Tuesday, July 29, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 60



ফুলকৌড়ি পর্ব-০৩

0

#ফুলকৌড়ি
(৩)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

কৌড়ির একটা বিষমে গোটা বাড়ির লোক একজায়গায় হয়ে গেলো।বিষম লেগে কাশতে কাশতে গলা দিয়ে রক্ত উঠে যাওয়ার উপক্রম হলো তবুও কিছুতেই বিষম ছাড়তে চাইলোনা।তখন ছোটো ছোটো হাতে নাফিমকে পানি নিয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে,গ্লাসটা তার হাত থেকে তড়িঘড়ি করে নিয়ে পানি খেতে গিয়ে এই বিষমের উৎপত্তি।যা এখন রূপ নিয়েছে প্রাণনাশ করা কাশিতে।কৌড়ির বিষমের কাশিটা প্রথমে কানে যায় মান্যতার।কৌড়ির রুমে এসে দেখে কৌড়ি অনবরত বুক চেপে কেশে চলেছে।গালে হয়তো ভাতের লোকমা ছিলো,সেগুলো মেঝোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।আর নাফিম ভয়ার্ত গলায় তাকে এটাওটা বলে চলেছে।দৌড়ে এসে কৌড়িকে ধরতেই নাফিমকে বকতে থাকলো সে।

‘এই তোকে না বলেছিলাম,ওকে একদম ডিস্টার্ব করবি না।নিশ্চয় তোর আবোলতাবোল বকার কারনে এই অবস্থা ওর।

আরও এটা-ওটা বলতে থাকলো মান্যতা।নাফিম শুধু বাচ্চামো অসহায় গলায় বললো’সত্যি বলছি আপু,আমি আজ আবোলতাবোল বলিনি।আর কিচ্ছু করিও নি।মান্যতাকে বকতে দেখে,কাশতে থাকা গলায় কৌড়ি-ও নাফিমের কথা মেনে বলতে চাইলো,ছেলেটা সত্যি বলছে,আপু।ওকে কিছু বলবেন না,ও কিছু করেনি।তবে গলা দিয়ে শব্দ বেরই করতে পারলো-না।
শুধু মাথা ঘনঘন নাড়িয়ে মান্যতা বকতে নিষেধ করলো। মান্যতা সেটা বুঝুলো কি বুঝলো না,কৌড়ির কাশি না থামতে দেখে এবার জোর গলায় মা’কে ডাকতে থাকলো।একপর্যায়ে মান্যতার গলার জোরালো স্বর শুনে সবাই এসে হাজির হলো কৌড়ির থাকতে দেওয়া ঘরে।সান্ত্বনা রহমান এসেই তড়িঘড়ি কৌড়ি পাশে বসতে বসতে, ছেলেকে ভয়ার্ত নজরে দাড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা আন্দাজ সরূপ ছেলেকে বকতে থাকলেন।সেটা শুনে সেই অনবরত কাশি গলায় কৌড়ে কোনোমতে বাধোবাধো স্বরে বললো।

‘ও কিছু করেনি,ওকে বকবেন না।

নাফিমকে ছেড়ে কৌড়িকে নিয়ে ব্যস্ত হলো সবাই।মাথায় হাত বুলানো,ফের পানি খাওয়ানো কোনো কিছুতেই জেনো কাশি কমলোনা কৌড়ির।একপর্যায়ে নীহারিকা বেগম এসে,কৌড়িকে নিজের সাথে জাপ্টে ধরে তার পিঠের মেরুদণ্ডে মৃদুভাবে হাতের তালু দিয়ে আঘাত করতেই আস্তে আস্তে বিষম ছেড়ে জোরালো কাশি থেকে মৃদু কাশিতে পরিনত হলো কৌড়ির।ততক্ষণে গলা চিরে রক্ত বের হয়ে গেছে।এখানো ছেড়ে ছেড়ে কেশে চলেছে সে।সেই অবস্থায় নীহারিকা বেগমেকে শক্তপোক্ত করে দু’হাতে জাপ্টে ধরে, গলা ছেড়ে কেঁদে দিলো।গলা দিয়ে যদিও কথা বের করতে কষ্ট হলো তবুও কান্নরাত ভাঙা ফ্যাসফ্যাসে স্বরে বললো।

‘আমি খেতে পারছিনা,গলায় প্রচন্ড ব্যথা করছে।গলা দিয়ে কিছুতেই খাবার নামতে চাইছেনা আমার।আমি পারছিনা খেতে…

ফুপিয়ে কেঁদে চললো কৌড়ি।দীর্ঘশ্বাস ফেললেন নীহারিকা বেগম।মমতাময়ী স্পর্শে নিজের সাথে আগলে নিলেন কৌড়ি কে। ফের মাথায় হাত বুলাতে থাকলেন,তবে সান্ত্বনা সরূপ একটা বর্নও মুখ দিয়ে বের করলেন না।স্বান্তনা সরূপ কি বানী দেবেন মেয়েটাকে,এটাই জেনো ততক্ষণাত মাথায় এলো না উনার।তবে রুমের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা রানিসাহেবাকে বললেন।

‘রানী,ওর জন্য গরম স্যুপ জাতীয় কিছু বানিয়ে নিয়ে এসো।পাতলা করে সুজি রান্নাও করতে পারো।যাও….

‘আমি আর কিচ্ছু খেতে চাইনা।

কান্নারত কৌড়ির কথার বিনিময়ে নীহারিকা বেগম কিছুই বললেন না।শুধু রানিসাহেবাকে চোখ দিয়ে ইশারা করলেন যেতে।মেয়েটার শরীর কাঁপছে,ক্ষুধায় কাঁপছে নাকি অতিরিক্ত কাশতে কাশতে ছেড়ে দেওয়ার কারনে বুঝতে পারলেন না তিনি।তবে ক্ষুধার জন্য এটাই উনার মনে হলো।কারন উনাক জড়িয়ে ধরা মেয়েটার হাত দুটো খুবই দূর্বল আর নিস্তেজ মনে হচ্ছে সাথে, শরীরটাও ভিষণ হালকা লাগছে।

ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত কৌড়ি নিশ্চুপ নীহারিকা বেগমের কাঁধে মাথা রেখে বসে রইলো।আর ঘরে উপস্থিত ব্যক্তিগুলো সবাই অসহায় নজরে তারদিকে তাকিয়ে রইলো।কি শান্ত ফুটফুটে একটা মেয়ে,তার মানসিক পরিস্থিতি সবাইকে জেনো ভিতর থেকে বেশ ব্যথিত করলো।

.

কৌড়িকে থাকতে দেওয়া হয়েছে নিচের একটি ঘরে।সেই ঘর থেকে বের হয়ে রানিসাহেবা দ্রুত পায়ে কিচেনের দিকে চলে গেলেন।আর তার পিছে ধীরপায়ে বের হলো নাফিম।মাথা নিচুকরে ছেলেটা এগিয়ে সিঁড়িপথ ধরলো।শেষ সিঁড়িটা পার করে দোতলার টানা বারান্দার পা রাখতেই,নজরে পড়লো স্থির মোটাসোটা একজোড়া পা। তড়িৎ গতিতে বুঝতে পারলো পাজোড়া কার?মুখ উচু সেই ব্যাক্তির দিকে তাকালো নাফিম।সবসময়ের শক্ত চোয়ালের শীতল নজরখানা নজরবিদ্ধ হলো।কালো ট্রাউজার আর এ্যাশ কালারের টিশার্ট পরা পাহাড়ের মতো উঁচু লম্বা মানুষটা সটান দাঁড়িয়ে আছে।নাফিমকে তাকাতে দেখে মূহুর্তেই প্রশ্ন করলো সামনে স্থির দাড়িয়ে থাকা মানুষটি।

‘সবাই ওভাবে ছোটাছুটি করে ও রুমে গেলো কেনো?কি হয়েছে নাফিম?

দাদাভাই এরকম ভয়ংকর গম্ভীর গলায় সবসময় কথা বলে কেনো বুঁজে আসেনা নাফিমের।এভাবে কথা বললে তার যে সহজ কথাও গুলিয়ে যায় এটা জানেনা দাদাভাই? কেনো ছোটো দাদাভাইয়ের মতো তার সাথে একটু সহজ গলায় কথা বলতে পারেনা।

‘আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি নাফিম?

‘আমার ফুলকৌড়ি ভাত খেতে পারছে-না।খেতে গিয়ে বিষম লেগেছে। তাই কাঁদছে?

‘আমার ফুলকৌড়ি মানে?

থতমত খেলো নাফিম।কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে মূহুর্তেই জেনো ভুলে বসলো সে।কথা শুধরে নিতে ফের চটপট গলায় বললো– আমার নয়,তোমার ফুলকৌড়ি।

‘আমার ফুলকৌড়ি!

সময় নিয়ে ধীরকন্ঠে বাক্যগুলো উচ্চারণ করল নিভান।মুহূর্তেই গভীর কালো-বাদামী মিশেলে নজরজোড়া আর-ও শীতল হলো তার।সেটা দেখে আর-ও ঘাবড়ে গেলো নাফিম।নিজের কথার ভুলটা বুঝতে পেরে চোখ মোটামোটা করে ফেললো সে।ফের চুপসে যাওয়া গলায় ধীরেধীরে বললো।

‘আমার ফুলকৌড়ি তোমার ফুলকৌড়ি,কারও নয়।ওই যে মেয়েটাকে তখন তোমার সাথে নিয়ে আসলে না।আমি তারই কথা বলছি।আর ওর নামই ফুলকৌড়ি।

চুপসানো গলায় কথাগুলো কোনোরকমে একটানা বলে ফাঁকফোকর খুঁজলো কোথা থেকে দৌড় দেবে সে।তবে দাদাভাই নামক পাহাড়ের মতো দেখতে উচু লম্বা মানুষটাকে পাশ কাটিয়ে দৌড় দেওয়া-ও সহজ কথা নয়।তাই নিভানো গলায় ফের নাফিম বললো।

‘দাদাভাই আমি যাই?

একটু চমকালো নিভান। যদি-ও চমকানোর কথা নয়।তবুও, গড়ীতে বসা মাথা নিচু করে নিঃশব্দে কেঁদে যাওয়া সেই রমনীর কথা হঠাৎই মনে পড়ে গেলো তার।তখন পাশে না তাকিয়েও অনুভব করতে পেরেছিলো, মেয়েটার কাঁদছে। আর সারাপথ কেদেছে এটা-ও তার অজানা নয়।তবে আশ্চর্যের বিষয় হলেও,মেয়েটার সাথে তার কোনো প্রকার কথা হয়নি।

‘দাদাভাই যাবো?

‘হুমম।

হাঁপ ছেড়ে বাচলো জেনো নাফিম।এক সেকেন্ড-ও দাঁড়ালো না।দৌড়ে চলে গেলো সে।নাফিম চলে যেতেই
নিচে ঘরটার দিকে একপলক তাকিয়ে নিজের রুমের দিকে প্রস্থান করলো নিভান।যাবার আগে মৃদুস্বরে একবার আওড়ালো,–ফুলকৌড়ি।অদ্ভুত নাম।

দোতলার খোলা বারান্দার ওমাথায় দাঁড়িয়ে দিবা লক্ষ্য করলো নাফিমের সাথে নিভানের কথা বলাকে।কাছে এগোতেই নিভানের প্রশ্নগুলো না শুনলেও,নাফিমের বলা চঞ্চল্য স্বরের কথাগুলো শুনতে পেলো এবং বুঝতে পারলো কার বিষয়ে কথা বলছে নিভান।নিভান,মেয়েটা সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছে!মন কিছুতেই মানতে চাইলো-না তার।এবাড়িতে তো মেয়েটার ভালোমন্দের খোঁজ নেওয়ার অনেক মানুষ আছে,তবে নিভানকে কেনো খোঁজ নিতে হবে?খোঁজ না নিলে হচ্ছে না তার।তবে কি মেয়েটার প্রতি ইন্টারেস্ট হয়ে পড়লো নিভান?তবে কি করবে সে?

.

‘হঠাৎ মেয়েটার কি হয়েছিলো?

নীহারিকা বেগম ঘরে ঢুকতেই বেডের উপর শয়নরত জাহিদ হাসান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে স্বামীর কাছে এগোলেন তিনি।পাশ গিয়ে বসতেই বললেন।

‘অতিরিক্ত কান্নাকাটির ফলে গলায় ব্যথা করে ফেলেছে তাই খাবার খেতে গিয়ে গলায় আটকিয়ে গিয়েছিলো।সেই খাবার গিলবার জন্য তারাহুড়ো করে পানি খেতে গিয়ে বিষম লাগিয়েছে।

‘এখন কি অবস্থা?

‘এখন ঠিক আছে।তবে ভাত খেতে পারিনি।পাতলা করে সুজি রান্না করে দিয়েছে রানি।তাই খাইয়ে,ঔষধ খাইয়ে শুইয়ে দিয়ে আসলাম মেয়েটাকে।ওর ঘুমানো প্রয়োজন। কাল থেকে ঘুমিয়েছে বলে তো মনে হয় না।ঘুম হলে শারিরীক, মানসিকভাবে অনেকটা সুস্থতাবোধ করবে। ঠিক হয়ে যাবে।

‘মান্যতা আর মৌনতাকে ওর সাথে একটু সময় কাটাতে বলো।মাইন্ড ফ্রেশ থাকবে, বাড়ির দিকের কথা আর সেভাবে ততোটা খেয়ালে আসবে-না।এখন কাকে রেখে এসেছো ওর কাছে?মেয়েটার যা বিধস্ত অবস্থা, একলা ঘরে মেয়েটা আবার ভয় পায় কিনা তার ঠিক নেই।

‘আপনি চিন্তা করনেন না আমি মান্যতাকে ওর কাছে থাকতে বলে এসেছি।

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জাহিদ সাহেব।কাছের বন্ধুটা হঠাৎ ইহকাল ত্যাগ করলো অথচ নিজের পঙ্গুত্বের অসহায় অসুস্থার জন্য একবার দেখতে যেতেও পারলেন না তিনি।বন্ধু নামক মানুষটার কাছে কতো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার ছিলো উনার।সারাজীবন-ও হয়তো সেই উপকারের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেও কম পড়বে।হয়তো মানুষটার ঋন শোধ করেছেন উনি,তবুও সেই দুঃসময়ে তার উপকারের কথা ভুলবেন কিকরে!যেখানে নিজের আপন রক্ত সম্পর্কিত ভাইয়েরা তাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন সেখানে ওই বন্ধু নামক মানুষটা যে উনার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়ে সাহায্যে করেছিলেন।তপ্ত শ্বাস ফেলে নীহারিকা বেগমের হাতের উপরে হাত রাখলেন জাহিদ সাহেব। ফের বললেন।

‘মেয়েটার দিকে খেয়াল রেখো নীহারিকা।একটা সময় মুখ থুবড়ে পড়তে গিয়ে ওই মেয়েটার বাবা আল্লাহর রহমত সরূপ সেই থুবড়ে পড়া থেকে আমাকে উদ্ধার করেছিলো।এটা মনে রেখো।ওর জেনো একুটও অযত্ন নাহয়।আমি জানি তুমি থাকতে তা কখনো হবেনা।তবুও বলছি।কারনটা তুমি জানো।তবুও,কারনটা বাদে মেয়েটা কিন্তু আহসানের যক্ষের ধন ছিলো,অতিরিক্ত আদরের ছিলো।যারজন্য ভাবিসাহেবা তার নিজের জীবন তুচ্ছ মনে করেছিলো।আহসান আর দ্বিতীয় বিয়ে করার কথা ভাবেনি।সেই মেয়েটাকে ভালো না রাখতে পারলে,সেখানে গিয়ে তো আমাকে তারকাছে জবাবদিহিতা করা লাগবে।আর জবাবদিহিতার চেয়ে বড়কথা।আমার বিবেক আমার বিবেচনা।আমাকে জেনো আমার বিবেক বিবেচনার কাছে কখনো ছোটো, বা অসম্মান হতে না হয়।আমি সারাজীবন কিভাবে চলেছি তুমি তো দেখে এসেছো।

নীহারিকা বেগম চুপচাপ স্বামীর কথাগুলো শুনলেন।
ফের জাহিদ সাহেবের শক্তপোক্ত হাতটার উপর নিজের অন্য হাতটার কোমল স্পর্শে রেখে নমনীয় গলায় বললেন। —বলেছিতো আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না।ও এবাড়ির অন্য সব ছেলেমেয়েদের মতো করে থাকবে।তাই অযথা চিন্তা করে প্রেশার বাড়িয়ে নিজেকে আর-ও অসুস্থতার দিকে ঠেলে দেবেন না।

‘আমাকে সেবা করতে তোমার খুব কষ্ট হয় তাই না নীহারিকা।

মধ্যেবয়স্ক সুদর্শন জাহিদ সাহেবের মুখের দিকে নিটোল নজর ফেললো নীহারিকা বেগম।যৌবন বয়সে মানুষটা অতিমাত্রায় সুদর্শন ছিলো,এখানো সেই সৌন্দর্যের বিন্দু পরিমাণ ঘাটতি হয়নি।যদিও বয়স বেড়েছ,পঙ্গুত্বের অসহায়তায় তাকে ঘরে শুয়ে বসে থাকতে হয়।তবু-ও সৌন্দর্য বিনষ্ট হয়নি।সুদর্শন শরীরে যৌবন বয়স চলে যাওয়ার সাথে সাথে পরিবর্তন এসেছে। তবে সেই পরিবর্তনগুলো জেনো আরও তার সুদর্শনতা বাড়িয়ে দিয়েছে।এই মানুষটার কাছে তিনিও খুবই ঋনী।সেখানে তাকে সেভাবে করতে কষ্ট,অনিহা!তা কিকরে সম্ভব!
সময় নিয়ে উত্তর দিলেন নীহারিকা বেগম।

‘এটা কেমন কথা! আপনার এতোদিনে তাই মনে হলো।আমি বিরক্ত হই আপনার সেবা করতে?তবে যে বলতে হয় আমিও তো আপনার কাছে ঋনী।যে সম্মান আপনি আমাকে আর নিভানকে দিয়েছেন।সেই সম্মানের পরিবর্তে সারাজীবন আপনার সেবা-ও যে কম পড়ে যাবে।তবে শুধু সেই সুবাধে আমি আপনার সেবাযত্নটা করি না।আপনি আমার বিশ্বাস ভরসার স্থান,আমার জীবনের শান্তি সুখের বটবৃক্ষ।সেই ছায়াস্থল বটবৃক্ষটাকে সেবাযত্ন ছাড়া অযত্নে রাখি কিকরে?আমি যে তবে অসহায়।

‘নিভান আমারই সন্তান নীহারিকা।কখনো ওভাবে আর বলবেনা।আমি মনেপ্রাণে মানি,ও তোমার গর্ভধারণ করা মানে আমারই সন্তান।আমার বড় সন্তান।আর তুমি আমার পরম পাওয়া সৌভাগ্যময় স্ত্রী।সেখানে তুমি বা সে আমার কাছে কোনো ঋনি হওয়ার স্কোপ রাখো না।আর কখনো এই ধরনের কথা তোমার মতো বুদ্ধি বিবেচিত নারীর মুখ থেকে না শুনি।

স্বামীর কথায় মনভরা তৃপ্তি পেলেন নীহারিকা বেগম। বরাবরই এই তৃপ্তি তিনি পেয়ে এসেছেন।নিভান এই মানুষটার সন্তান না হওয়া সত্ত্বেও তাকে কখনো বুঝতে দেওয়া হয়নি,যে সে এই মানুষটার সন্তান নয়।এবাড়ির আর নিজের ছেলে হওয়ার সেই প্রাপ্য স্নেহ সম্মান মর্যাদা সম্পূর্ণরূপে ছেলেটাকে তিনি দিয়ে এসেছেন।যদিও ছেলেটার পক্ষ থেকেও সেই শ্রদ্ধা মর্যাদাও তিনি পেয়ে এসেছেন আর পানও।শুধু বাবা ডাকটা বাদে।তবে সেই ডাকটা ডাকার জন্যও তিনি কখনো জোরাবাদি করেননি।হয়তো নীহারিকা বেগমের মতো, ছেলের বাবা ডাকটা নিয়ে মনেমনে আক্ষেপ রয়েছে উনারও।যেটা উনি মুখফুটে কখনো বলতে পারেন না।

‘নিভান কোথায়?এতো পথ জার্নি করে এসে আবার অফিস গেছে নাকি?এসে তো আমার সাথে দেখা করল না।

সচকিত হলেন নীহারিকা বেগম।বললেন–না,ও অফিস যায়নি।বাড়িতে আছে তো।

‘ডেকে দাওতো।দেখি ওদিকের খবরা-খবর একটু শুনি।আর মেয়েটা উঠলে আমার কাছে একবার নিয়ে এসো।

‘আচ্ছা।

বলে উঠে দাঁড়ালেন নীহারিকা বেগম।রুম থেকে প্রস্থান করার আগেই জাহিদ সাহেব ফের বললেন।—আমকে একটু উঠিয়ে বসিয়ে দিয়ে যাও তবে ও আসলে কথা বলতে সুবিধা হবে।

জাহিদ সাহবকে উঠে বসিয়ে দিয়ে নীহারিকা বেগম নিভানকে ডাকতে গেলেন।তাকে ডেকে দিয়ে তিনি আর বাবা ছেলের মধ্যে থাকলেন না।

.

দরজায় করাঘাত পড়তেই সেদিকে নজর দিলেন জাহিদ সাহেব।নিভানকে দেখেই ভিতরে আসতে বললেন। লম্বা লম্বা পা ফেলে ভিতরে এলো নিভান।বেডের পাশে অবস্থানরত ড্রেসিং টেবিলটার সামনে থেকে টুলটা টেনে খাটের পাশঘেষে বসলো সে।বসা মূহুর্তেই হাতের ফাইলটা এগিয়ে দিলো জাহিদ সাহেবের দিকে।নিভানের হাতের পুরনো ফাইলের দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে ফেললেন জাহিদ সাহেব।অফিস ফাইল তো এমন নয়। জিজ্ঞেস করলেন।

‘কিসের ফাইল এটা?

‘আহসান আঙ্কেলর আম্মা দিয়েছেন। বলেছেন আপনার কাছে দিতে। আমি দেখিনি।

ফাইলটা হাতে নিলেন জাহিদ সাহেব।মূহুর্তেই নিভানের সামনে খুললেন সেটা।মনোযোগ দিয়ে ভিতরের কাগজপত্র গুলো দেখতে দেখতে বললেন।–মেয়েটার নাম জেনো কি?

জাহিদ সাহেবের মুখের দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইলো নিভান।মেয়েটার নাম কি সে-ও তো জানে-না। কাল যখন জাহিদ সাহেব তাকে ডেকে বললো-উনার এক কাছের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মারা গিয়েছেন সেখানে উনার অবশ্যই উপস্থিত থাকা দরকার।তিনি তো যেতে পারবেন না,এবাড়ির কেউ একজনের উপস্থিত থাকাটা সেখানে জরুরি।আর ছেলে মানুষ বলতে উপস্থিত তখন নিভান ছাড়া কেউ বাড়িতে ছিলো-না।তাই নিভানকে যাওয়ার কথা বললেন তিনি।নিভান উনাকে বাবা বলে না ডাকলেও,সহজে উনার আদেশ নিষেধ ফেলেনা।তাই সময় নিয়ে রাজিও হয়েছিলো।সেখানে যেতে যেতে প্রায় দাফনকার্য শেষ হয়ে গিয়েছিলো আহসান আঙ্কেল নামক মানুষটার।নিজের পরিচয় জানান দিয়ে কবর জিয়ারত করে,আহসান আঙ্কেলের মা নামক বৃদ্ধাকে বলে যখন চলে আসবে।তখন ক্রন্দনরত অসহায় মুখে বৃদ্ধা জাহিদ সাহেবের সাথে একটু কথা বলতে চাইলেন। নিভানও না করতে পারিনি।জাহিদ সাহেবের নম্বরে ফোন দিয়ে ধরিয়ে দিয়েছিলেন।তাদের মধ্যে কি কথা হয়েছিল নিভানের জানা নেই।তবে জাহিদ সাহেবের সাথে বৃদ্ধা ভদ্রমহিলার কথা বলা শেষ হলে যখন তাকে ফোনটা ধরিয়ে দেওয়া হলো।জাহিদ সাহেব শুধু তাকে এটুকু বললেন।—মেয়েটাকে তোমার সাথে করে নিয়ে এসো নিভান।

মেয়েটাকে নিয়ে যখন চলে আসতে চাইলো নিভান।আরেক ঝামেলায় পড়েছিলো।এমনিতেই মেয়েটা তো আসতে চাইছিলোনা।তারউপর মেয়েটার চাচারাও তাকে আসতে দেবে-না।তারমধ্যে থেকে মেয়েটার এক চাচাতো ভাইও খুবই উগ্র আচারন করেছিলো।মেজাজ তো নিভানেরও চড়ে গিয়েছিলো।তবে মৃত্যু বাড়িতে অশোভনীয় আচারন করাটা ঠিক হবেনা বিধায় নিজেকে কন্ট্রোলে রেখেছিল।বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা আবারও জাহিদ সাহেবকে ফোন দিয়ে, উনার ছেলেদের কাছে ধরিয়ে দিতে বললেন।নিভান ঝামেলা থেকে মুক্ত হতে সহজ সমাধান হিসাবে তাই করলো।

জাহিদ সাহেবের ফোন ধরতেই,আহসান আঙ্কেলের মেঝো ভাই নামক লোকটা কেমন মিইয়ে গেলো।পরবর্তী আর ঝামেলা করেনি। মেয়েটাকে চুপচাপ তার সাথে আসতে দিয়েছিলো।তবে ওই উগ্র মস্তিষ্কের ছেলেটাকে সহজে শান্ত করা যাচ্ছিলো।সেটা আর সামান্যতম গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি নিভান।মেয়েটাকে নিয়ে চলে এসেছিলো।গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার মূহুর্তে বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা তড়িঘড়ি করে তার হাতে ফাইলটা ধরে দিয়েছিলেন।তখন-ও মেয়েটা না আসার জন্য বাহানা করেই যাচ্ছিলো।

‘নিভান।

হঠাৎ মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় ডাকটা নিভানকে একটু চমকাল।কি জিজ্ঞেস করেছিলেন জাহিদ সাহেব মনে হতেই আবারও খেয়াল হলো,না মেয়েটাকে সেভাবে খেয়াল করেছিলো সে।আর না তাদের মধ্যে কোনো কথা হয়েছিলো,তবে মেয়েটার নাম বলবে কি করে সে।তবে একটু আগে নাফিমের থেকে জেনে নেওয়া নামটা বলবে কি সে?সত্যিই কি মেয়েটার নাম ফুলকৌড়ি?হঠাৎ তখন দিবার প্রশ্ন করা কথাটার কথা মনে পড়লো।দিবাও তো বলেছিলো মেয়েটার নাম কৌড়ি।তবে ফুলকৌড়ি না বলে কৌড়ি বলবে কি?

‘নিভান,কিছু হয়েছে কি?তুমি কি কিছু নিয়ে ভাবছো?

‘না তেমন কিছু নয় আপনি বলুন?ওহ আপনি তো মেয়েটার নাম জিজ্ঞেস করছিলেন।মেয়েটার নাম মনে হয়….

‘নামটা আমি জেনে নিয়েছি ফাইল থেকে।মেয়েটার নাম
,কাশফিয়া আহসান কৌড়ি।

নিভানের চুপ থাকা দেখে জাহিদ সাহেব বুঝতে পেরেছিলেন,মেয়েটার নামটা সম্পর্কে নিভান জ্ঞাত নয়।তবে ফাইলের বিভিন্ন কাগজে মধ্যে মেয়েটার স্কুল কলেজ সম্পর্কিত কাগজও আছে।সেখান থেকে জেনে নিয়েছেন তিনি।যদিও নামটা তিনি আহসানের মুখে বেশ কশেকবার শুনেছিলেন তবে খেয়ালে ছিলোনা উনার।

চলবে…

ফুলকৌড়ি পর্ব-০২

0

#ফুলকৌড়ি
পর্ব(২)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

মধ্যেদুপুর অথচ বিস্তৃত আকাশটা এমন মেঘের ঘনঘটায় ঢেকে আছে মনেহচ্ছে,সূর্যটা ডুবে গিয়ে সন্ধ্যা নাম-নাম ভাব।নামীদামী জিনিস দিয়ে সাজানো গুছানো বড়সড় রুমটার একপাশের দেয়ালজুড়ে বিস্তৃত জানালা।আর সেই জানলাার পাশে জড়োসড়ো হয়ে বসে মেঘাচ্ছন্ন আকাশের অসময়ের রঙ বদল দেখে চলেছে কৌড়ি।তার জীবনের সমীকরণটাও ঠিক আজকের আকাশের মতো।জীবনটা তার মধ্যদুপুরও গড়াইনি অথচ অসময়ের মেঘের ঘনঘটায়,সেই দুপুরটা ভর সন্ধ্যা রূপে ধরা দিলো কৌড়ির জীবনে।দুপুরের মেঘেভরা আকাশটা দেখে জীবনের মধ্যদুপুরটা কালো অন্ধকারাচ্ছন্ন সন্ধ্যাবেলার মতো বলে অন্তত মনেহচ্ছে কৌড়ির।না হলে কতো সুন্দর দিনগুলো যাচ্ছিলো তার।মা ছিলোনা অথচ দাদীআপা আর বাবাকে নিয়ে কতো সুন্দর দিনগুলো পার হয়ে যাচ্ছিলো তার।আর সেই সুন্দর দিনগুলোর ক্ষান্ত তার জীবনের মধ্যদুপুর আসার আগেই সমাপ্তি রূপে পরিণয় নিলো।দুপুর পার হলেনা অথচ তার জীবনে সন্ধ্যা নেমে গেলো!নিজের আপনজন,পরিচিত সবকিছু ছেড়ে অন্যের আশ্রিতা হয়ে গেলো সে!অন্যের আশ্রিতা হয়ে যেতে হলো তাকে!
জীবনটা তার এমন রূপ কেনো হলো,মায়ের ভরপুর আদর শাসনটা ঠিকঠাক মতো পাওয়া হলো-না,তার আগেই মা চলে গেলেন।তবুও বাবার আদর ভালোবাসায় তো খুব ভালো ছিলো তবে কেনো জীবনের মধ্যে দুপুরটা গড়ানোর আগেই এখন আবার বাবাও,তাকে একাকি করে মায়ের কাছে চলে গেলেন।বাধ্য হয়ে মায়ের মতো আদর মমতায় মুড়িয়ে রাখা দাদীআপাকে-ও ছেড়ে চলে আসতে হলো তাকে।এ কেমন নিয়তির শিকলে বাঁধা পড়লো সে?

কালো মনির ডগরডগর সুন্দর নয়নযুগলের কার্নিশ বেয়ে আপনমনে আবারও একদল অশ্রু বয়ে চলে গেল।
ঘন পল্লবগুলো ভিজে দলা বেঁধে গেলো অথচ কৌড়ি চোখের পলক ফেললো না।অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মেঘমালায় ডুবে থাকা আকাশপানে।বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান কৌড়ি।বাবা আহসান হাবীব এবং মা জেবা নাহারের বৃদ্ধা বয়সের সন্তান সে।কৌড়ির বাবারা হলেন পাঁচ ভাই।সবার বড় বাবা হওয়া সত্ত্বে- ও, সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে তিনি ছোটো চাচারও শেষে।তারজন্য নাকি কম ব্যাঙ্গাত্মক কথা শুনতে হয়নি উনাকে।কিন্তু শেষ বয়সে সন্তান লাভে থোড়াই না উনাদের দোষ ছিল।সন্তান দেওয়া নেওয়ার মালিক তো আল্লাহ।তিনি সেই বিশেষ রহমত সরূপ, সন্তানসুখ কখন একজোড়া দম্পতিকে দেবেন সেটা শুধু তিনিই জানেন।অথচ সেই মহান স্রষ্টার সিদ্ধান্ত মেনে না নিয়ে না বুঝে কতো মানুষ উপহাস করে বসে।উপহাস্য সরূপও দেখে।

প্রথম বয়সে একটা সন্তান লাভের আশায় কতো ডাক্তার কবিরাজের শরণাপন্ন হয়েছিলেন উনারা।দুজন কারও কোনো সমস্যা না থাকা সত্ত্বেও, যৌবন বয়স গড়িয়ে যাওয়ার একপর্যায়েও সন্তান লাভে সক্ষম হননি উনারা।একটা সময় শেষমেশ হাল ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর উপর অবিচল হলেন।ভরসা করলেন।তিনি দিলে দিবেন না দিলেতো আর উনাদের হাতে কিচ্ছু নেই।বাবার বয়স চল্লিশের অধিক গড়িয়ে যাওয়ার পর হঠাৎই একদিন কৌড়ির পৃথিবীতে আসার সুখবর পেলেন।যে উনারা সন্তানসুখ লাভ করতে চলেছেন।হয়তো সেসময় উনারা আর আশা রাখের-নি,যে এই বয়সে এসে উনারা আর সন্তানের মুখ দেখতে পাবেন।কিন্তু সৃষ্টিকর্তার উপরে সকল জ্ঞান, বিচার, বিবেচনা কার চলে?সে আস্পর্ধা রাখার ক্ষমতা যে এই জগত সংসারে কার-ও নেই।স্বয়ং তিনিই যখন উত্তম পরিকল্পনাকারী।সেখানে উনার পরিকল্পনার উপরে পরিকল্পনা।তা কি কখনো মেনে নেন তিনি।

তার জন্ম হওয়ার কথাগুলো দাদিআপার থেকে জানা কৌড়ির।জীবন থেকে নির্দিষ্ট সময়ের অধিক সময় চলে যাওয়ার পর যখন সন্তান জন্ম দিতে সক্ষম হলেন মা।তখন তার আয়ুটা কমে এলো।কৌড়িকে জন্ম দিতে গিয়ে তিনি নিজের জীবনটা বিসর্জন দিলেন।জীবনের বিনিময় জীবন দিয়ে গেলেন।তারপর ছোট্টো কৌড়িকে মানুষ করার জন্য বাবা আর বিয়ে করেননি।দাদিআপা বলতেন।–তোর মা মরার পর তোর বাপেরে কতো সাধলাম একখান বিয়ে কর বাপ।নাহলে এই দুধের শিশু মানুষ করবো কি-করে? আর বু্ড়ো বয়সে বা তোরে দেখবো কে।কিন্তু কে শোনে কার কথা।তোর বাপ কিছুতেই আমার কথা শুনলো না।বিয়ের কথা কইলে তোর বাপে কইতো কি জানিস ছেড়ি?

‘আমার মেয়ের মা লাগবে না আম্মা।আমি আমার মেয়ের আম্মা আব্বা দু’জনেই হয়ে আমার মেয়েরে আদর যত্ন দিয়ে মানুষ করতে পারবো।তাই বলে আমার সোনার টুকরো রত্মটাকে আমি সৎমা নামক কারও হাতে তুলে দিয়ে অবহেলার পাত্রী হতে দিতে চাই-না।

‘কত বুঝাইলাম অথচ তোর বাপে কানেই তুললো না আমার কথা।তবে তোর বাপের কথামতো সে ঠিকই তোরে আদর যত্ন কইরা আলগাইয়া বড় কইরা তুললো।একটু আঘাত ছুতে দেয় নাই তোরে কোনোদিন।ব্যাটা মানুষ হইয়াও কি সুন্দর তোরে সামলাইলো।তোরে একখান কথা কই বুবু।আমি মরার পর তোর বাপেরে আদর যতন করার লোক আর নাই বুঝলি।দুনিয়ায়টা বড়োই স্বার্থপর,এখানে নিঃস্বার্থভাবে মায়াদয়া ভালোবাসা দেখানোর মানুষের খুবই অভাব।তাই তুই যেখানেই থাকোস তোর বাপারে একটু আমার মতো করে আদর যতন করিস।মা বাপের মতো নিঃস্বার্থভাবে কেউ আদর যতন করতে পারেনা।ওরকম আর কেউ হয়না বুঝলি।কেউ হয়না।

চোখ বুঝে ফেললো কৌড়ি।হড়হড় করে আবারও দুচোখের কার্নিশ বেয়ে নামলো নোনাজল। দাদিআপা রয়ে গেলো,রয়ে গেলো তার কথা।অথচ সেই আদর যত্ন পাওয়ার হকদার মানুষটাই,উনার প্রাপ্য ভালোবাসা আর যত্নের ভাগটা না নিয়ে তাকে ঋনি করে চলে গেল।আর আশ্রয় থাকতেও তাঁকে অন্যের আশ্রিতা করে দিয়ে গেল।এবার ফুপিয়ে বাবা বাবা বলে কেঁদে দিলো কৌড়ি।কেনো তার আপনজন গুলো একে একে এভাবে তাকে নিঃস্ব করে দিয়ে চলে যাচ্ছে।দু’হাতে গ্রীল চেপে ধরে তৃষ্ণার্থ পাখির ন্যায় আকাশের দিকে ফিরে,ওই বিশালত্ব ছাপিয়ে যাওয়া আকাশের মালিকের কাছে কাতরস্বরে অভিযোগ জানালো।

‘ও মাবুদ তোমার দয়ার নজর কেনো আমার উপরে একটু সুস্পর্শ করোনি।আমাকে কেনো এতটা অসহায় করে দিলে।কেনো?

কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেলো কৌড়ির।গলা দিয়ে আর কথা বের হতে চাইলো না।মাথা নুইয়ে দুহাতের মুঠোয় গ্রিল চেপে ধরলো কৌড়ি।ফের বাবার দেওয়া উপদেশ এর কথা মনে পড়লো,বাবা সবসময় তাকে বলতেন।–যতো বিপদ আপদ আসুক , দুঃখ কষ্ট হোক।কখনো সৃষ্টিকর্তার উপরে অসন্তুষ্ট প্রকাশ করবেনা।
বরংচ তার কাছে আর্জি জানাবে।ধৈর্য্য ধরবে।তার ফল সরূপ সৃষ্টিকর্তা তোমাকে আরও ভালো কিছু দেবেন।

মাথা নুইয়ে চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায় আবারও ফুপিয়ে কেঁদে দিলো কৌড়ি।ফের বিড়বিড় করলো বললো– ও মাবুদ তোমার সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট না থাকার কারনে আমাকে ক্ষমা করো।সবকিছু সয়ে নেওয়ার জন্য আমাকে ধৈর্য্য দাও।

মাথায় স্নেহের পরশ পেতেই মুখ উঁচু করে তাকালো কৌড়ি।ঝাপসা দৃষ্টিতে সুন্দর হাস্যজ্বল একখানা মুখ নজরে পড়ল তার।পরিপাটি করে শাড়ী পরা,খুব সুন্দর দেখতে মাঝবয়সী এক ভদ্রমহিলা।কে উনি?উত্তর সামনে হাঁটু মুড়ে বসা ভদ্রমহিলাই দিয়ে দিলেন।

‘তুমি যার আদেশে এবাড়িতে আসতে বাধ্য হয়েছো আমি উনার কর্ত্রী।তোমার আঙ্কেলকে দেখলেও আমার সাথে দেখা হয়নি কখনো তোমার।তাই আমাকে চিনবে না।

কৌড়ি ভেজা চোখে চেয়ে থাকলো সেই সৌন্দর্যে ভরপুর লাবন্যময়ী মাঝবয়সী নারীরপানে।যে পরিচয়টা দিলেন ভদ্রমহিলা সেই হিসাবে বয়সের সামন্য আচও পড়েনি এখনো উনার চেহারায়।সামনে বসা ভদ্রমহিলা কৌড়ির ভেজা চোখমুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।হাত উঠিয়ে মমতাময়ী স্পর্শে কৌড়ির চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বেশ মায়ামায়া কন্ঠে আদুরেস্বরে বললেন।

‘তুমি সেই কখন এসেছো অথচ তোমার কাছে আসতে আমার কতো দেরী হয়ে গেলো দেখলে।এভাবে মেঝেতে বসে আছো কেনো?অসুস্থ হয়ে পড়বে তো।আর কান্নাকাটি করে এতো সুন্দর চোখমুখের কি অবস্থা করেছো ফেলেছো তুমি?এটা কিন্তু একদম ঠিক নয়।তুমি এভাবে কান্নাকাটি করলে,সেখানে ভালো থাকতে পারবেন তোমার বাবা? কি করে ভালো থাকবে বলো তো?তার আদরের একটা মাত্র মেয়ে এভাবে যদি কেঁদে-কেটে অস্থির হয়ে পড়ে,আল্লাহ যে তাকে দায়ী করবেন।আর তিনি তোমার চোখের পানির দায়ী হলে কখনো ভালো থাকতে পারবেন?কান্নাকাটি করেনা,মা।যদি কান্নাকাটি করার হয়,নামাজে দাড়িয়ে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করো।বাবার জন্য দোয়া করো।তাতে বরংচ আল্লাহ খুশি হবেন।আর একদম কান্নাকাটি নয়। আমরা আছি তো।এই যে আমি তোমার বড়মা,আমি আছিতো।

ফুপিয়ে কান্না থামলেও চোখ দিয়ে পানি পড়া বন্ধ হয়নি কৌড়ির।সামনে বসা মমতাময়ীর আদুরে কথায় কান্নার জেনো আরও ভিতর থেকে উগলে ভেঙে এলো তার।সেটা দেখে সামনে বসা নিহারিকা বেগম সংগোপন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।ফের প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললেন–তুমি সেই কখন এসেছো অথচ এখনো পোশাক পাল্টাওনি।সেই বেশেই বসে আছো,শরীর খারাপ করবে তো?
এভাবে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বে তো মা।উঠো,গোসল সেরে নেবে।নিশ্চয় কান্নাকাটি করে মাথা ধরিয়ে ফেলেছো,তারউপর কতো পথ জার্নি করে এলে।আর একটুও কান্নাকাটি নয়, উঠো।

উঠে দাড়ালেন নীহারিকা বেগম।মুখে তাড়া দিতে থাকলেও হাত থেমে নেই উনার।হাত ধরে কৌড়িকেও উঠে দাঁড় করালেন।সঙ্গে সঙ্গে কপাল কুঁচকে গেলো উনার।বাচ্চা মেয়েটার এরকম সাদা শাড়িতে কেনো?
গ্রামের মেয়েরা সেই পুরানো যুগের মতো এখন তো আর শাড়ী পরে না।আধুনিকতার ছোয়াতো এখন আর শুধু শহরতলীতে সীমাবদ্ধ নেই।স্মার্ট ফোন এসে তা গ্রামের প্রতিটি ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে।আর না কৌড়ির বিয়ে হয়েছে?তবে এমন ধারার সাদা শাড়ী পরা কেনো মেয়েটার?বাবা মারা গিয়েছে তাই?এরকম কোনো প্রচলন আছে কি?

‘তুমি এরকম পোশাকে কেনো?তাও আবার সাদা শাড়ীতে?

