের গোলুমোলু মিষ্টি চেহারায় অসহায় ভঙ্গিমা ভালো লাগলোনা কৌড়ির।মিষ্টি হেসে, নাফিমের গাল দুটো টেনে দিয়ে বললো।

‘নাফিমতো মোটেই দুষ্ট ছেলে নয়,খুব ভালো ছেলে।তবে আপু তোমার বড় হয়না,তার সাথে এভাবে ঝগড়া করা ভালো ছেলে হয়ে মোটেই ঠিক হয়নি তোমার।আর আপু
তোমাকে দুষ্টমী করে উল্টাে-পাল্টা নামে ডাকে,যদি-ও ঠিক নয়।তাই বলে আপুর সিক্রেট তুমি সবার সামনে এভাবে বলে দেবে?আপু লজ্জা পায় না।

‘আমাকে মোটু বলে,আমার ভালো লাগে?

নাফিমকে জবাবে কি বলবে ভেবে পেলো না কৌড়ি।তবুও ভালোমন্দ কথা বলে এটাওটা বোঝাতে লাগলো তাকে।

ঝরঝরে নজর মুগ্ধ হওয়ার মতো একটা সকাল।নিজের আরামদায়ক বিছনায় বালিশ আঁকড়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে নিভান।চোখ বন্ধ থাকলে-ও,জেগে আছে সে।স্বপ্ন দেখে ঘুমটা ভেঙেছে তার।একজোড়া মুগ্ধকর আঁখিদ্বয় অশ্রুবরণ করে চলেছে।অথচ সে নিটোল চোখে চেয়ে চেয়ে সেই চোখজোড়া দেখছে,কিন্তু কিছুই বলছেনা।শুধু যে আজ স্বপ্নটা দেখেছে,এমনটা নয়।এই স্বপ্নের উৎপত্তি হয়েছে,আজ থেকে তিনদিন আগে।হঠাৎ এরকম একটা স্বপ্নের মানে টা কি,বুঝে উঠতে পারছেনা নিভান।এমন স্বপ্ন এর আগে সে কখনো দেখেনি।অথচ আজ তিনদিন ধরে রাতে ঘুমালেই একই স্বপ্ন দেখে চলেছে।রাতে যেকাবার এই স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে,পুনরায় আবার ঘুমাতে গেলে সেই একই স্বপ্ন।
ওই একজোড়া ক্রন্দনরতা চোখ তাকে আজ তিনদিন ধরে অস্থির করে তুলেছে।রাতের আরামে ঘুমটা তার হারাম করে তুলেছে।আর সময় অসময়ে চোখ বুঁজলেই ওই একজোড়া চোখ ভেসে উঠছে,তার বদ্ধ দুয়ারের অন্তরিক্ষে।বিষয়টা বেশ অদ্ভুত লাগছে তার কাছে।এইযে চোখ বন্ধ করে আছে।সেই মোটামোটা ভেজা আঁখি জোড়া ভেসে বেড়াচ্ছে তার বদ্ধ আক্ষিপটে।

চেনা পরিচিত এরকম কোনো নজরে নজর পড়েছে বলে মনে তো হয়না নিভানের।তবে আকস্মিক এরকম একটা স্বপ্ন রোজ রোজ দেখে যাওয়ার মানেটা ঠিক কি?বালিশের পাশে থাকা ফোনের তীব্র ভাইব্রেশনে ভাবনা কাটলো নিভানের।চোখ না খুলেই নির্দিষ্ট জায়গা থেকে ফোনটা হাতড়িয়ে নিলো।দেখার বিশেষ প্রয়োজন মনে করলোনা।কলটা কে করেছে,হয়তো বুঝে নিতে পেরেই চোখ বন্ধ রেখেই রিসিভ করে কানে ধরলো সে।

‘বল

গম্ভীর কণ্ঠটা আর-ও গম্ভীর।সেটা বুঝে ওপাশের মানুষটা সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো।

‘সকালে দৌড়াদৌড়ি না করে,এখনো শুয়ে আছিস যে?
ব্যাপার কি? শরীর ঠিক আছো তোর?
আজ তোর অফিস বাদে-ও রেস্টুরেন্টে সময় দিতে হবে মনে আছে তো।

‘হুমম।

‘রেস্টুরেন্টের দিকে কয়টায় আসবি?

এবার চোখ খুলে উঠে বসলো নিভান।বেড থেকে নেমে ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বললো–‘যে সময়টাতে রোজ বৃহস্পতিবার যাই।

‘ওকে।আয় তবে।দেখ,আরও একটু সময় নিয়ে তাড়াতাড়ি আসতে পারিস কি-না।এক সপ্তাহের মতো দেখা হয়না,একটু আড্ডা দেওয়া হবে।আল্লাহ হাফেজ।

নিভানের কাছে সময় চাওয়াটা অহেতুক তবুও বললো তৃনয়।নিভানও তৃনয়ের কথার উত্তর সরূপ কোনো জবাব দিলোনা,শুধু আল্লাহ হাফেজ বলে ফোনটা কেটে দিলো।


নিজেকে ফর্মাল ড্রেসে রেডি করে নিয়ে উপর থেকে নিচে নামতেই, ড্রয়িংরুমে দীবাকে-ও রেডি হয়ে বসে থাকতে দেখলো নিভান।সেদিকে বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে ডায়নিং খাবার রেডি করতে ব্যস্ত মায়ের দিকে তাকালো নিভান।স্বামী সংসার প্রিয় কাকে বলে এই নারীটিকে না দেখলে কেউ বুঝবেনা।

‘মা,আমি বের হচ্ছি।আল্লাহ হাফেজ।

‘সে-কি,খেয়ে যাবিনা।এইতো খাবার প্রায় রেডি।খেয়ে যা।

সামনের দিকে এগোতেই নিভান,নিহারীকা বেগমেকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলবে।তার আগেই দীবার পাশে বসা ফাতেমা বেগম গম্ভীর কন্টে বললেন।–নিভান, দাদুমনিকে একটু তোমার গাড়িতে করে তার গন্তব্য মতো পৌঁছে দিওতো।

ভদ্রমহিলা সম্পর্কে নিভানের দাদি হলেও তারসাথে বিশেষ সম্পর্ক নেই নিভানের।না নিভান উনাকে দাদীমা বলে ডাকে।আর না উনি নিভানকে অন্য নাতীদের মতো দাদুভাই বলে সম্বোধন করে।তবুও দুজন দু’জনের জায়গা থেকে সম্পর্ক ঠিক রাখার প্রয়াস করে যাচ্ছে।বিধায় দাদির চেয়েও গম্ভীর গলায় মা’কে উদ্দেশ্য করে তখনের উত্তরে নিভান বললো।

‘আমার আজ খেয়ে যাওয়ার সময় হবেনা মা।অফিসে ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং আছে।আমি বাহিরে খেয়ে নেবো।আর কারও বাহিরে যাওয়ার প্রয়োজন হলে আমার গাড়ীটা বাদেও বাড়িতে আর-ও দুটো গাড়ী আছে।হাফিজ ভাইকে মাসে মাসে বেতনটা বেকার বেকার দেওয়া হয় না।

চলে গেলো নিভান।শ্বাশুড়ি আর ননদ ঝি’য়ের অসন্তুষ্ট মুখের দিকে নিষ্পলক কিছুসময় তাকিয়ে থেকে নিজের কাজে মন দিলেন নীহারিকা বেগম।জাহিদ সাহেবের খাবার নিয়ে কেটে পড়লেন সহসা।যদিও নিভানের এহেন ব্যবহার নিয়ে শ্বাশুড়িমা আগে অনেক অভিযোগ আর কথা শোনালেও,এখন যে শোনাবেন না।এটা তিনি জানেন।তবুও শ্বাশুড়ির এই অসন্তুষ্ট মুখটা ঠিক ভালো লাগলোনা উনার।দীবা হয়তো জানতো,সে বললে নিভান নিয়ে যাবেনা।তাই নানিমাকে হয়তো নিভানকে বলার জন্য হাত করেছে, বুঝিয়েছে।কিন্তু এটাতেও যে নিভান গলবে না।সেটা এতোদিন ধরে নিভানকে দেখার পরও বুঝিনি মেয়েটা!

সকাল সকাল বাড়ির পিছনের বাগানটাতে গিয়েছিলো কৌড়ি।মুলত রানীসাহেবা তাকে নিয়ে গিয়েছিলো, তার করা সবজি বাগান দেখাতে।সেখান থেকে ফিরছিলো কৌড়ি।বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে ড্রয়িংরুমের ঘটনাটা সদর দরজায় দাঁড়িয়ে দেখেছে সে।মানুষটা এমন অদ্ভুত টাইপের কেনো?কাল যে ধমকটা দিলো,তারপর আর ওই মানুষটার সামনে পড়তে চায়না কৌড়ি।যদি কোনো কারনবশত মানুষটার সামনে সেও কোনো ভুল করে ফেলে,আর সেই ভুলের জন্য যদি ওরকম ঘর কাপিয়ে একটা ধমক দেয়,ওই অদ্ভুত মানুষটা।তবেতো সে শেষ।সেদিনই তার জানাজার ব্যবস্থা করতে হবে।তাই রানিসাহেবা ভিতরে চলে গেলেও সে ভিতরে ঢুকতে পারলো-না।নিভান সদর দরজার দিকে আসতে দেখেই তড়িৎ গতিতে ফের বাগানের দিকে চলে গেলো সে।
নিভানও বুঝতে পারলো,কেউ তাকে দেখে দৌড়ে চলে গেছে।

বাড়ির লন এরিয়াতে পা রাখতেই কাওকেই সেভাবে নজরে পড়লোনা নিভানের।আর এসময়ে তো মৌনতা, নাফিম কেউই বাড়িতে থাকে-না।তবে?ভাবনা আর সামনে এগোলো না নিভান,গাড়িতে উঠে বসলো।তবে তার তীক্ষ্ণ অনুভব শক্তি বলছে,কেউ তাকে সুক্ষ নজরে পর্যবেক্ষণের করছে।হয়তো তার চলে যাওয়ারই অপেক্ষা করছে।গড়ীতে বসেই আরও একবার সতর্ক নজর আশেপাশে বুলালো নিভান।হঠাৎ নজর উপরের দিকে যেতেই দেখলো,সদ্য ঘুম থেকে উঠা ইভান বেলকনির রেলিঙে দুহাত দুপাশে ভর করে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে।দুই ভাইয়ের মধ্যে গলাগলি টাইপের বিশেষ সম্পর্ক নেই।তবে যেটুকু আছে দুজনের ভিতরে পুষে রেখেছে। কেউ কাওকে সেই অনুভুতি দেখাতে রাজী নয়।নিভান মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার আগেই ইভান তারদিকে তাকালো।কৌড়ির লুকানোর ব্যপারটা হয়তো কিছু বুঝে ফেলেছে সে।তাই নিভানকে চোখ দিয়ে বাগানের পাশে পিলারের আড়ালে নজর দিতে ইশারা করলো।ইভানকে ইশারা করতে দেখে একটু আশ্চর্য হলেও, ইশারা বুঝতে সময় নিলো না নিভান।কপাল কুঁচকে সেদিকে তাকাতেই নজর শিথিল হয়ে এলো তার।কাল রাতে নাফিমের মোটাতাজা শরীরের বাহুভেদ করে ডগরডগর যে নজরজোড়া উঁকি দিয়েছিলো,সেই ডগর ডগর নজরজোড়া আজ পিলারের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে।কাল কম্পিত ভয়ার্ত ছিলো আর আজ সে নজরজোড়া সতর্ক।কপাল এবার একটু নয় বেশ কুঁচকে গেলো নিভানের।

‘মানেটা কি?তাঁকে দেখে এরকম লুকানোর কি আছে?অদ্ভুত মেয়ে তো বটে,আশ্চর্য!তবে নিভানের মনেহলো ওই মেয়েটার ডগরডগর নজরজোড়ার সাথে কোথা-ও একটা খুব সাংঘাতিক মিল আছে।কাল রাতে-ও তার মনে হয়েছিল। তবে কোথায়?তার স্বপ্নে দেখা ক্রন্দনরত চোখজোড়া!

চলবে….

#ফুলকৌড়ি
(৭)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

সকাল থেকেই মায়ের পিছনে ঘ্যান-ঘ্যান করে চলেছে মান্যতা।শরৎকাল শুরু হতে না হতেই তার সব বান্ধবীগুলো,কি সুন্দর লাল পাড়ের সাদা শাড়ী পরে সেজেগুজে কাশফুলের রাজ্য থেকে ঘুরে এসেছে।ফেসবুকে কতো সুন্দর সুন্দর পিক আপলোড করেছে।আর দুটো ’মাস নিয়ে এক একটা ঋতু, অথচ শরৎ এর একমাস পার হয়ে গেলো।সে এখনো যেতে পারলো-না।পেঁজা তুলোর মতো শুভ্র কাশফুলের নরম পাপড়িগুলো কে ছুঁয়ে দেখতে পারলো-না।ভাল্লাগে না।নীহারিকা বেগম দুপুরের রান্নার বন্দোবস্ত করছিলেন।মেয়ের এমন ঘ্যানঘ্যানানিতে অতিমাত্রায় বিরক্ত হলেন।এতোবড় মেয়ে এরকম কানের পাশে অযথা প্যানপ্যানানি করলে কার ভালো লাগে।ভার্সিটিতে যাওয়া বাদ দিয়ে,এখন তিনি কাশফুলের রাজ্য হারিয়ে যাওয়ার বাহানা জুড়েছেন।

‘এই তোদের ভার্সিটির পশ্চিম এরিয়াজুড়ে না কাশফুলের আগান-বাগান।তবে সেই জিনিসটা আবার আলাদা করে অন্যত্র দেখতে যাওয়ার মানেটা কি?

‘মা,আমাদের বাড়িটাতো জমিদার বাড়ি থেকে কোনো অংশে কম নয়,তবে আলাদা করে দিয়াবাড়ি,রাজবাড়ি, জমিদারবাড়ি এগুলো দেখতে যাওয়ার দরকারটা কি? ব্যাপার তেমনই।জানো না, গোয়ালের দোরগোড়ায় ঘাষ গরুর মুখে রোচে না।

‘তা যা বলেছিস!খুব ভালো জিনিসের সাথে নিজের তুলনা করেছিস।নাহলে তোকে বোঝাতে এতো কাঠখড় পোড়ানো লাগে।

সিরিয়াস ভঙ্গিতে কথাটা বললেও,কথার মধ্যে যে তাকে নিয়ে কঠিন অবজ্ঞা করা হলো।বেশ বুঝলো মান্যতা।নাকে কেঁদে জোরেশোরে মা’কে ডেকে উঠলো সে।

‘আম্মু।

নীহারিকা বেগম সে ডাকে গুরুত্ব দিলেন না। মান্যতা ফের বললো।

‘আমি কিন্তু আমার বান্ধবীদের সাথে যেতে পারতাম কিন্তু সেটা আব্বু শুনলে মনোক্ষুণ্ণ হতো।আর বড়ো- দাদাভাই জানলে রাগারাগি করতো।যা আমিও চাইনা।তাই বলে এসব বলবে তুমি?

