Monday, July 28, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 58



ফুলকৌড়ি পর্ব-৪২+৪৩

0

#ফুলকৌড়ি
(৪২)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

সময়টা মধ্যহ্ণ।শহুরে পিচঢালা রাস্তা।নিভানের গাড়ী চলেছে শাশা শব্দ তুলে তার গন্তব্যে।গাড়ির গতিবেগ খুব অস্বাভাবিক নাহলেও স্বাভাবিক নয়।অথচ ছেলেটা সবসময় সাবধানতা অবলম্বন করে নিয়মমাফিক গাড়ি চালাতে পছন্দ করে, অভস্ত্য।অনার্স লেবেলে গিয়ে নিভান যখন গাড়ি চালানো শিখলো,অল্প সময়ের মধ্যে দক্ষ হয়ে উঠলো।তারপর থেকে তার গাড়ীতে যতবার নীহারিকা বেগম চড়েছেন,নিপুণহাতে ছেলেটার দক্ষভাবে গাড়ী চালানো উপলব্ধি করেছেন।কোলাহল রাস্তায় বরাবর ছেলেটা নর্মাল গতিবেগে কি সুন্দর দক্ষতার সহিত নিপুণহাতে গাড়ী চালায়,তার গাড়িতে চড়লে আল্লাহর ভরসা করে তিনি নিশ্চিন্তে থাকেন।শান্তি পান,তৃপ্তি অনুভব করেন।সেই ছেলেটা প্রথম এক্সিডেন্ট করলো সেদিন।তবে নিজ দোষে নয়।বেখেয়ালিতে চলতে গিয়ে একজন মায়ের সঙ্গে তার বাচ্চাটাকে বাঁচাতে নিজেকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিলো।তবে আজ!নিভানের হাত কেনো অদক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে!গাড়ির গতিবেগ কেনো স্বাভাবিকের তুলনায় অস্বাভাবিক চলছে।কেনো ছেলেটার নির্বিকার চাহুনি উনার কাছে এলোমেলো ঠিকছে!নিভান ক্লান্ত বলে!কতোটা পথ জার্নি করে বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই আবার জার্নি।সেই ক্লান্ততায়?নাকি অন্যকিছু?আচ্ছা কৌড়ির অসুস্থতার সংবাদ নয়তো!হ্যা আজ নিজ চোখে ছেলের পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন নীহারিকা বেগম।যখন নিভানকে জানালেন কৌড়ির অসুস্থতার খবর।হঠাৎই ছেলেটার স্বাভাবিক মুখের শান্ত আদল পাল্টে গেলো।কুঞ্চিত কপাল মূহুর্তেই মিলিয়ে গিয়ে, চোখের আকার হলো স্থির,ঠান্ডা।যেনো ভয়ংকর কোনো দুঃসংবাদ শোনানো হয়েছে তাকে।অদ্ভুত চোখে চেয়ে চেয়ে ছেলের পরিবর্তিত রূপ দেখলেন তিনি।তখনও খেয়ালে ছিলোনা,কৌড়ির প্রতি নিভানের আলাদা নজরভঙ্গি।কিছুসময় নীরবতায় কেটে গেলেও,যখন নিভান খুব স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,চলো।তখন যেনো উনার হুঁশ ফিরলো।তারপর থেকে নিভানকে সুক্ষ নজরে থেকেথেকে দেখছেন তিনি।আর অনুভব করছেন ছেলের অস্বাভাবিক পরিবর্তন!কৌড়ির প্রতি তার দূর্বলতা!এটাতো নিশ্চয় একদিনে হয়নি!তবে এতোটা দূর্বল কৌড়ির প্রতি উনার ছেলে হলো কবে থেকে? কখন?যা উনার নজর এড়িয়ে গেছে!নজরে পড়েনি!আশ্চর্য!গাড়ির গতিবেগ আগের চেয়েও আরও অস্বাভাবিক হতেই,নীহারিকা বেগমের ভাবনার ছেদ ঘটলো।তড়িৎ বললেন।

‘নিভান,গাড়ি থামা।

মায়ের মৃদু আতঙ্কিত গলার শব্দে হুশে ফিরলো এমন ভাবে মায়ের দিকে তাকালো সে।ফের অমায়িক হাসল।
সে হাসি এলোমেলো ঠেকলো,নীহারিকা বেগমের কাছে।আরেকধাপ আশ্চর্য হলেন তিনি।নিভান এমনটা করছে?এই ছেলে উনার!ততক্ষণে নিভান নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে বললো

‘ভয় পাচ্ছো কেনো,মা।আমাদের একটু তাড়াতাড়ি যাওয়া উচিত,তাই গতিবেগ একটু বাড়িয়ে দিয়েছি।ভয় পেও না।

আশ্বাস!আজ কেনো যেনো,নিভানের কথার আশ্বাসে ভরসা পেলেন না তিনি।নিভানের হাতের দিকে তাকালেন তিনি।স্ট্রিংয়ের রাখা শক্তপোক্ত হাতদুটো সাবলীল নয়।কেমন অ-সাবলীল কাজ করছে।এর আগেও তো নিভানকে গাড়ি চালাতে দেখেছেন তিনি।অদ্ভুত চোখে চেয়ে চেয়ে ছেলের অস্বাভাবিক কান্ড দেখলেন আর বিস্মিত হলেন।কৌড়ির অসুস্থতায় সংবাদে এতো অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছে ছেলেটা।যার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে চাইছেনা কিন্তু ভিতরের অস্বাভাবিকতায় বহিঃপ্রকাশ ঘটে যাচ্ছে ছেলেটার।কি আশ্চর্য!গলায়ও আশ্চর্যতা ঢেলে তিনি ফের বললেন।

‘নিভান গাড়ি থামা।

কেমন যেনো ক্লান্ত মনেহলো নিজেকে।অনেকটা সময় যুদ্ধ চালিয়ে বিরতি নেওয়ার পালা এমনভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের কথা মানলো নিভান।ফাঁকা দেখে রাস্তার সাইডে গাড়ি দাঁড় করালো।মূহুর্তেই মাথা এলিয়ে দিলো সিটে।গতকাল তার আগের দিন পরিক্ষা শেষ হওয়ার পর মেয়েটার সাথে কথা হয়েছে। তারপর আর কথা হয়নি।প্রচুর ব্যস্ত ছিলো নিভান।আর তার থেকেও ব্যস্ত ছিলো মন।কখন কাজ কমপ্লিট করে বাড়িতে ফিরবে সে।জাহিদ সাহেব তো আগে থেকেই কৌড়ির সম্পর্কে জানেন।এবার মা’কে জানিয়ে,সবাইকে নিয়ে কৌড়ির কাছে যাবে সেই তাড়ায়!অথচ তাড়া নিয়ে যাচ্ছে সে।কিন্তু কিভাবে! নিজেকে এলোমেলো করে নিয়ে।কৌড়ি এতো অসুস্থ জানায়নি কোনো তাকে?

‘পিছনে গিয়ে বোস।

ততক্ষণে গাড়ির পিছন সিট থেকে নেমে এসেছে তন্ময়ী আর ইভান।ভাইয়ের অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে ইভান অবাক নাহলেও তন্ময়ী হয়েছে।একটু নয় বেশ অবাক হয়েছে। কেননা নিভান-নামক শ্রদ্ধাভাজন মানুষটাকে তার জানা আছে।তাই সহসা প্রশ্নও করলো সে, ইভানকে।

‘নিভান ভাইয়াকে কেমন অস্বাভাবিক লাগছে না?

‘ভাসুরের নাম ধরতে নেই।তওবা পড়ো।

সিরিয়াস বিষয়েও কেমন ফাজলামো।কপাল কুঁচকে অদ্ভুত নজরে ইভানের দিকে তাকালো তন্ময়ী।সেটা দেখে একগাল হেসে দিলো ইভান।চমৎকার সে হাসি।তবুও সে হাসিতে মোটেই গললোনা তন্ময়ী।সেভাবেই চেয়ে রইলো।সেটা দেখে তড়িৎ ইভান বললো।

‘তোমার ভাসুরকে শুধু এখনো অস্বাভাবিক লাগছে এটাই শুকরিয়া করো প্রভুর কাছে।কৌড়ি বলতে সে যে অন্ধ,মেয়েটা অসুস্থ তাতে আবার হসপিটালাইজড্
এটা শুনে তোমার ভাসুর এখনো উদভ্রান্ত পাগল হয়নি।এখনো সুস্থ মানুষের মতো আচারণ করছে।প্রভুর শুকরিয়া করো।

প্রহসন করে বলা ইভানের কথাগুলো হঠাৎ বিশ্বাস করতে পারলোনা তন্ময়ী।কৌড়ি আর নিভান ভাইয়া!যদি তাই হয়ে থাকে,তবু্ও নিভান ভাইয়ার ব্যক্তিত্ব এমন উতলা উদভ্রান্ত কখনো সে ভাবতে পারেনা।তবে মন থেকে হওয়া,টান মায়ার সম্পর্কগুলো আসলেই অদ্ভুত অন্যরকম হয়।তাতে নিজের স্বভাব, ব্যক্তিত্ব সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়।এলোমেলো করে দেয় মন।এটা সে ইভানকে দিয়ে হাড়েহাড়ে অনুভব করছে।যে মানুষটার কর্মকান্ডে রাগ,ক্ষোভ,ঘৃণা জন্মেছিলো মনে।আজ মন তারই বশে।তার ছোঁয়ায়,তার ভালোবাসায় পার হচ্ছে নিজের দিনগুলো।সামনে সিটে গা ছাড়িয়ে বসা মানুষটাকে দেখে,কেমন যেনো তাকে নিয়ে অবিশ্বাস্য ভাবনাগুলো বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো।ফের বোকা নজর ঘুরিয়ে ইভানের মুখের দিকে আনতেই,হেসে মাথা ঝাকলো ইভান।বুঝালো তুমি যেটা ভাবছো,সেটাই।ফের সময় নিয়ে ফিসফিসিয়ে মৃদুস্বরে বললো

‘মনে হচ্ছে গাড়ি আমাকে চাালাতে হবে।

ততক্ষণে মায়ের আদেশ মেনে নেমে পড়লো নিভান।নেমে পড়লেন নীহারিকা বেগমও।তিনি নামতেই ইভানকে উদ্দেশ্য করে বললেন–তন্ময়ীকে নিয়ে সামনে গিয়ে বোস।দাদাভাই ক্লান্ত।গাড়ি তুই চালা।

মায়ের আদেশ মেনে তন্ময়ীকে নিয়ে সামনে বসলো ইভান।জায়গা পরিবর্তন করে নিভান-ও গিয়ে বসলো পিছনের সিটে।সহসা চোখ বুঁজে গা এলিয়ে দিলো সিটে।খুলে ফেললো শার্টের উপরের পরপট কয়েকটা বোতাম।যেনো গায়ে জ্বালা ধরে গিয়েছে তার।অথচ ঠান্ডার মধ্যও এসি চলছে নির্বিকার ভঙ্গিতে।নীহারিকা বেগম সুক্ষ খেয়ালি নজরে সবটা খেয়াল করলেন।ধীরেসুস্থে গিয়ে বসলেন ছেলের পাশে।ফের ইভানকে গাড়ি ছাড়তে বললেেন।সময় গড়ালো।গাড়ী চলছে স্বাভাবিক গতিতে।আর সেই স্বাভাবিকতা বজায় রেখে গাড়ির মধ্যে চলছে পিনপিন নীরবতা।হঠাৎই সেই নিঃশব্দতা ছাড়িয়ে নিভানের শান্ত গলার স্বর শোনা গেলো।ছেলেটা তখনও চোখ বুঁজে গাড়ির সিটে গা এলিয়ে বসে আছে।নীহারিকা বেগম স্থির নজরে সেদিকে তাকিয়ে। আর সেটা বুঝে মনেহয় নিভান কথা পাড়লো।

‘মা,আমি কৌড়িকে বিয়ে করতে চাই।

নীহারিকা বেগম শুনলেন।কিন্তু কিছু বললেন না।সবটা বুঝেও কেনো যেনো নিভান আর তার কর্মকাণ্ডগুলো বিশ্বাস করে উঠতে পারলেন না।সত্যিই ছেলের পরিবর্তন নজরে পড়ার মতো।অথচ এরআগে উনার নজরে পড়লো না।কিকরে?

‘মা।

নীরবতা ভেঙে এবার কথা বললেন নীহারিকা বেগম।গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বললেন। —শুনেছি তো।

মায়ের প্রসন্ন স্বর শুনে নিভান কেনো যেনো আর কথা বাড়ালো-না।তখনও ছেলের শ্যাম শান্ত মুখের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে নীহারিকা বেগম।কি নির্বিকার শান্ত আদল।অথচ তার বিচলিত কর্মকাণ্ড বলে দিচ্ছে,ভিতরে ভিতরে কতোটা অশান্ত সে।সহসা হাত বাড়িয়ে নিভানের শক্ত-পোক্ত রুক্ষ হাতের উপর নিজের কোমল হাতটা রাখলেন।এ স্পর্শ যেনো নীরব আশ্বাস।মাতৃস্পর্শ পেতেই নড়েচড়ে উঠলো নিভান।তবে চোখ খুললো-না।সেভাবে চোখ বুঁজে রেখে মায়ের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বুকে চেপে ধরলো।যেনো ভিতরে বয়ে চলা অস্বাভাবিকতার ঝড়টা ঠান্ডা করতে চাইলো।ছেলের বলিষ্ঠ বুকে হাত পড়তেই মূহুর্তেই চমকে উঠলেন নীহারিকা বেগম।ছেলের হৃদস্পন্দনের অস্বাভাবিকতা টের পেলেন নিগাঢ়ভাবে।বুকের খাঁচার ভিতরের হৃদযন্ত্রটা যেনো ঢিপঢিপ তালে নয় উগ্রবেগে উথাল-পাতাল ঝড় বইছে তালে চলছে।মানেটা কি?এতোটা অস্বাভাবিক আচারন কৌড়ির জন্য!নজর যেনো পিছনের সব বিস্ময়, আশ্চর্যতা ছাড়িয়ে গেলো।ছেলের বুঁজে থাকা মুখের দিকে কেমন আশ্চর্যজনক নজর নিয়ে তাকিয়ে রইলেন।মনেহলো,উনি উনার গর্ভে ধারণ করা লালিতপালিত এতোদিনের চেনা সুপরিচিত শক্তপোক্ত, কঠিন ব্যাক্তিত্বের ছেলেটাকে নয়,সম্পূর্ণ অজনা অচেনা কাওকে দেখছেন।আর তার অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ডগুলো বেজায় অবাক চোখে উপলব্ধি করছেন।নিভান!

হঠাৎই অনেক আগের পুরানো কিছু স্মৃতি মনে পড়লো।সেই মানুষটারই তো ছেলে।ছেলের কর্মকাণ্ড তো বাবার মতোই হবে!হওয়ার কথা!মানুষটার গায়ের রঙটা ছিলো শ্যামকালো।কিন্তু ভিতরের মনটা ছিল অমায়িক। ঝকঝকা পরিচ্ছন্ন,মায়াময়।নিজের মানুষ বলতে তার ভালোবাসা যত্নগুলো ছিলো নজরে লাগার মতো।যেমন ধৈর্যশীল শান্ত স্বভাবের মানুষ ছিলেন তেমন সহনশীল।আর নীহারিকা বলতে মানুষটা ভালোবাসায় মুড়িয়ে রেখেছিলেন। একটা সময় কটাক্ষ করে কতো আত্মীয় স্বজন কত কথা বলতো–রঙেচাপা ছেলেদের বউ সুন্দর হলে,সেসব ছেলেরা নাকি বউ যত্নে রাখে।খুব ভালোবাসে।তাই আওসাফ-ও তার বউ বলতে পাগল।আরও কতো কথা।লজ্জা পেতেন।সেই লজ্জায় যেনো দ্বিতীয়বার না পড়তে হয়,তাই মানুষটাকে আড়ালে বকতেন।কথা শুনাতেন।অথচ কে শোনে কার কথা।তার যত্নশীলতা চলতো তার নিয়মে।আর তারইতো ছেলে নিভান!

ঠিক কতোটা সময় ঘুমিয়ে কাটিয়েছে কৌড়ির জানা নেই।তবে ঘুমের ঔষধের প্রভাব কাটতেই গভীর ঘুমটা কেটে গিয়ে সকল ইন্দ্রিয় যেনো সচল সজাগ অনুভব হলো।ঘুমের প্রভাব পুরোপুরি না কাটায় আর শারীরিক দূর্বলতায় চোখ যেনো ডুবে রইলো।কিছুতেই মেলাতে ইচ্ছে করলো না।তবে ঘুমের রেশটা কেটে সকল ইন্দ্রিয় যখন সচল হলো সুপরিচিত তীব্র একটা সুগন্ধ নাকে এসে বাড়ি খেয়ে মস্তিষ্কে হানা দিলো।অনুভবে নাকি সত্যি?আচ্ছা মানুষটার তো আসার কথা ছিলো।তবে কখন আসার কথা ছিলো?আজ না গতকাল!ঘুমের ঔষধের ঘোরে খেয়াল করতে পারলো-না।গভীরভেবেও
সময়টা দিন চলছে নাকি রাত, সেটা-ও আন্দাজে করতে পারলোনা।তবে কি মানুষটা নিজের কথা রাখতে সত্যিই চলে এসেছে?হঠাৎ ডাক্টারের বলা নিজের অসুস্থতা কারনগুলো কানে বেজে উঠলো।মূহুর্তেই মনটা তিতকুটে অনুভূতিতে ডুব দিলো।কেনো এসেছে মানুষটা?তার জীবনটা অভিশপ্ত!আর সেই জীবনে যাকে জড়াবে সেও তো অভিশপ্ত হবে।নিশ্চয় মানুষটা শুনেছে,সে অসুস্থ।কারনটাও এতোসময় জেনে নিয়েছে।তবে এখনো কেনো এখানে মানুষটা!কৌড়ি শিওর,মানুষটা এসেছে।এবং তিনি তার অতি সন্নিকটে বসা।এতোসময় যে সুগন্ধটা মৃদুমৃদু নাক লাগছিলো এখন সেটা তীব্র,গাঢ় রূপ নিয়েছে।চোখ মেলতে চেয়েও মেললোনা কৌড়ি।পেশেন্ট বেডের পাশে,স্টিলের টুলে বসা মানুষটা তখনও তীক্ষ্ণ নজরে কৌড়ির ঘুমন্ত মুখের পানে চেয়ে।গভীর নজরে কৌড়ির ঘুমন্ত মুখের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে চলেছে সে।পুরো ঘন্টাখানেকের অপেক্ষার প্রহর বুঝি শেষ হলো এবার।তবে সজাগ হয়েও কৌড়ি যখন চোখ মেললো না,কারনটা বুঝি অনুধাবন করতে পারলো।সময় নিয়ে
ঝুকলো নিভান।কৌড়ির মুখের সন্নিকটে মুখটা নিয়ে খুব শান্তকন্ঠে বললো।

‘ডক্টর কি বলেছে জানো?বলেছে,বিয়ের আগে বাচ্চা হওয়ার প্রসেসিংটা কমপ্লিট করে নিতে।তুমি কি বলো?ডক্টরের পরামর্শটা কিন্তু আমার বেশ মনে ধরেছে।

সর্বাঙ্গের কম্পিত শিরশিরানিটা জানান দিলো সামনের মানুষটার শীতল গলার কথার ওজন, ভার।ফাজলামো করে বলা কথাটার গলার স্বর মোটেও সুবিধার ঠিকলো না কৌড়ির কাছে।তারউপর রেগে গেছে মানুষটা!গলার স্বরটা তেমনই জানান দিলো।ভিষণ কান্না পেলো কৌড়ির।ভুলেও চোখ মেললোনা।আর চোখ না মেলেও আন্দাজ করতে পারলো,সামনে বসা মানুষটার কঠিন করে রাখা মুখাবয়ব।শান্ত অথচ রাগান্বিত দুটো চোখ।
নিভান,কৌড়ির গতিবিধি খেয়ালি নজরে দেখলো।আরও ঝুকলো সে।ফের রাগ সামলাতে না পেরে বলেই বসলো।

‘তোমাকে কি বলে ছিলাম!বলো?বলেছিলাম না,কঠিন অসুখ বাঁধালে তোমাকে কিন্তু নিভান ছেড়ে কথা বলবে না।আস্ত রাখ…

‘মেরে ফেলুন-না আমাকে!এরকম অভিশপ্ত জীবন আমার চাইনা।যার সদ্য জীবন বাঁচাতে মা চলে গেলেন, যার চিন্তায় বাবাও গত হলেন।এখন আপনি!মেরে ফেলুন!সত্যিই এই অভিশপ্ত জীবন আমার চাই-না।

নিভান চোখবুঁজে দাঁতে দাঁত চেপে কৌড়ির বকে চলা প্রলাপ শুনলো।কৌড়িকে প্রেশার দিয়ে এমন কথাগুলাে সে বলতে চায়নি।কিন্তু মেয়েটাকে এরকম হসপিটালের বেডে শুয়ে থাকতে দেখে নিজেকেও ঠিক রাখতে পারিনি, পারছে না।পাতলা শরীরটা কিভাবে বেডের সাথে লেপ্টে আছে!একটু আগে রক্তের একটা সেলাইন শেষ হয়েছে।নিজ হাতে সেলাইনের লাইনের সুচটা টেনে খুলেছে সে।ফর্সা হাতটা ফুলে জায়গাটা লাল হয়ে আছে।কি অবস্থায় নিয়ে গেছে নিজেকে!ডক্টর বলেছে, সমস্যাটা শুরু হওয়ার কিছুমাস বা বছরের মধ্যে ডাক্তারের শরাণাপন্ন হওয়া উচিত ছিলো আপনাদের।অথচ বোকা মেয়েটা মাত্রাধিক পর্যায়ে যাওয়ার পর ব্যাপার সবাইকে জানিয়েছে।জানিয়েছেতো না জেনেছে সবাই।রাগ কি তবে সহজে কন্ট্রোলে রাখা যায়!সেই অসুস্থ মেয়েটাকে,না পারছে কাছে টানতে আর না পারছে তারউপর জমা রাগ ক্ষোভের কথাগুলো ভিতরে চেপে রাখতে।কৌড়ি কথা শেষ করতেই অনিমেষ গলায় বললো।

‘কিন্তু আমার যে এই অভিশপ্ত নারীটাকেই চাই।চাই মানে চাই।তুমি অভিশপ্ত হও বা কলঙ্কিনী তবুও তোমাকে চাই আমার।

দৃঢ়কণ্ঠের বার্তায় এবার চোখ মেললো কৌড়ি।মূহুর্তেই দুপাশের কার্নিশ বেয়ে হড়হড় করে নামল নোনাজলের স্রোত।ভাসমান নোনাজলের ঝাপসা চোখে নজরে পড়লো,ক্লান্ত শুষ্ক একটা কঠিন মুখাবয়ব ।শ্যামবর্ণ রঙটা আজ আরও চাপা দেখাচ্ছে। সবসময় পরিপাটি রূপটা নেই।কেমন উদভ্রান্ত!অথচ মায়াময়।গায়ের সাদা শার্টটার এলোমেলো অবস্থান!এরকম উদভ্রান্ত অগোছালো কখনো দেখেছে মানুষটাকে?কখনো দেখেনি কৌড়ি!সবসময় তার পরিপাটি রূপ দেখেছে।অথচ আজ এই রূপ।ফের চোখ বুঁজে নিলো কৌড়ি।কারজন্য এমন উদভ্রান্ত,পাগল পাগল অবস্থা মানুষটা?তারজন্য!কঠিন চোখে কৌড়ির কান্না দেখে গেলো নিভান।কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে চলা নোনাজলের দিকে কিছু সময় চেয়ে ধপ করে উঠে দাঁড়ালো সে।গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বললো।

‘আজ মঙ্গলবার, এখান থেকে তিনদিন পর শুক্রবার।আর সেদিনই আমাদের বিয়ে।এখন সন্ধ্যা, একটু পরেই তোমাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরছি।

কৌড়ির বিস্মিত মুখের দিকে না চেয়ে বাহিরের পানে পা বাড়ালো নিভান।সেটা লক্ষ্য করেই আশ্চর্য গলায় কৌড়ি বলে উঠলো।

‘এটা হতে পারেনা।

থেমে গেলো নিভান।পিছে মুড়ে বললো–কি হতে পারে না?তুমি ওবাড়িতে যেতে চাইছো না নাকি বিয়েটা করতে চাইছো না?

‘বিয়েটা!

‘কেনো হতে পারেনা?

কেনোর উত্তর দিতে গিয়েই থমকে গেলো কৌড়ি।সেদিকে কেমন অদ্ভুত নজরে চেয়ে রইলো নিভান।সেই নজরে বেশি সময় তাকিয়ে থাকতে পারলোনা কৌড়ি।নজর ফিরিয়ে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে কান্না আটকিয়ে কেমন করুণ গলায় বললো–কেনো বুঝছেন না আপনি!

আবারও কৌড়ির দিকে এগোলো নিভান।বেডের পাশে দাড়িয়ে শান্ত নির্বিকার গলায় শুধালো—কি বুঝবো?কি বোঝাতে চাইছো তুমি?

নিভানের দিকে ফিরলো কৌড়ি।শান্ত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকা চোখ দুটোতে চোখ রাখলো।কথাটা বলতে গলায় বিঁধলেও,ঢোক গিলে কথাটা কাটাছেঁড়ার মতো ভেদ করে মুখে আনলো।–যদি আমি কখনো মা না হতে পারি!

দাঁড়িয়ে থেকেই নিভান ঝুকলো কৌড়ির পানে।শার্টের বোতাম খোলা থাকায় উঁকিঝুঁকি দিলো লোশমের আস্তরণে আকর্ষণীয় বলিষ্ঠ বুক।পলকে নজর সরিয়ে নিভানের চোখ চোখ রাখলো কৌড়ি।সেই নজরে নজর স্থির রেখে দৃঢ়কণ্ঠে বললো নিভান।

‘যদিও ডাক্তার তেমন কিছু বলেননি।তবে তুমি যদি কখনো মা না হতে পারো।আমিও কখনো বাবা হতে চাই না কৌড়ি।

থামলো নিভান।কৌড়ির নিষ্পলক তাকিয়ে থাকা চোখের দিকে বেশ কিছুসময় তাকিয়ে থেকে এবার কন্ঠ কোমল করে বললো–সেদিন ঝড়বর্ষার দিনে যখন তোমাকে ওই অবস্থায় দেখলাম।আমার কলিজার মধ্যে লুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করেছিলো তোমাকে।আজও সেই ইচ্ছেটার তীব্র তেষ্টা পেয়েছে।তৃষ্ণায় পাগল পাগল অনুভব হচ্ছে ভিতরটা।কিন্তু আমি পারছি না তোমাকে কাছে টানতে।আর আমি চাইছিওনা সম্পর্কের বহির্ভূত তোমাকে ছুঁতে।প্লিজ কৌড়ি,এই তৃষ্ণাটুকু মেটাতে সাহায্য করো আমাকে।ঠুনকো অসুস্থতা বা অযৌক্তিক কোনো বাঁধা আমাদের দুরত্বের কারণ হতে পারেনা।তাই এসব কারণ উল্লেখ করে আমার তৃষ্ণাটা দমবন্ধ করা অনুভূতিতে পরিণত হতে দিওনা।প্লিজ।

এমন মানুষকে স্বামীরূপে পাওয়া ভাগ্য। শুধু ভাগ্য নয় সৌভাগ্যতো বটেই।অথচ সেই মানুষটাকে নিজের দূর্ভাগ্যের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বঞ্চিত করবে কত পাওয়া থেকে!যা মানুষটার প্রাপ্য।কিন্তু মানুষটা তো বুঝতেই চাইছেন না।আর বুঝবে এ আশা করেনা কৌড়ি।তবুও মানুষটার ভালো তো সে চায়।কৌড়ির ভাবনার মাঝেই নিভান সরে দাঁড়ালো।ওই ভারাক্রান্ত অবুঝ চোখ, কান্নায় রক্তিম আভা ছড়ানো লাল নাক,শুষ্ক ঠোঁট। মলিন মুখ তাঁকে টানছে।একটু নয় গভীরভাবে টানছে।যখন তখন কিছু একটা অঘটন ঘটে যেতে পারে।এজন্য হয়তো হারাম নারী থেকে দূরে থাকার নিষেধাজ্ঞা,জরুরি। নিভান আর দাঁড়ালোনা।আর না কৌড়ির উত্তরের আশা করলো।সহসা পা বাড়িয়ে কেবিনের বাহিরের দিকে অগ্রসর হলো।সেটা লক্ষ্য করেই কৌড়ি দূর্বল গলায় কয়েকবার ডাকলো তাকে।তবুও পিছু ফিরলো নিভান।এই ডাকের অর্থ তার জানা আছে।খুব ভালো করে জানা আছে।এবার শেষ দূর্বল অস্ত্র ব্যবহার করলো কৌড়ি।মৃদু চঞ্চল গলায় ডাক দিলো।

‘নিভান।

থামকালো পা।সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে ফের পা বাড়ালো সামনের দিকে।এই ডাক উপেক্ষা করার নয়!তবুও উপেক্ষা করতে হবে তাকে।ভিতর থেকে দূর্বল
করে দেওয়া এই ডাকের অর্থ কৌড়ি জানে।তাই দূর্বল করতে এই ডাক।তবে কৌড়ির চাওয়া আবদার পূরণ করা তারজন্য কখনো সম্ভব নয়।আবদার তো নয় অনর্থকর অনাবদার।যা নিভানের দ্বারা পূর্ণ করা আদৌ সম্ভব্য নয়।

নিভানের চলে যাওয়ার পানে কেমন করুন চোখে তাকিয়ে রইলো কৌড়ি।নজরের আড়াল হতেই চোখ বুঁজে নিলো সে।আশা করেছিলো,এই ডাকেও কাজ হবেনা।তবে শেষ চেষ্টা করতে আপত্তি কোথায়, মানুষটাকে থামাতে।তাই ভিতরের বিড়ম্বনা অস্বস্তি ঠেলে দিয়ে তার বয়সের কতোবড় মানুষটাকে নাম ধরে ডেকেছে!অথচ ফলাফল শূন্য।ফলাফল শূন্যইতো আশা করেছিলো সে।তবুও চেষ্টা বিফলতা আনতেই মনটা হতাশ হলো।ভিতরটা হুহু করে উঠলো তীব্র যাতনায়।

গতকাল বিকাল থেকে অতিমাত্রায় পেটব্যথা আর স্বাভাবিকের চেয়ে প্রচন্ড রক্তক্ষরণে পাগলপ্রায় অবস্থা ছিলো তার।শরীরের এই অবনতির কথা বাড়ির মানুষ জানতে পারলো রাতে।তখন ডক্টরের শরণাপন্ন হওয়ার মতো অবস্থা ছিলো-না।সময়টা ছিলো গভীর রাত।তাই সারাটা রাত প্রচন্ড ব্যথায় কাটাতে হয়েছে তাকে।সকাল হতেই শারিরীক অবনতির কারণে আর দেরী করা হয়নি।হসপিটালে আনতেই ইমার্জেন্সিতে ডক্টর দেখানো হয়েছে।সবটা করেছে নাহিদ আর কৌড়ির ছোটো চাচা।তারপর ডক্টর রোগীর বক্তব্য অনুযায়ী বিভিন্ন টেস্টসহ নিজেও পরিক্ষানিরিক্ষা করলেন। রিপোর্ট দেখার আগে যেটা ধারনা করলেন,অবলীলায় রোগীর সামনে সেটা উপস্থাপন করলেন।তবে রিপোর্ট অনুযায়ী ঔষধ দেওয়ার আগে,কৌড়ির অতিমাত্রায় পেটব্যথা আর বিল্ডিং বন্ধের ঔষধসহ ঘুমের ঔষধ খাইয়ে দিয়েছিলেন।যার রেশ কেটে গিয়ে ভর করেছে এখন অনেক চিন্তা।নিজের অসুস্থতার ভাবনা বাদ দিয়ে ভর হয়েছে ওই মানুষটার চিন্তা।

‘সত্যিই কি মানুষটা বিয়ের চিন্তা ভাবনা করে ফেলেছে!

ভাবনাটা আর এগোতো পারলোনা।তন্মধ্যে কেবিনে ঢুকে পড়লো প্রিয় কিছু মুখ।নীহারিকা বেগমকে দেখেই কেমন যেনো মন আবেগপ্রবণ হলো।সহসা কেদে ও ফেললো।তা দেখে তড়িঘড়ি করে কৌড়ির কাছে গিয়ে বসলেন তিনি।স্নেহময় হাতে কৌড়িকে বেড থেকে তুলে বুকে জড়িয়ে নিয়ে আদুরে বুঝদারী কতো কথা বলতে থাকলেন।মাথায় ঘনোঘনো মাতৃত্ব স্পর্শে আদর ছোয়াতেও ভুললেন না।একপর্যায়ে গিয়ে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললেন।

‘আমার নিভানের বউ হবি কৌড়ি?চল-না তোকে একেবার নিয়ে রেখে দেই আমার কাছে।এই কৌড়ি জানিস,তোরজন্য আমার ছেলেটা ভালো নেই।আমার নিভান সমগ্র পৃথিবীর মেয়ে রেখে এই ফুলকৌড়িতে এতো পাগল হলো!কিকরে রে?বিশ্বাস কর,তোরজন্য ছটফট করতে দেখে আমারই বিশ্বাস হচ্ছিলোনা,ও আমার সেই নিভান।যার নিজের ইচ্ছে,আকাঙ্ক্ষা,শখ, চাওয়া পাওয়া বলতে মুখ ফোটেনি কখনো।অথচ আজ আমার কাছে কি নির্দ্বিধায় সে চেয়ে বসলো তোকে!চল-না কৌড়ি, আমার বাচ্চাটাকে ভালো রাখতে।

চলবে…

#ফুলকৌড়ি
(৪৩)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

দুপুরের ব্যস্ত যানযটপূর্ন রাস্তায় নিভানের গাড়ীটা চলছে খুব স্বাভাবিক গতিতে।স্ট্রায়িংয়ে হাত রেখে দক্ষ এবং মনোযোগ সহকারে গাড়ী চালাচ্ছে সে।সুগভীর শান্ত নজর তার পিচঢালা ব্যস্ত রাস্তায় হলে-ও বিশেষ মনোযোগ পাশে বসা নারীটিতে।রক্তশূন্যতায় গোলগাল ফর্সা মুখখানা আরও ফ্যাকাশে রঙ ধারণ করে দুধ-সাদা রঙের ন্যায় উজ্জ্বল,উজ্জীবিত দেখাচ্ছে।তাতে গায়ে জড়িয়ে কালো রঙ!সেই কালো রঙটার মধ্যে ফ্যাকাশে ফর্সা মুখটা আরও ঝকঝক করছে।পূর্নিমা চাঁদের ন্যায় ঝলমলে দ্যুতি ছড়াচ্ছে।হরিনী চোখজোড়া ফুলোফুলো, প্রানহীন।যে চঞ্চল চোখজোড়া বারবার তাকে টেনেছে,মেয়েটার প্রতি চরম আগ্রহী করে তুলেছে।আজ তা নিঃস্পৃহ। অথচ সেই নিঃস্পৃহ চোখজোড়ার প্রতি আজ আরও মায়া,টান অনুভব করছে নিভান।শান্তশিষ্ট চুপচাপ থাকা মেয়েটা আজ আরও নীরব,শান্ত।সংগোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিভান।গতকাল পরিচিত অপরিচিত সকল মুখগুলো উপেক্ষা করে কৌড়ির দাদিআপার কাছে সহজ সরল ভঙ্গিমায় প্রস্তাব রেখেছিলো সে।

‘আমি আপনার নাতনীকে বিয়ে করতে চাই।আমি তার সকল ভালো মন্দের গার্ডিয়ান হতে চাই।আর আমি এটাও আশা রাখছি আমার রাখা প্রস্তাবে আপনি দ্বিমত পোষণ না করুন।

ভদ্রমহিলা হয়তো আশা করেননি ওরকম সিচুয়েশনে বিয়ের প্রস্তাব।আশ্চর্য তো হয়েছিলেন সাথে বিচলিত।
বিচলিত হওয়ার কারণ,হয়তো উনার মনোবাসনা ভিন্ন রকম ছিলো।যা উনার চেহারায় চাহুনির ভঙ্গিমার প্রকাশ পেয়েছে।এবং তা নিভানের বুদ্ধিদীপ্ত নজরে-ও সুক্ষভাবে টের পেয়েছে।তাদের বাক্যলাপের মাঝে ঘনোঘনো নাহিদের দিকে তাকানো,সেটা আরও স্পষ্ট করে দিয়েছিলো।তবে দ্বিমত পোষণ করার স্কোপ পাননি ভদ্রমহিলা।নিভানের প্রস্তাব রাখার সাথে সাথে নীহারিকা বেগমও আমায়িক ব্যবহারে সহমত জানিয়ে,ছেলের বউ হিসাবে কৌড়িকে পাওয়ার আবেদন জানালেন।আবদার করলেন।সাথে মান্যতা ইভান, মৌনতা তো ছিলোই।সবাই যেনো ভদ্রমহিলাকে দ্বিমত পোষণ করার করার সুযোগই দিলো-না।একমাসের মতো সময় পার করে এসেছেন,যে বাড়িতে।কাছ থেকে দেখেছেন প্রতিটি ব্যক্তিকে।সেখানে হয়তো অমত পোষণ করার কারণও তিনি খুঁজে পান-নি।তবে বুদ্ধিমতি নারীটি মূখ্য চাল হিসাবে,নাতনির সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রেক্ষিতে আশ্বাস জানালেন।–যে কৌড়ি রাজি হলে,উনার অমত পোষণ করার প্রশ্নই উঠে-না।

দক্ষ হাতে রাস্তার বাক ঘুরাতে গিয়ে সুক্ষ হাসলো।ভদ্রমহিলা ভেবছিলেন,হয়তো কৌড়ি রাজি হবেনা।তবে
নিভানের মা,নীহারিকা বেগমও যেনো ভদ্রমহিলার বুদ্ধির আরও এক কাঠি উপরের চাল দিলেন।ছেলের সুখশান্তি ভালোথাকা বলে কথা!ফাঁকফোকর থাকবে কেনো সেখানে!ভদ্রমহিলা কথাটা বলতেই তিনি বললেন –আমি আপনার আগে কৌড়ির কাছে প্রস্তাব রেখেছি,ও সম্মতি না জানালেও অসম্মতি প্রকাশ করেনি।নীরব ছিলো।আর নীরব থাকাতো সম্মতিরই লক্ষন,তাইনা?বিধায় আপনি আর অমত পোষন করবেন–না চাচিমা।আপনার নাতনিকে আমি মেয়ের মতো আদর যত্ন গুছিয়ে রাখবো।আর আমার ছেলে!আপনি যেভাবে খুশি নাতী জামাই হিসাবে তাকে পরখ করে নিতে পারেন।যেভাবে ইচ্ছে খোঁজখবর করে যাচাই করে নিতে পারেন।আল্লাহর রহমতে ত্রুটি পাবেন না।

ভদ্রমহিলা দ্বিমত করার যেনো আর কোনো ফাঁকফোকড় পেলেন না।দ্বিতীয়ত আর কোনো শব্দও উচ্চারণ করলেন না।তবে উনার বেজার মুখের অপ্রকাশিত কথা মুখের অসন্তুষ্টতার ভঙ্গিমায় প্রকাশ পেয়েছিলো,যা নিভানের সুক্ষ নজর পদেপদে ঢেড় টের পাচ্ছিলো।উনি যে মনেমনে অবশ্যই অন্য আশা পোষন করেছিলেন,এটা বুঝেও নিভান তা ভ্রূক্ষেপ করেনি।তবে প্রস্তাব যখন পারিবারিকভাবে রাখা হয়েছে। এবং সেখানে সরাসরি সম্মতি না থাকলেও নীরব সম্মতি রপ্ত করা গেছে।দ্বিতীয়ত তা বিগড়ে যাক নিভান আর তা চাইনি।কৌড়িকে নিয়ে কোনো রকম পার্সেন্টটিস রিক্স! সে নিতে চায়না।তাই যতদ্রুত সম্ভব কৌড়ির রিপোর্টসহ সকল ডাক্তারী ফর্মালিটি কমপ্লিট করে,সেই সন্ধ্যায় সবাইকে নিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরেছে।সাথে কৌড়ির দাদিআপাকে নিয়ে এসেছে।কৌড়ির চাচারা, এই অসুস্থ অবস্থায় মেয়েটাকে এভাবে নিয়ে আসতে দিতে চান-নি।তবে নিভানের কাওকে তোয়াক্কাহীন কৌড়ির প্রতি অধিকারবোধের কাছে হার মেনেছে।মানতে বাধ্য হয়েছে জাহিদ সাহেবের একটা ফোন কলের কাছে।তাতে তারা অসন্তুষ্ট হলেও আর দ্বিমত পোষন করেন নি।নিভানও সেই অসন্তুষ্টতা তোয়াক্কা করেনি।এমনকি নাহিদের অনুনয়ও না।

হসপিটালের সামনে গাড়িটা এসে থামতেই ভাবনার ছেদ ঘটলো নিভানের।কাল ওখানের ডাক্তার দেখিয়ে তার মনপুত হয়নি।যদিও প্রাইভেট ক্লিনিক ছিলো।ডক্টরও অভিজ্ঞতায় খারাপ ছিলেন না।তবে নিজের পছন্দনীয় সুপরিচিত ডক্টরের কাছে পুনরায় আরও একবার দেখিয়ে, সুপরামর্শ নিতে চাইছে।বিধায় সকাল সকাল কৌড়িকে নিয়ে হসপিটাল মুখি হওয়া।যদিও মেয়েটা আসতে চায়নি।তবে নিভান কি শুনবার পাত্র।এমন অসুস্থতা নিয়ে কেউ হেলাফেলা করে!অথচ বোকা মেয়েটা রোগটা বাড়িয়ে কোথায় নিয়ে গেলো!
গাড়ী থামতেই কৌড়িও নড়েচড়ে বসলো।সিটবেল খুলে নিভানকে গাড়ি দরজা খুলতে দেখে মৃদুস্বরে চঞ্চল গলায় বললো।

‘আমি বললাম তো কাল ঔষধ খাওয়ার পর থেকে মোটামুটি ঠিক আছি।ভালো হতে তো সময় লাগবে!আবার ডাক্তার দেখানোর কোনো প্রয়োজন ছিলো-না।নেই প্রয়োজন! কেনো সবকিছুতে অবুঝপনা করছেন?

বিষয়টা নিয়ে কথা নলতে ভিতরে ভিতরে লজ্জায় গাট হলো।যে বিষয়টা নিয়ে বিয়ের দশবছর পরও স্বামীর জানার কথা ছিলোনা।তা আজ কতো খোলামেলায় প্রকাশ পেলো।অথচ মানুষটার এমন আচারণ এযেনো স্বাভাবিক অসুখের ন্যায় একটা রোগ।

‘অবুঝপনা!আমি করছি!না তুমি করেছো!সেদিন কি বলেছিলে,তুমি কোনো অসুখে ভুগছো-না।জোর গলায় বললে,ডাক্তার দেখানোরও কোনো প্রয়োজন নেই।তোমার এই দেখাদেখি অপ্রয়োজনীতার মধ্যে কি দেখতে হলো আমাকে!তুমি নিথর হয়ে হসপিটালের বেডে শুয়ে আছো!তোমার আন্দাজ আছ আমি যখন শুনলাম তোমাকে হসপিটলাইজড্ করা হয়েছে,আমার কি….

কথা শেষ করলো না নিভান।চোখ বুঁজে নিজেকে ধাতস্থ করলো।ফের গাড়ির দরজা খুলে বের হতে হতে বললো–তখন আমার কথা শোনার প্রয়োজন মনে করোনি।সো এখন আমি যেটা বলবো,করবো শুনতে বাধ্য তুমি।আর এই অসুস্থতার বিষয়ে বাধ্য নয়,আমি যেটা বলবো সেটাই হবে।এখানে কোনো অজুহাত বাহানা,দ্বিমত আমি শুনবোনা।সুতরাং অযথা বাহানা করো-না কৌড়ি।

সে অসুস্থ!অথচ কাল থেকে মানুষটা কেমন তারসাথে কড়া গলায়,রুক্ষ ভাষায় কথা বলছে!কারণটা হয়তো তার জানা।তবুও মানতে কেনো যেনো কষ্ট হচ্ছে।নিভানের কথায় মনেমনে অসন্তুষ্ট হলো।সেটা মুখের বহিঃপ্রকাশেও ঘটলো।নিভান স্পষ্ট খেয়াল করল।তবে দাঁতে দাত চেপে নিজেকে শক্ত রাখলো।এ মেয়ে নিজের ভালো বোঝেনা।তাকেসহ নিজেকে ভালো রাখতে গেলে
এই মেয়ের বাহানাকানো তােলা যাবেনা।তার অসন্তুষ্টতা মোটেই গ্রাহ্য করা যাবেনা।নিজে বের হয়ে কৌড়ির পাশের দরজা খুলে দিলো।কৌড়ি বের হলো ধীরেসুস্থে।বের হতেই নিভান শুধালো।

‘হাঁটতে অসুবিধা হবে?

‘না।

অসন্তুষ্ট স্বর!বুঝেও অবুঝ হয়ে রইলো নিভান।গাড়ীর দরজা লক করে পাশাপাশি হাটলো দু’জন।হসপিটালে ঢোকার আগে অতিরঞ্জিত দশতলা ভবনটা একবার মাথা উঁচু করে দেখে নিল কৌড়ি।সাথে বিভিন্ন ডক্টরের বিভিন্ন বিষয়ের উপর নামীদামী সার্টিফিকেট ধরা সাইনবোর্ড।তারমধ্যে ডক্টর মৌমিতা নাহার নামের সাইনবোর্ডটা জ্বলজ্বল করছে।নামটা আগেই শুনেছে সে।আর তার কাছেই যে নিয়ে এসেছে এটা বেশ বুঝেছে কৌড়ি।ভিতরে ঢুকে রিসিপশন এরিয়া পার করে নিভানের অনুসরণ অনুযায়ী লিফটে ঢুকলো।সামন্য সময়ের ব্যবধানে ছয়তলায় গিয়ে থামলো লিফট।লিফট থেকে পার হয়েই ছয়তলার রিসিপশন ডেস্ক।সামনে এগোতেই ডক্টর মৌমিতার চেম্বার নজরে পড়লো।সেখানে নেমই প্লেটে জ্বলজ্বল অক্ষরে লেখা।

ডক্টর মৌমিতা নাহার।
এমবিবিএস এন্ড এফসিপিএস (গাইনি এন্ড অবস)
কনসালট্যান্ট রিপ্রোডাক্টিভ এন্ড এন্ডোক্রাইনোলজি ও ইনফার্টিলিটি।
বিএসএমএমইউ (—-)
গাইনিও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ এবং সার্জন।

বয়সটা ঠিক কোন গানিতিক সংখ্যায় গিয়ে ঠিকেছে,গাঢ় গোলাপি শাড়ি পড়া অতি সুন্দরী নারীটার অনুধাবন করতে পারলোনা কৌড়ি।শালিন মার্জিতরূপে পরা গোলাপি শাড়ীর সাথে ম্যাচিং করে মাথায় হিজাব বাঁধা অসম্ভব সুন্দর নারীটা তারা ঢুকতেই মিষ্টি হেসে স্বাগত জানালেন।যেনো কতোদিনের চেনাপরিচিত।যদিও তারসাথে আসা মানুষটার সাথে যে বেশ চেনাপরিচয় এটা উনার ভালোমন্দ আলাপে বুঝতে পারলো কৌড়ি।তবে অসম্ভব অমায়িক ব্যবহার।এখন তিনি,কৌড়ির গতকালকের রিপোর্ট দেখছেন।সময় নিয়ে বেশ মনোযোগ সহকারে রিপোর্ট দেখার পর মুখ খুলেলেন তিনি।

‘আল্ট্রা রিপোর্ট এন্ড অন্যন্য টেস্ট রিপোর্ট তো আমার কাছে ঠিকই মনে হচ্ছে।তবে,আপনি যখন পুনরায় রোগীর সমস্যা বিবরণ করে আলট্রা রিপোর্ট করতে চাইছেন।তাহলে তো আমাকেও পুনরায় রোগীর সমস্যা শুনতে হবে।

‘অবশ্যই।রোগী তো সাথেই,আপনি সমস্যা জেনে নিন।

মানে কি?তাকে আবারও রোগের বিবরণ দিতে হবে।তাও আবার এই মানুষটার সামনে!কখনো না!রোগ জেনেছে ঠিক আছে।তাই বলে তার বিবরণ দিতে হবে মানুষটার সামনাসামনি!লাজলজ্জা সব কি বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে নাকি!না!বড়মা কতো করে বোঝালো বলে সে এসেছে।আর এখন!

‘কৌড়ি,উনাকে সমস্যাগুলো বলো।

কৌড়ি কেমন যেনো অসহায়,অদ্ভুত নজরে তাকালো।নিভান পলকেই তা বুঝে নিলো।মূহুর্তেই উঠে দাঁড়ালো সে। মুখে সৌজন্যে হাসি ফুটিয়ে,ডক্টরকে উদ্দেশ্য করে বললো—আপনি ওর থেকে সমস্যাগুলো জেনে নিন।আমি একটু আসছি।

দুজনকে সুক্ষ নজরে খেয়াল করলেন ডক্টর মৌমিতা।
নিভানের সাথে সাথে মূহুর্তেই কৌড়ির দ্বিধা, অস্বস্তিটা তিনিও টের পেলেন।বাচ্চা মেয়ে।যদিও ফোনে মেয়েটার সম্পর্কে নিভানের কাছে ডিটেইলসে আগেই জেনেছেন। তবুও নিভানকে উদ্দেশ্য করে বললেন–আপনি না ফোনে জানালেন,সি ইজ ইয়োর উডবি ওয়াইফ।তাহলে সমস্যা কোথায়?

সৌজন্যেমূলক ঠোঁটে ঝুলানো হাসিটা নিভানের আরও একটু প্রসারিত হলো।মাথা নিচু করে থাকা কৌড়ির পানে একপলক তাকিয়ে ফের ডক্টরকে উদ্দেশ্য করে বললো।

‘উডবি!এখনো পুরোপুরি আমার নয়।হয়তো এজন্য সমস্যা।

হাসলেন ডক্টর মৌমিতা।এখনকার যুগে এসে এখনো এতোটা রাখঢাক গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ডের মধ্যে আছে!যেভাবে অবাধ বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়াচ্ছে এন্ড মেলামেশা করে চলেছে ছেলেমেয়েরা।কতো ওয়েল ফ্যামিলির মেয়েরা আসেন উনার কাছে।সাথে নির্দ্বিধায় তাদের বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে আসে।বিবাহ হয়নি।লিভেন সম্পর্কে আছেন।অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন।আর সেসব অপরিপক্ক ফুলকে নষ্ট করতে। যদিও উনার হাতদ্বারা এখনো এতোটা অমানবিক পাপ কাজ হয়নি!মনেমনে তপ্ত শ্বাস ফেললেন।সাথে নিভানের এই সুন্দর মানসিকতার পরিচয়কে সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ জানালেন।যদিও জে এইচ জে ব্রান্ড গ্রুপ এন্ড লিমিটেডের অল্প বয়স্ক তুখোড় এই ব্যাবসায়ীর চারিত্রিক এন্ড ব্যাবসায়ী নীতির সুনাম দেশজু্ড়ে।ছেলেটাসহ উনার ফ্যামিলি কে তিনি ঈশিতার মধ্যেমেই চিনেন।ঈশিতা উনার ফ্রেন্ড।
সেই হিসাবে নিভানের কোনো গার্লফ্রেন্ড ছিলো বলে উনার জানা ছিলো-না।তবে কালরাতে ফোনে মেয়েটা সম্পর্কে ডিটেইলস জানার পর আর আজ সরাসরি দেখার পর একটু আশ্চর্য হয়েছেন।এতো বড় একজন সনামধন্য ব্যাবসায়ীর বাচ্চা একটা গার্লফ্রেন্ড।যদিও গার্লফ্রেন্ড বলে মিঃ নিভান সম্বোধন করেননি।বয়সের তারতম্যটাও বেশ।যদি-ও দুজনকে একসাথে দেখামাত্র নজরে পড়বেনা সেই বয়সের তারতম্য।তবে পরিচয় মিললে অবাক তো সবাই হবেই।

‘আপনি কিন্তু ভুলপও তাকে আমার গার্লফ্রেন্ড ভেবে ভুল করবেন না।এখান থেকে দু’দিন পর আপনিও কিন্তু বিয়ের নিমন্ত্রণ পাচ্ছেন।সো সি ইজ মাই ওয়াইফ, একপ্রকার ধরেই নিন।তাই আমি আশা রাখছি,তাকে ট্রিটটা আপনি তেমনই করবেন।

দৃঢ়কণ্ঠ অথচ কোমল বার্তা।আশ্বাস দিলেন ডক্টর মৌমিতা।আমায়িক হাসিটা ঠোঁটে কোণে অক্ষত রেখেই বললেন—অবশ্যই।আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।এন্ড কংগ্রাচুলেশনস।বিয়ে করছেন তবে?

ডক্টর মৌমিতার শেষের কথার প্রেক্ষিতে চমৎকার হাসলো নিভান।উত্তর যেনো তাতেই মিললো।–‘হয়তো তারই আশার অপেক্ষা ছিলো।এসে গেছে যখন বিয়ে করতে আপত্তি কিসের!

কথাগুলো মনেমনে আওড়ালেও মুখে বললো-থ্যাঙ্কিউ ডক্টর।আমি বাহিরে অপেক্ষায় আছি,প্রয়োজন পড়লে অবশ্যই আমাকে ডাকতে ভুলবেন না।

এতোসময় দুজনের বাক্যালাপে কৌড়ি চুপ থাকলেও নিভানের কথাগুলো তাকে,মানুষটার জীবনে কেমন যেনো গুরুত্বপূর্ণ আলাদা স্পেশালি একজন একান্ত মানুষের অনুভব করালো।আচমকা চেয়ে পড়লো সে নিভানের পানে।তখনও মানুষটার বাক্যালাপ চলছে সামনের নারীটির সাথে।অথচ কৌড়ির ভিতরের চঞ্চল অনুভূতিগুলো আঁটকে আছে।যখন নিভান বললো,সি ইজ মাই ওয়াইফ।কথার দৃঢ়তায় কৌড়ির মনেহলো,তার সমস্ত অধিকার শুধু এই মানুষটার।সে সমগ্রটাই শুধুটাই যেনো এই মানুষটার।কোথাও যেনো ভিতরের অসন্তুষ্টতা মন খারাপ,খারাপ চিন্তাগুলো ধূলিকণার মতো উড়ে গেলো।

‘কৌড়ি,আমি বাহিরে অপেক্ষা করছি।আর সমস্যাগুলো উনাকে সুন্দরভাবে বিবরণ দেবে।হুমম?

ভাবনায় আচমকা কথা পড়তেই তড়িৎ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।নিভান বাহিরে পা বাড়ালো।কৌড়ি সেদিকে একপলক তাকিয়ে ডক্টরের দিকে ফিরলো।ফিরতেই কেমন অস্বস্তিতে পড়ে গেলো।ডক্টর মৌমতা কেমন হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিয়ে তারপানে তাকিয়ে আছেন।ফের কন্ঠে মাধুর্যতা ঢেলে চলে যাওয়া মানুষটার প্রশংসায় ডুব দিলেন।

‘ছেলেটাকে আমি অনেকদিন ধরে চিনি।আজ পুনরায় নতুনত্বভাবে আরেকধাপ চিনলাম।সেই হিসাবে কিন্তু তুমি সৌভাগ্যবতী নারী।

কৌড়ির বলার কিছু পেলোনা।তবে লজ্জা পেলো ভিষণ।লজ্জায় মাথা নিচু করে নিয়ে হাসফাস করলো।হাত কচলে লাল করে ফেললো।সেটা লক্ষ্য করেই ডক্টর মৌমিতা প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললেন।

‘এবার ডিটেইলসে জানা যাক, সমস্যা কি?যদিও আমি আগের রিপোর্টগুলো দেখে রোগ নির্নয় করতে পারছি।বাট রোগীর মুখ থেকে সমস্যা গুলো জানলে,রিপোর্ট করতে আমার আরও সুবিধা হবে।

কৌড়ি মাথা নাড়ালো।ভিতরে ভিতর অস্বস্তি অনুভব করলেও ডক্টরের প্রশ্ন অনুযায়ী নিজের সমস্যাগুলো বলতে থাকলো।কোমল স্বরে যেমন একের পর এক ডক্টরের প্রশ্ন বাড়লো,উনার ব্যবহারে কৌড়ির উত্তর দেওয়ার স্পৃহা দ্বিগুণ হলো।

অনিয়মিত ঋতুস্রাব সাধারণত যৌবনের প্রারম্ভে এবং যৌবন শেষে হতে পারে। যৌবনের প্রারম্ভে সাধারণত ১২ থেকে ২০ বছর বয়সে কারো শরীরের ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোন যদি অপরিপক্ব (প্রিমেচিউর) থাকে তবে অনিয়মিত ঋতুস্রাব হয়। আবার নারী শরীরে মেনোপজ শুরু হওয়ার আগে এ ধরনের সমস্যা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের শারীরিক জটিলতার কারণেও এই সমস্যা হতে পারে।

অনিয়মিত পিরিয়ড কেন হয়?

নারীদের নিয়মিত ও সময়মতো পিরিয়ড (মাসিক) হওয়াটাই স্বাভাবিক।অনিয়মিত পিরিয়ড নারী স্বাস্থ্যের জন্য মোটেও ভালো নয়। অনিয়মিত পিরিয়ড বা একেবারেই পিরিয়ড বন্ধ হওয়া মূলত পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের (POS) জন্য হয়ে থাকে।তবে আরও অনেক কারণ আছে,যার জন্য পিরিয়ড নিয়মিত হয় না। এই সমস্যা হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।তন্মধ্যে জটিল সমস্যা হলো,TSH &FSH (Thyroid stimulating Hormone & Follicle Stimulating Hormone!

অনিয়মিত পিরিয়ড কী?
প্রতি চন্দ্রমাস পর পর হরমোনের প্রভাবে পরিণত মেয়েদের জরায়ু চক্রাকারে যে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায় এবং রক্ত ও জরায়ু নিঃসৃত অংশ যোনিপথে বের হয়ে আসে তাকেই ঋতুচক্র বলে।মাসিক চলাকালীন পেটব্যথা, পিঠব্যথা, বমি বমি ভাব হতে পারে। আর যাদের এই মাসিক ঋতুচক্র প্রতি মাসে হয় না অথবা দুই মাস আবার কখনও চার মাস পর পর হয়, তখন তাকে অনিয়মিত পিরিয়ড বলে।অনিয়মিত পিরিয়ডে নারীদের বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে।পিরিয়ড অনিয়মিত (তথা একাধারে অনেকদিন বন্ধ থাকার কারনে জরায়ুর রাস্তা পুরো হয়ে রক্তনালী বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভবা থাকে।ওভারিয়ন সিস্ট দেখা দিতে পারে,সন্তান জন্মদানে বন্ধ্যত্ব প্রকাশ পেতে পারে।আবার অনিয়মিত(তথা মাসের মধ্যে পিরিয়ড কয়েকবার এবং বেশিদিন স্থায়ী থাকার ফলে জরায়ুর রাস্তা ফুলে বিভিন্ন সমস্যা তৈরী হয়।সমস্যা গুরুতর হলে জরায়ু ক্যান্সারের মতো ভয়ংকর রোগে উপনীত হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে।এবং সন্তান ধারণ ক্ষমতাতেও জটিলতা দেখা দেয়।

মাসিক অনিয়মিত কেন হয়?

অনিয়মিত পিরিয়ড বা একেবারেই পিরিয়ড বন্ধ হওয়া পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোমের (POS) জন্য হয়ে থাকে।তবে আরও অনেক কারণ আছে,যার জন্য পিরিয়ড নিয়মিত হয় না।যেমন অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করা, ক্যাফেইন জাতীয় খাবার গ্রহণ যেমন অতিরিক্ত কফি পান করা,স্ট্রেস নেওয়া,অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করা, অপরিচ্ছন্ন থাকা,মদ্যপান বা ধূমপান করা ইত্যাদি।

টিনেজার ও মধ্যবয়সী নারীদের মধ্যে অনিয়মিত পিরিয়ডের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এর পেছনের কারণটি হলো হরমোন। আর লম্বা সময় স্ট্রেসে থাকলে অনেকেরই মাসিক দেরিতে হতে পারে।এ ছাড়া একজন নারী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু তা জানতেন না। এর পর নিজে থেকেই তার মিসক্যারিজ বা গর্ভপাত হয়ে যেতে পারে।এ ঘটনায় সাধারণ পিরিয়ডের তুলনায় কিছু দিন পর বেশি রক্তপাত হতে পারে,যাকে অনেকেই দেরিতে মাসিক হওয়া বলে ধরে নেন।ওজন কম হলে সময়মতো পিরিয়ড নাও হতে পারে। এমনকি কিছু দিন বন্ধও থাকতে পারে। জরায়ুতে টিউমার ধরনের এক ধরনের বৃদ্ধি হলো ফাইব্রয়েডস।এগুলো পিরিয়ডের স্বাভাবিক চক্রকে বাধা দিতে পারে।জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করা।যেমন-পিল,প্যাঁচ, ইনজেকশন,আইইউডি। এগুলো ব্যবহার করলে পিরিয়ড দেরিতে হওয়া বা পরিবর্তন হওয়াটা স্বাভাবিক।মনোনিউক্লিওসিস, ঠাণ্ডা, সর্দি, গলার ইনফেকশন- এ ধরনের সমস্যায় পিরিয়ড দেরিতে হতে পারে।তবে বড় কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন থাইরয়েডের সমস্যা বা পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের কারণেও পিরিয়ড দেরিতে হতে দেখা যায়।

নিয়মিত মাসিক হলে শরীরের হরমোনাল ব্যালেন্স ঠিক থাকে।তবে অনিয়মিত পিরিয়ড বিভিন্ন সমস্যা তৈরি করতে পারে।তাই এ বিষয়ে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।এবং অনিয়মিত পিরিয়ড জনিত যে সমস্যাগুলো সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হলো,সেসব লক্ষ্মণ দেখা দেওয়ার সল্প সময়ের মধ্যে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।নাহলে জরায়ু টিউমার,জরায়ু ক্যান্সার এবং বন্ধ্যাত্বের মতো জটিল রোগের সম্মুখীন হতে পারে।

‘আপনার রোগি তথা কাশফিয়া আহসান,( Follicle Stimulating Hormone)সমস্যা ভুগছেন।আরও কিছু সমস্যা রয়েছে তবে জটিল নয়আমাদের দেশের অধিকাংশ নারীরা হরমোন সমস্যায় ভুগছেন।বিভিন্ন জটিলতার কারণে তারা মারাত্মক কিছু না ঘটলে সহজে ডাক্তারের শরাণপন্ন হতে চান,না।তবে সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি তারা ডাক্তারের শরণাপন্ন হন তাহলে রুগী এবং রোগের সেবা প্রদানে সহজ হয়।রুগীর রোগ নিরাময়ে জটিলতা দেখা দেয় না।কমপ্লিকেশন কম হয়।

নিভান মনোযোগ দিয়ে ডক্টরের কথাগুলো শুনলো।কিছু কিছু কথায় শুধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো তবে মুখে কিছু বললোনা।ডক্টর ফের বললেন—তবে আমি আশা রাখছি আমার দেওয়া আলট্রা রিপোর্টসহ অনন্য টেস্টগুলোও একই রোগ নির্ণয় করবে।যদি উনার দেওয়া বিবরণ আগের ডাক্তারের কাছে যথাযথ পেশ করে থাকে।আর যদি রিপোর্ট সেইম আসে তবে উনাকে কিছু মাস পর্যন্ত ডক্টরের পরামর্শ অনুযায়ী থাকতে হবে।এবং নিয়মিত ঔষধ সেবন করে যেতে হবে।এবং স্বাস্থ্য সচেনতা হতে হবে।নিয়মিত খাদ্যাভ্যাস মেনে চলতে হবে।

তন্মধ্যে,নিজের ওজনের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে।নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে।মানসিকভাবে বেশি স্ট্রেস নেওয়া যাবে না।খাদ্যাভ্যাসে অনিয়ম করলে চলবেনা। বাহিরের খোলামেলা খাবার বর্জন করতে হবে।আরও বিভিন্ন করণীয়।যেগুলো রিপোর্টের একটা চার্টে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য থাকবে।

‘নিয়মিত ডক্টরের পরামর্শ অনুযায়ী থাকলে আপতত জটিল কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে না,এটা আশা রাখা যাচ্ছে তবে?

‘আল্লাহর রহমতে ইনশাআল্লাহ।আমি আশা রাখছি ঔষধ নিয়মিত চললে এবং নিজের স্বাস্থ্য এবং খাদ্যাভ্যাস সচেতন থাকলে,বাচ্চা কনসিভসহ পরবর্তী কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে-না।বাকিটা আল্লাহ যেটা চাইবেন সেটাই হবে।

দরজা খোলার শব্দে পিছনে ফিরলো নিভান।একজন নার্সের পাশাপাশি কৌড়ি আসছে।আলট্র,রক্ত টেস্টসহ বিভিন্ন টেস্টের জন্য তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো।নিভান সাথে যেতে চেয়েছিলো তবে কৌড়ি ফের অসম্মতি প্রকাশ করায় একজন নার্স দিয়ে পাঠানো হয়েছিলো তাকে।সেই ফাঁকে কৌড়ির বিবরণ অনুযায়ী ডক্টরের শরণাপন্ন হয়ে বিস্তারিত জেনে পরামর্শ নিয়েছে নিভান।ওই মেয়ে যা!ডক্টর কি বলেছে,কি পরামর্শ দিয়েছে সেটা নিয়ে কখনো মুখ খুলবেনা।তাই ম্যাডামের অলক্ষ্যে পরামর্শ নিতে হলো তাঁকে।কৌড়ি এসে নিভানের পাশের চেয়ারে বসে পড়লো।মেয়টাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে!চেহারায় প্রকাশ পাচ্ছে সেটা।নিভান কিছু বলতে নিয়ে-ও বলতে পারলো না।এরমধ্যে নার্স, কৌড়ি আর নিভানকে একপলক লক্ষ্য করে ডক্টরকে উদ্দেশ্য করে বললো।

‘রিপোর্ট আধাঘন্টা পরে পাবেন ম্যাম।

যদিও নিভান কথাগুলো শুনলো তবুও ডক্টর তাকে আলাদাভাবে বলে দিলেন।নার্সের কথা অনুযায়ী নিভান বুঝলো,রিপোর্ট পেতে সময় লাগবে।যদিও স্পেশালি ইমার্জেন্সিতে ডাক্তার দেখোনো হয়েছে,কোথাও সেকেন্ড দেরী হওয়ার কথা না।তবে রিপোর্ট তৈরী হতে তো সময় লাগবেই।এটুকু সময় তো ব্যায় হবে।দুপুরের খাবারটা খাওয়া হয়নি কৌড়ির।পাশে অফিস। অফিস যাবে নাকি কোনো রেস্টুরেন্টে?বাহিরের খাবার এখন কোনোমতে কৌড়ির খাওয়া যাবেনা!আবার মেয়েটা ক্লান্ত!যদিও খেতে চাইবে-না নিভান যানে।তবুও খেতে তো হবেই।

‘এক্সকিউজ মি ডক্টর।আমরা তাহলে ঘন্টাখানেক পরে আসছি।

‘লাঞ্চ করা হয়নি মনেহচ্ছে। না হওয়ারই কথা, সময়টা তো আমার এখানেই পার হয়ো গেলো।তবে লাঞ্চটা কিন্তু আমার এখানেই সেরে নেওয়া যেতো।

ফের সৌজন্যেতা দেখিয়ে হাসলো নিভান।বিনয়ের সাথে অফারটা ফিরিয়ে দিয়ে বললো।–থ্যাঙ্কিউ ডক্টর।তবে অনেক্ক্ষণ তো হসপিটালে,আমার মনেহচ্ছে ওর আপতত এখন একটু খোলামেলা পরিবেশ দরকার।

ডক্টর মৌমিতাও সৌজন্যে হেসে বললেন–‘অবশ্যই।

নিভান আর কৌড়ি বের হতেই ডক্টর নিজের কাজে ব্যস্ত হলেন।নার্সকে উদ্দেশ্য করে বললেন–লাঞ্চের আগে আপতত আর কোনো রুগী পাঠিও না।

নার্স সেকথা কানে তুললো কি-না বোঝা গেলোনা।সে এখনো তাকিয়ে আছে নিভান আর কৌড়ির যাবার পানে।তাদের প্রতি ডক্টরের এতো আগ্রহ,আহ্লাদ।যদিও এই হসপিটালে সব ধনাঢ্য ব্যক্তিদের দেখা যায়।
আর তাদের ফ্যামিলি। তবে চলে যাওয়া মানুষটার মেয়েটার প্রতি অতিরিক্ত খেয়াল ধ্যান তাকে যেনো মুগ্ধ করলো।মানুষটাকে সে চেনে,সেই প্রেক্ষিতে প্রশ্ন শুধালো।

‘ম্যাম,একটু আগের রুগীর সাথে যিনি ছিলেন,উনাকে আমার চেনা চেনা লাগছে।

‘আমাদের হসপিটালের সামনাসামনি এগোরোতলার যে ভবনাটা…

হঠাৎই মনে পড়ায় ডক্টর মৌমিতার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বেশ মুগ্ধ উচ্ছ্বসিত গলায় নার্সটা বললেন–উনি জে এজ জে গ্রুপ এন্ড লিমিটেডের (C,O),নিভান আওসাফ আহমেদ। আজ ফর্মাল ড্রেসআপ ছাড়া ছিলেন বলে হঠাৎই চিনতেই পারিনি।তবে গার্লফ্রেন্ডের প্রতি উনি বেশ খেয়ালি,যত্নশীল।

‘গার্লফ্রেন্ড নয় উডবি ওয়াইফ।দুদিন বাদেই বিয়ে..

নিভান নামের লম্বা চওড়া হ্যান্ডসাম লোকটাকে মাঝেমধ্যে দেখে নিপা।তবে দূর থেকে।গায়ের শ্যামবর্ণ মায়াময় রঙটার সাথে ফর্মাল ড্রেসেআপে মাঝেমধ্যে লোকটাকে যখন দেখে,মনটা পুলকিত হয়।নজর আকর্ষিত হয়।তবে ওর বাহিরে ভাবা পাপের সাথে সাথে ঔদ্ধত্যও।তাই ভাবনা ওই পর্যন্তই।তাদের হসপিটালের অনেক নার্স এমনকি সদ্য হওয়া ডাক্তারানীগন ,উনার ব্যাক্তিত্বে মুগ্ধ।রঙে চাপা হলেও সেই সৌন্দর্যের কথা সবার মুখেমুখে।লোকটা বিয়ে করছে?মেয়েটাকে একটুখানি মনেহলো না!

ডক্টর দেখিয়ে বাড়িতে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা নেমে গেলো কৌড়িদের।বাড়ি ফিরতে এতো দেরী হতো-না, কিন্তু মানুষটা দুপুরের খাবারটা খেতে কোথায় নিয়ে গেলো তাকে! একগ্রহ থেকে আরেকগ্রহে।এরচেয়ে বরং বাড়ি এসে খেয়েদেয়ে রিলাক্সে যেতে পারতো তারা।
কোথায় ডক্টরের চেম্বার আর কোথায় তৃনয় ভাইয়ার রেস্টুরেন্ট।পাক্কা পয়তাল্লিশ মিনিট লেগেছে যেতে!তার বেশি ছাড়া কম নয়!তাদেরকে দেখে তো তৃনয় ভাইয়া খুশিতে গদগদ।এর আগেও দেখাসাক্ষাৎ সহ টুকটাক কথা হয়েছে কৌড়ির সাথে তার।মানুষটা তন্ময়ী আপুর মতো আমায়িক মানসিকতার।দেখা হলে বিনয়ের সাথে একদম নিজের বোনের মতো ট্রিট করে।আজও তার ব্যতিক্রম হলো-না।সে অসুস্থ জেনে নিজ হাতে স্বাস্থ্যসম্মত রান্না করে খাওয়ালেন।হয়তো এজন্য উনার ওখানে নিয়ে যাওয়া।শেফ হিসাবে দারুন তিনি।উচ্চশিক্ষিত একজন মানুষ। যার বাহিরের ডিগ্রী আছে।ভালো উচ্চপদস্থ কোনো চাকরিবাকরিতে যোগ দিতে পারেন।অথচ তা না করে,কি নির্দ্বিধায় নিজের প্যাশনের মধ্যে ডুবে আছেন।যেনো এই শেফ নামটাতেই মহা সুখি তিনি।খাওয়া শেষে দুই বন্ধুর মধ্যে বেশ রমরমা আড্ডা চললো।যদিও কথা তৃনয় ভাইয়াই বলেছেন।উত্তর সরূপ সামনের মানুষটা শুধু পাল্টা উত্তর দিয়ে গেছেন।কিছু নিয়ে হয়তো তৃনয় ভাইয়ার উপর অসন্তুষ্ট।নাহলে, তৃনয় ভাইয়ার উপস্থিতিতে তাকে এতোটা চুপচাপ কৌড়ি কখনো দেখিনি।দুই বন্ধুর বেশ দৃঢ় বন্ধন দেখেছে।

রেস্টুরেন্টের রিসিপশন এরিয়ার পাশাপাশি আলাদা একটা গার্ডেন আছে।সেখানে বিভিন্ন ইনডোর গাছসহ মাছের বিশাল বিশাল ভিন্ন একুরিয়াম রাখা আছে।দুই বন্ধুর কথোপকথনে মধ্যে না থেকে সেখানে গিয়েছিলো কৌড়ি।ঘুরেফিরে যখন তাদের মধ্যে ফিরে এলো, দেখলো দুজনের মুখ থমথমে,ভার।সামন্য সময়ের মধ্যে কি কথা হলো বুঝলোনা কৌড়ি।তবে কিছু একটা তো হয়েছে।এটা বেশ বুঝেছিলো।তবে তার সামনে আর পর্যালোচনা না করার কিছু বুঝে উঠতে পারিনি।তার উপস্থিতি থমথমে পরিস্থিতি কাটিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবে বিদায় নিয়ে চলে এলো তারা।অবশ্যই চলে আসার তৃনয় ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে মানুষটা কেমন শান্তস্বরে কিছু কথা বলে এসেছিলো।যা কৌড়ির সম্পূর্ণ বোধগাময় হয়নি।অদ্ভুত গলায় শুধু বলেছিলেন–

‘ট্রাস মি তৃনয়,আমি আমার সকল না পাওয়া ইচ্ছেগুলো ভুলে গিয়েছে শুধু ওকে পেয়ে।যা আমি আমার এতোদিনের হাজার সফলতার মধ্যেও, নিজের বিসর্জন দেওয়া ইচ্ছে আকাঙ্ক্ষার ব্যথা ভুলতে পারিনি।না পাওয়ার মন খারাপগুলো এক নিমেষেই কেমন করে যেনো ভুলে যেতে বাধ্য হয়েছি।তোকে বর্ণনা দেওয়া সত্যিই সম্ভব নয়।জানি,জীবন মানে সবার কাছে একই রকম ডেফিনেশন নয়।আলাদা আলাদা যুক্তিতর্ক,আদালা আলাদা রুচিবোধ,আলাদা আলাদা শখ,সপ্ন,আলাদা আলাদা ইচ্ছেরা।হয়তো জীবন মানে সফলতার চূড়ায় পৌঁছানো।আমি সফলতা একটু হলেও ছুঁয়েছি তো,এজন্য জীবন মানে আমার কাছে ভিন্ন ডেফিনেশন মনে হচ্ছে।তবে আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে সেটাই বলেছি তোকে।হয়তো হারিয়ে যাওয়ার পর,হারিয়ে যাওয়া জিনিসের মর্ম বোঝা যায়।তবে উচিত নয় কি, হারিয়ে যাওয়ার আগে নিজের জীবনের সাথে তাকে জড়িয়ে নেওয়া?তাকে নিজের জীবনে মূল্যবান জায়গাটস করে দেওয়া?আমার মনেহয় মনের মতো উত্তম সঙ্গীনি হলে পৃথিবীতে আর কিছু চাইনা।ক্ষনিকের জন্য নাকি দীর্ঘস্থায়ী ভাবনা,জানিনা।তবে তেমনটা মনে হচ্ছে আমার।মা’কে দেখেছিতো।আমি চেয়েছিলাম আমার জীবন সঙ্গীনিও তেমনটা হোক।তাই ভাবনাটা আমার উত্তম সঙ্গীনিতেই আঁটকে গেছে,সফলতায় নয়।সফলতাতো পরিশ্রমের অর্জিত ফল।পুরুষ মানুষ যখন,পরিশ্রম করলে সৃষ্টিকর্তা বাধ্য হন সফলতা দিতে।তাই উত্তম সঙ্গীনি আগে।যাই হোক,আমি বাড়িতে ফেরার আগে তোকে যেন বাড়িতে গিয়ে পাই।আসছি।

সেখান থেকে ডক্টরের কাছে গিয়ে রিপোর্ট নিয়ে,পুনরায় ডক্টর দেখিয়ে বিভিন্ন পরামর্শ নিয়ে,বাড়ি আসতে আসতে সন্ধ্যা।তৃনয় ভাইয়ার সাথে ওরকম অদ্ভুত কথাবার্তা হওয়ার পর থেকে মানুষটা কেমন চুপচাপ হয়ে রয়েছে।কৌড়ির মনে কৌতুহল জাগলেও,প্রশ্ন করা হয়ে উঠেনি তার।সন্ধ্যায় মাগরিবের আযানের পর গাড়িটা যখন বাড়ির গেটে ভিড়লো,বাড়ির ভিতর বাহিরের চিত্র দেখে কৌড়ির চোখ কপালে উঠলো।বিস্মিত হওয়ার কয়োকধাপ পেরিয়ে একবার নিভানের মুখের দিকে তো একবার বাড়ির ভিতরসহ আশপাশটায় নজর দিলো।কয়েকঘন্টা বাড়িতে নেই,তারমধ্যে পুরো বাড়ির সাজসজ্জা পাল্টে গেলো।সত্যিই কি তবে?

চলবে…

ফুলকৌড়ি পর্ব-৪০+৪১

0

#ফুলকৌড়ি
(৪০)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

একে একে কৌড়ির পরিক্ষার দিনগুলো পার হতে লাগলো।সঙ্গী হিসাবে সেই মানুষটাকেই পেয়েছে সে।যে তাকে দায়িত্ব নিয়ে,নিয়েযাবে বলে আগেই আদেশজারী করে রেখেছিলো।সঙ্গী হিসাবে মানুষটা একটুও মন্দ নয়।একদম মনের মতো।যদিও পরবর্তী পরিক্ষার দিনে যখন তিনি, কৌড়িকে পরিক্ষা দিতে নিয়ে যাবেন বলে বললেন।বাড়ির বড়রা বেশ অবাক হয়েছিলেন।বিশেষ করে,বড়মা।অবাক হয়েই মুখ ফসকে বলেছিলেনও-তুই নিয়ে যাবি কৌড়িকে পরিক্ষা দিতে!

মানুষটা অপ্রস্তুত হয়েছিলো কি-না কৌড়ির জানা নেই।যদিও মুখের আন্দাজে কৌড়ির মনে হয়েছিলো,মানুষটা একটুও অপ্রস্তুত নয়।বরং বরাবরের মতো স্বাভাবিক।
একদম নিজের ব্যক্তিত্ব আর শান্ত আচারনের মতোই খুব স্বাভাবিক।আর কি সুন্দর অবলীলায় আর সাবলীল কন্ঠে বড়মাকে জানিয়েছিলেনও–ওকে আমি নিয়ে গেলে সমস্যা কোথায়?

বড়মার বিস্ময় নজর যেনো কৌতুহল হয়ে উঠেছিলো।
যা সেই ভোরবেলার আবাছা আলোতেও লক্ষ্য করেছিল কৌড়ি।আর যেটা লক্ষ্য করে তার অপ্রস্তুততা যেনো দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিলো।তবুও গাঁট হয়ে সে দাঁড়িয়ে ছিলো।বড়-মা যেনো কেমন দ্বিধান্বিত গলায় শুধু বলেছিলেন।

‘সমস্যা নেই,কিন্তু তুই তো অসুস্থ!এখনো ঠিকঠাক সুস্থ হোসনি।এই অবস্থায়?

‘আমি ঠিক আছি মা।ওকে নিয়ে যেতে অসুবিধা হবেনা।আর ইভানও যেতে পারছেনা।হাফিজ ভাইকে দিয়েও একটা মেয়েকে এভাবে এতোদূরে একা ছাড়া ঠিক নয়।আমি অন্তত ভরসা পাচ্ছিনা।

ইভান ভাইয়াকে আগে থেকে কি বলে রেখেছিলো, কৌড়ির বিশেষ জানা নেই।তবে সেদিন সকালে ইভানকে উঠতে দেখিনি কৌড়ি।তাই বিশেষভাবে আর কিছু বলেওনি বড়মা।তবে কেমন যেনো উনার নজর থেকে কৌতূহলই সরছিলোনা।সেটা বুঝে,ভিতরে ভিতরে কৌড়ি যে কি অপ্রস্তুত হয়েছিলো।সাথে লজ্জায়,আড়ষ্টতায় মনে হয়েছিলো,মানুষটার তারসাথে যেতে না করুক।তবে তিনি যেতেও না করেনি আর কৌড়ির মুখ ফুটে কিছু বলা হয়নি,বিধায় যেতে হয়েছিলো তাকে।তারপর থেকে আর কোনো প্রশ্ন তোলেনি কেউ।বড়মাও কেমন ছেলের অস্বাভাবিক আচারনের স্বাভাবিকতা দেখে নিজেও স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিলেন।তবে উনার সামনে সেদিন থেকে সহজভাবে চলতে ফিরতে কেমন যেনো অস্বস্তি কাজ করে।তবে কৌড়ি যে নিরুপায়।তা নিয়ে মজা করতেও ছাড়েনি,ইভান আর মান্যতা।সয়ে নিতে হয়েছিলো কৌড়িকে।বলারই বা কি আছে এখন।

তবে মানুষটার আরও একটা কাজে কৌড়ি কৌতুহলী হয়েছে, মনে জেগেছে বিভিন্ন প্রশ্ন।তবে না কৌড়ি প্রশ্ন করতে পেরেছে আর না সেই মানুষটা নিজ থেকে কৌড়ির কৌতুহলী মনের উত্তর দিয়েছে।সেটাতেই যেনো কৌড়ির কৌতুহল আরও বেড়েছে।রোজ পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে,মানুষটার পাশাপাশি নাহিদকেও দেখেছে সে।দু’জনেই খুব স্বাভাবিক।ছেলেটা পরিক্ষার হল থেকে বের হলে শুধু দুইটা কথা জিজ্ঞেস করতো,কেমন আছিস? আর পরীক্ষা কেমন হয়েছে?কৌড়ি না চাইতেও, একটাই উত্তরে কথা সমাপ্ত করতো,আলহামদুলিল্লাহ। তারপর সে চুপচাপ হয়ে যেতো।আর কথা বলার প্রয়োজন মনে করতোনা।যদিও নাহিদের বেলায় কথা বলার ইচ্ছেশক্তিটা কাজ করেনা তার।তবুও রক্তের সম্পর্ক আর মানুষ বলে তো কথা।বিধায় এড়িয়ে যেতেও পারেনা।তবে নাহিদকে দেখেও পাশের মানুষটার নির্লিপ্ত আচারন,তাকে অবাক করে দিয়েছিলো।মনেমনে আশ্চর্যও হয়েছিলো বৈকি।
সেদিন যে ছেলেটার কারণে তাকে এবাড়িতে থাকতেই দিলো-না।কতো রাগ-অভিযোগ দেখলো।এমনকি পরে এবাড়িতে থাকার অপশন যেনো না থাকে,তাই দাদিআপাকেও কৌশলে ওবাড়িতে নিয়ে গেলো।সেই মানুষটা,নাহিদকে তারজন্য অপেক্ষা করতে দেওয়া! তারসাথে কথা বলতে দিতে এলাও করা।সর্বোপরি চলে আসার সময় দু’জনের হ্যান্ডশেক করে মৃদুহেসে বিদায়ের গমন।নাহিদের বার্তা —ভালো থাকবেন ভাই।কৌড়িকে কেমন যেনো বিস্মিত করেছিলো!অবাক করেছিলো!তেমন মনেমনে কৌতুহলীও করে তুলেছিল।তবে নাহিদের সাথে প্রথম দিনের আলাপনের পর,কি কথা হয়েছিলো কৌড়ির তো জানা নেই। সেদিন যেনো মানুষটা আসার পথে অনেক্ক্ষণ নিশ্চুপ ছিলো।অনেকটাই শান্ত, গম্ভীর।কৌড়ির সাথেও কম কথা হয়েছিলো।যদিও তার, প্রয়োজন অপ্রয়োজন সবকিছুর খেয়াল রেখেছিলেন মানুষটা।তবুও কেমন অদ্ভুত শান্ত লেগেছিলো মানুষটাকে।তাই চেয়েও আর নাহিদের বিষয় নিয়ে কৌড়ি প্রশ্ন করতে পারি-নি।তবে সেদিন বাড়িতে এসে দাদিআপাকে প্রশ্ন করতে ভোলেনি কৌড়ি।নিজের কৌতূহল দমাতে না পেরে জিজ্ঞেস করেছিলো।

‘তোমার নাতী হঠাৎ এতো ভালো হয়ে গেলো কি-করে?যেখানে মেজোমাও আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন,ওই ছেলে মানুষ হওয়ার নয়।সেখানে উনার এতো পরিবর্তন কি করে হলো?নাকি লোক দেখানো?

শেষ কথাটায় কেমন ভৎসনা ছিলো।বৃদ্ধা প্রথম না বুঝে প্রশ্ন করলেন।–কার কথা কইছিস?নাহিদের?

‘হুমম।

বৃদ্ধা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ফের বললেন—তোর মতো আমারও প্রথমে ওর ভালোমানুষি দেইখা অবিশ্বাস হইছিলো।আরশাদকে নিয়ে নাহিদ যেদিন এবাড়িতে আইলোনা,আমিতো জানতাম না।তুই কইলি,তাই জানতে পারলাম।সেদিন এখান থেকে যাবার পর কারও সাথে কথা কয়-নায়।ঘরের দরজা বন্ধ কইরা সারারাত নাকি নেশা-ভান করছে।সাথে ঘরের জিনিসপত্র ভাইঙ্গা তছনছ করছে।মেজো বউতো সেদিন আমার ডাইকে কাইন্দে কাইটে তো একশার।কতো কিছু কইলাম,দরজাই তো খুললো-না।অন্যদিনের মতো মুখ চালাইলোনা।পরের দু’দিন খাওয়া নাওয়া বাদ দিয়ে ঘুম।মেজোবউতো কাঁদতে কাঁদতে,শাপশাপান্তরও করলো।মরে যাক ওই ছেলে,বাইচা থাইকা ওর লাভ নাই।মরলে সবার কলিজা জুড়োই।মা তো,মুখে হাজার শাপশাপান্তর করলেও অন্তরে তো উল্টো দোয়া গায়।সেখানে সন্তানের জন্য দরদ, মায়া ভরা।যাই হোক দুদিন বাদে ঘর থেকে বাইর হইলো।এই দুদিন না খাইয়া না দাইয়া, বাচলো কিকরে আল্লাহই জানে।তবে ছেলেটার মুখের দিইকা তাকানোই গেলো না।কি উশৃংখল,নিষ্ঠুর অমানুষের মতো মুখখান দেখা গেছিলো। বংশের বড় নাতী আমার,যদিও খারাপ পথে পা তার।তবুও কেমন জানি কলিজা জ্বইলা উঠলো।সেদিনও কারও সাথে কোনো কথা না কইয়ে,ভরসন্ধ্যায় গোসল সেরে ভাত খাইতে বইছিলো।কি হইছিলো, কি জানি।ভাত সামনে নিয়েই গলা ছেড়ে হুহু করে কাইন্দা দিছিলো।গালে তুলতে গিয়েও গালে তোলেনাই ভাত।পাশে মেজো বউ দাঁড়ানো ছিলো।তাকে জড়াইয়া ধইরাও কাঁদলো।বারবার মাফ চাইলো।কি হইলো ওর তারপর, ভাতের থাল রইখা সেই অবস্থায় তোর আব্বার কবরস্থানের সামনে গিয়াও কাঁদলো।মাফ চাইলো বারবার।আবোলতাবোল এটাওটাও কইলো।সেসময় কেমন তারে যেনো পাগলপাগল বইলা মনে হইলো আমার।সেদিনের পর থাইকা কি হইলো,মোড়ের বাজে পোলাপানদের সাথে আর মিশেনা।রাস্তাঘাটে তেমন বাহিরি হয়-না।নেশাভানও আর করতে দেখালাম না।তোর মেজোচাচা কোনো উল্টো পাল্টা আবদার করলেই,কথা শোনাই।তাকে সঙ্গ দেয়না।কেমন কইরা যেনো সেই বিশৃঙ্খলা জীবনডারে দুইরা ঠেইলা দিলো।অদ্ভুতভাবে পাল্টাইয়া গেলো ছেলেটা।একদিন তোর ঘরে আইসাও তো হাহুতাশ করে কাদলো।যে ছেলে জীবনেও আমার ভালোমন্দ খোঁজখবর লইনাই কখনো।সেই ছেলে আমারে নিয়ম কইরা খোঁজখবর নেওন শুরু করলো।কি স্বভাবের ছেলে ছিলো আর কি হইয়া গেলো!আমিও একটু একটু কইরা তারে বিশ্বাস করতে শুরু করলাম।প্রথমতেো আমার মনে হইলো,ও তোরে পাওয়ার লইগা এমন ভালো মানুষ সাজছে।পরে ওর কথাবার্তায় ব্যবহারে সেটা আর মনে হইলোনা।

একটু থামলেন বৃদ্ধ। ফের বললেন—দেখলিনা সেদিন আসবার সময় কি কইলো।সবতো গুছাইয়া দিলো ও।
আসতেও তো বাধা-নিষেধ করলো না।আরও আমি আসতে চাইলাম না,দেইখা কইলো–ওর পরিক্ষা চলছে দাদিআপা।তুমি ওরকাছে গিয়ে থাকলে ওর মন ভালো থাকবো।পরিক্ষা ভালো হইবো।তাই ওর ভালোর জন্য ভাইবা ওরাসাথে যাও।

‘আমিতো আরও মনেমনে ভাইবা রাখছিলাম।নাহিদ যখন ভালো পথে ফিরছে,তোরে নিয়ে বাড়িতে রাখবো।জাহিদরেও ফোনে সেই কথা কইছিলাম।সে মানা কইরা দিলো। কেনো জানি রাজি হইলো-না।বিপদের সময়ের বন্ধু বইলা কথা, সে না করলে কি জোর করা কথা কহন যায়।নিজের মাইয়াদের মতো হয়তো তোর উপরেও মায়া পইড়া গেছে,এজন্য হয়তো মানা করছে।তয় এবার তোরে নিয়ে যাবার কথা কইমু।বিপদ যখন নাই,পরের বাড়িতে ঝামেলা হয়ে থাইকা লাভ আছে?

সত্যিই কি তবে ছেলেটা ভালো পথে ফিরলো! দাদীআপার বুদ্ধি জ্ঞান নজরভঙ্গি নাহয় দূর্বল হয়ে পড়েছে।যদিও সেটা মন থেকে মানেনা কৌড়ি।কথার কথা।তবে নিভান নামের মানুষটা!যার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তায় বিশাল এক ব্যবসা চলছে।কতশত কর্মচারী তার আয়ত্তধীন।যার সুক্ষ নজরে চলছে ব্যবসার প্রতিটি কার্যক্রম।সেই মানুষটার নজরভঙ্গি, জ্ঞান,বুদ্ধি বিবেচনা নিশ্চয় ভুল হবেনা।আর ভুল যদি হতো,তবে ওই বুদ্ধিমান ব্যাক্তিটি নিশ্চয় ওই ছেলেটার সাথে স্বাভাবিক চেনাপরিচিতর মতো আচারন করতোনা। দুদিনের সাক্ষাতে অমায়িক বন্ধুত্বপূর্ণ আচারন তাদের মধ্যে নাহলেও,হয়েছে তো কিছু একটা।তা না হলে দুজনের মধ্যে যেভাবে কথা হতে দেখেছে কৌড়ি।সেটা অন্তত নিভানের মতো মানুষের পক্ষে এতো সৌজন্যতা দেখনো সম্ভব নয়।তাও আবার এটা জেনে যে,ওই ছেলেটা কৌড়িকে পছন্দ করে।কৌড়িকে চায়।সেখানে নিভান দেখাবে সেই ছেলেটাকে সৌজন্যেতাবোধ,কৌড়ি নিজেও আশা করে-না।তবে কি সত্যিই বিপথ ছেড়ে সুপথে ফিরেছে ছেলেটা?

সময়টা অপরাহ্ন।বিকাল আর সন্ধ্যার মধ্যবর্তী সময়।গাড়ী চলছে তার নিজ গতিতে।বিশাল বড় পিচঢালা রাস্তার দু’পাশের হাজারও দোকানপাট রেখে শাশা করে চলেছে গাড়ীটা তার নিজ গন্তব্যে।ক্লান্ত চোখে খেয়ালি নজরে সেটা দেখছে কৌড়ি।মূহুর্তেই সেই দোকানপাট পিছে ফেলে সবুজ অরণ্যে ঘেরা বিস্তৃত বিল নজরে পড়লো কৌড়ির।গাঢ় সবুজ ধানের পাতায় মাইল কি মাইল বিলে পরিপূর্ণ।হঠাৎই গাড়ীটা ব্রেক কষতেই হুঁশ ফিরলো এমনভাবে পাশে ফিরলো কৌড়ি।ফ্যাকাসে নীল কালারের একটা জিন্স হাফ টিশার্ট পরা।তাতে শক্তপোক্ত লোমযুক্ত হাতদুটো পরিস্ফুট,আকার্ষনীয়।ফর্মাল ড্রেসের সাথে মানুষটা ঘড়ি পড়লেও কেনো জানি সাধারণ ড্রেসের সাথে পরেনা।তাই হাতটা ফাঁকা। সাধারণ মাথার ঘন-কালো চুলগুলো পরিপাটি।সুন্দর শ্যামলটে সচ্চ একটা মুখ।ক্লান্তি নেই সেই মুখে।একদম সতেজ সচ্চ।হয়তো এরকম জার্নি রোজ করার অভ্যাস আছে মানুষটার।সেজন্য সহজে ক্লান্ত দেখায় না।ফর্মাল ড্রেসের বাহিরে এরকম সাধারণ পোশাকে,বিগত তিনমাসে মানুষটাকে কখনো দেখেছে,কৌড়ির মনে হয়না। বাড়ির সাধারণ ট্রাউজার টিশার্টে দেখেছে।তবে এরকম সাধারণত বাহিরের সাধারণ পোশাকে নয়।
আজ হঠাৎ এরকম পোশাকে দেখেই কেমন যেনো অন্য রকম লাগছে মানুষটাকে।শ্যামবর্ণ লম্বাটে পুরুষটাকে আরও হান্ডসাম আর আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে। যা আজ সকাল থেকে নজর মনকে আকর্ষিত কর চলেছে কৌড়িকে।পরিক্ষা দিয়ে বিথীও এটা নিয়ে ফাজলামো করতে ছাড়লোনা।

‘কি দেখছো?

লজ্জায় আড়ষ্ট হলো কৌড়ি।অথচ নিভানের সহজসরল গলার প্রশ্ন।সেখানে নেই কোনো লজ্জামো দেওয়ার রংচঙ।তবুও নিজের কাজে ভিতরে ভিতরে হাসফাস হয়ে লজ্জায় আঢ়ষ্ট হলো কৌড়ি।তবে মূহুর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে কথা ঘুরিয়ে বললো।

‘হঠাৎ এখানে গাড়ি থামালেন যে?

এবার দুষ্টমিতে মাতলো নিভান।গা এলিয়ে দিলো সিটে।দুষ্টুদের গলায় জড়ো করে ফিরতে উত্তর দেওয়ার বদলে প্রশ্ন করলো-‘কেনো?আমাকে নিয়ে সংশয় আছে নাকি?

‘থাকলেও।হলাম কলঙ্কিনী।আপনিই তো।কথাটা মনে গাইলেও মুখ ফুটে বলতে পারলোনা কৌড়ি।নিভানের সচ্চ নজরে একপলক নজর রেখে পাশে খোলা জানালায় নজর ফেললো।স্বভাবসুলভ নরম অথচ স্পষ্ট গলায় বললো।–আমি কৌড়ি।আমি নিজেকে শুধু একজন পুরুষের জন্য সব হারামস্পর্শ থেকে এমনভাবে বাঁচিয়ে রেখেছি,আপনি ভাবতেও পারবেন না।সেখানে
সেদিন যদি নাহিদ ভাইয়া আমাকে ছুতো,আজ হয়তো আমি এখানে থাকতাম না।আপনার সাথেও না।এতোদিনে আমার জায়গা থাকতো নিরালায় কবরে।তারপর ঝড়বর্ষার ওইদিন যদি ওই ছেলেগুলোর শিকারী হয়ে যেতাম।নিজেকে একমুহূর্ত বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা আমি করতাম না।সেখানে আপনার প্রতি বিশ্বাস ভরসার স্পৃহা জানতে চাইছেন?আপনার প্রতি বিন্দুমাত্র সংশয় রেখে আমি আপনাকে বিশ্বাস ভরসা করিনি।

স্পষ্ট উত্তর।চোখ বুঁজে কৌড়ির নিজের প্রতি অগাধ বিশ্বাসের স্মৃতিমধুর প্রতিটি শব্দ শুনলো নিভান।ঠোঁটে লেগে থাকলো তার অমায়িক হাসি।সময় ঘনিয়ে যেতেই বললো।–পৌরশুদিন তোমাকে সময় দিতে পারবো-না। অফিসের কাজে ঢাকার বাহিরে যেতে হবে।থাকতে হবে দু-চারদিন।

‘সমস্যা কোথায়?ইভান ভাইয়া তো আছেন।ভাইয়া না আসতে পারলে হাফিজ ভাইয়া আসবেন।

নিজের কথার প্রেক্ষিতে এরকম উত্তর মোটেও আশা করেনি নিভান।তবে কৌড়ি বলে কথা।উত্তর তো এরকমই আসবে।চোখ খুললো ইভান।অভিযোগ হানলো।–তুমি আমার ক্ষেত্রে প্রচুর উদাসীন কৌড়ি।

বিস্তৃত বৃহৎ মাঠের দিকে নজর তখন কৌড়ির।সূর্যটা পশ্চিমকাশে ঢুলে পড়েছে।নিভুনিভু ভাব তার।বিস্তৃত সবুজ মাঠে সেই নিভুনিভু গাঢ় কমলাভাব আলোটার আলো এসে পড়েছে,কি সুন্দর অপরূপ সৌন্দর্য তার।নিভানের অভিযোগে হাসলো কৌড়ি।সেটা দেখতে পেলো না নিভান।ফের অভিযোগ করার আগেই কৌড়ি বললো–নাহিদ ভাইয়ার সাথে আপনার এমন বন্ধুসুলভ সম্পর্ক তৈরী কি করে হলো?

কৌড়ির হিজাবে মুড়ানো মাথাটার পিছনটা ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছেনা নিভান।সেদিকে নিষ্পলক কিছুসময় তাকিয়ে থেকে চোখ বুঁজে নিলো,মূহুর্তেই নাহিদের বলা একটা কথা বারবার কানে বাজতে।লাগলো–আমি আপনার মতো করে ওকে চাইতে পারিনি, তাই ও আপনার হয়ে গেছে।হয়তো হওয়ারই ছিলো।তবে রক্তের সম্পর্কিত আপনজন হিসাবে আমাকে ওর ভালোমন্দ খোজখবর টুকু অন্তত রাখতে বাঁধা দেবেন না ভাইয়া।প্লিজ।

সচ্চ চোখদুটো দিয়ে যখন তারমতো কৌড়ির জন্য পরিক্ষার হলের বাহিরে আপেক্ষা করছিলো ছেলেটা।
নিভানের মনে হয়েছিলো,তারমতো ওই ছেলেটাও তার বোন অথবা প্রিয়জনের জন্য অপেক্ষা করছে।মনেমনে ভালো লেগেছিলো।তখনও নাহিদকে সে চিনতে পারিনি।নিজের দেখা উশৃংখল অভদ্র ছেলেটার এমন ভদ্র সচ্চ রূপ।চেনা কি যায়?তারপর যখন দেখলো,ছেলেটার অপেক্ষা নিভানের প্রিয়জনকে ঘিরে।তখন মনে হলো,ছেলেটাকে ইচ্ছেমতো মেরেধরে শেষ করে দিতে।ক্রোধে জ্বলেছিলো শুধু ভিতরে ভিতরে।
তবে কারণ থাকলেও হুটহাট কারও উপর রেগে যাওয়া বা রাগ দেখানো যায়না।আর পাবলিক-প্লেসে সেটার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো তো আরও অযৌক্তিক, অসঙ্গতিকপূর্ন।বিধায় দাঁতে দাঁত চেপে শুধু নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে গিয়েছিলো।কৌড়ির জন্য অপেক্ষিত নজর শুধু তার হবে।সেখানের ভাগিদার কেউ নয়।হতে পারেওনা।আর সেই হতে পারাটা যেনো গায়ে শুলের মতো বিধছিলো তার।তবে ক্রোধিত হওয়া নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে শুধু নিশ্চুপ ছেলেটার সাথে কৌড়ির আলাপন দেখেছিলো।পরের পরিক্ষার দিন যখন ছেলেটা নিজ ইচ্ছেতে তারসাথে অমায়িক হেসে আলাপন জুড়লো।কেনো জানি নিভান সেই হাসিতে,সেই চাহুনিতে কোনো ছলনা দেখিনি।অতিচালাকি খুঁজে পায়নি।যেটা সে মনেমনে অনুভব করেছিলো।একপর্যায়ে ছেলেটার কথায় তার সাথে আশপাশে ঘুরলো,চা খেলো।তবুও ছেলেটার কোনো কাজ অসঙ্গতপূর্ণ লাগেনি তার।যেটা নিভান তার চতুর বুদ্ধি নজর দ্বারা খুঁজে চলছিলো।অথচ ওই ছেলেটার সাথে কখনো নিজের না দেখা হোক,কখনো তার ছায়া মাড়াতে নাহয়, মনেপ্রাণে এটাই চেয়ে এসেছিলো নিভান।তার পরিবর্তনে হয়ে গেলো,নিদারুণ একটা অদ্ভুত সম্পর্ক।বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক না-হলে-ও,কেমন যেনো সুপরিচিত সুপরিচিত একটা সম্পর্ক হয়ে গেছে।যেটা নিভান চায়নি। একদম চায়নি।অথচ সেদিন ছেলেটা কি নির্দ্বিধায় বললো—আমি আপনার মতো করে ওকে চাইতে পারিনি তাই ও আপনার হয়ে গেছে।হয়তো হওয়ারই ছিলো।তবে রক্তের সম্পর্কিত আপনজন হিসাবে ওর ভালোমন্দ খোঁজখবরটুকু রাখতে অন্তত বাঁধা দেবেন না ভাইয়া।প্লিজ।

ছেলেটার ওই সম্পর্কিত ভাইয়ের আড়ালে আলাদা চাওয়া ছিলো,সেটা নাহিদের কথার ভাঁজে স্পষ্ট টের পেয়েছিল নিভান।কৌড়িকে ভালোবাসে ছেলেটা, কৌড়িকে চায়।এটা যেনো নাহিদের উপস্থিতিকে অসহ্য করে তুলেছিলো তাকে। শরীরে জ্বলন ধরে গিয়েছিলো।
নিজের নিঃশ্বাসকে পর্যন্ত ভারী লেগেছিলো নিভানের।ছেলেটাকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করেছিলো।কিন্তু চাইলেই কি সব ইচ্ছে পূর্ন করা যায়।তার যে কৌড়িকে নিয়ে সংসার করার অনেক ইচ্ছে। কতোকতো ইচ্ছে।উফফ!এই আকুতি সে কাকে জানায়!কি করে জানায়!

