Sunday, August 17, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 448



এক মুঠো প্রণয় পর্ব-১১+১২

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_১১
লেখনীতেঃএকান্তিকা নাথ

” জ্যোতি তুই কি এই পরিস্থিতির জন্য আমাকেই দায়ী করিস কেবল?তোর জীবনটা কি আমিই নষ্ট করি দিয়েছি ভাবিস?নাকি তোর দমবন্ধ অনুভূতির কারণ এই বিয়েটা?বিয়েটা থেকে মুক্তি চাস কি তুই?আমায় সবটা জানাতে পারিস নির্দ্বিধায়।”

মেহেরাজ ভাইয়ের শীতল কন্ঠে আকস্মিক প্রশ্ন শুনে চোখ ঘুরিয়ে তাকালাম আমি।কালকের মতোই পানির বোতল হাতে নিয়ে দরজার দ্বারে দাঁড়িয়ে আছেন উনি। রাত প্রায় একটা ছুঁইছুঁই।সামনে পরীক্ষা বলেই পড়ছিলাম।আজও মেহেরাজ ভাই এভাবে হাজির হবেন আমি ভাবিনি।কিয়ৎক্ষন তাকিয়েই পুনরায় দৃষ্টি সরাতেই মেহেরাজ ভাই আমার সামনে এলেন।চেয়ার টেনে বসে শান্ত স্বরে বলে উঠলেন,

” সামান্তা যদি কিছু বলে থাকে তা সিরিয়াসলি নিস না।মেহু বলল ও তোকে ছাদে দেখে অস্বাভাবিক আচরণ করেছে?তুই কি সিরিয়াসলি নিয়েছিস?আশা করি তোকে তা বলেও দিতে হবে না।তুই খুব ম্যাচিউরড জ্যোতি। এইটুকু বোঝার ক্ষমতা আছে তোর।তাই না?”

আমি মনে মনে হাসলাম।তখন সামান্তা আপু যা বলেছিল তার জন্যই বুঝাতে এসেছেন উনি?কিন্তু বুঝানোর কি প্রয়োজন?আমি কষ্ট পেলে উনার কিংবা অন্য কারোর ও বিশেষ ক্ষতি হবে কি?হবে না।তবে বুঝানোর কি প্রয়োজন?মেহেরাজ ভাই আবারও বললেন,

” কালকে রাতে তোর বলা কথাগুলো আমি অনেকক্ষন ভেবেছি। ভেবে মাথার মধ্যে এই ভাবনা কাজ করছে যে, এই বিয়েটা বোধ হয় আমার দোষের জন্যই হয়েছে।কিন্তু এটা সত্যি যে, বিয়েতে আমারও মত ছিল না জ্যোতি।আর এই পরিস্থিতি সৃষ্টির দায় আমি মাথায় নিয়ে সেদিন তোকে স্যরিও বলেছিলাম।আজ প্রয়োজন হলে আবারও বলছি।”

আমি এবার মাথা তুলে চাইলাম।মেহেরাজ ভাইয়ের দৃষ্টি শান্ত। কন্ঠ শীতল।যেন কোন রাগ নেই আজ।কেমন স্নিগ্ধ চাহনী।নির্বিকারভাবে দুয়েক পলক তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই বলে উঠলাম,

” স্যরি বলেছিলেন।মনে আছে আমার।এখন কি করা উচিত আমার মেহেরাজ ভাই?”

মেহেরাজ ভাই আগের মতোই তাকালেন শান্তভাবে।বললেন,

” তুই আমাকেই কেন শুধু দায়ী করছিস এই পরিস্থিতির জন্য?”

আমি একপলক তাকিয়ে শান্তভাবে বললাম,

” আচ্ছা, আপনি দায়ী নন।আর কিছু?”

মেহেরাজ ভাই এবার চুপ হয়ে গেলেন।আমি হালকা হেসে বললাম,

” আপনি ইনিয়ে বিনিয়ে এই বিয়েটা থেকে মুক্তি চাইছেন মেহেরাজ ভাই?আমি খুব ভালোভাবে জানি আমি আপনার আর সামান্তা আপুর মাঝখানে চলে এসেছি দুর্ভাগ্যবশত।কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমারও এতে দায় নেই।আমি কখনো আপনাদের সুখ কেড়ে নিতে চাই নি।শান্তি কেড়ে নিতে চাইনি।আপনি চাইলে সামান্তা আপুর সাথে সম্পর্কটা আগের মতোই চালিয়ে যেতে পারেন। আমি বাঁধা দিব না।তবে বিয়েটা থাকুক।হুহ?বিয়েটা ভাঙ্গবেন না।এমন নয় যে আমি আপনার সামনে বিয়ে নিয়ে কোন অধিকার দাবি করব।পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমি খুব শীঘ্রই চেষ্টা করব গ্রামের বাড়িতে দাদীর কাছে ফেরত যাওয়ার।আপনি চাইলে সামান্তা আপুকে বিয়ে করতে পারেন।এমন তো অনেকই হয় যে একজন পুরুষ দুই- তিনটে বিয়ে করে।তাই না?”

কথাগুলো একদমে বলে ফেলেই থামলাম।পরমুহুর্তে মেহেরাজ ভাইয়ের দিকে একপলক তাকাতেই শিউরে উঠলাম।এতক্ষন যতোটা শান্ত, স্নিগ্ধ চাহনী ছিল এখন ঠিক ততোটাই রাগ মিশ্রিত হলো তার চাহনীতে।চেহারায় জ্বলজ্বল করল অদৃশ্য রাগ!চোখজোড়াও লালচে দেখাল।আমি তাকিয়ে রইলাম এক দৃষ্টিতে।মেহেরাজ ভাই শীতল অথচ শক্ত গলায় বলে উঠলেন,

” তোর কি আমাকে তেমন পুরুষ মনে হয় জ্যোতি?যে বিয়ে করেও পরকীয়ায় জড়াবো আমি?তোরা মেয়েরা পুরুষদের কি ভাবিস আসলেই জানা নেই।তোদের কি মনে হয় পুরুষরা মেয়ে বলতেই পাগল?যেখানেই মেয়ে দেখছে সেখানেই মেয়েদের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে?মেয়েদের বিয়ে করে নিচ্ছে?”

ছোট্টশ্বাস ফেলে উত্তর দিলাম,

” আপনি কথাগুলোকে নেগেটিভলি নিচ্ছেন মেহেরাজ ভাই।যেখানেই মেয়ে দেখছেন সেখানেই সম্পর্কে জড়াচ্ছেন কিংবা বিয়ে করছেন, এমন কোন কথা আমি উল্লেখ করিনি।আমি উল্লেখ করেছি আপনাদের ভালোবাসার কথা।দুইজন দুইজনকে ভালোবেসেছেন। বিয়ে করার, সংসার করার স্বপ্ন দেখেছেন।আমার জন্য কেন সেসব থেমে যাবে?”

মেহেরাজ লালভ দৃষ্টিতে তাকিয়েই বলে উঠলেন কঠোর গলায়,

” আমি যদি চাইতাম তবে সেদিনই বিয়েটা থেমে যেতে পারত জ্যোতি।আমি চাইলে তোকে বিয়ে না করে চলে আসতে পারতাম।পারতাম না?কেন করিনি?কারণ আমি অতোটাও মনুষ্যত্বহীন নই।অতোটাও অমানুষ নই। আমার জন্য তোকে এসবের দায় নিয়ে অনেক ভোগান্তিতে পড়তে হবে মানতে পারতাম না।তাহলে নিজেই নিজের কাছে অনেক নিচু হয়ে যেতাম।তখন বিয়েটা অনেক ভেবেচিন্তেই করেছিলাম।পুরোরাত ভেবেছিলাম।ভালোবাসার কথা ভাবলে সেদিনই বিয়েটা করতাম না।আর একটা কথাও মাথায় রাখিস, আমি অন্যায় কাজে মত দিতে পারি না।না তো, দু নৌকায় পা দিয়ে চলতে পারি।”

তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসলাম।প্রশ্ন ছুড়লাম,

” দয়া করেছেন মেহেরাজ ভাই?আমার কি কৃতজ্ঞবোধ প্রকাশ করা উচিত আপনাকে?”

” সারারাত ভেবে চিন্তে যখন বিয়েটা করেছিলাম যেহেতু অবশ্যই যুক্তি নিয়ে করেছিলাম।দয়া হলে সেটা বিয়ে পর্যন্ত যেত না জ্যোতি।”

আবারও প্রশ্ন করলাম তাচ্ছিল্য নিয়ে,

” তবে?বিয়েটা করে দায়িত্ব পালন করেছেন?”

মেহেরাজ ভাই উঠে দাঁড়ালেন। টাউজারের পকেটে হাত গুঁটিয়ে ঠোঁট গোল করে শ্বাস ফেললেন।তারপর বললেন,

” আমার দ্বারা অন্যায় কাজ হয় না সচারচর।তোকে বিয়ে না করলে বিষয়টা সেদিন চরম অন্যায় হতো।হয়তো বা নিজেকেই ক্ষমা করতে পারতাম না।আমি যেটা বলতে এসেছিলাম, সামান্তা হয়তো নিজের হুশে নেয়।আদরে, আহ্লাদে বেড়ে উঠেছে ও।বয়সে তোর থেকে বড় হলেও ও তোর থেকে বেশ ইমম্যাচিউরড জ্যোতি।পরবর্তীতেও যদি ও এমন কোন দোষারোপ করে বুঝে নিতে পারবি না নিজ থেকে?”

আমি আনমনর হাসলাম।প্রিয় মানুষকে এতটাই ভালোবাসেন যে তারই প্রিয় মানুষের আচরণে অন্য কেউ কষ্ট পেয়ে ভুল বুঝুক এটাও চাননা।কত ভালো গুণ!মাঝেমাঝে আপসোস হয়!মেহেরাজ ভাই যদি এই ভালোবাসাটা আমায় দিতেন, ঠিক এভাবেই আমায় ভালোবাসতেন?খুব বেশি ক্ষতি হতো কি?হয়তো হতো।হয়তো এই কঠিন হৃদয়ের মানুষটির ভালোবাসা হারিয়ে সামান্তা আপুর মতোই পাগলপ্রায় অবস্থা হতো আমার।তার থেকে না হয় এই সর্বনাশা ভালোবাসা না পাওয়ায় শ্রেয়!

.

মেহু আপু আর মেহেরাজ ভাই বেরিয়ে যাওয়ার পরই শিমা আপা আসলেন।আমি হালকা হাসলাম।শিমা আপা বেশ অদ্ভুত মানুষ।কেমন জানি ক্ষ্যাপাটে স্বভাব।কথা বলার ক্ষেত্রে কি কিি বললে কেউ কষ্ট পাবে, আঘাত পাবে না ভেবেই কথা বলে যান।তবুও এই ক্ষ্যাপাটে মহিলার সাথে আমার দুই চারটা কথা হয় এই অনেক।শিমা আপাকে রান্না ঘরে টুকটাক সাহায্য করে রান্না প্রায় শেষ হয়ে আসতেই আমি গোসলের জন্য গেলাম।কিছুক্ষন পর বের হয়ে ভেজা চুল তোয়ালে দিয়ে মুঁছতে মুঁছতেই কানে এল শিমা আপার কন্ঠ,

“জ্যোতি মাইয়াডার মায় নাকি ছোডবেলায় মাইয়াডারে রাইখা অন্য পুরুষের লগে পালাইয়া গেছে।হায়রে!কেমন হের মা আর কেমনই বা হের মার চরিত্র!মাইয়ার দিকেও তাকাইল না ঐ মায়?নাজানি মাইয়াডার চরিত্র কেমন হয়।বড় ভাই তো বহুত ভালা মানুষ।ভালো মাইনষের কপালে ভালা জুটলেই ভালা।”

শিমা আপার বলা কথাগুলো শুনে পা থেমে গেল আমার।গ্রামের বাড়িতে মায়ের চরিত্র নিয়ে কথা শুনতে শুনতে এখন এসবে আর বিশেষ অপমানিত বোধ করি না।বরং অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।কিন্তু এখানে এসেও যে সে একই অপমানের সম্মুখীন হতে হবে কখনো ভাবিনি আমি।শুকনো ঢোক গিলে দাঁড়িয়ে থাকতেই এবার আরো একটা কন্ঠস্বর কানে এল।কন্ঠস্বরটা ফাতেমা আন্টির। শিমা আপার কথাগুলোকে বেশ গুরুত্ব দিয়েই উনি বলে উঠলেন,

” সে কি বলো শিমা।মেয়েটারে দেখতে তো নম্র ভদ্র পরিবারেরই লাগল।মেয়ের মা যে এমন ছিল তা তো শুনিনি।তুমি কার কাছে শুনলে এমন কথা?”

” আরে নাবিলা আপার আম্মাই কইছে আমারে।”

” সত্যি নাকি?মেহেরাজ প্রেম ট্রেম করে শেষ পর্যন্ত এমন মেয়ে বিয়েই বা করল কেন?হয়তো মেয়েটা ভালো।মেয়ের মা ছিল আরকি তেমন।নয়তো মেহেরাজের মতো বুদ্ধিমান ছেলে নিজ থেকে বিয়ে করত নাকি এমন মেয়েকে?”

” নিজ থেইকা বিয়া করল কে কইল?বিয়া তো ওগো জোর কইরা দিল। সে বহুত কাহিনী!আপনে আবার এডি কারোরে বইলেন না ফাতেমা আপা।”

ফাতেমা আন্টি মাথা নাড়ালেন।মুহুর্তেই বলে উঠলেন,

” আরেহ না না, বলব না।”

কথাটা বলে সামনে তাকাতেই আমাকে দেখে চমকে গেলেন।চোখ বড়বড় করে বলে উঠলেন,

” একি মা!তুমি গোসল সেরে বের হলে নাকি?একটু এসেছিলাম বাসায় একা একা কি করছো দেখতে।দেখি শিমা রান্না করছে তাই ওর সাথে কথা বলছিলাম।”

আমি সৌজন্যতা দেখিয়ে হাসলাম।মানুষজাতি অদ্ভুত!পেছনে পেছনে একটা মানুষের নামে চরম পর্যায়ের খারাপ কথা বলতে পারলেও সামনে এলেই প্রশংসার জুড়ি মেলে।বললাম,

” ভালো তো।বসুস আন্টি।”

আন্টি বসলেন না।হেসে বলে উঠলেন,

” না না, মা।কাজ আছে বাসায় অনেক।যেতে হবে যে।”

আমি আর কথা বাড়ালাম না।আন্টি চলে যেতে নিয়েও থেমে গেলেন যেন।বাঁকা চোখে আমার দিকে তাকিয়েই পরখ করলেন কি যেন।আমি স্থির দাঁড়িয়ে রইলাম।দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফাতেমা আন্টির দৃষ্টি দেখছিলাম।হঠাৎই চোখে চোখ পড়ল।চোখাচোখি হলো।সঙ্গে সঙ্গে আন্টি থমমত খেয়ে গেলেন।আমি হাসলাম।দু পা বাড়িয়ে কিছু বলব ঠিক তখনই কলিং বেল বাঁজল।ঘাড় ঘুরিয়ে একপলক দরজার দিকে তাকিয়ে এগিয়ে গেলাম।পরমুহুর্তেই দরজা খুলে চমকে গেলাম আমি।আব্বা আর মেহেরাজ ভাই দুইজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছালেও স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা চালালাম।মনে মনে ভাবলাম, আব্বা কেন আসল?এতদূর পাড়ি দিয়ে আব্বা কি আমাকেই দেখতে এল?আমি কেমন আছি তা দুচোখে দেখার জন্যই এলেন?কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই অনুভব করলাম কষ্ট হচ্ছে আমার।আজ যদি অন্যসব বাবা মেয়ের মতে আমার আর আব্বার সম্পর্কটাও স্বাভাবিক থাকত কত ভালো হতো।কি দোষ করেছি আমি?আমি কষ্টকে দমিয়ে নিলাম।আব্বাকে দেখে কেমন আছে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো।দেরিও করলাম না।দ্রুত সালাম দিয়ে বললাম,

” কেমন আছেন আব্বা?দাদী ভালো আছে?বাড়ির সবাই কেমন আছে?”

আব্বা আমার দিকে তাকালেন।আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গলা ঝাড়লেন।তারপর কিছু বলতে নিতেই আকস্মিক এক ঘটনা ঘটল।নিচতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত ছুটে এলেন সামান্তা আপু।চোখমুখে কান্নার স্পষ্ট চিহ্ন।আমি নির্বিকার ভাবে উনার ছুটে আসার দিকেই তাকিয়ে থাকলাম।কিন্তু তার পরমুহুর্তেই আরো এক আকস্মিক ঘটনা ঘটালেন তিনি।হুট করেই এসে মেহেরাজ ভাইকে দুই হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।আব্বা বোধ হয় সেই দৃশ্য দেখে আমার থেকেও বেশি অবাক হলেন।চোখমুখে সে অবাক হওয়ার রেশ দ্রুতই জ্বলজ্বল করে ফুটে উঠল তার।

#চলবে…

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_১২
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

আব্বা বোধ হয় চোখের সামনে এমন দৃশ্য দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না।মুখভঙ্গি বিদ্ঘুটে করে তাকালেন মেহেরাজ ভাইয়ের দিকেই।সামান্তা আপু দুই হাতে ঝাপটে জড়িয়ে আছেন মেহেরাজ ভাইকে।চোখজোড়া দিয়ে অঝোরে বইছে নোনা পানি।সেই নোনা পানি মুহুর্তেই ভিজিয়ে তুলল মেহেরাজ ভাইয়ের ছাঁইরাঙ্গা টিশার্টকে।নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে সেই দৃশ্য অবলোকন করে কান্না পেল আমারও।বুকের গহীনে কষ্টরা সুপ্তভাবে জানিয় গেল তাদের উপস্থিতি।তবে সেটা সামান্তা আপুর জন্য নয়।কষ্টটা নিজের অনুভূতির পুরুষকে অন্য কেউ আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে বলে।কান্নাটা নিজের সাধের পুরুষের বুকে অন্য কারো মুখ গোঁজা দেখে।শুধু আজ নয়, যখনই আমার চোখের সামনে সামান্তা আপু মেহেরাজ ভাইকে এমন ভাবে জড়িয়ে ধরেছেন তখনই আমি এই কষ্ট অনুভব করেছি। এই রুদ্ধশ্বাস অস্থিরতা আমি টের পেয়েছি।তবুও যে কান্না করা, কষ্ট পাওয়া বারণ আমার।কারণ যেখানে অধিকার নেই সেখানে এসব শুধুমাত্র তাচ্ছিল্যেরই চিহ্ন।আমি কষ্ট দমিয়ে স্বাভাবিক থাকলাম।তাকিয়ে রইলাম সেদিক পানেই। মেহেরাজ ভাই ক্রমশ নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলেন।প্রথম ধপায় ঠান্ডা মাথায় চেষ্টা করলেও পরের ধপায় আচমকায় বলিষ্ঠ হাত জোড়া দিয়ে সামান্তা আপুকে ঠেলে দূরে সরালেন। রক্তলাল চক্ষু নিয়ে কন্ঠ কঠিন করে বলে উঠলেন,

” সামান্তা, আগেও বলেছি। এখনও বলছি, এসব কোন ধরণের বেয়াদবি?একটা মেয়ে হয়ে তোমার নিজের কোন সম্মান নেই?এভাবে নিজের মানসম্মান বিসর্জন দিয়ে বেহায়ার মতো একজন পুরুষকে জড়িয়ে ধরা কোন ধরণের সভ্যতার প্রকাশ?”

সামান্তা আপু ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠলেন মেহেরাজ ভাইয়ের ধমকে।হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলেন,

” পুরুষটা তুমি বলেই জড়িয়ে ধরেছি।বিশ্বাস করো, রাজ ভাইয়া।আমি এটা এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না যে তুমি বিয়ে করে নিয়েছো। তুমি আর আমার নেই এটা আমি মানতে পারছি না।তুমি কেমন ভালোবেসেছিলে আমায়? ভালোবাসলে তো অন্য কাউকে বিয়ে করতে না রাজ ভাইয়া।এতগুলো দিনের সম্পর্ক ভুলে গিয়ে এক মুহুর্তেই বিয়ে করে নিলে?আমায় তুমি ভালোবাসোনি রাজ ভাইয়া।কোনদিনই বাসোনি।ঠকিয়েছো।”

শেষের কথাগুলো খুব অভিমান নিয়েই বললেন সামান্তা আপু।মেহেরাজ ভাই তপ্ত শ্বাস ফেলে একবার সামান্তা আপুর মুখের দিকে চাইলেন।তারপর বলে উঠলেন,

” তোমার নিজেকে স্বাভাবিক করা উচিত সামান্তা।নিজের স্বাভাবিক জীবনে ফেরা উচিত।এসব পাগলামো করে কদিন কাঁটবে? কিই বা হবে?তার থেকে সব ভুলে যাওয়া বেটার।ভালো থাকবে। আর,আমি যদি ভালো নাই বেসে থাকি।তোমাকে যদি ঠকিয়েই থাকি তবে তোমার তো উচিত আমার কাছেপাশে আর না ঘেষা।আমাকে ঘৃণা করা উচিত।তাই না?”