‘বড় হয়েছো বলে এখনো এতোবড় হয়ে যাওনি,যে বাবা মায়ে’র অনুমতি ছাড়া বাঁধনহারা পাখির মতো উড়ে বেড়াবে।আর এবাড়ির মেয়েদের যে সেভাবে চলতে দেওয়া হয়নি,এটা তুমি-ও খুব ভালোভাবে জানো।

হঠাৎ মায়ের কন্ঠ গম্ভীর হয়ে যাওয়ার, নিজের বলাকে সংযাত করলো মান্যতা। ফের মিনমিনে গলায় বললো।

‘এজন্যতো তোমার অনুমতি চাইছি।তুমি, বাবাকে আর দাদাভাইকে বুঝিয়ে বলবে।অবশ্যই শুধু দাদাভাইকে বুঝিয়ে বললে হবে,দাদাভাই যেটাতে সম্মতি দেয়।সেই সিদ্ধান্তে তো বাবা আর কখনো অমত পোষন করেননা।
ও আম্মু?

এবার মান্যতার ঘ্যানঘ্যানানিতে অতিমাত্রায় বিরক্ত হলেন নীহারিকা বেগম।বিরক্তি স্বরে বললেন।

‘যাবি ভালো কথা।তবে বাড়ির গাড়িতে করে।আর ভুলেও সাথে রানীকে না নিয়ে যাওয়ার বাহানা একটুও করবিনা।তবেই যেতে পারবি।

‘আমি তো একা যাবোনা সাথে দীবা আপুও যাবে। তবে রানীসাহেবাকে আবার কি দরকার?

‘রানীসাহেবাকে কি দরকার মানে?ও গেলে সমস্যা কোথায়?ওর বুঝি ঘুরতে মন চায়না।আর ওকে তোদের সাথে কোথাও পাঠালে আমি একটু স্বস্তিতে থাকতে পারি।যদি-ও সব আল্লাহ ভরসা।সন্তানদের নিয়ে বাবা মায়ের কতো দুশ্চিন্তা, জ্বালা ও তোরা কি বুঝবি।বিয়ে হোক,সন্তান জন্ম দে তারপর বুঝবি।মা কোনো অযথা অকারণে সন্তানের নিয়ে চিন্তা করে,বিশেষ করে মেয়ে সন্তানদের নিয়ে।একই পেটে লালিত হওয়া কোন সন্তানকে ছোটোবড় কেমন চোখে দেখে,আর কাকে কম-বেশি কতোটা ভালোবাসে।আর তাদের নিয়ে ভালোমন্দ কতো চিন্তা ভাবনা মায়ের।সময় হলে ঠিকই বুঝবি।

মান্যতা জানে,শেষের এমন কথাগুলো মা এতোটা আক্রোশ নিয়ে কিসের জন্য তাকে শোনালো।ছোটো দাদাভাই যে সবসময় বাবা মায়ের মুখের উপর বলে দেয়,বড়দাদা ভাইকে বাবা মা বরাবরই বেশি প্রায়োরিটি দেয়,বেশি ভালোবাসে।সেজন্য আম্মু মাঝেমধ্যে এরকম কথা তাকে উদ্দেশ্য করে শুনিয়ে থাকেন।মান্যতা মায়ের মন খারাপটা বুঝে নরম গলায় বললো।

‘আচ্ছা রানিসাহেবাকে নিয়ে যাবো।তবুও এরকম দুঃখী দুঃখী কথা বলবেনা তো।ও আম্মু, তুমি আর ছোটমা-ও যাবে নাকি আমাদের সাথে ঘুরতে?

অদ্ভুত নজরে মেয়ের দিকে তাকালেন নীহারিকা বেগম।
ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে, তা দেখে জোর করে মুখে হাসি টেনে কেটে পড়লো মান্যতা।তাকে রান্নাঘর ত্যাগ করতে দেখে নীহারিকা বেগম গম্ভীর গলায় বললেন।–তোদের সাথে কৌড়িকেও নিয়ে যাস।মেয়েটা সারাদিন মন খারাপ করে রুমে বসে থাকে।কারও ডাকে ছাড়া সহজে রুম থেকে বের হয়না।ও-কে ও সাথে করে নিয়ে যাস।বাহিরে একটু ঘোরাঘুরি করলে মেয়েটার মনটা একটু ভালো হবে।

কৌড়িকে এমনিতেই নিজের সাথে নিয়ে যাওয়ার প্লান ছিলো মান্যতার।মা বলতেই সেটা শিরোধার্য হয়ে গেল।

.

শরৎ ঋতুর পরিপূর্ণ সৌন্দর্যতার বিবরণ মনেহয় এক কাশফুলেই বহন করে।পৃথিবীতে নানাধরণের নজরকাঁড়া অপরূপ সৌন্দর্যময় ফুল আছে।তবে যে কারও মন কেড়ে নিতে মনেহয় শরৎ ঋতুতে ফোটানো কাশফুলের জুড়ি নেই।কাশফুল মানে অবাধ অপরূপ সৌন্দর্য।স্নিগ্ধ ভরপুর সাজানো একটা বিকেল।সেই স্নিগ্ধতায় ভরপুর বিকালটা কাশফুলের দুলে দুলে বয়ে যাওয়া অবাধ সৌন্দর্যে মন আরও সতেজতায় ভরিয়ে তুলছে।বিস্তৃত নীল আকাশটা যদিও মৃদুতর ছড়াছড়া কালো মেঘমন্দ্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।বৃষ্টি আসবে কি-না কারও জানা নেই।তবুও চারপাশের পরিবেশটা নজর মন আবেশিত করে দেওয়ার মতোই স্নিগ্ধকর।নতুন নববধূবেশে থাকা বউয়ের রূপের মতো নজরকাঁড়া,মনোমুগ্ধকর।

উত্তরার দিয়াবাড়ির কাশফুল বাগানের পিচঢালা পথের প্রান্তরে ,পকেটে হাত গুঁজে হেঁটে চলেছে নিভান।পাশে পায়ে পা মিলিয়ে হেঁটে চলেছে তৃনয়।দায়িত্ব আর কাজ পাগল ছেলেটার কাজ থাকা সত্ত্বেও, এখানে একপ্রকার জোর করে নিয়ে এসেছে সে।প্রথম একটু রাগারাগি করলেও, শরতের এই মনোমুগ্ধকর বিকাল দেখে তার বন্ধু রূপে ছেলেটার রাগ পড়েছে মনেহয়।শ্যামবর্ণ মুখের শান্ত অবয়বটা দেখেতো অন্তত তাই মনেহচ্ছে।এতো সময় চুপচাপ দু’জনে হাটলেও এবার মুখ খুললো তৃনয়।

‘স্কলারশিপ পেয়েও নিজের স্বপ্নপূরণে পিছু হাটলি,বি সি এসটা তো অন্তত দিতে পারতিস?এখানে কিন্তু আঙ্কেলের দোষ দেওয়া যায় না।স্কলারশিপ পেয়ে তখন পরিস্থিতির খাতিরে আঙ্কেলকে সাপোর্ট দিতে বাহিরে যেতে পারিসনি, ঠিক আছে।কিন্ত যখন পরিস্থিতি ঠিকঠাক হলো তখনতো আঙ্কেল সাপোর্ট দিয়েছিলো তোকে।পিছুপা হলি কেনো?

সব জায়গায় নিজের আবেগ অনুভূতি দৃঢ়চিত্তে চেপে রাখার চেষ্টা করলেও,দু’জন ঘনিষ্ঠ বন্ধু যখন একজায়গায় হয়।দু’জনে মন খুলে কথা বলার চেষ্টা করে।যদি-ও নিভান কমই বলে।বিকেলের হিমেল হাওয়ায় সাদা কাশফুলের ভেলাগুলো দুলেদুলে চলছে।সেদিকে একপলক তাকিয়ে সামনের দিকে নজর দিলো নিভান।তৃনয়ের কথার উত্তরসরূপ কিছু সময় তাকে অপেক্ষা করালো।ফের বললো।

‘উনাকে ওই অবস্থায় রেখে,আমি নিজের স্বপ্নপূরণের কথা ভাবিনি।কারন আমার বিবেক ঋনি ছিলো উনার কাছে।সেটা শোধ করবার পালা এসেছিলো তখন।আর পরিস্থিতি ঠিক হলে পরবর্তীতে যাওয়ার কথা বলছিস, আমি,জে এস জে ইন্ডাস্ট্রির কর্নধরের চেয়ারে বসে সমস্ত কিছু পরিচালনা করলেও,সেখানের কোনো কিছুর দাবিদার,হকদার বলে নিজেকে মানিনা।আমি যা হতে চেয়েছিলাম,সেটা শুধুমাত্র নিজের মেধা আর চেষ্টাতে।সেখানে যখন বাঁধা পড়েছে, ইনাফ।আর বি সি এস।প্রিপেইড হয়েছিলাম,চেয়েছিলাম পরিক্ষা দেবো।কিন্তু সেভাবে সময়টা আর পেলাম কোথায়।উনি আর মা-ও নিষেধ করলেন।

নিভানের জীবন বৃত্তান্ত সম্পর্কে মোটামুটি জানা তৃনয়ের,তাই আর ঘাটালো না সে।তবে ছেলেটার এই সারাদিনের ব্যস্ত লাইফ,দায়িত্ব, কাজ।সবকিছু ভালো লাগলেও,নিভানের এই অতি নিস্পৃহতা ভালো লাগেনা তৃনয়ের।কলেজ লাইফ থেকে বেস্ট ফ্রেন্ড তারা,তৃনয়ের আগে নিভানের কোনো বেস্টফ্রেন্ড ছিলো বলে জানা নেই।শান্ত গম্ভীর ছেলেটার ভার্সিটি লাইফে এসে কিছু সংখ্যক বন্ধু হলেও,কলেজ লাইফ থেকে একমাত্র বন্ধু ছিলো তৃনয়।গম্ভীর ছেলেটার সাথে ফ্যামিলি, আর্থিক, সবদিক থেকে বেশ তফাৎ থাকলেও,কিভাবে কিকরে জেনো খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেলো তারা।মায়া আর অদ্ভুত এক টানের সম্পর্ক তৈরী হলো।সেখান থেকেই নির্দ্বিধায় একে অপরের ভালো মন্দটা জানা,বোঝা।

‘তুই ভুল ধারনা পোষন করে আছিস।আঙ্কেলের নজরে তুই তার বড় সন্তান।মান্যতা, ইভান,সবার মতো সবকিছু পাওয়ার,সব অধিকারের যোগ্য সন্তান হিসাবে তোকে তিনি সেই সম্মাননাটা দিয়ে আসছেন তুই।তারপর উনার সবকিছু তোর কিছুই নয়,এটা কেনো ভাবিস। যে প্রায়োরিটিটা উনি তোকে দেয়,সেখান থেকে তোর মুখে উনি শব্দটা আমার তাই ভালো লাগে-না।সেখানে উনার কেমন লাগার কথা তোর আমার সবার জানা কথা।তবুও তিনি কিন্তু উনার সবকিছুর যোগ্য উত্তরাধিকারী মনে করে উনার ইন্ডাস্ট্রির সমস্ত পরিচালনার ভার তোর হাতে তুলে দিয়েছেন।তোর ভালোমন্দ যেকোনো সিদ্ধান্তঃ বিনাবাক্যবয়ে মেনে নেন।তারপর ও তোর মনে হয়ে তুই উনার কিছুই না?

এই প্রথম নয় এর আগেও এমন বিভিন্ন কথা বুঝদার কথা দ্বারা ছেলেটাকে বোঝানোর চেষ্টা করে তৃনয়।কিন্তু যে বুঝদার তাকে কি অন্য কেউ শত বুঝিয়েও বুঝদারের কিনারার সন্ধান দিতে পারে।তৃনয়ের ভাবনার মাঝে নিভান দৃঢ় গলায় বললো।

‘আমি জানিনা, আমার সবসময় কেনো মনেহয় আমি ওবাড়ির কেউ না।শুধু মা আছে বলে তাই মনেহয় ওবাড়িতে থাকা।

‘এসব কেমন কথা নিভান।ইভান মান্যতা তোর ভাইবোন।ছোট থাকতে ইভান যা করেছে করেছে,এখন কিন্তু তোকে মানেও।যদি-ও সেটা ওর হাবভাবে বুঝতে দেয়না।আর মান্যতা,আঙ্কেলের মতো সে-ও তার দাদাভাইয়ের সমস্ত সিদ্ধান্ত চোখ বুঁজে মেনে নেয়।তবুও তুই এরকমটা কি করে বলতে পারিস?শুধু গুটিকয়েক মানুষের জন্য,তোর কাছের মানুষের অনুভূতি গুলো এভাবে ইগ্নোর করতে পারিস না।

নিভান উত্তর দিলোনা।দৃঢ় চোয়ালে সামনের দিকে এগিয়ে চললো সে।হয়তো তৃনয়ের কথাই ঠিক,সম্পর্কে এতো কঠোরতা ঠিক নয়।নিজেকেও বা এতো ছোটো করে দেখা ঠিক নয়,যেখানে সবাই তাকে মাথায় তুলে রেখেছে।ভাবনা সেদিকে আর এগোলোনা।না চাইতেও গম্ভীর মুখাবয়বের ঠোঁটের কোণ প্রসারিত করল।প্রসঙ্গ এড়াতে বললো।

‘আমাদের বাঙালিয়ানা রেস্টুরেন্টের নামটা কিন্তু তোর হাতের দুধ চিংড়ীর রেসিপি,কলাপাতায় মোড়ানো ইলিশে ভাপা,আর সাধারণ ঘি পোলাওটা কিন্তু বেশ নাম-ডাক করিয়ে দিয়েছে।সপ্তাহে বৃহস্পতিবারে এই দিনটায় কি পরিমান লোকের সমাগম হয় এই রেসিপি গুলোর জন্য আমাদের রেস্টুরেন্টে।দেখেছিস? যদি-ও আমাদের বাঙালিয়ানা রেস্টুরেন্টের সব খাবারের মোটামুটি নামডাক আছে।তবে সিক্রেট শেফের হাতের এই রান্নাগুলো কিন্তু বেশ মজা করেই খায় খাদ্যপ্রিয় মানুষগুলো।

নিভান প্রসঙ্গ এড়াতে চাইছে।বুঝতে পেরে দীর্ঘশ্বাস ফেললো তৃনয়।নিভান ফের বললো–যদিও রেসিপিগুলো কমন,তবুও তোর হাতের আলাদা স্পেশালিটি থাকায় রান্নার স্বাদগুলো আলাদা হয়।চেষ্টা তো আমিও করি।তবুও তোর রান্নার মতো স্বাদ আনতে পারিনা কেনো?কার হাতের স্পেশাল রেসিপি এই রান্নাগুলো,আজ আমাকে বলতো?যে হুবুহু তার হাতের গুনটা রপ্ত করেছিস?আন্টির হাতের?