সেদিন ছেলেটা চলে যাওয়ার সময় আরও একটা কথা বলেছিলো।–ওকে ভালোবাসার জন্য আলাদা করে ওর থাকাটা আমার প্রয়োজন নেই।ওকে প্রয়োজন নেই।

খড়কুটো দিয়ে যেনো সযত্নে কেউ বুকের ভিতরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলো।কথাটা উপলব্ধি করতেই এমনই অনুভব করেছিলো নিভান। কৌড়ির প্রতি ভালোবাসা কি নিগাঢ় সেটাও অনুভব করতে পেরেছিলো।তবে ওর চাইলেও কি আর না চাইলেও কি!কৌড়িকে যে নিভানের চাই।সেখানে বিন্দুমাত্র কম্প্রোমাইজ চলবে না।মনের কুটুরিতে জ্বলন, পচন,ভাঙন যাই ধরুক।কম্প্রোমাইজ চলবে না।

‘সন্ধ্যা নামছে।বাড়িতে যেতে হবে তো?

কৌড়ির প্রসঙ্গ বদলানোর কারণ,নিভানের নিশ্চুপতা।নিশ্চয় কথাগুলো প্রকাশ করতে চাইছেনা।তাই চুপ।কৌড়িও জোর করে উত্তর পেতে চাইলোনা। কিন্তু নিভানের কি হলো।খুব শান্ত গলা একটু একটু করে শব্দ সাজিয়ে বললো–নাহিদকে আমি প্রথম দিন চিনতে পারিনি।তবে কার-ও জন্য ওর সচ্চ অপেক্ষা আমার ভালো লেগেছিলো।তোমার জন্য অপেক্ষা,আমার মন আমাকে কখনো ক্লান্ত হতে দেয়না।বিরক্ত বোধ করায় না।অস্বস্তি ধরায় না। আমার অপেক্ষার নজরভঙ্গিটা আমি যেনো ওর নজরেও দেখতে পেয়েছিলাম।বিষয়টা আমার সেকারণেই ভালো লেগেছিলো।তবে আমি যদি জানতাম আমার মানুষটার জন্য অপেক্ষা করছে ও।বিলিভ মি,ওকে ওখানে আমি কিছুতেই দাঁড়িয়ে থাকতে দিতাম না।কখনোই না।তোমার সাথে ওর ভালোমন্দ আলাপনটা দেখে,ওর নাকমুখ ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করছিলো। আমার সেদিনও ভালো লাগিনি,আজও ভালো লাগিনি।কখনোই ভালো লাগেনা তোমার সাথে ওর আলাপন।তবে তোমার প্রতি ওর আচারন আমাকে ঔদ্ধত্য, অভদ্র, অসভ্য হতে দেয়না।আমার ভিতর থেকে বাঁধা দেয়।আমি চেয়েও পারিনা,নিজের ঔদ্ধত্যের সীমাটা পার করতে।আমার ভদ্রতার খোলাসাটা ছেড়ে ভিষন অভদ্র হতে।অসভ্যতা করতে।

নিভান এবার সোজা হয়ে বসলো।ফের কিছুটা রাগত স্বরে বললো।–তবে ও যেমন ওর নরম শান্ত আচারন কথা দ্বারা আমাকে ভিতরে ভিতরে শেষ করে দিচ্ছে।
যার জ্বলেনর তপ্ততা আমি বহিঃপ্রকাশ করতে পারছিনা।আমি-ও ওকে ওর মতো করে শাস্তি ফিরিয়ে দেবো,দেখো।ওকে তো আমার অনাগত সন্তানদের মামা বানিয়ে শাস্তিস্বরূপ শোধটা আমি তুলবোই।

বাচ্চামো রাগ।সহজসরল গুছানো কথা।অথচ রাগের মধ্যে লুকিয়ে আছে কতো না প্রকাশ করা কথা।যা তার সামনে প্রকাশ করতে চাইছেনা নিভান।কিন্তু ভিতরে ভিতরে কষ্ট পাচ্ছে।আর সেটা প্রকাশ পাচ্ছে,তার এলোমেলো কথায়।অবাক চোখে সেটা দেখলো কৌড়ি।সময় নিয়ে বললো।

‘আপনার রেগে যাওয়া উচিত নয়!

‘ওর চোখে তোমার জন্য ভালোবাসা উপলব্ধি করা।ওর গলার স্বরে তোমার জন্য দরদমাখা বাক্য।এগুলো বুঝেও তুমি কি করে বলছো আমার রাগা উচিত নয়।

‘সেটা ওর সমস্যা।ও কাকে ভালোবাসলো কি না বাসলো সেটাতে আপনার যায় আসা উচিত নয়।উচিত কি?

‘অবশ্যই উচিত নয়।তবে মানুষটা তুমি!তোমাকে ও ভালোবাসার নজরে কেনো দেখবে?তোমাকে শুধু ওর বোনের নজরে দেখা উচিত। ভালোবাসার নজরে শুধু আমার নজর দেখবে তোমাকে।শুধু আমিই তোমাকে ভালোবাসবো।অন্য কেউ নয়।

অবুঝপনা!স্পষ্ট পাগলামো!উফ!এই মানুষটাকে এরকম অবুঝ কখনো ভাবিনি কৌড়ি।অথচ মানুষটা অবুঝপনা করছে!আশ্চর্য হতে গিয়েও নিরস হলো
কৌড়ি।মুখ ঘুরিয়ে ফের বাহিরের পানে দৃষ্টি ফেলে গলায় বললো– এখন না রেগে সেটা তাকে তখন বুঝিয়ে বলতেন যে,আমার দখলদারি মানুষটার দিকে তুমি ওভাবে তাকাতে পারো-না।তাকে ভালোবাসার অধিকার তোমার নেই।তা কেবলই শুধু আমার হক।আমার অধিকার।সে যদি তখন না শুনতো বা না মানতো। তখন না-হয় মেরেধরে একটা ব্যবস্থা নিতেন।এটা আপনি নিভানের কাছে আহামরি কিছু না।সেদিনের ছেলেগুলো তো মনেহয় এখনো হসপিটালে।

‘সেই মেরেধরে হসপিটালে পাঠানোর কাজটা তো আমি তোমার জন্য করতে পারলাম না।

‘কেনো?আমি কি করলাম?থোড়াই না আমি আপনাকে বাঁধা দিয়ে রেখেছিলাম।

‘রক্তের সম্পর্ক তৈরী করে বসে আছো যে।

রাগ আর কোথায় দেখাবে!তাই কথার ছলে মিটিয়ে নিচ্ছে।মিষ্টি হাসলো কৌড়ি।সেও কথা বাড়াতে বললো-এটাতেও আমার দোষ?

‘দোষ নয় বলছো।রক্তের সম্পর্কিত কিছু নাহলে আমার প্রিয় জিনিসের দিকে নজর দেওয়া,ওর চোখ সত্যিই উপড়ে ফেলতে আমার সময় লাগতো না।

বিভৎস কথা।চোখ বুঁজে নিলো কৌড়ি।বাহিরের পানে এখনো মুখ তার।সূর্য ডুবে গিয়েছে।সন্ধ্যার মিষ্টি গুনগুন হাওয়া বইছে।সেই হাওয়া ক্ষনে ক্ষনে ছুঁয়ে যাচ্ছে কৌড়ির ফর্সা মুখ।ফের সেই হিমেল হওয়াটা মুখটা ছুয়ে দিতেই,ক্লান্ত শরীরটা কেমন শিহরণ দিয়ে উঠলো।সময় নিয়ে কোমল মৃদুকন্ঠে বললো–উল্টো পাল্টা ভেবে ভয় পাচ্ছেন কেনো?আর কেনোই বা এতো পাগলামো অবুঝ কথাবার্তা।কৌড়ি তো আপনার।সে বলেছে যখন সে আপনার।তখন সে আপনারই।সেখানে অন্যের,চাহুনির বিবরন,কন্ঠের মধূর বার্তা, ভালোলাগা, ভালোবাসা, আপনার কি যায় আসে!কৌড়ি তো আপনারই।

এতক্ষণে সন্ধ্যার কোমল ঝরঝর দক্ষিণা হাওয়াটা বুঝি শরীর ভেদ করে মনের গহীনে গিয়ে লাগলো।কয়েকদিনের দহনে জ্বলা অশান্ত মন শীতল হলো,শান্ত হলো।সুখ সুখ প্রজাতিগুলো অনুভূতি হয়ে ঘুরলো যেনো মনের আনাচে-কানাচেতে।সেই অনুভূতিতে কালো বোরোকা আর হিজাবে মোড়া মেয়েটাকে দু’হাতে বুকের গহীনে জাপ্টে ধরতে ইচ্ছে করলো।মূহুর্তেই সেই ইচ্ছে দমন করে নিশ্চুপ নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো কৌড়ির পানে।অথচ মেয়েটার মুখ দেখা যাচ্ছে না।সে বাহিরের পানে তাকিয়ে।তবে এতোসময়ের চলা প্রসঙ্গে আর কথা বলতে ইচ্ছে করলো-না।কৌড়ির স্বীকারোক্তি, সহজ উত্তরটা বুঝি সেটা ক্ষান্ত করে দিল।
সময় পার হলো।ক্ষানিক বাদেই হঠাৎ উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললো –চলো-না কৌড়ি, কোনো এক অজানাতে আজ হারিয়ে যাই দুজনে।

কৌড়ির সহজ সরল উত্তর —চলুন।

সেই সন্ধ্যায় গাড়ি কোথা থেকে না কোথায় ঘুরে আসলো কৌড়ির জানা নেই।তবে মানুষটার চেনাজানা ফাঁকা রাস্তা, নিরিবিলি নদীর পাড়,ঝলমলে কফিশপ, কোথাও বুঝি বাদ নেই।কোথা না কোথা থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে এসেছে।হাতে হাত রেখে হাঁটিনি তারা,বেশি কথা হয়নি,চোখে চোখ রেখে কথা বলিনি অথচ অদ্ভুত এক অনুভূতি।

মাগরিবের নামাজ শেষে চায়ের অপেক্ষা করছিলেন জাহিদ সাহেব।সময়মতো চায়ের ট্রে নিয়ে হাজির হলো নীহারিকা বেগম।সাথে কৌড়ির দাদিআপাও।ভদ্রমহিলাকে এই সময়ে নিজের রুমে দেখে কিছুটা বিচলিত হলেন।মনেমনে চিন্তিত শঙ্কিত হলেন,তিনি না আবার চলে যাওয়ার আবদার জুড়তে এসেছেন।
ভদ্রমহিলা এসে থেকেই বাড়িতে চলে যাবেন বলে বেশ কয়েকবার আবদার জুড়েছেন।কিন্তু ভদ্রমহিলাকে তো এখন যেতে দেওয়া যাবে-না।তবে পুনরায় যদি বাড়িতে যাওয়ার আবদার জোড়েন,তবে তো মুশকিল।সেই ভাবনাতেই তিনি মনেমনে বিচলিত হলেন।আর উনার আশংঙ্কা বাড়িয়ে দিয়ে ভদ্রমহিলা উনার পাশে এসে বসলেন।এবং সহসা বললেন।

‘বাড়িতে যেতে চাইলাম,এতোদিনে যাইতা তো দিলা না।তবে ভালোই হইলো।কৌড়ির আর দুইখান পরিক্ষা আছে।শেষ পরিক্ষার দিনে কিন্তু আমি ওরে একেবারে লইয়া বাড়িতে ফিরমু।আর না করতে পারবা-না কিন্তু।

চলবে…..

#ফুলকৌড়ি
(৪১)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসালম

কৌড়িকে নিয়ে যাবার জন্য ভদ্রমহিলা বেশ চেপেই ধরলেন।পাঁচ সন্তানের জননী,বুদ্ধিমতী নারীটা বুঝালেন বিপদ যখন কেটে গিয়ে ছায়া হয়েছে অযথা নিজের বাড়ির মেয়ে পরের বাড়িতে আর কতোদিন?মেয়েটার সবকিছু থাকতেও পরের বাড়িতে আশ্রিতা হিসাবে পড়ে আছে,এটা নিয়ে পাড়াপড়শির যেমন বিভিন্ন কানকথা বলেছে আরও নানা ইঙ্গিতমূলক বাক্য, আচারন।উনার নিজেরও বিষয়টা মানতে কষ্ট হলেও কৌড়ির কথা ভেবে সবার সব কথা নীরবে সয়ে গেছেন।আজ যখন সবকিছু ঠিকঠাক।সেখানে মেয়েটা নিজের পরিবার, নিজের পিতৃভূমি,তার সকল হক থেকে দূরে থাকবে কেনো!সেখানে বিশেষ কোনো যুক্তি দেখিয়ে উনাকে রোধ করার ফাঁকফোকর পেলেননা জাহিদ সাহেব।তবে হ্যা না-ও কিছু বললেন না।শুধু বিচক্ষণ মানুষের মতো চুপচাপ শুনলেন।আর কিছু ভাবলেন।কাওকে তিনি কথা দিয়ে রেখেছেন।কথা দিয়ে রেখেছেন কী!ছেলেটা এই প্রথম মুখফুটে নিঃসঙ্কোচে উনারকাছে কিছু চেয়েছে।দৃঢ়রূপে পাওয়ার আশা করেছে।বিশ্বাস ভরসা করে কৌড়িকে পাওয়ার আবদার আবেদন জানিয়েছে।
জানিয়েছে–উনি থাকতে যেনো কৌড়ি,নিভান ব্যতিত দ্বিতীয় কারও নাহয়।সরাসরি কথাটা না বললেও, নিজের চতুর কথাদ্বারা বুঝিয়ে তেমনটা।সেই ছেলেটার উনার কাছে করা প্রথম আবদার, চাওয়া তিনি বিফলে ফেলে যেতে দেবেন কি করে!এমন পরিস্থিতিতে ভদ্রমহিলার কাছে প্রস্তাব রাখাও শোভনীয় দেখায়-না।আবার কৌড়ির পরিক্ষার আগে নিভান এবিষয়ে কথা তুলতেও নিষেধ করেছে।তার মা’কেও আপতত এবিষয়ে জানাতে বারণ করেছে।তবে কি করবেন?সেই ভাবনায় ডুবে রইলেন।ভদ্রমহিলা আরও কিছুক্ষণ কথা বলে,চা নাস্তা সেরে চলে গেলেন।এতোসময় নীহারিকা বেগম সবটা নীরবে শুনেছেন এবং নিজেকে স্বামীকে চুপ থাকতে দেখেও আশ্চর্য হয়েছেন।তবে তিনি-ও চুপ ছিলেন।কিছু বলতে গিয়ে-ও কেনো যেনো অধিকার বোধের ঘাটতিতে কিছুই বলতে পারলেন না।ভদ্রমহিলা চলে যেতেই নীরবতা ভেঙে ততক্ষণাত বললেন।

‘কৌড়িকে কিন্তু আমি যেতে দেবো না।বলে দিলাম।বাবা মা নেই যখন মেয়েটাকে আমার কাছে রাখবো।জানি মেয়েমানুষ,একদিন পরের হাতে তুলে দিতে হবে।আমার তো আর অনেকগুলো ছেলে নেই যে, নিজের কাছে রাখবো।যদিও নিভান যদি রাজী থাকতো,তবে দ্বিতীয়বার ভাবতাম না।ওকে আমার নিভানের বউ করে পুতুলের মতো আদর যত্নে রাখতাম।তা যখন হওয়ার নয়,তখন আমি নিজ ছেলে দেখে ওকে বিয়ে দিয়ে আমার কাছাকাছি রাখবো।মান্যতা মৌনতার মতো এবাড়ি আসা যাওয়া করবে ও।উনি বাড়িতে নিয়ে যেতে চান,নিয়ে যাবেন।কিন্তু কয়েকদিনের জন্য।ঘুরেফিরে আবার চলে আসবে।

একনাগাড়ে বলে চলা নারীটাকে বেশ খেয়ালী আর সুগভীর নজরে পর্যবেক্ষণ করলেন।ফের মনেমনে হাসলেন।ছেলের বউকে নাকি অন্য ছেলে দেখে বিয়ে দেবে নীহারিকা।নিভান জানলে মায়ের উপর কিরাগ হবেনা!আচ্ছা নীহারিকা কি ছেলের মনের খবর রাখেনা।সহসা তিনি প্রশ্ন করলেন।

‘তোমার কি ইদানীং নিভানের পরিবর্তন নজরে পড়ছে না?মনে হচ্ছে না,নিভানের মাঝে পরিবর্তন এসেছে?

‘মানে?

কৌড়ির কথাটা বলতে গিয়েও বললেননা।নিচ্চয় নিভান বুঝেশুনে তাকে কৌড়ির কথা অন্য কাওকে জানাতে নিষেধ করেছে।তবে ছেলের পরিবর্তন নজরে পড়ছেনা, আর ছেলের মনের খবর নীহারিকা আন্দাজ করতে পারছেনা।এটাতে বেশ আশাহত হলেন।সময়ও বা কৈই তার।উনাকে সেবা করতেই তার যায় দিন।ছেলেমেয়েদের দিকে বিশেষ খেয়াল ধ্যান দেবে,এই সময়টাও বা পাচ্ছে কোথায়!মনেমনে ব্যথা অনুভব করলেন।নিজের স্ত্রীর কথার উত্তর সরূপ বললেন।

‘মানে কিছু না।তবে এক ছেলে বিয়ে করে সংসার করছে এবার অন্য ছেলের দিকে খেয়াল ধ্যান দাও।তারওতো সংসার গুছিয়ে দেওয়ার দ্বায়ভার আমাদের।
আর ছেলে কি চাইছে সেটাও বুঝতে চেষ্টা করো।বড় হয়েছে সবকিছু মুখফুটে বলতে পারেনা,চাইতে পারেনা।খেয়াল রাখো।

স্বামীর কথাগুলো বিশেষ মনোযোগে শুনলেও এই মূহুর্তে এই কথাগুলোর অর্থ খুঁজে পেলেন না।হচ্ছিলো কৌড়ির কথা সেখানে নিভান এলো কোত্থেকে!আশ্চর্য। মনেমনে কথাগুলো বলতে গিয়েও তিনি যেনো কেমন নিভে গেলেন।নিভানের পরিবর্তন!জাহিদ সাহেবের বলা শব্দটা মনে ঘুরপাক খেতে লাগলো।নিভানের পরিবর্তন নজরে পড়েছেও উনার।তবে সেটাতে বিশেষ কোনো খেয়াল ধ্যান দেওয়ার মতো কিছু আছে বলেও তো মনে হলো না উনার।নিভানের প্রসঙ্গ নিয়ে বিশেষ ভাবতে বসলেন না তিনি।কৌড়ির দাদীআপার কথাগুলো মাথায় বিশেষ ঘুরপাক খেতেই তিনি সেদিকে খেয়ালী হয়ে ফের জাহিদ সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললেন — সে যাই হোক।আপনি কৌড়িকে দাদিআপাকে ভালোভাবে বলে দিয়েন,কৌড়িকে কিন্তু আমি ছাড়ছিনা।

‘সে তোমার ছেলে তোমার চেয়ে আরও ভালোভাবে বুঝে নেবে’ বাক্যগুলো ভিতরে আওড়ালেও জিহ্বা ভেদ করে ঠোঁট পর্যন্ত নিয়ে আসলেন না।কারণ হিসাবে নিভানের সতর্কবার্তা মানলেন।শুধু মুখে বললেন।

‘আমি দেখছি,কি করা যায়।

স্বামীর কথায় শান্ত হলেন নীহারিকা বেগম।উঠতে গিয়ে ফের কিছু একটা ভেবে বললেন–ছেলের বিয়ের কথা ভাবছেন,মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত সে কথা ভাবছেন না!এতো ভালো ভালো প্রস্তাব আসছে।নাকচ কেনো করছেন?বিয়ের উপযুক্ত মেয়ে ঘরে বেশিদিন রাখা ঠিক নয়।একসময় প্রস্তাব আসলেও বাছতে বাছতে দেখবেন মেয়ের আর উপযুক্ত পাত্র মিলছেনা।চৌধুরী সাহেবের ছেলে বিহান ছেলেটা খারাপ কিসে ছিলো?উনাদের প্রস্তাবটা কেনো নাকচ করলেন?

‘বিয়ের আগে তো দেখতে শুনতে জানাশোনা ছেলে হিসাবে সিয়ামও তো খারাপ ছিলোনা।তবে বিয়ের পরে দীবার কি হলো?সেখানে আর সংসারই করতে চাইছে না!নিজের মেয়ের বেলাও কি তাই চাইছো?শুধু বাহিরের চাকচিক্য দেখে মেয়ের উপযুক্ত বলে মনে করছো!বিয়ের মতো কাজে ভেবেচিন্তে বুঝেশুনে এগোতে হয়।আমার মেয়ের কপাল অন্তত দীবার মতো পর্যায়ে গিয়ে ঠেকুক আমি বাবা হয়ে তা অন্তত চাইনা।নিভান মানা করেছে মানে কিছু একটা ভেবে বুঝে মানা করে দিয়েছে।আর দ্বিতীয়ত আমার মেয়ের বাবা ভাইয়ের ঐশ্বর্য কম নেই।তাই বিত্তশালী পরিবারের ছেলে নয়,একটা উপযুক্ত ভালো সৎ ছেলের হাতেই তুলে দিতে চাই আমার মেয়েকে।দরকার পড়লে আমিই গুছিয়ে দেবো মেয়ের সংসার। তবুও আমার মেয়ের ভালো থাকা চাই।বাদবাকি ভাগ্য আছে তাইই হবে।

নীহারিকা বেগম আর কোনো কথা বাড়ালেন-না।কারণ জাহিদ সাহেবের কথা উনার অযৌক্তিক বলে মনে হয়নি।তবে জাহিদ সাহেব কথা শেষ করে কিছু একটা ভাবতে বসলেন।

রান্নাঘরে রাতের খাবারের গোছগাছ করছেন নীহারিকা বেগম।মনেমনে তখন জাহিদ সাহেবের বলা নিভানের বিষয়টা নিয়ে গভীর ভাবনায় ডুবে।মাথায় বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে।ছেলের পরিবর্তন!সেভাবে কৈ কিছু নজরে পড়েছে।তবে প্রথম যেদিন কৌড়িকে পরিক্ষা দিতে নিয়ে যাওয়ার কথা বললো,বিষয়টা উনার হজম হয়নি।ঠিকঠাক লাগেনি।কেমন যেনো নিভানকে অন্য রকম মনে হয়েছিলো।তবে ইভান যখন সবার সামনে বললো,তার শরীর খারাপ তাই দাদাভাই কৌড়িকে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।ভাবনার বিষয়টা সেখানেই ডুবিয়ে দিলেন। তবে আজ জাহিদ সাহেব কিসের পরিবর্তনের কথা বললেন? অপেক্ষিত নজর সদর দরজার দিকে আপনাআপনি পড়তেই, মূহুর্তেই যেনো ভুলিয়ে দিলো মাথায় ঘুরপাক খাওয়া ভাবনাগুলো। রাত হয়ে গেছে অথচ ছেলেমেয়ে দুটো এখনো ফেরেনি।এতো দেরিতো হয়না!তবে দেরী হচ্ছে কেনো?সন্ধ্যার পর একবার খোঁজ নিয়েছিলেন,তারপর আর খোঁজ নেওয়া হয়নি।এরমধ্যে কেউ কিছু না বললেও ননদ এসে কটুক্তি করে গেছেন– সামর্থ্য দুটো ছেলেমেয়ে, এভাবে কেউ ছাড়ে।কখন কি ঘটিয়ে ফেলে, কি ঘটে যায়!তার ঠিক আছে!কি যে বাবা মা হয়েছেন আপনারা আল্লাহ মাবুদ জানেন।

আরও কতো কথা।কানে নেননি নীহারিকা বেগম।তবে পাশে থাকা স্বান্তনা রহমান সেই কথার উত্তরে কিছু বলতে গেলেও উনাকেও চোখ দিয়ে ইশারা করে আটকিয়ে দিয়ে চুপ থাকতে বললেন।শুধু শুধু তর্ক বাড়বে।মনমালিন্য হবে।তা না করে যার যা স্বভাব সেই তাই করে নিজের মনের খোরাক মিটাক।যদিও ডালিয়ার কথাগুলো অযৌক্তিক নয়।আর না ভুল।তবে তার বলার দৃষ্টিভঙ্গি আর যাদের নিয়ে ধারনা করে কথাগুলো বলছে সেটা ভুল।ভুল হয়তো নয়।সামর্থ্য দুটো ছেলেমেয়ে, সত্যিই তো।কিন্তু উনার মায়ের মন এমন দুটো ছেলেমেয়েকে নিয়ে ডালিয়া কটুক্তি করে কথা বলছে,যা উনার মন কখনো সায় দেয়না।ওরা কিছু খারাপ করতে পারতে এই ধারনার সৃষ্টি হয়না মনে।
তাই তিনি বিষয়টা অযথা বাড়ুক এটা চাননা।ডালিয়ার উত্তর সরূপ বললে উনি অনেক কথাই বলতে পারবেন।জানাতো আছে উনার অনেক কিছু। তবে ঝামেলা বাড়ুক আপতত এটা তিনি চাইছেননা।তাই সুযোগ বুঝে আরও এটাওটা বলে,যখন নীহারিকা বেগমেকে টলাতে পারলেননা চলে গেলেন ডালিয়া বেগম।তিনি চলে যেতেই স্বান্তনা রহমান মুখলেন।

‘আমাকে কিছু বলতে দিলে না কেনো?নিজের মেয়ের বেলায় কি কি করছে, কি মেনেগুনে চলছে তা দেখিনি।যখন তখন বিবাহবহির্ভূত দুটো ছেলেমেয়েকে চলতে ফিরতে দিয়েছে।মানা করেছে কখনো?বরং নিজেই নিজের মেয়েকে এগিয়ে দিয়েছে। যত্তসব!এখন এসেছে বানী শোনাতে।ছেলেমেয়ে দুটো কি ঘুরতে গেছে!অদ্ভুত সব চিন্তা ভাবনা।

‘থাক।বাদ দে।শুনলে আবার অযথা ঝামেলা বাড়বে।আমরা তো জানি ওরা কেমন,তাই না?

‘তোমার এই চুপ থেকে সহ্য করাটাতেই উনি আশকারা পান।আর এতো কিছু বলতে সাহস করেন।নাহলে বড়ো ভাইয়ের বউ হিসাবে তোমাকে, উনার সীমিহ এবং মেপে কথা বলা উচিত ছিলো।

‘বাদ দে তো!তোর ভাই কি বলছিলো জানিস?

কথা ঘুরাতে প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললো,এটা বুঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বান্তনা রহমান বেজার গলায় শুধালেন।-কী?

‘নিভানের পরিবর্তন নজরে পড়েছে কি-না?মানে কি বলতো?ছেলেটার আবার কিসে আর কেনোই বা পরিবর্তন হবে!বরাবর যেননটা দেখি তেমনটাই তো দেখছি। উনার আবার কি আলাদা নজরে পড়লো কে জানে!

দীর্ঘশ্বাস এবার শব্দ করে ছাড়লেন স্বান্তনা রহমান।এই রোবটের মতো সেবারত নারীটার বিরুদ্ধে কিছু মন বলতে না চাইলেও মুখ অধৈর্য্য হয়ে বলে ফেললো।

‘তোমার কি ছেলের দিকে নজর দেওয়ার সময় আছে নাকি যে,তার পরিবর্তন তোমার নজরে পড়বে!

আশ্চর্য হলেন নীহারিকা বেগম। কেমন অদ্ভুত গলায় প্রশ্ন শুধালেন–তারমানে তোরও মনেহয় নিভানের মাঝে পরিবর্তন এসেছে?কৈ আমার তো নজরে পড়েনি!

‘পড়বে কি করে?ছেলেটার দিকে ফিরে তাকানোর সময় আছে তোমার?

হঠাৎই মন খারাপ হয়ে গেলো।বিষন্ন গলায় বললেন–
‘সেজন্য তো ওর খেয়াল রাখার জন্য বিয়ে দিয়ে একটা বউ আনতে চাইলাম।রাজি হয় ছেলেটা?মায়ের ব্যস্ততা দেখে না!একটা অসুস্থ মানুষের সারাদিন খেয়াল ধ্যান রাখা।ও বোঝেনা?

‘বোঝে বলেইতো অভিযোগ করেনা।যাইহোক কৌড়িকে তোমার কেমন লাগে বলো-তো?

‘কেমন লাগে মানে?মান্যতা মৌনতার আর ওরমধ্যে কোনো তফাৎ আমি করিনা।আর ও কতো ভালো মেয়ে এটাতো তুইও জানিস।সেখানে ওর দাদিআপা আরও নিয়ে যেতে চাইছেন বলে আমি তোর ভাইকে সাফসাফ জানিয়ে দিয়ে আসলাম,ওকে কিন্তু যেতে দেবোনা।সেখানে ওকে আমার কেমন লাগে জানতে চাইছিস!ওর মতো মেয়ে সহজে মেলেনা।

হাসলেন স্বান্তনা রহমান। তিনি খুব ভালো করে জানেন এবং চিনেন বড়জাকে।আর কৌড়ির প্রতি উনার মায়া ভালোবাসাও খেয়াল করেছেন।তবুও কথাটা জানতে ইচ্ছে হলো বলে প্রশ্ন করলেন।উত্তর পেয়ে মজার ছলে বললেন–‘তাহলে ছেলের বউ বানিয়ে একেবারে রেখে দাও।

‘আমার আর-ও ছেলে থাকলে অবশ্যই কৌড়িকে তার বউ করে রেখে দিতাম।আর যদি ‘নিভান রাজি থাকতো তাহলে তো কথাই ছিলানা। অবশ্যই নিভানের বউ করে রেখে দিতাম।

‘আমার মনেহচ্ছে তোমার ছেলের,কৌড়িকে মনে ধরেছে।

তড়িৎ বড়োবড়ো চোখ করো বিস্ময় নজরে স্বান্তনা রহমানের দিকে তাকালেন নীহারিকা বেগম।সেটা দেখে একগাল হাসলেন।ফের ভ্রু নাচিয়ে বললেন–ওভাবে তাকিয়ে পড়লে কেনো?বউমা হিসাবে কি কৌড়িকে তোমার পছন্দ নয়?

‘নিভান!তুই সত্যি বলছিস?কি আশ্চর্য কথা!

নীহারিকা বেগমের বলার বিস্ময়কর ভঙ্গিমাতে একটু হাসলেন স্বান্তনা রহমান। ফের বললেন–আরেহ আমি সত্যি মিথ্যা এসব জানিনা।শুধু নিভানের চোখ, কৌড়ি যেখানে থাকে সেখান থেকে সরেনা।এটা খেয়াল করেছি।আরও কিছু বিষয় নজরে পড়েছে,।তাতে মনে হয়েছে, কৌড়ির প্রতি ওর ভালোলাগা জন্মেছে।সেই ধারনা থেকে বলছি।

বিস্ময় কাটিয়ে নীহারিকা বেগম উৎফুল্ল গলায় বললেন–তাহলে তো বলতেই হয় আমার ছেলের সুমতি হয়েছে।

নীহারিকা বেগমের উৎফুল্ল মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন স্বান্তনা রহমান।মানুষটাকে অনেক বৎসর যাবৎ চেনে, জানে মানে।তবুও মনের মধ্যে খুূদমুূূদ করা একটা প্রশ্ন শুধিয়েই ফেললো।–তোমার কৌড়িতে কোনো প্রবলেম নেই তো বুবু?

‘কি সমস্যা থাকবে?ও যেমন মেয়ে,কোনো সমস্যা থাকার কথা?

কথাটা বলেই স্বান্তনা রহমানের মুখের দিকে তাকিয়ে পড়লেন তিনি।সময় নিয়ে বুঝলেন।কেনো,সে এমন কথা শুধিয়েছে।হয়তো শ্বাশুড়িদের ভালো চরিত্রও পাল্টে যায় ছেলের বউদের ক্ষেত্রে।ছেলে যেমনই হোক বউ নির্বাচন করতে পৃথিবীর সেরা নিখুঁত অদ্ভুত রকমের মানুষ হয়ে উঠেন।যেমনটা নিজের শ্বাশুড়িমাকে দেখেছেন।তিনি নিজের ছেলেদের জন্য বউমা নির্বাচনে সবদিক থেকে পারফেক্ট চেয়েছিলেন। রূপেগুনে প্রাচুর্যে, সবদিক থেকে নিখুঁত।হয়নি।বিশেষ করে বড় ছেলে সন্তানের ক্ষেত্রে।হয়তো এখন এই বিয়সে এসে সব ঠিক।কিন্তু একটা দীর্ঘসময় উনার অসন্তুষ্টতা নিয়েই সময় কেটেছে।কেটে গেছে বহুবছর।
হয়তো প্রতিটি মায়ের চাওয়া এমন।তবে উনার চাওয়া ভিন্ন।দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।ফের স্বান্তনা রহমানকে উদ্দেশ্য করে বললেন।

–যদি নিভান কৌড়িকে পছন্দ করে থাকে।আর সেই প্রস্তাবে কৌড়ি যদি রাজি হয়।আমি কখনোই না করবো-না।আমি দেখবো না,কৌড়ির আগেপিছে কিছু ছিলো বা আছে কি-না।সে এতিম, নাকি আমার ছেলের অর্থপরিমান তার বাবা মায়ের অর্থবিত্ত ঐশ্বর্য আছে কিনা। আমার শুধু আমার নিভানের জন্য একটা সুন্দর মিষ্টি বউ চাই।যে আমার বাচ্চাটার সকল অপূর্ণতার, পূর্ণতা হবে।ওর সুখ দুঃখ,বুঝবে।ওর ভালোমন্দের খেয়াল রাখবে,সর্বোপরি ওকে বুঝবে।ওকে ভালোবাসবে,ওকে ভালো রাখবে।ও সুখে- শান্তিতে থাকবে এই কমনায় সবসময় একটা সুন্দর মনের মেয়ে, ওর বউ হিসাবে আনতে চেয়েছিলাম বা চাই।কৌড়ি,আমার নিভানের জন্য মোটেই মন্দ হবে-না।মেয়েটার বলা, চলা,সবকিছু নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করি সবসময়।তুই বল মেয়েটার মধ্যে ত্রুটি পেয়েছিস কখনো?আমি তো পাইনা।জানিনা ভাগ্যে কি লেখা আছে তবে আমার কৌড়িকে খুব ভালো লাগে।যেমনটা আমার তন্ময়ীকেও ভালো লাগে।জানিনা কখনো ওদের মায়ের মতো হতে পারবো কি-না।মা হতে পারবো কি-না।তবে ছেলে বউদের ক্ষেত্রবিশেষ শ্বাশুড়ি নামটা পেয়েছি যখন,তখন শুধু শ্বাশুড়ি নয় শ্বাশুড়ি-মা হতে চাই।জানিনা ওদের মা হতে পারবো কিনা।তবে হতে চাই।

স্বান্তনা রহমান অমায়িক হাসলেন।ফের উচ্ছ্বসিত গলায় বললেন–‘তুমি ভালো মেয়ে,ভালো মা,ভালো স্ত্রী, ভালো বউমা, ভালো জা,ভালো মামি চাচি,ভালো বোন তো বটেই ,ভালো ভাবী এবং ভালো শ্বাশুড়িও হবে ইনশাআল্লাহ।আর নিভানের বউ যদি কৌড়ি হয়,সেও দেখবে রূপেগুনে একদম তোমার মতো হবে।পারফেক্ট শ্বাশুড়ির পারফেক্টে বউমা।

‘আমার পারফেক্ট বউমা হওয়া লাগবেনা।আমার নিভানের মনের মতো হলেই হবে।ওকে ভালো রাখলেই হবে।তবে দোয়া কর তোরা যা ভাবছিস তাই যেনো হয়।কৌড়ির দিকেই যেনো ওর মনটা ঝোঁকে। ওরকম একটা মেয়েকে সারাজীবন আমার কাছে রেখে দিতে চাই।

‘তাই হবে দেখে নিও।আমার নজর, মন বলছে নিভান কৌড়িকে পছন্দ করে।

এবার নীহারিকা বেগম নিজেও বেশ সন্তুষ্ট নিয়ে হাসলেন।সত্যি যদি কৌড়ি নিভানের বউ হয়,পুতুলের মতো আদর যত্নে রাখবেন উনি মেয়েটাকে।মনেমনে আরও হাজার সন্তুষ্টির ভাবনায় ডুবে ভাবতে থাকলেন অনেক কিছু।তবে ছেলের মন বুঝতে পারলেন না,এটা তে মনেমনে একটু নিজের প্রতিও ক্ষুন্ন হলেন।এতোদিন বিয়ে কর,বিয়ে কর বলে পাগল করলেন।বিয়ে করবো না,বিয়ে করবোনা,বলে যে ছেলে উল্টো গেয়ে আসলো।সেই ছেলের পরিবর্তন নজরে পড়লোনা!কিকরে?সেদিন মনটা একটু খুদমুদ করছিলো,তবে নিভানের কঠিন করে রাখা মুখাবয়ব আর নির্বিকার স্বভাবের কাছে বিষয়টা টেকেনি।যাই হোক,ছেলে এখন প্রস্তাব রাখলেই হয়।

চিন্তিত মুখে নিজের বেডে পা ঝুলিয়ে বসে আছে মান্যতা।চিন্তার বিষয়টা কৌড়িকে নিয়ে।হঠাৎ ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দে সেদিকে তাকালো সে।কৌড়ি তারদিকে ফিরতেই সহসা প্রশ্ন করলো সে।

‘তোর না সেদিন শরীর খারাপ হলো?পনেরো দিন হয়েছে?পনেরো দিন যেতে না যেতে আবার পিরিয়ড!সমস্যা কি আর কবে থেকে?

এসব বিষয় নিয়ে কারও সাথে খোলামেলা কথা বলতে বা আলোচনা করতে কৌড়ির ভালো লাগেনা।কেমন যেনো অস্বস্তি অনুভব হয়।যার কারনে পিরিয়ডের এই অনিয়মিত কষ্টদায়ক পীড়া মাসের অধিকাংশ সময় সহ্য করে চলছে তবুও কাওকে মুখ ফুটে কিচ্ছু বলতে পারছেনা।মুলত বলতে চাইছেনা সে।বিষয়টা টের পেয়েছে মান্যতা।কারণ আগে নিজে বাহিরে বের হয়ে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনলেও,এই মাসের মধ্যে সেভাবে বাহিরে বের হওয়া হয়নি।যার কারনে এমাসের মধ্যে কয়েকবার প্যাড কিনতে বাধ্য হয়ে মান্যতাকে বলতে হয়েছে। আর বিষয়টা সেভাবেই নজরে পড়েছে তার।এর আগেও জিজ্ঞেস করেছিলো,এড়িয়ে গেছে সে।

‘কৌড়ি,আমি একটা মেয়ে।আর আমাকে অসুবিধা খুলে বলতে সমস্যা কোথায়?এরআগেও তোর কাছে জিজ্ঞেস করেছি উত্তর দিসনি।বিষয়টা আমার কাছে ভালো ঠিকছেনা।এবাড়িতে এসেছিস মাত্র চারমাসের মতো, অথচ তোর শরীর খারাপ হয়েছে কতোবার।একবছরের প্যাড ইউজড করে ফেলেছিস তুই।সমস্যা কি?আমাকে বল?প্লিজ!

লজ্জায় আড়ষ্ট হলেও, মান্যতার পাশে এসে বসলো কৌড়ি।কিছুটা আড়ষ্টতা নিয়ে বললো-যে সময়টা থেকে আমার পিরিয়ড শুরু হয়েছে। সেখান থেকেই অনিয়মিত।আগে বছরে প্রায় দুই তিনবার শরীর খারাপ হতো।প্রায় তিন চারমাস পরপর একবার।পনেরো বিশদিন করে সমস্যা থাকতো।বিষয়টা নিয়ে কখনো কারও সাথে খোলামেলা কথা হয়নি।তাই সেভাবে ভালোমন্দ জানা ছিলো-না।আর অতোটাও সমস্যা মনে হয়নি।দেরীতে হচ্ছে হোক,সমস্যা কোথায়?তাই কাওকে নিজের অসুবিধার কথাও জানানো হয়নি।তবে বিগত পাঁচ ছয়মাসের অধিক সময়,উল্টো সমস্যা দেখা দিয়েছে।এখন চার পাঁচমাস পরপর আর হয়না।এখন অনিয়মমাফিক হতে থাকে।কেনো জানিনা।প্লিজ আপু কাওকে বলোনা।কেউ এবিষয়ে জানলে আমার লজ্জা লাগবে।

মান্যতা অবাক হলো।মাসে একবার তাই কয়েকটাদিন কি ব্যথা,যন্ত্রণা অস্বস্তিতে ভুগতে হয়।সেখানে এই মেয়ে বলে কি!তবে।কৌড়ি যে ধরনের মেয়ে,বিষয়টা চেপে রাখা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

‘এটাতে লজ্জা পাওয়ার কি আছে কৌড়ি?নিয়মের বাহিরে গেলে যেকোনো বিষয়ই অসুখ বলে ধরা উচিত।আমার মনে হচ্ছে তোর বিষয়টা নিয়ে চুপচাপ থাকা উচিত নয়।তোর বলতে অস্বস্তি হলে আমি আম্মুকে জানাই।তবে ডাক্তার দেখানো অবশ্যই প্রয়োজন।

‘বিষয়টা সবাই জেনে গেলে সত্যিই আমি ভিষন লজ্জা পাবো।

দীর্ঘশ্বাস ফেললো মান্যতা।হতাশ গলায় বলল-দাদাভাই জানলে কি হবে বুঝতে পারছিস?এমনিতেই ডক্টর মৌমিতাকে দেখানোর কথা ছিলো।দেখাসনি।কিছু বলে নি।একবার যদি কোনোভাবে জেনে যায়,বিষয়টা কিন্তু ভালো হবেনা।

মুখ ছোটো হয়ে গেলো কৌড়ির।এজন্য তো সেদিন ডক্টরের কাছে যেতে আপত্তি জানিয়েছিলো সে।যায়নি।এবার সত্যিই যদি জেনে যায়।মানুষটার এমনিতেই চারদিকে নজর খোলা থাকে।আর তারউপরে তো এক্সট্রা।মনেমনে শঙ্কিত হলো।মান্যতাকে উদ্দেশ্য করে বললো।

‘উনি জানবেন কিকরে?এজন্য তো বলছি কাওকে কিছু বলার দরকার নেই।

‘দরকার আছে কিনা,সেটা তোর কাল পরীক্ষা হয়ে যাক তারপর দেখছি।

‘কাল পরিক্ষা দিয়ে তো আর এবাড়িতে আসা হবেনা।

মন খারাপ করে কথাটা বলতেই তড়িৎ মান্যতা বললো–তুই দাদাভাইকে এখনো ঠিকঠাক চিনে উঠতে পারিসনি।তোর মনেহয় এবাড়িতে আর আসা হবেনা?দাদাভাই তোর ওবাড়িতে চলে যাওয়া বা থাকা সহজে মেনে নেবে?মানবেনা কখনো।যাই হোক,দাদাভাই জানে দাদিআপা কাল তোকে একেবার নিয়ে যেতে চাইছেন?

কৌড়ি মাথা নাড়ালো।ফের মুখে বললো–‘না।

‘এবার এই বাড়িটা না ভাঙচুর করে ফেলে।

মজার ছলে হেসে কথা বলতেই কৌড়ির ভিতরে ভিতরে আতঙ্কগ্রস্থ হলো।সত্যিই তো!তবে বলবে কিকরে সে!আজ তিনদিন মানুষটা বাড়িতে নেই।ফোনে অতি প্রয়োজন ছাড়া যোগাযোগ হয়না তাদের।দুদিন আগে পরিক্ষার খবর নেওয়ার পর আর কথা হয়নি।তবে কি কৌড়ি ফোন দিয়ে জানাবে?জানানো উচিত?না জানালে যদি আগের রাগের ভাঙচুরের ঘটনাগুলোর মতো পুনরাবৃত্তি কোনো অঘটন ঘটায়!

‘যাই হোক,পড়।আমি আসছি একটু।

কথাটা বলে চলে গেলো মান্যতা। কৌড়ি দ্বিধায় পড়ে গেলো কি করবে।বলবে?নাকি বলবে না?কখনো মানুষটাকে নিজ থেকে ফোন দেওয়া হয়নি,সেই দ্বিধায় আরও সংকোচিত হলো মন।উফ কি এক জ্বালা।উঠে পড়ার টেবিলে গিয়ে বসলো সে।সময় অতিবাহিত হলো তবুও পড়ায় মন বসলো না।মনে ঘুরপাক খেতে লাগল বিষয়টা।ফোন নিয়ে ডায়ালে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত নামের নাম্বারটা নিয়েও বেশ কিছুসময় ঘাটাঘাটি করলো।তবে দুপা এগোলেও তিন পা পিছিয়ে যেতে যেতে,রাতের খাবারের সময়টা পর্যন্ত গড়িয়ে গেলো তবুও ফোন দেওয়া হলোনা।রাতে খাবার খেয়ে এসে ফের পড়ার টেবিলে বসতেই মান্যতাকে তারদিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে দেখে মনে প্রশ্ন জাগলো। তবে কোনো এক দ্বিধায় প্রশ্ন করতে পারলো-না।আশা করেছিলো, মান্যতা নিজ থেকে কিছু বলবে।কিন্তু মান্যতাকে কিছু না বলে শুয়ে পড়তে দেখে,নিজেও পড়ায় মনোযোগ দিলো।

ফজরের আযানের পর বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো কৌড়ি।সারারাতে ঘন্টা দুই ঘুমিয়েছে।সেই ঘুম ভেঙেছে ফজরের আযানের পর।নামাজ না থাকায় ফ্রেশ হয়ে বেলকনিতে এসেছে।বাহিরের প্রকৃতি এখনো অন্ধকারে আচ্ছন্ন।হাতের ফোনটার দিকে তাকালো।সারারাতে যতবার ঘুম ভেঙেছে মনে হয়েছে মানুষটাকে তার যাবার কথা জানানো উচিত কি?তবে এই উচিত অনুচিতের দ্বিধায় এখন মনেহচ্ছে,এখন যদি ফোন না দেওয়া হয় আর জানানোর সুযোগ হবেনা।আর তার যাওয়ার পর বিষয়টা জানলে,আবারও না কোনো উল্টোপাল্টা কান্ড ঘটিয়ে বসে।এবার আর অন্তত সেরকম কিছু চাইছেনা কৌড়ি।নিজের আড়ষ্টতা নিয়ে ফোনের দিকে বেশ কিছুসময় তাকিয়ে ফোন লাগালো কাঙ্ক্ষিত নাম্বারে।সময় নিয়ে ফোন রিসিভ হলো।ফোন রিসিভ হতেই বুকের যন্ত্রণার মৃদুমৃদু কম্পন অস্বাভাবিক হলো।তবে কাঁপা কন্ঠে সালাম জানতে ভুললোনা।ওপাশের মানুষটা সময় নিয়ে সালামের উত্তর দিলো।ঘুম জড়ানো ভারী কন্ঠস্বর তার।শিরশির করে উঠলো কৌড়ির সর্বাঙ্গ।শিহরণে বুঁজে এলো চোখ।ওপাশ থেকে তখন ঘুম জড়ানো মিষ্টি কন্ঠের ডাক এলো।

‘কৌড়ি।

কৌড়ির মুদিত চোখজোড়া যেনো আবেশে আরও ডুবে এলো।এই মানুষটার ডাক কেনো এরকম কলিজা কাঁপিয়ে দেয়?উফফ!তখন কিযে অনুভব হয়!নিজেকে যেনো নিজের মধ্যে মনে হয়না।সহসা নিজেকে ধাতস্থ করলো।চোখ বুঁজেই কথার সূচনা করলো।

‘এই ভোরবেলা আপনাকে বিরক্ত করলাম।

অবান্তর কথা।কৌড়ি জানে।তবুও করলো।সেরকমই উত্তর দিলো অপরপাশের মানুষটা।

‘ফোনটা তুমি দিয়েছো কৌড়ি।সেখানে সময়টা,রাত না দিন,ভোর না সকাল,সময় না অসময়, তোমার অপেক্ষা গুরুত্ব হতে পারেনা।তোমার কখনো মনে হওয়া উচিত না,আমি বিরক্ত হয়েছি।

প্রসঙ্গ এড়াতে চাইলো কৌড়ি।—আজ শেষ পরিক্ষা।

‘জানিতো আমি।

‘দাদিআপা আজ একেবারে নিয়ে যেতে চাইছেন আমাকে।

দুপাশে নীরবতা চললো কিছুসময়।ফের শান্ত কন্ঠের বার্তা এলো।–যাও।

সহজে মেনে নিলো?হঠাৎই কৌড়ির মনেহলো তার যাবার বিষয়ে সে না বললেও মানুষটা জানে।এখন কি উপায়ে জেনেছে কৌড়ির জানা নেই।সে বিষয়ে প্রশ্নও করলোনা।নিশ্চয় মানুষটা ভেবেচিন্তে তাকে যেতে বলছে।না হলে তার একেবারে চলে যাওয়ার বিষয়টা শুনে ক্ষিপ্র হয়ে কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াতো তার জানা আছে।মানুষটা সম্পর্কে ইদানীং ধারণা হয়েছে সুগভীর।নিভানের কথা মেনে শান্ত এবং সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলো সে।

‘হুম।রাখছি তবে।

তড়িৎ আবারও সেই ঘুমঘুম ভারী গলার ডাক পড়লো।
—কৌড়ি।

সহসা ডাক শুনলো কৌড়ি।—হুমম।

‘মান্যতা যাচ্ছে তোমার সাথে।তাই ভুলেও মন খারাপ করবেনা।পরিক্ষা মনোযোগ সহকারে এবং সুন্দরভাবে দেবে। কেমন?

এবার নিশ্চিত হলো কৌড়ি।তার যাবার বিষয়টা সম্পর্কে মানুষটা নিশ্চিত জানে।নাহলে বিষয়টা এতো তাড়াতাড়ি মেনে নেওয়া কথা না। আর না এতো শান্ত থাকার কথা মানুষটাকে!হঠাৎই কালরাতে মান্যতার মুচকি মুচকি হাসির বিষয়টা মনে পড়লো।তাহলে কি আপুও জানে?হয়তো।মান্যতা যাবে!মন উৎফুল্ল হলো কৌড়ির।ফের সংক্ষিপ্ত পরিসরে উত্তর দিলো।—হুমম।

একটু সময় নিয়ে কৌড়ি ফের বললো-রাখছি তবে।উঠে নামাজ পড়ে নিন।

সময় নিয়ে ওপাশ থেকে উত্তর এলো।–হুমম।

কথার পরিসমাপ্তি ঘটার পরও কেউ ফোন কাটলো না।বালিশে মুখ গুঁজে কানে ফোন রাখা নিভানের।ওপাশ থেকে মৃদুশব্দে কৌড়ির ধীমেধীমে পড়া নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। সময় নিয়ে বেশ কিছুসময় সেই ছন্দময় শব্দ শুনলো নিভান।কোমল কন্ঠে ফের ডেকে উঠলো।

‘কৌড়ি

কৌড়ির কেনো যেনো মনে হচ্ছিলো ওপাশের মানুষটার বলা এখনো শেষ হয়নি।আর তারও এখনো নিজের মনের মধ্যে জমা খচখচানো কাঙ্ক্ষিত কথাগুলো শোনা বাকি আছে।যা সে শুনতে চায়।নিভান ডাকতেই সহসা উত্তর দিলো।—বলুন।

কৌড়ির বলার ভঙ্গিমা,ওপাশের মানুষটাকে শান্তি দিল।হাসলো সে।যা বালিশের তলানিতে মিলিয়ে গেলো।
মনের মধ্যে কতো কথা,শত অনুভূতি চেপে রাখা মেয়েটাকে আর অপেক্ষা করালো-না নিভান।যেনো ওই মেয়েটার মনের কথাগুলো বুঝে আবার তাকেই অভিব্যক্ত করাটা তার দ্বায়।হ্যাঁ দ্বায়ই তো।মেয়েটাকে ভালো রাখতে চায় যে সে।তাইতো দুজনের মনের অভিব্যক্তর দ্বায় সে নিয়েছে।ভাবনার একপর্যায়ে ঘুম জড়ানো অনুভূতিপূর্ন নির্মল কন্ঠে বললো।

‘আমি কাল সন্ধ্যায় ফিরছি।পৌরশুদিন তোমার কাছে আসছি।শুধু আমি নই, আমরা আসছি।তোমাকে একেবারে আমার কাছে নিয়ে আসার জন্য আসছি।সে পর্যন্ত সাবধানে থাকবে কৌড়ি!আল্লাহ হাফেজ।

থামকালো কৌড়ি।থামকলো নিজের হ্দস্পন্দন।থামকালো যেনো সকল ইন্দ্রিয়ের কর্মাকর্ম।কি বলছে এসব মানুষটা!তন্মধ্যে তারমধ্যে নিভানকে বিদায় বার্তা জানাতে ভুললোনা।ফের ফোনটা সামনে নিয়ে নিষ্পলক সেদিকে তাকিয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো।

সেদিনের পরের দিন ফেরার কথা থাকলেও ফিরতে পারলোনা নিভান।তবে তার পরের দিন অফিস ট্যুর শেষ হতেই আর কোথাও এক সেকেন্ড সময় ব্যয় করলো না।বাড়িতে ফিরতেই কেমন যেনো নিস্তব্ধ পরিবেশে পা পড়লো মনেহলো।হওয়ারই কথা।কৌড়ির সাথে মান্যতা একা নয় মৌনতাও গিয়েছে।বাচ্চাপাটি বাড়িতে না থাকলে পরিবেশ তো নিস্তব্ধই থাকবে।তবে এই নিস্তব্ধতা কেমন যেনো অস্বাভাবিক ঠিকলো।তার গাড়ীর শব্দ হলো অথচ আজ মা দরজা খুললেন না।রানী সাহেবা খুললো।তাও তড়িঘড়ি করে খুলে দিয়ে চলে গেলেন।কেনো?বরাবরই অফিসের কাজে দূরে কোথাও ট্যুরে গেলে,বাড়িতে ফিরতেই গাড়ীর শব্দ পেতেই মা এসে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন।আজ ভিন্ন!মা বাড়িতে নেই?থাকার তো কথা।হাফিজ ভাইকে গাড়ী বের করতে দেখলো।মা বাড়িতে না থাকলে হাফিজ ভাইয়েরও থাকার কথা নয়।ভাবনার একপর্যায়ে ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়ালো নিভান।তখনই হন্তদন্ত হয়ে বোরকার পর্দায় আবৃত নীহারিকা বেগমকে দেখেই কপাল কুঁচকে গেলো নিভানের।বাহিরের পোশাক!এই অসময়ে মা কোথায় যাচ্ছেন?কিছুক্ষণ বাদে তন্ময়ী আর ইভানকেও রেডি হয়ে বের হতে দেখে প্রশ্নটা মনে চড়াও হলো।নিভানকে দেখে নীহারিকা বেগম কিছু বলতে যাবেন।তার আগেই নিভান প্রশ্ন করলো।—এই অসময়ে কোথায় যাচ্ছো মা?নানুমা ঠিক আছেন তো?সকালেই তো কথা হলো তিনি ঠিক আছেন।তবে এতো তাড়াহুড়ো করে…

নিভানের কথা কেড়ে নিয়ে নীহারিকা বেগম ব্যস্ত এবং বিচলিত গলায় বললেন—তোর নানুমা ঠিক আছেন।তবে কৌড়ি নাকি কাল থেকে ভিষণ অসুস্থ।কাল কেউ জানায়নি আমাদের।সকালে মান্যতা ফোন দিয়ে বললো,মেয়েটা নাকি হসপিটালে ভর্তি।

চলবে…

ফুলকৌড়ি পর্ব-৩৮+৩৯

0

#ফুলকৌড়ি
(৩৮)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

কৌড়ির ফোনটা প্রায়শই নাফিমের হাতে দেখা যায়।সেদিন রাতেও ড্রয়িংরুমে বসে কৌড়ির ফোনটা নিয়ে গেম খেলছিলো নাফিম।আশেপাশে কেউ ছিলোনা।শুধু ডাইনিং টেবিলে প্রতিদিনের ন্যায় খাবার সাজাচ্ছিলেন তিন নারী।যাদের খেয়াল ড্রয়িংরুমে ছিলোনা।নিভান গিয়ে বসেছিলো নাফিমের পাশে।বরাবরের মতো নিভানকে দেখে দ্বিধান্বিত হয়ে ভয়ে গেম খেলা ছেড়ে ফোনটা তারদিকে এগিয়ে দিয়েছিলো নাফিম।
প্রথমে ভেবেছিলো,ফোনটা নেবেনা।নাফিম কে খেলতে বলবে কিন্তু তারপর কিছু একটা ভেবে ফোনটা নিয়েছিলো নিভান।নাফিম চলে যেতেই ফোনটা নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে,রেকর্ড অ্যাপসের মধ্যে হাত লেগে ঢুকে গিয়েছিলো।বেশ অনেকগুলো রেকর্ড।বেশিরভাগ বিথী বলে নাম সেভ করা সেই মেয়েটার সাথে কথোপকথনের রেকর্ড।রেকর্ডিং অ্যাপস থেকে চলে আসতে গিয়েই আবারও হাত লেগে রেকর্ড ওপেন হয়ে যায়।ওটাই হয়তো সেদিনের শেষ কথা ছিলো,তারপর আর কারোর সাথে কথা হয়নি। যার কারনে রেকর্ডের তালিকায় প্রথম ওই রেকর্ডটা থাকায়
অনিচ্ছুক সত্ত্বে জানতে পেরেছিলো,বিথীর আর কৌড়ির মধ্যে হওয়া কথাগুলো।বিথীর উপদেশ মুলক বানীগুলো।সেখানে আরও রেকর্ড ছিলো,কৌতুহল জাগলেও শোনেনি নিভান।ওটুকু শুনেই নিভানের মনে হয়েছিলো মেয়েটার স্বাধীনতা হরন করছে।মেয়েটার প্রতি এক্সট্রা লেভেলের পজেসিভ হয়ে পড়েছে সে,তাই বলে এভাবে অন্য গোপনীয়তা হরন করার বিষয়টা অতিরিক্ত।সেরকমই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ায় নাহিদের ভালো হয়ে যাওয়ার বিষয়টা সম্পর্কেও জানতে পারেছিলো সে।তবে সেদিন নিজথেকে শোনেনি।নাফিম ফোন নিয়ে ঘাটাঘাটি করছিলো,আর কিছু একটা শুনছিলো।সে পাশে এসে বসতেই কথাগুলো শুনেছিলো।বাচ্চা মন হয়তো কৌতহলবশত শুনছিলো, কি রেকর্ড আছে বা গানটান কিছু কি-না।আর তাকে পাশে বসতে দেখেই বরাবরের মতো ফোনটা রেখেই দৌড় দিয়েছিলো।তবে নাফিম ফোন রেখে গেলেও রেকর্ড বন্ধ করেনি নিভান।সেদিন ইচ্ছাকৃতভাবেই রেকর্ডটা মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলো।
একবার নয় দু’বার,খুব মনোযোগ দিয়ে শুনেছিল।আর সেদিন মনে গেঁথে গিয়েছিলো অজনা শঙ্কা।তবে সেদিন রেকর্ড শোনার পর রেকর্ডগুলো ডিলিট দিয়েছিলো নিভান।সাথে রেকর্ড অপশন-ও অফ করে দিয়েছিলো।প্রায়সই নাফিমের হাতে ফোন থাকে।মেয়েটার তারসাথেও মাঝেমধ্যে কথা হয়।বিষয়টা ভালো দেখায় না।

সেদিন থেকেই মনটা কৌড়িকে নিয়ে অদ্ভুত এক আশংঙ্কায় কুঁকড়ে আছে।কোনোভাবে কৌড়িকে যদি হারিয়ে ফেলে!এমন শঙ্কা মনের কোণে কোথাও একটা এঁটে খুঁতখুঁত কাজ করছিলো!আর সেই শঙ্কা থেকে আজ হাফিজ ভাইকে না যেতে দিয়ে কৌড়ির সাথে এক্সট্রা সতর্কতাসরূপ ইভানকে পাঠালো।তাতে হোলোটা কি?ইভানকে বারবার বলে সতর্ক করে দেওয়া সত্ত্বেও ইভান তো সেই ব্লান্ডারটাই করলো!যে দৃশ্যাবলী মনেমনে দৃশ্যমান করতেও মনকে কখনো প্রশ্রয় দেইনি।দিতে চাইনি নিভান।সেই দৃশ্যই কি পরিতৃপ্ত করে দিলো না তাকে! মনকে কিভাবে ওই দৃশ্যাবলী দেখার পর ক্রোধে জ্বলে উঠা আগুনের অনল থেকে রক্ষা করবে!কি করে নিজেকে ঠান্ডা করবে সে?উফফ!কৌড়ি!

‘দাদাভাই প্লিজ!ওরা শুধু কথা বলছে।ওরা ভাইবোন ভালোমন্দ কথা বলতেই পারে।প্লিজ উল্টো পাল্টা ভেবে কিচ্ছু করোনা।প্লিজ দাদাভাই,আমার রিকোয়েস্ট। প্লিজ প্লিজ।তুমি অসুস্থ।প্লিজ দাদাভাই।

মৃদু হাসলো নিভান।কি ঠান্ডা ভয়ংকর তাচ্ছিল্যময় হাসি।ইভানের বুক কেঁপে উঠলো।সে নিশ্চিত, সেদিনের মতো আজও দাদাভাই একটা অঘটন ঘটাবে!তন্মধ্যে নিভান শীতল মার্জিত গলায় বললো।—এতো সুন্দর দৃশ্যবালী দেখার জন্য ওরসাথে আমি তোকে পাঠিয়ে ছিলাম ইভান?ওরা দু’জনে নির্জন পুকুরপাড়ে বসে গল্প করবে আর আমি দুনয়ন পরিতৃপ্ত করে দেখবো!

মার্জিত কথাগুলো মোটেই নিভানের ঠান্ডা গলায় ঠিক লাগলোনা ইভানের।কি করবে,কি বলবে ভেবে উঠতে পারলো-না।কেমন পাগল পাগল লাগলো।সত্যিই তো দাদাভাই তাকে বিশ্বাস করে পাঠিয়ে ছিলো,সেই ভরসা বিশ্বাসের মর্যাদা কি রাখতে পেরেছে সে?পারিনি তো!মূহুর্তেই মুখটা ছোটো হয়ে গেলো তার।দূর্বল নমনীয় গলায় অপরাধীর ন্যায় মুখ করে বললো।–‘স্যরি দাদাভাই।

‘বাড়িতে আসছিস কখন?

নিভানের ঠান্ডা গলার বার্তা প্রশ্ন নয় উত্তর বলে দিচ্ছে, আর একমুহূর্ত নয়।এক্ষুনি চলে আসবি।অথচ এখন কোনোমতোও যাওয়া সম্ভব নয়।কৌড়ির দাদিআপা রান্নাবান্নার বিশাল আয়োজনে নেমেছে।প্রিয় নাতনীটাকে অনেকদিন পর কাছে পেয়েছে বলে কথা।সেই মানুষটাকে এখন কি বলে উপেক্ষা করে বাড়িতে যাবার কথা বলবে সে!ভিতরে ভিতরে ভিষণ অসহায় বোধ করলো ইভান।কন্ঠে ফুটে উঠলো সেই অসহায়ত্ব।

‘প্লিজ দাদাভাই,একটু বুঝতে চেষ্টা করো।এখন আসা সম্ভব নয়।কি করে আসবো?

‘এইযে আজ আমি অফিসে এসেছি,মৃদুল ড্রাইভ করে নিয়ে এসেছে।এখন বল,তবে তুই কি চাইছিস?এই অবস্থায় আমি ড্রাইভ করি আবারও উল্টো পাল্টা কিছু ঘটিয়ে হসপিটালে পড়ে থাকি?এবার মনে কর আর বেঁচে ফিরলাম না আমি।

দূর্বল জায়গায় আঘাত!মুখটা আরও অসহায় দেখালো ইভানের।কন্ঠস্বর আগের ন্যায় দূর্বল, নমনীয় রেখে বললো।-কেনো পাগলামি করছো?তুমি এমনটা ছিলেনা দাদাভাই!এমনটা তোমার কাছে কাম্য নয়।

এবার আর নিজের ভিতরের ক্রোধটাকে চাপিয়ে রাখতে পারলোনা নিভান।এতোসময় বহুত চেষ্টা করেছে তবে আর অনড় থাকতে পারলোনা।টেবিলের উপরের ফুলদানিটা মূহুর্তেই হাতে নিয়ে ছুঁড়ে ফেললো।টেবিলের সরাসরি কাঁচের দরজায় গিয়ে সেটা করাঘাত করলো।মূহুর্তেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।সেই চূর্ণবিচূর্ণ কাঁচের টুকরো টুকরো শব্দে অফিসকক্ষ যেনো মৃদু ভূমিকম্প বয়ে গেলো।শব্দ ছড়িয়ে পড়লো,অফিসকক্ষের বাহিরে স্টাফকক্ষেও।সবার নজর প্রশ্নাতীত হলো।তবুও সাহস জুগিয়ে কেউ প্রশ্ন করতে এলোনা।শুধু ক্ষনে ক্ষনে সেদিকে নজর দিলো।ততোসময়ে নিভানের ক্রোধিত কন্ঠস্বর বজ্র গলা নিলো–এই তোরা কি বাধ্য করছিসনা আমাকে এমনটা করতে?ইভান,ওই ছেলেটার জন্য মেয়েটার সবকিছু থাকা সত্ত্বেও বাবার মৃত্যুর দিনে বাড়ি ছাড়তে হয়েছে তাকে।অন্যের আশ্রিতা হয়ে থাকতে হচ্ছে! বিষয়টা নিশ্চয় তোর অজনা নয়!আর না নেহাৎই ছোটোখাটো কোনো কারণে বাড়িছাড়া হতে হয়েছে তাকে বলে তোর মনেহয়!বিষয়টা কোন পর্যায়ে গেলে তাকে বাড়ি ছাড়তে হয়েছে সেটাও নিশ্চয় তোর আন্দাজ আছে! করতে পারছিস আন্দাজ!তবুও কেনো সব বুঝে ওকে ওখানে নিয়ে গেলি?ও তো আবদার জুড়বে,ওর সবকিছু ওখানে।তুই কেনো বুঝলিনা?ওই ছেলেটাকে বিশ্বাস করে তার কথায় তুই ওকে ওবাড়িতে নিয়ে গেলি!কেনো?আর ওর-ও বিবেকবোধ দেখ,দিব্যি কি সুন্দর প্রকৃতি বিলাশ করছেন ম্যাডাম।তাও আবার সেই ছেলেটার সাথে,যে মাত্রই ওর জীবনের দুঃস্বপ্ন।আশ্চর্য হচ্ছি আমি!শুধু ওর আমাতেই সমস্যা।ওকে কাছে পেলে….

কথা শেষ করলোনা নিভান। দাঁতে দাত চেপে বাকি কথা গিলে ফেললো।ছোটো ভাইয়ের সামনে তা আর প্রকাশ করতে চাইলোনা।ফের কিছুটা সময় নিয়ে শান্ত গলায় বললো।–ফোন ওর কাছে দে।

বকাগুলো নীরবে হজম করলেও,কৌড়িকে চাইতেই চোখ বড়োবড়ো হয়ে গেলো ইভানের।কৌড়িকেও বকবে নাকি?বকারই তো কথা।যে কান্ড ঘটিয়েছে মেয়েটা।কি দরকার ছিলো এতো সুন্দর ঘটা করে বসে ওই খাটাশটার সাথে কথা বলার।আচ্ছা কৌড়ি যে মেয়ে, এমন ঘটা করে কথা বলার তো নয়।পরিক্ষার কেন্দ্র ছেলেটাকে দেখেও তো কথা বলিনি সে।এমনকি বাড়িতে আসার পথে ভুলেও ছেলেটার দিকে নজর দেয় নি কথাতো দূর।তবে এখন এতো ঘটা করে কথা বলছে কেনো?যাই হোক দাদাভাইয়ের এখন কৌড়ির সাথে কথা বলতে দেওয়া যাবেনা।নাহলে আরেক কেলেঙ্কারি বেঁধে যাবে।আর সেই কেলেঙ্কারির কারণ ধরে যদি কৌড়িকে আর ওবাড়িতে না পাঠাতে রাজী হয়!তবে এদিকে দাদাভাইকে ঠান্ডা করবে কিকরে?অসহায় নজরে আকাশের পানে তাকালো ইভান।ফের অসহায় কন্ঠে মিনমিন করে বললো –ইয়া আল্লাহ মাবুদ রক্ষে করো!

‘কি হলো ফোন ওর কাছে দে।

ইভান পড়লো বিপাকে। তবুও আরেকবার রোধ করার চেষ্টা করে বললো–‘পরে কথা বললে হবে না?পরে কথা বলে নিও?

‘ইভান…

কলিজা মোচড় দেওয়ার মতো শীতল ডাকটা শুনেই তড়িঘড়ি করে ইভান ফের বললো—প্লিজ দাদাভাই,মেয়েটাকে বকো-না।আমার দোষ,আমার যা বলার বলো।ও বাড়িতে এসে ভিষণ খুশী।আমি এতোটা উচ্ছল ওকে ওবাড়িতে কখনো দেখিনি।

আগুনে ঘি ঢাকার মতো কাজ করলো ইভানের বলা বাক্যগুলো।ইভান তখনও বুঝতে পারিনি সে আরও একটা ব্লান্ডার করে ফেলেছে।নিভানের তাচ্ছিল্যেময় ঠান্ডা গলায় উত্তর পেতেই নিজের গালে কোষে দু’চারটা চড় অনায়সে মারতে ইচ্ছে করলো তার।–‘সে তো দেখতেই পাচ্ছি তিনি বাড়িতে গিয়ে আপন মানুষদের পেয়ে কতো আনন্দিত, উচ্ছ্বসিত।

প্রায় তিন মাসের মতো নিজ বাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন কৌড়ি অথচ এবাড়িতে আসার পর মনেহচ্ছে তিনমাস নয় কত যুগ সে এবাড়ি থেকে দূরে।পরিচিত একই ঘরবাড়ি,আগানবাগান,পুকুরঘাট অথচ সবটাই যেনো কৌড়ির চোখে নতুন লাগছে।পরিক্ষার কেন্দ্রে বিথীর সাথে দেখা হলেও,পরিক্ষা দিয়ে কোনোমতে বাড়িতে গিয়েই মেয়েটা আবার চলে এসেছে তার এখানে।কতো কথা, কতো গল্প,কতো মনখারাপ হলো এই কয়েক ঘন্টার মধ্য।কৌড়ির মনেহলো,মেয়েটা কতো কথা জমে রেখেছে তারজন্য।একসাথে নিজের ঘরে বসে গল্প করছিলো কৌড়ি আর বিথী।দুপুর গড়িয়ে বিকালের আভা ছড়াতেই দুজনে,কৌড়িদের মুখামুখি শান বাঁধানো ঘাটটায় গিয়ে বসেছিলো।কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে বিথী উঠে গিয়েছে ওয়াশরুমে।আর বিথীর ফোনটা নিয়ে ঘাটাঘাটি করছিলো কৌড়ি।হঠাৎ অনুভব করলো তার মুখোমুখি শান বাঁধানো বসার জায়গাটা দখল করে নিয়েছে কেউ।মুখ উচু করে তাকাতেই আগের সেই উগ্র লাল চোখের চাহুনী,নেশাখোর টাইপের ছন্নছাড়া চেহারা কিছুই নজরে এলো-না কৌড়িট।সেখানে শান্ত নজর আর সুদর্শন মুখটা নজরে পড়লো কৌড়ির।যে উগ্র ছেলেটার জন্য তাকে বাড়ি ছাড়তে হয়েছিলো, সেই ছেলেটা কি এই?হঠাৎ মেলাতে পারলোনা কৌড়ি।তবুও মনেমনে শঙ্কিত হলো।ছেলেটা এখানে এসেছে কেনো?

‘কেমন আছিস?

গলার সেই একগুঁয়ে উচ্চ স্বরটাও বিলিন।কি নম্রভাব সেখানে।তার আলাপনের উত্তর দেওয়া উচিত কি?উচিত অনুচিত খুব একটা ভাবা প্রয়োজন মনে করলো-না কৌড়ি।শুধু গাঁট হয়ে বসে রইলো।সেদিন যখন সবসীমা পার করে তারসাথে নরপিশাচের মতো আচারণ করেছিলো।তাকে বাজে উদ্দেশ্য ছুঁতে চেয়েছিলো ছেলেটা। তারপর থেকে,এই ছেলেটার সাথে কথা বলা তো দূর ঘৃনার মুখটাও দর্শন করার ইচ্ছেও করে-না কৌড়ির।আর যারজন্য বাবার মৃত্যুর শোকটাও ঠিকঠাক পালন করতে পরিনি,বাড়ি ছাড়া হতে হলো তাকে।সেই ছেলেটার কথার উত্তর দেওয়ার বিশেষ প্রয়োজন আছে বলে মনে করেনা কৌড়ি।কথাই বলতে চায়না সে।সামনের ছেলেটা বুঝি সেটা খুব ভালোভাবে বুঝতে পারলো,অপরাধবোধটা যেনো ধিকেধিকে জ্বললো বুকের ভিতর।কৌড়িকে পাওয়ার ইচ্ছে সেই ছেলেবেলা থেকে।সেখানে কৌড়ির সাথে ওই বাজে নোংরা আচারণটা সে করতে চায়নি।আগেও করতে চায়নি,সেদিনও করতে চায়নি।কিন্তু বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে তাদের কথা শুনতে বাধ্য হয়েছে।বলাবাহুল্য তখন বন্ধুদের পরামর্শটা তার কাছে যথাযথ মনে হয়েছিলো।শুধু তখন নয়,তখনকার সব পরামর্শ তারকাছে যথাযথ মনে হতো।যা এখন আফসোস হয়ে দাঁড়িয়েছে।তাকে অপরাধবোধে ভোগায়।আর সবচেয়ে বড় আফসোস এটাই,সেই বুঝলো সে।তবে কৌড়িকে হাতছাড়া করার পর।এটা যদি কয়েক বছর আগে বুঝতো,তবে কৌড়িকে মনেহয় হারাতে হতোনা তাকে।জোর করে, গুন্ডামী করে ভয় দেখিয়ে, শাসিয়ে, যে আর যাই হোক মনের মানুষের ভালোবাসা হোক বা তাকে,আদায় করা সম্ভব নয়।তা এখন হাড়েহাড়ে অনুভব করছে।সত্যিই কি কৌড়ি শুধু তার আফসোস হয়ে থাকবে?মূহুর্তেই
পিছনের করা অপরাধমূলক উগ্র আচারনগুলো দুনয়নে ভেসে উঠলো।তাচ্ছিল্যের মৃদু হেসে অপরাধবোধে মাথা নিচু করে নিলো সে।মন বললো।হয়তো আফসোস হয়েই থাকবে কৌড়ি তার !তবে স্বীকারোক্তি তো তাকেই জানাতেই হবে।

‘বড়চাচা আর তোরসাথে এযাবৎকালের আমার করা সকল অন্যায় আচারণের অপরাধী আমি।জানি ক্ষমার যোগ্য নয়।তবুও ক্ষমা করিস আমায়।আমি আমার করা আচরনের জন্য অন্যকে দায়ী করতে চাইনা,তবুও বলছি আমি ইচ্ছাকৃতভাবে তোরসাথে বা বড়চাচার সাথে ওই অন্যায়মুলক উগ্র আচরনগুলো করিনি। করতে চায়ওনি।আর না সেদিন তোকে বাজেভাবে ছুঁতে চেয়েছিলাম।আমার সবকিছু খারাপ আমি জানি।কিন্তু তোকে বাজেভাবে ছুঁতে চাওয়ার মানসিকতা আমি কখনো পোষণ করিনি।বিশ্বাস কর,শুধু বন্ধদের দেওয়া পরামর্শ অনুযায়ী ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম।ওরা বলেছিলো,আমার দ্বারা তুই কলঙ্কিনী হলে,তুইও বাধ্য হবি আমার হতে আর চচাও বাধ্য হবে তোকে আমার সাথে বিয়ে দিতে।আমি তোকে পাওয়ার লোভে,ওদের পরামর্শ নিয়েছিলাম।আর সেই পরামর্শে যে তোকে একেবারে হারিয়ে ফেলবো,তা তখন বুঝিনি।দোষ আমার নয় বলছিনা।দোষ পুরো আমার।আমি অন্যায় করেছি,বাজে আচারণ করেছি।কিন্তু তোকে পাওয়ার আগ্রহটা আমার কোনোকালেও মিথ্যা ছিলো-না,ফুল।শুধু পন্থা অনুসরণ করাগুলো ভুল ছিলো।যদিও সেই ভুলের মাশুল মনে হয়,তোর বোঝা বোঝা ঘৃনার অনল নিয়ে আমাকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বয়ে যেতে হবে।আমি রাজি বইতে।তবুও বলবো ক্ষমা করিস আমায়।তোর জীবনের সকল খারাপ পরিস্থিতিগুলো ক্রিয়েট করার জন্য দ্বায়ী আমি।পাারলে সত্যিই আমাকে ক্ষমা করে দিস।

মাথা উঁচু করলো নাহিদ।কৌড়ির অবিশ্বাস্য নজরে নজর রাখলো সে।ওই নজরে তারজন্য দ্বিধা, সংশয় অবিশ্বাস, ঘৃনা সব যেনো স্পষ্ট।হয়তো তার কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারছেনা বা চাইছে না মেয়েটা।অবিশ্বাস্য
শুভ্র মুখখানা কি মায়াময়।এই মায়াই-তো ডুবেছিলো সে।আর তারজন্য কতো পাগলামি,কতো উগ্রতামী করলোই না জীবনে সে!অথচ ক্ষতি ছাড়া ভালো কিছু হলো না!ভুলটা তো অবশ্যই তারই ছিলো।দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভিতরে ভিতরে পুড়তে থাকা সবচেয়ে জঘন্যতম অপরাধের স্বীকারক্তি জানিয়ে পুনরায় আওড়ালো।

‘আমাকে অবিশ্বাস কর!পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ ছেলে ভাব!তবুও এটুকু অন্তত বিশ্বাস কর,আমি সেদিন তোকে বাজেভাবে ছুঁতে চায়নি ফুল।শুধু আমার করে পাওয়ার জন্য ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম।

আবারও একই বিষয়ে সাফাই।কৌড়ির অবিশ্বাস্য পলকহীন নজর এবার এলোমেলো হলো।দৃঢ়কণ্ঠে শক্ত গলায় একটাই বাক্য ছুড়লো—আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না,জানতেও চাইনা।আপনি চলে যান।আর দ্বিতীয়ত আপনি কখনো আমাকে ফুল নামে ডাকবেন না।ওটা শুধু বাবার মুখেই মানাতো আর কারও মুখে নয়।আপনার মুখে তো নয়ই।

এলোমেলো হাসলো নাহিদ।তবুও মেয়েটা কথা বলেছে, এই শান্তি।দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো সে।তন্মধ্যে সেখানে হাজির হলো ইভান।তাকে দেখে তড়িঘড়ি করে কৌড়িও উঠে দাঁড়ালো।কিছু প্রয়োজন পড়লো কি-না?
সেটা খেয়াল করেও নিজের কথা শেষ করতে নাহিদ বললো–যদি-ও তোর কাছে আমি বিশ্বাসযোগ্য মানুষ নই।তবুও বিশ্বাস করতে বলছি আমাকে।আমার দ্বারা আর কখনো তোর ক্ষতি হবে-না,আল্লাহ প্রমিজ।তাই বলছি এতো কষ্ট করে শহর থেকে এখানে এসে পরিক্ষা না দিয়ে বাড়িতে থেকে পরিক্ষা দে।ঝামেলা,কষ্ট দু’টোই রক্ষে হবে।তারপরে নাহয় আবার শহরে চলে যাস।

আবার শহরে চলে যাস কথাটা মুখ আওড়াতে চাইলো না।তবুও বুকের ভিতরের ব্যথা দমিয়ে কথাটা বলতে হলো নাদিহকে।ফের ইভানের দিকে তাকিয়ে সৌজন্যে হেসে চলে গেলো সে।ইভানের অসহায় নজর আরও অসহায় হয়ে ধরা দিলো।ফোনে তখন অডিও কলে নিভান।নিশ্চয় সব শুনেছে।এবার কি হবে?নাহিদ চলে যেতেই কৌড়ির খেয়ালী নজর ইভানের মুখে মনোবেশিত হলো।ইভানকে তারদিকে কেমন করে তাকিয়ে থাকতে দেখে কপাল কুঁচকে গেলো তার।সহসা প্রশ্ন করলো।

‘কিছু লাগবে ভাইয়া আপনার?

সহসা ফোন এগিয়ে দিলো ইভান।অসহায় মুখ,কাচুমাচু নজর।দূর্বল গলায় বললো —ফোন ধরো।কথা বলো।

কে প্রশ্ন করে হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিলো কৌড়ি।ইভান তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে গা এলিয়ে শান বাঁধানো বসার জায়গায় বসে পড়লো।এবার কৌড়ির পালা!ইভানকে উত্তর না দিতে দেখে ফোনটা কানে নিলো কৌড়ি।সকাল থেকে ফোন দিয়ে তন্ময়ী আপু,মৌনতা, মান্যতা আপু,ছোটোমা,বড়মা জ্বালিয়ে দিচ্ছে।এখানে যেনো না থাকা হয়।তাড়াতাড়ি চলে আসি যেনো।সেরকম তাদেরই কারও কল হবে মনেকরে ফোনটা কানে তুললো সে।সময় যেতেই ওপাশ থেকে শুধু ঘনো নিঃশ্বাসের আওয়াজ আসতেই চমকে ইভানের মুখের দিকে তাকালো।ইভান যেনো অপেক্ষায় ছিলো।সে তাকাতেই চোখ দিয়ে ইশারা করলো,তুমি যাকে ভাবছো সেইই।সহসা হৃদস্পন্দনের গতিবেগ বেড়ে গেলো তার।চোখের আকার ছাড়ালো দ্বিগুন।
মূহুর্তেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো গম্ভীর আর অতি শীতল কন্ঠের কঠিন বার্তা।

‘কার অনুমতি নিয়ে তুমি ও-বাড়িতে গেছো?আবার থাকার চিন্তাভাবনাও করে ফেলেছো!

আজ প্রায় পাঁচদিনের মতো মানুষটা তারসাথে ইচ্ছে করে কথা বলে-না।আজ তার পরিক্ষা এটা জেনে-ও একবারও তাকে দোয়া জানানোর প্রয়োজন মনে করল না।আর না কথা বলার।এখন আসছে কৈফিয়ত নিতে!
সুক্ষ এক অভিমান জমে ছিলো কৌড়ির মনে।সেই অভিমান থেকেই সহসা উত্তর দিলো।

‘এটা আমার বাড়ি। এখানে আসতে অনুমতি কেনো লাগবে?আর এখানে থাকার চিন্তাভাবনা কি! এখানেই থাকার কথা ছিলো,আর এখানেই থাকার অধিকার আমার।

‘ওটা তোমার বাড়ি নয়,ওটা তোমার বাবার বাড়ি।

‘সমান কথা।বাবার মানে আমার।আর দ্বিতীয়ত বাবার আর কোনো সন্তান নেই।তারমানে এটা এখন আমারই বাড়ি।তাই এখানে থাকার সম্পূর্ণ অগ্রঅধিকার আমারই।

‘বাহ।কৌড়িতো দেখি উড়ে বেড়াচ্ছে।তা ইন্ধন যোগাচ্ছে কে?তোমার ওই সো কলড উগ্র বাজে স্বভাবের ভাই।তা থেকে যাও তবে তার কথায়।থাকবে?

এতো শান্ত আর স্বাভাবিক কন্ঠ।কৌড়ি উত্তর দিতে ভুলে গেলো।মুলত সাহস যুগিয়ে উত্তর গুছিয়ে বলতে পারলো না একটা শব্দও।কেমন ওপাশের মানুষটার গলা অতি স্বাভাবিকের মধ্যে-ও অস্বাভাবিক ঠিকলো তার কাছে।একটু নয় অনেকখানী অদ্ভুত অস্বাভাবিক ঠিকলো।

‘বলছো না যে, থাকবে?

প্রশ্নের প্রেক্ষিতে জবাব যেনো সহসা মুখ থেকে বেরিয়ে এলো কৌড়ির।—‘থাকলে অসুবিধা কোথায়?

আগুনের ফুলকির ন্যায় দরদরিয়ে ঝলসানো মেজাজে ঘি ঢিলে দিলো যেনে কৌড়ি।মূহুর্তেই তার বহিঃপ্রকাশ ঘটলো নিভান।কি ভাঙলো বুঝতে পারলো-না কৌড়ি।তবে তীব্র ঝনঝন শব্দে কানের তালা ছুটে যাওয়ার উপক্রম হলো তার।চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো।ভয়ে মাথা থেকে পা অব্দি শিহরে উঠলো তার।কথা বলতে বলতে ইভানের থেকে বেশ কিছুটা দূরে চলে এসেছে সে।তবু-ও তার চোখমুখ খিঁচে নেওয়া দেখে ইভান বেশ বুঝতে পারলো,ফোনের ওপাশের মানুষটা ক্ষেপেছে ভিষণ।আর তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া চলছে।খারাপ লাগলো ভিষণ।তবে করার কিচ্ছু নেই।ফোনের ওপাশের মানুষটা তখন তীব্র রাগে অন্ধ।রাগে বজ্র কন্ঠে বার্তা ছুড়লো।

‘থাকলে অসুবিধা কোথায়?এই অসুবিধা কোথায় তুমি জানো-না?জেনে-বুঝেও কি করে জিজ্ঞেস করতে পারো,থাকলে অসুবিধা কোথায়?আর ওই উগ্র বাজে ছেলেটার সাথে বসে খোশগল্পে কি করে মেতে আছো তুমি? তাকে বিশ্বাস করে তুমি ওবাড়িতে গেছো!আবার তার পরামর্শ অনুযায়ী থাকতেও চাইছো!আবার বলছো থাকলে অসুবিধা কোথায়?আমার কথা একবারও কি মনে হয়না তোমার?

তীব্র ক্রোধ।সেদিনের মতো কি ভয়ংকর রাগ,কান্ড।তাকে ঘিরেই।এই লোকটা কি পাগল হলো!উফফ!কন্ঠ নমনীয় হলো এবার কৌড়ির।কোমল গলায় বললো।

‘প্লিজ আপনি অসুস্থ।পাগলামো করবেন না।

‘আমি অসুস্থ, এটা তোমার খেয়ালে আছে!খেয়ালে আছে বলছি কেনো,আমি মানুষ এটা তোমার মনেহয় বলে তো আমার মনেহয় না!তার ভালোমন্দ খেয়াল ধ্যান তোমার থাকবে,এটা আশা করাও অনুচিত।

‘প্লিজ।

‘তুমি আমাকে না জানিয়ে কেনো গেলে ওবাড়িতে কৌড়ি।তাও আবার ওই ছেলেটার কথায়!

‘আমি কারও কথায় এবাড়িতে আসিনি।এটা আমার জন্মস্থল।এখানে আমার টান,মায়া, ভালোবাসা সবকিছু। আমি সেই টানেই এসেছি।আর দাদিআপার কথা কিকরে ফেলতে পারতাম?আর আমি কারও সাথে খোশগল্প মেতে থাকিনি,উনিই এসেছিলেন কথা বলতে।বলেছেন আমি শুনেছি,উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি।ব্যাস চলে গিয়েছেন।

কৌড়ির কথার ধরন বুঝে নিভান বুঝি এবার একটু শান্ত হলো।তীব্র আক্রোশে ফেটে পড়া কন্ঠ এবার দূর্বল হলো।এক্সডিন্টে মাথার ছেঁড়াকাটাযুক্ত জায়গা ঝিমঝিম করে উঠলো।চেয়ারে গা এলিয়ে চোখ বুঁজে দূর্বল গলায় বললো–‘চলে এসো কৌড়ি।

এই ডাক,এই আহ্বান!ফিরিয়ে দেওয়া যায়।নাকি ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব!কি করবে সে এখন?এদিকে দাদিআপাকে-ও কি বলবে!আবার এই মানুষটাকে কি করে না বলবে!তবুও অবুঝের মতো বললো–এখন!কিভাবে সম্ভব।

‘কৌড়ি।

কি অদ্ভুত ডাক।পৃথিবীর সমস্ত মোহমায়া যেনো এই ডাকে কেটে গিয়ে শুধু ওই মানুষটার সম্মোহনী ডাকে মন তলিয়ে যায়।এই ডাকের অর্থ, তার কাছে সহজ সরল আবদারের প্রার্থনা,চলে এসো কৌড়ি। অসহায় হলো স্বর।বললো–‘আমি দাদুআপাকে কি বলবো?

‘জানিনা।শুধু যতো দ্রুত সম্ভব চলে এসো।বিকজ,আই ফিল ইনসিকিউর অ্যাবাউট ইউ।প্লিজ কৌড়ি,চলে এসো।

মধুময় আহ্বানে পিষ্ট হলো কৌড়ির মন।তবুও কন্ঠে বিস্ময় নিয়ে বললো–‘পাগল হয়েছেন!

অদ্ভুত ক্লান্ত হাসলো নিভান।এখনো চেয়ারে গা এলিয়ে চোখ বুঁজে আছে সে।মাথার ঝিমঝিম ব্যথাটা যেনো ধীরধীরে বাড়ছে।মাথায় বামহাতটা চেপে ধরলো সে।ফের খুব স্বাভাবিক, সহজ গলায় বললো।–তুমি আমার কাছে আসতে যতো দেরি করবে পাগলামোর মাত্রা ততো সীমা ছাড়াবে।আল্লাহ হাফেজ কৌড়ি।

ফোন কেটে দিলো নিভান।বুঝতে পেরেও কানে ফোন নিয়ে হতভম্ব হয়ে কিছুসময় দাঁড়িয়ে থাকলো কৌড়ি।ফের বিথী এসে ডাকতেই নড়েচড়ে দাঁড়ালো সে।ধীর পায়ে এগোলো ইভানের দিকে।গভীর ভাবনায় ডুবে আছে,এমনভাবে পুকুরের দিকে নিটোল চোখে তাকিয়ে আছে ইভান।কাছে গিয়েও সাড়া পাওয়া গেলোনা।তাই কৌড়িকে ডাকতে হলো তাকে।সে ফিরতেই তারপানে কেমন অসহায়া হয়ে তাকালো কৌড়ি।ইভান ব্যাপারটা বুঝতে পেরে কৌড়ির চেয়েও অসহায় চাহুনি ফেললো তারদিকে। দু’জনের একটাই ভাবনা,কি করবে এখন!কোনদিকে যাবে?

চলবে…..

#ফুলকৌড়ি
(৩৯)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

রাত প্রায় বারোটার দিকে বাড়ি ফিরলো ইভান আর কৌড়ি।সাথে কৌড়ির দাদিআপাকে-ও নিয়ে এসেছে।ভদ্রমহিলা নিজেও আসতে চান-নি এবং তাদেরকে-ও আসতে দিতে চান-নি।কতো আয়োজন করেছিলেন, সেসব সবকিছু ফেলে চলে আসতে হয়েছে। আর তারজন্য ইভানকে কতোকিছু বলে উনাকে ম্যানেজ করে তারপর উনাকেসহ তারা আসতে পেরেছে!বাবাকেও উকিল ধরেছিলো।বাবা নাহলে উনাকে নিয়ে আসা তো সম্ভবই হতোনা,সাথে নিজেদেরও আসা হতোনা।তাতে মহাপ্রলয় বয়ে যেতো।উফ!একেই বলে বুঝি প্রেমিক।রুমে ঢুকতেই তন্ময়ীকে দেখে মিষ্টি হেসে,তাড়াহুড়ো করে ওয়াশরুমে ঢুকলো।সারাদিনের জার্নি।সমস্ত শরীর যেনো অস্বস্তিতে ডুবে আছে।গোসল সেরে ফ্রেশ হওয়া খুব প্রয়োজন।যদিও কৌড়িদের বাড়িতে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হওয়ার কাজটা সেরেছিলো।সারাদিনের একই পোশাকে জড়িয়ে থাকা শরীরের অস্বস্তি কি আর তাতে কমে?তাই বাড়িতে ঢুকতেই আগে মনে হয়েছে, গোসল সেরে শরীরের ভিতরবাহিরটাকে স্বস্তি,শান্তি দেওয়া উচিত।ওয়াশরুমে ঢোকার আগে তন্ময়ীকে বললো-তনু প্লিজ আমার পরিহিত পোশাকগুলো দিও।

তন্ময়ী ততক্ষণাৎ ওয়ারড্রব থেকে বের করে বাসায় পরার জন্য ট্রাউজার আর টিশার্ট এগিয়ে দিলো।এতো দ্রুত। ইভান একটু অবাকই হলো।যদিও সম্পর্ক তাদের বেশ সহজ হয়েছে।তবুও এতোটা নয়।তন্ময়ী সবসময় তার থেকে দূরে দূরে থাকার ট্রায় করে।যদিও কথা হয়।রাতে একসাথে থাকা হয়।তবুও স্বামী স্ত্রীর মতো সম্পর্কে আগলা বাধন তো রয়েই গেছে!সময় নিয়ে
গোসল সেরে ট্রাউজার পরে খালি গায়ে মাথা মুছতে মুছতে বের হলো ইভান।তন্ময়ীকে দেখে ফের মিষ্টি হাসলো।অথচ মেয়েটার মুখ মলিন। কেনো?

‘মন খারাপ তোমার?কিছু হয়েছে তনু?শরীর ঠিক আছে?

জোর করে হাসলো যেনো তন্ময়ী।তড়িৎ বললো–মন খারাপ কেনো হবে!মন খারাপ নয়।আর শরীর-ও ঠিক আছে।

ইভানের চোখ যেনো তন্ময়ীর জোরপূর্বক ঠোঁট এলানো দৃশ্যতেই আঁটকে রইলো।–কিছুতো হয়েছে?কি হয়েছে বলো?

ইভানের কন্ঠ দৃঢ় শোনালো।তন্ময়ী কথা ঘুরাতে গিয়েও চুপ হয়ে গেলো।ভিতরে ভিতরে নিজেকে ধাতস্থ করে প্রসঙ্গ এড়িয়ে বললো–বললেন যে আজ আসবেন না? তবুও ফিরলেন যে।

ইভানের দৃঢ় দৃষ্টি তখনো তন্ময়ীর চোখমুখে ঘুরপাক খাচ্ছে।মেয়েটা প্রসঙ্গ এড়াতে চাইছে বেশ বুঝলো।তবুও উত্তর সরূপ বললো–তুমি তোমার বরকে ছাড়া থাকতে পারলেও, দাদাভাই তার বউকে ছাড়া থাকতে পারেনা।তাই বাধ্য হয়ে আসতে হলো।

ইভানের কথায় কৌতুহলী হলো তন্ময়ীর মন।তড়িৎ বললো—মানে?

‘মানে কিছুনা।তোমার মন খারাপ কেনো সেটা না বললে আমিও বলছি-না।

মায়ের বুঝদার বানী,শ্বশুর বাড়ীতে অনেক কিছুই হয়, তাই বলে সব কথা বরের কানে তুলতে নেই।সব মন্দটা মানিয়ে না নিলেও কিছু কিছু মন্দ মানিয়ে নিতে হয়।না হলে সংসার হয়না।তাই ইভানের সামনে সেটা আর প্রকাশ করতে চাইলো-না।আর না নিজের মানের উত্তর নিতে চাইলো।ইভান বুঝতে পেরেছে তার মন খারাপ!আর উত্তর না নিয়ে ছাড়বেনা বান্দা, এটা বুঝে প্রসঙ্গ এড়াতে রুমের বাহিরের দিকে যেতেযেতে বলল–আমি খাবার নিয়ে আসছি।একটু অপেক্ষা করুন।

‘তনু, দাঁড়াও।

দাঁড়িয়ে পড়লো তন্ময়ী।ইভান কেনো দাড়াতে বললো সেটা বুঝে বুকের ভিতর তোলপাড় শুরু হলো।ক্ষুনক্ষরে যদি টের পায় ফুপুমনি উল্টো পাল্টা শুনিয়েছে তাকে কেলেঙ্কারি আরেকটা বাঁধবে।এবাড়িতে এসে ইভানের সাহচর্য পেয়ে এটুকু বুঝেছে।ছেলেটা অন্যায় কথাকাজ একদম সহ্য করতে পারেনা।আর এসব নিয়ে যদি বাড়ির সবার সামনে ইভান উচ্চবাচ্য করে তবে সে-ও তো ছোটো হয়ে যাবে।স্বামী না আসতেই সে কান ভাঙিয়েছে।উফ!কি এক জ্বালা হলো।ইভান তার মুখ দেখে বুঝলো কিকরে?এটাই বুঝে আসলোনা তন্ময়ীর।তার মুখে কি লেখা ছিলো তার মন খারাপ?যারকারনে ইভান আসছে শুনেই শাড়ী পরেছে সে।শাড়ীতে কেমন লজ্জা লাগছিলো।তাই তারউপরে শাল জড়িয়ে একপ্রকার ঢেকে রেখেছে।কি একটা জুবুথুবু অবস্থা!

‘কি হয়েছে তন্ময়ী।প্লিজ বলো?

দরজার কাছাকাছি দাড়ানো তন্ময়ী।আর তন্ময়ীর পিছনে দাঁড়িয়ে দরজা টেনে দিতে দিতে ধীরকন্ঠে শুধালো ইভান।ইভানের বুক বিধলো তন্ময়ীর পিঠে।মোহগ্রস্ত হলো তন্ময়ী।শ্বাস ঘনো হলো তার।তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার প্রচেষ্টা করে বললো–দরজা আঁটকে দিলেন কেনো?খাবেন তো?খাবার আনতে হবে তো?

দরজা আটকে দেওয়া হয়ে গেলেও ইভান সরলো-না। সেভাবেই বললো—ওবাড়ি থেকে পর্যাপ্ত খেয়ে এসেছি।আমি আর খাবো-না।তবে তুমি আমার প্রশ্নকে বারবার এড়িয়ে যেতে পারো-না।আমার প্রশ্নের উত্তর দাও?কি হয়েছে?

তন্ময়ী ঘুরে দরজা ঘেঁষে দাড়ালো।নাহলে নিঃশ্বাস জানি কেমন আঁটকে আসছিলো তার।ঘুরে দাঁড়িয়ে আরও এক বিপদে পড়লো।ইভানের উন্মুক্ত ফর্সা চওড়া বুকটা দেখে অস্বস্তি বাড়লো।ইভান সেই অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে দিয়ে তন্ময়ীর মুখোমুখি হয়ে কাছাকাছি দাঁড়ালো।হাত রাখলো তন্ময়ীর মাথা বরাবর দরজায়।একপ্রকার আঁটকে দিলো তাকে।তড়িৎ চোখ বুজে নিলো তন্ময়ী।কথা বলতে গলা কাঁপলো তবুও বললো।–বললাম তো কিছু হয়নি।মন খারাপ ন…

‘মিথ্যা বলবেনা তন্ময়ী!

ইভানের দৃঢ়কন্ঠে বুঁজে থাকা চোখ আরও খিঁচে নিলো তন্ময়ী।তড়িৎ বলতে শুরু করলো।

‘ফুপিমণি বলেছে,আমি দেখতে ভালো না।তাই নতুন বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও আমার বর আমাকে নিয়ে ঘোরার বদৌলে অন্য মেয়েকে সময় দিচ্ছে।সব ছেলেদের প্রথম আকর্ষণ সৌন্দর্য।বিয়ে ভেঙে যাওয়া আমাকে,উদ্ধার করতে আপনি আমাকে বিয়ে করলেও,আপনিও পুরুষ।যার নজর ঘরের অসুন্দর স্ত্রীতে আঁটকে নেই।সৌন্দর্যময়ী নারীতেই আটকে আছে।না-হলে কি স্ত্রী বাদে অন্য মেয়েকে সময় দেয় কেউ?

তন্ময়ীকে ফুপুমনির পছন্দ নয় তাই সুযোগ পেতেই কটাক্ষ করে কথা শোনাতে দ্বিধা করেনি।হয়তো আরও অনেক কথাই শুনিয়েছে!সেটা পরে দেখছে ইভান।আগে তন্ময়ী কি ভাবছে,সেটা জেনে নিক।সহজ হওয়া সম্পর্কটা না আগের ন্যায় হয়ে যায়।

‘তোমার ধারনা কি?আমাকে ভুল বোঝা আগের ঘটনার মতো?আমার চরিত্র খারাপ?