সামান্তা আপু জড়ানো গলায় বলে উঠলেন,

” তুমি না বাসলেও আমি তো বেসেছিলাম। এখনও ভালোবাসি।শুধু এই কয়েক মুহুর্তের ব্যবধানে তোমার আর জ্যোতির বিয়ে হওয়াটা আমায় ভালো থাকতে দিচ্ছে না।কান্না পাচ্ছে, অসহ্য লাগছে সব।বুকের ভেতর অস্থির লাগছে।কিচ্ছু ভাল্লাগছে না আমার রাজ ভাইয়া।সব আবার আগের মতো ঠিক করে দাও না। প্লিজ। আমি তোমায় ভালোবাসি। তুমি নামক সর্বনাশা প্রেমিক আমার জীবন থেকে চলে গিয়েই বুঝিয়ে দিলে আমার জীবনে কি ভীষণ সর্বনাশ ঘটেছে। ”

মেহেরাজ ভাই পকেটে হাত গুঁটিয়ে লম্বা শ্বাস টানলেন।শান্ত গলায় বললেন,

” বিয়েটা হয়ে গিয়েছে।এটাই সত্য।মেনে নাও, নিজেকে মানিয়ে নাও। ভালো থাকবে। বাসায় যাও এখন।”

সামান্তা আপু অশ্রুভরা চোখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলেন।তারপরই তীব্র অভিমান বুকে নিয়ে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন।আমি শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবটুকুই দেখে গেলাম।একনজর আব্বার দিকে তাকাতেই দেখলাম আব্বার মুখাবয়ব কঠিন রূপ নিয়েছে।বোধ হয় দৃষ্টিটাও প্রখর।পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ফাতেমা আন্টি আর শিমা আপা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছেন।যেন কিছুক্ষন আগের দৃশ্যটা তাদের কাছে চমকপ্রদ কিছু।শিমা আপা কিছু না বললেও ফাতেমা আন্টি যেতে যেতেই মেহেরাজ ভাইকে বললেন,

” মেহেরাজ বিয়ে করেছো বললে সেদিন।বউ আছে বাসায়।বুঝলাম তোমার সাথে সামান্তার সম্পর্ক ছিল, তা বলে বিয়ের পর বউয়ের সামনেও প্রেমিকার সাথে প্রেম করাটা কেমন সভ্যতা?তোমার থেকে তো এটা আশা করা যায় না মেহেরাজ।”

কথাগুলো বলেই চলে গেলেন ফাতেমা আন্টি।মেহেরাজ ভাইয়ের মুখচোখ দেখে সুবিধার বোধ হলো না।বোধ হয় ভেতরে ভেতরে রাগে সমস্তটা জ্বলে যাচ্ছে তার।আমি ইতস্থত বোধ করে আব্বার উদ্দেশ্যে বলে উঠলাম,

” আব্বা ভেতরে আসুন না।বসুন।”

আব্বা চুপচাপ হাতে থাকা ব্যাগগুলো নিয়ে ভেতরে আসলেন।বাদবাকি বাবাদের মতোই মেয়ের শ্বশুড়বাড়িতে আসতে ব্যাগভর্তি জিনিস আনা আধৌ কতটুকু যুক্তিযুক্ত বুঝলাম না।আব্বা থম মেরে সোফায় বসে নির্বিকার ভাবে চেয়ে থাকলেন মেহেরাজ ভাইয়ের দিকে।ছোটবেলায় যখন আমার কিংবা চাচাতো ভাই বোনদের রেজাল্ট আব্বার আশানুযায়ী হতো না ঠিক তখনই আব্বা এমন করে তাকিয়ে থাকতেন। যেন অনেক আশার জিনিসই আজ তাকে অপমানে অপমানে রাঙ্গিয়ে তুলেছে।বুঝলাম বিষয়টা অবশ্যই মেহেরাজ ভাই।আব্বাসহ বাড়ির সবার কাছেই মেহেরাজ ভাই মহান।সে কারণেই বোধহয় আব্বা আশাহত হলেন।পরমুহুর্তেই আব্বা আমার দিকে তাকালেন।বরাবরের মতোই গম্ভীর গলায় বললেন,

” তুই ভালো আছিস এখানে?”

আব্বার প্রশ্নে কেন জানি না ভালো লাগা কাজ করল।বোধহয় আব্বা সচারচর এমন প্রশ্ন করেননি বলেই।মনে হলো, ইশশ!বিয়ে করলে যদি অন্যদের বাবাদের মতো আব্বাও খোঁজখবর নেয়, আমাকে অন্য বাবাদের মতোই ভালোবাসেন তবে বোধহয় আরো কয়েকবছর আগেই বিয়ে করে ফেলা উচিত ছিল।আর কিছু পাই বা না পাই, আব্বার স্নেহ তো পেতাম।নিজের অবুঝ ভাবনায় নিজেই হাসলাম আনমনে। স্বাভাবিক ভাবে বললাম,

” ভালো থাকব না কেন আব্বা?”

আব্বা আর কিছু বললেন না।থমথমে মুখ করে বসে রইলেন।আমি পা বাড়িয়ে রান্নাঘরে গেলাম।শিমা আপার রান্না শেষ। তাই আর দেরি করল না।আমি রান্নাঘরে ডুকা মাত্রই আমাকে বলে চলে গেলেন দ্রুত।আমি একপলক তাকিয়ে নাস্তার ট্রে নিয়ে নাস্তা সাঁজালাম।জানালা দিয়ে চোখে পড়ল দুপুরবেলার তীব্র রোদ। তবুও চুলায় চা বসালাম।কারণ আব্বার কাছে রোদ, বৃষ্টি লাগে না। আব্বা সবসময়ই চা খেতে পারেন। বলা যায় চা তার অত্যাধিক পছন্দ!ট্রের একপাশে চায়ের কাপ রাখতেই পেছন থেকে মেহেরাজ ভাই বললেন,

” এই দুপুরে চা করছিস? চাচা এখন চা খাবে?পাগল তুই?”

আমি ঘাড় বাকিয়ে তাকালাম।মেহেরাজ ভাই চলাফেরা করেন একদম নিঃশব্দে।কখন আসে, কখন যায় বুঝায় যায় না।এই যে এখনও উনি রান্নাঘরে কবে ডুকলেন আমি টের পাইনি।এতটা নিঃশব্দে চলা যায় কি?কে জানে!মৃদু গলায় বললাম,

” আব্বা খায়। জিজ্ঞেস করবেন আব্বাকে?”

মেহেরাজ ভাই টানটান মুখ স্বাভাবিক করে পাশে এসে দাঁড়ালেন।বললেন,

” জিজ্ঞেস করার প্রশ্নই আসে না।চাচার সামনে দাঁড়াতে পারছি না।”

” আব্বার সামনে দাঁড়াতে না পারার মতো কিছু করলে অবশ্যই দাঁড়াতে পারবেন না।আর যদি না করেন, তবে কেন… ”

বাকিটা আর বলা হলো না আমার।মেহেরাজ ভাই ঠান্ডা গলায় বলে উঠলেন,

” অপরাধবোধ হচ্ছে।”

আমি চোখ তুলে চাইলাম।চেহারা কি ভীষণ মলিন।কপালে ভাজ। মানুষটাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে।হয়তো সবদিকের চাপ সহ্য করতে করতে ক্লান্তি এসে ভর করেছে সমস্ত শরীরজুড়ে।একমুহুর্তের জন্য মায়া হলো আমার।ইচ্ছে করল হাত ছুঁইয়ে কপালে রাখি।বলি,” এতোটা ক্লান্তি আপনাকে মানায় না মেহেরাজ ভাই।” কিন্তু বলা হলো না।চায়ের পাতিলে মনোযোগ দিয়ে স্পষ্ট গলায় বললাম,

” কোন অপরাধ করেছেন আপনি?”

উনি স্পষ্ট ভাবেই উত্তর দিলেন,

” না।”

আবারও প্রশ্ন ছুড়লাম,

” তবে? ”

মেহেরাজ ভাই মলিন গলায় শুধালেন,

” উনি আমার এককালের শিক্ষক ছিলেন।উনার সামনেই পরিস্থিতিটা তৈরি হবে কখনো ভাবিনি।”

আমি তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসলাম।আব্বার কি আসলেই কিছু এসে যাবে?আব্বা কি আসলেই তার মেয়ের স্বামী অন্য কাউকে ভালোবেসে জেনে মেয়ের জীবনের জন্য অনুতপ্ত হবেন?হয়তো হবেন না।উনার কাছে আমি ছিলাম বোঝা।সে বোঝা যেখানেই যাক,যেভাবেই থাকুক, যার কাছেই যাক।উনি মুক্ত হলেই হলো।
বললাম,

” চিন্তা করবেন না মেহেরাজ ভাই।আব্বা কিছু বলবে না আপনাকে। আমার আব্বা বাকিসব আব্বাদের মতো নয় যে মেয়ের স্বামীকে অন্যকোন মেয়ের সাথে দেখে রেগে যাবে।মেয়ের সংসারের অধিকার চাইবে। আমার আব্বা ব্যাতিক্রম।দেখেননি? তখন সামান্তা আপুর সামনেও কিছু বলেননি। বললে তখনই বলে ফেলত। ”

মেহেরাজ ভাই এবার গাঢ় চাহনীতে তাকালেন আমার দিকে।বললেন,

” তোর কি অভিযোগ আছে সামান্তাকে নিয়ে?নাকি অভিমান?ও এমনই জ্যোতি।ছোটবেলায় খেলনা হারালেও নাকি এক সপ্তাহ এমন পাগলামি করত। অন্য কারো কাছে একই রকমের খেলনা দেখলেই কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করত।তুই কি কষ্ট পাস এসবে?”

আকস্মিক এই প্রশ্নে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।কষ্ট পাই কিনা?হ্যাঁ, কষ্ট তো পাই। আঘাত ও পাই।কিন্তু তা প্রকাশ করাটা কি যৌক্তিক?যৌক্তিক নয়।তাচ্ছিল্য নিয়ে হেসে বললাম,

” কষ্ট কেন পাব মেহেরাজ ভাই?প্রেমের সম্পর্ক আপনার আর সামান্তা আপুর ছিল। তাই আপনাদের কষ্ট হচ্ছে একে অপরকে ছাড়তে।আমার সাথে তো ছিল না যে অন্য একজনকে মানতে না পেরে কষ্ট পাব।”

মেহেরাজ ভাই পকেটে হাত গুঁটিয়ে বুক টানটান করে দাম্ভিক ভাব নিয়ে দাঁড়ালেন।চলে যেতে যেতে শান্তস্বরে বললেন,

” আমি তোর কন্ঠে কষ্টের আওয়াজ শুনেছি।তোর চোখে বিষাদের ছোঁয়া দেখেছি।”

তারপর চলে গেলেন।নিষ্পলকভাবে সেই চলে যাওয়ার দিকেই তাকিয়ে থাকলাম আমি।বুকের গহীন থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতেই ঠোঁট নাড়িয়ে হালকা স্বরে বলে উঠলাম,

” কষ্ট যাদের সঙ্গী তাদের কন্ঠে স্বভাবতই কষ্ট থাকতে পরে মেহেরাজ ভাই। স্বভাবতই তাদের চোখে বিষাদ ছুঁতে পারে।এটা বিশেষ কিছু নয়। ”

.

আব্বা নাস্তা ছুঁয়েও দেখলেন না।এমনকি উনার পছন্দের চাও হাত বাড়িয়ে নিলেন না।শুধু গম্ভীর গলায় বললেন,

” এসব নিয়ে যা জ্যোতি।মনমেজাজ ভালো লাগছে না।”

আমি তবুও বললাম,

” চা টা নিতে পারেন আব্বা।চা তো আ…”

বাকি কথাটা আমি বলতে পারলাম না।আব্বা তার আগেই ধমক দিয়ে কঠিন কন্ঠে বলে উঠলেন,

” কথা কানে যায় না তোর জ্যোতি?বললাম তো নিয়ে যা।”

আব্বার ধমকে চুপ হয়ে গেলাম।আব্বাকে দেখামাত্রই যে আনন্দস্রোত হৃদয়ে অনুভূত হয়েছিল তা মুহুর্তেই পরিণত হলো বিষাদ অনুভূতিতে।আব্বা ঠিক আগের মতোই আছেন।আগের মতোই আমাকে অপছন্দ করেন।আমিই হয়তো বেশি আশা করে ফেলেছিলাম।আব্বা কেন আমার খোঁজ নিতে এতদূর ছুটে আসবেন?আমি মরি, বাঁচি আব্বার কি তাতে আধৌ কিছু এসে যায়?না।ভাবতে ভাবতেই নাস্তার ট্রে নিয়ে চলে যেতে নিতেই আব্বা ফের বললেন,

” জ্যোতি শোন।”

আমি দাঁড়ালাম।পেছন ঘুরে তাকাতেই আব্বা উঠে আমার সামনে এলেন।পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে আমার হাতে গুঁজে দিয়েই বললেন,

” এখানে হাজার দশ আছে।রাখ। তোর লাগবে।প্রতিমাসে এসে দিয়ে যাব আমি হাতখরচ।”

আমি অবাক হলাম না।আব্বা বরাবরই এই দায়িত্ব বেশ দক্ষভাবে পালন করে এসেছেন।গ্রামের বাড়িতে থাকাকালীনও পালন করেছেন।একমুহুর্তের জন্য মনে হলো টাকাগুলো আসলেই নেওয়া উচিত।অন্তত মেহেরাজ ভাইয়ের ঘাড়ে বোঝা হয়ে থাকার থেকে আব্বার কাছ থেকে টাকা নেওয়া খারাপ কিছু নয়।আব্বার সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক।আর মেহেরাজ ভাইয়ের সাথে স্বল্পদিনের একটা বাধ্যগত সম্পর্ক।দুদিনের সেই সম্পর্কের জেরে মেহেরাজ ভাইয়ের কাছে হাত পাতাটা ব্যাপক লজ্জ্বাজনক বিষয়।আমি টাকাগুলো নিলাম।জিজ্ঞেস করলাম,

” এইজন্যই এসেছিলেন আব্বা?”

আব্বা উত্তর দিলেন,

” হ্যাঁ। আবার চলে যাব। ”

আমি আর দাঁড়ালাম না। পা চালিয়ে ট্রে টা নিয়ে ফের রান্নাঘরে আসলাম। ভেবেছিলাম আব্বা আমার খোঁজ নিতে এসেছেন।আমি কেমন আছি তা দেখতে এসেছেন।আমার ভাবনা ভুল।আমি স্থির হয়ে স্বাভাবিক চাহনী ফেললাম জ্বলন্ত চুলায়। বসার ঘর থেকে মেহেরাজ ভাইয়ের গলা ঝাড়ার আওয়াজ পেলাম। মুহুর্তেই কান খাড়া হলো।মেহেরাজ ভাই বলতে লাগলেন,

” চাচা, আমার আর জ্যোতির বিয়েটা আকস্মিকভাবেই হয়েছিল। এটা তো আপনার জানাই ছিল। জ্যোতির সাথে যে আমার বিয়ের আগে থেকে সম্পর্ক ছিল এমন নয়।মিথ্যে বলব না, সামান্তার সাথে আমার সম্পর্ক ছিল।দীর্ঘ চারবছরের।জ্যোতির সাথে বিয়েটা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃতই হয়েছিল।আর সামান্তা সে বিয়েটাই বোধ হয় মেনে নিতে পারে নি।সেদিনের পর থেকেই ও এমনই হয়ে আছে।তখনকার আকস্মিক জড়িয়ে ধরাটাও ওর পাগলামো ব্যাতীত কিছু নয়।আমি ছোট চাচাকে জানিয়েছি বিষয়টা।আমার মনে হলো সত্য না লুকিয়ে আপনাকে বলে ফেলাটাই বেটার হবে। তাই বলে দিলাম চাচা।”

কথাগুলো শুনেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আব্বার দিকে চাইলাম।আব্বার চাহনী তখনও থমথমে।কি বুঝেই উঠে দাঁড়ালেন আব্বা।তারপর মেহেরাজ ভাই আর আমাকে বলেই বিদায় নিলেন। আমি আগ বাড়িয়ে কিছু না বললেও মেহেরাজ ভাই আটকালেন। তবুও আব্বা থাকলেন না।চলে গেলেন।

#চলবে….

এক মুঠো প্রণয় পর্ব-১০

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_১০
লেখনীতেঃএকান্তিকা নাথ

কাঁটল আরো ছয় ছয়টাদিন।মেহেরাজ ভাইকে এখন আর অগোছাল চুল, রাঙ্গা চোখ নিয়ে দুঃখ যাপন করতে দেখি না।বুদ্ধিমান মানুষরা বোধ হয় দুঃখকে দীর্ঘস্থায়ী না করে স্বল্পমেয়াদী রাখতেই ভালোবাসে।যেমনটা মেহেরাজ ভাই।নিজের পরিপাটি রূপে ফিরতে দেরি হলো না তার।কিন্তু যতোটা পরিপাটি তার বাহিরের রূপ দেখাচ্ছে ততোটাই পরিপাটি আছে কি উনার অন্তরের রূপও?আমি নিশ্চিত উনার ভেতরটা অতোটা পরিপাটি নেই।দুঃখ যাপন না করলেও দুঃখ আগলে রাখার বিষয়টা বোধহয় উনার সাথে আমার মিল আছে বলেই এই বিষয়টা আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারলাম।অন্যদিকে সামান্তা আপুর পাগলামো ক্রমশ বাড়ল।ক্রমশ বেসামাল হয়ে উঠল একুইশ বছর বয়সী মেয়েটা।আবেগ, অনুভূতিকে সামলাতে না পেরে প্রায়সই ছুটে আসেন মেহেরাজ ভাইয়ের কাছে।নিজের ভেতরের দুঃখ গুলো উগড়ে দিয়ে ঝাপটে ধরেন নিজের শখের পুরুষকে।কখনো বা হাউমাউ করে কান্না করে উঠেন।এতসব কিছুর পরও মেহেরাজ ভাইয়ের প্রতিক্রিয়া শূণ্য!এতটা কঠিন হয়ে থাকা যায় নিজেরই শখের নারীর দুঃখে?হয়তো থাকা যায়।যদি সেখানে মেহেরাজ ভাই থাকে তবে বোধ হয় অবশ্যই থাকা যায়।কারণ মেহেরাজ ভাইকে কখনো নিজের দায়িত্বের উর্ধ্বে গিয়ে আবেগ-অনু়ভূতিতে গা ভাসাতে দেখিনি।দুইজন যেন সম্পূর্ণ দুরকম।এই দুইজন মানুষের সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম বিষয়গুলোও আমি খেয়াল করেছি এই কয়দিনে।সঙ্গে খেয়াল করেছি নিজের পরিবর্তনও।কেমন জানি একাকীত্বে ক্রমশ ডুবে মরছি আমি।বাড়িতে আর যায় হোক দাদীর সঙ্গ পেতাম, দাদীর সাথে মন খুলে কথা বলা হতো।কিন্তু এখানে কিছুই নেই।কেউই নেই। নিজের আপন মানুষের খুব অভাব বোধ করতে লাগলাম ক্রমশ।মেহু আপু,মেহেরাজ ভাই এদের সাথে কথা হয় মাঝে মাঝে তাও টুকটাক কথাবার্তা।সকালের দিকে দুইজনই বেরিয়ে যায়।তারপর আমি পুরোপুরি একা এই বাসায়।মাঝে শিমা আপার সাথে যদিও কথা হয় তাও অল্পক্ষনের জন্য। সন্ধ্যায় মেহু আপু ফিরলেও দুয়েকটা কথা বলেই ঘুম দেয়।আমি অবশ্য আগ বাড়িয়ে কথা বলার সময় চাই না ।আর মেহেরাজ ভাইয়ের সাথে কথা তখনই হয় যখন উনিই আগ বাড়িয়ে কথা বলেন।কেন জানি না উনার সাথে নিজ থেকে কথা বলা হয়ে উঠে না।তবে এই কয়দিনে সাঈদ ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছে।ভেবে দেখলাম শিমা আপা আর সাঈদ ভাইয়ের সাথেই যা কথা হওয়ার হয় আমার।বাকিটা সময় আমি একা।সম্পূর্ণ একা। আনমনে ভাবলাম গত ছয়দিনের ঘটনা।মেহেরাজ ভাইয়ের স্বাভাবিক রূপ, সামান্তা আপুর পাগলামো সবটা।তারপর অন্যমনস্ক ভাবেই ঘড়ির দিকে তাকালাম।রাত প্রায় সাড়ে বারোটা।অথচ সেই সন্ধ্যায় বই নিয়ে বসেও আমার এখনো কিছুই পড়া হয়নি।অতিরিক্ত ভাবনা আমায় ঘিরে ধরেছে আজকাল।কি ভাবছি, কি চিন্তা করছি তা বোধহয় আমার নিজেরই নিয়ন্ত্রনে নেই।খেয়াল করেছি আজকাল ঘুমোতে গেলেও ঘুম হয়না।সর্বক্ষন আমি কিছু ভাবছিই কেবল।শুধুই ভাবছি।কিন্তু কিসের এত ভাবনা?এসব ভাবনার আড়ালে কি আমি আমার জীবনের উদ্দেশ্যটা হারিয়ে ফেলছি?বিষয়টা ভেবেই আমি আৎকে উঠলাম।আমার জীবনের উদ্দেশ্য তো কখনোই মেহেরাজ ভাই ছিল না।তবে কেন তার বিষয়ে এত ভাবছি?তাকে নিয়ে কি ঘটছে তা নিয়েও বা কেন ভাবছি?আমি চোখ বন্ধ করলাম।জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে চোখ মেলে তাকাতেই বাটন ফোনটা বেঁজে উঠল আওয়াজ তুলে।ক্ষীণ চোখে চেয়ে মিনার ভাইয়ের নাম্বারটা দেখলাম।বিকালে কল দিয়েছিলাম আমি।কিন্তু মিনার ভাই নাকি তার কোন এক বন্ধুর বিয়েতে গিয়েছেন তাই আর দাদীর সাথে কথা বলা হয়ে উঠিনি।বলেছিলাম বাড়ি গিয়ে কল করতে।এখন হয়তো বাড়ি ফিরেই কল দিয়েছেন।আমি কল তুললাম।কানে নিয়ে বললাম,

” আসসালামুআলাইকুম মিনার ভাই।কেমন আছো?”

মিনার ভাই ওপাশ থেকে ব্যস্ততা দেখিয়ে বলে উঠলেন,

” তখন বিয়েবাড়িতে ছিলামরে জ্যোতি।মাত্রই ফিরলাম বাড়িতে।দাদীর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।তুই তখন বললি বাড়ি এসে কল করতে। কিন্তু দাদী তো ঘুমাচ্ছে।ডাকব?”

