Monday, July 28, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 57



তোমার জন্য সব পর্ব-০১

0

#তোমার_জন্য_সব (১)
✍️ #রেহানা_পুতুল
“কি ব্যাপার? আপনারা তিনজন কেন এসেছেন?

“স্যার আপনি নাকি আমাদেরকে ডেকেছেন?”

“এটা কে বলল?”

“কলি বলেছে স্যার।”

মাহমুদ গম্ভীর মুখে কলির দিকে চাইলো। বলল,
“মিথ্যা বললেন কেন কলি? আমি কেবল আপনাকে ডেকেছি।”

“স্যার আমি ভেবেছি এসাইনমেন্টের বিষয়ে আমাদের তিনজনকেই ডেকেছেন।”
নিচু গলায় বলল কলি।

মাহমুদ বিরক্তিকর কন্ঠে কলিকে বলল,

“ভার্সিটিতে পড়ুয়া একজন স্টুডেন্ট হয়ে যদি সঠিকভাবে কথার না মানে বোঝেন। তাহলে পড়াশোনা বাদ দিয়ে দেন।”

কলি ভীষণ অপমানিতবোধ করলো। পাশে দাঁড়ানো থেকে খেয়া ও রিমি বলল,

“স্যার আসলে এটা নয়। সত্যিটা হলো ও আপনার কথা শুনতে পেয়েছে। নার্ভাসনেস থেকেই আমাদেরকে সঙ্গে করে এনেছে। সরি স্যার।”

” তারমানে নার্ভাস হওয়ার কাজ করেছে কলি।”

ওরা তিনজন চুপসে যায়। দৃষ্টি বিনিময় করে একে অপরের।
“খেয়া, রিমি আসুন।”

খেয়া,রিমি চলে যায়। মাহমুদ চেয়ার থেকে উঠে রুমের দরজায় গিয়ে দেখে ওরা গিয়েছে কিনা। আবার এসে চেয়ারে বসলো। কলি জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে টেবিলের সামনে। মাহমুদ ল্যাপটপে তার মেইলে প্রবেশ করলো। কলিকে নির্দেশ দিয়ে বলল,

“এই মেইলটা পড়ুন কলি। এবং আমাকে শুনিয়ে পড়তে হবে। রুমে অন্যকেউই নেই। পড়ুন। হারিআপ।”

কলির বুক ধড়পড় করছে। ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে। স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

“স্যার দেখতে পাচ্ছিনা।”

“স্টাচু হয়ে থাকলে কিভাবে দেখবেন। ঝুঁকে আসুন ল্যাপটপের সামনে।”

“স্যার আমার কথা শুনুন প্লিজ।”
ভীতু স্বরে বলল কলি।

“শোনাশুনির পাত্র মাহমুদ নয়। পড়ুন বলছি।”

মৃদু ধমকে বলল মাহমুদ। কলি ঝুঁকতে গেলে বুকের ওড়না পড়ে যেতে থাকে। হাত দিয়ে ওড়না সামলে নেয়। মাহমুদ ঠায় চেয়ে আছে কলির মুখাবয়বের দিকে। কলি কম্পিত ঠোঁটে শব্দ করে পড়লো বাংলায় লেখা মেইলটি।

“আপনি আমার নামে একটা মামলা দিবেন স্যার। নইলে আমিই আপনার নামে মামলা দিয়ে দিবো। তাহলে দুজনের দেখা হবে প্রতি সপ্তাহে। বলতে পারেন এটা আমার পক্ষ হতে আপনার জন্য একটা আল্টিমেটাম। হুহ!”

পড়া শেষে কলি শুকনো ঢোক গিলে নিলো।

মাহমুদের চোখদুটো মরিচ লাল হয়ে উঠলো। টেবিলে চাপড় মারলো। কলি কেঁপে উঠলো।

“আপনাকে ত দেখলে মনে হয় ভেজা মাছটিও উলটে খেতে জানেন না। নিরীহ গোবেচারা টাইপের। অথচ আস্পর্ধা হিমালয়ের মতো। একজন টিচারকে প্রপোজাল করা মেইলে নাহ? তাও আবার ভিলেন স্টাইলে। ইডিয়েট কোথাকার! পিছনের বেঞ্চে বসেন এসব অসভ্যতামি করার জন্য? অন্য কোর্সের টিচারদেরকেও সেইম মেইল দিলেন নাকি? আমি চাইলে ক্লাসে সবার সামনে বা এখন খেয়া,রিমির সামনে আপনাকে অপমানিত করতে পারতাম। কিন্তু আমি একজন টিচার। এটা আমার সঙ্গে যায়না। যদি ছোট হতেন বয়সে, চাপটে পিঠের চামড়া তুলে নিতাম। তাই ভদ্রভাবে আপনাকে সতর্ক করে দিচ্ছি। ইন ফিউচারে আমার ছায়া মাড়াতেও চেষ্টা করবেন না। কি মনে থাকবে? ”

“স্যার খুউব মনে থাকবে। তবে সত্যি বলছি এই মেইল আমি আপনাকে দেইনি। ওদেরকে ডেকে আনি। শুনে নিন।”

ভীরু ও বিব্রতকর স্বরে বলল কলি।

” দাঁড়ান। কাউকে ডাকতে হবে না।
যেই মেইল হতে আমাকে মেইলটা করা হয়েছে। এটা আপনার মেইল নয়?”

“স্যার…”

“এক শব্দে আনসার চাই। ইয়েস অর নো। এই মেইল আপনার নয়?”

“হ্যাঁ।”

“এনাফ। এবার আসতে পারেন।”

“আমাকে ভুল বুঝেছেন স্যার। বিষয়টা ভিন্নরকম।”

“গো আউট।”

কলির জলপূর্ণ চোখদুটো টলমল করছে। চোরের মতো পালিয়ে গেলো কলি মাহমুদের সম্মুখ হতে। ওয়াশরুমে ঢুকে পানির ট্যাপ ছেড়ে দিলো। হুড়মুড় করে আটকে থাকা অশ্রুগুলো ঠেলেঠুলে বেরিয়ে এলো আঁখিযুগল হতে। চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিয়ে দিলো। ক্লাসে গিয়ে ব্যাগ হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। সবাই যারযার মতো ব্যস্ত। খেয়া ও রিমি কলির পিছনে ছুটে এলো। হাত ধরে থামালো। কলি তাদের হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিলো প্রচন্ড ক্ষোভে।

“এই কলি। তোর মুখে অমাবশ্যা ভর করলো কেন? মাহমুদ স্যার কি বলল?”

“তোদের সঙ্গে আর কোন কথা নয়। তোদের জন্যই আজ মাহমুদ স্যার আমাকে কি ইনসাল্ট না করলো।”

কলি স্যারের বলা সবকথা ওদেরকে শুনালো।
“স্ট্রেঞ্জ! এতদিন পরে স্যার মেইলদাতাকে খুঁজে বের করলো কেন?”

“তা আমি কি করে জানি। গেলাম। ভালোথাকিস তোরা।”

কলি লম্বা লম্বা পা ফেলে ভার্সিটির আঙিনা ছেড়ে যায়। খেয়া ও রিমি অনুতপ্ত হয়। ঠিক করে দুজনে মিলে স্যারকে সত্যিটা বলে দিবে। রিমি খেয়াকে বলে,

“দোস্ত, এই ক্যাবলাকান্তরে মুরগী বানাতে গিয়ে নিজেরাই মনে হয় এখন মুরগী হতে হবে। সত্যিটা বলা যাবে?”

“আরেহ ছাড় মামু। একটা বুদ্ধি বের করবো। জাস্ট ওয়েট।”

“কিভাবে? দেখলি কলিরে কি ধোলাই দিলো। তুই কিভাবে হাত করবি তোর ড্যাসিং হিরো মাহমুদ খানকে?”

খেয়া ফিচলে হাসে। বলে,

“কলি দেখতে কেমন ল্যাবেনডিস। গেঁয়ো। আর আমার লুক দেখ। ম্যালা ডিফারেন্স। বুঝলি রিমিঝিমি।”

“আহ প্রেম! মধু মধু! তুই পারবি। হিম্মতি বালিকা।”

বনানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদ খান। এই বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েই তার কর্মজীবন শুরু। লেকচারার, সিনিয়র লেকচারার, অতিক্রম করে সদ্য সহকারী অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হয়েছেন নিজ মেধায় ও প্রজ্ঞায়। শিক্ষক পিতা আবদুর রহমানের একান্ত ইচ্ছে ছিলো ছেলেও যেন তার মতো এই মহৎ পেশায় যুক্ত হয়। সেভাবেই ছেলেকে গড়ে তুলেছেন।

পনেরো দিন আগে আসা মেইলটি হঠাৎ মাহমুদের চোখে পড়ল সাতদিন পূর্বে। অবাক হয়ে গেলো সে। কয়েকবছর ধরে আছে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। অথচ এমন অপ্রীতিকর কিছু কখনো তাকে ফেইস করতে হয়নি। ভয়ানক ক্ষেপে গেলো সে। মেইলটা এসেছে একটি ছেলের মেইল এড্রেস হতে। তার ডাউট হলো। একটা ছেলে তাকে এমন মেইল দিবে কেন? ব্যস্ততার ফাঁকে অবসর পেলেই সে বিভিন্ন পক্রিয়া চালিয়ে যেতে লাগলো। উদ্দেশ্য খুঁজে বের করে পানিশমেন্ট দিতে হবে মেইলকারীকে। নয়তো প্রশ্রয় পেয়ে যাবে। অবশেষে সে নিশ্চিত হলো এটা একটি মেয়ের মেইল এড্রেস। কিন্তু কে সেই মেয়ে। মাহমুদ কৌশল করে সেই মেইলের রিপ্লাই দেয়।

“কাল তুমি ক্লাসে আসার সময় ভার্সিটির মেইন গেইটের পাশে যে কাঁচা ফুলের দোকান রয়েছে। সেখান থেকে দুটো গোলাপ নিয়ে নিও। আমার পক্ষ থেকে গিফট তোমার জন্য। আমি বলে রেখেছি। আমি নিরস মানুষ। রস করে মেইল দিতে পারলাম না বলে দুঃখিত!”

পরেরদিন দশটায় মাহমুদ একটি ফটোকপির দোকানের ভিতরে দাঁড়িয়ে থাকে। বাহানা করে কিছু সিট ফটোকপি করতে দেয়। তবে সুক্ষ্ম চাহনি পথের উপরে। দেখলো কলি নামের ভোলাভালা মেয়েটি ফুলের দোকানে গিয়ে দাঁড়ালো। ইতি-উতি চাইলো। দোকানিকে কিছু একটা বলল। এবং দোকানি তাকে টকটকে দুটো তাজা ফুটন্ত গোলাপ হাতে দিলো। কলি ফুলগুলো হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে রেখে দিলো। না নিয়ে চলে গেলো।

পিছন দিয়ে মাহমুদ দোকানে এসে জানতে চাইলো,

“মামা মেয়েটি ফুল নিল না কেন?”

“কি জানি স্যার। রাইখা চইলা গ্যালো। কিছুই কইল না।”

মাহমুদ বিস্মিত হলো কিছু কারণে। কলির মতো শান্ত স্বভাবের মেয়ে তাকে এই মেইল দিতে পারলো? কিন্তু কেন সে ফুল নিলনা। হয়তো হাতে তুলে দেওয়া হয়নি বলেই। আরো বিস্মিত হলো, সে ভেবেছে এটা খেয়ার কাজ। খেয়া মেয়েটি বেশ চটপটে ও মর্ডান। পোষাকেই বোঝা যায় ধনীর দুলালি। যদিও তার সঙ্গে কখনো অমার্জিত আচরণ করেনি। কি আশ্চর্য! মানুষ ভাবে এক হয় আরেক।

মাহমুদ ভীষণ চটে আছে আছে কলির উপরে। ক্লাসে গিয়ে নোট দেখার অজুহাতে কলিকে আস্তে করে বলল, যেন ক্লাশ শেষে তার অফিস-রুমে যায়। কলি নার্ভাস ফিল করে। খেয়া ও রিমিকে নিয়ে যায়। তবুও রক্ষা পায়না মাহমুদ স্যারের তর্জন গর্জন হতে। কঠিন ভাষায় ঝেড়ে তার হৃদয়টা ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। তাহলে ফুল রাখলো কেন? তাকে ধরার জন্য? সেটাই হবে।

সেদিনের পর হতে কলিকে ভার্সিটিতে ক্লাসে আর দেখা যায়নি। মানুষ মন্দ এবং ভালো দুটো কাজের জন্যই কারো নজরে পড়ে যায়। তাই কলিকে মাহমুদ মন্দ কাজের জন্যই ভালো করে চিনে নিলো। একদিন ক্লাসে গিয়ে ওর কথা জিজ্ঞেস করলো মাহমুদ।

“কলি নামের মেয়েটি আসেনা কেন? কেউ বলতে পারবেন?”

মাঝ বেঞ্চ হতে কেউ একজন গলা তুলে বলল,
“স্যার কলি আর কোনদিন ক্লাসে আসবে না। স্টাডি ছেড়ে দিয়েছে।”

চলবে।

ফুলকৌড়ি পর্ব-৬০+৬১

0

#ফুলকৌড়ি
(৬০)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

সারারাত মুশলধারায় বর্ষনের পর ভোরের দিকে বর্ষার তোপ কমেছে।প্রকৃতি এখন নিস্তব্ধ, শান্ত।কিছুটা ঠান্ডাভাবও নেমেছে।তারমধ্যে শীততাপনিয়ন্ত্রক রুমটা বেশ আরামদায়ক।কৌড়ি বিভোরে ঘুমাচ্ছে।সামন্য নড়চড় নেই।যেনো রূপকথার রানী,তার শ্রান্ত শরীরটা ঘুমের দেশে বিলিন করে দিয়েছে।গায়ের চাদরটা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো।ঘুমের ঘোরে একপেশে হয়ে শোয়ার কারণে শুভ্র পিঠের কাঁধের অংশটা ঝলমলে রোদ্দুরর মতো উঁকি দিচ্ছে।শুভ্র গলার অংশটাও ।যেখানে এখনো স্পষ্ট হয়ে আছে,নিভানের উন্মাদিত হয়ে বউকে ভালোবাসার চিহ্ন।মাথার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিছনায়।মায়াবিনী মুখটাও ঢেকে আছে।সেখান থেকে মৃদুমন্দ উঁকি দিচ্ছে ফর্সা গাল।
নিভান গায়ে শার্ট জড়াতে জড়াতে খেয়ালি নজরে দেখলো বউকে।মুলত হাতে কাজ চললেও,সুগভীর,শান্ত মুগ্ধ চোখজোড়া তার বউতে আঁটকে।সারারাত তাকে কাছে পাওয়ার পরও মেয়েটা যেনো এখনো তাকে টানছে।অথচ ঘন্টাখানেক পর তার কনফারেন্স শুরু।সেখানে এ্যাটেণ্ড থাকতে হবে আরও আধাঘন্টা আগে থেকে।বিধায় অনুভূতিকে প্রশ্রয় না দিয়ে বাধ্য হয়ে মেয়েটাকে ছেড়ে উঠতেই হলো নিভানকে।

মৃদু নড়েচড়ে উঠলো কৌড়ি।মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে নিলো।নড়াচড়ায় ফর্সা কাধটা আরও একটু উন্মুক্ত হলো।জানালার কাচ ভেদ করে পর্দার ফাঁকফোকড় দিয়ে সূর্যের রশ্মিটা সেই কাঁধে পড়তেই পূর্নিমা চাঁদের মতো দ্যুতি ছড়ালো। আকর্ষিত করলো।নিভান সেদিকে চেয়ে শার্টের বাটুন লাগাতে লাগাতে পূবদিকের বিশাল বড় কাঁচের জানালাটার কাছে চলে গেলো।পর্দাটা বেশ আঁটোসাঁটো করে টেনে দিতেই, সকাল নয়টায়ও রুমটা কেমন সাঝবেলা মনেহলো।নিভান পুনরায় নিজের স্থানে ফিরে এসে নিজেকে প্রস্তুত করতে ব্যস্ত হলো।
অথচ ঘুরেফিরে নজর তার কৌড়িতে।নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়ে কৌড়ির পাশে বিছানায় গিয়ে বসলো নিভান।কৌড়ির চোখেমুখে ঢেকে থাকা এলোমেলো চুলগুলো নরম স্পর্শে সরিয়ে দিলো।উন্মুক্ত হলো আদূরে মায়াময় মুখটা।সেই ঘুমান্ত মুখটা অদ্ভুত শান্ত মুগ্ধ নজরে চেয়ে চেয়ে দেখলো কিছুক্ষণ।কালরাতে নিজের অনুভূতি, নিজের পুরুষ চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি এই মায়ামায়া মুখটার আকর্ষণের কবলে পড়ে।এমনিতেই মেয়েটাকে নিভানের কারণে অকারণে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।যার সর্বোচ্চ সীমাটা ছাড়িয়েছে সে কালরাতে।আপনমনেই ঠোঁটে হাসি ফুটলো নিভানের।হাত বাড়িয়ে ছুলো,কৌড়ির ফর্সা কাঁধের মৃদুমন্দ রক্তজমাট জায়গাটায়।ফের মাথা নিচু করে ঠোঁটের গভীর স্পর্শ বসালো সেখানে।কৌড়ি ঘুমের ঘোরেও কেপে উঠলো।নিভান টের পেলো।ঠোঁটের হাসিটা তার চওড়া হলো।কালরাতে তার প্রতিটি স্পর্শে মেয়েটা এভাবে কেঁপে কেঁপে উঠেছে।

নিভানের ঠোঁটের স্পর্শ স্ত্রীর কাঁধ ছুলো গলা ছুলো,নরম গালটা ছুলো।ফের গভীর স্পর্শটা ছুলো কৌড়ির কপাল।এতো আদূরে মেয়েটা!নিভানের ভালোবাসা আদরে যেনো বউটার কোনো বাধানিষেধ নেই।নিভান নিবেদিত করলেই,সে যেনো সেই আদর ভালোবাসাগুলো কুড়িয়ে নিতে ব্যস্ত সযত্নে।কৌড়ি সম্পর্কে কিছু ধারণা তার কালরাতের পর পাল্টে গিয়েছে।নিভান মিষ্টি হাসলো।কৌড়ির গায়ের চাদরটা ঠিক করে দিয়ে ফের আলতো করে তার কপালে আরও একটা চুমু দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আর দেরী করা যাবে-না। সময় হয়ে যাচ্ছে।

হঠাৎ কিছু একটা ভেবে কৌড়ির ফোনটা হাতে নিলো।
ফোনে সল্প চার্জ আছে দেখে,চার্জে বসিয়ে দিলো ফোনটা।একবার চেইক করে-ও নিলো,কল করলেই যেনো কৌড়িকে পাওয়া যায়।ফোনটা সাইলেন্ট নয় নরমাল মুডে আছপ।দেখেই রেখে দিলো ফোনটা।হঠাৎ দরজায় নক পড়তেই সেদিকে এগলো।দরজা খুলে দেখলো,হোটেল সার্ভিস-বয়।সকালে উঠতেই খাবার অর্ডার করে ওয়াশরুমে গিয়েছিলো নিভান।যা নিয়ে এসেছে ছেলেটা।খাবারগুলো গুছিয়ে রেখে,নিভান পুনরায় আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।গায়ে ব্লেজার জড়িয়ে অফিশিয়াল ব্যাগটা গুছিয়ে নিয়ে চলে যেতে উদ্যোক্ত হতে-ও,বিছনার কাছে এসে দাঁড়ালো।পুনরায় বিছনায় বসলো।গভীর নিদ্রায় ডুবে থাকা বউটাকে একপলক দেখে কলম আর কাগজ বের করে কিছু লিখলো।সেটা টেবিলের উপর কৌড়ির হেয়ারক্লিপটা দিয়ে চাপা রেখে ফের উঠে দাঁড়ালো।কৌড়ির গায়ের চাদরটা আবারও সরে গিয়েছে। সেটা ঠিক করে দিয়ে বউয়ের গালে নরম স্পর্শে ওষ্ঠ ছুঁয়ে নিজের কাজে বেরিয়ে গেলো।

নিভান বেরিয়ে যেতেই ঠোঁটে হাসি ফুটলো কৌড়ির।ঘুম চোখে সে হাসি সাঝ সকালে ঝিলে ফোঁটা চমৎকার পদ্মফুলের মতো দেখালো।গভীর ঘুমটা কৌড়ির এখনো কাটেনি তবে নিভান কাছে আসায় পারফিউমের তীব্র সুঘ্রাণে ঘুমটা হালকা হয়ে গিয়েছে তার।তবে লজ্জায় দ্বিধায় ভুলেও চোখ খুলতে পারি নি।তার এখানো অনুভব হচ্ছে, মানুষটা তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে লেপ্টে আছে।সকাল হতে না হতেই কি-করেই বা সেই মানুষটার চোখে চোখ মেলাতো সে!কাল রাতটা মনে করে লজ্জায় গায়ের চাদরটা আরও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিল কৌড়ি।না দেখেও হাত বাড়িয়ে বেডটেবিলটা থেকে একটু আগে নিভানের লিখে যাওয়া চিরকুটটা হাতের মুঠোয় নিলো।মুদে থাকা চোখজোড়া পিটপিট করে চিরকুটটার দিকে তাকিয়ে রইলো।

নিভানের বনলতা,
ঘুম ভেঙে নিজেকে একা রুমে পেয়ে ভয় পাবে-না কিন্তু একদম।আমি হোটেলের ছয়তলার কনফারেন্স রুমে আছি।তোমার কাছাকাছিই আছি।দ্বিতীয়ত,উঠে ফ্রেশ হবে,খেয়ে নেবে।আর অবশ্যই অবশ্যই ঔষধ খাওয়ার কথা মনে থাকে যেনো!আমি কিন্তু এসে ঔষধ চেইক করবো।সুতরাং ভুলেও যেনো ঔষধ খাওয়াটা মিস না হয়ে যায়।তৃতীয়ত,কোনো অসুবিধা মনে করলে অবশ্যই ফোন করবে লক্ষ্মীটি।

ইতি
তোমার অসভ্য মানুষটা।

আদূরে আদূরে সম্বোধনে কৌড়ির ভিতরটা পুলকিত হলো।মুগ্ধতায় ভরে উঠলো মন।ভালোবাসা প্রগাঢ় হলো সেই মানুষটার প্রতি যে,তাকে তার মনের মতো করে ভালোবাসছে।ওই মানুষকে তার মতো খুব কাছ থেকে না দেখলে, না জানলে কেউ বুঝতে পারবেনা,আসলে মানুষটা ঠিক কেমন?কতোটদ সুন্দর, কতোটা যত্নশীল!কতোটা মুগ্ধকর তার আচরণ!সম্পর্কের প্রতি সে কতোটা বিনয়ী শ্রদ্ধাশীল আর কতোটা অমায়িক!নিজের একান্ত নারীকে গভীরভাবে ভালোবাসতে পুরুষ ঠিক কতোটা বিনয়ী আচারণ করে কৌড়ির জানা নেই। তবে তার পুরুষটা অদ্ভুত অন্যরকম, আলাদা।কালকের রাতটার পর সেই পুরুষটার প্রতি কৌড়ির মায়া,টান ভালোবাসা দ্বিগুণ হয়েছে।দ্বিগুণ নয় গুণহীন হয়েছে।সে ওই মানুষটাকে চায় তার জীবনআয়ু যতদিন চলবে ততোদিন পর্যন্ত।এমনকি মরণের পরবর্তী জীবনে-ও।কৌড়ি আনমনে হাসলো।চিরকুটটা রাখতে গিয়ে দেখলো অপর পৃষ্ঠায়-ও কিছু লেখা আছে।কৌড়ি পৃষ্ঠা উল্টে চোখের সামনে ধরলো।

পাখির নীড়ের মতো সেই মোহমায়া দুটো আঁখি!
যারা কেঁড়ে নিয়েছিলো আমার নৈশর নিদ্রা।
যে আঁখি ভুলতে চেয়ে হৃদগহীন আমার দ্বন্দ্বে জড়ালো।
যার মায়ায় আমার দিন ডুবলো,সন্ধ্যা নামলো।
তবুও না সে আখির মায়া না আমায় ছাড়লো
বরং আমার নিজস্বতা ভুলিয়ে,আমার মধ্যে তাকে বরণ করলো।
গন্তব্য আমার থমকে গিয়েছিল,সেই শোভিত মুখশ্রীতে।
যার কারুকার্যতার মনোমুগ্ধতা ডুবিয়েছে আমাকে, অতল মায়ার কোনো যাদুর বনশ্রীতে।
আমি ছিলাম অন্যমনা,
তবে সেই আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম তার চলাবলা আর বানীতে।
আজ আমার অস্তিত্ব অস্তমিত হলো সেই মায়াবীনিতে।

নিভানের বনলতা,নিভান নিজেকে বারংবার তোমাতেই হারিয়ে ফেলতে চাই।তোমাতেই নিজের অস্তিত্ব অস্তমিত করতে চায়,আমার ভালোবাসা।

কাব্য শেষে লেখাটুকু পড়ে কৌড়ি আবেগপ্রবণ হলো।
সবসময় ওই কঠিন গম্ভীর মুখ করে থাকা মানুষটাকে দেখলে,কেউ কল্পনাও করতে পারবেনা,মানুষটা তার স্ত্রীর কাছে ঠিক কতোটা আবেগী।কতোটা উন্মুক্তমনা।
কৌড়ি সেই মানুষটার স্ত্রী!বড়োই আশ্চর্য লাগে তার।কখনো ভাবেনি ওই মানুষটার সম্মুখীন দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারবে অথচ সেই মানুষটার শরীরজুড়ে থাকে সে।তার বলিষ্ঠ বুকের মধ্যে আর দু’হাতের বাহুবন্ধনীতে আজ সে আগলে রাখা মুকুল।নিজেকেও মাখিয়েছে মানুষটাজুড়ে।চিরকুটটা হাতের মুঠোয় নিয়ে বুকে জড়ালো কৌড়ি।যেনো নিভানের হাতের লেখা নয়,নিভানের হাতটাকে নিয়েই বুকে জড়ালো সে।সেভাবেই পরম আবেশে চোখ বুঁজে নিলো।বিড়বিড় করে ঠোঁট নাড়িয়ে আওড়ালো–কৌড়িতো আপনাতেই হারিয়ে গেছে,আপনাতেই অস্তমিত হয়েছে।সেই হারানোর গভীরতা যে বড়োই সুদূরপ্রসারী।আর অস্তমিত!এই অস্তমিত সূর্যের আলোকরশ্মির মতো নয়,একটা নির্দিষ্ট সময়ে সে উঠলো আবার একটা নির্দিষ্ট সময় গড়িয়ে সে ডুবে গেলো।এই অস্তমিত বহমান নদীর মতো নিজেকে তারমাঝে বিলিন করে দেওয়া।যেখানে সে নিজেকে ডুবালেও,অস্তিত্ব হারায়না।বরং উল্টে শান্তি আর সুখের প্রবাহমান স্রোত খুঁজে পায়।

দুপুরের রান্নার বন্দোবস্ত করছিলেন নীহারিকা বেগম।যদিও সরঞ্জাম সব গোছগাছ করা।উনার কাজ হলো, শুধু চুলার তাপে বসিয়ে পাকানো।তন্মধ্যে তারমধ্য দুটো তরকারি শেষ করে মাংসকষার খুন্তিটা স্বান্তনা রহমানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে নীহারিকা বেগম ছুটে চললেন জাহিদ সাহেবের গোসল সারতে।উনার গোসলের সময় হয়ে গেছে,দেরী করলে অস্বস্তিতে ভোগেন।তাই স্বামীর সেবায় ছোটো জায়ের হাতে কাজ ফেলে ছুটলেন তিনি।কিচেনের সিংয়ে ধোয়াপোঁছার কাজ করছে রানী।নীহারিকা বেগম ছুটতেই,স্বান্তনা রহমান আর রানী টুকিটাকি কথা বলতে বলতে দুজনে নিজেদের কাজে মগ্ন রইলেন।তন্মধ্যে ফাতেমা খাতুন নিজের ঘর থেকে হাঁক ছাড়লেন।

‘ছোটোবউমা,রাণীকে একবার আমার রুমে পাঠাওতো।

দু’বার হাক ছেড়ে কথাগুলো বলতেই স্বান্তনা রহমান পিছে ফিরলেন।রানি কেবল ধোয়াপোঁছার কাজে হাত দিয়েছে।সিংয়ে অনেক থালাবাসন।মুখ ফিরিয়ে কন্ঠ উচু করে শ্বাশুড়িকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন–আম্মা খুব দরকার। আমিই আসবো?

‘না,তোমার আসতে হবেনা।আমার একটু কাজ ছিলো রাণীকে দিয়ে।যাই হোক,ও কাজে থাকলে পরে পাঠিও।

রানীর হাত ততক্ষণে থেমে গেছে।সেটা দেখে স্আান্তনা রহমান বললেন –রানী আপা,যা-ও দেখো আম্মা কি বলছেন।

রানী হাত ধুয়ে কিচেন ছাড়ার আগেই স্বান্তনা রহমান কিছু একটা মনে করে ফের ডাকলেন তাকে–আপা।তন্ময়ী বাড়িতে নেই?ও কি ভার্সিটিতে গিয়েছে?ওকে দেখছি না তো?

‘ছোটো বউমাতো নিজের রুমে। বেশ কয়েকদিন ধরে দেখছি চোখমুখের অবস্থা ভালো-না,শরীরটা মন্দমন্দ ভাব।জিজ্ঞেস করলেই।বলে,তেমন কিছুনা।এমনিতেই শরীর খারাপ।বড়ভাবী তো সকালেও শুধালেন।

শুধিয়েছেন তো তিনিও।রানীর বক্তব্যের মতো একই উত্তর পেয়েছেন।কিন্তু ইদানীং মেয়েটার হাবভাব ভালো ঠেকছেনা উনার।তন্ময়ীর এই হঠাৎ শরীর খারাপের ভাব,চোখমুখের ক্লান্ততা উনাকে অন্যকিছু ইঙ্গিত দিচ্ছে।তবে তাই যদিই হয়ে থাকে,তবে বিষয়টা জানাতে দ্বিধা কিসের?নাকি লজ্জায় জানাতে পারছেনা মেয়েটা?নাকি তিনিই ভুলভাল ভাবছেন?প্রাপ্তবয়স্ক দুজন ছেলেমেয়ে এতো তাড়াতাড়ি কি ফ্যামিলি প্লানিংয়ে যাবে?তাই যদি হবে,তবে মেয়েটার হোলোটা কি?ইদানীং খাওয়া দাওয়াও তো ঠিকঠাকভাবে করছেনা তন্ময়ী।খাবার দেখলেই যেনো দূরেদূরে থাকছে।বিষয়টা লক্ষ্য করেছেন তিনি।

‘ভাবী আমি আম্মার কাছে গেলাম।

হুঁশে ফিরলেন এমনভাবে রানীর দিকে তাকালেন তিনি।ফের বললেন–আচ্ছা যাও।যাবার আগে তন্ময়ীকে একবার ডেকে দিয়ে যেওতো।

‘আচ্ছা ছোটোভাবী।

রানী চলে গেলো।স্বান্তনা রহমান নিজের কাজে মন দিলেন। তন্ময়ীর সঙ্গে সঙ্গে উনার আরও একটা ভাবনা মাথায় এলো।ইদানীং শাহেদ সাহেবের আচারণ কেমন অস্বাভাবিক ঠেকছে।বাড়িতে থাকলে,কেউ ফোন দিলেই দূরে গিয়ে কথা বলছেন।শান্তশিষ্ট মানুষটার আচারণ কখনো গম্ভীর ছিলোনা।তবে ইদানীং কেমন গম্ভীর গম্ভীর ভাব।যা তিনি শুধিয়েও উত্তর পাচ্ছেন না।

‘কিছু করতে হবে ছোটোমা?

ভাবনা কাটলো উনার।হলদেটে উজ্জ্বল মুখটা কেমন শুকিয়ে ছোটো হয়ে আছে।চশমার আড়ালের চোখদুটোতেও কেমন যেনো ক্লান্তি ভরপুর।আচ্ছা, ইভানের সাথে মেয়েটার সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো?স্বান্তনা রহমানের ভাবনার মাঝে,তন্ময়ী সিংয়ভরা বাসনকোসন দেখে সেদিকে এগোলো সে।শ্বশুর বাড়ীতে তাকে মেয়ের মর্যাদায় পুতুল করে রেখেছে বললে চলে।তবুও মেয়ে হলেও তো হাত পা নেড়ে খেতে হয়।একটু আধটু কাজ না করলে কি হয়!মায়ের বানী অনুযায়ী তন্ময়ী কাজ না করলেও শ্বাশুড়ি, চাচাশাশুড়ির সাথে সাথে থাকার চেষ্টা করে। ইদানীং তাও পারছেনা।মনে হচ্ছে এই বুঝি তার হাবভাব টের পেয়ে তারা ধরে ফেললো।আর জেনে ফেললো নতুন অতিথি আসার আগমন। যদিও এটা চেপে রাখার বিষয় নয়।তন্ময়ী চেপে রাখাটা যুক্তিযুক্তও মনে করেনা।তবুও মনেমনে ইভানকে নিয়ে একটা সংশয় কাজ করছে!সেই সংশয় কাটিয়ে সুখসংবাদটা ইভানকে দিতে চেয়েও পারছেনা সে।বাসনে হাত দেওয়ার আগেই স্বান্তনা রহমান তন্ময়ীর হাত চেপে ধরলেন। বললেন-

‘আমি তোমাকে এখানে কাজ করানোর জন্য ডাকেনি।
আর ওগুলোতে তোমাকে হাত লাগাতে কে বলেছে!রানী এসে করে নেবে।তোমাকে ডেকেছি অন্যকারণে।সত্যি করে বলো-তো তোমার কি হয়েছে?ইভানের সঙ্গে কিছু হয়েছে কি?

হঠাৎ প্রশ্নবানে হকচকিয়ে গেলো তন্ময়ী।কিছুটা আমতা আমতা করে বললো–আমার কি হবে।আর ইভানের সঙ্গে কিচ্ছু হয়নি আমার।সবকিছু ঠিক আছে ছোটো-মা।

স্বান্তনা রহমান কেমন তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে ফের প্রশ্ন করলেন–‘কিচ্ছু হয়নি?সব ঠিক আছে?

তন্ময়ী জবাব দিতে পারলো না।সত্যি বলতে শ্বাশুড়ি আর চাচীশ্বাশুড়ী দুজনেই অমায়িক মনের মানুষ।ছেলে মেয়েদের ভালোমন্দে তারা বেশ নজরদারি এবং খবরদারি।তাদের চোখ এড়ানো সহজ নয়।তন্ময়ীও চায় না, সেই নজরদারি খবরদারি চোখ তার বেলায় ফাঁকি যাক।তবে..

‘আমি মান্যতা, মৌনতা,তোকে,কৌড়িকে কখনো আলাদা ভাবিনা।দেখিনা।ভাবতে চাইওনা।দেখতে চাইও না।আমি ভাবি তোরা সবাই আমার নিজের।সেখানে আমি একজন মা।আমার নজর বলছে,তোর কিছু একটা তো হয়েছে।হয়তো ইভানের সঙ্গে কিছু।নয়তো…

‘বিলিভ মি,আমার ইভানের সঙ্গে কিচ্ছু হয়নি ছোটমা।

‘তবে কি তুই প্রেগন্যান্ট?

সহসা মুখের উপর প্রশ্ন পড়তেই তন্ময়ী জবাব দিতে পারলোনা।মাতৃত্ব ব্যাপারটা ঢাকাচাপার জিনিস নয়, তবে কোনো একটা কারণের সংশয়ে পড়ে সে কাওকে নিজের প্রেগন্যান্সির কথা জানাতে পারছিলোনা।বাড়ির সবাই হয়তো সুসংবাদটা শুনে খুব খুশি হবে।বাট ইভান!সে কি খুশি হবে?যে এখনো নিজের ক্যারিয়ার গোছাতে ব্যস্ত।সে কি আদৌও এতো তাড়াতাড়ি নতুন কারও আগমনটা মেনে নেবে?নিতে পারবে?দোষ কি তন্ময়ীকে দেবে না যে,তুমি একটু সতর্ক থাকতে পারলেনা?নাকি সহজভাবে মেনে নেবে।আজ কয়েকদিন ধরে এসব ভেবে চলেছে তন্ময়ী।কয়েকবার ভেবেছে,ইভানকে সে বলে দেবে।যা হয় হবে!স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসায় একটা নতুন প্রানের আগমন ঘটতেই পার।এটা দোষের বা কি? আর এতো ভাবাভাবির ও বা কি?তবুও বলতে পারিনি।বরং তার কি হয়েছে জানতে চেয়ে ইভানকেই উল্টো কাল আবোলতাবোল বলেছে।ইদানীং ঘনোঘনো মুডসুয়িং হচ্ছে।এই ভালো তো এই খারাপ।কি যে হচ্ছে! উফফ!এতো সিদ্ধান্তহীনতা তাকে আরও অসুস্থতাবোধ করাচ্ছে।

‘তন্ময়ী।কি হয়েছে?কি ভাবছিস এতো? আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি তোক?তুই প্রেগন্যান্ট?

তন্ময়ী এবার অসহায় মুখ করে স্বান্তনা রহমানের দিকে তাকালেন।তাতে উনি বোঝার বুঝে নিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁটে হাসি ফুটলো উনার।উচ্ছ্বসিত গলায় বললেন-এত ভালো একটা খবর, তুই আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখছিস পাগল মেয়ে!নিশ্চয় লজ্জায় বলতে পারিসনি?ইভান জানে?

শেষের বাক্যের উত্তর সরূপ তন্ময়ী মাথা নেড়ে না জানালো।তা দেখে স্বান্তনা রহমানের হাসি চওড়া হলো। মেয়েটা লজ্জা পেয়ে কাওকে জানাইনি।তন্ময়ীকে কাছে টানলেন তিনি।বুকে জড়িয়ে নিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বললেন–ওরে বোকা মেয়ে,এতো সুন্দর সুসংবাদ তুই ওকেও জানাসনি!আল্লাহ.

আজ কয়েকদিন বাদে তন্ময়ীর মুখে হাসি ফুটলো।এবার যেনো অনুভব হলো,সত্যিই সে মা হতে চলেছে।লোকে ঠিকই বলে,খুশি ভাগ করে নিলে খুশি দ্বিগুন হয়।সেই খুশির মর্মতাও খুব সুগভীর আর আনন্দদায়ক হয়।আচ্ছা, নতুন প্রানের আগমনে ছোটোমা যতোটা খুশি তারচেয়ে তো দ্বিগুণ খুশি ইভানের হওয়ার কথা। সে কি খুশি হবে?তন্ময়ীর ভাবনার মাঝে উচু গলায় স্বান্তনা রহমান হাঁক ছাড়লেন।–ও বুবুনি!তুমি কোথায়?তাড়াতাড়ি এদিকে এসো।

কানে স্বান্তনা রহমানের হাঁক যেতেই নীহারিকা বেগম কেমন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন।গায়ের এ্যাশ কালারের কালো পাড়ের শাড়ীটা অর্ধভেজা।জাহিদ সাহেবকে গোসল করাতে গিয়ে রোজ এরকমটা অর্ধভেজা হয়ে যান তিনি।জাহিদ সাহেবকে গোসল করিয়ে পোশাকটা কোনোমতে গায়ে জড়াতেই স্বান্তনা রহমানের হাক শুনতেই দৌড় দিলেন তিনি।নাজানি কি না কি হয়েছে?কিন্তু কিচেনে আসতেই চিত্র অন্য রকম দেখে পায়ের গতি কমালেন।ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন, কি হয়েছে তার ঠিক নেই?কিছু হয়নি দেখে স্বস্তির শ্বাস নিলেন।নীহারিকা বেগমকে দেখতেই স্বান্তনা রহমান কেমন উচ্ছ্বসিত গলায় বললেন–বুবুনি,তুমি এসেছো?তোমার ছোটো বউমা তো কান্ড ঘটিয়ে বসেছে!

তন্ময়ী লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো।স্বান্তনা রহমান বলেই চললেন–তোমার ছোটো বউমা মা হতে চলেছে।আর তোমার ছোটো ছেলে বাবা!

ওহ আল্লাহ, বলিস কি?আমি দাদি হবো!

বিস্ময়ে মুখে হাত চেপে ধরলেন তিনি।তন্মধ্যে স্বান্তনা রহমান উচ্ছ্বসিত গলায় বললেন-আরেহ তুমি একা দাদি হবে কেনো।আমরা দাদি হবো।

‘ওই তাই।আমরা দাদি হবো।এতো মহা সুসংবাদ!

নীহারিকা বেগম আনন্দে বাকহারা হলেন।তন্ময়ীর কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে নিলেন বুকে।কপালে চুমু খেলেন,মাথায় চুমু খেলেন।বিস্ময় হয়ে থাকা মন ভাবতে বসলেন,তার দুষ্টু ছেলেটা বাবা হবে!ঈশশ,সেই চঞ্চল, দুষ্ট,প্রানবন্ত ছেলেটা তার বাবা হবে!বাবা!ততক্ষণে স্বান্তনা রহমানের হাঁকে কিচেনে একটা জটলা বসে গেলো।বাড়িতে যে ক’জন মানুষ ছিলেন সবাই হাজির হলেন।সুসংবাদটা সবার কানে যেতেই খুশির হাট বসলো যেনো।হৈচৈ পড়ে গেলো পুরো বাড়িতে।

‘আরেহ হাফিজ কোথায়!হাফিজকে ডেকে মিষ্টি আনতে পাঠা-ও বড়বউমা।আমি বুড়মো হতে চলেছি! কতোদিন পরে বাড়িতে একটা নতুন বাচ্চা আসতে চলেছে!আমার ইভান দাদুভাই বাবা হবে!সুখবর জানাও সবাইকে।জাহিদকে খবরটা দিয়ে এসো,বলো সে দাদু হতে চলেছে।

শ্বাশুড়ির খুশির বার্তায় জাহিদ সাহেবের কথা মনে পড়লো নীহারিকা বেগমের। তখন তাড়াহুড়ো করে চলে এসেছে,মানুষটাও হয়তো অস্থির হয়ে আছে বাহিরে কি হলো?এই ভেবে।হুইলচেয়ারে বসা থাকলে নিজেই আসতে পারতো।কিন্তু বিছনায় বসা মানুষটার ছটফট করা ছাড়া উপায় নেই।দীর্ঘশ্বাস ফেলে তন্ময়ীকে বুক থেকে ছাড়লেন তিনি।মায়াময় দৃষ্টি ফেললেন মেয়েটার লাজুক মলিন মুখের দিকে।উজ্জ্বল হলুদ মুখটা মলিন হওয়ার কারণ,তবে এটা!তন্ময়ী কোনো একটা অসুস্থতায় ভুগছে এটা তিনি বেশ বুঝতে পেরেছিলেন।যার উত্তর, বারবার শুধিয়েও মেলেনি।হয়তো মেয়েটার লজ্জায় বলতে পারিনি।কিন্তু কারনটা এটা হতে পারে এটা তিনিও আশা করেন-নি।অমায়িক হাসলেন নীহারিকা বেগম।তন্ময়ীর মাথায় মমতার হাত ছোঁয়ালেন।সেই হাত নেমে এলো মেয়েটার গালে।অতঃপর সেই হাত নিজের ঠোঁটে এনে স্পর্শ করে নীহারিকা বেগম বললেন –আমার আয়ু কেটে নিয়ে হলেও আল্লাহ তোমাদের দীর্ঘজীবী করুক।সুস্থ থাকো।সুখে থাকো।

বলে তিনি আর দাড়ালেন না।তন্ময়ীর চোখের টলমল পানিটুকু মুছে দেওয়ার সময়ওকরলেনা,ছুটলেন জাহিদ সাহেবের কাছে।ছটফট করা মানুষটাকে তিনি কিছুতেই অপেক্ষা করাতে পারেননা।সঙ্গে এতো সুন্দর একটা সুসংবাদ উনাকে না জানিয়ে অপেক্ষায় রাখার মানেও হয় না! নীহারিকা বেগম চলে যেতেই ফাতেমা বেগম তন্ময়ীর কাছে গেলেন।তন্ময়ীর চোখে টলমলানো জল দেখে তাকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন–এতো খুশির একটা মুহূর্তে কেউ মন খারাপ করে!পাগল মেয়ে!

ইভান উনার বড় যত্নের নাতি।বংশের বড়নাতী নাহলেও বড় ছেলের প্রথম বাচ্চা হিসাবে,ছোটোবেলা থেকে তাকে অন্য নজরে দেখে এসেছেন ফাতেমা বেগম।ছেলেটাও ছিলো,নিভানের পরপর উনার ঘেষা।কিন্তু কিছু ঘটনার কারণে দাদী নাতীর সম্পর্কে দূরত্ব এসেছে।যা উনাকে মর্মাহত করে।সেসব ঘটনায় হয়তো উনার-ও দোষ ছিলো।যার অনুশোচনা উনাকে মনেমনে এখন বড্ড পোড়ায়।সেই নাতীর ঘর আলো করে এই বংশে নতুন বংশপ্রদীপ আসতে চলেছে।উনি খুব খুশি।খুশি উনার আচারণে প্রস্ফুটিত হলো।কন্ঠে সেই খুশি দ্বিগুণ ঢেলে ছেলের বউয়ের উদ্দেশ্য বললেন–ছোটো বউমা, নাতবউয়ের বাড়ীতে খবর পাঠাও।আসতে বলো তাদের।বলো,তাদের মেয়ে মা হতে চলেছে।

‘কি বলছো দাদুমা!ছোটো দাদাভাই বাবা হবে!আমি ফুপিমা হবো?আল্লাহ!

মান্যতার চমকিত কন্ঠে সবাই সেদিকে ফিরলো।সবার আগে রানীই বললো–হ মান্য মা।আমাদের বাড়িতে নতুন মেহমান আসতে চলেছে।ছোটো বউমা মা হতে চলেছে।আল্লাহ!কতোবার যে আলহামদুলিল্লাহ বলেছি।

চোখমুখে খুশি ঝরিয়ে কথাগুলো বললেও,ভদ্রমহিলার চোখে পানি।এই একটা কারণে উনার সংসার হয়নি।বন্ধ্যা নারী তিনি।যার এই একটা কারণে সংসার হলো না।কদর করলো-না স্বামী নামক লোকটা।ছেড়ে দিয়েছে তাকে।স্বাম্তনা রহমান যেনো খুশির মাঝেও রানীর চোখের জলের কারণ বুঝলেন।রানীর পাশে এসে কাঁধে হাত রাখলেন।বিনয়ী কন্ঠে বললেন– মন খারাপ কেনো করছো আপা?তোমাকে কতবার নিষেধ করেছি মনখারাপ করবেনা।মানুষের মাঝে অপূর্ণতা,সেগুলো তাদের নিজহাতের কামাই না।প্রভু চেয়েছেন বলেই কিছু অপূর্ণতা দিয়েই তাদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন।তোমার আপন রক্ত নেই,তাই বলে কি তুমি সন্তানহারা?এবাড়িতে তোমার কতোগুলো সন্তান!তারা সবাই তোমাকে কতো ভালোবাসে!তুমি জানাোনা?
আর-ও একজন আসতে চলেছে।মন খারাপ কোরোনা।

রানী মুহূর্তেই চোখের পানি মুছে ফেললো। হ্যা তার নিজ সন্তান না থাকলেও,এবাড়ির ছেলেমেয়ে গুলো উনাকে মা সমতুল্য ভালোবাসে।একথা অস্বীকার করার নয়।আর তাদের খুশির মুহূর্তে সে চোখের পানি ফেলে দুঃখ করতে পারে না।ততক্ষণে তন্ময়ীকে নিয়ে ফাতেমা বেগম সোফায় বসলেন।মান্যতা-ও ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানালো।এটা-ওটা বলে খুনসুটিতে মাতলো।হঠাৎ একটা প্রশ্ন এলো তার মস্তিষ্ক।তন্ময়ীকে মশকারা করে শুধিয়েও বসলো সে।–ছোটোদাদাভাই জানে, দুষ্টমশাই বাবাা হতে চলেছেন?

ইভানের কিছু বইয়ের দরকার ছিলো।তাই সকাল সকাল খেয়েদেয়ে বাইক নিয়ে ছুটে এসেছিলো বইয়ের সমগ্র নীলক্ষেতে।বই কিনে ফিরতে পথেই দুজন বন্ধুর সাথে দেখা হলো।তাদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে কখন যে বেলা গড়ালো।বুঝতেই পারলোনা।কফিশপ থেকে বেরিয়ে বন্ধুদের বিদায় দিয়ে বাইকে উঠতে যাচ্ছিলো, এমনই সময় ফোনটা বেজে উঠলো তার।প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করে মান্যতার নামটা দেখতেই কপাল কুঁচকে এলো।এই মেয়ে প্রয়োজন ছাড়া তাকে ফোন দেয়না।নিশ্চয় ভার্সিটি থেকে নিয়ে যেতেই তাকে ফোন করেছে।এখন ইভান কিছুতেই উল্টো রাস্তায় যাবেনা।ফোনটা রিসিভ করে মানা করে দেওয়ার আগেই ওপাশ থেকে মান্যতার উচ্ছাসিত গলা ভেসে এলো।—দাদাভাই কোথায় তুই?তাড়াতাড়ি বাড়িত আয়। আর অবশ্যই মিষ্টির দোকানটা বাড়িতে ধরে নিয়ে আসিস।আজ বাড়িতে মহা খুশির দিন।

ইতিমধ্যে মান্যতা জানতে পেরেছে,ইভান জানেনা তার বাবা হওয়ার কথা।তন্ময়ীও বারবার নিষেধ করছে,
তাাকে এখন না জানাতে।তাই আর সরাসরি মান্যতা, ইভানকে জানালোনা না।তবে ইভানের মনেহলো,বাড়িতে নিশ্চয় কিছু একটা হয়েছে।এদের তো আবার কারণের অভাব লাগেনা।যেকোনো একটা কারণ হলেই পার্টিসার্টি, খাওয়া দাওয়া।মেয়েলোকের তো খুশিরদিবসের শেষ নেই।তাই মান্যতা যতোটা উচ্ছ্বসিত গলায় বার্তা জানালো ইভান ততোটা নিরাশিত গলায় বললো।

‘আমি সকালে লন্ডনে এসেছি।ওমা!এটা বাড়ির কেউ তোকে জানাইনি?আর মিষ্টির দোকন কি তোর শ্বশুরের! যে উঠিয়ে তার বউমার জন্য বাড়িতে নিয়ে আসবো আর দোকনদার আমাকে কিছু বলবেনা।গাধী একটা!মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করছে,ফ্রিজ থেকে বের করে খা।সকালেও আমি ফ্রিজ খুলতেই দেখেছি,কয়েকরকম মিষ্টিতে নর্মাল ভরা।

খুশির একটা বার্তা দেওয়ার জন্য ফেন করলো অথচ বরাবরের মতোই কতো আবোলতাবোল কথা শুনিয়ে দিলো!তাই অসন্তুষ্ট গলায় বললো মান্যতা–‘দাদাভাই, তুই খুব খারাপ।

‘তা আমি জানি।এই পদবী নতুন নয়।তা কি মহাখুশির সুসংবাদ শুনি?নিশ্চয়,তৃনয় ভাইয়া আমাদের বাড়ির ঝামেলাবানুকে তাড়াতাড়ি তাদের বাড়িতে ট্রান্সফার করার ডেট ফিক্সড করতে এসেছে ?সেই খুশিতে আমাদের বাড়ির ঝামেলাবানু মিষ্টি খেতে চাইছে!তাই কি?

‘দাদাভাই! তুই মিষ্টি নিয়ে বাড়িতে আসবি কি আসবি না সেটা তোর ব্যাপার। পরে যেনো আফসোস না করিস!বলে দিলাম!আর আমাদের বাড়িতে মহাখুশিতে তোর মিষ্টি না আনলেও আমাদের মিষ্টি খাওয়ার অভাব পড়বেনা।বুঝেছিস?

‘ইভান নিজের টাকা বাঁচানোতে কখনো আফসোস করে না।

‘করবি করবি।

ইভানকে আর কিছু বলতে না দিয়ে ফোনটা কেটে দিলো মান্যতা।ধপাত করে বসে পড়লো তন্ময়ীর পাশে।ফের বললো–তোমার বরটা খুব খারাপ।

তন্ময়ী হাসলো।ফের বললো–কিন্তু আমি ভরসা বিশ্বাস দিয়ে বলতে পারি,আমার ভাইটা কিন্তু খুব ভালো।তুমি ঠকবেনা।তোমাকে ভিষণ যত্নে রাখবে সে।

মান্যতা অপ্রস্তুত হলো।এই কারণে সে একই বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও তন্ময়ীর আশেপাশে খুব একটা ঘেঁষে না।মান্যতার সিদ্ধান্তহীনতার কারণে নিজের ভাইয়ের প্রস্তাব আঁটকে আছে।ভাই ভালো হওয়া সত্ত্বেও,সেটা কোন বোন মেনে নিতে পারেনা।মান্যতা সেটা খুব ভালো বোঝে।কিন্তু তন্ময়ী তো জানেনা,মান্যতা কিসের জন্য সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে।তবে সিদ্ধান্ত সে স্থির করেছে।শুধু দাদভাই আসার অপেক্ষা।তবে পরিস্থিতি সহজ করতে বললো—আমার ভাইও ভালো।ওটা আমি এমনি এমনি বলেছি।

তন্ময়ী মিষ্টি হাসলো।মান্যতার ফর্সা কোমল হাতটা নিজের নরম হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো—সেটা আমি জানি।তবে আমার ভাইও খারাপ না।আম্মুও না।তুমি আমার ভাই,আমার মায়ের কাছে ভালো থাকবে মান্য।যেমনটা আমি তোমাদের বাড়িতে আছি।এতোদিনে আম্মু যতো মেয়ে দেখিয়েছে ভাইয়াকে।ভাইয়া,না বলেছে।মেয়ে দেখা তো দূর,শুধু বলেছে এখন সে বিয়ে করতে চায়না।আম্মু অনেক বুঝিয়েছে কিন্তু সে তার সিদ্ধান্তে অনড় থেকেছে।আমি ভাবতাম,সত্যি ভাইয়া বুঝি এখন বিয়ে করতে চায়না।আসলে বিষয়টা তা ছিলোনা এখন বুঝছি!ও তোমাকে পছন্দ করে!তোমাতে দূর্বল!সেটা আমার বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে লক্ষ্য করছি।যা এখন বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে।ওর বোন হিসাবে তোমার কাছে অনুরোধ।ওকে ফিরিয়ে দিওনা।
সত্যি আমার ভাইটা খুব ভালো।ও তোমাকে আভিজাত্যপূর্ণ জীবন না দিতে পারলেও,সুখে শান্তিতে রাখার চেষ্টা করবে।ভালোবেসে আদর যত্নে আগলে রাখার চেষ্টা করবে মান্য।

ইভান বাড়িতে এলো ঘন্টাখানেক পরে।মান্যতাকে ইচ্ছেমতো পচালেও মিষ্টি সে নিয়ে এসেছে।মান্যতার বিশেষ পছন্দ রসমঞ্জুরী আর আরও দুইপ্রকার মিষ্টি।
বাড়িতে ঢুকতেই ড্রয়িংরুমে একটা শান্তশিষ্ট উচ্ছসমূখর পরিবেশ পেলো।হইহট্টগোল না থাকলেও সবাই বেশ হাসিখুশী। আর সবার মধ্যেমনি হয়ে বসে আছে তন্ময়ী।মাথা তার নমনীয়।চোখেমুখে লাজুকলতা ভাব।কেনো?হঠাৎ কি এমন ঘটলো লজ্জায় লাল হয়ে আছে মেয়েটা?তারসাথে তো বাঘিনীর সম্পর্ক।কিছু বলতে পারেনা,ইভানকে সে গিলে খায়।কাল রাতেও তো ঝগড়া হলো দু’জনের।একটা প্রশ্নে কতো কথা শোনালো তাকে!অথচ বউয়ের ভালো ভেবেই তো প্রশ্ন শুধিয়েছিল!কিন্তু উত্তর মিললো কি!সব কথা কি না জানলে নয়?বউ বলে আমার সবকিছু কি তোমাকে জানতেই হবে?আর কতো কথা!কালরাতের কথা মনে পড়তেই নিজেকে কেমন গম্ভীর করে নিলো ইভান।হঠাৎ তাকে দেখে মান্যতা লাফিয়ে উঠলো।উচ্ছ্বসিত গলায় এগিয়ে এসে বললো–মিষ্টি এনেছিস?

হাতের দিকে লক্ষ্য করে ইভানকে কিছু বলতে না দিয়ে মিষ্টির ভারী প্যাকেটটা হাত থেকে নিয়ে নিজের পছন্দের মিষ্টি দেখে মান্যতা দ্বিগুণ খুশি হয়ে
বললো– মিষ্টি যখন এনেছিস,সুসংবাদটা তোকে দেওয়াই যায়। নাহলে তো আমি কাওকে বলতে দেবেনা ভাবছিলাম।আর আমার পছন্দের মিষ্টি এনেছিস যখন তবে শোন।আমি ফুপিমা হতে চলেছি।আর তুই বাবা!

বাবা!

মান্যতার উচ্ছ্বসিত বাক্যলাপে এতো সময় বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে থাকা ইভানের কপালের ভাজ টনটন হয়ে গেলো।বিস্ময়ে নয়নে মান্যতার মুখের দিকে পলকহীন তাকিয়ে রইলো।মস্তিষ্কে ধারণ করার চেষ্টা করলো মান্যতা ঠিক কি বললো?মান্যতা ফুপিমা হতে চলেছে আর সে বাবা!বাবা!বাবা শব্দের মর্মার্থটা মস্তিষ্ক ধারণ করতেই, কয়েকজোড়া খুশিতে ভরপুর চোখ আর এক একটা হাস্যজ্বল মুখ উপেক্ষা করে তন্ময়ীর পানে তাকালো সে।মেয়েটা যেনো আগের তুলনায় মাথাটা আরও ঝুঁকে নিয়েছে।ইভানের বিস্ময় নজর হঠাৎ শীতল হলো।সেই শীতল নজরে স্থির তন্ময়ীরপানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সবাইকে উপেক্ষা করে বড়বড় কদম ফেলে সিড়ি বেয়ে চলে গেলো উপরে।নিজের রুমে।

‘এই দাদাভাই!এরকম পালিয়ে গেলে চলবেনা।আর শুধু এই মিষ্টিতেও চিঁড়ে ভিজবেনা।আমাদের ট্রিট চাই। মৌনতা বাড়িতে আসুক তোকে ধরছি, অপেক্ষা কর।

স্বান্তনা রহমান বললেন-আরেহ বেচারা লজ্জা পেয়েছে।

‘লজ্জা আর ছোটোদাদাভাই!বরং বলো, লজ্জা আরও ছোটো দাদাভাইকে দেখে পালাই পালাই করে।উল্টে সে আরও ছোটোদাভাইকে দেখে নিজে সরমায়।তাই বলো।

স্বান্তনা রহমান হাসলেন। সঙ্গে পাশে বসা সবাই।অথচ কারও হাসির মৃদু ঝলকানিও তন্ময়ীর কানে গেলো-না। কর্ণগোচর হলো শুধু ইভানের সিড়ি বেয়ে উপরে যাওয়া, পায়ের শব্দ।সেই শব্দে অকারণে কলিজামোচড় দিয়ে উঠলো তন্ময়ীর।মারাত্মক একটা খবর! অথচ ইভান কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে নীরবে চলে গেলো? ইভানের স্বভাবের সঙ্গে এমন নীরবতার মানায়?মান্যতা তো ঠিকই বলেছে।লজ্জা পাওয়ার মতো ছেলে ইভান নয়।তবে?সত্যি কি বাবা হওয়ার সুসংবাদে সে খুশি নয়?নাকি তার ভাবনায় সঠিক,এতো তাড়াতাড়ি কেউ তাদের জীবনে আসুক,এটা চায়নি ইভান?নাকি কালকে রাতের ঝগড়া?নাকি এতোবড় একটা নিউজ তারথেকে চুপিয়ে রাখার জন্য এই নীরবতা?ইভানকে সে ভয় পায়না।কোনোক্রমেই না।অথচ আজ কেনো জানি মনেমনে ভয় ধরেছে তাকে নিয়ে।সংশয় হচ্ছে, তার সামনে কিকরে দাঁড়াবে? ইভানকে বকবে তাকে?প্রচুর রাগ করবে?করলেও কি,ইভানের রাগে কি সে ভয় পায়?পায় নাতো?তবুও কেনো এতো সংশয় মনে।যা এই কয়দিন পুষে পুষে বিস্তর হয়েছে।ফ্যানের বাতাসেও কেমন ঘেমেনেয়ে গেলো সে।

আধাঘন্টার বিরতিতে কনফারেন্স রুম থেকে বের হয়ে লিফট ধরলো নিভান।গন্তব্য নিজেদের বরাদ্দকৃত হোটেলরুম।রুমের মধ্যে এসে দেখলো কৌড়ি তখনও ঘুমে।কাছে আসতেই বুঝলো,বউটা তার উঠেছিলো।গোসল সেরেছে, খেয়েছে আবার ঘুমিয়েছে।নিভান ডাকলেোও দু’বার। তবে মেয়েটা গভীর ঘুমে।একটু পরে নিভানকে আবার বের হতে হবে।শহরের নামকরা বড়বড় বিজনেসম্যানদের নিয়ে এই কনফারেন্স।নিভানকে সারদিন ব্যস্ত থাকতে হবে।কৌড়িকে আজ সারাদিনে সময় দেওয়া হয়ে উঠবেনা। বিধায় কৌড়ির ঘুমটা আর ভাঙলোনা।বরং ঘুমিয়ে কাটুক।একাকিত্ব আর অনুভব হবেনা।কৌড়ির গায়ের চাদরটা ঠিকঠাক করে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো নিভান।তারআগে বউকে একধাপ ভালোবাসতে ভুললোনা ।উঠে দাঁড়িয়ে কিছু একটা ভেবে কৌড়ির খাবারটা অর্ডার করলো সে।অপেক্ষা করতে লাগলো খাবার আসার।হঠাৎই ফোনটা ভাইব্রেট হলো।কনফারেন্স রুমে ঢোকার আগে ভাইব্রেট করে রেখেছিলো নিভান। ফোনটা বের করে দেখলো ইভান ফোন দিয়েছে।ফোনটা রিসিভ করলো সে।ওপাশে তখন বুকের মধ্যে অজানা অনুভূতিতে তোলপাড় চলছে ইভানের।তখন তন্ময়ীর উপরে রাগ হলেও রুমে এসে কেমন বুক ধড়পড় অনুভব হতে লাগলো ইভানের।জীবনে কখনো এরকম অনুভব হয়নি তার।ভালোমন্দ সব বিষয় সবসময় কেমন সে হাসিমজার মধ্যে দিয়ে সল্ভ করেছে।কিন্তু আজকের বিষয়টা কেমন স্পর্শকাতর।যখনই মান্যতার বলা কথাটা কানে বেজে বেজে উঠছে।সে বাবা হতে চলেছে!বাবা!ততবারই ক্ষনে ক্ষনে কলিজা ছটফট করে চলেছে। উত্তেজনায় হৃদপিণ্ড বারংবার কেঁপে কেঁপে উঠছে তার।নিজের এই অনুভূতি যেনো নতুন।সেই নতুন অনুভূতি কিছুতেই তাকে স্থির শান্ত থাকতে দিচ্ছে না।না পারছে তন্ময়ীকে ডেকে শেয়ার করতে।তন্ময়ীর উপরে তার ভিষন রাগ।ভিষন!!

‘ইভান কথা বলিস না কেনো?

‘দাদাভাই!

কন্ঠ কেমন এলোমেলো! ডাকটাও স্বাভাবিক লাগলোনা নিভানের।কপাল চিন্তায় কুঞ্চিত হলো তার।কৌড়ির থেকে সরে গিয়ে রুমের খোলা বারান্দায় চলে গেলো সে।ভিতরে এসি চলছে।বারান্দায় গিয়ে দরজাটা আঁটকে দিলো।তড়িৎ শুধালো-কি হয়েছে ইভান?বাড়িতে সবাই ঠিক আছেতো?সকালেও তো মার সঙ্গে কথা হলো।বললেন,বাড়িতে সবাই ঠিক আছে।

‘বাড়িতে সবাই ঠিক আছে।

‘তবে কি হয়েছে? এমনভাবে কথা….

‘দাদাভাই!তুমি বড়চাচ্চু হতে যাচ্ছো।আর আমি বাবা।

কন্ঠটা কেমন দূর্বল শোনালো!সেই সঙ্গে কথাটা বুঝতেও সময় লাগলো নিভানের।কথাটা ব্রেণে গেঁথে যেতেই কিছুটা বিস্ময় নিয়ে সহসা শুধালো সে–‘কি বলছিস!এতো তাড়াতাড়ি?

‘হয়ে গেছে দাদাভাই।

হাসলো নিভান।মৃদুতর হলেও সেই হাসির শব্দ ইভানের কান পর্যন্ত চলে গেলো।সে-ও হেসে দিলো।কেমন অবুঝ বাচ্চাদের মতো শুধালো–তাড়াতাড়ি হয়ে গেছে,তাই না দাদাভাই?তবে আমার বাবা ডাকটা শুনতে একটুও অসুবিধা নেই।সে আসুক।আমার প্রাণটা নিয়ে হলেও পৃথিবীতে আসুক।

‘পাগল বাচ্চা আমার।

আদূরে ডাকটাতে ইভান কেমন আরও বাচ্চা হয়ে গেলো।ধপাৎ করে বেডে শুয়ে পড়লো।শুধালো–‘তুমি খুশি হওনি দাদাভাই?

‘আরেহ,খুশি না হওয়ার মতো কথা নাকি!আশ্চর্য! আমাদের বাড়িতে কতোদিন পরে বাচ্চা আসবে।আমার বাচ্চাটার বাচ্চা!আর আমি খুশি হবোনা!আমি খুব খুশি বাচ্চা।এই তোকে তো অভিবাদন জানানো হয়নি! কংগ্রাচুলেশনস ভাই।

‘লাভ ইউ, দাদাভাই।

থ্যাঙ্কিউ এর বদৌলে লাভ ইউ।চোখ বুঁজে নিলো নিভান।ছোটো বেলার কিছু স্মৃতি মুহূর্তেই মানসপটে ভেসে উঠলো।সে যেটাই বলতো ইভানের থেকে ফিরতে উত্তর আসতো, লাভ ইউ দাদাভাই।তখন নিভানও নিজের ভালোবাসা খুব যত্নের সাথে দ্বিগুণ বহিঃপ্রকাশ করতো।ইদানীং তা আর হয়না।দু-ভাইয়ের মধ্যে আরও কিছুক্ষণ বাক্যলাপ হলো।শেষে নিভান বললো-তন্ময়ীর দিকে খেয়াল রাখিস।

তন্ময়ীর দিকে খেয়াল রাখিস,কথাটা বলতেই ইভানের হাসিখুশি মুখটা নিভে গেলো।সে তো খেয়াল রাখতে চায়।তবে হয়তো মেয়েটা তার খেয়াল নিতে চায়-না।
সমোঝোতার সম্পর্কে হয়তো বাধ্য মেয়েটা মায়ের বানী মেনে স্বামীর সঙ্গে সমোঝোতায়ই করে নিয়েছে।ইভানকে ভালোবেসে নয়।তবে ইভান মানে দোষ তার!

কৌড়ির ঘুম ভাঙলো ফোনের রিংটোনে।চোখ খুলতে প্রচন্ড আলসেমি হলো তার তবুও কোনোরকম চোখ খুলে ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো মান্যতা ফোন দিয়েছে।ফোনটা ধরলো সে।ঘুমুঘুমু গলায় শুধালো।

‘আপু,কেমন আছো?

‘আলহামদুলিল্লাহ, খুব ভালো। তুই ঘুমাচ্ছিলি?

‘হুম।

‘তাহলে তো তোকে ডিস্টার্ব করলাম?

‘একদম না।তুমি বলো?

‘এই বউমনি,তুইতো বড়মাম্মা হতে চলেছিস!

কৌড়ি আশ্চর্য হয়ে উঠে বসলো।সঙ্গে সঙ্গে মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলো তার।অতিরিক্ত ঘুমানোর ফল হয়তো।তবুও মাথা চেপে ধরে কৌতুহলী গলায় শুধালো–‘মানে?

‘আরেহ ছোটো দাদাভাই বাবা হবে।ছোটো বউমনি মা।

কৌড়ি সহসা বললো –‘বলো কি?

‘হুম।

‘আলহামদুলিল্লাহ। ইয়া আল্লাহ,আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আপু।তন্ময়ী আপু কোথায়?

মান্যতা উত্তর দেওয়ার আগেই নাফিম তার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বললো—তুমি ছোটো বউমনির সঙ্গে পরে কথা বলবে,আগে আমার সঙ্গে কথা বলো।ও বড়বউমনি তুমি কবে আসবে?আই মিসড্ ইউ।আমার তোমাকে খুব বেশি বেশি মনে পড়ছে।

পাশ থেকে ফোঁড়ন কাটলো মৌনতা–বউমনিকে না বউমনির ফোনটাকে মনে পড়ছে সেটা বল?

নাফিম প্রতিবাদ জানিয়ে বললো–‘একদম ফালতু কথা বলবিনা।সত্যি আমার বউমনিকে খুব মনে পড়ছে।

প্রথমে তেজীকন্ঠে কথাগুলো বললেও,পরে কথাগুলো বলতে গিয়ে স্বর নিভে এলো নাফিমের।সেটা বুঝে কৌড়ি মায়ামায়া কন্ঠে বললো–‘আহারে,আই মিসড্ টুহ নাফিমসোনা।আমি তাড়াতাড়ি চলে আসবো।মন খারাপ করেনা।কেমন?

‘ওকে বউমনি।তবে তাড়াতাড়ি আসবে কিন্তু?

‘আচ্ছা।

কৌড়ি আচ্ছা বলতেই নাফিমের হাত থেকে ফোন কেড়ে নিলো মৌনতা।ফোনটা কানে নিয়ে
বললো– বউমনি ভিডিও কলে এসো।তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে।

কৌড়ি নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে ভিডিও কল করলো।কৌড়ি বাড়ি থেকে যাবার পরপর কি কি হয়েছে, কি কি ঘটেছে সব উগলে দিতে থাকলো মৌনতা।মান্যতা তন্ময়ীকে ডাকতে গিয়েছিলো।ওদের কথার মাঝেই এসে পড়লো দুজনে।দুই জা দুই ননদে বেশ ঘন্টাখানেক বকবক করলো বিভিন্ন আলাপে।কৌড়ি বাড়িতে ফিরলে কিকরে একসাথে সবাই ইভানকে চেপে ধরে রেস্টুরেন্টের বিল বাড়াবে,সেটাও পরিকল্পনা করে নিলো।শুধু রেস্টুরেন্টের বিল বাড়ানো নয়,ঘুরতেও নিয়ে যেতে হবে সেই পরিকল্পনাও কষে ফেললো।কথা শেষ করে আবারও চোখ বুঁজে কিছুক্ষন ঝিম মেরে বসে রইলো কৌড়ি।তারউপর মাথাটা ঝিমঝিমানো থেকে একটু একটু করে ব্যথার উপসর্গে গড়াচ্ছে ।চোখ বুঁজে বসে থাকা কৌড়ি সময়-জ্ঞান উপেক্ষা করে আবারও নরম বিছানায় গা এলিয়ে দিলো।

নিস্তব্ধ শীতল পরিবেশ।রুমের মধ্যে সল্প আলোর বাল্বটা জ্বলছে।কৌড়ি মৃদু চোখ খুলে আবার বুঁজে নিলো।বুঝতে পারলো,ধরণীতে রাত নেমেছে।আরও একটা রাত এসেছে তার জীবনে।মুহূর্তেই কাল রাতের সময়টা মানসপটে ভেসে উঠলো।স্ত্রী হিসাবে ভালোবেসে নিজেকে নিবেদিত করেছিলো স্বামীরূপে সেই পুরুষটার বাহুডোরে।অস্তিত্বে।আর সেই মানুষটা তাকে মনপ্রাণ উজাড় করে সযত্নে ভালোবাসেছে।সেই ভালোবাসায় উগ্রতা ছিলেনা,উশৃংখলতা ছিলো-না।ছিলো নমনীয়তা, কোমলভাব।যা মানুষটার প্রতি সম্মানবোধ, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা বাড়িয়ে দিয়েছে কৌড়ির।আনমনেই হাসলো কৌড়ি।স্পষ্ট টের পেলো,মানুষটা রুমের মধ্যে আছে।তার গায়ের তীব্র সুঘ্রাণে চারপাশটা সুবাসিত হয়ে আছে।এরকম তীব্র সুঘ্রাণ তখনই পাওয়া যায়,যখন সে স্বয়ং রুমে উপস্থিত থাকে।নাহলে সে বেরিয়ে যেতেই তীক্ষ্ণ ঘ্রানটা কেমন ম্লান হয়ে যায়।

জেগে গিয়েও কৌড়ি কিছুক্ষণ চুপচাপ পড়ে রইলো।
আজ সারাটাদিন ঘুমে পার হলো তার।এরকম রেকর্ডকরা ঘুম এটুকু জীবনে তার বহু আছে।তবে আজকের ঘুমটা কেমন যেনো চোখ থেকে সরছেই-না।
চোখ যেনো গভীর নিদ্রায় ডুবিয়ে রাখতে চাইছে।তবে ওয়াশরুমে যাওয়া প্রয়োজন।আর তার থেকেও প্রয়োজন কাল রাতের পর যে মানুষটাকে দেখা হয়নি তাকে দেখা।তবে মানুষটা কি করছে?শব্দ নেই কেনো? মানুষটার সম্মুখীন হওয়া আজ যেনো লজ্জার।কৌড়ি গায়ের চাদরটা সরিয়ে মুখটা ডানপাশে ঘুরিয়ে নিলো।মুহূর্তেই আবাছা আলোয় নজরে পড়লো সোফায় বসা মানুষটাকে।সোফায় হেডে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ।এক পা আরেক পা আঁকড়ে পাজোড়া ছড়িয়ে রাখা সোফায় সম্মুখে কাচের টেবিলটার উপরে।পায়ের পাশে রাখা খোলা ল্যাপটপটা।হাতজোড়া কোলের মধ্যে রাখা।মানুষটা কি ঘুমিয়ে পড়েছে?কখন এসেছে?এসে তাকে ডেকেছিলো কি?

কৌড়ি নিঃশব্দে উঠে বসলো।আগে ওয়াশরুমে যাওয়া প্রয়োজন।সেই অনুপাতে ওয়াশরুমে চলে গেলো।সেখান থেকে ফিরে দেখলো মানুষটা সেভাবেই শুয়ে আছে।তবে কি ঘুমিয়ে পড়লো?পায়ের চলন নমনীয় রেখে ধীর কদমে নিভানের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সে।সারাদিন মানুষটা খেয়েছে কি-না? কি করেছে?এগুলো খোঁজ রাখা তার দ্বায়িত্ব ছিলোনা?অথচ সে ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিলো পুরোদিন।ভিতরে ভিতরে অপরাধ বোধ হলো সঙ্গে মন খারাপ হলো কৌড়ি।নিভানকে ডাকবে কি ডাকবেনা,দোটানায় পড়লো সে।তবে অপেক্ষা করতে হলোনা তাকে।চোখ বুঁজে রেখেই তার হাতটা টেনে ধরলো নিভান।কোলের মধ্যে বসিয়ে দিয়ে
দু’হাতে জড়িয়ে নিলো নিজের বলিষ্ঠ চওড়া বুকে।ফের মৃদুস্বরে বললো–ঘুম ভাঙলো তবে!

কৌড়ি উত্তর দিলোনা।বরং নিজকেও মিশিয়ে নিলো মানুষটার বুকে।দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো নিভানের কোমর।নিভান ফের বললো–‘এতো ঘুম!

কৌড়ি এবার হাসলো।নড়েচড়ে আবারও সেই বলিষ্ঠ বুকে শান্ত হলো।নিভান মাথা উঁচু করে সেই বুকে জড়ানো নারীটাকে একবার দেখলো।চুমু খেলো তার মাথার চুলের ভাজে।ফের বললো –এসে কতবার ডাকলাম উঠলেনা।দুপুরে খাওনি কেনো?

মানুষটা ডেকেছিলো!নিজের প্রতি হতাশ হলো কৌড়ি।
তবে উত্তর দিতে দ্বিধা করলোনা। বললো–‘ইচ্ছে করেনি।খেতে একটুও মন চায়নি।আপনি খেয়েছিলেন?

‘হুম।কনফারেন্সে লাঞ্চের ব্যবস্থা ছিলো।আমাকে খেতেই হয়েছিলো।

নিভান সোজা হয়ে বসলো।কৌড়িকেও সোজা করে বসালো।বললো–‘চলো খেয়ে নেবে।

ক্ষুধা কৌড়িরও লেগেছে তাই আর দ্বিমত করলো-না।
নিভান আগেই খাবার অর্ডার দিয়ে রেখেছিলো।রুমের লাইট জ্বালিয়ে কৌড়ি খেতে গিয়ে দেখলো সব ভারী খাবার। কৌড়ির ওসব কিছুই খেতে মন চাইলো না।বউয়ের মুখ দেখে নিভান যেনো তা বুঝে গেলো।শুধালো–কি খাবে?

‘সাদাভাত আর কোনো নর্মাল আইটেম।ভর্তাভাত হলেও চলবে।আমার একটুও এগুলো খেতে ইচ্ছে করছেনা।

নিভানের শুধানোর ভঙ্গিতে কৌড়ি যেনো কেমন সংকোচহীন বলে দিলো।নিভান কৌড়ির বলার মধ্যে হোটেল ম্যানেজমেন্টে ফোন দিয়ে আর্ডারও করে ফেললো।খাবার আসলে কৌড়িকে নিজে হাতে খেতে দিলো না নিভান।নিজে সযত্নে খাইয়ে দিলো।কৌড়ি দ্বিমতও করলো।শুধু মানুষটাকে দেখে গেলো।খুব ক্যাজুয়াল তার ভাবভঙ্গি।যেনো কৌড়ির সঙ্গে সম্পর্ক তার যুগযুগান্তরের।সে কাছ থেকে যতো মানুষটাকে বুঝছে দেখছে,ততোটাই বিমোহিত হচ্ছে।এতো নিখাঁদ ভালোবাসা পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার।কৌড়ি সত্যি সৌভাগ্যবতী।ভাবনার একপর্যায়ে ভিতরে ভিতরে ভিষণ আবেগপ্রবণ হলো কৌড়ি।নিভানের ভাত মাখানো হাত সরিয়ে দিয়ে হঠাৎই তাকে জড়িয়ে ধরলো সে।নিভান একটু অবাক হলো।একহাতে প্লেট, অন্য হাতে খাবার মাখানো।চেয়েও কৌড়ির পিঠে হাত রাখতে পারলো না।তবে কোমল গলায় শুধাল–কি হয়েছে?

‘কিচ্ছু না।আমি আর খাবো না।আপনি খেয়ে নিন।

‘দুপুরে খাওনি।এখন এতোটুকুতেই শেষ।

কৌড়ি সামন্য মুখ উঁচু করলো।বললো–‘সত্যি আর খেতে ইচ্ছে করছে না।

নিভানও আর জোর করলো না।কৌড়ির মসৃণ কপালে চুমু খেতেই মুখটা সরিয়ে নিয়ে পুনরায় বুকে রাখলো সে।নিভান হাতে ধরা খাবারের প্লেটটা ধরাসহ কৌড়ির পিঠ আঁকড়ে ধরলো।সেভাবেই খাবার খেলো সে।কৌড়ি সরে যেতে চাইলেও তাকে সরে যেতে দিলোনা।

রাতে খাবার খেয়ে নিভান ভেবেছিলো, কালকে রাতের মতো কৌড়িকে নিয়ে একটু বের হবে।তবে সন্ধ্যা হতেই মাথার মধ্যে কেমন ঝিমধরা হয়ে রয়েছে তার।তা যেনো ক্রমশই বেড়ে চলেছে।তাই ইচ্ছে সত্ত্বেও বের হওয়া হলো-না।কৌড়িকে বেডে বসিয়ে,তার কোলে মাথা রেখে কৌড়ির হাতটা ডুবিয়ে দিলো মাথার ভাজে। চুলের মধ্যে।মুখে বললো না কিছু।কৌড়িরও নীরবে হাত চললো।নরম হাতের স্পর্শে আরামবোধ করলো নিভান।চোখ বুঁজে নিলো সে।কিছুটা সময় পার হওয়ার পর কৌড়ি অনুভব করলো,নিভানের ডানপাশের কপালের সোজাসুজি মাথার মধ্যে একটা ডোরাকাটা শক্ত কিছু। দাগ হয়তোবা!যা বারবার হাতে বিঁধছে। হঠাৎই মনে পড়লো, এইতো কিছুদিন আগে মানুষটা মারাত্মক এক্সিডেন্ট করেছিলো।কপালসহ মাথায় ব্যান্ডেজে জড়ালো ছিলো অথচ কৌড়ি নিভানের কপালে কখনো দাগই দেখেনি।তাহলে কি আঘাতটা মাথায় লেগেছিলো?তড়িৎ মুখনিচু করে ঘনো চুলগুলো সরালো সে।মুহূর্তই উন্মুক্ত হলো লম্বা ছয়টা সেলাইযুক্ত কাটা দাগটা!কৌড়ি যেনো শিহরে উঠলো!আঘাতটা তো ছোটোখাটো নয়!তখনই কেমন শান্ত গলায় নিভান বললো–

‘ওই জায়গাটায় তোমার ছোয়ার হক নেই।ভালোবাসা দেখানো মানা।

কৌড়ি যেনো নিষেধাজ্ঞার কারণটা খুব ভালো করে জানে।তবুও বললো–কেনো?

‘কারন তুমি আমাকে দেখতে যাওনি।

কৌড়ি ক্ষীনস্বরে বললো –‘আমি যেতে চেয়েছিলাম।

নিভান শান্ত অথচ অভিযোগী গলায় বললো–‘আমিও অপেক্ষায় ছিলাম কিন্তু তুমি যাওনি।

‘স্যরি।

‘গ্রহনযোগ্য নহে।

কৌড়ি খুব ইচ্ছে করলো জায়গাটায় একটু ভালোবাসা ছুয়ে দিতে কিন্তু নিভানের কথায় নয়,লজ্জায় পারলোনা।শুধু বললো–‘ওকে।

নিভান তড়িৎ চোখ খুললো।কেমন বিস্মিত গলায় শুধালো—ওকে্!

কৌড়ি হেসে দিলো বললো–তাহলে এই অপরাধী আর কি বলবে বলুন?

নিভান সহসা কৌড়ির কোল থেকে মাথা সরিয়ে তাকে টেনে নিয়ে নিজের বুকের নিচে এনে শুইয়ে দিলো।একপল কৌড়ির খিঁচে থাকা চোখের দিকে তাকিয়ে,মুখ ডুবালো কৌড়ির গলার ভাঁজে।যেখানে চকচক করছে স্বর্নের চিকন চেনটা।যা বড়োই আকর্ষণীয়।কৌড়ি আকস্মিক ঘটনায় স্থির হয়ে গেল।নিভান গলায় মুখ ডুবাতেই শক্তকরে চোখবুঁজে নিলো।নিভান আপন অনুভূতিতে ডুবে থেকেই বললো–ইট’স নট ওকে্ আমার অপরাধী।তুমি জানো,আমি মানতেই পারিনা তুমি আমাকে দেখতে যাওনি।আমি যদি সত্যি মরে যেত….।

তড়িৎ চোখ খুলে নিলো কৌড়ি।হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরলো নিভানের।সহসা নিভানের বলা ঠোঁট ডুবে গেল কৌড়ির গলার খাঁজে। নিভানের কথা বন্ধ হয়ে গেলো।যা কৌড়ি করতে চেয়েছিলো। চুপ হয়ে গেলো নিভান।কৌড়ি কেমন অসন্তুষ্ট অভিমানর গলায় বললো–‘আপনি তো নাফিম নন।তবে এ কেমন ছেলেমানুষী কথা!মৃত্যু চিরন্তন সত্যি।তাই বলে বারবার বলতে আছে!আপনি তো আমার কাছে আছেন,তবুও কেনো মৃত্যুর কথা!

‘আমি মানতেই পারিনা তুমি আমাকে দেখতে যাওনি।

‘স্যরি।

‘কৌড়ির কন্ঠ এবার অসহায় দূর্বলদের মতো শোনালো।নিভানও আর প্রসঙ্গ বাড়ালোনা।চুপ করে কৌড়িকে জড়িয়ে শুয়ে রইলো।মাথার মধ্যে ব্যাথার ঝিমঝিমানিটা এখনো কাটিনি তার।নিভানকে চুপ হতে দেখে কৌড়ি মাথায় রাখা হাতটা আগের ন্যায় চুলের মধ্যে ডুবিয়ে দিলো।ধীরেধীরে নরম আঙুলগুলো নড়তে লাগলো সেখানে।দুপক্ষের কেউ আর কোনো শব্দ করলোনা।

গভীর রাত।শীততাপনিয়ন্ত্রক রুমটা একদম চুপচাপ।
শুধু ঘনো নিঃশ্বাসের আওয়াজ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো শব্দ নেই।নিভান ঘুমালেও কৌড়ির চোখে ঘুম নেই।সারাদিন ঘুমানোর ফলে নাকি অপরাধবোধে,জানা নেই কৌড়ির।নিভানের কোমর জড়িয়ে রাখা হাতটা সরিয়ে দিয়ে উঠে বসলো সে।নিস্প্রভ চোখে,আবাছা আলোয় নিভানের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ।ফের নিভানের গায়ের চাদরটা ঠিক করে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।নিঃশব্দে পা ফেলে হোটেলের খোলা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র থেকে ভেসে আসা একদল শীতল হাওয়া ছুঁয়ে দিলো তাকে।গায়ের ওড়নাটা শক্ত হাতে জড়িয়ে নিলো কৌড়ি।বাহিরে কালকের মতো তুমুল বর্ষন নাহলেও মৃদুমন্দ বর্ষন হচ্ছে। যার একটুআধটু ছিটেফোঁটা গায়ে এসে লাগলো কৌড়ির।হোটেল এরিয়ার সমুদ্রের পাড়ে
বে-লাউঞ্জখ্যাত শপটা এখনো খোলা।প্রতিরাতের ন্যায় ঝলমলে তার রূপ।হালকাপাতলা গানের আওয়াজ ভেসে আসছে সেখান থেকে।কৌড়ির মনোযোগ সেই ভেসে আসা সুরে নেই।তার মনমস্তিস্ক জুড়ে নিভানের মাথার কাটা জায়গার চিত্রটা ভেসে বেড়াচ্ছে।সত্যিই কি সেদিন চাইলে সে যেতে পারতোনা মানুষটাকে দেখতে?হয়তো পারতো।তবে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও, না ইচ্ছে থাকাটাকে জোর দেওয়াতে তার আর যাওয়া হয়ে উঠেনি।মুলত সে ইচ্ছের গুরুত্ব দেয়নি।না-হলে যাবার উপায় ঠিকই বের হতো।মানুষটা তাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসলেও তার না যাওয়াটা এখনো স্বাভাবিক ভাবে নেয়নি।ভুলতে পারিনি।কৌড়ির ভিষণ মন খারাপ বাড়লো।নিভান যখন এককথা বারবার আওড়ে যাচ্ছিলো-তুমি আমাকে দেখতে যাওনি এটা আমি এখনো মানতে পারিনা।কথাটায় কেমন যেনো নিভানের কন্ঠে অনুযোগের সাথে সাথে ভারী শোনালো।যা ভার কৌড়িকে ভিতরে শান্ত থাকতে দিচ্ছে না।তখন খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো,জায়গাটাকে আদূরে স্পর্শে ছুয়ে দিয়ে নিভানের অনুযোগ মেটাতে।কিন্তু পারেনি।আচ্ছা এখন তো মানুষটা ঘুমিয়ে আছে।তার অভিযোগ মানাতে না পারলেও মনের শান্তির জন্য জায়গাটা একটু ভালোবেসে ছুঁয়ে দিয়ে খায়েশ তো মেটাতে পারবে?ভাবনাটা মাথায় আসতেই কৌড়ি আর দাড়ালোনা।ওই মানুষটা তার ভুল,দোষ,ত্রুটি,মন্দ নিয়েই যদি তাকে এত ভালোবাসতে পারে!সে কেনো পারবেনা!যেখানে মানুষটা তারকাছে ত্রুটিহীন।অসাধারণ।

কৌড়ি রুমে ঢুকে,বারান্দার দরজাআবৃত কাচটা টেনে দিলো।গিয়ে বসলো নিভানের পাশে।আলতো হাতে স্পর্শ করলো,সেই কাটা জায়গাটা।আবাছা আলোয় মাথা নিচু করে খুব কাছে গিয়ে দেখলো কিছুক্ষণ।ফের
নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করলোনা।মুখ নিচু করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো সেই জায়গাটায়।গভীর চুমু খেলো সেখানে।ফের ক্ষীনস্বরে বললো–স্যরি।

‘ক্ষমা গ্রহনযোগ্য হবে তবে শর্ত প্রযোজ্য।

ঘুম জড়ানো কন্ঠস্বরের বার্তা কানে আসতেই চমকে উঠলো কৌড়ি।তবে সরলো-না।বরং নিজেকে দৃঢ় রেখে মুখটা আরও নিচু করে নিভানের গালে ছোয়ালো।ক্ষীন স্বরে বললো

‘যেকোনো শর্ত গ্রহনযোগ্য।মাঞ্জুর।

শর্ত জানালো না নিভান।তার বদলে কৌড়িকে টেনে নিলো গায়ে জড়ানোর চাদরের নিচে।শর্ত মুখে না বলে নিজের আচারণ দিয়ে বোঝালো নিভান।কৌড়িও যেনো সেই অজানা শর্তে নিজেকে সপে দিলো দ্বিধাহীন।শর্ত যদি হয় বরের ভালোবাসা! তবে সে শর্ত দ্বিধাহীন মানা যায় বৈকি?তাতে যদি সম্পর্ক দৃঢ় হয়,অনুযোগ অভিযোগ দূর হয়।তবে সে শর্তে বারবার কৌড়ি দ্বিধাহীন রাজী।মানুষটার অস্তিত্বে নিজের অস্তিত্ব বারংবার বিলিন করতে রাজী।

চলবে….

#ফুলকৌড়ি
(৬১)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

তন্ময়ী অন্তঃসত্ত্বা!সুসংবাদটা পাওয়ার সাথে সাথেই মিষ্টিমিঠাই,ফলফলাদি নিয়ে ততক্ষণাত মেয়ের বাড়িতে চলে এসেছিলেন তাহমিনা বেগম।দুপুরের পরপর এসে বিকালে চলে যেতে চেয়েছিলেন তবে এবাড়ির মানুষগুলো উনাকে যেতে দেননি।তিনিও আর না করেন নি।যদিও তন্ময়ীকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেপোষন করেছিলেন।তবে নীহারিকা বেগম বলেছিলেন–আপা, এসেছেন যখন রাতটা থেকে কালকে নাহয় তন্ময়ীকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন।জামাই বাড়িতে এসেছেন বলা কথা! বাড়ির মানরক্ষার্থে অন্তত একটা রাত সেখানে থাকুন।

আত্মীয়তা রক্ষার্থে এমন সম্মানীয় আবদারে তিনি আর দ্বিমত করেননি।তৃনয়-ও সঙ্গে এসেছিলো তবে এবাড়ির সবার সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় সেরে বোনের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সে চলে গিয়েছে।রাতে তন্ময়ীর সাথে ঘুমিয়ে ছিলেন তিনি।মেয়েটা কেমন ছটফট করেছে সারারাত।তিনিও বারবার জিজ্ঞেস করেছেন-শরীর খারাপ লাগছে কিনা?তবে মেয়েটা না বলেছে।এমনিতেই চাপা স্বভাবের মেয়ে তন্ময়ী।ভালো মন্দলাগা সহজে প্রকাশ করতে চায়না।যদিও উনারও মনে হয়েছে মেয়ে শরীর খারাপের জন্য নয়,অন্য কারণে ছটফট করেছে। কিন্তু কারণটা কি বুঝতে পারলেন না!এবাড়ির সবাই যথেষ্ঠ পরিমান ভালোবাসে এবং খেয়াল রাখে তন্ময়ীকে।তা শুধু উপরে উপরে তা নয়।এ বাড়ির মানুষগুলো সম্পর্কে আগে থেকে ধারণা আছে উনার।আর তার থেকেও বড়কথা,মানুষের কথার ধরণ আর ব্যবহারের আন্তরিকতা দেখলে বোঝা যায়।তারা ঠিক কেমন মানসিকতার মানুষ। সেখানে তিনি যেমনটা চেয়েছিলেন মেয়ে উনার তেননটা রাজরানী হয়ে আছে। তবে সমস্যা কোথায়?ইভানের সঙ্গে সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো?থাকারইতো কথা।ছেলেটা একটু চঞ্চল হলেও উনার মেয়ের প্রতি খেয়ালী এবং দায়িত্বশীল।সেটা তিনি তন্ময়ীর বিয়ের পর,ইভানের ওবাড়িতে থাকা আসায় খেয়াল করেছেন। তবে কালকে এবাড়িতে আসার পর ইভানকে সেভাবে তিনি দেখেননি।এসে একবার সাক্ষাৎ হলো,কুশলাদি বিনিময় হলো তারপর আর তিনি দেখেননি।দেখেননি ভুল,রাতে খাবার টেবিলে একবার দেখেছিলেন।কিন্তু মেয়ে আর জামাইয়ের মধ্যে সেই বসব বিনিময়ে সাক্ষাৎ যেনো উনার নজরে পড়েনি।চঞ্চল ছেলেটাকে এবার যেনো একটু গম্ভীর মনেহলো উনার।এদের মধ্যে সব ঠিকঠাক চলছে তো?

ব্যাগে নিজের জিনিসপত্র গুছানো তন্ময়ীকে এবার তিনি বেশ গাঢ় নজরো খেয়াল করলেন।মেয়েটার হাত দুটোতে নেওয়া জিনিস যেনো ব্যাগে ঢুকাতে ভিষণ দ্বিধা।ব্যাগে ঢুকাতে গিয়েও পুনরায় বাহিরে রাখছে।ভিতরে কি নিয়েছে তা বারবার চেক করছে।ঘুরেফিরে চঞ্চল নজরদুটো তার দরজার পানে অথচ তিনি এসে পাশে দাঁড়িয়েছেন সে খেয়াল নেই মেয়েটার।কি আশ্চর্য! এতো বিচলিত কি কারণে মেয়েটা?আর একটু কাছে এগিয়ে গেলেন তিনি।মেয়ের অস্থির হাতদুটো ধরে তার অস্থিরপনা আঁটকে দিয়ে বললেন।

‘কি হয়েছে তনু?সব ঠিকঠাক আছে তো?কাল থেকে এসে দেখছি, তুই কেমন অস্থির হয়ে আছিস!কি হয়েছে তন্ময়ী?

মেয়েটাকে যেনো একটু অপ্রস্তুত দেখালো।সেরকমই অপ্রস্তুত গলায় বললো–কি হবে আম্মু!সব ঠিক আছে।
তুমি জানোতো,এবাড়ির মানুষ সবাই আমাকে কতো ভালোবাসে তারপর আর কি হব….

‘ইভানের সঙ্গে সবকিছু ঠিক আছে তো?

মেয়ের অপ্রস্তুত গলায় হড়বড়িয়ে বলে যাওয়ায় কথায় আরও সন্দেহ বাড়লো তাহমিনা বেগমের।তাই তন্ময়ীর মুখের কথা শেষ করতে না দিয়ে তিনি মনে চলা দ্বিধান্বিত প্রশ্নটা শুধিয়েই ফেললেন।কিন্তু উনি প্রশ্নটা শুধাতেই তন্ময়ীর যেনো ভিষন কান্না পেলো।কালকে খবরটা পাওয়ার পর থেকে ইভানের সঙ্গে দেখা হলেও একান্তে সাক্ষাৎ হয়নি তাদের। নিশ্চয় ইভান খুশি নয়।তা-না হলে কিকরে এতোবড় একটা নিউজ শোনার পর তার থেকে দূরে থাকতে পারে!একবারও তার সঙ্গে কথা বললোনা!কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলো না!ইভান কিকরে এমনটা করতে পারে?পারে না!তবে মায়ের প্রশ্নে সচেতন হলো তন্ময়ী।ভিতরের উগলে আসা কান্নাটা আঁটকে বললো–ইভানের সাথে কেনো সবকিছু ঠিকঠাক থাকবেনা আম্মু! সবকিছু ঠিকঠাক আছে। শরীরটা খারাপ তো এজন্য এরকম অস্থির দেখাচ্ছে।

মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন তাহমিনা বেগম।তন্ময়ী সহজে মিথ্যা বলেনা।আর বললে তা উনি ধরতে পারেন।আজও উনার যেনো পারলেন।উনার দিকে না তাকিয়ে নজর এদিকে ওদিকে চঞ্চল রেখে কথা বলাতে তিনি বেশ বুঝলেন।তবে মেয়ে যখন জামাইকে আড়াল করার চেষ্টা করছে।নিশ্চয় নিজেদের মধ্যে রাখতে চাইছে ব্যাপারটা।তাই তিনি আর ওবিষয়ে ঘাটলেন না। তবে তন্ময়ীর হাতদুটো চেপে ধরে বসালেন।ফের বললেন–সেদিন আমি নিরুপায় ছিলাম।আমি মা,বিয়ে ভেঙে যাওয়া বদনামী মেয়ের ভবিষ্যতটা যেনো দুর্নাম আর কটাক্ষের মুখে দেখতে পাচ্ছিলাম।মা হচ্ছিস না, সন্তান জন্ম দে।তারপর বুঝবি,এই মায়েদের কথা জ্বালা কতো দুশ্চিন্তা।সেখানে ইভানের প্রস্তাব দেওয়াকে আমি তোর জন্য সৌভাগ্যের দ্বার খুলে যাওয়া মনে করেছিলাম।তবে এটা ভুলেও ভাবিসনা,তোর মা অর্থসম্পদের মোহে পড়েছিলো।তা নয়।কারণটা ছিলো, নিভানের ভাই ইভান।ওদেরকে তো আমি আগে থেকেই চিনতাম।আমার মনে হয়েছিলো,ওর থেকে ভালো ছেলে আর তোরজন্য হয়না।তবে তখনও আমি জানতাম না,ওই তোর বিয়ে ভেঙে ছিলো।যখন নিভান আমাকে বিষয়টা ক্লিয়ার করলো,আমি না করেছিলাম।কিন্তু ইভান,ছেলেটা নিজের অপরাধ স্বীকার করার সঙ্গেসঙ্গে তোকে পাওয়ার জন্য আকুলতা প্রকাশ করলো।সেদিন ও কেঁদেছিলোও।আমি পারিনি নিজেকে কঠিন সিদ্ধান্তে আঁটকে রাখতে।আমি মেনে নিয়েছিলাম ওর আকুলতা।ওর চাওয়া।সেখানে তুই যদি বলিস,নিজের মেয়ে কথা না ভেবে তুমি অন্যের ছেলের কথা।কেনো ভাববে?আমি বলবো ভাবনা ভুল,তোর কথা ভেবেই আমি ওর চাওয়ায় সম্মতি দিয়েছিলাম।

একটু থেমে ফের বললেন তাহমিনা বেগম–তোর হয়তো মায়ের উপর অভিযোগ থাকতেই পারে।তোর বিয়ে ভাঙা সত্ত্বেও কেনো আমি সেই তার সঙ্গে তোর বিয়ে দিলাম! এবং সেই ইভানের সঙ্গেই মানিয়ে নিতে বললাম!ও অপরাধ করেছিলো,কিন্তু ছেলে হিসাবে ওকে কখনো আমার খারাপ ছেলে মনে হয়নি তনু।দ্বিতীয়ত যে ছেলে আমার মেয়েকে পাওয়ার জন্য এতো আকুলতা প্রকাশ করতে পারে!যার সমস্ত কোয়ালিটি এবং বাপের এতো অর্থসম্পদ প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও একজন ভিক্ষুকের ন্যায় আমার কাছে আমার মেয়েকে চায়!আমার মনে হয়েছিলো,আমার মেয়ে সেই ছেলের কাছেই ভালো থাকবে।আমি সেদিন ওর অন্যায় ভুলতে বাধ্য হয়েছিলাম।হয়তো আমি তোরকাছে অপরাধী।সেদিন তোর মনের কথা না ভেবে,তোর ভালো কিসে হয় সেকথা ভেবেছি।তবে আমি জানিনা, সত্যিই সেদিন ঠিক ভেবেছিলাম কি-না? হয়তো ন…

‘তুমি ঠিকই ভোবেছিলে আম্মু।

মায়ের আশাভঙ্গজনিত কথাটা মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো তন্ময়ী।ফের নমনীয় কন্ঠে বললো তন্ময়ী।একবার নয় কয়েকবার আওড়ালো।ফের চিন্তিত মা’কে দুশ্চিন্তামুক্ত করতে বললো–ইভান আমাকে খুব ভালো রেখেছে, মা।সেদিন তুমি ইভানের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার কথা বলাতে,আমি সাময়িক অসন্তুষ্ট হলেও এখন আর অসন্তুষ্ট নেই।ও সত্যিই আমাকে খুব ভালো রেখেছে আম্মু।ওর সঙ্গে আমার সামন্য একটু ঝগড়া হয়েছে তাই মন খারাপ।তবে বিশ্বাস করো,তাতেও ওর কোনো দোষ নেই।আমিই খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছিলাম এজন্য এখন খারাপ লাগছে।

তাহমিনা বেগম বুঝলেন, দুজনের মধ্যে কিছু একটা হয়েছে। তাই নিয়ে মেয়ে এতো অস্থির। সেখানে বিষয়টা মেয়ে বলতে চাইছেনা।সেখানে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে তৃতীয় ব্যাক্তি হয়ে উনার খোঁচাখোঁচি করার কোনো মানে হয়না।তাতে ঝামেলা বাড়ে।সামন্য ঝামেলা,প্রাপ্ত বয়স্ক দুজন। নিজেরাই ঠিক করে নেবে।তাই আর ওবিষয়ে কথা বাড়ালেন না।শুধু বললেন–স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঝামেলা হলে বিষয়টা দীর্ঘ করতে নেই।তাতে শয়তানের ইন্ধন থাকে।তাতে খারাপ ছাড়া ভালো হয়না।যেটা হয়েছে মিটিয়ে নাও।আমি কি ইভানকে আমাদের সঙ্গে যাবার কথা বলবো।যদিও বলেছি,রাজি হয়নি।

‘থাক মা।ও এখন পড়াশোনায় ব্যস্ত।সামনে বি-সি এস পরিক্ষা। আমি যাই,ও নাহয় পরে আমাকে গিয়ে নিয়ে আসবে।

‘আচ্ছা। তবে রেডি হয়ে নাও।আমি বেয়াইনদের ওখানে যাই।

মেয়ের গালে আদূরে হাত রেখে চলে গেলেন তিনি।উনার যাবার পথে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো তন্ময়ী।হয়তো কারও আসার অপেক্ষাও করছিলো।কিন্তু না।অপেক্ষা যেনো দীর্ঘ হচ্ছে কিন্তু ইভানের আসার কোনো নামগন্ধ নাই। হতাশ নিশ্বাস ছেড়ে ব্যাগ গুছানোতে ব্যস্ত হলো তন্ময়ী।ব্যাগ গোছানোর শেষ পর্যায়ে এসে হঠাৎ কারও পায়ের আওয়াজে কলিজা মোচড় দিয়ে উঠলো তার।হৃদবেগ বাড়লো।এরকম তো হওয়ার কথা নয়!কিন্তু হচ্ছে কেনো?ইভান রুমে এলো।তবে ভুলেও আশপাশ তাকালোনা। গায়ের টিশার্টটা চেঞ্জ করে একটা শার্ট জড়ালো।ফের ফোনটা নিয়ে রুমে বাহিরে যাওয়ার আগে তন্ময়ী বিস্মিত গলায় তাকে ডাকলো।

‘ইভান।

কেমন যেনো অভিমানী ডাক।ইভানের চওড়া বুকের ছাতি যেনো মৃদু কেঁপে উঠলো।মূহুর্তেই থেমে গেলো পা। তবুও তীব্র অভিমানে পিছে ফিরলোনা সে।শক্ত হয়ে কেমন দাড়িয়েই রইলো।সেটা দেখে তন্ময়ী নিজেই উঠে দাড়ালো।দরজার সম্মুখে গিয়ে প্রথমে দরজা আটকালো।ফের দরজায় পিঠ লাগিয়ে ইভানের কঠিন করে রাখা মুখের দিকে দৃষ্টি ফেললো।মূহুর্তেই ভিতরটা নাড়া দিয়ে উঠলো তার।ইভান এমন নয়!ইভান হাসিখুশি হাস্যজ্বল চঞ্চল ছেলে।তাকে এরকম কঠিনতা মানায় না!একদম না!

‘তোমার এভাবে চুপ থাকা মানায় না।

ইভান সবসময় অধৈর্য্যবান ব্যাক্তি।তার ধৈর্য্যশক্তি কম।অল্পতে অধৈর্য্য হয়ে যায়।তন্ময়ীর সামান্য কথাতে অধৈর্য্যশীলতার পরিচয় দিয়ে কঠিন গলায় বললো-তো কি বলতে চাইছো।তোমার সাথে ঝগড়া কথা উচিত? কিন্তু তুমিতো চাও,আমি তোমাকে অযথা প্রশ্ন না করি! প্রশ্ন করে বিরক্ত না করে তুলি!

‘এটা অযথা বিষয় নয়?

ইভান ধপাধপ পা ফেলে তন্ময়ীর সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালো। মুখ নিচু করে কঠিন গলায় শুধালো–তো কিসের বিষয়?হ্যা বলো?কিসের বিষয়?আজ তিনদিন ধরে তোমাকে জিজ্ঞেস করছি,তন্ময়ী কি হয়েছে? আমি তোমার হাসবেন্ড। ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করতে পারিনা?না!জিজ্ঞেস করলেই,আমি অযথা প্রশ্ন করি!স্বামী বলে স্ত্রীর সবকিছু আমাকে কেনো জানতে হবে!স্ত্রীর সব বিষয় না জানলে কি নয়!তবে কি করতে বলছো?বলো?

‘তাই বলে তুমি বিষয়টা জানার পরও চুপ থাকবে?

তন্ময়ী করুনকন্ঠে শুধালো।সে বাচ্চাটাকে নিয়ে ইভানের প্রতিক্রিয়া দেখতে চায়,জানতে চায়।অথচ ইভানের প্রতিক্রিয়া বলছে,সে সত্যিই বাচ্চাটাকে এতো তাড়াতাড়ি চায়নি।ইভানের রাগ বাড়লো।আগেপিছে না ভেবে দাঁতে দাঁত চেপে বললো–থাকবো না বলছো?তুমি আমাকে ভালোবাসাে না,এটা আমি জানি।তাই বলে তুমি আমাকে তোমার ভালোমন্দ জানাবে না?আমি ভালোবাসী তোমাকে। আমার জানতে ইচ্ছে হয়!স্বামী না মানো।মানুষ নই আমি?বলা যায় না আমাকে?বলবে কিকরে! ভালো না বাসলে তাকে শরীর দেওয়া যায়।কিন্তু মন দেওয়া যায় কি?তুমি শরীর দিয়েছো,মন দিতে পারোন…

‘ইভান!তুমি আমাকে এভাবে বলতে পারোনা?

ইভান তাচ্ছিল্যেময় একটা হাসি ছুড়লো।আর হাসি বলে দিলো,তন্ময়ীর উপরে তার প্রগাঢ় অভিমান,অভিযোগ। বললোও তেমনটা।মুখ নিচু করে তন্ময়ীর চোখে চোখ রেখে বললো–বলতে পারিনা,তাই না?আমিও বলতে চাইনা,জানো!কিন্তু আমি কেনো জানিনা,তোমার বা দাদাভাইয়ের মতো ভিতরে সবকিছু চেপে রাখতে পারি না।ইদানীং খুবকরে চাইছি,কিন্তু পারছিই না।তবুও রাখছি।কিকি চেপে রেখেছি শুনবে?ওইদিন তুমি যখন বললেনা,তুমি আমাদের সম্পর্কটা এগিয়ে নিয়ে যেতে চাও?বিশ্বাস ভরসা করো আমাকে!তুমি মিথ্যা বলেছিলে তন্ময়ী।

তন্ময়ী চোখ বুঁজে নিলো।বিষয়টা ইভান ধরে ফেলেছিলো। যা তাকে বুঝতে দেয়নি!ইভান সেই বন্ধ চোখের দিকে নিস্প্রভ তাকিয়ে বললো–ওদিন তোমাকে যখন প্রথম গভীর স্পর্শ করলাম।আমি বুঝেছিলাম,তুমি মুখে বললেও আদৌও তোমার সায় নেই।সায় নেই আমাদের সম্পর্কে।তবে আমার স্ত্রী তার ভরসা বিশ্বাস অটুট করতে আমাকে আহবান জানিয়েছে,আমি তাকে ফিরাই কিকরে?দ্বিতীয়ত আমি পুরুষ। আমি দূর্বল ছিলাম সেই নারীতে।ভেবেছিলাম, কত সম্পর্ক তৈরী হয় একঅপরকে না জেনে না বুঝে।সেসব সম্পর্কে যদি প্রগাঢ় ভালোবাসা তৈরী হতে পারে।আমাদের সম্পর্কেও নয় কেনো?আমাদের সম্পর্কেও ভালোবাসা টান তৈরী হবে।একটা সময় সব ঠিক হয়ে যাবে।আমার সম্পর্ক তোমার ভুলবোঝা দূর হয়ে যাবে।তোমার সঙ্গে হওয়া অন্যায় ক্ষমা করে দিয়ে আমাকে একটু হলেও ভালোবাসবে তুমি।স্বামী স্ত্রীর মায়ার বাঁধনে পড়বে তুমি।কিন্তু কঠিন সত্য হলো, তুমি আমাকে ক্ষমা করতে পারোনি তন্ময়ী।তুমি শুধু আন্টির কথাতে মানিয়ে নিয়েছো আমাকে।মানতে বাধ্য হয়েছো।নাহলে আমার বাবা হওয়ার খবর অন্যের কাছ থেকে শুনতে হয় আমাকে?

‘তোমার অভিযোগ সবটা ঠিক নয় ইভান।সেটা তুমিও জানো।

তন্ময়ীর চোখ বেয়ে অশ্রু গড়ালো।কেমন নিস্প্রভ গলায় কথাটা বললো।সেই নাড়ানো শুষ্ক ঠোঁটের দিকে চেয়ে রইলো ইভান।তন্ময়ী কি বলেছে সেটা যেনো কানেই ঢুকালো-না।তার প্রেক্ষিতে বরং কেমন অদ্ভুত গলায় শুধালো–আচ্ছা সত্যি করে বলোতো,তুমি ওকে চেয়েছিলে?যারজন্য আমি বারবার জানতে চাওয়া সত্ত্বেও তুমি বলতে চাওনি..

তন্ময়ী তড়িৎ চোখ খুলে ফেললো। কন্ঠ উঁচু করে কেমন কঠিন গলায় বললো–‘ইভান!এবার বাড়াবাড়ি বলছো কিন্তু।

‘তবে আমাকে বলতে অসুবিধা কোথায় ছিলো?

কিছুটা নম্র গলায় শুধালো ইভান।কন্ঠে নিদারুণ অসহায়বোধ।এই অবস্থায় তন্ময়ীকে সে এতো কথা শোনাতে চাইনি।উত্তেজিত করতে চাইনি।চেয়েছিলো,তন্ময়ীর উপরে হওয়া রাগটা কিছুটা কমলে তারপর কথা বলবে দুজনে।কিন্তু তার আগেই কেমন অধৈর্য্য হয়ে রাগটা উগলে দিলো।যা সত্যিই সে চায়নি।তন্ময়ীর পাতলা পেটের দিকে তাকালো ইভান।মনটা যেনো তার আরও খারাপ হয়ে গেলো।যে বাচ্চাটা আসার সুসংবাদে তারা খুশিতে মশগুল থাকবে!তা না করে ঝগড়া করছে!ইভানের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে তন্ময়ী কেমন অপরাধী কন্ঠে বললো –আমি তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম।পারিনি এজন্য,বাচ্চাটা এতো তাড়াতাড়ি আসা তুমি ঠিক ভাবে নেবে কি-না এইভাবে।

ইভান কেমন অদ্ভুত শান্ত নজরে চাইলো তন্ময়ীর পানে।সেই নজরে নজর রাখলোনা তন্ময়ী।চোখ বুজে নিলো সে।ইভানের শান্ত নজর বলছে,তার ধারণা ভুল।সে একটু বেশিই ভেবে ফেলেছে।সেই বুঁজে থাকা নজরের পানে চেয়ে কেমন বিস্ময়ভরা অদ্ভুতকন্ঠে বললো– ও আমার।ও যখনই আসুক,আর যেই পরিস্থিতিতেই আসুক।আমি মানবোনা তাকে,এই ধারণা তোমার হলো কি করে তন্ময়ী?তুমি আমাকে এতোটা নিচু মানসিকতার মনে করো?আমার সম্পর্কে সত্যিই তোমার ধারণা এতোটা বাজে!

‘তুমি আমাকে ভুল বুঝছো ইভান।তোমার সম্পর্কে এমন ধারনা আমি পোষন করিনা।

ইভানের যেনো তন্ময়ীর কথা কানে গেলোনা।কেমন অভিমানী গলায় বললো–পোষণ করোনা?কিন্তু তোমার কথাকার্যকলাপ তো সেটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে।আমার এখন কি মনেহয় জানো?সেদিন জেদ করে জোর করে তোমাকে আমার কাছে ধরে রাখার জন্য বিয়ে করা একদম উচিত হয়নি?আসলে জোর করে সবকিছু পেতে নেই।বিশেষ করে তুমি ভালোবাসো এমন জিনিস তো নয়। আমার মনেহয় তা জোর কোরে নিজের কাছে রাখার থেকে মুক্তমনে তার মতো তাকে ছেড়ে দেওয়া উচিত।নিজের কাছে যদি ভালোবাসার জিনিস ভালো না থাকে তার মতো অসুখী মানুষ আর মনেহয় পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় কেউ হয়না।ভালোবাসাকে ভালো না রাখার অপরাধবোধ সত্যিই ভিষণ যন্ত্রণাদায়ক।তাকে আমি ভালো রাখতে পারছিনা!আহা কি ব্যর্থতা!সেই যন্ত্রণা ভোগ করার থেকে সেই ভালোবাসা যদি অন্যের কাছে ভালো থাকে সেটাই তো শ্রেয়।নয় কি?আমার তো মনে হয় পুরুষ মানুষ হয়ে সেই ব্যর্থতা উপলব্ধি করার থেকে সেটাই শ্রেয়!সত্যিই আমার সেদিন তোমাকে পাওয়ার লোভে তোমার বিয়ে ভাঙা উচিত হয়নি।তোমাকে তোমার ইচ্ছেতে ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিলো।তবে বিশ্বাস করো,তোমাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা সেদিন আমি সংবরণ করতে পারি-
নি

কথা শেষ করে ইভান দাঁড়ালো না।কোনো রকম দরজার নব মুড়িয়ে পায়ে শব্দতুলে চলে গেলো।তন্ময়ী ডাকতে চেয়েও ডাকলোনা।কেমন যেনো সবকিছু অসহ্য লাগছে! নিস্তেজ! স্বাদহীন!প্রচন্ড বিস্বাদ!হ্যা সে ইভানকে ভালোবাসে না।তবে ইভানের সম্পর্কে যে ধারণা তার ছিলো তা পাল্টে গেছে।ইভান খারাপ ছেলে নয়।তাই বলে ইভান যেগুলো বলে গেলো সবটাও ঠিক নয়।ইভানকে ভালো না বাসলেও,ইভানের প্রতি তার দূর্বলতা সৃষ্টি হয়েছে।সেটা একটু অধটু নয়।ইভানকে ছাড়া জীবনে দ্বিতীয় পুরুষ সে চায়না।

হঠাৎ ধপাধপ্ পায়ের আওয়াজে ভাবনা কাটলো তন্ময়ীর।মুখ উচু করে তাকানোর আগেই ইভানের গলার ছেলেমানুষী আওয়াাজ এলো–আমার সাথে যেটা ইচ্ছে করো তবে ভুলেও আমার বাচ্চাটাকে সামন্য কষ্ট দেওয়ার চেষ্টাও করোনা তন্ময়ী।আমি কিন্তু সহ্য করবো-না।একদম না!

‘তুমি তার মা’কে কষ্ট দিচ্ছো!আবোলতাবোল বলছো!তাতে সে কষ্ট পাচ্ছে না?তুমিই তো কষ্ট দিচ্ছো তাকে!
আমাকে না বলছো?

ইভান কেমন চোখ বুঁজে ঘনোশ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়ালো। তন্ময়ী যেনো ইভানের দূর্বলতা টের পেয়ে বললো–তুমি একবারও তাঁকে ছুঁয়ে দেখলে না ইভান?

ইভান রয়েসয়ে চোখ খুললো।তারপর কেমন শীতল, স্থির নজরে তন্ময়ীরপানে চাইলো।ফের দূরত্ব ঘুচিয়ে তন্ময়ীর খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।খুব শান্ত গলায় বললো–তুমি কখনো আমার স্পর্শ সেভাবে অনুভব করেছো?করলে নিশ্চয় বুঝতে পারতে,আমি তাকে ছুঁয়েছি কি-না!তুমি বরং তোমার গর্ভের ভিতরে সদ্য জমাটবাধা আমার অংশের কাছে জিজ্ঞেস কোরো,তোর বাবা তোকে ছুয়েছিলো?ও বলে দেবে।

বড়ো তাচ্ছিল্যের স্বরে শেষের বাক্যদ্বয় জানালো ইভান।নিজের ব্যর্থ অনুভূতিতে চোখ বুঁজে নিলো তন্ময়ী।তবে কর্নণদ্বয় ইভানের চলে যাওয়া টের পেলো।বুঁজে থাকা চোখের কর্ণবেয়ে নোনাজল গড়াতেই তা মুছে নিয়ে চোখ খুললো তন্ময়ী।মাথা নিচু করে পেটের দিকে চাইলো।ইভান ওকে ছুয়েছিলো?কখন?সে টের পায়নি! আশ্চর্য!খেয়াল হলো কাল রাতেও বেশ কয়েকবার বমি হয়েছে। ক্লান্ত হয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলো খেয়াল নেই।হয়তো তারপর! হয়তোবা?চোখে অশ্রু অথচ ঠোঁটে হাসি ফুটলো তন্ময়ীর।সত্যি তার এই মূহুর্তে ওবাড়িতে যাওয়া প্রয়োজন।

আজ কয়েকদিন এই ভালো তো এই কালো মেঘে আকাশটা ছেয়ে গিয়ে ঝুপঝাপ বৃষ্টি নামছে।কাল রাতের পর আবহাওয়াটা যেনো বেশি খারাপ।সকাল থেকে ঘুমোট ভাব।মনে হচ্ছে,এ-ই ভরা কার্তিক মাসে কালবৈশাখী ঝড় উঠবে।ভয়ংকর ঝড়।তন্ময়ী ধীরপায়ে রুমের জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।

প্রকৃতিতে বৈরীভাব।আকাশটা ঘনোকালো মেঘপুঞ্জে ঢাকা।ঝড়োমেঘ সঙ্গে তুমুল বর্ষন চলছে।সময়টা দুপুর বারোটার সময় হলেও,নিকষকালো সন্ধ্যাবেলা মনে হচ্ছে।আজ-ও নিভান অফিসিয়াল কাজে ব্যস্ত।ঘুম থেকে উঠে তাকে আজ-ও দেখেনি কৌড়ি।তবে দেখিনি ভালোই হয়েছে।তা নাহলে সকাল সকাল এতো লজ্জা নিয়ে তার সম্মুখীন হতো কি-করে কৌড়ি।যদিও মানুষটা কাছে এলে,তার সমস্ত লজ্জারা যেনো মূহুর্তেই নাম জানা কোনো এক সুদূরপ্রসারে পালিয়ে বেড়ায়।বেডে হেলান দিয়ে বসা কৌড়ির ঠোঁটে প্রসারিত হাসি।সাফেদ দন্তের দেখা না মিললেও,বিলে ফোটা শাপলার মতো সৌন্দর্য নিয়ে এলিয়ে আছে দুটো ঠোঁট। আচমকা চোখ বুঁজে নিলো সে।বদ্ধদ্বারের অন্তঃপটে ভেসে উঠলো কিছু মধুময় চিত্র। কেউ একজনকে দেখতে না যাওয়ার অপরাধে তাকে সাজাপ্রাপ্ত হতে হয়েছে।অপরাধীর শাস্তি ছিলো,সাজা দেওয়া ব্যক্তির থেকে পর্যাপ্ত ভালোবাসা পাওয়া।যার স্নিগ্ধতা, মুগ্ধতা কৌড়ির সর্বাঙ্গে ছেয়ে আছে।যার অনুভব তখনের ন্যায় এখনো সতেজ।তবে কৌড়ির মনে সুখ ছেয়ে যায় তখন,যখন নিভান ছোট্টো বাচ্চাটার মতো তাকে বুকে আগলে নিয়ে ঘুমায়।যার শক্তপোক্ত হাত দুটো দরদভরা কোমলস্পর্শে কৌড়িকে তার বলিষ্ঠ বুকে জড়িয়ে নেয়।যখন ঠোঁটের নরম নরম স্পর্শে ছুঁয়ে দেয় কৌড়ির কপাল।চুলের মধ্যে আঙুল নাড়িয়ে, আলতো হাতে পিঠ চাপড়িয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে কৌড়িকে।কৌড়ি সেই সময়টা অবাক হয়ে উপলব্ধি করে।ভাবে,এমন করে কি প্রত্যেকটা পুরুষ তার স্ত্রীকে ভালোবাসে!এতো সুন্দর করে!যে স্পর্শে এতো মুগ্ধতা, এতো কোমলতা,এতো স্নিগ্ধতা উপলব্ধি হয়!

কাঁচের দরজা ভেদ করে বজ্রপাতের ঝলকানিতে চোখমুখে অনুভব করতেই চোখ খুলে ফেললো কৌড়ি। বাহিরের প্রবল ঝড়বৃষ্টির শব্দ ভিতরে না এলেও, বিদ্যুতের মৃদু আলোর ঝলকানি ঠিকই অনুভাবিত হচ্ছে।কৌড়ি গায়ের চাদরটা সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বারান্দার কাঁচের জানালাটার কাছে গিয়ে সম্মুখে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখলো,প্রবল বর্ষনে পুরো শহর ভিজে একাকার।সাগর উত্তাল।বৃষ্টির তোপে ধুসর রঙে ছেয়ে গেছে দূরদূরান্ত।কৌড়ি কিছুসময় সেখানে দাঁড়িয়ে বর্ষনের তোপে প্রকৃতিকে হারিয়ে যাওয়া রঙ বদলটা দেখলো।তারপর পুনরায় বজ্রপাত হতেই,বিদ্যুতের আলোটা যেনো খুব কাছ থেকে অনুভব করলো সে।সঙ্গে সঙ্গে কানে হাত চেপে ধরে, রুমের সঙ্গে লাগোয়া বারান্দার কাঁচের দরজাটা থেকে সরে এলো সে।টেনে দিলো ভারী পর্দাগুলো।মুহূর্তেই রুমটা যেনো দিনেদুপুরেও,কোনো বন্দীশালায়ের অন্ধকার রুমে পরিনত হলো।বজ্রপাতে তার ভীষণ ভয়।ঠিক ভয় নয়।এযেনো কেমন একটা অনুভূতি।সে জানে রুমে থাকাকালীন, আল্লাহ চাইলে সে বজ্রপাতের অনিষ্ট থেকে বেঁচে যাবে।তবুও ভিতুময় কেমন কেমন অনুভূতি।দ্রুত গিয়ে রুমের মৃদু আলোর বাল্বটা জ্বালিয়ে দিলো সে।রুমে অকারণে অতিরিক্ত আলো ভালো লাগেনা তার।পুনরায় বেডে এসে বসতেই ফোনটা বেজে উঠলো।জ্বলজ্বল অক্ষরে ইংলিশ বর্ণে স্কিনে ভেসে উঠলো Nivan নামটা।কৌড়ির মুখে ফের হাসি ফুটলো।কলটা রিসিভ করে ফোনটা কানে তুলতেই ওপাশ থেকে এলো চিন্তিত কন্ঠস্বর।

‘উঠেছো?ভয় পাচ্ছো?আমি আসবো?

কন্ঠে যেনো মায়া ঢালা।কৌড়ি আনমনে হাসলো।কাল কনফারেন্স শেষ করতে কতো সময় লেগেছে।আর আজ মানুষটা তারজন্য ব্যস্ত।কাজে মন দিতে পারছে-না!কাজ ফেলে আসতে চাইছে!চিন্তিত কন্ঠেস্বরের মালিককে নিশ্চিন্ত করতে কৌড়ি বললো–‘আমি ঠিক আছি।আপনি টেনশন করবেন-না।অস্থির হবেন না।

‘শিওর?ভয় পাবে না তো?

‘ভয় পেলে অবশ্যই আপনাকে চলে আসতে বলবো।

কন্ঠ যেনো স্বাভাবিক হলো নিভানের।সহসা
শুধালো—খেয়েছো?

‘হুমম।

‘আর মেডিসিন?নিয়েছো?

‘হুমম।

‘গুডগার্ল।এইতো লক্ষীসোনা আমার।

কন্ঠ যেনো বেশ চাপা এলো।কৌড়ি বুঝলো আশেপাশে মানুষ আছে।দুই একজনের মৃদু কন্ঠস্বরের আওয়াজও ভেসে আসছে।তবে নিভানের সম্বোধনে মন পুলকিত হলো কৌড়ির,যেনো সে আহ্লাদীত কোনো বাচ্চা!আর খুব খুব আদূরে!কৌড়ি,বাবা মায়ের শেষ বয়সের সন্তান ছিলো।তাও একমাত্র সন্তান।তবুও মনেহয় এতোটা আহ্লাদীত ছিলোনা,যতোটা আহ্লাদী বিগত দিনগুলোতে মানুষটা তাকে করে তুলেছে।রোজ রোজ মানুষটার কথাকাজে ব্যবহারে তাকে অনুভব করাচ্ছে।কৌড়ি আনমনে হাসলো।তার ক্ষেত্রে ওই মানুষটার আচারণ বার্তা এতো স্পর্শকাতর, কৌড়ির তো মনেহয় পৃথিবীর সব আহ্লাদ জড়ো করে ওই মানুষটা তারপানে এনে ঢেলে দেবে।দেবে কি! দিচ্ছেই তো!

শীতল আবহাওয়া। ঠান্ডা ভাব।নিদ্রায় ডুবে থাকার আরামদায়ক সময়।অথচ আজ আর কিছুতেই চোখে ঘুম ধরা দিলো-না।বিছনায় পা মেলে দিয়ে কৌড়ি কিছুসময় ফোন নিয়ে ঘাটাঘাটি করলো।এটাওটা দেখলো।হঠাৎই একটা মডেলের গাঢ় লালরঙের আটপৌড়ে বেনারসি পরে নিদারুণ সাজের কিছু পিক নজরে আসলো।মেয়েটার চেহারা চমৎকার।আটপৌড়ে পরা শাড়ীর সঙ্গে সাজটাও বেশ রুচিশীল।কৌড়ি পিকগুলো দেখলো।মূহুর্তেই নিজের বিয়ের আগেপিছের দিনের কথাগুলো মনে পড়ে গেলো তার।মডেলের পিক দেখা বাদ দিয়ে নিজের গ্যালারিতে ঢুকলো সে।ফোন থাকলেও হুটহাট তার ছবি তোলা হয়না।তার গ্যালারির অধিকাংশ পিক মৌনতা আর মান্যতার সুবাধে তোলা।এবং কিছু পিক মান্যতার ফোন থেকে নেওয়া।গ্যালারিতে অনেকের পিক আছে।কৌড়ি নিজেরসহ সবার পিকগুলো দেখলো।দেখতে দেখতে নিভান আর তার একটা পিক সামনে এলো।পুরো গ্যালারিজুড়ে হাতেগোনা এই একটাই পিক দু’জনের।আশ্চর্যের বিষয় হলেও দুজনের একসঙ্গে আর কোনো পিক নেই।বিয়ের দিনের পিক।শুভ্র রঙের উপর সোনালী কারুকার্যের ভারী শেরওয়ানিতে লম্বা চওড়া শ্যামবর্ণ মানুষটাকে অসম্ভব সুদর্শন এবং ব্যক্তিত্ববান লাগছে।মুগ্ধকর।কৌড়ি ছবিটা জুম করলো।খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিভানের খাড়া নাক,ভাসাভাসা চোখ,পুরো ঠোঁট,চওড়া কপাল,ছোটো করে কাটা চুল,পুরুষালী স্বরউচু গলার বহিরাঅংশ দেখলো।দেখলো মানুষটা উচ্চতায় তার থেকে কতখানি লম্বা।আনমনে ঠোঁটে হাসি ফুটলো কৌড়ির। নিভানের কাঁধ সমান উঁচ্চতা তার।অথচ পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি লম্বা সে।তাহলে মানুষটার উচ্চতা ঠিক কতোটুকু?

দু’জনের পাশাপাশি বসা ছবিটা বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কিছুক্ষণ প্রসন্ন চিত্তে দেখলো কৌড়ি।নিজের শাড়ী পরা আরও কিছু ছবিও দেখলো।ফের চঞ্চল নজরে বাহিরের মুশলধারা বৃষ্টিতে দৃষ্টিপাত করলো।ঘনোবর্ষন হলেও এখন আর মেঘের চমকিত সেই ডাক নেই।আকাশ ভেঙে শুধু কেমন অঝোরধারায় জল নামছে।এমন বর্ষা হলে বাহিরের উঠানে,পুকুরের শানবাঁধানো জায়গাটায় দাঁড়িয়ে কতো ভিজেছে কৌড়ি।মন চঞ্চল হলো।পিছনের কথা মনে পড়তেই বৃষ্টিতে ভিজতে মন চাইলো।ফের ফোনের দিকে তাকাতেই আরও একটা ইচ্ছে জাগলো তার। হঠাৎই এই বর্ষণমুখর দিনে তার শাড়ী পরে ভিজতে মন চাইলো।কৌড়ি আগেপিছে ভাবলোনা।উঠে দাঁড়ালো।তার আগে নিজের পছন্দের একটা গান প্লে করে দিলো।ফোনে সুর উঠলো,আর সে ছুটলো হোটেল রুমের কর্ণারে রাখা ট্রলিটার পানে।

মন মোর মেঘের ও সঙ্গী
উড়ে চলে দ্বিগদিগন্তেরও পানে।
নিঃস্বমো সন্ধ্যে শ্রাবন বর্ষনো সঙ্গীতে..

এই রবীন্দ্র সংঙ্গীতে কেমন একটা একাকিত্ব, মনখারাপ, নিঃসঙ্গ ভাব। সুর।তবুও কৌড়ির ভালো লাগে।ট্রলিটা খুলতেই নজরে পড়লো খয়েরী পাড়ের গাঢ় সবুজ কাতান স্লিক শাড়ীটা।শাড়ীটা ভারী।এই শাড়ীটাও ওই মানুষটার পছন্দ।একদম নতুন। ভাজভাঙা হয়নি।কৌড়ি ঘুরতে আসাতে শাড়ী নিতে চায়নি।কিন্তু মান্যতা তা জানতেই নিজের পছন্দে শাড়ী বেছে কয়েকটা শাড়ী গুছিয়ে দিয়েছিলো আর দুষ্টীমি করে
বলেছিলো।–মধুচন্দ্রিমায় যাচ্ছিস।বাঙালি নারী, শাড়ী নাহলে চলে!দেখবি কখন আবার মন পরতে চাইবে!আবার তোর মন পরতে না চাইলেও দাদাভাইয়ের তো চাইতেই পারে।তাই না?আর পুরুষ মানুষ তার একান্ত নারীকে একান্ত শাড়ীতেই দেখতে পছন্দ করে।

মধ্যদুপুরেও চারপাশটা কেমন সন্ধে সন্ধে মনেহলো।
রুমের সেই মৃদু আলোতে কৌড়ি গায়ে শাড়ী জড়ালো।ফোনের সেই মেয়েটার মতো আটপৌড়ে করেই শাড়ী পরলো।ঘরের আবাছা আলোতে আয়নায় তবুও নিজের সেই শাড়ীনারী নারী রূপটা স্পষ্ট। শাড়ী গায়ে জড়ালেই যেনো নারী অন্যরকম।যতোই বয়সে অপরিণত হোক, নারী যেনো শাড়ীতেই পরিপূর্ণা।অনন্যা।আলাদা মাধুর্যময়ী।নিজেকে দেখতে দেখতে,কৌড়ি দু’হাতে কাঁচের সবুজ খয়েরী চুড়ি পরলো।এগুলোর কৃতিত্বও মান্যতার।তার শাড়ীর সঙ্গে ম্যাচিং চুড়ি ছিলোনা।সেটা শুনে মান্যতা নিজের কাছে থাকা চুড়ি গুলো এনে দিয়েছিলো। কৌড়ি বারবার মানা করেছিলো।শোনেনি মেয়েটা।তখন মনে হয়েছিলো, কি কাজে লাগবে।অথচ মনের পাগলামো পূর্ণ করতে কাজে লাগলোই।কৌড়ি হাসলো।খয়েরী আর সবুজের মিশেলে চুড়িতে ফর্সা হাতের সৌন্দর্য যেনো বেশ আকর্ষনীয় দেখালো।সেই আকার্ষরিনীয় হস্তে রিনিঝিনি শব্দতুলে কৌড়ি মাথার মধ্যমনিতে সিঁথি তুললো।জাদুর ছড়ির মতো ঘুরিয়ে কিভাবে কিকরে যেনো দু’হাতের আঁটোসাঁটো খোঁপা বাঁধলো।মায়াবী মুখটা যেনো আরও স্পষ্ট হলো।সেই মুখে মৃদুমন্দ প্রসাধনী ছোঁয়ালো।মুখে হালকা ফেইসক্রিম আর ঠোঁটে গাঢ় খয়েরী লিপস্টিক লাগালো।ক্ষনিকেই মুখের লাবন্যতা যেনো অন্যরকম সৌন্দর্যময়ী রূপ ধারণ করলো।কৌড়ি নিষ্পলক চোখে তা চেয়ে চেয়ে নিজেকে দেখলো কিছুক্ষণ।নিজের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলো যেনো তার চোখজোড়া।কানে একজোড়া ছোট্ট দুল ছিলো।সেটা খুলে সেখানে কানটানা একজোড়া ঝুমকোজোড়া পরলো।ফর্সা গলায় চিকন স্বর্নের চেইনটা যেনো বেশ মানানসই।তাই আপতত আর গলাতে কিছু পরলো-না।সাজের সাথেও যেনো মানিয়েছে বেশ।পুনরায় আয়নায় তাকাতেই নিজেকে কেমন সাধারণের তুলনায় একটু অন্যরকম দেখালো।কৌড়ি সময় ব্যায় করলোনা।কেমন দুরন্ত পায়ে ছুটে গেলো বারান্দার দোরগোড়ায়।তখন ফোনে গান বদলে গিয়ে নতুন আরও একটি বর্ষামুখর গান চললো,

পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে,
পাগল আমার মন জেগে উঠে।
চেনাশোনার কোন বাইরে,যেখানে পথ নাই নাইরে
সেখানে অকারণে যায় ছুটে।

অফিশিয়াল কাজ আপতত কমপ্লিট।মিটিং সেরে বাহিরে সময় ব্যায় না করে,নিজেদের বরাদ্দকৃত হোটেল রুমে ফিরলো নিভান।কার্ড প্রেস করে রুমের দরজাটা খুলতেই মৃদুস্বরে গানের আওয়াজ ভেসে এলো…

-এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকেনা তো মন,
কাছে যাবো কবে পাবো ওগো তোমার নিমন্ত্রণ।

কৌড়ি গান শুনছে!রুমে ভিতরে ঢুকতেই আচমকা নজর চলে গেলো বারান্দায়। যেখানে বারান্দার অর্ধগ্রিল ঘেঁষে শাড়ী পরিহিতা এক রমনী চোখবুঁজে আকাশপানে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।বৃষ্টির অঝোরে ঝরা বর্ষন পুরোটা তাকে না ছুঁতে পারলেও,মৃদুমন্দ ছিটেফোঁটা তাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে।মুক্তোর দানার ন্যায় সেই ফোঁটাফোঁটা পানি দানা বেধেছে তার রাঙানো লালওষ্টে, বুঁজে থাকা চোখে,নাকে,গালে,গলায়।মেয়েটার ঠোঁটে প্রসারিত হাসি।বাহিরের ধূসরে ছেয়ে যাওয়া ঝমঝমে বৃষ্টি আর একান্ত নারীর স্বর্গরূপা সাজ!এযেনো অপার্থিব দৃশ্য!নিভান কেমন পলকহীন,দৃঢ়,গভীর নয়নে সেই নারীকে অবলোকন করতে করতে, তারইপানে এগোলো।যতোই এগোলো মেয়েলী একটা মিষ্টি গন্ধে মোহাবিষ্ট হতে লাগলো তার নাসাপথ।আর তা ছড়িয়ে পড়তে লাগলো রন্ধ্রে রন্ধ্রে।সঙ্গে মুগ্ধ হতে থাকলো নিভানের দুটো বুদ্ধিদীপ্ত গম্ভীর চোখ।ফর্সা শরীরে গাঢ় সবুজ শাড়ীটা যেনো পাহাড়ী নজরকাঁড়া কোনো মায়ারণ্য রূপ।সঙ্গে কানের টানা ঝুমকোজোড়া!গলায় চিকচিক করা স্বর্নের চেইনটা!দু’হাতে ভরা খয়েরী সবুজ কাঁচের চুড়ি!আর মৃদুমন্দ বৃষ্টিতে ভেজা সে নারী!নিভান বারান্দার দোরগোড়ায় গিয়ে ঘনোঘনো পলক ফেললো কয়েকটা।এই নারীর এই রূপ-লাবণ্যেতা উপেক্ষা করা কঠিন সাধুপুরুষেরও কাম্য নয়।নিভান ঠায় দাঁড়িয়ে বিমুগ্ধ নজরে সেই রূপ-লাবণ্যে উপভোগ করতে লাগলো।তবে কৌড়ি যেনো টের পেলো নিভানের এসে দাঁড়ানোটা।মূহুর্তেই চোখ খুললো সে।বললো–আপনি এসেছেন?আজ এতো তাড়াতাড়ি?

ঝর্নায় ন্যায় উচ্ছল যেনো সে কন্ঠস্বর!যার উচ্ছলতার টের আগে কখনো পায়নি এই নারী কন্ঠে নিভান।সেই কন্ঠের উচ্ছলতার রেশ যেনো ছড়িয়ে পড়েছে নারীটার চোখেমুখে।সেই ডগরডগর হরিনী চোখ হাসছে।যে চোখ দুটো এতোটা ঝলমলে খুশি নয় বরং ভারাক্রান্ত মায়াবী শান্ত নয়নে ধরা দিয়েছে নিভানের নয়নে।আজ তার উচ্ছ্বসিত রূপ!হাসছে সেই ওষ্ঠদ্বয়।যে ওষ্ঠদ্বয়ে নিভান এর আগেও বহুবার হাসি দেখেছে।তবে এতো মাধুর্যপূর্ন নয়।এযেনো পদ্মের ফুটন্ত রূপ!হাসছে যেনো সেই মায়াবী পুরো মুখাবয়ব!নিভান, এই কৌড়িকে চেনেনা!এতো উচ্ছলতা নিয়ে কখনো কৌড়িকে বলতে শোনেনি সে!তবে এই অচেনা উচ্ছল কৌড়িই যেনো অমায়িক অসাধারণ লাবন্যময়ী লাগলো তার। মনেহলো,বাহিরে ধূসরে ছেয়ে যাওয়া বৃষ্টির চিত্ত আর এই উচ্ছলতায় ভরা স্বর্গরূপা নারীর হাস্যজ্বল রূপের দৃশ্যপট! তার পৃথিবী এখানেই থমকে যাক!অন্তত যুগ ধরে এই দৃশ্যই অবলোকন করুক তার চক্ষুযুগল।নিভান যেনো ঘোরে ডুবলো।কৌড়ি কি জিজ্ঞেস করেছিলো ভুলে বসলো।
তার প্রেক্ষিতে জিজ্ঞেস করলো–হঠাৎ আমাকে ভুলে বৃষ্টির সঙ্গে সখ্যতা? তাও আবার এতো অপরূপা সাজে?

কৌড়ির হাসিতে এবার সাফেদ দন্তের দেখা মিললো। নিভানের প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে খুব স্বাভাবিকতর দাড়িয়ে থাকা।সহজ কন্ঠস্বর!তাকে লজ্জার বিভ্রান্তে ফেললোনা।বরং নিভানের মতোই খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে সেও বললো– হঠাৎ ইচ্ছে জেগেছে তাই।

নিভান একটু অবাক হলো!এ কি সেই কৌড়ি বলছে যে, নিজেকে কখনো কারও সম্মুখে ঠিকঠাকভাবে মেলে ধরতে চায়না!তার সম্মুখেওনা!তবে সেসব ভাবনা ভুলে
নিভান যেনো সেই মুক্তোঝরানো হাসিমুখের মুগ্ধতার গভীরে ডুবলো।কৌড়ি সেই মুগ্ধতার মোহজাল বাড়িয়ে দিয়ে বলতেই নিভান কদম বাড়িয়ে দূরত্ব ঘুচালো।বললো—আমারও যে হঠাৎ কিছু ইচ্ছে মনে জেগেছে!

নিভানের ইঙ্গিত হঠাৎই ধরতে পারলোনা কৌড়ি।আগের ন্যায় উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললো-আমি আমার ইচ্ছে অপূর্ণ রাখিনি।

কথাটা বলেই ঘুরে দাঁড়ালো কৌড়ি।হাতদুটো মেলে দিলো দু’দিকে।সেই মেলে রাখার হাতের উপরে নিভান নিজের হাতদুটো রাখলো।কৌড়ি এবার চমকে উঠলো।পিছে ফিরে তাকানোর আগেই নিভান তার কানের কাছে মুখ এনে বললো–তবে তুমি কি আমার ইচ্ছেও অপূর্ন রাখতে না করছো?