চোখ খুুলে ফেললো তন্ময়ী।ইভানের বলা কথার উত্তর সরূপ বলতে ইচ্ছে করলো,আমি আগে ভুল করেছি।যদিও ভুল আপনারও কম ছিলোনা।তবে দ্বিতীয়বার আপনাকে ভুল বোঝার বোকামিটা আর করছিনা।তবে ইভানের সাপাইটা তারসামনে গাইতে পারলোনা।উল্টো করে বললো–‘আমি কৌড়িকে বিশ্বাস করি,ভরসা করি।ও তেমন মেয়ে নয়।কখনোই নয়।আমি এই অল্প সময়ে ওকে যেটুকু চিনেছি,জেনেছি।আমি বড়বোন হিসাবে ছোটো বোনকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারি। ভরসা করতে পারি।যদিও করি আমি।সেখানে দ্বিধাদ্বন্দ্বের কোনো ফাঁকফোকর নেই।বিশ্বাস করুন, নেই।

মাথা ঝুকালো ইভান।মাথার সামনের লম্বা ভেজা চুলগুলো গিয়ে পড়লো তন্ময়ীর চোখে-মুখে।মূহুর্তেই আবার চোখ বুঁজে নিলো তন্ময়ী।অনুভূতিতে দোল খেলো শরীর মন।অনুভূতির তীব্রতা বাড়িয়ে দিয়ে ইভান কেমন মোহগ্রস্ত কন্ঠে শুধালো—আর আমাকে বিশ্বাস করা যায়না?ভরসা করা যায়না?

দম এবার আঁটকে এলো তন্ময়ীর।উত্তর দেওয়ার বদলে বললো–প্লিজ সরে যাও ইভান।

হাসলো ইভান।আপনি থেকে তুমি।এতোদিনে মনেহয় মেয়েটাকে নিজের অনুভূতির ডোরে বাঁধতে পারলো।সরলো-না ইভান।বরং আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে দাড়ালো তন্ময়ীর।কন্ঠে আরও মায়া ঢেলে দিয়ে বললো–আজ হঠাৎ সেলোয়ার-কামিজের বাদে শাড়ী পরেছো কেনো?

উত্তর দিতে পারলোনা তন্ময়ী।দু’পাশের খামচে ধরা শাড়ির অংশবিশেষটুক আরও শক্ত হাতে খামচে ধরল।
কেনো পরেছে?এই কথা কিকরে নিজমুখে বলবে সে!
ইভানের গভীর নিশ্চল চোখদুটো তন্ময়ীর মায়াময় মুখে স্থির থাকলও,তার গতিবিধি অনুধাবন করতে পারলো ইভান।একটু একটু করে মেয়েটা অনুভূতিতে দূর্বল হশে পড়েছে তারপ্রতি,আজ ক্ষনিকের দূরত্বে সেটা যেনো স্পষ্ট।শাড়ীর অংশবিশেষ খামচে ধরা বাম হাতটা ছাড়িয়ে দিলো ইভান।আবারও একই মোহগ্রস্ত কন্ঠে শুধালো–আমাদের সম্পর্কটা কি এগোনো যায়-না তনু?একটু ভরসা,বিশ্বাস করা যায়না কি আমাকে?

অনুভূতিতে পিষ্ট তন্ময়ী তখন একটা শব্দও উচ্চারণ করার পর্যায়ে নেই।চোখমুখ খিঁচে সেভাবেই চুপ হয়ে রইলো সে।সেই মুখের দিকে মোহগ্রস্তের ন্যায় মায়ামায়া চোখে তাকিয়ে রইলো ইভান।মাঝেমধ্যে খুব ইচ্ছে করে মেয়েটার এই মায়াভরা চোখে,গোলগাল গালে,লালচে ঠোঁটে মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবাসতে।গভীরভাবে ছুঁয়ে দিতে।তবে বাধ্য সে।পারে-না।আজও হয়তো সেই চাওয়াটা বুকের ভিতরেই চাপা রাখতে হবে তাকে।একটু একটু করে সরে দাঁড়িয়ে পিছে মুড়লো ইভান।মূহর্তেই তার শক্ত হাতটা বাধা পড়লো একটা কোমল হাতের বাঁধনে। শিহরে উঠলো শরীর।কম্পিত হলো হৃদয়।সেই কম্পিত হৃদয়ের কম্পন আরও বাড়িয়ে দিয়ে তন্ময়ী মৃদু কাপা কন্ঠ বললো।

‘আমাদের সম্পর্কটা আমি এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই ইভান।

সুখ সুখ অনুভূতিতে ছেয়ে গেলো মন।শিরশির করে উঠলো সমস্ত সত্তা।তবুও নিজের সেই অনুভূতি দমিয়ে রেখে ইভান প্রশ্ন ছু্ড়লো–‘বিশ্বাস করো,ভরসা করো আমাকে?

নীরব রইলো তন্ময়ী।সেটা বুঝে হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলো ইভান।নিজের লাজ ছেড়ে তখন তন্ময়ী বললো।

‘ভরসা বিশ্বাস তৈরী না হলে আমাদের সম্পর্কটা আমি কিছুতেই এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইতাম না।আমি তোমাকে বিশ্বাস করি,ভরসা করি ইভান।

ঘুরলো ইভান।মূহুর্তেই দুহাতে আগলে নিলো তন্ময়ীর মায়াময় মুখটা।ফের সন্দিহান কন্ঠে বললো–মিথ্যা বলছো না-তো?তুমি স্ত্রী হয়েও স্বামীকে সঙ্গ দিচ্ছো না এই অপরাধবোধে নিজেকে আমার কাছে সপে দিতে চাইছো না-তো?তাই যদি হয়,তবে তোমার শরীরটাকে আমার চাই-না।আমি পুরুষ,স্ত্রীকে একান্তভাবে পাওয়ার চাহিদা আমার আছে।তাই বলে,অবিশ্বাস, অভরসা নিয়ে তাঁকে আমি ছুঁতে চাই-না।আমি তোমাকে কাছে নিয়ে শান্তিতে ঘুমাচ্ছি তাতেই চলছে আমার।

ইভানের শান্ত চোখে সাহস করে চোখ রাখলো তন্ময়ী।স্পষ্ট স্বরে জানালো-আমি মিথ্যা বলছি-না ইভান।আমি বিশ্বাস করি তোমাকে।

ইভান গভীরপানে চেয়ে রইলো তন্ময়ীর চোখ দুটোতে।সেখানে যেনো পরখ করে নিতে চাইলো,তন্ময়ীর বলা কথার সত্যমিথ্যা।সময় অতিবাহিত হতেই,নিজের দু’হাতে আজলে রাখা তন্ময়ীর মুখটা নিজের আরও কাছে টেনে আনলো।ঠোঁট বসালো তন্ময়ীর ছোট্রো কপালটায়।বিয়ের রাত থেকে রোজ রাতে এই ঠোঁটের স্পর্শ সে পেয়ে চলেছে।তবে তার স্পর্শ,গাঢ়ত্ব আজ যেনো ভিন্ন।চোখ বুঁজে এলো তন্ময়ীর। হাতজোড়া আপনা-আপনি চলে গেল,ইভানের চওড়া পিঠে।শখের নারীটার কোমল স্পর্শ পেতেই ইভসন যেনো এতোদিনে নিয়ন্ত্রণে রাখা নিজের সত্তা হারালো।কপাল থেকে ঠোঁট ঘেঁষে নিয়েই তন্ময়ীর চিকন লালচে ঠোঁটে বসালো।অনুভূতিতে মোহ হারিয়ে ইভানকে আরও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো তন্ময়ী।আশকারা পেতেই মাতাল হয়ে উঠলো ইভান।সময় চললো,বাড়লো শখের নারীটাকে একান্তরূপে পাওয়ার পাগলামী।তাতে প্রশ্রয় দিলো সেই নারীটিও।

শীতল,শুনশান রাত।চারদিকে মৃতুপুরীর মতো নিস্তব্ধ। কৌড়ির চোখে ঘুম নেই।অথচ সেই ভোরে ঘুম থেকে উঠে জার্নি, তারপর পরিক্ষার টেনশন,এরপর বাড়ি, সেখান থেকে আবার জার্নি।শরীর প্রচন্ড ক্লান্ত লাগছে অথচ দু’চোখে ঘুম নেই।শোয়া থেকে এই পর্যন্ত এ-পাশ ও-পাশ করেও ঘুম কিছুতেই ধরা দিচ্ছে না দুচোখের দুয়ারে।গা থেকে কম্বল সরিয়ে উঠে বসলো কৌড়ি।পাশে শুয়ে দাদীআপাকে একবার দেখে নিলো।উনার ঘনত্ব শ্বাসপ্রশ্বাস বলে দিচ্ছে,উনি গাঢ় ঘুমে।বেড থেকে নেমে রুমের মধ্যে কিছুসময় হাটাহাটি করলো। তবুও ক্লান্ত মনকে কিছুতেই স্থির করতে পারলো-না।অনবরত চলা শ্বাসপ্রশ্বাস কেমন রূদ্ধ হয়ে চলছে।এরকম মাঝেমধ্য হয়।খোলা, নির্মল পরিবেশ পেলে আবার ঠিক হয়ে যায়।অথচ এই রাতে যাবে কোথায়?বেলকনিতে গেলো। তবু-ও যেনো স্বস্তি পেলোনা,ভালোও লাগলোনা।শেষমেশ ছাঁদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।কিন্তু এতো রাতে ছাঁদে যাওয়া ঠিক হবে কি-না? এই দোনোমোনোয় কিছুসময় অতিবাহিত করলো।যখন মাত্রাধিক হাসফাস করে উঠলো ভিতরটা।তখন ভাবলো,ছাঁদে যাবে সে।তাতে যাই হয়ে যাক।গায়ের ওড়নাটা মাথায় সুন্দর করে দু-প্যাচানো দিয়ে ফের গায়ে জড়িয়ে নিলো।সঙ্গে চাদরটা জড়িয়ে নিলো আষ্টেপৃষ্টে।চাদরটা গায়ে নিতেই আবারও সেই মানুষটার কথা মনে পড়লো সাথে তার পাগলামোগুলো।আচমকা ঠোঁটের কোণ প্রসারিত হলো কৌড়ির।ছাঁদে যাবার আরেকেটা রিজন মনের মধ্যে ঘুরেফিরে চলছে।তাই মনটাও অদ্ভুতভাবে টানছে সেখানে।কেনো জানেনা কৌড়ি।হয়তো কারণ,সেই মানুষটা।

দরজা চেপে দিয়ে ছাদের দিকে পা বাড়ালো কৌড়ি।ড্রয়িংরুমে নীল বাল্বের নিভুনিভু আলোতো ছেয়ে আছে চারপাশটা।সেই আলাতে ধীরপায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলো সে।নমনীয় পায়ে একে একে ধাপ পার করতে থাকলো প্রতিটি সিড়ি।তাকে উপরে উঠতে দেখে,এতো সময়ের অপেক্ষিত দুটো সুগভীর,স্বচ্ছ চোখ যেনো সুক্ষ হাসিতে জ্বলজ্বল করে উঠলো।সেই হাসির উৎপত্তি ছড়ালো পুরো ঠোঁটের কোণ থেকে।কিচেনে থাকা মানুষটা তখন মনোযোগ দিয়ে কফি বানাচ্ছে।আজ মন যেনো বলছিলো,কৌড়ি বের হবে।আর তার সাথে সচ্ছ অলিক এক সাক্ষাৎ হবে।আজ আর কৌড়ি তাকে এড়িয়ে যাবে না।সময় নিয়ে কফি বানানোয় মনোযোগ দিলো নিভান।যেনো তাড়া নেই।একটু নাহয় অপেক্ষা করুক মেয়েটা।

ছাদে পা রাখতেই দক্ষিণা ঠান্ডা বাতাসে কুঁকড়ে এলো কৌড়ির পাতলা শরীর।গায়ের চাদরটা আপনাআপনিই আরও আষ্টেপৃষ্টে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো।ছাদের বড়ো-বড়ো লাইটের আলোতে,আশেপাশের সবকিছু পরিচ্ছন্ন, ঝকঝকা।কুয়াশা ঘেরা রাতের প্রকৃতি আরও মুগ্ধময়।ছাদে লাগানো গাছগুলো লাইটের আলোতে আরও চিরসবুজ।কি সুন্দর দেখাচ্ছে সবকিছু।আল্লাহর নেয়ামতের বড় একটা নেয়ামত, রাত।এই রাতটা না আসলে মনেহয় দিনের গুরুত্ব,মর্মটা অনুধাবিত হতোনা।
চারপাশটা নিস্তব্ধায় ঘেরা বিশাল বড় ছাদটাই একাকি পা রাখতে শরীরটা ভিতর থেকে কেমন ছমছম করে উঠলো।অথচ কোনো কারণে এক মনোবলে ছাঁদে পা রাখলো কৌড়ি।ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে বসলো,নির্দিষ্ট বসার সেই শানবাঁধানো জায়গায়।হাতদুটো কোলের মধ্যে নিয়ে কিছুটা জড়োসড়ো বসলো।আজ আকাশে স্বচ্ছ একটা মস্ত বড় থালার ন্যায় চাঁদ উঠেছে।কি সুন্দর পরিপূর্ণ অবয়ব তার।আশাপাশে আজ তারার মেলা নেই।বিধায় ওই আকাশে তার ঝলসানো পূর্ণ রূপটা যেনো আর-ও ঝলমল করছে।আর তার ঝলসানো রূপের মধ্যে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে সেই ছোটোবেলায় শোনা দাদিআপার মুখের অবাস্তব আলৌকিক গাছটা।যে গাছের নিচে এক বুড়ির বসাবস।ছোটোবেলায় গল্পটা অতি সত্যায়িত অতি বাস্তব মনে হলেও,বড় হয়ে তার সত্যায়িত মিললো পুরো অবাস্তব এক কল্পকাহিনিতে।মৃদু হাসলো কৌড়ি।তা মিলিয়ে গেলো পুনরায় ঠোঁটের বাঁকে। হঠাৎই কারও উপস্থিত অনুভব করলো।মূহুর্তেই হৃদপিন্ডের ধুকপুকানির অস্বাভাবিকতা টের পেলো।তারসাথে টের পেল,মানুষটা কে?গায়ের তীব্র সুগন্ধটাও জানিয়ে দিলো,সেই মানুষটা এসেছে।ভিতরে ভিতরে একটু সংকোচিত হলেও,নড়নচড়ন করলো না কৌড়ি।সেভাবেই চুপচাপ বসে রইলো।তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছিলো,মানুষটা যেনো তার অপেক্ষায় আছে।ছাদে এসে মানুষটাকে না পেলেও মনে হচ্ছিলো, মানুষটা আসবে।নিভান এসে স্বাভাবিক দুরত্ব বজায় রেখে বসলো।হেলান দেওয়ার জায়গায়টায় বেশ আয়েশ করে হেলান দিয়ে পা মেলিয়ে দিলো।মূহুর্তেই পায়ের সিম্পল স্যান্ডেলজোড়া খুলে তারউপর পা রেখে অন্য পায়ের সাথে পা জড়িয়ে নিলো নিভান।ফের ঠোঁট ছোঁয়ালো কফির মগে।সেটা বেখেয়ালি নজরেও কৌড়ি দেখতে পেলো।সহসা নিভান একটা কফির মগ তার সামনে এগিয়ে দিয়ে বললো।

‘কফি খেয়ে মাথা ঠান্ডা করো।তোমাকে তোমার বাবার বাড়ি থাকতে দিলাম না।কতো কষ্ট!আসলে তোমার বাবার বাড়ি থাকতে দিলাম না তাতে কষ্ট পাচ্ছো নাকি কার-ও কথা রাখতে না পেরে থাকতে পারোনি তাতে কষ্ট পাচ্ছো?

স্পষ্ট পরিহাস।সাথে দুষ্ট হাসির বার্তা।ভিতরটা রাগে টইটম্বুর হলো।তবুও ভুলেও নিভানের দিকে ফিরলোনা কৌড়ি।অন্যদিকে মুখ করে শক্তকন্ঠে বললো।

‘আপনি প্রচন্ড খারাপ একটা মানুষ।

হাসি বিস্তৃত হলো নিভানের ঠোঁটের কোনে।নিঃশ্বাসের মৃদু শব্দ সে হাসি পরিস্ফুটও হলো।দুষ্টুমিষ্টি স্বরে ফের শান্তস্বরে বললো–সারাটাজীবন সেই মানুষটাকেই তোমাকে সহ্য করতে হবে।ভালোবাসতে হবে,তার সঙ্গীনি হয়ে তারকাছেই থাকতে হবে।তোমার জীবনের প্রতিটি সময় বয়ে নিয়ে যেতে হবে সেই মানুষটার সাথে।সুতারং সে কেমন বলে লাভ আছে!মন্দ বললেতো গায়ে তোমারই পড়ে যাবে।সুতারং নিজের জিনিসের দোষ ঢাকতে শেখো।

অদ্ভুত শিহরনে ছেয়ে গেলো কোমল শরীরের ভিতর বাহিরটা।অনুভূতির কবলে পড়ে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নিয়ে অন্যপাশে ফিরে রইলো।কিছুসময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো।ফের চোখ খুলে কুয়াশাচ্ছন্ন রাতের প্রকৃতিতে গাঢ় নজর ফেললো।তন্মধ্যে আবারও নিভান কফির মগটা কোড়ির সামনে এগিয়ে দিয়ে বললো’–নাও,কফি খেয়ে নিজেকে ঠান্ডা করো।তারপর ধীরেসুস্থে রাগ জেদ দেখাও।আমাকে ছাড়া তো রাগ জেদ অনুভূতিগুলো তুমি আর অন্য কারও উপর প্রয়োগ করতে পারো-না।সো আমি-ও অপেক্ষারত।মনে করে এসেছি তোমার দুয়ারে।

ঘাড় ফিরিয়ে একপলক নিভানের দিকে তাকালো।
শক্ত দৃষ্টি নিভানের মুখপানে ফেলতেই,শান্ত আর নমনীয় হয়ে গেলো সে দৃষ্টি।নিভান মিষ্টি হেসে তখনও চেয়েছিল কৌড়ির মুখপানে।মাথায় সাদা ব্যান্ডেজটা আষ্টেপৃষ্টে জড়ানো।শ্যাম মুখের মায়াটা যেনো তাতেই চৌগুন বেড়ে গেছো।মায়াময় দুটো সুগভীর চোখ।পুরো ঠোঁটের কোণের হাসির ঝলকানির প্রভাব যেনো সেই সচ্চ চোখদুটোতেও ভেসে বেড়াচ্ছে।সেই সুগভীর হাস্যোজ্জ্বল নজরে নজর পড়তেই সারা শীরর মৃদু কম্পিত হলো।তবু-ও আজ আর নজর সরালো না কৌড়ি।তবে বেশিক্ষণ নজরও স্থির রাখতে পারলো-না।স্পষ্ট গলায় বার্তা ছুড়লো—‘আমার মাথা ঠান্ডাই আছে।লাগবে-না আমার।আর এটা খেলে মাথা গরম হয় ছাড়া ঠান্ডা হয় বলে তো আমার অন্তত মনে হয়-না।উদাহরণ না-হয় নাই দিলাম।

কথাগুলো বলতে বলতেই মুখ ফিরিয়ে নিলো কৌড়ি।এলোমেলো নজর ফেললো সামনে।সেটা দেখে আর-ও বিস্তৃত হলো নিভানের হাসিমাখা ঠোঁট।শেষের কথার ইঙ্গিতটা যে তাকে ঘিরে সেটা স্পষ্ট।ঠোটের কোনে হাসি রেখেই কেমন শান্ত স্বরেই সে-ও বললো।

‘তোমার মনেহয় সামন্য এই তিক্ত কফিটা আমার রাগের কারণ?জেনে-বুঝেও কারণ হিসাবে দোষটা কফির উপরে চাপিয়ে দিচ্ছো?যাই হোক,আমারটা থেকেতো খেতে বলছি-না।এটা অতিরিক্ত কশ, তিক্ত।পারবেনা-ও না খেতে তুমি।ফিলিংস আলাদা অনুভব করায়।মিষ্টান্ন নয় তবু-ও একটা শান্তি, স্বস্তির অদ্ভুত ফ্রেশ অনুভূতি।যা মিষ্টান্ন না-হয়েও আমি মিষ্টি অনুভব করি। স্বস্তি পাই,শান্তি পাই।তাই হয়তো তিক্ত হয়েও এতো পছন্দনীয়।তবে তোমার জন্য আলাদা ফ্লেভারের বানিয়ে নিয়ে এসেছি।মিষ্টান্ন ফ্লেভারের।মিষ্টি হলে-ও আমার কেনো জানি মনেহয় তার অনুভব শক্তি কশ,তিক্ত।যদিও তোমার কাছে সেটা মিষ্টি,তুমি ঠিকই সেটা সাচ্ছন্দ্যে পান করে এড়িয়ে নিতে পারবে।কিন্তু আমার যে তিক্ততায় অভ্যাস।আমি পারছি না সেই তিক্ততা ত্যাগ করতে।তোমার মতো এড়িয়ে যেতে, পরিত্যাগ করতে।কিছুতেই পারছিই না।আরও নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিতে ইচ্ছে করছে সেই তিক্ততাকে।সেটা তোমার যদি অতি পাগলামো বলে মনেহয় তবে তাই।আমি নির্দ্বিধায় সেই তিক্ততার নেশায় ডুবে যেতে চাই।তার দরূন আমি পাগল, প্রচন্ড খারাপ মানুষ হতেও রাজি।

ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাকে কি সুন্দর নিষ্ঠুর মানুষ বানিয়ে দিলো!নিভানের মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কৌড়ি।একটু আগের মোহে ডুবিয়ে রাখা,মিষ্টি হাসিটা মুখে নেই,মায়াময় নিগাঢ় দৃষ্টিটা তার আধারে আচ্ছন্ন।গায়ে হালকা টিশার্ট।তাও আবার হাফ সিল্ভ। শীত লাগছেনা?কৌড়ি গায়ে মাথায় কি সুন্দর করে ওড়না জড়িয়েছে,তারউপরে আবার মোটা চাদর জড়ানো।তবুও ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব, ভিতরটা ছুঁয়ে দিচ্ছে।গায়ের উপর থেকে আলগোছে আস্তেধীরে চাদরটা টেনে খুলে ফেললো কৌড়ি।পাশাপাশি বসা নিভানের কোলের উপর চাদরটা রাখলো।তড়িৎতেই কোলের দিকে তাকলো নিভান।ফের কৌড়ির মুখের দিকে।
মেয়েটার গায়ে মাথায় সুন্দর করে ওড়না পেচানো।
ততক্ষণে কৌড়ির গাঁট হয়ে বসে সামনে নজর ফেললো।নিভান কৌড়ির ব্যাপারটা বুঝে চুপচাপ চাদরটা গায়ে জড়ালো।উষ্ণ চাদরটার উষ্ণতায় কলিজার ভিতরটাও পর্যন্ত ছুঁয়ে দিলো।তন্মধ্যে কৌড়ি স্থির নজরটা সামনে রেখে তাকে নিষ্ঠুর উপাধি দেওয়ার কৈফিয়ত সরূপ বলতে শুধু করলো।

‘দাদিআপা আমাকে একটা আলাদা সমীকরণে মধ্যে বেড়ে তুলেছেন।হয়তো তিনি যেমন তেমনটাভাবেই গড়ে তুলতে চেয়েছেন।মা ছিলেন না।সেই শূন্য বয়স থেকেই মায়ের জায়গায় আমি উনাকে চিনতে জানতে শিখেছি।হয়তো সেই কারণেই,উনার গড়া সমীকরণেই সীমাবদ্ধ হয়েই বেড়ে উঠেছি।আমার বলা চলা দুষ্টমী,চলাচল সবকিছু একটা সমীকরণ তিনি তৈরী করে দিয়েছিলেন।ঠিক নির্দিষ্ট তৈরী আবার নয়।উনার শাসনে আদরে সেটা একটু একটু করে সেই সমীকরণ আস্তে আস্তে প্রভাবের হয়ে গিয়েছিলো আমার ভিতর বাহির।আর তারমধ্যে থেকে নড়চড় হলেই মায়ের মতো শাসন করতেন।জানিনা মায়েদের শাসনবারণ ঠিক কেমন হয়।তবুও চাচিমাদের দেখেছি তো তাই বলছি।আদর দিতে যেমন কম করেননি, তেমন শাসন করতেও পিছুপা হোন নি।এই কৌড়ি এখানে যাবিনা,ওখানে যাওয়া ঠিক নয়।এদের সাথে মিশবিনা।ওদের সাথে মেশা ঠিক নয়।
স্কুল কলেজ থেকে আসতে সময়সীমা পার হয়ে গলেই তিনি আর বাড়িতে বসে থাকতেন না।হুটহাট কোথাও বের হতে দিতেননা, ঘুরতে যেতে দিতেন না।আশেপাশে চাচাদের বাড়ি থাকলেও অবাধ সেখানে যাওয়া-আসা পছন্দ করতেন না।বাবাও সেটা নীরবে সমর্থন করতেন।
আমি এসব বিসয় নিয়ে ঝগড়া করতাম দাদিআপার সাথে।আবসর উনার কথা মানতামও।আস্তে আস্তে যত বড় হতে শুরু করলাম,আমি কেমন যেনো উনার ধরাবাঁধা সীমারেখায় অভ্যস্ত হয়ে পড়লাম।বিধায় সব বিষয়ে চাইলেও কেমন যেনো আমি দ্বিধায় জড়িয়ে যাই।আমার জন্য কোনটা ঠিক কোনটা ভুল,দাদিআপা বারবার অন্ধ ব্যক্তির ন্যায় হাত ধরিয়ে পথ দেখিয়ে দিয়েছেন।আমি তাতেই যেনো অতি বিশ্বাসী হয়ে গেছি।আমার আবেগ আমার দূর্বল অনুভূতি সেখানেই যেনো বারংবার আমাকে থামিয়ে দেয়।আর দ্বিতীয়ত বাবা সমসময় বলতেন,এমন কিছু কখনো করবেনা,আমার পরিচ্ছন্ন ফুলের গায়ে মূর্ছা পড়ে।কেউ কখনো আমার ফুলের দিকে আঙুল তুলে আমাকে ছোটো বড় কথা না বলতে পারে।মা নেই,বাবা দাদিতে মানুষ করতে পারি নি।এমন বাক্য-ও যেনো না শুনতে হয় কখনো।বাবা আমাকে ফুল বলে ডাকতেন।আর সেই ফুলকে তিনি কিভাবে সংরক্ষিত রাখতে চেয়েছিলেন,আপনাকে বলে হয়তো বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়।বাবা স্কুল শিক্ষক ছিলেন।আমাদের গ্রামে উনার আলাদা একটা সম্মান শ্রদ্ধা ছিলো।দাদিআপার দেওয়া শিক্ষা, আর বাবার সম্মান শ্রদ্ধার স্থান থেকে হোক বা উনাদের অতি আদর ভালোবাসায়।তাদের দেওয়া সমীকরণের বাইরে আমার আর যাওয়া হয়নি কখনো।প্রয়োজনও মনে হয়নি আমার।আমার মনেহয় ওরকম রক্ষন পরিবেশে বেড়ে উঠা আমার সৌভাগ্য।যার কারণে আমার স্কুল কলেজের বন্ধুবান্ধবীর সংখ্যা খুবই ক্ষীন।কারন আমি সেভাবে মানুষের সাথে হুটহাট মিশতে পারি-না আর মিশুকে হয়ে উঠতেও পারি।তবুও আপনজন প্রিয়জন বলতে যে কয়জন সীমাবদ্ধ ছিলো বা আছে আমার জীবনে আমি তাতেই অত্যন্ত সুখী।

একটু থামলো কৌড়ি।পাশের মানুষটার অদ্ভুত শান্ত নজর তখন তারপানে।মোহিত হয়ে কৌড়ির কথাগুলো শুনছে এবং অনুধাবন করছে।মেয়েটাকে কতো রক্ষনশীলতার মধ্যে মানুষ করা হয়েছে।সেটা কৌড়ির কথায় বেশ অনুধাবন করতে পারছে।নিজের মন নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ট্রেনিং যার আগে থেকে আছে সে কখনো তার দূর্বল আবেগে গা ভাসায়?
সেতো নিজের মন আর আবেগকে প্রশ্রয় প্রধান্য দেওয়ার আগে নিজের ফ্যামিলি আর ফ্যামিলির সম্মানের কথাকে চিন্তা করবে।এটাই তো স্বাভাবিক।কৌড়কে তার বরাবর ম্যাচুর মেয়ে বলে মনে হয়েছে। তাই বলে দায়িত্বশীল মানুষদের মতো এতোটা-ও নয়।কারণ এই বয়সের মেয়েদের যতোই কঠিন রক্ষানাবেক্ষনের মধ্যে রেখে মানুষ করা হয়না কেনো,তাদের মন তাদের মানসিকতা ঠিক কতোটা আবেগী চিন্তাভাবনার হয় সেটাতো মান্যতাকে দিয়ে দেখা।আশেপাশে তো অভাবই নেই।যেখানে পরিনত বয়সের দীবা এখনে পাগলামে করে চলেছে,সেখানে কৌড়িকে অদ্ভুত বলে মনেহলো তার।যদিও মা, কৌড়ির এসব বিষয় নিয়ে সবসময় প্রশংসা করেন।তবুও আজ যেনো অদ্ভুতই লাগছে তার।কৌড়ি ফের বলতে শুরু করলো।—এতো সময়ে হয়তো বুঝে গিয়েছেন, আমি ঠিক কিরূপ রক্ষনাবেক্ষনের মধ্যে বড় হয়েছি।আর সেখানের ছায়া ছিলেন বাবা।বাবা আমার শুধু ছায়া ছিলেন এমনটা নয়।তিনি, মা-হীনা আমার মা ছিলেন।যিনি মায়ের মৃত্যুর পর চাইলেই কারনবশত হোক বা অকারণে আবার বিয়ে করতে পারতেন।করেননি শুধু আমার কারণে।সেখানে মায়ের ভালোবাসা গুছিয়ে রাখার আবদানও কম নয়।তিনি আমার সুখঅসুখের সঙ্গী ছিলেন।যদিও প্রতিটা বাবা মা তার সন্তানের সুখঅসুখের সঙ্গী হয়ে থাকে।কিন্তু একটা মা-হীনা সন্তানের সুখঅসুখের সঙ্গী হওয়া সহজ কথা নয়।আমার ভালো মন্দ,আপনজন বলতে সবটা তাকে ঘিরে।আমার সম্মান,আমার শ্রদ্ধাবোধ সবটাই।আমার কারণেই সেই উনাকেই কেউ অসম্মান করে কথা বলুক, নিচু দেখাক বা আমার কোনো কর্মে উনাকে ছোটো হতে হয়।এগুলো আমি আগেও চায়নি,এখনো চাইনা।আর দাদিআপা।যিনি মায়ের দায়িত্বের বোঝা নিয়ে আমাকে লালিতপালিত করেছেন,তাকেও বা অসম্মান হতে দেই কিকরে!যিনি প্রতিনিয়ত আমাকে সতর্ক করেই চলেছেন।কখনো যেনো আমার দ্বারা বাবার সম্মানে আঘাত হানার মতো কাজ নাহয়।সেখানে আমি উনার আদেশ হোক বা উনাকে উপেক্ষা করি কি করে?জানেন,আমার আবেগ মাঝেমধ্যে আপনার মতো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।খুব করে মনের কথা শুনতে ইচ্ছে হয়।আমার জন্য পাগলামো করা মানুষটাকে আমার জীবনে খুব করে প্রশ্রয় দিতে মন চায়।পারিনা।দাদিআপার আর বাবার দেওয়া সেই সমীকরণের সীমাবদ্ধের বেড়াজালে আঁটকে যাই।তখন মন যতো দূর্বল হোক আর কাঁদুক তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাখতেই হয়।তাকে স্বান্তনা দেইই,যা আমার তা আমার ভাগ্য জোরে এমনিতেই আমার হবে।তাকে আঁটকে রাখার সাধ্য প্রভু ছাড়া কার আছে।

নীরব সমর্থন।মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকা নজর খুশিতে ঝলমল করে উঠলো নিভানের।হঠাৎই চোখ বুঝে নিয়ে বিস্তৃত হাসলো।মাথা এলিয়ে দিল শান বাঁধানো হেলান দেওয়া উঁচু জায়গাটায়।এতো বুঝদার মেয়েটা!নিভানের কৌড়ির তো এমনই হওয়া উচিত।চোখ বুঁজে থাকা অবস্থায় নিভান বললো।–আমি এতোদিনে তোমার কথা মা’কে জানিয়ে দিতাম।আমি জানতাম আমাকে উপেক্ষা নয়,আমার অনুভূতিকে এড়িয়ে চলো তুমি।সমান কথাই তো হলো।তাই তোমার মতপ্রকাশ বিহীন জানাতে ভয় পেয়েছি।যদি তুমি অমত পোষন করো।

আজ যেনো কৌড়ির দ্বিধা কেটে গেলো।মন খুলে কথা বলতে ইচ্ছে করলো।তাই নিভানের কথার উত্তর সরূপ বললো।

‘আপনাকে উপেক্ষা করা সহজ কথা নয়।সহজে কোনো নারী উপেক্ষা করতে পারবে বলে মনে হয়না আমার।যারা বোকা,অতিলোভী তারা ছাড়া।অথবা বাধ্য হয়ে।তবুও পারবে বলে মনে হয়না আমার।দীবা আপু পেরেছে কি?পারিনি।না-হলে নিজের সাজানো গুছানো ঘর সংসার ছেড়ে তিনি কি আপনাকে পাওয়ার আশায় উপেক্ষিত হয়েও এবাড়িতে পড়ে থাকতে পারতেন না!ক্ষনিকের জন্য ফুপুমনির কথার বাধ্যতায় আর সিয়াম ভাইয়ার পাগলোতে মোহগ্রস্থ হয়ে পড়েছিলেন।মোহ কেটে যেতেই,দেখুন তার পরিণিতি।যদি-ও আপনার চাওয়ায়ও খামতি ছিলো,আমার মতো করে যদি তাকে চাইতেন।হয়তো….

মূহুর্তেই চোখ খুলে ফেললো নিভান।ঘাড় বাকিয়ে তাকালো কৌড়ির স্বাভাবিক মুখপানে।নিশ্চয় কেউ দীবার কথা কৌড়িকে জানিয়েছে।তবুও ভালো।তার আর কৌড়ির মধ্যে কোনো রাখঢাক থাক এটা সে কদাপি চায়না।পুনরায় আগের স্থানে গা এলিয়ে দিলো।চোখদুটোও ফেরছে বুজে নিলো।ফের কৌড়িকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বললো।

‘আমি চাইনি তাকে।মা চেয়েছিলেন।তখন তুমি ছিলেনা।তাই দীবাকে বউ করার বিষয়ে মা আমার মতামত জানতে চাইলে,আমি তার সিদ্ধান্তকেই নিজের সিদ্ধান্ত হবে বলে জানিয়েছিলাম।ও সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগে হোক বা সিয়ামের মোহে পড়ে আমার একটা উপকারতো অবশ্যই করেছে।তোমাকে আসার সময় দিয়েছে আমার জীবনে।এই কারণে হলেও,ওর-ও একটা উপকার আমার করা দরকার।সিয়ামের সাথে ওর সংসারটা আমি নাহয় নিজ হাতে গুছিয়ে দেবো।যদিও তুমি আমার জীবনে আসার ছিলে আর আমারই হওয়ার ছিলে।

সেদিন রাতে মান্যতা তাকে দীবার বিষয়ে বলেছিলো।সেদিন যেমন কথাগুলো শুনতেই মনটা অদ্ভুত অনুভূতিতে খচখচ করেছিলো।আজও কথাগুলো বলতে গিয়ে কেমন তিক্ত অনুভব হলো। তবুও বললো কৌড়ি।কেনো জানি পাশের মানুষটার রিয়াকশন কেমন হয় জানতে মন চাইলো।মনের সেই তিক্ত অনুভব দময়ি রেখে আরও একটা প্রশ্ন করলো।

‘আর আপুর ভালোবাসা ঋনটা চোকাবেন কি-করে?তিনি কিন্তু আপনাকে….

‘কারও ভালোবাসার ভালোলাগার দ্বায় আমার হতে পারে-না।সে ভালোবাসে বলে আমাকেও তাকে বাসতে বাধ্য হতে হবে এটা বাধ্যতামূলক নয়।হতে পারেনা।

কৌড়ি হাসলো।মজার ছলে বললো–আমার দ্বায় আছে বলছেন?আমি বাধ্য?আমার জন্য বাধ্যতামূলক?

নিভান জানতো শান্তশিষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়েটা তার কথার প্রেক্ষিতে এই কথাগুলো বলবে।ধপ করে চোখ খুললো।চোখ খুলে সহসা কৌড়ির দিকে এগিয়ে এসে উত্তেজিত গলায় বললো — হ্যা বাধ্য তুমি।অবশ্যই দ্বায় আছে তোমার।শুধু নিভান বলতে বাধ্যমূলক তুমি।তোমাকে যে দীবার কথা বলেছে,সে এটা বলেনি।দীবাতে আমি কখনোই ইন্টারেস্ট ছিলাম না আর না ছিলাম ওরজন্য পাগল।মা বলেছিলেন,সম্পর্কটা না হওয়ার ছিলো,দ্যাটস এ্যানাফ।তারপর ওর অন্যত্র বিয়ে,ভালো মন্দ কোনো কিছুতেই আমার কখনো যায় আসেনি।যায় আসেওনা।কিন্তু তোমার সবকিছুতে আমি ইন্টারেস্ট,তোমার ভালো মন্দ সবকিছুতে যায় আসে আমার।তুমি বুঝদার বুদ্ধিমতি মেয়ে হিসাবে নিশ্চয় এটা বুঝতে পরেছো?আর এটাও নিশ্চয় বুঝতে পেরেছো,
আমার জীবনের একান্ত নারী হিসাবে আমি শুধু তোমাকে পেতে চাই।তোমাকেই ছুঁতে চাই,তোমাকেই ভালোবাসতে চাই।আমার শুধু তোমাকে চাই কৌড়ি।শুধু তোমাকে।ওসব অযথা কথা টেনে তোমার জায়গায় অন্য নারীকে বসিয়ে তুলনা করে কথাবলাটাকে মোটেই আমি পছন্দ করছি-না।বুঝতে পারছো?দ্বিতীয়ত তুমি আর সে আমার জীবনে ভিন্ন দুজন নারী।যার একজন আমার জীবনের সব।অন্যজন সম্পর্কিত ব্যতিত কিছুই না।সো তোমার জায়গায় অন্য কাওকে নিয়ে আর কখনো উল্টো পাল্টা প্রশ্ন তুলবে-না।

জানা কথাগুলো আবারও সেই মানুষটার মুখ থেকে শুনে স্তম্ভিত হলো কৌড়ি।নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল সামনের হঠাৎই ক্ষেপে উঠা মুখটার দিকে।প্রকৃতির হিমশীতল বরফঠান্ডা হাওয়াটা যেনো অন্তরকোণে ছড়িয়ে পড়লো।ঠোঁটের কোণ প্রসারিত হলো এলোমেলো সচ্ছ হাসিতে।নজর সরিয়ে অন্যত্র নিলো সেই হাসি আড়াল করার জন্য।নিভান সরে গিয়ে ফের মাথা এলিয়ে দিলো নির্দিষ্ট জায়গায়।ঘাড় কাত করে প্রসঙ্গ এড়াতে কৌড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে খুব স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো।

‘তোমার নেক্সট এক্সাম কবে?

কৌড়িও ততো সময়ে স্বাভাবিক করে নিলো নিজেকে।বললো — পৌরশু দিন।

‘সেদিন আমি যাচ্ছি।ওই গাধাটার সাথে তোমাকে আর পাঠাচ্ছি না।

‘এখানে ইভান ভাইয়ার কোনো দোষ নেই কিন্তু। অযথা আপনি তার উপর রাগ করে কথা বলছেন।আমি যেতে চেয়েছিলাম।দাদিআপাও জোর করলেন।তাই তিনি আর না করতে পারেননি।এখানে উনার দোষ কোথায়?

‘সবার প্রতি তোমার এতো মায়া।আমার বেলায় শূন্য হয়ে পড়ে কেনো সব?

উত্তর দিলো-না কৌড়ি।লজ্জায় ফের মুখ ঘুরিয়ে নিলো অন্য পাশে।নিভানও সেটা বুঝে আর কথা বাড়ালোনা।কৌড়ির জন্য বানানো কফিটা ঠান্ডা হয়ে গেছে,কথা বলতে বলতে সেটা আর কৌড়ির খাওয়া হয়নি।নিজেরটাও অর্ধেক পড়ে আছে মগে।সময় চললো দু’জনে দুপাশে চুপচাপ বসে রইলো।

‘রুমে যাবেনা?ঠান্ডা লাগছে তো!

‘ঘুম আসছেনা!তাই যেতেও ইচ্ছে করছেনা।

সম্পর্কেটা হালাল হলে সময়টা হয়তো অন্যরকম ভাবে কাটতো।একই চাদরের নিচে মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে রাতটা এখানেই পার করে দেওয়া যেতো অনায়াসে।মন উল্টো পাল্টা চাইতেই নিজেকে ভিতরে ভিতরে ধাতস্থ করলো নিভান।ফের বললো।

‘পরিক্ষা চলছে,ঠান্ডা লাগলে অসুবিধা।এই ঠান্ডায় আর থাকতে হবেনা।চলো।

উঠে দাড়ালো নিভান।কফি মগ দুটো হাতে নিয়ে কৌড়ির উঠার অপেক্ষা করলো।কৌড়ি উঠতেই চোখ দিয়ে তাকে সামনে এগোতে ইশারা করে সে পিছে হাটলো।ছাদের সিড়ি বেয়ে দোতলা থেকে নিচতলার সিঁড়িতে পা রাখতেই নিভান তাকে ডাকলো।

‘চাদরটা নেবে না?

কথাটা বললেও নিভানের গায়ে তখনও চাদরটা আষ্টেপৃষ্টে জড়ানো।দেওয়ায় মতিগতি যে নেই,শুধু কথা বাড়ানো বেশ বুঝলো কৌড়ি।সেটা খেয়াল করে বললো–‘আমার জিনিস আমার কাছে আর থাকছেই বা কোথায়?

কথাগুলো বলেই মুখ ঘুরিয়ে সিঁড়িতে দ্রুত পা চালালো কৌড়ি।নজরের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত সেদিকে তাকিয়ে রইলো নিভান।নজরের আড়াল হতেই মৃদুস্বরে আওড়ালো–এখনো আস্ত তোমাকেই তো পাওয়াা হয় নি।সেখানে আমার আবার প্রিয় জিনিস বলতে ভাগ্যদোষ আছে।হয়তো তারা আমার থেকে হারিয়ে যায় নয়তো কোনো বাধার দেয়াল এসে তাদেরকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।যানিনা তোমার আমার মাঝে আবার কোন বাঁধা এসে উপস্থিত হয়।তবে তুমি বলতে নিভান বিন্দুমাত্র কম্প্রোমাইজ করবে না।কৌড়ি বলতেই যে নিভানের চাই।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রুমে ঢুকলো নিভান।অথচ একজোড়া অশ্রুভেজা নয়ন তারপানে নিষ্পলক চেয়ে রইলো।সেদিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল করলো-না সে। আর কিসের অপেক্ষায় আছে দীবা!কিসের?সে যে আশায় ছিলো,তা কি কখনো পূর্ণ হওয়ার ছিলো?ছিলোনা তো!তবুও তো মন আশা বেধে ছিলো।কোনো একসময় নিভান তাকে বুঝে তারকাছে ফিরবে।যদিও আশাটা নিতান্তই অবান্তর।নিভানের ব্যাক্তিত্বের কাছে এই আশা মূল্যহীন। তবুও মন-তো।সুক্ষ এক আশা মনের কোণে বেধেই ছিলো।কিন্তু কৌড়ি নিভানের জীবনে আসার পর একটু একটু করে সে আশা চুরমার হতে শুরু করলো।তা ভাঙা চূর্ণবিচূর্ণ টুকটো গুলো নিঃশেষ হতে হতে আজ বুঝি একেবারেই শূন্য হয়ে গেলো।নিজের হাতে নিজের সৌভাগ্য পায়ে ঠেলে নাশ করা যাকে বলে।যা এখন প্রতি পদেপদে সে ভোগ করছে।এই আফসোস বুঝি তাকে সারাজীবন বয়ে নিয়ে,আওড়ে যেতে হবে।অথচ সিয়াম তার পিছনে পাগলের মতো লেগে আছে।
ইভানের বিয়েতে আত্মীয়তা রক্ষা করতে তাদেরকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিলো।দীবা বাজেভাবে বারণ করায় আর আসেনি।অথচ দামী উপহার পাঠাতে ভুল করেনি।ভুল করেনি দীবার একাউন্টে তার নিজ খরচ পাঠাতেও।এটা নিয়েও ঝামেলা হয়েছে।সিয়াম
বারবার নিজের ভুল অন্যায় স্বীকার করছে।তবুও মন গলছেনা দীবার।মন পড়ে আছে নিভানকে পাওয়ার নিষিদ্ধ এক চাওয়ায়।যা অন্যায়!পাপ!

চলবে…

ফুলকৌড়ি পর্ব-৩৬+৩৭

0

#ফুলকৌড়ি
(৩৬)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

ছাঁদের উপর শান বাধানো বসার স্থানে দুহাঁটু একসাথে মুড়ে ফুপিয়ে কেঁদে চলেছে কৌড়ি।সেই নিঃশব্দে কান্নার দমকে থেকে থেকে কেঁপে উঠছে তার পেলব শরীর।ফর্সা চোখমুখ লালাভ বর্ণায় ছেয়ে গেছে।ঠোঁটে দাঁত চেপে কান্নার ফলে ঠোঁটজোড়াও গোলাপিবর্ন ছেড়ে রক্তিম আভায় ছেয়ে পিষ্টে আছে যন্ত্রণায়।এতো পোড়া কপাল নিয়ে পৃথিবীতে কেনো জন্মছিলো সে!দূর্ভাগ্য বুঝি শুধু তারই প্রাপ্য!কেনো ওই মানুষটা তার ভিতরটা বুঝতে চাইলো না?ইদানিং তার সুখ-অসুখ সব নিজ থেকে বুঝে নিতে পারছে।আর এটুকু বুঝে নিতে পারলো না,কেনো সে মানুষটাকে দেখতে যেতে পারিনি। কৌড়ি কি এতোই,নিষ্ঠুর অমানবিক।মানুষটা এক্সিডেন্ট করেছে শুনে কি অনুভব অনুভূতি হয়েছিলো তার,এটা শুধু সেই জানে।একটা পলক মানুষটাকে দেখার জন্য মনটা কিভাবে ছটফটিয়ে ছিলো,সেটাও শুধু তার ভিতরটা জানে।অথচ সেই মানুষটা তাকে কিছু বলার বিন্দুমাত্র সুযোগ না দিয়ে রেগে-মেগে চলেই গেলো!তাকে একটাবার বোঝার চেষ্টা-ও করলো-না!এই বুঝল মানুষটা তাকে?এতো রাগ, এতো ক্ষোভ জন্মেছে তারউপর?কৌড়ির কান্নার গতিবেগ বাড়লো।হঠাৎ সামনে দু’খানা ফর্সা গোটালো পা দেখেই কান্নারা এবার হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এলো।বসা অবস্থায় মান্যতার কোমড় জড়িয়ে তার পেটে মুখ গুঁজে হেঁচকি তুলে কাঁদতে থাকলো।মান্যতাও পরম যত্নশীলতায় নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো তাকে।নিজের রুম থেকে বেরিয়ে নিচে যাচ্ছিলো সে।হঠাৎ দাদাভাইকে হনহনিয়ে ছাঁদ থেকে নামতে থেকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলো সে।নিভান কাছে আসতেই তাঁকে দেখেই চলা ধীর করলো।ফের গম্ভীর কন্ঠে তাঁকে আদেশ করলো ছাঁদে আসতে।বলেই চলে গেলো।মান্যতা ভেবে পায়নি দাদাভাইয়ের এমন আদেশর কারন।কেনো সে ছাঁদে যাবে!হঠাৎ কিছু মাথায় খেলতেই দ্রুত ছাঁদে এসে দেখলো,দাদাভাইয়ের রাগের কারন।

‘উনি আমার কথা কিছুতেই শুনলোই না আপু।আমি কেনো যেতে পারিনি,কারনটা উনি জানতেও চাইলেন না,শুনতেও চাইলেন না।বরং তার বিনিময়ে আমাকে ভুল বুঝে কতো উল্টো পাল্টা কথা শুনিয়ে চলে গেলেন।তুমি বিশ্বাস করো, আমি যেতে চেয়েছিলাম।উনি সেকথা কিছুতেই মানতে চাইছেন না।বিশ্বাসও করছেন না।আরও উল্টে আমার সম্পর্কে সবচেয়ে নিচু ধারনা করে বলে গেলেন,আমার প্রার্থনায় উনার দীর্ঘায়িত কামনা না করে মৃতু কামনা করবো!এটা উনি কিকরে বলতে পারলেন?কিকরে মুখে আনলেন উনি?

একাধারে কৌড়ির পিঠে আর মাথায় হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দিতে থাকলো মান্যতা।কৌড়ির কান্নার দমকে বেঁধে বেঁধে বলা কথাগুলো মন দিয়ে শুনলো।ফের মুখে মৃদু হাসি টেনে নরম গলাশ শুধালো।–দাদাভাইকে ভালোবেসে ফেলেছিস?

তড়িৎ মাথা নাড়ালো কৌড়ি।অর্থাৎ না।মান্যতা ফের শুধালো—তবে তার কথায় এতো কাঁদছিস কেনো?সে তার অনুভূতির আবেগ থেকে নাহয় শুনিয়েছে কথা।তোর মোটেও কান দেওয়া উচিত হয়নি।আর না এতো কান্নাকাটি করার প্রয়োজন আছে।

সব যেনো কেমন এলোমেলো মনে হলো কৌড়ির।নিজের আবেগ অনুভূতি ওই মানুষটার প্রতি আগ্রহী।তাই বলে কি তারপ্রতি ভালোবাসা জন্মেছে?কি জানি!তবে ওই মানুষটার প্রতি যে নিজের অগাধ মায়া।এটা অনুভব করে কৌড়ি।সেই মায়া থেকেই মান্যতার কথার উত্তর সরূপ বললো –আমি কিচ্ছু জানিনা।তবে উনার খারাপ আমি কখনো চাইনি আর চাইবোও-না কখনো।
সেখানে উনার মৃত্যু কামনা করবো আমি!উনি এটা কিছুতেই বলতে পারেনন না।রাগে হোক বা ক্ষোভে কথাগুলো বলে তিনি দোষ করেছেন। অন্যায় করেছেন।উনি সব দোষ আমার উপরে বর্তায়ে রাগ প্রকাশ করতেই পারেন।তাই বলে উল্টো পাল্টা যেকোনো কথা বলতে পারেন না।

হাসলো মান্যতা।ভালোবাসা জন্মায়নি নাকি!স্বীকার না করলেও কথার আচে ঠিকই বোঝা যাচ্ছে, চৈত্রের খরা নেমে মনে আষাঢ়ে শ্রাবণধারা নেমেছে মেয়েটার তার দাদাভাইয়ের জন্য।কৌড়ির পিঠে ফের হাত বোলাতে বোলাতে কোমল গলায় বললো।

‘আচ্ছা ঠিক আছে।দাদাভাইয়ের হয়ে মানলাম আমি।ভুল হয়ে গেছে।আর কাঁদিস না।মাইগ্রেনের ব্যথাটা আবার শুরু হয়ে যাবে।দু’দিন বাদ ফাইনাল পরিক্ষা।ব্যথা বাড়লে বুঝতে পারছিস,কি হবে?আর দাদাভাই রাগ করে উল্টো পাল্টা বলেছে,আবার ঠিক হয়ে যাবে।প্রিয় মানুষ বলতে,সে তাদের থেকে পাওয়া কষ্ট, ব্যথা মনে রাখেনা।রাখে-না বলতে ভুল।হয়তো ঠিকই মনে রাখে তবে তাদেরকে বুঝতে দেয় না।তোর সাথে রাগারাগি করেছে।বিশ্বাস কর আমি অখুশি হতে পারছি-না।দাদাভাই প্রিয়জনদের দেওয়া শত কষ্ট, শত ব্যথা সহ্য করতে সদা প্রস্তুত।তাকে এমনটা জেনে এসেছি,দেখেও এসেছি।,তবে বিপরীত মানুষটাকে সেই ব্যথা কষ্ট ফিরিয়ে দিতে কখনো প্রস্তুত হয়না।পছন্দ করে না সে।আমার দেখা,কষ্ট ব্যথা পেতে দেয়নি কখনো।আমার নজরে পড়েনি সেরকম কোনো ঘটনা।তবে তোর কাছে যখন নিজের ব্যথার,কষ্টের অনুভূতির কৈফিয়ত চাইছে।বহিঃপ্রকাশ করছে।তবে বিশ্বাস কর, সে অত্যন্ত তোকে ভালোবাসে।তোকে নিজের ভাবে।সম্পূর্ণ নিজের।যার প্রতি ও হকদার।নাহলে কখনো এরকমটা করতোনা।রাগ করে উল্টো পাল্টা বলেছে তাই কি,সে তোর কাছেই ফিরবে।

একটু থেমে ফের বললো–দাদাভাই রাগ করেছে কেনো সেটা তো বললিনা?

কান্না থেমে গেলেও এখনো বারবার চোখ মুছছে কৌড়ি।তারমানে নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে।হাত ডলে আবারও চোখ মুছে নিয়ে রয়েসয়ে বললো–আমি কেনো তাকে দেখতে যায়নি,সেই অভিযোগে অভিযুক্ত করে দুনিয়ায়র আজেবাজে কথা আমাকে শুনিয়ে গেছেন।

এবার শব্দ করে হাসলো মান্যতা।সেই হাসিতে লজ্জা পেলো কৌড়ি।মান্যতা বললো—তা তুই বলিসনি,তুই পরিস্থিতিতে পড়ে যেতে পারিসনি।এখানে তোর দোষ কোথায়?

‘সময় দিয়েছেন আমাকে বলতে?আর আমার কথা শোনার প্রয়োজন মনে করেননি উনি।শুধু নিজের মতো নিজেরটা বলে রাগ দেখিয়ে চলে গেলেন।

শব্দকরে দীর্ঘশ্বাস ফেললো মান্যতা। ফের বললো–যাই হোক খেয়াল তো আমারও ছিলোনা তুইও যে দাদাভাইকে দেখতে যেতে চাস বা তোরও দাদাভাইকে একবার হলেও দেখতে যাওয়া উচিত।এটা মাথায় ছিলো না।দাদাভাইয়ের এক্সিডেন্ট আবার হঠাৎ আমার পরিক্ষার প্রেশার পড়ে গেলো।সবমিলিয়ে কি এলোমেলো হয়ে ছিলাম,দেখলিইতো এইকয়দি।আমিও বা ঠিকঠাক এই চার-পাঁচটা দিনে কয়বার যেতে পেরেছি দাদাভাইকে দেখতে বলতো?প্রথমদিনতো ওই তাড়াহুড়োয় চলে গেলাম।তারপর তো বাড়ি থেকে দাদাভাইকে আর দেখতে যাওয়া হয়নি।পরিক্ষা পড়ে গেলো,পরিক্ষা দিয়ে আসার পথে সময় করে দেখা করে এসেছি,এই যা।বাড়ি থেকে উহ্য করে তো যাওয়া হয়নি।এজন্য তোর কথাও বিশেষ খেয়ালে ছিলো-না।স্যরিরে সোনা।তোর বকার অর্ধেক ভার আমি নিলাম।যদিও বকা তোর শোনা হয়ে গেছে।তবে এবার দাদাভাই উল্টো পাল্টা কিছু বললে বা রাগ দেখালে,আমি বুঝিয়ে বলে দেবো তোকে না বকতে।কেমন?আর কাঁদিস না।

মান্যতার কথার ছলে এবার কৌড়ির কান্না পুরোপুরি থেমে গেলো।হঠাৎই নিচ থেকে জোরে কিছু ভাঙার আওয়াজ আসতেই চমকে উঠলো দু’জনে। মান্যতার কোমর ছেড়ে, তার মুখের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ নজরে তাকালো সে।মান্যতাও কপাল কুঁচকে কৌড়ির মুখের দিক তাকিয়ে রইলো।ফের আবার জোরেশোরে কাচ ভাঙার শব্দ হতেই মান্যতার কোমর ফেরছে খামচে ধরলো কৌড়ি।মান্যতারও হুশ ফিরলো জেনো।মনেমনে কিছু ভাবলো,ফের কৌড়ির হাতটা চেপে ধরে চোখ বড়বড় করে বললো।

‘চল নিচে।আমার কেনো জানি মনেহচ্ছে নিশ্চিত এটা দাদাভাইয়ের কাজ।

আতঙ্কে কৌড়ির হরিনী চোখগুলোও আকার ছাড়ালো।
ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হলো।একটু আগে যা রাগ দেখিয়ে গেলো।আবার?তাকে আর কিছু ভাবার বা বলার সুযোগ না দিয়ে মান্যতা তার হাত খিঁচে টান দিয়ে নিচে দৌড় দিলো।অগ্যতা তাঁকেও দৌড়াতে হলো।

‘এই নিভান কি হয়েছে?

কথাটা জিজ্ঞেস করতেই,নিভানের দরজায় পা আঁটকে গেলো নীহারিকা বেগমেরম।পরিপাটি করে রাখা ঘরের অবস্থা দেখে আতঙ্কিত হলো চোখমুখ।সহসা ডান হাতটা মুখে চেপে ধরলেন।উনার পিছে আস্তে আস্তে এসে ভীড় করলো বাড়িতে থাকা সমস্ত মানুষ।ঘরের অবস্থা দেখে সবার মুখাবয়বের এক্সপ্রেশন একই রূপ ধারন করলো।সবার আতঙ্কিত মনে প্রশ্ন জাগলো।
ছেলেটা তো কখনো এতো রেগে যায়না?যায় না বললে ভুল,তবে বহিঃপ্রকাশ তো সহজে ঘটায় না।আর এতো বাজেরূপে তো কখনো ঘটায়না।তবে কি এমন হলো যে এতো রেগে গেলো?আর এই অসুস্থ অবস্থায় রেগেমেগে রুমের বেহাল দশা করে ফেলেছে! কি বাজে অবস্থা! একাকার অবস্থা করে ফেলেছে রুমের।দরজার পাশের বিশাল আকারের ফুলদানিতে ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ। তার খন্ডিত কোনো রূপ নেই।রুমের ওয়ালসেট আয়নাটারও বিশ্রী অবস্থা।ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে।অল্প একটু অবশিষ্ট কোনোমতে লেগে আছে ওয়ালে।সেই ভাঙা আয়নার সম্মুখে দাড়িয়ে আছে নিভান।তার ক্রোধিত মুখ আর বুঁজে থাকা নজর সেখানে দেখা মিলছে।হঠাৎ কি হলো ছেলেটার?আর এতো রেগেই বা গেলো কিসে বা কার উপর?নীহারিকা বেগম ভিতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই নিভান গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো।—ভিতরে এসো না মা।লেগে যাবে।
আমাকে একটু নিজের মতো থাকতে দাও।যাও।

ছেলের কথা শুনে কপাল কুঁচকে গেলো নীহারিকা বেগমের।তবে নিভানের কথা কর্ণপাত না করে ভিতরে
পা বাড়াতে গিয়েও,কোথায় পা ফেলবেন খুঁজে পেলেন না।থেমে গেলেন।প্রশ্নবিদ্ধ করলো নিভানকে।

‘ভিতরে আসবোনা কেনো?আর এই অসুস্থ অবস্থায় এসব কেনো নিভান?দুনিয়া গোল্লায় যাক,এতো হাইপার হলে নিজের কি অবস্থা হতে পারে জানা নেই তোর!তবুও এসব কি!কেনো?এতো রেগেও বা গিয়েছিস কি জন্য?আর আমাকে একা থাকতে দাও মানে?হয়েছে টা কি?কেনো এই অবস্থায়ও এতো হাইপার হচ্ছিস?

‘আমার যা হয়ে যায় যাক।প্লিজ মা,আপতত আমাকে একা থাকতে দাও।প্লিজ,ট্রায় টু আন্ডারস্ট্যান্ড।

জেদালো ভারী গম্ভীর কন্ঠস্বর আরও ভারী শোনালো।
অদ্ভুত দৃষ্টিতে নিভানের পানে চেয়ে রইলেন নীহারিকা বেগম।এরকম রাগ জেদ সহজে করেনা ছেলেটা।তবে যখন করে খুবই কঠিন হয়ে যায়।সামলানোও দ্বায় হয়ে পড়ে।কারও কথা শুনতে চায়না।নিজের রাগজেদে অনড় থাকে।কারও ভালোমন্দ কথায় টলতে চায় না।কাজই হয়না।ওর মতো ওকে ছেড়ে দিলে,মাথা যখন ঠান্ডা হয় নিজে থেকেই স্বাভাবিক হয়ে যায়।তবে হঠাৎ এতো রাগলো কি নিয়ে?প্রশ্নটা যেনো মনস্তাত্ত্বিকে ঘুরেফিরে বাড়ি খেতে লাগলো।উনার মতো দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যেকের মনে প্রশ্ন জাগলো।এতো রেগে গেলো ছেলেটা কি নিয়ে?কি হলো হঠাৎ ছেলেটার কেউ বুঝে উঠতে পারলো-না।তবে সদ্য দরজায় এসে দাঁড়ানো কৌড়ি আর মান্যতা ঠিকই বুঝতে পারলো,রুমের এই করুন দশা কিসের জন্য আর কার জন্য!রুমের দৃশ্য দেখেই মূহুর্তেই মুখে হাত চেপে ধরলো কৌড়ি।সেটা আর কেউ খেয়াল না করলেও দীবা খেয়াল করলো।মেয়েটার চোখমুখ লাল।বড়বড় চোখগুলোও ফুলোফুলো।কেঁদেছে কি?কিন্তু কেনো?
কৌড়ি ছাঁদ থেকে নেমে এলোনা?নিভান তো একটু আগে ছাঁদ থেকে নামলো।আর তারপর পরপরই তো এসব কান্ড।ড্রয়িংরুমে বসেছিলো সে।নিভানকে ছাদ থেকে নেমে নিজের রুমে ঢুকতে দেখেছে সে।তবে কি দু’জনের মধ্যে কিছু হয়েছে।ঝগড়াঝাঁটি বা কথা-কাটাকাটি!নাহলে?ভাবনা সেখানেই স্থির রেখে নিভানের পানে চাইলো দীবা।ছেলেটা সেভাবেই অনড় দাঁড়িয়ে আছে।নিভানের সিদ্ধান্ত টলানো এতো সহজ নয়!মনেহলো তার ধারনাই ঠিক।সংগোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো দীবা।ফের আস্তে আস্তে পা পিছিয়ে নিয়ে চলে গেলো।খালি জায়গায় উপস্থিত হলো ইভান।বাড়িতে ছিলোনা সে।রুমে ঢুকতে গিয়েই নিভানের রুমের সামনে জটলা দেখে চলে এলো।দরজার সামনে দাঁড়াতেই সবার মতো তার-ও একই অবস্থা হলো।মনে জাগলো একই প্রশ্ন।সন্দেহের দৃষ্টি ফেললো ফুপুমনির দিকে।তবে না তিনিও ঢ়েনো তার মতো অবাক নজরে হা হয়ে নিভানের রুমের পানে তাকিয়ে আছে।তবে ব্যাপারটা কি?দাদাভাই এতো রেগে গেলো কি নিয়ে?
নীহারিকা বেগম ফের ডাকলেন।

‘নিভান

নিভানের এতো সময়ের বুঁজে থাকা ক্ষোভিত মন মায়ের ডাকে শান্ত হলো ঠিকই তবে সহসা চোখ খুললো না সে।বিষাদে টলমলা হরিণী চোখগুলো আবারও দুনয়নে ভেসে উঠছে তার।নিজ স্বার্থে মেয়েটাকে কাঁদিয়েছে সে!
আর তার কারনেই বিষাদে ছেয়ে গেছে ওই মায়ময় দুনয়ন।উফফ,চোখগুলো বারংবার ভেসে উঠছে মানসপটে আর সবকিছু শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে। সব জায়গায় এতো এতো ধৈর্য সহ্যর পরিধি ঠিক রাখতে পারলেও,ওই মেয়েটার বেলায় কেনো রাখতে পারলো-না।না গিয়েছে তাকে দেখতে?সে তো বলেছিলো যেতে চেয়েছিলো,হয়তো পরিস্থিতিতে পড়ে যেতে পারিনি।সেটা বুঝে হোক বা অবুঝে,মন কেনো মেয়েটার বেলায় এতো ধৈর্য্যহীন,অবুঝ হয়ে পড়লো।কেনো?ওই মেয়েটা তারজন্য কেঁদেছে আর কাঁদছে-ও।
উফফ!

‘দাদুভাই।

ফাতেমা বেগম ডাকলেন।এবার চোখ খুলে ফেললো নিভান।সামনের দেয়ালেন ভাঙা আয়নার নজর পড়তেই মায়ের স্পষ্ট মুখ দেখতে পেলো,পাশে আরও একজনকে নজরে পড়লো তার।তবে পুরোপুরি নয়।তার কাঁধের ওড়নার অংশ।বুঝতে অসুবিধা হলো-না, ওটা কৌড়ি।মন আবারও কারণবশত জ্বলে উঠলো।একটু আগের বুঝদার মন আবার অবুঝপনার খেলায় মাতলো।কেনো,কৌড়ি তাকে গ্রাহ্য করবেনা।পরিস্থিতি যেমনই থাকুক,তার কাছে কেনো যাবে-না?যদি সে মরে যেতো তবে ওই মায়াময় মুখটা দেখার তৃষ্ণা তো তার রয়েই যেতো।এটাই অপরাধ ওর।ভাঙা আয়নার পানে দৃষ্টি অনড় রেখে গম্ভীর, ঠান্ডা গলায় বললো।

‘দাদুমা প্লিজ।আমাকে একটু একা থাকতে দিন।প্লিজ দাদুমা।

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বৃদ্ধা।নরম গলায় বললেন–
‘ঘরের এই অবস্থার মধ্যে তুমি চলবে ফিরবে কিকরে?

‘আমি একটু পরে রানীসাহেবা ডেকে গুছিয়ে নেবো।

গম্ভীর কন্ঠস্বর।ছেলের পেট থেকে কিছু বের করতে পারবেন না,বেশ বুঝলেন নীহারিকা বেগম।তবু্ও কেমন থমকে দাঁড়িয়ে রইলেন।ইভান এসে মায়ের পাশে দাড়ালো।ফের চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করলো,সে দেখছে।ফের ছোটো চাচিকে ইশারা করলো,মা’কে নিয়ে যেতে।স্বান্তনা রহমান ইশারা মেনে,নীহারিকা বেগমের হাত ধরে নিয়ে চলে গেলেন।উনাার পিছুপিছু চলে গেলেন ফাতেমা বেগম আর ডালিয়া বেগমও।যেতে যেতে অদ্ভুত দৃষ্টিতে কৌড়িকে দেখে যেতে ভুললেন-না।কৌড়িও যেনো দাড়িয়ে থাকার সাহস পেলোনা আর।চঞ্চলা পা সহসা বাড়িয়ে চলে গেলো।চোখ নোনাজল আসাটা যেনো দাঁতে দাত চেপে কোনো রকম রোধ করে রেখেছিলো এতোক্ষণ সে।মান্যতাও পিছু নিলো কৌড়ির।সবার যাওয়াটা স্বাভাবিক ঠিকলেও কৌড়ির যাওয়াটা কেমন অদ্ভুত ঠিকলো ইভানের।চোখমুখের হাবভাবও ভলো দেখালো-না।পায়ের চলনটা-ও কেমন এলোমেলো ছিলো।

পা বাঁচিয়ে বাচিয়ে নিভানের কাছে যেতে যেতে ইভান বললো–কি করেছো কি রুমের অবস্থা!তোমার থেকে এটা আশা করা যায়!আমি হলে, না কেউ প্রশ্ন করতে আসতো আর না বিস্মিত হতো।তুমি আর এসব!মানা যায়?তা কার উপর এতো রেগে রুমের এই বেহাল দশা করলে?

ইভানের মজার ছলে বলা কথাগুলো শুনেও শুনলোনা নিভান।ভিতরে ভিতরে নিজেকে ঠান্ডা করার প্রয়াস চালালো।কৌড়ির চঞ্চল পায়ে চলে যাওয়াটা সে দেখেছে।এবার মনেহলো,রাগটা মাত্রাধিক হয়ে গেছে তার!উফফ!

‘মেয়েটাকে আবার বকেছো নিশ্চয়?আর তার রাগ দেখাচ্ছো নিজের উপর,তাই না?

ইভানের কথার উত্তর দিলোনা নিভান।শুধু পূর্ন দৃষ্টিতে ইভানের মুখপানে তাকিয়ে রইলো।ইভান গিয়ে ধপাৎ করে শুশে পড়লো নিভানের বেডে।হাত ছড়িয়ে বেডে শরীর এলিয়ে দিলেও পা ঝুলছে বেডের নিচে।সেই অবস্থায় হঠাৎ গান ধরলো সে।

‘আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি,আমি তোমার দ্বিধায় পুড়ে যাই।
এমন দ্বিধার পৃথিবীতে আমি তোমাকে চেয়েছি পুরোটাই।
আমি তোমার স্বপ্নে বাঁচি, আমি তোমার স্বপ্নে পুড়ি যাই।
এমন সাধের পৃথিবীতে আমি তোমাকে চেয়েছি পুরোটাই।

ইভানের হঠাৎ গানের গলায় কপাল কুঁচকে তারদিকে অদ্ভুত দৃষ্টি ফেললো নিভান।তারপর গানের শব্দগুলো কেমন যেনো নিজের সাথে মিলিয়ে দেখলো।মন হলো, নিজের পরিচিতি। সব তার নিজের কথা,ভিতরের কথা।
সহসা কপালের ভাজ মিলিয়ে গেলো।পা বাড়িয়ে নিজে গিয়েও ধপাৎ করে শুয়ে পড়লো ইভানের পাশে।সহসা ইভান বললো।

‘আস্তে।ব্যথা পাবে তো।

ব্যথা পেলো,যন্ত্রণা অনুভব হলো শরীরে। তবে সে ব্যথা ভিতরের জ্বলন স্পর্শ করে মন ছুঁতে পারলো-না।সময় নিয়ে বললো।—আমি কি ওকে চেয়ে অন্যায় করে ফেলেছি ইভান?ওর আমার হতে অসুবিধা কোথায়?

‘কাওকে মন থেকে নিজের করে চাওয়াটা অন্যায় কি করে হয়!আর কৌড়ি।ও তো তোমারই।তুমি ভাবছো,ও তোমার হতে চাইছে না?তোমার প্রতি দূর্বল নয় ও,? দূর্বলতা নেই ওর?আমার লাইফের সবচেয়ে কঠিন অভিজ্ঞতা, মেয়েদের মন যেটা বলে মুখ তার বিপরীত শব্দ আওড়ায়।এটা ওদের চোখের দিকে তাকালে বুঝবে।মানুষের মনের সত্যি মিথ্যা কেনো জানি চোখে প্রকাশ পায়।ওইযে বলে-না মেয়েদের বুক ফেটে যাবে কিন্তু মনের কথা মুখে সহজে প্রকাশ করবেনা তারা।তবে এসব বলছো কেনো?সত্যিই কি তুমি কৌড়ি-কে বকেছো?

উত্তর দিলোনা নিভান।সময় নিয়ে ফের নিজের মতো বললো–আচ্ছা আমি যদি মরে যেতাম।ও কি একবারও দেখতে যেতো না আমাকে?

রাগ অভিমানের শুরু কোথা থেকে এবার বুঝি ইভান ধরতে পারলো।পাশ ফিরে একপলক পাশে শোয়া মানুষটাকে দেখে নিয়ে মৃদু হাসলো।প্রিয় মানুষটার এক্সিডেন্ট।বাড়ি,হসপিটাল।হসপিটালের বিভিন্ন ঝামেলা সামলাতে সামলাতে বিশেষভাবে কৌড়ির কথাটা মাথায় ছিলোনা।হসপিটালের মোটামুটি বাড়ির সবার যাওয়া আসা চললেও,কৌড়ির যে একবারও সেখানে পা পড়েনি।আর সেটা নিয়েই তবে তার দাদাভাই ক্ষেপেছে!রুমের এই ছেলেমানুষী লন্ডভন্ড তছনছ কাহিনী করে চলেছে।এই বুঝি তার আগের সেই দাদাভাই!কাওকে মন থেকে পাওয়ার তীব্রতা বুঝি ব্যাক্তিত্ববান মানুষটাকেও বুঝি ব্যাক্তিত্বহীন করে দেয়?
ছেলেমানুষী বানিয়ে দেয়?আশ্চর্য।এতো শক্তকঠিন ব্যাক্তিত্বপূর্ন দাদাভাইও, সেই চাওয়ার কাছে হার মেনে গেলো।

‘এতো অভিযোগ?এতো অভিমান?তুমি ওকে পেয়ে গেলে কলিজায় লুকিয়ে রাখবে দেখছি!

এবারও উত্তর দিলোনা নিভান।চোখ বুঁজে নিলো।বদ্ধ নয়নে ভেসে উঠলো,মায়া-মায়া সেই টলমলানো হরিনী নজর।গোলগাল ফর্সা লালাভ মুখ।তাকে কৈফিয়ত দেওয়ার জন্য বলতে যাওয়া কাঁপানো ঠোঁট।ওই বিষাদ নজর,লালাভ মুখ,কাঁপানো ঠোঁট।সব তার কথার ব্যথায় অস্বাভাবিক হয়েছে।কষ্ট দিয়েছে সে মেয়েটাকে!ভিতরের জ্বলনটা আবারও দপদপ করে উঠলো।তবুও নজর খুললো না। ইভান ফের বললো।

‘ও পরিস্থিতির স্বীকার। ওর উপর রাগ দেখিয়ে লাভ আছে?তুমি ওর পরিস্থিতিটা বুঝবেনা?বাড়ির সবাই তো আর আমার মতো জানেনা,ওই মেয়েটাতে তুমি কি অনুভব করো।সে তোমার কি!জানলে নিশ্চয় তোমার কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করতো।জানে-না বলে,ভেবেছে ওর হসপিটালে গিয়ে কাজ কি?আর ও-ও হয়তো কাওকে বলতে পারি-নি নিজের মনের কথা,তোমাকে দেখতে যেতে চায়।ওকে তো তুমি ভালো করেই চেনো এবং জানো।তবুও অভিযোগ কেনো?

কন্ঠ শান্ত অথচ স্বরে অভিমান ভরা।–ওর কাছে ফোন ছিল ইভান।আর সেই ফোনে আমার নাম্বারটাও ছিলো।যেটা আমি নিজ হাতে সেভ করে দিয়েছিলাম।ও আমাকে একটা ফোন দিতে পারতো না?পারতো না?

শান্ত গলায় কথাগুলো বললেও,কথার মধ্যে যেনো হাজার আকুলতা,অভিমানে টইটম্বুর।তবু-ও কৌড়ির হয়ে সাফাই গাইলো ইভান।

‘তুমিতো ওকে খুব ভালো করে এতোদিনে জেনে গেছো দাদাভাই।মেয়েটা কেমন স্বভাবের।আর জেনেবুঝে-ও অভিযোগ করবে?

‘জানিনা ওকে জেনেশুনেও কেনো ওর প্রতি অভিযোগ জন্মালো।ও বলেই হয়তো অভিযোগ।ও হসপিটালে যেতে পারিনি,ঠিক আছে।কিন্তু ,আমাকে তো একটাবার ফোন দিতে পারতো?আমার ভালোমন্দ জানার প্রয়োজন ছিলোনা।শুধু একটা বার ফোন দিতো।আমি ওর উপস্থিতি হোক বা ফোনকলের অপেক্ষায় ছিলাম ইভান।ও কেনো একটু বুঝলো না, আমার দূর্বলতা।আমার একটুখানি ওকে দেখার তীব্রতা!আমি যখন এক্সিডেন্ট করলাম,আমার মনে হচ্ছিলো।আমার বুঝি ওর কাছে আর কখনো ফেরা হবেনা।সেই তৃষ্ণা নিয়েই আমি মরতে মরতে বেঁচে গেলাম।তারপর বেঁচে গিয়েও, ও কি আমাকে একটু একটু করে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে-না?

‘হাম তেরি মোহাব্বতমে ইউ পাগল রেহতি-হে,
‘দিয়াওনাভি আব হামকো দিয়াওনা কেহতা-হে।

মজার ছলে দারুণ কন্ঠে গানের কলিজোড়া গেয়ে উঠলো ইভান।ফের ঠোঁটে চমৎকার হাসি ফুটিয়ে পাশ ফিরে তাকালো নিভানের পানে।নিভান তখনো চোখ বুঁজে। ইভানের গানের শব্দগুলো তাকো উল্লেখ্য করে গাওয়া বুঝতে অসুবিধা হলোনা।প্রতিক্রিয়া দেখালো না সে।সেভাবেই চুপচাপ চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলো।অনুভব করার চেষ্টা করলো,নিজের মধ্যে অন্য কারও অস্তিত্বকে।ইভান খেয়ালী নজরে বেশ কিছুক্ষণ নিভানকে পর্যবেক্ষণ করে চঞ্চলা গলায় বললো।

‘দু’দিন পর মেয়েটার পরিক্ষা।এমনিতেই প্রেশারে আছে।সারাদিন তাকে বইয়ের টেবিলে ছাড়া দেখা যায়না।আর আমার অতি ধৈর্য্যশীল,বুঝদার দাদাভাই,তার পাগলামী মেয়েটার উপর প্রয়োগ করে মেয়েটার প্রেশার দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে!মানা যায়?তুমি অবুঝপনা করেছো? সত্যি মানতে পারছিনা!

নিভান এবারও উত্তর দিলোনা। চুপচাপ সেভাবেই রইলো।ইভান-ও আর কথা বাড়ালো-না।সে-ও নিশ্চুপ হয়ে গেলো।সময় চললো।নীরবতায় ছেয়ে গেলো বিশাল বড়ো রুমটায়।চারপাশটা কেমন শুনশান নিস্তব্ধতা।বেশ সময় কেটে যাওয়ার পর ইভান উঠে বসলো।বসে থেকেও কিছুসময় ব্যয় করলো।ফের উঠে দাড়ালো।
কাঁচের টুকরো লক্ষ্য করে পা বাঁচিয়ে যেতেযেতে শিথিল গলায় বললো।

‘প্রানপাখি উড়াল দেওয়ার আগে নিজের অনুভূতির কাছে তাকে আঁটকে দাও।না-হলে আমার মতো ভুগতে হবে,পুড়তে হবে।জ্বলতে হবে!এই ভোগ,এই পোড়া,এই জ্বলন,খুব যন্ত্রণার দাদাভাই।শেষ করে দেবে তোমাকে।

চলে গেলো ইভান।হঠাৎ মাথায় যন্ত্রণা শুরু হলো নিভানের।এক্সিডেন্টে মাথায় আঘাতটা লেগেছে বেশি।তবে সেই ব্যথা জেগেছে,নাকি ইভানের কথায় নতুন ব্যথার সৃষ্টি হয়েছে?

পূর্ব আকাশে নতুন আরও একটিদিনের সূচনা দিয়ে সূর্য উদিত হোলো।কি অপরূপ তার ঝলমলে রূপ।তেমনই রূপের প্রশংসা পেয়েছে কৌড়িও।অথচ সেই ঝলমলে রূপে যেনো আজ ঘোর আমাবস্যা নেমেছে।ডায়নিং টেবিলে চুপচাপ খাচ্ছে সে।খাচ্ছে কম,হাত দিয়ে খাবার ঘাটছে বেশি।কাল বিকালের ওই ঘটনার পর না ঠিকঠাক মতো গলা দিয়ে খাবার নামাতে পেরেছে আর না বইয়ে মনোযোগ দিতে পেরেছে আর-না দু’চোখে ঘুম নেমেছে তার।ওই চুপচাপ শান্তশিষ্ট মানুষটা শুধু তারজন্য এতো পাগলামি করলো!এতো রেগে গেলো!
কাল যেনো কৌড়ির মনকে ধরেবেধে রোধ করে রাখার সব সীমা ছাড়িয়ে ফেললো।ভাবনায় বিভোর কৌড়ি হঠাৎ সুপরিচিত সুগন্ধে মুখ উচু করে তাকলো।হুম,সেই মানুষটাই।আজ আর কৌড়ির নজর নামলোনা।অনিমেষ চেয়ে রইলো,কপালে সাদা ব্যান্ডেজ জড়ানো শ্যামবর্ণ মুখে।নিভান এসে আশেপাশে না তাকিয়ে চেয়ার টেনে বসলো।শান্ত গলায় ডাক দিলো রানিকে।

‘রানিসাহেবা,আমাকে কফি দিন।

রানির বদৌলে তড়িৎ রানাঘর থেকে বের হয়ে এলো স্বান্তনা রহমান।ব্যস্ত গলায় বললেন—তুই কেনো অসুস্থ শরীর নিয়ে নিচে নেমে এলি।ভাবী,তোর খাবার রেডি করে রেখেছেন।ভাইয়ের খাবারটা দিয়ে এসেই,তবে তোর খাবারটা নিয়ে উপরে যাবেন।তার আগেই চলে এলি?

‘সমস্যা নেই,শরীর ঠিক আছে আমার ছোটোমা।খাবার দিতে হবে-না।এককাপ কফি বা চা হলেই আপতত চলছে।

কন্ঠে কোমলতা মিশিয়ে স্বান্তনা রহমান বললেন–অসুস্থ শরীরে খাবার না খেয়ে এখন চা, কফি খাবি?খাবারটা এখন খুব প্রয়োজন। খাবারটা খেয়ে তারপর না-হয় চা,কফি খা।

নিভানও খুব স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিলো।—খাবার খেতে এখন ইচ্ছে করছেনা ছোটোমা।

‘ঔষধ আছে তো।নরমাল নয় সব হাই-পাওয়ারের।না খেলে চলবে!

‘ খাবারটা পরে না-হয় খাচ্ছি।আপতত আমাকে এককাপ কফি দিন।

স্বান্তনা রহমান আর কিছু বললেন-না।চলে গেলেন।যেতে গিয়ে কিছু একটা খেয়াল করে পিছু মুড়ে কৌড়ির পানে তাকালেন তিনি।অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করলেন।কৌড়ি ঘনোঘনো নজর উঠিয়ে নিভানকে দেখছে।অথচ নিভানের নিরেট দৃষ্টি,তার হাতে থাকা ফোনে।অদ্ভুত!বেশ কয়েকদিন এই বিষয়টা নিভানকে খেয়াল করেছেন তিনি।তখন কৌড়িকে দেখেছে উল্টো।আজ দু’জন দুজনের বিপরীত।ব্যাপার টা কি? চলছেটা কি এদের মধ্যে?মনে প্রশ্ন নিয়ে চলে গেলেন।তিনি রান্নাঘরে ঢুকে দেখলেন,রানী কফির জন্য দুধ অলরেডি বসিয়ে দিয়েছে।এরপর তিনি নিজ হাতে কফি বানালেন।কফি বানানো শেষ হতেই,নিভানের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা মগটায় ঢেলে ট্রে-তে গুছিয়ে দিলেন।রানী সেটা হাতে নেওয়ার আগেই কিছু একটা ভেবে তাকে থামিয়ে দিলেন।রানী প্রশ্নবোধক নজরে তাকাতেই তিনি চোখ দিয়ে ইশারা করে বললেন পরে বলছেন।ফের কৌড়িকে গলা চড়িয়ে ডাক দিলেন।

‘এই কৌড়ি,নিভানের কফিটা একটু নিয়ে যা তো।

খাওয়া থেমে গেলো কৌড়ির।নিভানের পানে আবারও আড়চোখে চাইলো সে।আজ ভুলেও মানুষটা তারদিকে একবারও তাকায়নি।অথচওই মানুষটার দ্বিধাহীন নজর তাকে ঘিরে থাকে।অমাবস্যার ঘোর অমানিশি বুঝি এবার মনের চারধারে ছেয়ে গেলো।স্বান্তনা রহমানের ডাকে উঠার জন্য প্রস্তুতি নিতেই,নিভান ভরাট গলায় বললো।

‘ছোটোমা,কফিটা রানিসাহেবাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিন।তাকে খাবার ছেড়ে উঠতে হবেনা।

খুব স্বাভাবিক গলায় কথাটা বললো নিভান।অথচ কৌড়ির কানে সেটা অস্বাভাবিক লাগলো।আর তার চেয়ে অস্বাভাবিক লাগলো, সামনে বসা মানুষটার আচারণ।পলকহীন চোখে নিভানের দিকে চেয়ে রইলো কৌড়ি।অথচ মানুষটার খেয়াল ধ্যান হাতের ফোনেই।ধ্যানতো আর দিকে থাক এটাতো চায়নি কৌড়ি।তবে কেনো মন কাঁদছে।স্বান্তনা রহমান কি বুঝলেন, রানীকে দিয়ে কফি পাঠিয়ে দিলেন।রানী এসে কফি দিয়ে গেলো।সেটা তুলে মুখে নিলো নিভান।অদ্ভুত শান্ত নজরে মাথা নিচুকরে,হাত দিয়ে খাবার ঘেঁটে যাওয়া কৌড়িকে খুব কৌশলে একবার দেখে নিলো।সুক্ষ হাসলো ফের সে হাসি মূহুর্তেই ঠোঁটের ভাঁজে মিলিয়ে নিয়ে মনেমনে আওড়ালো।

‘শাস্তি পাচ্ছো তুমি।একটু সময় দাও আমাকে,অপেক্ষা করো।এই শাস্তির বিনিময়ে নিভান তোমাকে তার নিজের এতো কাছে আনবে,তুমি নিজেই আর দুরত্ব চাইবে-না।তখন এই শাস্তির বদৌলে নিভান তোমাকে এক সমগ্র পৃথিবী সুখ দেবে।অজস্র ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখবে,নিভানের প্রানপাখি।

চলবে…

#ফুলকৌড়ি
(৩৭)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

গাঢ় শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর।চারপাশটা ঠান্ডায় যবুথবু অবস্থা।ক্ষনে ক্ষনে যেনো হাত-পা বরফ হয়ে আসছে।সেই হীম-পড়া শীতের ভোরে বাড়ি থেকে রেডি হয়ে বের হচ্ছে কৌড়ি।শিক্ষাজীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা অধ্যায়।আজ থেকে তার ইন্টারমিডিয়েট পরিক্ষা শুরু।এবাাড়ি থেকেই নিজ গ্রামে গিয়েই পরিক্ষা দিতে হবে তাকে।আর যাওয়ার উদ্দেশ্যে এই শীতের হিমশীতল সকালে তাকে রওনা হতে হচ্ছে।অথচ বাড়িতে থাকলে সবকিছু কতো সহজ হতো তার।নিরাপদ জার্নি হতো।সময়-মতো সুন্দর সুস্থ মস্তিষ্কে গুছিয়ে প্রস্তুতি নিয়ে পরিক্ষা দিতে যেতে পারতো।না টেনশন থাকতো,এতো জার্নি করে ঠিকমতো সময় কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারবে কি-না?আর না মানসিকভাবে তাকে এতোটা এলোমেলো থাকতে হতো!আফসোস নিজের বাড়ি-ঘর সব থাকতেও কতোদূর থেকে জার্নি করে তাকে পরিক্ষা দিতে হচ্ছে।
আবার মাথার মধ্যে চতুর্দিকের ভাবনায় ছড়ানো-ছিটানো।তন্মধ্যে সব ভাবনার মুল হয়ে দাঁড়িয়েছে,সেই মানুষটাকে নিয়ে।

‘খেয়ে গেলিনা!তবে আমি ইভানকে বলে দিয়েছি,একটু বেলা হলেই যেনো তোর খাবারের ব্যবস্থা করে দেয়।

কথাটা বলে তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন।—আমি খাবার দিয়ে দেবো?নিবি?

নীহারিকা বেগমের কথায় ভাবনা কাটলো কৌড়ির।স্মিথ হাসলো।অমায়িক স্বভাবের অসম্ভব অদ্ভুত ভালো এই নারীটা এই তিনমাসের মধ্যে কতো আপন হয়ে গেছে।আপন হয়ে গেছে কোথায়,তাকে আপন করে নিয়েছে মানুষটা।কেমন নিজ সন্তানের মতো আপন।নীহারিকা বেগমের গলা জড়িয়ে ধরলো কৌড়ি।ফের বিগলিত বিনয়ী গলায় বললো।

‘এতো সকালে খাওয়া যায়,নাকি খেতে ভালো লাগে?আর পরিক্ষার টেনশনে আমার মাথাসহ পেটটাও ভরা।একটুও খেতে ইচ্ছে করছেনা বড়মা।তাই খাবার দিয়ে নষ্ট করো না।আমার ক্ষুধা লাগলে আমি অবশ্যই ইভান ভাইয়াকে বলে কিছু একটা কিনে খেয়ে নেবো।তাই অযথা টেনশন নিওনা তুমি।আর খাবারও দেয়া লাগবে না।তুমি শুধু দোয়া করো,আমার পরিক্ষাটা ভালো হয় যেনো।

‘অযথা টেনশন?তোরা সন্তানেরা যে কবে বুঝবি বাবা মায়েদের এই অযথা টেনশন ঠিক কি?যাই হোক, নিজেরা মা বাবা হ তারপর ঠিকই বুঝবি মা বাবাদের এই অযথা টেনশন ঠিক কি?আর ইভানকে বলে বাহিরে খেয়ে নিবি কতো,সে তো আমি জানি!তোকে চিনিনা বুঝি!তবে বেলা হলে আমি ফোন দিয়ে ইভানকে খাবার কিনে দেওয়ার জন্য বলে দেবো।এবার বের হ,দেরী হয়ে যাবে।রাস্তাঘাটে কতো জ্যাম থাকে।যতো সকাল সকাল বের হবি ততোই ভালো।

ফের নিজের থেকে কৌড়িকে ছাড়িয়ে,মমতার নজরে তারদিকে তাকালেন তিনি।আঙুল ছুয়ে দিলেন কৌড়ির গালে ফের মায়ামায়া আদূরে গলায় বললেন।–আর দোয়া।সে তো আমার পেটের সন্তান,আমার পিঠের সন্তান, আমার আগলে রাখা সন্তান,আমার নিয়ন্ত্রাধীন সকল সন্তানদের জন্য সর্বসময়ে তাদের ভালোটা আমার মনস্তাত্ত্বিকে জপতে থাকে।আমার দোয়ায় সবসময় আমার বাচ্চারা ভালো থাকুকু,ভালো রাখুক ওদের প্রভু,মঙ্গল হোক, এই কামনায় থাকে।আর মায়ের দোয়া প্রভু সহজে বিফলে ফেলেননা,তোর পরিক্ষাও আল্লাহর রহমতে ভালো হবে।একদম টেনশন নিবিনা,কেমন?

বিমোহিত নজরে এতোসময় সামনের নারীটাকে দেখছিল কৌড়ি।এতো ভোরে,এই ঠান্ডায় কেউ এখনো উঠেনি।উঠেনি বলতে ভুল,উঠেছিলো।নামাজী ব্যাক্তিগন উঠে নামাজ পড়ে নিয়ে আবার শুয়েছে।শোয়ারই তো কথা।এতো সকালে এতো ঠান্ডায় কেউ কি আর নিজেদের আরাম বাদ দিয়ে জেগে বসে থাকবে।থাকার কথা নয়!অথচ এই মমতাময়ী নারীটা উঠে তার সবকিছু গুছিয়ে রেডি করে দিলো।খাবার না খেলেও,চা নাস্তা না খাইয়ে ছাড়িনি।কি অদ্ভুত সম্পর্ক।নেই রক্তের টান,নেই আত্মীয়তার কোনো সম্পর্ক।অথচ দূরের একটা সূত্র ধরে কতো মায়াময় এই সম্পর্ক।যেনো রক্ত নয়,আত্মীয়তাী নয় আত্মার সম্পর্ক।আত্মার টান।আর সেই আত্মার টানেই বুঝি বাধতে চেয়েছিলো,ওই মানুষটা তাকে।অথচ!হঠাৎই মন খারাপ হলো কৌড়ির। ড্রয়িংরুমে জ্বলতে থাকা বড় ঝকঝকা লাইটের আলোয় চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে আসলো,আশপাশ দিয়ে উপরনিচ সব জায়গায়।শূন্য!কেথাও কোনো মানুষের অস্তিত্ব নেই।আবারও উপরের দোতলার কাঙ্ক্ষিত রুমটার দিকে নজর দিলো কৌড়ি।নিঃশব্দ রুম।মনটা আরও বেজায় খারাপ হলো কৌড়ির।আজ চারটাদিন!
মানুষটা যে নীরব আচারন করছে তারসাথে,সেটা কি কখনো মানুষটার থেকে আশা করেছিলো সে।নাকি চেয়েছিলো তার মন?এই যে সে পরিক্ষা দেবে,সবাই তাকে কতো সাহস যোগাচ্ছে,কতো ভালোমন্দ কথা বলছে অথচ ওই মানুষটা তার ব্যাপারে কি নির্বিকার।সেই আগের মতো নির্জীব।বাড়িতে আছে।দু’বেলা তারসাথে দেখা হচ্ছে, অথচ না আগের মতো কথা বলার আগ্রহ দেখাচ্ছে!আর না তাকে দেখলে সেই দ্বিধাহীন নজরে তাকিয়ে থাকছে, আর না শুধুই তাকে খেয়াল করে মুগ্ধ নজরে দেখছে!যদিও এসব চায়নি চায়নি কৌড়ি।তবে তারপ্রতি অনাগ্রহী হোক এটাও তো মন চায়নি তার। এই অনাগ্রহতা সহ্য হচ্ছে না তার।মন পুড়ছে। ভালো লাগছে কিছু।সবকিছু যেনো বিষাদময় লাগছে।

‘কি হলো।যেতে হবে তো।থমকে দাঁড়িয়ে রইলি যে?

চমকাল কৌড়ি।মূহুর্তেই আবার নিজেকে সামলিয়ে নিলো।ভিতরে ভিতর দীর্ঘশ্বাস ফেলে জোরপূর্বক মুখে মৃদু হাসি টেনে বললো-কাওকে তো বলে যেতে পারলাম না।খারাপ লাগছে।

‘সবাই তো ঘুমে।এখন তুই নিশ্চয় এটা চাইছিস না,এই ঠান্ডায় সবাইকে ডেকে তুলে বলে যেতে।

কৌড়ি তড়িৎ মাথা নাড়ালো।ফের মুখে বললোো–না। কখনো না।

‘তবে ভেবেচিন্তে লাভ আছে?আর না মন খারাপ করে লাভ আছে?মন খারাপ করিসনা,সবাই ঘুমথেকে উঠলে দেখবি তোরসাথে যোগাযোগ করে নিয়েছে।তখন দোয়া চেয়ে নিস।

ভিতরে ভিতরে আবারও দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো কৌড়ি।মুখের মৃদু হাসিটা একটু প্রসারিত করে বললো–আচ্ছা। তবে যাই।

তড়িৎ কথা ধরলেন নীহারিকা বেগম।মিষ্টি ধমক দিয়ে বললেন–যাই কি!যাই বলতে নেই।বল আসি।আর খবরদার পরিক্ষা দিতে যাচ্ছো ভালো কথা,ওবাড়িতে থাকার চিন্তাভাবনা করবেনা কিন্তু একদম।দাদীআপা বলেছে,পরিক্ষার কেন্দ্রে এসে দেখা করে যাবেন।সেখান থেকেই দেখা করে কিন্তু চলে আসবে।বাড়িতে গিয়ে থাকার চিন্তা ভাবনা করবেনা একদম!ঠিক আছে?

সহসা কৌড়ি উত্তর দিতে পারলে।আজ কতোদিন বাদে সে নিজের শহরে পা দিচ্ছে!কতো পরিচিত অপরিচিত মানুষের সাথে দেখা হবে।নিজের শহরের রাস্তাঘাটা গাছপালা,আকাশ!আপন বাতাস!উফফ,কতোগুলো দিন পর দেখবে সে।ভাবনা মূহুর্তেই অন্যদিকে চলে গেলো তার।নীহারিকা বেগমকে বিদায় জানিয়ে লন এরিয়াতে গিয়ে দেখলো,শীতের ভারী জ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে ইভান গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে হাতে হাত ঘেঁষে চলেছে।মূহুর্তেই মনটা আবার-ও খারাপ হয়ে গেলো।বিচিত্র মন,অদ্ভুত এক আশা করেছিলো।তা বুঝি আশাতেই রয়ে গেলো।দোষ আর আশার কোথায়!দোষটা তো তার নিজের।পথটা তো সেইই এলোমেলো করে দিয়েছে।তবে আকাঙ্ক্ষিত মন কেনো আবার উল্টো পাল্টা চাইবে?আশা করবে?তবে পাগল মনটা সেটা বুঝলে তো।অবুঝ মনটা তো বলছে ওই মানুষটা তাকে কিছুতেই অবজ্ঞা করতে পারে না!কেনো জানি মানুষটার আচারনে,অদ্ভুত পাগলামোতে এই বিশ্বাসটা দৃঢ়রূপে মনে জন্মে গেছে তার।সেই মনোবলে কিছু একটা ভেবে আবারও পিছে ফিরলো সে।কুয়াশায় ঘিরে থাকা দোতলা বাড়িটা নিস্তব্ধ।দোতলার লন এরিয়ার দিকের বেলকনিগুলোও কেমন শূন্য, নিস্তব্ধ,নীরব।ঘুরেফিরে আরও একবার সেই কাঙ্ক্ষিত খোলা,স্তব্ধ বেলকনির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে এগোলো কৌড়ি।মূহুর্তেই বেলকনিতে পা রাখলো নিভান।এলোমেলো চুল।ফুলোফুলো চোখ।ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে চেয়ে রইলো কৌড়ির গমন পথে।মেয়েটার গায়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়ানো সেই শালটা।মুখের হাসিটা যেনো আরও একটু প্রসারিত হলো নিভানের।দু-হাত ট্রাউজারের দুপকেটে গুঁজে বেশ নির্বিকার শান্ত নজরে কৌড়ির গাড়িতে উঠা দেখলো।ফের চমৎকার মৃদু হাসিটা ঠোঁটটা ছেয়ে,মৃদুস্বরে আওড়ালো।

‘বেস্ট অপ লাক,মাই ডিয়ার।

শব্দটা মুখ আওড়ে কিছু সময় নিশ্চুপ থাকলো।নজর স্হির রাখলো এরিয়ার কালো গাড়িটার খোলা জানালায়পানে।সুগভীর নজর খুব সুক্ষ ভাবে তাকে পর্যবেক্ষণ করে ঠোঁট মৃদুস্বরে আওড়ালো।–কষ্ট পাচ্ছো!আমার চেয়েও বেশি কি!ভাবছো, নিভান রাগে জেদে পড়ে তোমাকে আর চাইছে না বা চাইবে না সে?তোমার প্রতি সে আর আগ্রহ পাচ্ছে না?যদি এই ভাবনা মনে পুষে থাকো,তবে খুব ভুল ভাবছো।তুমি জানো-না! তোমাকে পাওয়ার আগ্রহ, ইচ্ছে নিভান ইহকালে-ও ছাড়বে না।ছাড়া সম্ভব নয় নিভানের।বরং তোমাকে পাওয়ার আগ্রটা নিভানের বেড়েছে।দিনকে দিন সেই বেড়ে চলা আগ্রহের তীব্রতা নেশাদ্রব্যের মতো শুধুই হ্রাস পেয়ে চলেছে।আর তোমাকে চাইছেনা বা চাইবে না নিভান!তবে নিভানের আগামী বেঁচে থাকার দিনগুলো চলবে কি করে?তুমি জানো কি!নিভান তোমাকে চাইছে,তার প্রতি নিঃশব্দের নিঃশ্বাসে।শুধু তোমাকেই তার করে পাবার জন্য চেয়ে চলেছে সে।এন্ড ডু ইউ বিলিভ মি, নিভান তোমাকে বিন্দু পরিমান কষ্ট পেতে দিতে চায়নি।

নিভানের শান্ত নজরটা এখনো লন এরিয়ার কালো রঙের গাড়িটার খোলা জানালায়।ফ্রন্ট সিটে চুপচাপ বসে আছে কৌড়ি।ইভান যেনো কিছু গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত।গাড়ির ভিতরে ঢোকেনি এখনো সে।কানে ফোন, সঙ্গে কারও সাথে ফোনালাপ চলছে তার।কিছু একটা মনে পড়তেই নড়েচড়ে দাড়ালো।ঘরে ফিরবে ভেবে ফের কাঙ্ক্ষিত জায়গায় নজর দিলো আবারও।ভুলেও এদিকওদিক তাকাচ্ছে না কৌড়ি।মাথা নিচুকরে হাতের দিকে তাকিয়ে বসে আছে মনেহচ্ছে। মন খুব খারাপ তাহার তবে!কারণটা সে আচ্ করতে পেরে আবার-ও অদ্ভুত হাসিতে ছেয়ে গেলো নিভানের ঠোঁট।স্পষ্ট স্বরে গান না গাইলেও গুনগুনিয়ে সুর তুললো।

Ishq bhi tu hai pyar bhi tu hai
Tu hi meri mohabbat hai
Saans mein teri saans mein le loon
Teri agar ijazat hai

গুনগুনানোর সুরটা বাড়িয়ে পা বাড়ালো রুম।বেডের পাশের ল্যাম্পটেবিল থেকে ফোনটা নিয়ে ধপ করে আধশোয়া হয়ে পড়লো বেডে।ফের ইভানের হোয়াটসঅ্যাপ আইডিতে ঢুকলো।সেকেন্ডের মধ্যে দক্ষ হাতে টাইপ করলো।

‘সাবধানে নিয়ে যাবি।

সেন্ড করতেই সঙ্গে সঙ্গে দুটো টিকচিহ্নে গোলাকর ঘরটা পূর্ন হয়ে গেলো।তারমানে ইভানের ফোনে কথা বলা শেষ।মূহুর্তেই রিপ্লাই এলো।

‘যথা আজ্ঞা বড়ো সাহেব।তোমার মতো দক্ষ ড্রাইভার নই,তবে আমি জানি, আমি আমার দাদাভাইয়ের জান, কলিজা,প্রানপাখি সাথে করে নিয়ে যাচ্ছি।আর তাকে কিভাবে নিয়ে যেতে হবে,রাখতে হবে।সেটাও খুব ভালো করে জানি।সো,আমার প্রতি বিশ্বাস ভরসা রাখতেই পারো।

ঠোঁটের মৃদু হাসিটা বিস্তৃত হলো নিভানের।মেসেজে লেখা শব্দগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো কিয়ৎক্ষন।ফের পুনরায় মেসেজ আসতেই সেদিকে নজর দিলো– আমার জায়গায়,তোমার যেতে ইচ্ছে করছেনা?