‘যদিও মা রান্নাগুলো জানেন।এবং খুবই সুন্দর রান্না করেন। তবে আমি দাদিমা যেভাবে রান্না করতেন,সেটাই রান্নার সময় বেশি ফলো করি।উনার রান্নার হাতটা দারুন ছিলো।বাবা চাচারা,আমরা ভাইবোনেরা সবাই উনার হাতের রান্না খুবই তুষ্টতার সহিত ভোগ করতাম।

গম্ভীর মুখে এক টুকরো হাসি ফুটলো,সঙ্গে সঙ্গেই তা আবার মিলিয়ে গেলো।তৃনয়ের কথার উত্তর সরূপ ঘাড় বাকিয়ে শুধু একবার তারদিকে তাকালো নিভান।শীতল গলায় বললো।

‘আমাদের রেস্টুরেন্টেটা যেমন আমরা সাধারণভাবে উপস্থাপন করে,সেখানে নামীদামী নয় অতিসাধারণ সব বাঙালিয়ানা খাবারেরই জোগান দিতে চেয়েছিলাম।সেরকম সাধারণ ভাবে রান্নার মধ্যে অসাধারণ হয় তোর বানানো রেসিপিগুলো।যেটা আমাদের রেস্টুরেন্টেটাকে আরও উন্নতি সাধন করতে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

‘হয়তো।তবে সু-গৃহিনী হওয়ার কথা ছিলো আমার বউয়ের হয়ে গেলাম আমি।

হেসে দিলো তৃনয়।সেটা দেখে নিজের মুখের হাসিটা আরও একটু প্রসারিত করলো নিভান।বললো–সুগৃহিনী হওয়া কি শুধু স্ত্রীলোকের দায়িত্ব,নাকি এটা শুধু তাদেরই কর্ম?দেশ বিদেশের ছোটো বড় নামাদামী সব হোটেল রেস্তোরাঁ গুলোতে গিয়ে দেখ,সেখানে বড়বড় ডিগ্রীধারী শেফ-রা,অধিকাংশ পুরুষই।

‘হুম এজন্য তো স্কলারশিপ পেয়ে বিদেশ থেকে ডিগ্রী অর্জন করে-ও,নিজের ইচ্ছেপূরনে নেমেছি।যদি-ও চাকরীর জন্য বিভিন্ন ভার্সিটিতে-ও এপ্লাই করছি।একটা প্রাইভেট ভার্সিটি থেকেও অফার এসেছে।দেখি করা যায়।

দেশে চাকরীর বড় অভাব।চাইলে তৃনয় বাহিরের দেশে সেটেল্ড হয়ে যেতো পারতো।তবে আরও একটা কারনে সে ওই সূদুর বিদেশভুইয়ে থাকতে পারিনি।তবে সেটা নিভানের সামনে উহ্য করে বলতে সাহস পায়না,আর না সেই সাহস দেখাতে চায় সে।যদি না এতো বছরের বন্ধুত্বে ফাটল ধরে যায়?আর যে প্রিয় মানুষটাকে পাওয়ার সাধনায় তার মন আকৃষ্ট হয়ে রয়েছে,যোগ্যতায় সেই মানুষটাকে মুখ ফুটে চাওয়া যে বড়োই অপরাধ।হঠাৎ নিভানকে থামতে দেখে ভাবনা কাটলো তৃনয়ের।নিভানের কুঞ্চিত নজরের দিকে তাকিয়ে সামনে তাকাতেই নিজের হৃদপিণ্ড ছলাৎ করে উঠলো তার।সেই প্রিয় মুখটা।ফর্সা শরীরে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি জড়ানো, কি স্নিগ্ধ কি সুন্দর দেখাচ্ছে।শরতের কাশফুলে সাজানো বিকালটাও জেনো সেই সৌন্দর্যের কাছে ফিকে মনে হলো।নজর সরিয়ে নিলো তৃনয়।অবাক কন্ঠে শুধালো।

‘মান্যতারা এখানে আসবে তুই জানতিস না?দীবা আর মৌনতাও এসেছে দেখছি।

তৃনয়ের কথার উত্তর দেওয়ার আগে,প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করতে উদ্যোক্ত হলো নিভান,মা-কে ফোন দেবে তাই।তার আগে রানীসাহেবাকে গাড়ী থেকে বের হতে দেখে হাত থেমে গেলো,বুঝলো মায়ের অনুমতি নিয়েই বেরিয়েছে তারা।মান্যতারা আসবে সে জানতো না।উত্তরটা দিয়েই পিছে মুড়ে,গাড়ি যেখানে রাখা সেদিকে যাওয়ার জন্য এগোলো। তবে তৃনয়ের কথায় থেমে গেলো,তবে পিছে মুড়লো না।

‘এই নিভান, মান্যতাদের সাথে ওই নতুন মেয়েটা কে-রে?এতো অনিন্দ্য সুন্দরী?

চোখ বন্ধ করতেই,হঠাৎই সেই ক্রন্দনরত চোখজোড়া আবারও ভেসে উঠলো নিভানের বদ্ধ অক্ষিপটে।সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলে ফেললো সে।ভুলে-ও পিছে মুড়লো-না।তবে নতুন মেয়েটা বলতে কে বুঝতে পারলো। তীক্ষ্ণ গলায় কথার বান ছুড়ে দিলো তৃনয়ের দিকে।

‘অনিন্দ্য সুন্দরীকে নজরে লেগেছে নাকি?

‘আল্লাহুম মাগফিরুলি।এগুলো কি বলিস!আমি-তো, তাকে দেখে এমনিতেই কথাটা বলে ফেললাম।যতো অনিন্দ্য সুন্দরি আমার সামনে দিয়ে যতোই ঘুরে বেড়াক না কেনো,আমার নজর সেখান থেকে কুঞ্চিতও নাড়াতে পারবেনা।

ঘাড় বাঁকিয়ে তৃনয়নের দিকে তাকাতেই,বোকা হেসে দিলো তৃনয়।বললো-ওরা হয়তো আমাদের দেখিনি।তাই বলে আমাদের যাওয়া উচিত নয়,ওদের দিকে?হঠাৎই দেখা যখন হয়ে গিয়েছে, চল কথা বলে আসি।

শীতল চোখে তৃনয়ের দিকে তাকাতেই সে ফের বললো-তুই এরকম হইছিস ক্যান ভাই।এতো অনুভূতি শূন্য।এরকম থাকলে বউ টিকবেনা তোর।

‘নিজেরটা টিকিয়ে দেখাস তারপর আমার কথা ভাবিস।আমারটা টিকবে কি টিকবেনা,সেটা আমি বুঝে নেবো।এখন চল আমার অফিসে অনেক কাজ পড়ে আছে।যেতে হবে।

সামনে এগোলো নিভান।কিন্তু তৃনয়ের পা কিছুতেই সামনে এগোতে চাইলো-না।প্রিয় নারীটাকে শাড়ী পরা অবস্থায় কাছ থেকে একটু দেখতে পেলো-না।কি আফসোস।পিছে ফিরলো আরও একবার।আফসোস জেনো আরও জোরালো হলো।ফের সামনে ফিরে, বিড়বিড় করে নিভানকে বকতে বকতে এগোলো সে।

‘নিজের অনুভূতি তো সব বিসর্জন দিয়েছে, এখন তাকে জুটি বানিয়ে তার গুলোও বিসর্জন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত নিচ্ছে।

বিকালবেলা ঘুম থেকে উঠে যখন বাড়িতে বোনদের কাওকে দেখলোনা নাফিম।এমনকি কৌড়িকে-ও না। তখন কেঁদে কেটে স্বান্তনা রহমানকে অস্থির করে তুললো।কেনো বোনেরা তাকে নিয়ে গেলো-না, সন্ধ্যার পরে তারা বাড়িতে ফিরলেই নানা অভিযোগ জুড়লো নাফিম।মৌনতা সেই অভিযোগে একদম গুরুত্ব না দিলেও।দীবা বুঝালো তাকে।কাজ হলো-না।কৌড়ি বুঝালো তবু-ও মুখ ভার করে রইলো,কথা বললো-না তার সাথে।কৌড়ি যেতে চাইনি।মান্যতা একপ্রকার তাকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিলো।তাতে আবার শাড়ী পরিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো,শেষে কৌড়ি যেতে চাইলেও।শাড়ী আর পরেনি।দীবা আপু আর মান্যতা আপু শাড়ি পরে গেলেও।সে আর মৌনতা সাধারনভাবেই গিয়েছিলো।

চেষ্টা করেও যখন নাফিমের গোমরা মুখের আদল কেউ পাল্টাতে পারলোনা।তখন মান্যতা,নাফিমের কাছে এসে তার ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললো।

‘আচ্ছা ভুল হয়েছে তোকে নিয়ে যায়নি,কিন্তু এখনতো কিছু করার নেই।তবে ভুলের মাশুল হিসাবে আমি সুন্দর একটা অফার দিচ্ছি। কাল তোকে অনেকগুলাে চকলেট কিনে দেবো,আর আজ রাতে তুই ঘুমোনো অব্দি আমার ফোনটা তোরকাছে থাকবে।তুই যতো ইচ্ছে কার্টুন দেখ।

রাগ ভেঙে নাফিম উৎফুল্ল হয়ে বললো।—সত্যি বলছো বড়আপু।

‘তিন সত্যি।

নাফিমকে মানাতে পেরে খুশি হলো মান্যতা। নাফিম- ও খুশিমনে ফোন নিলো।কাল স্কুলে সাপ্তাহিক ছুটি,আর সপ্তাহের এই দু’দিন প্রাইভেট টিচার আসে না তার।এখন সে ইচ্ছেমতো কার্টুন দেখবে,গেইম খেলবে।ড্রয়িংরুমে বসেই ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে।স্বান্তনা রহমান খানিক বিড়বিড় করে বকে নিজের রুমে চলে গেলেন।সারা বিকাল থেকে সন্ধ্যা ছেলের বকবকানিতে মাথা ধরেছে উনার।এখন একটু না শুয়ে পড়লে নয়।এরকম যে যার কাজে চলে গেলো।

রাত সাড়ে নয়টা বাজে তখনও নাফিম ড্রয়িংরুমে বসে ফোন দেখছে।স্বান্তনা রহমান আর নীহারিকা বেগম রাতের খাবার সাজাচ্ছেন ডাইনিং টেবিলে।সাথে রানিও এটাওটা এগিয়ে গুছিয়ে দিচ্ছে। এই চারটা মানুষ বাদে নিচে কেউ নেই।বাড়ির কলিং বেলটা বাজতেই রানি সাহেবা গিয়ে দরজা খুলে দিলো।সেদিকেও হুঁশ নেই নাফিমের।সে এতো সময় ফোনে গেইম খেললেও,এখন মান্যতা গ্যালারি ভরা পিকগুলো দেখতে ব্যস্ত।

হঠাৎ মনেহলো তার পাশে এসে কেউ বসেছে।পাশ ফিরে তাকাতেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল সে।উৎফুল্লতায় ডুবে থাকা মুখটা সঙ্গে সঙ্গে মিইয়ে গেলো।দাদাভাই কখন এসে পাশে বসলো!মা এতো সময় বারবার সাবধান করে যাচ্ছিলো।বলছিলো,তোর দাদাভাই আসার ডময় হয়ে গেছে ফোনটা রাখ।এসে যদি দেখে পড়া বাদ দিয়ে ফোনে গেম খেলছিস,দেখিস!সেই তাই হলো? হঠাৎ বোকার মতো কাজ করে বসলো নাফিম।পরাস্ত সৈনিকের মতো ফোন নামক অস্ত্রটা সসম্মানে নিভানের দিকে বাড়িয়ে দিল।সেটা দেখে কপাল কুঞ্চিত হলো নিভানের।হাত বাড়িয়ে সেটা নিতেই নাফিম দৌড়ে চলে গেলো।আশ্চর্য হয়ে সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নজর ফিরিয়ে আনতেই,নাফিমের রেখে যাওয়া ফোনের গ্যালারিতেই নজর স্থির হয়ে গেলো।

হালকা কলাপাতা রঙের একটা সালোয়ার কামিজ পরা মেয়েটার।ফর্সা সাধাসিধা গোলগাল মুখটা আটকে আছে গাঢ় জলপাই রঙা একটা হিজাবে।সেভাব কিছুতে নজর আটকালো না নিভানের। নজর সোজা গিয়ে আটকালো মান্যতার পাশে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটার ডগরডগর কাজল-কালো চোখে।শীতল,স্থির নজরে সেই চোখে তাকিয়ে রইলো কিয়দক্ষন।নিঃসন্দেহে মায়াবীনি যাদুময়ী দু’টো চোখ।

ফোনটা রাখতে গিয়েও,রাখতে পারলোনা নিভান।মন টানলো।যে জিনিসটা কখনো করা হয়নি,সেটাই করতে বাধ্য করলো নিজের মন।মান্যতার ছবিটা একপাশে ফেলিয়ে কৌড়ির ছবিটা জুম করলো সে।সত্যিই তৃনয়ের ভাষ্যনুযায়ী অনিন্দ্য সুন্দরী মেয়েটা।ছবিটা আরও জুম করতেই,কৌড়ির মোটামোটা চোখজোড়া স্কিনের উপরে আরও বড় হয়ে ধরা দিলো।কাছ থেকে সেই যাদুময়ী মায়াবিনী ডগরডগর চোখজোড়া,গভীর আর নিস্প্রভ নজরে দেখলো নিভান।হঠাৎই ফোনটা সোফার একপাশে রেখে দিয়ে, নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।আশেপাশে ভুলেও নজর না দিয়ে গটাগট সিঁড়ি পথ ধরলো।রুমের মধ্যে গিয়ে বাহিরের পোশাক ছেড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে চোখেমুখে পানির ছিটা দেওয়ার সময় চোখ বন্ধ করতেই,সেই ক্রন্দনরত চোখজোড়া ভেসে উঠলো বন্ধ অক্ষিপটে।চোখ খুলে ওয়াশরুমের আয়নার নিজের প্রতিবিম্বের দিকে নজর দিলো নিভান।মনেমনে বিড়বিড়ালো।

‘নারী তুমি সত্যিই ছলনাময়ী।আর তোমার কঠিন ছলনা হলো,চোখের নোনাঅশ্রুদ্বারা পুরুষকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করা।

চলবে….

ফুলকৌড়ি পর্ব-৪+৫

0

#ফুলকৌড়ি
(৪)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

নিভানের সাথে কথা বলার একপর্যায়ে জাহিদ সাহেব লক্ষ্য করলেন,নিভানের চোখজোড়ার রক্তিম আভা।ছেলেটা কি কোনো কারনে অসুস্থ!প্রশ্নটা মনেমনে আওড়াতেই সংগোপিত দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।এই ছেলে নিজের ভালোমন্দটা সহজে কখনো কারও সামনে বুঝতে দিতে চায়না আর বহিঃপ্রকাশ করা তো দূর।করে-ও না।এই যেমন এখন,ভিতর অসুস্থতাবোধ করছে অথচ বাহিরটা কতোটা স্বাভাবিক রেখে উনার সাথে কথা বলে চলেছে ছেলেটা।মনেহচ্ছে সুস্থ সবল একজন মানুষ।অথচ নিভানের প্রতি সন্তান হিসাবে স্নেহ ভালোবাসা ছাড়াও উনার আলাদা একটা টান,মায়া রয়েছে।মনের ভিতরে দৃঢ়ভাবে কাজ করে সেই মায়া,সেই তীক্ষ্ণ টান।সেই মায়ার টান থেকে তিনি নিভানকে কিকরে জেনো বুঝে নিতে পারেন।নীহারিকাকে নিজের জীবনে জড়ানোর সাথে সাথে নীহারিকার এই অতি মূল্যবান রত্নটাকে-ও তো তিনি নিজের ভেবে নিয়েছিলেন।সেই মায়া,টান থেকেই তো নিয়েছিলেন।যদিও উনার মা সেটা চাননি।
নিজের অবিবাহিত সুদর্শন ছেলের জন্য হাজার বুঝিয়ে কোনোমতে নীহারিকাকে ছেলের বউ মানতে চাইলেও,নিভানকে ছেলের বাচ্চা হিসাবে মানতে চাননি।তবে নিজের ছেলের জেদের কাছে হয়তো হার মেনে গিয়েছিলেন।

‘তোমার কি কোনো কারনে শরীর খারাপ?