নিজের দিকে তাকালো কৌড়ি।অচমকা কাল সন্ধ্যাবেলার চিত্র ভেসে উঠলো মানসপটে।সে শাড়ী পরে এমনটা নয়।বাবার সাথে তার বন্ডিংটা ছিলো খুবই ভালো।ভালোমন্দ সব কথা বাবাকে না বলা গেলেও, নিজের জীবনের নিত্যকার অধিকাংশ কথা বাবাকে বলতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করতো কৌড়ি।বাবাও তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন।আর ভালো মন্দ আদেশ উপদেশ দিতেন।তিনজনের সংসারে বাবার ছিলেন দুই-মা।আর এই দুই মায়ের মধ্যে সবসময় বাবার কাছে ভালো সাজার দন্ডতা চলতো।সেটা ভালোমন্দ সাজে হোক বা একে অপরের বিরুদ্ধে নালিশে।যদিওবা সেটা তাকে ভালোবাসার দাদিআপার একটা অন্য পন্থা ছিলো সেটা কৌড়ি জানতো। তবে বাবার কাছে দেওয়া দাদিআপার সেই মিছিমিছি অভিযোগ নালিশ শালিসিগুলো সে বেশ উপভোগ করতো।কাল সন্ধ্যায় দাদিআপাকে রাগাতে,উনাকে ক্ষেপাতে সেরকম একটা মজা করেছিলো কৌড়ি।

সন্ধ্যার নামাজের পর দাদিআপা যখন বসেবসে তসবিহ গুনছিলো।আচমকা দাদিআপাকে রাগাতে দুষ্ট বুদ্ধি সাজালো সে।নিজের পরিহিত সালোয়ার-কামিজে পাল্টে আচমকা দাদিআপার সাদা শাড়ী পরলো।সাথে ব্লাউজ পেটিকোটও পরতে ভোলেনি।তাতে দাদিআপা আরও ক্ষিপ্ত হবেন হাহুতাশ করবেন আর নামাজে শেষে বাবা যখন বাড়িতে ফিরবেন তখন তাকে দেখিয়ে নানান অভিযোগ আর নালিশি জুড়বেন।যদিও কৌড়ির জানা সেসব অনুযোগ মিছিমিছি।তবুও কেনো জানিনা কৌড়ির দাদিআপার সাথে বাঁদরামী গুলো করতে বেশ ভালো লাগতো।তবে কালকে দাদিআপা সেই নালিশ করার সুযোগই পাননি।নামাজ শেষে উনার ছেলে আর সুস্থ সমেত বাড়িতে ফেরেননি।সুস্থ মানুষ বাড়ি থেকে নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন ফিরেছিলেন লাশ হয়ে।
মসজিদে মুসল্লীদের বয়ান অনুযায়ী নামাজে সিজদাহরত অবস্থায় বাবা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে।তারপর আর নিজে কি পরা ছিলো এটা আর খেয়ালই হয়নি।তারপরের পরিস্থিতি যা হলো,শাড়ী পাল্টে অন্যকিছু পরার সময় পেলো কোথায় সে।আচমকা দাদিআপার কথা মনে পড়তেই আবারও দুচোখ ভরে উঠলো কৌড়ির।মানুষটা বাবাকে প্রচন্ড ভালোবাসতো সাথে তাকেও।সেই বৃদ্ধা মানুষটা বাবাকে ওই অবস্থায় দেখে কতোটা বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন।সেটাতো কৌড়ি দেখেছিলো,আর তাকে কিভাবে আগলে রেখেছিল। সেই মানুষটা বাবাকে ছাড়া তাকে ছাড়া কেমন আছো?

‘কৌড়ি।চলো গোসল সেরে নেবে।

নামটা ইতিমধ্যে বাড়ির ইঁচড়েপাকা ছেলেটার কাছ থেকে জেনে নিয়েছেন নীহারিকা বেগম।কৌড়িকে বেশ সময় ধরে চুপ থাকতে দেখে তাকে ডেকে উঠলেন তিনি।বুঝলেন মেয়েটার একরকম পরিস্থিতিতে প্রশ্ন করা উনার ঠিক হয়-নি।তাই প্রসঙ্গ পাল্টাতে কৌড়িকে তাড়া দিলেন।তবে কৌড়ির কথাগুলো কানে ঢুকলোনা বোধহয়। সে আচমকা বললো।

‘আমি দাদিআপার কাছে যেতে চাই।

যদি-ও বাচ্চাদের মতো আবদার।তবু-ও করে বসলো কৌড়ি।কৌড়ির কেঁদেকেটে ফুলনো মুখের দিকে নির্বাক হয়ে কিছুসময় তাকিয়ে রইলেন নীহারিকা বেগম।
বাড়ির বাচ্চা পার্টি ঠিকই বলেছে।মেয়েটা অদ্ভুত এক মায়াবিনী সৌন্দর্যর অধিকারী।আর এরকম মায়ামায়া কন্ঠে আবদার করলে ফেরানো যায়?কিন্তু মেয়েটা যার কাছে যাওয়ার আবদার জুড়েছে, তারইতো অনুরোধে এখানে আনা মেয়েটাকে।সংগোপন তপ্ত শ্বাস ফেলেেন তিনি।ফের কৌড়ির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন।

‘তুমি নিশ্চয় জানো,তোমাকে এখানে কেনো পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন তোমার দাদি আপা।তবু-ও জেনে-বুঝে এরকম আবদার করলে চলবে মা?সব ঠিক হয়ে যাবে।

চাচাতো ভাই নামক ওই কুকুটার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য দাদিআপা যে তড়িঘড়ি করে আঙ্কেলের কাছে অনুরোধ জানিয়ে তাঁকে এখানে পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন এটা কৌড়ি জানে।বাবা বেঁচে ছিলেন তাই তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিতো বারবার জানোয়ারটা। আর এখন ববা৷ বেঁচে নেই।হয়তো বৃদ্ধা দাদিআপার পক্ষেও তাকে আগলিয়ে রাখার সাধ থাকলেও শক্তি, ক্ষমতা কোনেটাই নেই।আর কথা বাড়ালো না কৌড়ি।নীহারিকা বেগমের নির্দেশনা অনুযায়ী চুপচাপ গোসল করতে চলে গেলো।সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন নীহারিকা বেগম।কতো সুন্দর ফুটফুটে একটা মেয়ে,কি শান্ত কি নিস্পাপ চেহারা।অথচ ভাগ্য তাকে কোথায় এনে দাঁড় করালো।

.

নিজের রুমের আরামদায়ক বিছানার উপর উপুড় হয়ে শুয়ে কেঁদে চলেছে দিবা।তখন নিভানকে প্রশ্ন করলেও উত্তর মেলেনি তার।মিলেছে আপমানসরূপ,মুখের উপর ধড়াম করে দরজা লাগিয়ে দেওয়ার উচ্চশব্দ।দিবা জানতো উত্তর মিলবে-না। নিভান তাকে কখনোই উত্তর দেবেনা।আর উত্তর পাওয়ার জন্য নিজের জেদীরূপটা প্রকাশ করলে,পুনরায় নিজের খারাপটা নিমন্ত্রণ করে আনা ছাড়া ফলটা ভালো হবেনা।বিধায় সে-ও আর বাড়াবাড়ি না করে চুপচাপ চলে এসেছে।তবে তার শেষের প্রশ্নে নিভান কেনো অতসময় ধরে নিরব ছিলো।এটাই তাকে বিচলিত করে চলেছে।সে আগের ন্যায় সহজে নিভানের স্বাভাবিক ব্যবহার পাবেনা এটাও জানে।তবে চেষ্টা করে চলেছিলো তো সে।হয়তো কোনো একদিন সেই চেষ্টা সফল হতো।তবে ওই মেয়েটাকে দেখার পর কেনো মনেহচ্ছে সেই চেষ্টা আর কখনো সফল হওয়ার নয়।তবে যাই হোক সে নিভানকে পুনরায় নিজের দিকে ফিরানোর চেষ্টা করবে।ওই মেয়েটাকে যেটুকু দেখেছে নিভান,আর তার আশেপাশে মেয়েটাকে ঘেঁষতে দেবেনা।তবে নিভান?দিবা নিজ মনে তো ভেবে নিচ্ছে,সে তার চেষ্টায় একদিন না একদিন সফল হবে।তবে নিভান যেই ধরনের ছেলে তাকে কি আর কখনো মেনে নেবে নিজের জীবনে?

হঠাৎ ফোনের আওয়াজে মাথা কাত করে বালিশের পাশ থেকে ফোনটা তুলে নিলো দিবা।আননোন নম্বর দেখে রিসিভ করতে মন চাইলো-না তবে ফেনটা থেমে নেই।একবার বেজে ক্ষান্ত হয়নি সে।দ্বিতীয়বার আবার বেজে উঠায় বিরক্ত হয়ে ফোনটা রিসিভ করলো দিবা।ওপাশের মানুষটার গলা শুনতেই ক্রোধে জর্জরিত হয়ে পড়লো সে।

‘কি খবর আমার সুন্দরী বউ?তোমার আশায় আশায় থাকায় পানি ফেলো দিলো বুঝি নিভান?যার আশায় বিয়ে করা বর কে ছাড়তে চাইছো, তাকে দেখলাম তোমার চেয়েও সুন্দরী মেয়ে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে।সেজন্য বুঝি কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে পড়েছো বউ?অথচ তোমার জীবন থেকে কি সুন্দর নিজের স্বামীকে বিদায় করে দিতে চলেছো তাতে কোনো বিরহজ্বালা নেই তোমার!ঈশ,পুরানো প্রেমিকের প্রতি কি দরদ তোমার!তোমার কান্নারত গলা শুনে আামরই বুক জ্বলছে।তবে আমি যদি নিভান হতাম না তবে……

সিয়ামের ব্যাঙ্গাত্মক কথায় দিবার ক্রোধ আরও দ্বিগুণ হলো।কৌড়িকে নিয়ে আসার সময় হয়তো এই ছেলে কোথা থেকে দেখেছে বিধায় তাঁকে উস্কানোর জন্য এই ফোন কল।সিয়ামের বাজে ইঙ্গিতপূর্ন কথা শেষ করতে দিলোনা দিবা।সিয়ামের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে কড়া গলায় বললো—একদম আজেবাজে কথা ভুলেও মুখে আনবেনা।এজন্য তো তুমি নিভান নও,আর না তার যোগ্য কখনে হতে পারবে।সবাইকে কি তোমার নিজের মতো চরিত্রহীন মনে করো।নাকি নিজে শুঁকুন তো সেই নজরে সবাইকে অনুভব করো।আর আমার চরিত্রে কাঁদা ছুঁড়ানোর আগে,একবার নিজের দিকে তাকা-ও।লজ্জা করে-না আমাকে আবার ফোন দিয়ে নাটক করো।

‘সেই তো আমার কাছে ফিরতেই হবে তবে এতো রঙঢঙ দেখাও কেনো?তোমার ওই পুরোনো আশিকি তোমাকে আর গ্রহণ করবে-না।সো রঙঢঙ না দেখিয়ে সসম্মানে চলে এসো।আমি তোমাকে সদাসর্বদা গ্রহন করতে প্রস্তুত।

সিয়ামের হেসে হেসে ফের ব্যাঙ্গাত্মক কথায় মাথার ভিতর ধপ করে আগুন জ্বলে গেলো দিবার।দাঁতে দাত চেপে একই স্বরে বললো—তোমার মনে হয় এতো কিছু হয়ে যাওয়ার পর-ও আমি তোমার কাছে কখনো ফিরবো?হাও ডিজগাস্টিং ফানি।তুমি নিজেকে কি ভাবো?রাজপুত্র।যদিও তাই,তবু-ও আর আমি তোমার কাছে ফিরছি না।আমি একবার বাহিরের চাকচিক্যের মোহে পড়ে মানুষ চিনতে ভুল করেছি।আর দ্বিতীয়বার সেই মোহে পড়ে ভুল করততে চাইনা।কান খুলে শুনে নাও শেখ সিয়াম মাহমুদ আমি তোমার কাছে আর কখনোই ফিরছিনা।সুতরাং আমাকে অযথা ফোন দিয়ে বিরক্ত করবে না।

‘তবে কার মোহে আঁটকে যেতে চাইছো।তোমার সাধুসঙ্গ চরিত্রবান প্রেমিক পুরুষের মোহে?

‘বাজে কথা বলা বন্ধ করো সিয়াম।নিভানের সাথে আমার তেমন কোনো সম্পর্ক কখনোই ছিলো-না,এটা তুমি খুব ভালো করে জানো।সো যে নোংরা কাঁদায় নিজে ডুবে আছো তা অন্যের দিকে ছোড়াছুড়ি বন্ধ করো?নাহলে কিন্তু ভালো হবে না।

‘তবে চলে আসছো না কেনো?নিভানকে পাওয়ার লোভেইতো পড়ে আছো ওখানে।আবার চরিত্রের ভালো গুনাগুন শোনাও আমাকে তুমি।আর কাকে ভয় দেখাও তুমি? আমাকে,সিয়াম মাহমুদ শেখকে!

‘হ্যা তোমাকেই ভয় দেখাচ্ছি শেখ সিয়াম মাহমুদ।আর ফিরবো মানেটা কি?লজ্জা করছেনা একথা বলতে তোমার!কি চাইছো?তুমি মদ গাঁজা খেয়ে সারাদিন চৌদ্দটা মেয়ের সাথে ফূর্তি করে এসে আমার উপর জুলুম করবে।আর আমি সেটা অবলা নারীর মতো সহ্য করবো।এতোটা অবলা আমাকে মনেহয় তোমার?এতোটা অবলা যে আমি নই এটা তুমিও খুব ভালো করে জানো।আর আমি মরে গেলেও তোমার কাছে কখনোই ফিরছিনা।আই জাস্ট হেইট ইউ।

ওপাশ থেকে সিয়াম প্রতিত্তোর করার আগেই রাগেক্ষোভ ফোন কেটে দিলো দিবা।সঙ্গে সঙ্গে নম্বরটা ব্লকলিস্টে ফেলে দিলো।রোজ নতুন নতুন নম্বর দিয়ে তাকে বিরক্ত করা এই ছেলে স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে।তপ্ত শ্বাস ফেললো দিবা।সে আর ওই খুবলে খাওয়া নারী দেহলোভী লোকটার কাছে ফিরতে চায়না।কখনোই চায় না।নিজের এই পরিনতির জন্য তার নিজের স্বইচ্ছায়ই সিদ্ধান্ত দায়ী,তবে কাকে দোষী করে বুকের ভিতরের জ্বলা আগুন নিভাবে সে।বিয়ের আগে ক্ষুনাক্ষরেও যদি টের পেতো সিয়াম প্লেবয় স্বভাবের ছেলে তবে জীবনেও সে সিয়ামের ভালোবাসা নামক ফাঁদে পা দিতো না।আর না তাকে বিয়ে করতে কখনো রাজী হতো।বড়মামীর বড় ছেলের বউ হওয়ার প্রস্তাব উপেক্ষা করাটা জীবনে তার যে কতোবড় ভুল করেছে সেটা এখন হাড়েহাড়ে বুঝতে পারছে সে।তবে তার এই সিদ্ধান্তে তার মা-ও যে কম দায়ী নয়।চোখ বুঁজে নিজের জীবনের সবচেয়ে মস্ত বড় ভুলটা করার জন্য আফসোস আওড়াতে থাকলো দিবা।

.

গোসল সেরে নামাজের বিছনায় বসে আছে কৌড়ি।বড়সড় ঘরটায় সে একা আর কেউ নেই।তাকে গোসল করতে পাঠিয়ে নীহারিকা আন্টি খাবার আনার কথা বলে চলে গেছে।এখনো ফেরেননি। অথচ নামাজের বিছানার সিজদাহরত জায়গায় নজর রেখে-ও কৌড়ি অনুভব করতে পারছে,গভীর কোনো নজর তাকে দেখে চলেছে। কে? অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো নজরে নজর পড়ার ভয়ে ঘাড় ফিরিয়ে দরজার দিকে তাকাতেও তার কেমন দ্বিধা কাজ করলো।বেশ কিছুক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরও, যখন একই ইন্দ্রিয় অনুভব করলো।ঘাড় ঘুরাতে বাধ্য হলো সে।অথচ শূন্য দুয়ারই নজর পড়লো তার।কেউ নেই।আর না সেখানে কোনো প্রানী দাঁড়িয়ে থাকার নিদর্শন পেলো।কিন্তু হঠাৎ কেনো মনে হলো এরকম?হয়তো মনের ভুল।হবে হয়তো?

‘তোমার নামাজ পড়া শেষ হয়ে গেছে তবে উঠে খেয়ে নাও।

আবারও একজন অচেনা নারী অবয়ব।শ্যামবর্ণের মিষ্টি একখান মায়াবী মুখ।অমায়িক তার মুখের মৃদু হাসি। সেই হাসি হাসি মুখে খাবারের ট্রেটা বিছানার পাশে টেবিলে রেখে কৌড়ির পাশে এসে দাঁড়ালেন তিনি।ফের ব্যস্ততা দেখিয়ে বললেন–সেই কখন খেয়েছো তার ঠিক নেই,উঠো মেয়ে।খেয়ে নেবে।

কাল দুপুরে খাওয়া হয়েছে আর খাওয়া হয়নি কৌড়ির।দাদি, চাচিরা জোরাজোরি করেছিলো খাওয়ার জন্য কিন্তু খায়নি সে।সত্যি বলতে ক্ষুধায় কাতর সে।তবে খাওয়ার ইচ্ছেটা জেনো নেই তার।উঠে দাড়ালো কৌড়ি।উঠে দাঁড়াতেই ভদ্রমহিলা নামাজের বিছানাটা নেওয়ার জন্য নিচু হতে গেলেই।কৌড়ি ব্যস্ত ভঙ্গিতে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো –কি করছেন কি?আমি গুছিয়ে নিতে পারবো।

নিচু হয়ে নামাজের বিছানাটা তুলে ভাজ করতে শুরু করলো কৌড়ি।তবে সেটা নরম স্পর্শে কৌড়ির কাছ থেকে নিয়ে ভদ্রমহিলা কৌড়িকে বিছানায় বসিয়ে সেটা গুছিয়ে রাখতে রাখতে বললেন।

‘সেটাতো আমি জানি তুমি পারবে।তুমি যে ভারী মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে এটা তোমাকে দেখেই বুঝে ফেলেছি আমি।তবে ভাবীর আদেশ,তোমাকে মায়ের মতো খেয়াল করতে বলেছেন।ভাইজান অসুস্থ বিধায় তারকাছ থেকে নড়ার গতি নেই ভাবিজানের।তাই তোমার খাবারটা নিয়ে আমাকেই আসতে বললেন।আর নির্দেশ দিলেন,মেয়েটার সাথে জেনো মায়ের মতো ব্যবহার করি, খেয়াল রাখি।

অবাক হয়ে ভদ্রমহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কৌড়ি।মহিলা যে স্বভাব চরিত্রে বেশ সহজ সরল স্বভাবের এটা বেশ বুঝলো সে।নামাজের বিছানাটা গুছিয়ে রেখে কৌড়িকে চুপচাপ বডে থাকতে দেখে তার পাশে এসে বসলেন মহিলা।ফের বললেন—মন খারাপ করোনা মেয়ে।সবার বাবা মা চিরকাল বেঁচে থাকেনা।এমনকি আমারাও চিরকাল বেঁচে থাকবোনা।এই দেখো আমাকে, এবাড়ির আশ্রিতা কিন্তু আমি।কিন্তু কেউ দেখলে বুঝতেই পারবেনা এবাড়ির আশ্রিতা আমি।সেই কোন ছোটো কালে বাবা মাকে হারিয়েছি,ঠিকঠাক বাবা মায়ের মুখটাও মনে নেই।রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করে বেড়াতাম।হঠাৎ একদিন ক্ষুধার জ্বালায় এবাড়ির বড়কর্তার পা আঁকড়ে ধরেছিলাম,উনার মনেহয় আমাকে দেখে হয়তো মায়া হয়েছিলো।তাই এবাড়িতে এনে ঠাই দিয়েছিলেন।সেই থেকে আমি এবাড়িতে।কতোগুলো বছর পার হয়ে গেলো এবাড়িতে।বুঝলে মেয়ে,এবাড়ির মানুষগুলো ভিন্ন ভিন্ন স্বভাবের হলেও সবাই বেশ ভালো।

কৌড়ির আশ্চর্যতা জেনো বাড়লো সামনের মহিলার সংক্ষেপন জীবন কাহিনি শুনে।তার থেকেও দুঃখের জীবন ছিলো এই মহিলার।সঙ্গে সঙ্গে মনেমনে আলহামদুলিল্লাহ যাপন করল কৌড়ি।কৌড়িকে অবাক উনার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভদ্রমহিলা ফের ব্যস্ততা দেখিয়ে বললেন।-এই দেখ,নিজের জীবন বৃত্তান্ত খুলে বসে তোমার খাওয়ায় দেরি করে দিলাম।খেয়ে নাও মেয়ে, বেলা অনেক গড়িয়েছে। আসরের আজান পড়লো বলে কথা।আর কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে আমাকে একবার ডাক দিও।

হঠাৎই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ভদ্রমহিলা।ফের বললেন–
জানো মেয়ে আমি কখনো মা হতে পারবো-না।তাই এবাড়ির প্রতিটি বাচ্চাগুলোকে আমি আমার সন্তানসম নজরে দেখি।আমার নাম রানি।তাই তারা সবাই আমাকে রানিসাহেবা বলে ডাকে।যদি-ও রানিসাহেবা নামটা নিভান বাবাই প্রথম ডেকেছিলো।সেই থেকে এই নামের উৎপত্তি,এই বাড়ির বাচ্চাগুলোর রানীসাহেবা আমি।তাই আমিও রানিসাহেবা সবার সবসময়ের আবদারে হাজির।তুমিও তোমার যেকোনো প্রয়োজনে, আবদারে এই রানিসাহেবাকে ডাকতে পারো।

মূহুর্তেই দৃঢ় গম্ভীর কণ্ঠের আওয়াজ এলো।-রানিসাহেবা আমাকে একমগ কফি দিয়ে যান তো।

একগাল হেসে দিলেন ভদ্রমহিলা। সেই হাসি মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখলো কৌড়ি।ভদ্রমহিলা ব্যস্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে কৌড়িকে উদ্দেশ্য করে ফের বললেন।

‘তাড়াতাড়ি খেয়ে নেবে কিন্তু মেয়ে,মন খারাপ করে খাবার না খেয়ে কিন্তু একদম বসে থাকবে-না।কেমন?আমি তোমার সাথে আরও গল্প করতাম।তবে নিভান বাবা সহজেই কফির অর্ডার করেনা।যদি না তার অতিরিক্ত মাথাব্যথা না করে।তাই সে যখন অর্ডার করে তার কাজটা সবার আগে।এটা আমার মনেহয় বুঝলে মেয়ে। নাও এবার লক্ষ্মীমেয়ের মতো খেয়ে না-ও।

ব্যস্ত ভঙ্গিতে দ্রুত পা চালিয়ে চলে গেলেন ভদ্রমহিলা।
সেদিকে বেশ কিছুসময় তাকিয়ে সামনে রাখা খাবারের দিকে মনোযোগ দিলো কৌড়ি।ভাত মাখিয়ে মুখে তুলতেই মনে হলো,গলায় ভিষণ ব্যথা তার।এই মুখে দেওয়া ভাতের লোকমাটা কিছুতেই তার গলা দিয়ে নামবে না।ভিষণ ব্যথা করছে।মুখ থেকে ভাতটা বের করার আগেই নিজের মুখের সামনে পানি ভরা কাঁচের গ্লাসটা নজরে পড়লো তার।কেউ একজন তার সামনে পানি ধরে দাঁড়িয়ে আছে….

চলবে….

ফুলকৌড়ি পর্ব-০১

0

#ফুলকৌড়ি
(১)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

—দিবা আপু,নিভান ভাইয়া বউ নিয়ে এসেছে।জানো কি সুন্দর দেখতে সে,আমাদের বাগানের সদ্য ফোঁটা শুভ্র বেলীফুলের ন্যায় রূপ তার।মলিনত্ব শুভ্ররঙা শাড়িতেও তাকে,স্নিগ্ধ বেলীফুলের ন্যায় সতেজ দেখাচ্ছে।এসো এসো দেখবে।কি সুন্দর দেখতে সে,তোমার থেকে-ও আর-ও বেশী খুব খুব সুন্দর।একটা জীবন্ত বেলীফুল সে।

কথাগুলো একনাগাড়ে বলে চঞ্চল পায়ে চলে গেলো মৌনতা।সেদিকে এখনো নিষ্পলক নজরে তাকিয়ে আছে দিবা।মেয়েটা এগুলো কি বলে গেল?নিভান বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছে?তা কি করে সম্ভব!নিভান তো মৃত ব্যক্তিকে দেখতে গিয়েছিলো,তবে?আর মৌনতা শেষে কি বলে গেলো,তার থেকে-ও সুন্দর নারী।সত্যি কি-তাই?যে সৌন্দর্যতার অহংকারে সে নিভানের মতো শ্যামবর্ণ পুরুষের বদৌলে অন্য কাওকে নিজের জীবনে বেছে নিলো।যদি-ও সেই সৌন্দর্যের অহংকার তারজন্য পতন বয়ে এনেছে।দীর্ঘশ্বাস ফেললো দীবা।নিভানের মতো ব্যাক্তিত্বপূর্ন ছেলেকে উপরে করা তার যে কত বড় ভুল হয়েছে এটা সে এখন প্রতিটি পদেপদে অনুভব করতে পারছে।হয়তো এই ভুলের মাশুল তাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে,আর আফসোস করে যেতে হবে।সেই নিভান তারচেয়ে-ও সুন্দরী রমনী বিয়ে করে নিয়ে এসেছে।মৌনতার কথা গুলো জেনো মন মানতেই চাইলো-না দিবার।এতোসময় হুঁশ হারিয়ে ফেলেছিলো জেনো সে।কথাগুলো মাথায় গেঁথে যেতেই তড়িৎ গতিতে বেড থেকে উঠে বসলো।চঞ্চল পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে নিচতলায় যাওয়ার জন্য সিঁড়িপথ ধরলো।তাড়াহুড়োর জন্য দু-একবার হোঁচট ও খেলো,তবে সেদিকে খেয়াল দিলো না।আর না নিজের পায়ে পাওয়া ব্যাথাকে গ্রাহ্য করলো।

.

বাড়িটার নাম “বেলাশেষে”।বিশাল বড় দুতলা বাড়িটার সদর দরজায় সামনে দাঁড়িয়ে উৎসুক মুখর বাড়ির প্রতিটি সদস্য,আর বাড়ির সদর দরজার ওপাশে স্ট্রেইট দাঁড়িয়ে আছে নিভান।বরাবরের মতোই মুখ অবায়বে কঠিনত্য ভাব তার।দুধে সাদা পাজামা পাঞ্জাবিতে শ্যামবর্ণের উঁচু-লম্বা পুরুষটার মুখের এই কাঠিন্যভাবটা জেনো সবসময় তার ব্যাক্তিত্বের সাথে বেশ যাচিত।শ্যামবর্ণ রঙটা বাদে ছেলেটার সবকিছু বেশ আকর্ষণীয় ছিলো দিবার কাছে।নিভানকে পেয়েও সে,এই রঙটার জন্যই নিভানকে উপেক্ষা করে দ্বিতীয় কাওকে নিজের জীবনে বেছে নিয়েছিলো।অথচ এখন ছেলেটার সেই শ্যামবর্ণ রঙটাই তাকে আকার্ষিত করে।অতি আকর্ষিত।কিন্তু..অতীত মনে পড়তেই ফের হুঁশ ফিরলো দিবার।তখন মৌনতার বলা কথাগুলো মাথায় আসতেই চকিতে নিভানের পাশে তাকালো সে।নজর স্থির হয়ে গেলো তার।বুকের মধ্যে কিছু হারিয়ে ফেলার আলোড়ন শুরু হলো।নিজের জীবনের বাজে অভিজ্ঞতার পর পুনরায় যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলো,তাকে আবার-ও হারিয়ে ফেলানোর ভয়!সিঁড়ির মাঝ বরাবর থেকে আর-ও দুকদম পা আচমকা আরও দুই সিঁড়িতে নামিয়ে দিলো দিবাকে।নিজের লোভী সিদ্ধান্তের কারনে জীবন এমনিতেই তাকে অনেকটা নিচে নামিয়ে দিয়েছে।এখন আর-ও নিচে!ভিতরটা হু হু করলেও,দিবার নজরটা সামনের পানেই স্থির রইলো।

চিকনচাকান বেলীফুলের ন্যায় শুভ্ররঙা শরীরে সাদা মলিন শাড়িটাও জেনো মেয়েটার মুখের সৌন্দর্যের অবায়বকে একটুও কমাতে পারি-নি।মেয়েটার ফোলা ফোলা নাকমুখ,ডগরডগর ঘনপল্লবিত ভেজা রক্তিম চোখজোড়া,সেই শুভ্ররঙা সৌন্দর্যের মায়া জেনো আরও চড়াও করে দিয়েছে।ইশ,মেয়েটা কাঁদছে কেনো?নিভানের মতো ছেলেকে কেউ জীবনসঙ্গী হিসাবে পেলে কাঁদতে আছে নাকি?শুভ্র শাড়ীর আঁচলের অংশবিশেষ কিছুটা মাথায় থাকার কারনে, কি সুন্দর দেখাচ্ছে মেয়েটাকে।সত্যিই কি এটা নিভানের বউ?তার রূপের অহংকার কি তবে চুরমার করে দিলো নিভান?

‘মেয়েটাকে এভাবে বাহিরে দাঁড় করিয়ে রাখলে কেনো ছোটো বউমা?কতোদূর থেকে এসেছে?তাতে মেয়েটার অবস্থা দেখেও তো ভালো মনে হচ্ছে না।দূর্বল লাগছে তাকে দেখতে।

ফাতেমা বেগমের গলার তীক্ষ্ণ আওয়াজ পেতেই সদর দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো সবাই।ফাঁক পেয়ে আশেপাশে তাকালো-না নিভান।বড়বড় কদম ফেলে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো।সিঁড়ি পথে দিবাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে-ও তাকে নূন্যতমও গ্রাহ্য করলো-না।না নিজের চলার পথ ধীর করলো,আর না নজর ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলো।এমনভাবে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে চলে গেলো,মনেই হলো-না তার আশেপাশে বা সামনে কেউ আছে।এই অগ্রাহ্যতা সেদিন থেকেই,যেদিন ওই শ্যাম পুরুষটাকে অগ্রাহ্য করে অন্য কাওকে বেছে নিয়েছিলো নিজের জীবনে সে।নিভান চলে যেতেই এবাড়ির ছোটো বউ স্বান্তনা রহমান উত্তর দিলেন।

‘বড়ভাবী আসার অপেক্ষা করছিলাম আম্মা।

ফাতেমা বেগম ধীর কদমে সামনে এগোলেন।আশি উর্ধ্বে বয়স হয়ে গেছে উনার।তবুও চেহারার জৌলুশ এখনো কমেনি আর না চলাফেরায় দূর্বল ভাব এসেছে। এখনো শক্তপোক্ত ভাবে চলাফেরা করতে পারেন। কিছুটা বিরক্তস্বরে তিনি বললেন।—কেনো?বড়বউমার অপেক্ষা কেনো করছো।একি নতুন বউ যে,বড় বউমা না এলে তাকে বরন করে ঘরে ঢুকাতে পারছো-না।সমস্যা কোথায়?আর বড় বউমা বা কোথায়?

‘দাদাভাই এসেছে দেখে আমি আম্মুকে ডাকতে গিয়েছিলাম দাদুমা।আব্বু ওয়াশরুমে গিয়েছে,তাই দাদাভাই এসেছে জেনেও আম্মু নিচে আসতে পারিনি।

এবাড়ির বড় মেয়ে মান্যতা।দাদিমার কথার উত্তর দিয়ে দিলো।দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ফাতেমা বেগম।দারজার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়ানো মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি।মেয়েটার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার নিরক্ষর করলেন।যে বয়োবৃদ্ধ নজরে সহজে কেউ মুগ্ধ হয় না, সেই নজরজোড়া মুগ্ধ হলো উনার।মেয়েটার মাথায় কাপড় দেওয়াটা আর মাথা নিচু করে থাকাটা আরও মুগ্ধ করলো উনাকে।নিজের কুঁচকে যাওয়া হাতটা দিয়ে আলতো স্পর্শে মেয়েটার চিকন কোমল হাতখানা ধরলেন তিনি। মূহুর্তেই কেঁপে উঠলো মেয়েটা।তবে মাথা উচু করলো না।কম্পনটা ফাতেমা বেগম-ও টের পেলেন।যদি-ও কোমল গলায় তিনি সহজে সবার সাথে কথা বলেন না তবে সামনে দাঁড়ানো মেয়েটার চোখমুখে শোকের আনাগোনা এখনো সতেজভাবে পরিলক্ষিত।তাই তিনি গলার চড়াও আওয়াজটা বের করতে পারলেন না।নামনীয় গলায় শুধালেন।

‘নাম কি তোমার?

এবারেও মাথা উঁচু করলোনা মেয়েটা।এই সামনে দাঁড়ানো মানুষগুলো তার সম্পূর্ণ অচেনা।যদিও তাদের মুখ দেখেনি এখনো।শুধু পায়ের আবরণ গুলোই দৃষ্টি গোচর হয়েছে তার।যে মানুষটার সাথে এতো পথ পাড়ি দিয়ে এবাড়িতে এসেছে,সেই মানুষটাকেও পর্যন্ত নজর তুলে দেখা হয়নি।মানুষটা কে? আর কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাকে?সংকোচ,দ্বিধা তারমধ্যে একটু বেশি।একা একা মানুষ হওয়ায় সহজে সে কারও সাথে মিশতে পারে-না।বাহিরের অপরিচিত কারও সাথে কথা বলতে গেলেও সেই দ্বিধাটা সহজেই স্বভাবে তার ধরা দেয়।তবে বাবার উপদেশ আদেশ,নিজের স্বভাব ব্যবহারেও যে সে পরিলক্ষিত রাখতে চায়।হঠাৎ বাবা কথা মনে পড়তেই কলিজা মোচড় দিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠলো মন।কান্নারা গলায় এসে ফের দলাপাকিয়ে যন্ত্রণা দিল।সামনে অপেক্ষারত বয়োবৃদ্ধার শুধানো উত্তরখানা মুখ থেকে বের হতেই চাইলো না।সামনে দাড়িয়ে থাকা অভিজ্ঞ বৃদ্ধা নারীটা জেনো সেটা বেশ বুঝতে পারলেন।ফের নরম কন্ঠে শুধালেন।

‘বলবে না তোমার নাম কি?

‘কৌড়ি।

কান্না গলায়ও নিজের নামটা তড়িঘড়ি করে বললো কৌড়ি।নাহলে সামনে দাড়ানো বয়োবৃদ্ধার সাথে যে বেয়াদবি হয়ে যাবে।কৌড়ির উত্তর পেয়ে মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়া কিছু বলতে যাবেন ফাতেমা বেগম।তার আগে প্রানবন্ত কন্ঠে পাশ থেকে কেউ বলে উঠলো।

‘ফুলকৌড়ি নাকি পানকৌড়ি।কোনটা তোমার নাম?

স্বান্তনা রহমান সঙ্গেসঙ্গে ছেলের পানে চোখ মোটামোটা করে কঠিন চোখে তাকালেন।অসভ্য ছেলের কোথা-ও মুখ স্থির থাকেনা।সম্মানের বারো বেজে যায়,এই ছেলে যেখানে থাকে।মুখ কাচুমাচু করে মাথা নিচু করে নিলো নাফিম।সে তো সবসময় সত্য কথা বলে তবে কেনো তাকে সবসময় এরকম চোখ মোটামোটা করে, বকে ধমকিয়ে শাসন করা হয়।ভাল্লাগেনা তার একটুও।তবে কৌড়ি নামের মেয়েটার তার ভীষন ভালো লেগেছে।কি শান্ত।তার আপুদের মতো এতো বকবক করেনা।আর কি সুন্দর দেখতেও।সবাই বলে এ-বাড়ির মেয়েগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দিবা আপু সুন্দর।তার-ও মনেহয়।তবে আজ থেকে দিবা আপু কাট।দিবা আপুর থেকে কতো সুন্দর এই মেয়েটা।এতোসময় সে হা হয়ে দেখেছে।সবাই দাদাভাইকে বিয়ে দেওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে,অথচ দাদাভাই এতো সুন্দর সুন্দর মেয়ে দেখেও বিয়ে করতে চায়না।অথচ এবাড়ির কেউ তাকে একবারও বিয়ে করার কথা বলেনা।তাকে বিয়ে করার কথা বললে,সে আগে যাকে পছন্দ করতো করতো।এখন নির্দ্বিধায় এই ফুলকৌড়ি নাকি পানকৌড় নামক মেয়েকে বিয়ে করতে চাইবে।বাড়ির সবাই দাদাভাইকে বিয়ে দেওয়ার জন্য যখন দাদাভাইয়ের মতামত চেয়েছিলেো,নিশ্চয় তারও চাইবে।তো ছেলের মতামত সরূপ দাদাভাই বিয়েতে রাজী নাহলেও সে অবশ্যই রাজী হবে।এবং বলবে,এই ফুলকৌড়ি নামক মেয়েটাকে তার বউ হিসাবে চাই।চাই মানে চাই।যদিও দাদাভাইয়ের মতো এখনো বড় হয়নি।তবে সে মেপে দেখেছে,দাদাভাইয়ের হাটু পর্যন্ত সে।আর মাথা পর্যন্ত হতে কতক্ষণ….

‘ওই পাকা বুড়ো কি ভাবছিস?নিশ্চয় আবোলতাবোল?না হলে তোর মুখ থেকে এতো উল্টোপাল্টা কথা বের হতো না।

মান্যতার সুক্ষ আপমানমুলক কথাগুলাে গায়ে মাখলো না নাফিম।এগুলো তার সয়ে গেছে।বোনেরা তাঁকে এভাবেই কারনে অকারনে পচায়।নিজের আশপাশটা ফাঁকা দেখে চঞ্চল গলায় শুধালো।

‘আপু,ওই সুন্দর মেয়েটা কোথায় গেছে।

‘তুই যখন তোর আবোলতাবোল গবেষণায় ব্যস্ত ছিলি, দাদিমা তখন ওকে ঘরে নিয়ে গেছেন।ক্যান বলতো?

কপাল কুঁচকে শেষের প্রশ্নটা করল মান্যতা।সেটা দেখে একগাল বোকাবোকা হেসে দিলো নাফিম।ফের বললো।—মেয়েটা খুব সুন্দর তাই-না আপু।কি সুন্দর দুটো মোটামোটা চোখ দেখেছো?আমার না খুব সুন্দর লেগেছে ওই মোটামোটা চোখ দুটো।

নজর মান্যতারও আটকে গিয়েছিলো কৌড়ির সৌন্দর্যে তাই সেও অকপটে স্বীকার করলো।—ঠিকই বলেছিস মেয়েটা আসলেই খুব সুন্দর।এমনকি আমাদের দিবা আপুর থেকেও বেশি সুন্দর।

মুখে সুন্দর হাসি ফুটিয়ে কথাগুলো বললেও ফের নাফিমের দিকে কপাল কুঁচকে বললো—সুন্দর মেয়ে মানেটা কি?আবার সৌন্দর্যের বিবরন ও দিতে শিখেছো দেখছি।মোটামোটা সুন্দর চোখ,ব্যাপার কি?

কথাগুলো বলতেবলতে নাফিমের কান চেপে ধরলো মান্যতা।চোখ পাকিয়ে তাকাতেই নাফিম মুখ ভার করে বললো।
‘সুন্দর মেয়ে মানে সুন্দর মেয়ে।আমার তাকে খুব পছন্দ হয়েছে তো আমি কি করবো।হুমম।

‘খুব পেকে গেছো।এই বয়স কতো তোর?

‘কেনো তুমি জানো না।সেদিন না তোমরা সবাই মিলে আমার এগোরোতম জন্মদিনের উইশ করলে আমাকে।এখন আবার না জানার রংঢং করছো।

মান্যতা কথাটা কথার কথা বলেছিলো।কিন্তু এই ছেলে যে মহা সেয়ানা এটা মাথায় ছিলো-না তার।কান ছেড়ে দিয়ে চোখ পাকিয়ে ফের বললো।–খবরদার ওই মেয়েকে একটুও বিরক্ত করবি না।মেয়েটার বাবা মারা গিয়েছে।তাতে মেয়েটার শরীর মন দুটোই খারাপ।বুঝলি তো?

হঠাৎ চঞ্চল ছেলেটা শান্ত বাচ্চা হয়ে গেলো।সেটা দেখে মান্যতা মৃদু হেসে নাফিমের হাতটা নিজের হাতে জড়িয়ে নিয়ে বললো—চল দেখে আসি মেয়েটা কি করছে।তোর মতো আমার-ও না তাকে খুব ভালো লাগছে।

নাফিমও বোনের কথায় সায় দিয়ে মান্যতাকে অনুসরন করলো।

.

দিবা এখনো সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে।আগে মৌনতা প্রশংসাবানী এখন মান্যতারও অতিরিক্ত প্রশংসা।যদিও নিজে চোখে দেখেছে তবে কৌড়ির প্রসংশা শুনতে একটুও ভালো লাগলো-না তার।মূহুর্তেই যে সৌন্দর্যে সবাই বিমোহিত হলো,নিভান কি মেয়েটাকে মোটেও- দেখে-নি।যদি দেখে থাকে তবে সবার মতো সেও সেই সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে পড়লো নাতো?মনটা হাসফাস করে উঠলো দিবার।ঘাড় ঘুরিয়ে উপরতলার কাঙ্ক্ষিত রুমটার দিকে তাকালো সে।খোলা দরজায় লাগানো আভিজাত্যপূর্ণ স্বর্ণালি পর্দাগুলোর স্থিরতা ছাড়া আর কিছুই নজরে পড়লোনা তার।

—স্যরি আপু,তখন তোমাকে ভুল কথা বলার জন্য।কিন্তু আমি মিথ্যা বলিনি।আম্মু যেটা আমাকে বলেছে সেটাই বলেছি আমি।কাল থেকে দাদাভাইকে বাড়িতে না দেখে আম্মুকে যখন জিজ্ঞেস করলাম।দাদাভাই কোথায় গেছে,দাদাভাইকে দেখছি না কেন?আম্মু তখন বলেছে দাদাভাই বিয়ে করে বউ আনতে গেছে।কিন্তু আম্মু যে তখন কথাটা রাগ করে বলেছিলো,এটা আমি বুঝতে পারিনি।

মুখে হাসি ফুটতে না চাইলেও জোর করে মুখে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করলো দিবা।ফের সহজ সরল মৌনতার কাচুমাচু মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো–ঠিক আছে পাগলি আমি কিছু মনে করিনি।তুই কোথায় যাচ্ছিলি যা।

চলে গেলো মৌনতা।মৌনতা বয়সে ছোটো হলেও,বরাবর বাড়ির প্রতিটি ব্যক্তির বিষয়ে তার কৌতুহল বেশি।কে কোথায় গেছে, আজ বাড়িতে কে নেই?নেই কেনো?কার মন খারাপ, মনখারাপ কেনো?কি হয়েছে তার?কে খেয়েছে না খেয়েছে,তবে খায়নি কেনো?ক্লাস সেভেনে পড়লে-ও মেয়েটার এসব বিষয়ে খেয়াল ধ্যান একটু বেশিই।ছোটো মামি হয়তো কাজে ব্যস্ত ছিলো,সেই ব্যস্ততার মধ্যে গিয়ে মেয়েটা হয়তো বারবার জিজ্ঞেস করছে “দাদাভাই কোথায়?তাই হয়তো উত্তর সরূপ এমন কথাই বলে দিয়ছেন মামি।দীর্ঘশ্বাস ফেললো দিবা।তবে নিভান মেয়েটাকে বউ করে না নিয়ে আসলেও,সবার মতো নিশ্চয় মেয়েটার সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়েছে।আর সেই আকৃষ্টতায় সম্পর্ক তৈরী হতে কতক্ষণ!

