Monday, July 28, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 56



তোমার জন্য সব পর্ব-১১

0

#তোমার_জন্য_সব (১১)
✍️ #রেহানা_পুতুল
মাহমুদ নরম হেসে বলল,
“কলি আসেন।”
মাহফুজা গোপনে উল্লসিত! আপ্লুত! রান্নাঘরে গিয়ে বাতাসীকে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে,

“এই বাতাসী, তোর মাষ্টার সাবের সঙ্গে এই মেয়েটাকে মানাবে বউ হিসেবে?”

বাতাসী বেকুবের মতো চাইলো গৃহকত্রীর মুখপানে। একটু দম ফেলে বলল,
“মাশাল্লাহ। ভালই মানাইবো। খালাম্মা, উনি কি মাস্টার ভাইয়ার বিয়ার পাত্রী? লাইন মারে উনার লগে? ”

“আরেহ নাহ। উনি পাত্রী নয়। মাষ্টার সাবের ছাত্রী।”

রসপূর্ণ কন্ঠে বললেন মাহফুজা। তিনি সরে গেলে বাতাসী ঠোঁট বাঁকিয়ে আহ্লাদী স্বরে মনে মনে উচ্চারণ করলো,

“উঁহু! পাত্রী না ছাত্রী। বড়লোকের রঙের শ্যাষ নাই।”

টেবিলে খেতে বসলো মাহমুদ, কলি ও মাহফুজা। আতিথেয়তায় কলি মুগ্ধ হলো। কাঁচুমাচু হয়ে একটু একটু করে খাচ্ছে।

“এই মেয়ে সংকোচ কিসের? ধরে নাও আমি তোমার মায়ের বোন খালা। মায়ের চেয়েও ভালা।”

মমতা জড়ানো সুরে মধুর হেসে বলল মাহফুজা।

কলি সহাস্য হেসে,
” খাচ্ছিতো আন্টি। কষ্ট করে এত রেসিপি কেন করতে গেলেন?”

“কই কতো। খাওতো।”

“মা এটা ভালো বলছ। লাইক কমেন্ট দুটোই দিলাম।”
সুখী সুখী গলায় বলল মাহমুদ।

“তোর লাইক,কমেন্ট চাইনা। আমার এমনিতেই পপুলারিটি আছে। ”

“ওরেব্বাস! বলে কি। আমি, আনুশকা, বাবা, তোমার পিছনে আছি তাহলে?”

“আবার জিগায়।”
মজা করে বলল মাহমুদা।

কলির এত ভালো লাগছে মাহফুজাকে বলার মতো নয়। কি প্রাণোচ্ছল! কি দিপ্তীময় উদ্দীপনা! দেখে মনে হচ্ছে বিশাল রাজ্যজয় করা রাজার মতো পৃথিবীর সব সুখ শান্তি উনি একজনই দখল করে বসে আছেন। খাবার শেষ করে মাহমুদ বেসিনে গিয়ে হাত ধুয়ে নিলো। ফের এসে মায়ের পাশে বসলো। টেবিলের মাঝখানে থাকা কাচের ছোট্ট বৈয়ামটা টেনে আনলো নিজের দিকে। ঢাকনা খুলে এক চিমটি মৌরি তুলে নিলো আঙ্গুলের ডগায়।

তখনই মাহফুজা বলে উঠলো,

“এটা মুখে দিস না এখন। ডেজার্ট আছে। অরজিনাল স্বাদের তারতম্য ঘটবে পরে।”.

” ওফ হো। আগে বলবে না ডিয়ার মম। কি ডেজার্ট? ”

বাতাসী তিন বাটি ফালুদা এনে তিনজনের সামনে রাখলো।

“নে। তোর ফেবারিট ।”

মাহমুদ ঝটপট খেয়ে নিলো।
“হেব্বি হয়েছে জননী। জাস্ট ফাটাফাটি!”

“কলি খেয়ো কিন্তু তোমার আন্টির হাতের ঠান্ডা ঠান্ডা স্পেশাল ফালুদা। ”

মাহমুদ নিজের রুমে গিয়ে দরজা ভিড়িয়ে বিছানায় গা ছেড়ে দিলো। ভরপুর ভোজনের পর রেস্ট না দিলে অস্বস্তি লাগে।

কলিও, মাহফুজার রান্নার প্রশংসা করলো হৃদ্যতাপূর্ণ কন্ঠে। মাহফুজা সারাবাসা ঘুরে ঘুরে দেখালেন কলিকে। আবার এসে ড্রয়িংরুমে বসলেন। তখন আবদুর রহমান বাসায় এলেন বাইরে থেকে। মাহফুজা কলিকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি কলির সঙ্গে ড্রয়িংরুমে বসে খানিকক্ষণ আলাপ করলেন। পরে নিজেদের বেডরুমে চলে গেলেন ফ্রেস হওয়ার জন্য। বাতাসী তার জন্য দুপুরের খাবার এনে রাখলো টেবিলে। তিনি খেয়ে খাওয়া শেষে রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লেন।

কলি নিজ থেকে যেচে আগ্রহ নিয়ে কোন কিছুই জানতে চাইলো না মাহফুজা বা বাতাসীর কাছে। এই উৎসাহটুকুও তার মাঝে অনুপুস্থিত। যা তারজন্য জানা অনাবশ্যক। তা সে কখনোই জানতে চায়না। এমনিতেই সে এসেছে টিচারের কথার মান রাখতে। যদিও আসার পর তার ভালোলেগেছে বাসা ও মাহফুজাকে। খোলামেলা মনোরম পরিবেশ বাসার। ব্যালকনিতে রয়েছে নানান রঙের ফুলগাছ। লতায় পাতায় গলাগলি হয়ে আছে বারান্দার প্রতিটি গ্রীল।

কলি বিনয়াবনত স্বরে বলল,

“আন্টি আমি আসি। এমনিতেই গল্প কথায় লেট হয়ে গেলো। আমার টিউশনি থাকে সন্ধ্যায়।”

“ওহ হো! তোমার স্যার ত মনে হয় ঘুমিয়ে গেলো। দাঁড়াও দেখি। তার রুমতো তোমার দেখাও হয়নি।”

“আন্টি, লাগবে না। আমার আপনাকে দেখতেই ভালোলাগছে কেবল।”

মাহফুজা ভুবনমোহিনী হাসি ছড়িয়ে ছেলের রুমে গেলো। দরজা ফাঁক করে,

“এই মাহমুদ, ঘুমাচ্ছিস? কলি চলে যাচ্ছে। তোর রুম দেখবে না সে?”

মাহমুদ হাই দিতে দিতে ঘুম জড়ানো স্বরে বলল,

“আমি দিয়ে আসছি। আসতে বলো এদিকে।”

মাহফুজা পা ঘুরিয়ে কলির সামনে এলো। কলি দেখতে চাইল না মাহমুদের রুম। গাঁইগুঁই শুরু করলো। মাহফুজা তার হাত ধরে ছেলের রুমের ভিতরে নিয়ে গেলো।

“এটা তোমার স্যারের রুম। ও দিয়ে আসবে তোমাকে। রোড ফ্রি থাকলে বিশ মিনিট ও লাগবে না।”

কলি এক ঝলক নজর বুলিয়ে দেখে নিলো। ভদ্রতার খাতিরে বলল,

” হুম। সুন্দর। স্যার আপনি ঘুমান। আমিই চলে যেতে পারবো।”

মাহমুদ প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না কলিকে। টেবিল থেকে মেরুন কালারের বড় সানগ্লাসটা চোখে দিয়ে নিলো। ট্রাউজারের দুই পকেটে হাত গুঁজে বেরিয়ে গেলো কলি ও তার মায়ের পাশ কাটিয়ে। সোজা নিচে চলে গেলো লিফটে করে। বাইকের তালা খুলে বসে রইলো। মাহমুদা কলিকে এগিয়ে দিতে চাইলো নিচে গিয়ে। কলি অনুরোধ করে তাকে আসতে দিলো না। একাই লিফট দিয়ে নিচে চলে গেলো।

মাহমুদের কাছে গিয়ে বলল,
“স্যার আসি।”

“আমি ঘুম নষ্ট করে উঠে এলাম কেন?পিছনে উঠে বসুন।”

গম্ভীর স্বরে বলল মাহমুদ।

কলি দাঁড়িয়ে রইলো।

“কলিই আমি অপেক্ষা করছি। আপনাকে পৌঁছে দিয়ে এসে ঘুমাবো। বাসার এড্রেস বলেন।”

কলি বিরস মুখে উঠে বসলো মাহমুদের পিছনে। কিছুদূর যাওয়ার পর স্প্রীড বেকারে ধাক্কা খেলো বাইক। কলি তাল সামলাতে না পেরে মাহমুদের গায়ে ঝুঁকে পড়লো অনিচ্ছাকৃতভাবে। দুজনেই ভারি অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। যদিও এক অপ্রত্যাশিত নবসুখে মাহমুদের ভিতরে ভূমিকম্প হয়ে গেলো। যে সুখের কথা আবার গোপনও রাখতে হচ্ছে তাকে।

কলির নাকমুখ রাগে জ্বলে উঠলো। কলিকে তাদের বাসার নিচে নামিয়ে দিলো মাহমুদ। কলি সৌজন্যতা দেখিয়ে কোন কথা বলল না মাহমুদের সঙ্গে। এমনকি তাদের বাসায়ও যেতে বলল না। থমথমে মুখে সিঁড়ি ডিঙিয়ে উপরে উঠে গেলো। তার ধারণা মাহমুদ ইচ্ছে করে দেয়নি। তা সত্যি। বাট সে আরেকটু কেয়ারফুল্লি থাকলে এমন হতো না।

মাহমুদ বুঝলো বিষয়টা। তাই সেও কলিকে পিছু ডাকল না। কারণ গেটে গেয়ারটেকার বসা। পাছে আবার কি ভেবে বসে সেইলোক কলি সম্পর্কে। মাহমুদ বাড়ির উপরে তাকালো। ভালো করে চিনে নিলো কলিদের বাসা।

কলি বাসায় গিয়ে মনে মনে,

আজব পুরুষ। মায়ের সঙ্গে দেখলাম কি সুন্দর ফ্রেন্ডলি দুষ্টমিষ্ট স্বরে কথা বলে। আর এখন কি ভাব তার কন্ঠে ও কথায়। এডপ্ট নাকি স্যার। না তা হবে কেন। মায়ের সঙ্গে চেহারার মিল আছে। তার মা এত প্রাণবন্ত সে এমন কেন। হুম। স্যারের বাবাকে এমন দেখলাম। ভারি মেজাজের। বাবার স্বভাবটাই বোধহয় পেয়েছে।

মাহমুদ বাসায় চলে গেলো। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো। প্রচন্ড মুড অফ। কেন যে ওই ধাক্কাটা খেলো। যেখানে নিজেই এত সংযত হয়ে চলে এবং কথা বলে কলির সঙ্গে। সেখানে রাস্তাটা করলো কি। বেশি কিছু ভাবতে পারল না। দু’চোখে রাজ্যের ঘুম হামলে পড়লো।

সন্ধ্যার পর মাহফুজা বাড়ন্ত কিশোরীর মতো ছটপট করতে লাগলো। চোখেমুখে অস্থিরতার ঝাঁপি। স্বামীর পাশ ঘেঁষে বসলো আদুরে বিড়ালছানার ন্যায়।

“কিছু বলবে মনে হয় তুমি?”

ভরাট কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন আবদুর রহমান।

মাহফুজা তাকে কলি সম্পর্কে সব বলল নিজের মতো করে। শুনে আবদুর রহমান বললেন কপাল চুলকে বললেন,

“আমার কোন আপত্তি নেই। লাইফ যার তার যদি পছন্দ হয় কলিকে। তাহলে প্রস্তাব দিতে পারো তার পরিবারকে। আর তারা মিডেল ক্লাস। এটা ম্যাটারনা। মেয়ের পৈত্রিক সম্পত্তি,অর্থবিত্ত এসব দিয়ে আমরা কি করবো? এসব তো খোঁজে তারা। যারা ক্ষুদ্র মনের। আমাদের কম আছে নাকি।”

মাহফুজা খুশীতে বাক-বাকুম হয়ে উঠলো। আনুশকাকে ফোন দিলো।

“হ্যাঁ আম্মু,কেমন আছো?”

“ভালো আছি। শোন আম্মু,কলিকে তোর ভাবি হিসেবে কেমন লাগবে?”

হঠাৎ করে এমন কিছু শোনায় আনুশকার কাশি উঠে গেলো। সে সামান্য পানি খেয়ে নিলো। কৌতুহলপূর্ণ স্বরে,

“ঝেড়ে কাশো ত আম্মু। তুমি ঝেড়ে না কাশাতে আমার কাশি উঠে গেলো।”

মাহমুদা বিস্তারিত মেয়েকে বলল। শুনে তার মেয়ে বলল,

“লাইফ ভাইয়ার। সো ডিসিশনও ভাইয়ার। সে যদি কলিকে নিয়ে হ্যাপি থাকে। আমাদেরতো আপত্তি থাকার কথা নয়। তোমার নিজের পছন্দ হয়েছে কলিকে। আব্বুর ও আমার অপিনিয়ন শুনলে। তোমার পক্ষেই গেলো। মেইন মানুষটার অপিনিয়ন শুনে নাও এবার।”

মাহমুদা মোবাইল রেখে দিলো। তার আনন্দ আর ধরে না। শিশু নতুন খেলনা পেলে যেমন খলবল করা উচ্ছ্বাসে মেতে উঠে। সারাবাড়ি ঘুরে বেড়ায়। ঠিক তেমনিই মাহফুজা এদিক ওদিক পায়চারি করছে। অপেক্ষা মাহমুদ ঘুম থেকে উঠার। আর তর সয়না তার।

“হ্যাঁ বাবা উঠছিস। একটু দরকার ছিলো। ”

“কি মা? বসো এবং বলো।”

“বাবা কলিকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। ভালো মনের মেয়ে। হাজারো মন্দের ভীড়ে এমন একটা চরিত্রবান, নম্রভাষী, মিশুক,বন্ধুবৎসল মেয়ে পাওয়া সোনার হরিণের মতো। একে হাতছাড়া করা যাবে না কিছুতেই। তোর বাবা বোনেরও অমত নেই।”

মাহমুদ দেখলো যেখানে তার মা নিজেই কলিজে চুজ করে ফেলেছে। সেখানে সে একটু শক্ত অবস্থান থাকলে ফলাফল সুনিশ্চিত। সে বিস্ময়ভরা কন্ঠে বলল,

“আরেব্বাস! দ্বিপাক্ষিক আলোচনাও ইতিমধ্যে চূড়ান্ত করে ফেললে? মা এই মেয়ের সঙ্গে আমার না ফ্রেন্ডশিপ রিলেশন আছে, না ভালো সখ্যতা আছে। বরং ভার্সিটির অন্য ছাত্রীদের সঙ্গে আরো সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। এরমধ্যে তুমি তাকে পুত্রবধূ ভেবে বসে আছো। এটা ঠিক হলো? এসব ত আমিও কল্পনাও করিনি মা।”

মাহফুজার মুখ বেজার হয়ে গেলো। মুখে ভর করলো তিমির আঁধার।
মাহমুদ মায়ের পিঠে হাত দিয়ে বলল,

“ছেলেমানুষী করো না। আমাকে কয়দিন সময় দাও। দেখি ওর সঙ্গে এমনিতে কথা বলে বলে সখ্যতা করা যায় কিনা। হুট করে এমন কিছু বললে ও নিতেই পারবে না। ভার্সিটি সত্যিই ছেড়ে দিবে। ছাত্রী হিসেবে ওকে ত আমি চিনি।”

“তা তুই ঠিক বলেছিস। আচ্ছা তাহলে মেশার চেষ্টা করো। ওর নাম্বার টা আমার মোবাইলে সেভ করে দে কলি লিখে।”

মাহমুদ মায়ের মোবাইলে কলির নাম্বার সেভ করে দিলো।
“এই যে দিলাম। নাও।”

ছেলের মুখে আশাবাদী কথা শুনে মাহমুদার মুখার্কৃতি পরিবর্তন হলো। কোমল হেসে চলে গেলো।

অডিটোরিয়ামে আজ বাংলা বিভাগের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সামনের সব ম্যাডাম,স্যাররা উপস্থিত। আজ সবাই ফ্রেন্ডলি মজা করছে। নাচ,গান,অভিনয়,আবৃত্তি, কৌতুক একে একে সবই হলো। সবাই নতুন ড্রেস পরে সেজেগুজে এসেছে যার যার মতো করে। বাদ যায়নি খেয়া, কলিও। কলি আজ আরেকটা নতুন ড্রেস পরে এসেছে। অসম্ভব মায়াবি ও আকর্ষণীয় লাগছে তাকে। সে বরাবরের মতো পিছনের বেঞ্চে বসে আছে। মাহমুদ লুকানো চোখে অনবরত দেখে যাচ্ছে কলিকে।

মিসেস হেড বলল,

” একটা সারপ্রাইজ দিবো। এখন মাইক্রোফোনে তোমাদের গান গেয়ে শোনাবে মাহমুদ স্যার। সে অল্পস্বল্প গাইতে পারে। আমাদের জন্য ওই অল্পস্বল্পই যথেষ্ট। নাকি বলো?”

হুররে! বলে সবাই হাততালি দিয়ে স্যারকে উৎসাহ দিলো মঞ্চে মাইক্রোফোনের সামনে যাওয়ার জন্য।

স্যার মিসেস হেডের দিকে নৈরাশ্যপূর্ণ দৃষ্টিতে চাইলেন। ম্যাডাম মুচকি হাসলেন।

রিমি বলল,
“গানের মডেল লাগবে না। খেয়া আসুক।”

“নাহ। মডেল উঠে আসতে হবে না। আপনাদের মাঝথেকে আমি পছন্দ করে নিব একজনকে মনে মনে।”

“ইয়াহু! কে সেই ললনা স্যার। পরে জানাবেন কিন্তু। ”

“ওহ সিউর। প্রমিজ। তবে আজ নয়। সময় হলেই।”

খেয়া ধরে নিলো তাকেই মিন করে বলছে।
মাহমুদ ভরাট কন্ঠে গাইতে লাগলো ভারতের প্রয়াত শিল্পী শ্যামল মিত্রের সেই বিখ্যাত প্রেমের গান।

“কি নামে ডেকে বলবো তোমাকে,
মন্দ করেছে আমাকে ওই দুটি চোখে।

আমি যে মাতাল হাওয়ার ই মতো হয়ে,
যেতে যতে পায়ে পায়ে গেছি জড়িয়ে।

কি করি ভেবে যে মরি/ বলবে কি লোকে,
মন্দ করেছে আমাকে ঐ দুটি চোখে।

পালাতে পারি নি আমি যে দিশাহারা
দু’টি চোখ যেন আমায় দিচ্ছে পাহারা।

ধরা পড়ে গেছি আমি নিজেরই কাছে
জানি না তোমার মনেও কি এত প্রেম আছে।

সত্যি যদি হয় বলুক যা বলছে নিন্দুকে
মন্দ করেছে আমাকে ঐ দুটি চোখে।

কি নামে ডেকে বলবো তোমাকে
মন্দ করেছে আমাকে ওই দুটি চোখে।”

মুখরিত করতালিতে হল কলরবপূর্ণ হয়ে উঠলো। রিমি ও অনান্যরা বলল,

“স্যার হিন্টস দেন প্লিজ। সে কি খুব মর্ডাণ গার্ল? কিংবা…?”

“নোওও। সে অতি সাধারণ। এই গানের সঙ্গে কেমন মডেল যায় আপনারাই মিলিয়ে নেন।”

ক্লাসের সবাই এ ওর দিকে চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। পেলনা। অনুষ্ঠান শেষে সবাই চলে যায় হাসাহাসি করতে করতে। কলিও চলে গেলো। সেও বুঝল না স্যার কাকে মিন করে গাইলো।

খেয়া উদভ্রান্তের মতো বের হয়ে গেলো বিক্ষিপ্ত পায়ে। সে নিশ্চিত হলো সে নয়। তবে কে তাও বুঝল না। কারণ স্যার নিদিষ্ট কারো দিকেই বেশিসময় চেয়ে থাকেনি। সবার দিকেই চেয়ে চেয়েই গান গেয়েছে।

সেদিন রাত নয়টার দিকে মাহমুদের ফোন বেজে উঠলো উচ্চস্বরে। ফোন রিসিভ হলো। ওপাশের কথা শোনার পরেই মাহমুদ উদ্বিগ্ন স্বরে,

“ওহ মাই গড! এড্রেস বলুন। আমি এক্ষুনি আসছি আপনাদের বাসায়।”

মাহমুদ দ্রুতবেগে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। বাসার কাউকে কিছু বলার সময়টুকুও নেই তারহাতে।

চলবে…১১

তোমার জন্য সব পর্ব-১০

0

#তোমার_জন্য_সব (১০)
✍️ #রেহানা_পুতুল
কলি পা ঘুরিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলে পিছন হতে ডাক পড়লো।
” এই কলি শুনুন। এদিকে আসুন।”

কলি দৃষ্টি আড়াল করে মাহমুদের টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
“কেন এলেন?”

“এমনিই স্যার।”
মিনমিনে স্বরে বলল কলি।

“কারণ ছাড়া আপনি আসেন নি। বলুন বলছি।”

” স্যার দুটো কোর্সেই আমি সর্বোচ্চ মার্ক পেলাম কিভাবে? সিমপ্যাথি দেখালেন নাকি?”

মাহমুদ দুর্বোধ্য হাসলো। বলল,

“অদ্ভুত! একজন এলো নাম্বার কম পেলো কেন সেই অভিযোগ নিয়ে। আপনি এলেন বেশি পেলেন কেন সে অভিযোগ নিয়ে। আপনি, খেয়া পেয়েছেনটা কি আমাকে? নাকি আমি আপনাদের টিচার, এটা ভুলে যান। হুঁ? কোন সিমপ্যাথি নয় কলি। যা পেয়েছেন তাই দিয়েছি। জাস্ট ইট। সিমপ্যাথির প্রশ্ন আসবে কেন?”

“আচ্ছা বুঝলাম স্যার। আসি।”

কলি চলে গেলো ম্লান মুখে। মাহমুদ তাকে আর কিছু বলল না। খেয়াকেও সে জিজ্ঞেস করলো না সেদিন কার বাইকে চড়েছিলো সে। কারণ খেয়া তার চিন্তাভাবনা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। সুতরাং তাতে তার বিন্দুমাত্র কৌতুহলবোধও কাজ করছে না।

আজ খেয়ার মন ভালো নেই। ব্লেড দিয়ে হাত কেটে ফেলেছে। হাত নিশপিশ করছে তার। স্থির থাকতে পারছে না একদন্ডও।
কাউকে মে*রে ফেলতে পারলে ভালো হতো। সেটাতো পসিবেল না। কিছু একটা ভাঙ্গতে পারলে মনের কিছুটা দহন কমতো। সে টেবিল থেকে একটা গ্লাস নিয়ে সজোরে তার রুমের মেঝেতে ছুঁড়ে মারলো। নিমিষেই অজস্র কাঁচের গুঁড়িতে মেঝে মাখামাখি হয়ে গেলো। বাসার সবাই ছুটে এলো।

তনিমা জিজ্ঞেস করলো,
“কিরে কিভাবে ভাঙ্গলো গ্লাস?”

“ভাবি আমি ভেঙ্গেছি ইচ্ছে করেই। মাহমুদ স্যার আমাকে ভিন্নচোখে দেখে না। বিয়ে ক্যান্সেল। ”

“কি বলিস? কিভাবে বুঝলি?”

খেয়া তার দেখা কারণগুলো বলল তনিমাকে।
“স্যার কি অন্য কোন ছাত্রী বা মেয়েকে ভালোবাসে?”