আমি ছোট্টশ্বাস ফেললাম।খেয়াল করেছি মিনার ভাই পাল্টে যাচ্ছেন ক্রমশ।তাকে কেমন আছে জিজ্ঞেস করলে কিছু না কিছু বলে সে প্রশ্নকে সুকৌশলে এড়িয়ে যায়।উত্তর দেয় না।কিন্তু কেন?কেমন আছে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কি খুব কঠিন নাকি?কে জানে।মৃদু গলায় বললাম,

” লাগবে না মিনার ভাই। পারলে কাল সকালে দাদী উঠলে একবার কল দিও।তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি শুধু শুধু।”

মিনার ভাই পাল্টা উত্তরে বলল,

” কি বললি?”

” কিছু নয় মিনার ভাই।এতরাতে বাড়ি ফিরলে। ক্লান্ত নিশ্চয়। ঘুমাও গিয়ে। ”

মিনার ভাই চুপ থাকলেন কয়েক সেকেন্ড।তারপর ভরাট গলায় বলে উঠলেন,

” আজকাল চোখে ঘুম নামে না রে।”

কথাটার মধ্যে কি ছিল কিজানি। আমার মন খারাপ হলো।চারদিকে সবার কেবল মন খারাপ।সবার জীবনে কেবল বিষাদের অস্তিত্ব।মিনার ভাইকেও কি বিষাদ ছুঁয়ে গিয়েছে?হয়তো।নাহলে তো এভাবে বলত না সে।কেন জানি না আমি তার বিষাদ জানার জন্য আগ্রহ দেখালাম না।তার বিষাদ লাঘবের জন্য সহানুভূতিও দেখানো হলো না।তার আগেই কল রেখে দিলেন মিনার ভাই।আমি চেয়ারে বসে চোখ বুঝলাম আবারও। এত এত বিষাদের মাঝে কেমন জানি দমবন্ধ অনুভব হলো।ঠিক তখনই মেহেরাজ ভাইয়ের গম্ভীর স্বর আমার কানে পৌঁছাল,

” না পড়ে এত রাতে কার সাথে কথা বলছিলি জ্যোতি?”

হঠাৎ মেহেরাজ ভাইয়ের গলা শুনেই বিস্মিত হয়ে চোখ মেলে চাইলাম।দেখলাম দরজার দ্বারে পানির বোতল হাতে নিয়ে মেহেরাজ ভাই দাঁড়িয়ে আছেন।রাত প্রায় সাড়ে বারোটা।ঘরের আলো জ্বালিয়ে পড়ছিলাম বলে আর দরজা ও লাগানো হয়নি।মেহেরাজ ভাই কি দরজায় দাঁড়িয়ে আমার আর মিনার ভাইয়ের কলে কথা বলাটা লক্ষ্য করেছেন?করলেও বা কি?নিজেকে স্থির করে স্পষ্ট গলায় উত্তর দিলাম,

” মিনার ভাইয়ের সাথে।”

মেহেরাজ ভাই মাথা নাড়ালেন।পরমুহুর্তেই বললেন,

” পড়ালেখা ঠিকঠাক মতো হচ্ছে তোর?পরিবেশ কিংবা পরিস্থিতি তোর পড়ালেখায় প্রভাব ফেলছে না তো জ্যোতি?যদি তেমনটা হয় আমায় জানাবি।”

আমি আগের মতোই স্বাভাবিক থাকলাম।কয়েক মুহুর্ত চুপ থেকে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজালাম।উত্তরে বলে উঠলাম,

” পরিবেশ পরিস্থিতি তো কতকিছুতেই প্রভাব ফেলল মেহেরাজ ভাই।শুধু কি পড়ালেখাতেই?আমার জীবনেও মস্ত বড় প্রভাব পড়ে নি?”

মেহেরাজ প্রগাঢ় দৃষ্টিতে চাইলেন আমার দিকে।গম্ভীর কন্ঠে উত্তর দিলেন,

” সেই প্রভাবের জন্য জীবন থামিয়ে রাখাটা বোকামো।পরিবেশ কিংবা পরিস্থিতির প্রভাবে প্রভাবিত না হয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখাটাই বুদ্ধির কাজ।আই হোপ তুই থেমে থাকবি না।রাইট?”

আমি হাসলাম।তাচ্ছিল্যের হাসি।আমি কোনকালেই বা থামতে পেরেছি?কোনকালেই বা দুঃখ দেখিয়েছি?জীবন আমায় একরাশ অস্বাভাবিকতার মাঝে মিশিয়ে দেওয়া স্বত্ত্বেও আমাকে প্রতিনিয়ত স্বাভাবিক থাকতে হয়েছে।ছোটবেলায় মা যখন ছেড়ে গেল তখনও।নয় বছর বয়সে যখন মিথিকে হারালাম তখনও।ষোড়শী বয়সে যখন এক যুবকের সামনে অজান্তেই নিজের অনুভূতি জানান পেয়ে অপমানিত হতে হলো তখনও।অবশেষে আজও!এত বেশি স্বাভাবিক থাকতে থাকতে আজ যেন হাঁপিয়ে উঠেছি আমি।অস্ফুট স্বরে কঠিন গলায় বললাম,

” পরিস্থিতিটা আপনার জন্য মেহেরাজ ভাই।নাহলে আজ আমি অন্তত এইটুকু হলেও ভালো থাকতাম দাদীর সাথে।শহুরে যান্ত্রিকতায় পিষে যেতাম না আমি।”

মেহেরাজ ভাই ভ্রুঁ কুঁচকে নিলেন।প্রশ্ন করলেন,

” তোকে তো জোর করে আনা হয়নি জ্যোতি।জিজ্ঞেস করেছিলাম তো?”

আমি আগের মতোই কঠিন গলায় উত্তর দিলাম,

” ওটা জোর না হোক, সম্মতিও বলা যায় না।”

মেহেরাজ ভাই যেন আমার কথাকে বিশেষ গুরুত্ব দিলেন না।শান্তস্বরে বললেন,

” এক্ষেত্রে তোর আমার কারোরই সম্মতি নেই,ছিল না।”

” বাধ্য হয়ে আমাকে আপনাদের বাসায় আনার তো প্রয়োজন ছিল না মেহেরাজ ভাই।সত্যি বলছি, এখানে আসার পর আমার দমবন্ধ অনুভব হচ্ছে।কেন অনুভব হচ্ছে তা আমার জানা নেই।সেদিন আপনি বিয়েটা না করলেই সব ঠিক থাকত।সবটা!”

মেহেরাজ ভাই মুহুর্তেই প্রশ্ন ছুড়লেন,

” তোর কি মনে হচ্ছে বিয়েটা আমি নিজ ইচ্ছায় করেছি?কিংবা তোকে দমবন্ধ করে মেরে ফেলার জন্য প্ল্যান করে বিয়ে করেছি?”

আমার ভেতরের স্বত্ত্বা রাগে রাগান্বিত হলো।নিজের চোখের সামনে অপ্রিয় মানুষটার সাথে কথা বাড়ানোর আর বিন্দুমাত্রও ইচ্ছে জাগল না।শুধু জানব, উনিই দায়ী।কেবল উনিই।উনি চাইলেই আমাকে বুঝতে পারতেন, আমার পরিস্থিতিটা বুঝতে পারতেন।উনি বুঝলেন না।উল্টো আমাকেই চাপা কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ছেন।আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিলাম,

” জানি না।শুধু জানি আজ আমার জীবনের এই হাল আপনার জন্যই মেহেরাজ ভাই।আমি মুক্ত থাকতে চাইছি, শুধুই মুক্তি চাইছি এসবের থেকে।”

মেহেরাজ ভাইয়ের দৃষ্টি এবার লালাভ হলো যেন।শীতল চাহনীতে আমার মুখে তাকিয়েই শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে বলে উঠলেন,

” মুক্ত হতে হলে সেভাবে নিজেকে গড়ে নে। তখন না তো সমাজ তোকে আটকাবে, আর না তো তোর কিংবা আমার পরিবার।এমনকি আমিও না। আর হ্যাঁ,এই পরিস্থিতির জন্য আমাকে দায়ী করা বন্ধ কর জ্যোতি।”

কথাগুলো বলেই মেহেরাজ ভাই আর দাঁড়ালেন না।আমি কথাগুলো শ্রবন করেই জ্বলজ্বল চাহনীতে তাকিয়ে থাকলাম।মুহুর্তেই অনুভব করলাম আমার ভেতরের স্বত্ত্বা জাগ্রত হয়ে তেজ ছড়াল।মেহেরাজ ভাই কি আমাকে অবজ্ঞা করেই বাক্যগুলো বলে গেলেন? ঠিক যেভাবে ষোড়শী বয়সে অবজ্ঞা করেছিলেন?মাথার মধ্যে ধপধপ করল।দুইজন পুরুষের প্রতি ক্ষনিকেই জেদ চাপল।প্রথম জন হলো আমার আব্বা, দ্বিতীয়জন হলো মেহেরাজ ভাই।

.

রাত হলো।প্রায় নয়টার ঘর ছুঁয়ে গেল।অথচ সাঈদ ভাই আজ পড়াতে আসলেন না।অন্যদিন আটটায় এসেই হাজির হন।আজ আসলেন না।টেবিল চেয়ারে বসে বসে বইয়ে মনোযোগ দিয়েছিলাম।তখনই মেহু আপু ঘুমুঘুমু চোখে সামনে এসে দাঁড়ালেন।বুঝলাম, উনি মাত্রই ঘুম ছেড়ে উঠেছেন।মেহেরাজ ভাইকেও কিছুক্ষন আগে বাসায় ডুকতে দেখেছিলাম।বোধ হয় নিজের ঘরেই আছেন।আমি মেহু আপুর দিকে তাকালাম।কিছু বলার আগেই আপু বলে উঠল,

” আজ বোধহয় সাঈদ ভাইয়া আসবে না।চল ছাদে যাই।লুডু খেলব। নাবিলা, তুই, সামান্তা আর আমি।সামান্তার মনও ভালো থাকবে বল?”

আমি সংকোচ বোধ করলাম।আমি গেলে সামান্তা আপুর প্রতিক্রিয়া কেমন হবে?এই কয়দিনে ঠিক বুঝেছি সামান্তা আপু মুখে না বললেও আমাকে তিনি খুব একটা পছন্দ করেন না।কিংবা আমাকে দেখলেই তার মুখ বিষাদে কালচে রূপ ধারণ করেন।এইটুকু বুঝেই মেহু আপুর প্রস্তাব নাকোচ করে বললাম,

” না আপু, পড়া আছে।পরে একদিন না হয় খেলব?”

আপু আমার কথা শুনলেন না।টেনেটুনে নিয় শেষ পর্যন্ত রাজি করিয়ে নিয়েই গেলেন।আপুর এই দিকটা ভালো।পাঁচ মিনিট সময়ও যদি মিশেন ঐ পাঁচ মিনিটই মনে হবে উনি আমাকে অনেক বেশি আপন ভাবেন।আমি ধীরে ধীরে মেহু আপুর পিছু পিছু ছাদে গেলাম।মুহুর্তেই ছাদে লুডুর আসর জমল।নাবিলা, আমি,সামান্তা আপু আর মেহু আপু। সামান্তা আপুর মানসিক অবস্থা সামাল দিতেই এই প্রচেষ্টা।আজকাল আর সামান্তা আপুকে একা কোথাও ছাড়াও হয় না।এমনকি রাতেও উনার সাথে নাবিলা গিয়ে ঘুমায়।ধীরে ধীরে এই বিষয়টা দৃষ্টিকটু ঠেকল সবার চোখে।মেহেরাজ ভাইয়ের চাচা, চাচীসহ মোটামুটি সকলেরই জানা হয়ে গেল তাদের কঠিন প্রেমের কথা।এতকিছুর পরও মেহেরাজ ভাই স্বাভাবিক।যেন কিছুই ঘটেনি তার জীবনে।কিছুই হারায় নি সে।বিপরীতে সামান্তা আপু ততোটাই অস্বাভাবিক।লুডু খেলার একপর্যায়েই সামান্তা আপুর একটা গুঁটি কাঁটা পড়ল।তাও আমার গুঁটির চালেই।সামান্তা আপু সঙ্গে সঙ্গেই কেঁদে দিলেন ছোট বাচ্চাদের মতো।চোখ বড়বড় করে আমার দিকে তাকিয়েই ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা চালালেন।আমি অবাক হলাম।সামান্য একটা গুঁটি কাঁটার জন্যই কি উনি বাচ্চাদের মতো করে কাঁদছেন এভাবে?প্রথম বুঝতে না পারলেও পরমুহুর্তেই সামান্তা আপুর কথায় স্পষ্ট বুঝে উঠলাম।সামান্তা আপু অস্ফুট স্বরে বললেন,

” এই লুডু খেলাটাও বুঝিয়ে দিচ্ছে আমি তোমার কাছে পরাজিত।আমি হেরে যাচ্ছি জ্যোতি।কেন জানি না, আমি তোমায় সহ্য করতে পারছি না।প্লিজ, আমায় শান্তি দাও জ্যোতি।আমার শান্তি এভাবে দিনের পর দিন কেড়ে নিচ্ছো কেন জ্যোতি?”

আমি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম।এমনিতেও ছাদে এসে লুডু খেলার খুব একটা ইচ্ছে আমার ছিল না।মেহু আপুই জোর করে টেনে এনেছিলেন।কিন্তু আমার উপস্থিতিতে যে অন্য কারোর এতটা কষ্ট হবে জানতে পারলে কখনোই আসতাম না আমি।কিংবা, আমি কারো শান্তি কেড়ে নিচ্ছি এটা জানলেও আসতাম না।ছোট্টশ্বাস ফেলে দ্রুত উঠে দাঁড়ালাম।হালকা হেসে বলে উঠলাম,

” আমি দুঃখিত আপু।ভীষণ ভাবে দুঃখিত।আপনি প্লিজ কাঁদবেন না।আপনার শান্তি আপনারই হোক আপু।আমি কোন হস্তক্ষেপ করব না।আমায় অপরাধী ভাববেন না আপু।”

কথা গুলো বলেই দ্রুত পায়ে ছাদ থেকে নেমে বাসায় আসলাম।একটা মেয়ের কষ্টের জন্য সে সম্পূর্ণ ভাবে আমাকে দোষীভাবে বিষয়টা ভাবতেই মন খারাপ হলো আবারও।আমি কি সত্যিই উনার শান্তি কেড়ে নিচ্ছি?আমার চোখ টলমল করল।ধীর পায়ে রুমে ডুকতেই চোখে পড়ল চেয়ারে বসে থাকা সাঈদ ভাইয়ের দিকে।আমি অবাক হলাম। ভেবেই নিয়েছিলাম উনি আসবেন না।এখন পড়াতে আসবেন তা আশাও করিনি।মুহুর্তেই টলমল করে উঠা চোখ জোড়াকে স্বাভাবিক করার জন্য অন্যদিকে তাকালাম। সাঈদ ভাই বোধ হয় হাসলেন।বলে উঠলেন,

” বোকা মেয়ে, কান্না পেলে কেঁদে নিতে হয়।জানো না?আপন মানুষদের সামনে কান্না লুকোতে হয় না।”

আমার কান্নারা এবার আরো অগ্রসর হলো। আমি প্রাণপন কান্না আটকানোর চেষ্টা চালিয়ে চোখ লাল করে চাইলাম। বললাম,

” এই শহরে আমার কোন আপন মানুষ নেই সাঈদ ভাই।যারা ছিল তাদের রেখে এসেছি বাড়িতে। আর এখানে যারা আছে তারা সবাই আমার পরমানুষ।”

সাঈদ ভাই অমায়িকভাবে হাসলেন।উত্তরে বললেন,

” এই কয়টা দিনে তোমার সাথে এত ভালোভাবে মিশলাম।টিচারের মতো এইটুকুও বিহেভ না করে একদম ভাইবোনের মতো খুনসুটিময় সম্পর্ক গড়ে তুললাম। আর তুমি বলছো আপন নয়?”

সাঈদ ভাইয়ের কথা শুনে বলতে ইচ্ছে করল, ” যাদের আপন মানুষের সংখ্যা কম থাকে, কিংবা আপন মানুষদের হারিয়ে ফেলার অভ্যাস থাকে তারা পুনরায় কাউকে আপন ভাবতে ভয় পায় সাঈদ ভাই।তারা খুব সহজেই আর কাউকে আপন ভাবতে পারে না।” কিন্তু বলতে পারলাম না।চোখমুখ স্বাভাবিক করে ঘনঘন শ্বাস ফেললাম কেবল।উনি আবারও বলে উঠলেন,

” আমি তোমায় আপন ভাবলাম জ্যোতি।ভাবলাম তুমি আমার বোন, এবার তোমার দিক থেকে কি আমাকে আপন ভাবতে সংকোচ আছে?আপন ভাবা যায় কি এই মেয়েবাজ ছেলেটাকে?”

সাঈদ ভাইয়ের কন্ঠ শুনে যেন আমি খুশি হলাম।কিন্তু সে খুশিটা দেখানো গেল না।মনে মনে বোধ হয় এই যান্ত্রিক শহরে আমিও কোন আপন মানুষ খুঁজছিলাম।কিন্তু আপন মানুষ পাওয়ার সেই খুশিটুকু প্রকাশ না করেই বললাম,

” যায়।”

” বেশ!তবে আমার বোনটার মন খারাপ হলো কেন?কেউ কিছু বলেছে?”

এড়িয়ে গিয়ে বললাম,

” না, এমনিতেই।পড়াবেন না আজ? ”

পড়ানোর অযুহাত দিয়ে কাঁটিয়ে গেলাম সেই মন খারাপের প্রশ্নকে।কাঁটিয়ে গেলাম আস্ত এক বিষন্নতাকে।সাঈদ ভাইও অবশ্য দ্বিতীয়বার আর প্রশ্ন করলেন না।তবে পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে ধীরে ধীরে আমার মন ভালো করে দিলেন ঠিকই।আমি হাসলাম।সত্যিই সাঈদ ভাই প্রাণবন্ত!এমন একটা ভাই পাওয়া গেলে খারাপ হয় না।

#চলবে….

এক মুঠো প্রণয় পর্ব-০৯

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_০৯
লেখনীতেঃএকান্তিকা নাথ

মেহেরাজ ভাই পুনরায় সেই থলেভর্তি চিঠিগুলো নিয়ে ফেরত আসলেন।এদিক সেদিক তাকিয়েই বসার ঘরে ঠাঁই বসে থাকা আমার দিকে চাইলেন একবার।গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন,

” জ্যোতি?লাইটার আছে না রান্নাঘরে?এনে দে তে।”

আমি সচেতন হয়ে চাইলাম।লাইটার চাইলেন কেন উনি?তবে কি সব চিঠিগুলো পুড়িয়ে দিবেন উনি? এতদিনের প্রেমপত্র, এতদিনের স্মৃতি পুড়িয়ে ছাঁই বানাবেন?বিস্মিত হলাম।উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,

” কেন?”

মেহেরাজ ভাই নিজের দাম্ভিকতা বজায় রেখে গম্ভীর গলায় শুধালেন,

” প্রয়োজন ছিল।দিতে পারবি না?”

আমি উত্তর দিলাম না।পা বাড়িয়ে রান্নাঘরে গেলাম।তারপর লাইটারটা এনে উনার হাতে দিতেই উনি ধুপধাপ পা ফেলে বেরিয়ে গেলেন।আকস্মিক আমার কি হলো বুঝলাম না।কৌতুহল নিয়ে চাইলাম উনি কোথায় যাচ্ছে।তারপর কি বুঝেই উনার পিছু পিছু ছাদ অব্ধি গেলাম। মেহেরাজ ভাই আমাকে তার পিছু পিছু দেখে বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখাল না।নির্লিপ্ত চাহনীতে একবার তাকিয়েই ঝুঁকে গিয়ে ছাদের খসখসে ফ্লোরে থলেটা রাখলেন।তারপর হাঁটু গেড়ে বসলেন তার পাশে।একে একে থলেটা থেকে সমস্ত ছবি, সমস্ত চিঠি,সমস্ত চিরকুট আর হাজারখানেক শুকনো ফুল বের করে স্তূপ জমালেন।দেরি না করে মুহুর্তেই আগুনের কমলা শিখায় জ্বালিয়ে দিলেন সেই স্তূপ।আমি নির্বিকার হয়ে চেয়ে থেকে সমস্তটা পর্যবেক্ষন করছিলাম কেবল।চোখের সামনে তাদের এতবছরের প্রণয়ী স্মৃতির বিনাশ দেখে আৎকে উঠলাম।মেহেরাজ ভাই বরাবরই কঠিন। তাই বলে এতটাই কঠিন যে প্রেয়সীর প্রণয়ী স্মৃতি মুঁছে দিতেও দুবার ভাবলেন না?কই, আমি তো পারিনি।মেহেরাজ ভাইয়ের প্রতি তীব্র ঘৃণা রেখেও আমি মেহেরাজ ভাইকে নিয়ে লেখা ডায়েরীটা পুড়িয়ে ফেলতে পারিনি।মুঁছে দিতে পারিনি সেই প্রথম অনুভূতির অস্তিত্ব!আমি তাকালাম।বারকয়েক পলক ফেলে অস্ফুট স্বরে বলে উঠলাম,

” পুড়িয়ে দিলেন ওসব?”