ভাবনাটা মাথায় আসতেই মূহুর্তেই পা চালিয়ে উপরে সেই কাঙ্ক্ষিত রুমটার দিকে পা বাড়ালো দিবা।যদিও উপেক্ষা আর অপমান ছাড়া সেই মানুষটার থেকে কিছুই মিলবে-না।তবু-ও তার যে নিজের মনে চলা প্রশ্নের উত্তরের বিহিত চাই।নাহলে যে খাওয়া ঘুম হারাম হয়ে যাবে তার।রুমটার সামনে এসে বুঝতে পারলো,দরজাটা খোলা।নিস্তব্ধতায় ঘেরা শুনশান রুমটা ভিতরে পা রাখার আগেই গম্ভীর বজ্রকন্ঠের কঠিন ভাষায় আওয়াজ এলো।

‘কার অনুমতি নিয়ে রুমে ঢুকতে যাচ্ছিলি?যেখানে দাঁড়িয়ে আছিস সেখানেই থেমে যা।কিছু বলার থাকলে সেখান থেকেই বল।নাহলে,গেইট আউট ফর্ম মাই রুম।বাড়িটা তোর মামুর হলেও রুমটা আমার।সেখানে প্রবেশ করতে গেলে অবশ্যই নিভান আওসাফ আহমেদ এর অনুমতি লাগবে।

পুরুষালী গলার কাঠিন্য আওয়াজে বুকের ভিতর কম্পন শুধু হলো দিবার।পর্দার এপাশ থেকেও নিভানের শক্তপোক্ত চোয়াল না দেখেও অনুভব করতে পারলো সে।তবুও নিজেকে যতসম্ভব স্বাভাবিক রেখে কাঁপা গলায় বললো।–এতো কড়াকাড়ি কিন্তু আগে সেভাবে ছিলোনা আমার সাথে।

‘পাস্ট ইজ পাস্ট।অতিতের প্রভাব নিভান আওসাফ আহমেদ সহজে তার বর্তমান লাইফে আচ ফেলতে দেয়না।সেটা নিয়ে ঘাটাঘাটি করা-ও তার স্বভাব নয়।যে থুতু সে একবার মুখ থেকে উগড়ে ফেলে দিয়েছে,সেই থুথু কোথায় গিয়ে পড়লো।তা দেখা তো দূর সেটা মাড়ানোর সময়ও নিভান আওসাফের নেই।সো আউট।আর দ্বিতীয়বার এই রুমে প্রবেশ করার কথা মাথাতে আনার আগেও দশবার চিন্তা ভাবনা করে নিবি।নয়তো নিভান আওসাফ আহমেদকে তো তোর চেনা আছে।

দিবা এখনো থু-থুতেই আঁটকে আছে।নিভান তাকে থুথুঃ এর সাথে তুলনা করলো।যে মেয়েটাকে একসময় সে নিজের জীবন সঙ্গী হিসাবে পেতে চেয়েছিলো,সেই মেয়েটাকে এতো বাজেভাবে আপমান করতে পারলো সে।মূহুর্তেই টানাটানা চোখজোড়া ভরে উঠলো দিবার।হয়তো এই বাজেভাবে আপমানটা তার যথাযথ প্রাপ্য ছিলো।আর একমুহূর্তও এখানে থাকতে ইচ্ছে করলোনা। পা চালিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে কাঁদতে মন চাইলো।তবে সেই কাঙ্ক্ষিত প্রশ্নটা যে এখনো বাকি।আপমান যখন গায়ে মেখেছে আরও একটু নাহয় মাখলো।কিন্তু নিভানের কাছ থেকে প্রশ্নটার ভালোমান্দ উত্তর না নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত যে তার শান্তি মিলবেনা।পরপর কয়েকবার ঢোক গিলে কান্না আটকানো গলাটা স্বাভাবিক করে নেওয়ার চেষ্টা করলো দিবা।ফের নিভানকে উদ্দেশ্য করে শুধালো।

‘তুমি মেয়েটাকে দেখেছো?তুমিও নিশ্চয় ওই মেয়েটার সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে গেছো, তাইনা?

দিবার ইঙ্গিত মূহুর্তেই বুঁজে আসলোনা নিভানের।গম্ভীর গলার স্বর তবুও হঠাৎই আপনাআপনি মুখ থেকে বের হয়ে গেলো–কে?

‘যে মেয়েটাকে তুমি নিয়ে এসেছো।কৌড়ি।

চলবে কি?

এমনই শ্রাবণ ছিল সেদিন পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব

0

#এমনই_শ্রাবণ_ছিল_সেদিন
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি

১১.
টিএসসির মোড়ে রাজু ভাস্কর্যের আশপাশে সব জায়গায় লোকে লোকারণ্য। সবাই শ্যুটিং দেখতে দাঁড়িয়ে পড়েছে। বামপাশের বটতলায় ভাপা পিঠা বিক্রি হয়। সেখানেই আজকের শ্যুটিংটা চলছে। আজকে শট আমিন নিচ্ছে। মেহফুজ চুপচাপ পাশে বসে আছে শুধু। আর মাত্র পাঁচটা মিনিট বাকি শট শেষ হতে।

গাড়ি থেকে কফির ওয়ানটাইম ইউজ মগগুলোতে খেয়াম প্রায় দশজনের জন্য কফি ঢালল। দায়িত্বটি ইব্রাহীমের ছিল। বেচারা শীতের মধ্যে জ্বর লাগিয়ে কাজ করতে এসেছে। তাই দায়িত্বটা খেয়াম নিয়ে কফির মগটা আগে তার হাতেই দিলো। এরপর চলল মেহফুজ আর অন্যান্য সহকারীর কাছে। মেহফুজ সামনে কলাকারদের অভিনয় দেখতে ব্যস্ত ছিল। খেয়াম হঠাৎ করেই কফির মগটা তার সামনে ধরতে সে বেশ তির্যক দৃষ্টিতে তাকাল আর বলল, ‘ডাক না দিয়ে মুখের ওপর মগ ধরা কী ধরনের কাজ?’

-‘মগটা দেওয়ার সময়ই তো ডেকেছিলাম।’ একটু অপরাধীর মতো মুখ করে বলল খেয়াম।

মেহফুজ কথা বাড়াল না। মগটা হাত থেকে নিয়ে নিলো চুপচাপ। খেয়াম বাকিদের কফি দেওয়া শেষ করে গাড়ির কাছে চলে এল। ততক্ষণে শট নেওয়া শেষ। আজ তরঙ্গের কোনো শিডিউল ছিল না। তাই আজ সেটে সে নেই। শট শেষ করে সবাই ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর মাঝে খেয়াম একটু ফ্রি। তাই সে হাঁটতে হাঁটতে একজন ভাপা পিঠা বিক্রেতার কাছে এল। এবার শীতে আর বাড়ি যাওয়া হয়নি। তাই আর মায়ের হাতের পিঠা খাওয়ার সুযোগও হয়নি। তবে কেনার সময় পড়ল এক মসিবতে। সেটের কয়েকজন তাকে পিঠা কিনতে দেখে মজা করে বলে উঠে পিঠা তাদেরও খাওয়াতে। তারা মজা করে বললেও খেয়াম প্রায় সবার জন্যই পিঠা কিনে আনে। গরম গরম ধোঁয়া তোলা ভাপা পিঠার লোভ আর কেউ সামলাতে পারে না। ইমরান দুটো নিয়ে একটি মেহফুজকে দেয়। মেহফুজ অনাগ্রহ দেখায়, ‘আমার ভালো লাগে না এগুলো। তোরা খা।’

ইমরান পিঠাতে কামড় বসাতে বসাতে বলে, ‘আরে ব্যাটা খাইয়া দ্যাখ। ভালোই লাগে।’
বলেই আবার মেহফুজের দিকে এগিয়ে ধরে। মেহফুজ অনাগ্রহের সাথেই হাতে নেয়। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে খেয়াম। সে অবশ্য নিয়ে যাওয়ার জন্য কিনতে চেয়েছিল। কিন্তু তা আর সম্ভব হয়নি বলে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়েই সবার সঙ্গে খাচ্ছে। মেহফুজের ভাপা পিঠা মোটেও পছন্দের নয়। শেষ কবে খেয়েছে তাও তার মনে নেই। ইমরানকে দেখে একবার পাশে খেয়ামের দিকে তাকাল। কী মজার সঙ্গে খাচ্ছে তারা! প্রায় সবার কাছেই এই পিঠা খুব প্রিয়। তার কেন ভালো লাগে না সেটা সেও জানে না। সবার এই মজা নিয়ে খাওয়া দেখেই সেও এক কামড় দেয়। কিন্তু তা মুখে ঢোকা পর্যন্তই। গলা দিয়ে আর নামল না যেন। মুখের মধ্যে নিয়ে মুখটা বুঁজে গোল করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সে। এটা খাওয়া তার পক্ষে জীবনেও সম্ভব নয়। মুখের অংশটুকু ফেলে দেওয়ার মুহূর্তেই সে দেখল দুটো বাচ্চা ছেলে খেয়ামের কাছে টাকা চাইছে খাওয়ার জন্য। খেয়াম পিঠা খেতে খেতে তাদের জিজ্ঞেস করে, ‘টাকা দিয়ে কী করবি?’

একজন উত্তর দেয়, ‘পিডা খামু।’

খেয়াম কথার মধ্যেই হঠাৎ মেহফুজের দিকে তাকাল। তার দিকেই তাকিয়ে আছে সে। পিঠাটা সে এমনভাবে ধরে দাঁড়িয়ে আছে যেন ফেলেই দেবে সে। খেয়াম তা বুঝতে পারল। আর সাথে সাথেই জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি ওটা ফেলে দিচ্ছেন?’

মেহফুজ হ্যাঁ বলতে পারল না। বেশ লজ্জা লাগছে হঠাৎ। খেয়াম ইতোমধ্যে নিচে তাকিয়ে দেখে নিয়েছে মেহফুজের ফেলে দেওয়া অংশটুকু। তাই সে নিশ্চিত হয়েই জিজ্ঞেস করেছে। মেহফুজের চুপ থাকার বিষয়টাও খেয়াম বুঝতে পারল।

-‘ওটা আমাকে দিন। ফেলার প্রয়োজন নেই।’ তার মিষ্টি হাসিটা হেসে বলল।

মেহফুজ সেই হাসি মুখটা এক ঝলক দেখল। তারপর পিঠা তার হাতে তুলে দিয়ে নিজের গাড়ির কাছে এসে দাঁড়িয়ে নয়নের কাছে পানি চাইল। নয়নের পানি নিয়ে আসার সময়টুকুতে মেহফুজ ফিরে দেখল আবার খেয়ামকে।
বাচ্চাদুটো বলছে, ‘আফনে ট্যাহা দ্যান। কিইন্না খামু। খাওয়াতা খামু না।’
খেয়াম চোখ পাকিয়ে তাকাল ওদের দিকে, ‘আমি বলেছি তোদের এঁটো পিঠা দেবো? আর তোরা তো রাস্তায় ফেলে দেওয়া খাবারও খাস। এখন খুব শুচিবাইগিরি দেখাচ্ছিস, না? তোদের তো দরকার টাকা। সেটা তো জানি। আর টাকাটা তো তোদের কাছে রাখবি না। আমি তোদের টাকা দেবো না। পিঠা খাবি বলেছিস পিঠা খাওয়াব। খেলে খা, না খেলে ভাগ।’

-‘আইচ্ছা পিডা দ্যান। পিডা খামু।’

সেটা শুনে খেয়াম নিজের পিঠা দুটো দিয়ে দিলো ওদের। আর মেহফুজের একটু খাওয়া পিঠাটা সে ফেলল না। মেহফুজ পানির বোতলটা হাতে ধরে রেখে দেখল সেই অচিন্ত্য দৃশ্য। খেয়াম তার এঁটো করা পিঠাতে কামড় বসাচ্ছে আর খেতে খেতে গল্প করছে বাচ্চা দুটোর সাথে।
***

আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন,
ঝর ঝর ঝর ঝর ঝরেছে,
তোমাকে আমার মনে পড়েছে।
তোমাকে আমার মনে পড়েছে।।

সহসা বৃষ্টির ছাটে ঘুমটা ভেঙে গেল খেয়ামের। আর তারপর কানে পৌঁছল লতা মঙ্গেশকরের মিষ্টি গান ‘আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন।’ রাহি গাইছিল। গানটা মেয়েটা বরাবরই দারুণ করে। শ্রাবণের সকালটা এমন গানে শুরু হওয়াই মনটা আনন্দে হয়ে নাচতে চাইল তার।
শিয়রের জানালাটা খোলা। এ জন্যই বৃষ্টি বিন্দু বুঝি তার সঙ্গে দুষ্টুমিতে মত্ত হয়েছে। দুষ্টুমির বাহানায় যেন সে বলছে, “আলসে মেয়ে! দেখ পৃথিবীটা জেগে গেছে। তুই কেন পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস?”

ছাই রঙে ঢেকে গেছে আকাশের নীল সীমানা। মাঝে মাঝে জানালার পাশ দিয়ে শোনা যাচ্ছে রিকশার টুংটাং শব্দ। ঝুম বৃষ্টি চারপাশে। বৃষ্টির ঝমঝম আওয়াজ বিনা আর কোনো শব্দ নেই। বৃষ্টিতে চারপাশ নিশ্চুপ। ব্যস্ত শহরের কোলাহল নিশ্চুপ।

বিছানা গুছিয়ে নতুন বাসার ছোট্ট ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল খেয়াম। এই বর্ষণেও কর্মজীবী মানুষগুলো থেমে নেই। স্কুলব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে শিশুরাও নেমে গেছে পথে। মাথার ওপর নানা ঢঙের ছাতা মেলে চলছে তারা। পাশ থেকে গান গাওয়া সেই মিষ্টকণ্ঠী বলল, ‘শুভ শ্রাবণ সকাল।’ খেয়াম তা শুনে মিষ্টি করে হাসল, ‘বেশ বললি তো। শুভ শ্রাবণ সকাল।’

-‘নে, চা’টা ধর। আবার গরম করে নিয়ে এলাম।’

-‘এত কষ্ট করতে গেলি কেন?’ চায়ের কাপটা সে রাহির হাত থেকে তুলে নিতে নিতে শুধাল।

রাহি সেই প্রশ্নকে অবজ্ঞা করে বলল, ‘খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজাও তৈরি। চটপট হাত-মুখ ধুয়ে নে।’

খুশিতে খেয়াম আত্মহারা, ‘কী বলিস দোস্ত! আজকের সকালটা এত এত দারুণ কেন? সকাল সকাল বর্ষণ, তোর গান, এরপর খিচুড়ি আর ইলিশ। উফ! আমি তো পাগল হয়ে যাব।’ রাহি হাসতে হাসতে ঘরে চলে গেল। ঘর থেকে বলল, ‘আচ্ছা শোন, আঙ্কেল ফোন করছিলেন আমাকে। বললেন তোর মেহফুজ সাহেবের বাসায় যাচ্ছেন। ওখান থেকে ফিরে এসে নাশতা করবেন আমাদের সঙ্গে।’ খেয়ামও ঘরে ফিরে এল, ‘ওহ্, আমাকে নিশ্চয়ই ফোন করছিল বাবা। না পেয়ে তাই তোকে করছে। কিন্তু এত সকাল সকাল গেল কেন?’

-‘আমি জিজ্ঞেস করছিলাম এ কথা। বললেন তোর গুরুগম্ভীর সাহেব সকালেই যেতে বলছেন।’

চা’টা শেষ করে খেয়াম ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। পরীক্ষা শেষে দেশের বাড়ি চলে গিয়েছিল সে। মাস দুই পর ফিরে রাহিকে সঙ্গে করে মিরপুর দশের দিকে এসে এক রুমের একটি বাসা খুঁজে নিয়েছে। জায়গাটা যানজটপূর্ণ হলেও রাহির বুদ্ধিতেই এদিকে আসা।

-‘এত সকাল সকাল এমন নামিদামি মানুষদের ঘুম ভাঙে?’
খেয়ামের প্রশ্নটা শুনে রাহি ফোনের স্ক্রিন থেকে নজর উঠাল। তারপর বলল, ‘হেলথ কনশিয়াস হলে অবশ্যই সকাল সকাল ঘুম থেকে জাগবে। আর তোর সাহেবকে দেখে তো মনে হলো তিনি খুবই স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ। ওনার ফিটনেস দেখিসনি?’

-‘তুই তখন থেকে আমার সাহেব আমার সাহেব করতেছিস ক্যান? ব্যাটার স্বাস্থ্যের দিকে জীবনে একবারই ভুল করে তাকাইছিলাম। এরপর আর সাধ জাগে নাই। তোর মতো অত বেহায়া নজরে দেখি নাই।’
কাটকাটভাবে বলল খেয়াম। এরপর রান্নাঘরের দিকে এগোলো সে। রাহি হাসল ভীষণ। তাকে হাসতে দেখে খেয়াম আবার কটমট চোখে তাকায়।
***

প্রথমবার আরিফ বন্ধুর বাড়িতে এসে উপরের ঘরটাতে এলেন। মেহফুজ তাকে আজ নিজের ঘরের ব্যালকনিতে বসতে দিয়েছে। সামনের টি-টেবিলটাতে এক মগ ধোঁয়া তোলা কফি। পাশেই গোছানো ভাঁজে পড়ে আছে ‘প্রথমআলো’ পত্রিকা। আর আকাশজুড়ে এখন কালো মেঘের ঘনঘটা। গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে। মৃদুমন্দ বাতাসের মাঝে টিপটিপ করে গুঁড়ি পড়ছে।

বেশ মুগ্ধ হলেন আরিফ। সামান্য ব্যালকনিটাও কী সুন্দর যত্নে সাজানো। মেহফুজের সাথে যতবার ফোনে কথা বলেছেন ততবারই মুগ্ধ হয়েছেন তিনি। ভয় বুকে নিয়ে ফোনটা করতেন। ভাবতেন এত বড়ো মাপের মানুষ তার ফোনটা কি রিসিভ করবে? আর রিসিভ করলেও নিশ্চয়ই বিরক্ত হবে! কিন্তু সে সব ভাবনা বারবারই বদলেছে তার। কী অমায়িক সুরে কথা বলে ছেলেটা! ফোন করলে সালামটাও দিতে ভোলে না। আর কাল রাতে ফোন করতেই সে খুব সকালে এসে দেখা করতে বলল নিজের বাড়িতে। আসার পর তিনি ভাবেননি এভাবে মেহফুজের থেকে আতিথেয়তা পাবেন। প্রাণভরে দোয়া করলেন তার জন্য। কফির দিকে খেয়ালই নেই আরিফের। ব্যালকনির সৌন্দর্য আর সামনে লনের সৌন্দর্যটুকু দেখছেন বিমোহিত নয়নে। কত যত্নে গড়া সবটা!

-‘আঙ্কেল দাঁড়িয়েছেন যে? কফিটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো।’

-‘আমি দেখছিলাম তোমাদের এত সুন্দর সাজানো-গোছানো বাড়িটা।’

আরিফ যখন আসেন তখন মেহফুজ বাথরুমে ছিল। গোসল শেষ হওয়া মাত্রই এসে দাঁড়াল সে। মৃদু হেসে আরিফকে প্রস্তাব জানাল, ‘নিচে চলুন নাস্তা করে নিই। তারপর ধীরে-সুস্থে কথা বলা যাবে।’ এ প্রস্তাবে আরিফ একটু বিব্রত হয়ে পড়লেন, ‘আরে না না। তুমি করে এসো। আমি অপেক্ষা করছি, সমস্যা নেই।’

-‘আমি নাশতা করব আর আপনি বসে থাকবেন? এটা কী করে হয়? আসুন প্লিজ। আর না করবেন না। মা অপেক্ষা করছেন আমাদের জন্য।’

নীহার ছেলের আবদারে খিচুড়ি রান্না করেছেন। সঙ্গে ইলিশ মাছ ভাজা, বেগুন ভাজা, ডিমের অমলেট আর জলপাইয়ের চাটনি। নাশতা টেবিলে সাজিয়ে তিনি মুনকে ডাকতে গেছেন। মেহফুজ নিচে আসতেই কাজের মেয়েটি চেয়ার টেনে দিলো। আরিফ বসলেন তার সঙ্গে। তার মধ্যেই নীহার নেমে এলেন।

-‘অনেক খুশি হলাম ভাই। আমিই আপনাকে ডাকতে চেয়েছিলাম। আসার পর তো তেমন করে আপনার যত্ন নিতে পারিনি। আজ একটু মুখে তুলুন আমাদের বাড়ির অন্ন।’ বলে নীহার মেহফুজের সামনের চেয়ারটা টেনে বসলেন।
আরিফ হালকা হাসলেন, ‘মেহফুজের কথায় আর না বসে পারলাম না।’

-‘বেশ করেছেন। সত্যিই অনেক খুশি হয়েছি।’

নাশতা শেষে মেহফুজ আরিফকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। গাড়িতে যেতে যেতে কথা আরম্ভ করল তারা।
-‘আসলে আজকের শট ঢাকার বাইরে হবে তো তাই দ্রুতই আসতে বলেছি আপনাকে। আমি আপনাকে পৌঁছে দিয়ে তারপর স্টুডিয়োতে যাব।’

-‘এত কষ্ট করতে হবে না বাবা। আমাকে সামনেই নামিয়ে দিয়ো।’

-‘এই বৃষ্টিতে আর কষ্ট করতে হবে না আঙ্কেল। কী যেন বলতে চেয়েছিলেন?’

-‘হ্যাঁ, খেয়ামের কাজের ব্যাপারেই কথা বলার ছিল।’

-‘আচ্ছা। আপনার সঙ্গে লাস্ট যখন কথা হয়েছিল তখন বলেছিলেন সামনে ওর পরীক্ষা। এর জন্য আপাতত কাজ করতে পারবে না ও।’

-‘হ্যাঁ। পরীক্ষার পর তো বাড়িতে গিয়ে থেকেছে দুমাস। এরপর ঢাকায় ফিরেছে। কিন্তু তোমার কাজের কোনো শিডিউল ছিল না বলে আর যোগাযোগ করেনি তোমার সাথে।’

-‘এক সপ্তাহ হলো আমার কাজ শুরু হয়েছে আবার। ও কি এখন কাজে আসতে চায়?’

-‘আসলে ও একটু খামখেয়ালি ধরনের। এ জন্য তোমার সাথে যোগাযোগ করেনি। তোমার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে ওকে কি কাজে নেওয়া সম্ভব?’

-‘এই ব্যাপারটা ও নিজেই যোগাযোগ করে আমাকে কিংবা আমার ব্যক্তিগত সহকারীকে জানাতে পারত। আপনাকে এত কষ্ট করে কেন পাঠিয়েছে? আপনারা আমার পূর্ব পরিচিত মানুষ। আপনাদের একটু সাহায্য করতে পারলে আমার ভালোই লাগে। এতে আপত্তি থাকার কিছু নেই।’

-‘ও ভেবেছিল এভাবে কাজ করাটা কেউ মেনে নেবে না। তুমি হয়তো রাজি হবে না। তাই যোগাযোগ করেনি।’

এ পর্যায়ে মেহফুজ খানিকটা বিরক্ত হলো খেয়ামের ওপর। সে চেয়েছিল পরীক্ষা শেষ করেই খেয়াম কাজে ফিরুক। বলতে নেই, সে একাকী সময়গুলোতে কখনো কখনো ভেবেছে তাকে নিয়ে। অপেক্ষা করেছে তার ফোন আসার। যখন দুমাস, তিনমাস করে চার-পাঁচ মাস কেটে গেল সে ধরেই নিয়েছিল খেয়াম আর ফিরবে না। অথচ, সে খেয়ামকে আশ্বস্ত করেছিল তার পড়াশোনার জন্য যখন প্রয়োজন আর যতদিন প্রয়োজন ছুটি নিতে পারবে। এরপরও মেয়েটির এমন চিন্তাভাবনা জন্য তার প্রতি ধীরে ধীরে মেজাজ খারাপের সৃষ্টি হলো মেহফুজের।

-‘আপনি ওকে বলবেন নয়নকে কল করে যেন আমার শিডিউলগুলো জেনে নেয়।’
***
‘অন্তিম পর্ব’
অনলাইনের জন্য এটাই অন্তিম পর্ব। এই উপন্যাসের আর কোনো পর্ব প্রকাশিত হবে না পেইজে৷ কোনো ই-বইও করা হবে না। পড়তে চাইলে বই সংগ্রহ করে পড়তে হবে পাঠককে। বইটি স্বপ্নবাড়ি বুকশপ সহ অনলাইন যে কোনো বুকশপ থেকে নিতে পারেন।
***

এমনই শ্রাবণ ছিল সেদিন পর্ব-১০

0

#এমনই_শ্রাবণ_ছিল_সেদিন
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি

১০.
নিস্তব্ধ শহর আর রাস্তার দু’ধারে ল্যাম্পপোস্টের আলো। মাঝে মধ্যে দুচারটা বড়ো বড়ো গাড়ির যাওয়া আসা। রাস্তার ধারের দোকানপাটগুলোর সামনে ছোটোখাটো বাল্বের আলো জ্বলছে। ছেঁড়া কাঁথা, কম্বল, বস্তা গায়ে দিয়ে ঘুমিয়ে আছে ফুটপাতে বসবাস করা মানুষগুলো। মেহফুজের গাড়িটা চলছে দ্রুত গতিতে। রাতে শহরের রাস্তায় শীতের বর্বরতা বেশ খানিকটা অনুভব হয় ফুটপাতের এই মানুষগুলোর করুণ অবস্থা দেখে। এদের দেখেই বোঝা যায় শীতের প্রখরতা কতখানি। তাই আর গাড়ির জানালাটা খোলারও সাহস হয়নি নয়নের। নয়ন গাড়ি চালানোর ফাঁকে গাড়ির ফ্রন্ট মিররে একবার তাকাল মেহফুজের দিকে। গাড়িতে ওঠার পর থেকে তাকে বেশ চুপচাপ দেখছে সে। অন্যান্য দিনে দেখা যেত বাড়ি পৌঁছনোর আগ পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে কথাবার্তা বলত সে। নয়নের মনে হচ্ছে তার স্যার বোধ হয় খেয়ামের বিষয় নিয়েই ভাবছে বসে। যেটা তার মতো একজন ডাইরেক্টরের সঙ্গে একেবারেই যায় না। তার মতো একজন মানুষ কিনা সাধারণ কর্মচারীকে নিয়ে ভাবছে? তার স্যারটা কি নিজের পজিশন আর স্টেটাস ভুলে যাচ্ছে? নাহ্, ব্যাপারটা তার একদমই ভালো লাগছে না। মেনে নিতে পারছে না সে। সে কি কিছু বলবে এই বিষয়ে তাকে? একজন অ্যাসিসট্যান্ট হিসাবে নয়, শুভাকাঙ্ক্ষী হিসাবে তো কিছু বলা-ই যায়। অনেক সময় তো শিক্ষকরাও অঙ্ক ভুল করে বসেন। সেই ভুলটা নিশ্চয়ই একজন ছাত্র শুধরে দিতে পারে? ফ্রন্ট মিররে নয়ন আরেকবার মেহফুজকে দেখে কথা বলার প্রস্তুতি নিলো। কিন্তু তার আগেই মেহফুজ বলল, ‘ইব্রাহীম কি আর কোনো ফোন করেছিল?’ নয়ন সাবধানে ড্রাইভিং স্টিয়ারিং ধরে ফ্রন্ট মিররের দিকে চেয়ে থেকেই জবাব দিলো, ‘জি স্যার, করেছিল। সব ঠিক আছে। সমস্যা নেই।’ মেহফুজ এটুকু জিজ্ঞাসা করেই চুপ। এবার নয়ন মনের কথাগুলো বলতে মুখ খুলল, ‘স্যার কিছু কথা বলব? যদি বেয়াদবি না নেন।’ জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল মেহফুজ তার দিকে, ‘কী কথা? বলো।’

-‘খেয়ামকে নিয়ে আমরা একটু বেশিই ভাবছি না? মানে ও তো আর পাঁচজন কর্মীদের মতোই কিছু। অথচ ওকে নিয়ে…’
কথার মাঝপথে থেমে যেতে হলো নয়নের। মেহফুজ বলে উঠল, ‘আমার ওকে নিয়ে ভাবার এক বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছা নেই। যতটুকু করতে হচ্ছে একজন বাবার অনুরোধের জন্য। ওর বাবা প্রায়ই আমাকে ফোন করেন। কখনো ধরি, কখনো ধরি না। কিন্তু যতবারই ধরেছি ততবারই ওনার কথাগুলো শুনলে ফোন রাখতে পারি না। ওনাদের বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বলই এখন এই মেয়ে। আর মাও সেদিন বলছিল, উনি এক সময় আমার বাবাকে আর্থিকভাবে সহায়তা করেছিলেন যখন আমরা দেশের বাড়ি ছিলাম। তখন ওনাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা আমাদের থেকেও ভালো ছিল। এই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্যই আর ওনার অনুরোধেই ওনার মেয়েকে এইটুকু কেয়ার নিতে হচ্ছে। আর আমিও শুধুই এই কৃতজ্ঞতা থেকে করছি এটুকু। সেদিন দেখলে না? যখন ওর বেতনটা দিচ্ছিলাম ওর বাবার হাতে তখন কীভাবে কেঁদে ফেলেছিলেন উনি! আমার খারাপ লাগে। আমি উপলব্ধি করতে পারি একজন বাবার কষ্ট। কারণ, আমার ঘরেই এমন একটি বাস্তব চিত্র আছে।’

নয়ন চুপ করে গেল। সেও উপলব্ধি করতে পারল মেহফুজের বলা কথাগুলো। বুঝতে পারল মেহফুজের এতটা সদয় হওয়ার কারণ। এই মানুষটাকে তার সত্যিই ভীষণ অদ্ভুত লাগে, ভালো লাগে খুব। এই সময়ে এমনভাবে কে ভাবে পরের জন্য? তাও শুধু কৃতজ্ঞতা থেকে? এই মানুষটি পারে। কারণ, এই মানুষটির ভেতরের অন্তরটা যে নরম কাদার মতো কোমল, আর স্বচ্ছ পানির মতোই পরিষ্কার। সে তো ভুলেই গিয়েছিল তার এই রূপটির কথা। গত বছর তার বোনটা প্রেগন্যান্ট অবস্থায় মরতে বসেছিল। হসপিটালে ভর্তি করার পরও তার অবস্থার কোনো উন্নত হচ্ছিল না। এদিকে তার বোনের স্বামীটার সে কী রাগারাগি! তার চিন্তা ছিল শুধু বাচ্চাটাকে নিয়ে। বাচ্চাটার কিছু হয়ে গেলে ওই বউ সে ঘরে রাখবে না। এমনই ছিল তার বক্তব্য। মেহফুজ সেদিন শুধু আর্থিকভাবেই সহায়তা করেনি নয়নকে। তার বোনের উন্নত চিকিৎসা প্রদানের সকল ব্যবস্থাও করে দিয়েছিল। এখানেই শেষ হতে পারত তার উদারতা। কিন্তু সেদিন তার বোনের স্বামীর কথাগুলো সেও শুনেছিল। তার বোনটা সুস্থ হওয়ার পর একটি অচিন্তনীয় কাজ করে বসেছিল মেহফুজ। ওই স্বামীর ঘরে তার বোনের ভবিষ্যত যাতে অনিশ্চিত না হয় সে জন্য নিজেদের কোম্পানিতেই একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেয় সে তার বোনের। যার বিন্দু পরিমাণও নয়ন কল্পনা করেছিল না। সেই মানুষটির থেকে তুচ্ছ কোনো সাধারণ কর্মীর ক্ষেত্রে এতটা দায়িত্বশীল আচরণ পাওয়া অবশ্যই অস্বাভাবিক কিছু নয়।

মেহফুজ নীরব মুহূর্তের মাঝে বলে উঠল, ‘কিছুটা স্বজনপ্রীতি সত্যিই কাজ করছে আমার মধ্যে। এটা অস্বীকার করা যায় না। আর তরঙ্গ সাহেবকে তো চিনিই। এ কারণেই এতটা ভাবতে হচ্ছে। কিন্তু মেয়েটাকে বুদ্ধিমতী বলেই জানতাম।’

-‘সুপারস্টার দোরগোড়ায় আসলে বুদ্ধিমতী মেয়েরা নিরেট মাথারই হয়ে যায়। বছরখানিক আগের কথা মনে আছে স্যার? ওই যে সামান্য ফেসবুক সেলেব্রিটি এক মেয়েকে নিয়ে কত রঙ্গ তামাশাই না করেছিল তরঙ্গ স্যার! লাইভে এসে কী না কী গান করত মেয়েটা। তাকে একদিন ধরে নিয়ে এল অভিনয়ে। তারপর কোথায় গেল সেই মেয়ে?’

-‘খেলা করা শেষ হলে যেখানে যাওয়ার কথা সেখানেই। আমার যতটুকু করার করেছি। এর থেকে বেশি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আর আমার সেই টাইম ওয়েস্ট করার উপায়ও নেই।’

নয়ন খেয়াল করল মেহফুজকে। চোখে মুখে কেমন রাগ আর বিরক্তি ফুটে উঠেছে তার। সে বলল, ‘কিন্তু স্যার আপনি কি লক্ষ করেছেন তরঙ্গ স্যারের ভাবমূর্তি? আমার কাছে কেন যেন মনে হচ্ছে সে সত্যিই সিরিয়াস খেয়ামকে নিয়ে।’

-‘সময়ই বলে দেবে। এখন গাড়ি টান দাও জোরে।’
***

অন্যান্য কিছু দিনের মতো আজও হোস্টেল ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায় খেয়ামের। গেটের দারোয়ানের সাথে আরিফ আগে থেকেই কথা বলে গিয়েছিলেন বলে ঝামেলার সম্মুখীন কমই হতে হয় তাকে। তবে এরপরও যে ঝামেলা হয় না তা নয়। হোস্টেল সুপার তাকে বেশ কয়েকবারই ডেকে পাঠিয়েছিল। কতরকম প্রশ্ন আর জেরা! আজ তো গেটের দারোয়ান এক প্রকার ঢুকতেই দেবে না বলে ঝামেলার সৃষ্টি করে বসে। দারোয়ানের বক্তব্য, খেয়ামের দেখাদেখি এরপর থেকে অন্যান্য মেয়েরাও চাইবে এভাবে রাত দশটার পরেও ঘোরাফেরা করতে। তাকে ছাড় দিলে অন্য মেয়েরাও এমনটা করতে চাইবে। তরঙ্গকে বেশ দূরেই নামিয়ে দিতে বলেছিল সে। তরঙ্গ করেছিলও তাই। তবে সে ফিরে যায়নি। খেয়াম আর দারোয়ানের বাকবিতণ্ডার মাঝে হুট করেই কোথা থেকে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। আর তাকে কে না চেনে? সে কয়েকটা কথা বলতেই দারোয়ান পথ ছেড়ে দেয়। আর সেটা হোস্টেলের অন্যান্য মেয়েদের চোখেও পড়ে যায়। সেই থেকে হোস্টেলের কোনো না কোনো রুম থেকে কেউ না কেউ আসছেই খেয়ামের সঙ্গে তরঙ্গের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে। আর তাদের প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত খেয়াম এক পর্যায়ে বলে বসে, ‘আমার কাজের জায়গা নিয়ে আর একটা কথা বলতেও রাজি না আমি। আপনারা প্লিজ আর কোনো প্রশ্ন করবেন না আমাকে।’
সেই সব মেয়েগুলো মুখ বেজার করে চলে গেলেও রুমমেটদেরও আগ্রহের শেষ ছিল না। সবার সব কথার উত্তর দিয়ে কিছুক্ষণ আগে সে বইটা নিয়ে একটু বসেছে। তবে পড়তে বসেও মন স্থির করা কষ্টসাধ্য হয়ে গেল। সারা পথ তরঙ্গ তার সব বিষয়ে প্রশ্ন করে তাকে জেনেছে, তার পছন্দ অপছন্দের বিষয়গুলোও জেনেছে। বেশ আগ্রহী তরঙ্গ তার প্রতি। কিন্তু এই উঁচু জায়গার মানুষ হয়ে তার মতো সাধারণ মানুষের প্রতি আগ্রহ দেখানো যে খ্বু বেশি সুখের আর স্বাভাবিক নয়। অবশ্যই চিন্তার বিষয়। কোনো কারণ ছাড়া তার মতো মানুষ কেনই বা আগ্রহ দেখাবে? ‘তার প্রেমে পড়েছে তরঙ্গ’ এই কথাটি একদমই মিথ্যা এবং অবিশ্বাস্যকর। তরঙ্গ নিজে মুখে বললেও তা বিশ্বাস করা অসম্ভব। এবার তো তাকে আরও সাবধান থাকতে হবে। তার প্রতি স্টুডিয়োর যেসব মানুষের আগ্রহ ছিল, তা শুধু তাকে বিছানায় পাওয়ার জন্যই। আর এসব জায়গায় কাজের জন্য এমন অনেক মেয়েদেরই নাকি সম্মান বিসর্জন দিতে হয়। কিন্তু এত বড়ো বিসর্জন সে তো কোনোদিনও দিতে পারবে না।
***

ড্রয়িংরুমের ডিভানেই হেলে ঘুমিয়ে পড়েছে মুন। সামনের টি টেবিলে তার ল্যাপটপ, আর কতরকম ফাইলপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গায়ে ভারী কোনো শীতের পোশাক নেই বলে কুঁকড়ে পড়েই ঘুমিয়েছে। মেহফুজ ড্রয়িংরুমে ঢুকে তাকে এভাবে দেখে ডেকে উঠল, ‘কীরে? মুন? এখানে কেন ঘুমোচ্ছিস?’

আকস্মিক ডাকে মুন একটু চমকে উঠল। মেহফুজকে দেখে চোখটা মুছে বলল, ‘কাজ করতে করতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তুই কি মাত্র এলি?’

-‘হুঁ। যা রুমে গিয়ে শুয়ে পড়। আর এত রাত জেগে কাজ করতে বলে কে? অফিসের কাজ বাড়ি টেনে আনবি না। বিরক্ত লাগে দেখতে।’

মুন হেসে বলল, ‘মুহিতও বাবাকে রাগারাগি করত অফিসের কাজ বাড়ি বসে করলে।’

মেহফুজ সিঁড়ির দিকে পা বাড়াচ্ছিল। মুহিতের নামটা শুনতেই থেমে যায়। মুনের দিকে তাকায়। মেয়েটার মুখটা আজ ভীষণ শুকনো লাগছে। নিশ্চয়ই মুহিতের কথা ভেবেছে আজ সারাদিন। মেহফুজের বসার ইচ্ছা ছিল না। কেন যেন আজ কলেজ জীবনের এই বন্ধুটিকে তার সত্যিই ভাবি বলে মনে হচ্ছে। এতগুলো বছরে কখনো মনে হয়নি এই মেয়েটা এ বাড়ির বউ। মেয়ের মতোই থেকেছে। আর বন্ধুর মতোই মিশেছে সে তার সাথে। ভাবির মতো কোনো আচরণ, কোনো কাজ কখনো করতে দেখেনি তাকে। কিন্তু সামান্য এই একটা কথায় মেহফুজ হঠাৎ নতুন করে উপলব্ধি করল, এই মেয়েটি শুধু তার বন্ধু নয়। তার ভাইয়ের বউ। আর তার ভাবি। সে এসে বসল তার সামনের সোফাটায়।
-‘কী কাজ করছিলি?’

-‘এই পুরোনো ফাইলগুলোই ঘাটাঘাটি করছিলাম। বাসায় বসে আর তো কোনো কাজ নেই। তুই এখানে বসলি যে? ফ্রেশ হয়ে আয়, খেতে দিই।’

-‘খাব না।’

-‘তাহলে কি কফি করে আনব?’

-‘নাহ্, রুমে গিয়েই ঘুমিয়ে পড়ব। বাড়িতে কথা বলছিস না কেন?’

মুনকে একটু গম্ভীর দেখাল এ প্রশ্নে। মেহফুজ বলল, ‘আঙ্কেল কল করেছিল আজও। ফোন ধরছিস না তোর ভাইয়ের। বাড়িতেও কথা বলছিস না তাদের সঙ্গে। এটা তো ঠিক না।’

-‘কী বলেছে তোকে বাবা?’ রাগ নিয়ে জিজ্ঞেস করে মুন।

মেহফুজ একটু চুপ থাকে। এরপর বলে, ‘দ্যাখ মুন, জীবনটা ছোটো হলেও সহজ না। এভাবে চলে না, চলতে পারবি না তুই। আর এটা জীবনও না। একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মাঝে আছিস তুই। তোর ভাই যে হাফ বাঙালি হাফ ব্রিটিশ ছেলেটাকে দেখেছে তোর জন্য, সে কিন্তু সত্যিই পারফেক্ট। বলা যায়, মুহিতের থেকেও যোগ্যতায় বেশি সে। আমার মনে হয় তোর রাজি হওয়া উচিত। আল্লাহ পাক চাইলে ভালো থাকবি তুই। তুই যেভাবে জীবন কাটাতে চাইছিস এটা আদৌ সম্ভব না। একা একটা মানুষ কখনোই সুখী হতে পারে না। তোর তো আঙ্কেল আন্টির কথাও ভাবা উচিত। তারাও তো তোকে নিয়ে চিন্তিত।’

-‘মেহফুজ, তোর এসব বলার রাইট আছে। তুই চাইলে আমাকে চলে যেতেও বলতে পারিস। কারণ, এ বাড়িতে আমার কোনো অধিকার নেই বললেই চলে। জোর করে পড়ে আছি এক রকম। কিন্তু আমার জীবন কীভাবে চলবে আর কীভাবে আমি সুখী থাকব এটা নিয়ে ভাবার তো অধিকার আছে আমার। আমি যেমন আছি ভালো আছি। এটা কেন তোরা মানতে চাইছিস না? আমি বিয়ে করলেও যে সেখানে সুখী থাকব এটা কেন মনে হচ্ছে তোদের? আমি পারি না আর পারবও না মুহিতের জায়গা অন্য কাউকে দিতে। এই বিষয়টা আমি কেন বোঝাতে পারছি না তোদের?’

-‘তুই যে কথাগুলো বললি সবটাই ভিত্তিহীন। কে বলেছে তোর অধিকার নেই এ বাড়িতে? তুই অন্য কাউকে বিয়ে করলেও যখন খুশি তখন তুই এ বাড়িতে এসে থাকবি, অফিসটাও তুই সামলাবি। আমি তোকে শুধু এ বাড়ির সদস্য হিসাবে না, তোর বন্ধু হিসাবেও বলছি তোকে কথাগুলো।’

মুনের কণ্ঠটা কান্নায় কেঁপে ওঠে। সে বলে, ‘যদি বন্ধু হয়ে ভাবিস আমার কথা, তবে কেন বুঝতে পারছিস না আমাকে?’ বলতে বলতে চোখদুটো থেকে তার বড়ো বড়ো দু’ফোটা জলও গড়িয়ে পড়ল। তা দেখে মেহফুজ থেমে যায়। উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আচ্ছা থাক আর কাঁদতে হবে না। এখনও তোর স্বভাব আগের মতোই থেকে গেল। তোকে বিয়েও করতে হবে না। যা ওঠ, রুমে যা।’

মুন নড়ল না। মাথাটা নিচু করে ভেজা চোখদুটো মুছে বসে রইল। মেহফুজ তাড়া দিয়ে বলল, ‘কীরে ওঠ, উঠতে বললাম না? শীতের মধ্যে এভাবে কুঁজো বুড়ি হয়ে বসে থাকতে হবে না।’ এরপর মুন উঠে মেহফুজের পাশাপাশি সিঁড়ি বেঁয়ে উপরে উঠতে লাগল। মেহফুজ বলল, ‘বাবা অনেক ইমপ্রুভ করেছে। খেয়াল করেছিস? এখন কথা বললে তাকিয়ে থাকে।’

-‘হ্যাঁ, আমিও খেয়াল করেছি। কিন্তু তুই তো বাবার কাছে তেমন যাস না। ঘুমিয়ে পড়লে যাস। তখন কি আর তোকে দেখতে পারে?’