“তা মনে হয়না। সে যে টাইপের পারসন।”

“তাহলে ফাইনালি স্যারের সঙ্গে কথা বল।”

“নো নিড ভাবি। যা বোঝার বুঝে গেছি। আমিও স্টপ হয়ে গেলাম। আব্বুকে বলো অন্য ছেলে দেখতে।”

“অন্যছেলে দেখবে কেন? ফাহিম না তোকে ভালোবাসে?”

“আচ্ছা তার কথা ভেবে দেখবো।”

খেয়া কাটাহাত এতক্ষণ লুকিয়ে রাখলো। এবার ওয়ান টাইম ব্যাণ্ডেজ় লাগিয়ে দিলো তুলো দিয়ে ব্লাড মুছে ফেলে। উদভ্রান্তের মতো হয়ে সে বালিশে মাথাগুঁজে আছে উপুড় হয়ে। অশ্রু বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে বিরামহীনভাবে। কি করবে বা কি করা উচিত কিছুই বুঝে উঠছে না। তনিমা তার কাছে এসে মাথায় হাত রাখলো,

” একমাত্র ভালোবাসার জন্য পৃথিবীতে কারোই নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তুই নিদোর্ষ। নানাভাবে চেষ্টা করেছিস। শেষবারের মতো করে যা আরো দু চারদিন। আমার কথাটা রাখ।”

“হুঁ” বলে খেয়া ওভাবেই পড়ে রইলো আগের মতো।”

আজ শুক্রবার। রেবেকা, সন্ধ্যায় স্বামী ও দুই মেয়ের সামনে গরম গরম নাস্তা নিয়ে রাখলেন। ডালপুরি, পেঁপে,আলু, ডিম দিয়ে ম্যাগী নুডলস রান্না ও দুধ চা। শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘাড়,মুখ মুছতে মুছতে একপাশে বেতের মোড়াটা টেনে বসলেন। অনেক আগের এই মোড়াটা তার খুব শখের। বহুবছর ব্যবহারে মোড়াটি সৌন্দর্য হারিয়েছে। পুরোনো হয়ে গিয়েছে। বাসায় কিছু দূরাত্মীয়রা এলেই বলে উঠে,

” এই মোড়াটা আপনার পুরান ঢাকার বাসায় থাকতে না? মাশাল্লাহ জিনিস টেকে আপনার হাতে। হিসাব না করলে খরচের শহরে টেকা মুশকিল। রাস্তায় নামার দশা হয়। ”

রেবেকার বুঝতে অসুবিধা হয়না তাদের তুচ্ছ করে বলা কথাগুলো। রেবেকা জবাব দেয় অধৈর্যমাখা কন্ঠে।

“পুরান ঢাকা কি আবার? এখনো তো পুরান ঢাকায় আছি। স্থান বদল হয়েছে মাত্র। ”

“নাহ, আগের গিঞ্জি বাসার চেয়ে এই বাসার পরিবেশ উন্নত। বাসায় কিছু ফার্নিচার আপডেট করেছেন দেখলাম।”

“আশ্চর্য! স্থান বদল হলে, কিছু নতুন ফার্নিচার আপডেট হলে পুরান ঢাকা নতুন ঢাকা হয়ে যায় নাকি? আগে ছিলাম চকবাজার। এখন আজিমপুর আছি। নিউমার্কেটের কাছাকাছি। দুটো লোকেশনই পুরোনো ঢাকায় পড়েছে। ”

চনচনে গলায় বললল রেবেকা।

ঘরে উপযুক্ত মেয়ে রেবেকার। তাই আজিমপুর থেকেই সেকেন্ড হ্যান্ড কিছু ফার্নিচার আপডেট করতে হলো। একটু ভালো বাসায় উঠলো। নয়তো তাও করত না। সেই আদি আসবাবপত্র দিয়েই পোড়াজনম কাটিয়ে দিতো সে। কি করবে না কাটিয়ে। সে নিরুপায়। অসহায়।

তবুও রেবেকা এই মোড়াটি ফেলে দেয়না। এই মোড়ায় বসে অনেকদিন ঝগড়া করেছে সে স্বামীর সঙ্গে। ঝগড়া করার জন্য মনে খুব জোর পায় সে এই মোড়ায় বসলে। রেবেকার মুখ সারাক্ষণ ভার হয়ে থাকে। এখনো ভার। যেনো এই বাসায় এইমাত্র কয়েকটা বিরাট কোন গণ্ডগোল হয়ে গিয়েছে। তবে এর সঠিক কারণটা নুরুল হক,তার তিন মেয়ে অবগত। কিন্তু বাইরের মানুষ ত জানেনা। বুঝবেও না।
তাই গরম পুরিতে কামড় বসিয়ে নুরুল হক ধীর কন্ঠে বললেন,

“রেবেকা তুমি যে সারাক্ষণ এমন গোমড়া মুখ করে থাকো। কারণটা আমরা জানি। কিন্তু বাইরের কেউ দেখলে কি ভাববে? ভাববে এদের দাম্পত্যকলহ লেগেই থাকে হরদম। এতে কলির বিয়েতেও প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। ধরো পাশের বাসায়,বা নিচে কেয়ারটেকারের কাছে কেউ এলো। জিজ্ঞেস করলো, নুরুল হকের পত্নী কেমন? পাত্রপক্ষ পাত্রী খুঁজতে গেলে আগে পাত্রীর মায়ের স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে খোঁজ নেয়। কারণ মায়ের অনেককিছুই মেয়েরা ধারণ করে। নেগেটিভ পজেটিভ দুটোই।”

নুরুল হক আর কিছু বলতে পারলেন না। এমনিতেই অনেক বলে ফেলছেন। রেবেকা তার মুখে ঝামটি মেরে গজগজ সুরে বলল,

” কিইই? আমার স্বভাব, চরিত্র খারাপ?এই মেয়েরা কিছু বলিস না কেন?”

নুরুল হলো নিরীহ চাহনি ফেললেন দুই মেয়ের উপরে। তার চোখের ভাষা জুলি পড়ে ফেলল।
“কিছুই ত বলা যায়না তারে। চব্বিশ ঘন্টাই বোম হয়ে থাকে। ভালো কথা বললেও ফোটে উঠে।”

জুলি তার নুডলস, পুরি, চা খেয়ে শেষ করে ফেলল। একটু বুদ্ধি খাটালে কেমন হয় দেখি। সে আয়েসী ঢংয়ে বলল,
“আম্মু নাস্তাগুলো জোস হইছে। হেব্বি মজা লাগছে।”

কিসের ভিতর কি পান্তা ভাতে ঘি। রেবেকা দাঁত কিড়মিড়িয়ে জুলিকে নির্দেশ দিলো।
“উঠে গিয়ে সোজা পড়ার টেবিলে বসবি। একঘন্টার আগে উঠলে তোর পায়ের নলি খুলে ফেলবো আমি। নাস্তা খাওয়ার আছে। খাবি। এত মজা শুনতে চাইছি আমি? বদের হাড্ডি হইছিস।”

জুলি এক সেকেন্ড সময়ও আর মায়ের সামনে রইল না। উঠে চলে গেলো। কলির নাস্তা খাওয়াও শেষ। কন্ঠকে নিচু করে মমতার সুরে বলল,

“আম্মু তুমি খাবে না নাস্তা?”

“খেতেই ত এলাম। দিলো খেতে? দেখলি তো তার কথার ধরণ। আরো নরম করে সহজ করে বলা যেতনা? মেয়ে কি তার একার? আমার নয়? আমার দায় নেই মেয়ে নিয়ে? আমি বুঝি না কিছু? খাব না আমি।”

মাকে এখন কিছু বলায় বোকামি। কলি নাস্তার ট্রে নিয়ে কিচেনে রেখে দিলো। জুলির রুমে গেলো। বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে পড়লো। জুলি পড়া বন্ধ করে দিলো। বলল,

“আপা টম এণ্ড জেরি চলে আমাদের বাসায় প্রতিদিন একবার হলেও। তাইনা?”
“হুম।”

নুরুল হক দীর্ঘস্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। হ্যাংগার থেকে ঝুলানো শার্টটা গায়ে জড়িয়ে বের হয়ে গেলেন।

কলির মোবাইল বেজে উঠলো। সে দেখলো স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে মাহমুদ স্যার। স্যার কেন আবার ফোন দিলো। আজব। উনিতো অকারণে হুটহাট ফোন কখনোই দেয়নি। কলি রিসিভ করেই নিজের রুমে চলে এলো। সালাম দিলো মরা কন্ঠে।

“কলি সেমিস্টার ফাইনাল শেষ। এখন দু’চার দিন পড়াশোনার চাপ নেই। মা আবারও আপনার কথা বলল। কবে আসবেন বলেন? এজন্যই ফোন দিলাম।”

“রবিবার স্যার।” একব্যাকে জানিয়ে দিলো কলি। যেহেতু যেতেই হবে। রক্ষা নেই।

ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন রেখে দিলো মাহমুদ।

তার এই দিকটা কলির ভালোলাগে। প্রয়োজন শেষ করেই ফোন রেখে দিবে। সাহিত্যের স্যার হিসেবেও অতিরিক্ত একটি বাক্যও বলার চেষ্টা করে নি কখনো। কি সামনে কি মোবাইলে। খুবই পারসোনালিটিসম্পন্ন ও গাম্ভীর্যপূর্ণ মানুষ। পুরুষ মানুষের গর্ব ও আকর্ষণই তো এসব। শুধু টাকা থাকলেই চলে না। চ্যাঁছড়া ছেলে মেয়েদের কলি দুইচোখে দেখতে পারে না।

রবিবারে মাহমুদ ক্লাসে কলিকে দেখেই চমক খেলো। কলি যখন অন্যদিকে চায় তখন সে কলিকে দেখে। চোখ ফেরাবার উপায় নেই। আজ কলিকে বেশ সুন্দর লাগছে। সে যে আহামারি সেজেছে। তা কিন্তু নয়। অন্যদিন সে এত ছিমছামভাবে আসে। তার আসল রূপটাই লুকানো ছিল। কলির পরনে নতুন একটু পিংক কালারের সুতি ড্রেস। হাতে নতুন একটি ঘড়ি। যেটা আগে চোখে পড়েনি মাহমুদের। ঠোঁটে মেরুন কালারের হালকা লিপিষ্টিক। চোখে টানা কাজল। চোখ দুটো অসম্ভব মায়াবতী লাগছে। নজর কাড়ার মতো। কপালের মাঝখানে ছোট্র একটি কালো টিপ দেওয়া। কালো টিপে এমনিতেই মেয়েদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। আর গোলাপি রঙটাই মেয়েদের জন্য তৈরি হয়েছে। রূপ লাবণ্যে এনে দেয় স্নিগ্ধতা। শ্যাম্পু করা কৃষ্ণকায় সিল্কি কেশগুলো পিছনে পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে বাঁধা। মাহমুদ বুঝলো তাদের বাসায় যাবে বলেই এই পরিপাটি শৈল্পিক সাজ। ক্লাস শেষ করে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে যায় সে।

সে বাস স্টপেজের গলির মুখে বাইক নিয়ে অপেক্ষা করছে কলির জন্য। ভার্সিটির সামনে থেকে উঠলে দু’জনেরই সমস্যা হতে পারে। তাই সে কলিকে একটু আগেই ফোনে জানিয়েছে কোথায় থাকবে। কলি গিয়ে দাঁড়ালো মাহমুদের সামনে। মাহমুদ দেখলো কলি ওড়না গলায় এক প্যাঁচ দিয়ে মাথায় দিয়েছে। এখন আরো সুন্দর লাগছে। হৃদয় হরণ করা রূপে দাঁড়িয়ে আছে সদ্য কলি নামের যুবতী মেয়েটি।

মাহমুদের খুব ইচ্ছে করছে কলিকে সুন্দর লাগছে এটা বলার জন্য। কিন্তু ইচ্ছেকে মাটিচাপা দিতে হলো নিজের ব্যক্তিত্বের কাছে। এই কথা বলে সে যতটুকু আনন্দ পাবে। তার বিনিময়ে তার যতটুকু ব্যক্তিত্ব ক্ষুন্ন হবে। সেটা তার কাছে ইম্পর্ট্যান্ট।

মাহমুদ তাকে বলল,
“সাপোর্ট নিয়ে বসুন।”

“স্যার আমি বাসে আসি। ঠিকানা বলুন।আপনি চলে যান।”

মাহমুদের ভ্রুযুগল কুঞ্চিত হলো। বিরক্তও হলো। এই কথা শোনার জন্যতো সে এতক্ষন অপেক্ষা করেনি।

“বাইকে প্রবলেম?”

“স্যার পড়ে যাওয়ার জন্য ভয় করে।”

“আপনি বাসে করে আজ যেতে পারবেন না। আমার বাসা বকশীবাজার। দূর আছে৷ ঘেমে একাকার হয়ে যাবেন। বাইকে বসুন কলি। যেভাবে বসলে ভীতি থাকবে না মনে হবে। ঠিক সেভাবেই বসবেন কেবল নিজের সুবিধার জন্য। ব্যাস।”

কলি ম্লানমুখে মাহমুদের পিছনে বসলো। কিন্তু তাকে ধরল না। বাইকের সাপোর্ট নিয়েই বসলো সে। পুরো পথ দুজন কোন কথা বলল না। চুপচাপ রইলো। কলিকে নামিয়ে বাইকে তালা মেরে বাড়ির নিচে রাখলো মাহমুদ। লিফট দিয়ে ছয়তলায় চলে গেলো। লিফটের আয়নায় কলিকে মাহমুদ ভালো করে দেখে নিলো। আজ কেন জানি কলিকে পলকহীন চোখে দেখতে ভালোলাগছে তার কাছে।

কলিংবেলের আওয়াজ শুনেই বাতাসী এসে গেট খুলে দিলো। ভিতরে চলে গেলো ব্যস্ত পায়ে। মাহমুদ কলিকে ড্রয়িংরুমে বসতে বলল। সে মাকে সকালেই জানিয়েছে আজ কলিকে নিয়ে আসবে।

“কই মা, তোমার অভিমানীনিকে নিয়ে আসলাম ধরে।”

মাহফুজা বেগম ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে এলেন হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে। কলি বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। বিনয়ের সঙ্গে,
“আন্টি আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন আপনি?”

“আরেহ দাঁড়াতে হবে কেন মেয়ে? বসো বসো। আমি তোমার কড়া মাহমুদ স্যার নাকি?”

কলি মৃদু হাসলো। পরক্ষনে মাহফুজা ও কলি পাশাপাশি এক সোফায় বসলো।
বাতাসী তার নির্দেশমতে হালকা নাস্তা এনে দিলো কলিকে। পেঁপের জুস ও কেক। মাহফুজার অনুরোধে কলি সামান্য মুখে নিলো। মাথায় ওড়না দিয়ে কলি নম্রভাবে বসে আছে। মাহফুজা খুঁটে খুঁটে অনেক প্রশ্ন করলেন তার পরিবার ও গ্রাম সম্পর্কে। কলি একে একে নমনীয় স্বরে তার সব জিজ্ঞাসার জবাব দিলো। চোখেমুখে বিরক্তিভাব এলো না তার। কারণ তারও বেশ পছন্দ হয়েছে মাহফুজাকে। নিজের মা সারাক্ষণ চড়া মেজাজে কথা বলে বাসার সবার সঙ্গেই। এমন মধুর স্বরে শীতল গলায় যেন কথা বলতেই পারে না রেবেকা।

মাহমুদ নিজের রুমে চলে গেলো। ফ্রেস হয়ে বেছে নিয়ে একটি টিশার্ট ও নতুন টাউজার পরে নিলো। ড্রয়িংরুমে এসে বসলো মায়ের পাশে। মাহফুজা উঠে দাঁড়ালো। বলল,

“বেলা হয়ে গেলো। লাঞ্চ করে নে আগে। এই কলি মা আসো টেবিলে। একসঙ্গে খাবে।”

“আন্টি আমি খাবনা। বাসায় গিয়ে খাবো।”

মাহমুজা বিহ্বলিত স্বরে,

” ওমা! কি কথা এসব। বাসায় অতিথি এলে না খেয়ে চলে যায়? আসো বলছি। তোমার স্যার বাইকে করে তোমাকে পৌঁছে দিবে। লেট হবে না। আর বাসায় ত বলেই আসছ আজ আমাদের বাসায় আসবে। এত বিব্রত হও কেন খালি খালি?”

মাহফুজ নরম হেসে বলল,
“কলি আসেন।”

মাহফুজা গোপনে উল্লসিত! আপ্লুত! রান্নাঘরে গিয়ে বাতাসীকে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে,

“এই বাতাসী, তোর মাষ্টার সাবের সঙ্গে এই মেয়েটাকে মানাবে বউ হিসেবে?”

চলবে…১০

তোমার জন্য সব পর্ব-০৯

0

#তোমার_জন্য_সব (৯)
✍️ #রেহানা_পুতুল
কলি আবার বসে গেলো। মাহমুদ আফসোস করে বলল,
“চলে গেলো। আপনি দেখতে পেলে আমার বেশ উপকার হতো।”

কলি নির্বোধ চাহনি নিক্ষেপ করে মাহমুদ স্যারের দিকে চাইলো।

“না বোঝাইটাই শ্রেয়। যেহেতু আপনি দেখেন নি। জানতে ইচ্ছুক?”
বলল মাহমুদ।

“শুনি, কি দেখলেন অমন সিরিয়াস মুডে?”

মাহমুদ বলল। শুনে কলি অগ্রাহ্য সুরে বলল,

“এটা? তো এটা আমি দেখলে আপনার কি উপকার হতো? বুঝলাম না। বরং বুঝলাম এতে আপনার ক্ষতি হলো। মেন্টালি লস।”

খাবার চলে এলো দুজনের। মাহমুদ কলির প্রশ্নের জবাব দেওয়া থেকে রক্ষা পেলো বলে হাঁফ ছাড়লো। সাদাভাত,গরুর মাংস দুই প্লেট,দেশী শিং মাছের ঝোল,লালশাক ভাজি,কচু ভর্তা,কাঁচকলা ভর্তা,চিংড়ি ভর্তা, সালাদ, মুগমশারি মিশ্রিত পাতলা ডাল।

এতকিছু দেখে কলি বলল,
“স্যার এত মেন্যুর প্রয়োজন ছিল না একদম।”

“এই প্রথম আমার অভিমানীনি একজন ছাত্রীকে ট্রিট দিচ্ছি। এত না হলে যে আমার হৃদয় অশান্ত রয়ে যাবে।”

গাম্ভীর্যপূর্ণ কন্ঠে বলল মাহমুদ।
কলি চাপা হাসি হাসলো।

“আমার মা আপনার নাম দিয়েছে অভিমানীনি।”

“আন্টির সঙ্গে কথা বলে সেদিন আমার ভালো লাগলো। খুবই জলি মাইন্ডের উনি। আমার আম্মুতো খুব বোরিং।”

“আপনার আন্টি আপনাকে আমার সঙ্গে তার বাসায় যেতে বলেছে। সেদিন আপনি যে কলি, উনি বুঝতে পারেনি। নয়তো আপনাকে উনি ছাড়তো না। এটা আমার নয় উনার কথা।”

কলি প্রতিউত্তরে কিছু বলল না। দুজন খাওয়া শেষ করলো। ধোঁয়া উঠা কাপভর্তি দুধ চা এলো। কলি কয়েক চুমু খেয়েই বলল,

“গরমে এত গরম চা খাওয়া পসিবেল না।”

“আমি জুড়িয়ে দিই?”

“না না স্যার। কি বলছেন। চা বেশিও। শীত হলে আরো বেশি খাওয়া যেতো।”

“তাহলে শীত আসুক। বেশিই খাবেন।”

“হুম খাইতো বন্ধুরা মিলে।”

“আপনিতো কিছুই বলছেন না। তাই আমার ফেভারিট চা অর্ডার করলাম।”

মাহমুদ তার কাপের চা কম অর্ধেক খেয়ে নিলো। হুট করেই কলির কাপের সঙ্গে নিজের কাপ বদলে নিলো। কলি হকচকালো। ভ্রু কুঁচকালো।

“আপনার উপকার করলাম। কমটুকুই খান। যেহেতু গরম।”

“কিন্তু স্যার আমার খাওয়াটা…”

মাহমুদ বুঝতে দিলনা কিছু কলিকে। প্রসঙ্গ চেঞ্জ করে ফেলল।

“ওহ! যে জন্য ডেকেছিলাম। সেটা হলো একটু আগেই যেটা বললাম, আমার জননী আপনাকে বাসায় নিয়ে যেতে বলেছে। এবং সিরিয়াসলি। নট ফান। আরেকটা বিষয় হলো খেয়াকে নিয়ে।”

কলি মাহমুদের মুখের কথা কেড়ে নিলো। বলল,

“আন্টি যেহেতু বলছে। অবশ্যই আসবো স্যার। তবে অন্যদিন।”

“আচ্ছা কলি এটা বলুন। আপনিওতো সাহিত্যের স্টুডেন্ট। যদিও আমার মতই নিরস৷ টিচার স্টুডেন্ট রিলেশনকে আপনি কিভাবে দেখেন?”

কলি ধুম করে হেসে উঠলো। বলল,

“আমি এভাবে কখনো ভাবিনি স্যার। কিন্তু খেয়ার সঙ্গে আপনার বিয়ে ঠিক। সেখানে আপনি টিচার হলেই কি আর খেয়া ছাত্রী হলেই বা কি। যা ইচ্ছা করতে পারেন।”

রেস্টুরেন্টে লোক বেড়ে যাওয়াতে কলি ও মাহমুদ টেবিল ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো। বিল মিটিয়ে লিফট দিয়ে তিনতলা থেকে রাস্তার উপরে চলে এলো তারা দুজন।

মাহমুদ প্রসঙ্গ তুললো আবার।
“ধরেন বিয়ে ঠিক হয়নি। তখন?”

কলি উদাসী গলায় বলল,

“এটা আমি জানি না। আপনার জরুরী কথা এসব? ওহ নো! অবশ্য আপনার স্থানে হয়তো ঠিক আছে। আচ্ছা স্যার। গেলাম ভালো থাকবেন। ”

আলতো হেসে বলল কলি।

“কলি শুনুন,ছাত্রী হয়ে এই কাজটা করুন? ধরে নিন এটা আপনার টাস্ক একজন শিক্ষক হতে। আপনি এই প্রশ্নের উত্তর কিংবা মতামতটা জানালেই পরবর্তী আলাপে এডভান্স হতে পারি।”

কলি নেত্রপল্লব উল্টিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে স্যারের দিকে চাইলো।

“আপনি সময় নিয়ে ভেবে জানাবেন আমাকে। টিচার,স্টুডেন্টের রিলেশনকে আপনি কিভাবে দেখেন? যেকোন ধরনের টিচার হতে পারে সেটা।”

কলি শুকনো মাটিতে হোঁচট খাওয়ার মতো হতবিহ্বল হয়ে গেলো। তার বোধগম্য হচ্ছে না, এই প্রশ্নের আনসার মাহমুদ স্যার তার কাছ থেকে জানতে চায় কেন? আর এটা বলার জন্যই বা রেস্টুরেন্টে নিয়ে আসলো কেন? হয়তো সেদিন খাওয়াতে পারেনি বলে নিজের সঙ্গে নিজে জেদ ধরলো। সরাসরি এটা বললে যদি সে মাইন্ড করে তাই কথা ছিলো বলাটা বাহানা মাত্র। স্যার জেদী এটার তার মাও বলল। নিজেও দেখেছে। আবার বিষয়টা এটাও হতে পারে তাকে ইজি করা ছাত্রী হিসেবে।

কলি ভাবুকের মতো মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালো স্যারকে।
“থ্যাংক ইউ কলি। আমি অপেক্ষায় থাকবো।”

কলি ব্যস্ত নগরীর মানুষের যানজট ঠেলে বাসে উঠে পড়ে। চলে যায় বাসায়। রাতে ঘুমাতে গেলে ঘুরেফিরে মাহমুদের কথাগুলো মনে পড়ছে তার। চিন্তা করলো,

হঠাৎ স্যারের এত নমনীয়, সহনীয় আচরণ আমার সঙ্গে? সবই কি গিলটি ফিল থেকে? হয়তো। খাল্লি বাল্লি। খেয়াকে নিয়ে কোন প্রবলেম হয়তো।

মাহমুদ স্যারের বাকি কোর্সের পরিক্ষা আজ। সে টেবিলে গুরুগম্ভীরভাবে বসে আছে। লুকানো চোখে দেখছে খেয়া নকল করে যাচ্ছে নিঃসংকোচে,নির্ভয়ে। তার নকল উরুর উপর রাখা। হয়তো সেফটিপিন দিয়ে আটকিয়ে নিয়েছে। মাহমুদ আজও খেয়াকে কিছু বলল না। দাঁত কিড়মিড় করে নিজের রা*গ সংবরণ করলো। নকল ধরে ভরাক্লাসে অপমানও করল না তাকে। না দেখার ভান করে রইলো। পরিক্ষা শেষে সবাই খাতা দিয়ে বেরিয়ে গেলো। কলিও বেরিয়ে গেলো। খেয়া ইচ্ছে করে লাস্টে তার খাতা জমা দিলো। আবদার করে বলল,

“স্যার আজতো আমাদের পরিক্ষা শেষ। আপনার বাইকে করে চলুন না একটু ঘুরে আসি। এই বেশি দূরে না স্যার৷ যেমন উত্তরা দিয়া বাড়ি হতে পারে। তারপর লাঞ্চ করবো। ট্রিট আমার পক্ষ হতে। ”

“আমার মুড নেই খেয়া। আমি বোরিং পারসন। সো আমার থেকে এসব এক্সপেক্ট করা বোকামি হবে আপনার।”

“আমি কি করলে আপনার মুড অন হবে স্যার?”