মেহেরাজ ভাইয়ের মুখ আগের মতোই টানটান।জ্বলন্ত অগ্নিশিখার দিকে স্থির চোখে চেয়ে থাকলেন।ঠোঁট নাড়িয়ে শান্ত স্বরে উত্তর দিলেন,

” স্মৃতি মানুষকে পোড়ায় জ্যোতি।যে স্মৃতি বহন করে সুখ কুড়ানো যায়না সেই বিষাদ স্মৃতি ধ্বংস করে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।”

আমি ক্ষীণ দৃষ্টিতে তাকালাম।মেহেরাজ ভাই কঠিন এটা আমার জানা ছিল।জীবনের এই পর্যন্ত কখনো উনাকে আবেগে গা ভাসাতে দেখিনি।অনুভূতিতে পা পিঁছলে যেতে দেখিনি।কিন্তু তাই বলে এতটা স্বার্থপর হওয়া আসলেই উচিত?যে মেয়েটা তার সমস্তটা দিয়ে ভালোবাসল উনাকে সে আজ কেবল উনার কাছে এক বিষাদের স্মৃতি?কেবলই?সেটুকু হলেও বোধহয় ঠিক ছিল।কিন্তু উনি তো সেই মেয়েটার সমস্ত পাগলামো, সমস্ত ভালোবাসাময় স্মৃতি একমুহুর্তে পুড়িয়ে দিতেও দুবার ভাবলেন না।এতটা কঠোর তার হৃদয়?অবশ্য উনার হৃদয়ে যদি আবেগ অনুভূতির মূল্য থাকতোই তবে কি ষোড়শী এক কিশোরীর পায়ে কাঁচের টুকোরোর আঘাত হেনে রক্তরাঙ্গা করতে পারত পুকুরের সিঁড়ি?যদি উনার হৃদয় কঠোরই না হতো তবে কি এক যুবতী মেয়েকে তার চরিত্রের অপমানে ডুবিয়ে একঝাক লোকের মাঝে রেখে নিশ্চিন্তে চলে যেতে পারতেন?কথাগুলো ভেবেই উনার প্রতি একরাশ তাচ্ছিল্য এসে ভর করল ক্ষনিকে।সত্যিই উনি স্বার্থপর!আমার দেখা সবথেকে সার্থপর মানুষ!ঠোঁট চেপে বলেও ফেললাম কথাটা,

” আপনি অনেকটা স্বার্থপর মেহেরাজ ভাই।সুখ কুড়ানোর আশায় মুহুর্তেই ভুলে গেলেন সব স্মৃতি?আপনার কাছে কেবল নিজের ভালো থাকার মূল্যটাই সব?”

মেহেরাজ ভাই একদম শান্ত চাহনীতে চাইলেন আমার দিকে।আমি চমকে গেলাম সেই চাহনীতে চোখ রেখে।কি ভীষণ লাল টকটকে চোখজোড়া।আর কি ভীষণ শান্ত, স্থির চাহনী।উনি বললেন,

” তুই বোকা জ্যোতি।স্মৃতির আড়ালেও স্মৃতি থাকে।ভালোবাসার আড়ালেও ভালোবাসা থাকে।সব যে প্রকাশ করা যায় তেমন নয়।আমি প্রকাশ্যের স্মৃতিগুলো মুঁছে দিলাম জীবন থেকে, গোপণ রাখা স্মৃতিগুলো মন থেকে মুঁছে ফেলা কি এত সহজ?কেউ কি পারে মনের স্মৃতি নিজ থেকে মুঁছতে?”

আমি নির্বিকার তাকিয়েই থেকে স্পষ্ট গলায় বলে উঠলাম মুহুর্তে,

” যে স্মৃতি মন থেকে মোঁছা যায় না, সেই স্মৃতি বাস্তবে মুঁছে দিয়ে আপনি সুখের আশা রাখছেন। এটা বোকামো নয়?যদি মনের মধ্যে সেই স্মৃতি না থাকত তবে বোধ হয় পারতেন।”

মেহেরাজ ভাই দৃষ্টি সরালেন।ভরাট গলায় শুধালেন,

” আমি কখনো কোনকিছু নিয়ে আশা রাখি না।এখনও আশা নেই কোন কিছু নিয়ে।স্মৃতিগুলো পুড়িয়ে দিয়েছি কারণ এসবের এখন আর কোন অস্তিত্ব নেই।অস্তিত্বহীন জিনিস আবর্জনা ব্যাতীত আর কিছুই নয় আমার কাছে।”

“সামান্তা আপুও আপনার কাছে আবর্জনা? উনার তো কোন দোষ নেই মেহেরাজ ভাই।এমনিতেই কষ্ট পাচ্ছে, আরো পাবে।”

” পাওয়া উচিত।ভালোবাসলে বিশ্বাস থাকতে হয়।যেখানে বিশ্বাস থাকে না সেখানে ভালোবাসা ঠুনকো।ও আমাকে পুরোপুরি না জেনেই ভালোবেসেছে।আরনপুরোপুরি না জেনেই ভালোবাসা হারিয়েছে। সবটা ওর জন্যই।সেক্ষেত্রে কষ্ট পাওয়া দোষের কিছু নয়।”

প্রিয় মানুষের কষ্ট দেখে ও কিছুই যায় আসে না উনার?আধো কি এতটা কঠিন উনি ভালোবাসার দিক দিয়ে?নাকি সবটা উগড়ানো কথা?আমি বুঝে উঠলাম না।তাচ্ছিল্য নিয়ে আবারও বললাম,

” আপনি সত্যিই ভীষণ স্বার্থপর মানুষ মেহেরাজ ভাই।”

” জীবনে কখনো কাউকে কঠিনভাবে ভালোবেসেছিস জ্যোতি?কঠিনভাবে ভালোবাসলে বুঝবি , সে মানুষটাকে পাওয়াটাই মুখ্য নয়।সে মানুষটা ভালো থাকুক এটাই মুখ্য।আর তার জন্য যদি স্বার্থপরও হতে হয় তবে স্বার্থপর হওয়াটা অনুচিত নয়।”

আকস্মিক উত্তরে আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।জীবনে কঠিনভাবে ভালোবেসেছি কিনা কাউকে প্রশ্নটা মস্তিষ্কে ছুড়ে দিতেই উত্তর এল, হ্যাঁ।ভালোবেসেছি। ভালোবেসেছি বলেই তাকে ঘৃণায় বেঁধেছি।ভালোবেসেছি বলেই শ্রদ্ধা করেছিলাম ।ভালোবেসেছি বলেই তার স্বার্থপরতা মানতেও আমার হৃদয়ে বাঁধল।কিন্তু আমার ভালোবাসা কি কঠিন ভালোবাসা?হয়তো না।আমার ভালোবাসা বরাবরই সীমিত।আমি কখনো চাইনি উনি আমার হোক।কিংবা উনাকে আমার পেতেই হবে।তবুও আড়াল হতে তাকে অনুসরন করেছি, শ্রদ্ধা করেছি।ঠিক তেমনই আড়াল হতে ঘৃণাও করেছি।

আমার ভাবনার সমাপ্তি ঘটল।সমাপ্তি ঘটল ছাদের উপর জ্বলতে থাকা কমলা রাঙ্গা আগুনের শিখারও।ক্ষনিকের মধ্যে সব ছবি, সব চিঠি, সব চিরকুট পুঁড়ে পরিণত হলো কালচে ছাঁইয়ে। মেহেরাজ ভাই তখনও নিশ্চুপ হয়ে সেখানেই বসে রইল।আমি আর দাঁড়ালাম না।ঘুরে পেছন ফিরলাম দ্রুত।তারপর পা বাড়িয়ে ছাদের দরজার কাছে যেতেই অবাক হলাম। সামান্তা আপুর টলমল চোখের অশ্রু গড়িয়ে পড়তে দেরি করল না।ফর্সা ধবধবে শরীর যেন সে অশ্রুর সাথে তাল মেলাতেই কেঁপে কেঁপে উঠল।আমি হতবাক হয়ে চেয়ে থাকতেই উনি বলে উঠলেন,

” এমনটা কেন হলো জ্যোতি?কেন হলো এমনটা?আমি পারছি না সহ্য করতে কিছু। আমি বাঁচতে পারছি না।”

সামান্তা আপুর কথায় আমি নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয় রইলাম।সত্যিই কি প্রিয় মানুষকে অন্য কারো সাথে সহ্য করা কোন নারীর পক্ষে সম্ভব? সম্ভব নয় বোধ হয়।হয়তো আমিও পারতাম না।হ্যাঁ, সামান্তা আপুর মতো কাঁদতে পারতাম না বোধহয়।দুঃখ প্রকাশও করা হয়ে উঠত না হয়তে। আহ্লাদী কন্ঠে বোধহয় বলতেও পারতাম না, আমি বাঁচতে পারছি না।তবে এইটুকু জানি, আমার হৃদয়েও রক্তক্ষরণ হতো।আমারও কষ্ট হতো।সেখানে নরম মনের সামান্তা আপুর তো কষ্ট হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।যে স্থানে উনি নিজে থাকবেন এই স্বপ্নটাই দিনের পর দিন বুনে এসেছেন, সে স্থানে আমাকে মেনে নেওয়া কঠিনই হওয়ার কথা।আমি ছোট্টশ্বাস ফেলেই বললাম,

” যে পুরুষটাকে ভালোবেসেছেন সে নিষ্ঠুর পুরুষ।তার হৃদয় কঠোর।সেই কঠোর পুরুষের সান্নিধ্যে থাকার জন্য এতটা ভেঙ্গে পড়লে চলবে আপু?কাঁদবেন না।”

আপু ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করলেন।কিন্তু পারলেন না।পরমুহুর্তেই ডুকরে কেঁদে ওঠে বলে উঠলেন,

” ছোটবেলা থেকে আমি যা চেয়েছি তাই পেয়েছি জ্যোতি।কখনো নিজের কোন জিনিসে অন্য কারো ছোঁয়া পেতে দিইনি।এমনকি নিজের বাবা মাকেও কখনো কারো সাথে ভাগ করিনি। এইজন্যই আমার কোন ভাইবোনও নেই।কিন্তু জীবনের আসল খেলাটায় এসে আমি হেরে গিয়েছি।আসল জিনিসটাই আমি হারিয়ে ফেলেছি।আসল মানুষটাই অন্য কারো হয়ে গিয়েছে।তোমার হয়ে গিয়েছে।চোখের সামনে এই নির্মম সত্যটা আমায় বাঁচতে দিচ্ছে না।আমি মরে যাচ্ছি।মরে যাচ্ছি আমি জ্যোতি।কাল রাতে ভীষণ করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছি।কিন্তু সাহস হয়ে উঠেনি আমার জ্যোতি।আমি খুব ভীতু।নিজেকে শেষ করতে পারিনি।”

আমি বিস্মিত হলাম।পৃথিবীটা সত্যিই অদ্ভুত।কত মানুষের জীবনে কত সমস্যা, কত দুঃখ।তবুও বেঁচে থাকে প্রতিনিয়ত সেসব দুঃখ হৃদয়ে নিয়ে।আর সে পৃথিবীতেই কেউ কেউ আবার অন্য এক মানুষের জন্য জীবন বিসর্জন দেয়।জানি দুঃখ হয়, কষ্ট হয়, সে মানুষটাকে ছাড়া দমবন্ধ লাগে।কিন্তু তাই বলে অন্য একজনের জন্য নিজের জীবন ত্যাগ করবে?নিজের বাবা মা কিংবা আপন মানুষদের কথা না ভেবে শুধুমাত্র একটা মানুষের অভাবে তারা বাঁচতে পারে না?কি অদ্ভুত!আর যাদের জীবনে প্রতি বাঁকে বাঁকে দুঃখ?প্রতি বাঁকে বাঁকেই সমস্যা?তাদের কি করা উচিত তবে?সামান্তা আপু বোধহয় বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছেন কম।তাই এই একটা দুঃখকেই নিজের জীবনের বেঁচে না থাকার একমাত্র কারণ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। অথচ পৃথিবীতে শতসহস্র মানুষ প্রতিনিয়ত হাজার হাজার দুঃখ, হাজার হাজার সমস্যার সম্মুখীন হয়েও দিন শেষে বেঁচে থাকার জন্য একটু আলো খুঁজছে।বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। কথাগুলো ভেবেই নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকলাম। বিপরীতে উত্তর দেওয়ার মতো কি আসলেই আমার কাছে কোন কথা আছে?নেই।দৃষ্টি সরিয়ে ছাদের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলাম ঠাঁই বসে থাকা মেহেরাজ ভাই নড়েচড়ে উঠলেন।সদ্য নিভে যাওয়া আগুনের উত্তপ্ত ছাঁই গুলো নির্বিকারভাবে মুঠোয় ছেঁপে ধরলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ছাদের কার্নিশ ঘেষে দাঁড়িয়ে ছুড়ে দিলেন নিচে। একে একে পুরো ছাঁই ফেলে দিয়ে পরিষ্কার করলেন জায়গাটা।তারপর আর দাঁড়ালেন না।পা বাড়িয়ে আমাদের দিকেই এগিয়ে এলেন।সামান্তা আপু নড়েচড়ে দাঁড়ালেন।কান্নার বাঁধ ভেঙ্গে জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করলেন,

” ছাঁই গুলোর মতো কি আমাকেও তুমি নিজের জীবন থেকে ছুড়ে ফেলে দিলে রাজ ভাইয়া?আমায় কি আধৌ তুমি কোনদিন এতটুকু ভালোবেসেছিলে?বেসেছিলে ভালো?”

মেহেরাজ ভাই নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়ালেন একমুহুর্ত।প্রিয় মানুষের অভিমানে, অভিযোগে করা এতগুলো প্রশ্নের একটার ও জবাব না দিয়ে রক্তরাঙ্গা চোখে কেবল শীতল চাহনী ফেললেন সামান্তা আপুর মুখে।তারপর আর দাঁড়ালেন না।সিঁড়িতে পা ফেলে দ্রুত নিচে চলে গেলেন।আমি অবাক হয়ে চেয়ে থাকলাম কেবল দুইজনার পানে। এই দুইজন মানুষের মাঝে কতখানি ভালোবাসা, কতখানি অনুভূতি।তবুও বিচ্ছেদ?দায়ী কি আমিই?

.

সাঈদ ভাইয়া আজ দেরি করেই এলেন।চেয়ারে আরাম করে বসেই আমার দিকে চাইলেন। তারপর একটা সুন্দর হাসি উপহার দিলেন। বিনিময়ে আমিও সৌজন্যতার সাথে হাসলাম।পরচিয়ের দুদিনের মাথাতেই বুঝতে পারলাম, এই মানুষটা খুব মিশুক প্রকৃতির।ফ্লাটিংয়ে দুর্দান্ত দক্ষ। সঙ্গে চঞ্চল প্রকৃতির। তবে উনার হাসিখুশি কথাবার্তা নিমিষেই কোন মানুষের মন ভালো করতে যথেষ্ট।আমি পড়ায় মনোযোগ দিলাম।মাঝপথেই মেহু আপু নাস্তাসমেত হাজির হলো।টেবিলের এককোণে নাস্তা রাখতেই সাঈদ ভাই বলে উঠলেন,

” কি আশ্চর্য!তুমি কি টিপিক্যাল বউ বউ ভাব শুরু করেছো মেহু? জানোই তোমায় ভালোবাসি, এখন এমন করে খাবার টাবার আনলে তো ভালোবাসা আরো বেড়ে যাবে প্রিয়।”

আমি অবাক হলাম।কি বলে এই লোক?মুহুর্তেই চোখ উঁচু করে চাইলাম মেহু আপুর দিকে।মেহু আপুর মুখে বিশেষ প্রতিক্রিয়া নেই।শুধু একবার সাঈদ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলেন,

” সাঈদ ভাই, আপনি প্লেবয় টাইপ ছেলে তা ভাইয়া থেকে আপনাদের বন্ধুমহল এমনকি আমাদের কাজিনমহল সবাই জানে।এসবকিছু নাবিলা, নাফিসা, সামান্তা উপভোগ করলেও আমি উপভোগ করতে পারি না।পর থেকে ভালো ভাবে কথা বললে বলবেন।”

আপুর কথা শুনে আবারও অবাক হলাম।সাঈদ ভাই প্লেবয়?হ্যাঁ হতেই পারে।সাঈদ ভাইয়ের ফ্লার্টিং লেভেল ভয়ানা।কথায় ও কেমন জানি একটা ভাব আছে। যেন মেয়েদের সাথে উনার বহু বছরের কথোপকোতনের অভ্যাস।হতেই পারে এই লোক চরম লেভেলের মেয়েবাজ।মেহেরাজ ভাই আমার টিউটর হিসেবে রাখার জন্য তার আর কোন বন্ধুকে পাননি?আশ্চর্য!আমি সাঈদ ভাইয়ের মুখের দিকে তাকালাম।সাঈদ ভাই তখনও মেহু আপুর দিকেই তাকানো।ঠোঁট চওড়া করে হেসে বলে উঠলেন,

” তুমি আমায় প্লেবয় বললে মেহু?নাহয় নাবিলাকে একটু পছন্দ করি, বন্ধুর প্রেমিকা হিসেবে সামান্তাকে একটু ভালোবাসি। আর নাফিসা তো আমার কলিজা।তাই বলে প্লেবয়?মানায় এই উপাধি?”

মেহু আপু আগের মতোই নির্বিকার থেকে উত্তর দিলেন,

” পড়াতে এসেছেন।সামনে আপনার ছাত্রী আছে।ছাত্রীর সামনে একজন টিচার হিসেবে নিজের কতটুকু সম্মান রাখছেন?যায় হোক পড়াবেন, তারপর চলে যাবেন।আর হ্যাঁ, জ্যোতির সাথে এসব কিছুর চেষ্টা করবেন না বলে দিলাম সাঈদ ভাইয়া।ও এসব পছন্দ করে না।চেষ্টা করবেন ওর সাথে এজ এ স্টুডেন্ট হিসেবেই বিহেভ করতে।”

কথাগুলো বলেই মেহু আপু চলে গেল।আমি বোকা বোকা চোখ করে চেয়ে থাকলাম।এদের মধ্যে কি চলছে কিছুই বোধগম্য হলো না পুরোপুরি ভাবে।একপলক সাঈদ ভাই তো একপলক মেহু আপুর যাওয়ার দিকে তাকিয়েই বইয়ে মনোযোগ দিলাম পুনরায়।

#চলবে….

এক মুঠো প্রণয় পর্ব-০৮

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_০৮
লেখনীতেঃএকান্তিকা নাথ

দাদীর সাথে কথা বলার উদ্দেশ্যে মিনার ভাইয়ের নাম্বারে দুই তিনবার লাগাতার কল দিলাম।ওপাশ থেকে কল তুলল না মিনার ভাই।আমি হতাশ হলাম।পুনরায় কল না দিয়ে মোবাইলটা টেবিলের এককোণে রেখে দিলাম।ঠিক কিয়ৎক্ষন পরই ওপাশ থেকে কল এল।নিঃসন্দেহে কলটা মিনার ভাইয়েরই হবে তা ভেবে খুশি হলাম।কল তুলে বললাম,

” তুমি কি ব্যস্ত আছো মিনার ভাই?কল দিলাম কয়েকবার।তুললে না কল।”

মিনার ভাই উত্তরে বললেন,

” বাজারে আসছিলাম।বন্ধুদের সাথে আছি।কিছু বলবি? ”

আমি হতাশ হলাম।মিনার ভাই বাজারে থাকলে দাদীর সাথে আর কথা বলবই বা কি করে।চোখ ছোট ছোট করে উত্তর দিলাম,

” না, তেমন কিছু নয়।ভেবেছিলাম দাদীর সাথে কথা বলব।তুমি কেমন আছো?বাড়ির সবাই ভালো আছে?”

মিনার ভাই ছোট করে উত্তর দিলেন,

” আছে।”

আমি আর কিছু বলার পেলাম না।মিনার ভাই কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে আবার প্রশ্ন ছুড়লেন,

” তুই ভালো আছিস জ্যোতি?”

এমন আহ্লাদী প্রশ্নে বুক ছিড়ে দীর্ঘশ্বাস এল।ইচ্ছে করল বলতে, ” আমি ভালো নেই মিনার ভাই।নিজেকে প্রতিমুহুর্তে সদ্য জম্মানো আগাছার ন্যায় উপলব্ধি করছি।বড্ড একা লাগছে এখানে এসে। দাদীর কথা মনে পড়ছে।দাদীর শূণ্যতা ভীষণভাবে অনুভব করছি।” কিন্তু বলা হলো না। নির্বিকার চাহনীতে বাটন ফোনটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।তারপর হঠাৎই মেহেরাজ ভাইয়ের গলা ঝাড়ার আওয়াজ আসল কানে।আমি ফিরে চাইলাম। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীর মুখচাহনী নিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন।জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কিছু বলার প্রস্তুতি নিতেই উনি প্রশ্ন ছুড়লেন,

” তুই কি ফোনে কথা বলছিস?কার সাথে কথা বলছিস?”

মিনার ভাই তখনও কল কাঁটে নি।আমি একবার মোবাইলের দিকে তাকিয়েই উত্তর দিলাম,

” মিনার ভাইকে কল দিয়েছিলাম।আপনার কি কিছু বলার আছে মেহেরাজ ভাই?”

” হ্যাঁ। একটু দরকার ছিল।”

আমি একনজর তাকিয়ে মৃদু গলায় বললাম,

” একটু অপেক্ষা করুন মেহেরাজ ভাই।আমি মিনার ভাইয়ের সাথে কথা বলেই আসছি।”

আমার কথাটা বোধহয় মেহেরাজ ভাইয়ের মানে লাগল।সবসময় বুক উঁচিয়ে একঝুড়ি মান নিয়ে থাকা মেহেরাজ ভাই বোধ হয় মিনার ভাইয়ের পরে তার সাথে কথা বলার বিষয়টা মেনে নিতে পারলেন না। মুহুর্তেই মুখের ভাবমূর্তি বদলাল।চোখমুখ গম্ভীর থেকেও গম্ভীর করে ধুমধাম পা ফেলে চলে গেলেন।আমি একপলক চাইলাম সেদিক পানে।ছোট্ট শ্বাস ফেলে মোবাইল কানে নিয়ে আবারও বললাম,

” আমি ভালো আছি মিনার ভাই। তুমি বাড়ি পৌঁছাবে কখন?”

” বোধ হয় বিকাল হবে।কেন?”