সুগভীর শান্ত চোখ দুটো মেসেজের শব্দগুলোয় আঁটকে রইলো।ফের সময় নিয়ে উত্তর দিলো।–অমূল্য কিছু পেতে গেলে কিছু ইচ্ছেদের বিসর্জন দিতে হয়।মনের ছোটো ছোটো চাওয়া পাওয়া ছাড়তে ইচ্ছে না করলেও ছাড়তে হয়।তাতে মঙ্গলজনক কিছু পাওয়ার সম্ভবনা থাকে।

মেসেজ দেখে চমৎকার হাসলো ইভান।ফের মজার ছলে রিপ্লাই দিলো।–‘তোমার মনে হয়না,তুমি রোমিও টাইপ প্রেমিক হয়ে গেছো?

মেসেজ দেখলো নিভান।তবে মেসেজের উত্তর না দিয়ে লিখলো।–দেরী হয়ে যাচ্ছে।গাড়ী ছাড়।আর সাবধান, খুব সতর্কতার সহিত গাড়ি চালাবি।আর কোনো সমস্যা হলে সেকেন্ড সময় অপব্যয় করবিনা,আমাকে জানাবি।

ফোনের সময়ের দিকে তাকালো ইভান।ভাবলো আসলে আর সময় ব্যয় করা উচিত হবেনা।নিভানকে বিদায় জানিয়ে ফোন রেখে উচ্ছল মুখে একবার কৌড়ির দিকে তাকলাো।মেয়েটা চুপচাপ,শান্ত হয়ে বসে আছে।নজর তার ভোরের কুয়াশাচ্ছন্ন বাগানের দিকে।

‘কি মন খারাপ?

একটু চমকে ইভানের পানে তাকালো কৌড়ি। সময় নিয়ে মুখে জোরপূর্বক মৃদু হাসি টেনে সহসা মাথা নাড়ালো।মুখে কিছু বললোনা।মৃদু হাসলো ইভান।ফের বললো—তবে আমার জায়গায় দাদাভাইকে আশা করোনি,বলছো?

ধ্বক করে বুকের ভিতরে ধাক্কা দিয়ে উঠলো।সেই ধাক্কার ঢেউয়ে নোনাজ্বল এসে ভীড় করতে চাইলো চোখে।তবে তা সফল হতে দিলোনা কৌড়ি।কারনে হোক বা অকারনে এরকম ছিচকাদুনি মেয়ে তো সে কখনোই ছিলো-না।তবে ইদানীং কথায় কথায় কেনো মন খারাপ হয়!আর তার রেশ কাটাতেই চোখে নোনাজল ভরে যায়।কেনো?শান্ত নজর এলোমেলো হলো কৌড়ির।নিজেকে যতসম্ভব ঠিক রাখার প্রয়াস চালিয়ে বললো।

‘আপনার যেতে ইচ্ছে না করলে,হাফিজ ভাইকে পৌঁছে দিতে বলতেন।আমার কিন্তু উনার সাথে যেতে কোনো অসুবিধা হতো না।উনিও কিন্তু নিজের বোনের মতো যথেষ্ট খেয়াল রাখেন আমার।

আসলে মেয়েরা অদ্ভুত হয়,মনে এক কথা আর মুখে তাদের আরেক কথা।অথচ অভিমানী চোখ,গলার স্বর বলে দেয় ভিতরের কথা।অন্তরের জপে চলা কথা।কৌড়ির কথার উত্তরসরূপ ভিন্নবাক্য ছুড়লো ইভান।বললো।-‘দাদাভাই কে তুমি একবার বললে সে কিন্তু এই অসুস্থ অবস্থায়ও তোমাকে নিয়ে যেতে দ্বিতীয়বার ভাবতো না।

অভিমানের প্রগাঢ়তায় ছেয়ে গেলো মন।জপে উঠলো সে,’বলতে হবে কেনো।তিনি এতো বুঝদার,আর তার বেলায় এসে অবুঝ হয়ে গেলেন!অবুঝপনা শুধু তার বেলায় কেনো? মনেমনে যে অভিমান জমলো,সেই অভিমান কথার স্বরেও ছড়ালো সে।বাহিরের পানে নজর স্থির রেখে বললো।

‘দেরী হয়ে যাচ্ছে ইভান ভাইয়া।গাড়ী ছাড়ুন।

সংগোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়ী ছাড়লো ইভান।মেয়ে মানুষ বলতে তার সৃষ্টির জটিল জীব মনেহয়।তাদের মন বোঝা যে কতো কঠিন, এটা ইভান হাড়হাড়ে টের পেয়েছে।তন্ময়ীকে পেতে তার যা বেগ পোহাতে হয়েছে।
তারচেয়ে সাত রাজার ধন জয় করা সহজ মনে হয়েছে।আর এবার বুঝি দাদাভাইয়ের পালা।

নিজের অফিস কক্ষে বসে আছে নিভান।ফর্মাল ড্রেসআপে থাকলেও মাথায় এখনো সাদা গোলাকার সেই পট্টি জড়ানো।এই অসুস্থ অবস্থায়ও তাকে ইমার্জেন্সি অফিসে আসতে হয়েছে।সেটা নিয়ে মা- কতো হম্বিতম্বি করলেন।অফিস গোল্লায় যায় যাক।তুই এই অবস্থায় কিছুতেই বাড়ি থেকে বের হতে পারবিনা। সম্পূর্ণ সুস্থ হবি তারপর বাড়ির বাহিরে আর অফিস!এরআগে কোনো কিছু নয়।আর অফিস-টফিস তো নয়ই।আরও কতো কি?বাড়ির মোটামুটি সবাই তাতে ইন্ধন জোগালো।বাধ্য হয়ে না পেরে ছোটো চাচ্চু ক্লায়েন্টের সাথে কথা বললেন।যাদের জন্য নিভানকে অফিস যেতে হবে।অনেক বুঝিয়ে কথা বলেও কাজ হলো-না।তারা নিভান ছাড়া ডিল মানতে রাজী নয়।
বিধায় মা’কে বুঝিয়ে শুনিয়ে বাধ্য হয়ে তারপর তাকে অফিসে আসতে হয়েছে।ক্লায়েন্টদের সাথে মিটিং শুরু হবে একটু পরে।অফিসে এসে নিজকক্ষে বসে নিজের পি-এ মৃদুল এবং শাহেদ সাহেবের সাথে,অফিস বিষয়ক কথা বললো কিছুক্ষণ। তারপর তারা নিজ দায়িত্বে চলে যেতেই মূহুর্তেই মাথায় এলো কৌড়ি।যদিও সারাদিন মেয়েটাই ঘুরেফিরে চলেছে তার মাথায়।বিশেষ চিন্তা মেয়েটা বাড়ি ফিরবে কখন?মেয়েটা পরিক্ষার হলে ঢোকার পর আরও দু’বার খোজ নিয়েছে নিভান।সাড়ে বারোটার পর থেকে আর খোজ নেওয়া হয়নি।এখন কয়টা বাজে?মূহুর্তেই হাতের ঘড়িটার দিকে তাকালো নিভান।প্রায় চারটা।এতোসময় বাড়িতে আসার অর্ধেক পথ মনেহয় চলে এসেছে।একটা খোঁজ নেওয়া দরকার! তখন বাড়ির ঝামেলা মিটিয়ে অফিসে এসে কথা বলতে বলতে কখন এতো বেজে গেলো খেয়াল হয়নি নিভানের।উফফ!তড়িৎ ফোনটা পকেট থেকে বের করলো।ইভান গাড়ী চালাচ্ছে ভেবে ফোনটা দেবে কি-না দ্বিধাদ্বন্দ্ব করেও ফোনটা দিলো।একবার কলে ফোনটা ধরলো না ইভান।বিষয়টা সাধারণ ভাবে নিলো নিভান।দ্বিতীয়বার ফোন দিতেই রয়েসয়ে ফোন ধরলো ইভান।

‘কোথায় তোরা?বাড়িতে পৌঁছাতে আর কতক্ষণ লাগবে?

কথাগুলো বলতে বলতে নিভানের মনে কেমন খটকা তৈরী হলো।রাস্তায় থাকলে তো,যানবাহনের শব্দ হবে।তবে ইভানের আশেপাশে এতো শুনশান কেনো?এতো নীরব।নিভানের কথায় হঠাৎই উত্তর দিতে পারলো-না ইভান।আমতাআমতা করে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো-না।সেটা বুঝে খটকা আরও দৃঢ় হলো নিভানের।সেই অনুযায়ী সহজ গলায় প্রশ্ন ছুড়লো।

‘কোথায় তুই ইভান?

দাদাভাইয়ের তীক্ষ্ণ ব্রেনের কাছে নিজের চালাকি খুবই নগন্য, তাই চালাকি না করে জড়ানো গলায় আমতা আমতা করে বললো– আমরা কৌড়িদের বাড়িতে দাদাভাই।

যে ভয়টা পাচ্ছিলো সেটাই করলো ইভান।
মূহুর্তেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো নিভান।চকমকানো গলায় মৃদু চেচিয়ে বললো–‘হোয়াট?

‘দাদাভাই আমার কথা না শুনে অশান্ত হবে না!প্লিজ দাদাভাই!

অথচ কথা শুনলোনা নিভান।মূহুর্তেই রাগান্বিত গলায় একের পর এক বাক্য ছুড়লো।—‘ইভান,তোরা ওখানে কি করছিস?আমি কি বলেছিলাম তোকে?আর ওরসাথে হাফিজ ভাইও যেতে পারতাে।সেখানে তোকে পাঠিয়েছি আমি।কেনো জানিস না?ও-তো বুঝতে চায়না আমাকে,তুইতো বুঝিস তবুও এই ব্লান্ডারটা কেনো করলি? কেনো ও-কে নিয়ে ওবাড়িতে গিয়েছিস ইভান?

নিভানকে ঠান্ডা করতো ইভান তড়িঘড়ি উত্তর দিলো–
‘দাদীআপা জোর করেছিলেন আসতে,বৃদ্ধা মানুষটা নাতনীকে দেখার জন্য আমাদের যাবার আগেই কেন্দ্রে গিয়ে বসেছিলেন।কৌড়িকে দেখে কতো কাঁদলেন। কৌড়ির পরিক্ষা শেষ হওয়া অব্দি উনি ওখানেই ছিলেন।কৌড়ি পরিক্ষা দিয়ে বের হতেই,ওকে বাড়িতে নিয়ে যাবার আবদার জুড়লেন।আমার কাছে বারবার তাকে নিয়ে যাওয়ার আকুতি করলেন।কৌড়ি-ও যেতে চাইলো।আমি আর না করতে পারি-নি দাদাভাই।আমি তোমার কথা রাখতে পারিনি, স্যরি দাদাভাই।

কিছুটা শান্ত হলো নিভান।ফের কিছু একটা মাথায় আসতেই তড়িৎ কঠিন গলায় বললো– মিথ্যা বলার বা কথা ঢাকার একদম একটুও ট্রায় করবিনা ইভান।শুধু কি দাদিআপা গিয়েছিলো,কৌড়ির পরিক্ষার কেন্দ্রে? নাকি অন্যকেউও?আর তারই আশ্বাসে তাকে বিশ্বাস করে ওবাড়িতে গিয়েছিস তাই না?

গলা শুকিয়ে এলো ইভানের।এই মানুষটাকে এতো তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন আর এতো চালাক হতে কে বলেছিলো!একটু কম হলে পারতো-না।এখন কি বলবে সে?মিথ্যা বলারও উপায় নেই।আর সত্য বললে যে দাদাভাইয়ের মেজাজ আরও তিনগুণ চড়ে যাবে।তাতে খারাপ ছাড়া ভালো তো মোটেই হবেনা!এটা ইভানের বেশ জানা।উফফ!

‘ইভান।নাহিদ নামের ওই ছেলেটাও গিয়েছিলো তাইনা?

নিভানের ভারী গলায় চমকালো ইভান।হৃদপিণ্ডের ধুকপুক তীব্র হলো।প্রানপাখিটা যেনো উড়ে যাওয়ার অবস্থা তার।কেনো যে সবার কথা মেনে এখানে আসতে গেলো।এখন জবাব পেতেই দাদাভাই ক্ষেপে যাবে।আর
দাদাভাই ক্ষেপে গেলে সে হোক বা কৌড়িকে।কারও রক্ষে থাকবেনা।

‘ইভান,আমাট প্রশ্নের উত্তর দে?

‘দাদাভাই প্লিজ।ওকে নিয়ে সুস্থ সমেত বাড়িতে ফিরলে তো হলো?

‘আমার প্রশ্নের যথাযথ এন্সার দে ইভান!

গলা কাঁপলো তবুও সাহস জুগিয়ে উত্তর দিলো ইভান।
‘ হুম মিঃ নাহিদও গিয়েছিলেন। তবে দাদীআপা আশ্বাস দিয়েছেন,উনাকে দেখেও মনে হয়েছে উনি আর আগের মতো নেই।তারদ্বারা কৌড়ির কোনোরূপ ক্ষতি হবেনা,এটা আমারও মন বলছে।

‘মিঃ নাহিদ মাই ফুট।তারদ্বারা কৌড়ির ভালো হোক বা মন্দ।আমি চাইই-না কৌড়ি ওর আশে-পাশেও থাকুক।
সেখানে ও ভালো হয়ে যাক বা মন্দ থাকুক,আই ডোন্ট কেয়ার!কৌড়ি কোথায় ?

নিভানের দাঁতে দাত চেপে রাগান্বিত গলার কথাগুলো শুনলো ইভান।লোকটাকে তারও বিশেষ পছন্দ নয় তবে কি করবে সে।কৌড়ির উপর হক তার বাড়ির মানুষেরই তো বেশি, আগে।সেখানে কোন অধিকারে গলার জোর দেখিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলবে সে?দু-দিন মেয়েটাকে তাদের বাড়িতে রেখেছিলো বলে! দ্বিতীয়ত সত্যিই ছেলেটা-কে দেখে,তার আগের সেই অদ্ভুত চোখ লাললাল নেশাখোর টাইপ আর একগুঁয়ে ছেলেটা বলে মনে হয়নি।অথচ এই ছেলেটার জন্যই কৌড়ির বাড়িছাড়া।নিজ বাড়িঘর ছেড়ে,নিজের বাবার মতো আপনজনের শোকছায়ার দিনে,অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া।

‘ইভান।কৌড়ি কোথায়?

‘ওর একটা ক্লোজ ফ্রেন্ড এসেছিলো,মেয়েটার নাম বিথী। হয়তো তারসাথে কোথাও গল্প করছে।ওদের বাড়িতে একটা পুকুরঘাট ওদিকেই যেতে দেখেছিলাম বেশ কিছুসময় আগে।

‘আমি হোয়াটসঅ্যাপে কল করছি, আমাকে ইমিডিয়েটলি ও-কে দেখা!

ইভানের মনেহলো তার দাদাভাইয়ের মাথা খারাপ হয়ে গেছে।একটু নয় পুরোটাই গেছে।কৌড়িকে নিয়ে তার দাদাভাই ভিষণ সিরিয়াস,এটা সে ইতিপূর্বে জেনে গিয়েছে।তাই বলে এতো সিরিয়াস।ভাবা যায়?এই তার সেই দাদাভাই,যার চিন্তাভাবনা ছিলো ব্যবসার উন্নতি। হাজারগন্ডা মেয়ে রিজেক্ট করেছে বিয়ের জন্য।সে আপতত বিয়ে করতপ চায়না।আর সেই বান্দা কৌড়িতেই পাগল হয়ে গেলো!তাও একটুআধটু নয়।একেবারে ছন্নছাড়া পাগল পাগলভাব যারে বলে!অদ্ভুত পরিস্থিতিতেও ইভানের মুখে হাসি ফুটলো।সেই হাসি মিলিয়ে গেলো,নিভানের হোয়াটসঅ্যাপ ফোনকলে।ফোনকল রিসিভ করার আগে আশেপাশে বিশেষ নজর দিলো ইভান।কোনো হৈচৈর উপস্থিতি নেই বাড়িটায়।পুরো বাড়ি নীরব।কৌড়ির চাচাতো ভাইবোনের সংখ্যা নিতান্তই কম।কৌড়ির বাবা বড় ছিলেন,উনার মধ্যেবয়সের একমাত্র সন্তান কৌড়ি।মেজো চাচার এক ছেলে এক মেয়ে।আর তার পরের চাচার দুই ছেলে।তারা নাকি ভিন্ন শহরে পড়াশোনা করছে।বছরে বাড়িতে মেহমানের মতোই আসা-যাওয়া তাদের।তারপরের জনের দুই মেয়ে এক ছেলে।মেয়ে দুজন বিয়ে দিয়েছেন।আর ছেলেটা কৌড়ির বছর খানেক বড়।সেও পড়াশোনা করছে গ্রাম ছেড়ে ভিন্ন শহরে।আর কৌড়ির ছোটো চাচারও দুই ছেলে।তারাও কৌড়ির বড়।আহসান আঙ্কেলের কোনো বোন নেই।সেটা ইভান জানে।বাবার সাথে সেদিন কৌড়ির দাদিআপার ফোনালাপ শুনেছিলো সে।ভদ্রমহিলা সেদিন কান্নারত গলায় বলেছিলেন-আমার একখান মেয়ে থাকলে,ওই ইয়াতিম অভাগী মেয়েটাকে তোমাদের কাছে কি পাঠানো লাগতো?কি দূর্ভাগ্য আমার,একখান মেয়ে নেই।আর ছেলেগুলো যার যার চিন্তায় ব্যস্ত।পরের ঝামেলা তাদের টানার সময় আছে!তাই তোমার আশ্রয়ে পাঠাতে হলো মেয়েটাকে।

বাচ্চাদের হৈচৈ না থাকায়, আশেপাশে চাচাদেরর বাড়িগুলোও নীরব।শান্ত একটা পরিবেশ।তিনজনের থাকার আবাসস্থল হিসাবে কৌড়িদের একতলা বাড়িটা বেশ মোটামুটি।তবে বাড়ি করা ভিটেমাটির অংশবিশেষ একেবারে ছোটো নয়।বড়সড় একটা পুকুরসহ,বিভিন্ন গাছপালায় ভরা বাড়িটা।বিল্ডিংয়ের পাশে ছোটোখাটো টিন দিয়ে ছাওয়া একটা রান্নাঘর।আর সেই রান্নাঘরে বিশেষ রান্নার আয়োজন করছেন কৌড়ির দাদিআপা।সাথে উনার দুই ছেলের বউ আছেন।তাদেরকে বিশেষভাবে ইভান না চিনলেও, কৌড়ি এবাড়িতে ঢুকতেই সবাই কেমন হামলে এসেছিলো।তখন কৌড়ির আলাপে জেনেছে সে।উনারা কৌড়ির চাচিরা।ঘর থেকে বেরিয়ে কাঁচা উঠনে পা রেখে রান্নাঘরের দিকে বিশেষ সতর্ক নজর ফেলে ইভান পুকুরঘাটের দিকে এগোলো।তারআগে ফোনটা রিসিভ করলো।নিভানের গায়ে ফর্মাল ড্রেস দেখেই তড়িৎ কিছু বলতে যাবে তারআগে নিভান বিবশ গলায় বললো।

‘ফোন রিসিভ করতে এতোসময় লাগে ইভান?

নিভানের কথায় ইভান গুরুত্ব না দিয়ে তখনের প্রশ্নটা করলো।

‘তুমি এই অসুস্থ অবস্থায় অফিসে কেনো?

আবারও চেয়ারে গা এলিয়ে হেলান দিয়ে বসে পড়েছে নিভান।সবকিছু নিয়ে মস্তিষ্ক যেনো তার ক্লান্ত।একটু স্বস্তি, শান্তি তার কোথায় মিলবে?সংগোপনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অদ্ভুত ক্লান্তিময় গলায় বললো।

‘আমি অসুস্থ এটা কি তোদের মাথায় আছে?থাকলে নিশ্চয় এই অবস্থায় আমাকে টেনশনে রাখতে ইচ্ছাকৃত ঝামেলায় জড়াতিস’না।অন্তত একটু স্বস্তি আর শান্তিতে থাকতে দিতিস আমায়।বাই দ্যা ওয়ে,ও-কে দেখা।

ইভান করলো আরেক গাধামি।সামনে না তাকিয়ে নিভানের কথার ধরন দেখে তড়িঘড়ি ব্যাক ক্যামেরা অন করলো।ফোনটা সরাসরি উঁচু করে পুকুরপাড়ের দিকে তাক করতেই তার চোখও চড়কগাছ।থতমত খেয়ে ফোনের স্কিনের দিকে তাকাতেই নিভানকে শান্ত নজরে নিষ্পলক সেদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে,আত্মাটা ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি করা শুরু করলো।দম আঁটকে এলো।হতভম্ব নজর একবার পুকুরের শান বাধনো ঘাটে বসার জায়গায় তো একবার ফোনের স্কিনে নিভানের মুখের দিকে ঘুরতে ফিরতে লাগলো।আজ তারদ্বারা শুধুই ব্লান্ডার হয়ে যাচ্ছে।
দাদাভাইয়ের অতি শান্ত নজর,কঠিন শিথিল মুখাবয়ব!পাক্কা কালবৈশাখী ঝড়ের আগমনী বার্তার পূর্বাভাস দিচ্ছে।উফফ,কি যে লেখা আছে কপালে কে যানে!
ধড়ফড়ানো মনে শুধু একটাই বাক্য আওড়ালো,আল্লাহ মাবুদ রক্ষে করো।

চলবে….

ফুলকৌড়ি পর্ব-৩৪+৩৫

0

#ফুলকৌড়ি
(৩৪)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

কম্বলের নিচে নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে কৌড়ি।সেটা বুঝে তাকে বুকে জড়িয়ে নিলো মান্যতা। স্নেহের হাত মাথায় বুলিয়ে স্বান্তনা দিতে থাকলো।তবে মুখে কোনো শব্দ প্রয়োগ করলোনা।কি বলবে আসলে সেটাই বুঝে উঠতে পারছেনা।কৌড়ি কি তাহলে সত্যিই দাদাভাইকে পছন্দ করেনা!আর দাদাভাইকে পছন্দ করে-না বলে কি তার যত্নগুলো নিতে চাইছেনা।নাহলে এমন যত্নবান, দায়িত্বশীল পুরুষ কোন মেয়ে না তার জীবনে চায়?আর সেই দায়িত্ববান যত্নবান,খেয়ালী দাদাভাইকেই কৌড়ি চাইছেনা!কিন্ত কেনো?এরকম খেয়ালী ছেলেদের প্রতি তো মেয়েদের মন গলতে সময় লাগেনা।তবে?মান্যতার ভাবনার মাঝেই কৌড়ির ফুপিয়ে বলে উঠলো।

‘উনি আমার সাথে জোরাবাদী করছেন আপু।উনি এমনটা করতে পারেন না!

দীর্ঘশ্বাস ফেললো মান্যতা।ফের নমনীয় কন্ঠে বললো।

‘তুই শুধু দাদাভাইয়ের জোরাবাদিটা দেখলি?তোর প্রতি তার যত্ন খেয়ালটা নজরে পড়লোনা?অনুভব করলি না, তুই নামক মেয়েটাতে সে কতোটা খেয়ালী,দায়িত্ববান
যত্নশীল?তুই মেয়েটাতে সে কি অনুভব করে?না-হলে এতোটা জোর আর অন্য কারও সাথে তাকে কখনো করতে দেখেছিস?এই ধর দীবা আপু।সে অসুস্থ হলো,পড়লো,মরলো কি বাচলো।তাঁর বিষয়ে কখনো দাদাভাইকে কোনো কথা বলতে শুনেছিস,মাথা ঘামাতে দেখেছিস?নাকি এমনটা করতে দেখেছিস?তবে কেনো একটু বুঝতে চাইছিস না,তুই নামক রমনীতে দাদাভাই ঠিক কি অনুভব করে?তুই দাদাভাইয়ের কাছে ঠিক কি?কেনো বুঝতে চাইছিস-না?ওই মানুষটাও যে আপন বলতে খুবই দূর্বল!তাদের সামান্য অসুস্থতায়,কষ্টে যে সে চুপচাপ থাকতে পারেনা।

‘দাদিআপা বারবার বলে দিয়েছেন। রোজ ফোন করলে একবার নয় হাজরবার করে সতর্ক করেন,আমি যেনো এমন কাজ না করি যাতে আমার মৃত বাবা মাকে অসম্মান করা হয়!তাদেরকে অসম্মানিত হতে না দেই।

‘এখানে উনাদেরকে অসম্মানিত করার কি হলো?

‘উনার কথাগুলো মানা মানেই তো উনাকে প্রশ্রয় দেওয়া।আর প্রশয় দেওয়া মানেই তো..

‘মানেই তো মানে কি?কিচ্ছু না।তোর মনেহয় দাদাভাই তেমন ছেলে?উনি কখনো তোরসাথে প্রেমময় সম্পর্কে জড়াবেন না।আর জড়াতে চাইবেনও না।আমার বিশ্বাস, তোর প্রতি যে ধ্যান খেয়াল উনার।উনি স্ত্রী রূপে ছাড়া আর অন্য কোনো রূপে তোকে চাইবেনা।

কৌড়ি মাথায় চুমু খেলো মান্যতা।নিজের সাথে আরও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়ে বললো–তুই দাদাভাইয়ের।এটা ওই ব্যক্তিটা যখন পাকাপোক্তভাবে মন থেকে মেনে নিয়েছে,তোকে*ও মানিয়েই ছাড়বে।সে কোনোরূপই।
ছাড় পাবি-না তুই।আর দাদাভাই যখন বলেছে তোকে ডাক্তার দেখাতেই হবে,তো তুই মরে গেলেও ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হওয়াই লাগবে।এবং তাকে নিজের অসুস্থতা খুলে বলাই লাগবে।সুতরাং এতো ভেবেচিন্তে রাতের ঘুম হারাম না করে শান্ত হয়ে ঘুমা।ওদিকে যে আরেকজনের ঘুম হারাম করে দিয়ে এসেছিস,সেটাতো বেশ বুঝতে পারছি।

নিভানের জেদালোপূর্ন কথাগুলো পুনরায় মনে করতেই কৌড়িও যেনো মান্যতার কথাগুলো মনেমনে মেনেই নিলো।কান্না থেমে গেছে তার অনেক আগেই।ঠান্ডায় মান্যতা জড়িয়ে ধরায় যেনো উষ্ণতায় আর-ও আরাম পেলো।ঘুম না আসলেও চুপচাপ পড়ে রইলো মান্যতার বুকে।এই মানুষগুলো তাকে এতোটা আপন করে নেবে,ভালোবাসবে এটা কখনোই সে আশা করেনি।আর মান্যতা বলে এই অমায়িক স্বভাবের মেয়েটার সে এতো প্রিয় হয়ে উঠবে,এটাও কল্পনায় ছিলো না।সর্বোপরি ওই মানুষটা তাকে চাইবে,দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করার স্পর্ধা করেনি কৌড়ি।আর সেই মানুষটা তাকে এমনভাবে চাইছে,উফফ।

‘এই কৌড়ি।

হঠাৎ ডাকে একটু চমকালো সে।ছোটো করে বললো–হুমম।

‘এই-যে আমি তোমাকে মাঝেমাঝে তুই করে বলি।মন খারাপ হয়?রাগ করোনা তো?

‘একটু-ও না।বরং ভালো লাগে।আপন আপন মনে হয়।তুমি আমাকে তুই করে ডাকতেই পারো।ডাকতেই পারো কি, ডাকবে।

‘এখন নাহয় ডাকলাম।পরে তো আবার সেই তুমি করে সম্বোধন করতে হবে।

‘কেনো?

‘দাদাভাই আমার কতোবড় জানো!সেই বড় ভাইয়ের বউ তুমি হবে বলে কথা।

‘আপুু।

শব্দ করে হেসে দিলো মান্যতা।বললোা–ওরকম কেনো
করিস?আমার দাদাভাই খুব ভালো।যে মানুষটা তার নিজের আপনজনকে মনপ্রাণ দিয়ে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে পারে,আগলে রাখতে পারে।না জানি সে তার বউটাকে কতো ভালোবাসবে!কিভাবে আগলে রাখবে!বউ হ তারপর বুঝবি।একটা সময় গিয়ে দেখবি, ওই মানুষটাকেই ছাড়া তোর চলছে-না।

গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো কৌড়ি।সে কি আর ইচ্ছে করে অনাগ্রহ প্রকাশ করছে!ওই মানুষটাকে অনাগ্রহ বা উপেক্ষিত করার যোগ্যতা তার আছে কি!শুধু দায়বদ্ধতার খাতিরে নিজের মনটাকে ধরেবেঁধে অনুভূতিগুলো চেপে রাখতে হচ্ছে।নিজেকে ছোটো হতে দেখলেও,নিজের মৃত বাবা মা’কে কিকরে সে ছোটো হতে দেখে!যারা তার অসময়ে আশ্রয় দিয়েছে, তাদেরকেও বা কিকরে ঠকায়?এইযে দুবেলা ফুপুমনি অবহেলিত,বাকা,ছোটো নজরে তাকে দেখে।মাঝেমধ্যে কথার ছলে কটু বাক্য শুনাতেও পিছুপা হোন না।
এমন কুইঙ্গিতপূর্ন কথা বলেন,যেনো নিজের রূপলাবণ্যে দিয়ে এবাড়ির ছেলেগুলোকে সে পটাতে এসেছে।এমনকি লোভীও সে।এগুলো নিজের জন্য মানা গেলেও,মৃত বাবা মায়ের নামে সহ্য করবে কি করে কৌড়ি! আপনজন বলতে এক ওই দাদাআপাই আছে।যিনি মায়ের মমতা দিয়ে স্নেহ আদরে তাকে মানুষ করেছেন।উনার আদেশ উপদেশগুলোও উপেক্ষ কি-করে করবে?কোনো একটা কান্ড ঘটলে উনাকে-ও কি কথা কম শুনতে হবে।তবে পা কোনদিকে বাড়াবে সে?সারাদিনে অনেক ঘুমিয়েছে,তাই আপতত চোখে ঘুম ধরা দিলো-না।তবে মাথায় চিন্তারা ঘুরপাক খেলো বৈচিত্র্যময়।তন্মধ্যে যে মানুষটাকে একটু আগে প্রচন্ড খারাপ বলে আখ্যায়িত করে এলো,সেই মানুষটাকে নিয়েই মন মস্তিষ্কের ভিতর চকরির মতো ঘুরপাক খেতে থাকলো।ওই মানুষটাকে নিয়ে ভাবতে বসলে সবথেকে একটা কথা তাকে বিশেষভাবে ভাবায়,ওই মানুষটা তাকে পছন্দ করে,শুধু তাকেই চায়!কি অদ্ভুত অনুভূতিতে ছেয়ে যায় তখন শরীর-মন।মানুষটার চাওয়ার তীব্রতা দেখে,আবেগি মন খুব সাড়া দিতে চায়।তবে পরবর্তীতে দাদিআপার,বিথীর কথাগুলো বিবেক দিয়ে ভাবলে,মন মস্তিষ্ক দিশাহারা হয়ে পড়ে।যেমনটা এখন দিশাহারা অবস্থা।

দেখতে দেখতে আরও কয়েকটা দিন চলে গেলো।ইভানের রিসেশনের পর বাড়িতে আস্তে আস্তে মেহমান ও কমতে শুরু করলো।বললে চলে আপতত বাড়িতে কোনো মেহমান নেই।এরমধ্যে ইভানও তন্ময়ীকে নিয়ে ওবাড়ি থেকে ঘুরে এলো।তাহমিনা বেগম ইভানের প্রতি মনেমনে মনোক্ষুণ্ণ থাকলেও জামাই আদরে সামান্য পরিমান-ও অনাগ্রহ দেখালেন না।আর না কোনো ত্রুটি রাখলেন।বরং নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী ইভানকে জামাই হিসাবে যথেষ্ঠ পরিমাণ আদর যত্ন করলেন।মেয়েকেও উপদেশ দিলেন,সবকিছু মানিয়ে গুছিয়ে নিতে।ইভানের রিসেশনের দু’দিন পর কৌড়ির ডাক্তার দেখানোর কথা থাকলেও ডাক্তার দেখানোর মতো সুযোগই হয়নি।হঠাৎ পরিক্ষার ডেট পড়ায় মান্যতাও ব্যস্ত হয়ে গেলো।তবে কৌড়ি চাইছে, ডাক্তার দেখানোর বিষয়টা কোনোভাবে চাপা পড়ে যাক।কেননা,অসুস্থ বলতে নিজের এই লজ্জাজনক শারীরিক বিষয়টা যদি এবাড়ির সকালেসহ ওই মানুষটা জানে,লজ্জার কি আর শেষ থাকবে!যদিও মান্যতা বলেছে,কাল অবশ্যই তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে।সেই টেনশনে আছে আপতত সে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে এলোমেলো মনে ফের পড়ায় মনোযোগ দিলো।

আর একসপ্তাহ পর পরিক্ষা।আপতত কলেজ বন্ধ।রুমে বসে পড়ছে কৌড়ি।পড়ছে তো না।ইদানীং একজন মানুষকে নিয়ে ভাবনাটা বেড়ে গিয়েছে তার।তিনি সময়ে অসময়ে মনস্তাত্ত্বিকে এখন অবাধ চলেফিরে বেড়ান।কি এক জ্বালা!চেয়েও তাকে মনস্তাত্ত্বিক থেকে সরানো যায়-না।পড়ার ফাঁকে আবারও সেই মানুষটার বিচারণ!উফফ!শব্দটা প্রয়োগ করে চোখজোড়া বুঁজে কিছুসময় সেভাবে থেকে ফের চোখ খুলে বইয়ের পাতা মনোযোগী হবার চেষ্টা করলো।তবে সেই মানুষটা হয়তো কৌড়ির এই অবজ্ঞা মেনে নিতে চাইলোনা,তাই বাস্তবে ধরা দিলো।হঠাৎই কৌড়ির ফোন বেজে উঠলো। এখন আবার কে ফোন দিয়েছে?এই অসময়ে তো কখনো ফোন দেয়না কেউ?কথাগুলো ভাবতে ভাবতে,ফোন হাতে নিয়ে চোখের সামনে আনতেই নজর স্থির হয়ে গেলো তার।হৃদস্পন্দন ধকধক ধ্বনিতে আওয়াজ করে উঠলো।’নিভান’ নামটা স্কিনে পরিচ্ছন্নভাবে জ্বলজ্বল করছে।বয়সে তারথেকে-ও কতোবড় মানুষটা অথচ তারই নামটা কি অবলীলায় লেখা।সেই থেকে এই পর্যন্ত নামটা চেঞ্জ করার কথা মাথায় এলেও,পুনরায় কি নাম লিখে সেভ করবে সেটা ভেবে নামটা আর কাটা হয়নি।যদিও মানুষটা অতি প্রয়োজন ছাড়া কখনো তাকে ফোন দিয়ে বিরক্ত করেনা।এখন আবার কি জন্য দিল?হৃদ স্পন্দনে গতিবেগ হ্রাস পেলো।মন চাইছে কলটা ধরতে,মস্তিষ্ক বলছে না।মন মস্তিষ্কের দ্বিধাদন্ডে মনকে আজ প্রশ্রয় দিলো কৌড়ি।যদিও হৃদ যন্ত্র তার লাফিয়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম।তবুও কলটা রিসিভ করে চোখ বুঁজে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো সে।ফোনটা রিসিভ হয়েছে!ওপাশের মানুষটার ঠোঁটের কোণেও যেনো এক টুকরো হাসি ফুটলো।সে-ও, তার নিজস্ব অফিসকক্ষে বসা আরামদায়ক চেয়েরটায় শরীর এলিয়ে দিয়ে মৃদুস্বরে ডাকলো।

‘কৌড়ি।

এবার হৃদস্পন্দন থেমে গেলো কৌড়ির।এ কেমন ডাক!তাকে অস্বাভাবিক করে তোলে।গায়ের নুইয়ে থাকা লোমগুলােও কেমন কাঁটার মতো তথাস্তু হয়ে দাঁড়িয়ে সমস্ত শরীরে ডাকের জানান দিয়ে শিরশিরানি বয়ে যায় রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আজ যেনো কিসের টানে ডাক অবজ্ঞা করতে পারলোনা কৌড়ি।খুবই নিন্মস্বরে ছোটো করে উত্তর দিলো।–হুমম।

ওপাশের মানুষটার হাসিটা যেনো আর-ও একটু বিস্তৃত হলো।সময় নিয়ে বললো–তুমি পড়ছো, তাই-না?বিলিভ মি কৌড়ি,আমি তোমাকে একটুও ডিস্টার্ব করতে চাই নি।কিন্তু তোমার কথা খুব মনে হচ্ছিলো।কেনো জানিনা কথা বলতেও খুব ইচ্ছে করছিলো।তাই ডিস্টার্ব করলাম।আমি জানি আমার ফোনকলে তুমি বিরক্ত হয়েছো,তবুও অল্পক্ষণের জন্য এই অপছন্দ মানুষটাকে একটু সয়ে নাও।একটু ডিস্টার্ব হও।

উত্তর দিলোনা কৌড়ি।শুধু চোখ বুঁজে কথাগুলো শুনে গেলো।বুকের ভিতর যে উথালপাতাল ঝড় চলছে তার।গলা দিয়ে কথা বের করবে কিকরে সে?আর বলবেও বা কি সে?তাই নীরবে সেই ভরাট গলার কথাগুলো শুনে গেলো।উত্তর পাওয়ার আশাও করলোনা নিভান।ফের সুন্দর সাবলীল গলায় বললো।

‘আমি কখনো নিজেকে অন্যের কাছে ছোটো করে দেখাতে পছন্দ করিনা।করিনিও কখনো।আমার নেই কিচ্ছু,তো নেই।তাই বলে আমাকে কেউ ছোটো করে দেখবে,এমনটা কখনো কারও সামনে প্রেজেন্ট করেনি আমি।বারবার কারও কাছে নিজের ভালোমন্দ অনুভূতি প্রকাশ করে নির্লজ্জতার বহিঃপ্রকাশও ঘটায়নি কখনো।ইউ নো,তুমিই একমাত্র ব্যক্তি।যেখানে আমি নিজেকে ছোটো করতে প্রস্তুত হয়েছি।নিজের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েও বারবার নির্লজ্জতার পরিচয় দিয়েছি।নির্লজ্জও বানিয়েছি নিজেকে।আর যতক্ষণ তুমি আমার না হতে চাইবে ততক্ষণ পর্যন্ত হয়তো এই নির্লজ্জতার দফা বহাল থাকবে।নির্লজ্জ হতে রাজিও আমি,তোমাকে তোমার কাছে বারবার চেয়ে নিজেকে ছোটো করতেও রাজি আমি।তবে যে নিভান আমি ছিলাম, সেই নিভান হারিয়ে।নিজের সেই দৃঢ়পণ,ব্যক্তিত্ব,সবকিছু খুইয়েও তোমাকে পেতে চাইছে মন।কেনো কৌড়ি?আমি কেনো পারছিনা,আমার মন আমার মস্তিষ্ক থেকে তোমাকে দূরে সরাতে?আমার এতো এতো কাজের প্রেশারের মধ্যেও কেনো পারছিনা, তুমি নামক কৌড়িকে সেই কাজের প্রেশারের মধ্যে চাপা ফেলতে।এই কৌড়ি বলো-না?আমিতো এতোটা দূর্বল কারও প্রতি কখনোই ছিলাম না।তবে কিকরে হোলাম তোমার প্রতি?

চোখ বেঁয়ে নোনাজল গড়ালো কৌড়ির।এভাবে কিকরে একটা মানুষ কাতরভাবে তাকে চাইতে পারে!কিকরে!আবার সেই মানুষটা।যার কাছ থেকে এসব কথা-কাজ অবিশ্বাস্য।কখনোই আশা করেনি।অথচ সেই মানুষটা তার কাছে পুরো খোলামেলা পুস্তক।অথচ অন্য পাঁচ দশটা মানুষের সামনে,মানুষটা কি গম্ভীর। অনুভূতিহীন।শক্তপোক্ত দৃঢ়মনের মানুষ।সেই মানুষটা শুধুই তার খোলামেলা হতে চাইছে।মানেটা কি?বুঝতে কি পারছে না কৌড়ি।পারছে।খুব ভালোভাবে পারছে।এরকম মানুষকে নিজের করে পাওয়ার সৌভাগ্য কজনের হয়?
কৌড়ির হয়েছে।অথচ সেই সৌভাগ্য নিজ ইচ্ছেতে বরন করার ক্ষমতা তার নেই।তবে নিজের মনকে আর বাঁধ সেধে রাখবেনা কৌড়ি।নিজ ইচ্ছেতে সেই সৌভাগ্য বরণ করার ক্ষমতা তার না থাকলেও ওই মানুষটার তো আছেই।পারলে ওই মানুষটা তাকে নিজের করে নিক।যেভাবে পারে তাকে সেভাবেই নিজের করে নিক।সে কখনো অমত পোষন করবে-না।তবে মুখে স্বীকারোক্তি জানানো হয়তো কখনো তারদ্বারা হবেনা।

‘এই কৌড়ি।শুনছো তুমি?

দৃঢ়কণ্ঠের ডাক ফের পড়তেই ভাবনা কেটে গেলো। না চাইতেও ফের জবাব দিয়ে ফেললো কৌড়ি।’হুমম।

‘একটুও কথা বলতে ইচ্ছে করেনা আমার সাথে তাই না?

উত্তর দিলোনা কৌড়ি।কারন মন যা বলছে মুখে তার বিপরীত উত্তর দিতে হবে।মিথ্যাও মুখ দিয়ে সহজে বের হবেনা।তাই বরাবরের মতো নিশ্চুপ রইলো।নিভান ফের বললো।

‘আচ্ছা কৌড়ি,আমার যদি হঠাৎ কিছু হয় যায়।ধরো হঠাৎই আমি বরাবরের মতো দূরে চলে গেলাম।তোমার থেকে খুব দূরে।যেখানে গেলে কেউ আর কখনো ফেরে না।আচ্ছা কৌড়ি,আমার অবর্তমানে তুমি কি একটুও কষ্ট পাবে আমার জন্য?আমি নেই, কখনো মন খারাপ হবে তোমার?

বুজে থাকা চোখজোড়া টেনে আরও গভীরভাবে টেনে বুঁজে নিলো কৌড়ি।ফের মৃদুস্বরে আওড়ালো–এগুলো কি বলছেন আপনি।

কথাটা শোনা হলোনা নিভানের।তার আগেই তার পি-এ নক করলো দরজায়।মনোযোগ ছিন্ন হলো নিভানের।মনে পড়ল,একটা ইম্পর্ট্যান্ট মিটিংয়ের জন্য একটু পরে বের হতে হবে তাকে।সেজন্য ডাকতে এসেছে মৃদুল।মৃদুলকে ফাইলপত্র নিয়ে বের হয়ে গাড়িতে বসতে বলে,পাঠিয়ে দিল।ফের ফোনটা কানে তুললো সে।তার আগে দেখে নিলো সংযোগ আছে কি-না। আছে।দেখেই মৃদু হেসে ফোনটা কানে নিলো।ফের অমায়িক কন্ঠে বললো।

‘তোমাকে খুব বেশি ডিস্টার্ব করলাম।সেই ডিস্টার্বের বিনময়ে যে স্বস্তি শান্তিটুকু দিলে আমাকে,তারজন্য নিভানের ভালোবাসা গুচ্ছিত রইলো তোমার জন্য।যদি সুস্থ থাকি,তবে সন্ধ্যায় দেখা হচ্ছে।আল্লাহ হাফেজ।

মনেমনে, আপনি সর্বদা সুস্থ থাকেন শব্দগুলো বললেও মুখে চুপ থাকলো কৌড়ি।আল্লাহ হাফেজ বলে মনেমনে বিদায় জানালো হবে।আজকে নিভান যেনো নাছোড়বান্দা।মায়াময় কন্ঠে বললো।—এই কৌড়ি, আল্লাহ হাফেজ বলবে-না।

ঘনো নিঃশ্বাস ফেললো কৌড়ি।নিঃশ্বাসের শব্দ ওপাশ থেকে নিভানও শুনলো।নিভানের মায়াময় কন্ঠের বশিভূত হলো কৌড়ি।কৌড়ি মৃদুস্বরে বললো।—আল্লাহ হাফেজ।

নিজেই ফোন কেটে দিলো সে।ওপাশ থেকে মৃদুহেসে ফোনের দিকে কিছুসময় তাকিয়ে থেকে ফোন প্যান্টের পকেটে ঢুকালো নিভান।ফের দ্রুত কেবিন ত্যাগ করে নিজের গন্তব্যের দিকে পা বাড়ালো।

সময়টা মধ্যহ্ণ!গায়ের পরিহিত সাদা শার্টটার দিকে আবারও তাকালো ইভান।রক্তের ছোপছোপ দাগে ছেয়ে আছে শার্টটা।এই অবস্থায় কিভাবে সে বাড়ির ভিতরে যাবে বুঝে উঠতে পারলোনা!বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই তো মা চাচিদের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে তাকে।আর প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে তো এই দুপুরবেলা একটা হুলুস্থুল কান্ড ঘটবে।তবুও তো যেতে হবে।তবে মায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে,উনার প্রশ্নের সম্মুখীন হবে কিকরে সে?কি করে বলবে তার আদরের ছেলেটা মারাত্মক এক্সিডেন্ট করে হসপিটালের বেডে পড়ে আছে।শুধু যে হসপিটালের বেড পড়ে আছে এমনটা তো নয়।গুরুতরভাবে এক্সিডেন্ট হয়ে আইসিইউতে নির্জীব শুয়ে আছে।গাড়ির সিটে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলো ইভান।মূহুর্তেই ভেসে উঠলো সেই বিভৎস এক্সিডেন্টে দুমড়ে মুচড়ে গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে থাকা গাড়িটা।মূহুর্তেই পথচারীরা হৈহৈ করে উঠলো।

‘ওই বুঝি অসচেতন রাস্তা পারাপর করতে গিয়ে মা-সহ বাচ্চাটাকে বাঁচাতে,গাড়ির লোকটা বুঝি মরলো।

ব্যস্ত শহুরে রাস্তার পথচারীর মধ্যে সে-ও একজন ছিলো।তবে কল্পনাতেও আনেনি মারাত্মক এক্সিডেন্টে মরতে বসা মানুষটা তার আপনজন হবে।সকল পথচারীর মতো সে-ও এক্সিডেন্টের কথা শুনে এগিয়ে গিয়ে গাড়িটা নজরে পড়তেই বুকটা ঝড়ের মতো কেঁপে উঠেছিলো তার।নজর যেনো কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইছিলোনা,গাড়িটা তার আপনজনের।আর ভিতরের আহত মানুষটা আর আত্মার একাংশ।মানুষটা আঘাত পেলে তার-ও ব্যথা লাগে,কষ্ট অনুভব হয়।মূহুর্তেই পথরে বনে যাওয়া হাতগুলো কিভাবে যে টেনেহিঁচড়ে গাড়ির সিটে রক্তাক্তে এলিয়ে থাকা মানুষটাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলো,সেটা শুধু ইভান যানে।তারপর সর্বসাহায্যে হসপিটালে পৌঁছে কাকে কিভাবে জানাবে ভেবে উঠতে পারছিলো।নিভান শুধু একটা নাম নয়।ওই নামের মানুষটা,নিজের আপনজনদের মধ্যে আবেগ ভালোবাসা আর অনেকের দূর্বলতার স্থান।ওই মানুষটা এক্সিডেন্ট করেছে!অসুস্থ হয়ে হসপিটালের বিছানায় শুয়ে!সবাই মূর্ছা পড়বে।তার অসুস্থতার কথা শুনে তারপ্রতি যত্নশীল মানুষগুলোও অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে,এটাও ধারণা আছে ইভানের।বিশেষকরে বাবা,মা,নানুমা।তাই দুপুর এগোটার দিকের ঘটনা এখন দুপুর তিনটে, এখনো কাওকে জানাতে সাহস পায়নি ইভান।শুধু ছোটো চাচ্চুকে জানিয়েছিলো।আপতত তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে,তিনিই এখন হসপিটালে অবস্থান করছেন।সহজ সরল মানুষটাও আপনজনের এমতাবস্থায় ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছেন।দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ইভান।

পরিস্থিতির সম্মুখীন তো হতেই হবে।ছোটো চাচ্চুর গাড়ীটা নিয়ে এসেছে সে।গাড়ী থেকে বের হলো ইভান।আজকের দুপুরের চারপাশটা কেমন নিস্তব্ধ।আশেপাশে তাকিয়ে মেইন দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজাতেও সময় নিলো সে।কেমন যেনো সাহসে কুলচ্ছে না।এলোমেলো শ্বাস ফেলে কলিংবেলের চাপতেই, মুহূর্তেই দরজা খোলার শব্দ পেলো ইভান।কিছুটা আশ্চর্যও হলো।সময় না নিলেও মিনিট সময় পার হয়ে অন্য সময় দরজা খুলতে। আর আজ সময় নিলো-না!মনেহলো দরজার পাশে কেউ ওত পেতে বসে ছিলো,দরজা খোলার জন্য।তবে কি দাদাভাইয়ের এক্সিডেন্টের কথা জেনে গিয়েছে বাড়ির সবাই?

‘ও আল্লাহ।ও ইভান বাবা তোমার গায়ে রক্ত মাখামাখি কেনো?কি হইছে তোমার?

রানির চিল্লানোতে মূহুর্তেই যেনো,দুতলা বাড়িটা গমগম করে উঠলো।নীহারিকা বেগম টেবিলে খাবার গোছাচ্ছিলেন,রানিকে এমন হাহাকার করতে শুনেই সব ফেলে দৌড় এলেন।সাথে স্বান্তনা রহমানও পিছু নিলেন।ততক্ষণে ইভান ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়িয়েছে।ইভানকে দেখেই আঁতকে উঠলেন নীহারিকা বেগম।দ্রুত কাছে এসে গায়ে হাত দিয়ে ইভানকে পরখ করতে করতে আতঙ্কিত কন্ঠে বললেন।

‘কি হয়েছে তোর?এতো রক্তে মাখামাখি কেনো তুই?

ফের ইভানের ঘাড় কাধ মাথার চুলগুলো উল্ট পাল্টে দেখতে দেখতে স্বান্তনা রহমানকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকলেন—দেখেছিস ছোটো,তোকে সকাল থেকে বলছিলাম না।আমার বুকটা কেমন করছে,কি যেনো খারাপ হতে চলেছে।আমার কথা মিললো তো!মায়ের মন কখনো মিথ্যা বলে না।আর না ভুল জানান দেয়।তারউপর সেই দুপুর থেকে ছেলে দুটোকে ফোন দিয়ে পাচ্ছিনা।আমার মনটা আরও খুদমুদ করছিলো, জ্বলছিলো।তুই তো বিশ্বাস করছিলি-না আমার কথা।দেখেছিস,একটা বিপত্তি বাধিয়ে তারপর বাড়িতে এলো।আমার মন তবে ভুল বলছিনা।

ইভান দূর্বল অনড় নজরে মায়ের বিচলতা দেখে গেলো।একেই বলে বুঝি মা।যার অন্তর, সন্তানের সুখ অসুখে ভালোমন্দে বিপদআপদে আগেই টের পেয়ে যায়।উফ!সেই মা’কে কিকরে জানাবে তার আদরের সন্তানের ভয়ঙ্কর বিপদের কথা!

‘কই,তোর তো কোথাও কাটাছেঁড়া নেই।তবে সমস্ত শরীরে এতো রক্ত মাখামাখি কেনো?কার কি হয়েছে ইভান?ও ইভান কথা বল?এমন রক্তে মাখামাখি কেনো তুই?

ততক্ষণে ড্রয়িংরুমে সবাই হাজির।সিঁড়ির গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে আতঙ্কিত নজরে ইভানকে দেখছে তন্ময়ী।পা এগোবে সে সাহস হচ্ছে না তার।এ কয়েকদিনে ইভানের সাথে কাছাকাছি ঘুমানো ছাড়া বিশেষ সম্পর্ক এগোইনি তাদের। তবে হালাল সম্পর্কের টান হোক বা ছেলেটার বারবার অনুতপ্ততা।তাকে মায়ায় জড়াতে বাধ্য করেছে।একটা অদ্ভুত টান তৈরী হয়েছে।এখন ভুলেও তন্ময়ী চায়না ওই ছেলেটা কোনো প্রকার বিপদআপদে পড়ুক।সেই ছেলেটার এতো রক্তে মাখামাখি,কেমন যেনো ভিতর থেকে অসড় অসড় অনুভব হলো।বিধায় চেয়েও সামনে এগোতে পারলোনা।ইতিমধ্যে ফাতেমা বেগম এবং ডলািয়া বেগমও সেখানে হাজির।রানির গলা শুনে মান্যতা মৌনতা কেউ বাদ রইলোনা।কৌড়ি মান্যতার রুমে ছিলো।মান্যতা আগে এসে নিচে নেমে গেলে-ও,ইভানকে এমন অবস্থায় দেখেই ধীর হয়ে গেলো তার পা।তবে সিঁড়ির মাঝ বরাবর এসে নীহারিকা বেগমের অবিচলিত করা প্রশ্নে, ইভানের বলা নির্দয় বাক্যগুলোয় নিঃশব্দে থেমে গেলো তার পা।নিঃশ্বাস আঁটকে
ধব্ক করে উঠল বুক।

‘আমার কিচ্ছু হয়নি মা।তবে…

‘তবে কি বল?ও ইভান আমার নিভানের কিচ্ছু হয়নি তো?

প্রশ্ন করতেই নীহারিকা বেগমকে শক্তকরে জড়িয়ে ধরলো নিজের শক্তপোক্ত বুকে।ফের বললো-শান্ত হও।দাদাভাই ঠিক হয়ে যাবে।একদম পাগলামো করবেনা,তবে সুস্থ হয়ে দাদাভাই কিন্তু আমাকে বকবে।

‘আমার নিভানের কি হয়েছে ইভান?

নীহারিকা বেগমকে আরও শক্তপোক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ইভান।ফের চোখ বুঁজে নিঃশ্বাস ফেলে একনাগাড়ে বললো।–‘দাদাভাই এক্সিডেন্ট করেছে মা।

‘আমার নিভান ঠিক নেই তাইনা?

উত্তর দিতে পারলো-না ইভান।গলা রোধ হয়ে এলো তার।তবে মা’কে ভুলেও কাছছাড়া করলো-না।নিভানের এক্সিডেন্ট!আতঙ্কে হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো সবার।আবেগে কেঁদে ফেললো মান্যতা মৌনতা।মুখে হাত চেপে ধরলেন ডালিয়া বেগমও।কি সর্বনাশ,কিভাবে কি হলো? বলে মুখেও আওড়ালেন!বিচলিত হলেও বৃদ্ধা আমেনা বেগমও।স্বান্তনা রহমান তো হাত পা নাড়ানোর শক্তিই পেলেন না।সকালবেলা সুস্থ সাবলীল ছেলেটাকে উনিই খাবার বেড়ে খাওয়ালেন।এখন বলছে সেই ছেলেটা মারাত্মক এক্সিডেন্ট করেছে!হঠাৎই কথাটা যেনো বিশ্বাস হলোনা।ভুল শুনেছেন বলে মনে হলো।তারপর নীহারিকা বেগমের পাগলামি করা দেখে হুঁশ ফিরলো যেনো উনার।

‘ও ইভান,আমার বাচ্চাটা ঠিক নেই বল?আমার বাচ্চাটা আমার আগে ছেড়ে চলে যাবে না-তো,ওর বাবার কাছে?

‘বড়ো বউমা এগুলো কি বলতে শুরু করলে তুমি?

ধমকে উঠলেন ফাতেমা বেগম।তাতে এবার কেঁদে ফেললেন নীহারিকা বেগম।ইভানকে জড়িয়ে হাওমাও করে উঠলেন।ফের শ্বাশুড়িকে উদ্দেশ্য করে
বললেন–ওর আমার উপর অনেক অভিযোগ, খুব অভিমান মা।আপনি জানেন না।আমার বাচ্চাটা প্রকাশ করতে চায়না বলে!কিন্তু আমি মা,আমি ওর মনের কথা জানি।ওর আমার উপর খুব অভিমান।খুব অভিযোগ।
ও ওর বাবাকে খুব ভালোবাসতো।আমি জানি, ও আমার উপর অভিমান করে ওর বাবার কাছে গিয়ে শান্তিতে থাকতে চায়।একটু স্বস্তি আর শান্তিতে থাকতে চায়।

গলা ছেড়ে কাঁদতে কাদতে কথাগুলো বলে ফের বললেন।–ও আল্লাহ আমার প্রানটা নিয়ে, তুমি আমার বাচ্চাটাকে সুস্থ করে দাও।আমার আয়ু কেটে তাকে যুগ যুগ বাচিয়ে রাখো।

ফের ইভানকে উদ্দেশ্য করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন–এই ইভান আমাকে নিয়ে চল-না,আমার বাচ্চাটার কাছে।

সেই যে পা থেমে গেছে কৌড়ির।তা আর সচল অনুভব হলো না তার।নিস্পলক স্তব্ধ নজরে শুধু ড্রয়িংরুমে চলা ঘটনাগুলো দেখে চলেছে সে।কানে শুনছে সব।তবে কি শুনছে সব যেনো তালগোল পাকিয়ে মস্তিষ্কে বিচরন করছে।বাজে অদ্ভুত একটা ধকধক অনুভূতিতে তোলপাড় করছে হৃদস্পন্দন। বাবা মারা গিয়েছিলো যেদিন,ঠিক একই অনুভূতিতে কেঁপেছিলো বুকের ভিতর বাহির।কি এসব ভাবছে সে?মানুষটা মরতে যাবে কেনো?তবে হয়তো তার এটা খেয়ালে নেই।মানুষ মরণশীল।সে পিঁড়ি অনুযায়ী এসেছে বলে পিঁড়ি অনুযায়ী চলে যাবে।এমনটা নিয়ম সৃষ্টিকর্তা করেন নি।যার যখন সৃষ্টিকর্তার থেকে ডাক আসবে তখনই তাকে চলে যেতে হবে!এটা অতি বাস্তবিক সত্যি কথা।

চলবে….

#ফুলকৌড়ি
(৩৫)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

গভীর রাতের প্রহরের ন্যায় এই মধ্যে দুপুরেও বাড়িটা শুনশান বিরাজ করছে।নিস্তব্ধ, নীরব!মানুষের অভাবে খা-খা করছে-ও বৈকি।এতোবড় বাড়িটার কোথাও কেউ নেই যেনো।অথচ বাড়িতে কম মানুষও নয়।অসুস্থ
জাহিদ সাহেব নিয়মানুযায়ী দুপুরের খাবার খেয়ে একটা ভাতঘুম দেন।আজও তার অন্যথা হয়নি।দুপুরে খেয়েই ঘুমিয়েছ।যারকারনে বাড়িতে এতোবড় একটা দূর্ঘটনার ঘটনায় সবাই যে মূর্ছা পড়েছে।এটা তিনি জানেনও না।নাফিমও ঘুমে।জ্বরে অসুস্থ দীবাও গভীর ঘুমে পড়ে আছে বিছানায়।বাড়িতে আপতত তিনজন মানুষের আনাগোনা চলছে।তবুও সেই মানুষগুলোর আনাগোনা ঘুমিয়ে থাকা মানুষগুলোর থেকেও খুব একটা পার্থক্য নেই।সেই রক্তে মাখামাখি অবস্থায় আবারও বাড়ির সদস্যগুলো নিয়ে হসপিটালে ছুটতে হলো ইভানকে।বাদ গেলেন না বৃদ্ধা ফাতেমা বেগমও।স্বান্তনা রহমানও যাবার প্রস্তুতি নিতেই,বাড়ির অসুস্থ মানুষগুলোর কথা ভেবে ফের রয়ে গেলেন।নাহলে নিভানকে যে তিনি নাফিমের থেকে কোনো অংশেও আলাদা নজরে দেখেন না।আপন সন্তানের মতোই মনে করেন।সেই ছেলেটা অসুস্থ!তিনি না গিয়ে বাড়িতে থাকতে পারেন!তবে বাড়ির মানুষগুলোর কথা না ভাবলেও যে নয়।তাই বাধ্য হয়ে শ্বাশুড়ি মায়ের কথায় তিনি রয়ে গেলেন।তবে মন ছটফটিয়ে চলেছে,ওই মারাত্মক অসুস্থ ছেলেটাকে একপলক দেখার জন্য।সোফার একপাশে দু’হাতে মাথা চেপে মনেমনে শত প্রার্থনা করে চলেছেন তিনি।যেনো ছেলেটার মহাবিপদ কেটে যায়,দ্রুত সুস্থ হয়ে ফিরে আসে।

স্বান্তনা রহমানের অপর পাশের সোফায় বসে আছে তন্ময়ী আর কৌড়ি।দুজনেই চুপচাপ।তন্ময়ী ক্ষনে ক্ষনে চোখ মুছলেও,তার কান্নার শব্দ নেই।কৌড়িও নীরব।স্বান্তনা রহমানের মতো মাথায় দুহাত চেপে বসে আছে।
নিজের ভিতরে কি চলছে,সেটা শুধু সেইই জানে।সকালের ফোন কলের কথাগুলো বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে, আর বুকব্যথাটা জ্বলনে রুপান্তরিত হচ্ছে।সেই জ্বলনের বহিঃপ্রকাশ না কান্নার জ্বলে নিভিয়ে ফেলতে পারছে,না ভিতরটাকে কোনোপ্রকার স্বস্তি দিতে পারছে।তবে মনেমনে প্রার্থনা করে চলেছে।–মানুষটা সুস্থ সমেত তারকাছে ফিরে আসুক।হ্যাঁ তারকাছে ফিরে আসুক।

‘জানো কৌড়ি,পৃথিবীতে মানুষের বাঁচার অনেক শখ।আমারও বাঁচার অনেক ইচ্ছে,শখ।তবে এই মূহুর্তে আমি আমার নিঃশ্বাসের বিনিময় হলেও,ওই মানুষটা সুস্থ হয়ে ফিরে আসার প্রার্থনা করছি।আমার এই দোয়ার কারন শুনবে না তুমি?

দু’হাতে চেপে রাখা মাথাটা একটুখানি তুললো কৌড়ি।হরিণী বড়োবড়ো কালোমনির শান্ত চোখজোড়া মূহুর্তেই জ্বলজ্বল করে উঠলো।চোখের কালোমনির পাশের সাদা অংশটুকুও মৃদু লালচেবর্ণে ছেয়ে আছে।সেদিকে বিশেষ খেয়াল করলোনা তন্ময়ী।ফের বলতে শুনতে করলো।

‘নিভান ভাইয়া আমার জীবনের এমন একটা সম্মান শ্রদ্ধার স্থান।আমি উনাকে ভাইয়ের বন্ধু কম,উনার আচার আচারণে নিজের ভাইয়ের মতো জেনেছি বেশি। পাশে পেয়েছিও সবসময় তেমনটা রূপে।উনি আমার জীবনে মা ভাইয়ার পরপরই এমন একটা শ্রদ্ধীয় মানুষ।
যেখানে উনার অবদান একটা একটা বলে শেষ করার নয়।নিজের বোনের মতো দায়িত্ব পালন করেছে।যেভাবে একটা ভাই পালন করে,উনি আমার প্রতি করেছেন।দাদাভাই বিদেশ থাকাকালীন আমাদের সমস্ত দায়দায়িত্ব নিজগুণে নিপুনভাবে সামলিয়েছেন।তখন ভাবতাম,দূরসম্পর্কের জন্য কেউ কিভাবে এতেটা করে!সেখান থেকেই শ্রদ্ধাটা আরও বেড়ে গেলো।যদিও দাদাভাইয়ের সাথে বন্ধুত্ব হওয়ার পর থেকে,আমার আর দাদাভাইয়ের জীবনে অর্থাৎ আমাদের জীবনে উনার অনেক অবদান।শুধু অর্থ দিয়ে নয়,আমাকে নিজের বোনের মতো স্নেহ করা,আমার দাদাভাইকে বন্ধু কম নিজের ভাইয়ের মতো ভালোবাসা,মা’কে মায়ের মতো সম্মান শ্রদ্ধা করা।খেয়াল রাখা।আমাদের মধ্যে যে দূরসম্পর্ক।সেই সম্পর্কের প্রতি যত্নশীল হওয়া।কে করে এই জামানায়? সত্যিই আমি উনার মতো,ছেলে, বন্ধু, ভাই,খুব কমই দেখেছি।আর ওরকম মানুষের বেচে থাকা,সুস্থ থাকা পৃথিবীতে খুব দরকার।আমার চেয়েও বেঁচে থাকা দরকার।

চেনা পরিচিত মানুষগুলো মানুষটাকে কতোটা সম্মান কতোটা শ্রদ্ধা করে।ভালোবাসে।অথচ তারকাছেই সেই মানুষটা ভালোবাসার কাঙাল।আর সেই মানুষটার হতে পারছেনা সে।উফফ! নিজের আলাদা ভাবনায় মশগুল হলো কৌড়ি।স্বান্তনা রহমান এতোসময় মাথা হাত চেপে বসে থাকলে-ও তন্ময়ী কথা শুরু করতেই,ওর মুখের তাকিয়ে নীরবে কথাগুলো শুনে গেলেন।তন্ময়ী কথা শেষ করতেই উঠে দু-জনের মধ্যর ফাঁকা জায়গায় গিয়ে বসলেন তিনি।দু’জনেই উনার দিকে তাকালো।সেটা দেখে দূর্বল হেসে তন্ময়ীর মাথায় হাত রেখে বললেন।

‘মন খারাপ করো না।সব ঠিক হয়ে যাবে।দেখবে নিভান এই সুস্থ হয়ে ফিরলো বলে কথা।এতো মানুষের প্রার্থনা বিফলে যেতে পারে!পারে না।

মাথা নাড়ালো তন্ময়ী।স্বান্তনা রহমানের হাত জড়িয়ে কাঁধে মাথা রেখে বললো–এই প্রার্থনাই তো করে চলেছি বারংবার।ভাইয়া সুস্থ হয়ে দ্রুত ফিরুক।

তন্ময়ী ভরসার কাঁধ খুঁজে নিয়ে সেখানে মাথা রাখলো।কৌড়িও যেনো ভরসার কোল খুঁজে পেলো।দ্বিধাহীন নীরবে মাথাটা এলিয়ে দিলো স্বান্তনা রহমানের কোলে।তড়িৎ কৌড়ির মুখের দিকে তাকালেন তিনি।তার আগেই কৌড়ি মুখ লুকিয়ে নিয়েছে স্বান্তনা রহমানের পেটের শাড়ির ভাঁজে।চিবুকের একপাশ আর মাথার চুলের অংশ ছাড়া নজরের আড়ালে চলে গেলো সব।তবুও সেদিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে কৌড়ির মাথায় স্নেহের হাত রাখলেন তিনি। ইদানীং একটা বিষয় তিনি খুবই সুক্ষ ভাবে লক্ষ্য করেছেন,যা সহজে সবার নজরে পড়ার কথা নয়।কৌড়ির প্রতি নিভানের মায়াময় শান্ত নরম চাহুনি।একদিন খেয়াল করার পরে গুরুত্ব দেননি তিনি।তবে বিয়ে বাড়ির এতো মেয়েদের উজ্জ্বল সাজগোজ ছাড়িয়ে,সাধারণভাবে ঘুরতে থাকা কৌড়ির পানে সেই একই মায়াময় মুগ্ধ নজর আবদ্ধিত হওয়া।বিষয়টা সাধারণ বলে মনে হয়নি উনার।নিভান যে চরিত্রের ছেলে,তারসাথে মিলিয়ে তিনি যে উত্তর পেলেন।সেটাও অবিশ্বাস্য লেগেছে।বিষয়টা নিয়ে তিনি নীহারিকা বেগমের সাথে আলাপ করতে চেয়েছিলেন।কিন্তু বিয়ের হাজার তাল-ঝামেলায় আর হয়ে উঠে-নি।

কৌড়ির চুলের ভাঁজে আঙুল বিচরণ করলেন তিনি।মুগ্ধ হয়ে ফর্সা কান,গলা এগুলো পর্যবেক্ষণ করলেন।মেয়েটার সৌন্দর্যের কমতি নেই।যে কার-ও নজরের মুগ্ধতা ছড়াবে।তবে নিভান শুধু সৌন্দর্যের পাগল নয়।ও ছেলে আলাদা ধাতুর।যা দীবার বিষয়েসহ,আরও অনেক সৌন্দর্যময়ী মেয়ের বিষয়ে তিনিসহ পরিবারের সবাই ঢেড় টের পেয়েছেন।তবে কৌড়ি!বিষয়টা ভাবিয়েছে উনাকে।যদিও ছেলেমেয়ে দু’টোই চাপা স্বভাবের।একজন পড়াশোনা নিয়ে যেমন ব্যস্ত।অন্যজন বিজনেস নিয়ে তার দ্বিগুণ ব্যস্ত। দু’জনের কাউকে সেভাবে ফোনেও দেখা যায় না।আর না কখনো কথা বলতে শুনেছেন।বিধায় কৌড়ির দিক থেকে কিছু না থাকলেও,নিভানের দিক থেকে কিছু একটা চলছে।তবে তাই যদি হয়,বউমা হিসাবে কৌড়ি মোটেও মন্দ হবেনা।শুধু ছেলেটা সুস্থ হয়ে ফিরলেই শুকরিয়া।

আজ হসপিটালে নিভানের অসুস্থতার চারদিন চলছে।মারাত্মক এক্সিডেন্টে বেঁচে ফিরার কথা নয়।তবুও বেঁচে ফিরেছে সে।হয়তো জীবন এখানেই শেষ নয় তার।জীবনের এগিয়ে যাওয়ার পাতা এখনো বাকি।তাই হয়তো ফিরে এসেছে।রহম করেছেন আল্লাহ।হসপিটালের স্পেশাল কেবিনের রুগী বেডটায় হেলান দিয়ে পা মেলিয়ে বসে আছে নিভান।গায়ের হালকা শীততাপনিয়ন্ত্রক বস্ত্রটা কোমর পর্যন্ত দেওয়া।চোখ বুঁজে আপনমনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে।এক্সিডেন্ট হওয়ার প্রায় চব্বিশ ঘন্টা পরে তার নাকি জ্ঞান ফিরেছে।জ্ঞান ফেরার পর অনেককেই দেখেছে হসপিটালে।মাকে হাওমাও করে কাঁদতে দেখেছে,বাড়ির প্রতিটি সদস্যকে তারজন্য মলিন রূপে দেখেছে সে।যে ফুপুর সাথে তার কখনো আদর আহ্লাদিত সম্পর্ক গড়ে উঠেনি,সেই ফুপু তাই মায়ামায়া করে কথা বললো।দাদুমা।তিনি তো কেঁদেই দিয়ে কতো আদূরী কন্ঠে এটা ওটা বললেন।এই চারদিনে নিজের আপনজন, আত্মীয় স্বজন বলতে কেউ বাকি নেই,তাকে দেখতে আসতে।অথচ যাকে দেখে মন শান্ত হতে চাইছে। নজর খুঁজেছে। আজ চারদিনেও তার দেখা মেলেনি।কি-করে মেয়েটা এতো নিষ্ঠুর হতে পারে!তার কি একটুও মায়া হয়নি তার প্রতি।আর মারাত্মক এক্সিডেন্টের কথা শুনেও কি একটুও কষ্ট, খারাপ লাগিনি মেয়েটার!অদ্ভুত হাসলো নিভান।সে হাসি যেনো বর্ণনা দিলো নিজের প্রতি তাচ্ছিল্যতা।

‘আসবো দাদুভাই?

পুরানো বৃদ্ধা কাঁপা কন্ঠস্বর কানে ভেসে আসতেই মৃদু কেঁপে উঠলেন নীহারিকা বেগম।কতোগুলো দিনপর দেখা।কতোগুলো দিন কোথায়,প্রায় দুই যুগেরও বেশি।এরমধ্যে নিভানের সাথে টুকিটাকি সম্পর্কের আদান-প্রদান থাকলেও, উনার সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয়নি ওবাড়ির ছাড়ার পর আর।হয়তো নাতীর অসুস্থতার কথা শুনে এসেছেন।ভদ্রমহিলা অনুমতি চাইলেও অনুমতি পাওয়ার আশা করলেন না।ভিতরে ঢুকেই নিভানের কাছাকাছি গিয়ে বসলেন।নিভানকে এই অবস্থায় দেখে কেদেও ফেললেন।ফের নিভানের মাথায় হাতে জড়ানো ব্যান্ডেজে হাত ছুঁইয়ে আদূরে গলায় বললেন।

‘এখন কেমন আছো দাদুভাই?আমি তোমার এক্সিডেন্টের কথা কাল সন্ধ্যায় শুনেছি,নাহলে আসতে কি আমার দেরি হয়!

শ্যামবর্ণের জৌলুশ একটা বৃদ্ধা আবায়ব।জিনগতভাবে হয়তো এই একই বর্নের একোই মুখাবয়ব পেয়েছিলেন বাবা আওসাফ আহমেদ।আর সেই একোই জিনগতভাবে বাবার কাঠামো বর্ন পেয়েছে সে।বিধায় এই মুখটার দিকে তাকিয়ে শক্তপোক্তভাবে কোনো কথা বলতে পারে-না নিভান।পারেনা বলতে ভুল।ওবাড়ি ছাড়ার পর,প্রায় বারো বছর পর এই দাদুমার অসুস্থতার কথা শুনে উনাকে দেখতে গিয়েছিলো নিভান।তখন কম কথা শুনিয়ে আসিনি।যদিও সে যেতে চায়নি ওবাড়ি।তবে মরণাপন্ন একজন মানুষ তাকে দেখতে চেয়েছে, তাই মায়ের কথা মেনে ওবাড়িতে যেতে বাধ্য হয়েছিলো সে।হয়তো ওবাড়ি ছাড়ার ক্ষেত্রে দাদুমার কোনো দোষ ছিলো-না।তবে তিনি যে ধরনের শক্তপোক্ত মহিলা,তিনি চাইলেই ছেলেদের মুখের উপর কথা বলে নিজের জোর দেখাতে পারতেন।এবং তাদেরকে ওবাড়িতে রাখার সুব্যবস্থা-ও করতে পারতেন।তবে তিনি সেটা করেননি।নীরব ছিলেন।মায়ের ভাস্যনুযায়ী হয়তো এটা-ও ঠিক।ভাগ্য চেয়েছিলো অন্যরকম,তাই আজ তারা এখানে।ভাগ্য ভিন্ন।ভাবনা ছেড়ে কিছুটা দূরে দাঁড়ানো মায়ের দিকে একপলক চেয়ে মৃদুস্বরে বললো।

‘কান্নাকাটি করবেন না।আমি এখন ঠিক আছি।আপনি কেমন আছেন?শরীর ঠিক আছে আপনার?

‘কান্নাকাটি করবো না বলছো?ওই একইভাবে তো তোমার বাবাও চলে গেলেন।আমার প্রথম সন্তান ছিলো আওসাফ।সেই সন্তান আমার আগে চলে গেলো!আমার অবস্থা বুঝতে পারছো?সেই ঘরপোড়া গোয়ালিনী আমি।আমার নিজের কারও এক্সিডেন্টের কথা শুনলে যে আমার পরাণ যায়!আর তুমি আমার সেই সন্তানের সন্তান।তোমাকে সেই আদর আহ্লাদে এই দুহাতে মানুষ করতে পারিনি হয়তো।কাছেও রাখতে পারিনি বলে মনে করো,আমি তোমার মন্দে ব্যথিত হইনা?আমার আফসোস তুমি বুঝবেনা দাদু।তবে তোমার মন্দেও একইভাবে ছটফটায় আমি।কষ্ট পাই,ব্যাথা পাই।যেমনটা আমার আওসাফের মন্দে ব্যথা কষ্ট অনুভব করতাম।আমার বংশের প্রথম নাতী তুমি আমার।অথচ তোমাকে না নিজের কাছে রাখতে পারলাম আর না,নিজের বড় সন্তানের আদরের সন্তান হিসাবে যোগ্য সম্মান দিয়ে আদর আহ্লাদে নিজ হাতে বড় করে পারলাম।না-হলে কি তোমাকে অন্যের দারস্থ হয়ে থাকতে হয়,আর না তোমার এই মহাবিপদের তিনদিনের মাথায় এসে আমাকে দেখতে হয় তোমাকে!

ভদ্রমহিলা কাঁদলেন।বেড থেকে কিছুটা দূর দাড়িয়ে সেই নীরবে কান্না নীহারিকা বেগম-ও দেখলেন,এবং নিজেও উপলব্ধি করলেন।ভদ্রমহিলার প্রতি এতোদিনের অভিযোগ বুঝি তরতর করে কমে যেতে থাকলো উনার।আজ নিজেও সেই একই পরিস্থিতির মোকাবেলা করছেন।উনার সন্তান করুনাময়ের অশেষ রহমতে এখনো বেঁচে আছে।কিন্তু ওই বৃদ্ধা মহিলার সন্তানের লাশতো উনার দুচোখের সামনে দিয়ে কবরে নিয়ে শায়িত করা হয়েছিলো।তবে কি পরিস্থিতি হয়েছিলো উনার!কিভাবে সামলিয়ে ছিলো নিজেকে!আজ তা বেশ ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারলেন।সেদিন নীহারিকা বেগমের উপরে দেখানো রাগ ক্ষোভে বলা কথাগুলো হয়তো যথার্থ না থাকলেও,একেবারে অনর্থ ছিলোনা।আর স্বামীর বাড়িছাড়া সেটাতো নিতান্তই ভাগ্যে ছিলো।নয়তো ওই অল্প বয়সে একটা বাচ্চা নিয়ে ওই সংসারে টিকে থাকা দীর্ঘস্থায়ী কখনো সম্ভব হতোনা।যেখানে নিজের দেবরের নজর পড়েছিলো উনার উপর।যার ঘরসংসারও ছিলো।সেই ঘর ভাঙতে চায়নি বলেই নিজ থেকে ওই সংসার ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন তিনি।ইজ্জত নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন,স্বামীর সম্পদ নিয়ে নয়।

বাবার নামটা বারবার আসতেই চোখ বুঁজে নিলো নিভান।ববা নামক মানুষটাকে সে প্রচন্ড ভালোবাসতো, এমনকি ওই মানুষাটও তাকে প্রচন্ড ভালোবাসতো।নিভানের যেটুকু স্মৃতিতে স্মরণ আছে,বাবা সবসময় তার সাথে আদুরে গলায় কথা বলতো।মানুষটা তাকে এতো ভালোবাসতো,সেই ছোট্টো সময়ের ভালোবাসা স্মৃতিতে স্মরণে না থাকার কথা থাকলেও,স্পষ্ট স্মরণে আছে নিভানের।তাই তো সেই একই আদর পিতৃস্নেহ পাওয়া সত্ত্বেও,জাহিদ সাহেবকে কখনো বাবা ডাকটা ডাকা হয়নি।চোখ বুঁজে থাকা নিভানের মুখের দিকে অনড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ভদ্রমহিলা।একদম ছেলের কপি।নিভান ছোটো থাকতে ততোটা অনুরূপ না মনে হলেও এখন পুরো অনুরূপ মনে হয়।সেই চোখ, ঠোঁট, গড়ন। এমনকি উঁচু লম্বা,গায়ের বর্ন।ভদ্রমহিলা উঠে দাঁড়ালেন। নিভানের কপালে ব্যান্ডেজ জড়ানো সাদা পট্রির উপর প্রগাঢ় চুমু একে দিলেন।মনহলো নিজের ছেলেকেই আদর করছেন।এই উপলব্ধি উনার এখান থেকে অনেকগুলো বছর আগে নিভান যখন দেখা করতে গিয়েছিলো উনার সাথে তখনই অনুভব করেছিলেন।তরপর প্রতিটা রাত উনার আফসোস আর দীর্ঘ নিঃশ্বাসে কেটেছে,নিজের ছেলের অংশকে কাছে ধরে রাখতে না পারার।নিজের আদূরের বড় সন্তানের অস্তিত্ব, রক্ত অন্যের দারস্থ হয়ে মানুষ হওয়ার।উফফ সেই আফসোস কি কখনো মিটবে!মিটবে না।প্রগাঢ় চুমু একে সরে আসলেন ভদ্রমহিলা। ফের আবার নিভানের কপালের ব্যান্ডেজ ছুয়ে আদুরে গলায় অপরাধী মুখ করে বললেন।

‘দাদুমাকে ক্ষমা করো দাদুভাই।তার আদর ভালোবাসা থেকে তোমাকে বঞ্চিত রাখার জন্য ক্ষমা করো।তোমার সাথে হওয়া সকল অবিচার অন্যায়ের জন্য ক্ষমা করো তোমার এই হতভাগা দাদুমাকে।

নিজ রক্ত যতোই দূরে থসক।আর নিজের প্রতি যতোই অন্যায় অবিচার করুক,এই বংশীয় রক্তের টান মায়া যেনো অন্যরকম।দাদুমার আদর ছোঁয়া,বাবার ছোঁয়ার মতো যেনো উপলব্ধি করলো নিভান।সেই প্রেক্ষিতেই মুখে আওড়ালো।

‘এমনভাবে বলবেন না দাদুমা,বাবা কষ্ট পাবেন।উনার মা উনার সন্তানের কাছে এভাবে ছোটো হয়ে কথা বলছে!উনি বেঁচে থাকলে হয়তো এই দৃশ্যটা কখনো মানতেন না।আর আমিও চাইনা,আমার মৃত্যু বাবার মা অসম্মতি হোক।

দাদির ভালোবাসা পেয়েও চোখ মেললো-না নিভান।সেভাবে চোখ বুঁজে রেখে বললো কতগুলো।

‘আর আমার আওসাফের আমানত।তার কলিজার টুকরো যে আমি আগলে রাখতে পারিনি,তারজন্য ও কি আমার উপর মনোক্ষুণ্ণ হবেনা!কষ্ট পাবেনা!

এতোদিন পর এই কথাগুলো মনেহলো!মনে কথাগুলো আসলেও,কথা বাড়ালোনা নিভান।চুপ রইলো।নিভানের থেকে সরতেই ভদ্রমহিলার নজর পড়লো পাশে।নীহারিকা বেগম-কে দেখেই পরাণ কেঁদে উঠলো।নীরবে কিছু সময় তাকিয়ে কাঁপা স্বরে আওড়ালেন।

‘কেমন আছো নীহারিকা?

গলা কাঁপলো নীহারিকা বেগমের।গত হওয়া স্বামী না থাকলেও উনাকে তিনি ভুলে যাননি।আর না তার পরিবারকে।আর না কয়েক বছরের সংসারকে।যখন একাকি সময় পার করেন,মনে পড়ে ফেলে আসা দিনগুলো। সবকিছু।আবার দীর্ঘশ্বাসের সাথে মিলিয়ে যায় মনে পড়া অতিত।ভদ্রমহিলা প্রশ্ন জবতেই, সময় নিয়ে নীহারিকা বেগম উত্তর দিলেন।—ভালো আছি।আপনি কেমন আছেন মা?

‘এইতো আছি ভালো।তবে মা না-হয় সন্তানের ভালোর জন্য তাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো,তুমি সেটা বুঝেও অবুঝ রইলে কিকরে?এই মা-টা কেমন আছে একটু খোঁজখবর নিলে না?জানতে চাইলেনা?আমার অসুস্থতা মৃত্যুশয্যা পর্যন্ত গড়িয়েছিলো।শুধু নাতিকে দেখতে চায়নি আমি,তোমাকেও চেয়েছিলাম।কৈ মা’কে তো একবার দেখতে গেলেনা?মা’কে বুঝি এখনো ক্ষমা করতে পারোনি?

খোঁজ নিয়েছিলো নীহারিকা বেগম।ওই বাড়ির একটা সদস্যর সাথে এখনো যোগাযোগ আছে উনার।তার কাছেই খোঁজ নিয়েছিলো।তবে ভদ্রমহিলা হয়তো জানেন না।জানাতে চাইলোওনা নীহারিকা বেগম। ধীর পায়ে এগিয়ে শ্বাশুড়ি মায়ের কাছে গিয়ে বসলেন।আলতো স্পর্শে উনার হাতটা ধরে বললেন—আপনি তো জানেন সবকিছু। পরিস্থিতি যেটা দাড়িয়েছিলো,ওই বাড়িতে পা রাখার ইচ্ছে আর কখনো হয়নি মা।তবে আপনাদের আমি ভুলিনি মা।আর আপনি এমন কোনো অন্যায় আমার সাথে করেননি যে আপনাকে আমার ক্ষমার নজরে দেখতে হবে।

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ভদ্রমহিলা।ফের রয়েসয়ে বললেন–তুমি যারজন্য ওবাড়িতে পা মাড়াতে চাওনা,সে এখন আর ওই বাসভবনে থাকেনা।সবকিছু বেঁচেকিনে মা-ভাইদের ফেলে পর শহরকে আপন করে নিয়েছে।স্ত্রী সন্তান নিয়ে বিদেশে স্থায়িত্ব হয়েছে।এক সন্তানকে চোখের সামনে দিয়ে কবরে শায়িত করা হলো।অন্য সন্তানকে পরের বাড়ির মেয়ের জন্য কাছছাড়া করতে চায়নি আমি।তাই সেদিন আমার আওসাফের কাছে জবাবদিহিতা করা লাগবে জেনেও আমি তোমাদের প্রতি অবিচার করলাম।সেদিন নীরব থেকে বাড়িছাড়া হতে বাধ্য করলাম।অথচ সেই তাই হলো।সেই সন্তান নিজের ভালোর জন্য,নিজের সুখের জন্য আমার কাছছাড়া হয়েই গেলো।অথচ আমি তোমাদের কাছে আমার মৃত সন্তানের কাছে কতোবড় দ্বায়ী হয়ে রইলাম।আমাকে ক্ষমা করে দিও নীহারিকা!ক্ষমা করে দিও!

মনেমনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভদ্রমহিলাকে স্বান্তনা দিতে থাকলেন নীহারিকা বেগম।সেখান থেকে কিছুক্ষণ পর নিভানের আরও ছোটো চাচা ঢুকলো কেবিনে।যিনি নিভানের দাদুমাকে সাথে করে নিয়ে এসেছেন।তবে নিভানের জন্য ফলমূল নিয়ে আসতে, মাকে এগিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন।ভদ্রমহিলা অসুস্থ নাতীকে দেখার জন্য উনাকে পথে কোথাও দাঁড়াতে দেয়নি।বিধায় উনাকে হসপিটালে পৌঁছে দিয়ে উনি পুনরায় ফলমূল আনতে গিয়েছিলেন।নীহারিকা বেগম যখন বাড়ি ছেড়েছিলেন ছেলেটা ছোটো ছিলো।কেবল ইন্টারমিডিয়েট পড়ে।সেই ছেলের এখন ভরা সংসার।ভালোমন্দ আলাপন সেরে,সাংসারিক ভালোমন্দ কথায় মত্ত হলো তিনজনে।সেখানে নিভান শুধু নীরব দর্শক।
সবার কথা শুনে যাচ্ছে।যদিও ছোটো চাচার সাথে তার মোটামুটি সম্পর্ক।যোগাযোগ ও আছে।চলতো মাঝেমধ্যে।তবে ওবাড়িতে আসা যাওয়া ছিলো-না।সেই সম্পর্কে উনি নিভানের সাথেও মাঝেমধ্যে টুকটাক কথা সারছেন।তবে নিভানের মন অন্য কোথাও।নজর আবদ্ধ কেবিনের দরজায়।এই বুঝি সেই কাঙ্ক্ষিত মুখটা দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো।কিন্তু নসহ!সময় অপেক্ষার গড়াচ্ছে।অপেক্ষা করতে করতে আজ চারটা দিন।অথচ সেই মুখটার দেখা নেই।মাথা সোজা করে চোখ বুঁজে নিলো নিভান।শক্তমনে হঠাৎই অভিমানেরা জায়গা করে নিলো,যেখানে যুক্ত হলো অভিযোগেরাও।সে মনেমনে আওড়ালো।

‘তুমি এতো নিষ্ঠুর নির্দয়া কি-করে হতে পারো কৌড়ি?
কি করে?তবে কি আমি তোমাকে কোমল ফুলটা ভেবে মারাত্মক ভুল করে ফেললাম?

শীতের দক্ষিণা হিমেল হাওয়া বইছে এলোমেলো ভাবে।প্রচুর ঠান্ডাভাব।সেই ঠান্ডাভাব ছাড়িয়ে যাচ্ছে নিভানের হালকা ফুলসিল্ভ সাদা টিশার্টটা ভেদ করে।তবুও অনড় ছেলেটা।যেনো শীতল বাতাসটা তার শরীর ছুঁয়ে গেলেও ভিতরটা ছুঁয়ে দিতে পারছেনা।যে ঠান্ডা ভাবটায় শরীর হিম হয়ে আসছে,তা কিছুতেই ভিতরের জ্বলন’টা নিভাতে পারছেনা।বাড়িতে এসেছে কাল বিকালে তবুও মেয়েটার দেখা নেই।দুর প্রান্তে স্থির হয়ে থাকা বাদামিবর্ন নজরজোড়া এবার আপনমনে বুঁজে নিলো নিভান।হঠাৎ সেই শান্ত পায়ের কদমধ্বনি। হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠলো নিভানের।কৌড়ি এসেছে।মেয়েটার পায়ের নিঃশব্দতাও তার চেনা।সে শতভাগ সিওর কৌড়ি এসেছে।ভিতরের জ্বলনটা কমার বদৌলে বেড়ে গেলো দ্বিগুণ।তবে ভুলেও পিছু ফিরলো না নিভান।প্রগাঢ় এক অভিমানে সেভাবেই চোখবুঁজে অনড় দাঁড়িয়ে রইলো।মনেমনে অভিমানী মন প্রশ্ন যাপলো, সত্যিই কি মেয়েটা তারজন্য এসেছে?মরে যাচ্ছিলো তাই মেয়েটা দেখতে যায়নি,আর এখন তো সে সুস্থ।
দুরুদুরু বুকে নিভানের কয়েক কদম পিছে এসে দাড়ালো কৌড়ি।সেদিনের পর এই মানুষটাকে একটাবার দেখার জন্য কতোটা উতলা হয়ে ছিলো তার মন।সেটা শুধু সেই জানে। হসপিটালে যাওয়ার জন্যও মুখিয়ে ছিলো।অথচ সবার হসপিটালে অবাধ যাওয়া আসা চললেও, তাকে যেনো সেখানে নিয়ে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।এমনটা ভেবে বসেছিলো সবাই।দ্বিধায়,লজ্জায় সেও আর বলতে পারিনি, মানুষটাকে একটু দেখতে সেও হসপিটালে যেতে চায়।কাল বিকালে যখন মানুষটাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হলো।কৌড়ি সামনাসামনি না যেতে পারলেও,দরজার আড়াল থেকে অসুস্থ মানুষটাকে খুব খেয়াল করে দেখেছিলো।শ্যামবর্ণ মুখটা সেই গম্ভীর্য।কপালে মোটা করে ব্যান্ডেজ জড়ানো।হাতেও সেই একই অবস্থা।ইশ,ওই অবস্থায় মানুষটাকে দেখে পরানটা কিভাবে ছলকে উঠেছিলো!আজ সকাল থেকেও সুযোগ পায়নি মানুষটাকে দেখার, আর কাছে যাওয়া তো অপ্রকাশ্যভাবে বারণ।এই নিষেধ বারণ কেউ না করলেও,কুন্ঠায় এই নিষেধ যেনো সম্পর্কের অধিকারের।তবে বারবার খেয়াল রেখেছে,মানুষটা ড্রয়িংরুমে আসলো কি-না?রুম থেকে বের হলো কি-না? কিন্তু না আজ সারাদিনে মানুষটা সকাল থেকে রুম থেকে বের হয়নি।তার সকল প্রয়োজন অপ্রয়োজন রুমে মেটানো হয়েছে।সেখানেও বাড়ির সবার অবাধ যাতায়াত থাকলেও,সম্পর্কের খাতিরে তার যাওয়া প্রশ্নেবিদ্ধের!

‘কিজন্য এসেছো?

ভারী গলায় চমকে উঠলো কৌড়ি।মুখ উঁচু থাকলেও,খেয়ালি নজর ভাবনায় ডুবে ছিলো।গম্ভীর স্বরের বার্তা কানে আসতেই নজট খেয়ালি হয়ে উঠলো।
উচুলম্বা মানুষটার পিছন দেখা গেলেও,সামনে দেখার উপায় নেই।তবে মানুষটার গম্ভীর গলাটা আজ আরও দৃঢ়।কিন্তু তারসাথে তো কখনো এতো কঠিন গলায় কথা বলেনা।তবে কি?ভাবনা না এগিয়ে কিছু বলতে গিয়েও দ্বিধায় পড়লো কৌড়ি।কি বলবে?কি জিজ্ঞেস করবে সে?কখনো নিজ ইচ্ছেতে মানুষটার সাথে কথা হয়নি তার!তবে কি জানতে চাইবে?আর জানতে চাওয়াতে আসছে যাচ্ছেই বা কি?কৌড়ির নীরবতা আরও জ্বালিয়ে দিলো নিভানকে।মূহুর্তেই ঘুরে কৌড়ির মুখোমুখি দাঁড়ালো সে।ক্ষোভিত গলা শুধালো।

‘বাড়িতে কুকুর বিড়াল পুষলেও মানুষের তারপ্রতি একটু মায়া জন্মায়।টান হয়।সেখানে আমিতো মানুষ।আমার দূর্বলতা তুমি।জেনেও তোমার কি একটুও আমার জন্য মায়া হয়নি কৌড়ি?আমি মরে যেতে পারতাম,সেটা জেনেও কি আমাকে একটু দেখতে ইচ্ছে হয়নি তোমার?

তীব্র অভিযোগে বুক কেঁপে উঠলো। হৃদপিণ্ডে বিধলো যেনো সূচালো তীর।সেই যন্ত্রণায় চোখে ভিড় করলো নোনাজল।তবে সেই নোনাজল দাঁতে দাঁত চেপে রোধ করলো কার্নিশ বেয়ে গড়ানো থেকে।গলা কাঁপলো কথা বলতে গিয়ে।তবুও বললো।

‘আমি যেতে চেয়েছিলাম।

‘আমি অপেক্ষাতে ছিলাম।কিন্তু তুমি যাওনি।কেনো?

এই কেনোর জবাবদিহিতা দিতে গিয়েও দিতে পারলোনা কৌড়ি।শুধু অনিমেষ চেয়ে রইলো নিভানের ক্ষোভিত শ্যামবর্ণ মুখে।কৌড়িকে চুপ থাকতে দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো নিভান।যেনো সেই হাসি নিজের উপর তাচ্ছিল্য করা।মুখে বললোও সেরকম তাচ্ছিল্যময় কথা।আগের সেই ক্ষোভ নেই গলায়।গলার স্বর এবার শীতল হলো।সেই শীতল গলার শিথিল বাক্যে কৌড়ির স্পন্দন থমকে গেলো।

‘বিগত চারদিন আমি হসপিটালে শুয়েবসে এটা রিয়েলাইজড্ করলাম,আমি সত্যিই তোমার উপর জোরাবাদী করছি।তুমি ঠিকই বলেছো।আমার,তোমার উপর অনুভূতি জন্মাতেই পারে,সেটা আমার অনুভূতি আর মনের ব্যাপার।তাই বলে তোমার তো বাধ্যবাধকতা নেই,যে সেই একই অনুভূতি তুমি আমাতেও অনুভব করবে।সেই ক্ষেত্রে আমি সত্যিই তোমার উপর জোরাবাদী করছি।দুঃখিত।খুব খুব দুঃখিত।

চোখ বুঁজে ফেললো কৌড়ি। মূহুর্তেই চোখের কার্নিশ বেয়ে অর্নগল নোনাজল গড়ালো। সেটা দেখে ভিতরটা আরও জ্বলে উঠলো নিভানের।তীব্র আক্রোশ নিয়ে কৌড়ির মুখের কাছাকাছি গিয়ে দাড়ালো সে।ফের নিজের ভিতরে জমা সকল অভিমান অভিযোগ মিশিয়ে রাগমিশ্রিত কন্ঠে বললো।

‘তুমি প্রার্থনা করতে আমার ফিরে না আসার।তোমাকে জোরাবাদী করার মানুষটা একেবারে মিলিয়ে যেতো তোমার জীবন থেকে,সেই সুখে তুমি মুক্ত পাখির মতো ডানা মেলে বেড়াতে।প্রার্থনা করতে তুমি আমি না ফিরে আসতাম,তোমার কাছে।

চলবে….

ফুলকৌড়ি পর্ব-৩২+৩৩

0

#ফুলকৌড়ি
(৩২)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

বিয়ে বাড়ি মানেই হৈ-হুল্লোড়ে ছোটাছুটি।তবে বাড়ির অধিকাংশ অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা মেহেন্দি অনুষ্ঠানে যাওয়ায় বাড়িটা আপতত কিছুটা হৈ-হুল্লোড়মুক্ত শব্দহীন, শান্ত।সন্ধ্যা নেমেছে সেই কখন।মান্যতার পড়ার টেবিলে মনোযোগী হয়ে পড়ছে কৌড়ি।যদিও স্থির,মনোযোগী নজর তার বইয়ের পাতায় তবে অমনোযোগী মনটা তার পড়ে আছে অন্যকোথাও।অন্যকোথাওটা ঠিক কোথায়!যে মানুষটার থেকে বারংবার নিজেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলো।তারকাছে?হ্যাঁ তার কাছেই তো!পারছে কোথায় ওই মানুষটাকে নিজের মনস্তাত্ত্বিকে ভাবনা থেকে দূরে রাখতে!যতোই দূরে রাখতে চাইছে,ওই মানুষটা যেনো ততোই টানছে তাকে।তারপ্রতি ভয়াবহ দূর্বল করে তুলছে।দূর্বল তো এমনিতেই হয়ে পড়েছে সে।শুধু উপরে নিজেকে শক্ত রাখার প্রয়াস করে চলে।তবে সেই প্রয়াস,প্রচেষ্টাটাও রাখতে দিচ্ছে কোথায় মানুষটা!বিকেলের বলা গম্ভীর মুগ্ধকন্ঠের অনূভুতিপূর্ন কথাগুলো বারবার মনস্তাত্ত্বিকে হানা দিচ্ছে।শান্তিতে কোনো কিছুতেই তাকে মনোযোগী হতে দিচ্ছে না।না পারছে বইয়ের পাতায় মনোযোগী হতে আর না পারছে বিয়ে বাড়িতে হৈ-হুল্লোড় করে কাটাতে।যদিও শারিরীক কারনে আপতত হৈ-হুল্লোড় তার ভালো লাগছেনা।আবার পনেরো দিন পর পরিক্ষা। আপতত সেই টেনশনে মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।তারউপর ওই মানুষটা!যাকে না পারছে বিভিন্ন দিকের কথা ভেবে সহজে নিজের জীবনে জায়গা দিতে।আবার আর না পারছে নিজের মনস্তাত্ত্বিক থেকে দূরে সরিয়ে ফেলতে।বরাং বারবার মনেহচ্ছে,ওই মানুষটা শুধু তাকে চায়!উনার সকল মুগ্ধকরা অনুভূতি শুধুই তাকে ঘিরে!উফফ এই ভাবনা গুলো সর্বাঙ্গে যেমন থেমেথেমে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে তেমন মনমস্তিষ্ককে এলোমেলো করে দিচ্ছে।দু’হাতে মাথা চেপে ধরলো কৌড়ি।কি এক যন্ত্রণা!তাকে নিয়ে মানুষটার অনুভূতিগুলো জানার পর আরও যেনো মন ছটফট করছে।যতোই মন থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছেনা কেনো,পারছেইনা!হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো।সচকিত হয়ে মাথা উঁচু করে ফোনের দিকে তাকালো।বিথী ফোন করেছে।ফোনটা রিসিভ করে,কানে চাপলো কৌড়ি।প্রতিনিয়ত কথা হয় দু’জনের।সেই হিসাবে ভালো মন্দের বার্তা শুরু হলো।একপর্যায়ে গিয়ে বিথী জিজ্ঞেস করলো।

‘তোর মন খারাপ নাকি?

সচকিত হলো কৌড়ি।তড়িৎ বললো—আরেহ না।

‘তবে কথার স্বর ভালো লাগছে-না কেনো?কথাগুলো যেনো কেমন লাগছে!

‘জানিসতো বাড়িতে বিয়ে।তারউপর পনেরো দিন পর পরিক্ষা টেনশনে মাথায় কাজ করছেনা।এখানে আসার পর পড়ার গ্যাপ গিয়েছিলো প্রায় অনেকদিন।সেই গ্যাপ পড়া চ্যাপ্টারগুলো সেভাবে কভার করা হয়নি।তারউপর যা সিলেবাস।কিভাবে সবটা কমপ্লিট করবো সেটাই ভাবছি।

‘টেনশন নিচ্ছিস কেনো।আরেহ সব ভালো হবে।ইউ আর এ গুড স্টুডেন্ট।এটা তো শুধু আমরা বলিনা,তুই ও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করিস।তবে কেনো এতো ভাবছিস?সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে দেখিস।বরাবরের মতো তোর পরিক্ষাও ভালো হবে।

‘হুমম।তোর পড়াশোনা কেমন চলছে?