মাথাতো যন্ত্রণায় ফেটে যাওয়ার উপক্রম।তখন রানীসাহেবা কফিতো দিয়ে গিয়েছিলো কিন্তু তা আর
খাওয়া হয়ে উঠেনি,মান্যতার গলা ফাটিয়ে চিল্লানোর কারনে।রুম থেকে বের হয়ে চিল্লানোর কারনটা জানার আগেই নাফিমের সাথে দেখা হলো।ওর সাথে কথা বলে রুমে গিয়ে দেখলো কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে।রানীসাহেবা কে দিয়ে আবার কফি বানানোর আগেই জাহিদ সাহেব ডেকে পাঠালেন তাকে।তাই আসতেই হলো।অসহ্য মাথা যন্ত্রণা করছে।তবুও স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো নিভান।

‘তেমন কিছু না, আপনি কি বলছিলেন বলুন।

নিভানের এই অতি স্বাভাবিক থাকা জিনিসটা মাঝেমাঝে জাহিদ সাহেবের মেনে নিতে খারাপ লাগে।তবে ছেলেটার স্বভাবই যে এটা।দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।ফের বললেন—তুমি কোনো যন্ত্র নও নিভান।তুমি সুস্থ স্বাভাবিক একজন মানুষ।আর সেই মানুষের ভালো লাগা,খারাপ লাগা থাকবে।ভালোমন্দ সুস্থ অসুস্থতা সকল প্রকার অনুভূতি থাকা স্বাভাবিক।সেখানে নিজেকে এতো চেপে রাখা উচিত নয়। রাখলে চলে-না।নিজের ভালোমন্দ অনুভূতিগুলাো সবার কাছের প্রকাশ না করা গেলেও অর্থাৎ প্রকাশ করতে তুমি না চাইলেও, নিজের জীবন থেকে বন্ধুসুলভ কাওকে না কাওকে বেছে নিয়ে সেই ভালোমন্দ অনুভূতিগুলো প্রকাশ করা উচিত।সেটা বাবা,মা ভাই, বোন অথবা তোমার জীবনের একান্ত কোনো ব্যক্তি যেকেউ হতে পারে।তবুও বলতে হয়।নিজের জীবন নিয়ে এতোটা বেখেয়ালি বা অনুভূতিশূন্য হলে চলে না।

থামলেন জাহিদ হাসান সাহেব।আজ নুতন নয়,নিভানের নিজের প্রতি এই আচারনের জন্য এরকম উপদেশ আদেশ প্রায়শই তিনি দিয়ে থাকেন।তবে ছেলেটা বরাবর চুপচাপ শোনে।অতঃপর যা তাই।নিভানের শিথিল হয়ে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ফের বললেন।–আমার মনেহচ্ছে তুমি মাথাব্যথার অসুস্থতা অনুভব করছো।যাও গিয়ে রেষ্ট নাও।এবিষয়ে আমি পরে তোমার সাথে কথা বলে নেবো।

হুমম”শব্দটা উচ্চরন করে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে, টুল ছেড়ে উঠে দাড়ালো নিভান।ফের লম্বা কদম ফেলে কয়েক পা সামনে আগাতেই পিছন থেকে ফের জাহিদ সাহেব ডেকে উঠলেন তাকে।

‘নিভান।

হয়তো পিছে ডাকা মানুষটা তাকে পুনরায় ডেকে কি বলতে চাইছে এটা নিভানের জানা।চোখজোড়া বন্ধ করে শ্বাস ফেলে ততক্ষণাত আবার চোখজোড়া খুলে ফেললো সে।নিভান পিছে ফিরতেই জাহিদ সাহেব কিছুটা স্নেহশীল গলায় বললেন।

‘আমি তোমার বাবা।সেটা তুমি মানো কি না তা আমার বিশেষ জানা নেই,তবে আমি মানি।বাবা ছেলের সম্পর্কের জোরে বলছিনা,নিজেকে তোমার একজন বন্ধুসূলভ আপনজন ভেবে তোমার ভালোমন্দের অনুভূতিটা আমাকেও জানাতে পারো।নির্দ্বিধায় বলতে পারো তোমার ভালোমন্দটা আমাকে।

উত্তর সরূপ নিভান ফের মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে চলে গেলো।সেদিকে নির্বাক নজরে তাকিয়ে রইলেন জাহিদ সাহেব।আপন রক্ত বলতে নিজের দুই সন্তান আছে উনার,মান্যতা আর ইভান।তবুও এই ছেলের মুখে বাবা ডাকটা শোনার জন্য কেনো এতো আকুল উনার হৃদয় গহ্বর।কেনো ব্যাকুলতাভাবে শুনতে চায় সেই ডাকটা মন।এটাই বুঝতে পারেন না তিনি।নীহারিকার সাথে সেই ছয় বছর বয়সে নিভান এবাড়িতে পা রেখেছিল, এসেছিলো।সেখান থেকে কতোগুলো বছর চলে গিয়েছে,অথচ কখনো নিভান তাকে ভুলেও বাবা ডাকেনি।শান্ত,গম্ভীরভাব অতটুকু ছেলে কি বুঝতো,না বুঝতো উনার জানা নেই।তবে কখনো ভুলেও বাবা বলে ডাকেনি।উনার প্রতি শ্রদ্ধা সম্মান হয়তো যথাযথ দেখিয়ে গিয়েছে,কখনো তা ক্ষুন্ন করেনি।উনার আদেশ উপদেশ মেনেছে।কিন্তু সেই বাবা ডাকটা ডেকে নয়।কেনো ডাকেনা নিভান উনাকে বাবা?ভুলেও তো দু-একবার ডেকে ফেলা যায়।দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে বেডের হেডে মাথা এলিয়ে দিলেন জাহিদ সাহেব।
তবে কি বাবা নামক আচার ব্যবহার কোনো ক্রুটি থেকে গেছে উনার?

‘এতো তাড়াতাড়ি কথা শেষ হয়ে গেলো আপনাদের?

মূহুর্তেই বিষন্নতা কাটিয়ে নীহারিকা বেগমের লাবণ্যময় মুখের দিকে তাকালেন জাহিদ সাহেব।মূহুর্তেই বিষন্নতা কেটে গেলো উনার।বয়স বেড়েছে,তিন ছেলেমেয়ের মা হয়ে গিয়েছে।একটা গোটা সংসারের খেয়ালধ্যান, নিয়ন্ত্রণ কর চলেছে।অসুস্থ একজন রুগ্ন ব্যক্তিকে টেনে চলেছে বছরের পর পর।অথচ রূপ লাবন্যে কোথাও সেই বয়স, পরিশ্রমের ঘাটতি নেই।এই লাবন্যময়ী নারীর সেই আঠারো পার হয়ে গিয়েছে আড়াই যুগ আগেই। অথচ সেই রূপ সেই লাবন্য।বেশী হয়েছে ছাড়া, ঘাটতি পড়েনি।এই মুখটা দেখলে,সব কষ্ট, বিষন্নতা কেটে গিয়ে শান্তি ভর করে মনে।

‘ওকে এককাপ আদা চা বানিয়ে দাও নীহারিকা।

‘কাকে?

‘নিভানকে।ছেলেটার মাথা ধরেছে মনেহয়।

শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন নীহারিকা বেগম।এই ছেলেকে নিয়ে আর পারলেন না তিনি।কাওকে না বলা যায়,মাকে তো নিজের ভালোমন্দটা একটু জানানো যায়।তবুও জানাবে না।এই মানুষটাকেও,নিভান নিজের অসুস্থতার কথা জানিয়েছে বলে-তো মনেই হয়-না নীহারিকা বেগমের।নিশ্চয় উনার মতো নিভানের চোখমুখের হাবভাব দেখে বুঝেছেন মানুষটা।নীহারিকা বেগম বাহিরের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে ফের জাহিদ সাহেবের দিকে ফিরলেন।জাহিদ সাহেবের কোলের মধ্য এলোমেলো কাগজের মেলা দেখে বললেন।

”কিসের কাগজপত্র ওগুলো?

এলোমেলো কাগজগুলো ফের ফাইলে গুছিয়ে রাখতে রাখতে জাহিদ সাহেব বললেন–আহসানের হাইস্কুলের বেতন বিষয়ক চেক,আরও অনন্য বিভিন্ন কাগজপত্র আর ওর নিজের সেভিংসের কিছু চেকবই, কাগজপত্র। ওর নামের জমির দলিলপত্রও আছে দেখছি।নিভানকে দিয়ে পাঠিয়েছেন চাচিমা।

কপাল কুঁচকে এলো নীহারিকা বেগমের।–কিন্তু এগুলো কেনো দিয়েছেন?

‘জানিনা।হয়তোবা নিজের অনন্য ছেলের লোভের হাত থেকে নিজের আদরের নাতনির হকটা বাঁচাতে।যাতে কৌড়ির হক নষ্ট না-হয়।তবে আমার মনেহয় চাচিমার এগুলো পাঠানো ঠিক হয়নি।প্রয়োজন ছিলো-না।

‘আপনার মনেহচ্ছে প্রয়োজন ছিলোনা তবে এবাড়িতে মেয়েটার বাঁচার জন্য আমার মনেহয় কাগজপত্রগুলো প্রয়োজন।চাচিমা বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছেন।

নীহারিকা বেগমের কিছুটা ক্ষোভান্বিত গলায় বলা কথাগুলো অর্থ হয়তো কিছুটা বুঝলেন জাহিদ সাহেব।তাই ওবিষয়ে আর কথা বাড়ালেন-না।নীরব ভুমিকা পালন করলেন।সেটা বুঝে নীহারিকা বেগমও চুপ হয়ে গেলেন।এবাড়িতে যে তুচ্ছতাচ্ছিল্য স্বীকার নিভান অথবা তিনি হয়েছেন।তাতে তো এই মানুষটার কোনো দোষ নেই।তবে কেনো কথার ছল বুঝিয়ে তাকে দোষটা বুঝিয়ে দিচ্ছেন।কথা ঘুরানোর জন্য তিনি জাহিদ সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললেন।

‘মেয়েটাকে এখানে পাঠানোর বিশেষ কারনটা কি বললেন না-তো?তখন চাচিমা কিসব বললেন আমি ওই ছেলেটার বিষয় ছাড়া ঠিক বুঝতে পারিনি?ব্যাপারটা ঠিক কি?

‘তুমি নিভানকে চা বানিয়ে দিয়ে এসো তারপর বলছি।

চমকে উঠার মতো করে নড়ে উঠলেন নীহারিকা বেগম।কথায় কথায় ছেলেটার কথা ভুলে বসেছেন তিনি।আর কথা না বাড়িয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে।সেদিকে তাকিয়ে নির্বিশেষে রইলেন জাহিদ সাহেব।

.

রান্নাঘরে আসতেই রানীকে কফি বানাতে দেখলেন নীহারিকা বেগম।জিজ্ঞেস করতেই বুঝতে পারলেন কফিটা নিভান চেয়েছে।কফিটা বানানো শেষে তিনিই, নিভানের ঘরে সেটা নিয়ে গেলেন।ঠান্ডা পরিবেশের রুমটায় চারদিকের জানালা দরজায় ভারী ভারী পর্দা ছড়িয়ে থাকার কারনে,এই শেষ দুপুরের দিকেও ভর সন্ধ্যাবেলার মতো লাগছে।ভিতরে ঢুকতেই নীহারিকা বেগম মৃদুস্বরে নিভানকে ডাকলেন।

‘নিভান।

‘মা, আমি এখানে।

গলার স্বর পেয়ে নিভানের বেডের দিকে এগিয়ে গেলেন নীহারিকা বেগম।নিভানকে মাথা চেপে ধরে বসে থাকতে দেখে কফিটা দ্রুত বেড টেবিলের উপর রেখে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন।

‘ও বাবু, মাথা বেশি ব্যথা করছে?আমাকে বলিস নি কেনো?এতো ব্যথা করছে তবে ঔষধ খাসনি?

‘এই একটু ধরেছে মাথাটা, ব্যস্ত হওয়ার দরকার নেই।ঠিক হয়ে যাবে।

‘একটু কি কেমন সেটা আমি বেশ বুঝতে পারছি।হয়তো তোদেরকে সময়টা ঠিকঠাক আমার দেওয়া হয়ে উঠেনা, দিতে পারি-না আমি কিন্তু তোদের ভালোমন্দটা বোঝার ক্ষমতা তো এই মায়ের আছে।ঠিক বুঝতে পারি আমি।

কথা না বাড়িয়ে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো নিভান।ছেলের কালো ঘনো চুলের ভারী শক্তপোক্ত মাথাটা কোলের মধ্যে অনুভব হতেই পরাণ চড়াৎ করে কেঁপে উঠলো নীহারিকা বেগমের।কতোদিন পর ছেলেটা উনার কোলে মাথা রেখে শুয়েছে।নিশ্চয় ছেলেটার শরীর বেশি খারাপ লাগছে?অতিরিক্ত শরীর খারাপ ছাড়াতো ছেলেটা সহজে মায়েদের সান্নিধ্যে চায় না।নিভানের ঘন-কালো চুলের মধ্যে আঙুল ডুবিয়ে দিলেন।হালকা নড়াচড়া করতে করতে বেশ নমনীয় গলায় বললেন।

‘শুয়ে পড়লি যে,কফিটা খাবি-না?

‘লাগবেনা।তুমি যেভাবে মাথার চুলগুলো নড়াচড়া করছো ওভাবে কিছুক্ষণ নড়াচড়াকরতে থাকো।কফিটা আর লাগবেনা।

চাপা শ্বাস ফেলে নিভানের মাথার চুলগুলো আলতো হাতে নড়াচড়া করতে লাগলেন নীহারিকা বেগম।হালকা রূপে পর্দার ফাঁক ঘেঁষে আসা মৃদু আলোতে নিভানের মুখটা ঠিকঠাক দেখতে পেলেন না তিনি।তবুও সেই মায়ামায়া শ্যামবর্ণ মুখের দিকে নিটোল নজরে তাকিয়ে রইলেন।উনার আর দুই ছেলেমেয়ের গায়ের বর্ন বিদেশিনীদের মতো গৌররঙা অথচ নিভানের গায়ের রঙটা শ্যামবর্ণ হলেও তার চেহারায় আলাদা অদ্ভুত এক মায়া ছড়িয়ে আছে।শক্তপোক্ত চোয়ালের গম্ভীর চোখমুখের দিকে তাকালে আলাদা টান শান্তি অনুভব হয়।সেই মায়া টান অন্যদের গাৌররঙা মুখয়াবয়ে তিনি খুঁজে পাননা।যদিও সকল সন্তানদের প্রতি স্নেহ মমতা উনার সমান।তাদের সবাইকে তিনি সমানরূপেই ভসলোবাসেন।তবে নিভানের প্রতি মায়া টানটা জেনো অন্যরকম।হয়তো মা ডাকটা তিনি এই ছেলের মুখে প্রথম শুনেছিলেন তাই।নারীত্বের যে মা হওয়ার বড়সড় অনুভূতিটাও তো তিনি এই ছেলে জন্ম হওয়ার মধ্যেমেই লাভ করেছিলেন।তবে ছেলেটা এই মায়ামায়া চেহারাটা পেয়েছে,তার বাবার চেহারার মতো।সংগোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন নীহারিকা বেগম।তবে নিষ্পলক নজর নিভিনের আবাছা মুখাবয়ব থেকে সরালেন না।
ডাকলেন তিনি।

‘ও বাবু।

ছোটো করে ডাক শুনলো নিভান।–হুমম।

‘তোর তো ঠিকঠাক খেয়াল,খোঁজখবর রাখতে পারিনা আমি।ও বাবু একটা বিয়ে করে ফেল-না।বয়স তো কম হলোনা।

নীহারিকা বেগমের কথায় নীরব থাকলো নিভান।সময় গড়াতেই ছেলেকে উত্তর দিতে না দেখে ফের নীহারিকা বেগম বললেন।–কি-রে আমি কি বলছি শুনছিস?

