#তোমার_জন্য_সব -৩০
✍️ #রেহানা_পুতুল
কলি মনে মনে বলল,
ভালোবাসা সত্যি হলে প্রয়োজনে অনেক কিছুই বিসর্জন দিতে হয়। আশাকরি আমার কড়াডোজে এবার তুই খেয়া সিধা হয়ে যাবি।
হৃদয় দিয়ে হৃদয় কিনেছি। কারো ছিনিয়ে নেওয়ার সাধ্যি নেই।
কলি এবার নিজেই সংকোচবোধ করলো। সে কবে থেকে এমন এলো। ভালোবাসা বুঝি মানুষকে সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী করে তোলে? সে মাহমুদের দিকে মুখ তুলে চাইলো না আর। চলে যেতে পা বাড়ালো। মাহমুদ হাত টেনে ধরলো কলির। শিহরিত চোখে বলল,
“কলিকে ভালোবাসি। কলি বিকশিত হচ্ছে স্বমহিমায়। এটা আমার জন্য সুসংবাদ।এতটাই ভালোবাসতে চাই, যেন তার সমস্ত পাপড়িগুলো সঠিক নিয়মে প্রস্ফুটিত হতে পারে। আর আমি নিতে পারি তার সমস্ত অঙ্গসুরভির স্বাদ।”
“হাত ছাড়ুন স্যার!”
“স্যার?”
“এটা বাসা নয়।”
“ওহ! সরি। মনে পড়েছে। বাইকে যাবে একসংগে?”
“নাহ। লোকে দেখবে। জানাজানি হয়ে যাবে।”
“একটু আগে যে কাজ করেছেন,জানাজানি এমনিতেই হয়ে যাবে। তবে এটা মনে হয় ঠিক হয়নি কলি। আমরা স্বামী স্ত্রী। কিন্তু খেয়া জানলো নেগেটিভ কিছু।”
“আপনার কথা লজিক্যাল। আমাদের পবিত্র হালাল সম্পর্ককে খেয়া জানলো হারাম হিসেবে। আমি বাসায় গিয়েই খেয়াকে বিয়ের বিষয়টা জানিয়ে দিচ্ছি। তাহলেই চুকে যাবে সব।”
মাহমুদ বিষম খাওয়া কন্ঠে বলল,
“হায় হায়! তাহলে ত দুনিয়া রটে যাবে এবার?”
“নো স্যার। দুনিয়া নয় ক্লাসের দেয়ালটাও জানবে না। আমার কাছে সেই মহাষৌধ আছে।”
“কি জানতে পারি?”
কৌতুহলভরা সুরে জানতে চাইলো মাহমুদ।
“বাসায় আসুন। বলব। আমি গেলাম।”
কলি বের হয়ে বাসায় চলে গেলো। ওয়াশরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নিলো। বাতাসী টেবিলে কলির জন্য খাবার নিয়ে রাখলো। কলি তার আগেই বরাবরের মতো স্বশুর শাশুড়ীর রুমে গেলো দেখা করতে।
“বাবার শরীর খারাপ নাকি মা?”
“হ্যাঁ কলি। হঠাৎ করেই কেমন শরীরটা নেতিয়ে আসতেছে।”
প্রেশার চেক করতে হবে, বলে কলি প্রেশারের মেশিনটা নিলো। চেক করে দেখলো প্রেশার লো। দূর্বল শরীর। কলি দায়িত্বসুলভ ভঙ্গিতে মায়াজড়ানো স্বরে বলল,
” শরীর হঠাৎ এমন হলো কেন? বাবা ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করছেন না? ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে সন্ধ্যায়। আমি খেয়ে সিরিয়াল নিচ্ছি ইবনেসিনায়। লালবাগে আমাদের বাসার কাছে ওদের ব্রাঞ্চ আছে। আমরা কিছু হলেই সেখানে দেখাই।”
আবদুর রহমান চোখ বন্ধ করে নির্জীবের মতো পড়ে আছে। কলি উঠে গিয়ে ভাত খেয়ে নিলো। মনে পড়লো, খেয়াকে সেই বিষয়টা জানানোর কথা। ব্যস্ত ভঙ্গিতে আনুশকার রুমের বারান্দায় গেলো। সরাসরি খেয়ার হোয়াটসঅ্যাপে কল দিলো। খেয়া রিসিভ করলো সেই আশায়। ভিডিও ক্লিপের বিষয়টা জানার জন্য।
“খেয়া যেজন্য তোকে ফোন দিলাম। মাহমুদ স্যার বিয়ে করেছে শুনলি না,তার বউ আমি কলি। আমি যে ক্লাসে বলছি কাবিন হয়েছে আমার। সেটা স্যারের কথাই বলছি। একবারেই তুলে নিয়েছে। আশাকরি ক্লিয়ার হলি। বিষয়টা আমরা হাইড রেখেছি। এটা সংকোচের জন্যই। এর বাইরে কিছুই না। আশাকরি দুকান করবি মা। আর তোর ভিডিওর বিষয় পরে জানাচ্ছি। এখন বিজি।”
“নাহ। লাঞ্চ করেছি মা। এক ফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা করতে হয়েছে। একত্রে খেলাম।”
রাতে কলি স্বশুরকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো। মাহমুদ ব্যস্ত থাকার জন্য যেতে পারেনি। ডাক্তার পরিক্ষা দিলো। কলি পরিক্ষাগুলো করিয়ে নিলো সেখানেই।
রাতে মাহমুদ কলির থেকে পিতার শারিরীক কন্ডিশনের খোঁজখবর নিলো। তারপর প্রসঙ্গক্রমে খেয়ার বিষয়টা জানতে চাইলো। কলি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে মাহমুদকে বুঝ দিলো। নয়তো সে দেখতে চাইবে। তাকে না দেখানোই সমীচীন হবে। কলি মাহমুদের খোলা বুকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হলো। একই বালিশে একই কাঁথার নিচে। পনেরো সেকেন্ডের ভিডিও করলো। সেন্ড করে দিলো খেয়ার হোয়াটসঅ্যাপ মেসেঞ্জারে। কোন রিপ্লাই এলনা। তারমানে খেয়ার বিশ্বাস অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে ভিডিও ক্লিপ্টা।
মাহমুদ জিজ্ঞেস করলো,
” কি করলে কলি?”
কলি বলল,
” খেয়া বিলিভ করে না আমাদের বিয়ের কথা। প্রমাণ দিলাম।”
“আগে বলবা না তুমি? কোন বলিষ্ঠ প্রমাণ দিতাম। সেও তা দেখে বলিষ্ঠভাবে বিলিভ করতো। তুমি প্রমাণ দিলে যৎ কিঞ্চিৎ। সেও বিশ্বাস করবে যৎকিঞ্চিত। শুরু করবো কিছু?”
কলি মাহমুদের ঠোঁট বন্ধ করলো নিজের একহাত দিয়ে চেপে ধরে। মাহমুদ কলির হাতের তালুতে দুঠোঁটের নিবিড় স্পর্শ দিতে লাগলো।
পরেরদিন কলি হাসপাতালে গিয়ে রিপোর্ট নিলো। জানা গেলো র*ক্ত স্বল্পতার জন্য এমন হয়েছে। হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়াতে ক্লান্তিবোধ ও শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছে। আর হিমোগ্লোবিন শরীরে নানাবিধ কারণেই কমতে পারে। এক ব্যাগ রক্ত দিয়ে দিলেই ঠিক হয়ে যাবে। র*ক্তের গ্রুপ জানা হলো। কলির সঙ্গে মিলে গেলো রক্তের গ্রুপ। তারপর কলিই নিজ থেকে আগ্রহান্বিত হয়ে স্বশুরকে রক্ত দিলো। উনার দৈনন্দিন খাবারের প্রতি বিশেষ যত্ন নিলো। এভাবে এক সপ্তাহে নিজ দায়িত্বে স্বশুরের তদারকি করলো। সেবাশুশ্রূষা করে সুস্থ করে তুলল। তারা পুরো পরিবারের স্নেহ, মমতা বৃদ্ধি ও গভীর হলো কলির উপর।
মাহফুজা বলল,
“দেখলেন ত, আমার পছন্দ কত দারুণ? কত ভালো ফ্যামেলির মেয়েকে আনলাম। বাবা,মা ভালো হলে সন্তানেরাও ভালো হয়। নিজের গায়ের র*ক্ত দিয়ে আপনাকে সুস্থ করে তুললো।”
” এই সেরেছে। এবার ত তুমি এই ক্রেডিট নিতে নিতেই আমাকে জব্দ করবা।”
প্রাণময় হাসি দিয়ে বলল আবদুর রহমান।
“আমার শ্বশুরকে নিয়ে হাসপাতাল, ডাক্তার, রিপোর্ট, ব্লাড দেওয়া,সব মিলিয়ে দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছে। আরেকদিকে ফাস্টফুড সামলানো। তাই দেওয়া হয়নি।”
“স্বশুর মিনস মাহমুদ স্যারের ফাদার?”
“হুম।”
“এবার বল কলি।”
কলি খেয়াল করলো,খেয়ার গলার স্বর হালকা নমনীয়। চাহনি নরম। কন্ঠে নেই আগের মতো তেজস্বীয়তা ও দম্ভ! কোন ঐশ্বরিক যাদুবলে যেন খেয়ার সব অহমিকা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো এক লহমায়। হ্যাঁ তাই। একজন মেয়ে বা নারীর সম্ভ্রম লুটে গেলে তার আর মর্যাদাটুকু রইলো কই।
কলি সংক্ষেপ করে বলল,
” একদিন দুপুরে আমার ফেসবুক মেসেঞ্জারে সেই ভিডিও ক্লিপ দিয়েছে তোর প্রাক্তন নেহাল। সম্ভবত সে আমার নাম ফেসবুকে সার্চ করে বের করেছে। আর নাম হয়তো তোর কাছেই শুনেছে। নিশ্চয়ই তুই আমাকে মুরগী বানানোর গল্পটা তাকে বলেছিস বেশ রসিয়ে রসিয়ে। তুই চাইলে স্ক্রিন শট দিতে পারি তোকে। আমি ভিডিও প্লে করে দেখে ত স্তব্ধ হয়ে গেলাম। ভাবলাম তোর কোন শত্রু হয়তো। এডিট করে এমন করেছে।
জিজ্ঞেস করতেই বলল,
” খেয়া আমার সঙ্গে বেঈমানী করেছে। আমাকে ছারখার করে দিয়েছে। সে তার এক স্যারকে লাভ করে। আপনার সঙ্গে নাকি তার মনোমালিন্য হয়েছে। এটা আপনি রাখেন। প্রয়োজন মনে করলে তাকে শায়েস্তা করতে পারবেন এনিটাইম। ”
বুঝলি এবার। আমি ভুলেও গেছি খেয়া। কিন্তু তুই সেদিন আমার দোকানে খুব বাজে আচরণ করেছিস আমার সঙ্গে। আবার আমার বর মাহমুদের পিছু ছাড়ছিস না। তাই তোকে বলতে বাধ্য হলাম। আমার কাছে এটা গচ্ছিত থাকবে। কখনোই কেউ দেখবে না। আমার বরও দেখবে না।
খেয়ার মুখ দিয়ে কোন রা সরছে না। আশি বছরের বৃদ্ধার ন্যায়
পা টেনে টেনে কলির সামনে হতে চলে গেলো। কলি খেয়ার চলে যাওয়া দেখলো পলকহীন চোখে।
খেয়া দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,
নেহাল তাহলে রিমুভ করেনি এটা? একবার দেশে তার পা পড়ুক। বুড়িগঙ্গার কালো জল তার র*ক্তে লাল করে ফেলব আমি খেয়া।
খেয়া সেদিন মধ্যরাত অবধি কলিকে নিয়ে ভাবলো। কলির কাছে যেমন সে সারাজীবনের জন্য ছোট হয়ে গেলো। বড় গলায় কথা বলার কোন পথ অবশিষ্ট রইল না। সেইম একটা ভিডিও ক্লিপ যদি কলির হয়। আর তা যদি তার কাছে থাকে। তাহলে ব্যপারটা কেমন হয়। খেয়া বিলম্ব করল না। একটা পাতি মাস্তানকে ফোন দিলো। যে কিনা তারসঙ্গে কলির ফুড শপে গেলো।
খেয়া তাকে বলল,
” আপনি আর একজন ছেলে হলেই হবে। আগামীকাল সে ভার্সিটি থেকে যাওয়ার সময় তুলে নিবেন। অন্তরঙ্গ কিছু মুহূর্ত ক্রিয়েট করবেন দুজন মিলে কলির সঙ্গে। ভিডিও করে নিবেন। দেন আমাকে দিবেন। আমি ভিডিও হাতে পেলেই আপনাকে ক্যাশ দিয়ে দিবো।”
ওপাশ হতে জবাব এলো,
“যথাসময়ে কাজ হয়ে যাবে। আমি ভাড়ায় খাটি। এসব কাজ পল্টুর কাছে মশা মাছি মারার মতো।”
তারপরের দিন কলি ভার্সিটিতে যায়। মাহমুদ যায়নি কারণবশত। কলি ক্লাশ শেষে বের হয়ে নিচে যায়। হেঁটে গিয়ে বাস স্টপেজে দাঁড়ায়। অপেক্ষা বাসের জন্য। কিন্তু তার কাঙ্ক্ষিত বাস আসছে না। কলি পা বাড়ায় সামনের দিকে।
“চোর যখন চুরি করে, সে মনে করে কেউই দেখেনি। কেউই জানে না। কিন্তু সে নিজের অজান্তেই এমন এক প্রমাণ রেখে যায়, যা তার গোটা জীবনটা ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সঙ্গে তার পরিবারেরও।”
“তোর মনে হয় পাখনা গজালো ইদানীং? নিউ বিজনেস দিলি। কাবিন হলো। মাহমুদ স্যারের নেক নজর লাভ করলি। সবমিলিয়ে ফাঁফরে আছিস। তাই না? কিন্তু তুই কি জানিস পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে?”
কলি বাঁকা হাসলো। ধীর কন্ঠে খেয়াকে বলল,
“খেয়া এটা বাসা নয়। পাবলিক প্লেস। আমি এমন কিছু তোকে এখন বলতে চাই না,যাতে তুই বাসা পর্যন্ত না যেতে পারিস। সুতরাং ভালোর ভালো স্থান ত্যাগ কর বলছি। সিচুয়েশন অপ্রীতিকর করে তুলতে চাই না আমি। কারণ আমি তোর মতো অভদ্র নই। একজন মেয়ে হয়ে অন্য একজন মেয়ের এতটুকু গুরুত্ব আমার কাছে আছে।”
খেয়া নাকমুখ লাল করে চলে গেলো। তবে মনের ভিতর কঠিন শংকা কাজ করছে। কলি কি মিন করে কিসের ইঙ্গিত দিলো তাকে। কিছুই বুঝে উঠছে না সে। ভীষণ গোলমেলে লাগছে তার কাছে।
কলি বসে পড়লো চেয়ারে। ম্যানেজার কিছু একটা ডাউট করলেও কলিকে জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না। কলির বাকিদিন কাটলো অসহিষ্ণু মেজাজে। ভাবছে,
খেয়া মেয়েটা কি মানুষ? সেই শুরু থেকেই নানাভাবে, নানা প্রকারে আমাকে হেনস্তা করায় চেষ্টায় লিপ্ত হয়ে আছে। আগের চেয়ে এখন যেন বেড়ে গিয়েছে এই খেয়া। এর অবশ্য স্পষ্টত দুটো কারণ আছে। সেদিন মাহমুদ স্যারের হয়ে তাকে চড় মারা। এবং যখন সে জানলো আমি স্যারকে পছন্দ করি। এবং স্যার আমার অনুভূতিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। বাকি ইতিহাস শুনলে যে খেয়ার কি হাল হবে। ওহ নো! বলেই কলি ডানে বামে মাথা দুলিয়ে আলতো হেসে উঠলো।
সেদিন কলি সময়ের আগেই বাসায় চলে গেলো। তবে নিজেদের বাসায় গেলো। যদিও কলি বিয়ের পর শ্বশুরের বাসায় বেশিরভাগ সময় থাকে। সেখান থেকেই পড়াশোনা চালিয়ে নিচ্ছে। আনুশকার রুমেই সে পড়াশোনা করে। ভার্সিটি যাচ্ছে। দোকান পরিচালনা করছে। সন্ধ্যায় কলিকে দেখেই জুলি গোল গোল চোখে চাইলো বোনের দিকে।
“আচ্ছা দিবো। হ্যাঁরে, মাহমুদ, আপা,ভাই কিছু বলে আমাদের দোকান নিয়ে? তোর সময় দিতে হয় যে,আবার সেই বাসা থেকে ডিমের পুডিং, ভেজিটেবল রোল বানাই নেস বলে?”
“ধুর! কি যে বল না। আমি আমাদের বাসার মতই সেখানে ফুল ফিড্রম নিয়া চলতে পারি। তারা কিছুই মনে করে না। বরং আমাকে মেন্টালি সাপোর্ট দিতে পারছে। এই ভেবেও তারা আনন্দ পায়। এডুকেটেড ফ্যামিলির পারসনগুলো খুবই ব্রড মাইন্ডের হয় আম্মু!”
” সহনশীলতা,পরোপকারী, মহৎ মনের মানুষগুলোই এমনিই।”
বলল কলির বাবা। কলির বাবার দিকে চেয়ে বলল,
“আর আব্বু, উনারা যে যা আমার কাছে এক্সপেক্ট করে,তার তো কমতি হচ্ছে না। আমি আমার দায়িত্বগুলো সবই পালন করছি।”
“আলহামদুলিল্লাহ মা। ঠিকভাবে চলিস তাদের মন যুগিয়ে।”
কলি দোকানের ভালোমন্দ বিষয়গুলো বাবার সঙ্গে শেয়ার করলো। নুরুল হকও বুঝে নিলেন। কলি বাবা মায়ের সঙ্গে একত্রে ডিনার সেরে নিলো। রাতে একাই রিকশা নিয়ে বাসায় চলে গেলো। তালের পিঠাগুলো বের করে নিজ হাতে একটি প্লেটে নিয়ে নিলো। স্বশুরের রুমে গিয়ে তাদের দুজনের সামনে রাখলো।
“কি এটা বৌমা?”
“বাবা এটা তালের পিঠা। মা আপনাদের জন্য দিলো কিছু।”
“বাহবা। আঞ্চলিক পিঠার স্বাদতো ভুলতেই বসেছি আমরা শহুরে বাস করা মানুষেরা। তাল কি গ্রাম থেকে আসা?”
“নাহ বাবা। আব্বু শখ করে একটা কিনে নিয়েছে।”
মাহফুজা পটাপট তিন চারটে পিঠা খেয়ে নিলো। আবদুর রহমান মুখে দিতে গেলে কলি বলে উঠলো,
“বাবা খাওয়ার আগের মেডিসিন খেয়েছেন?”
“খেলাম মা।”
“তাহলে খেতে পারেন পিঠা।”
“ওহ! দারুন স্বাদ লাগলো। আরো খেতে হবে বেয়াইনের নরম হাতের নরম পিঠা।”
“আপনি যে গিয়েছেন বাবার বাসায়? কার অনুমতি নিয়েছেন?”
কলি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। মুখের উৎফুল্লভাব মুহূর্তেই মিলিয়ে গেলো। সে জবাব দেওয়ার আগেই মাহফুজা বলে উঠলো ছেলের উদ্দেশ্যে,
“মাহমুদ কি হলো আজ তোর হঠাৎ? কলি আমাকে ফোনে বলেছে তাদের বাসায় যাচ্ছে। আসবে রাতে। আমি তোর মা। তোর ও আর কলির অভিভাবক। আমার কাছে বললে তোর কাছে আলাদা করে এত বলতে হবে কেন?”
মাহমুদ পিঠা খেল না। চলে গেলো।
“বাপের মতো একটা গোঁয়ার হয়েছে। কলি পিঠা রুমে নিয়ে যাও। এত মজার পিঠা পাবে কই?”
কলি ছোট একটি কাঁচের বাটিতে করে তিনটে পিঠা নিয়ে রুমে ঢুকলো। মাহমুদ ল্যাপটপের টেবিলে বসে কাজ করছে। কলি একটি পিঠা নিয়ে মাহমুদের মুখের সামনে বাড়িয়ে ধরলো। মাহমুদ কলির হাত চেপে ধরলো। তিন কামড়ে পিঠা খেয়ে নিলো। উঠে দাঁড়ালো। পানি খেয়ে নিলো। বিছানার উপরে উঠে শুয়ে গেলো। কলিকে আদেশপূর্ণ কন্ঠে বলল,
“দরজা অফ করে বেডে আসুন।”
কলি অনুগত স্ত্রী হয়ে ঠিক ঠিক বিছানায় উঠে গেলো। বসে রইলো।
“শুয়ে পড়ুন বলছি।”
কলি শুয়ে পড়লো ঠোঁট উল্টিয়ে। মাহমুদ কলির পায়ের উপর এক পা তুলে দিলো। কলির রাঙা দুই ঠোঁটের মাঝে আঙুল বুলাতে বুলাতে বলল,
“বাসায় এসে আপনাকে না দেখে ভালো লাগেনি। বিয়ে হলো কয়মাস হলো। এখনো আপনার সব ধরনের জড়তা কাটেনি। কি করতে হবে আমার বলেন ত? নাকি আপনার পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমার প্রতি মনোযোগ হারাচ্ছেন?”
“কিছুই করতে হবেনা স্যার। মনোযোগ হারানোর প্রশ্নই আসে না।”
ছোট্ট করে বলে কলি মাহমুদের বুকে মাথা রাখলো।
“আজ নাইট ড্রেস পরলেন না যে? চেঞ্জ করে আসুন। এতে সবভাবেই কম্প্রোটেবল ফিল হবে আপনার।”
খেয়া চলে গেলো। মনটা অশান্তিতে ছেয়ে আছে। রাতে মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে অনবরত তাকাচ্ছে। তখন সময় দশটা। খেয়ার হোয়াটসঅ্যাপে টুং করে আওয়াজ হলো পরপর দুটো মেসেজের। একটা ভিডিও ক্লিপ। পনেরো মিনিটের। আর একটা মেসেজ। খেয়া মেসেজটা পড়লো।
“তোর ক্রাশ মাহমুদ স্যার ও ডিপার্টমেন্টে কখনো যাবে না এটা। ডোন্ট ওরি। কেবল মন চাইলে মাঝে মাঝে আমি অন করে দেখবো,কিভাবে আমার ক্লাসমেট খেয়ার থেকে একসঙ্গে দুজন যুবক মজা নিচ্ছে।”
খেয়া ভিডিও ক্লিপ অন করলো। দেখেই সে স্তম্ভিত! বাকরুদ্ধ! তার নাকমুখ দিয়ে তপ্ত ধোঁয়া নির্গত হতে লাগলো।
এই ভিডিও নেহাল রিমুভ করেনি? সে মিথ্যা বলেছে আমাকে? কিন্তু কলি কিভাবে পেলো এটা? এবার?
চলবে…২৮
#তোমার_জন্য_সব -২৯
✍️ #রেহানা_পুতুল
খেয়া ভিডিও ক্লিপ অন করলো। দেখেই সে স্তম্ভিত! বাকরুদ্ধ! তার নাকমুখ দিয়ে তপ্ত ধোঁয়া নির্গত হতে লাগলো।
এই ভিডিও নেহাল রিমুভ করেনি? সে মিথ্যা বলেছে আমাকে? কিন্তু কলি কিভাবে পেলো এটা? এবার?
খেয়া মুহূর্ত দেরী করল না। কলি তার মাথা পুরোপুরি নষ্ট করে দিয়েছে। সে সদ্য দেশ ছাড়া তার কাজিন নেহালকে মেসেজ দিলো। ভয়েজ নোট দিলো একাধিক। কিন্তু নো রেস্পন্স। খেয়ার মরি মরি দশা। সে কলির হোয়াটসঅ্যাপেও ভয়েজ নোট দিলো। কলি ননদ আনুশকার রুমে পড়ার টেবিলে বসে পড়ছে। রুমের দরজা চাপানো। খেয়ার ভয়েজ নোটটি প্লে করে হেডসেট দিয়ে শুনলো।
“কলি প্লিজ, বল তুই এই ভিডিও ক্লিপ কোথায় পেলি? কে দিলো?”
কলি ঠোঁট ভিড়িয়ে হাসছে।
খেয়ার গলার স্বর দুর্বল! নিরীহ! মিনমিনে! মনে হচ্ছে জেলখানার পালানো আসামি। কলি রিপ্লাই দিচ্ছে না খেয়ার। কারণ সে প্রয়োজন মনে করছে না। তার কাজ শেষ। এবার ডাঙায় তোলা মাছের মতো খেয়ার তড়পানো দেখবে সে। খেলারাম খেলে যা।
কলির হোয়াটসঅ্যাপ মেসেঞ্জারে খেয়া ফোন দিয়ে বসলো। কলি রিসিভ করলো। নয়তো বজ্জাতটা দিতেই থাকবে। নেট অফ করারও সুযোগ নেই। নেটে তার কাজ আছে। কলি রিসিভ করে আনুশকার বারান্দায় গেলো। গ্রিল ধরে বাইরে দৃষ্টি রেখে খেয়ার সঙ্গে কথা বলছে। মাহমুদ বোনের রুমে গিয়ে দেখলো কলি নেই। বারান্দা হতে তার কন্ঠ শোনা যাচ্ছে। মাহমুদ বারান্দার দরজায় গিয়ে একটু চেপে রইলো। যেন কলি টের না পায়। কলি কার সঙ্গে কথা বলছে?
“কলি প্লিজ তুই এই ভিডিও ক্লিপ কোথায় পেলি?”
“আমি যেখান থেকেই পাই। মেয়েটাতো তুই। নাকি বলবি এটা প্রযুক্তির ভেলকিবাজি?”
” বল না কে দিলো?”
“যার সঙ্গে তুই প্রতারণা করেছিস। যাকে ঠকিয়েছিস। যার বিশ্বাস নষ্ট করেছিস। যার ইমোশন নিয়ে খেলেছিস। যার সময়,অর্থ ও শরীরের ক্ষতি করেছিস। সেই দিলো।”
“নেহাল? আমার কাজিন?”
“ইয়েস সিস। ইয়েস।”
সপ্রতিভ কন্ঠে বলল কলি।
“সে তোকে কেন দিলো?”
“সেটা তোর পাক্তন বয়ফ্রেন্ড নেহালকে আস্ক করিস।”
“ওকেহ। বাট তুই আমাকে দিলি কেন?”
“এইতো। জায়াগামতে এসে গেছিস। এটাই টু দ্যা পয়েন্ট। আমি দিয়েছি তুই মাহমুদ স্যারকে যেন আর বিরক্ত না করিস।”
“এতে তোর এত লাগে কেন কলি?”
অবিনীত স্বরে জিজ্ঞেস করলো খেয়া।
“মাহমুদ স্যার আমার ক্রাশ। আমি মাহমুদ স্যারকে ভালোবাসি এবং অনন্তকাল ধরে বাসবো। তার ছায়ায় আমি কোন মেয়ের ছায়াও দেখতে চাই না।”
“মাহমুদ স্যার কি তোকে বিয়ে করবে?”
“শত কোটি বার করবে৷ করতে বাধ্য তিনি।”
“আমার মতো স্যারকেও ব্ল্যাকমেইল করেছিস মনে হয়? তুই তো দেখি ঠান্ডা মাথার ক্রিমিনাল। ”
অবজ্ঞার স্বরে বলল খেয়া।
কলি চট করে ফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলো। মাহমুদ খেয়ার কথা না শুনলেও কলির প্রতিটি রিপ্লাই সে শুনতে পেলো। কলি রুমে ঢুকতেই মাহমুদকে দেখে ভূত দেখার মতো ভড়কে গেলো। মাহমুদ পুরো দরজা দখল করে দাঁড়িয়ে আছে। কলি যেতে পারছে না।
মাহমুদ কলির একহাত ধরে দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“আমি তোমার ক্রাশ? আমাকে নিয়ে এত জেলাস? কই ভুলে কখনো একবারও তো বলনি আমাকে ভালোবাসো? অথচ খেয়াই হবে হয়তো, তাকে বললে আমার ছায়াতে কারো ছায়াও তোমার সহ্য হয়না। নাহ?”
কলি তীব্র সংকোচে দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে বসে পড়লো। চোখ মেলে তাকাবার জো নেই তার। মাহমুদ কলির হাত ধরে দাঁড় করালো। প্রায় টেনে নিয়ে গেলো নিজেদের বেডরুমে। কলির মাঝে পালাই পালাই ভাব। কলি দেয়াল চেপে দাঁড়ালো। মাহমুদ কলির দুহাত দেয়ালের উপর মেলে ধরলো। আঙ্গুলে আঙ্গুল গুঁজে নিলো। দুই জোড়া হাত, এক জোড়া হয়ে গেলো চোখের পলকেই। কলির স্বাস প্রশ্বাস বেড়েই চলছে।
“স্যার ছাড়ুন না। আর ইউ ক্রেজি? ক্রেজি ফর মি?”
“ইয়েস মাই লাভ! ক্রেজি ফর ইউ। আমাকে তুমি করে বলবে এবং ভালোবাসি বলবে। এক্ষুনি। এই মুহূর্তে। আমিও আর আপনি সম্বোধন করে কথা বলব না। ভার্সিটি গেলে একটু কেয়ারফুল্লি থাকলেই হবে দুজনের। সেমিস্টারও আর বেশি নেই।”
“ঠোঁট কিন্তু বেপরোয়া হয়ে উঠবে। এবং ক্রমশ নিচে নামতে থাকবে। সো বলো বলছি।”
“বাকি থাকুক স্যার। পরে বলব।”
“বাকির নামে ফাঁকি। আজ থেকে নো স্যার,নো আপনি। মাহমুদ এবং তুমি বলবে।”
কলি হাত ছাড়াতে পারছে না। মাহমুদ কলির পেটে, পিঠে সুড়সুড়ি দিতে লাগলে কলির হাসি চলে আসে৷
“বল, মুক্ত হতে হলে?”
“আহু! উঁহু! ছাড়েন না বলছি।”
মাহমুদ ছেড়ে দেয় কলিকে। কলি বিছানায় উঠে কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে যায়। মাহমুদ লাইট অফ করে বেডে উঠে যায়। কলির কাঁথার নিচে ঢুকে পড়ে। কলি পিটপিট চোখে চায় মাহমুদের দিকে। মাহমুদ কলিকে জড়িয়ে ধরে। কলিই নিজ থেকেই মাহমুদের কানের কাছে হিসহিসিয়ে বলল,
“ভালোবাসি মাহমুদকে। জীবন দিয়ে ভালোবাসি।”
ওরেহ! আমার ফুটন্ত গোলাপ কলি। যেই ঠোঁট দিয়ে এই ভালোবাসি শব্দটি উৎসারিত হয়েছে। সেই মিষ্টি ঠোঁটজোড়াকে নিবিড়ভাবে আদর করে দিতে চাই। কলি বলল,
“উঁহু! নাহ ব্যথা!”
” ব্যথা দিব না। যত্ন করে আদর করবো। ”
বলে কলির অধরযুগল মাহমুদ নিজের মুখে পুরে দিলো। তার অবাধ্য হাত উম্মাতাল খেলা করে যাচ্ছে কলির বুকের উপরে। কলি, উঁহু ব্যথা পাচ্ছি তো বলে উঠলো। মাহমুদ হাত থামিয়ে দিলো। নিজের ঠোঁটজোড়া সরিয়ে নিলো।
কলিকে জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার ডায়াবেটিস আছে কলি?”
“নাতো।”
ভ্রু কুঁচকে বলল কলি।
“তাহলে ডায়াবেটিস রোগীর মতো এত ব্যথা ব্যথা করে কেনো? হাতটা দিব কই? বলে দাও?”
“কোথাও দিতে হবে না। বেশরম পুরুষ আপনি।”
” লজ্জা নারীর ভূষণ। পুরুষের নয়৷ লক্ষ বার হাত দিতে হবে৷ কি সুন্দর রজনী। একই কাঁথার নিচে মিশে আছে দুটো হৃদয়। দুটো শরীর। অথচ সেই দুটো দেহের আলিঙ্গন হবে না। আঙ্গুল আঙ্গুলে ঠোকাঠুকি হবে না। তা হয় না।”
বলে মাহমুদ কলির পেটের উপর হাত বুলাতে লাগলো আলতো করে। বলল,
মাহমুদ কথা বাড়ালো না। কারণ সে বুঝলো, কলি তার কাছ হতে কিছু গোপন রাখতে চায়। কলির চাওয়া,ইচ্ছার গুরুত্ব তার কাছে অধিক।
ভার্সিটিতে কলির ক্লাস থাকে তিনদিন মাত্র। তাই সে বাকিদিনগুলোতে প্রায় পুরোদিন সময় দিতে পারে তাদের দোকানে। যদিও এতে বাসায় টুকটাক হলেও সমস্যা হচ্ছে। এসব কলি বুঝে। তবুও তার কিছুই করার নেই। তার বাবা,মা,বোন,পরিবারের ঢাল হয়ে তাকে দাঁড়াতেই হলো।
এমন এক বিকেলে কলি শ্বশুর, শাশুড়ী, ননদকে নিজেদের দোকানে নিয়ে গেলো। ইচ্ছেমতো খাওয়ালো। আবদুর রহমান পিতৃসুলভ কন্ঠে বললেন,
“হয়েছে মা। এভাবে নিজের মানুষদের খাওয়াতে থাকতে ব্যবসা চলবে না মা।”
কলি আন্তরিক হাসলো। কন্ঠে কৃতজ্ঞতা ঢেলে বলল,
” বাবা,আপনারা সবাই আমার পরিবারের জন্য যেই সাপোর্ট দিয়েছেন, তার ঋণ অপরিশোধযোগ্য।”
“এত নমনীয় করে বলতে হবে না ভাবি। এটা আমাদের কর্তব্য। তুমি আমাদের পরিবারের একজন। তো সেই একজনের ভালোমন্দ আমরা দেখব না। বলো?”
বলল আনুশকা।
“#তোমার_জন্য_সব করতে পারি আমি কলি। সব। যেদিন বাইক এক্সিডেন্ট করেছি। সেদিনই আমি টের পেলাম, এই কলি মেয়েটাই আমার একলা জীবনের সঙ্গী হওয়ার জন্য যথেষ্ট। নিকষ কালো আঁধারেও যার হাত ধরে আমি পৌঁছে যাব দূর দিগন্তে। পাড়ি দিতে পারি সাত সমুদ্র তেরো নদী। অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করলে ভার্সিটিতে জানাতাম। স্যারদেরকে ইনভাইট করতাম অবশ্যই। কিন্তু তুমি চাও না বলেই হাইড করে যাচ্ছি।”
স্যার, বলে কলি মাহমুদের হাঁটুর নিচে বসে পড়ল। কপাল ঠেকিয়ে ধরলো মাহমুদের হাঁটুতে। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। বলল,
“আমিও আপনার জন্য সব করতে পারি। সব।”
“সব লাগবে না। উঠো। আপাতত রাতের আনন্দটুকু দাও। এই প্রমাণ পেলেই আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখি মানুষ। আজ কোন ব্যথা শুনব না।”
মুচকি হেসে বলল মাহমুদ।
সেই নিস্তব্ধ নিশিতে কলি মাহমুদের সুখের বাধা হয়ে রইল না। সমস্তই উজাড় করে দিলো। যেমন করে অকাতরে সব বিলিয়ে দেয় প্রকৃতি মানুষকে। মাহমুদও সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে এতটুকু পিছপা হলো না।
নিসংকোচে, নিলজ্জায়, নিদ্বিধায় সারারাত্রি ধরে কলির সবটুকু নির্যাস আস্বাদন করলো মধুপিয়াসী ভ্রমরের ন্যায়।
তার পরের একদিনের ঘটনা। কলি ভার্সিটিতে গেলো। খেয়াও এলো। গত সপ্তাহে খেয়া ভার্সিটিতে এল না । কলি তাকে এভাবে জব্দ করবে এটা তার কল্পনাতীত ছিলো। তাই তার গোটা শরীর ও মন অসাড় হয়ে ছিলো। ক্লাস শেষে খেয়া কলিকে ডাকলো। বলল,
“নেহালকে পাচ্ছি না জানতে। তুই বল কখন,কিভাবে, কেন সে এই ভিডিও ক্লিপ তোকে দিলো?”
“এটা বলার মুড নাই এখন। পরে অবশ্যই বলল। ডোন্ট ওরি।”
“তাহলে এটা বল,আমাকে যে মাহমুদ স্যারের পিছু ছাড়তে বললি,তুই কি সত্যি স্যারকে লাভ করিস? সেদিন রাতে তোর বলাগুলো মনে হলো মিথ্যা।”
“সত্যি হলে কি করবি?”