যদিও জানাশোনা উত্তর তবুও জিজ্ঞেস করলো কৌড়ি।—আরেহ এতো পড়াশোনা দিয়ে কি হবে ভাই।
তারউপর সেই পড়াশোনা নিয়ে টেনশন!আমি বিথী জানিসইতো পড়াশোনা নিয়ে সবসময় চিল থাকি।পড়াশোনা নিয়ে টেনশন নিয়েছি কখনো।তাতে যাহা আছে কপালে।আপতত তুইও টেনশন নিসনা।

টেনশন নিসনা বললেই কি হয়।মাথায় ভাবনা যে তার কতপ্রকার এসে চেপেছে এটা যদি সে,এই চিলমুডে থাকা মেয়েটাকে বোঝাতে পারতো!বোঝাতে চাইলোওনা কৌড়ি।তাই ওই বিষয়ে আর কথাও বাড়ালোনা।দুই বান্ধবীতে মিলে আরও কিছুসময় কথা বললো।কথা শেষ করে কৌড়ি যখনই ফোন কাটতে যাবে তখনই বিথী পুনরায় তাকে অদ্ভুত গলায় ডেকে উঠলো।

‘এই কৌড়ি।

ডাকটা অদ্ভুত ঠেকলো কৌড়িরও। কপালও কিঞ্চিৎ কুঁচকে গেলো।কিছুটা চিন্তিত গলায় বললো—এভাবে ডাকলি কেনো?কিছু হয়নি তো ওদিকে?

‘আরেহ না।তবে তোকে কিছু বলার ছিলো।

‘কি?

কথাগুলো বলবে কি বলবেনা কিছুটা দ্বিধায় ছিলো বিথী।যার কারনে কল করে কথাগুলো বলতে চেয়েও বলেনি।তবে বলেই যখন ফেলেছে আর দ্বিধা রাখলো না।বললো।

‘জানিস নাহিদ ভাইয়া না ভালো হয়ে গেছে।আগের মতো আজেবাজে ছেলেদের সাথে মোড়ের মাথায় বসে থাকে না।এমনকি সময় অসময়েও তাকে আড্ডা দিতে দেখা যায় না।একেবারে খুবই ভদ্রসদ্র ছেলে না হয়ে গেলে-ও,স্বাভাবিক ছেলেদের মতো চলনফিরন করছেন।কথাবার্তা চালচলনে আগের সেই উগ্র আচারন আর নেই।জানিস আব্বু এসেও প্রায় বলে,মাস্টারের ভাইয়ের ছেলেটা বুঝি এবার ভালো পথে ফিরলো।নিশির সাথেও প্রায় দেখা হয়।ও-ও বলেছে,ভাইয়া নাকি আগের মতো ওসব উল্টো পাল্টা সাইপাস আর খায়না।ওর সাথে-ও নাকি আগের মতো বকাবকি চিল্লাপাল্লাও আর করে-না।মাঝে একদিন কলেজে যাওয়ার পথে আমার সাথে দেখা হলো। আমার কাছে-ও তোর খবর জানতে চাইলেন।উনি যেভাবে জিজ্ঞেস করলেন মনে তো হলো আমার সাথে যে তোর যোগাযোগ আছে।এটা উনি সিইওরলি জানেন।সেভাবেই তো প্রশ্ন করলেন বলেও মনেহলো আমার।তাই আমিও আর এড়িয়ে যেতে পারিনি।বলেছিলাম,তুই ভালো আছিস।তারপর ভালো ছেলের মতো চলে গেলেন।উনার আচারন দেখে আমার সত্যি মনেহচ্ছে উনি ভালো পথে ফিরেছেন তবে!আগে তো আমাকে দেখলেই,এই ছেমড়ি ছাড়া শব্দ ব্যবহার করতো না।সেদিন নাম ধরেতো ডাকলেন সাথে তুমি করেও কথা বললেন।

কিছুটা অবাক হলো কৌড়ি।দাদিআপার সাথে রোজ কথা হয়।কৈ,দাদিআপা তো এবিষয়ে তাকে কিছু বলেন নি!আবার বিথীর কথাও অবিশ্বাসযোগ্য নয়।মেয়েটাকে চোখবন্ধ করে বিশ্বাস করে এমনটা নাহলেও অবিশ্বাস সে কখনোই করতে পারবেনা।যাই হোক এসব নিয়ে আর সে ভাবতে চায়-না।যে ছেলেটার জন্য মা-হীন জীবনটা তার আতঙ্কে কেটে গিয়েছে।জীবনে কতোকিছু ত্যাগ করতে হয়েছে।এমনকি নিজের বাড়িতে সাচ্ছন্দ্য বসাবস করার অধিকারটুকু থেকেও বঞ্চিত।আজ পরের বাড়িতে আশ্রিতা হতে হলো।বাবার তাকে নিয়ে চিন্তায় ব্লাডপ্রেশার বাড়ানো বা এই অকাল মৃত্যুর জন্য ছেলেটা কোনোভাবে কি দ্বায়ী নয়?আর সেই ছেলেটার ভালোমন্দে চাইলেই কি মন সহানুভূতি দেখায়!দেখায় কি-না কৌড়ির জানা নেই।তবে সে দেখাতে পারলোনা।সংগোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিথীকে বললো।

‘যাই হোক,ভালো হলেই ভালো।তবে আমার ফোন নাম্বর চাইলে কখনো দিস-না যেনো।আমি সত্যি, তোকে কিন্তু দাদিআপার থেকেও একফোঁটা কম বিশ্বাস ভরসা করি না।

‘আমি জানি সেটা।আর আমার জ্ঞানত আমি কখনো তোর সেই ভরসা বিশ্বাস ছুটতে দেবনো।এটা তুই আমার উপরে ভরসা রাখতে পারিস।

‘ভরসা রাখি বলেই তো তোকে এক্সট্রা সর্তক করলাম।

‘হুমম।

দু’জনে আরও কিছু সময় ভালোমন্দ কথা বললো।ফের ফোন রাখলো।ফোন কেটে দিয়ে ভাবনায় ব্যস্ত হলো কৌড়ি।হঠাৎ উগ্র স্বভাবের ছেলেটার পরিবর্তনের কারন কি!ছোটো বেলা থেকেই বাজে উগ্র স্বভাবের ছেলেটা হঠাৎই পরিবর্তন হয়ে গেলো!বিষয়টা বিস্ময়কর!
যেখানে ওর মা-ও কখনো আশা রাখেনি ছেলেটার আর ভালো পথে ফিরবে।একপ্রকার আশা ছেড়ে দিয়ে, নিজের ছেলে নেই বলে ঘোষনাও দিয়ে দিয়েছিলো।সেখানে নিজের মায়ের ওমন কথাতেও যে ছেলে ভ্রুক্ষেপ করেনি,সেই ছেলের হঠাৎ পরিবর্তনের কি কারন?তাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা!যদি তাই হয় তবে তা কখনোই সফল হতে দেবেনা কৌড়ি।আর যাই হোক ওই ছেলেটাকে জীবনসঙ্গীনি কখনো সে হবেনা। আর না কখনো সে নিজের জীবনসঙ্গিনী করবে তাকে।

‘ফুলকৌড়ি।একা একা রুমে বসে কি করছো তুমি?

নাফিমের ডাকে ভাবনা কাটলো কৌড়ির।সম্বিৎ ফিরে মিষ্টি হেসে কিছু বলতে যাবে তার আগেই কিছুটা বিস্ময় স্বরে নাফিম ফের বললো—তুমি পড়ছো?তোমার পড়তে এতো ভালো লাগে?যে সবাই এতো আনন্দ মজা করছে,তারমধ্যে তুমি তাদের সাথে আনন্দ মজা, সাজগোজ না করে বই পড়ছো!আমার তো একটুও লাগেনা পড়তে।আরও বাড়িতে কোনো আনন্দ মজা হলে-তো মোটেই ভালো লাগেনা।

কথা বলতে বলতে কৌড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়ালো নাফিম।চেয়ার ঘুরিয়ে নাফিমের সম্মুখীন হলো নিজেও।আদূরে স্পর্শে নাফিমের গাল দুটো টেনে দিয়ে বললো—পাকা বুড়ো।আমার যে কয়দিন পর পরিক্ষা, না পড়লে হবে!না পড়লে তো আমি পরিক্ষায় গোলগোল ডিম পাবো।তখন এবাড়িতে আমার জায়গা হবে।ফেল করার অপরাধে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে।কে খাওয়াবে তখন আমাকে?হুমম?

মজার ছলে কথাগুলো বলতেই নাফিম তড়িৎ উত্তর দিলো।–দাদাভাই খাওয়াবে।দাদাভাই তো অনেক টাকা উপার্জন করে,তুমি জানোনা?আর জানো দাদাভাই খুব ভালো।দুষ্টমী না করলে,সে কাওকেই বকেনা।এমনকি আমি পরিক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করলেও আমাকে-ও বকেনা।শুধু দাদাভাই কেমন গলায় শান্ত হয়ে অল্প কথা বলে তাতেই ভয় পাই আমরা।নাহলে দাদাভাই খুব ভালো।আমি যা চাই তাই এনে দেয়।মা বকলেও কি! এনে দেয় দাদাভাই।আর আমার খারাপ রেজাল্টে সবাই বকলেও দাদাভাই আর বড়আম্মু কখনো বকেনা।তুমি পরিক্ষা খারাপ করলে তোমাকেও কিছু বলবেনা,দেখো।

দাদাভাই খাওয়াবো”কথাটা বুকের ভিতর কেমন একটা শিরশিরি অনুভূতি জাগালো।তবে ভিতরেটা ভিতরে হজম করে বাহিরের প্রকাশভঙ্গীতে মৃদু হাসলো কৌড়ি।প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললো–আচ্ছা যাই হোক।তুমি মেহেন্দি অনুষ্ঠানে যাওনি?

মূহুর্তেই মুখ ভার করে মন খারাপ করে নিলো নাফিম।ফের বললো–আমার গায়ে জ্বরতো এজন্য আম্মু যেতে দেয়নি।তুমি-ও আমার মতো অসুস্থ নাকি?তুমি যাওনি কেনো?

নাফিমের কপালে হাত দিয়ে জ্বরের তাপমাত্রা দেখলো কৌড়ি।বললো–জ্বর আসলো কখন?আর আমি-তো এমনিতেই যায়নি।

‘আমাকে রেখে যাওনি ভালো হয়েছে।এখন আমি তোমাকে মেহেদী মাখিয়ে দেবো।চলো

কথাটা কৌড়ির হাত ধরে বললো।কৌড়িও সচকিত দৃষ্টি ফেললো নাফিমের হাতে।ছেলেটার হাতে একটা মেহেদী টিউব।এতক্ষণে খেয়াল করলো সে।নাফিম এটা পেলো কোথায়?তবে কিি মেহেন্দি অনুষ্ঠান সেরে আপুরা এসেছে?প্রশ্ন করলো কৌড়ি।

‘ওবাড়ি থেকে মেহেন্দি অনুষ্ঠান সেরে আপুরা চলে এসেছে নাফিম?

‘না-তো।কেনো?

‘তবে তুমি মেহেদী পেলে কোথায়?উনারাতো ডালা সাজিয়ে সব নিয়ে গেছেন।তাহলে এটা পেলে কোথায় তুমি?

নাফিম সহজ সাবলীল স্বীকারোক্তি জানালো—দাদাভাইয়ের হাতে তো আরেক ডালা মেহেদী দেখলাম।তোমার রুমের দিকে আসছিলাম,সেটা শুনে আমার হাতে একটা ধরিয়ে দিয়ে বললো,তোমাকে দিতে।আমিও ভাবলাম তোমাকে লাগিয়ে দেই।

স্তব্ধ হয়ে নাফিমের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কৌড়ি।
এটাও মানুষটার স্মরণে থাকতে হলো।মনে মুগ্ধতা ছেয়ে গেলো।মন দূর্বল হয়ে পড়লো আরেকধাপ।তবে মূহুর্তেই নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে একগাল হেসে নাফিমকে বললো—তুমি লাগাতে পারবে?আমি কিন্তু আবার লাগাতে পারিনা।

‘আমিও তো,ওইযে হাতে ড্রয়িং করেনা!ওরকম পারিনা।তবে এমনি অনেককিছু ড্রয়িং করতে পারি।আমি সেরকম একে দেবো।আমার ড্রয়িং খাতা দেখো,আমি একটুও বাজে আকাই না।আমার অন্যন্য সাবজেক্ট বাজে হলেও আমার ড্রয়িং বাজে নয়।টিচার্সরা আমার আকা খুবই ভালো বলে।

বাচ্চা ছেলেটা এমনভাবে কৈফিয়ৎ দিচ্ছে,কৌড়ির মায়া হলো।যদিও তার ফর্সা হাতদুটো নাফিমের ড্রয়িং খাতা নয়।যে আঁকলাম ভালো হলোনা আবার মুছে আঁকলাম।হাতের অবস্থা খারাপ হতে পারে বুঝেও নাফিমের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো সে।বললো–তবে আঁকাও।

নাফিম হাত ধরে বেডে এনে বসালো কৌড়িকে।খুশি মনে কৌড়ির ডান হাতটা ধরলো মেহেদি লাগানোর জন্য।তবে হাতের সীমিত তালুর দিকে তাকিয়ে আকা ভুলে গেলো সে।বুঝতে পারলো এটা সত্যিই তার ড্রয়িং খাতা নয়।এখানে যেমন খুশি ঘরবাড়ি নদীনালা বা প্রাকৃতিক যেকোনো দৃশ্য আকা সম্ভব নয়।তবে কি আঁকাবে সে?কৌড়ির উৎসাহিত ঝকঝকা মুখের দিকে তাকালো।মুখটা নীরসত করে কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে বললো।

‘এতো ছোটো জায়গায় আঁকাবো কি?

কৌড়ি দুকাধ ঝাঁকিয়ে ঠোঁট উল্টে বোঝালো-সে কি জানে।সেটা দেখে নাফিম আরও হতাশ হলো।তন্মধ্যে সেখানে প্রবেশ করলেন নিভানের নানুমা।রসিকতা করে বললেন– ব্যাপার কি?দু’জনে চুপিচুপি কি করছো?

কৌড়ি কিছু বলার আগে নাফিম নীরস ভঙ্গিতে বললো-ফুলকৌড়িকে মেহেদী লাগিয়ে দিচ্ছি।তবে আমি আঁকতে পারছিনা নানুমা।এটুকু জায়গায় কি আঁকানো যায়?

ভদ্রমহিলা এসে বসলেন দু’জনের পাশে ফের নাফিমের কথায় তাল মিলিয়ে বললেন-আসলেইতো এতো ছোট্টো হাতে আকা যায়!যাই হোক,আমার কাছে মেহেদী টিউবটা দাও দেখি।দেখি আমি পারি কিনা লাগিয়ে দিতে?

নাফিম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো–তুমি আকাতে পারো নানুমা?

‘দেখি পারি কি-না।

দু’জনের কথার মাঝে কোনো কথা বললো না কৌড়ি।নাফিম টিউবটা দিতেই ভদ্রমহিলা কৌড়ির পানে তাকিয়ে বললেন–কিরে আমার হাতে মেহেদি লাগাতে কোনো সমস্যা নেই তো?

কৌড়ি মৃদু হাসলো।জানেনা নানুমা মেহেদী লাগাতে পারেন কি-না।তবে তিনি ভালোবেসে যখন লাগাতে চাইছেন,সে যেমনই হোক না কেনো না বলার কোনো প্রশ্নই আসেনা।তাই মাথা নাড়িয়ে মুখে বললো—আপনি লাগিয়ে দিন।আমার সমস্যা নেই।

ভদ্রমহিলা হাসলেন।নাতী উনার নাতবৌ নির্বাচন করতে মোটেই ভুল করেনি।আজ দুদিন মেয়েটার সাথে থাকছেন।সত্যি বলতে মেয়েটাকে উনার সর্বদিক থেকে মনে ধরেছে।কৌড়ির হাত ধরে কোনো আঁকাআকি নয়, শুধু ফর্সা চিকনচাকন আঙুলের গোলাকৃতি করে নখ বাদে চামড়ার উপর প্রলেপ লাগিয়ে দিলেন।সঙ্গে সঙ্গে নাফিম মৃদু চিৎকার দিয়ে বললো।–কি করছো নানুমা। না আঁকিয়ে এরকম লেপ্টে দিচ্ছো কেনো?

‘আমিও তো ভাই আঁকতে পারিনা।তাই আমদের সময় আমরা যেভাবে শুধু আঙুলে মেহেদী মাখতাম সেভাবেই মাখিয়ে দিচ্ছি।

নাফিম কৌড়ির মুখের দিকে তাকালো।দেখলো কৌড়ির স্বাভাবিক মুখাবয়ব।তারমানে নানুমা ভুলভাল লাগাচ্ছে না।তাই সেও চুপচাপ হয়ে গেলো।দুহাতে নখের অংশটুকু ছাড়া একটা নির্দিষ্ট পরিমাপ করে গাড় কালো খয়েরী মেহেদী রঙটা ফর্সা হাতজোড়ায় বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে।বামহাতের তলায় আবার গোলাকৃতি করে মেহেদীর প্রলেপ আঁকিয়ে দিয়েছেন।ফর্সা হাতটা সত্যিই নজরের মাধুর্য ছড়িয়েছে।

‘নাও,আমি যেটুকু পারি সেটুকু করে দিলাম।

টিউব দিয়ে নয়।টিউবের মাথায় মেহেদী এনে,নানুমা উনার তর্জনী আঙুলের মাথায় করে মেহেন্দিটা এতো সুন্দর পরিমাপ করে লাগিয়ে দিয়েছেন।সত্যিই প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।প্রশংসা করলোও কৌড়ি।খোশমেজাজে বললো।

‘খুব সুন্দর হয়েছে নানুমা।আমি এভাবে মেহেদী লাগাতে গেলে তো শুধু লেপ্টে যায়,এঁকেবেঁকে যায়।

নাফিমও কৌড়ির মতো নানুমাকে প্রশংসা করলো।ফের কিছু একটা ভাবলো।তড়িৎ বললো–ফুলকৌড়ি তোমার ডানহাতটা দাও।

কৌড়ি,কেনো?প্রশ্ন করার আগেই তার হাতটা সর্তকতা অবলম্বন করে নিজের কাছে নিলো নাফিম।ফের নানুমার হাত থেকে টিউবটা নিয়ে কৌড়ির হাতের তালুতে ইংরেজিতে ওর নামের ওয়ার্ড গুলো ক্যাপিটাল লেটারে লিখে দিলো।সেটা দেখে কৌড়ি কপাল কুঁচকে বললো।–এটা লিখছো কেনো?

‘আমার নামটা তোমার হাতে লিখে দিলাম।

স্বাভাবিক হলো কৌড়ির কপালের ভাজগুলো।ফের বললো—কেনো?

নাফিমের মুখ কাচুমাচু হয়ে গেলো।নানুমাও কৌতুহলী নজরে তারদিকে তাকিয়ে আছেন,কি উত্তর দেয় ছেলেটা।নাফিম একবার নানুমা তো একবার কৌড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে সংকোচ নিয়ে বললো।

‘আমি দীবা আপুকে দেখেছি সিয়াম ভাইয়ার নাম তার হাতে লিখতে।

‘উনিতো আপুর হাজবেন্ড তাই লিখেন।তুমি কেনো লিখলে?

‘ বড় হয়ে আমি তোমাকেই বিয়ে করবো।তাই আগে থেকে তোমার হাতে আমার নাম লিখে দিলাম

‘ওমা তাই।তুমি তবে বউ হিসাবে ফুলকৌড়িকে ঠিক করে রেখেছো।

নিভানের নানুমা হেসে কথাটা বললেন।কৌড়ি কিছুটা অবাক হলো।ফের হেসে মজার ছলে বললো–তুমি জানো, তুমি যখন বড় হবে।আমার তখন নানুমার মতো বয়স হয়ে যাবে।তখন তোমার পাশে আমাকে মানাবে?খারাপ দেখাবেনা।লোকে বলবে,ওরে বাবাহ নাফিমের বউতো দেখি বুড়ি।

মন খারাপ হলো নাফিমের।তবে প্রশ্ন করতে ভুললো না।
‘কেনো?তখন তুমি অসুন্দর হয়ে যাবে?

‘তা তো অবশ্যই।

‘তবে আমি তোমার মতো দেখতে সুন্দর আরেকটা মেয়েকে নাহয় আবার বিয়ে করে নেবো।

‘আমাকে ছেড়ে তুমি আরেকটা বিয়ে করবে?

মিছেমিছি বিস্ময় দেখিয়ে কথাটা বললো কৌড়ি।এই নিয়ে নানুমা আর কৌড়ি নাফিমের সাথে বেশ মজার ছলে তর্কবিতর্ক করতে থাকলো।একপর্যায়ে গিয়ে নাফিম বললো,হাতে লেখাটা থাক।তবে সে কৌড়িকে নয়,কৌড়ির মতো দেখতে সুন্দর একটা মেয়েকে না-হয় বিয়ে করবে।

দ্বিতীয় আর কোনো বাধা বিপত্তি ছাড়াই তন্ময়ীর আর ইভানের বিয়েটা হয়ে গেলো।তৃনয়ের সেই বন্ধুর বাংলোবাড়িতেই বিয়েটা অনুষ্ঠিত হয়েছে।বিয়ে বাড়িতে মানুষের উপচে পড়া ভিড়।বিয়েটা পড়ানো হয়ে গেলেও বিয়ের বিভিন্ন কার্যক্রম এখনো বাকি।সেগুলো কাজী সাহেব নিপুণ হাতে করে চলেছেন।আপতত বিয়ে বাড়ির সকলের উপস্থিতি সেখানেই।কৌড়িও সবার সাথে সেখানে ছিলো।তবে নাফিমের জন্য বেশিক্ষণ সেখানে দাঁড়াতে পারলো।ছেলেটার জ্বর বেড়েছে।জ্বর অবস্থায় কিছুতেই স্বান্তনা রহমান আসতে দিতে চাননি।তবে ইভান মানেনি।ছোটো ভাইটা তার বিয়েতে উপস্থিত থাকবে না!এটা কিকরে হয়ে!অসুস্থ ছেলেটা বিয়ে বাড়িতে এসে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছে।জ্বরটাও প্রচন্ড বেড়েছে।এতো সময় মান্যতার কাছে থাকলেও,বিয়ে পড়ানোর আগে নিরিবিলি কৌড়ির কাছে রেখে গিয়েছে সে।হাত ধরে পাশে দাঁড়ানো ছেলেটার কপালে হাত রাখতেই হাতটা যেনো জ্বলে গেলো কৌড়ির।ফর্সা গোলগাল মুখটা কেমন টকটকে টমেটোর মতো লাল দেখাচ্ছে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে মানুষের ভিড় থেকে ওকে নিয়ে সরে দাঁড়ালো কৌড়ি।নেতিয়ে আসা নাফিমকে কাছে টেনে জড়িয়ে নিলো।নাফিমও দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো কৌড়ির কোমর।শীতের মধ্যেও আগুনের মতো তপ্ততা অনুভব করলো কৌড়ি।নাফিমের অবস্থা মোটেই ভালো না।আপতত বিশ্রাম খুবই জরুরি।চঞ্চল নজরে এদিক ওদিক তাকালো কৌড়ি।অধিকাংশ পরিচিত মুখ।তবে কাকে ডাকবে সে?

‘কি হয়েছে?ওর জ্বরটা বেড়েছে নাকি?

নিভানের কন্ঠ পেয়ে পাশে তাকালো কৌড়ি।মূহর্তেই নজর ঘুরিয়ে নিজের ডানহাতের দিকে নজর পড়লো তার।হাতের তালুটা দেখতে গিয়েও দেখলো-না।রাতে নানুমা মেহেদী মাখিয়ে দেওয়ার কিছুক্ষণ পর হাত ধুয়ে যখন হাতদুটো দেখলো।ফর্সা হাতদুটো গাঢ় খয়েরি রঙে চকচক করছিলো।সাথে নাফিমের নামটাও।অথচ সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠার পর হাত ধুতে গিয়ে হাতের দিকে নজর পড়তেই আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলো সে।নাফিমের নামের এন অক্ষরটা সুস্থ সাবলীল,আস্ত থাকলেও পরের অক্ষরগুলো মেহেদী দিয়ে লেপ্টে মুছে দেওয়া।একটু নয় খুব আশ্চর্য হয়েছিলো কৌড়ি।সেই থেকে এই পর্যন্ত যতবার হাতে নজরে পড়ছে,মনে প্রশ্ন জেগেছে।কে করেছে এই অকাজ?তবে এই মানুষটাকে সেখান থেকে যতবার নজরে পড়েছে,কৌড়ির মনের সন্দেহের তীরটা কেনো জানেনা কারন ছাড়াই মানুষটার উপর গিয়েই বর্তাচ্ছে।কৌড়ির ভাবনার মধ্যে নাফিমের কপালে হাত রেখে তাপমাত্রা পরীক্ষা করলো নিভান।নাফিম একটু মুখ উচু করে দেখলো তাকে।দেখেই বললো।

‘দাদাভাই বাড়িতে যাবো।

নিভান কিছুটা চিন্তিত গলায় বললো।–ওরতো প্রচুর জ্বর!বাড়িতে যাওয়া প্রয়োজন!কি করি এখন!

সম্বিৎ ফিরলো কৌড়ির।তন্মধ্যে ফোন বের করে তৃনয়কে কল করলো নিভান।নাফিম সম্পর্কে জানিয়ে বাড়ি যাওয়ার মনস্থির করলো।

‘নাফিমকে আমার কাছে দাও।

দ্বিধান্বিত গলার স্বর।–আমি-ও যাবো।

আশ্চর্য হলো নিভান।মেয়েটা তারসাথে যেতে চাইছে!কৌড়িকে যেটুকু চিনেছে,তার অনুভূতি জানার পর মেয়েটা একা কখনোই তার সঙ্গ পছন্দ করবেনা।সেই মেয়েটা তারসাথে যেতে চাইছে।শরীর খারাপ নয়-তো মেয়েটার! যদিও কাল মেয়েটার চোখমুখের প্রকাশভঙ্গি বলছিলো,মেয়েটা কোনো কারনে অসুস্থ।তবে কি সত্যিই অসুস্থ মেয়েটা!বললো–তুমি কেনো যাবে?শরীর খারাপ লাগছে?নাকি এখানেই থাকতে ভালো লাগছে না।

দুটোই।তবে কৌড়ি কারন হিসাবে প্রথমটা বেছে নিয়ে বললো–শরীর ভালো লাগছেনা।

কিছুটা বিচলিত হলো নিভান।বললো–ডক্টরের কাছে যাওয়া কি প্রয়োজন?

‘না।ডক্টরের প্রয়োজন নেই।বাড়িতে নিয়ে গেলেই হবে

অস্বস্তি হলো কৌড়ির।এই কারনেই বলতে চাইছিলোনা। তবে সত্যিই শরীর ভালো লাগছেনা তার।পিরিয়ড জনিত সমস্যা তো আছেই।অনিয়মিত পরিয়ড।তাতে তো বিভিন্ন কমপ্লিকেশন্স রয়েছে।সকাল থেকে আবার মাথাটাও কেমন ধরে আছে।সব অনুষ্ঠান অসুস্থতা বলে কাটিয়ে দিলেও,বিয়েতে আসবেনা।এটা কেমন দেখায়!তাই শরীর খারাপ নিয়েও বাধ্য হয়ে বিয়েতে আসতে হলো তাকে।এখন আবার যেতে চেয়ে এই মানুষটার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে।এজন্য বলতে চাইছিলো না।তবে নাফিম যখন যাচ্ছে সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইছিলোনা।তারমধ্যে নিভান বললো।

‘এখনো তো খাওনি।বিয়ে বাড়িতে না খেয়ে চলে যাবে?

‘নাফিম না খেয়ে চলে যাচ্ছে আমি না খেয়ে গেলে সমস্যা কোথায়?আর এমনিতেই আমার খেতেও ভালো লাগছেনা।বাড়ি যেতে মন চাইছে।

কৌড়ির মুখের পানে শান্ত নজর ফেললো নিভান।সাধারণ একটা মুখাবয়ব।বিয়ে বাড়ির এক্সট্রা সাজগোজের লেশ সেই চোখেমুখে নেই।সাজ বলতে গাঢ় নেভিব্লু কালোরের একটা দামী চুড়িদার পরা।সাথে নেভিব্লু রঙেরই হিজাব জড়ানো মাথায়।ব্যাস এটুকুই। তাতেই এই বিয়ে বাড়ির সকল রমনীর মধ্যে নিভানের নজর কাড়ছে এই মেয়েটা।কৌড়ির এলোমেলো নজর নাফিমের দিকে,সেটা খেয়াল করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিভান।বললো–চলো।

স্বস্তি পেলো কৌড়ি।নাফিমকে কোলে তুলে নিল নিভান।গাড়িতে গিয়ে বসে মান্যতাকে ফোন করে জানিয়ে দিলো নাফিম আর কৌড়িকে নিয়ে এসেছে সে।কারন জানতে চাইলোনা মান্যতা। দাদাভাই নিয়ে গেছে মানেই কারন আছে।আর নাফিমের তো জ্বর ছিলোই।পিছনের সিটে নাফিমকে জড়িয়ে বসা কৌড়ির পানে একপলক তাকিয়ে গাড়ি চালানোয় মনোযোগ দিলো নিভান।কিছুদূর আসতেই সামনের আয়নায় দেখতে পেলো কৌড়ি ফের তার হাতটা দেখছে।মনেমনে হাসলো নিভান।ফের সাবলীল গলায় কৌড়িকে উদ্দেশ্য করে বললো।

‘তোমার সন্দেহ ঠিক।কাজটা আমিই করেছি।

চমকে সামনে তাকালো কৌড়ি।তবে তার ধারণা ঠিক। ফের নাফিমের দিকে তাকালো।এতোটুকু একটা বাচ্চা ছেলেকে কেউ হিংসা করে,আশ্চর্য!নিভান বুঝি কৌড়ির মনোভাব কিছুটা বুঝলো।ফের বললো।

‘তবে ভুলে-ও ভেবো-না,আমি নাফিমকে জেলাস ফিল করে কাজটা করেছি।যদি জেলাসি হয়ে থাকে তবে পাত্র স্থান ভেদে নামটায় হয়েছে।তোমার হাতে অন্য কারও নামের সিলমোহর।মানা যায়!কৌড়ির হাত হোক বা সর্বাঙ্গে,অন্য কারও অধিপত্যে।মানবে বলছো নিভান!উহুম।মানবে না নিভান!

ছিটে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঁজে নিয়েছে সেই কখন।শরীটা কেমন অসাড় অসাড় লাগছে তার।মাথাটার ঝিমঝিমানিটা কেমন একটু একটু বাড়ছে।এই মানুষটাকে আর উপেক্ষা করবে কিকরে সে?সবাই বলে মানুষটা অনুভূতিহীন। তার দেখাও তেমনটাই।সবার সামনে মানুষটা কেমন অদ্ভুত গম্ভীর্যপূর্ন,শান্ত,চুপচাপ। অথচ তার কাছে কতো সহজ সাবলীল।রাখঢাক নেই।সেই মানুষটার অনুভূতি গুলো কিভাবে আর উপেক্ষা করে চলবে!তবে দাদীআপাকে কি কৈফিয়ত দেবে সে?মৃত বাবা মাকে কোনোপ্রকার অসম্মানিত করা হবে নাতো!মানুষটার প্রতি দূর্বলতা বাবা মাকে ছোটো করে দেবে না-তো!মনের মধ্যে আবারও দোটানা শুরু হলো।
বুঁজে থাকা চোখের কোণ ঘেঁষে গড়ালো নোনাজল।সেটা লক্ষ্য করেই গাড়ি থামিয়ে পিছে ফিরলো নিভান।বিচলিত গলায় বললো।

‘এই কৌড়ি,শরীর বেশি খারাপ লাগছে?আমাকে বলো কি হচ্ছে?

কান্নারা যেনো ভিতর থেকে এবার উপচে বেরিয়ে আসতে চাইলো।তবে দাঁতে দাত চেপে সেই কান্না আটকালো কৌড়ি।কার উপর অভিমান হলো জানা নেই।তবে অভিযোগের স্বরে বললো–আমাকে কেনো একটু শান্তিতে থাকতে দিচ্ছেন না?

মুখাবয়ব পাল্টে গেলো নিভানের।কৌড়ির বুঁজে থাকা চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুসময়।মেয়েটার চোখের নোনাজল বলছে,তারপ্রতি দূর্বলতা।তবে কেনো এতো আপত্তি?এবার অভিযোগ সেও হানলো।রুক্ষ গলায় বললো—-এই তুমি আমাকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছো,বলছো?দিচ্ছো কোথায়!

তড়িৎ উত্তর দিলো কৌড়ি।—তবে কি চাইছেন,এবাড়ি থেকে আমি চলে যাই?আপনার শান্তি হোক?

‘তুমি যদি আমার শান্তি প্রশান্তিটা কিসে সেটা বুঝতে! তবে তো হয়েই যেতো।

কঠিন হয়ে এলো নিভানের চোয়ালদ্বয়।আর একটা শব্দও উচ্চারণ করলো-না সে।আর না কৌড়ির উত্তর পাওয়ার অপেক্ষায় রইলো।হাতের তালু দ্বারাা স্ট্রারিংয়ে আঘাত করে,গাড়ি চলমান করলো।সেই আঘাতে কেঁপে উঠে ঘুমন্ত নাফিমকে আরও শক্তকরে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো তবুও চোখ খুললোনা।

বাড়িতে ঢুকতেই ছেলের অবস্থা দেখে স্বান্তনা রহমান অস্থির হলেন।নাফিম ঘুমিয়েছে।নিরিবিলি জায়গা হিসাবে মান্যতার রুমে শুইয়ে দিলো ওকে।ওকে শুইয়ে দিয়েই চলে গেলো নিভান।স্বান্তনা রহমান ছেলেকে ভালোভাবে শুইয়ে,গায়ে কম্বল জড়িয়ে দিয়ে কৌড়িকে ওর খেয়াল রাখতে বলে চলে গেলেন।হাতে অনেক কাজ।বিয়ে বাড়ির কাজ বলে কথা।তা বাদেও একটু পরে বউ নিয়ে আসবে তার বিশেষ আয়োজন।বাড়িতে বরযাত্রী যাওয়া ছাড়াও অঢেল মেহমান।তাদের খেদমত খাদিম তো লেগেই আছে।স্বান্তনা রহমান চলে যেতেই কৌড়ি ওয়াশরুম ঢুকলো। জামাকাপড় চেঞ্জ করে শুয়ে পড়লো নাফিমের পাশে।সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটা তার পাশ ঘেঁষে তাঁকে জড়িয়ে ধরে ঘুমে তলিয়ে গেলো।সেটা দেখে নাফিমের মাথার চুলগুলো হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে কপালে ছোটো করে একটা চুমু দিলো কৌড়ি।গায়ের পাতলা কম্বলটা ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে সে-ও চোখ বুজলো।খানিকক্ষণ পর অনুধাবন করলো রুমে কেউ ঢুকেছো।অকারনেই হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো তার।তবে ভুলেও চোখ খুললোনা।তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে,সেই মানুষটা এসেছে।যতোই তার পায়ের গতিবেগ বেড়ে কৌড়ির কাছাকাছি হতে থাকলো।রুমে ঢোকা মানুষটার গায়ের সুগন্ধে অনুধাবন সত্যি হতে লাগলো কৌড়ির।বেডের পাশে এসে সেই পদধ্বনি স্থির হয়ে যেতেই,নিজেও বরফ জমার মতো জমে চুপ হয়ে রইলো।হঠাৎ সমস্ত রুমে পদচারণেট শব্দ শুনে চোখ অল্প খুললো সে।কি খুঁজছে মানুষটা!নিভানকে আবার তাদের দিকে ফিরতে দেখেই চোখ বন্ধ করে নিলো সে।আবার বাহিরের পানে পদচারণ শুনে চোখ খুলে দেখলো,মানুষটা চলে যাচ্ছে। স্বস্তি পেলো কৌড়ি।উঠে দারজা লাগিয়ে ঘুমাবে কি-না ভাবতেই আবার সেই পদচারণ।দ্রুত ফের চোখ বন্ধ করে নিলো।সেই একই ব্যাক্তির পদচারণ এসে থামলো বেডের পাশে।মূহুর্তেই ভারী কিছু একটা গায়ের উপর পড়তেই বুঝতে পারলো,ভারী কম্বল জাতীয় কিছু একটা তাদের গায়ের পাতলা কম্বলটার উপর ঝাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।আসলেই প্রয়োজন ছিলো।আর সেটা থেকে সেই একই কড়া সুগন্ধ ছড়াচ্ছে।দম বন্ধ হয়ে এলো কৌড়ির।চেয়েও চোখ খুলতে পারলোনা।হঠাৎ নিজের নাকেমুখে শক্ত চুলের আবরণ অনুভব হতেই মিটিমিটি চোখ খুললো সে।দেখলো,মানুষটা নাফিমের কপালে চুমু দিচ্ছে।শিহরে উঠলো কৌড়ির সমস্ত শরীর।একটু আগেই সে ওই একই জায়গায় নাফিমকে চুমু দিয়েছে।নিভানকে সরে যেতেই দেখেই আবারও চোখ বন্ধ করে নিলো।সেটা আরও প্রগাঢ় হলো,কারও শক্ত হাতের ছোঁয়া নিজের মাথায় পেতেই।নড়চড় করলোনা,শুধু নির্জীব হয় পড়ে রইলো।সেই বুঁজে রাখা চোখের দিকে, মুখের দিকে নিষ্পলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখ নিচু করে কৌড়ির কাছাকাছি হলো।ফের ধীর,শিথিল গলায় বললাে।

‘তুমি যদি জানতে তুমি নিভানের ঠিক কোথায় নিজের জায়গাটা করে নিয়ে বসেছো?তুমি নিভানের ঠিক কি?তবে আর শান্তিতে থাকতে চাইতে না,নিভানকেই চাইতে।আমাকে চাইতে কৌড়ি।আমি জানি তুমি জেগে আছো।তবে এবার তুমি না চাইলে নিভানের শেষ চাওয়াটুকুসহ সে-ও নিঃশেষ হয়ে যাবে।তবে তোমার শান্তি ভঙ্গ করতে,তোমার দুয়ারে আর আসবে-না।তবুও চলে যাওয়ার কথা আর কখনো মুখে এনো না কৌড়ি!কখনোই বোলো-না কৌড়ি!কখনো না!

চলবে….

#ফুলকৌড়ি
(৩৩)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

নিস্তব্ধ রজনী।শীতের শীতল রাত।হয়তো চারপাশটা সেকারনে আরও শান্ত,নীরব।নিজহাতে কড়াকরে কফি বানিয়ে ছাঁদে এলো নিভান।মূহুর্তেই শীতল ঠান্ডাভাবটা যেনো,ফুলসিল্ভ টিশার্ট পরা শক্তপোক্ত পেটানো শরীর ভেদ করে কলিজা ছুঁয়ে দিলো।তবুও পা পিছে নিয়ে রুমে যাওয়ার চিন্তা করলোনা সে।সামনে এগিয়ে গেল।
ছাদের চারপাশের বড়বড় বাল্বের লাইটিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।ঝাপসা কুয়াশার মধ্যেও সেই লাইটের আলোতে
সবকিছু ঝকঝক করছে।চারপাশের গাছগুলোও বেশ মনোমুগ্ধকর লাগছে।আশেপাশে খেয়ালি নজর ফেলে সামনে এগোলো নিভান।নির্দিষ্ট স্থানে যাবার আগেই পা ধীমে কপাল কুঁচকে গেলো তার।ইভানে এখন এখানে!
ছাঁদের রেলিঙের ওয়াল ঘেঁষে বাহিরের পানে স্থির নজরে তাকিয়ে আছে ছেলেটা।গায়ের রক্ত হিম হয়ে জমে যাওয়ার মতো ঠান্ডাভাব পড়েছে।তারমধ্য ছেলেটা একটা টিশার্ট গায়ে এরকম চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে!তা বাদেও ছেলেটার জীবনে আজ একটা বিশেষ রাত।সেখানে নিজের রুম বাদে এতোরাতে ছাঁদে কি করছে সে?ফের কিছু ভাবলো তারপর ধীমে পা বাড়ালো।পাশে গিয়ে দাঁড়ালো ইভানের।বললো।

‘তুই এখন এখানে?

কারও আগমনের পদধ্বনির টের আগেই পেয়েছিলো ইভান।পিছে ফিরে না দেখলেও বুঝতে পেয়েছিলো কে এসেছে।কেননা,এতো রাতে দাদাভাই ছাড়া ছাঁদে সহজে কেউ পা মাড়ায় না।তাই কাছে আসার অপেক্ষা করছিলো।প্রশ্নবিদ্ধ হতে হবে এটাও জানতো।নিভান প্রশ্ন করতেই মৃদু হাসলো সে।সে হাসিতে যেনো মলিনতা আর ক্লান্তি ঝরে পড়লো।বললো।

‘এমনিতেই।তোমার হাতে কফি নাকি?এতোরাতে তোমাকে কফি বানিয়ে দিলো কে?আমারও প্রয়োজন।দাওতো ওটা আমাকে।

বলেই নিভানের হাত থেকে কফির মগটা নিলো ইভান।তখনো ইভানের মলিন মুখের দিকে স্থির নজরে তাকিয়ে নিভান।ইভান কফির মগটা নিতেই গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো–ওটা আমার এঁটো হয়ে গেছে।ওটা রাখ,আমি আর একটা এনে দিচ্ছি।

‘লাগবেনা।এটাই চলবে।

বলেই কফিতে চুমুক দিলো ইভান।মূহুর্তেই তিতেভাটাতে নাকমুখ কুঁচকে ফেললো সে।সে-ও কফি খায় তবে এতো কড়া নয়।মুখের মধ্যে থাকা তরল পদার্থ ফেলে না দিয়ে কোনোমতে গিলে বললো।-এতো কড়াভাবটা তুমি গলা দিয়ে নামাও কি করে?এতো উটকো তিতেভাব!নামে গলা দিয়ে তোমার!

‘এরথেকেও তিতে কথার রেশ ইদানীং তাকে হজম করতে হচ্ছে।সেখানে সামন্য কফির এই তিতেভাবটা আর এতো কি!এটাতো তারকাছে নরমাল,ফিকে।

হাসলো ইভান।কফিতে আর চুমুক না দিয়ে,নিভানের হাতে দিয়ে দিলো।হঠাৎই হাতে ভর দিয়ে ধপাৎ করেই ওয়ালের উপর বসে পড়লো।সেটা দেখেই নিভান কিছুটা আতঙ্কিত গলায় বললো–পড়ে যাবি তো ইভান!

‘আমি পড়ে যাবো আর তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে?আর এটাও আমি বিশ্বাস করবো!আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে তুমি আমাকে কখনো পড়ে যেতে দেবেনা,সেটা জানি আমি।আচ্ছা বাদ দাও।একটু আগে আমার বাচ্চা বউমনিটা সম্পর্কে কি অভিযোগ জানালে?

এবার সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিভান।ইভানের কথার উত্তর দিলোনা।ইভানও উত্তর পাওয়ার আশা করলো না।ফের বললো–তা আমার ওমন সুন্দর শান্তশিষ্ট বউমনিটা তোমাকে কি এমন শোনালো শুনি?যে তাকে নিয়ে অভিযোগ জানাচ্ছো।তাও আবার তুমি নিভান?
যে সহজে কাওকে অভিযোগ জানায় না।তবে যাই হোক,নিজের মানুষের ওরকম দু’একটা কথা শোনাই যায়।আর শুনতেও হয়।তাতে না দোষের কিছু হয়,আর না দোষ নিতে হয়।মহাপাপ হয় বলে-ও তো আমার মনেহয় না।

‘দোষের কিছু যদি নাহয়ে থাকে আর মহাপাপ যদি না হয়।তবে তুই এখানো কি করছিস?এতো রাত হয়ে গেছে,তবুও ওই মেয়েটাকে একা রুমে ফেলে তুই কেনো এখানে?

ইভান চুপ হয়ে গেলো।নির্বিঘ্নে তাদের বিয়েটা হয়ে গেলেও,তন্ময়ী যে এখনো তারসাথে স্বাভাবিক নয়।এটা সে জানে,এবং মেয়েটার আচারনে বুঝতে পারছে।বিদায়ের সময় মেয়েটা প্রচুর কেঁদেছে,মেয়েটার ওই কান্নায় তাকে অসম্মানিত করার অপরাধ বোধটা যেনো মনেমনে তীব্র হয়েছে।তারপর থেকে যেনো কিছুই ভালো লাগছেনা।গাড়িতে বসেও মেয়েটা নিঃশব্দে সারা পথ কেঁদেছে।একটাও কথা বলেনি,শুধু চুপচাপ কেঁদেছে।সে না পেরেছে সান্ত্বনা দিতে আর না পেরেছে নিজের একান্ত ব্যক্তি হিসাবে মেয়েটাকে কাছে টেনে ভালোমন্দ কথা আওড়াতে।বরং তন্ময়ীর কান্নার নোনাজলগুলো তার অপরাধবোধকে ভিতরে ভিতরে প্রবল করে তার থেকে সরিয়ে রেখেছে।সেই থেকে মেয়েরটার সম্মুখে যেতে ইচ্ছে করছে না।অথচ মন চাইছে,আজকে রাতটা বিশেষই হোক।শারিরীক চাহিদার জন্য নয় মানসিক চাহিদার জন্যই বিশেষ হোক।তাদের জন্য বিশেষ হোক।মেয়েটাকে চেয়েছিলো মনেপ্রাণে, সেই মেয়েটাকে নিজের করে পেয়েছে এই আনন্দে রাতটা বিশেষ হোক।তবে চাইলেই কি সবকিছু হয়!

‘পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে বেড়ালেই কি সবকিছুর সমাধান মিলে যায়?যায়-না।মিলবেও না।তবে চেষ্টার অসাধ্য তো কিছু নেই,চেষ্টা করতে হয়।বরং সাহস নিয়ে সেই পরিস্থিতি অনূকূলে হোক বা প্রতিকূলে সম্মুখীন হতে হয়।তাতে নিজের ভালো হোক বা মন্দ,জয় হোক বা পরাজয়।সেই পরিস্থিতির একটা সমাধান মিলে যায়।রুমে যা।পরিস্থিতি থেকে কখনো পালিয়ে বেড়াতে নেই।
নিজেকেই ঠিক করে নিতে হবে সবকিছু,এমনটা সাহস রাখ।মেয়েটা যেমনই ব্যবহার করুক,ওর সঙ্গ ছাড়িস না।একটা সময় দেখবি ও তোকে ভালোবাসুক আর নাই বাসুক,তোর সঙ্গটা ছাড়তে পারবেনা।পরিস্থিতি সম্মুখীন করতে শেখ।পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে বেড়ালে বা পিছু হাঁটলে কখনো সবকিছু ঠিকঠাক হবে না।যা রুমে যা।

মন দিয়ে নিভানের কথাগুলো শুনলো ইভান।নীতিবাক্যের ন্যায় কথাগুলো মন থেকে মেনে মাথা নাড়ালো।সামনে কি আছে কপালে সে জানেনা।তবে সত্যি বলতে পরিস্থিতি থেকে পালালে তো তাকে চলবে না।আর পিছু হাঁটলে চলবে।যদিও সে পিছু হাঁটতে চায়না।সম্মুখীন হতে চায়।তবে মেয়েটার ওই মায়ামায়া ক্রন্দনরত মুখটার দিকে তাকালেই কেমন বুকটায় ব্যথার জ্বলন হচ্ছে বলে রুমে যাচ্ছে-না।চাইছে মেয়েটা ঘুমিয়ে যাক তারপর নাহয় যাবে।তবে নিভান কথাগুলো শোনাতেই,মৃদু হেসে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে গন্তব্যের পানে অগ্রসর হলো সে।ইভানের যাবার পানে একপলক তাকিয়ে, তারাবিহীন আকাশের দিকে তাকালো নিভান।ফের চোখবুঁজে শ্বাস ফেললো।সবাইকে নীতিবাক্য শোনানো কতোই না সহজ।অথচ নিজের জীবনে সেই নীতিবাক্যের কর্ম ফলানো কতোই না কঠিন।বিকালে ওই মেয়েটাকে যে বলে আসলো,সে না চাইলে নিভান আর কখনো তারকাছে যাবেনা।পারবে কি নিভান মেয়েটাকে ছাড়া দূরে দূরে থাকতে?আচ্ছা কৌড়ি যদি কখনো তার না হতে চায়?তবে কি করবে নিভান?উফফ!

ধবধবে সাদা রজনী গন্ধা আর গাঢ় লাল গোলাপ দিয়ে সাজানো হয়েছে ইভানের ঘরটা।দরজায় দাঁড়িয়ে ক্ষীন বাতির নীল আলোতে সেটা খেয়াল করে দেখলো ইভান।যদিও বিয়ের কাজ সেরে ওবাড়ি থেকে আসার পর,ঘরে ঘুকতেই সাজানো ঘরটা নজরে পড়ছিলো তার।তবে তখন অতোটা মনযোগ দিয়ে দেখা হয়নি।সত্যি বলতে তন্ময়ীর কান্নারত মুখটাই তখন মনে ভেসে বেড়াচ্ছিলো।যার কারনে কেমন যেনো ইচ্ছে কাজ করে নি।ঘরের আলাদা সৌন্দর্যও নজরে কাড়েনি।তবে তখন ঘরের সৌন্দর্য নজর না কাড়লেও এখন কেমন যেনো নজরে কাড়ছে।আলাদা অদ্ভুত অনুভূতিতে বারবার হৃদয় কেঁপে উঠছে।ঘরের ভিতরের আরও দুকদম পা বাড়তেই আপনাআপনি বেডের দিকে নজর পড়লো তার।তন্ময়ী ঘুমিয়ে আছে।তার অধিকার নিয়ে শুয়েছে মেয়েটা।আজ থেকে এই রুমটা তারও।মনেপ্রাণে শীতল একটা দোলা বয়ে গেলো ইভানের।কতোদিনের ইচ্ছে আকাঙ্ক্ষা আজ পূর্ণ হয়েছে।স্ত্রী হিসেবে এই রুমে তন্ময়ীর পদচারণ থাকবে।ঘরের সমস্ত কিছুতেই ছোঁয়া থাকবে শুধু ওই নারীর।তারউপরে একান্তভাবে সকল আদর শাসনের হক থাকবে শুধু ওই রমণীটার।চাওয়াটা তো এখনো সেই একই আছে।পূর্ণও হয়েছে।তবে পাওয়াটা হবে কিনা ইভানের জানা নেই।দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওয়াশরুমে চলে গেলো সে।যদিও পুরুষ মনটা তার টানছিলো তার বেডে শয়নরত রমনীরপানে।সেখান থেকে এসে এশারের নামাজ আদায় করে নিল।আদায় করলো আরও দু’রাকাআত শুকরিয়ার নাামাজ।

নামাজে তার বড়োই অবহেলা, যেটা দেখে নানুমা মা প্রায়ই তাকে প্রচুর বকাবকি করেন।তবুও শয়তান যেনো পিছু ছাড়েনা।আজ কোনো কারনে তার মন খারাপ দেখে নানুমা ফের উপদেশ দিলেন।—নানুভাই,প্রভুর ইবাদতে গাফেল হতে নেই। নামাজ জীবনে সকল বালা মুসিবত,হতাশা দূর করে দেয়।মনের যতো দুঃখদুর্দশা অশান্তি কাটিয়ে দেয়।জীবনে যতোই বিপদ আসুক না কেনো,নামাজ আঁকড়ে ধরে থাকলে সব দূরীভূত হয়ে যায়।তাই নামাজ ছাড়বে না।যখন মুসিবত আসবে, হতাশায় ভুগবে তখন আরও দৃঢ়ভাবে নামাজকে আঁকড়ে ধরবে।দেখবে আল্লাহ তোমার সকল বিপদ মুসিবত থেকে দূরে রেখেছেন।হতাশা গ্লানি দূর করে দিয়েছেন।তাই ভুলেও নামাজে কখনো অবহেলা করবে না।আর এমনিতেই একজন মুসলমান হিসাবে তোমার দ্বায় তোমার সৃষ্টিকর্তা “আল্লাহর” ইবাদাত করা।

নামজ পড়লে শত দুশ্চিন্তা আর মুসিবতেও মনে প্রশান্তি অনুভব হয় এটা ইভান যানে,তবুও কেনো জানে-না শয়তানকে প্রশ্রয় দিয়ে নামাজে অবহেলা করে ফেলে।তবে নানুমার বুঝদার কথাগুলো মনে পড়তেই,গ্লানিভরা মনে প্রশান্তি আনতে নামাজ পড়তে খুব ইচ্ছে হলো তার।নামাজ পড়লো।আজ থেকে স্বামী স্ত্রীর নতুন জীবনে পদার্পণ করারা জন্য, দু’জনের শুকরিয়া আদায় করার জন্য যে নফল নামাজের প্রয়োজন ছিলো।স্ত্রী বিহীন সেটাও আদায় করে নিলো।শুকরিয়া আদায় করলো আল্লাহর।সত্যি বলতে মন হালকা হলো।সারাদিনে যে বিচলিতা অনুভব হচ্ছিলো সেটা কেটে গেলো মূহুর্তেই।নামাজ শেষে জায়নামাজ গুছিয়ে,বেডে শয়নরত নারীরপানে এগোলো।যে এখন তারজন্য হালাল।ভারী কম্বলে মেয়েটার গলা অব্দি ঢাকা।মায়াময় মুখটা শুধু উন্মুক্ত।সারাদিনে ক্লান্তিতে মেয়েটা হয়তো ঘুমে বিভোর।মায়াময় মুখটা দেখেই পুরুষ মনে ইচ্ছে জাগলো ইভানের।সেই আকাঙ্ক্ষাটা নিয়ন্ত্রণে রাখার ইচ্ছে পোষন করলো না।মুখ নিচু করে তন্ময়ীর কপালে গাঢ় চুমু বসালো।কেঁপে উঠলো নারী কোমল শরীর।সে ঘুমায়নি।এই ঘরে আসার পর থেকে হঠাৎই কেমন একটা অনুভব হচ্ছিলো তার।এখনো হচ্ছে।এতো বিলাসবহুল জীবন তার কখনো ছিলোনা,না ছিলো নিজের রুমের এতো বিলাসিতা।সেখানে পুরোই অচেনা সবকিছু।চেনা পরিচিত ঘর বেড সবকিছু রেখে হঠাৎই কি অন্যকোনো বেডে ঘুম আসে?সবার আসে কি না তন্ময়ীর জনা নেই। তবে তন্ময়ীর আসে-না।তাই ক্লান্তি থাকা সত্ত্বেও চোখে ঘুম ধরা দিচ্ছে না তার।ঘুমায়নি সে।নারীমন আরও একটা বিষয় নিয়ে খুদমুদ করছিলো।যতোই তাকে অসম্মানিত করা সেই পুরুষটার প্রতি মন অসন্তুষ্ট হোক বা রাগান্বিত।তাকে যেনো আজকের এই বিশেষ রাতে নিজের কাছাকাছি নাহলেও রুমে চাইছিলো মন।এসব ভাবতে ভাবতে ইভানকে রুমে আসতে দেখেই চোখ বুঁজে নিয়েছিলো সে।ইভানকে নামাজ আদায় করতেও দেখেছে সে।এশারের নামাজ সে,দাদিশ্বাশুড়ি নানিশ্বাশুড়ীর সাথে পড়ে নিয়েছে।উনারাই বলেছিলেন,দম্পত্ত্য জীবন শুরু হওয়ায় শুকরিয়া সরূপ নামাজটা দুজনের একসাথে আদায় করে নিতে।অথচ বান্দা একাই পড়ে নিলো তাকে ডাকলো না!ক্ষীন শান্ত হওয়া রাগ ক্ষোভটা আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো তার।ইভান তখনো ঠোঁট ছুঁইয়ে তন্ময়ীর কপালে।হালাল সুখ তৃপ্ততা বুঝি একেই বলে।চম্বুকের মতো টানছে মেয়েটা,ঠোঁট যেনো সরাতেই ইচ্ছে করছেনা।চোখ খুললো তন্ময়ী।ক্ষোভিত গলায় বললো।

‘আপনি আমাকে ছুঁলেন কেনো?

হাসলো ইভান।ঠোঁট সরিয়ে তন্ময়ীর চোখে চোখ রেখে বললো।—অধিকার আছে তাই।

সুগভীর নজরে নজর পড়তেই ভিতরে ভিতরে বিচলিত হলো তন্ময়ী।তবে উপরে নিজেকে কঠিন রাখার প্রয়াস চালিয়ে শক্ত কন্ঠে বললো।—অধিকার তো এখন শরীরের উপরেও আছে।তবে বলে চাইছেন কি বৈধ ধর্ষ…

তন্ময়ীর ঠোঁটে শক্ত করে নিজের পুরুষালী মোটাসোটা বৃদ্ধা আঙুলদ্বারা চেপে ধরলো ইভান।কথা শেষ করতে দিলোনা।ভিতরে ভিতরে ক্রোধে ফেটে পড়লো,তবে প্রিয় নারীটাকে সেই ক্রোধ দেখাতে চাইলো না।নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালিয়ে সময় নিয়ে শান্ত কন্ঠে বললো।—যদি শুধু শরীরের দরকার হতো।তবে ইভানের মেয়ের অভাব ছিলোনা,আর না ইভান তোমার পিছু পড়ে থাকতো।আমার জীবনে একটা তন্ময়ীর দরকার ছিলো।চেয়েছিলাম আমি তোমার মতো একটা মেয়েকে আমার জীবনে।শুধু সেটারই অভাব ছিলো।আলহামদুলিল্লাহ, সেটা যেভাবেই হোক পেয়ে গেছি।হয়তো তোমার সাথে কোনোভাবে অন্যায় করে ফেলেছি, তাই বলে অমানুষ ভেবোনা।যে,প্রিয় নারীটা হালাল হয়েছে বলেই অনুমতিবিহীন ঝাপিয়ে পড়বো।আমাকে এতোটাও ছোটো করে দেখোনা তন্ময়ী।প্লিজ ট্রায় ট্যু আন্ডারস্ট্যান্ড।

শেষের কথাটা এতোটা করুন শোনালো খারাপ লাগলো তন্ময়ীর।এমনকি চোখ ফেটে নোনাজল টলমল করলো তবে মনের চাপা রাগে সেটা গড়াতে দিলো না।ইভান সরে দাঁড়ালো।রুমের বাহিরের পানে অগ্রসর হতে হতে বললো—নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ো।একটা মশাও তোমাকে ছুঁয়ে দেখবেনা।

কথাটা মন মানতে চাইলোনা তন্ময়ীর।নারীমন যা চাইছে তা না পারছে রাগে ক্ষোভে মুখে প্রকাশ করতে।আবার না পারছে নিজেকে শান্ত রাখতে।এতোসময়ের টলমটল নোনাজল এবার চোখ বেয়ে গড়ালো।কম্বলের কিছু অংশ শক্ত হাতে ধরে চুপচাপ সেভাবেই পড়ে রইলো।দরজার কাছে গিয়ে ইভানের কি হলো,পিছে ফিরে তাকালো সে।মূহুর্তেই চোখ বন্ধ করে নিলো তন্ময়ী। সেটা দেখে ফের এলোমেলো হাসলো ইভান।কিছু একটা ভেবে দরজা লাগিয়ে,বেডে এসে ধপাৎ করে তন্ময়ীর পাশে শুয়ে পড়লো।তন্ময়ীর ইচ্ছে বুঝেও তাকে আর ঘাটালোনা।

অপরিচিত রুম,অপরিচিত বিছানা,পরিচিত হলেও অপরিচিত পুরুষ শরীর তারপাশে শুয়েছে উপলব্ধি করতেই শরীর জমে গেলো তন্ময়ীর।হৃদস্পন্দনের গতিবেগ বেড়ে গেলো।কম্বলটা আর-ও শক্তহাতে আঁকড়ে ধরলো সে।তবে ইভানের শোয়া নিয়ে অভিযোগ জানালোনা।সেটার ফায়দা লুটাতেই ইভান নিজের ফর্মে চলে এলো। দুষ্টমী করে বললো।

‘তোমার কম্বলটা শেয়ার করা যাবে?যদিও আমি অপছন্দনীয় ব্যক্তি তোমার, তবে কথা দিচ্ছি ফায়দা লুটবোনা।

উত্তর এলোনা।উত্তর আসবে আশাও করেনি ইভান।নিজ গরজে ঢুকে পড়লো কম্বলের ভিতর।অদ্ভুত অনুভূতিতে শরীর ছেয়ে গেলো।মুখে যতোই নীতিবাক্য আওড়াক,স্ত্রী রূপে প্রিয় নারীর সান্নিধ্যে ছুঁতে চাইলেই হাতের মুঠোয়।তাহলে কি আর নিজেকে ঠিক রাখা যায়।তবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার আলাদা গুণ আছে ইভানের।তাই চুপচাপ থাকলো। সময় গড়ালো।তবে ক্লান্ত থাকা সত্ত্বেও দু’জনের কারও চোখে ঘুম নামলো না।তন্ময়ী শান্ত হয়ে শুয়ে থাকলেও, ইভান শান্ত হয়ে শুয়ে থাকতে পারলো না।শুধু নড়াচড়া করতে থাকলো।আসলে ঘুম আসছেনা তার।কি করবে সে?বেশ কিছুসময় পার হওয়ার পর,বিরক্ত নিয়ে তন্ময়ী মুখ খুললো।বললো।

‘এতো নড়াচড়া করছেন কেনো?পাশে একজন শুয়েছে, সে খেয়াল নেই?নিজে না ঘুমালেও তাকে অন্তত ঘুমাতে দিন।

তন্ময়ীর নীরব পড়ে থাকা দেখে ইভান মনে করেছিলো তন্ময়ী ঘুমিয়ে গেছে।মেয়েটা ঘুমাইনি!তারমানে সে তারমতো ছটফট না করলেও, ঘুমাতে পারছে-না।দুষ্ট হাসলো ইভান। মজার ছলে বললো—এতো সুন্দর করে নিজের রুমটা সাজানো।রজনীগন্ধা আর গোলাপ ফুলের কম্বিনেশনে ঘরটা সুবাসিত হয়ে আলাদা সুগন্ধে ঘরময় ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে।এরপর ফুলসজ্জার রাত বলে কথা।তারউপর বউরূপে প্রিয় নারীটা কাছাকাছি শুয়ে আছে।ঘুম আসে?নাকি ঘুমানো যায়?তুমি বলো?

রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভূতিরা শিরশিরালো তন্ময়ীর।দম আঁটকে আসার মতো বাক্যগুলো।তবুও কথার ছল ছাড়লো না সে।ঘাড় ঘুরিয়ে শক্ত গলায় পরিহাসের স্বরে বললো।

‘এই যে একটু আগে ডায়গল ছাড়লেন,শরীর চাই-না আপনার।তবে ডায়লগ শুধু মুখেমুখে।বলা আর কাজে করে দেখানো কি এতোই সহজ!

তন্ময়ীর চোখে চোখ রাখলো ইভান।সুগভীর শান্ত নিরেট নজর।তারচেয়েও শান্ত গলায় বললো।–‘আমি কখন বললাম আমার শরীর চাই।তবে আমার তোমাকে চাই।শুধু কাছে চাই।

‘এতো সহজে আমাকে পাবেন বলছেন?

‘দুর্লভ্য হলেও একটা সময় গিয়ে যে তোমাকে পাবো।এটা জেনেও কেনো সময়টা এগিয়ে আনতে চাইছোনা?প্লিজ তন্ময়ী একটু সহজ হওনা।

ইভানের অসহায় কন্ঠের বার্তাগুলো নাড়িয়ে দিলো কোমল সত্তা।তবুও বহিঃপ্রকাশে টললো না তন্ময়ী।আর না।উত্তর দিলো।কিভাবে উত্তর দেবে,গলা কাঁপছে তার।উত্তর দিতে গেলেই যে দুর্বলতা প্রকাশ পাবে তার।ধরা পড়ে যাবে সে।তাই চুপ হয়ে রইলো।পদক্ষেপ বাড়লো ইভান।আরও একটু কাছ ঘেঁষে তন্ময়ীর পাশাপাশি গিয়ে শুলো।তন্ময়ী টের পেলো তবে কিছু বললো-না। শুধু নিঃশ্বাস আঁটকে চুপচাপ রইলো।কাত হলো ইভান।দুঃসাহসিকতার সহিত মুখটা নিয়ে রাখলো,তন্ময়ীর মাথার পিছনে কাঁধের কাছে।ফের বিনয়ী কন্ঠে বললো — স্যরি তনু।প্লিজ এতোটা কঠিন হয়েও না আমি প্রতি, একটু সহজ হও।

স্যরি কথাটা শুনতেই বুকটা ধ্বক করে উঠলো তন্ময়ীর।তবে সহজে রাগজেদ ছাড়তে পারলো না।তড়িৎ উঠে বসে,ইভানের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বললো।—আজকের দিনটা স্বাভাবিক অন্য দশ পাঁচটা দম্পতির মতোই হতো।যদি সেদিন আপনি ওরকম অবুঝপনার মতো কান্ডটা না ঘটাতেন।

‘এরজন্য কি দ্বায়ী তুমি একটুও নও?ছিলেনা দ্বায়ী।তুমি অন্য কারও হয়ে যাচ্ছো,আমি সেটা মেনে নিয়ে চুপচাপ তোমাকে অন্যকারও হতে দেখবো,বলছো?

নিভে গেলো তন্ময়ী।শুয়ে থাকা সুদর্শন সুপুরুষটার মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে হঠাৎই আড়ষ্টতা অনুভব করলো।এলোমেলো হয়ে এলো নজর।বধুর সাজসজ্জা ছেড়ে সাধারণ লালরঙা শাড়ী পরা মেয়েটাকে আবাছা আলোয় বেশ মোহনীয় সুন্দর দেখাচ্ছে।নজর অতিশয় মুগ্ধ হলো ইভানের।নিজের পদক্ষেপ আরও একধাপ বাড়ালো,মনেমনে ভাবলো তাতে যা আছে কপালে।তন্ময়ীর হাত ধরে কাছে টেনে নিলো।হঠাৎ কাজে হতভম্ব হলো তন্ময়ী,ফের ছটফটিয়ে উঠলো ছাড়া পাওয়ার জন্য। তবে ইভান ছাড়লোনা।শক্ত হাতদ্বারা নিজের বুকে জড়িয়ে নিলো মেয়েটাকে।
ফের তন্ময়ীর ছোট্টো কপালটায় বসালো নিজের ঠোঁট।তন্ময়ী যতোই ছটফট করলো,চুম্বনের গভীরতা ততোই বাড়লো।শক্তকরে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে রাখলো তন্ময়ীর কপালে।যখন ছটফটানিতে দূর্বল হয়ে ধীরে ধীরে শান্ত হতে থাকলো মেয়েটা,তখন নিজেও ঠোঁট সরিয়ে নিলো ইভান।আদূরে গলায় বললো।

‘শান্ত হও প্লিজ।তুমি কাছে থাকা ছাড়া আমি দ্বিতীয়ত কোনোভাবে তোমাকে ছুঁয়ে দেখবোনা।আর না কোনোরূপ স্বামীত্ব ফলাবো।রাগ জেদ যেটাই করো,কাছে থেকে করো।ভালোবাসতে হবেনা,তবে আমার মৃত্যু আগ পর্যন্ত এভাবে শুধু আমার কাছে থেকো।প্লিজ তন্ময়ী,দূরে সরে যেওনা।প্লিজজ…

কিসের টানে হঠাৎ যেনো কথাগুলো শুনতেই শান্ত হয়ে গেলো তন্ময়ী। অচেনা বুকে শান্তি মিললো।অস্বস্তি হওয়ার কথা থাকলেও বিন্দমাত্র অস্বস্তি হলোনা।তবে কোনো কারনো কান্না পেলো ভিষন।কেঁদে ফেললো সে।শব্দ হলো-না তবে চোখ বেয়ে নোনাজল গড়লো অবিরাম।ইভান অনুভব করলো তবুও ছাড়লোনা মেয়েটাকে।বরং আরও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো নিজের শক্তপোক্ত বুকে।তারসাথে ভালোভাবে নিজেদের গায়ে জড়িয়ে নিলো কম্বলটা।ফের হাত দিয়ে তন্ময়ীর চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো।

‘তোমাকে অসম্মানিত করার জন্য আমি বিয়ের আগের দিন রাতে আন্টির সাথে কথা বলেছিলাম।তোমার বিয়ে ভাঙার দোষটা আমি অকপটে স্বীকার করেছিলাম।সত্যি বলতে দাদাভাই সাহস না জোগালে,তোমাকে না পাওয়ার ভয়ে কখনোই আমি নিজের দোষটা স্বীকার করতাম না।আন্টি আমার এহেন কাজে আমার প্রতি মনোক্ষুণ্ণ, অসন্তুষ্ট হলেও ক্ষমা করে দিয়েছেন। যদিও তোমার মা-তো একটু বকাবকি করেছিলেন।মেয়েকে আমার সাথে বিয়ে না দেওয়ার জেদও ধরেছিলেন।তবে আমার চাওয়ার কাছে সেই রাগজেদ টিকিয়ে রাখতে পারেন নি।ব্যর্থ হয়েছেন।আমি জানি না,আমার উপরের রাগ জেদের ক্ষোভটা কখনো তোমার মিটবে কিনা। তবে দুজনে যখন একসুতোই বাঁধা পড়েছি,যাই হোকনা কেনো দূরে সরে থাকার কথা প্লিজ ভেবোনা।যেই শাস্তি দাওনা কেনো,ইভান মাথা পেতে নেবে।শুধু দূরে থাকার শাস্তিটা বাদে।প্লিজ তনু,তোমাকে ভালোবাসতে হবেনা আমাকে, শুধু কাছে থেকো।এভাবে আমার লক্ষীসোনা বউটা হয়ে আমার কাছে থেকো।আই প্রমিজড্,তুমি না চাইলে এই কাছে থাকার থেকে একটুও এগোবো-না আমি।

মায়ের কাছে দোষ স্বীকার করেছে ইভান!তাতেই যেনো বিগলিত হলো তন্ময়ী।এরপর ইভান এতোএতো কথা বললো,তবে একটা শব্দও উচ্চারণ করলোনা।আর না নড়নচড়ন করলো।ইভানের শক্তপোক্ত আলিঙ্গনে শুধু চুপচাপ রইলো।যদিও পুরুষালি শক্তপোক্ত বলিষ্ঠ বুকে নিজের শরীরকে কেমন অদ্ভুত অনূভুতি অনুভব করাচ্ছে। দম বন্ধবন্ধ লাগছে।তবু্ও শান্ত হয়ে পড়ে থাকার চেষ্টা করলো।ইভানও আর কথা বাড়ালো না।সারাদিনে শারীরিক মানসিকভাবে বেশ ক্লান্তি গিয়েছে।তন্ময়ী তার কথা মেনেছে,শান্তিতে চোখ বুজলো সে।বুকে শয়নরত রমনীকে বাম হাত দিয়ে আরও শক্তপোক্তভাবে আগলে নিলো।ফের ডান হাতটা রাখল নিজের মাথার নিচে।এরপর থেকে প্রতিটা রাত যদি মেয়েটাকে এভাবে বুক জড়িয়ে নিয়ে ঘুমানো যায়,তবে তার রাতসহ দিনগুলোও মন্দ কাটবেনা।

ক্ষুধার চোটে ঘুম ভেঙে গেলো কৌড়ির।নড়তে গিয়ে বুঝলো পাশে জায়গা কম।মুখ উঁচু করে দেখলো,পাশে নাফিম নেই।মান্যতা আপু শুয়ে আছে অন্যপাশে নানুমা।কৌড়ি নড়েচড়ে আবার শুয়ে পড়লো।কিন্তু অতিরিক্ত ক্ষুধায় ঘুম আসলো তার।আর সেই বিকাল থেকে এই পর্যন্ত ঘুমে।এখন ক’টা বাজে কে জানে।শুয়ে থাকতেও ভালো লাগছেনা।উফফ।কি এক জ্বালা!

‘ক্ষুধা লেগেছে বুঝি?

মান্যতার প্রশ্নে সচকিত হয়ে বললো-তুমি এখনো ঘুমাও নি আপু?

‘শুয়েছি তো একটু আগে।শুয়ে পড়তেই আমার ঘুম আসে না।শুধু ঠান্ডায় চুপচাপ আছি।

বলেই উঠে বসলো মান্যতা।সেটা দেখেই কৌড়ি বললো- ‘আবার উঠছো যে?

‘ভাইয়ের বউটা দুপুরে না খাওয়া।রাতেও না খেয়ে ঘুমিয়ে আছে।আমার আজ্ঞা আছে, সে যখনই উঠবে তাকে যেনো অবশ্যই খাওয়ানো হয়।

কপাল কুঁচকে ফেললো কৌড়ি।তবে মান্যতার কথা বুঝে উঠতেই কপাল শিথিল হয়ে গেলো তার।আজ্ঞা দেওয়া মানুষটা কে বুঝেই মনেমনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে।কেনো মানুষটা তার মায়াজালে এমনভাবে জড়িয়ে নিচ্ছে তাকে।যদিও পেটে প্রচুর খিদে তবুও বললো।

‘এখন খাবো-না আপু।ঠান্ডায় উঠতে ইচ্ছে করছে না।তুমিও শুয়ে পড়ো।

হাত ধরে টেনে তুললো কৌড়িকে।এবার নজর পড়লো গায়ের মোটা কম্বলে।সেই একই সুপরিচিত কড়া সুগন্ধ।হয়তো মানুষটার ব্যবহৃত কম্বল।বিধায় তার গায়ের সুগন্ধটা ছড়াচ্ছে।কৌড়ির ভাবনার মাঝেই হাত টেনে বেড থেকে নামালো তাকে।ফের বললো।

‘চলো।শুধু তুমি একা খাবেনা আমিও খাবো।বিয়ে বাড়ি থেকে খেয়ে আাসার পর রাতে খেতে ইচ্ছে করেনি।কিন্তু একন মনেহচ্ছে আমারও ক্ষুধা লেগেছে।

এবার আর দ্বিমত করতে পারলোনা কৌড়ি।প্রথমে ওয়াশরুমে গেলো সেখান থেকে ফ্রেশ হয়ে দু’জনে নিচে গেলো।কিচেনের ফকফকা লাইটটা জ্বলছে।দুজনেই কথা বলতে বলতে সেদিকে এগোলো।সেখানে গিয়ে ঈশিতাকে চুলায় কিছু করতে দেখে মান্যতা বললো।

‘তুমি এখনো ঘুমাইনি আপু।

হঠাৎ কথায় একটু চমকে গেলেও,মান্যতা আর কৌড়কে দেখে শ্বাস ফেলে বললো।–মাথাটা ধরেছে প্রচুর।আদা চা খাওয়াটা প্রচুর দরকার।তাই কিচেনে এসেছি।

‘কাওকে ডাকতে।

‘সবাই ক্লান্ত। তাতে আবার শীতের রাত।কাকে বিরক্ত করবো।তাই নিজে চলে এলাম।তা এতো রাতে তোরা এখানে?

ফ্রিজের দিকে এগোলো মান্যতা। খাবার বের করতে করতে বললো—ক্ষুধা লেগেছে,তাই খেতে এলাম।আর রাতে কৌড়িও খায়নি।তাই ওকেও সাথে নিয়ে এলাম।

‘খাবার আমার এখানে নিয়ে আয়।আমি গরম করে দিচ্ছি।

মান্যতা হাতের কাজ সারতে সারতে বিনয়ী কন্ঠে বললো।–লাগবেনা।আমি করে নিতে পারবো।তোমার মাথা ব্যথা করছে,আপতত চা খেয়ে রেস্ট নাও।

চায়ের পানি এখনো ফুটেনি।সেটা দেখে ঈশিতা ফের বললো–তোরা কেউ চা খাবি?পানি আরও একটু দেবো তাহলে।

মান্যতা ফের বললো –আমি-তো খাবোনা।কৌড়িকে জিজ্ঞেস করো।

জিজ্ঞেস করার আগেই কৌড়িও না জানিয়ে দিলো।ঈশিতার নজর পড়লো কৌড়ির দিকে।ফর্সা গোলগাল মুখ,ফুলে আরও গোলুমোলু দেখাচ্ছে। মেয়েটার শরীর খারাপ নাকি?বিয়ে বাড়ি থেকেও তখন চলে এলো।তারপর বাড়িতে এসে বউ নিয়ে কতো হৈচৈ হলো তখনও তো মেয়েটাকে কোথায় দেখেনি।কিছুটা চিন্তিত গলায় শুধালো সে।

‘তোমার চোখমুখ এতো ফুলোফুলো দেখাচ্ছে কেনো?তোমার শরীর ঠিক আছে তো?

বিনয়ী হাসলো কৌড়ি।ফের বললো —শরীর ঠিক আছে আপু।অনেক্ক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলামতো এজন্য এরকমটা দেখাচ্ছে।

চায়ের পানি ফুটে গিয়েছে।আদা,এলাচ,দারচিনি লবঙ্গ এর কম্বিনেশনে পানিটা ঘনো করে জ্বালিয়ে নিয়ে তাতে চা পাতা ঢেলে,মশল্লা চা বানিয়ে নিলো।মাথাটা পুরোপুরি না ছাড়লেও,আল্লাহর রহমতে অতিরিক্ত ব্যথা থেকে নিস্ক্রিয় পাবে।চা-টা ঢেলে নিয়ে মান্যতাদের বলে ড্রয়িরুমে চলে গেলো সে।ঈশিতা চলে যেতেই দুজনে মিলে খাবার গরম করে ডায়নিং টেবিলে নিলো।ফের খেতে বসে টুকটাক কথা বলতে থাকলো।

দীর্ঘ সময় ছাঁদে পার করে নিজের রুমের দিকে যেতেই ড্রয়িংরুমে নজর পড়লো নিভানের।রুমের দিকে আর পা না বাড়িয়ে সিঁড়িপথ ধরে নিচে নামলো সে।শেষ সিঁড়ি রেখে ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই,মনোযোগী হয়ে চা পান করা ঈশিতাকে শুধালো।

‘তুমি এখনো ঘুমাওনি?

‘আরেহ তুই।তুইও জেগে আছিস?আমার মাথাটা কেমন ধরেছে তাই চা খেতে এলাম।

‘ঔষধ লাগবে?

‘তোর ভাইয়ার মতো কথায় কথায় ঔষধ আমি খাইনা।এটা তুই জানিস না।

কথার উত্তর না দিয়ে স্মিথ হেসে ঈশিতার পাশে গিয়ে বসলো নিভান। ঈশিতা বললো।

‘তুই চা খাবি?

না বলতে গিয়েই ড্রয়িংরুমের সরাসরি ডাইনিংয়ের দিকে নজর পড়লো তার।মুলত টুংটাং মৃদুশব্দে নজর ওদিকে গেছে।তবে এই উঠেছেন ম্যাডাম।

‘কি হলো খাবি?

‘এক্সট্রা থাকলে খাওয়ায় যায়।আর যদি নতুন করে বানাতে চাও তবে থাক।

‘এক্সট্রা আছে।দেরী কর দিচ্ছি।

ঈশিতা উঠতে যাচ্ছিলো।সেটা দেখে নিভান বললো।—তুমি বসো।আমি দেখছি।

নিভান উঠলো।ড্রয়িংরুম পেরিয়ে ডায়নিং স্পেসে পা রাখতেই কৌড়ির নজর আপনাআপনি চলে গেলো নিভানের পানে।সুগভীর নজরজোড়া তারপানে স্থির রেখে সামনে এগোচ্ছে মানুষটা।খাওয়া রুদ্ধ হয়ে গেলো কৌড়ির। মাথা নিচু করে নিলো সে।মান্যতাও খেয়াল করলো নিভানকে।তড়িৎ জিজ্ঞেস করলো।

‘কিছু লাগবে দাদাভাই?

‘তোরা খেয়ে নে।আমি নিচ্ছি।

কিচেনে গিয়ে চায়ের পাত্র থেকে কাপে চা নামিয়ে ড্রয়িংয়ে যাওয়ার আগেই দেখলো ডাইনিংয়ে এসে বসেছে ঈশিতা।নিভানকে দেখতেই বললো—এখানে বোস।কথা বলি।

নির্দ্বিধায় কৌড়ির পাশের চেয়ারটা টেনে বসে পড়লো নিভান।বসেই পরপর চায়ের কাপে দু’বার চুমুক দিলো।
কৌড়ি আরও সংকোচিত হলো।সেটা খেয়াল করে মিটিমিটি হাসলো মান্যতা।ঈশিতা কথা তুললো।

‘বড়ো ভাইয়ের আগে ছোটো ভাই বিয়ে করে ফেলেছে বিষয়টা কেমন না?

নিভানের নির্লিপ্ত উত্তর।–‘কেমন আবার?

‘তোর কাছে কেমন-সেমন না মনে হলেও আমাদের কাছে কেমন সেমন যেনো মনে হচ্ছে।যাই হোক ইভান বিয়ে করে নিয়েছে,এটা ভেবে অন্তত এবার নিজের বিয়ে কথাটা ভাব।বয়সতো থেমে থাকছেনা।আর তা বাদেও সবার তোকে নিয়ে কতো ইচ্ছে আকাঙ্ক্ষা।আর কতোদিন সময় নিবি ভাই?

সংকোচ ছাড়াই পাশের মেয়েটার দিকে তাকালো নিভান।মনেমনে দুর্বোধ্য হেসে বললো–তবে মেয়ে দেখো বিয়ে করে ফেলি।

‘সত্যি বলছিস!কতোগুলো মেয়ে রিজেক্ট করছিস মনে আছে! তোরজন্য মেয়ে পছন্দ করবো ভাবতেই তো ভয় হয়।এই না আবার না করে দিস।মান ইজ্জত সব যায়!
তবে আমার ননদের মেয়ে আছে না,রুশা।তুই এবার বিয়েতে রাজি হলে,ও পাত্রী হিসাবে মন্দ নয়।দেখতে শুনতে বেশ ভালোই মেয়েটা।

নিভানের ঈশিতার কথায় কোনো কান-মন নেই।সে নির্লিপ্ত নজরে তাকিয়ে আছে কৌড়ির পানে।সে চাইছে উত্তর কৌড়ির দিক থেকে আসুক।বাক্যদ্বারা না আসলেও ভঙ্গিমাদ্বারা আসুক।আসলোও তাই।নিভান কথাটা বলতেই ফট করে নিভানের মুখের দিকে তাকালো কৌড়ি। নিভানকে নির্লিপ্ত নজরে তাকিয়ে থাকতে দেখেই মূহুর্তেি চোখ সরিয়ে নিলো সে।এবার শব্দকরে হাসলো নিভান।চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে, গা-ছাড়া ভাব দিয়ে বললো।

‘ওসব বাদ দাও তো।ওসব মেয়ে নিভানের চলবে না।

‘দেখেছিস,এই কারনেই মেয়ে পছন্দ হলেও তাদের কাছে প্রস্তাব রাখতে পারিনা।তুই পৃথিবীর সব বিষয়ে সিরিয়াস হলেও,বিয়ে বিষয় আসলেই এমন গা-ছাড়া ভাব দেখাস। কেনো করিস এমন?দুদিন পর ইভান বাচ্চার বাবা হয়ে যাবে।আর তুই বিজনেস নিয়েই পড়ে থাকিস।

‘আপু।

মান্যতা এতোসময় চুপচাপ খাবার খেতে খেতে দুপক্ষের কথা শুনলেও এবার কেমন হাসফাস করে উঠলো।ঘনোঘনো পানি খেতে থাকলো।বড়ো ভাইয়ের সামনে এহেন কথাবার্তায় কখনো সামিল হয়নি এমনকি সামনে ও থাকিনি সে।তাই কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। সেটা খেয়াল করেই ঈশিতাকে ডাকলো নিভান।ঈশিতা সেটা বুঝেই বললো।

‘ওরা তো কি হয়েছে।ওরাও বড় হচ্ছে,সবকিছু বুঝতে শিখছে।আর ইভান বাচ্চারা বাবা হয়ে যাবে এটাতে খারাপ কি বলা হলো।বাচ্চা হওয়াটা বুঝি খারাপ কথা!

মা নানুমা আর এই মানুষটা তাকে বিয়ে দেওয়া নিয়ে যেনো মাঝেমাঝে প্রসঙ্গ উঠলেই পাগল হয়ে যায়।তাই ঈশিতাকে ঠান্ডা করতে বললো—আবার আমার বিয়ে নিয়ে হাইপার যাচ্ছো!উফফ, তোমাদেরকে বুঝিয়ে আর পারা যায়না।তবে বললেই কি যে কাওকে নিজের জীবনে জায়গা করে দেওয়া যায়।নাকি নিজের বলে ভাবা যায়।আমি পারিনা ভাবতে।সে হবে আমার পুরো জীবনের সঙ্গীনি।তাকে তো বুঝেশুনে নিজের জীবনে জড়াতে হবে তাইনা?বিয়ে করবো ভাবলাম,আর যে কাওকে নিজের জীবনের সাথে জড়িয়ে নিলাম।হলো এটা?যাকে আমি আমার আমিটা দিয়ে দেবো,তাকে পরোখ করে নেবোনা।তাকে আমার আমিটা দেওয়া যায় কি-না। তবে…

কথা শেষ করতে দিলোনা ঈশিতা।বললো–কেমন মেয়ে চাই তোর?সেটা তো বললেই হয়।তা না,যার কথাই বলি সে রিজেক্ট।পৃথিবীর সব মেয়ে তোর অযোগ্য তাই না।

রহস্যময় হাসলো নিভান।শান্ত গলায় বললো–তা বলতে পারো।শুধু একজন বাদে আর পৃথিবীর সব মেয়ে নিভানের অযোগ্য।

ঈশিতা সন্দিহান নজরে নিভানের দিকে তাকালো।ফের সন্দিহান গলায় বললো।—তোর কাওকে পছন্দ আছে বলে মনে হচ্ছে।

আর বসে থাকতে পারলোনা কৌড়ি।এভাবে বসে থাকা যায়না।দরকার নেই তার পেট-মহাজনকে শান্ত করার।না খেয়ে কেউ মরেনা।বরং হৃদযন্ত্রায় সে যখনতখন মরে যেতে পারে।আর এখানে বসে থাকা মানে নিজের মৃতুকে চুপিসাড়ে আহ্বান জানানো।উঠে দাঁড়াতেই মনে হলো গরম চুলার উপরের ঝলছে যাওয়া আগুন থেকে কেউ তাকে বাঁচিয়েছে।তড়িৎ কিচেনের দিকে অগ্রসর হলো সে।তাকে দেখে মান্যতাও চলে গেলো।সেদিকে গভীর নজরে তাকিয়ে রইলো নিভান।ঈশিতার সন্দেহতা বাড়লো।হঠাৎ মাথায় যা খেললো মুখে বলে বসলো সে।

‘আমার অভিজ্ঞ নজর এবং মন বলছে তুই কৌড়িকে পছন্দ করিস।

হাসি চওড়া হলো নিভানের।নজর ঘুরিয়ে নিস্পাপ নজরে ঈশিতার পানে তাকালো সে।সেই হাসিহাসি শ্যামবর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে যা বোঝার বুঝে নিলো ঈশিতা।কিছুটা বিম্ময় নিয়ে বললো–ও-তো বাচ্চা মেয়ে ভাই!

মূহুর্তেই নজর অসহায় দেখালো নিভানের।সেটা বুঝে দমে গেলো ঈশিতা।ভাইয়ের অসহায় নজরে পড়ে নিতে অসুবিধা হলোনা।সেখানে স্পষ্ট অক্ষরে খোদাই করে যেনো লেখা-ওই বাচ্চা মেয়েতে তোমার ভাই মন হারিয়ে বডে আছে, এখন তোমার ভাইয়ের উপায় নেই।

দুঃখী হলো ঈশিতা।তবে মেয়েটা কৌড়ি ভেবেই মনেমনে খুশিও হলো।রূপেগুনে একেবারে পরিপূর্ণা।নিভানের জন্য উপযুক্ত মেয়ে।তবে?

কন্ঠ ধীর করে ঈশিতা শুধালো—তবে ‘বাড়িতে বিয়ের কথা কেনো বলছিসনা?ফুপা-ফুপুকেও জানা।অবশ্যই তুই সিদ্ধান্ত নিলেই তো সবকিছু ওকে।

রান্নাঘর থেকে এখনো পানির আর থালাবাসনের টুংটাং শব্দ হচ্ছে। চেয়ারে গা এলিয়ে চোখ বুঁজে নিলো নিভান।বললো—ওকে বোঝাও তবে।

‘কৌড়ি জানে তোর ফিলিংস সম্পর্কে?

চোখ বুঁজে রেখেই মৃদু হাসলো নিভান।ধীর গলায় বললো—‘জানে।

বিস্ময় নিয়ে ফের শুধালো ঈশিতা–ও রাজি নয়?

এবার হাসি চওড়া হলো নিভানের।ঈশিতার বিস্ময় বাড়িয়ে দিয়ে বললো–‘না

‘বলিস কি?তুই কে আর অন্যন্য মেয়েদের নজরে কি!
আর কারা তোকে মেয়ে দেওয়ার জন্য ওতপেতে বসে আছে।এটা ও জানে!নাহলে তোকে না বলে!

হাসিটা আরও একটু চওড়া হলো নিভানের।বললো–‘এবার বোঝো কেনো তোমার ভাই মেয়েটাতে মন হারিয়েছে।এতোদিনের শক্তপোক্ত ব্যক্তিত্ব চূর্ণ করে দিয়ে একটা বাচ্চা মেয়েতে পাগল হয়েছে।

এগো খোলামেলা অনুভূতি প্রকাশ।সত্যিই সামনে নিভান বসে আছে,এটা যেনো ক্ষনিকের জন্য অবিশ্বাস্য মনে হলো ঈশিতার।ভাইটা যে তার বেকায়দায় ফেসে গেছে বেশ বুঝলো।কৌড়ি রাজি নয়।মনেমনে ভাইটার জন্য দুঃখও অনুভব হলো।নরম কন্ঠে বললো

‘আমি বোঝাই ওকে।

বোনের নিজের প্রতি স্নেহময় কথায় হাসলো নিভান।চোখ খুলে একপলক ঈশিতার দিকে তাকিয়ে ফের বন্ধ করে নিলো।বললো।

‘আপতত না।পনেরো দিন পর ওর পরিক্ষা।আপতত সেদিকেই ধ্যানজ্ঞান থাকুক।তারপর এডমিশনের পড়া পরিক্ষাটাও ঠিকঠাক দিয়ে নিক।এরপরেরটা আমিই বুঝে নেবো।

‘এখনো তো পাঁচ-ছয় মাসের ব্যাপার?

এবার মৃদু শব্দ করে হাসলো নিভান।সেই চমৎকার হাসিটা স্নেহভরা নজরে দেখলো ঈশিতা।নিভান বললো।
‘ভাই বিয়েতে ঘোর আপত্তি ছিলো।এখন এটুকু সময় অন্তত সবুর করো।আর আপতত কাওকে কিছু জানিও না।মা’কেও না।ঝামেলাটা ওর হবে।

‘হুমম।

দুভাইবোনের মধ্যে আর বিশেষ কথা হলোনা।ঈশিতা উঠে দাড়ালো।কিচেনের দিকে একপলক তাকিয়ে ফের নিভানের বুঁজে থাকা চোকমুখের দিকে তাকিয়ে চলে গেলো।ঈশিতা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর মান্যতা আর কৌড়িও নিভানকে পাশ কেটে চলে যাওয়ার আগেই মান্যতাকে ডেকে উঠলো নিভান।

‘মান্য।

দাঁড়িয়ে পড়লো দুজনেই।চোখ খুললো নিভান।নজর ফেললো মান্যতার মুখে,তারমধ্যে একপলক কৌড়িকেও দেখে নিলো।কেনো যানি মেয়েটার ফ্যাকাসে চোখমুখ বলছে,মেয়েটা কোনো অসুখে ভুগছে কিন্তু নিজের স্বভাবজাত অনুযায়ী কাওকে কিছু বলছে না।বা বলতে পারছেনা।সংগোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিভান।স্বাভাবিক গলায় অকপটে মান্যতাকে উদ্দেশ্য করে বললো।—কাল ইভানের রিসিপশন,কাল যাওয়া হবে কিনা জানা নেই।হয়তো যাওয়া হবেনা।তবে পৌরসু দিন অবশ্যই ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবে।তুমি তো ডক্টর মৌমিতাকে চেনো।

মাথা নাড়ালো মান্যতা।ফের মুখে বললো।–চিনবো না কেনো।উনার কাছেই তো যাওয়া হয় বেশিরভাগ আমাদের।

‘উনাকে বলে রাখবো আমি।তোমারা শুধু গিয়ে দেখিয়ে আসবে।অসুস্থতা কি জনাবে।

আশ্চর্য হয়ে কৌড়ি নিভানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।ফের বললো—কিন্তু আমি-তো কোনো অসুখে ভুগছিনা।তবে আমি উনার কাছে কেনো যাবো?

আমি যেতে বলেছি তাই যাবে।অসুস্থ না থাকলেও সাধারণ চেকাপ করেই চলে আসবে।

নিভানের জেদপূর্ন কথায় রুক্ষ গলায় কৌড়ি বললো।
‘এটার কোনো প্রয়োজন তো দেখছি না আমি।

‘কিন্তু আমি দেখছি।

‘তবে আপনি অযথা জোরাবাদী করতে চাইছেন আমার সাথ।

রাগ হলো নিভানের।রাগে চোখমুখ শক্ত হয়ে কৌড়ির মুখের পনে তাকিয়ে মান্যতাকে বললো।—মান্য রুমে যাও।ও একটু পরে যাচ্ছে।

আশ্চর্য হয়ে কৌড়ি আর নিভানের ঝগড়া দেখছিলো মান্যতা।শান্ত ভিতু মেয়েটা তার ভাইয়ের সাথে ঝগড়া করছে!নিভান ডাক দিতেই ধরপড়িয়ে উঠলো বুক।কৌড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলো,সে-ও আতঙ্কে আছে।তার নজর বলছে,আমাকে একা রেখে যাবেনা আপু।সেই হিসাবে নিভানকে ডাকলো সে।

‘দাদাভাই।

মান্যতার ডাকের স্বর শুনে এবার কিছুটা জোর গলায় বললো নিভান।—-মান্যতা তুমি রুমে যাও।আমি বলছি তো ও একটু পরে যাচ্ছে।

“মান্যতা” ডাকটা ঠিক হজম হলো-না মান্যতার।এই ডাকটা দাদাভাইয়ের ভালো মেজাজের ডাক নয়,বুঝে কৌড়ির পানে দূর্বল নজর ফেলে চলে গেলো সে।কৌড়িও পা বাড়াতে চাইলো কিন্তু কিছুতেই যেনো তার পা উঠলোনা।আর এটাও বুজে আসলো না,সে যে অসুস্থ এই মানুষটা বুঝলো কিকরে?

‘রাগ জেদ যতো পারো দেখা-ও।গোটা তুমি হাজারটা সহ্য করার ক্ষমতা নিভানের আছে।তবে রাগ জেদ এমন জায়গায় অযথা প্রয়োগ করোনা,যেখানে বাধ্য করা লাগে তোমাকে।আমি কোনোরূপ চাইনা তোমাকে বাধ্য করতে।আমি চাই,নরমালি তুমি কথা শোনো আমার।অযৌক্তিক বা অযথা হলে শোনার দরকার নেই।কিন্তু তুমিতো শুনতেই চাইছোনা।তবে নিজের রাগ জেদ বহাল রাখার জন্য ডাক্তার দেখাতে চাইছোনা ভালো কথা।একটু নয় বেশ ভালো কথা।তবে অসুস্থতায় ভুগে যদি কোনো কঠিন অসুখ বাধিয়েছো।বিশ্বাস করো কৌড়ি, সেদিন তোমাকে আমি নিভান আস্ত রাখবো-না।
সেদিন রাগ জেদ কাকে বলে,নিভানকে দেখবে।

একটু থামলো নিভান।কৌড়িকে দেওয়া বিকালের কথাটা রাখতে পারলো-না সে,আর আদৌও রাখা সম্ভব নয়।তার কথার নড়চড় কখনো হয়না অথচ এই মেয়েটার বেলায়।সব কেমন এলোমেলো।চোখ খিঁচে বুঁজে থাকা কৌড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে সংগোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে।রুক্ষ গলার স্বর ছেড়ে শান্ত গলায় বললো।–মোটেও ভবিষ্যৎ নিভানকে দেখার চিন্তা ভাবনা করেনা কৌড়ি।যদি মনেমনে ভেবে থাকো,আমি শুধু মুখেমুখে বলছি।তোমাকে কিছু বলবোনা।তবে খুব ভুল ভাবছো।ভবিষ্যত রাগে জেদেপূর্ন নিভানকে যদি দেখতে চাও,তোমাকে ডিস্টার্ব করা ছেলেগুলোর থেকে জেনে নিও।নিভানের রাগ জেদ ঠিক কতোটা বাজে।
এতো দূরে যাওয়ার দরকার নেই।তোমার বড়মার কাছে জিজ্ঞেস করবে, সেই রাগান্বিত জেদালো নিভান কেমন?নাহলে তোমার মান্যতা আপুর কাছে জিজ্ঞেস করো।দরকার পড়লে তোমার ইভান ভাইয়াকেও জিজ্ঞেস করতে পারো।সবার কাছ থেকে আমার সম্পর্কে জেনে তারপর যেটা খুশি সেটা করো।এরপর তোমার ইচ্ছে তুমি ডাক্তার দেখাবে কি দেখাবে না।
আমার থেকে নিজেকে দূরে রাখবে রাখো কিন্তু রাগে জেদে হারিয়ে ফেলার চিন্তা ভাবনা ভুলেও করো-না।

থামলো নিভান।সময় পার হলো চোখ খুললো কৌড়ি।হরিণী বড়বড় চোখে তখন নোনাজলে টইটম্বুর।নিভান তখনও চেয়ে কৌড়ির মুখপানে।মনেমনে নিভানের প্রতি ক্ষোভ জন্মালো কৌড়ির।সেই ক্ষোভ থেকে সংকোচ ছাড়াই বললো।

‘আপনি প্রচন্ড খারাপ!

চলবে….

ফুলকৌড়ি পর্ব-৩০+৩১

0

#ফুলকৌড়ি
(৩০)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

অপমানে থমথমে হয়ে উঠলো দীবার ফর্সা সুন্দর মুখাবয়ব।যতোটা রূঢ়ভাষায় তার কথার উত্তর নিভান দিলো, ততোটা রূঢ়ভাবে প্রশ্ন সে কৌড়িকে করেনি।তবে নিভানের উত্তরের ভাষা বলে দিচ্ছে কৌড়ির প্রতি নিভানের অনুভূতিরর জোর।প্রথম দেখায় নিভানের পাশাপাশি কৌড়িকে দেখায় যে শঙ্কা মনে সৃষ্টি হয়েছিলো দীবার। তা একটু একটু করে বাস্তবিত রূপ নিচ্ছে।আর নিভান সেই বাস্তবতায় কৌড়ির মাঝে ডুবে যাচ্ছে।আর তাকে দীর্ঘনিশ্বাসের সহিত সরল চোখে তা দেখে যেতে হচ্ছে।এটা যে কতোটা যন্ত্রণাদায়ক যদি বিয়ের আগে একটাবার অনুভব করতে পারতো।তবে কখনো নিভানকে ছাড়ার কথা ভাবতোনা।ভুলে-ও ভাবতো না।এখন একজনের স্ত্রী হয়ে নিছকই এই ভাবনা অবৈধ,হারাম।তবুও মন কেনো মানে না!কেনো মানতে চায় না!নিভানকে যে আর তারদিকে ফেরানো আর কখনো সম্ভব নয়।এটাও বেশ বুঝতে পারছে দীবা।আরও নিভান যে ধরনের ছেলে,দীবা যতোই ছলাকলা করুক আর যতোই তন্ত্রমন্ত্র পড়াক।নিভানকে সে তারদিকে কখনোই ফেরাতে পারবেনা।তবে কৌড়ির পাশাপাশি নিভানকে দেখলেই তার কি যেনো হয়ে যায়।যতোই নিজের মন আর যবানকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেনা কেনো, তারা নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে যায়।চায়না সে, নিজের বয়স আর স্বভাবের বাহিরে গিয়ে অস্বাভাবিক আচারন করতে তবু্ও করে ফেলে।দীবার থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে কৌড়ির মন খারাপ হলো।তারজন্য দীবাকে কথা শুনতে হলো!বিষয়টা মোটেই ভালো লাগলোনা তার।যদি-ও তাকে নিয়ে দীবার ইঙ্গিতসরূপ কথাগুলো তার মোটেও ভালো লাগেনি।তাই বলে তারজন্য কাউকে ছোটোবড় কথা শুনতে হবে!লজ্জিত হতে হবে!এটা কখনোই চায়না সে। শুধু দীবার জন্য নয়,কারও জন্য চায়না সে।মনেমনে ভাবলো নিভানকে কিছু বলবে।ভাবনা মতোই নিভানের দিকে তাকাতেই দেখলো,চোখমুখ শক্ত করে তারদিকে তাকিয়ে আছে মানুষটা।মানুষটার চোখমুখের এক্সপ্রেশন বলে দিচ্ছে–এখানে আমার কথার উপরে একটা শব্দ-ও তুমি উচ্চারণ করে দেখো।তোমার খবর আছে।

যে কথাগুলো বলবে বলে মনেমনে সাজিয়েছিলো।ঠোঁট কেনো গলা অব্দি আসার আগেই কথাগুলো যেখান থেকেই গুছিয়ে নিয়ে আসছিলো সেখানেই মাটি চাপা দিয়ে ফেললো সে।সামনের মানুষটা মানেই আতঙ্ক,ভয়!সেই আতঙ্ক,ভয়,মানুষটার আচারনে কিছুটা কাটলে-ও পুরোটা কাটেনি।অদ্ভুত মানুষটার সাথে দুঃসাহসিক আচারন করার সাধ্যি তার কখনো হবে কি-না,সে জানে না।তবে যেটুকু কথার তর্ক সে মানুষটার কথার পরিবর্তে করে,তা মনে সাংঘাতিক ভয় রেখে।

‘এই তোরা এভাবে থমকে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?চল।ইভানদের ফোন দিয়েছি,আসছে ওরা।আরেহ নিভান তুই কখন এলি?কৌড়ি, তুমি-ও এসেছো?