-‘যাই না তো ইচ্ছা করেই। আমাকে দেখলেই মুহিতের কথা মনে পড়ে যায়। আর তখনই কেঁদে ফেলে। ভালো লাগে না রে। সহ্য করতে পারি না।’
***

-‘তুমি কি আমাকে ইগনোর করতেছ, খেয়াম? হোয়াই?’
দুম করেই ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে তরঙ্গ। খেয়াম বেসিনে হাত ধোঁয়ার মুহূর্তে চমকে যায় তরঙ্গে আকস্মিক আগমনে।

-‘ইগনোর করব কেন? কী বলছেন স্যার? আপনি যখনই যে কাজে হেল্প চাইছেন আমি করে দিচ্ছি তো।’

-‘উহুঁ। তুমি বুঝতে পারতেছ আমি অলরেডি ইন্টারেস্টেড তোমার সঙ্গে ফ্র্যাঙ্কলি মিশতে। আর এটাই তুমি ইগনোর করতেছ। তুমি চাও না আমার সঙ্গে মিশতে। কিন্তু কেন?’

খেয়াম একটু বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে যায় তরঙ্গের এ প্রশ্নে। ভেবে পায় না কী বলবে। এখন অবধি যতগুলো শিডিউল পড়েছে ততগুলো শিডিউলের দিনে খেয়াম তরঙ্গের থেকে সব সময় যেন দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে। আর এদিকে তরঙ্গও প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে সব সময়ই তাকে ডাকে। যেটা ইতোমধ্যে সেটের প্রায় সবার চোখেই পড়েছে।

তরঙ্গ চেয়ে আছে খেয়ামের দিকে, তার প্রশ্নের উত্তরের আশায়। কিন্তু খেয়াম অপ্রস্তুত চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ইতস্তত ভঙ্গিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তরঙ্গ হঠাৎ তখন অভাবনীয় একটি কাজ করে বসে। খপ করে খেয়ামের হাতটা ধরে বলে, ‘আই নিড টু টক টু ইয়্যু। চলো আমার সঙ্গে।’

খেয়াম এ আকস্মিকতায় এলোমেলো কথা বলা আরম্ভ করে। কিন্তু তার কিছুই কানে পৌঁছায় না তরঙ্গের। খেয়ামকে টেনে ধরে তার মেকআপ রুমে নিয়ে আসে। রুমের দরজা বন্ধ করে দেওয়ার আগেই ওপাশ থেকে তখন কেউ একজন দরজা টেনে ধরে। তরঙ্গ চেঁচিয়ে ওঠে, ‘কার এত বড়ো দুঃসাহস?’

বলতেই সামনের ব্যক্তিটিকে দেখে একটু সময়ের জন্য নীরব হয়ে যায় সে। তাকে সে একেবারেই আশা করেনি এই সময়ে। মেহফুজ শান্ত, কিন্তু তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তরঙ্গ বেশ অসহ্য ধরা গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু প্রয়োজন? আমার শট আসতে তো বাকি।’
মেহফুজ জিজ্ঞেস করল, ‘ওর এখানে কী প্রয়োজন?’
তরঙ্গ সোজা উত্তর দেয়, ‘এটা আমাদের পার্সোনাল বিষয়। এভাবে এসে জেরা করার অর্থ কী?’
খেয়ামের হাতটা তখনও তরঙ্গের হাতের মুঠোয়। মেহফুজ সেদিকে একবার তাকিয়ে খেয়ামকে বলে, ‘তোমার কাজ আছে এখানে? যদি থাকে তাহলে শেষ করে বাইরে এসো। তোমার কোনো পরিচিত এসে খোঁজ করছে তোমার।’

বলেই মেহফুজ চলে যায়। খেয়াম তখন তরঙ্গের থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে রেগে বলে, ‘এটা আপনার থেকে আশা করিনি। আপনার মতো মানুষ এমন আচরণ করছেন আমার সঙ্গে, যেটা সবার চোখেই লাগছে। আর সব থেকে খারাপ লাগছে আমার।’

-‘দেখো, আমি মানুষের কথা কোনো সময়ই পরোয়া করি না। আমার যেটা করতে ভালো লাগে, যেটা আমার পছন্দ আমি সেটাকেই গুরুত্ব দিই বেশি। এমন নয় যে আমার বেকার, গরিব কোনো বন্ধু নেই। আমার থেকে লো ক্লাসে বিলং করা কোনো আত্মীয় নেই এমনটাও না। আমি তাদের পরিচয় দিতে কখনোই হেজিটেশন ফিল করি না। বাইরে কখনো দেখা হলে তাদের সাথে হাই ফাইভ করতেও ভুলি না। তাহলে তোমাকে নিয়ে কে কী ভাবল এটা দেখারও টাইম নেই আমার। আমাকে নিয়ে কী সমস্যা তোমার সেটা বলো? আমি মন থেকেই তোমার সঙ্গে একটা গুড রিলেশন গড়তে চাই। আমাকে নিয়ে তোমার কী ভাবনা আর কী সমস্যা?’

-‘তার আগে আপনি বলুন, আমার মতো মানুষের সাথে কেন আপনার কোনো সম্পর্ক তৈরি করার ইচ্ছা হলো?’

-‘এটার উত্তর স্পেসিফিকলি অনেকভাবেই দেওয়া যায়। প্রথমত আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ, খেয়াম। ইয়্যু সেভ্ড মাই লাইফ। আর তোমার মতো মানুষ বলতে তুমি কী বোঝাও? তোমার কাজ? বাট এক সময় আমিও একটা কম্পিউটারের দোকানে বসছি আমার আব্বুর সাথে। আমি তোমার মতো ভালো ভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ পাইনি। আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা খুব হাই নয়। একটা ন্যাশনাল ভার্সিটিতে কোনোরকমে অনার্স পাস করে বের হইছি। এদিক থেকে তুমি আমার থেকেও এগিয়ে। আর তুমি কতটা এক্সেপশনাল তা তুমি নিজেও জানে না। তোমার চারিত্রিক গুণ, কর্মশক্তি, স্ট্রং পার্সোনালিটি, এগুলোই তোমাকে আমার পছন্দ হওয়ার কারণ। এর থেকে বেশি কিছু আমি গুছিয়ে বলতে পারতেছি না। এখন সিদ্ধান্ত তোমার।’

এমন পরিস্থিতিতে শেষ কবে পড়েছিল খেয়াম? আদৌ পড়েছিল কখনো? মনে তো পড়ছে না এমন কিছু! এর জন্যই বুঝি তরঙ্গের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকতে তার সারা গায়ে অস্বস্তির কাঁটা ফুটছে। তবে তার মনে পড়ে তার মায়ের একমাত্র অতি আপন বোনের ছেলে আশিকের কথা। যে ছিল তার থেকে প্রায় বছর আটেকের বড়ো। একদিন হঠাৎই এক সন্ধ্যায় আশিকের আগমন হয় তার শোবার ঘরটিতে। তখন সে সবে ক্লাস টেনে উঠেছে। তার সঙ্গে এ গল্প, সে গল্প জুড়ে বসে হঠাৎ করেই বড্ড বেমানান একটি কথা বলে বসে আশিক। খালাতো ভাইয়ের সম্পর্ক থেকে বেড়িয়ে সে নতুন একটি সম্পর্ক গড়তে চায় খেয়ামের সঙ্গে। সেই নতুন সম্পর্কটির নাম বলেছিল সে ফ্রেন্ডশিপ। ক্লাসমেট বা ইয়ারমেট কিংবা প্রতিবেশী সমবয়সিদের সাথে ছাড়া এর বাহিরে এত বড়ো বয়সের কারও সঙ্গে ফ্রেন্ডশিপ বলে কখনো কিছু হওয়া সম্ভব কিনা সে বিষয়ে খেয়ামের জ্ঞানের মস্তিষ্ক ছিল সেদিন কেবলই প্রশ্নবিদ্ধ। তার জানাতে আর অভিজ্ঞতাতে এমন বয়সের পার্থক্যে কখনোই ফ্রেন্ডশিপ সম্ভব নয়। তবে এতটুকু বুঝার ক্ষমতা তার ছিল। এই বয়সের পার্থক্যে এমন সম্পর্ক গড়তে চাওয়ার একটি মাত্র কারণ পছন্দ বা ভালোবাসার। সেদিন সে আশিককে সামলে নেওয়ার মতো পরিপক্কতা অর্জন করেনি। কিন্তু ভাগ্যিস সেদিনই ভাইয়া বাড়িতে এসেছিল! আর সে সবটাই শুনতে পেরেছিল টিনশেডের পাশের ঘরটিতে বসে। আর বাদ বাকিটা সেদিন ভাইয়াই কীভাবে যেন সামলেছিল আশিককে ডেকে নিয়ে গিয়ে। এরপর আর আশিককে কোনোদিনও সে তার আশপাশে অবধি ঘেঁষতে দেখেনি। তবে আজকের পরিস্থিতি আরও বেশি জটিল। এখন তো আর ভাইয়া নেই। সামলাতে হবে যে তাকেই। এখন শুধুই নিজেকে টিকিয়ে ভবিষ্যত গন্তব্যে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময়। হঠকারীর মতো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না কোনোভাবেই। আগে পিছে ভেবেই তাকে অতি সাধারণ বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
খেয়াম একবার দরজার বাহিরে তাকিয়ে কী যেন দেখে। এরপর তরঙ্গকে বলে, ‘ভালো সম্পর্ক তৈরি বলতে আপনি অনেকটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা বলছেন, রাইট?’

তরঙ্গ একটু হাসে, ‘হ্যাঁ, ঠিক ধরতে পারছ।’

খেয়ামও হাসে। সে বলে, ‘আপনি একটু বসুন। আপনার মেকআপ ঠিক করতে হবে আবার। শীতের মধ্যেও ঘেমে গেছেন। আমি হৃদয় ভাইকে ডেকে যাই।’

-‘ডেকে যাই মানে? তুমি আমাকে নেগলেক্ট করতেছ কিন্তু। আর আমার মেকআপ নিয়ে তুমি আপাতত না ভেবে আমার কথাগুলো নিয়ে ভেবে জবাব দাও।’

-‘আমি এখানে কাজে আছি, স্যার। আপনাকে বা যে কাউকে নেগলেক্ট করার সাহস দেখিয়ে কাজ খোয়ানোর সাধ নেই। তবে হ্যাঁ, কথা সম্পূর্ণই ক্লিয়ার করা উচিত।’

তরঙ্গ খেয়ামের সুরে সুর মেলায়, ‘এক্সাক্টলি। আমিও সেটাই বলতেছি।’

-‘আমরা কিন্তু বাইরে গিয়েও কথা বলতে পারি। যেহেতু আপনার আমার মধ্যকার একটা না হওয়া সম্পর্ক নিয়ে সবার মন সন্দিগ্ধ। তাই ভেতরে কথা বলে সেটাকে না বাড়ানোটাই ভালো। এর মধ্যে কিন্তু সেদিনের হোস্টেলের ব্যাপারটা সোশ্যাল মিডিয়াতে মোটামুটি ঝড় তুলে দিয়েছে। কে বা কারা আপনার ছবিও তুলে আপলোড করে দিয়েছে।’

-‘সেটা নিয়ে ভাববার বিষয় আমার। তোমার হওয়ার কথা না কিন্তু। তুমি ভেতরে ঢুকে গিয়েছিলে বলে তোমার ছবি তুলতে পারেনি। শুধু আমার ছবিটাই আসছে। তাহলে তুমি এত কেন ভাবতেছ?’

-‘আপনার কথায় ভাবছি। নিউজটার শিরোনাম ছিল কিন্তু বেশ বাজে।’

-‘আমি বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলব না, খেয়াম। এখানে কিছু কাণ্ডজ্ঞানহীন, নির্বোধ চরিত্রের মানুষ আছে। তাদের অস্বাভাবিক দৃষ্টি আমার সহ্য হয় না। তখন কী করে দরজা টেনে ধরে কথা বলতে চলে আসলো দেখলা না? মানুষের প্রাইভেসি বলে কিছু থাকে তা এত জ্ঞানী মানুষদেরও নতুন করে পুনরায় বুঝাতে হয়। যাচ্ছেতাই!’ প্রচণ্ড ক্রোধিত গলা তরঙ্গের।

তখন মেহফুজের অকস্মাৎ উপস্থিতি খেয়ামও কল্পনা করেনি। এখানে যতবার তাকে ডাকার প্রয়োজন পড়েছে মেহফুজের, ততবার সে অন্য কোনো ব্যক্তির মাধ্যমে তাকে ডেকে পাঠিয়েছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পূর্বের ঘটনাটা ছিল কল্পনাতীত। তবে মেহফুজকে বলা তরঙ্গের চড়া বাক্যগুলো খেয়ামের সহ্য হলো না।

-‘স্যরি স্যার। আমাদের মধ্যে এমন কোনো স্বাভাবিক ব্যাপার ঘটছিল না, যে সেখানে কারও হঠাৎ আগমন অনাকাঙ্ক্ষিত। কেননা, আপনি যেভাবে আমার হাতটা ধরেছিলেন সেটাতে আমি নিজেই অপ্রস্তুত আর হতভম্ব হয়েছিলাম।’ বেশ কাঠিন্য সুর খেয়ামের।

তরঙ্গ মাছি তাড়ানোর মতো করে বলল, ‘যা হোক বাদ দাও, আমাদের কথার প্রসঙ্গে আসা যাক। আচ্ছা তার আগে তুমি তোমার গেস্টের সঙ্গে কথা বলে আসবে? অনেকক্ষণ যাবৎ ওয়েট করতেছে সে।’

-‘সে আজ সারাদিন অপেক্ষা করলেও আমার সমস্যা নেই। আমি কথা শেষ করেই বের হবো।’

-‘এটা বোধ হয় ঠিক হবে না। প্রয়োজনে আসছে সে নিশ্চয়ই?’

-‘না। সে প্রয়োজনে আসেনি। যে এসেছে কেবল কৌতূহলী হয়ে। মানে আমার অতি প্রয়োজনীয় মানুষগুলো যে আসেনি তা আমি নিশ্চিত। এই শহরে আমার ভার্সিটির চারটা ফ্রেন্ডস ছাড়া আমার কাছে প্রয়োজনীয় কেউ নয় এখানে। আর বাবা-মা কখনোই হঠাৎ করে এভাবে এখানে চলে আসবে না। ফ্রেন্ডসও এখানে কখনোই দেখা করতে আসবে না। কারণ, তারা এ মুহূর্তে ভার্সিটিতে।’

-‘তোমাকে চমকে দেওয়ার জন্যও তো তারা আসতে পারে।’

-‘না পারে না। তারা জানে আমি এখানে কখনোই তাদের আশা করব না। আর যে এসেছে সে আমার প্রয়োজনীয় কেউ নয় বলেই আমার তাকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি না আসা অবধি সে হয় সারাদিন অপেক্ষা করবে আর না হয় চলে যাবে। তার কৌতূহল দমানোর দায়িত্ব আমার নয়।’

ছোটো এই মেয়েটির কথা বা আচরণ কিছু মানুষের কাছে হয়তোবা অশিষ্টতা বলেই মনে হবে। কিন্তু যারা তাকে কাছ থেকে জানার সুযোগ পাবে এবং তাকে চেনার সুযোগ পাবে, কেবল তারাই বুঝতে পারবে তার আচরণ কোনো অশিষ্টতা নয়। বরং এটাই মেয়েটির স্বাতন্ত্র, অসাধারণত্ব। তরঙ্গের ভালো লাগে মেয়েটির এমন আরও নতুন আচরণের সাথে পরিচিত হতে। একটু হেসে জিজ্ঞেস করে সে, ‘কেমন করে জানলে সে কৌতূহলী হয়ে তোমার সাথে দেখা করতে আসছে? আর এই শহরে তোমার তেমন কোনো কাছের মানুষ নাই। তাহলে তোমারও তো তাকে দেখার জন্য কৌতূহল সৃষ্টি হওয়ার কথা।’

খেয়াম অপরিবর্তনীয় সুরে বলে, ‘সে কৌতূহলী হয়ে এসেছে এটা নিশ্চিত হয়েছি তার এখানে দেখা করতে আসার ব্যাপারটাতে। এখানে শ্যুটিং চলে, টিভির পর্দার মানুষগুলোর আনাগোনা এখানে। আমি তাদের মাঝে কী কাজ করছি বা কেমনভাবে করছি তা জানা আর দেখায় তার মূল উদ্দেশ্য। আমাকে তার সিরিয়াসলি প্রয়োজন হলে সে হোস্টেলের ঠিকানাতে আসত এবং ওখানে অপেক্ষা করত। এখানে যেহেতু এসেছে সে, তার মানে এ খবরটা নিয়েই সে এসেছে আজ আমি এ সময়ে এখানেই থাকব। এ ছাড়াও বোঝার আরও একটা উপায় হচ্ছে আপনি।’

-‘আমি?’ পৃষ্ট চেহারা তরঙ্গের।

-‘হ্যাঁ আপনি। আপনি যে আমার হোস্টেলের সামনে রাত বারোটায় দাঁড়িয়েছিলেন তা তো প্রতিটা মানুষ জানে। আর যে ব্যক্তি এসেছে সেও জানে। সে জানে আমি ওই হোস্টেলেই থাকি। আমার ছবিটা আপনার সাথে প্রকাশ না হলেও আমার নামটা তো প্রকাশ হয়েছে। আর সেটা গেটের দারোয়ানের দ্বারা হোক আর যার মাধ্যমেই হোক। আমার এসব বিষয়ে জানার আগ্রহ নিয়েই সে এসেছে এখানে। আর এসব মানুষের থেকে আমি বেশ সূক্ষ্ম একটা দূরত্ব বজায় রাখি। তাদের সাথে কথা বলতে হলেও কথা বলার জন্য এমন একটি সময় বেছে নিই যখন তার নিজের হাতেও অজস্র সময় না থাকে।’

-‘তোমার বয়সের সাথে তোমার বুদ্ধির তুলনা করাটা সত্যি একেবারেই অযৌক্তিক।’
তরঙ্গ বেশ মুগ্ধতা প্রকাশ করে বলে। প্রশংসাটুকু যেন খেয়াম সানন্দে গ্রহণ করল না। তাকে পুলকিত দেখাল না। স্বাভাবিক ভাবমূর্তিতে বলল, ‘আমি যা বলতে চাইছি তা এখন বলি?’

-‘হ্যাঁ বলো।’

-‘আমি আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেই জায়গাটার পায়ের নিচের জমিন মজবুত নয়। যখন তখন ভেঙে পড়ে যেতে পারি নিচে। কিন্তু আমি এখন চেষ্টায় আছি এই দুর্বল জায়গায় দাঁড়িয়ে সামনে এগিয়ে আসার পথ তৈরিতে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি যদি আমার পথ তৈরির সময়টুকু আশপাশের রঙিন ছবিগুলো দেখার মাঝে ব্যয় করি তাহলে আমার পথটা তৈরি হবে না দ্রুত। এদিকে পায়ের নিচের দুর্বল জমিনটুকুও ভেঙে পড়ার সময় ঘনিয়ে আসবে। তখন আমি না পারব আমার এগিয়ে যাওয়ার পথটুকু তৈরি করতে আর না পারব সেই জমিনে টিকে থাকতে। আমার বাবা সময় নিয়ে দারুণ কিছু কথা বলেন। প্রতিটা কাজেরই একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকে। সেই সময় আমি যেমন তেমনভাবে ব্যবহার করে কাজটা করতে পারি। কিন্তু সময় শেষে কাজটা সঠিক এবং সম্পূর্ণ হলো কিনা সেটাই দেখার বিষয়। যে কাজের জন্য যে সময়টা আমাকে দেওয়া হয়েছে, সেই সময়টা আমি সেই কাজে ব্যয় না করে বাইরে থেকে কেবল দেখতে চাকচিক্য কিন্তু তা আমার জন্য অপ্রয়োজনীয় আর অকল্যাণকর, এমন সব কাজে যদি ব্যয় করি তবে আমি আমার জীবনের লক্ষ্য থেকে ছিটকে পড়ব নিশ্চিত। প্রতিটা কাজের যেমন একটা নির্দিষ্ট বয়স থাকে তেমন নির্দিষ্ট সময়ও থাকে। আমার এখন যে সময়টা সেই সময়টা আমার আগামী দিনে চলার পথ তৈরির সময়। আশপাশের রঙিন ছবি দেখার সময় নয়। আমার আগামী দিনে চলার পথ তৈরি হয়ে গেলে আমি এই রঙিন ছবি দেখার অফুরন্ত সময় পাবো।’

কথাগুলো বলে খেয়াম থামল আর দেখল সামনের মানুষটির চেহারা। অসন্তুষ্টির চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তরঙ্গ। খেয়াম জানত, এই ব্যক্তিটি তার অতি নম্রতাপূর্ণ কথাগুলোতেও টলবে না নিজের চাওয়া থেকে। এ কটা দিনে তাকে চিনে গেছে খেয়াম। তরঙ্গ মানুষটি বড্ড বেশিই গোঁয়ার। নিজের চাওয়া পাওয়া আদায়েই সে সদা নিবদ্ধ। আর তার ওপর সে আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এই কারণেই, একজন সাধারণ কর্মীর প্রতি তার আগ্রহ জন্ম নিয়েছে যা শুধু সে ছাড়াও ইতোমধ্যে সবাই বুঝতে পেরেছে। সেখানে কর্মীটি তাকে ভীষণ যত্নে এড়িয়ে যাচ্ছে। যা তরঙ্গের জন্য ভয়ংকর অপমানজনক। এখানে নিজের চাওয়াটা আদায় করে নেওয়া যেন এক প্রকার যুদ্ধ জয় করার মতো তরঙ্গের কাছে। খেয়াম এও জানে, এই রগচটা, বেপরোয়া মানুষটি নিজের সন্তুষ্টি অর্জনে আরও বেশি বেপরোয়াও হতে পারে। সে রাজি না হলে যে অপমানে মুখ থুবড়ে পড়তে হবে তরঙ্গকে এই স্টুডিয়োর মানুষগুলোর সামনে! যা তরঙ্গ এ জীবনে মেনে নিতে পারবে না।

খেয়ামকে থামতে দেখেই তরঙ্গ বলে উঠল, ‘আমি তোমার ক্যারিয়ারে বাধা হবো। এমন ধারণা কেন হলো তোমার? আমি কি তোমার জন্য ক্ষতিকারক? এটা ভাবতেছ তুমি?’

খেয়াম হেসে মাথা নাড়িয়ে না জানায়। তরঙ্গ থামল না, ‘তবে? তুমি নিশ্চয়ই এ কারণে অবাক হচ্ছো না যে একজন সেলেব্রেটি তোমার প্রতি আগ্রহী? তুমি অবশ্যই আমাকে বুঝতে পারছ, আমাকে বিচার করতে পারছ আমি মানুষটা কেমন।’

খেয়াম পূর্বের হাসিটা বহাল রেখে বলে, ‘আমি ভিনগ্রহের প্রাণী নই যে অবাক হওয়ার জিনিসেও অবাক হবো না। বরং আমিও অন্য সবার মতো অবাক হচ্ছি, আপনি বদ্ধ পরিকর আমার সঙ্গে মিশতে।’

তরঙ্গের দৃষ্টি নিবদ্ধ খেয়ামের চমৎকার হাসিতে। মেয়েটাকে সে কী করে বোঝাবে তার অতি তুচ্ছ বিষয়েও সে যে ক্ষণে ক্ষণে মুগ্ধ হয়ে পড়ছে? আর এ কারণেই তার সঙ্গে মেশার একটি প্রবল টান সৃষ্টি হচ্ছে। সেই টানও যে ক্ষণে ক্ষণে বেড়েই চলেছে। এতগুলো বছরে কত মেয়েই তো তার পাশাপাশি ঘুরল, ফিরল। কিন্তু এমন সাংঘাতিক টান তাদের জন্য আসেনি কখনো। তাদের দূর থেকে দেখতেও যেমন আকর্ষণীয় তেমন কাছ থেকেও। কিন্তু এই মেয়েটিকে দূর থেকে দেখলে কখনোই আকর্ষণ সৃষ্টি হবে না। যত কাছে আসবে তত তার আকর্ষণের বিষয়গুলো চোখ পড়বে। আর তখন হতে হবে মুগ্ধ। এই যে, এখন যেমন সে হচ্ছে। সে ভাবনা থেকে ফিরল কথার প্রসঙ্গে, ‘আমি তোমার জায়গা উপলব্ধি করতে পারছি, খেয়াম। আমি শুধু চাই আমাদের মাঝে একটা ভালো সম্পর্ক থাকুক। যে সম্পর্ক থেকে আমরা কখনো চাইলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কিছু ভালো লাগা, খারাপ লাগা দুজন দুজনের সাথে শেয়ার করতে পারি বিনা সঙ্কোচে। অবশ্যই প্রেমিক-প্রেমিকার মতো নয়। আর আমি এমন কিছুই চাইব না যাতে তুমি তোমার লক্ষ্য থেকে ছিটকে পড়ো। এইটুকু বিশ্বাস তুমি করো আমাকে। আমি যা বলি তা সরাসরিই বলি। তোমাকে আমার ভালো লাগার একটাই কারণ, তুমি আমার কাছে প্রচণ্ড ইউনিক। এমন মানুষ আমার জীবনে কম আসছে। বলতে গেলে আসেইনি। এর জন্যই তোমার প্রতি আমার এতটা আগ্রহ। সেটা কোনো খারাপ কিছুর উদ্দেশ্যে নয়। এই সম্পর্কে তোমার আমার বয়সটার অ্যাডজাস্টমেন্ট থাকাটা মূল নয়। কারও শুভাকাঙ্ক্ষী হতে বয়সের অ্যাডজাস্টমেন্ট থাকাটা কখনোই মূখ্য নয়, খেয়াম। আমরা শুধু একে অপরে ওয়েল উইশিং থাকতে চাই। কথা বেশি আর টানব না। সে সময়ও নাই। আমি নিজেকে তোমার কাছে কতটা এক্সপ্লেইন করতে পারছি তা আমি জানি না। বাট যা বলছি আমি তা অনেস্টলি বলছি।’

-‘বুঝলাম, আচ্ছা আপনার যাওয়া উচিত এখন। শট দেওয়ার সময় সত্যিই হয়ে গেছে।’

-‘সেটা আমিও জানি। বাট আমার ইচ্ছা করতেছে না যাইতে, তোমার ক্লিয়ার কাট আন্সার না পাওয়া পর্যন্ত।’

খেয়াম হেসে বলল, ‘আপনি তো আর আমাকে প্রপোজ করেননি। তাহলে এত ভাবছেন কেন?’

-‘তুমি আমাকে কীভাবে বিচার করলা সেটা জানার জন্য।’

-‘যেভাবে আপনি নিজেকে প্রকাশ করেছেন সেভাবেই বিচার করেছি।’ নির্বিকার লাগল খেয়ামকে।

তরঙ্গ পরাস্ত ভঙ্গিতে চেয়ে থাকে খেয়ামের দিকে। যে চেহারাটা দেখে খেয়ামের খুব হাসি পেয়ে গেল। একটা মানুষ তার চাওয়া হাসিলে কতখানি উন্মত্ত হতে পারে তা চোখের সামনে এই মানুষটির মাঝে দেখে খেয়াম আরও এক নতুন চরিত্রের মানুষকে চিনতে পারল। মানুষ চেনার অভিজ্ঞতার ঝুলি আরও একটু ভারী হলো তার। খেয়াম বেরিয়ে আসলো মেকআপ রুম থেকে। তরঙ্গ তাকে পেছন থেকে ডেকে উঠল তখন, ‘খেয়াম! এটা আমি সত্যিই আশা করছিলাম না তোমার থেকে।’ খেয়াম দাঁড়িয়ে গেল তার দিকে ফিরে। জিজ্ঞেস করল, ‘কী আশা করেননি?’ তরঙ্গ সে প্রশ্নের উত্তরের বদলে আবারও জিজ্ঞেস করল, ‘আমাকে বিচার করলে কীভাবে?’
খেয়াম হেসেই জবাব দিলো, ‘বয়সেই বড়ো, বুদ্ধিতে না।’
***

এমনই শ্রাবণ ছিল সেদিন পর্ব-০৯

0

#এমনই_শ্রাবণ_ছিল_সেদিন
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
#পর্ব_৯ (পূর্বাংশ)

শহরে আসার সাড়ে পাঁচ মাসের মধ্যে এই প্রথম কোনো অঘটন ঘটল খেয়ামের সঙ্গে। সেদিন গাজীপুর থেকে ফেরে সে গায়ে বেশ জ্বর নিয়ে। ঠিক দুদিন পর আবার শ্যুটিঙের ডেট পড়ে। সেদিন রোযা রেখে আর জ্বর গায়ে নিয়েই ছুটে যায় আবার কাজের গন্তব্যে। সেদিনের শ্যুটিং ছিল বিকালে। স্টুডিয়োর কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ পেছন থেকে একটা বাইকের ধাক্কা পায় সে। তারপর কিছু বুঝে উঠার আগেই রাস্তার মাঝে পড়ে প্রায় বুঁজে আসা নিস্তেজ চোখ দুটোতে দেখে, তার দিকে ছুটে আসছে কয়েকজন পথচারী। এরপর তাকে কয়েকজন ধরে গাড়িতে উঠিয়ে নেয়। কাছের একটা হাসপাতালে তাকে ভর্তি করে দেয় তারা। পুরো পথেই তার জ্ঞান ছিল। কিন্তু পায়ের যন্ত্রণায় শুধু মনে হচ্ছিল, তার সময় বোধ হয় শেষ।

প্রায় দুদিন হলো সে হাসপাতাল ভর্তি। পায়ের একটা হাড় ফেঁটে গেছে। প্লাস্টার করে দেওয়া হয়েছে। সদর হাসপাতালের পঞ্চাশ বেডের রুমে এক গাদা রোগীদের মাঝে থাকছে সে। রাহি শুধু তিনবেলা খেতে দিতে আসে তাকে। এ ছাড়া তাকে খুব একটা সময় রাহি দিতে পারে না। বাসায়ও কাউকে জানায়নি সে। এর মাঝে গতকাল রাতে ইব্রাহীম তাকে ফোন করেছিল শিডিউলের দিন কেন আসছে না সে, তা জানার জন্য। তাই অসুস্থতার কথা জানাতে তাকে বাধ্য হয় খেয়াম। আর আজ সকাল হতেই ঘুম ভেঙে দেখে ইব্রাহীম তাকে দেখতেও চলে এসেছে। সে বিদায় নিতেই দুপুরের সময় হাজির হলো আরও একটি মানুষ। তবে সেই মানুষটির আগমন ছিল খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত। আসার পর থেকে নাকে টিস্যু চেপে তার বেডের পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে প্রায় পাঁচ মিনিট যাবৎ। দাঁড়িয়ে শুধু আশপাশের পরিবেশ দেখছে সে। এর মাঝে একটা কথাও বলেনি সে খেয়ামের সাথে। আর খেয়াম বিছানায় হেলে বসে তার ঘৃণায় নাক শিটকানো চেহারাটা দেখছে। শেষে তার দিক থেকে কোনো কথা না আসায় খেয়ামই জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার আপনি? হঠাৎ?’
খেয়ামের কথায় তার দিকে ফিরে তাকায় সে। তার প্রশ্নের কী জবাব দেবে সে ভাবতে থাকে। এর ফাঁকে খেয়াম আবার তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘স্যার কি আমাকে দেখতে এসেছেন?’

এ প্রশ্নটা ব্যক্তিটির কাছে বেশ উদ্ভট লাগল। হ্যাঁ, দেখতেই তো এসেছে সে। তাকে দেখতে না এলে এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সে কী করতে আসবে? এটা আবার জিজ্ঞেসও করতে হয়? তাই খ্যাঁক মেরে উঠে বলল সে, ‘তোমাকে না তো এই মানুষগুলোকে দেখতে আসছি? কী অদ্ভুত প্রশ্ন!’
বলেই সে খেয়ামের প্লাস্টার করা পা’টার দিকে তাকায়।

-‘আসার পর থেকে তো আশপাশের রোগীগুলোকেই দেখছেন। তাই জানতে চাইলাম আরকি।’

কথাটায় পাত্তা দিলো না ব্যক্তিটি। খেয়ামকে বলল, ‘ইব্রাহীমের থেকে শুনলাম। হাঁটার সময়ও কি অমনোযোগী হয়ে হাঁটো? যদি এর থেকে বড়ো কিছু হয়ে যাইত?’

খেয়াম খেয়াল করল তার বলা দ্বিতীয় কথাটি। সেই কথার বিপরীতে বলল, ‘হাঁটার সময়ও অমনোযোগী হয়ে হাঁটি না, আর কাজের সময়ও অমনোযোগী থাকি না। আপনি কি বসবেন স্যার?’

এ কথার পর হঠাৎ দুজন নার্স ব্যক্তিটির কাছে এগিয়ে আসে। তরঙ্গ! তরঙ্গ! বলে তারা চেঁচিয়ে উঠে তাকে অনুরোধ করে তাদের সঙ্গে ছবি তুলতে আর তাদের হাতে অটোগ্রাফ দিতে। এমনিতেই তরঙ্গের মেজাজ খারাপ হয়ে আছে এই জায়গায় আসার পর। শুধু খেয়ামের জন্যই সে এখনও দাঁড়িয়ে আছে। তার ওপর এই নার্সগুলোর সঙ্গে এমন ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে তার সারা অশরীরে ঘৃণায় অস্বস্তির কাঁটা বিঁধছে যেন। অবশেষে আর না পেরে তরঙ্গে তাদের বলেই বসল, ‘একটু স্পেস প্রয়োজন আমার।’

তারা বাধ্য হয়ে সেখান থেকে যেতেই তরঙ্গ হাঁপ ছাড়ল। ধপাস করে বসে পড়ল খেয়ামের পায়ের কাছে। বিরক্ত কণ্ঠে বলল, ‘এই, তুমি চলো তো আমার সঙ্গে। ভালো কোনো হসপিটাল নিয়ে গিয়ে কেবিনে শিফ্ট করে দেবো। আমার দম বন্ধ হয়ে আসতেছে এই শীতেও, পেটের নাড়িভুড়িও সব উগ্রায় আসতেছে। তুমি ক্যামনে থাকতেছ?’ খেয়াম হেসে ফেলল, ‘কী বলেন? আমি কেন যাব? আমার তো সমস্যা হচ্ছে না। আপনি এসেছেন কিছুক্ষণের জন্য। চলে যাওয়ার পর তো আর সমস্যা হবে না।’

-‘সেটা তো চলে যাওয়ার পরের কথা। এখনি তো বসে কথা বলতে সমস্যা হচ্ছে আমার। আর তুমি কী বললে? এই আনহাইজিনিক পরিবেশে তোমার সমস্যা হচ্ছে না? খাবার খাও কী করে?’

-‘খাবার খাই হাত দিয়ে। আর এখানে থাকতেও আমার সমস্যা হচ্ছে না আপনার কষ্ট হলে আপনি…’
খেয়ামের কথা শেষ হবার আগেই তরঙ্গ মহাবিরক্ত দেখিয়ে বলল, ‘ধুর! বললাম না কথা বলব? তার জন্যই তো এখনও পাকা দশ মিনিট আছি।’

খেয়াম তরঙ্গের ব্যাপার ঠিক বুঝতে পারছে না। তাকে সহ্য করতে না পারা এই মানুষটি হঠাৎ এসে হাজির, তাও হাতে করে এক গাদা খাবার নিয়ে। এখন আবার বলছে তার সঙ্গে কথাও বলবে। মনের ভেতরে কোনো প্রশ্ন জাগলে তা সে প্রকাশ না করা অবধি শান্তি পায় না। এ ক্ষেত্রেও তার স্বভাবের পরিবর্তন ঘটল না। তরঙ্গকে জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার, আপনি ঠিক আছেন তো?’ যেন সে প্রচণ্ড বিস্মিত তরঙ্গের আগমন আর আচরণে।
তরঙ্গ তিরিক্ষি নজরে তাকাল, ‘ঠিক আছি মানে?’

-‘না মানে আপনি এসেছেন আমাকে দেখতে? আবার বলছেন কথাও বলবেন! ব্যাপারটা বিশ্বাস করা মুশকিল।’

খেয়ামের এ কথায় তরঙ্গ অপ্রস্তুত হলো। তোতলাভাবে বলল, ‘ওই আর কী… মানে…এমনিই। ধন্যবাদ দিতে আসছি।’ বলার সময়ও তরঙ্গের দৃষ্টি অস্থির হয়ে আশপাশ ঘুরছিল।

-‘ধন্যবাদ দিতে আসছেন মানে? আমার অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার জন্য?’ কণ্ঠে বিস্ময় ঢেলে খেয়াম জিজ্ঞেস করল।

-‘আরে নাহ, কী বলো? অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার জন্য ধন্যবাদ দিতে আসব ক্যান? ওই যে সেদিনের জন্য।’

-‘কোন দিনের জন্য?’ যেন খেয়াম ভুলে গেছে তেমনটা চেহারা করে জিজ্ঞেস করল।

-‘সেদিন ওই যে আমার প্যান্টের ফাঁকা থেকে সাপটা টেনে বের করলা।’

-‘এত দিন পর আজকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছা হলো?’

তরঙ্গের মেজাজ প্রচণ্ড খারাপের দিকে যাচ্ছে। মেয়েটিকে সে যে সেদিনের পর থেকেই ভীষণ মিস করছিল তা সে কী করে বলবে? আবার এদিকে অনবরত প্রশ্ন করেই চলেছে খেয়াম। ইচ্ছা করছে তার বাজখাঁই গলায় ধমক দিতে একটা। কিন্ত খেয়ামের পায়ের অবস্থা দেখে সেই ইচ্ছাটা দাবিয়ে রাখল। সেদিন খেয়াম ওই দুঃসাহসিক কাজটা না করলে হয়তো সত্যিই খুব খারাপ কিছু হতো তার সঙ্গে। আল্লাহ সেদিন তাকে বাঁচানোর অসিলা করে খেয়ামকে পাঠিয়েছিল। আর আজকে সেই মেয়েটিকে এভাবে দেখে ভীষণ খারাপ লাগছে তার। কী কষ্টটাই না পেয়েছিল বাইকের ধাক্কা খেয়ে! তার ওপর আবার এমন অস্বস্তিকর পরিবেশে থাকতে হচ্ছে । আরও দুদিন আগেই কেন জানতে পারল না সে? তাহলে সত্যিই সে খেয়ামকে এমন জায়গায় রাখত না।

-‘পায়ের কী অবস্থা এখন? কতদিন লাগবে সুস্থ হতে?’ খেয়ামের প্রশ্নটা এড়িয়ে পালটা প্রশ্ন করল সে।

-‘মাসখানিক।’

-‘তোমার বাবা-মা কোথায়? এখানে কেন রাখছে তোমাকে? বাসায় নিয়ে গেলেই তো পারে।’

-‘আমার বাবা-মা থাকে দেশের বাড়িতে। তাদের জানাইনি।’

-‘ও, আর কেউ নেই এখানে? কোনো রিলেটিভ?’

-‘না, এখানে আমার কোনো রিলেটিভ নেই।’

-‘থাকো কই তাহলে?’

-‘হোস্টেল।’

-‘তাহলে তোমার দেখাশোনা কে করতেছে?’

-‘সেভাবে কেউ না। আমার বান্ধবী আসে খাবার দিতে। আর এখানের নার্স এসে মাঝে মাঝে দেখে যায়।’

-‘হোস্টেল ফিরবে কবে?’

-‘আগামীকাল।’

মেহফুজ ব্যস্ত থাকায় খেয়ামের খবর শুনেছে মাত্র ঘণ্টাখানিক আগেই। একটা দরকারে মুনকে নিয়ে বাইরে এসেছিল সে। এ খবর শোনামাত্রই মুনকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে রেস্টুরেন্ট ঢুকে কতরকম খাবার নিয়েই নয়নকে সঙ্গে করে ছুটে আসে হাসপাতাল। নয়নকে জিজ্ঞেস করে, ‘কত নম্বর ফ্লোরে, নয়ন?’

নয়ন মেহফুজের চিন্তিত মুখ দেখতে মশগুল তখন। খেয়ামকে নিয়ে তাকে এমন চিন্তাগ্রস্ত দেখে সে রীতিমতো অবাক। মেহফুজ এদিকে ব্যতিব্যস্ত হয়ে আরও একবার জিজ্ঞেস করে তাকে, ‘ইব্রাহীম কোন ফ্লোরের কথা বলেছে যেন?’

নয়নের থেকে কোনো উত্তর না আসায় হাঁটার মাঝে মেহফুজ পাশে ফিরে তাকায়। নয়ন তার দিকেই চেয়ে আছে বোবার মতো। তা তেখে তার ওপর ধমকে ওঠে সে, ‘কী দেখছ? কথা বলছ না কেন?’

ধমকে থতমত খেয়ে নয়ন জিজ্ঞেস করে, ‘জি স্যার? কী শুনছিলেন?’

মেহফুজ বিরক্তি নিয়ে তাকায় তার দিকে। নয়ন অবশেষে বুঝতে পারে মেহফুজ কী জানতে চাইছে। সে দ্রুত পায়ে সামনে এগিয়ে মেহফুজকে নিয়ে আসে পঞ্চাশ বেডের রুমটির সামনে। তবে দরজার মুখে ঢুকতেই মেহফুজ বড়োসড়ো একটি ধাক্কা খায় সামনের অনাকাঙ্ক্ষিত, আশ্চার্যন্বিত একটি দৃশ্য দেখে। থমকে যায় নয়নও। তরঙ্গ খেয়ামের বিছানাতে বসে খাবার বক্স থেকে খুলে প্লেটে খাবার বাড়ছে। আর খেয়াম তাকে বাধা দিয়ে কিছু বলছে। মেহফুজ দ্রুত বেরিয়ে আসে রুম থেকে। মিনিটখানিক সময় সে একই জায়গায় জড়ীভূত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। নয়ন খেয়াল করে মেহফুজের কাঠিন্য চেহারাখানা।

হঠাৎ করে তার হাতের খাবারের প্যাকেটগুলো সে নয়নের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘এগুলো নিয়ে ওকে দেখে আসো।’

বলেই মেহফুজ পা বাড়াল যাওয়ার জন্য। নয়ন খাবারের প্যাকেট হাতে নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে চেয়ে রইল মেহফুজের যাওয়ার দিকে। তবে মিনিটখানিক না পেরোতেই মেহফুজ আবার ফিরে আসে। কেমন যেন বিমূঢ় দেখায় তাকে।

-‘খাবারগুলো দিয়েই চলে আসবে না। কিছুক্ষণ কথা বলবে। আর…’
কথা বলতে বলতে থেমে যায় মেহফুজ। কোমরে বাঁ হাত রেখে ডান ভ্রুটার মাঝে আঙুল দিয়ে চুলকাতে থাকে খাবারের প্যাকেটগুলোর দিকে তাকিয়ে। তাকে হঠাৎ যেন অচেনা লাগছে নয়নের কাছে। তার স্যারকে এর আগে কখনও সে এমন অপ্রতিভ হতে দেখেনি। তবে তার এমন অবস্থার কারণ কিছুটা আন্দাজ করতে পারল সে। তাই সে বলে বসল, ‘আর তরঙ্গ স্যার না ওঠা অবধি দাঁড়িয়ে থাকব, তাই তো?’