” দাদীর সাথে কথা বলব।বাড়িতে গিয়ে একবার কল দিও মিনার ভাই।আমি অপেক্ষায় থাকব।”

মিনার ভাই চুপ থাকলেন।কিছুক্ষন পর কি বুঝে বললেন,

” এইজন্যই এতবার কল করলি?আচ্ছা, বাড়ি গিয়ে কল দিব।রাখলাম।”

কথাটা বলেই কল কেঁটে দিল। মিনার ভাইয়ের শেষের কথাটা কেমন যেন অন্যরকম শোনাল।গলাটাও অন্যরকম বোধ হলো।মিনার ভাই কি অভিমান দেখালেন?নাকি অভিযোগ করলেন?বুঝে উঠলাম না।মোবাইলটা আগের ন্যায় রেখে দিয়েই রুম ছেড়ে বের হলাম।ঘড়ির কাঁটায় তখন সবে সকাল নয়টা।মেহেরাজ ভাইকে বসার ঘরে দেখা গেল না।মেহু আপুর ঘরেও দেখা গেল না।বাধ্য হয়েই উনার ঘরে উঁকি দিলাম।চোখে পড়ল গোছাল, পরিপাটি ঘর।মেহেরাজ ভাই বরাবরই বেশ গোছাল।উনার চলন-বলন থেকে সবকিছুতেই একটা গোছাল পরিপাটি ভাব আছে।এমনকি উনার পা ফেলে ফেলে হাঁটাটাও বেশ গোছাল।এত পরিপাটি মানুষের ঘরটাও পরিপাটি হবে স্বাভাবিক।আমি এদিক ওদিক চাইলাম। মেহেরাজ ভাইকে দেখা গেল না।দুবার ডাকলামও। সাড়া এল না।অবশেষে পা ফেলে উনার ঘরে ডুকলাম।টেবিলের উপর একঝাঁক রং বেরংয়ের কাগজ।গাঢ় দৃষ্টিতে চাইতে বুঝলাম, এগুলোকে কাগজ বলা যায় না শুধু, বলা যায় সুন্দর হাতের লেখনীতে চিঠি। সঙ্গে সামান্তা আপুর হাজার খানেক ছবি।সব দুমড়ানো মোঁচড়ানো অবস্থায় পড়ে আছে।আমি অবাক হয়ে আরো দু পা এগোলাম।হাজারটা চিঠি, হাজারটা ছবি, হাজারটা শুকনো ফুল। সবই বড্ড অযত্নেই যেন ফেলে রেখে গেলেন মেহেরাজ ভাই।কিন্তু কেন এভাবে রাখলেন? দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।মেহেরাজ ভাইকে না পেয়েই রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলাম দ্রুত।সঙ্গে সঙ্গে মেহু আপুর সম্মুখীন হলাম।আপু উৎসুক চাহনীতে চেয়েই প্রশ্ন ছুড়লেন,

” তুই কি ভাইয়াকে ডাকলি?ভাইয়াকেই খুঁজতে গেলি ও ঘরে?ভাইয়া তো বেরিয়ে গেল।যদিও আরো পরে বের হওয়ার কথা ছিল।কিন্তু হঠাৎই কি হলো, বের হয়ে গেল দেখলাম।”

আমি ভ্রু কুঁচকে ফেললাম।বেরিয়ে গেল কেন?উনার কি যেন দরকার ছিল আমার সাথে।তবে?মিনার ভাইয়ের সাথে কথা বলছি দেখেই কি দরকারটা না বলে চলে গেলেন?কিন্তু কেন?উনি কি রাগ করেছেন এতে?নিজের বোকা বোকা ভাবনায় পরমুহুর্তেই নিজেকে ধমক দিলাম।রাগ করবেন কেন?রাগ কি যার তার উপর করা যায়? আমি মেহু আপুর দিকে তাকিয়েই প্রশ্ন করলাম,

” কেন?”

মেহু আপু উত্তর দিলেন,

” ভাইয়ার ইন্টার্ভিউ আছে। হয়তো তাই।”

আমি মাথা নাড়ালাম।তারপর আবারও ঘরে এলাম।চোখ বুঝে ভাবলাম, এ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কি?আমি কি অনেকটা বোঝার মতোই হয়ে রইলাম না এই বাসায়?মেহেরাজ ভাই শুধু শুধু আমার দায়িত্ব কেন বহন করবেন?কেনই বা আমি আগাছার মতো পড়ে থাকব এইখানে?ভাবলাম অনেকক্ষন।তারপর মনকে বুঝালাম,টেস্ট পরীক্ষার আর দেড় মাস।তখন বাড়ি গেলে দাদীকে পড়ালেখার অযুহাত দেখিয়ে থেকে যেতে হবে।তবুও স্বস্তি মিলবে।দিনশেষে নিজেকে বোঝানো যাবে, আমি বোঝা হয়ে থাকছি না।

.

মেহু আপু তার ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন।শিমা আপাও রান্না করে রেখে চলে গেলেন দুপুরের আগে আগেই।বাকি থাকলাম আমি।সেই দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত একা একা বাসায় থেকে উদাস হলাম।কয়েক ঘন্টা বই খাতায় মনোনিবেশ করে কাঁটালেও এবার একা বোধ হলো।জানালার দ্বারে দাঁড়িয়ে বাইরের আকাশ দেখলাম।বিশাল নীল আকাশ।তার মাঝে শুভ্র মেঘের খেলা ভীষণ চমৎকার দেখাল।নির্বিকার ভাবে বেশ কিছুক্ষন সে চমৎকার দৃশ্যে তাকিয়ে থাকতেই কলিং বেল বাঁজল।আমি পা চালিয়ে দ্রুত দরজা খুললাম।মুহুর্তেই চোখে পড়ল শুভ্র রাঙ্গা শার্ট পরিহিত মেহেরাজ ভাইকে।চোখমুখ বরাবরের ন্যায় শান্ত,গম্ভীর। আমি একপলক তাকিয়েই প্রশ্ন ছুড়লাম,

” কেমন হয়েছে আপনার ইন্টার্ভিউ?”

মেহেরাজ ভাইয়ের সোজাসাপ্টা উত্তর,

” হবে না চাকরীটা।”

আমি আর কিছু বললাম না।চুপচাপ নিজের ঘরে পা বাড়াতে নিতেই মেহেরাজ ভাই আবারও বলল,

” দাঁড়িয়ে যা।কথা আছে।”

আমি দাঁড়ালাম।পেছন ফিরে একবার তাকাতেই উনি বললেন,

” আনোয়ার চাচা কাল এবং আজ দুইদিনই কল দিয়েছেন।তোর সাথে কথা বলার জন্যই কল দিয়েছেন।তোর নাম্বার মিনারের কাছে আছে, অথচ তোর বাবার কাছে নেই?অদ্ভুত!”

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।বাদবাকি বাবা-মেয়ের মতো যদি আব্বার সাথে আমার সম্পর্ক থাকত, তবে অবশ্যই আমার নাম্বার আব্বার কাছেও থাকত। কিন্তু আব্বার সাথে আমার সম্পর্কটা তো স্বাভাবিক নয়।আব্বা তো কোনকালেই আমায় ভালোবাসতে পারলেন না।তবে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে হঠাৎ এত ভালোবাসা দেখানোর মানে কি?আমি তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসলাম।উত্তরে বললাম,

” আব্বা আমার নাম্বার দিয়ে কিই বা করত? তাই উনার কাছে নেই।”

” মিনার তোর ফুফাত ভাই।ওর যদি তোর নাম্বারের প্রয়োজন থাকে, তবে তোর বাবারও আছে। নাহলে উনি দুইদিনে দুই তিনবার কল করে তোর খোঁজ নিত না।আর উনি তো তাও খোঁজ নিলেন।তুই কেমন?ফুফাত ভাইকে কল করে খোঁজ নিতে পারলি, বাবাকে কল করে খোঁজ নিতে পারলি না?”

মেহেরাজ ভাইয়ের কথা ভালো লাগল না আমার।আচমকাই বলে উঠলাম,

” আপনার মোবাইলে কল করাতে বিরক্ত হয়েছেন এটা বললেই তো হয়ে যায় মেহেরাজ ভাই।সমস্যা নেই।আমি আব্বার সাথে কথা বলে নিব।আর এটাও বলে দিব, আপনাকে যাতে কখনো কল না করে।তবে আব্বা যে আমার কথা খুব একটা মানেন এমন নয়।ভবিষ্যৎ এ আবার ও কল দিলে আমি দুঃখিত।”

মেহেরাজ ভাই চোয়াল শক্ত করলেন।মুখ টানটান করে আমার দিকে তাকিয়েই দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

” অসহ্যকর!তোর সাথে কথা বলাটাই বোকামো।”

আমি ঘনঘন শ্বাস নিলাম। রাগ হলো সামনের মানুষটার প্রতি। তীব্র জেদ জম্মাল ভেতরে ভেতরে।মেহেরাজ ভাই অবশ্য সে রাগ-জেদের কিছুই বুঝে উঠলেন না।উনি মোবাইল বের করে কল লাগালেন আব্বাকে।আমার দিকে শীতল চাহনীতে তাকিয়েই ঠান্ডা গলায় শুধালেন,

” চুপচাপ এখানে দাঁড়িয়ে থাকবি।চাচা কল রিসিভড করা মাত্রই কথা বলবি।এর অন্যথা আমি চাইছি না এই মুহুর্তে। ”

আমি আৎকে উঠলাম।এমন ঠান্ডা গলায়ও কেউ শাসাতে পারে?উনি পারেন।আমি স্থির পায়ে শান্ত হয়ে দাঁড়ালাম।মুহুর্তের মধ্যেই আব্বা কল ধরলেন।ওপাশ থেকে আব্বা ভরাট গলায় বলে উঠলেন,

” রাজ,বাসায় গেছো তুমি?”

আমি চোখ বড়বড় করে চাইলাম।মুহুর্তেই অনুভব করলাম আব্বার প্রতি আমার একরাশ অনীহা।মস্তিষ্ক ফাঁকা বোধ করলাম।কি বলব আব্বার সাথে?আধো আব্বার সাথে কি আমার কোন কথা বলার মতো আছে এখনো?আব্বার ঘাড় থেকে তো বোঝার ভার নেমেই গেল।তবুও?তবুও কেন কল করলেন আব্বা?দায়িত্ব দেখাচ্ছেন?নাকি লোক দেখানো ভালোবাসা?আমি বার কয়েক নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ে থাকলাম। মেহেরাজ ভাই সালাম দিয়েই আব্বাকে বললেন,

” জ্যোতি আমার সামনেই আছে চাচা।কথা বলুন।”

কথাটা বলেই মেহেরাজ ভাই মোবাইল এগিয়ে দিলেন আমার দিকে।কাঁপা হাতে মোবাইলটা এগিয়ে নিতেই আব্বা বলে উঠল,

” জ্যোতি?ভালো আছিস?”

আমি হতভম্ব হয়ে তাকালাম। একমাত্র মেয়ে হওয়া স্বত্ত্বেও আব্বা কোনদিন আমায় এভাবে বলে নি।কোনদিন এভাবে জানতে চাননি আমি ভালো আছি কিনা।তবে আজ হঠাৎ?ভেতরে ভেতরে আবেগে আপ্লুত হলেও বাইরে আমি কঠিন থাকলাম।গলা ঝেড়ে উত্তর দিলাম,

” খারাপ থাকার কথা কি আব্বা?আর ভালো আছি কি নেই এইসব জানার কি আপনার প্রয়োজন আছে?অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন না করাই তো ভালো।”

আব্বা বোধহয় রেগে গেলেন।চাপাস্বরে ক্রোধ নিয়ে বললেন,

” আমার আর কোন সন্তান নেই জ্যোতি। তুই আমার মেয়ে হোস। এক এবং একমাত্র সন্তান।ভালো আছে কিনা জানার প্রয়োজন নেই বলছিস আমার?”

আব্বার রাগ এখনও আগের মতোই আছে দেখে তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসলাম। বাড়িতে থাকলে হয়তোবা আব্বার বলিষ্ঠ হাতের থাপ্পড়ের ভয়ে চুপ থাকতাম।কিন্তু সেই ভয় আর কাজ করল না।বুক চিড়ে আসল তীব্র তাচ্ছিল্য।বললাম,

” ভালো থাকার জন্য বিয়ে দিয়েছেন আপনারা বড়রা বুঝেশুনে।খারাপ থাকার জন্য তো দেননি।তাই না? ”

” তোর কথার ধরণ বদলেছে।”

” আব্বা,আগে তো বাড়িতে থাকাকালীন কোনদিন জানতে চাননি কেমন আছি।তখন তো আপনার চোখের সামনেই ছিলাম।এখন এতদূর আসার পর জানতে চাইছেন তাই হয়তোবা কথার ধরনও বদলেছে।”

আব্বা চুপ থাকলেন। পরমুহুর্তেই বললেন,

” রাজ বলল, তোর কাছে নাকি মোবাইল আছে?”

উত্তর দিলাম,

” দাদী দিয়েছিলেন সেদিন।আপনাকে কল করলে বিরক্ত হবেন কি হবেন না তাই আর কল দেওয়া হয়নি আব্বা।”

” আচ্ছা রাখলাম।ভালো থাকিস।”

আব্বার শেষ কথাটায় কান্না পেল আমার।”ভালো থাকিস” কথাটুকুও যেন আব্বার থেকে পাওয়া বড় কোন প্রাপ্তি আমার।আব্বার আদর-স্নেহ না পাওয়া মেয়েগুলো বোধহয় এভাবেই আব্বাদের এইটুকু কথার জন্য ছটফট করে। এইটুকু কথোপকোতনেই আবেগে আপ্লুত হয়।আমি অবশ্য কাঁদলাম না।দ্রুত প্রশ্ন ছুড়ে জিজ্ঞেস করলাম,

” আপনি ভালো আছেন আব্বা?”

আব্বা চুপ থাকলেন।তারপর কি বুঝে গম্ভীর স্বরে উত্তর দিলেন,

” হ্যাঁ।”

ব্যস এইটুকুই।তারপর আব্বা কল কেঁটে দিলেন।আমি নিষ্প্রভ হয়ে চেয়ে রইলাম।আব্বার থেকে এইটুকু কথাও আমার ভাবনার বাইরে ছিল।এইটুকু আগ্রহও আমার কাছে আসমান ছোঁয়া মনে হলো।কিন্তু সেই অনুভূতি দেখাতে পারলাম না কাউকেই।মোবাইলটা মেহেরাজ ভাইয়ের দিকে এগিয়ে দিয়েই স্পষ্ট গলায় বললাম,

” আপনার মোবাইল মেহেরাজ ভাই।”

মেহেরাজ ভাই হাত বাড়িয়ে মোবাইল নিলেন।গম্ভীর স্বরে বললেন,

” বাবা মায়ের সাথে আরো নম্রভাবে কথা বলা উচিত জ্যোতি।যাদের বাবা মা নেই তারা দুইবেলা মনের মধ্যে ইচ্ছে পোষণ করেও কথা বলতে পারে না বাবা মায়র সাথে।বাবা মায়ের কন্ঠ শুনতে পায় না।সেদিক থেকে তোর বাবা আছে এইটা ভেবে সুখী হওয়া উচিত তোর।শত হোক, দিনশেষে উনি তোর বাবা।”

আমি চুপচাপ শুনে গেলাম সবটা।মেহেরাজ ভাই কি করে বুঝবে আমার এভাবে কথা বলার মানে?কিভাবে বুঝবে কেন এরকম ভাবে কথা বললাম?উনি তো আর দেখেননি আমার প্রতি আব্বার তীব্র রাগ, তীব্র ক্ষোভ।বলিষ্ঠ পুরুষালি হাতে সেই ছোট জ্যোতির গালে চড়!দেখেছেন কি? দেখেননি।তবে কি করে বুঝবে?কথাগুলো ভেবেই মুখচোখ টানটান করে ঠাঁই বসে রইলাম বসার ঘরে।আব্বার প্রতি রাগ, জেদ স্মরন হতেই তীব্র অভিমান জম্মাল আম্মার প্রতি।আম্মা এমনটা কেন করল?কেন?

.

মেহেরাজ ভাই নিজের ঘরে গেলেন।কিয়ৎক্ষন পর আবার বেরও হলেন ঘর ছেড়ে।তবে হাতে করে ছোট এক থলে নিয়ে।থলের এককোণায় বেরিয়ে আসা কাগজগুলো দেখে আমি নিশ্চিত হলাম এগুলা উনার টেবিলের উপর থাকা সেই রংবেরংয়ের চিঠিগুলোই।হয়তো সামান্তা আপুরই দেওয়া সবগুলো চিঠি।কিন্তু এগুলো নিয়ে যাচ্ছেন কোথায় মেহেরাজ ভাই?সামান্তা আপুকে ফেরত দিতে?

#চলবে….

এক মুঠো প্রণয় পর্ব-০৭

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_০৭
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

তখন সন্ধ্যা।কিয়ৎক্ষন আগেই সামান্তা আপুরা আর নাবিলারা সবাই বাসায় ফিরেছেন।বেলকনিতে বসে সেসবই বলাবলি করছিল মেহু আপু।হঠাৎই বারকয়েক কলিং বেলের আওয়াজ পেয়েই আমি আর মেহু আপু ছুটে গেলাম।আমরা পৌঁছানোর আগেই সেখানে উপস্থিত হলেন মেহেরাজ ভাই।এতক্ষন ঘরেই ছিলেন উনি। বোধ হয় এতবার কলিং বেলের আওয়াজ হওয়াতেই এগিয়ে এসে দরজা খুললেন ।মুহুর্তেই চোখে পড়ল এক বিধ্বস্ত রমণীকে।রমণীটি আর কেউই নয়, সামান্তা আপুই।উনার লম্বা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে রইল মুখে।ফর্সা মুখ মলিন দেখাল।ফোলা চোখজোড়াও নিভু নিভু।আমি একনজর তাকিয়েই কষ্ট অনুভব করলাম।হৃদয়ে অপরাধবোধের অস্তিত্ব উপস্থিত হয়ে জানান দিল, আমিই অপরাধী।দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির এই অবস্থার জন্য আমিই দায়ী।আমার জন্যই আজ তারা এক থেকে দুই হলো।আমার জন্যই দুটো মানুষের মিল হওয়ার কথা থাকলেও তাদের মিল হলো না। অনুশোচনায় দগ্ধ হলাম আমি।তবে তা প্রকাশ করতে পারলাম না।আমি বরাবরই দাদীর মতোই।বাস্তবে কোন অনুভূতি প্রকাশ করতে পারি না।না ভালো লাগা, না ভালো বাসা আর না তো অনুশোচনা।কিন্তু ডায়েরীর পাতা হলে তা আলাদা।সেখানে নিজের সমস্তটা উজাড় করে দিতে পারি।বোধ হয় এই কারণেই ডায়েরীতে মেহেরাজ ভাই সম্পর্কিত অনুভূতি জেনে রেগে গিয়েছিলেন মেহেরাজ ভাই।ছোট্ট শ্বাস ফেললাম।ভাবনা ছেড়ে বের হয়ে চোখজোড়ার দৃষ্টি স্থির রেখে কেবল তাকিয়েই থাকলাম।সামান্তা আপু ঘরে ডুকলেন না।মেহেরাজ ভাইয়ের দিকে হতবিহ্বল চাহনীতে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকেই ঝট করে নজর সরালেন।অন্যদিকে তাকিয়েই নিঁখুতভাবে উপেক্ষা করলেন মেহেরাজ ভাইকে। মেহু আপুর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,

“মেহু আপু, আম্মু সবার জন্যই রান্না বসিয়েছে।আজ রাতের জন্য আর রান্না করতে বলোনা শিমা আপাকে।আম্মু সবাইকেই খেতে বলেছে বাসায়।”

সামান্তা আপু উনার বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে।ছোটবেলা থেকেই শহরে বড় হয়েছেন।আদব কায়দা, কথাবার্তা, শিক্ষায় সবকিছুতেই আমার থেকে এগিয়ে। এমনকি রূপ কিংবা সৌন্দর্যের দিক দিয়েও। সেই হিসেবে আমি বড্ড অযোগ্যই মেহেরাজ ভাইয়ের জন্য।অনেকটা বাঁধরের গলায় মুক্তোর মালা প্রবাদটার মতোই বোধ হলো এই অবস্থাটা।আমার নিজের উপর অভিমান হলো।এভাবে যোগ্যতা ছাড়া অন্য একজনের গলায় বোঝাস্বরূপ ঝুলে পড়া বোধহয় একদমই উচিত হয়নি।অন্তত যোগ্য মানুষটাকে যোগ্য কেউই পেত।সুখে থাকত।দিনশেষে কি আমায় অযোগ্য বিশেষণটা বয়ে বেড়াতে হতো তাহলে?লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেহেরাজ ভাইয়ের দিকে তাকালাম।টানটান গম্ভীর মুখে একরাশ বিষাদের ছোঁয়াই কেবল।যেন হতাশায় তার ভেতরটা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। তারই স্পষ্ট ছাপ চোখেমুখে।এটা অবশ্য অস্বাভাবিক নয়।এত বছরের প্রেম, এত বছরের মনের মানুষ ছেড়ে আসা কি এতই সহজ?কষ্ট হবে না?হবে।আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম মেহেরাজ ভাইয়ের মুখচাহনী।চোখজোড়ায় হয়তো প্রেয়সীর জন্য অভিমানও খেলা করল। বোধহয় সে জন্যই চোখজোড়া রক্তিম দেখাল। মেহেরাজ ভাই মুহুর্তেই নিরবে প্রস্থান করলেন সেই স্থান থেকে।হয়তো সামান্তা আপুর মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহসটা টিকিয়ে রাখতে পারলেন না।দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে তাকালাম। মেহু আপু এগিয়ে উত্তর দিলেন,

” আজই তো ফিরল সবাই।এতদূর থেকে এসে এখন আবার সবার জন্য রান্নার প্রয়োজন কি? চাচীর উপর দিয়ে দখল যাবে না?”