কৌড়ি এবার বুঝলো সে কি বলে ফেলেছে।যার দরূন উত্তর দিতে পারলো-না।বরং বরের স্পর্শে অনুভূতিতে নারী কোমল শরীর হিম অনুভব হলো।মূহুর্তেই লজ্জারা এসে ভীড় করলো সর্বাঙ্গে।হঠাৎ নিজের সাজপোশাকের কথা মনেহলো।এবার যেনো লজ্জায় গলে এলো শরীর।সেই গলে আসা শরীরটা বড়োযত্নে নিভান নিজের বলিষ্ঠ বুকে ঠাই দিলো।আগলে নিলো শক্তপোক্ত বাহুবন্ধনীতে।কোমল হাতের উপরে শক্ত হাতের চাপ লাগতেই পরপর কয়েকটা চুড়ি খুলে পড়ে গেলো।টাইলসকৃত ফ্লোরে তা ঝনঝন আওয়াজে বেজে উঠলো।কৌড়ি আঁতকে উঠে,কেমন মুখ ফসকে নিভানকে মৃদুশব্দে ডেকে উঠলো।–নিভান!

কৌড়ির আতঙ্কিত ডাকের বিপরীতে নিভান মৃদু হেসে বললো-ভেঙে যাক।যতো ইচ্ছে কিনে নিও।আমি দেবো।

ভেঙে যাওয়ার জন্য তো বলেনি কৌড়ি।বলেছে আতঙ্কিত হয়ে।কৌড়ি ফের কিছু বলতে যাবে তারআগে কন্ঠস্বর নিভে এলো তার।বউয়ের ফর্সা গলার ভাঁজে গভীর চম্বুনে নিবিষ্ট করলো নিভান নিজের ওষ্ঠদ্বয়।যা কৌড়িকে দেখলেই তাকে বড়োই আকর্ষণীয় বস্তুর ন্যায় টানে।গভীর উষ্ণ স্পর্শে কৌড়ির পাতলা শরীরটা খিঁচে নিভানের বলিষ্ঠ বুকের সঙ্গে আরও মিশে গেলো।শ্বাস রুদ্ধ হওয়ার জোগাড়।সেই রুদ্ধশ্বাস এবার আঁটকে এলো এবার নিভানের জড়ানো স্বরের ডাকে।

কৌড়ি।

এ ডাকের অর্থ কৌড়ির জানা।তবে এ ডাকটার উত্তর দিতে চায়না কখনো কৌড়ি।তবে অসময়ে ডাকটা শুনে লজ্জায় বিমুঢ় হয়ে গেলো সে।মন মস্তিষ্কে তোলপাড় শুরু হলো।চোখ খিঁচে অনবরত শুধু মাথা নাড়ালো।মুখে কাঁপা স্বরে আওড়ালো–উহুম।অর্থাৎ না।

‘হুমম।অর্থাৎ না নয় হ্যা।

নিভান হেসে দিলো। সে হাসির শব্দ মোহগ্রস্তের ন্যায় কৌড়িকে দূর্বল করে দিলো।আর তারচেয়ে দূর্বল করে দিলো নিভানের গলার হুমম শব্দটা। যার বিপরীতে কৌড়ি আর একটা শব্দও প্রয়োগ করতে পারলো-না।আর না সে ডাকের আহ্বান উপেক্ষা করে ফিরিয়ে দিতে পারলো।নিভানও কেমন মধ্যেদুপুরটাকে মধ্যেরাত বানিয়ে নিলো।আর অসময়টাকে কেমন সময়।

সময়টা বর্ষনমূখর বিকেলবেলা।সিয়াম বাহিরে যেতে চেয়েও যেতে পারলো-না।বাহিরে বর্ষার তোড় কেমন সেটা সদর দরজা খুলে দেখে এসে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে পড়লো সে।এতো বর্ষায় বাহিরে যাওয়া যায়!সোফায় বসতেই নজর পড়লো কিচেনে।দীবা কিছু একটা করছে।সুশ্রী মুখখানা তার আষাঢ়ে মেঘের মতো গম্ভীর।সেদিন রাতে মেয়েটা শান্ত হয়ে ঘুমালেও সকালে উঠে ওবাড়িতে যাওয়ার জন্য বেশ গলাবাজি করে তারসঙ্গে ঝগড়া করেছিলো।সিয়াম না পেরে শান্তস্বরে বলেছিলো—আচ্ছা তুমি যদি ওবাড়িতে ভালো থাকো,তবে ওবাড়িতেই রেখে আসবো তোমাকে।
আপতত শান্ত হও।তবে ওবাড়িতে যাবার আগে আরও একবার ভেবে দেখো।আমি খারাপ মানুষ আমার সঙ্গে ভালো থাকবে না সেটা নাহয় বাট ওবাড়িতে ভালো থাকবে তো?

সিয়ামের কথায় দীবা আর দ্বিতীয়ত কথা বাড়াইনি।চুপ হয়ে গিয়েছিলো।কথা বলেনি আজও। তবে তার কথা ভেবে হোক বা অন্যকিছু, মেয়েটা আর ওবাড়িতে যাওয়ার জেদ করেনি।এমনকি প্রসঙ্গ টানেনি।সিয়ামও সেখানেই চুপ।তবে নিভানের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে সিয়ামের মায়ের সঙ্গে তার শ্বাশুড়ির এবাড়িতে চলে আসায় দীবার এবাড়িতে থাকাটা আর-ও সহজ হয়েছে। তবে দীবা তার সঙ্গে কথা না বললেও,সিয়ামের বাবা মায়ের সঙ্গে আগের ন্যায় আচারণ করছে।কথাবার্তায় গম্ভীরভাব হলেও বলছে।হঠাৎ ফোন বেজে উঠায় ভাবনা কাটলো তার।এক বন্ধু কল করেছে। তারসঙ্গে মিট করা কথা ছিলো। সেইই ফোন করেছে। ফোন রিসিভ করে কথা বললো সিয়াম।এ অবস্থায় কোনোরূপ বাহিরে যাবেনা সে।জানিয়ে দিলো।আরও টুকিটাকি কথাবার্তা বলে ফোন রাখলো।হঠাৎ কিছু একটা মনে করে শুভাকাঙ্ক্ষী একজনের নম্বরে ডায়াল করলো।যাকে সে এতোদিন প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতো সঙ্গে নিজের অপছন্দের ব্যাক্তি।ওপাশ থেকে দৃঢ় কন্ঠস্বরের আওয়াজ ভেসে আসতেই সালাম দিলো সিয়াম।নিভান সালামের উত্তর দিতেই সিয়ামের দৃষ্টি চলে গেলো কিচেনে।যেখানে দীবা এখনো একমনে কিছু করে চলেছে।জীবনে সে অনেক ছেলেমানুষী করেছে। তবে এই মেয়েটার বেলায় এসে দিল কিকরে আঁটকে গেলো বুঝে আসেনা সিয়ামের।আর এই মেয়ের জন্য কতো কিছু বাধ্য হয়ে ছেড়েছে।কতোকিছু ছাড়তে হয়েছে। নিজের স্বভাব আচারনের বদলও করতে হয়েছে।যা বাপের এক রাজপুত্র হিসাবে,যখন যেটা যা ইচ্ছে করা সিয়ামের জন্য সহজ ছিলো-না।তবুও কেমন মেয়েটাকে পাওয়ার আশায় সেই নিত্যনতুন আকাঙ্ক্ষার জীবন
ত্যাগ করতে হয়েছে।তবে এটাতে সিয়ামের ভালো ছাড়া মন্দ হয়নি।যার অনুভব ধীরেধীরে অনুভাবিত হয়েছে সিয়ামের।সিয়াম আনমনেই বললো–‘থ্যাঙ্কিউ নিভান। দীবাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।

এটা ভুল ধারণা আপনার।আমি ফিরিয়ে দেই-নি।যেটা কখনো আমি আমার ভাবিনা তার দিকে আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকাইনা।যা আমার নয় তা অন্যকে দেওয়া নেওয়ার হকও আমার নয়।সুতরাং আপনার জিনিস আপনি হাসিল করেছেন।

‘সুপরামর্শ তো আপনার ছিলো।নাহলে দীবাকে আমার কাছে ফিরানো সহজ ছিলো কি?ছিলো না।

‘ছিলো কি ছিলো,তা আমি জানিনা।তবে থ্যাঙ্কিউয়ের থেকে আমি যেটা আপনার থেকে আশা করছি তা হলো,দীবাকে ভালো রাখা।ও আমার রক্তের সম্পর্কের কিছু না হলেও,ও আমারই একজন ফ্যামিলি মেম্বার্স।আর আমি কখনো চাইনা,আমার ফ্যামিলি মেম্বার্সের কেউ একজনও দুঃখী থাকুক।অশান্তি, অসুখে থাকুক।তারজন্য আপনাকে সুপরামর্শ দেওয়া।

‘যেটার জন্য হোক তবুও ধন্যবাদ আপনাকে।

সিয়াম এতোটা বিনয়ী কখনো ছিলোনা।আর নিভানের ক্ষেত্রে তো নয়ই।ওবাড়ির জামাই আর দীবাকে পাওয়ার গর্বে সবসময় নিভানের সম্মুখে একটা অন্যরকম ভাবভঙ্গিতে থেকেছে।যা নিভানও কখনো পরোয়া করেনি।সেই সেই না পরোয়া, সিয়ামকে আরও নিভানের বিপক্ষে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে।সেই দ্বন্দ্ব আগে ভঙ্গ হলেও,সম্পূর্ণ ভঙ্গ হয়েছে নিভানের বিয়ের আগের রাতে।যখন নিভান তাকে ফোন দিয়ে বিনয়ের সঙ্গে তার বিয়েতে আমন্ত্রণ করলো।এবং নিজের থেকে দীবাকে মানানোর একটা প্রচেষ্টা করতে বললো।মানুষের জীবনে ভুলভ্রান্তি অন্যায় থাকতে।পারে।সেগুলো সে কোন পরিস্থিতি করেছে বুঝিয়ে শুনিয়ে সিয়ামকে একটা সুযোগ দিয়ে মানাতে।আরও নানাবিধ সুপরামর্শ।
সিয়াম ভিষন আশ্চর্য হয়েছিলো সেদিন।বিয়ের আগ থেকে দীবার মুখে নিভানের ভালো গুনগান শুনতে শুনতে একটা অদ্ভুত আক্রোশ তৈরী হয়েছিলো। শত্রুতা না করে কেমন শত্রু মনোভাব পোষন করতো।নিভানের প্রতি দীবার দূর্বলতা সেই শত্রুতা মনোভাব যেনো বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিলো।আর সেই শত্রুতা মনোভাব থেকে রাগ-ক্ষোভে কিনা কি বলেছে লোকটাকে।আর সেই লোকটা তার সংসার জোড়ার সুপরামর্শ দিচ্ছে!

‘সিয়াম।আমি আরও একটা কথা বলতে চাই?

দৃঢ়কণ্ঠের বার্তায় ভাবনা কাটলো সিয়ামের।নড়েচড়ে বসলো সে।তবে তখনো নজর তার দীবাতে।সেখানে নজর রেখেই বললো—বলুন।

‘দ্বিতীয়ত দীবা যদি কখনো আপনাকে অভিযুক্ত করে এবাড়িতে পা রাখে।আপনি কিন্তু দ্বিতীয়বার সুযোগ বা সুপরামর্শ আর পাবেন না। এবং তাকেও না।জাহিদ সাহেব, শাহেদ সাহেব তাদের আদরের ভাগ্নীর ব্যাপারে চুপ আছেন কিন্তু আমার পরামর্শে।দ্বিতীয়বার কিন্তু আমি আপনাদের বিষয়ে মস্তিষ্ক ঘামাবো-না।আমার কথাগুলো ভালো না লাগলে, আমি দুঃখিত।বাট আমার মনেহয় একজন মানুষকে বারবার সুযোগ দেওয়া অনুচিত।

নিভানের এই কার্টছাট কথায় সিয়ামের ব্যক্তিত্বে আঘাত হানলো।নজর সরে এলো তার দীবা থেকে।গম্ভীর হয়ে গেলো সুদর্শন মুখাবয়ব। দোষ কি তার একার ছিলো?ওদের বাড়ির মেয়ের দোষ ছিলোনা?তবে কেনো বিচার সর্ব পর্যায়ে তার বিপক্ষে যাবে?সে যা করার বিয়ের আগে করেছে কিন্তু দীবা!আঘাত হানা মনটাকে সামালে নিলো সিয়াম।সে বাবা মায়ের আদূরের দুলাল হলেও বখে যাওয়া ছেলে নয়।আর দ্বিতীয়ত জোড়া না লাগা সম্পর্কটাকে সে জোড়া লাগাতে চায়।বিভক্তি করতে চায়-না।মুলত দীবা যেমনই থাকুক সে দীবাকেই চায়।দীবা তার জীবনে আসার পর থেকে অন্য নারীতে তার মন বসেনি।তার আর অন্য কোনো নারী চাইনা।সুতরাং
কিছু কথা ব্যাক্তিত্বে আঘাত হানলেও না চাইতেও তা হজম করতে হবে।যেখানে নিজের দোষটাও খুব ছোটো খাটো বিষয় ছিলোনা।কমও ছিলেনা।এটা ভেবে নিজের পুরুষ জেদ, ইগো সরিয়ে বিনয়ী গলায় উত্তর দিলো।

‘সেই সুযোগ আমি যতোসম্ভব না দেওয়ার চেষ্টা করবো
নিভান।তবে দীবা আমাকে বুঝলে হয়।ওর চাওয়াতো এক মানুষের আঁটকে আছে।

‘আর সেই মানুষটা মনেপ্রাণে শুধুমাত্র তার স্ত্রীকে চায়।শুধুমাত্র তারই স্ত্রীকেই।এটা আপনার বউকে বুঝিয়ে নিজের ভালোবাসায় আঁটকে রাখর চেষ্টা করুন।আঁটকে রাখুন।ভালোবাসায় বন্যপ্রাণীও আঁটকে থাকতে বাধ্য হয়।

‘হুমম।

ফোনে কেটে দিলো নিভান।সিয়াম সেই ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ফের পাশ ফিরতেই দেখলো ডালিয়া বেগম শূন্য দৃষ্টি ফেলে তারদিকে ফিরে দাঁড়ানো।সিয়াম ফোন কাটতেই তিনি বললেন-নিভানের সঙ্গে কথা বলছিলে?

‘জ্বি আম্মা।

‘নিভান তোমাকে পরামর্শ দিয়েছিল দীবাকে মানানোর চেষ্টা করতে ?

সিয়াম মৃদু মাথা নাড়িয়ে হ্যা জানালো।ফের মুখ বললো–হ্যা আম্মা

চলবে…

বাকি অংশ পরবর্তীতে যোগ করা হবে।

ফুলকৌড়ি পর্ব-৫৮+৫৯

0

#ফুলকৌড়ি
(৫৮)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

অফিশিয়াল কিছু কাজের জন্য সকাল সকাল জাহিদ সাহেবের শরণাপন্ন হতে হলো নিভানকে।যদি-ও রোজ সকালে অফিসে বের হওয়ার আগে উনার সাথে একবার দেখা করে তারপর অফিস যায় নিভান।রাতে অফিস থেকে ফিরেও একবার দেখা করার চেষ্টা করে ,যদিনা তিনি ঘুমিয়ে পড়েন।জাহিদ সাহেবের রুমে ঢুকে উনার শরীরের খবরাখবর নিয়ে অফিশিয়াল কাজের কথায় মত্ত হলো দু’জনে।কথাবার্তা শেষ হতেই জাহিদ সাহেব একটু সময় নিলেন।ফের বললেন– তৃনর আর মান্যতার বিষয়টা নিয়ে কি ভাবলে?তৃনয় প্রস্তাব রেখেছে বিষয়টা খুবই ভালো লেগেছে কিন্তু প্রস্তাবটা বেয়ান সাহেবা রাখলে বিষয়টা আরও ভালো হতো-না?

‘আন্টিই প্রস্তাব রাখতে চেয়েছিলেন।তৃনয় মানা করেছে।

একটু আশ্চর্য হলেন জাহিদ সাহেব। শুধালেন–কেনো?

‘বিয়ের মতো একটা বন্ধনে ছেলে মেয়ে দুজনেকেই সংসারের জালে আঁটকে পড়তে হয়।সেখানে শুধু তৃনয় মতামত বা প্রস্তাব রাখলে-তো হবে-না।মান্যতার মতামতও গুরুত্বপূর্ণ।প্রয়োজনীয়।যদিও আমি মান্যতার সাথে তৃনয়ের বিষয়ে কথা বলেছি।সিদ্ধান্ত নিতে মতামত জানাতে সময় চেয়েছে সে।সেটা আমি তৃনয়কে জানিয়েছি।তাই আপতত আন্টিকে মানা করে রেখেছে তৃনয়।যদিও মান্যতার সময় চাওয়ার বিষয়টা আন্টি জানে না।তৃনয়,আন্টিকে বলেছে পরপর ওবাড়িতে দুটো বিয়ে হলো।আপতত আমরা সময় নিয়ে বিয়ের প্রস্তাবটা রাখি।সেটা মেনেছেন আন্টি।তবে মান্যতা ভালোমন্দ মতামত প্রকাশ করলেই আন্টিকে পাঠানো হবে প্রস্তাব নিয়ে।

মেয়ের বিষয়টা তিনি এতো গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখেন নি।কারন মান্যতা বাবা,ভাইয়ের সিদ্ধান্তের বাহিরে যাবার মতো মেয়ে নয়।সেজন্য মান্যতাকে নিয়ে এতোটা তৎপর ভেবে দেখা হয়নি। এজন্য নিভানের সকল সিদ্ধান্ত তিনি চোখ বুঁজে মেনে নেন।ছেলেটার সবদিকে খেয়াল থাকে।কারও অধিকার থেকে এক সুতা পরিমাণ হক যেনো নষ্ট নাহয়,ছেলেটার নিদারুণ খেয়াল সবসময় সেদিকে তৎপর থাকে। কন্ঠে সন্তুষ্টতা বজায় রেখে তিনি বললেন।

‘বেশ ভালো।তবে ওদিকে চৌধুরী সাহেব তো মনেহয় আমাদের উপর বেশ মনোক্ষুণ্ণ হয়েছেন!তোমার বিয়ের নিমন্ত্রণে তো আসলেনই না,গতকাল কথা হলো।কথার ভঙ্গিমায় বুঝলাম তিনি প্রস্তাব নাচকে বেশ অসন্তুষ্ট।তবে আরও একবার বিষয়টা নিয়ে ভেবে দেখতে বললেন।

‘আপনি কি বললেন?

‘বলেছি কাওকে কথা দিয়ে ফেলেছি। সেজন্য আপনার প্রস্তাব রাখতে পারছিনা।

নিভানের ঠোঁট সুক্ষ প্রসারিত হলো।সেটা খেয়াল করলেন জাহিদ সাহেব।তুখোড় বিজনেসম্যান হওয়ায় হঠাৎই একটা কথা মাথায় এলো।সেই অনুযায়ী শুধিয়ে ফেললেন সামনে বসা ছেলেটাকে–এই কারণে যদি ব্যবসায়ী সম্পর্ক নষ্ট করতে চান?

‘করবেন।সমস্যা কোথায়?

জাহিদ সাহেব জানেন উনার সামনে বসা ছেলেটাও তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন একজন বিজনেসম্যান।তাকে জেনেশুনে প্রশ্নটা করা অযাচিত।তবুও কৌতুহল বসত করলেন।যার সদুত্তর যেমনটা আশা করেছিলেন ঠিক তেমনটাই পেলেন।তবে নিভানের উত্তরে মনের ভিতর আরও একটা প্রশ্ন হানা দিলো উনার।

‘উনার প্রস্তাব নাকচ করার কারণ মান্যতার উপযুক্ত পাত্র শুধু তৃনয়কে বলে মনে করো,কেনো জানি এটা আমার মনে হয়না।কারণতো একটা আছে!আমাকে কি বলা যায়, উনার প্রস্তাব নাকচ করার তৃনয় বাদে-ও দ্বিতীয় কারণটা কি?

‘উনার ছেলে এই বিয়েতে রাজি নন।উনি শুধু বিজনেস আর উনার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ঠিক রাখতে ছেলের উপর উনার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছেন।ছেলের পছন্দ অন্য কাওকে।সেখানে আমি জেনেশুনে আমার বোনকে বলি দেই কিকরে!দ্বিতীয়ত আমি চাই-না,আমার বোন শুধু আরাম-আয়েশে থাকার জন্য ওরকম ধরাবাঁধা সম্পর্কে বাঁধা পড়ুক।আমি চাই আমার বোন আরাম-আয়েশ বাদেও সুখে-শান্তিতে থাকুক।চৌধুরীবাড়ির মতো খুব আরাম-আয়েশ না দিতে পাারলেও আমার বোনকে তৃনয় অনন্ত সুখে-শান্তিতে রাখবে।এটা আমার বিশ্বাস।আমি মনে করে তৃনয়ের প্রতি আমার বিশ্বাসে আপনিও বিশ্বাসী?

জাহিদ সাহেব মুখে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে নিভানের কথায় সায় জানালেন।বিনিময়ে নিভানও মৃদু হাসলো।ততক্ষণাত কিছু একটা ভেবে জাহিদ সাহেব ফের
বললেন–আচ্ছা ওসব বাদ দাও।সেই যখন সিদ্ধান্তঃ নেওয়া হয়ে গেছে চৌধুরী সাহেবের ভাবনা বাদ দেওয়াই ভালো।

কথাটা বলে তিনি একটু চুপ হলেন।যেটা তিনি বলতে চেয়েছিলেন, ছেলেকে সেটা কিভাবে বলবেন ভিতরে ভিতরে আড়ষ্ট কাজ করলো উনার।

‘কিছু বলবেন।

বলছিলাম,সেই যখন কক্সবাজার যাচ্ছো।মেয়েটাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাও। একবারে ঘুরিয়ে নিয়ে এসো নাহয়।এরপর ওর কোচিং শুরু হবে।সামনে এডমিশন পরিক্ষা।রেজাল্টের পরে আবার ভর্তির কার্যক্রম আছে।এটাওটাতেই কেটে যাবে সময়। তাড়াতাড়ি তো আর সময় হবেনা।এখন যখন সুযোগ আছে,এই সুযোগে ওকেও নাহয় তোমার সাথে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসলে।

জাহিদ সাহেব যে হানিমুনের কথাটা ঘুরতে যাবার নাম দিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলছেন,সেটা বেশ বুঝলো নিভান।বাবার এমন প্রস্তাবে ভিতরে ভিতরে নিজেও একটু আড়ষ্টতায় ডুবলো।তবে বাহিরে নিজেকে সহজ রেখে মন জাহিদ সাহেবের প্রস্তাব মানতে চাইলেও মুখে বললো –ও আমার সাথে গিয়ে কি করবে।ওখানে আমাকে ব্যস্ত থাকতে হবে।ওরদিকটা খেয়াল রাখার সময় হবেনা।বরং পরিক্ষার পরে নাহয় দেখা যাবে।

‘যে দুদিন অফিশিয়াল কাজে যাচ্ছো।সেই দুদিন নাহয় ব্যস্ত থাকলে।তারপর আর-ও এক্সট্রা দুদিন নিয়ে না-হয় ঘুরেফিরে আসলে।

বিষয়টা নিয়ে জাহিদ সাহেবের সাথে বাকবিতন্ডায় যেতে চাইলোনা নিভান।মুরুব্বি মানুষটার সাথে এটা নিয়ে আলোচনা করা কেমন একটা অস্বস্তির বিষয়।তাই উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো–আচ্ছা দেখছি কি করা যায়।

‘কি করা যায় কি!দুই ভাই আমার দুই বউমাকে নিয়ে ঘুরে এসো।ওদের ভালো লাগবে।নিজেদের ভালো লাগা মন্দ লাগা বাদ দিয়ে মাঝেমধ্যে ওদের ভালো লাগা মন্দ লাগাটাও একটু চিন্তাভাবনা করতে হয়।করা ভালো।তাতে সংসার জীবন সুখে শান্তির হয়।যদিও তুমি বুঝদার ছেলে।তোমাকে এগুলো বলে বোঝাতে হবেনা।তবে তোমার ভাইকে বোঝানো একটু দরকার।তিনিতো থাকেন তাহার মতিগতি নিয়ে।

‘ইভান যথেষ্ঠ বুঝদার ছেলে।যেখানে ও নিজের জীবন নিয়ে যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছে তা আমার কাছে অযথা বলে মনে হয় না।আর যদি কখনো অযথা প্রমানিত হয়।আমরা তো আছি।

হাসলেন জাহিদ সাহেব।নিভানের সামনে ইভানকে নিয়ে কথা বলা অনর্থক।তার কোনো কাজে মন্দ খুঁজে পায়না যে ছেলে,সেই ছেলের সামনে তার নিন্দা করে লাভ আছে!যদিও নিভান ঠিক।কেননা,ইভানকে ছায়ার মতো আগলে রাখলেও ইভানের অন্যায়গুলো কখনো নিভান প্রশ্রয় দেয়না।

‘আসছি।আপনি বিশ্রাম নিন।

নীহারিকা বেগম তখনই রুমে ঢুকলেন।হাতে উনার জাহিদ সাহেবের সকালের খাবার ট্রে।নিভান বেডটেবিলের পাশে দাঁড়িয়েছিলো,মা’কে খাবার নিয়ে আসতে দেখেই সরে দাঁড়ালো। নীহারিকা বেগম বললেন– এখনো কথাবার্তা শেষ হয়নি।এবার তো না খেয়েই অফিসে দৌড়াবি।তোদের নিয়ে আর পারা যায়না।কথা শেষ এবার ডাইনিংয়ে যা।খেয়ে নে।

নিভান সম্মতি জানিয়ে চলে যাচ্ছিলো।জাহিদ সাহেব তাকে আবারও ডাকলেন–নিভান।দাঁড়াও।

নিভান পুনরায় দাঁড়িয়ে পড়লো।জাহিদ সাহেব এবার নীহারিকা বেগমে উদ্দেশ্য করে বললেন–নীহারিকা সেই ফাইলটা কোথায় রেখেছিলে।নিয়ে এসো।

‘কোন ফাইলটা?

প্রশ্ন করেই যেনো উনার হুশ ফিরলো।দ্রুত পায়ে গিয়ে আলমারি খুলে ফাইলটা এনে জাহিদ সাহেবের কাছে দিলো।জাহিদ সাহেব সেটা নিভানের দিকে এগিয়ে দিতেই কপালে সুক্ষ ভাজ পড়লো নিভানের।ফাইলটা খুবই পরিচিত তার।একদিন নিজেই এটা বহন করে এনে জাহিদ সাহেবের হাতে হস্তান্তর করেছিলো সে।

‘এটা এখন আর আমার দায়িত্ব নয়।এর দায়িত্বের মালিক এখন তুমি।তাই এই আমানত তোমার কাছেই রেখে দাও।

ফাইলটা হাতে নিলো নিভান।কৌড়ির বাবার উইল করে যাওয়া নিজের সম্পত্তির কিছু কাগজপত্র, ব্যাংক একাউন্ট কাগজপত্র এবং চেইক।সাথে কৌড়ির বিষয় কাগজপত্র ও সার্টিফিকেট নিয়ে এই ফাইল।নিভান ফাইলটা খুললো।কৌড়ির স্কুল কলেজের এবং বার্থ সাটিফিকেট এই ধরনে কাগজপত্রগুলো বের করে নিয়ে পুনরায় ফাইলটা জাহিদ সাহেবের দিকে এগিয়ে দিলো সে।বললো–আমার দায়িত্ব আমি নিয়ে নিয়েছি।এবং তা যথাযথ পালন করার চেষ্টা করবো।বাকী কাগজপত্র গুলো আমার দায়িত্ব নয়,আপনি রাখুন।আর আপনি না রাখতে পারলে,কৌড়ির দাদিআপার কাছে ফাইলটা দিয়ে দিয়েন।এগুলো আমার প্রয়োজন নেই।

‘আমার মনেহয় ঘুরেফিরে ফাইলটা তোমার দায়িত্ব আসবে।আমি তোমাদের বিয়ের দিন রাতে কৌড়ির দাদািআপাকে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম উনি নেননি।

‘আপনি আমাকে জানেন এবং চিনেন।এই দায়িত্ব আমি কখনোই নেবোনা।আমার স্ত্রীর সকল ভরণপোষণের দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষমতা আল্লাহর রহমতে আমার আছে।সুতরাং সেই সক্ষমতা থাকা বা না থাকা সত্ত্বেও এগুলো আমার প্রয়োজন নেই।আপনার কাছেই রেখে দিন।পরে বুঝিয়ে উনাকে ফাইলটা নাহয় দিয়ে দিবেন।

নিভান আর দাঁড়াতে চাইলোনা।বললো–অফিসের দেরী হয়ে যাচ্ছে। আপনি খেয়ে নিন।আমি আসছি।

নিভান আর দাঁড়ালো না।চলে এলো।সেদিকে তাকিয়ে রইলেন জাহিদ সাহেব।লোভ, হিংসা,অহংকার এই মন্দ জিনিসগুলো সহজে সংবরণ করা যায়না।যদি মানুষ নিজে সংবরণ না করতে চায়।তার উৎকৃষ্ট ভালোমন্দ উদহারন দুটোই উনার বাড়িতে ছিলো।একদল সেই নিকৃষ্ট রূপটা দেখিয়ে চলে গেছে।আরেকজন উত্তম রূপটা দেখিয়ে নিজের শখ স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষা বিসর্জন দিয়ে রয়ে গেছে। এজন্য ছেলেটাকে তিনি এতো ভালোবাসেন।হ্যা নিজের রক্তের চেয়েও তিনি খুব বেশি ভালোবাসেন।

সকালের সময়টা তাড়াহুড়ো লেগে যায় সবার।আর তার চেয়েও তাড়াহুড়োয় থাকতে হয় বাড়ির গিন্নীদের।
কারণটা বাড়ির ছেলেমেয়েদের স্কুল কলেজ ভিন্ন সময়ে সঙ্গে পুরুষদের অফিসও।খাবার রেডি করা থেকে ছেলেমেয়েদের সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠিয়ে,গুছিয়ে খাবার খাইয়ে স্কুল কলেজে পাঠানো,যেনো একটা যুদ্ধ জয়।আপতত যুদ্ধ জয় করে ছেলেমেয়ো সব স্কুল কলেজে চলে গিয়েছে।বাড়িটা এখন ফাঁকা।শাহেদ সাহেবও কেবল খেয়ে উঠে চলে গেলেন।আপতত রেডি হয়ে অফিস বের হবেন।তাই স্বান্তনা রহমানকেও ছুটতে হলো স্বামীর পিছে পিছে।ডাইনিংয়ে কেবল খাবার খেতে বসলো ইভান।টেবিল পরিস্কার।পানির জগ গ্লাস আর ফ্রুটসের ঝুড়িটা ছাড়া আপতত বিলাশ বড় টেবিলটা ফাঁকা। ফ্রুটসের ঝুড়ি থেকে একটা আপেল তুলে নিলো ইভান।তাতে একটা কামড় বসিয়ে আশেপাশে নজর দিলো।তবে কিচেনে রানীসাহাবাকে ছাড়া আর কাওকে নিচে দেখতে পেলোনা।তার বউটা কোথায়?রুমেও তো দেখলো না।তবে?

‘রানীসাহেবা আমার জন্য সকালের বিল কি মওকুফ হয়ে গেছে?টেবিলে দেখছি কিচ্ছু নেই।ব্যাপার স্যাপার কি?

এবাড়িতে সবার শেষে ঘুম থেকে উঠে ইভান।এজন্য খাবারটাও তার সবার শেষে হয়।তা নিয়ে মায়ের কতো কথা।সেরকমই একটা কথা সে বলে দিলো।সেটা শুনে রানী হেসে বললো–খাবার থাকবেনা কেনো!অবশ্যই খাবার আছে।সবার প্রায় খাওয়া শেষ তো, তাই টেবিল পরিস্কার করে নিলাম।একটু বসো।আমি দিচ্ছি।

‘তুমি একহাতে আর কতো কাজ করবে।তোমার ছোটো বউমা কোথায়?বাড়িতে দু’দুটো বউ এনে লাভ কি হলো।সেই যদি সবদিকে খেয়াল তোমাকেই রাখতে হয়।

ইভান যেমন মজার ছলে কথাগুলো বললো।তেমন সিরিয়াস হয়ে উত্তর দিলো রানী–‘বউমাদের দোষ খুজবেনা একদম।বউমা-রা আমার খুব ভালো।বড় বউমাকে নিভান বাবা ডেকেছে তাই গেছে।আর ছোটো বউমা-তো এখানেই ছিলো।টেবিলের সবকিছুতো সেই গুছিয়ে রেখে গেলো।

‘রানী সাহেবা,তোমাদের মনে হয়না তোমাদের নিভান বাবা একটু বেশি বউ পাগল?

ইভান যে মজা করছে এটা বুঝে চওড়া হাসলো রানী।বললো–তা বউ পাগল হলে দোষ কোথায়?বউ পাগল হওয়া ভালো।সে তো শুধু বউপাগল তা তো নয়।সে তো মা পাগল,ভাই পাগল,বোন পাগল,পর বলতেও পাগল।সম্পর্ক বলতে সে পাগল।

রানী কিচেন থেকে খাবার এনে ইভানের সম্মুখে টেবিলে রাখতে রাখতে কথাগুলো বললো।সেটা শুনেে ইভান বললো–তা অবশ্যই।তবে আমার আবিস্কার বলছে, ভবিষ্যতে তোমাদের নিভান বাবা সব সম্পর্কের থেকে একটু বেশিই বউপাগল হবে।আমি কিন্তু তোমাদের নিভান বাবার মতো অতশত বউ পাগল নই।আমি ভাই খাঁটি মাটির মানুষ।ওসব পাগল টাগল নই।

‘সে আমি জানি,তুমি কেমন খাঁটি মাটির মানুষ।বউ পাগল নও বলে তার বিয়েটা ভেস্তে দিয়ে নিজেই বিয়েটা করে নিয়েছো।তিনি আবার বউ পাগল নয়!

এই রানীসাহেবা,’তুমি এই সিক্রেট জানলে কিকরে?

আশেপাশে একপলক তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করলো ইভান।তেমন ফিসফিসেয়ে উত্তর দিল রানী।বললো — তোমাকে বলবো কেনো!এখন বলো বউপাগল আমাদের নিভান বাবা নাকি তুমি?

‘অবশ্যই তোমাদের নিভান বাবা।

রানী হাসলো।ফিরতে কিছু বলতে যাবে তার আগেই নিভান চেয়ার টেনেন বসতে বসতে বললো—‘আমাাকে নিয়ে আবার কি হলো?

কন্ঠ পেয়ে ইভান নড়েচড়ে বসলো।রানীও একটু সরে দাঁড়ালো।নিভান বসেই বললো–কি হলো?

‘রানীসাহেবা বলছিলো,তুমি নাকি মা পাগল ছেলে, ভাই-বোন পাগল ভাই,এবং বউ পাগল বর।তাই আর কি!আমিও রানীসাহেবার কথায় সম্মতি জানাচ্ছিলাম।

নিভান কেমন শান্ত নজরে ইভানের অপ্রস্তুত হাস্যজ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।পিছনে না তাকিয়ে বুঝতে পারলো,রানীসাহেবা কেমন অসহায় মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ইভানের মুখের এই উল্টো পাল্টা কথাগুলো যে সম্পূর্ণ রানীসাহেবার মুখের নয়,সেটা অজানা নয় তার।তাই রানিকে সহজ করতে বললো–রানীসাহেবা আমাকে এককাপ কফি দিন তো।

রানী দ্রুত কিচেনে চলে গেলো।ইভান বললো–তুমি এখনো বাড়িতে?ব্যাপার কি?

ইভানের মুখের দুষ্ট হাসি বলে দিচ্ছে, সে এখন অতি ফাজলামো মুডে আছে।নিভান বললো-প্রয়োজন ছিলো তাই।

‘তারমানে আমার আবিস্কার ঠিক।সত্যি তুমি বউপাগল হয়ে যাচ্ছো।এটা রানি সাহেবা মনেমনে মানলে-ও মুখে মানতে চাইছে-না।তোমার বিষয়ে সবার ধারণা একঘেয়েমী,একটু এদিক ওদিক হলেও কেউ মানতে চায়না।তেমনটা আমারও,আমি সত্যি বললেও সবাই ভাবে আমি ফাজলামো করছি।

সত্যিটা মুখ দিয়ে বের হয়ে যাওয়ায় অপ্রস্তুত হাসলো ইভান।নিভান গুরুত্ব দিলোনা।সে জানতো কথাগুলো ইভানের।তাই বললো–তো এগুলো বাচ্চামো,ফাজলামো ছাড়া কি!যাই হোক আমার তোর সাথে কথা আছে।

নিভানের কথা কানেই তুললো না ইভান।কন্ঠে দুষ্টমীর সুর তুলে বললো–তাহলে আমি গিয়ে ফুলকৌড়িকে বলি তার বর তাকে একটুও ভালোবাসে না।

‘ইভান!

ইভান গাল ভরে হেসে দিলো।খাবারের জন্য শব্দ করতে পারলো না।নিভান বিরক্ত হলো।যা বলতে এসেছিলো, সেটা বলতে শুরু করলো।–আমি কাল কক্সবাজার যাচ্ছি।

‘হানিমুনে!

গলার স্বরে আর ঠোঁটের মিটিমিটি হাসিতে স্পষ্ট মজা।নিভানের মনেহলো ইভানের আজকের শিকারী সে।তাই ইভানকে কাটিয়ে উঠতে বললো–ইভান,আমার অফিসের সময় হয়ে যাচ্ছে।ফাজলামোটা অন্তত এখন রাখ।

‘আচ্ছা বলো।

‘অফিশিয়াল কাজে যেতে হচ্ছে। বাবা বললেন যাচ্ছি যখন তোদের তিনজনকেও নিতে।কৌড়ি,তন্ময়ী আর তুই।বিষয়টা তিনি ভুল বলেননি।তন্ময়ীকে নিয়ে কোথাও তোর ঘুরে আসা উচিত ছিলো।সেটা হয়নি যখন, প্রস্তুতি নিয়ে রাখ।সকালেই আমরা বের হবো।

‘আমি যেতে চাইনা ভাইয়া।

তন্ময়ী কথাটা বলতেই নিভান ইভান দুজনেই তাকলো।মেয়েটা মূহুর্তেই অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়ালো।ইভান এমনিতেই না বলতো।সামনে তার বিবিএস পরিক্ষা।বিগত দিনগুলোতে একটার পর একটা ঝামেলার কারণে পড়াশোনার গতি একদম লো।সামনে যে দিনগুলো আছে, পড়াশোনাটা ঠিকঠাক করতে চায়।প্রিপ্রারেশন প্রপার নিতে চায়। নাহলে স্বপ্ন তার স্বপ্নই থেকে যাবে।তবে ইদানীং তন্ময়ীর আচারণ তার ঠিকঠাক লাগছে-না।মেয়েটার কিছু একটা হয়েছে।আচারণ কথাবার্তা তার অদ্ভুত। যা তাকে বলছেনা।এড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কি?বারবার শুধিয়েও তো উত্তর মিলছেনা।এখন ঘুরতে যাওয়ার বিষয়টা নিয়ে উত্তরেও কেমন তড়িঘড়ি করলো।কেমন অস্বাভাবিক। অথচ মেয়েদের ঘুরতে যাওয়ার কথা বললেই দুকদম আগে চলে তারা।সেখানে তন্ময়ীও আলাদা নয়।তবে কি হলো মেয়েটার।নিভান শুধালো।

‘কেনো?

তন্ময়ী কি বাহানা দেবে খুঁজে পেলোনা।হঠাৎ করে মনে পড়লো ইভান যে বিসিএস পরীক্ষার প্রিপ্রারেশন নিচ্ছে বাহানা সরূপ সেটাও মন্দ হয়না।সামনে তারও ইয়ার ফাইনাল পরিক্ষা। তাই বললো–আসলে সামনে আমার ইয়ার ফাইনাল এক্সাম। ওরও বিসিএস প্রিপ্রারেশন। আমরা নাহয় পরে যাবো।আপনি কৌড়িকে নিয়ে ঘুরে আসুন।

নিভান কেমন রয়েসয়ে বললো–
‘কয়েকদিনের জন্য।আমার মনেহয় খুব একটা সমস্যা হতো না।

তন্ময়ী ততক্ষণাত উত্তর দিতে পারলোনা।মুখে মুখে উত্তর দেওয়া তার স্বভাব নয়।আর যাকে সে সম্মান শ্রদ্ধার নজরে দেখে,তার কথা টলানো,ফেলানো কেমন মন খারাপ করে দেয় তাকে।তবে উপায় নেই।ইভান খাওয়া বাদ দিয়ে এতক্ষণ চুপচাপ দেখছিলো মেয়েটাকে।এবার তন্ময়ীর হয়ে সে বললো–দাদাভাই ওর শরীরটা ভালো না।তাই যেতে চাইছে না। তুমি বরং বউমনিকে নিয়ে ঘুরে এসো।

মেয়েটার শরীর ভালো না!ওবাড়িতে বমি করে অসুস্থ হয়ে পড়লো।কাল রাস্তায় আসতে গিয়েও বমি করলো।হয়তো সে কারণেই বলছে।তাই বিশেষ কথা বাড়ালোনা আর নিভান।মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।মুখে ইভানকে বললো– অ্যাজ ইয়োর,স উইশ।

ততক্ষণে রানী কফি আনলো।নিভান কোনোমতে সেটা খেয়ে বের হলো।সকালের খাবারটা সে আগেই খেয়ে নিয়েছে।ইভান আর খাবারে মনোযোগ দিতে পারল না। মাথা ঘুরিয়ে কিচেনের দিকে তাকিয়ে রইলো।তন্ময়ী রানীসাহেবার সাথে কথা বলছে।হঠাৎ ভাবনা মাথায় পোকা হয়ে নড়তে লাগলো-মেয়েটার হোলোটা কি?তার কেনো মনে হচ্ছে তন্ময়ী তার কাছ থেকে কিছু একটা লুকোচ্ছে!কিন্তু কি?

কৌড়ির কাল থেকে মন খারাপ।অথচ কাওকে বুঝতে দেয়নি সে। কাল ওবাড়ি থেকে ফেরার পথে কানন নেমে গিয়ে ভার্সিটিতে চলে গিয়েছে।বাড়িতে ফিরতেই দুপুরের পরে বিথী আর দাদীআপাকে নিয়ে ছোটোকাকুও চলে গিয়েছেন।দাদীআপাকে যেতে দিতে চাইনি কৌড়ি।তবে দাদীআপার যুক্তির কাছ হার মেনে যেতে দিতে বাধ্য হয়েছে সে।উনাকে আঁটকে রাখার যুক্তিতর্কে তিনি যখন বললেন–‘তুই যেমন আমার বংশের রক্ত। ওও তেমন।ওর মন্দ খবরে কি কইরা আমি এখানে বইসা থাকি বল!তবে তুই বিশ্বাস না করিস,ও আর আগের সেই নাহিদ আর নাইরে আপা।আগে ওরজন্য মন আমার না কাদলেও এখন কাঁদে।

তখন আর কৌড়ির বিবেক কিছুতেই উনাকে আটকে রাখার যুক্তিতর্কে যেতে চায়নি।নাহিদের জন্য দাদিআপাকে আগে এতো ছটফট করতে কখনো দেখেনি কৌড়ি।অথচ এবার তার খারাপ সংবাদ শুনে ছটফট করেছেন তিনি।

ভাবনার একপর্যায়ে ফোনটা হাতে নিলো কৌড়ি।সারাদিনে একবার দাদিআপার সাথে একবার অন্তত কথা বলার অভ্যাস। অথচ কালকে চলে যাওয়ার পর, অভিমানে কথা বলা হয়নি কৌড়ির।উনারা বাড়িতে গিয়ে পৌঁছেছেন এই খবরটা ছোটো কাকুই দিয়েছেন। কৌড়ি কাল সারাদিন অভিমান পুষে রাখলেও আজ সারাদিন ছটফট করেছে কথা বলার জন্য।অথচ বারবার হাতে ফোনটা নিয়েও কল দেওয়া হয়নি তার।ফোন দিলো কৌড়ি।একবার কল হয়ে কেটে গেলো।পুনরায় ফোন দিলো কৌড়ি।এবার কলটা রিসিভ হলো।অথচ দাদীআপা নয়।ধরলো অন্যকেউ।তার নমনীয় কন্ঠ শুনতেই চোখমুখ কঠিন হয়ে গেলো তার।কেনো জানি এই লোকটার ব্যাপারে সে কখনো নমনীয় হতে পারে-না।

‘কেমন আছিস ফুল?

ফোনে কেটে দিতে ইচ্ছে করলো।তবে কাটলোনা কৌড়ি।কেমন শক্তগলায় উত্তর দিলো–আপনি ঠিকই জানেন আমি কেমন আছি।

‘আলহামদুলিল্লাহ।আমি দোয়া করি তুমি সবসময় ভালো থাক।

আমার মনেহয় আপনার দোয়া ছাড়াও আমি খুব ভালো থাকবো,কথাটা ঠোঁটের আগায় এনেও নিজেকে সংযম করে নিলো কৌড়ি।কেনো জানি বললো না।বললো–
-দাদিআপাকে ফোনটা দিন।

‘উনি আম্মার সাথে খাচ্ছেন।ফোনটা আমার এখানে ফেলে রেখে গিয়েছিলো।কলটা রিসিভ করতে চাইনি, তবে দ্বিতীয়বার কলের লোভটা সামলাতেও পারি-নি।

ধপ করে ফোনটা কেটে দিলো কৌড়ি।মূহুর্তেই রাগে ক্ষোভে চোখ দিয়ে জল গড়ালো তার।তারজন্য কেউ খারাপ থাকুক এটা সে চায়নি কখনো।নাহিদের খারাপ থাকার দ্বায়ও তার নয়।অথচ কেউ আঙুল তুলে দ্বায়ী না করলেও দ্বায়ী যেনো সে।এমনটা বুঝাচ্ছে।দাদীআপা কাল থেকে এখানো অব্দি একটা ফোন দিলো-না।সে অভিমান করেছে যেনেও একবার কল দিয়ে কথা বলতে চাইলো-না।তিনিও কি নিভৃতে বুঝাতে চাইছেন, তার নাতীর খারাপ থাকার দ্বায় কৌড়ির?তবে কি ওবাড়িতে তারজন্য আপন বলতে আর কেউ রইলোনা। দাঁতে দাঁত চেপে কান্না আটকালো কৌড়ি।সে কাঁদবে না।কারজন্য কাদবে?কিজন্য কাঁদবে? সে নামক ঝামেলা ঘাড় থেকে নামিয়ে ফেলেছে ওবাড়ির মানুষগুলো এটাই তো অনেক! নিজের মনের অযাচিত আবোলতাবোল ভাবনায় এবার কেঁদেই ফেললো কৌড়ি।কান্নার শব্দ যেনো ঠোঁট ভেঙে না বের হয়,তারজন্য দাঁত দিয়ে এবার ঠোঁট এমন জোরে কামড়ে রাখলো।নিচের নরম ঠোঁটটা কেটে যেতে বাধ্য হলো।লবনাক্ত তরল পদার্থ টের পেয়েও অনড় থাকলো নিজের কাজে।একসময় রাগে ক্ষোভে ফোনটা বেডে ছুঁড়ে দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো সে।দরজা চাপিয়ে কাঁদলো কিছুক্ষণ।একটা সময় মাইগ্রেনের ব্যাথাটা শুরু হয়ে গেলো।চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে দিয়ে ওয়াশরুম থেকে বাহিরে বের হয়ে বেডে গিয়ে শুয়ে পড়লো সে।নরম বালিশে মাথা পড়তেই অশ্রুরা যেনো আপনমনে গড়িয়ে পড়তে থাকলো।সেদিকে বিশেষ খেয়ালধ্যান দিলো-না কৌড়ি।চোখ বন্ধ করেই পড়ে রইলো।

আজকেও বাড়িতে এসে বউকে ঘুমে পেলো নিভান।তবে নিজের রুমে দেখে স্বস্তি পেলো।দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে রুমে ঢুকে অফিসিয়াল ব্যাগটা সোফার সামনে টেবিলে রাখলো সে।সাথে ব্লেজারটাও।টাইটা নাটটা ঢিলে করতে করতে কৌড়িরপানে চেয়ে রইলো সে।আজ মেয়েটার চুলগুলো ছাড়া।সেই লম্বা এলোমেলো চুলে মুখটা ঢেকে আছে।টাইয়ের নাটটা ঢিলে করে খুলে রেখে কৌড়ির কাছে এগোলো নিভান।মুখ গলায় জড়ানো এলোমেলো চুলগুলো মুলত সরিয়ে দেওয়ার জন্য। অথচ পাশে বসে চুলগুলো সরাতেই আশ্চর্য হলো সে।চোখের কোণে পানি জমে আছে মেয়েটার।সাদা মৃসন ফর্সা গালটা লালচে আভায় ছড়িয়ে।কেনো?কি হয়েছে মেয়েটার?

কৌড়িকে ডাকতে গিয়েও ডাকলো-না নিভান।বরং মাথাটা ঠিকঠাক করে বালিশে শোয়াতে গিয়ে দেখলো শুষ্ক হয়ে থাকা লাল ঠোঁট জোড়ার নিচের অংশটার মধ্যবর্তী জায়গাটা কিছু অংশ কেটে আছে।আশ্চর্য!
সন্ধ্যার পরেও তো কথা হলো মেয়েটার সাথে।কন্ঠতো ঠিকঠাকই ছিলো।কাল কক্সবাজার যাচ্ছে সেটাতো সকালে জানালো।বিকালে ফোন করেও বললো, সবকিছু গোছগাছ করে নিতে।সন্ধ্যার পরও কথা হোলো।তবে হোলোটা কি?এই অবস্থা কেনো মেয়েটার?এবার আর না ডেকে পারলোনা নিভান।

‘কৌড়ি?

মেয়েটার ঘুম গাঢ় জানতো নিভান।তবে তিনবার ডাক দিতেই চোখ মেলে তাকালো কৌড়ি।নিভানকে খুব কাছে দেখতেই সজাগ হলো ব্রেইন।মূহুর্তেই কি হোলো তার।এগিয়ে এসে নিভানকে জড়িয়ে ধরলো।উপুড় হয়ে থাকা নিভানও খেই হারিয়ে বেডে কাত হয়ে শুয়ে পড়লো।আগলে নিলো মেয়েটাকে।অনুভব করতে পারলো মেয়েটা কাঁদছে।

‘কি হয়েছে? মন খারাপ কেনো?

নিভানের পিঠের শার্ট খামচে কৌড়ি আরও শক্তকরে জড়িয়ে ধরলো তাকে।বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে দিয়ে মাথা নাড়িয়ে জানালো তার কিচ্ছু হয়নি।অথচ তার কর্মকান্ড বলছে হয়েছে অনেককিছু।নিভান দু’হাতে তাকে বুকে জড়িয়ে রেখে মাথায় দীর্ঘ চুমু খেয়ে বললো।

‘আচ্ছা ঠিক আছে বলতে হবেনা।তবে এ কেমন পাগলামি কৌড়ি।নিজেকে কেউ এভাবে কষ্ট দেয়!আমার কৌড়িতো বুঝদার।এরকম অবুঝপনাতো তাকে মানায় না! আমি তার কাছে আশা করিনি যেকোনো কারণেই হোক নিজেকে এভাবে সে কষ্ট দেবে!তবে কেনো এই পাগলামী?

নিভানের নম্র আহ্লাদিত কন্ঠের অভিযোগের বানীতে কৌড়ির কান্না যেনো এবার বাঁধ ভেঙে এলো।ফুপিয়ে উঠলো সে।সেই ফোঁপানোর স্বরেই বললো-‘আমার জন্য কারোর খারাপ কিছু হোক,কেউ খারাপ থাকুক। এটা আমি কখনো চাইনি। চাইনা কখনো।সে খারাপ ছিলো তাই ভাগ্য তাকে খারাপ রাখছে।তবে কেনো তার দ্বায় আমার হবে?কেনো দাদীআপা সেটা বুঝবেন না!অথচ যারজন্য আমার জীবন এলোমেলো হলো,আমার থেকে দাদিআপার কাছে সেই আপন হয়ে গেলো!আমার কথা না ভেবে তার কাছেই ছুলে চলে গেলেন!তারতো সবাই আছে?আমার কে আছে,এটা বুঝতে চাইলেন না?আর চলে গেলেন তো ভালো কথা,তাই বলে আমাকে ভুলে গেলেন। একবার খোঁজ নিলেন না?আমি আগে না-হয় বোঝা ছিলাম তাই বলে অন্যের হাতে তুলে না দিতেই পর করে দিলেন আমাকে?আমার সব সম্পর্ক, সবকিছু বিনষ্ট করে দিয়েছে ওই লোকটা।তবুও সে ভালো।আর তার খারাপ থাকার দ্বায় আমার!কেনো?কেনো আমার এরকম অলক্ষুণে জীবন হোলো।কেনো আপন মানুষ গুলো স্থায়ী থাকেনা আমার জীবনে?

‘কৌড়ি!এসব কি কথাবার্তা?রিলাক্স!কিচ্ছু হয়নি।উহুম আর একটা শব্দও নয়।

নিভান চাইছিলো যে কারণে মন খারাপ মেয়েটার,মন থেকে তা বের দিক।তাই চুপচাপ কৌড়ির অভিযোগনামা শুনে যাচ্ছিলো।তাই আবোলতাবোল বলে যাবে মেয়েটা?আশ্চর্য!কৌড়িকে নিজের থেকে আলগা করতে চাইলো নিভান।কৌড়ি হতে চাইলোনা।তাই নিভানও আর জোর করলোনা।মেয়েটা চুপ হয়ে গিয়েছে। তবে ফুঁপানো এখনো বন্ধ হয়নি।সেই ফুঁপানো আওয়াজে এবার শেষ অভিযোগ জানালো–কেউ আমাকে ভালোবাসে না।কেউ না।

‘আমিও না?

কৌড়ি উত্তর দিলোনা।নিভান যতোটা আহ্লাদিত গলায় প্রশ্নটা শুধালো তারচেয়ে আহ্লাদিত গলায়
বললো–সবাইকে কেনো ভালোবাসতে হবে তোমাকে!
আমি ভালোবাসি তোমাকে।আমৃত্যুকাল আমি ভালোবাসবো তোমাকে।

কৌড়ি এবার মুখ তুলে চাইলো।এই মানুষটা তাকে ভালোবাসে এটা সে জানে।যা মুখে কখনো স্বীকার করিনি ।যদিও সেই স্বীকারোক্তিতো তার যায় আসেনা। তবুও আজ কথার ছলে হলেও সেই স্বীকারোক্তি যেনো কৌড়ির মনটাকে শীতল করে দিলো।কৌড়িকে মুখ তুলে চাইতে দেখে নিভানও তাকলো ওরদিকে।সুন্দর মুখটাকে কেঁদেকেটে বিবর্ণ করে ফেলেছে মেয়েটা।নিভান হাত বাড়িয়ে ঠোঁটের কাটা জায়গাটা ছুলো।চোখ বুঁজে নিলো কৌড়ি।শক্ত আঙুলের ঘনো আলতো স্পর্শে শিহরণ বয়ে গেলো সর্বাঙ্গে।খাচমে রাখা পিঠের শার্টের অংশ আরও শক্ত হাতে খামচে ধরলো সে।নিভান টের পেলো তবে প্রতিক্রিয়া দেখালোনা।কেমন শীতল গলায় বললো–

‘কাকে ব্যাথা দিয়েছো জানো?যাই হোক ব্যাথা যখন দিয়ে ফেলেছো আর জানতে হবে-না।তবে দ্বিতীয় কোনো দিন যেনো তোমাকে এই অবস্থায় আর না দেখতে হয় আমাকে।,কখনো না দেখতে হয়।সেদিন কিন্তু আমি প্রচন্ড অসন্তুষ্ট হবো কৌড়ি।প্রচুর বকবো তোমাকে।

কথাগুলো বলতে বলতে নিভানের ওষ্ঠ ছুঁয়ে গেলো স্ত্রীর রাগের স্বীকার হওয়া তারই ওষ্টজোড়ায়।একটু আগে যতোটা ব্যাথায় জর্জরিত করা হলো সেই রক্তিম ওষ্ঠদ্বয়কে,নিভান তারচেয়ে পরম আহ্লাদে আদরে ছুঁয়ে দিলো সেখানে।একটা সময় গিয়ে সেই ছোঁয়া আর নিতে পারলোনা কৌড়ি।আচমকা সরে গিয়ে নিভানকে পুনরায় জড়িয়ে ধরলো।নিভানও তাকে আগলে নিলো বুকে।কৌড়ির মাথার ভাজে গাল ছুঁয়ে মোহনীয় কন্ঠে বললো–আমার ভালোবাসা যথেষ্ঠ নয় তোমার জন্য?

‘যথেষ্ঠ।তবে মায়ের ভালোবাসাও চাই আমার।যা জন্মের পর থেকে দাদীআপা আমাকে দিয়ে এসেছেন।স্বামিত্ব আর মাতৃত্বের ভালোবাসা এক নয়।সেই দুজনের আলাদা আলাদা অনুভূতির ভালোবাসা,যত্নগুলো একজনের কাছ থেকে পাওয়া সম্ভব কি?বলুন না?

নিভান এবার মৃদু হাসলো।আসলেই তো তাই।সে-ও তো একটা সময় কৌড়ির জায়গাটা ফেস করে এসেছে। প্রিয়জন হারানো মানুষগুলো,প্রিয়জন হারিয়ে যাওয়ার পর অনুভব করে আসলে তারা কি হারিয়েছে।সেইসব মানুষের ভালোবাসা আদর যত্নগুলো আসলে কি অন্য মানুষ দ্বারা পূর্ণ হয়?নিভানের তো মনেহয়, হয় না।বাবা হারিয়ে যাওয়ার পর,জাহিদ সাহেবের মতো মানুষ পেয়েও বাবার ভালোবাসা যত্নগুলো ভুলতে পেরেছে সে?মামাদের থেকেও তো কম আদর ভালোবাসা পায়নি নিভান।তবে উনারা কি কখনো নিতে পেরেছেন বাবার সেই নির্দিষ্ট জায়গাটা?পারিনি।পারেনা কেউ।ঈশিতা নিশিতাও মায়ের মতো ভালোবাসা দিয়ে পারিনি মায়ের জায়গাটা নিতে।বিনিময়ে কষ্টে থাকা বেছে নিয়েছিলো নিভান।তবুও মায়ের সংস্পর্শ ছাড়েনি।কেউ পারেনা কারও জায়গাটা নিতে।সকল সম্পর্কের ভালোবাসা আদর যত্নের জায়গাগুলো আলাদা আলাদা হয়।সেই জায়গা থেকে আলাদা আলাদা অনুভূতির ভালোবাসা,যা একজন নির্দিষ্ট ব্যাক্তির ভালোবাসা দ্বারা সম্ভব নয়।সম্ভব হলেও পূরণ হয়না সেই ভালোবাসা। হওয়ার নয়।আর প্রিয়জন হারা মানুষগুলো সেইসব মানুষের ভালোবাসা পেতেই মুলত কাঙাল।

চলবে…..

#ফুলকৌড়ি
(৫৯)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

সুন্দর হাস্যজ্বল একটা দিন।ঝলমলে দুপুর।বিস্তৃত নীল আকাশ।সেই নীল আকাশপানে সচ্চ কাঁচের ন্যায় টুকরো টুকরো সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে।নীল সাদার মিশ্রণে আকাশটা যেনো অদ্ভুত সুন্দরে পরিনত হয়েছে।একদল নাম না জানা পাখির ডানা ঝাপটিয়ে এদিক ওদিক পানে ছুটে চলাকে সেই নীল সাদা আকাশের সৌন্দর্যতা যেনো অপরূপ কোনো রূপকথা!
একটু আগেই কৌড়ি আর নিভান এসে পৌঁছেছে কক্সবাজার। লাক্সারিয়াস ফাইভস্টার একটা হোটেলের আটতলায় উঠেছে তারা।আভিজাত্যের পূর্ণ ছোঁয়া লেগে আছে পুরো হোটেলসহ আটতলা ভবনের এই সুবিশাল রুমটায়।কৌড়ির ক্ষনিকের জন্য মনে হলো,নিভানের বেডরুমটা এখানে তুলে আনা হয়েছে।যদিও আসবাবপত্র সেই রুমের তুলনামূলক এই রুমটায় কম।চারপাশটায় একবার চোখ বুলিয়ে হোটেলরুমের বিশাল বড় কাচের জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো কৌড়ি।সমুদ্রের খুব কাছে হোটেলটা।চারপাশটা তার চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যে ভরপুর!আভিজাত্যের ছোঁয়ায় পরিপূর্ণ রূপ দিতে কি নেই!আর যে উদ্দেশ্য হোটেলটা গড়ে উঠা,সেই সমুদ্রের উচ্ছল ঢেউ!তর্জন গর্জনের শব্দ!উফফ আল্লাহর অপার নিখাঁদ নিখুঁত সৌন্দর্যতার বিবরণ যেনো দেখতে পাচ্ছে কৌড়ি।জীবনের এই প্রথম কাছ থেকে সমুদ্র দেখছে সে।অদ্ভুত ভালো লাগা আর প্রশান্তি কাজ করছে হৃদয়গহ্বরে।যা বর্ননাহীন।নিটোল চোখে কৌড়ি অদ্ভুত এক সৌন্দর্যের মোহে তাকিয়ে রইলো বিস্তৃত সমুদ্রেরপানে।

‘কি এখনো মন খারাপ?

হঠাৎ দৃঢ় পুরুষালী হাতের ছোঁয়ায় কেঁপে উঠলো সে।বলিষ্ঠ ঠান্ডা হাত দুটো তাকে পিছন থেকে আঁকড়ে ধরেছে।সদ্য গোসল সেরে আসা ঠান্ডা হাত দুটো তার নরম হাতের উপর দিয়ে কোমর জড়িয়ে তাকে সেই মানুষটার সাথে বাহুবন্ধনীতে বেঁধে নিয়েছে।নিজস্ব ম্যান পারফিউমের সুঘ্রাণটা ছাড়িয়ে সদ্য নেওয়া বডিওয়াশের গন্ধটা মূহুর্তেই কৌড়ির নিউরনে নিউরনে পৌঁছে গেলো।স্পর্শে হোক বা ঘ্রাণে।চোখ বুঁজে এলো কৌড়ির।নিভান কি জিজ্ঞেস করেছে ভুলেই বসেছে সে।
নিভানের ভেজা চুলের ফোঁটা ফোঁটা পানি তখনও ঝরে চলেছে।যা কৌড়ির গলায় বর্ষন হচ্ছে।সেই বর্ষণ গড়িয়ে ভিজে যাচ্ছে তার বক্ষপট।কৌড়ি আরও আবেশিত হলো।মিশে গেলো জড়িয়ে রাখা পুরুষটার উন্মুক্ত চওড়া বুকের সাথে।পেলব শরীরটা আপোষ মেনে পায়রার মতো পোষ মানতেই হাসলো নিভান।মাথা নিচু করে নরম স্পর্শে তার গালে নিজের গালটা ছোয়ালো।খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির স্পর্শে খিঁচে এলো কৌড়ি।তা পরোয়া করলোনা নিভান।গাল সরিয়ে এবার ওষ্ঠ ছোঁয়ালো সেখানে।ঘনো স্পর্শের অত্যাচার চললো নরম তুলতুলে গালটাতে কিছুক্ষণ।তারমধ্য কেমন মোহনীয় গলায় নিভান ফের জিজ্ঞেস করলো।

‘কি হলো?বলো?মন খারাপ এখনো?

অনুভূতিতে ভরাডুবি কৌড়ি।জবাবে মাথা
নাড়ালো শুরু।বলতে পারলোনা কিছু।নিভান মানলো না।বললো–মুখে বলো।কথা বলো।

অনুভূতির দোলাচলে চাপা পড়া কৌড়ি এবার স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো।চোখ খুললো।মূহুর্তেই উন্মোচন হলো হোটেল এরিয়ার চারপাশের অপার সৌন্দর্যতা।তারসাথে বিস্তৃত সমুদ্রের তেজস্বী ঢেউ। সেখান থেকে মুখ ফিরিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে নিভানের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলো সে।সম্পূর্ণ পারলোনা।তখনো পেছনের মানুষটা তাকে শক্তপোক্ত করে জড়িয়ে।তবে কৌড়িকে ঘাড় ঘুরাতে দেখে সে-ও তারদিকে তাকালো। ঠোঁটে মৃদু হাসি টানলো কৌড়ি।যা চিকন ওষ্ঠদ্বয়ের সৌন্দর্যতা বাড়ালো।নিভান মুগ্ধ হয়ে সেই ওষ্ঠ পানে তাকিয়ে রইলো।কৌড়ির খুশি ঝলমলে চোখদুটো সেই মুগ্ধ চোখে গিয়ে স্থবির হলো।তারপর মৃদু মুগ্ধ স্বরে বললো।

‘কেউ আমার সাথে সাথে আমার ভালোমন্দের দায়িত্বটাও নিয়ে নিয়েছে।সে আমার মন খারাপ থাকতে দেয় কোথায়!তবে বলুন আমার কি মন খারাপ থাকতে পারে!নাকি সে মন খারাপ করে থাকতে দেবে আমাকে?

নিভান হাসলো।ফের তড়িৎ কৌড়কে ঘুরিয়ে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো।আচমকা বউয়ের ওষ্ঠদ্বয়ে নিজের ওষ্ঠদ্বয় নিবেদিত করলো।সেকেন্ডে সেকেন্ডে সময় চললো তবে নিবেদিত ওষ্টদ্বয় থামলোনা।একটা সময় উন্মুক্ত পিঠে বউয়ের নখের ডোবা আঁচড়ে তার হুঁশ ফিরলো। ছেড়ে দিলো কৌড়িকে।নিঃশ্বাস আঁটকে আসা কৌড়ি যেনো বেঁচে ফিরলো।নিভানের উন্মুক্ত বুকে মাথা রেখে শ্বাস নিতে ব্যস্ত হলো সে।তা দেখে নিভান মৃদু শব্দ করে হাসলো।সেই মৃদু শব্দে কৌড়ির লজ্জারা হুড়মুড় করে হানা দিলো।ইচ্ছে করলো,লোকটার পিঠে দুই একটা কিল-চড় বসাতে।কিন্তু তা কি কখনো হওয়ার!তবে মনোবাসনা পূর্ণ করতে উন্মুক্ত পিঠে খামচি বসাতে ভুললোনা সে।বউয়ের এরকম মৃদুমন্দ আঁচড়ে যদিও নিভানের কোনো ব্যাপার স্যাপার মনেহয়না।বরং তাতে আরও বউয়ের প্রতি ভালোবাসার সীমাটা বাড়ায়।
তবুও কৌড়ির সাথে মজা করতে বললো।

‘ছেড়ে দিয়েছি তারপরও ব্যথা দিচ্ছো?তবে কিন্তু আমিও ছেড়ে দেবোনা।ব্যথার পরিবর্তে দ্বিগুণ ব্যথা কার্যক্রম চলবে কিন্তু!সুতারাং রাজী থাকলে তুমি যেরূপ ইচ্ছে ব্যথা দিতে পারো আমাকে!আমি কিছু মনে করবো না।

লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে কৌড়ি এবার আরও জোরে খামচি দিলো।খামচি অনুভব করেই কৌড়িকে এবার নিজের সাথে আরও জোরে চেপে নিলো নিভান।শব্দ করে হাসলোও।সময়টা যেনো অদ্ভুত সুন্দর মনে হোলো তার।থমকে দিতে পারলে হয়তো ভালোই হতো।যদিও প্রভু তাকে থমকে দেওয়ার মতো ক্ষমতা প্রদান করলে অবশ্যই সে এই সময়টা থমকে দিতো।দু’হাতের বন্ধুনীতে জড়ানো নারীটাকে আর চারপাশের সুন্দর পরিবেশের মুগ্ধতা কিছুক্ষন অনুভব করলো নিভান।ফের একটু সময় নিয়ে বললো–জার্নি করে এসেছো।ফ্রেশ হয়ে নাও, ভালো লাগবে।

জার্নিটা আর হয়েছে কোথায়!ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ফ্লাইটে এসেছে তারা।আর সেখান থেকে প্রাইভেট গাড়ীতে।তবুও নিভান এসেই গোসল সেরে নিয়েছে।মানুষটা কেমন একটু শুচিবায়ু টাইপের।সবসময় ফিটফাট।নিয়ম মেনে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা থাকা চাই।
এটুকু কৌড়ি এই কয়দিনে বেশ বুঝে গেছে।

কৌড়ি গোসল সেরে বের হতেই দেখলো নিভান রেডি হয়ে বসে আছে।ফোনে মনোযোগ।কৌড়ি জানে,তারা শুধু এখানে মধুচন্দ্রিমায় অথবা ঘুরতে আসিনি।নিভান এখানে অফিসিয়াল কাজে-ও এসেছে।আপতত দুদিন সে অফিসিয়াল কাজে ব্যস্ত থাকবে,এটা-ও তার জানা।তার উপস্থিতিতে নিভান তারদিকে তাকাতেই চোখ সরিয়ে চুল মোছায় ব্যস্ত হলো সে।লম্বা চুলের এই এক দশা।ভিজালেই মুছতে, শুকাতে সমস্যা।যদিও ওয়াশরুমে হেয়ারড্রাইয়ার ছিলো।তবে এবাড়িতে আসার আগে সে কখনো ওটা ব্যবহার করেনি।বিধায় ওটা ব্যবহারে তার দ্বিধা,সংকোচ আছে।যদিও ওটার ব্যবহার সে জানে।তবুও কেনো জানি ভালো লাগে-না।

‘চুল দিয়ে তো পানি পড়ছে!পিছনের জামার অংশতো ভিজে যাচ্ছে!এতোচুল টাওয়ালে শুকানো তো মুশকিল।হেয়ারড্রাইয়ারটা ইউজড করতে!

‘এমনিতেই শুকিয়ে যাবে।

কৌড়ি নিজের কাজে ব্যস্ত রইলো।নিভান সেটা দেখে উঠে দাড়ালো।হেয়ার ড্রাইয়ারটা এনে,কৌড়িকে দাঁড় করালো নিজের সামনে।কৌড়ির হাত থেকে তোয়ালেটা নিয়ে রেখে দিয়ে,বউয়ের চুল শুকাতে ব্যস্ত হলো।কৌড়ি মুখ উঁচিয়ে কেমন নিস্পাপ চোখে তা দেখতে থাকলো। সেটা দেখে নিভান মিষ্টি হাসলো।ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো-কি হয়েছে?কৌড়ি উত্তর দিলোনা।নিভান নিজ থেকে যেনো বউয়ের চেয়ে থাকার মানে বুঝে উত্তরটা দিয়ে দিলো।

‘সকালে সেভাবে খেলে-না।এখন তো এই চুলের কারণে দুপুর পার করে তোমাকে রাতে গিয়ে খেতে হবে দেখছি!আর বউতো আমার খুবই লক্মী,নিজ থেকে নিজের ভালোমন্দ বা ক্ষুধার কথাতো জানাবেই-না।

কৌড়ি,নিভানের অন্য কথায় মনোযোগ দিলো-না।চুল প্রসঙ্গে বললো-‘চুল কিছুটা কেটে ফেলা উচিত?তাইনা? দাদিআপাকে কতো বলেছি,অথচ তিনি কখনোই চুল একছটা কাঁটার পক্ষপাতিত্ব ছিলেন না।

‘আমিও পক্ষপাতিত্ব নই!চুল শুকাতে সমস্যা হলে আমি আছিতো!সঙ্গে এই হেয়ারড্রাইয়ার।

বেশ উচ্ছ্বাস নিয়ে কথাটা বলতে বলতে হাতের হেয়ারড্রাইয়ারটাও দেখালো নিভান।কৌড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎই মনেহলো সদ্য গোসল করে আসা বউটাকে একটু অন্যরকম লাবন্যময় দেখাচ্ছে।চুল শুকানো বাদ দিয়ে হুটকরে কোমড় জড়িয়ে ধরে কৌড়িকে কাছে টানলো সে।আচমকা কাছে টানায় কৌড়িও মুখ উঁচু করে তাকালো।সদ্য গোসল নেওয়া স্নিগ্ধ মায়াময় মুখটা মুগ্ধ নজরে দেখলো কিছুক্ষণ নিভান।ফের কৌড়ির চোখে চোখ রেখে মোহনীয় কন্ঠে বললো —
-চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য, অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ছেড়ে যে নাবিক হয়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন চোখে দেখে দারুচিনি দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি আমি তারে অন্ধকারে, বলেছে সে, এতোদিন কোথায় ছিলেন?
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নিভানের বনলতা।

কবিতার লাইন শেষ হতেই চমৎকার হাসলো নিভান।কৌড়ির নাকে আলতো করে নিজের নাকটা ঘষা দিয়ে কেমন ঘনোস্বরে ফের বললো–আমার বনলতা!

নরম আদুরে স্পর্শ পেয়েও আজ আর কৌড়ি চোখ বুজলো-না।বরং নিভান নাকে স্পর্শ করে সরে যেতেই মুগ্ধ হয়ে তাকে দেখতে থাকলো।এই মানুষটা তাকে এতো সুন্দরভাবে উপলব্ধি করে।মানুষটার নরম নরম আদূরে ভালোবাসাময় স্পর্শ,কৌড়ির প্রতি শখের বস্তুর মতো আহ্লাদী আচারণ।যা কৌড়িকে মুগ্ধ করে। মানুষটার প্রতি টান ভালোবাসা সম্মান বাড়ায়।হঠাৎই কৌড়ির চোখ ভরে উঠলো।অশ্রুদের আটকাতে দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরতেই নিভান তার ঠোঁটের নিচে দাঁড়ি চেপে ধরে আঁটকে দিলো।অসন্তুষ্ট গলায় বললো–একদম না।কাল ব্যথা দিয়েছো কিচ্ছু বলিনি।আজ কিন্তু ছাড়া পাবে-না মিসেস নিভান।

সর্তক বানীতে কৌড়ি ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে মিষ্টি হাসলো।অথচ চোখে তার থৈথৈ ভরপুর জল।সেই জল লুকাতে সামনের মানুষটার বুকে আশ্রয় নিলো।অনুভব করলো, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভালোবাসাময় নিরাপদ স্থান।যেখানে নিরাপত্তার সাথে সাথে কৌড়ির সুখ শান্তি সব আছে।নিভান আগলে নিলো বউকে।চুমু খেলো মাথায়। সময় নিয়ে বললো–কারণে অকারণে এভাবেই নিজের জায়গাটা করে নেবে।দুঃখ হোক বা সুখবিলাসে, নিভানের এই চওড়া বুক নামক স্থানটা তোমার জন্য সদাসর্বদা উন্মুক্ত।শুরু তোমার জন্য।

আবেগপ্রবণ হলো কৌড়ি।আরও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো নিভানকে।সদাসর্বদা মানুষটা তাকে ভালো রাখার প্রচেষ্টায় লেগে থাকে।কালও তো,আবেগপ্রবণ হয়ে দাদীআপার জন্য একটু কাদলো কি!কতো ভালোমন্দ কথা বলে বুঝ জ্ঞান দিলো,সাথে আহ্লাদ দিলো ভালোবাসা যত্ন দিলো।আর তারচেয়ে না চাইতে যেটা দিলো,সেটা কৌড়ির কাছ পরম পাওয়া হয়ে রইলো।কালরাতে যখন কৌড়ি কান্নাকাটি সেরে চুপ হলো।সেখান থেকে কিছুক্ষণ বাদেই দাদিআপা তাকে ফোন দিলো।কৌড়ির অভিমানী মনটা ফোন ধরতে নারাজ ছিলো।তবুও আরেকমন তো দাদীআপার সঙ্গে কথা বলার জন্য ব্যাকুল হয়ে ছিলো।সেটা হয়তো তার পাশে থাকা দায়িত্ববান মানুষটা বুঝে গিয়েছিলো। তাই তার সেই ব্যাকুল মনটাকে ইন্ধন দিয়ে ফোনটা ধরিয়ে কানে ধরলো।সঙ্গে তাকে বুকে জড়িয়ে দাদীআপার সঙ্গে কথা বলতে মানলো।কৌড়ি ফোন ধরলো।তারপর অভিমানে অভিযোগে দাদিআপার সঙ্গে কথা বলতেই বুঝতে পারলো,এদিক থেকে কেউ একজন তার মনখারাপের কথা জানিয়েছে।সঙ্গে দাদীআপাকে নিয়ে অভিমান অভিযোগও।বিধায় দাদীআপাও আদর আহ্লাদ দিয়ে নিজের সমস্যার কথা জানিয়ে তাকে মানানোর চেষ্টা করলেন।একজন ভালোবাসার মানুষ তাকে পরম আদরে বুকে চেপে রাখলো,আরোকজন ভালোবাসার মানুষ তাকে আদর দিয়ে নরম সুরে কতোকিছু বলে মাননানোর প্রচেষ্টা করতে লাগলো।কৌড়ি অভিমান অভিযোগেরা কি আর অটল থাকতে পারে?পারলেও,কৌড়ি দু’জন মানুষের আহ্লাদিত ভালোবাসায় তা আর পুষে রাখতে পারলো-না।মুলত রাখতে চাইলো না।

দুপুরের খাবারটা সেরে কৌড়ি এসে হোটেলের আরামদায়ক বিছানাটায় শরীরটা এলিয়ে দিল।জার্নির কঠিন প্রভাব শরীরে না পড়লেও,ঔষধের একটা ঘুম ঘুম প্রভাব তার উপর সেই ঔষধ খাওয়ার শুরু থেকেই কাজ করে চলেছে।যদিও প্রয়োজনের তুলনায় ঘুম তার একটু বেশি।গভীর।আর কাল রাতেও দেরীতে ঘুমিয়েছে।আবার সকাল সকাল উঠতে হয়েছে।জার্নিতেও ঘুম ঘুম ভাবটা লেগে ছিলো।যা পূর্ন হয়নি।এখন চোখ বুঁজে আসছে তার।নিভান বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে।অফিসিয়াল কথাবার্তা। কৌড়ি তাতে বিশেষ মন দিলোনা।চোখ বুঁজে নিলো সে।ঘুমঘুম ভাবটা চোখে লেপ্টে আসতেই কেউ মাথায় হাত রাখলো তার।মোটামোটা আঙুলের হাতটা কপাল আর মাথার অংশজুড়ে পড়তেই চোখ মেললো সে।খুব কাছে দেখতে পেলো নিভানকে।

-আমাকে বের হতে হবে ইমার্জেন্সি।যদিও আমি হোটেলের মধ্যেই থাকবো।তবুও তুমি কি একা থাকতে পারবে?

চোখে ঘুম।পলক পড়ছে ঘনোঘনো।তবুও কৌড়ি মাথা সামন্য ঝাকিয়ে বললো–হুমম।

নিভান মাথা নিচু করে কৌড়ির কপালে চুমু খেলো।মৃদু হেসে বললো–গুডগার্ল।

ফের বললো–দুটো দিন তোমাকে একটু কিছুসময় কষ্টকরে একা-একা থাকতে হবে তারপর সর্বক্ষণ আমি তোমার সঙ্গী হবো।কেমন?

কৌড়ি ফের মৃদু উপর নিচ মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি দিলো।সেটা দেখে নিভান পুনরায় জিজ্ঞেস করলো।–পারবে তো একা থাকতে?

চোখ ঘুম ডুবে এলো কৌড়ির।চোখ বুজেই মৃদু হাসলো সে।ঘুমঘুম চোখে ঘনো স্বরে বললো–আমি বাচ্চা নই।আপনি অযথা আমাকে নিয়ে…

কথা শেষ করতে দিলোনা নিভান।বুঁজে থাকা চোখ।মায়াবী একটা মুখ।আর মৃদু প্রসারিত হওয়া ওষ্ঠদ্বয়।তাকে বড়োই টানলো।নিভান আবারও মাথা নিচু করে কৌড়ির সেই সদ্য প্রস্ফুটিত হওয়া ফুলের মতো মেলে থাকা ওষ্ঠদ্বয়ে চুম্বন দিলো।কৌড়ির বুঁজে থাকা চোখ আরও খিঁচে এলো।সময় নিলোনা নিভান।আলতো স্পর্শে সরে এলো।তবে সরে এসে কৌড়ির বুঁজে থাকা চোখের খুব কাছে নিজের অবস্থান রেখে কেমন মোহনীয় স্বরে বললো– তুমি বাচ্চা নও,এটা আমি জানি।তবে মন আমার তোমাতে অন্যকিছু অনুভব করে।মন বলে তুমি আমার কাছে একটা আদূরে পুতুল।একটা অমূল্য যত্নের রত্ন।তুমি জানোনা,সেই আদূরে পুতুলটাতে আমি নিভান কি অনুভব করি।সেই মূল্যবান রত্নটা কিভাবে যত্নে ভালোবাসায় আগলে রাখতে ইচ্ছে করে আমার।নিভানের ভালোবাসা তুমি।তুমি জানানো কিভাবে নিজের কাছে তোমাকে রাখতে ইচ্ছে করে।

ঘুমে তলিয়ে আসা চোখজোড়া কিছুতেই পল্লব মেলতে চাইলোনা।তবুও নিভানের মোহনীয় স্বরের প্রেমময় বাক্যে কৌড়ি চোখ মেলে তাকালো।তবে ঘুমে ডুবো চোখজোড়া তার নিভু নিভু হয়ে রইলো।সেটা দেখে নিভান মিষ্টি হাসলো।কৌড়ির চুলের মধ্য আঙুল ডুবিয়ে বুলিয়ে দিয়ে মুখটা আরও একটু নিচু করে বললো–যাই হোক,তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।

কৌড়ি সত্যিই চোখ বুঁজে নিলো।সেটা দেখলো নিভান।হঠাৎ কিছু একটা ভেবে কৌড়িকে ফের ডাকলো নিভান।তবে কৌড়ি এবার আর চোখ খুললো-না।মুলত ঘুমে নিভে আসা চোখটা সে মেলে তাকাতে পারলোনা।তবে ডাক শুনলো–হুমম।

বউয়ের আহ্লাদী আচারনে নিভানের ঠোঁট প্রসারিত হলো।ইচ্ছে করলোনা দুপুরবেলা বউটাকে এভাবে একা রুমে ফেলে যেতে।বরং ইচ্ছে করলো,মেয়েটাকে কাছে নিয়ে জড়িয়ে রাখতে।আদূরে স্পর্শে তার মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে।তবে যেতে হবে তাকে।তাই কৌড়ি সাড়া দিতেই সে বললো–যদি একা রুমে থাকতে খারাপ লাগে অথবা ভয় হয়।তুমি ততক্ষণাত আমাকে কল করবে।আমি যতোই ব্যস্ত থাকিনা কেনো,চলে আসবো।তুমি আমাকে বিরক্ত করবেনা মনে করে কল দিতে কিছুতেই দ্বিধা করবেনা।কেমন?

‘আপনি ব্যস্ত হবেন না।আমি থাকতে পারবো।

কোনেমতে কৌড়ি বাক্যদ্বয় উচ্চারণ করতেই নিভান বলে উঠলো–তবুও।

‘হুমম।শব্দটা উচ্চারণ করেই কৌড়ি যেনো কেমন ঘুমে তলিয়ে গেলো।তার হঠাৎই গাঢ় শ্বাসপ্রশ্বাসটা বলছে,সে ঘুমিয়ে গিয়েছে।ঘুমটা গভীরে না গেলেই, ঘুমিয়ে তলিয়েছে সে।নিস্পাপ মুখটা দেখলো কিছুক্ষণ নিভান।তারপর তার ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে দিলো কৌড়ির সমগ্র মুখ।কপাল,চোখের পাতা,নাক,ঠোঁট, গাল,কোথাও বাদ থাকলো-না।বউকে একধাপ ভালোবাসা দিয়ে তারপর বাহিরে যাওয়ার জন্য নিজের কাজে ব্যস্ত হোলো সে।

‘হেই মিঃ নিভান।কেমন আছেন?

হোটেলের লবি এরিয়াতে আসতেই হঠাৎ কারও সম্বোধনে মুড়লো নিভান।যদিও কন্ঠস্বর তার পরিচিত।এবং সে যেনো জানতো বাবার ব্যবসায়ে উদাসীন ছেলেটা কক্সবাজারের এই বিজনেস কনফারেন্সে নিজে একজন বিজনেসম্যান হিসাবে অবশ্যই সামিল হবে।বিহানের এখানে আসার কারণটা হয়তো নিভানের জানা।তবুও খুব স্বাভাবিক হয়ে মুখে কৃত্রিম হাসি টেনে তার সম্বোধনের সোজাসুজি উত্তর না দিয়ে একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে উত্তর দিলো সে।

‘হ্যালো মিঃ বিহান।আই অলওয়েজ ট্রাই টু বি গুড।আপনার কি খবর?

‘থাকারই কথা।

কথাটা বিহান মিনমিনিয়ে বললেও নিভানের কান এড়ালোনা।তবে ভালোমন্দ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো-না সে। বিহান যেনো নিজেকে,সামনের মানুষটার মতো ধৈর্য্যশীল পরিচয় দিতে পারলোনা।নিভানের কেমন আছেন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কেমন যেনো ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন শুধালো–শুনলাম ওয়াইফকে নিয়ে এসেছেন!কনফারেন্সের সাথে সাথে মধুচন্দ্রিমায়-ও!নট ব্যাড!তা তিনি কৈ?

নিভানের ইচ্ছে করলো বিহানের নাকটা এক চটকান দিয়ে ফাটিয়ে দিতে।নেহাৎ ছেলেটা ভদ্রভাবে কথা বলছে বিধায় কাজটা করতে পারলো-না সে।একজন বিজনেস পার্টনার আরেকজন বিজনেস পার্টনাটকে সালিনতা বজায় রেখে ভদ্রভাবে প্রশ্ন করতেই পারে।যদি উদ্দেশ্য প্রবন না হতো তবে নিভান-ও উত্তর দিতে কার্পন্য করতোনা।তবে কার্পন্য অবশ্যই করতে হচ্ছে তাকে।মুখে ভদ্রতার হাসি বজায় রেখে কেমন অদ্ভুত গলায় বললো।

‘ আমাদের ব্যাক্তিগত খোঁজখবরও রাখছেন দেখছি?মন্দ নয়!বাট বিজনেস পার্টনার হয়ে এতো গভীরে খোঁজখবর রাখবেন, আশা রাখিনি।ধন্যবাদ।

স্পষ্ট উপহাস।বিহানকে ইতস্তত দেখালো।তবুও কেমন মিনমিনে স্বরে উত্তরে বললো সে–‘রাখতেই হয়।

উত্তরটা বিষবাক্য হয়ে কানে ধরা দিলো নিভানের।তবুও যতসম্ভব ধৈর্যশীলের পরিচয় দিয়ে নিজেকে শান্ত রেখে বললো-

‘অন্যের পার্সোনাল লাইফ নিয়ে খোঁজখবর রেখে লাভ কি বলুন?আমার মনেহয় অন্যের পার্সোনাল লাইফ নিয়ে হোক বা অন্যের লাইফলাইনের বিষয়ে খোঁজখবর রেখে লস্, আফসোস ছাড়া কোনো লাভ আছে!তারচেয়ে বরং বিয়ে করে নিজের একটা পার্সোনাল লাইফলাইন বানিয়ে ফেলুন।নিয়মিত সেই লাইফলাইনের স্পেশালি ভালোমন্দ খোজখবর রাখুন।তাকে দেখুন হালাল নজরে।আমার মনেহয় তাতে ভরপুর শান্তি। হালাল প্রজেক্টে বলে কথা! লাভ ছাড়া লসেস্ নেই।যদিও আমার মনেহয় আপনি আবেগপ্রবণ কাঁচা ব্যবসায়ী।বুদ্ধিমান পাকা ব্যবসায়ী হলে লস্ প্রজেক্টের পিছনে অন্ততঃ পড়ে থাকতেন বলে মনে হয় না।

বিহানের বিবর্ন হয়ে আসা মুখাবয়ব দেখে থেমে গেলো নিভান।থেমে গেলো না বরং থেমে গিয়ে কথার রহস্য রাখতে বেশ মজা পেলো।ঠোঁটের কৃত্রিম হাসিটা আরও একটু প্রসারিত করে ফের বললো-যাই হোক।কনফারেন্সে দেখা হচ্ছে।আসছি।

নিভানের,তাকে এড়িয়ে চলে যাওয়া দেখে বিহানের খুব করে গলাবাজি করে বলতে ইচ্ছে করলো—মেয়েটা যদি কৌড়ি হতো তবে হালাল কাজটা আপনি না বললেও খুব শীঘ্রি সেরে ফেলতাম আমি।তবে আপনি সিংহ হয়ে নিজের শিকারিকে পরিবেষ্টন করে রাখবেন।অন্যকে তা ছোঁয়াতো দূর নজরস্পর্শ করতে দেবেননা।এটা ভাবিনি।নাহলে,কৌড়িকে দেখে যেদিন মনে দূর্বলতা অনুভব হয়েছিলো,সব উপেক্ষা করে হলেও মেয়েটাকে নিজের করে নিতাম।যেভাবেই হোক নিতাম।

মনেমনে আত্নচিৎকার দিয়ে কথাগুলো বললেও তা ভুলেও মুখে উচ্চারণ করার দুঃসাহসিকতা দেখালো না।নিভান সম্পর্কে সে জানে।সঙ্গে তার বিজনেস পাওয়ার সম্পর্কেও।সৎ নিষ্ঠাবান বিজনেসম্যান ছেলেটা সম্পর্কের বেলায় আরও দায়িত্ব এবং আরও নিষ্ঠাবান।সেখানে সামন্য এদিকওদিক হলে কাওকে ছেড়ে কথা বলেনা।বিন্দুমাত্র ছাড় দিয়েও কথা বলেনা।যদিও বিহানের মানসিকতা সীমা ছাড়াতে চায়।তবে ছাড়িয়ে লাভ কি!আদৌও কি কৌড়িকে কখনো সে পাবে?নাকি পাওয়া সম্ভব?

ঘুম ভাঙলো কৌড়ির।অলস্য ভঙ্গিতে মৃদু চোখ মেলে তাকাতেই দেখতে পেলো,রুমের মধ্যে কৃত্রিম জিরো বাল্বের হলুদ সবুজ কম্বিনেশনের মৃদু আলোটা জ্বলছে।হঠাৎ ঘুম ভেঙে কোথায় আছে,বুঝতে সামন্য সময় নিলো।ফের বুঝে উঠতেই মনেহলো,সেই তো দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুমিয়েছিলো।আর সবে উঠলো।রুমে কৃত্রিম আলো জ্বলছে, তারমানে বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমে রাত গড়িয়েছে।তবে লাইট জ্বালালো কে?সহসা আশেপাশে তাকালো সে।রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দায় লম্বা একটা অবয়ব দেখতে পেলো।অবয়বটা দেখেই ধাতস্থ হলো সে।সময় নিয়ে উঠে বসলো।বেডের সোজাসুজি সামনের দেয়ালে ঘড়িটা তখন জানান দিলো রাত দশটা বাজে।এতোক্ষণ ঘুমিয়েছে সে।যদিও এরচেয়ে দীর্ঘ সময়ে ঘুমানোর নজির আছে তার।

গায়ের চাদরটা সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে।ফের বারান্দার দিকে একপলক তাকিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।সে ওয়াশরুমে ঢুকতেই বারান্দায় দাড়ানো মানুষটাও পিছে ফিরে একপলক দেখে পুনরায় হোটেল এরিয়ার রাতের ঝলমলে সৌন্দর্যে নজর রাখলো।মুলত নজরটা তার গভীর সমুদ্রের নোনাজলে।যা দুপুরের সময়ে উত্তাল থাকলেও এখন শান্ত, নীরব।উচ্ছাস,উত্তালহীন।রাতের নীরব সৌন্দর্যে পাড়হীন সেই সুবিশাল সমুদ্রের থৈথৈ পানি যেনো অপরূপ এক অন্যরকম সৌন্দর্য!অপরূপ সেই সৌন্দর্যের মুগ্ধতা বাড়িয়ে দিয়েছে,হোটেল সম্মুখীন কতৃপক্ষের নিজস্ব বিচ এরিয়ার কফিবিচ নামে খ্যাত বে- লাউঞ্জ শপটা।দিনের বেলায় তার সৌন্দর্য কাঠের তৈরি ছনের একটা ঘরমাত্র হলে-ও, রাতের বেলায় তার সৌন্দর্য কোনো রুপকথার নগরীর থেকে কম নয়।সন্ধ্যার পর থেকে লাল নীল,বিভিন্ন লাইটিংয়ে তার সৌন্দর্য হয়ে উঠে নজর ধাঁধানো।আশেপাশে নৌকাশেইপ সহ বিভন্ন বসার স্থানগুলোও বেশ নজর আকর্ষণীয়।যেখানে বসে বিচে ঘুরতে আসা মানুষগুলো নীরব সময় কাটায়।বিকাল চারটের পর থেকে বে- লাউঞ্জ এরিয়াটা ওপেন করা হয়।সেখান থেকে রাত দুইটা পর্যন্ত বে- লাউঞ্জ খোলা থাকে।সন্ধ্যার পর থেকে লাউঞ্জ এরিয়াটায় মানুষের মেলা বসতে শুরু করে।সমুদ্র উপভোগ করা,একান্তে সময় কাটানো,খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে সব চলে এখানে।রাত একটু গভীর হতে শুরু হলেই,লাইভ গানের শো-ও চলে সেখানে।কেউ কেউ সরাসরি সেই গানের লাইনগুলো উপভোগ করলেও,কেউ কেউ আবার সমুদ্রের পাড়ে হাঁটতে হাঁটতে গানের শব্দগুলো অনুভব করে।নিভানের কক্সবাজার এলেই এই হোটেলে থাকা হয়।ব্যবসায়ী সুত্রে এনাদের সাথে দৃঢ় একটা সম্পর্ক আছে কি না তার।

হঠাৎই পাশে কারও অস্তিত্ব টের পেতেই ভাবনা কাটলো নিভানের।ঘার ঘুরিয়ে পাশে ফিরলো।মিষ্টি হেসে বললো—ঘুম কাটলো তবে?আমার তো মনেহলো আজ রাতে আর ঘুম কাটবেনা তোমার!

‘মনেহচ্ছে কোনো ঔষধের প্রভাবে ঘুমটা একটু বেশিই হচ্ছে।

‘শুধু ঔষধের প্রভাব?

কৌড়ি হেসে দিলো।আসলেই যে শুধু ঔষধের প্রভাব তা তো নয়।বিষয়টা মানুষটা বুঝতে পেরেছে।পারারই কথা!একসপ্তাহ হতে চললো,থাকছে মানুষটার সঙ্গে ।তাও আবার মানুষটার খুব কাছে। নিঃশ্বাসের সাথে মিশে।হঠাৎই নিভানের দিকে তাকিয়ে কেমন উচ্ছসিত গলায় সে জানালো–জানেন, দাদিআপারও আমার ঘুম নিয়ে অভিযোগ ছিলো।এতো সময় কিকরে ঘুমিয়ে থাকতে পারি?সময় নেই অসময়ে কিকরে ঘুমিয়ে যাই?এতো ঘুম ভালো নয়?আরও কতশত অভিযোগ।

‘ আমার কিন্তু কোনো অভিযোগ নেই।

হঠাৎই নিভান দূরত্ব ঘুচিয়ে ফেললো। কৌড়ির কোমর পেচিয়ে কাছে টেনে নিলো তাকে।হঠাৎ আক্রমণে কৌড়ি চোখ বুজে নিলো।বলিষ্ঠ বুকে মিশে গেলো তার পিঠ।খামচে ধরলো কোমরে জড়িয়ে ধরা নিভানের হাত।সঙ্গে সঙ্গে সেই হাতজোড়া চলে গেলো শক্ত হাতের বাঁধনে।কোমরে শক্ত হাতের স্পর্শ দৃঢ় হতেই চোখ মেলে তাকানোর আর সাহস হলোনা তার।বরং মুখের কাছে নিভানের শ্বাসপ্রশ্বাসের ঘনত্ব টের পেতেই আর-ও শক্তপোক্ত ভাবে খিঁচে নিলো আঁখি। নিভান তা দেখলো।একটু আগে যখন মেয়েটা হাসলো।সদ্য ঘুম থেকে উঠা লুচির মতো ফোলাফোলা গালে কি মোহনীয় দেখালো সে হাসি!নিভান, কৌড়ির খিঁচে থাকা চোখমুখের দিকে তাকিয়ে কেমন ঘনোস্বরে বললো–

‘এইযে আমাকে ছাড়া দীর্ঘ সময় একাএকা ঘুমিয়ে পার করছো তবুও আমার অভিযোগ নেই কেনো জিজ্ঞেস করবে-না?

কখনো না।উত্তর লজ্জাজনক আসবে এটা কৌড়ি জানে।তাই ভুলেও নিভানের শুধানো বাক্যের প্রতিক্রিয়া দেখালো না।নিভানও অপেক্ষা করলোনা বউয়ের প্রতিক্রিয়ার।মেয়েটাকে কাছে পেলেই তার যে কি হয়!শুধু আদর ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখতে ইচ্ছে করে।নিজের মাথা নিচু করে কৌড়ির গালে ঠোঁট ডুবালো।শিহরে উঠলো কৌড়ির সর্বাঙ্গ। নিভান সেটা অনুভব করেই আরও শক্ত বাঁধনে নিজের সাথে চেপে ধরলো তাকে।ফের কেমন নেশাময় স্বরে বললো–কারণটা হলো,আমার বউটা ঘুমিয়ে থাকলে তাকে ইচ্ছেমতো আদর ভালোবাসা যায়।মনমতো ভালোবাসতেও আমার খুব সুবিধা হয়।

নিঃশ্বাস আঁটকে এলো কৌড়ির।কি অসভ্য লোক!আশ্চর্য!এসব কথা কেউ মুখে বলে!উফফ!কৌড়ি যেন লজ্জায় হাসফাস করে উঠলো।শক্ত বাঁধনে নড়া দুঃসাধ্য হলো।তবে তার নরম গালে খোঁচাখোঁচা দাঁড়ির স্পর্শ অসহনীয় করে তুললো তাকে।উপায় হিসাবে অস্পষ্ট স্বরে নিভানকে ডাকলো সে।কাজে তো দিলো না।বরং স্পর্শের দৃঢ়তা আর ঘনো হলো।সত্যিই এবার কৌড়ির শ্বাস আঁটকে এলো।আর সেই শ্বাস আঁটকে আসা স্বরে কোনোমতে বললো।

‘নিভান প্লিজ।

নিভান হাসলো।মৃদু শব্দও হলো।তবও সে সরলোনা।বরং বললো-আমি সেই সন্ধ্যা থেকে তোমার ঘুম ভাঙার
অপেক্ষা করছি।

মানেটা কি!সে নিঃশ্বাস আঁটকে মরে যাওয়ার উপক্রম আর লোকটা হাসছে।আরও কিসব বলে চলেছে!হঠাৎ কৌড়ির মনেহলো হাতের বাঁধন ঢিলা হয়েছে।সঙ্গে সঙ্গে পিছনে মুড়ে নিভানকে জড়িয়ে ধরলো সে।শ্বাস নিলো ঘনোঘনো।তার সঙ্গে মৃদুস্বরে উচ্চারণ করলো।–আপনি খুব অসভ্য।

নিভান, বউয়ের অসহনীয় অবস্থা টের পেয়েই হাতের বাঁধন ইচ্ছেকৃত ঢিলা করেছে।বউয়ের থেকে অসভ্য আখ্যা পেতেই শব্দহীন হাসলো সে।মুখটা কৌড়ির কানের কাছে নিয়ে দুষ্টমিষ্টি গলায় বললো–এর চেয়েও অসভ্য হলে তখন কি আখ্যা দেবে কাশফিয়া আহসান কৌড়ি?

কৌড়ি মুখে কিছু বললোনা।শুধু জোরসে খামচে ধরলো নিভানের পিঠ।যা শার্ট ভেদ করে চামড়ায় আচড় কাটলো।আঘাত পেয়েও নিভানের দুষ্ট হাসি প্রসারিত হোলো।বিনিময়ে বউটাকে আরও শক্ত বাঁধনে বুকে চেপে নিলো নিভান।এরপর একটু একটু করে সময় কাটতে থাকলো।দুজনেই দুজনের অবস্থানে নীরব।উপভোগ করলো সময়টা।উপভোগ করলো,খোলা সমুদ্র থেকে তেড়ে আসা শীতল বাতাস।বে- লাউঞ্জ নয়,দূর কোথা থেকে দারুন কন্ঠে ভেসে আসা কিছু গানের বাক্য।

Dil main hoo tum,akho main tum.
Pahle najar,sae yaara.
Yaa isqaka sajas hain dua mila hum dubara.

রাতের আকাশটা মৃদুমন্দ মেঘাচ্ছন্ন।তবুও তারাদের আনাগোনা সেখানে স্পষ্ট।চাঁদটাও যেনো রূপোর গোল থালা হয়ে ধরা দিয়েছে আকাশে।সেই থালার মতো চাঁদটায় ক্ষনে ক্ষনে একেক দলা কালো মেঘ এসে ছুঁয়ে দিয়ে প্রকৃতিতে কিরণ দেওয়া থেকে আবাছা করে দিচ্ছে।আবার যখন মেঘের দলাগুলো সরে যাচ্ছে, রূপালি চাঁদটা ঝলমলে হয়ে ধরা দিচ্ছে।সমুদ্রের পাড়ে বে- লাউঞ্জ এরিয়ার দোলনায় বসেবসে চাঁদের এই রূপ পাল্টে যাওয়া দেখছে কৌড়ি।নিভান একটু দূরে ফোনে কথা বলছে।রাতে ডিনার সেরে কৌড়িকে নিয়ে বের হয়েছে নিভান।কৌড়ির ঘুম আসছিলো।বলতেই নিভান তাকে নিয়ে সমুদ্রের পাড়ে চলে এসেছে।বে- লাউঞ্জে মানুষে ভরপুর।লাইভ গানের শোও চলছে সেখানে।তাই নিভান আর তাঁকে নিয়ে সেখানে যায়নি।এই নিরিবিলি জায়গাটা বেছে নিয়েছে।এখানে মানুষের আনাগোনা কম।কৌড়িরও জায়গাটা বিশেষ ভালো লেগেছে। যদিও লাউঞ্জের পাশাপাশি জায়গাটা।মৃদুমন্দ দোল খাওয়া দোলনাটায় হঠাৎ জোরে দোল পড়তেই পিছে ফিরলো কৌড়ি।তবে নিভানকে দেখে কিছু বললো-না। একবার দোল দিয়ে পুনরায় দোলনাটা ধরলো নিভান।বললো–চলো,হাঁটি।

কৌড়ি দাঁড়িয়ে পড়লো।সঙ্গে সঙ্গে কৌড়ির চিকন আঙুলের ফাঁকে নিজের আঙুল গলিয়ে হাতটা ধরলো নিভান।বালুময় চরে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে থাকলো দুজনে।মৃদুমন্দ কথাও চললো।তবে হোটেল থেকে বের হওয়া অব্দি নিভানের মনেহচ্ছে,কেউ তাদেরকে ফলো করছে।গাঢ় নজরে দেখছে।মানুষটা কে হতে পারে, নিভানের মনেহচ্ছে জানা।তবে বিশেষ পাত্তা দিলো-না নিভান।মনোযোগ দিলো পাশের নারীটিতে।বিস্তৃত সমুদ্র নীরব,পাশে থাকা নারীটি নীরব!আশেপাশে মানুষের মুখরিত পরিবেশ তবুও অতিরিক্ত হৈচৈ নেই।কেমন শান্ত শান্ত।সমুদ্রের দূরপ্রান্ত থেকে ভেসে মন জুড়ানো হিমেল বাতাস।চারপাশটা কেনন যেনো অদ্ভুত মনোরম পরিবেশ।কিছুসময় হাঁটতেই নিবান শুধালো।

‘পানিতে পা ভেজাবে?

‘ ভেজাবো?

‘তুমি চাইছো না?

কৌড়ি ততক্ষণাত মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।অর্থাৎ সে পা ভেজাতে চায়।সেটা দেখে নিভান বললো–তবে জুতা খুলে ফেলো।

মূহুর্তেই পায়ের স্লিপারজোড়া খুলে ফেললো কৌড়ি।ততক্ষণে নিভান, নিজের জিন্স গুটিয়ে পায়ের জুতা খুলে হাতে নিয়েছে।কৌড়ি জুতা খুলতেই সেটাও হাতে নিলো।ততক্ষণাত কৌড়ি বলে উঠলো–আমি নিতে পারবো।আপনি কেনো আমার জুতা হাতে নিচ্ছেন। আমার কাছে দিন।আপনারটাও দিন।

‘আমিও পারবো।চলো।

কৌড়িকে দ্বিতীয়ত কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পুনরায় তার হাতটা ধরলো এবং দুকদম এগিয়ে সমুদ্রের নোনাজলে পা ডুবালো তারা।কৌড়ি চেয়েও আর কিছু বলতে পারলোনা।নিভান সেই সুযোগ দিলোইনা।পায়ের গোড়ালি সমান পানিতে পা ডুবিয়ে গন্তব্যহীন হেঁটে চললো তারা।কিছুদূর যেতেই হঠাৎ ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামলো।বৃষ্টি গায়ে লাগতেই থেমে গেলো দু’জন।নিভান আকাশেরপানে চাইলো।রাতের আকাশের মেঘাচ্ছন্ন ঠিক পরিমাপ করা গেলো-না।ভাদ্রমাস!মেঘ পরিমাপ করার আগেই হঠাৎ করেই ঝুপঝাপ বৃষ্টি নামলো।নিভান খালি পায়ে কৌড়ির হাতটা ধরে দৌড় দিলো।কৌড়িকেও বাধ্য হয়ে দৌড়াতে হলো।দৌড়ালো আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেকেই।আবার কিছু মানুষ বৃষ্টিবিলাশে মুখরিত।

দৌড়ে এসে কফিবিচ খ্যাত বে- লাউঞ্জে ঢুকে পড়লো দুজনেই। ততক্ষণেই অর্ধভেজা হয়ে গেছে দু’জনে।মাথার চুল ঝাড়তে ঝাড়তে কৌড়ির দিকে লক্ষ্য করলো নিভান।কৌড়ির একটা ঢিলাঢালা থ্রিপিস পরা ছিলো।বৃষ্টিতে ভিজে তা গায়ের সাথে লেপ্টে গেছে।যদিও গায়ে মাথায় সুন্দর করে ওড়না দেওয়া।তবুও গোলাপি রঙ হওয়ায়, ভিজে ওড়নার ওপাশের লম্বা বেনুনিটা সাদৃশ্য।
সঙ্গে নারী অবয়ব।ফর্সা মুখটা বৃষ্টির ছিটাফোঁটা পানিতে রূপার মতো জ্বলজ্বল করছে।লাউঞ্জ এরিয়ার রঙবেরঙের লাইটের আলোতে এনারী যেনো অন্যরকম অপরূপা।হঠাৎ আশেপাশে তাকালো নিভান।লাউঞ্জে তখন মানুষের সমাগমে ভরপুর।কৌড়িকে নিয়ে ওই অবস্থায় সেখানে থাকতে চাইলোনা নিভান।নারীটা তার একান্ত।ভেজা অবস্থায় তাকে দেখার অধিকার কারও নয়।অধিকার থাকলে শুধু তার।মুগ্ধ হওয়ার থাকলে শুধু সে মুগ্ধ হবে,অন্য কেউ নয়।অথচ অনেকের নজর কৌড়িকে ঘুরে-ফিরে।নিভান খপ করে কৌড়ির হাত ধরল।ততক্ষণে বৃষ্টির তোপ বেড়েছে।কৌড়ি প্রশ্নবোধক নজরে তাকাতেই নিভান বললো।

‘চলো।বৃষ্টি থামবে বলে মনেহয়না।হোটেলে গিয়ে নাহয় একেবারে চেঞ্জ করে নেবে।

খুব স্বাভাবিক গলা।অথচ কৌড়ির কাছে শব্দগুলো নয় গলাটা কেমন অস্বাভাবিক ঠিকলো।সেই আকাশ ভাঙা ঝুপঝাপ বৃষ্টির তোপে হোটেলে ফিরলো তারা।ততক্ষণে কাকভেজা দু’জনে।হোটেল রুমে ঢুকতেই আশেপাশে বিবেচনা না করে,গায়ের ভেজা ওড়ানাটা টেনে গা থেকে ছাড়িয়ে ফেললো কৌড়ি।অসময়ে ভেজা কাপড়গুলো গায়ে প্রচন্ড অস্বস্তি দিচ্ছে।রুমের অন্যত্র দাড়িয়ে থাকা নিভান তখন নিস্পলক চোখে বউয়ের পানে চেয়ে।আজ বৃষ্টিতে ভেজা কৌড়ি অন্যরকম আকর্ষিত করছে তাকে।কি সুন্দর দিনের পর দিন নিজের স্বামীনামক পুরুষ সত্ত্বাকে নিয়ন্ত্রিন করে যাওয়া নিভানকে অস্বাভাবিক করে তুলছে।এই নারীটিকে কাছে নিয়ে নিভানের বুকে চেপে ঘুমানো হয়।স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসার তুলনায় তাকে হয়তো একটু কম ভালোবাসা হয়।তবে তার নারী সত্ত্বাকে প্রবলভাবে অনুভব করা হয়।যা নিভানকে নিয়ন্ত্রন হারাতে বাধ্য করে এবং নারীটাকে একান্তভাবে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করে।তবুও মেয়েটার কথা ভেবে নিজেকে দমিয়ে রেখেছে নিভান। তবে আজ তা কাজে দিচ্ছে কোথায়!
প্রচন্ড এলোমেলো মনেহচ্ছে নিজেকে।কৌড়িই বা তাকে স্বাভাবিকই বা থাকতে দিচ্ছে কোথায়!এরকম বোকামো কেউ করে!তার পুরুষ সত্ত্বাাটা যেনো আজ অন্য কথা বলছে।অন্য কিছু চাইছে।

হঠাৎ ওয়াশরুমের দরজার শব্দে ঘোর কাটলো নিভানের।কৌড়ি ওয়াশরুমে ঢুকেছে।এতো সময়ের রুদ্ধ করে রাখা শ্বাস এবার হাসফাস করে উঠলো।চঞ্চল হয়ে উঠলো মন।ব্যাকুল হয়ে উঠলো পুরুষ সর্বাঙ্গ।উফফ!নিজেকে স্বাভাবিক করে নিতে চাইলো কিন্তু কিছুতেই পারলো-না নিভান।আশপাশে ফিরে লম্বা লম্বা শ্বাস ছাড়লো তবুও কাজ হলো বলে মনেহলোনা নিভানের।বড়বড় কদম ফেলে হোটেলের খোলা বারান্দায় চলে গেলো সে।প্রকৃতিতে তখন বর্ষনের ঘোর তুফান বইছে।বৃষ্টির ছটা এসে ভিজে দিচ্ছে বারান্দা।সেই বর্ষন মুখর বারান্দায় দাঁড়াতেই কাকভেজা নিভান এবার ভিজে একাকার হলো।রাতের প্রকৃতিতে তখন ধূসর রঙ ছড়িয়েছে।নিভান, নিজে আর প্রকৃতির মাঝে কোনো তফাৎ খুঁজে পেলোনা।সবই তো ঠিক ছিলো!হঠাৎ কেনো বারিধারা নেমে সবকিছু এলোমেলো করে দিলো!তুফান ছড়িয়ে দিলো মনমস্তিস্কে!

‘ভিজছেন কেনো?ঠান্ডা লেগে যাবে তো।

বলিষ্ঠ দেহের সটান দাঁড়িয়ে থাকা নিভান আজ বউয়ের কন্ঠে যেনো মৃদু কেঁপে উঠলো।উফফ!কেনো এলো এখানে কৌড়ি!ঘুমিয়ে পড়তে পারতোনা!চোখ বুঁজে নিলো নিভান।আজ কি কৌড়িকে চাইলে, সে বারণ করবে?তাকে কি রোজকার তুলনায় আজ একটু বেশি ভালোবাসতে দেবে-না কৌড়ি?নিভানের ভাবনার মধ্যে কৌড়ি পাশে এসো দাঁড়ালো।সদ্য শুকনা শাড়ী পড়া মেয়েটা আবারও ভিজে যেতে থাকলো।তবুও পরোয়া করলোনা।তার কেনো জানি,তখন থেকে মনে হচ্ছে মানুষটা স্বাভাবিক নেই।কি একটা কারণে হঠাৎই অস্বাভাবিক আচারভ করছেন!কিন্তু কেনো?হঠাৎ কি হয়েছে?কৌড়ি কেমন মায়ামায়া গলায় শুধালো।

‘কি হয়েছে?এভাবে কেনো ভিজছেন?শরীর খারাপ করবে তো!

নিভান চোখ খুললো।সত্যকে কেউ এড়িয়ে যেতে পারেনা।তার মতোন ছেলের এড়িয়ে যাওয়ার মানায় না।তেমন মানে-ও হয় না।মনেমনে কথাগুলো বললেও,পাশে দাঁড়ানো নারীটার দিকে তাকানোর সাহস হলো-না তার।তাকালেই আজ আর সে কিছুতেই এই নারী থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারবেনা।তবুও নিভান যতোসম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রেখে পাশে তাকালো।কৌড়িকে শাড়ী পরা দেখেই ভিতরের বৈরীভাবটা দ্বিগুণ চড়া দিয়ে উঠলো।তবে সদ্য শুকনো কাপড় জড়ানো মেয়েটা ভিজে যাচ্ছে দেখে কোনোরকম ঠোঁটে হাসি টেনে বলল-কি হবে।কিচ্ছু হয়নি তো।তুমি আবার এখানে আসতে গেলে কেনো?বৃষ্টিতে ভিজে যাবে তো!

ভিজে যাবে কি!ভিজে গেছে।নিভান কৌড়ির হাত ধরলো।কোমল হাতটা ছুতে কখনো দ্বিধা হয়নি নিভানের।আজ হলো।সঙ্গে মৃদু কম্পনও।কৌড়িকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে বললো–আবার ভিজে গেছো তো।মুছে না-ও।

বলেই কেমন ওয়াশরুমে পালিয়ে যাওয়ার মতো চলে গেলো নিভান।কৌড়ির দিকে ঠিকঠাক ভাবে তাকালোও না।চরম আশ্চর্য হলো কৌড়ি।নিভানের কথাকাজের অস্বাভাবিকতা ঢেড় টের পেলো।তবে কারণটা কি বুঝতে পারলোনা।বেড বসলো কৌড়ি।শাড়ীর সামনের দিকে মুছতে মুছতে খেয়াল হলো।তখন তাড়াহুড়ায় ট্রলির প্রথমে যা পেয়েছে তাই নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেছে।ভেবেছিলো, রুমে এসে চেঞ্জ করে নেবে।কিন্তু রুমে এসে নিভানকে ওভাবে বারান্দায় বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে,শাড়ী চেঞ্জ করার কথা আর খেয়ালেই ছিলোনা।চলে গিয়েছিলো বারান্দায়।এখন কি চেঞ্জ করবে?ধ্যাত।বারবার এই চেঞ্জের ঝামেলা ভালো লাগছে-না। ভেবে, কৌড়ি আর চেঞ্জ করলোনা।বরং নিভানের ভাবনায় বিভোর হলো।হঠাৎ মানুষটার হলোটা কি? সেটাই ভেবে পাচ্ছেনা।অনেকটা সময় পার হওয়ার পরও যখন নিভান বের হচ্ছেনা।কৌড়ি ডাকবে কি ডাকবে না।ভেবে না পেয়ে শুয়ে পড়লো।হালকা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব লাগায় পায়েট কাছ থেকে চাদরটা জড়িয়ে চোখ বুঁজে নিলো,তবে ঘুমালো না।মুলত হঠাৎ নিভানের হোলোটা কি,কেনো এতো বিচলিত দেখাচ্ছে তাকে?সেই ভাবনায় বুদ হয়ে রইলো সে।


ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে নিভান দেখালো কৌড়ি ঘুমিয়ে পড়েছে।নিষ্পলক চোখে মায়াবীর মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ।ফের নিজের কাজে ব্যস্ত হলো সে।প্রকৃতিতে তখনও বৈরীভাব চলছে।সঙ্গে তুমুল বর্ষন।ওয়াশরুম থেকে টওয়াল পেঁচিয়ে বেরিয়ে আসা নিভান,ট্রাউজার আর টিশার্টে নিজেকে চেঞ্জ করে নিলো।মাথার চুলগুলো মুছতে মুছতে রুমের বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে,হালকা আলোর বাতিটা জ্বালিয়ে দিলো।ফের ল্যাপটপ নিয়ে বসলো,হোটেল রুমে বরাদ্দকৃত একসিটের সোফায়।সামনের কাচের টি-টেবিলটা টেনে নিয়ে পা সটান রাখলো সেখানে।ল্যাপটপটা কোলের মধ্যে রেখে ওপেন করে মন বসালো স্কিনে।অথচ মন কিছুতেই সেখানে বসতে চাইলো-না।মন যেতে চাইলো চাদর জড়িয়ে শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকা মেয়েটার কাছে।গিয়ে তার শান্তির ঘুমটা ভেঙে দিয়ে তাকে ভালোবাসায় ডুবিয়ে রাখতে।নিভান,সোফার হেডে মাথা এলিয়ে দিলো।চোখ বুঁজে পড়ে রইলো সেভাবে কিছুক্ষণ।ফের মনমস্তিস্কের দন্ডে মনকে প্রশ্রয় দিয়ে ল্যাপটপ বন্ধ করে, সামনের টি-টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়ালো সে।ওই মেয়েটাকে সামন্য উপেক্ষা করা তার সাধ্যি নয়।নয়ই।

বিছানায় গিয়ে কিছুক্ষণ বসলো নিভান।প্রকৃতিতে তখনও মুশলধারায় বর্ষন চলছে।রুম আর বারান্দার সাথে লাগোয়া কাঁচের দরজটায় বৃষ্টির তোপে কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে এসেছে।সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পাশে শুয়ে থাকা রমনীর পানে চাইলো নিভান।তার নিদ্রা হারাম করে দিয়ে শান্ত বাচ্চার মতো কি সুন্দর আরামে ঘুমাচ্ছে। নিষ্পলক চোখে সেই রমনীর পানে চেয়ে কিছুটা সময় আবারও ক্ষয় করলো।তারপর শব্দহীন ধীরেসুস্থে তারপাশে শুলো নিভান।কৌড়ির গায়ে জড়ানো অবশিষ্ট চাদরটা নিয়ে নিজের গায়ে জড়ানোর আগেই কৌড়ি এসে গুটিশুটি মেরে বুকের মধ্যে ঢুকে পড়লো।অশান্ত নিভান তা দেখে কিছুটা সময় নিশ্চুপ থেকে মেয়েটাকে আগলে নিলো দু’হাতে।দীর্ঘ একটা চুমু খেলো বউয়ের মাথায়।ভাবলো,ঘুমের ঘোরে হয়তো কাছে এসেছে।কিন্তু অবাক হলো।যখন কৌড়ি খুব স্বাভাবিক গলায় শুধালো—কি হয়েছে আপনার?

সেই প্রশ্নে যেনো বিমুঢ় চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ নিভান।উত্তর না দিয়ে,নিজেও প্রশ্ন শুধালো–তুমি ঘুমাও নি এখনো?

কৌড়ি মুখ উচু করে তাকালো।নিভান কেমন শান্ত চোখে চেয়ে আছে।সে চোখে চোখ রেখে তারপর কেমন মায়ামায়া গলায় শুধালো–বলুন না আমাকে আপনার কি হয়েছে?

অশান্ত নিভান,বউয়ের কাছে আসায়,মায়ামায়া স্বরের কথায় আরও ভিতরে ভিতরে আরও বিচলিত হয়ে উঠলো।হঠাৎই কৌড়িকে বুকের উপর থেকে সরিয়ে বালিশে শুইয়ে দিলো সে।কৌড়ির প্রশ্নবোধক চোখের পানে চেয়ে কেনন অদ্ভুত গলায় বললো–জানতে চাও আমার কি হয়েছে?

শান্ত হলেও কেমন অস্বাভাবিক চহুনি।যা অস্থির!আর তারচেয়েও অস্বাভাবিক অস্থির লাগলো নিভানের গলার স্বর।তার শুধানো প্রশ্ন।কৌড়ির মস্তিষ্ক যেনো তড়িৎ কাজ করলো। মূহুর্তেই বুঝে নিলো কিছু।তৎপর সমস্ত ইন্দ্রীয়ের বহমান রক্তকনিকা যেনো ছলকে উঠলো।লজ্জায় অসঢ় হয়ে এলো সর্বাঙ্গ।রুমের মৃদু আলোতে নিভানের ওই কেমন অস্বাভাবিক শান্ত চাহুনীতে নজর রাখা সম্ভব হলোনা আর তার।সহসা চোখ বুঁজে নিলো সে।নিভান বুঝে ফেললো,বুদ্ধিমান বউটা তার কথার ইঙ্গিতে বুঝে নিয়েছে সব।নিভানের কি হয়েছে,আর কি চাই?কৌড়ির বুঁজে নেওয়া চোখের দিকে তাকিয়ে নিভান আরও নেশাময় হয়ে উঠলো।
ভারী অশান্ত হয়ে পড়লো ভিতরের অনুভূতিতে জর্জরিত বৈরী ভাবটা।মুখ নিচু করে বউয়ের কানের কাছে মুখ ডুবালো সে।ছটফটিয়ে উঠে বিছানার চাদর শক্তমুঠোয় খামচে নিলো কৌড়ি।নিভান তা বুঝে আরও উতলা হলো।আবেদনময়ী স্বরে ডাকলো।

‘কৌড়ি।

এ ডাক সর্বনাশা!এ ডাক যেনো কারও অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে যাওয়ার আহ্বান।কেমন নেশাময় স্বর!শক্ত শিরদাঁড়া কাঁপিয়ে দিচ্ছে।কৌড়ি ডাকের উত্তর দেওয়ার অবস্থায় নেই।সারা শরীরে তার ভয়াবহ লজ্জার কম্পন।কি হতে চলেছে এখন?কি হতে চলেছে আজকের রাতটা?ভেবেই শিরশিরিয়ে উঠলো শরীর সঙ্গে ভিতরের মনটাও।নিভান-ও আশা করলো-না বউ তার ডাকের সাড়া দেবে। উত্তর দেবে।বরং বউকে একান্ত কাছে পাওয়ার উদ্দেশ্যে আবেদনময়ী গলার স্বর আরও ঘনো হয়ে এলো তার।সেই স্বরেই অভিযোগ আবদার দুটোই জানালো।

‘এখন কেনো ডাক শুনছো-না?জানতে চাওনা আমার কি হয়েছে?এই কৌড়ি,আজ কি তোমাকে একটু বেশি ভালোবাসালে খুব ক্ষতি?

কৌড়ি পাথর বনে রইলো।হৃদস্পন্দন তার ছটফট করছে।কখন নাজানি চামড়ার বুকটা ভেদ করে বেরিয়ে আসে।সমস্ত ইন্দ্রিয় কেমন অসহনীয় অনুভূতিতে চঞ্চল হয়ে আছে।নিভান আবদার জানালেও,থেমে নেই।বউকে ভালোবাসতে ব্যাকুল সে।স্পর্শের অসংলগ্নতা চললো বউয়ের গলামুখে।যেনো চম্বুকের আকার্ষনের মতো মেয়েটা টানছে।নিয়ে যেতে চাইছে সম্পর্কের অতল গভীরে।নারী শরীরের আলাদা সুগন্ধটা যেনো তাকে ভালোবাসার চরম পর্যায়ে ঠেলেঠুলে এগিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য করছে।নিভান পরম আবেশে সেই বাধ্যতার বশিভূত স্বীকার করলো।যেনো নিজেকে অনুভব কোনো যাদূর বশবর্তী মানব।যা তাকে যাদূর বলে টানছে আর এগিয়ে যাচ্ছে।তারমধ্যেও বললো–বলোনা,কৌড়ি।খুব কি অসুবিধা হবে?খুব কি ক্ষতি?

বরের ভালোবাসায় কৌড়ি তখন অনুভূতির জোয়ারে ভেসে চলেছে।মুখ দিয়ে রা শব্দটা বের করার জো নেই।যেনো সে নিজেও চাইছে,নিভান তাকে ভালোবাসুক।একজন স্বামী তার স্ত্রীকে যেভাবে ভালোবাসে,নিভান ঠিক সেভাবে তাকে ভালোবাসুক।অনুভূতিতে এলোথেলো কৌড়ি,নিভানের আকুল আবদনে এতোসময় বিছানার চাদর আঁকড়ে ধরা হাতদুটো আলগা করলো।নিজের ইচ্ছেতে আঁকড়ে ধরলো নিভানকে।নরম,কোমল হাতের ছোঁয়া পিঠে পড়তেই নিভান যেনো মূহুর্তেই সম্মতি পেয়ে গেলো।স্পর্শ আরও ঘনিষ্ঠ হলো।ঘনো জড়ানো গলায় ফের শুধালো–সত্যিই তোমার কোনো অসুবিধা নেই তো?

অনুভূতিতে জুবুথুবু কৌড়ি স্বামীর ভালোবাসায় কেমন যেনো বশ্যতা স্বীকার হয়ে গেলো।নিভানের শুধনো প্রশ্নে উত্তর দেওয়া যেনো অত্যাবশ্যক মনে করে মাথা নাড়িয়ে না জানালো।অর্থাৎ স্বামীর অস্তিত্বে নিজেকে বিলিন করে দিতে তার কোনো অসুবিধা নেই।নিভান যেনো আকাশ ছোঁয়া আশকারা পেলো।আর সেই আশকারা পেতেই এতো দিনে নিয়ন্ত্রণ রাখা নিজের পুরুষ সত্ত্বাকে অবাধ মুক্ত করে দিলো।জমানো ভালোবাসা উগলে দিতে থাকলো একান্ত নারীটিতে। চললো নিভানের পাগল করা উথাল-পাথাল ভালোবাসা।বাহিরের মুশলধারা বর্ষনের সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে যেনো নিভানের ভালোবাসা।কৌড়িও যেনো স্বামী নামক মানুষটার কাছে নিজেকে অবাধ ছেড়ে দিলো।সেটা উপলব্ধি করে নিভানও আজ প্রথম নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করলো।খুব ঘনিষ্ঠ মূহুর্তে স্ত্রীর কানে মুখ ডুবিয়ে বললো–নিভান তোমাকে খুব ভালোবাসে,
আমার ভালোবাসা।নিভান তোমাকে তার চেয়ে-ও খুব খুব যত্নে রাখবে।খুব খুব ভালোবাসবে।দেখো!

চলবে….

ফুলকৌড়ি পর্ব-৫৬+৫৭

0

#ফুলকৌড়ি
(৫৬)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

নিভানের পিতৃস্থানীয় বাড়িটায় সময়টা বেশ আনন্দে ফূর্তিতে কাটলো সবার।আর আতিথিয়েতা তো মাশাআল্লাহ,খুব আমায়িক।সকাল হতেই খাওয়া দাওয়া সেরে বিদায় নিয়ে বের হলো নিভানরা।রওনা দিলো বাড়ির পথে।আবিদা জাহানের মনেহলো,ছেলেমেয়েগুলোকে এবাড়িতে আঁটকে রাখতে।একদিনের হৈ-হুল্লোড়ে বাড়িটা কেমন প্রান ফিরে পেয়েছিলো।ছেলেমেয়েগুলো চলে যেতেই বাড়িটা কেমন খা খা করছে।পুনরায় শান্ত নিষ্প্রাণ হয়ে পড়েছে।ছটফটে ইতুটারও কেমন মন খারাপ বসে আছে।ওরা চলে যেতেই কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে!তবে নিভান উনাকে কথা দিয়ে গেছে সপ্তাহে একদিন হলেও সে এবাড়িতে আসবে।উনার সাথে দেখা করে যাবে।এবাড়ির মানুষগুলোর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবে।এতেই তিনি খুশি,সন্তুষ্ট।ছেলেটাকে একেবারে ধরে রাখার অধিকার তিনি অনেক আগেই হারিয়েছেন বিধায় যুক্তি দেখিয়ে, হক খাঁটিয়ে, সম্পর্কের জোর চাপিয়ে ধরেবেধে রাখতে চাননা।নিভানকে রাখা সম্ভবও নয়।তবে যেটুকু আপনে থেকেই পাচ্ছেন তাতেই শুকরিয়া।বাড়ির সামনের লন এরিয়া থেকে গাড়ি দুটো চোখের আড়াল হতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।উনার বাহু চেপে রাখা আশহার সাহেবকে বললেন–আমাকে ঘরে নিয়ে চলো ছোটোখোকা।

মায়ের মন খারাপ বুঝে উনাকে ঘরের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বললেন–আপনি কিন্তু দুশ্চিন্তা করবেননা আম্মা।নিভান কিন্তু বলে গিয়েছে, সে সপ্তাহে একবার হলেও বউমাকে নিয়ে ঘুরে যাবে।

‘তুমি আমাকে নিয়ে চিন্তা কোরোনা ছোটোখোকা।আমি ঠিক আছি।তবে আমার আওসাফ বেঁচে থাকলে মনেহয় আমার গুছানো সংসারটাও ঠিক থাকতো।

বৃদ্ধা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।মায়ের সাথে সাথে আশহার সাহেবও একটা শ্বাস ছাড়লেন।বড় সন্তানের প্রতি বাবা মায়েদের একটা অন্যরকম টান থাকে।প্রথম সন্তান বলে কথা!মা হোক বা বাবা, ডাকটাও তো তার মুখেই প্রথম শোনা হয়।পিতামাতৃত্বের স্বাদ অনুভূতিাটও তো সেই প্রথম সন্তান দ্বারা উপলব্ধিত হয়।সন্তানের প্রতি সকল অনুভূতি অনুভব প্রথম সন্তান দ্বারাই হয়ে থাকে,বিধায় তাদের প্রতি মায়া টান,ভালোবাসাটাও একটু বেশী হয়।গভীর হয়।আশহার সাহেবেরও তো সেই টান আছেন।ইতু নিতুকে তিনি সমান ভালোবাসলেও,নিতুর প্রতি মায়াটা উনার একটু বেশি।সেই হিসাবে বড় ভাইয়ের প্রতিও উনার মায়ের টান,স্নেহ,ভালোবাসা একটু গভীরে।আর সেই সন্তানের সন্তান,এবাড়ির প্রথম নাতী হলো নিভান।তারপ্রতি সেই টান ভালোবাসা থাকবেনা!তা কিকরে হয়?প্রচলিত প্রচলন,লোকে বলে–আসলের চেয়ে নাকি সুদের মায়া বেশি।আসলেইতো তাই!আর সেই সুদের মায়া যদি হয়,সেই প্রথম মাতৃস্বাদ প্রাপ্ত সন্তানের সন্তান।তাহলে তো কথাই নেই!দূরে থাকলেও নিভানের প্রতি আশহার সাহেবের যে,মায়ের মতো একই টান ভালোবাসা নেই।তা নয়।ছেলেটাকে তিনিও তো ভালোবাসেন।বড়ো ভাইয়ের বড় দরদের অমুল্য আমানত হিসাবে নিজের কাছে রাখতেও চান।তবে না সেদিন চেয়েও পেরেছিলেন আদরের ভাইপো-কে কাছে রাখতে,আর না আজ চেয়েও পারবেন। এসব ভেবে একপর্যায়ে মা’কে সান্তনা দিতে দিতে ভিতরের দিকে অগ্রসর হলেন তিনি।

বাড়ি ছেলেমেয়েগুলো বাড়িতে আসতেই বাড়ির প্রানটা যেনো ফিরে এলো।বিয়েতে আসা আত্মীয় স্বজন এই দুদিনের মধ্যে কমে গিয়েছে।বললে চলে নেই।শুধুমাত্র নিভানের নানুমা ছাড়া আপতত আত্মীয়- স্বজন বলতে বাড়ি ফাঁকা।ওবাড়ি থেকে এসে,ওবাড়িতে ঘুরেফিরে বেড়ানো,অতিথি আপ্যায়নের গল্পে মুগ্ধ মশগুল সবাই।নীহারিকা বেগমতো কৌড়িকে আলাদা ডেকে নিয়ে ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে গিয়ে বসলেন।কেমন অশান্ত গলায় শুধালেন–নিভানের দাদুমা,নিভানকে ওবাড়িতে থেকে যাওয়ার কথা কিছু বলেননি কৌড়ি?

কেমন উৎকন্ঠা, অশান্ত,অস্থির হয়ে শব্দগুলো প্রয়োগ করলেন তিনি।যেনো কোনো কিছু নিয়ে আশংঙ্কায় ছিলেন।কৌড়ির কেমন মায়া হলো।বুঝতে পারলো, ছেলে দূরে সরে যাওয়ার নীরব ভয় সংশয় থেকে এমন উৎকন্ঠিত বাক্য,প্রশ্ন।হয়তো আজ দু’দিনে তিনি এই ভয়ে সংশয়ে কাটিয়েছেন।বুঝদার ছেলেকে নিয়েও উনার এতো ভয়?এতো সংশয়?সন্তান দূরে যাওয়ার ভয়,তাকে হারানোর অনিশ্চয়তা বুঝি বুঝদারপনা আর বয়স মানেনা?বাবা মায়ের মন তা হয়তো কোনো ঘটনাক্রমে সংশয়িত হয়েই থাকে।তবে নীহারিকা বেগমের সংশয়,দুশ্চিন্তা দূর করতে কৌড়ি উত্তর দিলো—দাদুমা তো তেমন কোনো আবদার করেননি।তবে মাঝেমধ্যে উনাকে একটু দেখে আসার আবদার জানিয়েছেন।তোমাকেও যেতে বলেছেন, বড়মা।

‘আবার বড়মা।শুধু মা বলবি।

কৌড়ি দেখলো একটু আগের সংশয় ভিতু কন্ঠ মূহুর্তেই
উচ্ছ্বাসে পরিনিত হয়েছে।চোখমুখে যে উৎকন্ঠার আধার ছিলো,তা মূহুর্তেই কেটে গিয়ে দুপুরের রোদের ন্যায় ঝলমলে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।নীহারিকা বেগম সবিনয়ে বলতে থাকলেন—আমার নিভান আমাকে শুধু মা বলে ডাকে জানিস!ওর ডাকে আমার কলিজা জুড়িয়ে যায়।কতো দুশ্চিন্তা,অপারগতা,যন্ত্রণা,সব যেনো সেই ডাকেই সহস ধুয়েমুছে ভিতরটা সচ্চ হয়ে যায়।মনেহয়,আমার জীবন, আমার মাতৃত্ব স্বার্থক আমি এমন সন্তান জন্ম দিতে পেরেছি বলে।আমার বাচ্চা। আমি ওকে খুব ভালোবসি জানিস কৌড়ি।কিন্তু ওরই তো মা,ওকে ঠিকঠাক বোঝাতে পারিনা।বোঝাতে পারিনা,আমি তোর বাবার থেকে একচুল কম ভালোবাসিনা নিভান!আমি তোর বাবার মতোই তোকে খুব ভালোবাসী।

ফের উদাস কন্ঠে বললেন–ওকে কষ্ট দিসনা কৌড়ি।ভালো রাখিস।ওর আমার প্রতি অনেক অভিমান অভিযোগ আছে,যা ও কখনো প্রকাশ করেনা।হয়তো করতেও চায়-না। তুই উত্তম সঙ্গী হয়ে ওর চাপা দুঃখ কষ্টগুলো বের করে নিস।সেটা আমার নামে অভিযোগ হলেও,কষ্টগুলো ওর মনে থেকে দূরীভূত করার চেষ্টা করিস।এটা আমার তোর কাছে দাবী।আমি জানি তুই পারবি ওর জমা কষ্টগুলো,দুঃখগুলো ভুলিয়ে দিতে, ওকে ভালো রাখতে।একজন স্ত্রীর স্বামীর দুঃখ দুর্দশা হতাশা, কষ্ট ভুলিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা থাকে,এজন্য মা হয়ে সন্তানের সুখ কামনায় কথাগুলো তোকে বলা।

‘উনি তোমাকে খুব ভালোবাসেন বড়মা।স্যরি মা।

হেসে ফেললেন নীহারিকা বেগম।বললেন –আমি জানি সেটা।আচ্ছা ওসব রাখ।ওবাড়ির গল্প করতো শুনি।আশহারের বউকে আমি দেখিনি।কেমন?ওর মেয়ে দুটো কেমন?

বউ শ্বাশুড়ি গল্পে মেতে উঠলো।কতোশত প্রশ্ন!কতশত পুরানো মধুময় স্মৃতি উগলে দেওয়া!ওবাড়ির প্রতি টান মায়া সব যেনো কন্ঠে ঝুরে পড়লো নীহারিকা বেগমের।
কৌড়ি প্রশ্নের উত্তর দিলো।শ্বাশুড়ির ওবাড়ির প্রতি টান মায়ার গল্প শুনলো।উনার সন্তুষ্টচিত্তে বলার ভঙ্গিমা মুগ্ধ হয়ে দেখলোও।আর এটাও বুঝলো,তার শ্বশুর নামক কবরে শায়িত মানুষটা তার শ্বাশুড়িকে খুব ভালোবাসতেন।যা তিনি আরেক সংসারের বেড়াজালে পড়েও এখনো ভুলতে পারেননি।যেমন নিভান ভুলতে পারিনি তার বাবাকেও।

‘হাতের বালাজোড়া কে দিয়েছেন? দাদুমা?

কথার একপর্যায়ে কৌড়ির হাতের দিকে নজর যেতেই শুধালেন নীহারিকা বেগম।সেদিকে একপলক তাকিয়ে মৃদু হেসে মাথা ঝাকিয়ে উত্তর দিলে কৌড়ি।মুখ বললো–হুমম।দাদুমা দিয়েছেন।

নীহারিকা বেগম বালাজোড়া আলতো হাতে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখলেন।এই বালাজোড়া শ্বাশুড়িমার খুব যত্নের।বিয়ের পর শ্বশুরবাবা নাকি নিজ শখে গড়িয়ে দিয়েছিলেন শ্বাশুড়িমাকে।স্বামীর শখের বালাজোড়া তাই নিজ যত্নে যক্ষের ধনের মতো গুছিয়ে রাখতেন।আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে ঘুরতে গেলে তখনই এই বালাজোড়া উনাকে পরতে দেখা যেতো।তাছাড়া আলমারীর লকারে সযত্নে তা আগলে রাখতেন।সেই বালাজোড়া আজ নিভানের বউকে দিয়ে দিলেন তিনি!তবে নিভান তার কতো যত্নের।হয়তো পারেননি সেই যত্ন সযত্নে আগলে রাখতে।তবে ভালোবাসা যত্ন ঠিকই মনের কুঠোরে রয়ে গেছে।

শ্বাশুড়ির কাছ থেকে ছাড় পেতেই কৌড়ি রুমে এলো।রুমে ঢুকতেই মুখে আপনাআপনি মৃদু হাসি ফুটল তার।চারপাশটা নিষ্পলক চোখ চেয়ে দেখলো কিছুক্ষণ।সঙ্গে বদ্ধ রুমের মধ্যে ভেসে বেড়ানো সেই মানুষটার শরীরের নিজস্ব সুগন্ধ রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করতে লাগলো।যা মানুষটার অনুপস্থিতিতেও,রুমের মধ্যে চারিদিকে তীব্র সুবাস ছড়িয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে।সময় নিয়ে কৌড়ি ভিতরে ঢুকলো।বাসায় পরিধিয় সালোয়ার কামিজ নিয়ে মূহুর্তেই আবার ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো।ফ্রেশ হয়ে গায়ের গহনা সব খুলে শাড়ী ছেড়ে সেলোয়ার-কামিজ পরতেই মনে হলো শান্তি।একে শাড়ী, তাতে একগাদা গহনা পরে থাকাতে কি যে অস্বস্তি লাগছিলো!উফফ!এবার যেনো শান্তি।পরম শান্তি।আগের পরিহিত জামাকাপড়গুলো ধুয়ে নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হলো কৌড়ি।বেলকনিতে তা মেলে দিয়ে এসে ধপ করে বেডের আড়াআড়ি শুয়ে পড়লো সে।নরম বিছনায় শরীর মেলে দিতেই,ঘরময় ঘুরে বেড়ানো সুগন্ধটা যেনো নাকে কড়া হয়ে ধরা দিলো।ঘাড় কাত করে পাশে ফিরলো সে।জীবনের প্রথম স্বামী নামক পুরুষটার সঙ্গে কাটানো প্রথম রাতের মূহুর্তগুলো দুনয়নে ভেসে উঠলো।পরপর ভেসে উঠলো,ওবাড়িতে থাকা প্রতিটি রাতের সুন্দর সুন্দর মূহুর্ত।এমনকি কালকে রাতের ওই বেসামাল মূহুর্তগুলোও।ভাবতেই লজ্জায় চোখ বুঁজে নিলো কৌড়ি।ঠোঁটে ফুটলো বিস্তর হাসি।পাশ থেকে খামচে একটা বালিশ উঠিয়ে নিয়ে বুকে চেপে ধরতেই সেই ঘরময় ছুটে বেড়ানো সুগন্ধটা যেনো আর-ও প্রকট হলো।সেই অনুভূতিতে কৌড়ি বালিশটা যেনো আরও শক্তভাবে বুকে চেপে নিলো।মানুষটা কাছে নেই অথচ মনেহচ্ছ,খুবকাছে আছে মানুষটা।যেমনটা তাকে বুকে আগলে ঘুমায় তেমনটা।ওবাড়ি থেকে বের হয়ে মাঝরাস্তা থেকে অফিসে চলে গিয়েছে মানুষটা।তারা চলে এসেছে বাড়িতে।অথচ না থেকেও মানুষটার উপস্থিতি যেনো ঘরময়।

‘ওভাবে শুয়ে আছিস কেনো?বালিশ মাথায় না দিয়ে বুকে?ব্যাপার কি?