আত্মবিশ্বাসী সুরে বলল কলি।
“তুই প্রমাণ দিতে পারলে স্যারকে আর চাইব না।”
“আয় আমার সঙ্গে”
মাহমুদ চেয়ারে বসে আছে। রুমের ভিতরে এলো কলি ও খেয়া। কলি দরজা চাপিয়ে দিলো।
“কি ব্যপার কলি, খেয়া? আপনারা দুজন একসঙ্গে?”
খেয়া চুপটি করে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। কলি মাহমুদের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। মাহমুদের গলা পেঁচিয়ে ধরলো দুহাত দিয়ে। মুখ ঝুঁকিয়ে মাহমুদের একগালে গাঢ় চুমু খেলো। বলল,
“স্যার, আমি আপনাকে ভালোবাসি, এটার প্রমাণ পেলেই খেয়া আপনাকে ভুলে যাবে।”
মাহমুদ নিমিষেই উঠে দাঁড়ালো। কলির দু’গাল চেপে ধরে ঠোঁটে চুমু খেলো। খেয়ার দিকে মুখ তুলে চাইল মাহমুদ।
খেয়ার মুখাবয়বে একরাশ কাঠিন্যতা ও অসিহষ্ণুতা ভর করলো। তার কর্ণকুহরে যেন উত্তপ্ত সীসা ঢেলে দিলো মাহমুদ নিজের হাতেই। সে দুপদাপ পায়ে বের হয়ে গেলো রুম থেকে।
কলি মনে মনে বলল,
ভালোবাসা সত্যি হলে প্রয়োজনে অনেক কিছুই বিসর্জন দিতে হয়। আশাকরি আমার কড়াডোজে এবার তুই খেয়া সিধা হয়ে যাবি। হৃদয় দিয়ে হৃদয় কিনেছি। কারো ছিনিয়ে নেওয়ার সাধ্যি নেই।
#তোমার_জন্য_সব -২৬
✍️ #রেহানা_পুতুল
হঠাৎ তার হোয়াটসঅ্যাপে একটা মেসেজ এলো। সে মেসেজটি পড়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলো। আবার সেই উটকো ঝামেলা? তার দৃষ্টিভ্রম হলো নাকি। সে মেসেজটি পুনরায় পড়লো বোঝার জন্য।
“স্যার খেয়াকে নিয়ে আসা হয়েছে দেশে। সে এখন ভালোর দিকে আছে। আপনি কি খেয়াকে বিয়ে করবেন?
এটা ক্লিয়ার করে জানান। আমার স্বশুর বলেছে আপনি খেয়াকে বিয়ে করলে তাদের বাড়ির একটা ফ্ল্যাট আপনার নামে লিখে দিবে।”
মাহমুদ বুঝলো এই মেসেজ খেয়ার ভাবি দিয়েছে। এবং মনে মনে আওড়ালো,তারমানে এই মেয়ের মাথা থেকে এখনো আমার ভূত যায়নি। মাহমুদ সঙ্গে সঙ্গেই সেই মেসেজের রিপ্লাই দিলো।
“সরি। আমি আমার মায়ের পছন্দের এক মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেছি।বউ এখন আমার পাশেই আছে। খেয়ার জন্য শুভকামনা।”
মেসেজ সেন্ড হয়ে গেলো। মাহমুদ খেয়াল করলো তার মেসেজের আর কোন রিপ্লাই এলোনা।
সকালে কলির আগেই মাহমুদ ঘুম থেকে জেগে গেলো। মাহমুদ কলির দিকে কাত হয়ে ঝুঁকলো। কপালে,ঘাড়ে হাত রাখলো। দেখলো কলির গায়ে এখন জ্বর নেই। কলি উঁহু বলে কুঁকিয়ে উঠলো। মাহমুদ হেসে বলল,
“কপালে হাত রাখলেও ব্যথা পান আপনি? তো হাত কোথায় রাখবো বলে দেন?”
কলি নিরুত্তর। মাহমুদ কলির চোখের সামনে সেই মেসেজটি ওপেন করে ধরলো। কলি পিটপিট করে চেয়ে মেসেজ দুটো পড়লো। পরক্ষণেই চোখ বড় করে ফেলল। মোবাইলটা নিজের হাতে নিয়ে নিলো। ভালো করে পড়লো। চোখে মুখে কাঠিন্যতা ভর করলো। অভিমানে মুখ গোঁজ করে ফেলল। মাহমুদ লুকানো চোখে কলির অভিব্যক্তি পরখ করে দেখলো। এবং মনে মনে বলল,
“এইতো কাজ হচ্ছে। তোমার ভিতরে আমাকে নিয়ে এই জেলাসিভাব হোক এটাই ত আমি চাই। তুমি কবে থেকে যেচে আমাকে একটু ভালোবাসা বিলাবে? নিবিড়ভাবে আলিঙ্গন করবে? ”
“ব্যথা আছে এখনো? ব্যথা না কমলে মেডিসিন চেঞ্জ করতে হবে।”
কলি সংকোচপূর্ণ নিচু স্বরে বলল,
“এ কথা আর জিজ্ঞেস করবেন না আমাকে।”
“এটা স্বামী হিসেবে আমার কর্তব্য কলি। কর্তব্য পালনে বাধা দিচ্ছেন কেন?”
কলি শুয়ে রইলো। মুখে আর কিছুই বলল না। মাহমুদ বলল,
“উঠতে পারবেন? আমি ধরবো? ওয়াশরুমে যাবেন?”
“লাগবে না। আপনি উঠে যান।”
“কেন?আমার ওমে সুখ পাচ্ছেন না কলি?”
কলি চোখ বুঁজে ফেলল লজ্জায়। মাহমুদ উঠে গিয়ে ফ্রেস হলো।রুমে এসে দেখে তার মোবাইলে মেসেজ এলো।
“এই ওয়াশরুমে স্যাভলন নেই। ব্যাথা করছে।”
কলি ওপাশ ফিরে আছে। মাহমুদ আড়চোখে কলির পিঠের দিকে চাইলো। মুচকি হাসলো। কমন ওয়াশরুম থেকে স্যাভলনের বোতল এনে তাদের ওয়াশরুমে রাখলো। কলির গালের উপর ঝুঁকে বলল,
“স্যাভলন এনে রেখেছি ফুলকলি। হট ওয়াটারের সঙ্গে বেশি করে ইউজ করবেন। শেষ হলে আবার আনবো। তবুও ব্যথা দ্রুত দূর হওয়া চাই।”
কলি ঠোঁট কামড়ে ধরলো নিজের। মাহমুদ নাস্তা খেয়ে এসে রুমে প্যান্ট শার্ট পরে নিলো। রেডি হয়ে কলিকে বলল,
“থাকেন। নাস্তা খেয়ে নিবেন। সন্ধ্যায় এসে শ্বশুর বাড়ি যাবো।”
মাহমুদ চলে গেলে কলি আস্তে করে উঠে দাঁড়ালো। রুমের দরজা বন্ধ করে দিলো। বেশ সময় নিয়ে স্যাভলন ইউজ করলো।তারপরে ফ্রেস হলো। নিজের হাতে বিছানা পরিপাটি করে গোছালো। মাহমুদের ভেজা তাওয়েলটা নিয়ে ব্যালকনিতে রোদে দিলো। ক্ষুধাটা পেটের ভিতর চনমনিয়ে উঠলো। বের হতে যাবে,অমনি বাতাসী নাস্তার ট্রে নিয়ে রুমে এলো।
“ভাবিসাব। নাস্তা খেয়ে লন। রঙ চা আইনা দিতাছি।”
“বাতাসী, মা,বাবা,নানু, আপু সবাই নাস্তা খেয়েছে?”
“হ খাইছে সবাই। কব্বেই।”
“তুমি খেয়েছো নাস্তা?”
“ওরেহ! আমি খাই সবার আগে। রাজত্ব ত আমার হাতে ভাবি। সবকিছু বানাই আর খাই। ”
“হুম। আচ্ছা চা মগ ভরে নিয়ে এসো।”
কলি মাহমুদের টেবিলে বসে নাস্তা খেয়ে নিলো। পরে বাতাসী চা বিস্কুট নিয়ে দিলো।নাস্তা খাওয়ার পর কলি বারান্দায় গিয়ে রোদে বসলো। দরজার টোকা মেয়ে আনুশকা ও তার নানু কলির রুমে চলে গেলো। অনেকক্ষন তারা গল্পগুজব করলো। কলি আনুশকার বর ও বরের পরিবারের কথা জানতে চাইলো।
আনুশকা বলল,
“ভাবি জাহিদদের নিজের বাড়ি বংশাল। তার ছোট দুবোন। বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বাবা মা আছে। বাসা ভাড়া দিতে হয় না তাদের। উপরন্তু পায়। আর জাহিদ ত ক্যাশ পাঠাচ্ছেই। সে কানাড়ায় থাকে। ইঞ্জিনিয়ার। ছয়মাস হয় দেশ থেকে গেলো। রোজই ভিড়িও ফোনে কথা হয়। সব মিলিয়ে বিন্দাস লাইফ। আমি চাইলেই কোন জব করতে পারি। কিন্তু প্রয়োজন নেই। তারাও চায়না। আরেহ ভাবি শোন,আমার ভাই মানে তোমার জামাই ত অনেক ভদ্র আছে। আমারটা তো লুইচ্চা নাম্বার গ্রেট ওয়ান। তাদের বাসায় আমার ওয়াশরুমে বাথটাব আছে। তো শাওয়ারের সময় সেই বাথটাবে সব খুলে শুয়ে তাকে ভিড়িও কলে দেখাতে হয়। বুঝো এবার।”
কলি হতবুদ্ধির মতো হা হয়ে গোলগোল চোখে আনুশকার দিকে চেয়ে রইলো। আনুশকার নানু কলির দিকে চেয়ে বলল,
“অমন চাইয়া থাইকা লাভ নাই বইন। ব্যাডার মন যুগায়া চলতে হয়। নইলে হে অন্য মাইয়ার শরীর দেখতে চাইবো। ব্যাডার জাতটাই অমন। স্বামী কিছু দেখতে চাইলে বাধা দিও না। স্বামীরা এসবেই দিলে শান্তি পায়!”
কলি অবাক হয়ে গেলো। কি বলে এসব। এ দেখি সব খুল্লাম খুল্লাম কাজ কারবার। তারা চলে গেলো। দুপুরে কলি গোসল করে একরকম রেডি হয়ে নিলো। কখন নিজের প্রিয়জনদের মুখখানা দেখবে। সেই প্রতিক্ষায় প্রহর গুনছে। মাহমুদ কলিকে ফোন দিয়ে দুপুরে খেয়েছে কিনা খবর নিলো। মাহফুজাও কলির শারিরীক খোঁজ খবর নিলো মাথায় মাতৃস্নেহের পরশ বুলিয়ে দিয়ে।
মাহমুদ বিকেলে বাসায় এলো। সন্ধ্যায় কলি ও ছোটবোনকে নিয়ে স্বশুরের বাসায় গেলো। সেখানে সবাই মিলে আমোদ ফূর্তি করলো। রাতে জুলি ও শাশুড়ীর জোরাজোরিতে মাহমুদ ও আনুশকা রয়ে গেলো। বিয়ের পর ছেলেদের স্বশুরের বাসায় একরাত নাকি থাকতে হয়। আনুশকা জুলির রুমে ঘুমালো। রাতে বিছানায় শুয়ে মাহমুদ কলিকে বলল,
“আপনার বেডরুম সুন্দর আছে। কিন্তু আপনার বেডে আমি কখনো ঘুমাবো। এটা অকল্পনীয় ছিলো।”
কলি বলল,
“সেইম টু মি স্যার। মানুষ যা কল্পনা করে না তাই বাস্তবে প্রতিফলিত হয়।”
“আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে ভয় হয়? ব্যথা পুরোপুরি গিয়েছে?”
“হাউ ফানি! যে নিজেই আমাকে ভয়ে তটস্থ করে রাখতো,সে আমাকে ভয় পায়?”
“ব্যথা গিয়েছে?”
কলি চোখ কটমট করে চাইলো মাহমুদের দিকে। মাহমুদ চুপ হয়ে গেলো। কলির পেটের উপরে হাত দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। সকালে মাহমুদ চলে গেলো নাস্তা খেয়ে নিজেদের বাসায়। বাসা থেকে ভার্সিটি যেতে হবে। তাই।
কলি আজ ক্লাসে গেলো। সে আগের মতই বাসে বা সি এন জিতে যাতায়াত করে। মাহমুদের বাইকে আসে না। যেন কেউ না বুঝতে পারে। খেয়াও ক্লাসে আজই প্রথম আসলো। কলি ও খেয়া কেউ কারো সঙ্গে কথা বলে না। ক্লাসের দু’চারজন স্টুডেন্ট কলির দিকে কেমন সন্দেহতীত চোখে তাকালো। মাহমুদ ক্লাসে গেলে কথা প্রসঙ্গে একজন বলল,
“স্যার কলির মনে হয় বিয়ে হয়েছে। আমাদের মিষ্টি খাওয়ানোর ভয়ে অস্বীকার করছে।”
মাহমুদ বলল,
“কলি সত্যিই বলছে উনারা?”
কলি গম্ভীর সুরে বলল,
“স্যার আমার কাবিন হয়েছে। এম.এ কমপ্লিট হলেই অনুষ্ঠান করে তাদের বাসায় তুলে নিবে।”
ক্লাস শেষে সবাই বেরিয়ে গেলো। কলি মাহমুদের অফিস রুমে গেলো মাহমুদ আছে না বেরিয়ে গেলো দেখার জন্য। তাদের মধ্যে সমঝোতার একটি চুক্তি হয়েছে। ভার্সিটিতে তারা দুজন আগের মতই টিচার স্টুডেন্ট হয়ে আচরণ করবে। যেন কেউই এতটুকু ডাউট না করতে পারে।
রুমের দরজা চাপানো ভিতর থেকে। কলি চাপানো দরজা ঠেলেই ভিতরে প্রবেশ করলো। তাতে সে যা দেখলো, তক্ষুনি তার চোখদুটো কোটর হতে বেরিয়ে আসার উপক্রম। সে দেখলো খেয়া মাহমুদকে চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে দু-হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে কি কি যেন বলছে। মাহমুদ হাত দিয়ে খেয়াকে ছাড়ানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হচ্ছে।
অমনি কলি গিয়ে খেয়ার গালে কষে চড় বসিয়ে দিলো।
হোয়াট! দুই পয়সার সস্তা মেয়ে আমার গায়ে হাত তুলিস? তোর এত বড় আস্পর্ধা? বলেই উত্তেজিত হয়ে খেয়াও ফের কলির গালে চড় মারতে হাত উঠালো।
নিমিষেই মাহমুদ খেয়ার হাত ধরে ফেলল। রক্তচক্ষু নিয়ে বলল,
“আপনি অন্যায়ভাবে কলির গায়ে হাত তুলতে চেয়েছেন। তাই।”
খেয়ার কন্ঠে অনুযোগ ঝরে পড়লো মাহমুদকে নিয়ে। বলল,
“আমারটা অনুচিত? তার আগে সেই যে কাজটা করলো সেটা খুব উচিত হয়েছে? তাকে কিছু না বলে উল্টো আমাকে শাসাচ্ছেন স্যার?”
মাহমুদ নিজের রাগকে সংবরণ করলো। শান্ত গলায় খেয়াকে বলল,
“আপনি আমার পিছনে দাঁড়িয়েছিলেন। কলি আপনার গায়ে হাত তুলল আমি দেখার আগেই। তাকে আটকানোর সুযোগটুকুও হয়নি। আর তাকে কিছু বলিনি এই অভিযোগ? বলিনি, আপনার যে কাজটা আমার কাছে খারাপ লেগেছে। ভুল লেগেছে। সেই একই কাজ কলির চোখেও দৃষ্টিকটু লেগেছে। তাই ছাত্রী হিসেবে সে আপনাকে চড় দিলো। ক্লিয়ার?”
“নাহ স্যার। ক্লিয়ার নই। আপনার লজিকটা আমার কাছে লেইম লেগেছে।”
কলি কিছুই বলছে না। ঘটনার আকস্মিকতায় সে হতবুদ্ধির ন্যায় হয়ে গেলো। বিরক্তিকর মুখে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো।
“এই কলি দাঁড়া। আমার কথার আনসার দে বলছি। নইলে পরিণাম ভয়াবহ হবে। স্যারের হয়ে তুই আমাকে চড় মারলি কেন?”
“আমি সহজ সাধারণ একজন মেয়ে। ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে চুপচাপ বসে থাকা ছাত্রী। তোর মতো বিত্তশালী বাবার মেয়ে নই। ঠিক এই বিষয়গুলোকেই মাথায় রেখে কয়েকমাস আগে তুই মুরগী বানালি আমাকে। স্যারের কাছে আমাকে দিয়ে ইমেইল পাঠালি। সেই ব্যাঙ ও মানুষের গল্পের মতো তুই পাড়ে বসে মজা লুটলি। আর আমি ব্যাঙের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে গেলো। স্যার আমাকে সেই এক ইমেইলকে কেন্দ্র করে তীব্রভাবে অপমান করলো।
আত্মসম্মানটুকুই আমাদের মধ্যবিত্তদের বেঁচে থাকার সম্বল। সেই লজ্জা, সংকোচ ও গ্লানিতে ক্লাসে আসতে পারিনি দিনের পর দিন। বাসায় মিথ্যা বলতে হয়েছে। রাতদিন মায়ের বকুনি হজম করতে হয়েছে। ম্যামের কাছেও মিথ্যা বলতে হয়েছে। সামনে পরিক্ষা ছিলো। রেজাল্ট ভালো করার জন্য ঘুম মেরে রাত জেগে জেগে পড়াশুনা করতে হয়েছে। এতকিছু হলো আমার,তবুও তোকে কিচ্ছু বলিনি। আমার স্থানে তুই হলে কি করতি একবার ভেবে দেখ? তাই আজ সুযোগ পেয়ে তোর উপর আমার জমে থাকা পুরোনো ঘৃণার কিছুটা লাঘব করলাম। স্যার ছিলো মাধ্যম মাত্র। ব্যাস। এটাই। এর বাইরে কিছুই না।
ক্লাসের সবাই জানে তুই মাহমুদ স্যারকে পছন্দ করিস। এতে দোষের কিছুই নেই। করতেই পারিস। কিন্তু প্রশ্ন এখানেই, স্যার যখন তোকে অন্যচোখে দেখে না, এটা জানার পরেও তুই কেন স্যারের পিছু ছাড়িস না?”
মাহমুদের কঠিন দৃষ্টি টেবিলের উপরে স্থির। কলির সাহসিকতা ও তার প্রতি অধিকারবোধে সে আশ্চর্য হয়ে গেলো। খেয়া সরাসরি কলিকে জিজ্ঞেস করলো,
” তাতে তোর জ্বলছে কেন? তুই কি স্যারকে পছন্দ করিস?”
” কেন? তুই করতে পারলে আমি স্যারকে পছন্দ করতে পারি না? কেবল তোর প্রেমে ভরা,মধুয় ভরা একটা বিশাল হৃদয় আছে। আমার থাকতে পারে না?”
কলির কথাগুলো শুনে মাহমুদের হৃদয় আনন্দে নেচে উঠলো। কলির দিকে প্রীতিময় চাহনি নিক্ষেপ করলো এক ঝলক।
কলি হনহন পায়ে রুম হতে বেরিয়ে গেলো। খেয়া ফের মাহমুদের হাত টেনে ধরলো। আপ্লুত স্বরে বলল,
“স্যার কলির কথা সত্যি? আপনি না বিয়ে করেছেন বললেন ভাবির কাছে? ”
“সেটা জানার পরেও তো আপনি আমার সান্নিধ্য কামনা করেন। তাহলে কলি পছন্দ করলে সমস্যা কোথায়?”
“তারমানে কলির পছন্দকে আপনি গুরুত্ব দিতে চাচ্ছেন? প্রশ্রয় দিতে চাচ্ছেন? ও আপনার যোগ্য?”
“দিতে চাচ্ছি না। দিচ্ছি অলরেডি। আর যোগ্যতা? যার মনুষ্যত্ববোধটুকু আছে, সেই আমার চোখে যোগ্য। যা আপনার মাঝে নেই। থাকলে এত ইগনোর করার পরেও আপনি বেহায়া,ছ্যাচড়ার মতো আমাকে চাইতেন না।”
মাহমুদ হাতের কাজ সেরেই রুম থেকে প্রস্থান নিলো। বাইক স্ট্রাট দিয়ে সোজা বাসায় চলে গেলো। হীনমন্যতায় ভুগছে বেশ। কি বলবে কলিকে। কলিইবা তাকে কি বলবে। বাসায় গিয়ে নিজের রুমে গেলো। দেখলো কলি নিজেদের রুমে নেই। সে ড্রেস চেঞ্জ করে ফ্রেস হয়ে নিলো। বাতাসী টেবিলে ভাত এনে দিলে খেয়ে নিলো।
তারপর মাহমুদ আনুশকার রুমে গেলো। দেখলো কলি উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। মাহমুদ কলির পিঠের উপর নিজের হাত রাখলো। সংকোচপূর্ণ কন্ঠে বলল,
“কি ব্যপার? আপনি এখানে কেন? আমাদের রুমে আসুন।”
কলি মুখ গোঁজ করে রইলো। মাহমুদ কলির হাত ধরে ফের বলল,
“কলি মন খারাপ? আমাদের রুমে আসুন না। কথা আছে।”
কলি বলল,
“এটা রুম নয়? আপনি চলে যান। আমি এখন থেকে এই রুমে থাকবো। আমার কিছু ভালো লাগছে না।”
“প্লিজ আসুন বলছি। নইলে আমি সত্যি সত্যি পাঁজাকোলা করে নিয়ে যাবো।”
কলি বুঝতে পারলো, মাহমুদ এটা করেই ছাড়বে। সে নিজ থেকেই উঠে গেলো রুমে। গিয়ে বারান্দায় চলে যেতে লাগলো। মাহমুদ হাত টেনে ধরে দাঁড় করালো। দরজা বন্ধ করে দিলো। কলিকে বিছানার উপরে বসালো। অপরাধীর ন্যায় জানতে চাইলো,
“মুখ ভার কেন? খেয়ার বিষয়টা নিয়ে? জেলাসী?”
কলি দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে অভিমানী কন্ঠে বলল,
“আমাকে কোন ছেলে এমন ঘনিষ্ঠভাবে ছুঁয়ে দেক? তখন আপনার কেমন লাগবে? শুরু থেকেই যদি আপনি হার্ড অবস্থায় থাকতেন, তাহলে সে এতটা এগোয় কিভাবে? আমি দেখতাম না পিছনের বেঞ্চে বসে? সে আপনাকে নানা বাহানায় কোন গিফট দিলে কেমন খুশীতে গদগদ হয়ে নিয়ে নিতেন।”
মাহমুদ নির্বাক চোখে চেয়ে রইলো কলির দিকে। আগের কলি আর বর্তমানের কলির ব্যবধান রাত দিনের মতো। যেই কলির সঙ্গে তার প্রণয় ঘটেনি। বন্ধুত্ব হয়নি। সখ্যতাটুকু গড়ে তুলতেও সে ব্যর্থ হয়েছে। নিজের সমস্ত অধিকারের ভার অর্পিত করে যাকে অবশেষে নিজের অর্ধাঙ্গিনী করে নিলো দুই পরিবারের আগ্রহে। সেই কলি যে আজ নিজের অধিকার পুরোটাই লুফে নিবে এবং তার যথাযোগ্য ব্যবহার করবে এত সহসাই। এ মাহমুদের কাছে ঘোরতর অবিস্বাস্য ঠেকলো।
যদিও সে এতেই বিপুল আনন্দ লাভ করেছে গোপনে। সেতো এই কলিকেই চেয়ে প্রতিটিক্ষন। কলি তার স্ত্রী হয়ে উঠুক। পূর্ণ অধিকারটুকু ফলাক। অভিমানে,অনুযোগে ফেটে তুলুক। সে তখনই কলির হৃদয়ের অতলান্ত হতে তার জন্য জমে থাকা ভালোবাসাটুকু ছেঁকে নিবে।
ঘড়ির কাঁটার টুংটাং আওয়াজে মাহমুদ সম্বিৎ ফিরে পায়। কলিকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। নিজেও কলির গা ঘেঁষে শুয়ে পড়ে। কলির চুল থেকে পাঞ্চ ক্লিপটা খুলে নেয়। চুলগুলো সারা পিঠময় ছড়িয়ে দেয়। চুলের নিচে নিজের মুখ ডুবিয়ে দেয়। জোরে স্বাস টেনে নেয়। কলিকে লেপ্টে ধরে খোলা বুকের মাঝে। কলির গালের উপর নিজের দুঠোঁট ঘষতে ঘষতে নিবেদিত কন্ঠে বলে,
“আপনি আমাকে ভুল বুঝলে আমি নিঃশ্ব হয়ে যাবো। আমার মৌনাকাশে শুধু আপনার আধিপত্য বিস্তার চলবে। দ্বিতীয় কারো নই। একটু ভালোবাসুন না আমাকে।”
কলি হুঁ হ্যাঁ কিছুই বলছে না। চুপটি করে ওভাবেই পড়ে আছে মাহমুদের বুকের মাঝে।
কলির বাবা নুরুল হক সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিলেন। বড় অংকের পেনশনের টাকাও হাতে পেলেন। সেখান থেকে একটা অংশ চলে গেলো ব্যাংকের লোন শোধ করতে গিয়ে। যেটা কলির বিয়ের জন্য নেওয়া হয়েছিলো। আরেকটা অংশ চলে গেলো গ্রামে একটা বন্ধকী জমি ছাড়াতে গিয়ে। কিছু টাকা ডিপোজিট করে ব্যাংকে রাখলেন নিজের নামে। বাকি টাকা বর্তমান ব্যাবসার জন্য গচ্ছিত রাখলেন বাসায়। কিছুদিন আগ থেকেই তিনি বাইরে বিভিন্ন লোকেশনে দোকান খুঁজতেছিলেন কলিকে নিয়ে একটা ব্যবসা দাঁড় করাবেন বলে। যেকোনো ছোট বড় ব্যবসার জন্য উপযুক্ত সেন্টার পাওয়া মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট। পাশাপাশি জনবহুল জায়গাও হতে হয়। যেখানে ক্রেতার সমাগম হবে। প্রথম ছয়মাস ব্যবসায় লস হবে এটাই মাইন্ড সেট করে নিতে হয়। তারপর থেকে ধীরে ধীরে লভ্যাংশ আসতে থাকে। বীজ পুঁতে ফেললেই যেমন ফল পাওয়া যায় না সঙ্গে সঙ্গে। তদরূপ ব্যবসার ক্ষেত্রেও এমন। শুরুতেই লাভ আসা করা বোকামি। ধৈর্য, অনেস্টি, শ্রম, নির্ভেজাল পন্য, ভালো আচরণ সবমিলিয়ে একটা ব্যবসা এগিয়ে যায় ও বৃহৎ আকার ধারণ করে।
কলিও অনলাইনে নিউ বিজনেস নিয়ে অনেক স্টাডি করলো। অবশেষে পরিবারের সবার সম্মতিতে ঠিক হলো ফাস্টফুড শপ দিবে কলি। কারণ সে নিজেই অনেক মেন্যু তৈরি করতে পারে। সেগুলো বাসা থেকে বানিয়ে নিতে পারবে মায়ের হেল্প নিয়ে। দু’বছর আগে সে শখ করে অনলাইনে একটা ফুডকোর্সও করেছে। দোকান ভাড়া নেওয়া হয়ে গেলো। প্লেস লালবাগের মধ্যেই। তাদের বাসার নিকটবর্তী। মেয়েদের কর্মস্থল ও বাসা কাছাকাছি হওয়া অপরিহার্য! দোকানে একজন স্টাফ নিয়োগ দিতে হলো। যেহেতু কলির স্টাডি এখনো শেষ হয়নি। তার বাবা ও স্টাফ মিলে পরিচালনা করবে। কিন্তু তার তত্বাবধানে চলবে সব। কারণ তার বাবার চেয়ে তার আইডিয়া ভালো হোম মেড ফুডের দরদাম সম্পর্কে। অন্যদিকে নুরুল হক প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডেকোরেশন সম্পন্ন হয়েছে। টেবিল চেয়ার থেকে শুরু করে যাবতীয় সরঞ্জামাদিও কেনা শেষ। খাবারের আইটেমগুলো কাঁচের বিভিন্ন সেল্ফে সাজানো হলো। কিছু খাবার কিনে এনেছে। কিছু খাবার বাসা থেকে বানিয়ে নেওয়া হয়। ফাস্টফুড দোকানের নাম দিলো ‘মজা’। কলিই নামটা ঠিক করলো।
তার মাস দুয়েক পরের কথা। কলির মিডটার্ম ও সেমিস্টার ফাইনাল শেষ হলো। তারপর এক সন্ধ্যায় কলি তাদের ‘মজা’ শপের ভিতরে ক্যাশে বসে আছে৷ পাশে দাঁড়িয়ে ক্রেতাদের খাবার পরিবেশন করছে তার ম্যানেজার। সেই সময়ে তার সামনে উপস্থিত হলো খেয়া। সঙ্গে একটি যুবক ছেলে। তার বেশভূষা মাস্তান টাইপের। কলি ঘাবড়ে গেলেও বুঝতে দিল না খেয়াকে। বলল,
“খেয়া তুই? ভিতরে আয়। কোথা থেকে এলি? ইনি কে?”
খেয়া কলির কথাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলো। দোকানের নেইম ফলকের দিকে একটুক্ষণ তাকালো। ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপের হাসি ঝুলিয়ে বলল,
“বাহ! দারুণ নাম দিলিতো কলি। ‘মজা’! তো মজা কি মানুষ খাবার থেকে নেয়? না তোর থেকেও নেয়?”
নিমিষেই কলির মুখ রক্তিম হয়ে উঠলো অপরিসীম লজ্জায় ও বিতৃষ্ণায়। চুপ করে রইল না। খেয়ার কথার প্রত্যুত্তরে বলল,
“সবাইকে নিজের মতো ভাবিস কেন খেয়া?”
খেয়া চমক খেলো। মুখাবয়ব বিকৃত করে বলল,
“হোয়াট?”
“চোর যখন চুরি করে, সে মনে করে কেউই দেখেনি। কেউই জানে না। কিন্তু সে নিজের অজান্তেই এমন এক প্রমাণ রেখে যায়, যা তার গোটা জীবনটা ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সঙ্গে তার পরিবারেরও।”
#তোমার_জন্য_সব -২৪
✍️ #রেহানা_পুতুল
অমনি কলি এমন এক নিষ্ঠুর বাক্য বলে ফেলল মাহমুদের উদ্দেশ্যে। যা শুনে মাহমুদ স্তব্ধ হয়ে গেলো। বিয়ের দ্বিতীয় রাতেই কলি তাকে এমন কিছু বলতে পারে যা তার কাছে অবিশ্বাস্য! অচিন্তনীয়!
“আপনি এই মুহূর্তে যা করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তা কোন মানুষের কাজ হতে পারে না। রেপিস্ট এর কাজ। আর একটু বাড়লে আপনাকে ডিভোর্সড দিবো আমি।”
নিমিষেই মাহমুদের শিহরিত অন্তর বিষিয়ে ব্যথায় নীল হয়ে গেলো। সব অনুভূতিরা পালিয়ে গেলো সাত সাগর তেরো নদীর ওপারে। তার সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বরফখন্ডের ন্যায় জমে শীতল হয়ে গেলো। সে আর কোন টু শব্দ করল না। কোন উচ্চবাচ্য করল না কলির সঙ্গে। কলির শরীরের উপর থেকে সরে গেলো। নিচে দাঁড়িয়ে তার দুই হাতের বাঁধন খুলে দিলো।
মাহমুদ একটি টি শার্ট খালি গায়ে পরে নিলো। ওয়ালেটটা ট্রাউজারের পকেটে রাখলো। চোখে চসমা পরে নিলো। মোবাইলটা হাতে নিলো। আয়নায় দাঁড়িয়ে কোনমতে চুল আঁচড়ে নিলো। টেবিলের উপর থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে নিলো। গলা তুলে ঢকঢক করে পুরো গ্লাসের পানি খেয়ে নিলো।
কলির সামনে এসে দাঁড়ালো। গম্ভীর মেঘমুখে বলল,
“খুব সরি হাত বাঁধার জন্য। কেবল নিজের অনুভূতিকে প্রাধান্য দিয়ে এমনটা আর হবে না। আর বাকি যেটা বলছেন আপনি। এনিটাইম করতে পারেন। বাধা নেই কোন। খেয়াকে বিয়ে করবো আমি। ঘুমিয়ে যান।”
কলি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেলো খেয়ার কথা শুনে। নির্বাক চোখে মাহমুদের মুখপানে চাইলো। মাহমুদ আস্তে করে দরজা খুলে নিলো।
“এতরাতে কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”
আতংকিত গলায় জানতে চাইলো কলি।
“সেটা আপনাকে বলতে বাধ্য নই আমি।”
বলেই মাহমুদ দাঁড়ালো না। বাসা থেকে বেরিয়ে লিফটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কলি মাহমুদের পিছন পিছন বাসার গেটের বাইরে গেলো।
আর্তির স্বরে ডাক দিলো,
“স্যার প্লিজ যাবেন না। আমার কথা ত শুনবেন।”
লিফট এলে মাহমুদ চলে যায় নিচে। বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। কলি নিজের রুমে এসে দরজা চাপিয়ে দিলো। বিছানায় বসে ঢুকরে কেঁদে উঠলো। অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। মাহমুদের নাম্বারে বারবার ট্রাই করে যাচ্ছে। বাট সুইচড অফ। কলি মহাচিন্তায় পড়ে গেলো।
হায় খোদা! বাসায় গেস্ট। জুলিও আছে। সকালে জানাজানি হলে খুব বাজে হয়ে যাবে। তার নানী হলো আরেক ডেঞ্জারাস পাবলিক। এনিহাউ একে বাসায় আনাতে হবে। কলি পূনরায় ট্রাই করেও ব্যর্থ হলো। পরে একটা মেসেজ দিয়ে রাখলো।
মাহমুদ মহল্লার একটি টি স্টলে গেলো। এটা বহুরাত অবধি খোলা থাকে। সেখানে ঢুকে পাতানো লম্বা কাঠের বেঞ্চটাতে বসলো। চা,সিগারেট খেতে লাগলো একের পর এক। চা দিতে দিতে ছেলেটা মাহমুদের দিকে আড়চোখে চায়। কিন্তু কিছু বলে না। রাত দুটোর দিকে সে দোকান বন্ধ করে ফেলে। মাহমুদ উঠে হাঁটতে থাকে। তিনটার দিকে মাহমুদ মোবাইল অন করলো। দেখলো কলির নাম্বার হতে মেসেজ।
“স্যার প্লিজ ফিরে আসুন। দোহাই আপনার। আমি কিছু বলতে চাই। এরপর আপনি যে পানিশমেন্ট দিবেন মাথা পেতে নিবো। আমার দিব্যি খেয়ে বলছি। আমার কষ্ট হচ্ছে খুব!”
মাহমুদ মেসেজ পড়েই আবার মোবাইল অফ করে ফেলল। যেন কলি ফোন না দিতে পারে। সে আরো কিছুক্ষণ রাস্তায় এদিক সেদিক পায়চারি করতে লাগলো। সাড়ে তিনটার দিকে বাসায় গেলো মাহমুদ ঢুলু ঢুলু চোখে। চাপানো দরজা ঠেলে রুমের ভিতরে গেলো। দরজা অফ করে সোফায় গিয়ে বসল থম মেরে।
কলি নিস্তেজ কন্ঠে ডেকে উঠলো,
“স্যার বেডে এসে ঘুমান। প্লিজ!”