“আমার মুড অনের দায়িত্ব আপনাকে দিতে চাই না।”

“তো কাকে দিতে চান?”

“আপাতত কাউকেই না।”

খেয়া ধুপধাপ পায়ে বেরিয়ে গেলো একরাশ মন খারাপ নিয়ে। কলির ফোন বেজে উঠলো,

“হ্যালো স্যার।”

“যাক নাম্বার সেভ করা আছে তাহলে। চলে যাচ্ছেন? ”

“হুম। বাসে স্যার।”

” আপনাকে একটা পার্সোনাল টাস্ক দিয়েছিলাম আমি। ”

“স্যার পরিক্ষার জন্য চিন্তা করার সময় পাইনি। সরি।”

“আজ রাতে ভেবে রাখবেন অবশ্যই। কাল ফোন দিব আমি।”

কলি এবার বিরক্ত হলো। মনে মনে বলল,
“আজব ত। মাহমুদ স্যারকে ত ভালো জানতাম। কিন্তু এখন উনার দু’একটা কথা কেমন যেন। খেয়াকে নিয়েই তা বেশ জানি। কিন্তু অন্য কোন মাধ্যম হতে জানলেই পারে। আমি কেন। সো ডিজগাস্টিং! সো বিরক্তিকর! হুহ! ”

কলি বাসায় গিয়ে নিজের মতো রইলো মাহমুদের বিষয়টাকে তেমন গ্রাহ্য করল না। পরক্ষণে মাহমুদ কল দিবে,মনে হতেই দায়সারাভাবে কিছুক্ষণ ভাবলো। ঘুমিয়ে গেলো রোজ রাতের মতো প্লে লিষ্টের ভারতীয় বাংলা গানগুলো শুনতে শুনতে। গান শুনতে কলির অদ্ভুত রকমের ভালোলাগে। যে গান তার হৃদয়ে হু হু করা বেদনা জাগাতে পারে,সেই গানই তার প্রিয় হয়ে উঠে। একটু আধটু গাইতে পারে না বলে কলির খুব আফসোস হয়।

কয়দিন পরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান তাদের ডিপার্টমেন্টের। নাচ,গান,আবৃত্তি সবই দেখা যাবে। নিদ্রায় দুচোখ বুঁজে আসে কলির।

পরেরদিন রাতে মাহমুদ কলিকে ফোন করলো। কুশলাদি বিনিময় করে রাশভারি কন্ঠে বলল,

“আমাকে আপনার কিছু জানানোর কথা। আপনি ত নিজ থেকে জানাবেন না। বলুন।”

কলি গাঁইগুঁই করল না। যত দ্রুত সম্ভব বিদাই নিতে পারলেই বাঁচে। শান্তস্বরে বলল,

“এটা নেগেটিভলি দেখার কিছুই নেই। বহু বছর আগে থেকেই টিচার, স্টুডেন্ট রিলেশন করে আসছে। আবার দেখা গেলো পারিবারিকভাবে প্রোপোজালের মাধ্যমেও বিয়ে হয়। তবে এখানে জড়তা কাটতে সময় লাগে যদি স্টুডেন্ট বেশি সংকোচমনা হয়।”

“আচ্ছা। থ্যাংকস কলি।”

মাহমুদ ফোন রেখে দিয়ে চিন্তায় ডুবে গেলো। মনে মনে বলল,

“তার মানে পারিবারিকভাবেও প্রস্তাব পাঠানো যায়। এটাতো মাথায়ই আসেনি। এগেইন থ্যাংকস কলি।”

কলি ফিচলে হাসলো। সচেতনভাবেই আওড়ালো,

ভবের মাঝারে আমরা সবাই পাগল! মেন্টাল! নয়তো মাহমুদ স্যারের মতো মুডি,ভারি মেজাজের,ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, গাম্ভীর্যপূর্ণ মানুষ কিভাবে এত হ্যাংলামো আচরণ করতে পারলো আমার সঙ্গে। হাউ ফানি! জানি খেয়াকে নিয়েই। তবুও। আমার থেকে কেন রে ভাই।

রাতে অনলাইনে গিয়ে খেয়া তার সেমিস্টার রেজাল্ট সিট দেখলো। মাহমুদ স্যারের দুটো কোর্সেই সে খারাপ করেছে। দুটোতেই এ মাইনাস। তার মাথা ভনভন করছে। ভাবলো কি আর হলো কি? এ দেখি হিতে বিপরীত। তার জিপিএ এত খারাপ আসলো। ইমপসিবল। মেনে নেয়া যাচ্ছে না।

পরেরদিন সে ভার্সিটি গিয়েই কিছু ক্লাসফ্রেন্ডকে জিজ্ঞেস করে তাদের রেজাল্ট জেনে নিলো। ঠিকই ত আছে। কলির আসতে আজ লেট হয়েছে ক্লাসে। তাকে দেখেই খেয়া বলল,

“এই কলি তোর রেজাল্ট দেখ। নেট আছে না তোর মোবাইলে?”

“হুম আছে। দেখছি।”

কলি ব্যাগ বেঞ্চের উপরে রাখলো। দাঁড়িয়েই চেক করে দেখলো তার রেজাল্ট। মাহমুদ স্যারের দুটো কোর্সে তার জিপিএ ফোর, আউট অফ ফোরের মধ্যে। সর্বোচ্চ মার্ক পেলো কলি। খেয়ার সারামুখে রাগ ও বিস্ময়ের চিহ্ন ফুটে উঠলো। মুখাকৃতি
থমথমে। দ্বিতীয় কোন উচ্চবাচ্য করল না কলির সঙ্গে।
মাহমুদ স্যার ক্লাসে এলেও খেয়া রেজাল্ট নিয়ে কথা তুলল না। মেঘমন্দ্র মুখে বসে রইলো। মাহমুদ স্যার বুঝতে পারলো। সে ক্লাস নিয়ে চলে গেলো। সব ক্লাস শেষ হয়ে গেলে মাহমুদের রুমে যায় খেয়া।

সালাম দিতেই তাকে মাহমুদ জিজ্ঞেস করলো,
” খেয়া কি বিষয়ে এলে বলো?”

“স্যার আমার রেজাল্ট এত খারাপ হলো কিভাবে? আমিতো এ প্লাস পাওয়ার কথা?”

ঘোর অনুযোগ করে বলল খেয়া।

“নকল করে এ প্লাস পাওয়ার কথা? সেটাতো আপনার মেধার প্রকাশ হলো না। কিভাবে এ প্লাস এক্সপেক্ট করেন আপনি? নকল করে আনসার দেয়া কাউকেই আমি নাম্বার দেইনা। নকল করে লিখা আর মুখস্থ থেকে লিখা আমরা টিচারেরা দেখলেই বুঝতে পারি।”

অসহিষ্ণু স্বরে বলল মাহমুদ।

” স্যার আমি কোন নকল করিনি। খাতায় লিখা থাকলে আপনি নাম্বার দিবেন না? কলি একমাসের মতো ক্লাস করেনি। তবুও হায়েস্ট নাম্বার পেলো স্যার? তার প্রতি আপনার সদয় আচরণ চোখে পড়ার মতো স্যার। আমার রেজাল্ট চেঞ্জ করে এ দিন অন্তত। প্লিইইজ স্যার! ”

আবদারের সুরে আহ্লাদী ঢংয়ে বলল খেয়া।

মাহমুদের বিরক্তি ও রা*গ বেড়ে গেলো খেয়ার উপর। টেবিলের উপর ডাস্টার দিয়া আঘাত করে গমগমে স্বরে বলল,

“আপনি এত মিথ্যাবাদী মেয়ে কেন? আমি দেখেছি দু’দিনই আপনি নকল করেছেন। মনে করেছেন আমি দেখিনি? টিচারের চোখ ফাঁকি দেওয়া এত সোজা? আর দেখলেও কিছুই করব না? দুই নাম্বার কাজের সঙ্গে মাহমুদ আপোষ করে না। জেনে রাখুন। যে যতটুকু মার্ক ডিজার্ভ করে সে ততটুকুই পেয়েছে। আর একটা কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি, সবসময় আমার সামনে ওড়না অসংলগ্ন অবস্থায় থাকে কেন আপনার? মেয়েদের ওড়নার কাজ কি? বুক ঢেকে রাখা। আর আপনিতো না পরার মতো করে রাখেন।”

পরের কথাগুলো কলি শুনতে পেলো। সে মাত্রই স্যারের রুমে প্রবেশ করলো। খেয়া আর এক সেকেন্ডও স্যারের সামনে থাকলো না। প্রচন্ড বেগে চোখমুখ রক্তিম করে বেরিয়ে গেলো গটগট পায়ে। কলির দিকে তাকালো ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে। কলির মন চাচ্ছে এই মুহূর্তে স্যারের সামনে থেকে লুকিয়ে যেতে। উফফস! শিট! স্যার মুখের উপর খেয়াকে এগুলো কি বলল? বলাটা ঠিকই। খেয়া মাহমুদ স্যারের সামনে কিভাবে দাঁড়ায় তা সবাই জানে,দেখে। রা*গী মানুষদের এই এক সমস্যা মাথা গরম হলে মুখের লাগাম থাকে না।

মাহমুদও দেখলো খেয়াকে বলা তার পরের কথাগুলো শুনতে পেলো কলি। নিজেই ইতস্ততবোধ করছে। কি করবে। তার মেজাজটাই চড়ায় উঠে গেলো খেয়ার সাহস দেখে ও কথাশুনে। কলি পা ঘুরিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলে পিছন হতে ডাক পড়লো।

” এই কলি শুনুন। এদিকে আসুন।”

চলবে…৯

তোমার জন্য সব পর্ব-০৮

0

#তোমার_জন্য_সব (৮)
✍️ #রেহানা_পুতুল
মাহমুদ ক্রোধান্বিত হয়ে উঠলো। চোয়াল শক্ত করেও শান্ত সুরে বলল,

“ঠিক আছে ভাবি। বুঝলাম খেয়ার প্রবলেমটা। আচ্ছা দেখি কি করা যায়। আপনি বাইরে গিয়ে খেয়াকে পাঠান। সমস্যা নেই। আগে কথা বলি খেয়ার সঙ্গে।”

তনিমা আশাবাদী মনে ক্যাফের বাইরে গিয়ে খেয়াকে পাঠালো। সে নিজে গেল না আর। খেয়া ভীরু ভীরু চিত্তে নববধূর মতো লজ্জাবনত মুখে মাহমুদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মাহমুদ খেয়ার সামনে উত্তেজিত হলনা। তিরিক্ষি মেজাজ দেখাল না। কিছু কিছু সময়ে কাউকে শায়েস্তা করতে হয় শান্ত থেকেই। চট করে তেতে গেলে নিজেরই ক্ষতির সম্ভাবনা প্রকট হয়ে উঠে।

“বসুন খেয়া।”

স্মিত হেসে স্বাভাবিক কন্ঠেই বলল মাহমুদ। সে খেয়ার আপাদমস্তকে নজর বুলিয়ে নিলো একবার। বাহ্যিক গড়নের দিক দিয়ে বিবেচনা করলে খেয়াও সুন্দর। পছন্দ করার মতো মেয়ে! কিন্তু সব সুন্দর সবাইকে টানেনা। এটাও নির্জলা সত্যি। কফি ও ফ্রেঞ্চফ্রাই অর্ডার দিলো মাহমুদ। খেয়া দিলো চিকেন ললিপপ মাহমুদের জন্য। খেয়া কিছু বলছে না। চুপচাপ খাচ্ছে। মাহমুদ খেতে খেতে খেয়াকে বলল,

“আপনার ভাবির মুখে ডিটেইলস শুনলাম। এক পাক্ষিক প্রণয়ে পূর্ণতা আসে খেয়া?”

“স্যার..”

খেয়াকে থামিয়ে দিলো মাহমুদ।

“নোওও। প্রশ্ন করেছি আমি।”

“স্যার সাধনায় কিনা হয়। আপনি যেভাবে বলবেন আমি সেভাবেই চলবো। নয়তো মরে যাবো আমি।”

নিচু মাথায় নিচু স্বরে বলল খেয়া।

“আপনার ভাবিকে আপনার ছদ্মনামের মাহি সাজিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলার কোন প্রয়োজন ছিলো কি?”

“স্যার আমিতো সেদিন ভার্সিটিতে আপনার কাছে গিয়েছিলাম এই কথাগুলো বলার জন্যই। কিন্তু আপনিতো বলার কোন স্কোপই দেননি আমাকে। না শুনেই বেরিয়ে গেলেন। তখন আমি বাসায় গিয়ে জানাই। আর ভাবিকে মাহি সাজাই। কারণ আপনি যদি আমার কন্ঠ শুনে,নাম শুনে রেগে যান। তাই লুকোচুরি করতে বাধ্য হয়েছি স্যার। প্লিজ ফরগিভ মি স্যার।”

“তো আমি যদি এখন রেগে যাই?”

“সেজন্যই ত ভাবিকে নিয়ে আসা আপনাকে বুঝানোর জন্য।”

অসহায় সুরে বলল খেয়া।

মাহমুদ বুঝল তনিমার কথা সত্যি নয়। খেয়া কিছুটা সাইকো কিংবা মনোব্যাধীতে ভুগছে, এটা মিথ্যা। যেটা চায় সেটা না পেলে নিজেকে আঘাত করে বসে। এটাও ভুল। সে থোড়াই কেয়ার করা টাইপ মেয়ে। তাইতো আকারে ইঙ্গিতে নিলজ্জের মতো বিয়ের কথা বলতে পারলো ছাত্রী হয়ে স্যারকে। কলি মরে গেলেও একথা বলতে পারবে না। এখানেই কলি ও খেয়ার পার্থক্য। কি বিপাকে পড়লো সে। চাকরিটাই ছেড়ে দেওয়ার উপক্রম। নাহ। বর্তমানে চাকরি পাওয়া সোনার হরিণ। এটা করা যাবে না। বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করতে হবে।

“মরতে চাইলেই মরা যায়না খেয়া। পৃথিবীটা অনেক সুন্দর। এখানে বেঁচে থাকতে পারাটাই সবচেয়ে আনন্দের বিষয়।”

“কিন্তু স্যার, যে যেভাবে বাঁচতে চায়,তার ব্যতিক্রম হলে লাইফটা দূর্বিষহ হয়ে উঠে।”

“তা অবশ্যই রাইট। আগে একাডেমিক লাইফ শেষ হোক। পরে বিয়ের কথা ভাবুন।”

“স্যার আমরা এখন না হয় বন্ধু হই। পরে অন্য রিলেশনে এগোবো? আপনাকে কোনভাবেই পাচ্ছিনা বলে বাসায় জানাতে বাধ্য হলাম।”

“সমস্যা নেই। ভালো করেছেন। শুনুন কি বলি, ভার্সিটিতে, ক্লাসে বেশি ক্লোজ হওয়ার চেষ্টা করবেন না। মিসেস হেড টের পেলে আমার জব চলে যেতে পারে। এত ভালো একটা মর্যাদার জব আমি হারাতে চাইনা। আপনি আগের মতই স্টুডেন্ট হিসেবে চলবেন।”

“স্যার তাহলে কি আমি আপনাকে ফ্রেন্ড ভাবতে পারি?”

“সিউর। তবে বন্ধুত্বের সংজ্ঞাটা ভালো করে জেনে নিবেন। এবার আসতে পারেন।”

খেয়া উঠে গিয়ে বিল দিয়ে দিলো। মাহমুদকে দেয়ার সুযোগই দিল না।
মাহমুদ বিদঘুটে মনে বাসায় গেলো। পরিবারের সবাইকে সব জানালো। এবং বলল,

“এবার বলো, এমন শেইমলেস টাইপের একটা মেয়েকে একমাত্র ছেলের বউ বানাবেন? নিজেই পছন্দ করলো আমাকে। নিজেই ভালোবাসলো। নিজেই পরিবার ম্যানেজ করে বিয়ের প্রপোজাল পাঠালো। আমার নূন্যতম রেসপন্সের তোয়াক্কা না করেই। একমাত্র মেয়ে বলে তারাও ধেই ধেই করে নেচে উঠলো মেয়ের কথায়। আশ্চর্য! চকচক করলেই সোনা হয়না।”

তার বাবা চড়া সুরে বললেন,

“আমি এক্ষুনি ফোন দিচ্ছি তার বাবাকে। ইয়ার্কি? ”

“বাবা, আপনার কিছুই করতে হবে না। আমি যেহেতু খোলাখুলি তার সঙ্গে কথা বলেছি। আমাকে হ্যাণ্ডেল করতে দিন।”

“ওকে। যা ভালো বুঝিস।”

তার মা বলল,
“তাহলে কথা বললি যে, কন্ঠ চিনিসনাই?”

“না মা। সে কথা বলেনি। তার ভাবি কথা বলেছে মাহি সেজে।”

“তবে আন্দাজে পরিবারকে ব্লেইম দেয়া ঠিক হবে না। মাহি রূপী খেয়া মেয়েটা হয়তো বাসায় বলেছে তুইও তাকে পছন্দ করিস। ব্যক্ত্বিত্বের জন্য প্রকাশ করতে পারছিস না তার কাছে। ”

“রাইট বলছো মা। মে বি। ”
সহমত জানিয়ে বলল মাহমুদ।

“আচ্ছা শোন,ওই কলি মেয়েটাকে একদিন বাসায় নিয়ে আয়না। একটু গল্প করবো। সেদিন ত চিনতে না পারায় ভালো করে গল্প হয়নি ওর সঙ্গে।”

মাহমুদের চওড়া কপালে ভাঁজ পড়লো। মুচকি হেসে বলল,

“কেন? ও ছাত্রী হয়ে স্যারের বাসায় আসবে নাকি?”

“কি এমন বুইড়া স্যার বুইড়া স্টুডেন্টরে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে স্টুডেন্টদের ফ্রেন্ডলি রিলেশন। আমার ছোটবোন, তোর খালা মারজিয়ার স্বামী তার হাউজ টিচার ছিলো। পরে প্রেম করে বিয়ে করলো। আর তুই একটা ছাত্রীকে বাসায় আনার মুরোদ নেই। ওরে আমাকে ফোনে ধরিয়ে দিস। আমার ফোনে ত নাম্বার এখন নেই।”

মাহমুদ মায়ের বাচ্চামোপানা দেখে অট্রহাসিতে ফেটে পড়লো। মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

” আই উইল ট্রাই মাই বেস্ট, মাই ডিয়ার মম।”

সেই রাতে মাহমুদ খেয়াকে নিয়ে চিন্তা করলো প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে শব্দ করেই বলল,

খেয়া, মিথ্যা,ছলনার আশ্রয় নিয়ে কেউ কখনো কারো মনে আসন গাঁড়তে পারে না৷ সফল হতে পারে না। প্রথমত তুমি ব্যক্তি হিসেবে ট্রিকি, দ্বিতীয়ত মিথ্যাবাদী, তৃতীয়ত নিলজ্জ্ব,বেহায়া একটা মেয়ে। অতএব তোমার ভরাডুবি দেখতে পাচ্ছি আমি। ফাইনালি যেটা করলে তুমি,তোমার ভাবিকে দিয়ে তোমাকে যে রূপে প্রেজেন্ট করলে আজ আমার কাছে,এটা খুব বাজে কাজ করে ফেলেছো। খুব বাজে। তুমি ভেবেছ কি? আমি ধরতে পারব না তোমার চালাকি,কৌশলগিরি। তুমি ধনীর দুলালি। এভাবেই আমাকে পেয়ে যাবে? যেভাবে কলিকে নাস্তানাবুদ করে সফল হয়েছো তোমার সেই ক্ষুদ্র ইচ্ছায়। কিন্তু একজন মানুষকে জয় করা এত সহজ? তাও মিথ্যা,চালাকি,শঠতা করে? ইমপসিবল।

আমি তোমার সঙ্গে ফ্রেন্ডলি চলব না। আবার আমি তোমাকে এটাও বুঝাব না যে,আমি তোমাকে ডিজলাইক করি। বিয়ে করব না। আমি তোমার সঙ্গে আগের মতই স্বাভাবিক আচরণ করবো। যেমনটি করি ক্লাসের অন্য সব স্টুডেন্টদের সঙ্গে। তবে এর কারণটা খুব গোপন থাকবে। খুব লুকানো থাকবে। জাস্ট আই হেইট ইউ খেয়া।

কয়েকদিন পর আজই প্রথম মাহমুদ ক্যাম্পাসে গেলো। সেমিস্টার ফাইনাল শুরু হলো বলে। নয়তো সে আজও আসত না ভার্সিটিতে। ক্লাসে হেঁটে হেঁটে সে পরিক্ষা নিচ্ছে। খেয়া তাকে দেখে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো। মাহমুদ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই তাকালো। খেয়া একটা গোপন সুখানুভূতি নিয়ে পরিক্ষা দিতে লাগলো। মাহমুদ খেয়ার সামনে গেল না ইচ্ছে করেই। কারণ ক্লাসের অনেকেই জানে খেয়া তাকে পছন্দ করে। খেয়া সেটা স্পষ্টতই বুঝিয়েছে সবাইকে। মাহমুদ কয়েকজনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। পরে কলির পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। কলি আড়চোখে তাকে দেখে নিলো। একবারও মুখ তুলে চাইল না মাহমুদের দিকে। আপন মনে হাত চালিয়ে লিখে যেতে লাগলো।

মাহমুদও তাকে কিছু বলল না। সামনে টেবিলে গিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসলো। ইউটিউবে খেলা দেখতে লাগলো সাইলেন্স করে। তবে সুক্ষ্ম দৃষ্টি রয়েছে স্টুডেন্টদের উপরে। স্যারের নিরবতায় পিছনে ফিসফাস শুরু হলো। এ ওর থেকে হেল্প চাচ্ছে। মাহমুদ সজোরে ডাস্টার দিয়ে টেবিলে আঘাত করলো ক্ষুব্ধ চাহনিতে। সবাই আবার চুপ হয়ে গেলো। মাহমুদ দেখলো খেয়া নকল করছে। খেয়ার ধারণাকে সত্যি করে দিয়ে মাহমুদ না দেখার ভান করে রইলো আজ। পরিক্ষার সময়সূচি শেষ হলে স্যার খাতা জমা দিতে আদেশ দিলো সবাইকে। সবাই গিয়ে স্যারের সামনে টেবিলে খাতা জমা দিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলো। খেয়া ও কলি সবার শেষে গেলো রিভিশন দিয়ে৷

কলি খাতা রাখতে গেলে মাহমুদ বলল,

“আপনি খাতা হাতে রাখুন। নিচ্ছি। খেয়ারটা আগে নিই।”

এতে খেয়া উৎফুল্ল হলো মনে মনে। বুঝলো স্যার তাকে পছন্দ করেছে বলেই তার খাতা আগে নিয়ে নিচ্ছে। খেয়াকে কষ্ট দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখছে। মাহমুদ তার খাতা নেড়েচেড়ে গম্ভীর স্বরে বলল,

“হুম পিলাফ করেছেন সব। ঠিকাছে খেয়া। আপনি আসুন।”

খেয়া চলে গেলো। কলি নম্রভাবে স্যারের সামনে নিজের খাতা রাখলো। মাহমুদ কলির খাতাও নেড়েচেড়ে দেখলো। দরজার বাইরে এক পলক দেখে নিলো। এবং কলিকে আস্তে করে বলল,

” আসলে টিচার হয়ে এভাবে বলতে সংকোচ হচ্ছে৷ না বলেও পারছি না। ইয়ে, কলি আপনার সঙ্গে আমার জরুরী কথা আছে। একটু সময় হবে কি?”