সামান্তা আপু হাসলেন হালকা। বললেন,

” আম্মু পারবে সামলাতে।তোমরা বাসায় এসো রাতে।আচ্ছা, আমি বরং রাতে আবার ডেকে যাব।নাবিলাদের বলে আসি গিয়ে।”

কথাগুলো বলেই সামান্তা আপু দুই পা বাড়িয়ে চলে যেতে নিলেন।পরমুহুর্তেই আবার কি বুঝে ফিরে এলেন।গাঢ় চাহনীতে আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কি যেন পরখ করলেন।আমি অস্বস্তিতে পড়লাম।শুকনো ঢোক গিলে বললাম,

” কিছু বলবেন আপু?”

সামান্তা আপু মাথা নাড়ালেন।ঠোঁট চওড়া করে উত্তর দিলেন,

” তোমাকে বলা হলো না তাই।তুমিও এসো জ্যোতি।আম্মু তোমার কথা বিশেষ করে বলেছে।”

আমি মাথা নাড়ালাম।হালকা গলায় জবাব দিলাম,

” হ্যাঁ, যাব।”

সামান্তা আপু আর দাঁড়ালেন না।দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে গেলেন। আমি নির্বিকার ভাবে চেয়ে থাকলাম সেদিক পানে।একটা মানুষের কতটা পরিবর্তন?সবার মুখে শুনে এসেছি এই সামান্তা আপু নাকি খুবই চঞ্চল।খুবই হাসিখুশি।আজ আমি তার মুখে একফোঁটাও হাসির রেশ দেখলাম না।একটুও চঞ্চলতা দেখলাম।সব কি আমিই কেড়ে নিলাম?

.

রাত আটটার দিকে হঠাৎই বাসায় এক অপরিচিত যুবকের আগমন ঘটল। তখন বাসায় আমি আর মেহু আপুই ছিলাম।আমি এই যুবককে চিনি না, জানি না।তবে মেহু আপুর ভাবমূর্তি বদলাল।দরজা খুলে এই যুবককে দেখেই জটফট নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকালেন আপু।হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলাম আমি৷ কি আশ্চর্য!এই ছেলেটা কে?আপুই বা হঠাৎ এমন করল কেন?আমি কি বলব বুঝে উঠলাম না।অপরিচিত ছেলেটিই মাথার চুলে হাত নাড়িয়েই প্রশ্ন ছুড়ল,

” তুমিই জ্যোতি?”

আমি অবাক হলাম।এই লোক আমায় চিনে কি করে?চেনার তো কথা নয়।চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে থাকতেই লোকটি আবারও বলল,

” বাসায় ডুকব? নাকি এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকব?”

আমি বুঝলাম না কি বলা উচিত।অপরিচিত ছেলে মানুষ।আর বাসায় আমরা দুটো মেয়ে মানুষ।উনাকে কি বাসায় আসতে বলা উচিত?আমি বোকাবোকা চাহনীতে তাকিয়ে থাকলাম। উনি হাসলেন। আবারও বললেন,

” আমি সাঈদ।মেহেরাজের কাছের বন্ধু। আজ থেকে তোমার টিউটরও।তুমি আমায় সাঈদ ভাইয়া বলেই ডাকতে পারো। আরো পরিচয় লাগবে কি?অবশ্য ভবিষ্যৎ এ আরো একটা পরিচয় দিতে পারব।তবে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।”

আমি তখনও নির্বিকার চেয়ে থাকলাম।কি বলা উচিত মাথায় এল না।কিয়ৎক্ষন চুপ থেকেই বললাম,

” আসুন।”

কথাটা বলেই এদিকওদিক চাইলাম।মেহু আপু এখনও ঘরের ভেতরে।সাঈদ ভাই নামক লোকটাকে বসার ঘরে বসতে বলেই ধীর পায়ে মেহু আপুর ঘরের সামনে গেলাম।দরজায় টোকা দিয়ে বললাম,

” আপু?মেহু আপু?তুমি ঠিক আছো?”

মেহু আপু কিয়ৎক্ষন সময় নিলেন।তারপর একদম ঠিকঠাকভাবে ঘর ছেড়ে বের হলেন।তবুও চোখমুখ অস্থির দেখাল।আমি বুঝলাম, আপু কেঁদেছেন।কিন্তু কেন?লোকটাকে দেখে কাঁদার কি আছে?বুঝলাম না।আপু ঠোঁট চওড়া করে বলে উঠলেন,

” উনি সাঈদ ভাইয়া। ভাইয়ার বন্ধু।সপ্তাহে তিনদিন রাত আটটায় পড়াবে তোকে।মাত্রই কল করে ভাইয়া জানাল বিষয়টা।তোর পড়ার টেবিল গোছানো হয়েছে?নাকি বইগুলো এখনো বড়োসড়ো ব্যাগটার ভেতরেই?”

আমি ছোট্ট শ্বাস ফেললাম।দাদী, মেহেরাজ ভাই সকলেই পড়ালেখায় গ্যাপ না দিতে বললেও আমি আজ সারাদিন বই ছুঁয়েও দেখিনি।এমনকি বইগুলো ব্যাগ থেকে বেরও করা হয়নি।দুপুর পর্যন্ত ঐ ঘরটা ঝাড়গোছ করতে করতেই কেঁটেছে।তারপরের সময়টা মেহু আপুর সাথেই কাঁটিয়েছি।এতকিছুর মাঝেই এত বই টই এর কথা মাথাতেই এল না। ছোট ছোট চোখে তাকিয়েই বললাম,

” শুধু রুমটাই গোছানো হয়েছে আপু।বইপত্র কিছুই এখনো ব্যাগ থেকে বের করাও হয়নি।”

” ঠিকাছে, তাড়াতাড়ি বই বের করে আমি আর তুই মিলে পড়ার টেবিল গুঁছিয়ে ফেলি চল।উনি বরং পাঁচ দশমিনিট বসার ঘরেই বসুক।”

কথাটা বলেই হাত চেপে নিয়ে গেলেন সে ঘরে। পড়ার টেবিলে দ্রুত বইপত্র গুঁছিয়েই দুইপাশে চেয়ার ঠিক করে রেখে গেলেন আপু।আমার দিকে তাকিয়েই বলে উঠলেন,

” উনি টিচার হিসেবে ভালো।অন্য টিচারের মতো ভয় পেতে হবে না। ভালো করে পড়বি জ্যোতি।আমি চাই তুই অনেক বড় হও।অনেক ভালো রেজাল্ট আসুক তোর।”

আমি ক্ষীন দৃষ্টিতে চাইলাম।বুকের ভেতর পরীক্ষা নামক ভয় বাসা বাঁধল।আসলেই কি অতো ভালো রেজাল্ট আসবে?দাদী, মিনার ভাই, মেহেরাজ ভাই, মেহু আপু এত এত জনের আশা পূরণ করতে পারব?নাকি দিনশেষে এটাই প্রমাণ হবে যে, আমি কিছুই না।আমার পড়ালেখার গন্ডিও কিছুই না।আব্বার সামনে কি অবশেষে মুখ থুবড়ে পড়তে হবে আমায়?ভাবতে ভাবতেই সাঈদ ভাই নামক লোকটা সামনে এসে বসলেন।হালকা হেসে বলে উঠল,

” পড়াব নাকি দাঁড়িয়েই থাকবে?”

আমি বসলাম।সামনে থেকে বই বের করে আড়চোখে চাইলাম উনার দিকে।মস্তিষ্কে ঘুরল অন্য প্রশ্ন, সাঈদ ভাই আর মেহু আপুর মধ্যে কি সম্পর্ক আছে?সম্পর্ক যদি থাকেও তবে উনাকে দেখে আপু এমন ছুটে ঘরে গিয়ে দরজা লাগাল কেন?আর সাঈদ ভাইও কেন আপুকে ছুটে ঘরে গিয়ে দরজা আটকাতে দেখে কোন প্রতিক্রিয়াই দেখালেন না?

.

রাতের খাবারটা খাওয়া হলো সামান্তা আপুদের বাসায়ই৷ সামান্তা আপুর আম্মু বরাবরই ভালো মনের মানুষ।প্রায়সই বাড়িতে গেলে আমায় বেশ স্নেহও করতেন।আজও ব্যাতিক্রম হলো না।মাথায় হাত বুলিয়ে খাবার বেড়ে দিলেন। যতক্ষন না খাওয়া শেষ হলো ততক্ষনই পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেন।আমি আসার সময় হালকা হাসলাম।দরজা দিয়ে বের হয়ে চলে আসব ঠিক তখনই নাবিলা আর নুসাইবাকে চোখে পড়ল।নাবিলারা তিনবোন। নাফিসা আপুর বিয়ে হয়েছে গতবছরই।বাকি দুইজন নাবিলা আর নুসাইবা।নুসাইবা বয়সের দিক দিয়ে মিথিরই সমান।এতদিনে মিথি বেঁচে থাকলে নির্ঘাত ওর মতোই বেড়ে উঠত।হাতে পায় ওর মতোই শরীর হতো।এমন গোলগোল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে নিশ্চয় হাসত।আমি এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলাম নুসাইবার দিকে। হঠাৎ ই নাবিলার কন্ঠ আসল কানে,

” জ্যোতি? সে সন্ধ্যা থেকে সুযোগ খুঁজে যাচ্ছি তোর সাথে কথা বলার।কথা আর বলাই হলো না।এখনও সবার শেষেই খেতে আসলাম আমি।সব এই নুসুর জন্য।এতক্ষন ধরে ঘুমাচ্ছিল।সামান্তা আপু এই পর্যন্ত তিনবার ডেকে এল।বুঝলি?”

আমি হাসলাম নাবিলার কথা শুনে।নাবিলা ছটফটে স্বভাবী। একদম মনপ্রাণ খুলে কথা বলে সবার সাথে।শুনেছি, সামান্তা আপুও সেই প্রকৃতির।প্রচুর চঞ্চল আর প্রাণবন্ত। আর সে চঞ্চল মেয়েটিকেই চোখের সামনে এমন নিরব হয়ে যেতে দেখে ক্ষণে ক্ষণে অনুশোচনায় দগ্ধ হলাম আমি।আসলেই কি সবকিছুর জন্য আমিই দায়ী?সবকিছু কি আমারই দোষ?জানি না।কিছুই জানি না।ঠোঁট নেড়ে উত্তরে বললাম,

” আমিও খাবার টেবিলে খুঁজেছি তোকে।ভাবলাম তুই বুঝি নেই বা আসবি না।”

” উহ তেমন না।আমি বরাবরই ছোট চাচীর হাতের রান্না পছন্দ করি।তার হাতের খাবারের লোভ সামলাতে পারি না।কিন্তু নুসু তখন থেকে মরার মতো ঘুমাচ্ছিল।আম্মু আবার ওকে নিয়ে না আসলে বকত।তাই।”

আমি হাসলাম।নুসাইবার মুখে আলতো হাত রেখেই বললাম,

” তুই, নুসাইবা, নাফিসা আপু তিনজনই একদম একরকম দেখতে।দেখলেই বুঝা যায় তোরা তিনজনই বোন।”

নাবিলা হাসল খিলখিলিয়ে। বলল,

” এই কথাটা গ্রামের বাড়িতে গেলেও তুই বলতি।এখনও বললি।এই পর্যন্ত তোর থেকে হাজারবার শুনে ফেলেছি কথাটা।”

আমি মলিন হাসলাম।আরো কিছুক্ষন ওর সাথে কথা বললাম।তারপর মেহু আপু ও বাসা থেকে বের হতেই দুইজনে একসাথে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম।বাসায় এসে নিজের ঘরে ডুকে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়েই পড়তে হবে।না পড়লে তো জীবন চলবে না।দাদীর স্বপ্নপূরণ হবে না।আব্বাকে জবাব দেওয়া হবে না।বিষয়গুলো মাথার মধ্যে ঘুরতেই দ্রুত শোয়া ছেড়ে উঠে বসলাম।টেবিলের সামনে গিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়তে লাগলাম।ঘড়িতে তখন সাড়ে এগারোটা।মেহেরাজ ভাই এখনও বাসায় ফেরেনি।কেন ফেরেনি?সামান্তা আপুদের বাসায় না যাওয়ার জন্য অযুহাত দেখাতেই কি ফেরেনি?

.

ঠিক রাত একটা বাঁজেই দরজা খোলার আওয়াজ আসল।আমি ঘাড় কাঁত করে তাকালাম। আমাকে যে ঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছে সে ঘর থেকে মোটামুটি বসার ঘর থেকে সদর দরজা সবই দৃশ্যমান।আমি ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে দেখলাম মেহু আপু দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে।অথচ কোন কলিং বেল বাঁজে নি।কৌতুহল বশত তাকিয়ে থাকলাম আরো কিয়ৎক্ষন।দেখলাম মেহেরাজ ভাইকে ঘরে ডুকতে। কেমন ক্লান্ত আর মলিন মুখ।লম্বা- চওড়া, উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের মানুষটাকে কেমন উদাস দেখাল।সুদর্শন মুখটায় যেন সহস্র হতাশা ফুটে উঠল।যে হতাশা সমেতই তীব্র অসহায়ত্বের ছাপ ফুটে উঠল তার দৃষ্টিতে।যেন চোখের দিকে তাকিয়েই মুহুর্তে বুঝে ফেলা যায় মানুষটার ভেতরে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে সব।আমি চেয়ে থাকলাম।উনি হালকা গলায় মেহু আপুকে বললেন,

” ঘুমাসনি?ভাবলাম জেগে আছিস কিনা তাই নিচে থাকতেই কল করে জানিয়ে দিলাম।তুই যা ঘুমকাতুরে, সঙ্গে সঙ্গে কল ধরবি ভাবিনি।”

মেহু আপু বিনিময়ে প্রশ্ন ছুড়লেন,

” এতক্ষন কি করছিলে বাইরে?তুমি তো কোনদিন এত দেরি করে বাসায় আসো না।”

” কাল একটা চাকরির ইন্টারভিউ আছে না?তাই সাঈদের বাসায় গিয়েছিলাম৷ তাই দেরি হয়ে গেল।”

মেহু আপু শক্ত গলায় ফের বলল,

” মিথ্যে অযুহাত দিও না ভাইয়া।তুমি গম্ভীর হয়ে থাকলেও আমি তোমায় বরাবরই জেনে ফেলি এটা ভুলে যেও না।সামান্তার সম্মুখীন হবে না বলেই দেরি করে আসলে তাই না?কিন্তু ছোট চাচী অনেক কষ্ট পেয়েছে।উনি তো তোমাদের মধ্যকার এসবের কিছুই জানেন না।”

মেহেরাজ ভাই ঠোঁট গোল করে তপ্তশ্বাস ছাড়লেন।আমি সবটাই স্পষ্ট দেখতে পেলাম এই ঘর থেকে।রাতের নিরবতায় বসার ঘরের প্রত্যেকটা কথাও স্পষ্ট শুনতে পেলাম।তার মানে আমার ধারণাটাই ঠিক ছিল?মেহেরাজ ভাই সামান্তা আপুর সামনে পড়তে হবে বলেই পালিয়ে বেড়ালেন?আমি দৃষ্টি সরালাম দ্রুত।বইয়ের পাতায় নজর রাখতেই আবারও কানে আসল মেহেরাজ ভাইয়ের আহত কন্ঠ,

” তেমন নয় মেহু।বুকের ভেতরে যন্ত্রনা হচ্ছিল বড্ড।বন্ধুদের সাথে আড্ডা না দিলে সে যন্ত্রনা কমে আসত না।তাই। জ্যোতি কি ঘুমিয়ে গিয়েছে?”

আচমকা আমার নাম শুনেই কান খাড়া হলো।মস্তিষ্ক সচেতন হলো।মেহেরাজ ভাই আমার খোঁজ করছেন কেন?কি কারণে?ভ্রু বাঁকিয়ে আবারও বসার ঘরের দিকে তাকালাম।মেহু আপু বলল,

” না, ও পড়ছে ওর ঘরে।ঘুমাবে আরো পরে।”

মেহেরাজ ভাই মাথা নাড়ালেন।বললেন,

” ওহ,সাঈদ কেমন পড়িয়েছে?জিজ্ঞেস করেছিস?”

” না, করিনি।”

” আচ্ছা, ও পড়ুক।কাল সকালে জিজ্ঞেস করে নিব।আনোয়ার চাচাও কল করেছিল। বলেছিলাম বাসায় এসে কল দিয়ে কথা বলিয়ে দিব।এত রাতে বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছেস উনি।তার থেকে সকালেই বরং কল করব।তখন জ্যোতিও থাকবে।”

আমি অবাক হলাম।আব্বা? আব্বা কল করেছিল আমার সাথে কথা বলার জন্য?এটা ভাবনারও বাইরে।আব্বার কি সত্যিই এই আপদটাকে মনে পরে?নাকি শুধু লোক দেখানো দায়িত্ব দেখাতেই কল করলেন আব্বা?বুঝলাম না।সরু চোখে চাইতেই দেখলাম মেহেরাজ ভাই পা বাড়ালেন।মেহু আপু পেছন থেকে প্রশ্ন ছুড়ল তৎক্ষনাৎ,

” খেয়েছো তুমি?নাকি না খেয়েই আড্ডা দিলে এতক্ষন যাবৎ?”

মেহেরাজ ভাই বিনিময়ে উত্তর দিলেন না।পা জোড়া চালিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।মুহুর্তেই ধাম করে দরজার আওয়াজ আসল কানে।বুঝলাম, মেহেরাজ ভাই নিজের ঘরের দরজা লাগালেন।আমি শ্বাস ফেললাম।নিজেকে দুইদেশের সীমানায় আস্ত এক কাঁটাতার বোধ হলো।যে কাঁটাতার পেরিয়ে যেতে গিয়ে রক্তাক্ত হয় পা।ঠিক সেভাবেই যেন আমাকে কেন্দ্র করে দুই পাশে দুটো মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে।মানুষগুলো আর কেউ নয়।সামান্তা আপু আর মেহেরাজ ভাই।আর আমি তাদের মাঝে থাকা আস্ত এক কাঁটাতার!

#চলবে…..

এক মুঠো প্রণয় পর্ব-০৬

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_০৬
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

খাওয়া শেষ হতেই মেহেরাজ ভাই উঠে পা বাড়ালেন নিজের ঘরের দিকে।আমি আর মেহু আপু তখনও টেবিলে খাবার নিয়ে বসা৷ কিয়ৎক্ষন পর খাওয়া শেষ হলো।মেহু আপু থালাবাসন গুলো রান্নাঘরে নেওয়ার জন্য হাতে তুলতেই উঠে দাঁড়ালাম আমি।বললাম,

” আমি ও নিয়ে যাই কিছু?দুইজনে মিলে করলে তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে আপু।”

আপু হাসলেন। বললেন,

” তুই ছোটমানুষ।পারবি?”

আপুর কথা শুনে হাসি পেল।কিন্তু হাসলাম না।উত্তরে বললাম,

“বাড়িতে এত কাজ করতাম।কখনো দেখোনি আপু ?রান্নাবান্না থেকে সবই তো করতাম।তোমার কি মনে হয় পারব না?”

আপু মাথা নাড়িয়ে বললেন,

” না, না।তেমন নয়।এতদূর জার্নি হলো।ক্লান্ত না তুই?তাই বললাম।”

আমি কিছু বললাম না বিনিময়ে। আপুর সাথে সাথে হাতে কিছু প্লেটবাটি তুলে নিয়ে রান্নাঘরে গেলাম।কিয়ৎক্ষন পর দুইজনে সব ধুঁয়ে গোঁছগাছ করে বেরিয়ে আসলাম।মেহু আপু এক নজর আমার দিকে চাইলেন। মৃদু গলায় বললেন,

” সে এক জামাটাই পরে আছিস এখনো।পাল্টাবি না?আগে জামা পাল্টে নে।তারপর ঘুমাবি।”

আমি নিজের দিকে চাইলাম।হ্যাঁ, জামা পাল্টানো হয়নি।ব্যাগের কথা মনে পড়তেই ধীর পায়ে পা বাড়ালাম মেহেরাজ ভাইয়ের ঘরের দিকে।দরজার সামনে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলাম উনি আছেন কিনা।পরক্ষনেই উনাকে রুমের কোথাও না দেখে স্বস্তি মিলল।কিন্তু সে স্বস্তি বেশিক্ষন টিকল না।দরজার ওপাশে পা এগিয়ে ব্যাগটা হাতে নিতেই মেহেরাজ ভাইয়ের গমগমে স্বর কানে আসল,

” জ্যোতি, শোন।”

আমার পা জোড়া থেমে গেল তৎক্ষনাৎ।পেছন ফিরে না তাকিয়েই বলে ফেললাম,

” জ্বী, বলুন।”

মেহেরাজ ভাই হালকা কাঁশলেন।কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে বলে উঠলেন,

” এই পরিবেশে মানিয়ে নিতে কষ্ট হবে তোর?তুই যদি চাস তো আবারও ফিরে যেতে পারিস বাড়িতে।তখনও এই কথাটাই জিজ্ঞেস করেছিলাম।উত্তর দিসনি।উত্তরটা জানা দরকার।”

আমি এবার ঘাড় ঘুরিয়ে চাইলাম মেহেরাজ ভাইয়ের দিকে।মুখচোখ থমথমে।কেমন যেন গম্ভীর ভাব।শুধু যে এখনই তেমন না, উনার চোখমুখ প্রায় সবসময়ই গম্ভীর থাকে।কথাবার্তাও বলে খুব কম।আর এই স্বল্পভাষী গম্ভীর মানুষটাকেই প্রেমের প্রথম জোয়ারের উপস্থিতিতে ভালো লেগে গেল আমার।কিশোরী বয়সে প্রেমের মানে বুঝতেই আমি বুঝে উঠলাম উনাকে,এই মেহেরাজ ভাইকেই।উনার এই গম্ভীর ব্যাক্তিত্বকেই।এই ব্যাক্তিত্বের সামনে আমি নড়বড়ে অনুভব করতাম পূর্বে।সামনের মানুষটার সামনে নুঁইয়ে গিয়ে দুর্বলতা প্রকাশ পাওয়ার ভয়ে সবসময়ই এড়িয়ে চলার চেষ্টা চালাতাম।কিন্তু আজ আর সেই অনুভূতি কাজ করল না।অদ্ভুতভাবে টের পেলাম, আজ এইক্ষনে মেহেরাজ ভাইয়ের সামনে আমি আর নড়বড়ে অনুভব করছি না। বরং ভেতরটা প্রখরভাবে কঠোর অনুভব করলাম। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে উত্তর দিলাম,

” আপনার যদি অসুবিধা হয় বলে দিবেন,দাদীকে বললে দাদীই এসে নিয়ে যাবে আমায়।”

মেহেরাজ ভাই ভ্রু কুঁচকালেন।বললেন,

” তুই কি ঘুরেফিরে দোষটা আমাকেই দিতে চাইলি?”