মান্যতার গলা শুনে চমকে বুকের থেকে বালিশ সরিয়ে ফেললো কৌড়ি।ততক্ষণে মান্যতা এসে বসে পড়লো কৌড়ির পাশে।কৌড়ির উত্তরের অপেক্ষা না করে ফের বললো —

‘জানিস, আগে এঘরে আসতে কেমন একটা দ্বিধা ভয় কাজ করতো।ভয় অবশ্যই না।দাদাভাইয়ের সম্মুখে পড়ার অস্বস্তি।যদিও দাদাভাই যেখানে থাকে, ছোটোদাদাভাই বাদে সেখানে আমাদের কাওকে পাওয়া যায়না।সত্যি বলতে দাদাভাইয়ের সম্মুখে বসা চলা,কথা বলা সাহসে কুলাইনি কখনো।দাদাভাইয়ের ওই গম্ভীর মুখ,ভারী কন্ঠ, শান্ত চাহুনী।সবসময় আতঙ্কিত করে রাখাত আমাদের।আর রাখেও। অথচ দাদাভাই কিন্তু অকারণে বকাঝকা রাগারাগি অযথা চিল্লাপাল্লা এসব করতোনা।এখনো করেনা।তবুও কেমন একটা তারপ্রতি ভয়সয় কাজ করে।তবে তুই দাদাভাইয়ের বউ হওয়ার পর সেই দ্বিধা আতঙ্ক ভয়সয় যেনো কিছুটা কেটে গেছে।তবুও দাদাভাইয়ের সম্মুখে পড়তে যেনো কেমন একটা অনুভব হয়।এখন এই রুমে ঢুকতে গিয়ে কেমন মনে হচ্ছিলো!যদিও জানি দাদাভাই রাতের আগে ফিরবেনা।তবুও…

‘ফিরলেও কি!কিচ্ছু বলবেন না উনি।তুমি বসে না থেকে শুয়ে পড়োতো।

মান্যতা কৌড়ির পাশাপাশি শুয়ে পড়লো।কিছুটা প্রহসন করে বললো–একেই বলে বউকা পাওয়ার।অথচ দুদিন আগে কিন্তু কেঁদেকেটে ভেসে যাচ্ছিলো আমাদের কৌড়ি।

হাসলো কৌড়ি।নজর তার ছন্দতুলে ঘুরতে থাকা বৈদ্যুতিক ফ্যানটার।সেদিকে তাকিয়ে সহসা মান্যতা শুধানোর মতো করে বললো—এসি না চালিয়ে ফ্যান ছেড়েছিস!যা গরম পড়ছে!উফ!জান যায়যায় অবস্থা!

এসির রিমোটটা হাত বাড়িয়ে বেডটেবিলটার পাশ থেকে নিয়ে মান্যতার কাছে দিল কৌড়ি।সহসা শুধালো–দীবা আপুকে দেখলাম না-তো?উনি বাড়িতে নেই আপু?তোমাদের সাথেও ওবাড়িতে গেলেন না?

‘তােদের বিয়ের দিন রাতে সিয়াম ভাইয়ার সাথে ঘুরতে বেরিয়ে নাকি,সিয়াম ভাইয়াদের বাড়িতেই চলে গেছেন।
সকালেই তো তোরা গাজীপুর চলে গেলি,এজন্য হয়তো জানিস না।

‘উনাদের সব মিটমাট হয়ে গেছে?

‘তা জানিনা।তারপর তো আর এবাড়িতে আসলেন না।আমারও আপুর সাথে কথা হয়নি।উনি সিয়াম ভাইয়াদের বাড়িতে আছেন,এটুকু শুধু আম্মুর কাছ থেকে শুনেছি।তাছাড়া সেভাবে কিছু জানিনা।তবে মিটমাট হয়ে গেলেই ভালো।আপুর মন খারাপ আমারও ভালো লাগেনা।আপু খারাপ নয় জানিস।শুধু বিয়ের পর কেমন জানি একটা হয়ে গেছেন।আমি বুঝিনা আপুতো জেনে-বুঝে সিয়াম ভাইয়াকে বিয়ে করেছিলেন। তবে উনাকে নিয়ে এতো সমস্যা কিসের।ভাইয়াকেও কিন্তু আমার একেবারে খারাপ মনেহয় না।আপুকে কিন্তু প্রচন্ড ভালোবাসেন।তবুও এতো ঝামেলা কিসের আমি বুঝিনা।

‘আমার উপরে দীবা আপুর খুব রাগ তাই না আপু?

মান্যতা সহসা পাশ ফিরে কৌড়ির দিকে তাকালো।ফের বললো।

‘তা কেনো হবে!থোড়াই না তুই তার ভালোবাসার মানুষ আর না ভালোবাসার সংসার কেড়ে নিয়েছিস!যা সে হারিয়ে আফসোস করছে,সংসার ছেড়ে এলোমেলো জীবনযাপন করছে!তা তার ডিসিশনে,এবং নিজের ইচ্ছেতে!সেখানে তোর উপরে কেনো কারও উপরে আপুর রাগ করা উচিত নয়।নিজ থেকে খুইয়ে দিলে সে জিনিস কি আর সহজে পাওয়া যায়?যায় না!শুধু তা হারনোর বেদনায় আফসোস করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকেনা!

আফসোস!দীবা আপুর মতো তাকেও কি করতে হবে? সহসা মনে প্রশ্নটা আসতেই ভিতরে ভিতরে কেমন থমকে গেলো মান্যতা।সেদিনের পর আর তৃনয়ের সাথে তার কথা হয়নি।আর না দেখা হয়েছে।সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে লোকটাকে এখনো নিজের ডিসিশন জানানো হয় নি।আর না লোকটাও তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে।আচ্ছা,দাদাভাইকে নিজইচ্ছেতে হারিয়ে দীবা আপু যেমন সিয়াম ভাইয়ার সাথে ভালো নেই।তার ডিসিশনও যদি দীবা আপুর মতো হয়!তৃনয়কে বিয়ে না করে সে যদি অন্য কাওকে বিয়ে করে!আর সুখি না হয়?তখন কি দীবাআপুর মতো অবস্থা হবে তার!কাওকে অভিযোগ করার থাকবেনা।শুধু ভিতরে ভিতরে পুড়ে শেষ হতে হবে?আফসোস করতে হবে?সাথে উত্তম জীবনসঙ্গিনী হারানোর বেদনায় ছটফটিয়ে মরতে হবে?এমনটা কি তারসাথেও হবে?দীবা আপুর এবাড়িতে পড়ে থাকার সত্যিটা তো সেও জানে,তবে কৌড়ির সামনে খোলাখুলি প্রকাশ করেনি। পাছে মেয়েটার না আবার মন খারাপ হয়ে যায় তাই!দীবা আপু সম্পর্কে আগে যেটুকু শুনেছে জেনেছে,এখনতো দাদাভাই কৌড়ির স্বামী।অন্য মেয়ে দাদাভাইকে ভালোবাসে,তাকে পাগলের মতো চায়!নিজের স্বামী, সংসারধর্ম ছেড়ে বসে আছে দাদাভাইকে পাওয়ার জন্য।এটা কোনো স্ত্রী সহ্য করতে পারে? মানতে পারে? মান্যতার মনেহয় কখনোই পারেনা। সে যতোই ধৈর্য্যশীল সহনশীল মেয়ে হোক না কেনো,স্বামীর বেলায় তারা পারেনা এসব মানতে!যদিও কৌড়ি বুদ্ধিমান মেয়ে বুঝতে পারে সবকিছু। তবে চুপ হয়ে থাকে।বুদ্ধিমান মানুষেরা যে কথা বলে কম।আচ্ছা সেই বুদ্ধিমান মেয়েটার কাছ থেকে নিজের জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের পরামর্শ নেবে?নেওয়াই যায়।সহসা চুপচাপ থাকা কৌড়িকে ডাক দিলো সে।

‘কৌড়ি।

‘হুমম।বলো আপু।

‘আমাকেও কি দীবা আপুর মতো কোনো একটা সময় গিয়ে আফসোস করতে হবে?

প্রশ্নটা কৌড়ি বুঝলোনা।ভাবান্তর কপালে মৃদু ভাজ ফেলিয়ে পাশে তাকাল।মান্যতা উপরের দিকে তাকিয়ে আছে।স্থির দৃষ্টিটা তার বৈদ্যুতিক ঘুরতে থাকা ঝা চকচকে পাখাটার দিকে।এসি ছাড়লেও,আলসেমিতে কেউ উঠে পাখাটা বন্ধ করেনি।কৌড়ি বুঝলো না মান্যতার প্রশ্ন!আপু ভবিষ্যতে কি নিয়ে আফসোস করার কথা বলছে?কৌড়িকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকতে দেখে হয়তো মান্যতাও বিষয়টা বুঝলো।তাই পুনরায় বললো—তৃনয় ভাইয়াকে বিয়ে করার বিষয়টা নিয়ে বলছি।সবাই বলে উনি ছেলে ভালো।দ্বিতীয়ত দাদাভাইয়ের বন্ধু।সত্যি বলতে এমনিতেই উনি ছেলে ভালো।তবে…

তবে বলে থেমে গেলো মান্যতা।আর একটা শব্দ মুখ থেকে আর করলোনা।কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে চুপচাপ রইলো কৌড়ি।হয়তো সেই তবের পরে রয়েছে মান্যতার ব্যাক্তিগত কোনো বিষয়।যা সে বলতে চায়না।কৌড়িও আর খুঁচিয়ে শুনলো-না।খুঁচিয়ে শোনা তার স্বভাব, পছন্দ কোনোটাই নয়।তাই চুপচাপ মুখ ফিরিয়ে সে-ও মান্যতার মতো উপরের দিকে তাকালো।মান্যতার প্রশ্নের উত্তর কি দেওয়া উচিত এটাও ভেবে পেলোনা।যেখানে প্রশ্ন উত্তর সবই আপুর কাছে রয়েছে। সেখানে আলাদা কি সদুত্তর দেবে!বুঝে আসলোনা।তবুও তাকে বিশেষ কেউ ভেবে যখন প্রশ্ন শুধিয়েছে উত্তর দেওয়াটা কৌড়ির মনেহলো অনিবার্য।

‘ তৃনয় ভাইয়া সত্যিই খুব ভালো ছেলে আপু।আমার সাথে যে কয়বার দেখা হয়েছে কখনো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেন নি।নিজের দৃষ্টি সংযত রেখে সবসময় কথা বলেছেন। বিষয়টা আমার ভিষন ভালো লেগেছে। আর ব্যবহার!তন্ময়ী আপুর যেমন অমায়িক, অসাধারণ, উনারও।সেখানে আমার থেকে তো তুমি উনাকে বেশি ভালো জানো।আর সবদিক থেকেই তো ভাইয়া দারুন গুনের অধিকারী।সেখানে একটা মেয়ের আর কি চাই বলো-তো!ওমন ছেলেই তো মেয়েরা জীবন সঙ্গিনী হিসাবে চায়।আমিও চেয়েছিলাম।পেয়েছি।আর দ্বিতীয়ত উনি তোমার দাদাভাইয়ের বন্ধু।শুনেছি অনেক বছরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।সেখানে তোমার দাদাভাইয়ের মতো স্বামী পাওয়া ভাগ্য। যেকোনো নারীর সৌভাগ্য।সেখানে তাঁর বন্ধু নিশ্চয় তার মতো।তা-না হলে এতোবছর বন্ধুত্ব টিকতো-না। থাকতো না।আর তার স্ত্রী হলে তুমি কি সৌভাগ্যবতী হবেনা?যেমনটা আমি হয়েছি।বাদবাকি ভাগ্যের উপর।সৃষ্টিকর্তা যা লিখেছেন ভাগ্যে,তাই তো হবে নাকি!আর ত্রুটি তো মানুষের মধ্যেই থাকে তাইনা?ভুল, অন্যায়,ত্রুটি, অপরাধ তাদের দ্বারাই হয়।এসব তো তাদের জন্যই সৃষ্টি!আর এসব নিয়েই সংসার!বেহেশত ছাড়া আমার মনেহয় নিখাঁদ সংসার পৃথিবীতে নেই।সুতরাং ভাগ্যকে সংবরণ করা থোড়াই না আমাদের হাতে!তারমধ্যে নিজের ভালো কোনটাতে হতে পারে,হবে,ভেবেবুঝে নিতে হয়।জ্ঞানী বুদ্ধিমান নারীরা কখনো তারজন্য ভালো কিছু পেলে,তা কখনোই জেনে-বুঝে হাত ছাড়া করেনা।

মান্যতা অবাক হয়ে কৌড়িকে দেখতে থাকলো।একটা বাচ্চা মেয়ে! অথচ এতো বুঝজ্ঞান তারমধ্য!হয়তো পরিস্থিতি তাকে সময়ের আগে এতো বুঝতে জানতে বাধ্য করেছে!চুপচাপ থাকা সল্পভাষী মেয়েটা এতো কথাও মনেহয় এই প্রথম শুনলো মান্যতা। মান্যতা তার পানে চেয়ে আছে বুঝে পাশ ফিরে তারদিকে তাকালো কৌড়ি। মৃদু হেসে বললো –তোমার জীবন সঙ্গীনি হিসাবে তৃনয় ভাইয়া বেস্ট হবে।তবে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত একান্ত তোমার।তুমি যেটা ভালো মনে করবে সেটাই হবে।

মান্যতা মাথা সোজা করে চোখ বুঁজে নিলো।কি ভেবে নিজের হাতের পাশের কৌড়ির হাতটা ধরে নিয়ে বুকে চেপে নিলো।মৃদুস্বরে বললো—দাদাভাইকে খুব ভালো রাখিস বউমনি।খুউব।

ওই মানুষটার জন্য সবার যেনো একটাই অনুরোধ,একটাই আর্তনাদ!কেনোযে,কৌড় কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেনা!শুধু এটুকু বোঝে,এই মানুষগুলো ওই মানুষটাকে খুব ভালোবাসে।খুউব।কৌড়ি একটু সরে এসে মান্যতা গা ঘেঁষে শুলো।ফের মান্যতার বুকের মধ্যে জড়িয়ে রাখা হাতটার উপর অন্য হাতটা রেখে আশ্বাস দিলো।তা বুঝে এবার শক্তপোক্ত বাঁধনে কৌড়ির দু-হাত চেপে ধরলো মান্যতা।তবে চোখ খুললো না।ওভাবে চুপচাপ শুয়ে রইলো দুজনে কতক্ষণ!

সারদিন গিয়ে রাত এগোরোটার দিকে বাড়িতে এলো নিভান।ড্রয়িংরুম পার করতেই জমজমাট ডাইনিং রুমের দিকে একপলক তাকালো।রাতের খাবারে ব্যস্ত সবাই সেখানে।সেই একপলকেই বুঝে নিতে পারলো তার বউয়ের অস্তিত্ব ওখানে নেই।সারাদিনে মেয়েটার সঙ্গে কথা হয়নি।খুব ব্যস্ত ছিলো নিভান।মায়ের সঙ্গে অবশ্যই কয়েকবার কথা হয়েছে। কখন আসছে সে?তন্মধ্যে রাতে সবাইকে ডাইনিংয়ে খেতে দেওয়ার আগেও মা ফোন দিয়েছিলেন।কখন আসছে সে?নিভান বলেছিল, জ্যামে আঁটকে আছে সে।আসতে দেরী হবে।সেই ভাবনা মতোই হয়তো মা সবাইকে খেতে দিয়েছেন।ভাবনার একপর্যায়ে রুমে ঢুকলো নিভান।ঝকঝকা লাইটের আলোয় কোথাও কারও অস্তিত্বের গন্ধ পেলোনা সে। বুঝতে পারলো বউটা তার রুমে নেই।তবে গেলো কোথায়? গায়ের ব্লেজার গলিয়ে শার্টটা খুলতে খুলতে চারপাশে আরও একবার নজর ফেললো।নজর পুনরায় হতাশ হলো।শার্ট ছেড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো সে।সময় নিয়ে গোসল সেরে বের হলো।তখনো রুমটা ফাঁকা। কারও আসার কোনো সাড়াশব্দও পেলো-না।নিঃশব্দে শ্বাস ফেলে মাথা মোছায় মনোযোগ দিলো।মাথা মুছে পুনরায় গায়ে টিশার্ট জড়ালো।মাথার চুলগুলো কোনোরকম হাত দিয়ে ঠিকঠাক করে নিচে নেমে গেল।ততক্ষণে ডাইনিংয়ে সবার খাওয়া শেষ। যে যার রুমে চলে গেছে।তবুও নজর একবার চারপাশ থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসলো নিভান।কোথাও কেউ নেই।শুধু মা রান্নাঘরে কিছু করছেন।

‘ নিভান এসেছিস?আচ্ছা বোস,খাবার দিচ্ছি।

হঠাৎ নিভান শুধালো—সবাই খেয়েছে মা?

নিভানের প্রশ্নের কারণ ধরতে না পারলেও,নিজ গতিতে হাতের কাজ সারতে সারতে উত্তর দিলেন নীহারিকা বেগম–হ্যা, সবাই খেয়েছে।শুধু কৌড়ি খায়নি।ওর নাকি ভালো লাগছেনা খেতে।তোর নানুমাকে খাবার দিতে গিয়ে ডাকলাম,কিছুতেই খেতে আসলো-না।বকাবকিও করলাম তবুও শুনলোনা।

নিভান বুঝলো বউটা তার কোথায় আছে।দ্বিতীয়ত আর মায়ের কথায় প্রতিত্তোর করলোনা সে।নীহারিকা বেগম ছেলের জন্য রান্নাঘরে খাবার গুছিয়ে রাখছিলেন, ইতিমধ্যে নিভানকে আসতে দেখেই খাবারগুলো এনে তার সম্মুখে দিলেন।খাবার সম্মুখে আসতেই,খাবারে মনোযোগ দিলো।মা’কে পুনরায় রান্নাঘরে দিকে যেতে দেখে ডাক দিলো নিভান।।–‘মা।

নীহারিকা বেগম পিছু ফিরলেন।বললেন—কি হয়েছে? কিছু লাগবে?

‘না।তুমি খেয়েছো?

নিভান না খেলে তিনি কখনো খেয়েছেন কি-না মনে নেই।নিভান বাড়ির বাহিরে থাকলে হয়তো দৈবিসই খেয়েছেন।তবে নিভান বাড়ির বাহিরে থাকলেও,তিনি ফোন দিয়ে খোঁজ নিয়েছেন,ছেলে খেয়েছে কি-না?তার হ্যা না উত্তরে তারপর মুখে খাবার তুলেছেন।তবুও ছেলে জিজ্ঞেস করতেই বরাবরই খাবেন,খেয়েছেন এরকমটা বলে এড়িয়ে যান।আজও অন্যথা হলোনা।এড়িয়ে যাওয়ার ভঙ্গিতেই বললেন–রাত কতো হয়েছে দেখেছিস?সাড়ে এগারোটা বাজতে চললো।তোদের তো কাজের শেষ হয়না তাই বলে এতোরাত করে এখনো কেউ না খেয়ে বসে থাকে।

‘আমার সঙ্গে অল্প খাবে, মা?তোমাকে হাতে মাখাতে হবেনা, আমি খাইয়ে দেবো নাহয়।

অনেকদিন পর এরকম আবদার!ফেলতে পারলেন না ছেলের আবদার।হয়তো নিভান বরাবরের মতোই বুঝে গিয়েছে তিনি খাননি।মাতৃহৃদয় আবেগাপ্লুত হলো।অথচ পা নড়তে চাইলোনা।

‘এসে বসো।

নীহারিকা বেগম নিজের আবেগ ঢাকতে বাহানা ছুড়লেন–‘রান্নাঘরে কাজ আছে তো!

‘সকালে রানীসাহেবা করে নেবে।

যেখানে মন চাইছে দ্বিতীয়ত আর বাহানা জুড়লেন না।
নীহারিকা বেগম গোটা গোটা পায়ে নিভানের পাশাপাশি চেয়ারে এসে বসলেন।বললেন–তুই খা।আমি তোরসঙ্গে
আবার খেয়ে নিচ্ছি।

‘চেয়ারটা ঘুরে নিয়ে বসো।আমিই খাইয়ে দিচ্ছি।

নিভানের অনড় সিদ্ধান্তে চেয়ারটা ঘুরে নিয়ে বসলেন নীহারিকা বেগম।নিজেকে ক্ষনিকের জন্য মনেহলো ছোটোবাচ্চা।হ্যা, নিভানের আদেশে মন থেকে তেমনটা অনুভব করলেন তিনি।ক্ষনিকের জন্য সত্যিই বনে যেতে ইচ্ছে করলো,সামনের ছেলেটার সন্তানতুল্য হয়ে যেতে।
অথচ সেই সন্তানের জন্ম দেওয়ার প্রায় ত্রিশ বছর পার হয়ে গেছে। চুলে পাক ধরেছে উনার।চেহারার জৌলুশতা কমে গিয়ে সারাঅঙ্গে বাতব্যাথা জেগেছে।সেই ছেলে বিয়ে দিয়ে নাতী-নাতনী হওয়ার সময়ও চলে এলো।অথচ মন সাজতে চাইছে নাদান বাচ্চা!মনেমনে নিজের প্রতি হাসলেন নীহারিকা বেগম।

‘মা, খাবার নাও।

মৃদু চমকে নিভানের মুখের দিকে তাকালেন তিনি।চৌকস শ্যামবর্ণের স্বাভাবিক কি সুন্দর মায়াময় একটা মুখ।নিভান জন্মের পর অনেকেই কানাঘুঁষা করে বলতেন–নীহারিকার পাশে যেমন তার বরকে মানায় না তেমন ছেলেটাও হয়েছ বাবার মতো।নীহারিকার কোলে মানায় না।সাধারণ রঙের কারনেই এসব বলতো সবাই এটা উনি জানতেন। অথচ উনি চেয়ে চেয়ে দেখতেন।আর উনার মাতৃমন,মনতাময়ী সত্তা বলতেন–না।ছেলেটা যেনো একটু বেশিই উনার কোলে মানায়।খুব মানায়।

‘খাবে-না?

হুঁশ ফিরলো যেনো!তড়িৎ হা করলেন তিনি।নিভান সযত্নে গালে লোকমা তুলে দিলো।অথচ উনি চাবালেও গিলতে পারলেন না।মনেহলো,গলায় কিছু একটা দলাপাকিয়ে আছে।যা খাবার গিলতে বাধাসৃষ্টি করছে।
নিভানও মায়ের মুখে খাবার দেবার পরপরই নিজের মুখে একলোকমা তুলে নিলো।তা চেয়ে চেয়ে দেখলেন নীহারিকা বেগম।কি নির্বিকার আচারণ।সত্যিই যেনো সন্তানকে গালে তুলে খাওয়াচ্ছে আর নিজে সেই একই এঁটো খাবার থেকে খাচ্ছে!যা তিনিও নিভানের ছোটোবেলায় করেছেন।অথচ তফাৎ আজ সময়ের, ব্যাক্তির।সেই ব্যাক্তির এই কাজটা করতে না আছে দ্বিধা সংকোচ, না আছে অযত্ন অবহেলা।কোনোমতে খাবারটা গলা থেকে নামিয়ে পেটে চালান করলেন নীহারিকা বেগম।অনেকদিনের মনের মধ্যে জমে থাকা একটা প্রশ্ন অ,তিনি শুধাতে সাহস পেতেননা।পাছেই কি না কি উত্তর শুনতে হয়।আজ তা সাহস করে শুধালেন।

‘আমার উপরে তোর খুব অভিমান,অভিযোগ তাই-না নিভান?মা তোকে ঠিকঠাক আদর ভালোবাসা দিতে পারিনি। সময় দিতে পারিনি।তোর শখ ইচ্ছের গুলোর গুরুত্ব দিতে পারিনি।বিনিময়ে শুধু দিয়ে গেছে অবহেলা আর অযত্ন!

খাবার মাখানো আঙুলগুলো হঠাৎই ক্ষনিকের জন্য থেমে গেলো নিভানের।পরমূহর্তেই তা আবার সচল হয়ে খাবার মাখাতে থাকলো।লোকমা বানিযে সম্মুখে ধরে চোখ দিয়ে ইশারা করলো নিভান নিতে।নীহারিকা বেগম বাধ্য মেয়ের মতো নিলেনও।তবে অপেক্ষা করলেন নিভানের উত্তর। নিভান উত্তর দিলো রয়েসয়ে। মায়ের মুখে খাবার তুলে দিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত সচ্চ এক বাচ্চাদের মতো ভুবন ভুলানো চমৎকার একটা হাসি দিলো।ফের বললো–

‘অভিমান অভিযোগ ছিলোতো!খুব অভিযোগ ছিলো!তারসাথে যোগ হয়েছিলো অভিমানেরাও।কেনো আমার মায়ের আবার বিয়ে হবে!সবাই বলেছিলো তো,আমার মায়ের আবার বিয়ে হলে আমার মা আর আমার থাকবেনা।বাবাতো নেই মা থেকেও থাকবেন না।
সত্যিই তো থাকিনি!কেউ কেউ এসবও বলেছিলো, আমার মায়ের বিয়ের পর নতুন সংসার হবে,সেই সংসারে মা ব্যস্ত থাকবেন।আমাকে ভুলে যাবেন।অযত্ন অবহেলা ছাড়া তখন আর আমার কিছু জুটবেনা।সত্যিই তো অবহেলা অযত্নরা আমার সঙ্গী হয়ে গেলো!
আমার মায়ের থেকে পাওনা ভালোবাসা যত্নরা গেলো বাবার মতো হারিয়ে!আচ্ছা সেই বাবা হারানো ছেলেটার কি মায়ের উপরে তখন অভিযোগী অভিমানী হওয়া উচিত ছিলো না?ছিলো কি জানিনা।তবে সেই ছোট্টো অবুঝ মনে একটু একটু করে অভিযোগ বাসা বেধেছিলো,সঙ্গে জন্মেছিলো একরাশ অভিমানেরা।

একটু থামলো নিভান।মায়ের ফাঁকা গালে পুনরায় আরেক লোকমা খাবার গুঁজে দিয়ে ফের বলতে শুরু করলো–তবে সেই অবুঝ ছেলেটা তখন বুঝিনি তাকে ফেলে তার মা দ্বিতীয় আর কারও ঘরোনি হতে চায়নি।বিয়ে করতে চাইনি অন্য কাওকে।অবুঝ ছিলো কি-না ছেলেটা!ছেলেটা এটাও বুঝিনি সেই অবলা অসহায় নারী,তার পরিবারে কাছে, তার সমাজের কাছে,তার বয়সের কাছে নিরুপায় ছিলো!বাধ্য হয়েছিলো তার আদরের সন্তানকে রেখে অন্যত্র বিয়ে বসতে!জোর করা হয়েছিলো তাকে।অথচ হতভাগ্য সন্তান আমি, আমার নিরুপায় মা’কে বোঝার ক্ষমতা, বয়স তখন আমার হয়নি।তারপর আমার মা যখন পুনরায় সংসারী হলেন,সেই সংসারে ভাগ্যবশত আমারও ঠাই হলো।যদিও ঠাইটা করে নিয়েছিলেন আমার মা,তার সুখের বিনিময়ে!শর্ত জুড়েছিলেন,আমার দ্বিতীয় বাবাকে।পুনরায় দ্বিতীয় সংসারে উনার আদরের সন্তানকে ছাড়া কিছুতেই তিনি বিয়ে বসবেন না তিনি। সন্তুষ্ট চিত্তে রাজী হয়েছিলেন আমার পিতৃতুল্য মানুষটা।আমি বাবাহারা সন্তান বাবার পরে মায়ের মমতালোভী ছিলাম তো!মায়ের প্রতি অভিযোগ অভিমান জমলেও মায়ের সঙ্গ ছাড়তে পারলাম না।অথচ মায়ের সংসারে ঠাই হলেও, সবার সঙ্গেসঙ্গে মায়ের আদর ভালোবাসাও নুইয়ে এলো।তবে মায়ের সঙ্গে থাকতে পারছি তো!এই পরম ভাগ্য!নতুন সংসারে মায়ের বেখেয়াল অযত্ন,তাকে কাছে না পাওয়া,মায়ের প্রতি আমার অভিমান অভিযোগ বাড়িয়ে দিলো।অথচ দুর্ভাগা অবুঝ সন্তান আমি তখনো বোঝার ক্ষমতা হয়নি ,আমার মায়ের নতুন সংসার হয়েছে!তিনি তখন আমার মা বাদেও কারও বউ কারও ভাবী কারও বউমা,কারও মামি চাচি হয়েছেন।উনার দায়িত্ব খেয়াল তখন আর শুধু আমাতে আঁটকে নেই!তিনি আর তখন শুধু আমার মা-তে আঁটকে ছিলেন না!উনার দায়িত্ব বেড়ে গেছে।শত চেয়েও তিনি আর পারেননা,তার বাবাহারা সন্তানটাকে একটু বেশি খেয়ালে রাখতে!একটু বেশি বেশি আদর যত্ন ভালোবাসা দিতে!কাছে রাখতে!আমার মতো ভাবতেন হয়তো,সন্তান কাছে আছে এই ঢেড়!তবে যখন বুঝতে শিখলাম,জানলাম তখন অনুভব করলাম আমার মায়ের প্রতি আমার অভিমান অভিযোগেরা মাত্রই নিছক।আমার চোখের আড়াল তিনিও সন্তানকে কাছে না পাওয়ার কষ্টে কাঁদেন। ছেলেকে খাবার খোঁটা দিলে তিনিও খান না।ছেলের অযত্ন অবহেলায় তিনিও ব্যাকুল হন।মূর্ছা পড়েন।ছেলের শখ আহ্লাদ ইচ্ছেগুলো হারিয়ে যাওয়ায় তিনিও ব্যথিত হন। আত্মগ্লানিতে ভোগেন!অথচ তিনিতো সেই নারীজাতি যে,নারী শত কষ্ট,বাধাবিপত্তি,নিজের মৃতুসঙ্গ নিয়ে সন্তান পেটে লালিতপালিত করেও,আহ শব্দ মুখ থেকে বের করেন না।তিনি নিজের কষ্ট ব্যথাগুলো কি করে সন্তানকে বলবেন?জানতে দেবেন?কিন্তু আমি সন্তান আমারওতো দ্বায় থাকে বাবা মা’কে বোঝার।তাই আমার মতো করে আমিও বুঝে নিয়েছি।আমার মায়ের বিরুদ্ধে নিছকই মনে গাঁথা অভিমান অভিযোগগুলো ধুইয়ে মুছে নিয়েছি।

কথা শেষ করে নিভান আবারও একটা স্বতঃস্ফূর্ত হাসি দিলো।সচ্ছ পরিচ্ছন্ন মৃদু হাসি।যে হাসিতে ঠোঁট প্রসারিত হলো অথচ দন্তের দেখা মিললো-না।ফের চড়ুইয়ের মতো হা করে নিজ মুখে ভাত তুলে নিলো।ছেলের মায়ামাখা হাসি,খাবার তুলে নেওয়া চেয়ে চেয়ে হতবিহ্বল চোখ দেখলেন নীহারিকা বেগম।নিভানের তো উনার সম্পর্কে ভিতরের এতো কিছু জানার কথা নয়!তবে জানলো কি-করে?সপ্রশ্নের সাথে সাথে উত্তরও যেনো নিজেই দিলেন।হয়তো নিভানের নানুমা নয়তো জাহিদ সাহেব জানিয়েছেন।এই দুজন মানুষ ছাড়া তো এসব কথা কেউ জানেনা।সেদিকে আর ভাবতে গেলেন না তিনি।তবে অবাক হয়ে বুঝদার,ধৈর্য্যশীল ছেলেকে দেখতে থাকলেন।যদিও ছেলের ধৈর্য্য সহ্য সম্পর্কে উনার ধারনা আছে।তাই বলে ওই বাচ্চা নিভান ভিতরে ভিতরে এতো অভিযোগ অভিমান জমা করে রেখেছিলো!আজ হয়তো ওর মনে অভিমান অভিযোগ নেই।কিন্তু একটা সময় উনার বিরুদ্ধে এতো এতো অভিযোগ জমেছিলো!যা ছেলেটা কখনো মুখের কথা দ্বারা হোক বা নিজের ব্যবহার দ্বারা,কখনো বহিঃপ্রকাশ করেনি। সব চেপে রেখেছিলো নিজের বুকের ভিতর হৃদয় গহীনে!

‘তুই বিশ্বাস করিস,আমি তোর বাবার থেকে তোকে একচুলও কম ভালোবাসিনা?

মুখ তুলে চাইলো নিভান।মায়ের ভারী কন্ঠস্বর!চোখের কিনারা ঘেঁষে জল থৈথৈ!একটু-ও ভালো লাগলো-না। এমনিতেই মা’কে ব্যাথা দিয়ে কথা বলার আগেই তার গলা রোধ হয়ে যায়।বিবেক বাঁধা সৃষ্টি করে!বুকে কাঁপন তোলে।যার কারনে শত অভিযোগ অভিমান পুষলেও মায়ের বিরুদ্ধাচারণ করে একটা কথাও ঠোঁটের আগায় আনিনি কখনো নিভান।আনতে পারিওনি!সেই মায়ের চোখে জল!ডানহাত এঁটো থাকায় বাম হাত বাড়িয়ে দিয়ে মায়ের চোখের জল মুছে দিলো নিভান।অমায়িক দৃঢ় কন্ঠে বললো।

‘এতো বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্ন আসছে কেনো!মা তুমি আমার।তুমি ভালোবাসলেও আমার মা,না বাসলেও আমার মা।একটু কমবেশি ভালোবাসলে কি তুমি মা, আমার মা থাকবেনা? বাতিল হয়ে যাবে?না-তো!আমার মা তো আমারই থাকবে।সেখানে এতো বিশ্বাস অবিশ্বাস দিয়ে কি হবে।তবে তোমাকে কিন্তু আমি বাবার থেকে একটু কম ভালোবাসি।এই বিশ্বাসটা নিশ্চয় পুষে আছে মনে?

‘থাকবেনা কেনো!সত্যিই তো তুই আমার থেকে তোর বাবাকে বেশি ভালোবাসিস।

মায়ের বিশ্বাসভরা দৃঢ়কন্ঠের বাচ্চামোতে নিভান আবারও হাসলো।এবার ঝলমলে দন্তের কিছুটা অংশ দেখা গেলো।সহসা খাবার রেখে হঠাৎ দু-হাত দু’দিকে প্রসারিত করলো নিভান।নীহারিকা বেগমের সেই কাছে ডাকার আহ্বান একটু বুঝতে সময় লাগলো। আর বুঝে উঠতেই হুড়মুড়িয়ে পড়লেন ছেলের বুকে।এবং মৃদু শব্দ করে কেঁদেই ফেললেন।নিভান কতো যত্নের আহ্লাদের ছেলে ছিলো আওসাফের।আর সেই ছেলেকে তিনি কতো অযত্নে অবহেলায় মানুষ করলেন!নিভান মায়ের মাথা হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করলো।ফের বললো–তুমি যেমন আমাকে বাবার থেকে একচুল কম ভালোবাসোনা।আমিও তোমাকে বাবার থেকে একতিলও কম ভালোবাসিনা।অভিমান অভিযোগ যাই থাকুক না কেনো মনে,খুব ভালোবাসি মা।

নীহারিকা বেগম নিভানের সেকথায় বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখালেন না।বরং নিজের মনের মধ্যে চলা আকুলতা প্রকাশ করে বললেন।

‘পরকালে আমি তোর বাবার সম্মুখে গিয়ে কি করে দাড়াবো নিভান?তার এতো আদরের ছেলেকে আমি যে নিজের সুখের জন্য বড্ড অবহেলায় মানুষ করেছি,তার কি জাবাব দেবো?এবার তোর বাবার কবর যিয়ারত করতে গেলে,তারকাছে আমার হয়ে একটু ক্ষমা চেয়ে নিস বাবু।নাহলে যে আমাকে তার সামনে গিয়ে কঠিন অপরাধী হয়ে দাড়াতে হবে!

‘আর তোমার নামে সালিশ নিয়ে গেলে বুঝি বাবা আমাকে ছাড়বেন!বাবা কি তোমাকে কম ভালোবাসতেন!নিশ্চয় তিনি তোমার পরিস্থিতি বুঝবেন।আর পরকালে যদি আমাদের একসাথে থাকা হয়।তিনি কখনো তোমাকে দোষী ঠাওরাবেন না।আমি দোষী ঠাওরাতে দেবোনা মা।বাবাকে খুব ভালোবাসী তাই বলে তোমাকে কম নয়।এইযে তুমি কাঁদছো না,বাবা এটাতে আরও আমার উপর অসন্তুষ্ট হবেন।কেনো আমি তোমার চোখে জল আসতে দিলাম!

বলতে বলতে নিভানের গলার স্বরও কেমন রুদ্ধ হয়ে এলো।মা ছেলের এই আবেগঘন দৃশ্য আরও একজন দেখলো।সিঁড়ির গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে ইভান নিষ্পলক চোখে দেখে গেলো।সামন্য বিষয়েও সে মা বাবাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। আঙুল তুলে অভিযোগও করেছে।অথচ তার চাওয়া পাওয়া কখনো কি অপূরনীয় রেখেছেন বাবা মা?রাখেন নি!বরং চাওয়ার আগেই সবকিছু পেয়ে গিয়েছে সে।অথচ দাদাভাই পেয়েছে কি!
হয়তো এখন সাফল্য তার নাকের ডগায়।তাকে চেনে সবাই একনামে।তবে সাফল্য তো সবকিছু নয়।সাফল্যর বাহিরে একটা পরিবার থেকে যে আদর ভালোবাসা তার পাওয়ার কথা ছিলো,তা তো সে পায়নি।বরং বিনিময়ে কতোকিছু সহ্য করেও মুখ থেকে কখনো একটা কটুবাক্যও বের করেনি।মায়ের প্রতি তীব্র অভিমান অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও,তা কখনো প্রকাশ করেনি।বাবা মায়ের বিরুদ্ধাচারণ করিনি।চুপচাপ সব সয়ে গেছে!সেই ওইটুকু বয়স থেকে এতোকিছু!সইলো কিভাবে !সে পারতো?কখনোই না!কেনো সে দাদাভাইয়ের মতো হতে পারিনি!আসলে কি সবাই নিভান হতে পারে?পারেনা!নিভান হয় হাজারে একজন।একশো পার্সেন্টেজে দশজন।সেই দশজনের একজন তার মায়ের ছেলে আর তার দাদাভাই নিভান।তার দেখা শ্রেষ্ঠ ভাই।

মা’কে এতো এতো স্বান্তনা বানি আওড়িয়ে চুপ করিয়ে, খাইয়ে,নিজে খেয়ে তারপর এবার বউয়ের উদ্দেশ্য পা বাড়ালো নিভান।সে বাড়িতে এসেছে মেয়েটা শোনেনি?
না-হলে তার দেখা নেই কেনো?নাকি ঘুমিয়ে পড়েছে?
ঘুমিয়ে পড়লে তো মুশকিল! তবে নানুমার সম্মুখ দিয়ে কিভাবে নিয়ে আসবে মেয়েটাকে?আর ইদানীং ওই মেয়েটাকে ছাড়া নিভানের দিন-রাত!উফফ!নানুমার রুমের দরজা মৃদু খোলা।ভিতরে ফকফকা লাইট জ্বলছে।সেই মৃদু ফাঁক থেকেই দেখা গেলো,নানুমা পায়ের সঙ্গে পা জড়িয়ে বেড হেলান দিয়ে বসে আছেন।আর তারপাশে কৌড়ি ঘুম।ঘুম নাকি চুপচাপ চোখ বুঁজে শুয়ে আছে নিভান বুঝতে পারলোনা।দরজায় মৃদু শব্দ করে অনুমতি চাইলো নিভান।

‘নানুমা আসবো?

বৃদ্ধা চোখ তুলে তাকালেন।হঠাৎ মুখে মৃদু হাসি ফুটলো উনার।বললেন—এসো এসো।

নিভান ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো–খবর কি?শরীর ঠিকঠাক আছে তো আপনার?

ভদ্রমহিলা একটু রসিকতা করে বললেন –আমার খবর নিতে এসেছো নাকি বউকে?

‘দুটোই।এবার বলুন শরীর ঠিক আছে আপনার?

‘আলহামদুলিল্লাহ। তোমার কি খবর?

‘আলহামদুলিল্লাহ।

নিভান এরমধ্যে কৌড়িকে দেখলো।মেয়েটা ঘুমে বিভোর।আজ চারদিনে নিভান খুব ভালো করে বুঝে গিয়েছে, তার বউটা ভিষণ ঘুমকাতুরে।ঘুম পেলে সে জায়গা দেখেনা, ঘুমিয়ে পড়ে।কাল কি সুন্দর শান্ত বাচ্চাদের মতো তার বুকের উপর ঘুমিয়ে থাকলো। যতক্ষণ না নিভান নিজ থেকে নাড়ালো ততক্ষণ মেয়েটা নড়েনি।চুপচাপ তাকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে থেকেছে।আজ চারদিনে বুকের ভিতরের সাথে সাথে বাহিরটাও জুড়ে নিয়েছে মেয়েটা।মেয়েটার স্পর্শ না পেলে যেনো প্রশান্তি পাওয়া যায়না।

‘রাত তো অনেক হয়েছে, এখনো জেগে আছেন?শরীর খারাপ করবে তো!ঘুমিয়ে পড়ুন।

নিভান উঠে দাড়ালো।নানুমার সম্মুখ দিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।লজ্জা এমনটা নয়।তবে সমীহ বলে একটা কথা তো থেকে যায়।সম্পর্ক যতোই কাছের থাকুক না কেনো,সমীহের দেয়াল কখনো কোনো সম্পর্কে ভঙ্গ করেনি নিভান।সব সম্পর্কে সম্মান,স্নেহ শ্রদ্ধাবোধের সাথে সাথে সমীহটা বজায় চেষ্টা করেছে।আজ নাহয় না ঘুমালো সে!কথা বলতে নানুমার পাশে এসে বসেছিলো নিভান।সেখান থেকে উঠে কথাগুলো নানুমাকে উদ্দেশ্য করে বলে দরজার দিকে পা বাড়াতেই বৃদ্ধা ফের রসিকতা করে বললেন–‘বউ নিতে এসেছো। না নিয়েই চলে যাচ্ছো যে?

থেমে গেলো নিভান।মনটা উল্টো গান গাইলেও,পিছে ফিরে কৌড়ির দিকে তাকিয়ে বললো—ঘুমিয়ে আছে তো!নিয়ে যাবো কিকরে?

‘তবে এতো লম্বা চওড়া রিষ্টপুষ্ট শরীরখানা কিসের জন্য শুনি? একটা ফিনফিনে পাতলা মেয়েটাকে তুলে নিয়ে যেতে পারবেনা!’তা তাকে এখান রেখে ঘুম হবে তো তোমার?

নানুমার রসিকতায় এবার মৃদু হাসলো নিভান।বললো —
‘চেষ্টা করে দেখি।

‘চেষ্টা করতে হবেনা বাপু।তোমার বউ তুমি নিয়ে যাও।আমিও স্বস্তিতে থাকি তুমিও শান্তিতে ঘুমাও।

নিভান ঘুরে এগিয়ে এলো।যেখানে নানুমা নিজেই বলছেন সেখানে সমীহ দেখানোর আর প্রয়োজন পড়ে না।বেডের কাছ এসে কৌড়ির দিকে তাকিয়ে বললো—আমার বউটা তো শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে,সে আপনাকে অস্বস্তি দিলো কিকরে?

ভদ্রমহিলা হাসলেন।বললেন–এইযে তােমার বউয়ের বরটা যখন তখন এসে আমার রুমে হানা দিতে পারে,তারজন্য পাহারাদার হয়ে বসে আছি।এটা আমার স্বস্তি হরণ নয় বলছো?আর দ্বিতীয়ত আমার নাতি তার বউটাকে ছাড়া শান্তিতে থাকবেনা জেনে আমি কিকরে স্বস্তিতে থাকি মশাই?

‘তাই তো!আমার বউয়ের বরটার হয়ে এতো কিছু চিন্তা ভাবনা করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ভালোবাসা নানুমা।

নিভান মৃদু হাসলো।মাথা নিচু করে ধপ করে পাতলা শরীরটাকে কোলে তুলে নিলো সে।ভদ্রমহিলা এবার রসিকতা ছেড়ে বেশ অমায়িক নম্রসূলভ কন্ঠে বললেন–ও-কে খাইয়ে দিয়েছি আমি।খেতে চাইছিলো না,তবুও জোর করে কয়েক লোকমা খাবার খাইয়ে দিয়েছে।রাতের ঔষধটা খাওয়া হয়নি তবুও ওর ঘুমটা ভেঙো না।কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়েছে।হয়তো শরীরটা ভালো লাগছিলো না তাই। ঘুমটা প্রয়োজন।

নিভান মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে নানুমার রুম থেকে বের হলো।রুমের বাহিরে পা রাখতেই কৌড়িকে বুকের সাথে শক্তবাধনে চেপে ধরলো।এতোক্ষনে মনেহয় শান্তি পেলো ভিতর বাহিরটাজুড়ে।খোলা বারান্দার করিডোরের আলোতে মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো,মেয়েটা তখনও ঘুমে বিভোর!শুধু ক্ষনে ক্ষনে ঘনো নিঃশ্বাস ছাড়া তার আর কোনো সাড়াশব্দ নেই।কিছু ছোটো খাটো এলোমেলো চুল চোখমুখ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।আনমনেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো নিভানের।মাথা নিচু করে পরপর নরম স্পর্শে চুমু খেলো বউয়ের কপাল,গালে।ফের কাব্যিক স্বরে আওড়ালো।

সুখের আড়ালে যাতনা ছিলো মন-পাড়াতে,
সেই যাতনা ভুললো মোর হৃদয়,তোমার আগমনে।
যাতনা ভুলিয়ে ডানা মেলে সুখ সুখ নিয়ে এলে তুমি।
সৌভাগ্যের পদচারণ হয়ে আমার জীবনে।

চলবে…..

#ফুলকৌড়ি
(৫৭)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

সারাদিনের অবসাদ ক্লান্তি এক নিমিষেই যেনো দূরীভূত হয়ে গেলো মেয়েটার সান্নিধ্যে পেয়ে।সামন্য স্পর্শের এতো শক্তি যে,একজন সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমী ব্যক্তিকে নিমিষেই সেই স্ত্রী স্পর্শদ্বারা শান্তি দিতে পারে!
ক্লেশে ভরা মনমস্তিস্ককে মূহুর্তেই প্রশান্তিতে ভরে তুলতে পারে!এতো মহাত্ম গুন দিয়ে সৃষ্টিকর্তা সৃজন করেছেন তাদের!তবে এজন্য কি প্রতিটি পুরুষের সঙ্গীনি করে একজন হালাল স্ত্রী নির্ধারণ করে দিয়েছেন প্রভু?আর তাদের মধ্যেই স্বামীজাতিদের শান্তি, সুখ, সমৃদ্ধি নির্গত করেছেন!যা সেই হালাল স্ত্রী মধ্যে খুঁজে নিতে বলেছেন অন্যত্র হারাম স্ত্রীর মধ্যে নয়!পুরুষের শারীরিক মানসিক শান্তি প্রশান্তির উত্তম সঙ্গীনি হওয়ায় কারনেই কি তবে সে অর্ধাঙ্গিনী?হ্যা তাই!নাহলে নিভানের অবসাদে ভরা ক্লান্ত শরীরটা কিকরে মহূর্তেই অবসাদ কেটে গিয়ে সতেজ স্নিগ্ধ হয়ে উঠলো!ক্লেশে ডুবে থাকা মস্তিষ্কটা হঠাৎই কিকরে পরম শান্তি শান্তি অনুভব করলো!আলগোছে হাসলো নিভান।হাতের বাঁধন দৃঢ় করে মেয়েটাকে আরও একটু কাছে টেনে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে জড়িয়ে নিলো।কৌড়িও একটু নড়েচড়ে আবার চুপ হয়ে গেলো।মাথার নিচে আরও একটা বালিশ এঁটে মাথা উচু করে সেই চুপচাপ ঘুমন্ত মেয়েটাকে দেখলো কিছুক্ষণ।এক টুকরো ঝলমলে চাঁদ যেনো তার বুকটাজুড়ে চুপচাপ শুয়ে আছে।আর তার কিরণে ঝলমলিয়ে উঠছে আশপাশটা!নিজের বুকের উপর রাখা কৌড়ির ফর্সা হাতটা নরম স্পর্শে নিজের হাতের মধ্যে নিলো নিভান।স্থির মুগ্ধ চোখে তা দেখলো কিছুপল।ফর্সা হাতে মেহেদী রঙটা মিলিয়ে এসেছে প্রায়!মেহেদীর রঙটা মিলিয়ে এলেও হাতের সৌন্দর্যতা মোটেও নষ্ট হয়নি।ফর্সা চিকনচাকন হাতটা বেশ আকর্ষণীয়।পুনরায় হাতটা বুকে চেপে ধরলো নিভান।মেয়েটা গভীরঘুমে বিভোর।তার ঘনো উষ্ণ শ্বাসগুলো বুকের সর্বত্র ছেয়ে যাচ্ছে।আপনমমেই চোখ বুঁজে নিলো নিভান।হঠাৎই ফোনটা বেজে উঠলো তার।হোয়াটসঅ্যাপে কেউ কল দিয়েছে।এতো রাতে আবার কে?চোখ খুলে,বেডটেবিলটা থেকে ফোনটা নিলো নিভান। কলদাতার নাম দেখে ঠোঁটে হাসি ফুটলো তার।পুনরায় হাত বাড়িয়ে বেডটেবিলটার উপরে থাকা ল্যাম্পস্যাডটা জ্বালিয়ে দিলো।ফের ভিডিও কলটা রিসিভ করতেই ওপাশের হাস্যজ্বল এক রমীনিকে দেখা গেলো।তিনি কথা বলার আগেই নিভান তাকে সালাম জানালো।সে উত্তর দিতেই নিভান বললো–আমার কথা মনে পড়লো তবে তোমার?

‘মনে পড়লো মানে?বিয়ের দিনও তো কথা বললাম।আজ দু’দিন তুই ব্যস্ত এজন্য কথা বলতে পারিনি।ঈশির কাছে শুনলাম,ওবাড়িতে গেছিস।তাই আর বিরক্ত করি নি।এখন তোর সাথে কথা বলার আগে ফুপির কাছে ফোন দিয়েছিলাম।শুনলাম বাড়িতে এসেছিস,তাই কল দিলাম।

‘আচ্ছা ঠিক আছে।স্যরি।আর এতো এতো কৈফিয়ত দিতে হবেনা।

‘স্যরি কি!তুই আমাকে মনে করে ফোন দিস কখনো?বরং আমিই তোকে ফোন দিয়ে খোঁজ নেই।দু’দিন ফোন দিয়ে খোঁজ নিলাম না ওমনি অভিযোগ?

নিভান হাসলো।তার বড়োমামার দুই মেয়ে।ছোটোজন ঈশিতা।আর ইনি বড়।নাম নিশিতা।এই দুই বোনের ভুমিকা তার জীবনে অস্বীকার্য।তাদের জীবনে তারা
তাকে এতো প্রায়োরিটি,এতো আদর যত্ন ভালোবাসা দিয়েছে।যা কখনো ভুলবার নয়।নিভান কখনো ভুলতে পারবেনা।নিশিতার অভিযোগে নিভান নরম গলায় বললো–আচ্ছা আবার ‘স্যরি।ওকে।

ইট’স নট ওকে।বিকজ আমি তোর বউকে এখনো দেখিনি।দেখিনি বললে ভুল।মান্যতা, ঈশি ওরা পিক পাঠিয়েছিলো।বাট আমার আদরের ভাইয়ের বউটাকে ছবিতে দেখে কি আর মন ভরে?সরাসরি এখনো দেখতে পায়নি।দেখার জন্য মনটা কেমন ছটফট করছে, তুই জানিস।বুঝতে পারছি এখন বাংলাদেশে অনেক রাত।তবুও তাকে দেখার উদ্বেগে এতো রাতে আমাকে ফোন দিতেই হলো।বিশ্বাস কর তোর বিয়েতে যাবার জন্য মনটা যে কি ছটফট করেছে,কি বলবো তোকে।পারলাম না।যাই হোক,ওসব বাদ দে।তা কৈ সে?দেখা আমাকে।

নিভান একটু অপ্রস্তুত হলো।বুকে শয়নরত রমনীকে একপলক দেখে নিয়েই পুনরায় ফোনে নজর দিলো।নজর ফোনে থাকলেও অনুভব করতে পারলো,কৌড়ি তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে।একহাতে তাকে কাছ থেকে সরানো সম্ভব নয়!নিভানও চাইছেওনা,কাছ
থেকে মেয়েটাকে সরিয়ে দিতে।তাই প্রসঙ্গ এড়াতে বললো—আপু,উদয় উচ্ছ্বাস কোথায়?আর ভাইয়া?কেমন আছে সবাই।

লন্ডনে তখন সন্ধ্যা ছয়টা।ড্রয়িংরুমের দিকে একপলক তাকালো নিশিতা।ফের বললো–ওরা সবাই ড্রয়িংরুমে।আমি ওদের জন্য নাস্তা রেডি করছি আর তোর সাথে কথা বলছি।যাই হোক ওদের কথা বাদ দে।
আরেহ দেখা ওকে।

চুলের আঁচে বসানো ফ্রাইপ্যানে কি যেনো ভাঁজছে নিশিতা।তা দেখতে পেলোনা নিভান।তবে বোনের সুশ্রী চেহারার কর্মব্যস্ততা অনুভব করতে পারলো বেশ।সময় নিয়ে বললো–ফোনের ভিডিও কলে দেখা আর পিকে দেখা, সেই সমান কথাই তো হলো।তা না করে তুমি একেবারে সামনাসামনি দেখো না-হয়।

‘সমান কথা নয়।বিয়ের সাজগোজে দেখা আর সাধারণভাবে দেখা সমান কথা নয়।আমারও কবে বাংলাদেশে আসা হবে তারও ঠিক নেই।ততদিন পর্যন্ত তাকে সামনাসামনি দেখার জন্য কি আমি বসে থাকবো?দ্বিতীয়ত বিয়ের সাজগোজের যে পিকগুলো আমি দেখেছি,তা দেখে আমার মন তৃপ্ত হয়নি।ঈশিতা আম্মা, সবাই তোর বউয়ের প্রশংসায় এতো পঞ্চমুখ!আমার তাকে দেখার তৃষ্ণা, তারসাথে কথা বলার ইচ্ছে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।আজ দুদিন তুই ব্যস্ত ছিলি,তাই চেয়েও কল দিয়ে ডিস্টার্ব করতে পারিনি।তৃতীয়ত আমার গোমড়ামুখো ভাইটা কোন চাঁদমাখা মুখখানা দেখে এতো পাগল হয়ে দু’দিনের মধ্যে বিয়ে করে নিলো,সেই চাঁদ মুখখানা আমিও একটু দেখি।

শেষের কথাগুলো একটু ফাজলামো করে মজার ছলেই বললো নিশিতা।বিনিময়ে নিভান মৃদু হাসলো।পুনরায় বাহানা দিয়ে বললো– ‘ও ঘুমিয়ে গেছে আপু।

‘তো।ঘুমালে নতুন বউকে দেখা নিষেধ নাকি।সত্যি বলতে সবার প্রশংসায় ওকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে ভাই।আরেহ দেখা না?আমি বুঝলাম না ওকে দেখাতে তোর সমস্যা কোথায়?

নিশিতার নাছোড়বান্দামীতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো নিভান।আসলেই তো তাকে দেখাতে সমস্যা কোথায়?যাই হোক দেখাতে সমস্যা কোথায় এটা যদি আপুকে সে বোঝাতে বা বলতে পারতো।আবারও একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে,
ফোন ঘুরিয়ে ঘুমন্ত কৌড়িকে দেখালো নিভান।এলোমেলো অবিন্যস্ত চুল ।সুন্দর একটা গোলগাল মুখ।ল্যাম্পস্যাডের কমলাভাব আলোতে সৌন্দর্যের উজ্জ্বলতা যেনো ঠিহরে পড়ছে।কি নিস্পাপ বাচ্চাদের মতো ঘুমিয়ে আছে মেয়েটা!

‘মাশাআল্লাহ।নজর না লাগুক কারুর।সবাই যে প্রশংসা করেছে আলহামদুলিল্লাহ তারচেয়ে খুবই সুন্দর।ভাই, ও নাকি খুব শান্তসূলভ?

বউয়ের প্রশংসায় হাসি মুখটা আরও একটু প্রসারিত হলো নিভানের।ফের নিশিতা প্রশ্ন করতেই হালকা মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিলো।সেটা দেখে নিশিতা বললো–আমার ভাইয়ের ব্যক্তিত্বের সাথে সাথে পছন্দও মার্জিত,রুচিশীল মনাতেই হবে।তবে তুই কিন্তু আমাদের সেই ভদ্র-সদ্র নিভান আর নেই।বেশ নির্লজ্জ হয়ে গেছিস!

এতোসময় ফোনের স্কিনে নজর রেখে কৌড়ির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেও,মেয়েটা কোথা শুয়ে আছে নজর পড়তেই চোখ সরিয়ে শেষের কথাগুলো বললো নিশিতা।সেটা বুঝে নিভান কিছু বলতে যাওয়ার আগেই নিশিতার পিছন থেকে পুরুষালী গলায় কেউ
বললো–ওর আর দোষ কোথায়?দোষ তো তোমারই।রাত চৌদ্দটার সময় নব বিবাহিত দম্পত্তিরদের ফোন দিয়ে এমনিতেই বিরক্ত করলে,তারউপর নাছোড়বান্দার মতো বউ না দেখে ছাড়বে-না।বান্দা এতো বাহানা দিচ্ছে তুমি তো শুনলেই না।বউ না দেখে ছাড়লেই না।এখন দোষ ওর উপর চাপাচ্ছো? ওকে দিচ্ছো?

‘এই তোমাকে উপদেশ দিতে এখানে ডাকা হয়েছে?তুমি আমার কথায় নাক ঢুকাতে আসলে কেনো?

‘যাক বাবাহ,সত্যি কথার কোনো ভাতই নেই।

‘জানো যখন তোমাকে উপদেশ দিতে ডেকেছে কে?আর নির্লজ্জামীগুলো তোমরা বোন জামাইরাই শিখাচ্ছো পড়াচ্ছো,আমাদের ভাইগুলোকে।আমি ঈশির থেকে শুনেছি,নিভান বিয়ের ঘোষণা দিতেই সজীব (ঈশিতার বর)ওকে আবোলতাবোল বলে শিখিয়ে লজ্জা ভাঙিয়েছে।তোমাদের মুখে তো সারাক্ষন নির্লজ্জ কথা লেগেই থাকে।সারাদিন কানে সেসব বাণি ঢুকতে থাকলে আমার ভাইয়ের আর কি দোষ!

‘তোমার ভাই নিরিহ!দোষ এখন সব আমাদের!আশ্চর্য!

দু’জনের ঝগড়া দেখে নিভান আশ্চর্য!যেকোনো টপিকে এরা এরকম ঝগড়া করে এটা সে জানে।তবুও এখন?ফোনের ক্যামেরা সে ঘুরিয়ে নিয়েছে অনেক আগেই।আশ্চর্য হয়ে দু’জনের ঝগড়া দেখতে থাকলো।একপর্যায়ে নিশিতার হাত থেকে ফোন নিয়ে ওর বর নিভানক উদ্দেশ্য করে বললো–

‘আশ্চর্য শালাবাবু তুমি তোমার আপুকে কিছু বলছো না কেনো?তুমি বলতে পারলে না, বিয়ের পর পাড়ার অতি ভদ্র সভ্য ছেলেটাও নির্লজ্জ হয়ে যায়।তাকে নির্লজ্জতা সেখানো লাগেনা।আর দ্বিতীয়ত যারা বউকে একটু বেশি ভালোবাসে তারা পারিবারিক সমাজে নির্লজ্জ বলেই আখ্যায়িত হয়।সুতরাং বিবাহিত পরবর্তী জীবনে কেউ নির্লজ্জ বললে কথা কানেই তুলবে না।ওকে।

নিভান প্রাণবন্ত হাসলো।ফের বললো–‘ওকে ভাইজান।

পাশ থেকে নিশিতা বললো–ইন্ধন জুগিয়ে আর তোমাদের মতো বানিওনা।

দুজনের কেউ কথা কানে তুললো না।তারা তাদের মতো কথা চালিয়ে গেলো–তা তোমার মিসেসের শরীর এখন ভালো আছে?আমাদের এখানে কবে আসছো শালাবাবু?

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো।আপনাদের ওখানে তাড়াতাড়ি যাওয়া হবেনা ভাইয়া।সামনে ওর এডমিশন আছে।আপতত তারও প্রস্তুতি নিতে হবে।আর আমার ঝামেলাটা তো জানেনই।তবে ওর এডমিশন পরিক্ষাটা হয়ে গেলে,দেখি কোথায় কি হয়।তারপর আসার চেষ্টা করবো।

‘চেষ্টা নয়।আসতেই হবে।আর আসার টিকিট কিন্তু আমার।তোমার আপু তোমাদের জন্য গিফট অলরেডি পাঠিয়ে দিয়েছে।আমার পক্ষ থেকে এখানে আসার টিকিটটা উপহারসরূপ তোলা রইলো।না বলতে পারবেনা।আর না বললেও আমি শুনছি না।ওকে।

‘আচ্ছা সে নাহয় দেখা যাবে।

‘দেখা যাবে কি তোমার বাচ্চা বউটার এডমিশন পরিক্ষাটা হয়ে যাক, তারপর আমিই দেখছি।

প্রতিত্তোর করলোনা নিভান।
মানুষটা অমায়িক চরিত্রের।বোনের থেকে কম স্নেহ যত্ন পায়নি নিভান,এই মানুষটার কাছে।মানুষটার প্রতি শ্রদ্ধা সম্মান এমনিতেই চলে আসে।যতোই সফলতায় ডুবে থাকুক,এসব মানুষের মুখের উপর যেকোনো বিষয়ে না বলে তাদের যত্নগুলোকে ছোটো করতে বা খোয়াতে রাজি নয় নিভান।সফল ব্যাক্তি হয়েও নিজকে বড় দেখাতে পারে না সে।আরও কিছুক্ষণ কথা চললো দুজনের মধ্যে।একটা সময় দু’জনের আলাপ শেষ হতেই ফোনটা ফের নিশিতা নিলো।নিভানকে বললো–ভাই ওকে আবার একবার দেখা।

‘তুমি আমাকে আবার নির্লজ্জ বলবে।

‘বলবো না। দেখা না!একটা কাজ বাকি আছে।

নিশিতার বাহানা দেখে ওঁর স্বামী ভদ্রলোক চলে গেলেন।নিভান এবার বিনা সংকোচে ফোনটা ঘুরিয়ে কৌড়ির দিকে ধরলো।ফোনের স্কিনে ঘুমান্ত সুন্দর মুখটা ভেসে উঠতেই মুখ এগিয়ে ফোনের স্কিনে কৌড়ির কপালে চুমু দিলো নিশিতা।ফের বললো–এই আদরটুকু ওর পাওনা ছিলো।হয়ে গেছে।এবার রাখ।আর কাল ওরসাথে আমাকে অবশ্যই কথা বলিয়ে দিস।পার্সেল রিসিভ করে জানাস,কেমন হয়েছে।

‘আচ্ছা ঠিক আছে।

‘রাখছি তবে।আল্লাহ হাফেজ।

ফোন কাটতে যাবার আগেই নিভান তাকে ডেকে উঠলো–আপু।

‘কি হয়েছে?কিছু বলবি?

‘স্যরি।

‘কেনো?তখন নির্লজ্জ বললাম তাই?আরেহ ওটাতো আমি এমনিতেই বলেছি।তবে এমনিতেই বললেই কি, আজ যেভাবে মেয়েটাকে আগলে রেখেছিস,সারাজীবন ওভাবেই আগলে রাখিস বাবু।

‘সেটার জন্য না।

‘তবে?

‘তোমাদের আসার অপেক্ষা না করে বিয়ে করে নিলাম। যেখানে তুমি বা তোমরা আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।অথচ গুরুত্ব দিলাম না।

‘ইটস ওকে বাবু।আমি কিচ্ছু মনে করিনি।বরং খুব খুশি হয়েছি,তুই নিজ থেকে কাউকে পছন্দ করে বিয়ে করতে চাইছিস!বিয়ে করেছিস।আলহামদুলিল্লাহ।

থ্যাঙ্কিউ এন্ড লাভ ইউ,আপু।

‘লাভ টুহ্ বাচ্চাসোনা।খবরদার কাল মনে করে ওরসাথে আমাকে কথা বলিয়ে দিস।কেমন?

নিভান মৃদু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো।পুনরায় আল্লাহ হাফেজ জানিয়ে কথার পরিসমাপ্তি ঘটালো দুজনে।

ফোনটা রেখে কৌড়ির দিকে তাকালো নিভান।মেয়েটা কেমন গুটিয়ে এসে তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে।কথা বলার মধ্যেও অনুভব করেছে,মেয়েটার বারবার কুঁকড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরা।কেনো?ঠান্ডা লাগছে নাকি?সহসা হাত বাড়িয়ে কৌড়ির গাল,গলা এবং খোলা হাতের অংশ ছুলো নিভান।বেশ ঠান্ডা।তড়িৎ এসির দিকে তাকালো 18c দেওয়া।তাও আবার কুল মুডে।তখন বাহির থেকে এসে অতিরিক্ত গরম লাগায়,এতো কমে তাপমাত্রায় দিয়ে রেখেছিলো নিভান।তারপর আর কমানো বাড়ানো হয়নি।তারকাছে তাপমাত্রা স্বাভাবিক লাগলেও হয়তো কৌড়ির জন্য স্বাভাবিক নয়।বেড টেবিল থেকে এসির রিমোটটা নিয়ে তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিলো নিভান।তবুও কৌড়ির ঠান্ডাভাব কমলো-না।সেটা বুঝে পায়ের কাছ থেকে চাদরটা পা দিয়ে টেনে নিয়ে জড়িয়ে দিলো।উষ্ণতা পেতেই,তাকে ছেড়ে দিয়ে চাদটা জড়িয়ে নিয়ে সেরে যেতে চাইলো কৌড়ি,তা কেমন অদ্ভুত চোখে অবলোকন করলো নিভান।তবে কাছ থেকে কৌড়িকে সরতে দিলোনা।বরং গায়ের থেকে চাদরটা সরিয়ে দিলো।সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা আবার তার কাছ ঘেঁষে উষ্ণতা খুঁজলো।নিভানের বুকের কাছের টিশার্ট খামচে ধরে তার শরীরে মিশে যেতে চাইলো।পায়ের ফাঁকে পা গলিয়ে দিলো।মুখ গুঁজে দিলো তার গলার ভাঁজে।অতঃপর সব বুঝেও নিভান চুপচাপ কিছুক্ষণ বউয়ের ঘুমের ঘোরের কর্মকাণ্ড শান্ত চোখে দেখলো।মেয়েটা অদ্ভুত ঘুমকাতুরে আজ কয়েকদিনে তা বেশ উপলব্ধি করেছে নিভান।তাই বলে এতো গাঢ়!এইযে একটা মানুষ তাকে অন্য রুম থেকে তুলে আনলো।আরেকটা বেডে শুইয়ে দিলো।এতোসময় ধরে ফোনে কথা বললো।অথচ বউটা তার জাগলোই না? এতো ঘুৃম কাতুরে যে,কিচ্ছু অনুভব করতে পারলো-না?আশ্চর্য!

নিভান হাসলো।উষ্ণতা খুঁজে ফেরা শরীরটাকে মূহুর্তেই নিজের শরীরের উপর তুলে নিলো।হাতের কাছে টেনে রাখা চাদরটা কৌড়ির পিঠের ওপর দিয়ে দুজনকে জড়িয়ে নিলো।কৌড়ি একটু নড়েচড়ে ফের শান্ত হয়ে গেলো।সেটা খেয়ালি চোখে দেখে,কৌড়ির মুখের এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে দিলো নিভান।নিটোল ছোট্টো ফর্সা কপালটা উন্মুক্ত হতেই সেখানে প্রগাঢ় একটা চুমুও বসালো সে।ফের ডান হাতটা কৌড়ির পিঠের ওপর দিয়ে তাকে নিজের সাথে আগলে রেখে বাম হাতটা নিজের মাথার নিচে রাখলো নিভান।সুগভীর শান্ত চোখজোড়া তার কৌড়ির সুশ্রী মুখে।এখান থেকে কয়েকদিন আগেও সে একা ঘুমাতো।মেয়ে মানুষের সান্নিধ্যে পছন্দ না থাকায় তখনো অনুভব হয়নি,এরকম এতো কাছে কাওকে আদর যত্নে বুকে আগলে রাখাতেও চরম সুখ।অনাবিল প্রশান্তির।স্বর্গসুখ কেমন জানা নেই নিভানের।তবে মেয়েটাকে কাছ পাওয়ার পর যে প্রশান্তি, সুখ সে শরীর মনে অনুভব করে,তা পুরুষ হিসাবে উপলব্ধি করা দুনিয়ায় স্বর্গসুখই বলা যায়।

এখন মনে হচ্ছে তার জীবনে কৌড়ির আগমনটা আরও কিছুদিন আগে আসা উচিত ছিলো!না না,হয়তো কিছু মাস আগে!সময়টা কিছু বছর আগে আসলেও হয়তো মন্দ হতোনা!বরং সব থাকতেও যে নিঃসঙ্গ জীবনের এক একটা একাকিত্ব দিন নিভান পার করেছে,সেই জীবনের সারাদিনের ক্লান্তি অবসাদে ঢাকা শরীর মনের একজন সুখকর সঙ্গী হতো।চাপা স্বভাবের নিভান,সেই সঙ্গীনির কাছে নিজের দুঃখটা ভাগ করতে না পারলেও,এই যে মেয়েটাকে কাছে পাওয়াতে যে সুখ, প্রশান্তি সে, শরীর মনে শান্ত নদীর ধারার মতো বয়ে চলার অনুভূতি অনুভব করছে।অন্তত সেই সুখটুকু পেতো!এরকম টুকরো টুকরো সুখ,টুকরো টুকরো শান্তিই তো চাওয়া পাওয়া ছিলো নিভানের।খুব বেশি চাওয়া পাওয়া তো তার কখনোই ছিলো-না।তবে দেরীতে হলেও ভাগ্য তার সহায় হয়েছে।নাহলে বাবা মারা যাওয়ার পর পরিস্থিতির অনুকূলে পড়ে সবসময়ের ভাবনা অনুযায়ী নিজের জীবনের প্রতি অভিমান অভিযোগী হয়ে নিভান নিজেকে নিন্দা করে গিয়েছে–জীবনে কি আছে তার?সব থাকতেও কি তার বলে এই পৃথিবীতে আদৌও কিছু আছে?জীবনে সাচ্ছন্দ্য জীবিকার অভাব না থাকলেও, সেই জীবনে ভালোবাসা,খেয়াল, আদর যত্নের তো নিদারুণ অভাব ছিলো।যা ভাগ্যক্রমে ঘুচেছে এমন সময় এসে,যে সময়ে এসে আদর যত্নের আর বিশেষ প্রয়োজন পড়েনা।গুরুত্ব রাখেনা।তবে সেই আদর ভালোবাসার খামতি পূরনের জন্য হয়তো ভাগ্যের লিখন তাকে সময়ে এসে বিশেষ উপহার হিসাবে কৌড়িকে দিয়েছে।এখন নিভানের মনে হয়,তার একটা আস্ত সুখকর পৃথিবী আছে।সেখানে পেঁজাতুলোর মতো শুভ্র কোমল একটা বউ আছে।যাকে বুকে জড়ালে সারাদিনের ক্লান্তি,অবসাদ মূহুর্তেই দূরীভূত হয়ে গিয়ে আকাশসম প্রশান্তিতে মনটা ডুবে যায়।যার ছোয়ায় দুঃখগুলো ডুবে গিয়ে সুখ ধরা দেয়।কি অদ্ভুত জীবন।

ঘড়ির ঢং শব্দ ভাবনা কাটলো নিভানের।কৌড়ির মুখ থেকে নজর সরিয়ে দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকাতেই দেখলো একটা বাজে।ভাবনায় এতো মশগুল ছিলো টেবিল লাইটটাও অফ করতে খেয়ালে নেই।মাথার নিচ থেকে হাতটা বের করে লাইটটা অফ করে দিলো নিভান।পুনরায় হাতটা এনে রাখলো মাথার নিচে।রাত অনেক হয়েছে অথচ ঘুম ধরা দিচ্ছে না চোখে।অথচ তার বুকে শয়নরত নারীটা গভীর ঘুমে বেহুশ।আনমনে হাসলো নিভান।ঘুম চোখে ধরা না দিলেও,এবার চোখ বুঁজে নিলো সে।

ঘুম ভাঙতেই নড়েচড়ে উঠলো কৌড়ি।অনুভব করতে পারলো,কারোর খুব কাছে শুয়ে আছে সে।গায়ের সুগন্ধটা বলে দিচ্ছে মানুষটা কে!নিজের কোমল শরীর,হাত পায়ের অবস্থানও কোথায় কোথায় সেটাও ঘুম কেটে যাওয়া সচল ব্রেনে সহজেই বুঝে নিলো।মানুষটার একটা হাতের উপর শুয়ে আছে সে।অন্যহাতটা তাকে পরম ভালোবাসায় মানুষটার সাথে জড়িয়ে রেখেছে।কৌড়ির মুখ গুঁজে আছে সেই পরম আদরে আগলে রাখা মানুষটার বুকে।সদ্য ঘুম ভাঙা কৌড়ির ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটলো।অনুভব করলো মানুষটার সাড়াশব্দহীন শরীরটা বলছে মানুষটা গভীর ঘুমে।সেই সুযোগ নিয়ে কৌড়ি আরও একটু ঘনিষ্ঠ হলো বরের সাথে।ঘুম ভেঙে গেলেও বুঝতে দিলো-না মানুষটাকে।অথচ তার ধারনা ভুল প্রমানিত করে দিয়ে তাকে জড়িয়ে রাখা মানুষটা বলে উঠলো।

‘নামাজ পড়তে হবেনা?

চমকে চোখ খুলে ফেললো কৌড়ি।তারমানে মানুষটা ঘুমিয়ে ছিলো-না?ছিঃ!একটু আগে নিজের করা কর্মে ভিষন লজ্জিত হলো সে।মুখে বলি না ফুটতে চাইলেও কোনোরকম বললো।

‘হুমম।উঠুন।

‘উঠবো কিকরে?

ততক্ষণাত নিজের অবস্থানের কথা মনে পড়তেই হাত পায়ের অবস্থান সরিয়ে নিতে চাইলো কৌড়ি।তবে হতে দিলো নিভান।বরং নিজের হাত পা দিয়ে নিবিড় বাধনে জড়িয়ে নিলো কৌড়িকে।সদ্য ঘুম ভাঙা ঘনো স্বরে বললো—বললাম আর সরে যেতেই হবে?একদম না।তোমার উচিত ছিলো আর-ও কাছে আাসা।বরকে একটু ভালোবাসা।তুমি না ভালোবাসলেও তাকে একটু সুযোগ করে দেওয়া।

লজ্জা পেলো কৌড়ি।মুখ ডুবিয়ে রাখলো, লজ্জা দেওয়া মানুষটার বুকে।সারারাতে ঘুম ভাঙিনি কৌড়ির।কাল রাতে কোথায় শুয়েছিলো আর এখন কোথায় শুয়ে আছে?এখানে কে নিয়ে আসলো তাকে?কিভাবে আসলো?এসব মাথাতে না আনলেও,সকাল সকাল বরের ভালোবাসায় সিক্ত হলো।সে জানে এখানে তাকে কে নিয়ে আসতে পারে! নিভানের দুষ্টমিষ্টি অভিযোগী বার্তার পরিবর্তে নিচু গলায় বললো–নামাজের সময়টা পার হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।

বুকে নিবিড়বন্ধনে জড়িয়ে রাখা মেয়েটাকে আরও শক্ত করে বুকে চেপে নিলো নিভান।কৌড়িকে আগলে রাখা হাতটা,তার মাথার খোলা চুলের ভাঁজে চলে গেলো।পরম আহ্লাদে মাথার মধ্যে আগুল বোলাতে বোলাতে গলার ঘনো স্বরটা বজায় রেখেই বললো–সকাল সকাল ব্ল্যাকমেইল?ইট’স ভেরী ব্যাড!

বিনিময়ে কৌড়ি হাসলো। যা নিভান দেখতে পেলো-না।তবে অনুভব করতে পারলো।ততক্ষণাত কৌড়ির মাথায় রাখা হাতটা দিয়ে মেয়েটার মুখটা তার বুক থেকে আলগা করে ধরলো নিভান।সকাল সকাল বউয়ের মায়াবিনী মুখের মিষ্টি হাসিটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো নিভান।যা রুমের আবাছা নীল আলোটায় বেশ মুগ্ধকর লাগলো। যেদিন থেকে মেয়েটার প্রতি দূর্বলতা অনুভব করেছে,সেদিন থেকেই মেয়েটাকে নিজের নিজস্বতা রূপে চেয়ে এসে নিভান।তবে সে আশা পূর্ণ হবে,মেয়েটাকে এতো কাছে পাবে!এটা কখনো ভাবিনি সে।যদি কখনো কৌড়ি,নিভানের না হওয়ার অস্বীকৃতি জানাতো।তবে হয়তো মেয়েটাকে আর এতো কাছে পাওয়া হতোনা কখনো নিভানের।এভাবে বুকে জড়িয়ে যে শান্তি সুখ মেলে তাও হয়তো আর হতোনা।ভালোবাসাও হতো-না।

কথাগুলো ভাবতেই কেমন যেনো মনটা হাসফাস করে উঠলো নিভানের।কৌড়ির আগলা করে ধরে রাখা মাথাটা পুনরায় হাত দিয়ে চেপে এনে ধরলো নিজের ঠোঁটের ভাঁজে।শুষ্ক ঠোঁটের দীর্ঘ গাঢ় ছোঁয়া বসালো কৌড়ির মৃসণ কপালে।সেখান থেকে সরে এসে কৌড়ির বুঁজে থাকা দুচোখের পাতায় পরম আহ্লাদে নিজের ঠোঁটের আদর ছোয়ালো।এই চোখ দুটো তাকে খুব টানে।মেয়েটাকে খুব খুব ভালোবাসতে বাধ্য করে।এতো মায়াভরা দু’টো চোখ!ওই চোখ দু’টো ভারাক্রান্ত থাকলে, অশ্রু ঝরলে নিভানের কলিজায় গিয়ে বিঁধে।আর এই চোখ দুটো প্রানউচ্ছল থাকলে নিভানের হৃদয় মন সবকিছু শান্তিতে থাকে।ঠোঁটের উষ্ণতা ছুঁইয়ে দিয়ে সরলো নিভান।কৌড়ির মুখের দিকে কোমল নজর ফেলে সময় নিয়ে বললো– আচ্ছা উঠে নামাজ পড়ে নাও।

কৌড়িও ঘুম ঘুম চোখে ঘনোঘনো পলকে বরকে দেখলো কিছুক্ষণ।নব্য বউ হিসাবে সকাল সকাল বরের ভালোবাসায় লজ্জায় মূর্ছা যাওয়ার কথা থাকলেও,মূর্ছা গেলো-না সে।বরং সেই মানুষটার নরম নরম ভালোবাসা কেমন বিগলিত মনে উপভোগ করলো!মানুষটা ছোঁয়া,আদর যত্নগুলো ভিষণ অন্যরকম।ভিষণ আদূরে ছোয়া।খুব দরদী কোমলতা ভরা সেসব স্পর্শে।যেনো নিজেকে কেউ বিন্দু আঘাত না দিয়ে পরম আদরে স্পর্শে ভালোবেসে ছুঁচ্ছে।সব ছোঁয়ায় ভালোবাসা যত্নগুলো যেনো চুইয়ে চুইয়ে পড়ে।কৌড়ির মনেমনে পুরুষ নিয়ে যে ভয়টা ছিলো।তা কেমন ধীরে ধীরে মানুষটার আচারনে কেটে যাচ্ছে।কেটে যাচ্ছে কি, কেটে গিয়েছে।কৌড়িকে চেয়ে থাকতে দেখে নিভান নম্র আদূরি গলায় শুধালো।—উঠবেনা?

কৌড়ির যেনো হুঁশ ফিরলো।নড়েচড়ে উঠতে গিয়েই ওড়নায় টান পড়লো।তা দেখে নিভান মৃদু হেসে হাতটা আগলা করতেই গায়ের ওড়না ঠিক করে কৌড়ি উঠে বসলো।মাথার চুলগুলো আজও খোলা।অথচ স্পষ্ট মনে আছে শোয়ার আগে চুলগুলো বেনী করে শুয়েছিলো।পরপর আজ কয়েকদিন সে বেনীকরে রাখা চুলগুলো সকাল হলেই খোলা পাচ্ছে।কারণটা না জানলেও,চুল খুলে ফেলা ব্যক্তিটা কে?হয়তো সে জানে।তবে চুল খোলার রহস্য কি এটা সে জানতে চেয়ে এই সকাল সকাল প্রশ্নের উত্তরে বিব্রত হতে চাইলোনা।তাই নিঃশব্দে চুলগুলো খোঁপা করে আলস্য ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো। ফের ধীর পায়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।পিছনে ফিরে দেখলো না দুটো মুগ্ধ চোখ তার প্রতিটি মুভমেন্ট কিভাবে অবলোকন করে চলেছে!সেই মুগ্ধ চোখের মানুষটার,চোখের সাথে-সাথে মনের মধ্যে-ও মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়লো।মন প্রার্থনায় গেয়ে
উঠলো।–প্রতিটি সকালের আগমনী বার্তা তার এভাবেই হোক।এই নারীকে ভালোবাসা মধ্যে দিয়েই প্রতিটি ভোর এভাবেই মুগ্ধতায় কেটে সকালের সূর্য উঠুক।তারপর সেই মুগ্ধতার রেশ ধরে সকাল পেরিয়ে দুপুর কাটুক,আর দুপুর পেরিয়ে রাত।আর সেই রাত পেরিয়ে একই মুগ্ধতায় আরও একটা সকাল আসুক তাদের জীবনে।
চলবে…

ফুলকৌড়ি পর্ব-৫৪+৫৫

0

#ফুলকৌড়ি
(৫৪)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

সবুজ সমাহারে দৃষ্টিনন্দিত পরিবেশ।শিল্পীদম্পতি তৌকির আহমেদ এবং বিপাশা হায়াত গড়ে তুলেছেন এই নক্ষত্রবাড়ি রিসোর্ট।বিশাল আয়তকার জায়গাজুড়ে চারপাশটা শুধু সবুজঘেরা।বিশাল আয়তকার বলতে প্রায় ২৫ বিঘার জায়গাজুড়ে তৈরি এই অবসর যাপনকেন্দ্রে আছে দিঘি, কৃত্রিম ঝরনা,কনফারেন্স হল, সুইমিংপুল,রেস্টুরেন্ট,একটি আবাসিক ভবন।নক্ষত্রবাড়ী প্রকৃতিপ্রেমী ও ভ্রমণপিপাসুদের কাছেও অতি জনপ্রিয় নাম। এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, পুকুরের পানির ওপর কাঠ-বাঁশ ও ছনের সমন্বয়ে নির্মিত শীততাপনিয়ন্ত্রিত কটেজগুলো।যার বারান্দায় বসে চারপাশের বৈচিত্র্যময় সবুজেঘেরা প্রকৃতি উপভোগ্য বেশ মাধুর্যপূর্ন।রাতের জোছনা বা পূর্ণিমা বিলাসে এর জুড়ি কৃতিত্বপূর্ণ ।প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়ার আরেক মুগ্ধতা নক্ষত্রবাড়ী।

ভিতরে ঢুকতেই চারপাশটা নজর ঘুরিয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকলো কৌড়ি।আশেপাশে সবাই উচ্ছসিত।ভিতরে ঢুকেই যেনো ছড়িয়ে পড়লো তারা। গাজীপুর জায়গাটা বিশেষকরে নক্ষত্রবাড়ী রিসোর্ট নিভানের মুখস্থ। মাসে দুই-তিনবার অন্তত এখানে আসা যাওয়া হয় অফিসিয়াল কাজকর্মের জন্য। মুলত বাহিরের ক্লায়েন্টরা যখন তাদের ভ্যারাইটিস ফুডের ফ্যাক্টরিটা পর্যবেক্ষণের পরিদর্শনে আসেন এবং পরিদর্শন শেষে সবকিছু পর্যালোচনার জন্য মিটিং সারতে এই জায়গাটা বেছে নেয় নিভান।মাঝেমধ্যে ক্লায়েন্টরাও নিরিবিলি প্রাকৃতিক কোথাও ঘুরতে চান।তখনও গাজীপুর হিসাবে এই জায়গাটা নিভানের বেশ মনেহয়।সেই সুবাধে ক্লায়েন্টদের মিটিং আওয়ার,প্রকৃতিতে ঘুরেফিরে বেড়ানো,মনপুত খাওয়া দাওয়া,একটু নিরবিচ্ছিন্ন কাটানো,মাসের মধ্যে দুই একবার এই রিসোর্টে হয়ে থাকে।তাই নিভান আর ঘুরলোনা,গিয়ে বসলো আবাসিক ভবনের নিচতলায় ক্যান্টিনে।যেখানে ঘুরতে আসা ভ্রমণকারীদের আলাদা নিরিবিলি বসার সুব্যবস্থা রয়েছে।মুখোমুখি গদিওয়ালা চারসিটের একটা টেবিলে গিয়ে বসল নিভান।বিকালের কমলাভাব সূর্যের রশ্মিটা এসে মৃদুমন্দ লুকোচুরি খেলছে সেখানে।
জানালাহীন খোলামেলা জায়গাটা থেকে বাহিরের পরিবেশটা সাদৃশ্য।নিভান কফি অর্ডায় দিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বাহিরের প্রকৃতিতে নজর দিলো।বাহিরের প্রকৃতিতে তো নয়,নিজের জন্য স্পেশাল করে গড়া তুলতুলে পুতুল এক কন্যার প্রকৃতিতে মুলত নির্দিষ্ট তার নজর।সুইমিংপুলের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে কৌড়ি।সাথে নাফিম।নাফিম উচ্ছসিত হয়ে হাত দিয়ে এটাওটা দেখাচ্ছে হয়তোবা, নয়তোবা কিছু জিজ্ঞেস করছে।দূর সেটা থেকে সেটা অনুধাবন করতে পারলোনা নিভান।তবে এটা অনুভব করতে পারলো, নাফিমের বড়বউমনির মন খারাপ। সে একটু পরপর আশেপাশে,পিছনে নজর ফেলে কাউকে খুঁজছে।ফের হতাশ হয়ে কিছুক্ষণ বাদে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে প্রকৃতিতে নজর দিচ্ছে।নিভান অনেকটা সময় ধরে শান্ত স্থির নজরে বউয়ের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করলো। দেখলো।মেয়েটা, গাড়িতে উঠে সেই যে মাথা নিচু করে চুপচাপ বসলো।তারপর আর না আশেপাশে চোখ তুলে তাকিয়েছে,আর না গাড়ীর মধ্যে থাকা অন্য কারোর কথায়,হাসি,মজায় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, জানিয়েছে।নিভান কিছুক্ষণ পরপর সামনে থেকে নজর সরিয়ে বউয়ের নিশ্চুপতা দেখেছে অথচ সেই খেয়ালও বোধকরি মেয়েটা করিনি।দৃঢ় স্থির নজর ছিলো তার ফর্সা দু’হাতের মুঠোবন্ধনিতে।নিভানও কেনো জানি সেই নিশ্চুপতা ভাঙিনি।মেয়েটাকে চুপচাপ থাকতে দিয়েছে।সম্পর্কে কিছুকিছু সময় হয়তো অন্য মানুষটাকে একটু নিজের মতো করে থাকতে দেওয়া উচিত। খেয়ালী হয়েও, একটু বেখেয়ালি আচারণ করা উচিত।একটু অন্যমনস্কতাও হয়তো মাঝেমধ্যে হওয়া উচিত।তাহলে হয়তো সম্পর্কে একে অপরের প্রতি শারীরিক আকাঙ্ক্ষা, চাহিদা বাদেও কে কার প্রতি কতোটা যত্নবান,কতোটা গুরুত্বপূর্ন,দু’জনের মর্মস্পর্শীতা,কে কার প্রতি কতোটা বিশ্বাসযোগ্য,ভরসাপূর্ন ঠিকভাবে বোঝা যায়।সর্বপরি ভালোবাসার যত্নশীলতার কার প্রতি কতোটা গাঢ়ত্ব ঠিকঠাক হয়তোবা অনুভাবিত হয়। যেমনটা নিভান অনুভব করে কৌড়ির প্রতি।

কফি চলে আসায় গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলে কফিতে মনোযোগ দিলো নিভান।কফি হাতে আবারও শান্ত,স্থির নজর ফেললো সেই মায়াবী রমনীরপানে।মন এমন একটা জিনিস যেখানে নিজের শক্তপোক্ত ব্যাক্তিত্বও যেনো কিছুকিছু মূহুর্তে হেলিয়ে দেয়!মাঝেমধ্যে হয়তো সূর্যের মতো হেলতে হেলতে একটা নির্দষ্ট সময়ের কক্ষে গিয়ে ডুবিয়েও দেয়।সেখানে যেনো আর নিজের অস্তিত্ব কাজ করেনা।অন্যের ভূগর্ভে সমর্পিত হয়ে তাহাতে বিলিন হয়ে যায়।তখন নিজের শক্তপোক্ত ব্যাক্তিত্ব হোক বা কঠিন মন। সমস্ত অনুভূতিরা কেমন নিস্পৃহ কাজ করে।ওই মেয়েটার মায়ায়, ভালোবাসায় নিজের মনটাকে এমন একটা অস্থির বাঁধনে বেঁধে ফেলেছে নিভান।চাইলেও মেয়েটার সাথে কোনোকারণে অভিমানী অভিযোগী হয়ে দূরত্বটা মনেহয় কখনো গড়া হয়ে উঠবেনা তার।হয়তো মনটা মনোক্ষুণ্ণ হবে,সাময়িক অসন্তুষ্ট হবে তবুও বিপরীতে ওই মেয়েটার মনখারাপ সহ্য হবেনা।নিজের আত্মসম্মানে আঘাত পাওয়ার পর-ও যে মন মানতেই চায়না।,মেয়েটা ভুল করেছে!উল্টে মন নিজেকেই বোঝাতে চায়, মেয়েটা অবুঝ।হয়তো কোনোকারনে অবুঝপনা করে ফেলেছে!তাই বলে তুই অভিযোগী হবি!এ কেমন বুঝদারপনা তোর?এতো ধৈর্য্য এতো সহ্য,ওই মেয়েটার বেলায় এসে কেনো এতো দ্রুত বিচ্যুত হবে!নিস্পৃহ হয়ে পড়বে!কেনো?তার ছোট্টো আদূরে মায়াবী মুখে কালো মেঘদুরের আনাগোনা দেখেও কি বুঝতে পারছিস না,মেয়েটা অনিচ্ছাকৃত ব্যবহার করে ফেলেছে!যা সে নিজেও চাই নি।

‘স্যার অন্যকিছু লাগবে?

ওয়েটার প্রশ্ন করতেই নিভান নজর সরিয়ে ওয়াটারের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো–নো,থ্যাঙ্ক’স।

ওয়েটার চলে যেতেই নিভান পুনরায় নির্দিষ্ট স্থানে নজর দিলো।তবে আর চুপচাপ বসা হলো-না তার।আর না ক্ষনিকের জন্য বেখেয়ালি হওয়া হলো।হাত থেকে কফিমগটা রেখে তড়িৎ উঠে পড়লো সে।কাঠের সেতু তৈরী করা।সেখানে সেতুর মাথায় কাঠের রেলিঙ চেপে দাড়িয়ে আছে কৌড়ি।আর তার পায়ের কাছে বসে উবু হয়ে মান্যতা শাড়ী উঁচিয়ে তার পা দেখছে।নিশ্চয় বেখেয়ালিতে হাঁটতে গিয়ে মোচড় লেগেছে।উফফ!কি যে করে!নিভান দ্রুত হেঁটে চলে গেলো কৌড়ির কাছে।গিয়েই সহসা জিজ্ঞেস করলো—কি হয়েছে?

উত্তর দিলো মান্যতা–পায়ে মোচড় লেগেছে মনেহয়!আমি একটু সামনে ছিলাম।দেখিনি।নাফিমের গলার শব্দ শুনে পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি ও ব্যথায় দাড়িয়ে পড়েছে।

নাফিম বললো–হ্যা। বউমনি হাঁটতে গিয়ে পায়ে মোচড় লেগেছে।

তড়িৎ হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো নিভান।সেটা দেখে মান্যতা উঠে দাঁড়ালো।শাড়ী উঁচিয়ে কৌড়ির পায়ে হাত রাখার আগেই কৌড়ি পা টেনে নিলো।নিভান মুখ উচু করে শান্ত স্থির চোখে তাকালো।কৌড়ি কি দেখল সেই চোখে, মূহুর্তেই পা বাড়িয়ে দিলো।নরম,কোমল পায়ে রুক্ষ হাতের নম্র স্পর্শ পেতেই শিরশির করে উঠলো শরীর।
জুতোটা খুব বেশী উঁচু নয়।মিডিয়াম লেবেলের।পায়ে মোচড় খাওয়ার মতো নয়।তবু্ও কিকরে মোচড় লাগলো বুঝতেই সংগোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিভান।পা-টা হালকা চেপে মৃদু ঘুরিয়ে ফিরেয়ে দেখলো।কৌড়ির মৃদু ঘনোঘনো কেপে উঠা টের পেতেই তার মুখের দিকে তাকালো নিভান।শুধালো।

‘ব্যথা পাচ্ছো?

গলায় কারা যেনো সেই কখন থেকে জটপাকিয়ে বসে আছে।স্বর বের হতেই চাইছেনা।নাফিম কখন থেকে তার সাথে বকবক করে চলেছে অথচ এখনো অব্দি একটা কথাও বলিনি ছেলেটার সাথে সে।শুরু থেকে তাকে সঙ্গ দেওয়া বাচ্চা ছেলেটার উচ্ছসিত কথার পরিবর্তে জোরপূর্বক মুখে হাসি টেনে প্রতিটা মুগ্ধকর বাক্যে মাথা দুলিয়ে হ্যা না স্বীকারোক্তি জানিয়েছে।পা মোচড় খেয়ে যখন পড়ে যেতে নিলো, ছেলেটা হাত ধরে আটকালো।সঙ্গে সঙ্গে সামনে থাকা মান্যতাকে মৃদু চিৎকারে ডাকালো।মান্যতা এসেও অনর্গল প্রশ্ন শুধালেও এখনো অব্দি মুখ খোলেনি কৌড়ি।মান্যতা প্রশ্ন শুধিয়েছে আর সে হ্যা না বাক্যে শুধু মাথা দুলিয়ে উত্তর দিয়ে গেছে।আর এখন এমন একটা মানুষ প্রশ্ন শুধিয়েছে,যার উত্তর দেওয়ার জন্য ঠোঁটের আগায় কথা এসেও কান্নারা আটকিয়ে দিচ্ছে।অভিমানী মন বলতে চাইছে,এই বিপত্তিটা তো আপনার জন্যই হলো।
তবে বিপত্তি হয়েছে এবং সে ব্যথা পেয়েছে বেশ হয়েছে!
এটা হয়তো তার শাস্তি!সে আরও ব্যথা পাক,তবুও মানুষটাকে বলবেনা কতোখানি ব্যথা পেয়েছে সে।মানুষটা কতোটা খারাপ হলে মানায়,তার চোখের আড়াল হলেও তাকে চোখের আড়াল করেনি। কেমন সে ব্যথা পেতেই দৌড়ে চলে এলো।নিশ্চয় তাকে নজরের মধ্যে রেখেছিলে।অথচ হাজার খুঁজে ফিরেও তাকে চোখের নাগালে পায়নি কৌড়ি।বলবে না সে কিচ্ছু!হাজার ব্যথা পেলেও বলবে না সে।তখন হুটকরে অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ পাওয়ায় ওরকম রূঢ়ভাবে কথাগুলো হয়ে গেছে।যা তার নিজেরও ভালো লাগেনি।তাই বলে তাঁকে একটু বুঝবেনা মানুষটা!কেনো বুঝবেনা!কেনো?কেনো তার চোখের আড়াল হবে!কেনো তার থেকে দূরে দূরে থাকবে মানুষটা!কেনো?

চোখজোড়া টলমলিয়ে উঠলো কৌড়ির।কাছের মানুষ থেকে আদর, ভালোবাসা, আহ্লাদ পেতে পেতে হঠাৎ তাতে ভাঁটা পড়লে,ব্যথা ছাড়া শরীরও মনে হয় ব্যথার যন্ত্রণায় ছটফটায়!মনটা কাতর হয়ে পড়ে!অসহ্য যন্ত্রণায় বুকের ভিতরটা টনটন করে।সেখানে সে-তো ব্যথা পেয়েছে।ব্যথা পেয়েছে শরীরে, ব্যথা পেয়েছে মনেও।আর তারচেয়েও ব্যথার যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে কাওকে ব্যথা দিয়ে।আবার তার ব্যথায় সেই মানুষটাকে ব্যথিত হতে দেখে আরও মন খারাপ হচ্ছে তার।সবকিছু নীরব সহ্য করেও এতো কেনো ভালোবাসে মানুষটা তাকে?কেনো ভালোবাসবে?যার মর্যাদা সে রাখতে পারছেনা,পারিনি!একমন তার হয়ে গাইছে তো অরেকমন ব্যাথা মানুষটাকে নিয়ে গাইছে!মনের দোলাচালে কৌড়ির ভিতরটা ঝড়, তুফান, ঘনোবর্ষার একসাথে আগমনের মতোই নাজেহাল অবস্থা।টলমলা চোখের কিনারা ভেদ করে এবার নোনাজলের স্রোত ভেসে আসতে চাইলো।

‘খুব ব্যথা পেয়েছিস?কাঁদছিস কেনো সোনা?ব্যথা হচ্ছে খুব?

প্রশ্ন শুধিয়ে মাথা নিচু করে কৌড়ির পায়ে খেয়ালি হয়েছিলো নিভান।মান্যতার আহ্লাদিত গলার বাক্যদ্বয় শুনতেই তড়িৎ মুখ উচু করে তাকালো সে।স্বপ্নে দেখা সেই অভিমানী ক্রন্দনরত ঘনোপাপড়ি ভেজা বড়বড় হিরণটানা চোখ!রাজহংসীদের চরে বেড়ানোর মতো দিঘী টলমল পানি সেই হ্রদে।সাথে তীব্র অনুশোচনা ।হৃদস্পন্দন থমকে গেলো নিভানের।কলিজাটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো।এই হরিণটানা আঁখির টলমল জ্বল,পায়ের মোচড় লাগার ব্যথার নয়!এতো তাকে না বোঝার অভিমানী অভিযোগী বর্ষন।এই ক্রন্দনরত চোখজোড়া তো তার খুবই পরিচিত।খুব চেনা।নিভান মাথা নিচু করে মৃদু হাসলো,পুনরায় তা আবার ঠোঁটের ভাজে মিলিয়ে নিলো।সেই হরিনী চোখে অভিমানী জল টলমলালেও ভুলেও তা কিনারা ভেদ করছেনা!মায়াবিনীর অভিমান কি আরও একটু দৃঢ় করবে নিভান?করলে ক্ষতি কি!প্রিয়তমার অভিমান ভাঙানো তো তার মিলি সেকেন্ডের ব্যাপার!কেমন দুষ্ট হেসে মাথা নিচু করেই নিভান বললো।

‘ব্যথা বেশি করছে?

অনেক্ক্ষণ পর অভিমানি রিনরিনে ভারী মিষ্টি কন্ঠ ভেসে এলো–‘আমার পায়ে তেমন ব্যথা লাগেনি।সামন্য ব্যথা পেয়েছি।ঠিক আছি।

নিভানের হাসি মৃদু থেকে প্রসারিত হলো।কৌড়ির পা-টা তার জুতার উপর আলতোভাবে রেখে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো। –‘এই জুতা পায়ে দিয়ে হাঁটতে পারবে?গাড়ীতে নর্মাল স্লিপার আছে এনে দেবো?

‘লাগবে-না।আমি ঠিক আছি।

নিভানের হাসিটা আরও একটু প্রস্ফুট হলো।তা পুনরায় ঠোঁটের ভাঁজে মিলিয়ে নিয়ে উঠে দাড়ালো।অভিমান অভিযোগ করার কথা তার!অথচ যে ব্যথা দিলো সেই ব্যথিত হয়ে উল্টো অভিমান করে বসে আছে?এই অদ্ভুত কর্মের সমাধান কি!সমাধান নিভানের তুড়ির ব্যাপার। তবে পাবলিকপ্লেসে তা প্রয়োগ করা মোটে-ও যথাযথ নয়।তাই মুখটা স্বাভাবিক রেখেই বললো।

‘আর ইউ সিওর?হাঁটতে পারবে তুমি?

কৌড়ি উত্তর দেওয়ার আগেই মান্যতা বললো—ব্যাথায় চোখে পানি এসে গেছে!আর তুই বলছিস হাঁটতে পারবি?

‘আমি তেমন ব্যাথা পায়নি আপু।হঠাৎ আঘাত লাগায় ব্যথায় চোখে পানি এসে গেছে।

কথাটা বলেই কেমন চমকে উঠলো কৌড়ি।চকিতে নিভানের দিকে তাকাতেই মনটা কেমন ছলাৎ করে উঠলো।নিজের অভিমান অযথা ঠিকলো।শ্যামবর্ণ মায়াময় শান্ত মুখটা দেখে আবারও তীব্র অনুশোচনায় ডুবলো মন।তন্মধ্যে মান্যতা সন্দিহান গলায় শুধালো।

‘সিওর?তুই ব্যাথা পাসনি?হাঁটতে পারবি?

চোখ নিচু রেখে মাথা ঝাকিয়ে উত্তর দিলো–‘হুমম।

নিভান অদ্ভুত শান্ত নজরে মেয়েটাকে দেখলো।কিছু একটা বলবে তারমধ্যে এতোসময়ে চুপ থাকা নাফিম বলে উঠল–বউমনি তাহলে চলো-না,ওইযে রাজারবাড়ি ওটা দেখে আসি।ছোটো দাদাভাইরা ওদিকে গেছে আমি দেখেছি।চলো না ওদিকেই যাই।রাজারবাড়ির পুকুরঘাটটা কি সুন্দর দেখো?চলোান বউমনি?

নাফিম হাতের আঙুলটা পুনরায় কৌড়ির আঙুলের মধ্যে ডুবিয়ে সামনে এগোলো।বাধ্যতামূলক কৌড়িকেও এগিয়ে যেতে হলো।সঙ্গে সঙ্গে পায়ের মোচড় লাগা জায়গাটায় মৃদু ব্যাথা অনুভব করলো।যা আরও দুকদম সামনে বাড়াতেই সয়ে গেলো।নিভান সেই এগোনো পদক্ষেপে তাকিয়ে রইলো।মান্যতাও তাদের পিছনে এগোলো।তবে পিছু ফিরে আরও একবার নির্বিকার নিভানকে দেখে নিলো।তার খুবকরে মনেহচ্ছে দু’জনের মধ্যে মান-অভিমান কিছু একটা তো হয়েছে।নাহলে দুজনেরই আচারণ তার কাছে এমন অস্বাভাবিক অদ্ভুত ঠিকলো কেনো!

বাড়িটা জমিদার রাজার বাড়ির মতো তৈরী করা হলেও মুলত রাজার বাড়ি নয়।আগেরকার আমলের জমিদার বা রাজাবংশীয়দের নিয়ে সিনেমা তৈরী করার জন্য,রাজার বাড়ির মতো এই বাড়িটা বানানো হয়েছে। মুলত সেটা পুরানো আমলের জমিদার বাড়ির প্রতিফলিত একটা শুটিং স্পট নির্মাণ করা।বাড়ির সম্মুখে বড়সড়ো ধাপে ধাপে সিঁড়ির একটা ঘাট বাঁধানো রয়েছে।আশেপাশে ঘুরেফিরে সেখানে গিয়ে বসলো সবাই।এমনিতেই কৌড়ি শান্ত মেয়ে তাকে আরও শান্ত দেখে তন্ময়ী জিজ্ঞেস করলো–মনখারাপ কৌড়ি?

কৌড়ি জোরপূর্বক ঠোঁটে হাসি ফুটালো।ফের বললো-না আপু।মনখারাপ কেনো হবে?

ইভান ফাজলামো শুরু করলো –কিন্তু ‘আমার তো মনে হচ্ছে তোমার খুব মন খারাপ! দাদাভাই সঙ্গ দিচ্ছে না তাই?

কৌড়ি দৃঢ় কন্ঠে উত্তর দিলো—‘মোটেই না!

ইভান তারচেয়েও দৃঢ় গলায় বললো—মোটেই হ্যাঁ।

ফের দুষ্টমী স্বরে ইভান বললো—তবে দাদাভাইয়ের
এখানে নিত্য আসাযাওয়া,এজন্য হয়তো এতোএতো ঘুরতে ভালো লাগছেনা।তবে তুমি বললে কিন্তু নিশ্চয় আসতো?একমাত্র বাচ্চা বউ বলে কথা।

তন্মধ্যে তন্ময়ী বললো—তা আমি তোমার একমাত্র বউ বলছি,এই পুকুর একটু ঝাপ দাওতো।দেখি একমাত্র বউয়ের কথা কেমন শোনো।

ইভান ধপ করে তন্ময়ীর পাশে বসে পড়লো।বললো–যদি ইজ্জত রক্ষা করার একটা ভালোমতো উপায় থাকতো তবে অবশ্যই আমি আমার একমাত্র বউয়ের কথা শুনতাম।বাট উপায় নেই এজন্য শুনতে পারছিনা।আমি দ্বিতীয়বার আর লুঙ্গির ওই সাদাসিধা প্যচালে পড়তে চাই-না।

সবাই হাসলো।হাসলো তন্ময়ীও।তবে সবার অগাচরে তন্ময়ীর কানের কাছে মুখটা নিয়ে ইভান বললো–তবে দুপুরের মতো যদি রাতেও আহ্বান করে ওভাবে কাছে ডাকো।সঙ্গে আদর ভালোবাসাটা যদি একটু অন্যরকম হয়,তবে ইভান তোমার জন্য পুকুরে ঝাপ দিতে নয়, জীবন উৎসর্গ করে দিতেও রাজি হয়েযাবে।এবার বলো রাজি হে?

তপ্ত আগুন যেনো কানের ভিতরটা পর্যন্ত ছুঁয়ে গেলো।তার আভাও যেনো কানের সাথেসাথে চোখেমুখেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো।এমনটা অনুভব করলো তন্ময়ী।কতোবড় অসভ্য ছেলেটা!আশেপাশে কতো মানুষ অথচ কিসব নির্লজ্জের মতো কথাবার্তা বলে যাচ্ছে!তড়িৎ মুখ উচু করে আশেপাশে তাকালো তন্ময়ী।না।কারোর তাদের দিকে খেয়াল নেই।হাফ ছেড়ে বাচলো যেনো মেয়েটা। ফের পাশে বসা ইভানের দিকে কড়া চোখে তাকালো।ইভান থোড়াই না তাতে পরোয়া করলো।আর-ও কিছু বলবে বলে মুখ খুলছিলো,তার আগেই তন্ময়ী তাকে ঠেলা দিয়ে সরিয়ে দিলো।তবে ইভানকে একচুল নাড়াতে পারলোনা।তাই হুমকিস্বরূপ শক্তকন্ঠে বললো—আর একটাও উল্টো পাল্টা শব্দ যদি তুমি প্রয়োগ করেছো না!তোমার খবর আছে বলে দিলাম!

‘খবরটা যদি,তোমার আদর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হয়,কোনো ব্যাপার না।আমি খবর কেনো,খবরের হেডলাইন ডেডলাইন সব হতে রাজী।

এই ছেলেকে দমানো তার কর্ম নয়।বিরক্ত এবং ধৈয্যচুত হয়ে তন্ময়ী নিজেই উঠে দাঁড়ালো। নাফিম,ইতু আর কৌড়ি, পুকুরের পানির কাছে সিঁড়িতে। নাফিম নিচু হয়ে পানি ছুড়ছে এদিক ওদিক,তাকে সঙ্গ দিচ্ছে ইতু। আর কৌড়ি চুপচাপ আশপাশটা দেখছে।তন্ময়ী ধপাধপ্ সিড়ি বেয়ে ওদের কাছে গেলো।আশেপাশে সবাই তখন ছবি তোলায় ব্যস্ত। দুরপ্রান্তে বসা এক মানবের শান্ত,স্থির চোখজোড়া তখনও তার প্রিয়তমা স্ত্রীরপানে নিবন্ধিত।দুরে থেকেও বুঝতে পারলো। মেয়েটার মন খারাপ!তবে একান্ত সময় না পেলে কিভাবে সমোঝোতা করবে?আর কিভাবেই বা কাটাবে সেই নারীর মন খারাপ?সবার সাথে ঘুরতে নিয়ে এসে নিজের কাছ বসিয়ে রাখাও তো উচিত-না!তবে সঙ্গ দেওয়া মনেহয় অবশ্যই উচিত।সঙ্গ দেওয়ার ভাবনাটা তার কেবলই মনমস্তিস্কে উদয় হয়েছে এমনটা নয়।বরং সঙ্গ ছেড়ে মেয়েটাকে কিছু সময় একা ছাড়তে চেয়েছিলো নিভান।যা হিতে বিপরীত হয়ে গেলো।মেয়েটার ওই ক্রন্দনরত চোখজোড়া! উফফ,জ্বালা ধরিয়ে দেয় তার বুকে।কোনোপ্রকার স্বস্তিতে,শান্তিতে থাকতে দেয়না।কিছুতেই দেয়না।নিজের জন্য হলেও সে দেখতে চায়, ওই মায়াবীনি মুখের উচ্ছ্বসিত উজ্জ্বল হাসি।

বউটাকে সঙ্গ দিতেই উঠে দাঁড়ালো নিভান।তন্মধ্যে এসে হাজির হলো ইভান।সঙ্গে কানন। পিছনে নিতু আর মান্যতাকেও দেখা গেলো।নিভান পুনরায় পুকুরঘাটের দিকে তাকালো। সেখানে কেউ নেই।শূন্যঘাট।তারমানে বাকিরাও পিছনে আসছে।নিভান সংগোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুনরায় বসে পড়লো।ওয়েটারকে ডেকে,যে যার পছন্দের মেন্যু অনুযায়ী খাবার অর্ডার দিতে বললো।আস্তে আস্তে সবাই এসে হাজির হলো।মূহুর্তেই চারসিটের তিনটে টেবিল বুক হয়ে গেলো।শেষ টেবিলে গিয়ে বসলো নাফিম, কৌড়ি আর বিথী।মাঝখানের টেবিল থেকে মূহুর্তেই উঠে এলো ইতুও।হাতে তার নিতুর ফোন।পিক উঠিয়েছে তাই উচ্ছ্বসিত হয়ে দেখাচ্ছে।

‘দেখো তোমাকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে!হাসলে আর-ও সুন্দর দেখাতো।

ইতুর কথাতে নয় বিথীও খেয়াল করেছে কৌড়ি আজ বেশিই চুপচাপ। কৌড়িকে কয়েকটা পিক দেখিয়ে ইতু আর নাফিম পিক দেখায় ব্যস্ত হলো। সেদিকে একপলক তাকিয়ে বিথী বললো।–কি হয়েছে তোর?

“কিছু না তো! কি হবে?

‘আমিতো তোকে অনেক আগে থেকেই দেখছি মুডঅফ।ভাইয়াও কেমন চুপচাপ। অথচ দুজনের একসাথে ঘোরার কথা।

‘ইভান ভাইয়ার কথা শুনলিনা!ভাইয়া বললেন তো, উনিতো এখানে সবসময় আসেন।এজন্য আলাদা করে ঘোরাঘুরি করেননি।আর আমিতো সবার সাথে ঘুরছিই।

‘কৌড়ি।

বিথীর ডাকটায় কেমন করে তাকালো কৌড়ি। তবুও মুখ দিয়ে শব্দ বের করলো না। সেটা দেখে বিথী পুনরায় বললো।

‘এই কয়েকমাসের দুরত্বে তুই এতোটাও পাল্টে যাসনি যে আমি তোকে বুঝতে ভুল করবো।আর আমাদের বন্ধুত্বটা এতোটাও ঠুনকো হয়ে যায়নি যে, তুই আমার কাছ থেকে কথা গোপন করবি।তবে তোদের একান্ত কথা হলে সেটা আলাদা।আমি তা জানতে চাইনা। তবে আমি নিশ্চিত তোর কোনো কারণে মন খারাপ।

‘উনি আমাকে ব্যাডলি ছুইনি কারনবশত ছুঁয়েছে।সেটা নিয়ে আমি উনার সাথে খারাপ রিয়াকশন করে ফেলেছি।

ইতস্তত হয়ে কথাটা বলতেই,বিথী বিস্ময় নিয়ে বললো।
‘তুই!

বিথীর রিয়াকশনে কৌড়ি মুখটা আরও ছোটো হয়ে গেল।বিথী বললো-তুই ভাইয়াকে চিনিস না?তারপরও?

‘আমি ইচ্ছেকৃত করেনি। অনিচ্ছাকৃত হয়ে গেছে!

‘এটা নিয়ে ভাইয়া রাগ করেছেন,অসন্তুষ্ট হয়েছেন?

‘নাহ।

‘তবে তা নিয়ে মন খারাপ কেনো করছিস?

‘আমি যেটুকু জানি উনাকে।উনি মনেমনে অসন্তুষ্ট হলেও তা বহিঃপ্রকাশ করবেননা কখনো।নিজের মনে চেপে রাখবেন।তবুও অসন্তুষ্টতা প্রকাশ করবেন না।

বিথী মজার ছলে বললো–দুদিনে এতোটা জেনে গেছিস?

বিথীর কথার টোন বুঝে কৌড়ি উত্তর দিলো-না।বরং মুখটা সেভাবেই ছোটো করে বসে রইলো।সেটা দেখে বিথী একপেশে তাকে জড়িয়ে ধরলো।নিচুস্বরে বললো –আচ্ছা মনখারাপ করিস-না।ভাইয়া তোকে অসম্ভব ভালোবাসেন।একদম অসম্ভব।বিশ্বাস কর,এরকম করে সবদিক দিয়ে খেয়াল ধ্যান রেখে একটা মেয়েকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে ছেলেমানুষ আমি কমই দেখেছি।সেখানে তিনি তোর প্রতি অসন্তুষ্টতা পুষে রাখবেন?কখনোই-না।তখন সুযোগ বুঝে তুইও নাহয় উনাকে স্যরি বলে দিস।হয়ে যাবে!

বিথীর বুঝদারপনা কথায় মৃদু হেসে সম্মতি জানালো কৌড়ি।তবে মন সেই অস্থির, বিচলিতই রইলো।ওয়েটার খাবার এনে টেবিলে রাখতেই ধ্যান সেদিকে দিলেও,মন পড়ে রইলো সেই শ্যামবর্ণ মায়ামায়া মুখে।শান্ত, স্থির সুগভীর দু’টো চোখে।কৌড়ি তখন ওমন রূঢ় আচারণ করার পর কেমন আরও শান্ত থমথমে হয়ে গিয়েছিলো সেই নজর,মুখ।অথচ চেহারার নির্বিকারত্ব দেখে বোঝার উপায় ছিলোনা,মানুষটা তার ব্যবহারে ঠিক কতোটা অসন্তুষ্টতা হয়েছেন!বারবার সেই চোখমুখ মনোসপটে ভেসে উঠছে আর অনুশোচনায় অপরাধবোধে বুকের ভেতরটা দগ্ধ হচ্ছে।মাথাটা কেমন ভারী করে তুলছে।পিছন ফিরে মানুষটাকে একবার দেখতে ইচ্ছে করলো।অথচ দেখা হলো-না তার।সামনে টেবিলে রাখা কোল্ড কফি মগটায় আনমনে হাত দিতেই ওয়েটার সতর্কতা করে বললেন– ম্যাম আপনার জন্য কফি না।ফাস্ট টেবিলের স্যার নিষেধ করলেন বলে আপনাকে কফি দেওয়া হয়নি।উনি বললেন আপনার নাকি ক্যাফেইন জাতীয় খাবার নিষিদ্ধ। তাই আপনি জুস নিন।অ্যারেঞ্জ ফ্লেভার অথবা ম্যাংগো,দুটো রাখলাম যেকোনো একটা নিতে পারেন।চাইলে অন্যন্য তা আছে।দেবো?

‘লাগবে না।

কৌড়ি দেখলো,জুস কফিসহ টেবিলে বিভিন্ন খাবার সাজানো।পিৎজা,চিকেন বার্গার,পাস্তা,মেয়োনিজ,ফ্রেঞ্চ ফ্রাই,চিকেন স্যান্ডউইচ,পটেটো ওয়েজেজ।ওয়েটারের বার্তা অনুযায়ী এগুলো থেকেও টেষ্ট করতে পারেন। আর মিষ্টিতে স্ট্রবেরি কেক এবং ভ্যানিলা কাপ।এগুলোও ট্রায় করা যেতে পারে।

ওয়েটার বার্তা জানিয়ে চলে গেলো।কৌড়ি কেমন অদ্ভুত চোখে তার যাওয়া দেখলো।ভিতরে অনুশোচনায় ডোবা মনটা যেনো চনমনিয়ে উঠলো।সর্বদা সর্বক্ষণ মানুষটার ধ্যান থাকে কৌড়ির খেয়ালে।আর সেই কৌড়ি ব্যাথা দিল মানুষটাকে।খাবারের রুচি এমনিতেই নেই।এবার যেনো তা নিঃশেষ হয়ে এলো।ভিতরটা উগলে এলো কান্নায়।পাশ থেকে বিথী বললো–দেখেছিস,তুই যতো দূরে থাকিসনা কেনো ভাইয়া ঠিকই তোর খেয়াল রাখে।আর রাখবেও।সেখানে তোর প্রতি অসন্তুষ্ট হলেও বেশিক্ষণ মনে পুষে রাখতে পারবেন না।

অসন্তুষ্ট বহিঃপ্রকাশ করবেনা, পুষে রাখবে-না,এটা সেও জানে।সেজন্য তো গ্লানিটা তার বেশি।মানুষটাকে বুঝেশুনেও অকারণে তারসাথে রূঢ় আচারণ তাকে শান্তিতে স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছে না।মন ওই মানুষটার সঙ্গে চাইছে,সাথে তার দু’হাতের শক্তপোক্ত বন্ধনীর স্পর্শ চাইছে!খুবকরে চাইছে!

আড্ডা মজাতে ইভানের জুড়ি মেলা ভার।সাথে তারই ভার্সন কানন যুক্ত হয়েছে।জমজমে হয়ে উঠেছে টেবিল।
তবে হাসি গল্পে টেবিল ক্রস করছেনা কেউ।ইভানের দুষ্ট ফাজলামো কথাগুলো কানে আসলেও,মধ্যে টেবিলে বসা তন্ময়ীরা তা কানে তুলছেনা।তারা নিজেদের মতো গল্প করছে।মাঝেমধ্যে পিছুনের টেবিলে বসা কৌড়িদের খোঁজখবর নিচ্ছে।যদিও ইতু কৌড়দের সাথে গিয়ে যোগ হয়েছে মৌনতা।ইতু, মৌনতা আর বিথী।তিন বকবকানি খোশগল্পে মাতিয়ে তুলেছে টেবিল।

গোধূলী সন্ধ্যা।সূর্যটা অস্তমিত হয়েছে সেই কখন!এই মাগরিবের আযান পড়লো বলে।নাস্তা সেরে সবাই, পুকুরের পানির উপরে নির্মিত কাঠ বাশ ছন দিয়ে করা কটেজগুলো ঘুরেঘুরে দেখলো।এবার নিভান বউয়ের পাশেপাশে হেঁটে তাকে সঙ্গ দিলো তবে কথা হলোনা দু’জনের মধ্যে আর না দৃষ্টি বিনিময় হলো।কৌড়িও অনুভব করলো তার পাশের মানুষটাকে।তবে গ্লানিভরা মন কেমন যেনো পাশে তাকিয়ে মানুষটার দিকে নজর ফেলতে পারলোনা।স্বাভাবিকভাবেই বাঁশ কাঠের নির্মিত রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে দেখে এলো কটেজগুলো তারা ।সূর্য হারিয়ে গিয়ে পশ্চিম আকাশে উদয় হয়েছে সিঁদুররঙা লাল আর গাঢ় নীল আলো।সেই লাল নীল গোধুলেলগ্নের আলোয় সবুজ সমাহারে ঘেরা ঘনো এই প্রকৃতিকে কি-যে মোহনীয় লাগছে।অবর্ননীয় রূপ।সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির মাধুর্যতা যেনো উপচে উপচে পড়ছে। পাশে তাকালো নিভান।প্রকৃতির মাধুর্যতার লীলাভূমিতে তার বউটাও কোনো অংশে কম কিসে!সে যে গোলাপের আবরণীর ন্যায় স্নিগ্ধময়ী অনন্য।গোধুলির উদিত হওয়া সিঁদুররঙা লাল নীল মোহমায়া রূপের ন্যায় অপরূপা।

আযানের আগেই তারা রিসোর্ট থেকে বের হলো।রিসোর্ট থেকে বের হতেই ইভান বললো।-অনেকদিন পর যখন সবাই একসাথে বের হয়েছি।চলো-না একটু লং ড্রাইভে যাই দাদাভাই।মন খুলে ঘোরাঘুরি করি।আবার কবে কখন এরকম একসাথে হতে পারবো তার ঠিক নেই।

বড়রা বাদে বাচ্চারা যেনো নেচে উঠলো।অগ্যতা বাচ্চাদের উচ্ছ্বসিত মুখের দিকে তাকিয়ে নিভান আর না বলতে পারলো-না।কৌড়ির সাথে একান্ত সময় কাটাতে বাচ্চাদেরকে নিজের গাড়ীতে নিলো নিভান।নাফিম ইতু মৌনতা আর বিথী।সঙ্গে বউটা নিয়ে নিভান গাড়ীতে উঠলো।গাড়ীতে উঠতেই উদাস মনে মেয়েটা জানালার বাহিরে তাকালো।নিভান কিছু বলতে গিয়েও যেনো বলতে পারলোনা।পথিমধ্যে আযান হতেই,একটা মসজিদ দেখে গাড়িটা পার্ক করে নামাজ পড়ে নিলো।নামাজের অভ্যস্তটা হয়েছে তার,বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে।বাবা মারা যাওয়ার পরে ছোট্টো নিভান যখন বাবার কাছে যাবার জন্য খুব বাহানা করে কাদছিলো।তার সাথে ঘুমানোর জন্য জেদ করছিলো।কোনোমতেও সেই বায়না যখন কেউ থামাতে পারছিলো।নিভান ছটফট করছিলো।তখন কোনো এক বয়স্ক লম্বা দাড়িওয়ালা মুরুব্বি তাকে কাছে নিয়ে কি সুন্দর নমনীয় মিষ্টি গলায় বলেছিলেন–বাবার সাথে থাকতে চাও?

ছোট্টো অবুঝ নিভান মাথা নাড়িয়ে ক্রন্দনরত কন্ঠে বলেছিলো—হ্যা।আমি বাবার সাথেই থাকতে চাই।

‘তাহলে যে তোমাকে সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করতে হবে।নামাজ পড়তে হবে,আর নামাজ শেষে প্রার্থনা করে আল্লাহর কাছে বলতে হবে আমি বাবার সাথে থাকতে চাই।

নিভান তখন অবুঝ হলেও নামাজ সম্পর্কে দৃঢ় ধারনা ছিলো তার।বাবার সাথে প্রতি ওয়াক্তে নাহলেও বাবা বাড়িতে থাকলে প্রায় ওয়াক্ত নামাজে সে বাবার সাথে মসজিদে যেতো।আর সেজেগুজে জুমার নামাজ তো কখনো মিস করতো-না।বাবা নামাজী ছিলেন।নামাজী হওয়ার গুনটা বংশ পরম্পরায় পেয়েছিলেন।তাই মুরুব্বির কথা তার অবুঝ মন নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছিল।ততক্ষণে বাবার দাফন শেষ।তবুও বাবাকে কাছে পাওয়ার আশায় নিজে নিজে নামাজ পড়েছিলো।তখন কোনো ওয়াক্ত ছিলোনা তবুও নামাজ পড়েছিলো নিভান।এবং কেঁদেছিলো আর দোয়া করেছিলো,সে বাবার কাছে যেতে চায়,বাবার সাথে থাকতে চায়।তারপর ছোট্টো নিভান রোজ মায়ের সাথে নামাজ পড়তো।আর দু-হাত তুলে অবুঝমনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতো– আমি বাবা-র সাথে থাকতে চাই।

বাবাকে না পেয়ে ছটফট করতো নিভান।ঘনোঘনো জ্বর অসুখে ভুগেছেও সে।তবে বাবার কাছে থাকার যে তীব্র রাগ জেদ বাহানা ছিলো।সেই রাগ জেদ বাহানা আস্তে আস্তে কমে গিয়েছিলো।হয়তো তার ছোট্টো হৃদয়টা নামাজে মধ্যেমে আল্লাহর রহম, নেয়ামত অর্জন করতে পেরেছিলো।সেই করুনায় রাগ জেদ কমে গিয়ে সেখানে ভর করেছিলো গম্ভীর্যতা,ধৈর্য্যশীলতা,সহনশীলতা।তবে সেই মুরুব্বির কথার অর্থ”‘আমি বাবার সাথে থাকতে চাই'” বাক্যের অর্থদ্বয় নিভান যতো বড় হয়েছে ততোই গভীরভাবে তার মর্মার্থ অনুধাবন করেছে।ভদ্রলোক তাকে বাবার সাথে থাকার জন্য নিজের আয়ু নিস্ক্রিয় করতে প্রভুর কাছে কামনা করতে বলেনি।বলেছিল,শুধু নিজের ইচ্ছেটা প্রকাশ করতে।যাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে সে বাবার সাথেই জান্নাতে থাকতে পারে।আনমনে হাসলো নিভান।মায়ের চেয়ে বাবাকে খুব ভালোবাসতো সে।সর্বদা বাবার সঙ্গ পাওয়ার জন্য কত জেদ,কতো অবুঝপনা করেছে নিভান!বাবা মারা যাওয়ার পরে তা সময়ের সাথে সাথে সয়ে গেছে।তবুও অবুঝ ইচ্ছেটা তার রয়ে গেছে।অবশ্যই সে জান্নাতে বাবার সাথে থাকতে চায়।পাশে তাকালো নিভান।সেখানে নিজের সঙ্গিনী হিসাবে এই মেয়েটাকেও চায় সে।

হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো নিভানের।ব্লুটুথটা কানে গুঁজে নিতেই সংযোগ স্থাপন হলো।ওপাশ থেকে ইভান বললো—কোথায় তোমরা?দেরী হচ্ছে কেনো আসতে?আমার শ্রীপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর সাফারি পার্কের সামনে গাড়ী থামিয়েছি কেবল। এসো।

‘সন্ধ্যার সময় ওখানে কেনো?

‘নিতু বলছিলো গাজীপুরে জায়গাটা ঘোরার জন্য বেস্ট।তাই এলাম।

‘গাজীপুর হিসাবে জায়গা ঘোরার জন্য বেস্ট হলেও,
এখন বনজঙ্গল দেখার সময় না!ওখানে খোলামেলা জীবজন্তুর মেলা।যা রাতে উপভগ্য করার সময় নয়।আর বাচ্চাদের নিয়ে রাতে ওখানে ঘোরাফেরাও ঠিক হবে-না।চাইলে তোরা ঘুরে আয়।আমি ওদের নিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীর দিকে যাচ্ছি।

‘নিতু বলছিলো নন্দন পার্ক বলে আরেকটা জায়গা আছে।তবে ওখানে এসো।

‘ওখানেও রাতের বেলা খুব একটা উপভোগ্য নয়।চাইলে তোরা যা।আমি ওদের নিয়ে শীতলক্ষ্যার দিকে যাচ্ছি। তোর ঘুরে আয়।

ইভান দ্বিরুক্তি করলোনা।সংযোগ বিচ্ছিন্ন হতেই নিভান গাড়ী চালানোতে মনোযোগ দিলো।পাশে একপলক তাকাতেই দেখলো,কৌড়ি গাড়ীর জানালায় হাত রেখে তার উপর মুখটা সপে বাহিরে তাকিয়ে আছে।রাতের রাস্তায় গাড়ী চালানোতে বরাবর এক্সট্রা সতর্ক অবলম্বন করে নিভান।বিধায় কৌড়ির পানে বিশেষভাবে খেয়াল দিতে চেয়েও পারলোনা।গাড়ীতে অন্যরা না থাকলে কোথাও গাড়ী থামিয়ে দুজনের অমীমাংসিত ঝামেলাটার চুটকিতেই সমাধান করে ফেলতো।তা এখন হওয়ার নয়।দীর্ঘশ্বাস ফেলে ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দিলো সে।

ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে শীতলক্ষ্যা নদীর উৎপত্তি।শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে বর্মী খেয়াঘাট।কাছাকাছিই চারশো বছরের পুরানো বর্মী বাজার।সেখান থেকে কিছুটা দূরেই গাড়ী থামালো নিভান।কিছুটা দূরে বলতে বরমা সিংহস্রী ব্রিজের কাছেই গাড়ীটা পার্ক করলো।গাড়ী থেকে নামতেই হৈচৈ করে বাচ্চার ব্রিজে উঠে গেলো।অন্যন্য ব্রিজের মতো এই ব্রিজের রেলিঙের পাশ ঘেষে একের পর এক সোডিয়ামের কোনো আলো নেই। তবে ব্রিজের উপর দিয়ে চলা একের পর এক গাড়ির আলোতে ঝলমলে উজ্জ্বল চারপাশটা।নদীর নাম যেনো সার্থক।কচুরিপানায় ভরা শান্ত শীতল পানি।তার বহমানে নেই কোনো তরঙ্গ উচ্ছাস।ছলছল কলকলভাবের তাপ-উত্তাপ।চুপচাপ শান্ত শীতল বয়ে চলেছে সে।রেলিঙ ঘেঁষে উপর থেকে সুগভীর শীতলপানির বহমান দেখতে থাকলো সবাই।দিনের বেলা হলে এই নদীতে নৌকা চড়া যেতো।রাতে বেলা ভুলেও বাচ্চাদের নিয়ে সেই রিক্স নেওয়া যাবেনা।একটাও সাঁতার জানেনা সেভাবে।
নাফিম দেখতে দেখতে হঠাৎ উবু হওয়ায়,পাশে দাড়ানো কৌড়ি আতঙ্কিত হয়ে তাকে চেপে ধরে সোজা করে দাড় করিয়ে দিলো।বললো–সোজা হয়ে দেখো নাফিম।নিচু হয়ে দেখোনা,পড়ে যাবা।

‘সোজা হয়ে তো সামনে দেখা যায়।নিচে কি দেখা যায়?আমিতো নিচে দেখতে চাই।একটু বউমনি।

নাফিমের আদূরে কন্ঠের অনুরোধ ফেলতে পারলোনা কৌড়ি।তাকে ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো।আর নাফিম হালকা মাথা নিচু করে নদীর একান্ত ছন্দেছন্দে চলা বহমান পানি দেখতে থাকলো।সাথে কৌড়িও।অন্ধকারে তার আসল বৈচিত্র্য অনুভব না করতে পারলে-ও,শান্ত নদীতে চলা বাহারি নৌকাগুলোর ছলাৎ ছলাৎ শব্দে বয়ে যাওয়া উপভোগ করতে থাকলো।নিভান গাড়ীর গায়ে হেলান দিয়ে সুগভীর চোখে শীতলক্ষ্যার অনুরূপ শান্ত, নিজের বউটাকে দেখতে থাকলো।মেয়েটার চোখে তীব্র অনুশোচনা অথচ তার ঠোঁট নিরুপায়, নিস্তব্ধ।এরকম মানুষেরা ভিতরে ভিতরে পুড়ে ছাই হয়ে যায়,দগ্ধ হয়।অথচ নিজেকে কারও কাছে খোলামেলা উপস্থাপন করতে পারে-না।নিজের ভালোমন্দ অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ করতে পারেনা।নিভান সোজা হয়ে দাঁড়াল।পা বাড়ালো প্রিয়তমা অভিমানির পানে।তন্মধ্যে আরও একটা গাড়ি এসে থামলো তার গাড়ির পাশে।

ইভানরা হয়তো পার্কে সময় কাটায়নি।সোজা চলে এসেছে এখানে।নাহলে এতো তাড়াতাড়ি আসার কথা নয়।গাড়ি থামতেই নেমে পড়লো সবাই।কোলাহলহীন নির্মল পরিবেশ। সবাই যেনো জায়গাটা উপলব্ধির সাথে সাথে উপভোগও করলো।নিভানের আর বউয়ের কাছে যাওয়া হলোনা।সবাই ব্রিজের এপাশ ওপাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেখতে থাকলো।গল্প কথার মধ্যে বিভিন্ন রকম মতামত প্রকাশ হলো।তন্মধ্যে দিনের বেলা হলে জায়গাটা বেশ উপভোগ করা যেতো।আশেপাশে ঘুরেও দেখা যেতো।সর্বোপরি এই শান্ত শীতলক্ষ্যায় নৌকা চড়ে হৈহৈ করে কিছুক্ষণ বেড়ানোও যেতো।সবাই যার যার মতো ঘুরেফিরে সময়টা উপভোগ করতে লাগলো সাথে ব্যক্ত করতে থাকলো নিজেদের অনুভূতি।হঠাৎ নাফিম বললো।

‘বউমনি চলোনা ব্রিজের ও-মাথা থেকে ঘুরে আসি?

আঙুল দিয়ে দেখালো নাফিম।মানুষজন যা সব ব্রিজের এমাথায় আর মধ্যেখানে।ওমাথায়ও আছে তবে সংখ্যায় দু-একজন। কৌড়ি সম্মতি জানালো।নাফিম বরাবরের মতো কৌড়ির আঙুল নিজের আঙুলের মধ্যে পেচিয়ে নিয়ে সামনে আগ্রসর হলো।কিছুদূর যেতেই নিজের পাশে বটবৃক্ষের মতো বলিষ্ঠ দেহের ছায়া অনুভব করলো।তারসাথে নিজের কোমল অন্যহাতের তালুতে সেই মানুষটার শক্তহাতের স্পর্শ পেলো।সঙ্গে সঙ্গে শরীর শিহরে উঠলো তার।পা থামাতে গিয়েও নাফিমের হেঁটে চলা গতিতে স্থির দাঁড়াতে পারলো-না।ততক্ষণে তার নরম আঙুলের ভাঁজে গেঁথে গিয়েছে কারও শক্তপোক্ত বড়বড় আঙুলের ভাজ।তার হাতটা দখল হয়ে গিয়েছে কারও ভরসা বিশ্বাসযোগ্য হাতের মুঠোয়।অথচ নিজের ভিতরের ভরপুর আত্মগ্লানিতে পাশে ফিরে মানুষটাকে একবার মুগ্ধ চোখে দেখা হলো-না তার।শুধু হাতে হাত রেখে হাটা হলো!আর তাকে অনুভব করা হলো!

বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ওখান থেকে বের হয়ে কাপাসিয়া ব্রিজ ঘুরে রওনা হলো বাড়ির পথে।কাপাসিয়া ব্রিজেও বেশ কিছুক্ষণ সময় ঘোরাঘুরি করে পার করলো।রাতও অল্প হয়নি!এতো রাত করে বাচ্চাদের নিয়ে এভাবে বাহিরে থাকাও ঠিক নয়।তবে তাদের আনন্দিত উচ্ছ্বসিত মুখগুলো,নিভানকে দৃঢ় হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দেয়নি।

পুরানো আমলের করা বড়সড় রুমটা দক্ষিণা পাশে হওয়ায় রুমে সর্বক্ষণ এলোমেলো হাওয়া বইতে থাকে।কৃত্রিম বাতাসের প্রয়োজন তেমন একটা হয়না।তবুও বাহির থেকে এসে ফ্যানটা ছেড়ে দিলো নিভান।রুমের মধ্যে প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রের কোনো কমতি নেই।তন্মধ্যে রুমের মধ্যে দুই সিটের একটা ডাবল সোফায়ও আছে।সেখানে গিয়ে বসলো নিভান।গা এলিয়ে দেওয়ার আগেই মনেহলো,একবারে ফ্রেশ হয়ে এসে বসলে ভালো হয়!উঠে দাঁড়াতেই দরজার পানে নজর দিলো।ফাঁকা দরজা।কারও পায়ের ধ্বনিও শোনা যাচ্ছে না।তারমানে কৌড়ি এখনো নিচে।তার সঙ্গ দেওয়াতে মেয়েটার ক্ষনিকের অভিমান কাটালেও, মন খারাপ কাটেনি!দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওয়াশরুমে ঢুকলো নিভান।ফ্রেশ হয়ে এসে পোশাক চেঞ্জ করে নিলো সে।দুপুরে ইমার্জেন্সি যে পোশাকগুলো অর্ডার করেছিলো,তা সন্ধ্যার একটু আগে এসে পৌঁছেছে।বাড়িতে ঢুকতেই ছোটোচাচী বিনয়ের সাথে পার্সেলটা হাতে ধরিয়ে দিলেন।ইভানকে দিয়ে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো রুমে নিয়ে এসেছে নিভান।এখানে তার কিছু নেই।যা আছে কৌড়ির প্রয়োজনীয় জিনিস।ভারী শাড়ী পরে মেয়েটা কাল সারারাত ঘুমাতে পারিনি শুধু উশখুশ করেছে।অথচ ঘুমকাতুরে মেয়েটা ঘুমানোর জন্য ছটফট করেছে।নিভানেরও ঘুম হয়নি।নিজের বেড ছাড়া হঠাৎ অন্য কোথাও তার ঘুম হয়-না।

পা দুটো সামনে এলিয়ে দিয়ে গা-ছাড়া ভাব নিয়ে সোফায় বসলো নিভান।কিছুক্ষণ পর মাথাটাও এলিয়ে দিলো সোফার হেডে।পিছনের জানালা ভেদ করে নির্মল ঠান্ডা বাতাস এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে।অকৃত্রিম সেই বাতাসের কাছে যেনো ফ্যানের এই কৃত্রিম হাওয়া কিচ্ছু নয়।চোখ বুঁজে নিলো নিভান।মূহুর্তেই কৌড়ির মেঘমেদুরে ডুবে থাকা মুখ,আর অসহায়ত্ব নিয়ে চাওয়া হরিনী ডাগরডাগর চোখজোড়া ভেসে উঠলো বদ্ধ নয়নে।উফ!মেয়েটার থেকে সামন্য নিজেকে দূরে রাখা তো দূর, অভিমানী অসন্তুষ্ট নিয়েও থাকার কায়দা বুঝি তার আর ইহকালে হবেনা।মন কাঁদবে, বুক কাঁপবে, মস্তিষ্কও তাতে সায় জানিয়ে বলবে ও অবুঝ,ও ছোটো,কি বলতে গিয়ে কি বলে ফেলেছে তাই ধরে তুই অভিমানী হয়ে বসে থাকবি?সম্পর্কে একজন অবুঝ হলে আরেকজন বুঝদার হতে হয়।মায়াময়, স্নেহশীল, দায়িত্ববান,যত্নশীল হতে হয়।নাহলে সেই সম্পর্ক অযত্নে হারিয়ে যায়।নষ্ট হয়ে যায়।আর তুই তো তা হতে দিতে পারিস-না।

কারও মৃদু পায়ের শব্দে অস্পষ্ট হাসলো নিভান।এই নিঃশব্দে চলা পায়ের শব্দও তার চেনা। চোখ খুললো নিভান।সোজা হয়ে বসলো।কৌড়ি সেটা খেয়াল করেনি।নিভানকে চুপচাপ চোখে বুঁজে শুয়ে থাকতে দেখে নিঃশব্দে ভিতরে ঢুলো।তারপর শব্দহীন হাতে
হিজাব খুলতে ব্যস্ত হলো সে।তখন পিনগুলো মানুষটা ফেলে দেওয়ায় হিজাব বাঁধবে কি দিয়ে,ভাবতে গিয়ে মনেহলো, স্টোনের বড়বড় কয়েকটা সেফটিপিন তো আছে তারকাছে।মুলত সেটা দিয়েই কোনোরকম হিজাব বেঁধে চলে গিয়ছিলো সে।বিধস্ত মন লজ্জায় চাইনি ঘুরতে যেতে,তবুও সবার কথা ভেবে যেতে হয়েছিলো।।তবে লজ্জায় মানুষটার দিকে একবারও ফিরতে পারিনি সে।

‘কৌড়ি।

হঠাৎ ডাকটা কর্ণগোচর হতেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো কৌড়ির।কান্না পেলো ভিষন।দাঁতে দাত চেপে তা আটকালো।সারাটা বিকেল আত্মগ্লানিতে ভুগেছে সে।আত্মগ্লানি যেনো দ্বিগুণ হয়েছে,সে ওমন ব্যবহার করার পরও মানুষটার তারপ্রতি খেয়াল ধ্যানে,যত্নে।তাকে সঙ্গ দেওয়ায়।সেই সঙ্গসর্স্পে নিজের অযথা ক্ষনিকের অভিমান মুছে গেলেও,আত্মগ্লানি মুছেনি।
ওই মানুষটার সাথে ওমন ব্যবহার করার পর মানুষটা কতোট কষ্ট পেয়েছে সে জানেনা,তবে সে ভিতরে ভিতরে জ্বলেপুড়ে মরছে।অসহ্য এক অনুশোচনা তাকে যন্ত্রণায়,ব্যথায় পাগল করে তুলছে।এমনকি মাইগ্রেনের ব্যথাটাও যোগ হয়েছে সাথে। মানুষটার ডাকটায় তা যেনো প্রকট হলো।ব্যথায় ঝিমঝিম করে উঠলো মাথার শিরা উপশিরাগুলো।ঠোঁটজোড়া ভেঙে ফুপিয়ে আসতে চাইলো সেই নরম ডাকে।তা কাদলো-না।তবে ডাক শুনতেই চড়াৎ করে মুখ ঘুরিয়ে পিছে ফিরলো সে।সরাসরি তাকালো নিভানের চোখে।কেমন শিশুসুলভ অবুঝ সে চাহুনি।ওই মেঘজমা মুখটা,জ্বলজ্বলে চোখজোড়া,শুষ্ক ঠোঁটদুটো বেশ কিছুসময় দেখলো নিভান।তারপর কি ভেবে মৃদু হেসে ডানহাতটা বাড়িয়ে দিলো কৌড়ির দিকে। আহ্বান জানালো।

‘কাছে এসো।

চিলছো মারার মতো মনটা যেনো দৌড়ে চলে গেলো সেই মানুষটার আহ্বানে।অথচ কৌড়ি পারলোনা যেতে।আত্মগ্লানি অনুশোচনা যেনো তার পা দুটো বেঁধে রাখলো অদৃশ্য এক বন্ধনীতে।তবে সেই আদুরে আহ্বানে স্থির হয়ে দাড়িয়েও থাকতে পারলোনা।ছোটো ছোটো কদম ফেলে এগোলো।চেয়েছিলো নিভানের পাশে গিয়ে বসবে।অথচ সেই মানুষটা তা হতে দিলোনা।নিভানের বাড়ানো হাতটা কৌড়িকে নাগালে পেতেই,তার কোলের মধ্যে বসিয়ে দিলো তাকে।এবার আর নিজের শান্ত রাখলোনা কৌড়ি।মূহুর্তেই শক্ত বাঁধনে জড়িয়ে ধরলো নিভানের গলা।ঠোঁট ভেঙে এলো নীরব কান্নায়।দাঁতে দাঁত চেপে তা আটকাতে চেষ্টা করলেও,আঁখি দ্বয়কে মানানো গেলোনা।তবে এতক্ষণে বুঝি তার বুকের ভিতরে বয়ে চলা দহনক্রিয়া কমলো।স্বস্তি পেলো,শান্তি পেলো।সুখ অনুভব করলো মানুষটার শরীরের পুরুষ স্পর্শে, গন্ধে।অনেকটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর অপরাধীস্বরে বললো–।আ’ম এক্সট্রিমলি স্যরি!