মেহফুজ চকিতে তাকায় নয়নের দিকে। তার চেহারার কাঠিন্যভাবটা এখনও স্পষ্ট। নয়ন তার এমন চেহারা দেখে খানিকটা চমকাল। ভাবল, ভুল কিছু বলে ফেলল কিনা। কিন্তু মেহফুজ একটুক্ষণ নীরবে চেয়ে থেকে তারপর বলে, ‘ওকে বলবে না আমার কথা। তুমি দেখতে এসেছ ওকে, ঠিক আছে? আমি নিচে গাড়িতে ওয়েট করছি।’

বলেই সে চলে গেল তার বড়ো বড়ো পা ফেলে। তার মেজাজ চটে যাওয়ার একটি জ্বলন্ত কারণ যে তরঙ্গ, তা নয়নের বুঝতে সমস্যা হলো না। কেবল সমস্যা, তার দেখতে আসার কথা খেয়ামকে জানাতে কেন বারণ করল?
***

ঘর থেকে বেরিয়ে করিডোর। করিডোর ধরে হেঁটে ডান দিকে একদম কর্ণারে তালাবদ্ধ একটি কক্ষ। যেটা আশহাব ও তার দুই পুত্র আহবাব মুহিত আর আরহাম মেহফুজের লাইব্রেরি ঘর বলেই উল্লেখিত হতো বছর চারেক আগেও। মুহিত মারা যাওয়ার পর থেকে এই ঘরটিতে আশহাবের আর কোনো পদার্পণ ঘটেনি। আর মেহফুজ তখনও বাড়ির বাইরে থাকত তার পেশার জন্য। তখন থেকেই রুমটি তালাবদ্ধ ছিল। এ বাড়িতে তারা তিনজনই ছিল একান্ত মুহূর্তে বই পড়ে সময় কাটানোর মতো মানুষ। সেই ঘরটি এখন সপ্তাহে একবার কি দুবার খোলা হয়, যখন মেহফুজ ঘরটিতে ঢোকে। তবে এখন এই ঘরটিতে বইয়ের শেল্ফগুলো সাদা কাপড়ে ঢেকে অবহেলায় ফেলে রাখা হয়েছে বিশাল ঘরটির এক কর্ণারে। বই পড়ুয়া মানুষগুলোর অস্তিত্ব যে বিলীন, তারই প্রমাণ। ঘরটির মাঝ বরাবর একটি পিয়ানো। মুহিত আর মেহফুজের কিছু কিছু শখ ছিল একই। দুজনের শখ প‚রণ করতেই আশহাব এই পিয়ানোটি কিনেছিলেন, যখন তারা স্কুলের গণ্ডি সবে পেরিয়েছে। পিয়ানো মাস্টার রেখে তাদের পিয়ানো বাজানোও শিখিয়ে দেন। আর ঘরটির উত্তরের জানালার কাছে বড়ো একটি গোলাকৃতির মাঝারি সাইজের টেবিল, সাথে দুটো চেয়ার। টেবিলের এক কোণে কলমভর্তি একটি কলম দানি, একটি ল্যাম্প বিনা ব্যবহারে পড়ে থাকে দিনের পর দিন। ঘরটির পূর্বদিকের দেয়ালভর্তি মেহফুজ আর মুহিতের একক কিছু ছবির ফ্রেম বেঁধে রাখা। অন্যদিকে তাদের বাবার ছবিও আছে কয়েকটা। তবে সেগুলো আশহাবের খুব জোয়ান সময়ের ছবি। কিছুক্ষণ আগেই মেহফুজ ঘরটিতে এসেছে। এ বাড়ির সব থেকে বড়ো ঘর এটিই। যে ঘরটির উত্তর, দক্ষিণে বড়ো বড়ো মাত্র দুটো জানালা। মেহফুজ ঘরে ঢুকে প্রথমেই সেই জানালার কাচের পাল্লা দুটো খুলে দেয়। আজও তা-ই করেছে। তারপর ঘরের মাঝে মৃদু আভার হলুদ বাতি জ্বেলে দেয় সাঁঝের আলো হিসাবে।

নিঝুম কুয়াশায় মোড়া সাঁঝ। জানালার কাচের পাল্লাগুলো কুয়াশার জলে ভেজা। মুক্তদানার মতো জলবিন্দুগুলো গড়িয়ে পড়ে কাচের গায়ে আঁকাবাঁকা স্বচ্ছ দাগ তৈরি হচ্ছে। দক্ষিণের জানালা বরাবার দাঁড়িয়ে আছে মেহফুজ। এখান থেকে লনের বাগানের জায়গাটুকু দেখা যায় স্পষ্ট। শীতে সারা শহরে কুয়াশার চেহারা ফুটে না উঠলেও এই লনের সামনে দাঁড়ালে কুয়াশার আস্তরণ পুরোটাই চোখে পড়ে। অপূর্ব লাগে দেখতে এই নিঝুম, মায়াবী, কুয়াশাচ্ছন্ন সন্ধ্যা ক্ষণ। ছোটো সময়ে যখন সে আর মুহিত এক সঙ্গে এই ঘরে আসত বাবার সাথে, বাবা তখন তাদের দুটো বই দিয়ে নীরবে পড়তে বলে তিনিও ওই গোল টেবিলের সামনে বসে বই পড়তেন। পড়তে পড়তে সন্ধ্যাও নেমে আসত কখনো। তখন তারা দুভাই দক্ষিণের এই জানালার সামনে দাঁড়িয়ে মায়ের হাতে তৈরি বাগানের ফুলগুলো দেখত আর নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করত কে কোন গাছটা নেবে। ছোটো থেকেই দুভাইয়ের পছন্দেরও মিল অনেক। এই কুয়াশা জড়ানো সন্ধ্যাও তারা দুই ভাই ভীষণ পছন্দ করত। ইদের আগের দিন চাঁদরাতে ইফতার শেষ করে নামায আদায় করেই ছুটে আসত এই ঘরটিতে। এই ঘরের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে চিকন কাঁচির মতো চাঁদটা দেখা যেত স্পষ্ট। আর সেটা এখনও।

-‘কীরে, আযান পড়ে গেছে শুনতে পাসনি?’ মা এসে দাঁড়িয়েছেন দরজার মুখে। মেহফুজ ফিরে তাকাল তার দিকে। খুব বেশি সময় হয়নি আসা হয়েছে ঘরটিতে। ক্ষণিকের মধ্যেই পুরোনো মিষ্টি মুহূর্তগুলোর স্মৃতিচারণে আটকা পড়ে গিয়েছিল সে। মাগরিবের আযানের ধ্বনি একদমই তার কর্ণকুহরে পৌঁছয়নি। মা এসে খেজুর আর পানির গ্লাসটা হাতে তুলে দিলেন তার।

-‘কী করছিলি? নিচে আয়।’

-‘কিছু না। সন্ধ্যা প্রদীপ দিতে এসেছিলাম। চলো।’

ইফতারের জন্য খাবার টেবিলে মেহফুজ বসতেই মুন জিজ্ঞেস করল, ‘কোথাও কি বের হবি?’

-‘হ্যাঁ, একটু কাজ আছে।’

-‘আমাদের তো শপিংয়ে যাওয়ার কথা ছিল। যাবি না?’

-‘যাব না কেন? তুই আর মা বেরিয়ে পড়বি। আমি কাজটা সেড়েই চলে আসব। শুধু ফোন করে তোদের লোকেশন জানিয়ে দিবি।’

এর মাঝেই নয়ন এসে হাজির হয়। তাকে দেখে মেহফুজ শেষবারের মতো পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, ‘রোযা রাখছ না কেন বলো তো? আজ তো কোনো শিডিউল ছিল না।’ নয়ন বেশখানিকটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ল যেন। ইতস্তত মুখ করে হেসে বলল, ‘আসলে স্যার…একটু কষ্ট হয়ে যায় বেশি।’

মুন হেসে ফেলে তার কথায়। নীহার বলেন, ‘এ কথা বললে চলবে? আল্লাহ শুনবেন এ কথা?’ নয়ন লজ্জিত মুখ করে কিঞ্চিৎ হাসে। মেহফুজ ইফতার শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘তুমি বসো, আমি নামাযটা ঘরেই পড়ে আসি। মসজিদে গেলে দেরি হয়ে যাবে।’

-‘সমস্যা নেই স্যার, আপনি মসজিদেই যান। দেরি হবে কীসের?’

নয়নের এ কথায় মেহফুজ চোখা নজরে তাকায় তার দিকে। তার চাউনি দেখেই নয়নের মনে পড়ে যায় তাদের কাজের কথা। মুখটা অপরাধীর মতো করে মৃদুস্বরে তখন বলে ওঠে সে, ‘স্যরি স্যার।’ মেহফুজ উপরে চলে যায়। নামায শেষ করে খুব দ্রুতই বেরিয়ে পড়ে তারা।

-‘স্যার ড্রাইভার নেবেন না?’ গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে নয়ন।

মেহফুজ তাকে ইশারায় ড্রাইভিং সিটে উঠতে বলে তার পাশের সিটে উঠে বসে পড়ে। নয়ন বুঝতে পারে আজকে তাকেই ড্রাইভিং করতে হবে। এ ব্যাপারটাতে সে ভীষণ খুশিই হয়। কেননা, তার নিজের একটা গাড়ি কেনার বহু পুরোনো শখ। আর নিজের গাড়ি নিজেরই ড্রাইভিং করার ইচ্ছা তার। মাঝে মাঝে যখন মেহফুজ তাকে ড্রাইভিং করতে বলে তখন নয়নের মনে হয় যেন নিজের গাড়িই সে ড্রাইভিং করছে। বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে সে তখন।
গাড়িটা ছুটছে খেয়ামের বর্তমান লোকেশন সদর হাসপাতালের দিকে। মেহফুজ হাত ঘড়িতে সময় দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘ও ফোন করে কী বলেছে?’

নয়ন একবার ড্রাইভিং এর ফাঁকে মেহফুজের দিকে তাকিয়ে আবার সামনে নজর রাখে। জবাব দেয়, ‘বলল তরঙ্গ স্যার ওর থেকে খেয়ামের ফোন নম্বর চেয়ে নিয়েছে। ও আবার সাহস করে তরঙ্গ স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিল কী প্রয়োজন। স্যার তখন ধমক দিয়ে ওঠে ওকে। পরে আবার ওকে বলে খেয়ামের আজ হসপিটাল ছেড়ে হোস্টেল ফেরার কথা। তাই দেখা করতে যাবে।’

-‘তাহলে ফরিদপুর থেকে ওর বাবা-মা এখনও কেউ আসেনি?’

-‘কাউকেই তো দেখলাম না। বোধ হয় জানায়নি খেয়াম বাড়িতে।’ এটুকু বলে নয়ন থেমে যায়। মেহফুজের দিকে একবার তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘স্যার আপনি কি ওর বাসায় খবর পাঠিয়ে দিয়েছেন?’

-‘হ্যাঁ, এভাবে তো ও হোস্টেল থাকতে পারবে না। ওকে দেখাশোনা করার জন্য কে আছে ওখানে? বাসায় তো যেতেই হবে। পাগল না কি মেয়েটা! বাসায় না জানালে দেখবে শুনবে কে ওকে? তাই আমি আজ কথা বলেছিলাম ওর বাবার সাথে।’

-‘সেটাই তো। এখন তাহলে ওকে আমরা হোস্টেল নামিয়ে দিয়ে আসব?’

-‘হুঁ, আর ওর এক মাসের স্যালারিটাও দিয়ে দেবে বোনাসসহই।’

-‘মানে অ্যাডভান্স স্যালারি?’

-‘না। যে এক মাস কাজ করতে পারবে না সেটার।’

রাস্তার বাঁ পাশে গাড়িটা দাঁড় করেছে নয়ন। মেহফুজ রাস্তার এপাশ থেকেই দেখছে রাস্তার ওপাশের বিস্ময়কর দৃশ্য। খেয়াম প্লাস্টার করা পা’টা উঁচু করে আরেক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার কোনো বান্ধবীর ঘাড়ে হাত ফেলে। পাশে তার আরও চারজন ছেলে আর মেয়ে বন্ধুকে দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত তারা নিতে এসেছে ওকে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, তরঙ্গ তার গাড়িটার দরজা খুলে খেয়ামকে ভেতরে ঢোকার কথা বলছে বেশ শক্তমুখে। খেয়ামকে দেখা যাচ্ছে সে নারাজ তার গাড়িতে উঠতে। বারবার না বলছে হয়তো। যা তার চেহারার অভিব্যক্তি দেখা বোঝা যাচ্ছে। নয়ন আর মেহফুজ দুজনেই নির্বাক দৃষ্টিতে দেখছে সেই দৃশ্য। প্রায় দশটা মিনিট চলল সেই বিস্ময়কর মুহূর্ত। অবশেষে তরঙ্গের জোরাজুরিতে খেয়ামকে উঠতে হলো তার গাড়িতে। সাথে উঠল তার বন্ধুরাও। মিনিটখানিকের মধ্যে গাড়িটা এগিয়েও গেল।

নয়ন গাড়িটার দিকে চেয়ে থেকে বলে, ‘কাহিনিটা তো এমন হওয়ার কথা ছিল না, স্যার।’ মেহফুজ সিটে হেলান দিয়ে মাথার পিছে দুহাত ফেলে আরাম করে বসল। চেহারাটা তার স্বাভাবিক, মসৃণ। তারপর হঠাৎ ফোন করে মুনকে। ওপাশ থেকে মুন জানায় তারা মাত্রই বেরিয়েছে বাসা থেকে। তাকে বসুন্ধরার সামনে চলে আসতে বলে। কথা বলা শেষ করে নয়নকে সে বলল, ‘আজকের মতো কাহিনি এখানেই শেষ। পরবর্তীতে দেখা যাবে আবার। আপাতত বসুন্ধরার সামনে চলো।’

#এমনই_শ্রাবণ_ছিল_সেদিন
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি

৯.
ইদটা কাটিয়ে খেয়াম প্রায় দেড় মাস পর ঢাকা ফেরে। এই দেড়টা মাস ছিল তার জীবনের সব থেকে আলস্যকর সময়। শুধু খাওয়া, ঘুম, পড়া আর বিশ্রাম ছাড়া কিছুই করার সুযোগ পায়নি সে। তবে এই দেড়মাসে কিছু অনাকাঙক্ষিত ঘটনাও ঘটেছে তার সাথে। ইব্রাহীমের ফোন, মেসেজ তো অনবরত তার ফোনে আসতই। তবে সেই সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে তরঙ্গের ফোন কল। প্রায় প্রায়ই ফোন করে সে তার কাছে। কোনো কোনো দিন কথা বলতে বলতে আধঘণ্টার বেশি সময়ও কাটিয়ে দেয় তরঙ্গ। কখনো তার লাইভ প্রোগ্রামের সময়সূচি বলে তাকে টিভিতে দেখার আমন্ত্রণও জানায়। তরঙ্গের সহজ, সাধারণ এমন নতুন আচরণ খেয়ামকে অনেকটাই ভাবনাতে ফেলে দিয়েছে। ঘটনাগুলো সে তার রুমমেট ও একমাত্র বেস্টফ্রেন্ড রাহির কাছে না বলেই পারল না। এসব জেনে রাহি নিমিষেই বলে ফেলে, ‘দোস্ত, পোলা তোর প্রেমে পড়ছে। খাসা প্রেম এক্কেরে।’ খেয়াম তা শুনে চেহারা কুুঁচকায়। অবিশ্বাসের সুরে বলে, ‘এমন একটা কথা বললি যে কথার বাপ-মা নাই।’ রাহি হাসে, ‘বাপ-মা নাই মানে? অবশ্যই ভিত্তি আছে কথার। তুই ভাবতেছোস অত বড় সিঙ্গার, অ্যাক্টর তোর মতো সাধারণ মানুষের প্রেমে ক্যান পড়ব? তুই প্রথমে তোর আউটলুক বিচার কর। কোনো কৃত্রিমতা নাই তোর চেহারায়। একদমই ন্যাচরাল বিউটি যারে কয়। যা তুই অবশ্য নিজে বুঝতে পারিস না। এই চেহারার প্রেমে একজন খাঁটি হৃদয়ের মানুষ পড়বেই।’ চোখে মুখে উচ্ছ্বাসের হাসি রাহির। খেয়াম যেন মহাবিরক্ত, অতিষ্ট আর অধৈর্য রাহির কথায়। তেমন অভিব্যক্তিতে চেয়ে আছে সে তার দিকে। আর রাহি ওদিকে থেমে নেই।

-‘আর তোর পার্সোনালিটিও কম যায় না, দোস্ত। তার ওপর পোলাটারে দুই দুইবার যেভাবে উপকার করছোস তাতে এই পোলা তোর প্রেমে পড়বে তা অস্বাভাবিক কিছু না।’

খেয়াম তার কথাকে যেন ফাউল কথা বলেই উড়িয়ে দিলো। নির্বিকারভাবে ফোনটা নিয়ে চেপে যাচ্ছে সে। রাহি তার মনের এই ভাব বুঝতে পারে। সে ভেংচি কেটে বলে, ‘এমন ডোন্ট কেয়ার রিয়্যাক্ট দিলি তো? আমার কথা যদি সত্যি না হয় তখন এসে বলিস।’

এর উত্তরে খেয়াম বলে, ‘দোস্ত, এই দেড়মাসে আমার একটা বিরাট উপকার হইছে। রাত, দিন প্রাণ খুলে পড়তে পারছি, বুঝছোস? কিন্তু সমস্যা হলো ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষার খুব বেশি দেরিও নাই। বাবা বলতেছে কাজ ছেড়ে দিতে। পরে না হয় আবার বাবা কথাবার্তা বলে কাজে ঢোকাবে। কিন্তু এটা তো সম্ভব না, তাই না? একে তো কাজের মাঝে কত কত ফাঁক পড়ে যাচ্ছে। আবার কাজ ছেড়ে কাজ পাওয়া যায়?’

রাহি বুঝতে পারল তরঙ্গের ব্যাপারে কথা বলতে খেয়ামের অনীহা ভাব। তাই সে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। রাহি তাই রাগ করে উঠে চলে গেল। আর সে যেতেই খেয়াম ফোনটা বুকের ওপর নিয়ে ভাবনাতে পড়ে অন্য কাউকে নিয়ে। ভাবে, এই দেড়টা মাসে সেটের অনেকেই তো তার খোঁজ খবর নিয়েছে কল করে। শুধু একজন বাদে। যার থেকে ফোন কল অবশ্য আশা করাও বোকামি। কিন্তু তবুও মনের কোথাও যেন ‘তার থেকে ফোন আসবে’ এমন আশার ক্ষীণ আলো জ্বলত।
***

স্টুডিয়োর উপর তলায় এসে পৌঁছয় মেহফুজ আর ইমরান। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে মেহফুজ সবাইকে বলে, ‘আর মাত্র পাঁচ মিনিট টাইম দিচ্ছি সেট রেডি করতে। আজকে শট নিতে হবে অনেক রাত পর্যন্ত। বেশি টাইম নিস না তোরা।’

খেয়াম লাভ শেপের রেড ক্যান্ডেলগুলো জ্বালানোর ফাঁকে একবার তাকাল মেহফুজের দিকে। সেট প্রায় রেডি। শুধু ক্যান্ডেলগুলো জ্বালানোই বাকি আছে। মেহফুজ সোজা স্টোরিবোর্ডের কাছে এল। অন্যান্য কলাকার স্টোরিবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে মেহফুজের গল্পের চিন্তা-ভাবনা শুনছে তার থেকে। তরঙ্গসহ আরও তিনজন অভিনেতা এসে সেটে দাঁড়াল। ততক্ষণে সেট সম্পূর্ণ রেডি। তাদের দেখে মেহফুজ তাদের কাছে এসে কিছু সময় তাদেরও আবার বোঝাল আজকের স্ক্রিপ্টের কাহিনিটুকু। তবে সেদিকে তরঙ্গের একদমই নজর নেই। খেয়াম তারার পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল তার সঙ্গে। সেদিকেই নজর তরঙ্গের। কথার ফাঁকে খেয়ামের নজর এল তরঙ্গের দিকে। তরঙ্গ হেসে হাত উঁচু করে তখন তাকে হাই জানায়। মেহফুজ তা খেয়াল করে তরঙ্গকে বলে ওঠে, ‘আমি কী বলছি আর তুমি কোনদিকে চেয়ে আছ, তরঙ্গ?’ কথাটা বলেই সে রাগান্বিত চেহারা নিয়ে তরঙ্গের দৃষ্টি লক্ষ করে তাকায় খেয়ামের দিকে। খেয়ামের প্রতি তরঙ্গের এত সৌজন্য আচরণ, ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারল না মেহফুজ। তবে রাগ হতে থাকল তার দুজনের ওপরই। এর মাঝেই আরও তিনজন কলাকার মেকআপ শেষ করে সেটে এসে দাঁড়াল। রাগটা শেষমেশ ঝারল মেহফুজ তাদের ওপর, ‘কটার সময় সেটে আসার কথা ছিল সবার? আমি কি আজকে সারা রাত ভরে শট নেবো?’

খেয়াম কাজ সেড়ে ছাদের এক কোণে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তরঙ্গের জন্য। তরঙ্গ তাকে অপেক্ষা করতে বলেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার ভাবনাতেই মশগুল ছিল সে। হঠাৎ তরঙ্গের কী হলো তা নিয়ে সে বেশ চিন্তাগ্রস্ত।

শট দেওয়া শেষে তরঙ্গ একটুও না বসে সোজা চলে এল তার কাছে। একটুখানি হাসল খেয়ামের দিকে চেয়ে। অপ্রস্তুতভাবে হাসল খেয়ামও। জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু বলবেন স্যার?’ তরঙ্গের ইচ্ছা করছে খুব, এত সুন্দর একটা নিস্তব্ধ রাতে ছাদে দাঁড়িয়ে খেয়ামের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এভাবেই কাটিয়ে দিতে। এই কটা দিনে সে ভীষণ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে ছিল খেয়ামের ফেরার জন্য। আর আজ সে ফিরে এসেছে। কিন্তু তার সঙ্গে বলার মতো কোনো কথা তরঙ্গ খুঁজে পাচ্ছে না। তবে আনন্দে টইটুম্বুর তার মনটা।

রাত বাজে প্রায় সাড়ে এগারোটা। নয়ন হঠাৎ কল করে খেয়ামকে জানাল তাকে আজকে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব সে নেবে। খেয়াম সম্মতি জানিয়ে ফোন রাখতেই তরঙ্গ হঠাৎ তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমাকে তো ফিরতে হবে হোস্টেল, না? টেনশন করতেছ ফেরা নিয়ে? আমি পৌঁছে দিলে সমস্যা?’

-‘না না স্যার। আপনি কেন পৌঁছে দেবেন? নয়ন ভাইয়া এগিয়ে দেবে বলল তো।’

-‘নয়ন কেন? ও তো ডাইরেক্টর সাহেবের লেজ।’ বেশ অসন্তুষ্টি আর রাগ তরঙ্গের গলায়। খেয়াম কিছু খুঁজে পায় না বলার মতো। এবার তার মাথার মধ্যে ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে রাহির বলা কথাগুলো। তরঙ্গের নিষ্পলক দৃষ্টির সামনে প্রচণ্ড বিব্রত হয়ে পড়ছে সে। তবে কি সত্যিই এই খেপাটে পাগলটা তার প্রেমে পড়ল? এও কি সম্ভব?

মেহফুজ শট নেওয়া শেষ করে ভিডিয়ো নিয়ে কথা বলছিল ইমরানের সঙ্গে। তার ফিরতে আরও রাত হবে। নয়নকে দেখে কথার ফাঁকে তাকে ইশারা করল কিছু একটা বোঝাতে। তার ইশারা পেয়ে নয়ন খেয়ামকে খুঁজতে থাকল সব জায়গায়। খেয়ামকে পৌঁছে দিয়ে আসার কথায় ইশারায় জানিয়েছে মেহফুজ। কিন্তু খেয়ামকে তো সেটের আশপাশে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না! শেষে তাকে তরঙ্গের সাথে ছাদ থেকে নেমে আসতে দেখা গেল। নয়ন ঝটকা খেলো যেন তরঙ্গকে খেয়ামের সাথে দেখে। সে একবার বিস্ময় নিয়ে তাদের দেখে পরেরবার মেহফুজের দিকে তাকাল। মেহফুজ ওদের দুজনকে এক সঙ্গে দেখে ফেলল কিনা তা দেখার জন্য। কিন্তু মেহফুজের দিকে চেয়েও সে আরেকটাবার ঝটকা খেলো মেহফুজের প্রকাশিত ক্রোধযুক্ত চেহারাখানা দেখে। নয়ন তা দেখে দ্রুত পায়ে খেয়ামের সামনে এসে দাঁড়াল, ‘কই ছিলে, হ্যাঁ? কখন থেকে খুঁজছি তোমাকে? তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আমাকে ফিরে আসতে হবে না?’ খেয়াম অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল, ‘আসলে… স্যার একটু ডেকেছিল ছাদে। কথা বলছিলাম।’ এমন একটা কথা শুনতে একটুও প্রস্তুত ছিল না নয়ন। সে একবার আড়দৃষ্টিতে মেহফুজের দিকে তাকাল। মেহফুজের চোখা দৃষ্টি এদিকেই। নয়ন তা দেখে খেয়ামকে বলল, ‘আচ্ছা, চলো এখন।’

-‘ওকে আমি পৌঁছে দিয়ে যাব। তুমি তোমার কাজ করো, যাও।’ কাটকাট সুরে বলল তরঙ্গ। খেয়াম তরঙ্গের আচরণে শুধুই বিস্মিত হচ্ছে। যেন অদৃশ্য অধিকার প্রয়োগ করছে তরঙ্গ তার ওপর। দিনের বেলা হলে হয়তো সে কারও গাড়িতেই যেতে রাজি হতো না। এদিকে নয়নও আর কিছু বলতে পারল না। চেয়ে রইল খেয়ামের মুখের দিকে। খেয়াম তখন তরঙ্গকে বলল, ‘ভাইয়া হয়তো আমাকে, তারা আপুকে মানে আমাদেরকে পৌঁছে দেবে আজ। স্যার বোধ হয় দায়িত্ব দিয়েছে। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আমরা নয়ন ভাইয়ার সঙ্গেই যাই।’

-‘আরে কীসের কষ্ট? না কি তুমি আমাকে ট্রাস্ট করতে পারতেছ না খেয়াম?’
খেয়াম এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না। কথা তো সত্য, অবিশ্বাস তো আছেই তার বাইরের পুরুষগুলোর প্রতি। তবে তা এই মুহূর্তে অকপটে স্বীকার করাটা তরঙ্গের জন্য অনেকখানিই অপমানজনক। আর সেটা তার একেবারেই করা উচিত নয়। ওদিকে যে আরও দুটো জ্বলন্ত চোখ তার দিকে চেয়ে আছে তা আর খেয়ামের নজরে পড়ল না। সে নিজের নিরাপত্তা বস্তুগুলোর ভরসাতে নয়নকে মানা করে তরঙ্গের সাথে যেতে রাজি হলো। আর তখনি হঠাৎ মেহফুজ চেঁচিয়ে ডেকে উঠল, ‘নয়ন! আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরব। কোথাও যেতে হবে না তোমাকে।’

চলবে।

এমনই শ্রাবণ ছিল সেদিন পর্ব-০৮

0

#এমনই_শ্রাবণ_ছিল_সেদিন
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি

[কমেন্টের স্ক্রিনশটটা খেয়াল করবেন সকলে]

৮.
খেয়াম এখন শুধুই পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। কারণ, মেহফুজের ছবির শ্যুটিঙের কাজ সম্পূর্ণ শেষ। এখন শুধু ধারণকৃত ভিডিয়োগুলো একত্রিত ও ধারণকৃত শব্দ সম্পাদনা, সব ধরনের শব্দ মিশ্রণ এবং সংগীতের সুর করা ও সংগীত ধারণ করা হচ্ছে। কম্পিউটার গ্রাফিক কোনো দৃশ্য থাকলে তা যোগ করা হচ্ছে। এখানে আপাতত খেয়ামের কোনো কাজ নেই। তাকে বেতনটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে কিছু দিনের জন্য বিরতি দিয়েছে কাজ থেকে। মেহফুজের পরের কাজ আরম্ভ হলে তখনই তার কাজ শুরু হবে। কারণ, মেহফুজের অধীনে ছাড়া সে আর কারও কাজে নিয়োজিত হবে না বলে ভেবেছে। প্রায় মাস দুয়েকের লম্বা একটা ছুটি পেয়েছে সে কাজ থেকে। এর মাঝে বাড়ি থেকেও ঘুরে এসেছে। পড়াশোনা, ইউনিভার্সিটি, বন্ধুদের নিয়ে বেশ চলে তার সময়গুলো। সেই সময়ের মাঝে নতুনত্ব আসে তো সেদিন, যেদিন সে ফেসবুকের ইনবক্সে নয়ন খন্দকার আইডি থেকে মেসেজ পায়। তার লেখা একটি ছোটো গল্পের প্লট পছন্দ হয়েছে বর্তমানের জনপ্রিয় পরিচালক আরহাম মেহফুজের। এবং খুব শীঘ্রই তার প্লটে একটি নাটক নির্মাণ করতে চায় সে। তার গল্পটা চেয়ে নয়ন এই কথাগুলো বলে মেসেজ করেছে তাকে। তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চায়। ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে খেয়ামের দুদিন সময় লাগল। এ দেশের লেখক সমাজে জনপ্রিয় লেখকদের সুন্দর লেখার শেষ নেই। শেষে কিনা আরহাম মেহফুজ তাদের রেখে তার মতো চিপাগলিতে আটকে থাকা মানুষের অখাদ্য লেখা পছন্দ করল? তার জানামতে আরহাম মেহফুজ একজন বিচক্ষণ মানুষ। তবে এমন বোকামি কী করে করছে সে? না কি সত্যিই ভিন্ন এবং ভালো লাগার মতো কিছু খুঁজে পেয়েছে তার লেখাতে? এসবের পাশাপাশি আরও একটি চিন্তা উদয় হলো খেয়ামের। এখনকার পরিচালক তো কতশত লেখকদের গল্প নিয়ে কাজ করে সামান্য কৃতিত্বটুকুও দেয় না। আর সম্মানী তো দূরে থাক। সেখানে এই মানুষটা এতটা নীতিবান! সে চাইলে তাকে না জানিয়ে বা তার থেকে অনুমতি না নিয়েই কাজ শুরু করতে পারত। তাতে খেয়াম চাইলেও কিছু বলতে বা করতে পারত না। অবশ্য করার ইচ্ছাও হতো না তার। কিন্তু মানুষটার চারিত্রিক গুণাবলিতে সে দিন দিন আকৃষ্ট হয়েই চলেছে।
তার থেকে এসব জানার পর রাহি অতি উত্তেজনায় তাকে বলল, ‘দোস্ত, তোর ভাগ্য খুইলা যাচ্ছে রে। এখনি ফোন করে তোর মেহফুজ স্যারকে জানায়া দে ষষ্ঠ তারা মানুষটা তুই নিজেই।’

খেয়ামের এখনও বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি। সে নীরবে ঠায় বসে রইল। রাহি তার কাঁধ ঝাঁকিয়ে আবার বলল, ‘কীরে, খুশিতে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলি নাকি? ফোন করে জানা ওনারে। যোগাযোগ করতে চাইছে না তোর সঙ্গে?’
খেয়াম দেবম‚র্তির মতো বসে থেকে বলল, ‘আমি পারব না ওনার সামনে যাইতে। বলতেও পারব না আমার পরিচয়।’

রাহি এ কথায় রাগান্বিত হলো, ‘মানে কী? কী হইছে তোর? এমন ভং ধরছিস ক্যান? বলবি না তো কী করবি? কাজ করতে দিবি না ওনারে তোর গল্পে?’

-‘দেবো না ক্যান? করবে, অবশ্যই করবে। আমি আমার পরিচয় দিয়ে ওনার সামনে যাইতে পারব না রে।’

-‘আরে ক্যান? কারণ কী?’ বিরক্তিতে চেঁচিয়ে ওঠে রাহি।

খেয়ামের অস্বস্তির কারণ খেয়াম নিজেও বুঝতে পারছে না। এত দিন মানুষটার সামনে কাজ করতে কোনো দ্বিধা, সঙ্কোচ কাজ করেনি তার। হঠাৎ করে তার মনের অন্তঃস্থলে অতিথি পাখির মতো অজানা এক রাশ অযৌক্তিক, অকারণ লজ্জা আর সংশয় কোথা থেকে এসে যেন হঠাৎ বাসা বেঁধেছে। ওই মানুষটির সামনে নিঃসঙ্কোচে কাজ করতে সে পারবে না, যখন ওই মানুষটি জানতে পারবে Dew Drop নামের এলোমেলো লেখাটি তারই। যেই গল্পে একজন বিদেশিয়ো সুন্দরী রমণী এ দেশের মাটিতে আসে বেড়াতে। আর এখানে আসার পর এ দেশের শ্রাবণধারার প্রেমে পড়ে যায় সে। আর তারপর আরও একটি চমকপ্রদ ঘটনা ঘটে যায় তার সাথে। তার থেকেও চার বছরের ছোটো এ দেশের একজন বর্ষাপ্রেমিক ছেলের প্রেমে পড়ে সে। একই সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে অনাকাক্সিক্ষতভাবে কবে যেন সেই ছেলেটিও ভালোবেসে ফেলে তাকে। কিন্তু মেয়েটির বাগদত্তা অপেক্ষা করে আছে তার জন্য তার জন্মভূমিতে। একটি অসম আর অসমাপ্ত প্রেমের গল্পই সে এক বৃষ্টির রাতে তার অগোছালো চিন্তাধারা মিশিয়ে লিখেছিল। আর আজ সেই গল্পটির ঠাঁই হবে কিনা টিভির পর্দায়! এও কি সম্ভব? এত বড়ো বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে ওঠা যে তার পক্ষে অসম্ভব। কী করে বোঝাবে সে এই কথা রাহিকে?
***

পৌষের মাঝামাঝি। কুয়াশার পুঞ্জীভূত ধুম্রজাল চিরে পুব আকাশে রবি নিজেকে উদিত করে জানান দিচ্ছে নগরবাসীকে, ‘রাত যে পোহালো।’ মেহফুজের ঘুম ভেঙেছে তার উদয় মুহূর্তের পূর্বেই। খুব ভোরে তার দৌড়ানোর অভ্যাস। কাছের লেক থেকে ফিরে লনে এসে দাঁড়িয়েছে। মাকে দেখা যায় উপরে তার ঘরের জানালা থেকে। ছেলেকে দেখে হাত নেড়ে সুপ্রভাত জানালেন তিনি। তারপর ইশারায় লনে বসতে বললেন ছেলেকে। মেহফুজ গিয়ে বসে লনের ডান পাশে রাখা শৌখিন ধাঁচের বেতের চেয়ারগুলোর একটিতে। মা আসছেন কফি নিয়ে, তা সে জানে।

লনের ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশিরবিন্দুগুলো মুক্তোদানার মতো ঝলমল করছে কোমল সূর্যরশ্মিতে। কী যে সুন্দর লাগছে দেখতে! লনের বাম পাশে মায়ের হাতে রোপণ করা নানান ফুলের গাছ। অর্কিড, বার্ডস নেস্ট ফার্ন, বস্টন ফার্ন, সিলভার ফার্ন, রিবন ফার্ন দিয়ে সাজানো বাগানের এক ভাগ। আবার অন্য ভাগে অ্যাজেলিয়া, জেনারিয়াম, অ্যান্থুরিয়াম, স্যালভিয়ার মতো রংবাহারি ফুলের গাছেও ভরিয়ে তোলা। ক্রোটোন, ফক্সটেল, অ্যালপিনিয়া, ক্যালডিয়াম, ক্যালানথিয়ামের মতো পাতাবাহার আর নানাজাতের পাম গাছও রেখেছেন তিনি। গাছগুলোর পাতা থেকে টুপটুপ করে শিশির ঝরে পড়ার দৃশ্য আর পাখিদের কলরব মনটাকে যেমন আন্দোলিত করে তুলে, তেমনই চোখের আরামও দেয়। সকাল আর বিকালে এখানটাতে বসলে মনটা অন্যরকম প্রশান্তি আর স্নিগ্ধতায় ছেয়ে যায় যেন।
মা এলেন শাল গায়ে জড়িয়ে হাতে দুমগ কফি নিয়ে। ছেলেকে আজ বেশ প্রফুল্ল লাগছে যেন। বসতে বসতে বললেন, ‘ছবিটা মুক্তি পেয়ে গেল অবশেষে?’ মেহফুজ কফিতে চুমুক দিয়ে মৃদু হেসে হ্যাঁ জানাল। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘মুন ওঠেনি?’

-‘না। শীত এলে তো বেলা করে ওঠে।’

-‘অফিসের দেরি হয়ে যাবে তো।’

-‘তুই কখন বের হবি?’

-‘এইতো ঘণ্টা দুইয়ের মধ্যে।’

-‘আমি রান্না চাপাই গিয়ে তাহলে। তুই আয়।’

মা বিদায় নেওয়ার পর মেহফুজ নয়নকে কল করে। তিনবার রিং বাজলে নয়ন ঘুমু ঘুমু স্বরে হ্যালো বলতেই মেহফুজ তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘আমাকে কোনো আপডেট দিলে না যে? গতকাল রাতেই তো জানানোর কথা ছিল।’

নয়ন যেন লাফ দিয়ে উঠে বসেছে, এমন তড়িঘড়ি কণ্ঠে বলে, ‘স্যার…আসলে…মানে কী বলব! কাল রাতে যে কখন দ্রুত ঘুমিয়ে পড়েছি তা বুঝতেই পারিনি। আমি এখনি আপনার বাসায় চলে আসছি।’

-‘ধীরে ধীরেই আসো। সমস্যা নেই।’

নয়ন কোনোরকমে নাশতা সেরেই উপস্থিত হয়েছে মেহফুজের বাসায়। মাঝেমাঝে নয়নের কার্যকলাপ এমন হয় যেন মেহফুজের আজ্ঞাবহ দাস সে। যার জন্য কিছু আদেশ করার পূর্বেই তাকে প্রস্তুত থাকতে হয়। তাকে এমন পড়িমরি করে শীতের এই সকালবেলায় আসতে দেখে মুন কতক্ষণ তাকে নিয়ে নীহারের রান্নার পাশে দাঁড়িয়ে হাসি মজা করেছে তার সাথে। মেহফুজ তৈরি হয়ে নিচে নেমে নয়নকে দেখে একটুও অবাক হলো না। নয়ন তার অতি বাধ্য একজন কর্মচারী। গত চার বছরে তার এমন কার্যকলাপ দেখে সে অভ্যস্ত। খাবার টেবিলে বসে তাকে ডাকল, ‘নয়ন এসো, খেতে খেতে কথা বলি।’
সে ড্রয়িংরুমে বসেছিল হাতে পত্রিকা নিয়ে। ডাইনিং স্পেস থেকে মেহফুজের কণ্ঠ শুনে এগিয়ে এসে বলল, ‘আমি খেয়ে এসেছি স্যার। সমস্যা নেই, আপনি নাশতা করেন। আমি অপেক্ষা করছি।’

-‘আরে বললাম বসতে, বোসো।’

নয়ন কখনোই মেহফুজের আদেশ অমান্য করতে পারে না। তাই আদেশ পেয়েই সে তার পাশের চেয়ারটা টেনে বসে পড়ে। মুন রান্নাঘর থেকে এসে দুজনের খাবার বেড়ে দেয়। মেহফুজ তাকেও বলল, ‘তুইও বসে পড়। দেরি করে কী করবি?’

-‘না, আজ দেরি করেই যাব। তোরা খেয়ে নে।’

খাবার বেড়ে দেওয়ার মুহূর্তে মুন আর নয়নের চোখে চোখ পড়লে দুজন সৌজন্য বিনিময়ের হাসি হাসল কেবল। মুন রান্নাঘরে ফিরে যেতেই নয়ন কথা শুরু করল, ‘স্যার সে একজন মেয়ে। নামটা যেন কী বলল! আরাধ্যা না আরদ্রা? ঠিক মনে পড়ছে না এখন। তো যা-ই হোক, সে রাজি হয়েছে গল্পটা আমাদের দিতে। যদিও রাজি তো হবেই। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হলো সে আমাদের সঙ্গে মিট করবে না। মানে আমরা যেহেতু তার গল্পের মূল কাহিনিটুকু নেবো তাই তার দেখা করাটা খুব জরুরি নয়। সে বলেছে, আমরা তার সম্মানীর বিষয় ভাবতে চাইলে সেটা বিকাশ বা অন্য কোনো মাধ্যমেও ব্যবস্থা করতে পারি। আর আমারও মনে হলো যেহেতু গল্পের পুরো গঠন, সংলাপ, সব আপনিই সাজাবেন তাই তার সঙ্গে সামনাসামনি সাক্ষাৎ না হলেও চলে আমাদের। ছোটোখাটো ফেসবুক রাইটার তো। আমাদেরও তার সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশের দরকার কী?’

মেহফুজ খেতে খেতে বলল, ‘ফেসবুক রাইটার বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা উচিত নয় আমাদের। আর সে যদি না চায় তো আমাদেরও প্রশ্ন আসে না তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার। কথাবার্তা বলে সব ক্লিয়ার করে নিয়ো। এই গল্পটা নিয়ে আমি আগামী বছর কাজ শুরু করব। মানে আষাঢ়, শ্রাবণ মাসেই।’
***

গাজীপুরের বেলাই বিলের পাশে সেট রেডি করে ফেলেছে সবাই। এবারের গল্পটি মিলে মোট আরও দুটো গল্পে তরঙ্গ মেহফুজের সঙ্গে কাজ করবে। আজকের শটে দুজন কলাকারদের চরিত্র চাষী আর আরেকজনের বিলের মাঝি চরিত্র। আর তরঙ্গ একজন চিত্রশিল্পীর ভূমিকায় অভিনয় করবে এই গল্পে। বিলের পাশের সবুজ মাঠটাতে দাঁড়িয়ে চিত্র অঙ্কন করবে সে। তার বড়ো বড়ো চুলগুলো আর কিছুটা ভাবুক চেহারার জন্যই তাকে এমন একটি গল্পে নির্বাচন করেছে ইমরান। মেকআপ চলছে তার। কিন্তু সে মেকআপের ফাঁকে আড়চোখে এবং কড়া চাউনিতে দেখছে খেয়ামকে। বেশ দীর্ঘ ঘেড়ওয়ালা সাদা-কালো রঙ মিশেলে একটি গোল জামা পরেছে খেয়াম। তার ওপর গায়ে একটি কালো শাল। মাথায় সাদা ওড়নাটা থাকলেও তার কোমর ছাড়িয়ে যাওয়া রেশমী কালো চুলগুলো পিঠের মাঝখানটায় পড়ে আছে। প্রায় অনেকগুলো দিন বাদে তাকে দেখে তরঙ্গের মনে হচ্ছে, মেয়েটা এই কদিনে দেখতে আরও মিষ্টি হয়েছে। এর মাঝে একদিন অবশ্য মেয়েটার সঙ্গে তার একবার রাস্তায় দেখা হয়েছিল। সে গাড়িতে জ্যামে বসেছিল। খেয়ামকে সেদিন বাইপাসে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গাড়ির জানালাটা নামিয়েছিল তার জন্য। কিন্তু সে অপমানিত হয়েছিল যখন খেয়াম তাকে দেখেও একজন অচেনা মানুষ ভেবে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছিল। প্রথমে সে ভেবেছিল হয়তো খেয়াম চিনতে পারেনি। কিন্তু তার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সে জানালার কাছে ঘেঁষে বসে। তাতে জ্যামে আটকে থাকা মানুষগুলো তার জানালার কাছে ভিড় করে তার থেকে অটোগ্রাফ, ফটোগ্রাফ নিতে আরম্ভ করলেও কিন্তু খেয়াম তা দেখে এক বিন্দু আগ্রহ দেখায়নি তার প্রতি। এ আচরণ খেয়ামের মতো ছোটোখাটো কর্মচারীর থেকে তরঙ্গ জীবনেও প্রত্যাশা করেনি। তার অহংকারের ভিত যেন মেয়েটা একটু আগ্রহ সহকারে তার দিকে না তাকিয়েই নড়িয়ে দিয়েছে। মনে মনে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত সে মেয়েটার ওপর। আজ এই মেয়েটাকে একটা চরম শিক্ষা দিয়েই ছাড়বে সে। এইটুকুন মেয়ে, অথচ তার ভাবখানা আকাশ ছোঁয়া যেন। কীসের এত ভাব তার? তাই-ই সে দেখবে আজ।
সব কিছু মিলিয়ে শট নিতে নিতে প্রায় বিকাল পার হয়ে গেল। রমজান মাস চলছে। আরেকটু বাদেই মাগরিবের আজান দেবে। রোজা রাখার মতো মানুষ হয়তো এই সেটে কেউ নেই বললেই চলে। দীর্ঘ সময়ের কাজ থাকার জন্য খাবার তারা সঙ্গে করেই এনেছিল। সবাই যখন খেতে আরম্ভ করেছে খেয়াম তখন বেশ দূরে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। তারা তাকে খেতে আসতে ডাকলে সে জানায়, ‘আমি রোজা রেখেছি আপু। আপনারা খেয়ে নিন।’

তা শুনে নয়ন তখন অন্য একজন সহকারীকে বলে, ‘স্যারও কিন্তু রোজা রেখেছেন।’

সেই সহকারী তা শুনে জবাব দেয়, ‘স্যারের খাবার আলাদা রেখে দিয়েছি। খেয়ামের খাবারটাও তাহলে আলাদা রাখি?’