অমায়িক হেসে কথাটা জিজ্ঞেস করতেই,কৌড়ি দীবার দিকে একপলক তাকিয়ে উত্তর দিলো–ইভান ভাইয়া, জোর করে নিয়ে এসেছেন আমাকে।আমার মানা তিনি একটুও শোনেন নি।

‘ঠিক করেছে।বিয়ে বাড়ির আনন্দ বলে কথা।ভালো লাগবে-না আবার কেনো?যতোই শরীর খারাপ থাক,বিয়ের আনন্দ কেউ মিস করে?ইভান একদম ঠিক করেছে।আমার পক্ষ থেকে বিয়েতে ওর একটা এক্সট্রা গিফট পাওনা রইলো।

এবাড়িতে আসা একদিনের মধ্যে আমায়িক ব্যবহারের ঈশিতা বেশ ভাব পাতিয়ে নিয়েছে কৌড়ির সাথে।বিশেষ করে নিভানের সেই আচারনে পর থেকে, ফুফুর কাছ থেকে মেয়েটা সম্পর্কে জেনে আরও নিজ থেকে ভাবটা জমিয়েছে।যদিও কৌড়ি এখনো সেভাবে মিশে উঠতে পারিনি।দুজনের কথায় মূহুর্তেই পরিবেশ আগের ন্যায় হলো।ঈশিতা ভিড় থেকে একটু দূরে গিয়েছিলো, ইভানদের আসতে বলার জন্য।বিধায় বিষয়টা সম্পর্কে সে আবগত নয়।কিন্তু অন্যন্য কাজিনেরা,কৌড়িকে নিয়ে নিভানের ব্যবহারে একটু আশ্চর্য হলো!বাহিরের মেয়েটাকে নিয়ে,দীবার সাথে রূঢ় আচরন!মনেমনে প্রশ্ন তৈরী করলো।তবে যাকে নিয়ে মনে প্রশ্ন তৈরী হলো,তাকে প্রশ্ন করার স্পর্ধা কারও নেই।বিধায় কেউ আর কিছু বললো না।তবে কৌড়ির পানে বাঁকা নজরে তাকাতেও ভুললো না তারা।কৌড়ি খেয়াল করলো বিষয়টা তবে কি করার আছে তার।নিভান-ও খেয়াল করলো,তবে বিশেষ গুরুত্ব দিলো-না।ইভানরা আসতেই,ঈশিতা গহনা আর শাড়ী কেনার জন্য তাড়া দিলো।সবাই গহনার দোকানের দিকে এগোলেও, ঈশিতাকে বলে নিভান অফিসে চলে গেলো।যদিও ঈশিতাসহ ইভান চেপে ধরেছে,কিছুতেই যেতে দেবেনা তাকে।তবে কাজ হলো না। গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে তার।তবে যাবার আগে সবার চোখের আড়ালে কৌড়িকে হুমকিমূলক বার্তা ছুঁড়ে দিয়ে যেতে ভুললো না।মান্যতার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা কৌড়িকে উদ্দেশ্য করে মিহিকন্ঠে বার্তা ছুঁড়ে দিয়ে গেলো।

‘ভালোমানুষি অপাত্রে দান কখনোই করবে-না।তুমি চাইলে-ও নিভানের,আর না চাইলেও নিভানের।যদি বলো,তোমার হ্যাঁ স্বীকারোক্তি না পাওয়া সত্ত্বেও তোমার সাথে জোর করছি।হ্যা জোর করছি আমি!তুমি হ্যাঁ না যাই বলো না কেনো, তুমি নিভানের।আর নিভান ভালোমানুষি কখনো অপাত্রে দান করা পছন্দ করে না।সো,বি এক্সট্রা কেয়ারফুল।নিজেকে সাবধানে রেখো,ভালো রাখার চেষ্টা করো।অসম্মানিত হওয়ার থেকে রক্ষা করো।না-হলে নিভানের কাছে অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া লাগবে তোমাকে।তোমার ভালোর কৈফিয়ত না দেওয়া লাগলেও,অবশ্যই মন্দের কৈফিয়তটা দেওয়া লাগবেই।আর আমার উপরে দেখানো রাগে জেদে ভরা যে শরীরের মধ্যে ভালোমানুষি মনটা নিয়ে ঘুরছো।সে সবকিছু তোমার হলেও,আস্ত তুমিটা তোমার নও।তুমিটা আমার।আর নিভানের জিনিস নিভান কখনো হেলায়ফেলায় নষ্ট করে-না।কষ্ট পেতে দেয় না।অসম্মানিত হতে দেয়ন।সো মাথায় রেখো,কৌড়ি।আস্ত শরীরটা তোমার হলেও,তুমি তোমার নয়।

নিভান শান্ত পায়ে চলে গেলো।সেদিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থেকে নিজের আপাদমস্তক নজর বুলিয়ে দেখলো কৌড়ি।নিজের ব্যথা লাগলে,কষ্ট পেলে,সেটাও কাউকে কৈফিয়ত দেওয়া লাগবে!আশ্চর্য!নিজের সবকিছু অথচ সে নিজের নয়!সেটাই বলে গেলো মানুষটা!ঘোর কাটালো তার।নিভানের কথাগুলো একে একে ফের মন পড়তেই,মনের অদ্ভুত সুক্ষ এক ভালোলাগা সৃষ্টি হলো।পরোমূহর্তে কিছু একটা ভেবে মিলিয়ে গেলো সেই ভালোলাগা।নিভানের যাবার পানে তাকলো সে।জেদ নিয়ে মনেমনে আওড়ালো–কৌড়ি যা ইচ্ছে তাই করবে।আর কৈফিয়ত!বসে আছে সে,আপনাকে দেওয়ার জন্য।

দূরত্ব কদমে কদমে বাড়লেও, যেনো কৌড়ির মনে কথা ঠিকই,শুনতে পেলো, বুঝতে পারলো,এমনভাবে পিছে তাকালো নিভান।সঙ্গে সঙ্গে নজর ফিরিয়ে নিলো কৌড়ি।সেটা দেখে মৃদু হেসে নিজের গন্তব্যে এগোলো নিভান।মান্যতা দু’জনের বিষয়টা লক্ষ্য করলো।নিভান চোখের আড়াল হতেই মান্যতা মজার ছলে মিহিকন্ঠে বললো।

‘দাদাভাই চুপিচুপি তোমায় কি বলে গেলো?

হঠাৎ কথায় পরাণ চমকিয়ে উঠলো কৌড়ির।পাশে ফিরে মান্যতার দুষ্ট হাসির মিষ্টি মুখটা দেখতেই নজর অসহায় করে ফেললো সে।অর্থাৎ এসব কথা তোমায় বলি কিকরে আপু?কৌড়ির মুখের এক্সপ্রেশন দেখে হেসে ফেললো মান্যতা।ফের মজার বললো।

‘আচ্ছা ঠিক আছে, বড়ভাই আর বড়ভাবীর গোপনীয় কথা আমি শুনছি-না।তবুও মুখটা ওরকম করে রেখো-না।আমার দাদাভাই আবার কিন্তু প্রিয়জনদের বেচারা মুখ সহ্য করতে পারেনা।আরও তুমি তার.…

‘আপু।

এবার খিলখিলিয়ে হেসে দিলো মান্যতা। সেই হাসিতে কৌড়ির হৃদস্পন্দন দুরুদুরু হলো।সতর্ক নজর আশেপাশে ফেলতেই দেখলো,সবাই সামনে এগিয়ে গেছে।শুধু তারা দু’জনে পিছনে।হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো,এমনভাবে শব্দ করে নিঃশ্বাস ছাড়লো কৌড়ি।কৌড়ির হাল বুঝে হাসি থামিয়ে ফেললো মান্যতা।হাত বাড়িয়ে নিজের হাতের মুঠোয় কৌড়ির হাতটা নিয়ে স্বাভাবিক গলায় বললো।—জানো কৌড়ি,আমার গোটা লাইফে দাদাভাইকে আমি গম্ভীর স্বভাবের জেনে এসেছি।অবশ্যই দেখে এসেছিও তেমন।আমাদের সব ভাইবোন থেকে ভিন্ন,একদম আলাদা।তাকে হাসতে কম দেখেছি,সবার সাথে প্রাণখোলা মিশতে খুব কম দেখেছি।যেকোনো সম্পর্কে অনুভূতি খোলাখুলি প্রকাশ করতেও খুবই ক্ষীন দেখেছি।অথচ সবটাই কিন্তু দাদাভাইয়ের মধ্যে ভরপুর।কিন্তু সে দেখাতে পছন্দ করে-না আর দেখায়ও-না।তবে তোমার বেলায়,সেই দাদাভাইটা কেমন ভিন্ন।হয়তো এতোদিনে জেনে গিয়েছো এমনকি বুঝে গিয়েছো,দাদাভাই তোমাকে পছন্দ করে।তবে একটু আধটু পছন্দ নয়,একবারে নিজের বলে পছন্দ করে।আমিও বুঝেছি এবং দেখেছিও, তোমার প্রতি তার অনুভূতির প্রকাশভঙ্গী।খুবই কঠিন!দৃঢ় মনোবল স্বভাবের মানুষ হয়েও,যা সেও ভিতরে চেপে রাখতে পারেনা।দাদাভাইকে যেমনভাবে ছোটো থেকে এই-অব্দি দেখে এসেছি,বিশ্বাস করো কৌড়ি। আমার কাছেও এই দাদাভাইকে কেমন অবিশ্বাস্য এলোমেলো লেগেছে।কিছুতেই আমি বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলাম না,এ-কি আমার সেই দাদাভাই!গম্ভীর, কথা কম বলা,হাসতে কম পরা,মিশতে না পারা,অনুভূতি প্রকাশে অক্ষম দাদাভাই!কতোখানি তীব্র সেই অনুভূতি বুঝতে পারছো।তোমাকে ভেঙে বলতে পারছি না হয়তো সেকারণেই আমার মতো গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারছো না।তবে তোমার কাছে আমার একটাই চাওয়া।প্লিজ কৌড়ি,ওই মানুষটাকে কখনো বিমুখ করো-না।তোমাকে যদি সে নিজের একান্ত স্ত্রী রূপে চায়,তুমি তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার ভুল করো-না।তুমি চোখবুঁজে ওই মানুষটাকে বিশ্বাস করতে পারো,ভরসা করতে পারো।তুমি কখনোই ঠকবে-না।আমার ভাই বলে বলছি না,তুমি ওই মানুষটাকে জানো না।জানলে,তুমিও ওই মানুষটাকে কখনোই তুমি ফিরিয়ে দিতে পারবে-ও না।

থামলো মান্যতা।কৌড়ির হতবিহ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো–তোমার সাথে আরও অনেক কথা আছে।বাড়িতে অনেক মানুষ।রাতে শোয়ার প্রবলেম হতে পারে।তুমি আমার কাছে ঘুমাবে।রাতে আমরা অনেক গল্প করবো।শুনবে না?

ঘোর কাটলো কৌড়ির।কিছু বলার আগেই, দূর থেকে মৌনতার কন্ঠ ভেসে এলো–এই আপু,তোরা আবার দাঁড়িয়ে পড়লি কেনো।দেরী হয়ে যাচ্ছে তো, আয়।

কথা সেখানেই ক্ষান্ত রেখে মান্যতাও এবার তাড়া লাগিয়ে বললো–এই চলো,চলো।আমাদের রেখে ওরা না আবার শপিং সেরে ফেলে।

শপিংমল থেকে বের হয়ে গাড়িতেই বসতেই,কিছু একটা ভেবে ফোন হাতে নিলো নিভান।ফোন ওপেন করে ডায়ালে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত নম্বরটাতে ফোন লাগালো।ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই নিভান শুধালো–তুই কোথায়?শপিংয়ে আসলি না যে?তন্ময়ীর সাথে তো তোরও আসার কথা ছিলো,তবে আসলি না কেনো?

‘আরেহ মেয়েদের শপিংয়ে আমি গিয়ে কি করবো।তাই যায়নি।আর এদিকে একটু কাজ ছিলো,বিধায় যেতে পারিনি।

তৃনয়ের স্বাভাবিক গলার কথাগুলো,কিছুতেই স্বাভাবিক লাগলোনা নিভানের।সে জানে তৃনয় কেনো আসিনি শপিংয়ে।নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো নিভান।প্রসঙ্গ পাল্টে ফের শুধালো–আন্টির খবর কি?শরীর এখন কেমন? ভালো আছে কি?

‘শরীর তো ভালো আছে।তবে তনুর প্রতি মনেহয় একটু অসন্তুষ্ট হয়েছেন।আম্মু বলতে চাইছেন,কিছু না ঘটলে কিছু রটে না।নিশ্চয় তন্ময়ী কিছু করেছে না-হলে হঠাৎ এরকম কথা পাত্রপক্ষরা পেলো কোথায়?অনকে বুঝিয়েছি তবুও মুখ থমথমে ভাব উনার।কথাও সেভাবে বলছেন না।এই আর কি।

নিভান কি বলবে বুঝে উঠতে পারলো-না।ইভানের প্রতি রাগ উঠতে গিয়েই মন দূর্বল হয়ে পড়লো।ভেবে দেখলো,আজ যদি ইভানের সিচুয়েশনে সে পড়তো।তবে কি করতো?আরেকমন বললো,যাই করতো না কেনো,অন্তত ইভানের মতো বোকামি সে কিছুতেই করতো-না।ভাবনা ছেড়ে নিভান ফের শুধালো।

‘আন্টি কি ওই ছেলের জায়গায় ইভানকে মানতে পারছেন না?

আরেহ মা মানবে কি, সে নিজেই তো মানতে পারছেনা।কথাটা ঠোঁটের চৌধারে এনেও বলতে পারলোনা তৃনয়।ইভানের জন্য মান্যতাকে পাওয়া তার আরও কঠিন হয়ে দাঁড়ালো। সে ভেবে রেখেছিলো,তন্ময়ীর বিয়ের পর একটা চান্স নেবে।তাতে যা হয়ে যায় হবে।তবে বিষয়টা এখন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।বোনের ননদকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেওয়ার বিষয়টা কি কেউ ভালো চোখে দেখবে?নাকি ভালো মনে মেনে নেবে?ওবাড়ির কেউ মানবে?নিভান মানবে?বোনটার কি তার এহেন প্রস্তাবে শ্বশুরবাড়িতে অসম্মানিত হতে হবে না?এসব ভেবে ভেবে সে দিন পার করছে।এগুলো সে নিভানকে কি করে বোঝায়!কিকরে বলে।তবে নিভানের কথার উত্তর সরূপ বললো।

‘আরেহ না।মা কেনো মানতে পারবেন না।ইভান সবদিক থেকে পারফেক্ট ছেলে।আর তাকে মেয়ের জামাই হিসাবে চাইবেনা,এটা কিকরে হয়!এমনিতেই তন্ময়ীর উপর একটু মনখারাপ আছে বলে ওরকমটা করছে।

নিভান কিছু ভাবলো।ফের বললো–আমি অফিস শেষে তোর বাসায় আসছি।আন্টির সাথে আমার কথা আছে।রাখছি।

ফোন কাটতে গিয়েও তৃনয়ের প্রশ্ন থেমে গেলো নিভান–
‘আম্মুর সাথে তোর আবার কি কথা?

‘তোর মতো গাধাকে বলবো কেনো?যে নিজের কাজটা সাহস নিয়ে ঠিকঠাক করে উঠতে পারেনা।তাকে বলে সময় নষ্ট করে লাভ আছে?

‘তুমি আমাকে গাধা বলতে পারিস-না।এই আমি কি ঠিকঠাক করতে পারিনি?আমি পড়াশোনা থেকে শুরু করে যে কাজটায় উদ্যোগ নিয়েছি,সেটা পুরোপুরি সাহসের সহিত সাকসেসফুল করে এসেছি। তুই আমাকে নতুন চিনছিস?নাকি নতুন করে আমাকে চিনাতে হচ্ছে?

বোনকে সেধে অন্যের ঘাড়ে তো কখনো চাপাতে চায় না নিভান।তবে বন্ধুর মনের দোনোমোনোতাও বুঝতে অসুবিধা হলোনা।মনেমনে ভুগছে ছেলেটা, সেটাও বেশ আন্দাজ করতে পারলো।তাই বললো।

‘নতুন করে চেনাতে,জানাতে হবেনা।তোকে চিনি, জানি বলেই বলছি।তবে ভেবে দেখ।সব ঠিকঠাক থাকলেও, জীবনে যে জিনসটা আঁকড়ে মৃত্যুর দুয়ার পর্যন্ত বাঁচতে হবে।সেই জিনিসটা তুই সাহসের সহিত নিজের করে নিতে পেরেছিস কি-না?আমার সন্দেহতা আছে, সত্যিই তুই সেটা চাস কি-না?মনেপ্রানে চাইলে কি কেউ নিজের হৃদয়ে বসানো মানুষটা থেকে দূরে থাকতে পারে নাকি নিজেকে তার থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতে পারে?আমি পারছি কৈ?আমার যে কৌড়িকে চাই।

শব্দ করেই শ্বাস ফেললো নিভান।সেটা হতবাক হয়ে থাকা ওপাশের ছেলেটা-ও শুনতে পেলো।নিভান ফের বললো–রাখছি।রাতে দেখা হবে। আল্লাহ হাফেজ।

উত্তর এলোনা।কল কেটে দিলো নিভান।অথচ ওপাশের ছেলেটা তখনো স্তব্ধ।নিভান তার কথাদ্বারা কি বোঝাতে চাইলো,নিজেও বুঝতে চাইলো?বিশেষ করে কৌড়িকে দিয়ে উদাহরণ দেওয়া শেষের কথাটা!তবে কি নিভান জানতে পেরেছে তার মনের কথা?কবে, কিভাবে, কখন?সে তো তার আচারন দ্বার কখনো বুঝতে দেয়নি তাকে।শুধু তাদের খুব ভালো বন্ধত্বটা নষ্ট হয়ে যাবে বলে।তবে কিভাবে জানলো?মান্যতাকে দেখা মূহুর্তেই চোখমুখের এক্সপ্রেশন বদলে যায় তার।সেখানে ভীড় করে বিশেষ মুগ্ধতা।ভিতরে ভিতরে সে দূর্বল হয়ে পড়ে।সেসব আচারনই কি তবে বুঝে নিয়েছে তার বুদ্ধিমান চতুর বন্ধুটি!

কুয়াশাচ্ছন্ন সুন্দর একটা সকাল।হেমন্তঋতু গিয়ে শীতের ঘনঘটায় প্রকৃতি আচ্ছন্ন হয়েছে গোটা কয়েকদিন হলো।সামনে কৌড়ির পরিক্ষা।অথচ বিয়ের হইহট্টগোলের আমেজে পড়াশোনা হচ্ছে না।কৌড়ি মুখে কিছু না বললেও নীহারিকা বেগম বেশ বুঝতে পারলেন তার অসুবিধার।তাই বিয়ের কয়েকদিন মান্যতার রুমে থাকতে বলেছেন তিনি, কৌড়িকে।যেখানে বিশেষভাবে থাকতে দেওয়া হয়েছে নীহারিকা বেগমের আম্মাকে।বয়সের খাতিরে বিভিন্ন ব্যথা-বেদনায় আক্রান্ত মানুষটাকে একটু স্বত্বি শান্তিতে থাকতে দেওয়ার জন্য মান্যতার রুমটা আলাদা করে উনাকে স্পেস দেওয়ার জন্য বাছাই করে থাকতে দেওয়া হয়েছে।আপতত কৌড়িরও একটু পড়াশোনার জন্য স্পেস দরকার।তাই ভেবেচিন্তে সেখানে কৌড়িকেও জায়গা করে দিলেন।বৃদ্ধা মানুষটা তা নিয়ে দ্বিরুক্তি করলেন না।বরং খুশিই হলেন।বিয়ে বাড়িতে রাতের বেলায় রুমটায় অনেক মানুষের থাকার জায়গা হলেও,দিনের বেলায় রুমটায় শুধু কৌড়ি আর বৃদ্ধ মানুষটার আনাগোনা।তবে মান্যতা মৌনতার আশা যাওয়া রুমটাতে অঢেল চলছেই।

সকাল হতেই পুনরায় বিয়ে বাড়ির হৈচৈ শুরু হলো।যে যার দায়িত্ব অনুযায়ী কাজেকর্মে লিপ্ত হলো।গল্পগুজব, রান্নাবান্না,আলাপ আলোচনা,যে যার কর্ম অনুযায়ী লিপ্ত।সকাল হওয়ার পর কৌড়ি এখানো বাহিরে বের হয়নি।গভীর মনোযোগ বইয়ের পাতায় তার।একটু আগে এসে রানীসাহেবা তাকে আর নানুমাকে চা নাস্তা দিয়ে গেছে।আপতত ওই খাবারেই চলে যাবে তার দুপুর অব্দি।তবে বড়মা কি তা হতে দেবে?তবুও বাহিরে হৈচৈ নিজেকে সামিল করার নিয়ত তার নেই।রুমের বাহিরেই কেনো জানি যেতে ইচ্ছে করছেনা।এতো মানুষের ভিড়ে নিজেকেই কেমন পরপর মনেহচ্ছে।অদ্ভুত সব চিন্তাভাবনা।তবুও সেই চিন্তাভাবনা থেকে কিছুতেই নিজেকে সহজ করতে পারছেনা।বিধায় গভীর মনোযোগটা পড়াশোনায় দিয়েছে।এমনিতেই এতো অচেনা মানুষের মধ্যে নিজেকে কেমন মনেহচ্ছে, তার উপর পড়াশোনায় ভিষন চাপ।অথচ সেই চাপ অনুযায়ী পড়তেও পারছে-না সে।আপতত পড়ায় মনোবেশিত করেছে।নানুমাও তাকে ডিসটার্ব করছেন-না।চায়ের কাপ হাতে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তিনি বেলকনিতে গিয়ে বসেছেন।সকালের মিষ্টি মিষ্টি রোদ্দুর এসে পড়েছে সেখানে।সেই সোনালী রোদ্দুরে তিনি গা ভাসাচ্ছেন আর চা খাচ্ছেন।পড়ার একফাঁকে নজর যেতেই কৌড়িরও ইচ্ছে হলো উনাকে সঙ্গ দেওয়ার।দ্বিধাদন্ড ছাড়াই চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে সে-ও উঠে উনার কাছে চলে গেলো।বৃদ্ধা মানুষটার সাথে দিলখোলা সম্পর্ক তৈরী নাহলেও একটুআধটু মিশুকে সম্পর্ক তৈরী হয়েছে।একদম বড়মায়ের কপি মনে হয়েছে।বৃদ্ধ মানুষটার মুচকি হেসে মিষ্টি মিষ্টি কথা মনে ধরেছে কৌড়ির।প্রায় দু-মাসের অধিক সময় বাদে মনে হয়েছে,দাদিআপার সঙ্গ পেয়েছে সে।কৌড়িকে বেলকনিতে দেখতেই বৃদ্ধা মৃদু হেসে বললেন।

‘পড়াশোনা ছেড়ে এসেছিস তবে?

বিনিময়ে কৌড়ি মৃদু হেসে উনার পাশে গিয়ে দাঁড়লো।বৃদ্ধা আবার শুধালেন।–তোর সাথে তুই করে কথা বলছি।কিছু মনে নিচ্ছিস না-তো?

কৌড়ি চঞ্চল গলায় উত্তর দিলো–একদম না।আপনি আমার সাথে তুই করে বলতেই পারেন।

বিনিময়ে ফের মৃদু হাসলেন বৃদ্ধা।বয়সের ভারে কুঁচকে আসা মুখাবয়বে সেই হাসিটা দারুন মুগ্ধতা ছাড়লো। কৌড়িও সেটা মুগ্ধ নজরে দেখলো।অথচ বৃদ্ধার নজর বেলকেনির গ্রীল ভেদ করে লন এরিয়ায় চেয়ার পেতে গোল টেবিলের মধ্যমনি হয়ে বসা যুবকের পানে অটল।কিছুসময় বাদে সেটা বুঝে,নানুমার নজর লক্ষ্য করে কৌড়িও সেদিকপানে তাকালো।নজর স্থির হয়ে গেলো তারও।জাহিদ আঙ্কেল শাহেদ আঙ্কেল দিয়ে ইভান ভাইয়ার মামারাসহ বেশ কিছু মুরুব্বি মানুষের মধ্যমনি হয়ে বসে আছে, তাকে সবসময় হুমকির মুখে রাখা মানুষটা।হালকা শীতের প্রতাপে গায়ে জড়ানো তার কালোরঙা হুডি।হুডিটা মাথায় জড়ানো নেই।পরিপাটি করে রাখা ঘনোকালো চুলগুলো সোনালী রোদ্দুরে চকচক করছে।শ্যামবর্ণ মুখের আদল আরও উজ্জ্বল উজ্জীবিত দেখাচ্ছে।গায়ের লম্বা হাতার হুডিটার কনুই পর্যন্ত সরিয়ে গুটিয়ে রাখা।ডানহাতে চায়ের কাপ।সময় নিয়ে নিয়ে তাতে ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছে।সবার মধ্যেমনি হয়ে বসে থাকা মানুষটাকে বেশ আকর্ষণীয় আর হ্যান্ডসাম লাগছে।ওই শ্যামসৌন্দর্য পুরুষ যেকোনো নারীর স্বপ্নের কাম্য পুরুষ।আর ওই মানুষটা তাকে পছন্দ করে!মনে উঠতেই,অদ্ভুত শিহরনে তোলপাড় বয়ে চললো ছোট্টো বুকের ভিতরটায়।মনটা কোনো কারনে সুখ অনুভূত অনুভব হতে গিয়ে-ও নিরাসিত হলো।এ কেমন দোটানায় মধ্যে পড়ে গিয়েছে তার মন মস্তিষ্ক?কোনপথে যাবে সে?এ কেমন জ্বালা!মুখ ফিরিয়ে নিতে গিয়ে দেখলো নানুমা এখনো নিষ্পলক ওই মানুষটার পানে তাকিয়ে রয়েছে। মনে প্রশ্ন জাগলো কৌড়ির।নাতীকে নানুমা এতো স্নেহময় মুগ্ধ নজরে কি দেখছে?তবে চেয়েও প্রশ্ন করতে পারলোনা।দ্বিধাদ্বন্দ্বের জালে ফেলে দিলো মন।পাশে দাঁড়ানো বয়োবৃদ্ধ মানুষটা সেটা বুঝতে পারলো কি-না জানা নেই কৌড়ির।তবে নিজের মতো করে বলে উঠলো।

‘জানিস নানুমা!ওই ছেলেটার গায়ের রঙ শ্যামকালো হলে কি হবে,আমার নজরে দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ।আমার সকল নাতিনাতনিদের মধ্যে সবচেয়ে স্নেহময় আর নিস্পাপ আদূরে একখানা মুখ।আমার এতিম বাচ্চাটা,আমার নিভান।ছোটো বেলা থেকে কতোকিছু সহ্য করে এসেছে আমার বাচ্চাটা।অথচ কখনো উফ-তাক শব্দ ওর মুখ দিয়ে বের হয়নি।প্রিয় বাবাকে হারালো,মায়ের অবহেলা পেলো।অথচ ছেলেটা চুপচাপ।জানিস,আমি ওর ওই ছোট্টো নিস্পাপ আদূরে মুখখানা দেখতাম আর ওকে জড়িয়ে ধরে হাওমাও করে কাঁদতাম।ভাবতাম,আমার এই এতিম বাচ্চাটার কি হবে।একসময় চিন্তায় চিন্তায় নিজের অসুখ বাঁধিয়ে ফেললাম।আমার ছেলে, ছেলে বউরা সান্ত্বনা দিলো।ওরা থাকতে নিভানকে কখনো কষ্ট পেতে দেবেনা।নিজেদের সন্তানের মতোই মানুষ করবে।ঈশিতা।আমার নাতনী।ও পর্যন্ত কি বলতো জানিস?বলতো,ওমন আদূরে মায়ামায়া একটা মুখ।দাদুমা তুমি কিকরে দুশ্চিন্তা বাড়াও,আমরা ওকে অযত্নে অবহেলায় বড় হতে দেবো!ছেলেটা, সবার প্রিয় জানিস!প্রিয় হয়ে উঠেছে তার স্বভাবে,তার ব্যবহারে।

থামলেন বৃদ্ধা।জেনো জিরিয়ে নিলেন।ফের বলতে শুরু করলেন–নীহিরিকার যখন জাহিদের সাথে দ্বিতীয় বিয়ে হলো।আমি ওকে দিতে চায়নি।আমার এমিত বাচ্চাটা পরের বাড়ি কষ্ট পাবে!আমি চায়নি।আমার ছেলেরাও দিতে চায়নি।তবে জাহিদ সেটা মানেনি।নিজ সন্তানের দাবী করে এবাড়িতে নিয়ে আসলো ওকে।
সত্যি বলতে,ও নিভানকে মেনে নিয়েছিলো সেভাবেই।একদম নিজ সন্তানের মতোন।অথচ আমার এতিম বাচ্চাটাকে এবাড়ির কেউ ভালো চোখে দেখলো-না।তবুও আমার বাচ্চাটা কখনো কাওকে অভিযোগ জানাইনি।ছোট্ট বাচ্চাটা কি বুঝতো জানিনা।তবে কখনো কারও নামে ভালোমন্দ বিচার দেওয়া,দোষারোপ করা এসব গুণ ও কখনো আয়ত্ত করেনি।ওর প্রতি আলাদা একটা মায়ামমতা আমার।অদ্ভুত টান।যা অন্য নাতিনাতনীদের প্রতি অনুভব করিনা আমি।সেই আলাদা টানটা আসে না আমার ওদের প্রতি, যা একমাত্র ওরপ্রতি কাজ করে।এবাড়ি থেকে আমার কাছে বেড়াতে গেলে,আমি যখন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এটাওটা জিজ্ঞেস করতাম ওকে।ওর বাচ্চা কন্ঠে একটাই উত্তর ছিলো, আমি মায়ের কাছে ভালো আছি নানুমা।অথচ ওর আর ওর মায়ের মুখ দেখলেতো আমি বুঝতে পারতাম।ও কতোটা ভালো আছে।মাঝেমধ্যে অনেকদিন করে রেখে দিতাম আমার কাছে। জাহিদ আবার সেটা বেশিদিন দীর্ঘ হতে দিতোনা।নিয়ে আসতো ওকে।সত্যি বলতে জাহিদ কখনো ওকে পরের ছেলের নজরে দেখিনি।তবে ওর বাড়ির লোক কেউ নিভানকে পছন্দ করতোনা।জাহিদের চাপে পড়ে সবাই নিভানকে মেনে নিলেও,মন থেকে কেউ মেনে নেয়নি।এরপর ইভান নানুভাই জন্মালো।আমার যেমন ওর উপরে অদ্ভুত এক স্নেহ মায়া।ওর-ও ইভান নানুভাইয়ের উপরে অদ্ভুত এক স্নেহ মায়া।ইভান নানুভাই জন্মানোর পর আর ওকে আমার কাছে রাখতে পারিনি।ইভানকে ছাড়া ওবাড়িতে যেতোনা ও।আর কোনোসময় গেলেও থাকতোও-না।এরপর সকল প্রতিকূল অনুকূলের মধ্যে দিয়ে একটু একটু করে বেড়ে উঠলো।যে ইভানের প্রতি ওর আদর,যত্ন ভালোবাসা ছিলো মা আর সন্তানের মতো,সেই ইভানের সাথে ওর দূরত্ব তৈরী হলো,এবাড়ির কিছু মানুষের কুমন্ত্রণায়।যদিও সেটা সামসময়িকতার জন্য ছিলো।তবু-ও দু ভাইয়ের মধ্যে আগের যে অটুট বন্ধনটা ছিলো, সেটা এখন আর দেখা যায়-না।তারপর এবাড়ির মানুষগুলো পরিস্থিতির প্রতিকূলে পড়ে এমন একটা পর্যায়ে এসে দাঁড়ালো।আপন ভাইরা স্বার্থপরের মতো দূরে সরে গেলো।সেখানে সেই পর হয়ে, ওকেই নিজের সপ্নটা বিসর্জন দিতে হলো।দিলেও।তখন আর আমি চুপ থাকতে পারলাম না।পারলাম না বলতে চাইলাম না চুপ থাকতে।ওকে স্বার্থপরের মতো বারবার বললাম–কেনো নিজের ইচ্ছে, স্বপ্ন বিসর্জন দিবি তুই নানুভাই?ওই মানুষগুলো তোর এই বিসর্জন,ত্যাগটা বুঝবেনা।তোকে বুঝবেনা!

ও সেদিন উত্তর দিয়েছিলো—আমি নিজেকে মহান বোঝানোর জন্য বা কারও জন্য কিছু করছিনা নানুমা।আমি আমার বিবেকবোধ থেকে নিজের স্বপ্নটা ত্যাগ করতে চাইছি।যেখানে যে ব্যাক্তিটা আমাকে নিজ সন্তানের মতো আগলে রাখার চেষ্টা করেছে।বাবার বঞ্চিত আদর ভালোবাসা দিয়ে যাচ্ছে।তাকে এই অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে আমি আমার স্বপ্নের পথে উড়াল দেই কিকরে?এতোটা স্বার্থপর হতে তো শেখাওনি তোমারা,আমাকে।তবে শুধু নিজেরটা ভাবি কিকরে?আর আমার মা।তিনি যেখানে ভালো থাকবেন না সেটা জেনেও সেখানে আমি আমার স্বপ্নের পথে পা বাড়াবো কিকরে?আমার ইচ্ছেগুলোর ডানা মেলে দেই কিকরে? আমার মা ভালো থাকার কাছে,আমার স্বপ্ন যে নিতান্তই নগন্য।

‘স্কলারশিপ পেয়েও ছেলেটা বাহিরে পড়ার স্বপ্নটা ছেড়ে দিল।জাহিদের ধসে পড়া ব্যবসার হাল ধরলো।তারপর একটু একটু করে নিজের ভালো থাকাটাও ছেড়ে দিলো।ভুলে গেলো, ও নিজের ভালো থাকা।নিজে কিসে ভালো থাকবে,কিসে মন্দ থাকবে,সেটা না ভেবে নিজের ভাইবোন,আপনজনদের নিয়ে ভাবনা বাড়লো।ভাবতে থাকলো।আজ ও সফল।তবে নিজের ইচ্ছে আকাঙ্ক্ষা, ভালোলাগা, মন্দলাগা সবটা ত্যাগের বিনময়ে সে সফল।অথচ ওকে দেখ,কি নির্জীব।মনেহয় ও ওর ইচ্ছে আকাঙ্ক্ষা,ভালোলাগা মন্দলাগা নয়,নিজেকেই বিসর্জন দিয়ে দিয়েছে?

কথা বলতে বলতে বৃদ্ধ মানুষটার দূর্বল গলা কেঁপে কেঁপে উঠলো।সেই কম্পনে কৌড়ি অনুভব করতে পারলো,ওই মানুষটার প্রতি এই বৃদ্ধার আলাদা স্নেহ ভালোবাসা।বিমূঢ়, স্তব্দ কৌড়ি।সে ভুলেও আশা করেনি।ওই মানুষটার অতীত এমন হতে পারে।সেজন্য কি সেদিন মানুষটা বলেছিলো,সে এবাড়ির কেউ নয়।ভাবনা কেমন অস্থির এলোমেলো হয়ে উঠলো কৌড়ির।অদ্ভুত কারনে ব্যথার তোলপাড় শুরু হলো বুকের ভিতর।চঞ্চল নজর গিয়ে পড়লো,লন এরিয়ার সেই নির্দিষ্ট স্থানে।নজর গিয়ে থামলো,সেই শ্যামবর্ণ মুখাবয়বে।হঠাৎই নানুনার মতো তারও মনে হলো,পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুদর্শন যুবকটা বুঝি সবার মধ্যমনি হয়ে ওই বসে আছে।আর তার শ্যাম সৌন্দর্যের কাছে যেনো পৃথিবীর অন্যন্য সুদর্শন সুপুরুষেরা সব ফিকে।কৌড়ির এলোমেলো অনুভূতি অনুভবের মধ্যে, পাশে বৃদ্ধা দাড়ানো নারীটা শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।ফের বললেন

–ওর জন্য আমার সবসময়ের প্রার্থনা।ও একটু অভিযোগী হোক,একটু অভমানী হোক।মনের মধ্যে চেপে রাখা বিয়োগ ব্যথার ক্লেশগুলো সেই অভিমানে অভিযোগে মুক্ত হয়ে যাক।তারপর নিজের ইচ্ছেমতো ভালো থাকুক।পৃথিবীর সবসুখ প্রভু তার রহমতের হাতদ্বারা ওর উপর ঢেলে দিক।ও এমন একজন জীবনসঙ্গিনী পাক।সে যেনো ওর সমস্ত অপূর্ণতা, পূর্নতায় ছেয়ে দেয়।ওর সকল অপূর্ণতার পুর্নাঙ্গীনি হয়।

চলবে….

#ফুলকৌড়ি
(৩১)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

আজ তন্ময়ীর মেহেন্দি অনুষ্ঠান।ইভানদের বাড়ি থেকে যখন অনুষ্ঠানের সকল আয়োজন নিয়ে ওবাড়ির পথে রওনা হবে সবাই।তখনই ইভানকে ফোন করে জানিয়ে দিলো,সে মেহেন্দি অনুষ্ঠান করতে চায়না।এমনকি হাতে মেহেদি লাগাতেও সে ইচ্ছুক-নয়।ইভান অসন্তুষ্ট হলো!মেয়েটাকে এতোকরে বোঝালো অথচ মেয়েটা তাকে বোঝার চেষ্টাই করলোনা। বুঝলোই না তাকে!দগ্ধ হলো মন।কি করবে হঠাৎ বুঝে উঠলো না।মেয়েটাকে ছেড়ে দেওয়া তাঁরপক্ষে কখনো সম্ভব নয়।আর এখন এই পরিস্থিতিতে এসে মেয়েটাকে মাঝ দরিয়ায় দাঁড় করিয়ে তো আরও কখনো নয়!দু-জনের মধ্যে তর্কবিতর্ক হলো।ইভান পুনরায় তন্ময়ীকে বোঝানোর চেষ্টা করলো।
তবুও কাজ হলোনা।তন্ময়ীর একটাই কথা,মেহেন্দি অনুষ্ঠানে জন্য কেউ যেনো ওবাড়ি থেকে তাকে মেহেদী পরাতে এবাড়িতে না আসে।অসহায়বোধ করলো ইভান।কি করবে সে এখন?কিভাবে তন্ময়ীর এসব জেদালোপূর্ন অযৌক্তিক কথাটা বাড়িতে জানাবে?কথা শেষ করে কল কেটে দিয়েছে তন্ময়ী।হাতে থাকা ফোনটার দিকে দূর্বল নজরে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে, দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ঘনোঘনো।ক্লান্ত শরীরের ন্যায় বসে পড়লো নিজের বেডে।মাথার চুলগুলো দু’হাতে খামচে ধরে বেশ কিছুসময় ভাবলো।সামনের চলা দিনগুলোতে কি আছে ভাগ্যে,এটা তার জানা নেই।তবুও তন্ময়ীকে কোনোমূল্যে ছাড়তে চাওয়া বা ছাড়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।জোরেশোরে তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে।গমন পথ বাড়িয়ে দিলো মায়ের কাছে যাওয়ার পানে।
নীহারিকা বেগম তখন রান্নাঘরে ব্যস্ত হাতে কর্মে লিপ্ত।মায়ের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালো ইভান।ভরাট গলায় ডেকে উঠলো

‘আম্মু।

কন্ঠ যেনো কেমন শোনালো।উদ্বিগ্ন হয়ে কপাল কুঁচকে ফেললেন নীহারিকা বেগম। তড়িৎ কাজের হাত থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

‘কি হয়েছে?কিছু বলবি?

ভিতরে ভিতরে ইভান ইতস্ততবোধ করলো।তবুও বলতে তো হবেই।তাই মনের দ্বিধা কাটিয়ে বললো–এবাড়ি থেকে মেহেন্দির ডালা নিয়ে, ওবাড়িতে না পাঠালে হয় না?

‘এ কেমন কথা ইভান!যদিও এই আচার অনুষ্ঠান কড়াকড়ি নয় তবুও মেহেন্দি অনুষ্ঠানটা বিয়েতে মানা হয়।আর যেখানে সবাই যখন মনস্থির করেছে ওবাড়িতে যাবার জন্য সেখানে হঠাৎ না মানাটা কেমন দেখায়?আর ওরাও অপেক্ষা করছে,সেখানে না যাওয়াটা কতোটা যৌক্তিক!সবকাজে ছেলেমানুষী করলে হয়-না ইভান।আর মেহেন্দির ডালা নিয়ে ওরা যাবে,তোর সমস্যা হচ্ছে কোথায়?

সমস্যা আমার নয় সমস্যা তোমার ছোটো বউয়ের। কথাটা মনেমনে কঠিন গলায় আওড়ালেও, তন্ময়ীকে দোষী করতে চাইলো না।তাই ইনিয়েবিনিয়ে বললো—আমার সমস্যা নেই।তন্ময়ীর কথা ভেবে বলছিলাম, মেয়েটার মানসিক অবস্থা আগের ন্যায় নেই।ও বলছিলো,এতো উহ্য করে মেহেন্দি অনুষ্ঠান করার দরকার নেই।বিয়ে যখন হচ্ছে মেহেদী এমনিতেই পরে নেবে।

মন মিথ্যা বলতে চাইলোনা।তবে বাধ্য হয়ে বলতে হলো তাকে।কিছুটা অবাক হয়ে নীহারিকা বেগম বললেন-
—তন্ময়ী নিজেই চাইছেনা মেহেন্দির অনুষ্ঠান করতে?

মুখে কিছু না বলে এবার মাথা উপর নিচ মৃদু ঝাঁকিয়ে ইভান জানালো।সেটা দেখে সহসা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন নীহারিকা বেগম।মেয়েটার বিয়ে ভেঙে গিয়ে আবার নতুন করে অন্যত্র বিয়ে হচ্ছে। মানসিকভাবে হয়তো প্রস্তুত নয়।একজনকে নিয়ে এক রকম ভেবে রেখেছিলো।এখন আবার হঠাৎ আরেকজনকে নিয়ে ভাবতে হচ্ছে ।তাই হয়তো এসব আচারনিষ্ঠা বিশেষভাবে ভালো লাগছে-না।নীহারিকা বেগম,উনার মতো বুঝে আপতত সবাইকে তন্ময়ীদের বাড়িতে যাওয়া থেকে আটকে রাখলেন।তিনি কথা বলবেন তন্ময়ীর সাথে।যেভাবেই হোক বিয়ে যখন হচ্ছে আচার অনুষ্ঠানতো করতে হবে।এসবে বাড়ির সম্মানও জড়িয়ে আছে।বুঝিয়ে শুনিয়ে ব্যবস্থা তো একটা করতেই হবে।না-হলে এবাড়ির সম্মানের ব্যাপার তো পরে,মেয়েটাকেই কটুবাক্য শুনতে হবে।নিন্দিত হতে হবে।তিনি হাতের কাজ ফেলে ছুটলেন নিভানের কাছে।যদি মেহেন্দি অনুষ্ঠান হয় তবে ছেলেটা ঠিক তন্ময়ীর দিকটা সামলে নিতে পারবে।যেখানে ওবাড়ির সাথে আগে থেকে নিভানের একটা দারুণ সম্পর্ক আছে।আর যদি মেহেন্দি অনুষ্ঠানটা না-হয় তবুও ছেলেটা,সমাজের নাকউঁচু মানুষের উল্টো পাল্টা বলা বা ভাবা থেকে দমিয়ে রাখতে পারবে।এ-বাড়ির ও-বাড়ির দু-য়োবাড়ির সম্মান,নিজের যোগ্যতা বলে অটুট রাখতে পারবে।


নিজের ঘরে চুপচাপ বসে আছে তন্ময়ী।ঘোলাটে নজরজােড়া তার ফোনের পানে নিশ্চল।ইভান কতশত বার ফোন দিয়েছে অথচ সে ধরেনি।নিজেকে কেমন অনুভূতিহীন জড়বস্তু মনেহচ্ছে।একটু আগে কতোকরে ভাইয়া তাকে বুঝিয়ে গেলো,অথচ মন কিছুতেই গলতে চাইছেনা।এইযে মা,হলুদের অনুষ্ঠানের পর এখনো তার সাথে সেভাবে কথা বলেনি।দায়ী কে?ইভানের সবকিছু মাফ করা গেলেও,মায়ের সাথে তার যে অস্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরী হয়েছে।এটার জন্য ইভানকে ক্ষমা করবেনা সে।কিছু সময় মনেহচ্ছে বিয়েটা ভেঙে দিতে।আবার মন বলছে,এবার বিয়ে ভেঙে গেলে মা আর ভাইয়ের সম্মান তো নষ্ট হবেই।সাথে মায়ের যদি কিছু হয়ে যায়!

কিন্তু মায়ের এই ব্যবহার তাকে কষ্ট দিচ্ছে। আর সেই কষ্ট ইভানের প্রতি রাগ জেদ অভিমান আরও বাড়াচ্ছে।
অথচ বিপরীত লিঙ্গ বলতে,ইভানের প্রতিই তো তার প্রথম অনুভূতি জন্মেছিলো।তবে বাবাহীন,মায়ের একার এই শ্রমের সংসারে গা ভাসিয়ে চলতে চায়নি সে।তেমন মন মানসিকতা নিয়ে-ও বেড়ে উঠেনি।মা এবং ভাইয়ের আদর্শমতো চলার চেষ্টা করেছে।সেখানে ইভানের রাখা প্রস্তাব, তার করা পাগলামির প্রতি অনূভুতি জন্মালেও তা প্রকাশ করেনি তন্ময়ী।বরাবর অনুভূতি চেপে রেখে নিজেকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে সে।সেই দমিয়ে রাখা মৌন সম্মতিও যেনো ইভানের প্রতি অগাধ আগ্রহী আর দূর্বল ছিলো।থাকবেনা কেনো,ছেলেটা তাকে বুঝে কি নিখুঁতভাবে তার মনের মতো করে প্রস্তাব রেখেছিলো।যা কখনো সে কোনো পুরুষ মানুষের কাছে আশা রাখেনি।প্রেমের সম্পর্কে না জড়িয়ে সময় মতো তাকে চেয়ে নেওয়া।ইভানের এহেন প্রস্তাবে মনেমনে বিগলিত হয়েছিলো তন্ময়ী।তবে হ্যা সূচক সম্মতি না দিলেও,নাকচ সে করেনি।দেখা না হলেও,ফোনালাপে তার সকল ইতরামি কথাগুলো সহ্য করে তাকে আশকারা দেওয়ার হকতো সেই তৈরী করে দিয়েছিলো।একদিন দু’দিন তিনদিন করে যখন সময় পার হয়ে সপ্তাহে গিয়ে ঠিকতো,তখন একটা মানুষের কলের অপেক্ষা তো সে করতো!সম্পর্কের নাম ছিলোনা।অথচ সেই সম্পর্কে মায়া,টান ছিলো অদ্ভুত।সেই মায়া টান নিস্ক্রিয় হয়ে পড়লো,ইভানের একটা কার্যে।অথচ ইভান,সেই কার্যে নিজের পক্ষে কি নিপুনভাবে সাফাই গেয়েছে।সেই সাফাই সত্য কি মিথ্যা জানা নেই তার।তবে ইভানের হয়ে নিভান ভাইয়া কখনো মিথ্যা বলতে পারে!এটাও সে বিশ্বাস করেনা।নিজের ভাইয়ের মতোই শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ,ভরসা করে নিভানকে তন্ময়ী।অথচ ইভানের হয়ে সেই সবার কথা ভেবেচিন্তেও নিজের মনকে মানাতে পারছে-না তন্ময়ী!

না নিজের মায়া টান থেকে ইভানকে ক্ষমা করতে পারছে!না ইভানের সাফাই তার মনকে গলাতে পারছে।আর না নিভানের যৌক্তিক কথায় নিজের মনকে ইভানের প্রতি মানাতে পারছে!কি এক যন্ত্রণায় আছে।উফফ!তবে এই পরিস্থিতির জন্য নিজেকেও কম দ্বায়ী করছেনা তন্ময়ী!ইভানের এ-কথাতো সত্য। ইভানকে নিজের জীবনে প্রশ্রয় দেওয়ার হক যখন নীরবে দিয়েছিলো।তখন নিজের চোখে দেখা দৃশ্যাবলী নিয়ে একবার তো তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যেতো!ভালো হতো বা মন্দ তবে এই পরিস্থিতির সম্মুখীন তো তাকে হতে হতোনা।ইতুরে ইভানকে তো সে আগে থেকেই চিনতো জানতো।বিয়ে ভাঙার মতো কান্ড,ছেলেটার দ্বারা অসম্ভব কিছু নয়।তবুও কেনো এরকম ভুলটা করলো!এখন কোনদিকে যাবে?

‘তুমি ওবাড়ি থেকে মেহেন্দি দিতে আসতে নিষেধ করেছো কেনো?

চমকে মায়ের মুখের দিকে তাকালো তন্ময়ী।এখনো গম্ভীর সেই ফর্সা গোলগাল মুখখানা।মায়ের প্রশ্ন এড়িয়ে ধরা গলায় বললো।–বিশ্বাস করোো আম্মু, উনারা যে অভিযোগ জানিয়ে বিয়েটা ভেঙে দিয়েছেন।আমি তেমন কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে নেই।

‘আমি জানি।

‘তবুও তুমি আমার সাথে কথা বলছোনা?অভিমান করে আছো?তুমি ছাড়া কে আছে আমাদের?তুমি ওরকম আচারন করলে,আমার যে দম বন্ধ হয়ে আসে।মনে হয়, আমার বলে এই পৃথিবীতে কিচ্ছু নেই।

দুচোখ বেয়ে নোনাঅশ্রু গড়ালো তন্ময়ীর।দ্রুতপানে পা বাড়িয়ে মেয়ের কাছে গেলেন।মা’কে সামনে পেতেই জড়িয়ে ধরলো তন্ময়ী।ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো।পিঠে হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দিলেন তাহমিনা বেগম।মুখে কিচ্ছুটি বলেননা,শুধু দীর্ঘশ্বাস আওড়ালেন।তন্ময়ীর বিয়ে ভাঙার পর ক্ষনিকের জন্য উনারও মনে হয়েছিলো,কিছু না ঘটলে এরকম কথা পাত্রপক্ষরা পেল কোথায়?নিজ মনে সেসব কথা ভেবে তন্ময়ীর উপরে অভিমান জন্মে ছিলো উনার।সেই অভিমান গলেছে কাল রাত্রে নিভানের সাথে কথা বলার পর।কালরাতে ছেলেটা দেখা করতে এসেছিলো উনার সাথে।ভালোমন্দ কথার পর,ভণিতা ছাড়াই ইভানের করা ভুলের দোষ স্বীকার করেছে সে।সাথে মিনতি-ও করেছে,বিয়েটা না ভাঙার।ছেলেটা নাকি তন্ময়ীকে ভিষন পছন্দ করে।যেখানে তন্ময়ীর কোনো সম্মতি বা হাত ছিলোনা।আর যখন শুনলো,তন্ময়ীর বিয়ে।সেই বিয়ে ঠেকাতে কিভাবে কি করবে বিবেচনা না করে বিয়েটা ভেঙে দিয়েছে।এসব শুনে তাহমিনা বেগমও চড়াও হয়েছিলেন।এমনকি ইভানের সাথে মেয়েকে বিয়ে দেবেননা,এটাও জানিয়ে ছিলেন।তবে নিভানের অমায়িক যুক্তিতর্ক আর নরম ব্যবহারের কাছে নমনীয় হতে বাধ্য হয়েছেন।আর দ্বিতীয়বার মেয়ের বিয়ে ভাঙার খবর পাড়াপ্রতিবেশি বা আত্মীয় স্বজন জানলে, মেয়েটার বাঁচা মুশকিল হয়ে যাবে।সব বিবেচনা করে তিনিও আর কথা বাড়ালেন না।তবে নিভান যাওয়ার আগে ভাইয়ের পক্ষ থেকে বারবার ক্ষমা চেয়ে গিয়েছে।যদিও মেয়ের সম্মান নিয়ে ছেলেখেলা করার জন্য, ইভানের প্রতি তিনি মনোক্ষুণ্ণ হয়ে রয়েছেন তবে তা আর চেয়েও প্রকাশ করতে চাইলেন না।দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়ের মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন।

‘মা হও তারপর বুঝবে মায়েদের কতো জ্বালা।আর যদি হয় মেয়ে সন্তান তখন যেনো,চিন্তা-ভাবনা,বিবেচনাবোধ বিবেকবোধর জ্বালা শতগুণ!যাই হোক,সত্যি বলতে পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে মা তোমাকে অবিশ্বাস করেছিলো। তোমার প্রতি মনোক্ষুণ্ণও হয়েছিলো।মা’কে ক্ষমা করে দিও।

‘এসব কি বলছো আম্মু!আমার জন্য তোমাকে অসম্মানিত হতে হয়েছে,আমিই স্যরি।খুব খুব স্যরি আম্মু।

তাহমিনা বেগম এবার শব্দকরেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
প্রসঙ্গ এড়িয়ে মেয়ের মাথায় চুমু খেয়ে বললেন–মেহেন্দির অনুষ্ঠান হবে।ওবাড়ি থেকে মেহমান আসার আগে রেডি হয়ে নাও।আর তোমার বান্ধবীরাও তোমার অপেক্ষা করছে,ওরা তোমার জন্য রেডি হয়নি।চুপচাপ ড্রয়িংরুমে বসে আছে।আমি ওদেরকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নেবে।

তন্ময়ী মুখে কিছু না বলে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।তাতেই তাহমিনা বেগমের মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো।মেয়েকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।তন্ময়ীর কপালে চুমু দিয়ে ফের রেডি হয়ে নিতে বলে চলে গেলেন।মা যেতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো তন্ময়ী।মনে প্রশ্ন জাগলো বিভিন্ন। তার বিরুদ্ধে মায়ের এই মান ভাঙলো কিকরে মন জানতে চাইলো।তবে আপতত জানার যখন উপায় নেই।মা’কে প্রশ্ন করার সাহসও করতে পারলোনা।তখন আর মনে প্রশ্ন রেখে লাভ আছে!তবে যে এই সাধনটা করেছে,তাকে মন থেকে ধন্যবাদ।

তন্ময়ী বিয়ের অনুষ্ঠান করতে চায়না,এটা নিভান ছাড়া দ্বিতীয় কান হতে দিতে চাইলেন না নীহারিকা বেগম।
বাড়ির একটা পিঁপড়া পক্ষীকেও জানতে দিলেনও না।
তবুও কথাটা কিভাবে কি করে যেনো ইভানের ফুপু ডালিয়া বেগমের কান অব্দি পৌঁছে গেলো।আর তিনিও যেনো এমন একটা মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায় মূখিয়ে ছিলেন,নিজের পেটের কথাগুলো উগরে দেওয়ার জন্য। যা তিনি নিজের বড়োভাইয়ের জন্য পারছিলেন না।এখন যখন সুযোগ পেয়েছেন তবে কথার খেই কেনো ছাড়বেন?ছাড়বেন না তিনি।এমনিতেই ইভান ওরকম একটা মেয়কে বিয়ে করতে চাইছে, এটা যেনো তিনি সেদিন থেকেই মানতে পারছিলেননা।তবে বাধ্য হয়ে চুপ থাকতে হয়েছে উনাকে।এবার কথার খেই যখন পেয়েছেন চুপ থাকার প্রশ্নই উঠেনা।কন্ঠে উপহাস মিশিয়ে,ড্রয়িংরুমের ভরা মজলিসে বেশ কটাক্ষ করে তিনি নিজের মা’কে অর্থাৎ ইভানের দাদুমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন।

‘এমনিতেই মেয়েটার গায়ে রঙ ময়লা,চাপা!তারউপরে বংশের কোনো বিশেষ নামগন্ধ নেই।তাতে আবার,মেয়েটার বিশেষ ছেলেবন্ধু আছে বলে নাকি বিয়ে ভেঙেছে।সেই মেয়েকে কোন হিসাবে ইভান বিয়ে করতে চাইলো আমার বুঁজে আসছে না।তোমারা-ও আবার তাতে ইন্ধন জুগিয়ে,বিয়েতে মতামত দিলে।ছেলেটার না-হয় মহান হওয়ার সাধ জেগেছে তাই বলে তোমারাও কিকরে, ছেলেটার ভবিষ্যতের দিকে না তাকিয়ে ওর সম্মতিতে সহমত পোষণ করলে?ওর নাহয় বুদ্ধুিসুদ্ধি লোপ পেয়েছে,তোমরা কিকরে বুদ্ধিতে খাটো হলে!নাও,এখন রঙঢঙ সহ্য করো। জাত-বংশ না দেখে, ঘরে বউ আনতে চাইলে যা হয়!যত্তসব রংঢং!

হঠাৎ এতো আত্মীয় স্বজনের মধ্যে কথাগুলো এমন কটাক্ষের স্বরে বলায় ইভানের দাদুমা কিছুটা থতমত খেলেন।বিব্রতবোধ-ও করলেন।মধ্যবয়স্ক মেয়ে উনার।উপযুক্ত এক মেয়ের মা অথচ কোন কথা কোথায় কিভাবে বলতে হয়,মেয়েটা যেনো উনার শেখেইনি।শেখেনি বলতে ভুল,সারাজীবনতো নিজের মতো করে বুঝিয়ে শিখিয়েই তো এসেছেন।তবে মেয়েটা নিজগুণে আয়ত্ত করলে তো!নিজের একমাত্র মেয়ে বলে ছোটো করে কথাও বলতে পারেন না বলে।তাই বলে নিজের বাড়ির সন্মান নিয়ে ছোটো করে কথা বলা।তিনি মানতে চাইলেন না।কিছুটা গম্ভীর স্বরে বললেন।

‘তুমি এভাবে কথা বলতে পারোনা ডালিয়া।মেয়েটা দেখতে শুনতে,যথেষ্ঠ মার্জিত।নাহলে নিভান বা তোমার বড়োভাই কখনো এ-বিয়েতে সম্মতি প্রকাশ করতো না।আর মেয়েটাকে আমারও বিশেষভাবে পছন্দ।সেখানে ইভান দাদুভাই কোনো ভুল করেছে বলে আমার মনে হয়না।

রাগ লাগলো ডালিয়া বেগমের।মা-ও ওই মেয়েটার হয়ে কথা বলছেন।তাও আবার এতোগুলা মানুষের সামনে,ওই সামন্য মেয়েটার জন্য উনাকে ছোটো করে কথা বলছেন!তিনি পুনরায় কটাক্ষের স্বরে বললেন।

‘এবাড়ির বউ হিসাবে কোনদিক থেকে উপযুক্ত বলে মনে হলো ওই মেয়েটাকে তোমার?যেমন গায়ের রঙ,ইভানের পাশে মানায় মেয়েটাকে?ওর থেকে বাড়িতে যে মেয়েটার পিছনে ঘুরঘুর করতো সেটাই তো ভালো ছিলো।অন্তত দেখতে তো শ্রী।জাতপাতেও চলার মতো।

ভদ্রমহিলা আবারও মেয়ের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য মুখ খুলতে যাবেন।তার আগেই রাগান্বিত গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠস্বরের বার্তা এলো–সংসার করবো আমি।
মেয়েটা বউ হবে আমার।তার গায়ের রঙ ময়লা হোক বা কয়লা,তা নিয়ে আপনার এতো মাথাব্যথা বা চিন্তা কিসের ফুপিমণি?সংসার তো আপনি করবেন না আর না তাকে এবাড়িতে এনে আপনার কাঁধের উপর ঝুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে!তবে এতো সমস্যা কিসের আপনার?আপনি এবাড়ির আউটসাইডার, আপনি তাকে পছন্দ করে চাইলে ভালোবাসতে পারেন,না চাইলে নয়।তাই বলে আমার বউয়ের যোগ্যতা অযোগ্যতা মাপার বিচারক আপনি কে?আপনাকে তো মানা হয়নি বিচারক!না আপনার সিদ্ধান্ত জানা হয়েছে।তবে তাকে নিয়ে ছোটো বড়ো কথার দুঃসাহস দেখান কিকরে আপনি?

‘উনি তোমার ফুপুমনি হয় ইভান।উনার সম্মান বজায় রেখে কথা বলার চেষ্টা করো।

দাদুমার থমথমে গলার আজ্ঞা পেতেই ঠোঁটের কোণে হাসি এনে দাঁড় করালো ইভান।সে হাসিতে ফুটে উঠলো তাচ্ছিল্যতা।কিছুটা দ্বায়ী হলেও আজ দাদুমায়ের জন্য ফুপুমনির এই অধঃপতন।তবে সে বিষয়ে ভাবনা না এগিয়ে গম্ভীর গলায় বললো —উনি বড়ো হয়ে নিজের ব্যবহার আর যবান দ্বারা আগে নিজের সম্মান আর শ্রদ্ধার স্থানটা ধরে রাখার চেষ্টা করুক।আমি অবশ্যই উনার সাথে সম্মান শ্রদ্ধার সহিত কথা বলবো।

অপমানে থমথমে হয়ে থাকা ডালিয়া বেগম আবারও মুখ খুললেন।বললেন-আমি তোমার ভালোর কথা ভেবে কথাগুলো বলছিলাম আর তুমি আমাকে এমন কথা শোনালে?আমি এবাড়ির বহিরাগত!

‘ভালোর জন্য।আমার ভালো আপনাকে ভাবতে হবেনা।কে বলেছে আমার ভালো জন্য আপনাকে ভাবতে?আমার ভালো ভাবতে গিয়ে পিছনে কি কি করে এসেছেন,জানা নেই আমার।নাকি মনে নেই আপনার?সেসব বলে নিজের অপরাধকেও ছোটো করে দেখতে চাই না আমি।তবে আমার ভালো আর আপনাকে না ভাবলেও চলবে।এবাড়িতে আমার ভালো ভাবার জন্য অনেক মানুষ আছে।আপতত তারাই যথেষ্ট।আর আপনার ভালো ভাবার,সবচেয়ে বড় উদাহরণ তো আপনার মেয়ে।তাই নিজের মেয়ের জন্য যে ভালোটা করে রেখেছেন,আমার ভালোটাও সেখানেই ব্যয় করুন।হয়তো তার এলোমেলো জীবনটা পুরোপুরি নষ্ট হওয়া থেকে বেঁচে যেতে পারে।

‘ইভান।

ডালিয়া বেগমের চড়াও গলার ডাকে ইভান হাসলো।ফের বললো —ভুল কিছু বললাম নাকি আমি?ভুল বলে থাকলে,আদরের ভাইপো হিসাবে ক্ষমা করে দেবেন।তবে আমি ইভান।নিভানের মতো অত ধৈর্য্য, সহ্যশক্তি আমার নেই।যে যা বলছে,যা করছে আপনজন মনে করে চুপচাপ শুনবো।আর না আমি জাহিদ হাসান,শাহেদ হাসান।যে তাদের আদরের ছোটোবোন, নিজের স্ত্রীকে লোকসমাগমে নিচু করে কটুবাক্য শোনাচ্ছে,তা নীরবে হজম কর নেবো।

ড্রয়িংরুমে মানুষ বলতে ইভানের মামিরাই ছিলো।ডালিয়া বেগমের স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে উনারা অবগত তাই আর বিশেষ কথা কেউ বাড়ালেন না।চুপচাপ দুপক্ষের ছুড়াছুঁড়ি কথা শুনে গেলেন।একপর্যায়ে যখন ডালিয়া বেগম নীরব হয়ে গেলেন,উনারা ইভানকে থামার জন্য বললেন।ডালিয়া বেগমের থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে থামলো ইভান।সে চায়নি এতো মানুষের সামনে ফুপিমণিকে ছোটো বড় এতো কথা শোনাতে।তবে কথা না বলার উপায় কি রেখেছেন ফুপুমনি?আর তন্ময়ীকে ওভাবে বলায় নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারিনি সে।মেয়েটার ওই মায়াবী গায়ের রঙ তাকে যে বিশেষ আকর্ষণ করে।আর সেই গায়ের রঙ নিয়ে কটাক্ষ করে কথা।মোটেই ভালো লাগিনি ইভানের।এরমধ্যে নীহারিকা বেগম এসে তাড়া দিলেন,মেহেদীর ডালা নিয়ে ওবাড়িতে যাওয়ার।কথাটা শুনতেই স্বস্তির শ্বাস ফেললো ইভান।মেয়েটা জেদ ছেড়েছে তবে!যাক তবেই শান্তি।বিয়ে বাড়ির পরিস্থিতি ফের মুখরিত হলো।চাপা পড়ে গেলো ডালিয়া বেগমের থমথমে মুখ।

গোধুলি বিকাল।সন্ধ্যা নাম নাম ভাব।বাড়িতে এখন লোক সমাগম কম।মেহেন্দি অনুষ্ঠানে গিয়েছে সবাই।নিভানের যাওয়ার কথা থাকলেও নিভান যেতে পারিনি।
নানু-মায়ের ঘরে ঢুকলো নিভান।ঘরটা ফাঁকা।নানুমা ঘরে নেই?তাহলে কোথায়?নিচে কোথাও তো দেখলো-না।পিছে মুড়ে বের হতে গিয়েই অনুভব করলো বেলকনির দরজায় কেউ এসে দাঁড়িয়েছে।নানুমা বেলকনিতে ছিলো!শব্দ পেয়ে পিছে মুড়ে তাকাতেই দেখলো কেউ নেই।মানেটা কি!সে স্পষ্ট কারও নরম পায়ের শব্দ শুনলো।মান্যতারা তো বাড়িতে কেউ নেই তবে ওখানে কে?আর নানুমা তার সাথে নিশ্চয় লুকোচুরি খেলবেনা।ধূর্ত মস্তিস্কে কিছু একটা ভাবতেই কৌতুহল বশত বেলকনির দিকে এগোলো।বেলকনির দরজায় গিয়ে, বেলকনিতে কৌড়িকে দেখেই কপাল কুঁচকে গেলো তার।তবে আন্দাজ ঠিক ছিলো।কিছুটা কৌতুহলী গলায় জিজ্ঞেস করলো।

‘তুমি এখানে।মান্যতাদের সাথে যাওনি?

রক্ষা হলো-না।নানুমা মনে করে সে দেখতে গিয়েছিলো রুমে কে এসেছে।মানুষটাকে দেখেই নিঃশব্দে পা চালিয়ে ফের চলে এসেছে তবুও বুঝে ফেলেছে মানুষটা।উফফ। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।কথার উত্তর দিতে চাইলো।কারন,সকালে নানুমায়ের কথাগুলো শুনে আর মানুষটাকে নিখুঁত নজরে দেখে মনে কিছু-মিছু একটা অনুভূতির জন্ম নিয়েছে।সেই অনুভূতি আজ সারাদিন তাঁকে জ্বালিয়ে মেরেছে। এখন কথা বাড়িয়ে সেই অনুভূতিকে আর প্রশ্রয় দিতে চায়না।হোক একটু বেয়াদব!তবুও ওই গম্ভীর স্বরের মানুষটার কথার উত্তর সে দিতে চায়না।সামনে মানুষটা কি বুঝলো কি বুঝলো না।ওয়ালে কাঁধ ঘেঁষে দাঁড়ালো।ফের দুষ্ট হেসে বললো।

‘গ্লাস আঁটকে দেই?কি বলো?

বেকায়দায় পড়ে গিয়েছে। উত্তর না দিলে ছাড়া পাবেনা সেটা বেশ আন্দাজ করতে পারলো কৌড়ি।স্বভাবজাত
নমনীয় অথচ অসন্তুষ্ট গলায় বললো–আমার ভালো লাগছিলো না।তাই যায়নি।

কৌড়ির অসন্তুষ্ট গলার স্বরে মৃদু হাসলো নিভান।বললো—মান্য আর মৌনতা তোমাকে না নিয়ে যেতে চাইলো?

‘আপু অনেক জোরাজোরি করেছিলো।এমনকি রাগ করেছে।আমিই যায়নি?

কৌতুহলী গলা নিভানের–‘কেনো?

‘এমনিতেই।

এমনিতেই যায়নি এমনটা নয়।পিরিয়ড চলছে তার।আর পিরিয়ডে পেটব্যথা সহ বিভিন্ন সমস্যা চলে তার।তার উপর আরও একটা সমস্যা আছে।আর সেসব সমস্যা জনিত কারনে কোথাও গিয়ে মনোশান্তিতে থাকতে পারেনা সে।বিধায় মান্যতাকে বুঝিয়ে না করে দিয়েছে।না-হলে মান্যতা আপু বাদ অমায়িক ব্যবহারের ঈশিতা আপুর কথা সে ফেলতে পারতোনা।কৌড়ির কথা শুনে সংগোপন দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিভান।মেয়েটার মলিন মুখ বলছে অন্য কথা।গোধূলি লগ্নের মিষ্টি আলো এসে পড়েছে মেয়েটার মসৃন মুখে।সেই আলোয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা কোনো কারনে অসুস্থ।চোখমুখ শুখিয়ে আছে।তবে অসুস্থতার কথা বলতে পারছেনা কাওকে।বা ইচ্ছাকৃত কাওকে বলছেনা।দীর্ঘশ্বাস চেপে নিভান ফের শান্ত গলায় শুধালো।

‘কোনো কারনে শরীর খারাপ তোমার?

চমকে নিভানের মুখের পানে তাকালো কৌড়ি।সুগভীর শান্ত নজরের নিভানকে তারদিকে নিটোল নজরে তাকিয়ে থাকতে দেখেই মূহুর্তেই মুখটা আবার ফিরিয়ে নিলো।মানুষটা বুঝলো কি করে সে অসুস্থ?তবে কি বুঝে গিয়েছে তার কি কারনে শরীর খারাপ? উফফ! ভিতরে ভিতরে অস্বস্তিতে গাঁট হলো মনস্তাত্ত্বিক।লজ্জায় হাসফাস করে উঠলো সর্বাঙ্গ।তড়িৎ বললো—আমার তো শরীর খারাপ নয়।

নীরব, অথচ গভীর নজর।কৌড়ির মুখের পানে স্থির রেখে বললো –তবে চোখমুখ ওরকম দেখাচ্ছে কেনো?

মনেমনে বিচলিত হলো কৌড়ি।কেমন দেখাচ্ছে?খুব বাজে?উফফ! কি এক জ্বালা!এতো খেয়াল করতে বলেছে কে মানুষটাকে!উত্তর দিতে চাইলো না।তবুও বাধ্য হয়ে উত্তর দিতে হলো।বেকায়দায় আছে সে।এই মানুষে ভরা বিয়ে বাড়িতে যদি মানুষটাকে আর তাকে আঁটকে থাকা বেলকনিতে কেউ দেখে ফেলে তবে কি হতে পারে ভাবতে পারছে সে!তাই ফের তড়িৎ গলায় বললো—আর পনেরো দিন পর পরিক্ষা।পড়াশোনার চাপ যাচ্ছে তো এজন্য।

”পনেরো দিন পর পরিক্ষা। এবিষয়ে তো খেয়াল রাখা হয়নি।এখন আর মেয়েটা শুধু এবাড়ির দায়িত্ব নয়।মেয়েটার ভালোমন্দের সুব্যবস্থার দ্বায় তো এখন তাকেই রাখতে হবে।খেয়াল ছিলোনা তবে খেয়াল তো এবার রাখতে হবে।বললো — পড়াশোনা কেমন চলছে?

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো।

‘পড়াশোনাতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?

‘না।

কথা যেনো বাড়াতেই ইচ্ছে করলো।কি অসুস্থতায় মেয়েটার এই মলিন মুখ।সেটাও জানতে ইচ্ছে করলো।তবে মেয়েটার আড়ষ্টতায় পথরের মতো নিশ্চল হয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে দমিয়ে নিলো নিভান।শ্বাস ফেলে সোজা হয়ে দাড়ালো সে।চলে যাবে বলে মনস্থির করেও দাঁড়িয়ে রইলো।ফের কি মনে করে কৌড়ির পাশাপাশি গিয়ে গ্রিল ধরে দাঁড়ালো।উঁচু লম্বা মানুষটাকে কাছাকাছি অনুভব হতেই নিঃশ্বাস আঁটকে এলো কৌড়ির।সেটা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো,পাশে দাঁড়ানো মানুষটার গায়ের কড়া পারফিউমের সুগন্ধে।তবে নড়চড় বন্ধ করে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কৌড়ি।শক্ত হাতো চেপে ধরে রইলো গ্রীলের লৌহ। পলকহীন নজর তার বাহিরের পানে।সেই মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে নিভানও নজর ফেললো গোধূলি লগ্নের ধীমে আসা সূর্যের পানে।শান্ত আর খুব সাবলীল গলায় বললো।

,জানো কৌড়ি,ভালোলাগা ভালোবাসাটা ঠিক কি।এর বিশেষ সজ্ঞায়িত আমার জানা ছিলো না।ছিলোনা বলতে,আমার লাইফে আমি ভালোলাগা ভালোবাসার বিভিন্ন বিভিন্ন ডেফিনেশন্স শুনে এসেছি।দেখেছি তেমনটাও।বিভিন্ন বইতে পড়েছিও তেমনটা।তবে নিজে জানার উপলব্ধিটা হয়নি কখনো।অনুভব করিনি কখনো আমি।এই উনত্রিশের কাছাকাছি বয়সে আমার পছন্দনীয়,মোহনীয়,নজর আকর্ষণ করার মতো অনেক কিছুই নজরে পড়েছে।এমনকি বিভিন্ন রূপবতী মেয়েও।নজরে দেখেছে তাদের তবে কখনো তাদের প্রতি বিশেষ অনুভূতি অনুভব করাইনি।নজর দেখেছে,ওখানেই ক্ষান্ত। দ্বিতীয়বার আর নজর সেদিকে ফিরে তাকায়নি।অথচ হঠাৎ একদিন একজোড়া ক্রন্দনরত চোখ আমার স্বপ্নে মিললো।জানো,আমাকে ঘুমাতে দিলোনা কতোদিন।আমার একটাই দোষ ছিলো,আমার খুব কাছে বসে সেই চোখজোড়া ক্রন্দন করেই চলছিলো।অথচ আমি ফিরে তাকাইনি।তাই বাধ্য হয়ে চোখজোড়া আমার স্বপ্নে হানা দিলো।শাস্তিসরূপ কতোগুলো দিন আমাকে ঘুমাতে দিলোনা।আমি জীবনের প্রথম মায়া,টান অনুভব করলাম সেই ক্রন্দনজোড়া নজরে।যখন তাকে বুঝলাম সে স্বপ্ন আসা বন্ধ করে আমাকে শান্তিতে ঘুমাতে দিলো।অথচ সেই ক্রন্দনরত চোখজোড়া পরিনত হলো সচ্চ একজোড়া মায়ামায়া ডাগরডাগর হরিনী চোখে।সেই ক্রন্দনরত চোখজোড়া আমাকে রাতে আরামে ঘুমাতে দিলেও সেই সচ্চ ডাগরডোগর চোখজোড়া কেঁড়ে নিলো আমার দিনগুলো।এরপর এক বিকালের গোধূলি লগ্নে একটা গোলগাল মায়াবীনি মুখ,আমার বুকের বা পাশটায় জায়গা করে নিলো।বিশ্বাস করো আমি মোটেও হিংসুটে ছেলে নই।অথচ আমি হিংসে করলাম এক যুবককে।কারন তার নজরও মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলো সেই গোলগাল মায়াবিনী মুখশ্রীতে।আমার কেনো জানি সহ্য হলোনা।সেই একই অপরাধের অপরাধী হয়ে আমার অপরাধ মুক্ত পাখির মতো ছেড়ে দিয়ে তার অপরাধে অভিযুক্ত করে নিষেধাজ্ঞা দিলাম।তারপর এক বৃষ্টি ভেজা দিনে সেই মায়াবিনীর অসহায় মুখ আমার বুকে ঝড় তুলে দিলো।আমি তাকে পুরোপুরি জায়গা করে দিলাম আমার সত্তায়।

‘আচ্ছা কৌড়ি,ওই টান ওই মায়া,ওইযে বুকে ঝড়তোলা অনুভূতি ওগুলোকে ঠিক কি অনুভূতি বলে?ভালোলাগা নাকি ভালোবাসা?আমার মতে তো,এই দুই অনুভূতির উর্ধ্বে গিয়ে,তাকে পেয়ে যাওয়া মানে আমাকে পৃথিবীতে এক টুকরো জান্নাতের সুখ অনুভব করানো।স্বর্গসুখ লাভ করা।

চলবে…

ফুলকৌড়ি পর্ব-২৮+২৯

0

#ফুলকৌড়ি
(২৮)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

বিয়ের নিমন্ত্রণে বাড়িতে ছোটোবড়ো বিভিন্ন মানুষে ভরপুর।এই দুমাসে এবাড়ির সবার সাথে সুপরিচিত হয়ে গেলেও,হঠাৎ এতো অচেনা মানুষের মধ্যে কৌড়ির একটু চলতে ফিরতে অস্বস্তি হচ্ছে।ভিতরে ভিতরে খুবই দ্বিধা, অস্বস্তি অনুভব করছে।আর সবচেয়ে বড় অস্বস্তি দিচ্ছে,এবাড়ির অতি পরিচিত আত্মীয় স্বজনেরা যখন তাকে নিয়ে প্রশ্ন,কৌতুহল দেখাচ্ছে।সে মেয়েটা কে?কার মেয়ে!নিজের সামনে বারংবার প্রশ্নটা করতে দেখে মনেমনে ভিষণ বিব্রতবোধ অনুভব করছে।তাই যেখানেই মানুষের আনাগোনা কম সেখানেই নিজের উপস্থিতি রাখছে সে।তবুও বিয়ে বাড়ি বলে কথা।বললেই কি আর নিজের মতো স্বস্তিতে থাকার জায়গা মেলে।কথাগুলো আনমনে ভাবতে ভাবতে ছাদের উদ্দেশ্য যাওয়ার জন্য এগোচ্ছিলো কৌড়ি।হঠাৎই বাহুতে ধাক্কা খেয়ে দুকদম পিছনে সরে যেতেই সামনে নজর পড়লো তার।অচেনা তবে সল্প সময়ের মুখ চেনা একটা ছেলে।দেখতে শুনতে সুদর্শন ছেলেটা মান্যতার আপুর মামাতো ভাই।যাদেরকে সকালের দিকে আসতে দেখেছে,এবং তখনই পরিচয় জেনেছে কৌড়ি।

‘স্যরি স্যরি, আমি দেখতে পায়নি।

কথাটা বলেই মাথা উঁচু করতেই হা হয়ে কৌড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো ছেলেটা।অপরিচিত মেয়েটাকে ফুফুবাড়িতে নতুন দেখে মনে প্রশ্ন বিঁধলেও,নজর বিঁধে গেলো কৌড়ির শুভ্র নির্মল শোভিত মুখখানায়। ঘনোপল্লবযুক্ত ডগরডগর আঁখিজোড়া দ্বিধাহীনভাবে কয়েকবার ঝাপটাতেই,ছেলেটার মুগ্ধ নজরজোড়া যেনো আর-ও মুগ্ধতায় ডুবে গেলো।দোতলার খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রথম থেকে শেষ অব্দি সেই হঠাৎ ঘটে যাওয়া দৃশ্যাবলী খুব শান্ত আর মনোযোগ সহকারে কেউ একজন দেখলো।তার ধারালো নজর জানান দিচ্ছে,সেই হঠাৎ ঘটে যাওয়া অঘটনা তার মোটেও পছন্দ হয়নি। তন্মধ্যে কৌড়ি রিনরিনে গলায় বললো।

‘স্যরি, আমি-ও খেয়াল করিনি।

কথাটা বলেই ছেলেটার পাশ কাটিয়ে চলে গেলো সে। হুঁশ ফিরলো যেনো ছেলেটার।তড়িৎ পিছে ফিরলো। দেখলো সিড়ি বেয়ে কৌড়িকে উপরে যেতে।ছটফটিয়ে ছেলেটাও পা বাড়ালো সেদিকে। সিঁড়ির মাথার ধাপে গিয়ে পা রাখতেই,বলিষ্ঠ শরীর অবয়বে সামনে হাজির হলো কেউ। নিভানকে সামনে দেখতেই মাথা চুলকিয়ে, মুখে মিষ্টি হাসি এনে বললো।

‘তাড়াহুড়ায় সামনাসামনি পড়ে গেলাম,স্যরি ভাইয়া।

কথাটা বলে পাশ কাটাতে গেলেই,পুনরায় ছেলেটার পথ রোধ করে দাড়ালো নিভান।এবার ছেলেটার মুখের হাসি মুছে তড়িৎ বললো—কিছু বলবে ভাইয়া?

নিভান ছেলেটার হাত ধরে সামনে এনে দাড় করালো।
ছেলেটা তার ছোটোমামার একমাত্র ছেলে আনাফ।বয়সেও তার অনেক ছোটো।কৌড়িকে নিয়ে কথাগুলো বলতে ভিতরে ভিতরে ভিষন দ্বিধা হচ্ছে।ছোটো ভাইবোনদের সামনে সে এসব বিষয়ে কখনো কথা বলতে বা এসব বিষয়ে আলোচনা করতে কমফোর্টেবল নয়।তবু-ও বলতেই যে হবে তাকে।কৌড়ি মানে,সেখানে সে ছাড়া আর দ্বিতীয় কার-ও আগমন নয়।আগমন ঘটতে চাইলেও,সেই সংযুক্ত লাইন তাকে পার করে কৌড়ি পর্যন্ত পৌঁছানোর দুর্বোধ্য বিষাক্ত কাটাতার সে।কৌড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতে গেলে সেই যন্ত্রণাদায়ক কাটাতার পার করতেই হবে।আর সেই কাটাতর পার করা যে-কারও জন্য সহজ হতে দেবে না সে।সেটা যেই হোক না কেনো।ছেলেটার মাথার সিল্কি এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দিতেে দিতে বেশ ঠান্ডা গলায় বললো।

‘এতো তাড়াহুড়ো করে কোথায় ছুটেছিস?

এতোসময় নিভানের গম্ভীর মুখের গতিবিধি লক্ষ্য করছিলো আনাফ।কিন্তু নিভানের ঠান্ডা গলার প্রশ্নটা শুনতেই উত্তর দিতে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো সে।ভাইয়া যদি জানতে পারে যে,সে ওই মেয়েটার পিছু নিচ্ছিলো তবে বিষয়টা মোটেই তারজন্য ভালো দাঁড়াবেনা।আবার এই মানুষটার সামনে মিথ্যা বলেও পার পাবেনা সে।তাই কিছুটা অপ্রস্তুত গলায় বললো

‘আসলে ওই মেয়েটা কে এটাই জানতে চাইছিলাম।

কৌড়ির সমবয়সী ছেলেটা।সামনে ইন্টার পরিক্ষা।তার মুগ্ধ নজর আর আবেগ বুঝতে সময় লাগলো না নিভানের।তবুও জিজ্ঞেস করলো।– কেনো?মেয়েটা কে, জেনে কি করবি?

স্বাভাবিক গলায় সহজ প্রশ্ন।সামনের ছেলেটা যেনো আশকারা পেলো কিছুটা।বললো—মেয়েটা কিন্তু খুব সুন্দর দেখতে ভাইয়া।শহরের মেয়েদের মতো শুধু মুখ সুন্দরী নয়,হাত পায়ে-ও সুন্দরী।কি সুন্দর তার চোখদুটো।

আনাফকে কষে একটা নয় পরপর কয়েকটা থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করলো নিভানের।কিন্তু যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজের সংযম সহজে বিচ্যুত হতে দেয়না, সংযাত রাখতে পারে বলে ছেলেটা তার হাতের কঠিন থাপ্পড় থেকে বেচে গেলো।আর স্নেহের ভাই বলেও কথা।ছেলেটার মাথার চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে এবার টিশার্টের খোলা বোতামে হাত রাখলো নিভান।বেশ স্নেহশীল হাতে খোলা বোতাম লাগিয়ে দিতে দিতে বললো।

‘যে মেয়েটার পিছু নিতে চাইছিস।সে বাদে বিয়ে বাড়িতে আরও অনেক মেয়ে আছে।তাদের পিছু ঘুরে বেড়া এমনকি দৌড়ে বেড়া,ভাইয়া কিচ্ছুটি বলবে-না।একদম কিচ্ছু বলবেনা।তবে ওই মেয়েটা বাদে।ভুলেও দ্বিতীয়বার আর ওর পিছু নিতে যাস না।আনাফ-তো খুব ভালো ছেলে তাই-না!আর একপলকে যে খেয়ালী নজরে ওকে দেখে ফেলেছিস,সবটুকু ভুলে যা।মনে-কর ওকে দেখিসনি তুই।কেমন?

অবাক হলো ছেলেটা।ভাইয়া সবসময় গম্ভীর গলায় এটাওটা আদেশ করে চললেও এমন শিথিল আর কঠিন গলায় কখনো কথা বলেনা।তবে?বিস্ময়ে গলায় ছেলেটা বললো–কেনো ভাইয়া?মেয়েটা কি স্পেশাল কেউ?

‘হুমম।খুব স্পেশাল।

অদ্ভুত নজরে নিভানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো ছেলেটা।সামনের মানুষটার তুলনায় বয়স কম হলে-ও, মেয়েটাকে নিয়ে সামনের মানুষটার কঠিন গলার সতর্কতামূলক বানীগুলো তাকে বুঝিয়ে দিলো অনেক কিছু।ভিতরে ভিতরে ভিষন মন খারাপ হলো তার।তবে মুখের আদলে সেটা উহ্য করতে পারলো-না।মনের কৌতুহল মেটাতে দূর্বল গলায় ফের বললো।

‘মেয়েটা কি তোমার স্পেশাল কেউ?

ছোটো ভাইয়ের এবারের প্রশ্নে ভিতরে ভিতরে একটু বিব্রতবোধ করলো নিভান।তবে বিষয়টা যখন কৌড়িকে নিয়ে উত্তর দিতে দ্বিধা মোটেও করলোনা।বললো।

‘তুই জেনে কি করবি সে ভাইয়ার স্পেশাল কেউ কি-না।তবে ভাইয়া যখন নিষেধ করেছে,মেয়েটার আশেপাশে ভুলেও না,তবে না। কেমন?

হঠাৎই স্বপ্নবোনা মনটা ভেঙে গেলো আনাফের।যেমন তাড়াতাড়ি স্বপ্ন বুনেছিলো,তারচেয়ে শত তাড়াতাড়িতে স্বপ্নগড়া মনটা ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো তার।আর মেয়েটা এমন একজনের স্পেশাল কেউ।যেখানে ভুলেও আর এক পা-ও এগোনো সম্ভব নয়। উচিত-ও হবে-না।
নিভানের কথার উত্তর সরূপ তার মুখের দিকে তাকিয়ে ভদ্র ছেলের মতো মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালো।নিভানও মিষ্টি হেসে, একটু আগে ছেলেটার এলোমেলো গুছিয়ে দেওয়া চুলগুলো ফের মাথায় আঙুল চালিয়েছে এলোমেলো করে দিলো।মুখে বললো–এইতো গুড বয়।

গুড বয় ট্যাগটা মোটেই পেতে ইচ্ছে করলোনা ছেলেটার,মন খারাপ করে ফের সিঁড়ির পথ ধরতেই নিভান পিছু ডাকলো।—আনাফ।

পিছু ফিরলো ছেলেটা।ছোটো ভাইয়ের বেজার মুখ দেখেও মনের কঠিন চাওয়াটা চেপে রাখলোনা।বললো- কৌড়িকে যখনই নজরে পড়বে,বড়ো ভাইয়ের বউয়ের ন্যায় সম্মানের নজরে দেখবি।পারলে মাথা নিচু করে রাখবি।তবুও সম্মান শ্রদ্ধা ছাড়া দ্বিতীয় তৃতীয় কোনো ভালোমন্দ নজর নয়।ঠিক আছে?

কথাটা মোটেও পছন্দ না হলেও ফের ভদ্র ছেলের মতো মাথা নাড়ালো আনাফ।কেননা,আজ্ঞাটা যে দিচ্ছে তাকে প্রচন্ড মানে এবং সমীহ করে তার মা বাবা।এমনকি সেও।বিপরীতে আদর স্নেহ কম পায় না।তবে আনাফের মুখাবয়ব দেখে তার ভিতরের মনটা বুঝতে সময় লাগলো না নিভানের।গম্ভীর কন্ঠ ছেড়ে উচ্ছল কন্ঠে বললো–ওর থেকে-ও সুন্দর দেখতে মেয়ে তোরজন্য বউ করে আনবে ভাইয়া।ওকে?

ছেলেটার মুখে যেনো একটা টুকরো হাসি ফুটলো।মৃদু হেসে মাথা দুলিয়ে বললো।—ওকে ভাইয়া।

ছেলেটা চলে যেতেই ঠোঁটের হাসি মিলে গেলো নিভানের।তপ্ত শ্বাস ফেলে সেদিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে ছাঁদের সিঁড়িপথের দিকে তাকালো।বিয়ে উপলক্ষে বাড়িতে আত্মীয় স্বজনের ঢল।সময়টা বিকাল হবোহবো।দুপুরে খাবারের পর সবাই হয়তো বিশ্রামে। বিধায় ড্রয়িংরুমের দিকে মানুষের আনাগোনা সেভাবে নেই।আশেপাশে খেয়ালী নজরে তাকিয়ে ছাঁদের সিঁড়িপথ ধরলো নিভান।ছাঁদের দরজার সামনে গিয়ে দেখলো।সকালে মামাদের বসার জন্য ছাদে আলাদাভাবে টেবিল চেয়ারের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো।সেটা নামানো হয়নি।ছাদের দরজার দিকে পিঠ ফিরে সেই চেয়ারে বসে আছে দীঘল চুলের এলোকেশী কন্যা।খোলা চুলগুলো ছাঁদের ফ্লোর ছুঁইছুঁই।গভীর মনোযোগে দিয়ে ম্যাডাম কিছু করে চলেছে।

বিয়ে উপলক্ষে বাড়ির প্রতিটি রুমে যেনো ঠেসেঠুসে মানুষ ভরে আছে।এমনকি কৌড়িকে থাকতে দেওয়া তার নিজের রুমটাও বাদ যায়নি।মৌনতা আর মান্যতা আপু কেউ বাড়িতেই নেই।শপিংয়ে গিয়েছে।সাথে দীবা আপুসহ তার মামাতো কিছু ভাইবোনও গিয়েছে। তাকে-ও নিয়ে যেতে চেয়েছিলো এমনকি যাওয়ার জন্য জোরাজোরিও করেছিলো।সে যায়নি।মূলত অত অপরিচিত মানুষের মধ্যে নিজেকে কেমন কেমন লাগছিলো।তন্মধ্যে সবার পরিপাটি রূপ,সাজ পোশাক চালচলনের কোয়ালিটিই আলাদা।সেখানে নিজেকে কেমন অদ্ভুত অনুভব হচ্ছিলো।বিধায় বিভিন্ন বাহানায় তাদের সাথে যেতে না করে দিয়েছে।এখন বাড়িতে কিছু মুরুব্বি মানুষ বাদে সবই অপরিচিত মুখ।কোথাও নিজেকে মানিয়ে নিতে স্বস্তি পাচ্ছেনা কৌড়ি।মনেমনে একটু ফাঁকা জায়গা খুজছিলো।হঠাৎ ছাঁদের কথা মনে হতেই চলে এসেছে সে।হাতে পায়ে নখ বেড়েছে বলে সাথে নেল-কাটার এনেছে।নিরিবিলি বসেবসে নখকাটা যাবে।তবে আসতে গিয়ে পথে ঘটলো বিপত্তি।বিপত্তি পাশ কাটিয়ে ছাঁদে এসে চারপাশের সবুজ মনোরম পরিবেশ দেখে মন ভালো হয়ে গেলো তার।ভুলে গেলো সবকিছু।কিছুক্ষণ বাগানের মধ্যে হাটাহাটি করে,চেয়ারে বসে নখকাটায় মনোযোগ দিলো সে।হঠাৎই ছাঁদের দরজা শব্দ হওয়ায় মনোযোগে বিঘ্ন ঘটলো তার। পিছু ফিরলো সে।নিভানকে ছাঁদের দরজা আঁটকে দিতে দেখেই হৃদপিণ্ড লাফিয়ে,বুকে কম্পন ধরে গেলো তার।আতঙ্কিত হয়ে সহসা উঠে দাড়ালো সে।এমনিতে ওই মানুষটা আশেপাশে থাকলে কাঠের পুতুল মনেহয়। নিজেকে নিজের মধ্যে অনুভব হয়না।যারকারনে বোবা মানুষের মতো আচারন করতে হয় তার।ভুলেও মানুষটার সাথে কথা বলেনা সে।আর ইদানীং ওই মানুষটার কথাবার্তা,আচারনতো তাকে ভিতরে ভিতরে ছটফটিয়ে মারছে।অথচ না পারছে সে গিলতে আর না পারছে কোনো একটা কারনে ফেলতে।আর সেই মানুষটা আবারও তার দুয়ারে!

‘বসো।

গলার স্বরটা শুনতেই স্বাভাবিকভাবে চলা নিঃশ্বাস বুকে বিঁধে গেলো কৌড়ির।সামনে তাকাতেই দেখলো,তার সামনাসামনি চেয়ারে বসে পড়েছে মানুষটা।কখন?টের পেলোনা সে।তড়িৎ বললো।

‘আমি নিচে যাবো।

মুখ তুলে কৌড়ির পানো চাইলো নিভান।শান্ত অথচ দৃঢ় নজর।নজরে নজর মিলতেই সহসা বসে পড়লো কৌড়ি।বুকের ভিতরের কম্পন দ্বিগুণহারে বাড়লো।সেই কম্পন আরও বাড়িয়ে দিয়ে নিভান বাম হাতটা পাতলো তারপানে।শক্তপোক্ত হাতের তালুটা নজরে পড়তেই নজর তুলে নিভানের দিকে তাকালো।কৌড়ি তাকাতেই নিভান চোখ দিয়ে ইশারা করলো হাত রাখতে। সহসা ইশারা বুঝলোনা কৌড়ি।সেটা বুঝতে পেরে নিভান বললো।

‘হাতটা দাও।

হাতটা দিলেনা কৌড়ি বরং হাতটা টেবিলের উপর থেকে সরিয়ে নিলো নিজের কাছে।টেবিলের উপরে নেলকাটারটা রেখে তখন যে উঠে দাঁড়িয়ে ছিলো,সেটা এখন সামনের মানুষটার হাতে।আর তার হাতটা চাইছে কেনো সেটাও বুঝতে বাকি রইলো-না কৌড়ির।সেটা বুঝে দৃঢ় কন্ঠে কৌড়ি বললো।

‘আমার কাজটা আমি করে নিতে পারবো।

‘তুমি পারবে কি পারবেনা সেটা আমি জিজ্ঞেস করিনি।আমি হাতটা দিতে বলেছি,তুমি দেবে।

নিভানের জেদালো পূর্ণ কথা শুনে কন্ঠ আরও দৃঢ় হলো কৌড়ির। গলায় দৃঢ়তা বজায় রেখে বলল–‘আপনি বললেই তো হবেনা।

‘তবে কাকে বলতে হবে? কে বললে হবে?তুমি যে এই বেখেয়ালিতে চলাফেরা করে অন্যের আমানত খেয়ানত করছো,হক নষ্ট করছো।তাতে কিচ্ছু হচ্ছে না?

নিভানের রাগমিশ্রিত দৃঢ়কণ্ঠের কথাগুলো কানে আসতেই সহসা প্রশ্ন করলো কৌড়ি।–মানে কি?আমি আবার কার হক নষ্ট করলাম?

আবারও দৃঢ়কণ্ঠের জবাব নিভানের–‘আমার!

ভয়,সংকোচ কথার ফেরে অনেক আগেই কেটে গিয়েছে কৌড়ির।সহসা আবারও প্রশ্ন করলো-কিভাবে?

মৃদু হাসলো নিভান।হয়তো এই প্রথম নিভানকে হাসতে দেখেছে কৈৌড়ি।শ্যামবর্ণ মুখের, পুরো ঠোঁটের হাসিটা মন কাড়লো কৌড়ির।মুগ্ধ নজরে দেখলো সে।সেই ফাঁকে কৌড়ির হাত টেনে নিজের হাতের মুঠোয় নিলো নিভান।সমস্ত শরীর মৃদুতর কেঁপে উঠলো মেয়েটার।হাত টেনে,পুরুষালি হাতটা থেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলো।তবে সামনের মানুষটার শক্ত হাতের চাপে পারলো না।কৌড়ির হাতের পানে চাইলো।চকচকে ফর্সা হাতটা নিজের শ্যামবর্ণ হাতের মধ্যে বেশ আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে।
গোটালো আঙুলগুলোর মধ্যে তিনটে আঙুলের বাড়তি নখ কাটা শেষ, আপতত দুই আঙুলের নখ আছে।অনামিকা আঙুলটা বেশ নরমস্পর্শে ধরে নখ কাটতে গেলেই হাত আবারও ছাড়িয়ে নিতে চাইলো কৌড়ি।সেটা দেখে নিভান স্বাভাবিক গলায় বললো।– -হাত নাড়িয়েও না,ব্যাথা পাবে।

‘আমি বলেছি তো কেটে নিতে পারবো।

‘আমি বলেছি কি তুমি কাটতে পারবে-না।

কৌড়ি বেশ বুঝতে পারলো, সামনের মানুষটার জেদের সাথে সে পেরে উঠবেনা।প্রশ্ন মনে রয়ে যাওয়ায় আগের কথায় ফিরে গেলো সে।–আমি আপনার কি হক নষ্ট করেছি?

‘একটু আগে যে নিজের বেখেয়ালিতে একটা ছেলের গায়ের উপর পড়লে,ওটা কি কারও হক নষ্ট নয়।

আশ্চর্য হলো কৌড়ি।সে কি ইচ্ছেকৃত পড়েছে নাকি।কিছুটা কৈফিয়তের স্বরে বললো-ওটা একটা এক্সিডেন্ট ছিলো মাত্র।ইচ্ছাকৃত কোনোমতেও ছিলো-না।

‘জানি সেটা আমি।তবুও তোমার বেখেয়ালিতে চলা উচিত হয়নি।তোমার বেখেয়ালীর জন্য অন্যের হক নষ্ট, সে কিন্তু কিছুতেই মেনে নেবেনা কৌড়ি।

‘আমি মানুষ আমার দ্বারা ভুল বা অন্যায় হতেই পারে।
সে কেউ মানলো কি না মানলো তা আমার বোঝার বা দেখার প্রয়োজন নেই।আর আমি আমার অন্য কারও নই।

মনেমনে বিস্তর হাসলো নিভান।কৌড়ির জেদালো কথাগুলো শোনার জন্য কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছে তার।যদিও এবিষয়ে কথা উঠাতে চাইনি সে।তবে দু’জনের মধ্যে ভয় সংকোচ, দ্বিধার দেয়াল ঘুচানোর জন্য সুযোগটা লুফে নিয়ে ছাঁদে এসেছে সে।আর একের পর এক কথা বাড়িয়ে চলেছে।তাই কথা বাড়তে বললো।

‘প্রয়োজন তোমার না থাকলেও তার আছে।আর তুমি তার না ননে করলেও, সে তোমাকে অবশ্যই তার মনে করে।আর তোমার ইচ্ছে তোমার চাওয়া,আমার নয়।আমার ইচ্ছে,চাওয়াটা তোমার ভিন্ন।

বামহাতটা ছেড়ে দিয়ে কৌড়ির ডানহাতটা ধরলো নিভান।এবারও হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো কৌড়ি তবে পারলোনা।কৌড়ির ডান হাতটা হাতে নিতেই,ফর্সা হাতের উপর কুচকুচে কালো জটটা নজরে পড়লো নিভানের।মূহর্তেই ভেসে উঠলো সেদিনের দৃশ্যটা যেদিন তার ফোনটা দেওয়ার জন্য পর্দার ফাঁক ঘেঁষে হাতটা বাড়িয়ে ছিলো মেয়েটা।চকচকে ফর্সা হাতের উপর জটটা দেখে নিভানের মনে হয়েছিলো, ফর্সা হাতের উপরে কেউ যেনো নজরটিকা দিতে একটা কালো দাগ একে দিয়েছে।আর সেটা নজর কাঁটার বদৌলে নজরের মুগ্ধতা বাড়িয়ে দিচ্ছে।সেদিন জটটা মুগ্ধ হয়ে দেখেছিলো নিভান।আজ সেই জটটা ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করলো খুব।তবে ইচ্ছেটা দমিয়ে ফেললো নিভান।সেদিক থেকে নজর সরিয়ে নখ কাটায় মনোযোগ দিলো।একেএকে নিঃশব্দে নখের বাড়তি অংশ কেটে চললো সে।কৌড়ি দ্বিধান্বিত নজর কাটিয়ে সেটা দেখলো।শ্যাম গায়ে নেভিব্লু কালারের একটা টিশার্ট পরা।মাথার ঘনোকালো চুলগুলো এলোমেলো।গায়ের রঙ শ্যামবর্ন হলেও,সুদর্শন একটা আদল।দুপুরের সূর্যের তেজস্বী আলো কমে গিয়ে বিকালের নরম আলোতে মানুষটাকে বেশ দেখাচ্ছে। মুগ্ধ হলো কৌড়ির নজর।ভিতরে ভিতরে কিছু একটা হয়ে গেলো।তবে সে দূর্বল হতে চায়না আর না চায় লোভী হতে।মনের কথাটা হঠাৎই মুখে বহিঃপ্রকাশ করলো সে।

‘আমি লোভী হতে চাইনা।

একমনে কৌড়ির হাতের নখগুলো কাটছিলো নিভান।দারুণ একটা মূহুর্ত উপভোগ করছিলো সে।হঠাৎই কৌড়ির কথায় হাত থেমে গেলো তার।কৌড়ির কথাটা বুঝে উঠতেই,পুনরায় হাত চালালো সে।নখগুলো কাটা শেষ করে বললো—ডানহাতের শাহাদাত আঙুল দিয়ে নখ কাটা শুরু করবে,তারপর ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙুল পর্যন্ত কেটে বামহাতের কনিষ্ঠ আঙুল দিয়ে শুরু করে ডানহাতের বৃদ্ধা আঙুলে এসে নখ কাটা শেষ করবে।এটাই হচ্ছে নখ কাটার উত্তম পন্থা।কখনো এভাবে এলোমেলো নখ কাটবেনা।

প্রতিত্তোর এলোনা।হয়তো তার কথার উত্তর আগে চাই তার।সেটা বুঝে নিঃশব্দে মুখ নিচু করে হাসলো নিভান।কৌড়ির মুখের পানে চেয়ে সেই হাসি বিস্তৃত হলো।অথচ হাসিটা মোটেও সুখকর হাসি বলে মনেহলো না কৌড়ির।অযাচিত কারনে ধ্বক করে উঠলো বুক।সেই ধ্বক করে উঠার ধাক্কাটা আরও তিগুণ হারে বাড়িয়ে দিয়ে নিভান স্বাভাবিক গলায় বললো।

‘তোমাকে যে লোভী শব্দটা প্রয়োগ করেছে,সেতো জানে আমি এবাড়ির কেউ নই।এখন আমিই যখন এবাড়ির কেউ নই,তখন তুমি লোভী হবে কিকরে!