নিভান জানা সত্ত্বেও খোঁচালো–কিসের জন্য?

‘আপনাকে অকারণে অসন্তুষ্ট করেছি এজন্য।

নিভান হাসলো।সোফার হেডে মাথা এলিয়ে পুনরায় চোখ বুজে নিলো।খুব সাবলীল গলায় বললো—সামন্য বিষয় নিয়ে মন খারাপ করে কেউ?এটা নিয়ে মন খারাপ করার কি আছে!আমি তোমাকে বিয়ে করেছি, আর তুমি আমার জন্য হালাল হয়ে গিয়েছো তারমানে এই নয়, আমার যখন তখন তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তোমাকে ছোঁয়ার দলিল হয়েছে!অধিকার হয়েছে! তোমার ভালোমন্দ না বুঝে তোমাকে ছোঁয়ার গ্যারান্টি পেয়ে গেছি!হক পেয়ে গেছি!আমাদের সম্পর্কে স্পর্শ হোক বা অন্যন্য চাহিদা অনুভূতি। আমিও যেমন চাইবো,তোমাকেও তেমন চাইতে হবে।তবেই না আমরা একজন অপরজনের।তবে তুমি না চাইলেও আমার চাওয়ায় আচারণে, স্পর্শে, বার্তায় যদি অহেতুক উগ্রতা, অস্বাভাবিকত্বতা না-থেকে থাকে,নিশ্চয় আমি তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধাচারণ করতে পারি?পারি কি,আমার মনেহয় অবশ্যই পারি!সেটার জন্য আমার মনে হয়না আমি আমার স্ত্রীর হক নষ্টকারী অপরাধী!তাকে ছুঁয়ে কঠিন কোনো অপরাধ করে ফেলেছি।যেখানে আমার স্ত্রীর প্রতি আমার দায়িত্বশীলতা, যত্নশীলতা,কর্তব্য তার হক।সে না চাইলেও সেসব হক তারজন্য থেমে থাকবেনা।After-all i love her.so i want to keep her well.

‘চলবে..

#ফুলকৌড়ি
(৫৫)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

সোজাসাপ্টা সাবলীল স্বীকারোক্তি “সর্বোপরি আমি তাকে ভালোবাসী তাই ভালো রাখতে চাই।একটা মানুষ নিখুঁতভাবে সবদিকে খেয়ালধ্যান রেখে কি করে এতোটা ভালোবাসতে পারে?না পারলে এই মানুষটাকে তাকে এতো ভালোবাসে কিকরে!আর সেই ভালোবাসা, নিজের এলোমেলো অনুভূতির দাবানলে পড়ে কৌড়ি হেয় করে বসলো?মানুষটাকে ব্যথা দিলো!ভাবতেই নিবিড়বাঁধনে আরও শক্তপোক্ত হাতে নিভানকে জড়িয়ে ধরলো সে।ঠোঁট নাক-মুখ গভীরভাবে সপে দিলো নিভানের উন্মুক্ত গলার ভাঁজে।যেখানে পুরুষালী নিজস্ব গায়ের গন্ধ আর টিশার্ট থেকে ভেসে আসা সুগন্ধ, একত্রে একাকার হয়ে নেশালো অদ্ভুত এক মনোমুগ্ধকর সুগন্ধ ছাড়াচ্ছে।সেই নেশালো সৌরভে কৌড়ি মোহিত হলো।মোহাবিষ্ট হয়ে আরও নিবিড় ঘনিষ্ঠ বন্ধনে মিশে গেলো নিজের একান্ত পুরুষটার শরীরে।শ্বাস ঘনো হলো।কথা বের হতে চাইলোনা স্বর ভেদ করে মুখ থেকে।তবুও জড়ানো গলায় নিভানের কথার প্রেক্ষিতে ধীমে ধীমে বললো–

‘আমি কিচ্ছু জানিনা,জানতে চাইওনা।আমি শুধু জেনে রাখতে চাই,যাই হয়ে যাক এই মানুষটা শুধু আমারই।আমার সমস্ত অপরাধ, ভুলত্রুটি,অন্যায় যতোই সীমা ছাড়াক না কেনো, সে কখনো আমাকে তারকাছ থেকে দূরে সরাবেনা।আমার প্রতি তার রাগ অভিমান অভিযোগ যাই হোকনা কেনো, সে তার দু’হাতের শক্তপোক্ত বন্ধনি থেকে কখনো আমাকে আলাদা করবেনা।সর্বদা এভাবেই তারকাছে আামকে আগলে রাখবে।পরিস্থিতি আর জীবনের গতিবিধি যেখানে গিয়েই ঠেকুকনা কেনো সে আমার থেকে কখনো দূরে যাবেনা।যাবার চেষ্টাও করবেনা।

কোমল নারীস্পর্শটা নিবিড়রূপে পেতেই নিভানের পুরুষালী সত্ত্বাটা যেনো সংযম হারাতে চাইলো।যতোই নিজেকে সংযাত রাখার চেষ্টা করুক না কেনো।দিনশেষে এই একান্ত হালাল নারীটার পুরুষ সে!স্বামী সে!যাকে মনের ব্যাকুলতায় শরীরও একান্তভাবে পেতে চায়। আর সেই স্ত্রীর এরকম নিবিড়স্পর্শ পেলে কোন স্বামী তা উপেক্ষা করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায়!নাকি রাখতে পারে?কোনো মহাপুরুষ ছাড়া অন্য কোনো পুরুষ রাখতে পারে কি-না নিভানের জানা নেই।তবে নিভান কোনো মহাপুরুষ নয়।তবু-ও আজ তাকে মহাপুরুষের গুন ধারন করে ধৈর্য্য ধরতে হবে।শুধু আজ নয় হয়তো আরও কিছুটাদিন।বিকালের ঘটনাটার পর কৌড়ির অনুশোচনা হয়তো তাদের গভীর সান্নিধ্যে বাধা হয়ে দাড়াবেনা।তবে নিভানের বিবেক বলছে,তিনদিন আগে মেয়েটা কঠিন শারীরিক অসুস্থতা থেকে মুক্তি পেয়েছে।তাও পুরোপুরি সুস্থ নয়,ঔষধ চলছে মেয়েটার।স্বাভাবিক পিরিয়ড জনিত অসুস্থতা হলে হয়তো বিষয়টা সাধারণভাবে নেওয়া যেতো।কিন্তু ডাক্তারের মুখের বর্ননা অনুযায়ী প্রায় মাসের অর্ধেকের অধিক সময় অনিয়মিত পিরিয়ড সার্কেলে ভুগেছে মেয়েটা।
শুধু গত মাসে নয়, পিছনের মাসগুলোতে নাকি এরকম অনিয়মিত পিরিয়ড চলে এসেছে তার।সেই বিবেচনায় হলেও হয়তো তার আরও একটু ধৈর্য্য ধরা দরকার।বউটা তো তারই।কঠিন হলেও নিজেকে একটু সংযাত করলে তো ক্ষতি নেই।বরং তার মনেহয় ভালো।কোনো এক বিজ্ঞ ব্যাক্তি বলেছিলেন,মেয়েদের নাকি যেটা দেওয়া হয় সেটা নাকি তারা দ্বিগুণ রূপে ফেরত দেয়।সেটা ভালোবাসা, যত্ন, অযত্ন, যন্ত্রণা, কষ্ট যাই দেওয়া হয় না কেনো!নিভান নাহয় ভালোবাসা যত্ন দিক,দেখা যাক তা দ্বিগুণ রূপে ফেরত পাওয়া যায় কি-না!নিজের একান্ত ভাবনার মধ্যে কৌড়ির বলা কথাগুলো তাকে প্রশান্তি দিলো।ভিতরের নীরব নিবিড় অভিমান অভিযোগগুলো ধুয়েমুছে যেতে থাকলো।শক্ত হাতের বাঁধুনি আরও জোরালো হলো।কৌড়ির কথার প্রেক্ষিতে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে জবাবের বদলে বললো–

‘যদি বলি, আমার এখনি তোমাকে চাই।এবং খুব কাছে চাই।

এমনিতেই নাকমুখ ডুবিয়ে বসে আছে কৌড়ি।হঠাৎ এমন আবদারে সর্বাঙ্গ মৃদু কাঁপন দিয়ে বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠলো তার।নিঃশ্বাসও কেমন আঁটকে গেলো।তবে দ্বিতীয়বার আর নিজের অনুভূতির অসহ্যকর দাবানলে পড়ে ভুল করবেনা সে।মানুষটাকে চেনে জানে।ইদানীং বুঝতেও শুরু করেছে সে।উত্তর দিতে সময় নিলো।তবুও বললো–‘আমি জানি আপনি অবিবেচক, বিবেকহীন নন।

নিভানের ঠোঁটের কোণের হাসি চওড়া হলো।সোফার হেডে শক্তকরে সঁপে রাখা মাথা আরও শক্তকরে সপে দিলো।প্রশ্ন ছুড়লো।–জেনেশুনেও এতো অভরসা, অবিশ্বাস কেনো?

কৌড়ি ততক্ষণাত উত্তর দিলো–অভরসা,অবিশ্বাস নয়।

‘তবে?

উত্তর দিতে লজ্জা, অস্বস্তি হলো।তবুও বললো–আমার কেমন জানি হয়েছিলো।

এবার নিভানের হাসির মৃদু শব্দ হলো।লজ্জা বাড়লো কৌড়ির।সাথে সাথে নাকমুখ আরও ডুবিয়ে দিলো নিভানের গলার ভাঁজে।সেই লজ্জা আরও বাড়িয়ে দিয়ে নিভান দুষ্ট স্বরে শুধালো–কেমন?

নিভানের দুষ্ট গলার স্বর বুঝে তার পিঠ খামচে ধরলো কৌড়ি।ফের অতি নিচুস্বরে বললো—জানিনা।

নিভানের হাসি প্রস্ফুট হলেও,বউটাকে আর লজ্জায় ডুবালোনা।তবে উত্তর পেয়েও পুনরায় বললো –সত্যিই অভরসা অবিশ্বাস নেই তো?

সময় নিলো না কৌড়ি।মূহুর্তেই উত্তর দিলো—না।

নিভান এবার চোখ খুলে মাথা উচু করে বসলো।অভরসা অবিশ্বাস নেই যখন তখন বউটাকে একবার পরিক্ষা করে নেওয়া যাক।বিকালের ন্যায় অনুমতিবিহীন কৌড়ির ব্লাউজের হুকে হাত বসালো।পরপর তিনটে হুক খুলে বিকেলের পিন ফুটে যাওয়াটা আলগা করলো।সুচ ফোঁটার মৃদু চিহ্ন থাকলেও লম্বা দাগটা মিলিয়ে গিয়েছে।লাল ফোলা ফোলা ভাবটাও নেই।নিভান কোমল স্পর্শে জায়গাটা ছুলো।এতোসময় কৌড়ি চুপচাপ গাঁট হয়ে বসে থাকলেও এবার আর পারলোনা।তবে বিকেলের মতো ভুলও করলো না।
পুরুষালী রুক্ষ হাতের কোমল স্পর্শ শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঝড় তুলে দিলেও,ঢাল হিসাবে সেই মানুষটাকেই ক্ষত করলো কিন্তু মানুষটাকে ছাড়লোনা।বরং গলায় ডুবে থাকা মুখ এবার গলার ভাজ ছেড়ে নিভানের কানের পাশের নরম জায়গায় এনে শক্তকরে গুঁজে নিয়ে নিভানের পিঠের টিশার্টের অংশ দু’হাতের বলিষ্ঠ মুঠোয় চেপে ধরলো।শক্ত মুঠো টি-শার্টের অংশ ভেদ করে পিঠে আঁচড় কাটলো।তবুও নিভান নির্লিপ্ত। বরং কৌড়ির নখের আঁচড় আর ফর্সা কাঁধ তাকে নোশালো বস্তুর মতো টানলো।নিভান আগেপিছে ভাবলোনা।মাথা নিচু করে ঠোঁট বসালো বউয়ের কাঁধে। ইচ্ছে ছিলো পিনফোটা জায়গাটায় একটা আলতো চুম্বন দেওয়া।অথচ নিভানের সেই নেশালো আকর্ষণ চম্বুকের ন্যায় টেনে ধরে রাখলো কাঙ্ক্ষিত রমণীর ফর্সা মসৃন নরম কাঁধে।পুরুষালী সত্ত্বাটাকে সংযম হারিয়ে করে দিলো এলোমেলো।আলতো স্পর্শ হয়ে উঠলো,ঘনো।সেই ঘনো স্পর্শ আর কাঁধে রইলো-না।তীব্র অনুভূতির তাড়নায় কাঁধ থেকে সরে এলো নারী নরম গলার ভাজে,কন্ঠিতে।এমনকি কন্ঠি থেকে ফর্সা উন্মুক্ত গলার নিচে।অসংযত অনুভূতি স্পর্শকাতর জায়গা অনুভব হতেই মূহুর্তেই সচেতন হয়ে উঠলো নিভান।এ-র বেশি এগোলে আজ আর নিজেকে,এই নারী থেকে গভীর সান্নিধ্যে দূরে রাখা যাবেনা!একটু আগের ভাবনাগুলো সব বিফলে যাবে।ততক্ষণাত সরে এলো নিভান।তবে ভুলেও কৌড়িকে ছাড়লোনা।বরং দু’হাতে মেয়েটাকে চেপে নিলো বুকের ভিতর।সোফার হেডে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঁজে,অনুভূতিতে এলোমেলো নিজের উথাল-পাতাল ভিতরটাকে সংযাত করে নেওয়ার চেষ্টা করলো।সঙ্গে অনুভব করলো বুকের মধ্যে থাকা পাতলা দেহটার প্রবল কাঁপুনি। তার ঘনো শ্বাস প্রশ্বাসের ওঠানামা।আনমনেই হাসলো নিভান।এই মেয়ে সাংঘাতিক আদূরে।অথচ সামন্য আদর পেলেই নিজেকে ঠিক রাখতে মেয়েটা হিমশিম!এতো নাজুক মেয়েটাকে নিয়ে সামনের দিনগুলো ঠিক কেমন হতে চলেছে তার,কে জানে!বহুক্ষণ দুজনে চুপচাপ থাকলো।অনেক্ক্ষণ পর যখন অনুভব হলো,বুকের সাথে মিশে থাকা মেয়েটা স্বাভাবিক।তখন গিয়ে মুখ খুললো নিভান।

‘পায়ের ব্যাথার কি অবস্থা?ব্যাথা বেশি নাকি কম?

কৌড়ির ভিতরে তখনো ঝড়ো হাওয়ার মতো বয়ে চলছে অনুভূতির এলোমেলো তান্ডব।উপারে শান্ত দেখা গেলেও ভিতরটা এখনো লজ্জায় অশান্ত।গলার স্বরতো নিরোধন হয়ে গেছে সেই কখন!জীবনের প্রথম এতো ঘনিষ্ঠ পুরুষ স্পর্শ। তাও স্বামী নামক একান্ত পুরুষটার!মানুষটা তাকে কাছে টানলেও,আজ দুদিনে কখনো এতো গভীর, নিবিড়ভাবে ছুঁইনি।উফফ,কি নাজেহাল দমবন্ধকর অনুভূতি!নিভান প্রশ্ন করলেও উত্তর দিতে পারলোনা কৌড়ি।শুধু মাথা নাড়িয়ে না জানালো।তাতে বিশেষ কি বোঝালো সে নিজেও বুঝলোনা।নিভান তা বুঝে হাসলো।তবে নীরবে।বললো।

‘কথা বলো।

সময় নিয়ে কেমন অস্পষ্ট স্বরে কৌড়ি বললো–পায়ে তো সেভাবে ব্যাথা লাগিনি।ঠিক আছে।

‘তখন তো দেখলাম, নাফিম হাত ধরে সামনে এগোতেই তুমি কেমন ব্যাথা অনুভব করে চোখমুখ বন্ধকরে নিলে!

এটাও খেয়াল করেছে মানুষটা!লজ্জা যেনো কিছুটা কেটে গেলো কথার ছলে। বললো–হালকা মোচড় লেগেছিল।তাই হঠাৎ পা ফেলতেই একটু ব্যাথা অনুভব হয়েছিলো।তবে হাটাহাটিতে তা ঠিক হয়ে গেছে।

‘একটুও ব্যাথা নেই তো?

‘না!

আবারও কিছুক্ষণ চুপচাপ দু’পক্ষ।সময়টা নীরবতায় উপভোগ করলো।ফের নিভান বললো–কাল শাড়ী পরে ঘুম হয়নি, তাই-না?

এটাও খেয়াল করেছে মানুষটা!কৌড়ি আশ্চর্য হতে গিয়েও,নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো।ঠোঁটের কোণে ফুটলো নীরব মিষ্টি হাসি।মানুষটা নিজ থেকে তাকে বোঝে,তার আর কি চাই!নিভানের প্রশ্নের উত্তর সরূপ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।ফের মুখে ছোট্টো করে বললোো—হুমম।

চোখ খুলে কৌড়ির মাথার সিঁথির ভাঁজে চুমু খেলো নিভান।ফের বললো–‘আচ্ছা,উঠে পড়ো তাহলে।কাল ঘুমাওনি,ঘুমানো প্রয়োজন।বেডের উপর দেখো তোমার পোশাক আনিয়েছি।ফ্রেশ হয়ে ওটা পরে নাও।

কৌড়ি উঠতে যাচ্ছিলো অথচ শক্ত হাতের বাঁধন তখনো মুক্ত হয়নি।আঁটোসাটো বাধনেই তাকে আঁটকে রেখেছে।কৌড়ি নিভানের মুখের দিকে চাইলো।সেটা দেখে নিভান দুষ্টমিষ্টি গলায় বললো–এতো তাড়াহুড়ো কেনো!বলছি বলেই সঙ্গে সঙ্গে উঠতে হবে?শুধু আমার থেকে দূরেদূরে থাকার সুযোগ খোঁজা তাইনা?

সুযোগ খুঁজে দূরে দূরে আর যাবে কোথায়?আর দূরে গিয়ে থাকবেই বা কোথায়?কৌড়ি তার প্রশান্তি,সুখের ঠিকানা তো পেয়ে গেছে।পালিয়ে গিয়ে হোক বা দূরেদূরে অথবা ঘুরিফিরে, একটু শান্তিতে থাকার জন্য যে তার এই মানুষটার কাছেই আসা লাগবে।তার বুকেই আশ্রয় নিতে হবে।যার বুকে সে নিজের নিরাপত্তা খুঁজে পেয়েছে,সুখ খুজে পেয়েছে।সেই জায়গাটা ছেড়ে কি পালিয়ে বেড়ানো যায়!নাকি সেই মানুষটা থেকে দূরেদূরে থাকা যায়!কতশত ভাবলেও কৌড়ি মুখে কিছু বললোনা।নীরবে সেই ভারসাপূর্ন আশ্রয়ে মাথা রাখলো।কোমল শরীরটা ছেড়ে দিলো সেই শক্তপোক্ত হাতের বাঁধুনিতে।দু’হাতে আবারও আঁকড়ে ধরলো সেই বলিষ্ঠ পিঠ।কথা না বললেও নীরব স্পর্শে বুঝিয়ে দিলো-আমি আপনার থেকে পালিয়ে বেড়াতে চাইনা।আর না দূরেদূরে থাকার প্রয়াস করছি।

নীরবে আরও কতকমূহর্ত পার হয়ে গেলো।কেউ আর কোনো কথা বাড়ালোনা।শুধু রাতের একদল বুনো হাওয়া জানালা ভেদ করে ক্ষনে ক্ষনে ছুয়ে গেল তাদের।

ওয়াশরুমে ঢুকে গায়ের থেকে শাড়ী নামাতেই যেনো স্বস্তি পেল কৌড়ি।মনেহলো,গায়ের থেকে ভারী কোনো বস্তু নেমে গেছে।হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিভানের দেওয়া প্যাকেটা খুলতেই দেখতে পেল তাতে একজোড়া লেডিস্ নাইট স্যুট।এটা পরে ওই মানুষটার সম্মুখে যেতে হবে এখন!বাড়িতে অলটাইম সালোয়ার কামিজ পরতো কৌড়ি।ওবাড়িতে আসার পর রাতে কম্ফোর্টেবল পোশাক পরে ঘুমানোর জন্য মান্যতা, তাকে লেডিস্ টিশার্ট আর প্লাজু কিনে দিয়েছিলো।তা শুধু সে রাতেই ব্যবহার করতো।নাইট স্যুটটা কিছুটা ওরকম হলেও কমফোর্টেবল হতো।যদিও স্যুটজোড়া কিছুটা তেমনই।তবে লেডিস্ টিশার্ট আর প্লাজুর মতো ততোটাও ঢিলাঢালা নয়।ক্লান্তিতে অতশত বেশি আর ভাবলোনা কৌড়ি।পরে নিলো।পাজামাটা ঠিকঠাক মনে হলেও,নাইট স্যুটের শার্টটা লেডিস্ টিশার্টের তুলনায় শর্ট।স্যুট জোড়া গায়ে জড়িয়ে নিজেকে একবার কেমন অদ্ভুত চোখে দেখে নিলো কৌড়ি।মোটেও খারাপ দেখাচ্ছে না।আর না পোশকটা অশালীন।পোশাকটা গায়ে স্বস্তি দিচ্ছে, তবে মন ভুগছে অস্বস্তিতে।এই পোশাকে ওই মানুষটার সামনে!উফফ!!দুপুরে গোসল সেরে নিতুর সেলোয়ার-কামিজ পরেছিলো।বিকালে বাহিরে যাওয়ার সময় তা রুমে খুলে রেখে গিয়েছিলো।সেটা পরলে-ও তো হতো।খেয়ালেই ছিলোনা।

কিছুক্ষণ দ্বিধা দন্ডে ভুগে যখন বুঝতে পারলো,এই পোশাকেই বের হতে হবে তাকে।আর ওই মানুষটারই সাথেই থাকতে হবে!নিজেকে ধাতস্থ করলো।আপতত ওড়না পরতে পারলে এতো অস্বস্তিও লাগতো না।হঠাৎ অনুভব করলো,রুমের মধ্যে নীরব।লাইটের আলোটাও তীক্ষ্ণ নয়,মৃদু।ওয়াশরুমের দরজাটা হালকা খুলে উঁকি দিলো কৌড়ি।সত্যি তাই!নিভান লাইট অফ করে,সবুজ বাতির মৃদু আলোটা জ্বালিয়ে শুয়ে পড়েছে।এবার কিছুটা স্বস্তি পেলো সে।খোলা পোশাকগুলো হাতে নিয়ে বের হলো।সেগুলো আপতত সোফার উপরে রেখে,ওড়নাটা খোজ করলো।মৃদু আলোতে তা খুঁজে পেতে সময় লাগলো।বিকালে ঘুরতে যাবার আগে পোশাক পাল্টিয়েছিলো ওয়াশরুমে।আর পোশাকগুলো পাল্টে রেখে এসেছিলো বারান্দায়।মনে পড়তেই, সেখান থেকে ওড়নাটা নিয়ে গায়ে দিলো।রাত অনেকে হয়েছে।তারা বাড়িতে ঢুকেছে প্রায় এগোরোটার দিকে।বাহির থেকে খেয়ে এসেছিলো বলে খাবারের ঝামেলা আর করতে হয়নি।ক্লান্তিতে যে যার রুমে চলে গিয়েছে।কৌড়িরও প্রচুর ক্লান্তিতে ধরেছে।ঘুমে চোখ জুবুথুবু অবস্থা।অথচ হঠাৎ আবার কোথা থেকে একদল কুন্ঠা,দ্বিধা ঘিরে ধরছে তাকে।মনটা যেনো বেডে গিয়ে ধপাৎ করে এলিয়ে দিয়েছে,অথচ পা টনটন!বেডের দিকে এগোতে কেমন দ্বিধা করছে!যদিও মানুষটা কাছে টানলে কিন্তু সেসব দ্বিধা,অস্বস্তি, কুন্ঠা লজ্জা মূহুর্তেই সব গায়েব হয়ে যায়।তবে মানুষটার কাছে পৌছানো অব্দি তা প্রকট থেকে যায়।কেমন অদ্ভুত সব অনুভূতির বেড়াজালে আটকে গিয়েছে কৌড়ি।যার কোনো তাল- ঠিক নেই।বলা নেই কওয়া নেই লজ্জা, কুন্ঠা, অস্বস্তিরা, হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হয়,আবার হুটহাট মিলিয়ে যায়!একটু আগের কথাগুলো মনে পড়লে যেনো এসব অনুভূতিগুলো আরও দৃঢ় হচ্ছে।ভাবতে ভাবতে কখন যে বেডের পাশ পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে বুঝতে পারলো-না কৌড়ি।বুঝতে পারলো যখন তার কোমল হাতে টান পড়লো।মূহুর্তেই বেডে পড়ে গেলো সে।এবং চকিতেই ঢুকে গেলো কারও কাত হয়ে শুয়ে থাকা বলিষ্ঠ বক্ষতলায়।নিঃশ্বাস আঁটকে এলো।কোমল হাতজোড়ার অবস্থান আপনাআপনিই চলে গেলো উন্মুক্ত চওড়া পিঠে।সহসা সর্বাঙ্গ ছমছম করে শিহরে উঠলো।চোখমুখ ডুবে গেলো লোশমভরা বুকে।যেখান থেকে তীক্ষ্ণ জেন্স পারফিউমের সুগন্ধ সরাসরি নাকের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করে মস্তিষ্কে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে মাতোয়ারা করে তুলছে নারী কোমল মনটাকে।কৌড়ি মূহুর্তেই মোহাবিষ্ট হলো।নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হলেও কোনো উশখুশ করলো-না। বরং শান্ত থাকলো।কিন্তু তাকে শান্ত থাকতে দিলো-না স্বামী নামক নির্লজ্জ পুরুষটা।মেয়েটাকে আঁটোসাটো বাঁধনে বেঁধে নিয়ে মুখ ডুবিয়ে দিলো কৌড়ির গলার ভাঁজে কানের পাশে।অসংযত স্পর্শ চললো সেখানে।তারসাথে চললো ঘনো স্বরের অসংলগ্ন বার্তা।

‘তুমি আমাকে যতোটা ধৈয্যশীল,সহনশীল পুরুষ ভাবো।আমি ততোটা একদম নই।বিশেষ করে তোমার ক্ষেত্রে।তোমাকে কাছে পাওয়ার তাড়না সম্পর্কে সামন্যও জ্ঞাত নও তুমি!শুধু অসুস্থ বলে ছাড় পেয়ে যাচ্ছো।তবে তোমার সময়সীমা একসপ্তাহ।সেই সময়টা পিছানো ছাড়া এগোবে-না এক সেকেন্ডও।সুতরাং অবিশ্বাস অভরসা যখন নেই সর্বক্ষণ,বি রেডি!কারন তোমার দেওয়া সময়সীমাটা ফুরিয়ে আসছে,একসপ্তাহ থেকে অলরেডি তিনটা দিন চলে গিয়েছে।আর আজকের পর ভেবোনা সময়টা একসপ্তাহ পর্যন্তও গড়াবে!যদি-ও ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কোনো মানা বারণ নেই।তবে মানাটা আমার ক্ষেত্রে নিজথেকে প্রযোজ্য মনে করেছি আমি।তবে তাই বলে আমার হালাল স্ত্রীর থেকে রোজ রোজ উপবাস!নো ওয়ে!

উপবাস!কি নির্লজ্জ কথাবার্তা!মুখের লাগামে যেনো সামন্য কুন্ঠাও নেই!এতোসময়ের পাথর বনে যাওয়া মেয়েটা এবার নড়েচড়ে উঠলো।যদিও দীর্ঘকার শরীরের মধ্যে তা খুবই মৃদুতর হলো।তবুও আশ্চর্য হয়ে খিঁচে রাখা চোখমুখ খুলে ফেললো সে।বিস্ময়ে অস্পষ্ট স্বরে মুখ দিয়ে বের হয়েই গেলো–ডক্টরের পরামর্শ অনুযায়ী মানে?এসবও জিজ্ঞেস করতে হলো ডক্টরের কাছে!

নিভান হাসলো।একদম স্বতঃস্ফূর্ত।সেই হাসিতে লজ্জা পেয়ে পুনরায় চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো কৌড়ি।
বুঝতে পারলো,নির্লজ্জ পুরুষটার থেকেও নির্লজ্জ প্রশ্ন শুধিয়ে ফেলেছে সে।লজ্জায় গুটিয়ে যেতে চাইলো অঙ্গ।তা হতে দিলোনা নিভান।নিজের সাথে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে মেয়েটা নড়তেও পারলো না।গুটিয়ে যাওয়া তো দূর!নিভান সেই লজ্জা টের পেতেই গলা থেকে মুখ উচু করে কৌড়ির পানে তাকালো।হালকা সবুজ আলোয় ফর্সা গোলগাল মুখটা লোভনীয় স্বরে আহবান জানাচ্ছে তাকে।সেকেন্ড সময় ব্যায় করলোনা নিভান,আহ্বানে সাড়া দিতে।কৌড়ির গালে ঠোঁট ডুবিয়ে জড়ানো গলায় উত্তর দিলো—কৌড়ি বলতে নিভান প্রচন্ড নির্লজ্জ,বেহায়া,অসভ্য!তা হয়তো তুমি এখনো বুঝে উঠতে পারোনি!তুমি যে অসুস্থতা কাওকে না জানিয়ে পুষেছো!তা ক্ষনিকের নয়।আবার দীর্ঘস্থায়ী না হলেও একেবারে সারারও নয়।সেখানে এমন একটা বন্ধনে আমরা জড়িয়েছি,জানতেই হতো আমাকে।জানাটা গুরুত্বপূর্ণ-ও মনে করেছি আমি।তাই জেনে নিয়েছি।বিষয়টা নরমাল!

বিষয়টা নরমাল?তাহলে কৌড়ির ভিতরটাতে এমন ঝড় তুফান বয়ে যাচ্ছে কেনো!হ্দপিন্ডটার গতিবেগ এ্তো খারাপ পর্যায়ে!কখন না জানি যন্ত্রটা বুকের চামড়া ভেদ করে ছিটকে বেরিয়ে আসে!বাহিরে কৌড়ি অসাড় হয়ে চুপচাপ পড়ে থাকলেও,ভিতরের সত্ত্বাটা ঝড় তুফানের মতো এলোমেলো।কৌড়ির ঠোঁট ভেদ করে আর একটা শব্দ বের করার চেষ্টা করলোনা।যেখানে নিঃশ্বাস ফেলা দুষ্কর সেখানে গলার শব্দরা এমনিতেই বিলিন।শব্দ বেরোনোর মতো পরিস্থিতি এমনিও নেই।পুরুষালী ঠোঁটজোড়ার এলোমেলো বিচরণ চলছে তার সমগ্র মুখজুড়ে।অনুভূতিতে শিথিল সে।কথা বলবে কিকরে!যেখানে শরীরের সাড় নেই!হঠাৎ নিভান থেমে গেলো।মুখ উচু করে কৌড়ির বুঁজে থাকা চোখমুখের দিকে কিছুক্ষণ শান্ত,স্থির চোখে তাকিয়ে তাকে ডাকলো।

‘কৌড়ি।

ডাকটা কেমন যেনো মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনালো।অনুভূতিতে জুবুথুবু হয়ে চোখ বুঁজে থাকা,কৌড়ি তবুও সহসা ডাক শুনলো–হুমম।

‘আর ইউ শিউর,আমার প্রতি তোমার পূর্ন আস্থা, বিশ্বাস ভরসা আছে?অভরসা, অবিশ্বাস নেই?

কৌড়ি ততক্ষণাত উত্তর দিলো–শিওর।

উত্তর পেয়েও নিভান মুগ্ধ চোখে কিছুক্ষণ কৌড়িরপানে চেয়ে রইলো।সত্যি বলতে,তার এই হঠাৎ স্বামী জাতীয় অসংলগ্ন আচারণ নীরবে কৌড়ির মেনে নেওয়া হুটকরে মনে হুল হয়ে প্রশ্ন তুললো-মেয়েটা কি বিকালের ঘটনার পর নীরবে মেনে নিতে চাইছে সব?নাকি স্বামীর আদর ভালোবাসা পেতে তারও সায় আছে।যদি-ও কৌড়ির নারীগত আচারণ বলছে সায় আছে।তবুও মনের খচখচানি থেকে প্রশ্নটা তৃতীয়বারের মতো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শুধালো নিভান।এবং উত্তর পেতেই মনটা ঠান্ডা হলো।ঠোঁট ফুটলো মিষ্টি হাসি।ছোট্টো বউটাকে আদর দিতে মনটা আবারও অসংলগ্ন হয়ে উঠলো।তবে এবার আর বেপরোয়া হয়ে উঠলোনা নিভান।আজ বেপরোয়া হলে চলবেনা!মাথা নিচুকরে চুমু খেলো কৌড়ির মসৃন কপালে,ডাগরডোগর বদ্ধ দুচোখ,খাঁড়া নাকে,তুলোর মতো ফর্সা দুগালে।ফের নরম ওষ্ঠে।

জায়গাগুলোই চুম্বনের স্পর্শ দীর্ঘ হলেও,ঠোঁটের চুম্বনটা একটু বেশিই দীর্ঘ হলো।কৌড়ি তখনো চোখ বুঁজে শান্ত মেয়েটার মতো বরের আদরে ডুবে আছে।উম্মুক্ত পিঠে হাতের বাঁধনটা পরপর শক্ত হতেই থাকলো।চুম্বন শেষে নিভান কৌড়ির হাতের বাঁধন মুক্ত করে ধপাৎ করে তার পাশে শুয়ে পড়লো।সেকেন্ড সময় ব্যায় না করে কৌড়ির পাতলা শরীরটা তুলে নিলো নিজের বলিষ্ঠ শরীরের উপর।গা থেকে ওড়নাটা সরিয়ে,ওর মাথার চুলের বেনুনিতে হাত দিলো।বেনীটা ওয়াশরুমে দাঁড়িয়েই করেছিলো কৌড়ি।পরপর মোটা আঙুলের ভাজে বেনী খুলে ফেললো নিভান।নিজের মাথার নিচে আরও একটা বালিশ দিয়ে মাথাটা উচু করে, কৌড়ির চুলের ভাজে আঙুল চালালো।কপাল মুখ থেকে এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে, মুখ উচু করে ফের সিথির সম্মুখে কপালে চুমু খেলো।একহাতে কৌড়িকে জড়িয়ে রেখে, অন্যহাতটা কৌড়ির মাথার চুলের ভাঁজে গলিয়ে দিয়ে বললো—ঘুমিয়ে পড়ো।

কৌড়ি শব্দ করলো-না।স্বামীর আদর ভালোবাসার মোহ এখনো কাটিনি তার।গত দুদিনে মানুষটা কাছাকাছি থাকলেও,তার স্পর্শ পেলেও এতোটা গভীরে অনুভব হয়নি।যা আজ হলো।স্বামীর আদর ভালোবাসা ঠিক কি!আর কতোদূর সেই ভালোবাসা গড়ায় এটা কৌড়ি জানে।তবে সেই স্পর্শের অনুভূতি এতোটা প্রবল হয়,নিজেকে এতোটা এলোমেলো করে দেয়, কৌড়ির জানা ছিলোনা।নিজেকে সামলাতে হিমশিম কৌড়ি,শান্ত হয়ে চুপচাপ রইলো নিভানের উন্মুক্ত বুকে।তবে অনুভব করলো,উন্মুক্ত বুকটা তারকাছে বিছনার চেয়ে আরাম আর শান্তির।যা তার ক্লান্ত শরীরটাকে আর বেসামাল মনটাকে দ্রুত নিস্তেজ করে দিয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে দিলো।বেশ কিছুসময় পর কৌড়ির ঘনো শ্বাস বুকে পড়তেই নিভান মুখ সামন্য উচু করে চাইলো।মেয়েটা ঘুমে বিভোর।ঘুমন্ত কৌড়ি আরও মোহনীয় আরও আকর্ষনীয়, আরও মুগ্ধময়,আরও সুন্দর।যা চম্বুকের ন্যায় টানলো নিভানকে।কিন্তু ঘুমান্ত মেয়েটাকে একটুও বিরক্ত করতে ইচ্ছে করলোনা তার।তাই মাথাটা বালিশে এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঁজে নিলো সে।হাতের বাঁধন দৃঢ় করে অস্পষ্ট স্বরে কেমন দূর্বল মায়ামায়া গলায় বললো।

‘আমার বলতে কিচ্ছু না থাকলে-ও,তুমি অমৃত্যুকাল আমার হয়ে থেকো কৌড়ি।আমাকে বাহিরে শক্তপোক্ত মানুষ হিসাবে সবাই জানলেও,আমি ভিতর থেকে ভিষন দূর্বল কৌড়ি।সেটা তুমি জানোনা!তুমি কেনো।কেউই জানে-না কৌড়ি!আমার সবলতা বাবা ছিলেন।অদ্ভুত এক সবলতা।হয়তো প্রতিটা সন্তান তার নিজ নিজ বাবার মধ্যে সেই সবলতা অনুভব করে।কিন্তু বাবাকে ঘিরে আমার সব অনুভূতি ছিলো অদ্ভুত ধরনের।উনাকে জড়িয়ে ধরলে অদ্ভুত এক শক্তি,শান্তি, নিরাপত্তা অনুভব করতাম।মনে হতো-তিনি আমার বলরেখা।যা টপকে কখনো কোনো খারাপ কিছু আমাকে ছুঁতে পারবেনা।তিনি ছুঁতে দেবেননা।অথচ বাবা হারিয়ে যেতেই,সেই সবলতা হারিয়ে ভিতরের আমি দুর্বল হয়ে পড়লাম।মনে হতে থাকলো,বাবা হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার জীবনের সবলতা,সুখ,শান্তি,নিজ আশ্রয়,আপনমানুষ সব হারিয়ে যেতে শুরু করলো!হারিয়ে গেলেও তাই!আমার গোছানো সুন্দর জীবনটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেল।
তবুও আমি খুঁটির মতো শক্ত থাকার চেষ্টা করলাম।যদিও জীবনের একটা একটা ধাক্কায় আমি খুঁটির মতো শক্ত হতে বাধ্য হলাম।অথচ ভিতরের মনটা আমার ভিষন দূর্বল হয়ে পড়লো।বাহিরের শক্তপোক্ত আমি ভিতরের দূর্বলতায় নিজেকে আর গুছিয়ে নিতে চেয়েও কিছুতেই গুছিয়ে নিতে পারলাম না।বাহিরের নিভান সফলতায় আকাশচুম্বী হলেও ভিতরের নিভান কতো ব্যর্থ তুমি জানোনা কৌড়ি।আর সেই পুরানো সবলতা, অদ্ভুত এক শক্তি,শান্তি আমি তোমাতে অনুভব করেছি।বাবাকে জড়িয়ে ধরলে যেমন একটা সুখ সুখ অনুভব হতো।তোমাকে বুকে জড়িয়ে নিলে তেমন অদ্ভুত এক সুখ সুখ আমাকে ঘিরে ধরে।ভিতরের দূর্বলতা কেটে গিয়ে সেখানে প্রশান্তি অনুভব করে।মন বলে-আমারও একজন আপন মানুষ আছে।আামর বাবার মতো আপন মানুষ।

আপনমনে কথা বলতে বলতে একটু থামলো নিভান।পুরুষ মানুষের নাকি কাঁদতে নেই অথচ বাবাকে মনে পড়লে তার চোখে অশ্রু না ঝরলেও মন কাঁদে।ভিষণ কাঁদে।নিভান চোখ বুঁজে নিলো।মূহুর্তেই কার্ণিশ বেয়ে অযত্নে নোনাজল গড়ালো।কেনো বাবা চলে গেলেন, তবে তার আরও একজন আপনমানুষ থাকতো।কৌড়িকে জড়িয়ে রাখা হাতের বাঁধন দৃঢ় হলো তার।চোখ বুঁজে রেখেই অস্পষ্ট স্বরে ফের বললো—বাবা অসময়ে আমাকে ছেড়ে চলে গেলেও,তুমি যেওনা কৌড়ি।অন্তত আমার মৃত্যুর আগ অব্দি আমাকে ছেড়ে কোথাও যেওনা।আমার মৃত্যুর অপেক্ষা করো আমার ফুলকৌড়ি।

চলবে….

ফুলকৌড়ি পর্ব-৫২+৫৩

0

#ফুলকৌড়ি
(৫২)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

চারপাশটা ঘনো অন্ধকার।নিঃশব্দ নিরিবিলি শান্ত পরিবেশ ।ঝিঁঝি পোকার মৃদু আলোড়ন ছাড়া তেমন কোনো শব্দ নেই।নেই আজকের আকাশে চাদের দেখাও।তবে কিছু সংখ্যক নক্ষত্র আকাশের বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মিটিমিটি জোনাকি পোকার ন্যায় জ্বলজ্বলে আলো ছড়াচ্ছে।চমৎকার দৃশ্যাবলী।কৌড়িকে বুকে জড়িয়ে নিতেই আচমকা বুকে কিছু একটা বিধলো নিভানের।বুঝতে পারলো জিনিসটা কি?
তবে পেলব শরীরটাকে নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে না নিতে পারলে কেমন শান্তি পাওয়া যায়না।মেয়েটাকে কাছে পাওয়ার যে বাসনা,সেই বাসনা তৃপ্ত হয়না।সহসা সন্তপর্ণে কৌড়ির গলায় হাত রাখলো নিভান।পুরুষলী রুক্ষ হাতের দৃঢ় স্পর্শ পেতেই মূহুর্তেই শিহরণ দিয়ে মৃদু কেপে উঠলো নরম ফিনফিনে শরীরটা।অনুভব করলো নিভান।তবে হাত থামালো না।রুম থেকে আসা মৃদু আলোতে কিভাবে কিকরে যেনো অভিজ্ঞ হাতে কৌড়ির গলার মালাহারটা খুলে ফেললো।খুলে ফেলতেই সেটা হাতে এনে নিজের ট্রাউজারের পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো।মেয়েটাকে এবার নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়ে মৃদুস্বরে শুধালো।

‘সাজিয়ে দিলো কে?

কৌড়ি কেমন যেনো সাহস দেখিয়ে নিভানের বুক থেকে মাথা তুললো।মাথাটা হালকা পিছে সরিয়ে নিভানের মুখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললো—ছোটোচাচী।

জানালার ফাঁক গলিয়ে রুমের মৃদু আলো এসেছে পড়েছে কৌড়ির মুখে।সেই লুকোচুরি আলোতে সাজবিহীন একটা স্বর্ণের টিকলিতে মেয়েটাকে অপূর্ব লাগছে।নিটোল ফর্সা কপালে ওই আকাশের নক্ষত্রের ন্যায় জ্বলজ্বল করছে টিকলিটা।এই মেয়েটাকে যে সাজপোশাকেই আর যেমন রূপেই দেখুক না কেনো, নজর মুগ্ধ হতে বাধ্য হয় নিভানের।নিভান গভীর নিস্প্রভ নজরে কিছুক্ষণ একহারা দেখলো মেয়েটাকে।এই নারীটাকে ঘিরে তার চাহিদা ভালোবাসাগুলো ভিষন নরম,কোমল।তাকে একটু ছোঁয়া,একটু ভালোবাসার,একটু কাছে পাওয়ার তীব্রতা খুব গাঢ় হলেও,তারপ্রতি ভালোবাসাগুলো খুব আলতো,তাকে ছুঁয়ে দেওয়ার বাসনাগুলো খুব নরম।একদম খাঁটি মন থেকে বেরিয়ে আসা স্নিগ্ধ মনোবাঞ্ছা।অথচ পুরুষ চাহিদাটা যখন মেয়েটাকে ঘিরে নিজের ভিতরটাকে তোলপাড় শুরু করে দেয়, তখন নিজেকে সংযাত রাখা, সংযম করা কঠিন দ্বায় হয়ে পড়ে।এই দ্বায়টা কালথেকে উৎপাত করা শুরু করে দিয়েছে।অথচ মস্তিষ্ক, বিবেক প্রতিমূহর্তে সেই চাহিদার বিপক্ষে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলছে,মেয়েটা অসুস্থ।তাকে সময় দেওয়া অতি অবশ্যই প্রয়োজন।যেখানে মেয়েটা আমৃত্যু পর্যন্ত তোর।সেখানে এতো অসংযত, অসংযম কেনো!এতো তাড়াহুড়োই বা কেনো!কর-না নিজের পৌরুষ আকাঙ্ক্ষাকে একটু সংযম, সংযাত।তবেই না তুই নিয়ন্ত্রাধীন পুরুষ!যার কামনা বাসনাগুলো একান্ত স্বস্ত্রীর জন্য হলেও, প্রয়োজনে সে সংযমী।

নিজের ভাবনায় বিভোর হয়ে আলগোছে কৌড়ির কপালের টিকলির নিচে দু-ভ্রুর মাঝে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে সময় নিলো নিভান।নিজ পুরুষ চাহিদাকে সংযাত করার প্রচেষ্টা করলো হয়তো!স্পর্শ পেতেই চোখ বুঁজে নিলো কৌড়ি।নিভান শুধু কৌড়ির কপালেই থেমে থাকলো না, গড়ীরভাবে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিলো প্রিয়তমা স্ত্রীর নাকের উপরের অংশভাগকেও।ফের চোখবুঁজে থাকা কৌড়ির দিকে একপল তাকিয়ে নিজের ওষ্ঠ নিয়ে রাখলো সেই একান্ত নারীর গোলাপের পাপড়ির ন্যায় নরম ওষ্ঠে।আচমকা গভীর স্পর্শে কৌড়ি চোখমুখ আরও খিঁচে বন্ধ করে নিলো।শক্তহাতে খামচে নিলো,নিজস্ব পুরুষটার পিঠের শার্টের অংশবিশেষ।তারপর পুরুষালী ওষ্ঠের স্পর্শ যখন সয়ে এলো,সময় পেরুতেই ধীরেধীরে নিজেকে সহজ করে নিলো স্বামীর স্পর্শে।এরপর সময়ের কাঁটাটা এক দুই করে এগোতেই থাকলো।একটা সময় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকলো।অথচ স্ত্রীকে ছাড়ার লক্ষ্মণই পরিলক্ষিত হলো-না সেই মানবের মধ্যে।হাতে মুঠোয় শার্টের অংবিশেষ দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হতে থাকলো কৌড়ির।শার্ট ভেদ করে সেই মুঠো বলিষ্ঠ পিঠেও আঁচড় কাটলো বৈকি।তবুও ভ্রুক্ষেপহীনভাবে তার ওষ্ঠজোড়া গভীর আশ্লেষে ছুয়ে যেতে থাকলো সেই পুরুষ ওষ্ঠজোড়া।একটা সময় শ্বাসের অকুলনে ছটফটিয়ে উঠলো কৌড়ি।আর ঠিক তখনই ছেড়ে দিলো নিভান তাকে।আলাদা হলো দুজোড়া ওষ্ঠ।কৌড়ি নিভানের বুকে মাথা রাখলো।থেমে থেমে দূর্বল নিঃশ্বাস ফেলে আরও জড়োসড়ো হলো সেই ভরসাপূর্ন আশ্রয়ে।নিভান দু’হাতে তাকে আগলে নিয়ে আলগোছে হাসলো। ফের দুষ্টমিষ্টি গলায় বললো।

‘এইযে তোমাকে বারবার এরকম অপরূপা অনন্য সাজে সাজিয়ে আমার সম্মুখে উপস্থাপন কোরে,আমার সংযমের পরিক্ষা নিচ্ছে সবাই!নিচ্ছো তুমিও!এটা কি ঠিক?একবার নাহয় ঠিক।বারবার কিকরে তা ঠিক হয়?
ঠিকযে নয়,তার অপ্রাপ্য শাস্তি এটা।

অপ্রাপ্য শাস্তি!যে ছোঁয়ার স্পর্শ উপরিভাগ হলেও কলিজা ছেদ করে যায় তা সাধারণ বা অপ্রাপ্য হয় কি করে!কথার সারাংশ বেশ বুঝলো কৌড়ি। উত্তর দিলো-না।নিজের শ্বাস স্বাভাবিক করতে ব্যস্ত সে।সেদিকে খেয়াল দিলো-না নিভান।তবে মেয়েটাকে আরও সতর্কস্পর্শে আগলে নিলো নিজের সাথে।ফের নজর রাখলো সামনের নিকেষ কালো অন্ধকারে।সময় অতিবাহিত হলো।কিয়ৎক্ষন দু’জনের মুখে শব্দরা ভিড়লোনা।বেশ অনেকটা সময় পর নিভান শুধালো।

‘ঘুম পাচ্ছে?

অনেকক্ষণ পর নিজেও স্বাভাবিক হলো কৌড়ি।নিভান প্রশ্ন শুধাতেই নমনীয় গলায় উত্তর দিলো সে।–ঘুম পেলেও বারান্দায় এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে।

এভাবে দাড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে!কথার মর্মার্থটা অনুভব করেই মেয়েটাকে আরও নিবিড় স্পর্শে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো নিভান।দক্ষিণের মৃদুমন্দ হাওয়া বয়ে চলেছে ঝিরিঝিরি।দুজনকে ছুয়ে দিচ্ছে তা ক্ষনে ক্ষনে।সময়টা বেশ উপভোগ্যময়।তবুও কৌড়ির কথা প্রেক্ষিতে নিভান বললো–সেই অসুস্থ হওয়ার পর ঘুমটা প্রয়োজন ছিলো তোমার।অথচ তারপর একটা রাতও ঠিকঠাকভাবে ঘুমাতে পারলে না।অসুস্থতা তো বাড়বে!শরীর আরও খারাপ করবে তো!

‘একটা রাত আর কিচ্ছু হবে-না।জেগে থাকলেও রাতগুলো তো আমার দুশ্চিন্তায় আর কষ্ট ক্লেশে কেটে যাচ্ছে না!বেশ শান্তিপূর্ণ আর আরামেই যাচ্ছে। আর এমনিতেই আমি যথেষ্ঠ সুস্থ আছি।

নিভান আর কথা বাড়ালো-না।দক্ষিণা হাওয়ার ঝাঁপটাটা এবারে একটু তীব্র রূপে বইলো।দুজনের শরীরটা ছুঁয়ে যেতেই চোখ দুটো বুঁজে নিয়ে কেমন স্বস্তি শান্তির ঘনো নিঃশ্বাস নিলো নিভান।কৌড়ি সেটা বুঝতে পেরে মাথা উচু করে আবারও তাকালো নিভানের মুখের পানে।তখনো নিভান চোখ বুঁজে।তবে চোখবুঁজেও কৌড়ির গতিবিধি অনুভব করতে পারলো।কেমন অদ্ভুত গলায় বলতে থাকলো।

‘মায়ের সাথে এবাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর আরও দু’বার এবাড়িতে এসেছি।এই ভূতুড়ে বাড়িটা আমাকে অদ্ভুত শান্তি দেয়,স্বস্তি দেয়,জানো!এখানের আলো বাতাস,খোলা আকাশ,এই ভূতুড়ে বাড়িটা,সবকিছু কেমন আমার আমার মনেহয়।একান্ত, নিজস্ব মনেহয়।আপন আপন মনেহয়।অথচ এই স্বস্তি এই শান্তি এই আপনতা,এই নিজস্বতা আমার ওই বাড়িতে কখনো অনুভব হয়না।এবাড়িতে সামন্য শিশুকাল ছাড়া আমার কিচ্ছুটি নেই।এই শিশুকালও ধোঁয়াশার মতো শুধু একদলা আবাছা স্মৃতি।তা সত্ত্বেও এবাড়িটা কেমন যেনো আমাকে টানে।অথচ ওবাড়িটায় আমার শৈশব কৈশোর বেড়েওঠা,কতো কতো-স্মৃতি, ভালোমন্দ সবকিছু,থাকা সত্ত্বেও ওবাড়িটাতে আমি সেই আপনতা, নিজস্বতা খুঁজে পাইনা।নিয়মকরে স্বস্তি শান্তির শ্বাস প্রশ্বাস তো ছেড়ে যাই,তবে প্রানখুলে স্বস্তি শান্তি পাইনা। সবসময় মনেহয় ওবাড়িতে আমার বলে কিচ্ছুটি নেই। কিচ্ছু না।

কৌড়ি অবাক।অদ্ভুত শোনালো নিভানের গলার প্রতিটি বাক্য।অথচ সেই অদ্ভুত গলার স্বরটা পড়ার ক্ষমতা হলো না তার।পুরুষালি স্বরের সেই শব্দগুলোয় অনুরাগ অভিযোগ, নাকি অভিমান মিশানো ছিলো বুঝলোনা কৌড়ি।কেমন আশ্চর্য গলায় বললো।

‘ওবাড়ির সবাই কিন্তু আপনাকে খুব ভালোবাসেন।বড়মার কথা বাদ আঙ্কেল কিন্তু আপনাকে প্রচন্ড স্নেহ করেন, ভালোবাসেন।ইভান ভাইয়া,মান্যতা আপু,এমনকি নাফিম,মৌনতাও কিন্তু আপনাকে যথেষ্ঠ শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসেন।

তুমি যে সুন্দর চিত্তটা ওবাড়িতে এসে দেখেছো কৌড়ি।এমন চিত্তটা আগে ছিলোনা ওবাড়ির।আর নিভানকে ভালোবাসার মানুষও তখন ওবাড়িতে সীমিত ছিলো কৌড়ি।খুবই কম।হয়তো সংখ্যায় মা বাদে ওই একজনই ছিলেন।যার পিতৃস্নেহ কখনো তাকে ওই বাড়িটা পরিত্যাগ করতে দেয়নি।বারবার তার এগোনো পা-কে আরও দুকদম করে পিছিয়ে দিয়েছে।আটকিয়ে রেখেছে নিজ মায়াজালে।তবে সেই মানুষটাও কি জানতো,ওই বাড়িটায় সারাটাক্ষন ওই ছোট্টো নিভান কি কি সহ্য করতো?কতো ছোটো বড় কটুবাক্য শুনতে হয়েছে তাকে?নিজের বলে কিছু নেই,পরের ছেলে পরের ছেলে বলে কতো লাঞ্চনা,অবাঞ্ছিত কথা শুনতে হয়েছে?কোনো কিছু ধরার,কোনো কিছু ছোয়ার একছত্র অধিকার ছিলো না সেই ছেলেটার!সম্পর্কের সুত্র অনুযায়ী নিভানের ডাকগুলোও তাদের পছন্দ হতো না। যার ছিলো সব অথচ ধরা,ছোঁয়ার অধিকার ছিলোনা কিচ্ছু।সে যে পর রক্ত ছিলো!ছিলো আগাছাও!সবকিছু সেই ছোট্টটা থেকে এই নিভান কতোকিছু ভেবেই না গিলে হজম করে এসেছে কৌড়ি!সেই নিচুবাক্যগুলো,অবলেহা অপমানগুলো যদি তুমি শুনতে,জানতে,নিজচোখে দেখতে কৌড়ি!সেই অবহেলা!উফফ!এইযে তুমি এবাড়িতে এসে নাটক সিনেমার মতো সুন্দর সাজানো গোছানো একান্নবর্তী পরিবারের দৃশ্যগুলো দেখছো।পরিবারের পরিবেশটাও এরকম ছিলোনা।সেখানে নিচু মানসিকতার আরও কিছু লোক ছিলো।যারা পরিবারের অসময়ে নিজেদের রঙ দেখিয়ে নিজ পরিবার ছেড়েছে, সংসার ছেড়েছে।আর এই নাটক সিনেমার দৃশ্যের মতো সাজানো গোছানো সংসারটা হয়েছে তাদের বিদায়ের পর।যদিও সাজানো গোছানো সংসারটা গড়তে বেশ সময় লেগেছে।আর সেখানে আজীবন অবহেলা অবজ্ঞা সহ্য করেও দুটো মানুষের মুখ চেয়ে নিজের ইচ্ছে আকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করে,কঠিন অবদানের মধ্যে নিভান তারপ্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান আর ভালোবাসার জায়গাগুলো নিজগুণে অর্জিত করে নিয়েছে।এসব শ্রদ্ধা সম্মান ভালোবাসা তোমার নিভান এমনি এমনি সহজে পাইনি কৌড়ি। বিনিময় দিয়ে পেতে হয়েছে।চাইলেই কি সেসব ক্ষতবিক্ষত কাটাছেঁড়ার দাগ সহজেই মন থেকে মুছে ফেলা যায়?নিভানতো চেয়েছিলো মুছে ফেলাতে অথচ দাগ কিছুতেই উঠেনি।এতো এতো ভালোবাসা পাওয়ার পরও ডলে ঘেঁষে-মেজেও তা উঠে নি।যদিও ভাগ্য, প্রভু প্রদত্ত ছাড়া খান্ডানো সম্ভব নয়।নিভান নিজের ভাগ্য মেনে নিয়ে সামনে এগিয়েছে।সেখানে কাওকে বুঝতে দেয়-না নিজের ভিতরের ক্ষত। ব্যথা,বেদনা।নিজমনে কৌড়িকে আলাপনে রেখে হাজার কথা আওড়ালেও, আজ তাকেও জানতে দিলেনা, বুঝতো দিলো-না নিজের গোপনীয় ব্যথা।বুকে জমে থাকা শতশত কথাগুলো।ভিতরের দগ্ধ হয়ে থাকা ক্ষত চিহ্নের গল্পগুলো।অথচ মেয়েটা নির্বাক চহুনিতে তাকিয়ে আছে তার কথার কিছু একটা প্রতিত্তোর পাওয়ার জন্য ।অনেকটা সময় পর নিভান মুখ খুললো।

‘সেজন্য তো দাদুমার বারবার এবাড়িতে ফেরার অনুরোধ,আমি ফিরিয়ে দিয়ে ওবাড়িতে থেকে গেছি। মায়ের জন্য থেকে গেছি।আঙ্কেলর পিতৃস্নেহে, ভাইবোনদের ভালোবাসায় থেকে গেছি।

কোথাও যেনো একটা সুর কাটা!ঠিক মিলছে-না গানের শব্দগুলো কথাগুলো,সাথে সুরটাও কেমন ছাড়া ছাড়া অগোছালো ভাব!কৌড়ি নিষ্পলক,নির্বাক চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকলো,তাকে জড়িয়ে রাখা মানুষটাকে।অথচ বিয়ের একটাদিন কেটেছে মাত্র।তারমধ্যে লজ্জা লাজুকলতা ভুলে গিয়ে মানুষটাকে একটু বোঝার জন্য কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।সবসময়ের মতো সাবলীল মুখভঙ্গি মানুষটার।অথচ মুখে উচ্চারিত শব্দগুলো,গলার স্বর ঠিক লাগলো-না কৌড়ির।তবে কাওকে খুঁচিয়ে তার ভিতরের কথাগুলো কখনো জানার শোনার অভ্যাস নেই কৌড়ির।সেই অনাড়ী অভ্যাসের জন্য,মন কতো কিছু জানতে চাইলেও প্রশ্ন করা হয়ে উঠলো-না তার।তবে মুখোভঙ্গিমায় জানা বোঝার চেষ্টা করলো,তাকে ভালো রাখার প্রয়াসে থাকা মানুষটার ভিতরে ঠিক কি চলছে।সক্ষম হলোনা তার চেষ্টা। তবুও চেয়ে রইলো সে।মেয়েটাকে অনুভব করে নিভান এবার চোখ খুললো।মিষ্টি হেসে মাথা নিচু করে কৌড়ির মুখের কাছাকাছি হয়ে জিজ্ঞেস করলো।

‘কি হয়েছে?কি দেখছো?

শান্ত,অদ্ভুত মায়াময় গলার স্বর।কৌড়িও ঘোরে পড়ে গেলো।উত্তর দিলো–‘বোঝার চেষ্টা করছি।

হাতের বাঁধন শক্ত হলো নিভানের।কৌড়ি মুখ উচু করতেই যেটুকু বাঁধন আগলা হয়েছিলো,পুনরায় তা দৃঢ় করে নিলো নিভান।মূহুর্তেই দুজনের শ্বাসপ্রশ্বাস মিশে একাকার হয়ে মিলিয়ে গেলো।নিভান ফের অদ্ভুত গলায় শুধালো —বুঝতে পেরেছো কি?

ওই দৃঢ় চহুনী।গলার স্বর।শ্বাসপ্রশ্বাসের ঘনত্ব বেশিক্ষণ নিতে পারলোনা কৌড়ি।কাল থেকে তার একটা নির্ভরতম জায়গা হয়েছে।জায়গাটা খুব আরামদায়ক, খুব প্রশান্তির।সেখানে মাথা রাখলো সে।হঠাৎ বিয়ের আগের বলা নিভানের নানুমার কথাগুলো মনে পড়লো তার।তিনি মানুষটার শৈশব কৈশোরের বিভিন্ন অসুখকর গল্প শুনিয়ে বলেছিলেন—এই মানুষটার জীবনের এমন একজন জীবন সঙ্গীনি আসে,সেই সঙ্গীনি যেনো এই মানুষটাকে খুব করে বোঝে।তাকে খুব ভালোবাসে।যত্ন নেয়।আজ সেই জীবনসঙ্গীনি কৌড়ি নিজেই।অথচ এই মানুষটাকে তিল পরিমান বোঝার ক্ষমতাজ্ঞান তার নেই।তবে সে এই মানুষটাকে খুব ভালোবাসবে,যত্ন নেবে,আগলে রাখবে।তাতে মানুষটাকে বুঝুক আর না বুঝুক।তবে প্রশ্নকৃত মানুষটার উত্তরসরূপ সে বললো।

‘নাহ।তবে ঠিকই একদিন বুঝে যাবো।সেদিন হয়তো আমার থেকে-ও আপনি আপনাকে-ও বুঝতে পারবেন না।

ঠোট প্রসস্থ হলো নিভানের।যেটা কৌড়ির নজর গোচর হলো-না।দু’হাতের বন্ধনী আরও শক্ত করে নিভান বললো—আই উইশ,সেই সময়টা খুবই দ্রুত আসুক।

প্রতিত্তোর করলোনা কৌড়ি।
সময়টা আর-ও কিছুক্ষণ পার হলো।দুজনেই চুপচাপ।শান্ত কৌড়ির আজ যেনো চুপ থাকতে ইচ্ছে হলো-না। মানুষটার সাথে কথা বাড়াতে,তার কথার বিপরীতে মানুষটার কথাও শুনতে ইচ্ছে হলো।তাই প্রাসঙ্গিক কথা বাড়াতে বললো—এবাড়িটা কেমন শান্ত নিরিবিলি।তবে বাড়ির চারপাশটায় কেমন পুরানো জমিদার বাড়ির ভাব রয়েছে।জানেন,আমি একবার বাবার সাথে জমিদার বাড়ি দেখতে গিয়েছিলাম।বাড়িটা কিছুটা এরকম গঠনাভাব ছিলো।যাই হোক,তবে এবাড়ির সবকিছুর থেকে সুন্দর হচ্ছে পুকুরঘাট দুটো।আপনি দেখেছেন,বাড়ির পিছনের বিলাশ বড়ো পুকুটার দুটো শানবাঁধানো ঘাট?বাড়ির ভিতরের দিকের ঘাটটা বেশি সুন্দর।ঘাটের পাশের কামেনি ফুল গাছটা কতো বড়!ফুল ফুটে গাছ ভরে গেছে।পুকুর তো পুরো সাদা হয়ে গেছে কামেনি ফুলের পাপড়িতে।ওপাড়ের বাশবাগনটাও ভিষন সুন্দর।বাগানের মধ্যেও গাছগুলো এতো বড়বড়, মনেহচ্ছে আমরা পিঁপড়ে হাঁটছি।

এযেনো নানা বাড়ির গল্প মায়ের সাথে।নিভান মনোযোগ দিয়ে শুনলো।সচারাচর কৌড়ি এতো কথা বলেনা।কথার বলার কারনটাও হয়তো ধরতে পারলো সে।কৌড়ির কথার বিপরীতে বাহির থেকে নজরটা হাঁটিয়ে এনে নিজের বুকের মধ্যে জড়িয়ে থাকা রমনীর দিকে ফিরলো।তখনও কৌড়ি অনর্গল বলে যাচ্ছে। একটা সময় থামতেই নিভান বললো।

‘এবাড়িটা পছন্দ হয়েছে খুব?

‘পছন্দ হওয়ার মতোই তো বাড়ি।কতো সুন্দর পরিবেশ।

‘তবে থেকে যাবে নাকি?

কৌড়ি মাথা উচু করে ফের তাকালো।কেমন অবাক করা সেই চাহুনী।হয়তো নিভানকে সে বুঝে উঠতে পারছেনা।আজ মানুষটার হলোটা কি?হুটহাট কেমন কেমন অসংলগ্ন কথা বলছে!তবে নিভানকে গাঢ় চোখে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে দেখে যত্রতত্র চোখ নামিয়ে নিয়ে বললো–পছন্দ হলেই যে, সব জায়গায় বা সেই জায়গায় থেকে যেতে হবে এমনটা নয়।বড়জোর সেই ভালোলাগার টানে সেই জায়গায় বারবার যাওয়া আসা যায়,তবে নিজেদের আপনজন ছেড়ে,ভালোবাসার মানুষগুলো ছেড়ে একেবারে থেকে যাওয়া যায়না।

সংগোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো নিভান।নজরটা আবার নিকেষ কালো অন্ধকারাচ্ছন্নে ডুবিয়ে বললো—তা যা বলেছো।তবে তুমি চাইলে যাওয়া আসার বদলে থেকে যেতে পারো।এবাড়িতে সারাজীবন থেকে যাওয়ার অধিকার রয়েছে তোমার।

নিভান দীর্ঘশ্বাস সংগোপনে ছাড়লেও বুকে মাথা রাখা রমনীটি বুঝি তা অনুভব করতে পারলো।আবারও মুখ তুলে চাইলো সে।কি চলছে মানুষটার মনে?কেনোই বা মানুষটা বারংবার এমন অদ্ভুত সব কথা বলে চলছে?কেমন অবুঝ চাহুনিতে চেয়ে থেকে তারচেয়েও অবুঝ গলায় কৌড়ি বললো–ওবাড়ির মানুষগুলোও আমাদের খুব ভালোবাসে।

চোখ বুঁজে নিলো নিভান।সময় নিলো নিজেকে ধাতস্থ করতে।ফের চোখ খুলে মুখে মিষ্টি হাসি টানলো।কৌড়ির মনেহলো,ওই হাসি তারজন্য জোরপূর্বক।কৌড়ির অবুঝ চেয়ে থাকা চোখের দিকে তাকিয়ে সেই হাসি প্রসস্থ করলো নিভান।অনেকটা সময় পর দীর্ঘ একটা চুমু খেলো কৌড়ির কপালে।ফের কৌড়ির মাথার পিছে হাত রেখে নিজের বুকে চপে ধরে বললো–হুমম।সবাই আমাদের খুব ভালোবাসে।

সহজ শব্দের কিছু বাক্য। একটু আগে কৌড়িও উচ্চারণ করলো অথচ এতোটা বিষাদ অস্বাভাবি কি লেগেছিলো নিজের কানে?নাতো!তবে খুব শান্ত সহজ গলায় বলা মানুষটার কথাগুলো এতো অস্বাভাবিক শোনালো কেনো?কি চলছে মানুষটার মনে?তার কি কোনো কারণে মন খারাপ?নাকি কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তায়?কৈ একটু আগে তো সবকিছু ঠিকই ছিলো।তবে হঠাৎ কি হলো?

‘আমার কেনো মনে হচ্ছে আপনি ঠিক নেই!

পুরানো স্মৃতিগুলো মনে পড়তেই কেমন যেনো বিষাদে ছেয়ে গিয়েছিলো ভিতরটা।হয়তো তার আচ কথার মধ্য প্রভাব ফেলেছে।আর তার শান্তশিষ্ট বুদ্ধিমান বউটা ঠিকই সেটা অনুভব করতে পেরেছে।কৌড়িকে নিবিড়-বন্ধনে জড়িয়ে নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার সময় নিলো নিভান।ঘনো ঘনো শ্বাস ফেললো।ফের কিছুটা প্রানবন্ত গলায় বললো।

‘বাহ,আমার বউটা বলতে বলতে আমাকে বুঝতেও শিখে গেছে।নট ব্যাড।

সিরিয়াস প্রশ্নের প্রাণবন্ত উত্তর কৌড়ি আশা করেনি।বিধায় উত্তরে একটু লজ্জা পেলো।তাই প্রসঙ্গ ঘুরাতে মাথার মধ্যে চলা কৌতুহল থেকে প্রশ্ন শুধালো–এ-বাড়িটা-তো বিশাল বড়ো।বাড়ি বাদেও আশেপাশে জায়গাও তো অনেক।তবে এবাড়ি ছেড়ে বাবাকে ওখানে কেনো সমাধিস্থ করা হয়েছে?

‘এবাড়ি থেকে তো কবরস্থান বেশি দূরে নয়।দূরে নয় বললে আবার ভুল,পনেরো বিশ মিনিটের রাস্তা।মেইন রোডের পাশে ওই কবরস্থান জায়গাটার সম্পত্তি তালুকদার বংশীয়।আমাদের বংশীয় নাম।ওটা অনেক আগের পুরানো কবরস্থান।তালুকদার বংশীয় পারিবারিক কবরস্থান।ওখানে কোনো বাহিরের মানুষ নয়,এই তালুকদার বাড়িরই মৃত্যু ব্যক্তিদেরই শুধু সমাধিত করা হয়।বাবার,বাবা, দাদু এবং তাদের দাদুদের আরও পিঁড়িও নাকি ওখানে সমাধিত করা।পাশে যে মসজিদটা দেখেছো,ওটা অনেক আগের স্থাপিত।এখন নতুনত্ব করা হয়েছে।

পনেরো,বিশ মিনিটের পথ!তবে আজ এবাড়িতে আসতে এতোসময় লাগলো!কালরাতে যখন নিভান তাকে নিয়ে বাবার কবরস্থানে আসলো তখনতো এতো সময় লাগিনি?ততক্ষণাত প্রশ্ন শুধালো সে।

‘কালরাতে তো কবরস্থানে আসতে এতোসময় লাগিনি তবে আজ এবাড়িতে আসতে এতো সময় লাগলো কেনো?

‘রাতে রাস্তায় জ্যাম ছিলোনা।তাই ফাঁকা রাস্তায় সময় লাগিনি আসতে।জ্যাম থাকলে অবশ্যই আজকের মতো এতোসময় লাগত আসতে।

এই সহজ কথাটা কৌড়ির মাথায় ছিলো না!তবে কাল এবাড়ির এতো কাছাকাছি থেকে ঘুরে গেলো তারা!হঠাৎ নিভানের বললো–আমি মারা গেলেও,মা’কে বলে রেখেছি ওই কবরস্থানে বাবার পাশেই যেনো আমাকে সমাধিত করা হয়।

চড়াৎ করে কৌড়ি নিভানের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে কেমন করে তার মুখের দিকে তাকালো কৌড়ি।সত্য,সহজ বাক্য।অথচ কাল বিয়ের রাতটা গিয়ে আজ আরেকটা রাত এলো কেবল।তারমধ্যে এরূপ বাক্য!
বাক্যগুলো যেনো কোনোরূপে আশাই করেনি সে।তবে নিভান যতোটা সহজভাবে সাবলীল গলায় কথাগুলো বললো,কৌড়ির পরানটা যেনো তার চেয়ে চৌগুন অস্বাভাবিকভাবে ছটফটিয়ে উঠলো।ঠোঁট দুটোও সেই তালে তাল মিলিয়ে সহসা বলে উঠলো।

‘এ কেমন অশোভনীয় কথা?

নিভানের যেনো হুশ ফিরলো।হুটকরে মৃত্যু নামক বাস্তবতাটা,তার গলায় এতো সাবলীল ভাষায় নিতে পারিনি কৌড়ি,তাই এমন প্রতিক্রিয়া।এরকম একটা মূহুর্তে তারও হয়তো বলাও উচিত হয়নি।তবে স্ত্রীকে বিচলিত হতে দেখে অদ্ভুত এক শান্তি পেলো নিভান।স্বান্তনা সরূপ নরম গলায় বললো—অশোভনীয় কথা কেনো হবে?মৃত্যু সত্য।তুমি আমি কেউ এই কঠিন সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে এড়িয়ে যেতে পারবো-না।সেখানে কার কখন প্রভুর ডাকে সাড়া দিতে হয়,তারআগে নিজের ইচ্ছেটা প্রকাশ করে যাওয়া ভালো।বাবার পাশে থাকার ইচ্ছেটা আমার সেই বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে।ওই ছোট্টো মনটা যখন বাবাকে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে থাকতে দেখলো।মায়ের কাছে শেষ জেদ করেছিলাম,বাবার পাশে বাবার সাথে ঘুমানোর। তখন মারা যাওয়া কি,বুঝতাম না।মা আমার শেষ জেদটা পুরুন না করলেও, ইচ্ছেটা আমার নষ্ট হয়ে যায়নি। ক্ষীন হয়নি।তুমি আমার জীবনে আসার আগে প্রায়সই যখন বাবা-র সাথে কবরস্থানে দেখা করতে আসতাম।শুধু বলতাম,বাবা তোমার কাছে কবে চলে আসবো।কবে তোমার পাশে তোমার মতো করে শান্তিতে ঘুমাবো।তারপর তুমি এলে।বাবার কাছে তাড়াতাড়ি যাওয়ার ইচ্ছেটা আমার ক্ষীন হতে শুরু করলো,তবে নষ্ট হয়ে যায়নি।একদিন যখন যেতেই হবে,জায়গাটা নির্ধারণ করে রাখলাম।

নিভানের পিঠের শার্টের অংশবিশেষে খামচে রাখা
কোমল দু’হাতের মুঠোর আঙুলগুলো আরও দৃঢ় হলো অথচ মুখে শব্দরা ভিড়লোনা কৌড়ির।সামনের মানুষটার সাবলীল বলে যাওয়া শব্দতে আপতত বাক্যহারা সে।ডগর ডগর হরিনী চোখদুটো দিয়ে শুধু নির্বাক চহুনীতে দেখে গেলো সামনের শ্যামপুরুষটাকে।
হঠাৎ নিভানকে যেনো অচেনা ঠিকলো তার।গম্ভীর হলেও যে পুরুষটাকে সে জানতো,সে পুরুষ টাও যেনো এই পুরুষটা নয়।যদিও কথার প্রসঙ্গে কথা উঠেছে তাই বলে কাল বিয়ে হতে না হতে আজ মৃত্যুর কথা!সেই অচেনাত্ব বাড়িয়ে দিয়ে কিছু একটা মনে পড়তেই নিভান শুধালো।—সেদিন ওই এক্সিডেন্টে যদি আমি না ফিরতাম?মরে যেতাম?তুমি অন্য কারও নিবিড় ভালোবাসায় এভাবে তাকে জড়িয়ে থাকতে কৌড়ি?

এবার কৌড়ির বিচলতা বাড়লো।সেই না হওয়া ভবিষ্যতে সে কি করতো,কি না করতো তার জানা নেই। জানেনা সে। তবে এই মানুষটার সাথে পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর একটায় অনুভব অনুভূত হয়েছে।সেটা, এই ব্যাক্তি ছাড়া দ্বিতীয়ত তার জীবনে আর কেউ এলাউড্ নয়।সে, জীবনে যাই হয়ে যাক।সেই মানুষটার মুখে এমন অদ্ভুত কথা!কেমন আহত গলায় নিচুস্বরে কৌড়ি শুধালো।–‘কি হয়েছে আপনার?এসব কথা কেনো?

‘আমাকে তো সেদিন দেখতে যাওনি।সত্যিই যদি আমি মরে যেতাম কৌড়ি?

এ কেমন অবুঝপনা।এই মানুষটার সাথে কি এরকম অবুঝপনা কথাবার্তা মানায়?তবুও বললো—আমি সেদিন আপনাকে দেখতে যেতে চেয়েছিলাম।আপনি আমাকে বিশ্বাস করুন বা না করুন, এটাই সত্য।তবে আমার ভিতরটা কি চেয়েছিলো,সেটা আমি কাওকে বহিঃপ্রকাশ করতে পারিনি।যার দ্বায়ভার দোষী সাব্যস্ত হতে হয়েছে আমাকে।

কৌড়ি সহজে আবেগপ্রবণ হয়না।হঠাৎ হঠাৎ কেঁদেকেটে ভাসিয়ে দেওয়ার ঘটনায়ও সে কেঁদেকেটে ভাষায় না।তবে আপনজন হারানোর বেদনা,সে জানে।
কাল বিয়ে হতে না হতে,এই মানুষটার এমন সব কথা!আপনজন হারানো মনটাকে টলিয়ে দিলো।দূর্বল করে তুললো।তাই নিভানকে কৈফিয়ত দেওয়ার সময় ডগরডগর চোখে জল ছলছল, থৈথৈ না করলেও, গলা কাঁপলো তার।সেটা অনুধাবন করে নিভান এবার সত্যিি নিজের প্রতি বিরক্ত হলো।এতো আবেগ,এতো অনুভূতি বহিঃপ্রকাশ তো সে কখনো করেনা।তবে আজ কি হলো!আর করলোই যখন এমন একটা সময়ে,একটু হিসাব করে রয়েসয়ে কথা বললে কি হতো!এতো আবেগপ্রবণ হয়ে মেয়েটাকে কষ্ট দেওয়ার খুব দরকার ছিলো কি?যেখানে তারা সদ্য বিবাহিত দম্পতি। মেয়েটার মনে কি প্রভাব পড়তে পারে,জেনেও বোকামি করতে কেনো চাইলো মন!উফফ!

‘আপনি আমার উপর এতো অসন্তুষ্ট?

কৌড়ির পিঠ থেকে হাত সরে এসে গলার পিছে এসে থামলো নিভানের হাতজোড়া।গলা ছুয়ে সেই হাতজোড়া থামলো কৌড়ির মসৃণ তুলোর মতো দু-গালে।ছোট্রো মুখটা দু’হাতে আজলে নিয়ে নিভান নরম, আদূরে স্বরে বললো।-কে বলেছে আমি তোমার অসন্তুষ্ট?আমি তোমার উপর অসন্তুষ্ট নই।

‘তবে এসব কথা কেনো?পুনরায় সেই অভিযোগ। আর মৃত্যু!আমরা জানি মৃত্যু অবধারিত।তাই বলে আজকের দিনে এসব বলবেন আপনি।

নিভান এবার স্বতঃস্ফূর্ত হাসলো।তবে মৃদু হাসি।লাজলজ্জা ভুলে সেই চমৎকার হাসি মাখানো ঠোঁটের দিকে চেয়ে রইলো কৌড়ি।ততক্ষণাত সেই হাসিমাখা ঠোঁট নড়ে উঠলো।কেমন মায়ামায়া স্বরে প্রকাশ করলো– স্যরি,মন খারাপ করিয়ে দেওয়ার জন্য।তবে তোমার যদি আমাকে নিয়ে এতো সঙ্কা,এতো ভয় হয়,তবে প্রভুর কাছে তোমার প্রার্থনায় সবসময় রেখো আমায়।

কৌড়ি চোখ বুঁজে নিলো।মনেমনে বললো–সে রাখতেই হবে।তবে ততক্ষণাত চোখ খুলে ফেললো সে।মুখের খুব কাছে গোচর হলো,সেই মায়ামায়া শ্যামবর্ণ মুখ অবয়ব। খুব সাহসিকতা দেখিয়ে কালরাতে একটা লাজলজ্জাহীন কাজ করেছিলো কৌড়ি।সেটাতে পরক্ষনে লজ্জা ও পেয়েছিলো খুব।তবে কালকের সেসব ভুলে বিয়ের দ্বিতীয় দিন গিয়ে রাতে কৌড়ি আরও একটা নির্লজ্জতামী কাজ করলো।বাম হাতটা নিভানের পিঠের শার্ট খামচে রেখে ডান হাতটা নিভানের মাথায় এনে রাখলো।ছোটো ছোটো করে কাটা চুলগুলোয় হাত রাখতেই সর্বাঙ্গ শিহরে উঠলো তার।ভিতরে অনুভূতিরা তখন রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছটফটালো।তবে সেসবে পাত্তা না দিয়ে,হাত দিয়ে নিভানের মাথাটা নিচু করে নিলো।ফের মুখ উঁচিয়ে নিজের নরম ঠোঁটটা ছুঁইয়ে দিলো,সেই চওড়া কপালের মাঝে।হাত পায়ের তীব্র কম্পন টের পেয়েও ঠোঁট সরালোনা কৌড়ি।আজ সকালেও ভেবেছিলো,এই দুঃসাধ্য কাজটা কখনো তার দ্বারা করা হবেনা অথচ দিন পেরিয়ে রাত গড়ানোর আগেই সেই দুঃসাধ্য কাজটা সে করে ফেললো।শ্যামবর্ণ মায়াময় মুখটা আজ তার লাজলজ্জা ভুলিয়ে দুঃসাধ্য কাজটা করিয়ে নিলো।নিভান বিস্মিত হলো বউয়ের কাজে।তবে হাতের বাঁধন দৃঢ় করার সাথে সাথে শান্ত হয়ে উপভোগ করলো বউয়ের ভালোবাসা।

চলবে…

#ফুলকৌড়ি
(৫৩)প্রথমাংশ
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

কাল বিকালেই চলে যেতো নিভান আর কৌড়ি।তবে আবিদা জাহানের অনুরোধে যেতে পারিনি।নিভানেরও এবাড়ির প্রতি বিশেষ দূর্বলতা থাকায়,একবার অনুরোধে কেমন সে-ও থেকে গিয়েছে।সকালে যখন নিভান পুনরায় যাবার কথা বললো।বৃদ্ধা মুখটা অসহায় দেখালো।নিভান বুঝলো সেই অসহায়ত্ব।তবে বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখালো-না।তবে বৃদ্ধা মানুষটা নাতীর কাছে আবারও অনুরোধ করে বসলেন —আর একটা দিন কি থেকে যাওয়া যায়-না দাদুভাই?বিশ্বাস করো,তোমাদের এবাড়ি থেকে একদম যেতে দিতেই ইচ্ছে করছেনা। তবে তা স্বার্থপরতা হয়ে যায়।তাই আর-ও একটা দিন যদি থেকে যেতে তোমরা।এই বৃদ্ধা মানুষটার মনটা খুব শান্তি পেতো,সন্তুষ্ট হতো।

নিভান তড়িৎ কিছু বললো-না।তবে নিজের মনও কি চাইছে-না বৃদ্ধা মানুষটার অনুরোধ পুনরায় সায় দিতে? চাইছে তো।তবে কি করবে সে?দাদিমার অনুরোধ, ইচ্ছেকে বারবার প্রশ্রয় দিলে এবাড়ির প্রতি মায়া বাড়বে তার।তখন ওবাড়ির প্রতি সব মোহমায়া ত্যাগ করে এবাড়িতে থাকতে চাইবে মন।যেটা দাদুমা সবসময় চেয়ে এসেছেন,চেয়ে এসেছে তার মনও।তবে মনকে কখনোই প্রাধান্য দেয়নি সে।নাহলে শত গঞ্জনা,অপমান সহ্য করে ওবাড়িতে থেকে যাওয়ার কোনো মানেই ছিলো-না।সবকিছু ছেড়েছুড়ে এবাড়িতে এসে থাকতে পারতো সে।নিজের ভাগ্যের নির্ধারিত সুখ, সাচ্ছন্দ্য, আরাম আয়েস,পাওনা আদর, ভালোবাসা সবকিছু ছাড়তে পারলেও পারিনি, নিজের মায়ের স্নেহ মমতা ছাড়তে।ত্যাগ করতে।তাই মায়ের স্নেহ মমতা আর ভালোবাসার বাঁধনে বাঁধা হয়ে ওবাড়িতে রয়ে যেতে হয়েছে তাকে।এখনো থাকতে হচ্ছে। এখন অবশ্যই মায়ের প্রসঙ্গ বাদেও বিষয়টা আলাদা।এখন যে শুধু মায়ের স্নেহ মমতার বন্ধনে আটকা পড়ে আছে এমনটা নয়।এখন সময়ের চিত্ত বদলেছে।বদলেছে অনেকের মন-মানসিকতাও।আজ ওবাড়ির প্রতিটি মানুষের স্নেহ মমতার বন্ধনে আটকা সে।এমনকি যে দাদুমা পর্যন্ত তাকে হেয় নজরে দেখতো,তিনিও আজ নিভান চোখের আড়াল হলে বারবার খোঁজখবর নিতে থাকেন।এইযে কয়েকঘন্টার জন্য বাড়ি থেকে এসেছে,তারমধ্যে কতোবার ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,তারা বাড়িতে ফিরছে কখন? শুধু যে দাদুমা ফোন দিয়েছেন,এমনটা নয়।সবাই ফোন দিয়ে বিরক্ত করে দিচ্ছে,তাকে।কিকরে সেসব মায়া,টান ত্যাগ করে এবাড়িতে রয়ে যাবে সে?অথচ স্বস্তি শান্তি তার এবাড়িতে,আর ভালোবাসার মানুষগুলো তার ওবাড়িতে।কি এক দোটানা!

‘দাদুমা,আমি আবার আসবো তো।সময় পেলেই আপনার নাতবৌকে নিয়ে আপনার এখান থেকে ঘুরে যাবো।

‘আর সেবার এসে যদি আমাকে মৃত দেখতে হয় তোমাকে?আফসোস হবেনা আর একটিবার এই অসুস্থ বুড়িটার অনুরোধ রাখতে না পারার জন্য?

নিভান ভিতরে ভিতরে ভিষন অসহায়বোধ করলো।অথচ বাহিরে নিভান,শক্তকঠিন দৃঢ় হয়ে বসে থাকলো।কৌড়িও চুপচাপ তার পাশে বসে আছে। কিছু কথা তারও বলতে ইচ্ছে করছে,তবে সম্পর্কের নতুনত্ব ভেঙে নিজের ইচ্ছে আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করতে জিহ্বা কিছুতেই নাড়াতে ইচ্ছে করছেনা।মন সায় দিচ্ছে না।তন্মধ্যে
সেখানে উপস্থিত নিভানের ছোটো চাচী ঝুমুর বললেন।

‘নিভান থেকে যাওনা।দাদুমা এতো করে যখন বলছেন, অসুস্থ মানুষটার অনুরোধটা আরেকটাবার রাখো।কাল সকালে অব্দি না-হয় আজ বিকাল পর্যন্ত থেকে যাও।

নিভান সময় নিয়ে সায় জানালো।মূহুর্তেই বৃদ্ধা মানুষটার চোখমুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।আবেগ প্রবন হয়ে তিনি বলেই বসলেন—এই বুড়ির অনুরোধটা রেখেছো,আমি খুব খুশি হয়েছি দাদুভাই।খুব খুশি হয়েছি।

নিভান সৌজন্যে হাসলো।তবে মনেমনে আরেকটা দিন এবাড়িতে কাটানোর সুযোগে সে-ও খুশি হলো।খুশিটা সর্বসম্মুখে বহিঃপ্রকাশ না করলেও পাশে থাকা মেয়েটা হয়তো বুঝে ফেললো।কৌড়ি নিভানের দিকে একপলক তাকাতেই,নিভান নিজেকে আড়াল করতে উঠে দাঁড়ালো।দাদুমাকে বিশ্রাম নিতে বলে,এবাড়িতে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত রুমটার দিকে চলে গেলো।সেদিকে তাকিয়ে মনেমনে হাসলো কৌড়ি।নিজের গম্ভীর,দৃঢ় মনোবল খোলাসা থেকে সহজে বের হতে চায়না মানুষটা।দীর্ঘ সাড়ে চারমাসের পরিচিতিতে কৌড়ি, নিজের ব্যাতিত অন্তত কারও সামনে ওই মানুষটাকে নিজের গম্ভীর স্বভাব, দৃঢ় মনোবলের খোলাসা ছাড়তে দেখিনি।বাহিরের মানুষের সাথে খুব কম এবং ব্যাক্তিত্বের সাথেই কথা বলে।সেখানে মানুষটাকে ভিতর থেকে তো দূর বাহির থেকেও বোঝা দ্বায় হয়ে যায়।সেই হিসাবে নিঃসন্দেহে কৌড়ি সৌভাগ্যবতী।ওই মানুষটা তার ভিতর বাহিরটা সানন্দে সপে দিয়েছে তাকে।

‘ছোটো বউমা,আশহারকে বলো লোক ডাকিয়ে পুকুর থেকে মাছ তুলতে।আর আজ সব বাড়ির শাকসবজি মাছ,মাংস রান্না করবে।সব টাটকা।আমার আওসাফ বাড়ির শাকসবজি, পুকুরের সদ্য ধরা মাছ,বাড়ির পালা হাস মুরগির গোশত খেতে খুব ভালোবাসতো।নিশ্চয় নিভান দাদুভাইও বাবার মতো ধারা পেয়েছে।যদিও দেখলাম তো তার খাবার পরিমাণ সীমিত।বাবার মতো খাদ্যরসিক নয় সে।আবার জিজ্ঞেস তো করা হলোনা তার খাবারের পছন্দ অপছন্দতা।তবুও বাড়ির টাটকা শাকসবজি মাছ-মাংসতে মনেহয়না তার অপছন্দ হবে।তুমি ময়নার মাকে নিয়ে রান্না গোছানোর ব্যবস্থা শুরু করে দাও।

বয়স্ক মানুষটা একাধারে এত কথা বলতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠলেন।শারিরীক অসুস্থতার তোড়ে ঘনো শ্বাস ফেলাতেই সেটা বোঝা গেলো।তা দেখে তড়িৎ নিভানের ছোটো চাচী ঝুমুর বললেন –আম্মা, আপনি ব্যস্ত হবেন না।অসুস্থ হয়ে পড়বেন তো!আপনি না বললেও,নিভান থাকার কথা বললেই আমি আপনার চিন্তাভাবনার মতোই ব্যবস্থা করবো ভেবে নিয়েছিলাম।আর আপনার ছেলে তো মাছ ধরার জন্য লোক ডাকতে গেছেন।আপনি নিভানকে না মানাতে পারলেও কি,আজ তিনি নিভানকে আর বৌমাকে কিছুতেই যেতে দিতেন না।

ছেলের বউয়ের আচারণে খুশি হলেন আবিদা জাহান।যদিও শুধু আজ নয়,ঝুমুর এবাড়িতে বিয়ে হয়ে আসা থেকে এ-অব্দি তিনি তার উপর খুশী,সন্তুষ্ট।ঝুমুর সহজ সরল মেয়েমানুষ। সংসারের মারপ্যাঁচ বুঝলে-ও,সহজে সেসব ঝামেলায় জড়াতে চায়না।হিংসা অহংকার জিনিসটা তারমধ্যে ক্ষীন।হুটহাট সবার সাথে যেমন মিশতে পারে,তেমন সবাইকে আপন করে নিতেও তার সময় লাগে-না।মিষ্টি চেহারার সাথে সাথে মিষ্টিভাষী, কোমল স্বভাবী সে।এইযে একটা অসুস্থ মানুষকে পালাসহ, সংসারটা কি সুন্দর নিপুনহাতে না সামলে চলেছে।

‘আম্মা আপনি বিশ্রাম নিন।দুশ্চিন্তা করবেন না।আমি আপনার ভাবনা অনুযায়ী সবকিছুর ব্যবস্থা করছি।যাই দেখি,ময়নার মা’কে মশলাপাতি গোছানো,বাটাবাটি করতে বলি।চলো কৌড়ি।

এতোসময়ে নিরবদর্শক কৌড়ি এবার নড়েচড়ে বসলো।উঠার প্রস্তুতি নেওয়ার আগেই আবিদা জাহান বললেন—দাদুমনি আমার এখানে কিছুক্ষণ সময় থাক।তুমি বরং নিতু ইতু দাদুমনিকে এখানে ডেকে দাও।

‘আচ্ছা।

ঝুমুর বেরিয়ে গেলেন।কৌড়ির সাথে টুকটাক কথা শুরু করলেন আবিদা জাহান।মেয়েটা বেশ শান্তশিষ্ট,কোমল স্বভাবের।বেশ পছন্দ হয়েছে উনার।কৌড়ির বাপের বাড়িতে কে কে আছে,তার নানু দাদু আছেন কি-না?টুকিটাকি খোশগল্পে মত্ত হলেন তিনি।অল্প প্রশ্নত্তোরে কৌড়িকে ছেড়ে দিয়ে নিজের ছেলেবেলা,সংসারী জীবন,স্বামী সন্তান এসব নিয়ে গল্পে ডুবলেন। তারমধ্য ইতু নিতুও এসে হাজির হলো।ছোটো চাচার দুই মেয়ের মধ্যে নিতু বড়।স্বভাবে মেয়েটা মৃদুভাষী শান্ত,চুপচাপ স্বভাবের।আর ছোটো, ইতু।বড়টার বিপরীত স্বভাবের সে।সারাক্ষণ যেনো তার মুখে খই ফুটছে।কারও নিষেধ বারণে তার মুখ বন্ধ নেই।মুখের সঙ্গে সঙ্গে স্বভাবেও চঞ্চল সে।তবে লাজুকে।যারসামনে সে নিজের মনের কথা গাইতে পারেনা,চঞ্চল স্বভাব প্রকাশ করতে পারেনা।তারসাথে সে সহজে মিশেনা। কৌড়ি স্বভাবে শান্তশিষ্ট হলেও কৌড়ির সাথে তার দারূন পটে গেছে।ভাব হয়েছে। অথচ একবার কোনোমতে নিভানের সাথে আলাপ সেরে তার সামনে আর সহজে যায়নি সে।দুবোন দাদুমার ঘরে পা রাখতেই,দৌড়ে এসে কৌড়ির হাত জড়িয়ে কৌড়ির পাশে বসে পড়লো ইতু।বিনিময়ে কৌড়ি মিষ্টি করে হাসলো।তন্মধ্যে নিতু বললো।

‘সবজায়গায় এতো দৌড়াদৌড়ি লাফালাফি কিসের?
ঘাসফড়িংয়ের মতো সারাদিন ছটফটিয়ে যাচ্ছে!তুই যেভাবে উনার হাতটা টেনে ধরলি,পড়ে যেতেন তো উনি।

বয়সে বড় অথচ কাল সাক্ষাতের পর থেকেই মেয়েটা, আপনি সম্বোধনে তারসাথে কথা বলে চলেছে।কৌড়ির বিষয়টা বেশ অস্বস্তি দিচ্ছে। তবুও মেয়েটা মানতে নারাজ।কাল না পেরে একবার আপনি বলতে নিষেধও করেছে।তবুও নিতু সেই থেকে তাকে আপনি করে বলে চলেছে।কৌড়ি নিষেধ করায় তখন এটাও বলেছে—আপনি আমার বসয়ের বড় নাহলেও সম্পর্কে আমার অনেকটা বড়।ভাইয়া এবাড়ি বড়ছেলে,তার বউকে তুমি সম্বোধন করে কথা বললে আম্মু তো রাগ করবেনই।আমারও কেমন যেনো ভালো লাগবেনা।

কৌড়ি আর কিছু বলেনি।ইতুকে বকতে দেখে কৌড়ি নরম গলায় বললো—থাক আপু,ওকে বকবেন না।ওর বয়সটা চঞ্চলতার।আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।আর ঠিক না হলেও কি!বাড়িতে দুএকজন এরকম না থাকলে বাড়িটা কেমন যেনো বাড়িই মনে হয়না।

ইতু মুখটা ভার রেখে ততক্ষণাত গম্ভীর গলায় কৌড়ির কথার প্রেক্ষিতে বললো-এটা আম্মু আর আপু বুঝলেতো!আমি উনাদের মতো ওরকম চুপচাপ শান্ত হয়ে সবসময় থাকতে পারিনি।

নিতু ইতুর কথার উত্তর না দিয়ে কৌড়ির কথার দিলো–

‘বাহ,আপনি দেখি বাবা আর দাদুমার মতো কথা বললেন।বাবা আর দাদুমার লাই পেয়ে পেয়ে দিন দিন ওর চঞ্চলতা, লাফানো ঝাঁপানো আরও বাড়ছে।দল যতো ভারী হচ্ছে ততো স্বভাব ঘাসফড়িং হচ্ছে।আর মুখ চললেই তো থামতেই চায়না।

এবার আবিদা জাহান মুখ খুললেন–থাক না দাদুমনি।সবে ক্লাস সিক্সে উঠেছে।ওরকম বয়সে সবাই একটু-আধটু ওরকম থাকে।বয়সের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে।ঠিক হয়ে যাবে কি,ঠিক হয়ে যায়।ওরকম বয়সে আমিও ইতু দাদুমনির মতো চঞ্চল সাথে উড়নচণ্ডী স্বভাবের ছিলাম।আমার ছেলেবেলার ছায়াটা আমি ইতু দাদুমনির মধ্যে দেখতে পাই।উপলব্ধি করি।আর সেই বয়সেই তো আমার বিয়ে হয়ে গেলো।তারপর তো সেই ছটফটে স্বভাব, অর্নগল কথা বলা সবতো ছুটে গেলো।আমি হয়ে গেলাম সংসারের দোলাচলে পাক্কা সুগৃহিনী।তারপর মা হলাম।ভরা সংসার হলো আমার।স্বামী পরাপর হলো,সুস্থসবল সন্তান হারালাম।এতো নাতীনাতনিদের ভিড়ে কৈ আছে আমার সেই ঘাসফড়িংয়ের মতো লাফিয়ে চলা,আর বেশিবেশি কথা বলার স্বভাব। সেতো সেই কবেই চুকেবুকে গেছে।ছোটো দাদুমনিরও এরকম চুকেবুকে যাবে।তাই তাকে বকোনা, নিষেধ করোনা।তুমি বরং কাছে এসো দেখি জ্বরটা কমেছে কিনা?

নিতু আর একটা শব্দও উচ্চারণ করলেনা।ইতুকে সে প্রচন্ড ভালোবাসে।তবে তার ছটফটে স্বভাবে মাঝেমধ্যে বিরক্ত হয়ে দুই একটা কথা বলে,বকাবকি করে।তবে মা আর সে যখনই ইতুকে বকে তখনই দাদুমা আর বাবা তার ঢাল হয়ে এরকম ইমোশনাল কথাবার্তা শুনিয়ে তাদেরকে চুপ করিয়ে দেয়।দাদুমার কাছে গিয়ে বসলো নিতু।যদিও জ্বরটা কমেছে তবে দাদুমার হাতের শীতল মায়ামাখা ছোঁয়া, আদুরে স্পর্শ তার ভালো লাগে।কাছে গিয়ে বসতেই নিতুর কপালে হাত রেখে জ্বর পরিমাপ করলেন আবিদা জাহান।কালকের একশো চারের ঘরের তাপমাত্রাটা কমে গেছে। তবে পুরোপুরি গায়ের তপ্ততা কমেনি।নিতু জ্বর পরিমাণ মাপতে মাপতে ইতুর দিকেও খেয়াল করলপন তিনি।আপুর বকাতে ইতু মনখারাপ করে চুপচাপ বসে আছে।যা মেয়েটার স্বভাবের সাথে বড়ােই বেমানান।উনার নজরেও ভালো লাগেনা।তা দেখে আবিদা জাহান,ইতুর রাগ ভাঙাতে বললেন–ছোটো দাদুমনি,আমার রসূনের আচারের বৈয়মটা এনে তোমার ভাবিমনিকে খেতে দাও দেখি।

ইতুর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো।বছরে বড়বড় দুই বৈয়ম রসুনের আচার বানানো হয়।দাদুমার পছন্দনীয় বলে বানানোটা জরুরি।মুলত দাদুমাই বানান।শুধু যে দাদুমার পছন্দ এমনটা নয়,দাদুমার মতো তারও পছন্দ।আর দাদুমার হাতের আচার মানেই উফফ!মারাত্মক লোভনীয় স্বাদ। কিন্তু রান্নাঘরে যে রসুনের আচারের বৈয়মটা রাখা হয়,ওটাতে সহজে হাত দেয়না ইতু।মায়ের বকুনির সাথে সাথে কয়েকটা মারও ফ্রি।সাথে বাবার কাছে হাজারটা নালিশ।তবে মাঝেমধ্যে সুযোগ পেলে অবশ্যই ছাড়েও না ইতু।একবাটি আচার অনায়সে খেয়ে নেয় ইতু।তবে দাুমার ঘরের আচারের বৈয়মগুলো তারজন্য ফ্রী।তবুও মা দেখতে পেলে ফ্রী-টা লাভ, সুদবুদসহ বকাবকি রাগারাগি করে উশুল করে নেন।তবে দাদিমা যদি বলেন–তিনি খেতে বলেছেন,বিষয়টা আলাদা।তখন মা একটুআধটু বকলেও রাগারাগি আর করেননা।বাবাকে নালিশও জানান না।দাদিমার আদেশ পেতেই,ঘরের সাথে লাগোয়া ছোট্টো রুমটার দিকে ছুট লাগালো ইতু।তা দেখে নিতু আর আবিদা জাহান হাসলেন।নড়বড়ে স্বরে ফের বললেন।

‘নারকেল নাড়ুর বৈয়মটাও নিয়ে এসো দাদুমনি।

ইতু শুধু বৈয়ম আনলোনা।সাথে বাটি চামচও আনলো।
বৈয়মের মুখ খুলে একবাটি কৌড়িকে দিয়ে নিজেই আরেক বাটিতে নিয়ে খেতে বসলো।দ্বিতীয়ত আর কারও কথা ভাবলো-না।তাতে কেউ কিছু বললোওনা।কৌড়ি আচার খাওয়ার আগে দাদুমা তাকে আর নিতুকে নাড়ু বের করে দিলেন।নিতু নিলো।কৌড়িও সেটাই খেলো আগে।নারকেল নাড়ু সে আগেও খেয়েছে তবে এটার স্বাদ আলাদা, অসাধারণ।আচারটা খেতেই বুঝতে পারলো,পরিপক্ব হাতের বানানো এগুলো।বাটা রসুনের আচার নয়, সরিষার তেলে ডুবানো বিভিন্ন মশলার উপকরণে আস্ত কোয়া ছাড়ানো রসুনের আচার।রসুনের আচারটা এই প্রথম খেলো কৌড়ি।সত্যিই অসাধারণ স্বাদগন্ধ।আচার খাওয়ার ফাকে ফাকে রসুনের আচার বানানোসহ বিভিন্ন আচার বানানোর গল্প শুনলো দাদুমার মুখ থেকে।এরমধ্যে বিরতিহীন ইতুর আচার খাওয়া নিয়ে মজা-ও করলো নিতু।সেটা নিয়ে ক্ষেপলােনা ইতু।নাতবৌ নাতনিদের নিয়ে গল্পগুজবের সময়টা যেনো আবিদা জাহানের কাছে সুখ সুখ,শান্তি শান্তি একটা অনুভূতি অনুভব হতে লাগলো।তিন ছেলে উনার।একজনকে তো কবেই হারিয়ে বসলেন।দ্বিতীয়জন,নিজের স্বার্থ, সুখসাচ্ছন্দ্যে বিলাসবহুল জীবনযাপন গড়তে মা’কে ছেড়ে নিজ ইচ্ছায় সুখের দেশে পাড়ি জমিয়েছে।সেখানে কেমন সুখে তার দিন পার হচ্ছে, আবিদা জাহান জানেননা।তবে আল্লাহর কাছে সর্বদা কামবা করেন, তাকে সুখে রাখুক।আর তৃতীয়জন তার বৃদ্ধবয়সের অবলম্বন হয়ে রয়ে গেছেন।বিশাল বড় বাড়িটাতে সামন্য এই কয়জন মানুষের পদচারণ নগন্য।সারাক্ষন নীরব নিস্তব্ধ থাকা বাড়িটাতে দু’জন মানুষ বাড়তেই কেমন একটা হৈচৈপূ্র্ন ঝলমলে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।কেমন তৃপ্ত অনুভব হলো উনার নজর,তৃপ্ত হলো উনার বৃদ্ধা মন।সেই মনে আরেকটা আকাঙ্ক্ষা চেপে বসলো,এই ছেলেমেয়ে দুটোকে যদি তিনি এবাড়িতে বরাবরের জন্য রেখে দিতে পারতেন।

সকাল পেরিয়ে এগোরাটা বাজতে না বাজতে তালুকদার ভিলাতে হঠাৎ গাড়ীর শব্দ।এই অসময়ে কে বা কারা এলো?দৌড়ি গিয়ে ছাদের কোণ ঘেঁষে দাঁড়ালো ইতু।মুখ নিচু করে সামনের লন এরিয়ায় দেখার চেষ্টা করলো,অসময়ে কে বা কারা এসেছে?কৌড়ি তখন নিতু আর ইতুর সাথে ছাঁদটা ঘুরে-ঘুরে দেখার সাথে সাথে আশেপাশের সবুজ সমাহারের মনোমুগ্ধকর পরিবেশে ডুবে ছিলো।নিভানের দাদুবাড়ি জায়গাটা গাজীপুরেরশ্রীপুর উপজেলার রাজবাড়ী এলাকায়।আশেপাশের প্রতিটি বাড়ি,সবুজের সমাহারে ছেয়ে আছে।শহরের পরিবেশের মতো শুধু বহুতল উঁচু উঁচু রঞ্জিত বিল্ডিংয়ে একের পর এক সীমানাভেদ করা বাড়ি করা নয়।বালু সিমেন্ট রড কংক্রিট দিয়ে তৈরী করা গাছপালাহীন ফাঁকা বাড়িও কম।প্রতিটি বাড়িতে,ফল-ফুল ছাড়াও বিভিন্ন গাছের আগানবাগান।উঁচু নিচু প্রতিটি বিল্ডিংয়ের সামনে পিছনের লন,ছাঁদবারান্দা,এমনকি ছাঁদেও সবুজ সমাহারে ছাওয়া।শহরের ছোঁয়ায় সমৃদ্ধি, বোনা,আলাদা এই সবুজ সমাহারের পরিবেশটা কৌড়িকে বিমুগ্ধ করেছে।তাই মুগ্ধ হয়ে আশপাশটা দেখছিলো।হঠাৎ জোরেশোরে গাড়ির হর্ন বাজতেই ইতু পিছেপিছে নিতুও কৌতুহলী নজর নিয়ে ছাদে কিনারায় এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো।মূহুর্তেই কপাল কুঞ্চিত করে বললো–

‘এতো ছেলেমেয়ে!এনারা কারা?

দু’জনের দেখাদেখি কৌড়িও এগিয়ে গেলো।নজর নিচমুখো করতেই চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার।আচমকা ঠোঁট ফুটলো হাসি।ততক্ষণাত নিচে বিনা আমন্ত্রণে আগত মেহমানদের কাছে পৌঁছে গেলেন,এবাড়ির ছোটো ছেলে অর্থাৎ নিভানের ছোটো চাচা আশহার সাহেব।তিনি বাড়ির পিছনের পুকুরে মাছ মারার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।হঠাৎ অসময়ে বাড়িতে গাড়ির হর্ন বাজার শব্দ শুনে,সদরে চলে এলেন।এসেই গাড়ী ভর্তি মানুষ দেখে চমকে গেলেন।ইভানকে ড্রাইভিং সিট থেকে নামতে দেখেই অমায়িক হেসে দিলেন।ইভান সালাম দিলো।ফের স্বতঃস্ফূর্ত কন্ঠে বললোো—বিনা নিমন্ত্রণে চলে এলাম চাচাজান।শুধু বাড়ির ছেলেটাকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াবেন,তা তো হতে দেওয়া যায়না।

‘আরেহ কি বলো,নিভান কেনো একা এবাড়ির ছেলে হতে যাবে।তুমি নাফিম,তোমরা সবাই আমাদের আপনজন।চলে এসেছো ভালো করেছো।চলো চলো, ভিতরে চলো।আম্মা দেখলে খুব খুশি হবেন।

‘আপনজন হলে শুধু দাদাভাইকে নিমন্ত্রণ দিয়ে নিয়ে আসলেন কেনো?আমাদের কেনো নিমন্ত্রণ দিলেন না।

‘তোমাদেরকেও আসার কথা বলেছিলাম।কিন্তু ভাবি-তো না করলেন।বললেন, বিয়ে বাড়িতে মানুষ ভরপুর। বাড়ির ছেলেমেয়ে সব চলে গেলে বিষয়টা কেমন দেখায়।তাই তো আর জোরাজোরি করতে পারলাম।

ততক্ষণে গাড়ী থেকে মান্যতা মৌনতা নাফিম, তন্ময়ী,
নেমে পড়েছে। এমনকি বিথী আর কাননকেও নিয়ে আসতে ভুলিনি ইভান।আশহার সাহেবের সাথে দুষ্টমিষ্টি তর্কবিতর্ক করতে করতেই বাড়ির ভিতরে পা রাখলো ইভান।সঙ্গে সবাই।ভিতরে ঢুকতেই আশহার সাহেব নিজের স্ত্রীকে ডাক দিলেন।যদিও তিনিও গাড়ীর শব্দ পেয়েছেন তবে রান্নাঘর ছেড়ে বাহিরের দিকে উঁকি দেওয়ার সময়টুকু পাননি।তিনি আসতেই আলাপ পরিচয় সারলো সবাই।আলাপ পরিচয় সেরে সবাইকে বসতে বলে তিনি নাস্তা পানির ব্যবস্থায় ব্যস্ত হলেন।

‘দাদুমার ঘরটা কোথায়?চলুন উনার সাথে দেখা করে আলাপ পরিচয় সেরে আসি।

ততক্ষণে ছাঁদ থেকে নেমে এসেছে কৌড়ি।নাফিমের চোখ গেলো সেদিকে।দৌড়ে গিয়ে কৌড়িকে জাপ্টে ধরে বললো–আমি তোমাকে অনেক মিস করেছি ফুলকৌড়ি।স্যরি স্যরি বড়বউমনি।

নাফিমের বাচ্চামোতে কৌড়ি হেসে ফেললো।সঙ্গে সঙ্গে
স্নেহময় হাতে আগলে নিলো তাকে।ফের নিজেও বললো–আই মিসড্ ইউ টুহ্ ছোটোসাহেব।

ইভান আর কানন বাদে সবাই কৌড়ির দিকে এগিয়ে গেলো।একদিন সে ওবাড়িতে না থাকায় সবাই তাকে কতোখানি মিস করেছে,মিষ্টি অভিযোগে সেসব বর্ননা দিতে থাকলো।আর বাড়ির নতুন বউ বাড়িতে না থাকলে সে বাড়িতে কি হৈচৈ ভালো লাগে?কোনোকিছু মজা লাগে?এসব মিষ্টি মিষ্টি অভিযোগ নিয়ে টুকিটাকি একের পর এক কথা হতেই থাকলো।তারমধ্যে নিতু ইতুর সাথে পরিচয় হলো সবার।

বিশাল বড়ো পুকুরটার এপার ওপার,ওপাড়েই শানবাঁধানো ঘাট।এপাড়ের ঘাটের একপাশের শানবাঁধানো বসার জায়গায় বসে আছে নিভান।পুকুরে জাল ফেলে এক নামেমাত্র জেলে মাছ ধরছে।তিনি প্রফেশনাল না হলেও জাল ফেলার হাত সুনিপুণ।এটাও যেনো একটা অভিজ্ঞতার বিষয়।নাহলে সবাই পারে-না কেনো?কি সুন্দর নিপুনহাতে তিনি জাল ফেলছেন পুকুরে,আর তা গোল চাদরের মতো বিছিয়ে সর্বত্রে ছড়িয়ে কেমন একটা ছন্দময় আকর্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে!দুইবার জাল ফেলাতেই বেশ বড়সড় কয়েকটা রুই কাতলা পড়েছে জালে।জেলে মাছ ধরলেও, মাছগুলো এতোসময় সংরক্ষণ করছিলেন আশহার সাহেব। গাড়ীর হর্ণের শব্দ শুনতেই তিনি বাড়ির সদরে চলে গেছেন।যাবার আগে এবাড়ির সারাক্ষণ কর্মরত বুয়াকে ডেকে মাছ কাটার তাগিদ দিয়ে গেলেন।বাড়ির পিছনের উঠান অর্থাৎ পুকুরপাড় সাইডের কিছুটা দূরত্বে বসে মাছ কাটছেন বুয়া ময়নার মা।আর তার সামন্য দূরত্বে চেয়ারে বসে তা পর্যবেক্ষণ করছেন নিভানের দাদুমা।জেলের মাছধরা থেকে নজর সরিয়ে সেটা একপলক দেখে পুনরায় মুগ্ধ নজর ফেললো জেলের হাতের জালে।

‘হ্যালো দাদুমা,কেমন আছেন?

চঞ্চল, উচ্ছসিত কন্ঠে আবিদা জাহান উনার থেকে কিছুটা দূরত্বে বাড়ির পিছনের সদর দরজায় তাকালেন।ইভানকে চিনতে বেশকিছুসময় সময় লাগলো উনার।নিভানকে দেখতে গিয়ে হাসপাতালে দেখেছিলো ইভানকে।পরিচিতও হয়েছিলো।তবে বয়স হয়েছে,সাথে অসুস্থা খেয়ালে রাখতে দেয়না কোনোকিছু।হঠাৎ খেয়াল হতেই অমায়িক হেসে দিলেন তিনি।কিছু বলার আগেই ইভান ফের বললো—বিনা আমন্ত্রণে চলে এলাম দাদুমা।দাদাভাইকে একা আদর যত্নে ডুবিয়ে রাখবেন তা তো মানা যায় না।তাই তার আদর যত্নে ভাগ বসাতে চলে এলাম।

ছেলেটা এরকমই উচ্ছল।সেদিনও লক্ষ্য করেছিলেন তিনি।তাই অমায়িক কন্ঠে বললেন–খুব ভালো করেছো দাদুভাই।তা কেমন আছো তুমি?

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো।আপনার শরীর এখন কেমন?

‘আলহামদুলিল্লাহ আছে মোটামুটি।

ইভানের সাথে কানন ছিলো। আবিদা জাহানের সাথে তাকেও পরিচয় করিয়ে দিলো ইভান।ময়নার মা মাছকাটা বাদ দিয়ে বাড়ির ভিতটে গিয়ে তড়িৎ দুটো চেয়ার এনে দিয়ে ফের মাছ কাটতে বসলেন।চেয়ারে আরাম করে আবিদা জাহানের মুখামুখি বসে খোশগল্পে মেতে উঠলো ইভান।ভুলেও নিভানের তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টিতে আঁখি মেলালোনা সে।ওই চোখে তাকালেই তার দূরদর্শী চতুর বুদ্ধিসম্পন্ন দাদাভাই ধরে ফেলবে,দলবল নিয়ে কেনো এবাড়িতে হাজির হয়েছে ইভান।কানন স্বভাবে কিছুটা ইভানের মতো।তাই ইভান আর আবিদা জাহানের খোশগল্পের মধ্যে তার অবদানও একবারে চুটিয়ে।নিভান সেসব তীক্ষ্ণ চোখে কিছুসময় অবলোকন করে,মনেমনে ইভানের খামখেয়ালি ছেলেমানুষীর কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পুকুরের দিকে নজর ফেললো।লোকটা পুকুরের পূর্ব দিক থেকে জাল ফেলা শুরু করেছিলো।এখন উত্তরের কোনাকোনি সাইডে চলে গেছে।জাল ফেলে, বড়বড় মাছগুলো একাএকা সংরক্ষণ করতে প্রায় হিমশিম খাচ্ছে।তবে এজীবনে নিভানের পুকুরে জাল ফেলা তো দুর,জাল ফেলে বাস্তবে এই মাছ ধরা মনেহয় প্রথম দেখলো।সেখানে মাছ সংরক্ষণ করে ব্যাগে রাখা তার পক্ষে ওই অভিজ্ঞ লোকটার থেকেও হিমশিমের ব্যাপার।তাই উনাকে সাহায্য করতে গিয়ে নিজেকে লজ্জায় ফেলা সত্যিই লজ্জাজনক। তাই উঠতে চেয়েও আর উঠলোনা নিভান।তবে একটু সময় নিয়ে আশহার সাহেব চলে এলেন।তড়িঘড়ি করে লোকটার কাছে চলে গেলেন।
তন্মধ্যে বাড়ির মধ্যে থেকে মেয়েলি কন্ঠের শোরগোল কিছুটা কানে এলো নিভানের।তারমধ্যে উচ্চধ্বনি হলো মৌনতার কন্ঠ।নিভান বুঝতে পারলো,শুধু কানন আর ইভান আসিনি। পুরো দলবল নিয়েই হাজির হয়েছে ইভান।কেনো? বুঝতে অসুবিধা হয়নি।তবে এই বয়সে এসে ইভানের এখনো সেই ছেলেমানুষী ভয়টা রয়ে গেছে।মনে-মনে হাসলো নিভান।একটা তৃপ্তময় হাসি।একটা সময় ঘনিষ্ঠতা ছাড়িয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে ছাড়াছাড়া সম্পর্ক ছিলো।তখনোও ইভান একই ভয়ে এই ছেলেমানুষীটা করেছে।নিভানের সাথে রাগ করেছে,জেদ দেখিয়েছে।বিনিময়ে সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছে।তবুও দিনশেষে নিভানকে চোখে আড়াল হতে দেখলেই,বাবা মা বোন কাওকে না কাওকে দিয়ে খোঁজ নিয়ে বারবার জেনেছে,দাদাভাই বাড়ি আসবে কখন?সে বাড়ি আসছেতো?সে বাড়ি বাদে অন্য কোথাও গিয়ে থাকছে-না তো?থাকবে না তো?এই ছেলেটার জন্য নিভান কোথাও গিয়ে রাত পার করলে,তাকে একটু স্বস্তি একটু শান্তিতে থাকতে দেইনি ছেলেটা।যেনো দূরে গিয়েও কাছে থাকার আহ্বান।আজ-ও ছেলেটা কি সেই ভয়ে এখানে ছুটে এসেছে!এখনো নিভানের স্নেহবন্ধন থেকে যাবার ভয় পায় ইভান?কেনো?ছেলেটা তো অনেক বড় হয়েছে, সেই অপ্রাপ্ত বয়স্ক ইভান আর নেই।তার বিয়ে হয়েছে, মিষ্টি একটা বউ হয়েছে।তারপরও ইভান এখনো তার দূরত্বতে, তাকে হারিয়ে ফেলার ভয় পায়!একেই কি তবে বলে ভ্রাতৃত্বের স্নেহময় বন্ধন!তার প্রতি ইভানের সেই অটুট অবুঝ ভালোবাসা।যা অপ্রাপ্ত অবুঝপনা ছেলেটার জেদ রাগের মধ্যেও অটুট ছিলো!আর এখনো প্রাপ্ত বুঝদার ছেলেটার মধ্যে অটুট আছে!হঠাৎ ইভানের ছেলেবেলার একটা কথা মনে পড়ে গেলো নিভানের।তখন হয়তো নাফিমের বয়সী ছিলো ইভান।কোনোকারণে রেগে গিয়ে টেবিলের একডজন গ্লাস ভেঙে ফেলেছিলো ছেলেটা।শেষে টেবিলে আলাদা করে যে গ্লাসটা পড়ে ছিলো, সেটা ছুড়ে ফেলতে গিয়ে নিভানের গায়ে লেগেছিলো।মা ততক্ষণে অগ্নিশিখা।ইভানকে মারতে আসায়,নিভান তাকে আগলে নিয়েছিলো।মায়ের সম্মুখ থেকে তাড়াতাড়ি সরিয়ে নিয়ে নিজের ঘরে এনে দরজা আঁটকে দিয়েছিলো।ততক্ষণে ইভান শান্ত হয়েছে।নিভান তাকে কিছু বলার আগেই ইভান তাকে জড়িয়ে কেঁদে দিয়ে বলেছিলো।

‘তুমি খুব ব্যাথা পেয়েছো, তাই-না দাদাভাই?আমি তোমাকে ইচ্ছে করে মারিনি?আমি দেখিনি তোমাকে দাদাভাই? স্যরি দাদাভাই।

‘ইট’স ওকে সোনা।আমি জানিতো আমার ইভান সোনাটা আমাকে কখনো ইচ্ছেকৃত ব্যথা দিতে পারেনা।

নিভানকে আঘাত করার দরূন ইভান তখনোও ঠান্ডা হয়নি।নিভানের স্বান্তনা বানি কাজে দেয়নি।ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছিলো আর অবুঝ গলায় বলছিলো–‘দাদাভাই আমি তোমাকে ব্যথা দিলে তুমি কখনো আমাকে বকোনা,মেরোনা, তোমার থেকে দূরে সরিয়ে দিও-না।শুধু ভালোবেসো দাদাভাই।বেশিবেশি ভালোবেসো দাদাভাই।মা বাবা যতযত তোমাকে ভালোবাসে।তুমি ততোততো তারচেয়ে বেশি আমাকে ভালোবেসো দাদাভাই।ভালোবাসবে না দাদাভাই? বলো?

‘দাদাভাইতো তোকে খুব ভালোবাসে।আর সবসময় খুব ভালোবাসবে সোনা।তুই শত ব্যথা দিলে-ও ভালোবেসে যাবে।চুপ।আর কাঁদে না।তাহলে কিন্তু এবার দাদাভাই সত্যিই বকবে।

নিভান তার কথা রাখতে পেরেছে কি-না,সে জানেনা।হয়তো ভ্রাতৃত্বের সেই স্নেহময় ভালোবাসার সার্টিফিকেট শুধু একমাত্র ইভানই দিতে পারবে।ইভানের দিকে ফের নজর দিলো নিভান।মিষ্টির বাটি হাতে তার।টপাটপ খেয়ে চলেছে।ছোটো চাচী একটু আগে এসে ভিতরে নাস্তা করার জন্য ডেকে গেলেন।বান্দা খোশগল্পে এতো মত্ত,ভিতরে যায়নি বলে পুনরায় চাচি মিষ্টির বাটিটা দিয়ে গেলেন।এক্সট্রা আরেকটা চেয়ারে উপরে আরও কি কি যেনো রেখে দিয়ে গেছেন।তবে নিভান তা দেখতে না পেলেও বাটি হাতে নিয়ে ইভানকে কাঁটাচামচে একটার পর একটা করে মিষ্টি তুলতে আর সদানন্দে মুখ পুরতে দেখছে সে।।সেখানে খাওয়া আর গল্প বাদে পৃথিবীর আর কে কোথায় আছে আপতত সেসবে তার খেয়াল, ধ্যান নেই।মাত্রাধিক সুদর্শন ছেলেটার হাসিখুশি মুখটা যেনো তার চেহারার জৌলুশতা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়।

নীরবতায় ডুবে থাকা বাড়িটায় হঠাৎ শোরগোল। বেশ ভালো লাগল আবিদা জাহানের।ওবাড়ির প্রতিটি বাচ্চা মিশুকে এবং স্বভাবে অমায়িক।অল্প সময়ের মধ্যে নিতু ইতুও কেমন ওদের সাথে মিশে গিয়েছে। মনেহচ্ছে কতোদিনে আত্মীয়তা,পরিচিত সবার।অথচ আজই সবার প্রথম দেখা,প্রথম পরিচয়।মেয়েগুলো বসে নেই, কাজ না পারলেও যে যেটুকু জানে হাতেহাতে টুকটাক ঝুমুরকে সাহায্য করে দিয়েছে।ঝুমুর বারবার নিষেধ করায় এখন একজায়গায় বসে গল্পে মেতেছে।অন্যদিন এই সময়টা আবিদা জাহানের চুপচাপ একাকি নিজ ঘরেতেই কেটে যায়।আজ তা আর হলোনা।আজ এরা আর তাকে ঘরে শুয়ে-বসে থাকতে দিলোনা।বসার ঘরের সোফার মধ্যেমনি করে উনাকে বসিয়ে গল্পে মেতেছে।মাঝেমধ্যে গল্পের উপস্থাপনা উনাকেও করতে হচ্ছে। বিষয়টা মন্দ নয়।মনটার সাথে সাথে অসুস্থ দূর্বল শরীরটাও কেমন যেনো হঠাৎ ফুরফুরে অনুভব হচ্ছে।
শরীরে যেনো কোথায় কোন অসুখে ভুগেছিলেন তা যেনো মূহুর্তেই ভুলে বসলেন।ক্ষনে ক্ষনে শ্বাসকষ্টের যে সমস্যাটা দেখা দেয়,তা যেনো কোন দূরপ্রান্তে উড়াল দিয়েছে।আসলে উনার অসুখটা শরীরের থেকে মানসিক বেশি।আর সেই মানসিক পীড়া শরীরের অসুখকে দিনকে দিন ভারী করে তুলছে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের চতুর্পাশের হাসিখুশি মুখগুলো মুগ্ধ নজরে দেখতে থাকলেন।হ্যা,বৃদ্ধা বয়সে এসে এরকমই একটা পাওনা তো তিনিও আশা করেছিলেন।সবসময় নাতিনাতনিদের হৈ-হুল্লোড় কোলাহল, হাসিখুশিতে ভরপুর থাকবে বাড়িটা এরকমই তো চেয়েছিলেন।অথচ ভাগ্য এমন এমন গলিতে গিয়ে মোড় নিলো,নাতীনাতনী থাকা সত্ত্বেও এত বড়ো বাড়টি সবসময় নীরবই পড়ে থাকে।নিতু আর ইতু বাড়িতে না থাকালে,বিশেষ করে ইতু বাড়িতে না থাকলে ক্ষনে ক্ষনে তো মৃতুপুরীর মতো নিস্তব্ধ, শুনশান হয়ে পড়ে বাড়িটা।

সবাই খোশগল্পে মজে থাকলেও কৌড়ি দাঁড়িয়ে আছে রানাঘরে ঝুমুরের পাশে।সবার সাথে গল্প করার মধ্যে হঠাৎ তার মনেহলো,ছোটোচাচীকে সাহায্য না করা হোক তবুও তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালে,কথা বললে ব্যস্ত কর্মরত উনারও ভালো লাগবে।সত্যিই কৌড়িকে রানাঘরে দেখতেই ভদ্রমহিলা অমায়িক হেসে দিয়ে বললেন–তুমি আবার উঠে আসলে কেনো?কিছু লাগবে কি?

‘না।এমনিতেই আসলাম।আপনি একা একা কতোশত কাজ করছেন,আমাদের কাওকে রান্নাঘরে ঢুকতে দিচ্ছেন না।বিষয়টা ভালো দেখায়?আমারতো ভালো লাগছে না।

‘ওরে আল্লাহ।সত্যিই তো শ্বাশুড়ি কাজ করবে আর তার বাচ্চা বউমা চুপচাপ দেখে যাবে বিষয়টাতো সত্যিই কেমন দেখায়।এসো তবে কাজে হাত লাগাও।

প্রথম কথাগুলো মজার ছলে বললেও,শেষের কথাটা বলতে বলতে কৌড়ির দিকে বড়সড় একটা মাছের পাত্র ধরিয়ে দিলেন।তাতে বড়বড় কাতল মাছের পিছ করে রাখা।সুন্দরকরে ধোয়া পরিস্কার করা।কৌড়ির হাতে সেটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন–আপতত বউমা কে কাজের চাপে রাখতে,শ্বাশুড়ির আর এটুকু কাজ বাকি আছে।বউমা যখন নিজেই শ্বাশুড়ির সাহায্য করতে চাইছে তবে মাছগুলোতে একটু কষ্ট করে লবন হলুদ মাখিয়ে দাও।তবে খবরদার মরিচের গুঁড়ো নেবে-না।ওটা আমি মাছভাজার সময় নিজে লাগিয়ে নেবো।

‘আচ্ছা ঠিক আছে।

সানন্দে কাজে হাত দিলো কৌড়ি।সকালে এবাড়িতে নিভান থাকার কথা বলতেই,শাড়ী ছেড়ে নিতুর একটা নতুন থ্রিপিস পরেছে সে।নিতু নিজেই অফার করেছিল।কৌড়ি না বললেও শোনেনি।নিতু তার থেকে স্বাস্থ্যে ভালো তাই থ্রিপিসটা গায়ে একটু ঢিলাঢলা হয়েছে।তবে ফর্সা গায়ে কাঁঠালি রঙটা বেশ চড়াও হয়েছে।মেয়েটাকে বেশ পছন্দ হয়েছে ঝুমুরের।মিষ্টি মেয়েটার সাথে কথা বলেও আলাদা শান্তি।বয়স অল্প হলেও বেশ বুঝদার।

‘বাটাবাটি, কাটাকাটি সব কাজ-তো ময়নার মা’ই গুছিয়ে দিয়েছে।আমি শুধু রান্না করছি।তবে তোমাকে কিন্তু এখানে মাছগুলোতে লবন হলুদ লাগানোর জন্য আটকায়নি,গল্প করার জন্য আটকিয়েছি।এখন বলো তো,এই বাড়িটা তোমার কেমন লাগলো?মাঝেমধ্যে এই শ্বশুরবাড়ীতে আসা যাবে তো?যদিও থেকে গেলে আমার একজন দারুন সঙ্গী হয়।তবে তোমার শ্বাশুড়ির হক তো চেয়ে নেওয়াও অন্যায়।তাই থেকে যাওয়ার কথা বলতে পারছিনা।

‘এবাড়িটা আমার খুব ভালো লেগেছে ছোটোচাচী।আমি আসবো মাঝেমধ্যে।

‘আর এবাড়ির মানুষগুলো বুঝি পছন্দ হয়নি?

ঝুমরের কথায় কৌড়ি বিচলিত হলোনা বরং অমায়িক হাসলো।ফের বললো–যেবাড়ির মানুষগুলো ভালো নয়, সেটা রাজপ্রাসাদ হলেও সেখানে যেতে বা থাকতে আমার একটুও ভালো লাগে-না।বাড়ি ভালো হয় বাড়ির মানুষগুলোর গুনে,বাড়ির অবকাঠামো আর রঙচঙের সৌন্দর্যের গুনে নয়।এটা বাবা বলতেন।আমিও মানি।

মেয়েটা গুন স্বভাব আচার-আচরণ বলে মেয়েটা বাবা, মায়ের কাছ থেকে বেশ ভালোই শিক্ষা পেয়েছে।ঝুমুর কৌড়ির কথার প্রশংসা করলেন।এরকম টুকটাক কথা হতে থাকলো তাদের মধ্যে।

বড় পুকুরটায় প্রায় ঘন্টাখানেক আগে জাল ফেলে মাছধরার ঘোলাপানির কোনো চিহ্ন নেই।মাছধরার সময় পানিটা হালকা ঘোলাটে হয়ে গেলেও,তা পুনারায় সচ্চ,টলটলে।দুপাশে বসার স্থান করে শানবাঁধানো ঘাটটার একপাশে নিভান আর অন্যপাশটায় ইভান বসে আছে।সেই কখন এসেছে এবাড়িতে আর মাত্রই দু’ভাইয়ের সম্মুখীন সাক্ষাৎ হলো।অনেকটা সময় পর নিভান মুখ খুললো।খুব সহজ সাবলীল গলায় শুধালো।

‘হঠাৎ দলবল নিয়ে হাজির?কেনো?

‘দাদুমা একেক দিন আবদার জুড়ছে আর তুমি তাতে সায় জানিয়ে থেকে যাচ্ছো।কেনো?তাহলে তো আমার আর আসা লাগতো-না।

ইভানেরও সহজ সরল স্বীকারোক্তি।অদ্ভুত শান্ত চোখে তারদিকে তাকিয়ে রইলো নিভান।ফের বললো–তো প্রবলেমটা কোথায়?উনি অসুস্থ মানুষ।আবদার জুড়লে পিতৃসুত্রে তা রাখার দ্বায় আছে আমার।যাই হয়ে যাক রক্তের দ্বায়টা তো এড়াতে পারিনা আমি।বাবার জন্য হলেও সেটা রক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ।

‘যেমনটা মায়ের জন্য রক্ষা করে যাচ্ছো!তাই না?

সত্য হলেও ইভানের মুখে কথাটা মানতে পারলো না নিভান।কপাল কুঁচকে কিছুটা ক্ষিপ্র গলায়
বললো—হোয়াট রাবিশ!এসব কি ধরনের অবুঝপনা ছেলেমানুষী কথাবার্তা!তুই কি এখনো ছোটো আছিস ইভান?এখনো এসব কথাবার্তা তোর মাথায় ঘুরেফিরে চলে!আর আমি এখানে থেকে গেলে, তুই কি পারবি আমাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে?কেউ পারবে?এসব বোকামো,পাগলামো নয়?

‘তারমানে দাদুমা বললে তুমি এবাড়িতে থেকে যাবে?

‘তা কেনো থাকবো!থাকার হলে বহুবছর আগেই এসে আমি থাকতাম।

‘মায়ের জন্য পারো-নি তাই না?

‘সমস্যাটা কি তোর ইভান?

সবসময় কথা প্যাচানো, কথা বাড়ানো ইভান।আজ কথা বাড়াতে চাইলো-না।রক্তের সম্পর্কের প্রতি কার কতোটা দূর্বলতা আছে ইভানের জানা নেই।তবে নিভান আওসাফ আহমেদের আছে।কঠিন দূর্বলতা।যে ছেলেটা অবুঝ বয়স থেকে-ও কখনো বাবার নামের টাইটেল নিজের নাম থেকে মুছতে দেয়নি।এতোবড় নামীদামী ব্যাবসায়ীর চেয়ারে বসে যখন নিজের পিতার নাম জাহিদ হাসান না বলে দ্বিধাহীন আওসাফ আহমেদ বলে পরিচয় দেয়।সেই ছেলেটার রক্তের টান সম্পর্কে ইভানের ঢেড় জানা আছে।ওবাড়ির সামন্য অর্থ,আরাম-আয়েশ সুখসাচ্ছন্দ্য দাদাভাইকে টানেনা।সেসবের প্রতি দাদাভাইয়ের বিন্দু লোভ, টান নেই।এটাও ইভান জানে।আর সহধর্মিণীও পেয়েছে তেমন।যদি বলে তারসাথে রাস্তায় জীবনযাপন করতে।মেয়েটা চোখবুঁজে সেই রাস্তায় থাকতে রাজি হয়ে যাবে।সেখানে এবাড়িতে থেকে যাওয়াটা কোনো বাঁধাই না।ইভান জানে ইভান নিজের মনের সংশয়,ভয় থেকে ছেলেমানুষী করছে।নিভান যদি এবাড়িতে থাকতে চায় ইভান তাকে কখনো আটকে রাখতে পারবে-না।তবে রক্তের টানের থেকে আত্মার টানের বন্ধন দৃঢ় হয়।সেখানে একই মায়ের সন্তান তারা।আর দাদাভাইয়ের আলাদা একটা টান ভালোবাসা তারপ্রতি রয়েছে,সেখানে দাদাভাই কখনো তার চাওয়া পাওয়া, ভালোবাসা, মায়া অগ্রাহ্য করতে পারবে-না।তারদিক থেকে সহজে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারবেনা।সেখানে সবগুলো ভাইবোনের ভালোবাসা টান মায়া সে কিকরে উপেক্ষা করবে?তাই ভুলেও যদি দাদাভাই থেকে যাওয়ার পরিকল্পনা করে,এবাড়িতে কিছুতেই একেবারে থাকতে দেবেনা ইভসন।তাই দলবল নিয়ে হাজির।যদিও এটা দলবলেরা জানেনা।জানে শুধু ইভানের ভিতরটা।

নিভানের কথার উত্তর দিলোনা ইভান।গায়ের টিশার্টটা একটানে খুলে ফেললো।প্যান্টের পকেট থেকে ওয়ালেট আর ফোনটা বের করে শানের উপর রেখে ঝপাৎ করে পুকুরের পানিতে লাফ দিয়ে পড়লো।ইভান সুইমিং জানে,তাই বিচলিত হতে গিয়েও হলো-না নিভান।স্থির হয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে সেভাবে বসে থেকে ইভানের সাঁতরানো দেখতে থাকলো।অদ্ভুত ছেলেটার কখন কি মনেহয় কে জানে!এবোবড় হয়েছে তবুও ছেলেটার ছেলেমানুষী গেলো না!সময় নিয়ে নিভান বললো।

‘তুইযে এই লাফিয়ে ঝাপিয়ে গোসল করে চলেছিস।গোসল সেরে পরবি কি?

সাঁতরানোর মধ্যেও ইভান মুখ উঁচু করে হাসলো।ফের বললো—তুমি আছো কিসের জন্য।

‘আমি এবাড়িতে থাকার জন্য আসিনি ইভান।ক্ষনিকের জন্য এসেছি।সেটা ভেবে না সঙ্গে করে এক্সট্রা কিছু নিয়ে এসেছি,আর না এখানে আমার কিছু আছে।

‘ভেরী গুড।তবে তুমিযে কাল স্যুট পরে আসলে।এখন গায়ের এই টিশার্ট,পরনের এই ট্রাউজার কোথায় পেলে?

‘এটা এক্সট্রা গাড়িতে থাকে আমার।

‘অর্ডার দিলে তো হয়ে যেতো।

‘কাল এখানে থেকে যাবো ভাবিনি।মনে হয়েছিলো, যত রাত হোক বাড়িতেই চলে যাবো।কিন্তু যাওয়া হয়ে উঠেনি।তবে সকালেই বাড়ি যাওয়া হবে বলে রাতে-ও আর অর্ডার করা হয়নি।এখন মনেহচ্ছে করলে ভালো হতো।

‘এখন অর্ডার দিয়ে দাও।

‘আসতে সময় লাগবে। তারমধ্যে কি করবি?

‘আরেহ চাচাজান আছেননা?উনার লুঙ্গিসুঙ্গি পরে নেব।

ইভান পরবে লুঙ্গি!হেসে ফেললো নিভান।নিভানের বড়মাম বাংলাদেশ ব্যাংকের সিনিয়র কর্মকর্তা ছিলেন।তিনি অফিস টাইম বাদে বরাবরই লুঙ্গিতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন।ইভান তখন ছোটো।একেবারে ছোটো নয়।তখন হয়তো ক্লাস ফোর কি ফাইভে পড়ে।বড়মামাকে দেখে ইভানের লুঙ্গি পরার শখ জাগলো।যেন-তেন শখ নয়,ভিষন শখ।লুঙ্গি কিনবেই কিনবে এবং পরবেই পরবে।বাধ্য হয়ে মা তাকে ছোটো লুঙ্গি কিনে দিলেন।ইভান খুশিমনে তা পরলো।কিন্তু বেচারা সামলাতে পারলোনা।শত চেষ্টা করেও সামলিয়ে উঠতে পারলোই না।বরংবার তা খুলেখুলে পড়ে যেতে লাগলো।তবুও শখ বলে কথা,ইভান চেষ্টায় সচল থেকে গেলো।কিন্তু সেই চেষ্টা যখন সর্বসম্মুখে ইজ্জতের দফারফ করে দিলো।তখন গিয়ে ছেলেটা ক্ষান্ত হলো।বস্ত্রহীন ইভান,লজ্জায় কেঁদেকেটে লুঙ্গি ছিঁড়ে ফেললো।এবং কঠিন শপথ করলো,পোশাক না থাকলে না পরে থাকবে তবুও লুঙ্গি সে আর কখনো পরবেনা।জীবনে পরবেনা।সেই থেকে আজও পর্যন্ত ইভান কখনো লুঙ্গি পরেনি।নিভান অন্তত পরতে দেখেনি।

‘হাসছো কেনো?তখন ছোটো ছিলাম বলে সামলাতে পারতাম না। তবে এখন নিশ্চয় সামলাতে পারবো।

নিভান কিছু বলতে যাচ্ছিলো।তন্মধ্যে আযানের ধ্বনি ভেসে আসায় চুপ হয়ে গেলো।ততক্ষণে ইভান সারাপুকুর সাঁতরিয়ে চলেছে।নিভান তা চেয়ে চেয়ে দেখলো।

‘আরেহ ইভান ওয়াশেরুমে গোসল করতে।

আশহার সাহেবের কন্ঠে ইভান গলা চড়াও করে উত্তর দিলো–সমস্যা নেই আঙ্কেল।পুকুরে গোসল করতে বেশ ভালোই লাগছে।আপনি শুধু একটা তোয়ালের ব্যবস্থা করে দিন।গামছা হলে-ও চলবে।

নিভানকেও ভিতরে গোসল করার তাগাদা দিয়ে আশহার সাহেব বাড়ির মধ্য চলে গেলেন।নিভান ভিতরে গেলোনা।গায়ের টিশার্টটা খুলে ইভানের দেখাদেখি সেও পুকুরে নেমে পড়লো।সুইমিং জানা থাকলেও ইভানের মতো পরিপক্ব নয় সে।তাই আর বিশাল বড় পুকুরটার টলটলে সচ্চ পানিতে সাঁতরানো হলো-না তার।ছয় সাতটা সিঁড়ি বেয়ে কোমর সমান পানিতে গিয়ে বসলো সে।শানের উপর আগের থেকেই একটা গোসলের মগ ছিলো।সেটা হাতে নিয়েই নেমেছিলো।আর তা দিয়েই পানি কাটিয়ে গোসল করার চিন্তা ভাবনা করলো।

বাড়ির পিছনের বাগানটা দেখবে বলে নিতু ইতুকে সাথে মেয়েরা সব বেরিয়েছিলো।পুকুরঘাটে নিভান আর ইভানকে গোসল করতে দেখে,ডানপাশ ঘুরে তারা বাগানে চলে গেলো।তবে কৌড়ি যেতে পারল না।নাফিম জেদ ধরেছে,বাহানা করছে।সেও পুকুরে ডুবিয়ে দাদাভাইদের মতো গোসল করবে।কিন্তু নিভান থাকায় জেদটা জোরালো করতে পারছে-না।আর না দৌড়ে গিয়ে নামতে পারছে।তাই কৌড়িকে ধরেছে উকিল।কৌড়ি পড়েছে মহাজ্বালায়।একে নাফিম সাঁতার জানে-না।তাতে আবার অচেনা পানি-তে ওর ঠান্ডা লাগার ধাত আছে।কিছুতেই নিভান রাজি হবেনা তাকে পানিতে নামতে দিতে। এখন কি করবে সে?