-‘হ্যাঁ রাখো।’

বেশ দূর থেকে দেখা গেল মেহফুজ আর ইমরান গ্রামের মধ্যে থেকে বেরিয়ে কথা বলতে বলতে সেটে আসছে। দুজন পুরোনো বন্ধু বলেই দূরে কোথাও শ্যুটিঙে এলে তাদের দুজনকে একা একা এদিক সেদিক ঘুরতে ফিরতে দেখা যায়। তারা সেটে এসে পৌঁছতেই আজান দিয়ে ফেলে। নয়ন মেহফুজের খাবারের ব্যবস্থা করার মুহূর্তে মেহফুজ তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘বাকিরা কই?’

-‘কানাইয়া বাজারে যে নতুন ব্রিজ হয়েছে ওখানে চা খেতে গেছে।’

মেহফুজ ইমরানকে বলল, ‘তো তুই বস। দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’

-‘না, ভাবতেছি আমিও চা খেয়ে আসি। তুই ইফতার কর।’

-‘খেয়েদেয়ে যেতি?’

-‘খা, সমস্যা নাই। এখনি আসতেছি।’
বলেই সে নয়নকে জিজ্ঞেস করল, ‘যাবা নাকি, নয়ন?’

-‘স্যারের কাছে থাকি, ভাই।’

-‘আরে যাও, ঘুরে এসো।’ মেহফুজ বলল।

নয়ন জিজ্ঞেস করল, ‘যদি কিছু দরকার পড়ে আপনার?’

-‘আমার কোনো দরকার পড়বে না। আর পড়লেও আমি দেখে নেবো। যাও তুমি।’

তা শুনে ওরা এগিয়ে যেতেই সন্ধ্যার আবছা আলোয় একটু দূরে খেয়ামকে দেখল নয়ন। তার মনে পড়ল, খেয়ামও তো রোজা রেখেছে। ও কিছু খেয়েছে নাকি? ভাবতেই ডেকে উঠল তাকে, ‘এই খেয়াম, ওদিকে কী করো? ইফতার করেছ?’

খেয়াম হালকা পানি মুখে দিয়ে রোজা ভেঙে এদিকে ওদিকে চেয়ে বাড়ি-ঘর দেখছিল। কিছুক্ষণের জন্য কারও বাড়িতে গিয়ে তাহলে নামাজ আদায় করে আসত। নয়নের ডাক শুনে সে তার দিকে ফিরল। মেহফুজও নয়নের দৃষ্টি লক্ষ করে তাকাল খেয়ামের দিকে। খেয়াম এগিয়ে এসে নয়নকে বলল, ‘জি ভাইয়া করেছি। আপনারা কই যান?’

-‘আমরা যাই একটু চা খেতে।’

-‘স্যারকে এই বিলে একা রেখে?’

-‘সমস্যা নেই, পরিচিত মানুষ আছে এখানে। পাশের গ্রামেই। তুমি কী ইফতারি করলে? তোমার খাবার তো আলাদা রাখা হয়েছিল স্যারের খাবারের সঙ্গে। স্যার ওই যে ইফতারি করছে গাড়িতে বসে। তুমি যাও, খেয়ে নাও।’

খেয়াম একবার ঘাড় ফিরে তাকাল লাল মার্সিডিজ বেঞ্চ গাড়িটার দিকে। গাড়ির দরজাটা খোলা। ভেতরে আলো জ্বলছে। গাড়ির জানালা থেকে দেখা যাচ্ছে মেহফুজকে। সেও এদিকেই তাকিয়েই আছে। খেয়াম দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে মুখে হাসি টেনে বলল, ‘সমস্যা নেই। আমি হালকা পাতলা ইফতার করেছি। আমি আসলে নামাজ পড়ার জন্য ওদিকে দেখছিলাম কারও বাসায় যাওয়া যায় কি না।’

-‘আরে স্যারের সাথে যেয়ো ওনার পরিচিতর বাসায়। এখন যাও, ইফতার করে আসো আগে।’ বলেই সে মেহফুজের দিকে তাকাল। মেহফুজ খাওয়ার মাঝে দেখছে তাদের। গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে মেহফুজকে বলল নয়ন, ‘স্যার, খেয়ামও রোজা ছিল। তাই ওকে খেতে যেতে বলছি।’

মেহফুজ ইশারায় নয়নকে বলল খেয়ামকে চলে আসতে। নয়ন তখন বলল, ‘খাবার তো আসার সময়ই নিয়ে আসছিলাম। তুমি কই থেকে কী খেলে? যাও যাও, খেয়ে নাও গিয়ে!’

বলেই ইমরান আর সে বাজারের দিকে রওনা হলো।
অস্বস্তিতে কাঠ হয়ে খেয়াম হাতের নখ কামড়াচ্ছে। মেহফুজ খাওয়া শেষ করে গাড়ি থেকে নেমে হাতটা ধুতে ধুতে খেয়ামকে দেখল। সে একই জায়গাতে দাঁড়িয়ে আছে। মেহফুজ একটু গলা ছেড়ে তাকে বলল, ‘খাবার রাখা আছে গাড়িতে। খেতে আসো।’

খেয়ামের পা জোড়া চলতে বহু কষ্ট হচ্ছিল। হঠাৎ করে এত আড়ষ্টতা এল কোথা থেকে সেটাই সে বুঝছে না। মেহফুজের সামনে একা এলেই হাত-পা যেন থরথর করে কাঁপে তার। গাড়ির কাছে সে এগিয়ে আসতেই মেহফুজ ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে কারও উদ্দেশ্য বিনায় বলল, ‘নামাজের টাইম পার হয়ে যাবে। ওরা কখন আসবে কে জানে!’

এ কথা শুনে খেয়াম বুঝতে পারল, তার খাওয়ার জন্যই মেহফুজ এখানে অপেক্ষা করছে। আপাতত সেটে তারা দুজন ছাড়া কেউ নেই। মেহফুজ এই বিলের পাড়ে খেয়ামকে ভর সন্ধ্যাবেলায় একা ফেলে যেতে পারবে না বলেই সবার ফিরে আসার কথা ভাবছে। খেয়াম কিছু বলল না। গাড়িতে ঢুকে জুস আর খেজুর খেয়ে বেরিয়ে এল। মেহফুজকে বলল, ‘আপনি যেতে পারেন। সমস্যা নেই।’

মেহফুজ দাঁড়িয়ে ফোন চাপছিল। হঠাৎ খেয়ামের কথা শুনে তার দিকে চোখ তুলে চেয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে গিয়েও নিতে পারল না। দ্বিতীয়বারের মতো নজর বাধা পড়ল তার খেয়ামের মুখের দিকে। খেয়াম বুঝতে পারল না তার এহেন চাউনির কারণ। যদিও মেহফুজ আবারও তখনি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছিল। সে বাজারের পথের দিকে চেয়ে বলল, ‘একা থাকা কিছুটা রিস্ক।’

কথাটা বলে সে আঁড়চোখে খেয়ামের দিকে আবার তাকাল। তবে এবার তার নজর ছিল খেয়ামের জামার হাতার দিকে।

খেয়াম জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি নামাজ পড়তে যাবেন তো?’

মেহফুজ মুখে উত্তর দিলো না। মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানাল শুধু।

-‘আমিও কারও বাসায় যেতে চাইছিলাম নামাজ আদায়ের জন্য। তখনই নয়ন ভাই ডাক দিলো।’

মেহফুজ আশপাশে একটু দেখে গাড়ি লক করে বলল, ‘তাহলে চলো আমার সাথে।’

গা শিরশির করা হাওয়া বিলের পাড়ে। পৌষের শীতের দাপট বোঝা যায় নগরের বাইরে এলে। ভরা বর্ষাতে বেলাই বিলের জলরাশির সৌন্দর্য এই পৌষে এসে খুঁজে পাওয়া যায় না তেমন। বিল শুকিয়ে জায়গায় জায়গায় চর পড়ে যায়, জলরাশিতে শাপলাও দেখা যায় না। তবুও মেহফুজ তার এবারের গল্পটির মাঝে ঢাকার আশপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জায়গাগুলোকে কেন্দ্র করে সেট তৈরি করছে এসব জায়গায়।

পাশের গ্রামে ঢুকে মেহফুজ তার পরিচিত একজনের বাড়িতে গিয়ে খেয়াম আর সে নামাজ আদায় করে সেখান থেকে খুব দ্রæতই বেরিয়ে আসে। মেহফুজের থেকে অনেকটা দূরত্ব রেখে খেয়াম তার পিছু পিছু চলছে। বিলের কাছাকাছি এসে তারা একটু দূর থেকে দেখতে পায় চিকেন ফ্রাই করার আয়োজন করছে সকলে বিলের পাড়ে বসে। আরও কিছু মুহূর্ত এই বিলে তারা কাটাবে। খেয়াম ভেবেছিল কাজ শেষ করে একটু দ্রুতই ফিরবে সে হোস্টেল। পড়াশোনার চাপটা বেশ। সামনে পরীক্ষা। এদিকে শরীরটাও তেমন টানছে না আর। তাই মনটাও সায় দিচ্ছে না এতখানি সময় কাটাতে। বিড়বিড় করে আক্ষেপের সুরে স্বগতোক্তি করল, ‘এই কাজের পাশাপাশি আর আমার পড়া! কী দরকার ছিল ইংরেজির মতো বিষয় নেওয়ার? সাধারণ, সহজ কোনো বিষয় নিলেই পারতাম।’ মেহফুজ ফোনের আলো জ্বেলে চলার মাঝেই খেয়ামের মৃদুকণ্ঠে কথা বলা শুনতে পায়। তবে স্পষ্ট বুঝতে পারে না। চলা থামিয়ে পিছু ফিরে সে। খেয়ামকে জিজ্ঞেস করে, ‘কিছু বললে?’ খেয়াম ক্ষণিকের জন্য মেহফুজের কথা শুনে চমকায়, সে শুনে ফেলল কিনা এই ভেবে। তবে দ্রুত সামলে উঠে বলে, ‘না, কিছু বলিনি।’

-‘ও, তো তুমি অত পিছে পড়ে আছ কেন? আমার সাথে আসো।’

-‘সমস্যা নেই।’

কথাটা শুনে মেহফুজ হাঁটার মাঝে আরেকবার পিছু ফিরে তাকাল ওর দিকে। তারপর হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘রাতে এমন স্পট মেয়েদের জন্য নিরাপদ নয়। পেছন থেকে কেউ টেনে নিয়ে গেলে বুঝতেও পারব না।’ তার এমন নির্বিকারভাবে বলা কথাগুলো শুনে খেয়ামের বুকটা নিমিষেই কেঁপে উঠল। এই মানুষটা মোটেও রসিকতা করার মতো মানুষ নয়। আর তার সাথে তো তেমন সম্পর্কও নেই। অতএব, কথাটাকে গুরুত্ব না দিয়ে পারল না সে। পেছন থেকে দ্রুত পদে হেঁটে এসে এসে মেহফুজের পাশাপাশি চলতে শুরু করল। মেহফুজ তখন একবার আড়চোখে তাকাল তাকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে। তারপর সে নজর ফিরিয়ে নিতেই খেয়ামের কেন যেন মনে হলো মেহফুজ মিটিমিটি হাসল। কিন্তু সে ভুল দেখেছে কিনা তা জানতেই বারবার চোরা দৃষ্টিতে দেখতে থাকল মেহফুজকে।

সেটে পৌঁছে ওরা দেখল চিকেন ফ্রাইয়ের সব বন্দোবস্ত করে ফেলেছে সবাই। এদিকে শীতের প্রকোপ খেয়ামের গায়ের চাদরটা ভেদ করেই যেন কামড় বসাচ্ছে শরীরে। সবাইকে একবার দেখে সে হাঁটতে হাঁটতে বিলের চর পড়া জায়গাতে এসে দাঁড়াল। তখন হঠাৎ ইব্রাহীমও তার পাশে এসে দাঁড়াল।

-‘শীতের রাইতে চিকেন ফ্রাই। ওহ্ সেই! ইমরান স্যার ভালোই কিছু খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করে শ্যুটিং শেষে।’ খেয়াম পাশে ফিরে তাকিয়ে তাকে দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কতক্ষণ কাটাবে সবাই এখানে?’ তার প্রশ্ন আর কণ্ঠে ইব্রাহীম মন খারাপের আভাস পেল। সে উল্টো জিজ্ঞেস করল, ‘কী হইছে গো? মন খারাপ না কি?’
খেয়ামের উদ্দেশ্যহীন দৃষ্টি সামনে, বহুদূরে। হঠাৎ করেই ভাইয়ের কথা আজ ভীষণ মনে পড়ছে তার। গত বছর রোজার মাসেই ভাইটা তার বাড়িতে এসেছিল। ভেবেছিল, ভাইটা এসে বাবাকে বলবে, ‘আমার ভুল হয়ে গেছে বাবা। আমাকে ক্ষমা করে দাও।’ আর তারপরই আবার তাদের পরিবারটা আগের মতো সুখী পরিবার হয়ে যাবে। ভাইয়া চাকরি করে প্রতি মাসে বাড়িতে টাকা পাঠাবে, বাবার আর মুদির দোকান চালাতে হবে না। ছুটিতে ভাইয়া বাড়ি আসবে, কত মজা হবে আবার। তার পরীক্ষা শেষ হলে ভাইয়া তাকে ঢাকা নিয়ে যাবে, ভাইয়ার কাছে থেকে পড়বে সে। কিন্তু এসব ভাবনা যে ভাবনাই রয়ে গেল। আর ভাইটা! সে যে আরও ভাবনার বাহিরে এক অচিন্তনীয় উপহার প্রদান করে গেল তাদের। সেই উপহারের ওজন বইতে না পেরে তাকে ছুটে আসতে হলো এই অচেনা, অজানা শহর আর মানুষের মাঝে। শুধুই ক’টা টাকার জন্য। অথচ, আজ তার থাকার কথা ছিল কোথায়!

-‘খেয়াম! এই খেয়াম!’

কারও ডাকে চিন্তার মহল থেকে বেরিয়ে আসে খেয়াম। ইব্রাহীম উদ্দেশক চোখে দেখছে তাকে। তার দিকে তাকাতেই ইব্রাহীম ফের জিজ্ঞেস করল, ‘কী হইছে তোমার?’ খেয়াম অনান্তরিকভাবে হাসে, জবাব দেয়, ‘শরীর, মন কোনোটাই ভালো লাগছে না আজ। হোস্টেল ফেরা দরকার।’ ইব্রাহীম খেয়ামের মুখটার দিকে তাকায়। কী যেন খোঁজার চেষ্টা করে তার চেহারাতে।

তরঙ্গ মাদুরের ওপর বসে গিটারে টুংটাং আওয়াজে সুর তুলছে। একেক সময় একেক গানের সুর। হঠাৎ অগ্নিশিখার হলুদে কিরণে সে দেখতে পেল খেয়ামকে। ইব্রাহীমের পাশাপাশি হেঁটে আসছে খেয়াম। শীতে প্রচÐ কাহিল অবস্থা যেন তার। কুঁকড়ে হাঁটছে। এর মাঝে তারা এসে তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার কফি খাবেন?’ তরঙ্গের বক্র চাউনি সামনে, খেয়ামের দিকে। তারাকে বলল, ‘একটু আগেই তো চা খাইয়া আইলাম।’

তারা এ কথা শুনে চলে যাচ্ছিল। তরঙ্গ হঠাৎ আবার ডেকে উঠল তাকে, ‘শোনো, তোমাকে আনতে হবে না। খেয়ামকে দিয়ে পাঠাও।’

তারা সম্মতি জানিয়ে চলে এলেও একটু যেন রাগ হলো তার। তবে সেটা তরঙ্গের ওপর না খেয়ামের ওপর তা বোঝা গেল না। বয়সে সে খেয়ামের থেকে বছর পাঁচেকের বড়ো। আর খেয়ামের থেকে বহু আগেই কাজ করছে সে এখানে। মোটামুটি সবার সাথেই তার ভালো সম্পর্ক, খেয়ামের সঙ্গেও। কিন্তু তার থেকেও ভালো সম্পর্ক সবার সঙ্গে খেয়ামের। এর কারণ সে জানে। খেয়াম খুব হাসিখুশি একটা মেয়ে, দেখতেও চমৎকার। তার প্রতি অনেকেরই আগ্রহ আছে তাও সে জানে। কিন্তু এই সেটে একমাত্র তরঙ্গই তাকে সহ্য করতে পারে না। অথচ তারপরও খেয়ামের প্রতি তরঙ্গের আগ্রহও আজ সে স্পষ্ট বুঝতে পারল। সে তো দেখতে খারাপ নয়, খেয়ামের থেকেও ফর্সা সে। কিন্তু খেয়ামের প্রতি যে আগ্রহ সবার, ততটা আগ্রহ তার প্রতি সবার প্রকাশ পায় না কেন? সে কি খেয়ামের থেকে দেখতে খারাপ? বরং খেয়ামের থেকেও স্মার্ট সে সব দিক থেকে। এসব ভাবতে ভাবতেই এল সে খেয়ামের কাছে। গাড়ি থেকে কফি এনে তরঙ্গকে গিয়ে দিতে বলল। ততক্ষণে মাদুরে প্রায় সবাই বসে পড়েছে। খেয়াম কফি আনার সময় খেয়াল করল মেহফুজ তার গাড়ির হুডির সঙ্গে হেলে দাঁড়িয়ে ইব্রাহীমের সঙ্গে কথা বলছে। সে মুহূর্তে এক ঝলক তাদের দুজনের চারটা চোখ মিলিত হলো। খেয়াম কফি নিয়ে চলে এলেও মেহফুজ তার যাওয়ার দিকেই চেয়ে রইল।

-‘স্যার আপনার কফি।’

তরঙ্গ শুনতে পেলেও ভ্রুক্ষেপ করল না খেয়ামের কথা। পাশে বসে থাকা এক সহকারী ছেলের সঙ্গে কথা বলছে সে। খেয়াম আরও একবার ডাকল তাকে। তখনও তরঙ্গের একই ভাব। পাশের সহকারী ছেলেটি তাকে ইশারায় কফির মগটা তরঙ্গের পাশে রাখতে বলল। খেয়াম তার কথা মতোই মগটা তরঙ্গের পাশে রেখে চলে আসার মুহূর্তে আচমকা বজ্রকণ্ঠে তরঙ্গ চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওই মেয়ে! তোমারে ঠ্যাঙের কাছে রাখতে বলছি কফি?’
পাশের সহকারী ছেলেটি তখন বলল, ‘ভাই আমিই বলছি ওরে। আপনি কথা বলতেছিলেন দেখে।’

তরঙ্গ কর্ণপাত করল না ছেলেটির কথা। খেয়াম তার দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘আমি আপনাকে দু’বার ডেকেছিলাম। আপনি কথা বলছিলেন তখন। তাই আর ডেকে বিরক্ত করতে চাইনি।’

-‘উদ্ধার করে দিছো আমারে। এই যে আমি না দেখে পায়ের গুঁতাতে ফেলে দিলাম মগটা। আর গরম কফিটা যদি আমার পায়ে পড়ত, তো কী হইত?’

-‘আমি বুঝতে পারিনি এমনটা হবে। দুঃখিত স্যার।’ খেয়াম নত সুরেই বলল।

-‘দুঃখিত বললেই হবে, না? কাজ দেখেশুনে করা লাগে না? আমি কথা বলতেছিলাম। কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত দাঁড়ায় থাকতে খুব কষ্ট হয়ে যাইত?’

খেয়াম বুঝতে পারছে তরঙ্গ ইচ্ছা করেই এই বাহানায় তাকে এখন শুধু শুধুই রাগারাগি করবে। কিন্তু তার যে মোটেও কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। সে নির্দোষ, এটাও তার বুঝিয়ে বলতে ইচ্ছা করছে না। তাই সে ক্ষমা চেয়ে কথার শেষ দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তা আর হবে বলে মনে হয় না। কারণ, তরঙ্গ এমন কোনো সুযোগের জন্যই হয়তো অপেক্ষা করছিল। তার থেকে বয়সে বড়ো এই ছেলেটিকে খেয়ামের মনে হয়, ছেলেটির পূর্ণপরিণত ভাব এখনও তার হাঁটুতেই আটকে আছে। নয়তো তার মতো সামান্য কর্মচারীকে অপদস্থ করে সে কী মজা পায়?
তরঙ্গের চেঁচামেচি থামল মেহফুজের উপস্থিতিতে। তরঙ্গের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে সবাইকে হাঁক ছেড়ে বলল মেহফুজ, ‘এই, সবাই কাজ শেষ করো জলদি। আমাদের ফেরার সময় হয়ে গেছে।’

ইমরান তখন বলল, ‘এখনও তো সব ফ্রাই করা হলোই না। খাওয়ার পর্ব তো বাকিই। এত তাড়া দিচ্ছিস ক্যান?’
মেহফুজ এ প্রশ্নের উত্তরে কিছু বলল না। অগ্নিদৃষ্টিতে তরঙ্গের দিকে শুধু তাকিয়ে রইল। তরঙ্গ অবশ খেয়াল করল না তার দৃষ্টি। ইমরান আবারও মেহফুজকে বলল, ‘আরে দাঁড়ায় আছস ক্যান? পাশে এসে বস ব্যাটা। বেশি টাইম লাগবে না। আর কিছুক্ষণ।’

ইমরানের আবদারে মেহফুজ বসল। খেয়াম তখন তরঙ্গের আদেশ রক্ষা করতে আবারও এক মগ কফি আনল তার জন্য। তারপর সেও বসল তরঙ্গের থেকে কিছুটা দূরে।

নীহারিকাবৎ রাত। চারপাশের বাতাস যেন ভীষণ বিক্ষুব্ধ। থেকে থেকে বাতাসের তীব্রতায় কেঁপে কেঁপে উঠছে খেয়াম। তরঙ্গের চোখজোড়া বারবার প্রচণ্ড আগ্রহের সঙ্গে আড়নজরে দেখছে তাকে। লক্ষ করছে খেয়ামের কেঁপে ওঠা। ওদিকে মেহফুজের কী একটা কথা শুনে সবাই হো হো শব্দে হেসে উঠল। খেয়ামও তার কথা শুনে হাসছে। মানুষটাকে খেয়ামের গম্ভীরই লাগত। আজ সে আবিষ্কার করল, মেহফুজ ভারি রসিকতাও জানে। একবার ঘাড় কাত করে দেখতে চেষ্টা করল সে মেহফুজের মুখটা। মেহফুজ তার কাতারেই বসেছে। কিন্তু প্রায় সাত আটজনের পরে। তবে দেখা গেল তার মুখের বাঁ পাশটা শুধু। আগুনের জ্বলজ্বল হলদে আভায় তার খোঁচা খোঁচা দাড়ির ফর্সা মুখটা দেখতে খুব ভালো লাগছে। হঠাৎ ইব্রাহীমের কথা কানে এল খেয়ামের।

-‘খেয়াম, শীত করতেছে বেশি? আমার জ্যাকেটটা দেবো?’

-‘না ভাইয়া। ঠিক আছি।’ বেশ অস্বস্তি নিয়ে বলল খেয়াম।

-‘আরে দেখতেছি তো কাঁইপা কাঁইপা উঠতেছ। লাগলে নেও। সমস্যা কী?’

-‘সমস্যা নাই ভাইয়া। আমার আসলে ভালো লাগে না কারও কিছু ব্যবহার করতে।’

কথাটা শুনে ইব্রাহীম একটু নিভল যেন। বোঝা গেল, ভালো লাগল না তার খেয়ামের কথাটা। এ কথায় তরঙ্গও বাঁকা চোখে তাকাল তার দিকে। খেয়ামের ঠান্ডা দেখে সেও চাইছিল তার চাদরটা এগিয়ে দেবে। কিন্তু দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছিল সে। ভাগ্যিস দেয়নি! নয়তো তাকেও অপমান হতে হতো এই পুঁচকে মেয়ের কাছে।

মেহফুজের তাড়া পেয়ে সবাই চিকেন ফ্রাই করা প্রায় অর্ধেকটা বাকি রেখে উঠে পড়ল। সব গোছগাছ আরম্ভ করে তারা। শুধু তরঙ্গই তখনও বসেছিল নিচে। গাড়ি ছাড়ার পূর্ব মুহূর্তে উঠবে বলে আলস্যতা নিয়ে বসে ফোন চাপছিল। ফোন চাপার মাঝখানে হঠাৎ তার পায়ে প্যান্টের ফাঁকে গোড়ালির কিছুটা ওপর ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ অনুভব হচ্ছিল। কিন্তু সেদিকে কোনো মনোযোগ নেই তার। তারপর সেখানে যখন কিছু নড়চড় করছে বলে মনে হলো, ঠিক তখন সে বুঝতে পারল সেটা কী হতে পারে। পা নড়াতেও তখন তার ভয় হচ্ছিল। শুধু তাকিয়ে দেখল সাপের লেজটুকু বেরিয়ে আছে, আর সেটার পুরো শরীরটা তখন ইতোমধ্যে তার প্যান্টের ফাঁকে ঢুকে পড়েছে। সে মুহূর্তেই ভীষণ আশ্চর্য এক কাণ্ড ঘটাল খেয়াম। লেজটা ধরে এক টানে প্যান্টের ফাঁক থেকে সাপটাকে বের করে দূরে ছুড়ে মারল। বিস্ময়ে অভিভ‚ত তরঙ্গ। বড়ো বড়ো চোখ করে চেয়ে দেখছে সে খেয়ামকে। খেয়াম তখন তাকে বলে উঠল, ‘স্যার, যত সমস্যা আপনার শুধু প্যান্টেই হয়? আর সেটাও আমিই সমাধান করি। নিন, এবার তো উঠুন।’

তরঙ্গ বিস্ময়ে কথা বলতে ভুলেই গিয়েছিল। উঠে দাঁড়িয়ে বিস্ময়পূর্ণ গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কী করলা তুমি ওইটা?’

-‘কী করলাম?’ জবাবে খেয়ামের নির্বিকার ভঙ্গিতে পালটা প্রশ্ন।

-‘ভয় করল না তোমার?’

-‘ভয় করলে কি আর ওকে বের করতে পারতাম?’
***

এমনই শ্রাবণ ছিল সেদিন পর্ব-০৭

0

#এমনই_শ্রাবণ_ছিল_সেদিন
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি

৭.
কাজ আর পড়াশোনা সব মিলিয়ে দিনগুলো বেশ ভালোই যায় খেয়ামের। বাবা মাসে একবার করে হলেও আসেন তাকে দেখতে। বাড়িতেও সে মাস শেষে টাকা পাঠাতে পারে। এত কিছুর মাঝে খেয়াম সব কিছু নিয়ে খুশি হলেও কিছু বিষয় নিয়ে সে চিন্তিত থাকে। প্রথম চিন্তা তার, রাত হলে এখনো তাকে কেউ একজন ফলো করে। কিন্তু সে হোস্টেলে ফেরার পর সেই ব্যক্তিটির উপস্থিতি আর পায় না। রাস্তাতে যতবারই সে তাকে দেখার জন্য পিছু ফেরে আর ততবারই সে একগাদা পথচারীদের দেখতে পায়। তাদের মাঝে সেই ব্যক্তিটিকে আর খুঁজে পায় না। দ্বিতীয় চিন্তা, তার যেমন কাজ তাতে নিশ্চয়ই পঁচিশ হাজার টাকার মতো বেতন পাওয়া কাজ নয়। এটা সত্যি, তাকে রোদ, বৃষ্টি সব কিছুর মাঝেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করতে হয়। কিন্তু তারপরও কি এত টাকা তার এই কাজের মূল্য? টাকা পয়সার বিষয় নিয়ে সে কোনো সময়ই কারও সঙ্গে আলোচনা করে না। এমনকি তার কাছের বান্ধবী রাহিকেও জানায় না তার বেতন কত। কিন্তু এই বিষয়ে সে সকল লজ্জা ভেঙে একদিন তারা নামের সহকারীটির কাছে জিজ্ঞেস করেছিল তার বেতন কত। সেও তার মতোই বেতনের বিষয় গোপন রেখেছে বলে তাকে জানায়নি। আর সর্বশেষ চিন্তা তার তরঙ্গকে নিয়ে। এর মাঝে আরও তিনবার তরঙ্গকে সে ছোটো-বড়ো কথা শোনাতে বাধ্য হয়েছে। এ জন্য আবার তাকেও মেহফুজ, আমিন এবং অন্যান্য সহকারীর কাছে বকা খেতে হয়। তবে তার ভয় হয়। কবে যেন এই কারণে তাকে কাজ থেকে বের না করে দেয় মেহফুজ।

একদিনের ঘটনা। সংলাপ অনুযায়ী সেদিন কলাকারদের অঙ্গভঙ্গি ঠিক খাপ খাচ্ছিল না, তাদের অভিনয়ের মধ্যে গড়মিল হচ্ছিল। এমনকি তরঙ্গ নিজেও অভিনয়ের মধ্যে গড়মিল করে ফেলছিল বারবার। স্ক্রিপ্ট সুপারভাইজার আবির এসব ঠিকঠাক করে সামগ্রিক ক্লিপটি মেহফুজকে দেখায়। মেহফুজ ক্লিপটি সম্পূর্ণ দেখার পর আবিরকে বলেছিল, ‘শট আবার নিতে হবে। পরবর্তী পর্বে এটা যাবে না।’

এতে অন্যান্য কলাকার নতুন করে আবার শট দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলেও তরঙ্গ কোনোভাবেই কোনো শিডিউল দেয় না। চলচ্চিত্র প্রযোজক ইমরান কয়েকবার তার কাছে গিয়েও ফিরে ফিরে আসে। কোনো ডেটই দিতে পারে না তরঙ্গ। শেষমেশ মেহফুজ নিজে তাকে ফোন করে। কতক্ষণ তাদের মাঝে বাকবিতণ্ড চলে। তারপর তরঙ্গ শ্যুটিঙের ডেট দেয়। মূলত তরঙ্গ সব সময় চায় মেহফুজ তার কাছে ছোটো হোক। এ কারণেই সে ইচ্ছা করেই সব কিছুতেই বেয়াড়াপনা করে। ব্যক্তিগতভাবে সে মেহফুজকে একদমই সহ্য করতে পারে না। সেদিন স্পটে আসার পর খেয়াম অতি দ্রুতই তার কস্টিউম রেডি করে তার সামনে আনে। কস্টিউমের মাঝে হঠাৎ একটু ময়লা দেখতে পায় খেয়াম। তরঙ্গও দেখতে পায় তা। কিন্তু তরঙ্গের থেকে অভিযোগ আসার আগেই খেয়াম তা পরিষ্কার করে আনে। তরঙ্গ কস্টিউমটা ধরে কয়েকবার এদিক ওদিক দেখে বলে ওঠে, ‘এত সস্তা জিনিস পরে তো আমি শট দিতে পারব না। আমার আলাদা একটা ইমেজ আছে। আর সবার মতো আমাকেও যা খুশি দিয়ে চালিয়ে দিলেই হবে?’
এ নিয়ে সে ঝামেলার সৃষ্টি করে বসে। তখন খেয়াম না চাইতেও তাকে বলে বসে, ‘কিন্তু স্যার আপনার গায়ের সেম ম্যাটেরিয়ালের ফতুয়া আমি ফুটপাতে ওই যে ভ্যানের ওপর বিক্রি করে যারা তাদের কাছে দেখেছি। সেখানে এটার দাম বোধ হয় বলতে শুনেছিলাম দু’শ কি তিন’শ। আপনি নিশ্চয়ই বড়ো কোনো মল থেকে কিনেছেন? এ জন্যই আপনার থেকে দামটা বেশি নিয়েছে।’

এরপর তরঙ্গের ভয়ানক দৃষ্টির চেহারাটা ছিল সত্যিই দেখার মতো। খেয়াম চাইছিল না এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে। কিন্তু সে সত্যিই তরঙ্গের পোশাকের একই মানের পোশাক অনলাইনেও সস্তা দামে দেখেছে আর ছোটখাটো দোকানেও। তরঙ্গের এই অতিরিক্ত দাম্ভিকতা খেয়াম যেন কোনোভাবেই হজম করতে পারে না। এ কারণেই মুখ থেকে তার আপনাআপনিই বেরিয়ে আসে তরঙ্গের উদ্দেশ্যে বলা কথাগুলো। তার বিনিময়ে অবশ্য সেদিনও আবার তরঙ্গ যা তা বলে অপমান করেছিল তাকে। সেদিন অন্যান্য সহকারীও তাকে রাগারাগি করেছিল। যার জন্য খেয়াম পরবর্তীতে আর কোনো উত্তর দেয়নি তরঙ্গকে। এখন অবধি তার কাজটা টিকেই আছে মেহফুজের জন্য।
***

বড় ছাতার নিচে বসে আছে তরঙ্গ। আর তার সামনে বসে আছে তারিন। গরমে তারিনের মুখের মেকআপ বারবার খারাপ হয়ে যাচ্ছে। হৃদয় তখন থেকে তার মেকআপ ঠিক করে যাচ্ছে। সেদিকে যেন তার একেবারেই হুঁশ নেই। সে দেখে চলেছে দূরে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে কথা বলা মেহফুজকে। তরঙ্গ আড়দৃষ্টিতে তারিনের দৃষ্টি লক্ষ করে মেহফুজের দিকে তাকাল। মেহফুজের পরনের ডার্ক ব্লু কালার টি শার্ট ভেদ করে তার ব্যায়ামপুষ্ট শরীরটার গঠন হালকা ভেসে উঠেছে। রোদের মধ্যে তার ফর্সা গালটার লালচে ভাব তরঙ্গের নজরেও পড়ছে স্পষ্টভাবে। তরঙ্গ তাকে সহ্য করতে না পারলেও সে অস্বীকার করতে পারে না, মেহফুজ নিঃসন্দেহে একজন আকর্ষণীয় চেহারার যুবক। টিভির পর্দার হিরোর থেকেও বরং বেশিই। মেয়েদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো ক্ষমতাই শুধু নয়, তার হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতাও আছে তার বাবা আর তার মৃত ভাইয়ের সুবাদে। তরঙ্গ শুনেছে, মেহফুজের বাবা অসুস্থ হওয়ার পর তার পরিবর্তে মেহফুজকে রাজনৈতিক দল থেকে আহ্বান জানিয়েছে এবং এখনও জানায় তাদের সঙ্গে যুক্ত হতে। কিন্তু মেহফুজ সেদিকে একদম আগ্রহী নয়। তার ওপর সে ছিল এক সময় সেনাবাহিনীর একজন কমিশন্ড অফিসার। সব মিলিয়ে তার মতো ছেলের কাছে তরঙ্গ নেহাৎই তুচ্ছ। তবুও যেন সে নিজেকে মেহফুজের পাশে বিশেষ কিছু প্রমাণ করতে চায় বারবার। মনে মনে সে অনেক বেশিই হিংসা করে তাকে। আর তাই তো সে কোনো কারণ ছাড়াই মেহফুজকে সহ্য করতে পারে না। এই যে এখন যেমন তারিন বিশেষ নজরে মেহফুজের দিকে চেয়ে আছে, মেহফুজ তা বারবার লক্ষ করেও তা গুরুত্বহীনভাবে এড়িয়ে নিজের কাজেই মনোনিবেশ করে যাচ্ছে। এমনটা তরঙ্গ আজ নতুন দেখছে না। তারিনের মতো আরও অনেক বড়ো বড়ো অভিনেত্রী, মডেলকেও দেখেছে। তারা নিজেদের ব্যক্তিত্ব খুইয়েও কতবার যেচে পড়ে প্রস্তাব দিয়েছে মেহফুজকে। সেটে আসলেও মেয়ে কর্মীগুলোর মাঝে সে আলোচনা হতে শুনেছে, ‘কীসের হিরো? আমাদের মেহফুজ স্যারকে কোনোদিক থেকেই টেক্কা দেওয়ার মতো ক্ষমতাবান কোনো হিরো এখনো পয়দা হতে দেখলাম না।’

এসব শোনার পর তরঙ্গের ইচ্ছা করে সেই সব মেয়েদের সামনে গিয়ে বলতে, ‘তোদের স্যার আদৌ স্বাভাবিক নাকি ইম্পোটেন্ট আগে তা যাচাই কর।’

এমনটা একদিন সে আরিশা নামের একজন জনপ্রিয় মডেলকে বলেও বসেছিল। আরিশা সেদিন তার এ কথায় রেগে গেলে তরঙ্গের উত্তর ছিল, ‘আজ অবধি শুনেছ আরহাম মেহফুজের বিছানায় কখনো কোনো মেয়ে জায়গা পেয়েছে? আরে ক্ষমতা থাকা লাগে তো!’
তরঙ্গ জানে, তার এই কথাগুলো কেবল নিজেকে নিজে সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া কিছুই নয়। মেহফুজ এই চলচ্চিত্রের জগতে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে তার বড়ো পর্দার আর্টফিল্মগুলোর জন্যই। আর তা খুব স্বল্প সময়েই। তার বয়সের কাছে তরঙ্গ হয়তো সামান্য কিছুটা ছোটো। কিন্তু তার এই জলদি সাফল্য সে কেন যেন কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না। একটা মানুষ পরিপূর্ণ কিংবা খুঁতবিহীন কখনোই নয়। কিন্ত মেহফুজকে দেখলে এই কথাটি তার কাছে একেবারেই ভিত্তিহীন লাগে। তখন নিজের সঙ্গে সে মেহফুজের তুলনা করে ফেলে। আর সেখানেই সে বারবার হেরে যায়। এই হারটাই সে মেনে নিতে পারে না।

ভাবনাতে তার ব্যাঘাত ঘটল টি-টেবিলের মাঝে পানির গ্লাস রাখার শব্দে। মেহফুজের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে সামনে চেয়ে দেখল খেয়ামকে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে তরঙ্গের একটা চিন্তা মাথায় এল। এখানে প্রতিটা মেয়ের থেকেই মেহফুজকে নিয়ে কোনো না কোনো প্রশংসামূলক মন্তব্য করতে শুনেছে সে। কিন্তু খেয়ামকে সে লক্ষ করেছে। কখনো মনের ভুলেও মেহফুজের দিকে সে তাকাতে দেখেনি তাকে, আর মেহফুজকে নিয়ে কোনো মন্তব্য তো দূরে থাক। মেয়েটা কি একটু আলাদা? না কি সে-ই ভুল চিনছে? খেয়ামকে নিয়ে এই দুই প্রশ্নের মাঝে তার মন প্রথম প্রশ্নটিকেই প্রাধান্য দিলো। মেয়েটার সঙ্গে বেশ কয়েকবার রাগারাগি হয়েছে তার। কিন্তু আজ-কাল মেয়েটাকে রাগারাগি করলেও কেন যেন তাকে কাজ থেকে বের করে দেওয়ার ইচ্ছাটা তার মাঝে আসে না এখন। মাঝেমাঝে নিজের অজান্তে সে খেয়ামের হাসি মুহূর্তটুকুকে বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে। আর তারপর সম্বিৎ ফিরে পেয়ে চকিতে সেই দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের মেয়েটার চেহারার মাঝে সৌন্দর্যের যেন কমতি নেই। তার মাঝারি আকারের কপাল, আয়ত আকৃতির বড়ো বড়ো দুটো চোখ, সুচালো নাক, পাতলা দুটো ঠোঁট, সামান্য ফোলা ধরনের গালদুটো আর তার হাসি। এই সবটাই তরঙ্গ মাঝে মাঝে খুঁটিয়ে খুটিয়ে দেখে আর মুগ্ধ হয়। মেয়েটার ওপর তার অত্যাধিক ক্রোধ আর ক্ষোভ থাকলেও তা সে যেন কী কারণে উপলব্ধি করতে পারে না কিছু কিছু সময়।

আজ শ্যুটিং চলছে ঢাকার রাস্তার একটি বাইপাসে। খেয়াম আপাতত তারিনের দেখাশোনাই করছে বারবার। মেহফুজ ইশারায় তারিনকে শট দেওয়ার জন্য রেডি হতে বলে একবার খেয়ামের দিকে তাকাল। সে মুহূর্তে খেয়ামেরও দৃষ্টি পড়ে যায় মেহফুজের দৃষ্টিতে। ক্ষণিকের জন্য দুটো চোখের চাউনিই যেন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে কিছুটা। খেয়াম নিজের এই অপ্রস্তুত হওয়ার কারণটা উপলব্ধি করতে পারে। তবে মেহফুজের দৃষ্টিও যে তারই মতো অপ্রস্তুত ছিল, তা আর সে উপলব্ধি করতে পারল না।

রোদে দাঁড়িয়ে নীল রঙের জর্জেট কাপড়ের ওড়নাটা দিয়ে ঘর্মাক্ত মুখটা মুছতে গিয়ে একটু ব্যথায় লাগল খেয়ামের। মুখের একটা পাশ লালও হয়ে গেছে তার। ঠিক সে সময় মেহফুজ তার পাশ কাটিয়ে এসে গাড়ির মধ্যে থেকে টিস্যু পেপারের বক্স থেকে টিস্যু নিয়ে আবার তার পাশ কাটিয়ে চলে গেল। আর খেয়াম তখন তার থেকে টিস্যুর সন্ধান পেয়ে মনে মনে খানিকটা কৃতজ্ঞবোধ হলো মেহফুজের প্রতি। সে যখন টিস্যুতে মুখটা মুছতে ব্যস্ত তখন তার সামনে দিয়ে তরঙ্গকে হেঁটে যেতে দেখার সময় সে খেয়াল করল, তরঙ্গের প্যান্টের পিছে ফাটা। সেটা দেখে একটু সময়ের জন্য সে বিভ্রান্ত হলো, এটা কি ফ্যাশন না সত্যিই প্যান্টের জায়গাটুকু ছেঁড়া? কিন্তু সেই ফাটা অংশ থেকে তার প্যান্টের নিচের আন্ডারওয়্যার দেখা যাচ্ছিল। আর এটা নিশ্চয়ই কোনো ফ্যাশন হতে পারে না! রাস্তার পাশ ঘেঁষে সাধারণ দর্শকে ভর্তি। তাদের মাঝে এমন একজন জনপ্রিয় হিরোর এই বেহাল অবস্থা দেখে কেউ ছবি তুলে নিলে তা অনলাইন জায়গাগুলোতে ছড়াতে দুমিনিট সময়ও লাগবে না। এমন ভাবনা হতেই খেয়াম তরঙ্গের সঙ্গে হওয়া ঝামেলাগুলোর কথা ভুলে দ্রুত তার দিকে এগিয়ে এল। তরঙ্গ দাঁড়িয়ে স্ক্রিপ্ট দেখছিল তখন। খেয়াম ঠিক তার পিছে দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে সে তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ তরঙ্গ তা বুঝতে পারে পিছু ফিরে তাকে দেখে কপাল কুঁচকায়। ভারী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘কী ব্যাপার? কী চাই?’ খেয়াম অপ্রস্তুত চেহারায় হাসে। এরপর খানিকটা আমতা আমতা করে বলে, ‘ইয়ে মানে একটা কথা জিজ্ঞাসা করার ছিল স্যার।’

-‘কী কথা?’ ধমকেই বলল তরঙ্গ।

খেয়ামের মুখে তখনো সেই আগের মতোই হাসি। তরঙ্গ তার দিকে ঘুরে দাঁড়াতে গেলে খেয়াম হইহই করে বলে ওঠে, ‘আরে আমার দিকে ঘুরবেন না। আপনি যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকুন না!’