“হ্যাঁ স্যার বলেন?”

“এখানে ত প্রবলেম। বাইরে কোন রেস্টুরেন্টে আসুন।”

ভারি মুডে বলল মাহমুদ। কলি আজ আর আপত্তি করল না। বিনাবাক্যব্যয়ে রাজী হলো। এমনিতেই ছাত্রী হয়ে বেশি করে ফেলেছে। যথেষ্ট হয়েছে।

“কোন রেস্টুরেন্ট বলেন স্যার? আমি রিকশা নিয়ে যাচ্ছি।”

মাহমুদ খুশি হলো কলির উপর।

” ‘আয়োজন’ এ চলে আসুন। আমি বাইক নিয়ে চলে আসছি। চিনেন ত? এইতো পাশেই।”

“চিনি স্যার। আসছি।”

মাহমুদ, কলি রেস্টুরেন্টে বসলো। পাশাপাশি নয়। মুখোমুখি চেয়ারে। মেন্যুলিস্ট এগিয়ে দিয়ে মাহমুদ অনুরোধের ঢংয়ে বলল,

“লাঞ্চ করবো। অর্ডার দিন। সবই থাকে ওদের আয়োজনে।”

কলি দোনোমোনো শুরু করলো।
” স্যার আমি বাসায় গিয়ে লাঞ্চ করবো।”

“স্যারের ইচ্ছার অবমাননা করবেন?”

কলি মৌন রইলো। মাহমুদ নিজেই অর্ডার দিয়ে দিলো। কলি জিজ্ঞেস করলো,
“আপনার পা এখন সম্পূর্ণ ভালো হয়েছে স্যার?”

মাহমুদের মুখটা ভার হয়ে গেলো। একটা অব্যক্ত অভিমানের নীল প্রলেপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে তার সারা মুখজুড়ে। বিলম্ব না করেই বলে ফেলল,

“যদি বলি আমার এক্সিডেন্ট আপনার জন্যই হয়েছে। বিলিভ হবে?”

কলি নির্বাক হয়ে মাহমুদের দিকে তাকালো। মাহমুদও কলির চোখের দিকে চাইলো মুখের পাংশুটেভাব দূর করে করে। কলি দৃষ্টি আড়াল করার চেষ্টা করলো। এবং বিস্মিত ও ব্যথিত কন্ঠে বলল,

” আমার জন্য?”

“ওহ হো! আপনি অন্যভাবে নিবেন না। সেদিন আপনার না খেয়ে চলে যাওয়া,হার্ট করে কথা বলা একজন মানুষ ও টিচার হিসেবে নিতে পারিনি। এটা তখন আপনার স্থানে যে কেউ হলেও এমন হতো। ইভেন কোন ছেলে হলেও সেইম ঘটনা ঘটতো। ক্লিয়ার? বুঝাতে পেরেছি কলি।”

” তা না হয় বুঝলাম স্যার। কিন্তু এখন তো আমার জন্য হয়েছেন। ভীষণ কুন্ঠাবোধ হচ্ছে নিজের কাছে। এটা আমি কল্পনাই করতে পারিনি।”

অনুতপ্তর সুরে নিচু মাথায় বলল কলি। কলির গলা ধরে এলো। বলল,

” আপনার মিস বিহেভিয়ারের জন্য যতটা আঘাত আমি পেয়েছি। তারপর আমার চালচলনে আপনি যতটা মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন। ফাইনালি এতবড় এক্সিডেন্ট। সব মিলিয়ে এখন আমিই আপনার কাছে ঋণী হয়ে গেলাম। এ ঋণ শোধ করার এবিলিটি আমার নেই স্যার।”

মাহমুদ হতচকিত হয়ে গেলো। তার ভীষণ ইচ্ছে করছে কলির আঁখিকোণে জমে থাকা শিশিরবিন্দুর ন্যায় অশ্রুকণাটুকু আঙ্গুলের ডগা দিয়ে মুছে দিতে। কিন্তু এটা করা হয়তো অশোভনীয় হয়ে যাবে। ভেবেই হাত প্রসারিত করতে গিয়েও গুটিয়ে নিলো মাহমুদ।কলির ছলছল চোখের দিকে চেয়ে বলল,

“কলি এনি প্রবলেম? আপনার আঁখিতে অশ্রু টলমল করছে কেন?”

কলি দার্শনিকের মত করে বলল,

“কুঠার গাছকে আঘাত করে চলে যায়। কিন্তু গাছ ঠিকই মনে রাখে।”

“কলিইই..”

“হ্যাঁ স্যার। তবে এখন আপনার জন্যই খারাপ লাগছে। অতিরিক্ত টাকাওতো ব্যয় হয়ে গেলো আমার জন্য।”

“এভাবে নিজেকে দায়ী করবেন না। এটা হয়তো আমার জন্য বরাদ্দ ছিলো। আমি মরেও তো যেতে পারতাম।”

“এভাবে বলবেন না স্যার প্লিজ। আপনার জরুরী কথাগুলো?”

কলির কথার জবাব দিতে যাবে মাহমুদ। অমনি তার শানিত দৃষ্টি আকস্মিক আটকে গেলো রেস্টুরেন্টের কাঁচের দেয়াল ভেদ করে রাস্তার উপরে। দেখলো খেয়া একটি যুবক ছেলের মোটর বাইকের পিছনে উঠে বসলো দুই পা দুই পাশে দিয়ে। সে ছেলেটাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো খুশি খুশি মনে।

মাহমুদ অবাক চোখে দেখল আর ভাবল,
“খেয়ার ক্লোজলি বসার ভঙ্গিতে মনে হলো বয়ফ্রেন্ড। কিন্তু তাহলে তাকে যে বিয়ে করতে চায়,এটা কেন?”

“স্যার কি হয়েছে?”
বলে কলি চেয়ার থেকে উঠে ঘাড় ঝুঁকিয়ে বাইরে তাকালো। দেখলো ব্যতিক্রমী কিছুই না। রোজকার মতো সেই নানা বর্ণের,নানা শ্রেণির ও নানান বয়েসী মানুষের জটলা। সেই ইট, কাঠের যান্ত্রিকতা। সেই যানবাহনের বিষাক্ত কালো ধোঁয়া উড়িয়ে ঘেঁষাঘেঁষি করা ভীড়।

কলি আবার বসে গেলো। মাহমুদ আফসোস করে বলল,

“চলে গেলো। আপনি দেখতে পেলে আমার বেশ উপকার হতো।”

কলি নির্বোধ চাহনি নিক্ষেপ করে মাহমুদ স্যারের দিকে চাইলো।

চলবে…৮

তোমার জন্য সব পর্ব-০৭

0

#তোমার_জন্য_সব (৭)
✍️ #রেহানা_পুতুল
মাহমুদ স্তম্ভিত হয়ে কপাল ভাঁজ করে ফেলল। তার আহত মন ও শরীর আরো আহত হয়ে গেলো। দুমড়ে মুচড়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে সে ভিতরে।

“ওহ! মাত্রই জানলাম। আপনাকে উষ্ণ অভিনন্দন স্যার। শুভবিবাহ মোবারকবাদ।”

আন্তরিক হেসে সন্তুষ্টি চিত্তে বলল কলি।

“আমি তোমার কাছে অভিনন্দন চেয়েছি কলি? আজ হাসপাতালে আমি তোমার জন্যই। তোমার আচরণ নিতে পারিনি বলে বেখেয়ালি ছিলাম। ব্রেন ঠিকভাবে কাজ করছিল না। তবে এখন তুমি আসাতে ভালো লাগছে। থ্যাংকস কলি। তোমরা মেয়েরা আসলেই ডেঞ্জারাস! পুরুষকে মারতেও পারো। বাঁচাতেও পারো।”

মনে মনে বিষাদ ঢেলে কথাগুলো বলল মাহমুদ।

মাহফুজা ভেজা স্বরে কলিকে বলল,

“জানো মা, তোমাদের স্যার আর কোনদিনও এভাবে বাইক এক্সিডেন্ট করেনি। তার আঠারো বছর বয়স থেকে সে মোটর সাইকেল চালায়। ও খুব সাবধানী। যদিও আবার বেশ জেদীও বটে। কাল যে ওর কি হলো। আল্লাহ আমার দিকে চেয়ে ওরে বাঁচিয়ে রাখছে। দেখো পায়ে পাঁচটা সেলাই দিয়েছে। ছিলে গেলো পা টা। ভাগ্যিস মাথাটা রক্ষা পেয়েছে হেলমেট থাকার জন্য।”

কলি মাহফুজার হাত ধরে শান্তনা দিলো।
“আন্টি ভেঙ্গে পড়বেন না। আমার তো শুনেই অনেক খারাপ লাগলো স্যারের জন্য। তাইতো ক্লাস শেষ করেই ছুটে এলাম। আল্লাহ রহম করেছেন।”

মাহমুদ নিরবে কলির কথাগুলো শুনতে পেলো। তার অশান্ত হৃদয় উদ্বেলিত হয়ে উঠলো নিমিষেই।

কলির সঙ্গে আনুষকাও সামান্যক্ষণ কথা বলল পরিচিত হয়ে। তারপর কলি উঠে দাঁড়ালো। মাহমুদের বেডের খুব কাছে গেল না। দুই হাত দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ালো। হৃদ্যতাপূর্ণ কন্ঠে বলল,

“স্যার আমি আসি। আপনি কি খান না খান তাই কিছু আনতে পারিনি। সরি। সাবধানে পথ চলবেন। নিজের খেয়াল রাখবেন। আমি ফোন দিয়ে খবর নিবো।”

কলি তাদের সবাইকে সালাম দিয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো। মাহমুদ দু’চোখ বন্ধ করে ফেলল। আবারও মনে মনে বলল,

“তোমার কিছু আনতে হবে না কলি। তোমাকে যে রূপে দেখেছি এই কয়দিন। সেখানে তুমি আমাকে দেখতে এসেছ। সুন্দর করে কথা বলেছ। এটাই আমার জন্য বড় সারপ্রাইজড। এটাই আমার বড় প্রাপ্তি।”

কলি বাসায় চলে গেলো। মাহমুদের কথা বেশিক্ষণ মাথায় রাখল না ইচ্ছে করেই। সামনের সপ্তাহে সেমিস্টার ফাইনাল। তাই ফ্রেস হয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে পড়ার টেবিলে বসলো। হুট করে খেয়ার কথা মনে হলো তার। আপন মনে বলতে লাগল,

“খেয়া ফ্যাশনেবল। বড়লোকের মেয়ে।।মাঝে মাঝেই দেখতাম মাহমুদ স্যারের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলতো। আর সে যে মাহমুদ স্যারকে পছন্দ করে সেটা পরোক্ষভাবে তো বোঝালই। কিন্তু স্যারকে দেখে তো তেমন মনে হলো না। বিয়েটা কি পারিবারিকভাবে? নাকি স্যারের বন্ধুত্ব ছিল খেয়ার সঙ্গে। যেটা ক্লাসের কেউই বুঝতে পারেনি। ধূর জাহান্নামে যাক। কি ছাইঁপাশ ভাবছি নিজের পড়াশোনা রেখে।”.

কলি পড়ায় মনোনিবেশ করলো। তিনদিন হয়ে গেলো, মাহমুদ এখনো হাসপাতালে। সুস্থতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ফোনেও কথা বলতে পারছে। বাসার লোকজন আসা যাওয়ার মধ্যে আছে। সন্ধ্যার পর মাহমুদের ফোন বেজে উঠলো। কেবিনে কেউ নেই। তার মা পাশের কেবিনের একটা বাচ্চাকে দেখতে গিয়েছে। মাহফুজা বরাবরই মানবিক! নরম মনের। অচেনা মানুষের দুঃখ, বেদনাতেও নিজে জর্জরিত হয়ে যান। টিভিতে, পত্রিকায় অপঘাতে মৃত্যুর সংবাদ পেলেও কেঁদে বুক ভাসান। মাহমুদ মায়ের এসব কোমল স্বভাবগুলো তেমন পায়নি। পেয়েছে বাবার মতো। ভিতরে চুরমার হয়ে গেলেও উপর দিয়ে সহজে সেই, আবেগ,অনুভূতি প্রকাশ করেনা।

মাহমুদ নাম্বার চিনতে পারল না। রিসিভ করে ম্যাড়ম্যাড়ে স্বরে হ্যালো বলল।

“স্যার আসসালামু আলাইকুম। আমি কলি বলছি। কেমন আছেন স্যার?”

মাহমুদ আপ্লুত হয়ে গেলো কলির কন্ঠ শুনে। কিন্তু কলিকে তা বুঝতে দিল না৷ মনে মনে আওড়ে নিলো,

“দূর্ঘটনা থেকে দেখি ভালো কিছুর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। অন্তত কলি এবার স্বাভাবিকভাবে কথা বলবে অন্য সবার মতো।”

“স্যার চুপ হয়ে আছেন? আচ্ছা সরি। রাখি তাহলে। আপনার হয়তো খারাপ লাগছে কথা বলতে। একচুয়েলি আপনার নাম্বার ছাড়া আর কারো নাম্বার আমার কাছে নেই। তাই আপনাকেই কল দিতে হলো।”

মাহমুদ কলিকে ক্লান্ত গলায় ডেকে উঠলো।
“কলি রাখবেন না। আমি ঠিক আছি। কেমন আছেন? এ নাম্বার কার?”

“আলহামদুলিল্লাহ। আপনি এখন কেমন আছেন স্যার? এটা আমার আম্মুর নাম্বার। আপনার হোয়াটসঅ্যাপে ট্রাই করলাম। পেলাম না। পরে বুঝলাম। আপনি অসুস্থ। নেট ইউজ না করাটাই যুক্তিসঙ্গত। আপনার শারীরিক কন্ডিশন এখন কেমন স্যার?”

“শারিরীক কন্ডিশন ভালোর দিকে কলি। মানসিক কন্ডিশন ভালো না।”

“এটা স্বাভাবিক স্যার। একদিকে সামনে আমাদের পরিক্ষা। আরেকদিকে আপনার বিয়ে। সবমিলিয়ে চাপে আছেন আপনি। ”

মাহমুদ ক্রোধে নিজের হাত মুঠি করে নিলো। বলল,

“আপনার ধারণা ভুল কলি। এমন কিছুই না।”

কলি আলতো হাসলো মুঠোফোনের ওপ্রান্তে। হেয়ালি সুরে বলল,

“আচ্ছা বাদ দেন স্যার। সহজেতো মনে হয় ভার্সিটি আসতে পারবেন না। তাইনা স্যার?”

“এই ভিতরে আসা যাবে না। তবে আশাকরি আপনাদের এক্সামের সময় আসতে পারবো। ধন্যবাদ কলি ফোন দিয়ে আমার খবর নেওয়ার জন্য।”

কলি বিদায় নিলো। মাহমুদ দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বলল,

আপনি একটা চিজ কলি। যতই আপনাকে দেখছি। অবাক হচ্ছি। আমার নিজের অজান্তেই আপনি আমার মনের বাগিচায় বিচরণ করতে শুরু করেছেন মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায়। যতই আমি প্রসঙ্গ তোলার চেষ্টা করি কাছাকাছি হওয়ার জন্য। ততই আপনি দূরত্বের বেড়ি দিয়ে দেন। ভেবেছিলাম পালটা জানতে চাইবেন, কেন মানসিকভাবে ভালো নেই আমি। তা না করে হেসে উড়িয়ে দিলেন। সেদিনও একই কাজ করলেন।
প্রথমত’র বিষয়টা ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেলাম। যেন আপনার মাঝে কৌতুহলবোধ কাজ করে। মানুষ স্বভাবতই কৌতুহল প্রিয়। উৎসুক। কিন্তু আপনি যেন মনোযোগের সাথেই সেটা স্কিপ করে গেলেন। একবারও জানতে চাইলেন না প্রথমত কি? স্ট্রেঞ্জ কলি! আমিও টিচার হওয়ার দরুণ এরবেশি এডভান্স হতে পারছি না। উফফস! মাহমুদ সযতনে কলির মায়ের নাম্বারটা সেইভ করে নিলো মোবাইলে। হয়তো কাজে লাগতেও পারে।

মাহমুদ রিলিজ হয়ে বাসায় চলে গেলো। তার অসুস্থতার জন্য ছোট বোন আনুশকাও তাদের বাসায় রয়েছে। ড্রয়িংরুমে সবাই বসে নাস্তা করছে। টিভিতে খবর চলছে। মাহফুজা ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন,

“কিরে তোর সেই অভিমানী ছাত্রী তোকে একবারও দেখতে এলনা?”

“এলোতো মা। খেয়া ও রিমি যেদিন আসলো। তারপর যে মেয়েটা এলো সেইতো কলি। আবার গত পরশু ফোন করেও খবর নিলো।”

মাহফুজা বলল,
“আলহামদুলিল্লাহ! তোর সঙ্গে ইজি হচ্ছে হয়তো। আমি নামটা জিজ্ঞেস করতে ভুলেই গেলাম। তাই বুঝতে পারিনি সেইই কলি। এমন জানলে তারসঙ্গে আরো সময় গল্প করতাম। খুব ভালোলাগছে কলিকে আমার। কি আটপৌরে জীবন যাপন। কি পরিপাটি বসার ধরন। পোষাকে কি শালীনতা। ব্যবহারে কি মার্ধুযতা। কি স্নিগ্ধ! কি লাবন্যময়ী চেহারা!”

আনুশকা বলল,

“হ্যাঁ আমিতো জানি। সেই মেয়েটাই কলি। নাম জিজ্ঞেস করলাম আর বলল, কলি।কিন্তু ভাইয়ার অভিমানীনি কলি মানে?এই ভাইয়া কাহিনী কি বলো না?”

গলায় উৎসুক ভাব এনে জানতে চাইলো মাহমুদের ছোটবোন আনুশকা।

মাহমুদ বোনকে নেত্রপল্লব তুলে ইশারায় বলল,

“এখন বাবা আছে। পরে বলবে সব।”

আবদুর রহমান এতক্ষন অন্যমনস্ক ছিলেন। তাই কলির কথা শুনতে পাননি। মাহমুদ তার বাবাকে জিজ্ঞেস করলো,

“বাবা জরুরী কথা। আপনি যে পাত্রীর নাম্বার আমাকে দিলেন, সেই মেয়েতো ধানমণ্ডি পড়ে। নাম মাহি। তবে বাড়ির লোকেশন ঠিক আছে। কিন্তু সেদিন বললেন খেয়া। বুঝলাম না।”

আবদুর রহমান চকিতে চাইলো ছেলের দিকে। উদ্বিগ্ন গলায় বলল,

“কি বলিস। মাহি? ধানমন্ডি পড়ে? আমার ত নাম মনে নেই। কোথায় পড়ে তাও মনে নেই। তবে এই মেয়েটাকেই তো দেখলাম। আমাকে পা ছুঁয়ে সালাম দিলো। তার বাবাই ডেকে দেখালো। তুই ভালো করে খবর নিসতো।”

“আচ্ছা আমি খবর নিচ্ছি সহসাই। বিয়ের মতো মহৎ বিষয় নিয়ে ফাজলামো!”

বিরক্তিকর কন্ঠে বলল মাহমুদ।

তার মা বলল,
“কি ভূতুড়ে কাণ্ড! অন্য মেয়ে ফোন দিবে কেন তোকে? খেয়া মেয়েটা যথেষ্ট ভালো। সুন্দর। আমার পছন্দ হয়েছে।”

“ভাবি হিসেবে আমারও খেয়াকে বেশ ভালোলেগেছে। মিশুক! চটপটে! বন্ধুবৎসল! হাসিখুশি! প্রাণোচ্ছল! এমন মেয়েরাও ভালো মনের হয়। মনে যা আসে মুখে তা বলে দেয়। কোন ভণিতা করে না।”

মাহমুদ ঝিম মেরে মা বোনের কথা হজম করে গেলো বনজি ঔষধীর মতো।

আবদুর রহমান চলে গেলে মাহমুদ ছোটবোনকে সব জানালো। এবং সেদিন এক্সিডেন্ট হয়েছে কলি মেয়েটার জন্যই তাও জানালো মা,বোনকে। তারা দুজন আতংকিত চোখে তার দিকে চাইলো। তার মা বড় বড় চোখে জিজ্ঞেস করলো,

“কি বলিস? কিভাবে?”

মাহমুদ সেদিনের কাহিনি বলল। শুনে তারা দুজন বলল,

“এখানে কলি মেয়েটা কারণ। কিন্তু সে দায়ী নয়। দায়ী তুমি নিজেই। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছ। ইগোতে লেগেছে বেশ। সে তার স্থানে রাইট। বড্ড অভিমানীনি। ”

মাহমুদ থ বনে গেলো মা বোনের পক্ষপাতীত্ব কথায়। আহাম্মকের মতো চেয়ে রইলো তাদের দিকে। তাদের কথায় তার অশান্ত হৃদয়টা লায় পেয়ে গেলো। অজান্তেই কলির প্রতি একটা অদৃশ্য টান অনুভব করলো সে।

ডুবে গেলো কল্পনায়। পথ চলায় কাকে,কখন,কিভাবে ভালোলেগে যাবে,তা পূর্ব থেকে জগতের কোন মহামানবও বলতে পারবে না। ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে নিঃশব্দ রাত্রির মতো নিরালায় চুপটি করে বসে থাকা কলি নামের মেয়েটিকে তার ভালোলাগছে কেন? তার কথা সময় অসময়ে মনে পড়ে কেন?
উত্তর খুঁজে নেয় মাহমুদ নিজেই। হয়তো কলির প্রখর ব্যক্তিত্ব, প্রবল আত্মসম্মানবোধ,সংযমীভাব, নমনীয় আচরণ, দূরত্ব বজায় রেখে চলা, সরল, শালীন সাজসজ্জা ইত্যাদি। এসবের জন্যই সে একটা শক্ত আসন গেঁড়ে বসেছে মাহমুদে হৃদয়ে। নাগালের বাইরের জিনিসকে কাছে পাওয়ার দূর্বার আকর্ষণ মানুষের সেই আদিকাল হতেই।

আনুশকার ডাকে ঘোর কাটে মাহমুদের। মাহমুদ সুস্থ হলে একটা ফন্দী আঁটলো মনে মনে। সরাসরি মিট করে নিশ্চিত হতে হবে খেয়ার সঙ্গে।

তারপর মাহির সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করলো মেসেজ দিয়ে। মাহিও রাজী হলো। এবং প্লেস জানিয়ে দিলো মাহমুদকে। যথাসময়ে মাহমুদ সেখানে চলে গেলো। কফিশপে বসে অপেক্ষা করছে। দেখলো তার সামনে এসে বসলো শাড়ি পরিহিত অচেনা একটি মেয়ে। সুন্দর!