‘বউমনি,আমিও পুকুর গোসল করবো।তুমিও চলোনা, তবে দাদাভাই বকবেনা।

বাহানা জারি রইলো বিরতিহীন। পুকুরের ঘাটে বসে গোসল করতে থাকা মানুষটা মনেহয় সেই অব্যহত জারী শুনতে পেল।পিছন ফিরে মুখ উঁচিয়ে বললো–কি বলছে ও?

কৌড়ি জানে উত্তর পেতেই গম্ভীর মুখে মানুষটা বলবে– না,পুকুরে গোসল দেওয়া যাবেনা।ওকে ভিতরে নিয়ে গোসল করিয়ে দাও।আর এই গম্ভীর বার্তা শুনতেই বাচ্চা ছেলেটার মন খারাপ হয়ে যাবে।সুন্দর মুখখানা গুমোট হয়ে থাকবে।এমনিতেই মানুষটার গলার আওয়াজ শুনতেই চুপ হয়ে গেছে ছেলেটা

‘কৌড়ি।

‘ও-ও আপনাদের সাথে পুকুরে গোসল করতে চাইছে।

নিভান কিছুসময় চুপ থেকে বললো—আচ্ছা পাঠিয়ে দাও।

কাচুমাচু হয়ে দাড়ানো নাফিম লাফিয়ে উঠলো।তড়িৎ কৌড়ির ওড়নার আচল ধরে টান দিয়ে বললো—চলো।

‘এই আমি কোথায় যাবো?দাদাভাই হ্যা বলেছে যখন তুমি যাও।আমি ঘাটে দাড়িয়ে থাকছি। যাও।

কৌড়িকে ছাড়া যাবে-না নাফিম।ছোটো দাদাভাইয়ের সাথে দুষ্ট মিষ্টি যেমনই হোক,তার দারুন সখ্যতা হলেও বড়দাদাভাইয়ের সাথে একদম নয়!অগ্যতা নাফিমের বাহানায় কৌড়িকে যেতে হলো।তবে সিঁড়িতে পা রাখতেই উদোম গায়ে নিভানকে গোসল করতে দেখে কেমন অস্বস্তি হলো।নাফিম পানিতে নামার আগে নিভান বললো।–‘ও গোসল করে পরবে কি!ওকে চেঞ্জ করে গামছা জাতীয় কিছু পরিয়ে দাও।

অগ্যতা গামছা এনে নাফিমকে চেঞ্জ করে দিল।ছেলেটা লজ্জা পাচ্ছিলো তবে পুকুরের গোসলের আনন্দে তা ক্ষীন হলো।নাফিমের প্যান্ট শার্ট আর চশমা হাত নিয়ে উপরে চলে গেলো কৌড়ি। নাফিম পুকুরে নামতেই তাকে কোলের মধ্যে সিঁড়িতে বসিয়ে নিজের হাতের মগটা ধরিয়ে দিলো নিভান।বললো–পুকুরে নামা যাবে না।ডুবে যাবে।এখানে বসে গোসল করে নাও।

‘নাফিম আমার কাছে আসবি?

ইভান ডাকতেই নাফিম কোথায় বসে আছে মূহুর্তেই যেনো ভুলে গেলো।উচ্ছসিত হয়ে দাঁড়িয়ে উঠতেই,নিভান তাকে হাত ধরে বসিয়ে দিলো।নিজের একটা হাত দিয়ে ওর পেট চেপে ধরে ইভানকে উদ্দেশ্য করে বললো–ও সাঁতার জানেনা ইভান।ওকে নিয়ে একদম ফাজলামো নয়।

গম্ভীর গলাা শুনতেই নাফিম দমে গেলো।চুপচাপ দাদাভাইয়ের কোলের মধ্যে বসে পড়লো।পুকুরে নামতে দিয়েছে এই ঢেড়।এখন বাড়াবাড়ি করলে,দাদাভাই সোজা উপরে উঠিয়ে দেবে।ওর থেকে চুপচাপ গোসল করাই ভালো।আর কোলের মধ্যে বসে আছে এটাওতো ভসবতে হবে! তবে ইভান তাকে উস্কানো বন্ধ করলো-না।তাতে কান মন দিলে-ও, সায় দিতে পারলো-না নাফিম।কানন এসে দাঁড়ালো সবে।ও ওয়াশরুমে গিয়েছিলো।ওয়াশরুম থেকে বের হতেই ঝুমুর জানালো সবাই বাড়ির পিছনের বাগানে। তাই ওও চলে এসেছে।কৌড়ির পাশাপাশি এসে দাঁড়াতেই ইভান এবার নাফিমকে ছেড়ে ওর পিছু নিলো।বললো–কানন সাঁতার জানো?

‘গ্রামের ছেলে সাঁতার জানবোনা।হ্যা ভাইয়া।

‘তবে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?নেমে পড়ো।

‘গোসল করে পরবোটা কি ভাইয়া?ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিওনা টাইপ মাথায় কাজ করবে তখন।হুদাই গামছা পরে বসে থাকতে হবে।

‘আরেহ অতশত ভাবলে কি আর হয়।নেমে পড়ো তো।

কানন সত্যিই ভাবলোনা।গা থেকে শার্ট গলানোর আগে নিচু গলায় কৌড়িকে উদ্দেশ্য করে বললো—ফুলবানু ব্যাডনিউজ আছে।

কাননের স্বভাব সম্পর্কে জানে কৌড়ি।সত্যি যদি ব্যাড নিউজ হতো,কন্ঠে এতো রসিকতা এনে বলতো-না।মুখেও চিন্তাভাবনার প্রলেপ থাকতো।তাই বিচলিত না হয়ে সহজ গলায় জিজ্ঞেস করলো—কি ব্যাড-নিউজ?

‘আমাদের নাহিদ আরশাদ সাহেব নাকি আবার-ও পুরানো ক্যারেক্টারে ফিরে গিয়েছেন।সাথে মাতলামো, পাগলামো শুরু করছেন।আগের দিন নাকি হাত-ফাত কেটে নাজেহাল অবস্থা করে ফেলেছেন। হসপিটালে ভর্তি করা লাগছে নাকি উনাকে।আহারে বেচারাকে দেখতে যেতে আমার খুব ইচ্ছে করছে।দাদিআপা আর আব্বুতো আজ সকালেই চলে যেতো।তুই যেতে চাইলে বল,ভাইয়াকে বলি?

চলবে…..

#ফুলকৌড়ি
(৫৩)শেষাংশ
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

ফাজলামো করে ঘনোঘনো ভ্রু নাচালো কানন।অর্থাৎ কৌড়ি যাবে কি-না? কিন্তু বিষয়টা কাননের কথাবার্তায় যে ধারায় ফাজলামো ঝরে পড়লো, কৌড়ির কাছে তা একটুও ফাজলামো মনে হলোনা।শত্রু হলেও নিজের জন্য কারও অমঙ্গল কখনো চাইনি আর চায়ও-না সে।নাহিদকে একেবারে পছন্দ করেনা কৌড়ি তাইবলে তার মন্দটা হোক এটা চায়না কখনো।

‘ও যা আমাকে বকে ধমকিয়ে জ্বালিয়েছে না!চল-না নিভান ভাইয়ার বউ ইন্ট্রডিউস করিয়ে তোকে দেখিয়ে এবার একটু শোধবোধ নিয়ে আসি।

‘তুই পুকুরে নামবি নাকি আমি ঠেলা মেরে ফেলে দেবো তোকে!কুকুর কামড়িয়েছিল তাই শোধ নিতে এখন তুইও যাবি কুকুরকে কামড়ে দিতে!অসভ্য, পুকুরে নাম গোসল কর, যা।

কানন মৃদু হেসে গায়ের শার্ট গলিয়ে ঝপাৎ করে পুকুরে নেমে পড়লো।তারপর শুরু হলো ইভান আর তার সারা পুকুরময় দাপানো।প্রতিযোগিতাও হলো দুজনের মধ্যে,ওপাড়ের ঘাট থেকে ওপাড়ের ঘাট।একটা সময় ক্ষান্ত দিয়ে সিড়িঘাটে এসে বসলো দুজনে।নিভান এতোসময় ধৈর্য্য নিয়ে দুই প্রাপ্তবয়স্ক বাঁদরের বাদরামি দেখলো।একজন সম্পর্কে শালাবাবু আরেকজন কলিজার ভাই।কি বলা যায় তাদের?নিভানের পাশে এসে ইভান বসতেই নাফিমের দিকে নজর দিলো।নাফিমের পরনের গামছার ফাঁক দিয়ে তার ফর্সা পা দেখা যাচ্ছে। সেটা লক্ষ্য করে চোখ দিয়ে ইশারা করলো ইভান।নাফিম কি বুঝে সেদিকে তাকালো।তবে উরুর অংশ বেরিয়ে যেতে দেখে তাড়াতাড়ি ঢেকে ফেললো।
তবে তার মনে হচ্ছে, ছোটো দাদাভাই আরও কিছু দেখে ফেলেছে।যদিও ইভান দেখেনি।তবে নাফিমের আতঙ্কিত নজর খেয়াল করে মিছেমিছি নাফিমকে ক্ষেপাতে বললো–আরেহ ঢেকে কি লাভ দেখেই তো ফেলেছি।

নাফিম কেঁদে দেবো যেনো।এতো মানুষের সামনে বেইজ্জতি।এতোসময় নিভানের সান্নিধ্যে থেকে তার কাছে কিছুটা সহজ হয়ে যাওয়ায় মুখ উচু করে কন্ঠে খাদ মিশিয়ে ডাকলো—দাদাভাই।

নিভান কিছু বলার আগেই ইভান ফের বললো–আরেহ দাদাভাই কি!দু’বছর আগে যখন তোর ইয়ে কেটেছিলো,তুই কাঁদছিলি আমি ধরেছিলাম তোকে।তখন তোর লজ্জা কোথায় ছিলো?

‘উফফ,ইভান!

পাশে বসা কানন খিলখিলিয়ে হাসলো।ইভান ভাইয়া যেমন মিশুকে ছেলে তেমন জোশ।নিভান এবার সত্যি বিরক্ত হলো।ইভানকে থামিয়ে দিয়েও কাজ হলোনা।সে কি কারও কথা শোনে!সে আছে খোঁচাতে। না পেরে নিভান এবার কৌড়িকে ডাক দিলো।কৌড়ি ছিলো নিজের খেয়ালে।একবার নয় দুবার ডাক দেওয়া লাগল তাকে।

‘এই কৌড়ি।শুনছো।এই নাাফিমকে নিয়ে যাওতো।চেঞ্জ করিয়ে দাও।

কৌড়ি এলো।নাফিমকে কোল থেকে উঠিয়ে দেওয়ার সময় ফের নাফিমের গামছা ধরে টান দিলো ইভান।নিভান হাত চেপে ধরে আটকালো।মিছেমিছি রাগ দেখালোও।তাতে থোড়াই না ইভানের গেলো এলো।নাফিমকে নিয়ে উপরে উঠে চেঞ্জ করিয়ে দিলো কৌড়ি।ওদের গোসলের মধ্যে আশহার সাহেব এসে বডিওয়াশ শ্যাম্পু রেখে গিয়েছিলেন।সারা পুকুরের শেওলা গায়ে জড়িয়ে এবার এবার বডিওয়াশ, শ্যাম্পু নিতে ব্যস্ত হলো ইভান।নিভানের হয়ে গেছে।কয়েক সিঁড়ি উপরে উঠে কৌড়ির কাছে তোয়ালে চাইলো সে।সেটা দেখে ইভান এবার কৌড়ির পিছে লাগলো।

‘কি বলেছিলাম ফুলকৌড়ি?বলেছিলাম না,ওই মানুষটা থেকে দূরে থেকো।নাহলে কিন্তু তার প্রেমে পড়ে যাবে।সব মেয়েরা কিন্তু ওই একই ভুল করে।মানলেনা আমার কথা।তুমিও সেই ভুল করলে।দেখেছো,শেষমেশ বিয়েই
করে নিতে হলো।এখন আবার খেদমতও করতে হচ্ছে।
এজন্য লোকে বলে,গরীবের কথা বাসি হলে ফলে।তখন শুনলে-না আমার কথা এখন খেদমত করে যাও।

নিভান থোড়াই না কানে তুললো ইভানের কথা।তবে কৌড়ি তাজ্জব বনে গেলো।তখনও হা হয়ে ইভানের কথাগুলো শুনে যাচ্ছে।এমন কথা কখনো বলেনি ইভান বরং তার দাদাভাইয়ের গুনোকীর্তন গেয়ে দিনের পর দিন উসকিয়ে গেছে তাকে।ফাযিল লোকটা এখন পাল্টি খাচ্ছে। উল্টো গান গাইছে।

‘কি ফুলকৌড়ি ফলে গেলো তো আমার কথা?

এবার নিভান বললো–ফুলকৌড়ি কি?

ইভান হেসে বললো—ফুলকৌড়ি ইজ ফুলকৌড়ি।তুমি কি বলতে চাইছো,ফুলকৌড়িকে আমি বউমনি বলবো।নেভার এ্যাভার।অতটুকু একটা মেয়েকে বউমনি বলা যায়!যদি পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের একটা বুড়িছুড়ি হতে তবে ভেবে নাহয় দেখা যেতো।ভেবে দেখা যেতো কি!বড় ভাইয়ের বউ হিসাবে বউমনি বলে ডাকতেই হতো।কিন্তু এমন একটা বাচ্চা মেয়েকে বউমনি ডাকা যায়?

কৌড়ি এবার আর ইভানের দিকে নয় নিভানের দিকে ছোটো মুখ করে তাকালো।উন্মুক্ত শরীর।একটানা মাথা মুছে চলেছে মানুষটা।কৌড়িকে তাকাতে দেখেই মিষ্টি হেসে দিলো নিভান।নিভানের হাসি দেখে কৌড়িও মৃদু হেসে মাথা নিচু করে নিলো।সে তো জানে ইভান কেমন?তবে কেনো বোকামো করে ওমন ছোটো মুখ করে তাকালো!নিজের বোকামোতে যেনো নিজেই লজ্জা পেলো কৌড়ি।ইভানকে থামাতে নিভান ফের বললো —‘তবুও আর ফুলকৌড়ি নয়।ও তোর মেয়ের বয়সী হলেও ওকে বউমনি বলেই ডাকবি।

‘আরেহ ফুলকৌড়ি আমাদের ফুলকৌড়ি।ও তোমার বউ হওয়ার আগে আমাদের ফুলকৌড়ি ছিলো। ছিলো নাা নাফিম?

পুকুরপাড়ের শানবাঁধানো ঘাটের একপাশে বিশাল বড়ো একটা কামেনিফুল গাছ অপরপাশে ঝাঁপানো একটা করমচা গাছ।সেখানে সুবজের মিশলে লাল করমচাঁতে গাছ হেলে পড়েছে।সেখান থেকে করমচাঁ তুলছিলো নাফিম।ইভান তাকে উদ্দেশ্য করে বলতেই
নাফিম নাকমুখ কোঁচকালো।অর্থাৎ তাকে একটু আগে চরম বেইজ্জতি করার কারণে ইভানের কথায় উত্তর দেবে-না সে।ইভান সেটা দেখে এবার কৌড়িকে ছেড়ে নাফিমের পিছু লাগলো।নিভান বিরক্তির সাথে সাথে ইভানের কাজে এবার অধৈর্য্য হয়ে পড়লো।বুঝতে পারলো,ইভানের আজকের টার্গেট নাফিম এন্ড কৌড়ি।
এরা সামনে থেকে না সরা পর্যন্ত এই ইতোড় ছেলেটা কিছুতেই থামবে-না।নিভান কোনোরকম চেঞ্জ করে নাফিম আর কৌড়ি ডেকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে চলে গেল।ততক্ষণ পর্যন্ত বিরতী চললো ইভানের ইতুড়েপনা।ওরা চলে যেতেই কানন হাসি থামিয়ে বললো।

‘আপনি পারেন-ও বটে ভাইয়া।

বিনিময়ে একগাল হাসলো ইভান।ইদানীং তার সবচেয়ে জ্বালাতে ভালো লাগে তন্ময়ীকে।আজ তাকে জ্বালানোর সুযোগ পায়নি ইভান।তাই সুযোগটা ব্যবহার করলো নাফিম আর কৌড়ির উপর দিয়ে।সারাদিনে একবার কারও পিছু না লাগলে মনেহয় দিনটা কেমন যেনো রুচিহীন খাবারের পানসে গেছে তার।

ডায়নিংটেবিল ভর্তি খাবার সাজানো।চিংড়ি মাছ দিয়ে মোচাঘণ্ট,নারকেলের দুধ দিয়ে লাউ চিংড়ি, রুইমাছের মাথা দিয়ে মুড়িঘণ্ট,চিংড়ি মাছের মালাইকারি,রুইয়ের দই মাছ,কাতলা মাছের মাখোমাখো ভুনা এবং সর্ষে ইলিশ সাথে দুধ পোলাও,দেশি মুরগির রোস্ট, রাজহাঁসের মাংশ ভুনা এবং হাঁসের ডিমের কোরমা।মিষ্টান্নতে রয়েছে পায়েশসহ, গাজরের হালুয়া,এবং দই।সঙ্গে দুই তিন পদের আচার।টেবিলভর্তি টায়টায় খাবার।আর খাবার সুগন্ধে মৌ মৌ করছে চারপাশটা।টেবিল ভর্তি খাবার দেখেই ইভান হায় হায় করে উঠলো।ঝুমুরকে উদ্দেশ্য করে বললো–কি করেছেন কি আন্টি!এতো আপনি পুরো বিয়ে বাড়ির আয়োজন করে ফেলেছেন।

বিনিময়ে ঠোঁটে মাতৃসূলভ স্নেহময় হাসি ফুটিয়ে ঝুমুর বললো –এ-তো বাড়িরই সবকিছু।আলাদা আয়োজনের আর সময় পেলাম কোথায়?তোমার আসবে জানলে আলাদা আয়োজন করা যেতো।

‘যা করেছেন আর আলাদা আয়োজনের দরকার নেই।এই খেয়ে সবাই শেষ করতে পারলে হলো!

সবাই চেয়ার টেনে বসে পড়লো।ঝুমুরকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলে ইভানও চেয়ারে টেনে বসে পড়লো।সঙ্গে সঙ্গে পাশের চেয়ারে বসা নিভান চাপাস্বরে
বললো।–সাবধান খেতে গিয়ে আবার লুঙ্গি না খুলে যায়!এটা কিন্তু সেই ছেলেবেলা নয় সর্বসম্মুখে বেইজ্জতি হলো,কেঁদেকেটে লুঙ্গী বর্জন করে ফেললাম!আর সবাই সেই ইজ্জত হারানোর বিবস্ত্র দৃশ্যটা ভুলে গেলো!সুতারাং খাবার চেয়ে মনোযোগ লুঙ্গিতে!এই বয়সে ইজ্জত হারালে কি হবে নিশ্চয় বুঝতে পারছিস?

সবার পিছু পড়ে থাকা ছেলেটা আতঙ্কগ্রস্থ হলো।গোলগাল নজরে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে থাকা নিভানের দিকে তাকিয়ে রইলো।শেষে কি-না দাদাভাইও!এবার নিজের পরনের লুঙ্গির দিকে একবার অসহায় নজর দিলো।গোসল শেষে যখন আশহার সাহেবের লুঙ্গি পরলো ইভান।তন্ময়ী আর মৌনতাতো খিলখিলয়ে হেসে দিলো।সাথে নাফিম মান্যতাও বাদ যায়নি।নাফিম তো বলেই বসলো–ছোটো দাদাভাই তোমাকে কেমন পাগল পাগল বোকাবোকা লাগছে।

আসলে লুঙ্গি পরায় পাগল পাগল লাগিনি।লুঙ্গি পরার ধরনে অদ্ভুত পাগল পাগল বোকাসোকা দেখাচ্ছিলো।পরে যখন আশহার সাহেব ঠিকঠাক করে পরিয়ে দিলেন,তারপর যা একটু সামলে চলতে পারছে ইভান।নাহলে নিজে যখন পরেছিলো,শুধু পায়ে পেঁচিয়ে জড়িয়ে যাচ্ছিলো।খুলে যাওয়ার সম্ভবনায় কোমরের গিটের ওখানে সর্বক্ষণ চেপে ধরে রাখা লাগছিল।তখন বুঝেছে না বুঝেশুনে পুকুরে গোসল করতে নামার ঠিকঠাক শাস্তি!ততক্ষণে উপায়হীন!আর সেই উপায়হীন অসহায় মানুষটাকে,তার ভালো দাদাভাইটাও সুযোগ নিয়ে খোঁটা দিচ্ছে।

‘ইভান,কি ভাবছো?খাবার শুরু করো।

আশহার সাহেবের কথায় ইভান জোরপূর্বক সৌজন্য হাসি মুখে ফুটিয়ে বললো–এইতো শুরু করছি আঙ্কেল।

অথচ তখনও তার মন আতঙ্কগ্রস্থ।এরকমই খাবার টেবিলে তার বেইজ্জতিটা হয়েছিলো।লুঙ্গি পরে খাবার খেতে বসেছিলো।খাবার খেতে খেতে লুঙ্গির কথা আর মনে ছিলোনা।খাবার শেষে চেয়ার ছেড়ে যখন উঠে দাঁড়ালো। তখন মনেহলো তার পরনের লুঙ্গি গায়েব।নিচে পড়ে গেছে।সবাই তখন তারদিকে চেয়ে!ছিঃ ছিঃ সেকি বেইজ্জতি!এখনো মনে উঠলে ইভানের কান-মাথা গরম হয়ে যায়।সেই কান্ড যদি আজও ঘটে!ওরে আল্লাহ, ইজ্জত হারানোর লজ্জায় তার বুড়িগঙ্গার ওই পচা বর্জ্য নোংরা পানিতে ডুবে মরা ছাড়া আর উপায় থাকবেনা।ইভান অসহায় মুখ করে নিভানের দিকে তাকালো।দাদাভাই সেই বিদঘুটে পুরানো স্মৃতিটা ঠিক খাবার সময় মনে করিয়ে দিয়ে,তার খাওয়া আঁটকে রেখে নিজে কি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে খেয়ে চলেছে।খাবারের গন্ধে চারপাশটা ম-ম করছে,সবাই খাচ্ছে অথচ সে খেতে পারছেনা।নিজের পরিস্থিতি বিবেচনা করে ইভান কন্ঠ নিচু করে নিভানকে বললো–দাদাভাই এখন আমি কি করবো?

‘এত খাবার সামনে রেখে জিজ্ঞেস করছিস, কি করবো!

‘দাদাভাই প্লিজ। হেল্প মি।আমার চেঞ্জ করা দরকার। নাহলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে আমাকে দেশান্তরি হতে হবে।এটা নিশ্চয় তুমি চাওনা?

‘সেটা আমি চাইনা।তবে এখানে আমি কি হেল্প করতে পারি!না আছে এখানে আমার কোনো পোশাক-আশাক, আর না আছে তোর আমার সমবয়সী কেউ।তবে?দ্বিতীয়ত অর্ডায় দিয়েছি তো, আসতে সময় লাগবে।সেটুকু সময় তো ধৈর্য্য ধরতেই হবে।

নিচুগলায় নিভানের নির্লিপ্ত উত্তর ইভানকে আরও অসহায় করে তুললো। সে আবারও রিকুয়েষ্ট করলো — দাদাভাই প্লিজ।আমি বেইজ্জতি হলে তুমিও তো লজ্জা পাবে তাই-না?

‘আমি কেনো লজ্জা পাবো?

‘পাবেনা বলছো?

নিভানের হাসি পেলো।তবে ভুলেও সে হাসলো না।বরং নির্লিপ্ত গলায় বললো–‘উল্টোপাল্টা না ভেবে খেয়ে নে।কাননকে দেখ,ও লুঙ্গির গিটে হাত চেপে কি সুন্দর খেয়ে চলেছে।বুদ্ধি খাটা আর ওকে অনুসরণ কর।আর এতো দুশ্চিন্তা করারও বা কি আছে,খাবার শেষে চেয়ার ছেড়ে উঠার আগে লুঙ্গি ঠিকঠাক আছে কি-না দেখেশুনে উঠলেই তো হলো।

শেষের বাক্যদ্বয় বলতেই হেসে ফেললো নিভান।পুরনো স্মৃতি মনে পড়েছে কিনা!মূহুর্তেই হাসিটা আবার মিলিয়ে নিলো ঠোঁটের ভাঁজে।ইভান কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো সেই চাপাহাসি ছড়ানো মুখটার দিকে।দাদাভাই নিশ্চয় পুরানো সেই বিদঘুটে স্মৃতি মনে করে হাসছে?ইভানের চোখের সামনেও যেনো মূহুর্তেই সচল হলো সেই স্মৃতি।কান-মাথা যেনো হঠাৎ গরম হয়ে এলো।তবে দাদাভাইয়ের পরামর্শ একেবারে মন্দ নয়।যাই হয়ে যাক, খাবার শেষে উঠার আগে লুঙ্গি ঠিকঠাক আছে কি-না চেক করে নিলেই তো হলো।

‘ইভান,এখনো প্লেট ফাঁকা তোমার। কি ব্যাপার?খাবার পছন্দ হচ্ছে না?

‘না না।খাবার কেনো অপছন্দ হবে।এইতো খাচ্ছি।

তাড়াহুড়ো করে নিজের প্লেটে খাবার তুলে নিয়ে খাওয়া শুরু করলো ইভান।তবে বারবার লুঙ্গি রিচেক দিতে দিতে খাবারটা ঠিকঠাকমতো স্বাদ তৃপ্তি নিয়ে খেতে পারলোনা সে।কোনোমতে খাবার শেষে অবশ্যই লুঙ্গি ঠিকঠাক আছে কি-না দেখেই তারপর উঠলো।বেসিনে হাত ধুতে গিয়ে পড়লো আরেক মুশকিলে।একহাতে লুঙ্গির গিট ধরা অন্যহাতে এঁটো। এখন গিট ছাড়লে যদি খুলে যায়?এমনিতেই আশহার সাহেব যেভাবে শক্তকরে বেঁধে দিয়েছিলেন লুঙ্গিটা সেই শক্তপোক্ত অবস্থানে নেই।কেমন যেনো নড়বড়ে মনে হচ্ছে। এখন যদি খুলে যায়?ওরে আল্লাহ সব শেষ।তন্ময়ীকে বেসিনের পাশে এসে দাঁড়াতে দেখেই বললো–আমার লুঙ্গির গিটটা একটু ধরে রাখোনা,আমি একটু হাতটা ধুয়ে নেই।

‘সব জায়গায় তোমার ফাজলানো।এখানে কতো মানুষ, আমি তোমার লুঙ্গির গিট ধরে দাঁড়াবো!আশ্চর্য!

ইভানের অবস্থা হয়েছে রাখালের গল্পের বালকের মতো,সে মিথ্যা বলে মজা পেত।আর ইভান ফাজলামো করে।বালকের যখন মহাবিপদ এলো তখন আর তার কথা বিশ্বাস করে কেউ তাকে সাহায্য করতে গেলোনা।এখন ইভানের হয়েছে তাই।সবসময় ফাজলামোর ফল,
,এখন ইভানের বিষয়টাকেও ফাজলামো মনে করে তন্ময়ীও আর তাকে সাহায্য করতে চাইছেনা।এজন্য বলে,সব কাজে মাত্রাধিক বাড়াবাড়ি করতে নেই।মনেমনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো ইভান।ফের নরম স্বরে অনুনয় করে বললো–সিরিয়াসলি তন্ময়ী,আমার হেল্প প্রয়োজন।হয় হাত ধুইয়ে দাও নয়তো লুঙ্গীর গিট ধরো।প্লিজ তনু।সোনা বউ আমার, লক্ষী বউ আমার।বিশ্বাস করো,আমি তোমার সাথে ফাজলামো করছিনা।

ইভানের মুখের অসহায় নাজেহাল অবস্থা দেখে তন্ময়ীর পেট ফেটে হাসি পেলো।তবে আশেপাশে তাকিয়ে নিজেকে সামলে নিলো।ইভানের লুঙ্গির গিট ধরা নয়, ইভানের হাত ধুইয়ে দিলো সে।ইভান যেনো হাফ ছেড়ে বাচলো।হাত ধুয়ে তড়িৎ গিয়ে সোফায় জড়োসড়ো হয়ে বসলো সে।

‘কি ভাই চাপে আছেন মনে হচ্ছে!

কাননের কথায় ইভান বললো–
‘তুমি বিশ্বাস করো আমি আর আমার সজ্ঞানে জীবনেও লুঙ্গি পরবোনা।এটা যেমন সহজ সরল দেখতে এ সামলে চলা ততোটা কঠিন।একদম ভােলোভালা সহজ সরল নয়।দারূন চাপের জিনিস।এই চাপ আর কখনো ভুলেও নিচ্ছি না আমি।যদিও লুঙ্গি জিনিসটা বেশ আরামদায়ক।তবুও না।

কানন হেসে ফেললো। বললো — আমি গ্রামের ছেলে।তবে লুঙ্গিতে অভ্যস্ত নই।লুঙ্গিটা ঠিকঠাক পরতে পারিনা।আপনার মতো আমারও একই অবস্থা হয়।

দু’জনে গল্পে মেতে উঠলো।একেএকে ড্রয়িংরুমে হাজির হলো নিভান, আশহার সাহেব,নাফিম।ছেলেদের খাওয়া হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে মেয়েদের ডেকে খেতে বসালেন ঝুমুর।আবিদা জাহানও তাদের সাথে বসলেন।সবাই চুপচাপ খেলেও,তন্ময়ী খেতে পারলোনা।হুটকরে কাল পেটব্যথা শুরু হলো,তারপর বমি।সেই রেশ এখনো কাটিনি।সেখান থেকেই কিচ্ছুটি খেতে ভালো লাগছে না সাথে কিছুর গন্ধ নিতেও যেনো ভালো লাগছে না তার।খাবার সামনে দেখলেই যেনো পেটের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠছে। অসহ্য অসহ্য লাগছে।তবুও মানুষের বাড়িতে এসে তো আর বাহানা দেওয়া যায়না।তাই নীরবে প্লেটে সাদা ভাত তুলে নিয়ে মোচা চিংড়ির ঘন্টটা একটু নিলো।দুগাল খেতেই বেশ ভালো লাগলো।একটু একটু করে কয়েকটা পদ খেয়ে যেই মাছের পদ ধরলো, ওমনি গা গুলিয়ে উঠলো তার।কোনো মতে দাঁতে দাঁত চেপে তা আটকালো।পাশে বসা বিথী তা লক্ষ্য করে কন্ঠ নিচু রেখে বললো—আপু,ঠিক আছেন আপনি?

তন্ময়ী মাথা নাড়িয়ে সায় জানিয়েও কেমন করে বিথীর দিকে তাকালো। ফের বললো—মাছ খেতে পারছিনা বিথী।এতোবড় মাছের পিছটা নিয়েই ঝুটা প্লেটে ফেলে দেওয়া কেমন দেখা যায়?এখন কি করবো?

বিথী মাছ খেতে তেমন পছন্দ করে-না।বিশেষ করে এই রুই কাতলা জাতীয় কাটামাছ।তবে তন্ময়ীর সিচুয়েশন বুঝে সে বললো–সমস্যা নেই,আমাকে দিন।

‘এটা এঁটো হয়ে গেছে বিথী।কিভাবে তোমাকে দেই?

‘কালও তো আপনার প্লেট থেকে মৌনতা আর আমাকে খাইয়ে দিলেন।তখন ঝুটা খেতে পারলে এখন কেনো খেতে পারবোনা।দ্বিতীয়ত আমি তো দেখলাম আপনি সেভাবে হাতই লাগাননি।

তন্ময়ী কৃতজ্ঞতাপূর্ন চোখে বিথীর দিকে তাকলো।ফের মাছের পিছটা তার প্লেটে চুপিসারে উঠিয়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো।–থ্যাঙ্কিউ বিথী।

বিনিময়ে মিষ্টি হাসলো বিথী।তবে মাছ উঠিয়ে দিয়েও রক্ষা হলোনা তন্ময়ীর।তার প্লেট খালি দেখে ঝুমুর একপিচ ইলিশ মাছ তুলে দিলেন।না চাইতেও বাধ্য হয়ে যেই মুখে তুললো,ওমনি পেটের ভিতর নাড়িভুড়ি সব উল্টে আসার জোগাড় হলো।আর বসে থাকতে পারলোনা তন্ময়ী।ড্রয়িংরুমে নিভানরা বসে আছে দেখে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে শিংয়ে চলে গেলো সে।ফের হড়হড় করে বমি করে দিলো।সঙ্গে সঙ্গে ঝুমুর দৌড় দিলেন।কৌড়িও চলে গেলো।চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সবাই।আবিদা জাহান বললেন–তোমরা বসো। খেয়ে নাও।বউমা গেছে,নাতবৌমা গেছে সামলে নেবে।

আবিদা জাহান আগেও খেয়াল করেছেন,সবাইকে কিছু খেতে দিলেই মেয়েটা খাচ্ছেনা।কেমন খাবার থেকে দুরে দুরে থাকছে।মাছমাংসের গন্ধ যেনো সইতে পারছে-না। তখন বিশেষ গুরুত্ব দেননি,মনে করেছিলেন মেয়েটা হয়তো কাঁচা মাছ-মাংসের গন্ধ সহ্য করতে পারে-না।কাটাপোছাটা হয়তো অভ্যাস নেই।কিন্তু এখনতো মনে হচ্ছে,ব্যাপারটা আলাদা।উনার অভিজ্ঞ নজর বলছে ভিন্ন কথা।তবে সেরকম কোনো আভাসও তো শুনলেন না।এসব বিষয় তো চেপে থাকেনা।থাকার কথা নয়ও।

‘এখন ঠিক লাগছে?

মেয়েটার চোখমুখে মাথায় ঘনোঘনো পানি ঝাপটা দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ঝুমুর।তন্ময়ী মাথা নাড়িয়ে সম্মতি সূচক উত্তর দিলো। -হ্যা ঠিক লাগছে।

যা খেয়েছিলো মোটামুটি সব বের হয়ে গেছে,স্বস্তি তো লাগারই কথা।ঝুমুর ফের জিজ্ঞেস করলেন—খাবার অসুবিধা লেগেছে তোমার কাছে?

‘কি বলেন আন্টি।খাবার খুবই সুস্বাদু এবং ভালো হয়েছে।অসুবিধাটা আমার বাড়ি থেকেই লাগছিল।যার জন্য খেতে ভালো লাগছিলো না।মাছমাংস দেখলে অসহ্য অসহ্য লাগ…

কথাটা শেষ করতে গিয়েই নিজের মনেও কেমন একটা দ্বিধা তৈরী হলো।হঠাৎ করে বিগত দুদিন থেকে কেমন কেমন যেনো লাগছে তার।অস্থির অস্থির অনুভব হচ্ছে ।উফফ!কিযে হচ্ছে, কে জানে! নিজের ভিতরটা অস্থির অস্থির লাগছে তাতে অন্যকেও অস্থির করে তুলছে।এই অনুশোচনায় চুপ হয়ে গেলো। কথা শেষ না করে দমে গেলো সে।বলতেও কেমন সংকোচ হলো।

‘সেটা তুমি আমাকে বলবেনা,তবে আমি তোমার জন্য মাছমাংস বাদে আলাদা কিছুর ব্যবস্থা করতাম।

‘আলাদা আর কি ব্যবস্থা করবেন।আমারতো এমনিতেই কিচ্ছু খেতে ইচ্ছে করছেনা।

তন্ময়ীর এবারের কন্ঠ মিনমিনে।ঝুমুর কিছু একটা আন্দাজ করলেন।তবে খোলাখুলি বিষয়টা জিজ্ঞেস করতে পারলেননা।সদ্য মেয়েটার সাথে পরিচয়।সে নিজ থেকে না বললে তার ব্যাক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে আগ বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেস করা একদম উচিত নয়।কৌড়ি এতোসময় চুপচাপ দাড়িয়ে দুজনের কথপোকথন শুনছিলো।তন্ময়ীর দূর্বল মুখটার দিকে তাকিয়ে কেমন মায়া হলো তার।এমনিতেই মায়াবী একটা সুন্দর মুখ।একটু ক্লান্ত,দূর্বলতার ছাপ পড়লেই মুখটা যেনো আরও মায়ময় হয়ে উঠে।তন্ময়ীর হাতটা চেপে ধরে বললো–আপনি গিয়ে রুমে রেস্ট নিন আপু।এরকম শরীর খারাপ নিয়ে আপনার আসা উচিত হয়নি। চলুন।

তন্ময়ী কথা বাড়ালোনা।বাড়ি থেকে শরীর খারাপ লাগলেও এতোটা খারাপ অনুভব হয়নি।যতো সময় যাচ্ছে ততো যেনো শরীর খারাপটা ভিতর থেকে জেঁকে বসছে।তন্ময়ীর আর খাওয়া হলোনা।নিচের একটা রুমে তাকে রেস্ট নিতে রেখে আসলো ঝুমুর।ড্রয়িংরুমে বসে থাকায় ইভান সেটা লক্ষ্য করলো।

রুমটা পরিপাটি গুছানো।এসি নেই তবুও বেশ ঠান্ডা। তারমধ্যে বিরতিহীন মৃদু খটখট শব্দে বৈদ্যুতিক পাখাটা চলছে।চোখের উপর হাত রেখে তন্ময়ী চুপচাপ শুয়ে আছে।নিয়মিত ব্যবহারের চশমাটা পড়ে আছে,তার শয়নরত বালিশের পাশে।ইভান নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে বসলো তার পাশে।হঠাৎ মেয়েটা শরীর খারাপ হওয়ার কারণ কি?কালও বমি করেছে। তবে ফুডপয়েজেনিং বলে এড়িয়ে গিয়েছিলো।ইভানও তাই ভেবে আর কথা বাড়াইনি।তবে পেটে সমস্যা কি এখনো যায়নি?নাহলে হঠাৎ আবার বমি!

‘তনু।

কপাল থেকে হাত সরালো তন্ময়ী।সবসময় ইভানের চোখমুখে যে চঞ্চলতা আর দুষ্টিমীরা ঘুরেফিরে বেড়ায় তা এখন নেই,সেখানে চিন্তারা রেখাবেষ্টিত।

‘শরীর বেশি খারাপ?ডাক্তারের কাছ যাবে?শরীর বেশি খারাপ লাগলেতো ডাক্তারের কাছে যেতেই হবে,আমিও না।এখনই যাবে?

চঞ্চলতা, ভারী দুষ্টমী একপাশে ফেলে দায়িত্ববান হাসবেন্ডের মতো চিন্তা ভাবনা, কথা।অদ্ভুত এক চরিত্র ছেলেটার।ছেলেটার বাহিরের অতিরিক্ত চঞ্চলতা আর অহেতুক দুষ্টমী কেউ পছন্দ না করলেও,তার ভিতরটা কেউ একবার বুঝতে পারলে অবশ্যই ইভানের প্রতি যেকেউ আকার্ষিত হবে।তাকে স্নেহ করবে ভালোবাসবে, তারপ্রতি টান তৈরী হবে।তন্ময়ী হাসলো।ইভানের এসব আচারণের কারণেই হয়তো খুব তাড়াতাড়ি পিছে ফেলে আসা খারাপ সময়টা ভুলতে পেরেছে তন্ময়ী।ভুলতে পেরেছে ছেলেটার করা অন্যায় কর্মকান্ডটাও।ছেলেটা এই চঞ্চল তো, পরিস্থিতি বদলে এই দায়িত্ববান।ভাবনা ছেড়ে কেমন দূর্বল গলায় আবদার জানালো তন্ময়ী।

‘ইভান শোবে আমার পাশে,আমি একটু তোমার কাছে ঘুমাই।

তন্ময়ী জুড়ছে এমন আবদার!ইভান যেনো বিস্মিত হলো।কপালে ভাজ ফেলে স্থির চোখে কিছুসময় তন্ময়ীকে দেখে ধপাৎ করে তার পাশে শুয়ে পড়লো।আজ তন্ময়ীকে কাছে টানা লাগলোনা।নিজেই ইভানের কাছে এসে তাকে জড়িয়ে চোখ বুঁজে নিলো।তার মনেহচ্ছে কোথাও একটা গড়মিল হচ্ছে।আর গড়মিলটা মনেহয় একটু একটু করে পরিস্কার হচ্ছে তারকাছে।তাই যদি সত্যি হয়,তবে তা কিকরে জানাবে সে ইভানকে!বিষয়টাও বা ইভান কিকরে নেবে?

‘মুলত কি কারণে শরীর খারাপ লাগছে তোমার?বলবে আমাকে?সত্যিই কি ফুডপয়েজিনিং হয়েছে নাকি অন্যকিছু?

‘আমার কথা বলতে ভালো লাগছেনা ইভান।গলা ব্যথা করছে প্রচুর।

‘আচ্ছা ঠিক আছে।চুপচাপ থাকো।

তন্ময়ীর চুলের ভাঁজে আঙুল চালিয়ে নড়াচড়া করতে থাকলো ইভান।মেয়েটা যেনো আরাম পেলো।খুব ধীরেধীরে তার দূর্বল নিঃশ্বাস ছাড়া আর কোনো শব্দ পাওয়া গেলোনা।নড়াচড়া তো একদম নয়।

বিকালের দিকে তন্ময়ীর শরীর আবারও চনমনে হয়ে উঠলো।তন্ময়ীকে সুস্থ দেখে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলো নক্ষত্রবাড়ী রিসোর্টে যাবে।মুলত নিতু ইতুই অফরটা করেছে।সঙ্গে সঙ্গেই মেয়েদলেরা ঘুরতে যাওয়ার জন্য লাফিয়ে উঠলো। এবাড়ি থেকে পনেরো বিশ মিনিটের রাস্তা। গাড়িতে গেলে এতোসময়ও লাগবে-না।আবিদা জাহান আর আশহার সাহেব মেয়েদের সিদ্ধান্তে আশকারা দিতেই সবাই তৎপর হলো রেডি হতে।নিজের রুমে রেডি হচ্ছে কৌড়ি।আবারও শাড়ী পরতে হয়েছে তাকে।গরমে একটুও পুনরায় গায়ে শাড়ী জড়াতে ইচ্ছে করছিলোনা তবুও বাধ্য হয়ে জড়াতে হলো।কেননা এবাড়িতে আসার সময় এক্সট্রা পোশাক আনিনি। তাই ঘুরতে যাওয়ার জন্য পুনরায় শাড়ী অঙ্গে জড়াতে হলো তাকে।শাড়ী ছাড়া উপায় নেই।কি সুন্দর নিতুর একটা ড্রেস পরে আরামে ঘুরছিলো সে!আরাম শেষ!

কালকে যে শাড়ীটা পরে এবাড়িতে এসেছিলো,সেটাই পরলো কৌড়ি।চুলটা খোঁপা করে,মুখে হালকা প্রসাধনীর প্রলেপ লাগালো।এর বেশি সাজ সে কখনো সাজেনা,দুই একসময় অতিরিক্ত ঠোঁটে লিপস্টিকটা লাগানো ছাড়া।মেয়েদের না-কি চোখে কাজল পরলে দারুন মায়াবী দেখায়।চোখের সৌন্দর্যতা বৃদ্ধি পায়।চেহারার লাবন্য বাড়ে?অথচ কাজলটাও লাগানো হয়না কখনো কৌড়ির।এসব ভাবতে ভাবতে হিজাবটা গুছিয়ে মাথায় জড়ালো সে।মাথায় পিনআপ করে কাঁধে পিনআপ করতে গিয়ে বাঁধলো বিপত্তি।ভাবনায় বিভোর অন্যমনস্ক কৌড়ির হিজাব শাড়ী ব্লাউজ ভেদ করে সুচালো পিন গিয়ে ফুটলো নরম কাঁধে।মূহুর্তেই মৃদু আওয়াজ তুলে”আহ”শব্দটা মুখ থেকে বেরিয়ে এলো।জ্বালাময় ব্যথা পেলেও পুনরায় ঠোঁট চেপে ব্যথা নিবারণ করে নেওয়ার চেষ্টা করলো।ততক্ষণে রুমের উপস্থিত ব্যক্তিটি চলে এলো তারকাছে।আয়নায় কৌড়ির বন্ধ চোখমুখ দেখেই সহসা শুধালো।

‘কি হয়েছে?

প্রশ্ন শুধালেও নিভান চুপচাপ নেই।এতোসময় তার লক্ষ্য ছিলো কৌড়িকে ঘিরে।বিধায় কি হয়েছে সেটুকুও লক্ষ্য করেছে সে।প্রথমে কৌড়ির হাত থেকে পিনটা নিয়ে কপালে ভাজ ফেলিয়ে লক্ষ্য করে দেখেই তীর্যক বাক্য ছুড়লো।

‘এটার মধ্যে আর সুচের মধ্যে পার্থক্য কোথায়!আর এই তুমি সমস্ত গায়ে মাথায় বিঁধাচ্ছো?

কথা শেষ করার আগেই কৌড়ি মাথায় যে দুটো পিনআপ করেছিল সে দুটোও খুলে নিয়ে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো।কৌড়ি ব্যথা ভুলে তাজ্জব চোখে হা হয়ে তা দেখলো।ড্রেসিং টেবিলের সম্মুখে আলপিনের যে কৌটাটা ছিলো।তড়িৎ সেটা নিয়েও ফেলে দিলো নিভান।কৌড়ি বিস্ময় যেনো বাড়লো।মানুষটা পাগল হলো নাকি?

‘ওসব আলতু ফালতু জিনিস যেনো গায়েমাথায় বিঁধতে না দেখি!

মুখে কথা চললেও হাত চললো তার কৌড়ির হিজাবে।হিজাবটা এমনিতেই মাথা থেকে সরে গলায় ঝুলছিলো। সেটা গলা থেকে সরিয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখলো নিভান।কৌড়ির গায়ের ব্লাউজটার গলা বেশ ছোটো।বললে চলে ব্লাউজটা গলার সাথে মিশে আছে।সামনের গলাটা একটু বড় হলেও পিছনের গলাটা কাঁধের সাথে মিশে আছে।ব্লাউজটা খোলাফেলার হুকগুলোও কোনো কারনে পিছনে।হাঁফ ছাড়লো নিভান।নাহলে এই ভরা বিকালবেলা বিবাহিত বউয়ের সাথে একটা কেলেঙ্কারির হয়ে যেত।কৌড়ির দিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল না দিয়ে টপাটপ ব্লাউজের তিনটি হুক খুলে ফেললো সে।বিস্ময়, ধ্যান কাটলো যেনো কৌড়ির।সাথে খোলা কাঁধের কাছে পুরুষালী হাতের রুক্ষ স্পর্শ পেয়ে সর্বাঙ্গ যেনো খিঁচে এলো তার।রন্ধ্রে রন্ধ্রে চঞ্চল হলো কিছুু এলোমেলো অনুভূতি।সেই অনুভূতির শিহরনে দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো।তবে মানুষটার থেকে সরে আসতে যেনো বিবেকে বাঁধা দিলো।ততক্ষণে কৌড়ির ব্লাউজের কভার সরিয়ে ফর্সা মসৃণ কাঁধটা উম্মুক্ত করে ফেলেছে নিভান।ইনারের ফিতাটায় হাত দিতেই কৌড়ি হাত চেপে ধরলো।শব্দগুলো গলায় জড়িয়ে গেলো।কি বলবে সে?নিষেধও তো করা উচিত নয়।হক আছে মানুষটার!তবে?

কৌড়ির হাতটা সরিয়ে দিয়ে নিজের বুকে রাখলো নিভান।কিছুটা গম্ভীর গলায় আদেশের স্বরে বললো–হাত যেনো এখান থেকে না নড়ে।

আদেশ মোতাবেক কৌড়ি হাত সরালো না। তবে নিভান যখন পুনরায় ইনারের ফিতাটায় হাত দিলো,চোখমুখ খিঁচে বুঁজে নিলো কৌড়ি।নিঃশ্বাস যেনো এবার তার আঁটকেই আসবে!কেনো বুঝছেনা মানুষটা।অস্পষ্টস্বরে নিভানকে সে ডেকেই বসলো।

‘নিভান প্লিজ।

ব্যাস কিছু মূহুর্তের জন্য হাত থমকে গেলো।তবে দূর্বল হলে চলবেনা!ভিতরটা সে পথরকঠিন রাখার চেষ্টা করছে।নাহলে এতোক্ষণে কতো উল্টো পাল্টা কিছু হয়ে যেতো!হাত সচল হলো নিভানের।খুব স্বাভাবিক গলায় বললো—বলো,শুনছি আমি।

মানুষটা কি তার ভিতরের দমবন্ধকর আর্তনাদের ব্যাপারটা তার শব্দচয়ন দ্বারা বুঝলো না?না-কি বুঝে- শুনেই এড়িয়ে গেলো?তা নাহলে এতো স্বাভাবিক উত্তর কিকরে দিতে পারে?নিভান শুনতে চাইলেও কৌড়ি আর বলতে পারলোনা কিছু।চেয়েও শব্দ গুছিয়ে আনতে পারলোনা,কিছু বলার জন্য।কারন ততক্ষণে তার শব্দ প্রয়োগ করা কন্ঠস্বরের দ্বার চাপিয়ে ইনারের ফিতাটা সরিয়ে ফেলেছে নিভান।এবং নিজ কর্মে ব্যস্ত সে।ফিতাটা সরাতেই উন্মুক্ত হলো পিন ফুটে যাওয়া জায়গাটা।মোটা একফোঁটা রক্ত এসে হাজির হলো যেন মূহুর্তেই জায়গাটার মুখে।পিনটা যে ভিতরে অনেকটা বিঁধে গিয়েছিলো,সেটা দুধে ফর্সা কাঁধে কালচে একটা লম্বা দাগের চিহ্নতে বেশ বোঝা যাচ্ছে।নিভান রক্তের ফোঁটাটা আঙুলের মাথায় মুছে নিলো।ফের সেখানে আলতো চাপে আরও একটু রক্ত বের করে দিতেই কৌড়ি যেনো এবার ছটফটিয়ে উঠলো।তবে ব্যথায় নাকি অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে? তা নিভান বুঝেও বুঝলো না।

কৌড়ির আঙুলগুলো আরও শক্ত স্পর্শে খামচে ধরলো নিভানের বুকের কাছের শার্টের অংশ।কৌড়ির স্পষ্ট টের পেলো তার নখের আঁচড়গুলো বসে যাচ্ছে মানুষটার বুকে।তার স্পর্শে হয়তো ব্যথাও পাচ্ছে মানুষটা! তবে সামনের মানুষটা নির্বিকার। যেনো কিছুই হচ্ছেনা।কৌড়ি এবার না পেরে বললো–ওটা সামন্য।ওটুকুতে কিচ্ছু হবেনা।প্লিজ ছেড়ে দিন।

প্লিজ ছেড়ে দিন’ নিজের মুখের বাক্যদ্বয় যেনো নিজেরই কানেই অদ্ভুত শোনালো।কেমন অহেতুক কঠিন,কিছুটা বাজে হয়তো।কৌড়ি যেনো নিজেই অবাক হয়ে গেলো নিজের আচরণে।স্পর্শতো বাজে নয়,তবে কেনো এমন শব্দ প্রয়োগ করলো।স্ত্রী ব্যথা পেলে অবশ্যই স্বামীর খেয়াল রাখার হক আছে।ব্যথাযুক্ত জায়গা দেখার,স্পর্শ করার হকও আছে।সেখানে মানুষটা সম্পর্কে সে জানা সত্ত্বেও এমন কেনো বিহেভ করলো!নিজের বলা বাক্যদ্বয় যদি নিজের কাছে এতো রুষ্ট লাগে তবে মানুষটার কেমন লেগেছে? কি ভাবছে মানুষটা?নিভানের হাত সরে যেতেই মূহুর্তেই চোখ খুলে ফেললো সে।নিভানের মুখোভঙ্গিমা বোঝার আগেই ঘর ছেড়ে বাহিরে চলে গেলো সে।আবার কৌড়িকে কিছু ভাবতে দেওয়ার আগেই তার সম্মুখে এসে হাজির হলো সে।হাতে অ্যান্টিসেপটিক্।খুব স্বাভাবিক তার মুখোভঙ্গিমা।তুলোর সাহায্যে অ্যান্টিসেপটিক লাগিয়ে নিয়ে,পিন বিঁধে যাওয়া জায়গাটায় চেপে চেপে কয়োকবার মুছিয়ে দিলো নিভান।না নড়াচড়া আর না একটা শব্দ ব্যবহার করলো কৌড়ি।কেমন মায়ামায়া চোখে পলকহীন নিভানকে দেখতে থাকলো সে।যে ব্যক্তি স্ত্রীর অসুস্থতার কথা ভেবে নিজের কামনা বাসনা নিয়ন্ত্রণে রাখে।সুযোগ পেয়েও নিজের অনুভূতিতে প্রলুব্ধ হয়না,সেই ব্যক্তির সাথে কি এমন রূঢ় আচারণ মানায়?মন বলছে নিজের অজান্তেই অহেতুক একটা ভুল করে ফেলেছে কৌড়ি।যা তার মোটেও করা উচিত হয়নি।নিভান দায়িত্ব এবং যত্নশীলতার সহিত অ্যান্টিসেপটিক লাগিয়ে দিয়ে পুনরায় সযত্নে কৌড়ির ব্লাউজের হুকগুলো লাগিয়ে দিলো।কৌড়ির মনেহলো দু’হাতে মানুষটাকে আগলে নিতে।জাপ্টে ধরতে।তারপর নিজের অনুসূচনা ব্যাখা করে স্যরি বলতে। তা না হলে,তার কেনো জানি মনে হচ্ছে এই মানুষটা আর নিজ থেকে তাকে কাছে টানবে-না।ভালোবাসবে না।
কিন্তু নিজের ভিতরের চাওয়াটা ভিতরেই রয়ে গেলো।কেনো জানি তা প্রকাশ করতে পারলো না।নিভান সরে দাঁড়ালো। খুব সাবলীল গলায় বললো—তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিচে এসো।আমি নিচে যাচ্ছি।

কৌড়ি পিছু ডাকতে চেয়েও যেনো ডাকতে পারলো-না আর।গলা যেনো নিজের ভুলে রোধ হয়ে এলো।ঈষৎ কাঁপলোও।যারজন্য শব্দ বের হলো-না।শুধু স্থির চোখে নিভানের চলা যাওয়া দেখলো।

চলবে….

ফুলকৌড়ি পর্ব-৫০+৫১

0

#ফুলকৌড়ি
(৫০)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

ওবাড়ি আর ঠিক দাদু-মা বলতে বুঝতে কৌড়ির একটু সময় লাগলো।তবে ততক্ষণাত সে প্রশ্ন করলো-না।নিজে থেকে বুঝতে চেষ্টা করলো,নিভানের কথার অর্থ।আর কাকেই বা দাদু-মা বলছে আর ওবাড়ি বলতে কোথায় যেতে চাইছে মনুষটা!তবে বুঝে উঠার আগেই দরজায় কড়া নাড়লো কেউ।কৌড়িকে ছেড়ে দাঁড়ালো নিভান।ছাড়া পেতেই গায়ে মাথায় ওড়নাটা ঠিকঠাক করে জড়িয়ে নিলো সে।নিভান গিয়ে দরজা খুললো।ওপাশে মা-কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই ভিতরে ভিতরে একটু অপ্রস্তুত হলো।তার রুমের দরজা কখনো আটকানো থাকে-না।দরজায় লাগানো ভারী পর্দাগুলো,দরজা আটকানোর কাজ সেরে দেয়।যদিও নক বিহীন রুমে কেউ ঢোকেনা।যার কারণে রাতে ছাড়া দরজা আটকানোর প্রয়োজনও পড়েনা। অথচ আজ আটকাতেই হলো।আর বিষয়টা তাকে একটু অস্বস্তি দিলো।যাতে ভিতরে ভিতরে একটু অপ্রস্তুতবোধও করলো।তবে নীহারিকা বেগম সেসবে বিশেষ ভ্রুক্ষেপ করলেন না।কেমন চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন–কি সিদ্ধান্ত নিয়েছিস?কৌড়িকে নিয়ে যাবি নাকি ওবাড়িতে?

‘ভিতরে এসো মা।

দরজা ছেড়ে দাঁড়ালো নিভান।নীহারিকা বেগম চিন্তিত মুখেই ঘরে ঢুকলেন।ফের বললেন–বয়স্ক মানুষটা অসুস্থ।ক’দিন বাঁচে কবে মরে তার ঠিক নেই।অসুস্থ মানুষটা যখন একবার আবদার করেছেন।কৌড়িকে নিয়ে তোকে কিন্তু একবার যাওয়া দরকার।বংশের বড় ছেলে তুই।বিয়ে করেছিস। তিনি আসতে পারলেন না।তাই বলে-কি নাতবউ দেখার ইচ্ছাপোষণ করবেন না!যা একবার ঘুরে আয়।তোর ছোটো চাচ্চু কতো করে বলে গেলেন কাল।সকাল হতে না হতেই আবারও ফোনকোলে ব্যস্ত করে তুলেছেন।যাচ্ছিস কি-না তোরা।রিসিপশন যখন হচ্ছে না,তখন আজই একবার যেতে তড়া দিচ্ছেন নাকি তোর দাদুমা।নাতবউকে দেখার জন্য নাকি অস্থির করে তুলছেন।

‘আমাকেও ফোন দিয়েছিলেন।কথা হয়েছে দাদুমার সঙ্গে।।দাদুমা উতলা হয়েছেন,আজ একবার কৌড়িকে ওবাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য।তাকে দেখার জন্য।চাচ্চুও বললেন,তিনি বেশ অসুস্থ।বারবার বলছেন নাকি দেরী হলে তিনি যদি আর কৌড়িকে না দেখতে পান।তাই চাচ্চু-ও বারবার রিকুয়েষ্ট করলেন,একবার যেতে।

‘কি করবি?যাবি?এখন নাকি বিকালে যেতে চাইছিস?কাল বিয়ে হলো, বাড়ি ভর্তি মেহমান।কৌড়ির ছোটোচাচাও তো আছেন। ভদ্রলোক সকাল সকাল চলে যাবার কথা বলছিলেন।বাড়িতে নাকি উনার স্ত্রীও অসুস্থ।বড় ছেলেটা তো কাল রাতেই ফিরে গিয়েছে হোস্টেলে।পরিক্ষা আছে নাকি তার।ছোটো ছেলেটা আর উনি আছেন।আছেন বলতে তোর বাবাই আটকে রেখেছেন।

‘কৌড়িকে তো রেডি হয়ে নিতে বললাম।এখনই যাবো ভাবছি।অফিসেও একটা কাজের ঝালেমা হয়েছে,যদিও না গেলেও চলতো।তবে বের হচ্ছি যখন সেটা মিটিয়ে তারপর ওকে নিয়ে ওখান থেকেই চলে যাবো ভাবছি।

‘আচ্ছা তাই কর।ওকে নিয়ে একেবার বের হ।

কথাটা বলেই তিনি কৌড়ির দিকে এগোলেন।কৌড়ি এতোসময়ে বুঝতে পারলো ওবাড়িতে আর দাদুমার কাছে বলতে কোথায় যেতে চাইছেন মানুষটা।কাল আলাপপরিচিতির সময়ে,ছোটো চাচাশ্বশুর বলে একজনকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন বড়মা।পরিচিত হয়ে কৌড়ি সালাম দিতেই ভদ্রলোক মিষ্টি হেসে সালামের উত্তর দিয়ে মাথায় হাত দিয়ে তো দোয়াও করে দিয়েছিলেন।তারপর একটা নামীদামী গিফ্টবক্সও তার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন।তাতে কি ছিলো তা কৌড়ির এখনো দেখা হয়নি।ওরকম অনেক গিফ্টবক্স উপহারসরূপ পেয়েছে সে।যা এখনো খুলে দেখা হয়নি।বিয়ের এতো তালঝামেলায় ভদ্রলোকের কথাতো কৌড়ির মাথা থেকে বেরই হয়ে গিয়েছে।তবে সেখানেই যাওয়ার কথা বলছে।আপন শ্বশুরালয়!মাথায় হাত পড়তেই ভাবনা কাটলো তার।

‘যা ঘুরে আয়।বৃদ্ধা মানুষটা দেখতে চাইছেন।আর ওটাও তো তোর আরেকটা শ্বশুরবাড়ী,হক আছে তোর যাওয়ার।দেখে আয় আপন শ্বশুরালয়।ঘুরে আয়,ভালো লাগবে।

কৌড়ি মিষ্টি হেসে মাথা নাড়ালো।নীহারিকা বেগম আর কথা না বাড়িয়ে ওদেরকে রেডি হয়ে নিতে বলে চলে গেলেন।মা চলে যেতেই নিভান কৌড়ি দিকে এগোলো।বললো–যাও।রেডি হয়ে নাও

কৌড়ি আশেপাশে একবার তাকালো।এরুমের কোথায় কি, কিচ্ছু তার জানা নেই।তবুও সমস্যা নেই।নিজের বলতে ড্রেস,শাড়ী গহনাপত্র সবকিছু দুটো ট্রলিতে ভর্তি গোছানো আছে তার।ট্রলি দুটো এঘরেই আছে।তবে জিনিসগুলো এখনো গুছিয়ে কবিনেটে তোলা হয়নি। এখন কথা হলো,কোন পোশাকে সে রেডি হবে!নতুন অপরিচিত জায়গায় কোন পোশাকে গেলেই বা তাকে মানাবে?হুট করে বুঝে উঠলো-না।হঠাৎ বোকার মতো প্রশ্ন করে বসলো সে।

‘শ্বশুরবাড়িতে কিভাবে যেতে হয়?

বউয়ের বোকা প্রশ্ন বুঝতে সময় লাগলো নিভানের।কৌড়ির চিন্তিত চোখমুখের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে সে-ও বোকাবোকা উত্তর দিলো— সেজেগুজে যেতে হয়।

তড়িৎ কৌড়ি সংশোধনী গলায় বললো–‘আমি তা বলিনি।মূলত কি পরে রেডি হবো আমি সেটাই বলছি।

হাসলো নিভান।তবে কৌড়ির চিন্তিত মুখ দেখে তাকে আর জটিলতায় ফেলতে চাইলো-না।যদিও মন চাইছিল একটু দুষ্টিমী করতে!তবে করলোনা।শুধু আরও একটু কাছে গিয়ে, কৌড়ির গালে নরম স্পর্শে হাত রেখে বললো –যেটাতে তুমি কমফোর্টেবল ফিল করো,সেটাই পরো।সেটা শাড়ী হোক বা ড্রেস।হুমম?

কৌড়ি মাথা নাড়ালো।নিভান ফের বললো –এরুমের প্রত্যেকটা জিনিসে তোমার হক।ওবাড়ি থেকে এসে যেখানে যে জায়গাটা প্রয়োজন হয়,নিজের মতো করে তোমার সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে নেবে।কোনোকিছু ছুতে বা কোথাও কিছু রাখতে কোনোরূপ দ্বিধা করবে-না।কেমন?

কৌড়ি ফের উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে মুখে মৃদুস্বরে বললো —হুমম।

নিভান ফের নরম স্বরে শুধালো–‘দ্বিতীয়বার আমাকে আর বলতে হবে না-তো?

কৌড়ি এবার মাথা এদিকওদিক নাড়িয়ে না সম্মতি জানিয়ে ফের আগের ন্যায় মৃদুস্বরে বললো–না।

নিভান সহসা কৌড়ির কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো–এই তো লক্ষ্মীসোনা বউ আমার।

আচমকা গালে হাত রাখা,কপালে ঠোঁট ছোঁয়া কৌড়ির ভিতরটায় কেমন ঝড় বয়ে চললো। অথচ বাহিরে সে সাবলীল দাঁড়িয়ে। নিভান সরে দাঁড়ালো। ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বললো।–কেবিনেট খোলো।দেখো, ওখানে তোমার সবকিছু রাখা আছে।তোমার ভালোমন্দ যেটা ইচ্ছে হয় পরো।

নিভান ওয়াশরুমের দরজা লাগিয়ে দিতেই কৌড়ি জোরেশোরে কয়েকবার নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো।সময় নিয়ে কেবিনেটের দিকে এগোলো।বিশাল বড় তিনপাল্লার ওয়াল কেবিনেটায় হাত রাখতেই সমস্ত শরীরটা কেমন শিরশির করে উঠলো।কেমন যেনো নতুন নতুন অজানা অচেনা অনুভূতি।কেবিনেট খুলতেই চোখ বড়বড় হয়ে গেলো কৌড়ির।পুরো শাড়ীর বাজারটা মনেহয় এখানে তুলে এনে রেখেছে।বিভিন্ন ডিজাইনের ভিন্ন ভিন্ন নামকরা শাাড়ী।আশ্চর্য!শাড়িগুলো আবার নিজের মতো করে থরেথরে গুছিয়েও রেখেছে।তবে কৌড়ি ড্রেস খুঁজলো।আজ কয়েকদিন শাড়ী পরে বুঝেছে শাড়ী সামলানোর ঝামেলা আর জ্বালা।তবে ড্রেস কৈ?ড্রেস-তো নেই।কৌড়ি কৌতুহলবশত কেবিনের আরেকটা দ্বার খুলতেই,সেখানে দেখা গেলো ড্রেসের সমাহার।এ-কি অবস্থা!হঠাৎ একটা জিনিস কৌড়ির নজরে পড়লো।কেবিনেটের পাশাপাশি তাঁ’কে একটা পরিচিতি ড্রেস ভাজকরা,তারসাথে ছেলেদের একটা কালো ফর্মাল প্যান্ট আর একটা সাদা শার্ট।একই সাথে রাখা।কৌড়ি ছুলো জিনিসগুলো।ফের পরপর একের পর একটা ভাজ করে রাখা সবগুলো কাপড় একসাথে হাতে নিলো।ভাজকৃত কাপড়ের প্রথমে সাদা শার্টটা রাখা।সেটা সরিয়ে ফেলতেই বিস্ময়ে চোখ বড়বড় হয়ে গেলো কৌড়ির।নেভিব্লুর সাথে সাদা মিশ্রনের ফ্রকজাতীয়
সেই ড্রেসটা।সাথে ওড়না চুড়িদারসহ।যেটা পরা অবস্থায় সেদিন অফিসে বমি করে ভাসিয়ে ফেলেছিলো সে।পরিবর্তন করার পরে ড্রেসটার কথাতো আর মাথাই ছিলো-না কৌড়ির। খেয়ালই হয়নি।সেটা এখানে?কিকরে?হঠাৎ ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ তড়িৎ পিছে মুড়লো সে।গোসল সেরে খালি গায়ে মাথা মুছতে মুছতে নিভান বেরিয়েছে।সেদিকে বিশেষ খেয়ালি হলোনা কৌড়ি।তবে সহসা বিস্ময়কর গলায় প্রশ্ন ছুড়লো।

‘এগুলো এখানে কি করে?

আকস্মিক প্রশ্নে মুখ তুললো নিভান।কৌড়ির হাতের দিকে তাকিয়ে অমায়িক হেসে স্বাভাবিক গলায় বললো–ওগুলো যেখানে পেয়েছো,সেখানেই তো থাকার কথা।নয় কি?আমার বউয়ের জিনিস আমার কাছে গচ্ছিত থাকবে না তো কোথায় থাকবে! কার কাছে থাকবে!

ভিতরে ভিতরে অনুভূতির ভরা জোয়ার বয়ে চলেছে।তবুও সহসা ফের প্রশ্ন কৌড়ির।–‘আপনার কাছে এলো কি করে?

শান্তশিষ্ট মেয়েটার প্রশ্নবানে নিভানের হাসি চওড়া হলো।মাথা মুছতেমুছতে মুখে হাসি রেখেই উত্তর দিলো-
লন্ড্রিতে দেওয়ার পর পার্সেল করে ওগুলো আমার কাছে পাঠানো হয়েছিলো।

‘আপনি পাঠাতে বলেছিলেন?

নিভান এবার মাথা মোছা বাদ দিয়ে কৌড়ির দিকে এগোলো।ততক্ষণাত কৌড়ির খেয়াল হলো,সামনের মানুষটার ট্রাউজার পরা উন্মুক্ত প্রশস্ত পেটানো বুক, পিঠ।বর্ষায় ডোবা কাশফুলের ন্যায় বুকের আস্তরনে নুইয়ে আছে ঘনো লোশমগুলো।যা আগে কখনো দেখা হয়নি কৌড়ির।লজ্জায় ঝিমঝিমেয়ে উঠলো ভিতরটা।উষ্ণ অনুভূতিতে হাসফাস করে উঠলো মন।সেই লজ্জা, হাসফাস দ্বিগুণ করে দিয়ে নিভান এসে দাঁড়ালো তার সন্নিকটে।তার বলিষ্ঠ বুকটা এসে থেমে গেলো কৌড়ির চোখ বরাবর। মূহুর্তেই চোখমুখ শক্ত করে নিয়ে নজর নিম্নমুখী করে ফেললো কৌড়ি।তা দেখে ঠোঁটের দুষ্ট হাসিটা আরও বিস্তৃত হলো। মাথা নিচু করে মৃদুস্বরে কেমন ধীমেধীমে বললো।

‘হুমম।আমি বলেছিলাম ড্রেসটা লন্ড্রি করে আমার কাছে পার্সেল করতে।তোমার প্রতি হয়তো তখনো সেভাবে গাঢ়করে কোনো অনুভূতি জন্মাইনি আমার,তবুও মনমস্তাত্ত্বিকের দোলাচলে কোথাও যেনো তোমাকে আমার আমার অনুভব হতে থাকলো।সেই আমার আমার অনুভব থেকেে তোমার পরিধিয় জিনিসগুলো সেদিন আমি নষ্ট বা ফেলে দিতে বলতে পারিনি।কেনো পারিনি!সেটাতো একটু একটু করে পরে অনুভব করলাম।তবে জানো,একটা সময় এই জিনিসগুলো আমাকে ভরসা দিয়েছে বিশ্বাস জুগিয়েছে।সবচেয়ে কঠিন আশ্বাস জুগিয়েছে যে, এই জিনিসগুলো আমার কাছে মানে ওর মালিকও আমার হয়ে আমার কাছে ঠিকই আসবে একদিন।

কৌড়ি মুখ তুলে চাইলো।ঘনপল্লবি আঁখিদুটো মেলে কেমন অদ্ভুত চোখে দেখতে থাকলো তারদিকে ঝুঁকে থাকা মানুষটাকে।যার গা থেকে ভেসে আসছে সদ্য স্নানকরা বডিওয়াশের তীব্র সুবাস এবং কড়া শ্যাম্পুর সুগন্ধ।মোহিত হলো কৌড়ি।ডগর ডগর হরিনী চোখে কেমন অবাক করা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েই রইলো।পাগল নাকি মানুষটা!ফের মন গেয়ে উঠলো,কারজন্য পাগল?শুধু তোরজন্য!কৌড়ি মোহনীয়তা আরও প্রগাঢ়ত্ব রূপ নিলো।ঘনপল্লব ফেললো-না।ফ্রেশ ভেজা স্নিগ্ধ একটা শ্যামারঙা মোহনীয় মুখাবয়ব।ভেজা চুল।সেই ভেজা চুল থেকে ভেসে আসছে কড়া সুগন্ধ।কেমন শান্তনদীর মতো নিটোল চোখে চেয়ে আছে মানুষটা।সেভাবেই চেয়ে থেকে মিষ্টি হাসলো নিভান।হাতের তোয়ালেটা কৌড়ির কাঁধে ঝুলিয়ে দিয়ে,তার হাত থেকে ভাজকৃত কাপড়গুলো নিতে নিতে বললো।

‘দেরী হয়ে যাচ্ছে।যাও রেডি হয়ে নাও।পারলে গোসল সেরে রেডি হয়ে নিও।ফিরতে দেরী হবে তো,এজন্য বলছি।

কৌড়ির সম্বিৎ ফিরলো।তড়িৎ মুখ নিচু করে নিলো।সহসা সরে দাঁড়ালো সে।তারমধ্য আবারও দরজায় নক পড়তেই,নিভান হাতের কাপড়গুলো কেবিনেটে রাখতে উদ্যোক্ত হলো।তন্মধ্যে ওপাশ থেকে মান্যতা
বললো–কৌড়ির জন্য আম্মু শাড়ী পাঠিয়েছেন।আসব?

‘এসো।

মান্যতা সহসা ভিতরে ঢুকলো।হাতে তার কালো একটা স্লিক বেনারসি শাড়ী।সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ পেটিকোট।
কৌড়ির সামনে সেটা ধরে বললো–ওবাড়িতে যাচ্ছিস বলে আম্মু পাঠালেন।বললেন,নতুন বউ যাচ্ছিস।শাড়ী পরে গেলে ভালো দেখাবে।আর এগুলো আম্মু স্পেশালি তোরজন্য কিনেছিলেন।দেওয়া হয়নি।আম্মু নিচে ব্যস্ত, তাই আমাকে দিয়ে পাঠালেন।

নিভান ননদ ভাবীর কথা ঢুকলো-না।নিজের কাজে মনোযোগী হলো সে।কৌড়ি শাড়ীটা হাতে নিলো।শাড়ী পরার ইচ্ছে ছিলোনা।সেই শাড়ী পড়তেই হবে!তবে শাশুড়ীর মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে মান্যতার হাত থেকে শাড়ীটা নিলো।মান্যতাও আর দেরী করলো না।নিভানের অগোচরে কৌড়ির ডানগালটা আলতো করে টেনে দিয়ে তড়িৎ চলে গেলো সে।

‘শাড়ী পরতে অসুবিধা হলে,ড্রেস নাও।মা’কে বললে মা অবশ্যই বুঝবেন।

আয়নার সামনে দাড়িয়ে শার্টের বাটুন লাগাতে লাগাতে কথাটা বললো নিভান।সেদিকে একপলক তাকাতেই মূহুর্তেই সম্মোহনী হয়ে পড়লো নজর।তবে তড়িৎ নিজেকে সামলে নিয়ে জবাব দিলো সে–সমস্যা নেই।ড্রেসের থেকে শাড়ী পরাটা উচিত হবে।

দাড়ালো না কৌড়ি।ওয়াশরুমে চলে গেলো।রঙে শ্যামবর্ণ হলে কি হবে,উচু লম্বা মানুষটা সবদিক থেকে আকর্ষনীয়।নজর তার দিকে গেলে,কেমন অদৃশ্য ফেভিকলের আঠার মতো আঁটকে থাকতে চায়।যা নির্লজ্জতা।নজরের বেহায়াপনা।আপতত এই বেহায়াপনা করতে গিয়ে লজ্জায় পড়তে চায়না কৌড়ি।
তাই সহসা পা বাড়িয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো সে।
বিশালকার ওয়াশরুমটা পরিচ্ছন্ন পরিপাটি এবং আভিজাত্যের কোনো কমতি সেখানে নেই।কাপড় রাখার স্টিলের হোল্ডিংয়ে হাতের কাপড়গুলো রেখে দিয়ে,নিভানের কথামতো গোসলটা সেরে নিলো।সময় নিয়ে নিজেকে পরিচ্ছন্ন করে,শরীর মোছার জন্য তোয়ালেটা মুখের কাছে নিতেই,আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে এলো।ভিজে শরীরেও কেমন উষ্ণ উষ্ণ অনুভূতি অনুভব হলো।প্রতিটা জিনিসে মানুষটার ছোয়া,তার নির্দিষ্ট সুগন্ধ।উফফ,উথাল-পাতাল করে দিচ্ছে কৌড়িকে!হাসলো কৌড়ি।যে মানুষটা তাকে নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়েছে,তার সুগন্ধে-তো ডুবতেই হবে তাকে।ডুবতে বাধ্য কৌড়ি।বাধ্য নয় কি?অবশ্যই বাধ্য!

শাড়ীটা ভিজে যাওয়ার ভয় থাকলেও ওয়াশেরুমেই শাড়ীটা পরে নিলো কৌড়ি।কেননা রুমে গিয়ে ওই মানুষটার সম্মুখে শাড়ী পরা কখনো হয়ে উঠবে-না।বিষয়টা তার জন্য মোটেই সহজ এবং স্বাভাবিকও নয়।যাই হোক,বেনারসি হলেও শাড়ীটা খুব ভারী নয়।মোটামুটি।সাথে বেনারসি স্লিক হওয়াশ দারুন সফট।সহজেই পরে নিতে পারলো কৌড়ি।তবে গুছিয়ে নয়।তবুও চলার মতো।নিজের জামাকাপড়ের সাথে অন্য আরেকজনেরটাও ধুয়ে নিয়ে বের হলো ওয়াশরুম থেকে।সবকিছুতে কেমন নতুন নতুন অন্যরকম ভালা লাগা আবার কিছুটা নাজুক লজ্জা অনুভূতি।ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখলো নিভান রুমে নেই।স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে,রুমের লাগোয়া বেলকনিতে চলে গেলো সে।সেখানে লম্বা করে স্টিলের স্ট্যান্ড টানানো।জামাকাপড়গুলো সেখানে শুকাতে দিয়ে রুমে এসে তাড়াতাড়ি শাড়ীটা ভালোভাবে পরে নিলো।ভেজাচুলগুলো তোয়ালে দিয়ে মুছতে মুছতে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই,আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের পিছনে নজর থমকে গেলো তার।মানুষটা দরজায় এসে কখন দাড়িয়েছে!হৃদস্পন্দন দ্রুত হলো।সহসা মনে প্রশ্ন জাগলাে, তাকে কি শাড়ী ঠিকঠাক করে দেখে নিয়েছে মানুষটা?প্রশ্ন যেনো সেখানেই থেমে গেলো তার,পিছনের মানুষটাকে তারদিকে এগোতে দেখে।শীতের সকাল সকাল গোসল।সেই ঠান্ডা হাত পায়ে যেনো আরও শীতলতা ছড়িয়ে কম্পন বইলো।দুরুদুরু মনটার উষ্ণ উষ্ণ অনুভূতি যেনো রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।আর সকল অনুভূতির পারদ ছাড়িয়ে পড়লো,যখন পিছনের মানুষটা কেমন অদ্ভুত সম্মোহনী চাহুনী নিয়ে তার পিঠ ঘেঁষে পিছনে এসে দাড়ালো।কিছু সময় অপলক আয়নায় মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থেকে মাথা নিচু করে ঘনো গলায় বললো।

‘লুক অ্যাট দ্যা মিরোর!

গলার ঘনো স্বরটায়, মূহুর্তেই পাথরের মূর্তি বনে যাওয়া মেয়েটা কেমন মোহাবিষ্ট হলো।সত্যি সত্যিই নজর তুলে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকালো।ফর্সা দুধে সাদা শরীরে কালো শাড়ীটা, তপ্ত মধ্যদুপুরের সূর্যের কিরণের ন্যায় দ্যুতি ছড়াচ্ছে।নিজেও কেমন নিজের রূপে ক্ষনিকের জন্য বিমোহিত হয়ে পড়ল কৌড়ি।অথচ শক্ত দুটো হাত সেই কখন তার কোমর পেচিয়ে নিয়ে ওকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে খেয়াল নেই তার।হাতের বাঁধন শক্ত হতেই হুঁশ ফিরলো তার।তড়িৎ নিজেকে ভুলে আয়নায়,নিজের পিছনে দাড়ানো সুদীর্ঘ লম্বা চওড়া মানুষটার দিকে ফিরলো সে।অথচ সেই মানুষটা কি আর কৌড়ির তাকানোর অপেক্ষা আছে?সে তার নিজের কাজে ব্যস্ত।পুরুষালী শক্ত নাকটা,ফর্সা নিটোল গলার বাঁকে বিঁধতেই চোখ মুদে এলো কৌড়ির।সেকেন্ডে চঞ্চল হয়ে উঠলো ভিতরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভূতিগুলো।তা টের পেয়েও নিভান কেমন জড়ানো গলায় বলে গেলো।

‘দেখেছো নিজেকে?কোনো সাধুপুরুষও কি পারবে,এই আকর্ষণীয়তা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে!তাও আবার নিজের একান্ত নারীটা থেকে!উফফ!আমি যতোই নিজেকে ধরেবেধে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছি,তুমিই ততোই চম্বুকের ন্যায় টেনে যাচ্ছো আমাকে।টুটাচ্ছো আমার অহামিকা, আমার নিজস্বতা।এইযে কালো শাড়ীটা পরেছো,নজর কাটার বদলে নজর-তো আরও ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। আকর্ষিত হচ্ছে।আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে দেখে নিয়েছো নিশ্চয়!কিভাবে রাখবো তোমার থেকে নিজেকে দূরে!তোমাকে না ছুঁয়ে!টেল মি কৌড়ি?উফফ,এতো আকর্ষনীয় কেনো তুমি।এতো টানছো কেনো আমাকে?তুমি অসুস্থ!এটা কি করে মাথায় রাখবো…

‘প্লিজ।

কথা থেমে যাওয়ার আকুতি নাকি নিজেকে ছাড়া পাওয়ার আকুলতায় শব্দটা মুখ ফুটে বের করল কৌড়ি, সে নিজেও জানেনা।মেয়েলি মায়বাী শরীরের মিষ্টি সুগন্ধে মাতোয়ারা মানুষটা শুনলো কি শুনলোনা,কৌড়িকে আরও শক্তবাধনে নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো।পুরুষালী হাতের শক্ত বাঁধনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা কৌড়ির মনেহলো,সে লোহার খাঁচায় বন্দিনী।আর সেই লোহার বেড়ি তাঁর নরম শরীটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরে রেখেছে নিজের বাঁধনে।তবে সেই স্পর্শে অস্বস্তি নেই,দ্বিধা নেই,ব্যথা নেই।আছে কিছু দমবন্ধকর অনুভুতি।কৌড়ির শ্বাসটা যেনো সেই দমবন্ধকর অনুভূতিতে মাঝেমধ্যে নিঃসাড় হয়ে আসছে।কথা বলার পরিস্থিতিতে সে নেই,ঘনোঘনো শক্ত নাক আর পুরো ঠোঁটের বিচরণ চলছে তার গলার সর্বত্রজুড়ে।তবুও কোনরকম ছাড়াছাড়া জড়ানো গলায় বললো সে।

‘দেরী হয়ে যাচ্ছে কিন্তু. …

হাতের বাঁধন যেনো আরও ঘনো আরও দৃঢ় হলো।সাথে গলার স্বর—তো?

এই সামন্য তো শব্দে কৌড়ি যেনো মূর্ছা যাওয়ার মতো নুইয়ে পড়লো।শক্ত হাতের বাধনের উপর নিজের কোমল হাতটা রাখলো।মূহুর্তেই শক্তহাতজোড়া আলগা হয়ে কোমল হাতজোড়া নিজের হাতের বাঁধনে নিয়ে,নিজের সাথে চেপে ধরার আগেই সুযোগ নিলো কৌড়ি। উল্টোমুখো হয়ে নিভানকে শক্তকরে জড়িয়ে ধরলো।মুখে তার ঘনো নিঃশ্বাস।বিচক্ষণ সৈনিকের ন্যায়
যুদ্ধে জয়ী হওয়া স্ত্রীর সফলতায় হেসে ফেললো নিভান।
নরম পাতলা শরীরটা নিজের সাথে শক্ত বাঁধনে জড়িয়ে নিয়ে মৃদুস্বরে বললো–দিস ইজ নট ফেয়ার!

কৌড়ি টুঁশব্দও মুখে উচ্চারণ করলো-না।উচ্চারণ করার পরিস্থিতিতে থাকলেই না মুখে কথা বের হবে!এতোসময়ের সুখ সুখ মরমর অনুভূতির রেশ সামলাতেই বিচলিত সে।যে মানুষটা তাকে বিচলিত করে তুললো আবার সেই মানুষটারই বলিষ্ঠ বুকে আশ্রিত হয়ে ঘনোঘনো নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার প্রচেষ্টায় মগ্ন হলো।উফফ,কখনো কি ভেবেছিলো তার ইহকালের চিরন্তন সুখের জায়গা হবে এই মানুষটার বুকে?এটাও কি কখনো ভেবেছিলো,এই মানুষটা কখনো তারই হবে?শুধু তার?আজ হয়েছে!কাল দুপুরের পর থেকে মানুষটা একান্ত তার হয়ে গেছে।আর সেখান থেকে বিগত উনিশটা বছর কাটানো জীবনের পরিবর্তন এসেছে।পরিবর্তিত হয়েছে তার জীবন।এইযে,কাল এই সময়টাও পর্যন্ত মানুষটা তাকে ছুয়ে দেখেনি অথচ তিন কবুলের কি শক্তি,কি মাধুর্যতা।দুটো নরনারীকে কাছে আনে।একটা অজানা অচেনা মানুষকেও আপন করে নিতে বাধ্য করে মন।সেই অচেনা অজানা পুরুষটার নিরবিচ্ছিন্নভাবে ছুয়ে দিলেও তাতে কেনো জানি বিবাহবহির্ভূত পুরুষের ছোঁয়ার মতো ঘেন্না থাকে-না। অস্বস্তি থাকে-না।থাকে একরাশ লজ্জা, আর অসংখ্য অদ্ভুত টুকরো টুকরো ভালো লাগার অনুভূতি।যে অনুভূতিতে এখন ডুবে আছে কৌড়ি।অথচ কালকের এই সময়টাও পর্যন্ত সে নিজেও চায়নি এই মানুষটা তাকে কোনোরূপ ছুঁক।আর সেই মানুষটা তাকে এমন উতালপাতাল ঝড়ো হাওয়ার মতো ছুঁয়ে দিলে,নিজেকে কিকরে ঠিক রাখা যায়!

কৌড়ির ভাবনার মাঝেই নিভানের ডানহাতটা এলোমেলো চললো তার ভেজা চুলে।হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়লো।আগের দিন রাতের পরে মেয়েটার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানা হয়নি।কাল এতশত ব্যবস্থার মধ্যেও খোঁজ রাখা হয়নি।ভেজা চুলের ভাঁজে হাত থামিয়ে শুধালো নিভান।

‘শরীর এখন কেমন তোমার?মেডিসিন নেওয়ার পর ঠিকঠাক লাগছে?

খোলামেলা নয় খুবই সুক্ষভাবে প্রশ্ন! বুঝতেও একটু সময় লাগলো কৌড়ির।তবুও লজ্জাজনক বিষয়।যা এখন মানুষটার কাছে পুরোপুরি খোলামেলা।যারকারনে বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়।তাই মৃদুস্বরে ছোটো করে উত্তর দিলো কৌড়ি।–হুমম।

‘নামাজ পড়েছিলে সকালে মনেহয়?

মনেহয়?হয়তো তাকে নামাজ পড়তে দেখেছে নয়তো নিশ্চয় কোনোকিছু খেয়াল করেছে মানুষটা।নাহলে এমন প্রশ্ন?প্রশ্নটায় কেমন একটু গুটিয়ে গেলো কৌড়ি।হাতের মুঠোয় আঁটোসাটো নিভানের পিঠের কাছের শার্টের অংশটা আরও দৃঢ় মুঠোয় চেপে ধরলো।ছোট্টো মুখটা আরও চেপে নিলো,সেই বলিষ্ঠ বুকটায়।তারপর মৃদুভাবে উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি সরূপ হ্যা জানিয়ে মুখে আওড়ালো।–হুমম।

দু’হাতের বন্ধনীতে কোমল শরীরটার আড়ষ্টতা বুঝে নিভান সে প্রসঙ্গে আর কথা বাড়াতে চাইলো-না।তবে একটা কথা না বললেই নয়,তাই গলার দৃঢ়তা বজায় রেখে বললো–আজকের পর থেকে তোমার যেকোনো অসুস্থতা,প্রয়োজন অপ্রয়োজনীয়তা,ভালোমন্দ তুমি আমার কাছে বলবে।নির্দ্বিধায় নিজ থেকে সবকিছু জানাবে আমাকে।আমি চাইনা তোমার সামান্য কোনোকিছুও দ্বিধাজাল হয়ে গোপনীয় থাক আমার কাছে।জানাবে তো?

কৌড়ির আড়ষ্টতা যেনো বাড়লো বৈ কমলো না।কি উত্তর দেবে সে?কোনোমতে মাথা নাড়িয়ে কি সম্মতি জানিয়ে দেবে?

‘কি হলো?

দৃঢ়কণ্ঠটা কর্ণপাত হতেই কৌড়ি কথা না বলে মাথা মৃদু উপর নিচ নাড়িয়ে সম্মতি দিলো।তবে স্বামী নামক মানুষটা তাতে মনেহয় মোটেই সন্তুষ্ট হলোনা।বললো–

‘কথা বলো।মুখে বলো।

পেলব শরীরটা যেনো নির্দেশ পেতেই পুরুষালী শরীরে আরও মিশে গেলো।তবে অপর মানুষটা উত্তর না পাওয়া অব্দি তাকে ছাড়বে-না,অনঢ় থাকবে বুঝতে পেরে মৃদুশব্দে বললো।

‘জানানোর কি দরকার। আপনি তো এমনিতেই জেনে যান।

সহসা মুখে হাসি ফুটলো নিভানের।স্ত্রীর জবাবে সন্তুষ্ট নাহলে-ও,খুনসুটি করার একটা প্রত্যয় তৈরি করে দিয়েছে।তাই জবাব পেতেই বললো সে।

‘তারমানে তুমি,আমকেই তোমার সবকিছু জেনে নিতে বলছো?আমার স্ত্রীর অসুবিধা তবে আমাকেই জেনে নিতে হবে!ওকেহ্!

গলার স্বরে স্পষ্ট দুষ্টমী ভঙ্গিমা,কৌতুক।কৌড়ি যেনো আরও মুর্ছা গেলো।কোনোরকম হাসফাস গলায় বললো— দেরী হয়ে যাচ্ছে না?

মৃদু শব্দ হলো হাসির।স্ত্রীর কথা ঘুরানোর বুদ্ধিমত্তায়, তাকে নিজের সাথে আরও শক্তপোক্ত বাঁধনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়ে,সেই হাসিহাসি গলায় নিভান
বললো–যাচ্ছে তো!

ফের কৌড়ি ভেজা চুলে সুদীর্ঘ একটা চুম্বন একে বললো–আচ্ছা রেডি হয়ে নাও।আর ডিস্টার্ব করবোনা।

সময় পার হলো অথচ কৌড়িকে ছাড়লোনা নিভান।এই মেয়েটাকে একটু এরকম বুকে জড়িয়ে কাছে পাওয়ার কতো তৃষ্ণা ছিলো তার।কালকের দুপুরের পর পবিত্রতা পেয়েছে সেই তৃষ্ণার।অথচ তাকে কাছে পেতেই তৃষ্ণা কমার বলদে আরও বেড়ে গিয়েছে বহুগুণ।কালরাতে মেয়েটাকে কাছে নিয়ে ঘুমানোর পর সেই তৃষ্ণার মাত্রাটা আরও প্রগাঢ় রূপ নিয়েছে। সর্বক্ষণ যেনো তার সঙ্গ পেতে চাইছে।তার পেলব শরীরটাকে এভাবে বুকে জড়িয়ে সারাক্ষণ তাকে কাছে রাখতে চাইছে শরীর, মন।

কাল বিয়ে হতে না হতেই আজ স্যার অফিসে আসবেন?বিষয়টা বস নামখ্যাত নিভান আওসাফ আহমেদ নামক মানবের জন্য আশ্চর্যের বিষয় নাহলে-ও,নতুন দম্পত্য জীবন শুরু হওয়া মানবের বিষয়ে খুবই আশ্চর্যজনক।অফিসের পিয়নের কাছে বসের আগমনী বার্তা শুনেই,সেই আশ্চর্যতা থেকে অফিসের সমস্ত স্টাফগন কৌতুহলী নজর নিয়ে ক্ষনে ক্ষনে চোখ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসছে অফিস রুমের মেইন ঘোলাটে কাচের দরজা থেকে।অথচ অপেক্ষার অবসান হচ্ছেই-না।সেখান থেকে প্রায় মিনিট দশেক যেতেই সবার কৌতূহলী নজরের অপেক্ষার অবসান ঘটলো।আর সবার কৌতুহলী নজর উবে গিয়ে মুগ্ধ স্থবির নজর সেদিকে আটকে রইলো।

চারমাস কি সাড়ে চারমাস আগে এরকম একটা দৃশ্যে অফিসের সবাইকে খনিকের জন্য আশ্চর্য হতে বাধ্য করেছিলো।অফিসের বসকে একটা বাচ্চা মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে পায়ে পা মিলিয়ে হেটে আসতে দেখে,তারপ্রতি কোমল আচারন দেখে মনে আচমকা কৌতুলহ হয়েছিলো।আজ আবারও সেইম দৃশ্য।তবে আজ যেনো সবার নজরে কৌতুহল নয় কেমন মুগ্ধতা বিরাজ করছে।নিত্যদিনের সাজ।ফর্মাল ড্রেসআপ। তবে আজ কালো শার্টের উপরে কালো স্যুট।উচুলম্বা শ্যামবর্ণ পেটানো শরীরে বেশ অন্যরকম লাগছে।লোকে বলে, বিয়ে হলে নাকি মেয়েদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়।অন্যরকম মুগ্ধতা ছড়িয়ে বেড়ায় সেই নারীঅঙ্গে।আচ্ছা ছেলেদের-ও কি সেরকম কোনো সৌন্দর্যের উপমা ছড়ায় বিয়ের পর?তা নাহলে বিভিন্ন ফর্মাল ড্রেসআপে রোজকার দেখা একই বেশের মানুষটাকে আজ কেনো অন্যরকম লাগছে?একটু মাত্রারিক্ত বেশিই হ্যান্ডসাম।গম্ভীর্যবান পুরুষটা বরাবরই যেমন একটা আত্মপ্রত্যয়ী মুভমেন্ট নিয়ে অফিসে প্রবেশ করে,আজও তেমনটা।তার সেই আত্মপ্রত্যয়ী দৃঢ় চোয়ালে আজও সবাই ফিদা।তবে অন্যদিনের গম্ভীর্য চেহারায় এতোটা জৌলুশতা মুগ্ধতা অনুভব করিনি কেউ।শ্যামবর্ণ গম্ভীর্য মুখের অবয়বে সবসময় একটা কাঠিন্যভাব লেগে থাকতো।কোথাও যেনো মনেহচ্ছে সেই কাঠিন্য ভাবটা আজ কোমল,নরমতায় রূপায়িত হয়েছে।ঠোঁটে হাসি না থাকা সত্ত্বেও শ্যামবর্ণ মুখটা কেমন স্বতঃস্ফূর্ত।নাকি নজর ভঙ্গি আজ অন্যরকম দেখতে চাইছে,তাই!হয়তো বা আবার হয়তো বা না।তবে সেই হান্ডস্যাম চৌকস পুরুষটার পাশাপাশি হেঁটে আসা ম্যাচিং ড্রেসআপে অনন্যময়ী সেই নারীটা যেনো,মেড ফর ইচ আদার।বাচ্চা পুতুল একটা মেয়ে!

সেদিন যখন সম্পূর্ণ একটা অচেনা অজানা মেয়ের প্রতি স্যারের দৃঢ় চিন্তিত মুখ, কুঞ্চিত কপালে রেখা দেখেছিলো রাইসা,সঙ্গে ওভার পজেসিভ কিছু কান্ড।
সেদিন কেনো জানি মনে হয়েছিলো কিছু একটা কানেকশন তো দুজনের মধ্যে আছেই।আজ সেই কানেকশন,ওই গম্ভীর্য আত্মপ্রত্যয়ী মানুষটার পরিপূর্না রূপ নিয়েছে ।অফিস মেইন ডোর পেরিয়ে স্টাফরুমের মধ্যে ঢুকতেই নিজের নজর সংযাত করে নিয়ে নিজের অবস্থানে গিয়ে বসে পড়লো রাইসা।মনেমনে যেনো একটা দীর্ঘশ্বাস চাপা পড়লো।

‘উফ,একেই বলে বুঝি ভাগ্য। না না শুধু ভাগ্য নয়, রাজভাগ্য।ওরকম একটা মানুষকে স্বামীরূপে পাওয়ার সৌভাগ্য।

‘আর ইউ ওকে?

হঠাৎ প্রশ্ন করায় মুখ তুলে তাকালো কৌড়ি।পাশে চলতি মানুষটার দৃঢ় মুখাবয়ব সম্মুখে,অফিসের বিভিন্ন কর্মকর্তারা বসকে সালাম বা মর্নিং উইশেস জানিয়ে চলেছে,তাদের প্রেক্ষিতে মৃদুশব্দে হোক বা মাথা নাড়িয়ে প্রতিত্তোর করে চলেছে মানুষটা।তারমধ্যে তারদিকে নজর না ফেলেও ঠিকই তাকে সুক্ষনজরে খেয়াল রেখে চলেছে।এই আত্নবিশ্বাসী, আত্মপ্রত্যয়ী মানুষটার সাথে পায়ে পা মিলিয়ে চলতে গেলেও তাকে কিছুটা তেমন হতে হবে।সেই ভাবনা থেকে নিজের ভিতরের দূর্বলতাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে চলতি পথেও মৃদু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো যে,সে ঠিক আছে।

কিন্তু পাশাপাশি চলতে থাকা মানুষটার যেনো হ্যা সম্মতিসূচক বার্তা ঠিক মনে হলোনা।কেননা,তার নজর যেখানেই থাকুক না কেনো,লক্ষ্য পাশে থাকা অর্ধাঙ্গিনীর গতিবিধির উপর।মেয়েটা গাড়ী থেকে নামার পরই কেমন যেনো মুখের স্বতঃস্ফূর্ত মিষ্টি চেহারার বদল ঘটেছে।হঠাৎ আকস্মিক এমন পরিবর্তনের কারণ?মেয়েটা কি কোনো কারনে ভিতরে ভিতরে অস্বস্তি ফিল করছে না অন্যকিছু?

‘কোনো কারণে তুমি কি আনকমফোর্টেবল ফিল করছো?

কৌড়ি কিছুটা চমকে তাকালো।ফের মুখে জোরপূর্বক মৃদু হাসি টেনে নমনীয় গলায় বললো–আসলে তেমনটা নয়।

অথচ ঠিক তেমনটাই!অফিসে এতো এতো মানুষের উপস্থিতি!তাদের সম্মুখ দিয়ে এই মানুষটার পাশাপাশি হেঁটে চলা,কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতিতে জেঁকে ছিলো মনে!মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো এলেবেলে সব ভাবনা।যার পূর্ব অভিজ্ঞতাও তার রয়েছে।এই অচচ্ছন্দতা সে আগেই অনুভব করেছে।তারউপর আবার অফিসের মেইন দরজা পেরিয়ে সম্মুখে তাকাতেই কতকত কৌতুহলী নজর তাদের দিকে তাক হতেই ভিতর থেকে যেনো আরও অদ্ভুত, দুর্বল এক অনুভূতিতে হানা দিয়ে আঘাত হানলো অদৃশ্য হাতে কোনোরূপ ধরেবেঁধে রাখা মানসিকতায়।যা ভিতরে ভিতরে দাবিয়ে রাখতে চাইছিলো সে।মুখের অবয়বে বহিঃপ্রকাশ করতে চায়নি কোনোক্রমে।অথচ পাশে যে একজন তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন চতুর মানুষ সঙ্গী হয়ে কদমে কদমে পা মিলিয়ে হেঁটে চলেছে তারসাথে,সে খেয়াল যেনো তার ছিলোনা!ছিলো তো।তবে দৃঢ় চোয়াল সম্মুখে রেখেও তাকে এতো পরিচ্ছন্নভাবে খেয়াল করে চলেছে,এই আন্দাজটা ছিলোনা।কৌড়ির পাশে হেঁটে চলা মানুষটা কৌড়ির উত্তরে অমায়িক হেসে দিলো।সচ্চ নরম হাসি।পাশে থাকা স্ত্রীকে স্বস্তি আর প্রশ্রয় দেওয়ার হাসি।যা কৌড়িসহ অফিস কর্মকর্তা, যাদের নজরে পড়লো আশ্চর্য হয়ে দেখলো।সেদিকে আত্মপ্রত্যয়ী মানুষটার বিশেষ বিন্দু খেয়াল নেই।সে আছে নিজ স্ত্রীধ্যানে।পাশে চলা রমনীর দিকে একপলক তাকিয়ে কেমন দৃঢ়কণ্ঠে বললো– তুমি আমার সাথে আছো।তোমার লিগ্যাল হাসবেন্ডের সাথে।তারপরও আনকমফোর্টেবল ফিল করছো?আমি পাশে আছিতো ম্যাডাম।

ভাসাভাসা মায়াময় চোখজোড়া কি সুন্দর পলক ফেলে তাকে আস্বস্ত করলো।কৌড়ি আস্বস্ত হলেও,মনেমনে বললো–আপনার মতো আত্মপ্রত্যয়ী মানুষ পাশে আছে বলেই তো আমি আনকমফোর্টেবল ফিল করছি।নিজেকে কেমন আপনার পাশে মানাচ্ছে-না মানেচ্ছ-না মনেহচ্ছে।

একপর্যায়ে সকালের নজরের আড়াল হয়ে নিজস্ব কেবিনে ঢুকে পড়লো নিভান।কৌড়ি পিঠে আলতো স্পর্শে হাত রেখে নিজের সাথে সাথে তাকেও ঢুকিয়ে নিলো কেবিনে,যা অফিস স্টাফদের অনেকের নজর গোচর হয়েছে।গম্ভীর, দৃঢ়প্রত্যয়ী বস নামধারী মানুষটা আসলেই নিজের একান্ত,নিজস্ব মানুষটার ক্ষেত্রে বিশেষ,একদম আলাদা।বুঝতে অসুবিধা হলোনা কারও।বসধারী গম্ভীর মুখ করে রাখা কাঠিন্য মানুষটা যে নয়।তিনি যেনো নিজের একান্ত নিজস্ব নারীর বিষয়ে ভিষণ কোমল,নরম।একই মানুষের স্থান ভেদে দুরকম ভাবমূর্তি,তা আজ অনেকেরই নজরে পড়েছে, খেয়াল করেছে।অনুভবও করেছে সবাই।যা আগে কখনো অন্যকারও ক্ষেত্রেবিশেষে নজর পড়েনি কারও।সবসময় নিজের কাঠিন্য গম্ভীর্য ব্যক্তিত্ব নিয়ে থাকা মানুষটাকে নিয়ে এবিষয়ে উনার অগোচরে ট্রলও কম হয়নি।সবাই কমবেশি এটা নিয়ে ট্রল করতো,স্যারের সবকিছু পারফেক্টলি থাকলেও এতো জলদগম্ভীর আর সল্পভাষী মানুষটার কখনো বউ টিকবে-না।অথচ তার উপরেই আবার ফিদা ছিলো অফিস ফিমেল স্টাফ-রা।
মুখে ট্রল করলেও মনেমনে স্যারের সেই গম্ভীর্য স্বভাবে, সল্পভাষীতে এবং আত্মপ্রত্যয়ী ব্যক্তিত্বে মোটামুটি সবাই ডুবুডুবু।

কেবিনে ঢুকতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সোফায় বসলো কৌড়ি।বিশাল বড় শীততাপনিয়ন্ত্রক কেবিনটা পরিপাটি টিপটপ সাজানো গোছানো।একজন মানুষের জন্য একটা অফিসকক্ষ কি এতো বড় প্রয়োজন?একপাশে ওয়াল আর তিনপাশে ঘোলাটে কাঁচের বেষ্টনে বেষ্টিত অফিরুমটার মাঝবরাবর অফিসিয়াল বড়সড় কাচের টেবিল,সেখানে অফিস কক্ষের মালিকের বিশেষ নেইম-প্লেটসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি রয়েছে।তবে গুচ্ছ আর্টিফিশিয়াল ফুলের ফুলদানিতটা বেশ নজর কাড়ছে।সবকিছু পারফেক্ট পরিপাটি করে গুছানো।টেবিলের ওপাশে আরামদায়ক বড়সড় কেদারা, অপরপাশেও দুটো রয়েছে।তবে অফিস মালিকের স্পেশাল কেদারার তুলনায় ছোটো।টেবিলের কিছুটা দুরত্ব মেইনটেইন রেখে তিনসিটের একটা বড়সড় সোফা।সেখানেই বসেছে কৌড়ি।আগেও একবার আসা হয়েছিলো, তবে বিশেষ খেয়াল করা হয়নি।নিভান গায়ের ব্লেজারটা খুলে নিজের বসার চেয়রটার উপর রাখতে রাখতে কৌড়িকে বললো–অফিসে ঘন্টাখানেক সময় থাকতে হবে,সমস্যা হবে না-তো?

কৌড়ি মুখ তুলে চাইলো।তবে উত্তর দেওয়ার আগেই নিভান ফের প্রশ্ন করলো—কি,সমস্যা হবে?

কৌড়ি মৃদু হেসে মাথা নাড়ালো।কিন্তু মন বলছে,প্রচুর সমস্যা হবে।কোথাও যেনো মনেমনে একটা অস্বস্তি কাজ করছে।কৌড়িকে খেয়াল করে নিভান তার পাশে এসে বসলো।একটু দুরত্বে,তবে কৌড়ির মুখোমুখি হয়ে আড়াআড়ি বসলো।নির্দ্বিধায় কৌড়ির হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে খুব কোমল গলায় শুধালো–কি কারনে এতো নার্ভাস ফিল করছো,জানতে পারি? কি হয়েছে কৌড়ি?সকালে কিন্তু কথা হয়েছিলো,তোমার ভালোমন্দ সবকিছু জেনে নেওয়ার দায়িত্বটা আমার।
দায়িত্বটা,পরোক্ষভাবে হোক বা প্রত্যক্ষভাবে তুমিই দিয়েছো।এখন বলো এতোটা আনকমফোর্ট ফিল কি কারণে?

কৌড়ি মাথা নিচু করে নিলো।কথা গুছাতে থাকলো কি বলবে।নাকি বলবে, কিছুইনা।তবে এই সামন্য কিছুইনা বলে কি এই চতুর মানুষটার থেকে পার পাওয়া যাবে?কৌড়ির মনেহয়, যাবেনা।তাই বাহানা করার চেষ্টা করলোনা।মাথা উচু করে কেমন অসহায় নজর ফেলে মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে কিছুটা দ্বিধান্বিত গলায় বললো–আমার কেনো জানি মনেহয়, আপনার পাশে আমাকে ঠিকঠাক লাগে-না।সবদিক থেকেই কেমন…

কথা শেষ করতে দিলোনা নিভান।কৌড়ির দিকে সামন্য ঝুঁকে কেমন অদ্ভুত দৃঢ় স্বরে বললো–‘এই পাগল তুমি!তুমি জনাো,তুমি কি বলছো?এই,এই সংশয়টা তুমি রপ্ত করা শুরু করলে কবে থেকে?আমি আমার জীবনের পরিপূর্ণ রূপ দিতে আমার অর্ধাঙ্গিনী হিসাবে শুধু তোমাকেই চেয়েছি।দ্বিতীয় আর কিছু নয়।এমনকি তুমি বাদে আর কাওকেই নয়।সেখানে দ্বিতীয়ত কোনো কারণ,কিন্তু,যোগ্য অযোগ্যতা বিচার বিবেচনা করার সামন্য চিন্তাভাবনা ভুলেও আমার মনমস্তিষ্কের কোথাও সংশয় সৃষ্টি করতে দেইনি।যা আমার তা যেমনই হোক,তাতে সংশয় কিসের!।আর তুমি বলছো কি!তোমার অন্তত আমার যোগ্য অর্ধাঙ্গিনীর উপর এরূপ সংশয়টা রপ্ত করা একদম উচিত হয়নি।একদমই না।

সামনের মানুষটা থেকে এমন জবাবটা জায়েজ জেনেও
আবেগাপ্লুত হলো কৌড়ি।চোখে জ্বলজ্বল করছে মৃদু নোনাস্রোত।সেসব উপেক্ষা করে হেসে ফেললো সে।তখনো নিভান দৃঢ় চোয়ালে তারপানে তাকিয়ে,কৌড়ির হাসিতে সে ভোলেনি।শান্ত চাহুনী তার সামনে বসা মায়াবী রমনীর জ্বলজ্বল করা ডগরডগর চোখে।কৌড়ি সেই চাহুনী লক্ষ্য করে মনেমনে কুন্ঠিত হয়েও নিভানের দিকে একটু এগিয়ে বসলো।শক্তহাতের মুঠোয় তখনো নিজের কোমল হাতটা আবদ্ধ।সেটা ছাড়িয়ে নিয়ে, নিজেই এবার রুক্ষ হাতটা চেপে নিলো নিজের হাতের মুঠোয়।মিষ্টি গলায় নরম সুরে বললো– আপনার কিন্তু একদম রেগে যাওয়া উচিত নয়।আমি শুধু আমার সংশয়টা প্রকাশ করেছি মাত্র ,আপনার অর্ধাঙ্গিনীর উপর সংশয়টা প্রগাঢ় রপ্ত করেনি।তবে সংশয়টা মনে প্রশ্রয় দিয়ে যদি আপনার অর্ধাঙ্গিনীকে ছোটো করা হয়ে থাকি,খুব স্যরি।

স্যরি শব্দটা এতো নম্র আর মিষ্টি শোনালো এবার নিভানের মুখের আদল যেনো বদল হলো।নিজের অবস্থানে অটল বসেই,কৌড়ির হাত ধরে টেনে তাকে আরও একটু কাছে আনলো।শক্ত দু’হাতে তার মুখটা আজলে নিয়ে,নিজের মুখটা কৌড়ির মুখের কাছাকাছি আনলো।তারপর নিজের খাঁড়া নাকটা দিয়ে কৌড়ির কোমল নাকে শক্তকরে একটু ঘষা দিলো।একবার নয় কয়েকবার দিলো।যেনো ভুলকরে বলে ফেলা কথার শাস্তি।কৌড়ি শাস্তি উপভোগ করতেই চোখ বুঁজে নিলো। মনে চললো চঞ্চল অনুভূতিদের দোলাচল।ফের নাকে, পুরো ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়া পেতেই চোখ খুলে ফেললো সে।অনিমেষ চেয়ে রইলো আদর দেওয়া মানুষটার দিকে।নাক থেকে ঠোঁট সরিয়ে, কালো হিজাবে বাঁধা কপালের অল্প ফাঁকা অংশে দীর্ঘ ঠোঁট ছুঁইয়ে নিভান বললো–‘পাগল মেয়ে।আর কখনো এমন সংশয়কে মনে প্রশ্রয় দেবেনা।কেমন?

কৌড়ি ওভাবেই মাথা নাড়ালো।বউয়ের কপালে সুদীর্ঘ আরও একটা চুম্বন শেষে নিভান ফের বললো—হিজাব খুলে ফেলো,ভালো লাগবে।অনেকটা সময় থাকতে হবে-তো,যাবার আগে আবার বেঁধে নিও।

দীঘল চুলগুলো হেয়ারড্রায়ার দিয়ে সম্পূর্ণ শুকাতে পারিনি কৌড়ি,সময়ের অভাবে।আর মাথার চুল ভিজে থাকলে,মাইগ্রেনের ব্যথাটা যত্রতত্র শুরু হতে সময় লাগবেনা।তাই সামনের মানুষটার নির্দেশ যথাযথ মনে করে হিজাবের পিনে হাত দিতেই,হঠাৎই আবার নির্দেশ এলো–ওয়েট,ওয়ান-মিনিট।

কৌড়ি হাত থেমে গেলো।মনে তৈরী হলো প্রশ্ন। তবে কিছু সেকেন্ডের মাথায় সেই প্রশ্ন দূরীভূত হলো কারও দরজার নকে এবং ভারিক্কি গলার স্বরে।

‘স্যার, আসবো।

নিভান উঠে দাঁড়ালো।আজ আর অফিসের পিয়ন অহিদ সাহেবকে ভিতরে আসার অনুমতি দিলোনা।বরং নিজই এগিয়ে গেলো।পিয়ন আসবে,এটা সে জানতো।নিভান অফিসে ঢুকতেই মিনিট পাচেকের মাথায়,কফির মগ নিয়ে অহিদ সাহেবের আগমন রোজকার।আজ মিনিট পাচেকের জায়গায় আরও একটু দেরী হলো।তবে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে দরজার সম্মুখে গিয়ে দাড়াল সে।দরজা নিজ হাতে আগলা করতেই অহিদ সাহেব যেনো একটু অপ্রস্তুত হলেন।সম্মতি নিয়ে উনি যাওয়ার বদৌলে স্বয়ং এমডি স্যার দরজা খুললেন।বিষয়টা উনাকে অপ্রস্তুত করে দিলো।

‘স্যার আপনার কফি।

ট্রেতে দুমগ কফি দেখে কপালে ভাজ পড়লো নিভানের।মূহুর্তেই তা আবার মিলিয়ে গেলো।অহিদ সাহেব সেটা লক্ষ্য করে তড়িঘড়ি করে বললেন—ম্যাডামও তো এসেছেন এজন্য দুটো দিলাম।

‘ইট’স ওকে।থ্যাঙ্কিউ।

হাতে ট্রেটা নিতে নিতে গম্ভীর স্বরেই উত্তর দিলো নিভান।অহিদ সাহেব সবাভজাত উত্তর দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন।কিছু একটা ভেবে উনাকে ডাকলো নিভান।বললো —মিটিং রুমের সবকিছু রেডি হলে,মৃদুলকে দরজায় এসে নক না করে,আমাকে ফোনকল অথবা মেসেজ করতে বলবেন।

‘ওকে স্যার।

সম্মতি জানিয়ে অহিদ সাহেব চলে যেতেই নিভান দরজা ছেড়ে ভিতরের দিকে এগোলো।সোফার দিকে এগোতে এগোতে বললো।—এবার খুলতে পারো।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কৌড়ি হিজাব খুলে ফেললো।কাঁটায় আবদ্ধ চুলের খোপাটা খুলে দিতেই,সাদা ঝকঝকে টাইলসকৃত ফ্লোরটা ছুঁয়ে গেলো।চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে নাড়িয়ে দিতেই কড়া মিষ্টি শ্যাম্পুর সুঘ্রাণটা যেনো মৃদুতরভাবে আশপাশটা ছড়িয়ে পড়লো।যেটা নিভানের নাকে গিয়েও ঠিকলো।তবে সে আপতত অফিস টেবিলটায় পিঠ ঠেকিয়ে বউয়ের সৌন্দর্য অবলোকনে ব্যস্ত, মগ্ন।

কালো স্লিক বেনারসিটা বেশ দক্ষ হাতে পরিপাটি করে পরা।সাথে গায়ের ম্যাচিং কালো ব্লাউজটা যেনো তার নিটোল ফর্সা শরীরে ঝকঝক করছে।বিভিন্ন অঙ্গে গহনায় ছাওয়া।কানে ঝুমকো।গলায় বেশ বড়সড় একটা মালাহার সাথে নানুমার আশীর্বাদসরূপ বিছাচেইনটাসহ কালরাতে তার দেওয়া নীলাপাথের চেইনটা-ও পরা।নানুমার দেওয়া চেইনটা সেই খুলতে নিষেধ করেছিলো,বলেছিলো উনি চলে যাওয়ার পর খুলতে।মুরুব্বি মানুষ ভালোবেসে নিজের গলার হার খুলে দিয়েছেন,তাই হয়তো খুলিনি মেয়েটা।তারউপর মা মনেহয়,ওবাড়িতে যাওয়া উপলক্ষে বিভিন্ন গহনার সাথে আরও একখানা মালাহার চাপিয়ে দিয়েছেন। মেয়েটা এতোটা শান্ত এবং চাপা স্বভাবের কাওকে নিজের অস্বস্তি বা অনিচ্ছার কথা বলতেই পারেনা।এইযে এতো গহনা পরিয়েছে নিশ্চয় ইচ্ছে করেনি পরতে। তবুও বাধ্য হয়ে অপরপক্ষের ইচ্ছের গুরুত্ব দিয়েছে।মনেমনে হাসলো নিভান।প্রচলিত আছে,য্যাসেকি সাথ ত্যাসিই মিলে।

ডানহাত ভর্তি চিকন চিকন একগাছি স্বর্নালি চুড়ি সাথে মধ্যেবর্তি চিকন চুড়িগুলোর এপাশ ওপাশ মোটামোটা দুটো চুড়।বামহাতে একটা মেল ওয়াচ্।মুখে প্রসাধনী বলতে নিত্যদিনের সাধারণ ফেসক্রিম হয়তো-বা।আর ঠোঁটে গাঢ় মেরুন কালেরর লিপস্টিক।এরপর দীঘল কালো চুলগুলো ছেড়ে সোফায় বসে আছে,এক এলোকেশী অপরূপা,অনন্যা।তিনদিন আগের সেই বাচ্চা বাচ্চা চেহারাট যেনো নেই।এ-যেনো স্বয়ং সম্পূর্ণা একজন অনন্যাময়ী নারী।সেই রমনীর মনে নাকি সংশয় রপ্ত হয়েছে,এই শ্যামবর্ণ মানবের পাশে নাকি ওই অনন্যাময়ী নারীকে মানায় না?ঢেড় মানায়।নিভানের মনেহয়, তারপাশে মেয়েটাকে একটু বেশিই যেনো মানায়।অবশ্যই মানাক আর না মানাক,মন যেকোনো রূপেই তাকে চায়।

সোফায় বসা অপরূপা মানবী যেনো চম্বুকের ন্যায় টানলো নিভানকে তবে ভুলেও এই অসময়ে অঘাটন ঘটাতে চাইলো-না সে।তাই নিজের চোখের দ্বারা তৃপ্ত হতে চাইলো।কৌড়ি বুঝতে পারলো।তবে ভুলেও সেই নেশালু দৃষ্টিতে খেয়ালি হতে চাইলো না।তবে বুকের ভিতরে কাঁপন চললো ক্ষয়ে ক্ষয়ে।হঠাৎ তরল পদার্থের ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজে মাথা উঁচু করে সামনে তাকালো সে।দুটো মগ দু’হাতে।একটা মগের ঘনো তরল অন্যমগে ঢেলে নিচ্ছে।কেনো?অহিদ সাহেবের কথা সে শুনেছে।কফি দুজনের জন্য।যদিও কফি খাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার নেই। তুবও কি করতে চাইছে মানুষটা?

‘তোমার ক্যাফেইন জাতীয় খাবার তথা কফি খাওয়া একদম নিষিদ্ধ।তোমার প্রেসক্রিপশনের খাবারের চার্টে সেটা জ্বলজ্বল অক্ষরে লেখা,একদম নিষিদ্ধ।আর সেদিন ডক্টরও আমাকে নিজেই সাজেশন দিয়েছিলেন,ক্যাফেইন জাতীয় খাবার একদম নয়।সুতরাং….

কথা শেষ না করে থামলো নিভান।ঠোঁটের কোণে তার জ্বলজ্বল করছে তার দুষ্টোমাখা হাসি।কৌড়ি সেটা না বুঝে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নিভানের মুখে।এতসব কিছুর মধ্যে এই সামন্য কথাও মনে রেখেছেন মানুষটা!

‘সুতরাং কফি থেকে দূরে।তবে জে এইচ জে গ্রুপ এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের এমডির স্পেশাল গেস্ট তুমি।মিষ্টি মুখ করানোতো প্রযোজ্য।প্রথমবার আপ্যায়ন করার সুযোগ হয়নি,দ্বিতীয়বার আপ্যায়নে ত্রুটি করা ঘোর অন্যায়। এখন তুমি এমন একজন গেস্ট স্বয়ং অফিসের এমডি সাহেব নিজেই তোমাতে আপ্যায়িত।এখন কফি খাওয়াতো নিষেধ,মিষ্টিমুখ করা-ও জরুরি।এবার তুমি আপ্যায়ন কিভাবে পেতে চাইছো মিসেস নিভান?তবে বিষয়টা আমার উপর ছেড়ে দিলে কথা ভিন্ন।তোমার কফিটা যখন আমাকেই পান করতে হবে,সেখানে বিশেষভাবে আপ্যায়নের অতিরিক্ত যত্নটা-ও আমার উপর বর্তায়।

সাবলীল ধীর কন্ঠে একের পর এক বলে যাওয়া বাক্যে
মুগ্ধতা কাটিয়ে দিয়ে মূহুর্তেই ভীড় করলো লজ্জারা।ফর্সা গোলগাল মুখটা আরক্ত হলো মৃদু রক্তিম আভায়।নিভানের কথার প্রতিটি শব্দ উষ্ণ অনুভূতিতে ছেয়ে গেলো নারীসর্বাঙ্গের প্রতিটি রক্তকণিকায়।মাথা নিচু করে হাসফাস করলো কৌড়ি।তবে মুখে তার লাজুক মিষ্টি হাসি।একটা মানুষ এতো অবলীলায় কিকরে এসব নির্লজ্জ কথাবার্তা বলে যেতে পারে!তবুও আবার সেই মানুষটা।অবিশ্বাস্য!

‘নাও।

তড়িৎ মুখ তুলে চাইলো কৌড়ি।কফির মগটা চোখের সামনে দেখতেই নিভানের মুখের দিকে তাকালো।ঠোঁটের কোণে দুষ্ট হাসি নয় এবার মিষ্টি হাসিরা জড়ো হয়েছে।সোফায় ফের আগের অবস্থানে বসতে বসতে নিভান বললো।

‘একটু খেলে কিচ্ছু হবে-না।নাও।তবে তুমি চাইলে কিন্তু কফির বদলে মিষ্টিমুখটা অন্যভাবে ক…

তড়িৎ কফির মগটা নিভানের হাত থেকে নিয়ে ঠোঁটে বসিয়ে নিলো কৌড়ি।সময় নিয়ে ঠোঁট সরালো।যেনো মুখের সমস্ত লজ্জায় আরক্ত হওয়া পেশিগুলো কফির মগের আড়ালে ঢেকে ফেলতে চাইলো।সেটা দেখে নিভানের মুখের হাসি চওড়া হলেও আর লজ্জায় ফেলতে চাইলেনা মেয়েটাকে।অনেক হয়েছে।এবার সাধারণ টুকটাক কথায় ফিরলো দুজন।কথা বেশিদূর এগোলোনা,ফোনের মেসেজ নোটিফিকেশন টোন বেজে উঠলো।সেদিকেও মস্তিষ্ক সজাগ রেখেছিলো নিভান।ফোন চোক করতেই দেখলো মৃদুল মেসেজ করেছে।
মেসেজ পড়ে ফোনটা রেখে দিলো নিভান।কৌড়িকে উদ্দেশ্য বললো—জাস্ট আধাঘন্টা, পারবে-না একাকি কাটাতে? নাহলে ওপাশের রুমে গিয়ে বেডরেস্ট নিতে পারো?

অফিস রুমের সাথে লাগায়ো রুমটার দিকে তাকালো কৌড়ি।এই অফিসরুমটায় স্পেশাল কিছু স্মৃতি রয়েছে তার।ওই রুমটাও তার রোমন্থন।

‘কি হলো,খুব অসুবিধা হবে এই আধাঘন্টা একাকী থাকতে?

‘না।আপনি যান।আমার অসুবিধা হবে-না।

নিভান উঠে দাঁড়ালো।কপি মগের দিকে তাকাতেই দেখলো,কফির কিছু অংশ তরল এখনো মগে আছে।কিছু একটা ভেবে তড়িৎ কৌড়ির কফিমগে নিজের খাওয়া এঁটো তরল পদার্থটা ঢেলে দিলো।কৌড়ি অবাক হয়ে সেটা দেখলো।কফি ঢালা শেষে নিভান চমৎকার হেসে বললো–বরের প্রতি তো তোমার ভালোবাসা কম।যদি এই এঁটো তরল পদার্থের বিনিময়ে তা একটু বৃদ্ধি পায়।তবে খাওয়াটা বাধ্যতামূলক নয়।তোমার ইচ্ছে অনিচ্ছা যথার্থ সেখানে।

কথা শেষ করে কৌড়ির দুপাশের চোয়ালে নরম হাত রাখলো নিভান।মিষ্টি হাসি তখনো ঠোঁটে ঝুলছে তার।কৌড়ির অবাক করা ডগরডগর চোখের দিকে তাকিয়ে চোখের পলক ফেলে ফের আশ্বস্ত করলো সে।মৃদুস্বরে বললো –আমার এঁটো না খাওয়ার অপশন আছে কিন্তু।না খেলে সমস্যা নেই।

ফের কৌড়ির খোলা চুলের সিঁথির মাথায় একটা দীর্ঘ চুমু দিয়ে বললো–একাকী থাকতে অসুধিধা হলে আমাকে নির্দ্বিধায় ফোন অথবা মেসেজ কোরো।আমি কাওকে পাঠিয়ে দেবো।কেমন?

নরম নরম ভালোবাসাগুলো যেনো কৌড়িকে ভিতর থেকে বেশ আবেগী করে তুললো।আর সব থেকে মায়া লাগলো,কলিজায় গিয়ে সপাৎ করাঘাত করলো, নিভানের একটা কথায়,বরের প্রতি তো তোমার ভালোবাসা কম,যদি এই এটাে তরলপদার্থের বিনিময়ে তা একটু বৃদ্ধি পায়।কৌড়ির মনেহলো মানুষটাকে সপাটে জড়িয়ে ধরে তার কপালেও দীর্ঘ একটা আদর ছোঁয়াতে। তবে এই গণ্ডি কখনো পার করতে পারবে কি না জানা নেই তার।আজ তো পারলোনা।তবে নিভানের কথার বিনিময়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে বললো —ঠিক আছে।জানাবো।

নিভান সরে দাড়ালো।বাহিরের পানে আগ্রসর হতেই,
দরজার দোরগোড়ায় গিয়ে পিছু ফিরে তাকাতেই মুখে চওড়া হাসি ফুটে উঠলো তার।কফিটা সাবলীলভাবে নির্দ্বিধায় পান করে চলেছে কৌড়ি।এলোকেশী অপরূপা নারীর নজর বিশাল বড়োসড়ো কাচের জানালার ওপারে।নিভান দরজা চেপে দিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলো।নিভান বেরিয়ে যেতেই উঠে দাঁড়ালো কৌড়ি।এতোসময় কোলের মধ্যে পড়ে থাকা হিজাবটা নিয়ে রেখে দিলো নিভানের ব্লেজারের উপর।হাতের পিনগুলো রাখলো অফিস টেবিলের উপর।আবারও পরতে হবে যখন তাই আর হ্যান্ডব্যাগে রাখলো না।ফের কফির মগটা নিয়ে শান্ত পদক্ষেপ বাড়ালো,কাঁচেঘেরা জানালার পাশে।

বাহিরে ঝলমলে কড়া রোদ।নিত্যদিনের ভিন্ন ভিন্ন ব্যস্ত কর্মমুখর মানুষের বিপুল আনাগোনা চওড়া রাস্তাটায়।বিভিন্ন চাকার যানবাহনের অবাধ চলাচলও সেখানে।কফির মগে একটু একটু করে চুমুক দিলো আর বাহিরের সবকিছু কেমন মনোযোগ দিয়ে তীক্ষ্ণ খেয়ালি নজরে অবলোকন করতে থাকলো কৌড়ি।এবারের কফির স্বাদটা ভিন্ন।তার কফির মগে মিষ্টান্নের আভাস থাকলেও এটার স্বাদ কেমন হালকা কশ বা তিক্ত।হয়তো অন্য মগের কফিটা তিক্তই ছিলো।তবে তার মিষ্টান্ন কফির সাথে মেশানোর পর সেটা হালকা,সাবলীলতায় রূপ নিয়েছে।মিষ্টি করে হাসলো কৌড়ি।তবে দুইয়ের মিশ্রণে জিনিসটার স্বাদ মন্দ হয়নি।বেশ দারুন একটা কম্বিনেশন হয়েছে।উপভোগ্য বেশ স্বাদ দিচ্ছে।

সকাল থেকেই উদ্বিগ্ন মান্যতা।তৃনয় বিয়ের প্রস্তাব রেখেছে মানে,যখন তখন একটা কিছু হয়ে যেতে পারে।ইদানীং তাদের ভাইবোন ভাগ্যে হুটহাট বিয়ে হওয়ার প্রবণতা সঙ্কা পেয়েছে।সেই সঙ্কায় এবার নিজেও আতঙ্কিত সে।তৃনয় ছেলে খারাপ নয়।যদি তার প্রস্তাবে বাড়ির সবাই রাজি হয়ে হুটকরে বিয়ে নামক সম্পর্কে বাঁধা পড়ে যেতে হয়।তখন?বিষয়টা ঠিক কেমন দাড়াবে।ওই মানুষটার সম্মুখীন হতে তো তার ভীষণ সংকোচ,লজ্জা।সারাটা জীবন সেই মানুষটার সাথে কাটাতে হবে।কি করে?উফফ!ওই মানুষটাও সব জেনেশুনে কেনো তাকে এরকম পরিস্থিতিতে ফেললো?কতবার ফোনটা হাতে নিয়েছে কল করার জন্য, অথচ বারবার ডায়ালে গিয়েই ফিরে আসছে!যে মানুষটাকে একটা কল করার দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারছেনা,সেই মানুষটার সাথে আমৃত্যুকাল পর্যন্ত সংসার!ধপাৎ করে বসে পড়লো মান্যতা। ফের গা এলিয়ে দিলো নিজের আরামদায়ক বিছানাটায়।

সম্পর্ক ছিলো,সেটা তৃনয় জেনেছিলো বিষয়টা মান্যতার কাছে নরমাল ছিলো।বাট ওই জানোয়ার ছেলেটা তাকে অসভ্য অসভ্য প্রস্তাব দিয়েছিলো।সেই বিষয়গুলো তৃনয় জানে, এটা তারকাছে ভিষন লজ্জার।এমন একটা খারাপ ছেলের সাথে একসময় হুটকরে সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছিলো,এটাই মান্যতাকে হীনমন্যতায় ভোগায়।ভিতরটা আর লজ্জায় কুঁড়ে কুঁড়ে খায়।তৃনয় ছাড়া এই বিষয়ে সেভাবে আর কেউ জানেনা।দাদাভাই, ছেলেটা সম্পর্কে জানলেও এতো গভীরে জানেনা।এটা সে দাদাভাইয়ের কথাকাজে আগেই বুঝেছে।বিধায় লজ্জাটাও একমাত্র সেখানেই।অথচ বিষয়টা লোকটার কাছে যেনো কিছুই নয়।বিছানায় শুয়ে আরও কিছুটা সময় ছটফটালো মান্যতা।ফের আবারও ফোনটা হাতে নিয়ে অন করে ডায়ালে চলে গেলো।নম্বরের দিকে তাকিয়ে ফের ভাবতে বসলো ফোন দেবে নাকি মেসেজ করবে?মেসেজ দেখার সময় আছে লোকটার?যা ব্যস্ত মানুষটা।কাল রাতেও পর্যন্ত এবাড়িতে থাকার সময় হলো-না তার!আন্টির মুখেও তো গল্প শুনেছে,ছেলেটা সারাদিনে এত ব্যস্ত থাকে,নিজের দিকে একটু খেয়াল রাখার সময় হয়না।আরও কত কি!এমনিতেই মান্যতা সরাসরি এবং দ্রুত কথা বলতে চায় তৃনয়ের সাথে ।আরও কিছুসময় দ্বিধাদ্বন্দে ভুগে কলটা করেই বসলো মান্যতা।বুকের মধ্যে চললো উথাল-পাতাল ঢেউ।সেই ঢেউয়ের ঘনত্ব বাড়িয়ে দিয়ে ওপাশ থেকে চমৎকার পুরুষালী কন্ঠে বার্তা এলো।

‘সূর্য বুঝি আজ পশ্চিমে উদিত হলো?

যদিও লোকটা সামনে নেই তবুও তার বার্তায় চোখমুখ শক্তকরে চেপে বুঁজে নিলো মান্যতা। ওই মানুষটার মান্যতার প্রতি দূর্বল অনুভূতি অনেক আগেই টের পেয়েছে মান্যতা।তবে দূর্বলতাটা যদি,ওই জানোয়ার ছেলেটার সাথে সম্পর্কে যাওয়ার আগে টের পেতো মান্যতা।তবে কখনোই ওই জানোয়ার ছেলেটার উপরে উপরে মন ভোলানো প্রস্তাবে রাজী হতোনা।ভাইয়ের বন্ধুর মতো এবাড়িতে আসা যাওয়া করতো,এবং তাদের সাথে খুবই কমই কথা বলতো তৃনয়।বিধায় সেভাবে স্পেস রেখে তারাও চলতো।তবে তারপ্রতি তৃনয়ের দূর্বলতা টের পেলো,ওই ছেলেটার সাথে সম্পর্ক ছেদ হওয়ার পর।তবে ততোদিনে তৃনয়ের সামনে যাওয়া তারজন্য লজ্জাজনক হয়ে দাড়িয়েছিলো।অথচ একই অনুভূতিতে অটল সেই মানুষটা।যার নজরে নজর রেখে কথা বলার সাহস, দৃঢ়তা মান্যতার নেই।

‘চুপ থাকার জন্য এই নিজ থেকে কল দেওয়ার মতো অঘটনটা নিশ্চয় তুমি করোনি?

‘আমি আপনার সাথে দেখা করতে চাই?

কোনোরকম সহজ গলায় মান্যতা কথাটা বললেও, তার প্রেক্ষিতে তৃনয় মিছেমিছি বিস্ময় দেখিয়ে বলো–তোমার ঘরের জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখোতো,সত্যি সত্যিই আজ সূর্য পশ্চিমে উদিত হলো কি-না?

‘তৃনয় ভাইয়া প্লিজ।কথা বলাটা জরুরি।

জরুরি কি জরুরি না তৃনয় খুব ভালো করে জানে।নিভান বা জাহিদ সাহেব বললে বিয়েতে হয়তো মান্যতা অমত পোষন করবেনা।তবে দুটো নরনারী একটা পবিত্র বন্ধনে আঁটকে পড়ার আগে নিশ্চয় তাদের মতামত গুরুত্বপূর্ণ? আর এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা তৃনয় মোটেও এড়াতে চায়না।তাতে অপরপক্ষের মতামত না বা হ্যা যাই হোকনা কেনো।তবে মান্যতার মতামত তারজন্য না হওয়ার কারণ সে জানে।সেই হীনমন্যতা ভাঙার জন্য হলেও মেয়েটার সাথে একান্ত কথা বলা জরুরি।মেয়েটা যখন নিজ থেকে কথা বলতে চাইছে,বিষয়টাতো আরও জরুরি।তৃনয় আর ফাজলামোতে গেলোনা।বললো–

‘আমি আসবো নাকি তুমি আসবে?

চলবে…..

#ফুলকৌড়ি
(৫১)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

ব্যস্ত নগরীর ব্যস্ত যানযট,কোলাহল,মানুষের আনাগোনা, ব্যস্ত পায়ে তাদের এদিক ওদিক দূরন্ত বা সতর্ক পায়ে চলাচল,দূর থেকে কেমন দেখতে বেশ ভালোই লাগলো কৌড়ির।অবিচল নজরে সেদিকে তাকিয়ে সময়টা পার করতে থাকলো সে।অথচ খেয়াল করলোনা,অফিসের একদল নারী স্টাফদের তাকে ঘিরে কৌতুহলী নজর!স্যারের বউকে কাছ থেকে দেখার কথা বলার প্রবল আকাঙ্ক্ষা।নিভান অফিসকক্ষ ছেড়ে চলে যেতেই রাইসার নেতৃত্বে মেয়ে স্টাফেরা এসে হাজির হয়েছে এমডি স্যারের অফিসকক্ষের দোরগোড়ায়।রাইসা বাদে অন্যরা এমডি স্যারের অফিসকক্ষে ঢুকতে বেশ আতঙ্কিত। দ্বিধা সংকোচ করছে।স্যার জানলে রক্ষে থাকবেনা।এমডি স্যারের অনুমতিবিহীন প্রয়োজন ছাড়া উনার রুমের আশপাশ ঘুরঘুর বা অফিসকক্ষে প্রবেশ একদম নিষিদ্ধ।সেখানে এভাবে অযাচিত ঢুকে পড়া অশোভন।দৃষ্টিকটু। নিয়মবহির্ভূত।সবার সিনিয়র শীলা মাহমুদা এসব বিষয়ে বেশ সতর্ক থাকেন।তিনি বেশ নিন্ম অথচ দৃঢ় গলায় বললেন।

‘রাইসা,স্যার জানলে কিন্তু বিষয়টা ভালো দেখাবে-না।তিনি কিন্তু নিয়মভঙ্গ মোটেও পছন্দ করেন-না। শেষে কিন্তু আমাদেরই লজ্জায় পড়তে হবে।এভাবে অযাচিত প্রবেশ, বিষয়টা কিন্তু আমার ঠিক লাগছেনা।

কতো সাহস যুগিয়ে বিষয়টাতে উদ্যোগ নিয়েছে সে।এই ভদ্রমহিলা কেনো সেটা টুটিয়ে দিচ্ছে!কাশফিয়া নামক মেয়েটার প্রতি তার ভিষন কৌতুহল।অতটুকু একটা মেয়ে নাকি ওই জাদরেল গম্ভীর এমডি স্যারের অর্ধাঙ্গীনি!যদিও গতবার মেয়েটার জন্য স্যারের অদ্ভুত সব স্বভাববিরুদ্ধ কান্ড দেখেছে।মেয়েটার প্রতি আলাদা মায়া,টান খেয়াল করেছে।তবুও কিকরে এতোটুকু একটা মেয়ে ওই গম্ভীর মানুষটাকে সামলে চলে!যার একজন খুবই শান্তশিষ্ট তো অন্যজন দৃঢ় গম্ভীর স্বভাবের।দীর্ঘ সময় ধরে দেখে আসা প্রেম- সম্পর্কিত সম্পর্কে পুরো রিফ্রেশ থাকা স্যার হঠাৎ এরকম একটা বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করলেন।বয়স,স্বভাবে দু’রকম মানুষ দুটোর কম্বিনেশন ঠিক কেমন!কৌতুহলী মনের প্রশ্ন থেকেই মেয়েটাকে কাছ থেকে দেখার এবং তারসাথে কথার বলার তীব্র বাসনা জেগেছে রাইসার মনে।মনটাও কেমন আকুপাকু করছে মেয়েটার চালচলনে সেসব কৌতুহলী উত্তর পাওয়ার জন্য।যা না করা পর্যন্ত রাইসার চঞ্চল মন কিছুতেই শান্ত হবেনা।সে হিসহিসিয়ে বললো।

‘শীলা আপু,আপনি একটু বেশি হাইপার হয়ে যাচ্ছেন।আরেহ, কুল। আমরা কি স্যারের বউ তুলে নিয়ে যাচ্ছি নাকি?নাকি তুলে নিয়ে যাওয়ার প্লান করছি?আমরা জাস্ট উনার সাথে কথা বলার,দেখা করার একটু আগ্রহ প্রকাশ করছি।আর উনার রুমে অনুমতি বিহীন প্রবেশ করছি কোথায়?উনার ওয়াইফের অনুমতি নিয়েই তবে তো ঢুকবো।আর স্যারের ওয়াইফ মেয়েটা!মেয়েটার অনুমতিও যথেষ্ট প্রযোজ্য এরুমে প্রবেশ করার জন্য।
আর মেয়েটাকে আমি আগেও কাছ থেকে দেখেছি।খুব শান্তশিষ্ট অমায়িক মানসিকতার।অহংকার দাম্ভিকতা তারমধ্যে লক্ষ্য করিনি।

শীলা মাহমুদা কেমন দ্বিধান্বিত হয়ে বললো—‘তবুও?

শীলার কথা কানে না তুলে তাকে আশ্চর্য করে দিয়ে রাইসা দরজায় নক করলো।আতঙ্কিত হলো সবাই। ঘনোঘনো পিছে ফিরে দেখলো।তাদের মনে শঙ্কা তৈরী হলো,এই বুঝি স্যার এসে জদলগম্ভীর স্বরে শুধালেন–এখানে কেনো আপনার?

রাইসা দরজায় নক করে থামিনি।বরং দরজা ঠেলে মুখ বাড়িয়ে দিয়ে ভিতরের মানুষটাকে নিজের উপস্থিতি জানান দিলো।তবে প্রবেশের অনুমতি চাওয়ার আগেই চোখ আঁটকে গেলো তার,কালো শাড়ী পরিহিতা দীঘল এলোকেশী কালোচুলের অপরূপা নারীতে।হঠাৎ করাঘাতে কৌড়িও একটু অপ্রস্তুত হলো।নিভান বলে গেলো আধাঘন্টা সময় লাগবে তার মিটিং সারতে।তবে কে এলো?কাঁচের জানালা থেকে নজর সরিয়ে দরজার দিকে নজর ফেলতেই এবার সে সত্যিই অপ্রস্তুত হলো,নিজের খোলা চুলের এলোমেলো পরিস্থিতি উপলব্ধি করে।তবে মনেহলো মেয়েটাকে সে চেনে।চেহারার আদলে বলে দিচ্ছে এর আগেও মেয়েটাকে সে দেখেছে।এবং এই অফিসেই দেখেছে।আগেরবার অফিসে এসে অসুস্থ হয়ে পড়ায়, তাকে বেশ সাহায্য করেছিলো মেয়েটা।

‘আসবো?

অনুমতি!মন দোলাচালে ভুগলো।কি বলবে সে?আর এই রুমে প্রবেশ করার জন্য সেই বা অনুমতি দেওয়ার কে? তবে কিছু একটা ভেবে মুখে সৌজন্যে হাসি ফুটিয়ে বললো—আসুন।

হুড়মুড় করে চারপাঁচজন ঢুকে পড়লো কক্ষে।কৌড়ি মনেমনে দ্বিধান্বিত হলো খুব।এনারা!এনাদের তার কাছে কি?এনাদের এমডি স্যার অফিস-রুমে নেই,এটা এনার জানেনা?তবে রাইসাকে সহসা তার সামনে এসে দাঁড়াতে দেখেই মনেমনে অপ্রস্তুত কৌড়ি,উপরে নিজের স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললো —ভালো আছেন আপু?