মাহমুদ না পেরে বিছানায় এলো। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো নিজের বালিশে। শরীর,খারাপ লাগছে বেশ। মনের অবস্থা তার চেয়েও শোচনীয়! কলি নিজ থেকেই অপরাধীর সুরে বলল,
“স্যার আমার সেই কথা আমি ফিরিয়ে নিচ্ছি। আর কোনদিনও অমন কুফা শব্দ উচ্চারণ করব না। আপনি ফোর্স করে সুখ পেতে চেয়েছেন। অথচ আমি আপনার কাছে সময় চেয়েছি। তাইতো আমার রাগকে সংবরণ করতে পারিনি। আপনাকে সবসময় দেখে এসেছি একচোখে। এখন ভিন্নভাবে ভাবতে,দেখতে একটু অসুবিধা হচ্ছে আমার। ঠিক হয়ে যাবে সব। এগেইন সরি স্যার।”
মাহমুদ রুক্ষ স্বরে বলল,
“মাথা ব্যথা করছে। গতরাতের মতো আমার আরামদায়ক ঘুমের ব্যবস্থা করে দিন।”
কলি মুখে আর কিছু বলল না। মাহমুদের চুলে আস্তে করে বিলি কাটতে লাগলো। চুলগুলো টেনে দিলো। কপালে ম্যাসাজ করে দিলো। হাত পা টিপে দিলো। এভাবে বেশ সময় পার হয়ে গেলো। দেখলো মাহমুদ গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। কলিও পাশে তার বালিশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
সকালে কলি উঠে ফ্রেস হয়ে নিলো। রুমের এলোমেলো কাপড়চোপড়গুলো গুছিয়ে রাখলো নিদিষ্ট জায়গায়। বের হয়ে আনুশকার রুমে গেলো। নানু পান খাচ্ছে বসে বসে। কলিকে দেখেই হেসে উঠলো। চোখের পাতাকে ছোট করে বলল,
“কাছে আহো,চুল ভিজানি দেহি।”
কলি অপ্রস্তুত কন্ঠে মিথ্যা বলল,
“নানু আমার শারীরিক সমস্যা চলতেছে। তাই অফ।”
নানু মুখ গোঁজ করে বলল,
“ও বুঝলাম। তবে বইন একটা কথা কই। পুরুষ মানুষ হইলো ভ্রমরের জাত। কাছে থাকা ফুলের মধু না পাইলে অন্যফুলে উইড়া যাইবো মধু খাওনের লাইগা। প্রেম, সোহাগ দিয়া স্বামীরে ভুলায়া রাইখো। নইলে নিজেই চোক্ষে আঙ্গুল দিয়া কাঁনবা।”
কলি পূর্ণ মনোযোগে কথাগুলো শ্রবণ করলো এবং বিশ্বাস করতেও দুবার ভাবল না। যার প্রমাণ কয়েক ঘন্টা আগেই পেয়ে গেলো। খেয়াকে বিয়ে করবে, মিথ্যে করে হলেওতো একথা স্যার তাকে শুনিয়ে ফেলল। কলি আনুশকার রুমের বারান্দায় গেলো। এই বারান্দায় আনুশকার কিছু ফুলগাছ রয়েছে।
কলি দেখলো অলকানন্দা, বেলী,নয়নতারা,হাস্নাহেনা ফুল ফুটে আছে। এখন বর্ষাকাল। এগুলো বর্ষাকালের ফুল। কলি সব ফুল ডাঁটাসহ ছিঁড়ে নিলো। আনুশকার থেকে চেয়ে সুতা নিলো। ফুলগুলোর গোড়া এক করে ভালো করে বেঁধে নিলো কলি। সাজিয়ে একটি পুষ্পতোড়া তৈরি করে ফেলল। সেগুলোর ফাঁকে ফাঁকে কিছু পাতা গুঁজে দিলো সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য।
আনুশকা বলল,
“তোমাদের রুমে রাখার জন্য? না ভাইয়াকে গুড় মর্নিং জানানোর জন্য?”
মাহমুদ চমকালো। ফুল হাতে নিলো। নিরস ভঙ্গিতে কলিকে থ্যাংকস জানালো। অতিরিক্ত একটি শব্দও বলল না কলিকে। মনে মনে বলল,
দুধের স্বাধ ঘোলে মেটেনা কলি। এতটা অবুঝ কেন তুমি?
কলি বুঝতে পারলো মাহমুদ তার উপর বেজায় অসন্তুষ্ট। মাহমুদ আজ কলিকে ডাকল না। নিজেই নাস্তা খেতে চলে গেলো। আবদুর রহমান ছেলেকে আদেশ দিয়ে বলল,
“বৌমাকে নিয়ে তাদের বাসায় বিকালে যাস। এটা নিয়ম।”
“বাবা আমার জরুরী কাজ আছে বাইরে। ফিরতে লেট হবে। এক ফ্রেন্ড বাইরে যাবে। রাতে ফ্লাইট। দিনে আমাকে নিয়ে তার বাকি থাকা শপিংগুলো করবে। কলিকে কাল তাদের বাসায় নিয়ে যাবো।”
“আচ্ছা কালই যাস।”
মাহমুদ নাস্তা খেয়ে রুমে এসে রেডি হয়ে নিলো। গায়ে পারফিউম ছড়িয়ে দিলো। কলি চোখ বন্ধ করে পারফিউমের ঘ্রাণ নিলো নিঃস্বাস ভরে। নিজ থেকেই মাহমুদকে জিজ্ঞেস করলো,
” কারো অপ্রিয় হয়ে সামনে থাকার চেয়ে আড়ালে থাকা ভালো।”
কলি আর কিছুই বলার সুযোগ পেলনা। মাহমুদ বেরিয়ে গেলো। কলি যেন আকাশ থেকে পড়লো। এত জেদ তার পুরুষটার? এত প্রকট অভিমান? দুপুর, বিকাল,সন্ধ্যা গড়িয়ে গেলো। মাহমুদের আসার নাম নেই। কলির মন খারাপের পাল্লা ভারি হতে লাগলো। বাসায় কারোই মন খারাপ নেই। কারণ মাহমুদ সবাইকে কারণ বলেই বেরিয়েছে। কলি সংকোচে কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারছে না মাহমুদের কথা। ঝিম মেরে প্রহর গুনতে লাগলো। রাত হয়ে গেলো তাও মাহমুদ এলো না। কলি বার বার ফোন দিচ্ছে মাহমুদকে। কিন্তু সুইচড অফ। তার অস্থিরতা আনুপাতিক হারে বেড়েই চলল। কত কু কথা মনে উদয় হতে লাগলো।
ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটা ছুঁই ছুঁই। কলি রুমের জানালার গ্লাস সরিয়ে বাইরে চেয়ে আছে। দৃষ্টি ক্লান্ত! অসহায়। অম্বরে মেঘ ডাকছে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। তুমুল বৃষ্টি। তখনই মাহমুদ টলতে টলতে রুমে প্রবেশ করলো। বাসার গেট বন্ধ ছিল না সে আসবে বলে। নিচে সিকিউরিটি গার্ড রয়েছে একাধিক। তাই বন্ধ না করলেও তেমন অসুবিধা হয় না। কলির কলিজায় পানি এলো মাহমুদকে দেখে। ভিজে জুবুথুবু মাহমুদ। তাওয়েল এগিয়ে দিলো কলি। মাহমুদ ওয়াশরুমে চলে গেলো।
কলি তাকে কিছুই বলল না। কারণ জানে সে,মাহমুদ তার কথার রিপ্লাই দিবে না। গত রাত থেকেই কথা বলেনা মাহমুদ তারসঙ্গে। কলি বিছানায় গিয়ে তার বালিশে শুয়ে পড়লো। মাহমুদ ওয়াশরুম থেকে বের হলো পরনে তাওয়েল পেঁচিয়ে। চশমা,ওয়ালেট,সেলফোন সব টেবিলের উপরে রাখল। মাহমুদ তাওয়েল পরেই বিছানায় শুয়ে পড়ল। কলির লজ্জার বেহাল দশা। ‘নাউজুবিল্লাহি মিন জালিক’। এত বড় একটা শরীরে মাত্র একটা তাওয়েল? আর সব উদাম? এর কি কোন হুঁশ নেই। এত বেশরম পুরুষ সে? মাল খেয়ে টাল হলো নাকি? মাহমুদ চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। দৃষ্টি নিবু নিবু।
কলি চোরা চোখে দেখলো মাহমুদকে। চোখ দুটো ভয়ংকর লাল হয়ে আছে। সম্ভবত মাহমুদ স্বল্প পরিমাণে হলেও ড্রিংকস করেছে। কলি পায়ের নিচের কাঁথাটা দিয়ে মাহমুদের শরীর ঢেকে দিলো। উদ্দেশ্যে যেন তার চোখে না পড়ে কিছু। কিন্তু কাঁথা একটা। তারও ঠান্ডা লাগছে। এবার নিজে কি গায়ে দিবে। তবুও ভাঁজ হয়ে শুয়ে রইলো কলি।
রাত আরো গভীরে ডুবে গেলো। বাইরে ঘন বরষা। বৃষ্টির সাথে সাথে আকাশে থেমে থেমে বজ্রধ্বনি হচ্ছে। ভয়ংকর গর্জনে কলি ওহ! বলে মাহমুদের কাছে নিজেকে একটু ভিড়িয়ে নিলো। কাঁথাটা একটু নিজের গায়ের উপরে দেয়ার চেষ্টা করলো। মাহমুদ চোখ বন্ধ রেখেই এক হাত মেলে দিলো। কলিকে নিজের বাহুর উপরে টেনে আনলো। নিজেও কাত হলো। একই কাঁথার ভিতরে কলিকে নিজের শরীরের সঙ্গে পেঁচিয়ে নিলো এক পা দিয়ে। কলির বুক উঠানামা করছে তীব্র গতিতে। নিজের গায়ের সঙ্গে মাহমুদের পুরো উদাম শরীরের স্পর্শ পেতেই এক অচেনা নিবিড় শিহরণ তাকে দোল দিয়ে যাচ্ছে বিরামবিহীনভাবে।
তার ভিতরে এমন লাগছে কেন। এমন স্বর্গীয় অনুভূতি এর আগে কখনো হয়নি তার। এত ভালোলাগছে কেন? উঁহু! এবার কলি নিজেই আদুরে বিড়ালের মতো মাহমুদের খোলা বুকে নাক মুক ঘষতে লাগলো। মাহমুদ প্রায় নেশাগ্রস্ত। কেননা সে সত্যি নেশা করে এসেছে। ঘুম জড়ানো চোখ মেলল না সে। তবে কিছু উপলব্ধি করতে পারলো। কলির নিটোল দেহের সংস্পর্শে সে আরো আগুন হয়ে উঠলো। মোমের মতো কলিকে গলিয়ে দেওয়ার এইতো মোক্ষম সুযোগ।
মাহমুদ নিজের উপর ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল। সীমাহীন উত্তেজনায় কাঁপছে দুজন নব বর বধূ। পরিবেশ যেন স্বর্গীয় কিছু প্রত্যাশা করে দুজনের থেকে। মাহমুদ একটু একটু করে এগোয়। কলির গাল, ঘাড়, বুক অধর, ভিজিয়ে দিলো নিজের দুই ঠোঁটের উষ্ণ আলিঙ্গনে। শাড়ির নিচে দিয়ে কলির মসৃণ পেটে হাত রাখলো। কলি চোখ বন্ধ করে অন্যরকম নবসুখের স্বাদ উপভোগ করছে বৃষ্টিভেজা নিশুতি রাতে। তার যত কষ্ট আর লজ্জাই লাগুক। তবুও মাহমুদকে আজ আর বাধা দিবে না এই রোমাঞ্চকর পরিবেশে। যা ইচ্ছে করুক। লুটেপুটে নিক তার গোপন সব। কলি নিজের দু’হাত দিয়ে লাজরাঙা মুখখানা ঢেকে রাখলো।
শেষ রাতের দিকে দুজনে ক্লান্ত মাঝির মতো নিদ্রা-ঘোরে সপে দিলো দুজনকে। প্রভাতকালেই উঠে কলি গোসল করে নিলো। বিছানায় উঠে আবার শুয়ে পড়লো। টের পাচ্ছে শরীর খুব ব্যথা করছে। রাতেও খায়নি। তাই কলির ক্ষুধার্ত শরীরে ফের অবসাদ নেমে এলো। তার দুচোখ বুঁজে এলো অল্প সময়ের ব্যবধানেই।
নাস্তা তৈরি হয়ে গেলো। কলিকে আজ না দেখে নানু তাদের রুমে গেলো। দেখলো মাহমুদ টেবিলে বসে ল্যাপটপে কাজ করছে৷ তিনি সোজা বারান্দায় চলে গেলেন। এসে ঘুমন্ত কলির দিকে চাইলেন।
“ওমা! আল্লাহ রহম করো। কলির তো কোন জ্ঞানই নেই। পুরো শরীর হিম হয়ে আছে। হাসপাতালে নিতে হবে। এম্বুলেন্স ডাক জলদি। হঠাৎ এমন হলো কেন?”
তড়িতেই মাহমুদ এপ এ প্রবেশ করে উবার ডাকলো। ডাকা মেডিক্যাল তাদের বাসার নিকটবর্তী। উবার তাদের অ্যাপার্টমেন্টের নিচে গ্যারেজে চলে এলো লোকেশন অনুযায়ী। মাহমুদ ও আনুশকা কলিকে শোয়া অবস্থায় তুলে ধরলো পিঠের নিচে হাত দিয়ে। বাতাসী লিফট ধরলো। ব্যতিব্যস্ত ও উদ্বিগ্নতার মাঝে দিয়ে কলিকে ঢাকা মেডিক্যাল হসপিটালে নেওয়া হলো। মেডিসিন বিভাগের ওয়ার্ডের একটি সিটে ভর্তি করা হলো জরুরীভাবে। বাসার অতিথিরা সকালে চলে যাবে। সেজন্য মাহমুদ মাকে আসতে বারণ করলো। বাবাকেও আনল না কিছু একটা ভেবে। মাকে মানা করে দিলো কলিদের বাসায় যেন না জানানো হয়। নয়তো অহেতুক চিন্তা করবে তারা।
ডাক্তার এলো তৎক্ষনাৎ। ভালো করে কলির নার্ভ শিরা উপশিরা দেখলো। এবং স্যালাইন দেয়া হলো কলিকে। ডাক্তার মাহমুদ ও আনুশকার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“পেশেন্ট কি হয় আপনাদের?”
“আমার ভাবি। ভাইয়ার ওয়াইফ। আজ বিয়ের চতুর্থ দিন।”
ডাক্তার ভালো করে লক্ষ্য করলো কলির পানে। সত্যি তাই। এই মেয়েটি নবোঢ়া। কলির দুহাত ভর্তি মেহেদি ও বেশভূষায় যা স্পষ্ট।
“উনার শরীর দুর্বল। শেষ খাবার কখন খেয়েছে?”
“কাল দুপুরে। তারপর আর কিছুই খায়নি।” বলল আনুশকা।
“কেন?”
“ভাইয়া বাইরে ছিলো। সে চিন্তায়। ভাইয়া সম্ভবত বলে যায়নি ভাবিকে।”
মাহমুদ অবাক চোখে বোনের দিকে চাইলো।
“উনার কি কোন ঠান্ডার সমস্যা আছে?”
“তাতো জানিনা।”
বলল মাহমুদ ও আনুশকা।
ডাক্তার মাহমুদকে নিজের সঙ্গে ডেকে নিলো চেম্বারে। মাহমুদ চেয়ার টেনে বসলো।
” যে যে কারণে জ্বর এসেছে পেশেন্টের। এক,সম্ভবত উনি বেশসময় পানিতে ভিজেছিলেন। তাই ঠান্ডা লেগে গিয়েছে। দুই, ফিজিক্যাল রিলেশন করেছেন দীর্ঘসময়। যার জন্য উনার শরীর প্রচুর ব্যথা। আর এমন জ্বর আসার জন্য শরীরের যে কোন একটা অঙ্গই ব্যথা হওয়া যথেষ্ট। এরমধ্যে ক্ষুধার্ত শরীর ছিলো উনার। তাই ক্ষুধা, ব্যাথা ও জ্বরের তোড়ে সেন্সলেস হয়েছে। বিয়ের পরে এমন জ্বর প্রায় সব মেয়েরই আসে। আশাকরি জ্ঞান ফিরে আসবে। মেডিসিন লিখে দিচ্ছি। ঠান্ডা হতে উনাকে সতর্ক থাকতে হবে। এখন ভারি খাবার দিবেন না। হালকা নরম খাবার দিবেন। বিকেল বা সন্ধ্যায় বাসায় নিয়ে যেতে পারবেন।”
শুনে মাহমুদ হহতবুদ্ধি ন্যায় হয়ে গেলো। মেয়েদের এমন সময় জ্বর আসে সে এই প্রথম শুনলো। সে ডাক্তারকে একটা ব্যক্তিগত বিষয় জিজ্ঞেস করলো। ডাক্তার বলল,
“নাম লিখে দিচ্ছি। এটা খেলে আশাকরি কোন অঘটন ঘটে যাবে না। আপনাদের সময় হলে তখন খাওয়া বন্ধ করে দিলেই হবে।”
মাহমুদ ডাক্তারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাইরে চলে গেলো। ফার্মেসি থেকে মেডিসিনগুলো কিনে নিলো। কলির জন্য স্যুপ,সেদ্ব ডিম,কলা,আঙ্গুর কিনে নিলো। সিটের পাশে গিয়ে টুল টেনে বসলো। আনুশকা বলল,
“কিরে ভাইয়া? কি বলল ডাক্তার?”
“বলল পানির ঠান্ডায় জ্বর আসলো। ঠিক হয়ে যাবে।”
“উফফস! থ্যাংকস গড! বাঁচলাম। আম্মু কি যে ভয় পেলো। ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি।”
আনুশকা ফোন করে কলির শারিরীক কন্ডিশন জানিয়ে দিলো মাকে। মাহফুজা স্বস্তির স্বাস ফেলল। আনুশকা কলির মাথা তুলে নিজের হাতে স্যুপ ও ডিম খাইয়ে দিলো। টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে দিলো। এভাবে দুপুর হয়ে গেলো। সে বলল,
আনুশকা চলে যায়। মাহমুদ বেডের সামনে কলির মাথার নিকট বসলো। কলি চোখ বন্ধ করে আছে৷ মাহমুদ কলির মাথায় একটু হাত বুলিয়ে নিলো। কিছু আঙ্গুর ধুয়ে কলির মুখে একটা একটা করে পুরে দিতে লাগলো। কলি চার,পাঁচটা খেয়ে আর খেলো না। মাহমুদ কলিকে সব ট্যাবলেট খাইয়ে দিলো। আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো,
” ব্যথা করছে না? ব্যথা কমে যাবে এবার।”
কলি বিরক্ত ও লজ্জাবোধ করলো মাহমুদের মুখে এহেন বাক্য শুনে। চোখ বন্ধ করে কাত হয়ে গেলো। মাহমুদ মনে মনে বলল,
“পরিশ্রম করলাম আমি। আর ব্যথা পেলো তুমি।”
গতরাতে মাহমুদ মানসিক যন্ত্রণা ভোলার জন্য একটি বারে যায়। ড্রিংকস করে বৃষ্টিতে ভিজে মধ্যরাতে মাতাল হয়ে বাসায় ফিরে। তার কান্ডজ্ঞান ছিলো কিছুটা অস্বাভাবিক। তাই তাওয়েল পরেই শুয়ে গিয়েছিলো। এবং রাতের আঁধারে কলির দেহের ওম পেয়ে বহুদিনের ক্ষুর্ধাত বাঘের ন্যায় বন্য হয়ে উঠেছিলো। হুঁশ ছিল না। সকালে হুঁশ ফিরলে নিজের পরনে তাওয়েল ও কলির পরনে অন্য শাড়ি দেখে বুঝেছিলো রাতে কি ঘটেছে। এজন্যই ত তারকাছে এত রিফ্রেশ লাগছে। এদিকে কলি অভিমানে,রাগে,বাথরুমে গিয়ে ঝর্ণা ছেড়ে ইচ্ছেমতো ভিজেছে ও অশ্রুপাত করেছে। যার ফলশ্রুতিতে ব্যথায় ও ঠান্ডায় জ্বর এসে গিয়েছে। সেই জ্বরের ধকল সামলাতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে।
মাহমুদ বাইরে গিয়ে পাশেই হোটেলে বসে ঝটপট খিচুড়ি দিয়ে লাঞ্চ সেরে নিলো। এসে দেখে কলি ঘুমিয়ে আছে। কলি কপালে পুরুষ হাতের ছোঁয়া পেতেই চোখ মেলে তাকালো। দেখে মাহমুদের চোখজোড়া তার চোখে নিবদ্ধ হয়ে আছে। কলি বিব্রত হয়ে চোখের পাতা বুঁজে ফেলল।
সন্ধ্যায় ডাক্তার এসে কলিকে দেখে রিলিজ দিয়ে দিলো। জ্বর আছে। তবে অল্প। মাহমুদ নিচে গিয়ে একটা রিকসা ঠিক করে এলো। যেন কলিকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে না হয়। সে কলিকে ধরে সিটের নিচে দাঁড় করালো। স্যান্ডেল এগিয়ে দিয়ে পরতে সাহায্য করলো। কলিকে ধরে ধরে নিচে হাসপাতালের নিচে নিয়ে এলো। রিকশায় করে বাসায় চলে গেলো।
বাতাসী উড়ে গিয়ে বাসার দরজা খুলে দিলো ড়োরবেলের আওয়াজ কানে যেতেই। মাহমুদ কলিকে নিয়ে নিজেদের রুমে চলে গেলো। তাদের পিছন পিছন গেলো বাকি সবাই। মাহমুদের নানী ছাড়া বাকি অতিথিরা চলে গিয়েছে গ্রামে। কেউ গেলো ঢাকায় নিজের বাসায়।
স্বল্পভাষী আবদুর রহমান কলির কপাল ধরে দেখলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন। মাহফুজাও কলির কপালে হাত রাখলেন। কিন্তু কিছুই বললেন না। কারণটা তিনি জানেন তাই। তিনি বাতাসীকে নির্দেশ দিলেন কড়া করে মসলা চা তৈরি করার জন্য।
বাতাসী চা বানিয়ে রুমে নিয়ে এলো। কলি চায়ের সঙ্গে একটু শুকনো মুড়ি চাইলো। বাতাসী একটি কাঁচের বড় বাটিতে করে এক বাটি মুড়ি নিয়ে দিলো। গল্প কথায় মাহমুদ, আনুশকা,তার নানু মুড়ি খেয়ে বাটি সাবাড় করে ফেলল।
“সকালে ভার্সিটি যেতে হবে। বলে দাও কাল বিকেলেই যাব।”
মাহফুজা নিজের রুমে গিয়ে বেয়াইনকে সে খবর জানিয়ে দিলো। আনুশকার বর দেশের বাইরে থেকে ভিড়িও কল দিয়েছে। তাই আনুশকা নিজের রুমে চলে গেলো। নানুও বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। নাতির উদ্দেশ্যে বলল,
“কয়দিন ক্ষ্যামা দিস। ব্যথা সারুক।”
“অবশ্যই পরামর্শদাতি আমার।”
রুম খালি হয়ে গেলো। বাতাসী এসে ট্রে নিয়ে চলে গেলো। মাহমুদ দরজা লাগিয়ে দিলো। কলির পাশে গিয়ে বালিশে সোজা হয়ে শুইলো। কলির একহাত টেনে নিজের কোলের উপরে রাখলো। অনুতপ্তের সুরে ভার গলায় বলল,
“ওহ,ভোরে এতসময় ধরে শাওয়ার নেওয়ার কি হেতু ছিলো? আর এত আরলি শাওয়ার নিতে হবে না। এটা মফস্বল নয় যে কেউ দেখে যাবে। তাই ঊষাকালেই পুকুরে গিয়ে গোসল সেরে আসতে হবে। আস্তে ধীরে করবেন। ঠান্ডা লাগলে গিজারের পানি ইউজ করবেন। পরনের পোশাক নিজে ধুতে যাবেন না ভুলেও। বাতাসী আছে। ওয়াশিং মেশিন আছে। সো আপনি কেন ধুবেন।”
কলি বুঝল মাহমুদ ব্যক্তি হিসেবে অসম্ভব ভালো। যথেষ্ট কেয়ারিং ঠিক তার মা বাবার মতো। তবে একরোখা, মুখকাটা ও রোমান্টিক। কলি ক্ষীণস্বরে বলল,
“তো আমি করবটা কি? আমাদের বাসায় ত নিজের পোশাক নিজে ধুই। আম্মুকে অনান্য কাজে হেল্প করি।”
“আপনি পড়াশোনা করবেন। আর বাকি কাজগুলোর পরিবর্তে আমাকে সান্নিধ্য দিবেন। আপনার আদুরে আদুরে স্পর্শ আমাকে দিওয়ানা করে দেয়। পিপাসায় হৃদয় ফেটে যাচ্ছে। গতরাতে অজ্ঞানে কিছু করেছি। সজ্ঞানে কবে যে করবো আর দেখবো,এটা অনিশ্চিত এখন।”
কলি মনে মনে বলল,
“ওহ গড! সেভ মি। এর কণ্ঠনালি অফ হয়ে যাক। ঘুরে ফিরে সেই একই বিষয় নিয়েই কথা বলছে। যেন এক টুকরো অমৃতের সন্ধান পেলো।”
কলি নিজের হাতটা সরিয়ে নিলো মাহমুদের কোলের উপর থেকে। মাহমুদ কাজে বাসার বাইরে গেলো। রাতে সবাই ডিনার সেরে ফেলল। আনুশকা কলিকে রুমে ভাত নিয়ে দিলো। কলি নিজের হাত ভাত খেয়ে নিলো। আনুশকা প্রেসক্রিপশন দেখে কলিকে সব রকমের মেডিসিন নিয়ে দিলে। কলি খেয়ে নিলো। বাতাসী গিয়ে কলিকে মশারি খাটিয়ে দিলো। কলি ঘুমিয়ে গেলো।
মাহমুদ বাসায় ফিরে খেয়ে একবারেই রুমে প্রবেশ করলো। ফ্রেস হয়ে ট্রাউজার পরে খালি গায়ে মশারির ভিতরে ঢুকে পড়লো। কলি টের পেয়ে দেয়ালের দিকে চেপে গেলো। মাহমুদ উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
“আহা দেয়াল! তুমি বড়ই সৌভাগ্যবান। জড়বস্তু হয়েও একজন মানবীর কত মধুর স্পর্শ পাও। আর আমি জলজ্যান্ত একজন মানব। পুরুষ মানব। স্রস্টার শ্রেষ্ঠ জীব! তবুও পাই না। চেয়েও পাই না। একেই বলে কপাল। কপালের নাম গোপাল।”
কলি আধোঘুমে। মাহমুদ কলির কপাল ছুঁয়ে দেখলো জ্বর তেমন নেই। তবে হালকা গা গরম এখনো আছে। কলির শরীরের ব্যথাতো চোখে দেখা যায় না। অনুভবও করতে পারছে না সে। তাই সে কলির ঘাড়ের উপর ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলো,
“কলিই ব্যথা করছে?”
কলি লজ্জায় বিছানার চাদর খামচে ধরছে। মাহমুদের ভারি উত্তপ্ত নিঃশ্বাস তার ঘাড়ে, বুকে আছড়ে পড়ছে বিরতিহীনভাবে। কলি চোখ বন্ধ করে আছে না শোনার ভান করে। মাহমুদ তার কানের সঙ্গে নিজের ঠোঁটকে ছুঁই ছুঁই করে বলল,
“এক রাত বেশি খাওয়ার জন্য কয়েক রাত উপোস থাকতে হবে,এমন জানলে অল্পই খেতাম। আস্তেই খেতাম। কঠিন শিক্ষা পেলাম। সাথে শাস্তিও। ওকেহ ঘুমান। খারাপ লাগলে জাগাবেন। শুভরাতি।”
কলি ঘুমিয়ে আছে। দুর্বল ও অভুক্ত শরীরে সারাদিন পর ভাত খাওয়ার দরুন শরীর ছেড়ে দিলো আলগোছে। নয়নজুড়ে নেমে এলো অতল ক্লান্তিকর নিদ্রা।
মাহমুদও চোখ বন্ধ করে ফেলল ঘুমানোর নিমিত্তে। তার পূর্বে সনু নিগমের বাংলা গানের প্লে লিস্ট অন করে দিলো ইউটিউবে। বেজে চলল তার অতি প্রিয় একটি গান।
সামান্য কি কথা নিয়ে যে,
অভিমান করেছিলে আমার সাথে।
……..
একটু সহজ হতে ছিলো না তো দোষ,
কি এমন দোষ হতো করলে আপস।
……
যদি দু’জনে ভুলে যেতাম সব অভিমান।
কি এমন ক্ষতি ছিলো বলো তাতে…”
হঠাৎ তার হোয়াটসঅ্যাপে একটা মেসেজ এলো। সে মেসেজটি পড়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলো। আবার সেই উটকো ঝামেলা?
#তোমার_জন্য_সব -২২
✍️ #রেহানা_পুতুল
“আপনি গল্প করতে চেয়েছেন স্যার। ”
“সময়ের কাজ অসময়ে করতে নেই। এটা আপনার কথা। গল্প করার মতো মানসিক এনার্জি এখন আমার মাঝে অবশিষ্ট নেই। চলে যান বলছি।”
আদেশের ঢংয়ে বলল মাহমুদ।
কলি ম্লান মুখে বিছানায় এসে ফের শুয়ে পড়লো। খারাপ লাগছে তার। অনুতাপ হচ্ছে বেশ। যেই মানুষটা তার প্রতি এত কেয়ারিং। তাকে ওভাবে মুখের উপর মানা করে দেওয়াটা নেহাৎ অন্যায় হয়েছে। বেড শেয়ার করে ঘুমানো যেতো। কিন্তু ভয় ও আড়ষ্টতার জন্যই ত সে মানা করেছে। যদি স্বামীর অধিকার ফলানো শুরু করতো মাহমুদ? সে কি করতে পারতো? সেতো মেন্টালি প্রিপেয়ার্ড নয় এই সময়ের জন্য।
কলি উঠে গিয়ে আবার বারান্দায় যায়। দেখে মাহমুদের চোখ বন্ধ। কলি বিগলিত স্বরে ডাক দিলো,
“স্যার….স্যার… শুনছেন?”
মাহমুদ ক্লান্তিপূর্ণ চোখ দুটো মেলে তাকালো কলির মুখের দিকে। কিছু বলছে না। কলি ফের বলল অনুরোধ করে,
“স্যার প্লিইজ। বেডে আসুন না। প্লিইজ।”
“নাহ কলি। আমি বেডে গেলে আপনার সমস্যা হবে। আপনি মেঝেতে শোবেন বা সোফায় কাত হয়ে থাকবেন।”
“নাহ। বেডেই থাকবো।”
“প্রমিজ?”
“হুম। প্রমিজ।”
মাহমুদ তৎক্ষনাৎ উঠে গেলো রুমে। বেডে তার বালিশে শুয়ে পড়লো উপুড় হয়ে হাত পা ছড়িয়ে। কলিও তারপর এলো। মাহমুদের পায়ের উপর দিয়ে বিছানায় উঠে গেলো। দেয়াল ঠেস দিয়ে বসে রইলো। ডিম লাইটের আলো বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। মাহমুদ কলিকে দেখল। এবং তিরিক্ষি মেজাজে বলল,
” সবসময় দেয়াল ঘেঁষে থাকা কি আপনার বেশি পছন্দ? আপনার বিয়ে মনুষ্য জাতির সঙ্গে না হয়ে দেয়ালের সঙ্গে হলেই বেশ হতো।”
কলি ওভাবেই ভাবলেশহীনভাবে বসে বসে নখ খুঁটতে লাগলো।
“নখ খুঁটছেন কেন ছোট বাচ্চার মতো? শুয়ে পড়ুন।”
র*গচটা কন্ঠে মৃদু ধমকে বলল মাহমুদ।
“আমার এখন ঘুম আসছে না। শুইতেও ইচ্ছে করছে না। ”
“ওহ! তাহলে কাজ করুন বসে বসে। উঠে যেতে হবে না। এখানে বসেই করতে পারবেন। সওয়াবও পাবেন দিগুণ।”
“কি কাজ?”
” হঠাৎ রাত জেগে থাকাতে ও অনেকগুলো নিকোটিন টানাতে প্রচণ্ড মাথাব্যথা করছে। হাত পা কামড়াচ্ছে। অসুস্থবোধ করছি। আর এই অবস্থার জন্য আপনিই দায়ী। তাই এখন আমার ঘুমের আরামদায়ক ব্যবস্থা আপনাকেই করতে হবে।”
কলি অবাক হলো। ক্ষীণ গলায় বলল,
“কি করতে হবে আমাকে?”
“আমার সারামাথার চুলগুলো টেনে দিবেন। কপাল ম্যাসাজ করে দিবেন। দুই হাত টিপবেন বাহু পর্যন্ত। দুই পা টিপবেন হাঁটু পর্যন্ত। আমার ঘুম না আসা পর্যন্ত ননস্টপ সেবা দিবেন। বাসর রাতের এসাইনমেন্ট এটা আপনার জন্য। কুইক। ঘুমাতে হবে আমার।”
গম্ভীর স্বরে কলিকে আদেশ দিয়ে মাহমুদ ওপাশ হয়ে গেলো। দুচোখ বন্ধ করে ফেলল। মনে মনে বলল,
এটাই তোমার প্রাপ্য শাস্তি। বাসর রাতে জামাইকে আনন্দ দান করতে পারনি। এবার সেবা দান করো।
কলি জমে গেলো বরফখণ্ডের ন্যায়। এগুলো করতে হবে এখন আমাকে? উহু! শিট! এর চেয়ে রাতে পাশে ঘুমাতে দিতাম সেই ছিলো ভালো। নয়তো আমি এখন ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকতাম। তাও ঢের ভালো ছিলো। কেন যে বললাম শুইতে মন চাচ্ছে না। নিজের কথার জন্য নিজেই কি বাঁশটা এখন খেলাম। ভাবতেই কলির মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো।
“কি হলো কলি? আরাম পাচ্ছি না কেনো?”
উপুড় হয়ে থেকেই বলল মাহমুদ।
কলি মলিনমুখে মাহমুদের মাথার কাছে গেলো। কাঁপা কাঁপা হাতে মাহমুদের চুলগুলো মুঠিধরে টানলো কিছুক্ষণ। কপালে ম্যাসাজ করে দিলো। দুইহাত টিপে দিলো। পায়ের পাতা থেকে ট্রাউজারের উপর দিয়ে হাঁটু পর্যন্ত টিপে দিলো। আবেশে মাহমুদের চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে এলো। কলি যখন নিশ্চিত হলো মাহমুদ গভীর ঘুমে বিভোর। তখন কলি হাত সরিয়ে নিলো। তার দু’হাত ব্যথা হয়ে গেলো। দু’চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগলো। দলাই মলাই হয়ে নিজের বালিশে কাত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
সকালে মাহমুদের আগেই কলির ঘুম ভেঙ্গে গেলো। সে শব্দহীনভাবে উঠে গেলো শাড়ির কুচি ধরে। বারান্দায় গিয়ে মাহমুদের তাওয়াল, মশার স্প্রে,গ্যাসলাইট এনে রাখলো রুমে। আবার গিয়ে গ্রিলে থাকা পুরোনো কাপড়টি হাতে নিলো। সেটা দিয়ে সিগারেটের খোসাগুলোকে জড়ো করে রাখলো একস্থানে। ওয়াশরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নিলো। ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ে নিলো। এই ড্রেসিংটেবিলটা আগে ছিল না। নতুন বউ আসবে বাসায়। সেজন্য কেনা হয়েছে। কলি যতটুকু পারলো লাগেজ থেকে তার প্রসাধনীগুলো বের করে নিলো। পরিপাটি করে সব সাজিয়ে রাখলো ড্রেসিংটেবিলের সব সেল্ফে। বডি লোশন,আমন্ড ওয়েল, ময়েশ্চারাইজার, পারফিউম,ত্বকের একটা জেল, থেকে শুরু করে সব। মেকাপ বক্স রাখলো অন্য সেল্ফে। চিরুনি হোল্ডারটাও গুছিয়ে নিলো। এটাও যে নতুন দেখলেই বোঝা যায়। ভাবছে কি করবে এবার সে।
তারপর গিয়ে দুই সিটের বেতের সোফাটায় বসলো। মুঠোফোনটা হাতে নিলো। মাহমুদের নাম লিখে সার্চ দিলো ফেসবুকে। আইড়ি পেয়েও গেলো। মাহমুদ বিয়ে করেছে এমন কিছুই নেই। বিষয়টা কি হাইড রেখেছে তার জন্যই? যেনো ভার্সিটির কেউই না জানে। নয়তো স্যারদেরকেও ইনভাইট করতে হতো। এটা পরে জেনে নিবে জিজ্ঞেস করে। হয়তো। সে নিজেওতো পোস্ট দেয়নি। দিবেও না। কলি পিটপিট চোখে মাহমুদের আপাদমস্তক দেখে নিলো। হুম। সুন্দর হ্যান্ডসাম যুবক।
” হইছে। সালাম দিতে হবে না। কাল এসেই ত সালাম দিলে। ”
“খালাম্মা ভালো কাজে বাধা দিতে নাই। সালাম যত দেওন যায় ততই সওয়াব।”
রুটির গোলা তৈরি করতে করতে বলল বাতাসী।
“রেডিও স্টপ কর বাতাসী।”
বাতাসী চুপ হয়ে গেলো।
“উঠে এলে কেনো মা? মাহমুদ ঘুমায়? ”
“জি মা। উনি ঘুমায়। আমার ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছে। ড্রেসিংটেবিলটা গুছিয়ে নিলাম লাগেজের কসমেটিকগুলো বের করে।”
“খুব ভালো করেছে। বাকি কাপড়চোপড়গুলো তোমাদের ওয়ারড্রবে রেখে দিও। একি তোমার নাক খালি কেন? কাল নাকফুল পরোনি?”