হাই,হ্যালো পর্ব সেরেই মাহমুদ সহাস্য হেসে জিজ্ঞেস করলো,

“আপনি মাহি?”

“জ্বি না। আমি তনিমা। মাহির ভাবি। মাহি ভয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।”

“কেন? পাত্রী পাত্রকে দেখবে না?”

তনিমা নিরিহ ঢংয়ে আকুতিমাখা সুরে মাহমুদকে বিস্তারিত বলল। এবং খেয়া মাহমুদের সঙ্গে মিলিয়ে নিজের ছদ্মনাম মাহি রাখলো। তাও জানালো।

মাহমুদ ক্রোধান্বিত হয়ে উঠলো। চোয়াল শক্ত করেও শান্ত সুরে বলল,

“ঠিকাছে ভাবি। বুঝলাম খেয়ার প্রবলেমটা। আচ্ছা দেখি কি করা যায়। আপনি বাইরে গিয়ে খেয়াকে পাঠান। সমস্যা নেই। আগে কথা বলি খেয়ার সঙ্গে।”

চলবে…
#Romantic #shortstory #shortstorywriter #rপুতুল #romanticsuspense #lovestory #loveshortstoryputul #writer #writing #genre #samajik #Rehana #putul

তোমার জন্য সব পর্ব-০৬

0

#তোমার_জন্য_সব (৬)
✍️ #রেহানা_পুতুল
ধন্যবাদ স্যার। আপনার ছায়া থেকে,দৃষ্টি থেকে, আমি দূরে থাকতে ইচ্ছুক।”
কাঠ কাঠ গলায় বলল কলি।

কলির ভাবভঙ্গি ও কথায় মাহমুদের মাঝে বিস্ময়ের সীমা রইল না। কলির প্রতি এবার রা*গ হলো না তার। বরং চুম্বকের মতো আকর্ষণ অনুভব করলো। এই হৃদয় ভাঙ্গচুর করা অনুভব তার জীবনে এই প্রথম। সে ধ্যানমগ্ন ঋষির ন্যায় কলির মুখপানে ঠায় চেয়ে রইলো শীতল চাহনিতে।

মাহমুদ প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করতে পারলো,কলির কথায় অভিমান,ক্ষোভ, বিরক্ত, উপচে উপচে পড়ছে। একটু কৌশলের আশ্রয় নিলো সে।

“ছাত্রী হয়ে শিক্ষকের কথার মর্যাদা দিবেন না? আপনাকেত আমি অনুগত,বাধ্য ছাত্রী মনে করতাম।”

কলি কোন প্রতিউত্তর খুঁজে পেল না। সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো। মাহমুদ তাকে নিয়ে একটি ফাস্টফুডে প্রবেশ করলো। পিছনে গিয়ে কর্ণারের টেবিলটায় বসলো। একজন ওয়েটার গিয়ে মেন্যুলিস্ট দিলো। কলির ভারি অস্বস্তি লাগছে। সে টেবিলের উপর মাথা উপুড় করে রাখলো খানিকক্ষণ।

“কলি আমি একটু কিছু বলতে চাই আপনাকে।”

কলি মাথা তুলে নিলো। নিরস ভঙ্গিতে বলল,
“শুনছি স্যার।”

কলির সামনে মেন্যু লিস্ট এগিয়ে দিয়ে বলল মাহমুদ,
” সেটা বলছি। কি খাবেন। যা ইচ্ছে অর্ডার করুন।”

“কিছুই না স্যার।”

“কলি কিছু অর্ডার ত দিতে হবে।”

“আপনি দিয়ে আপনি খান না স্যার। তাদের দরকার বিলের। একজন খেলো না দুজন খেলো সেটা বিষয় না তাদের কাছে।”

“আপনি কি এটা বুঝতে পারছেন,যে অতিরঞ্জিত করে ফেলছেন আমার সঙ্গে? বলুন কি খাবেন।”

হালকা মেজাজে বলল মাহমুদ।

” আমি নয়। আপনিই অতিরিক্ত করছেন স্যার”
থমথমে সুরে বলল কলি।

মাহমুদ হতভম্ব হয়ে গেলো কলির নির্দয় আচরণে। মনে অসম্ভব রকমের আঘাত পেলো।
” বেশ খেতে চাচ্ছেন না যেহেতু ফোর্স করব না। যেটা বলতে চাই তা হলো, আপনি আমার ছায়াও মাড়াবেন না।’ আমার বলা এই কথাটা আমি চূড়ান্তভাবে তুলে নিলাম চিরদিনের জন্য। আপনি এনিটাইম আমার ছায়া ভালোভাবেই মাড়াতে পারবেন। আর খুব সরি আমার মিস বিহেভিয়ারের জন্য। প্লিজ অভিমান পুষে রাখবেন না।”

” স্যার আমি ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চের একজন সাধারণ স্টুডেন্ট। আমার অভিমান,কষ্টে আপনার এত দায় কেন?”

ভারি মুডে জানতে চাইলো কলি।
মাহমুদ তপ্ত স্বাস ছাড়লো। বলল,

” প্রথমতটা বাকি থাকুক আপাতত। দ্বিতীয়ত,
একজন ছাত্রী আমার উপর বিরক্ত। এটা একজন শিক্ষকের জন্য ভালো কথা নয়। তৃতীয়ত,আমার মা আদেশ করেছে আপনাকে সরি বলতে। মায়ের কথার গুরুত্ব আমার কাছে অপরিসীম। আবারও সরি বলছি কলি।”

কলি এবার বিব্রত হলো স্যারের নমনীয় আচরণে। মার্জিত গলায় বলল,

“প্লিজ স্যার এভাবে বলবেন না। আচ্ছা বুঝলাম। স্যার উঠি? আমার বাস ধরতে হবে।”

“না। আরেকটু। মোটরসাইকেল বনানী টু লালবাগ। রোড ফ্রি থাকলে এই বড়জোর ত্রিশ মিনিট।”

“স্যার আমি বাইকে যাব না। আমার পড়ে যাওয়ার ভীতি আছে।”

“যেভাবে বসলে ভীতি থাকবে না। সেভাবে বসবেন। বাইকে না চড়লে ভেবে নিব আপনি এখনো ক্রুদ্ধ আমার উপরে।”

কলি উঠে গিয়ে নিচে রাস্তার উপরে চলে এলো। মাহমুদ ওয়েটারদের হাতে কিছু সম্মানী দিয়ে ত্রস্ত পায়ে নিচে নেমে এলো।

“কলি আমি পৌঁছে দিতে চাই। নয়তো বুঝে নিবো আপনি স্বাভাবিক হন নি আমার উপর।”

একদিকে লেট। রাস্তায় জ্যাম। আরেকদিকে মাহমুদের চাওয়া। কলির মানা করার জো নেই। তবুও কলি বিনীতভাবে প্রত্যাখ্যান করলো মাহমুদের প্রস্তাব।

“স্যার আপনি যা ইচ্ছা ভাবতে পারেন। কিন্তু এটা আমার পক্ষে অসম্ভব।”

বাস এলে কলি উঠে যায়। মাহমুদের চোখ আরক্ত হয়ে উঠলো। বাইকে চড়ে জোরে স্টার্ট দিলো। ভাবতে লাগলো কলির কথা। ফাস্টফুডে নিয়েও একটা মেয়েকে খাওয়াতে পারল না। বারবার বলেও বাইকে চড়াতে পারল না। কলির ব্যক্তিত্ব এতটাই প্রখর, ভাঙ্গবে তবু মচকাবে না। অথচ অন্যকোন মেয়ে হলে বলার সঙ্গে সঙ্গেই লুফে নিতো। বুকের বাঁ পাশটা চিনচিন ব্যথা করে উঠলো মাহমুদের। বিক্ষুব্ধ মেজাজে বাইক দ্রুত গতিতে চলে যাচ্ছে। মাহমুদ কলিকে নিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে আছে। সে নিতে পারছে না কলির অপমানগুলো।

হঠাৎ একটা প্রাইভেট কারের ধাক্কায় মাহমুদ ছিটকে পড়ে যায় রাস্তার একপাশে। এক দুজন করে মানুষের জটলা লেগে যায়। পুলিশ এগিয়ে আসে। নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিক্যালে। এবং তার বাইক পুলিশের হেফাজতে নিয়ে নিলো। মোবাইলের ডায়াল নাম্বার চেক করে বাসায় ফোন দিলো। পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে তার পরিবারের সবাই ছুটে এলো।

কলি বাসায় গিয়েই হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নিলো। ক্ষুধাটা বেশ চনমনিয়ে উঠেছে পেটের ভিতর। কলির বোন মিলি এলো বাসায়।
“কিরে আপা কখন এলি।”

“এইতো বিকেলেই। তোর লেট হলো কেন?”

“ঝড়,তুফান,বাসের জন্য ওয়েট। এইতো।”

“ওরে আমার ছুলুবুলুটা। আমার মামপাখিটা। দেখিতো।”

মিলির তিন বছরের মেয়ে সুহিকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে বলল কলি। জুলি লাফিয়ে লাফিয়ে এলো তাদের সামনে।
বলল,
“বড় আপা তোর জন্য একটা সাদীর প্রস্তাব আনছে। মোবাইলে ছবি দেখ। মন্দ না বেটা। হিরো হিরো ভাব আছে।”

কলি হোঁচট খেলো।
“আপা সত্যিই। কে? কই ছবি?”

রেবেকা এসেই চনচন করে উঠলো। জুলিকে ধমকে উঠলো।

“পেটে কিছুই হজম হয়না তার। বদ হজমের সিরাপ খাস তুই? পাজী মেয়ে। সব কথা এভাবে বলতে হয়?”

“আম্মু থাক না। বলছে কি হয়েছে? সমস্যা নেই।”
বলল কলি।

“এই মিলি তুই ভালো করে বল কলিকে।”

জুলি তার রুমের বারান্দায় চলে গেলো। একটু মন খারাপ হলে বা মা বকা দিলেই সে বারান্দার কোণে গিয়ে চুপটি করে দাঁড়ায়। সেখানে তার একটি ছোট্ট টিয়া পাখি আছে। পাখি পুষতে তার ভীষণ শখ। খাঁচার ভিতরেই থাকে বন টিয়া পাখিটি। বিভিন্ন উপায়ে কিছু টাকা জমিয়েছিলো সে। পরে দুলাভাইকে নিয়ে নিজেই কাঁটাবন গিয়েছে। তখন অবশ্য তার আর টাকা লাগেনি। মিলির জামাই ছোটশালিকে খাঁচাসহ এই বন টিয়া পাখিটি কিনে উপহার দিয়েছিলো। বহু সাধনা করে টিয়াকে তাদের নামগুলো বলা শিখিয়েছে জুলি। স্বাগতম, শুভসকাল,শুভ দুপুর,শুভ বিকেল শিখিয়েছে। জুলির অফুরন্ত আনন্দ হয়,যখন টিয়া নাকি নাকি সুরে জুলি, কলি,মিলি বলে ডাকে।

কলিকে, মিলি পাত্রের কথা বলল। তার চাচাচো দেবর হয় সম্পর্কে। কলি মুখের উপর মানা করে দিলো। বলল,

“রিলেটিভের ভিতরে বউ হওয়ার ইচ্ছে নেই আপা। আগ্রহ আসেনা আমার।”

তার মা রেবেকা হই হই করে উঠলেন কপাল চাপড়ে। এমনিতেই রেবেকার মেজাজ রাতদিন তেতে থাকে সংসারে ঘানি টানতে হিমশিম খেতে হয় বলে। তার মধ্যে মেয়েদের এত নকশা,খুঁত ধরা তার সহ্য হয়না। সে মিলি ও কলির সামনে এসে বলল,

“এই পর্যন্ত কতগুলো বিয়ের ভালো ভালো প্রস্তাব আসলো। উনার এটার হলে সেটা হয়না। সেটা হলে ওটা মিলেনা। খালি অমিলই খুঁজে পায়। তার জন্য পাত্র অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নিতে হবে। এইখানে খারাপ কিরে মেয়ে। জানাশুনা ছেলে। পরিচিত। আজকাল ভালো ছেলে পাওয়াই ত মুশকিল। প্রায় সবগুলো ছেলের চরিত্রে দোষ পাওয়া যায়। হয় ডিভোর্স হওয়া,নয় দুই তিনটা প্রেম করেছে,কেউ আবার বিপত্নীক। হাহ!”

“আহা আম্মু হইছে। চুপ করো।” বলল মিলি।

রেবেকার মুখ আর থামে না। গজগজ করতে করতে চলে গেলো।

কলি স্থির হয়ে আছে। মিলি বড় সন্তান বলে বাবা,মায়ের জন্য তার ভালোবাসা,টান সবচেয়ে বেশি। কেননা জীবনের টানাপোড়েনে তাদের হা-হুতাশ দেখেছে খুব কাছ থেকে ছোটবেলা থেকেই।

সে বোনকে শান্তনা দিয়ে বলল,

“থাক বোন। আম্মুর উপর মন খারাপ করিস না। দেখ, আমাদের আম্মু,আব্বুর অল্প আয় দিয়ে কত কষ্ট করে সংসার টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমাকে বিয়ে দিয়ে দিলো। কেন? অর্থাভাবের জন্যই ত। একটা ভাই নেই আমাদের। যে বড় হয়ে চাকরি করবে। কোন ভরসায় তিনটা মেয়েকে ধরে রাখবে? বল?
গ্রামে হলে হাঁস মুরগী, সবজি গাছ,পুকুরের মাছ,ক্ষেতের ধান,গাছের নারকেল,সুপারি গাছ থেকেও আয় বের করা যায়। একটা মধ্যবিত্ত সংসারে গ্রামে এসব ভালো সাপোর্ট দেয়। যেটা শহরে একদম নেই। আগে আম্মু আমাদের সবার ড্রেস সেলাই করতো। এখন কোমর আর মাথা ব্যথার জন্য সেটাও পারে না। ছুটা বুয়া এসে একবেলা কাজ করে দিয়ে যায়। আর সারাদিন সব কাজ আম্মুরই করতে হয়। তুই যা পড়াশোনা ও টিউশনির ফাঁকে আম্মুকে টুকটাক হেল্প করিস কাজে। জুলিত তাও করে না। একটু পড়াশোনা, মোবাইলে গেম,টিকটিক, ও তার টিয়া পাখি নিয়েই পড়ে থাকে। ”

কলির চোখ ভিজে উঠলো। অভিমানী সুরে বলল,

” তাই বলে আমার মন না টানলেও হ্যাঁ বলতে হবে? কারো গলায় ঝুলে পড়বো বাঁদরের মতো? আমার খরচ অনেকটা আমি কাবার দিই আপা। তিনটা মেয়েকে পড়াই তাদের বাসায় গিয়ে গিয়ে। নিজের ব্যক্তিগত খরচ,মোবাইলে রিচার্জ,ভার্সিটির বেতন,জুতা,ব্যাগ,জামাকাপড় সবই আমার টিউশনির টাকা থেকে চলে। জুলিকে দিই কিছু মাঝে মাঝে। অনার্স শেষ হলেই জবে ঢুকে যাবো। এখন চাইলে পারব না। পড়ার ব্যাঘাত ঘটবে। আমিতো অবিরাম চেষ্টায় আছি সংসারের হাল ধরার।”

“তা আমি বেশ জানি কলি। তুই আদর্শ বাবা মায়ের আদর্শ মেয়ে হয়েছিস।”

নুরুল হক এলেন কলির রুমে। কিছু বললেন না । সারা অবয়ব জুড়ে এক অসহায় ব্যর্থ পিতার নিদারুণ চিহ্ন। দুই মেয়ের মাথায় পিতৃস্নেহের পরশ বুলিয়ে ফের চলে গেলেন নিজের রুমে। ভারি স্বাস ছেড়ে বিছানার অবসাদগ্রস্ত শরীরের ভার ছেড়ে দিলেন।

বাসায় বিয়ে নিয়ে বিক্ষিপ্ত কথাবার্তা হওয়ার দরুন মিলির অন্যকিছু আর মাথায় এলোনা। মাহমুদ স্যারের কথাও মনে হলো না। সে পরেরদিন ভার্সিটিতে গেলো। ক্লাস টিচার ক্লাস শেষ করে বললেন,

“মাহমুদ স্যারের দুইটা ক্লাস অন্য স্যার এসে নিবে। তিনি আপাতত আসতে পারবেন না। গতকাল বিকেলে বাসায় যাওয়ার সময় বাইক এক্সিডেন্ট করেছে।”

হঠাৎ এমন খবরে পুরো ক্লাসে পিনপতন নিরবতা নেমে এলো। সবাই স্যারের খোঁজখবর নেওয়া শুরু করলো। খেয়ার চোখ ছলছল করে উঠলো। সে জিজ্ঞেস করলো,

“স্যার কিভাবে জানলেন?”

“মাহমুদ স্যারের ছোট বোন ফোন করে সকালে হেড প্রধানকে অবগত করেছে।”

“স্যার কোন হসপিটালে মাহমুদ স্যার?আমাদের দেখতে যাওয় উচিত না?”

দুঃখী দুঃখী গলায় জিজ্ঞেস করলো রিমি।

“অবশ্যই উচিত। আমরা সব টিচাররাও এক সঙ্গে যাবো। মিসেস নাজমা ম্যাডামও যাবেন।”

“স্যার আপনি এড্রেস লিখে দেন। যার যার ইচ্ছে হয় স্যারকে দেখতে যাবে।”
বলল রিফাত।

তিনি বোর্ডে হাসপাতাল, ডিপার্টমেন্ট ও কেবিন নাম্বার লিখে দিলেন।
সেদিন বিকেলে বাংলা বিভাগের সব স্যার,ম্যাডামরা মাহমুদ স্যারকে দেখতে গেলেন। স্টুডেন্টরা যে যার মতো গেলো দেখতে। খেয়া ও রিমি ঠিক করেছে তার পরেরদিন যাবে।

কলি এতক্ষণ পিছনে বসে সব শুনেছে। মানবিকবোধ থেকে তারও খুব খারাপ লাগছে স্যারের জন্য। সেও বোর্ড থেকে হাসপাতালের এড্রেস লিখে নিলো খাতার এককোনে।

কলি বাসায় গিয়ে রাতে মাহমুদ স্যারের কথা বলতেই তার বাবা,মা গিয়ে দেখে আসতে বলল। কলি ঠিক করলো পরের দিন ক্লাস শেষ করেই ডাকা মেডিক্যাল যাবে। তারপর বাসায় ফিরবে।

বিকেল পাঁচটা। কলি হাসপাতালে গেলো। তিনতলায় গিয়ে সরাসরি কেবিনে প্রবেশ করলো। শুরুতেই চোখে পড়লো মাঝবয়েসী দুজন নর নারীকে। পাশে বসা একটি মেয়েও রয়েছে। তার সিনিয়র হবে। কলি তাদেরকে সালাম দিলো।

“কে তুমি?”

মাহমুদের বাবা বলল।

মাহফুজা বলল,
“কে আর হবে। তার ছাত্রী হবে। কতজন যে এলো দেখতে। বসো মা।”

কলি দেখতে পেলো মাহমুদ বেডে শোয়া। খেয়া ও রিমি তার পাশে দাঁড়িয়ে। খেয়া বিষাদগ্রস্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। খেয়া বলল,

“আরেহ কলি তুইও এলি। ভালোই হলো।”

“তোরা কখন এলি?”

কলি জিজ্ঞেস করলো।

“আমরাতো গাড়ি নিয়ে এসেছি। আরো আগেই। তুই বাসে এলি?”

“হুম।”

কলি বিনম্রভাবে বসে আছে বাকি বেডের একপাশে। মাহমুদ কলিকে দেখলো। কিন্তু কথা বলল না। কারো সঙ্গেই সে কথা বলেনি। কথা বলা নিষেধ। এবং পারছেও না। কিছুক্ষন স্যারকে দেখে খেয়া,রিমি চলে গেলো।

কলি বলল,
“তোরা চলে যাচ্ছিস?”

“হ্যা কলি। তুই থাক। আমরা দুজন ত আরো আগেই আসছি। আর কেবিনে একসঙ্গে বেশিমানুষ দেখলে নার্স এসে ঝাড়বে।”

“এটা রাইট খেয়া।”
বলল মাহমুদের ছোটবোন আনুশকা।

খেয়া তাগিদ দিয়ে আনুশকাকে মনে করিয়ে দিলো,
“আপু স্যারকে হরলেক্স ও ফ্রুটসগুলো খাওয়াবেন।”

কলি খালি হাতে গেলো বলে ইতস্ততবোধ করতে লাগলো।
তারা দুজন চলে গেলে আবদুর রহমান বিস্মিত কন্ঠে ছেলেকে বললেন,

“এই মাহমুদ, খেয়া মেয়েটা যে কতকিছু নিয়ে আসলো, ও তোর স্টুডেন্ট?”

“মাহমুদ মুখ নেড়ে ইশারায় বোঝাল ‘হ্যাঁ’। ”

“ওহ! মাশাল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ! এবার বুঝলাম কেন সে এতোকিছু নিয়ে আসলো তোরজন্য। এত কেয়ার করলো। এর সঙ্গেইতো তোর বিয়ে ঠিক করেছি আমি। এই মেয়েই তোর পাত্রী।”

আন্দোলিত কন্ঠে বলল আবদুর রহমান।

মাহমুদ স্তম্ভিত হয়ে কপাল ভাঁজ করে ফেলল। তার আহত মন ও শরীর আরো আহত হয়ে গেলো। দুমড়ে মুচড়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে সে ভিতরে।

“ওহ। মাত্রই জানলাম। আপনাকে উষ্ণ অভিনন্দন স্যার। শুভবিবাহ মোবারকবাদ।”

আন্তরিক হেসে সন্তুষ্টি চিত্তে বলল কলি।

চলবে…,
#Romantic #shortstory #shortstorywriter #rপুতুল #romanticsuspense #lovestory #loveshortstoryputul #writer #writing #genre #samajik #Rehana #putul

তোমার জন্য সব পর্ব-০৫

0

#তোমার_জন্য_সব (৫)
✍️ #রেহানা_পুতুল
মাহমুদ বিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইলো বাবা মায়ের মুখপানে।
মাহফুজা বললেন,

“কিরে কোন সমস্যা? মুখ অমন করছিস কেন?”

“সমস্যা নয়? আমি কিছুই জানিনা। আর বাবা পাত্রী ঠিক করে ফেলল?”

আবদুর রহমান একটু নড়ে চড়ে বসলেন চেয়ারে। মাহফুজা ছেলের পাশে গিয়ে খাটের উপর বসলেন দুই পা তুলে। ছেলেকে একটু স্বাভাবিক করতে বললেন,

“বাবা চা খাবি? বানাতে বলব?”

“হ্যাঁ বলো। মাথা ধরেছে। ”

“এই বাতাসী শুনে যা। এদিকে আয়।”

গলা হাঁকিয়ে ডাক দিলো আবদুর রহমান।
বাতাসী তড়িতেই এলো।

” খালুজান বলেন?”

“আমি না। তোর খালাম্মা কি বলে শোন।”

“বাতাসী কড়া করে মসলা চা বানিয়ে নিয়ে আয় তিন কাপ। দারুচিনি,লবঙ্গ,এলাচ,তেজপাতা,লবণ দিবি। ফ্রিজে ডিপ থেকে আদা নিয়ে ছেঁচে দিস।”

“আইচ্ছা খালাম্মা।”

মাহমুদ বলল,

“আশ্চর্য মা। প্রতিদিন চা বানানোর জন্য তুমি ওকে সেইম কথাগুলো বলো। কেন? ওর মনে থাকে না? ”

“ও ভুলে যায়। বাদ দে।”

“না কেন বাদ দিবো? এই বাতাসী দাঁড়া।”

বাতাসী বুঝলো মাহমুদ রেগে আছে। দাঁড়ালো নম্রভাবে।

“মা কি কি বলছে বল?”