তরঙ্গ যেন মহাবিরক্ত হলো, ‘মানে?’ বলে সে আবার খেয়ামের দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই খেয়াম ঘুরে এসে তার পিছে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘আরে মহা মসিবত তো! বললাম ঘুরে দাঁড়াবেন না। সমস্যা আছে তো।’

– ‘কী সমস্যা?’ বলার সময় রেগে প্রশ্নটা করে সে আবারও ঘুরে দাঁড়ায় খেয়ামের দিকে। আর খেয়ামও আবার তার পিছে এসে দাঁড়িয়ে একটু কঠিনভাবে বলে, ‘আপনি কি বাংলা কথা বুঝতে পারেন না? বললাম যে আপনি ঘুরে দাঁড়াবেন না আমার দিকে, সমস্যা আছে।’

তরঙ্গের অতি দ্রুত রাগ চড়ে যাওয়ার দোষটা আছে। শট দেওয়ার আগ মুহূর্তে খেয়ামের এই কাণ্ডে তার ভালোই রাগ চড়ে গেল। নাকের দুপাশ ফুলিয়ে গরম চোখে সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল খেয়ামের দিকে। খেয়াম গলা খাদে নামিয়ে আশপাশে একটু চোরাদৃষ্টিতে তাকিয়ে তারপর তরঙ্গকে বলল, ‘স্যার, আপনার প্যান্টের পিছে ফাটা।’

তার খাদে নামানো মৃদুস্বর তরঙ্গ ঠিকমতো শুনতে পেল না। সে চেঁচিয়ে বলল, ‘কী?’

তরঙ্গের এমন চেঁচানো কণ্ঠস্বর শুনে মেজাজ খেয়ামের একটু খারাপই হলো। চড় মারার জন্য পেছন থেকে সে একটা হাত ওঠাতে গিয়েও দ্রুত নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নিলো। এরপর তরঙ্গের কানের কাছে এসে সে বলল, ‘আপনার নিতম্বদেশের ওপর প্যান্ট ফাটা। বলা যায় কাটা।’ এবার তরঙ্গ ভ্রু, কপাল কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করল, ‘কোন দেশের ওপর?’ তার এমন প্রশ্নে খেয়ামের মেজাজ খারাপের সীমা পার হয়ে তার ইচ্ছা করল গাড়ির হুডের ওপর তরঙ্গের মাথা বাড়ি দিতে। মেজাজ খারাপের চোটে সে বলেই বসল, ‘আরে ধুর ছাই! আপনার পাছার ওপর প্যান্ট ফাটা। ফ্যাশনের জন্য কেটে রেখে আন্ডারওয়্যার দেখাচ্ছেন নাকি আল্লাহ মালুম।’ এ কথায় তরঙ্গের চেহারা রঙটা নিমিষেই বদলে গেল। অভিব্যক্তি তার এমন হলো যেন কেউ সত্যিই তার নিতম্বদেশ দেখে নিয়েছে। তার মতো একজন সেলেব্রেটির এমন দশা কেউ দেখলে তার ইমেজের জন্য কতটা ক্ষতিকর তা সে ভাবতেই প্রচণ্ড ঘামতে শুরু করল। উপায়হীন হয়ে সে অপ্রতিভভাবে সামনের দিকে তাকিয়ে খেয়ামকে বলল, ‘এই শোনো, একদম আমার পেছন থেকে সরবা না।’

-‘তো আমি কী করব? সারাদিন আপনার পিছে দাঁড়িয়ে থাকব?’

-‘তা কেন? এখন কী করব বলো তো?’

-‘কী আবার করবেন? চেঞ্জ করবেন।’

-‘আরে সেটা করার জন্যও তো এখান থেকে সরতে হবে। তখন যদি কেউ দেখে ফেলে?’

-‘দাঁড়ান, আমি ব্যবস্থা করছি।’

-‘কী ব্যবস্থা করবে?’

-‘ইব্রাহীম ভাইকে ডাকি। উনি আপনার পিছু পিছু যাবে। তারপর আপনি গাড়ির মধ্যে ঢুকে প্যান্ট চেঞ্জ করে নেবেন।’

-‘আরে তুমি পাগল না কি? তুমি জানো, ঠিক আছে। তাই বলে আবার ইব্রাহীমও জানবে? অসম্ভব! এক কাজ করো। তুমিই আমার পিছু পিছু আসো।’
***

-‘আল্লাহ কী বলিস? আমি তো হাসতে হাসতে শেষ!’
হাসির দমকে রাহি খেয়ামের গায়ের ওপর পড়ছে বারবার। হাসিটা কোনোরকমে থামিয়ে সে বলল, ‘শালা উজবুকের চরম শিক্ষা হইছে একটা। আচ্ছা, সত্যিই কি আর কেউ দেখে নাই ওর ফাটা প্যান্টের নিচ থেকে আন্ডারওয়্যার?’

খেয়াম ফোনের স্ক্রিনে নজর ফেলে মৃদু হাসতে হাসতে বলল, ‘কেউ দেখছে কি না দেখছে জানি না। আমি যখন ওর পিছু পিছু হাঁটতেছিলাম তখন অনেকেই তো আমাদের দিকে তাকাইয়া লক্ষ করতেছিল। ওরে গাড়িতে উঠাই দেওয়ার পর হঠাৎ মেহফুজ বুনো ষাঁড়ের চোখে চোখ পড়ে। কপাল কুঁচকায়ে কেমন করে যেন তাকায় ছিল আমার দিকে। পরে কাহিনি খুলে বললাম তারা আপুরে। সে তো আরেক বান্দা। হাসতে হাসতে আমার গায়ের ওপরই পড়ে তোর মতো।’

-‘দোস্ত, তোর মেহফুজ স্যারকে প্লিজ ওই নামে ডাকিস না। কী মাসুম আর কিউট দেখতে উনি! আমার বাপ বড়োলোক হলে আমি সোজা বিয়ের প্রস্তাব পাঠাই দিতাম ওনার বাসায়।’

খেয়াম একটু এক পেশে হেসে বলে উঠল, ‘হ, আর কিছু দোস্ত?’

-‘আচ্ছা দোস্ত, তোর দিকে কোনো সময় তাকায় না উনি? তুইও তো মাশা আল্লাহ দেখতে। ফরিদপুর থাকতে কলেজ টিচারও তোরে লাইন মেরে বসছিল। উনি কি একটু অন্যরকম চোখে তাকায় না তোর দিকে কোনো সময়?’

খেয়াম রাহির এ কথায় ফোনের ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে চোখ দুটো ছোটো ছোটো করে তাকাল ওর দিকে, ‘তুই কি গর্দভই থাইকা যাবি সারা জীবন? তুই-ই একটু আগে বললি তোর বাপ বড়োলোক হইলে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতি। তো আমার বাপ কি বড়োলোক? আমার কি তার সিনেমা, নাটকের নায়িকাদের মতো গ্ল্যামার লুক? তাহলে কোন আক্কেলে আমার দিকে তাকাবে উনি? তাও আবার অন্যরকম নজরে! হুহ্!’

-‘আরে ধুর! তুই বুঝোস নাই আমার কথা। ওইখানে তো অনেকেই তোরে কতরকম খারাপ, ভালো প্রস্তাব দিছিল। কীসের জন্য দিছিল? তুই সুন্দর দেখতে তাই তাদের নজর পড়ছিল তোর ওপর। তো সেরকম তো ওনার নজরও পড়তে পারে। সেটাই বলতেছি আমি।’

খেয়াম তাচ্ছিল্য প্রকাশে বাঁকা হাসল, ‘তার সাথে আমি যে ক’বার কথা বলছি শুধু সে ক’বার ওনাকে তাকাতে দেখছি আমার দিকে। তাও মনে হয় কী পরিমাণ বিরক্ত উনি আমার সাথে কথা বলতে! এর বাইরে কোনো সময়ও আমি ওনাকে আমার দিকে ভুলক্রমেও তাকাতে দেখি নাই। হ্যাঁ, আজকে একবার ভুলক্রমে আমার ওপর তার নজর পড়ছিল। তাও বোধ হয় সেকেন্ড দশেকের মতো। আর তাছাড়া, ওনার পার্সোনালিটি অনেক হাই বুঝলি।’

-‘কীরকম হাই?’

খেয়াম প্রশ্নটা শুনে একটুখানি ভাবল। ভাবুক মুখ করে বলল, ‘কীরকম হাই? এটা ঠিক বোঝানো যাবে না রে। অনেকটা অন্যরকম উনি। বলা যায়, এক্সট্রাঅর্ডিনারিও। বাপ ভাইয়ের মানি, পলিটিক্যাল পাওয়ার থাকার পরও নিজের যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিয়ে সেনাবাহিনীর জব করছে। এরপর সেই জব ছেড়ে যখন চলে এল তখন বাপের বিজনেস না, নিজে কিছু করার চিন্তা করল। আর আজকে নিজে কিছু করে নিজের যোগ্যতাতে এখানে এসে পৌঁছাইছে। চারপাশে ওনার সব সময় সুন্দরী সুন্দরী নায়িকা গিজগিজ করে। কখনো শুনি না কারও সাথে ওনার কোনো অ্যাফেয়ার আছে বা ছিল। একটা ছেলে পার্টনারের সঙ্গে উনি যতটা মিশুক, ততটাই মিশুক কিন্তু উনি কোনো মেয়ের সাথে না। মানে একটু হলেও একটা অদৃশ্য দূরত্ব বজায় রেখে মেয়েদের সাথে উনি হাসিঠাট্টা করেন। বোঝা যায়, একটু হলেও দূরত্ব রাখেন উনি মেয়েদের সাথে মেশার সময়। আবার যেমন এই যে তরঙ্গ, আমি ওনাকে শুধু ওর সাথে ছাড়া আর কারও সাথে কখনোও চড়া হয়ে কথা বলতে দেখি নাই এই তিনটা মাসে। আমি যে ওনাকে দু’বার অপমান করে কথা শুনাইছি, আমার সঙ্গেও এমন আচরণ করেনি। উনি আমাকে খ্বুই অপছন্দ করেন। কিন্তু তরঙ্গ বা অন্যরা যখন আমার কাজের জন্য রাগারাগি করে আমাকে কাজ থেকে বের করে দেওয়ার কথা বলে ওনাকে, তখন উনি কেমন গম্ভীর মুখ করে তাদের বলেন, ”এটা একান্তই আমার ব্যাপার” সে সময় জানিস কী মনে হয়? উনি যথেষ্ট উদারও আমার প্রতি। আমি ঠিক ওনারে নির্দিষ্টভাবে বিচার করতে পারি না। একটা মিস্টিরিয়াস মানুষ লাগে ওনারে আমার।’

খেয়ামের কথা শেষ হতে রাহি কেমন জ্ঞানীদের মতো মুখ করে বলে, ‘আসলেই মিস্টিরিয়াস উনি।’
***

-‘স্যার, ইমরান ভাই নাকি পরের কাজেও তরঙ্গকে অফার করেছে?’

মেহফুজ ফোনের স্ত্রিন থেকে নজর সরিয়ে এক ঝলক নয়নকের দিকে চেয়ে আবার স্ক্রিনে নজর ফেরাল। বলল, ‘কিছু সময় থাকে যখন একটা নতুন মুখ হিট খেয়ে যায় তখন ওই একই মুখ ওই সময়টাতে বারবার ভিন্ন ভিন্ন রোলে আনলে দর্শকদের ভালো লাগে। এক্ষেত্রে ইমরানের সিদ্ধান্তটা ভুল না।’

-‘কিন্তু ওর হামবড়া স্বভাবটার জন্যই মেজাজ খারাপ হয়। ক’দিন মিডিয়াতে এসেই নিজেকে হনু ভেবে নিয়েছে মিডিয়ার। আর এটা তো পরিষ্কার বোঝা যায়, ও অনেক জেলাস আপনার প্রতি। সহ্য করতে পারে না যেন আপনাকে। দামই দিতে চায় না বেয়াদব একটা!’

-‘এই মিডিয়াতে ওর জায়গাটা নির্মাণ হয়েছে আমার সঙ্গেই কাজ করার পর। ও সেটা ভুলে গেলেও দর্শক কখনো সেটা ভুলবে না। আমি ওকে শুধু আকাশে উড়ার সুযোগ দিচ্ছি। আর অপেক্ষায় আছি ওর মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ার।’

-‘স্যার, একটা প্রশংসা আপনার না করে পারি না আমি। আপনি কিন্ত অনেক ধৈর্যশীল আর দয়ালু।’ ঠোঁটে কিঞ্চিৎ মৃদু হাসি টেনে বলল নয়ন। মেহফুজ তেমন ভ্রুক্ষেপ করল না তার কথায়। কারণ, এর পূর্বেও নয়ন অন্তত একশবার এই প্রশংসাটি করেছে তার কাছে। আপাতত সে চিন্তায় আছে নতুন গল্প নিয়ে। গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে এবার ইদে ভিন্ন কিছু গল্প নিয়ে কাজ করতে চায় সে। তার হাতে যে স্ক্রিপ্ট রাইটারগুলো আছে তারা প্রত্যেকেই দারুণ লেখে। কিন্তু তাদের এবারের গল্পগুলো যেন তার মনমতো হচ্ছে না। সেসব চিন্তা নিয়েই বসে বসে ফেসবুকে অলস সময় কাটাচ্ছে সে। নয়ন সে মুহূর্তে বলল, ‘স্যার, এবারও কি ইদের বোনাস দেবেন বেতনের সাথে সবাইকে?’

-‘প্রতিবারই তো দিই। এবার দেবো না কেন?’

-‘না আসলে এরপরের কাজের জন্য তো আপনার বাজেট পড়ে যাবে অনেক। দেশের বাইরে থেকেও শ্যুট করে আসতে হবে। এর জন্যই জিজ্ঞেস করছি আরকি।’

-‘বোনাস প্রতি ইদেই পাবে সবাই।’

নয়ন ট্যাবটা চোখের সামনে ধরে সেটে কর্মরত স্থায়ী সহকারীদের বেতনের তালিকাটা তৈরি করছিল। এর মাঝে সে জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার, এই খেয়াম মেয়েটার বেতনের বিষয়টা আমি ঠিক বুঝলাম না। আপনি তো বললেন কোনো স্বজনপ্রীতি থাকবে না কারও বেতনের সময়। কিন্তু আপনি যে খেয়ামের বেতনটা পুরো চারগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। এবার তো সে বোনাসসহ ত্রিশহাজার প্লাস পাচ্ছে।’

মেহফুজ ফোনের স্ক্রিন স্ক্রল করার মাঝে গম্ভীরস্বরে তাকে বলল, ‘নয়ন, বাকিদের আরও ইনকাম সোর্স আছে। তাদের পরিবারে উপার্জনক্ষম আরও ব্যক্তি আছে। ওর বিষয়ে আমি কোনো স্বজনপ্রীতি দেখাইনি। সাহায্য করছি শুধু। ছোটো একটা মেয়ে, স্টুডেন্ট। পড়াশোনার ফাঁকে রাত, দিন কাজ করে এসে। পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা নেই বললেই চলে। ওর রোজগার আর ওর বাবার পেনশনের টাকা, এই নিয়ে সংসার টানছে। ওর মতো এমন অন্য কেউ হলেও সহায়তাটুকু করতাম। বুঝেছ?’

নয়ন একটু মুগ্ধতার চোখে তাকিয়ে মেহফুজের কথাগুলো শুনল। প্রসন্নচিত্তে হেসে বলল, ‘জি স্যার, বুঝেছি। আসলে আপনার মতো করে ব্যাপারটা ভেবে দেখিনি। এ জন্যই তো বলি, আপনি অনেক দয়ালু।’

.
রাত দশটার ওপাশে। নয়ন কাজ সেড়ে বিদায় নেয় মেহফুজের বাসা থেকে। রাতের খাবারটা আজ বাদ দিয়ে মেহফুজ গল্প নিয়ে নিজেই ভাবছে কিছু। এর মাঝে ইমরানের সাথে তার কথা হয় নতুন কোনো স্ক্রিপ্ট রাইটারের খোঁজে। ইমরান সময় নিয়ে খোঁজার কথা বলে ফোন রাখলেও মেহফুজ চিন্তামুক্ত হয়ে ঘুমাতে পারে না। গল্পের চরিত্রের প্রেক্ষাপট সে এবার কিছুটা তার মতো বর্ষাপ্রেমিক রাখতে চায়। কিন্তু গল্পের জন্য কোনো অনন্য প্লট সে নির্বাচন করতে পারছে না। অস্থির, নিদ্রাবিহীন রাতটার প্রায় অর্ধেক কেটে যায় তার এসব ভাবনা চিন্তার মাঝেই। ফেসবুক মাধ্যমটা তার কাছে বিরক্তির একটা দিক হলেও আজ সে নিউজ ফিড স্ক্রল করে যাচ্ছে অবিচলিতভাবে। সপ্তাহে একবার কি দু’বার সে সোশ্যাল সাইটের পর্দা তুলে। আজ সেখানে প্রবেশের পর নোটিফিকেশন বক্সে কমেন্টস, লাইক, ফলোয়ারস, ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট, এসব দেখতে দেখতে মহাবিরক্ত হলেও এই বিরক্তের মাঝে চলছে তার বহু ভাবনা। মিনিট দুই যেতেই আচমকা ভাবনার জাল কাটে তার, একটি প্রোফাইল পিকচারে নজর পড়ে। কুয়াশা জড়ানো সবুজ অরণ্যের মধ্যখানে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির আবির্ভাব। সবুজ ঘাসগুলোর ডগায় অচেনা সাদা জংলি ফুল। ভীষণ অদ্ভুত সুন্দর লাগল যেন ছবিটা তার। সাধারণত মেহফুজ কখনোই ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট চেক করে না। অজানা কৌতূহল নিয়ে আর নতুন কোনো চিন্তা আবিষ্কারের আশায় সেই ছবির মালিকের প্রোফাইলে ঢুকে সে। প্রোফাইলের মালিকের নামটা দেখে ফেক অ্যাকাউন্ট ছাড়া আর কিছুই মনে হলো না তার। ব্যক্তিটির প্রোফাইল নেম ষষ্ঠ তারা। কিন্তু তার ওয়ালভর্তি বর্ষা প্রকৃতি আর মেঘলা আকাশের ছবি। এই প্রোফাইল দেখে যে কেউ-ই নির্দ্বিধায় বুঝে যাবে, অ্যাকাউন্টটা ফেক হলেও অ্যাকাউন্টের মালিক নিশ্চয়ই বর্ষাপ্রেমিক, ঠিক তারই মতো। এই সাদৃশ্যের জন্যই মেহফুজ সেই ব্যক্তির টাইমলাইন স্ক্রল করে দেখতে থাকে। ব্যক্তিটি আবার কবিতা, গল্পও লেখে। ব্যাপারটা দারুণ লাগল তার। আগ্রহ জন্মাল ব্যক্তিটির প্রতিটা পোস্টে চোখ বুলানোর। লেখার হাত ব্যক্তিটির কাঁচা হলেও মেহফুজের বিরক্তিভাব যেন কোথায় উবে গেল গল্প আর কবিতাগুলো পড়তে পড়তে। ব্যক্তিটির গল্প কবিতাতে দুএকটা লাইক, কমেন্ট ছাড়া তেমন কোনো রেসপন্স নেই। তাতে মেহফুজ বুঝল, ব্যক্তিটি কেবল নিজের ভালো লাগার জন্যই লেখে। প্রতিটি কবিতা তার চার থেকে পাঁচ লাইনের। আর তা শুধু বৃষ্টি নিয়েই লেখা। অ্যাকাউন্টটা নতুন হলেও তাতে গল্প আর কবিতার সংখ্যা অনেক। কিছু কবিতা ডায়েরি পাতায় লেখা। সেই পাতার ছবিগুলো আপলোড করে রেখেছে। কতগুলো ছোটো ছোটো গল্পও পেল ওয়ালে। এবার নিমেষের মধ্যে সবটুকু বিরক্ত উধাও হয়ে গেল মেহফুজের, ওই কাঁচা হাতের লেখা গল্পগুলো পড়তে পড়তে।

ভোর চারটার কাছাকাছি সময়। এই প্রথম মেহফুজ টানা এতগুলো ঘণ্টা ফেসবুকে পার করল। সবগুলো লেখায় সে একটানা পড়ে গেছে। অচেনা ব্যক্তিটির ওয়াল থেকে বের হওয়ার সময় সে আরও একবার তার নামটা দেখল, তবে তার রিকুয়েস্ট কনফার্ম করল না সে। তবে চিন্তামুক্ত তার চেহারার অভিব্যক্তি। যেন যা সে খুঁজছিল তা সে হাতের নাগালে পেয়ে গেছে।

চলবে।

এমনই শ্রাবণ ছিল সেদিন পর্ব-০৬

0

#এমনই_শ্রাবণ_ছিল_সেদিন
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি

৬.
শরতের স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না রাত্রির সৌন্দর্য হৃদয়কে ছুঁয়ে যায় না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। দখিনের সমীরণ খুলে নির্মল স্নিগ্ধ কোমল চাঁদের আলো সবার কণ্ঠকেই সুরময় করে তুলে। নয়ন ড্রাইভিং স্টিয়ারিং ধরে কান পেতে শুনছে মেহফুজের গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠা সুর। তার স্যার মানুষটা বর্ষাপ্রেমিকই নয় শুধু, খাস প্রকৃতিপ্রেমীই বলা চলে। শ্যুটিং সেট থেকে বের হওয়ার পর থেকেই একটা চাপা আনন্দ তার চেহারাতে বিরাজ করছে। আর এখন সিটে মাথা এলে বসে রাতের আকাশের জ্যোৎস্না আলোকিত চাঁদটাকে দেখতে দেখতে ব্রায়ান অ্যাডমসের গানটি গুনগুন করে গাইছে সে,

‘Please forgive me, I know not what I do
Please forgive me, I can’t stop loving you
Don’t denz me, this pain I’m going through’

হঠাৎ করে তার এমন রোমাঞ্চকর অনুভূতির গানটা শুনতে শুনতে নয়ন প্রথম দিকে স্তম্ভিত হলেও এখন সে মুগ্ধ হয়ে শুধুই শুনছে। প্রথমবার তার স্তম্ভিত হওয়ার কারণ, এই প্রথম সে তার স্যারকে এক নতুন অভিব্যক্তিতে আবিষ্কার করল। এই মানুষটাকে তার বড্ড ভালোই লাগে। যদিও তার সাথে কেবল কাজের কথাবার্তা আর আলোচনা ছাড়া ব্যক্তিগত বিষয়ে খুব কম কথায় হয়। তবুও মানুষটার ভেতরের কোমল মনটার জন্যই সে এই মানুষটার সঙ্গ ছাড়তে চায় না। নয়ন একবার ফ্রন্ট মিররে তাকিয়ে দেখল মুখে ঈষৎ হাসি হাসি ভাব তার স্যারের। আজ এত খুশি কেন সে? মহা কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করেই বসল, ‘কোনো ভালো একটা দিন বুঝি কাটিয়েছেন স্যার?’

মেহফুজ গানটা থামিয়ে হাসিটা মুখে লেপ্টে রেখেই বলল, ‘পুরো দিনটা ভালো না হলেও ভালো কিছু মুহূর্ত ছিল।’

নয়ন বাড়তি আর কোনো প্রশ্ন করল না। তবে সে আন্দাজ করতে পারল হয়তো তার স্যারের আজকের ভালো মুহূর্তগুলো।
***

-‘মন খারাপ?’
প্রশ্নটায় খেয়াম ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। রাহি দাঁড়িয়েছে তার কাঁধ স্পর্শ করে। কোনো উত্তর এল না খেয়ামের থেকে। দৃষ্টিজোড়া আবার তার উদাসীন হয়ে পড়ল রাতের জ্যোৎস্নালোকিত আকাশ পানে। রাহি জিজ্ঞেস করল, ‘ফিরছিস কখন?’

খেয়ামের থেকে উত্তর এল, ‘সন্ধ্যার পর।’
বলেই পা দুটো চেয়ারে উঠিয়ে হাঁটুতে থুঁতনি ঠেকিয়ে বসল।

-‘কী হইছে রে? রুমে আসার পর শুনলাম তুই নাকি ফিরেই এখানে বসে আছিস। কোনো সমস্যা?’

-‘বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ করছি, আমি যেদিনই রাত করে বা সন্ধ্যা করে ফিরি কেউ একজন আমার পিছু আসে। কয়েকবার মনে হলো আমি গাড়িতে উঠলেও আমার গাড়ির পিছু পিছু এক বাইকার আসে। আমি সেই বাইকারকে বেশ কয়েকবার দেখছি।’

-‘কী বলিস? কতদিন যাবৎ এমন হইতেছে?’

-‘চার পাঁচদিন মনে হয়।’

-‘কখনো তোর কাছে আসেনি? বা এসে তোর সামনে দাঁড়ায়নি?’

-‘না। আর এই ব্যাপারটা হয় শুধু রাতেই যখন ফিরি।’

-‘ভাবনার বিষয় খুব। তোর যদি খুব সমস্যা মনে হয় তাহলে আর কাজে যাস না।’

-‘আল্লাহ ভরসা। আমার কাছে যা থাকে, সে যদি সত্যিই আমার ক্ষতিকারক হয় তবে তাকে দমানো যাবে তা দিয়ে।’

-‘হুঁ, তুই এই কাজটা খ্বু ভালো করিস রে।’

-‘সবারই করা উচিত সাথে সেফটি নিয়ে চলা।’

-‘তুই কি এই কারণে মন খারাপ করে আছিস?’

খেয়াম উত্তর দিলো না এ প্রশ্নের। হাতে বইটা ধরে নাড়াচাড়া শুরু করল উদাসীন মনেই। সেদিন তরঙ্গকে অপমান করার পর তরঙ্গ শ্যুটিং সেটে চিৎকার চেঁচামেচি করে অস্থির করে ফেলেছিল। বারবার সবাইকে বলছিল তাকে কাজ থেকে বের করে দিতে। নয়তো সে নিজেই তাকে বের করে দেবে। তার এসব ঝামেলার মাঝে মেহফুজ এসে বেশ কিছু কথায় শুনিয়ে দেয় খেয়ামকে। এরপর অবশ্য তরঙ্গকে সে বলে খেয়ামকে সে কাজ থেকে বের করবে না। তরঙ্গ অগ্নিমূর্তি হয়ে তার কারণ জিজ্ঞেস করলে মেহফুজ উত্তর দেয়, ‘একান্তই আমার ব্যাপার এটা। যেহেতু সে আমার কথাই কাজে এসেছে।’
এ কথায় তরঙ্গ মেহফুজের সাথে আর কোনো তর্ক না করলেও খেয়ামকে খুব চড়া চড়া ভাষায় অপমান করেছিল। এরপর যতদিন শিডিউল ছিল তরঙ্গের, ততদিন তার খুব খারাপ আচরণের সাথে কাজ করতে হয়েছে খেয়ামের। তবে আজ সব থেকে বেশি খারাপ ছিল তরঙ্গের আচরণ। যাকে বলে মাত্রাতিরিক্ত। আপাতত এই বিষয়েই খেয়ামের মনটা খারাপ। রাহির সঙ্গে আর তেমন কোনো কথা বলল না সে। কিছুক্ষণ আগে তাকে ইব্রাহীমও বেশ ক’বার ফোন করেছিল। সে রিসিভ করেনি। হঠাৎ খেয়াল হলো তার, যে-কোনো খারাপ সময়েই মায়ের সাথে কথা বলে মনটা হালকা হয়ে যায় তার। মাকে কল করার জন্য ফোনটা হাতে নিতেই দেখল তাকে নয়ন দুবার কল করেছিল কখন যেন। সাধারণত খুব দরকার ছাড়া নয়নের থেকে তার কাছে তেমন একটা কল আসেনি কখনো। তাই অতি দ্রুতই সে কলব্যাক করলে নয়ন রিসিভ করে ওপাশ থেকে বলল, ‘সময় মতো ফোন রিসিভ করো না। আবার আমার কাজের সময় ফোন দিয়েছ কেন?’

-‘স্যরি ভাইয়া। আপনি এখন কাজে তা তো আর আমি জানি না।’

-‘যা বলার মেসেজেই তো বলে দিয়েছি।’

-‘ও, আমি তো খেয়াল করিনি। আচ্ছা আমি দেখছি।’

কথাটি শুনেই নয়ন ফোন রেখে দেয়। খেয়াম তার মেসেজটা দেখল। সে লিখেছে, ‘এমন বহু তামাশার শিকার সামনেও হতে হবে। তাই প্রথমদিনের মতোই প্রতিদিন সবটাকে হ্যান্ডেল করার জন্য মাইন্ডসেট রেখো। যেটা মনে রাখার সেটা মনে রেখো, আর যেটা ভুলে যাওয়ার সেটা ভুলে যেয়ো।’

নয়নের এমন ধারার কথাগুলো দেখে খেয়াম একটু নয়, অনেকখানিই বিস্মিত হলো। নয়ন তার এতটা সহায়ক, তা যেন তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, বিশ্বাস হচ্ছে না এই কথাগুলো নয়নের হতে পারে। এভাবে তো নয়ন কখনো তার সঙ্গে সরাসরিও কথা বলে না। তবে মনটা তার যে কারণে খারাপ ছিল এই মেসেজটা দেখার পর সেই কারণটা সে একেবারেই ভুলে গেল।
***

শ্যুটিং স্পটে আসার পর খেয়াম জানতে পারল মেহফুজের প্রচণ্ড জ্বর। তবুও সে সেটে এসেছে। কারণ, তরঙ্গ এমন একটি চরিত্রের মানুষ যার উগ্র মেজাজ আর বেয়াড়াপনার জন্য তাকে সামাল দিতে মেহফুজকেই উপস্থিত থাকতে হয়। দুজনের মাঝে সাপে নেউলের সম্পর্ক হলেও তরঙ্গ মেহফুজের কথার কাছেই পরাজিত হয়। আজকে অবশ্য আসার পর থেকে কোনো ঝামেলা করেনি তরঙ্গ। মেকআপ নেওয়ার পর শান্তভাবে বসে আছে হাতে গিটারটা নিয়ে। শট দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। মেহফুজ সব প্রস্তুতি নিয়ে বসতেই তরঙ্গ রেডি হলো শট দিতে। সবাই খেয়াল করল তরঙ্গের পায়ের দিকে। একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে সে। মেহফুজ লক্ষ করে জিজ্ঞেস করল তাকে, ‘পায়ে কী হলো তোমার?’

তরঙ্গ প্রশ্নটা শুনল। কিন্তু জবাব দিলো না। একই প্রশ্ন পুনরায় আমিন জিজ্ঞেস করলে সে তখন দায়সারাভাবে বলল, ‘আসার পথে হাঁটার সময় কীভাবে যেন পা মোচড় খেল। হালকা ব্যথা।’

*‘হালকা ব্যথা হলে তো খুঁড়িয়ে হাঁটতে না। আর আসার পর কিছু বললেও না তো আমাদের।’ মেহফুজ বলল।

-‘এত বলার কী আছে? আমাকে তো আর শটের মধ্যে দৌড়াতে হবে না। হাঁটার সময় না খোঁড়ালেই হলো।’

তরঙ্গের এমন আচরণের কারণেই মেহফুজ বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কখনো কথা বলে না তার সঙ্গে। তরঙ্গের জবাবে সে কোনো কথা না বলে কাউকে ইশারা করল বরফের ব্যবস্থা করতে। শট সে কিছুক্ষণ পরে নেবে। এ বিষয়েও তরঙ্গ বেশি কথা বলা আরম্ভ করল। তাকে আমিন জোর করেই চেয়ারে বসিয়ে দিলো একটু রেস্ট নেওয়ার জন্য। আর মেহফুজ ক্যামেরার সামনে বসল। মাথা যন্ত্রণায় চোখ বুজে নিজেই নিজের কপাল টিপতে থাকল। আজকের শিডিউলটা অবশ্য ক্যান্সেল করারও উপায় ছিল না। কারণ, তরঙ্গ আজ ছাড়া সময় দিতে পারত আরও তিনদিন পর। এতে মেহফুজের কাজ শেষ হতে বেশ দেরি হয়ে যেত।

আমিনের সঙ্গে কথার মাঝে তরঙ্গ একটু আঁতকে উঠল পায়ে ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ পেয়ে। বিরক্ত নিয়ে তাকিয়ে দেখল খেয়াম মচকে যাওয়া জায়গাটুকুতে ছোটো পলিথিনের মতো ব্যাগে বরফ ভরে চেপে ধরেছে। তা দেখেই সে খ্যাক দিয়ে উঠল খেয়ামের ওপর। তার চিৎকারের শব্দ শুনে মেহফুজ চোখ দুটো খুলে তাকাল সেদিকে। তরঙ্গের পায়ে হাত দিয়ে বসে আছে খেয়াম। তরঙ্গ চিৎকার করে বলল, ‘ফালতু মেয়ে একটা! এই তোমারে কে বলছে আমার পায়ে সেঁক দিতে?’

আমিন তাকে শান্ত করার চেষ্টা করল, ‘আমি বলছি ওকে। তোমার দরকার তো। তুমি নিজে তো এটা করতে না। তাই বাধ্য হয়ে ওকেই তোমার পায়ে হাত দিতে হলো।’

তরঙ্গ আমিনের কথায় কোনো পাত্তা দিলো না। খেয়াম বরফটুকু নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। শ্যুটিং স্পটে আসার পর থেকেই খেয়াম লক্ষ করেছে তরঙ্গের দৃষ্টি। সে যেন তরঙ্গের চক্ষুশূল।

খেয়ামকে দেখলেই তরঙ্গের ইচ্ছা হয় তাকে টেনে ধরে তার গালে একনাগাড়ে কতগুলো থাপ্পড় বসাতে। আর সেই মেয়ে এখন আবার পায়ে বরফের সেঁক দিচ্ছে! তার এত বড়ো স্পর্ধা তরঙ্গ সহ্য করতে পারছে না। সে চেঁচিয়ে আবার বলল, ‘ওই মাতারি! আমার সামনে থেকে যা, সর।’

তরঙ্গের এমন আচরণে আর কেউ বিরক্ত না হলেও মেহফুজ আর ইব্রাহীমের অত্যন্ত মেজাজ খারাপ হচ্ছে। শুধু কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে কেউ তাকে কিছু বলতেও পারছে না। তবে তাদের অবাক করে দিয়ে খেয়ামই তরঙ্গকে অতি শান্তস্বরে বলল, ‘মনের রাগের থেকে শরীরের যন্ত্রণাকে একটু প্রাধান্য দিন স্যার। আমার মনে হয় একটু পর আপনার পায়ের যন্ত্রণা আরও বাড়বে। তখন কষ্টটা আপনারই হবে।’

তরঙ্গের কুঞ্চিত ভ্রু আর ক্রুদ্ধ দৃষ্টিজোড়া হঠাৎ স্বাভাবিক হয়ে গেল খেয়ামের কথায়। রাগটাও গলে যেন পানি হয়ে গেল। হঠাৎ তার কী হলো কে জানে! খেয়ামকে আর রাগ দেখাতে ইচ্ছা হলো না। হয়তো কিছুটা উপলব্ধি করতে পারল, প্রতিদিন সে মেয়েটাকে যা নয় তাই বলে অনেক বাজে কথা শোনায়। তাতে মেয়েটা এক ফোঁটা কাঁদেও না। মেহফুজ তাকে প্রথমদিন ধমকানোর পর তারপর থেকে মাথাটা একদমই নত করে রাখে তার সামনে। তার উচ্চবাচ্যের পরও সে নজর তুলে তাকায় না। আজ আবার এত কিছু বলার পরও তার সামনেই মেয়েটা কত সাবলীলভাবে দাঁড়িয়ে তাকে সেবা দিতে চাইছে, তার পায়ের ব্যথা নিয়ে চিন্তা করছে। এ কদিনে তরঙ্গ দুটো ব্যাপার খেয়াল করেছে খেয়ামের ব্যক্তিত্বের। সবার কথায় মেয়েটা রাগ করে না, কষ্ট পায় না। শুধু মেহফুজের কথাতেই সে নীরব থেকে যায়। আর মেয়েটার মাঝে ভয় বলে ব্যাপারটা খুবই কম যেন। কারণ, তার আচরণ আর তার রাগের কাছে সেটের প্রায় বেশিরভাগ মানুষই তার সামনে দাঁড়ায় কাচুমাচু মুখ করে। অথচ, এই মেয়েটা তাকে এক বিন্দু পরিমাণ ভয় পায় না এত বকা শোনার পরও।

আজ খেয়ামের মুখটা খোলা, কাটা দিয়ে একটা খোঁপা করা তার, ওড়নাটায় মাথার অনেকখানি ঢেকে রাখা। গরম পড়ার পর থেকে মাঝেমাঝেই বোরখা ছাড়া কাজে আসে সে। চোখে, মুখে কখনোই তার প্রসাধনী দেখা যায় না। তরঙ্গ সেই প্রসাধনবিহীন মুখটার দিকেই কাঠিন্য চেহারা করে চেয়ে ছিল। খেয়াম তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি কি সেঁক দেবো স্যার? না আপনি নিজে নেবেন?’

প্রশ্নটা শুনে তরঙ্গ তখন দৃষ্টি ফেরাল তার থেকে। নীরব রইল সে। তাতে খেয়াম তার সম্মতি বুঝে নিলো। তার পায়ে সেঁক দিতে উদ্যত হতেই হঠাৎ পেছন থেকে তার ডাক পড়ল, ‘খেয়াম, স্যার তোমারে ডাকে।’

সৈকত এসে বলল তাকে। খেয়াম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতে সে আবার বলল, ‘মেহফুজ স্যার ডাকে। আর বরফ আমার কাছে দাও, আমি দিচ্ছি তরঙ্গ স্যারকে।’

খেয়াম চলে এল সেখান থেকে। মেহফুজ কখনোই তার নিজস্ব কাজে খেয়ামকে ডাকে না। এমনকি কোনো কাজেই মেহফুজ সরাসরি তাকে ডেকে আদেশ করে না। কাজের এই দুটো মাসে এই প্রথম সে ডাকল খেয়ামকে। কিন্তু তার সামনে যাওয়ার পর যেটা হলো তাতে খেয়াম বেশ বিরক্তই তার প্রতি। মেহফুজ ডাকলেও তার হয়ে কথা বলল নয়ন। খেয়াম তার এ আচরণে ভাবে, শুধু তার প্রতিটা ব্যাপারেই কি মেহফুজ নয়নকে ব্যবহার করে? না সবার ব্যাপারেই? এই প্রশ্নের উত্তরটা খেয়ামের বড্ড জানতে ইচ্ছা হয়। তার কারণ, সে দেখে মেহফুজ সেটের প্রায় সবার সাথেই দরকারে অদরকারে কথা বলে, হাসি ঠাট্টা-তামাশাও করে। শুধু তার সঙ্গে ব্যতিত।

আজকে রাত ১০ টার মধ্যে ২০০+ মন্তব্যের টার্গেট পূরণ হলে আরেকটি পর্ব দেব। ইদ করতে দেশের বাড়ি এসেছি বিধায় নেটওয়ার্ক খুবই বাজে আর আমিও ব্যস্ত।
***

চলবে।

এমনই শ্রাবণ ছিল সেদিন পর্ব-০৫

0

#এমনই_শ্রাবণ_ছিল_সেদিন
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি

৫.
-‘কী করে আসলি তুই খেয়াম?’

-‘‘নিজের মাথা নিজে ফাটাইছি বাঁশ দিয়ে।’ দুঃখভারাক্রান্ত চেহারায় বলল খেয়াম রাহিকে।

-‘এখন আর এই নিয়া ভেবে লাভ নাই। এই সমস্যার সমাধান কী করবি সেইটা ভাব।’

-‘উহঃ! এই টেনশনেই তো ঘুম উড়ে যাচ্ছে।’

রাহি চিন্তিত ভঙ্গিতে খেয়ামের কোলের ওপর হাতটা রাখল। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বলল সে, ‘উনি তোদের প‚র্ব পরিচিত, তাই না?’

খেয়াম বিরস মুখ করে হ্যাঁ জানাল।

-‘যেহেতু পরিচিত তাহলে তুই তো সরাসরিই গিয়ে কথা বলে আসতে পারিস। স্যরিটরি বলে সব ঠিকঠাক করে নিলি। একটু রিকুয়েস্ট করে বলবি।’

-‘এখন তার বাসা অবধি যেতে হবে?’

-‘বাসায় ঢুকতে পারবি না এমন তো কোনো সমস্যা নেই। তাহলে কাজ বাঁচাতে যেতে ক্ষতি কী?’