“নাহ মা। টিকলির সঙ্গে এটাচ যেটা ছিলো, সেটাই ত পরিয়ে দিলো পার্লারে। এখনো শুকায়নি। গায়ে হলুদের দিন ফুটো করলাম যে।”
“গলা,হাত,কান সবই ত খালি। মাহমুদ বের করে দেয়নি রাফ ইউজেরগুলো ?”
” নাহ।”
“লাগেজেই ত আছে। দেখতে ভালো লাগছে না মা। বিবাহিত মেয়ের নাক, কান,গলা, হাত খালি থাকা অশোভনীয়। বাসায় গেস্ট আছে। এখন গিয়েই পরে নিবে। গহনা বাহ্যিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে বিবাহিত মেয়েদের।
“আচ্ছা মা। রুমেই গিয়েই পরে নিবে।”
কলি আরো কিছুসময় গল্প করলো শাশুড়ীর সঙ্গে। মাহফুজা জিজ্ঞেস করলো,
“সকালে কি নাস্তা করতে তোমাদের বাসায়?”
“রুটি,পরোটা, সবজি, বানায় আম্মু। এইতো।”
“বাতাসী এখন রুটি বানাচ্ছে। গরুর মাংস আছে। সবজিও আছে। সবাই উঠুক। তখন নাস্তা করতে ডাক দিবে। এবার যাও রুমে।”
কলি নিজেদের রুমে চলে গেলো। মাহমুদের ঘুম হালকা হয়ে এলো। দরজা খোলার আওয়াজ কানে আসতেই হাই দিতে দিতে তাকালো। কলিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আপনি রাতে আমার মাথা টিপেন নি? কোন রুমে ছিলেন?”
“আপনার আরামদায়ক ঘুম কিভাবে হলো? আমি কিছুক্ষণ আগেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম।”
লাজুক গলায় বলল কলি।
“ওহ! সরি। একচুয়েলি এত দ্রুত ঘুম চলে এলো। বুঝতেই পারিনি। দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিন। বেডে আমার পাশে উঠে আসুন।”
“কেন? আলো ফুটে উঠেছে। দেয়াল ঘড়ির দিকে দেখুন। আটটা বাজে।”
“আলো, সময় আমি দেখছি না? দরজা বন্ধ করার সঙ্গে এসবের কি সামঞ্জ্য? চোরের মন পুলিশ পুলিশ? পুলিশের হাতে ধরা না পড়ে চোর কয়দিন পালিয়ে থাকতে পারে? ”
“না,মানে,এমনিই। এমন কিছুই না।”
কুন্ঠিত গলায় বলল কলি।
“রা*গা*বেন না বলছি আমাকে। মুড যথেষ্ট ভালো আছে আমার। ভালো থাকতে হেল্প করুন। দরজা অফ করে কাছে আসুন বলছি।”
গম্ভীর কন্ঠে বলল মাহমুদ। কলি দরজা বন্ধ করে দিলো। বিছানায় উঠে এলো। দেয়াল ঘেঁষে বসলো। মাহমুদ চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। এক পায়ের পাতা আরেক পায়ের পাতার উপর ক্রসচিহ্ন র মতো করে দিয়ে। পা নেড়ে যাচ্ছে অনবরত। ঘাড় বাঁকিয়ে কলিকে দেখলো।
” আবার দেয়াল ঘেঁষে বসলেন। আমি কালই দেয়াল ভেঙ্গে ফেলব। একটু শোন আমার পাশে।”
“না শুইলে কি করবেন?”
চোখ নামিয়ে বলল বলল কলি।
“কিছুই করব না। শুইতে বলছি।”
কলি বিরক্ত হলো। দুই হাঁটু ভাঁজ করে বসেই রইলো।
মাহমুদ চট করে কলির ভাঁজ করা দুই পা সোজা করে নিলো বিছানার উপরে। কলির কোলে মাথা দিয়ে কোনাকুনি হয়ে শুয়ে পড়লো। কলি শুকনো ঢোক গিলল বার দুয়েক। বলল,
“পানিই..পানি..খাবো..উঠে যান।”
“আমি দিচ্ছি। আপনি নড়বেন না। খবরদার! ”
মাহমুদ উঠে গ্লাসে করে কলিকে পানি দিলো। কলি সামান্য পানি খেলো।
“এই এতটুকু পানির পিপাসা লেগেছে? আর কত বঞ্চিত করবেন আমাকে?”
বলেই মাহমুদ আগের মতো কলির কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।
“স্যার দরজা খুলে দিই। কেউ আসতে পারে।”
কলির কন্ঠে অনুনয়।
“সেটা আমি দেখবো। নব দম্পতির বেড রুমের দরজা চব্বিশ ঘন্টাই বন্ধ থাকতে হয়।”
“মা বলছে, আমার সব সময়ে পরার জিনিসগুলো এখন পরে নিতে।”
কলি নানা বাহানা করেও আলাদা হতে পারছে না। মাহমুদ শিহরিত চোখে কলির মুখপানে চাইলো। বলল,
“আচ্ছা পরিয়ে দিচ্ছি। রাত ফুরিয়ে গেলো। বাসর ত হলো না। একটু খুনসুটি করি আমরা। দরজা বন্ধ মানেই সব নয়। কিছু কিছু।”
কলি চুপ রইলো। প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। মাহমুদ কলির একহাত টেনে নিজের বুকের উপরে চেপে ধরলো। নিবেদিত কন্ঠে বলল,
“কলিকে ভালোবাসি। কলির মুখে তার বরের নাম শুনতে চাই।”
কলির জন্য এটা খুব কঠিন প্রশ্ন। সে বলল,
“আমি জানিনা।”
“এসব বলে পার পাওয়া যাবে না। বলতেই হবে। আমার খুব ইচ্ছে আপনার মুখে আপনার হাজব্যান্ডের নাম শোনা।”
“লিখে দিলে হবে?”
“নোওও। সরাসরি আমার চোখের দিকে চেয়ে বলতে হবে।”
কলির বুক ধড়ফড় করছে। মাহমুদ কলির কোল থেকে মাথা তুলে নিলো। কলির গা ঘেঁষে বসলো। দু-হাত দিয়ে কলির দুগাল চেপে ধরলো। আকুল কন্ঠে বলল,
“ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইচ্ছেগুলোর পূর্ণতা মানুষকে বিপুল আনন্দ দান করে। আর আনন্দ না পেলে কোন মানুষ ভালো থাকতে পারে না। মানুষ আনন্দের পিছনে ছোটে। আনন্দ পাওয়ার জন্য সে অনেক কিছুই করতে পারে। আর যে যেভাবে আনন্দ নিয়ে ভালো থাকতে চায়,তাকে সেভাবে আনন্দ দিয়ে ভালোরাখা একান্ত উচিত প্রিয়জনদের।
প্লিজ কলি,আপনার লাইফ পার্টনারের নাম বলুন?”
“আপনার জন্য যা ক্ষুদ্র,যা সহজ। বিপরীতজনের জন্য তা কঠিন। এটাও বুঝতে হবে। তবুও বলছি, কলির বরের নাম মাহমুদ খান।”
দাঁত চিবিয়ে বলল কলি।
মাহমুদ মৃদু চিৎকার করে উঠলো উৎফুল্ল হয়ে।
“ম্যানি ম্যানি থ্যাংকস কলি। প্রচণ্ডরকম ভালোবাসি আপনাকে। খুব ডিপলি ফিল করি এভরি মোমেন্ট। ও হ্যাঁ! রাতে নিরিবিচ্ছিন্ন সেবা দিয়ে শান্তির ঘুম উপহার দেওয়ার জন্য স্পেশাল থ্যাংকস। এসাইনমেন্ট দশে দশ পেয়েছেন।”
এই বলে মাহমুদ কলির কপালে গাঢ় চুমু খেলো। হাতের পিঠে বেশ কয়েকটি চুমু খেলো ওভাবে বসে থেকে। পরে নেমে গেলো বিছানা থেকে। বিছানার সামনে দাঁড়িয়ে কলিকে বলল,
“একটু খাটের কিনারায় আসুন।”
কলি এলো। মাহমুদ কলিকে জড়িয়ে ধরল না। কলির মুখটাকে আলগোছে নিজের বুকে লেপ্টে লাগিয়ে নিলো। বলল,
“বুকে মাথা রেখে কান পেতে শোনো,হৃদয় কি বলে? আমার হৃদয় সমুদ্রের গর্জন শুনতে পাচ্ছেন? এই গর্জন বন্ধ করার অসীম ক্ষমতা একমাত্র আপনার হাতে।”
মাহমুদ গহনাগুলো বের করে নিলো। কলির পাশে বসলো। নিজের হাতে কলির গলায় সোনার চেইনটা পরিয়ে দিলো। উদাম ঘাড়ে ঠোঁট লাগাতে গিয়েও সরিয়ে নিলো। রাতের জন্য বাকি থাকুক। সে কলির কানে দুল পরিয়ে দিলো। দুই হাতে দুটি চুড়ি পরিয়ে দিলো। নোজ পিন পরাতে কলি ব্যথা পেলো। উঁহু ব্যথা! বলে মাহমুদের টিশার্ট খামচে ধরলো। নাকে একটু লোশন লাগিয়ে দিলো মাহমুদ। তারপর সে ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে চলে গেলো।
দরজায় টোকা পড়লে কলি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। একজন অপরিচিত বয়স্কা নারী। কলি সালাম দিয়ে তাকে ভিতরে যেতে বলল। তিনি ভিতরে গিয়েই সোজা বারান্দায় চলে গেলেন।
কিয়ৎক্ষণ পর ফিরে এসে কলির দিকে চাইলেন। নিরস ভঙ্গিতে বললেন,
চলবে…২২
#তোমার_জন্য_সব -২৩
✍️ #রেহানা_পুতুল
দরজায় টোকা পড়লে কলি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। একজন অপরিচিত বয়স্কা নারী। কলি সালাম দিয়ে তাকে ভিতরে যেতে বলল। তিনি ভিতরে গিয়েই সোজা বারান্দায় চলে গেলেন।
কিয়ৎক্ষণ পর ফিরে এসে কলির দিকে চাইলেন। নিরস ভঙ্গিতে বললেন,
“গেলাম দেখতে একটা, পাইলাম আরেকটা। কাহিনী কিগো? ”
“আপনি বসুন না। কে আপনি? চিনতে পারিনি?”
অত্যন্ত বিনয়ী গলায় বলল কলি। গ্রামে একটা প্রতীকী কথা প্রচলিত। স্বশুর বাড়ির কুত্তাকেও সালাম দিয়ে ইজ্জত করে কথা বলতে হয়। এটা কলি তার মায়ের কাছে শুনেছে। তাই সে প্রথম দেখা নারীটিকে না চিনলেও শ্রদ্ধার জায়গায় ঘাটতি রাখেনি।
তিনি বিছানার এককোণে বসলেন। কিঞ্চিৎ রাগত স্বরে বললেন,
“গেলাম তোমার ভেজা কাপড় দেখতে। তার বদলে পাইলাম একগাদা পোড়া বিড়ির ছাইঁ। সারারাইত মাহমুদ এতগুলা বিড়ি খাইয়া শরীরের যে বারোটা বাজাইলো,এটা পোষানোর উপায় আছে?”
কলি হতভম্ব হয়ে গেলো শুনে। লজ্জিত চোখে বসে রইলো। তখন মাহমুদ বের হলো ওয়াশরুম থেকে ব্রাশ করে। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আয়নায় চোখ রেখেই উচ্ছ্বাসভরা কন্ঠে বলল,
” কি নানু? নাতবউ পছন্দ হলো?”
“রাখ তোর পছন্দ। তোরে কোলে পিঠে কইরা মানুষ করছি এই মাইয়ার লাইগা বিড়ি টাইনা কলিজা জ্বালাইতে?”
“কলিজা নয়,হৃৎপিণ্ড জ্বলে গেলো নানু।”
কলির দিকে চেয়ে মাহমুদ বলল,
“এই কলি, আমার নানু আমার কোনপ্রকার অসুবিধা নিতে পারে না। তাই গরম হয়ে গেলো।”
কলি হাসলো নানুর দিকে চেয়ে। নানু মাহমুদের দিকে দেয়ে বলল,
“মাহফুজা যখন আমারে কইলো, পাত্রী তোর ছাত্রী। আমি ধইরা নিলাম তোগো দুইজনের ইটিসপিটিস ছিলো। এখন বারান্দার সুরুত দেইখা মনে হইলো এরে জোর কইরা বিয়া করছত। ”
মাহমুদ চেয়ার টেনে বসলো। কলিকে জিজ্ঞেস করলো,
“কলি আপনাকে জোর করে বিয়ে করেছি আমি?”
“না স্যার।”
নানুর বিষম খাওয়ার যোগাড়।
“কিরে? কেউ বউরে আপনি কয়,কেউ স্বামীরে স্যার কয়, এসব কি? এইটা অফিস?”
মাহমুদ হোহোহো করে হেসে ফেলল। বলল,
“সমস্যা নেই। চলুক আপাতত। তুমিতে এখন অভ্যাস হয়ে গেলে ক্লাসে সমস্যা। মুখ দিয়ে তুমি বেরিয়ে আসবে।”
“কত নমুনা তোগো। এই দুনিয়া মনে হয় আর মাষ্টার ছাত্রীর বিয়া হয়নাই। তোরাই একজোড়া। তোরাই একখান চিজ।”
পরক্ষণেই নানু কলির দিকে চেয়ে বললেন,
“মুসলমানের ঈদ যেমন তিনদিন ধইরা পালন করন যায়। তেমনি বাসর ঘরও তিনদিন ধইরা পালন করা যায়। বাকি দুই রাইতে যেনো বারান্দায় আর একটা বিড়ির খোসাও না পাই। নাস্তা খাইতে আয় দুইজনে।”
নানু চলে গেলো। মাহমুদ বারান্দায় গিয়ে নিজেই সিগারেটের পোড়া অংশগুলো একটি কাগজে মুড়িয়ে তুলে নিলো। রুমের বাইরে গিয়ে বিনে রেখে দিলো। ফিরে এসে কলিকে কানের কাছে মুখ নিয়ে হিসহিসিয়ে বলল,
“নানু কি বলছে? সময় দুই রাত। মনে থাকবে?”
কলি নিরুত্তর! লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। মনে মনে আওড়ে নিলো। যেমন নাতি,তেমন নানি। মুখে আটকায় না কিছুই।
“নাস্তা খেতে আসো।”
“আপনি যান। আমি পরে আসতেছি।”
“একসঙ্গে গেলে কি প্রবলেম?”
“আমি কুন্ঠিতবোধ করছি।”
মাহমুদ কলির সামনে গিয়ে ট্রাউজারের দুই পকেটে হাত গুঁজে সটান হয়ে দাঁড়ালো। পুরু কন্ঠে বলল,
“আমাকে সুযোগ দিলে এক রাতেই আপনার সমস্ত কুন্ঠাবোধ,লজ্জাবোধ, সংকোচবোধ লুট করে নিতে পারি। জাস্ট ওয়ান নাইট।”
কলি মনে মনে বলছে,
ইয়া আল্লাহ! মাটি ফেটে যাক। আমি গায়েব হয়ে যাই সেই ফাঁক দিয়ে। তাও এমন ঠোঁটকাটার হাত থেকে বাঁচি।
“ভাইয়া কিরে? বাসি নাস্তা খাবি তোরা দুজন?”
আনুশকার গলা ভেসে এলো। মাহমুদ চলে গেলো ত্রস্ত পায়ে। নাস্তা খাওয়া শুরু করলো। কলি তার পিছন দিয়ে নম্র পায়ে হেঁটে গিয়ে একটি চেয়ার টেনে বসলো।
“গুড় মর্নিং ভাবি!”
“মর্নিং আপু।”
স্মিত হেসে বলল কলি।
নানু চোখের পাতা উল্টিয়ে বলল,
“তুমি জামাইয়ের লগের চেয়ারে বইলা না?”
আনুশকা বলল,
” থাকুক না রঙিলা নানু।”
মাহমুদ রুটি, মাংস মুখে পুরে দিতে দিতে গোপনে বলল,
কয়মাস পর জামাইয়ের কোলে উঠে বসবে। তেমনই ইজি করে দিবো আস্তে আস্তে। নাস্তা খাওয়া শেষে মাহমুদ নিজের বেড রুমে চলে গেলো। ভার্সিটি থেকে রবি,সোম এই দুইদিনের ছুটি নিয়েছে। শুক্র,শনি এমনিতেই বন্ধ। তাই কর্মস্থলেও কোনো সমস্যা নেই। আজ শনিবার। আরো দুদিন বাসায় থাকতে পারবে। ভেবেই এক পশলা বৃষ্টির মতো আনন্দ অনুভব করলো সে।
নাস্তা খাওয়া শেষে মাহফুজা কলিকে বলল,
“পরিচয় হয়ে নাও কলি। আমার মাকেতো দেখলেই। ও আমার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী। এ হলো আমার ছোট বোন। এটা আমার দুষ্ট ভাগিনা ও ভাগনি। আর বিকেলে তোমাদের বাসা থেকে মেহমান আসবে। সুন্দর একটা শাড়ি পরে রেডি হয়ে থেকো। মেয়েকে স্বশুর বাড়িতে ভালো দেখলেই বাবা, মা আনন্দ পায়।”
কলি সবাইকে সালাম দিলো। আনুশকাসহ সবাই মিলে কিছুক্ষণ গল্পকথায় মেতে উঠলো। মাহমুদ বিছানায় শুয়ে শুয়ে কলির জন্য অপেক্ষা করছে। বেশ বেলা হয়ে গেলো। তবুও কলির রুমে আসার নাম নেই। সে মোবাইলে তার একটি প্রিয় গান ছেড়ে দিলো। লুফে দিয়ে দিলো বারবার শুনবে বলে।
“তাকিয়া আসমানের দিকে/সে কি বলো আছে সুখে/
ভাবিয়া কান্দিয়া মরি সে যে পাশে নাই।
……………….
ভাবতে ভাবতে তারে আমি, চোখ বুজিয়া জড়াই ধরি।
চোখ মেলিয়া দেখি আমি, সে যে বুকে নাই।”
গান শুনতে শুনতে মাহমুদের চোখ বুঁজে এলো। কলি প্রায় দুপুরের দিকে রুমে আসলো। দেখল মাহমুদ কোলবালিশ জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। কলি লাগেজ থেকে আরেকটা শাড়ি নিলো তার। বাকি প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোও হাতে নিলো। তার মোবাইলটা চেক করা দরকার। বাসা থেকে ফোন এলো নাকি। বালিশের নিচে পড়ে আছে মোবাইল।
কলি মাহমুদের মুখের উপর দিয়ে ঝুঁকে মোবাইলটা নিলো। তক্ষুনি মাহমুদ নিজের মুখের উপর কলির শাড়ির ছোঁয়া পেতেই জেগে গেলো। কলি মোবাইল হাতে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই তার শাড়ির আঁচলে টান পড়লো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো মাহমুদের মুঠোবন্দী তার আঁচলখানি। সে বুকের অংশের শাড়ির উপরে হাত দিয়ে ধরে রেখেছে। যেন বুক থেকে না খসে যায়।
মাহমুদ বলল,
“বুক থেকে হাত সরান বলছি।”
“কেন? কি করবেন? ছাড়েন বলছি স্যার। প্লিইজ।”
ভীরু লজ্জিত গলায় বলল কলি।
“কিছুই করব না। দেখেন কলি,এখন পর্যন্ত একটা চুমুও খাইনি আপনার গালে,ঠোঁটে। হাত,মুখ,ঠোঁট সবকিছুর ব্যবহার বন্ধ রেখেছি। কতটা সংযমী আমি। বুঝুন। কেবল দৃষ্টির ব্যবহার চলছে। প্লিজ সাপোর্ট মি কলি! নয়তো অন্যগুলো চলবে আপনার নিটোল অঙ্গে!
নেশালো কন্ঠে বলল মাহমুদ।
কলি সরে যেতে চেষ্টা করছে। পারছে না। হাতও সরিয়ে নিচ্ছে না। মাহমুদ একই মুহূর্তে দুটো কাজ করে ফেললো। একহাত দিয়ে কলির হাত সরিয়ে নিলো। মুঠোয় ধরা শাড়ির আঁচলখানিতে হালকা টান দিলো। অমনি কলির বুক ও ফর্সা মসৃণ পেট উম্মুক্ত হয়ে গেলো। কলির সুডৌল বুকের ধড়ফড়ানির দিকে মাহমুদ কামাতুর চোখে চেয়ে রইলো। তার দৃষ্টি চলে গেলো পাতলা ব্লাউজ ভেদ করে আরও ভিতরে। আরো গভীরে।
কলি দাঁড়ানো থেকে বসে গেলো চট করেই। মাহমুদের উপর বিতৃষ্ণায় তার অন্তর ফেটে চৌচির হয়ে গেলো। কান্না করে দিলো নিমিষেই। মাহমুদ ভ্যাবাচেকা হয়ে গেলো। শাড়ির আঁচল ছেড়ে দিলো। শশব্যস্ত হয়ে উঠে দরজা বন্ধ করে দিলো। কলির কান্নার গতি বেগবান হলো। সে মনে করেছে মাহমুদ তাকে আরো ডিপলি টাচ করবে। কিন্তু মাহমুদ সেসবের কিছুই করল না। কলির মুখোমুখি বসলো হাঁটু মুড়িয়ে। কলির মেহেদী ভরা রাঙা কোমল হাতখানার তালুকে নিজের একগালে ঠেকিয়ে ধরলো। আকুতি মাখা কন্ঠে বলল,
“সরি সরিই। প্রমিজ রাতের আগে আর কোন ফাজলামো করব না। কি করবো বলেন। বিয়ে করা নতুন বর আমি। উপোসে উপোসে হৃদয়টা তামা তামা হয়ে যাচ্ছে।”
কলি বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করলো ,
“আমি শাওয়ার নিবো কোন বাথরুমে?”
“কেন কলি? আমাদের রুমেই ত ওয়াশরুম আছে। যান।”
“আপনি বের হোন। ওয়াশরুমে নতুন শাড়ি পরা যাবে না। ভিজে যাবে। রুমে এসে পরতে হবে।”
বিষাদমাখা সুরে বলল কলি।
“স্ত্রী শাড়ি পরার সময় হাজব্যান্ড সামনে থাকতে পারবে না,এটা জানা ছিল না। ওকেহ! আমার মহারানীর যা হুকুম। যাচ্ছি।”
মাহমুদ বেরিয়ে যায়। কলি গোসল করে রুমে এসে শাড়ি পরে নিলো। দরজা খুলে দিলো। মাহমুদ একটু পর রুমে ডুকলো। কলি তাকে খেয়াল করেনি। সে চুলগুলোকে গোছা ধরে সামনে এনে তাওয়েল দিয়ে পানি ঝাড়তে লাগলো। মাহমুদ কলির পিঠে লেপ্টে থাকা ভেজা ব্লাউজের দিকে চেয়ে রইলো। মনে মনে কাব্য করে বলল,
“তোমার এলোকেশে বক্ষ জড়ায়ে গোপনে কত চুমি,
যদি এ সত্য জানিতে অঙ্গনা, কত যে মরিতে চাহিতে তুমি।”
আহা! কবি সাহিত্যিকরা এমনি এমনি নারীর সৌন্দর্যে মরেনি। ঘটনা যে পুরাই সত্যি। ভেবেই মাহমুদ শুকনো কাশি দিলো। কলি হকচকিয়ে গেলো। বলল,
“আমি হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে দিবো? পুরো ব্লাউজ ভিজিয়ে ফেললেন যে পিঠের অংশের দিক।”
“না স্যার। লাগবে না।”
“তাহলের ব্লাউজের পানিগুলো শুকিয়ে দিই? ঠান্ডা লেগে যাবে। এতে আমার বিরাট লস।”
কলি বুঝলো কথার ইঙ্গিত। এক পলক মাহমুদের দিকে চাইলো। দেখলো মাহমুদের চোখের কোণে আবারও রোমাঞ্চ খেলা করছে। সে পালাতে চায়। কলি বের হয়ে চলে গেলো আনুশকার রুমে। মাহমুদ তাকে আটকালো না। দরজা বন্ধ করে দিলো। কলির ব্যবহার করা ভেজা তাওয়েলটা উলটে পালটে নাকে চেপে ধরলো। কলির সারা অঙ্গের ঘ্রাণ যেন সে পুরো তাওয়েলজুড়ে রয়েছে। উফফস! পাগল হয়ে যাবো। আজ সময় যায়না কেন? আসেনা কেন রজনী? মাহমুদ ভেজা তাওয়েলটা নিয়ে বারান্দায় রোদে মেলে দিলো। কলির বাকি ভেজা বস্রগুলোর দিকে একবার নজর বুলিয়ে নিলো।
বিকেলে কলির পরিবারের লোকজন এলো। আসতে তারা যাবতীয় সবকিছু নিয়ে আসলো। দুই বেয়াই মোলাকাত করে নিলো একে অপরকে জড়িয়ে ধরে। দুপক্ষ মিলে একসঙ্গে বিয়ের অনুষ্ঠান করে ফেলেছে। তাই আলাদা করে আজ বৌভাতের ঝামেলা নেই। কলি বাবার মুখ দেখে হুহু করে কেঁদে ফেলল। বোনদের জড়িয়ে ধরলো। নিজের রুমে নিয়ে গেলো। সবাই মিলে হাসি তামাসায় রাত অবধি ছিলো। বাহারী স্বাদের নাস্তা ও বহু ব্যঞ্জনে রাতের নৈশভোজ করা হলো। ভরপুর খাবার খেয়ে সবাই চলে গেলো। কলি ও আনুশকা জুলিকে রেখে দিলো। জুলিও স্বইচ্ছায় রয়ে গেলো। জুলির খুব পছন্দ হলো বোনের বাসা।
রাতে আনুশকা, ও তার দুজন কাজিন, জুলি, মিলে লুড়ু খেলতে বসেছে। জুলি গিয়ে মাহমুদকে বলল,
“হ্যালো মাষ্টারমশাই,লুড়ু খেলবেন?”
“না জুলি। তোমরা খেলো গিয়ে।”
মাহমুদ বিড়বিড় করে বলল,
আমিও লুড়ু খেলব আজ সারারাত। নিশি থেকে ঊষালগ্ন পর্যন্ত। খেলায় হেরে গেলে চলবে না। জয়ী হতে হবে আমাকে।
রাত বেড়ে যাচ্ছে। সবাই সবাইর মতো অনান্য রুমে আছে। মাহমুদ একাকী রুমে শুয়ে আছে। প্রতিক্ষার প্রহর গুনছে। কলির আসার নাম নেই। মোবাইল নিয়ে যায়নি। নয়তো ফোন দেওয়া যেতো। মাহমুদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটলো। ক্রমশ মনের মাঝে বিরক্তি দানা বাঁধছে। চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে ভয়ানকভাবে। যেন কলিকে হাতের মুঠোয় ফেলেই গিলে ফেলবে। পিষে ফেলবে। নিশ্চয়ই আনুশকার রুমে লুড়ু খেলছে। নয়তোবা দর্শক হয়ে উপভোগ করছে। মাহমুদ হাত মুঠি করে দেয়ালে ঘুষি মারলো। পরক্ষনে ব্যথা পেয়ে উঁহু করে উঠলো। মাথার চুলগুলো উল্টে নিয়ে খামচে ধরলো। পুরো খাটজুড়ে হাত পা ছড়িয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে রইলো। মাত্রাতিরিক্ত অস্থির লাগছে।
তক্ষুনি দরজা ফাঁক হলো। কলি এলো। কিন্তু কলি দরজা বন্ধ করল না। মাহমুদকে শুনিয়ে বলল,
“স্যার আমি আনুশকার রুমে ঘুমাই? জুলি ত কাল চলে যাবে তাই।”
মাহমুদ রক্তচক্ষু নিয়ে কলির দিকে তাকালো। তৎক্ষণাৎ উঠে গিয়ে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিলো। কলিকে পাঁজাকোলা করে তুলে বিছানার উপরে ফেলে দিলো। কলি ঘাবড়ে গেলো ভীষণ! কিছু বলার সুযোগ পাচ্ছেই না।
মাহমুদ কলির দুই হাত খাটের দুই খুঁটির সঙ্গে উল্টিয়ে বেঁধে নিলো। কাঠ কাঠ গলায় বলল,
“ছোট বাচ্চা? ন্যাকামো? বিয়ে বুঝো। বাসর বুঝ না? স্বামীর মনের খোরাক বুঝনা? আর লজ্জা? তাও বন্ধ করছি। তোমার দুচোখ বেঁধে ফেলছি। তুমি কিছুই দেখবে না। জাস্ট ফিল করবে।”
মাহমুদ কলির বুক হতে শাড়ির পুরো আঁচল সরিয়ে ফেলল। কলিকে নিজের শরীর দিয়ে আবৃত করে নিলো।
কলির বেঁধে রাখা দুই হাতের আঙ্গুলগুলোয় সে নিজের দুই হাতের আঙ্গুলগুলো শক্ত করে গুঁজে দিলো। নিজের শুষ্ক ঠোঁটজোড়াকে কলির ঠোঁটের গভীরে ডুবিয়ে দিতে যাবে,
অমনি কলি এমন এক নিষ্ঠুর বাক্য বলে ফেলল মাহমুদের উদ্দেশ্যে। যা শুনে মাহমুদ স্তব্ধ হয়ে যায়। বিয়ের দ্বিতীয় রাতেই কলি তাকে এমন কিছু বলতে পারে, তার কাছে সেটা অবিশ্বাস্য! অচিন্তনীয়!
“স্যার আমি মিডেল ক্লাস পরিবারের মেয়ে। বড় আপা অনার্স কমপ্লিট করেনি। সুপাত্র পেয়ে যাওয়াতে আব্বু আম্মু আপাকে পাত্রস্থ করে দেয় আগেপরে সব বিবেচনা করে। জুলি ছোট। নাইনে পড়ে। আমাদের কোন ভাই নেই। আব্বু গভর্মেন্ট জব করে। রিটায়ার্ড হয়ে যাবে এক বছর বাদে। তখন,আব্বু যে পেনশনের টাকা পাবেন,তা দিয়ে উনি একটা বিজনেস দাঁড় করাতে চাচ্ছেন। এই বিষয়গুলো বিয়ে ঠিক হওয়ার বেশ আগেই আমাদের বাসায় ডিসকাসন হয়েছে। তো জব করা মানুষ তো হুট করে বিজনেস দাঁড় করাতে পারবে না। হিমশিম খেয়ে যাবে। তাই আব্বু,আম্মুর কথা, আব্বু ও আমি মিলেই যেন বিজনেস শুরু করি। অর্থাৎ আমাদের পারিবারিক বিজনেসটা পুরোপুরি আমার হস্তক্ষেপে চলতে হবে। আব্বু অনেক সময় অসুস্থ থাকে। আর লোকও রাখবো একজন প্রয়োজন বুঝে।”
মাহমুদ কফি পান করতে করতে মনোযোগ সহকারে কলির কথাগুলো শুনলো। এবং বলল,
“আমার করণীয়?”
“আপনার কিছুই করতে হবে না। আমাকে সেই ফ্রিডম দিতে হবে। এটা চাওয়া আমার। বিয়ে পিছাতে চেয়েছি। তাতো আর হলো না।”
অনুযোগ করে চাপাস্বরে বলল কলি।
“আমি এবং আমার পরিবার এসব বেশ উপলব্ধি করতে পারি। কারণ আজ আমরা সমাজের শ্রেনীভেদে যে সচ্ছল অবস্থানে আছি। তা কেবল পরিশ্রম, সততা ও বুদ্ধির জোরে। সো এ নিয়ে দ্বিতীয়বার চিন্তা করবেন না। আপনার পরিবারের জন্য যা যা করতে চান, করবেন। আমি স্যাক্রিফাইস করতে জানি। বাসায় গিয়ে আজই জানিয়ে দিবেন এই বিষয়টা। কেমন?”
কলি ঈষৎ হাসলো।
“আন্তরিক ধন্যবাদ স্যার। খুব ভালোলাগছে এখন। এটা নিয়ে এই কয়দিন দ্বিধায় ছিলাম আমি।”
“বিয়ে পেছানোর মতো উপযুক্ত কোন হেতু খুঁজে পায়নি আমার ফ্যামেলি। তাই মামা ও বাবা পেছায়নি। কিন্তু আমি আপনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছি বিয়ে পিছাতে। সরি।”
“হুম। কচু! ঘোড়ার ডিম করেছেন।”
গোপনে বলল কলি।
” হুম। ওহ! এক মিনিট কলি। আপনার বিয়ে ঠিক হলো যেন কার সঙ্গে?”
সিরিয়াস মুডে জানতে চাইলো মাহমুদ।
কলি ভ্যাবাচেকা খেয়ে উঠলো। দোনোমোনো করতে করতে অপ্রস্তুত গলায় বলল,
মাহমুদ তার তিন আঙুলের ডগার পিঠ কলির কোমল গালের একপাশে উপর থেকে নিচে বুলিয়ে নিলো। থুতনির মাঝে এনে আঙুল থামিয়ে নিলো। রোমান্টিক চাহনিতে বলল,
“ফাঁকি দেওয়ার ধান্ধা আর নয়। অনেক ফাঁকিঝুঁকি দিয়েছেন। আম্মু একটুও চিন্তা করবে না। এডাল্ট মেয়ে। তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। হবু বরের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করবে এটাই স্বাভাবিক। কলি হয়ে আর কতকাল থাকবেন? এবার ফুল হয়েতো ফুটুন। বিকশিত হোন সমস্ত অঙ্গসুরভি নিয়ে।”
কলির নাক মুখ দিয়ে যেন উষ্ণ ধোঁয়া বের হচ্ছে। কি করছে স্যার। এতো দেখি শিক্ষক বেশের আড়ালে কড়া ডোজের প্রেমিক।
একরাশ বিরক্তি ভর করলো কলির মুখশ্রীতে। সে না পেরে ঠনঠনে গলায় বলল,
“বিয়ে পড়ানোর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার চান্স থাকে শতভাগ। এটা বোধহয় আপনি জানেন না?”
মাহমুদের ভিতর থেকে রোমান্টিকভাব মিলিয়ে গেলো। চোখ থেকে চশমা খুলে নিলো। কাঠিন্য সুরে বলল,
” আল্টিমেটাম দিচ্ছেন মনে হয়?”
“ধরে নিন তাই। সময়ের কাজ অসময়ে করতে চান কেন? আপনি আমার জন্য পর পুরুষ। ভুলে যাবেন না।”
“কি করলাম আমি?”