” আপনাকে দোষ দিব?সে যোগ্যতা আছে আমার? ”

” তাহলে আমার অসুবিধার কথা আসল কেন?”

আমি তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসলাম।বললাম,

” ভেবে দেখুন,অসুবিধাটা আমার থেকে আপনারই বেশি হবে কিন্তু।তাই বললাম।”

মেহেরাজ ভাই বিরক্ত নিয়েই বললেন,

” অপ্রয়োজনীয় কথা!আমি তোর কাছে যা জানতে চেয়েছি তার উত্তর দিয়েছিস?”

আমি চুপ থাকলাম কিছুক্ষন।তারপর একনজর তাকিয়ে বললাম,

“এখানে আসার পর আবারও গ্রামের বাড়িতে ফেরত যাওয়াটা হাস্যকর ঠেকায় না মেহেরাজ ভাই? আপনি নামক পুরুষটার সাথে জড়িয়ে ছোট থেকে বড় সবার মুখেই আমার নামে অপমানজনিত কথাবার্তা সয়ে এসেছি।এখন ফেরত গিয় ঠাট্টা কিংবা উপহাসও সয়ে নিতে পারব।আমার পক্ষে কঠিন কিছুই নয়।এবার বাকিটা আপনার উপর। ”

” আমার খেয়াল হয় নি যে এখান থেকে ফেরত গেলে মানুষ উপহাস করবে।কথাটা তাহলে বলতাম না।ভেবেছি তোর পড়ালেখা কিংবক মানিয়ে নেওয়াতে ক্ষতি হবে তাই বলেছি।”

বিনিময়ে আমি উত্তর দিলাম না।মাথা নাড়িয়ে চলে আসতে নিতেই মেহেরাজ ভাই আবারো প্রশ্ন ছুড়লেন,

” তুই কিসে পড়িস?”

আমি চমকে পেছন ফিরে চাইলাম।আমি কিসে পড়ি এইটুকুও উনার জানা নেই?মেহেরাজ ভাইরা গ্রামের বাড়ি ছেড়ে এসেছে প্রায় দশ বছর।দশ বছর পর কি শুধু আমার নামটাই উনি মনে রেখেছেন?বয়স,কোন ক্লাসে পড়ি কিছুই জানেন না?অবশ্য জানারও কথা নয়।উনার কাছে কি আমি অতোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলাম যে উনি খোঁজ নিয়ে নিয়ে আমার সবকিছু জানবেন?তবুও গ্রামে যখন যেতেন দাদীর মুখে তো প্রায়সই আমার কথা শুনতেন।তাও জানেন না?হয়তো এক কানে শুনে অন্য কানে ঝেড়ে ফেলেছেন।কি দরকার অতো মনে রাখার?অথচ এই মানুষটার সবকিছুই আমি সুদূর দূরে থেকেও জেনে নিতাম।আড়ালে কিংবা সামনে যখনই উনার সম্বন্ধে যা জেনেছি সব মনে রেখেছি।আমার অবশ্য কষ্ট হলো না এইসব ভেবে।গলা ঝেড়ে উত্তর দিলাম,

” দ্বাদশ শ্রেণি।সামনেই টেস্ট পরীক্ষা।এরপর বোর্ড পরীক্ষা।তাই বোধহয় দাদী বারবার আপনাকে বলেছে পড়ালেখার বিষয়টা।”

মেহেরাজ ভাই চাইলেন মুখ তুলে।মাথা নেড়ে বললেন,

“হয়তো, ভালো করে মন দিয়ে পড়বি।নাবিলার সাথেই তো তাই না?”

আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললাম।উনি ফের প্রশ্ন ছুড়লেন,

” সাইন্স না?”

আমি আবারো মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললাম।উনি ছোটশ্বাস ফেলে বলে উঠলেন,

” টেবিলের কোণায় বড়োসড়ো ব্যাগটা তোর বইয়ের।বই, টেবিল, চেয়ার সব আছে।কাল থেকে পড়া শুরু করে দিস। ”

আমি মিনমিনে চোখে চাইলাম।ইতস্থত বোধ করে বলেই ফেললাম,

” এইখানে?মানে এই ঘরে?”

উনি অস্পষ্ট কন্ঠে বললেন,

” হ্ হু?”

” আপনার ঘরে?”

উনি চুপ থাকলেন ।কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে আমার অস্বস্তি বুঝেই বোধ হয় বলে উঠলেন,

” এই বাসায় আরো একটা রুম আছে।কেউ থাকে না ও রুমে, তাই ময়লা হয়ে আছে।কাল শিমা আপাকে বলব ঝাড় দিয়ে পরিষ্কার করে দিতে।বইপত্র নিয়ে ওখানেই শিফট করিস।আপাতত মেহুর সাথে মানিয়ে নিস।”

আমি মাথা নাড়ালাম।তারপরই দ্রুত কাপড়ের ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে আসলাম।মাথার ভেতর ভবনারা ডানা মেলল। মেহেরাজ ভাইয়ের আমার বিষয়ের জানার এত দরকার কিসের?আমার বিষয়ে আগ্রহ নিয়ে প্রশ্নই বা করলেন কেন?কোন ক্লাসে পড়ি, কিসে পড়ি এত কিছু জানার কি প্রয়োজন আছে?পরমুহুর্তেই মস্তিষ্ক জানান দিল, এটা কেবল এবং কেবলই তার দায়িত্ব।এইছাড়া কিচ্ছু নয়।আমার মন অবশ্য এর থেকে বেশি কিছু প্রত্যাশা করল ও না।কেনই বা করবে?

.

সকাল হলো। মেহু আপুর ঘরের জানালা দিয়ে স্বচ্ছ আলো ঘরে প্রবেশ করে তারই জানান দিল। আমি তৎক্ষনাৎ ঘুম ছেড়ে উঠলাম।পরনের ওড়নাটা দিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনেই জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।সঙ্গো সঙ্গে চোখে পড়ল অপর প্রান্তের ব্যস্ত নগরী।এই ভোরবেলায়ও শহুরে রাস্তা ফাঁকা নেই।গাড়ির পর গাড়ি জমে আছে ছাঁইরাঙ্গা রাস্তায়।অদূরে মানুষের চলাচলও চোখে পড়ল।আমি স্থির চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে সেসবই দেখতে লাগলাম।মুহুর্তেই এই ভীষণ ব্যস্ত শহরে নিজেকে খুব একা বোধ করলাম। বাড়িতে থাকলে দাদী নির্ঘাত ভোরে ভোরেই ঘুম থেকে ঠেলেঠুলে উঠিয়ে নামাজ পড়তে ডাকত। কিংবা উনুনে আগুন জ্বালিয়ে চা বানানোর জন্য কথা শোনাত।কিংবা ঘর ঝাড়ু দেওয়ার জন্য কঠিন গলায় কয়েকবার বকা দিয়ে বসত। ইশশ!সেই কঠোর দাদীকেই আজ খুব করে মনে পড়ছে আমার। সেই কঠোর দাদীকে ছাড়াই আমি একাকীত্বের সাগরে ডুবে যাচ্ছি আজ।আচ্ছা, দাদী এখন কি করছে? আমাকে কি মনে পরছে দাদীর?কে জানে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুম ছেড়ে বের হলাম আমি।সব নিশ্চুপ!মেহেরাজ ভাই কিংবা মেহু আপু কেউই ঘুম ছেড়ে উঠেনি।হয়তো এত সকালে ঘুম থেকে উঠেও না উনারা।আমি কিয়ৎক্ষন পায়চারি করে সদর দরজা মেলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম। মিনিট পাঁচের মধ্যেই প্রসস্থ ছাদ চোখে পড়ল।খসখসে মেঝেতে পা ফেলেই ছাদের কার্নিশে গিয়ে দাঁড়ালাম।চোখ বুলিয়ে দেখতেই চোখে পড়ল ছাদের এককোণে ফুলের অনেকগুলো গাছ।হরেক রকম ফুল।গোলাপ,গাঁধা সহ কাঠগোলাপও।কে লাগিয়েছে?নাবিলা, সামান্তা আপু নাকি মেহু আপু?নাকি নাবিলার বড়বোন নাফিসা আপু?উত্তর না পেয়ে পাশ ফিরে চাইতেই দেখতে পেলাম পঞ্চাষোর্ধ ফাতেমা আন্টিকে।কাল রাতেই মেহু আপু বলেছিল উনার নাম।আমি উনাকে দেখে কি বলব বুঝে না উঠলেও উনি ঝটফট বলে উঠলেন,

” এই কি।এত তাড়াতাড়ি ঘুম ছেড়ে উঠে গেলে?তোমার অভ্যাস আছে বুঝি এত ভোরে উঠার?”

আমি মাথা নাড়িয়েই উত্তর দিলাম,

” হ্যাঁ।”

উনি হাসলেন।বিনিময়ে আবারও প্রশ্ন ছুড়ে জিজ্ঞেস করলেন,

” তা তোমাদের বিয়েটা কোথায় হলো?কিভাবে হলো?আগে থেকেই সম্পর্ক ছিল?”

ভদ্রমহিলার অতি আগ্রহ আর কৌতুহল দেখে অবাক হয়ে চাইলাম আমি।বললাম,

” না, আগে থেকে সম্পর্ক ছিল না।”

” তবে এভাবে হুট করে বিয়ে হলো যে?পারিবারিক ভাবে বিয়ে হলে তো আমরাও জানতে পারতাম।এদিকে বলছো প্রেমের বিয়েও নয়।”

ভদ্রমহিলাকে উত্তরে বলার জন্য কিছুই খুঁজে পেলাম না আমি।মস্তিষ্ক ফাঁকা বোধ করলাম।চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতেই ভদ্রমহিলা আবারও বলে উঠল,

” নিরবতার উত্তর কি ইতিবাচকই ধরে নিব? আমি আগে কি ভাবতাম জানো? ভাবতাম মেহেরাজ আর সামান্তার মাঝে প্রেম আছে।দুইজনকে দেখতাম ছাদে আড্ডা দিত।সামান্তা ওর ফুলের বাগানে যত্ন করার সময় মেহেরাজও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখত।কখনো ফুল ছিড়ে হাতে দিত। এখন দেখি মেহেরাজ প্রেম করে বিয়ে করে বউও নিয়ে চলে এসেছে।সত্যিই তখন কি না কি ভেবেছি আমি।এখন হাসি পাচ্ছে এসব ভেবে।”

ভদ্রমহিলাকে বলা হলো না, উনার তখনকার ভাবনাই সঠিক ছিল।আর এখনকার ভাবনা মিথ্যে।শুধু হালকা হাসার চেষ্টা করলাম আমি।পরপর সেই স্থান ছেড়ে পা বাড়ালাম।এমন মানুষদের সামনে থাকলে ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়।কি না কি জিজ্ঞেস করে বসে।আমি স্বল্পভাষার মানুষ।পরে ভদ্রমহিলার বিশাল বিশাল প্রশ্নের উত্তর হিসেবে বিশাল বিশাল কথা কোথায় খুঁজে পাব?তার থেকে সরে আসা ভালো।

.

বেলা এগারোটার সময়ই শিমা আপা নামক মানুষটার আগমণ ঘটল।মেহেরাজ ভাই তখন বাইরে। আর মেহু আপু আমাকে উনার পরিচয় দিয়েই তড়িঘড়ি করে ঘরে গেল মোবাইলের রিংটোনের আওয়াজ পেয়ে।আমি চোখ মেলে চাইলাম শিমা আপার দিকে।মাথার চুলে পাঁক ধরেছে।গায়ের রং আমারই মতো চাপা।পান খাওয়া ঠোঁট জোড়া লাল টকটকে দেখাল। এমনকি দাঁতগুলোও পানের লালচে রংয়ের কারণেই বিচ্ছিরি দেখাল।তবুও কেন জানি না উনার ছটফটে স্বভাব আমার ভালো লাগল।উনি উচ্ছ্বল কন্ঠে আমার দিকে তাকিয়েই বলে উঠলেন,

” তুমি দেহি নতুন মানুষ।কেডা তুমি?আগে তো কহনও দেহি নাই।”

সরাসরি এমন প্রশ্নে আমি হাসলাম হালকা।উত্তরে বললাম,

” আমি?আমি জ্যোতি।মেহু আপুদের গ্রামের বাড়ির মানুষ।”

” তোমার লাইগাই কল কইরা ঘর ঝারতে কইল বড় ভাইয়ে?তুমি তো আইয়া আমার কাম বারাই দিলা মাইয়া।”

” আপনি চাইলে আমি সাহায্য করতে পারি খালা।তাহলে কাজ কমই লাগবে।”

শিমা আপা মুহুর্তেই রেগে গেলেন।রাগে ফোঁসফাঁস করে শ্বাস ছাড়লেন।ঝটফট করে বলে উঠলেন,

” এইই মাইয়া!তুমি আমারে কি কইলা?কি কইলা তুমি?”

আমি বোকা বোকা চোখে চাইলাম।কি বললাম আমি?আশ্চর্য!কি এমন বলে ফেললাম যে উনি এমন রেগে গেলেন?আমি ভাবলাম। কিন্তু কোন উত্তর খুঁজে পেলাম না।হতাশ হয়েই বললাম,

” কি বলেছি আমি?”

“তুমি আমারে খালা কইলা ক্যান?খালার মতো লাগে আমারে?আমারে আপা কইবা।শিমা আপা।বয়স আর কদ্দূর আমার!”

আমি ছোট্ট শ্বাস ফেললাম।আপা-খালা খেলায় ক্লান্ত হয়ে আবারও বলে ফেললাম,

” আচ্ছা খালা,আপাই ডাকব।”

শিমা আপা আবারও রাগলেন।বললেন,

” আবারও কয় খালা।কও শিমা আপা।”

আমি চোখ ছোট ছোট করলাম।হতাশ হয়ে কিছু বলব ঠিক সেই মুহুর্তেই মেহু আপু খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।ঠোঁট নেড়ে বলে উঠল,

” ও নতুন তো।অভ্যাস হয়ে যাবে শিমা আপা।তুমি রাগ করো না।”

শিমা আপা দাপট নিয়ে বললেন,

” রাগ করুম না?তোমারে মেহু আপা না কইয়া মেহু খালা কইয়া ডাকলে কেমন লাগব?”

” আচ্ছা, আর বলবে না।”

” মনে থাহে যেন।কিন্তু মাইয়াডা তোমাগো হয় কেডা?”

মেহু মৃদু গলায় উত্তর দিল,

“ও আমার ভাবী হয় সম্পর্কে।তবে এমনিতেই বোনই হয়।”

শিমা আপা বুঝলেন না।ভ্রু কুঁচকে চেয়ে বললেন,

“কি কও?”

মেহু আপু ক্লান্ত চোখে তাকালেন।বললেন,

“তুমি অতোসব বুঝে কি করবে?”

” জানুম না তাই বইলা?”

” ভাবি কাকে বলে?”

” ভাইয়ের বউরে। ”

” জ্যোতিও আমার ভাইয়ার বউ।হয়েছে?”

শিমা আপা অবাক হলো। চোখ বড়বড় করেই বলে উঠল,

” কি কও?বড় ভাইয়ের বউ? বড় ভাইয়ে বিয়া কইরা লইছে?বিয়া করছে ভালা কথা, দুইজন দুইঘরে থাকব ক্যান?ওগো সত্যি সত্যিই বিয়া হইছে?নাকি তুমি মিছা কথা কও?”

শিমা আপার প্রশ্নের জবাবে মেহু আপু কি বলবে তারই অপেক্ষায় ছিলাম আমি।কিন্তু অপেক্ষার প্রহর না কাঁটতেই বাসায় ডুকল মেহেরাজ ভাই।পায়ের মোজা খুলতে খুলতেই ভরাট গলায় উত্তর দিলেন,

” না, সত্যিই বলেছে আপা।বিয়েটা সত্যি সত্যিই হয়েছে।”

আমি চমকে গেলাম মেহেরাজ ভাইয়ের সহজ ভাষার স্বীকারোক্তিতে।উনি কি সত্যিই বিয়েটাকে সত্যি হিসেবে মেনেছেন?আধো এই বিয়ের অস্তিত্বকে নিজ থেকে স্বীকৃতি দিতে পেরেছেন?জানা নেই আমার।চোখ ফিরিয়ে মেহেরাজ ভাইয়ের দিকে নির্বিকারভাবে চেয়ে থাকলাম।উনি আবারও বললেন,

” পশ্চিমের রুমটায় ময়লা হয়েছে।অনেকদিন ও ঘরে যায় ও না কেউ।ধুলোময়লায় বোধহয় ও ঘরের অবস্থা বিচ্ছিরি রকম হয়ছে।তাই একটু পরিষ্কার করে দিতে বলেছি আপা।এবার সে ঘরে কে থাকবে না থাকবে এসব ভাবা কি আপনার জন্য অতি জরুরী বিষয় আপা?”

মেহেরাজ ভাইয়ের কন্ঠে কি ছিল কে জানে শিমা আপা একদম দমে গেলেন।সেকেন্ডেই তার দাপট দেখানো মুখ চুপসে গেল।পাজোড়া চালিয়ে দ্রুত সরে গেলেন সেই জায়গা থেকে।আমি অবাক হলাম।মেহেরাজ ভাইকে এতটাই ভয় পায়? অবশ্য ভয় পাওয়ারই কথা।ওরকম গোমড়া মুখ আর গম্ভীর কন্ঠ শুনে ভয় তটস্থ থাকা ছাড়া কি আর কোন উপায় থাকে?

#চলবে…

এক মুঠো প্রণয় পর্ব-০৫

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_০৫
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

মেহেরাজ ভাইদের বাসার প্রত্যেকটা ঘর উঁকিঝুকি দিলাম। অবশেষে গিয়ে মেহু আপুর ঘরটা পাওয়া গেল।দরজা খোলাই আছে।ভেতরে মেহু আপুকে বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুঁয়ে থাকতে দেখেই হাসি পেল।তবুও হাসলাম না।নরম গলায় বলে উঠলাম,

” আপু, আসব?”

আপু হঠাৎ হকচকিয়ে উঠল।শোয়া ছেড়ে সোজা উঠে বসে আমার দিকে তাকাল। বলে উঠল,

” এই জ্যোতি, তুই আমার ঘরে আসতে জিজ্ঞেস করে আসবি নাকি?যেকোন সময়, যখন ইচ্ছে তখনই আসতে পারিস। নিষেধ নেই।”

আমি সৌজন্যতামূলক হাসলাম।পা বাড়িয়ে আপুর কাছে গিয়েই বললাম,

” ও ঘরটা মেহেরাজ ভাইয়ের?তুমি আমাকে মেহেরাজ ভাইয়ের ঘরেই রেখে এলে?”

” চাচীরা বলেছিল, তোর আর ভাইয়ার বিয়ে হয়েছে।সেই হিসেবে তোরা একঘরেই থাকার কথা।হ্যাঁ, এটা ঠিক যে বিয়েটা ঠিক পরিস্থিতিতে হয়নি।তোদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হয়েছে, কিন্তু হয়েছে তো বিয়েটা। তোরা দুইজন এখন স্বামী-স্ত্রী, এটাই সত্য।তো দুইজনের একঘরে থাকা তো অযৌক্তিক নয় জ্যোতি।”

আমি ছোট্ট শ্বাস ফেললাম।ক্লান্ত চাহনীতে তাকিয়ে শুধালাম,

“যদি তোমার সাথে থাকব বলি অসুবিধা হবে কি আপু?”