বাতাসী ঠিক ঠিক সব বলতে পারলো।

“কিরে পারলি তো। পরে ভুলে যাস কেন? আজকের পর মা যেন আর তোকে কি কি দিবি বলতে না হয়। যা কিচেনে গিয়ে পড়ার মতো করে সবগুলো মসলার নাম মুখস্থ করে নিবি। আমি যেকোনো সময় জিজ্ঞেস করবো।”

বাতাসী রান্নাঘরে গিয়ে চা বসিয়ে দিলো। বিড়বিড়িয়ে উচ্চারণ করলো,

মাষ্টার সাব ঠিকই জানতে চাইবো। ভুইলা যাইব না। বলতে না পারলে মোর চাকরি ঝুইলা যাইবো।

বাতাসী অনবরত ছড়ার মতো টেনে টেনে বলতে লাগলো,

“রঙ চা বানাইতে নুন লাগে/আরো লাগে তেজপাতা।
খাইতে বড় স্বাদ লাগে/ দিলে একটু কুচি আদা।

দু’চারখান দারুচিনি লাগে/ গোটা কয়েক এলাচ।
দিতে পারলে চা হবে /এক্কেবারে ফাস কেলাস।

থাকলে লেবুর রসও লাগে/ আরো লাগে লং।
এক কাপ চায়ের লাইগা সবার/ দিলে কত ঢং।”

মাহমুদ তার বাবাকে বলল,

“বাবা ডিটেইলস বলো।”

তার বাবা পাত্রীর আদ্যোপান্ত শুনালো ছেলেকে। মাহমুদেরও মোটামুটি পছন্দ হলো শুনে। বলল,

“পাত্রীর নাম কি? কিসে পড়ে?”

“অনার্সে পড়ে। কোন ভার্সিটি জানিনা। নাম বলল কি জানি। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।”

“এখন আমাকে কি করতে হবে?”

“তোর বাবা ও আমি চাই তুই একবার মেয়েটির সঙ্গে বাইরে কোথাও নিরিবিলি দেখা করে আলাপ করে নে। মেন্টালিটি ম্যাচ হওয়াটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ”
বলল মাহফুজা।

“আমার যদি পছন্দ না হয়? আর কন্টাক করবো কিভাবে?”

“না হলে নাই। তবে পছন্দ হওয়ার মতই মেয়ে। মাশাল্লাহ। আমি মেয়ের নাম্বার এনেছি তার বাবার থেকে।”

“ঠিকাছে বাবা। তাদের বাড়ির এড্রেস দাও। আমি সময় করে আগে খোঁজখবর নিবো আমার মতো করে। এত তাড়ারতো কিছু নেই। ফোনে একবার কথা বলে দেখি ভালোলাগে কিনা? আনুশকা জানে?”

“নাহ। বলিনি। তোর পছন্দ হলে তবেই জানাবো তাকে।”

বাতাসী ট্রেতে করে চা এনে দিলো। সবাই চা খেয়ে প্রশংসা করলো তার। সে সলাজ হেসে চলে গেলো। আবদুর রহমান টেবিলের উপরে থাকা একটি নোটবুকের মধ্যে পাত্রীদের বাড়ির ঠিকানা লিখে দিলো। মোবাইল দেখে পাত্রীর মোবাইল নাম্বারও লিখে দিলো। পাত্রীর বড় ভাইয়ের ভিজিটিং কার্ড টেবিলে রাখলো। মাহমুদের থেকে বিদায় নিয়ে তার বাবা,মা নিজেদের বেডরুমে চলে এলো।

মাহফুজা যেতে যেতে বলল,

“মাথা ঠান্ডা রেখে সময় নিয়ে ভাবিস কিন্তু।”

মাহমুদের মাথায় বিয়ে নিয়ে কোন ভাবনাই ছিলো না। কিন্তু মাঝে মাঝেই তার মা,বাবা বিয়ের প্রসঙ্গ নিয়ে আসে। তারা তাদের মতো করে সুপাত্রীর সন্ধান করে যাচ্ছে গত একবছর ধরেই। একমাত্র ছোটবোন আনুশকার বিয়ে হয়ে গেলো গত বছরেই। তার পর হতেই তারা ছেলের বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। কিন্তু মনমতো পাত্রী মিলছেই না। এটা হলে ওটা হয়না। কেবলই মিসম্যাচ হয়। মাহমুদ টেবিল থেকে পাত্রীর ঠিকানা, মোবাইল নাম্বার,ভিজিটিং কার্ডটি ভালো করে দেখে রেখে দিলো পূর্বের স্থানে।

কলি রাত জেগে জেগে এসাইনমেন্ট লিখছে। হাত ব্যথা করছে একটানা লিখতে। বারবার হাত ঝেড়ে নিচ্ছে আর খেয়া,রিমি,মাহমুদ স্যারকে ঝাড়ছে ইচ্ছেমতো। জুলি হঠাৎ চড়ুই পাখির মতো ফুরুৎ করে কলির রুমে ঢুকলো। কলি ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। ভ্রু কুঁচকালো। বলল,

“কিরে ঘুমাসনি?”

“নাহ। ভিডিও বানাই। আপা টিকটক করবি আমার সঙ্গে? তোকে অনেকেই দেখতে চেয়েছে সেখানে? টিকটকে চেহারা ফাটাফাটি আসে। তোরেও হেব্বি লাগবে।”

“আম্মুকে বলব গিয়ে? ফাজিল কোথাকার। যা বলছি।”

জুলি দু-হাত তুলে মোনাজাতের ভঙ্গি করে বলল,

“হে খোদা। আমার নিরামিষ আপার কপালে একটা নিরামিষ জামাই জুটায়া দিয়েন। নয়তো সেই বেচারার লাইফটাই বরবাদ হো গায়া। আমারে দিয়েন আমিষ জামাই। খালি সিনেমা আর বায়োস্কোপ দেখবো। ”

কলি চোখ কটমট করে তাকাতেই জুলি নিজের রুমে চলে গেলো। জুলি আর কলি একসঙ্গেই ঘুমাতো আগে। তাদের বড় বোন মিলির বিয়ে হয়ে যাওয়ায় জুলি সেই রুম নিজের করে নিলো। তার নাকি প্রাইভেসি দরকার। সে বড় হয়ে গিয়েছে। বেড শেয়ার করে ঘুমাতে তার সমস্যা হয়। মূলত সে দরজা বন্ধ করে ক্যামেরা অন করে নেচে গেয়ে ভিডিও বানায়। দোষ তার নয়। বয়সের। উড়াউড়ি, দুরন্তপনা,পাগলামি করাই কিশোরী বয়সের কাজ। তবে কলি তার বিপরীত। সে বরাবরই চুপচাপ নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করে। পানসে জীবনে সে অভ্যস্ত।

মাহমুদ পরের দিন তার বাবার পছন্দ করা পাত্রীর বাড়ি দেখতে গেলো। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দূর থেকে দেখে নিলো। তারও বেশ ভালো লাগলো। সুন্দর চারতলা বাড়ি মোহাম্মদপুরে। তাহলে এবার পাত্রীকে ফোন দেয়া যায়। সে অবসর হয়ে ফোন দিলো। পাত্রী সালাম দিয়ে সুন্দর করেই কথা বলছে। নাম বলল মাহি। পড়ে ধানমন্ডির একটি ভার্সিটিতে। মাহমুদ দেখা করার কথা বলল। মেয়েটি রাজী হলো। মাহমুদ বলল,

” ঠিকাছে মাহি। আপনার সুবিধামতে লোকেশন ও টাইম আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করে দিবেন।”

মাহি তার দুইদিন পর মেসেজ করে বলল,

“ভাইয়া আমি একটু ঝামেলায় আছি। দু’চারদিন পর আমরা মিট করিই?”

মাহমুদ রিপ্লাই দিলো।
“ঠিক আছে। সমস্যা নেই।”

“এভাবে সৌজন্যতার খাতিরে টুকটাক মেসেজে কথা হচ্ছে মাহি ও মাহমুদের।”

কলি একে একে সব স্যারের এসাইনমেন্ট জমা দিয়ে দিলো। মাহমুদ স্যারের একটা বাকি রয়ে গেলো এখনো। তারটা জমা দিতে হলো সবার শেষে। মাহমুদ ক্লাসে গেলে কলি জমা দিয়ে নিচু স্বরে বলল,

“স্যার খুব সরি। সরি ফর লেট।”

মাহমুদ কিছুই বলল না প্রতিউত্তরে। কলি নিজের বেঞ্চে গিয়ে বসল। সে বরাবরই পিছনে বসতে পছন্দ করে। মাহমুদ অফিসে বসে কলির এসাইনমেন্ট দেখছে। খেয়া প্রবেশ করলো রুমে।

সালাম দিলো মাহমুদকে। বলল,

“স্যার আপনার সঙ্গে আমার একটু কথা ছিলো। ভাবলাম ইমেইল বা মেসেজ দিবো। কিন্তু চিন্তা করলাম একবার ঝামেলা হয়ে গেলো। এভাবে আর না দেই।”

“ঝামেলা ত আপনাদের হয়নি। যা হওয়ার কলির ও আমার হয়েছে। সে সাফারার হয়েছে আমার আচরণের জন্য। ভুল বুঝলো আমাকে। এখন ত সে আমার ছায়া থেকেও দূরে থাকতে চায়।”

“এতে কি আপনার গিল্টি ফিল হচ্ছে স্যার?”

” একজন সুস্থ বিবেকবোধসম্পন্ন হওয়া মানুষ হিসেবে গিলটি ফিল হওয়াটা উচিত নয় কি?”

“তা অবশ্য রাইট স্যার।”

“কি যেন বলবেন আপনি? ”

“কিভাবে যে বলি স্যার? আচ্ছা স্যার ব্যক্তিগতভাবে আমি কি কখনো আপনার সঙ্গে অযাচিত ভুল আচরণ করেছি?”

“নাতো? হঠাৎ এমন কথার কারণ? ”

জানতে চাইলো মাহমুদ।

“স্যার সদ্য ঘটে যাওয়া বিচ্ছিন্ন ঘটনার পর হতে মনে হলো আপনি আমার উপরে ফেডাপ হয়ে আছেন। এগেইন সরি স্যার। এক্সট্রেমলি সরি স্যার।”

“ইটস ওকে খেয়া।”

“স্যার একটা আবদার ছিলো। ”

“বলে ফেলুন।”

“স্যার আমি আপনাকে ট্রিট দিতে চাই। এই ধরেন লাঞ্চ করা।”

“এটা কেন খেয়া?”
ভ্রুকুটি করে বলল মাহমুদ স্যার।

“এমনিই স্যার। কোন কারণ নেই।”

“পৃথিবীতে কারণ ছাড়া কিছুই ঘটেনা। সেটা অতি ক্ষুদ্র বিষয় হলেও।”

“স্যার…”
আহ্লাদী সুরে ডেকে উঠলো খেয়া।

“কারণ বলুন। তবে বিবেচনা করে দেখব।”

“কারণ বললে যদি আপনি উল্টো রিয়েকশন করে বসেন?”

মাহমুদ উঠে দাঁড়ালো। তীক্ষ্ণ মেজাজে খেয়াকে বলল,

“যেহেতু আপনি বুঝতে পারছেন এমন সম্ভাবনা আছে। তাহলে না বলা বেটার হবে আপনার জন্য। ”

মাহমুদ তার অফিস রুম হতে বেরিয়ে গেলো। খেয়া হতাশ নয়নে মাহমুদের চলে যাওয়া দেখলো। পা ঘুরিয়ে নিজেও চলে গেলো।

গ্রীষ্মের আকাশে মেঘের ঘনঘটা। থেকে থেকে গর্জন করে উঠছে। বৈশাখী ঝড় নামবে এখুনি। বলতে না বলতে শুরু হয়ে গেলো তার উম্মাতাল নৃত্য। ক্লাসের সবাই চলে গিয়েছে। খেয়াদের নিজেদের গাড়ি। রিমিকে নিয়ে সেও চলে গেলো। কলি কোনভাবে বাসস্টপেজে গিয়ে রাস্তার পাড়ে উঠে দাঁড়ালো। সে আজ ছাতা আনেনি। ছাতা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সময় হচ্ছেনা বলে ছাতা সারাই করতে বিলম্ব হচ্ছে।

মাহমুদ আগে থেকেই সেখানে ছিলো। বাইক থামিয়ে মায়ের জন্য মেডিসিন কিনতে লাগল। অমনি বৃষ্টি শুরু হলো। গতি মন্থর হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলো। তখনই সে
কলিকে দেখতে পেলো পাড়ের শেষ প্রান্ত হতে। ঝড়ো হাওয়ায় কলির ওড়না বিক্ষিপ্তভাবে উড়াউড়ি করছে। কলি বারবার ওড়না সামলে নিচ্ছে। বৃষ্টির ছাঁটে মাহমুদের চোখের চশমার ফ্রেম ঘোলাটে হয়ে এলো। খুলে নিয়ে টিস্যু দিয়ে পানি মুছে আবার চোখে দিলো। এবার ভালো করে দেখলো কলিকে। কলি তাকে দেখেনি। ডাকলেও শুনবেনা।

মাহমুদ হেঁটে গিয়ে কলির পিঠ বরাবর পিছনে দাঁড়ালো। তার ছাতাটা কলির মাথায় উপরে ধরলো। কলি শুরুতে দেখতে পায়নি তাকে। মাথার উপরে কারো ছাতার আভাস পেয়েই চকিতে চাইলো পিছনে। হতবুদ্ধির মত দৃষ্টি তাক করলো স্যারের দিকে। নিমিষেই সরে গেলো।

“আহ! কলি ভিজে যাচ্ছেন।”

মাহমুদ দুপা এগিয়ে গিয়ে ফের কলিকে ছাতার ভিতরে নিয়ে নিলো।
বলল,
“বাসের জন্য অপেক্ষা? ”

“হুম স্যার।”

মাহমুদ খেয়াল করলো কলি নিজ থেকে কোন কথা বলছে না তারসঙ্গে। যেমন,
স্যার আপনি কেন এখানে? কিংবা আপনিও কি বাসের জন্য ওয়েট করছেন? এই জাতীয় প্রশ্ন।

“বাস ত আসছেনা। ঝড়,তুফানের মাঝে কতক্ষণ অপেক্ষা করবেন কলি?”

“সমস্যা নেই স্যার। বিকল্প ওয়ে নেই আমার কাছে। বাসা দূরে।”

“তাহলে সিনজিতে যান।”

কলি ইতস্তত বোধ করলো। বলতে পারল না,আমি মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। টানাপোড়েনের মাঝে বড় হয়েছি।

“না স্যার। আমি ঠিক আছি। আপনি আসতে পারেন।”

“বাসা কোথায় আপনার?”

“পুরান ঢাকা। লালবাগ।”

“কলি আমি বাইকে আসা যাওয়া করি। আসুন পৌঁছে দিই।” আন্তরিক স্বরে বলল মাহমুদ।

কলি অবাক চোখে চাইলো মাহমুদের দিকে।
মাহমুদ চাপা হাসি দিয়ে বলল,

“আচ্ছা আমার সঙ্গে যেতে হবে না। কিন্তু কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন। তারচেয়ে বরং উপরে আসুন। ফাস্টফুডের কিছু শপ আছে এখানে। অবিশ্রান্ত বৃষ্টি কমুক। তবেই যাবেন।”

“ধন্যবাদ স্যার। আপনার ছায়া থেকে,দৃষ্টি থেকে, আমি দূরে থাকতে ইচ্ছুক।”

কাঠ কাঠ গলায় বলল কলি।

চলবে..

তোমার জন্য সব পর্ব-০৪

0

#তোমার_জন্য_সব (৪)
✍️ #রেহানা_পুতুল
আমান স্যার রসিকতা করে বলল,

“হয়তো। নারী রহস্যময়ী। বোঝা মুশকিল। এদের অনেক আজগুবি ব্যাপার স্যাপার থাকে।”

সবাই নিজ নিজ ক্লাসে চলে গেলো চা পান করে। মাহমুদ স্যার ক্লাশ শেষে খেয়া,রিমি ও কলিকে গম্ভীর স্বরে বলল,

“আপনারা তিনজন আমার রুমে আসবেন। জরুরী প্রয়োজন।”

ওরা ব্যাগ নিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলো। কলির মন ভালো নেই। মুড অফ এই ভেবে, স্টাডির প্রয়োজনেও মাহমুদ স্যারের সান্নিধ্যে যেতে হবে তাকে। কিন্তু তার কিছুতেই এই স্যারকে ভালোলাগে না এখন। ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে খেয়া, কলিকে বলল,

“কেন ডাকলো স্যার? তুই কিছু জানিস? আর তোকে ধন্যবাদ ম্যামকে মিথ্যে বলে আমাদের রক্ষা করার জন্য।”

কলির ইচ্ছে করেনা খেয়ার সঙ্গে কথা বলতে। খেয়া তাকে ধন্যবাদ দিলো নিজের স্বার্থে। কিন্তু ভুলের জন্য একটা সরিও বলল না। পাজী মেয়ে একটা।

নিরুপায় হয়ে কলি বলল,

” না জানিনা। তবে ম্যাম, স্যারকে বলছে এসাইনমেন্টের জন্য আমাকে টাইম দিতে।”

“ওহ! আচ্ছা চল যাই।”

ওরা তিনজন গেলো। মাহমুদ স্যার খাতা দেখতে দেখতে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিলো মনে মনে।

“স্যার ডেকেছেন আমাদের।” বলল রিমি।

মাহমুদ মাথা তুলে তাকালো খেয়া ও রিমির দিকে। কলির দিকে দৃষ্টিপাত করল না। কলিও সেটাই চাইলো। কলি ওদের দুজন থেকে যথাসম্ভব দূরে দাঁড়িয়ে আছে। মাহমুদের মনে পড়লো নিজের বলা কথাটা।

‘ইন ফিউচারে আমার ছায়া মাড়াতেও চেষ্টা করবেন না।’

কলিও তাতে সহমত প্রকাশ করেছে। যার বহিঃপ্রকাশ এখন তার সামনেই দৃশ্যমান। কলির আত্মসম্মানবোধ ও ব্যক্তিত্ব মাহমুদের দৃষ্টি কাড়লো।

মাহমুদ স্যার খেয়াকে বললেন,

“আপনার আমাকে ফোন দেয়ার কথা ছিলো। ভুলে গেলেন?”

“না স্যার। সরি স্যার। একদম ভুলিনি। কিন্তু এরপর আর সময় সুযোগ করে উঠতে পারিনি।”

“ওকেহ। এখন বলুন। ফোনের টাকা বা এমবি সেইভ হবে।”

খেয়া নারভাস হয়ে চুপ করে আছে। রিমি খেয়াকে বলল,

“আমি বলি স্যারকে?”

“আচ্ছা।”

খেয়া মনে মনে ভাবলো,

আপনার নেক নজর পেয়ে ঝামেলাটা এড়ানোর জন্য দু’দুইটা দামী চকোলেট বক্স গিফট দিলাম। এখন দেখি ঘুষ দিয়েও লাভ হলো না। হুহ।

“স্যার আমি কি চলে যাবো?”

নিচু মাথায় বলল কলি৷

“ডাকলাম কেন তাহলে?”

কলির দিকে না চেয়েই বলল মাহমুদ।

কলি দাঁড়িয়ে নখ খুঁড়তে লাগলো। মাহমুদ চিবুকে হাত দিয়ে দৃষ্টিতে কাঠিন্যতা এনে রিমির দিকে চেয়ে,
“হ্যাঁ রিমি বলুন।”

রিমি ওদের মাঝে বলা কথাগুলো সব সম্ভব হলো না বলে একটু কাটছাঁট করে বলল।
“স্যার কিছুদিন আগে ক্যাম্পাসের মাঠে বসে বসে আমি আর খেয়া এটা ওটা বলে ফাজলামো করছিলাম। তো প্রসঙ্গক্রমে আমি আর খেয়া বলছিলাম মাহমুদ স্যার একটু ভিন্ন। পারসোনালিটিসম্পন্ন। দেখতেও ভালো। রুচিসম্পন্ন! স্মার্ট! তো আমিই প্রথমে বললাম, সাহিত্যের টিচারগুলো হয় মজার। কিন্তু মাহমুদ স্যারকে দেখলে মনে হয় অংকের শিক্ষক। রাতদিন অংকের জটিল সমাধান নিয়ে পড়ে থাকে। আর নয়তো ফিজিক্সের সূত্র নিয়ে রিসার্চ করে। কেমন গুরুগম্ভীর! খেয়া দুষ্টমি করে বলল,

” স্যারকে একটু বাজিয়ে দেখা যায়।”

“কিভাবে?”

“স্যারের সেল নাম্বার বা মেইলে মেসেজ দিয়ে। সেই মেসেজ এমন হতে হবে। যেন স্যারের মাথা ঘুরে যায়।”

“স্যার জানলে? আর এতে আমাদের কি বেনিফিট? ”

“মজা নেওয়া। এটাই লাভ। জানবে না স্যার।”

“কে দিবে?তুই না আমি?”

“আমরা দুজনের কেউই না। এমন কেউ দিতে হবে যেন স্যার স্তম্ভিত হয়ে যায়। অবিশ্বাস্য জিনিস যখন বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠে তখন অন্যরকম কিছু ঘটে।”

“কে দিবে?”

“আমাদের ক্লাসে কলি মেয়েটা সবচেয়ে শান্তশিষ্ট। ভদ্র। নিরীহ গোবেচারা টাইপের। কারো সাতেও নেই পাঁচেও নেই । তার থেকে স্যার যখন প্রপোজাল পাবে। সেই মজাটা হবে।”

তখন মাঠের এক পাশে কলি ছিলো। আমরা ওকে ডাক দিলাম। কলিকে খেয়া অনুনয় করে বিষয়টা বলল। কলি কিছুতেই রাজী হলো না। পরে বলল, তোর অন্য কোন মেইল আইডি থেকে দে। তারপর স্যারের রিয়েকশনটা দেখতে চাই। তাও কলি রাজী হচ্ছিল না। পরে আমি ও খেয়া ওকে নানাভাবে পড়ার কথা বলে পেঁচিয়ে ফেলি। ও বাধ্য হয় আপনাকে ইমেইল করতে।
বলল,

“আমার মূল জিমেইল আইডি থেকে দিব না। অন্য মেইল থেকে দিবো। লিখে দে মেসেজ।”

“মেইলটা আমি ও খেয়া মিলে রেডি করে ওকে খাতায় লিখে দেই। এইই।”

মাহমুদ স্থির রইলো কিয়ৎক্ষণ। অনুধাবন করতে পারলো খেয়ার ধান্ধায় তাকে দিয়ে কলিকে ছোট করার বিষয়ওটাও ছিলো।

সে রিমি ও খেয়াকে বলল,

“আপনাদের জন্য নিদোর্ষ কেউ আমার কাছে অপর্যস্ত হলো। সেই তীব্র অপমান হজম করতে না পেরে ক্যাম্পাস ছেড়ে দিলো। মিসেস হেড তাকে ফোন দিয়ে ক্লাসমুখী করেছে। তার এখন এই সেমিষ্টারে রেজাল্ট খারাপ হবে। এত কিছুর দায়ভার কে নিবে? আপনারা দুজন আমার থেকে কি পানিশমেন্ট ডিজার্ভ করেন বলেন? বিশেষ করে খেয়া আপনি? ”

রিমি নিজ থেকেই বলল,

“স্যার আমি খুব সরি ও লজ্জিত। কলি তোকেও বলছি। সরিরে দোস্ত।”

খেয়া বুঝতে পারলো হিতে বিপরীত হয়ে গেলো। চাইলো কি। হলো কি। ওর প্ল্যান ছিলো কলি তার কথা স্যারকে বলে দিলে,স্যার তার প্রতি ইমপ্রেস হবে কিছুটা। টুকটাক কথোপকথনের মধ্য দিয়ে স্যারের সঙ্গে রিলেশনে জড়াবে। স্যারকে তার পছন্দ। তাই চালাকি করে ইমেইলের আশ্রয় নিলো কলিকে ব্যবহার করে। কিন্তু হায় বিধিবাম! ফন্দি ভেস্তে গেলো।

রিমির দেখাদেখি খেয়া গিয়ে কলির দুহাত ধরলো। বলল,

“সরি কলি। আমিই দায়ী এতসব কিছুর জন্য। সামান্য ফান করতে গিয়ে বড় কিছু ঘটে গেলো।”

কলি কিছু বলল না। নিশ্চুপ রইলো। তার সমস্ত ক্ষোভ স্যারের উপর। খেয়া,রিমি তো তাকে নাজেহাল করেনি। তাকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে স্যার। সে বারবার সত্য প্রমাণ করতে চেয়েছে। কিন্তু স্যার সেই সুযোগ তাকে দেয়নি। মাহমুদ খেয়া ও রিমিকে ভার কন্ঠে আদেশ করে বলল,

“আপনারা দুজন চলে যান। কলি এদিকে আসুন। আমার দুটো কোর্সের এসাইনমেন্টের টপিক জেনে নিয়েছেন? ”

খেয়া ও রিমি মলিন মুখে বেরিয়ে গেলো। কলিও চলে যেতে উদ্যত হলো। কারণ টপিক সে জেনে নিয়েছে।

“কলি আমি ডেকেছি আপনাকে। শুনতে পাননি?”