নিরস ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো মাহমুদ।
“কি না করলেন? হাত ধরে ফেললেন, ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলেন। গালে,চিবুকে হাত দিলেন।”
লজ্জাবনত কন্ঠে দৃষ্টি নামিয়ে বলল কলি।
মাহমুদের জেদ হলো। সে ফের কলির গলা বরাবর চার ইঞ্চি নিচে বুকের উপরে চার আঙ্গুল রাখল। গম্ভীর মুখে ও কন্ঠে বলল,
“বুকের উপরে হাত রেখেছি এটা বলতে ভুলে গেলেন? পর পুরুষ আমি? ওকেহ! যেদিন থেকে আপন পুরুষ হবো,সেদিন থেকেই ছোঁবো। আমি আপনার ছায়াও মাড়াবো না আর। মাইন্ড ইট। পারিবারিক বিয়ে পারিবারিক নিয়মেই হবে। তার আগে না আমি আপনাকে চিনি। না আপনি আমাকে চিনেন। বেস্ট অফ লাক। আসতে পারেন আপনি। বাই।”
মাহমুদ উঠে গেলো নিমিষেই। বিল মিটিয়ে বের হয়ে গেলো গমগমে পায়ে। কলিও তার মতো করে বের হয়ে বাসায় চলে গেলো।
দুই পরিবার নিজেদের মতো করে বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মাহমুদের পরিবারের তেমন সমস্যা না হলেও বিপাকে পড়ে গেলো কলির পরিবার। নুরুল হল ব্যাংক থেকে লোন নিলেন গ্রামের হাউজ প্রোপার্টি দেখিয়ে। মাসিক কিস্তিতে শোধ করতে হবে। কিন্তু করবেন কিভাবে? তা ভেবেও দিশেহারা। রেবেকা স্বামীকে আস্বস্ত করলেন। বললেন,
“আপনি চিন্তা করবেন না। আমার যে ব্যংকে ডিপোজিট আছে। সেটা ক্লোজ করে ফেলব। সেই টাকা দিয়ে লোন নেওয়া ব্যাংকের কিস্তি দিতে পারবেন। আমার এই টাকায় যদি দরকার সারতো তাহলেত লোন নিতেই হতোনা।”
রেবেকা উঠে গেলো অন্যদিকে। নুরুল হক ভিতরে নরম হয়ে গেলেন রেবেকার জন্য। আজকাল রেবেকার মাঝে স্থিরতা ও ধৈর্যতা চোখে পড়ার মতো। সামান্যতেই হই হই আর হায় হায় করে উঠা রেবেকা কেন এত শান্ত হয়ে গেলো? কি হয়েছে রেবেকার? যারজন্য রেবেকার এই প্রকাশ্য পরিবর্তন? নুরুল হক উত্তর খুঁজে পেলনা।
মাহমুদ ক্লাসে কলির সঙ্গে একাডেমিক বিষয়েও কোন কথা বলে না। সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। আজকাল মাহমুদের ভাবখানা এমন, যেন কলিকে সে চেনেই না। অথচ মাত্র কটা দিন পার হলেই এই মেয়ের সঙ্গে তার বাসর উদযাপন হবে। হবে স্মরণীয় রাত্রি যাপন।
কলির সেমিস্টার ফাইনাল চলছে। মাহমুদ অন্যদের বেঞ্চের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু কলির বেঞ্চের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় না। যদিও প্রয়োজন হয়। তখন বরাবরের মতো শিক্ষকসুলভ আচরণ করে কলির সঙ্গে। মাহমুদের একরোখা মনোভাব কলির চেনা। তবুও তা নিয়ে কলির মাঝে বিশেষ হেলদোল পরিলক্ষিত হলো না। পরিক্ষা শেষ হলো। রেজাল্ট প্রকাশ হলো যথাসময়ে। কলি ধরে নিলো মাহমুদ তাকে ইচ্ছে করে মার্ক কমিয়ে দিবে। কিন্তু না। সে খুব ভালো রেজাল্ট করলো তার দুই বিষয়ে।
দিন ফুরিয়ে গেলো। বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো। দু’পক্ষের সমঝোতায় গায়ের হলুদের স্টেজ তৈরি হলো। কলি + মাহমুদের গায়ে হলুদ। কলি খুব চেয়েছে গায়ে হলুদে বর না আসুক। দুই পক্ষ আলাদা আলাদাভাবে গায়ে হলুদ করবে।
কিন্তু বরপক্ষ মানল না। বিশেষ করে বরের ছোট বোন আনুশকা। গায়ে হলুদের স্টেজে মাহমুদ চুপচাপ রইলো। একইভাবে কলিও। দুজন দুজনের সঙ্গে কোন কথা বলল না। দৃষ্টি বিনিময় করল না। অন্যরা ভেবে নিলো দুজন টিচার স্টুডেন্ট বলে সংকোচে ও ,ভদ্রতা বজায় রেখে চুপ হয়ে আছে।
কিন্তু তা নয় আদৌ। তারা দুজন জানে কেন এমন নিরবতায় চাদরে জড়িয়ে গেলো তারা। একজনের অসন্তোষজনক বিহেভিয়ার ও বাকিজনের একরোখা মনোভাবের স্বচ্ছ প্রতিফলন এটা।
ফটোগ্রাফারের অনুরোধে কিছু পোজ দিতে হয়েছে মাহমুদ ও কলিকে। গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান নাচে গানে শেষ হয়ে গেলো। মাহমুদ উঠে চলে গেলো বাসায়। কলির সঙ্গে সে টু শব্দটিও করল না। কি ভেবেছে কলি তাকে। সে ইমশোনকে কন্ট্রোল করতে পারবে না? প্রয়োজনে মানুষকে অনেক কিছুই পারতে হয়। তাই সেও পেরে যাচ্ছে। কলিও মনে মনে বলল,
“বেশ হয়েছে। আমি দারুণ মজা পেয়েছি। দু ‘বাক্যে কিছুদিনের জন্য স্টপ করিয়ে দিতে পারলাম। বাহ! আমার কথারও তো দেখি হেবি জোর আছে। শালা মাহমুদ। কি পেয়েছো। হুহ্!”
উৎসবে, আমেজে, বর্ণিল আলোকসাজে,ভরপুর খাওয়া দাওয়ায় মাহমুদ ও কলির বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেলো। বিয়ের দিনেও কলি ও মাহমুদ কোন বাক্য বিনিময় বা খুনসুটি আলাপে মগ্ন হয়নি। আগের দিনের মতই ফটোশেসনের জন্য কিছু ক্লোজলি পোজ দিতে হয়েছে কলির সঙ্গে।
গহীন গুহায় আটকে পড়া বিপথগামী মানুষের মতো ভীত কম্পিত স্বরে অনুনয় করে বলল কলি।
“পানি কোন তাপমাত্রার দিবো? নরমাল,ঠান্ডা, মিক্স?”
ব্যক্তিত্বপূর্ণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো মাহমুদ।
কলি তোতলানো স্বরে বলল,
“মিইই..মিইক্স।”
মাহমুদ রুমের বাইরে গেলো। ফিল্টার ও ফ্রিজ থেকে পানি মিক্স করে গ্লাসে নিলো। ফিরে এসে নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে দিলো। কলির সামনে দাঁড়িয়ে গ্লাস এগিয়ে দিলো তারদিকে। কলি গ্লাস ধরতে গিয়েও পারছে না। হাতের পাঁচ আঙ্গুল অনবরত কাঁপছে।
“আশ্চর্য! একটু আগে দেখলাম আপনার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। তারপর দেখলাম তোতলাচ্ছেন। এখন দেখি হাত কাঁপছে। মৃগী রোগী নাকি? এতো জটিল সমস্যা। আপনাকে নিয়েতো সংসার করা যাবে না।”
বাঁকা স্বরে বলল মাহমুদ।
কলি দু’হাত দিয়ে শক্ত করে গ্লাস ধরলো। কোনমতে পুরো গ্লাসের পানি খেয়ে নিলো। বেড সাইড টেবিলের ওপরে ওয়াটার পট রয়েছে। সেটা থেকে গ্লাসটিতে মাহমুদ একটু নরমাল পানি ঢেলে খেয়ে নিলো। তার পরনে বরের পোশাক নেই। সে আগেই চেঞ্জ করে ফেলেছে। নতুন ট্রাউজার ও টিশার্ট পরে নিলো। হাত খালি। ঘড়ি খুলে রেখেছে রোজরাতের মতই। তার শরীর থেকে পারফিউমের ঘ্রাণ গিয়ে কলির নাকে ঠেকছে। মাহমুদ কলির সামনে থেকে সরে এক চিলতে বারান্দাখানায় চলে গেলো।
কলির হার্টবিট ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। সে ছোট খুকী নয়। অনার্স থার্ড ইয়ারের ছাত্রী। বিয়ের প্রথম রাতে কি হয় তা বেশ অবগত সে। সেসব চিন্তা করতেই তার নিঃস্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম। সে এখন মাহমুদ স্যারের নিবন্ধিত নারী। ফোর্স করেও করতে পারে কিছু স্যার। ঠোঁটকাটা স্বভাবের মানুষ যিনি। তার মুখ, হাত ননস্টপ চলবে মনে হয়। কি করবে কলি। পালাবে কোথায়। যাকে সবসময় শিক্ষকের চোখে দেখে আসছে। আজ সে তার বিয়ে করা বউ। তার সবকিছু সে দেখবে। উপভোগ করবে। হায়! লজ্জায় তার মরি মরি দশা। স্যার কি তাকে কিছুদিন সময় দিবে আস্তেধীরে সহজ হওয়ার জন্য? মাহমুদ স্যার এখন তার স্বামী। এটা চিন্তা করতেই কলির প্রাণ উষ্ঠাগত!
বাসর রাত নব বর বধূর জন্য স্বপ্নের রাত। সুখের রাত। জেগে থাকার রাত। উপভোগের রাত। একে অপরের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যাওয়ার রাত।
মাহমুদ এক চিলতে বারান্দা থেকে একটু ঘুরে রুমে আসলো। ফুলের পাপড়ি ছড়ানো বিছানার একপাশে উঠে বসলো। একটা বালিশ নিয়ে হেলান দিলো আধশোয়ার মত হয়ে। নিজের একপায়ের উপর আরেক পা তুলে দিলো। কলির দিকে অবশ চোখে চেয়ে আছে। ঘোমটা ও মাথা ঝুঁকে থাকার জন্য কলি মাহমুদের মুখাভঙ্গি দেখতে পাচ্ছে না।
মাহমুদ স্থির গলায় বলল,
“মাথা তুলে সোজা হয়ে বসুন কলি। যেভাবে ঢুলে যাচ্ছেন, মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে যাবে। ডাক্তারও সোজা করতে পারবে না।”
কলি একটু সোজা হলো মাথা তুলে। মাহমুদ কলির মুখটা ভালো করে দেখার জন্যই এটা বলল।
“এইতো। গুড গার্ল। আমি জানি আপনি কি কি ভাবছেন? তাই সেগুলো জানতে চাইবো না। বলুন আপনার বিয়ের প্রথম রজনী কিভাবে উপভোগ করতে চান?”
কলি আঁখিপল্লব বুঁজে ফেলল লজ্জায়। মৌন হয়ে আছে।
“কি প্রশ্ন করলাম? ওহে পুষ্পকলি?”
কলি ছোট্র করে অস্ফুট স্বরে বলল,
“কিছুই চাইনা স্যার।”
মাহমুদ গম্ভীর গলায় বলল,
“বাসর রজনী উপভোগ করতে কে না চায়? এভাবেই বসে থাকতে চান সারারাত্রি?”
“ঘুমাবো স্যার। ক্লান্ত লাগছে।”
ক্ষীণ স্বরে বলল কলি।
“ক্লান্ত লাগছে? ক্লান্ত লাগার মতো পরিশ্রম না করেই ক্লান্ত। শরীর মন বেশী উইক নাকি?”
শক্ত গলায় বলল মাহমুদ। কলি চুপ করে আছে মুখ ভিড়িয়ে।
“ঠিক আছে। ঘুমান। কিন্তু শরীরের গহনা,পোশাক, না খুলে ঘুমাতে পারবেন না। বাসরঘরে নাকি বউদের এসব স্বামীরা ঘুলে দেয়। মানে গহনাগুলো আমি খুলে দিবো?”
“নাহ। আমিই পারবো।”
“ওকে আপনি খুলুন।”
কলি থম মেরে আছে। একই অবস্থায় বসা থেকে হাত উল্টিয়ে গলার জড়োয়া নেকলেস খোলার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না বারবার চেষ্টা করেও। অগত্যা নিরুপায় হয়ে মাহমুদকে বলল,
আচ্ছা দেখছি, বলে মাহমুদ দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো। সবাই নিজ নিজ রুমে আছে। সে পা ঘুরিয়ে চলে এলো রুমে। বিছানার উপরে উঠে বসল। বলল,
“মধ্যরজনীতে আপনার গহনা খোলার জন্য আমি ছাড়া কাউকে পাবেন না। সবাই নিদ্রারত এখন। দেখি একটু ঘুরুন পিঠ আমার দিকে দিয়ে। আমি হেল্প করছি।”
এসব না চেঞ্জ করে ঘুমানো যাবে না কিছুতেই। অস্বস্তি লাগবে। কলি অসহায়ের মতো মাহমুদের দিকে পিঠ ঘুরিয়ে বসলো। তখন কলির বসার স্থানের দলিতমথিত হয়ে গন্ধ বিলানো ফুলের পাপড়িগুলো মাহমুদ মুঠি ভরে এক হাতে নিলো। নাকে চেপে ধরে দু’চোখ বন্ধ করে জোরে স্বাস নিলো।
মাহমুদ কলির মাথা থেকে ওড়না খুলে নিলো। কানের ঝুমকোজোড়া খুলে নিলো। ব্লাউজের পিছনের ফিতার গিঁট খুলে দিলো। গলার নেকলেস হাত দিয়ে খোলা যাচ্ছে না। হুকে দাঁত বসিয়ে খুলে নিলো। কলি শিরশির করে কেঁপে উঠলো।
” কে গলায় এটা পরালো কলি? খোলা যাচ্ছিল না দাঁতের ব্যবহার ছাড়া।”
মাহমুদের সংস্পর্শে কলির বুক ধড়ফড় করছে। মাহমুদ কলির হাত টেনে বালাগুলো খুলে দিলো। বলল,
“নিচে নেমে আসুন। শাড়ি খুলে দেই।”
কলির মুখ রক্তিম হয়ে উঠলো। মাহমুদ বলল,
“সরি। শাড়ি নয়। শাড়ির উপরে আটকানো সেফটিপিনগুলোর কথা বললাম।”
কলি বিছানার ফুলগুলো মাড়িয়ে নিচে নামলো। নিজ থেকেই মাহমুদের পা ছুঁয়ে সালাম করে ফেলো। এটা তার মা রেবেকা তাকে শিখিয়ে দিয়েছে। বিয়ের রাতে স্বামীকে সালাম করতে হয়। মাহমুদ গাড়ির ব্রেক খাওয়ার মতো চমকে উঠলো। কলির দু’বাহু ধরে দাঁড় করালো। শিহরিত চোখে বলল,
“বাসর রাতে স্বামীর পা ছুঁয়ে সালাম দেওয়া বাঙালি মেয়েদের জন্য একটা প্রচলিত রেওয়াজ। তার মানে কলি মাহমুদের বউ। এটা মানছেন?”
কলি দৃষ্টি অবনত করে রাখলো। মাহমুদ টেবিলের উপর থেকে একটি সোনার আংটির বক্স হাতে নিলো। খুলে কলির আঙ্গুলে পরিয়ে দিলো। চুমু খেতে ইচ্ছে করলেও নিজের ইমোশনকে দমিয়ে রাখলো। শুধু কলির হাতের পিঠটাকে নিজের গালে আলতো ছোঁয়ালো। বলল,
“এটাও রেওয়াজ। বউকে সালামের সালামী দিতে হয়।”
দু’হাত পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো মাহমুদ।
কলি মাথা ঝুঁকিয়ে শাড়ির কুচির উপরিভাগের সেফটিপিনগুলো খুলতে গিয়ে পারল না। মাহমুদ কলির হাঁটুর সামনে হাঁটুগেঁড়ে বসলো। দু’হাত ব্যবহার করে সেফটিপিন সব খুলে দিলো। পরক্ষণেই দাঁড়ালো। দেখলো শাড়ির আঁচলেও কয়েকটি সেফটিপিন। সেগুলো ব্লাউজের সঙ্গে আটকানো। মাহমুদ নিজ থেকেই কলির পিঠে,কাঁধের উপরে হাত দিয়ে সেফটিপিনগুলো খুলে দিলো। মাহমুদের হাতের স্পর্শ পেয়ে কলির সারাদেহ টলছে। এমন নেশা জাগানিয়া অনুভূতির সঙ্গে সে আজই প্রথম পরিচিতি হলো।
মাহমুদ বলল,
“বাপসরে! মেয়েদের এক শাড়িতেই সেফটিনের বহর দেখি। পুরুষ হয়েছি। সেই বেশ। এই লাগেজে আপনার ব্যবহারের জন্য শাড়ি এবং সবই রয়েছে। ওটা ওয়াশরুম। ফাইনালি জানতে চাই কলি,
বাসর না হোক। একই বেডে পাশাপাশি দুজন ঘুমাই?”
কাতর স্বরে বলল মাহমুদ।
“নাহ স্যার। এতে খুব সমস্যা হবে। প্লিজ। আমাকে কিছুদিন সময় দেন। আপনি বেডে ঘুমান। আমি ফ্লোরে বিছানা করে ঘুমাতে পারবো।”
” নো নীড ডিয়ার কলি! এই পুষ্পোশোভিত বিছানা আপনার জন্য। এখানে আপনাকেই মানাবে এই রাতে। ফ্রেস হয়ে লাইট অফ করে ঘুমিয়ে পড়ুন। ডিম লাইট জ্বালিয়ে নিবেন। নয়তো পড়ে যেতে পারেন। আমি বারান্দায় আছি। গল্প করতে চাইলে আসতে পারেন।”
কথাগুলো বলেই মাহমুদ দেরী করল না। বেড সাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে নতুন একটি সিগারেটের প্যাকেট, গ্যাসলাইট ও মশার স্প্রে বোতলটা হাতে নিয়ে নিলো। তার তাওয়েলটা কাঁধের উপর রাখলো। চশমাটা চোখে দিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। বাইরে থেকে দরজা চাপিয়ে দিলো। চেয়ারটাতে তাওয়েল দিয়ে বসলো। নিজের চুলগুলো খামচি দিয়ে ধরলো। ছিঁড়ে ফেলতে পারলে তার হৃদয়ের উত্তাপ কিছুটা বিলীন হতো।চোখদুটো নেশাখোরের মতো লালবর্ণ ধারণ করলো। বহুদিনের অভুক্ত মানুষের ন্যায় একের পর সিগারেট জ্বালিয়ে নিচ্ছে আর শেষ করছে। বুকের বাঁ পাশে চিনচিন ব্যথা হচ্ছে।
কলি ওয়াশরুমে চলে গেলো। শাড়ি ব্লাউজ চেঞ্জ করে নিলো। অন্য একটা নতুন সুতী শাড়ি,ব্লাউজ পরে নিলো। মুখের মেকাপ তুলে ফ্রেশ হয়ে রুমে এলো। দেখলো শৈল্পিক করে ফুলসজ্জা সজ্জিত। বিছানা ভর্তি শত ফুলের রঙিন পাপড়ি। সে সেগুলো তুলে ফেলল না। ফুলসজ্জা তার দারুন পছন্দ হলো। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুরো রুম দেখলো কলি। কয়মাস আগের এই রুম আর আজকের রুমের পার্থক্য চোখে পড়ার মতো। নজর কাড়ার মতো। সে লাইট অফ করে দিয়ে ডিম লাইট জ্বালিয়ে দিলো। বিছানা থেকে গহনাগুলো তুলে টেবিলে রেখে দিলো। দুইহাঁটু ভাঁজ করে অবসাদজনিত দেহখানি এলিয়ে দিলো ফুলের পাপড়িগুলোর উপরেই। নিমিষেই তার তন্দ্রাচ্ছন্ন আঁখিযুগল গভীর নিদ্রাঘোরে তলিয়ে গেলো।
মশার স্প্রে মারার পরেও দু’একটা মশা আক্রমণ করে চলল মাহমুদের গায়ে। যেখানে সেখানে কুটকুট করে কামড়ে যাচ্ছে মশা। মাহমুদ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। শব্দহীন পায়ে রুমের ভিতরে এলো।
গভীর রাত! নির্জন কক্ষ! ফুলেল বিছানায় ঘুমন্ত এক যুবতী। রুমের আবছায়া হলদে আলোর সব মায়া ছড়িয়ে আছে সেই যুবতীর সারা অঙ্গে। তার পাশে ঘুরঘুর করছে এক তৃষিত যুবক। কি সম্মোহনী! কি লোভনীয় পরিবেশ! তবুও যুবকটি তাকে নিবিড় আলিঙ্গন করতে পারছে না। কি সুখসুধা পাবে এভাবে মনের বাইরে তাকে ছুঁয়ে? থাকুক না সে তার মতো করে। মাহমুদ ফের চলে গেলো বারান্দায়। পূনরায় আরেকটি সিগারেট জ্বালিয়ে নিলো। বিরহের ধোঁয়া উড়িয়ে দিলো রাতের বাতাসে।
রাত্রির শেষ প্রহরে কলির ঘুম ভেঙ্গে গেলো। কোন ডিস্টার্ব হয়নি বলে একটানা ভালো ঘুম হয়েছে তার। উঠে পরনের অবিন্যস্ত শাড়ি ঠিকঠাক করে নিলো। ঝরঝরে লাগছে তার নিজের কাছে নিজেকে। কলি দেখলো গোটা রুমে সে ছাড়া কেউ নেই। তাহলে স্যার কোথায় ঘুমালো? মাহমুদকে নিয়ে কলির ভাবনাগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যে হলো। সে চিন্তাই করতে পারেনি মাহমুদ তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ছোঁবেই না। তার ইচ্ছার মূল্যায়ন করবে এত বেশী। স্যার আসলেই কেয়ারিং মনে হয়। কলির ভালোলাগা কাজ করলো মাহমুদের উপর।
কলি পা টিপেটিপে সন্তপর্ণে বারান্দায় দরজায় গিয়ে উঁকি দিলো। হালকা আলোর সাদা বাল্ব জ্বলছে। সে দেখলো মাহমুদ চেয়ারে কোনরকম কাত হয়ে ঘুমিয়ে আছে। মেঝেতে তাকাতেই তার চক্ষু চড়কগাছ হলো। সবগুলো সিগারেটের খালি অংশ পড়ে আছে বিক্ষিপ্তভাবে। খালি প্যাকেটটাও পড়ে আছে। সে বিস্মিত চোখে মাহমুদের দিকে চেয়ে রইলো। শোয়ার নিদিষ্ট স্থান না হলে ভালো ঘুম আসা অসম্ভব। তাই মাহমুদেরও ভারি ঘুম এলোনা। সে কারো অস্তিত্ব অনুভব করতেই চোখ মেলে তাকালো। দেখলো কলি ঠায় চেয়ে আছে তার মুখ পানে।
সে জড়ানো কন্ঠে বলল,
“কলি আপনি? ঘুম ভালো হয়েছে?”
“আপনি কি করলেন এটা? সারারাত এখানে ছিলেন? এত সিগারেট টানলেন? মশার যন্ত্রণা সহ্য করলেন?”
অধিকারসুলব কন্ঠে নরম গলায় বলল কলি।
“যার কপালে বাসর উদযাপন নেই। তারতো এমনই যন্ত্রণা পোহাতেই হবে। সিগারেট খাওয়া,জেগে থাকা,মশার যন্ত্রণা সহ্য করা,ড্রিংকস করা। যদিও এটায় আমি নেই। রাত পোহাতে এখনো সময় বাকি। গিয়ে রেস্ট নিন। চলে যান।”
অভিমান,অনুযোগ মিশিয়ের ভারকন্ঠে বলল মাহমুদ।
“আপনি গল্প করতে চেয়েছেন স্যার। ”
“সময়ের কাজ অসময়ে করতে নেই। এটা আপনার কথা। গল্প করার মতো মানসিক এনার্জি এখন আমার মাঝে অবশিষ্ট নেই। চলে যান বলছি।”
কলি বুঝলো মাহমুদের কথার ইঙ্গিত। তবুও সে মাহমুদকে ধরে বসল না। এটা তারজন্য দুঃসাধ্য কাজ। আজ পর্যন্ত সে কোন ছেলের এতটুকু কাছাকাছি হয়েও বসেনি। সেখানে টিচারকে ধরে সাপোর্ট নিয়ে বসবে। নো। নেভার। প্রয়োজনে আবার পড়ে যাবে। পড়ে মরে যাবে। তবুও না।
কলিকে বাসার নিচে নামিয়ে দিলো মাহমুদ। “সাবধানে যাবেন।” বলে সেও চলে গেলো। বাসার নিচের গার্ড ও সেই বাড়ির দুজন লোক মাহমুদকে দেখেও কিছু মনে করল না। তারা সবাই জানে নুরুল হকের মেয়ের বাগদান হয়েছে। ছেলেরা এদের চেয়ে সচ্ছল পরিবার। নিজস্ব ফ্ল্যাট। ছেলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। রেবেকা নিজে বাড়ির সব বাসায় মিষ্টি বিতরণ করে মেয়ের বিয়ের কথা জানিয়েছে। বাদ দেয়নি বাড়ির নিচের গার্ডদেরকে বলাও।
কলির খুঁড়িয়ে হাঁটা দেখে, জুলি গোল গোল চোখে উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
“আপা তোর পায়ে কি হইছে?”
রেবেকা ছুটে এলো জুলির কথা শুনতে পেয়েই। কলি নিজের রুমে চলে গেলো। ব্যাগ রেখেই বিছানায় শুয়ে পড়লো। নাকমুখ কুঁচকে বলল, কিভাবে পড়ে গেলো। রেবেকা উদ্বিগ্ন গলায় জানতে চাইলো,
“কিভাবে এলি মা এই পা নিয়ে?”
“স্যার পৌঁছে দিয়েছে আম্মু।”
লজ্জা লজ্জা স্বরে বলল কলি।
“আলহামদুলিল্লাহ। আত্মীয় ভালো পেয়েছি আমরা। নিরহংকারী তারা প্রত্যেকেই। শিক্ষক পরিবার যে। সেজন্যই তাদের বিচার বিবেচনাটা সঠিক ও সুন্দর। সামনে বিয়া সাদি। খেয়াল করে পথ চলিস। হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নে। ডাইনিংয়ে যেতে হবে না। জুলি এখানে ভাত এনে দিবে।”
কলি চুপচাপ শুয়ে আছে। রেবেকা সুরা ফাতিহা পাঠ করে মেয়ের মাথায় তিনবার ফুঁ দিয়ে দিলেন। চলে গেলো সংসারের আপন কাজে।
“তার বউ থাকতে আমি কোন দুঃখে তার কোলে উঠবো? টিচারেরা কেয়ারিং তবে বোরিং। আমি বিয়ে করবো রোমান্টিক একটা ছেলেকে। তবে তারও মোটর বাইক থাকতে হবে। বাইকে চড়া আমার কাছে হেব্বি এনজয় লাগে। উফফস! দুই পা দুইদিকে দিয়ে জামাইয়ের পিছনে বসবো। দুই হাত দিয়ে তার পেট পেঁচিয়ে জড়িয়ে ধরবো। আমার শ্যাম্পু করা খোলা চুলগুলো হাওয়ায় উঠবে। হাওয়ায় চুল নিয়ে বেচারার নাম মুখে ছোঁয়া দিবে। সে চুলের ঘ্রাণ নিবে মুখ একপাশ করে। আমাদের দুজনের চোখে বড় স্টাইলিশ সানগ্লাস থাকবে। আমি পিছন থেকে তার পিঠের উপর গাল ঠেকিয়ে শুয়ে থাকবো। রোমাঞ্চটা জোস না আপা?”
“তার যদি বাইক না থাকে? দেন?” বলল কলি।
“কিনে নিবে। শিখে নিবে। এটা বিয়ের আগেই কন্ডিশন দিয়ে দিব। আর যদি থাকে,তাহলেত কেল্লাফতে। মাস্তি আর মাস্তি।”
“তোর মাথায় এসব আজেবাজে ভাবনা কে দেয়? ক্লাসে কাদের সাথে মিশিস তুই? নিলজ্জ্ব কোথাকার। বড় বোনের সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হয় জানিস না? দিন দিন বেহায়া হয়ে যাচ্ছিস। তোর পড়াশোনা ধরবো আমি। দেখিস। টিকটক করা তোর বন্ধ।”
“হুহ্! নিজে এক বোরিং। কপালে জুটছে আরেক বোরিং পারসন। তার বাইক থাকলেও যা রিকসা থাকলেও তা। যাহা লাউ তাহাই কদু। তোরা আনন্দের কি বুঝিস। ঠিকই আছে তোর সঙ্গে বোরিং এক মাষ্টার ব্যাডার বিয়ে হবে। যে লোক নিজের এনগেজমেন্টেও আসে না। সে যে কি পরিমাণ ছ্যাবলার ছ্যাবলা আর ক্যাবলার ক্যাবলা পুরুষ। তা আমি খুউব বুঝছি।”
ঠোঁট উল্টিয়ে কথাগুলো বলল ঝুলি।
কলি চেঁচিয়ে উঠার আগেই জুলি লম্বা লম্বা পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। একটু পর এসে ভাত দিয়ে গেলো কলির পড়ার টেবিলে। জুলির কথাবার্তায় কলির মনে সন্দেহ দানা বাঁধল। জুলি প্রেমে ট্রেমে পড়ল নাকি। কলি উঠে ফ্রেস হয়ে ভাত খেয়ে আবার শুয়ে পড়লো।
নুরুল হক অফিস থেকে বাসায় ফিরলেন। মেয়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছে শুনেই শশব্যস্ত হয়ে এলেন মেয়ের রুমে। পা ধরে দেখলেন মনোযোগের সহিত। মেয়ের মাথায় পিতৃস্নেহের পরশ বুলিয়ে দিলেন বার কয়েক। সতর্ক হয়ে পথ চলতে উপদেশ দিলেন।
মাহফুজা একমাত্র ছেলের বিয়ে নিয়ে অতিরিক্ত এক্সাইটেড হয়ে থাকে রাতদিন। বাসায় নিত্যকার কাজ শেষ হয়ে যখনই ফুরসত মিলে, কাগজ কলম নিয়ে বসে যায়। কিভাবে কি করবে। আয়োজনের কমতি রাখতে চায় না সে। মনের মতো একটা মেয়েকে সে জনমের জন্য পেয়ে যাচ্ছে। ঘাটতি থাকবে কেন? আনুশকা ও কলি তার দুজন মেয়ে। কলিকে সে কোনদিনই পুত্রবধূর নজরে দেখবে না। নিজের মেয়ের মতো দেখবে। আদর করবে। কলিও তাকে মায়ের মতই দেখবে। এটা তার ধারণা নয় শুধু পূর্ণ আস্থা কলির উপরে।
আনুশকাও স্বশুরের বাসায় অবসর হলেই নোট প্যাড নিয়ে বসে যায়। সবকিছুর লিস্ট করতে থাকে সিরিয়াল অনুযায়ী। দেশের বাইরে থাকা স্বামীর সঙ্গেও ভাইয়ের বিয়ে নিয়েই গল্প করে আজকাল। কলিকে সে বোনের মতো দেখবে। কাল ননদী খেতাব চায়না সে। শিক্ষক পিতার আদর্শ সন্তান তারা দুই ভাইবোন। সংসারে শান্তি ও আনন্দের পরিবেশ বজায় রাখার সমস্ত শিক্ষা ও দিক্ষা দিয়ে তাদের বড় করেছে মা, বাবা।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কলির পায়ের পাতা ফুলে গিয়েছে। মলম লাগিয়ে নিলো। মেডিসিন খেলো। তবুও ব্যথায় টনটন করছে পুরো পা। মাহমুদের উপর প্রচন্ড ক্ষেপে গেলো কলি। ক্লাসে সবার সামনে অমন বিদ্রুপ করে কথাটা না বললেই কি হতো না তাকে। এমন সময় কলির মোবাইল বেজে উঠলো।
স্ক্রিনে জ্বলে উঠলো ‘বদ মাহমুদ স্যার।’ বদ শব্দটা আগে ছিল না। কলিকে বারবার কটাক্ষ করে কথা বলাতে কলি এডিট করে বদ শব্দ যোগ করেছে মাহমুদ শব্দের আগে। এখন যেহেতু তার ভাষায় সেই বদের সঙ্গেই বিয়ে হতে যাচ্ছে,তাই সেদিন আবার বদ শব্দটি ছেঁটে ফেলবে। কলি রিসিভ করে সালাম দিলো।
কেমন আছেন না জিজ্ঞেস করে মাহমুদ সরাসরি জিজ্ঞেস করলো,
“রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেকোনো যন্ত্রণা প্রকট আকার ধারণ করে। এবং সেটা শরীর, মন দুটোরই।”
“জানি ঢের।”
“এমন সবকিছু জানলে ভালো হয়। বেডে শুয়ে আছেন?”
“হুম।”
“ভিড়িও কল দিবো পা দেখার জন্য?”
“আপনি ডাক্তার নয়। পা দেখে কোন কাজ নেই।”
“ওহ আচ্ছা। সেটাই।”
কলি মৌন রইলো এপ্রান্তে৷ গান শুনতে তার খুব ভালোলাগে। সুরে সে মাতোয়ারা। খাওয়া ভুলে গিয়েও সে গানে ডুবে থাকতে পারে।
সেদিন স্যারের ভরাট কন্ঠে পুরোনো দিনের রোমান্টিক গানটা অস্থির লেগেছে। এখন যদি দু’লাইন গান শুনতে পেতো তার ভালোলাগতো। ইউটিউবে শোনা যায়। লাইভ শোনার সুযোগ থেকে ইউটিউবের টা শুনবে কেন। এমন ভাবনা থেকেই কলি চট করে বলে ফেলল,
“স্যার দুলাইন গান শোনাবেন?”
বলেই কলি নিজের জিভ কামড়ে ধরলো। ওহ শিট! চাওয়াটা কি শোভনীয় হলো? কি ভাববে মানুষটা এবার?
মাহমুদ হঠাৎ ধাক্কা খাওয়ার মতো নড়ে উঠলো। এদিক ওদিক চাইলো তার খালি রুমের মধ্যে। ভুল কিছু শুনলো নাকি। কলির মতো নিরস, মুডি,বেরসিক টাইপের মেয়ে এই প্রথম এমন কিছুর আবদার করলো তার কাছে। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। সে না শোনার ভান করে জিজ্ঞেস করলো,
“কলি কি বললেন? ভালো করে শুনতে পাইনি।”
“কিছু বলিনি স্যার। রাখতে পারেন।”
কলি ঘাড় হেলিয়ে বালিশে কাত হয়ে শুয়ে আছে। কানে হেডসেট লাগনো। তার কানে ভেসে এলো মাহমুদের কন্ঠ হতে ভালোবাসার গান।
” তাকিয়া আসমানের দিকে/সে কি বলো আছে সুখে?
ভাবিয়া কান্দিয়া মরি/সে যে পাশে নাই।
বিধাতা আমাকে বলো,
কোথায় গেলে তারে পাবো?
যন্ত্রণাগুলো আমাকে/ভেতরে পোড়ায়।
ভাবতে ভাবতে তারে আমি/
চোখ বুজিয়া জড়াই ধরি।🫂
চোখ মেলিয়া দেখি আমি
সে যে বুকে নাই….”
কলির দু’চোখ আবেশে জড়িয়ে এলো।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলো।
মাহমুদ কলির বাচ্চামো কন্ঠ শুনে নিজের বুকের বামপাশ চেপে ধরলো হাত দিয়ে। একটা সুক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করলো তার বুকের চিলেকোঠায়। নিজেকে সামলে নিয়ে মধুর হেসে ফেলল। বলল,
“কলি,আজ আপনাকে নিয়ে আমার ইচ্ছেটা অন্যরকম ছিলো। কিন্তু হায় বিধিবাম! হলো না। আপনার পা ভালো হোক। তবেই সেই কাজটা করবো। দিবেন ত আমার ক্ষুদ্র ইচ্ছেটা পূরণ করতে?”
কলি মনে মনে বলল,
হায়রে প্রেমিক জাতি। তোমরা লায় পেলেই উঠে যাও জায়গামতো। তারপর বলল,
“হয়তো। বিবেচনা করে দেখতে হবে।”
“হয়তো? দ্যাটস মিন নট সিউর?”
“মেইবি।”
” মনীষীগণ বলেছেন, বড় সাধ পূর্ণ করতে না পারো,কিন্তু তোমার টুকরো সাধগুলো মেটাতে ভুল করো না। জীবন ক্ষণস্থায়ী। তাই যত পারো আনন্দ করো। আনন্দের মাঝে বেঁচে থাকো।”
কলির শুকনো গলায় কথাটা শুনে মাহমুদ চিন্তায় পড়ে গেলো। বিয়ে পড়ানোর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এই মেয়ের কোন ভরসা নেই। না জানি আবার কোন কঠিন শর্ত নিয়ে হাজির হয় এই হৃদয়হীনা মেয়েটি।
চলবে…১৮
#তোমার_জন্য_সব -১৯
✍️ #রেহানা_পুতুল
স্যার আপনার সঙ্গে আমার গুরুত্বপূর্ণ আলাপ আছে।”
“ওহ সিউর কলি। বলুন। কান পেতে আছি।”
“এখন নয়। পরে অবশ্যই বলবো।”
কলির শুকনো গলায় কথাটা শুনে মাহমুদ চিন্তায় পড়ে গেলো। বিয়ে পড়ানোর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এই মেয়ের কোন ভরসা নেই। না জানি আবার কোন কঠিন শর্ত নিয়ে হাজির হয় এই হৃদয়হীনা!
ওর শর্ত টা কি হতে পারে? অন্য কিছু? অন্যকিছু হলে বিবেচনা করা যায়। কিন্তু অন্যকিছু নয়। এটা একশো পার্সেন্ট সিউর। নিশ্চয়ই সেই অমানবিক আবদার। বিয়ে এক বছর পেছানো। নো ফুলকলি। সেটা কিছুতেই হবে না। দুই পরিবার মিলে যেখানে ডেট পাকা করে ফেলল,সেটা পেছানো এখন কোনভাবেই সম্ভব নয়। বিয়েটা কি ছেলেখেলা ওহে ফুলকলি। এমন সব ভাবনার বেড়াজালে আটকে গিয়ে ছটপটাতে লাগলো মাহমুদ।
কলি শুয়ে শুয়ে ভাবছে, অন্তত এর থেকে গান শোনা যাবে আর যাইহোক। এটা একটা ভালোলাগার দিক তারজন্য। কিন্তু কিভাবে তাকে সব উজাড় করে দিবো। শেইম! শেইম!