চলবে….

#ফুলকৌড়ি
(২৯)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

কৌড়ি এবাড়িতে এসেছে,আজ পাক্কা দু’মাস ছয়দিন।এই দুমাস ছয়দিনে,সামনের বসা মানুষটা সম্পর্কে সে যেটুকু জেনেছে শুনেছে এবং দেখেছে।আর যেটা বুঝেছে।তাতে এই মানুষটার সিদ্ধান্ত বিহীন একটা কাজ-ও এবাড়িতে হয় না।যেকোনো কাজে আগে তার মতামত গ্রহণযোগ্যতা পায়।আর সেই মতামতকে সবাই বিশেষ ভাবে গুরুত্বও দেয়,বিশেষ করে জাহিদ আঙ্কেল।
ভাইবোনেরা এই মানুষটাকে ভয় পেলেও,সম্মান শ্রদ্ধার নজরে দেখে।সেটা তাদের কথাকর্মে বোঝা যায়।
সবকিছুতে বাবার পরে দাদাভাইয়ের আদেশ নিষেধ বিনাবাক্যবয়ে মেনে চলে তারা।বড়মা,ছেলে বলতে অজ্ঞান।ইভান ভাইয়া,দাদাভাই বলতে পাগল।আঙ্কেলের এতোবড় ব্যবসা বড়ছেলে হিসাবে যে মানুষটা নিষ্ঠার সহিত সামলে চলেছে।বড়ছেলে হিসাবে যাকে এতোবড় ব্যবসার কর্ণধার বানিয়ে রেখেছে।সেই মানুষটা বলছে, সে নাকি এবাড়ির কেউ নয়!কি-করে এই মানুষটা এবাড়ির কেউ না হতে পারে!এমন অযুক্তিযুক্ত কথা কেউ বলে!নাকি এমন অযুক্তি কথা বিশ্বাসযোগ্য।
মানুষটার ছোটো বেলার গল্প।সল্প পরিসরে হলেও,সে বড়মার মুখে কথার ছলে গল্প শুনেছে।তিনি নিজ ইচ্ছেতে কৌড়ির সাথে টুকটাক গল্প করেছেন।সেখান থেকে জেনেছে প্রথম সন্তান হিসাবে মানুষটার প্রতি কতোটা দূর্বল বড়মা,সব সন্তানদের থেকে আলাদা স্নেহ আবেগ মানুষটার প্রতি।সেই মানুষটা বলছে,সে এবাড়ির কেউ নয়।কেনো এমন কথা বলছেন তিনি?
সংকোচ ভুলে নিভানের নির্বিকার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কৌড়ি।ওই দৃঢ় নজরও যে মিথ্যা বলছে,এটাও তো মনে বলছেনা কৌড়ির।তবে?পরাণটা কেমন ছটফটিয়ে উঠলো,উত্তরটা পাওয়ার জন্য।তবে মুখ ফুটে প্রশ্ন করতে পারলো না সে।সামনের মানুষটাকে আশকারা দেওয়ার ভয়ে,চাইলো না সে প্রশ্ন করতে।তবে মনস্তাত্ত্বিকের টানাপোড়েনে ভিতরে ভিতরে অস্থির তোলপাড় অনুভব করলো।মনেমনে বিচলিত হলো কিছু কথা জানার জন্য।তবে তা জিহ্বার ডগায় এনেও সামনের মানুষটাকে প্রশ্ন করা হয়ে উঠলো না তার।

‘কি ভাবছো,তোমার ইচ্ছে অনুমতি ছাড়া তোমাকে চেয়ে বসা,এই বর্ণহীন,নিঃশ্ব মানুষটাকে আপনজন করা যায় কি-না।

কথাটা অদ্ভুতভাবে বুক ভারী করে তুললো কৌড়ির।না চাইতেও কৈফিয়তের স্বরে তড়িৎ বললো সে–মোটেই আমি তেমনটা ভাবছি-না।

কৌড়ির নখ কাটা হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই।নখগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে নেলকাটারের পিছু ঘষার অংশে পালিশ করছে নিভান।নিজের কোমল হাতখানা যে কারও শক্ত হাতের মুঠোয়, সেদিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল ধ্যান নেই কৌড়ির।সে আছে সামনের মানুষটার সম্মুখে কিকরে নিজেকে কঠিন রাখা যায়। কৌড়ির উত্তর শুনে ঠোঁটের কোণে দুষ্ট হাসির রেখা ফুটলো নিভানের।মজার ছলে বললো–তবে কি ভাবছো,আপন করা যায়?

লজ্জা পেলো কৌড়ি।কথার প্যাচে পড়ে যাবে ভাবিনি।এলোমেলো নজর এদিকে ওদিক পানে ঘুরিয়ে অপ্রস্তুত গলায় বললো।—মোটেই তাও ভাবছি-না আমি।আপনি খুব বেশি বেশি ভাবছেন।

‘তবে কি ভাবছো,এই বর্ণহীন নিঃশ্ব মানুষটা আবার তোমাকে পাওয়ার স্পর্ধা দেখাচ্ছে কি করে?

দ্বিতীয়বার একই কথাটা নিভান আওড়াতেই,লজ্জা ভুলে খেয়ালী নজরে নিভানের শ্যামবর্ণ মুখের দিকে তাকালো কৌড়ি।একমনে মাথা নিচু করে মনোযোগী হয়ে তার নখের পরিচর্যা করে চলেছে মানুষটা।বিকালের নরম হয়ে আসা আলোতে শক্তচোয়ালের শ্যামবর্ণ মুখাবয়বের মানুষটাকে শুধুমাত্র রঙের জন্য কি কোনো কারনে সুদর্শন কম দেখাচ্ছে?কৈ কৌড়ির নজর তো সেটা বলছেনা।তবে মানুষটা কি-করে বলছে তিনি বর্নহীন!শ্যামবর্ণ মানুষ আবার বর্নহীন হয় কিকরে!আচ্ছা রঙে সাদা,কালো,শ্যাম, উজ্জ্বল কোনো মানুষই কি আসলে বর্নহীন হয়!এগুলো তো শুধু,জাস্ট রঙ।আর শুধু রঙ দিয়ে কি মানুষকে বিচার করা যায়!মানুষ বলতেই তো আল্লাহর দান শ্রেষ্ঠ জীব।তবে সেই শ্রেষ্ঠ জীব সম্পর্কে মানুষের ধারণা এতো উঁচুনিচু হয় কি-করে!মানুষের আচার ব্যবহার চালচলন কথাবার্তা যদি ভালো হয়, শ্রেষ্ঠ হয়। তবেই না সে সুন্দর,সুশৃঙ্খল,সুদর্শন।আর সামনে বসা মানুষটাতো সেসব গুনে একেবারে পরিপূর্ণ গুনোন্বিত।তবে?দৈহিক পেটানো শরীরের উচু লম্বা মানুষটার মায়ামায়া কাটকাট আদলের শ্যামবর্ণ মুখটাকে দেখলে,কে বলবে এই মানুষটা বর্ণহীন।আর তার ধারালো ব্যক্তিত্ব।যেকোনো মেয়ে তাকে পাওয়ার ইচ্ছে পোষন করবে।কৌড়ি কি করেনি!মুখে স্বীকারোক্তি পোষন না করলেও,মনকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা।সেই চেষ্টায় ভিতর বাহিরে কতোটা সফল অসফল হচ্ছে সেটা শুধু সেই জানে।নিজের ভাবনা মতোই গলায় কিছুটা অবাকতা নিয়ে বললো।

‘আপনি বর্ণহীন, নিঃশ্ব?

নিভান প্রহসন গলায় বললো-কেনো,মনেহচ্ছে না সেটা?

ভাবনার ঘোর মূহুর্তেই কেটে গেলো কৌড়ির।অপ্রস্তুত গলায় বললো–জানিনা।

এবার মুখ উঁচু করে তাকালো নিভান।সুডৌল অদ্ভুত মায়াময় মুক্তোদানার মতো গোলগাল একটা মুখ।দেখলে নজর,হৃদয় পরিতৃপ্ত হয়ে যায়।অথচ সেখানে নিষ্পলক তাকিয়ে মন নজর পরিতৃপ্ত করার দলিলনামা তার নেই।ভালোবেসে একটু ছোঁয়ার অধিকারও নেই।নিভান তাকাতেই নজর এলোমেলো করে এদিক ওদিক পানে চেয়ে,নিজের দ্বিধা কাটাতে চাইলো কৌড়ি।হাত টেনে নিয়ে সরাতে চেয়েও,সেই মানুষটার শক্তপোক্ত হাতের বাঁধন থেকে কিছুতেই হাত ছাড়াতে পারলো-না।শক্ত হাতের বিস্তৃত তালুতে কৌড়ির কোমল হাতের তালুটা, নিজের বৃদ্ধাআঙুলের দৃঢ়চাপনে ধরে রাখলো নিভান।শীতল চাহুনিতে কৌড়ির মুখের দিকে নজর ফেলে আবেগমিশ্রিত গলায় বললো।

‘এই কৌড়ি,আমার জন্য একটু লোভী হও-না।তুমি লোভী হলে আমার নিজের চাওয়া পাওয়া ইচ্ছেগুলো একেবারে নিঃশ্ব হয়ে যাওয়া থেকে বেঁচে যাবে।আমার জন্য একটু লোভী নাহয় হলে তুমি।খুব কি ক্ষতি হবে?

কথার উত্তর দিলোনা কৌড়ি।তবে চোখ বন্ধ করে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করলো।কেননা সামনের মানুষটার আকুল আবদনে বুকের মধ্যে ঝড় বইয়ে দিচ্ছে তার।কৌড়ির জবাবোর আশা না রেখে নিভান ওর হাত ছেড়ে দিলো।জানতো,সামনের মেয়েটা থেকে সহজে জবাব পাবে না সে।আশাও রাখেনি,তবে মেয়েটার বহিরাগত এক্সপ্রেশন জানতে চাইছিলো।মৃদু হাসলো নিভান।হাত ছাড়া পেতেই তড়িৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো কৌড়ি।ঘুরে সামনে এগোতে গেলেই নিভানের ডাকে,না চাইতে-ও পা থেমে গেলো তার।সেটা দেখে শিথিল গলায় সর্তকতাবানী সরূপ নিভান বললো।

‘বেখায়লিতে চলাফেরা করো-না কৌড়ি।আমার সব ইচ্ছে, চাওয়া পাওয়া আমি আমার আপনজনদের কথা ভেবে একটু একটু করে বিসর্জন দিয়ে দিয়েছি।তবে আফসোস হয়েও,মনে রাখেনি।তুমি আমার এমন চাওয়া।সেখানে আফসোস নামক শব্দটা প্রয়োগ করা তো দূর শস্য পরিমাণ স্যাক্রিফাইস করার দুঃসাহসিকতাও দেখাতে চাইনা আমি।যে কোনো মূল্যে রাজি নই আমি।আর আমার জীবনের শেষ ইচ্ছে বিসর্জন দেওয়া মানে,আমাকেই বিসর্জিত করা।আমার সবকিছু শেষ হওয়া।

নিঃশ্বাস আঁটকে রইলো কৌড়ির।বিগত দুমাস ধরে দেখে এসেছে, মানুষটা গম্ভীরর্য স্বভাবের।বাড়ির সবার সাথে খুব কমই কথা হয় মানুষটার।আর যেটুকু বলে খুবই শান্ত আর গম্ভীর স্বরে।ছোটো বড়ো সমবয়সী কারও সাথে সেভাবে মেলামেশা খোলামেলা নয় তার।অথচ তার বেলায় কথাবার্তা আচারন কতো সহজ সেই গম্ভীর্য মানুষটার।সেই মানুষটা তাকে পছন্দ করে ভাবলেই কৌড়ির পা থেকে মাথা পর্যন্ত সর্বাঙ্গ ঝিমঝিম করে উঠে।কেমন অদ্ভুত অদ্ভুত অনুভূতি হয়।যেখানে সে কখনো যেটা স্বপ্নেও ভাবেনি।সেখানে সেটা বাস্তবিকরূপে নিজের সাথে ঘটলে,নিজেকে কিভাবে ভালোমন্দের বেড়াজালে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়!তবু-ও রাখতে যে তাকে হবেই।বাবা মা মরা এবাড়ির আশ্রিতা সে।আর আশ্রিতা কি কখনো কার-ও সুখের নীড় হতে পারে!কিজানি,হয়তো পারে নয়তো না।আর ভাবতে চাইলোনা কৌড়ি,পা বাড়ালো পিছনের মানুষটা থেকে পালাতে।সেটা পিছনের মানুষটা নিস্প্রভ শান্ত নজরে দেখলো।কৌড়ি দৃষ্টিসীমা গোচর হতেই চেয়ারে গা এলিয়ে চোখ বুঁজে নিলো সে।শ্বাস ছাড়লো সংগোপনে।ফের মৃদুস্বরে আওড়ালো—তুমি কঠিন হতে চাইছো,হও।যতো কঠিন হতে চাইবে,তোমাকে চাওয়া পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা,তীব্রতা নিভানের ততোই বাড়বে।
তারপর নিজের আকুল অনুভূতি ছেড়ে কোথায় পালাবে তুমি!যেখানেই পালাতে চাওনা কেনো,লুকোনোর জায়গা হিসাবে তোমাকে খুঁজতে হবে নিভানের এই শক্তপোক্ত বুক।যা নিভান তোমাকে দেখার পর তোমার নামেই করে দিয়েছে।শুধু তোমারই নামে,কৌড়ি।

নিজের রুমে প্রবেশ করতেই ইভানকে নিজের বেডে শুয়ে থাকতে দেখে থমকে পা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো নিভান।স্থির নজরে,বেডে পা ঝুলিয়ে দু’দিকে দুহাত ছড়িয়ে শুয়ে থাকা ইভানকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করল।তারপর নিজের কাজে,ওয়াশরুমে চলে গেলো।নিভানের উপস্থিতি ইভানও টের পেয়েছে তবে প্রতিক্রিয়া দেখায়নি সে।কতোদিন পর নিজের ইগো ছেড়ে, প্রিয় জায়গাটায় শুয়েছে সে।একটা সময় এই জায়গাটা তার নিত্যকার ছিলো।তারপর সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো।কেনো হয়ে গেলো!নাহলে আর যাই হতো,তার জীবনের অন্তত এইদিনটা হয়তো দেখতে হতোনা তাকে।এরকম একটা দিনের সম্মুখে পড়ার আগে,তার দাদাভাই কাছে সে তন্ময়ী সম্পর্কে সবকিছু বলতো।আর দাদাভাই বিচক্ষণ ব্যক্তির মতো তাঁকে সবকিছু সুন্দরভাবে গুছিয়ে দিতো।নিভান ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে তোয়ালে দিয়ে হাতমুখ মুছতে মুছতে বললো।

‘হঠাৎ আমার রুমে?এ্যানি প্রবলেম?

চকচকে সাদা রঙ করা ছাঁদের পানে নজর স্থির ইভানের।নির্লিপ্ত গলায় বললো সে।-এই বেডটায় শুয়ে তুমি কি নির্দ্বিধায় কতো কঠিন কঠিন কাজ সহজভাবে সল্ভ করে ফেলো।তাই আমিও ভাবলাম,দেখি সেখানে শুয়ে আমার জীবনের এলেমেলো সবকিছু সল্ভ করা যায় কি-না। সবকিছুর ঠিক করার সল্যুশন খুজছি।কিন্তু আমি তোমার মতো করে পারছি-না সবকিছুর সহজ সমাধান মিলাতে।কেনো বলতো পারছিনা দাদাভাই?দেখেছো,কোনো বাবা সবসময় বলেন।সব জায়গায় শুধু দখলদারী নিলে হয়না।যোগ্য,বিচক্ষণ বুদ্ধিবিবেচক,জ্ঞানী ব্যক্তির দরকার হয়!নাহলে সব ধ্বস নেমে যায়।আমার জীবনের সবকিছু যেনো না চাইতেও একটু একটু করে ধ্বস নেমে যাচ্ছে।

‘কিসব আবোলতাবোল বকে চলেছিস ইভান।কি হয়েছে কি?

ইভানের মুখে ধ্বস নামা শব্দটা শুনতেই কিছুটা ধমকের স্বরে কথাগুলো বলতে বলতে তারদিকে এগোলো নিভান।সেটা দেখে তপ্ত শ্বাস ফেলে ইভান বললো।

‘আমি কখনো চাইনি,আমার জন্য কেউ মিনিমাম সামন্যটুকুও কষ্ট পাক।অথচ সেই আমার দ্বারাই সবাই ব্যথিত।নিজের পছন্দের চাওয়া পাওয়ার স্থায়িত্ব রূপ দিতে তন্ময়ীকে না চাইতেও অসম্মানিত,লজ্জিত করলাম।যেটা আমি কখনো চায়নি।বিশ্বাস করো দাদাভাই আমি একটুও চায়নি ওই মেয়েটাকে অসম্মানিত লজ্জিত করতে। সবার কথা ভেবে বিয়েতে ও রাজী হলেও, আমার প্রতি অসন্তুষ্ট।আমার দ্বারা ব্যথিত।কষ্ট পেয়েছে ও খুব।ও কখনো ক্ষমা করবে-না আমায়।আমি কিভাবে ওর সাথে সংসার গুছাবো। ওকে আমার করে রাখবো কিভাবে দাদাভাই?কিভাবে ঘৃনার বদৌলে ওর ফিরতি ভালোবাসাটা পাবো?আমি ওকে ছাড়তেও পারবো না।আবার ওর ঘৃনা নিয়ে একসাথে পথ চলবো কিভাবে দাদাভাই? সমাধান পাচ্ছি না!সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে আমার!সব!

একটু থামলো ইভান।পরপর বললো– এই দেখো,না চাইতেও আম্মুকে আবার কষ্ট দিয়ে ফেললাম।আমার সিদ্ধান্ত দ্বারা আম্মু অসন্তুষ্ট হয়েছেন,এটা বুঝে আম্মুকে বোঝাতে মানাতে গেলাম।অথচ পুনরায় আমার ব্যবহার কথাদ্বারা উনাকে কষ্ট দিয়ে এলাম।আমি চায়নি দাদাই আম্মুকে ওটা বলতে।কিন্তু কেনো জানি আম্মুর উপর অভিমান হলো,তিনিও তন্ময়ীর মতো কিছুতেই আমাকে বুঝতে চাইছেন না।অথচ আমর জীবনের প্রিয়,বিশেষ দু’জন নারীকে আনি বিশেষভাবে আগলে রাখতে চেয়েছিলাম।আমার দ্বারা ভুলেও কষ্ট পেতে দিতে চায়নি।অথচ তারাই আমার আচারন দ্বারা খুব বেশি ব্যথিত।অসন্তুষ্ট।আমি কেনো তোমার মতো নই দাদাভাই? আমার প্রিয় মানুষদের কেনো আমি ভালো রাখতে পারিনা?

স্থির দাঁড়িয়ে ইভানের মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো নিভান।গলায় কাতরস্বর!সুদর্শন ছেলেটার চোখমুখ কেমন ছন্নছাড়া ভাব।হাতগুলো কেমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে।অথচ ওই হাতদুটো একটা সময় তাকে ভরসা হিসাবে কতো বিশ্বাসে তার গলা জড়িয়ে ধরতো।সে না-ধরলেই কখনোই ইভান বলতোনা,দাদাভাই আমাকে ধরো আমি পড়ে যাবো।ছেলেটা যেনো মন থেকে ভরসা করতো,দাদাভাই যাই হয়ে যাক কখনো তাকে পড়ে যেতে দেবেনা।ব্যাথা পেতে দেবেনা।অথচ সম্পর্কের টানাপড়োনে আজ হাতদুটো অসহায় পড়ে আছে।ভরসা বিশ্বাস করেও,তার গলা জড়িয়ে ধরে বলতে পারছেনা,দাদাই আমার জীবনের এলোমেলো সবকিছু ঠিক করে দাও।গুছিয়ে দাও।সংগোপন দীর্ঘশ্বাস ফেলো নিভান।আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো ইভানের পানে।হাতের তোয়ালেটা বেডের একপাশে রেখে ইভানের মাথায় হাত রাখলো।সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটা চোখ বন্ধ করে নিলো।মায়ের পরে এই একজনের স্পর্শ তার ভূবন দুলিয়ে দেয়।পৃথিবীতে কখনো কোনো ভাইয়ের স্পর্শে কেউ মমতা খুজে পেয়েছে কি-না ইভানের জানা নেই।তবে এই স্পর্শে সে মমতা খুঁজে পায়।আদর,ভালোবাসা, আহ্লাদ খুঁজে পায়।এই মানুষটা তাকে ছুলে মনেহয়,মায়ের মমতাময়ী দ্বিতীয় কোল। কোমল আশ্রয়স্থল ।অথচ এই স্পর্শ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রেখেছিলো কতোগুলো দিন।উফ,সে যন্ত্রণা কি সে অনুভব করেনি!করেছে তো।

‘মন খারাপ কেনো করছিস?এটা নিয়ে কেউ মন খারাপ করে?তুই পুরুষ মানুষ।পুরুষ মানুষের এতো তাড়াতাড়ি দূর্বল হয়ে পড়লে চলে!তন্ময়ী ভুল বুঝেছে,সেটা তাকে বুঝিয়ে মানিয়ে নিতে হবে।যদিও হলুদের অনুষ্ঠানে মতো একটা বিশেষ দিনে অতোগুলা মানুষের সামনে নিজের বিয়ে ভেঙে যাওয়া।কতোটা লজ্জার, অসম্মানের,সেটা ওর জায়গায় না থাকলে হয়তো আমরা কেউ বুঝবিনা।আমরা আমাদের মতো চাইবো,বলে যাবে।সেখানে দাঁড়িয়ে ওইতো বুঝবে ওর কি হারিয়েছে আর কি গেছে।আর যেখানে ও অসম্মানিত হয়েছে লজ্জিত হয়েছে।কারনটাও তুই।আবার সেই মানুষটাকেই আবার গ্রহণ করা কি সহজ কথা?তবুও যে কারনেই হোক সে তোকে গ্রহন করতে চেয়েছে।সেখানে সেই অসম্মানিত হওয়া,লজ্জিত হওয়াটাকে তোকে মুছে ফেলতে হবে।জানিনা বিষয়টা মুখে বলার মতো সহজ হবে কি-না।তবে দ্বায়ী যখন তুই।তাকে পেতে হলে,প্রাপ্য শাস্তিটা তো পেতেই হবে ইভান।সেভাবে হোক চেষ্টা করতে হবে তাকে নিজের করে রাখার।তাকে করা অসম্মান মুছে দেওয়ার।আর তন্ময়ী খুবই ভালো এবং বুদ্ধিমতি মেয়ে।ওর সামনে নিজেকে খোলামেলাভাবে উপস্থাপন করলে,ও নিশ্চয় তোকে বুঝবে।

নিজের পাক্তপোক্ত হাতের ভারী পাঞ্জাটা ইভানের চুলে থামিয়ে দিলো নিভান।ছেলেটার বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে মন খারাপ হলো ভিষন।চঞ্চল ছেলেটা কিভাবে মূর্ছা পড়েছে।দুষ্টমী করা,মজা করা,সবার পিছে লাগা থাকা ছেলেটাকে এভাবে দেখা যায়।এবার নিভান বেশ সাবলীল গলায় বলো।আর মাকে আবার কি বলেছিস?নিশ্চয় বলেছিস মা আমাকে বেশি ভালোবাসে।তাইতো?

চোখ খুললো ইভান।মূহুর্তেই দুচোখের কার্নিশ বেয়ে নোনাজল গড়ালো।সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ঠোঁটে মৃদু হাসি টেনে বললো।–সত্যি বলবে,মা বাবা তোমাকে বেশি ভালোবাসে কি-না?

‘আর তোকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে কে?তোর অযথা অন্যায় আবদার মেটায় কে?

নিভান কথাটার উত্তর দিয়ে ইভানের চোখের পানি মুছিয়ে দিতে গেলেই ইভান,এতোদিনের ইগো ছেড়ে,দু-ভাইয়ের মধ্যে সকল দুরত্ব ঘুচিয়ে নিভানকে জড়িয়ে ধরলো।নিভানের কথার উত্তর না দিয়ে আকুল গলায় বললো।–স্যরি দাদাভাই।তোমার থেকে আমি আমাকে একটু একটু দূরে সরিয়ে নেওয়ার জন্য, খুব বেশি স্যরি।স্যরি দাদাভাই।

ইভানের আকুলতায় নিজেকে আর দূরে রাখতে পারলোনা নিভান।না কঠিন রাখতে পারলো।নিজের সাথে শক্তপোক্ত করে জড়িয়ে ধরলো স্নেহের ভাইকে।যেমনটা ছোটো বেলায় পরম স্নেহ ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরতো ইভানকে।ইভানের তার থেকে সরে যাওয়ার অনুতপ্ততা,নিভানকে আরও বিগলিত করলো।তবে সেসব আর না ঘেঁটে প্রসঙ্গ এড়াতে বললো–এতো বেশি মন খারাপ করার মতো কিচ্ছু হয়নি, বাচ্চা।দাদাভাই আছে তো,দাদাভাই সব ঠিক করে দেবে,ইনশাআল্লাহ।আর আম্মু,আরেহ মায়েরা-তো ওরকম ইমোশনাল হয়।
আমরা দোষ করবো,অন্যায় করবো,তাদের মতামতের বিরুদ্ধে গিয়ে অপছন্দনীয় কাজ করবো।আর তাদের কাজ ইমোশনাল হওয়া।তাই বলে তাদের আঘাত দিয়ে কথা বলা উচিত?কোনোমতও উচিত নয়।তবুও মানুষ আমরা ভুল,অন্যায় আমাদের দ্বারা হবেই।তোরও হয়েছে, ঠিক হয়ে যাবে।আজ তোর উপর মন খারাপ করেছে, কাল ঠিক হয়ে যাবে।সন্তান যতোই ব্যথা দিক,মা তারপ্রতি যতোই অসন্তুষ্ট হোক।দেখেছিস কখনো সেই সন্তানকে দূরে সরিয়ে রাখতে?আমাদের উপর যতোই রাগ, অভিমান হোক রেখেছে কখনো তার মমতাস্থল থেকে দূরে?দিনশেষে সন্তানের দোষ, অপরাধ কখনো মনে রাখেনা তারা।সেই সব ভুলে গিয়ে ঠিকই তাদের মমতাস্থলের ছায়াতলে মুড়িয়ে নেয়।তোর উপর রেগে গিয়েছে,তবে তন্ময়ীকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তে অখুশি হয়নি।আমি মায়ের সাথে কথা বলেছি। ঠিক হয়ে যাবে সবকিছু।উনি আমাদের মা।কারনে হোক বা অকারণে আমাদের উপর রাগ দেখাতে পারেন। অভিমান করতে পারেন,অসন্তুষ্ট হতে পারেন।
তাই বলে আমাদের উচিত নয় তাদেরকে কষ্ট দিয়ে,ব্যথা দিয়ে কথা বলা।আর কখনো নয় ঠিক আছে?

নিভান যেনো ছোটো কোথায় বাচ্চাকে বোঝাচ্ছে।যদিও ছোটো ভাইবোনগুলোকে সে বাচ্চায় মনে করে।ইভানও হ্যা বোধক সম্মতিতে মাথা নাড়লো। তবে মুখে সেই একই কথা আওড়ালো।–তবে আম্মু আব্বু সত্যিই তোমাকে বেশি ভালোবাসে।

নিভান হাসলো।ইভানের জ্ঞানবুদ্ধি হওয়া থেকে এই একটাই অভিযোগ–‘আম্মু আব্বু কোনো তোমাকে বেশি ভালোবাসে।আচ্ছা উনারা ভালোবাসলে সে কি করবে!
কিছুটা মজার ছলে নিভান বললো।

‘আচ্ছা আম্মু আব্বুকে বলে দেবো আমি।আজ থেকে তোর বিয়ের কবুল বলার সময়টা পর্যন্ত,যেনো আমার মতো করে একটু বেশি বেশি ভালোবেসে দেয় তোকে।
তাদের নাবালক ছেলে বলে কথা।নাবালক ছেলের বউ হয়ে গেলে নাহয় তাদের ভালোবাসাটা একটু কম হলেও চলবে।ও-কে?

‘ইট’স নট ফেয়ার।তুমি আমাকে এমনটা ভাবো দাদাভাই?

ইভানকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো নিভান।এই বিষয়ে কথা বাড়ালে আজ আর শেষ হবেনা।আয়নার সামনে দাঁড়ালো নিভান।এখন তাঁকে একটু বের হতে হবে।তাই নিজেকে পরিপাটি করতে ব্যস্ত হলো।হাতে কাজ চললেও মুখ বললো–তন্ময়ীর জন্য শপিং করতে গেলো সবাই।তুই গেলিনা কেনো?

‘কিচ্ছু ভালো লাগছিলোনা।আর ও-বাড়ি থেকে ওকেও নিয়ে শপিংয়ে যাবে ওরা।আমি গেলে ওর রাগ বাড়বে।হয়তো নিজের পছন্দ অপছন্দ বলবেও না।তাই যেতে ইচ্ছে হয়নি।

‘এটা কোনো কথা হলো ইভান।বিয়ে একবারই হবে, সেখানে দু’জনের পছন্দ অপছন্দতা থাকবে।আর তোদের মধ্যে যে ঝামেলা তৈরী করেছিস।সেটা দেখাসাক্ষাৎ কথাবার্তা নাহলে মিটবে কিকরে?যাই হয়ে যাক তোর যাওয়া উচিত ছিলো।

তড়িৎ ইভান উঠে দাড়ালো।বললো–তাহলে চলো,যাই।

‘চলো যাই মানে?আমি কোথায় যাবো?আমাকে অফিস যেতো হবে এখন।

নিভান কিছুটা অসন্তুষ্ট গলায় বললো–দাদাভাই!বিয়ের দু’দিন তো আপতত অফিস যাওয়া বন্ধ রাখো!

ফর্মাল ড্রেস ছাড়া নিভান অফিসে খুব কমই যায়।তবে একটুখানির জন্য এবেলায় আর ড্রেস চেঞ্জ করে ফর্মাল পোশাকে জড়ালোনা নিজেকে।ব্লু জিন্স আর নেভিব্লু টিশার্ট পরা ড্রেসটায় বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।চুল ঠিক করে গায়ে পারফিউম পুশড করতে করতে বললো–কাল থেকে বিয়ের দিন পর্যন্ত আপতত অফিসে পা দেবোনা।বিধায় এখন আমাকে যেতেই হবে।

‘ওসব জানিনা আমি।কৌড়ি ওদের সাথে শপিংয়ে যায়নি।আমি কৌড়িকে নিয়ে নিচে আসছি।তুমি গিয়ে গাড়ি নিয়ে বের হও।অপেক্ষা করো।

ইভান দাঁড়ালো না।ব্যস্ত পায়ে চলে গেলো।নিভান সেদিকে স্থির নজরে তাকিয়ে মৃদুস্বরে আওড়ালো।-তার ম্যাডাম যখন যাবে,তবে তো সে যেতে বাধ্য।


গাড়িতে অপেক্ষা করছে নিভান।ইভান যখন বলেছে কৌড়িকে সে নিয়ে আসবেই।তারমানে নিয়ে আসবেই।
সে যেই-ই বাঁধা দিক-না কেনো।কৌড়ি নিজে বাঁধা দিয়েও কাজ হবে-না।কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর দেখলো,সত্যিই কৌড়িকে নিয়ে ইভান আসছে।সাথে আনাফও আছে।ছেলেটা ইভানের সাথে মাথা নিচু করে কথা বলতে বলতে আসছে।মৃদু হাসলো নিভান।ওরা কাছাকাছি আসতেই মুখটা আগের ন্যায় স্বাভাবিক করে ফেললো।গাড়ীর কাছাকাছি আসতেই আশ্চর্য হয়ে ইভানের মুখের দিকে তাকালো কৌড়ি।ইভান ভাইয়া,বড়মাকে বলে তাকে নিয়ে এসেছে।সে আসতেই চায়নি।কিন্তু সবাই শপিংয়ে গিয়েছে আর সে বাড়িতে একা থাকবে,অনেক ভুজুংভাজুং বুঝিয়ে বড়মাকে দিয়ে তাকে কনভিন্স করিয়ে নিয়ে এসেছে।বলেছে মান্যতা আপুদের কাছেই শপিংয়ে যাচ্ছে।অথচ যাচ্ছে সেই মানুষটার গাড়িতে!ইভানের প্রতি মনেমনে অসন্তুষ্ট হলো কৌড়ি।মনেমনে ভিষন বকলোও।মানুষটা থেকে যতো দূরে থাকার চেষ্টা করছে ততোই কাছাকাছি হতে হচ্ছে।
ভাবলো সে যাবেই না।কথাটা মুখে বলার আগে নিভান বললো।

‘ উঠে বসো।

ড্রাইভিং সিটের পাশের ফ্রন্ট সিটের দরজার দিকে তাকাতেই নিভান চোখ দিয়ে ইশারা করলো উঠতে।নিভানের স্বর কানে যেতেই ইভানও তাল মিলিয়ে বললো–এই ফুলকৌড়ি,তুমি সামনে বসো।আমি আর আনাফ পিছনে বসছি।

কথাটা বলেই দু’জনে গিয়ে পিছনের সিটে বসে দরজা আঁটকে দিলো।সেটা দেখে কৌড়ি কি বলবে কি করবে, বুঝে উঠতে পারলোনা।এখন এখান থেকে চলে যাওয়া মানেই বেয়াদবি।আর বেয়াদবিটা করতে চেয়েও, হয়ে উঠলো না কৌড়ির।বাধ্য হয়ে ফ্রন্ট সিটে বসে পড়লো সে।মূহুর্তেই মাথা ঘুরিয়ে নজর দিলো জানালার বাহিরে।সেটা দেখে মৃদু হেসেই,ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে নিলো নিভান।কৌড়ির পাশের দরজা আঁটকে দিয়ে গাড়ি চালানোয় মনোযোগ দিলো।পিছন থেকে দুজনকে সুক্ষ নজরে একবার খেয়াল করলো ইভান।ফের আনাফকে উদ্দেশ্য করে বললো–সামনে আমাদের বড় ভাই আর ভাবী বসে আছে।ভুলেও তাদের দিকে নজর দিবি-না।আর তাদের কথাবার্তা-তো কানেই তুলবিনা, কেমন?

জানাসত্ত্বে-ও আনাফ বললো–সামনের মেয়েটাকে ভাইয়া পছন্দ করে?

‘সামনের মেয়েটা মানে কি?বলছিনা বড়ভাবী হয়।বউমনি বলবি।

‘ওকে।বউমনি বলবো।বলোনা ছোটো ভাইয়া,বড়ভাইয়া তাকে পছন্দ করে?

‘হুমম।ভিষন সিরিয়াস।

সেটা কি আর বুঝিনি সে।বড়ো ভাইয়ার কথাবার্তা আচারনে সে স্পষ্ট বুঝে নিয়েছে, মেয়েটাকে নিয়ে বড় ভাইয়া কতোটা সিরিয়াস।সামনে একপলক তাকিয়ে, দীর্ঘশ্বাস ফেললো ছেলেটা।ফের নিজের কাজে মন দিলো।ফোন নিয়ে ঘাটাঘাটি শুরু করলো।

কিছুদূর যেতেই কৌড়ির দিকে ফিরলো নিভান।হঠাৎই বললো–কি চাই তোমার?

কানে এলো কথা।কি চাই মানে?বুঝলোনা কৌড়ি।তাই প্রতিত্তোরও করলোনা।সেটা দেখে নিভান বললো—বলছো না যে,কি চাই তোমার?

উফফ,তাকে ঘিরে এই মানুষটার মুখে যেকোনো সম্বোধন বুকে খিল ধরিয়ে দেয় তার।আবারও একই কথা বলতেই, না বুঝেই বাহিরের পানে তাকিয়ে উত্তর দিলো কৌড়ি।—কিচ্ছু চাইনা।

‘আমাকেও না।

চোখ বন্ধ করে নিলো কৌড়ি।নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলেও, সেই নিঃশ্বাসের শব্দ পাশের মানুষটা পর্যন্ত আসতে দিলো না।আর না কথার উত্তর দিলো।চুপচাপ বসে রইলো সে।বরাবরের উত্তর পাওয়ার আশা করলোওনা নিভান।কিছুক্ষণ নীরবতায় কেটে গেলো।ফের নিভান বললো।

‘তোমার এবাড়িতে থাকতে মাঝেমধ্যে দম আঁটকে আসে তাই না কৌড়ি?মনেহয় নিজের মতো করে কোথাও গিয়ে থাকতে পারতাম।সেখানের সবকিছু শুধু তোমার হবে। এমনকি তোমার মাঝেমধ্যে বাড়িতে চলে যেতে ইচ্ছে করে,তাই না?

চকিতে নিভানের দিকে তাকালো কৌড়ি।নির্লিপ্ত মুখাবয়ব।দক্ষ হাতে সামনের দিকে নজর ফেলে গাড়ি চালানোয় মনোযোগ মানুষটার।অথচ তার মনের খবর জেনে বসে আছে।কিভাবে?সে তো ভুলেও কখনো প্রকাশ করেনি মনের কথা।তবে,তার মনের কথা জানলো কি করে মানুষটা!বুকের ভিতর ধুকপুকানি শুরু হলো।কৌড়ির বুকের ধুকপুকানির তীব্রতা বাড়িয়ে দিয়ে নিভান ফের বললো।

‘জানো,আমারও ইচ্ছে করে এমনটা।যেখানে আমার বলে সবটা থাকবে।আভিজাত্য বলে কিছু না থাকলেও, সেখানে আমার একটা তুমি থাকবে।আমার তোমার কিছু ইচ্ছে থাকবে।আমাদের ভালোবাসা থাকবে।যে ইচ্ছেগুলো বিসর্জন দিয়েছি,স্বপ্নগুলো হারিয়েছি সেটার আফসোস থাকবেনা।নিজের চারপাশের হাওয়া বাতাসগুলোয় আপন আপন গন্ধ থাকবে।যেখানে প্রান খুলে বাঁচা যায়।সবটা আমার বলে বাঁচার আকাঙ্ক্ষা বলতে পারো।

জ্যামে গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়লো।গাড়ি থামিয়ে গা এলিয়ে দিলো সিটে নিভান।তখনো কৌড়ি থমকে নিভানের পানে তাকিয়ে।ভয় সংকোচ তো এই মানুষটার তারপ্রতি সাবলীল আচারনে কবেই দূরীভূত হয়ে গেছে।সেখানে এসে এখন ভীড় জমিয়েছে অন্য অনুভূতিরা।নিভান অদ্ভুত মায়ামায়া নজরপ তাকালো কৌড়ির পানে।সে চোখে নজর পড়তেই,বুকের ভিতর কেমন কেমন করে উঠলো কৌড়ির।তবে কেনো জানি নজর সরাতে পারল না।অদ্ভুত মোহগ্রস্ত হয়ে তাকিয়ে রইলো।সেই মোহগ্রস্ত নজরের পানে তাকিয়ে নিভান ফের বললো।

‘এই কৌড়ি চলোনা আমাদের দু’জনের একটা সেরকম সংসার বানিয়ে ফেলি।যেখানে আমাদের ইচ্ছেগুলো মিলেমিশে একাকার হয়ে যাক।আমি আর তুমি থেকে শুধুমাত্র আমরা হয়ে যাই।যেখানে আমরা একেঅপরের নিঃশ্বাস হই,ভরসা হই,বিশ্বাস হয়ে বেঁচে থাকি।দিনশেষে শুধুমাত্র আমরা আমাদের হয়ে থাকি।

গাড়ির হর্নে মোহ কাটলো কৌড়ির।জ্যাম ছেড়েছে।এবারও পাশে বসা নারীটি থেকে উত্তর নেওয়ার আশা করলোনা নিভান।গাড়ি ছাড়লো।দু’জনের আর কথা হলোনা।শপিংমলের সামনে এসে গাড়ি পার্কিং করতেই পিচন থেকে ইভান আর আনাফ নেমে পড়লো।সেটা দেখে নিভান বললো।

‘তোরা চল,আমরা আসছি।

আজ্ঞা পেতেই দু’জনে মলের ভিতরের দিকে চলে গেলো।কৌড়ি কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলো’না।কৌড়ির পাশের দরজা খুলে দিতেই নেমে পড়লো সে।নিভানও বামলো।গাড়ী লক করে,শপিংমলের ভিতরের দিকে এগোলো।কৌড়িও তাকে অনুসরন করলো।শপিংমলের দোতলায় উঠার জন্য চলন্ত সিড়ির কাছে যেতেই,অনুমতিবিহীন কৌড়ির হাত ধরলো সে।আশেপাশে তাকিয়ে কৌড়ি আর কিছু বলতে পারলো না।দোতালায় উঠতেই জামাকাপড়ের ভরিভরি দোকান।মান্যতাদের কাছে না গিয়ে,সেখানের একটা নির্দিষ্ট দোকানে ঢুকলো।আভিজাত্যপূর্ন দোকানটায় সম্পূর্ণ দোকনটা শীতের বস্ত্রে পরিপূর্ণ।এখানে এলো কেনো মানুষটা?মনেমনে প্রশ্নের মাঝেই নিভানের গলা শুনতে পেলো দোকানির সাথে।

‘ভাই,শাল দেখানতো।বেশি দেখানোর প্রয়োজন নেই।দুই একটা দেখাবেন,যেনো বেশি ঘাটাঘাটি না লাগে।নজরে লেগে যায়।

দোকানি মূহুর্তেই ওপরের দিক থেকে তিনটে শাল বের করলো।চাদরের কারুকার্য আর গায়ের সিলমোহর বলে দিচ্ছে।একনম্বর ইন্ডিয়ান কাশমেরী শাল।দামও চড়া।তিনটে শালের মধ্যে কালোর উপরে কোলো সুতোর মিশিলে কাজ করা একটা চাদর পছন্দ করলো নিভান।দাম দরাদরি করলোনা।দোকানী দম বলতেই পেমেন্ট করে দিলো।দোকানী শালটা প্যাকেটিং করে দিতেই নিভান বললো।

‘প্যাকাটিং করা লাগবেনা।আমার কাছে দিন।

শালটা হাতে পেতেই পাশে দাঁড়ানো কৌড়ির গায়ে জড়িয়ে দিলো নিভান।আশ্চর্য হলো কৌড়ি।এটা তার জন্য কিনেছে মানুষটা!কিন্তু কেনো?হালকা শীতশীত ভাব পড়েছে।বাহিরে বের হতেই সেটা তীব্র অনুভব করলেও, প্রকাশ করেনি।অথচ পাশে থাকা মানুষটা ঠিকই বুঝে নিয়েছে।নিচু গলায় কৌড়ি বললো।

‘শালটা প্রয়োজন ছিলো-না।অযথা কিনলেন।

চলতি পথে উত্তর দিলো নিভান–তোমার কাছে অযথা মনে হতে পারে আমার কাছে নয়।আর ঠান্ডাভাব পড়েছে জেনে-ও কেনো কোনোকিছু গায়ে জড়িয়ে আসলে-না।তবে শালটা অপ্রয়োজনীয় মানুষটার থেকে জড়িয়ে নেওয়ার প্রয়োজন পড়তো-না।

মুখ ছোটো হয়ে গেলো কৌড়ির।সময় দিয়েছিলো ইভান ভাইয়া তাকে।বাসায় পরা ড্রেস পরেই চলে এসেছে,শুধু আলাদাভাবে হিজাবটা জড়িয়ে নিয়েছে মাথায়।আর কিছু নেওয়ার সময় পেয়েছে কোথায়?অথচ মানুষটা এমন করে বলছে যেনো,সে ইচ্ছে করে এভাবে এসেছে।ঠান্ডাভাব তারও লাগছে,তাই বলে কি চাদর কিনে দিতে বলেছে সে?আর কিনে দিয়ে কথাও শোনাচ্ছে!আর কখন বলেছে,তিনি অপ্রয়োজনীয় মানুষ।ধীর অথচ কাঠখোট্টা গলায় কৌড়ি বললো

‘আমার অনুমতি ছাড়া আর কোনোকিছু আমাকে কিনে দেওয়ার প্রয়োজন মনে করবেন না।আমি চাই না সেটা।

চলবে…..

ফুলকৌড়ি পর্ব-২৬+২৭

0

#ফুলকৌড়ি
(২৬)কপি করা নিষিদ্ধ।
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

ঘন্টাখানেক আগের মুখরিত হলুদের অনুষ্ঠানটা হঠাৎই যেনো নীরব বিস্বাদ থমথমে পরিবেশে ছেয়ে গেলো।মন ভালো নেই কারও।দূর্বল বিষন্ন মানসিকতায় আকস্মিক ইভানের প্রস্তাব পেতেই,মনেমনে বিস্মিত হলেন তাহমিনা বেগম।তবে ভগ্নহৃদয়ের দূর্বলতায় চোখমুখের এক্সপ্রেশনে সেটা প্রকাশ করতে পারলেন-না।নীরবে চেয়ে রইলেন ইভানের সুদর্শন আশাবাদী মুখের দিকে।কি বলবেন হঠাৎই জেনো ভেবে পেলেন না।সবদিক থেকে নিভানকে উনার খুব পছন্দ ছিলো।ছেলেটার আচার ব্যবহার কথাবার্তা চালচলন,সর্বোপরি ছেলেটার দৃঢ় ব্যক্তিত্বে বরাবরই মুগ্ধ হতেন।সব মায়েরাই তো চায় নিজের কন্যার জন্য এমন উপযুক্ত ছেলে।সেখানে নিভানের গায়ের রঙটা উহ্য করে দেখেন-নি কখনো।
সেই হিসাবে একসময় তিনি মনেমনে তন্ময়ীর জন্য নিভানকে,খুব পছন্দ করতেন।এটাও চাইতেন,মেয়ের জামাই হিসাবে নিভান হোক।এরকম উপযুক্ত ছেলে সহজে মেলে না।মনের কথা একসময় গিয়ে ছেলেকে-ও জানিয়েছিলেন তিনি।সেদিন তৃনয় বিভিন্ন কারন দেখিয়ে সাফ না করে দিয়েছিলো।তন্মধ্যে তন্ময়ীকে নিজের বোনের নজরে দেখে নিভান।নিজেদের কথার মধ্যে যদি কখনো তন্ময়ীর প্রসঙ্গ আসে কথাবার্তা-ও সেরূপ বলে নিভান।সেখানে তন্ময়ীর জন্য তার-কাছে প্রস্তাব রাখা বিব্রতকর।আশা করাটাও আরও লজ্জাজনক।ভাবাটা-ও উচিত নয়।তৃনয় একথা বলার পর তিনি মনের মধ্যে গড়া ইচ্ছে,আশা, সব ঝেড়ে ফেলে দিয়েছিলেন।আর সেই নিভানদের বাড়িতে,তন্ময়ী ইভানের বউ হয়ে গেলে কখনোই অসুখী হবে!ভালো থাকবে-না।এটা তিনি ভাবতেই পারেন না কখনো।তবু-ও তন্ময়ীর হয়ে ইভানের প্রস্তাবটা তিনি যেনো কখনোই আশা করেননি।নিজের মেয়ের সবদিক থেকে ইভান অনেক উঁচুতে।সেখানে কি আশা রাখা,আকাশ কুসুম ভাবার মতো।আরও সেই মেয়ের আজ হলুদের অনুষ্ঠানে বিয়ে ভেঙে গেছে।সেখানে আরও আশা রাখা তো উচ্চাকাঙ্খা।উনাদের মতো মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির জন্য উচ্চবিলাসিতা।

‘আন্টি,কিছু বলুন?

ঝাপ্সানো চোখে কয়েকবার দুর্বলচিত্তে পলক ঝাপটালেন তিনি।আরও কিছুসময় বিচক্ষণতার সহিত ভাবলেন।ফের চোখ বুঁজে মৃদু-ভাবে মাথা উপর নিচ কয়েক-বার ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিলেন।তবে মুখ দিয়ে কোনো টুশব্দ-ও উচ্চারণ করলেন না।চাইলেন না যেনো কথাই বলতে।সম্মতি পেতেই ইভানের বুকে এতোসময়ে জমে থাকা শক্তপোক্ত ভয়াবহ পাথরটা যেনো মূহুর্তেই সরে গেলো।মাথা নিচু করে জোরেশোরে নিঃশ্বাস ফেললো সে।সেই নিঃশ্বাস ফেলার দৃশ্যটুকু জহুরি নজরে পর্যবেক্ষণ করলেন,তাহমিনা বেগমের পাশে বসা নীহারিকা বেগম। তখনো ছেলের মুখের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন তিনি।উনার ইভান,প্রস্তাব রেখেছে মেয়েটাকে বিয়ে করার জন্য।এটা যেনো কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারলেন না উনি।উনার পাশে দাঁড়ানো স্বান্তনা রহমান, মান্যতা,মৌনতারও একই অবস্থা।অবিশ্বাস্য নজর।অথচ কৌড়ির মন গাইছে অন্য কিছু।তন্ময়ী আপু কি সেই মেয়ে,যাকে নিয়ে ইভান ভাইয়া বরাংবার তারসাথে এটাওটা বলে গেছে?না হাওয়া বউ হিসাবে দাবী করেছে।তবে কি আজ তন্ময়ী আপুর বিয়ে ভাঙার পিছনে ইভান ভাইয়া দ্বায়ী!তাই যদি হয় তবে কাজটা মোটেও ঠিক করেননি ইভান ভাইয়া।অসন্তুষ্টচিত্তে ইভানের মুখের দিকে তাকিয়ে, মূহুর্তেই মুখ ফিরিয়ে নিলো সে।

পাশে দাড়নো ডালিয়া বেগমও যেনো বিগতসময় ধরে নাটক দেখছিলেন,উনার মুখাবয়বে সেটা এতোসময় প্রকাশ পাচ্ছিলো।তবে ইভান বিয়ের প্রস্তাব রাখতেই তিনি আশ্চর্যিত হলেন,কপাল কুঁচকে ফেললেন বিরক্তিতে।এরকম একটা কান্ড ইভানের থেকে কখনোই তিনি আশা করেন নি।ছেলেযে বাপের মতো দয়ালু স্বভাব পেয়েছে বেশ বুঝলেন।তবে কি দেখে এই ছেলে, সদ্য বিয়ে ভেঙে যাওয়া ওই মেয়েকে নিজের সঙ্গীনি করতে চাইছে বুঝে আসলোনা উনার।একে মেয়ের গায়ের রঙ শ্যামলা।ইভানের ফর্সা রঙের পাশে কখনোই মানাবেনা।সেখানে মেয়ের বাপ তো নেই,আরও না আছে বাপের রেখে যাওয়া কোনো প্রতিপত্তি।এরকম একটা মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির মেয়েকে ইভান বিয়ে করবে!
জোয়ার্দার বাড়ির বউ বানাবে!জাহিদ হাসান জোয়ার্দারের ছেলের বউ!এতো রুচিহীন হয়ে গিয়েছে ছেলেটা।তাহমিনা বেগমের কাছে ইভানের রাখা প্রস্তাবে কেউ কিছু না বললেও,তিনি যেনো আর চুপ থাকতে পারলেন না।মুখ খুলবেন এমন ভাবনাটা মাথায় এনে, মুখে কিছু বলতে যেতেই হাতে টান পড়লো উনার।পাশে তাকাতেই দেখলেন,দীবা শক্তকরে হাত টেনে চেপে ধরেছে।চোখ বড়বড় করে,মাথা এদিকে ওদিকে নাড়িয়ে ইশারা করছে কিছু না বলতে।তিনি তবুও মানতে চাইলেননা।কিছু বলবে বলে উদ্যোক্ত হতেই,দীবা আরও শক্তকরে হাত চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বললো।

‘প্লিজ আম্মু,এখানে কোনোরূপ সিনক্রিয়েট করো-না।ওর লাইফ ওকে বুঝতে দাও।ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো যথেষ্ঠ বড় হয়েছে।ওর ভালোমন্দ কিসে ও সেটা খুব ভালোভাবে বোঝে।তাই ও কিসে ভালো থাকবে সেটা ওকে বুঝে নিতে দাও।অন্তত ওর বেলায় নিজেদের সিদ্ধান্ত ওর উপরে না ঝাপিয়ে,ওকে ওর মতো করে ভালো থাকতে দাও।তোমার মতোকরে বুঝতে যেয়ে ওর জীবনটা এলোমেলো করে দেওয়ার চেষ্টা করোনা।প্লিজ আম্মু!

মেয়ের কথার দেওয়া সুক্ষ খোঁচাটা বেশ উপলব্ধি করলেন ডালিয়া বেগম।কোন কারনে মেয়েটা এমন খোঁচা দিয়ে কথা বললো,এটাও বেশ বুঝলেন।বিরক্তও হলেন বৈকি।এতো ভালো ঘরবর দেওয়ার পর-ও মেয়ে সুখে নেই।নাকি সে ইচ্ছে করে সুখে থাকতে চাইছে না এটা তিনি কি বুঝতে পারছেন না!অবশ্যই পারছেন!তবে নিজের পেটের মেয়েযে জোর গলায়-ও তো কিছু বলতে পারেন না।আর বললে-ও,আগে শুনলে-ও এখন আর শুনতে চায়না মেয়েটা।বিরক্তিতে খেঁকিয়ে উঠে তিনি কিছু বলতে যাবেন তার আগেই দীবা আবার-ও হাত চেপে ধরে বললো।

‘এখানে বড়মামাও উপস্থিত আছেন,এটা মাথায় রেখো।

মেয়ে তাকে হুমকি দিচ্ছে, অসন্তুষ্ট নজরে মেয়ের পানে তাকিয়ে পিছনে ফিরলেন তিনি।বড়ভাই উনার কয়েক কদম পিছনে হুইলচেয়ার বসা।ছোটো বেলা থেকেই এই বড়ভাই নামক মানুষটাকে তিনি যেমন সমীহ করে চলেছেন,তেমন ভয় পেয়ে চলেছেন।উনার মুখেমুখে বা উনার সামনাসামনি কথা বলার,তর্ক করার স্পর্ধা করেননি এমনকি সাহস দেখেননি কখনো।মেয়ের হুমকিতে সত্যিই তিনি দমে গেলেন,আর মুখ খুললেন না।তবে মেয়ের প্রতি বেজায় অসন্তুষ্ট হলেন।

সম্মতি পেতেই তাহমিনা বেগমের পাশে বসা মায়ের পানে দূর্বল একটা চাহুনি দিয়ে উঠে দাঁড়ালো ইভান।মনেমনে আশা রাখলো,মা নিশ্চয় তাকে বুঝবে।আর সে বোঝালে,অবশ্যই বুঝবে।তাহমিনা বেগমের সম্মতির খবর পুরো হলুদ অনুষ্ঠানের সর্বজনের কাছে ছড়িয়ে পড়লো।অনুষ্ঠানের আমেজ,পুরোপুরি ভাবে না ফিরলেও থমথমে পরিবেশ কিছুটা কাটলো।তন্ময়ীর পাশে গিয়ে তার বান্ধবী আর কাজিনেরা বিভিন্নভাবে তাকে বোঝাতে লাগলো।নিভান-ও এতোসময়ে তৃনয়ের সাথে কথা সেরে নিয়েছে।তৃনয় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো ইভান নিভান দুজনের প্রতি।সেটা শুনে মনেমনে ইভানের প্রতি আরও অসন্তুষ্টতা বাড়লো নিভানের।ইভানের থেকে কোনো অংশে সে তৃনয়কে মনে করেনা।
বন্ধু কম নিজের ভাইয়ের নজরে দেখে সে।সেই বন্ধুর এরকম একটা অসম্মানিত,অসহায় পর্যায়ে দেখা সত্যি কি মন থেকে মেনে নেওয়া যায়!এতোসময় অন্য কেউ হলে তাকে কি যে করতো নিভান।সে তো তন্ময়ীর বিয়ে ভেঙে যাওয়ার খবর শুনতেই,বরপক্ষের বিরুদ্ধে একশান নেওয়ার ব্যবস্থা করছিলো।কিন্তু দোষ তো সেই নিজের ঘাড়েই চেপে বসেছে।এখন তাকেই সুস্থ সুন্দরভাবে দু’দিকেই সমাধান করতে হবে।না-হলে অন্যায় করা হবে।অন্যায় তো তার ভাইদ্বারা এমনিতেই হয়ে গেছে।সেখানে ভান আর তৃনয় দু’জনেই তার নিজের মানুষ।কাছের প্রিয় মানুষ।আর সেই প্রিয় দু’জন মানুষের মধ্যে একজনের দোষ ঢাকতে গিয়ে আরেকজনের উপর অবিচার করতে হচ্ছে তাকে।এটাই সে মন থেকে মানতে পারছে না।তবে এই ছাড়া উপায়ও নেই যে তার।

তাহমিনা বেগমের সম্মতি জাহিদ সাহেবকে জানাতেই তিনি নিজের স্ত্রী, ভাই এমনকি বাড়ির সবাই ডেকে পরামর্শ করলেন।সেখানে উনার সম্মতিই প্রাধান্য দিলো সবাই।তবে মনেমনে নীহারিকা বেগম একটু অসন্তুষ্ট হলেন,ছেলের এহেন কান্ডে।বড় ছেলেকে না বিয়ে দিয়ে ছোটো ছেলের বিয়ের সিদ্ধান্ত,উনার মনটাকে একটু অসন্তুষ্ট করে দিলো।তবুও সেটা তিনি বহিঃপ্রকাশ আনলেন না।ডালিয়া বেগমও একটু খুচখুচ করলেন, তবে মন খুলে নিজের মনের দ্বিমত প্রকাশ করতে পারলেন না।অতঃপর জাহিদ সাহেব তন্ময়ীর মায়ের সাথে এবং তার বাড়ির মুরুব্বিদের সাথে কথা বললেন।একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত হলো,বিয়ের ডেট যেদিনই সেদিনই বিয়ে হবে।আর আজ হলুদের অনুষ্ঠানও বহালই থাকবে।এই সিদ্ধান্তে সবাই সন্তুষ্ট হলেও,তন্ময়ী সন্তুষ্ট হতে পারলো না।সবার সম্মুখ দিয়ে ছুটে চলে গেলো সে ক্ষনিকের পরিচিত রাংলোবাড়ির ঘরটায়।ইভান নিস্পৃহ নজরে দেখলো,তন্ময়ীকে ছুটে যেতে।মন ছটফটিয়ে উঠলো তার।তবে অসাড় ভঙ্গিতে নিশ্চুপ দাড়িয়ে রইলো সে।কেনো জানি মন মস্তিষ্কে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।অনুতপ্ততায় হাত পা যেনো অচল অনুভব হলো তার।একটা ফাঁকা টেবিলের চেয়ারে বসে পড়লো সে।ইভানের সেই নিস্প্রভ দৃশ্যটা নিভান দূর থেকে লক্ষ্য করলো নিভান।ভাইয়ের নিস্পৃহতায় বুকের ভিতরটা তারও পুড়লো।ব্যথিত হলো। তবে মেয়েটার পরিস্থিতির কথা ভাবলেই ইভানের প্রতি ভিষণ রাগও হলো তার।ইভানের দিলে এগোলো নিভান।গিয়ে বসলো ইভানের সামনাসামনি চেয়ারে।তীক্ষ্ণ নজরে ইভানের মাথা নিচু করে রাখা মুখের দিকে তাকিয়ে রুক্ষ গলায় বললো।

‘তুমি এরকম একটা ব্লান্ডার করবে এটা কখনোই আমি ভাবিনি ইভান!তুমি যেমনটা ছিলে না কেনো,তোমার কাছ থেকে এতোটাও হীনমন্যতা আশা করে-নি আমি। কখনো না।আমার ভাই এমনটা করবে!হাও ইজ দিস পসিবল?

নিভান এসেছে টের পেয়েও মাথা উচু করেনি ইভান।
দাদাভাই যে তার উপর ভিষন রেগে আছে,এটা বেশ অনুভব করতে পারলো সে।আজ তার জায়গায় যদি অন্য কেউ থাকতো তবে এতোসময় বাজে অবস্থা হয়ে যেতো তার।সেসব ভেবেই মুখ উচু করে সামনে তাকানোর সাহস করিনি সে।তবে নিভানের রুক্ষ গলার কথাগুলো শুনতেই অসহায় মুখ করে তাঁরদিকে চাইলো।কন্ঠে খাদ নামিয়ে বললো।

‘দাদাভাই প্লিজ।

‘এই দাদাভাই প্লিজ কিসের!এই তুই যেটা চেয়েছিস,না কখনো বলা হয়েছে।এই বল, না বলেছি আমি কখনো?
বাবা না বললেও,আমি কখনো না বলেছি?তুই মুখ ফুটে না চাইলে-ও,আমি বুঝতে পারলেই সেটা নিজ থেকে দেওয়ার ট্রায় করেছি তোকে।তবে কেনো এরকম একটা হীন কাজটা করলি ইভান?আমাকে একটাবার জানাতিস।তৃনয়ের কাছে আমার সম্মানের কথাটা একবার-ও ভাবলি না?তোর যখন তন্ময়ীকে এতোটাই পছন্দ তবে আমাকে কেনো সেটা বললিনা?কেনো এমনটা করে মেয়েটাকেসহ ওর পরিবারকে অসম্মানিত করলি?আমার ভাইয়ের প্রতি আমার অটুট বিশ্বাসটা কেনো এভাবে নষ্ট হতে দিলি?

দাদাভাই ভিষন রেগে আছে এটা তার তুইতোকারি কথায় স্পষ্ট বুঝলো ইভান। এখন যদি কথা না বলে চুপ থাকে।তবে তন্ময়ীকে পাওয়ার আশাও ক্ষীন হয়ে দাড়াবে।তাই না চাইতেও মুখ খুললো ইভান।

‘ও সামন্য একটা বিষয় নিয়ে ভুল বুঝে এরকম একটা সিচুয়েশন তৈরী করেছে।যার ফলস্বরূপ এরকম একটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আমাদের সবাইকে দাঁড়াতে হয়েছে।আর এই পরিস্থিতির জন্য যদি আমি দ্বায়ী হয়ে থাকি,তবে তার কিছু অংশীদ্বারও ও।আর তুমিও শুধু ওর পরিস্থিতিটা বিবেচনা করে কিছুতেই ভুল বুঝতে পারো-না আমাকে। ওকে আমি বলেছিলাম,বাড়ি থেকে যদি কোনো বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তবে আমাকে জানাতে।ও সামান্য একটা ভুল বোঝাবোঝির কারনে, নিজমনে ক্ষোভ পুষে রেখে ইচ্ছেকৃতভাবে জানায়নি আমাকে।আর সামন্য একটা ভুল বোঝাবোঝির কারনে,ও এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে আমার থেকে দূরে সরে যেতে পারে-না।ও চাইলে-ও আমি সেটা হতে দিতে পারিনা।আর সেটা আটকাতে আমার এই পদক্ষেপটা নিতে হয়েছে।যার ফলস্বরূপ এই পরিস্থিতি।
ওকে বা ওর পরিবারকে অপমান অপদস্ত করার কোনোরূপ ইচ্ছে আমার ছিলো না।

রাগে টনটন হয়ে যাওয়া কপাল মূহুর্তেই কুঁচকে গেলো নিভানের।বললো—তোদের মধ্যে সম্পর্ক ছিলো?

‘না।

‘তবে?এসব কথা হওয়ার কারন ?

নিজেদের মধ্যে ঠিকঠাক হওয়া না হওয়ার সম্পর্কটা ছোটো পরিসরে বিবরণ দিল ইভান।আর সেই সম্পর্কের থেকে এই পরিস্থিতি কিকরে গড়ালো এটাও বললো।সেটা শুনে নিভান শক্তগলায় বললো।

‘তন্ময়ীর বোঝাবোঝিটা একদম ভুল নয় আর না সেই ভাবনামতো বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ভুল।বরং তোমার ওই মেয়েটার সাথে মাখামাখিটাই মাত্রাধিক ছিলো।আর যে কেউ ওসব দৃশ্য দেখলে,তন্ময়ী যেটা ভেবেছে, বুঝেছে।সেটাই বুঝবে,সেটাই ভাববে।নিশ্চয় আমার নজরও ভুল কিছু দেখেনি!আমার ব্রেইন ও ভুল কিছু ভাবেনি!

‘তুমি আমার চরিত্র নিয়ে অবিশ্বাস করতে পারো না দাদাভাই!তন্ময়ীর মতো তোমার দেখায় ভুল না থাকতে পারলেও,ভাবনায় বিস্তার ভুল ছিলো।

‘কিন্তু কার্যকলাপ তো তুমি তেমনটাই করেছো ইভান।সেখানে আমাদের নজর যেমনটা দেখবে,আগে সেরূপ ভাবনাই তো ভাববে।তাই না?

‘না তাই না!আমাদের দেখাও কিছু কিছু সময় ভাবনাতে গিয়ে ভুল হয়। ওই মেয়েটা আমার গার্লফ্রেন্ড ছিলো-না দাদাভাই।আমার ক্লাসমেট ছিলো,তবে ওরসাথে আগে সেভাবে পরিচিত ছিলাম না আমি।ওর বয়ফ্রেন্ডও আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিলো,ওরসাথে রিলেশনের পর মেয়েটাকে চিনেছি আমি।ওদের রিলেশনশিপের পরে বিভিন্ন সূত্রে আমি জেনেছি মেয়েটার একাধিক বয়ফ্রেন্ড ছিলো।এমনকি আমি নিজ চোখেও দেখেছি,শহরের বিভিন্ন নামীদামী কফিশপে রেস্টুরেন্টে মেয়েটার যাতায়াত।বন্ধুকে জানিয়েছিলাম,বিশ্বাস করে নি।ও ঢাকার বাহির থেকে পড়তে এসেছে, বিধায় শহর ঘোরাঘুরি ততোটাও হয়না ওর।বিধায় ওর নজরে মেয়েটার কার্যকলাপগুলো সেভাবে পড়েনি।যার ফলসরূপ ও আমার কথা বিশ্বাস করেনি।কিন্তু মেয়েটা দেখতে হ্যান্ডসাম আর বড়লোক বাপের ছেলে পেলেই পিছনের বয়ফ্রেন্ডটাকে,জীবনে চেনেনি দেখেনি এমনভাবেই ছুড়ে ফেলে দেয়।আমি সেই সুযোগটা নিয়ে আমার ফ্রেন্ডকে প্রুফ করতে চেয়েছিলাম মেয়েটা ভালো নয়।নেহাল ভিষন ভালো ছেলে দাদাভাই।আর ও ওরকম একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক এগোবে।মেয়েটাও দিনের পর দিন তাকে ঠকিয়ে যাবে।এটা আমি মানতে পারিনি, চাইনি কখনোই।যারজন্য মেয়েটার সাথে, তোমার আর তন্ময়ীর ভাষায় একটু মাখামাখি করতে হয়েছিলো আমাকে।এখানে দোষ আমার নেই,এটা আমি বলছিনা।তবে আমার কাছে বিষয়টা না জেনে এমন বাড়াবাড়ি তন্ময়ী করবে এটা আমি ভাবিনি।

‘বাড়াবাড়ি নয়।ওর জায়গা থেকে ও সম্পূর্ণ ঠিক।ভুলটা তুই করেছিস!সম্পর্কে না জড়ালে-ও,মেয়েটার দূর্বলতা নীরব সম্মতিতো তোরসাথে ছিলো।সেখানে অন্য একটা মেয়ের সাথে তোকে ওভাবে দেখলে তো ভুল বুঝবেই।

‘তুমিও তন্ময়ীর মতো কিছুতেই আমাকে বুঝতে চাইছো-না দাদাভাই।আচ্ছা ভাবো,এখন যদি কৌড়ি জানতে পারে।তুমি দীবাআপুকে বিয়ে করতে চেয়েছিলে।এখন বিয়ে কেনো করতে চেয়েছিলে,কৌড়ি কারন তো আর জানেনা।দীবাআপুকে বিয়ে করতে চেয়েছিলে, এটাই তার মুখ্য বিষয়।তুমি তার ভুল ভাঙানোর আগে সে যদি এটাও জানতে পারে,দীবাআপু তার স্বামী সংসার ছেড়ে এবাড়িতে পড়ে আছে শুধু তোমাকে পাওয়ার আশায়।এবার পরিস্থিতি যদি আমার মতো হয়।মনে করো কৌড়ি রাগে অভিমানে তোমাকে ছেড়ে অন্যত্র জায়গায় বিয়ের সম্মতি জানালো।তুমি কি করবে?

সবসময়ে শান্ত থাকা নিভানের কলিজা মোচড় দিয়ে উঠলো।কপাল অস্বাভাবিক কুঁচকে রাগতস্বরে বললো–‘মানেটা কি,এখানে এসব কথা আসছে কোথা থেকে?

মনেমনে ক্রুর হাসলো ইভান।যে যেই বিষয়ে ভুক্তভোগী তাকে সেই বিষয়ে বুঝিয়ে দূর্বল করতে হয়।নাহলে কি আর সে বোঝে অন্যের ব্যথা,দরদ।ইভান চটজলদি উত্তর দিলো।—তুমি আমাকে বুঝতে চাইছো না তাই আসছে।প্লিজ দাদাভাই এসব বাদে এখন তন্ময়ীকে একটু মানাও না।আমি নিশ্চিত ও তোমার কথা ফেলবে না।

কথা কানে গেলেও,ভাবনা কৌড়িতে চলে গেলো নিভানের।মেয়েটা কি তার পরিস্থিতিটা না বুঝে তাকেও ভুল বুঝে দূরে সরে যাবে?ভাবতেই বুকে চিনচিনে ব্যথার অনুভব সৃষ্টি হলো।হাসফাস হয়ে উঠলো নিঃশ্বাস।নজর এলোমেলো হয়ে কৌড়িকে খুঁজলো।খুঁজে পেলেও।ওই-তো তার থেকে সামন্য দূরত্বে মায়ের পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা।মান্যতা আর মৌনতাও দাঁড়িয়ে আছে পাশে।অপলক কিছুসময় সেদিকে তাকিয়ে থেকে উঠে দাড়ালো নিভান।সেটা দেখে ইভানের মুখে-ও মৃদু হাসি ফুটলো।দাদাভাই মেনে গিয়েছে মানে তন্ময়ীকেও মানাতে আর সময় লাগবে-না।বিয়েটা একবার ভালোই ভালো হয়ে যাক,তারপর সে বুঝে নেবে।

ঘরের দরজা এঁটে বসে আছে তন্ময়ী।সে কিছুতেই ইভানকে বিয়ে করবে-না।মা কি-করে তার মতামত না নিয়ে,ইভানের প্রস্তাব সসম্মানে গ্রহণ করলো!তন্ময়ীকে তার হাতে তুলে দেওয়ার সম্মতি কি করে জানালো। ওই অসভ্য ছেলেটার জন্য আজ তার জীবনে এমন পরিনতি।কতোশত মানুষের সামনে নিজের চরিত্র নিয়ে কথা উঠলো।আপমান অপদস্ত হতে হলো।আর সেই ছেলেটাকেই সারাজীবনের সঙ্গীনি হিসাবে তাকে গ্রহন করতে হবে!কিছুতেই না।ইভানের সঙ্গীনি সে কখনোই হতে চায়না।কখনোই না।দু-হাটু মুড়ে জড়োসড়ো হয়ে ফ্লোরে বসা তন্ময়ী,এবার দু-হাটুর মধ্যে মুখ গুঁজে হু-হু করে কেঁদে দিলো।মাথায় চললো এলোমেলো সব ভাবনা।

‘তনু,দরজাটা খোল।কিচ্ছু হয়নি সোনা। ভাই সব ঠিক করে দেবে।তবু-ও উল্টো পাল্টা কিচ্ছু মনে আনার চেষ্টা করিস না পাখি।এই তনু,দরজাটা খোল’না পাখি।কথা শোন না বোন আমার।

দরজার ওপাশে দাঁড়ানো প্রিয় মানুষগুলোর ভয়ার্ত গলার কথাগুলো,ডাকগুলো সবটাই কানে এলো তন্ময়ীর।তবে একটা টুশব্দও উচ্চারণ করলো না সে।শুধু কেঁদেই চললো।নাজুক মনে হঠাৎই প্রশ্ন বাসা বাঁধল,সবাই তার ভাবনায় চিন্তিত,আতঙ্কিত!অথচ তার মা একবারও এলেন না।তাকে ডাকলেনও না!তবে কি মা বিশ্বাস করে নিয়েছেন,উনারা যেটা বলেছেন সেটাই সত্য।ভাবনা যতোই দৃঢ় হলো তন্ময়ীর কান্নার দৃঢ়তার তোড়জোড়ও ততোই বড়লো।একসময় তৃনয়ের পাশে এসে দাঁড়ালো নিভান।তখনো লাগাতার তৃনয় এটা-ওটা বলে দরজা ধাক্কিয়ে চলেছে।নিভান চোখ দিয়ে ইশারা করে তাকে থামতে বললো।ফের নিজে মৃদুশব্দে দরজায় ধাক্কা দিয়ে বললো।

‘তন্ময়ী,দরজা খোলো।আমি কথা বলতে চাই তোমার সাথে।

নিভানের ভারিক্কি গলার স্বর পেতেই কান্না হালকা হয়ে এলো তন্ময়ীর।তবে নড়লোনা সে।উঠবেওনা আর দরজাও কিছুতেই খুলবেনা সে।নিশ্চয় ওই বেয়াদবটা নিভান ভাইয়া কে তার হয়ে সাফাই গাইতে পাঠিয়েছে।সে মরে যাবে তবুও কিছুতেই ওই বেয়াদবটাকে বিয়ে করবে-না।খুট করে দরজা খুলে যাওয়ার শব্দে মুখ তুলে সেদিকে চাইলো তন্ময়ী।নিভানকে দেখেই মাথা নিচু করে ফেললো সে।নিভান, মেয়েটার এলোমেলো অবস্থা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।ধীরপায়ে সেদিকে এগিয়ে তন্ময়ীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।ফের নরম গলায় বললো।

‘আমি কখনো মৌনতা আর মান্যতা থেকে আলাদা করে দেখিনি তোমাকে।এতো বছরের সম্পর্কে হয়তো আমার আচারনে তুমি বুঝতে পেরেছো।জানিনা আমার সম্পর্কে তোমার ধারনা নিজের ভাইয়ের মতো কি-না।

মাথা উঁচু করে তাকালো তন্ময়ী। মায়াবী টলমলে কাজলকালো চোখ দু’টো বলে দিচ্ছে সে নিজের ভাইয়ের মতো বিশ্বাস,ভরসা করে নিভান কে।সেদিকে তাকিয়ে নিভান বললো।

‘তবে আজ সেই ভাই বোনের সম্পর্কের বিশ্বাস, ভরসা ভঙ্গ করতে চলেছি কি-না আমি জানি-না।তবে আমার দ্বারা তোমার অমঙ্গল কোনো হতে পারে এটা কখনোই আমি ভাবতে পারিনা।

একটু থামলো নিভান।সত্যিই স্বার্থপরের মতো এককভাবে চেয়ে ফেলছে সে।তবুও বললো—তোমার মতো ইভানও কষ্ট পাচ্ছে তন্ময়ী।আমি জানি, ও তোমাকে অসম্মান করেছে।তবে পরিস্থিতিতে পড়ে যে করেছে এটা তুমিও জানো।ইভানকে তুমি কতোটা চেনো,জানো আমি জানিনা।তবে আমার ভাইকে আমি জানি,ও কখনো একটা মেয়েকে অকারণে অসম্মান করার মতো ছেলে নয়।আর কাওকে কথা দিয়ে তাকে ঠকানো,আমি অন্তত এই অবিশ্বাসটুকু আমার ভাইয়ের প্রতি কখনো করতে চাইনা।হয়তো চেয়েও অবিশ্বাস করতে পারবো-না।যদিও স্বার্থপরের মতো বলা হয়ে যাচ্ছে।তোমার পরিস্থিতিতে থাকলে একথা-গুলো মুখ দিয়ে বের করতে পারতাম কি-না জানিনা।তবে সত্যি বলতে আমরা সবাই আমাদের প্রিয় মানুষদের ক্ষেত্রে দূর্বল স্বার্থপর।তাই,আমার ভাইয়ের জন্য তোমার কাছে তোমাকে চাইতেই হচ্ছে।

তন্ময়ীর অবাককরা দূর্বল চাহুনীর দিকে তাকিয়ে দুর্বোধ্য হাসলো নিভান।বললো–আমাকে স্বার্থপর মনে হচ্ছে তোমার,তাই না?আমি জানি তোমার দিকটা না ভেবে আমি স্বার্থপরের মতো কথা বলছি।তবুও বলবো,ওকে ফিরিয়ে দিওনা তুমি।আমার বোন হয়ে আজীবন আমাদের সাথে থেকে যাও।

শ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে নিল তন্ময়ী।সেটা দেখে ফের নিভান বললো–এবার তুমি ভেবে দেখো,তুমি কি করতে চাও।তোমার সিদ্ধান্ত যদি এরপর না হয়।তবে তুমি ভেবো-না,ইভান তোমাকে কোনোপ্রকার ডিস্টার্ব করবে না।

নিভান তপ্তশ্বাস ফেলে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ানোর আগে আবার বললো—তুমি ভেবেচিন্তে তারপর সিদ্ধান্ত নাও।আমরা বাহিরে সবাই তোমার অপেক্ষায় আছি।

ইভান দীবাকে নিয়ে যুক্তি দেখাতেই কৌড়ির নিয়ে এলোমেলো ভাবনা মস্তিষ্কে চলতেই থাকলো নিভানের।কৌড়িকে নিয়ে নিভানের এতোদিনের কঠিন মন,এমন দূর্বল হয়ে পড়েছে।মেয়েটা তার হবেনা ভাবলেই, হৃদপিণ্ড সেকেন্ডে সেকেন্ডে ছটফটিয়ে উঠছে তার।বিচলিত হলো সে।আপতত মেয়েটার সাথে কথা বলা প্রয়োজন।তন্ময়ীর সাথে কথা বলে বাহিরে বের হয়ে কৌড়িকে কোথাও দেখতে পেলোনা সে।আশেপাশে খুঁজলো তবুও পেলোনা।বাধ্য হয়ে ফোন দিলো।একবার নয় কয়েকবার দিলো।পরপর কয়েকবার ফোন দেওয়ার পর রিসিভ হলো ওপাশ থেকে।ফোন রিসিভ হতেই এপাশ থেকে বিচলিত গলায় নিভান বললো।

‘এতোবার ফোন দিচ্ছি,ধরছো না কেনো?কোথায় তুমি? আমার তোমার সাথে কথা আছে,প্লিজ দুমিনিট হলেও আমার সাথে কথা বলে যাও,কৌড়ি।

চলবে…

#ফুলকৌড়ি
(২৭)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

দীর্ঘ সময় ধরে জমা আকাশের ঘনোকালো মেঘ সরে গিয়ে সেখানে যেনো ঝলমলে রোদ্দুরের দেখা মিলেছে।তন্ময়ীর সম্মতি এমনই প্রভাব ফেললো ইভানের মনে।সাথে বাড়ির বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোর মনেও।মান্যতা আর মৌনতা-তো ভিষন খুশি।তন্ময়ীকে তাদের ভিষন পছন্দ।ছোটো বউমনি হিসাবে মোটেই মন্দ হবে-না মেয়েটা।একেবারে তাদের মনমতোন,খুব মিষ্টি।পুনরায় আবার আংটিবদল হলো।আগের পাত্রপক্ষের আংটি খুলে ফেলে,যত্রতত্র নীহারিকা বেগমের হাতের আঙটি দিয়ে আপতত আংটিবদল সারা হলো।ইভান যখন আঙটি পরাতে গেলো তন্ময়ীর হাতে।সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে হাত সরিয়ে নিলো তন্ময়ী।ইভানের হাত থেকে আঙটি কেড়ে নিয়ে নিজেই নিজের আঙুলে পরে নিল।
পাশেবসা ইভানকে দাঁতে দাঁত চেপে মৃদুস্বরে বললো।

‘বিয়েতে সম্মতি দিয়েছি মানে,আমাকে ছোঁয়ার অধিকার দেইনি।সো ভুলেও অধিকার তো দেখাবেনই না।দ্বিতীয়ত যখন তখন ছোঁয়ার বাহানা-ও খুঁজবেন না।

দূর্বল চোখে,তন্ময়ীর কঠিন করে রাখা মুখাবয়বের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো ইভান।ফের আশেপাশে নজর ফেলে আর কথা বাড়ালোনা।চুপচাপ উঠে চলে গেলো।পূর্বে যে উৎফুল্লতা সবার মনে বিরাজ করছিলো সেই উৎফুল্লের সহিত হলুদ অনুষ্ঠান নাহলেও,মোটামুটি ভাবেই সীমিত পরিসরে অনুষ্ঠান শেষ করা হলো।বিয়ের মতো একটা সেনসেটিভ ইস্যু ঘোলাটে হয়েও,পুনরায় যেভাবে হোক মিটে যাওয়ায় সবার মনেমনে সাচ্ছন্দ্যতা অনুভব করলেও,তৃনয়ের মনটা ছোটো হয়ে গেলো।তন্ময়ীর বিয়ের পর সে চেয়েছিলো,সাহস করে হলে-ও একবার নিভানের সামনে প্রস্তাব রাখবে মান্যতার জন্য।তাতে যদি নিভান অসম্মতি জানায় বা তাদের বন্ধত্ব একটু নড়চড় হয়।তবু-ও রাখবে।আগে মনে হতো,চোখের ভালো লাগা একটু একটু করে মনে বাসা বেঁধেছে।বন্ধুত্বের কারনে সেটা একটু কষ্ট করে হলেও, চোখের আড়ালে থাকলে ভুলে যেতে পারবে।কিন্তু না।যখন পড়াশোনার জন্য স্কলারশিপ পেয়ে বিদেশ চলে গেলো,মেয়েটা জেনো সেই মনে বাঁধা বাসাটা আর-ও শক্তপোক্তভাবে বাঁধলো।তারপর সেই বাসা ভেঙে দেওয়ার কথা ভাবলেই বুকে পাহাড়সম ব্যথার অনুভব সৃষ্টি হয় তার।মনে এমন অনুভূতি জাগে,বাসা বাঁধা জায়গা থেকে মেয়েটাকে একটু নড়চড় করলেই নিজেকেই শেষ হয়ে যেতে হবে।অথচ মেয়েটাকে বলার ক্ষমতা নেই।নেই বললে ভুল হবে।তবে মান্যতার সামনে নিজের অনুভূতি কখনো প্রেমিক রূপে প্রকাশ করতে চায়নি সে।চেয়েছে,সবার সম্মতিতে তাকে নিজের স্ত্রী রূপে আপন করে নিতে।তাকে চেয়েছে প্রনয় নয় পরিনয় রূপে।তবে এখন বোনের জন্য এখন সম্পর্ক তৈরী হতে যাচ্ছে, সেই পরিনয় রূপে চাওয়া সম্পর্ক কি গড়া সহজ হবে!সম্পর্ক হওয়া ঘরে কি আর দ্বিতীয়বার সম্পর্ক তৈরীর প্রস্তাব রাখা যাবে!সেটা কি সবাই ঠিকঠাক চোখে দেখবে?যদিও তন্ময়ী ভালো থাকলে, সুখে থাকলে সেই ভালো।তৃনয়ের পরম শান্তির। তবুও কোথাও যেনো তার কিছু একটা হারিয়ে যাচ্ছে, এমনটা অনুভব হচ্ছে।সব কেমন হঠাৎই গড়মিল হয়ে গেলো কেনো!ভাগ্য বরাবরই সে যা চেয়েছে তার বিপরীত দিয়ে এসেছে। এবার চাওয়াটা যদি সেরকমই হয়।তবে তাকে নিঃশেষ হয়ে যেতে হবে।আজ মেয়েটাকে দেখার পর যেমন তাকে পাওয়ার প্রবলতা দ্বিগুনভাবে অনুভাবিত হয়েছে,সেখানে এই ঘটনার পর তাকে না পাওয়ার আকাঙ্খা, ভয়, দ্বিধা, শতগুণরূপে ব্যাথার অনুভূতি রূপে বাসা বেঁধেছে।

যদি-ও হঠাৎ করে বিয়ে।তবুও আত্মীয় স্বজন কাওকে বলতে বাদ রাখলেন না নীহারিকা বেগম আর জাহিদ সাহেব।বড় ছেলে বাদে যদিও ছোটোছেলের বিয়ে,তবুও দ্বিধাদন্ড রাখলেন না কাওকে নিমন্ত্রণ করতে।এবাড়ির ছেলে-মেয়েদের মধ্যে প্রথম বিয়ে।তাও আবার হঠাৎই করেই। তবুও আয়োজন ধুমধামভাবে করার চেষ্টা করলেন।কোথাও কমতি রাখতে চাইলেন না।বিশেষ করে নিভান।ভাইবোনদের মধ্যে ইভানের জায়গাটা তার জীবনে অন্যরকম একটা দূর্বলতার স্থান।মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের পরে এই পরিবারের প্রথম আপন বলে কেউ নিজের জীবনে স্থান করে নিতে পেরেছিলো।তার ছোট্ট নিঃসঙ্গ জীবনের একাকিত্ব দূর করে কথা বলার সঙ্গী হয়েছিলো।ভাগ্যের পরিহাসে বাবা হারিয়ে যাওয়ার পর যে হাসিখুশি জীবটা বিসর্জন দিতে হয়েছিলো সেটাও যেনো কিছুটা হলেও তার জীবনে ফিরে এসেছিলো ইভানের পৃথিবীতে আসার আগমনে।তার মুখে এক টুকরো হাসি ফোঁটাতো বাচ্চার ছেলেটার সুদর্শন মুখ,নরম স্পর্শ।একটু বড় হলে তার কাছে থাকার আবদার।আদূরে কন্ঠ দাদাভাই ডাকটা।তাকে ছাড়া একটা সময় ওই ছেলেটা কিচ্ছু বুঝতে চাইতো না।এরকম একটু একটু করে একটা সময় এমন দূর্বলতা তৈরী হলো ছেলেটার প্রতি।তার অন্যায় আবদারও পর্যন্ত নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছে নিভান।যদিও একটা সময় গিয়ে কিছু কারনে সম্পর্কে দূরত্ব এসেছে।তবুও ছেলেটার প্রতি সেই স্নেহ ভালোবাসাময় দুর্বলতা একতিল পরিমানও কমেনি।বরং বেড়েছে।যা হয়তো ইভানও জানে।আবার হয়তো বা জানে না।

নিমন্ত্রণ পেতেই নিকট আত্নীয়দের ভীড় লেগে গেলো বাড়িতে।বাড়ির ভিতরের দিকটা নীহারিকা বেগম আর স্বান্তনা রহমান নিপুণহাতে সামলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।এরমধ্যে বড়ছেলের আগে ছোটোছেলে কেনো বিয়ে করছে?এবিষয়েও কথা উঠলো।কথা উঠলো কি,কথাটা সবার মুখেমুখে।সেসব কথার উত্তরও তিনি অমায়িক হেসে সুন্দরভাবে বলে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।যদিও ছেলের এমন হুটকরে বিয়ের সিদ্ধান্তে মনে- মনে তিনি-ও একটু অসন্তুষ্ট হয়েছেন।তবে নিভান বুঝিয়ে বলায় সেই অসন্তুষ্টটা কিছুটা হলেও গলে বরফ হয়েছে।তবু্ও কাল থেকে ইভানের সাথে এবিষয়ে ভুলেও তিনি কথা বলেন-নি।কথাই বলেননি রাগে।তবে তন্ময়ী মেয়েটাকে উনার বেশ পছন্দ।মায়াবী চেহারার একটা মিষ্টি মেয়ে।হাসলে মেয়েটাকে কি সুন্দর দেখায়।আর সেই মেয়েটা উনার বাদর ছেলের বউ হবে।উনার ছোটো ছেলের বউ!একারনেই ছেলের প্রতি নারাজি তিনি উগ্রভাবে দেখাতে পারছেন না।রান্বাঘরে ব্যস্ত হাতে কাজ করছিলেন,আর মনেমনে ভাবছিলেন তিনি।হঠাৎ গলায় একজোড়া হাত পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরতেই বুঝতে পারলেন হাতজোড়া কার।তবু-ও বিশেষ পাত্তা দিলেন-না।দৃঢ়চিত্তে কাজেই মনোযোগ দিলেন।পাশ থেকে স্বান্তনা বেগম দেখলেন।মৃদু হেসে তিনিও নিজের কাজে মনোবেশিত হলেন।

‘ও আম্মু।খুব রাগ হয়েছো আমার উপর?

রাগ মনে না থাকলেও,গলায় কঠোরতা বজায় রেখে নীহারিকা বেগম বললেন।—ইভান আমার প্রচুর কাজ।এখান থেকে যা।তোর উল্টো পাল্টা বকবক শোনার সময় আপতত আমার নেই।যা…

টুপ করে মায়ের গালে একটা চুমু বসিয়ে দিলো ইভান।নীহারিকা বেগম বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে ইভানকে পিছন দিক থেকে ঠেলে সরিয়ে দিলেন।ফের পরিহাসের স্বরে বললেন—আমার নাবালক ছেলে হঠাৎ সাবালক হয়ে গেলো কবে?এটাই তো বুঝতে পারছি না!আর সেই ছেলে আমার সাবালক ছেলের আগে বিয়ের প্রস্তাব রাখছে,ব্যাপারটা একটু ধাক্কা খাওয়ার না?

নিজের কথার ফাঁদে নিজে আঁটকে যাওয়া!ব্যাপারটা খুবই দুঃখজনক।মনেমনে নিজেকে বেশ প্রবোধন করলো ইভান।ফের মা’কে ভুলাতে বললো–তোমার নাবালক ছেলে নাবলকই আছে।শুধু বিয়ে করতে চাইছে।আর বিয়ে করতে গেলে ছেলে আবার নাবালক সাবালক হতে হবে কোথায় লেখা আছে?দাদুমা গল্প করেন শোনোনা,আগের মানুষের নাকি একদম ছোট্রো বেলায় বিয়ে হয়ে যেতো।এমনকি পেটে পেটেও নাকি বিয়ে হয়ে যেতো।তাদের কি কিছুতে আঁটকে আছে নাকি?নাকি….

নীহারিকা বেগম ইভানের কথা শেষ করতে দিলেন না।এই ছেলের মুখের কোনো লাগাম নেই।কোথায় কি বলে বসে,তার ঠিক নেই।তিনি চোখ রাঙিয়ে দাঁতে দাত চেপে বললেন।—আমি তোর মা,বান্ধবী নই।কথা হিসাব করে বল,বেয়াদব।আর এখান থেকে যা নাহলে কিন্তু মোটেই ভালো হবেনা ইভান।

মুখ বেজার করার অভিনয় করলো ইভান।ফের স্বান্তনা বেগমকে উদ্দেশ্য করে অভিযোগের স্বরে বললো–দেখেছো ছোটোমা,এবার বলো মা কাকে বেশি ভালোবাসে। দাদাভাই নাকি আমাকে।দাদাভাই হলে তো ঠিকই তার কথা শুনতো।তাও আবার আদরে আহ্লাদে মনোযোগ দিয়ে শুনতো।শুধু আমার বেলায় তার যতো জ্বালা।আমার কথাই শুনতে ভালো লাগেনা উনার।

‘ইভান।

এই ছেলে নাকি বিয়ে করবে!ছেলের ইতুড়েপনায় তন্ময়ী এসে দুদিনও টিকবে কিনা উনার ঘোর সন্দেহ আছে। মায়ের চড়া গলার ডাক পড়তেই দমে গেলো
ইভান।বুঝলো উল্টো পাল্টা যাই বলুক না কেনো কাজই হবেনা।মা সত্যিি বেশ অসন্তুষ্ট হয়েছেন তার উপর।পাশে দাড়ানো ছোটো চাচির দিকে একবার অসহায় নজরে তাকালো।সেটা দেখে স্বান্তনা রহমান চোখের পলক ফেলে আস্বস্ত করলেন।বুঝালেন সব ঠিক হয়ে যাবে।হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে মাথা নিচু করে নিলো ইভান।রান্নাঘর থেকে যেতে গিয়েও,কিছু ভেবে ফের মায়ের কাছে এসে দাড়ালো সে।জানে,তার কান্ডে মা বকবে।তবুও আবারও দুহাত দিয়ে মা’কে পিছন থেকে জাপ্টে ধরলো।নীহারিকা বেগম রাগান্বিত হয়ে কিছু বলার আগেই অতি স্বাভাবিক গলায় ইভান বললো।

‘আই এ্যাম রিয়্যালি ভেরি স্যরি মা।আমি আমার কথা কর্মদ্বারা কখনো কাওকে কষ্ট দিতে চাইনি আর চাইনা কখনো।তবুও বারবার সবাই আমার কথা কর্মদ্বারা কষ্ট পায়। আর পাচ্ছেও।তবে বিশ্বাস করো আম্মু,আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আমার সেই কাছের মানুষগুলোকে মনোক্ষুণ্ণ হতে হবে,আমার কর্মদ্বারা সেসব মানুষগুলো কষ্ট পাবে।এটা আমি আরও চাইনি।তবুও সেই মানুষগুলোই কষ্ট পেয়েছে।হয়তো আমার ভাগ্য ভালো না,আমি চেয়েও কাওকে ভালো রাখতে পারিনা, এজন্য।বাট আমি নিরুপায় হয়ে এমন একটা ডিসিশন নিতে বাধ্য হয়েছি।আমি চাইনি তন্ময়ীর অন্য কোথাও বিয়ে হোক।আর সেই মেয়েটা আমার জন্য অসম্মানিত হয়েছে,এটা জেনেবুঝেও তাকে কিকরে আরও অসম্মানিত হতে দেই!যারজন্য না চাইতেও সেই সবাইকে কষ্ট দিতে হলো আমাকে।

ছেলের আগাগোড়া কথা কিছুই বুঝলেন না নীহারিকা বেগম।তবে এটা বেশ বুঝলেন তন্ময়ীর বিয়ে ভাঙার সাথে কিছু একটা সম্পর্ক আছে ইভানের।বিস্ময় নিয়ে কথাগুলো শুনতে শুনতে হঠাৎই উনার গালে ছেলের ফের স্নেহময় আদর পড়লো।বিগলিত হলেন তিনি।এমনিতেই মন শান্ত হয়ে গিয়েছে উনার।ইভানের প্রতি যে অসন্তুষ্টটা মনেমনে ছিলো,সেটা কেটে গিয়েছে সেই কখন।তবে ছেলেকে সেটা দেখাতে চাইছেন না বলে মুখেমুখে এতো চোটপাট। তবে ইভানের এবারের কথাগুলো মাতৃত্ব মনে কেমন জেনো দাগ টেনে দিলো।ছেলের ভাগ্য খারাপ মানে!ইভানের কখনো কথায় কেউ কখনো তো কিছু মনে করেনা।তবে কেনো ছেলেটা এমন বলছে?হঠাৎ ইভানের ফের কথায় ভাবনার ঘের কাটলো উনার।

‘তবে সত্যিই তুমি দাদাভাইকে বেশি ভালোবাসো মা।

আর দাঁড়ালো না ইভান।চলে গেলো সে।সেদিকে শূন্য নজরে তাকিয়ে রইলেন তিনি।আজ ইভানের কথায় কোনোরূপ মশকরা ছিলোনা।অতি স্বাভাবিক গলায় ছেলেটা কথাটা বলেছে। তবে কি সত্যিই তিনি ইভানের থেকে নিভানকে বেশি ভালোবাসেন।হয়তো একটু বেশি।মাতৃত্ব মন সেটা বুঝলেও মুখে স্বীকার করলেন না।স্বান্তনা বেগমের দিকে চেয়ে দূর্বল গলায় বললেন।

‘এই ও কেনো বোঝেনা ছোটো।ওরা সবাই আমারই পেটের সন্তান।ওদের সবাইকে আমি একই পেটে ধরেছি।একইভাবে লালনপালন করেছি।ওদেরকে আমি সমান ভালোবাসি।তবে নিভান আমাকে প্রথম মা হওয়ার অনুভূতি অনুভব করিয়েছে।ওর মধ্যে আমি আমার মাতৃত্বের প্রথম স্বাদ অনুভব করেেছি।ওর মুখে আমি প্রথম মা ডাক শুনেছি।তাই ওর প্রতি একটু দূর্বলতা বেশি আমার।কিন্তু বিশ্বাস কর ছোটো,আমি ওদের সবাইকে সমান ভালোবাসি।আচ্ছা তুই বল,নাফির আর মৌনতাকে তুই সমান না আলাদা আলাদা কম বেশি ভালোবাসিস?

‘নিজের পেটেধরা সন্তানদের কেউ আবার আলাদা আলাদা ভালোবাসতে পারে?নাকি আলাদা নজরে দেখা যায়?তুমি আবার ওর কথা শুনে এগুলো কি বলা শুরু করলে আপা?দেখোনা নাফিম আর মৌনতা সারাদিন কি নিয়ে ঝগড়ায় লেগে থাকে।ওদের ও তো একই কথা,একই অভিযোগ!মা আমাকে নয় তোকে বেশি ভালোবাসে।আমার প্রতিও কি ওদের অভিযোগ কম চলে!তবে সেসব কথায় আমরা অবুঝ হলে চলবে?নাকি চলে?তুমিই আমাকে এসব বোঝাও আবার এখন তুমিই আবার অবুঝ হচ্ছো?

‘ওরা ছোটো,ইভানতো আর ছোটো নয়।ও কেনো বোঝেনা।ও কেনো এমন অবুঝপনা কথা বলে বারবার।কেনো বলে?আমার সব সহ্য হলে-ও, এসব কথা সহ্য হয়না।ও বোঝেনা।

‘আমরা বড়রাই তাই মাঝে মাঝে কঠিন অবুঝ হয়ে যাই সেখানে ওর কথা বাদ দাওতো।ওসব নিয়ে মন খারাপ কোরো-না।বিয়ে করছে তো। বাচ্চার বাবা হোক তারপর সবই ঠিকই বুঝবে।আর ওসব কথা কি আর আজ,ও নতুন বলছে ।ও তো তোমাকে রাগানোর জন্য সবসময় ওসব বলে থাকে।

‘কিন্তু আজ ওর কথা রাগানোর জন্য ছিলো-না।কথাটা মনেমনে আওড়ালেন তিনি তবে মুখে আর সান্ত্বনা বেগমকে জানালেননা।কথা সেখানেই ক্ষান্ত রাখলেন তিনি।নিজ কাজে মনোযোগ দিলেও ইভানের বলা শেষ কথাটা বারংবার মনমস্তিস্কে চলতে থাকলো।

বিয়ে উপলক্ষে নীহারিকা বেগমের বাবার বাড়ির আত্মীয়-স্বজন এসেছেন।সাথে নিভানের বৃদ্ধা নানুমা-ও এসেছেন।নিভানের সাথে ভদ্রমহিলার বেশ অমায়িক সম্পর্ক।সকাল সকাল এবাড়িতই উনার আসার কথা শুনতেই, নিভান উনার সাথে দেখা করতে এলো।মান্যতার রুমে আরামদায়ক বিছানায় পা মেলিয়ে বসে আছেন তিনি।নিভানকে দেখেই মিষ্টি হেসে কাছে ডাকলেন।ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলেন।দুজনের ভালোমন্দ সাক্ষাৎ শেষে নিভানের শ্যামবর্ণ নিটোল কপালে বৃদ্ধা ঠোঁটের আদর দিতেও ভুললেন না।আদর পেতেই,ফিরতে আদর দিতেও ভুললোনা নিভান।নানুমার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে,দ্বিধাহীন উনার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।নিভানের চুলের মাঝে নিজের দূর্বল আঙুলগুলো চাপিয়ে নড়াচড়া করতে করতে বেশ রসিকতার সহিত বললেন।

‘কি ব্যাপার বলোতো নানুভাই?তুমি ইদানীং আমার সাথে দেখা করতেই যাচ্ছো-না।যেখানে সপ্তাহে রোজ তোমাকে দেখা যেতো সেখানে সপ্তাহে একদিনও তোমার দেখা নেই।আজ প্রায় দুমাস হতে চললো,অথচ নানুমার কথা মনে নেই।ব্যাপারটা কি?নানুমার নাতবউয়ের দেখা মিললো নাকি?যে নানুমাকে ভুলতে বসেছো?

অপ্রিয় হলপও কথাটা সত্য।তবে সেটা মুখে প্রকাশ করলো না নিভান।মৃদু হেসে নানুমার কথার উত্তর দিল।
–অফিসের প্রচুর ঝামেলা ছিলো।তারমধ্যেও আমি একদিন না জানিয়ে তোমার ওখানে গিয়ে দেখি,তুমি বাসায় নেই।বড়মামাদের ওখানে চলে গিয়েছো।তারপর তো আমি ফোনে তোমার সাথে কথা বলে নিয়েছি,তবুও এই অভিযোগ কেনো আমার নানুর রাঙা বউয়ের?

হাসলেন ভদ্রমহিলা।নিভানের কথার প্রসঙ্গ গেলেননা।প্রসঙ্গ এড়িয়ে নিভানের মাথায় স্নেহপূর্ন হাত বোলাতে বোলাতে বললেন—আমার ছোটো নাতী বিয়ে করছে অথচ বড়নাতী এখনো একটা নাতবউ খুঁজে নিতে পারলোনা।বিষয়টা কিন্তু আমি কিছুতেই মানতে পারছিনা নানুভাই।তাড়াতাড়ি নাতবউ খুঁজে ফেলো?
আমি যে আমার নানুভাইয়ের সুন্দরী বউটা দেখেই আল্লাহর ডাকে সাড়া দিতে চাই।

নিভান মৃদু হাসলো।বৃদ্ধার চোখ সেটা এড়ালো-না।তিনি বললে—ব্যাপার কি আমার নানুভাইয়ের মুখে হাসি কেনো?সত্যিই কি নাবৌ খুঁজে পেয়েছো তবে?