নিভান ফের ছোটো করে উত্তর দিলো–হুমম।

‘কি হুম হুম করছিস।বয়স কতো হয়েছে খেয়াল আছে?এবার একটা লাল টুকটুকে বউ এনে দেনা ঘরে।যে তোর খুব খেয়াল রাখবে।আর সেটা দেখে আমি একটু নিশ্চিতে থাকবো।যে আমার ছেলেটার ভালোমন্দের খেয়াল রাখার একটা সুনিশ্চিত মানুষ হয়েছে।

উত্তর দিলো না নিভান।সেটা দেখে নীহারিকা বেগম মিছেমিছি বিরক্ত দেখিয়ে বললেন—কি হলো?বল না, মেয়ে দেখবো?

ঠান্ডা অথচ গম্ভীর গলায় বললো নিভান।–আমি আমার ভালোমন্দের খেয়াল রাখতে জানি,মা।সেখানে তোমার ছেলের খেয়াল রাখার জন্য দ্বিতীয় কারও প্রয়োজনীতা তো দেখছি না আমি।যেদিন প্রয়োজনীতা অনুভব করবো,সেদিন না হয় ভেবে দেখবো।

‘বয়স কতো হয়েছে খেয়াল আছে তোর?প্রয়োজন নেই মানে কি?তুই কি এখনো দিবার বিষয়টা নিয়ে আপসেট আছিস?

যদিও উত্তর দিতে ইচ্ছে করলো না নিভানের।কিন্তু দিবাকে সে নয়, মা তারজন্য পছন্দ করেছিলো।বাড়ির খুব ভালো মেয়ে,বাড়িতেই থেকে যাবে।আর সে দীবাকে যাচাই বাছাই না করে মায়ের পছন্দ,সম্মতিকেই স্বকৃীতি দিয়েছিলো।এখন যদি মায়ের কথার উত্তর না দেয় নিভান।তবে মা যে তার আরও মন খারাপ করবেন।তাই সময় নিয়ে ঠান্ডা গলায় উত্তর দিলো—আপসেট থাকার মতো কি এমন হয়েছে!তোমার ছেলেকে এতোটা দূর্বল মনেহয়?সবার নিজস্ব একটা পছন্দ অপছন্দতা আছে। তুমি তাকে ছেলের বউ করতে চয়েছিলে,আর তার তোমার ছেলেকে পছন্দ হয়নি।তাই সে তোমার ছেলের বউ হতে চায়-নি।অন্য কাওকে পছন্দ হয়েছে, আর তারসাথেই সংসার পেতেছে।দ্যাটস সিম্পল সাবজেক্ট।
এখানে আমাকে আপসেট থাকার মতো কি হলো?পছন্দ অপছন্দতা তার-ও থাকতে পারে।তাই বলে সেই বিষয়টা ধরে আমি আপসেট থাকবো,এটা তোমারও মনে হলো কিকরে?

থামলো নিভান।সময় নিয়ে ফের বিরক্তমাখা দৃঢ় গলায় বললো—আর কখনো এবিষয়ে কথা বলতে বা শুনতে চাইনা আমি।ওই বিষয়টা নিয়ে আমাদের কথা এখানেই শেষ।বিষয়টা নিয়ে আর কখনো নড়াচড়া করবেনা।

নিভানের দৃঢ় গম্ভীর গলার কথাগুলো শুনে আর কথা বাড়ালেন না নীহারিকা বেগম।যে বিষয়টা নিভানের পছন্দ নয়,তা নিয়ে দ্বিতীয়বার কথা বলার আগ্রহ সে দেখায় না।পছন্দ নয় তার।তবে নিভানের মতো ছেলের বউ হতে কেউ অস্বীকৃতি জানাবে বা না করতে পারে এটা নীহারিকা বেগমও মানতে ঠিক নারাজ।নিজের ছেলে বলে নয়।তবে নিভানের মতো আলাদা ব্যক্তিত্বপূর্ন ছেলে খুবই কম দেখা যায়।সেই নিভানের প্রতি দীবার চালচলন,চাহুনি,বলা এগুলো দেখেই তো তিনি দীবাকে নিভানের বউ করার প্রস্তাব রেখেছিলেন।যেটা নিভানও ঠিকঠাক জানতোনা।তবে কি কারনে হঠাৎই মেয়েটা নিভানের বউ হতে অস্বীকৃতি জানালো।সিয়ামের সাথে মেয়েটার আগে থেকে সম্পর্ক ছিলো এমনটাও তো নয়।তবে কি কোনোকারনে ডালিয়া মেয়েকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বাহিরের সৌন্দর্য আর অর্থের চাকচিক্যের মোহে ডুবিয়ে দিয়েছে।যার পরিনতি এখন মেয়েটা হয়তো হাড়েহাড়ে অনুভব করছে।

.
সকালবেলা নিজেকে রেডি করে নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে যখন বের হচ্ছিলো নিভান।অচেনা একটা নম্বর থেকে কল এলো ফোনে।ফোনটা রিসিভ করতেই বুঝতে পারলো,আহসান আঙ্কেলের আম্মা। বৃদ্ধা মহিলা তার নাতনির সাথে কথা বলতে চান।কালকে নিভান চলে আসার সময় ভদ্রমহিলা তার নম্বরটা নিয়েছিলেন।আর এবাড়ির কারও সাথে আগে সেভাবে উনার যোগাযোগ না থাকায়,নিভানেরই নম্বরে কল করেছেন।

‘দাদু,আমার আপামনিটার সাথে একটু কথা কইয়ে দাও না।ছেড়ি’ডা যে ভালো নেই এইডা আমি জানি।কাল সারাদিন ছেড়িডার সাথে কথা কওয়ার জন্য কলিজাডা আমার ছটফটায়ছে,তয় সুযোগই পাই নাই।এখন একটু কথা কইয়ে দাওনা।

বৃদ্ধা মহিলার আকুলতার কাছে নীরব থাকলো নিভান।তার জীবনে কঠিন ত্রুটিগুলোর মধ্যে একটি হলো,সে কখনো কাওকে স্বান্তনাসরূপ মিষ্টিমিষ্টি বানী আওড়াতে পারে না।এবিষয়ে শূন্য অনুভূতি তার।ভদ্রমহিলা আবার-ও আকুলিত কন্ঠে,নিজের নাতনির সাথে কথা বলার জন্য অনুরোধ করলেন।

‘তোমাকে কি বিরক্ত করলাম, দাদু?একটু কি দেওয়া যায় না ছেড়িডার কাছে?

‘আপনি শান্ত হন,আমি দিচ্ছি।

সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছিলো নিভান।আশেপাশে নজর দিতেই দেখলো,ড্রয়িংরুমের আশেপাশে কেউ নেই।কি করবে ভাবতে সময় নিতেই দেখলো,মান্যতাকে ভার্সিটির জন্য রেডি হয়ে বের হতে।স্বভাব মতোই গম্ভীর গলায় ডাক দিলো নিভান।

‘মান্য।

দাঁড়িয়ে পড়লো মান্যতা। বরাবরই বড় দাদাভাইয়ের ডাকে কলিজা চমকিয়ে উঠে তার।কারন তার ডাকটা মানেই আতঙ্ক!

‘কিছু বলবে দাদাভাই?

বিনাবাক্যে নিজের ফোন মান্যতার দিকে এগিয়ে দিলো নিভান।ভরাট গলায় বললো—ওই মেয়েটার দাদু তারসাথে কথা বলতে চাইছে,ফোনটা দিয়ে এসো তার কাছে।

ফোনটা হাতে নিয়ে চঞ্চল পায়ে চলে গেলো মান্যতা।নিভান গিয়ে বসলো ডায়নিং টেবিলে।নীহারিকা বেগম সেখানে নেই।স্বান্তনা বেগম খাবার রেডি করছিলেন।নিভানকে ডায়নিং টেবিলে বসতে দেখে একটু আশ্চর্য হলেন।রাতের খাবার টেবিলে ছাড়া নিভানকে সহজে ডায়নিং টেবিলে দেখা যায় না।তবে স্বভাবসুলভ নিজের মৃদু হাসিটা একঝলক মুখে ফুটিয়ে খাবার দিতে ব্যস্ত হলেন।আজ আপতত সকালের ডায়নিং টেবিল ফাঁকা।
মৌনতা আর নাফিম হয়তো খেয়ে স্কুলে চলে গিয়েছে। সকাল সাড়ে আটটা থেকে তাদের স্কুল।মান্যতা হয়তো যাবার জন্য খেয়েদেয়ে বের হচ্ছিলো।আর ইভান?তার হয়তো কাল মাস্টার্সের এক্সাম শেষ হওয়ায়,রিলাক্সে নিশ্চিতে ঘুমাচ্ছে।আজ হয়তো তার সকাল হবে দুপুর দু’টো অথবা তারও পরে।জাহিদ সাহেবেরা চার ভাই।সম্পর্কের টানাপোড়েনে শুধু দু’ভাই এবাড়িতে থাকেন।জাহিদ হাসান আর উনার ছোটভাই শাহেদ হাসান।আপতত শাহেদ হাসান বাড়িতে নেই।অফিসের কাজে শহরের বাহিরে অবস্থান করছেন।নাহলে সকালের এই সময়টাতে তাকে-ও ডায়নিংয়ে পাওয়া যায়।

সকালে নিজের ইচ্ছাধীন নাস্তাটা,স্বান্তনা রহমান সামনে দিতেই খাবারে মনোযোগ দিলো নিভান।

.

মান্যতা গিয়ে কৌড়ির কাছে ফোনটা দিলো।কে ফোন দিয়েছে সেটাও বললো। ফোনটা কানে পাশে ধরতেই আচমকা একটা কড়া মিষ্টি সুবাস কৌড়ির নাক ছুঁয়ে মস্তিষ্কে গিয়ে বিধলো।সমস্ত শরীর শিরশির করে উঠলো তার।এই সুগন্ধটার তীক্ষ্ণ সুবাসটা,সে আগেও অনুভব করেছে।কখন?কাল!হ্যা কাল সারাপথ এই সুবাসিত গন্ধটা তার নাকের চৌধারে ঘুরে বেড়িলছে।যতক্ষণ না পর্যন্ত সেই মানুষটার পাশ থেকে দূরে গেছে ততক্ষণ পর্যন্ত এই সুবাসটা ছড়িয়ে ছিলো তার আশপাশ।তবে ফোনটা কি সেই মানুষটার?

‘ও আপা।খুব রাগ হইছে এই দাদিআপার উপর?কথা কইবি না?ও আপা কেমন আছিস তুই?

চমকে উঠলো কৌড়ি!কোন খেয়ালে ডুবে ছিলো সে!ওপাশে যে দাদিআপা এক নাগাড়ে কথা বলে চলেছে তবুও সেদিকে খেয়াল নেই তার!খেয়াল হতেই ওপাশের মানুষের কথাতে মনোযোগী হলো।দাদিআপার আদূরী ডাকের কথাগুলোয় অভিমান হলো খুব।অভিমানী গলায় বললো।

‘তুমি একটুও ভালো না দাদিআপা।আমাকে কেনো এখানে পাঠিয়ে দিলে।আমার তোমাদের ছাড়া থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে।তুমিও ভালো নেই বলো,দাদিআপা?ও দাদিআপা আমাকে ছাড়া থাকতে পারছে তুমি?আমার যে তোমাকে ছাড়া থাকতে কষ্ট হচ্ছে। আমাকে নিয়ে যাওনা দাদিআপা।বাবা নেই তো কি হয়েছে আমি তোমার সাথে থাকতে পারবো।

কথাগুলো বলতে বলতে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো কৌড়ি।
মাজিদা খাতুন ওপাশে নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।ফের নাতনিকে স্বান্তনা দেওয়ার কথায় লেগে পড়লেন।
মাাজিদা বেগমের বিভিন্ন বুঝদার কথায় একপর্যায়ে শান্ত হলো কৌড়ি।ওদিকের হালচাল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেও, তিনি সেভাবে উত্তর দিলেন না।তবে কথা শেষ করার আগে কৌড়িকে,ভালোভাবে চলাফেরা করার বেশ আদেশ উপদেশ দিলেন।সংযাত হয়ে ভেবেচিন্তে চলতে বললেন।যাতে পরের বাড়িতে কেউ খারাপ না বলে।যে উপদেশ নিষেধগুলো তিনি সবসময় কৌড়িকে দিয়ে থাকেন,সেগুলো দিয়ে একপর্যায়ে ফোন রাখলেন।

IPhone 15 PRO Max ফোনটার একের পর এক চেঞ্জ হওয়া স্কিন ফটো গুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো কৌড়ি।
নজর ফোনের দিকে থাকলেও,ভাবনা তার দাদিআপার এড়িয়ে যাওয়া কথাগুলোয়।তাঁকে এখানে পাঠিয়ে দেওয়য় ভালো রেখেছে কি,দাদিআপাকে ওই মানুষগুলো?যদি-ও নিজের আপনজন তারা?তবে তাদের স্বার্থপর কথাবার্তা,অতিলোভ,ব্যবহার নিজের আপনজন বলে তো পরিচয় দেয়না।সেখানে ওই বৃদ্ধা দাদিটা তার ভালো আছে কি?

‘মান্য, আমার অফিসের দেরী হয়ে যাচ্ছে।ফোনটা দাও।

জলদগম্ভীর ভরাট গলায়,ভুত দেখে লাফিয়ে উঠার মতো চমকে উঠলো কৌড়ি।ফোনটা হাত থেকে পড়তে পড়তে বেঁচে গেলো।এরকম গম্ভীর গলা কারও হতে পারে জানা ছিলোনা কৌড়ির।তাকে থাকতে দেওয়া রুমের দরজায় সামনে থেকে গলার স্বরটা আসছে।তড়িৎ গতিতে রুমের আশেপাশে।কৈ মান্যতা আপুতো কোথাও নেই।কাল বিকাল থেকে সারারাত মান্যতা নামে আপুটা ছিলো তারকাছে।বিধায় আপুটা সম্পর্কে একটু জানাশোনা হয়েছে তার।কিন্তু মান্যতাকে কোথাও না দেখে,ফোনটা নিজে গিয়ে দেবে কি-না ভেবে পেলোনা।তারমধ্যে নিভান আবারও ডাকলো মান্যতাকে।তবে এবার গলা কিছুটা শান্ত তবে গম্ভীর।

‘মান্য।

নিশ্চয় মান্যতা ভিতরে নেই।নাহলে তার এক ডাকে সাড়া দেবে না।এটা হতেই পারেনা।তাই গলার স্বরটা নরম করে রুমে যে আছে,ফোনটা নেওয়ার জন্য তাকে উদ্দেশ্য করে মান্যতাকে ডাক দিলো সে।ফের মান্য ডাকটায় উঠে দাঁড়ালো কৌড়ি।চঞ্চল পায়ে এগিয়ে গেল ফোনটা দেওয়ার জন্য।পর্দার ফাঁক থেকে ফোনটা বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কৌড়ি।অথচ ফোনটা ধরলো না কেউ।ক্ষীন সময় পার হওয়ার পর কথা বলতে উদ্যোক্ত হলো কৌড়ি।তার আগেই ছো মেরে তার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে ধপাধপ পা ফেলিয়ে কেউ চলে গেলো।আশ্চর্য হলো কৌড়ি।মনেহলো,ফোনটা নেওয়ার অপেক্ষার জন্য,তাকে অপেক্ষা করিয়ে শোধ নেওয়া হলো।অদ্ভুত মানুষ তো!