পা ভালো হলে কলি ক্লাসে গেল। কলি চোরাচোখে মাহমুদের আপাদমস্তক দেখে নিলো এক ঝলক। চমকিত মনে বলল,
কি ব্যাপার? এই বান্দা আজ প্রেমিকের সুরত নিয়ে হাজির হলো? নিউ জিন্স,নিউ টিশার্ট। যুবক থেকে তরুণ হয়ে গেলো দেখি। ঝরঝরে ঘন চুলগুলো আজ বেশ উড়ু উড়ু। অন্যদিনের চেয়ে বেশী স্মার্ট ও সুন্দর লাগছে। কাহিনী কি? যাক গা। খাল্লি বাল্লি।
মাহমুদ ক্লাসে কলিকে মুখে কিছু বলল না। চোখের ইশারাতেও কিছু বলল না। সে পরিবেশ বুঝে চলতে জানে। সীমা লংঘন না করার ক্ষমতা তার যথেষ্ট। ভার্সিটিতে সে আগের মতই কলির সঙ্গে টিচার, স্টুডেন্ট সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে লাগলো। বরং একটু বেশিই সতর্ক হয়ে চলে। কলি যেন বিরক্ত না হয় সেদিকে বিশেষ সজাগ থাকে। পারসন হিসেবে মাহমুদ খুব কেয়ারিং প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রেই।
সে অফিসে এসে মেসেজ দিলো,
“কলি ‘ডার্লিং’রেস্টুরেন্টে চলে যাবেন। খুব জরুরী কথা আছে।”
‘খুব’ শব্দটা মাহমুদ ইচ্ছে করে ব্যবহার করেছে কলিকে গুরুত্ব বোঝানোর জন্য। নয়তো কলি নাও আসতে পারে।
কলি ভ্রুযুগল কুঞ্চিত করে বলল,
দরকারতো আমার নিজেরই। কলি এক শব্দে ফিরতি মেসেজ দিলো।
“আচ্ছা স্যার।”
মাহমুদ ঠোঁট ভিড়িয়ে বাঁকা হাসি হাসলো। এ কি বিয়ের পরেও আমাকে স্যার স্যার করতে থাকবে নাকি। আগে অধিকারে আসুক রমনী।
কলি ‘ ডার্লিং ‘রেস্টুরেন্ট আগেই পৌঁছে গিয়েছে। এর নাম বন্ধুদের কাছে সে আগেও শুনেছে। কিন্তু সে এলো আজই প্রথম। সে পুরো রেস্টুরেন্টে বার দুয়েক মোহনীয় দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো।
অদ্ভুত সম্মোহনী পরিবেশ ‘ডার্লিং’ এর ভিতরে। কৃত্রিম সবুজাভ গাছগাছালী দিয়ে সজ্জিত। হালকা আলোর লাইটিং। রয়েছে একটি ছোট্ট পানির ফোয়ারা। নিচে দেয়া হয়েছে অসংখ্য পাথর। স্বচ্ছ পানিতে পাথরগুলো দেখতে বেশ নান্দনিক লাগছে। প্রতি টেবিলে কাপল বসা। টেবিলগুলো বাঁশের ছোট্টো বেড়ার বেষ্টনীতে ঘেরা। কলি এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।
একজন ওয়েটার এগিয়ে এলো। জিজ্ঞেস করলো,
“ম্যাম আপনি কলি?”
“হ্যাঁ।”
“আপনি এদিকে আসুন। স্যার আগেই রিসিপশনে ফোন করে বুক দিয়ে রেখেছে।”
কলি বসলো। টেবিলে মেন্যুলিস্ট , গ্লাস,টিস্যু রাখা আগে থেকেই। সে খেয়াল করে দেখলো পুরো রেস্টুরেন্টে এসাইডটাই কাপল জোন। তার মানে এটা কাপল ফেভার রেস্টুরেন্ট।
সিঙ্গেল চেয়ার নেই এখানে। একটা টেবিলের জন্য একটাই বেঞ্চ দুজন বসার হিসেবে। বলা যায় একটা মিনি রুম। কলি আশ্চর্য হলো ! বিরক্তি জমা হলো চোখের পাড়ে। এত নিরিবিলি প্রাইভেট প্লেস কেন বুকিং দিলো?
মাহমুদ ভার্সিটির সামনের পরিচিত কাঁচাফুলের দোকানটার গেলো। বাইক থেকে নেমে গেলো। আদেশ দিয়ে বলল,
“মামা যত রকমের ফুল আছে। সবগুলো থেকে একটা করে নিয়ে সুন্দর একটা পুষ্পতোড়া রেডি করুন।”
ফুল দোকানী হাতের কাজ রেখে দিলো। মাহমুদের অর্ডারের কাজ ধরলো। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বলে কথা। অতিরিক্ত ইজ্জত দিতেই হয়। মাহমুদ সব ফুল দেখে দুটো টকটকে তাজা বড় লাল গোলাপ বেছে নিলো। সেই দুটো গোলাপ আলাদা রাখলো। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে নিলো ফুটপাতের উপরে এসে। কয়েকটা সুখটান দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে দিলো শূন্যের মাঝে। ভাবলো,
আরেহ মদন মাহমুদ, তুইতো হেব্বি প্রেমিক পুরুষ হয়ে গেলি কলির ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়ে। প্রেম এমনিই বুঝলি। জগতের বড় বড় মহাপুরুষেরাও ভালোবাসার মানুষ পেলে কাবু হয়ে যায়। আর তুই ত কোন ছার। হাহ! তোর আজকের ক্যালকুলেশন ঠিকই আছে। হবু বউকে বিয়ের আগে একটু ইজি করে নিতে হয়।
ফুলের তোড়া প্রস্তত হয়ে গেলো। দামাদামিতে গেল না মাহমুদ। ফুল বিক্রেতা চা চাইলো তাই দিলো মাহমুদ। ফুলগুলোকে যত্ন করে বাইকে রাখলো। বাইক ছেড়ে গেলো দুর্বার গতিতে। ফুল বিক্রেতা মুচকি হাসলো মাহমুদের যাওয়ার ভঙ্গি দেখে। সে বিড়বিড়িয়ে বলল,
মাষ্টার সাব কি প্রেমে পড়ছে? না বিয়া ঠিক হইছে? হইলে আমার কি। এই ভেবেই বিক্রেতা তার বেসুরো গলায় গেয়ে উঠলো বারি সিদ্দিকীর বিখ্যাত বিচ্ছেদের গানের দু’চরণ।
“আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে /পুবালী বাতাসে-বাদাম দেইখ্যা/ চাইয়া থাকি,
আমার নি কেউ আসে রে।
যেদিন হতে নতুন পানি আসল বাড়ির ঘাটে/
অভাগিনীর মনে কত শত কথা উঠে রে…”
কলি বসে বসে মোবাইলে ইউটিউবে একটা সিনেমার ট্রেইলার দেখছে। মাহমুদ তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কলি চোখ তুলে তাকাতেই তব্দা খেলো। মাহমুদের চোখে বড় সানগ্লাস। অধরকোণে ঝুলছে মৃদু রোমাঞ্চিত হাসি। হাতে এক গুচ্ছ ফুলের তোড়া। বাকি হাত পিছনে লুকানো। দেখা যাচ্ছে না। ভীষণ সুন্দর ও রোমান্টিক লাগছে। পরিবেসশের সঙ্গে উপযুক্ত গেট আপ।
মাহমুদ দাঁড়িয়েই রইলো। পিছনে তার গোলাপ ধরে রাখা হাতটি সামনে নিয়ে এলো। কলির সামনে বাড়িয়ে ধরলো।নিবেদিত কন্ঠে বলল,
“কলিকে ভালোবাসি।”
কলি চমকে উঠলো। কাঁপা কাঁপা হাতে ফুলটি ধরলো। সানগ্লাসে ঢাকা মাহমুদের দু’চোখ। কলি তার চোখের ভাষা পড়তে পারল না। কন্ঠকে খাদে নামিয়ে লাজুক স্বরে বলল,
“থ্যাংক ইউ স্যার।”
“ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।”
মাহমুদ ফুলের তোড়ার পাশ থেকে আরেকটি সিঙ্গেল গোলাপ কলির দিকে বাড়িয়ে ধরলো। কলি জিজ্ঞাসু চোখে মাহমুদের মুখে চাইলো।
“সেটা দিয়ে আমি আপনাকে ভালোবাসার প্রপোজ করেছি। আর এটা আপনার হয়ে কিনেছি। আপনি ত আর আমার জন্য ফুলও কিনবেন না। প্রপোজও করবে না। আমি যেচে নিচ্ছি আর কি। সেটা আমাকে দিন। শুনিয়ে না বলুন। মনে মনে যা বলার তা বলুন। হৃদয়ের কথা আমি হৃদয় দিয়ে অনুভব করে নিবো।”
কলি গোলাপটি বাড়িয়ে ধরলো মাহমুদের দিকে। মাহমুদ প্রাণ দিয়ে কলির হাত থেকে গোলাপটি নিলো। কলির পাশে বসে পড়লো। কলি বেঞ্চের শেষ মাথায় গিয়ে দেয়াল ঠেসে বসল। মাহমুদ সানগ্লাস খুলে টেবিলের উপরে রাখলো। ফুলের তোড়াটি দু’হাত দিয়ে ধরে কলির দিকে বাড়িয়ে ধরলো।
“শুভ বিবাহ মোবারকবাদ। আপনার অনাগত যুগল জীবন মধুর ও শান্তির হোক।”
কলি হাত বাড়িয়ে ফুলের তোড়াটি নিলো। ভিতরে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তবুও যথাসম্ভব নিজের মাঝে কাঠিন্যতা ধরে রাখলো। কলি ফুল নিয়ে কিছু বলল না। মাহমুদ নিজ থেকেই বলল,
“আমাদের পরিবারে আমরা সবাই যেকোনো কিছু আর্টের সঙ্গে শুরু করি। আপনার বিয়ে ঠিক হয়েছে। আজকের সেলিব্রেশনটা সেদিনই করার ইচ্ছে ছিলো। বিয়েতে ইনভাইটেশন যেন পাই।”
কলি মৌন রইলো। সে নিজেও জানে তার কেমন লাগছে। মাহমুদ বলল,
“অর্ডার করেছেন কলি?”
” না স্যার। আপনি দেন।”
মাহমুদ চিকেন ফ্রাইড রাইস অর্ডার করলো। কলি পূর্বের অবস্থান ও অবস্থাতে থেকেই খেয়ে নিলো। মাহমুদ কলির দিকে চেয়ে বলল,
” দেয়াল ভেঙ্গে পড়ে যাবেন। এদিকে এসে বসুন।”
কলি না শোনার ভান করে রইলো।
মাহমুদ এক হাত প্রসারিত করে দিলো কলির দিকে। কলি ভ্রুক্ষেপহীনভাবে চেয়ে রইলো অন্যদিকে। মাহমুদ প্রথমে উঠে দাঁড়ালো সোজাসুজি হয়ে। কলি মনে করলো হয়তো ওয়াশরুমে যাবে। কিন্তু না। মাহমুদ তার খুব কাছে গিয়ে বসে পড়লো।
টেবিলের নিচ দিয়ে হাত বাড়িয়ে খপ করে কলির একহাত ধরে ফেলল। কলি হাত মোচড়ামুচড়ি করতে লাগলো। কিন্তু পারছে না আলগা করতে। এমতাবস্থায় তাদের দুজনের চোখ গেলো মাত্র চারহাত দূরত্বে পাশের টেবিলের এক জোড়া কপোত-কপোতীর দিকে। তাদের দুই জোড়া ঠোঁট একজোড়া হয়ে আছে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে একটু একটু তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তখানি। তারা দুজন কাজটাতে এতটাই বিভোর হয়ে আছে। যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে অন্য টেবিলের কাপলদের একই কাজের সঙ্গে। যে জুটি যত দীর্ঘসময় অধরে গাঢ় চুম্বন করে যেতে পারবে। তাকে কর্তৃপক্ষ হতে বিশেষ পুরুস্কার দেওয়া হবে।
“আচ্ছা এমন একটা রোমাঞ্চকর কাজের পুরুস্কার কি হতে পারে বলুন তো?”
কলির লজ্জার সীমা রইল না। মাথা নামিয়ে বসে রইলো। অসহিষ্ণু গলায় বলে উঠলো,
“স্যার কি করছেন? এমন অসভ্যতামি করার জন্য এখানে আসা?”
মাহমুদ কলির হাত ছেড়ে দিলো। দুটো আঙ্গুল কলির ঘাড় থেকে একটু নিচে বুকের উপরে এনে থামালো। বলল,
“মেয়েদের বুক ফাটে তবু মুখ ফাটে না। এই প্রবাদটা জানি। আবার একটা গান আছে না কি যেন? ওহ। মনে পড়েছে। ‘বাহির বলে দূরে থাকুক ভিতর বলে আসুক না।’
আমার সান্নিধ্য কি আপনাকে আনন্দ দান করেনি কলি? আর শুনুন মিস কলি, হাজব্যান্ড ওয়াইফ হয়ে জীবনকে উপভোগ করা আর গার্লফ্রেন্ড, বয়ফ্রেন্ড হয়ে উপভোগ করার বিশাল পার্থক্য। ক্লিয়ার? মন্দ কিছুই করিনি। অকারণে অপবাদ দিলেন। সেলিব্রেট করার জন্য এমন পরিবেশ পারফেক্ট। এটাই ছিলো মূখ্য।”
কলি থম মেয়ে বসে রইলো।
“ও হ্যাঁ। যেহেতু আমরা দুজন পূর্ব পরিচিত। সেই সুবাদে বিয়ের সাজপোশাক বা সবকিছু নিয়ে আপনার ব্যক্তিগত কোন সাধ থাকলে বলতে পারেন। আমি সর্বস্ব দিয়ে আপনার সেই সাধ পূর্ণ করার চেষ্টা করবো।”.
” নাহ স্যার। আমার এই বিষয়ে কোন চাওয়া পাওয়া নেই। এটা লাভ ম্যারেজ নয়। ‘অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ।”
চাহনি অন্যদিকে ফেলে জানাল কলি।
” তাহলে বুঝি কিছু বলা যায় না? হতে পারে। এই হাদিস বা রুলস আমার অজানা। এনিওয়ে,
আমার পার্ট শেষ। আপনি কি যেন বলবেন? প্লিজ বলুন। নিউ কোন কন্ডিশন বিয়ে নিয়ে?”
” নাহ স্যার। তবে কন্ডিশন।”
অফ মুডে বলল কলি।
“কন্ডিশন আর কন্ডিশন। হায়রে। বলুন?”
“বিষয়টা আমার পরিবার নিয়ে স্যার।”
” ওহ হো! সিউর কলি। প্লিজ।”
কলির মুখ ম্লান। দৃষ্টি আনমনা। কন্ঠ ভারি। সে বলতে লাগলো,
“আশ্চর্য কলি! পথের উপর থেকে সব বলবো? বাইকে চড়ুন। বলছি। স্প্রীড ব্রেকার দেখলে স্লো চলবে বাইক। নো টেনস।”
শক্ত চোয়ালে বলল মাহমুদ।
কলি দোনোমোনো করতে করতে বাইকে মাহমুদের পিছনে গিয়ে বসলো। মাহমুদ কলিকে নিয়ে লালবাগ চৌরাস্তার মোড়ে চলে গেলো। বাইক থামালো একটি নিরিবিলি হোটেলের সামনে।
” আসুন লাঞ্চ করতে করতে বিষয়টা বলি।”
বলেই মাহমুদ বীরের মতো গটগট পায়ে হোটেলের ভিতরে চলে গেলো। বেসিন থেকে হাত ধুয়ে ফ্যান বরাবর একটি টেবিলে বসলো। কলিও হাত ধুয়ে এসে মুখোমুখি চেয়ারে বসলো। দুটো বিফ খিচুড়ির অর্ডার দিলো মাহমুদ। কলি মনে মনে আওড়ালো,
বিয়ে ঠিক না হতেই অধিকার খাটানো শুরু করেছে। আমার অনুমতির তোয়াক্কা না করেই। কলি বলে উঠলো,
“স্যার আমার বাসাতো এই সামনেই। আমি বাসায় গিয়েই লাঞ্চ করতাম। দরকার কি ছিলো।”
” আপনার বাসা এখানে। এটা আমি জানি না? ওড়না উদ্ধারের কাহিনী শুনবেন না?”
“অবশ্যই স্যার। বলুন?”
“তো শুনতে হলে কোথাও বসতে হচ্ছে। নয়তো আমিও বাসায় চলে যেতাম।”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি মা। যাক তোমার স্যারের সঙ্গে আছো শুনে ভালো লাগলো। কিছুদিন পরেই তার বউ হবা। জড়তা কাটানো দরকার।”
বন্ধুসুলভ কন্ঠে বলল মাহফুজা।
কলি কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলেও মাহফুজাকে বুঝতে দিল না। ছোট্র করে ‘হুঁ’ বলল। স্পিকার অফ ছিলো। তবুও মাহমুদ মায়ের কথা শুনতে পেলো। কেননা তার মোবাইলের ভলিউম ফুল ছিলো। এবং সে কান পেতেও ছিলো শোনার জন্য।
“মা খুব ওপেন মাইন্ডের। ডোন্ট মাইন্ড।”
মাহমুদ ইচ্ছে করেই কলির অভিব্যক্তি দেখার জন্য কথাটা বলল। কলি হতবাক চোখে মাহমুদের দিকে চাইলো।
“ওভাবে চেয়ে লাভ নেই। আমার এই সেটের দোষ। আমার কানের দোষ।”
“আন্টি অতিরিক্ত করে ফেলছে। এটা অবাস্তব।”
“মানলাম। যুক্তিতে না যাই।খেয়ে নিন। খাবার চলে এসেছে। ”
চাপাস্বরে বলল মাহমুদ।
বিফ খিচুড়ি, সালাদ,কোক এসে গেলো। খাওয়া শেষে মাহমুদ বলল,
আমি বাইক নিয়ে বাস স্টপেজের কাছাকাছি এসে একটু থামলাম। ফটোকপির দোকানে কাজ ছিলো বলে। সেখান থেকেই আমার চোখ পড়লো চায়ের টং দোকানে দুজন ছেলের দিকে। তারা গ্যাসলাইট দিয়ে সিগারেট জ্বালাচ্ছিলো। একজনের হাতে চোখ যেতেই দেখলাম এটা আপনার ওড়না। ভালো করে চেয়ে দেখলাম আবার। ভুলও হতে পারে। আপনার ওড়না কেন ওদের হাতে আসবে। আমার তীক্ষ্ণভাবে তাকানো দেখেই ফটোকপির দোকানের অন্য একটা ছেলে বলল,
“স্যার এরা নষ্ট ছেলে। বখাটে! দেখেন কোন মেয়ের ওড়না ছিনিয়ে নিলো। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করাই এদের কাজ।”
আমি অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
“সত্যি বলছ তুমি?”
“একদম সত্য স্যার। আমি চিনি। প্রায় রাতে মদ খেয়ে এসে এইখানে মাতলামো করে । চা,সিগারেটের বিল দেয়না।”
” আমি তড়িতেই ছেলে দুটোর কাছে চলে গেলাম। ছেলেটার হাত থেকে ওড়না কেড়ে নিতে হলো। তারা ভয়ানক ক্ষেপে গেলো। হাতাহাতি শুরু করলো আমার সঙ্গে। লোক জড়ো হয়ে গেলো। তারা আমার পক্ষ নিলো। এবং তাদের ধরে ফেলল। তারা প্রাণপণ চেষ্টা করেও পালাতে পারেনি। বাস স্টপেজে পুলিশ ছিলো। ফটোকপি দোকানের সেই ছেলেটা গিয়ে দুজন পুলিশ নিয়ে এলো। উপস্থিত সবার সাক্ষ্যের ভিত্তিতে পুলিশ তাদের হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে নিলো। আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে জানতে চাইলো ওড়না কার? বললাম,আমার ডিপার্টমেন্টের এক ছাত্রীর। সেজন্যই আমার চিনতে অসুবিধা হয়নি। মাহমুদ থামলো। ভরা গ্লাসের অর্ধেক পানি খেয়ে জোরালো নিঃস্বাস ফেলল।
কলি মনে মনে উচ্চারণ করলো, আমার দিকে কতটা খেয়াল করলে উনি আমার ওড়না চিনতে পারলো। তারমানে ক্লাসে গেলে চোরাচোখে কেবল আমাকেই দেখে নাকি। উফফস!
” ধন্যবাদ স্যার। আপনাকে বারবার
আমার জন্য কষ্ট ও ঝামেলার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।”
নিচু মাথায় কৃতজ্ঞতার স্বরে বলল কলি।
“আগের এক্সিডেন্ট, আজকের ঘটনার জন্য শুধু ধন্যবাদ?”
বিরস কন্ঠে শুধালো মাহমুদ।
“অনেক ধন্যবাদ স্যার।”
“অনেক ধন্যবাদ?”
কলির চোখে ঠায় চেয়ে থেকে বলল মাহমুদ।
“আন্তরিক ধন্যবাদ স্যার।”
“কেবল আন্তরিক ধন্যবাদই প্রাপ্য আমি?”
ভারমুখে বলল মাহমুদ।
“বিশেষ ধন্যবাদ স্যার।”
“বিশেষ ধন্যবাদ ত দূরের মানুষকেও দেয়। কাছের মানুষকে আরো কিছু দিতে হয়।”
“ভার্সিটির টিচার স্টুডেন্টের সম্পর্ক কাছের নয়? ফ্রেন্ডলি নয়?”
“ওহ বুঝলাম। হয়তো। ”
মাহমুদ কলির হাতের দিকে খেয়াল করলো। তার দেওয়া আংটিটা নেই কোন আঙ্গুলেই। তার খারাপ লাগলো। কিন্তু কলিকে বুঝতে দিল না। প্রসঙ্গ চেঞ্জ করে বলল,
“এবার বলুল, তারা কেন আপনার ওড়না ছিনতাই করলো। পথ দিয়ে আর মেয়ে চলাফেরা করে না?”
“স্যার এই দুজন ছেলে আমাকে মাঝে মাঝে বিরক্ত করেছিলো। হাত ধরতে চেয়েছিলো। শেষদিন আমি স্যান্ডেল খুলে মারতে চেয়েছি। তাই এমন করেছে আজ।”
“হুম। শিক্ষক হিসেবে আমাকে জানাতে পারতেন। যাইহোক। সাবধানে পথ চলবেন। সবসময় ইগো নিয়ে থাকলে চলে না।”
কলি শান্ত মেজাজে বলল,
“দুজন বখাটেকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পেরেছেন। এতে অনেকের অনেক উপকার হলো। সেই চা বিক্রেতা মামাও রক্ষা পেলো। তারজন্য আপনাকে স্পেশাল থ্যাংকস।”
” শুধু থ্যাংকসে আমার পোষাবে না।”
“তো?”
” আপনি সেটা দিবেন না। যেটা আমি চাইবো। বাদ দেন। খাল্লি বাল্লি। আসুন। পৌঁছে দিই বাসায়।”
মাহমুদ কলিকে বাসার নিচে পৌঁছে দিলো। বাইক ঘুরিয়ে চলে গেলো।
এ এক আজব চিজ। কোন ধাতু দিয়ে বিধাতা তাকে গড়ালো। কি নিরস রসকষহীন নারীরে ভাই। কিছু বললে তার কারণ জানার জন্য নুন্যতম কৌতুহলের আভাস তার মাঝে দেখা যায় না।
কলি বাসায় গিয়ে আংটিটা নিয়ে অনামিকায় পরে নিলো। আবার খুলে ফেলল কিছু একটা ভেবেই। নেড়েচেড়ে দেখলো আংটিটা। ভারি সুন্দর। তার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। আজকের বিফ খিচুড়িটাও দারুণ ছিলো। বিফ খিচুড়ি তার ভীষণ পছন্দ। কিছু বিষয়ে ভাবলে তার হ্যাঁ বলতে ইচ্ছে করে মাহমুদকে। আবার শুরুর দিনের অপমানের কথা ভাবলে মানা করতে ইচ্ছে করে। দ্বিধাদ্বন্ধের দোলায় অনবরত দুলছে কলি। এত কনফিউশানে থেকে কিভাবে হ্যাঁ বা না বলবে সে। সে বাসার কাউকে এই বিষয়ে মত জানায়নি। তারাও তারকাছে মত জানতে চায়নি।
সাতদিন পর আবদুর রহমান ফোন দিলো নুরুল হককে। জানতে চাইলো কলির মতামত এবং তারা কবে আসবে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করতে।
নুরুল হককে পাশে বসা থেকে রেবেকা ফিসফিসিয়ে বলে দিলো,
বলেন কলি হ্যাঁ বলেছে। সমস্যা নেই।
নুরুল হক তাই জানিয়ে দিলো।
আবদুর রহমান মুঠোফোনের ওপ্রান্ত হতে সন্তুষ্টির হাসি দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলো।
জিজ্ঞেস করলো,
“ভাই সাহেব তাহলে আমরা কবে আসবো বিয়ের তারিখ ফেলতে?”
“ভাই সাহেব সামনের সপ্তাহে আসুন। শুক্রবারে। সেদিন আমার অফিস বন্ধ থাকে। আমি বাসায় থাকি।”
তারা দুজন ফোন থেকে বিদায় নিলো। মাহফুজা ছোট বাচ্চার মতো ছুটে এসে মাহমুদকে সংবাদটা জানালো।
“সুখবর আছে মাহমুদ। কঠিন সুখবর!”
” বলে ফেলো জননী?”
“তোর অভিমানীনি ফুলকলি রাজী বিয়েতে।”
“ফুলকলি! মজাতো নামটা। ফুলকলি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার নামে বিখ্যাত মিষ্টির দোকান আছে ঢাকার কয়েক স্থানে।”
” শোন,সে এক সপ্তাহের সময় নিয়েছে না। সেটাতো আরো আগেই ফুরিয়ে গেলো। তারাতো কিছুই জানাচ্ছে না। হয়তো সংকোচে। তাই আমি তোর বাবাকে দিয়ে একটু আগে ফোন করালাম। কলির বাবা বলল বিয়ের ডেট ফেলার জন্য সামনের শুক্রবারে যেতে তাদের বাসায়। তুই থাক। আমি আনুশকাকে ফোন করি।”
মাহমুদা উৎফুল্ল মনে চলে গেলো নিজের রুমে। মাহমুদের অশান্ত হৃদয় শান্ত হলো। হৃদয়ের পুরো আঙিনা জুড়ে সুখের বারতা ঝরে পড়ছে শিউলি ফুলের মতো। অনুভূতির বেহাল দশা। মাহমুদ মনে মনে ধন্যবাদ দিলো কলির ওড়না নিয়ে যাওয়া সেই বখাটে দুজন ছেলেকে।
কারণ দিনের আলোয় প্রকাশ্যে একটা মেয়ের বুক খালি করে ওড়না নিয়ে চলে গেলো কেউ। এটা সেই মেয়ের জন্য কতখানি দূর্বিষহ ও লজ্জার তা আর বলার অপেক্ষা থাকে না। মাহমুদ কলিকে সেদিন ওড়না ফিরিয়ে এনে না দিলে খালি বুকেই কলির বাসায় যেতে হতো। তাই মাহমুদ বিশ্বাস করলো তার কাছে বিয়ে বসতে কলির রাজী হওয়ার পিছনে এই ঘটনা বড় ভূমিকা রেখেছে।
সে কলিকে নিয়ে হারিয়ে গেলো কল্পলোকের অন্তপুরে। ডায়েরিতে লিখে ফেলল,
“ওহে ফুলকলি,তুমি আমার কাছে অনেক ঋণী হয়ে গিয়েছো। একবার বুকের মাঝে পাই। নিংড়ে নিংড়ে সুদসমেত পুষিয়ে নিবো। তোমার ঋণের বোঝা কমানোর গুরুদায়িত্ব শুধুই আমার। কেবইলই আমার। বাকির খাতায় নাম রাখব না তোমার।”
মাহমুদের ভীষণ ইচ্ছে করছে কলির হাতটা একটু ছুঁয়ে দেখতে। কলির মুখোমুখি হতে। কলির মুখ থেকে অন্তত ভালোলাগে কথাটি শুনতে। কিন্তু এটা সম্ভব নয়। কলি আর তার স্বভাব প্রায় একইরকম। ইগো! ব্যক্তিত্ব! মৃদুভাষী! চাপা,স্বভাবের! তবে তার রাগ মনে হয় কলির চেয়ে বেশী। এমন এলোমেলো ভাবনায় ডুবে গেলো মাহমুদ।
শুক্রবারের দুইদিন আগে রেবেকা কলিকে জানালো,
” এই কলি, পরশু তারা বিয়ের তারিখ ফেলতে আসবে। বাগদান অনুষ্ঠান আরকি।”
কলি চকিতে চাইলো মায়ের মুখপানে।
“আমি ত মত জানাইনি আম্মু।”
“তোর আব্বু তাদেরকে তারিখ বলল। বলে বিবাহের মতো শুভকাজে ঢিলেমি করা ঠিক নয়। আর তারাও ফোন দিয়ে জানতে চাইলো মতামত।”
পিতার কথার উপরে কলির কিছুই বলার রইলো না। সে অন্তঃসারশূন্য মুখে বলল,
“আচ্ছা আম্মু। ঠিকাছে।”
বৃহস্পতিবার ক্লাস শেষে মাহমুদ অফিসে কাজ করছে। তার মোবাইলে জ্বলে উঠলো। মেসেজের রিংটোন বেজে উঠলো।
“স্যার একটু দরকার ছিলো। আসবো?”
মাহমুদের মন অদ্ভুত আনন্দে নেচে উঠলো ময়ুরের পেখম ছড়িয়ে নাচার মতো। কাল বাগদান। আজ কলি দেখা করতে চাচ্ছে। নিশ্চয়ই ভালো কিছু বলবে। সে দ্রুত টাইপ করে মেসেজ সেন্ড করে দিলো।
“আমার কাছে আসতে আপনার অনুমতির প্রয়োজন নেই। আসুন।”
সত্যিই কি মাহমুদের ভাবনার মতই কলি কিছু বলবে? নাকি ভিন্ন কিছু বলবে। যা শোনার জন্য মাহমুদ কখনোই প্রস্তুত ছিল না।
চলবে…১৬
#ড়মান্তিচ
#তোমার_জন্য_সব -১৭
✍️ #রেহানা_পুতুল
“আমার কাছে আসতে আপনার অনুমতির প্রয়োজন নেই। আসুন।”
সত্যিই কি মাহমুদের ভাবনার মতই কলি কিছু বলবে? নাকি ভিন্ন কিছু বলবে। যা শোনার জন্য মাহমুদ কখনোই প্রস্তুত ছিল না।
মাহমুদ ভাবছে,কলির সঙ্গে ভালো করে সখ্যতা গড়ে উঠেনি। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও নয়। প্রেম সেতো আমার এক পাক্ষিক। সেই মানবীর বাস আমার কল্পনাতেই। সরাসরি বিয়ে ঠিক হলো। কিন্তু তা নিয়েও তার সঙ্গে সরাসরি কোন আলাপ হয়নি। কাল সবাই যাবে তাদের বাসায়। আমি যাব না। পাত্রের থাকাটা এত গুরুত্বপূর্ণ না। কলি আমাকে স্যার হিসেবে দেখে আসছে। নিজের বাসায় হবু বর হিসেবে দেখতে পেয়ে অপ্রস্তুত হয়ে যাবে সবার সামনে।
কলিও দোটানায় পড়ে গেলো। যেখানে স্যারের সঙ্গে কিছুই না তার। সেখানের বিয়ের প্রসঙ্গ তুলবে কিভাবে। কিন্তু যেতেই হচ্ছে। কি পেয়েছে উনি। সবকিছু উনাদের মর্জিমতেই হবে? তার চাওয়া পাওয়ার কোন মূল্য নেই? কলি আসলো মাহমুদের অফিস রুমে। মাহমুদ চেয়ারে দেখিয়ে বসতে অনুরোধ করল কলিকে। কলি বসল না। মাহমুদের মুখোমুখি চেয়ারের হাতল ধরে
দাঁড়িয়ে আছে ঝিম মেরে।
কিছু বলতে পারছে না। সংকোচে, বিরক্তিতে, ভিতরটা ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছে। এটা মাহমুদ বেশ অনুধাবন করতে পারলো। মাহমুদ টেবিলে থাকা নিজের গ্লাসটাতে ওয়াটার পট থেকে পানি ঢেলে নিলো। কলির দিকে বাড়িয়ে ধরলো। বলল,
এতো দেখি মেনকার শয়তান। গুরুগম্ভীর অথচ ঠোঁটকাটা স্বভাবের। কথা কম বললেও যেটা বলে ভিতরটা এফোঁড়ওফোঁড় করে দেয়। একদিন খেয়াকে বুকের ওড়না নিয়ে কিসব বলে ফেলল। সবটা সে শুনে ফেলল। মনে হলে এখনো তার মাটির নিচে গায়েব হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। কলি গ্লাস হাতে নিলো। দু’তিন ঢোক পানি খেয়ে রেখে দিলো।
মাহমুদ গ্লাসের বাকি পানিটুকু খেয়ে নিলো। বলল,
“আপনাকে দেখে আমার গলাও শুকিয়ে চৈত্রের কাঠ হয়ে যাচ্ছে।”
মাহমুদের বিশ্বাস ছিলো কলি একটু হলেও হেসে ফেলবে এখন। কিন্তু তার বিশ্বাস অবিশ্বাসে রূপ নিলো। কলি পূর্বের ন্যায় মেঘমুখে দাঁড়িয়ে রইলো। এতো দেখি রোবট। কিভাবে সংসার করবো। কাকে মন দিলাম। মাহমুদ কলির চোখের দিকে তাকালো। কলি চোখ সরিয়ে নিলো।
“কলি,কাউকে দেখতে এসেছেন না কিছু বলতে এসেছেন?”
কলিকে একটু এগিয়ে দিলো কথাটা বলে মাহমুদ। কলি হাতের মুঠি হতে একটা কাগজ মাহমুদের সামনে রাখলো।
কাগজটা হাতে নিলো মাহমুদ। অল্প হেসে বলল,
“শুনেছি নব্বই দশকের প্রেম এভাবে হতো। পত্র বাহক না পেলে প্রেমিক প্রেমিকা একে অপরের হাতে চিঠি দিয়ে পালিয়ে যেতো। ব্যাপারটা ভালো লাগলো। থ্যাংকস।”
কলির চোখের কোণে প্রগাঢ় বিরক্তি খেলা করছে। এই লোকের আজ হয়েছে কি। নাকি কাল বিয়ের দিন ঠিক হবে বলে আজ মৌজে আছে। কলি টু শব্দটিও করল না মাহমুদের সঙ্গে। বোবা মুখে এলো। আবার বোবামুখেই বের হয়ে গেলো ঘুরিয়ে।
মাহমুদ ঝটপট কাগজটা মেলে পড়তে লাগলো।
” স্যার, আমি জানি আন্টি আমাকে খুব পছন্দ করেছে। আপনি মায়ের ইচ্ছা পূরণ করার জন্য সহমত জানিয়েছেন। একইভাবে আমিও আমার বাবা,মায়ের পছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে মত দিয়েছি। এর বাইরে কিছুই না। সবই ঠিকাছে। কাল বাগদান অনুষ্ঠানে যেন বিয়ের ডেট ফেলা হয় এক বছর পরে। অর্থাৎ আমার অনার্স কমপ্লিট হলে। কারণ ক্লাসে,ভার্সিটিতে এটা জানাজানি হলে আমি মরে যাবো। নানান সমালোচনার ঝড় উঠবে। আমি নিতে পারব না এসব। প্লিইজ স্যার।”
“তোমার ধারণা ও বিশ্বাস সম্পূর্ণ ভুল কলি। আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
বাক্যটি মনে মনে উচ্চারণ করে মাহমুদ তড়িতেই কলিকে ফোন দিলো। কলির ফোন সুইচড অফ। একটু পর পর মাহমুদ ট্রাই করে যাচ্ছে৷ বাট সুইচড় অফ৷ এভাবে মাহমুদ রাতে ঘুমানোর সময় পর্যন্ত ফোন দিলো। কিন্তু কলিকে রিচ করা গেল না৷ মাহমুদ প্রচন্ডভাবে ক্ষেপে গেলো কলির উপর৷ সে বুঝলো কলি ইচ্ছে করেই মোবাইল বন্ধ রেখেছে৷ যেন তাকে ম্যানেজ করার চেষ্টা না করা যায় বিয়ে আরো আগে করার জন্য৷ মাহমুদ দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,
বিয়ে হবে। খুব সহসাই হবে। এই বর্ষাতেই হবে। অনেক জ্বালিয়েছো। তোমার জন্য অনেক করেছি। সব উসুল করতে হলে তোমাকে কাছে চাই। ফাজিল, অসভ্য মেয়ে কোথাকার। ক্ষিপ্ত মেজাজ নিয়ে মাহমুদ ঘুমিয়ে পড়লো।
আজ শুক্রবার। বিকেলে মাহমুদের পরিবারের সবাই বসলো। কিছু ঘনিষ্ঠজনও রয়েছে। স্বল্প আলোচনা হলো তাদের মাঝে। মাহফুজা ছেলেকে বলল,
“তোর কবে সুবিধা হয়? সেই অনুযায়ী তারিখ ফেলতে হবে।”
“কলির সেমিস্টার ফাইনাল পনেরোদিন পরে। উমম.. এক মাস পর যেকোন শুক্রবার।”
জানালো মাহমুদ।
আনুষকা বলল,
“বুধবার পাত্রীর সন্ধ্যা কোটাই। বৃহস্পতিবার গায়ে হলুদ। শুক্রবার বিয়ে। শনিবার বৌভাত। আর পরিক্ষার পর কয়দিন পড়ার প্রেশার থাকে না। রিলাক্স থাকে সবাই। সো সেমিস্টার ফাইনালের পর পরেই বিয়ের ডেট ফেলতে হবে।”
আবদুর রহমান বলে উঠলো,
“আরেক কাজ করা যায়। কাবিন করে রাখলে অনার্স শেষ হলে একবারে অনুষ্ঠান করে তুলে আনা যায়।”
মাহফুজা বলল,
“এটাও মন্দ বলেন নি। বিয়ে ত হয়েই গেলো। চিন্তা মুক্ত। কিন্তু সেটা হলেত আবার অন্যরকম প্রস্তুতি নিতে হবে দুই পক্ষেরই। মাহমুদের যেতে হবে। দুই রাত মেয়ের বাসায় থাকতে হয় কাবিনের পরে। তাদের সঙ্গে আলাপ করতে হবে। তারা কিভাবে কি চায়। সবারই সুবিধা অসুবিধা আছে।”
মাহমুদ ছোট মামা বলে উঠলো,
“দুলাভাই তারা পিপারেশন নিয়ে ফেলেছে পানচিনির হিসেবে। তারমধ্যে কাবিনের কথা তুললে প্যাঁচগোছ লেগে যাবে। মাহমুদের কথাই আমার কথা। আজ বিয়ের দিন পাকা হবে। এবং মেয়ের পরিক্ষা শেষ হলেই। এটাই ফাইনাল করবো আমরা। এখানে থেকেও মেয়ে পড়াশোনা চালিয়ে নিতে পারবে। মাহমুদের বাইকে করে যাওয়া আসা করবে। সমস্যা ত দেখি না আমি।”
সঙ্গে সঙ্গে আমিন বলে উঠলো আবদুর রহমান ও মাহফুজা।
সন্ধ্যার পর পাত্রপক্ষ এলো। পাত্র এলোনা। হাসি ঠাট্টায় বিয়ের দিন ধার্য হলো। সবাই রাতের খাবার খেলো। শরবত থেকে শুরু করে আয়োজনের কমতি করেনি নুরুল, রেবেকা দম্পতি। শাড়ি পরিহিত কলি মাথা ঢেকে সবাইকে সালাম দিলো। যেহেতু আংটি আগেই দেওয়া হলো তাকে। তাই আজ দুটো নোজ পিন উপহার দিলো পাত্রপক্ষ। একটা সোনার আরেকটা ডায়মন্ডের।
জুলি বলে উঠলো,
“আপাতো নাক ফোটায়নি। কিভাবে নাকফুল পরবে?”