নিভান মুখে কিছু বললোনা।তবে নানুমার মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা ঘনঘন উপর নিচ নাড়িয়ে হ্যা জানালো।বৃদ্ধা যেনো আসমানের চাঁদ হাতে পেলেন,এমনটাই খুশি হলেন।বললেন–সত্যি বলছো নানুভাই।কোথায় পেয়েছো তাঁকে!আর কে সে?দেখাও দেখি আমাকে।

‘সিক্রেট,নানুমা।তার কথা তো এখন কাওকে বলা যাবে না।

‘নানুমার কাছেও তাকে গোপন রাখতে চাও?নানুমা কাওকে বলবে-না। দেখাও দেখি,সেই সৌভাগ্যবতীকে।যে আমার নানুভাইয়ের শক্তপোক্ত মনটা দূর্বল করে সেখানে জায়গা করে নিতে পেরেছে…

কথা শেষ করতে পারলেন না তারমধ্য সেখানে উপস্থিত হলো নিভানের এক মামতো বোন।নাম ঈশিতা।মেয়েটা বিবাহিত।দুই বাচ্চার মা। নিভানের সাথে মেয়েটার একটা আবেগময় সম্পর্ক আছে।বাবা হারিয়ে যখন নানুবাড়িতে নিভানদের জায়গা হলো।সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকতো ছোট্টো নিভান।মায়ের মানসিক টানাপড়েনে একটা সময় এই বোনটায় তাকে মায়ের মতো আগলে রেখেছে।যে একটা বছর মামাবাড়িতে ছিলো,তাকে নিজ সন্তানের মতো স্নেহ করেছে।আদর ভালোবাসা দিয়েছে।ছোট্ট নিভানকে নিয়মমাফিক খাইয়ে দেওয়া,গোসল করিয়ে দেওয়া, ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া,ঘুরতে নিয়ে যাওয়া।রুটিন ছিলো যেনো মেয়েটার।সেই সময় থেকে মেয়েটার প্রতি কঠিন একটা দূর্বলতা রয়েছে নিভানের।আর তার থেকে দূর্বলতা বোন নামক ঈশিতা মেয়েটার তারপ্রতি।মেয়েটাকে রুমে ঢুকতে দেখেই কিছুটা আনন্দিত গলায় নিভান বললো।

‘ঈশু আপু।তুমি কখন এলে?

মেয়েটা মৃদহেসে সামনে এগোতে এগোতে বললো–এই তো কেবলই আসলাম।কেমন আছিস তুই?আমার ব্যস্ত ভাইটা বুঝি এখন আরও ব্যস্ত হয়ে উঠেছে!ইদানীং যে তাকে আর বোনের বাড়িতে দেখা যায়না।

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো?আর তুমি তো জানো,খুব ব্যস্ত না থাকলে কোনো না কোনো এক ফাঁকে আমি তোমার বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।

দুই ভাইবোনের ভালোমন্দ কথা চলতেই থাকলো।তার মধ্যে প্রসঙ্গ পাল্টে নানুমাও যোগ দিলেন।কথার একপর্যায়ে খোলা দরজায় কড়া নড়লো।রুমের সকলের নজর চলে গেলো সেদিকপানে।তবে কড়া নাড়া মানুষটা খেয়াল করলো-না,ভিতরে দু’জন নারী বাদেও একজন পুরুষ পরম আহ্লাদে তার নানুমায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে।অথচ পুরুষটা ঠিকই প্রিয় নারীটাকে খেয়াল করলো।অনুমতি পেতেই চায়ের ট্রে হাতে ভিতরে ঢুকলো কৌড়ি।যতো সামনে এগোলো ততো সাদৃশ্য হলো,একজন নারীর পিছনে আরেকজন নারীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকা পুরুষটাকে।অপ্রস্তুত হলো সর্বাঙ্গ।মূহুর্তেই ভিতরে ভিতরে শিহরে উঠলো তার পেলব শরীর।অকারণেই বুক ঢিপঢিপ করতে লাগলো।পায়ের গতি কমে গেলো।তবে থামলো না।মনেমনে আশ্চর্যও হলো।এতোটা আবেগময় হতে এই মানুষটাকে কখনো দেখিনি।সবসময় গম্ভীর্যরূপে ফর্মাল ড্রেসে শুধু বাড়ির বাহির যেতে আর ঢুকতে দেখেছে সে।এবাড়ির কখনো কারও সাথে হাসিমজা বা এরকম কোনো আবেগঘনো দৃশ্যমান হতে দেখিনি।
মাথা নিচু করে বেডের পাশে এসে চায়ের ট্রেটা বেডের পাশে টেবিলেটায় রাখার আগেই পুরুষালী কন্ঠে হাত কেঁপে উঠলো তার।

‘ট্রে একদম টেবিলের উপর রাখবে-না।ট্রে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে তুমি।

আশ্চর্য হলো উপস্থিত তিন নারীর মধ্যে দু’জন নারী।
আড়ষ্টতায় সামনে দাঁড়ানো সুন্দরী মায়ময় মেয়েটার পানে তো এক একবার নিভানের পানে তাাকালো তারা।
নিভান তো এমন ছেলে নয় তবে এমন কথা কেনো বলছে?আর মেয়েটাই বা কে?খুব সুন্দর মেয়েটা এবাড়িতে আগে কখনো দেখেননি উনারা।তবে কে?যার সাথে এমন আচারন করছে নিভান?আর নিভানতো এমনিতেই মেয়ে দেখলে,নিজের আগ্রহ টোটাল সেখানে খরচ করেনা।সেখানে মেয়েটার সাথে অকারণে এমন ব্যবহার।নিভানের নানুমা খেয়াল করে কৌড়িকে দেখতে থাকলেও,ঈশিতা চুপ থাকলো না।কপাল ক্ষীন কুঁচকে নিভানকে উদ্দেশ্য করে বললো।

‘ও অকারণে কেনো দাঁড়িয়ে থাকবে?আশ্চর্য, তুই ওরসাথে এমন করে কথা বলছিস কেনো?

গম্ভীর গলায় উত্তর দিলো নিভান।–‘দোষ করেছে তাই।

‘মানেটা কি?ও দোষ করলো কখন?ও হয়তো কার-ও আদেশে চা দিতে এসেছে।এখানে দোষের কোথায়?

নিভান কথা বললো না।শান্ত নজরে শুধু কৌড়ির অপ্রস্তুত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো সে।কাল কতো করে বললো,অল্প সময়ের জন্য হলেও তারসাথে যেনো দেখা করে।অবশ্যই দেখা করে।কিন্তু ফাজিল মেয়েটা,এরপর আর টোটাল দেখাই দিলো-না তাঁকে।
নিভান নিজেকে কিভাবে শান্ত রেখেছিলো, সেটা শুধু সেই জানে।নানুমা খুব খেয়াল করে নিভানকে দেখলেন।বয়োবৃদ্ধ নজরে যেনো বুঝে নিতে পারলেন নাতীর মনের কথা।ফের কৌড়ির সুশ্রী মুখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসলেন।মজার ছলে বললেন।

‘নিশ্চয় দোষ করছে মেয়েটা।না-হলে আমার নানুভাই অকারনে কাওকে শাস্তি দেওয়ার মতো ছেলে তো নয়।

অপ্রস্তুত হলো আরও কৌড়ি।মানুষটা এখানে আছে জানলে জীবনেও এই রুমের আশেপাশেও আসতোনা।এখন বের হতে পারলেই বাচে।কোনোমতে প্রসঙ্গ এড়াতে স্বভাবমতো নরম কন্ঠে বললো–বড়মা,নানুমার জন্য চা পাঠিয়েছেন।তাই আমি দিতে এসেছি।

ঈশিতা তড়িৎ করে বললো –এখানে দোষের কি করলো ও,যে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।আর দাদুমা তুমি ওর হয়ে কথা বলছো!এই তোমার নাম কি?

‘কৌড়ি।

‘আচ্ছা কৌড়ি,তুমি চা রেখে যাও।

সময় নিলো না কৌড়ি।নাম জানা গোলুমোলু দেখতে সুন্দর মেয়েটাকে মনেমনে অসংখ্য ধন্যবাদ দিয়ে চায়ের ট্রেটা রেখে চলে গেলো সে।সেদিকপানে তাকিয়ে নানুমা নিভানের কানের কাছে মুখ নিয়ে উৎফুল্ল কন্ঠে বললেন—ওই সুন্দর দেখতে ফুলকৌড়িটাই আমার নাতবৌ তাহলে?

মৃদু হেসে নিভানও ফিসফিসিয়ে বললো–কোনো,পছন্দ হয়নি?

‘ভিষন পছন্দ হয়েছে।আমার নাতীর একবারে যোগ্য নাতবৌ।

নানুমার কথার উত্তর সরূপ অমায়িক হেসে দিলো নিভান।তবে মনেমনে আওড়ালো-সে যোগ্য কি অযোগ্য জানিনা আর জানতে চাইওনা আমি।তবে ওই মায়াহরিনী ফুলকৌড়িটাকেই তোমার নাতীর চাই।

চলবে…

ফুলকৌড়ি পর্ব-২৪+২৫

0

#ফুলকৌড়ি
(২৪)কপি করা নিষিদ্ধ।
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

অফিস বের হচ্ছিলো নিভান।হঠাৎ জাহিদ সাহেবের ডাক পড়ায় চলে গেলো উনার রুমে।দরজার নক করতেই ভিতরে ঢুকতে বললেন তিনি।অসুস্থ শরীর নিয়ে সবসময়ের নিয়মানুবর্তিতা অনুযায়ী বেডে হেলান দিয়ে বসে আছেন।হাতে একটা ইসলামিক বই।নিভানকে আসতে দেখেই বইটা বুকমার্ক করে রেখে দিয়ে নিভানকে উনার পাশে বসতে বললেন।বাধ্য ছেলের মতো বসলো নিভান।নিভান বসতেই রয়েসয়ে তিনি বললেন।

‘কালরাতে নওশাদ সাহেব ফোন দিয়েছিলেন?

‘উনার সাথে তো অফিসিয়াল সকল কথাবার্তা কমপ্লিট হয়ে গেছে।এরপর সমস্ত অফিসিয়ালি সুবিধা অসুবিধা তো আমার সাথেই মিটানোর কথা।আপনাকে কিজন্য ফোন দিলো?

‘অফিসিয়াল কোনো কথাবার্তা বলার জন্য উনি ফোন দেননি।ব্যাক্তিগত কথা বলার জন্য ফোন দিয়েছিলেন।

ভিতরে ভিতরে একটু চমকালো নিভান।সেদিন নওশাদ সাহেবের ছেলে বিহানের বিহেভিয়ার সম্পর্কে স্মরণ হতেই মনটা আরও উচাটন করে উঠলো।কোনোভাবে কি কৌড়ির বিষয়ে বলেছেন উনারা।মন মস্তিষ্কে মধ্যে বিভিন্ন ভাবনা চললে-ও নিজের বহিঃপ্রকাশ স্বভাবিক রাখলো।বললো– ব্যাক্তিগত!কি বলতে চাইছেন উনি?

‘উনার একমাত্র ছেলে বিহানের জন্য মান্যতার হাত মেনেছেন।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো নিভান।ফের নিজের জায়গায় তৃনয়কে ভাবতেই বললো–আপনি কি বলেছেন?

‘আমি উনাদের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে কোানো সিদ্ধান্ত জানাইনি।তুমি তো ভালো করেই জানো,আমার সকল সিদ্ধান্ত তোমার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে।তুমি হ্যা বললে তবেই আমি সেটাতে মতামত প্রকাশ করি,না বললে নয়।উনারা প্রস্তাব রেখেছেন,আমি শুনেছি।আর আমার সিদ্ধান্ত সরূপ বলেছি,আমি আমার পরিবারের সিদ্ধান্ত ছাড়া তাদেরকে হ্যা বা না কোনো মতামত দিতে পারবো-না।এমনকি আমার মেয়ের মতামতটা-ও জরুরি।আর তার থেকেও তোমার মতামতটা বিশেষ।আমার মনেহয় তুমি মান্যতার বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত নিবে,মান্য তা কখনোই অমত পোষন করবে বলে মনে হয়না।এখন তুমি বলো আমার সিদ্ধান্ত কি নেওয়া উচিত।উনাদের ফ্যামিলি ব্যাকগাউন্ড বা ছেলে সবদিক দিয়েই তো বেশ ভালো।খোঁজখবরও না-হয় নেওয়া যাবে।তোমার কি মতামত?

‘আপনি না বলে দিন।

জাহিদ সাহেবের কথাগুলো শুনতে শুনতে মূহুর্তেই সেদিনের বিহানের নজরভঙ্গির দৃশ্যটা মনে পড়ে গেলো নিভানের।সেই দৃষ্টিতে লালসা বা কোনো কুরুচিপূর্ণ দৃষ্টিভাব ছিলোনা।তবে মুগ্ধতা ছিলো সীমাহীন।আর সেই মুগ্ধ হওয়া দৃষ্টির মালিকের মনে,সেই সৌন্দর্যমীয়কে নিয়ে ঠিক কি কি ভাবনা গড়াতে পারে, তা নিয়েই সেদিন অযথা ক্ষিপ্ত হয়েছিলো নিভান।আর সেই পুরুষটা হবে তার বোনের পুরো জীবনের জীবনসঙ্গী।কখনো না।আর তারথেকে মুল বিষয় হচ্ছে, তৃনয়।বন্ধুত্বের মর্যাদা রাখার জন্য,বন্ধুর বোনকে পছন্দ করা সত্ত্বেও কখনো তা প্রকাশ করেনি।মান্যতার সাথে সম্পর্ক গড়ার থেকে,বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রাখাটা তারকাছে বিশেষ মনে হয়েছে।বিধায় সেই অনুযায়ী, নিজের অনুভূতি ভিতরে চাপা দিয়ে এতোটা বছর চলে এসেছে।অথচ মান্যতাকে পাওয়ার কতো আকুলতা কতো প্রয়াস ছেলেটার।যা ক্ষনে ক্ষনে টের পেয়েছে নিভান।মান্যতাকে দেখলেই তৃনয়ের হাসফাস।নজর এড়িয়ে ঘুরেফিরে সেই মান্যতার মুখটাতেই মুগ্ধ চাহুনীতে তাকানো।মান্যতার কোনো বিষয়ে কখনো কথা হলে খেয়ালী হয়ে তার কথা শোনা।নিজের ব্রাইড লাইফ ছেড়ে দেশে চলে আসা।যা সবকিছু বুঝেছে তৃনয়ের এলোমেলো কথাকাজে আর আচারনে। তখন সেসব বুঝলে-ও বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি নিভান।তবে এখন গুরুত্ব দিতে হচ্ছে।কারন,নিজেরও যে একই দশা।
পছন্দের নারীকে ক্ষনে ক্ষনে দেখার তীব্রতা,নিজের করে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা,সর্বাবস্থায় তাকে কাছে রাখার ইচ্ছেটুকু কিভাবে ভিতরে কুঁড়ে কুঁড়ে জ্বালায়।আর তাকে না পাওয়ার ভাবনা।উফফ…সেই ভাবনাটা আর ভাবতে চায়না নিভান।যদিও তৃনয় আর মান্যতার বিষয়টা আলাদাভাবে ভেবে রেখেছিলো সে।তৃনয় চাকরী পেলেই,জাহিদ সাহেবের কাছে মান্যতাকে নিয়ে তৃনয়ের বিষয়টা তুলে ধরবে।তবে তার আগেই যখন কথা উঠলো,তখন বিষয়টা নিয়ে কথা বলাই সমীচীন।

‘আচ্ছা ঠিক আছে,আমি তাদের না বলে দেবো।তবে না বলার কারনটা কি আমি জানতে পারি নিভান?

‘আপনার তৃনয়কে কেমন লাগে?

হঠাৎ তৃনয়ের বিষয় উঠায় বিশেষভাবে বুঝতে পারলেন না জাহিদ সাহেব,নিভান ঠিক কি বলতে চাইছে।তবুও তিনি বললেন–ছেলেটাকে তো সেই কবে থেকেই দেখে আসছি।সবদিক থেকে তো বেশ ভালোই।পড়াশোনায়ও তো বেশ ভালো ছিলো।বাহিরের দেশ থেকে এমবিএ ও করে এসেছে।যদি-ও বাহিরের দেশে তার ব্রাইড লাইফ ছিলো,তবে দেশে এসে ব্যবসায় নেমেছে।এটাও তো বেশ ভালো।তা হঠাৎ তাঁকে নিয়ে জিজ্ঞেস করছো যে?

‘মান্যর জন্য কোনোভাবে তৃনয়কে কি আপনার অযোগ্য বলে মনেহয়?

একটু আশ্চর্য হলেন জাহিদ সাহেব।নিভানের কথার হাবভাব দেখেই যেনো কিছুটা আচ্ করতে পারছিলেন তিনি।মনের মধ্যে তৃনয়কে নিয়ে দোনোমোনো করছিল।আর সেটাই বললো নিভান।তবে সবদিক ভেবে বললো কি নিভান?নাকি বিষয়টা অন্যকিছু?মান্যতা বা তৃনয়ের মধ্যে কোনোপ্রকার সম্পর্ক তৈরী হয়নি তো?না তেমন আচার ব্যবহার তো মেয়েটার মধ্যে লক্ষ্য করেছেন বলে মনে হয়না উনার আর না ছেলেটার আচারনে।আর সেরকম আচারবিধি যদি বাড়ির মেয়ের মধ্যে লক্ষ্য করলে,বাড়ির আর কেউ গলা চড়িয়ে না বললেও,উনার বোন মুখে কুলুপ এঁটে থাকার মতো মেয়ে নন।তবে কি কারনে নিভান কেনো এমন প্রস্তাব রাখলো?নাকি নিজে থেকেই তৃনয়কে মান্যতার জন্য চয়েজ করছে তাই বলছে?তিনি বললেন—অযোগ্য বলে মনে হবে কেনো!
অপছন্দ হওয়ার মতো ছেলেতো সে নয়।তবে তুমি যখন তার হয়ে প্রস্তাব রাখছো,তখন নিশ্চয় তোমার বোনের ভবিষ্যৎ ভেবেচিন্তে।কিন্তু তৃনয়ের তো একটা পছন্দ অপছন্দতা আছে।তুমি-যে তাকে তোমার বোনের জন্য পছন্দ করে রেখেছো, এটা কি সে জানে?আমরা মেয়ে পক্ষের গার্ডিয়ান হয়ে তো আর নিজের মেয়েকে তাদের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব রাখতে পারিনা।আগ্রহটা তো তাদের দেখাতে হবে।

জাহিদ সাহেব খোলাখুলি প্রশ্ন না করলেও উনার কথা দ্বারা মুলত কি বোঝাতে চাইছেন সেটা বেশ বুঝলো নিভান।উনি মুলত তৃনয়ের মনোভাবটা বুঝতে জানতে চাইছেন।তৃনয় উনার মেয়ের প্রতি আগ্রহী কি-না?বা উনার কথায় এটাও স্পষ্ট, তৃনয় যদি মান্যতাতে আগ্রহী হয়ে না থাকে তবে নিভান কেনো আগ্রহী হয়ে তার হয়ে প্রস্তাব রাখছে?আর বিহান বা তৃনয়ের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মনেমনে তিনি হয়তো যোগ্য পাত্র হিসাবে বিহানকেই এগিয়ে দেখছেন।ছেলেমেয়ে বিয়ে দিতে গেলে হয়তোবা বাবা মায়ের নজরভঙ্গি অন্য রকম হয়ে যায়।যেখানে উনাদের ছেলেমেয়ে খুব ভালো থাকবে,খুব সুখে থাকবে।সেই জায়গাটাকেই যোগ্য মনে করেন।হয়তো জাহিদ সাহেবের কাছে সেটাই মনেহচ্ছে,সবদিক থেকে বিহান যোগ্য পাত্র।তবে কেনো তাকে রিজেক্ট করে তৃনয়কে পছন্দ করতে চাইছে নিভান।যেখানে তৃনয়ের মধ্যে সেরকম হাবভাব তিনি টের পাননি।বস্তুত,সেই ছেলে কখনো উনার মেয়ের হয়ে প্রস্তাব রাখেনি।নিভানও সময় নিয়ে বললো।

‘আমার জানা চেনামতে তৃনয় বিশ্বাস এবং ভরসাযোগ্য ছেলে।যেটা আমি-ও জানি,আপনি-ও হয়তো জানেন।নওশাদ চৌধুরীর বা এতোদিন যারা মান্যতার বিয়ের জন্য প্রপোজাল দিয়ে এসেছে,তাদের মতো হয়তো বিত্তশালী পরিবার বা নাম-ডাক তার নেই।তবে যেটুকু আছে আমার বোনকে যথেষ্ঠ সুখে এবং ভালো রাখার যোগ্যতা।আমার বিশ্বাস রাখতে পারবে সে।আর আমার এটাও বিশ্বাস,মান্যতাকে সেভাবে গুছিয়ে রাখার প্রয়াসও সে করবে।একটা দুটো বছর নয়,বিগত আট নয়টা বছর মতো তারসাথে বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক আমার।তার সবদিক বিবেচনা করেই তারপর আপনার কাছে তার হয়ে প্রস্তাব রেখেছি আমি।আর নিজে-ও সিদ্ধান্ত নিয়েছি,মান্যতার জীবনসঙ্গিনী হিসাবে তৃনয়কে।দ্বিতীয়ত আপনি যেটা নিয়ে ভয় পাচ্ছেন,সেটা বলতে আমার দ্বিধা নেই।তৃনয় মান্যতাকে পছন্দ করে।সেটা আমাদের বন্ধুত্বের কারনে হোক বা নিজের সীমার গন্ডি বজায় রাখার জন্য,কখনো তা প্রকাশ করিনি।তবে আমি তার প্রতিটা পদক্ষেপ লক্ষ্য করে এটুকু বুঝেছি।
মান্যতা তৃনয়ের কাছে ভালো থাকবে।ভালো রাখবে সে আমার বোনকে।সেখানে চারিত্রিক বিষয় বা অন্যন্য সবদিক থেকেই তাকে মান্যতার যোগ্য বলে মনে হয়েছে আমার।তবে এখানে আপনার বা মান্যতার মতামত-ও গুরুত্বপূর্ণ।আপনি আমার সিদ্ধান্ত জানতে চেয়েছেন আমি খোলামেলা জানিয়ে দিয়েছি।এবার আপনি সিদ্ধান্ত নিন,আপনি মেয়ের বাবা হিসাবে ঠিক কি সিদ্ধান্তে এগোবেন।আমার মনেহয় তৃনয় এতোদিন নিজের ভালোলাগাটা মনের মধ্যে চেপে চুপচাপ থাকলে-ও তন্ময়ীর বিয়ের পর,সে একবার হলে-ও নিজের পছন্দের কথা ভেবে আমাদের কাছে প্রস্তাব রাখবে।আপতত ততোসময় পর্যন্ত আমি চুপ থাকছি বা থাকতে চাইছি।আমি নিজেও চাইছি সে নিজ থেকে প্রস্তাব রাখুক আমাদের কাছে।এখন আপনি সবদিকে ভেবে দেখুন তাকে মেয়ে দেওয়া যায় কি-না।

‘এখানে ভাবাভাবির কিছু নেই।যেখানে তুমি ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছো।সেখানে আমার না করার প্রশ্নই আসে না।আমি বরাবরই তোমার সিদ্ধান্তে বিশ্বাস রাখি,ভরসা করি।সেখানে তোমার সিদ্ধান্ত দ্বারা মান্যতার ভবিষ্যত খারাপ হতে পারে,এটা কখনোই আমি ভাবতে পারি-না।তবে একটাই আশা রাখছি,তৃনয় নিজে প্রস্তাব রাখবে।না হলে আমি এটাও আশা রাখছি তোমার সিদ্ধান্তও না হবে।

‘হুমম।আমি-ও সেটার অপেক্ষায় আছি।

আরও কিছুসময় কথা বলে উঠে দাঁড়ালো নিভান।জাহিদ সাহেব-ও নিজের কাজে মনোবেশিত করলেন।

চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বসে আছে নিভান।চোখ বন্ধ রেখে গভীরভাবে কিছু ভেবে চলেছে সে।ভাবনার বিষয়বস্তু কৌড়ি।মেয়েটাকে যতোটা সহজ সরল ভেবেছিলো,মেয়েটা ততোটা সহজ নয়।হ্যাঁ,শান্তশিষ্টতা ঠিক আছে।তবে একেবারেই নরম মনের নয়।ওই কাজলকালো চোখে চোখ রেখে সেটা বুঝতে পেরেছে নিভান।মেয়েটা তার চালচলনেও কিছুটা বুঝিয়ে দিয়েছে তা।শান্তশিষ্ট, নম্রতা তার বাহিরের রূপ, ভিতরে সে শক্তপোক্ত এক কঠিন মনের মানবী।যাকে নিজের প্রতি দূর্বল হওয়াটা সহজ হবে বলে মনে করছেনা সে। আর ওই মানবীকে নিজের প্রতি দূর্বল করা যতোটা সহজ ভেবেছিলো ততোটাও সহজ হবে-না।আত্নকেন্দ্রীক ওই মানবী,বাধ্য হয়ে এ-বাড়িতে থাকলেও,নিজের সীমাবদ্ধতা বজায় রেখে চলছে।এটা সে অল্পস্বল্প মায়ের মুখ থেকে শুনেছে,জেনেছে।চাওয়া পাওয়া, ইচ্ছে আকাঙ্ক্ষা,চলনবলনে,সবকিছুতেই নাকি মেপে মেপে চলা তার।ছোট্টো একটা মেয়ে অথচ নিজের সীমাবদ্ধতা বজায় রেখে মেপে মেপে তার প্রিয় ব্যক্তিদের দেওয়া ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী চলেছে, মানা যায়!এতোটা বাধ্য হয়ে এখানকার যুগের মেয়েরা চলে!নাকি চলতে চায়?মৃদু হাসলো নিভান।মনেমনে আওড়ালো-তোমার শান্তশিষ্টতার পরপরই বাধ্যতা আর নিজকে সংবরণ করে রাখা,আমাকে তোমার প্রতি আরও আকৃষ্ট করেছে,আমার মায়াহরিণী যাদুময়ী।আর সেই আকৃষ্টতার অনুভূতি জানান দেয়,তুমি শুধু আমারই হবে কাশফিয়া আহসান কৌড়ি।শুধুই নিভানের।যেখানে নিভানের হৃদয়ে চাপা দেওয়া কঠিন পথরটা তুমি চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়ে নিজে ঘাঁটি পেতে শক্তপোক্তভাবে জায়গা করে নিয়ে বসেছো,সেখানে তো তুমি বাধ্য নিভানের হতে।এখন সে তুমি যতোই কঠিন মনের হওয়া কেনো,আর নিজেকে যতোই পরপর ভেবে সংবরণ করে নিজের সীমাবদ্ধের মধ্যে আঁটকে রাখো না কেনো!তুমি তো নিভানেরই।

দরজায় কড়া পড়তেই,চোখ মেলে সোজা হয়ে বসলো নিভান।সামনে তাকিয়ে দেখলো তৃনয় এসেছে।ফের গা এলিয়ে দিলো চেয়ারে।ভিতরে ঢুকলো তৃনয়।মৃদু হেসে গান ধরলো।

‘পৃথিবীতে সুখে বলে যদি কিছু থেকে থাকে তার নাম ভালোবাসা,তারই নাম প্রেম।

চেয়ারে শরীর এলোনো ভঙ্গিতেই কপাল কুঁচকে তৃনয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নিভান বললো।–তোর আবার ইভানের রোগে পেলো কবে থেকে?

চমৎকার হাসলো তৃনয়।চেয়ারে বসতে বসতে মজার গলায় বললো—যেদিন থেকে ইভানের ভাইয়ের মতো আমার বন্ধুটাও প্রেমে পড়েছে সেদিন থেকেই আমার বন্ধুটাকে দেখলেই সময় অসময়ে বসন্ত ঋতুটা ভর করছে আমার কন্ঠে।তা আমার বন্ধুটার প্রাণপাখিটার খবর কি?

শান্ত চোখে তৃনয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো নিভান।তৃনয়ের কথার উত্তর দেওয়ার বিশেষ প্রয়োজনবোধ করলো-না।সময় নিয়ে বললো—সন্ধ্যায় তন্ময়ীর গায়ে হলুদ তুই এখন এখানে কি করছিস?

‘ওদিকে আপতত আজকের অনুষ্ঠানের সবকিছু কমপ্লিট।আর কিছু কাজে শপিংয়ে এসেছিলাম,সেটাও আপতত শেষ।বাড়িতে যা মানুষের মেলা,মাইন্ড ঠান্ডা রাখার জন্য মনে করলাম তোর এখান থেকে একটু ঘুরে যাই।তাই চলে এলাম।কেনো,ডিস্টার্ব করলাম নাকি?

‘তোর মনেহচ্ছে আমি ডিস্টার্ব হয়েছি?

‘তুই ডিস্টার্ব হোস-নি।তবে তোর মন মস্তিকের অলিগলিতে যে চলছিলো তাকে তো ডিস্টার্ব করে দিলাম।

দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিভান।তৃনয়ের মজার ছলে বলা কথাটার ফিরতি উত্তর দিলো না।দেওয়াটা সে মোটেই প্রয়োজন অনুভব করলো না।যেদিন থেকে কৌড়ির প্রতি তার দূর্বলতা টের পেয়েছে তৃনয়।সেদিন থেকেই ইভানের মতো সে-ও কৌড়িকে নিয়ে পিছু লেগে আছে।
পাত্তা দিলে অসভ্যগুলো আরও পিছু লেগে থাকবে। তাই আপতত পাত্তা দিতে চাইছেনা সে।নিভানকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে ফের মজা করে তৃনয় বললো।

‘বল,সে অলটাইম তোর মাথার মধ্যে ঘুরছে কি-না?

‘মাথার মধ্যে ঘুরুক আর নাই ঘুরুক।সে এমনিতেই আমার।আর যে আমার,সে তো আমার মনমস্তিকের সর্বক্ষণের সঙ্গী।তাকে আবার আলাদাভাবে ভাবার বা মাথার মধ্যে ঘোরার কি আছে!

দুষ্ট হাসলো তৃনয়।বললো-ক্যা বাত হে,আমাদের নিভান সাহেব তো পুরোদস্তুর প্রেমে পিছিল গায়া।দেরী করছিস কেনো? বিয়ে করে নে।

চেয়ারে হেলান দেওয়া অবস্থায় চোখ বন্ধ করে নিলো নিভান।ফের নির্বিকার কন্ঠে বললো–দুনিয়াটা দেখা’র একটু সুযোগ করে দেই।দেখুক দুনিয়া,চারপাশটা নজর খুলে দেখুক,বুঝুক।বুঝুক আমাকেও।তার কখনো যেনো না মনে হয়,সে আমার থেকে-ও বেটার কাওকে পেতো।যদিও পাওয়ার মতো মেয়ে সে,তবুও যেনো মনে নাহয় ।অন্তত আমাকে বোঝার জন্য তাকে অবাধ চলাফেরার সুযোগটা তাকে আমি দিতে চাই।

‘তুই কি তাকে দীবার মতো ভাবছিস নিভান?কৌড়িকে কিন্তু আমার তেমনটা কখনোই মনে হয়-নি বা হয়ও না।

চোখ বুঁজে থাকা অবস্থায় নির্বিকার গলায় ফের বললো নিভান।

‘কখনো না।দীবা আর সে,দু’জনেই সবদিক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।আমি কখনোই তাকে দীবার সাথে তুলনা করে ছোটো করে দেখতে চাইনা।আর ও সেরকমও নয়।যদি ও সেরকম হতো,তবে কখনোই নিভান তারপ্রতি দূর্বল হয়ে পড়তো না।ও আমাকে তারপ্রতি দূর্বল করেছে!তুই ভাবতে পারছিস?নিভানকে ওর প্রতি দূর্বল করে ফেলেছে।আর তাকে দীবার সাথে তুলনা করলে নিজেকেই যে ছোটো করা হয়ে যায়!তুচ্ছ দেখানো হয়!সেই নিজেকে এতোটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে দেখি কি করে!যাই হোক,ওর সম্পর্কে ধারণা আমার নিজের মতো,অন্যরকম।আর সবচেয়ে বড়কথা দীবা ম্যাচুউর ছিলো।তবুও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছে।সেই তুলনায় বয়সটা ওর নিতান্তই কম।এরকম বয়সে ছেলেমেয়েরা আবেগে ভাসে-ডোবে।সেই আবেগের সিদ্ধান্তটা যেনো আমি না হই ওর।আমাকে চাইতে হবে ওর মনেপ্রাণে।আর কিচ্ছু চাইনা,শুধু এটুকু চাই ওর থেকে আমি।শুধু ওটুকুই চাই, ও আমাকে মনেপ্রাণে চাক।আমার মতো করে আমাকে ছাড়া ও আর দ্বিতীয় কোনো পুরুষকে না বুঝুক, না ভাবুক আর না চাক।

‘তবে কি তুই ওর সিদ্ধান্তকে নিজের অনুভূতির থেকেও প্রায়োরিটি দিতে চাইছিস?

‘দেওয়াটা উচিত নয় কি?নিভানের জীবনে প্রথম কোনো মেয়ের প্রতি দূর্বল অনুভব করেছে সে।তার প্রতি কি একটু ভরসা বিশ্বাস রেখে দেখা উচিত নয়কি?সেই সময়টা পর্যন্ত না-হয় আমি আমার মতো করে ওকে আগলে রাখার চেষ্টা করলাম।অমূল্য কিছু পেতে গেলে তো ধৈর্য্য ধরতেই হবে।সেই জিনিসটার প্রতি অটুট বিশ্বাস ভরসা রাখতে হবে।আর ওর প্রতি কেনো জানি না,সেই ভরসা বিশ্বাসটা আমার আপন ইচ্ছেতেই জন্মে গেছে।কেনো জানি মনেহয়,ও আমার ভরসা বিশ্বাস কখনোই ভঙ্গ করবেনা।ও আমারই হবে।আর যদি না হয় তবে,সেই সময়টা পর্যন্ত না-হয় আমি আমার মতো করেই ওকে আগলে রাখলাম।তবে কেনো জানি মন বলে,ও আমারই হবে।শুধু নিভানের।

তৃনয় অবাক হয়ে দেখলো, চেয়ারে গা এলিয়ে রাখা শ্যামবরণ পুরুষটাকে।গায়ের রঙটা শ্যামবরন হলে কি হবে তাকে সুদর্শন সুপুরুষই বলা যায়।লম্বা চওড়া গড়নের গম্ভীর ব্যাক্তিত্বপূর্ন ছেলেটা,কলেজ ভার্সিটি লেবেলে কখনো কোনো মেয়ের সাথে সম্পর্ক তো দূর, কথা অব্ধি সেভাবে মেয়েদের সাথে বলতোনা।অথচ এই পুরুষটাতেই মেয়েরা ফিদা ছিলো।তবে সে বিষয়ে কখনো গুরুত্ব দেয় নি নিভান।যাকে রিজেক্ট করে দীবা-ও এখন পস্তাচ্ছে।সেই কাটাকাট আদলের ব্যক্তিত্বপূর্ন পুরুষটা ফেঁসে গিয়েছে এক বাচ্চা মেয়েতে।তার গলার স্বর বলে দিচ্ছে,সে কোন লেভেলের দূর্বলতা অনুভব করে মেয়েটাতে।নিজে চোখে দেখেছে-ও তৃনয়।সেদিন ছেলেগুলোকে যেভাবে মারলো।উফফ, জান নিয়ে টানাটানি অবস্থা হয়ে গিয়েছিলো।ছেলেগুলো হয়তো এখনো হাসপাতালে।অথচ এতো বাড়াবাড়ি করতে কখনো দেখিনি নিভানকে। না নিজের অনুভূতিগুলো এতো খোলামেলা ভাবে ব্যক্ত করতে শুনেছে।সেই ছেলে ওই মেয়েটাতে এতোটা দূর্বল অনুভাবিত হয়েছে,যে নিজের অনুরক্তিগুলো মনের মধ্যে আর চাপিয়ে রাখতে পারলোনা।কাওকে মন থেকে নিজের করে চাওয়ার অনুভূতির তীব্রতা হয়তো এমনই।তবে সে কেনো পারছে না ব্যক্ত করতে।তবে কি তার চাওয়ায় খামতি আছে?হয়তোবা!তৃনয়ের ভাবনার মাঝে,চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলো নিভান।তৃনয়কে গভীর ভাবতে দেখে সময় নিয়ে বললো

‘ নওশাদ চৌধুরী,মান্যতাকে উনার ছেলের বউ করার জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন।এতোদিন অনেক প্রস্তাব এসেছে,নাকচ করে দিয়েছেন।এবারেরটা আর ফিরিয়ে দিতে চাইছেন-না।আমার কাছে মতামত চেয়েছেন উনি।কি করা যায় বলতো?

ছলাৎ করে উঠলো তৃনয়ের ভিতরটা।তোলপাড় শুরু হলো হৃদপিণ্ডে।এই চুপিচুপি ভালোবাসার যন্ত্রণা এতো দিন তাকে কষ্ট দিলেও, এতোটা ব্যথা অনুভব করায়নি।কি বলছে নিভান!মান্যতার বিয়ে!মেয়েটা অন্য কারও হয়ে যাবে?তা কি-করে সম্ভব!সহ্য করবে কি-করে সে?বুকে ব্যথা নিয়ে ধীরকন্ঠে জিজ্ঞেস করলো সে।

‘এতো তাড়াতাড়ি কেনো?

তৃনয়ের মুখের দিকে দৃঢ় নজর ফেলে নিভান বললো–
‘এতো তাড়াতাড়ি কোথায়?তন্ময়ী আর মান্যতাতো সেম ইয়ার।তন্ময়ীর এত তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যেতে পারলে, মান্যতার কেনো হতে পারবে-না।

‘হুম।তা তো ঠিক।তবুও ওর পড়াশোনা কমপ্লিট হওয়ার পর তো বিয়ের ভাবনাটা ভাবতে পারতিস?

‘এখন তো আর সেই যুগ নেই।যে পড়াশোনা অবস্থায় মেয়েকে বিয়ে দিলে,ওখানেই সেই মেয়ের পড়াশোনাটা শেষ হয়ে যাবে।শ্বশুর-বাড়ী থেকে আর পড়াশোনা করতে দেওয়া হবে-না।সুতারাং ভালো প্রস্তাব হাতছাড়া করে লাভ আছে কি!

কথার বাহানা দেওয়ার জন্য আর কোনো শব্দ খুঁজে পেলো-না তৃনয়।ভিতরে ভিতরে হাস-ফাস করে উঠলো বক্ষস্থল।বলবে কি নিভানকে যে,তোর বোনটা আমাকে দিয়ে দে।আমি তাকে,তোর বাবা আর তোদের চেয়ে-ও খুব যত্নে আমার কাছে গুচ্ছিত রাখবো।খুব ভালোবেসে আগলে রেখে দেবো আমার কাছে।পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাসা কুড়িয়ে এনে হাজির করবো তার পায়ের কাছে।তাকে দিয়ে দে না নিভান আমাকে।আমার বুকটা খালি হতে দিসনা নিভান।বুকের বা পাশটায় তোর বোনটা না থাকলে যে আমি আর আমি থাকবো না নিভান।আমি তৃনয় অর্থহীন হয়ে যাবো।

তৃনয়ের ভিতরের ছটফটানিটা জেনো মুখাবয়বে হালকা হলেও অনুভব করতে পারলো নিভান।নিজেও যে সেই একই জ্বালায় ভুক্তভোগী।তবে কেনো বুঝবেনা অন্যের ভিতরের জ্বালা।বেদনা!আর তৃনয়কে যে সাহস নিয়ে বলতেই হবে। না হলে তাকে যে হারাতে নিজের একান্ত চাওয়া পাওয়াটা।হারাতেই হবে।

ধরণীতে সন্ধ্যা নামনাম ভাব।সূর্যটা কমলা রঙের আভা ধারন করে প্রায় ডুবুডুবু অঙ্গসাজ।সেই সময়টাতে নিভানের গাড়ীটা বাড়ির পার্কিং এরিয়ায় এসে থামলো। এই সময়টাতে কখনো বাড়িতে আসেনা নিভান।আজ আসার কারন,তন্ময়ীর গায়ে হলুদ।সেখানে যেতে হবে তাই।যদিও অফিস থেকেই যতো পারতো সে।তবে বিভিন্ন তথ্যসূত্রে সে জানতে পেরেছে,তাহার যাদুময়ী মায়াহরিনীটা সেখানে যায়নি।ম্যাডামের নাকি কোনো কারনে প্রচন্ড শরীর খারাপ।বিধায় বাড়ির সবাই তন্ময়ীর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলেও,তিনি যাননি।কি কারনে শরীর খারাপ তথ্যটা ঠিকঠাক পায়নি নিভান।তবে এটুকু তথ্য পেয়েছে,মেয়েটার প্রচন্ড পেটব্যথা এবং হাতপায়ের যন্ত্রণায় কাতর সে।তাই যেতে চায়নি নিজেই।কিন্তু মেয়েটা ছাড়া ওখানে নিজে কি-করে কাটাবে।আর দ্বিতীয়ত অসুস্থ মেয়েটাকে দেখার তীব্র বাসনা জেগেছে মনে।তাই সরাসরি অনুষ্ঠানে না গিয়ে বাড়িতে এসেছে সে।গাড়ী থেকে নেমে ডোরবেল বাজাতেই রানী দরজা খুলে দিলো।ভিতরে প্রবেশ করতেই স্বাভাবিক গলায় নিভান শুধালো।

”কৌড়ি কোথায়,রানিসাহেবা?

কৌড়ির খোঁজ নেওয়াতে একটু আশ্চর্য হলো রানী।তবে সেটা প্রকাশ না করে,সে-ও স্বাভাবিক গলায় বললো–নিজের রুমে শুয়ে আছে।

“ও-কে বলুন রেডি হয়ে নিতে।আর আপনিও রেডি হয়ে নিন।আমারা এখন তন্ময়ীর হলুদ অনুষ্ঠানে যাবো।

‘মেয়েটার তো শরীর খারাপ বাবা!ও যাবে কি-করে?

‘শরীর কি বেশী খারাপ লাগছে?তাহলে তো ডাক্তারের কাছে যাওয়া প্রয়োজন।হয়েছে কি ওর?আর মা জেনেশুনে ওভাবে ও-কে একা রেখে গেলেন কেনো?

নিভানের উদ্বিগ্নতা নজরে পড়তেই দ্বিধায় পড়ে গেলো রানী।কি বলবে সে?মেয়েটার পিরিয়ডের ব্যথা চলছে।আর সেকারণেই অসুস্থ সে।যারকারনে এই অসুস্থ শরীরটা নিয়ে কোনোনতে সে তন্ময়ীর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যেতে রাজি হয়নি।মান্যতা মৌনতা তাকে কত জোর করলো, তবুও মেয়েটা রাজী হয়নি।এমনকি তারা নিজেরাও যেতে চাইছিলোনা।শেষমেশ তার অসুবিধার কথা জানিয়ে তাদেরকে পাঠানো হয়েছে।আর নীহারিকা বেগম,তিনিও তো মেয়েটাকে এই অবস্থায় রেখে যেতে চাননি।তবে তিনি না গেলেই নন।তাই সবকিছু বিবেচনা করে,রানীকে-সহ কৌড়িকে রেখে যেতে রাজী হয়েছেন।আর এটাও বলে গিয়েছেন—মেয়েটা একটু সুস্থতাবোধ করলে তাকে জেনো জানানো হয়।হাফিজকে পাঠিয়ে দেবেন,হাফিজ এসে নিয়ে যাবে তাদেরকে।মেয়েটা এখন কিছুটা সুস্থতাবোধ করছে তবে কিছুতেই সেখানে যেতে রাজি নয়।

‘রানীসাহেবা।

সহসা নিভানের ডাকে চমকে গেলেন তিনি।বললেন–সকাল থেকেই মেয়েটার শরীর খারাপ লাগছিলো।তবে এখন ভালো আছে।আর তার তেমন কিছু হয়নি,এই এমনিতেই একটু পেটব্যথা করছে।

‘ব্যথার কোনো ঔষধ খায়নি?

নিভানের এতো খুঁজিনামা দেখে ভিতরে ভিতরে আশ্চর্য হলো রানী।তবে সহসা উত্তর দিলেন–খেয়েছে তো।এখন আপতত ঠিক আছে।

রানীর সংকোচময় উত্তর দেওয়া দেখে মনেমনে কেমন একটা অনুভব হলো নিভানের।সাধারনত কোনো অসুস্থতা হলে তাকে তো খোলামেলা বলার কথা যে, মেয়েটার এই কারনে এই অসুস্থতা বোধ করছে বা অসুবিধা হচ্ছে।তবে কৌড়িকে নিয়ে রানীর কথাগুলো কেমন এড়ানো এড়ানো ভাব।সেটা বুঝতে পেরে সেই বিষয়ে আর ঘাটাঘাটি না করে তাকে আর-ও সংকোচে ফেলতে চাইলোনা নিভান। বললো—যদি শরীর বেশি খারাপ না লাগে তবে ওকে রেডি হয়ে নিতে বলুন।আমরা বের হবো।আর বাহিরে বের হলে শরীর মন দুটোই ভালো লাগবে।

নিভানের তাড়ায় রানীও একপ্রকার হার মেনে কৌড়ির রুমে চলে গেলো।না-হলে আবারও যদি মেয়েটার অসুস্থতা নিয়ে এটা-ওটা নিয়ে প্রশ্ন করে নিভান,তবে সে কি উত্তর দেবে।বিধায় বাধ্য হয়ে কৌড়িকে গিয়ে নিভানের কথাগুলো বলতেই,সে নাকচ করে দিলো।সে যাবে-না।আর ওই মানুষটার সাথে তো কখনোই নয়।কথাগুলো নরমস্বরে বললেও বাহিরে দাড়ানো নিভানর কানে এসে ঠিকই বিঁধলো।হয়তো ওই কন্ঠস্বর শোনার অপেক্ষায় ছিলো সে।তাই আর আলাদাভাবে কৌড়ির কথাগুলো এসে বলা লাগলো না তাকে।সহসা পা বাড়ালো সে।কৌড়ির রুমের দজার সামনে গিয়ে পর্দা সরিয়ে দাঁড়াতেই ঘুরে দাঁড়ালো কৌড়ি।বুকের ভিতরের যন্ত্রণাটা মূহুর্তেই বেড়ে গিয়ে ঘনোঘনো উঠানামা শুরু হলো তার।সকাল বেলা কিসব কথাবার্তা বলে গেলো মানুষটা।তারপর কি আর অবিচল হয়ে তার সামনে অটল দাঁড়িয়ে থাকা যায়।এমনিতেই মানুষটাকে দেখলে পরাণ যায়যায় অবস্থা হয় তার।আর সেই মানুষটা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ভাবলেই শরীরের তপ্ততা নেমে গিয়ে শীতলতা ভর করে সেখানে।আর ইদানীং মানুষটা তাকে নিয়ে যা বলা শুরু করেছে।কি করবে কি বলবে ভেবে পায়না সে।

‘রানীসাহেবা আপনি গিয়ে রেডি হয়ে নিন।ও যাবে।

নিভানের দিকে পিছে ফিরে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কৌড়িকে একপলক দেখে নিয়ে রুমের বাহিরের দিকে পা বাড়ালো রানী।সহসা কৌড়ি বললো–উনাকে বলে দিন রানীসাহেবা,আমি যাবো-না।আমার ভালো লাগছে না।

‘আপনি গিয়ে রেডি হয়ে নিন।ও যাবে।

কৌড়ি আর দ্বিতীয় কথা বলার সাহস পেলোনা।রানীও আর দাঁড়ালো না।তবে দরজার সম্মুখীন গিয়ে পিছে ফিরে তাকালো সে।নিভানের কথা-কাজ যেনো উনার সুবিধার ঠেকলো না।এতোবছর ছেলেটাকে দেখে আসছে।কখনো কারও উপর জোর খাটাতে দেখেনি,সেই ছেলে কৌড়ির উপর জোর খাটাচ্ছে।আর কৌড়ির প্রতি নিভানের দৃষ্টি,গলার স্বর।একটুও ঠিক লাগলোনা।কোনোকারনে দুই মানব মানবীকে যে-যার জায়গায় অটল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মৃদু হেসে চলে গেলেন তিনি।রানী চলে যেতেই নিভান মুখ খুললো।

‘কৌড়ি।

ছলকে উঠলো জেনো শরীরের সমস্ত রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাহিত রক্তকণিকা।হৃদপিণ্ড আরও দ্বিগুণ মাত্রায় ছটফটিয়ে উঠলো।ডাকের উত্তর দেওয়ার সাহসটা আর হয়ে উঠলো না।নিজের পরিহিত জামাটা দু-পাশের আস্তিন দু’হাতের মুঠোয় শক্ত করে খামচে ধরে পাথর কঠিন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে।বিপরীত মানুষটা থেকে উত্তর পাওয়ার আশাটা করলোও না নিভান।বললো।

‘শরীর খারাপ লাগছে যেতে চাইছোনা,ঠিক আছে।তবে আমার সাথে কেনো যাবেনা বলছো?আমাতে তোমার সমস্যা কোথায়?

আপনি মানেই তো ভয়ঙ্কর সমস্যা!কথাটা চেয়েও দিতে পারলোনা কৌড়ি।ওই গম্ভীর স্বরের মালিকের মুখে মুখে তর্ক করাটা কি এতোটাই সহজ বিষয়।কৌড়িরতো মোটেও সহজ বলে মনে হয়না।কেনো জানি পারেনা সে তর্ক করতে।কৌড়ি উত্তর দেবেনা বুঝে নিভান ফের বললো।

‘তোমার জন্য রানীসাহেবা-ও যেতো পারছে-না।নিজের আনন্দ অনুভূতি চেপে রেখে তোমাকে সঙ্গ দিচ্ছে এটা কি তোমার ভালো লাগছে?

এবার খারাপ লাগলো কৌড়ির।সত্যিই তো।মুখ খুললো সে।আলতোস্বরে বললো—তবে আপনি উনাকে নিয়ে যান।আমার সমস্যা হবেনা,আমি থাকতে পারবো।

এতোটা জেদী এতো কঠিন হৃদয়,ওই মানবীর সচ্ছ মুখের আদলে তো সেটা বোঝা যায়না।মায়ামায়া মুখটার দিকে তাকালে মনেহয়,ভেতরটা তার মোম গলানো তরল।অথচ তার গলার স্বরটা বলে দিচ্ছে,তিনি কঠিন হৃদয়ের মানবী।তার মন গলানো সহজ কথা নয়।
তবে কি শুধু তার বেলায় কঠিন হতে চাইছে মেয়েটা?কিন্তু কেনো?এই মূহুর্তেই কৌড়ির মুখটা নিজের বাদামীবর্ন চোখজোড়া দিয়ে পরখ করতে ইচ্ছে করল নিভানের।ওই ডগরডগর চোখের ভাষা পড়তে ইচ্ছে করলো।ওই মায়ামায়া মুখাবয়বের এক্সপ্রেশন জানতে ইচ্ছে করলো।আর বলতে ইচ্ছে করলো,কেনো তুমি আমার বেলায় এতো কঠিন হতে চাইছো কৌড়ি?আর কেনোই বা চাইছোনা আমাকে।নিভান তার দূর্বলতা তোমার প্রতি প্রকাশ করে ফেলেছে তাই!মনেমনে নিজের প্রতি নিজেই তাচ্ছিল্যের মৃদু হাসি হাসলো নিভান।নিজের ব্যাক্তিত্বের বাহিরে গিয়ে কখনো নিজেকে মেলে ধরেনি সে।নিজেকে ছোটো করে দেখবে এমন দূর্বলতা দেখায়নি কাওকে।সবসময় নিজের চরিত্রের ভিতর বাহিরটা কঠিন রূপে রূপায়ণ রেখেছে। অথচ এই মানবীর কাছে,এতো বছরের শক্ত খোলসের সেই ভিতরে বাহিরের কঠিন নিভানটা কেমন মূহুর্তেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে তার খোলাসাটা আলগা করে দিলো!

ক্ষনিকের জন্য চোখ বুঁজে দীর্ঘ একটা শ্বাস টেনে ফের চোখ মেলে নিলো নিভান।নজর স্থির করলো,নিজের হৃদ হরন করে নেওয়া সেই মানবীর পানে।হৃদয় এতোটা দূর্বল হয়ে পড়লো কিকরে এই নারীরপানে!যেখানে নিজেকে দূর্বল দেখাতে-ও মন দ্বিধা করছে-না।আর নিজেকে খোসালা রূপে জানাতে তো মোটেই নয়।কিছু সময় দু’দিকের দুই মানব-মানবী নীরবতায় ছেয়ে থাকলো।একজন তার ভাবনায়,অন্যজন মনের হাসফাসে।হাসফাস করা মানবীটি জানে তার পিছনের মানুষটা এখনো তার পিছে অটল দাড়ানো।যায়নি।ভাবনার অতল গভীর থেকে ডুব দিয়ে এসে মুখ খুললো নিভান।ধীরকন্ঠে গুছিয়ে গুছিয়ে খুব সুন্দর করে কৌড়িকে উদ্দেশ্য করে বললো।

‘শরীর বেশি খারাপ না লাগলে রেডি হয়ে নাও।তোমাকে বাড়িতে একা রেখে ওখানে আমি আমাকে স্থির রাখতে পারবো না কৌড়ি।আর-ও তুমি অসুস্থ,এটা জেনে একটু না!যদি-ও আমাকে ভালো রাখার দ্বায় তোমার নয়,তবে নিজেকে ভালো রাখার দ্বায়টাতো আমার।তুমি ভাবতেই পারো আমি স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি।যেখানে তুমি অসুস্থ জেনে-ও,আমি আমাকে ভালো রাখার জন্য তোমাকে আমার সাথে নিয়ে যাবার জোরবাদী করছি।আজ আমাকে ভালো রাখার জন্য না-হয় দ্বায়টা একটু কষ্ট করে হলে-ও তুমি বহন করো।আমি না-হয় স্বার্থান্বেষী মানুষ, তুমিও একটু না-হয় দয়ামায়াময়ী হলে।

চলবে….

#ফুলকৌড়ি
(২৫)কপি করা নিষিদ্ধ।
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

গোধুলি বিকেল।মাথার উপরে বিস্তৃত আকাশটা কাঁচের ন্যায় সচ্ছ পরিচ্ছন্ন নীল সাদায় মুড়ে আছে।চারপাশের প্রকৃতিভাব নির্মলতায় ছেয়ে।ঝলমলে সুন্দর একটা দিন।একমাত্র বোনের বিয়ে উপলক্ষে কাছের এক বন্ধুর বাংলোবাড়ি ভাড়া করেছে তৃনয়।অবশ্যই বিয়ে উপলক্ষে ভাড়া করতে চেয়েছিলো কিন্তু বন্ধুর বোনের বিয়ে!তাই তৃনয়ের সেই বন্ধুটা ভাড়া হিসাবে না দিয়ে এমনিতেই অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে দিয়েছে।বিয়ে উপলক্ষে বাংলোবাড়িটা সুন্দর করে সাজানো হয়েছে।গোধুলি লগ্নে মরিচবাতি দিয়ে সাজানো বাংলোবাড়িটা ঝকমকে আলো দিয়ে ঝলমল না করলেও,ফুলের সাজানো গেইট এবং লন এরিয়াতে করা স্টেজ,বেশ নজর কাড়ছে।আপতত সেখানে নিমন্ত্রিত মানুষের সমাগমে ভরপুর।নিভানের গাড়িটা সেই ফুল সাজানো গেইট দিয়ে পার করতেই,লন এরিয়ার মোটামুটি সবার আকর্ষণীয় নজর চলে গেলো সেখানে।গাড়ি নির্দিষ্ট পার্কিং এরিয়ায় এসে থামতেই অনেকের,কৌতূহলী নজর কে এসেছে দেখেই চোখ ফিরিয়ে নিল।তবে কিছু কৌতুহলী নজর এখনো সেদিকে তাকিয়ে।

গাড়ি থামতেই রানী আগেই নেমে গেলো।ড্রাইভিং সিটে বসা নিভান ততক্ষণাত পাশে বসা রমণীর দিকে তাকালো।যার সুন্দর শুভ্র শোভিত মুখখানা একটা সাদা হিজাবে মুড়ানো।গোলগাল শুভ্র মুখাবয়ব আর হিজাবের রঙটা মিলেমিশে একাকার।মুখের কোনো অংশে নেই কোনো সামন্য প্রসাধনীর প্রলেপন ছোঁয়া।নিভান শান্ত নজরে খেয়াল করে দেখলো,মুখাবয়ব, চোখ,ঠোঁট কোথা-ও কোনো অপ্রাকৃতিক কিছুরই লেশ ছোঁয়ানো নেই।অতিশয় সাধারণ ন্যাচারাল একটা মুখ।তবু-ও কি সুন্দর দেখাচ্ছে সেই বাঁধানো মুখশ্রী।শরতীয় সদ্য পুষ্পিত কাশফুলের ন্যায় স্নিগ্ধ সে রূপ দেখলে নজর তৃপ্তিময় উঠে।ঘনপল্লবিত ডাগরডাগর আখিযুগল যখন পরপর পলক ঝাপটায়, ইশশ কি-যে কম্পন ধরে বুকে।যদি মেয়েটা সেটা জানতো, বুঝতো!তবে নিজেকে কচ্ছপের ন্যায় খোলাসার মধ্যে লুকিয়ে রাখতো।ভিতরে ভিতরে চঞ্চলা হয়ে উঠলো নিভানের মন।ততক্ষণাৎ তপ্ত শ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো সে।বাড়ি থেকে এখানে আসা পর্যন্ত মেয়েটা কাঠের পুতুলের মতো নিশ্চল হয়ে বসে আছে।নজর তার সামনে অবিচল।নাহলে বাঁপাশে খোলা জানালার বাহিরে।তারদিকে তো ভুলেও ফেরেনি।তবে তার কথা রেখে তারসাথে অসুস্থ শরীর উপেক্ষা করেও এসেছে,এটাইতো পরম সৌভাগ্য। ঠোঁটের কোণ মৃদু প্রসারিত হলো নিভানের।সেটা বজায় রেখেই কিছুটা ঠাট্টার স্বরে বললো।

“মায়াহরিনীদের এতো রাগ,এতো জেদ,এতোটা কঠিন রূপ হয় এটা-তো আমার জানা ছিলো-না।তাও আবার শান্তশিষ্ট মায়াহরিনীর!আমার জানা-মতে তাদের ভিতর বাহির সবটা মায়াময় হয়।কিন্তু আমার মায়াহরিণীটির দেখছি ভিন্ন রূপ।নাকি আমি বলে তাই?কারনটা কি যে সে আমার প্রতি সুহৃদয়বান হতে চাইছে না!তার মায়া, শান্তশিষ্টতা,শুধু আমার জন্য নয়!আমার জন্য বরাদ্দ শুধু তার রাগ জেদ আর কঠিন্য রূপ!কেনো?তাকে তার অনুমতি ছাড়া চেয়ে ফেলেছি তাই?নাকি…

কথা শেষ করলোনা নিভান।খিঁচে চোখ বন্ধ করে নেওয়া কৌড়ির পানে শিথিল নজরে তাকিয়ে রইলো।
আমার মায়াহরিণী,বাক্যদ্বয়ে বক্ষস্থলে হৃদকম্পন তুলে দিলো কৌড়ির।তবুও চোখ বন্ধ করে নিজেকে স্বাভাবিক করার প্রয়াস চালালো।বুকের কম্পন যদি-ও শস্য পরিমাণ কমলোনা।বরং দ্বিগুণ তিগুণ বাড়লো।তবুও অস্ফুটস্বরে বললো।

‘গাড়ীর লক খুলে দিন।আমি বাহিরে যেতে চাই।

মুখের মৃদু হাসিটা চওড়া হলো নিভানের।মেয়েটার স্বভাব যেনো না চাইতেও মুখস্থ হয়ে গিয়েছে তার।তাই গাড়ীতে উঠার সাথে সাথে কৌড়ির পাশের দরজা লক করে দিয়েছিল।যেনো গাড়ী থামার সাথে সাথে মেয়েটা না নামতে পারে।একটু জ্বালানো আরকি!আর তার দূর্বলতা যখন মেয়েটা জানতে পেরেছে,তবে আর-ও না হয় একটু জানুক।খোলা বই হয়ে যাক কৌড়ির জীবনে সে।অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে বসে থাকা কৌড়ির মুখের দিকে কিছুসময় তাকিয়ে আর কথা না বাড়িয়ে দরজার লক খুলে দিলো নিভান।ততক্ষণাত নেমে পড়লো কৌড়ি।নামলো নিভান-ও।দুজনকে একসাথে বের হতে দেখে, দুর থেকে কিছু মানুষের মুখে হাসি ফুটলো।তৃনয়-ও তারমধ্যে একজন।বন্ধুদের সাথে কথা বলছিলো সে।
তাদের নজরও ছিলো পার্কিং এরিয়ায় নিভানের গাড়ির পানে।ওদের দুজনকে একসাথে বের হতে দেখে উৎসাহী কন্ঠে একজন বললো।

‘নিভানের সাথে মেয়েটা কে?সারাজীবন মেয়েসঙ্গ তো সন্ন্যাসী পুরুষদের ন্যায় এড়িয়ে এসেছে,নিজের মা বোনদের ছাড়া।সেখানে মেয়েটাকে ওর বোন বলে-ও তো মনে হচ্ছে-না।তবে কে?জুড়ি তো একবারে পারফেক্ট মিলেছে।

তৃনয়ের মুখের হাসিটা আরও একটু চওড়া হলো।সমানতালে এগিয়ে আসা কৌড়ির আর নিভানের পানে তার স্থির নজর।আজ হলুদের অনুষ্ঠানে সবাই হলুদ পোশাক পরিহিত।অথচ নিভানের ফুলকৌড়ি আগাগোড়া সাদা ড্রেসআপে।সাথে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি,তারউপরে হালকা হলুদ কোটি পরা নিভানকে। সত্যিই একে অপরের জন্য পারফেক্ট জুড়ি লাগছে।
কিছুটা হেয়ালিপনায়,পাশের বন্ধুটিকে উদ্দেশ্য করেই বললো।—পারফেক্ট জুড়িই তো।নিভানের নজর বলে কথা।

‘মানে কি!নিভান বিয়ে করেছে? করলো কবে?

‘বিয়ে করেনি তো।করলেতো তোরাও জানতে পারতিস।তবে বন্ধু আমাদের ফুলকৌড়িতে মেতেছে।পারফেক্ট না হয়ে যাবে কোথায়!

‘ফুলকৌড়ি মানে?মেয়েটার নাম?

‘হুমম।মেয়েটার নাম।এতোদিনের সন্ন্যাসী নেওয়া নিভান আওসাফ মেয়েটাতে ফেঁসেছে ভালোই।

‘রিয়্যালি

‘আসছে জিজ্ঞেস করে নিস।অবশ্যই জিজ্ঞেস করার দরকার নেই।শুধু বলবি তোর পাশে মেয়েটা কে ছিলো নিভান?মেয়েটাকে আমার দারুন লেগেছে। ব্যাস বুঝে যাবি,মেয়েটা তোর বন্ধুর ঠিক কি!কেমন?

কথাটা একসাথে এগিয়ে আসা মানব মানবীর দিকে তাকিয়ে কিছুটা ঠাট্টার স্বরে বললো তৃনয়।আর তৃনয়ের বলার ভঙ্গি,গলার স্বর একটুও সুবিধার ঠেকলো না ছেলেটার।সেদিকে তাকিয়ে ছেলেটা বোকা হাসার ট্রায় করে পরপর আচমকা কয়েকটা ঢোক গিললো।ভার্সিটিতে পড়াকালীন নিভানের বোন মান্যতাকে একবার প্রপোজ করেছিলো একটা ছেলে।মান্যতা ছেলেটাকে নিষেধ করা সত্ত্বেও ছেলেটা,মান্যতার পিছে ইতুড়ের মতো লেগে ছিলো।মান্যতা না মানায় হুমকিধামকিও দিয়েছিলো।সেসব হুমকিধামকি,বোন এসে ভাইয়ের কাছে অভিযোগ জানাতেই,ছেলেটার যা হাল করেছিলো নিভান।সাথে তারাও ছিল।বিধায় ব্যাপারটা নিজ চোখে দেখা।সুদর্শন পুরুষ হিসাবে খ্যাতিনামা ছেলেটার,সেদিনের ওই ছেলেটার মারের কথা মনে পড়তেই রূহ কেপে উঠলো।নিভান শান্তশিষ্ট তবে যাচিত কারনে রেগে গেলে সে মারাত্মক ভয়ংকর।আর সেই নিভানের পছন্দের মেয়েটার দিকে ভুল নজর পড়া-তো আর-ও আতঙ্কের বিষয়।আর তৃনয় কি না,তাকে হাসপাতালের আইসিইউয়ের দুয়ারে ঠেলে দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে। যদি-ও সুদর্শন যুবক হিসাবে পরিচিত সে,তবু-ও জীবনে মেয়ে না জুটলেও ওই রমণীর পানে ভুল নজরে তাকানো আর নিজের আত্মা নিয়ে টানাটানি সমপর্যায়ের কথা।

মনেমনে অতশত ভাবলেও নিভান কাছে আসতেই মজা নিতে ছাড়লো না ছেলেটা। সাথে তৃনয়ও।নিভান সেই মজাতে যোগ না দিলে-ও,বিপক্ষে কিছু বললো-ও-না।তবে মনেমনে এক তৃপ্তি অনুভব করলো।কৌড়িকে ঘিরে তাকে কেউ কিছু বললে, আলাদা অন্যরকম এক অনুভূতি হয়।সেই অনুভূতি জানান দেয়,ওই পুতুলের মতো মায়াময়ী মেয়েটা শুধুই তার।

গাঁদাফুলের সমাহারে সাজানো গায়ে হলুদের স্টেজে বসে আছে তন্ময়ী।উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ গায়ে কাঁচা রঙের হলুদ জামদানীটা আটপৌড়ে জড়ানো।লতানো শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে,হলুদ-লালরঙা কৃত্রিম ফুলের গহনায় জড়িয়ে আছে।উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ মুখাবয়বে লেগে আছে হালকা মেকাপের প্রলেপ।চিকন ঠোঁটজোড়ায় লেপ্টে আছে গাঢ় লালরঙা লিপস্টিক।গোলগাল চোখজোড়ার ঘন-পল্লবে ছেয়ে আছে মোটাকরে দেওয়া কাজলরেখা।
কি সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে।আস্ত একটা মায়াপরী।মেকাপ-বিহীন উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ মুখটা আর-ও মোহনীয় দেখায়।এই শ্যামবর্ণ মোহনীয় রূপের প্রেমে পড়েছিলো সেদিন ইভান।যেদিন প্রথম মেয়েটাকে তাদের বাড়িতে দেখেছিলো।দাদাভাই অসুস্থ ছিলো।তৃনয় ভাইয়ার সাথে দাদাভায়েট দারুন বন্ধুত্ব হওয়ায়,অসুস্থ দাদাভাইকে দেখতে এসেছিলেন তৃনয় ভাইয়া,উনার মা আর এই মায়াপরীটা।মেয়েটা মনেহয় তখন সদ্য ইন্টার ভর্তি হয়েছে।গোল কুচিফ্রক পরিহিত চুড়িদার।মাথায় হিজাবে মুড়ানো।চোখে গোল ফ্রেমের চশমা।সোফায় বসে মৃদু হেসে মান্যতার সাথে কথা বলছিলো।কি মিষ্টি লাগছিলো মেয়েটাকে।ভার্সিটি থেকে সবে বাড়িতে ফিরেছিলো ইভান।ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই তীক্ষ্ণ শূলের মতো নজরে বিঁধেছিল,সোফায় বসা হাস্যজ্বল মেয়েটা।মনে বিঁধেছিল,মারাত্মক ব্যাধির ন্যায়।সেই ব্যাধি দিনকে দিন মনমস্তিস্কে ছড়িয়েছে শুধু,সারেনি বৈ।অথচ মেয়েটাকে তা বোঝানোর পর-ও বোঝেনি।হয়তো বা বুঝেছিলো।তার কারনেই সেই নীরবে বুঝপনাটা, আবারও অবুঝপনায় গড়িয়েছে।মনেমনে আওড়ালো।

‘তুমি আমার জীবনের প্রথমা প্রেয়সী।আর সমাপ্তিটা-ও আমি তোমাতেই টানতে চাই।সেখানে তুমি রাগে জেদে অন্য কারও হতে চাইলে,ইভানের চলবে কি করে!

মানুষের আনাগোনা ঠেলে ধীরপায়ে স্টেজের দিকে এগোলো ইভান।তন্ময়ীর পাশে তার বান্ধবী আর কানিজ রিলেটেড কিছু মেয়ে বসা।হলুদ সাজে তাদের রূপের বহরের শেষ নেই।ইভানকে চেনেনা সেভাবে কেউ।তবে হালকা রঙের কাঁচা হলুদ পাঞ্জাবি পরা ইভানের সুদর্শনতায় মুগ্ধ হলো তারা।কিছু মেয়ে গলেও পড়লো।সেটা তাদেরও মুগ্ধ দৃষ্টি আর আচারনেই বোঝা গেলো।তবে সেসব লে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে ইভান মুখে অমায়িক হাসি টেনে বললো।

‘এক্সকিউজ মি ম্যাডামেরা।আমি কি আপনাদের কনের পাশে বসতে পারি একটু?

একজন নয় বেশ কয়েকজন একসাথে আহ্লাদী গলায় বলে উঠলো–ইয়েস,কেনো নয়।শিওর,শিওর।

মুখে বললেও মেয়েগুলোকে সরতে না দেখে ইভান ফের বললো–আমি মুলত আপনাদের কনের পাশেই বসতে চাইছি।সমস্যা হবে নাকি?

ছেলেটা এমনভাবে বলছে যেনো তন্ময়ীকে বিশেষভাবে চেনে।তন্ময়ীর শান্ত চাহুনি আর নীরবতাও সেটা বুঝিয়ে দিচ্ছে যেনো।তাই পাশে বসা মেয়েগুলো সরে বসলো।কিছু মেয়ে উঠে দাঁড়িয়েও পড়লো।তন্ময়ীর নীরব চাহুনীতে স্বাভাবিক দৃষ্টি ফেলে মিষ্টি হেসে তারপাশে গিয়ে বসলো ইভান।এখনো হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয় নি।কনে পক্ষের থেকে সব আয়োজন কমপ্লিট থাকলেও,বরপক্ষের থেকে হলুদের বারাত আসবে তারপর কনের হলুদ মাখানো শুরু হবে।সেটাই এখনো আসেনি।তাই যে যার মতো বিভিন্ন গল্পে মেতে আছে।সেই সুযোগটা ব্যবহার করছে ইভান।যদিও সুযোগ না থাকলেও, কি যায় আসতো বা যেতো!তার কাজ সে কমপ্লিটলি করে ফেলেছে।হলুদের বারাত আর আসবে বলেও মনে হয়না!

তন্ময়ীর সামনে রাখা ছোটোখাটো টেবিলটায় বিভিন্ন পদের মিষ্টি, পিঠা পায়েসের আয়োজন করে রাখা।সেখান থেকে সনন্দে একটা মিষ্টির পাত্রটা উঠিয়ে নিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সেখান থেকে একটা মিষ্টি কাটা চামচ দিয়ে মনোযোগ সহকারে কেটেকুটে খেতে থাকল ইভান।কনের জন্য রাখা মিষ্টি সে এমন নির্বিকার ভাবে খাচ্ছে, যেনো মিষ্টিগুলো তারজন্য রাখা হয়েছে।আর আশেপাশে কে আছে,কে দেখছে,খাওয়া উচিত কি-না! এসবের যেনো বিন্দু পরিমাণ কোনো পরোয়া নেই।কি নির্বিকার আচারন।তন্ময়ীর বিশ্বাস,এই ছেলে নিশ্চিত কিছু অঘটন ঘটিয়ে তারপর এতো শান্ত,এতোটা চুপচাপ।না-হলে এতো নির্বিকার থাকার কথাতো নয়।তেমন ছেলেও যে ইভান নয়।এটা সে বেশ জানে।মনোযোগ দিয়ে মিষ্টি খেতে খেতে শীতলগলায় ইভান বললো।

‘তোমাকে ভারী মিষ্টি আর খুব সুন্দর দেখাচ্ছে তন্ময়ী।তোমার শ্যামবর্ণ শরীরে হলুদের এই সাজ,উফ!তোমাকে দেখার প্রথম দিনের মতো বুকের ভিতরটা তোলপাড় করে দিচ্ছে।আর সেই হলুদের মোহনীয় সাজটা তুমি অন্য কার-ও জন্য সেজেছো?তোমার জন্য তোলপাড় করা জায়গায়,নিজ হাতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছো?কথা-তো এমন ছিলো না।

বুকের ভিতর তোলপাড় শুরু হলো তন্ময়ীর।তবে যতসম্ভব নিজেকে শান্ত আর স্বাভাবিক রেখে শক্তকন্ঠে বললো।

‘তবে কথা কেমন ছিলো?আপনি আমাকে নিজের ভেবে পা দিয়ে চেপে রেখে,অন্য মেয়েদের সাথে ফূর্তি করে বেড়াবেন।আর আমিও সেটা মেনে নিয়ে আপনার হতে রাজি হয়ে যাবো?তেমনটা?এটা আশা করা উচিত আপনার?

শান্ত চাহুনিতে তন্ময়ীর মুখের দিকে তাকালো ইভান।পূর্বের ন্যায় শীতল গলায় বললো।–তুমি ভুল বুঝেছো আমাকে।তোমাকে প্রথম দেখায় ভালো লেগেছিলো আমার।আমি ফালতু ছেলেদের মতো তোমার পিছু লেগে থাকিনি।আর না কখনো ডিস্টার্ব করেছি।আমি শুধু সোজাসাপ্টা স্বীকারোক্তি জানিয়ে ছিলাম,তোমাকে আমার ভালো লেগেছে।আমার জীবনের একান্ত নারী হিসাবে তোমাকে চাই।এটাতে কোনোরূপ মিথ্যা ছিলো না,আর না ছিলো সেই সোজাসাপ্টা স্বীকারোক্তিতে ছলনা।ছলনা থাকলে নিশ্চয় তোমার মতো করে স্বাধীনভাবে তোমাকে চলতে দিতাম না।সোজাসাপ্টা একটা প্রেমের সম্পর্কে জড়াতাম।সেখানে আমার ভালোমন্দ চাহিদাও থাকতো।ছিলো কি চাহিদা?পারতাম না আমি সেই সম্পর্কে ছলনা করে নিজের খারাপ মনস্কামনা পূর্ণ করতে?কখনো তেমন কোনো কথাবার্তা হয়েছে আমাদের। নাকি তেমন ব্যবহার পেয়েছো আমার থেকে?তুমি ও তো চাওনি সেরকম প্রেমময় সম্পর্ক হোক আমাদের মধ্যে,সেজন্য তো সময়মতো করে তোমাকে পাওয়ার অনুরোধটা রেখেছিলাম শুধু !

নিস্প্রভ চাহুনীতে মাথা কাত করে তন্ময়ীর কঠিনকরে রাখা মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো নিভান।উত্তর এলোনা অপরপক্ষ থেকে।আশা করলোওনা ইভান।আবারও বলতে শুরু করলো।—যাই হোক,কিন্তু সেদিন তোমার পক্ষথেকে তুমি আমার মতো করে সোজাসাপ্টা সম্মতি মেলে ধরোনি। দাওনি উত্তর ।তবে তোমার নীরবতাকেই আমি সম্মতি ভেবে নিয়েছিলাম।অন্য সম্পর্কের ন্যায় তোমাকে আমি নিজে কি চাই,সেই গন্ডির মধ্য আঁটকে রাখতে চায়নি কখনো।কেননা তুমি মেয়েটা কেমন?ডিটেইলসে আমার তখন জানাশোনা এমনকি বোঝা-ও হয়ে গিয়েছিলো।তাই চেয়েছিলাম তোমার লাইফ তুমি তোমার মতো করে,যেভাবে আগে চলে এসেছো, সেভাবেই চলো।শুধু সময় যখন আসবে,আমি তোমার মা ভাইয়ের কাছ থেকে চেয়ে নেবো তোমাকে।আর যখন চাইবো তখন যেনো শুধু তোমার সম্মতিটা পাই।আমি তোমাকে চেয়েছি আমার জীবনের একান্ত নারী হিসাবে,কোনো প্রেমিকা হিসাবে নয়।যার কারনে আমার আচারনটা আমি সেরকমই রেখেছিলাম।

থামলো ইভান।বলতে বলতে গলা কঠিন হয়ে এলো তার।ফের বললো –আর একটাই অনুরোধ করেছিলাম তোমাকে।বলেছিলাম, আমার চাওয়ার আগে যদি তোমাকে কেউ তোমার মা ভাইয়ের কাছে চেয়ে বসে, প্লিজ তন্ময়ী আমাকে জানিও।আমার অনুরোধটা তুমি রাখলেই না?এতোটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলে!অথচ আমি তোমার নীরবতাকেই সম্মতি ভেবে ভরসা করেছিলাম, বিশ্বাস রেখেছিলাম তোমার উপর।সেই বিশ্বাস, ভরসা তুমি,তোমার নীরব সম্মতির মতোই নীরবেই ভেঙে দিলে!তোমার মোটেও উচিত হয়নি,আমাকে এভাবে অতল সাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার।

‘বিশ্বাস ভরসা আপনি রেখেছেন?তবে আপনি কিকরে আমার উপরে সেই আস্থাটা ভরসা করেন?

‘সেই কারণে তুমি আমাকে ভুল বুঝে এরকম একটা পদক্ষেপ নিতে পারো-না তনু!তোমার বিশ্বাস ভরসার জায়গাটা যদি আমার প্রতি নড়বড়ে হয়ে গিয়ে থাকে।
তুমি বিষয়টা সম্পর্কে জানতে চাইতে আমার কাছে।আমাকে জানাবোঝার,এমনকি যেকোনো বিষয়ে প্রশ্ন করার অধিকারবোধটা কিন্তু আমি আগেই দিয়ে দিয়েছি তোমাকে।সেখানে তুমি আমাকে প্রশ্ন না করে,রাগে জেদে পড়ে বিয়ের মত একটা সারাজীবনের সেনসেটিভ ইস্যুতে নির্দ্বিধায় সম্মতি জানাতে পারো না!
তোমার কি মনেহয় ইভানের জীবনে মেয়ের অভাব পড়েছে,যে তাকে ফিরে আসতে হলো তোমার কাছেই! ইভানের দূর্বলতা ঠিক কোথায়,সেটা অনুভব হলো না তোমার! তুমি একটা মেয়ের সাথে আমাকে ঘুরতে ফিরতে দেখলে আর তোমার মতো করে বিশ্বাস করে নিলে।আর আমাকে ফেললে ফাঁসির দণ্ডনীয় আসামির কাঠগড়ায়।অথচ একনায়কতন্ত্র ভাবে বিচার করলে।সেখানে আসামির ভালোমন্দ স্বীকারোক্তি শোনা জানার প্রয়োজন মনে করলে-না!আর না সেই ফাঁসির আসামির শেষ ইচ্ছে জানার প্রয়োজনবোধ করলে!তবে সেদিন কেনো সরাসরি বলে দাওনি,ইভান আপনাকে আমার পছন্দ নয়।আমি আপনার প্রপোজাল একসেপ্ট করতে পারছি না।তবে আমি তোমাকে আমার ভাবার দুঃস্বপ্নটা বুকে লালন করতাম না।

বুকের ভিতর ব্যথার অনুভব সৃষ্টি হলো তন্ময়ীর।কঠিন করে রাখা হৃদয় ভিতরে ভিতরে ভেঙেচুরে চুরমার হলো।সেদিন যখন ইভান সোজাসাপ্টা নিজের অনুভূতি সুন্দরভাবে জানিয়ে দিয়েছিলো।সবদিক ভেবেচিন্তে হ্যা না কিছু না বললেও,মনেমনে ঠিকই ইভানের প্রতি অনুভূতিতে দূর্বল হয়ছিলো সে।মুগ্ধ হয়েছিলো,ইভানের তরফ থেকে তার ব্যবহার কথাবার্তা সিদ্ধান্ত আচারনের।অন্য কোনো গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ডের মতো সম্পর্ক না গড়িয়ে, সময়মতো তাকে চেয়ে নেওয়ায় চিন্তাভাবনা।সে-ও যেনো নীরবে সম্মতি দিয়েছিলো সেই চাওয়ার।বরাদ্দকৃত সম্পর্ক দু’জনের মধ্যে না থাকলেও হুটহাট একটুআধটু কথা হতো দু’জনের।তবে সেসব কথা না ছিলো প্রেমময়,আর না ছলনাময়। বরাবরই ঠাট্টা মশকরা করে তাকে রাগিয়ে দেওয়া, উল্টো পাল্টা বলে ক্ষেপানো।এগুলোই কাজ ছিলো ছেলেটার।তন্ময়ী সেসব কার্যকলাপে রেগে, যেতো ক্ষেপে যেতো।আবার মনের কোণে ভালো লাগাও সৃষ্টি হতো। আর সেই ভালো লাগা সেদিন ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো,যেদিন একটা কফিশপে ইভানকে আর নাম না জানা সেই মেয়েটাকে হাসিহাসি মজা করে কথা বলতে দেখলো।একবার নয় মেয়েটার সাথে ইভানকে বারংবার দেখেছে সে।ইভানের সাথে বাইকে ঘুরতে।কফিশপে কফি খেতে।ইভানের ভার্সিটি এরিয়াতে।মেয়েটার পোশাক আশাক চালচলন হাবভাবে,মোটেও ঠিক লাগিনি তন্ময়ীর।সেখানে ইভান তাকে ভালোলাগার কথা জানিয়ে,সেই মেয়ের সাথে ফূর্তি করে বেড়াচ্ছে!তন্ময়ীর ভালোলাগার অনুভূতিগুলাে যেনো সেখান থেকেই আস্তে আস্তে একটু একটু করে ফিকে হতে শুরু করলো।তবে হৃদয়,একান্ত মানুষ হিসাবে যার প্রতি একবার দূর্বল অনুভূত হয়।সহজে কি তাকে মনমস্তিস্ক থেকে বের করে দেওয়া যায়!নাকি চাইলেই ভুলে যাওয়া যায়?তবে মন কঠিন রেখে চেষ্টা করে গিয়েছে তন্ময়ী নিজেকে ঠিক রাখার।যেমনটা সে আগে ছিলো তেমনভাবে চলার।না ইভানের কাছে মেয়েটা সম্পর্কে জানতে চেয়েছে আর না আগ্রহ দেখিয়েছে জানার।শুধু মনকে এটা বলে ইভানকে এড়িয়ে গেছে,বড়োলোকের ছেলে কখন কাকে ভালো লেগে যায়া।ভালোলাগা শেষ হয়ে গেলে কখন কাকে আবার ছুড়ে ফেলে দেয়।বলা তো যায়-না।তাই নিজের দূর্বলতাকে কাবু করে,নিজেকেই শক্ত করে নিয়েছে সে।মনেমনে ভেবে রেখেছে,বাবাহারা সে।মা আর ভাই যেমনটা চাইবে তেমনভাবেই চলবে সে।এবং যাকে তার জীবনসঙ্গী হিসাবে নির্বচন করবে তাকেই বিয়ে করবে তন্ময়ী।

দীর্ঘশ্বাস ফেললো তন্ময়ী।আজ তবে কেনো ইভানের কথাগুলো ভিতরটাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিচ্ছে তাকে।কেনো মনেহচ্ছে,একবার মেয়েটা সম্পর্কে তার জানা উচিত ছিলো।চোখের দেখাও তো ভুল হতে পারে।ইভানকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা উচিত ছিলো,কেনো আমাকে কথা দিয়ে অন্য মেয়েকে নিয়ে এতো মাতামাতি!মাতামাতি!হ্যা মাতামাতিই তো ছিলো।রাগ জেদে ক্ষনিকের দূর্বল হওয়া মনটা আবারও কঠিন রূপায়িত হলো।তার, এই ইভানকে না জানিয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত একেবারেই ভুল নয়।কোন মেয়ে নিজের পছন্দের মানুষের সাথে অন্য একটা মেয়েকে সহ্য করবে?কে মেনে নেবে?সে যে কারনেই হোক না কেনো!আর কেনোই বা একটা মেয়েকে নিজের মিষ্টি মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে রেখে,অন্য একটা মেয়ের সাথে মজাফূর্তিতে ডুবে থাকবে।তার কি একটুও মনে ছিলোনা,তন্ময়ী বলে কাওকে সে নিজের করবে বলে কথা দিয়ে রেখেছে।অভিমানে কালোমনির চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠলো তন্ময়ীর।সেই মুখাবয়বের দিকে খুবই খেয়ালী নজরে তাকিয়ে রইলো ইভান।তার চাহুনী যেনো বলে দিচ্ছে, তন্ময়ীকে ভাবার সময়টা দিয়েছে সে।অনেক সময় পর দৃঢ়কণ্ঠে বললো ইভান।

‘বিয়েটা একটা ছেলে মেয়ের স্বামী স্ত্রী রূপে একসঙ্গে কাটানো সারাজীবনের একটা কঠিন সিদ্ধান্তের ব্যাপার।সেই মানুষটার সাথে তুমি সারাজীবন জড়িয়ে যাবে,এটা ভেবেও তুমি সেই সিদ্ধান্তে অনায়াসে সম্মতি জানালে কি করে তন্ময়ী?এটাই মানতে পারছিনা আমি।

‘আমিও মানতে পারিনি,আমাকে মিষ্টি মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে রেখে আপনি অন্য মেয়ে নিয়ে হাসিমজা করে শহরময় ঘুরে বেড়াবেন!আমার জায়গায় আপনি হলে মানতেন কি?

অবহেলায় হাসলো ইভান। ভুল তারও ছিলো।তন্ময়ীর কথা না ভেবে, আরেকজনের কথা ভাবতে গিয়ে নিজের জীবনকে হারিয়ে ফেলতে বসেছিলো সে।এখন সেটা খোলামেলা বলার সময় নয়।তবুও বললো-মানতাম না।তবে তোমার মতো না ভেবেচিন্তে বিয়ের মতো একটা ডিসিশনও নিতাম না।তুমি ভুল ডিসিশন নিয়েছো।আর আমাকে না জানিয়ে সেই ভুলকে অন্যায় রূপ দিয়েছো?

‘একদম না।

‘সেটাতো একটু পরে বুঝতে পারবে।তুমি তো ইভানেরই।
আর তোমাকে ইভান ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পুরুষ ছোঁবে এটা ইভান মানবে কিকরে?আর মেনে নেবে এটাও ভাবা তোমার ভুল।দ্বিতীয়ত তুমি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো নারীকে আমি একান্তভাবে আমার ভাবতেই পারি-না, ছোঁয়াতো দূর।তৃতীয়ত আমার বলা কথা তোমার কাছে মিথ্যা বলে মনে হতে পারে।কিন্তু সেই কঠিন সত্যটা মিথ্যা মনে করে ভুল বুঝে রাগে-জেদে বিয়ের মতো একটা কঠিন সিদ্ধান্তে জড়িয়ে পরবর্তীতে তুমি পস্তাতে চাইলেও,আমি তো তোমাকে পস্তাতে দিতে পারিনা।সেই কঠিন সত্যটা মিথ্যা মনে করলেও আমার হতে হবে তোমাকে।তোমার সম্মতি ছাড়াও যদি আমার হতে হয়।তবুও ইভানের হতে হবে তোমাকে।বাধ্য হয়ে হলে-ও।

রাগ জেদ ভুলে গিয়ে বিস্ময় ভর করলো তন্ময়ীর মুখাবয়বে।আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইলো ইভানের মুখের দিকে।যেটারই ভয় পাচ্ছিলো,সেটাই কি করে বসেছে ছেলেটা।সে তো ভেবেছিল,বিয়ের দিনতারিখ ঠিক হয়ে গেলে,ইভান আর কোনো কিছু করার সাহস দেখাবে না।
নিভান ভাইয়ার কথা ভেবে হলেও সাহস করবে না কোনো কিছু করার।তবে,ছেলেটা ইভান।এটাও তার মাথায় গেঁথে রাখা উচিত ছিলো।যার দুঃসাহসের কোনো কমতি নেই।বিস্ময়ে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো তার।

‘আপনি নিশ্চয় বিয়ে ভাঙার মতো উল্টো পাল্টা কিছু করেন নি?

বিস্তৃত হাসলো ইভান।ফের রহস্যময় গলায় বললো-তুমি মুখে যেটা বলছো সেটা নয়।মনে যেটা ভাবছো সেটাই করেছি আমি।

তন্ময়ী কিছু বলতে যাবে তার আগেই চারপাশে কেমন চাপা শোরগোল পড়ে গেল।হৈচৈ শুরু হলো।আনন্দঘন হলুদের অনুষ্ঠানে গুঞ্জন সৃষ্টি হলো বিয়ে ভাঙার।ছেলেপক্ষ হলুদের বারাত নিয়ে আসছে-না।তারা হঠাৎ বিয়ে ভেঙে দিয়েছে।কারন হিসাবে তাহমিনা বেগমকে বলেছে,–আমরা খোজখবর নিয়ে জেনেছি আপনার মেয়ের অন্যত্র সম্পর্ক আছে।কথাগুলো শোনা থেকেই মনমরা হয়ে বসে আছেন তাহমিনা বেগম।মেয়েটার অন্যত্র সম্পর্ক থাকলে হাবভাবে তো তিনি সেটা বুঝতে পারতেন।আর দ্বিতীয়ত উনার এককথায় মেয়েটাও রাজী হতোনা বিয়েতে।তবে কি ছেলের মা তন্ময়ীর গায়ের শ্যামবরন রঙ নিয়ে একটু তনুমনু করছিলেন।সেটারই দোষারোপ উল্টো ভাবে গাইছে।নাকি উনারা যা বলছেন সেটাই সত্য।তাই যদি সত্য না হবে,তবে আজ হলুদের দিন এসে উনারাই বা কেনো বিয়ে ভেঙে দেবেন?সম্মান তো উনাদেরও জড়িয়ে।মাথায় টলটলে ব্যথার উপসর্গ নিয়ে উঠে মেয়ের কাছে গেলেন তিনি।তন্ময়ীর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখলেন টলমলে চোখে মেয়েটা উনার দিকে তাকিয়ে আছে।আশপাশে আয়োজিত মানুষের ভিড়।সেই চোখ বলছে–উনারা যেটা বলেছেন সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা আম্মু ।মেয়ের প্রতি ভিতরে ভিতরে রাগে জ্বলে উঠা মাতৃত্ব সত্তা জেনো, মেয়ের চোখের নোনাজল দেখেই ভিতরেই নিভে গেলো।তিনি প্রশ্ন করার আগেই তন্ময়ী রোধ হওয়া গলায় বললো।

‘বিশ্বাস করো আম্মু,উনারা যে অভিযোগটা করছেন সেরকম কোনো সম্পর্ক আমার নেই।উনারা মিথ্যা তথ্য পেয়েছেন।

রাগ-ক্ষোভে আগেই ফেটে পড়েছে তৃনয়।শুধু নিভান শান্ত করে রেখেছে তাঁকে।বোনের কান্নারত গলার কথা গুলো শুনতেই মেজাজ আরও চড়ে গেলো তার।উল্টো পাল্টা কথা বলতেই থাকলো।হলুদের আনন্দঘনো মূহুর্তটা মূহুর্তেই বিগড়ে গেলো।ননান মানুষের মুখে নানান কথা উঠলো।তাহমিনা বেগম চেয়েও মেয়েকে আর প্রশ্ন করতে পারলেন না।যেখানে মেয়ে নিজেই স্বীকারোক্তি জানাচ্ছে।সেখানে তিনি আর কি জানবেন শুনবেন।বকে ধমকে মেরে কি আর স্বীকারোক্তি নেবেন!নাকি সেই সত্য মিথ্যা স্বীকারোক্তিতে হারনো সম্মান ফিরে পাবেন।হঠাৎই উনার প্রেশার বেড়ে গেলো।
মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নিলেই পাশে দাড়ানো নীহারিকা বেগম সামলে নিলেন উনাকে।এটা-ওটা বুঝ দিতে থাকলেন।কিন্তু তাতে কি আর কাজ হয়!হলুদের দিনে মেয়ের বিয়ে ভেঙে যাওয়া কি সমাজের চোখে ভালো কথা!নাকি নীরবে মেনে নেবে সেকথা সমাজের মানুষ!
উনাকে ধরে ফাঁকা জায়গায় একটা চেয়ারে বসিয়ে দিশয়ে নানান বুঝদার কথা বলতে থাকলেন নীহারিকা বেগম।পাশে দাড়ানো পরিচিত অপরিচিত অনেকে তখন নীরব দর্শক।এখনো তন্ময়ীর পাশে মাথা নিচুকরে বসে আছে ইভান।ক্রন্দনরত চোখে সেটা দেখে ভারাক্রান্ত গলায় বললো তন্ময়ী।

‘খুশী হয়েছেন আমাকে অসম্মানিত অপদস্ত করে?সুখ পেয়েছেন,শান্তি হয়েছে আপনার?

মাথা নিচু করেই তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো ইভান।সে এটা কখনোই করতে চাইনি।তবে না করেও উপায় ছিল না তার।আর বিয়েটা ভাঙার ব্যবস্থা সে অনুষ্ঠানের আগেই করতে চেয়েছিলো, কিন্তু সেটাও হয়ে উঠেনি।মাথা কাত করে তন্ময়রীর মুখের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললো ইভান।–আমি খুশি হয়েছি কি-না,এটা আমার থেকেও তোমার অন্তর ভালোভাবে জানে।তবে এই সিচুয়েশনের জন্য দ্বায়ী একমাত্র তুমি!

তন্ময়ীর ক্রন্দনরত মুখ তীক্ষ্ণ শূলের ন্যায় বিঁধে এফোড় ওফোড় করতে থাকলো ইভানের বুক।দোষী সে-ও কম নয়,তবে পরিস্থিতি যে তাকে ঠিক করতেই হবে।অনেক সময় ধৈর্য্য নিয়ে বসে থাকলেও এবার আর বসে থাকতে পারলো না সে।উঠে আগে বাবা আর ভাইকে খুঁজলো।নিভানকে দেখলো তৃনয়ের সাথে কথা বলতে সেদিকে না এগিয়ে,মহিলা মানুষের আনাগোনা থেকে কিছুটা দুর নিজের হুইলচেয়ার বসে আছেন জাহিদ সাহেব।পাশে গোলটেবিলের চেয়ারে বসা উনারই বয়সি কিছু মানুষ।সবাই বিষয়টাতে বেশ চিন্তিত।তপ্ত শ্বাস ফেলে সেদিকে এগোলো ইভান।জাহিদ সাহেবের কাছে গিয়ে উনাকে হুইলচেয়ারসহ সেখান থেকে সরিয়ে একটু ফাঁকা জায়গায় নিয়ে দাঁড় করালো।তারপর নিজে মাটিতে হাটু উনার সামনে বসলো।চমকে ছেলের উষ্কখুষ্ক মুখের পানে চাইলেন তিনি।দূর থেকে সেটা নিভান দেখে এগিয়ে এলো।জাহিদ সাহেব বিচলিত কন্ঠে বললেন —কি হয়েছে ইভান?

ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে ধাতস্থ করলো ইভান।বাবার পানে শান্ত নজর রেখে,সদ্য এসে পাশে দাঁড়ানো নিভানের সুক্ষ ধারালো দৃষ্টিপানে চাইলো।ফের বললো।

‘বাবা,আমি তন্ময়ীকে বিয়ে করতে চাই।তার বিয়ে ভেঙে গেছে, তাকে উদ্ধারিত হতে পাত্রস্থিত হয়ে বিয়ে করতে চাইছি এমনটা নয়।আমি তাকেই বিয়ে করতে চাইছি।

“আমি তাকেই বিয়ে করতে চাইছি”।কথাটা নিভানের চতুর ব্রেইন,ইভানকে পর্যবেক্ষণ করা বুদ্ধিদিপ্ত নজর সহজে নিলো-না।মাথার মধ্যে বিষয়টা নিয়ে যেনো ঘুরপাক খেতে লাগলো।কোথাও দুইয়ে দুইয়ে এক কি করে হয় মিলাতে থাকলো।জাহিদ সাহেব,ছেলের আচারনে অবাক,বিস্মিত!কি বলবেন ভেবে পেলেন না।বড় ছেলে এখনো বিয়ে করেনি,ছোটোছেলে বিয়ে করার প্রস্তাব রাখছে!মুখ উঁচু করে পাশে দাড়ানো নিভানের মুখের দিকে তাকালেন তিনি।নিভান তখনো তীক্ষ্ণ চোখে ইভানের দিকে তাকিয়ে ভাবনায় মশগুল।তন্ময়ীর বিয়ের খবর পাওয়ার পর থেকে ইভানের ছন্নছাড়া আচরন।বাড়ির বাহিরের অধিকসময় কাটানো।সেদিন কৌড়ির সাথে বলা,ফাজলামো কথাগুলো কিছুটা শুনেছিলো নিভান।তবে বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি।আজ তন্ময়ীর পাশে ঘুরঘুর করা।বিষয়টা কেমন ঘোলাটে লাগলো নিভানের।জহরি নজরে ইভানকে খেয়াল করতে থাকলো।মাথানিচু করে রাখার মতো ছেলেতো নয় ইভান।নিজের কোনো জিনিস পছন্দ হলে বা চাওয়ার হলে চোখে চোখ রেখে কোনো আড়ষ্টতায় চেয়ে নেয় সে।তবে কোন অপরাধে আড়ষ্টতায় মাথা নিচু করে বসে আছে সে।তবে কি?উফফ…আর ভাবতে চাইলোনা নিভান।যেটা সে ভাবছে তেমন ছেলে নয় ইভান।এমন অন্যায়টা সে কখনোই করতে পারেনা।তন্ময়ীকে পাওয়ার হলে সে আর কারও কাছে না বলতে পারলেও,নির্দ্বিধায় তারকাছে বলতো।দু’ভাইয়ের সম্পর্ক তেমন না হলেও,এসব বিষয়ে ইভান কখনো নিজেকে তারকাছ থেকে চাপিয়ে রাখেনা। সেই ছেলে এটা কিকরে করতে পারে?

‘নিভান।

জাহিদ সাহেবের ডাকে মৃদু চমকে উনার দিকে তাকলো।উনার মুখ বলছে উনি ইভানের প্রস্তাবে ঠিক কি বলবেন বুঝে উঠতে পারছেননা।যেনো সম্মতিটা তাকেই দিতে বলছেন।নিভানও হঠাৎ কি বলবে খুঁজে পেলোনা।ইভান কাতরস্বরে ফের বলে উঠলো।

‘প্লিজ দাদাভাই সম্মতি দাও।আমি চাইছিনা ওই মেয়েটা আমার জন্য আর কাঁদুক।

“আমার জন্য কাঁদুক”মানে!জাহিদ সাহেব কথার অর্থটা না বুঝলেও নিভান চমকে উঠল।ইভানের কথায় যেনো নিভানের ভাবনা সব হিসাব কড়ায়গণ্ডায় মিলে যাচ্ছে। মূহুর্তেই রাগে মাথাটা দপদপ করে উঠলো তার।চোয়াল হয়ে উঠলো দৃঢ়-কঠিন।তবে মোটেই তা প্রকাশ করার ভুল করলো না।শক্তকন্ঠে শুধু জাহিদ সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললো।

‘আন্টির কাছে গিয়ে প্রস্তাব রাখতে বলুন ও-কে।দেখুন উনি কি মতামত প্রকাশ করেন।তবে এখানে তন্ময়ীর মতামতটাও বিশেষ জরুরী।সে মত না দিলে কিন্তু কিছুই হবেনা।

মূহুর্তেই অসহায় নজরে নিভানের দিকে তাকালো ইভান।দাদাভাই যে বুঝে গিয়েছে সব।আর তারপ্রতিও অসন্তুষ্ট হয়েছে ভিষন,বুঝতে বাকি রইলো-না ইভানের।
চোখ বুঁজে শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো ইভান।গুটিগুটি পায়ে তন্ময়ীর মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সে।
ভদ্রমহিলা চোখ বন্ধ করে চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছেন।চোখের কোণে উনারও নোনাজলের আনাগোনা।ইভানের অপরাধবোধ যেনো ভিতরে ভিতরে পাহাড়সম হলো।সবকিছু যেনো ছিন্নভিন্ন করে দিতে ইচ্ছে করলো।সময়টা টেনে নিয়ে তন্ময়ীর প্রথম দেখা সেই দিনটায় নিয়ে যেতে মন চাইলো।শুরুটা আবার সেখান থেকে যদি করতে পারতো,কতোই ভালোই না হতো।তবে তা এখন আর কোনোমতেও সম্ভব নয়। এখন আর সিচুয়েশন মোটেই বিগড়ে যেতে দিলে হবে-না।হাঁটু গেড়ে বসলো উনার সমানে ইভান।চোখ খুললেন উনি।উৎসুক প্রশ্নবিদ্ধ নজর।উনাকে ঘিরে তখন,উনার আত্মীয় স্বজনেরা দাড়ানো।সবাই ভিন্ন ভিন্ন ভালোমন্দ কথা বলেই চলেছে।সেসব উপেক্ষা করে ইভান সোজাসাপ্টা বললো।

‘আন্টি,আমি একজন বেকার ছেলে।নিজের আপতত পরিচয় বলতে,আমি জুনায়েদ জাহিদ ইভান।বাবা বা ভাইয়ের সাফল্যে আমি পরিচিত হতে চায়নি কখনো নিজেই বরাবর সাফল্য অর্জন করতে চেয়েছি।সেই সাফল্য অর্জন করার আগেই,আমি আপনার মেয়েকে চাইছি।জানিনা একটা বেকার ছেলের হাতে মেয়ে তুলে দেওয়া যায় কি-না,বা ঠিক কি-না!তবে আমি আপনার কাছে আপনার মেয়েকে চাইছি।একটা বেকার ছেলের হাতে কি আপনার মেয়েকে তুলে দেওয়া যায়?আমি কথা দিচ্ছি,এই বেকার ছেলে কখনো সুযোগ দেবে-না আপনার মেয়েকে অভিযোগ করার।

চলবে…