চলবে……

#ফুলকৌড়ি
পর্ব(৫)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

বিশাল বড়ো দোতলা বাড়িটা এখন ফাঁকা।কোথা-ও কোনো শব্দ নেই।বাড়ির ছেলেমেয়ে গুলো বাড়িতে না থাকলে,এই নীরব পরিবেশটা বিরাজ করে।তরকারির শেষ বাটিটা ডাইনিং টেবিলের উপর রেখেই,ধপ করে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লেন স্বান্তনা রহমান।সকাল বেলা থেকে একজন একজন করে খাওয়াতে খাওয়াতে তিনি প্রায়সই ক্লান্ত হয়ে পড়েন,ঠিক ক্লান্ত নয় হাঁপিয়ে উঠেন।বড় ভাইয়ের অসুস্থতার জন্য বড়ো ভাবী এই সময়টা রান্নাঘরে থাকতে পারেন না, দিতে পারেন না।
যদিও চেষ্টা করেন।তবে রানী সবকিছু গুছিয়ে দিলে-ও, এই সকালের সময়টায় বারবার উপর নিচ করে ছেলেমেয়েদের ডেকে তুলে রেডি করে একের পর একজনকে খাইয়ে বের করে দিতে দিতে তিনি হাঁপিয়ে উঠেন।মেয়েটা উনার কথা মোটামুটি শুনতে মানতে চাইলেও,ছেলেটার যে বাহানাবাজির শেষ নেই।নিজ ইচ্ছায় কখনো ঘুম থেকে উঠবে-না,তাকে ডেকে ডেকে পাগলপ্রায় হয়ে যাওয়ার পর উঠবে।ক্লাস ফোরে পড়া ছেলে এখনো নিজে একা ব্রাশ করবে-না,নিজ হাতে খাবে না।সমস্ত কাজগুলো নিজে গো করবে না, তিনি করিয়ে দিতে গেলে-ও অযুহাত আর বাহানার শেষ নেই।
আর খাওয়ার বিষয়েতো বাহানাবাজিতে সুপার এক্সপার্ট একবারে ডিগ্রীধারী।ছেলের এই সকালবেলার রোজকার বাহানায় তিনি অতিষ্ট হয়ে হাঁপিয়ে যান।তারউপর একেক জনের স্কুল কলেজ, ভার্সিটি, অফিস টাইম আলাদা হওয়ায়, সকাল বেলা আর নিয়ম করে একসাথে খাওয়া হয়ে উঠেনা।যদিও জাহিদ সাহেব সুস্থ থাকাকালিন নিয়মটা বেশ জোরালো ভাবে চলতো।সে যার যখন অফিস আদালত,স্কুল কলেজ টাইম হোক না কেনো।নির্দিষ্ট একটা টাইমে সবাই একসাথে ডাইনিংয়ে হাজির হওয়া,এবং খাওয়া।স্বান্তনা রহমানের খুবকরে মনে হয়,ভাইজানের নিয়মের সিদ্ধান্তগুলো খুবই ভালো ছিলো।হাতাশার শ্বাস ফেলে মাথা কাত করে টেবিলে এলিয়ে দিলেন তিনি।

‘কি-রে, ওভাবে টেবিলে মাথা লাগিয়ে শুয়ে পড়েছিস কেনো?ক্ষুধা লাগছে খেয়ে নিবিতো।নাকি শরীর খারাপ লাগছে?

নীহারিকা বেগমের কথায় মাথা তুলে বসলেন স্বান্তনা রহমান।বললেন– শরীর খারাপ নয়,আর ক্ষুধার জন্যও শুয়ে পড়িনি।আমার ওই বাহানাবাজ ছেলেটা বাড়িতে নেই,তাই ভেবে একটু শান্তি করছি।

‘ওভাবে বলিস কেনো?ও একটু চঞ্চল তবে,আমাদের বাড়ির আশে-পাশের অন্যান্য ছেলেদের মতো অত-শত মাত্রাধিক দুষ্ট তো নয়।

‘তোমার মাত্রাধিক ধৈর্য্য তাই তোমার কাছে ওর দুষ্টিমিগুলা মাত্রাছাড়া মনে হয়না,বুবু।কিন্তু আমার অত ধৈর্য্যসহ্য নেই।তাই আমারও অতশত সহ্য হয়না।কি জ্বালানটা জ্বালায় সারাদিন দেখেছো।ছেলে না হয়ে যদি আরও একটা মেয়ে হতো,কিছুটা শান্তি থাকতে পারতাম।ওর জন্য মাঝে-মধ্যে আমার আর দুনিয়াদারি করার ইচ্ছে করে না।

জাহিদ সাহেবকে খাইয়ে,খাবারের এঁটো পাত্রগুলো নিয়ে আসতেই চলতি পথে কথা হলো দু’জায়ের।ছোটো জায়ের বিরক্তমাখা কথাগুলো শ্রবন করতে করতে রান্নাঘরে ঢুকলেন নীহারিকা বেগম।বললেন।

‘বাড়ির মধ্যে দুই একটা ওরকম না থাকলে চলেনা।তাই বলে তুই যা বলিস,ও অতোটাও না।

স্বান্তনা রহমান আবারও বকা শুরু করলেন।ছেলের চৌদ্দ গুষ্টির ষষ্ঠী উদ্ধার করতে লাগলেন।এবাড়ির কার কার জন্য এই ছেলে এতোটা বাহানাবাজ হয়েছে,বিগড়ে গেছে বলতে লাগলেন।তারমধ্য প্রথম সারিতে নীহারিকা বেগমকেও ছাড়তে ভুললেননা।তাকে দোষারোপ করেও কথা শোনালেন।কথার প্রেক্ষিতে নীহারিকা বেগম শুধু মৃদু হেসে গেলেন।এই দোষারোপের মধ্যে যেও শান্তি আছে।ভালো লাগা আছে।এবাড়ির সব ছেলেমেয়েগুলা যে উনার এক একটা শরীরের অংশ।সেই অংশ গুলো যতক্ষণ আঘাত,কষ্ট না পায় ততক্ষণ তিনি ভালো থাকেন।আর সেই অংশগুলোর মধ্যে থেকে একটা যদি ব্যথা পায়,সামন্য মুরছা যায় তিনিযে কিছুতেই ভালো থাকতে পারেন না।এটাই যে তার সংসার,এই সংসারের প্রানহীন জিনিসগুলোর ব্যথাও যে উনার প্রানে অনুভাবিত হয়।সেখানে এই বাড়ির ছেলেমেয়েগুলোতো উনার সেকেন্ডে সেকেন্ডে চলিত নিঃশ্বাস।স্বান্তনা রহমানকে শাান্ত করাতে প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন।

‘এই ছোটো, আম্মা খেয়েছেন?উনি তো আবার একটু বেলা না গড়ালে খেতে চান না।

ছেলেমেয়েদের বকা যেমন ভাবীর শুনতে ইচ্ছে করেনা।তেমন নিজেও সামন্য দু-একটা ধমক দিলেও,অতিরিক্ত বকেন না।ধৈর্য্য নিয়ে সবকিছু হ্যান্ডেল করেন।কিন্তু এত বছর সেই মানুষটার সান্নিধ্যে থেকে,সবকিছু মোটামুটি আয়ত্ত করতে পারলেও এই অতি ধৈর্য্য জিনিসটা তিনি আয়ত্ত করতে পারেননি।বললে আর চাইলেই কি সবটা হয়!তপ্ত শ্বাস ফেললেন স্বান্তনা রহমান।বাড়ির সবচেয়ে ছোটো সদস্য হওয়ায় নাফিমকে সবাই মাত্রাধিক আদর করে, ভালোবাসে।আর তার সম্পূর্ণ ফায়দা লুটে ওই বদমায়েশ ছেলেটা।ওই বাদর ছেলের বড়োমা বলতে, সব আবদার ওখানে।আর তেনার বড়োমাও তেমন।সেই ছেলের নামে উল্টো পাল্টা কথা ধৈর্য্য নিয়ে শুনবেন।নাহ,তেমনটা কখনো হওয়ার নয়।সে কারনেই যে প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলা বেশ বুঝলেন স্বান্তনা রহমান।

‘কোথায় খুইয়ে গেলি?কি জিজ্ঞেস করেছি শুনতে পাস নি।আর রানিও বা কোথায় গেলো?

‘আম্মা এখনো খাননি।আমি জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিলাম,উনার রুমে খাবার দিয়ে যাবো কি-না।উনি বললেন ডায়নিংয়ে এসে খাবেন।আর রানীতো কেবলমাত্র ওর রুমের দিকে গেলো।

স্বান্তনা রহমানের কথা শেষ করার আগেই রানী সেখানে হাজির হলো।বললো–কিছু দরকার ভাবীজান?

‘বেলা কতো হলো খেয়াল আছে।রোজরোজ আমার জন্য অপেক্ষা করতে হবে কেনো?তোমরা খেয়ে নিতে পারো না।যাও আম্মাকে ডেকে নিয়ে এসো।

আজ্ঞা পেতেই রানি চলে গেলো।নীহারিকা একটু বিরক্ত হয়ে ফের স্বান্তনা বেগমকে বললেন।–ক্ষুধা লাগলে যে যার মতো খেয়ে নিবি,আর কত বলবো তোদের।আমার জন্য অপেক্ষা করে বেলা গড়ানোর কোনো মানে আছে!

স্বান্তনা বেগম মাথা উঁচু করে এবার চেয়ারে সটান হয়ে বসলেন।বললেন–তোমার জন্য অপেক্ষা করি কে বললো!তুমিতো মানুষ নও, যন্ত্র।তোমার আবার ক্ষুধা, ঘুম,ব্যাথ,খারাপ লাগা ভালো লাগা আছে নাকি।এগুলো আমরা জেনেও তোমার জন্য অযথা অপেক্ষা করতে পারি?তোমার মতো যন্ত্রের জন্য অপেক্ষা করতে আছে নাকি?

রান্নাঘরের এঁটো জিনিসগুলো ধুইয়ে ডায়নিংয়ে এলেন নীহারিকা বেগম।স্বান্তনা বেগমের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন।-রেগে যাস কেনো?আচ্ছা আমি অপেক্ষা করতে বলে ভুল করে ফেলেছি।ক্ষমা কর আমাকে।যাই হোক রাগারাগি পরে করিস,বেলা অনেক গড়িয়েছি এবার তো খেতে শুরু কর।

চেয়ার টেনে বসতে গিয়ে হঠাৎই কৌড়ির কথা মনেহলো উনার।ফের ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন–মেয়েটা খেয়েছে?

হঠাৎ খেয়াল হলোনা স্বান্তনা বেগমের।বললেন–কোন মেয়েটা?

—কৌড়ি।

সকালের এতো ব্যস্ততায় মেয়েটার কথাতো ভুলেই বসেছিলেন স্বান্তনা বেগম।কাল একটা নতুন সদস্য যে তাদের বাড়িতে এসেছে,এটাতো মনেই ছিলো না উনার।মুখটা অসহায় ভঙ্গিমা করে নীহারিকা বেগমের দিকে তাকালেন তিনি।যাতে যা বোঝার বুঝে নিলেন নীহারিকা বেগম।তবুও কৈফিয়তের স্বরে স্বান্তনা’রহমান বললেন।

‘বিশ্বাস করো বুবু,আমার মেয়েটার কথা একটু বলতেও খেয়াল ছিলো না।নাহলে..

কথা শেষ করতে দিলেন না নীহারিকা বেগম।দু বাচ্চার মা হয়ে গিয়েছে অথচ,স্বান্তনা সেই সদ্য এবাড়িতে আসা কিশোরীর মতোই অবুঝ রয়ে গেছে।অবুঝ থাকারই তো কথা, মেয়েটার মনে যে মারপ্যাঁচ নেই।এতো বছর সংসারে কতো ঝঞ্জাট,উত্থানপতন গেছে,তবুও মেয়েটা আগে যেমন সহজ সরল মনের ছিল।এখনো তেমনটাই আছে।তিনি বললেন।

‘এখানে বিশ্বাস অবিশ্বাসের কি হলো?আমি তোকে চিনি না,নাকি জানি না!খেয়াল না থাকতেই পারে,আমারও তো মেয়েটার কথা খেয়াল ছিলো-না।তাই বলে কি সেটা অন্যায় হয়ে গেলো?

‘বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথদ নয়,তবে মেয়েটার কথা-তো খেয়াল রাখা উচিত ছিলো।সেটার জন্য বললাম।

স্বান্তনা রহমানের ছোটো মুখ করে বলা কথাটা শুনে নীহারিকা বেগম সংগোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।মেয়েটা এরকমই।তার ছোটো ভুল গুলোও তার অনেক বড়সড় ত্রুটি বলে মনেহয়।মাঝেমাঝে অন্যায় ভেবেও তো আফসোস করে।নীহারিকা বেগম হাজার বুঝিয়ে পারেন না।অথচ সেই স্বান্তনার সামনে দিয়ে আরও আরেক জা উনার কতো ত্রুটি করে চলে গেলো।সেটা থেকেও শিক্ষা নিলোনা মেয়েটা। বরাবরই উনারই আদর্শ, চালচলনকে আঁকড়ে ধরে থাকার চেষ্টা করেছে স্বান্তনা। স্বান্তনা বেগমের কাঁধে হাত রাখলেেন তিনি।ফের স্বান্তনা সরূপ বললেন।

‘আচ্ছা ঠিক আছে।সামন্য বিষয় নিয়ে মন খারাপ করে মুখ ছোটো করার মতো কিচ্ছু হয়নি।আমি দেখছি।

নীহারিকা বেগম কৌড়িকে ডাকতে ছুটলেন।সেদিকে তাকিয়ে রইলেন স্বান্তনা রহমান।কবে যে উনিও একটু সবদিক দিয়ে সবার খেয়াল ধ্যান রাখতে পারবেন।কে জানে?এক ছেলে নিয়েই যেখানে তিনি ধৈর্য্যহারা হয়ে পড়েন,ছেলে কাছে থাকলে তার বাহানায় নিজেকে ভুলতে বসেন।সেখানে সবার খেয়াল খোঁজ রাখা সত্যিই সম্ভব কি?তাহলে নীহারিকা নামক নারীটা পারে কি করে?অসুস্থ স্বামীকে সামলে,এবাড়ির সকল ছেলে-মেয়ের আবদার, চাওয়া, পাওয়া পূর্ণ করতে?যেখানে তিনি স্বান্তনা রহমান এক ছেলের বাহানাবাজিতে কাতর হয়ে পড়েন!পারেন কি করে গোটা সংসারের ভালোমন্দ সবকিছু একহাতে সামলিয়ে,ওই একটা নারীমস্তিস্কে সবার খোঁজ খেয়াল রাখতে?ভাবীর মতো তিনি হতে পারবেন কি-না, জানা নেই।তবে ওই গুনি নারীটির মতো হওয়ার সাংঘাতিক লোভ উনার।বরাবর ওই গুনি নারীটির মতো,উনার গুনে গুণান্বিত হতে চান তিনি।

জানালার গ্রিল ধরে নিজের জীবনের এলোমেলো হয়ে যাওয়া সমীকরণ গুলো নিয়ে ভাবনায় ডুবে আছে কৌড়ি।কাল সে কোথায় ছিলো আর আজ কোথায়?বাবাও তো!কাল তিনি এই সময়টাতে লাশ হয়ে রইলেও দুনিয়ায় বুকে ছিলেন।আর আজ তার মৃত্যুর একটাদিন পার হতে চলেছে।সময়টা কতো দ্রুত চলে যায়।স্রোতের চেয়েও জেনো তার গতিবিধি আরও দ্রুতগামী।কারও কষ্ট, ক্লেশ, যাতনার কাছে, সেই নিষ্ঠুর সময় নামক গতিবিধিটা থেমে নেই,তার জেনো কারও কোনো কষ্ট ক্লেশ, খারাপলাগা ভালোলাগাতে থেমে থাকলে চলেনা।সে তার রবের হুকুমে স্বাধীনচেতা হয়ে আপন গতিতে এগিয়ে চলেছে।বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো কৌড়ির।সঙ্গে দুচোখ বেয়ে দুফোঁটা নোনা অশ্রু।কারও পায়ের এগিয়ে আসার শব্দ নিজের রুমের পানের দিকে অগ্রসর হচ্ছে বুঝতে পেরেই,সদর্পে দু’হাতে চোখের অশ্রুঝরা মুক্তগুলো মুছে নিলো সে।পায়ের শব্দটা তার পিছনে এসে থামতেই,পিছে ফিরলো।

‘কৌড়ি।তুমি আবার-ও কান্নাকাটি করছো?