“নো প্রবলেম হবু বেয়াইন। এখন প্রযুক্তির যুগ। বিয়ের আগে পার্লারে গিয়ে টুক করে ফুটো করে আসলেই হবে। দুদিনেই নাক শুকিয়ে যাবে।”
বলল আনুশকা।
“হুম সেটাই। বিয়ের সময় নাক খালি থাকলে অসুন্দর লাগবে। সব সাজ ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে যাবে। মেয়েদের মুখের শ্রী হলো নাকফুল।”
বলল মাহফুজা।
দুই পক্ষের আলোচনার ভিত্তিতে সব পাকা করতে সময় লেগে গেলো। কলি মাকে দিয়ে বাবাকে জানালো বিয়ের তারিখ তার পড়াশোনা শেষ হলে ফেলার জন্য। নুরুল হক মেয়ের কথাকে গ্রাহ্য করলেন। আবদারের সুরে তাদের বললেন কথাটা। তারা মানলই না। উপযুক্ত যুক্তি উপস্থাপন করে দেখালো এক মাস পরে হলে কোন সমস্যা নেই। কলি তার মতো করেই চলতে পারবে। চাইলে নিজের বাসায়ও থাকতে পারবে। তবুও বিয়ে হয়ে যাক। পিছানোর দরকার নেই।
পাত্রপক্ষ বিদায় নিতে নিতে রাত হয়ে গেলো। কলি নিজের রুমে গিয়ে আজ আর কাঁদল না। ক্ষেপে গেলো মাহমুদের উপরে। গজগজ করে বলতে লাগলো,
“আপনি আমাকে পাবেন না মিস্টার মাহমুদ। এত রিকুয়েষ্ট করে লিখলাম। তবুও আমার চাওয়ার গুরুত্ব পেল না আপনার কাছে। দ্রুত বিয়ে করতে চাওয়া আপনার ভালোবাসা হতেই পারে না। এসব আপনার একরোখা মনোভাবের প্রতিফলন। একপ্রকার জেদও বটে। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাঁই করে ফেলব আপনার অন্তরকে। অভদ্র পুরুষ। ছাত্রীকে বিয়ে করার সাধ মিটিয়ে দিব। আমিও কম যাই না। আমার ঘাড়ের র*গ ও ত্যাড়া আছে।”
বোমের মতো তেতে আছে কলি। ফোঁস করে একটা আওয়াজ করলো মুখ দিয়ে। শাড়ি চেঞ্জ করে সামান্য খেয়ে নিলো ক্ষুধার যন্ত্রণায়। ঘুমিয়ে গেলো চটে যাওয়া মেজাজ নিয়ে।
ওহে, ফাইনালি আপনার বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো আপনার অপছন্দের শিক্ষক মাহমুদের সঙ্গে। যে কিনা আপনাকে কঠিনভাবে ইনসাল্ট করলো। রুক্ষ ভাষায় কথা বলল। আমার অধিকার প্রাপ্তিতে বাধা দিলে সামনে আরো শাসানিতে রাখবো আপনাকে। প্রয়োজনে বন্য হবো। সব ক্ষেত্রে ভদ্র টিচার হয়ে থাকবো নাকি। আমি পুরুষ। আমারও আছে একটা প্রেমিক হৃদয়।
আবার কলি ভার্সিটি আসা বন্ধ করে দিলো। মাহমুদের মেজাজ বিগড়ে গেলো। তবুও নিজের অনুভব, অনভূতিকে সংযত রাখলো। দাঁত কামড়ে ধৈর্যের পরিচয় দিতে লাগলো। কলিকে ফোন করল না। কোন রকমের যোগাযোগ করার চেষ্টা করল না।
অবশ্য তিনদিন পর কলি ক্লাসে এলো। কারণ সামনে পরিক্ষা। গ্যাপ দিলে সমস্যা আছে। এটা স্কুল, কলেজ নয়। কোচিং, প্রাইভেট পড়ে কাবার দিবে। ভার্সিটিতে ডিপেন্ডেড থাকতে হয় অধ্যাপকদের লেকচারের উপরে।
মাহমুদ ক্লাসে গিয়ে তৃষিত নয়নে কলির দিকে তাকালো। যেন মরুর বুকের পিপাসিত পথিক বহু প্রতিক্ষার পরে কিছু জলের ফোঁটার নাগাল পেলো। কলি ভুলেও চোখ তুলে তাকাচ্ছে না। মাহমুদ কলিকে তার চোখাচোখি করার ব্যবস্থা করলো। সে সাহিত্যের নানা প্রসঙ্গ টেনে জিজ্ঞেস করলো সবাইকে,
“বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক একটা উক্তি বলেন। যার কাছে যেটা সেরা মনে হয় সেটাই বলেন।”
একজন একেকটা বলতে লাগলো। কেউ হুমায়ুন আহমেদের, কেউ বংকিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের, কেউ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের,কেউ শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের জনপ্রিয় রোমান্টিক উক্তি বলল।
“কলি আপনি দাঁড়ান। আপনার কাছে কোনটা মনে হয়? বলেন।”
“স্যার আমি জানিনা। খুব গল্প,উপন্যাস পড়িনি আমি।”
দাঁড়িয়ে চোখ নামিয়ে বিরস গলায় বলল কলি। কলির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে মাহমুদ ব্যর্থ হলো। তার বিরক্তির সীমা রইল না। কড়া স্বরে বলল,
“বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী হয়ে একটা উক্তিও বলতে পারলেন না। আপনার বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়া উচিত হয়নি।”
কলির সারাগাল মরিচ লাল হয়ে গেলো। চনচনে সুরে বলল,
“স্যার আমি বহু উদ্ধৃতি জানি। আপনি রোমান্টিক উক্তি শুনতে চেয়েছেন। সেটা আমি পারিনা।”
“হ্যাঁ চেয়েছি। রোমান্টিক বা ভালোবাসার উদ্ধৃতি কি সাহিত্যের বাইরের পার্ট নাকি?”
এমন সময় আমান স্যার কোন একটা কাজে মাহমুদ স্যারের কাছে এলো। তিনি আলোচনা শুনলেন দরজায় দাঁড়িয়েই। রসিকতা করে বললেন,
“যারা প্রেমের উক্তি জানেন না। তাদের জন্য শিখে নেওয়া অপরিহার্য। নয়তো তাদের দাম্পত্যজীবন অন্ধকার।
-হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন।
“প্রেম শুধু দেখা ও চোখের ভাল লাগা থেকেই হয় না, রাগ থেকে প্রেম হয়, ঘৃণা থেকে প্রেম হয়, প্রেম হয় অপমান থেকে, এমনকি প্রেম হয় লজ্জা থেকেও। প্রেম আসলে লুকিয়ে আছে মানবসম্প্রদায়ের প্রতিটি ক্রোমসমে। একটু সুযোগ পেলেই সে জেগে উঠে।”
রসিক আমান স্যার আরো বললেন,
” অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
প্রেমের মাঝেই লুকায়িত কামনার বীজ।”
ক্লাস শেষে মাহমুদের খুব ইচ্ছে করছে কলিকে ডেকে কাছে আনতে। একটু কথা বলতে। তার কথা শুনতে। কিন্তু ক্লাসে যেভাবে ক্ষেপিয়ে দেওয়া হলো তাকে। এখন ডাকা ঠিক হবে না। দাউদাউ করে জ্বলে উঠতে পারে। মাহমুদ বেরিয়ে গেলো বাইক নিয়ে।
এদিকে মাহমুদের উপরে প্রবল বিতৃষ্ণায় কলির অন্তর ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। এই পুরুষের সঙ্গে চলবে কিভাবে সে। এতো দারুণ ঠোঁটকাটা স্বভাবের। চোখের সামনেই লজ্জা দিয়ে ফেলে। তখন এমন ভাব যেন চেনেই না। কলি বেখেয়ালিভাবে ঢুলে ঢুলে হাঁটছে। আচমকা রাস্তায় পড়ে থাকা ভাঙ্গা ইটের টুকরোয় হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলো। ব্যথায় উঁহু করে কুঁকিয়ে উঠলো। পাশ থেকে কলির দুজন ক্লাসমেট দেখে দৌড়ে এলো। কলিকে ধরে উঠালো। মাহমুদ তাদের দেখে বাইক থামালো।
#তোমার_জন্য_সব *১৪
✍️ #রেহানা_পুতুল
কলি মেঘমন্দ্র মুখে বিড়বিড়িয়ে বলল,
“আমার পছন্দের খেতা পুড়ি। এক জীবনে যার একজন ছেলে বন্ধু জুটল না কপালে। তার আবার বিয়ের পাত্র পছন্দ। তার পছন্দের গুরুত্ব থাকলে এই কাহিনী করতে না তোমরা আমার সঙ্গে।”
কয়েকদিন আগে মাহমুদ যখন কলির সঙ্গে কথা বলল। তখনই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে সে,কলির সঙ্গে প্রেম নয় কেবল বন্ধুত্ব করাও যাবে না। সে বাসায় গিয়ে অবসর হয়ে মাকে নিজের রুমে ডাকলো। গম্ভীরমুখে বলল,
” গুড! তাহলে সনাতন পদ্ধতিতে যেতে হবে। তার বাবা মায়ের ফোন নাম্বার আছে তোর কাছে?”
“না। তাদের নাম্বার আমি কই পাবো?”
“তুই তাদের বাড়ি চিনিস না?”
“হুম। পৌঁছে দিলাম যেদিন। দেখলাম ত।”
“তাহলে বাড়ির কেয়ারটেকারের কাছ থেকে তার বাবার নাম্বার যোগাড় করে দে আমাকে। কালই দিস। লেট করিস না।”
রাতে মাহমুদ তার ডায়েরিটা নিয়ে বসলো টেবিলে। এই প্রথম কলিকে বা কোন মেয়েকে নিয়ে তার ডায়রিতে লিখা। রুল টানা ডায়েরির একটি খালি পৃষ্ঠায় সে লিখলো,
” পৃথিবীতে তীব্র যন্ত্রণাগুলোর মধ্যে একটি যন্ত্রণা হলো কাউকে কিছু বলতে চেয়েও বলতে না পারা।” আবার লিখলো,
“কিছুদিন ধরে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলাম আমি। রা*গ,ক্রোধ,বিরক্তি,অভিমান থেকেও যে ভালোলাগা জন্ম হতে পারে তা আমার কাছে অচিন্তনীয় ছিলো। বলা যায় আমার জীবনে এটা এক অবিস্মরণীয় ঘটনা।
কে জানতো ক্লাসের শেষ বেঞ্চে ভর দুপুরের নিঃসঙ্গ গাঙচিলের মতো বসে থাকা শান্ত মেয়েটি আমার অবসরের কল্পনার সঙ্গী হবে। তার প্রতি আমি এক অজানা শিহরণ অনুভব করব। সে যত দূরে যায়। আমার হৃদয় তত তাকে কাছে চায়। তাকে আমি সামনের চেয়ে আড়ালে বেশি দেখি। আজকাল নিজেকে দিক হারিয়ে দিশেহারা নাবিকের মতো মনে হয়। সেই মেয়েটিই যেন আমার একমাত্র দিশা। ভালোবাসা বুঝি এমনি। যার কবলে পড়ে নিঃশ্ব হয়েছে ধরণীর কতশত মহাপুরুষগণ।”
মাহমুদ কলিকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে নিদ্রা-ঘোরে হারিয়ে যায়। তার পরেরদিন সে ভার্সিটি থেকে সোজা কলিদের বাসার নিচে চলে যায়। নাম্বার নিয়ে নেয় কলির বাবা নুরুল হকের। মাহমুদা আবদুর রহমানকে বলল কলির বাবাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে। তিনি ফোন দিলেন কলির বাবাকে।
নুরুল হক রেবেকা,বড় মেয়ে মিলি,মিলির জামাই হারুনের সঙ্গে আলাপ করলেন। তারা সহমত জানালো সব শুনে। এভাবে ফোনালাপে মাহমুদের বাবা,মা ও কলির বাবা,মা কথা আদান প্রদান করলেন প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে। রেবেকা একজন মা। তাই মায়ের মনে খচখচানি ভাবটা প্রকট। মেয়ের ভবিষ্যত কতটুকু শান্তির হবে এই আশংকা থেকে বড় মেয়ের জামাইকে ডেকে আনলো বাসায়। এবং আদেশ দিয়ে বলল,
“ভালো করে পাত্র ও পাত্রের পরিবারের খোঁজ খবর নাও লুকিয়ে।”
“আচ্ছা আম্মা। অবশ্যই। ”
জুলি বড় দুলাভাইকে দারুণ পছন্দ করে। এর বড় একটা কারণ দুলাভাইকে ভুলিয়ে ভালিয়ে মাঝে মাঝে তার প্রয়োজনীয় জিনিস আদায় করে নেয়। জুলি হারুনের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“শাশুড়ী আম্মার হুকুম পালন করেন। চাপা স্বভাবের মেজো শালির জ্বালা থেকে বঞ্চিত ছিলেন। এবার তার দুলহা নির্বাচনে গরু দায়িত্ব পালন করেন।”
“দেখলেন আম্মা আমাকে গরু বলল জুলি।”
অধিকার সুলভ কন্ঠে নালিশ দেওয়ার মতো করে বলল হারুন।
“থুক্কু। থুক্কু। গুরু বলতে গিয়ে গরু বলে ফেলছি দুলহা ভাই।”
“হারুন তুমি যাওতো বাবা। এই ট্যাটনা থাম। কাজের সময় ফাইজলামি করে। তুই স্থির থাকতে পারস না মেয়ে? সারাদিন টইটই করিস। তোর দরকার ছিলো গ্রামে থাকা। বান্দরের মতন গাছে গাছে লটকালটকি করবি।”
জুলি ধুম করে হেসে ফেলে। মাকে বলল,
“তাহলে আমাকে তোমার সারাদিন কলা দিতে হতও। ইয়া বড় বড় কাঁদি কাঁদি কলা।”
হারুন তিন চারদিন সময় ব্যয় করে পাত্রের তথ্য যোগাড় করলো। শ্বশুরের বাসায় গিয়ে জানালো সব।
” আম্মা যতটকু জানতে পেরেছি ছেলে ভালো। চরিত্রবান। কর্মঠ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক। তবে ইতঃপূর্বে কোন মেয়ের সঙ্গে রিলেশন ছিল কিনা বা ব্রেকাপ হয়েছে কিনা জানা যায়নি। আর এটা তাদের নিজস্ব ফ্ল্যাট। তার বাবাও বসে নেই। শেয়ার বাজারে অংশীদার আছে। গ্রামে ঘরবাড়ি আছে। তারা প্রতিবছর যাওয়া আসা করে। বাসায় সর্বদা একজন গৃহপরিচারিকা নিযুক্ত আছে তাদের। ”
” ছেলের রিলেশন নাই। থাকলে তাকেই বিয়ে করতো। ছেলেরা ফ্যামিলি ম্যানেজ করে নিতে তেমন সমস্যা হয় না। সুতরাং এটা নিয়ে আমার মনে ঘাপলা নেই।”
” আম্মা কুমিল্লার ছেলে কিন্তু ইতর। বদমায়েশ। কলির মতামত নিতে হবে সব বলে।”
“সেটা আমি দেখছি। তুমি এখন আসতে পারো কাজ থাকলে।”
দুই পরিবারের সব পছন্দে মিলে গেলো। রেবেকা ফোন দিলেন মাহফুজাকে। বললেন,
“আপা ছেলে মেয়ে একবার দেখা করে কথা বলে নেওয়া দরকার। নাকি বলেন? ওরা এখন এডাল্ট। তাদের মতামতের গুরুত্ব দেওয়ার দরকার আপা।”
“আপা, আপনি ও ভাই কি একটু আমাদের সঙ্গে বাইরে দেখা করবেন। দরকার ছিলো। কলি যেন না জানে। সেভাবেই আসবেন।”
বিনীত গলায় বলল মাহফুজা।
রেবেকা তব্দা খেলো। তবুও বলল,
“আপা আমি সময়টা আপনার বাইয়ের সঙ্গে আলাপ করে জানিয়ে দিবো।”
তার দুইদিন পর এক বিকেলে লালবাগ একটি রেস্টুরেন্টে মাহমুদের বাবা, মা ও কলির বাবা মা মুখোমুখি চেয়ারে বসলো। হালকা নাস্তার অর্ডার দিলো আবদুর রহমান। তিনি হৃদ্যতাপূর্ণ স্বরে বললেন,
“আপা, ভাই সাহেব ,কলিকে আমরা একটা সারপ্রাইজড দিতে চাই। পাত্রপক্ষের পরিচয়টা তার কাছে আপাতত গোপন রাখবেন।”
রেবেকা ও নুরুল হক একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন সন্দেহভাজন চোখে। তা দেখে হাসলেন মাহফুজা। তিনি নিজের মতো করে সব বুঝিয়ে বললেন কলির মা বাবাকে।
রেবেকা স্মিত হেসে বলল,
“হুম বুঝিয়ে বলাতে বুঝলাম আপা। কিন্তু কলি যখন দেখবে তার টিচার। তখন ত বেঁকে বসবে। যেহেতু তাদের মাঝে অন্য সম্পর্ক নেই।”
“আপা,ভাই সেটা আমার উপর ছেড়ে দিন। আমি সিচুয়েশন ও কলিকে হ্যান্ডেল করবো।”
এই ভিতরে মাহমুদ আর কোন কথা বলেনি কলির সঙ্গে। পড়াশোনা, ক্লাসের প্রয়োজনে যতটুকু দরকার। ঠিক ততটুকুই বলেছে। খেয়া ভার্সিটি আসছে না। মিসেস হেড খবর নিলো নিলো খেয়ার। জানা গেলো খেয়া এই সেমিস্টার ড্রপ দিয়েছে। কারণ তার চিকিৎসার জন্য পরিবার তাকে নিয়ে চেন্নাইতে চলে গিয়েছে। এতে মাহমুদ স্বস্তিবোধ করলো দুটো কারণে। এক খেয়ার ডিস্ট্রাব হতে রেহাই। দুই কলির সঙ্গে টুকটাক কথা বলা যাবে নানান বাহানায়। খেয়া দেখলে জেলাস ফিল করতো।
কলিকে মাত্র দুদিন আগে জানানো হলো আজ তাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। তাদের সবার পছন্দ হয়েছে। কলির মিডটার্ম পরিক্ষা শুরু হলে বলে মাহমুদের পরিবারের সঙ্গে কলির পরিবারের কথা চালাচালি সবকিছুই গোপন রইলো। কলি দুঃখমাখা কন্ঠে বলল,
“আশ্চর্য! পনেরোদিন ধরে তোমরা দেখাদেখি করছো। অথচ আমি কিছুই জানিনা?”
সর্বদা খিটমিটে মেজাজে ডুবে থাকা রেবেকা হই হই করে উঠলো না মেয়ের উপর। মেয়ের অভিমানকে প্রশ্রয় দিয়ে শান্ত গলায় শান্তনার ভঙ্গিতে বলল,
“তোর পরিক্ষা চলতেছিলো। তাই তোর বাবা বলল তোকে যেনো না জানাই। পড়াশোনার ক্ষতি হবে মন অন্যদিকে গেলে। কোন মা বাবা তার সন্তানের খারাপ চায়না। যেভাবে ভালো হয়,মঙ্গল হয়। সেটাই চায় নিজেদের ক্ষতি করে হলেও। আমরা তাদের মানা করেছি কত। শুনলই না। বলল সামনাসামনি এসে এক কাপ চা খাবে। আর কিছুই না। বারবার করে বাসায় আসতে চাইলে মানা করা যায় বল?”
“ছেলে কি করে আম্মু?”
“কোন প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে। পরশু আসুক। দেখবি। তোর অমতে কিছুই হবে না। আমাদের যতই ভালোলাগুক। তোর দুলাভাই ছেলে দেখেছে। তার খুব পছন্দ হয়েছে।”
“তারা কয়জন আসবে?”
“তিনজন ত বলল। চা,নাস্তা খাবে একটু।”
কলি এই দুইদিন গোমড়া মুখে ছিলো। কিন্তু বাবা মায়ের মুখের উপরে অতিরিক্ত কিছুই বলল না আর। মিলি ও হারুন চলে এসেছে। কলি বলল,
“এই সামান্যতে তোরা কেন এলি আপা?”
“আজব? আমাদের বাসায় আমি এনিটাইম আসতে পারি না।”
হেসে জবাব দিলো মিলি।
কলি শাড়ি পরে রেডি হয়ে বসে আছে। তার রুম ভিতরে। তাই ড্রয়িংরুমে কে বা কারা এলো কলি টের পায়নি। সেখানে বসে আছে নুরুল হক,হারুন,মিলি, রেবেকা,জুলি,আবদুর রহমান, মাহফুজা ও আনুশকা। রেবেকা, মাহফুজাকে বলল,
“আপা তুফান আপনি সামলাবেন কিন্তু।”
মাহফুজা সরস হেসে আস্বস্ত করলো রেবেকাকে।
মিলিকে বললো রেবেকা, কলিকে নিয়ে আসতে সঙ্গে করে। সবার বুকের ভিতর টিমটিম করছে লন্ঠনের নিভে আসা আলোর মতো। কলির বুকের গহীনেও দ্রিমদ্রিম বাজছে। এভাবে আর কোন পাত্রপক্ষের সামনে সে যায়নি।
শাড়ি পরিহিতা কলি লজ্জাশীলা নারীর মতো ড্রয়িংরুমে পা রেখে সবাইকে মুখে সালাম দিলো। মাহফুজাকে দেখে কলি অতি বিস্মিত হলো । তবুও ধরে নিলো পাত্রপক্ষের কোন রিলেটিভ হবে হয়তো তারা।
“আন্টি আপনি? উনি আনুশকা আপু না?”
চমকানো সুরে বলল কলি।
“আসো মা। কাছে এসো। বসো। আমাকে ত আর তুমি তোমাদের বাসায় আসতে বললে না। তাই নিজেই চলে এলাম গল্প করতে।”
কলি মিশ্র অনুভূতির করাতলে ঘায়েল হয়ে যাচ্ছে। মাহফুজার পাশে গিয়ে বসলো। সবার মুখ হাসি হাসি। মিলি ও জুলি মিলে দুই তিন ট্রে ভর্তি বাহারি পদের নাস্তা পরিবেশন করে দিলো সবাইকে। কলি বাবা মায়ের মুখের দিকে চেয়ে আছে বোকা বোকা চোখে। সবাই নাস্তা খেয়ে নিলো। মাহফুজা কলির হাত ধরে নুরুল হকের দিকে চেয়ে বলল,
“ভাইসাহেব আলহামদুলিল্লাহ। আমাদের কোন আপত্তি নেই আপনাদের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে।”
নুরুল হক ও রেবেকা আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলো।
মাহফুজা কলিকে বলল,
“তোমার পরিবারের কারো বিন্দুমাত্র দোষ নেই। তুমি তাদের উপর মনঃক্ষুন্ন হতে পারবে না। তোমার পরিক্ষা ছিলো বলে আর তোমাকে সারপ্রাইজড দেওয়ার জন্য আমিই একটু লুকোচুরির আশ্রয় নিলাম মা। উনারা আমার অনুরোধেই চুপ ছিলো। তুমি ছোট বাচ্চা নও। আশাকরি বুঝতে পেরেছো।”
“আন্টি আমি কিছুই বুঝতেছি না।”
“তোমাকে সারাজীবনের জন্য আমার কাছে নিতে যেতে চাই। আপত্তি আছে মা?”
কলির মাথায় যেন আকস্মিক বজ্রপাত হলো। তার সমস্ত শরীর দুলে উঠলো। চোখ বড় বড় করে কপালে তুলে সে কিইই বলে মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। আতংকিত গলায় একবাক্যে বলে উঠলো,
“অসম্ভব আন্টি! মরে গেলেও আমি এটা পারব না। উনাকে স্যার হিসেবে আমি শ্রদ্ধা করি। অন্যচোখে দেখা আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব! আমাকে ক্ষমা করবেন।”
চলবে…১৪
#তোমার_জন্য_সব (১৫)
✍️ #রেহানা_পুতুল
কলির মাথায় যেন আকস্মিক বজ্রপাত হলো। তার সমস্ত শরীর দুলে উঠলো। চোখ বড় বড় করে কপালে তুলে কিইই বলে মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। আতংকিত গলায় বলে উঠলো,
“অসম্ভব আন্টি! মরে গেলেও আমি এটা পারব না। উনাকে স্যার হিসেবে আমি শ্রদ্ধা করি। অন্যচোখে দেখা আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব! আমাকে ক্ষমা করবেন।”
“তুমি এক মাকে ফিরিয়ে দিবে?”
শীতল গলায় বলল মাহফুজা।
“আপনার পছন্দের জন্য দুটো জীবন বলী হতে পারে না আন্টি। স্যারও আমাকে শুধু ছাত্রী হিসেবেই দেখে। অন্যদৃষ্টিতে নয়।”
” তোমার স্যারের মত না জেনে আমরা এসেছি?”
হেসে বলল আনুশকা।
কলি বলল,
“উনি মায়ের অনুরাগী ছেলে। তাই মায়ের মুখের উপর মানা করতে পারেনি বিধায় হয়তো হ্যাঁ বলতে বাধ্য হয়েছে।”
“এমন কিছুই না। ঠিকাছে তোমার কথাই রইলো। তুমি যদি আমার কাছে থাকতে না চাও। নাই। বিয়ে জোরের বিষয় নয়। মনের বিষয়।”
হতাশ গলায় বলল মাহফুজা।
আনুশকা বলল,
“কলি বাচ্চামো করো কেন? তোমাকে প্রথমে আম্মু পছন্দ করেছে। এটা সত্যি। তারপর আম্মু আমাদের সবাইকে বলল তোমার কথা। ভাইয়া ও আমরা চিন্তা করে সহমত জানালাম। বিষয়টা যে আম্মুর ইচ্ছাকেই কেবল প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। তা মোটেও নয়। এটা দুজন মানুষের পুরো লাইফের বিষয়। আমরা ভেবেচিন্তেই সিদ্বান্ত নিয়েছি। তোমাদের পরিবারের সবাই, ভাইয়া ও আমাদেরকে পছন্দ করেছে।”
কলি নত মস্তকে মৌন হয়ে রইলো। পরক্ষণেই বলল,
“বুঝলাম। তবুও আমি সরি বলবো। স্যারকে আমি অন্যচোখে দেখতে পারব না।”
“রাজধানীতে বাস করেও তুমি দেখি মান্ধাতার আমলের মেয়েদের মতো কথা বলছ? আম্মুর মাথা হেঁট হয়ে যাবে এখন ভাইয়ার কাছে। ভাইয়া বারবার বলছে কলির মত না জেনে তোমরা যেওনা। পরে অপমানিত হবে।”
স্বল্পভাষী আবদুর রহমান নিরব ভূমিকা পালন করছেন। কি বলবেন তিনি। কিছুই বলার নেই। বাকিরা নিরব দর্শকের মতো চুপ হয়ে আছে। আড়চোখে কলিকে দেখছে ও কলির মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছে। মাহফুজা দীর্ঘস্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন। খেদ ঝেড়ে মরাকন্ঠে বললেন,
“সব ভুল আমারই হয়েছে। নিজের উপর অগাধ আত্মবিশ্বাস ছিলো। সব ভেস্তে গেলো। মাহমুদের কথাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিলো আমার।”
আনুশকা বলল,
“ফাইনাল একটা জিজ্ঞাসা কলি। আচ্ছা ভাইয়া যদি তোমার মুখোমুখি হয়ে বলে তোমাকে পছন্দ। তাহলে কি তুমি ইয়েস বলবে?”
“নাহ আপু। সরি।”
বলে কলি নিজের রুমে চলে গেলো।
” আপা,ভাইসাহেব আপনারা যাবেন না। একটু বসুন।”
নুরুল হক আন্তরিক গলায় অনুরোধ করলো অতিথিদের।
তারা তিনজন দাঁড়ানো থেকে আবার বসলো। রেবেকা,মিলি,নুরুল হক উঠে ভিতরে গেলো। জুলি ও হারুন বসে আছে। হারুন কথোপকথন চালিয়ে নিলো অতিথিদের। জুলি ও আনুশকা নানান রসবোধে মেতে উঠলো। নাইনে পড়ুয়া জুলি বন্ধুবৎসল ও স্বভাবে মিশুক প্রকৃতির। পৃথিবীর সব পর মানুষকে এক দেখায় আপন করে নেওয়ার অসীম ক্ষমতা এই বালিকা মেয়েটির।
আনুশকা অতি আগ্রহ নিয়ে জুলির সঙ্গে গল্প করছে। এক পর্যায়ে জুলি বলল,
“আনুপু আমি একটা মজার জোকস জানি। এক্ষুনি শোনাতে চাই আপনাকে। পরে যদি আপার বিয়ে না হয় তার স্যারের সঙ্গে। তাহলে আর কোনদিন শুনানো হবে না। আমার আফসোস রয়ে যাবে।”
আনুশকা দেখলো জুলি তার এত সুন্দর নামের অর্ধেক ঘ্যাচাং করে কেটে ফেলেছে। শুধু আনুপু বলছে। যদিও তার কাছে এটাও শুনতে বেশ লাগছে। শটকার্ট সহজ সরল শব্দ। আনুশকা চায়না এত হাসিখুশী মেয়েটার মনে বিন্দুসম হলেও অপূর্ণতাটা রয়ে যাক।
সে উৎসুক চাহনিতে বলল,
“সেটাই। বিয়ে না হওয়ার চান্স সেভেনটি পার্সেন্ট। অবশ্য হতেও পারে। জিরো পার্সেন্ট চান্স থেকেও মানুষ হিরো হয়ে যায়। ক্রিকেট খেলায় দেখনা,হারতে হারতে চার,ছক্কা মেরে জিতে যায়। আমার কাছে এই বিষয়টা অদ্ভুত মজার লাগে জুলি। ও হ্যাঁ তোমার কৌতুকটা? প্লিজ।”
“ওহ! শোন,
পার্কের খোলা বেঞ্চে বসে আসে দুজন কপোত-কপোতী। ছেলেটা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। বুক টান টান করে পাখির ডানার মতো দুই হাত দুই দিকে মেলে ধরলো। বলল,
প্রিয়া এই পৃথিবী শুধু তোমার আমার।কোন ভয় নেই। কোন দ্বিধা নেই। বুকে আসো। তখন সামনের পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিলো একজন অচেনা মুরুব্বি। তিনি থেমে গেলেন। তাদের দুজনের দিকে স্থির চোখে চাইলেন। বললেন,
তা বাবা তাহলে কি এই পৃথিবীর আমরা সব মানুষেরা তোমাদের ভাড়াটিয়া?”
“বাহ! জটিল গণিতের মতো সাবজেক্টের স্যার এত রসিক? লাইক সিরিয়াসলি? ”
কলিকে এতক্ষন মা,বাবা,বোন তাদের সাধ্যনুযায়ী জীবন নিয়ে বিভিন্ন যুক্তিখন্ডন করে বোঝালো। কলির ঘুরেফিরে দুটো কথা। এক, স্যার তাকে পছন্দ করেছে এটা তার বিশ্বাস হয়না। দুই, হলেও তার সংকোচ হয়। অন্য কেউ হলে এতটা হতো না। কলি বসে রইলো চেয়ারে নিজের রুমে। তারা ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসলো। কলির বিষয়টা জানালো।
আনুশকা উঠে এলো কলির কাছে। বলল,
“ভাইয়াকে বলবো আসতে তোমাদের বাসায়? বাইকে একটানে চলে আসতে পারবে। ভাইয়ার মুখ থেকেই শুনে নাও তবে। আম্মু,আব্বু কত অগাধ বিশ্বাস নিয়ে এসেছে তোমাদের বাসায়। শুভকাজকে অবহেলা করতে নেই কলি। রেস্পেক্ট করতে হয়। টিচার স্টুডেন্ট এর বিয়ে সেই আদিকাল থেকেই আমাদের সমাজে প্রচলিত ও জনপ্রিয়। প্লিজ হবু ভাবি ইয়েস বল না।”
“নাহ ভাইসাহেব। আজতো বিয়ের দিনক্ষন আমরা ঠিক করিনি। যেদিন পাকা কথা হবে বিয়ের। সেদিন খাবো। কথা দিলাম। আপনারা কলির মতামত নিয়ে সময়টা আমাদের জানাবেন।”
তারা হাসিমুখে চলে গেলো বিদায় নিয়ে।
কলি নিজের রুমে এসে আংটি ছুঁড়ে ফেলল মেঝেতে। জুলি সেই আংটি নিয়ে নিজের বুড়ো আঙ্গুলে দিয়ে বসে রইলো। কলি দরজা বন্ধ করে ফুঁফিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। মাহফুজা বাসায় গিয়ে জোরে নিঃশ্বাস ফেললেন।
তিনি বুঝতে পেরেছেন সেদিন ছেলের কথায়। তার সঙ্গে ছেলেও কলিকে বেশ পছন্দ করে বসে আছে। তাই ছেলের মনোবাসনা পূরণের জন্যই মা হয়ে উঠে পড়ে লাগলেন।
মাহমুদ তাদেরকে অবাক চোখে বলল,
“এত লেট হলো? তোমরা গেলে কখন আর এলে কখন? ডিনার করে এসেছো নাহ?”
“আরেহ নাহ। তারাতো যথেষ্টবার সেধেছে। আমরা করিনি। তোর অভিমানীনি ছাত্রীকে ম্যানেজ করতেই আমরা নাকানি চুবানি খেলাম। রীতিমতো ছোটখাটো একটা যুদ্ধ হাফ জয় করে এসেছি। আমরা রুমে যাই। কাহিল। বিশ্রাম নিতে হবে। তোর বোন থেকে ইতিহাস শোন।”
মাহমুদ চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বসে পড়লো দাঁড়ানো থেকে। তার বাবা মা নিজেদের রুমে চলে গেলো।
“আনুশকা এদিকে আয়।”
আনুশকা গিয়ে বসলো ভাইয়ের সামনে।
“আমার আংটি কই?