রাহির কথাগুলো মন্দ লাগল না খেয়ামের। সেও ভাবছিল এমনটাই। অন্তত মেহফুজের মায়ের সাথে কথা বললেও এ যাত্রায় কাজটা বেঁচে যেতে পারে তার। ওই মানুষটাও ভারি কোমল মনের। মেহফুজের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার মতো সাহস তার নেই। যা অনুরোধ করার, তা তার মায়ের কাছেই করতে হবে।

পরদিন বিকালে খেয়াম আর রাহি হোস্টেল থেকে বেরিয়ে চলে এল মেহফুজের বাসায়। ঢোকার সময় একটু ঝামেলা হয়েছিল। গেটের দারোয়ান ভেতর থেকে অনুমতি নিয়ে আসার পরই তারা ঢুকতে পেরেছে। আলিশান ড্রয়িং রুমটাতে বসার পর থেকে রাহির নজর এক মুহূর্তের জন্যও স্থির নেই। আশপাশটাতে নজর বুলিয়েই যাচ্ছে সে। প্রথমদিন খেয়াম আসার পরও এমনটা হয়েছিল তার সঙ্গে। কিন্ত সে মুহূর্তেই নিজের দৃষ্টিকে সংযত করে নিয়েছিল। অত্যাধিক প্রশংসনীয় কোনো বস্তুর ওপর সে আকৃষ্ট হলেও নিজেকে সামলে নেয় অতি দ্রæতই। কারণ, তা যদি তার যোগ্যতা আর সামর্থ্যের বাহিরে থাকে তবে সেই বস্তুর প্রতি আর দ্বিতীয়বার নজর তুলে তাকায় না। ছোটো থেকেই এই অভ্যাসটি তার মাঝে গড়ে উঠেছে। লোভ করা ব্যাপারটা তার মাঝে হয়তোবা কিঞ্চিৎ অংশে থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু তা কেবল অতি তুচ্ছ বিষয়ে।

তারা অপেক্ষা করছিল নীহারের জন্য। আসার পর শুনেছে মেহফুজ বাসাতে নেই। তা জেনে খেয়াম ভেতরে ভেতরে অজস্র শান্তি অনুভব করল যেন। কিন্তু অপেক্ষার প্রহরটা একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে। নীহার কি আসবেন তার সঙ্গে দেখা করতে, না কি আসবেন না? কিছুই বুঝতে পারছে না সে। কারণ, অপেক্ষার সময়টা আধা ঘণ্টা অতিক্রম করে গেছে। এদিকে বাহিরে শ্রাবণধারা অবিরামভাবে নামতে শুরু করেছে। খেয়াম অধৈর্য মনে নিচে তাকিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুণছিল। রাহির তখন দৃষ্টি পড়ল, বসার ঘরের মূল ফটকে একজনের প্রবেশ ঘটেছে। তার ঠিক পিছু পিছুই আরও একজন ঢুকল। রাহির দিকে প্রথম ব্যক্তিটির দৃষ্টি স্থাপন হলেও তার পর মুহূর্তেই সেই ব্যক্তিটির দৃষ্টি আটকাল খেয়ামের দিকে। খেয়ামকে দেখেই ভ্রæ, কপাল কুঁচকে গেল তার।
আশ্চর্যান্বিত হলো খেয়াম। কয়েক সেকেন্ড যাবৎ মেহফুজ তার দিকে কুঞ্চিত চেহারা নিয়ে তাকিয়ে থেকে তারপর উপরে চলে গেল। রাহি জিজ্ঞেস করল, ‘লোকটা কে রে?’

-‘উনিই মেহফুজ।’

-‘পুরোই অস্থির কিন্তু।’ মেহফুজের প্রতি আগ্রহযুক্ত কণ্ঠ রাহির। খেয়াম তার কথার ইঙ্গিত সহজে ধরতে পারল না মহা দুশ্চিন্তায়। বলল, ‘অস্থির কোথায় দেখলি? স্থিরই তো দেখলাম।’

-‘আরে ধুর! অনেক জোশ দেখতে উনি। সেটা বলতেছি।’ কথাটা শুনে খেয়াম বিরক্তভরা দৃষ্টিতে তাকাল রাহির দিকে।

সিঁড়ি বেঁয়ে নামতে দেখা গেল নয়নকে। খেয়াম নিশ্চিত, লোকটা তাকে ভালো-মন্দ কথা শুনাতেই আসছে। খেয়াম আর রাহি তাকে দেখে উঠে দাঁড়াতেই নয়ন এগিয়ে এসে বলল, ‘স্যারের সাথে দেখা করতে এসেছ?’

খেয়াম সহজভাবেই উত্তর দিলো, ‘স্যার ব্যস্ত থাকলে আন্টি এলেও চলবে।’

-‘আন্টি বলতে কি ম্যাম?’

-‘জি।’

-‘একটু ব্যস্ত আছেন উনি ওপরে। স্যারও ব্যস্ত। আমাকেই বলো, কী প্রয়োজন?’

-‘আমি আসলে আমার সেদিনের ব্যবহারের জন্য খুবই লজ্জিত। ওইভাবে কথাগুলো বলা আমার একদমই উচিত হয়নি। আমি খুব দুঃখিতও। ক্ষমা চাইতে এসেছি ওনার কাছে।’

-‘তোমার কপাল আছে, জানো? শুধু স্যারের বাবা মায়ের পরিচিত বলে কোনো কিছু ফেস করতে হয়নি তোমাকে। স্যার ঠিকই ধরেছে, যে তুমি স্যরি বলতেই এসেছ। আর এভাবে হুটহাট বাসায় চলে আসাটা উনি একেবারেই পছন্দ করেন না। যদি না ওনার সাথে কোনো দরকারে এসে ব্যক্তিগতভাবে ওনার মায়ের সাথে কোনো দরকারে আসো, তাহলে সমস্যা নেই। কিন্তু ওনার সাথে এভাবে হুটহাট দেখা করতে চলে আসবে না। স্যার বলেছে কাজে আসতে। সমস্যা নেই।’

খেয়াম দৃষ্টি নত করে সম্মতি জানিয়ে চলে এল বাসা থেকে। এত বড়ো মানুষগুলোর সাথে বাড়ি বয়ে এসে কথা বলা খেয়ামের কাছে একটু আগে পর্যন্ত স্বাভাবিক লাগলেও কিন্তু ওই বড়ো মানুষগুলো যে তার মতো করে স্বাভাবিক নজরে তা দেখে না, এতক্ষণে তা বোধ করতে পারল সে। এরপর থেকে তাকে যথেষ্ট বিচার-বুদ্ধি দিয়ে চলতে ফিরতে হবে সব সময়। কোনো কাজ করার পূর্বে অন্তত দুবার ভেবে তারপর সেই কাজে অগ্রসর হবে সে। বড্ড খামখেয়ালিপনা করে ফেলেছে এ ক’দিনে।

.
খেয়ামের কর্মজীবনের দেড় মাস হতে চলেছে। একটা মাসে সে নানা বিষয়ে, নানাভাবে বারবার হোঁচট খেয়েছে, তারপর নতুন করে আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। হোঁচট না খেলে কখনও যে উঠে দাঁড়ানো শেখা যায় না। এই কর্মজীবনে এসে সে বাহিরের মানুষের সম্পর্কে, বাস্তবতা সম্পর্কে প্রায় সত্তর ভাগ জ্ঞান অর্জন করেছে। ধৈর্যশক্তি তৈরি হয়েছে তার মাঝে অসীম। সেদিনের পর শ্যুটিঙের জায়গাতে তার কাজের ভুল-ত্রুটি কেউ চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে পারেনি। প্রতিটা কাজেই সে পরিশ্রমী আর কর্মঠ। তারই প্রমাণ দিয়েছে বারবার। শ্যুটিং সেটের প্রায় প্রতিটা মানুষের সাথে তার দারুণ একটা সম্পর্কও তৈরি হয়ে গেছে। তার কাজের প্রশংসায় একবার তারিন তাকে প্রস্তাব দিয়েছিল তার পার্সোনাল অ্যাসিসটেন্ট হওয়ার জন্য। কিন্তু কেন যেন সেটা তার ব্যক্তি স্বাধীনতার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াতে বলে মনে হলো। তাই সে খুব বিনয়ের সাথে নিজের সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়ে দেয় তারিনকে। তারিনের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ায় তারিন কিন্তু একটুও রাগ বা অপমান বোধ করেনি। বরঞ্চ খেয়ামকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। এর কারণ, খেয়ামের অতি চমৎকার ব্যবহার আর তার মিষ্টি হাসি। খেয়ামের হাসিতে প্রায় সবাই মুগ্ধতা প্রকাশ করে। তার আচরণ আর বুদ্ধির প্রশংসায় প্রতিটা মানুষ তাকে বিভিন্ন কাজে সহায়তা করে, কাজে ছাড়ও দেয় তাকে। এখানে আসার পর এই দেড় মাসে তার মতো বিভিন্ন পুরুষ কর্মীদের থেকে সে প্রেমের প্রস্তাবও পেয়েছে। তা সে এমন কৌশলে এড়িয়ে গেছে, যাতে ওই মানুষগুলো তার থেকে প্রত্যাখ্যান হয়ে তার প্রতি ক্ষিপ্ত না হয়। এমনকি কিছু মানুষের অশ্লীল প্রস্তাবের শিকারও হয়েছে সে। লজ্জা আর ঘৃণায় বারবার কাজ ছেড়ে চলে আসার সিদ্ধান্তও নিয়েছিল। কিন্তু পরক্ষণেই তাদের আচরণের পরিবর্তন দেখেছে সে। এতে সে কিছু কিছু সময় বিস্মিত হলেও পরবর্তীতে তার কারণও উদ্ঘাটন করেছে। তাকে সেখানের প্রতিটা মানুষ এতটাই স্নেহ করে যে তার হয়ে প্রতিবাদ সেই মানুষগুলোই জানায়। এসব দেখে খেয়াম মনকে আরও শক্ত করে। সে ভাবে, পৃথিবীতে সেই মানুষগুলোই টিকে থাকতে পারে স্ব-সম্মানে, যারা ভেতর থেকে মজবুত।
***

১৭ই অক্টোবর।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফল প্রকাশিত হলো। সেই মুহূর্তে খেয়াম শ্যুটিং সেটে। রাত বাজে দশটা। খেয়ামের ফলাফল প্রকাশিত হবে, তা সেটের প্রায় সকলেই অবগত ছিল। সন্ধ্যা থেকে রাত দশটা অবধি খেয়াম চিন্তাতে শুধু ঘেমেছে। ঘামতে ঘামতে তার শরীরের পরিচ্ছদের অবস্থা খুবই করুণ। রাত দশটার পরই তার ফলাফল পেয়েছে সে। ভাগ্য আর পরিশ্রম উভয় মিলিয়ে সে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স করার সুযোগ পেয়েছে। এদিকে জগন্নাথে সুযোগ হওয়ার জন্য প্রত্যেকেই তার কাছে মিষ্টি খাওয়ার আবদার ধরেছে। ইব্রাহীম সেই শুরু থেকেই খেয়ামকে পছন্দ করত আর প্রস্তাবও দিয়েছিল প্রেমের। কিন্তু সে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরও খেয়ামের প্রতি তার আগ্রহ কমেনি। সে হঠাৎ খেয়ামকে বলল, ‘কোনো জিনিসই বাসি ভাল্লাগে না। তাই নগদ নগদ মিষ্টি খাওয়াবা আমাগো।’ তা শুনে খেয়াম পড়ে গেল বিপাকে। তার কাছে যা অর্থ ছিল তাতে ভালো মিষ্টি এত মানুষের জন্য কেনা মুশকিল। আর রাত করে ফিরতে হয় বলে সে টাকা বেশি লাগলেও মাঝে মাঝে উবারের সাহায্য নিয়ে হোস্টেল ফেরে। টাকাটা তার ভাড়াতেই লেগে যাবে। মিষ্টি খাওয়ানোর ইচ্ছা তার প্রবল। তবে সেই ইচ্ছা পরেরদিন প‚রণ করতে চেয়েছিল সে। কিন্তু সবার আবদারে মুখের ওপর সে বলতেও পারবে না, ‘আজ না কাল খাওয়াব।’ শ্যুটিং শেষ হতে এখনও প্রায় অনেকক্ষণই বাকি। তাই আপাতত সবাই কাজেই অগ্রসর হলো। কিন্তু তার চিন্তা কমল না।

শ্যুটিং শেষ হওয়ার পর হঠাৎ করেই ইব্রাহীম মিষ্টি নিয়ে হাজির হলো। মিষ্টিমুখ করতে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেও খেয়াম ভাবতে থাকে, ‘মিষ্টি কেনার খরচটা কি ইব্রাহীম বহন করল?’ এমন কিছু হলে সে কালই টাকা পরিশোধ করে দেবে ভাবল। সেই সাথে তার আরও একটা ভাবনা শুরু হয়ে গেল। ভাবনাটা হতেই সে মেহফুজের সঙ্গে কথা বলার বেশ তাগিদ অনুভব করছে। সেদিনের পর তার মেহফুজের সঙ্গে এক বাক্যও বিনিময় হয়নি। একই সাথে সারাদিন থাকার পরও খেয়ামের যেন মনে হয় মেহফুজের উপস্থিতি সে টেরই পায় না। কারণ, মেহফুজের দিকে আগে সে যতটুকু মনের ভুলে তাকিয়ে থাকত। কিন্তু সেদিনের পর থেকে এই ভুলটাও হয় না তার।

শ্যুটিং শেষে খেয়াম সেট থেকে বেরিয়ে মেহফুজকে খুঁজে পেল তার গাড়ির কাছে। কার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলছে মেহফুজ সেই মুহূর্তে। মেহফুজের সাথে খেয়ামের কথাবার্তা না হলেও মেহফুজের সামনে যেতে কেমন যেন খুব অস্বস্তি ঘিরে ধরে তাকে। ঠিক সহজ হয়ে কথা বলতে পারে না সে। কেন এমন হয় তা সে বুঝতে পারে না। তাই মেহফুজকে আসলে কী সম্বোধন করে ডাকা উচিত তা নিয়েও সে বিভ্রান্তে পড়ে যায়। স্যার সম্বোধনটা কোনোভাবেই তার মুখ থেকে বের হতে চায় না, এদিকে ভাইয়া ডাকতেও তার মহাবিরক্ত লাগে। নিজের এই ব্যাপারটাতে সে নিজেই হতাশ তার প্রতি।

মুনের সঙ্গে কথা চলছিল মেহফুজের। কথা বলে জানতে পারল মুন আগামী পরশু প্লেনে উঠছে। তখন মেহফুজের থেকে কিছুটা দূরে এসেই দাঁড়িয়ে আছে খেয়াম। যদিও খেয়ামের দৃষ্টি মেহফুজের দিকে নয়। তবুও মেহফুজ তাকে দেখে বুঝতে পারল, খেয়াম তার সঙ্গেই কথা বলতে এসে দাঁড়িয়েছে। এর আগে মেয়েটা বেশ কয়েকবার তাকে বিভিন্ন প্রয়োজনে কল করেছে। কিন্তু কেন যেন তার একদমই ইচ্ছা হয় না খেয়ামের সাথে কথা বলার। তাই সে ততবারই নয়নকে দিয়ে খেয়ামের সঙ্গে কথা বলিয়েছে। তাই তারপর থেকে খেয়াম যে-কোনো দরকারই নয়নকে জানায়। কিন্তু আজ হঠাৎ তার কাছে কী দরকার পড়তে পারে? সেটাই ভাবছে মেহফুজ।
প্রায় ছাব্বিশ মিনিট কথা বলা শেষে মেহফুজ কান থেকে ফোন নামায়। তারপর হাঁক ছেড়ে নয়নকে ডেকে বলে, ‘বের হবো এখনি। জলদি এসো।’ সে মুহূর্তে খেয়াম গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসে তার কাছে।
-‘দুমিনিট টাইম হবে আপনার?’

আজও ঠিক কোনো সম্বোধন ছাড়াই খেয়াম কথা শুরু করল। অথচ সে ভেবে এসেছিল, স্যার বলেই কথা শুরু করবে। কিন্তু তার মুখের জবান যেন পণ করেছে, ‘মহা বড় বাজ পড়লেও স্যার আমি বলব না।’ মেহফুজও খেয়ামের এই সম্বোধন ছাড়া কথা শুরুর ব্যাপারটা বারবারই লক্ষ করে। কিন্তু কিছু বলে না সে। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চেয়ে রইল শুধু খেয়ামের দিকে। খেয়াম থুঁতনিটা গলার সাথে মিশিয়ে বলতে আরম্ভ করল, ‘আসলে আমি বোধ হয় শ্যুটিঙের কোনো শিডিউল মিস করে ফেলতে পারি আমার পড়াশোনার জন্য। এতদিন তো কোনো পড়াশোনা ছিল না, তাই সমস্যা হয়নি। যদি শিডিউল মিস করে ফেলি তাহলে আমাকে কাজ থেকে বের করে দেবেন না প্লিজ। প্রয়োজনে আমার গ্যাপ দেওয়ার দিনগুলো হিসাব করে রেখে সেই হিসেবে আমার টাকাটা দেবেন।’

-‘স্যালারির ব্যাপার তো নয়ন দেখাশোনা করে। ওকে জানিয়ে রাখলেই চলবে।’ বলেই মেহফুজ আর দাঁড়ায় না। চলে যায়। তার এই উপেক্ষা করা আচরণে খেয়াম ভেতরে ভেতরে একটু সংকুচিত হলো। তার কেমন জানি কষ্ট লাগে মেহফুজের এই আচরণগুলোতে। লোকটার সমস্ত বিষয়ই তো নয়ন দেখে। তাই নয়নের কাছে বলাটাই শ্রেয় ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে সে যে কেন তার কাছে আসতে গেল! তার কাছে না এলে তার এই অগ্রাহ্য করা আচরণটুকু তো আর পেতে হতো না।
***

এক সপ্তাহ হলো মুন দেশে ফিরেছে। দেশে ফেরার পর একদিনের মতো সে বাবার বাড়িতে ছিল। তারপরই সে শ্বশুরবাড়িতে চলে এসেছে। আসার পর আজই প্রথম সে অফিস যাতায়াত শুরু করেছে। রাতে বাসায় ফিরে নিজে হাতেই রাতের খাবারের আয়োজন করে ফেলল সে। এ বাড়িতে সে থাকলে একটু বোঝা যায় যে বাড়িতে কোনো মানুষ বসবাস করে। নীহার বড্ড শান্তি পান মেয়েটা বাড়িতে থাকলে। আগে যখন তার ছোটো মেয়ে মারিয়া ছিল বাসায়, তখন সারাদিনই দুই ননদ ভাবি মিলে বাড়িটা মাতিয়ে রাখত। এ বাড়িতে মারিয়া আর মুন বাদে যে তিনটা মানুষ বসবাস করত তাদের মধ্যে মেহফুজ ছোটোবেলা থেকেই একা আর হট্টগোলমুক্ত থাকতে পছন্দ করে। তাই সে বাড়িতে থাকলেও বোঝার উপায় নেই তার উপস্থিতি। আর নীহার; স্বামী অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর থেকে রঙিন দুনিয়ার সব কিছুই যেন তার চোখে সাদা-কালো। দায়বদ্ধতা থেকে সংসারটাকে দেখেশুনে রাখতে হয়। মনের একাংশে শুকিয়ে যাওয়া নদীর মতো চর পড়ে গেছে তার। মানুষ থেকেও মানুষবিহীন বাড়িটাতে মুনের অভাব তিনি প্রচÐ উপলব্ধি করেন, যখন মেয়েটা বাড়িতে না থাকে।
রাতের খাবার টেবিল সাজিয়ে মুন আর নীহার অপেক্ষা করছে মেহফুজের জন্য। সে এলেই খেতে আরম্ভ করবে তারা। এর মাঝে মুন টুকিটাকি অনেক খবরা-খবর নিয়ে নিলো শাশুরি মায়ের থেকে। মেহফুজ অবশেষে নিচে নামল। তাকে দেখে মুন বেশ চওড়া একটা হাসি দিয়ে বলল, ‘তুই কি আজকাল এক্সারসাইজ শুরু করেছিস না কি রে?’ মেহফুজের কালো পলো শার্টটার শর্ট স্লিভের নিচ থেকে তার ফর্সা পেশির মাংস ফুলে আছে। মুন সেটা লক্ষ করেই বলল। মেহফুজ চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বলল, ‘কোথায়? অনেকদিন বাদে দেখছিস তাই এমন লাগছে।’

নীহার ছেলের প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছেন। এর মধ্যে মুন বলল, ‘সত্যিই কি তাই, আম্মা?’

নীহার হেসে ফেললেন, ‘ওকে তো আমার সব সময়ই রোগা লাগে।’

-‘হুঁ, আমি তো বাবার মতো আটানব্বই ওয়েটের হলে তুমি ব্যাপক খুশি।’

মুন তখন বলল, ‘কিন্তু তোকে সত্যিই অনেক ফিট লাগছে আগের থেকে। নতুন কিছুই করছিস না?’

-‘আরে নাহ, ঘরের মধ্যে যেটুকু যা করতাম এখনো তাই-ই করি।’

-‘তাহলে বোধ হয় সত্যিই অনেকদিন বাদে দেখছি বলে তাই সব নতুন লাগছে।’

মেহফুজ ভাতের গ্রাস মুখে পুরে নিয়ে বলল, ‘তুই কিন্তু এই দেড় মাসে পারফেক্ট হয়ে গিয়েছিস।’

-‘বলছিস?’

-‘হুঁ, একদম।’

মুন খানিকটা লজ্জা পেল। নীহার হঠাৎ বললেন, ‘ওহ, আজ না আরিফ ভাই ফোন করেছিলেন। ওনার মেয়ে নাকি জগন্নাথে চান্স পেয়েছে?’ প্রশ্নটা মেহফুজকে করলেন তিনি। কিন্তু মেহফুজ কোনো উত্তর দিলো না। নীহার সেটা লক্ষ করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মেয়েটা কি কাজে আছে, মেহফুজ?’

-‘থাকবে না কেন? থাকার জন্যই তো আমার ঘাড়ে চাপিয়েছ।’

-‘কোন মেয়ের কথা বলছ তোমরা?’ মুন জিজ্ঞেস করল। মেহফুজ বলল, ‘তোর আম্মা স্বজনপ্রীতির চোটে একজন আনকুয়ালিফাইড মেয়েকে তোর অফিসে চাকরি দিতে চেয়েছিল। তুই নেই, তাই সেই সুযোগে প্রিম্যাচিওর মেয়েটিকে আমাকে অধম পেয়ে দিয়েছে আমার কাঁধে গছিয়ে।’

-‘কী যে বলিস তুই! ছোটো একটা মেয়ে। ওর বুদ্ধি কি এখনো অত ভার হয়েছে? অনেক ইনোসেন্ট কিন্তু।’ নীহার বললেন।

মেহফুজ সে কথার প্রতিবাদ জানিয়ে বলল, ‘কাজ আমার সঙ্গে করে মা। তোমার ছোটো পুচকে মেয়ের কথার ধার আর তেজ দেখলে বলতে না সে অনেক ইনোসেন্ট। যথেষ্ট ম্যাচিওরড সে। ছোটো তার শিক্ষাগত যোগ্যতায়। দেখতে শুনতে আর তার আচার আচরণে মোটেও সে পুঁচকে না।’

নীহার আর মুন মেহফুজের কথার সুরে বুঝতে পারল, মেয়েটার ওপর অনেক বেশিই ক্ষুব্ধ সে। মুন জিজ্ঞেস করল, ‘আমাকে কি বিস্তারিত বলবে তোমরা?’

তা শুনে নীহার খেয়ামের ব্যাপারে সব কিছু বললেন। মুন সব শুনে বলে উঠল, ‘পাগল তুমি আম্মা? আমার অফিসে এমন যোগ্যতার কোনো পদ আছে? তুমি জানো না? অসম্ভব। যদি পারে তো আমাদের কারখানার ওয়ার্কার হিসেবে ঢুকুক। এ ছাড়া আর কোনো কাজ নেই আমার কাছে।’

মেহফুজ তখন মাকে বলল, ‘তাহলে ওকে আর না হয় ওর বাবাকে বলে দেখো মুনের অফার।’

নীহার দ্বিমত জানালেন, ‘আরে ধুর! এর থেকে তোর কাজই অনেক সেফ আর ভালো আছে।’
***

আরিফ অনেক খুশি হয়েছেন মেয়ের ভালো ভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ হওয়ায়। ঢাকায়ও এসেছিলেন তিনি মেয়েকে নতুন ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার জন্য। কষ্ট হলেও তিনি মেয়ের পড়াশোনার পেছনে সর্বস্ব দিতে রাজি এখন। খেয়ামের আরও দুজন বন্ধুর সেখানে সুযোগ হয়েছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে খেয়াম প্রথম কিছুদিন ভার্সিটি অ্যাটেন্ড করেছিল। নতুন উদ্যমে তার জীবনটা চলতে আরম্ভ করেছে। কাজের মাঝেও সে যে এভাবে পড়াশোনার সুযোগ পাবে তা সে ভাবেনি। একদিন, দুদিন কাজে ফাঁক পড়লেও কোনো সময় তা নিয়ে কোনো ঝামেলায় পড়তে হয় না তার। তবে শেষ কিছুদিনে একটু বেশিই সে কাজে ফাঁক দিয়ে ফেলেছে। সেই ফাঁকটা অতি শীঘ্রই তাকে প‚রণ করতে হবে। নয়তো নয়ন যেভাবে তাকে বলেছিল, ‘শোনো খেয়াম, তুমি খুব ছোটো বলেই তোমাকে এই সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ছুটি অনেক বেশি পড়লে তখন কিন্তু ঝামেলায় পড়তে হবে।’ নয়নের কথাগুলো মনে পড়তেই ভেতরে ভেতরে একটা আতঙ্ক কাজ করছে তার, যদি কাজটা হারিয়ে ফেলে সে? তাই আজই ছুটে এল আবার কাজের জায়গায়।

সে পানির বোতল নিয়ে এসে দাঁড়াতেই তার পায়ের কাছে মেহফুজের মাথার ক্যাপটা এসে পড়ল। প্রচণ্ড রেগে আছে মেহফুজ। শট শুরু হওয়ার কথা সকাল সাতটায়। সেখানে বেলা বাজে দশটা। কিন্তু এখনো আজকের স্ক্রিপ্টের মূল চরিত্র এসে উপস্থিত হয়নি। সেই ব্যক্তিটিকে নিয়ে মেহফুজ যে ক’বারই কাজ করতে বাধ্য হয়েছে, সে ক’বারই তাকে এমন ধরনের সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে। আসি আসি বলেও ব্যক্তিটি সেটে আসে ঘণ্টা দুই, তিন পার করে। খেয়াম শুনেছে, সেই লোকটির প্রতি মেহফুজের এত বেশি রাগ যে পারলে সে হয়তো তার নামে সত্য মিথ্যা দিয়ে চার পাঁচটা মামলা ঠুকে দিলে শান্তি পেত। আরও শুনেছে, লোকটি নাকি বর্তমান ব্যান্ড সিঙ্গারদের মাঝে বেশ জনপ্রিয় একজন সিঙ্গার। পাশাপাশি সে অভিনয়টাকেও চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ কারণেই তার ফ্যান ফলোয়ারস অত্যাধিক। আর এই দাপটেই মাটিতে সহজে পা পড়তে চায় না তার। মেহফুজ নাট্য ও চলচ্চিত্রের জগতে একজন নতুন পরিচালক হয়ে যেমন খুব দ্রুতই সাফল্য আর মর্যাদাসম্পন্ন স্থান তৈরি করে নিয়েছে, ঠিক সেই মানুষটিও অতি অল্প সময়ে অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মেহফুজকে সে খুব একটা সমীহ করে চলে না। এসব শুধু খেয়াম শুনেছেই। আর আজ তার কিছুটা প্রমাণও মিলল। সেই লোকটির আচরণেরও নাকি খুব একটা সুনাম নেই। তাকে দেখার জন্য খেয়াম ভেতরে ভেতরে অনেক বেশিই উত্তেজিত। মনে মনে সে বলে চলেছে, ‘তুমি কোথাকার হনু হে! তোমার দর্শনে যে বড়োই ব্যাকুল আমি।’

বাজখাঁই সুরে মেহফুজ সহকারীদের বলে উঠল, ‘শটই নেবো না আমি। নোমানকে বল স্ক্রিপ্ট চেঞ্জ করতে এখানে। ওর কোনো চরিত্রই রাখব না। ওর যতটুকু যা সিন আছে তা এডিটের ব্যবস্থা কর।’ বলেই সে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা খেয়ামের দিকে অগ্নিঝরা দৃষ্টিতে তাকাল। খেয়াম সেই তখন থেকে হাতে পানির বোতল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেহফুজের হাতে আর তুলে দেওয়ার খবর নেই। মেজাজ এখন সপ্তম আকাশে মেহফুজের। ভেবেছিল সে, এই মেয়ের সাথে আর কথা বলবে না কোনোদিন। কিন্তু আজ সীমাহীন ক্রোধের কাছে সেই ভাবনা কখন যেন উবে গেল। আবারও বাজখাঁই গলায় সে চেঁচিয়ে উঠল খেয়ামের ওপর, ‘পানির বোতল কি ধরে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য এনেছ?’

খেয়াম ছুটে এসে মেহফুজের হাতে পানির বোতল তুলে দিলো। সহকারী প্রত্যেকে মেহফুজকে ঠান্ডা করতে ব্যস্ত। প্রায় এগারোটার ওপাশে এসে একটা গাড়ি থামল স্পটে। খেয়াম উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সেদিকে। তার সামনে নামল ঝাঁকড়া চুলের বাবরিওয়ালা একটি ছেলে। পরনে তার সাদা ধবধবে একটা ফতুয়া আর জিন্স প্যান্ট। গায়ের রংটা বাদামি, গোলগাল মুখ। আর তার হাতভর্তি চেইন আর ব্রেসলেট। গলায়ও কালো রঙের একটা মোটা চেইন ঝুলছে। তার ড্রাইভার নেমে একটা ছাতা নিয়ে অতি দ্রুত তার মাথায় ধরল। চুলগুলো পেছনে ঝুঁটি বাঁধতে বাঁধতে এগিয়ে আসছে সে। চেহারাতে সত্যিই একটা ব্যান্ড সিঙ্গার ভাব আছে লোকটির। মেহফুজ রাগের চোটে তার দিকে ফিরেও তাকাল না। সে আসতেই মেহফুজ চেয়ারে লাথি মেরে উঠে দাঁড়াল। আমিনসহ অন্যান্য সহকারীরা বুঝতে পারল, আজকের শট মেহফুজ জীবনেও নেবে না। আবার সেট ছেড়েও যাবে না সে। শ্যুটিঙের মাঝে তরঙ্গ কোনোরকম বেয়াড়াপনা করলে মেহফুজ আজ বড়োসড়ো কোনো ঝামেলা বাঁধাবে, নিশ্চিত। মেহফুজ বেশ দূরে গিয়েই বসল। তরঙ্গ সেটে এসে দাঁড়াতেই আমিন এগিয়ে এসে বলল, ‘একটু দেরি হয়ে গেল না? মেহফুজ স্যার তো সাংঘাতিক রেগে গেছেন।’

তরঙ্গ গলার চেইন আঙুলের মাঝে পেঁচিয়ে নাড়তে নাড়তে কেমন পরোয়া না করা অভিব্যক্তিতে বলল, ‘তাতে আমার বাল ছেঁড়া গেল।’

আমিন থতমত খেয়ে গেল তরঙ্গের এমন জবাবে। খেয়াম মেকআপ আর্টিস্ট হৃদয়ের পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিল তরঙ্গকে। তার চোখ দুটো কেমন ভয়ানক লাল আর ঘুম ঘুম ভাব যেন। মনে হচ্ছে ঘুম থেকে তাকে টেনে তুলে এখানে আনা হয়েছে। এই ছেলে আজ শট দেবে কী করে? আর এত বিশ্রী কেন এই ছেলেটার ব্যবহার? খেয়াম মৃদুস্বরে বলে উঠল, ‘কোথাকার থার্ডক্লাস এ? এত অশ্লীল কেন সে?’

তার মৃদু আওয়াজের কথাগুলো হৃদয়ের কানে পৌঁছে গেল স্পষ্টভাবেই। সে খাদে নামিয়ে আনা কণ্ঠে বলল, ‘আরে আস্তে বলো। শুনে ফেললে তোমার সম্মানের দফারফা করে বসবে। পুরো সেট মাথায় করে ফেলবে।’

-‘এমনও কোনো অভিনেতা হয়?’

-‘সে হয়।’

-‘একে কেন কাজে ডাকে?’

-‘টিভি দেখো না, না কি? দর্শকের কাছে খুবই প্রিয় মুখ সে। তার সাথে কাজ করতে হলে সবাইকেই তার এই আচরণ সহ্য করতে হয়।’

-‘বুঝলাম। কিন্তু সে শট দেবে কী করে? মনে তো হচ্ছে ঘুমে ঢুলে ঢুলে পড়ছে। এ আবার অভিনয়ও পারে?’

-‘শট দেওয়ার সময়ই দেখে নিয়ো।’

মেকআপ নেওয়া শেষে কাঠফাটা রোদ্দুরের মাঝে শট দেওয়া নিয়ে শুরুতেই তরঙ্গের বাহানা শুরু হলো, ‘আরে আমি কি মরুভ‚মির তরতাজা উট নাকি? এমন রোদে শট নেওয়ার পরিকল্পনা কোন আবালে করছে?’

পুরো শ্যুটিং সেট চেঁচামেচি করে মাথায় তুলে ফেলেছে সে। খেয়াম বারবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে মেহফুজকে খুঁজছে। আজকে দুই তুফান এক সঙ্গে হলে পুরো শ্যুটিং এলাকা যে তছনছ হয়ে যাবে, তা সে ভালোভাবেই টের পাচ্ছে। তরঙ্গকে মানানোর চেষ্টা করছে সবাই খুব। সে কোনোভাবেই রোদের মধ্যে শট দেবে না। তার একটাই কথা, ‘আরে ধুর বাল! তাকাতেই তো পারতেছি না। তার শট দেবো ক্যামনে?’

এ কথা শেষবার বলে সে কোল্ড ড্রিংক চাইল। তার কাজেই কমপক্ষে তিনজনকে নিয়োজিত থাকতে হচ্ছে সব সময়। দূর থেকে খেয়াম অসম্ভব বিরক্ত নিয়ে দেখছে তাকে। সে হঠাৎ খেয়াল করল মেহফুজ অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলতে বলতে হাঁটাহাঁটি করছে। সেই সকাল থেকে মানুষটা ঘেমে-নেয়ে বসে অপেক্ষা করছিল। হঠাৎ করেই তার জন্য মনটা কেমন আনচান করে উঠল খেয়ামের। বারবার চোখে ভাসছে মানুষটার কপাল আর চিপ বেঁয়ে গড়িয়ে পড়া তার ঘর্মাক্ত মুখটা। একটা কোল্ড ড্রিংকের বোতল খেয়াম তার জন্য নিয়ে যেতে পা বাড়াল। কিন্তু তখনি তরঙ্গ ডেকে উঠল তাকে, ‘ওই জোব্বাওয়ালি! হাতে কোল্ড ড্রিংকের বোতল নিয়ে কোনদিকে যাও? এখানে চোখে দেখো না?’

আমিন খেয়ামকে ডেকে বলল, ‘এদিকে নিয়ে আসো বোতল।’
বলেই সে তরঙ্গকে বলল, ‘মেকআপ তো খারাপ হয়ে যাচ্ছে তরঙ্গ। শটটা তাড়াতাড়ি দিয়ে দিলে ভালো হয় না?

-‘ধুর মিয়া! বললাম না এই ঠাডা পড়া রোদ্দুরের মধ্যে আমি কোনো শটমট দিতে পারব না?’

এর মাঝে খেয়ামের থেকে সে আরও একটা কোল্ড ড্রিংকের বোতল নিয়ে তাতে চুমুক দিতে আরম্ভ করেছে। আমিনসহ আরও কয়েকজন তাকে বোঝানোর কাজটা করেই যাচ্ছে। তখন মেহফুজ এসে দাঁড়াল, ‘কী ব্যাপার! শট নেওয়া শুরু হয়নি কেন এখনো?’

তরঙ্গ একবার নজর তুলেও তাকাল না মেহফুজের দিকে। আমিন এসে মেহফুজকে সমস্যাটা বলতে বাধ্য হলো। তা শুনে সে তরঙ্গকে জিজ্ঞেস করল, ‘শট দেওয়ার কথা ছিল তোমার সকাল সাতটায়। এখন প্রায় বারোটা বাজতে চলেছে। এমনিতেও এই শট এই ওয়েদারে যায় না। তারপরও তুমি এত লেট করছ কেন?’

-‘আমার সমস্যা আছে বলছি না? এত রোদে আমি শট দিতে পারব না। গায়ে উটের চামড়া না আমার।’

-‘গায়ে উটের চামড়া আমাদেরও নেই। এয়ারকন্ডিশনের মধ্যে বসবাস আমরাও করি। আমরা থাকতে পারলে তুমিও পারবে। এত ঝামেলা কোরো না তো, তরঙ্গ। যাও জলদি রেডি হয়ে নাও।’

-‘আরে মহা মসিবত তো! আমার শট দেওয়ার কথা ছিল নরম ওয়েদারে। রোদের মধ্যে শট দেওয়ার কথা তো ছিল না আমার। তাহলে আমি এখন কেন শট দেবো?’

-‘তাহলে তুমি লেটে কেন ঢুকলে? এখন কি তুমি শিডিউল আরেকটা দিতে চাচ্ছ শ্যুটিঙের? আমার তো এত সময় নেই হাতে। দেখো, এত বেশি ঝামেলা করলে তো আমাকেও ঝামেলার রাস্তাতে যেতে হবে।’ বেশ কড়া কণ্ঠেই বলল মেহফুজ।

তরঙ্গের মুখের মধ্যে পানীয় ছিল। মেহফুজের কথা শুনে সে তাচ্ছিল্যভাব প্রকাশের জন্য মুখের মাঝের পানীয়টুকু কুলকুচার মতো করে ছুড়ে মারল বাহিরে। আর তা গিয়ে পড়ল একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা খেয়ামের বোরখার ওপর। ব্যাপারটুকুতে সেটে দাঁড়িয়ে থাকা সবারই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। আর খেয়ামের চেহারা তখন রাগে হতবিহ্বল ভাব যেন। তরঙ্গ উঠে দাঁড়িয়ে চেহারা বিকৃত করে দায়সারা সুরে বলল, ‘ওকে ওকে, আজকেই এমন অসময়ে শট দিচ্ছি। এরপর এমন সময়ে আমাকে শট দেওয়ার কথা বলে পায়ে ধরলেও আমি রাজি হবো না।’

মেহফুজ আমিনের পাশে বসে শট নেওয়া দেখছে। আর অন্যদিকে খেয়াম তিরিক্ষি নজরে তরঙ্গের নিঁখুত অভিনয় মুহূর্ত দেখছে দাঁড়িয়ে। সত্যিই, তার অভিনয়ের প্রশংসা না করে থাকা যায় না। তার জন্য আজ স্পটে প্রচুর ভিড়ও জমা হয়েছে। ছেলেটার দম্ভ সম্পর্কে খেয়ামের পুরোপুরি আন্দাজ করা হয়ে গেছে এইটুকু সময়েই। প্রায় একটানা একঘন্টা সে শট দিলো। শট কাট করতে হয়েছে খুব কমবারই। এর মাঝে তার বাকি সহঅভিনেতা, সহঅভিনেত্রী দরকারে অদরকারে বিরতি নিলেও সে বিরতি নেয়নি। তাতে বোঝা গেল, সে যখন কাজ শুরু করে তখন পুরোপুরি মনোযোগ দিয়েই সে কাজ শেষ করে।

এক ঘণ্টার শট দেওয়া শেষে বড়ো দুটো স্ট্যান্ড ফ্যানের সামনে এসে বসল তরঙ্গ। এক সাথে পানি, ড্রিংক সব কিছুর ব্যবস্থা করে একজন মানুষ এগিয়ে আসছিল তার কাছে। খেয়াম হঠাৎ তার কাছ থেকে পানীয়র ট্রেটা নিয়ে তরঙ্গকে সে পার করে সোজা মেহফুজ আর আমিনের সামনের টি-টেবিলে রাখল সেটা। কাজটাতে ক্ষণিকের জন্য মেহফুজ আর আমিন হতজ্ঞান হয়ে তাকিয়ে ছিল তার দিকে। তবে বেশি সময় সে তাদের তাকিয়ে থাকার সুযোগ দিলো না। এরপরই সে আরেকটা ট্রে করে তরঙ্গের জন্য নিয়ে এল নাশতা। তরঙ্গের তখন অত্যাধিক মেজাজ চড়ে গেলেও বলতে পারল না, তাকে ফেলে কেন আগে অন্যদের নাশতা দেওয়া হলো? এই ব্যাপারটা নিয়ে রাগ দেখাতে গেলে তাকে হাভাতে ভেবেও বসতে পারে যে কেউ। খেয়াম তার টেবিলে নাশতার ট্রে রাখতেই তরঙ্গ রাগান্বিত কণ্ঠে বলল, ‘গ্লাসে পানি ঢালো।’
খেয়াম একবার শান্ত দৃষ্টিতে তাকে দেখে নিয়ে একটা গ্লাসে পানি ঢালল আর আরেকটা গ্লাসে ড্রিংক ঢালতে গিয়ে তা ছিটকে গিয়ে পড়ল তরঙ্গের প্যান্টের ওপর। প্যান্টের একদম মিডল পয়েন্টে লেগে জায়গাটুকু ভিজে গেল। তরঙ্গ তখন ‘ওহ শিট!’

বলে উঠে দাঁড়িয়ে জায়গাটুকু মুছতে মুছতে চেঁচিয়ে বলল, ‘এই, কী করলা এটা? তোমারে কাজে ঢুকাইণে কে? ঘাড় ধাক্কাইয়া একেবারে বের করে দেবো। কাজ জানো না কি চেহারা দেখাইতে আসছ? এই ওরে কাজে নিছে কে রে?’

শ্যুটিং সেট পুরো মাথায় তুলে নিয়েছে সে চিৎকার চেঁচামেচিতে। এর মাঝে অকস্মাৎ একটা ধমকে তরঙ্গ চমকে উঠল। একদম নীরব হয়ে হতবাক দৃষ্টিতে সে খেয়ামের দিকে তাকাল। তরঙ্গ দেখতে থাকল তাকে, মেয়েটার মুখ ঢাকা থাকলেও তার বড়ো বড়ো সুন্দর চোখদুটোর আকৃতি আরও বড়ো হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। চোখের চাউনিতেই যেন দুনিয়া ভস্ম করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে সে। তরঙ্গের মতো একজন মানুষকে এত সাধারণ কর্মী ধমক দিয়ে বসে, এর থেকে বিস্ময়কর ঘটনা আর কী হতে পারে? এমন স্পর্ধা তো স্বয়ং কোনো ডাইরেক্টরও দেখাবে না তার সামনে। খেয়াম ধারাল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলেও বেশ স্বাভাবিক সুরে তাকে বলল, ‘অল্পতেই দুনিয়া এমন মাথায় তুলে নেন কেন? এই যে দেখুন, আমার বোরখার নিচে কতখানি ভিজে! আপনি তখন কোল্ড ড্রিংক মুখের মধ্যে নিয়ে কুলকুচা করে ছুড়ে মারলেন আমার বোরখার ওপর। তখন তো তাকিয়ে দেখেননি, এখন দেখুন। আমাকে কিন্তু এটা পরেই সারাদিন সেটে কাজ করতে হবে। আর আপনি তো কস্টিউম চেঞ্জ করবেন। সমস্যা কী? সমস্যা নেই তো।’

খেয়ামের এমন স্পর্ধাজনক আচরণে আমিন এবং আরও অন্যান্য সহকারী খেয়ামকে ধমকানোর জন্য উদ্যত হতেই মেহফুজের বাধা পেয়ে তারা থেমে গেল। মেহফুজের থেকে হঠাৎ এমন বাধা পেয়ে তার ওপরও সবাই চরম বিস্মিত হলো।

খেয়াম কথা শেষ করে নির্বিকার ভঙ্গিতে তরঙ্গের সামনে থেকে চলে আসে। সে আন্দাজ করে নিয়েছে এরপর হয়তো তাকে আর কাজে রাখতে চাইবে না। তবুও এমন অসভ্য মানুষটাকে শিক্ষা না দিলে তার রাগটাই বৃথা যেত। তবে সে তার কাজ নিয়ে চিন্তিত হলেও মেহফুজের মুখ থেকে কিছু না শোনা অবধি এই কাজ ছাড়বেও না। আর ওদিকে, তরঙ্গ সহসা ঘটনায় তথাপি কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
***

চলবে।