পিছন হতে মাহমুদের ডাক পেয়ে কলির পা থেমে গেলো। মাহমুদের সামনে এসে চোখ নামিয়ে বলল,

“স্যার আমি টপিক জেনে নিয়েছি ক্লাস লিডারের কাছ হতে। এজ আরলি এজ পসিবেল এসাইনমেন্ট শেষ করে জমা দিবো।”

“সবারগুলো দেওয়ার পরে আমার গুলো দিবেন। চাপ নেওয়ার দরকার নেই আমার দুটোর জন্য। কোন হেল্প লাগবে নোট করার বিষয়ে?”

“না স্যার। আমিই পারবো। ধন্যবাদ।”

“একজন ছাত্রী হয়ে অকারণেই শিক্ষকের নাম্বার ব্লক লিস্টে রাখা বেয়াদবি নয় কি?”

“স্যার আনব্লক করে দিবো বাসায় গিয়ে।”

“এখন করলে সমস্যা কি?”

কলি মৌন হয়ে আছে।

“আপনার মোবাইলটা দেখি।”

মাহমুদ হাত প্রসারিত করলো। কলি তার মোবাইল স্যারের হাতে না দিয়ে টেবিলের উপর রাখলো। মাহমুদ এই প্রথম ধীরে ধীরে কোন যুবতী মেয়ের ব্যক্তিত্বের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করলো। অথচ ফ্রেন্ড সার্কেলে শুনতে পাওয়া যায়,এখনকার কলেজ, ভার্সিটির প্রায় মেয়েরা খুব এডভান্স। জড়তা নেই বললেই চলে এদের মাঝে। লায় পেলে ছেলেদের কোলে চড়ে বসে এরা। কই কলি মেয়েটা ত তার সম্পূর্ণ অপজিট।

মাহমুদ কলির মোবাইল টিপে তার নাম্বার আনব্লক করে নিলো। সেও ব্যক্তিত্ববান ছেলে। তাই মোবাইলটা কলির হাতে না দিয়ে তার সামনে ঠেলে দিলো। ঈষৎ হেসে বলল,

“বুঝলাম। আপনি নাম্বার ব্লক করতে পারেন। কিন্তু আনব্লক করতে পারেন না।”

মাহমুদ চাচ্ছে কলি একটু ইজি হউক। তার দিকে দৃষ্টি ফেলুক। চোখাচোখি হউক। নয়তো পড়ার বিষয়েও কোন হেল্প নিবে না মেয়েটি। কলিকে তার সরি বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পারছে না। একজন শিক্ষক হয়ে ছাত্রীকে সরাসরি সরি বলা তার পারসোনালিটির সঙ্গে বেমানান। খাপছাড়া।

কলির ফর্সা নাকের ডগা রক্তিম হয়ে গেলো। এই স্যার এমন কেন? ফোঁড়ন না কেটে কথা বলতে পারে না?

“আমি আসি স্যার।” বিরস গলায় বলল কলি।

“আসুন।”

কলি চলে গেলো। মাহমুদ পিছন হতে কলির দিকে অপলক চেয়ে রইলো।
মাহমুদ বাসায় গেলে তার মা মাহফুজা তাকে জিজ্ঞেস করলো,

“হ্যাঁরে মাহমুদ। সেই কলি মেয়েটা আজ ক্লাস আসছে? ঠিকঠাকভাবে ক্লাস করছে?”

“হ্যাঁ মা আসছে। এভরিথিং ইজ ওকে।”

“তোর সঙ্গে কথা বলেছে? তুই সরি বলছিস তাকে?”

“আমার সঙ্গে কথা বলেনি স্বাভাবিকভাবে। সরি বলতে গিয়েও পারিনি। ছোট ছোট লাগে নিজেকে। তোমার নামও মনে আছে দেখছি?”

” কি মিষ্টি আদুরে নাম। কলি। ফুটন্ত কলি। মনে থাকবে না? আমার মতো বড্ড অভিমানী যে মেয়েটা। কতটা আঘাত পেলে, কতট আত্মসম্মানে বাধলে, তোর আচরণে, সে ভার্সিটি ছেড়ে দিতে পারে। ভাবছিস?”

মাহমুদ মায়ের দিকে চেয়ে রইলো এক দৃষ্টিতে। তিনি ফের বললেন ছেলেকে,

“ভুল যেমন ছোট বড় সবারই হতে পারে। তদরূপ সরিও ছোট বড় সবাইকেই বলা যায়।”

“বুঝলাম মা।”

“বুঝলে হবে না। ওকে কাল ডেকে সরি বলবি। একদিন আমাদের বাসায় নিয়ে আসিস। দেখব আমার চেয়েও বেশী অভিমানী নাকি। সেই বয়সে আমি যেমন ছিলাম।”

মাহমুদের কাশি উঠে গেলো মায়ের আগ্রহ দেখে কলির প্রতি। শুধু কি মায়ের আগ্রহ? তার নেই? একটু হলেও সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের ভিতরে কাউকে নিয়ে কোন বোধ জন্মানোর জন্য একটা উপলক্ষ লাগে। সেই ইমেইল টা ছিলো হয়তো সেই উপলক্ষ। নইলে বারবার কলির কথা মনে পড়ছে কেন তার।

মায়ের কথায় মাহমুদের মন সামান্য প্রশ্রয় পেলো যেনো। রাতে সে মোবাইলটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করলো। ভাবলো,

কলি হয়তো এখনো জেগে আছে। এসাইনমেন্ট লিখছে। মেসেজে সরি বলব? না থাক। ও যেমন। বোবা কয়েকটি শব্দে সে সহজ হবে না। ভুল ও বুঝতে পারে। সরাসরি বলার ব্যবস্থা করবো। ভার্সিটিতে নয়। বাইরে হলে ভালো হয়। কিন্তু কিভাবে? এটাও তো এক কঠিন কাজ। মুনী ঋষির তপস্যার মতো। খেয়া হলে খুশীতে আত্মহারা হয়ে যেতো।

মাহমুদ ঘুমিয়ে পড়লো। কলিকে মেসেজে সরি বলা হলো না আর।
খেয়ার ভীষণ মন খারাপ। সে রাতেই নিরুপায় হয়ে তার ভাবিকে সব বলল। তার ভাবি তনিমা তাকে ভরসা দিলো কিছু একটা করবে বলে। একমাত্র ননদ বলে কথা।

তার একদিন পর মাহমুদ ক্লাসে গেলে কলি একটা কোর্সের এসাইনমেন্ট জমা দিয়ে দিলো। মাহমুদ ভরা ক্লাসে কিছু বলল না কলিকে। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে গেলো। তাকে বলছে সবারগুলো দিয়ে তারপর যেন তারটা দেয়। সেখানো উল্টো একদিন পরেই দিয়ে দিলো। তারমানে ছাত্রী হিসেবে মাহমুদ স্যারের কোন আনুগত্য কলি নিতে চায়না। মাহমুদের ভিতরে এক অজানা অনুভূতি ঢেউ খেলে গেলো কলিকে নিয়ে।

মাহমুদ বাসায় এসে মায়ের সঙ্গে এই বিষয়টাও শেয়ার করলো। বলল,

” মনে হয়না ওর তেজ বেশী?”

“একদম না। তুই ওর সঙ্গে একটু আন্তরিক হয়ে কথা বলিস। যেই রোবট হয়ে থাকিস। মানুষ সহজ হবে কিভাবে তোর জন্য?”

“চেষ্টা করবো মা।”

তার দুদিন পরে এক রাতে আবদুর রহমান, স্ত্রীকে নিয়ে মাহমুদের রুমে প্রবেশ করলেন। দু’চার কথা বলে প্রসঙ্গ তুললেন,

“মাহমুদ তোর জন্য পাত্রী ঠিক করেছি আমি। উত্তম প্রস্তাব পেয়েছি। তোর মায়েরও বেশ পছন্দ হয়েছে সব শুনে। ঢাকায় সেটেল্ড। নিজস্ব বাড়ি। আমরা জানি তোরও পছন্দ হবে পাত্রীকে। আমি দেখেছি নিজে গিয়ে।”

মাহমুদ বিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইলো বাবা মায়ের মুখপানে।

চলবে..

তোমার জন্য সব পর্ব-০৩

0

#তোমার_জন্য_সব (৩)
✍️ #রেহানা_পুতুল
ঝিমিয়ে আসা ধূলোয় মাখা শহরের অবসন্ন বিকেল। কলি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি বেখেয়ালি। ঝিরিঝিরি হাওয়া বইছে। সে হাওয়ায় কোন প্রশান্তি নেই। কেবলই উষ্ণতা। মুঠোফোন বেজে চলছে। কলি রিসিভ করলো। হ্যালো.. বলতেই ভেসে এলো একটি পুরুষ কন্ঠস্বর। যেন চেনা চেনা লাগছে কিছুটা।

“হ্যালো..কলি শুনতে পাচ্ছেন?”

কলি ছোট্র করে জবাব দিলো।

“জ্বি বলছি। কে?”

“আমি আপনার ভার্সিটির টিচার মাহমুদ খান।”

কলি স্তব্দ হয়ে গেলো। তার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছেনা।

“কলিইই…”

কলির হুঁশ হয়।

“জ্বি..জ্বি স্যার শুনছি। বলুন।”

“ভার্সিটি আসা বন্ধ করলেন কেন?”
ধীর কন্ঠে জানতে চাইলো মাহমুদ।

কলি জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো,
“স্যার আপনি আমার সেলফোনের নাম্বার কোথায় পেয়েছেন?”

“আজ আপনার বাবা এসেছিলো ডিপার্টমেন্টের অফিসে। নাম্বার উনার থেকে মিসেস হেড চেয়ে নিয়েছে। ”

কলি বিস্মিত স্বরে,
“আমার বাবা আজ ভার্সিটি গিয়েছে? কিন্তু কেন?”

“উনি রাইট। একজন পিতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র। আপনি ভার্সিটি আসেন না কেন তাই তলব করতে এলেন।”

“ওহ আচ্ছা। ম্যাম কি বলল বাবাকে?”

“ম্যামসহ সবাই বলল,কেউই জানেনা আপনি কেন আসছেন না। উনি বলল,আপনাকে সন্ধ্যার পরে ফোন দিবে।”

কলি মনে মনে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলল,
ম্যাম দিবে ভালো কথা। আপনি কেন দিলেন? ঘাড়ত্যাড়া পুরুষ। কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ভুল বুঝে মিসবিহেবিয়ার করলেন। আপনার ছায়া মাড়াতেও আমি রাজী নই। বদ মানুষ কোথাকার।

“স্যার কেন ফোন দিলেন বলেন?”

“আপনি ভার্সিটি আসছেন না কেন? সামনে পরিক্ষা। এসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে আপনার।”

” সরি স্যার। আমি এই ভার্সিটিতে আর স্টাডি কন্টিনিউ করব না।”

মাহমুদ মর্মাহত হলো। ব্যথিত স্বরে বলল,
“অন্য ভার্সিটিতে এডমিশন নিবেন?”

“হুম।”
মাহমুদ আশ্চর্য সুরে জিজ্ঞেস করলো,
“এই ভার্সিটিতে কি প্রবলেম?”

“স্যার এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত বিষয়।”

“আপনার ব্যক্তিগত বিষয়টার সঙ্গে কি আমি কোনভাবে যুক্ত আছি?”

“না স্যার।”

“হেড মিসেস ফোন দিলে কি বলবেন?”

“যা সত্যি তাই বলব।”

মাহমুদের কপালে চিন্তার ভাঁজ দৃশ্যমান হলো। হায় হায় বলে কি। সত্যিটা যদি সেই বিষয় হয়, তবে তো আমি ফ্যাসাদে পড়ে যাবো। এই মেয়ের যে আত্মসম্মানবোধ এত টনটনে, এত প্রখর তা কে জানতো।

কলির সঙ্গে মাহমুদের প্রফেশনাল সম্পর্ক। শিক্ষক ছাত্রী। নমনীয় হয়ে তাকে কিছু বলা মানে নিজের ব্যক্তিত্বকে বির্সজন দেওয়া। খেয়া,রিমি হলে সরাসরি রিকুয়েষ্ট করা যেতো। এই মেয়ের সঙ্গে আগেও তেমন কথা হয়নি। ক্লাসের প্রয়োজনে দু,এক বাক্য বিনিময় হয়েছে। মাহমুদ ভেবে পেলনা কিভাবে কলিকে বলবে। উপায়ন্তর না পেয়ে মাহমুদ সহজ পন্থাই অবলম্বন করলো।

“কলি আমার মনে হয় আপনি আমার আচরণের জন্য আসা বন্ধ করেছেন। যদি তাই হয় তাহলে বলব ভার্সিটি আসুন। বাচ্চামো করবেন না প্লিজ। নিজের ক্যারিয়ারের কথা একবার ভাবুন।”

“স্যার আপনি কি আমাকে ভার্সিটি যাওয়ার জন্যই ফোন দিয়েছেন?”

বিরস গলায় বলল কলি।

“হ্যাঁ। একজন দায়িত্বশীল শিক্ষক হিসেবে ছাত্রীর প্রতি এটা আমার কর্তব্য।”

“আপনি বলেছেন যেন কখনো আপনার ছায়াও না মাড়াই। তাই সে ভুলকে এড়াতে হলে এই ভার্সিটি বাদ দেওয়া ছাড়া আমার কাছে ভিন্ন কোন অপশন নেই স্যার। ভালো থাকবেন। রাখি। আসসালামু আলাইকুম। ”

“কলিইই প্লিজ শুনুন বলছি।”

কলি শুনল না। ধুম করে লাইন কেটে দিলো। কান হতে মুঠোফোনটাকে আলগা করে নিলো। নাক বরাবর চোখের সামনে এনে মাহমুদের নাম্বার ব্লক লিস্টে ফেলে দিলো। বলল,

এই সেল নাম্বারের মালিক আপনি জানলে ভুলেও রিসিভ হতো না মিস্টার মাহমুদ খান। পরক্ষণেই কলির ভাবনায় ভর করলো মাহমুদের সফট করে বলা কথাগুলো। আজকে এত শান্ত স্বরে, ঠান্ডা মেজাজে কথা বললেন স্যার। কারণ কি? অনুশোচনা হচ্ছে? বিবেক তাড়া করছে? দংশিত হচ্ছেন? দেখলেন ত কাউকে অন্যায়ভাবে আঘাত করলে সে আঘাত নিজের দিকেও আসে। এটাই প্রকৃতির নিখুঁত একটা সিস্টেম।

মাহমুদ ফের কলির নাম্বারে ফোন দিলো। বারবার ট্রাই করেও কাজ হলো না। বুঝতে পারলো কলি তার জন্যই ভার্সিটি ছেড়ে দিতে চায়। কেননা কলির কন্ঠে ও কথায় প্রকট অভিমান ও জেদ ঝরে পড়লো। মাহমুদ ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। বাসায় চলে গেলো খিটখিটে মেজাজ নিয়ে।

মিসেস নাজমা আশরাফ কলিকে ফোন দিলেন এশার নামাজের পরে। কুশলাদি বিনিময় করলেন। কলি আগেই সাজিয়ে রেখেছে কি বলবে হেডকে। মাহমুদ স্যার ফোন দেওয়াতে এই সুবিধা হলো, কথা গুছিয়ে বলা যাবে। নয়তো সত্যিটাই মুখ দিয়ে বের হয়ে যেতো। এতে তারই সমস্যা হতো। হেড, খেয়া,রিমিকে ধরতেন। আর খেয়া কলিকে ছেড়ে দিতনা। নাস্তানাবুদ করেই ছাড়তো। আর সত্যিই তো। সে এসময়ে কোথায় এডমিশন নিবে। টাকা কই। টিউশনি করিয়ে যে টাকা পায়, তা থেকে মাস শেষে এক টাকাও অবশিষ্ট থাকে না। মা রোজ রাগারাগি করছে। অসহ্যকর। এর চেয়ে ভার্সিটি যাওয়া ঢের ভালো।

অন্যের নাক কাটতে গিয়ে নিজের যাত্রা ভঙ্গ করা নেহাৎ বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। স্যারের ভিতরে অনুশোচনা হচ্ছে এটাই যথেষ্ট।

মিসেস নাজমা কলিকে উদ্বেলিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

“এবার বলতো তুমি ভার্সিটি কেন আসছ না?আজ তোমার বাবা এসেছে।”

কলি অবাক হওয়ার ভান করলো শুনে। মিসেস, তার বাবার বলা সবকথা বলল কলিকে।

“ম্যাম বাবাকে ত ব্যক্তিগত শারীরিক সমস্যার কথা বলা যায় না। আমার চলাফেরা করতে সমস্যা হচ্ছে।”

“কি হয়েছে? আমাকে বলো ফ্রিলি? আমরা দুজনই নারী।”

কলি স্বাভাবিক কন্ঠে তার শারীরিক সমস্যা নিয়ে বানানো একটি গল্প শুনালো মিসেস হেডকে। তিনি বিশ্বাস করলেন এবং সহমত জানিয়ে বললেন,

“পিরিয়ডের পরে এমন একটা প্রবলেম আমারো হয়েছে একবার। তুমি গাইনী চিকিৎসক দেখাও।”

“ম্যাম আমার আগেও এমন হয়েছে। তাই ফার্মেসীতে নাম বলে মেডিসিন নিয়েছি।এখন ইমপ্রুভমেন্ট হচ্ছে। দোয়া করবেন ম্যাম।”

“কবে আসতে পারবে ক্লাসে? পরিক্ষা সামনে।”

“নেক্সট উইকে আসবো ম্যাম। ইনশাআল্লাহ।”

মিসেস নাজমা খুশী হলেন। সন্তুষ্টি চিত্তে বিদায় নিলেন কলির থেকে।

রাতে মাহফুজা খান ছেলের মুখপানে দৃষ্টিপাত করেই টের পেলেন, ছেলের ভাবভঙ্গি ভালো ঠেকছে না। কোন কারণে মেজাজ বিগড়ে আছে। মায়ের সঙ্গে তার মধুর সম্পর্ক। বাবার সঙ্গেও ভালো। তবে অন্তরঙ্গ কম। তাই তিনি প্রসঙ্গ ছাড়াই সরাসরি ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন,

“মাহমুদ, বাবা তোর মন খারাপ কোন কারণে?”

“হুম মা।”

“মায়ের সঙ্গে শেয়ার করা যাবে? তাহলে মন হালকা হবে। স্বস্তি অনুভব করবি।”

“বসো মা। বলছি।”

মাহফুজা বেগম ছেলের রুমের ইজি চেয়ারটাতে বসলেন। অধীর আগ্রহ নিয়ে ছেলের দিকে তাকালেন। মাহমুদ মাকে সব বলল বিস্তারিতভাবে। তিনি হতচকিত হয়ে বললেন,

“তাজ্জব ব্যাপার! এইজন্য একটা মেয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দিবে? মেয়েটা বড্ড অভিমানী! আমিও আগে এমন ছিলাম। অল্পতেই ভেঙ্গে পড়তাম। মনোবল হারাতাম। সংকোচে,দ্বিধায় গুটিয়ে যেতাম। আর তখনই অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতাম। সেই সিদ্ধান্ত থেকে অতি সহজে আমাকে টলানো যেতনা। এসব এখন নষ্টালজিক অতীত আমার। মনে পড়লেই হাসি পায়।”

“মা মূল কথাই তোমাকে বলিনি। ওকে মিসেস হেড এতক্ষণে হয়তো ফোন দিয়ে দিয়েছে। যদি সে সত্যিই বলে দেয় সব,তবে বিষয়টা কি বাজে হবে ভাবছ? উফফস! কি যে টেনশন হচ্ছে। ”

“তুই মেয়েটার ফোনে আমাকে ধরিয়ে দে। আমি কথা বলছি। এখন মাত্র দশটা বাজে। ঢাকা শহরে এখন মাত্র সন্ধ্যা।”

“তুমিই কথা বলবে?”

“হ্যাঁ। সমস্যা কি? ”

“কিন্তু আমার নাম্বার থেকেতো কল যাচ্ছে না কেন যানি। তোমার মোবাইল দাও। আমি নাম্বার তুলে দিচ্ছি।”

কলির মোবাইলে রিং বাজছে। মাহফুজা খান ছেলের রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। মাহমুদ অবাক হলো। তার মোবাইল থেকে কল গেলনা। কিন্তু মায়ের মোবাইল থেকে কল গেলো। তারমানে কলি তার নাম্বার ব্লক লিস্টে ফেলে দিয়েছে। একজন শিক্ষক হিসেবে মাহমুদ বেশ অপমানিত বোধ করলো। সে কলির উপর সেদিনের মতো রেগে গেলো। কলিকে কাছে পেলে এখন পিষে ফেলতো। নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো কিছুক্ষন পর।

মিনিট দশেক পরে মাহফুজা খান ফিরে এলেন। নির্মল হেসে বললেন ছেলেকে,

“কথা বললাম কলি মেয়েটার সঙ্গে। আমার বেশ মনে ধরেছে। কি অমায়িক ব্যবহার। কি বিনয়ী ভাষা। তাকে তোদের হেড নাকি ফোন দিয়েছে। সে উনার সাথে কমিটমেন্ট করেছে রেগুলার যাবে ক্লাসে।”

মাহমুদ জোরে দম ছাড়ল। তবুও উদ্বেগ কাজ করছে তার ভিতরে। সে বলল,

“মা সে যাবে। তা না হয় ঠিক আছে। কিন্তু এবার ত আমার ভার্সিটি যাওয়া বন্ধ করতে হবে। সে নিজেই আমাকে বলছে, যা সত্যি তাই বলবে ম্যামকে।”

ওহ শিট! বলে মাহমুদ দেয়ালে ঘুষি মারলো। ব্যথায় নিজেই উঁহু করে উঠলো।

মাহফুজা বললেন,
“কে ব্যথা পেলো এখন? দেয়াল না তুই? পিচ্চিকালের এই বাজে স্বভাব তোর আর গেলনা? একটু কিছু হলেই দেয়ালে,টেবিলে চাপড় ঘুষি মারা। আমার মনে হয়না সে সত্যিটা বলছে। মাথায় এতটুকু বুদ্ধি থাকলে কেউ এটা বলবে না। ডাইনিংয়ে আয়। বাতাসী খাবার আনলো।”

“যাও আসতেছি।”

মাহমুদ কিছুটা উৎকন্ঠা নিয়ে খেয়ে ফের নিজের রুমে চলে গেলো। পিতা আবদুর রহমান স্ত্রীর কাছে জানতে চাইলেন,

“মাহমুদ কোন কথা বলল না যে, কিছু হয়েছে?”