তাকে মনে রেখেছে মেয়েটা?রাইসা বাদেও অন্যরা মুগ্ধ হলো যেনো তার আলাপে,ব্যবহারে।আর তারচেয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকলো,কালো শাড়ী পরা,হাটু ছাড়িয়ে পরা এলোকেশী অনন্যাময়ীকে।কি অপরূপা দেখতে!এযেনো প্রভুর নিজহাতে নিখুঁতরূূপে গড়া জীবন্ত মূর্তি।
সবাই ভাবনার মধ্যে রাইসা বেশ আপ্লূত কন্ঠে বললো।

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।তুম….আপনি

রাইসার দ্বিধা কাটিয়ে দিলো কৌড়ি।স্বভাবজাত নমনীয় কন্ঠে বললো –‘আমি সেদিনও বলেছিলাম আমি আপনার ছোটো।আপনি আমার সাথে তুমি সম্বোধন করেই কথা বলুন।

খুশি হলো রাইসা।সহসা শুধালো–তুমি কেমন আছো?

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো।

কৌড়ির সহজ ব্যবহারে সবাই যেনো একটু আশ্বস্ত হলো।তবে মন আতঙ্কিত সবার।সেই আতঙ্কিত মন বারবার নজরকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নিয়ে আসছে ঘোলাটে বিশাল বড়ো কাঁচের দরজা থেকে।তবে রাইসার আচারণ স্বাভাবিক। সে টপাটপ সবাইকে কৌড়ির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো।অফিসের কোন সেকশনে তারা কি কাজ করে,তাদের নাম।ভিতরে ভিতরে প্রচন্ড অপ্রস্তুতবোধ করলেও কৌড়ি সবার সাথে সহজ আচারণ করে আলাপ বিনিময় সারলো।

‘বসুন সবাই।

শীলা মাহমুদা অফিস সিনিয়র।শান্তশিষ্ট গম্ভীর এমডি স্যারকে অকারণে তিনি ভয় পান।ভয় পান বলতে সমীহ করে চলেন।এমডি প্রদত্ত অফিসের কড়াকড়ি সকল নিয়মগুলো দৃঢ়তার সাথে মেনে চলতে তিনি সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।এই রুমে স্যারের অবর্তমানে প্রবেশ করে মনটা উনার সেই থেকে ঢিপঢিপ করে চলেছে।এটা এরুমের সামনে এলে।কারনে অকারণে হয়ে থাকে।সবসময় সঙ্কায় থাকেন,এই বুঝি কোনো ত্রুটির কারনে কড়া গলায় স্যার কিছু শুনিয়ে দিলেন।আজ সেই স্যারের অনুমতিবিহীন উনারই রুমে প্রবেশ করায় সঙ্কটা যেনো সরীসৃপের মতো তিড়তিড় করে সারাগায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।যদিও বউয়ের অনুমতি দেওয়া নিয়ে হয়তো রা করবেন না স্যার।তবুও এ-ই রুমে এসে তাদেরকে দেখলে,বিষয়টা স্যারের চেয়েও তাদেরকে বেশি অস্বস্তি অপ্রস্তুত করে তুলবে।এখন এখানে বসা মানে, সেই অপ্রস্তুততাকে নিজে নিমন্ত্রণ করে আনা।তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি অফিসকক্ষ থেকে বের হতে চাইলেন।তবে সামনে দাঁড়ানো অপরূপাকে নারীর সাথে কথা বলতে বা কিছুসময় সঙ্গ পেতেও মন চাইলো উনার।দেখতে অপরূপা এবং স্বভাবে বেশ মিষ্টি একটা মেয়ে।তাই বকবক করে চলা রাইসাকে উদ্দেশ্য করে বললো।

‘ম্যাডামকে নিয়ে আমাদের ডেস্কে চলোনা রাইসা।ওখানে গিয়েই না-হয় চা কফির সাথে কথা বা আড্ডা দেওয়া যাবে।

‘বিষয়টা মন্দ নয়।

তার থেকে দ্বিগুণ বয়সী শীলা মাহমুদার মুখে ম্যাডাম ডাকটা শুনতেই কৌড়ির মনেমনে অপ্রস্তুততা বাড়লো।সেটা আরও দ্বিগুণ করে দিলো রাইসার উৎসাহিত কন্ঠে—চলো না,স্যারের মিটিং সেরে আসতে তো প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লাগতে পারে।সেটুকু সময় নাহয় আমাদের বকবক শুনে কাটালে।যদিও বিরক্ত লাগবে, তবুও সময় তো কেটে যাবে।

কৌড়ি কি বলতে তড়িৎ ভেবে পেলো-না।আদৌও কি তার যাওয়া উচিত?সময়টা একাকি পার করলেও, তার মোটামুটি তো খারাপ লাগছিলো-না।রাইসাকে সে অল্প চেনে,আর এতো অপরিচিত মানুষের সাথে আড্ডা দেওয়া গল্প করা তার যে হয়ে উঠেনা!ভিষণ কেমন কেমন লাগে।এমনিতেই সে ইন্ট্রোভার্ট টাইপের মেয়ে।বেশি মানুষের মধ্যে থাকলে হাসফাস লাগে,সহজে তাদের সাথে সহজ হতে পারেনা,মিশতে পারেনা।তবে এবাড়িতে আসার পর অনেকেটাই ঘরকুনো স্বভাবে পরিবর্তন এসেছে তার।আর রাইসা মেয়েটা যেভাবে বলছে,কিকরেই বা না বলবে!

‘আরেহ চলো-না।এতো চিন্তা ভাবনা করার কি আছে, দূর তো কোথাও যাচ্ছো না। স্যার এসে ঠিকই খুঁজে নেবেন।

গলায় স্পষ্ট দুষ্টমী।কৌড়ি বিষয়টা বুঝেও সহজ গলায় বলার চেষ্টা করলো–বিষয়টা আসলে, উনাকে নিয়ে ফ্যাক্ট নয়।

আরও
কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলো সে।মুখে সৌজন্যে হাসি বজায় রেখে ফের বললো–আচ্ছা চলুন।

হাতের কফির মগটা এতোক্ষণে টেবিলের উপর রাখলো কৌড়ি।ফের চুলগুলো মূহুর্তেই হাত খোঁপা করে নিয়ে কাটা আটকালো তাতে।চেয়ারে হেডে রাখা নিভানের ব্লেজারের উপর থেকে কালো হিজাবটা তুলে নিয়ে মূহুর্তেই সেটা অভ্যস্ত হাতে মাথায় এঁটে নিলো।রাইসা পিনআপ করতে সাহায্য করলো।তারপর টেবিলের উপর রাখা ফোনটা হাতে নিয়ে সবার সাথে বেরিয়ে গেলো সে।অফিসকক্ষ থেকে বের হতেই শীলা মাহমুদাসহ,অন্যরা যেনো হাফ ছেড়ে বাচলেন।সাথে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

নির্দিষ্ট আধাঘন্টা বাদেই কেবিনে ঢুকলো নিভান।নিস্তব্ধ নিঃশব্দ,নীরব শুনশান কেবিন।কেবিনে ঢুকতেই কপালে মৃদু ভাজ পড়ল তার।কোথাও কোনো প্রানির নিঃশ্বাসের শব্দ,বা তার আনাগোনার কোনো চিহ্নমাত্র নেই।মূহুর্তেই গোটা রুমটা সহ পাশের স্পেশাল কেবিনটায়ও পলকে নজর ঘুরিয়ে আনলো নিভান।কৌড়ি কোথায়?কেবিনে নেই কেনো মেয়েটা?কৌড়িতো এমন হুটহাট কোথায় যাওয়ার মতো মেয়ে নয়!তাও আবার না বলে।আর অফিসের বাহিরের যাওয়ার প্রশ্নই তো উঠে-না।তবে?
অফিসের বাহিরে যাওয়ার প্রশ্নই উঠেনা,বিষয়টা ভাবতেই একটু স্বস্তি পেলো নিভান।তাহলে মেয়েটা গেলো কোথায়?হঠাৎ তীক্ষ্ণ ব্রেইন কিছু একটা ভাবলো,সময় নিয়ে মুখে মৃদুমন্দ হাসি ফুটে উঠলো তার।স্বস্তির হাসি।ধীরপায়ে নিজের আরামদায়ক চেয়ারটায় গিয়ে বসলো সে।টেবিলে রাখা ল্যাপটপটা টেনে কাছে নিয়ে দক্ষ হাতের আঙুলগুলো ফটাফট চালালো তাতে।

অফিসের সিসিফুটেজ নিয়ন্ত্রণ বা দেখার জন্য আলাদা অফিস স্টাফ আছেন।অফিস চলাকালীন তিনি সর্বদা নিজের কাজে অব্যাহত থাকেন।তবুও প্রয়োজন অপ্রয়োজনীতায়,গোটা অফিস-রুমের সিসি ফুটেজের কানেকশন নিভানের আওতাধীন রয়েছে।দক্ষ হাতে কয়েকসেকেন্ডের মধ্যে গোটা অফিসটাকে নিজের ল্যাপটপের স্কিনে হাজির করে ফেললো নিভান।মূহুর্তেই ভাবনা অনুযায়ী সুগভীর বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুুটো চলে গেলো অফিসকক্ষের ফিমেল ডেস্কে। মুখের হাসি চওড়া হলো তার।যা ভেবেছিলো তাই।নিশ্চয় তার অবর্তমানে সাহসিকতা দেখিয়ে তার বউটাকে নিয়ে গেছেন ম্যাডামেরা।আর স্বভাবসুলভ কারও মুখের উপর না বলতে পারা মেয়েটা হয়তো বাধ্য হয়েই উনাদের সাথেই গেছে।কিন্তু কৌড়ির হাস্যজ্বল মুখ দেখে তো বাধ্য হয়ে গেছে মেয়েটা মনে হচ্ছে না।সিসিফুটেজটা বড়ো করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো নিভান।নিষ্পলক, শান্ত নজরটা তার সিসিফুটেজের একটা গোলগাল মায়াবিনী মুখেই আঁটকে আছে।যে নারীটা তার সহধর্মিণীনি।
ফিমেল স্টাফদের মধ্যেমনি হয়েই বসে আছে মেয়েটা।হাসিখুশি গোলগাল মিষ্টি একটা মুখ।মাঝেমধ্যে সবার কথার খেই ধরে হাত নেড়েচেড়ে নিজেও কিছু বলে চলেছে।কথার মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত মায়ামায়া হাসি।হাতের মধ্যে কিছু একটা খাবার,মাঝেমধ্যে টুকটুক করে খেয়ে চলেছে তা।আশ্চর্য! এতো খোলামেলা বাহিরের মানুষের সাথে কখনো কৌড়িকে সহজ হয়ে মিশতে দেখেছে নিভান?এমন কি এতো হাস্যজ্বল বদনে বাড়ির কারও সাথেও তো সেভাবে হেসে খেলে কথা বলত দেখেনি নিভান।দেখেনি বলতে ভুল।টুকটাক মান্যতার সাথে দেখেছে,তবে স্বতঃস্ফূর্ত নয়।হয়তো করেছে। সারাদিন বাড়িতে না থাকার দরুন নজরে পড়েনি তার।তবে কৌড়ির এই হাস্যজ্বল রূপ একদম আলাদা।অন্যরকম মায়াময়।ওই স্বতঃস্ফূর্ত হাস্যজ্বল বদন নিভানকে যেনো অন্যরকম শান্তি অনুভব করালো।সময় অতিবাহিত হলো তবুও নজর সরালোনা সেই হাসিহাসি মিষ্টি মুখটা থেকে।সুগভীর নজর নিষ্পলক দেখে গেলো মেয়েটাকে।

সময় অতিবাহিত হলো।ফোনের আওয়াজে মগ্নতা ভগ্ন হলো নিভানের।ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো, মা কল করেছেন।কলটা রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে নীহারিকা বেগমের কন্ঠ ভেসে এলো।

‘অফিস থেকে বেরিয়েছিস?

‘না।এই বের হবো।

‘অফিসের ঝামেলাটা আজ না নিলে হতোনা?মৃদুল অথবা তোর ছোটচাচ্চুকে দিয়ে ঝামেলাটা তো কাটানো যেতো!কোথাও যেতে চাইলে মনস্থিরটা সেই গন্তব্যেই রাখতে হয়।নাহলে…

‘মা,রিলাক্স।আধাঘন্টার কাজ।ব্যাপারটা মিটেও গেছে।এবার বের হবো।এতো হাইপার হচ্ছো কেনো?

কিজানি এতো হাইপার হচ্ছেন কেনো তিনি।মনেমনে তিনিও যেনো একটু চেয়েছিলেন পুরোনো সংসার থেকে ঘুরে আসার।এই বয়সে এসে কি এরকম আবেগপ্রবনতা মানায়? হয়তো মানায় না।তবে কেনো যেনো মন এতসব নিয়মের ধারাবাহিকতা মানতে চায়না।হয়তো সেই আবেগ থেকে নিভানকে এতোকিছু বলে ফেললেন।দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিভানকে কিছু বলতে যাবেন তারআগেই নিভান বললো।

‘কি নেয়ে টেনশন করছো?

নীহারিকা বেগম যেনো একটু থতমত খেলেন।তবুও বললেন–‘কি নিয়ে টেনশন করবো।এই তোরা গেছিস কি-না সেটা জানতে ফোন দিলাম।

‘বাড়িতে মেহমান না থাকলে আমি তোমাকেও সঙ্গে করে নিয়ে আসতাম মা।তাতে যে যেমনই মন্তব্য করতো-না কেনো,আর যেমনই দৃষ্টিতে দেখতো-না কেনো, তোমার ছেলে কাওকে পরোয়া করতোনা।কোনো কিছুতে কান দিতো না।তবে বাড়িতে মেহমান কমে যাক,তোমাকে নিয়ে এবাড়ি থেকে আমি ঘুরিয়ে নিয়ে যাবো।নিয়ে আসবো।বিচলিত হয়োনা,প্রেশার বেড়ে যাবে।

আবেগপ্লুত হলেন নীহারিকা বেগম।এই ছেলের কাছ থেকে ভালো মন্দ কোনো অনুভূতি লুকোনো যায়-না। পেরেছেন কি কখনো লুকাতে?পারেননি।আগে নিভান উনার আবেগ-অনুভূতি সম্পর্কে অবগত হলেও এরকম ভাবে মুখে কখনো প্রকাশ করে স্বান্তনা দিতোনা।তবে অবশ্যই সেটা যেভাবে হোক পূর্ণ করে বুঝিয়ে দিতো,মা তুমি আমার থেকে তোমার ভালো মন্দ ইচ্ছে,চাওয়াগুলো লুকিয়ে গেলেও তোমার ছেলে ঠিকই বুঝতে পারে।এমন একটা ছেলেকে গর্ভে ধারণ করতে পেরে তিনি গর্বিত।পৃথিবী না জানুক তিনি জানেন,তিনি রত্নগর্ভা।যদিও পৃথিবী জানতে বাকি নেই তিনি রত্নগর্ভা।

‘মা।

‘ওবাড়ি পৌঁছিয়ে আমাকে জানাস।আর সাবধানে গাড়ি চালাবি।রাখছি।আল্লাহ হাফেজ।

‘আল্লাহ হাফেজ।

নিভানের প্রস্তাবে মা যে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছেন।বেশ বুঝতে পারলো নিভান।তাই আর কথা না বাড়িয়ে মায়ের বিদায় বার্তা মেনে নিয়ে নিজেও মৃদুস্বরে বিদায় বার্তা জানিয়ে দিলো।

মায়ের ফোনটা কাটাতেই নিভানের ছোটোচাচা ফোন দিলেন। জানতে চাইলেন কতদূর এসেছে তারা?আসতে
আর কতক্ষণ বা লাগবে?

বিচিলিত যেনো সবাই!ছোটো চাচার সাথে কথা সেরে ফোন রাখল নিভান।স্থির নজর তখনো তার ল্যাপটপের স্কিনে।কৌড়ির হ্যান্ডব্যাগটা তার টেবিলের উপর, তার নিজস্ব ফোনটাও ছিলো ব্যাগের ভিতরে।নিভানের তাই মনে হয়েছিলো, কৌড়ি ফোন নিয়ে যায়নি।অথচ মায়ের সাথে কথার বলার মধ্যেও নিভান খেয়াল করেছে ডেস্কের উপর থেকে ফোন নিয়ে দুবার চেক করে নিয়ে রেখে দিয়েছে কৌড়ি।হয়তো কার-ও ফোনের অপেক্ষা।মৃদু হাসিতে পুনরায় ছেয়ে গেলো ঠোঁট। মেয়েটার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ফোন দিলো নিভান।কয়েক সেকেন্ড পার হতেই রিনরিনে মেয়েলি মিষ্টি স্বর ভেসে এলো।

‘আমি রাইসা আপুদের এখানে।আপনি এসেছেন?

ওপাশের সব রমণী যেনো তথাস্তু,চুপচাপ।শুধু একজন চঞ্চল।নিভান সেসবে পাত্তা না দিয়ে প্রিয় নারীটার কথার পরিবর্তে উত্তর জানাতে ব্যস্ত হলো।তবে কন্ঠে তার অতি ব্যস্ততা নেই।বরাবরের মতোই শান্ত,ঘনোস্বরে বললো।

‘হুমম,এসেছি তো।আমিতো আমার দিয়ে যাওয়া নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চলে এসেছি অথচ ম্যাডামের খোঁজও নেই,দেখাও নেই।আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে ম্যাডাম?

উত্তর কি দেবে কৌড় যেনো খুঁজে পেলোনা।তন্মধ্যে আশেপাশে তাকিয়ে আরও একটু দ্বিধায় পড়ে গেলো।সবটা দেখলো নিভান।ওই মিষ্টি মুখটার অপ্রস্তুতা যেনো মোটেই ভালো লাগলোনা তার।সেখানে মিষ্টি লজ্জা আর উচ্ছলতার প্রভাব যেনো নিদারুন মানায়।নিভান সেই অপ্রস্তুততা দূরীভূত করতে শান্ত, চমৎকার কন্ঠে বললো।

‘চলে এসো।যেতে হবে তো আমাদের।

রিনরিনে মেয়েলি মিষ্টি আওয়াজটা আবার ভেসে এলো—আসছি।একটু অপেক্ষা করুন।

ফোন কেটে দিলো নিভান।সবাইকে বলে কৌড়ি উঠে দাঁড়াতেই ফুটেজ কানেকশন অফ করে দিলো নিভান।গভীর দৃঢ়পন নজরটা তার এবার অফিসকক্ষের ঘোটালে কাঁচের দরজায়।সেখানে একটা ছায়া এসে হাজির হতেই মুখে মৃদু হাসিটা ফিরে এলো তার।কৌড়ি মুখ বাড়িয়ে অনুমতি চাওয়ার আগেই নিভান
বললো–দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে রাখি কি বলো?

নিভানের দুষ্টমী কথার ভঙ্গিমা বুঝে অমায়িক হেসে কৌড়ি ভিতরে ঢুকে পড়লো।কৈফিয়তের স্বরে বললো–
আপনাকে না বলে যাওয়া হয়তো উচিত হয়নি তবে উনাদেরকেও না বলতে পারিনি।ভেবেছিলাম অফিসের মধ্যে তো আছি,খুঁজে নেবেন আমাকে।তাই আর ফোন দিয়ে…..

‘খুজে নিয়েছি তো।কৈফিয়তের কোনো প্রয়োজন নেই।

উঠে দাঁড়ালো নিভান।কৌড়ির কাছাকাছি সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে মাথা ঝুঁকে বললো–তবে সামন্য একটু বিচলিত হয়েছিলাম এই ভেবে যে,আমার এতো সাধ্যসাধন করে পাওয়া শান্তশিষ্ট বউটা হঠাৎ উধাও হয়ে গেলো কোথায়?

নিভানের বলার ভঙ্গিমায় লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিলো কৌড়ি।সেই লজ্জা কাটিয়ে দিলো প্রগাঢ় এক চুমুতে নিভান।কৌড়ির মুখটা শক্তকরে দু’হাতে আঁজলে নিয়ে কপালে সঁপে দিলো নিজের ঠোঁটে।চেপে রাখলো কিছুক্ষণ। ফের সরে এসে কৌড়ির নাকের সাথে নিজের নাকটা ঘষা দিয়ে বললো–এভাবে কখনো আর সামন্য হলেও আমাকে বিচলিত করে দেবে-না।একটু হলেও নিজের অবস্থানটা কোথায় রাখছো জানাবে,সে যেখানেই থাকোনা কেনো আর যেখানেই যাওনা কেনো তুমি।কেমন?

কৌড়ি বাধ্য স্ত্রীর মতো উপর নিচ সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ালো।সেটা দেখে মৃদু হেসে পুনরায় টুপ করে কৌড়ির দুঠোঁটের মেলবন্ধনে একটা চুমু একে দিলো।কৌড়িকে লজ্জা পাওয়ার সময় না দিয়ে বললো–চলো।এরপর দেরি হয়ে যাবে যেতে।সবাই ফোন দিয়ে আমাকে পাগল করে দিচ্ছে।

কৌড়িও যেনো মূহুর্তেই ভুলে গেলো স্বামী নামক পুরুষটার সদ্য রাঙিয়ে দেওয়া ভালোবাসা।টেবিলের উপর থেকে নিজের হ্যান্ডব্যাগটা নিলো।তারপর ছড়িয়ে থাকা শাড়ীর আঁচলটা পিঠের উপর দিয়ে উঠিয়ে ডানহাতের ফাঁক গলিয়ে অন্যহাতে চেপে নিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে বের হওয়ার জন্য অগ্রসর হলো।দু’জনেই একসাথে বের হলো অফিস রুম থেকে।নিভানের অগ্রগতি বরাবরের মতোই আত্ম দৃঢ় স্বভাবের।কৌড়িও তার নমনীয় ধারা অটল রেখে পায়ে পা মিলিয়ে চললো।স্টাফরুম পার হওয়ার আগেই ধীমে গেলো তার চলন।নিভান এগোতেই পাশকেটে দুকদম ডানে গিয়ে আলাদা ওম্যান ডেস্কের দিকে মুখ বাড়িয়ে দিতেই দেখলো,তাঁরাও উঁকি দিয়ে দেখছে কিছু।কৌড়ির সাথে তাদের নজর বন্দি হতেই হাত নাড়িয়ে তাদেরকে বিদায় জানালো কৌড়ি।তারাও মিষ্টি হেসে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালো।সামনে এগোনো নিভান যেনো বউয়ের কান্ড স্পষ্ট উপলক্ষে করলো।মুখে মৃদু হাসি ফুটতেই মূহুর্তেই তা মিলিয়ে নিয়ে সামনে অগ্রসর হলো।কিছু মূহুর্ত পর অনুভব করলো,তার প্রিয়তমা স্ত্রী পুনরায় সঙ্গ নিয়ে পায়ে পা মিলিয়ে হেঁটে চলেছে তার।

শহর থেকে নিভানের আসল পিতৃগৃহটা বেশ ভিতরে।
বেশ ভিতরে বলতে ঢাকার জ্যাম পেরিয়ে প্রায় তিন ঘন্টার কাছাকাছি লেগেছে এই এবাড়িতে আসতে।এখানের আশপাশটা কেমন গ্রামীন পরিবেশের ছোঁয়া।অথচ চারপাশের বড়বড় আধুনিক কায়দায় বিল্ডিং, রাস্তাঘাট,পরিবেশ সব শহুরে ছোঁয়ায় আচ্ছাদিত।তবে বিশাল বিশাল এরিয়া নিয়ে করা বাড়িগুলো গ্রামীণ পরিবেশেকে বেশ উপলব্ধি করাচ্ছে।পুরানো বিশাল বড় দুতলা বাড়িটার বড়সড় লোহার গেটটা পেরিয়ে লন এরিয়ায় গিয়ে গাড়ীটা থামাতেই গাছপালা ভরা চারপাশটাকে দেখতেই,নিজের বেড়ে উঠা মাতৃস্থানীয়ার কথা মনে পড়ে গেলো মূহুর্তেই কৌড়ির।গাড়ী থেকে বের হতেই সেটা আরও দৃঢ়রূপে অনুভব করতে থাকলো সে।

রঙচটা বিশাল বড়ো দোতলা বাড়ি, দৈত্যের ন্যায় বুক ফুলিয়ে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে।অনেক আগের বাড়ি।যেটা তার কারুকাজ,গঠন,দেখেই বোঝা গেলো।এটা সদ্যপ্রাপ্ত হওয়া বড়োলোকিদের বাড়ি নয়।বাড়ির সামনে এরিয়ায় বিভিন্ন রকমের অবাধ গাছপালায় ভর্তি।ওবাড়ির লন এরিয়ার মতো নিদিষ্ট করে সাজানো গোছানোরূপে কোনো গাছ লাগানো নেই।অথচ তাতে মুগ্ধতা বা সৌন্দর্যের খামতি নেই।কেমন মায়ামায়া শান্তশান্ত নিরিবিলি পরিবেশ।

চারপাশটা বিশেষভাবে খেয়াল করার আগেই,গাড়ীর শব্দ পেয়ে হয়তো বড় বাড়িটা থেকেই বেরিয়ে এলেন বিয়ের দিনে পরিচিত হওয়া সেই চাচাশ্বশুর নামক মধ্যেবয়সী পুরুষটা।অমায়িক হেসে কুশলাদি বিনিময় করে, তাদেরকে নিয়েই বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলেন তিনি।ভিতরে প্রবেশ করতেই বাহিরের থেকে আরও শান্ত আরও নিরিবিলি পরিবেশ অনুভব করলো কৌড়ি।তারা বসার ঘরে প্রবেশ করতেই কোথা থেকে ছুটে এলেন সুদর্শনা এক নারী।চেহারার জৌলুশতায় তাকে নিতান্ত অল্প বয়সী লাগছে। বয়স ধারনা করতে পারলো না কৌড়ি। তিনি এসে প্রথমে নিভানের সাথে আলাপ বিনিময় সারলেন।ফের কৌড়ির পাশে এসে দাঁড়িয়ে অমায়িক মিষ্টি হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বললেন—এই বুঝি আমাদের বড় বউমা?মাশাআল্লাহ।

ফের নিজেই নিজের পরিচিত জানান দিলেন—আমি তোমার ছোটো চাচিশ্বাশুড়ি হই।কেমন আছো মা?

ভদ্রমহিলার অমায়িক ব্যবহারে কৌড়ি নিজেও সহজ আচারণ করলো।যদিও ভিতরে ভিতরে আড়ষ্টতায় ঘিরে আছে।তবুও মুখে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে স্বভাবসুলভ নরম কন্ঠে বললো—আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।আপনি ভালো আছেন?

‘আলহামদুলিল্লাহ।ওবাড়ির সবাই ভালো আছেন?আর বড়ভাবি,উনি কেমন আছেন?

‘আলহামদুলিল্লাহ সবাই ভালো আছেন।

‘তোমাদের বিয়েতে খুবকরে যেতে চেয়েছিলাম।কিন্তু যাওয়া হয়নি।মেয়েদের পরিক্ষা ছিলো সাথে তোমাদের দাদুমাও অসুস্থ ছিলেন।

‘ঝুমুর, এসব কথা পরে গল্প করো।দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেছে,ময়নার মা’কে টেবিল গোছাতে বলো।
ওদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করো।আমি নিভানকে মায়ের সাথে দেখা করিয়ে নিয়ে আসছি।

ভদ্রমহিলার সম্বিৎ ফিরলো যেনো।কিছুটা অপ্রস্তুত গলায় বললেন–ও হ্যা হ্যা, সবকিছু গোছগাছ করাই আছে।চলো,ওদেরকে আগে মায়ের সাথে দেখা করিয়ে নিয়ে আসি।তারপর ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নেবে।চলো বউমা।

‘গাড়ি থেকে ফল আর মিষ্টির প্যাকেটগুলোতো নামানো হয়নি।

নিভান কথাটা বলতেই নিভানের ছোটো চাচা বললেন–ওগুলো পরে আমি নামিয়ে নেবো।আগে চল,দাদুমা সাথে দেখা করবি। সেই সকাল থেকে ছটফট করছেন তোদের জন্য।অপেক্ষা করে বসে আছেন।ঘুমাচ্ছেনা, খাচ্ছেন না।

নিভান আর দ্বিরদ করলোনা।ভদ্রলোক অগ্রসর হওয়ার আগেই নিভান অগ্রসর হলো।এবাড়িতে দাদুমার রুমটা কোথায় তার জানা আছে।সেই বাড়ি ছাড়ার পর না চাওয়া সত্ত্বেও আরও দু’বার এবাড়িতে পা পড়েছে।তাই দাদুমার থাকার রুমটাসহ মা বাবার থাকার রুমটাও তার জানা।নিভান আর তার ছোটো চাচার পিছুপিছু কৌড়ি আর উনার ওয়াইফও অগ্রসর হলেন।ভদ্রমহিলা কথা বলেই চলেছেন। কৌড়ি কানে সেসব ঢুকলেও একটু আশ্চর্য হলো সে।এতোবড় বাড়িতে মাত্র এই কয়েকটা মানুষ থাকে।আর কেউ নেই।তবে চাচিশ্বাশুড়ি নামক মানুষটা যে বলেন উনার দুটো মেয়ে আছে তারা কোথায়?

কতোগুলো বছর আগের নতুন সেই বরবধুর চিত্র মানসপটে ভেসে উঠলেন আবেদা জাহানের,তবে পিছে ফেলে আসা নির্দিষ্ট দিনের সময়টা ঠিক মনে করতে পারলেন না।শোক আর রোগ উনাকে আগের সবকিছু ভুলিয়ে দিয়েছে।ইদানীং অনেককিছু ভুলিয়ে রেখেছে।অথচ এমন একটা যুগল তিনি অনেকদিন পর আবারও দেখলেন।সেই একই জুটি যেনো উনার সম্মুখে বসা।
বাবা ছেলের মধ্যে সবকিছুতে এতো মিল!ছেলেটার চেহারায়, স্বভাবে,ব্যবহারে,বউভাগ্যে সবকিছুতে যেনো অদ্ভুত মিল।হঠাৎ জীর্ণশীর্ণ বৃদ্ধা মনটা আঁতকে উঠলো উনার।মূহর্তই মেনেমনে সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া আর্জি করলেন, প্রভু সবকিছুতে মিল রাখলেও ছেলেটার ভাগ্য যেনো তার বাবা-র মতো নাহয়।এটুকুতে তুমি মিল রেখোনা।এই অসুস্থ দাসীর প্রার্থনাটা তুমি কবুল কোরো প্রভু।

নাতী এবং নাতবউয়ের সাথ আলাপপরিচয় শেষে ভালোমন্দ অনেক কথাই বললেন আবিদা জাহান।পাশে বসা নিভানকে কাছে পেয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে কাছে ডেকে কপালে চুমুও খেলেন।কৌড়িকেও বাদ রাখলেন না।বৃদ্ধা যখন কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালেন, কৌড়ির তখন মনেহলো একটা মানুষের বদৌলে কতো মানুষের আদর ভালোবাসা সে পাচ্ছে।অথচ তার আদর ভালোবাসার পৃথিবী ছিলো খুবই সীমিত।আজ একটা মানুষ তাকে এমন জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে,সেখানে নিজেতো তাকে ভালোবাসা আদর যত্নে ডুবিয়ে রেখেছে।নিজের বদৌলে অন্যদেরকেও তার ভাগের আদর যত্ন ভালোবাসা থেকে ভাগ দিয়ে কৌড়িকেও মুড়িয়ে রাখতে বাধ্য করেছে।আবেগপ্রবণ হলো মন।এই মানুষটাকে কৌড়ি খুব ভাালোবাসবে।খুব খুব।

‘ছোটো বউমা,যাও।দাদুভাইয়ের ঘরটা দেখিয়ে দাও। অনেকটা পথ এসেছে ওরা,ফ্রেশ হয়ে নিক।দুপুরের খাবারের সময়টাও তো পেরিয়ে যাচ্ছে,ওরা ফ্রেশ হতেই খেতে দাও।

‘এবার আপনার খাবারটা দেই আম্মা?

‘রুমে দিওনা।খাবার টেবিলেই আমার খাবারটা দাও।আজ ওদের সাথেই খাই।আশহার নাহয় আমাকে উঠিয়ে নিয়ে চেয়ারে বসিয়ে দেবে।

ছোটো ছেলেকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলতেই ছেলেও সম্মতি জানালো।ঝুমুরও আর দ্বিরুক্তি করলেন না।বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষটা অসুস্থতায় হঠাৎ চলাফেরায় অচল হয়ে পড়েছেন।চলাচল করতে পারেননা এমনটা নয়।তবে ধরে চলাফেরা করাতে হয়।অসুস্থতা মানুষটাকে টানাহেঁচড়া না করে উনার সমস্ত কাজ ঘরের মধ্যেই সম্পূর্ণ করা হয়।নিভানকে সাথে নিয়ে আশহার সাহেব বের হতেই,ঝুমুরও কৌড়িকে নিয়ে বের হওয়ার জন্য উদ্যোক্ত হতেই বৃদ্ধা মানুষটার হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়াই তড়িৎ বললেন।

‘ছোটো বউমা দাঁড়াও।

দাড়িয়ে পড়লেন ঝুমুর।সাথে দাঁড়িয়ে পড়লো কৌড়িও।
আবিদা জাহান ফের বললেন। –আমার আলমারিটা খোলো দেখি।তারপর ভিতরের লকারটা খুলে গহনার বাক্সটা আমার কাছে দাও।দাদুমনি আর একটু আমার কাছে এসে বসোতো।

শেষের কথাটা কৌড়িকে উদ্দেশ্য করে বললেন।শ্বাশুড়ির আদেশ পেতেই ঝুমুর সেই নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করলো।আলমারি খুলে গহনার বাক্সটা এনে দিতেই,বৃদ্ধ ভদ্রমহিলা বাক্স থেকে অনেক আগের পুরোনো ডিজাইনের ভারী একজোড়া বালা বের করলেন।তারপর তা পরিয়ে দওলেন কৌড়ির দু’হাতে। চুড়ির মেলায় যেনো হাত ভারী হয়ে পড়লো কৌড়ির।তবে ভালোবাসায় কাওকে মাঝ সমুদ্রে ডুবিয়ে দিলেও বলার কিছু থাকেনা।বলতে নেই।কৌড়িও বললোনা।চুপচাপ ভালোবাসা উপলব্ধি করলো।চুড়ি পরানো শেষে ভদ্রমহিলা কৌড়ির গালে হাত রেখে দোয়া করলেন।

‘তোমাদের পথচলা দীর্ঘায়ু হোক।খুব সুন্দর হোক।সুখি হও।

ফের মনেমনে দোয়া করলেন–তোমার স্বামীভাগ্যও যেনো সুদীর্ঘতম হয়।তোমার মৃত্যুক্ষন পর্যন্তও যেনো তুমি তোমার স্বামীর ভালোবাসা পাও,সংস্পর্শ পাও।

ফের মুখে বললেন–
‘যাও দাদুমনি,অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছো হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।যাও।দুপুরটাও গাড়িয়ে যাচ্ছে ,খেতে হবে তো।যাও…

ভিতরটা যেনো আবেগে টইটম্বুর।এই ধরনের ভালােবাসাগুলোর প্রতিদান কিকরে আর কোণ ভাষায় চোকাতে হয় কৌড়ির জানা নেই।তাই নিজের ভিতরের আবেগ অনুভুতি বহিঃপ্রকাশ না করতে পেরে বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো।ঝুমুর ততক্ষণে পুনরায় গহনার বাক্সটা গুছিয়ে রাখতে ব্যস্ত। তাই কৌড়িকেও দাঁড়িয়ে থাকতে হলো।ততক্ষণে আবিদা জাহান নাতনীদের খবর নিতে থাকলেন।কৌড়ি তখন বুঝলো এবাড়ি আরও দু’জন মানুষ তবে আছে।

‘বড় দাদুমনির জ্বরের কি খবর?জ্বর ছেড়েছে ছোটো বউমা?

‘না আম্মা।কাল ওই অসুস্থ অবস্থায় পরিক্ষা দিতে গিয়ে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছে।বেহুঁশের মতো ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। তাইতো নিভান আর বউমারা এসেছে জেনেও বাহিরে আসতে পারলো-না।

‘আর ছোটো দাদুমনি কোথায়?

‘ইতু!ওকে তো জানেন,একটু লাজুক স্বভাবের মেয়ে।এত বললাম তবুও ঘর থেকে বের হলো-না।নিতুর পাশে শুয়ে আছে।যাই হোক একটু সময় যেতে দিন আপনার নাতবৌয়ের মাথাটা ওই নষ্ট করে দেবে।

হাসলেন ঝুমুর।হাসলেন বৃদ্ধাও।কৌড়ি এলোমেলো কথার অর্থ বুঝলোনা।তবে দাড়িয়ে চুপচাপ শুনল সব।


আসরের আযানের পরপরই এবাড়িতে এসে হাজির হলো তৃনয়।মা,এখনো জামাইয়ের বাড়ি থেকে বিদায় নেননি।তাই মায়ের সাথে বোনের সাথে দেখা করে,কিছু সময় বাক্যবিনিময় করে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে গন্তব্যে পা বাড়ালো।এ-সময় মান্যতার ছাঁদে থাকার কথা।তৃনয় গিয়ে পেলোও তাকে ছাঁদে।ছাঁদের দরজায় পা রাখতেই দেখলো,ছাদের উত্তর পাশের পানিরট্যাঙ্ক রাখার জন্য আলাদা ছাঁদ করা।আর সেই ছোটো ছাঁদের সিঁড়িতে বসে একমনে হাতের নখ খুঁটে চলেছে মেয়েটা।এই জড়তা কিসের তৃনয়ের জানা।দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেই দুশ্চিন্তিত রমনীর দিকে অগ্রসর হলো সে।তাকে সর্বদা এড়িয়ে চলা নারীটা আজ নিজইচ্ছেতে তাকে ডেকেছে,সময় এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে ক্ষয় করা উচিত নয়।

‘কি খবর?কেমন আছো বাধ্যতা?হঠাৎ আমার তলব?

নিজের ভাবনা বিভোর হওয়া মেয়েটা তৃনয়ের নিঃশব্দের পদচারণ খেয়াল করেনি।মশকরা করে ডাকা পুরোনো ডাকটা কানে আসতে চমকে মাথা উচু করে তাকালো সে।তৃনয়কে সামনে দেখেই ভিতরে ভিতরে আড়ষ্টতায় ডুব দিলো মন।তবে সহজ আচারন করলো সে।বললো–কেনো আপনার তলব?আপনি জানেন না?

‘কি জানার কথা বলছো?আমি আবার কি অপরাধ করলাম?

জানা সত্ত্বেও গলায় স্পষ্ট ফাজলামো স্বর।মান্যতা এবার কিছুটা শক্তগলায় বললো–এটা কিন্তু ফাজলামো করার বিষয় নয় তৃনয় ভাইয়া।আপনার কি উচিত হয়েছে আমাকে না জানিয়ে এমন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার?

এবার সিরিয়াস হলো তৃনয়।বিয়ে উপলক্ষে নাকি সবসময় পাতানো থাকে জানেনা,ছাঁদে একটা গোলটেবিলের সাথে কিছু চেয়ার পাতা ছিলো।সেখান থেকে একটা চেয়ার উঠিয়ে নিয়ে কিছুটা দুরত্ব মেইনটেইন করে মান্যতার মুখোমুখি বসলো তৃনয়।
মান্যতার দিকে তাকাতেই নজর সরিয়ে ফেললো সে।বুঝতে পারলো একটু আগে বলা কথাগুলোর মধ্যে কিছুটা ভুল আছে।আর সেই ভুলটা পুনরায় উত্থান করে তৃনয় বললো।–তোমাকে কতোবার ফোন দিয়েছি, মেসেজ দিয়েছি দেখেছো নিশ্চয়?তারপরও এই ব্লেমটা করা তোমার সাঝে?

‘তাই বলে আপনি এরকম একটা সিদ্ধান্ত একাএকা নিয়ে নিবেন?এখানে আমার সিদ্ধান্তের কোনো গুরুত্ব নেই?

‘গুরুত্ব আছে বলেই তো,নিভান অথবা আঙ্কেলের কাছে প্রস্তাব রাখার আগে তোমার সিদ্ধান্ত জানার জন্য তোমার কাছে ফোন দিয়েছিলাম।তুমি ধরোনি?আমার ইগো হার্ট করে আমি বারংবার তোমাকে ফোনকল, মেসেজ দিয়ে গেছি।অথচ তুমি সাড়া দাওনি।কেনো?পারবে এন্সার দিতে?সেই ফালতু একটা ঘটনার পরে তুমি আমাকে তোমার শত্রু বানিয়ে নিলে।অথচ আমি বরাবরই তোমার মিত্রই থাকতে চেয়েছিলাম।ওই ফালতু ছেলেটার সঙ্গে সম্পর্কে যাওয়ার অনেক আগে থেকে তোমার প্রতি আমার ফিলিংস্ ছিলো।যা আমি প্রকাশ করতে পারিনি।যদিও সেটা আমার চরম ব্যর্থতা।তুমি সম্পর্কে জড়িয়েছিলে সেই অভিযোগও তোমার প্রতি আমার কখনো ছিলো না।যা অভিযোগ ব্যর্থতা ছিলো, শুধু নিজের প্রতি।কিন্তু আমার হৃদয়ের রানীকে কেউ বাজে উদ্দেশ্যে ইউজড্ করবে!সম্পর্কের নামে তাকে বাজেভাবে ধোঁকা দিবে! তাকে না ভালোবেসে তার শরীরকে নোংরা উদ্দেশ্য ছুঁতে চাইবে!এসব জানার পর তুমি বলো,আমার কাছ থেকে ঠিক কিরূপ ব্যবহার আশা করছিলে?আমি ওই নোংরা ছেলেটার উদ্দেশ্য জানার পরও তোমার হুশ ফিরবে কখন সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করবো?চুপচাপ থাকবো?তুমি যদি সেরকমটা আশা করে থাকতে আমার কাছ থেকে,আমি খুবই খুবই দুঃখিত। আমার দ্বারা চুপচাপ থাকা সম্ভব ছিলোনা।আমি নিভানকে জানিয়েছিলাম,ওই ছেলেটা খারাপ!
তোমাকে নিয়ে তার চিন্তাভাবনা এন্ড উদ্দেশ্যও খারাপ!
তো বেশ করেছিলাম।তুমি আমাকে যেমনই ভেবেছিলে আর আগামীতে যেমনই ভাবোনা কেনো,আমার মনেহয় কোনো আমি ভুল করিনি।বরং ভুল এটা ছিলো,ওই জানোয়ারটাকে যোগ্য শাস্তি না দিতে পারা।শুধু মার খাওয়াটা ওর প্রাপ্য ছিলোনা।আমার তো ইচ্ছে করেছিলো,ওকে মেরে পুঁতে ফেলতে। কিন্তু আমার এখন যেটুকু ক্ষমতা হয়েছে, তখনতো ছিলো-না।থাকলে হয়তো ওর চিহ্নও রাখতাম না আমি। আর যেটুকু ছিলো,সেটুকু প্রয়োগ আমি করেছিলাম।আর সেটুকু প্রয়োগ করেই তো আমি তোমার কাছে খারাপ হয়ে গেলাম,লোভী হয়ে গেলাম।আর তোমার ওই দুশ্চরিত্র প্রেমিকের গায়ে হাত তুলে পাপিষ্ঠও হয়ে গেলাম, তাই না?

স্পষ্ট ভৎসনা!রাগ ক্ষোভ যেনো ঠিহরে পড়ছে পুরুষালী স্বরে।সেদিন তো রাগে-ক্ষোভে লোভী আর আবোলতাবোল কথাগুলো বলে ফেলেছিলো মান্যতা।কারণটা তো ছেলেটাকে মারার উদ্দেশ্য নয়,তার চুপিচুপি সম্পর্কটা দাদাভাইয়ের সম্মুখে উন্মোচন করার ক্ষোভে, রাগে।তৃনয় যখন ছেলেটা আর ছেলেটার উদ্দেশ্য সম্পর্কে জেনেছিলো, তখন তারকাছে প্রকাশ না করে দাদাভাইয়ের কাছে কেনো জানালো?যার বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি এবং দাদাভাইয়ের কতো ভারী ভারী কথা শুনতে হয়েছিলো তাকে।সেসব রাগ ক্ষোভইতো ঝেড়েছিল সে তৃনয়কে। পরে তো বুঝতে পেরেছিলো নিজের ভুল।গভীরভাবে ভেবেছিলো,আদৌও কি সে তখন তৃনয়ের বলা কথাগুলোকে বিশ্বাস করতো?ছেলেটাকে তো সৎ চরিত্রবান ভেবেছিলো বলেই তো সে সম্পর্কে জড়িয়েছিলো।কিন্তু তার উদ্দেশ্য ছিলো লোভ, নোংরামো।এটাতো তখন জানতো না মান্যতা।তাই তৃনয়ের কথাগুলো বিশ্বাস করার কোনো প্রয়োজনবোধও ছিলোনা।এসব ভেবে বেচারা মনেমনে ভিষণ অনুতপ্ত হয়েছিলো।তবে তৃনয়কে উল্টো পাল্টা ব্লেম করে যে ভুলটা করেছিলো সেদিন,তার ভুলের স্বীকারোক্তি দেওয়া হয়নি।যা আজ অনন্য রাগক্ষোভের সাথেও প্রকাশ করে চলেছে তৃনয়।তবে যে সম্পর্কের লজ্জায় মানুষটার সম্মুখে সে দাঁড়াতে পারেনা,মুলত দাঁড়াতে চায়না।সেই সম্পর্কটা নিয়ে পুনরায় আলোচনা,সর্বাঙ্গে অস্বস্তি ধরালো মান্যতাকে।ভিতরে ভিতরে লজ্জায় আড়ষ্ট করে তুললো।তবে কথাতো উঠতোই!

‘ওসব পুরানো কথা ঘেঁটে লাভ আছে?যেটার জন্য আপনাকে ডাকা সেটা নিয়ে কথা বলাই ভালো।আমরা সেটা…

‘লাভ নেই মানে?অবশ্যই লাভ আছে।তুমি কি কারণে আমার সাথে কথা বলোনা?কেনো আমার সম্মুখীন হও না?কারন তো ওই একটাই।নাহলে আগে তো একটা সহজ সরল সম্পর্ক ছিলো আমাদের।কথা কম হলেও, দেখা হলে এড়িয়েতো যেতে না।অন্তত সৌজন্যেবোধ রক্ষার্থে ভালোমন্দ আলাপন তো হতো আমাদের।তবে সেদিনের ঘটনার পর তা কেনো হয়না,মান্যতা?

তৃনয়ের কথাগুলো তো অক্ষরে অক্ষরে সত্য।বিধায় মান্যতা জবাব দিতে পারলো-না।প্রসঙ্গ এড়িয়ে বললো- আমি আপতত বিয়ে করতে চাইছি না।

‘বিয়েটা করতে চাইছোনা নাকি আমাকেই বিয়ে করতে চাইছোনা?

‘যেটা আপনার মনেহয়?

‘কেনো মান্যতা? আমি জানি আমি তোমার যোগ্য নই..

‘আপনার ধারনা ভুল!বরং আপনার মতো ছেলের যোগ্য আমি নই।

‘এটা তোমারও ভুল ধারনা।

‘কেনো বুঝতে চাইছেন না আপনি?

‘কি বুঝবো?বলো?যে ঘটনাটা ঘটে গেছে সেখানে তোমার হাত ছিলো-না।আর থাকলেও ছেলেটার খারাপ মানসিকতায় তো তুমি সঙ্গ দাওনি।তবে সমস্যা কোথায়?সেই দুদিনের সম্পর্কতো চুকেবুকে গেছে।সেটা মনে রেখে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলে তো চলবেনা।সেখানে তুমি দাঁড়িয়ে থাকলেও আমি দাঁড়িয়ে নেই।আর না সেসব নিয়ে আমার সমস্যা আছে।সমস্যা নেই বলতে ভুল।সমস্যা ছিলো।তুমি যে হীনমন্যতায় ভুগছো!তার শতগুণ হীনমন্যতায়, অসহ্য মানসিক যন্ত্রণায় ভুগেছি আমি।বর্ণনা না করাই শ্রেয়।তবে একটা কথা কি জানো,আমরা যাকে মন থেকে চাই।পছন্দ করি।তাদের করা হাজার ভুল,অন্যায়গুলো কেমন ভুল অন্যায় বলে মনে হলেও,মনকে মানাতে পারিনা।মস্তিষ্ক চোখে আঙুল দিয়ে বারবার সেই ভুল অন্যায়গুলো উল্লেখ্য করলেও,
মন মানতে চায়-না সেসব ভুল অন্যায়।মনমস্তিস্কের টানাপোড়েন যেভাবে হোক মন জিততে চায়।মন হাজার যুক্ত দেখিয়ে মস্তিষ্ককে হার মানাতে চায়।সেই মানুষটার দোষ, ত্রুটি, না জেনে করা ভুল, অন্যায়গুলো সবকিছু ক্ষমা করে দিতে চায়।বেহায়া মন তবুও তাকেই পেতে চায়।আমার মনেহয় কি জানো?কারও গভীর প্রেমে পড়লে বা কাওকে মন থেকে পাগলের মতো চাইলে, ভালোবাসলে।সেই প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে একটা বিশেষ গুন থাকা অবশ্যই দরকার।আমার মনেহয় থাকতেই হয়।আর তা নিজেকে বেহায়া বা লজ্জাহীনতা করা।সেখানে হয়তো নিজের আত্মসম্মানবোধ বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকেনা।তবুও সই, সেই বেহায়া নির্লজ্জ মন বারংবার তাকেই পেতে চায়।

মান্যতা কাঠ পুতুলের মতো স্থির হয়ে কথাগুলো গিলে চলেছে।কথাগুলো কেমন যেনো দোদুল্যমান মনে ঝড় তুলে দিয়েছে।তৃনয় যেনো এতোদিনের সবকিছুর রাগ ক্ষোভ কথার উপর কথায় উগরে চলেছে।সাথে নিজের অনুভূতিগুলো অকপটে স্বীকার করে চলেছে।যা এতোদিন নিজে ভিতরে চেপে রেখেছিলো।বহিঃপ্রকাশ করতে পারিনি।একটু থেমে নিজেকে শান্ত করলো তৃনয়।বলতে বলতে বেশিই বলে ফেলেছে হয়তো।এতোকিছু বলা উচিত হয়নি।কিন্তু কি করবে সে।
নিজের অনুভূতি প্রকাশে অক্ষর তৃনয়,হারাতে হারাতে নিজের প্রেয়সীকে ফের ফিরে পাওয়া।নিজের প্রতি এবং মেয়েটার প্রতি চাপা ক্ষোভ, রাগ থেকে কথাগুলো বেরিয়ে এসেছে।যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়োও পারিনি সে।বলেছে বেশ করেছে তাতে যা হয় হবে।একটু সময় নিয়ে শান্ত কন্ঠে ফের বললো–

‘আর যে হারে বিয়ের প্রস্তাব আসছে তোমার,আজ না-হয় কাল বা পৌরশু। বিয়ের জন্য মতামত তোমাকে দিতেই হবে।সেখানে পিছনের সবকিছু ভুলে তুমি যদি অন্য কাউকে মেনে নিতে পারো,তবে সেই অন্যকেউ আমি নই কেনো?আর আমি হলেই বা সমস্যা কোথায়?

আপনি বলেই তো সমস্যা।যাকে দেখলে প্রতিনিয়ত মনেহবে,এই মানুষটা তার এক বাজে অতীত সম্পর্কে জানে।অতীতে খারাপ একটা ছেলের সাথে তার সম্পর্ক ছিলো,সেই ছেলেটা তারসাথে কি করতে চেয়েছিলো সেসব জানে।প্রতিটি মূহুর্ত এসব আড়ষ্টতা,খারাপ লাগা,লজ্জা নিয়ে এই মানুষটার সাথে অমৃত্যু পর্যন্ত সংসার করে যাবে কিকরে মান্যতা?একজন অপরিচিত মানুষ হলে তো,নিজের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করলেও তার সামনে অন্তত আড়ষ্টতা থাকতে হবেনা।মনেমনে কথাগুলো আওড়ে গেলেও মুখে কথাগুলো বলতে পারলোনা মান্যতা।আর না তৃনয়ের কথাগুলোর উত্তর দিতে পারলো।ঠিক কি উত্তর দেওয়া উচিত?এটাই সে ভেবে পেলোনা।

‘কি হলো?উত্তর দেবেনা,সেই অন্য কেউ আমি নই কেনো?নাকি সত্যিই আমাকে তোমার যোগ্য বলে মনে হয়ন…

‘আমার সময় চাই!

তৃনয়ের মুখের কথা কেড়ে নিলো মান্যতা।তোমার যোগ্য নই,এই একটা কথার জন্যই বারবার দূর্বল হতে হচ্ছে তাকে।চিন্তা ভাবনা সব থামিয়ে দিতে হচ্ছে সেখানে!আর সেই কথাটারই দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে যেনো বারবার তৃনয়।

‘ঠিক আছে।তবে তুমি যে বিষয়টা নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগছো,সেটা ছাড়া অন্যকিছু ভাবার জন্য যতো সময় চাই,সময় নাও। তবে উল্টোপাল্টা ভেবে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগো না।সময় চাইছো,সময় নাও।কেউ তোমাকে প্রেশার দেবেনা।তাঁরপর তোমার সিদ্ধান্ত হ্যা না যেটাই হোক, আমি মেনে নেবো।যদিও আঙ্কেলের কাছে আমি তোমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব রেখে ফেলেছি।নিভানকেও জানিয়েছি ব্যাপারটা।তবুও তারা যদি তাদের নির্ধারিত সিদ্ধান্তটস তোমার উপর বর্তায়, তবে তা মানিয়ে নিতে বাধ্য হতে হতে হবেনা।আমি বিষয়টা
বুঝে বলবো না-হয়।তারপরও সময় যখন নিচ্ছো আরেকটাবার ভেবে দেখো।

একটু সময় নিয়ে চুপ থেকে তৃনয় ফের বললো–আমার মনেহয় আমাদের কথা শেষ হয়ে গেছে।উঠছি।

উঠে দাঁড়ালো তৃনয়।মাথা নিচু করে তখনো মান্যতা হাত কচলে চলেছে।তবে তৃনয়ের কথা পরিবর্তে মুখে টুঁশব্দ উচ্চারণ করলো-না।বিকালের নরম আলোয় হালকা গোলাপি রঙের সেলোয়ার-কামিজটা মেয়েটার গায়ের রঙের সাথে মিলেমিশে একাকার।গোলাপি ওড়নাটা মাথায় সুন্দর করে চাপানো।মনের ভিতরের টানাপোড়েনের যন্ত্রনায় এককভাবে হাত কচলে যাচ্ছে।সেটা খেয়াল করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো তৃনয়। সামনের দিকে পা বাড়াতে গিয়েও থেমে গেলো সে।কেমন শ্রান্ত গলায় বাললো–তোমার সিদ্ধান্ত যদি না হয়, আজকের পর আর তোমাকে অস্বস্তিতে ফেলবো না।আর না কখনো তোমার সম্মুখীন হয়ে তোমাকে লজ্জা,বিড়ম্বনায় ফেলবো।আসছি বাধ্যতা।

“বাধ্যতা” আবারও সেই নাম।যো নামটা একসময় মশকরা করে ডাকতো তৃনয়,তা আজ কেমন আবেগে পরিপূর্ণ।এবার গলায় সেই মশকরা বা ফাজলামোর কোনো রেশ নেই।সেখানে ওই ডাকটা জানান দিচ্ছে একগুচ্ছ আবেগ,অনুভূতি।ভিতর থেকে কিছু একটা ঠেলে গিয়ে গলায় দলাপাকিয়ে গেলো মান্যতার।মন কেমন কেমন করে উঠলো।তবুও মুখ উচু করে সেই পুরুষটার চলে যাওয়া দেখলোনা সে।দোটানায় মনটা তখনো ছটফটিয়ে চলেছে।এখন কি করবে সে?

ঘড়ির কাঁটাটা সময়টা রাত সাড়ে দশটার কাঁটায়।চারপাশটা কেমন মনেহচ্ছে গভীর রাত।শহরে এই সাড়ে দশটা যেনো সন্ধ্যা। অথচ সন্ধ্যা নামতেই এবাড়ির আশপাশটা কেমন ঘনো,গাঢ় অন্ধকারত্বে ডুবে গিয়েছে।কৃত্রিম আলোও যেনো সেই গাঢ় অন্ধকারের ঘনত্ব কাটাতে পারছে-না।গাছপালায় আচ্ছাদিত মধ্যমনি হয়ে থাকা বাড়িটা যেনো কেমন ভুতড়ে বাড়ি বলে মনে হলো কৌড়ির।তাতে বাড়িটায় মানুষজন এতো কম,সাথে সেই কমসংখ্যক মানুষগুলোও কেমন শান্তশিষ্ট,চুপচাপ। সেজন্য বাড়িটা আরও নিরিবিলি ঠেকছে।যে ঘরটাতে তাদের থাকতে দেওয়া হয়েছে, সেই ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়ালো কৌড়ি।পুরানো বাড়িটায় থাকার রুমগুলো বেশ বড়বড়।সাথে খোলা বারান্দা, বাথরুম। সবকিছুই যেনো বিশালকার।বাড়িটা পুরনো আমলের তৈরী।সামনে যেমন বিভিন্ন গাছপালার বাগান, পিছনেও বিশাল আকারের শানবাধানো একটা পুকুর রয়েছে। যার চারপাশেও বড় বড় আমগাছ,আরও বিভিন্ন ধরনের গাছ লাগানো।পুকুরের ওপারেও বিশাল বাঁশঝাড় আর কাঠবাগান।কৌড়ি আশ্চর্য হয়েছে শহরের মধ্যেও পুকুরওয়ালা বাড়ি হয়!বিকালে বাড়িটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছে তাকে ছোটো চাচাশ্বশুরের মেয়ে ইতু।মেয়েটা ভারী মিষ্টি। একটু চঞ্চল স্বভাবের, কথাও বলে প্রচুর।তবে ভিষন মিশুকে।ছোটো চাচাশ্বশুরের দুই মেয়ে।একজন দেখে হঠাৎ যেনো মান্যতা কথা মনে হলো তো আরেকজন যেনো মৌনতা।চাচাশ্বশুড়ীর দৌলতে সাক্ষাতের পর কৌড়ির দুজনকে দেখে অন্তত তাই মনে হয়েছে।বয়সেও যেমন।পড়ালেখায়ও তারা যেনো মান্যতা আর মৌনতার সমবয়সী।বড়মেয়েটা অসুস্থ থাকায় ভালোমন্দ আলাপন ছাড়া সেভাবে তারসাথে কথা হয়নি।তবে ছোটোটার সাথে দীর্ঘসময় কাটানো হয়েছে।

ভাবনার একপর্যায়ে নিজের দিকে তাকালো কৌড়ি।নিজের সাজ থেকে কিছুটা আড়ষ্টতা অনুভব করলো।তন্মধ্যে গম্ভীর স্বরের ডাক পড়লো।

‘কৌড়ি,আমি এখানে।এসো।

পুনরায় নিজের দিকে একবার লক্ষ্য করলো কৌড়ি।নতুন পাটভাঙা গাঢ় লাল একটা জামদানি শাড়ী পরা।ছোটো চাচিশ্বশুড়ী ভিষন মিষ্টি ভাষী এবং সোজাসাপটা দিলখোলা মানুষ।মেয়েদের সাথেও বন্ধুসুলভ আচারণ উনার।সেই আচারণ কৌড়ির উপরও প্রভাব ফেলেছে। দুপুর হতে এটুকু সময়ের মধ্যে নিজের, নিজের বাপের বাড়ির,এবাড়ির অনেক কিছুই মনখুলে গল্প করেছেন তিনি।তার আচারণে কৌড়ির মনে হয়নি,সে প্রথপ্রথম এবাড়িতে এসেছে এবং এই মানুষটাকে এই প্রথম দেখেছে।বরং এরকমটা মনে হয়েছে তিনি যেনো তার কতোদিনের চেনাজেনা।সেই মানুষটা রাতের খাবার পর,কৌড়িকে ডেকে নিয়ে তার পরিহিত শাড়ীটা পাল্টে দিয়ে সেখানে নতুন এই জামদানী শাড়ীটা আটপৌড়ে করে তাকে পরিয়ে দিয়েছেন।আর গহনাতো কৌড়ির পরাই ছিলো।এক্সট্রা মাথায় একটা টিকলি ঝুলিয়ে দিয়েছেন।তারপর তাকে দেখে হাজারও প্রশংসার বার্তা ছুঁড়ে দুষ্টমিষ্টি গলায় আরও বলেছেন–বিয়ে হলে নতুন নতুন সবসময় একটু সেজেগুজে থাকতে হয়।

চাচীশ্বাশুড়ীর এরকম দিলখোলা কথায় কি-যে লজ্জায় পড়েছিলো কৌড়ি।উফফ!এখন মনেহচ্ছে রুমে আসার থেকে উনার ওখানে থাকা উচিত ছিলো।

‘কি হলো,এসো।

ফের ডাকে সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো কৌড়ি।ধীর কদমে পা বাড়ালো কাঙ্ক্ষিত মানুষটার ডাকে।
বিশাল খোলা বারান্দায় সটান দাঁড়িয়ে আছে নিভান।এই বারান্দায় দাঁড়ালে না সামনে দেখা যায় না পিছন।রুমটা বাড়িটার হয়তো সাইডে।কৌড়ি নজর ঘুরিয়ে ফিরেয়ে দেখলো,হ্যা রুমটা বাড়টিটার দক্ষিন পাশে।

‘দাঁড়িয়ে পড়লে কেনো?কাছে এসো।

কাছে এসো কথাটায় ভিতরটা কেমন যেনো উথলপাথল করে উঠলো।তবুও কৌড়ি এগিয়ে গেলো।তাকে পাশাপাশি দাঁড়ানোর সুযোগ না দিয়ে নিভান। কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে নিলো।একদম শক্তপোক্ত বাঁধনে।পরপর ঘনো চুম্বনে ছুঁয়ে দিলো কৌড়ির মাথার সিঁথি আর কপাল।ফের বললো।

‘আমার কাছে একটুও আসতে ইচ্ছে করেনা,তাই না?

উত্তর দেওয়ার পর্যায়ে নেই কৌড়ি।তবে সকল লজ্জা কাটিয়ে নিবিড়ভাবে মাথা চেপে দিলো অভিযোগ করা মানুষটার বুকে।নীরবে দু’হাতের মুঠোয় খামচে ধরলো সেই মানুষটার গায়ের পিঠের অংশের শার্ট।ফের ভিতরের আড়ষ্টতা কাটিয়ে নিজেও একটু নিবিড় হলো সেই পুরুষসলী শরীরের সাথে মিশে গিয়ে।কৌড়ির মনেহলো মানুষটা যেনো কতমূহর্ত ধরে তাকে কাছে পাওয়ার অপেক্ষায় ছিলো।আর সেই অপেক্ষাটা মৃদু অভিযোগের শব্দ হয়ে ঝরেছে।যার উত্তরও কৌড়ি মুখে নাহলেও,নিজের কর্ম দ্বারা দিয়ে দিয়েছে।হয়তো সেই মানুষটাও সেটা উপলব্ধি করে আর কথা বাড়াইনি।

চলবে….

ফুলকৌড়ি পর্ব-৪৮+৪৯

0

#ফুলকৌড়ি
(৪৮)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

বিয়ে বাড়ি মানেই আমেজ উল্লাস।সাজগোছ। হৈহুল্লোড়।আনন্দ খুশির উৎসব।সকাল হতেই পুরো বাড়িটা যেনো সেরকম আমোজে ছেয়ে আছে।বাড়ির গৃহিণীদের হাতে গত দুদিন রান্নার আয়োজন না থাকলেও,নাস্তাপানির আয়োজনে হুলুস্থুল ব্যস্ত তারা।বিশেষ করে নীহারিকা বেগমের যেনো একদন্ড কোথাও বসার বা জিরোনার ফুরসত নেই।সমানতালে মেহমানদের আবদার অনাবদারের ঝুড়িঝুড়ি আহ্লাদ মিটিয়ে চলেছেন,স্বান্তনা রহমান আর রানিসাহেবাও।সাথে নিভানের মামিরাও হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দেওয়ার প্রয়াস করছেন।তবে কোনো গল্পের আসরে ভাগ্যবশত মজে গেলে আর দেখা নেই তাদের।তা নিয়ে মাথাব্যথা বা কোনো ক্ষোভ নেই,বাড়ির সুগৃহীনিদের।যেখানে বাড়ির মানুষেরাই মেহমান সেজে বসে আছে,সেখানে বাড়ির মেহমানরা টুকিটাকিও কাজে হাত লাগাক,চান না নীহারিকা বেগম নিজেই।ব্যাথা-বেদনায় শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা থাকলেও তিনি কাজে তৎপর।বাড়ির বড়ো গিন্নি।আবার নিজের ছেলের বিয়ে বলে কথা।

বাড়ির পুরুষেরা,বাহিরে ক্যাটারিংয়ের লোকরা রান্নাবান্নাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত, সেখানের দেখাশোনায় মনস্থ।তৎপর।সেখানেও অবাধ নাস্তাপানির ব্যবস্থায় নিয়োজিত থাকতে হচ্ছে।আর বাড়ির বড়ো গিন্নি হিসাবে সবদিকে খেয়াল রাখার দ্বায় বলেও উনি মনে করেন।কাজের একফাঁকে নিভানের ঘরে উঁকি দিলেন তিনি।ঘর আপতত ফাঁকা,রুমে কেউ নেই।রুমে ঢুকলেন তিনি।শান্ত নীরব ঘরটা একপলক অবলোকন করলেন।
শৌখিনতা ছোঁয়ায় সবসময় পরিপাটি থাকা ঘরটা,আজ এলোমেলো অবস্থা।নিভান থাকাকালীন এ অবস্থা হওয়ার কথা নয়।তবে কাল রাতে তৃনয়সহ নিভানের কয়েকজন বন্ধু থাকায় রুমের এহেন এলোমেলো দশা।বুঝলেন নীহারিকা বেগম। ত্রস্ত হাতে গুছিয়ে দিলেন ঘরটা।ফের একপলক দেখলেন। দুপুরের পর এঘরে বউ আসবে উনার।এআশা কতো দিনের!সে আশা পূর্ণ হতে চলেছে।নিভান পূরণ করতে চলেছে।মনেমনে আনন্দ উপভোগ করলেন।ঘরটা গুছিয়ে যখন চলে যাবেন,বেলকনি থেকে নিভানের গলার আওয়াজ এলো।

‘মা,কিছু বলতে এসেছিলে?

চমকে বেলকনির দিকে চোখ গেলো নীহারিকা বেগমের।সহসা বললেন–তুই ওখানে।আমি এতোসময় তোর রুমে,দেখলি না?

দেখিনি নিভান।বেলকনিতে দাঁড়িয়ে লন এরিয়ায় নজর ছিলো তার।সেখানে হলুদ মেহেন্দি বিগত দুইদিনের আনুষ্ঠানিকতার সকল সাজসজ্জ নষ্ট করে,বিয়ে উপলক্ষে কাল রাত থেকে পুনরায় ইভেন্টের লোকজন সজ্জিত করেছে।কাজ সকাল সকাল কমপ্লিট হয়ে গেলেও তারা বিশেষ তদারকীতে তৎপর হয়ে আছে ।কোথাও কোনো কিছুর খামতি থেকে গেছে কি-না!বা ঘাটতি আছে কি-না।সৌন্দর্যবর্ধনে ঠিকঠাক লাগছে কি-না।নিভানও যেনো খেয়ালি নজরে সেটাই দেখছিলো।যদিও ওখানে খেয়াল রাখার বিশেষ দায়িত্বে মামারা আছেন।তবুও কিসব মনে করে দেখছিলো সে।
হঠাৎ রুমের মধ্যে শব্দ পাওয়ায়,মনেহলো রুমে কেউ এসেছে।মা’কে রুম থেকে বেট হতে দেখেই ততক্ষণাত প্রশ্নটা শুধালো সে।

‘আমি খেয়াল করিনি তুমি কখন এসেছো।

কথাগুলো বলতে বলতে রুমে ঢুকলো নিভান।মা’কে টেনে নিয়ে বসালে বেডে।ফের মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।মায়ের হাতটা নিয়ে রাখলো মাথায়।নীহারিকা বেগম তৎপর হলেন ছেলের ঘন চুলে আঙুল চালাতে।সময় নিয়ে বললেন।

‘আজ কয়েকদিন তো বেশ ঘুমের ঘাটতি যাচ্ছে।মাথা ধরেছে নিশ্চয়?

‘ওই একটু।

কিছুসময় নীরবে কেটে গেলো।নিরবতা কেটে নিভান শুধালো।-বললে নাতো,কিছু বলবে বলে কি এসেছিলে?

‘না।তেমন কিছু না।তুই কি করছিস।তাই দেখতে এলাম।সকালের খাবারটাও তো এখনো খেলিনা।তাই আর কি।

আবারও কিছু সময় নীরবতা চললো দু’পাশে। এবার নীহারিকা বেগম কথা পাড়লেন।বললেন–তোর দাদুমাকে তোর বিয়ের কথা জানাবি-না?তুই কিন্তু ওই বংশের বড়ছেলে এবং উনার বড় নাতী।যাই হয়ে যাক,সেই নাতীর বিয়েতে কিন্তু উনার থাকা উচিত।

‘ইনভাইটেশন কার্ড পাঠিয়ে দিয়েছি তো।সাথে দাদুমা আর ছোটো চাচ্চুর সাথেও কথা হয়েছে।দাদুমা অসুস্থ, ব্যথা বেদনায় বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছেন-না নাকি।ছোটো চাচ্চুও উনাকে ছেড়ে কাল আসতে পারেন-নি।আর এমনিতেই সবকিছুতো কেমন হঠাৎই হচ্ছে।তবে দাদুমা না আসলেও চাচ্চু বলেছেন,আজ বিয়েতে অবশ্যই আসবেন তিনি।

নীহারিকা বেগম ছেলের দায়িত্ববোধ দেখে খুশি হলেন।খুশিতে আপ্লুত হয়ে ছেলের কপালে চুমু-ও বসালেন।ফের আবেগে বলে বসলেন–তুই আমার খুব ভালো ছেলে।আমার গর্ভ সার্থক।আমি সত্যিই রত্নগর্ভা মা।

চোখ মেলে মায়ের ক্লান্ত মুখের দিকে তাকালো নিভান।খুশিতে ঝলমলে মুখটা দেখলো কিছুক্ষণ। ফের মায়ের মাথাটা হাত দিয়ে নিচু করে নিয়ে কপালে গাঢ় চুমু খেলো।মৃদুহেসে কেমন আদূরে কন্ঠে সে-ও জানালো।

‘তুমিও আমার সেই শান্তিময়ী মা।যার গর্ভে জন্ম নিয়ে আমিও সন্তান স্বার্থক।

নীহারিকা বেগম আবেগপ্রবণ হলেন।সেই আবেগের ঝরঝর বর্ষন ছেলের কপালে দীর্ঘ সময় ঠোঁট ছুয়ে ঝড়লেন তিনি।নিভানও চোখ বুঁজে কেমন নিশ্চুপ রইল সেই আদরে।

সকাল কেটে গিয়ে যখন দুপুর হতে লাগলো।সাজসাজ রবে চারিদকে হৈচৈ পড়ে গেলো।সকাল দশটা বাজতেই পাল্লারের কিছু মেয়েরা এসে হাজির বাড়িতে।সবকিছু ওই মানুষটার সিদ্ধান্ত মতো বাড়িতেই হচ্ছে।সময় যতো এগোতে লাগলো ভিতরের আবেগ অনুভূতির উৎকন্ঠা যেনো ততোই তীব্রহারে বাড়তে থাকলো।বুকের ভিতরের স্বাভাবিক থাকা সকল যন্ত্র আজ অনিয়ন্ত্রিত।সবকিছুর অস্বাভাবিকতা,উৎকন্ঠা সেকেন্ডে সেকেন্ডে টের পাচ্ছে কৌড়ি।সমুদ্রের উত্তাল ঝড় বয়ে চলেছে যেনো ভিতরে।সকাল থেকেই আজ বিয়ের দিন কথাটা যতবার শুনছে,ততোবার সেই ঝড়ের প্রখরতা যেনো ভিতরে ভিতরে বেড়েই চলেছে।সেই অস্বাভাবিক প্রখরতা চৌগুন হারে গিয়ে টের পেল, যখন পার্লার থেকে আগত দুজন মেয়ে তাকে সাজাতে বসালো।মান্যতার রুমে দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়ে এ-সি ছেড়ে মেয়েদুটো আধাঘন্টা আগেই তাকে সাজাতে বসেছে।রুমে পার্লারের দুটো মেয়ে আর সে বাদে আপতত কেউ নেই।সাধারণ সাজ দিতে বলা হয়েছে।অতিরঞ্জিত কোনো কিছু নয়।সেভাবেই সাজানো হচ্ছে।

গাঢ় লাল রঙের শাড়ীটাতে সোনালী জরির কাজ।এতো ভারী কাজ,শাড়ীর লাল অংশবিশেষগুলো খুব কম নজরে পড়ছে। বোঝা যাচ্ছে।মনেহচ্ছে লাল নয়,সোনার সুতোয় গাঁথা কারুকার্যের বুননে শাড়ীটা।সাথে কনুই পর্যন্ত একই বুননে ডিজাইনার ম্যাচিং ব্লাউজ। হয়তো দামী শাড়ীর সাথে এরূপ ম্যাচিং ব্লাউজ থাকাটা শোভনীয়।সেই ভারী শাড়ীটা সুনিপুণ সুদক্ষ হাতে পাল্লারের সুন্দরী এক রমীনি তাকে পরিয়ে দিয়েছে।ব্লাউজ পেটিকোট আগেই পরা ছিলো।শাড়ীটা পরিয়ে মেয়েটা যেনো হাফ ছাড়লো।কৌড়িরও মনেহলো সুদক্ষ হাত হলেও শাড়িটা পরাতে মেয়েটাকে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে।তবে শাড়ী পরানো শেষে মেয়েটা কৌড়ির দিকে তাকিয়ে কেমন মুগ্ধ গলায় বললো।–মাশা-আল্লাহ।যে আপনাকে পছন্দ করে স্যারের সাথে বিয়ে দিচ্ছেন, তার পছন্দও যেমন অতুলনীয়।যে এই শাড়ীটা পছন্দ করে কিনেছে।মাশাআল্লাহ।উনার পছন্দ এবং রুচিশীলতা প্রসংশাযোগ্য।

পাশে এসিস্ট করা মেয়েটাও কেমন হাস্যজ্বল মুগ্ধ বদনে সেকথার সায় জানালো।সামনে আয়না।মেয়েটার কথার জৌলুশে আপ্লুত হয়ে,একরাশ লজ্জা সীমাহীন উৎকন্ঠা নিয়েও দেখলো নিজেকে।আজ তিনদিন ভিন্ন রঙায় একটানা শাড়ী পড়ছে সে।আগের দুদিনও নিজেকে দেখে কেমন অন্যরকম মনে হয়েছিলো। একটা আলাদা মানুষ।আলাদা রূপ সৌন্দর্য।আজও তাই।কেমন যেনো অন্যরকম। নিজেকে চেনা দ্বায়।অথচ এখনো মেকাপের প্রলেপে সাজানো হয়নি তাকে।গহনার বড়বড় বক্সগুলো ড্রেসিং টেবিলের উপরে থাকেথাকে রাখা।সবকিছু ওই মানুষটার পছন্দে কেনা।সে-ও তো ওই মানুষটার একান্ত পছন্দ।শিহরণ দিয়ে উঠলো শরীর।একেএকে ছুঁয়ে যাবে, ওই মানুষটার পছন্দনীয় সবকিছু তাকে।রন্ধ্রে রন্ধ্রে কেমন শীতল স্রোতের প্রবাহ ছুটে চললো।সেই শীতলতায় কাটা দিয়ে উঠলো হাত পায়ের প্রত্যকটা লোমকূপ। হঠাৎ নজর গেলো টেবিলের উপরে রাখা নিজের ফোনটায়।কালকের বিকালের পর মানুষটা কেমন নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলো। না মানুষটার দেখা পেয়েছে আর না কথা হয়েছে তাদের।কাল মানুষটার কথাবার্তাগুলোও কেমন যেনো অদ্ভুত অদ্ভুত লেগেছে কৌড়ির কাছে,সাথে মানুষটাকেও।কি হয়েছে যানেনা কৌড়ি।কৌতূহল হলো জানার।তবে তার থেকেও বেশি মন আনচান করলো,ইচ্ছে জাগলো ওই মানুষটার সাথে একটু কথা বলার।কেনো জানেনা খুব ইচ্ছে জাগলো।ফোনটা হাতে নিলো কৌড়ি।আশেপাশে কে আছে,আর কাকে সে ফোন দিচ্ছে, এই সংকোচবোধ করলোনা। দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই কল দিলো কাঙ্ক্ষিত নম্বরে।খুব বেশি সময় নিলোনা ওপাশ থেকে কলটা তুলতে।দু’বার রিং হতেই ওপাশ থেকে ফোনটা তুললো সে।চমৎকার মিষ্টি গলায় শুধালো।

‘কি হয়েছে কৌড়ি?এ্যানি প্রবলেম?

খুব স্বাভাবিক গলা।তবুও ধকধক করে বাড়লো হৃদযন্ত্রের গতিবেগ।ভিতরে তার তান্ডব চলতে থাকলেও উত্তর দিতে ভুললোনা কৌড়ি।সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলো–উহুম।

নীরবতা চললো দু’পাশে। নিভান কি বুঝলো না বুঝলো সেই ছোটো উত্তরে।তবে আর প্রশ্ন করলো-না।অমায়িক মিষ্টি কন্ঠে জানালো—আমিও তো তোমার মতো রেডি হচ্ছি।তবে নো প্রবলেম,আমি লাইনে আছি।তুমি কানে ইয়ারফোন গুঁজে নিয়ে লাইনে থেকেই রেডি হও।হুমম?

‘হুমম।থ্যাঙ্কিউ।

কি আদুরে মিষ্টি সেই শব্দগুলোর স্বর।নিভান বিগলিত হলো।কন্ঠের ভাজে আরও নমনীয়তা ঢেলে ফের শুধালো–‘হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কল দেই?

‘নাহ।

‘আচ্ছা ঠিক আছে।রেডি হও তবে।আমি লাইনে আছি।

কৌড়ির কথা বলাতে পার্লারের মেয়েদুটোকে বিশেষ একটা আগ্রহবোধ হতে দেখালোনা।হবু বরের সাথে কথা বলা এযেনো এখন প্রচলন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাতে আবার বড়বড় ঐতিহ্যবাহী বিত্তশালী পরিবারের বিষশগুলোতো আলাদাই।কৌড়িকে কথা বলতে দেখে তন্মধ্যে পার্লারের মেয়েটা তাকে চেয়ারে বসতে ঈশারা করলো।ফের কথা কানটিনিউ করে যেতে বললো।কৌড়িও তাই করলো।ইয়ারফোন খুঁজে কানে লাগিয়ে বসেও পড়লো।অদ্ভুত টান তৈরী হতে শুরু করেছে মানুষটার উপর তার।সেখানে দ্বিধা সংকোচ রাখছেনা মন।লজ্জাগুলোও কেমন ভুলিয়ে দিচ্ছে।পুরো দু’ঘন্টা ধরে সাজালো পার্লারের মেয়েটা।দীঘল কালো চুলগুলো বাঁধতে গিয়ে তার সময় লেগেছে বেশি।শাড়ী পরানোর থেকেও তাকে ঝামেলা পোহাতে হয়েছে চুলে।তবে শাড়ী পরা থেকে শুরু করে প্রত্যহ সাজে, চুল বাধায়,গহনা পরায়, মেয়েটা প্রশংসা করে গেছে তার।আর ওপাশের মানুষটাও সেই প্রশংসা শুনেছে নিশ্চুপে।এই দু’ঘন্টায় ভুলেও ফোন কাটেননি তিনি।তবে বিশেষ কথাও হয়েছে তাদের, তেমনটাও নয়।তবে কেমন যেনো ফোন কাটতে ইচ্ছে হয়নি কৌড়ির।এমন পাগলামো কখনও করবে সে,আশা করেনি।তবে পাগলামোতে তীব্র প্রশ্রয় পেয়ে,নিজেও কেমন অটল ছিলো।নিভান নামক সুতোর টানটা যে তাকে বেশ মায়াময় টানে আঁকড়প নিয়েছে,এটাও বেশ উপলব্ধি করে ফেলেছে।

আজ শুক্রবার।বিয়ে বাদেও জুমা’র দিন হওয়ায়,সব ছেলেগুলো সকাল সকাল রেডি হয়ে নিয়েছে।জুমা’র নামাজ বাদেই বিয়ে পড়ানো হবে।গোসল সেরে নিজ নিজ সাজে প্রস্তুত সবাই।নিভানের রুমে এতোসময় সে একা একা রেডি হলেও এবার সেখানে হাজির হলো তৃনয় আর ইভান।সাদার উপরে গোল্ডেন কারুকার্য শোভিত শেরওয়ানি আর পাজামাতে সত্যিই বর বর লাগছে তাকে।শ্যামগায়ে মানিয়েছেও মাশাআল্লাহ।সবসময়ের মতো চুলগুলো জেন্টেলম্যানস লুকের মতো পরিপাটি।বিয়ে উপলক্ষে চুলে কাট দেওয়া হয়েছে।তাই আজ যেনো আরও পরিপাটি দেখাচ্ছে।খুব সাধারণ লুক।তবুও অসাধারণ সুদর্শন দেখাচ্ছে। ভাইকে দেখেই ইভান কেমন উচ্ছল গলায় বলে উঠলো—মাশা আল্লাহ।নজর না লাগযায়ে আমার ভ্রাতাশ্রীকে।

নিভান বিশেষ পাত্তা দিলো-না ইভানের কথায়।ইভান এসে দাঁড়ালো নিভানের সামনে।বললো– শেরওয়ানির সাথে সৌন্দর্যবর্ধনের গলার সেই হারটা, পরেছো কই?
আর শেরওয়ানিতে জড়ানো ওড়ানটাওতো গলায় জড়ালে না।

নিভান তখন আয়নার সামনে,নিজেকে ঠিকঠাক লাগছে কি-না দেখে নিতে ব্যস্ত। ইভান কথাটা বলতেই, স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো–এই,আমি পুরুষ!মেয়েলোক নই যে, গলায় ভারী হার ঝুলাবো।ড্রেসের সাথে ম্যাচিং করে গায়ে ওড়নাও জড়াবো।ওসব চলবে-না।আমি এভাবেই কমফোর্টেবল।দ্যাটস এনাফ।

‘ওটা শুধু বিয়ে উপলক্ষ সৌন্দর্যবোধনে পরা হয়। সবসময় পরছো এমনতো নয়।তবে একটাদিনে সমস্যা কোথায়?

‘একদিন হোক বা রোজ।সমস্যা আমার রুচিতে।আমার সৌন্দর্যবর্ধনের দরকার নেই।আমি এভাবেই ঠিক আছি।

‘ওকে।বলে ইভান অলস ভঙ্গিতে বসে পড়লো বেডে।এবার ইভানের সুরে সুর মিলিয়ে তৃনয় বললো—সব নাহয় ঠিক আছে।তবে মাথায় পাগড়িটা পর।নাহলে বর আর আমাদের মধ্যে পার্থক্য থাকলো কোথায়?কেমন একই রকম দেখতে সাজপোশাক লাগছে না!

‘তাতে আামাকে আমার বাউয়ের চিনে নিতে বিন্দুমাত্র আসুবিধা হবেনা,চল।আর নামাজটা তো আর পাগড়ি মাথায় দিয়ে হবে-না।টুপিতেই নামাজ সারতে হবে।সুতারং বিয়েটাও টুপিতেই সেরে নেবো।চল,চল।

তাড়া দিলো নিভান।এই ছেলেকে নিয়ে আর পারা গেলো না!বিড়বিড় করে বকে তৃনয়ও অলস ভঙ্গিতে বসে পড়লো ইভানের পাশে।ইভান এবার শুয়ে পড়লো।
অদ্ভুত নজরে দেখছে সে নিভানকে।দামী একসেট পাঞ্জাবি পাজামা।যদিও চুলের কাটসার্ট দিয়ে আজও মানুষটাকে হ্যান্ডসাম লাগছে।তবুও সেই জাঁকজমকপূর্ণ বর বর লাগছেনা।তবুও এভাবেই নাকি বিয়ে করতে যাবে!ধ্যাত।মানুষটা যে কি!ইভান তৃনয়কে লক্ষ্য করে নিভান বললো—আরেহ শুয়ে পড়লি কেনো ইভান?
নামাজের সময় চলে যাবেতো,চল।আলরেডি ১২.৪৫ অভার হয়ে গেছে।তৃনয়,তুই আবার বসলি কেনো?

তৃনয় কিছু বললোনা।ইভান বললো–ভাবছি।

নিভান এবার বিরক্ত হলো।বিরক্ত নিয়ে শুধালো।–কি ভাবছিস?

‘তোমার বিয়ে নাকি মুখভাতের অনুষ্ঠান।

নিভানের আরও বিরক্ত হওয়ার কথা।সেখানে ইভানের কথায় অমায়িক হাসলো সে।ফের নিজেকে আরও একবার দেখে নিয়ে পিছে মুড়ে ইভান আর তৃনয় দুজনকে উদ্দেশ্য করে বললো–‘মুখে ভাতের অনুষ্ঠান ।তোরাও খেতে চাইলে আয়।আমি যাচ্ছি।

চলে গেলো নিভান।ইভান ডাকলো তবুও পিছে ফিরলো না।তৃনয় ডাকলো তবুও ফিরলোনা।হতাশ হলো দুজনে।ফের একই শব্দে বিড়বিড়ালো দুজনে–এ কেমন বর!যার লোকশরম,লাজলজ্জা কিচ্ছু নেই।যেখানে ভাইবন্ধুরা হাত ধরে তাকে বিয়ের আসরে নিয়ে যাবে,আর সে লজ্জায় ঠিহরে মাথা নিচু করে ভাইবন্ধুর হাত চেপে ধরে থাকবে।তা না,ভাইবন্ধু রেখেই একা একা বিয়ে করতে চলে গেলো।আশ্চর্য ছেলে!


বাড়ির পাশেই জামেমসজিদ।বাড়ির ছোটো বড় সকল পুরুষ নামাজ আদায়ের লক্ষ্যে মসজিদে আগ্রসর হওয়ার প্রস্তুতি নিলো।সবাই একইসাথে যাবে।নিজের ঘর থেকে বের হয়ে নিভান সোজাা মায়ের ঘরে ঢুকলো।সেখানে নীহারিকা বেগম জাহিদ সাহেবকে প্রস্তুতি করাচ্ছিলেন।সাদা পাঞ্জাবি পাজামা পরিয়ে তাকে হুইলচেয়ার বসিয়ে গায়ে আতর লাগিয়ে দিচ্ছিলেন।
এমন সময় দরজায় টোকা পড়তেই জাহিদ সাহেব থেকে নিজেকে সরিয়ে আসার অনুমতি দিলেন।অনুমতি পেতেই নিভান ভিতরে ঢুকলো।মুগ্ধ নজরে নীহারিকা বেগম ছেলেকে দেখে গেলেন।তবে মুখে কিছু বললেননা।জাহিদ সাহেব কথা বাড়ালেন।

‘তুমি আসতে গেলে কেনো?আমিই তো আসছিলাম।

নিভান মৃদু হাসলো।সহসা উনার দিকে এগিয়ে একহাঁটু গেড়ে উনার সম্মুখে বসলো।উনার কোলের মধ্যে রাখা হাতটা উপর নিজের হাতটা কোমল স্পর্শে রাখলো।সেই স্পর্শে জাহিদ সাহেবের পুরুষ চওড়া হাতটা মৃদু কেপে উঠলো।এই স্পর্শের মালিকের প্রতি উনার ভিষণ মায়া, স্নেহ,দরদ,আবেগ।পোষা পাখি যে!লোকে বলে পোষা জিনিসের প্রতি আপন জিনিসের থেকে মায়া বেশি,দরদ বেশি।জাহিদ সাহেবের ভাবনার মধ্যে নিভান নম্র কন্ঠে শুধালো।

‘আপনি আমার এহেন সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট নন-তো?যদিও আজ বিয়ের দিন এমন প্রশ্ন বেমানান।

অবাক হলেন জাহিদ সাহেব।গলার স্বরেও তেমন অবাকতা ঢেলে শুধালেন–অসন্তুষ্ট কেনো হবো?

‘আপনি সবসময় আমার সকল সিদ্ধান্তকে প্রায়োরিটি দিয়ে এসেছেন।আমার জীবনে এমন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আপনার সিদ্ধান্ত জানতে চাইলাম না এজন্য?

অমায়িক হাসলেন জাহিদ।বয়স বাড়লেও সুদর্শন চেহারার জৌলুশতা এখনো কমেনি।বরং কাঁচাপাকা চাপদাড়িতে বেশ দেখায়।সেই মুখে হাসিটা যেনো আরও মুক্তোঝরায়।বাবার মুখের হাসিটাও তাকে বেশ আনন্দ দিতো।এরকম ঝলমলে ছিলো।নিভান সে মুখের দিকে চেয়ে রইলো নিষ্পলক। জাহিদ সাহেব নিজের হাতটা নিভানের হাতের নিচ থেকে টেনে নিয়ে, সেটা আবার ভারসাপূর্ন স্পর্শ নিভানের হাতের উপর রাখল।ফের অমায়িকতা কন্ঠে বললেন।

‘তুমিতো নিজের সিদ্ধান্ত জারী করার আগেই কৌড়িকে আমার কাছে চেয়েছিলে।তবে অসন্তুষ্ট হবো কেনো?আমি তখনই ভিষন খুশি হয়েছিলাম,যখন তুমি কৌড়িকে নিজের জন্য এবাড়িতে রাখতে চাইলে।ওই মেয়েটার বাবার কাছে আমি ঋনী।অসময়ের দূর্লভ বন্ধু আমার সে।আমি সেই মানুষটার কৃতজ্ঞতা, ঋন কখনো চোকাতে পারবো-না।তাই চেয়েছিলাম মেয়েটা যখন আমার ঋন শোধ করার কিছুটা সুযোগ দিয়েছে।তবে কৌড়ির সুখসমৃদ্ধি নিজ হাতে গুছিয়ে দেবো।তুমি আমার দায়িত্ববান বাচ্চা।আর সেই দায়িত্ববান সন্তানের অধিনে ওকে নিজের কাছে যখন রাখতে পারছি।এরচেয়ে ভালো সুখসমৃদ্ধি ওরজন্য আর কি হয়।আর দ্বিতীয়ত আমি কখনোই তোমার সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট হই-না।সিদ্ধান্ত ঠিকঠাক মনে না-হলেও,প্রশ্ন থাকে অন্তরে।তবে তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট কখনো হই-না।তুমি আমার প্রথম সন্তান।সেটা তুমি মানো আর না মানো।আমি মানি।মেনে এসেছি বরাবর। আর এটাও মনেপ্রাণে মানি, তুমি আমার দায়িত্ববান খুব ভালো বাচ্চা।বুঝদার বাচ্চা।তাই তুমি কখনো উল্টো পাল্টা সিদ্ধান্ত নেবে বা নিতে পারো বা ভুলভাল কাজ করবে?এটা আমি মানিনা।আমার মন মানেনা।আর সেই সিদ্ধান্তে আমি অসন্তুষ্ট হবো!এমন দিন কখনো না আসুক।এমন দিনটা আল্লাহ যেনো আমাকে না দেখান।তার আগেই মৃত্যু যেনো আমার দুয়ারে…

নিভান কথা শেষ করতে দিলো-না।তার আগেই হাত চেপে ধরলো উনার।সেই হাতটা নিজের মাথায় রেখে বললো—আপনি যেমন বাবা হয়ে আপনার সন্তানের অমঙ্গল কখনো আশংঙ্কা করেননা, চান-না।তেমন সেই সন্তানটাও তার বাবার মুখে এমন অমঙ্গলের কথা শুনতে চায়না।আশংঙ্কাও করেনা।মৃত্যু অপ্রিয় সত্যি।প্রতিটি প্রানীকে মৃত্যুর সম্মুখীন হতেই হবে।তবুও,আশংঙ্কা করেনা, শুনতে চায়না।আপনার কাছে একটাই চাওয়া পাওয়া আমার সবসময়।আপনার বড়ো সন্তান হিসাবে,আপনার দেওয়া দায়িত্ব কর্তব্যগুলো যেনো আমি নিষ্ঠার সাথে সর্বদাই পালন করে যেতে পারি।রবের কাছে আমার জন্য সবসময় সেই প্রার্থনাই করবেন।করে যাবেন।

‘আমার সকল প্রার্থনায় আমার সন্তানেরা।তোমরা।তোমাদের ভালোমন্দ প্রার্থনায় তো,বাবা হিসাবে আমার সর্বদা কাম্য।আমি সেই প্রার্থনাই সর্বদা উতালা হয়ে থাকি।আলাদা করে আমার সন্তানদের চাইতে হবেনা, এই বাবার দোয়া।আর তুমি।তুমি বাচ্চাটা আমার জীবনে কি?সেটা তুমি বুঝবে না নিভান।তবে বাবা হও, কিছুটা হলেও অনুধাবন করতে পারবে।নিজের প্রথম সন্তান।সেটা রক্তের সম্পর্কিত হোক বা আত্মার।আর যেমনই হোক।তার প্রতি বাবা মায়ের ভালোবাসা, মায়া, টান, ঠিক কেমন হয়।সেটা বাবা না হওয়া অব্দি বুঝবে-না।উপলব্ধি করতে পারবে না।

শক্তপোক্ত মানুষটা হঠাৎই কেমন আবেগপ্রবণ হলেন।নিভানের গালে হাত ছোঁয়ালেন। ফের বললেন–আমি জানি, তুমি তোমার বাবাকে প্রচন্ড ভালোবাসতে।সেই বাবার ভালোবাসা ছাপিয়ে,তাকে হারিয়ে দ্বিতীয় আর কাওকে বাবা বলা তোমার ছোটো মন সায় দেয়নি।তবুও তোমার বাবা না ডাকটা আমাকে ক্ষুন্ন করে,কষ্ট দেয়।ব্যর্থতা জানান দেয়।মনেহয় আমি তোমার প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারিনি।সত্যিই তো পারিনি।স্বার্থান্বেষীদের মতো তোমার ইচ্ছে আকাঙ্ক্ষা বিসর্জিত করে,আমার দায়িত্ব কর্তব্য সব তোমার উপর চাপিয়ে দিয়েছি।পারি-নি সন্তানের যথাযথ হক দিতে।সেখান থেকে ভাবলে মনেহয়,তুমি বাবা ডাকো-না।ভালোই করেছো।নাহলে এই ডাকটার ঋন তো থেকেই যেতো আমার।ডাকটার যথাযথ মূল্যায়ন না দিতে পারায় অপরাধবোধ নিয়েই বাঁচতে মরতে হতো আমাকে।

নিভান নিশ্চুপ শুনলো কথা।একটাও শব্দও উচ্চারণ করল না।যেনো উনার ভিতরে জমা নিজস্ব কথা নিজস্ব ব্যথাগুলো বের করে আনতে চাইলো।তাতে যদি মনে শান্তি মেলে।নীহারিকা বেগম তখন বাবা ছেলে থেকে অদুরে দাড়িয়ে দাঁতে দাত চেপে কান্না আঁটকে চলেছেন।নিভান,হুইলচেয়ারটা টেনে আরও ঘনিষ্ঠ হলো উনার সাথে।নিজের গালে ছোঁয়ানো হাতটা নিয়ে বুকে চেপে ধরলো।ফের নিজের শক্তপোক্ত খোলাসাটা ছেড়ে কেমন বাচ্চামো অবুঝ স্বরে বলতে থাকলো।

‘বাবাকে আমি খুব ভালোবাসতাম।এতো ভালোবাসতাম অতোটুকু বয়সে বাবাকে হারিয়ে বুঝতে পারলাম,আমার আর বাবার মতো ভালোবাসার মানুষ রইলো-না।মা’কে জিজ্ঞেস করুন,বাবা আমাকে মায়ের চেয়ে ভালোবাসতেন কিনা?সেই বাবার জায়গায় কিছুতেই মন থেকে অন্য কাওকে মেনে নিতে পারিনি।আমার বাচ্চা মন মেনে নেয়নি।বাবা ছাড়া বাবা ডাকটাও কাওকে ডাকা আমার ওই ছোট্টো মনটাও কেনো জানি সায় দেয়নি।দিতে চাইনি।আর যখন মনে সায় দিলো,তখন নিজের মধ্যে দ্বিধা কাজ করলো।বাবার মতো আদর যত্ন পাওয়া মানুষটাকে কিছুতেই আমার আর বাবা ডাকা হয়ে উঠলো-না।মন চাইলো অথচ মস্তিষ্কের বশিভূত আমি হতে পারলাম না।তবে
আপনাকে-ও আমি ভিষন ভালোবাসি।হয়তো বাবা ডাকটা ডেকে সেই ভালোবাসাটা জাহির করা হয়নি কখনো।তবুও প্রচন্ড ভালোবাসি।আমার জন্য আপনার অপরাধবোধ,ব্যথিত ধারনা ভুল।আপনি স্বার্থান্বেষী মানুষ নন।আর স্বার্থান্বেষী বাবাতো কখনো নন।আপনি খুব ভালো একজন বাবা।যে তার সন্তানদের বরাবর সমান প্রায়োরিটি দিয়ে এসেছে।তাদের হক সমানভাবে যথাযথ পালন করার চেষ্টা করেছে।আর কে বলেছে,আপনি বাবা হিসাবে আমার যথাযথ দায়িত্ব পালন করেননি?করতে পারেননি?করেছেন।একজন বাবা হিসাবে যতোট দরকার ততোটাই করেছেন।বড়ো সন্তান হিসাবে আমার প্রতি হয়তো একটু বেশিই করেছেন।ইভান ভুল বলে-না।আপনার,মায়ের মনথেকে নজরে লাগা ভালোবাসাটতো আমিও অনুভব করি।

হাসলা নিভান।ফের বলতে থাকলো–আর আমার স্বপ্ন ইচ্ছে বিসর্জন দিয়ে, আপনার দায়িত্ব কর্তব্য কাঁধে নেওয়ার ব্যাপারটাকে আপনি আপনার স্বার্থপরতা ভেবে ব্যথিত হচ্ছেন?কেনো?সেই দায়িত্ব কর্তব্য তো পালন করতেই হতো আমাকে।বাবার অসুস্থতার অবর্তমানে বাড়ির বড় সন্তানের কাঁধে এসে,বাবার বর্তিত দায়িত্ব কর্তব্য তো পড়বেই।আর বাবা মা,ভাই বোনদের প্রতি সেই দায়িত্ব কর্তব্য পালনে কখনোই আমার অনিহা ছিলোনা।সেখানে স্বপ্ন ইচ্ছেতো বিসর্জন দিতেই হতো।তাওতো আপনি চেষ্টা কম করেননি,সেই স্বপ্নের পথে আমাকে এগিয়ে দিতে।আমি দায়িত্ব ছেড়ে এগোতে চায়নি।এখানে আপনার দোষ কোথায়?আপনার দোষ নেই তো।দোষী যদি হতে হয়,দু’জনেই।

এবার গাল ভরে হাসলো নিভান।ফের চমৎকার কন্ঠে বললো—-দোষী তো আমরাই দুজনে তাইনা?

হাসলেন জাহিদ সাহেবও।ভিতরটা যেনো নিভানের কথার যুক্তিতর্কে জুড়িয়ে গেলো উনার।নিভানের বুক থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে দুহাতের কুটুরিতে তার মুখটা চেপে ধরলেন।পিতৃমন শিহরন দিয়ে উঠলো।ফের মুখটা টেনে নিয়ে স্নেহপূর্ণ চুমু বসালেন নিভানের চওড়া কপালে।নীহারিকা বেগম আর দূরে দাড়িয়ে থাকতে পারলেন না।দুজনের পাশে এসে দাড়ালেন।একটু মুড়ে নিজেও নিভানের মাথায় আদর ছুঁয়ে দিলেন।ফের সরে গিয়ে চুপ করে দাঁড়ালেন।জাহিদ সাহেব কপাল থেকে ঠোঁট সরিয়ে নিভানের মুখের দিকে মায়াময় নজরে তাকিয়ে কন্ঠে মাধুর্যতা ঢেলে বললেন—খুব সুখি হও।

বিনিময় নিভান শুধু অমায়িক হাসলো।জাহিদ সাহেব কিছু একটা ভেবে নিভানকে ডেকে উঠলেন–নিভান।

‘বলুন।

‘আমি জানি কৌড়িকে তুমি খুব ভালো রাখবে।সেই ভরসা বিশ্বাস অগাধ তোমার প্রতি আমার।তবু-ও ওর বাবার হয়ে দায়িত্ব পালনের খাতিরে বলছি ,মেয়েটাকে ভালো রেখো নিভান।তোমার সর্বোচ্চ চেষ্টা রেখো, মেয়েটাকে খুব ভালো রাখতে।

মাথা উপর নিচ নাড়িয়ে সম্মতি জানালো নিভান।ফের জাহিদ সাহেবের মাথায় টুপি পরিয়ে মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে মসজিদে নামাজ অগ্রসর হলো।নিচে হৈ-হুল্লোড় পড়ে গেছে নমাজে যাবার। সবার গলার স্বর ছাড়িয়ে নাফিম আর ঈশিতা আপুর ছেলের অধৈর্য্যেময় কন্ঠের বার্তা শোনা গেল।–কখন যাবো আমরা নামাযে, আর কখন হবে বিয়ে!

বিশাল বড় লন এরিয়ারটা ইভেন্টের কর্মীরা সাজিয়েছে বেশ চমৎকার আভিজাত্যপূর্ন নজর ধাঁধানোরূপে।সম্পূর্ণ ফুলদিয়ে চমৎকার প্রদর্শনীর স্টেজটা বেশ নজর কাড়ছে।আর্টিফিশিয়াল দুধেসাধা আর গাঢ় লালফুলের কম্বিনেশনে সাজানো হয়েছে পুরো স্টেজের চারপাশটা।রঙিন কাপড় দিয়ে স্টেজের ছাঁদের সৌন্দর্যবর্ধনে,ফুলের বিশাল বিশাল ঝাড়বাতি বানিয়ে ঝুলানো হয়েছে।সামনের পুরো এরিয়াজুড়ে সৌখিনতার ছোঁয়ায় সাজানো গুছানো চেয়ার টেবিল।সেখানে আমন্ত্রণিত মানুষের ঢল।আপতত সবাই এখন স্টেজে নিশ্চুপ কাজীর মুখে পাঠকরা বানিগুলো শুনে যাচ্ছে।

স্টেজের প্রস্থ মাঝ বরাবর সটান বেলিফুলের শতশত মালার ঝুলানো গাঁথুনি দিয়ে পর্দা তৈরি করা হয়েছে।ফুলের ঘনত্ব এতো বেশি যে,এপাশ ওপাশের মানুষগুলোকে অনুভব করা ছাড়া কাউকে দেখা যাচ্ছেনা।যার একপাশে বসে আছে ছেলেরা অন্যপাশে মেয়েরা।নিস্তব্ধ, নীরব পরিবেশ।শুধু কাজীর মুখের নিটোল,সচ্চবানিগুলো ছাড়া কোথাও কোনো টু-শব্দটি নেই।অথচ কৌড়ি স্পষ্ট টের পাচ্ছ,তার ধকধক করে তড়পানো হৃদস্পন্দনের গতিবেগ।তার মনে হচ্ছে আশেপাশে মানুষগুলোও এই শব্দের স্পষ্টতা শুনতে পাচ্ছে।এই শব্দের সুচনাতো অনেক আগেই শুরু হয়েছে।তবে একধারে চলছে,তাকে স্টেজে আনার আগমুহূর্ত থেকে।রাজকীয় ভাবে তাকে স্টেজে আনা হয়েছে।কি হৈ-হুল্লোড়ের।মিষ্টি সম্মোধন,অভ্যর্থনা জানিয়ে তাকে স্টেজ পর্যন্ত আনা হলো।অদ্ভুত ফিল হয়েছে তার।আর এখন আর-ও অদ্ভুত অনুভব হচ্ছে।হাত পায়ের হীমভাবটা যেনো প্রকট হচ্ছে।শ্বাসপ্রশ্বাসের তাল হারিয়ে যাচ্ছে।ভাবনাগুলো কেমন খেই হারাচ্ছে।
আর এলোমেলো অনুভূতি আর ভাবনার মাঝে যখন স্পষ্ট পরিচিত কন্ঠের কবুল বার্তা শুনলো।সব অনুভূতির দুয়ার ঢ়েনো খিঁচে বন্ধ হয়ে গেলো।মুখ উঁচু করে তার সামনাসামনি বসা মানুষটার দিকে চেয়ে পড়লো।অথচ মানুষটাকে নয় নজরে পড়লো বেলিফুলের আচ্ছাদিত দেয়ালটা।অথচ নিষ্পলক চোখে চেয়ে রইলো কৌরি।ফের কাজীর প্রতিটা বার্তা সমর্থন করে যখন আরও দুবার কবুল বললো।কৌড়ির তো হুঁশই উড়ে গেলো।হাত পায়ে হিম-ভাবের সাথেসাথে মৃদু কম্পনও শুরু হলো।সেই মৃদু কম্পন তীব্র হলো যখন একত্রে ওপাশের সবাই আলহামদুলিল্লাহ বাক্য বারবার আওড়াতে থাকলো।

কাজীসাহেব সময় নিয়ে ফের আবারও একই বানী আওড়াতে থাকলেন।মুখস্থ বানিগুলো একের এক শব্দ তুলে চঞ্চল স্বরে আওড়ে চললেন।তবে কি এবার তার পালা?হুঁশ ফিরলো কৌড়ির।তবে হাতে পায়ের শীতলভাব,কাঁপুনি বিন্দুমাত্রও কমলো-না।বরং বেড়েই গেলো।দুপাশে বসা ঈশিতা মান্যতা স্পষ্ট টের পেলো।তড়িৎ কৌড়ির হাতটা চেপে ধরে হাতের মুঠোয় নিলো ঈশিতা।মৃদু হেসে চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করলো।অপরপাশ থেকে মান্যতা আলতো স্পর্শে জড়িয়ে নিলো তাকে।তাতে কি কমলো তীব্রবেগে চলা হৃদযন্ত্রের উর্ধ্ব গতিবেগের শব্দ?কমলো কি হাতে পায়ের কাঁপুনি?শিরদাঁড়া বেয়ে চলা হিমশৈল ভাব?নাহ আরও তারা অস্থির করে তুললো কৌড়িকে।সেই অস্থিরভাব বাড়িয়ে দিয়ে ওপাশ থেকে কাজীসাহেব তার বানী শেষ করে মুখ্য শব্দে এসে থামলো।

‘বলুন মা,কুবল।

কৌড়ির সব আবেগ অনুভূতি এবার যেনো নিস্তব্ধ,শান্ত, নির্বাক হয়ে পড়লো।মূহুর্তেই গলা শুকিয়ে এলো।এবার অদ্ভুত অনুভতিতে বুকে খিল ধরে গেলো।কিসব হচ্ছে এসব!উফফ!স্বাভাবিক নিঃশ্বাস নিতে-ও যেনো বুকে বিঁধে এলো।তিনটে বর্নের একটা বাক্য আওড়াতে তাকে এমন অস্বাভাবিক করে কেনো তুলছে!অথচ ওপাশে একটা মানুষ ঠায় মাথা নিচু করে অপেক্ষা করে আছে, প্রিয় রমণীর মুখ থেকে কাঙ্ক্ষিত বর্নগুলো শোনার।কি অধীর অবর্ননীয় অপেক্ষা!তবে সে অপেক্ষায় তাড়াহুড়ো নেই।তার মনে হচ্ছে, যতো দেরী হয় হোক।যতো সময় নেয় নিক কৌড়ি,তবুও তিনবর্নের ওই শব্দটা বলা চাই।নিভানের হওয়া চাই তাকে।তবে নিভানের মতো ধৈর্য্য নিয়ে কাজী সাহেব বসে থাকতে পারলেন না।তিনি ফের মেলায়েম কন্ঠে বার্তা জানালেন।–বলুন মা,কবুল।

এবার ঈশিতা কৌড়ির হাত মৃদু ঝাঁকুনি দিলো।যার অর্থ কবুল বলে দাও।চোখ দিয়েও ঈশারা করলো।মান্যতাও অন্যপাশ দিয়ে মৃদুস্বরে বললো–কবুল বলে দাও কৌড়ি।

কাছাকাছি বসা বিথীসহ একেএকে ফিসফিসিয়ে সবাই বলতে থাকলো একই কথা।অথচ কৌড়ির শ্বাস কেমন রুদ্ধ হয়ে আসছে।সেই রুদ্ধশ্বাস গলায় আশেপাশে একবার তাকিয়ে মাথানিচু করে মৃদুস্বরে বলে দিলে কাঙ্ক্ষিত শব্দটা–কবুল।

কাজীসাহেব ফের বলতে বললেন।বলুন,আলহামদুলিল্লাহ তাকে আমি কবুল করিলাম।

আবারও রুদ্ধশ্বাস নিয়ে ফের কাজী সাহেবের বলা একই বানী দু’বার আওড়ালো।হয়ে গেলো সে একান্ত ওই মানুষটার।ওপাশ এপাশ সব পাশ থেকেই আলহামদুলিল্লাহ বার্তায় মুখোরিত হলো পরিবেশ।একপাল্লা হৈচৈ পড়লো।কৌড়ির তখন চোখ ফেটে কান্না এলো।কি কারনে কান্না এতো পেলো,জানা নেই তার।তবে ঠোঁট ভেঙে সত্যিই খুব কান্নারা উপচে আসতে চাইলো।যা কৌড়ি দাত চেপে আঁটকাতে চাইলো।তবুও দুফোটা টপটপ করে ঝরলো।সেটা খেয়াল করে মান্যতা তাকে জড়িয়ে ধরলো।মিষ্টি গলায় বললো–আমার বাচ্চা বউমনিটা।একদম না।

পরপর সবাই জড়িয়ে ধরলো।আদর করলো,দোয়া করলো।ওপাশ থেকেও, ওই মানুষটাকে জানানো কিছু অভ্যর্থনাও কানে এলো কৌড়ির।ফের সময় নিয়ে কাবিন নামায় সাক্ষর হলো দুজনের।এরপর কাজীসাহেব মোনাজাত ধরলেন মোনাজাতে মনযোগী হলো সবাই।নতুন নবদম্পতির অদূর ভবিষ্যত, তাদের সুখের সংসার জীবন,প্রজন্ম নিয়ে বেশ কিছুসময় মোনাজাত রাখলেন কাজী সাহেব।ফের খেজুর বিতরণ করা হলো।সাথে মিষ্টিমুখ।দু’পাশে সবাই তখন মিষ্টিমুখ করতে ব্যস্ত। নিভান ফুলের সমাহারে পর্দাটা একটু গোটালো।মুহূর্তেই বধুবেসে পা মুড়িয়ে বসে থাকা চমৎকার একটা মায়াময় মুখ অবলোকন করলো।যাকে চেনা দ্বায়।সোনালী কারুকার্যময় ভারী লাল বেনারসি গায়ে জড়ানো।সাথে গা ভর্তি বড়বড় গহনা।গালায় জড়ানো স্বর্নের জড়োয়া সেট।আলাদা করে একটা জুয়েলারি হারও।কানে বড়ো বড়ো ঝুমকো।নাকে নাকছাবি। ভারী ভারী চুড়িতে দুহাত পূর্ন।মেহেদীরঙা হাতে যা দারুণ আকর্ষনীয়।মাথায় সিঁথি ঢেকে এসে কপালে পড়ে আছে জড়োয়া সেটের ডিজাইনের সেই টায়রাটা।মাথার চুল থেকে শুরু করে আজ মেয়েটার প্রতিটা অঙ্গ আকর্ষনীয় রূপে সেজেছে।কি মায়াময় সেই চন্দ্রপ্রদীপ রূপ।মুগ্ধতায় ডুবে গেলো নয়ন। এই মেয়েটার আজ থেকে শুধুই তার।অন্তরিক্ষের অনুভূতিগুলো কেমন সুখ সুখ প্রজাপতি হয়ে ডানা উড়তে লাগলো।এই ক্ষনটার কতো অপেক্ষা ছিল তার।
কাল এসময়টাতোও তো এক্ষনটার অপেক্ষায় অস্থির ছিলো।অপেক্ষারত সেই ক্ষনটা কেটে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত রমনীটি হয়ে গেলো তার।মেয়েটা খেজুর খাচ্ছে। কি লোভনীয় চিত্র। তড়িৎ পকেট থেকে ফোন বের করে একটা পিক তুলে নিলো।ওমনিই নজর গেলো সবার সেদিকে।কৌড়িও তাকিয়ে পড়লো।নিভান চমৎকার হেসে মায়ামায়া কন্ঠে বললো।

‘কংগ্রাচুলেশনস মাই ডিয়ার লাইফলাইন।

লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিলো কৌড়ি।হৃদযন্ত্রের ধকধকানি পুনরায় নিজের অবস্থানে ফিরে এলো।ঈশিতা মিছেমিছি বকে উঠলো।এখনো বিয়ের কোনো আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়নি তুই বউয়ের মুখ দেখলি কেনো?ঈশিতার বকা বিন্দুমাত্র পাত্তা দিলোনা নিভান।হাত বাড়িয়ে কৌড়ির আধা খাওয়া খেজুরটা তার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে গালে ঢুকিয়ে দিয়ে পর্দার আড়ালে সরে গেলো।গম্ভীর্য ছেলেটার এমন উচ্ছল কান্ড সবাই এতোসময় হা হয়ে দেখছিলো।নিভান সরে যেতেই হেসে দিলো সবাই।মান্যতা বিথী এটা নিয়ে কৌড়ির সাথে মজা লুটতোও ভুললোনা।

বিয়ে পড়ানো শেষে ঈশিতা প্রদত্ত বাড়ির সমবয়সী ছেলেমেয়েরা মিলে বিয়ের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা পালন করলো।তন্মধ্যে, বর বউয়ের হাতে হাত রেখে প্রথম স্পর্শ করে সালাম প্রদর্শন।নব বরবধু দু’জনের মুখ আয়নাতে দেখা।দুধে-আলতা পানিতে আঙটি ফেলে খোজা।দু’জনে একে অপরকে মিষ্টি মুখ করানো।সমস্ত আনুষ্ঠানিকসহ ক্ষনে ক্ষনে নব বরবধূর ফটোশুট হলো।নিভান চলে যেতেই তন্মধ্যে সেখানে দাঁড়ানো নাফিম কোতুহলী মনে জিজ্ঞেস করলো।–আজ থেকে ফুলকৌড়িকে আমি কি বলে ডাকবো?

মান্যতা তার গোলুমোলু গালটা টিপে দিয়ে বললো–বড় বউমনি।

‘কিন্তু কৌড়িতো ছোটোমনিরও ছোটো।তবে কেনো তাকে বড়ো বউমনি বলে ডাকবো?

ঈশিতা আদুরে কন্ঠে বললো–কারণ ফুলকাৌড়ি এখন তোমাদের বড়দাদাভইয়ের বউ তাই।

নাফিম বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো–তুমি তবে দাদাভাইয়ের বউ হয়েই গেছো ?

গোল ফ্রেমের চশমাটা নাকের কাছে এসে ঠেকেছে নাফিমের।সেটা আলতো হাতে সেটা দিয়ে ঠেলে ঠিক করে দিয়ে বললো–

‘এইযে একটু আগে কাগজে কলমে লিখিত পড়িতভাবে তোমার দাদাভাই তাকে বউ করে নিয়েছে।এটাই বিয়ে।আর আজ দাদাভাই আর ফুলকৌড়ির বিয়ে ছিলোনা?

‘হুমম।

ঈশিতা ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো—তবে?

‘ফুলকৌড়ি আমার বড়োবউমনি।

সবাই হেসে দিলো নাফিমের বাচ্চামো কথাশ।ঈশিতা হেসে দিয়ে নরম স্পর্শে নাফিমের গাল চেপে দিয়ে বললো –এইতো নাফিম বুদ্ধিমান ছেলে।

নাফিম কৌড়ির সামনে গিয়ে তার গালক হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো–সত্যি তুমি আমার বড়ো বউমনি, ফুলকৌড়ি?

কৌড়ি ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয় উপর নিচ মাথা নাড়ালো।
ফের নাফিমকে কাছে টেনে নিজের সাথো জড়িয়ে নিয়ে বললো — সত্যি।

অতি আনন্দে নাফিম চিল্লায়ে নিজেও কৌড়িকে শক্তকরে জড়িয়ে ধরলো।সেই আনন্দে সবাই সামিল হলো।ফুলকৌড়ি পাগল নাফিমকে সবাই দুষ্ট মির ছলে খোঁচালো,হাসলো,মজা করলো।তবে আনুষ্ঠানিকতা শেষে নিভানকে আর আশেপাশে দেখা গেলো না।তারপর পুরো দুপুরটা কেটে গেলো আমন্ত্রিত মেহমানদের মেহমানদারীতে,সেখানেই দেখা গেলো ব্যস্ত নিভানকে।মেহমানদারী আর নিজেদের খাবার শেষে পুনরায় হই হুল্লোড় দুষ্টমি মজায় কেটে গেলো পুরো বিকাল।

ও আম্মু,দাদাভাইয়ের থেকে আমরা বিয়ের কোনো এনামি পায়নি।ঘর সাজানোর জন্য যে এনামিটা নেবো।দরজায় দাড়াবে কে?সেই ভয়ে তো দরজার সামনে দাড়াতেও পারছিনা।ঈশু আপু বড়োবোন বলে সম্মানের খাতিরে দাড়াতে চাইছেনা।উনি ছাড়া আর কার সাহস আছে দাদাভাইয়ের সামনে দাড়ানোর।উনি যখন চাইছেন না, তুমি একটু দাদাভাইকে বলে আমাদের এনামির একটা ব্যবস্থা করে দাওনা।

বাড়িতে মেহমান যারা রয়েছেন। সবাই আপতত বিশ্রামে।রান্নাঘরে ব্যস্ত হাতে কাজ করছিলেন নীহারিকা বেগম।সাথে রানীসাহেবাও।এতোসময় দল বেঁধে কিভাবে দাদাভাইয়ের কাছ থেকে বিয়ের এনামি পাওয়া যায়,সেই পরিকল্পনা করছিলো।নিজেরা গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াবে!সেটা কখনো হওয়ার নয়।তাই অনেকেই কে বুঝিয়েছে কাজ হয়নি।নিরাশ মুখে মা’কে ফাকা পেয়ে এবার দলবেধে এসেছে মা’কে দিয়ে কিছু হয় কিনা,তাই মানাতে। মান্যতার কথা শুনেই চকিতে তার মুখের দিকে তাকালেন নীহারিকা বেগম।আশ্চর্য গলায় বললেন।

‘মানে কি?এখন আমি ছেলের ফুলসজ্জার গেট ধরবো!
ছিঃ ছিঃ ছিঃ।তার কাছে এনামি চাইবো?এই মেয়ে, জ্ঞানবুদ্ধি কি সব লোভ পেয়েছে তোর?মা ওর আমি!আমি নাকি ছেলের ফুলসজ্জার এনামি চাইবো ছেলের কাছে!ও আল্লাহ এ-কেমন মেয়ে আমার!এই নির্বোধ মেয়েকে কোন বাড়িতে পাঠাবো আমি!

মায়ের আহাজারিতে আরও নিরাশায় ডুবে গেলো মান্যতার মুখ।সাথে পাশে দাড়িয়ে থাকা মৌনতা,বিথী তন্ময়ী সকলের মুখ চুপসে গেলো।বেশী চুপসে গেলো তন্ময়ীর মুখটা।এহেন আবদার সত্যিই ঠিক হয়নি।
মান্যতা ফের বললো–ছেলেতো কি হয়েছে।তুমি বলে দিলেই তো কাজটা হয়ে যাচ্ছে।

‘মান্য, আমার এখান থেকে যা।কি কান্ডজ্ঞানহীন মেয়ে।বলে কি-না ছেলেতো কি হয়েছে!এখন তোদের কাজ উদ্ধার করার জন্য আমি ছেলের কাছে নির্লজ্জ সাজব!
বেহায়া হবো!ও মাবুদ এমেয়ের বেশি বেশি বোধবুদ্ধি জ্ঞান দান করো।

মায়ের দ্বারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষা হবেনা,এটা বুঝে মান্যতা আর কথা বাড়ালো-না।সবাই মাথা নিচু করে নিরাশ মুখে ডায়নিংটেবিলে গিয়ে বসলো।সেখানে বসে ইভান চা খাচ্ছিলো।ওদের দেখেই ইভান পরিহাসের সুরে বললো –কলিজা ছিদ্র যখন,এসব কাজের খেয়াল মনে নিয়ে আসতে হয় কেনো?হুহ,এনামি চাই।ফকির হয়েছে সবকটা।

সবাই বেজার মুখে একবার তাকালো ইভানের দিকে।
তবে তন্ময়ী তাকালো চোখমুখ শক্তকরে।মান্যতা কিছুটা রাগান্বিত গলায় বললো — এখানে ফকিরের কি দেখলি তুই?এটা জাস্ট মজা করে পেতে চাইছি আমরা।

তন্ময়ীর চোখমুখ শক্তকরে রাখা দেখে ইভান দুষ্ট হাসলো।ফের বললো–আমি ব্যবস্থা করে দিতে পারি।তবে শর্ত আছে।

তন্ময়ী বাদে উচ্ছাসিত কয়েক জোড়া স্বর একত্রে বলে উঠলো–কি শর্ত।

ইভানের মুখের দুষ্ট হাসি আরও চওড়া হলো।সেটা দেখে মনেমনে আশংঙ্কাগ্রস্ত হলো তন্ময়ী।তবে চোখমুখের হাবভাবে সেটা ফুটতে দিলো-না।তবে ফাজিল ছেলেটা যে তাকে নিয়েই মনেমনে কিছু একটা প্লান করে চলেছে এটা স্পষ্ট তার মুখের দুষ্টমিষ্টি হাসির ঝলকানিতে বুঝলো।সত্যি সেটাই হলো।ইভান বললো -‘শর্ত শুধু তোর ছোটোবউমনি মানলেই চলবে।আর কাওকে মানতে হবেনা।

কারন না শুনতে চেয়ে সবাই তন্ময়ীকে চেপে ধরলো ইভানের শর্ত মানতে।যেখানে তন্ময়ী ইভানের বউ,সেখানে নিশ্চয় কঠিন কোনো শর্ত ইভান তাকে দেবেনা। এমন যুক্তিতর্কে তন্ময়ীকে বোঝাতে থাকলো তারা।তন্ময়ী পড়লো চিপায়। হতভম্ব চোখে একবার আশা নিয়ে তাকে বুঝানো মেয়েগুলোকে দেখলো,তো একবার ঠোঁটে দুষ্ট হাসি লেপটে রাখা ইভানকে দেখতে থাকলো।কি করবে এখন সে?তন্ময়ীর পরিস্থিতি বুঝে ইভানের দুষ্ট হাসি মাখা মুখটা যেনো আরও ঝলমলে হয়ে উঠলো।কালরাতে সত্যিই মেয়েটা তার কথা রাখতে তার কাছে ঘুমাইনি।ইভান শতচেষ্টা করেও মেয়েটার নাগাল পায়নি।তবে আজ কি করবে?হঠাৎ তন্ময়ী বলে উঠলো।–দরকার পড়লে কাল নিভান ভইয়ার কাছে থেকে এনামি আমি চেয়ে দেবো তোমাদের।তবুও কোনো বদ মতলবী মানুষের শর্ত মানতে রাজি নই।

‘ছোটো দাদাভাই বদ মতলবী?মান্যতা কথাটা জিজ্ঞেস করলো।তন্ময়ী উত্তর দেওয়ার আগেই মৌনতা চটপটে গলায় বললো–‘তুমি পারবে তো?

ইভানের দুষ্ট হাসিরা তখনো তার ঠোঁটজুড়ে মাখামাখি। নিশ্চিত অন্য কোনো ছক কষছে।তবুও তন্ময়ী শক্ত গলায় জবাব দিলো–‘দরকার পড়লে দাদাভাইকে দিয়ে পারিয়ে নেবো।

‘তাই তো। তৃনয় ভাইয়া আছে,সেটাতো মাথায় ছিলো-না আপু।তৃনয় ভাইয়াকে ধরলে তো এতোসময় সমাধান হয়ে যেতো সবকিছুর।

মান্যতাকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলতেই ধ্বক করে উঠলো মেয়েটার বুক।লোকটাকে সে সবসময় এড়িয়ে চলতে চায় অথচ ঘুরেফিরে তারই নাম নেবে সবাই।আবার ঘুরেফিরে তারই সামনেই পড়তে হয়।লোকটার কথাতো তারও মনে ছিলো।তবে উনার থেকে সাহায্য কখনোই নিতে চায়না বলে স্মরন করেনি মান্যতা।অথচ সেই নামেই গিয়ে গড়ালো বিষয়টা।

‘আপু চল।তৃনয় ভাইয়ারা ছাঁদে আড্ডা দিচ্ছেন।উনাকে গিয়ে ধরি।

কথাটা বলেই মান্যতার হাত টেনে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো মৌনতা।সাথে বিথী এবং অন্যন্য মেয়েগুলো উঠে দাড়ালো। না বলতে গিয়েও সবার দিকে তাকিয়ে না বলতে পারলোনা সে।তন্ময়ী উঠতে গেলেই হাত চেপে ধরলো ইভান।কাছে এসে বললো–আজ রাতে যেখানেই থাকোনা কেনো,ঘুম থেকে জেগে দেখবে তুমি ইভানের বুকের তলায়।

কথাটা বলেই আশেপাশে একবার নজর বুলিয়েই তড়িৎ তন্ময়ীর গালে চুমু বসালো সে।মূহুর্তেই সরে গিয়ে গুনগুন করতে করতে ছাঁদের দিকে অগ্রসর হলো।তন্ময়ী তখনো কাঠ পুতুলের মতো নিশ্চল দাঁড়িয়ে।

সারাদিনের হৈ-হুল্লোড়,দৌড়ঝাঁপ থেমে গিয়ে নিশুতিরাতের আগমন ঘটলো।ক্লান্তিতে বাড়িটা তখন নিস্তব্ধতায় ছাওয়া।কৌড়ি তখন একাকী বসে নিভানের ঘরের ওয়ালসেট ড্রেসিংটেবিলের টুলে।শান্ত নীরব, চারপাশে শীতলভাব রুমটাতে যখন তাকে ঢুকানো হয়েছিলো,অদ্ভুত অনুভূতিতে সর্বাঙ্গ কেমন শিরশির করে কেঁপে উঠেছিলো।কাল কোথায় ছিলো আর আজ কোথায় থাকতে হবে!এটা ভেবে শিরশিরানিটা যেনো ক্ষনে ক্ষনে তীব্ররূপে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সর্বশরীরে।আশেপাশে আবারও নজর খেয়ালি হয়ে উঠলো তার।শৌখিনতা আর আভিজাত্যের পরিপূর্ণ ছোঁয়ায় পরিপাটি করে রাখা ঘরটাকে,বড়বড় ক্যান্ডেললাইট দিয়ে সাজানো হয়েছে। হীমশীতল ঘরটার কোণায় কোণায় বড়বড় মোমগুলো নরম আলোয় শোভা পাচ্ছে।ধীমেধীমে আলোয় জ্বলছে তারা।শুধু যে ঘরের কোণায় কোণায় শোভা পেয়েছে তারা, এমনটা নয়।বেডের পাশের ল্যাম্পস্যাড টেবিলটার চারপাশজুড়ে।বেডের পায়ের কাছের ডিভানটারজুড়ে।,বেডের অন্যপাশের ইনডোর প্লান্টের চারপাশটাজুড়ে।দরজার পাশের বড়সড় ফুলদানিটা ঘিরে সাজানো গোছানো রূপে রূপায়িত হয়েছে তারা।রুমের নীলচে-সবুজ বাতির ধিমে জ্বলা আলোতে মুগ্ধ নজরে চারপাশটা দেখতে দেখতে বেডে এসে নজর থমকে গেলো কৌড়ির।বড়সড় শৌখিন বেডটার সাদা কাভারের বিছানাজুড়ে লাল গোলাগের পাপড়িতে সাজানো।সেখানে নবদম্পতির নামটাও লেখা উজ্জ্বল নক্ষত্ররূপে।হার্টবিট তালে তালে বেড়ে গেলো কৌড়ির।মূহুর্তেই নজর সরিয়ে ঘুরে বসলো সে।

আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের প্রতি নজর পড়তেই দৃষ্টি নিজের প্রতি মুগ্ধ হলো।বিয়ের সাজ পাল্টে তাকে পুনারায় সাজানো হয়েছে। বিয়ের ভারী সাজ পাল্টে আর ইচ্ছে করেনি তার একটুও সাজতে।তবে মুখফুটে নিজের ক্লান্তি আর অস্বস্তির কথা কাওকে না বলতে পারায়,পুনরায় আবার সাজতে হয়েছে তাকে।তবে বিয়ের সাজের মতো অতোটাও ভারী সাজ নয়।গাঢ় খয়েরী রঙের সবুজ একটা সাউথ বেনারসী সিল্ক শাড়ী পরানো হয়েছে।ভিতরে তার ছোটো ছোটো ফুলের স্বর্নালি কাজ।গলায় নতুনকরে ভারী জড়োয়ার সেটের গহনা পরানো হয়েছে।কানে বড়বড় ঝুমকো। হাতে গাদাগাদা চুড়ি।চুল উল্টিয়ে সিথীবিহীন সটান করে বড়করে খোঁপা বাঁধা হয়েছে।আর খোঁপায় শোভা পেয়েছে কতোকগাছি গাঢ় খয়েরী গোলাপ।ম্যাচিং ডিজাইনে টায়রা ঝুলানো মাথায়।হলকা মেকাপ হলেও ঘনপল্লবিত চোখে গাঢ় কাজলের প্রলেপটা বেশ চাকচিক্য ছড়াচ্ছে।আর তার থেকেও ঠোটের গাঢ় খয়েরী রঙা লিপস্টিকের প্রলেপনটা যেনো পুরো মুখের গৌরবর্ণের সৌন্দর্যতা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।সবকিছু নিটোল চোখে একবার নয় কয়েকবার দেখেছে কৌড়ি।সবকিছু ওই মানুষটার পছন্দসই।যেনো পোশাক গহনা নয় মানুষটাই লেপ্টে আছে সমগ্র শরীরজুড়ে।আবারও শিরশির দিয়ে উঠলো শরীর।কি অদ্ভুত এক অনুভূতি।
এই রুমে প্রবেশ করার পর, রুমের চারপাশটা যেনো ওই মানুষটার গায়ের কড়া পারফিউমের গন্ধে থৈ-থৈ করে নেচে-গেয়ে করে ভেসে বেড়াচ্চছে।অথচ মানুষটা নেই।হঠাৎ দরজা খোলার”‘খট” শব্দে পিছে মুড়ে উঠে দাঁড়ালো কৌড়ি।কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখতেই সমগ্র শরীরে লজ্জরা ভিড় করলো।উষ্ণ অনুভূতিতে শিরদাঁড়া কেঁপে উঠলো।হঠাৎ মনেহলো মাথায় কাপড় নেই।তড়িৎ মাথায় কাপড় টেনে দিলো।আটপৌড়ে পরা শাড়ী গহনার সাথে এটাই বুঝি বেমানান ছিলো।মাথায় কাপড় উঠাতেই পরিপূর্ণা নারী। হুশ ফিরলো নিভানের।মিষ্টি হেসে চমৎকার কন্ঠে সালাম জানালো।

‘আসসালামু আলাইকুম,রব্বাতুল বাইত।

লজ্জায় ডুবে থাকা কৌড়ির কথা বলতে গিয়ে হঠাৎই টের পেলো, কাটা বেঁধে যাওয়ার মতো তার গলায়ও কথারা বেঁধে জড়িয়ে পড়েছে।তবুও জড়ানো গলায় সালামের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলো।উত্তর পেতেই অনুমতি প্রার্থনা চাইলো,স্বামী নামক পুরুষটি।

‘ভিতরে আসবো?

ভিষণ লজ্জা পেলো কৌড়ি।নিজের ঘরে ঢুকতে তার কাছে অনুমতি চাইছে!বিষয়টা ভিতরে ভিতরে অস্থির করে তুললো তাকে।অবাধ্য অনুভূতিরা তাতে যেনো তাল মিলিয়ে পাল্লা দিয়ে তাকে জর্জরিত করে তুললো।
তবে ভুুলেও কথা বললোনা।মাথা উপর নিচ নাড়িয়ে শুধু সম্মতি জানালো।সম্মতি পেতেই নিভান নৈঃশব্দ্য দরজা চেপে ধীরেধীরে এগোলো কৌড়ির পানে।এতোদিন শুনে এসেছে বউ একহাত ঘোমটা টেনে বরের অপেক্ষায় বেডে বসে থাকে।অথচ তার বউটা ওখানে টুলে বসে কি করছে ?ভাবনাটা গাঢ় রূপ নিতে পারলো না,তার সম্মোহনী দৃষ্টির জন্য।যে দৃষ্টি তার বউয়ের মোহমায়া রূপে সম্মোহিত হয়ে আঁটকে গেছে।কি বর্ননাহীন অপরূপা লাগছে মেয়েটাকে!নিভান যতো কাছে আগাতে লাগল,কৌড়ির অবস্থা ততোই নজেহাল হতে শুরু করলো।দুপুরের শেরওয়ানি পাল্টে সাধারণ একটা সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা তার।এলোমেলো অবিন্যস্ত চুল।ক্লান্ত মুখ।অথচ মুখে চমৎকার হাসি।কৌড়ি মোহিত হলো।

‘আমাদের একসাথে পথ চলার অভিনন্দন আমার অর্ধাঙ্গিনী।

কি মোহিত কন্ঠস্বর!নিজের থেকে দুআঙুল দুরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে অপলক নজরে দেখলো কৌড়ি।সামনের মানুষটার অভিনন্দন অভ্যর্থনা যেনো কানে ঢুকেও ঢুকলোনা।সেটা বুঝে সামনের মানুষটা সুযোগ নিলো।মাথা নুইয়ে সদ্য হওয়া অর্ধাঙ্গিনীর কপালে নিজের কপাল ঠেকাল।শিহরে উঠলো কৌড়ি।যেনো বিদ্যৎ ভ্রষ্ট হলো।তবে নড়তে ভুলে গেলো।যেনো চম্বুক হয়ে টেনে রেখেছে মানুষটা অথচ কপালে কপাল রাখা ছাড়া তাকে মানুষটা কোনোরূপ ছুঁই নি।

‘প্রভু বুঝি নিজ হাতে ছুঁয়ে ছুঁয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে, আমাকে উপহার দেওয়ার জন্য তোমাকে গড়েছিলেন।কি অপরূপা গড়েছেন তোমাকে,জানো তুমি?আমার শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্য,সম্পত্তি,সুখ শান্তি বানিয়ে তোমায় উপহার দিয়েছেন আমাকে।জাজাকাল্লাহ।

কৌড়ি চোখ বুঁজে নিলো।উষ্ণতার জোয়ার বয়ে বেড়ালো রন্ধ্রে রন্ধ্রে।সেই বুঁজে থাকা চোখে গভীর ভালোবাসা ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করলো নিভানের।আর সেই গভীর ভালোবাসা তো ওই নির্দিষ্ট চোখে থেমে থাকবে না।তবে একটা কাজ না সেরে আপতত নিজের অনুভূতির উষ্ণতায় ডুবাতে চাইছেনা মেয়েটাকে।তবে গভীর নজরে অপলক মেয়েটাকে দেখতে থাকলো সে।একটা সময় মনেহলো,নাহ বেশিক্ষণ এভাবে থাকলে নিজেকে আর ঠিক রাখা যাবেনা।তখন ধীরেসুস্থে মুখ খুললো সে।বললো–ফ্রেশ হয়ে আসছি।ফের কথা বলছি।কেমন?

চোখ বুঁজেই কৌড়ি তড়িঘড়ি মাথা মৃদু উপর নিচ নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।নিভান সরে গিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকতেই কৌড়ি বুকে হাত দিতে ঘনোঘনো শ্বাস ফেললো। কি রুদ্ধশ্বাস অনুভূতি।সময় নিয়ে বের হলো নিভান।গোসল সেরে বের হয়েছে।একটু আগের ক্লান্তি তার চোখমুখে দেখা যাচ্ছে না।সেখানে ভর করেছে সতেজতা,স্নিগ্ধতা।মাথার চুলগুলো মুছতে মুছতে বের হয়েছে সে।ওয়াশরুমে ঢোকার আগে আরেক সেট সাদা পাজামা পাঞ্জাবি নিয়ে ঢুকেছিলো।আর সেটা পরেই বের হয়েছে।কৌড়ি বুঝলোনা,একরঙ মানুষের বারবার পরতে ভালো লাগে?অথচ মানুষটাকে সবসময় সাদা জিনিসই পরতে দেখে কৌড়ি।ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে কৌড়িকে বেডের এককোনে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে দেখে নিভান বললো।

‘আমার এশারের নামাজটা এখনো আদায় করা হয়নি।নামাজটা আদায় করে নেই।আর নানুমা বললেন,আজ উপলক্ষে দুই রাকাআত নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া প্রার্থনা করতে।

কথা শেষ করতেই হঠাৎ কিছু মাথায় এলো।কৌড়িকে উদ্দেশ্য করে শুধালো—তোমার পিরিয়ড বন্ধ হয়েছে?

লজ্জায় খিঁচে এলো ভিতরটা।মাথা নিচু করে নিলো কৌড়ি।ঔষধের প্রভাবে আজ সকাল থেকে পিরিয়ড বন্ধ। তবুও সংশয় আছে।তবে কি এসব বলা যায়?আর কিওবা বলবে সে।মাথা নিচু রেখে কোনোমতে মাথা এদিকে ওদিকে নাড়িয়ে না জানালো।সেটা খেয়াল করে নিভান বললো।

‘সমস্যা নেই।আজ আমি একা পড়ি।যেদিন তুমি সুস্থ হবে,সেদিন নাহয় দু’জনে একসাথে আবার পড়ে নেবো।

কৌড়ি তড়িৎ মাথা উচু করলো।নিভান অমায়িক হেসে চোখ দিয়ে আশ্বাস জনালো।ফের কৌড়ির কোলের মধ্যে মাথা মুছতে থাকা তোয়ালিটা আলতো হাতে ছুঁড়ে দিয়ে বললো।

‘আমি নামাজ সেরে নেই।তারমধ্য তুমি ফ্রেশ হ’য়ে কমফোর্টেবল কিছু পরে নাও।তোমার সবকিছু এরুমে আছে।সব তোমার।সালোয়ার কামিজও পরতে পারো।আমাদের এক জায়গায় যেতে হবে,এই বেশে তোমাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবেনা।

প্রশ্ন জাগলো মনে।তবে প্রশ্ন করলোনা কৌড়ি।নিভানকে সম্মতি জানিয়ে উঠে দাড়ালো সে।নিভানও সরে গিয়ে নামাজে দাঁড়ালো।ওয়াশরুমে ঢোকার আগে প্রথমে গহনাগুলো খুলে নিলো কৌড়ি।এরুমের কোথায় তার কি রাখা আছে, সে জানােনা।কিছু খুজতে-ও গেলোনা সে।মান্যতারা যখন এরুমে তাকে রেখে গিয়েছিল, তখন সাথে করে তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র একটা ট্রলিসমেত রেখে গিয়েছিলো।সেখান থেকে সুতি একটা থ্রিপিছ বের করে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো।সবকিছু পরিস্কার করে বের হতে তার বেশ সময় লাগলো।তবে চুলগুলো কিছুতেই একা খুলতে পারলোনা।ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখলো,নিভান এখনো নামাজের বিছনায় বসে।কৌড়ি কেমন অসহায় নজরে তারদিকে তাকালো। সেটা খেয়াল করে উঠে দাঁড়ালো নিভান।কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো— কি হয়েছে?

‘খোপাটা খুলতে পারছিনা না।

নিভানের বুঝতে সময় লাগলো।তবে কৌড়ি আঙুল উচু করে দেখাতেই,বুঝলো সে।কৌড়ির হাতটা ধরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড় করিয়ে,সমস্ত মনোযোগ ফুলে এঁটে থাকা খোঁপায় দিয়ে ফুলগুলো খুলতে থাকলো সে।
একটা খোঁপা করতে আর তাতে ফুল দিয়ে সৌন্দর্যবর্ধনে কতো ক্লিপ যে এঁটেছে,বলা মুশকিল।নিভান ধৈর্য্য নিয়ে তা খুলতে চেষ্টা করলো।আর আয়নায় কৌড়ি দেখে গেলো তাকে।বেশ সময় লাগলো খোপাটা খুলতে।সময় নিয়ে একসময় সফল হলো।
চমৎকার হেসে বললো–হয়ে গেছে।

নিভান সরে গিয়ে নামাজের বিছানা উঠাতে ব্যস্ত হলো।কৌড়ি তারমধ্যে চুলগুলো আঁচড়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করলো।তবে দীঘল চুলগুলোর যে অবস্থা!দুইপাচ মিনিটে আঁচড়ানোর কাজ সেরে নিতে পারবে বলে মনে হলোনা তার।আর কেমন হাত পা সহজভাবে নাড়াতেও তার অস্বস্তি হচ্ছে। তাই উপর উপর কোনোমতে আঁচড়িয়ে ওড়না মাথায় দিয়ে নিলো।তারমধ্যে নিভান রেডি হয়ে নিয়ে বললো—তোমার হয়েছে?