ম্লান হাসলো কৌড়ি।নীহারিকা বেগমের কথার জবাব দিতে গিয়েও,দিতে পারলো না সে।মাথা নিচু করে নিল।
পরপর কয়েকটা ঢোক গিলে গলা স্বাভাবিক করে নিয়ে শান্ত কন্ঠে বললো—আমি কাঁদছি না-তো।

‘মায়ের চোখ ফাঁকি দিতে চাইছো?এতো সহজ?

এবার আর চেয়েও কথা বলতে পারলো না কৌড়ি।শুধু মাথা এদিকে ওদিকে নাড়িয়ে না বোঝালো।অর্থাৎ সে মায়ের চোখ ফাঁকি দিতে চাইছেনা।আর তা যে সহজ কথা নয় সেটাও সে জানে।তবে সে কি করবে,বাবা যে তার পৃথিবীর একাংশ ছিলো।আর সেই অংশবিশেষ ডুবে যাওয়ায়,উনার স্মৃতি স্মরণে কান্নারা সময় অসময়ে এসে ভীড় করছে তার দু-নজরে।তবে সে কি করবে।কৌড়ির পরিস্থিতি বুঝে আর কথা বাড়ালেননা নীহারিকা বেগম। নরম স্পর্শে কৌড়ির হাতটা নিজের হাতের মুঠোই নিয়ে সামনে এগোতে এগোতে বললেন।

‘এবার কাঁদলে আমি কিন্তু সত্যিই বকা দেবো তোকে।যে সৃষ্টিকর্তার ডাকে চলে যাওয়ার তাকে কি কেঁদেকেটে তুই কোনোমতেও আটকিয়ে রাখতে পারবি,নাকি কেঁদে কেটে ফিরিয়ে আনতে পারবি?তবুও কেনো এতো মন খারাপ করছিস।আমরা আছি তো।

কথাগুলো স্বান্তনা সরূপ বললেও নীহারিকা বেগমও জানেন,বাবা নামক বটবৃক্ষ নিজের জীবন থেকে একবারে মুছে গেলে কেমনটা লাগে,আর কি অন্তর্দাহ হয়।একটু থেমে তিনি ফের বললেন।—আর মন খারাপ করে সারাক্ষণ রুমে বসে থাকলে চলবে?তুইও এখন থেকে আমাদের বাড়ির আরেকটা মেয়ে।খাবিদাবি,সারা বাড়িময়,মান্য মৌনতার মতো ঘুরে বেড়াবি।আমি কি করছি,ছোটো চাচি কি করছে।সব দেখবি,শুনবি তা না।মন খারাপ করে ঘরে বসে আছে মেয়ে।আর সেই কাল এবাড়িতে এসেছিস,এখনো তোর আঙ্কেলের সাথে একবারও দেখা করেছিস?করিস নি।মানুষটা না-হয় চলতে ফিরতে পারেনা বলে তোর সাথে দেখা করতে আসতে পারছে-না।তাই বলে তুই যাবিনা?আমাকে কতোবার বললো,নীহারিকা মেয়েটাকে একবার আমার কাছে নিয়ে এসো।জানিস তুই?কিন্তু তুইতো কান্নাকাটি করতে মহাব্যস্ত, এই অবস্থায় তোর আঙ্কেলের কাছে নিয়ে যাই কিকরে বল? মানুষটা আমাদের বকবে না?যে তোমরা থাকতে মেয়েটা এতো মন খারাপ করার সুযোগ পায় কি করে?তার বকা শুনবে কে!এখন খেয়েদেয়ে তারসাথে গিয়ে গল্প জুড়বি।

নীহারিকা বেগমের মন ভোলানো কথাগুলো বুঝতে পেরেও,তুই সম্বোধনের মন ভোলানো কথাগুলোয় সত্যিই কৌড়ির মন ভুলিয়ে দিলো,জুড়িয়ে গেলো।যদিও সে বুঝতে পারলো,তাকে অবুঝ বাচ্চাদের মতো কথার ছলে মন ভুলানো হচ্ছে।তবুও,নীহারিকা বেগমের মমতাময়ী কন্ঠের কথাগুলো তাকে মোহগ্রস্ত করলো।নিজের আপন আপন কাওকে মনেহলো তার।

‘বোস।

চেয়ারে বসতে গিয়ে সামনের দিকে নজর পড়লো তার।এবাড়ির বয়োবৃদ্ধা ফাতেমা বেগম এদিকে এগিয়ে আসছেন।খেতে বসবেন হয়তো।উনাকে আসতে দেখে আর বসলোনা কৌড়ি।উনি এসে বসার পর কৌড়ি বসলো।বিষয়টা কেউ নজরবন্দী না করলে-ও ফাতেমা বেগম বেশ খেয়াল করলেন।মনে মনে উনাকে মান্য করার জন্য,কৌড়ির এই শিষ্টাচারে তিনি খুশী হলেন।
তবে মুখের গম্ভীর্য আদলে সেটা প্রকাশ পেতে দিলেন না।কৌড়ি-ও নিজের গায়ে মাথার ওড়না সংযাত করে নিয়ে খেতে বসলো।যেটা বরাবর দাদি আপা শিখিয়ে দিয়েছেন।যেভাবে সে নিজে-ও চলতে চায়।তবে একটু এদিকে সেদিক হলেই যে দাদিআপা রাগ করতেন।আজ তিনি কাছে নেই বলে,উনার নিয়মনীতিগুলো আরও বেশি বেশিভাবে স্মরণে পড়ছে।

‘দিবা দাদুমনি কোথায়?সে খেয়েছে?

ফাতেমা বেগমের কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেললেন নীহারিকা বেগম।শ্বাশুড়ি মা’কে ঠিক কি বলবেন ভেবে পেলেন না।
স্বান্তনা রহমানের গালে চিবানো খাবার-ও ধীমে হয়ে এলো।একমাত্র মেয়ের মেয়েকে যে, তিনি এবাড়ির সব ছেলেমেয়েদের থেকে সামান্য হলেও একটু বেশি ভালোবাসেন।এটা এবাড়ির সবাই জানে।তাই বলে তার সব আহ্লাদ পূর্ণ করতে হবে, ন্যায় অন্যায় ভুল বিবেচনা না করে!একটা পোস্ট গ্রাজুয়েশন মেয়েকে,এখনো ছোটো ভেবে তার ভুল চিন্তা ভাবনাকে প্রশ্রয় দেওয়াটা, ঠিক ভালো লাগেনা স্বান্তনা রহমানের।এজন্য তো তিনি নানদের চোখের বালী।তিনি এখন বাড়িতে নেই,তাই কিছুটা হলেও স্বস্তিতে দিন কাটাচ্ছেন।দীবা মেয়েটা খারাপ এটা তিনি বলছেন না,মেয়েটার মাথায় ভুলভাল চিন্তাগুলো ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে খারাপ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে দেওয়া হয়েছে।যা এখন ভোগ করছে মেয়েটা।না গিলতে পারছে আর না ভোগ করতে পারছে।সম্পর্ক নিয়ে এমন ঝুলন্ত অবস্থায় আছে মেয়েটা।আর স্বান্তনা রহমানের শ্বাশুড়ি সব জেনেশুনেও,নিজের মেয়েকে কিছুই বলেন না।সবাই যখন চুপচাপ রানী তখন কিছুটা বিব্রত হয়ে উত্তর দিলো।

‘আম্মা,দীবা আম্মা এখন খাবে-না বলছে।সে খেতে আসে নাই শুনে,বড় ভাবীজান আমারে ডাকতে পাঠিয়ে ছিলেন।তার দরজায় শব্দ করতেই বললো, বিরক্ত না করতে।তার সময় হলে সে ঘুম থেকে উঠে খেয়ে নেবে।

ফাতেমা বেগম,নাতনীর এহেন আচারনে মনেমনে একটু বিরক্ত হলেন।তবে ক্ষুনাক্ষরেও সেটা মুখাবয়বে প্রকাশ করলেন না।দীবার বিষয়টা সেখানেই সমাপ্ত হলো।যেটা নীহারিকা বেগম মানতে পারলেও স্বান্তনা রহমান মানতে পারলেন না।তবে মুখ ফুটেও কিছুই বললেন না।কারও ভয়ে নয়,শ্বাশুড়িকে সীমহ করার গুনটাও তিনি তার পাশে বসা ভদ্রমহিলার থেকে রপ্ত করেছেন।এবং মান্য-ও করেন।কিন্তু মাঝেমাঝে অসহ্য এসব কারবার দেখে মুখ খুলতে বাধ্য হন।পাশে বসা ভদ্রমহিলার সকল গুন রপ্ত করতে, চাইলেও তার মতো ধৈর্য্য সহ্য তিনি এখনো রপ্ত করতে পারিননি।বিধায় সবকিছু ধৈর্যের বেলায় এসে খামতি পড়ে যায়।শ্বাশুড়ির কথায় ভাবনায় ভাঁটা পড়ে যায় স্বান্তনা রহমানের।তিনিও শ্বাশুড়ির প্রশ্ন মোতাবেক কৌড়ির উত্তর শোনার জন্য তার মুখের দিকে তাকালেন।

‘তুমি কোন ক্লাসে পড়ছো,মেয়ে?

খেতে খেতে কৌড়িকে বেশ ভালোভাবে লক্ষ্য করলেন ফাতেমা বেগম।মেয়েটার খাবারের শালীনতা শিষ্টাচারও উনার বেশ পছন্দ হলো।মনেহয়,মেয়েটা বেশ শান্তশিষ্ট প্রকৃতির।উনার নাতনীদের মতো উড়নচণ্ডী টাইপের নয়।কালকে মেয়েটাকে শাড়ী পরা অবস্থায় দেখে, মান্যতার বয়সী মনে হয়েছিলো উনার।কিন্তু আজ ড্রেস পরা অবস্থায় দেখে তো বেশ ছোটো ছোটো মনেহচ্ছে মেয়েটাকে।তাই তিনি আচমকা প্রশ্নটা করলেন।কৌড়িও গালের খাবারটা চিবানো বন্ধ রেখে নমনীয় গলায় উত্তর দিলো।

‘এবার ইন্টারমিডিয়েট পরিক্ষা দেবো।তিনমাস পর আমার পরিক্ষা।

কথাটা বলে মাথা নিচু করে নিলো কৌড়ি।বাবার ইচ্ছে ছিলো কৌড়ি ডাক্তার হবে।মানব সেবা করবে।সেই মোতাবেক পড়ালেখা করে আসছিলো।তবে জীবনের মধ্যে দুপুরে এসে থেমে গেছে সে।এবার কি আর বাবার স্বপ্ন পূর্ণ করতে পারবে।অন্যের আশ্রিতা এখন, কে পড়াবে তাকে আর।ইন্টার পরিক্ষাটা পর্যন্ত দিতে পারবে কি-না, তার ঠিক নেই।ডাক্তার হওয়া তো শুধুই ঘুমের ঘোরে থাকা বিলাসবহুল স্বপ্নের মতো ছাড়া কিছুই না।
সবাই চুপচাপ খাওয়ায় মনোযোগী হলেও আর খাবারে মনোযোগী হতে পারলোনা কৌড়ি।সেটা খেয়াল করলেন নীহারিকা বেগম।নিজ মনে ভাবলেন কিছু।ফের নিজের পাশে বসা কৌড়ির হাতখানার উপর নিজের হাতের মৃদু স্পর্শ রাখতেই, কৌড়ি উনার দিকে ফিরলো। সেটা দেখে মুখে মৃদু হাসি টেনে নীহারিকা বেগম চোখ দিয়ে ইশারা করলেন খাবার খেতে।ইশারা লক্ষ্য করে খাবার খেতে মনোযোগী হলো কৌড়ি।যদিও খেতে ইচ্ছে করলোনা তার।

‘কি-রে কাল এসেছিস,আর আজ একদিন পূর্ণ করেই তবে আমার সাথে দেখা করার সময় মিললো তোর।এত মন খারাপ ছিলো?আমি একবার যেতে চেয়েছিলাম। নীহারিকা বললো,তখন তুই ঘুমিয়ে গিয়েছিলি।

অমায়িক ব্যবহারের এই কাকু নামক মানুষটাকে কৌড়ি কয়েকবার দেখেছে।তবে উনি তখন সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন।বাবা আর কাকুর মধ্যে খুবই ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও,তাদের পরিবারের মধ্যে তেমন কোনো সম্পর্ক ছিলোনা।বাবা ঢাকাতে এলে কাকুর সাথে দেখা করতেন,এবাড়িতেও আসতেন।খেয়েদেয়ে যেতেন।যেটা কৌড়ি বাবার মুখে শুনেছে।কাকুও কোনো কাজে গ্রামে গেলে,বাবার সাথে যোগাযোগ করতেন,তাদের বাড়িতে থেকে আমোদ আহ্লাদ করে চলে আসতেন।সেই হিসাবে কাকু নামক মানুষটাকে চেনা কৌড়ির।তবে উনার
এক্সিডেন্টের কথা শুনে বাবা এসে দেখে গেলেও,কৌড়ির তারপর আর কাকুর সাথে দেখা হয়নি কখনো।

‘কি-রে এখনো মন খুব খারাপ?কিন্তু কি আর করার আছে আমাদের বল!সবাইকে তো একদিন যেতেই হবে সে পথে।কারও যে ছুটকারা নেই সে পথ থেকে।এইযে আমিও সময় গুনছি?কবে আমার ডাকটাও চলে আসে।

‘এসব কি কথা বলা শুরু করেছেন।মেয়েটাকে আপনার কাছে আনলাম মন ভালো করতে আর আপনি আরও মন খারাপ করে দিচ্ছেন।