মাহফুজা ঘটনার সারসংক্ষেপ বললেন স্বামীকে। তিনি শুনে বললেন,

“পথ চলায় এমন বিচ্ছিন্ন বিড়ম্বনা ঘটে। ব্যাপার না। সব ওকে হয়ে যাবে।”

“আপনার কনফিডেন্স লেবেল মাশাল্লাহ। ”
বলে মুচকি হাসলো মাহফুজা।

আজ বৃহস্পতিবার। শুক্র, শনি ডিপার্টমেন্ট অফ। যাক অন্তত দু’দিন গ্যাপ আছে। কলি যদি বলেও ফেলে। এই ভিতরে ম্যাম একটু ইজি হয়ে যাবে আমার উপরে। কিছু বিষয়ের প্রভাব সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হালকা হয়ে যায়। কথাগুলো ভেবেই মাহমুদ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।

রবিবারএ মাহমুদ বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে ভার্সিটি গেলো। মিসেস নাজমা আশরাফের মুখাকৃতি লক্ষ্য করলো তীক্ষ্ণ চোখে। বেশ হাসিখুশি দেখা যাচ্ছে তাকে। কলিও গেলো ভার্সিটি। এতে তার মা, বাবা,ছোট বোন বেজায় খুশি হলো। যাক মেয়েটা স্বাভাবিক হলো।

মিসেস হেড ক্লাস শুরু হওয়ার আগে কলিকে ডেকে পাঠালেন অফিস স্টাপ নবীকে দিয়ে। কলি গেলো এবং বেশ ইতস্তত বোধ করলো। কারণ অন্য সব শিক্ষকের পাশে মাহমুদ স্যারও বসা ছিলেন। মাহমুদের গলা শুকিয়ে আসছে। তার কপালে আজ কি আছে কে জানে।

আন্তরিকতাপূর্ণ স্বরে কলিকে হেড জিজ্ঞেস করলো,

“কেমন আছো তুমি এখন?”

“জ্বি ম্যাম আলহামদুলিল্লাহ ভালো। সুস্থবোধ করছি।”

তিনি সব স্যারদের উদ্দেশ্যে বললেন,

“আমি ওকে ডাকলাম আপনাদের সামনে এইজন্য,ও অসুস্থ ছিলো। তাই আসতে পারেনি। সবাই ওকে দু চারদিন সময় দিবেন। যেন ও সব কোর্সের এসাইনমেন্ট জমা দিতে পারে।”

“কলি তুমি ক্লাস লিডার থেকে টপিকগুলো আজই জেনে নিও।”

“জ্বি ম্যাম। অবশ্যই। ”

মাহমুদ তব্দা খেয়ে গেলো। আড়চোখে কলিকে পরখ করে দেখলো। মনে মনে কলিকে ধন্যবাদ দিতে ভুল করল না মিথ্যা বলে তার সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য ডিপার্টমেন্টে।

“মাহমুদ তুমিতো ওদের দুইটা কোর্স পাও। একটু কনসিডার করো ওকে। কেমন?”
বলল হেড।

“ঠিক আছে ম্যাডাম।”

“আসতে পারো কলি। মন দিয়ে পড়াশোনা করবে। প্রবলেম হলে জানাবে। এভাবে ইঁদুরের মতো গর্তে ঢুকে যেওনা।”
সহাস্য হেসে বলল হেড।

কলি চলে গেলো। মাহমুদ স্যারের দিকে ফিরেও চাইল না। অন্য স্যাররা কৌতুহলী চাহনি নিক্ষেপ করলো হেডের দিকে। তারা বলল,

“ও অসুস্থ ছিলো? তো ওর বাবা যে এলো? বুঝলাম না কিছুই।”

“আরেহ ওর একটা ব্যক্তিগত শারীরিক সমস্যা হয়েছে। যেটা বাসায় বলেনি সঙ্গত কারণেই।”

মাহমুদ সহ সবাই একে অপরের দৃষ্টি বিনিময় করলো নির্বোধের মতোন।

আমান স্যার রসিকতা করে বলল,

“হয়তো। নারী রহস্যময়ী। বোঝা মুশকিল। এদের অনেক আজগুবি ব্যাপার স্যাপার থাকে।”

সবাই নিজ নিজ ক্লাসে চলে গেলো চা পান করে। মাহমুদ স্যার ক্লাশ শেষে খেয়া,রিমি ও কলিকে গম্ভীর স্বরে বলল,

“আপনারা তিনজন আমার রুমে আসবেন। জরুরী প্রয়োজন।”

#Romantic #shortstory #shortstorywriter #rপুতুল #romanticsuspense #lovestory #loveshortstoryputul #writer #writing #genre #samajik #Rehana #putul

তোমার জন্য সব পর্ব-০২

0

#তোমার_জন্য_সব (২)
✍️ #রেহানা_পুতুল
কলি নামের মেয়েটি আসেনা কেন? কেউ বলতে পারবেন?”

মাঝ বেঞ্চ হতে কেউ একজন গলা তুলে বলল,

“স্যার কলি আর কোনদিন ক্লাসে আসবে না। স্টাডি ছেড়ে দিয়েছে।”

মাহমুদ থ বনে গেলো। বিষম খাওয়া চোখে সেই ছাত্রের দিকে তাকালো। অতঃপর জানতে চাইলো,

“এটা কিভাবে জানলেন আপনি?”

গালিব উঠে দাঁড়ালো। বলল,

“স্যার ওতো আজ প্রায় পনেরোদিন হলো ক্লাসে আসেনা। তাই ধারণা করে নিয়েছি।”

স্যার বিরক্তিকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তার দিকে। ক্লাসের বাকিরাও অদ্ভুত চাহনিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে।

পাশ থেকে দুজন বলল,
“স্যার গালিবের কাজই হলো তিলকে তাল বানানো। গুজব ছড়ানো। এজন্যই ওকে আমরা গুজব গালিব বলি।”

সবাই হো হো হো করে হেসে উঠলো। স্যার ডাস্টার দিয়ে টেবিলে জোরে আঘাত করলো। সবাই চুপ হয়ে গেলো।

“পনেরো দিন না আসা আর স্টাডি ছেড়ে দেওয়া এক হলো? আপনারা কেউ ক্লাসমেট হিসেবে কোনভাবে কন্টাক করার চেষ্টা করেন নি ওর সঙ্গে?”

ক্লাসের প্রায় সবাই সমস্বরে বলে উঠলো,
“স্যার ওর মোবাইল নাম্বার আমাদের কারো কাছে নেই। ফেসবুকে কজন এড আছি ওর সঙ্গে। এবং আমাদের আটান্ন ব্যাচেরও একটা মেসেঞ্জার গ্রুপ আছে। কিন্তু ওকে ফেসবুক বা গ্রুপেও দেখছিনা। অন্য স্যার, ম্যামরাও ওর কথা জিজ্ঞেস করেছে ক্লাসে। হয়তো অসুস্থ হবে বা কাছের কেউ মারা গিয়েছে। ”

স্যার বিজ্ঞের মত করে বলল,

“ধারণা করে জগতের সবকিছু চলে না। সত্যতা যাচাই করে বলতে হয়।”

ক্লাস শেষ করে চলে যায় মাহমুদ। ভাবলো,
মেয়েটা কি সেদিন আমার কথার জন্য আসা বন্ধ করে দিয়েছে? আশ্চর্য! খেয়া,রিমিকে আলাদা ডেকে জিজ্ঞেস করাটা সমীচীন হবে? উমম! না থাক। আরো দু’চারদিন দেখি। দেন নিজেই খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করবো।

একদিন ক্লাসে মাহমুদ স্যার এলে কয়েকজন স্টুডেন্ট তাকে ‘শুভ জন্মদিন’ বলে উইশ করলো। সে সবাইকে সৌহার্দপূর্ণ কন্ঠে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলো। এবং কিঞ্চিৎ অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

“আজ আমার জন্মদিন। কিভাবে জানলেন আপনারা?”

“স্যার গতবছর একদিন ক্লাসে প্রসঙ্গক্রমে আপনিই বলছিলেন।”

“ওহ! আচ্ছা! হয়তো। কিন্তু সবাই তারিখটা মনে রাখলেন? এটা সম্ভব?”

বিনয়ী হেসে বলল মাহমুদ স্যার।

সামনের বেঞ্চে বসা থেকে রিফাত বলল,

“স্যার খুব সরি। সত্যি বলতে আমাদের কারোই মনে ছিল না। আজ খেয়া ও রিমি এসে জানাল সবাইকে। খেয়া আপনার জন্য গিফটও এনেছে।”

মাহমুদ গাম্ভীর্যপূর্ণ মুখে বলল,

“আমি এমনিতেই গর্ববোধ করি আপনাদের নিয়ে। উইশ করেছেন এটাই যথেষ্ট।”

খেয়া ড্যাম কেয়ার টাইপের মেয়ে। সবার সামনেই উঠে গিয়ে মাহমুদ স্যারের হাতে একটি কাঁচা গোলাপ ও হার্ট শেপের ট্রিট চকোলেট বক্স উপহার দিলো। আহ্লাদী সুরে মিষ্টি হেসে,

” এগেইন হ্যাপি বার্থডে স্যার।”

মাহমুদের মুখমন্ডলে উৎফুল্লতার ছাপ পড়ল না। স্মিত হেসে,

“থ্যাংক ইউ খেয়া। থ্যাংক ইউ সো মাচ।”

খেয়া গিয়ে বেঞ্চে বসলো। স্যার দাঁড়িয়ে থেকে বক্স খুলে নিলো।
‘আসুন সবাই মিলেই ভাগ করে খাই।’ বলে খেয়াসহ ক্লাসের সবার সঙ্গে ভাগ করে নিলো সব চকোলেট। নিজের মুখে পুরে দিলো একটা। খেয়া এতে বেজায় মনঃক্ষুন্ন হলো। রিমির কানে মুখ নিয়ে খেয়া ফিসফিসিয়ে বলল,

“দেখলি কাণ্ড? এত দামী চকোলেট নিলামে তোলার জন্য স্যারকে দিয়েছি? কেমনটা লাগে ক?”

রিমি ও খেয়া বেস্ট ফ্রেন্ড। রিমি বেঞ্চের নিচ দিয়ে খেয়ার উরুতে হাত রেখে বলল,

“এত হাইপার হইসনা ইয়ার। বি কুল।”

পরেরদিন ক্লাস শেষে খেয়া ও রিমি মাহমুদ স্যারের অফিস রুমে গেলো। খেয়া ব্যাগের ভিতর হতে সেইম চকোলেট বক্স নিয়ে মাহমুদের সামনে রাখলো। মাহমুদ হকচকিয়ে গেলো। হাতের কাজ বন্ধ করে তীক্ষ্ণ চোখে খেয়ার দিকে চাইলো।

“স্যার প্লিজ মাইন্ড করবেন না। ভুল আমারই হয়েছে গতকাল। সবার সামনে দিয়েছি। তাই আপনি ক্লাসে বিতরণ করে দিতে বাধ্য হলেন। এটা আমার ফেবারিট চকোলেট স্যার। আর তা আপনি খেলেন মাত্র একটা। আমি স্বস্তি পাইনি। তাই আজ আবার আপনার জন্য নিয়ে এলাম। আপনি বাসায় নিয়ে গিয়ে সব খাবেন।”

“ওহ সিউর খেয়া। থ্যাংকস। তবে এটার একদম প্রয়োজন ছিল না। যেহেতু আপনারা দুজন এসেছেন। তাহলে বলুন তো, কলি মেয়েটার সঙ্গে আপনাদের ক্লোজনেস নেই নাহ?”

“নাহ স্যার? এনি প্রবলেম? ”

“সেদিন আপনারা চলে যাওয়ার পর তার কথায় মনে হলো আপনারা দুজন ওর ফ্রেন্ড। কিন্তু তারপর ক্লাসে সেদিন মনে হলো নাহ। নয়তো আপনাদের কাছে ওর সেল নাম্বার থাকতো।”

“রাইট স্যার! বাট লাস্ট সারিতে বসা একটা সিম্পল মেয়েকে আপনি এত প্রায়োরিটি দিচ্ছেন কেন স্যার?”

বিরস কন্ঠে বলল খেয়া।

মাহমুদ ভ্রু কুঁচকালো। জবাবে বলল,

“কারণ আমার মনে হচ্ছে সেদিন আমি তাকে হার্ট করে অনেক কথা বলেছি। সে বারবার বলছিলো সে মেইল দেয়নি। আপনাদেরকে ডাকতে চেয়েছে। আমি বারণ করেছি।”

“বুঝলাম। আচ্ছা স্যার মেইলের বিষয়টা সেদিন আমাদের সামনে কলিকে জিজ্ঞেস করেন নি কেন? জাস্ট কৌতুহল থেকে জিজ্ঞেস করা স্যার।”

বিনম্র হলায় জানতে চাইলো রিমি।

“আমার কাছে নারী মানেই অনেক সম্মানের! গুরুত্বের! এটা আমার বাবার কাছ থেকে শিখেছি! যেহেতু মেইল ব্যক্তিগত ছিলো। তাই দ্বিতীয় কারো সামনে জিজ্ঞেস করে তাকে খাটো করতে চাইনি। যে কেউ হলেও আমি এভাবেই ডেকে জিজ্ঞেস করতাম।”

স্যারের বিবেকবোধ ও ব্যক্তিত্বে খেয়া,রিমি মুগ্ধ হয়ে গেলো। দুজনের চোখের কোন চিকচিক করে উঠলো।

“বুঝতে পেরেছি স্যার।”

“মেইলের বিষয় আপনারা কিভাবে জানলেন? এটাত কলি আর আমার মাঝের বিষয় ছিলো?”

ঠান্ডা স্বরে জানতে চাইলো মাহমুদ।

রিমি ঠোঁট কামড়ে ধরলো। ইসস! নিজের কথায় নিজেই ফেঁসে গেলাম। মনে মনে উচ্চারণ করলো। খেয়া কটমট দৃষ্টিতে রিমিকে শাসালো। তাদের ইচ্ছে ছিলো কখনোই সত্যিটা না জানানো স্যারকে। কলির উপরেই থাকুক বিষয়টা। নয়তো কলির মতো তাদেরকেও সেইম ইনসাল্ট করবে স্যার। দুজন দোনোমোনো করতে শুরু করলো। যেন এই রুম থেকে বের হতে পারলেই বাঁচে। খেয়া বলল,

“স্যার আপনাকে মোবাইলে পরে ফোন দিয়ে বলি?”

“আমার সেল নাম্বার আছে?”

“হ্যাঁ স্যার। নোটের বিষয়ে একদিন আপনিইতো মেইল এড্রেস ও মোবাইল নাম্বার বোর্ডে লিখে দিলেন। তখন ক্লাসের সবাই টুকে নিলো।”

“ওহ আচ্ছা। এখন বলুন।”
ভারকন্ঠে বলল মাহমুদ।

“স্যার প্লিজ। এখন যেতে হবে। তাড়া আছে। বলতে টাইম লাগবে। এ টু জেড সব বলল স্যার। প্রমিজ।”

অনুনয় করে বলল খেয়া।

“ওকে। এখন আসতে পারেন।”

ওরা দুজন দ্রুত বেরিয়ে যায় রুম হতে। মাহমুদ ল্যাপটপের কিবোর্ডে হাত চালানো

সকাল হতেই রেবেকা চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলছে। সিলিং ফ্যান নষ্ট হয়ে গিয়েছে। গরম তার একদম সহ্য হয়না। মিস্ত্রিকে খবর দেওয়া হয়েছে। এখনো আসেনি। কাজ করার খালা তিনদিনের ছুটি নিয়েছে। শ্বাসকষ্ট নিয়ে সব কাজ সামলাতে হচ্ছে একহাতে। ডাক্তার একগাদা পরিক্ষা দিয়েছে। করানো যাচ্ছে না। বাড়তি আয় নেই। তাই বাড়তি টাকাও নেই। ভবিষ্যতে যে আয় বাড়বে তারও লক্ষন নেই। পরপর তিন মেয়ের জননী হলো। বড় মেয়ে মিলিকে কলেজ পাস করিয়ে পাত্রস্থ করলো। ছোট মেয়ে জুলি পড়ে নাইনে। ঘরের কাজে মাকে সাহায্য করেনা। সুযোগ পেলেই টিকটক আর কি যেন নিয়ে পড়ে থাকে। আপন মনে হাসতে থাকে মিটমিটিয়ে। খেতে বসলেও হাসে। ঘুমাতে গেলেও হাসে। দেখলে মনে হয় চব্বিশ ঘন্টাই এই মেয়ের ঘাড়ে ভূত বা জ্বীন ভর করে থাকে।

মাঝখানে আছে কলি। সে এখন বড় যন্ত্রণা রেবেকার জীবনে। তার ঘাড়েও মনে হয় ভূত চেপে আছে। নয়তো একমাস হয়ে গেলো বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়না কেন। হয়তো প্রেমঘটিত ব্যাপার হবে। একটা পুত্রের মুখ দেখল না রেবেকা। আহ! স্রস্টার হিসাবটাই বুঝেনা রেবেকা। স্রস্টা কাউকে ষোলকলা পূর্ণ করে দেয়। কাউকে কিছুই দেয়না, শূন্য করে রাখে। তাদের রাখছে এই দুয়ের মাঝামাঝি। মধ্যবিত্ত ঘরের বড় সমস্যা হলো, না চাইতে পারে কারো কাছে। না হাত পাততে পারে। আত্মসম্মানটুকুই এদের সম্বল।

নুরুল হক অফিস থেকে বাসায় আসলেন ক্লান্ত শরীরে। জুলি গেট খুলে দিলো। বাবার হাতে একটা ব্যাগ দেখে বলল,
” বাবা কি আনলে?”

“নে ধর। দেশী পেয়ারা। তোর মায়ের পছন্দ। ধুয়ে খাবি কিন্তু।”

জুলি বেসিন থেকে একটি পেয়ারা ধুয়ে নেয়। রেবেকার সামনে গিয়ে পেয়ারায় কামড় বসিয়ে বলে,

” স্বাদ আছে আম্মু। কিছু কচকচে। কিছু টসটসে। নাও খাও।”

রেবেকা মেয়ের গালে চড় মেরে বসলো।
“তোরা খা পেয়ারা। সারাদিন গতর খাটতে খাটতে মরি। তুই থাকস কি বা*ল ছা*ল নিয়া। তোর বোনের কি মরা হইছে কে জানে। কিছু বলেও না। দরজা ভিড়ায়া রুমে কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে থাকে। ক্লাসে যেতে নাকি মন চায়না উনার। তাহলে করবে টা কি? বিয়ে দেই। ঘর সংসার করুক। ভাগ আমার চোখের সামনে থেকে।”

জুলি লাল হয়ে যাওয়া ফর্সা গাল ঢলতে ঢলতে কলির রুমে গেলো। কলির উপরে রাগ ঝাড়ল। কলি মায়ের সব কথা শুনতে পেলো। নুরুল হক বুঝতে পারলো রেবেকার মতিগতি আজ ভয়ানক। এর বড় কারণ কলি পড়াশোনা না করা। না এটার একটা বিহিত করতেই হবে। কলিকে আর ঘাটিয়ে লাভ নেই। অফিসিয়াল পোশাক চেঞ্জ করে ফ্রেস হয়ে নেয় নুরুল হক। রাতের খাবার খেয়ে চিন্তিত মনে ঘুমানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে।

তার পরেরদিন আগেই বাসা থেকে বের হয়ে যান নুরুল হক। কর্মরত অফিসে যাওয়ার পূর্বে কলির ইউনিভার্সিটিতে যান তিনি। সরাসরি বাংলা ডিপার্টমেন্টের অফিসে প্রবেশ করেন। সালাম দিলেন স্যারদের। সব ম্যাডাম ও স্যারগণ উপস্থিত রয়েছেন। ক্লাস শুরু হতে আরো আধঘন্টা দেরী আছে। সবাই চা পান করছেন। ডিপার্টমেন্টের হেড মিসেস নাজমা আশরাফ বললেন,

“কে আপনি? ”

“আমি আপনাদের একজন ছাত্রীর পিতা।”

“ওহ আচ্ছা। বসেন প্লিজ।”
বলে নুরুল হকের জন্য চায়ের অর্ডার দিলেন তিনি অফিসের চা সরবরাহকারীকে। তারপর জিজ্ঞেস করলেন,

“কোন ছাত্রী? কি হয়েছে বলুন?”

নুরুল হক উদ্বিগ্ন স্বরে জানালো,

“আটান্ন ব্যাচ। নাম মাইমুনা সুলতানা কলি। কলি একমাস ধরে ক্লাসে আসছে না। বাসায় কাউকেই কিছু বলছে না। আবার বাসায়ও কিছু হয়নি ম্যাডাম। ওর মা আর আমি চিন্তা করলাম ভার্সিটিতে কিছু হলো কিনা। বা কোন মনোমালিন্য কারো সঙ্গে। তাই এলাম আমি। ওর মা বলল পড়াশোনা না করলে বিয়ে দিয়ে দিবে। আপনারা যদি ব্যাপারটা কাইন্ডলি দেখতেন ম্যাডাম।”

কাতর স্বরে বললেন নুরুল হক। মিসেস হেড কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে উনাকে আস্বস্ত করলেন,

“আমরাতো আরো ভাবছি আপনাদের পারিবারিক কোন দূর্ঘটনা ঘটলো কিনা। আপনি আসাতে অত্যন্ত ভালো হয়েছে। কলির মোবাইল নাম্বার দিন আমাকে। এবং আপনি নিশ্চিন্ত মনে ফিরে যান। আমি বিষয়টা খতিয়ে দেখছি। এবং সমাধান করে
কলিকে সাতদিনের ভিতরে ক্লাসে আনাচ্ছি।”

নুরুল হক হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। কলির নাম্বার লিখে দিলেন। সব স্যারকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে চলে গেলেন অফিসে।

বাকি স্যাররা কলির বিষয়ে বলাবলি শুরু করলো।
“ওতো পড়াশোনায় খারাপ না। মনোযোগী স্টুডেন্ট আমাদের। আঁটসাঁট চলাফেরা তার।”

“হুম। তবে যেটাই হোক। সেটা কতটা খারাপ হলে একটা মেয়ে ভার্সিটিতে আসা অফ দেয়? ভেরি স্যাড”।

বলল খটমটে আমান স্যার।

“আমি বাসায় গিয়ে রাতে ফোন দিয়ে কথা বলব কলির সঙ্গে। আপনারা সবাই নিজ নিজ ক্লাসে যান। সময় হয়ে গিয়েছে।”

বলে বেরিয়ে গেলো মিসেস হেড। একে একে বাকি টিচাররাও চলে গেলো ক্লাসের উদ্দেশ্যে। মাহমুদ স্যার একটু ঘাবড়ে গেলো।

কলি যদি হেডকে তার অপমানের কথা বলে দেয়। তাহলে আমার জন্য ভালো সমস্যা হয়ে যাবে। পা ঘুরিয়ে আবার অফিসে প্রবেশ করলো মাহমুদ স্যার। চট করে কলির নাম্বার নিজের ফোনে তুলে নিলো। বিকেলেই হেডের আগে ফোন দিতে হবে কলিকে।

ঝিমিয়ে আসা ধূলোয় মাখা অবসন্ন বিকেল। কলি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি বেখেয়ালি। ঝিরিঝিরি হাওয়া বইছে। সে হাওয়ায় কোন প্রশান্তি নেই। কেবলই উষ্ণতা। মুঠোফোন বেজে চলছে। কলি রিসিভ করলো। হ্যালো বলতেই ভেসে এলো একটি পুরুষ কন্ঠস্বর। যেন চেনা চেনা লাগছে কিছুটা।

“হ্যালো..কলি শুনতে পাচ্ছেন?”

#Romantic #shortstory #shortstorywriter #rপুতুল #romanticsuspense #lovestory #loveshortstoryputul #writer #writing #genre #samajik #Rehana #putul