কৌড়ি তড়িৎ উত্তর দিলো–হয়েছে।

নিভান তাকে একপল দেখলো।ফের নিজের ঘরের কেবিনেটের দিকে এগিয়ে গিয়ে কিছু একটা বের করে কৌড়ির সামনে এসে দাড়ালো।মাথার ওড়নাটা সরিয়ে দিয়ে বড়সড় সুন্দর একটা হিজাবে তাকে মুড়িয়ে দিলো।ফের ঠিকঠাক করে দিয়ে তারদিকে তাকিয়ে মুগ্ধ স্বরে বললো—মাশাআল্লাহ। তোমার জন্য শপিং করতে গিয়ে এটা দেখে পছন্দ হলো তাই নিয়ে নিয়েছিলাম।অসুবিধা আছে পরতে।

অদ্ভুত অনুভূতিতে জর্জরিত কৌড়ি মাথা নাড়িয়ে না জানালো।নিভান সম্মতি পেয়ে মৃদু হাসলো।নিজেকে একপল আয়নায় দেখে নিয়ে বললো–চলো।

মেইন রাস্তার পাশে বিস্তৃত জায়গা নিয়ে কবরস্থান। তিনপাশ উঁচু পাঁচিলে ঘেরা থাকলেও,রাস্তার সাইডে রেলিঙ করা।সেখান থেকেই দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন মৃতব্যক্তির,ইট সিমেন্ট বালু দিয়ে পাকা আধাপাকা নেইমপ্লেট জড়ানো কবরস্থান।হঠাৎ মনেহলো,আজকের দিনে মানুষটা তাকে এখানে নিয়ে এলো কেনো?

‘ভয় পাচ্ছো?

মেইন রোড।রাস্তার ঝলমলে আলো।তা বাদেও কবরস্থানের পাশ ঘেঁষে মসজিদ। সেখানে অতিরিক্ত লাইটের ব্যব্স্থা।ভয় পাবার কোনো অবকাশ নেই। কৌড়ি নিঃসঙ্কোচে বললো—না।

‘ওই যে বাবার কবরস্থান।

আঙুল উঁচিয়ে দেখালো নিভান।ততক্ষণাত কৌড়ির প্রশ্নের উত্তর মিলালো।কৌড়ি খেয়ালি নজরে দেখলোও সেখানে পাকা কবরস্থানের গায়ে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা– মরহুম মোহাম্মদ আওসাফ আহমেদ।আর কিছু লেখা।নামের তুলনায় অন্য লেখাগুলো ছোটো হওয়ায়, দুর থেকে কৌড়ি পড়তে পারলোনা।

‘বাবা আমাকে খুব ভালোবাসতেন জানো।খুব ভালোবাসতেন।তার কাজের ফাঁকে যেটুকু সময় পেতেন তিনি আমার পিছনে ব্যয় করতেন।আমাকে খাইয়ে দেওয়া,গোসল করিয়ে দেওয়া,স্কুলে নিয়ে যাওয়া,বুকে জড়িয়ে ঘুম পাড়ানো।সহজে মা’কে করতো হতো-না।তিনিই করতেন।বাবা থাকাকালীন এসব আদর যত্ন আমি মায়ের থেকে কম পেয়েছি।কম পেয়েছি বলতে, বাবাই মা’কে সুযোগ দিতেন না।হয়তো তিনি বুঝে গিয়েছিলেন,আমার কাছে তাকে আর বেশিদিন থাকা হবেনা।তাই হয়তো উনার সারাজীবনের আদর যত্নগুলো বেশি বেশি করে দিয়ে গিয়েছিলেন।তিনি প্রচন্ড আদর করতেন আমাকে,কৌড়ি।আমার এখনো মনেহয়,আমার গালে, আমার কপালে, উনার ছুঁয়ে দেওয়া আদরগুলো এখনো লেপ্টে আছে।আমি প্রায় স্নপ্ন দেখি,তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে ঘুমাচ্ছেন।এইতো আমাকে যত্ন করে খাইয়ে দিচ্ছেন। আমি খেতে চাইছিনা বলে,কতোশত গল্প শুনিয়ে আমাকে খাওয়াচ্ছেন।বাবাকে কেনো জানি আমি কিছুতেই ভুলতেই পারি-না।কেনো জানি পারিইনা।

দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিভান।কথাগুলো বলতে গিয়ে গলা যেনো কেঁপে কেঁপে উঠছিলো মানুষটার।কৌড়ি কেমন অসহায় নজরে সেটা দেখে যাচ্ছিলো।ওই কষ্টের অভিজ্ঞতা তো তারও আছে।ক্ষনেক্ষনে সেই কষ্ট, ব্যথাগুলোর অভিজ্ঞতা গুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠে।আজ দু’দিন ধরেও তো সেই ব্যথাগুলো ক্ষনেক্ষনে চাড়া দিয়ে উঠছে মনে।কৌড়ি নিভানের পাশে গিয়ে তার হাতটা নিজের কোমল হাতের মুঠোয় নিয়ে নিঃসঙ্কোচে আশ্বস্ত জানলো।

‘এতোরাতে তোমাকে এখানে নিয়ে আসার ইচ্ছে ছিলোনা।আজ দুদিন ধরে সুযোগ খুঁজছি,কিন্তু ব্যস্ততায় খাতিরে এখানে আসা হয়ে উঠেছেনা।আজ এখন এসময়ে হয়তো তোমাকে এখানে নিয়ে আসা ঠিক হয়নি।কিন্তু আমি চাইছিলাম,আমাদের নতুন জীবন শুরু হওয়ার আগে বাবার কাছে একবার তোমাকে নিয়ে আসতে।উনার আদরের ছেলের জীবনসঙ্গীনিকে একটু দেখিয়ে নিয়ে যেতে।

কৌড়ির হাতের মধ্যে থাকা শক্তপোক্ত হাতটা কৌড়ি আরও শক্তকরে চেপে ধরলো।যেনো নীরব আশ্বস্ততা।নিভান সময় নিয়ে বললো–আমি সামনে এগিয়ে গেলে তুমি ভয় পাবে?কবরস্থানে তো মেয়েদের যেতে নেই,তাই বললাম।

রাস্তায় ক্ষনে ক্ষনে বিভিন্ন পাল্লার যানবাহন চলছে।সাথে অল্পসল্প মানুষজন।কৌড়ি আশেপাশে খেয়াল করে বললো–আপনি কবর যিয়ারত করে আসুন।আমি ভয় পাবো-না।

কৌড়ি হাত ছেড়ে দিলো।নিভান একপলক তাকে দেখে সামনে এগিয়ে কবর যিয়ারত করলো।রাত হওয়ায় কবরস্থানের ভিতরে আর ঢুকলো-না।পাছে কৌড়ি-ও ববার ভয়না পায়।সেই বিবেচনাও করলো।সময় নিয়ে কবর যিয়ারত করলো নিভান।যিয়ারত শেষে কৌড়িকে নিয়ে গাড়িতে উঠলো।তবে গন্তব্য যে বাড়ির পথে নয়,এটা বেশ বুঝতে পারলো কৌড়ি।কেননা গাড়ি যে পথে এসেছিলো,তার অন্যপথ ধরলো নিভান।

‘তোমার খুবকরে মনে হয়, তুমি আমার থেকেও বেটার কাওকে ডিজার্ভ করো।তাই না?

কৌড়ি অবাক হয়ে নিভানের মুখের দিকে তাকিয়ে রয় কিছুক্ষণ।হঠাৎ সংকোচ দ্বিধা কাটিয় সময় নিয়ে কিছুটা অবাক কন্ঠে শুধায়–আপনার থেকেও ভালো কেউ?

‘হুমম।

নিস্তব্ধ গভীর রাত,জনমানবহীন শূন্য রাস্তা।বাতাসের মৃদু শা শা শব্দ ছাড়া কোথাও কোনো শব্দ নেই।নিভান কোথায় নিয়ে এসেছে,জায়গাটার নাম কৌড়ির বিশেষ জানা নেই।তবে একটা সুদীর্ঘ ব্রীজের রেলিঙ ঘেঁষে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে তারা।নিভান হুম বলতেই,সেই পাশাপাশি দাঁড়ানো দূরত্বটা ঘুচিয়ে ফেললো কৌড়ি।নিভানের সামনে এসে দাঁড়ালো।উচ্চতায় মানুষটা বুক সমান সে।তাই পায়ের সিম্পল স্যান্ডেলজোড়া খুলে নির্দ্বিধায় নিভানের পায়ের উপর পা রাখলো।নিভান শান্ত নজরে সেটা দেখলো।কৌড়িকে নিজের পায়ের উপর পা রাখতে দেখেই,ঝুঁকে তার কোমরটা জড়িয়ে নিজের কাছাকাছি টেনে নিলো।তাতে সুবিধাই হলো কৌড়ির। নিভান ঝুঁকে আসতেই আদূরে স্পর্শে তার মুখটা নিজের কোমল দু’হাতের তালুতে আজলে নিলো।
নিভানের শান্ত বাদামী বর্ণ নজরজোড়ায়,নিজের মায়াবী ডগরডগর নজরজোড়া স্থির রাখলো।ব্রিজের সোডিয়ামের লাল নীল আলোতে নিভানের শ্যামবর্ব চোখ মুখ স্পষ্ট।সেই মুখাবয়বে কিয়াদক্ষন চেয়ে থেকে
আবেদনময়ী কন্ঠে বললো

‘এই চোখ, এই নাক,এই ঠোঁট, এই শ্যামবর্ণ মুখাবয়বের থেকে-ও যদি কোনো আকর্ষণীয় মুখ অবয়ব থেকে থাকে,আমার মন,আমার মস্তিষ্ক, আমার হৃদয়, আমার নজর তবুও এই শ্যামবর্ণ মুখাবয়বেই আঁটকে থাকবে।
শত শত সৌন্দর্যের মধ্যে এই শ্যামবর্ণ পুরুষটাতেই আকর্ষিত হই আমি,মুগ্ধ হয় আমার নয়ন।মায়া মোহ টান সবকিছু ঘিরে এই শ্যামবর্ণ পুরুষটাতেই অনুভব করি আমি।আর সেই পুরুষটার থেকেও যদি আকর্ষণীয়, বেটার কোনো পুরুষ থেকে থাকে।তবু্-ও সেই পুরুষটা কখনো আমায় চাইনা।আমি এই শ্যামবর্ণ পুরুষটাতেই মুগ্ধ।আর আমার দেখা সুন্দর ব্যাক্তিত্বের সৌন্দর্যময় পুরুষ ”শুধুই আপনি” নিভান আওসাফ আহমেদ।

কৌড়ির আবেদনময়ী গলার প্রসংশাতে মন প্রশান্ত হলো নিভানের।সে এমনই একটা উত্তর আশা করেছিল কৌড়ির থেকে।কৌড়ি যেনো সেই উত্তরটা আরও দ্বিগুণ মুগ্ধকর ভাষায় প্রকাশিত করেছে।দু’হাতের বন্ধনী আপনাআপনি দৃঢ় হলো নিভানের।কৌড়ি আরও কাছে চলে এলো তার।কেঁপে উঠলো কৌড়ি,সমস্ত শরীরে বয়ে গেলো শীতল স্রোতের মৃদু কম্পন।বিয়ের পর এই প্রথম এতো কাছাকাছি আসা।যদিও নিজেথেকে এসেছিলো সে।তবে তখন অতোটা ভেবে কাছে আসে-নি।আবেগপ্রবণ হয়ে এসেছিলো।কেনো জানি তখন কোনো দ্বিধা সংকোচ কাজ করেনি।কিন্তু এখন!কৌড়ির মুখটা কাছাকাছি আসতেই,তার দিকে নিগাঢ় চোখে চেয়ে থাকলো নিভান।খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো তাকে।হিজাবে জড়ানো গোলগাল সুন্দর মায়াময় পরিচ্ছন্ন একটা মুখ।যা কোমলতায় আর স্নিগ্ধতায় ভরা।মোহবিষ্ট হলো নিভান।কৌড়ির কোমরে রাখা হাতটা আরও শক্তবাধনে আকড়ে নিলো।সহজে কৌড়ির মুখটা আরও কাছাকাছি আসতেই, তার কোমল ঠোঁটে প্রগাঢ় চুম্বন আঁকলো নিভান।অনুভূতিতে আবেশিত হয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো দু’পক্ষই।জীবনের প্রথম গভীর নারীস্পর্শ।নাহ,বিয়ের আগেও তার ঠোঁটজোড়া তো ছুয়েছিলো এই একান্ত নারীর কপাল।তবে জ্বরের প্রকোপে হুশ না থাকাই এই নারীটার জানা নেই সেই স্পর্শের কথা।

সময় অতিবাহিত হলো,তবে ঠিক কতোটা সময় অতিবাহিত হলো এটা কৌড়ি নিভান কারও জানা নেই।একটা সময় গিয়ে শেষ হলো সেই চুম্বন।ততসময়ে নিভানকে শক্তকরে আকড়ে ধরেছে কৌড়ি।সেটা বুঝে কৌড়িরর কোমর ছেড়ে দিয়ে তার গোলগাল মুখটা,নিজের রুক্ষ দু’হাতের তালুতে আজলে নিয়ে বেশ নিষ্পলক কিছু সময় দেখলো নিভান।ফের নিজের মুখের অতিসন্নিকটে কৌড়ির মুখটা টেনে নিয়ে মুগ্ধ কন্ঠে বললো।

‘আমার ফুলকৌড়ি।

#ফুলকৌড়ি
(৪৯)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

সময়টা গভীর রাত।ছাঁদের রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে দীবা।ঠান্ডা বাতাসগুলো ক্ষনে ক্ষনে ছুঁয়ে যাচ্ছে তাকে, তবু্-ও কেমন অনড় দাঁড়িয়ে রয়েছে মেয়েটা।গায়ে কোনো শীতবস্ত্র নেই অথচ শরীর কাটা দেওয়ার মতো শীতলতা।

‘এতো রাতে,এই ঠান্ডার মধ্যে এখানে দাঁড়িয়ে কি করছো?

পরিচিত কন্ঠের বার্তা পেয়েও ভাবান্তর হলোনা দীবার।
সারাটা দিন যেনো তার কেমন কেমন গিয়েছে।আসলেই কেমন?চারদিকে আনন্দ উল্লাসে ভরপুর অথচ নিজের বলে কোনো আনন্দ নেই,খুশি নেই।শুধু ভারী ভারী নিঃশ্বাস আর শ্বাস আঁটকে আসা অসহনীয় বুকব্যথা।সকাল থেকে চারপাশটা যত সাজসাজ রবে সেজ উঠছিলো বাড়িটা, হৈচৈ পরিপূর্ণ হচ্ছিলো চারিদিক।ততোই যেনো মনে হচ্ছিলো এবাড়িটাতে কেমন নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার।তার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার নির্ভরশীলযোগ্য বাড়ি এটা নয়।চারপাশের ভালোমন্দ সবকিছু কেমন অসহনশীল হয়ে উঠছিলো।খুবকরে মনে হচ্চিলো,একটু সহজভাবে নিঃশ্বাস ফেলার জন্য তার দুরে কোথায় চলে যাওয়া দরকার।খুব দূরে।নয়তো গভীরভাবে ঘুমিয়ে পড়া দরকার।সেই ঘুম যেনো না ভাঙে।চিরনিদ্রায়িত হলেও সমস্যা নেই।কিন্তু তার না দূরে যাওয়া হয়ে উঠলো আর না গভীর পড়া হলো।সকাল থেকে সিয়াম কেমন তার পিছুপিছু ঘুরেছে।যার জন্য ছেলেটাকে কতো বাজে কথা শোনালো। তবুও ছেলেটা পিছু ছাড়েনি।কেমন,যেখানে সে ঘুরেফিরেই যেনো ছেলেটা সেখানে।আচ্ছা, সিয়াম কি কোনোভাবে তার আচারনে বুঝে গিয়েছিলো তার মনে কথা?হবে হয়তো।সিয়ামের কন্ঠ পেয়েও কথা বললো-না দীবা।সিয়াম পাশে এসে দাড়ালো তার।ফের আপনমনে বলে উঠলো–আমারও কেনো জানি ঘুম আসছেনা,তাই ছাঁদে চলে এলাম।লং-ড্রাইবে যাবে দীবা?চলো-না কোথাও থেকে একটু স্বস্তি একটু শান্তি নিয়ে আসি।যাবে?

তৃষ্ণার্থ মন,খেইহারা মাঝির মতো দরিয়ার তীর খুঁজে পেলো যেনো।যদিও সময় নিয়ে উত্তর এলো।–চলো।

দীবা একবাক্যে সিয়ামের রাখা প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাবে,এটা আশা করেনি সিয়াম।কিছুসময় বিস্ময় নজরে রাগী জেদি মেয়েটার দিকে কয়েক- সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে সময় নষ্ট না করে বললো–এসো।আমি নিচে গিয়ে গাড়ি বের করছি।

বিনাবাক্যয়ে সিয়ামের সাথেই নিচে নামলো দীবা।শান্ত মেয়ের মতো চুপচাপ সিয়ামকে অনুসরন করে, গাড়িতে গিয়েও বসে পড়লো।গাড়িতে বসার আগে নিস্প্রভ নজরে লন এরিয়ার ফুলেফুলে সজ্জিত স্টেজটার দিকে একপলক তাকিয়ে নিঃশব্দে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললো।ফের অজানা গন্তব্যে সিয়ামের সাথে বেরিয়ে পড়লো।রাস্তা এগোলো,এগোলো অজানা অচেনা রাজপথ।
সিয়ামের গাড়িটা কোথায় না কোথায় বাক নিলো।অথচ থামলোনা কোথাও। বিরামহীন গাড়িটা চলতে থাকলো।না গাড়ী থামলো আর না দু’জনের মধ্যে কোনো কথা হলো।কিছুদূর গিয়ে গিয়ে একেকটা চা-পানের স্টল দেখ গেলো।মধ্যে রাতে বিভিন্ন স্ট্যান্ডগুলোতে বিশেষত এগুলো খোলা দেখা যায়।এরকম কয়েকটা স্ট্যান্ড ছাড়িয়ে যেতেই সিয়াম জিজ্ঞেস করলো।

‘কোথাও থামবো?কিছু খাবে?

দীবা তখন গাড়ীর জানালায় হাত সঁপে, তাতে মুখ রেখে অপলক নির্বাক নজরে নিস্তব্ধ,নীরব শহরটাকে দেখে চলেছে।বিধস্ত মনটা,আর এলোমেলো শব্দ বোনা মস্তিষ্কটা খোলা বাতাস পেয়ে কিছুটা হলে-ও শান্ত হয়েছে।সিয়াম প্রশ্ন শুধাতেই কেমন অনুভূতিশূন্য গলায় বললো–না।

সিয়াম কেমন শান্ত নজরে একবার তাকে দেখে ফের গাড়ী চালানোয় মনোযোগ দিলো।যে পরিকল্পনা সে কাল করবে ভেবেছিলো, তা এক্ষনি করার কথা ভাবল।ফলশ্রুতি যা হয় হবে।নিজের বাড়ির দিকে গাড়ি মোড় নিলো সিয়াম।গাড়ীটা কোথায় কিভাবে মোড় নিচ্ছে দীবা বিশেষ মনোযোগী নয়।মুলত তারই সুযোগ নিলো সিয়াম।প্রায় ঘন্টাখানেকর মতো সময় পার করে যখন বাড়ির সামনে এসে গাড়ীটা দাঁড় করালো সিয়াম,দীবার হুঁশ ফিরলো।গাড়ীর জানালা দিয়ে বিশাল লোহার গেইটটা পেরিয়ে,রাস্তার সোডিয়ামের বড়বড় আলোয় ঝকঝকা আলিশান বাড়িটা নজরে পড়তেই বুকটা ধ্বক করে উঠলো মেয়েটার।এবাড়ির একমাত্র বউ সে।বেশ কিছুদিন সংসার হয়েছিলো তার এবাড়িতে।বাড়ি চিনতে তার ভুল হওয়ার নয়।সিয়াম কেনো তাকে নিয়ে আসলো এখানে?মূহুর্তেই চেচিয়ে উঠলো সে।-তুমি এখানে কেনো নিয়ে আসলে আমাকে?হোয়াই সিয়াম?

দাঁতে দাঁত পিষলো শেষ কথায়।সিয়ামের মধ্যে বিশেষ হেলদোল দেখালো না।সে কাকে যেনো পোন করতে ব্যস্ত।ওপাশের মানুষটা ফোন না ধরায় বিরক্ত হয়ে বারবার কল দিচ্ছে সে।তৃতীয় ব্যাক্তিটি ফোন ধরতেই শান্ত গলায় বললো–বাড়ির মেইন গেটটা খুলে রাখুন খালা। আমরা আসছি।

আশ্চর্য!আমরা আসছি মানে!দীবা দ্বিগুণ স্বরে ফের চেচিয়ে বললো–আমরা আসছি মানেটা কি?তুমি আমার অনুমতি ছাড়া এবাড়িতে কেনো নিয়ে আসলে আমাকে?বলো?

‘তুমি এবাড়ির বউ তাই।

‘আমি এবাড়ির কেউ না।আমাকে ওবাড়িতে দিয়ে এসো সিয়াম।বাড়িবাড়ি করো-না।

ক্ষিপ্র হলো সিয়াম।রাগে টনটন হলো মাথার শিরা-উপশিরা।গলা চড়িয়ে বললো–কেনো যাবে ওবাড়িতে?মরতে?এই আমি তোমাকে এতো ভালোবাসী তোমার চোখে পড়েনা?অন্যায় করেছিলাম,তোমাকে পাওয়ার পর শুধরে নিয়েছি।কেনো বিশ্বাস করছো না আমাকে?কেনো?স্বামী থাকতেও কেনো পরপুরুষের জন্য এতো পাগলামি!বিয়ের আগে একাধিক বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে লিপ্ত হওয়া যদি ভ্রষ্টতা হয়,বিয়ের পর স্বামী স্ত্রী মতো হলাল সম্পর্কে থাকার পর অন্য পরপুরুষের কথা ভাবা কি সেই একই ভ্রষ্টতা নয়?তুমি তখন আমার জীবনে না থেকেও,আমার অন্যায় মানতে পারছো না।আমি কি করে মানি?তবুও মানতে হচ্ছে!কেনো ভেবে দেখেছো কখনো?ভাববে কিকরে! তুমিতো নিভানকে ছাড়া কাওকেই ভাবতে পারো-না।

বলতে বলতে সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, নিভান নামটা আসতেই খেয়াল হলো সিয়ামের।সে-তো এসব বলে ফের নিজেদের মধ্যে জটিলতা আনতে চাইনি।অথচ রাগে পড়ে জিহ্বা সংবরণ করা গেলো-না।নিজেকে শান্ত করার অভিপ্রায়শ চালিয়ে কিছুসময় চুপ থেকে নিজেকে ধাতস্থ করে,দীবার জ্বলজ্বলে চোখের দিকে তাকিয়ে কেমন দূর্বল গলায় বললো—ওবাড়িতে তুমি ভালো নেই,তারপর-ও, যে তোমাকে চাইছেনা তার সংস্পর্শে থাকতে সেখানেই যেতে চাইছো।অথচ স্বামী হয়ে আমার অন্যায় গুলো মার্জনা করে এবাড়িতে আমার কাছে থাকতে চাইছোনা কোনো দীবা?কেনো?

‘আমাকে ওবাড়িতে দিয়ে এসো সিয়াম।

সেই একরোখা জেদ!সিয়াম মুখ ফিরিয়ে নিয়ে গাড়ীর ডোর খুলতে ব্যস্ত হলো।তাতে যেনো দীবার রাগটা চড়ে গেলো।সিয়ামের হাত চেপে ধরে তেজস্বী গলায় বললো–সিয়াম,বাড়াবাড়ি ক….

সিয়াম কথা বলতে দিলোনা দীবাকে।পিছে মুড়ে মেয়েটাকে টেনে কাছে এনে দুগাল চেপে ধরলো।ফের তার কথার তেজস্ক্রিয় থামিয়ে দিলো নিজের ঠোঁটের সিক্ততায়।দীবা ছটফট করলো।ছাড়লো না সিয়াম।এতোদিন মেয়েটাকে ইচ্ছেমতো বিরক্ত করলেও,কখনো কোনোবিষয়ে জোর করেনি।জোট খাটায়নি তারউপর।তবে মনে হচ্ছে,এবার থেকে একটুআধটু খাটাতেই হবে।এই ট্রেনিং সে নিভানের থেকে পেয়েছে।ইচ্ছেমতো চড় কিল চললো সিয়ামের বুকে কাঁধে।তবুও ছাড়লোনা সে।একটা সময় গিয়ে নিজেকে ছাড়াতে না পেরে নিশ্চুপ হয়ে গেলো দীবা।সুযোগ লুফে নিলো সিয়াম।সময় সুদীর্ঘ হলো।সেই সুদীর্ঘ সময়টা পার হওয়ার পর সিয়ামের মনোহলো দীবার শরীরটা কেমন নিস্তেজ হয়ে ছেড়ে আসছে। ততক্ষণাৎ তাকে ছেড়ে দিয়ে বুকে আগলে নিলো সে।

‘স্যরি লক্ষ্মীটি!আমি জোর করতে চায়নি তোমাকে।ট্রাস্ট মি,আমি জোর করতে চায়নি তোমাকে।এই সংসারটা তোমার।সবকিছু ভুলে গিয়ে চলো-না দু’জনে মন দিয়ে সংসারটদ করি।প্লিজ দীবা।

‘আই হেইট ইউ সিয়াম।আই হেইট….

আর বলতে পারলোনা দীবা।সারাদিনের মানসিক টানাপোড়েনে আর নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারল না।সিয়ামের বুকের টিশার্টটা খামচে কেমন নিস্তেজ হয়ে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলো তারই বুকে।সিয়াম সময় নিলো।দীবার কথা বিশেষ প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে তাকে কোলে তুলে নিয়ে গাড়ী থেকে বের হলো।গেটের দরোয়ান যেনো এই সময়টার অপেক্ষায় তথাস্তু ছিলো।বাড়ির সামনে ছোটো সাহেবের গাড়ী দেখে সে আগেই দরজা খুলে বসে ছিলো।কিন্তু গাড়ি থেকে যখন কেউ নামছেনা,ভিতরে ঝগড়াঝাটির মৃদু শব্দ ভেসে আসছিল কানে।তিনি মুখ ঘুরিয়ে বসে ছিলেন।বড়লোকদের ব্যাপার স্যাপারই অন্যরকম,এতে মনকান না দেওয়াই শ্রেয়।দীবাকে কোলে নিয়ে বাড়ির দরজায় পৌঁছাতেই দেখলো,দরজা খোলা।বাড়ি দেখাশানার মহিলাটি সোফায় বসে আছে।মা বাবা বাড়িতে নেই,আপতত ওবাড়িতে।সিয়ামকে দেখতেই অর্ধবয়স্ক মহিলাটা তড়িৎ উঠে দাঁড়ালেন।সিয়ামের কোলে দীবাকে ওরকম নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকতে দেখে সহসা জিজ্ঞেস করলেন।

‘বউমার কি হইছে?

‘এমনিতেই একটু অসুস্থ,এছাড়া কিছু নয়।আপনি ব্যস্ত হবেন না।আর দরজা লাগানোর দরকার নেই,আমি গাড়ি পার্ক করে দরজা লাগিয়ে দেবো।আপনি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।

আর কথা না বাড়িয়ে সিয়াম নিজেদের ঘরের দিকে চলে গেলো।ভদ্রমহিলা কেমন নিস্পাপ চোখে দেখলেন সেটা।স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়াঝাটি হয়ে আলাদা থাকছিলো দু’জনে।মিটে গেলো সব!মিটে গেলেই ভালো।আরও কিছু ভাবতে ভাবতে তিনি চলে গেলেন।

বিশাল বড়ো বাড়িটার সর্বত্র আলো জলছে।আশেপাশে থেকে ভেসে আসা মৃদু আলোতে দীবাকে নিয়ে রুমে ঢুকলো সিয়াম।মেয়েটাকে যেনো আরও নিস্তেজ মনেহলো।কোনো সাড়াশব্দ নেই।একদম কাদামাটি।
দীবাকে বেডে শুইয়ে দিয়ে গায়ে ভারী কম্বল জড়িয়ে দিলো সিয়াম।মেয়েটা কোনো উফতাক শব্দ করলোনা।আর না সিয়াম ডাকলো।যদি ঘুমিয়ে থাকে ঘুমাক।আর যদি জেগে থেকে-ও, নীরব থাকতে চায়।তবে থাকুক।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরের নরম আলোটা জ্বালিয়ে দিয়ে, দরজা টেনে বাহিরে চলে গেলো সিয়াম।গাড়িটা পার্ক করতে হবে।সিয়াম চলে যেতেই চোখ খুললো দীবা।মূহুর্তেই বালিশ জড়িয়ে নিঃশব্দে কেঁদে দিলো।কিছুক্ষণ বাদে সিয়াম এসে দেখলো,দীবা ঘুমিয়ে পড়েছে।চোখের কোণে নোনাঅশ্রু।কিছুসময় চেয়ে চেয়ে দেখলো সেই জ্বলজ্বলে অশ্রু।তারপর নরমস্পর্শে তা মুছে দিলো।আলতো স্পর্শে ঠোঁট ছোঁয়ালো দীবার কপালে।রাগী জেদী মেয়েটা হয়তো শরীরের সাথে কুলিয়ে উঠতে না পেরে এইমূহর্তে তার সবকিছু মেনে নিয়েছে,কাল কি হবে এর পরিনিতি?জানা নেই সিয়ামের।জানা নেই বলতে ভুল।জানা আছে,তবে যা হয় কাল দেখা যাবে।আপতত এই নিয়ে ভেবে এখন মনস্তাত্ত্বিকে পীড়া দিয়ে লাভ নেই।দীবার কপাল থেকে ঠোঁট সরিয়ে,ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো সে।

সময়টা বসন্তের মধ্যে প্রহরের দিনগুলো চলছে।শীতের হিমহিমভাব আমেজ পুরোপুরি কাটেনি তখনো।যদিও বসন্তেও তার প্রভাব হালকা পাতলা চলে। তবে এবার
বসন্তে তার প্রতাপ বেশ ভারী প্রকট।কুয়াশাচ্ছন্ন হিমশীতল এক ভোর।ঘুম ভেঙে গেল কৌড়ির।নড়াচড়া করতে গিয়েই বুঝতে পারলো, কারও শক্তপোক্ত একটা হাতের বাঁধনে জড়িয়ে আছে তার হালকা পাতলা ছোট্রো শরীরটা।নিদ্রায়মাণ সকল ইন্দ্রিয় যেনো মূহুর্তেই সজাগ হলো।সহসা চোখ খুললো সে।টের পেলো,গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলে তার পিছনে নিদ্রায়িত এক দীর্ঘাকার পুরুষ।যার ভারী নিঃশ্বাসের ধোঁয়াগুলো তীব্রভাবে ছুয়ে যাচ্ছে তার গলা, ঘাড়, কাঁধ, পিঠজুড়ে।যার বলিষ্ঠ পুরুষালী শক্তপোক্ত বুকের পাটায় মিশে আছে তার পেলব দেহ।আর সেই মানুষটার একটা হাতের পোক্ত বাহুতে এলিয়ে আছে তার মাথা।আর অন্য হতটা জড়িয়ে রয়েছে তার কোমর ছড়িয়ে পেটে।সেই লোমভরা আকর্ষণীয় হাতটার উপর তার হাতটা রাখা।অতঃপর দু’জনের অর্ধ শরীর পর্যন্ত শীতবস্ত্রে ঢাকা।

নিজের অবস্থান ঠিক কোথায় লেপ্টে আছে?বুঝে উঠতেই সকল ইন্দ্রিয় কেমন তড়িঘড়ি নিয়ে সচল হলো।আর তারচেয়ে দ্বিগুন ব্যস্ততা নিয়ে রন্ধ্রে রন্ধ্রে বইতে শুরু করলো অনুভূতির উষ্ণ প্রবাহিতা।নড়তে চাওয়া হাত পা মূহর্তেই অসাড় বনে গেলো।কাল বেশ রাতে ফিরেছে তারা।সারাদিনের সাজপোশাকে শরীর কেমন ম্যাজম্যাজ করছিলো।রুমে ঢুকেই তাই আগে গোসল করে নিয়েছিলো কৌড়ি।নিভান আগেই ফ্রেশ হয়ে বিছানা পরিপাটি করতে ব্যস্ত ছিল।ফুলেফুলে সাজানো বেডটা মুলত পরিস্কার করছিলো।কৌড়ি গোসল সেরে বের হতেই,দায়িত্ববান ব্যক্তির ন্যায় তাকে জিজ্ঞেস করলো–একসাথে ঘুমাতে কোনো অসুবিধা নেইতো?

সেই নিজথেকে কাছে যাওয়া। প্রগাঢ় চম্বুন।তারপর কি করে বলে,আমার অসুবিধা আছে।যদিও কৌড়ির অসুবিধা ছিলাে-না।ছিলো একরাশ লজ্জা।যা সমগ্র শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছিলো তখন।আর চেনা মানুষটার সাথে একসাথে কাছাকাছি থাকার সংকুচিততা।রন্ধ্রে রন্ধন সেই সংকুচিততা তখন ঘুরেফিরে চলছিলো।কি উত্তর দেবে ভেবে না পেয়ে,নিরাশিত ভঙ্গিতে কেমন কেমন করে চেয়েছিলো মানুষটার দিকে।মানুষটা বরাবরের মতো কি বুঝেছিলো কৌড়ির জানা নেই।তবে
কাছে এসে কোমল স্বরে বলেছিলো–একটু একটু করে, তুমি এক-পা আমি-পা এগিয়ে সহজ করে নেই আমরা আমাদের সম্পর্কটা?তুমিও তো এগিয়েছো,আমি-ও এগিয়েছি।এবার দু’জনে একসাথে এগোই?

সেই প্রগাঢ় চুম্বনের কথা মনে পড়তেই অনুভূতিতে জুবুথুবু হওয়া কৌড়ি কোনো কথাই বলতে পারিনি।শুধু মাথা নিচু করে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো।তবে মৃদুতর মাথা উপর নিচ নাড়িয়ে হ্যা সম্মতি প্রকাশ করতেও ভুলেনি।কারণ মানুষটা যে তার সম্মতির দীর্ঘ অপেক্ষায় ছিলো।সেই মানুষটাকে উপেক্ষা করা যে অমর্যাদা।

‘তবে এসো ঘুমাবে।

বার্তা জানিয়ে মানুষটা সরে যেতেই লজ্জায় বুদ হয়ে থাকা কৌড়ি নড়েচড়ে দাড়ালো।মুখ উঁচু করে বেডের দিকে তাকাতেই ভিতরটা কেমন কম্পিত হলো।মানুষটার সাথে এক বিছানায় ঘুমাতে হবে!শুধু আজ নয়,এরপর থেকে রাত থাকতে হবে।স্বাভাবিক। তবুও কদম ফেলে সেদিকে যাওয়ার জন্য পা উঠতে চাইলো না তার।হঠাৎ নিভানকে সামনে এসে দাঁড়াতে দেখেই তারদিকে ফিরলো।অমায়িক হাসলো নিভান।হাতে মোটাসোটা একটা খাম তার।সেটা কৌড়ির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো—তোমার মোহরানা।স্বামী প্রদত্ত প্রাপ্য দেনমোহর। নাও।

কৌড়ির কয়েক পলক নিভানের দিকে আর হাতের খামটার দিকে তাকিয়ে নমনীয় কন্ঠে বললো–আপনার কাছে রেখে দিন।আমি কি করবো।

‘আমার কাছে কেনো রেখো দেবো?এটা একান্ত তোমার প্রাপ্য। এটা দিয়ে তুমি যা ইচ্ছে তাই করতে পারো।এই অর্থ আমার উপার্জন হলেও এটাতে আমার হক নেই যে, আমার কাছে রেখে দেবো।আর হক থাকলেও কি!এখন থেকে এঘরসহ এঘরের মালিকের দায়িত্ব তোমার।তার সবকিছুর হক তোমার।তাই স্ত্রী হিসাবে তার ভালোমন্দের সবকিছুর দায়িত্ব,হক তোমাকেই পালন করতে হবে।আমার সবকিছুর দায়িত্ব পালন করতে চাওনা? নেবেনা তুমি?

শ্বাস রূদ্ধ হওয়ার মতো প্রশ্নাবলী!যার উত্তর কৌড়ি মুখ ফুটে দিতে পারিনি।অথচ ভিতরে ভিতরে মন ঠিকই উত্তর দিয়েছিলো।-হ্যা আমি স্ত্রী হিসাবে আপনার সকল দায়দায়িত্ব আমৃত্যুকাল নিখুঁতভাবে পালন করে যেতে চাই।তবে মুখ কথাগুলো বলতে না পারলেও,আচারনে ঠিকই বুঝিয়ে দিয়েছিলো।নীরবে মানুষটা বাড়িয়ে রাখা খামটা নিজের দু’হাতে তুলে নিয়েছিলো।তারপর ফুলসজ্জার রাত উপলক্ষে মানুষটা তাঁকে আরও একটা বিশেষ উপহার দিয়েছিলো।একটা দামী নীলাপথরের চেইন।সেটা নিজ হাতে পরিয়ে দিতে দিতে বলেছিলো– এটা ছিড়েখুঁড়ে না যাওয়া পর্যন্ত কখনো গলা থেকে খুলবে-না।আমার নজর সবসময় তোমার গলায় ওটা জ্বলজ্বল আভা ছড়িয়ে পড়তে দেখে যেনো তৃপ্ত হয়।কখনো খুলবে না। কেমন?

অদ্ভুত মোহনীয় আবদার।মোহিত হয়েছিলো কৌড়ি।নিভানের কথার মায়ায় ডুবে সম্মতি-ও জানিয়েছিলো।
আর শুধু চেয়ে চেয়ে নিষ্পলক চোখে দেখেছিলো শ্যামবর্ণ মানুষটাকে।যেদিন থেকে মানুষটা নিজের বলে তাকে দাবী করলো।তারপর থেকে একটু একটু করে পৃথিবীর সমগ্র সুখ যেনো তার আঁচলে নিঙড়ে দিতে শুরু করলো।যাকে কৌড়ি কিছুই দিতে পারছে-না।আর সামনে কি দিতে পারবে,জানা নেই।

তারপর কৌড়ির হাত থেকে খামটা নিয়ে সোফার উপর রেখে দিয়ে মানুষটা খুব মায়াময় কন্ঠে বলেছিলো-চলো ঘুমাবে।আজ তিনদিনে অনেক ক্লান্তি গিয়েছে।তারউপর তুমি অসুস্থ।

কি সাবলীল বানী।মনেহয়,কতোদিনের সহধর্মিণী সে।তাকে নিয়ে গিয়ে বেডে শুইয়ে দিয়ে,খুব আদূরে একটা চুম্বন দিলো তার কপালে।তারপর নিজে গিয়েও শুয়ে পড়লো তার পাশে।দুজনের গায়ে ভারী কম্বল জড়ালো।সেদিনের সেই কম্বলটা।যে কম্বলটা নাফিম আর তার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিলো মানুষটা।যাতে এখনো মানুষটা গায়ের পারফিউমের তীব সুগন্ধে সুগন্ধিত হয়ে আছে।পুরো ঘরটাজুড়ে মানুষটার সুগন্ধে যেনো সুগন্ধিত।সেই ঘরের মালিক আস্ত পাশে তার,নাকে সুগন্ধটা তীব্র থেকে তীব্রতর লাগতেই সারাদিনের ক্লান্তি অবসাদে ডুবে এলো আঁখি। ঘুম এসে গিয়েছিলো মূহুর্তেই।তারপর আর কৌড়ির কিছু জানা নেই।একদম কিছু জানা নেই।এমনিতেই ঘুম কাতুরে মেয়ে সে।তারপর আজ কয়েকদিন ঔষধের প্রভাবে ঘুমালে যেনো চোখ মেলাতেই পারছে-না।আর গতকাল এতো ক্লান্ত ছিলো শরীর।ঘুমের মধ্যে কিচ্ছু টের পায়নি সে।তবে ঘুমাবার সময়তো এতো কাছাকাছি ঘুমাইনি তারা।তবে?

তবে?ভেবেই যেনো মুখে অস্পষ্ট হাসি ফুটলো কৌড়ির।এই হাসির কারণ কি,তার জানা নেই?তবে কালতো মৌনতা তাকে এভাবে জড়িয়ে শুয়েছিলো,কৈ এরকম অনুভব তো হয়নি!সময় নিয়ে নিজের অনুভুতিগুলোকে ধাতস্থ করলো কৌড়ি।তারপর আলতো হাতে গায়ের ভারী শীতবস্ত্রটা সরিয়ে ফেললো।নিজের পেটের উপর শক্তপোক্ত হাতটায় হাত রাখতেই ভিতরটা কেমন ছমছম করে উঠলো।তবু্ও নরম স্পর্শে সেই হাতটা ধরে সরিয়ে নিভানের গায়ে জড়ানো ভারী কম্বটার উপর রেখে তড়িৎ উঠে বসলো।মূহুর্তেই নড়েচড়ে উঠলো পিছনের মানুষটা,ফের শান্ত।কৌড়ি পিছে মুড়লো।

নীল সবুজের ধিমে আসা মিঠে আলোতে শ্যামবর্ণ মুখটা স্পষ্ট।নিদ্রাত বুজে থাকা চোখ,গাঢ় শ্বাসপ্রশ্বাস বলে দিচ্ছে মানুষটা এখনো গভীর ঘুমে।সেই ঘুম ভাঙার চেষ্টাও করলোনা কৌড়ি।সামনে ফিরে শব্দহীন নেমে পড়লো বেড থেকে।অপরিচিত রুমটায় আশেপাশে খেয়ালি নজরে তাকালো।সবকিছু নতুন,অপরিচিত। যেখানে আগে আসা হয়নি কখনো,কালকে রাতেই প্রথমে আসা এই রুমে।রুমের জানালা দরজা সব বন্ধ। প্রতিটি জানালা দরজায় ভারী ভারী পর্দায় শোভায়িত।রুমটা নীরব,শান্ত।রাতের মধ্যে আলোহীন।শুরু কৃত্রিম আলোটা ছাড়া বাহিরের পরিবেশ বোঝা দুঃসাধ্য।কয়টা বাজে?ঘুরেফিরে বামপাশের দেয়ালের দিকে ফিরতেই বড়সড় একটা দেয়ালঘড়ি নজর পড়লো।সেখানে সময়ের কাটাগুলো স্পষ্ট জানান দিচ,৫ঃ১৫।অর্থাৎ ফজরের আযান শেষে এখন ভোর।কৌড়ি বেডের দিকে আরও একবার তাকিয়ে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলো।হঠাৎ মনেহলো গায়ে ওড়না নেই।চমকে তড়িৎ আবার ফিরে এলো।মানেটা কি?গায়ের ওড়না গেলো কোথায়?নিজের শোয়ার জায়গাাটা অনুসন্ধান করে না পেয়ে,আস্তেধীরে নিভানের গায়ের কম্বলটা উচু করলো।মানুষটার শরীর দিয়ে পিঠের নিচে জড়িয়ে আছে ওড়নাটা।ভুলেও চেষ্টা করলোনা ওড়না ছাড়ানোর।কম্বলটা ঠিকঠাক করে দিয়ে,আশেপাশে নজর দিলো।কালকে নিভানের জড়িয়ে দেওয়া হিজাবটা সোফার উপর দেখে তড়িৎ গিয়ে সেটা উঠিয়ে নিজের গায়ে মাথায় জড়িয়ে নিলো।অদ্ভুত ভঙ্গিতে বুকে হাত চেপে শ্বাস নিয়ে আরও একবার বেডের দিকে তাকিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো।সময় নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে নামাজ পড়ে নিলো।কাল পিরিয়ড নিয়ে সন্দেহ থাকলেও,রাতে গোসলের পর সন্দেহটা কেটে গিয়েছে।রাতে গোসলটা সে ঋতুশ্রাব থেকে সুস্থ হওয়ার বদলে ফরজ গোসলের নিয়তেই করেছিল। বিধায় সন্দেহের প্রবনতা যেমন নেই,নামাজ পড়তেও অসুবিধা নেই।নিজে নামাজ পড়ার পর,গভীরঘুমে শয়নরত মানুষটাকেও ডেকে উঠিয়ে নমাজ পড়াতে মন চাইলো।তবে কোনো এক দ্বিধায় পড়ে মানুষটাকে আর ডেকে উঠানো হলো-না।নামাজের বিছানায় বসে নিজের অতিত বর্তমান নিয়ে বেশ ভাবলো।কতো দ্রুত নিজের জীবনের গতিবিধি পাল্টে গেলো।কাল এসময় কোথায় ছিলো,কি করছিলো!আর আজ কোথায়?

জায়নামাজ থেকেও ওই মানুষের শরীরের পারফিউমের সুগন্ধ।আশ্চর্য!মানুষটা ঘরের প্রতিটি জিনিসে সুগন্ধটা কি নিজ ইচ্ছাকৃত ছড়িয়েছে?নাকি তার স্বীয় সুগন্ধে সিক্ত হয়েছে এঘরের প্রতিটি জিনিস।হঠাৎ নিজের শরীর থেকেও একই সুগন্ধ অনুভব করলো কৌড়ি।শিহরিত হলো শরীর।তার গায়ে তো ইচ্ছেকৃত পারফিউমের ছিটেফোঁটা লাগানো হয়নি।এমনকি মানুষটা লাগিয়েও দেয়নি।তবে কি?তার খুব কাছাকাছি ঘুমানোর ফলশ্রুতি!তাই হয়তো।এঘরের সবকিছুর মতো স্বীয় সুগন্ধে সিক্ত করেছে তাকেও।আপন মর্জিতে ঠোঁট প্রসারিত হয়ে এলো কৌড়ির।নামাজের বিছানাটা গুছিয়ে আবারও বেডের দিকে নজর দিলো।লম্বাচওড়া মানুষটা কেমন কম্বলটা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিস্পাপ বাচ্চাদের মতো ঘুমিয়ে আছে।নিষ্পলক চোখে কিছুক্ষণ দেখে,নিঃশব্দে রুম থেকে বের হলো কৌড়ি।

আজ যেনো রুমের বাহিরে পা ফেলতে কিছুটা অস্বস্তি কাজ করলো কৌড়ির। কিছুক্ষণ দরজার মুখে দাঁড়িয়ে এদিকে ওদিকে তাকালো।বাড়িটা নিঃশব্দ।হয়তো সবাই এখনো ঘুমে।এবার ধীরে ধীরে পা এগোলো কৌড়ি। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই রান্নাঘর থেকে খুটখাট শব্দ এলো কানে।এসময়ে রানীসাহেবা থাকে কিচেনে।কোথায় যাবে ভেবে না পেয়ে সেদিকে এগোলো সে।সত্যি রানিসাহেবা কিচেনে।চুলার উপর চায়ের প্যান বসানো।তাতে অর্ধ প্যান পানি।পানি এখনো শিথিল।হয়তো কেবল পানি বসিয়েছে।পানি বসিয়ে তিনি সকালের নাস্তা বানানোর সরঞ্জাম রেডি করছেন।তাকে কিচেনে দেখেই সহসা তিনি কেমন ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললেন।

‘আরেহ নতুন বউ তুমি এতো সকালে এখানে কেনো?

কৌড়ি যেনো লজ্জায় পড়লো।”নতুন বউ” রানিসাহেবার মুখে হঠাৎ এমন সম্বোধন তাকে কেমন লজ্জার আড়ষ্টতায় ফেলে দিলো।ভেতরটা অদ্ভুত অনুভূতিতে হাসফাস করে উঠলো।তবুও বাহিরে নিজেকে ঠিক রাখার প্রচেষ্টা করে অপ্রস্তুত হেসে বললো–আমি-তো রোজ এরকম সকালেই উঠি।আপনি তো জানেনই।

‘তবে আজ।

কথাটা বলে নিজেও যেনো কেমন থতমত খেলেন।যেটা তার মুখভঙ্গিমায় প্রকাশ পেলো।কৌড়ি যেনো আরও অপ্রস্তুত হলো।তবে পরিস্থিতিতি সামলাতে
বললো–আজও ঘুম ভেঙে গেলো, তাই উঠে পড়লাম।
ঝুড়ির মরিচগুলো আপনার বাগানের না?

রানাঘরের কেবিনেটের পাশে বড়সড় একটা ঝুড়িতে গাছসহ মরিচগুলো রাখা।সেগুলো দেখেই মুলত বললো কৌড়ি।সেটা খেয়াল করে রানী বললো — হ্যা। শীতের আগে লাগিয়েছিলাম।বিয়ে উপলক্ষে বাড়ির চারপাশটা পরিস্কার করায়,সব গাছগুলো কেটে ফেলানো হয়েছে।

‘মরিচগুলোতো এখনো সেভাবে বড় হয়নি।আরও বড়বড় হতো তো।গাছগুলো কাটলো কেনো?আপনার লাউশাক শাছ,পুঁই মাচা সবকিছু কেটে দিয়েছে।

রানী হাসলো। মাথা ঝাঁকিয়ে বললো –হ্যা। পিছনের আগানবাগান সব পরিস্কার করে ফেলেছে তো।

কৌড়ির মন খারাপ হলোা।রানীসাহেবা কতো শখ করে গাছগুলো লাগিয়েছিলেন।এক বিয়েতে সব নষ্ট হয়ে গেলো।বাড়ির ভিতরের কাজকাম গুছিয়ে,প্রায়শই তিনি সেখানেই সময় দিতেন।সেই সময়টা বৃথা গেলো।ইশশ।
সদ্য বিবাহিত রমনীর জৌলুশ মুখটা মূর্ছা যেতে দেখেই রানি বললো–মন খারাপ লাগছে? মন খারাপ করোনা কৌড়িমনি।আল্লাহ বাচিয়ে রাখলে,সামনের বছর আবার লাগাবো সবকিছু।এবারের সবজিবাগানের কৃষাণী আমার সাথে নাহয় তুমিও হলে।কি হবে না?

মূহুর্তেই মেঘ কেএে গিয়ে যেনো ঝলমলে রৌদ্দুর ভর করলো কৌড়ির মুখে।কন্ঠেও সেই ঝলমলতা বজায় রেখে কৌড়ি বললোো–ঠিক আছে রানীসাহেবা।এবারের সবজি বাগান করতে,অবশ্যই আমি আপনার সঙ্গী হবো।

রান্নাঘরের ছোটো টুলটা টেনে বসে পড়লো কৌড়ি।মরিচের ঝুড়িটা টেনে নিতেই রানী বললো–আরেহ কি করছো?

‘মরিচগুলো বেছে রাখি।আমিতো সেভাবে কাজ জানিনা যে আপনাকে সাহায্য করবো।আর দাদিআপার থেকে যেটুকু শিখাছিলাম,তাতো এবাড়িতে এসে ভুলেই গেছি।

‘তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে-না।আর ওগুলো বাছতে গেলে হাত জ্বলবে-তো।সদ্য মেহেদী মাখা সুন্দর হাতদুটো জ্বলনে ব্যবহার করলে,নিভান বাবাতো বাড়ি মাথায় তুলবে।তোমার প্রতি যা যত্নবান ছেলেটা!অবশ্যই সবার প্রতি খেয়ালি,যত্নবান ছেলেটা।

‘উনি কিচ্ছু বলবেন না।

কথার ফাঁকেই কৌড়ি মরিচগুলো বাছা শুরু করে দিলো।রানী তার মেহেদীরঙা হাতদুটোর দিকে চেয়ে রইলো।গাঢ় খয়েরী মেহেদীরঙা ফর্সা হাতদুটো নজর কাড়ছে প্রচন্ড।সেই হাতদুটো নড়েচড়ে কাজ।কি অদ্ভুত সুন্দর যে দেখাচ্ছে।

‘রানিসাহেবা,ঝুড়ির মধ্যে তো দেখছি মরিচ বাদেও টমেটো বেগুন শিম মিশ্রিত।ঝুড়ি দিন আমি আলাদা আলাদা করে গুছিয়ে দিচ্ছি।

‘বললাম তো তোমার কিছু করা লাগবেনা,কৌড়িমনি।

‘দিন না আপনি।

রানি বাধ্য হলো দিতে।কৌড়িও ঝটপট হাতে একে একে আলাদা আলাদা গুছিয়ে দিতে থাকলো সবকিছু।রানী নাস্তা বানানোর কাজে মন দিলো,চায়ের দিকেও খেয়াল করলো।দুদিকেই নজর তার।তারমধ্য কৌড়ির সাথে টুকিটাকি গল্পে মেতে থাকলো।

‘রানিসাহেবা,তুমি একা একা কারসাথে এতো কথা বলছো?

সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গিয়েছে মান্যতার।নিজের একান্ত বেডটায় একা একা ঘুমাতে ঘুমাতে অভ্যাস হয়ে গেছে।কৌড়ি আর মৌনতা থাকলে বা দুই একজন থাকলে ততোটা ঘুমের অসুবিধা হয়না।কালরাতে বেশ কয়েকজন একসাথে ঘুমানোর ফলে,রাতে ঘুমে-তো ব্যাঘাত ঘটেছেই।সাথে সকালে আর ঘুমিয়ে থাকতেই পারলো-না।এতো সকালে কাকে গিয়ে বিরক্ত করবে,তাই বাগানের দিকে যাচ্ছিলো।ড্রয়িংরুম পার হতেই রানীসাহেবাকে কথা বলতে দেখেই কৌতুহলবশত কিচেনের দিকে এগোলো।কিচেনে রানিসাহেবাকে একা কথা বলতে দেখে কৌতুহল যেনো তার দ্বিগুন হলো।তাই সহসা প্রশ্নটা করলো।কৌড়ি নিচে টুল পেতে বসে থাকায় কেবিনেটের আড়ালে তাকে দেখা যাচ্ছিলো না।

‘আমি একা কই?নতুন বউমাও তো আছে।

‘নতুন বউমা?

হাসলো রানী।বললো–‘কৌড়িমনি।

কৌড়ি!সহসা বড়বড় পা ফেলে রান্নাঘরে ঢুকলো মান্যতা। তাকে দেখে অমায়িক হাসলো কৌড়ি।সহসা মান্যতা প্রশ্ন করলো –তুই সাতসকালে সকালে এখানে?

পুনরায় একই প্রশ্নে লজ্জা পেলো কৌড়ি।মান্যতাও প্রশ্ন করে কেমন যেনো বিব্রত হলো।রানীসাহেবার দিকে একপলক তাকিয়ে দেখলো,তিনি নিজের কাজে ব্যস্ত। কৌড়ির উত্তরের অপেক্ষা নাকরে বললো–চল।বাগান থেকে ঘুরে আসি।

ততক্ষণে কৌড়ির গোছানো প্রায় শেষের দিকে।তাই বললো–আর একটু আছে। এটুকু করে নেই।

‘রানীসাহেবা,তুমি একটু করে নিতে পারবে-না?ওকে নিয়ে যাই?

রানী ততক্ষণাত বললেন–আচ্ছা যাও।কৌড়িমনি তুমি উঠো,ওটুকু আমিই করে নেবো।এতবার নিষেধ করলাম শুনলে তো না।যাও হাত ধুয়ে বড়মায়ের সাথে যাও।

কৌড়ি বাধ্য মেয়ের মতো হাত ধুতে সিংয়ের সামনে দাড়ালো। মান্যতা দুষ্টমী গলায় ততক্ষণাত বললো–রানী সাহেবা,কৌড়িমনি থেকে’তোমার নতুন বউমা ডাকটা কিন্তু দারুন ছিলো।

ফের আমায়িল হাসলো রানী।বললো—আচ্ছা এবার থেকে তবে তাই বলে ডাকবো।

মান্যতার দুষ্টমি বুঝে কৌড়ি রাণীকে উদ্দেশ্য করে বললো–‘আপনার কৌড়িমনি ডাকটা আমার কাছে আরও আদূরে লাগে।

রানি সহসা উত্তর দিলো–‘আচ্ছা মাঝেমধ্যে নাহয় কৌড়িমনি বলেও ডাকবো।

মান্যতা মিছেমিছি বিরোধিতা করে বললো—তুই নতুন বউ তোকে কেনো কৌড়িমনি বলে ডাকবে।আগে এই বাড়ির মেয়ে মনে করে রানীসাহেবা নাহয় আদর করে ডাকতেন।এখন তার নিভান বাবার বউ তুই।এখন আর আদূরে নাম টাম না।বউ ইজ বউ।সো নতুন বউ বলে ডাকবে রানীসাহেবা।

কৌড়ি এসে মান্যতার হাত পেচিয়ে ধরলো।মিষ্টি অভিমান দেখিয়ে অভিযোগ করলো–পর করে দিতে চাইছো?

‘রায়বাঘিনী ননদিনী আমি তোর।নাম রক্ষা করতে হবে না!

কৌড়ি এবার মান্যতা জড়িয়ে ধরলো।আহ্লাদিত কন্ঠে বললো—তুমি আমার ভালো আপু।

‘আর তুই আমার দাদাভাইয়ের বউ।তুই জানিস?দাদাভাই আমাদের কাছে কি?আর তুই তার বউ!পুতুল বাচ্চা বউ!সবার আদূরে।এবাড়ি সংক্রান্ত আগে যে ভালোবাসা পেয়েছিস,তা আমাদের সম।অথচ ওই মানুষটার সবার কাছে আলাদা,সবার কলিজার একটুকরো আদর। ভালোবাসা।এবার সবার কাছে ভালোবাসা পাবি দাদাভাই স্পেশাল,আদর ভালোবাসা।সে সবার মধ্যেমনি মানে তার বউও।সেখানে কারও হিংসা বিদ্বেষও,সেই আদর ভালোবাসা একতিল কমার নয়।কমবেও না।তাই না রানীসাহেবা?

রানী সেকেন্ড সময় ব্যয় না করে উত্তর দিলো–একদম তাই।

তা কি আর কৌড়ি জানেনা!হাসলো তিনজন।ফের মান্যতা তাড়া দিয়ে বলো।–চল।

‘তুই যে ভাবী।ননদ হয়ে একটু মজা করবো।পারছি-না।বড় দাদাভাইয়ের বউ বলে কথা।মজা করতে কলিজায় মোচড় দিচ্ছে।

মান্যতার বলার ভঙ্গিমা দেখে হেসে দিলো কৌড়ি।বললো –কলিজায় মোচড় দিচ্ছে যখন,তখন আর মজা করে লাভ নেই।

হঠাৎ নীরব হলো দুপাশ।দুজনে হেঁটে চললো লন এরিয়া ছাড়িয়ে বাগানের দিকে।লন এরিয়ার অন্যপাশে তখনো বিয়ের স্টেজটা সাজানো গোছানো মোড়ানোয়।এপাশে সারিবদ্ধ করে বিভিন্ন ফুলের বাগান।বিয়ে উপলক্ষে গাছগুলো সুন্দর করে ছেটেছুটে পরিচ্ছন্ন করে সাজানো হয়েছে।মুল গেটের থেকে গাড়ি পার্কিং- এরিয়া পর্যন্ত সারিবদ্ধ দুটি ঝাউগাছের ফাঁকে ফাঁকে একটা করে বেলীফুলের ঝাড়।তাতে থোকা থোকা ফুল ফুটেছে।ঝাঁপানো গাছের নিচেও ফুল ঝরে পড়েছে। সকালের কুয়াশাচ্ছন্ন শিশিরভেজা ঘাসের উপরে পড়া শুভ্র ফুলগুলো এতো সতেজ স্নিগ্ধ। দুহাতে কিছু ফুল কুড়িয়ে নিলো কৌড়ি।তা দেখে মান্যতা ও কুড়ালো কয়েকগাছি।হঠাৎ কৌড়ি শুধালো।

‘তৃনয় ভাইয়া,তোমাকে পছন্দ করে আপু?

বিস্ময় নিয়ে কৌড়ির মুখের দিলো তাকালো মান্যতা। কৌড়ি বুঝলো কি-করে?এ ব্যাপারে সেভাবে তো কেউ জানেনা।তবে কৌড়ি জানলো কিকরে?ভিতরটা কেমন হাসফাস লাগলেও বাহিরটাতে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলো সে।সময় নিয়ে কেমন এড়ানো স্বরে বললো–

‘উনি কেনো আমাকে পছন্দ করবেন!যাই হোক, চল ওদিকে যাই।কি সুন্দর গোলাপ ফুটেছে দেখ।আমাদের ডাকছে যেনো।

কৌড়ি দ্বিতীয়ত প্রশ্ন করার সুযোগ পেলোনা।তার আগেই তার হাতটা ধরে গোলাপের সারিবদ্ধ বাগানের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো মান্যতা।আগে খেয়াল না করলেও আজ তিনদিন ধরে খেয়াল করছে,মান্যতা আপুর দিকে অদ্ভুত নজরে তৃনয় ভাইয়ার চেয়ে থাকা।মান্যতা আপুর একটু কাছে ঘেঁষতে চাওয়া,থেকে থেকে কথা বলার উদ্বিগ্নতা। অথচ মান্যতা আপু তাকে যেনো চেনেই না।কেনো এমন আচারন?তার নজরে যদি তৃনয় ভাইয়ার ভালো লাগাটা প্রকাশ পেয়ে থাকে,তবে কি মান্যতা আপুর নজর সেই ভালো লাগাটা।তার প্রতি ছেলেটার দূর্বলতা নজরে পড়েনি?সত্যিই কি পড়েনি?

‘হিজাবটা কিন্তু দারুন।তোকে বেশ মানিয়েছে।দারুন দেখাচ্ছে। দাদাভাই দিয়েছে?

হিজাব পরা তো অনেক আগেই দেখেছে!প্রশ্ন এখন?প্রসঙ্গ এড়াতে চাইছে আপু?হয়তো-বা।তাই কৌড়ি-ও আর সেসবে কৌতূহল দেখালোনা।শুধু মান্যতার প্রশ্নে ছোটো করে উত্তর দিলো–হুমম।

দু’জন প্রসঙ্গ পাল্টে মজে গেলো কথায়।কথার ফাঁকে দুষ্টমি হলো।মজা হলো।শিশিরভেজা ফুলগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখা হলো।তার ভেজা মাতাল গন্ধ নেওয়া হলো।কিছু স্নিগ্ধ ফুল তুলে কানে গোঁজাও হলো।এভাবেই চলতে থাকলো তাদের ভোরের বাগান বিলাশ।

বেলকনিতে দাঁড়িয়ে নিবিড়চোখে সদ্য বিবাহিত বউয়ের আর বোনের সকাল সকাল উচ্ছ্বসিত হওয়া পাগলামো গুলো দেখতে থাকলো নিভান।কাল মেয়েটা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর তাঁকে সুক্ষ স্পর্শে কাছে টেনে নিয়েছিলো সে।কিকরে পারতো,মেয়েটাকে পাশাপাশি রেখে কাছে না টেনে ঘুমাতে!এই মেয়েটাকে একটু কাছে পাওয়ার জন্য কতো উতলা হয়েছে মন!বরংবার তা সংবরণ করে গিয়েছে।কাল সেই সংবরণটা আর মানতে চাইনি। ধৈর্যহারা হয়ে ঘুমন্ত মেয়েটাকে নীরবে কাছে টানতে শরীর মন দুটোই বাধ্য করেছিলো।শরীরকে পাত্তা দেয়নি সে।মনটাকে পাত্তা দিয়ে মেয়েটাকে নিজের সাথে নিবিড়বন্ধনে জড়িয়ে নিয়েছিলো শুধু। কি স্নিগ্ধ শান্তিময় সে অনুভূতি।সেসব অনুভূতি ছাড়িয়ে আরও একটা অনুভূতি জেগেছিলো।তা হলো নিজের পৌরুষ অনুভূতি। যেটাকে সংবরণ করার ক্ষমতা নিভানের ছিলো।সংবরণ করেও ছিলো সে।অথচ মেয়েটাকে কাছে পাওয়ার স্পর্শে ঘুমাতে পারিনি প্রায় অর্ধ রাতের বেশিসময়।তারপর কখন কিভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিলো নিজেও জানেনা।সেই বউ সকাল সকাল তার নিবিড়বন্ধন ছেড়ে পাখির মতো উড়াল দিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বেড়াচ্ছে।আজ পাখি বাঁধন ছেড়ে বেরিয়ে গেছে।রোজ রোজ কি আর তা হবে!হতে দেবে-না নিভান।ওই নরম শরীরটা চুপচাপ বুকে পড়ে থাকার অনুভূতি! অবর্ননীয়!অস্পষ্ট হাসি ফুটলো নিভানের ঠোঁটে।হাসিটা ভিতরের।সুখের, প্রশান্তির।

হঠাৎ মান্যতার দিকে নজর পড়ায় ভাবনা কাটলো নিভানের।কিছু একটা ভেবে লন এরিয়ার আসার জন্য অগ্রসর হলো সে।লন এরিয়ায় পা রাখতেই দেখলো, কালকের পাতা চেয়ার টেবিলে বসে ননদ- ভাবী চুটিয়ে গল্প করছে।সাথে হাসি মজাও।তাকে দেখতেই দু-জনে চুপ হয়ে গেলো। দুজনের চোখমুখেরই দুধরনের আড়ষ্টতা।দুজনের এই আড়ষ্টতার কারণ নিভানের জানা।তাই বিশেষ গুরুত্ব দিলোনা।নিভানকে কাছে এসে দাঁড়াতেই উঠে দাঁড়ালো মান্যতা।ভাই ভাবীকে স্পেস দিতে তড়িৎ বললো—আমি আসছি।তোমারা কথা বলো।

মান্যতা কদম সামনে এগোনোর আগেই নিভান বললো—তোমার সাথে আমার কথা আছে মান্যতা।

বুক ধড়ফড় করে উঠলো মেয়েটার।কি কথা?ততক্ষনে কৌড়ি উঠে দাঁড়িয়েছে।এবার সে বললো–তোমরা কথা বলো।আমি একটু ভিতর থেকে আসছি।

নিভান ততক্ষণে বসে পড়েছে। সে কিছু বলার আগেই মান্যতা কৌড়ির হাত চেপে ধরলো।কেমন করে তাকালো তার দিকে।দাদাভাই মানেই আতঙ্ক।আর কথা আছে মানেই, ভয়ংকর কিছু।কিছুতেই কৌড়িকে ছাড়া যাবেনা।এমূহর্তে দাদাভাইয়ের সামনে সহজভাবে থাকার সাহস সে।মান্যতার পরিস্থিতি বুঝে নিজের আড়ষ্টতা কাটিয়ে নিভানের পাশের চেয়ারে বসে পড়ল কৌড়ি।তাকে দেখে বসে পড়লো মান্যতাও।নিভান সময় নিয়ে রয়েসয়ে বললো।

‘কাল তৃনয় বাবার কাছে তোমাকে চেয়ে বিয়ের প্রস্তাব রেখেছে।

শ্বাস যেনো বুকেই বিঁধে গেলো মান্যতার।তা আর বুক ভেদ করে নিঃশ্বাস হয়ে নাক দিয়ে বের হতে ভুলেই গেলো।যে ভয়টা পাচ্ছিলো,সেটাই হলো।লোকটাকে হাতের নাগালে পেলে,নিশ্চিত সে গলা চেপে ধরত।তার মতো নিঃশ্বাস না আঁটকে আসা পর্যন্ত ছেড়ে দিতোনা সে।অসভ্য লোক একটা!

‘ও বাবার আগে আমার কাছেই প্রস্তাব রেখেছিলো।বাবা এবং আমার একই কথা,তোমার সিদ্ধান্ত ইম্পর্ট্যান্ট।

বড়ো ভাইয়ের সামনে এমনিতেই সংকোচ,দ্বিধা কাজ করে।তারউপর এমন একটা বিষয়।মান্যতা আর-ও সংকুচিত হলো।কৌড়ি নীরব দর্শক।গলার কাছে বিঁধে থাকা নিঃশ্বাসটা কেমন হাসফাস করে উঠলো মান্যতার।তারসাথে মস্তিষ্কে ঘোরা একটা প্রশ্ন।মান্যতা শ্বাস ছাড়লো।দ্বিধা আড়ষ্টতা নিয়েও মস্তিষ্কে হাসফাস করা প্রশ্নটা করেই ফেললো।

‘তোমাদের সিদ্ধান্ত কি?

নিভান সহসা বললো–‘তৃনয়ের মতো ছেলেকে নাকচ করার মতো ত্রুটি বা যুক্তি তো আমি দেখছি-না।তার সঙ্গে বন্ধুত্বের সুদীর্ঘ সময় কেটেছে আমার।আমার জীবনের বিভিন্ন সিচুয়েশনে আমি তাকে বন্ধুর চেয়েও ভাইয়ের মতো কাছে পেয়েছি বেশি।সেই থেকে বন্ধু কম ভাইয়ের নজরে দেখে এসেছি তাকে।আমি ওরমধ্যে আর ইভানের মধ্যে কখনো পার্থক্য করে দেখিনি। দেখিনা।এটা তুমিও জানো।আর এটাও জানো,আমি তাকে আমার ফ্যামিলির বাহিরের কেউ বলে কখনো ভাবিনি।ভাবিওনা।সেখানে আমার সিদ্ধান্ত কি হতে পারে,নিশ্চয় তুমি বুঝতে পারছো।তবে এখানে আমার আর বাবার সিদ্ধান্তের চেয়েও তোমার সিদ্ধান্তটা ইম্পর্ট্যান্ট। তুমি কি চাইছো?ওকে খুব কাছ থেকে দেখেছি বলে, আমি আমার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে শুধু যাচাই করছি।তোমার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তোমার ভাবনা আলাদা হতেই পারে।তারসাথে সংসার করবে তুমি।সেখানে তুমি তাকে কেমন নজরে দেখছো,তোমার সিদ্ধান্ত কি সেটা গুরুত্বপূর্ণ।

মান্যতা কি বলবে ভেবে পেলোনা।নিঃসন্দেহে তৃনয় ভাইয়া ভালো ছেলে।তবে সমস্যা তার।সে কিভাবে সেই সমস্যাটা খোলামেলা উপস্থাপন করবে বাবা,ভাইয়ের সামনে!এমনকি সবার সামনে!প্রস্তাব যখন রেখেছে, সবার সামনে বিষয়টা প্রকাশ পেতে সময় লাগবে-না।আর ওই ভালো ছেলেকে রিজেক্ট করার কারণতো তাকে দেখানোই লাগবে।তখন কি বলবে সে?কিভাবে বলবে নিজের সমস্যাটা!তবে একটা উপায় আছে,ওই মানুষটার মুখোমুখি হওয়া।তারসাথে কথা বলা।ব্যাপারটা তো,সেই সেইম।যে লজ্জিত কারণগুলোর জন্য মানুষটাকে এড়িয়ে চলা।সেসব কারনের জন্য আবার তার মুখোমুখি। উফফ!কি যে ঝামেলায় পড়লো সে!এমন একটা সিচুয়েশনে দাড় করানোর জন্য মনেহচ্ছে, লোকটাকে হাতের কাছে পেলে সে খু’ন করে ফেলাতো।নিশ্চিত।

‘সময় নাও।তারপর হ্যা না সিদ্ধান্ত জানিও।তবে তৃনয়ের মতো ছেলের হাতে তোমাকে তুলে দেওয়া মানে,ভাই হিসাবে আমি নিশ্চিন্ত।আমরা কলিজাকে সর্বত্র দিয়ে আগলে রাখার উত্তম ভরসাযোগ্য একটা ছেলে,তৃনয়।

নিভান উঠে দাঁড়ালো।মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে মান্যতার মাথায় হাত রাখলো।ভরসাযোগ্য ছোঁয়া। ফের কোমল কন্ঠে বললো —তবে তুমি হ্যা না যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই সিদ্ধান্ত বলে মানা হবে।

নিভান চলে গেলো।কৌড়ি সেদিকে একপলক তাকিয়ে মাথা নিচু করে চুপ হয়ে বসে থাকা মান্যতার দিকে তাকালো।আজ চারমাসের অধিক সময় মান্যতা আপু নামক মেয়েটাকে দেখছে সে।তার ফোন নিয়ে মৌনতা, নাফিম,সে অবাধ ঘাটাঘাটি করে।কখনো প্রেম সম্পর্কিত কোনো কিছু-তো নজরে পড়েনি।এমনকি কখনো সেভাবে কারও সাথে কথা বলতেও দেখি-নি।তবে তৃনয় ভাইয়ার মতো ছেলেকে স্বীকার করতে আপুর এতো দ্বিধা কেনো?কেনো এই নীরবতা।

‘তৃনয় ভাইয়া তো খুব ভালো ছেলে আপু।তবে কেনো এতো দ্বিধা করছো?

মান্যতা কেমন দূর্বল নজরে কৌড়ির পানে তাকালো।কি করে বলবে সে,একটা বাজে ছেলের সাথে তার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো।যদিও কয়েকমাসের মধ্যে সম্পর্কটা ভেঙে গিয়েছিল। আর পুরো ক্রেডিটও ওই মানুষটার।
সেই ছেলের সাথে হাতে হাত ধরে হাঁটা!এই রেস্টুরেন্ট, সেই কফিশপ ঘুরতে দেখেছে, ওই লোকটা।তার সাথে রুমডেট করতে চাওয়া,কিসিংমিচিং করার জন্য জোরাজোরি করা।সব তথ্য ওই মানুষটার জানা।সে বর্ননা সে পেয়েছে।আর সেসব ভুলে সেই লোকটার সাথে নির্দ্বিধায় নির্লজ্জের মতো সংসার করবে কি করে সে?যেখানে মানুষটার সামনাসামনি হতেই স্মৃতিমন্থর হতে থাকে বিষয়গুলো।লজ্জায় মাতা উঁচু করে মানুষটার মুখের দিকে তাকানো হয়ে উঠেনা।তারসাথে আজীবনের সংসার!কিভাবে কিকরে সম্ভব?মান্যতার চাহুনি দেখে কৌড়ি আর প্রশ্ন করলো-না।আর না প্রশ্ন করা প্রশ্নের উত্তর পেতে চাইলো।শুধু মান্যতা বসে থাকা চেয়ারটার পিছনে গিয়ে তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে ভরসা দিলো।

মান্যতার সাথে সময় কাটিয়ে সেখানে থেকে বেশ ঘন্টাখানেক পরে রুমে ঢুকলো কৌড়ি।সে রুমে ঢোকার অপেক্ষায় ছিলো যেনো একজন।রুমের দরজা ফাঁক হতেই তাকে যেনো চিলেরছোঁ মেরে টেনে এনে বুকে শক্ত করে জড়িয়ে নিলো অপেক্ষায় তৃষ্ণার্থ মানুষটা।তার পাতলা দেহটা এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে,যেনো বুকে নয় নিজের শরীরের সাথে মিশিয়ে নিতে চাইছে মানুষটা।আশ্চর্য হয়ে হঠাৎ ঘটে যাওয়া কান্ডে বিমুঢ় হয়ে রইলো কৌড়ি।তাতে ক্লান্ত কি মানুষটা?না!গায়ের হিজাবটা টেনে ছাড়িয়ে নিয়ে বেডে ছুঁড়ে দিতেই,কৌড়ি এবার নিজেই নিজেকে শক্তকরে সঁপে দিলো সেই বুকে।মুঠোহাতে জড়িয়ে ধরলো মানুষটার বলিষ্ঠ পিঠ।

‘করছেন কি?আমার গায়ে ওড়না নেই।

বলেই যেনো বিব্রত হলো সে।অথচ সেই মানুষটা তার কথাগুলোকে পুরো আগ্রহ্য করে বললো—এটা শাস্তি।সকাল সকাল আমাকে রুমে ফেলে,উড়ন্ত প্রজাতির মতো আগানেবাগানে ঘুরে বেড়ানোর জন্য।

কৌড়ি চুপ।উত্তর করলো-না।যদিও উত্তর দেওয়ার পর্যায়ে নেই সে।চুলের আস্তরণে ঠোঁটের ছোঁয়া পেতেই হাতদুটোর বন্ধনি যেনো আরও দৃঢ় হলো।জড়িয়ে ধরা মানুষটা ফের বলতে শুরু করলো—সেদিন ওই বর্ষার দিনে যখন তোমাকে পাওয়া যাচ্ছিলো-না।পাচ্ছিলাম না তোমাকে।সেদিন কঠিনভাবে অনুভব করেছিলাম তোমার প্রতি আমার দূর্বলতা।আমার স্বাভাবিক নিঃশ্বাসের অকুলনতা।তারপর তোমাকে যখন পেয়ে গিয়েছিলাম।এভাবেই নিজের সাথে জড়িয়ে নিতে ইচ্ছে করেছিলো।বর্ষার পানিতে ভেজা ওই ক্রন্দনরত মুখটায় আদর ছুঁয়ে দিতে মন চেয়েছিলো খুব।আমি তৃষ্ণার্ত পথিক, অনাহারী হলে-ও বিবেক ছুতে দিলোনা আমার আহার।তারপর সেদিন হসপিটালে যখন তোমাকে ওভাবে নির্জীব ঘুমিয়ে থাকতে দেখলাম।তোমাকে ঠিক এভাবেই বুকে জড়িয়ে নেওয়ার তৃষ্ণাটা আমার চৌগুন হলো।অথচ আমি অসহায় পথিক,আমি বিবেকের বশিভূত।পারলাম না তোমাকে ছুঁতে।নিজের সংবরণ করলাম।তবে নিজেকে সহনশীল ব্যক্তি হিসাবে অমোঘ রাখতে পারলাম-না।আর একটাদিন দেরি নয়,তোমাকে আমার হালাল রূপে পাওয়ার তৃষ্ণায় পেলো।হালাল করে নিলাম।সেই তৃষ্ণার্থ পথিককে তুমি সকাল সকাল একা ফেলে প্রজাপতির মতো রঙিন পাখনা মেলে ঘুরে বেড়াচ্ছো!সেই পথিক কি-করে মেনে নেবে?

কৌড়ি শান্ত মেয়ে।তাকে যেনো আর-ও শান্ত অনুভব করলো নিভান।হঠাৎ তাকে ছোঁয়ার অনুযোগ নেই,অভিযোগ নেই।কেমন যেনো শান্ত মেয়ের মতো লেপ্টে আছে তার বুকে।হাতে থাকা ওড়নাটা মেয়েটার গায়ে জড়িয়ে দিলো নিভান।কৌড়ি এবার তড়িৎ মুখ উচু করে চাইলো।তা দেখে নিভান মৃদু হেসে দুষ্টমিষ্টি কন্ঠে বললো-বরটাকে খুব খারাপ মনে হয়েছে তাই-না?
বিয়ে হতে না হতেই…

নিভানের কথা শেষ করতে দিলোনা।তার আগেই মাথা ঘনোঘনো এদিকে ওদিকে নাড়িয়ে না সম্মতি জানিয়ে মুখে বললো–উহুম।আপনি একটুও খারাপ নন।একটুও না।

শেষের কথাগুলো নিভানের মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে পারলোনা।তাই সইচ্ছায় আবারও মাথা রাখতে হলো তার বুকে।লজ্জার আড়ষ্টতায় কথাগুলো বলে চুপচাপ রইলো।নিভানের হাসি চওড়া হলো।সেই অমায়িক হাসি কন্ঠেও রেশ পেলো।কৌড়ির পিঠে রাখা হাতটা,আলতো স্পর্শে বোলাতে বোলাতে
বললো–আমার বুঝদার লক্ষ্মীসোনা বউটা।আচ্ছা রেডি হয়ে নাও।আমাদের ওবাড়িতে দাদুমার কাছে যেতে হবে?

চলবে….

ফুলকৌড়ি পর্ব-৪৬+৪৭

0

#ফুলকৌড়ি
(৪৬)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

সময়টা বসন্ত ঋতু হলেও শীতের আভাস এখনো পুরোপুরি কাটিনি।দিনের বেলায় যেমন তেমন সন্ধ্যার পর থেকে তার প্রকোপের বিশেষ আগাগোনা দেখা যায়।রাত যতো বাড়ে ততোই যেনো তার প্রকোপ তীব্র হয়।ছাঁদের রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে দীবা।রাতের দক্ষিণা হিমেল হাওয়াটা ছুঁয়ে দিচ্ছে ক্ষনে ক্ষনে।মসৃন চামড়ায় সেই হাওয়াটা লাগার সাথে সাথে গায়ের লোমকূপ শিরশির করে কাটা দিয়ে উঠছে।তবুও লোহার ইস্পাতের মতো কঠিন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা।শান্ত নজরটা তার ঝলমলে ব্যস্ত নগরীতে।এই নগরীর প্রতিটি বিলাসবহুল নিবাস জানান দেয়,তারা বিত্তশালী।তারা উচ্চ আকাঙ্ক্ষী।আচ্ছা এখানের সবার মন মানসিকতা কি,এই রঞ্জিত নিবাসগুলোর মতো শুধু রঞ্জিত জীবন কাটানো!প্রতিটি মানুষের মনে কি শুধু উচ্চ বিলাসিতা আর উচ্চ আকাঙ্ক্ষা!এই এতো এতো প্রাচুর্যের ভীড়ে কেউ কি তারমতো একটু সুখে, একটু শান্তিতে দিন কাটাতে চায়না?নিভানের মতো মানুষের সাথে কি একটু ভালো থাকার আকাঙ্ক্ষা নেই তাদেরও!আছেতো।এখানের অনেকের সাথে পরিচিতি দীবার।এতো বিলাসবহুল জীবনযাপন করেও তারা দীবার মতো অসুখী।তাদের অনেকের মনে উচ্চবিলাসবহুল নয় ছোটোখাটো মনমতো স্বাভাবিক কিছু আকাঙ্ক্ষা।সৎ চরিত্রবান একজন পুরুষের সাথে একটু সুখে থাকার,একটু শান্তিতে থাকার আকাঙ্ক্ষা।সেই সৎ চরিত্রবান পুরুষটার সাথে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একটু বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা।স্বামী নামক পছন্দের পুরুষটার কাছ থেকে পাওয়া একটু প্রাপ্য সম্মান,একটু মর্যাদার আকাঙ্ক্ষা।যা কৌড়িকে প্রতিনিয়ত দিয়ে চলেছে নিভান।সবার মুখেমুখে,মেয়েটা সত্যিই সৌভাগ্যবতী।আসলেই তো সৌভাগ্যবতী।নিভানের মতো একটা ছেলেকে স্বামীরূপে পাওয়া মানে তো সৌভাগ্য বটেই।সেই সৌভাগ্যকে পেয়েও দূরে ঠেলে দিয়েছিলো সে।এখন আফসোস করে কেঁদেকেটে লাভ আছে কি!নেই।নিভান আর কখনো তার হওয়ার নয়।বুঝে-ও এ আফসোস যেনো তাকে সারাটা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে।আওড়ে যেতে হবে।

‘এখনো নিভানের আশায় অপেক্ষা করে থাকবে?ও তোমার কখনোই হওয়ার ছিলো-না।এটা কেনো বুঝতে তোমার এতো অসুবিধা?

গলার স্বরটা শুনেই পুরো শরীর যেনো আরও শক্ত হয়ে উঠলো দীবার।কাঠকাঠ গলায় জানালো।

‘আমি কারও আশায় বা অপেক্ষায় পড়ে নেই।আমি মুলত তোমার সাথেই সংসার করতে চাইছি-না।

“আমি কারও আশায় বা অপেক্ষায় পড়ে নেই” কথাটা চরম মিথ্যা!বলতে বুক কাপলেও জেদী গলায় জানালো দীবা।কেনো যেনো নিভানকে না পাওয়ার একটা দোষ বা ত্রুটি হিসাবে সিয়ামকেই দ্বায়ী মনে হয় তার।নিজেকেও কম মনে হয়না। তবে নিজ দোষের থেকে পরের দোষটা যে আমরা একটু জোরালো চোখেই দেখি।তাই হয়তো জোর করে হলে-ও নিজের ভাগের দোষটা অন্যের কাঁধে চাপিয়ে দিলেই নিজের দোষ দুর্বোধ্য।

‘দোষ কি আমার একার ছিলো?দোষী তুমি ছিলে-না?

চোখ বুঁজে নিলো দীবা।এখন আপতত কোনো সওয়াল-জবাব তার ভালো লাগছেনা।কন্ঠ কঠিন রেখেই বলল–

‘আমি কারও দোষ বিচার করার জন্য বসে নেই।তুমি বড়দের নিমন্ত্রণে এবাড়িতে এসেছো,নিমন্ত্রণ রক্ষা করেই চলে যাও।আর তোমার যাইচ্ছে গিয়ে তাই করো।নিভানের বিয়েটা মিটে গেলে আমাদের ডিভোর্সের ঝামেলাটা আমি মিটিয়ে নেবো।

এ মেয়ে কখনো তাকে ভালোবেসেছিলো?নাহলে এতো নির্দ্বিধায় কিকরে বলতে পারলো ডিভোর্সের কথা!গলা তো কাপলোনা বলতে,বুকটা কি কাপলোনা তার?শান্ত পদক্ষেপে দীবার পাশাপাশি গিয়ে দাঁড়ালো সিয়াম।কেমন যেনো খুব স্বাভাবিক গলায় বললো–নিমন্ত্রন!সে তো আমি তোমার দৌলতে জামাই হিসাবে পেয়েছি।
তাই আসতে বাধ্য হয়েছি।আর যা ইচ্ছে তাই করতে বলছো?তোমার জনামতে তো আমি একটা প্লেবয় তবে কেনো পারছিনা যা ইচ্ছে তাই করতে?রাগে জেদে তুমি চলে আসার পর হয়তো কিছু ভুল করেছি।কিন্তু সেটাও যেনো নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েছে,তোমাকে পাওয়ার আশায়।সব জায়গায় তুমি বাঁধা হয়ে আছো।আর ডিভোর্স!সে আমি চাইনা।প্লিজ ট্রায় টু আন্ডারস্ট্যান্ড দীবা।

‘নাটক করোনা সিয়াম।আমি ছাড়া তুমি স্ত্রীসঙ্গ কাটাচ্ছ না, এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলছো?

‘হ্যা,বিশ্বাস করতে বলছি।তোমাকে বিয়ের পর দ্বিতীয়ত কোনো নারীসঙ্গে যায়নি আমি।

হাসলো দীবা।তাচ্ছিল্যপূর্ন সে হাসি।বিদ্রুপের গলায় বললো—–বিয়ের আগে তো কাটিয়েছো,তাই নয়-কি?

‘সেটার জন্য আমি তোমার কাছে অনুতপ্ত হয়েছি।তবে সেই অনুতপ্ততায় হয়তো তোমার কিছু যায় আসছে-না। কিন্তু তুমি কি একই অপরাধ করো-নি।স্বামীর ত্রুটি উহ্য করে বারবার অন্য পুরুষের উদাহরণ দিয়ে তাকে নিচু দেখাও নি?তোমার মনে কি নিভান ছিলোনা?

‘উহ্য কখন করেছি।যখন তোমার মধ্যে ত্রুটি পেয়েছি তখন!যখন তোমার কাজিন ফ্রেন্ডস্-রা মজার ছলে বললো,আমার আগে-ও তোমার একাধিক সুন্দর সুন্দর গার্লফ্রেন্ড ছিলো,যা চুটকিতে তাদের ছুঁড়ে ফেলেছো তুমি!এ্যাফেয়ার ছিলো কতশত! তখন!

‘এসব শুনে আমাদের সম্পর্কে টানাপোড়েন আনার আগে কি নিভান তোমার মনের মধ্যে কোথাও আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে ছিলো-না?হ্যা আমার দোষের জন্য তুমি আমার চরিত্রে আঙুল তুলতে পারতে,সেটা নিয়ে রাগ ক্ষোভ দেখাতে,জেদ করতে।আমাদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ হতো, স্বাভাবিক।তুমি অন্য নিষ্ঠাবান পুরুষের সমকক্ষ করে উদাহরণ দিতে পারতে আমাকে!কিন্তু না!তুমি বারবার একজন নির্দিষ্ট পুরুষকে নিয়েই উদাহরণ দিয়ে আমার মন মস্তিষ্ককে বিগড়ে দিতে বাধ্য করেছো।তবে ভেবে বলো,তোমার মনে কি কোথাও তখনো নিভান ছিলো-না?আমি নাহয় খারাপ ছেলে।অভিযোগ করেছো, হ্যা মানছি।তোমার মনে কি স্বামী ছাড়া দ্বিতীয় পুরুষ ছিলো-না?সেটা কি ঠিক ছিলো!নাকি স্বামী হয়ে সেটা মানা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো?ছিলো?তুমি মানতে চাইছোনা আমার বিয়ের আগের নড়বড়ে রিলেশনগুলো।আমি কিকরে মানি?কোনো স্বামী মানে?

‘আমি তোমাকে মানতে বলিনি!

নিজের দোষ যেনো অকপটে স্বীকার করে নিলো দীবা।সিয়ামও যেনো নিজেকে জেতাতে চাইলো।বললো-তবে দোষ কেনো আমার একার ঘাড়ে চাপাচ্ছো?

নজর তখনো ঝলমলে শহরের কৃত্রিম সজ্জায়।নিষ্পলক নজর সেখানে রেখে ফের স্পষ্ট স্বরে উত্তর দিলো–ওকে,ফাইন।মামাকে,আমিই বলে দেবো আমি তোমার সাথে সংসার করতে চাইছি-না।এখানে তোমার কোনো দোষ নেই।

আর কত চলবে যুদ্ধ!মেয়েটা কি সত্যিই চাইছেনা আর তারসাথে সংসার করতে?এটা কি দীবার মন থেকে ছলেবলে নিভান-কে সরিয়ে দেওয়ার উচিত কর্মফল? নয় কি?দীবার মনে নিভান ছিলো,এটাতো সে জানতো।মেয়েটার হাবভাবে, কথা কাজে তা প্রকাশ পেতো।আর জেনেই তো সে না জানার ভান করে দীবাকে প্রপোজ করেছিলো।নিজের করে তাকে চেয়েছিলো।এবং ভালোবাসার দাবিদার জানিয়েছিলো।দীবার আগে অন্যসব সম্পর্কগুলোতে সে সিরিয়াস না থাকলেও দীবাকে দেখার পর এবং তারসাথে কথাবার্তা হওয়ার পর সে এই সম্পর্কটাতে সিরিয়াস হতে চেয়েছিলো।আর সিরিয়াস হয়েছিলো বলেই তো,দীবার মন থেকে নিভানকে জোর করে সরিয়ে ফেলানোর মনোবাসনা করেছিলো।তখন ক্ষনিকের জন্য সফল হতে পারলেও, দীর্ঘস্থায়ী সমাধান তো বাজে পরিস্থিতি, অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করলো।তবে সে দীবাকে ভালোবেসেছিলো।এবং এখনো বাসে।সেটা মেয়েটা স্বীকার করুক বা না করুক।আজ এখানে আসার একটাই কারন,মেয়েটাকে মানানো।শ্বাশুড়ির অনুরোধও বটে।আচ্ছা মপয়েটাকে যখন সে ভালোবাসে তবে কি শেষবারের মতো নিজের ইগো ছেড়ে আর একবার কি ট্রায় করে দেখবে, মেয়েটাকে মানানো যায় কি-না!

চোখ বুঁজে নিজেকে ধাতস্থ করলো সিয়াম।সত্যিই সে মন থেকে দীবার সাথে সংসার করতে চায়।প্রথম যেদিন দীবাকে দেখেছিলো,সত্যি বলতে রূপের মোহে পড়েছিলো।তারপর আস্তে আস্তে মেয়েটার প্রেমে।তারপর কিকরে কিভাবে যেনো মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেললো।মন তাকেই স্ত্রীরূপে পাওয়ার বাসনা জাগলো। এরআগে সম্পর্কে জড়ানো কখনো কোনো নারীকে নিয়ে মন এমন বাসনা করেনি।তারপর কত ছলাকলা করে দীবাকে বিয়ে করলো।সর্বোচ্চ সাপোর্ট দিয়েছিলো শ্বাশুড়িমা।আজ পরিনিতি ভাঙনের পর্যায়ে!ভিতরে ভিতরে নিজের ইগো দুমড়ে মুচড়ে ভাঙার চেষ্টা করলো সিয়াম।দীাবকে ডিভোর্স দিয়ে ঘরে সুন্দরী স্মার্ট বউ আনতে তার সময় লাগবো-না।তবে রাগী জেদি হলেও দীবাকে তো পাবেনা।যে মেয়েটা আর উড়ন্ত মনে বাসা বেঁধে গতি থামিয়ে দিয়েছিলো।দীবা চলে আসার পর রাগে জেদে বিয়ের আগের লাইফস্টাইলে চলে গিয়েছিলো সে।পেরেছিলো কি শান্তিতে একদন্ড কোথাও মনটাকে টিকাইতে?মনে হয়েছিলো,দীবাতেই সুখ তার দীবাতেই শান্তি।তাই মেয়েটাকে একদণ্ড স্থির থাকতে দেয়নি।ফোন দিয়ে হোক বা তাকে নজরে রেখে, যেভাবেই হোক জ্বালিয়ে গেছে সারাক্ষণ।হঠাৎ কিছু মনে পড়তেই ক্ষীন হাসলো সিয়াম।

নিভানের কথা মনে পড়লো তার।আজকে এখানে একান্তভাবে আসার নিমন্ত্রণ জানিয়েছে নিভান নিজেই।যে মানুষটার সাথে বিগত দিনগুলোতে তার সম্পর্ক ছিলো কাটাতারের মতো।যা কেউ কখনো ছুটোনোর চেষ্টা করেনি।দীবা সম্পর্কিত সিয়াম শ্বশুরবাড়িতে এলে শুধু হ্যান্ডশেক আর দুকথার আলাপ বিনিময় ছাড়া সেভাবে দুজনের সাথে কথা হয়নি।সেই হিসাবে ইভানের সাথে শালা-বোনজামাইয়ের সম্পর্ক বেশ মধুর।সেই কঠিন মানুষটা নিজের দিক থেকে কাটাতারের বেড়া ছুটিয়ে তাকে নিজে নিমন্ত্রণ করেছে।এবং বউকে যেভাবেই হোক মানানোর একটা অফার জানিয়েছে।সবাই যখন তাদের সম্পর্ক বাঁচানোর একটা একটা করে সুযোগ করে দিচ্ছে, তবে সে-ও নাহয় একটা শেষ চেষ্টা করে দেখুক।সামনে থেকে নজর সরিয়ে দীবার দিকে ফিরলো সিয়াম। হঠাৎই তার সামনে হাটুগেড়ে বসলো।চমকে উঠলো দীবা।সেই চমক বাড়িয়ে দিয়ে তার দু-হাত নিজের দু’হাতের মুঠোয় চেপে নিলো সিয়াম।দীবার ফুলোফুলো প্রশ্নবিদ্ধ চোখদুটোতে কাতর পথিকের ন্যায় তাকালো।এযেনো চেনাপরিচিত সেই স্বামীর চাওয়া নয়।এযেনো নতুন সিয়াম।যার সাথে কেবলই পরিচয়।এমনই অবাক হলো দীবা।

‘তোমাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম তারপর তার দ্বিতীয় কোনো নারীর রূপ লাবন্য আমাকে টানো-নি।আল্লাহ কসম টানেনি।সেই তোমাকেই শুধু আমি আমার স্ত্রীরূপে চেয়েছিলাম।যা বিয়ের আগের রিলেশনশিপে আর কাওকে আমি চাইনি।হ্যাঁ বিয়ের আগে আমার রিলেশন ছিলো।একটা নয় দুটো নয় অনেকগুলো মেয়েট সাথে…

কথাটা বলতে গিয়ে গলায় বিঁধে বিঁধে কথা বের হলো।
নিভানকে সরিয়ে দীবার মনে তো ঠিকই নিজের জন্য জায়গা করে নিতে পেরেছিলো সে।শুধু এই একটা কারনে জন্য আজ তাদের পরিনতি এই ছাড়োছাড়ো অবস্থা।দীবার বিস্মিত মুখাবয়বও বিস্ময় ছাড়িয়ে গিয়ে কঠিন হয়ে এলো।ফলসরূপ সিয়ামের হাতের মুঠো থেকে হাত সরাতে চাইলো।সিয়াম সেটা হতে দিলো-না।আরও শক্তকরে চেপে ধরলো তার হাত।এই হাত ছাড়তে চায় না সে।এটা কেনো কিছুতেই এই মেয়েটাকে বোঝাতে পারছেনা।তবে যাই হোক এতোদিন রাগে জেদে পড়ে অন্যভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছো।এবার নাহয় শেষ চেষ্টা হিসাবে ঠান্ডা মাথায় ঠান্ডা কথায় বোঝাবে।দেখা যাক সফল হয় কি-না।যদিও সে কঠিন অপরাধী।তবুও ক্ষমা পায় কি-না?ফের বলতে শুরু করলো সিয়াম।

‘আমি সত্যি বলছি,সেসব সম্পর্কে আমি কখনোই সিরিয়াস ছিলাম না।এরপর যখন তুমি এলে আমার লাইফে,আমি আর দ্বিতীয় কোনো নারীতে আসক্ত হই নি।মন আসক্ত হতে চাইনি।কেমন জানি তোমাতেই আসক্ত হয়ে পড়লাম।আর শুধু তোমাকেই চাইতে শুরু করলাম।চেয়ে গেছি।আজও চাইছি।প্লিজ দীবা আমি আমাদের ছাড়াছাড়িটা চাইনা।চাইছি-না।আমি তোমার সাথেই সংসার করতে চাই।একটু বুঝতে চেষ্টা করো।প্লিজ দীবা।আর রাগ জেদ করে থেকো-না।চলো না আমার সাথে।সংসার করি দুজনে।প্লিজ।

বিয়ে উপলক্ষে নীল মরিচবাতি দিয়ে ছাদটা সাজানো হয়েছে খুব সুন্দর করে।সেই ঝলমলে আলোতে সিয়ামের ফর্সা সুদর্শন মুখটা স্পষ্ট। আর তার থেকেও স্পষ্ট তার চোখের ভাষা।চোখ দুটো বলছে ছেলেটা যাই করে থাকুক, এই ক্ষনে বলা কথাগুলো মিথ্যা বলছে-না।কৌড়িকে নিয়ে নিভান যতোটা আগ্রহী, পজেসিভ।তার সামন্য একাংশ যদি দীবাকে নিয়ে থাকতো নিভান।তবে কখনোই দোটানায় পড়ে সিয়ামের মিষ্টি মিষ্টি ভালোবাসার বানীতে ভুলতো না দীবা।মামি প্রস্তাব রাখলেও নিভানের গাছাড়া ভাবে একটা সময় সিয়ামের প্রতি দূর্বল হয়ে মায়ের বিভিন্ন কান ভাঙানি কথাতে সিয়ামের সাথে বিয়েতে রাজী হয়ে যায় সে।বিয়ের পর যখন সিয়ামের কাজিন বন্ধুমহল থেকে জানলো,তার অনেকগুলো রিলেশনশিপের কথা।পুনরায় নিভানকে মনে পড়তে লাগলো তার।মায়ের কথায় আর সিয়ামের বাহিরের চাকচিক্য দেখে সিয়ামকে বিয়ে করা ভুল সিদ্ধান্ত বলে মনে হলো তার।এরপর একটার পর একটা ঝামেলা।রোজ রোজ অশান্তি।সিয়াম তাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে,মানাতে চেয়েছে।তবুও মন মানেনি দীবার।শুধু নিভানের চরিত্র সকল গুনাগুন মনে পড়েছে আর রাগে ক্ষোভে সেসব ইঙ্গিত করে ঝগড়াঝামেলা বেড়েছে। দিনকে দিন সেসব অশান্তি বাড়ার বৈ কমেনি।আর সেই পরিনতি আজ ছাড়াছাড়ির পর্যায়ে এসে থেমেছে।যা দীবা মনেমনে হোক স্পষ্টে, চেয়েছিলো।আশাও করেছিলো ভিন্ন কিছু।যা আজ রাত পেরিয়ে কালকের পরের দিন,গহীন সমুদ্রে ভাসিয়ে দোওয়ার মতো বিসর্জন দিতে হবে তাকে।বুক কেঁপে উঠলো।নিশ্চল সিয়ামের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলে-ও সেখানে ভেসে উঠলো অন্য মুখ।

‘প্লিজ দীবা।

নড়েচড়ে দাড়ালো দীবা।কিছু মনে পড়তেই শক্তকন্ঠে বললো।–আর তুষি যেটা বলেছিলো সেটাও কি মিথ্যে? তুমি রুমডেট করোনি কোনো মেয়ের সাথে?শুধু কি তাদের সাথে রিলেশন ছিলো?এসব জানার পরও স্বামী হিসাবে তোমাকে মেনে নিতে,মানিয়ে নিতে বলছো?তুমি হলে মানতে আমাকে?

তুষি,সিয়ামের চাচাতো বোন।একরত্তি ইঁচড়েপাকা মেয়েটার বয়স কতো হবে?এই কয়েকমাস আগেইতো আঠারো বছর পূর্ন হলো।পিচ্চি মেয়েটা অনেক আগে থেকেই তাকে মনেমনে পছন্দ করে।যা তার হাবভাবে প্রকাশ পেলেও সিয়াম পাত্তা দেয়নি।মেয়েটা যে বেশ ইনিয়েবিনিয়ে রসিয়ে তার বউয়ের কান ভাঙিয়েছে এটা আগেই টের পেয়েছিলো সিয়াম।শাস্তিস্বরূপ কষিয়ে দুটো দিতেও দ্বিধা করেনি।তা নিয়ে হাঙ্গামাও বাড়িতে কম হয়নি।এই মূহুর্তে অসভ্য মেয়েটাকে আরও কষিয়ে কয়েকটা চড় মারতে ইচ্ছে করলো।সামনে থাকলে হয়তো থাপ্পড় দুটো দিতে দ্বিধা করতো-না।তবে ভাগ্য ভালো মেয়েটার সামনে নেই।আশেপাশেও নেই।

চুপ থাকা সম্মতির লক্ষ্মণ।তাই বেশি সময় চুপ থাকলো না সিয়াম।তড়িৎ বললো–আল্লাহ কসম,আমি কোনো মেয়ের সাথে রুমডেট করিনি।বিলিভ মি,আমি আল্লাহর নামে মিথ্যা বলছিনা।ওই ফাযিল মেয়েটা আমাকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করে,তাই তোমার কাছে আমার নামে উল্টো পাল্টা বলে বুঝিয়েছে।যদিও পুরোপুরি নির্দোষ আমি নই।তবুও ও বাড়িয়ে বলেছে।

রুমডেট না করলেও প্রত্যেকটা রিলেশনশিপে কিসমিস চলেছে বহুত।এখন যদি এবিষয়ে দীবা জানে।এই মূহুর্তে ডিভোর্স হয়ে যাবে তাদের।নিভান বলেছে যে করে হোক দীবাকে মানাতে।আর সে চাায়ও মানাতে।তাই যেটা প্রশ্ন করেছে দীবা,সহজ ভাষায় সেটারই সত্যি উত্তর দিয়েছে শুধু সে।অথচ দীবার কেমন কেমন তীক্ষ্ণ নজর বলছে, সে সিয়ামকে বিশ্বাস করেনি।

‘তবুও আমি তোমার সাথে থাকতে চাইনা।তুমি একটু আগে বললে না,আমার মনে অন্য কেউ বাস করে।সত্যি তো তাই।তাই মনে কাওকে রেখে আমার তোমার সাথে সংসার হবেনা।

‘কাল বাদে নিভানের বিয়ে তবুও তুমি একথা বলবে।

‘ও কখনোই আমার প্রতি দূর্বল ছিলোনা।দূর্বলতা ছিলো আমার পক্ষ থেকে।তাই যা কিছু শুধু আমার পক্ষ থেকে।

‘আমি এখনো তোমার হাসবেন্ড।তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে এমন কথা বলতে পারো-না।

‘এজন্য তো সেপারেশন হতে চাইছি।

‘প্লিজ দীবা।একটু বুঝতে চেষ্টা করো।তুমি যেভাবে দেখতে চাইছো,জীবনটা ততোটা সহজ নয়।তুমি এখানে ভালো নেই এটা আমি জানি।চলো না আমার সঙ্গে দীবা।

সত্যিই বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়েদের বাপের বাড়িতে পড়ে থাকা জীবনটা আসলেই সহজ নয়।যে সাচ্ছন্দ্যবোধে,সুখে বিয়ের আগের দীর্ঘদিনগুলো সে বাপের বাড়িতে কাটিয়ে যায়,বিয়ের পর সেই একই সাচ্ছন্দ্যে সুখে বাপের বাড়িতে দিন পার করা মোটেও সহজ বিষয় নয়।কথাও নয়।আত্মীয় স্বজন আশেপাশে মানুষের তীর্যক দৃষ্টি,ইনিয়েবিনিয়ে বলা কটু বাক্য।মাথা বুক ভারী করে তোলে।জীবনে বেঁচে থাকা অতিষ্ঠ হয়ে যায়।যেখানে নিজের মায়ের কথা শুনতে হয়,সেখানে অন্য মানুষের তীর্যক ব্যাঙ্গ দৃষ্টি, কটু কথা আর বড় কি!সিয়ামের মন ভোলানো কথায় কান্না পেলো ভীষন।চোখে জলও জমে গেলো।তবে সিয়ামকে কেনো জানি সহ্য করতে পারলোনা।হাত ছাড়িয়ে নিলো দীবা।সিয়ামের কথার উত্তর না দিয়ে বড়বড় কদম ফেলে চলে গেলো নিচে।সেদিকে কিছুক্ষণ নির্বিকার তাকিয়ে মাথা নুইয়ে নিলো সিয়াম।মাথা ভিতরটা ফাঁকা হয়ে এলো তার।নিজের ইগো ছেড়ে দোষ স্বীকার করার পরও মেয়েটাকে বোঝাতে সক্ষম হলো-না সে!ভাবনায় আর আনতে পারলো না,কি হতে চলছে তাদের আগামী দিনের পরিনতি!

রাত প্রায় বারোটার কাছাকাছি সময়।কৌড়ি গোসল সেরে শুয়েছে।শুয়েছে কি!ঘুমিয়েই পড়েছে।মান্যতা ওয়াশরুম থেকে এসে দেখলো মেয়েটা ঘুমে।পাশে মৌনতাও ঘুমে বিভোর।একটা হাত তার কৌড়ির কোমর জড়িয়ে রাখা।আজ এরুমে আর কাওকে নেইনি সে।দাদাভাইয়ের বিশেষ নির্দেশ আছে।নজর সরিয়ে মাথার তোয়ালে খুলে চুল মোছায় মন দিলো।চুল মোছা শেষে শুতে গিয়ে পানির তৃষ্ণা পেলো।আপনাআপনি বেডটেবিলের উপর নজর যেতেই দেখলো জগ-ওয়াটার পট,কোনোটাতেই পানি নেই।কিন্তু পানি না খেলে যে তার ঘুম আসবেনা।পুরোনো অভ্যাস। শুতে গেলেই পানির তৃষ্ণা লাগবেই।আর না খাওয়া অব্দি ঘুম আসবে না।আলসেমি হলো প্রচুর।তবুও উঠে জগ হাতে নিয়ে পানি আনতে চলে গেলো।কয়েক সেকেন্ড পরেই শব্দ করে ফোনটা বেজে উঠলো তার।মাথার কাছে টেবিলে ফোনটা বেজে উঠায় ঘুম হালকা হয়ে গেলো কৌড়ির।ফোন কেটে গিয়ে পুনরায় বেজে উঠায় চোখ মেলে তাকালো সে।মান্যতার ফোন বাজছে অথচ আপু ফোন তুলছেনা।কেনো?ক্লান্তি আর শরীরের দূর্বলতায় ডুবে আসছে চোখ।তবুও চোখ মেলে ল্যাম্পস্যাডের মৃদু আলোয় চোখ বুলিয়ে নিলো সারাঘর।মান্যতাকে কোথায় না দেখে ফোনটা হাতে নিলো সে।ফোনের স্কিনে লেখা নামটা দেখে ফের চোখ বুঁজে নিলো।ঘুম চোখেই মুখে ফুটলো মৃদু হাসি।আবারও তাকিয়ে ফোনটা রিসিভ করে চোখ বুঁজে নিলো সে।

‘বাড়িতে এসেছেন?

ভারী ঘুমঘুম আওয়াজ।কি আদুরে মিষ্টি গলা।সেই ভারী
কন্ঠ কানে ভেসে আসতেই গাড়ির সিটে গা এলিয়ে দিলো নিভান।চোখ বুঁজে নিলো আপনমনে।কন্ঠের মালিককে চিনতে সময় নিলো না।উত্তর দিলো।

‘না।এখনো বাড়িতে ফেরা হয়নি।তুমি ঘুমিয়ে গিয়েছিলে মনেহচ্ছে?

‘হুমম।

এমনিতেই মেয়েটা অসুস্থ তারউপর সারাদিনের ঘোরাঘুরি ক্লান্তি,হলুদের অনুষ্ঠানের বাড়তি একটা ক্লেশ ঘুমতো আসবেই।নাহলে মিনিট দশেক আগে মান্যতাকে ফোন দিয়ে জানলো,মেয়েটা গোসল সারছে।তারমধ্যে ঘুমিয়েও পড়লো।কিছু একটা মনে পড়তেই শুধালো নিভান।

‘রাতে খেয়েছো তুমি?

‘হুমম।

হুমম মানে হলুদের অনুষ্ঠানের বিভিন্ন মিষ্টি মিঠাই পায়েশ অন্যন্য খাবার খাওয়ার পর আর আলাদা করে রাতের খাবারের চাহিদা হয়নি।তবুও খেয়েছে-তো।না বলার প্রশ্নই উঠেনা।আর না বললে উপাই আছে!নেই!তবে পরের প্রশ্নে ধরা খেয়ে গেলো সে।।

‘আর ঔষধ ?খেয়েছো?

এবার সরাসরি মিথ্যা বলতে পারলোনা কৌড়ি।চোখ মুখ খিঁচে চুপ করে রইলো।নিশ্চুপতায় ধরা পড়ে গেলো।
শব্দ করে শ্বাস ফেললো নিভান।

‘কৌড়ি।

মূহুর্তেই গলার স্বর পরিবর্তন। ডাক সুবিধার লাগলোনা।নিভানকে কথা বাড়ানোর সুযোগ না দিয়ে কৌড়ি তড়িৎ কৈফিয়তের স্বরে বললো।

‘আমার প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছিলো।আমি পারছিলাম না চোখ মেলে তাকিয়ে থাকতে।মনে হচ্ছিলো পৃথিবী গোল্লায় যাক আগে আমার ঘুম প্রয়োজন।তাই ঔষধের কথা তখন খেয়ালে ছিলো।

নিভান হাসলো কৌড়ির ছেলেমানুষী চঞ্চল কথায়।মেয়েটা মন খুলে তাকে জানাচ্ছে তার ভালোমন্দটা।কথা বাড়ানোর আর উপায় পেলোনা নিভান।তাই আর কথা বাড়ালোও না।বকলোনা।কালকের একটা দিনই-তো।পরের দিন থেকেতো ওই মেয়েটাসহ তার ভালো-মন্দ সবকিছু তার।তখন নিজেই নাহয় পালন করবে মেয়েটার অবহেলিত দায়িত্বগুলো।শ্বাস ফেললো নিভান।বললো।

‘ইট’স ওকে।তবে সকাল থেকে মেডিসিন নিতে যেনো অনিয়ম নাহয়।হুমম?

সহজে মেনে নিলো!একটু একটু করে যেনো নিজের প্রতি মানুষটার দূর্বলতা টের পেতে থাকলো কৌড়ি।হাত উচু করে বামহাতের অনামিকায় নজর দিলো সে।সমস্ত শরীর যেনো সুখানুভূতিতে আলোড়ন দিয়ে উঠলো।
ঠান্ডার মধ্যেও উষ্ণ আর্দ্র এক অনুভূতি টের পেল।ফের চোখবুঁজে নিয়ে উত্তর দিলো।–‘হুমম?

‘কৌড়ি।

‘বলুন।

‘তোমার ফোনটা তো আমার কাছে।দিয়ে আসতে ভুলে গিয়েছিলাম।তাই বাধ্য হয়ে মান্যতার ফোনে ফোন দিতে হলো।একটা পারমিশন নেওয়ার ছিলো।

পারমিশন!তারকাছ থেকে?আপনাআপনিই মুখ থেকে বেরিয়ে এলো–কি?

‘তোমার সবকিছু অর্থাৎ বিয়ের প্রয়োজনীয় সমস্ত শপিং যদি আমি আমার পছন্দ অনুযায়ী কিনি তোমার অসুবিধা আছে?তুমি অমত,অপছন্দ করবে?

আশ্চর্য!কৌড়ি যেনো বলতে ভুলে গেলো।ভাবতে ভুলে গেলো।কৌড়িকে চুপ থাকতে দেখে নিভান ফের বললো–সময় কম আর তুমিও অসুস্থ।এজন্য বলছিলাম কথাটা। আমি চাইছিনা,তোমাকে নিয়ে কেনাকাটায় অযথা টানাহেঁচড়ার করা হোক।যাতে তুমি অারও অসুস্থ হয়ে যাও।তবে তুমি যদি চাও,সমস্যা নেই।আমি আমার পছন্দ অনুযায়ী কিনবোনা।কালকের দিনটা তো এখনো সময় আছে।তুমি মান্যতা আর ঈশিতা আপুদের সাথে পরামর্শ করে নিজের পছন্দ অনুযায়ী নাহয় অনলাইনে শপিং করে নিও।

‘আপনার পছন্দে-তো আমার সমস্যা নেই।বরং সেটা আমার…

সহসা কথাগুলো বলে থেমে গেলো কৌড়ি।নিভান পাল্টা জিজ্ঞেস করলো–সেটা কি?

‘আমার সৌভাগ্যতা।

ঠোঁট বিস্তৃত হলো নিভানের।মনের প্রশান্তি থেকে হাসি ফুটলো ঠোঁটে। কৌড়ি দেখতে পেলোনা আর না বুঝতে পারলো।হঠাৎই নিভান শুধালো।

‘কৌড়ি।এইযে বিয়েটাসহ সকল কার্যক্রম আমার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হচ্ছে।সেখানে তোমার সিদ্ধান্ত আমি শুনতে চাইছিনা, জানতে চাইছিনা।গ্রহণযোগ্যতা দিচ্ছিনা। তুমি আমার প্রতি অখুশি, অসন্তুষ্ট?বাধ্য হয়ে মেনে নিচ্ছো সব।তাই না?

সময় নিলো কৌড়ি।মানুষটার সাথে একটা সময় সম্পর্ক ছিলো লুকোচুরির!এড়িয়ে চলার!ভীতির! আজ সেই মানুষটার সাথে এতো সোজাসাপ্টা সহজ সম্পর্ক সত্যিই কি কখনো আশা করেছিলো সে!এটাও কি আশা করেছিলো,আজ রাত বাদে কাল দিন পেরিয়ে ওই মানুষটা শুধু তার হবে!আর সে শুধু ওই মানুষটার!ভাবিনি।আর এটাও ভাবিনি কখনো এতো সহজ সুন্দর সাবলীলভাবে মানুষটার সাথে মনখুলে কখনো কথা বলতে পারবে।নিজের চাপা স্বভাবটা এড়িয়ে মানুষটাকে নিজের মনের কথা গুলো জানাতে পারবে।
অথচ ওই মানুষটা তাকে সুন্দর সহজ একটা পথ করে দিয়েছে।যে পথের রাস্তা আর গন্তব্য শুধু একান্ত তাকে জানিয়ে দেওয়া।তাকে চিনিয়ে দেওয়া।সেই রাস্তায় দিয়ে নিভানের কাছে পৌছানো অগ্রাধিকার শুধু তার। অন্য কেউ সেই পথে আলাউড্ নয়।ওই মানুষটা তাকে ছাড়া মানুষটার জীবনে সেই পথ ধরে অন্য কাওকে আলাউড্ করেনি।সন্তুষ্টচিত্তে হাসলো কৌড়ি।ফের স্বভাবসুলভ কোমল মায়াময় কন্ঠে প্রশ্নকৃত উত্তরের অপেক্ষারত মানুষটাকে উদ্দেশ্যে বললো।

‘প্রতিটি মানুষের জীবনে একটা বটবৃক্ষ নামক ছায়া খুব প্রয়োজন জানেন।বিশেষ করে নারী জাতির জীবনে।আমার অন্তত তাই মনে হয়।সেই ছায়াটা না থাকলে তারা জানে জীবন কি!জীবনের মানেটা কি!
হয়তো বাবা,নয়তো ভাই,নয়তো স্বামী,নয়তো সন্তান, এসব প্রিয় মানুষদের ছায়া তাদের খুব প্রয়োজন হয়।খুবব!তারা উপলব্ধি করে নীরবে বলতে পারেনা মুখফুটে।কেনো জানি তাদের মুখ ফুটে বলা কোথাও একটা বারণ!নিষেধ আছে‌!আমিও সেই বারনটা মনেপ্রাণে এতোদিন মেনে এসেছি।বাবা চলে যাওয়ার পর সেই বারণের তৃষ্ণটা এতো উপলব্ধি করেছি,আজ মুখ ফুটে বলতেই হচ্ছে। চাইছি আমি বলতে।জীবনে একা চলা যায়না,সঙ্গ নিতেই হয়।সেটা ভাগ্যে ভালো থাকলে সৌভাগ্য না থাকলে মন্দ।তবুও প্রতিটি মানুষের জীবনে একটা বটবৃক্ষ নামক সঙ্গী বলে ছায়া দরকার হয়।আমার ছায়া বাবা ছিলেন।তিনি আজ নেই।তিনি চলে যাওয়ার পর উপলব্ধি করলাম,আমার জীবনে কি হারিয়ে ফেলেছি আমি।সেই উপলব্ধি পুরোপুরি ক্ষান্ত নাহলেও কিছুটা ক্ষান্ত হলো হঠাৎই একজনের ছায়া আমার মাথার উপর এসে পড়তেই।বাবার পরে আমাকে নিজের মতো করে বোঝার ভরসাটা কেনো জানি তারমধ্যে অনুভব করলাম।নিজেকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম সেই ছায়ার উপর।সেই ছায়া আপনি।সেই ছায়া যদি বলে আমি তোমাকে রোদের তাপ ছুতে দেবোনা,ঝড়বর্ষার প্রলেপ লাগতে দেবোনা,কাঁটার আঘাত পেতো দেবোনা,কোনো বিপদ ছুঁতে দেবো-না।সেখানে অখুশী অসন্তুষ্ট হওয়ার কি আছে।অখুশী অসন্তুষ্ট হয় কেউ?যেখানে নিজের সিদ্ধান্ত আপনিই বর্তায়।সেখানে আলাদা একান্ত বলে নিজের সিদ্ধান্ত কিসের?যে সিদ্ধান্তে আমার ইচ্ছেরাও সামিল সেখানে নিশ্চুপ থেকে সবকিছু মেনে নেওয়া আমি বাঞ্ছনীয় মনে করি।তাই চুপ।জোরকরে,বাধ্য হয়ে নয়।

একটু থামলো কৌড়ি।ওপাশের মানুষটার শ্বাস প্রশ্বাসের আওয়াজ ছাড়া আর একটা শব্দ নেই।কেমন নিঃশব্দতা।সেই নিঃশব্দতা পেরিয়ে কৌড়ি ফের নমনীয় মায়াময় কন্ঠে বললো।–আমি অসন্তুষ্ট অখুশি নই।আমি আপনাতে এবং আপনার সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট, খুশী।

কথা শেষ করে শ্বাস ফেললো কৌড়ি।এতো কথা বলে ফেললো।সর্বাঙ্গ কেমন শরীর করছে লজ্জায়।এতো কথা তো সে বলেনা!অথচ বলেই ফেললো।ওপাশের মানুষটার নিশ্চুপতা দেখে ভিতরটা কেমন অদ্ভুত অনুভূতিতে আরও নিশপিশ করে উঠল।তড়িৎ ফোনটা সামনে নিয়ে সময় দেখলো।তখনো নিভান নিশ্চুপ।কৌড়ি সেকেন্ড সময় নিয়ে প্রসঙ্গ এড়াতে ফের বললো–রাত অনেক হয়েছে তো। এখনো বাহিরে কি করছেন?কাল অর্ধেক রাত প্রায় জার্নি করেছেন, আজ সারাদিনও প্রায় ছুটোছুটি। এখন রাত বারোটা বাজতে চললো,এখনো বাহিরে।আপনার ক্লান্ত লাগে-না?আমার তো একটু ক্লান্তিতেই শরীর খারাপ লাগে। ঘুম এসে যায়।আপনার ঘুম পায় না?

অধিকারবোধ!মেয়েটা যেনো তার জীবনে আলৌকিক একটা শান্তি।শুধু যে শান্তি তা নয়,প্রশান্তি আর সুখ-ও বটেই।যা হঠাৎই এসে জুড়ে নিয়েছে তার হৃদয়কুল,মন মস্তিষ্ক।পুরুষ মন প্রশান্তিতে ছেয়ে গেলো নিভানের।মেয়েটা যেনো তার নিশ্চুপতার খোলশ থেকে একটু একটু বের হচ্ছে।বিষয়টা মন্দ নয়।এটাই তো চায় সে,শুধু কৌড়ি তারউপর এরকম অধিকার দেখাক।শুধু কৌড়ি।

‘ক্লান্ত লাগে তো।তবে আমাকে খুঁটিয়ে খোঁজ নেওয়ার মানুষ কম ছিলোতো,এজন্য শরীরটা সহজে ক্লান্ত হতে চাইতো-না।তবে এখন যখন খোঁজ নেওয়ার মানুষ হয়েছে তখন মনেহয় শরীরটা প্রত্যহ ক্লান্তিতে ডুববে।আর ঘুম।দুটো দিন নাহয় বিসর্জন গেলো,তারপর থেকে প্রশান্তিতে ঘুমাবো।

কথার ইঙ্গিতে দারুণ লজ্জায় ডুবলো কৌড়ি।পরবর্তী কথার খেই হারিয়ে ফেললো।মনেমনে চমকালোও বটে।কালরাত বাদে দিনরাতটা কি সত্যিই অন্যরকম হতে চলেছে !তার জীবনটাও কি পরিবর্তন হতে চলেছে!এমনিতেই ওই মানুষটার আগমনে হটাৎই জীবনটা তার পরিবর্তন হয়ে গেছে।দিনগুলো সব অন্যরকম যাচ্ছে। অদ্ভুত শান্তি।সুখ সুখ।

‘কৌড়ি।

কথা আর বাড়াতে চাইলোনা কৌড়ি।ডাক পড়তেই সহসা বললো।–কাজ সেরে তাড়াতাড়ি চলে আসুন।রাখছি।

হাসলো নিভান।বুদ্ধিমান মেয়েটা তার ডাকের অর্থ বুঝে নিয়েছে। তাই কথা আর না-বাড়িয়ে সে-ও ছোটো করে উত্তর দিলো।–হুমম।ঠিক আছে।

‘আল্লাহ হাফেজ।

নিভানও মৃদুমন্দ মিষ্টি গলায় জানালো–‘আল্লাহ হাফেজ।

নিভান ফোনটা কান থেকে সরিয়ে বুকে চেপে ধরে চোখ বুজে নিলো।পাশের সিটে বসা তৃনয় সেটা খেয়াল করে কান থেকে হেডফোনটা সরালো।কিছুক্ষণ অপলক চোখে নিভানকে দেখে নিজেও সিটে গা এলিয়ে দিয়ে বললো–মেয়েটাকে এতো ভালোবাসিস?

‘প্রচন্ড।

হাসলো তৃনয়।পছন্দ, চাওয়া,ভালোলাগা,ভালোবাসা আসলেই অদ্ভুত। পৃথিবীতে তো সুন্দর জিনিসের অভাব নেই।অথচ সব সৌন্দর্য মানুষের মনটাকে আটকাতে পারে না।আটকায় না,ভালো লাগেনা।পছন্দ হয়না।ভালোবাসা তাৈরী হয়না।বিশেষ কারও ক্ষেত্রে গিয়েই সেই পছন্দ, ভালোলাগা, ভালোবাসায় আঁটকে যায়। মন,নজর,চাওয়া পাওয়া যেনো সেই মানুষটার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট হয়ে যায়।আর সেই মানুষটাকে চাওয়া পাওয়ায় তীব্রতায় মনটাকে এমন পাগল করে তোলে।মনেহয় সে ছাড়া পৃথিবী সৌন্দর্যহীন!জীবন অর্থহীন!বাঁচা মুশকিল!তার ক্ষেত্রেও তাই।বিয়ের জন্য মা কম সুন্দরী পাত্রী দেখাচ্ছেন না।অথচ মন পড় আছে সেই অবাধ্য মেয়েটায়।ভাবনা ক্ষান্ত রেখে ঘাড় ফিরিয়ে নিভানের দিকে চেয়ে বললো।

‘বসে থাকবি।বউয়ের জন্য স্পেশাল শপিং করতে এসেছিস।চল।রাত অনেক হয়েছে এবার-তো উনারাও আমাদের অপেক্ষায় বিরক্ত হয়ে যাবেন।

‘উনার জানেন নিভান আওসাফ আসছে,তার বউয়ের জন্য স্পেশালি শপিং করতে।আমি সারারাত বললে সারারাত অপেক্ষা করতে বাধ্য উনারা।বরং মুখিয়ে আছেন আমি যাবার জন্য।কন্ট্রাক্ট করেই এসেছি।
এমনিতেই অর্ডার দিলে সবকিছু বাড়িতে পৌঁছে যেতো।কিন্তু আমি চাইছি ওরজন্য নিজে হাতে সবকিছু কিনতে।

‘মাঝেমধ্যে তোকে আমার চেনাজানা নিভান ভাবতে খুব দ্বিধা হয়।অবাক লাগে জানিস!

নিভান হাসলো।প্রতিত্তোরে করলো-না।বরং চোখ বুঁজে রইলো কতক্ষণ। ফের মৃদুকন্ঠে বলো–Everything is fair in love and war,or does’t? সেখানে আমি নিভান কি আর কেমন ছিলাম শুধুমাত্র ওই মেয়েটার ক্ষেত্রবিশেষ ভুলে গেছি।ভুল যেতে চাইছি।আমার মধ্যে কতোটা পরবর্তীত এসেছে, জানিনা।তবে আমি নিভান ওই ফুলকৌড়িতে কি অনুভব করি সেটা যদি তোকে বোঝাতে পারতাম!সত্যিই কাওকে বোঝাতে পারতাম!

চলবে…

#ফুলকৌড়ি
(৪৭)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

বসন্তের মিষ্টি পড়ন্ত বিকেল।তপ্তহীন সূর্যের ঝলমলে আভায় প্রকৃতিতে কেমন স্নিগ্ধতার বড়ত্বতা ছড়িয়ে পড়েছে।যেনো প্রকৃতি নয় একোনো মায়াবন!প্রভুর আকা শ্রেষ্ঠতম অমোঘ শিল্প!সেই শিল্পত্বে দক্ষিণা হিমেল হাওয়ায় ক্ষনেক্ষনে ছুঁয়ে যাওয়ায়,প্রভুর কৃতত্ব, শৈল্পিকতার শ্রেষ্ঠত্বের মনোরমা মুগ্ধতার গুনাগুন যেনো চারপাশটা ভারী করে তুলেছে।কি অপরূপা সাজে সাজিয়েছে প্রভু বিকেলটা!অতুলনীয়!কালকের হলুদের স্টেজে আবারও হৈচৈ পরিপূর্ণ।চারপাশটা পরিপাটি সাজসাজ রব।সবকিছুতে যেনো একটা নিখুঁত সুন্দর পরিচ্ছন্ন সাজনি।রকমারী ডালা সাজিয়ে মেহেন্দি হাজির করা হয়েছে স্টেজের উপর।তার-ও একটা আভিজাত্যপূর্ন সাাজানো গোছানো সুন্দর সৌন্দর্যবর্ধন রূপ।পুরো লনএরিয়াসহ বাড়িটার একটা আলাদ রূপ হয়েছে।আর তাসাথে প্রত্যেকটা মানুষের সাজপোশাকও।আশপাশটা মুগ্ধ চোখে একবার দেখে নিয়ে নিজের দিকে তাকালো কৌড়ি।নিখুঁত বুননির গাঢ় একরঙা সবুজ একটা জামদানী পরোনো হয়েছে তাকে।ধবধবে দুধে আলতা ফর্সা গায়ে ম্যাচিং ব্লাউজের সাথে সবুজ শাড়ীটা যেনো,তপ্ত দুপুরের রোদের ন্যায় ঝলেমলে দ্যুতি ছড়াচ্ছে।পাতলা ফর্সা শরীরে শাড়ীটা ফুটেছে ভিষণ।আজও কৃত্রিম নয় অকৃত্রিম সবুজ গোলাপ আর শুভ্র সতেজ সাদা বেলিফুলের সংমিশ্রনে গহনা বানিয়ে বিভিন্ন অঙ্গে সাজানো হয়েছে তাকে।সবুজ গোলাপ সহজে দেখা যায়-না।এবাড়িতে আসার আগে সবুজ রঙের গোলাপ হতে পারে, সেই সম্পর্কে বিশেষ ধারনা ছিলোনা কৌড়ির।তবে এবাড়িতে আসার পর ছাঁদে লাগানো একটা টবে দেখেছিলো।মাত্র দুটো ফুল ফুটেছিলো গাছটাতে।তবে তার খোঁপা দিয়ে,কানে, মাথায়, গলায়, হাতে অনেক সবুজ গোলাপ জড়িয়ে গহনা পরা।সবুজ বুননি করে বানানো গহনার ফুলগুলাে নজরকাঁড়া, চোখধাঁধানো।এই আকর্ষণীয় ফুলগুলো ঠিক কোথা থেকে সংগ্রহ করে তাকে সাজানো হয়েছে কৌড়ির বিশেষ জানা নেই।আর চেয়ে-ও কারও কাছে জানতে পারিনি, প্রশ্ন করতে পারিনি সে।লজ্জা পেয়েছিলো খুব।কারণ তার সাজকৃত সকল কিছু নাকি সেই মানুষটার দেওয়া পছন্দনীয় জিনিস।এমনকি এই ফুলের গহনাগুলোও।তবে তাকে সাজানোর সময় দুষ্টমি করে মান্যতার মুখে শুধু দু-একবার বলতে শুনেছিলো–দাদাভাইয়ের পুতুল বউয়ের জন্য দাদাভাইয়ের স্পেশাল শপিং।একেবারে মুগ্ধতায় ছড়ানো সাজপোশাক।

তবে নিজেকে দেখে মান্যতা আপুর মতো কৌড়ির বলতেই হচ্ছে মানুষটার পছন্দ,রুচিশীলতা অসাধারণ।দারুন।একপলকে যে কার-ও পছন্দ হয়ে যাবে।যেতে বাধ্য।এক কথায় কি অমায়িক রুচিবর্ধক।

‘কি অপরূপা লাগছে তোকে!আমার তো চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছেরে কৌড়ি।হায় আল্লাহ,নজর না লেগে যায় আমার!

পরিচিত গলার স্বর পেতেই নজর তড়িৎ উচু করলো কৌড়ি।কিছু বলার আগেই দুর থেকে মৌনতা দৌড়িয়ে এসে বিথীকে জড়িয়ে ধরে উচ্ছ্বসিত গলায় বললো।–কেমন আছো বিথী আপু?তুমি আসা হলো তবে?

কৌড়িদের বাড়িতে দু’দিন থাকার সুবাধে বিথীর সাথে বেশ একটা ভাব জমিয়ে ফেলেছিলো মিশুকে মৌনতা।বিথীও প্রচন্ডে মিশুকে।তাই সহজে ভাব হয়ে গিয়েছিলো তাদের।একসাথে কৌড়িদের পুকুরে গোসল করা।গাছ থেকে বরই পেড়ে মেখে খাওয়া।নিজের বাড়িসহ তাদের গ্রামের আশপাশটা ঘুরে বেড়ানো।সেই সুবাধে ভালোই খাতির জমে বন্ধুত্ব হয়েছে দু’জনের মধ্যে।

‘খুব ভালো আছি।তুমি কেমন আছো মৌনি?

এই মিষ্টি ডাকটার জন্য মনেহয় দুদিনে বিথীর সাথে মিশুকে ভাবটা আরও গাঢ়ভাবে জমেছিলো মৌনতার।মিষ্টি হেসে বিথীর কথার জবাব দিয়ে সরে দাঁড়ালো মৌনতা।ততক্ষণে কৌড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছে।এই কাছের মানুষটাকে তার এই শুভক্ষণে কাছে পাবে আশা করেনি কৌড়ি।আশা করেনি ভুল।আশা তো করেছিলো খুব।তবে মেয়েটাকে এতোদুরে কেউ নিয়ে আসার সংকটে আশা চূর্ণ করতে হয়েছিলো তাকে।কালও তো কথা হলো।বললো–তার আসা হবে না।কতো আফসোস কতো দুঃখ বিমিময় হলো তা নিয়ে।কৌড়িরও ভিষন মন খারাপ হলো।অথচ ভাগ্য সহায় হয়ে কাছের বন্ধুটাকে তার এই শুভক্ষণে নিয়ে আসলো!

কথা বিনিময় ছাড়াই কৌড়ি জড়িয়ে ধরলো বিথীকে।
সময় নিয়ে বললো–বললি যে আসা হবে-না।এসেছিস তবে।

কান্নার আওয়াজ নেই।অথচ মন নোনাজলের অস্তিত্ব টের পেলো নিজের কাঁধে। নিজেও আবেগপ্রবণ হলো বিথী।কৌড়িকে নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বললো—মন খারাপ কেনো করছিস?এসেছি তো।তুই মন খারাপ করলে হয়?

‘আমার কেনো সবাই নেই, বল-না বিথী?কেনো আমার বলতে সবাই নেই।সব সুতো বাঁধন নেই।কেনো মা নেই,বাবা নেই।আপনজন বলতে কেউ নেই।কেনো নেই?আমার এই শুভক্ষণে কেনো তারা নেই?কেনো কেউ নেই?কেনো আমার প্রতি সবাই এতো নির্দয়া?আমার ভাগ্য কেনো এমন?তুই আসবিনা শুনে,কত মন খারাপ হয়েছিলো জানিস?

কৌড়ির দাঁতে দাঁত চেপে কান্নার এবার যেনো মৃদু শব্দ হলো।প্রানপ্রিয় বন্ধুটাকে দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে নিলো বিথী।আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো নিজেও।তবে নিজেকে ঠিক রাখার প্রয়াস করে স্বান্তনা সরূপ মোলায়েম কন্ঠে বিথী বললো—কে বললো তোর কেউ নেই।বাবা মা কি চিরকাল সবার থাকে?আর না সেই না থাকার জন্য সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে আমাদের কোনো অভিযোগ সাঝে?তুইতো বুঝদার মেয়ে,তোর কাছ থেকেই তো সবকিছু শেখা,জানা।তুই এরকম বললে সাঝে?এই যে এতো সুন্দর একটা ফ্যামিলি পেয়েছিস।
মানুষগুলো কত অমায়িক,ভালো।ভাইয়ার মতো একটা অসাধারণ মানুষ তোর।শুধু তোর।তারপরও বলবি আপনজন বলতে তোর কেউ নেই!মা বলেন,স্বামীই নারীর পরমআত্নীয়।মেয়েরা বাবার সংসারে লালিত- পালিত হয় ষোলো বছর,আঠারো বছর? বড়জোর কতো?অথচ স্বামীর বাড়ীতে থাকতে হয়,মৃত্যুর দিন পর্যন্ত। জীবনের চারভাগের তিনভাগ সময়টা স্বামীর সংসারে কাটাতে হয়।সেখানে পৃথিবীতে মেয়েদের আর ভাগ্য ভালো নাহলেও, স্বামীভাগ্য ভালো হওয়া,সুখকর হওয়া,শান্তিময় হওয়া উচিত।ভাইয়াকে দেখার পর, জানার পর,আমার মনে হয়ছে সেই সুখকর,শান্তিময় ভাগ্য নিয়ে তুই জন্মেছিস।সেই পরমআত্মীয়টা তুই পেয়েছিস।সেই তুই কিভাবে বলছিস তোর কেউ নেই।সবাই নেই।আমারই তো মনেহয় এক নিভানই তো তোর সব।ওরকম মানুষকে জীবনসঙ্গী পাওয়া সৌভাগ্য।আর কখনো এমন কথা বলবিনা।

শ্বাস ফেলে বিথী একটু চুপ হলো।ফের বললি–আমার জানটার বিয়েতে আমি থাকতে পারবোনা,আমারও ভিষন মন খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। আমি তোর বিয়েতে থাকতে পারবো না,ঈশশ কি অফসোস!তবে ভাগ্য সহায় হলো।সকালে ছোটো কাকু গিয়ে বাবাকে বললেন,আমাকে নিয়ে তোর এখানে আসার কথা।বাবা দ্বিমত করলেন না।আসতে দিলেন।

কৌড়ির কান্না আগেই কমে এসেছিলো।ছোটো কাকু নামটা শুনতেই বিথীকে ছেড়ে,তার সম্মুখে সোজা দাড়িয়ে বিস্ময় নিয়ে বললো–ছোটো কাকু এসেছেন?

বিথী হাসলো।কৌড়ির চোখের পানি আলতো স্পর্শে মুছে দিয়ে বললো—শুধু ছোটো কাকু নয়।কানন আর কিয়ান ভাইয়া-ও এসেছে।

কিয়ান ভাইয়া ঢাকাতেই থাকে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের স্টুডেন্ট সে।আর কানন,সেও ভালো স্টুডেন্ট। এবছর এডমিশন নিয়েছে।পড়ালেখার বিষয়ে বরাবর কিয়ান ভাইয়ের পরামর্শ নিয়ে তাকে অনুসরণ করে,সে-ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংলিশ বিভাগের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তির্ন হয়েছে।কিন্তু ছোটো কাকু চেয়েছিলেন ভিন্ন কিছু।যাই হোক,চাচাতো
ভাইবোন হিসাবে সম্পর্ক খুব একটা মিঠা না থাকলেও, ভালোমন্দ আলাপন চলতো।ছোটো চাচা আর তাদের বাড়িটা মুখোমুখি। বিধায় অন্য চাচাতো ভাইবোনদের থেকে এদের দু’জনের সাথে সম্পৃক্ততা ছিলো মোটামুটি।তবে কিয়ান ভাইয়া ঢাকায় পড়তে আসার পর,বাড়িতে গেলে দেখাসাক্ষাৎ হলে ভালোমন্দ আলাপনেই সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো কথাবার্তা। তবে বয়স সীমায় কানন তার বছর খানেকের বড় হওয়ায় কথাবার্তা মোটামুটি হতো।

‘কেমন আছিস মা?

ছোটো কাকুর এতো বড় দুটো ছেলে আছে তাকে দেখলে কেউ বিশ্বাস করবেনা।উনার চেহারায় বিশ্বাসযোগ্যতা পায়না।মনেহয় ছেলেদুটোর বড় ভাই তিনি।কৌড়ির বাবার পৌরুষ সুদর্শন আদল,তিনিও পেয়েছেন।চাচাদের মধ্যে ভাইদের চেহারায় বেশ একটা মিল আছে।সেই মানুষটাকে দেখেই কেমন কৌড়ি আবেগপ্রবণ হলো।মা ডাকটায় যেনো ভিতর থেকে গলে পড়লো।অথচ মনের কোথায় অনুরাগের ছোঁয়ায় শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।মানুষটা তাকে আদর যত্ন কম করতো এমনটা নয়।মা-ছাড়া ভাইয়ের মেয়ে হিসাবে ভালোও বাসতো ঠিকই।তবে কেমন ভালোবাসা ছিলো!যা তাকে পরের আশ্রিতা বানিয়ে দিলো।তবুও মায়া মমতা দেখিয়ে নিজেদের মেয়ে হয়েও তাদের কাছে তাকে আঁটকে রাখতে পারলোনা।একটা ছেলের উশৃংখলপনা থেকে নিজের বাড়ির মেয়েকে না বাচিয়ে অন্যের আশ্রয়ে পাঠিয়ে দিতেও বিবেকবোধে আটকালো-না।চারজন চাচা,কতোগুলো চাচাতো ভাইবোন সত্যিই কি তাকে আগলে রাখার মতো কউ ছিলোনা?

‘কাকুর উপরে এখনোও এতো অভিমান জমিয়ে রেখেছিস?

বাবার মতো হয়েছে মেয়েটা।আত্নকেন্দ্রীক! আত্মমর্যাদাসম্পন্ন!এবার বাড়িতে গিয়েও তাকে দেখা দেয়নি।বাড়ি থেকে বের হয়নি।সেদিন রাতে যখন অসুস্থ হয়ে পড়লো।কতোবার তার অসুস্থতার কথা নিয়ে এটাওটা জিজ্ঞেস করলো।অভিমানে মেয়েটা চোখ বুঁজে দাতে দাতত ব্যথা সহ্য করেছে।তবুও নিজের ব্যথা যন্ত্রণা উনাকে জানাইনি।আগে থেকে যে অপরাধবোধ উনাকে কুঁড়ে কুড়ে খাচ্ছিলেন।সেদিনের পর তা যেনো দ্বিগুন হলো।

সাজানো লন এরিয়াজুড়ে তখন মানুষ।স্টেজে কৌড়ির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক কেমন অসহায়ত্ব নজরে কৌড়ির মিষ্টি মুখের দিকে তাকিয়ে।পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো মান্যতা মৌনতা,বিথী আরও অনেকেই।উনাদের কে একটু আলাদা কথা বলতে দেওয়া দরকার। কথাটা ভেবে স্টেজের বাহিরে চেয়ার পাতানো ছিলো।সেখান থেকে দুোটা চেয়ার এনে দিলো মান্যতা।ভদ্রলোককে বসতে বলে,অন্যদের স্টেজ ছাড়তে ঈশারা করলো।
বিথী মৌনতাকে নিয়ে নিজেও স্টেজ ছাড়লো।স্টেজ ছাড়তেই মৌনতা,বিথীকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে চলে গেলো।উদ্দেশ্য বিথীকে সাজানো।বিথী নিষেধ করলো শুনলো না।একপ্রকার বাধ্য হয়ে নিজেও মৌনতার সাথে পা বাড়াবো।ওদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে আশপাশটা নজর দিলো মান্যতা।দূরে দেখতে পেলো,কৌড়ির চাচার সাথে আসা ছেলেদুটো ইভানের সাথে কথা বলছে।

‘সেদিন আমি তোর এখানে আসাটাকে আটকাতে পারতাম।অধিকারবোধে আটকিয়ে রাখিনি এজন্য হয়তো আমি অপরাধী।তবে আমি চেয়েছিলাম আটকাতে।মা’কে বলেছিলাম,কেনো ওকে অন্যের কাছে পাঠাতে হচ্ছেে?আমরা আছিতো।

মা সেদিন বলেছিলেন-কে আছিস ওরজন্য?আমিতো জানি কে কেমনভাবে ওকে আগলে রাখার জন্য আছিস!এতোদিনে কি করতে পেরেছিস?পেরেছিস ওই উশৃংখল ছেলেটাকে সুশৃঙ্খল বানাতে!ওর থেকে নিজেদের প্রাপ্য সাম্মান যেখানে আদায় করতে পারিসনি।সেখানে ওই মেয়েটাকে কি করে আগলে রাখবি।যদি নাহিদ ওর ওই সঙ্গপাঙ্গ নিয়ে এসে জোরজবরদস্তি করে কৌড়িকে বিয়ে করে নেয়।পারবি নাহিদকে আটকাতে?তোর মেজো ভাইকে আটকাতে?তাদের বিরুদ্ধাচরণ করতে?তোর ভাইয়ের মতো কৌড়িকে আগলে রাখতে?