নীহারিকা বেগমের মিষ্টি ধমকে মলিন হাসলেন জাহিদ সাহেব। এই পঙ্গুত্ব জীবন উনার আর ভালো লাগেনা।না মরে এরকম অন্যের দায়ভার হয়ে বেঁচে থাকার থেকে মনে হয় মরে যাওয়ায় ভালো। তবে নীহারিকার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা,বিরক্তহীন সেবা।তাকে বাচিয়ে থাকতে সাহস জোগায়।তবে নিজেকে মাঝে মাঝে নীহারিকার বোঝা মনেহয় উনার।উনার জন্য নাহীরিকার একদন্ড ফুরসত নেই।কোথা-ও যাওয়ার শান্তি নেই।নিজেকে খেয়াল করারও যো-টুকু পর্যন্ত নেই।নীহারিকা বেগমের রাগান্বিত মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন।

‘তোমরা সত্যি কিছুতেই মানতে চাওনা নীহারিকা।এরকম ধমক দিয়ে সত্যটাকে আড়ালে ডুবিয়ে রাখার চেষ্টা করো।তাই বলে সত্য কি মিথ্যা হয়ে যায়?সত্য যে অনিবার্য।প্রভুর সৃষ্টির শ্রেষ্ঠতা।সেই সত্যকে আড়ালে ডাবিয়ে রাখলে সত্য কি কখনো মিথ্যা হয়ে যাবে?যাবে না।কখনোই যাবার নয়।

থামলেন জাহিদ সাহেব। পাশে বসা কৌড়ির মাথায় হাত রাখলেন।ফের নরম কন্ঠে বললেন।–চিরন্তন বাস্তব বলে
সত্যকে মেনে নেওয়া সেখ,মা।তবে দুঃখ কষ্ট কম ছোঁবে তোকে।দূর্গম পথ সহজ মনে হবে।এই কঠিন পৃথিবীতে চলতে গেলে দুঃখ কষ্টে পতিত হয়ে মুরছা গেলে চলবে না।সত্যকে মেনে নিয়ে নিজেকে শক্ত কর।সামনের দিন গুলো সহজ হবে।

অন্যকে উপদেশ মুলক বানী শোনানো সহজ বিষয়।কিন্তু সেটা অপরপক্ষের মানা ঠিক তার বিপরীত বিষয়।এটা জাহিদ সাহেব জানেন।ক্ষনিকের এই পৃথিবীতে সৃষ্টিকর্তা মায়া,টান,ভালোবাসা তো এমনি এমনি সৃষ্টি করেনি।আর পিতামাতার মতো মহামূল্যবান সম্পর্কও।সেই পিতামাতা জীবন থেকে ডুবে গেলে,সূর্য অস্ত যাওয়ার মতো নিজের জীবনটাও অস্তমিত মনেহয়।নিজের বাবার মৃত্যুতে সেটা অনুভব করেছেন জাহিদ সাহেব।আর সামনে বসা এই মেয়েটার তো পিতামাতা দু’জনেই অস্তমিত।বাবা মা সমতুল্য চাচা চাচি থেকেও নেই।আর দাদি সে-ও যে ডুবুডুবু ভাব।আর সেই মেয়েটাকে এসব বানী শুনিয়ে কি সহজে শান্ত করা যায়?মেয়েটা যে কখনো বাচ্চা।সেই বাচ্চা মনে কতো আঘাত একটার পর একটা নির্মমভাবে হানা দিয়ে চলেছে।আর মেয়েটা ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।এটাও বা সত্য মানার থেকে কম কিসে?

প্রসঙ্গ পাল্টে জাহিদ সাহেব আরও বিভিন্ন কথা কৌড়ির সাথে বলতে থাকলেন।মেয়েটাও চুপচাপ শুনল সহজে উত্তর করলোনা।এবাড়ির এই মানুষটা বাদে সর্বত্র মানুষগুলো তার অপরিচিত।তবে এই মানুষটাও যে খুব পরিচিত এমনটাও নয়।বিধায় উনার সাথে সহজ হয়ে কথা কৌড়ির একটু সংকোচ হলো।তবে মানুষগুলো ভিষন ভালো। তার রক্তের সম্পর্কিত চাচা চাচির মতো অন্ততঃ নয়।

সারা সকাল দুপুরটা কৌড়ির একাকিত্ব কেটে গেলে-ও, বিকালের দিকে আবারও হৈচৈ পূর্ণ পরিবেশের মিলনমেলা শুরু হলো তার রুমে। মৌনতা চারটার পর স্কুল থেকে এসেই, কোনোমতে খাওয়া গোসল সেরে তারসাথে ওটাএটা নিয়ে বকবক শুরু করে দিলো।চিকনচাকন গড়নের ফর্সা মেয়েটা বেশ কৌতুহলী আর চঞ্চল।তবে প্রচন্ড মিশুকে স্বভাবের।তার অতি মিশুকতা সহজে মানুষ,তার কাছের মানুষ হয়ে যেতে বাধ্য।

‘কাল তোমার রুমে আসা নিষেধ ছিলো,এজন্য তোমার কাছে আসতে পারিনি আমি।সকালে স্কুল ছিলো,যদি-ও আমি যেতে চায়নি।আম্মুর বুকিনিতে যেতে হয়েছে।আর বাবা দাদাভাইরা জানলে বকবে,আমি স্কুল কেনো যায় নি।তাই,সকাল থেকে এই পর্যন্ত তোমার কাছে আসতে পারি নি।কিন্তু তুমি বিশ্বাস করো,আমি স্কুলে থাকলেও মন আমার তোমার কাছে আসার জন্য,তোমার সাথে কথা বলার জন্য ছটফট করছিলো।তবে চেয়েছিলাম টিফিন পিরিয়ডে বাসায় চলে আসবো।কিন্তু তখন বাসায় আসলে আম্মু আমাকে খুব পিটানি দিতো।আর জানো আমার একটা ছাগলী বান্ধবী আছে,সে-ও আমাকে কিছুতেই আসতে দেয়নি।বাড়িতে আম্মু আর স্কুলে তিন্নি।আসলে ওর বা কি দোষ।ও স্কুলে না আসলে আমার ক্লাসে মন বসে না।সেখানে আমি না থাকলে, ওর ও তো ভালো না লাগার কথা।যাই হোক কাল যখন তোমাকে দাদাভাই এবাড়িতে নিয়ে এলো,আমি মনে করছিলাম।দাদাভাই বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছে।তবে সাদা শাড়ীর জায়গায় লাল একটা শাড়ী পরলে, দাদাভাইয়ের বউ হিসাবে তোমাকে কিন্তু দারুন মানাতো।একদম পারফেক্ট জুড়ি।তুমি কিন্তু খুব সুন্দর দেখতে।দাদাভাইয়ের পাশে কিন্তু তোমাকে দারুন মানায়।তবে…

এত কথার জের ধরে একটু থামলো মৌনতা।কৌড়ির ডগর ডগর নিষ্পলক নজরের পানে চেয়ে ফের দুঃখী দুঃখী মুখ করে বললো–তবে যখন আমি শুনলাম তুমি দাদাভাইয়ের বউ না,আমার যে মন খারাপ হয়েছিলো।তোমাকে কি করে দেখাই!দেখানোর হলে সত্যিই তোমাকে দেখাতাম।আমি আরও ভেবেছিলাম,আজ স্কুলে গিয়ে আমার বান্ধবীদের তোমাকে দেখাতে নিয়ে আসবো।যে আমার দাদাভাই কি সুন্দর একটা বউ নিয়ে এসেছে দেখ তোরা।কিন্তু হলো না।

কৌড়ি আশ্চর্য হয়ে মৌনতার কথাগুলো শুধু নীরব শুনে গেলো।এই মেয়ে এসব বলছেটা কি!অজানা কারনে গায়ের নুইয়ে থাকা লোশম গুলো কাটা দিয়ে উঠলো।তবুও সেদিকে লক্ষ্যনেই তার,সে মৌনতার অনর্গল নড়ে যাওয়ার ঠোঁটের পানে তাকিয়ে আছে।কে এই দাদাভাই?তাকে কালকে নিয়ে আসা মানুষটা?সমস্ত গা ঝাঁকি দিয়ে শিহরে উঠলো কৌড়ির।

‘চলো ছাঁদে যাই?

আশ্চর্যতা দমন না হওয়ার কারনে,মৌনতার প্রস্তাব কর্নে বোধাহয় গেলোনা কৌড়ির।সেটা না বুঝেই কৌড়ের হাত শক্তপোক্ত করে ধরলো মৌনতা।ফের বললো—চলো ছাদে যাই।আমাদের ছাদটা খুব সুন্দর। আপু এখনো ভার্সিটি থেকে আসেনি। আপু আসলে তখন নাহয় রুমে বসে সবাই গল্প করবো।

কৌড়ি হ্যা না বলার সময় পেলো না।তার আগেই চঞ্চল পায়ে মৌনতা,তাকে নিয়ে ছাঁদে যাওয়ার উদ্দেশ্য চললো।অতি ছটফটি মেয়েটা সিঁড়িতে দ্রুত পা রাখতে যেয়ে,উপুড় হয়ে পড়ে নিতে গিলেই দু’হাতে সামলে নিলো তাকে কৌড়ি।ফের বললো—পড়ে যাবে তো মৌনতা।আস্তে চলো।

ব্যথা পেয়েও মিষ্টি হেসে দিলো মেয়েটা।মনহলো এরকম ব্যথা তার নিত্য পাওয়ার অভ্যাস আছে।বললোও তাই মেয়েটা।–দিনে এরকম দুই একবার অকারণে পড়ে যাই আমি।তাই ছোটো দাদাভাই আমাকে ডাকে আছাড়বিবি বলে।

আছাড়েবিবি!ভাবার আর সময় পেলোনা কৌড়ি।তার আগেই আবারও হাতে টান পড়ায় সিঁড়িতে ধপাধপ পা রাখতে হলো তাকে।

‘মৌনতা পড়ে যাবে।আস্তে।

শুনলো না মেয়েটার তার কথা।সোজা ছাঁদে নিয়ে গিয়ে তারপর কৌড়ির হাত ছাড়লো।

কাছে অথবা দূরে,আসরের আজানের সুমধুর ধ্বনিটা মুয়াজ্জিনের কন্ঠে হয়তো ভেসে একটু পরেই।ভাদ্রের আকাশে সূর্যের তপ্তের জৌলুশতা কমেনি।তব জ্বলজ্বলে সূর্যের দূরদূরান্ত আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কালো ছোটো ছোটো মেঘের ফালিগুলো।তবুও আকাশটা ঝলমলে।ছাঁদের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে কৌড়ি।আকাশ থেকে নজরটা সরিয়ে, ছাদের পানে দিলো।নজর শীতল হয়ে এলো তার।হঠাৎই মন উৎফুল্ল হয়ে উঠলো।বিগত দুদিনে হাসি না ফোঁটা ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটলো।

নাম জানা, অজানা ফুল গাছের সমাহারে পরিপূর্ণ ছাদটা।ফুলছাড়াও বিভিন্ন গাছ রেয়েছে।সুন্দরভাবে পরিকল্পনা করে সাজিয়ে গুছিয়ে ছাঁদের এই গাছগুলো রোপন করা হয়েছে। এবং রোজ যে তাতে পরিচর্যা চলে তা প্রতিটি গাছের চেহারায় প্রকাশ পাচ্ছে।

‘এদিকে এসো।

মৌনতার ডাকে আস্তেআস্তে ছাঁদের মধ্যের দিকে পা বাড়ালো কৌড়ি।মৌনতা দক্ষিণ পাশের বড়বড় ড্রামে লাগানো গাছগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে আছে।সেদিকে যেতেই কৌড়ি দেখলো,বড়োবড়ো ড্রামে লাগানো বিভিন্ন গাছে বিভিন্ন ফুল ফুটে আছে।কোনোটার ফুলের পাপড়ী, শুধু গাঢ় লাল।কোনাটার সাদা,গোলাপী পাতা একসাথে।কোনটার আবার গাঢ় মেজেন্টা।অথচ গাছের পাতা,গোড়ার শক্তপোক্ত মুলগুলো একই রকম দেখতে। মৌনতা, ড্রামে লাগানো গাছগুলো দেখিয়ে বললো।

‘জানো,বড়দাদাভাই আর আমার পছন্দ একইরকম।এই
বনসাই গাছগুলো বড় দাদাভাই লাগিয়েছে।আমারও ভিষণ পছন্দ।

কৌড়ি,মোটাতাজা গাছের ফুলের পাতাগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে
দেখতে লাগলো।আল্লাহর কি অপরূপ সৃষ্টি।দুঃখী মনও সেই সৃষ্টিতে শান্ত হয়ে যায়।কি আশ্চর্য।

‘দাঁড়াও আমি আম্মুর ফোন নিয়ে আসছি।ফুলের পিক উঠাবো, সাথে তুমি আর আমিও তুলবো।

কথা বলতে সময়,ছুটতে সময় নেই মেয়েটার।ছুটে নিচে চলে গেলো মেয়েটা।কৌড়ি বিবাহিত হয়ে গেলো,বিভিন্ন
ফুলের সমাহারে।অসময়েও বেলী ফুটেছে। ঝাঁকড়া কামেনী ফুলগাছের সবুজ পাতগুলো দেখা যাচ্ছে না, সাদা ছোটোছোট ফুলের সমাহরে।অলকানন্দার হলুদ ফুলগুলোতে সূর্যের আলো পেয়ে,তার হলুদ রঙটা আরও জ্বলজ্বল করছে।রঙ্গনা,জুই,রজনীগন্ধা চামেলিও বাদ নেই।বিভিন্ন প্রজাতির ক্যাকটাস জায়গা করে নিয়েছে ছাঁদের উত্তর ওয়াল ঘেঁষে।সাদা,কালো লাল খয়েরী হলুদের গোলাপ গাছের ও অভাব নেই।
আরও বিভিন্ন গাছ,ফুল হোক বা ফুলছাড়া।যা কৌড়ির নাম জানা নেই।আর কোনো গাছে কি লাগাতে বাকি আছে এই ছাঁদে।আছে হয়তো!

‘এই তোমার নাম কি ফুলকৌড়ি?

চমকে পিছনে তাকালো কৌড়ি।লম্বা চওড়া,ফর্সা একজন সুদর্শন যুবকে নজরে পড়ল তার।ছেলেটা,তার কালো ট্রাউজারের পকেটে দুহাত গুঁজে নিশ্চল নজরে তাকিয়ে আছে তারদিকে।ভীষন ভয় পেয়েছে কৌড়ি।পিছন থেকে এরকম ভুতের মতো কেউ কথা বলে!কি প্রশ্ন করেছে ছেলেটা সেটা জেনো মাথা থেকে বের হয়ে গিয়েছে।আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে নিলে কৌড়ি।মৌনতা এখনো আসেনি?হঠাৎই অস্বস্তি ঘিরে ধরলো তাকে।সেই অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে দিলো সামনের ছেলেটা,তার কথায়।

‘তবে নামের সাথে,তোমার সৌন্দর্যের নিদাারুন মিল আছে।ফুলকৌড়ি।

মৃদুস্বরে বেশ কয়েকবার ফুলকৌড়ি নামটা আওড়ালো ইভান ।ফের গভীরভাবে আশেপাশে নজর বুলিয়ে কৌড়ির মুখপানে নজর শান্ত রাখলো, কৌড়ির অস্বস্তি আরও শতগুণ বাড়িয়ে দিয়ে তার প্রশংসায় গীত গাইলো।

‘তুমি হাজার ফুলের মাঝে একটি জীবন্ত ফুলকৌড়ি।

চলবে….