দে।”
“আজব! আংটি কি ফেরত আনার জন্য কিনে দিয়েছো?”
“বিয়ে ফাইনাল হয়নি আংটি কেন রাখলো?”
বিরক্ত হয়ে বলল মাহমুদ।
” ধীরে বৎস ধীরে।”
হাত উঁচিয়ে সাধু,সন্নাসীর মতো বলল আনুশকা।
সে কলিদের বাসার সব ইতিবৃত্ত ভাইকে বুঝিয়ে বলল। মাহমুদ চিন্তিত সুরে বলল,
“তার মানে বিয়েটা মাকড়সার বাসার মতো ঝুলে আছে? যেকোনো সময় ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা বিপুল?”
“ইয়েস ব্রো। হান্ড্রেডপার্সেন্ট।”
“এখন আমার কি করতে হবে তাহলে?”
” কি বললাম এতক্ষণ? ওক্কে এগেইন রিপিট করি। কলির ফার্স্ট কথা হলো, তার বিলিভ হয়নি তুমি তাকে পছন্দ করেছো বিয়ে করার জন্য। দ্বিতীয় কথা হলো বিলিভ করলেও তার তোমাকে সেভাবে পছন্দ নয়। স্যার হিসেবেই দেখে তোমাকে সে।”
“তো আমার আংটি দিয়ে আসলি ক্যান? যা নিয়ে আয় গিয়ে।”
“এত ত্যাড়ামো করো কেন? এমন ভাবে তার সঙ্গে চলবা, যেন সে বিলিভ করতে বাধ্য হয় তুমি তাকে মন নয় শুধু, অস্থি,মজ্জা,পাঁজর,কলিজা,ফুসফুস, হার্ট,কিডনি, শিরা,উপশিরা, সব দিয়ে লাইক করো। এবং সেও যেন তোমাকে লাইক করে।”
আনুশকা চলে গেলে মাহমুদ তার ডায়েরিটা টেনে নিলো। একটানে লিখে ফেলল,
” আমার হৃদয়টা পোড়াতে এই অরণ্যহীন শহরে এত চন্দন কাঠ কোথায় পাও তুমি?”
তারপর ডায়েরিটা বন্ধ করে একপাশে ঠেলে রেখে দিলো মাহমুদ।
কলি আবার ভার্সিটি যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। মাহমুদের সঙ্গে চোখাচোখি হওয়ার জো রইল না আর। এই তীব্র সংকোচে তার প্রান উড়ে যাওয়ার দশা। মিসেস হেড কলিকে ফোন দিলো। কলি জানালো অসুস্থ। সুস্থ হয়েই ফিরবে ক্যাম্পাসে। এক সপ্তাহ পর কলি ক্লাসে গেলো। মাহমুদ বুঝতে পারলো বিষয়টা। তাই নিজেও কলির থেকে দূরে দূরে রইলো। কোন অযাচিত প্রসঙ্গ তুলে সামন্দ যাওয়া, কথা বলা, ফোন করা, মেসেজ দেওয়া সবকিছু থেকে নিজেকে বিরত রাখলো। এভাবেই পার হচ্ছে তার সময় ও দিন। তবে লুকানো নয়নে কলির প্রতি সুক্ষ্ম নজর রাখছে মাহমুদ।
তার পর একদিনের ঘটনা। বর্ষার এক বৃষ্টি ভেজা বিকেল। রাস্তাঘাট অন্যদিনের চেয়ে কিছুটা নিরব। বাস পাওয়া যাচ্ছে না। প্রচুর জ্যাম রাস্তায়। কলি ভার্সিটি থেকে বের হয়ে ছাতা মাথায় দিয়ে বাস স্টপেজ পার হয়ে ফুটপাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো। তার পথরোধ করে ফেলল দুটো যুবক ছেলে। তারা কলির সঙ্গে অশালীন কথা বলছে৷ এরা মাস্তান টাইপ। তাই কেউ কেউ দেখেও না দেখার মতো রইলো।
এক পর্যায়ে একজন ছেলে কলির বুকের উপর থেকে হ্যাঁচকা টানে ওড়নাটা নিজের হাতে নিয়ে পেঁচিয়ে নিলো। বলল,
“এভার যাও পারলে। প্রতিশোধ নিলাম। ওড়না পাবে না।”
কলি লজ্জায়,ঘৃণায়,আড়ষ্টতায় মিশে গেলো মাটির সঙ্গে। হাতের ব্যাগকে বুকে চেপে ধরে অসহায় ভঙ্গিতে অন্যদের সাহায্য চাইলো। কেউ এগিয়ে এলো না। কলি দাঁড়িয়ে রইলো ফুটপাতের কিনারা ঘেঁষে। ছেলেদুটো তার ওড়না নিয়ে বাইক চালিয়ে চলে গেলো। তাদের ধরার ও শায়েস্তা করার কোন সুযোগ নেই। কলি কেঁদে ফেলল।
পরক্ষণেই পিছন হতে কলির পিঠের উপর দিয়ে বুকের উপর ওড়নাটি মেলে দিলো মাহমুদ। কলি বিস্ময় ভরা কন্ঠে কাঁপা কাঁপা অধরে শুধালো,
মাহমুদ গিয়ে পৌঁছালো এড্রেস অনুযায়ী। যদিও খেয়াদের এই বাড়ি সে আগেও একবার দেখেছে। তবুও নিশ্চিত হওয়ার জন্য আবার জেনে নিলো। তিনতলা বাসায় প্রবেশ করেই মাহমুদ দেখলো সোফায় বসে আছে একজন বয়স্ক পুরুষ। সে সালাম দিলো।
“আংকেল আপনাকে আমার একটু চেনা চেনা মনে হচ্ছে। আপনার নাম যেন কি বলছিলেন সেদিন, ঠিক মনে করতে পারছি না।”
” আমি জাফর চৌধুরী। কিভাবে চেনা মনে হচ্ছে?”
” আপনার সঙ্গে একদিন দেখা হয়েছে পথচলায় আঙ্কেল। এটা বেশ কয়েকবছর আগের কথা।”
” একটু ধরিয়ে দাওতো। স্মৃতি ঘোলাটে হয়ে গিয়েছে। তাই সময় লাগছে। মনে করতে পারছি না।”
দ্বিধাজড়িত স্বরে বলল জাফর চৌধুরী।
মাহমুদের সব মনে আছে দিনের আলোর মতই স্পষ্টভাবে। সে প্রীত চোখে চেয়ে চমকানো সুরে বলল,
“প্রায় দশ বছর পূর্বের কথা আংকেল। আমি মাত্র ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন নিলাম। আমাকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন আপনি। প্লেস ধানমন্ডি আট। সময় বিকেলেবেলা। অকারণেই পুলিশ ভুল করে ভুল বুঝে সেদিন বিকেলে আমাকে ধরে ফেলল। এবং হট্রগোল বাঁধিয়ে ফেলল। আপনি সেই পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। পুলিশের জটলা দেখে আপনি দাঁড়ালেন। আমিই অসহায় কন্ঠে আপনার কাছে হেল্প চাইলাম।
মাহমুদের বলার মাঝপথেই খেয়ার বাবা তাকে থামিয়ে দিলেন। বললেন,
“ধানমন্ডির থানার ডি আই জি ছিলো আমার ঘনিষ্ঠজন। তাকে ফোন দিলাম। সে তোমাকে ধরা পুলিশকে ফোন দিলো। তারা তোমাকে ছেড়ে দিলো। তুমি অনেক আকুতি করে বললে আমি যেনো কাউকে বিষয়টা শেয়ার না করি। নয়তো কোনভাবে তোমার পরিবার জেনে যাবে। তাতে তোমার আদর্শবান শিক্ষক পিতার মর্যাদা ক্ষুন্ন হবে। ”
“ইয়েস আংকেল। ইয়েস! একদম রাইট। আপনার জন্যই পরে আর বেশি হেনস্তা করেনি পুলিশ আমাকে। আমি কি ঘাবড়ে নাই গিয়েছিলাম সেদিন।”
“স্বাভাবিক। তখন তোমার বয়সতো অল্প ছিলো। তোমাকেতো এখন আমি চিনতেই পারিনি বৎস! চেহারায় বেশ পরিবর্তন এসেছে। সেদিনের সেই টগবগে তরুণ ছেলেটা আজকের তুমি। বেশ সুদর্শন হয়েছো ইয়াংম্যান। আমার মেয়েটা এমনি এমনি ক্রেজি হয়নি। এখন বুঝলাম। আমি ওপেন মাইন্ডের লোক।সো ডোন্ট মাইন্ড। ”
” না না আংকেল। ঠিক আছে। আমিও আপনাকে দেখেই চিনতে পারিনি।সেদিন আপনার গোঁফ দাঁড়ি ছিল না।”
“হুম।রেখে দিলাম। মুসলমান আমরা। মৃত্যুর ভয়তো আছেই।”
যেদিন মাহমুদের সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে খেয়ার বাবার দেখা হয়েছিলো। সেদিন তার ক্লিন সেভ ছিলো। চোখে চশমা ছিল না। এখন মাহমুদ পাওয়ারজনিত সমস্যার কারণে চব্বিশ ঘন্টাই চশমা পরে থাকে। মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাঁটিগোঁফ।
মাহমুদ ও জাফরের কথোপকথনের ইতি ঘটে তনিমার আগমনে।
“বাবা খেয়া নড়ে উঠলো।”
উদ্বেগজনিত স্বরে বলল তনিমা।
“বাবা আগে একটু খেয়ার রুমে যাও। পরে ডিটেইলস জানাচ্ছি তোমাকে।”
“স্যার আপনি ওর পাশে বসে একটু হাতটা ধরেন। ওকে বোঝাবেন আপনি ওকে পছন্দ করেন। ভালোবাসেন। আমরা পরে সব বলছি আপনাকে।”
মাহমুদ হা হয়ে তাকিয়ে রইলো তনিমার দিকে। তার দু’চোখ দিয়ে যেন উষ্ণ ধোঁয়া বেরুচ্ছে। তনিমা দরজা চাপিয়ে রুমের বাইরে চলে গেলো। মাহমুদ কঠোর দৃষ্টিতে খেয়ার পানে চাইলো। খেয়ার চোখ বন্ধ। চিৎ হয়ে শোয়া। বিছানায় পড়ে আছে নির্জীবের মতো। হাত পা ছড়ানো। কোমরের উপর অবধি পাতলা একটি কম্বল দিয়ে ঢাকা। ঘুমের মেডিসিন দেয়া হয়েছে খেয়াকে।
মাহমুদ একটি চেয়ার টেনে খেয়ার মুখ বরাবর বসলো খাটের সামনে। দেখলো খেয়ার বুকে ওড়না নেই। গায়ে পাতলা একটি টিশার্ট জাতীয় কিছু। মাহমুদ নিজেই ইতস্ততবোধ করলো। না চাইতেই দৃষ্টি চলে যাচ্ছে খেয়ার বুকের দিকে। কি বিদঘুটে বিষয়। সে বিছানার আশপাশে খেয়ার ওড়না খুঁজেও পেলনা। বুঝে নিলো এই মেয়ে বাসায় তেমন ওড়না পরেই না। মাহমুদ আলতো করে খেয়ার গায়ের কম্বলটি বুকের উপর টেনে দিলো। এতেই খেয়া নড়ে উঠলো আবার। চোখের পাতা মেলে ধরলো। মাহমুদকে দেখেই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো অবিশ্বাস্য চোখে। মাহমুদের একহাত ধরে ফেলল নরম করে। মাহমুদ অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে গেলো। তবুও হাত সরিয়ে নিলো না। বরং নিজের একহাত খেয়ার হাতের পিঠে রাখলো। কারণ মৃত্যুপথযাত্রী কাউকে বাঁচানোর চেষ্টা করাও ফরজ। একজন মানুষ হিসেবে এই দায় প্রতিটি মানুষের উপরেই বর্তায়। এবং এটা নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব।
মাহমুদ এখানে বসে থাকলে হবে না। বাসায় যেতে হবে। তাই খেয়াকে হৃদ্যতাপূর্ণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“খেয়া পাগলামো করেন কেন? বাবা,মা কষ্ট পায়না? এই যে আমি আসলাম।”
খেয়া বিগলিত কন্ঠে বলল,
“স্যার আপনাকে কে আসতে বলল? কেন এলেন? আমি ঠিক আছি। আপনি চলে যেতে পারেন।”
মাহমুদ খেয়াল করলো,খেয়ার কন্ঠে গাঢ় অনুরাগ,অভিমান।
“আপনি ভালো থাকলে আমার কাছে ফোন গেলো কেন? রাত করে আসতে হলো কেন আপনাদের বাসায়?”
খেয়া চুপ হয়ে আছে শান্ত দিঘির জলের মতো। মাহমুদ খেয়ার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলো। বলল,
“আপনি থাকুন। আমি আসছি। বাসায় বলে আসা হয়নি। ড্রয়িংরুমে গিয়ে জানিয়ে দিই।”
মাহমুদ খেয়ার বেডরুম থেকে বেরিয়ে যায়। ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসলো। তার মাকে ফোন দিয়ে বলল,
“মা টেনশন করো না। আমি খেয়াদের বাসায় আসছি। এসে সব বলছি।”
মাহমুদকে খেয়াদের হেল্প হ্যান্ডিং মেয়েটা এসে ট্রে ভর্তি নাস্তা দিয়ে গেলো। সে খাচ্ছে না। বসে বসে ভাবছে। কি হবে,কি করবে সে।
তনিমা, খেয়ার বাবা, খেয়ার বড় ভাই সাহিল গিয়ে বসলো মাহমুদের পাশে। সবাই মিলে নাস্তা করলো। কথা শুরু করলেন খেয়ার বাবা।
“কিভাবে যে বলি বিষয়টা। খেয়া ছোটবেলায় তার মাকে হারায়। আমি আর দ্বিতীয় বিয়ে করিনি। সে খালাদের কাছে বড় হয়। পরে হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় হলে আমার কাছে নিয়ে আসি। ওর টেইক কেয়ারের জন্য একজন খালা সার্বক্ষণিক থাকতো আমাদের বাসায়। লক্ষ্য করি ও দিনে দিনে একরোখা,বেয়াড়া,জেদী হয়ে উঠে। বিশেষ করে যেটা চায় সেটা না পেলে সে অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে। আমরা সাইক্রিয়াটিস্ট এর শরনাপন্ন হই।
ডাক্তার বলল,
এটা ওর একটা মেন্টাল ডিজিজ। এটার চিকিৎসা হলো ওকে ওর মতো করে থাকতে দেওয়া। বাঁচতে দেওয়া। মাকে হারানোর জন্য সে কোনকিছু না পাওয়া, ব্যর্থ হওয়া, হারানোর বিষয়টা নিতে পারেনা। সেটা ব্যক্তি হোক আর বস্তু হোক। যাইহোক চলছে সব মোটামুটি। কিন্তু ইদানীং সমস্যাটা প্রবল আকার রূপ নিলো। গ্লাস ছুঁড়ে মারছে। ব্লেড দিয়ে হাত কেটে ফেলছে। পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে যাচ্ছে। যার ফলস্বরূপ এই সেমিস্টার রেজাল্ট খারাপ হলো।
এবং এগুলো হচ্ছে তোমার জন্য। না না। আমরা তোমাকে ব্লেইম দিয়ে বলছি না। বলার জন্য বললাম। তোমাকে খেয়া অনেক ভালোবাসে। যা জানলাম আমার বৌমা তনিমার কাছ থেকে।
হ্যাঁ মাহমুদ, আমি জানি পৃথিবীতে জোর করে সব করা গেলেও ভালোবাসা,অনুভূতি জোর করে আদায় করা যায়না। কিন্তু আমি ও আমরা তোমাকে বলতে চাই, তুমি যদি একটু মন বসাবার চেষ্টা করো ভিতর থেকে। হয়তো পারবে। মানুষের অসাধ্য কি আছে বলো। এমন বহু বিয়ে হয় ছেলে মেয়ের অমতে। পরে দেখা যায় সংসার করতে করতে মন বসে যায়। কিছুদিন পাশে থাকলে কুকুর, বিড়ালের উপরেওতো আমাদের মায়া জন্মে যায়। আমার লজিক ভুল নাকি বলো?”
পাশ থেকে তনিমা ও সাহিল বলল,
” বাবার কথাই আমাদের কথা। আমরা কেবল চাই আপনি খেয়াকে বিয়ে করুন। এবং ওকে ভালোবাসার চেষ্টা করুন দয়া করে। আপনার পারিবারিক স্ট্যাটাসের সঙ্গে আমাদের পরিবার মানানসই।”
জাফর চৌধুরী করুণ চাহনিতে বসে রইলেন পায়ের উপর পা তুলে।
তনিমা বলল,
“আজতো সন্ধ্যায় আমরা না দেখলে তার প্রানবায়ু বের হয়েই যেতো। তার সুইসাইড সফল হয়নি অল্পের জন্য। পায় ঝুলেই গিয়েছিলো সিলিং ফ্যানটার সঙ্গে। পড়ে ও গিয়ে ডাক্তার নিয়ে এলো বাসায়। ঘুমের ট্যাবলেট খাইয়ে দিতে বলল ডাক্তার। সে কিছু চেয়ে পায়নি এই ব্যর্থতা কেন জানি সে হজম করতেই পারেনা। তখন সে নিজেকে অনেক ক্ষুদ্র মনে করে। অযোগ্য মনে করে। আমরা আপনার বিষয়ে ওকে অনেক বুঝিয়েছি। কিন্তু ও মানতেই চায়না। আপনার প্রতি খেয়া সিরিয়াস রকমের অবসেস।”
সবকিছু শুনে মাহমুদ জমে গেলো বরফখন্ডের ন্যায়। গ্রীষ্মের এই খরতাপেও তার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেলো সর্পিল গতিতে। বহুবছর আগে যেই মানুষটা তাকে অনেক বড় বিপদ থেকে রক্ষা করলো। আজ এতটা বছর পরে এসে সেই প্রতিদান কি তাকে এভাবেই দিতে হবে?
খেয়ার বাবা নিদারুণ কন্ঠে বললেন,
” খেয়া যখন নিশ্চিত হবে তোমাকে কোনদিন পাবে না। তখন সে নিজেকে শেষ করে দিবে। এখন এনগেজমেন্ট হয়ে থাকুক না হয়। তোমার সুবিধা অনুযায়ী বিয়ে হবে। তাও খেয়া ভালোথাকবে। বুঝে নিবে যখনই হোক তুমি তারই হবে। আসলে বাবা হয়ে এসব বলতে আমারো বাধছে। কিন্তু আমরা নিরুপায়। আজতো এই সিচুয়েশন দেখে তনিমা বলল,
স্যারকে আনান। নয়তো রাতে আবার এক্সিডেন্ট ঘটে যেতে পারে।”
মাহমুদ বিপন্ন মুখে বলল,
” আচ্ছা আংকেল আমি বাসায় গিয়ে আলাপ করি আগে। এটা পুরো জীবনের বিষয়। হুট করে ডিসিশন নেয়া ঠিক হবে না। এখন উঠি আমি।”
“বাবা হুট করে হবে কেন? আমরা তোমার পরিবারের সঙ্গে আলাপে বসবো। তুমিও সময় নাও। ”
সাহিল বলল,
“আমি ক্লিয়ার করছি মাহমুদ ভাই। খেয়া আপনার স্টুডেন্ট। ভার্সিটি বলেন বা বাইরে বলেন আপনি আপাতত মিথ্যা করে হলেও খেয়াকে বোঝাবেন,আপনিও খেয়ার প্রতি অনুরক্ত। খেয়াকে পছন্দ করেন। তবেই আমার মা হারা একমাত্র আদরের ছোটবোনটা হাসিখুশি থাকবে। আপনার একটু সদয় আচরণ,সান্নিধ্য, কিছুক্ষণ গল্প করায় যদি একজন মানুষের জীবনটা ভালোভাবে বেঁচে যায়। তাতে আপনারও ভালোলাগার কথা। পৃথিবীতে কয়জন মানুষের হাতে এমন সুযোগ আগে কাউকে বাঁচিয়ে তোলার। ভালো রাখার। বলেন?”
মাহমুদ প্রতুৎত্তরে কিছুই বলল না। পাথর চোখে তাকালো সাহিলের দিকে।
তনিমা বলল,
“ভাইয়া যাওয়ার আগে খেয়াকে একটু বুঝিয়ে যান। ওর আনন্দে থাকার মেডিসিন আপনি। শুরু থেকে সব একবার চিন্তা করুন। রিয়েলাইজ করতে পারবেন একটা মেয়ে আপনাকে কতটা চায়। এমন করে আর দ্বিতীয় কোন মেয়ের হৃদয়ে আপনি বাস করতে পারছেন? এটা সৌভাগ্য হিসেবে ধরে নিন।”
মাহমুদ শক্ত চোয়ালে উঠে দাঁড়ালো। খেয়ার রুমে চলে গেলো গম্ভীর মুখে। খেয়ার পাশে বসলো। হাত ধরে বলল,
“খেয়া আমি আসি। ফোনে কথা হবে আমাদের। আমি হারাব না। এবার ভালো থাকবে অবশ্যই। ”
খেয়া ম্লান হাসে মাহমুদের মুখপানে চেয়ে৷
মাহমুদ নিজেকে সামলে অতিকষ্টে বাসায় এসে নিজের রুমে প্রবেশ করে। বিছানায় ধপাস করে পড়ে। মাথার চুল খামচি দিয়ে ধরে। ক্ষোভে, যন্ত্রণায় দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে তার হৃদয়টা।
মাহফুজা টের পেলেন ছেলে বাসায় এলো। তিনি ছেলের রুমে এলেন।
চিন্তাগ্রস্ত স্বরে কপাল ভাঁজ করে জিজ্ঞেস করলেন,
“কিরে মাহমুদ কি হলো? কি বিপদ তাদের? গেলি কখন? এলি এখন। রাত কয়টা বাজ?”
“খেয়াকে বিয়ে করতে হবে মা। নইলে ও মরে যাবে।”
বরফ শীতল গলায় মায়ের মুখপানে তাকিয়ে বলল মাহমুদ।
চলবে…১২
#তোমার_জন্য_সব *১৩
✍️ #রেহানা_পুতুল
বরফ শীতল গলায় মায়ের মুখপানে তাকিয়ে বলল মাহমুদ।
মাহফুজা শুকনো মাটিতে আছাড় খাওয়ার মতো নড়ে উঠলেন। দাঁড়ানো থেকে চেয়ার টেনে বসলেন। বুঝলেন ছেলের মুখ নিসৃত বাক্যটি ক্ষোভের ও অধৈর্য্যের।
তিনি বিস্মিত গলায় ছেলেকে শুধালেন,
“কোন এককালে উপকার করেছে বলে তোর মাথা কিনে ফেলেছে নাকি। এরা গোটা পরিবার মেন্টাল। পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হওয়া দরকার এদের। যত্তসব আজাইরা যুক্তিখণ্ডন। এটা বাংলা সিনেমা? নায়কের উপকার করলো। এবার ধনীর অবুঝ দুলালীকে বিয়ে করে সেই ঋণ পরিশোধ করো। পথ চলায় এমন উপকার মানুষ মানুষের করেই। এর চেয়ে বড় বড় উপকার তোর বাবা মানুষের করেছে। আমি করেছি। কিন্তু আমরা কোন প্রতিদান আশা করিনি। এখন একবিংশ শতাব্দী। যুগ অনেক এগিয়ে। বহু মনোচিকিৎসক রয়েছে। চিকিৎসা করাক। দেশের বাইরে নিয়ে যাক মেয়েকে। তারাতো পয়সাওয়ালা।”
“মা থামোতো। এমন শুরু করেছ,মনে হচ্ছে বিয়ে হয়ে গেলো।”
“শোন,তুই আর কোন যোগাযোগ করিস না। তারা বা সেই মেয়ে করতে চাইলে বাহানায় এড়িয়ে যাবি।”
মাহমুদ মায়ের বোঝার জন্য বলল,
“প্রথমে তোমরাওতো খেয়া মেয়েটাকে পছন্দ করেছো।”
“করছি বলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়নাই। আমরাতো তাদের কোন পাকা কথাই দেইনি। আমি শীঘ্রই তোকে বিয়ে করাবো। এরপর দেখি সেই মেয়ে কি করে। আমাকে মেয়ে ও তার বাবার নাম্বার দে। কিছু কথা শোনাবো।”
“একজন পারে না বাসায় চলে আসে। আরেকজনের সঙ্গে ত কথাই বলা যাচ্ছে না দুনিয়ার সব ইগো,আত্মসম্মান, পারসোনালিটি নিয়ে বসে আছে উনি।হুহ্! আমি ভেবে জানাবো মা।”
” ঠিক হয়ে যাবে। সময় লাগবে। আমি।গেলাম। ঘুমাবো। টেনশন করিস না। ঘুমায়া পড়।”
মাহমুদ খিটখিটে মেজাজ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
বিকেলের অবসরে কলি তার রুম লাগোয়া এক চিলতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সামনে দৃষ্টি প্রসারিত করলেই দেখা মেলে এক টুকরো উদার আকাশ। আজ আকাশের মন ভালো। তাই তার বুকে নেই কোন নীল মেঘের আনাগোনা। কেবলই থোকায় থোকায় গুচ্ছ পুষ্পরাশির ন্যায় সাদা মেঘপুঞ্জগুলো আপন মনে ভেসে বেড়াচ্ছে। তার বুক চিরে দু’ডানা মেলে উড়ে গেলো একটি অচেনা পাখি। একেলা পাখিটির মাঝে নীড়ে ফেরার তাড়া।
সঙ্গীর বিরহে পোড়া বিরহী প্রেমিকার মতো আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কলি। তার কোন প্রেমিক বা ছেলেবন্ধুও নেই। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে মেয়েদের জীবনে এসব আসার ফুরসত নেই। তাদের সময় কাটে,বেলা ফুরোয় যাপিত জীবনের রোজকার হিসেব মেলাতেই।
তখনই উড়ে এসে জুড়ে বসার মতো কলির ভাবনায় ঠাঁয় পেলো একটা বিষয়। মনে পড়লো মাহমুদ স্যারের মায়ের কথা। এক মিস বিহেভিয়ারের জন্য কম মাশুল দেয়নি স্যার। যথেষ্ট হয়েছে। শোধবোধ। উনার মা মিসেস মাহফুজা। এই নারীটি যেমন প্রাণোচ্ছল। তেমনি মমতায় ঘেরা তার অন্তরখানি। স্যারের বিয়েতে শুধু দাওয়াত নয় তাকে নিয়েই ছাড়বে এই স্নেহময়ী জননী। গায়ে হলুদ থেকে শুরু করে বিয়ের দিন,বৌভাত সবকিছুতেই হাস্যোজ্জ্বল উপস্থিতি থাকতে হবে তার। কি পরবে তখন। এত আয়োজনে পরার মতো ভিন্ন ভিন্ন ড্রেস কই? টাকাও কই? উপহারই বা কি দিবে? ত্রিশ দিন কাটাতে হয় যাদের হিসেব করে করে। সেখানে বিয়ের মতো আনন্দোৎসবে অংশগ্রহণ করার কথা কল্পনা করা তার জন্য বিলাসিতার নামান্তর।
আচ্ছা স্যারের বিয়ে কবে। কিঞ্চিৎ কৌতুহল জাগলো কলির মনে। এনগেজমেন্ট হয়ে গেলো নাকি। ক্লাসে এগুলো বলবে না স্যার। স্বাভাবিক। নিজের প্রয়োজনেই জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে হবে স্যারের থেকে। তাহলে হয়তো যতটুকু সম্ভব আগে থেকে একটু পিপারেশন নেওয়া যাবে। হুট করে ইনভাইটেশন পেয়ে গেলে বিপাকে পড়ে যাবো। তবে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করা যাবে না। এতে স্যার ধরে নিবে আমি তার বিয়ে খেতে উৎসুক হয়ে আছি। তার মাতো ছাড়বে না আমাকে। তাই জেনে নেওয়া। ভার্সিটি গেলে কথাপ্রসঙ্গে টপ করে জিজ্ঞেস করে ফেলবো।
কলির ভাবনায় ছেদ ঘটে রেবেকার আগমনে।
“হ্যাঁরে কলি তুই এখন কোন বর্ষে?”
“এটাতো সরকারি ভার্সিটি নয় আম্মু। এখানে সেমিস্টারের হিসাব। তোমার বোঝার সুবিধার্থে বলছি। আমি এখন তৃতীয় বর্ষে আছি অর্থাৎ সেভেন সেমিস্টারে আছি। কিন্তু কেন আম্মু বলতো?”
“নাহ এমনিই জানতে মন চাইলো।”
মলিন হেসে বলল রেবেকা।
কলি জানে মা কেন এটা জিজ্ঞেস করেছে। কারণ একটাই। তার পড়াশোনা যত দ্রুত শেষ হবে। তত দ্রুত একটা চাকরি করবে মেয়ে। টানাপোড়েন কমে আসবে সংসারে। কলি মাকে মোলায়েম স্বরে বলল,
রেবেকা চলে যায়। খানিক পর ফিরে আসে। কলির দিকে প্রেসক্রিপশনটা বাড়িয়ে দেয়। ধূসর মুখে চলে যায় পা ঘুরিয়ে।
কলির চোখ ভিজে উঠে আজ মাকে দেখে। ভাবে সংসারে এই মা নামক প্রাণটির কত ত্যাগ! কত যন্ত্রণা! নিরবে কত রোগ শোক বয়ে চলা স্রোতস্বিনী নদীর মতো। কলি সন্ধ্যার পর আসতে মায়ের ঔষধ নিয়ে এলো।
মাহফুজা পরেরদিন মেয়েকে ফোন দিলেন। যদিও স্বামীকে শুনান নি। অযথা টেনশন ঘাড়ে দেওয়ার মানে হয়না রিটায়ার্ড করা লোকটাকে। সব বললেন মেয়েকে। শুনে আনুশকা মাকে উপদেশের ভঙ্গিতে বলল,
“বুঝলাম। যেহেতু তোমার এতই পছন্দ ফুটন্ত কলিকে। অপরদিকে ভাইয়ার সঙ্গে কলির টিচার স্টুডেন্ট সম্পর্ক। এর বাইরে বাড়তি কোন সখ্যতা নেই। তাহলে একটু সময় নাও। ভাইয়া ট্রাই করে দেখুক, ভাব জমানো যায় কিনা। আর পারসোনালিটির জন্য যদি ভাইয়া না পারে এডভান্স হতে। তাহলে আট দশটা বাঙালী মেয়ের মতো বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে হবে তাদের বাসায়। যাও বিনা ভিজিটে এডভাইস দিয়ে দিলাম। সফল হলে আমায় ট্রিট দিতে বলবা তোমার একমাত্র পুত্রধনকে। ”
“এমন করে বলিস কেন? ফাজিল মেয়ে। তুইওতো আমার একমাত্র মেয়ে।”
“আম্মু কলিকে বাসায় আরেকদিন নিয়ে আসতে বলনা ভাইয়াকে। আমি দেখবো ভালো করে বিয়ের পাত্রী হিসেবে। ”
“একবার আসছে। আর আসবে নাকি। আল্লায় জানে। আচ্ছা আমি বলছি তোর ভাইকে।”
মাহফুজা দেরী করলেন না। মাহমুদকে আনুশকার আবদারের কথা জানালেন। মাহমুদ বলল,
“আমি হার্ডলি ট্রাই করবো। তবে মনে হয়না কাজ হবে।”
“আচ্ছা দেখ। আমার কথা বলিস।”
দু’দিন পর মাহমুদ ক্লাসে গিয়েই খেয়াকে খুঁজলো মনে মনে। দেখলো খেয়া আসেনি ক্লাসে। এই ভিতরে তাদের থেকে কোন ফোনও,আসেনি তার কাছে। স্বস্তির দম ফেলল মাহমুদ। নয়তো ক্লাসেও হয়তো সবার সামনে সিনক্রিয়েট করে বসতো খেয়া। মাহমুদ দেখলো কলি এসেছে ক্লাসে। অফিসে গিয়ে কলিকে মেসেজ দিলো।
“ক্লাস শেষে অফিসে আসবেন।”
কলি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে মাহমুদের।
“স্যার ডেকেছেন?”
“হুম। আমার ছোট বোন আনুশকা আপনাকে দেখতে চেয়েছে। কিবোর্ড এ আঙ্গুল চালাতে চালাতে ব্যস্ত সুরে বলল মাহমুদ। ”
কলি নির্বোধের মতো হেসে বলল,
“কারণ?”
“কারণ আপনার আন্টির অতিরিক্ত প্রশংসা আপনাকে নিয়ে।”
“ওহ বুঝলাম। বাসায় যাব না স্যার। উনি বাইরে আসুক না। সমস্যা কি? বাইরেই কোন কফিশপে আড্ডা দেওয়া যাবে।”
“ওহ সিউর কলি। তাই হবে। ম্যানি ম্যানি থ্যাংকস আমার আদরের ছোট বোনের ইচ্ছে পূরণ করার জন্য।”
” কারেকশন প্লিজ স্যার। ইচ্ছেটা এখনো পূরণ হয়নি। ও হ্যাঁ স্যার, খেয়া আর আপনার বিয়েটা কবে যেন?”
মাহমুদ হেসে ফেলল। বলল,
“কেন আসবেন নাকি?”
“আমি ইনভাইট পাবো নাকি?”
স্মিত হেসে বলল কলি।
“আপনার আন্টি আপনাকে ছাড়া আমার বিয়ে সম্পূর্ণ করবে না। এনিওয়ে, সেদিন রেস্টুরেন্টে আপনাকে নিলাম খেয়ার বিষয়ে কিছু কথা বলার জন্য। কিন্তু বলা হলো না। এখন আসুন না সময় থাকলে। এখানে এতক্ষণ কথা বলা দৃষ্টিকটু।”
“আন্টির কথায় আমি সহমত। এক পাক্ষিক ভালোবাসায় কোন পূর্ণতা আছে কি? এজ আর এজ পসিবেল আপনি বিয়ে করে ফেলুন। তখন ডাবল আপনাকে সিংগেল খেয়া আর বিরক্ত করবে না।”
“হুম করবো। মায়ের একটা মেয়েকে পছন্দ। তাদের বাসায় প্রপোজাল পাঠাবে বাবা। মা বলছে তার সঙ্গে আগে একটু ফ্রেন্ডশিপ করার চেষ্টা করতে। আমার মতো বোরিং ছেলের সঙ্গে কোন মেয়ে ফ্রেন্ডশিপ করবে বলেন?”
“আপনি চিনেন তাকে?”
মাহমুদ ধরা না পড়ার জন্য বলল,
“নাহ। মা বলল পরিচয় করিয়ে দিবে।”
“ভালো তো। সেটাই করুন। স্যার উঠি। বাসায় যেতে হবে।”
“বাইকে যেতে আপত্তি?”
“হ্যাঁ স্যার। ঘোর আপত্তি।”
কলি উঠে গেলো তাড়া করে। নিচে নেমে গেলো। বাস এলে উঠে গেলো ভীড় ঠেলে। মাহমুদ বিল মিটিয়ে দ্রুত নেমে এলো। কলিকে দেখতে পেল না। ভারী মুড নিয়ে বাসায় চলে গেলো মাহমুদ। বুঝলো কলির সঙ্গে এভাবে এগোনো এভারেস্ট জয়ের মতো। আবার নিজেও সরাসরি কিছু বলতে পারছে না। ব্যক্তিত্বে ভাটা পড়ে তাহলে। টিচার না হয়ে অন্য পেশায় হলে হয়তো বলা যেতো।
গ্রীষ্মঋতু শেষের দিকে। বরষার আগমনী সংকেত প্রকৃতিজুড়ে। এমন এক আলো আঁধারির শেষসন্ধ্যায় রেবেকা তাড়া দিলো কলিকে। পাশ থেকে নুরুল হকও বলে উঠলেন,
“কিরে মা। শাড়ি পরা হয়েছে? পাত্রপক্ষ এসে পড়বে যে। ”
রেবেকা ফের বলে উঠলো আশাবাদী কন্ঠে,
“সুন্দর করে রেডি হয়ে নে কলি। তারা বলছে দু’পক্ষের সবার পছন্দ এক হলে আজই তারা আংটি পরিয়ে দিবে।”
কলি মেঘমন্দ্র মুখে বিড়বিড়িয়ে বলল,
“আমার পছন্দের খেতা পুড়ি। এক জীবনে যার একজন ছেলে বন্ধু জুটল না কপালে। তার আবার বিয়ের পাত্র পছন্দ। তার পছন্দের গুরুত্ব থাকলে এই কাহিনী করতে না তোমরা আমার সঙ্গে।”