‘আমি কেমন মানুষ যেমন মা জানেন তেমন তুইও জানিস।সেদিন মায়ের কথায় সত্যি মন থেকে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।সত্যি ও যদি ভাইয়ের অবর্তমানে নিজের ক্ষমতা দেখিয়ে তোকে জোরজবরদস্তি করে বিয়ে করে নেয়।যেখানে মেজোভাই বরাবরই ইন্ধন জুগিয়েছে,জুগিয়ে আসছে ছেলেকে।সেখানে তাদেরকে উপেক্ষা করে সত্যিই কি আমি পারবো তোর মতো ফুলকে রক্ষা করতে?বড়ভাইয়ের অবর্তমানে মেজোভাইকে দমানো কি সহজ কথা ছিলো?আমিতো কখনো তাদের সাথে দ্বন্ডে জড়াইনি, যায়নি।যেতে ভয় পেয়েছি সবসময়।সেই আমিকি পারবো,তোকে তোর বাবার মতো করে আগলে রাখতে?প্রশ্ন আমাার কাছেই রশে গেলো।না পারলাম তার যথাযথ উত্তর মেলাতে।আর না পারলাম তোকে আঁটকে নিজের কাছে রাখতে।

ছোটো কাকু।সহজ-সরল মানুষ। বরাবরই এরকমটাই দেখে এসেছে কৌড়ি।সহজে কাওর সাথে ঝামেলায় জড়ানো,দ্বন্দ্বে যাওয়া।এগুলো উনার স্বভাবজাত নয়।তিনি সবসময় ঝামেলা মুক্ত থাকতে চান।থেকে এসেছেনও।চাচি তার বিপরীত।চতুর চালাক।তবে উনারও একটা গুন,ঝামেলা দ্বন্দ্বে না জড়ানো।তবুও প্রশ্নতো রয়ে যায়!ভদ্রলোকের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা কৌড়ির প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করলো–যদি সে ছোটো কাকুর নিজের মেয়ে হতো, কি করতেন তিনি?তাকে কিভাবে প্রটেক্ট করতেন?প্রটেক্ট করতেন না নাকি?নাকি এভাবে তাকেও নিজের আশ্রয় ছাড়িয়ে অন্যের আশ্রয়ে আশ্রিত করতেন?

হঠাৎ মাথায় হাত পড়তেই ভাবনা কেটে গিয়ে চমকে উঠলো কৌড়ি।পলকহীন নজর নিবিষ্ট করলো,সামনে বসা মানুষটার অসহায়ত্ব মুখে।সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা মানুষটার মুখে যদি ভারী কাঁচাপাকা চাপদাড়িরতে ভর্তি থাকতো।কৌড়ি এতোক্ষণে তার বুকে মাথা লাগিয়ে দিয়ে দুহাতে গলা জড়িয়ে ধরতো।বাবাকে ছেড়ে বিয়ে হয়ে পর বাড়িতে যাওয়ায়,দু এক ফোঁটা অশ্রুও বিসর্জন দিতো।বাবা কতো মন ভোলানো কথা বলে স্বান্তনা যোগাতেন।হঠাৎই কৌড়ির মনেহলো,
এযেনো ছোটো কাকু নয়।বাবা তার সামনে অসহায়ত্ব নজরে তাকিয়ে আছেন।সহসা কলিজা কেপে উঠলো কৌড়ির।তন্মধ্যে ভদ্রলোক বললেন–

‘জানিনা,নিজের মেয়ে হলে কি করতাম।তবে আমার উপর অভিমান যতো আছে পুষে রাখতে চাইছিস তো?রাখ।অধিকার আছে তোর।চাচা হিসাবে অপারগ মানুষটার বিরুদ্ধে অভিমান কেনো,রাগ, ক্ষোভ, অভিযোগ পুষে রাখাও জায়েজ তোর।তবে ছোটো কাকুকে অমানবিক অমানুষ মনে করিসনা।করিস না।

আঁতকে উঠল কৌড়ি।তড়িৎ বলো–এগুলো কি বলছেন ছোটো কাকু!আমার অভিমান আপনাদের উপর। তাই বলে অপরাধী ভাবি-না।এসব কেমন কথা!বাবা সামনে থাকলে আমার উপরে অসন্তুষ্ট হতেন।এখন নেই,তাই বলে কি তার সন্তুষ্টতা অসন্তুষ্টার খেয়াল আমার নেই!এমনভাবে বলবেন না।

‘কেমন আছিস মা?শরীর কেমন আছে তোর?

কৌড়ি কথা বলবেই আবেগপ্রবণ হয়ে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।কৌড়িও কেমন যেনো টান ছাড়তে পারলোনা।মৃদু হেসে বললো– আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।শরীরও ভালো আছে।আপনার শরীর কেমন আছে।বাড়িতে সবাই কেমন আছেন?

‘বাড়িতে সবাই ভালো আছে।আর আমি!আমি ভালো আছি।তবে মন তাকে ভালো রাখতে পারছি কই!তবুও দিন যাচ্ছে ভালো।

একটু থেমে ফের কেমন করুন গলায় বললেন।–তোর থেকেও বড় অপরাধী আমি তোর বাবার কাছে।সে যেনো আমার বিবেককে ধাক্কা দিয়ে বারবার বলে,পারলি না তোরা কেউ আমার মেয়েটাকে একটু আগলে রাখতে!পারলিনাতো!’বড়ভাইয়ের কবরের পাশে গিয়ে দু-বেলা মাফ চাই।তার যত্নের মেয়েটাকে আগলে রাখতে পারলাম না!আহ।ক্ষমা পাইনা জানিস!
রোজ সেই একইভাবে বিবেক ধাক্কা দিয়ে আমাকে কথা শোনায়।তোকে দেখার জন্য শহরে এসেছিলাম দুবার।দেখেছিলাম।তবে তোর সম্মুখীন হওয়ার সাহস হয়নি।লজ্জায়,কুন্ঠায়!কিয়ান-কে বলেছিলাম খোঁজ রাখতে।
ওই মাঝেমধ্যে খোঁজ দিতো আমাকে।আর মা-তো ছিলোই।তুই যখনই মায়ের সাথে কথা বলতিস,আমি সামনে থেকেছি প্রায়।

একের পর এক কথা হতে থাকলো দুজনের।কৌড়ি সহসজ সরল মানুষটার স্বীকারোক্তি শুনলো।মানুষটা এরকমই মনে কিছু চেপে রাখতে পারে-না।মনেমনে নিজেও দীর্ঘশ্বাস ফেললো।রক্তের সংযোজন তো!যতোই রাগ অভিমান অভিযোগ থাকুক।টান,মায়া এসেই যায়।কথা বলতেই মনটা আরও কিছু জানার জন্য খুদমুদ করে উঠলো কৌড়ির।সহসা জিজ্ঞেস করলো।—সেজো কাকু আর বড়োছোটো কাকু আসতে চাইলেন না?আপনি একা এসেছেন?আর ছোটো চাচী?

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ভদ্রলোক। বললেন–সবাই তো একই অপরাধে অপরাধী হয়ে আছে।মেয়েটার বিপদে পাশে থাকতে পারিনি,তার শুভক্ষণে তার পাশে থাকা লজ্জাজনক।সেই লজ্জা।আবার এবাড়ি থেকে বিয়ের নিমন্ত্রণ পেতেই,তোর সেজো কাকু বড়ছোটোকাকু বললেন-মেয়ে আমাদের বাড়ি থেকে বিয়ে হয়ে বিদায় হওয়ার কথা।সেখানে ছেলের বাড়ি থেকে নিমন্ত্রিত হচ্ছি। নিমন্ত্রণ পাচ্ছি। এরথেকে লজ্জাজনক আমাদের জন্য আর কি হতে পারে।সেখানে যাওয়া নিজেদের জন্যই অসম্মানের।লজ্জার।তাই আসলেন না।আর উনারা না আসলে,ছেলেমেয়েগুলো কি করে আসবে।
যেখানে পরিস্থিতিও অদ্ভুত।তবে রাজশাহী থেকে মুবিন বলেছে বিয়ের দিন আসবে।আর তোর ছোটোচাচী। সে অসুস্থ।পুকুরঘাটে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেলো,তুই অসুস্থ হয়ে পড়লি সেদিন।পায়ের ভিষণ খারাপ অবস্থা। নাহলে আসতে চেয়েছিলো।

দুজনের মধ্যে আরও কিছুসময় কথা চললো।সেখান থেকে কিছুক্ষণ বাদে কিয়ান আর কানন-ও আসলো।বোনের সাথে আলাপ পরিচয় সেরে,কিয়ান চলে গেল।সাথে কৌড়ির ছোটো চাচাও। কানন বসে পড়লো তার পাশে।কৌড়িকে বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখে বললো–এক পুঁচকে মেয়ে,শাড়ী পড়েছিস তো তোকে কতো বড় দেখাচ্ছে!তুই ঘটি থেকে এই চারমাসে কলসের মতো বড় হয়ে গেলি কিকরে?

আশ্চর্য! উদাহরণের কি শ্রী!তবে কাননের সাথে কথা কম হলেও সম্পর্কে ছিলো,তাদের ঠোকামোকির।সেই সম্পর্কগুলো যেনো ভুলে বসেছিলো কৌড়ি।তারজন্য এই ছেলেটাও নাহিদের কাছে হুমকিধমকিও তো কম খায়নি।

‘কি হলো?কথা বলিস না ক্যান?আর যারউপরে অভিমান রাগ করিসনা কেনো,আমার উপর অন্ততঃ অভিমান, রাগ,অভিযোগ করতে পারবিনা।আমি বলেছিলাম,চল কৌড়ি নাহিদ ভাইয়াকে টপকে তুই আর আমি পালিয়ে বিয়ে করে ফেলি।আমার কথা কানেই তুললিনা।শুনলিই না।তাহলে তোকে তো আর অন্ততঃ বাড়ি ছেড়ে আসতে হতো না।

‘তবে পরের দিন ঠিকই বিধবা হতে হতো।আর তোর বুকের পাটার সাহস কতো!তা তো আমার জানা আছে।ওই অসভ্যটা বাড়ির দরজায় পা রাখলে,রাস্তা থেকে হাক ছাড়লে যাকে ঘরের দরজা খুলতে দেখা যেতোনা।তিনি আসছেন,বানী শোনাতে।

ফিসফিসিয়ে কথাটা বলতেই দাঁত বের হাসলো কানন।
বোকা হাসি।কাকুর মতো ছেলেটাও সহজ সরল।একটা সময় কৌড়ি তাকে গাধা বলে ডাকতো।তার নানাবিধ কারনও ছিলো।ছেলেটা ফের বললো—তা এই অসাধ্য নিভান ভাইয়া সাধন করলো কিকরে?টোপসহ নাহিদ সাহেবের কাছ থেকে একবারে বরশি ছিনিয়ে নিলো। আর নাহিদ সাহেব কিচ্ছু বললেন-না।এক্কেবারে ভালো বাধ্য ছেলেদের মতো বরশি দিয়ে দিলো! মেনে নিলো! আবার শুনলাম আমার মেজো চাচার অভদ্র নেশাখোর ছেলেটা নাকি মানুষ হয়ে গেছে।ব্যাপারটা তো শুনেই বুকব্যথা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লাম।নাহিদ সাহেব ভালো হয়ে গেছেন!মেনেই নিতে চাইছেনারে মন!আর তোর বিয়ে, শুনেও তিনি চুপচাপ!সব হজম করতে ভিষণ কষ্ট হচ্ছেরে ফুলবানু।

বাবা তাকে ফুল বলে ডাকতো।আর তার পিছে বানু খাটিয়ে দিয়ে কানন তাকে ফুলবানু বলে ডাকতো।যেটা নিয়ে ক্ষিপ্ত হতো ভীষন কৌড়ি।আজ ক্ষিপ্ত হলোনা।কেমন বাবার কথা বলে পড়ে গেলো।মূহর্তেই কলিজা মোচড় দিয়ে চোখের কোণে জমলো নোনাজল।

‘বানু?

কৌড়ির ভিতরটা যেনো আরও ভেঙে এলো।মাথা নিচু করে নিয়ে চোখের নোনাজল সংবরন করার চেষ্টা করলো।পারলো না।পরপর গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা নোনাজল।সেটা দেখে অপরাধী গলায় কানন বললো।

‘বড়কাকুর কথা মনে পড়ছে?

কৌড়ি মুখে কিছু বললো-না।তবে কান্নার দমক চোপে রাখার প্রচেষ্টায় কেঁপে উঠলো তার শরীর।

‘তোর কান্না কিন্তু তিনি সহ্য করতে পারতেন না।তাই তুই কাদলে কিন্তু তিনি যেখানেই থাকুক কষ্ট পাবেন।’মন খারাপ করিস না।আমরা আছি তো…

কথাটা বলতেই কেমন বিবেকে নাড়া দিলো।তারা কি সত্যিই মেয়েটার আপনজন বলে ছিলো?কৈ ছিলো!না হলে একটা মেয়েকে প্রটেক্ট করার ক্ষমতা,সাহস কি ভাইবোন বা চাচা কারও ছিলোনা?নাকি চাইনি কেউ।সেই অপরাধ থেকে সহসা ফের কাননন বললো—

‘চাচাদের দায়িত্ব কর্তব্য দোষগুন কি ছিলো কি আছে, উল্লেখ করতে চাইনা আমি।তবে বড়ভাই হিসাবে হয়তো তোর ভালোমন্দের যে খেয়াল রাখা উচিত ছিলো,এটা
পারি-নি।ভিতু ছিলাম, তাই হয়তো পেরে উঠিনি।কেনো জানিনা, এই শহরে এসে তোর ভাইটা তোরমতো বড় হয়ে গেছে।তুই যেমন ছোট্রো ঘটিটা থেকে কলস হয়ে গেছিস।আমিও তেমন তোর গাধা ভিতু ভাইটা থেকে একটু সাহসী হয়েছি।কথা দিচ্ছি বানু,ভাই হিসাবে এবার সবসময় তোর খোঁজ রাখবো।খেয়াল রাখবো।যদিও জীবনে এমন একজনকে পেতে চলেছিস,হয়তো আমাদের আর প্রয়োজন হবেনা। নিভান ভাইয়া থাকতে হয়তো আর খেয়াল খোঁজ না রাখলেও চলবে।তবুও তোর এই ভাইটা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে আছে খেয়াল খোঁজখবর রাখবে।মন খারাপ করিস না।লক্ষীসোনা বোন আমার।কাকু কষ্ট পাবে।

কৌড়ি মুখ তুলে চাইলো।সাংঘাতিক আকারের ভিতু ছেলেটা তাকে এসব বলছে!কেমন যেনো অদ্ভুত নজরে কাননকে দেখলো সে।

‘চোখ মোছ। কি সুন্দর দেখাচ্ছে তোকে।সবতো নষ্ট হয়ে যাবে।ঈশশ, আমার সাহস যদি নিভান ভাইয়ার মতো একটু সাহস থাকত,তবে নাহিদ ভাইয়ার হাতের বরশিটা নিভান ভাইয়াকে ছিনিয়ে নেওয়ার আগে আমিই ছিনিয়ে নিতামরে ফুলবানু।

কথার মধ্যে ঠিকঠাক কথা কম ফাজলামো বেশি।এই ছেলের সহজ সরল চঞ্চল স্বভাব।কৌড়ি হাসলো।দু’হাতে চোখ মুছে নিলো নরম স্পর্শে।সামনে তাকালো।লন এরিয়ার অপজিট সাইডের বাগানের খোলা জায়গায় চেয়ার টেবিলের আসন পাতা।ছোটো কাকু আর কিয়ান ভাইয়া সেখানে বসে নিভান নামক মানুষটার সাথে আলাপে মেতেছে।সঙ্গে উনার মামারাও আছেন।জাহিদ আঙ্কেলও।

‘ওইযে নিভান সাহেবকে দেখা যাচ্ছে।যা তো,বরশিটা তার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আয়।কেমন সাহস দেখি কানন আশরাফের?

‘তুই আমাকে গাধা ভাবলেও আমি এতোটাও গাধা নই।যে বান্দা নাহিদের মতো উগ্র, উশৃংখল,হিংস্র আচরণের ছেলের সামনে থেকে খুব সহজে তার টোপেগাথা বরশিটা নিয়ে নিতে পারে।সে বান্দাকে যতোই শান্ত আর সরল দেখাক না কেনো!আমি বুঝে গিয়েছি তিনি কেমন! ঘুমান্ত,শান্ত টাইগার।উনার লক্ষ্যচুত যে সাংঘাতিক তীক্ষ্ণ। সেটা তার ওই বুঁজেথাকা চোখের পাতার দিকে তাকলেও বোঝা যায়।তার ওই বুদ্ধিদিপ্ত খোলা চোখের মনির দিকে না তাকালে-ও জানা যায়। আর তার হাত থেকে বরশি ছিনিয়ে নিতে বলছিস?আমি চির কুমার থাকতে চাই। তবুও মাফ চাই।এতোসময় মজা করছিলামরে ফুলবানু।

চারিদিকে মেহেদি মাখার হৈ-হুল্লোড়। মেহেদী আর্টিস্টদের ইনভাইটেশন করা হয়েছে।আপতত কনেসহ,বাড়ির মেয়েদের মেহেদী মাখাতে ব্যস্ত তারা।
কৌড়িসহ মেহেদী আর্টিস্ট মেয়েদের মধ্যে একজন স্টেজে বসা।আর সবাই লন এরিয়ার বিভিন্ন জায়গায়জুড়ে আলাদা আলাদা দল হয়ে গোলাকার ভাবে বসে মেহেদী মাখছে।গল্প হাসি মজায় চলছে তাদের মেহেদী উৎসব।স্টেজ থেকে কিছুটা দূরে মিউজিক সিস্টেম মৃদুমন্দ আওয়াজে গান বাজছে।সেখানে চলছে ছেলেদের বিশেষ আড্ডা।আড্ডার মুখ্যমনি ইভান,তৃনয়, সিয়াম এবং তাদের পরিচিত বন্ধু, কাজিনমহল।সেখানে অবাধ আড্ডা চলছে।বিকালে মেহেদী পর্ব শেষ করে সন্ধ্যার পর মেহেদী উৎসব উপলক্ষে নাচ গানের মৃদুমন্দ আসর বসবে।এটাই লক্ষ্য আর পরিকল্পনা তাঁদের।মাঝেমধ্যে ফাজলামোর সাথে সেসব আলোচনা ভেসে আসছে কৌড়ির কানে।কৌড়ির ডানহাতটা নিয়ে সবে মেহেদীর ঠান্ডা প্রলেপ বসিয়েছে আর্টিস্ট মেয়েটা।তারমধ্যে কানে এলো ভারী গলার শান্ত আওয়াজ।

‘এক্সকিউজ মি।আই উইল ট্রাই টু ডু ইট!

গলার স্বর পরিচিত।মুখ উচু করে তাকালো কৌড়ি।তারমধ্যে আর্টিস্ট মেয়েটা সম্বোধন পেতেই নিভানের মুখের দিকে তাকাতেই তড়িঘড়ি করে সরে গিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো–ইয়েস ইয়েস।,সিওর স্যার।

মেয়েটা উঠে গিয়ে জায়গা করে দিলো।সেখানে গিয়ে রয়েসয়ে বসলো নিভান।শ্যাম গায়ে জড়ানো কৌড়ির মতোই গাঢ় সবুজরঙা পাঞ্জাবি।সেটা কেমন সবুজ নয় পিত্তিরঙা দেখাচ্ছে।একই রঙের সুতোর কারুকাজ হওয়ায়,গলা এবং বুকের নিখুঁত কারুকার্যখচিত ডিজাইনটা ঠিকঠাক হঠাৎ বোঝা যাচ্ছে না।ঘনোকালো পরিপাটি চুল।যেটা শ্যামবর্ণ মুখের জৌলুশ সৌন্দর্যতার পরিস্ফুটতা বাড়িয়ে দিয়েছে।সেখানে খাঁড়া নাক,সুগভীর শান্ত ভাসাভাসা চোখ,আকানো পুরো ঠোঁট স্পষ্ট।ভারী গম্ভীর অথচ মায়ামায়া চেহারা।আর সেই মায়ামায়া চেহারার সৌন্দর্যতা বাড়িয়ে দিয়েছে,গাঢ় সবুজ পাঞ্জাবি আর সাদা পাজামাতে।বেশ লাগছে উঁচু লম্বাটে মানুষটাকে।কৌড়ির ভাবনার মাঝেই নিভানকে স্টেজে দেখে হৈহৈ পড়ে গেলো।সবার নজর পড়ে গেল।স্টেজে বসা দুজন স্পেশাল ব্যাক্তির উপর।ইভান-তো গানের সাউন্ড বাড়িয়ে দিলো।ফের ছটফটিয়ে এসে মজা নিতে নিতে কয়েকডজন ছবি তুলে নিলো।সেদিকে বিশেষ পাত্তা দিলোনা নিভান।নিজের কাজে মনোযোগী হয়ে সামনে বসা অপরূপা রমনীকে উদ্দেশ্য করে বললো।

‘হাত দিতে ভয় পাচ্ছো নাকি?পাছে তোমার হাতটা নষ্ট না হয়ে যায়?

নিজের দিকে তাকালো কৌড়ি।দু’জনেই একরঙের পোশাক জড়ানো।কেমন উষ্ণ উষ্ণ শিহরণ বয়ে যেতে লাগলো শরীরের আগাগোড়া।নিভান প্রশ্ন ছুড়তেই সেই শিহরণে মৃদুকম্পন দিয়ে দোলা দিলো সর্বাঙ্গে।সামনের মানুষটার শরীর থেকে ভেসে আসা কড়া পারফিউমের সুগন্ধ প্রজাপতি মতো ডানা মেলে ভেসে বেড়াতে লাগলো তার চারপাশ। মোহিত হলো মন,মনোযোগ।নিঃশব্দে হাতটা বাড়িয়ে দিলো নিভানের পানে।হাত ধরলোনা নিভান।শুধু নজর ইশারা করে দেখিয়ে দিলো হাতটা রাখবে কোথায়।মানুষটার আসনেবসা কোলের মধ্যে! মোহিত নজর সংকোচিত হলো।সেটা বুঝে বাড়ানো হাতটা সন্তর্পণে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কোলের মধ্যে রাখলো নিভান।কোলের মধ্যে অবশ্য নয়, নিজের মুড়োনো পায়ের উপর রাখলো।কম্পন দিয়ে উঠলো হাত।সাথে শরীীটাও।সেটা বুঝে কৌড়িকে সহজ করতে নিভান বললো।

‘একটা সময় মনে হয়েছিলো,তুমি যাদুময়ী,যাদুকারিনি।যে মোহিনী,কোনো মন্ত্রতন্ত্র জাদুবল ছাড়াই যে-কোনো পুরুষকে মোহিত করতে পারে!যেমনটা তার শান্তশিষ্ট আচারনে,ধীরস্থির কন্ঠে,মোলায়েম স্বভাবে,মায়ামায়া চাহুনিতে আমিও আঁটকে গিয়েছিলাম।আমার আগে আঁটকে গিয়েছিলো আরও অনেকেই।সেই মোহিনী আমার জেনেও এখনো আঁটকে যাচ্ছে আরও অনেকেই।আজ মনেহচ্ছে, তুমি ভুবনমোহিনী মোহমায়া রূপের বাসিনীও।এক দেখায় যার রূপেতে আঁটকে গেছে অনেকের নজর।আমি পারছি-না, সেই নজরগুলোকে চেয়েও আটকাতে।আবার না পারছি সেই চোখগুলো উপড়ে দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করতে!শুধু সবকিছু গিলে ফেলে নিজেকেই ঠিক রাখার প্রয়াস করে যেতে হচ্ছে।তা যে কতোটা কঠিন,উফফ!তোমাকে লুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে কৌড়ি।এমন কোথাও লুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে সেখানে এইরূপে আর কেউ নয় আমিই দেখবো তোমাকে। শুধু আমার নজর ওরকম মুগ্ধ হয়ে দেখবে তোমাকে।এই জনসম্মুখে তোমাকে এভাবে প্রেজেন্ট করাটা কিছুতেই ঠিক হয়নি!ঠিক হয়নি আমার!তোমাকে চুপিচুপি বিয়ে করে নেওয়াই উচিত ছিলো।

বান্দা এখানে এসেছে শুধু তাকে মেহেদী লাগানোর জন্য, এমনটা নয়!এটা নিভানের শান্তস্বরের সর্তক বার্তায় বেশ অনুভব করলো কৌড়ি।বান্দার নজর যে তাকে ঘিরে চারিদিকে ঘুরছে!এটাও টের পেলো কৌড়ি।তবে একটা কথা মনে খচখচ করতে লাগলো।সহসা প্রশ্নও করলো সে।

‘আপনিও কি তবে সেই রূপে মোহিত হয়েই…

হাসলো নিভান।চমৎকার সে হাসি মুগ্ধ নজরে অবলোকন করলো কৌড়ি।এতোসময় মেহদীর টিউব নিয়ে খোঁচাখোঁচি করছিলো নিভান।কিভাবে মেহেদী লাগাবে বুঝতে পারছিলো-না।পর্ব অভিজ্ঞতা নেই তার।কাননের মুগ্ধ নজর।কৌড়িকে হাসোনোর চেষ্টা। তার সাথে হেসে হেসে কথা বলা।সেই বাগানে বসেই খেয়াল করেছে নিভান।আরও কিছু মানুষের নজর খেয়াল করেছে।কেমন ক্ষনে ক্ষনে মুগ্ধ নজরে কৌড়িকে দেখছে তারা।বিষয়টা মোটেও ভালো লাগিনি নিভানের।যদিও মেয়েটার এমন মোহমায়া রূপে নিজেও মুগ্ধ। তবে সে যে শুধু কৌড়ির রূপে মুগ্ধ, তা তো নয়।কৌড়ির রূপতো তাকে আগে মোহিত করেনি!করছিলো ভিন্ন কিছু।মুখ উচিয়ে সেই কাজল কালো হরিনী চোখে নজর ফেললো নিভান।এই মায়াবিনী চোখদুটো তাকে আকৃষ্ট করেছিলো আগে।স্বচ্ছ হরিনী চোখদুটো ছিলো নোনাজলে ভরপুর।আজ সেই চোখে গাঢ় কাজলের প্রলেপ।এই কাজলকালো চোখদুটোতেই তো নিভান প্রথম দূর্বল অনুভব করেছিলো।তারপর একটু একটু করে ওই মেয়েটাতে।সেই চোখে চোখ রেখে নিভান অকপটে স্বীকার করলো।

‘নাহ।তবে একেবারে না নয়,তাও যে নয়।তা নয়।এই শক্তপোক্ত হৃদয়ের আমাকে তোমার প্রতি দূর্বল করেছিলো,তোমার এই চোখ।তবে এই কাজলকালো সচ্চ,সুন্দর চোখজোড়া নয়।তোমার সেই ক্রন্দনরত নোনাজলে টইটম্বুর চোখজোড়া।ওই চোখজোড়া আমায় ডেকেছিলো,তার গহ্বর থেকে ফোঁটায় ফোটায় গড়িয়ে পড়া নোনাজলগুলো আমার আদূরে স্পর্শ মুছে নিতে।অথচ আমি না বুঝে যখন তাকে পাত্তা দিলাম না।সেও আমাকে একটা রাত স্থির হয়ে শান্তিতে ঘুমাতে দিলো-না।দিনের ক্লান্তিতে আমার দুচোখ একত্র করতে দিলো-না।সহসা আর বদ্ধ দুয়ারে,কঠিন হৃদয়ে তার হানা প্রবেশ শুরু হলো।আমি অনুভব করলাম,ওই চোখজোড়া তার মালিকের দখলদারী আমার মনে বসিয়ে ফেলেছে।আমি রোজ তাকে দেখছি,মুগ্ধ হচ্ছি আর একটু একটু করে তার দখলদারত্বের বশিভুত হচ্ছি।অনুভব করলাম,তবে তা থেকে বেরিয়ে আসার বদলে তাতে আরও ডুবে যেতে প্রশান্তি বোধ করলাম।
সুখ অনুভব করলাম।বুঝলাম আমার শান্তি আমার প্রশান্তিটা ঠিক কোথায়!সেই চোখজোড়া থেকে তুমি।তারপর তোমার সর্বত্র কিছু।আমি আমার একান্ত বলেই ভেবে নিলাম।যার মালিকানা শুধু আমার।

কৌড়ির নজর স্থির।মৃতুব্যক্তির ন্যায় স্থির।ঘনপল্লবিত লেশগুলোর পলক নেই।কালোমনিটার নড়নচড়ন নেই।শান্ত।নিজেকেও কেমন কঠিন পাথর মনেহলো।শরীরটদ কেমন বরফঠান্ডা শীতলের মতো অনুভব হলো।হৃদযন্ত্র অসাড়।একেমন অভিব্যক্তি, অনুভূতি।কৌড়ির এই অচল অনুভূতি নিভান ঠিকে পেলো কিনা।সেভাবে জানা নেই।তবে কৌড়ির সেই স্থির চোখের দিকে তাকিয়ে কেমন আত্মবিশ্বাসী, ভরসাপূর্ন গলায় বললো–এতোটা মোহমায়ারূপী নাহলেও আমি তোমাকেই চাইতাম।বিশ্বাস করাটা একান্ত তোমার ইচ্ছে।তবে আমি তোমাকেই চাইতাম,কৌড়ি।

কৌড়ির অভিব্যক্ত সেরকমই নিশ্চল।হাতের মধ্যেখানে ঠান্ডা মেহেদীর প্রলেপ পড়তেই সচকিত হলো সে।তড়িৎ মুখ নিচুকরে হাতের দিকে তাকালো।নিজের হাতের মধ্যে নজরে পড়ার আগেই,লোশমে ভরা শক্তপোক্ত আকর্ষনীয় একটা পুরুষালী হাত নজরে পড়লো।পাঞ্জাবির হাতাটা কনুই পর্যন্ত গোটানোতে,হাতটা স্পষ্ট।হাতটা দেখে কেমন শিরশির করে উঠলো ভিতরটা।মানুষটা রঙে শ্যামবর্ণ হলে কি হবে,তিনি বড্ড আকর্ষনীয়।দুজনের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটিয়ে হঠাৎই কৌড়ির ফোনটা বোজে উঠলো।পাশেই ছিলো ফোনটা।দুজনেই সেদিকে তাকালো।নিভান একপলক তাকিয়ে নজর সরিয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিলো। অথচ কৌড়ির নজর ফোনে স্কিনে স্থির।নামধাম নেই।শুধু নম্বর।অথচ নম্বরের মালিকটা কে? সে জানে।তড়িৎ নিভানের মুখের দিকে তাকালো সে।বরাবরের মতোই নিস্পৃহ, নির্বিকার একটা মুখ।দ্বিধাদন্ডে ভুগলো কৌড়ি।ফোনটা ধরবে কি ধরবেনা!যদিও মন একদম অটল,ফোনটা ধরার কোনো কারন নেই।তবুও সামনের মানুষটাকে বিবেচনা করে মস্তিষ্ক বলছে ফোনটা ধরতে।এমন একটা সম্পর্কে তারা জড়াতে চলেছে,যেখানে জড়তা-সংকোচ রাখা উচিত নয়। ফোনটা কাছে নিয়ে আরও একবার নিভানের মুখের দিকে তাকিয়ে ফোনটা ধরলো কৌড়ি।লাউডস্পিকারও দিলো।মূহুর্তেই ওপাশ থেকে হড়বড়িয়ে কেউ ভারাক্রান্ত গলায় বলে উঠলো।

‘ফোনটা ধরেছিস ফুল!আমি কৃতজ্ঞ।এই ফুল,আমি নিজেকে অনেক বুঝিয়েছি কিন্তু আর পারছিনা।আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে,নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা।ভিষণ জ্বালাপোড়া করছে বুকটা।কেনো এমন হচ্ছে বলতো?আমি তো মনে করেছিলাম, তোকে ছাড়াই যখন তোকে ভালোবেসে যেতে পারছি।তবে তোকে ছাড়াও থাকতে পারবো।তবে কেনো পারছিনা,তোর বিয়ে এটা মানতে!জানিস,সেদিন যখন হসপিটালে নিভান ভাইয়া তোকে বিয়ে করার প্রস্তাব রাখলো।মনেহলো,আমার হৃদপিণ্ডে কেউ তীব্র আঘাতে হৃদপিণ্ডটা ছিনিয়ে নিতে চাইলো।আমি সেই আঘাত নিয়েও চুপচাপ সবটা দেখতে শুনতে বাধ্য হলাম।মনকে বোঝালাম,যাকে পেতে আমি এতটা উতলা,অসভ্য।সে আমার নয়।আমি তাকে আর জোরজবরদস্তি করে তার ঘৃনার শহরে হারিয়ে যেতে চাই না।মনকে সেখান থেকেই একটার পর একটা বুজ দিয়ে চলেছি।অথচ কিছুতেই মানতে রাজি নয় সে।
মানছেনা না।তীব্র ব্যথায় ছটফটিয়ে একটাই করছে সে, পৃথিবীর সবকিছুর বিনিময় শুধু তোকে পেতে চাইছে।নাহলে আবার ডুবে যেতে চাইছে সেই অন্ধকার গলিতে।আমি পারছিনা আর তাকে সামলে রাখতে।আমার পাপের শাস্তিস্বরূপ একেমন যন্ত্রণায় নিপতিত করেছিস তুই!এই ফুল,আমি তো ভালো হয়ে গেছি তাইনা?আমি আরও ভালো হয়ে যাবো।খুব ভালো। যেমনটা বড়কাকু চাইতেন তেমনটা।সেখানে তুই যা চাইবি,আমার সাধ্যবলে পৃথিবীর সবকিছু তোর পায়ে এনে দেবো।আমার কাছে চলে আয়-না ফুল।তোকে ছাড়া আমি যে মরে যাবো।

নিভান আঁকাআকির চেষ্টা করলোনা। তার দ্বারা হবেনা।তাই কৌড়ির ডান হাতের মধ্যে নিজের নামটা ইংলিশ ওয়ার্ডে খুব সুন্দর করে লিখতে মনোযোগী হলো।মনে হচ্ছে দুনিয়ায় সব মনোযোগ তার সেই লেখাতে। আশে পাশে কি হচ্ছে সেসবে তার বিন্দু মনোযোগ নেই।অথচ নাহিদের মাঝেমাঝে কিছু কথার প্রতিফলনে হাতটা মৃদু কেঁপে উঠছে।সেটা যেনো স্পষ্টই টের পেলো কৌড়ি।
তবে মানুষটা ভুলেও লেখা খারাপ হতে দিলোনা।এমন দৃঢ় মনোভাব রাখার চেষ্টা সেখানে।কৌড়ি কান দিয়ে একজনের ভারাক্রান্ত হৃদয়বিদারক কথাগুলো শুনলো।
আর নজর দিয়ে আরেকজনের মনোযোগী হয়ে লেখাটা বেশ খেয়াল করে দেখলো পলকহীন।তারচেয়ে খেয়াল করে দেখলো,সামনের মানুষটার গম্ভীর নির্বিকার মুখটা।আশ্চর্য যে মানুষ একটু আগে তাকে নাকি মুগ্ধ নজরে গিলছে সবাই বলে কতো কি অভিব্যক্তি জানালো।সেই মানুষটা নাহিদের এতো আবোলতাবোল পাগলামি কথা শুনেও এতো নির্বিকার।শান্ত।

‘এই ফুল।

‘বলেছি না,এই নামে ডাকবেন না আমাকে।আর নিজেকে সামলান।নিজেকে আবার খারাপ পথে নিয়ে যাবেন নাকি ভালো পথে অনড় রাখবেন,সেটা আপনার একান্ত মর্জি।সেখানে আপনি ভালো থাকলেন নাকি মন্দ। আমার দেখার জানার প্রয়োজন আছে বলে মনে করছিনা।আর আমাকে কেউ ধরেবেধে বিয়ে দিচ্ছে না।আমার নিজের একান্ত মর্জিতেই আমার বিয়ে হচ্ছে।সেখানে আপনার অনুভূতি অভিব্যক্তি আমার কাছে, জাস্ট ম্যাটার করে-না।সুতরাং দ্বিতীয়বার ফোন দিয়ে আপনি আমাকে বিরক্ত করবেন না,সেটাতে বরং আমিই প্রচন্ড বিরক্ত হবো।রাখছি….

ফোন কেটে দেওয়ার আগেই নিভান কেমন মুগ্ধময় স্বরে মুখ এগিয়ে নিয়ে বললো–মেহেদীর রঙে রাঙিত করে,আমার নামের স্টাম্প লাগিয়ে দিলাম।আজ না-হয় শুধু মেহেদীর রঙে আমার নামে তোমার হাত রাঙালাম ফুলকৌড়ি।কাল পুরো আমিময় রঙে নাহয় রাঙিয়ে দেবো তোমার সর্বত্র।

কান ঝাঝা করে উঠলো কৌড়ির।লজ্জায় চোখ নুইয়ে পড়ার বদলে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো কৌড়ি।এরকম লজ্জাজনক কথাতো এই মানুষটা কখনো বলে না। তবে?হঠাৎ ফোনের আলো জ্বলে উঠতেই হুশ রইলো কৌড়ির।নাহিদ ফোন কেটে দিয়েছে।তবে কি?

‘কবুলটা এখন পড়ে রাখলে কেমন হয় কৌড়ি?বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা নাহয় কাল হলো।

লজ্জা ভুলে কৌড়ি বিস্ময় নিয়ে ফের তাকালো নিভানের নির্জীব নির্বকার শ্যামল মুখে।কোথাও বিন্দু পরিমাণ উতলা হওয়ার চিহ্ন নেই।তবে এমন কথা কেনো?বিস্ময় নিয়ে শুধালো সে।

‘আপনি কি আমাকে নিয়ে কোনোরকম ইনসিকিউরড্ ফিল করছেন?

‘না।আমি জানি আমাকে না বিয়ে করলেও তুমি নাহিদ কে অন্তত কখনোই বিয়ে করবেনা।করতে চাইবেওনা।

‘তবে একথা কেনো?বিয়ে এখন না-হোক, কাল হোক।অসুবিধা কি?

‘এমনিতেই বলছিলাম।

কথাটা বলেই অমায়িক হাসলো নিভান।সে হাসি কৌড়ির কাছে বড্ড বোকা বোকা মনে হলো।অথচ এই মানুষটার কাছে বোকা হাসি হোক বা আচারন।কল্পনাও করে-না কৌড়ি।কখনোই না।তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন অতি চতুর মানুষটার কাছ থেকে বোকা আচারন কল্পনাও মূখর্তা।নিজের অজ্ঞতা।সেই অজ্ঞতা নিজের মস্তিষ্কে উপলব্ধি করতেই নির্মিশেষে নিভানের মুখের দিকে কেমন অদ্ভুত নজর তাকিয়ে রইলো কৌড়ি।মানুষটা হঠাৎ এমন আচরণের কারণ কি?কারণটা কি সে!সত্যি কি তাকে নিয়ে ইনসিকিউরড ফিল করছে মানুষটা?যা মানুষটা মুখফুটে বলতে চাইছেনা বা চায়না!

‘এক্সকিউজ মি ম্যাম। আমার কাজ শেষ।আপনি এসে ওকে মেহেদী লাগিয়ে দিন।

কৌড়ির ভাবনা কাটলো।স্টেজের সামনে চেয়ার আসনে বসে ছিলেন মেয়েটা।আজ্ঞা পেতেই স্টেজের দিকে এগোলেন।নিভান উঠে দাঁড়ালো।মেয়েটা আসার আগেই নিভান কেমন অদ্ভুত গলায় বললো।

‘আমার প্রিয় নারীটাকে অন্য কেউ পাগলের মতো চাইছে!সহ্য হয়?তাকে অন্যরা মুগ্ধ নজরে দেখছে!ধৈর্য্য ধরা যায়?আর তাকে হারানোর ভয়,যদি আমার অনিশ্চয়তা ভাবনা হয়।তবে ঠিকই ভেবেছো।তোমার পরিচিত মানুষগুলো আমাকে অনিশ্চয়তায় ডুবাচ্ছে কৌড়ি।তবে তুমি কিছুতেই আমাকে ডুবতে দিও-না।হাতটা শক্ত করে ধরে রেখো।খুব শক্ত করে ধরে রেখো।

কথা শেষ করেই পা চালিয়ে স্টেজ থেকে নামতে ব্যস্ত হলো নিভান।ইনসিকিউরড্!হ্যা সে অনিশ্চয়তায় ভুগছে।সে জানে কৌড়ি তেমন মেয়ে নয়।তবে তাকে চাওয়া পাওয়া লোকের অভাব নেই।নাহিদ তো মরিয়া হয়ে আছে।সাথে কানন নয় কিয়ানকে সে মুগ্ধ নজরে পলকহীন কৌড়িকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছে।সেই মুগ্ধ নজর কি চাইছে বা চাইতে পারে!নিভানের জানতে বাকি নেই।বাকি থাকার কথাও নয়।ভুক্তভোগী তো সেও ছিলো।আচ্ছা পৃথিবীতে কি একটাই কৌড়ি!নয় তো!তবে কেনো তাকে নিয়ে এতো মুগ্ধতা!এতো পাগলামো!বিহান চৌধুরীতো এখনো মুখিয়ে আছে।কাৌড়িকে পাওয়ার প্রয়াস তো সেও কম করেনি।মেয়েটার বাবা মা নেই।পরের বাড়ির আশ্রিতা বলে নিজ বাবা বিরোধিতা করেছেন।তবুও কি ছেলেটা শান্ত ছিলো?শুনেছে বাবার কথা?না!কৌড়িকে পাওয়ার আকুলতায় বাবার বিরুদ্ধাচারণ করেও মেয়েটার কলেজের সম্মুখে গিয়েও ধর্না দিয়েছে।বিহান চৌধুরী কৃতিত্ব সব খবর আছে নিভানের কাছে।

সেদিন ঝড়বরষার দিনের পর মেয়েটা আর একাকি কলেজে যায়নি কোনোদিন।হয়তো বাড়ির গাড়িতে গিয়েছে আর নাহলে কারও সাথে কারও সাথে যাতায়াত করতো বলে বিহান কথা বলার সুযোগ পেতোনা।পায়নি।তবুও চেষ্টা কি কম চালিয়ে গিয়েছে?ভাগ্য সহায় হয়নি আর নিভানের সুক্ষ চালে ছেলেটা বারবার কৌড়ির সাথে কথা বলা থেকে ব্যর্থ হয়েছে।এরমধ্যে কৌড়ির পরিক্ষার সময় এলো।আর কথা বলার সুযোগও হয়ে উঠলোনা।তবুও কি ছেলেটা পিছু ছেড়েছিলো কৌড়ির?না।বরং মরিয়া হয়ে উঠেছিলো কৌড়ির সাথে কথা বলার জন্য।আর সেই মরিয়া আচারণ তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলো কৌড়ির পরিক্ষা কেন্দ্র অব্দি।কিছুই নিভানের বুদ্ধিদীপ্ত চোখ এড়ায়নি। আর এড়ানোর মতো পাহারাদার রেখেছে কি সে!বিধায় নিভানও কৌড়ির পিছু ছাড়েনি।ছেলেটাকে যদি কৌড়িকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়।ছেলেটা বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও ছুটবে।এবং কোনো বাকবিতন্ডায় ছাড়া সদা কৌড়িকে বিয়ে করতে প্রস্তুত সে।এমন ব্যকুলতা সে বিহানের আচারনে নজরে টের পেয়েছে নিভান।নাহিদ, বিহান,কিয়ান আনাফ।সব কেমন ওতপেতে বসে আছে।আর সবকিছু জেনেশুনেও এদের মধ্যেও কেমনে,কিকরে নিশ্চয়তায় থাকবে সে!

ফর্সা হাতদুটোতে মেহেদীর রঙে সাজাতে ব্যস্ত আর্টিস্ট মেয়েটা।দীবা গাঢ় খেয়ালী নজরে দেখছে সেই সুক্ষতর, নিখুঁত হাতের কাজ।মূহুর্তেই মধ্যেই কতো সুন্দর করে তারা ফুটে তুলে মেহেদীর কারুকাজ।হাত ঘুরালেই যেনো নজর ধাঁধানো তাদের কারুকার্যতা।

ম্যাডাম, হাতে কারও নাম লিখতে চান?লিখবো কোনো নাম?

হঠাৎ স্টেজের দিকে চোখ দিলো দীবা।সেখানে এখন নিভান নেই।তড়িৎ নজর ফিরিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগে ভারী দুষ্ট গলায় কেউ একজন বলে উঠলো।

‘লিখুন।সিয়াম মাহমুদ।

মেয়েটা একপলক সিয়ামের দিকে তাকিয়ে নজর সরিয়ে নিলো।সিয়ামের কন্ঠস্বর পেতেই দীবা মুখ উচু করে কড়া চোখে চাইলো। চোখের চাহুনী বলে দিলো, দাঁড়াও লেখাচ্ছি তোমার নাম!ততক্ষণে সিয়াম এসে দাড়িয়েছে তাদের পাশে। দীবা মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে মেয়েটাকে কিছু বলতে যাবে তারআগেই হাতের দিকে নজর পড়লো।স্পষ্ট ইংরেজি গোটাগোটা অক্ষরে সিয়ামের নামটা হাতের মধ্যে দেখতেই রাগে জ্বলে উঠলো ডে।দাঁতে দাত পিষে মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বললো।—ও বললো আর ওর নামটা লিখে ফেললেন!আশ্চর্য!আমার হাতে লিখছেন,অথচ আমার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজনবোধ মনে করলেন না।

মেয়েটা হতবাক।লজ্জিতও।ছোটো মুখ করে অসহায় নজরে দীবার পানে চেয়ে রইলো।দীবার খারাপ লাগল।দাঁতে দাত পিষে একবার সিয়ামের দিকে নজর দিলো।সিয়াম,যেনো ব্যাপারটা কিছুই না এমন নিরুদ্বেগ মুখ করে তাকিয়ে রইলো।মুখে তার দুষ্ট মিষ্টি হাসি।সেটা দেখে আরও জ্বলে উঠলো দীবা।বাম হাত দিয়ে ডান হাতের মধ্যে লেখাগুলো লেপ্টে মুছে দেওয়ার আগেই সিয়াম কেমন উচ্ছল গলায় বলে উঠলো– মুছে ফেলতে চাইছো!ফেলো।তবে মুছে ফেললে কি চিহ্ন যাবে?লেখা মুছে যাবে তবে চিহ্ন যাবেনা।বরং বারবার ওই লেপ্টানো জায়গায় নজর যাবে,আর মনে হবে ওখানে কার নাম লেখা আছো।তা না করে দারুন একটা এ্যাডভাইস দেই?

দীবার প্রতিত্তোরের অপেক্ষা করলোনা সিয়াম।অপেক্ষা করলে হয়তো ভয়ংকর কোনো গালি বা মন্দ কথা শুনতে হবে।তাই আগের ন্যায় কন্ঠের উচ্ছলতা বজায় রেখে সহসা বলে গেলো –বরং তোমার হাতের নিখুঁত ডিজাইনের ভিড়ে নামটাকে হারিয়ে যেতে দাও।মুছে ফেললে হাতের ডিজাইন, নষ্টের সাথে সাথে এই খারাপ বরটাকেও মনে পড়বে ঘনোঘনো।যাকে তুমি মনেই করতে চাওনা।দারুণ এ্যাডভাইস না?

‘দূর হয়ে যাও আমার চোখের সামনে থেকে।তুমি বরাবরই এরকম।সাজানো গোছানো সবকিছু খারাপ, এলোমেলো করে দিতে অভ্যস্ত!

সিয়াম চলো গেলোনা।বরং রাগ ক্ষোভ নিয়ে দীবা উঠেই চলে গেলো।সেদিকে নির্বিকার তাকিয়ে রইলো সিয়াম।দীবার কথায় বুকের কোথাও সুক্ষ একটা ব্যাথার টের পেলো।হয়তো সেটা তার প্রাপ্য ব্যথা।তবে মনেমনে সে একটা পরিকল্পনা সাজিয়েছে।নিভানের বিয়েটা মিটে গেলে পরিকল্পনা পাকাপোক্ত করবে।ততক্ষণে বউয়ের পিছুনে একটু লেগে থাকুক!আর্টিস্ট মেয়েটা বুঝলো,দু’জন স্বামী স্ত্রী।তবে বনিবনা নেই দু’জনের মধ্যে।এজন্য ভাবভালোবাসাও নেই।

নাফিমও মেহেদী লাগাবে বলে বায়না ধরলো।ওকে নিয়ে মশকারা শুরু করলো মৌনতা।বললো–এই তুই শরীফ তো!নাহলে মেয়েদের মতো এরকম মেহেদী লাগাবি বলে বায়না ধরেছিস কেনো?ছেলেদের রঙ মাখতে নেই জানিস না।

পাশে বসা মান্যতা মূহুর্তেই ধমকে উঠলো। —এসব কি ধরনের কথা মৌন।ও বাচ্চা। ও এসব বোঝে?আর এ কেমন উদাহরণের শ্রী!দিনদিন বেশী পাকনামো হচ্ছে। কোথায় কাকে কি বলতে হয়,বুঝজ্ঞান হচ্ছে না দেখছি!

‘থাক।ও-ও তো বাচ্চা।বকো-না।কথার ছলে বলে ফেলেছে।

তন্ময়ী কথাটা বলে নাফিমকে কাছে ডাকলো।–নাফিম আমার কাছে এসো।আমি মেহেদী লাগিয়ে দিচ্ছি।

নাফিম সহসা প্রশ্ন করলো—ছোটো বউমনি ছেলেদের মেহেদী লাগাতে নেই ?

‘না,ছেলেদের রঙচঙ মাখা ঠিক নয় ।তবে তুমি ছোটোতো, তুমি লাগালে কিছু হবেনা।এসো লাগিয়ে দেই।

‘না। থাক তবে।আমি মাখতে চাইনা।দেখি গিয়ে ফুলকৌড়ির হাতে কি আঁকছে।কেমন দেখাচ্ছে তার হাতদুটো।

ছেলেটা সবার হাতের নিখুত ডিজাইনে মেহেদী দেওয়া দেখে,নিজেও মাখতে উৎসুক হয়েছে।তবে মৌনতাকে বকা খেতে দেখে মন কেমন মিইয়ে গেলো।সাথে ছেলেদের রঙ মাখা ঠিক নয়,ব্যাপারটা কেমন তার ছোট্ট পুরুষ মনে সহজেই মেনে নিতে বাধ্য হলো।উঠে চলে গেলো নাফিম।সাথে মান্যতাও।তখনো মুখ ভার করে বসে আছে মৌনতা।বিথী আগে থেকেই কৌড়ির ওখানে বসা।সবাই চলে যেতেই তন্ময়ী,মৌনতাকে একপেশে জড়িয়ে ধরেই বললো–মন খারাপ করেনা,ছোটো ননদিনী।ওরকম বড়রা একটু আধটু বকেই থাকে।তাতে মন খারাপ করলে চলে?চলে না!চলো,আমাদের নতুন বউয়ের হাতে কি আঁকানো হলো দেখে আসি।

মৌনতা উচ্ছল হেসে উঠে দাঁড়ালো।তন্ময়ী উঠে দাঁড়াতেই সেখানে এসে হাজির হলো ইভান।ইভানকে দেখেই দুজনেই ভ্রু কুঁচকে ফেললো।তাদের রিয়াকশন দেখে ইভান বললোো–আমি চোর না ডাকাত?আমাকে দেখে ওরকম চোখমুখ ছোটো হয়ে গেলো কেনো তোমাদের?

দু’জনেই পরিহাসের স্বরে একসাথে বল উঠলো–তুমি খুব ভালো মানুষ তাই!

মূহুর্তেই ইভান হেলে গিয়ে তন্ময়ীর কানের পাশে মুখ নিয়ে বললো—নয় বলছো?

শিরশির করে উঠলো তন্ময়ীর শরীর।চোখমুখের কুঁচকানো আকার যেনো মূহুর্তেই পাল্টে গেলো।সেটা খেয়াল করে মৃদু হেসে ইভান মৌনতাকে উদ্দেশ্য করে বললো –দেখি তো আছাড়েবিবি, কি ঘোড়ার ডিম এঁকেছিস হাতে!

‘দাদাভাই!!বাড়িতে কতো মানুষ,আর তুমি সেখানেও আমাকে উল্টো পাল্টা নামে ডাকছো!তুমি আমাকে উল্টো পাল্টা নামে ডাকবেনা,বলে দিলাম।আমার কিন্তু খুব রাগ হয়।

‘আমাদের আছাড়েবিবির দেখি প্রেস্টিজ হয়েছে!ভাবার বিষয়!ভাবলাম,মেয়ে বড় হয়ে গেছে।বিয়ে দিতে হবে।চিন্তা ভাবনা করিসনা,তোর বড়আপুর আগে তোকে বিয়ে দেওয়া হবে।

‘দাদাভাই!

দাঁতে দাঁত চেপে অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে ডাক দিলো মৌনতা।রাগে দুঃখে কি বলবে,খুজে না পেয়ে চলে গেলো সে।মৌনতা চলে যেতেই তন্ময়ী অধৈর্য্য গলায় বললো–তুমি ফালতু কথা জানো!উফফ!প্রতিটা মানুষ তোমার কার্যকলাপে অতিষ্ঠ!

‘তুমিও?

আবারও সেই একই ভঙ্গিতে প্রশ্ন। এবার যেনো আরও কাছাকাছি ইভানের মুখ।হৃদযন্ত্র ছটফটিয়ে উঠলো তন্ময়ীর।ইভানের বলার ভঙ্গিমায় গায়ের লোমগুলোও কেমন লজ্জায় নুইয়ে না পড়ে,তটস্থ হলো।কি একটা অবস্থা! নিজেকে ঠিক দেখাতে,মিছেমিছি রাগ দেখিয়ে তন্ময় বললো।

‘তুমি সাংঘাতিক অসভ্য!

‘এটা আর নতুন কি?তবে তুমি যদি চাও,আমি সেই অসভ্যতামীগুলো তোমার সাথে না করে অন্য কার-ও সাথে করতে পারি।কি বলো?

ভ্রু নাচিয়ে শেষে কি বলো বলতেই, কড়া চোখে তাকালো তন্ময়ী।মানে,চোখ দিয়ে শাসানো যাকে বলে।ইভান বেশ উপভোগ করলো। ফের তন্ময়ীকে আরও একটু ক্ষেপিয়ে তুলতে বললো।–যাক বাবাহ।তুমি তোমার সাথেও অসভ্যতামী করতে দেবে-না।আবার অন্য কারও সাথেও না।তাহলে আমি পুরুষ যাবো কোথায়?

‘যেখানে খুশি যাও।তবে আগামী একসপ্তাহ যাবৎ যেনো তোমাকে আমার ধারে-পাশে না দেখি।

‘দেখলে কি করবে?আদর নাকি অন্যকিছু চলবে?সে যাই হোক কিছু একটা চললেই এই ইভানেরও চলবে।তবে কাল রাতের দৃশ্যময়গুলো স্মরণ করো!আমি একসপ্তাহ অনায়সে এমনিতেই পার করে দিতে পারব।

তপ্ত রোদ গায়ে লাগার মতো ইভানের কথাগুলো শুনে কানমাথা ঝাঝা করে উঠলো তন্ময়ীর।তীব্র লজ্জায় চোখমুখের দৃশ্য পাল্টে গেলো।মৃদু লাল আভায় ছেয়ে গেলো ফুলোফুলো দুটো গাল।লজ্জা নিবারণে শক্তহাতে ইভানকে তারথেকে সরিয়ে দিয়ে মিছেমিছি শাসানো গলায় বললো–তুমি আসলেই দিনকে দিন মাত্রাধিক অসভ্য হয়ে যাচ্ছো। আগামী একসপ্তাহ নয় একমাসও যেনো তোমাকে আমার আশেপাশে না দেখি।

ইভানকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেলো তন্ময়ী।মানসপটে সত্যিই ভেসে উঠলো কালকে রাতের দৃশ্যময়।সামনে কেউ না থাকা সত্ত্বেও লজ্জায় যেনো বুূদ হলো ভিতরটা। হাসফাস করে উঠলো নিজেই।ইভান ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে তন্ময়ীর যাওয়া দেখলো।কাল হলুদের বেশের থেকেও আজ মেহেদীর সাজে সবুজ শাড়ী গহনাতে মেয়েটাকে আরও সুন্দর আরও মায়াবী লাগছে।সবুজ শাড়ীতে সৌন্দর্য যেনো তার হেসেখেলে লুটোপুটি খেয়ে বেড়াচ্ছে। কাল নিজেকে শতচেষ্টা করেও তন্ময়ীর থেকে দূরে রাখতে পারিনি।আজ রাখবে কিকরে!সেখানে বিবি আবার তাকে আদেশ জারী করে গিয়েছে,একসপ্তাহ নয় একমাসেও যেনো তার আশেপাশে ঘেষতে না দেখা যায় তাকে।ইভান দুষ্ট হাসলো।বিবি আদেশ জারী করলেই হলো নাকি!ইভানকে তো সে এখনো পুরোপুরি চিনে উঠেনি!এবার অবশ্যই চিনে যাবে।ইভানের অসভ্যতামীর পারদ ঠিক কতো হাই লেবেলের।বুঝেও যাবে!

চলবে..

ফুলকৌড়ি পর্ব-৪৪+৪৫

0

#ফুলকৌড়ি
পর্ব(৪৪)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

বাড়ির বাহিরের নজরকাঁড়া অতি সাজসজ্জায় যতোটা না অবাক,বিস্মিত হলো,বাড়ির ভিতরে গিয়ে ততোটাই হতবাক হলো কৌড়ি।বাড়িতে যেনো পরিচিত অপরিচিত আত্মীয় স্বজনের মেলা বইছে।যাদেরকে ইভান ভাইয়ার বিয়েতে দেখেছিলো সে।সবাই যেনো উপস্থিত।সবাই!আর-ও কিছু অপরিচিত মুখ আছে।যাদেরকে কৌড়ি চেনেনা।হতবাক নজর ড্রয়িংরুমে,চা নাস্তায় ডুবে থাকা মানুষগুলোর পানে স্থির রেখে মেইন দরজায় দাঁড়িয়ে পড়লো।বাহিরের লন এরিয়ায় ফুলে সজ্জিত স্টেজ, ফুলের বাগানসহ বিভিন্ন গাছগুলোতে মরিচবাতির ঝলকানি,চারপাশ পরিপাটি সাজসাজ রব।এতো আত্মীয় স্বজনের ভীড়!কারণটা বুঝেই হঠাৎই কৌড়ির অস্বস্তি বাড়লো।লজ্জায় ভিতরে ভিতরে নুইয়ে পড়লো।এতোকিছু এতো অল্প সময়ের মধ্যে ম্যানেজ করলো কিকরে মানুষটা!যদিও মানুষটা কখন কি করে বুঝে উঠা মুশকিল!তবে তিনি তাকে বিয়ে করতে চাইলেন আর সবাই নির্দ্বিধায় তা মেনে নিলো!জাহিদ আঙ্কেল মেনে নিলেন?তারচেয়ে বড়কথা,কাল প্রস্তাব রাখলো মানুষটা,সেই রাতটা পার করে আজ দিনটা গড়িয়ে কেবল সন্ধ্যা!তারমধ্যে আত্মীয় স্বজনের ভীড়।বাহিরের সাজসজ্জা, সবকিছু এতো সহজে হয়ে গেলো!কিকরে?মানুষের তো মেয়ে দেখতে, ফ্যামিলি নির্বাচন করে সিদ্ধান্ত জানাতে সময় লেগে যায় মাসের উপরে। সেখানে একটা রাত আর গোটা দিনের মধ্যে সর্বসম্মতি নিয়ে আয়োজন কমপ্লিট!

মানুষটার মুখে বলা, দু’দিন বাদে আমাদের বিয়ে।কথাটা সিরিয়াসলি নেয়নি কৌড়ি।সত্যিই নেয়নি।তখন মনে হয়েছিলো,মানুষটার কথা না মানায় তারউপর রাগান্বিত হয়ে কথাটা বলেছে।আজ যখন ডক্টরের চেম্বারে দৃঢ়তার সহিত ডক্টরকে জানালো,দু’দিন পরে আপনিও কিন্তু নিমন্ত্রণ পাচ্ছেন।তখনও কথাটা সিরিয়াসি মনে হয়নি কৌড়ির।ভেবেছে,কথার কথা বলেছে।তবে বিয়ে যে তাদের হবে,মানুষটা তাকে জীবনেও ছাড়বেনা,এটা কৌড়ি জানে।সে তারমধ্যে যতোই ত্রুটি থাকুক, তাকে ছাড়বেনা।এটা সে ভালোভাবে বুঝতে পেরেছে।তাই বলে,নিজের কথার সত্যায়িততা বাজায় রাখতে এতো দ্রুত পদক্ষেপ।গা ঝাড়া দিয়ে,সমস্ত শরীরে ঝিমঝিমানি দিয়ে কম্পন বয়ে গেলো কৌড়ির।ক্লান্ত শরীরে তা ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারলো।হৃদযন্ত্রটা বেড়ে গিয়ে একটু একটু করে অস্বাভাবিক হতে লাগলো।আর সেই অস্বাভাবিকতা বাড়িয়ে দিলো ড্রয়িংরুমে বসা কিছু পরিচিত মুখ।

কৌড়িকে দেখতেই যেনো মৌমাছির মতো তারা হামলে এসে পড়লো।চারপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে, কতো উল্টো পাল্টা বলে ফাজলামো করতে লাগল।তারমধ্যে মান্যতা উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললো-সারপ্রাইজ!এন্ড কংগ্রাচুলেশনস আমােদর বাড়ির বড়ো বউ।শাদী মোবারক হে।

হতবাক কৌড়ি তখন মান্যতা মৌনতা,ঈশিতা তন্ময়ীর বেড়াজালে আবদ্ধ।আরও কিছু মুখচেনা মেয়ে,যারা নিভান নামক মানুষটার মামাতো বোন,আত্মীয়।সকলের মধ্যমনি হয়ে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে।
বিস্ময় কাটাতে পাশে তাকালো।কৈ মানুষটা তো নেই!
তারসাথেই ছিলো তো!তবে গেলো কোথায়?মুখ উচুকরে সামনে তাকাতেই সিঁড়িপথ ধরে উপরে উঠতে থাকা নিভানকে নজরে পড়লো।উচুলম্বা মানুষটা মেরুদণ্ড কাঁটার মতো সোজা রেখে,সিড়ির ধাপে ধাপে পা রেখে উপরে উঠে চলেছে।হাতে তার,ডাক্তারের কাছ থেকে প্রাপ্ত কৌড়িট একগাদা রিপোর্ট! সাথে কৌড়ির ফোনটাও।কৌড়ি হতবিহ্বল চোখে,তার উপরে উঠা দেখতে থাকলো।হঠাৎই একে একে সিঁড়ি ধাপ পেরিয়ে উপরে উঠা মানুষটা থমকে দাঁড়ালো।যেনো সে, কৌড়ি তাকিয়েছে এটা কোনো যন্ত্র দ্বারা অনুভব করতে পারলো।পিছে ফিরে কৌড়ির হতবাক, বিস্মিত নজরের দিকে তাকিয়ে,মানুষটা চমৎকার হাসলো।সেই হাসিতে যেনো স্পষ্ট জানান দিলো–আমাকে তুমি ভুল চিনেছো।আমি এমনি এমনি কখনোই কিছু বলিনা।

চমৎকার সেই হাসিতে কৌড়ি আরও বিস্মিত হলো।আর্কষিতও হলো বটে।বিস্মিত নিষ্পলক নজর এবার মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো ওই শ্যামবর্ণ হাস্যজ্বল মুখে।কি মায়াভরা আদল!পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চেহারার ব্যক্তি বলে মনেহলো।কৌড়ির মনের খবর বুঝলো কি বুঝলোনা সিড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা,হাসি যেনো তার উপচে পড়তে লাগলো।হুঁশ ফিরলো কৌড়ির।নজর সরিয়ে নিয়ে সম্মুখে তাকালো।মূহুর্তেই মৌনতার খুশি খুশি হাস্যজ্বল মুখটা নজরে পড়লো তার।ততক্ষণাত উৎফুল্ল কন্ঠে মৌনতা বললো।–জানো,যেদিন তুমি এবাড়িতে এলে।আমি মনে করেছিলাম দাদাভাই বউ নিয়ে এসেছে।পরে যখন শুনলাম,তুমি দাদাভাইয়ের বউ নও।খুব মন খারাপ হয়েছিলো।এবার সত্যিই তুমি দাদভাইয়ের বউ হচ্ছো।আমি এত্তো এত্তো খুশি।

হাত প্রসারিত করে বাচ্চামো স্বরে কথাগুলো বলতেই মিষ্টি করে হেসে দিলো কৌড়ি।সাথে লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিলো।একেএকে সবাই উচ্ছ্বসিত হয়ে যার যার,তাকে নিয়ে ভালোলাগা ভালোবাসা অনুভূতিগুলো ব্যক্ত করতে লাগলো।ঈশিতাও বাদ গেলো না।কেমন মায়াভরা কন্ঠে বললো–ঈশশ, আমাদের নিভানের বাচ্চা বউ।

নিভান মানুষটা,তার গোটা বংশের আপন আত্মীয় স্বজনের কাছে কতোটা প্রিয় একজন মানুষ।কৌড়ি এই চারমাসে দেখেছে,বুঝেছে,জেনেছে।প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যমনি যেনো সে।নিভান বলতে তাদের কাছে যেনো চাঁদের টুকরো।তার কাছের মানুষগুলোর কাছে,তিনি যেনো আলাদা এক মায়া,টান,ভালোবাসা।আর তার বউ হবে কৌড়ি।সেই মানুষটার ভাগের ভালোবাসা পাবেনা,এটা হয়?সবার মধ্যমনি হয়ে ভাবনারত কৌড়ির হাতটা সন্তপর্ণে ধরলেন নিভানের নানুমা।ভীড় সরিয়ে দরজা থেকে ধীরস্থির পদক্ষেপে তাকে নিয়ে বসালেন সোফায়।কৌড়ির মায়াভরা মুখটায় আলতো স্পর্শে ছুঁয়ে দিয়ে নিজের গলায় হাত রাখলেন।কুঁচকে আসা ফর্সা গলায় জ্বলজ্বল করতে থাকা,অনেক দিনের পুরানো বিছা চেনটা খুলে আনলেন।কৌড়ির মাথার ওড়নাটা সরিয়ে পরিয়ে দিলেন গলায়।ফের কৌড়ির মুখটা দুহাতে আজলে নিয়ে গভীরভাবে চুমু খেলেন তার কপালে।কৌড়ির হতবিহ্বল নজরের পলক তখনো পড়েনি।অসাড় হয়ে রয়েছে।বৃদ্ধা প্রগাঢ় চুমু একে মুখটা সরাতেই কৌড়ির চোখের পলক পড়লো।সেই চোখে চোখ রেখে কোমল গলায় তিনি বললেন–

‘আমার নিভানকে ভালো রাখিস নানু।খুব খুব ভালো রাখিস।আর খুব ভালোবাসিস।ওর না পাওয়া ব্যথা গুলো তোর ভালোবাসায় ভুলিয়ে দিস।জানিস,ওর এই এতো বছর বয়সে নিজের আপনজন, কারও কাছে জোরকরে কখনো কিছু আবদার করেনি,চায়নি।নিজের বলে কোনো আকাঙ্ক্ষা জাহির করেনি।বরং আপনজনদের খাতিরে নিজের শখ, ইচ্ছে, ভালোলাগুলো বিসর্জন দিয়েছে।সেই ছেলেটা,আজ তোকে পাওয়ার জাহির করছে।আবদার রেখেছে, তোকে পাওয়ার।

মন কেঁদে উঠলো।চোখ পানি জমলো কৌড়ির।মানুষটা কিকরে তাকে এতো ভালোবাসতে পারে!কিকরে?কি আছে তারমধ্য যে,মানুষটা তারজন্য এতোটা পাগল হলেন!ভদ্রমহিলা নম্র চোখ তাকিয়ে রইলেন কৌড়ির দিকে। নিভান বিয়ে করবে।হঠাৎ এই সিদ্ধান্তে যেমন উনার পরিবারের সবাই অবাক হয়েছিলেন।মেয়েটা কে জানার পর,তিনি বাদে উনার ছেলে-ছেলেবউরা যেনো একটু বেশিই আশ্চর্য হয়েছিলেন।মেয়েটার বাহ্যিক সৌন্দর্যে,আর শান্তশিষ্ট নম্র আচারনে,শালিন চলাফেরায়,বউমারা তেমন আপত্তি না জানালেও ছেলেরা আপত্তি জানালেন।নিভান বিয়ে করবে উচ্চবংশ,নামাদামী বিত্তশালী পরিবারের কোনো এক রূপবতীকে।তা না একটা এতিম মেয়ে!মেয়েটাকে উনারা দেখেছেন,খুবই ভালো মেয়ে।সবদিক থেকে ঠিকঠাক থাকলেও,গার্ডিয়ান নেই এতিম মেয়ে বিয়ে করবে নিভান!গাইগুই করে নিভানের সিদ্ধান্তে অমত পোষন করলেন।ভদ্রমহিলা ছেলেদেরকে বোঝালেন।খুব সুন্দর করে বোঝালেন।একপর্যায়ে গিয়ে মানলেন,তবে নিভানের প্রতি মনেহয় একটু অসন্তুষ্টই রয়েই গেলেন।খুব ভালোবাসে যে ছেলেটাকে,হয়তো আশাটাও তেমন করেছিলো।সেজন্য এই অসন্তুষ্টতা।

‘এই, ও অসুস্থ!তাতে আবার বাহিরে থেকে এসেছে।তোরা এরকম ওকে চেপেচুপে বসিয়ে রেখেছিস কেনো?বিশ্রাম নিতে দে।রাতে আবার হলুদের অনুষ্ঠান। এই অসুস্থ শরীরে আবার এক ধকল যাবে।ছেলেটাকে এতো করে বললাম, বুঝালাম শুনলোইনা।বিয়ে মানে বিয়ে।

নীহারিকা বেগম কথাটা বলতে বলতে এগিয়ে এসে সবার মধ্যে থেকে কৌড়িকে তুলে দাড় করালেন।মিষ্টি হেসে বললেন—আপতত বিশ্রাম নে যা।রাতে হলুদের অনুষ্ঠান।তোকে না জানিয়ে এতো তাড়াহুড়ো করে সবটা করছে বকে,আমার ছেলেটার উপর অসন্তুষ্ট হোস না।নিজের ইচ্ছেগুলো হারিয়ে যেতে দেখতে দেখতে হয়তো তোর বেলায় আর ঝুঁকি নিতে চাইছেনা।

নীহারিকা বেগম কৌড়ির হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিলেন। ফের কোমল কন্ঠে শুধালেন—নিভানের সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট তুই?

এতো মানুষের ভালোবাসা যার দরুন পাচ্ছে তার সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট হবে কৌড়ি!না।তবে এতো তাড়াহুড়ো করে বিয়ে। এটা কেমন যেনো লাগছে তার।নীহারিকা বেগমের কথায় মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো সে।সেটা দেখে নীহারিকা বেগম মিষ্টি করে হাসলেন।কৌড়ির গালে আলতো স্পর্শে হাত রেখে বললেন–লক্ষী মেয়ে।

পাশ থেকে মান্যতা মৃদু চেচিয়ে বললো-লক্ষী মেয়ে নয়।বলো লক্ষী বউমা।

কৌড়ি লজ্জা পেলো।নীহারিকা বেগম সংশোধনী গলায় বললেন –হ্যাঁ লক্ষী বউমা আমার।

কেমন করে যেনো উঠলো কৌড়ির মন।অদ্ভুত ডাক!প্রসঙ্গ এড়াতে তড়িৎ বলল–দাদীআপা কোথায় বড়মা?

‘বড়মা নয়,নিভানের মতো মা বলে ডাকা শুরু কর।একদিনে যখন ডাকটা হওয়ার নয়,আজ থেকেই শুরু কর।দেখেছিস তন্ময়ীর অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।এখন আর আন্টি বলে ডাকেনা।

সোফায় বসা তন্ময়ী লাজুক হাসলো।কৌড়ি আরও লজ্জা পেয়ে কেমন করে নীহারিকা বেগমের দিকে অসহায় নজরে তাকালো।সেটা দেখে নীহারিকা বেগম হাসলেন।বুঝলেন কৌড়ির অস্বস্তি, লজ্জা।তাই এসব পর্ব রেখে বললেন–চাচিমাকে একটু আগে চা দিয়ে আসলাম,তোর দাদুমার রুমে।হয়তো এখনো ওখানেই।তিনি ঠিক আছেন। তুই রুমে যা।বাহিরের জামা কাপড় ছেড়ে আপতত বিশ্রাম নে।

কৌড়ি সম্মতি জানিয়ে আশেপাশে আরেকবার নজর দিলো।বাড়িতে মানুষ ভর্তি। তবে সময়টা মাগরিবের নামাজের পর,এজন্য হয়তো সবাই এখানো যে যার রুমে অবস্থান করছেন।ড্রয়িংরুমের মানুষগুলো সবাই তার পরিচিত।অথচ সবাইকে নজর পড়লেও একটা মানুষকে নজরে পড়ছেনা।দীবাআপু।সকাল থেকে বাড়ি থাকা অব্দি তাকে দেখেনি।এখনও এতো মানুষের ভীড়েও তাকে দেখা যাচ্ছেনা।দীর্ঘশ্বাস ফেললো কৌড়ি। উপরতলার কাঙ্ক্ষিত রুমটার দিকে একবার তাকিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।সাথে মৌনতা, মান্যতা পিছু নিতে ছাড়লো-না।

নিজের রুমের বেডের হেডে মাথা এলিয়ে পায়ের উপর পা জড়িয়ে চোখ বুঁজে বসে কৌড়ি।সব ঠিকঠাক থাকলেও কোথায় যেনো একটা সুর কেটে বসে আছে।কোথায়?দাদিআপার আচারণে?হুমম!বাহিরে মানুষের হইহট্টগোল শোনা যাচ্ছে।তাঁকে সাজাবে বলে মান্যতা মৌনতা একটু পরপর আসছে আর তাকে একের পর সাজের বহর শোনাচ্ছে।পার্লারের লোকদের ভাড়া করা হয়েছে।তারা আসলো বলে।এতো তাড়াহুড়ো করে বিয়েটা হচ্ছে।শপিংটাও ঠিকঠাক নাকি করতে পারিনি।অথচ বড়ো ভাইয়ের বিয়ে!কতো আহ্লাদিত গলায় অভিযোগ জানালো দুজনে।তবে আজসকালে কৌড়িরা বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর তারাও নাকি শপিংয়ে বের হয়েছিলো।হলুদের শপিংটা আপতত গুছিয়ে সেরে এসেছে।কাল মেহেন্দি,বিয়ের জন্য অনলাইনেও চলছে তাদের শপিং।কৌড়িকে দেখালো।তবে তার হলুদের বিশেষ শপিং নাকি করেছে ওই মানুষ।কখন?কৌড়ি জানা নেই।কাল থেকে তো এই অব্দি মানুষটা তারসাথে তবে শপিং করলো কখন?ঈশিতা আপু কেনাকাটার সময় কৌড়ির হলুদের শপিংয়ের জন্য নাকি নিভানের কাছে ফোন দিয়েছিলো, তাকে কিছুক্ষণ শপিংয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।তখন নাকি মানুষটা জানিয়েছে,কৌড়ির জন্য কেনাকাটা লাগবেনা তারা নিজদের ইচ্ছে মতো শপিং করে বাড়িতে ফিরুক।কৌড়ির জন্য নাকি সে ব্যবস্থা করে রেখেছে।তাই আর আলাদাভাবে কৌড়ির জন্য তারা কিছু কিনিনি।তবে মান্যতা ধারনা সরূপ এটাও বললো, অনলাইনে হবে হয়তো।নাহলে সারাদিন কৌড়ির সাথে থেকে আবার তারজন্য শপিং করলো কখন?আসলেই কখন?সব শুনে কৌড়ির ভাবনায় একটা কথা এলো,মানুষটা যখন নিভান।তার ব্রেইনে কি চলছে সেটা শুধু তার মস্তিষ্ক আর মস্তিষ্কের মালিক আল্লাহ জানে।হঠাৎ কারও ধীর পায়ের শব্দে ভাবনা কাটলো কৌড়ির।চোখ খুললো সে।সোজা হয়ে বসলো।মাজেদা খাতুন এসেই কৌড়ির পাশে বসলেন।নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন।

‘শরীরডা এখন তোর ঠিকঠাক লাগছে তো আপা?

সময় নিয়ে উত্তর দিলো কৌড়ি –‘হুমম ঠিক আছে।

ছোটো করে উত্তর দিয়ে চুপ রইলো কৌড়ি।মাজেদা খাতুনও চুপ থেকে কৌড়িকে দেখে গেলেন।সেই ছোট্টো কৌড়িটার দু’দিন বাদে বিয়ে।পেট থেকেই টেনে তিনিই তো বের করেছিলেন।তারপর মায়ের অকুলনে,মাতৃত্ব স্নেহ ভালোবাসায় কোলেপিঠে করে তিনিই তো মানুষ করলেন।এইতো সেদিনের কথা।অথচ আজ মেয়েটা বিয়ের উপযুক্ত।দু’দিন বাদেই তার বিয়ে!কি আশ্চর্য!
সময় কতো তাড়াতাড়ি পার হয়ে যায়।ছেলে আর ছেলের বউটা বেঁচে থাকলে,এই দিনটাতে কতোটাই না খুশি হতো তারা।অথচ মেয়েকে বিয়ে সাজে দেখার মতো সুখানুভূতি,নিজের কাছ থেকে বিদায় দিয়ে পর বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়ার মতো দুঃখবিলাস!কোনোটাই কপালে জুটলোনা তাদের।দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

‘তুমি আমার উপর অসন্তুষ্ট তাইনা দাদিআপা?

একটু অবাক হলেন তিনি।চকিতে বললেন — অসন্তুষ্ট কেনো হইবো?

‘বিয়ের এই সিদ্ধান্তে মত প্রকাশ করার জন্য।আমি হ্যা মত প্রকাশ করি এটা তুমি চাওনি তাইনা?

ভদ্রমহিলা একটু অপ্রস্তুত হলেন।নাহিদের বিষয়ে যে মনোভাব তিনি মনেমনে পুষেছিলেন সেটাতো তিনি কৌড়িকে সরাসরি প্রকাশ করেননি।তবে কেনো একথা বলছে মেয়েটা।তবে কি মেয়েটা উনার আচারণে কিছু আন্দাজ করে নিয়েছে!হবে হয়তো!কৌড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেও কিছু বলতে পারলেন-না তিনি।

‘তবে আমি তোমার উপর অসন্তুষ্ট!

ভদ্রমহিলা এবার বুঝতে পারলেন,মেয়েটা উনার মনোভাব বুঝে নিয়েছে সব।তাই তিনিও মায়ামায়া কন্ঠে বললেন–আমি তোকে নিজের কাছে রাখার লোভ করেছিলাম।

‘কিন্তু বাবা বেঁচে থাকলে,ও যদি ফেরেস্তা রূপও ধারন করতো তবুও ওরহাতে নিজের মেয়েকে তুলে দেওয়ার চিন্তাভাবনা কখনো ভুলেও করতেন*না।তুমি তো বাবার,মা।বাবাকে তো খুব ভালো বুঝতে,চিনতে।তুমি বলো না,বাবা এরকম চিন্তা ভাবনা কখনো পোষণ করতেন কি না?অথচ যে ছেলের জন্য নিজের সন্তানের মৃত্যুর শোকটা ঠিকঠাক ভাবে পালন করতে পারলে না।তার থেকে বাঁচাতে আমাকে রক্ষা করতে ব্যস্ত হয়ে এতো দুরে পাঠিয়ে দিলে।সেই আমাকেই আবার সেই ছেলেটার হাতে তুলে দেওয়ার চিন্তাভাবনা।আমাকে অসন্তুষ্টতা করেছে।

ভদ্রমহিলা কৈফিয়ত দিলেন না।নিজের বংশের রক্ততো।খারাপ ছিলো যখন খারাপ নজরে দেখেছেন।মন পুড়েছে তবুও খারাপকে খারাপ বলেছেন।ব্যবহারও করেছেন তেমন।কিন্তু ছেলেটা যখন ভালো পথে ফিরলো,তার কথাবার্তা আচারণে মুগ্ধ হতে বাধ্য হলেন তিনি।দূর্বলতা তো রয়েছেই,নিজের বংশপ্রদীপ।নিজের সন্তানের রক্ত।যারসাথে নিজের রক্তও মিশে আছে।সুপথে ফেরার পর ছেলেটা যখন উনার খোঁজখবর নিতো,কৌড়ির ঘরটায় এসে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতো।ছুঁয়ে ছুয়ে কৌড়ির বইখাতাগুলো দেখতো।উনার যেনো ভিতরে ভিতরে মায়া কাজ করতো।মনে হতো,ছেলেটা আর যতো খারাপ কাজ পিছে করে এসেছে।কৌড়িকে শুধু নিজের রাগজেদের ফল হিসাবে চায়নি।চেয়েছিলো সে খাঁটি মনে।নাহলে কৌড়ির অবর্তমানে, তার সবকিছুতে এতো মায়া,ভালোবাসা দেখায় কেনো ছেলেটা।সেই দূর্বলতা থেকে আর ছেলের বউয়ের ইন্ধনে মনেমনে ইচ্ছেটা পোষন করেছিলেন।চেয়েছিলেন পরিক্ষা শেষ কৌড়িকে বুঝিয়ে বলবেন।কিন্তু তার আগে উনার চাওয়া মনের মধ্যেই চাপা পড়ে গেলো।মেয়েটার ভাগ্যে যাকে লেখা ছিল,সেই এসে মেয়েটাকে চেয়ে নিলো।তবে কৌড়ির একথা সত্য, তিনি নাহিদকে নিয়ে মনেমনে যে চিন্তা ভাবনা পোষন করেছিলেন,নিজের ছেলে তার ফুলের মতো মেয়েটাকে নিয়ে এমন চিন্তা ভাবনা পোষণ করতো-না।

পরিবেশ নীরব গুমোটভাব!সেই নীরবতা কাটলো,দরজায় নক করার মৃদু শব্দে।কৌড়ি আগেই নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে চুপচাপ মাথা নিচু করে বসেছিলো।দরজায় শব্দ পড়তেই মাথা উচু করলো।কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে নজরে পড়তেই,ভিতরটা কেমন এলোমেলো অনুভব হলো।মাজেদা খাতুনও পিছু তাকালেন।তিনি তাকাতেই নিভান নমনীয় স্বরে শুধালো।—ভিতরে আসতে পারি,দাদীআপা?

‘অনুমতি লাগে?আইসো,আইসো।

ছেলেটার আচারণে তিনি বরাবরই মুগ্ধ হন।এবাড়িতে এক মাসের অধিক সময় থেকে গেছেন।ছেলেটা স্বভাব গুনে সবদিক থেকে ভালো। তবে তিনি আশা করেননি, একদিন কৌড়িকে সেই ছেলে উনার কাছে চেয়ে বসবে।উঠে দাঁড়ালেন তিনি।ততক্ষণে নিভান ভিতরে ঢুকে গিয়েছে।

‘তোমরা কথা কও।আমি আসতাছি।

‘,আপনি বসুন।আমি ওর সাথে কথা বলতে আসিনি।আপনার সাথে কথা ছিলো।

কথাটা বলে কৌড়ির ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে টুলটা টেনে সেটাতে বসে পড়লো নিভান।কৌড়িকে একপলক দেখে নিলো।মাথা নিচু রেখে নিজের হাত কচলে যাচ্ছে।ভদ্রমহিলা বসে পড়তেই,নিভান সময় নিয়ে শুধালো।

‘আপনি নাতজামাই হিসাবে আমাকে অপছন্দ?নীতনি আমাকে দিতে চাইছেন না,এমনটা কি?

কৌড়ির হাতের কচলানো যেনো বাড়লো।নিভান মাজেদা খাতুনের দিকে অটল নজর রেখে সেটা বুঝতে পারলো।ভদ্রমহিলা আঁতকে উঠার মতো করে বললেন।

‘অপছন্দ ক্যান হইবো,এসব কি কও তুমি?

‘তাহলে আপনার নাতনী পাওয়ার অযোগ্য বলে মনে করছেন?

দ্বিগুণ আঁতকে উঠা কন্ঠে তিনি ফের বললেন–ও মাবুদ, তুমি অযোগ্য হইবা কেনো।এইটা আমি মনেই করিনা।

মনেমনে হাসলো নিভান।ভদ্রমহিলাকে বিভ্রান্ত করার জন্য অকারণে এই প্রশ্নগুলো করা তার।ভদ্রমহিলার সাথে বিয়ের আগে একবার খোলাখুলি কথা বলা উচিত মনে করেছে সে।কৌড়ির প্রচন্ড একটা দূর্বলতার জায়গা এই দাদীআপা।হওয়ারই কথা।আর ভদ্রমহিলার সিদ্ধান্ত খোলাখুলি না হওয়া পর্যন্ত মেয়েটা নিজেও দ্বিধায় ভুগছে।হয়তো মনেমনে ভাবছে দাদিআপার অমতে গিয়ে বিয়েতে সম্মতি দেওয়াটা কি ঠিক হয়েছে তার?তার সম্মতিতে কি দাদিআপা সত্যিই অসন্তুষ্ট?ডক্টরের পরামর্শ অনুযায়ী এখন মেয়েটাকে স্ট্রেস নেওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ।মনেমনে যদি এই দ্বিধাগুলো পুষে থাকে!সেই স্ট্রেস দূরিভুত করার একটা চেষ্টা মাত্র করতে এসেছে নিভান।

‘তাহলে আমার কেনো মনেহচ্ছে,আমার দেওয়া বিয়ের প্রস্তাবে আপনি খুশি নন।অসন্তুষ্ট!

‘তুমি যা ভাবতেছো তেমনটা নয়।তয় আমি কৌড়িকে আমার কাছে রাইখা দিতে চাইছিলাম এইটা সত্য।

অস্বস্তি নিয়ে কথাটা বললেন মাজেদা খাতুন।কথার অর্থ নিভানের কাছে পরিস্কার।তবে উনি যেমন রাখঢাক রেখে কথাগুলো বললেন।উত্তরও নিভান তেমন দিলো–আপনি কিন্তু আপনার নাতনীর কাছে থাকতে পারেন আজীবন।যেমনটা আপনি মনেমনে পোষন করেছিলেন।

কথার ভার বলে দিচ্ছে, যে বিষয়টা দাদিআপা না বলতেও সে টের পেয়েছে।মানুষটাও টের পেয়ে গেছে। হাতের কচলানো বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই।কৌড়ি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে,সামন্য দূরত্ব বজার রেখে বসা মানুষটার পানে।আশ্চর্য মানুষ!সবদিকে তার এতো তীক্ষ্ণ খেয়াল কেনো?

‘চাইলেই কি সব হয়!নাতিন হোক বা মাইয়া।জামাই বাড়িতে থাকা শোভনীয় দেখায় না।সে যাই বলো-না ক্যান তুমি।যাই হোক তোমার কথা কও,আমি যাই।

উঠে দাঁড়িয়ে কিছুদুর এগোতেই পিছে ফিরলেন তিনি।সচ্চ হেসে জানালেন—তোমারে আমার অপছন্দ নয়।আমার ছেলের পরে আমার নাতিনের দায়িত্ব চোখ বুইজা তোমার উপর ছাইড়া দেওয়া যায়।সেই ছেলেডা আমার নাতিনের অযোগ্য কখনো হইতে পারে?নাকি আমার অপছন্দ হইতে পারে?

প্রশ্ন চিহ্ন ঝুলিয়ে দিয়ে ভদ্রমহিলা চলে গেলেন।নিভান সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে কৌড়ির পানে তাকালো।কৌড়ি তখন-ও অবাক চোখে তাকিয়ে দরজার পানে।

‘দাদিআপা তো মনখুলে সম্মতি জানিয়ে গেলেম,নাতনির কি খবর?তিনি কি ভাবছেন,আজ হলুদের অনুষ্ঠান বাদে বিয়ে কি দুদিন বাদে হবে?নাকি মন অন্য কিছু বলছে?

চকিতে কৌড়ি মুখ ফিরিয়ে নিভানের দিকে তাকালো।ফের মুখটা ছোটো করে দূর্বল গলায় জানালো-সবকিছু এতো দ্রুত কেনো?

বরাবরের মতোই কৌড়ির পানে সুগভীর শান্ত নজরে তাকালো নিভান।কৌড়ি কথাগুলো বলতেই শ্বাস ফেলে ঠান্ডার গলায় শুধালো–দ্রুত হলে সমস্যা কোথায়?তুমি কি আমার হতে চাইছোনা?

তড়িৎ মাথা উপর নিচ নাচিয়ে সম্মতি জানালো কৌড়ি।অর্থাৎ সে হতে চায়।সে শুধু এই মানুষটারই একান্ত নারী হতে চায়।

সুক্ষ হাসলো নিভান।সেই হাসি লক্ষ্য করে লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো কৌড়ি।নিভান বললো—তাহলে সমস্যা কোথায়।দুদিন আগে হোক বা দু’দিন পরে।আমারই যখন হতে হবে,তাড়াতাড়ি হলে বা সমস্যা কোথায়?আর দেরী করেও বা লাভটা কি?

তাকাতে বাধ্য হলো কৌড়ি।অসহায় কন্ঠে বলল-আমার কেমন যেনো লাগছে!

নিজের মনের ভিতরের চাপা কথা বা অনুভূতি সহজে প্রকাশ করেনা মেয়েটা।আজ করছে।কেমন যেনো একটু দুষ্টমি করতে চাইলো মন।নিভান কেমন দুষ্টমী গলায় যেনো শুধালো–কেমন লাগছে?

অচেনা কন্ঠ।এমন গলায় তো কখনো কথা বলিনি মানুষটা!অথচ মানুষটা নিজের জায়গায় অবিচল বসা।বরাবরের মতোই শান্ত নজর,নিশ্চল ভঙ্গিমা।তবে ঠোঁটে খেলা করছে লুকোচুরি দুষ্ট হাসি।নজর এলোমেলো হলো কৌড়ির।চোখ সরিয়ে কোলের মধ্যে রাখা হাতের দিকে নজর দিলো।ফের ছাড়াছাড়া গলায় বললো।

‘আপনি চলে যান,আমার কাজ আছে?

দুষ্ট লুকোচুরি হাসিটা প্রসারিত হলো নিভানের ঠোঁটে।মনটা আরও দুষ্টমিতে মেতে উঠতে চাইলো।আজ একটু প্রশ্রয় দিলো মনটাকে।কেমন মোহনীয় গলায় সামনের মেয়েটাকে অপ্রস্তুত করে দিয়ে বলে উঠলো।

‘আজ যেতে বলছো।কাল হয়তো একই সিদ্ধান্তে অটল থাকবে।পৌরশুদিন কি করবে?সেদিনতো তুমি আমাকে নিজেই থাকতে বলবে।তখন?

লজ্জায় অস্বস্তিতে বুদ হয়ে থাকা কৌড়িকে বাঁচালো ঈশিতা আর তারসাথে কিছু মেয়ে দলবল।যারা নিভানের পরিচিত কাজিন এবং আশেপাশে ফ্লাটের সুপরিচিত মেয়েরা।তাদেরকে দেখেই উঠে দাঁড়ালো নিভান।অসময়ে কৌড়ির রুমে সে,দেখে পিঞ্চ করতেও ছাড়লোনা।বরাবরের মতোই নির্বিকার, কথা বাড়ায়নি নিভান।শুধু যাবার আগে ঈশিতাকে বলে গেলো।

‘এক্সট্রা গাদাগাদা রঙচঙ মাখিয়ে ভুতের মতো সাজাবেনা ওকে।ও যেমনই আছে তেমনই পারফেক্ট আছে।ওর ন্যাচারাল চেহারা যেনো রঙচঙের ভিড়ে না হারায়।

গায়ে লাগলো কথাটা এমন স্বরে প্রতিবাদ জানলো ঈশিতা।গলা উঁচিয়ে বলল–এই এই আর তোর বউ যদি সাজতে চায়?

থামলোনা নিভান।যেতে যেতে বললো–ও চাইবেনা।আমি ওকে জানি।নিভান এমনি এমনি তো আর দূর্বল হয়নি ওর উপর।

আরও একগাদা কথার অস্বস্তি দিয়ে চলে গেলো নিভান।কৌড়ি আরও লজ্জা পেলো।সেই লজ্জা বাড়িয়ে দিয়ে মেয়েগুলো তারসাথে মশকারা করলো কিছুক্ষণ।ঈশিতা তাদেরকে ধমক দিয়ে চুপ করালো।তারপর মান্যতা আর তন্ময়ী হাতভরে হলুদের সাজসজ্জার সরঞ্জাম নিয়ে আসতেই সাজগোছ নিয়ে পড়লো সবাই।হলুদের শাড়ী আর ফুলের গহনা দেখেই কেমন যেনো হৃদপিণ্ড ঢিপঢিপ তাল হারিয়ে কেঁপে কেঁপে উঠলো তার।

চলবে…

#ফুলকৌড়ি
(৪৫)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

নিজের রুমে রেডি হচ্ছে নিভান।গায়ে কালো ছাইরঙা চেইক শার্ট।ছেলেটাকে আগে ফর্মাল ড্রেসআপে দেখা যেতো বেশি।ভার্সিটি লাইফ চুকানোর পর খুব কমই তাকে এধরনের রঙিন শার্টে দেখা গেছে।তবে ইদানীং আবারও তাকে দেখা যাচ্ছে বেশ।হয়তো প্রেমে পড়ার কেরামতি।তবে একটু পরে হলুদের অনুষ্ঠান।অনুষ্ঠানের পোশাক বাদে এরকম সাধারণ ড্রেসআপে রেডি হচ্ছে কেনো সে?নিভানের এখানে আসা থেকে চুপচাপ তৃনয়।অথচ এরকম চুপচাপ তাকে সাঝেনা।চুপচাপ থাকেও না সে।কিন্তু কি করার।নিভানকে কিভাবে বোঝাবে সে!নিভান যে ধারণা তারসম্পর্কে করছে তা সম্পূর্ণ ভুল।
অনেক্ক্ষণ ধরে চুপ থাকলেও এবার পেটের মধ্যে নিজেকে নির্দোষ প্রমান করার কাচুমাচুটা শুরু হলো। আর চুপ থাকতে পারলোনা তৃনয়।কাছের বন্ধুটার সাথে আজ যেনো কথা বলতেও কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। যদিও তার যৌক্তিক কারণ আছে।তবুও।কেমন অস্বস্তি নিয়ে জড়ানো গলায় বললো।

‘আমার সম্পর্কে তুই যে ধারনা করছিস সম্পূর্ণ ভুল।তুই আমাকে চিনিস নিভান।তুই যে অ্যালিগেশনগুলো আমার উপর অপর্ন করেছিস তা যথাযথ নয়।সম্পূর্ন ভুূল ধারনা তোর।আমি কখনো নিজের সফলতাকে অহংকার রূপে দেখিনি বা ভবিষ্যতে দেখবোওনা। আমার মনে কখনো একরকম ধারনার জন্ম নিতে দেব না যে,আমি সফলতার চুড়ায় উঠলে মান্যতাকে আমি ভুলে গিয়ে অন্য কাওকে নিজের জীবনে জড়াবো।বা সফলতার চুড়ায় পৌঁছাতে পারলে ওরকম মান্যতা আমার জীবনে বহু আসবে!আমি আর যাকে হোক,ওই মেয়েটাকে এতো ছোটো করে দেখিনা কখনো।দেখিওনি কখনো।ইভান যখন তন্ময়ীকে বিয়ে করলো,আমার মনে হয়েছিলো বিয়েটা না-হোক।শুধু বোনের ননদকে পাওয়ার আশংঙ্কা ক্ষীন হয়ে যাবে তাই।তারপর মনে হলো স্বার্থপরী করছি।যা হবে পরে দেখা যাবে,আগের বোনের সুখ।সেই আমাকে তুই এমন দোষারোপে ডুবিয়ে দিয়ে ভুল বুঝতে পারিসনা।

থামলো তৃনয়।নিভান নির্বিকার তার কাজ করে যাচ্ছে। যেনো তৃনয়ের কথাগুলো তার জানা,মুখস্থ।তাই বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখালোনা।তৃনয় সেটা বুঝেও ফের বলতে শুরু করলো।

‘কতবার আমি তোকে বলতে চেয়েছি মান্যতার কথা, জানিস?বন্ধুত্ব নষ্ট হবে,তোরসাথে সম্পর্ক খারাপ হবে বলে বলিনি।তারপর মান্যতারও আমার উপর ওই ফালতু ছেলেটাকে মারা নিয়ে,কবেকার রাগ মনে পুষে রেখে রেগে আছে।সেই থেকে তো আমার সাথে ঠিকঠাক কথাও বলে-না।দেখা হলেই এড়িয়ে যায়।এমনকি এবাড়ির সাথে একটা নতুন সম্পর্ক তৈরী হলো,সেখানে যতোবার দেখা হয়েছে আমাকে এড়িয়ে গেছে।কথা বলিনি।সেখানে ওর মতামতটা না জেনে আমি আঙ্কেলের কাছে প্রস্তাব রাখলে,সেই প্রস্তাবে যদি ও অসম্মতি জানায়!আমার সম্মান পরে,মায়ের অসম্মান হোক আমি চাইনি।তাই তুই যখন সেদিন ওরকম কথাগুলো বললি।আমি বুঝে গিয়েছিলাম,তোর কাছে নিজেকে লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে গিয়েছে মাত্র।আমার মনে মান্যতাকে নিয়ে অনুভূতি জন্মানো থেকে তুই আগাগোড়া সবটাই জানিস।যা বুঝতে দিসনি কখনো।চতুর তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন বিজনেসম্যান নিভানের কাছে তার কাছের বন্ধুর অনুভূতি লুকানো আসলেই গাধামী?এটা আমারও মাথায় ছিলো-না।যাই হোক সেদিন তোর কথায় বুঝতে পেরেছিলাম তুই চায়ছিস,আমি মান্যতা জন্য তার গার্ডিয়ানের কাছে বিয়ের প্রস্তাব রাখি।বিশ্বাস কর,আমি খুব এক্সাইটেড ছিলাম।ভেবেও নিয়েছিলাম পরের দিন মা’কে নিয়ে এবাড়িতে আসবো।হঠাৎ মান্যতার কথা মনে পড়লো।ভাবলাম,ও যদি আমার প্রস্তাবে সম্মত না হয়।তবে?
সেদিন সারারাত ঘুমাইনি কিভাবে মান্যতাকে মানাবো সেই চিন্তায়।রাতেই ওরসাথে যোগাযোগ করার ট্রাই করলাম।ফোন ধরেনি।হোয়াটসঅ্যাপে নক দিলাম, ফাযিল মেয়েটা আমার রিপ্লাইই দেয়নি।

‘সাবধানে ওয়ার্ড ইউজ কর।কার সম্পর্কে কথা বলছিস ভুলে যাসনা।

নিভানের হুমকিমুলক বার্তায় পাত্তা দিলোনা তৃনয়।বরং
একই টোনে বললোো–আর তোর বোন যেটা করছে, সেটা ঠিক?ও আমাকে বুঝেও অবুঝ হয়ে রয়েছে!বল এখন আমার কি করনীয়?ও এখনো সেই ঘটনা নিয়ে পড়ে আছে।ছেলেটা খারাপ ছিলো, এটা ওর ধ্যানে নেই।তুই ছেলেটাকে মেরেছিলি।ওর ধারণা আমি তোকে উসকিয়ে ছিলাম,এবং ছেলেটার সাথে ও রিলেশনে জড়িয়েছে সেটা তোকেই আমিই জানিয়েছিলাম।

‘ওর ধারনাতো ভুল নয়।তুইই-তো জানিয়েছিলি।

‘নিভান।

হাসলো নিভান।কাল কথার ছলে রেগে গিয়ে কি না কি বলেছে,তাই নিয়ে পড়েছে ছেলেটা।

‘তুই ভালোভাবে জানিস,আমি কি বলেছিলাম আর কি করেছিলাম!ওর খারাপ কখনো চাইনি আমি।ছেলেটার উদ্দেশ্য খারাপ ছিলো ওকে নিয়ে,যেটা আমি জানতে পেরেছিলাম আর তোকে জানাতে-ও বাধ্য হয়েছিলাম।আমার অনুভূতির অন্ধ মোহে পড়ে কোনো কিছু করিনি আমি।

‘তবে আর কি!মান্য যখন তোকে অপছন্দ করে।তোর প্রস্তাবে রাজী হবেনা ভাবছিস।তাহলে আর কি করার!আমি বরং মিঃ চৌধুরীর প্রস্তাবে আগ্রহী হতে বলি।এবং আসার নিমন্ত্রণ জানাই।কি বলিস?

‘নিভান।

অসহায় কন্ঠ তৃনয়ের।ডাক শুনে ঠোঁট থেকে মুছে যাওয়া হাসিটা ফিরে এলো নিভানের।অকপটে বললো-‘আরেহ মহা মুশকিল!’তো কি করতে বলছিস?বোন আমি তোর বাড়িতে গিয়ে উঠিয়ে দিয়ে আসবো।যে আমার একটাই মাত্র বোন বেশি হয়ে গিয়েছে,পাত্রস্থ করতে পারছিনা।তাই বন্ধুর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে গেলাম।

‘তা কখন বললাম!আমি জানি তুই বললে মান্যতা একবাক্যে বিয়েতে রাজি হবে।কিন্তু মন থেকে তো নয়।আমার প্রতি যে বিরূপ দৃষ্টি ওর মনে আগলে রেখেছে।সেখানে সবটা ঠিকঠাক কিকরে হবে?সেই ভাবনা আমাকে পাগল করে দিচ্ছে, আর তুই আছিস মজায়?

‘এই ভাবনাগুলো ওর প্রতি দূর্বল হওয়ার আগে ভাবা উচিত ছিলো-না।

‘সবকিছু কি ভেবেচিন্তে হয়।আর ওর প্রতি দূর্বলতা,ওই ঘটনার আগে থেকে জন্মেছিলো।এটা তুইও জানিস…

‘কৌড়িও কিন্তু রাজী ছিলো-না।তাকে মানাতে হয়েছে আমাকে।তারপর এই দিনটা এসেছে আমার জীবনে।

‘তোর বোন, মানানোর সুযোগ দিচ্ছে আমাকে?যেদিন তুই প্রস্তাব রাখার ইঙ্গিত দিলি সেদিন থেকে উল্টোপাল্টা চিন্তায় ভাবনায় মাথার মধ্যে আমার আওলাঝাওলা হয়ে আছে।সেখান থেকেই তোর বোনের সাথে কথা বলার,তাকে বোঝানোর সুযোগের চেষ্টা করছি।এর আগে ওকে বোঝানোর জন্য কথা বলার কতো চেষ্টা করেছি।সুযোগ দিয়েছে আমাকে?বিকালে তুই আবার তোর বোনের মতো বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে কথা বলে আসলি।অথচ আমার দিকটা কেউ ভেবেও দেখলিনা।কি যন্ত্রণায় আছি আমি!

কানে শুনলেও, তৃনয়ের কথায় বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখালো না নিভান।গায়ে পারফিউমের সুগন্ধটা ছড়িয়ে নিয়ে,টেবিল থেকে নিজের ফোনটা নিতে গিয়ে কৌড়িরটাও নজরে পড়লো।সেটাও পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে গাড়ির চাবিটা হাতে নিলো।তৃনয়কে তাড়া দিয়ে বললো—উঠ।বাহিরে যাবো।সাথে তুইও যাচ্ছিস।

‘নিভান।

ডাকের অর্থ নিভানের জানা।সেই প্রেক্ষিতে মজার ছলে বললো–তোর বিয়ে নিয়ে পরে দিনরাত একত্র করে ভাবতে বসিস। আপতত আমার বিয়েটা এনজয় কর।

‘নিভান।

‘বাচ্চাদের মতো এরকম আম্মা আম্মা করছিস কেনো?সুদর্শন যুবক,একটা মেয়ের মন জয় করতে পারিস-না।
এরচেয়ে চরম ব্যর্থতা একজন সুদর্শন পুরুষের জীবনে আর আছে!উঠ।

‘তোর বোন বাদে কতো মেয়ে পটে আছে জানিস?কথাটা বলতে গিয়েও বললোনা তৃনয়।একথা মুখ থেকে কোনোক্রমে বের হয়ে গেলে,বোনের আহ্লাদে ভাই তাকে মেরে তক্তা বানিয়ে ফেলতেও ছাড়বেনা।তাই প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললো।

‘একটু পরে হলুদের অনুষ্ঠান।তুই এখন কোথায় বের হবি?

‘প্রয়োজন আছে।গেলেই তো দেখতে পাবি।চল।

তৃনয় উঠে দাঁড়াতেই নিভান এসে তারসামনে দাঁড়ালো। তৃনয়ের গায়ে জড়ানো ফ্যাকাশে কালেরর হলুদ রঙা পাঞ্জাবি।উপরের দুটো বোতাম খোলা।সেখানে দ্বিধাহীন হাত রাখলো নিভান।বোতাম দুটো লাগিয়ে দিতে দিতে খুব শান্ত মসৃণ কন্ঠে বললো।

‘মান্যতা রাজী হবে।আর ও তোর সম্পর্কে যে ধরণাই মনে পুষে রাখুক না কেনো এটা জানে এবং মানে, তুই ভালো ছেলে।খুব ভালো ছেলে।বাবার কাছে প্রস্তাব রাখ।আমার জানামতে,তিনি তোর প্রস্তাবে অমত পোষন করবেননা।আর তিনি প্রস্তাবে সম্মতি প্রকাশ করা মানে মান্যর সম্মতি।তারপরও আমি মান্যর সাথে কথা বলে নেবো।বিয়েটা হলে হতে দে।সেই ছেলেটার পরে মান্যতা আর কোনো রিলেশনশিপে জড়াইনি।তাহলে এতো কেনো টেনশন নিচ্ছিস!ওকে মানাতে চাস বোঝাতে চাস, ভালো কথা।ও যখন সুযোগ দিচ্ছে না,বিয়েটা করেনে।তারপর মানানোর বোঝানোর সময়টা কাছ থেকে পাবি।দেখবি মানানোসহ সম্পর্কটা আর-ও সহজ হয়ে গেছে।আর বিবাহিত সম্পর্কে সৃষ্টিকর্তার আলাদা একটা রহমত থাকে।সেই পবিত্র সম্পর্কে দুটো আলাদা অচেনা নর-নারীর মধ্যেও তিনি অঢেল,মায়া,ভালোবাসা টান সৃষ্টি করে দেন।সুতারাং বিয়েটা করে নে।সমাধান এমনিতেই মিলে যাবে।

আবেগে আপ্লূত হলো তৃনয়।পুরুষ চোখে সহজে নোনাজল না জমলেও,ভিতর থেকে একটা আবেগের ঢেউ খেলে গেলো।এরকম বন্ধু থাকলে,আর কি চাই!জীবন সহজ।আবেগে আপ্লূত হয়ে কথা যেনো হারিয়ে গিয়েছে তার।নিভানের হাত সরিয়ে যেই ওকে জড়িয়ে ধরতে যাবে,নিভান ওর বুকে হাত দিয়ে বাধা দিয়ে বললো–আবেগে পরে ভাসিস ডুবিস।আপতত চল।

তৃনয় শুনলো না।নিভানের হাতটা জোরকরে সরিয়ে দিয়ে তাকে শক্তকরে জড়িয়ে ধরলো।তবে আবেগপ্রবণ হয়ে মুখে বলতে পারলো না কিছু।নিভান সেটা বুঝে নিজেও শক্তকরে ওকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো।পিঠে বারবার হাত বুলিয়ে ঠাট্টা করে বললো–তুই এরকম মেয়েদের মতো আবেগী হয়ে গেলি কবে থেকে।

‘যেদিন থেকে নিভান নামে আমার একটা সুবন্ধু হয়েছে সেদিন থেকেই।

হেসে উঠলো দুজনে।ফের একে-অপরকে ছেড়ে সরে দাঁড়ালো।তৃনয় গিয়ে দাঁড়াল আয়নার সামনে।নিজেকে একপল দেখে নিয়ে নিভানের পিছু নিলো।দু’জনে দরজা অব্দি পৌঁছানোর আগেই সম্মুখে এসে হাজির হলো ঈশিতা।হাতে তার তার নামী শপিংমলের একটা শপিং ব্যাগ।নিভানেকে সাধারণ বেশে রেডি হয়ে কোথাও যেতে দেখেই কপাল কুঁচকে গেলো তার।সহসা শুধালো।

‘তুই কোথাও যাচ্ছিস?

‘আমার একটু কাজ আছে।বাহিরে যেতে হবে।আপতত সেই উদ্দেশ্যে বের হচ্ছি।কেনো,কোনো প্রয়োজন?

‘মানেটা কি!একটু পরে হলুদের অনুষ্ঠান!এখন তুই বের হবি?

‘হলুদের অনুষ্ঠানে আমার কি কাজ?তোমরা কি আমাকেও হলুদ মাখানোর চিন্তা ভাবনা করছো নাকি?

কপালে ভাজ ফেলিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে কথাটা বলতেই, পাশে দাঁড়ানো তৃনয় হেসে দিলো।শব্দ শুনেও কর্ণপাত করলো না নিভান।ঈশিতার মুখের দিকে অদ্ভুত নজরে তাকিয়ে রইলো।সেই তাকানো উপেক্ষা করে ঈশিতা বললো —

‘হলুদের অনুষ্ঠানে তোর কি কাজ মানে?বিয়ে কি একা কৌড়ির হচ্ছে?ওর যে কারণে হলুদ ছোঁয়ানো হবে তোরও একই কারণেই ছোঁয়ানো হবে।আর তোকে হলুদ মাখানোর চিন্তাভাবনা মানে?বিয়ের বর কনে দুজনকে হলুদ ছোঁয়ানো নিয়ম।

‘নিয়ম না মানলে কি হবে?

‘কিচ্ছু হবে-না।তবে এটা বিয়ের একটা আনুষ্ঠানিকতা। এছাড়া কিছু না।

‘তাহলে মানা না মানাতে সমস্যা কোথায়? আর আমার এখন বাহিরে যাওয়াটা খুব প্রয়োজন।

শপিংব্যাগটা নিভানের হাতে ধরিয়ে দিলো ঈশিতা।ফের বললো–এতো কথা শুনতে চাইনা।রেডি হয়ে নিচে আসবি,এটাই জানি।

‘এটাতে কি?

‘তোর হলুদের পোশাক।

‘মানেটা কি?তুমি জানোনা আমার হলুদ রঙ নিজের গায়ে জড়ানো একদম পছন্দ নয়।

‘সেজন্য পুরোপুরি হলুদ পোশাক নেয়নি।তুই দেখে নে।
তবে রেডি হয়ে নিচে আসবি,দ্বিতীয়ত আর কোনো কথা শুনতে চাইনা।

ঈশিতা আর সেকেন্ড সময় ব্যায় না করে চলে গেলো।সেদিকে তাকিয়ে নিভান কিছু ভাবলো।বাহিরে যাওয়াটা তার খুব প্রয়োজন।তারপর আবারও কিছু ভেবে রেডি হতে চলে গেলো।তা নিয়ে তৃনয়ও মজা লুটলো।এটা বলতেও ছাড়লোনা।–

‘তোমার পুরুষ স্বাধীনতার অবক্ষয় হতে শুরু হয়ে গেছে বন্ধুু।

সময়টা রাত আটটার এদিক ওদিক।অথচ দিনের আলোর মতো ফকফকা পরিস্কার,চারপাশটা।ফুল দিয়ে আচ্ছাদিত চমৎকার চোখে ধাঁধানো সজ্জার স্টেজে এনে বসানো হয়েছে কৌড়িকে।পরনে তার,ভারী কাতান মোলায়েম হলুদ শাড়ী।দুধে আলতা গায়ের বর্ণে নিদারুণ মানিয়েছে হলুদ রঙটা।কৃত্রিম নয় অকৃত্রিম সতেজ টাটকা ফুলে সাজানো হয়েছে তাকে।রজনীগন্ধা আর গোলাপ ফুলের সংমিশ্রণে গহনা বানিয়ে তার বিভিন্ন অঙ্গ জড়ানো হয়েছে।তাতে গোলগাল মায়াবী চেহারার জৌলুষ যেনো চৌগুন বেড়ে গিয়েছে।হরিণী চোখজোড়া আজ মাশকারার ছোঁয়ায় অন্যরকম লাগছে।কেমন?আকর্ষণীয়,আরও মায়াময়।চিকন ঠোঁটজোড়া সেজে উঠেছে,কৃষ্ণচূড়ার লালাভ আভায়।নিভানের কথামতো কি, কৌড়ির ইচ্ছায়।অতিরঞ্জিত মেকওভারে সাজানো হয়নি তাকে।খুব সাধারণ সাজেই সাজানো হয়েছে।অথচ মোহমায়া রূপ যেনো উপচে পড়ছে।অসাধারণ অপরূপা এক রূপ।পছন্দের নারীটিকে আজ প্রথমবার শাড়িতে এবং সাজে দেখলো নিভান।সেই মোহমায়া অপরূপা রূপে যেনো নজর থমকে রইলো।থমকে রইলো হৃদস্পন্দনও।সচ্চ সুগভীর নিষ্পলক চোখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকলো নিভান।

‘ওয়াও,আজ ফুলকৌড়িকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে!

নিভানের হাতের বাধন ছাড়িয়ে নাফিম সামনে ছুটতেই হুঁশ ফিরলো তার।মূহুর্তেই তাকে দেখে হৈহৈ করে উঠল সবাই।সেটা খেয়াল হতেই নিজেকে স্বাভাবিক করে নেওয়ার চেষ্টা করে নিলো,কিন্তু বাহিরটাকে স্বাভাবিক দেখাতে পারলেও ভিতরটাকে কিছুতেই স্বাভাবিকতায় দমাতে পারলো নিভান।ভিতরের নতুন নড়েচড়ে উঠা কম্পিত অনুভূতিগুলো যেনো চঞ্চল উচ্ছ্বসিত পায়ে বুকের ভিতর নৃত্য করে চলেছে।হৃদয়ের সেই চঞ্চলা অনুভূতি নিয়েই ধীর পায়ে কৌড়ির পানে এগোলো নিভান।তার সামনে এগোনো একেক কদমে স্টেজে বসা মেয়েটার বুকের ভিতর-ও কম্পন ধরালো।লজ্জিত হয়ে শিরশির করে উঠলো গায়ের প্রতিটি লোমকূপ।মাথা নিচু করে নিয়ে সেই লজ্জা নিবারিত করতে চাইলো।পারলো কি?কে পারলো!তা যেনো এগোনো মানুষটার প্রতিটি পদক্ষেপের ন্যায় বেড়ে চললো।চারপাশটা উচ্ছ্বসিত,মুখরিত।নিভানের আগমন,এবং কৌড়িরপানে এগোনো পদক্ষেপ যেনো বাড়িয়ে দিলো,সেই উচ্ছসিত পরিবেশ।নিভান এসে কৌড়ির পাশাপাশি নয় সামনে দুহাটু সঁপে বসলো।দু’জনের মধ্যেখানে, হলুদের ডালা আর বিভিন্ন মিষ্টান্ন দিয়ে সাজানো টেবিলটা শুধু বাঁধা হয়ে রইলো।নিভান সেটা পরোয়া করলোনা।নির্দ্বিধায় মুখ বাড়িয়ে নিয়ে মুগ্ধ কন্ঠে বললো।

‘মাশাআল্লাহ।

আবারও হৈহৈ করে উঠলো সবাই।কৌড়ির হাত জড়িয়ে বসা নাফিমও নিভানকে অনুসরণ করে বলে উঠলো– ‘মাশাআল্লাহ।ফুলকৌড়িকে সত্যিই পরীদের মতো সুন্দর লাগছে,তাইনা বলো দাদাভাই?

নিভান কিছু বললোনা।অথচ তার হাস্যজ্বল নজর দুটো বলে দিলো অনেককিছু।দূর থেকে ইভান উচ্ছ্বসিত গলায় মজা লুটতে থাকলো।কান দিলোনা নিভান।তবে লজ্জায় আড়ষ্ট হলো কৌড়ি।সেই আড়ষ্টতা বাড়িয়ে দিয়ে নিভান হাত ছোঁয়ালো হলুদের বাটিতে।তর্জনী আর মধ্যমা আঙুলে মাখিয়ে নিলো হুলুদের গাঢ় প্রলেপ।চারপাশ থেকে মেয়েদের গুঞ্জন উঠলো।তন্মধ্যে মান্যতার গলার স্বর স্পষ্ট হয়ে ভেসে এলো।

‘হলুদ হাতে লাগিও-না দাদাভাই। বাটির পাশে দেখো গোলাপের পাতা আছে,সেটাতে লাগিয়ে নাও।

শুনলো কি মানুষটা!না!কৌড়ি স্পষ্ট দেখলো,হলুদের গাঢ় প্রলেপ লাগিয়ে নিয়েছে ডানহাতের দু আঙুলে।তারপর সেই আঙুলজোড়া দ্বিধাহীন ছুঁয়ে দিলো তার নরম গাল।হলুদের ঠান্ডা প্রলেপে নাকি কারও নমনীয় স্পর্শে!জানা নেই কৌড়ির!শিরশির করে উঠলো শরীর।
শীতল স্রোত বয়ে গেলো সর্বাঙ্গে।অতি লজ্জায় নুইয়ে পড়ার বদলে মুখ উঁচু করে তাকালো সে।তাঁকে ছুঁয়ে দেওয়া আঙুলজোড়ায় লেগে থাকা বাকি প্রলেপ ছুয়ে নিলো,নিভান নিজের গালে।সমস্ত শরীরে এবার তরঙ্গোচ্ছ্বাসের শীতল ঢেউ বয়ে চলল।গতিনিয়ন্ত্রন ছাড়িয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে থাকলো হৃদপিণ্ড।চারপাশটা তখন নিভানের কর্মে উচ্ছসিত।সেই উচ্ছ্বসিত কন্ঠগুলোকে উপেক্ষা করে সামনের হলুদে আচ্ছাদিত অপরূপা বেশে, হৃদয়ে ঝড় তোলা নারীটিকে উদ্দেশ্য করে বললো নিভান।

‘তোমার হলুদের সালামী নেবে না!

বাকরুদ্ধ কৌড়ি তখন অপলক চোখে চেয়ে।সাদা পাজামা পাঞ্জাবিতে মানুষটা।পাঞ্জাবির উপরের কটিটা শুধু হলুদের।তাও খুবই হালকা রঙের।অথচ শুভ্র সেই সাধারণে পোশাকে,কি মায়াময় আর হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছে সেই শ্যামলাটে পুরুষটাকে।

‘কি হলো,নেবেনা?

কানে কথা গেলে-ও কিছু বললোনা কৌড়ি।শুরু বোবা মানুষের মতো অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।কি মুগ্ধকর সেই দৃষ্টি। যদি নারীটি তারজন্য হালাল হতো,অনুষ্ঠানের সমস্ত মানুষকে উপেক্ষা করে ওই মায়াময় চোখে আদর ছুঁয়ে দিতো নিভান।আপতত তা সংবরন করলো।মিষ্টি কন্ঠে বললো।

‘শুনেছি হলুদের অনুষ্ঠানিকতার নিয়ম হচ্ছে, কনেকে হলুদ ছুয়ে তাকে সালামী দেওয়া।আমি তো হলুদ ছুঁয়ে দিলাম।সালামিতো এবার প্রযোজ্য।দিতেই হবে।নেবে না?

চমৎকার হেসে কথাটা জিজ্ঞেস করলো।কৌড়ির জবাবের অপেক্ষা না করে তার কোমল বাম হাতটা তুলে নিলো নিজের হাতের মুঠোয়।ফের ডান হাতটা পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে চমৎকার একটা জুয়েলারী বক্স বের করলো।ডান হাতের আঙুল দ্বারা সেটা খুলতেই,সাদা পাথরটা তার সৌন্দর্য ছড়িয়ে জ্বলজ্বল করে উঠলো।মুখর হলো পরিবেশ।দেরী করলোনা ইভান,বিভিন্ন এ্যঙ্গেলে ছবি উঠিয়ে নিলো কয়েকগাছি।বক্স থেকে রিংটা উঠিয়ে নিলো নিভান।আলতো স্পর্শে তা পরিয়ে দিলো কৌড়ির অনামিকায়।কৌড়ি বিস্মিত নজর একপলক সেটা দেখে আবার নজর স্থির করলো, সামনের মানুষটার শ্যমবর্ন মুখে।আবেগে কান্না ঠিহরে বের হতো চাইলো।দাঁতে দাত চেপে তা সংবরণ করলো।রিং পরানো শেষে মুখ তুলে চাইলো নিভান।চমৎকার সেই হাসিটা তখনো ঠোঁটে ঝুলে।

‘কান্নাদের আটকাচ্ছো কেনো?তাদেরকে আসতে দাও।ঠোঁট থেকে দাঁত সরাও।আমি তোমার চোখে সুখের কান্না দেখতে চাই,তবে তারসাথে ঠোটের চমৎকার হাসিটাও।

ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে হাসলো কৌড়ি।মায়াবী হরিণী চোখে তখন জ্বলে টইটম্বুর।সেই কান্না হাসিতে মোহগ্রস্ত হলো নিভান।অমায়িক কন্ঠে বললো–আমাকে রিং পরাবে না?

এবার লজ্জায় আড়ষ্ট হলো কৌড়ি।কিভাবে সম্ভব!এই এতো এতো আভিজাত্যপূর্ন আয়োজন সব শুধুমাত্র তারজন্য করেছে মানুষটা।অথচ সেই মানুষটার জন্য তার পক্ষ থেকে করার কেউ নেই।কিচ্ছু নেই।বাবা মা বেচে থাকলে,জীবনটা স্বাভাবিক হলে এমন দিনটা কি কখনো দেখতে হতো?তার বাবার অর্থ ঐতিহ্য কম থাকলেও এই মানুষটাকে একটা কিছু উপহার দেওয়ার মতো অর্থ সমর্থ্য তো ছিলো।কৌড়ির ভাবনার মাঝেই চোখ ইশারা করে কিছু দেখালো নিভান।ঈশারা লক্ষ্য করে তাকাতেই এবার আর বিস্মিত নয়,মনেমনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো কৌড়ি।নিভান স্পষ্ট খেয়াল করলো।নিজে রিংটা কৌড়ির হাতে তুলে দিলো।ফের পরাতে ইশারা করলো।আশেপাশে ছোটো বড় নানা মানুষের উৎসুক নজরের ঢল।নজর ফিরিয়ে রিংটা পরিয়ে দিলো নিভানের বাড়িয়ে দেওয়া ডানহাতে।ফের হৈচৈ শুরু হলো।সেসব হৈচৈ উপেক্ষা করে নিভান নুইয়ে কৌড়ির কানের কাছাকাছি হলো।চমৎকার কন্ঠে বললো।

‘আমার ফুলকৌড়ির আত্মসম্মানে আঘাত আনুক এমন কাজ কখনো করবেনা নিভান।চিন্তা করোনা,আমার শ্বশুরের প্রাপ্য সম্পদ থেকে এই রিংয়ের অর্থ আমি ঠিক সময়মতো নিয়ে নেবো।আপতত আমার ফুলকৌড়ির সম্মান যেনো হীন না-হয় সেই দায়িত্বটা নিলাম।

এবার কেঁদে ফেললো কৌড়ি।তবে মুখে তার মায়াবী হাসি।পাশ থেকে ভেসে এলো সফট ভলিউমের গানের কিছু কলি।

হাওয়া কেনো আজ হয়েছে মাতাল,কানে কানে বলে।
আছে যতো সুখ ভরে দেবো আজ তোরই আচলে…

ভেসে আসা সুরের সাথে মৃদুস্বরে মানুষটাও যেনো তাল মেলালো।কি ভয়ংকর সে কন্ঠে।ঝর তুলে দিলো কৌড়ির হৃদয়ে।হঠাৎ সুর থামিয়ে মিষ্টি কন্ঠে শুধালো নিভান।

‘এখনো মন খারাপ?

মাথা নাড়িয়ে না জানালো কৌড়ি।মায়ামায়া কন্ঠে বললো –থ্যাঙ্কিউ।

‘অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে তোমাকে।অসম্ভব!

নিজের কথার পরিবর্তে এই উত্তর আশা করেনি কৌড়ি।লজ্জা পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।হঠাৎ মনেহলো পাশে নাফিম ছিলো যে!এতো-সময়?পাশে তাকালো কৌড়ি।নেই ছেলেটা।ওইযে দুরে দাঁড়িয়ে ইভানের সাথে দুষ্টুমিতে মেতেছে।স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো কৌড়ি।

‘কৌড়ি।

তড়িৎ মুখ ফিরিয়ে সামনের মানুষটার দিকে তাকালো কৌড়ি। নিভান সুন্দর শান্ত কন্ঠে বললো-আমাকে একটু বাহিরে যেতে হবে।আর্জেন্ট।কোনোরূপ মন খারাপ করবে-না।হলুদের অনুষ্ঠান মন দিয়ে এনজয় করবে।আমি না থাকায় হোক বা কারও কোনো উল্টো পাল্টা কথায়।কোনোরূপ মন খারাপ করবেনা।এই সময়গুলো আর কখনো ফিরে আসবেনা,সেভাবেই তোমার কাছের মানুষগুলোর সাথে এনজয় করবে।আমি যেখানেই থাকিনা কেনো,নজর আমার তোমাতেই থাকবে।তাই ভুলেও যেনো দেখিনা,আমার ফুলকৌড়ির ঠোঁটের হাসি সরেছে।কেমন?

মোহগ্রস্তের মতো মাথা নাড়ালো কৌড়ি।উঠে দাঁড়ালো নিভান।তৃনয়কে দেখলো ইভানের সাথে কথা বলতে।
অথচ নজর তার ক্ষনে ক্নে মান্যতাতে গিয়ে ঠিকছে।মেয়েটার সাথে কথা বলা প্রয়োজন।তবে এখন নয়।তৃনয়ের দিকে এগোলো নিভান।মূহুর্তেই মেয়েদল এসে ভীড় করল কৌড়ির পাশে।হলুদ মাখার হৈচৈ পড়ে গেলো।তবে মুরুব্বিপাটি না আসা পর্যন্ত কেউ কৌড়িকে হলুদ ছোঁয়ালো-না।নিষেধ আছে।তারা আসবে তারপর হলুদ ছোঁয়ানো শুরু হবে।তবে নিভানের বিষয় আলাদা ছিলো বলে কেউ কোনো দ্বিরুক্তি করেনি।

তৃনয়কে সাথে নিয়ে নিভান বের হলো।যাওয়ার আগে বার্তা ছুঁড়ে গেলো।—দ্বিতীয় কোনো পুরুষ যেনো ওকে হলুদ না ছোঁয়ায়।না মানে না।

বার্তা শিরোধার্য।সেই বিষয়ে যুক্তিতর্ক হওয়ার আগেই নিভান বড়োবড়ো কদম ফেলে চলে গেলো।কারও দ্বিরুক্তি শুনলো না।নিভান চলে যেতেই সেখানে হাজির হতে শুরু হলো বাড়ির সিনিয়র পাটিরা।সাথে দীবাকেও দেখা গেলো।গম্ভীর মুখ।ফর্সা চোখমুখ লালাভ আভায় ছেয়ে আছে।চোখগুলো ফুলোফুলো ভাব।চোখমুখের হাবভাবেই বোঝা যাচ্ছে প্রচুর কেঁদেছে।কৌড়িকে আশ্চর্য করে দিয়ে তার পাশে এসেই বসলো সে।মিষ্টি করে হাসলোও।অথচ মেয়েটা কখনো তাকে দেখে হাসেনা।কেমন মুখটা গম্ভীর করে রাখে।আর এই চারমাসে তারসাথে কথা কতোবার বলেছে গুনে বলতে পারবে কৌড়ি।কৌড়িকে আরও আশ্চর্য করে দিয়ে মেয়েটা সুমিষ্ট কন্ঠে শুধালো——-শরীর এখন কেমন তোমার? ঠিক আছো?হলুদ কে মাখিয়ে দিয়েছে?নিভান?

নিভান নামটা নিতে গিয়ে গলা কপলো কি তার!কৌড়ি তো টের পেলো কাঁপা! কিজানি হয়তো!তবে এতো প্রশ্ন একসাথে!আশ্চর্য তো হলো সাথে উত্তর দিতে ভুললোনা কৌড়ি।–আলহামদুলিল্লাহ ঠিক আছি আপু।

তবে শেষের কথার উত্তর দিলোনা।তারআগেই গাড়ীর হর্নের শব্দে চোখ গেলো বাড়ির মুল গেটে।নিভানের গাড়িটা বের হচ্ছে।গাড়িটা বের হওয়ার আগেই আরও একটা গাড়ি বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো।যা দেখে ছলাৎ করে উঠলো দীবার কলিজা।সিয়ামদের ইনভাইটেশন করলো কে?বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা তো আপতত বাড়ির লোকদের আর কিছু কাছের মানুষদের নিয়ে হচ্ছে।তবে উনারা এখানে কেনো এসেছে নাকি অন্যকিছু। তবে ওদের আসার নিমন্ত্রন জানালো কে?
নিভান নাকি মামা!দীবার কতশত ভাবনার মাঝে,
গাড়ি এসে থামলো পার্কিং এরিয়ায়।গাড়ী থেকে প্রথমে নামলো সুদর্শন এক যুবুক।বাহিরের সৌন্দর্য্যে পারফেক্ট যাকে বলে।আভিজাত্যপূর্ন হলুদ পোশাকে আচ্ছাদিত সে।সময় নিয়ে ফ্রন্ট সিট থেকে নামলেন এক ভদ্রমহিলা।উনার পোশাক-আশাকেও আভিজাত্যের ছোঁয়া।দু’জনকে দেখেই শক্ত হয়ে গেলো দীবার শরীর।পাংশুটে হলো মুখাবয়ব।যেটা পাশে বসা কৌড়ি সুক্ষ নজরে খেয়াল করলো।কৌড়ির অপরিচিত মানুষ দুজন কাছে আসতেই বাড়ির মুরুব্বিরা বিনয়ী হয়ে আলাপপরিচয় সারলেন।ডালিয়া বেগম যেনো একটু বেশিই বিনয়ী হয়ে কথা বললেন।তাতেই কৌড়ি বুঝে গেলো মানুষ দুজন কে?ততক্ষণে কৌড়ির হলুদ ছোঁয়ানো কাজ শুরু হয়ে গেছে।নিভানের মামিদের দিয়েই শুরু হলো হলুদ ছোঁয়া।নিভান চলে যাওয়ায় ঈশিতাসহ বাড়ির মুরুব্বিরা তাকে বকতে বকতে হলুদ ছোঁয়ানো শুরু করলেন।তারমধ্যেই আগমন ঘটলো দীবার হাসবেন্ড আর তার শ্বাশুড়ির।সিয়ামকে ছেলেদের ভীড়ে চলে যেতে দেখলেও ভদ্রমহিলা এসেই বসলেন দীবার পাশে।খুব নমনীয় কন্ঠে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলেন।গম্ভীর স্বরে হলেও দীবাও উত্তর দিল।
যেটা পাশে থাকায় কৌড়ি শুনতে পেলো।তারপর ভালো মন্দ কিছু কথা হওয়ার পর ভদ্রমহিলা কৌড়িকে হলুদ ছোঁয়ালেন।ফের আমায়িক কন্ঠে বললেন।

‘ওরে বাবাহ এতো দেখি অনিন্দ্য সুন্দরী।এই পরী কোথা থেকে খুঁজে আনলো নিভান!

আরও কত প্রশংসা করলেন।ভদ্রমিলাকে যথেষ্ঠ ভালো মনের এবং অমায়িক ব্যবহারের বলেই মনে হলো কৌড়ির।তারপরও দীবা আপু সংসার করতে চাইছেনা। কেনো?শুধু কি ওই মানুষটার জন্য?কেমন যেনো শক্ত হয়ে এলো কৌড়ির শরীর। ভাবনাটা কেমন হঠাৎই অস্থির করে তুললো তাকে।

হলুদের ছোঁয়ায় মুখরিত হলো পরিবেশ।সফট ভলিউমে মিউজিক চলছে।যেটা ইয়াং ছেলেমেয়েরা মানতে চাইছেনা।তবে বাড়ির সিনিয়রপাটি এবং নিভানের বিশেষ নিষেধাজ্ঞা থাকায় সবকটাকে শান্ত করে রেখেছে ইভান।লনের বাগান সাইডে ঘাটি পেতেছে জাহিদ সাহেবসহ উনার বয়স্ক শালাবাবুরা সাথে শাহেদ সাহেবসহ আরও কিছু পরিচিত মানুষ।চা কফির বিশাল নাস্তারপানির সাথে তাদের বিভিন্ন আলোচনা চলছে।গানের লাউড ভলিউম কানে গেলে,নিভানের বড়মামার বাজখাঁই গলার একখান ধমক আসতে সময় লাগবেনা।তখন বন্ধ হয়ে যাবে সকল সাউন্ড।যদিও আজ কিছু বলবে বলে মনেহয়না ইভানের।তবুও নিভানের কথা মতো,সালিনতা বজায় রেখে উশৃংখলের মতো নয় সুশৃঙ্খলের মতো হলুদের অনুষ্ঠানটা সারতে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।যাতে কোনো মানুষের কোনোরকম অসুবিধা নাহয়।হলুদ মাখানোর একপর্যায়ে কোথা থেকে সিয়াম আসলো।দ্বিধাহীন হলুদের বাটি থেকে গোলাপের পাতায় হলুদ মাখিয়ে কৌড়ির গালে ছোঁয়াতে গেল,তারআগেই মাথা পিছেয়ে নিলো কৌড়ি।চোখ বড়োবড়ো করে তাকিয়ে রইলো সামনে।মান্যতা পাশ থেকে মৃদু চিৎকার দিয়ে বললো।

‘ভাইয়া, ছেলেদের কৌড়িকে হলুদ ছোঁয়ানো নিষেধ আছে।দাদাভাই নিষেধ করে গেছেন।

সিয়াম হাসলো।পাতাটা রেখে দিলো বাটিতে।ফের বললো–নিভানের ওয়াইফ যখন এরকম বাধ্যতামূলক নিয়ম থাকতেই পারে।

কাকে খোঁচা দিয়ে কথাটা বললো?দীবাকে?কথার টোন, ইঙ্গিততো সেরকমই শোনালো।সেদিকে একপলক তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে নিজের খেয়ালে মন দিলো।তবে বিড়বিড় করে এরা বলতে ভুললোনা।চরিত্রহীন।সুন্দরী মেয়ে দেখলেই ছোঁয়ার জন্য হাত নিসপিস করে,তা বলবেনা।শুধু অন্যের দিকে আঙুল তুলতে জানে ঠিকই।

মাথার খোঁপাটা খুলে যাওয়ার বাড়ির ভিতরে ঢুকলো তন্ময়ী।সেটা খেয়াল করল ইভান।তার খেয়ালি নজরটা প্রথম থেকেই হলুদ সাজে তন্ময়ীর উপর ছিলো।কি সুন্দর লাগছে আজ মেয়েটাকে।চোখে চশমা না থাকায় চেহারাটা আজ প্রস্ফুটিত।চেহারার উজ্জ্বলতা,স্পষ্ট।অথচ তাকে কাছ থেকে দেখার একটু সুযোগই পাচ্ছেনা ইভান।মেয়েটাও কেমন যেনো তার থেকে দূরে দূরে থাকছে।যেনো লুকোচুরি খেলতে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।সুযোগ পেতেই তন্ময়ীর পিছু নিলো সে।বাড়ির ভিতরে ঢুকেতেই মা,মামিদের নজরে পড়লো সাথে ফুপিমনিসহ দীবাআপুর শাশুড়ী এবং নিজের শ্বাশুড়িকেও নজরে পড়লো।নীহারিকা বেগম জিজ্ঞেস করলেন—কিছু লাগবে কি-না।

অপ্রস্তুত হেসে না জানিয়ে তড়িৎ উপরে চলে গেলো সে।নিজের রুমে ঢুকতেই আয়নার সামনে তন্ময়ীকে দেখতে পেলো।দরজায় ঠেস দিয়ে মোহগ্রস্তের ন্যায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো কতক্ষণ। তন্ময়ীর মনোযোগ চুল বাধাতে।বেশি সময় নিজেকে সামলিয়ে রাখতে পারলো না ইভান।শান্ত কদমে পা বাড়িয়ে তন্ময়ীর পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো সে।ভুত দেখার মতো চমকে উঠে তার গয়ের সাথে লেগে গেলো তন্ময়ী।সুযোগ পেতেই দুহাতে পিছন থেকে তাকিয়ে জড়িয়ে ধরলো ইভান।

‘এরকম ভুতের মতো নিঃশব্দে কেউ রুমে আসে ইভান!একটু হলে তো আমার জানটাই বের হয়ে যেতো!কি যে করো-না তুমি।উফফ।

তীক্ষ্ণ গলায় বাক্যগুলো ছুড়লো তন্ময়ী।অথচ বাক্যগুলো কানেই তুললোনা ইভান।নজর বেপরোয়া হলো তন্ময়ীর হলুদ ছোঁয়ানো গালে,কাজলকালো চোখে,গাঢ় লাল লিপস্টিক ছোঁয়ানো ঠোঁটে।মুক্তোর দানার ন্যায় জ্বলজ্বল করতে থাকা উন্মুক্ত গলায়।চুম্বনের ন্যায় টানলো হলুদরঙা সেই উজ্জ্বল গলা।বেসামাল হয়ে গলায় মুখ ডুবালো ইভান।হঠাৎ স্পর্শে চমকে গেলো তন্ময়ী।কুঁকড়ে ইভানের বুকের সাথে আরও মিশে গেল।খামচে ধরলো নিজের পেটে জড়িয়ে রাখা ইভানের হাত।চোখ বুঁজে এলো ইভানের স্পর্শে।
বেপরোয়া হয়ে উঠলো ইভানের ঠোঁট,সাথে যবানও।

‘আজ তো তুম গায়া।

‘ইভান।

ডাকার অর্থ-ছেড়ে দাও।অথচ ইভান উল্টে জড়ানো গলায় বললো–‘ওভাবে ডেকো-না প্লিজ।আমি আর-ও বেসামাল হয়ে যাবো।

গলা ছাড়লো ইভান।তন্ময়ীর হলুদ ছোঁয়ানো মুখে ঠোঁট ডুবালো।চোখমুখ আর-ও খিঁচে ডুবে গেলো তন্ময়ীর।এই স্পর্শ পুরানো হয়ে গেছে।অথচ ইভান যতবার তাকে ছুয়ে দেয় ততোবার সর্বাঙ্গে যেনো উথাল-পাতাল ঝড় বয়ে যায়।অনুভূতিতে জুবুথুবু হয়ে থাকা তন্ময়ীর হঠাৎই মনে দরজা খোলা।কথা বলতে গিয়ে গলায় জড়িয়ে এলো তবুও জড়ানো গলায় বললো।

‘ইভান দরজা খোলা,যেকোনো সময় কেউ এসে যেতে পারে?

একই জড়ানো গলায় ইভানও উত্তর দিলো।

‘এরুমে একজোড়া স্বামী স্ত্রীর বসাবস।এটা সবাই জানে।সেই রুমে নক ছাড়া ঢোকা শোভনীয় নয় এটাও সবাই জানে।

বেশ কিছুটা সময় চললো ইভানের বেপরোয়া ভালোবাসা।সুযোগ পেতেই তন্ময়ী উল্টো ঘুরে ইভানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।হেসে ফেললো ইভান।বললো।–এটা কিন্তু ভারী অন্যায়।

শক্তহাতে খামচে ধরলো ইভানের পাঞ্জাবির অংশ।পাঞ্জাবি ভেদ করে খামচি ধরা আচরটা পিঠেও লাগল।
ইভানের কথা পুরো দস্তুর উপেক্ষা করে তন্ময়ী অভিযোগী গলায় বললো

‘ইভান তুমি কিন্তু দিনকে দিন মাত্রাধিক অসভ্য হয়ে যাচ্ছো।সীমা ছাড়াচ্ছো।

ইভানের হাসি চওড়া হলো।ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে সে।শক্তহাতে নিজেও জড়িয়ে নিয়েছে তন্ময়ীকে।মেয়েটার কথার উত্তর সরূপ দুষ্ট গলায় বললো।

‘তারজন্য দ্বায়ী কে?

লজ্জায় লাল হলো তন্ময়ীর মুখ।যেটা ইভান দেখতে না পেলেও তন্ময়ীর কুঁকড়ে আসা শরীরের ছোঁয়ায় অনুভব করতে পারলো।তবু্ও তন্ময়ী শক্তগলায় উত্তর দিলো।

‘দ্বায়ী তুমি।

মৃদুস্বরে এবার ইভানের হাসির শব্দ শোনা গেলো।ফের দুষ্টমিষ্টি কন্ঠে বললো।

‘তাহলে দ্বায়ী যখন আমি,অসভ্যতামীর সীমাতো ছাড়াতেই হয়।কি বলো?

সীমা ছাড়ালো ইভান।তন্ময়ীকে আর কথা বলতে না দিয়ে নিজের বুক থেকে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে তার লালাভ ঠোঁটজোড়ায় দখল বসিয়ে নিলো।তন্ময়ীর প্রথম ছাড়ানোর চেষ্টা করে গেলো,পরবর্তীতে নিজেই কেমন শান্ত হয়ে গেলো।

চলবে…