আপু চুপ থাকলেন কিছুক্ষন।তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,

” সত্যি বলব?আমার সাথে একঘরে থাকতে গেলে তুই বিরক্ত হয়ে যাবি।রাতে দেখা যাবে ঘুমের মধ্যে হুটহাট লাথি মেরে ফেলে দিব। একবার নাবিলাকে সোজা ফ্লোরে ফেলে দিয়েছিলাম।সে থেকে নাবিলা, সামান্তা কেউই কোথাও গেলেও আর আমার সাথে ঘুমোয় না।”

আপুর কথা সত্য।নাবিলা একবার গ্রামের বাড়ি গিয়ে কথাটা বলেছিল আমায়।নাবিলা হলো মেহেরাজ ভাইয়ের মেঝ চাচার মেয়ে।আমার সমবয়সীই বলা যায়।আগে গ্রামের বাড়িতেই থাকত বিধায় তার সাথে আমার সখ্যতাও আছে।আমি হতাশ গলায় বললাম,

” আমি যদি মানিয়ে নিতে পারি তোমার সাথে? ”

মেহু আপু আমাকে পুনরায় হতাশ করে দিয়ে জবাব দিলেন,

” চাচীরা দুইদিন পর গ্রাম ছেড়ে শহরে ফেরত আসবে।এসে যদি কিছু বলে তখন সব দোষটাই আমার উপর পড়বে।তুই ভাইয়াকে বিশ্বাস করতে পারিস। ভাইয়ার সাথে একঘরে থাকলে তোকে তেমন কোন সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে না।ভাইয়ার ব্যবহার, আচরণ ভালো।বিশ্বাস নাহলে মিলিয়ে নিস৷ ”

আমি চোখ বুঝে বিশ্বাস করলাম সব কথা।কারণ সবটাই আমার জানা।মেহেরাজ ভাই যে মেয়েদের প্রাপ্য সম্মানটা করেন তাও জানা।তাই আর কথা বাড়ালাম না।বসে থাকলাম মেহু আপুর পাশে।আপু আরো নানান রকম কথার আসর জমালেন।আমি সেসব চুপচাপ শুনতে লাগলাম।আর মনে মনে ভাবলাম, সৃষ্টিকর্তা যা কিছু নেন তার পরিবর্তে অবশ্যই কিছু ফেরত দেন।এই যেমন দাদীর ভালোবাসা হারিয়ে ফেলার ভয়ে তটস্থ থাকা আমাকে আরো একটা ভালোবাসা ফেরত দিলেন।তা হলো মেহু আপু!এইটুকু সময়েই মনে হলো কতোটা ভালোবাসা উপহার দিলেন আমায়।আমি চোখ বুলিয়ে আপুর রুম দেখছিলাম। মুহুর্তেই চোখে পড়ল দেওয়ালে টাঙ্গানো চারকোণা ফ্রেমে বাঁধানো একটা ছবি।ছবিটা আমাদেরই ছোটবেলার।আমি, মিথি, মেহু আপু, নাবিলা চারজনই উপস্থিত ছবিতে।মিথির তখন বোধ হয় দুই বছর বয়স।আর আমি তখন সাত বছরের বালিকা। আমার কোলে কি সুন্দর মানিয়েছে মিথিকে।ফর্সা ধবধবে প্রাণবন্ত ছোট্ট মেয়ে!সেই ছোট্ট মিথিকে দেখে আমার মায়া হলো৷ কাছে টেনে চুমু খেতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু সম্ভব হলো না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,

“এই ছবিটা কবে তুলেছিলে আপু? মিথিও তো আছে এইখানে।”

আপু ছবিটার দিকে চাইলেন।বললেন,

” অনেক আগেকার ছবি।কবে তোলা হয়েছে তা তো মনে নেই। শৈশবের ছবি!জানি মৃত মানুষের ছবি রাখতে নেই তবুও কেন জানি না ছবিটা আমার খুব প্রিয়।আর ভালো লাগে বিধায়, মিথি থাকা স্বত্ত্বেও ছবিটা টাঙ্গিয়ে রেখেছি।”

আমি হালকা হাসলাম।সত্যিই প্রিয় মানুষদের ক্ষেত্রে অতো নিয়মকানুন মানতে মন চায় না।যেমন, আমার কাছেও মিথির একটা সুন্দর ছবি বাঁধানো আছে।এখনও আছে ব্যাগের মধ্যে।আবার এই যেমন, মেয়েদের কবরে যাওয়া নিষেধ স্বত্ত্বেও আমি মিথির কবরে যেতাম প্রায়শই।কথা বলতাম।দাদীও আমায় নিষেধ করত না কখনো।হয়তো বা দাদীও এই নিয়মকানুনের বেড়াজালে নিজের আবেগ-অনুভূতিকে মুঁছে দিতে পারত না। দু-চারবার দাদীকেও আমি দাদার কবরে খুব ভোরবেলা দেখতে পেয়েছিলাম।মানুষ জাতি সত্যিই কত অদ্ভুত!বিবেকবানরাও অনুভূতি দমাতে পারে না।আবেগ লুকোতে পারে না।আমি এসব ভেবে ভেবেই একপলকে চেয়ে রইলাম ছবিটার দিকে।পর্যবেক্ষন করলাম মিথির মিষ্টি হাসিটা।ঠিক তখনই মেহেরাজ ভাইয়ের গম্ভীর কন্ঠে নিজের নাম শুনতে পেলাম।তৎক্ষনাৎ অবাক হলাম। ভাবনা ছেড়ে দ্রুত বের হয়ে সামনে তাকালাম। চোখের সামনে মেহেরাজ ভাইয়ের জ্বলজ্যান্ত মূর্তি আবিষ্কার করেই উত্তর দিলাম,

” জ্বী।”

মেহেরাজ ভাই আগের ন্যায় গমগমে স্বরে প্রশ্ন করলেন,

” তোর কাছে কি মোবাইল আছে? ”

হঠাৎ প্রশ্ন করায় বুঝে উঠলাম না।আমি অস্পষ্ট স্বরে বললাম,

” হ্ হু?”

উনি আবারও বলে উঠলেন,

” মোবাইল নিয়ে এসেছিস?”

আমি মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলাম,

” হ্যাঁ, এনেছি।আজই দাদী একটা মোবাইল দিয়েছেন আমায়।নিয়ে এসেছি।”

” তোকে কেউ কল দিয়েছে হয়তো।রিংটোনের আওয়াজ আসছে তোর ব্যাগ থেকে।গিয়ে দেখ। কেউ কল দিয়েছে। ”

আমি উঠে দাঁড়ালাম।কল দেওয়ার কথা আর কারই বা থাকবে? মোবাইল নম্বর তো মিনার ভাই ছাড়া কারো কাছে নেই।হয়তো দাদীই কল দিয়েছেন। কথাটা ভেবেই দ্রুত পা বাড়ালাম।মেহেরাজ ভাইয়ের রুমে ফ্লোরে পড়ে থাকা ব্যাগটা থেকে বাটন ফোনটা বের করতেই কল কেঁটে গেল। আমি হতাশ হলাম। কিয়ৎক্ষন অপেক্ষা করতেই পুনরায় আবার কল এল।মুহুর্তেই খুশি হলাম আমি।উচ্ছ্বাসিত চাহনীতে চাইলাম মোবাইলের দিকে।নাম্বারটা আমি চিনি।এটা মিনার ভাইয়েরই নাম্বার।সঙ্গে সঙ্গে কল তুলে কানের কাছে নিয়েই বললাম,

” আসসালামুয়ালাইকুম মিনার ভাই।কেমন আছো তুমি?”

মিনার ভাই কিয়ৎক্ষন চুপ থাকলেন।আমার প্রশ্নকে কি সুন্দর এড়িয়ে গিয়েই বলে উঠলেন,

” নানী তোর সাথে কথা বলবে। এতদূর গেলি, এতক্ষন সময় কাঁটল। দাদী চিন্তা করবে তা তো জানতিই, গিয়ে একবার কল দিলি না যে?অন্তত গিয়ে যে পৌঁছাইলি তা তো বলতে পারতি।”

আমি চুপ থাকলাম।কিয়ৎক্ষন পর ওপাশ থেকে দাদীর কন্ঠ ভেসে আসল,

” এই জ্যোতি? আছস তুই?কথা কস না ক্যান?”

আমার মুখে হাসি ফুটল দাদীর গলা শুনে। বাড়িতে এই মানুষটার ভয়েই তটস্থ থাকতাম আমি।এই মানুষটার বকাবকির ভয়ে কোন কাজে ভুল করার সাহসই হতো না।আর আজ এই মানুষটা আমার থেকে কত দূরে।কত বেশি দূরত্ব দুইজনার মধ্যখানে। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে উত্তর দিলাম,

” আছি দাদী। কেমন আছো তোমরা?”

” কেমন থাকুম?তুই যে গেলি আর কল দিয়া কথা কইছস?আমি এইহানে চিন্তায় শেষ, গিয়া পৌঁছাইছস কিনা।আর তুই? ”

” আসলে আসার পর আর খেয়ালই ছিল না দাদী।কিছুক্ষন আগেই এসেছি। একটু পর কল দিতামই। মাত্রই মুখচোখে পানি দিয়ে মেহু আপুর ঘরে গেলাম।”

দাদী স্পষ্ট গলায় বললেন,

” আইচ্ছা বুইঝলাম।নিজের খেয়াল রাহিস।হাত মুখ ধুঁইয়া জিরাইয়া নে একটু।তারপর ঘুমাইয়া নে।তোর বই খাতা সব কিন্তু আমি মেহেরাজরে গোঁছাইয়া দিছিলাম।কাল থাইকা পড়ালেহাটা শুরু করিস ভালা কইরা। বিয়া দিয়া দিছি বইলা থাইমা যাইস না জ্যোতি।”

দাদীর কথাগুলো শুনে হাসি পেল।বিয়ে দিয়ে এখন বলছে বিয়ে দিয়ে দেওয়াতে থেমে না যেতে।সবথেকে বেশি হাসি আসল আব্বার কথা ভেবে।পড়ার সুযোগ চাইতেই কলেজ জীবনের গন্ডি পার না হওয়া আমাকে আব্বা এখনই বলে দিলেন,” আর পড়ার দরকার নেই।” আমার মাথায় মুহুর্তেই ক্ষোভ জাগল।সূক্ষ্ম জেদ মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে জড়ো হয়ে জানান দিল,” যেভাবেই হোক পড় জ্যোতি।অন্তত তোর আব্বাকে হলেও দেখিয়ে দিতে হবে তুই থেমে নেই।”

আমি ভাবনা ছেড়ে বের হলাম।দাদী আরো কিয়ৎক্ষন বলে গেলেন নিজের মতো।চুপচাপ সেসব শুনে গেলাম।একটা সময় পর দাদী কল রাখলেন।আমি মোবাইলটা আবারও রেখে দিলাম।একনজর চোখ বুলিয়ে মেহেরাজ ভাইয়ের ঘরটা দেখলাম।ছিমছাম সাদামাটাই ঘর।বিছানার উপর একটু আগের পরনে থাকা ঘামে ভেজা জামাকাপড়গুলোই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা।জানালা সোজা বরাবর একটা টেবিল আর চেয়ার।তার পাশেই আলমারি।একপাশে কাপড় রাখার আলনা।আমি আর দাঁড়ালাম না সে ঘরে।এক নজর চোখ বুলিয়ে দ্রুত বের হয়ে মেহু আপুর ঘরেই ফেরত এলাম।আপু ততক্ষনে ফ্রেশ হয়ে কাপড়চোপড় পাল্টে নিয়েছেন।আমাকে দেখেই হেসে বললেন,

” কথা হয়েছে বাড়িতে?”

মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলাম,

” হ্যাঁ।”

” দাদীর সাথে কথা হয় নি?”

” আর কার সাথেই বা কথা হবে?দাদীর সাথেই কথা বলে আসলাম।”

মেহু আপু এবার বিনিময়ে কিছু বলল না।আমি চুপচাপ বসে থাকলাম।ছোট থেকে কোনদিন এতটুকু পথ ভ্রমন না করায় শরীর ভেঙ্গে আসছে কেমন।চোখ নিভু নিভু হয়ে এল।মুহুর্তেই মন চাইল ক্লান্তির সাগরে ডুব দিয়ে ঘুমের দেশে তলিয়ে যাই। তবুও ঘুমোতে বাঁধা দিল মন।মাথাটা দেওয়ালে হেলান দিয়েই চুপচাপ বসে রইলাম এককোণে।শুনতে লাগলাম মেহু আপুর অল্পস্বল্প কথোপকোথন।

.

আমার চোখ লেগে এল।কখন লেগে এল জানা নেই।তবে মেহু আপুর ডাক পেয়েই হঠাৎ হকচকিয়ে উঠলাম।বুঝলাম যে, ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।মেহু আপু তাড়া নিয়েই বলে উঠল,

” এই জ্যোতি, উঠ উঠ।ভাইয়ার নাকি রান্না করা শেষ। খেতে ডেকে গিয়েছে এক্ষুনিই।”

আমি অতি কষ্টে চোখ মেলে চাইলাম।মেহু আপুকেও খাটের এককোণে হেলেদুলে শুঁয়ে থাকতে দেখে চোখ ছোট ছোট হয়ে এল।তার মানে আপুও ঘুম দিয়েছে।কিন্তু হঠাৎ জেগে উঠার কারণ কি?ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়ে বললাম,

” আপু ঘুমাই?সত্যি খুব ঘুম পাচ্ছে।”

আপু ছোট ছোট চোখে মোবাইলের স্ক্রিনে চাইল। ব্যস্ত কন্ঠে বলল,

” এলার্ম বেঁজেছে আরো দশমিনিট আগে।এখন এগারোটা বাঁজে।ভাইয়া রান্না শেষে করে নির্ঘাত তিনবার ডেকে চলে গিয়েছে।আমি বোধহয় শেষ বারই শুনতে পেলাম সেই ডাক।”

আমি কথার আগামাথা বুঝলাম না।ক্লান্ত গলায় প্রশ্ন ছুড়লাম,

” মানে?”

আপু উঠে বসে বললেন,

” আরেহ সন্ধ্যায় ও তো কিছু খাওয়া হয় নি।রাতের খাবার খাবি না?শিমা আপাকে তো বলেছিলাম আমরা গ্রামে থাকব কয়েকদিন। তাই আপাও আসেনি।প্রায় সময় শিমা আপা না থাকলে রান্নাটা ভাইয়াই করে। আজও ভাইয়াই রান্না করেছে।তখন তোকে কল আসার কথা বলে রান্না করতে রান্নাঘরে ডুকল তো।এখন রান্না শেষ করে ডেকে গেল।”

আমি হতবিহ্বল চোখে চেয়ে থাকলাম।মেহেরাজ ভাইয়ের রাগ রাগ চোখ, আর জেদ জেদ চেহারায় কখনো মনেই হয়নি উনি রান্নাও করতে পারেন।আচ্ছা,এতদূর ভ্রমন করে উনি ক্লান্ত হননি? আমার যেমন শরীর ভেঙ্গে আসছে উনারও কি একই অবস্থা না?তবুও রান্না করতে লেগে গেলেন?মেহু আপুর কথা আসলেই সত্যি।সত্যিই উনি দায়িত্ববান।আমি চুপচাপ সেসব ভাবলাম।মুহুর্তেই অন্য চিন্তা মাথায় আসল।ঘুমে বেঘোর থাকা আমি ঠিক কোন অবস্থায় ছিলাম যখন মেহেরাজ ভাই ডেকে গেল?এতটা ঘুমে বেঘোর ছিলাম যে ডেকে যাওয়ার পরও আমি ঘুমেই আছি।আমার অস্বস্তি হলো।তবুও নিজেকে স্থির করলাম। কপালে আসা অগোছাল চুল কানে গুঁজেই সোজা উঠে বসলাম।চোখেমুখে পানি দিয়ে এসে ঠাঁই আবারও বসতেই মেহেরাজ ভাই রুমে আসলেন।মেহু আপু তখন ওয়াশরুমে। আমি একবার উনার দিকে তাকিয়ে নজর সরাতেই উনি বলে উঠলেন,

” মেহু কোথায়?বেলকনিতে?”

আমি গলা ঝাড়লাম।পরিষ্কার গলায় উত্তর দিলাম,

” না, মেহু আপু ওয়াশরুমে।”

মেহেরাজ ভাই চুপ থাকলেন।কিয়ৎক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে কিছু না বলেই চলে গেলেন।আমি মিনমিনে চোখে চেয়ে থাকলাম।কিয়ৎক্ষন পর মেহু আপু বের হয়েই টেনে নিয়ে আসল বাইরে। খাবার টেবিলে চেয়ার টেনে বসাতেই আমি অবাক হয়ে চাইলাম।টেবিলের অপর পাশে মেহেরাজ ভাই টানটান মুখ নিয়ে বসে থাকলেন।কপালে ভাজ।আমি তাকালাম না আর।মেহু আপু খাবার বেড়ে প্লেটে রাখতে ব্যস্ত হলেন।তখনই মেহেরাজ ভাই কাঁটকাঁট গলায় বলে উঠল,

” জ্যোতি, তোর বইখাতা সব আলাদা ব্যাগে আছে।গ্যাপ দিস না।দাদী বারবার করে বলে দিয়েছিল বিষয়টা।পরে সব দোষ আমার উপরই উঠবে।এমনিতেও অনেক কথাই উঠেছে আমার নামে।অনেক কিছুই রটে গিয়েছে।”

আমি বিনিময়ে কিছু বললাম না।বুঝেই উঠলাম না মেহেরাজ ভাইয়ের কন্ঠে শাসন নাকি রাগ! নাকি সব রটনার জন্য অস্পষ্টভাবে আমাকেই দায়ী করলেন?

#চলবে….

এক মুঠো প্রণয় পর্ব-০৪

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_০৪
লেখনীতেঃএকান্তিকা নাথ

মেহেরাজ ভাইয়ের মুখ টানটান।চুলগুলো উষ্কুখুস্কু।এমন কি চেহারাও শুকনো দেখাল।আমি দূর হতে একপলক তাকিয়েই নজর সরালাম দ্রুত।কিয়ৎক্ষন পর উনি এগিয়ে এলেন এদিকে।দরজার দ্বারে পড়ে থাকা ব্যাগটা হাতে নিয়ে আমার সামনে দাঁড়ালেন।তারপরই গমগমে স্বরে বললেন,

” জ্যোতি শোন, বিয়েটা আকস্মিক ভাবে হয়েছে। বিয়েটা হোক যেমনটা তুই চাসনি, তেমনই আমিও চাইনি।জোর করছি না তোকে, তোর কি ওখানে যাওয়াতে মত আছে?পড়ালেখায় অসু্বিধা হবে তোর?”

মেহেরাজ ভাইয়ের গম্ভীর কন্ঠে কাঠিন্য। তবুও কেন জানি না উনার এই মতামত চাওয়ার বিষয়টা আমার ভালো লাগল। মানুষটার সাথে আমার কোন রক্তের সম্পর্ক নেই,নেই কোন আত্মিক সম্পর্কও। আবার এমনও নয় যে তার সাথে আমার বহুদিনের একসঙ্গে বাস। তবুও উনি আমি নামক নগন্য মানুষটার মতামত জানতে চেয়েছেন। এইটুকুই যথেষ্ট! উল্টোদিকে আমার আব্বা আর দাদী? যাদের সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক আছে, তারাই একবারও তো জিজ্ঞেস করলেন না আমার মনে কি চলছে।একবারও জানতে চাইলেন না আমি ভালো থাকব কিনা।আমি হতবিহ্বল নয়নে একবার মেহেরাজ ভাইয়ের দিকে তাকালাম।জিহ্বা দিয়ে ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে কিছু বলব তার আগেই আরমান ভাই বউ সহ বাড়িতে ডুকলেন।সঙ্গে নিয়ে আসলেন আত্মীয়স্বজনের ভীড়।ব্যস!মেহেরাজ ভাইকে আর বলা হলো না কিছু।সেই ভীড়ের মাঝেই উনি পা বাড়িয়ে বের হলেন দ্রুত।আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেখানেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম।কানাঘেষায় শুনতে পেলাম আমারই চরিত্রের প্রশ্ন।স্বজন অর্থ নিজের জন!অথচ সেই স্বজনরাই আমায় নিয়ে কথা চালিয়ে যাচ্ছে।কথাগুলো খুব বেশি শোভনীয় নয়।তবুও আমায় শুনতে হচ্ছে।পরপরই এক দূর সম্পর্কের ফুফু এসে সামনে দাঁড়ালেন।বিচক্ষন মানুষের মতো বলে বসলেন,

” কি রে, জ্যোতি? তোর নামে যে এসব শুনছি।সত্যি নাকি?তুই কিনা শেষে এমনটা করলি?আমি কিন্তু তোকে অনেক ভালোবাসতাম জ্যোতি।তোর মা করলে করেছে এসব তাই বলে তুইও করবি?বিশ্বাস হচ্ছে না রে।”

ফুফু আমায় ভালোবাসতেন কি বাসতেন না তা বুঝে উঠলাম না।তবে এইটুকু বুঝলাম যে, কথাগুলো উনি আমাকে আঘাত করার উদ্দেশ্যেই বললেন।আমি তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখালাম না।স্থির নয়নে তাকিয়ে শুধালাম,

” কি শুনেছেন ফুফু?”

ফুফু তরতর করে বলে উঠল,

” সে কি!তুই জানিস না নাকি?ও বাড়ির মেহেরাজ নাকি কি নাম ছেলেটার?ছেলেটার সাথে নাকি তোর প্রেমের সম্পর্ক?প্রেম করবি ভালো কথা, বিয়ে বাড়িতে নিজেদের চরিত্রের এভাবে জানান দেওয়ার কি আছেরে?”

আমি তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসলাম।বললাম,

” আপনি বোধহয় পুরো ঘটনাটা শোনেননি ফুফু।সেদিন রাতের ঘটনা এটা।আজ সকালে এই ঘটনার যাচাই বাছাই হলো তো।তা বুঝি আপনাদের কানে পৌঁছায়নি?”

আমার কথায় ফুফুর মুখ কালো হলো।বোধহয় বিশেষ খুশি হলেন না কথাগুলো শুনে।ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,

” মুখে মুখে কথা বলাও জানিস দেখছি।দাদীর সামনে দেখি ভিজেবেড়াল সেঁজে থাকিস। অবশ্য তোর আর দোষ দিই কি করে বল?মায়ের রক্ত মিশে আছে না শরীরে?অন্য পুরুষের সাথে পালিয়ে যাওয়া মায়ের মেয়ে আর কেমনই বা হবে?”

এই কথাটাতে এসেই আমি আটকে গেলাম।মুহুর্তেই কষ্ট অনুভব হলো।দমবন্ধকর সেই পরিস্থিতিতেও হৃদয়ে একটা শব্দেরই উপস্থিতি জানান দিল, ” মা “।এভাবে পরপুরুষের সাথে চলে গিয়ে আমাদের ছেড়ে যাওয়ার কি বিশেষ প্রয়োজন ছিল মায়ের? আমি আর কোন উত্তর দিতে পারলাম না।দ্রুত পা বাড়িয়ে সরে এলাম সেখান থেকে।মুহুর্তেই দাদীকে দেখতে পেলাম। আধ পাঁকা কোকড়া চুল, কুচকানো মলিন চামড়া আর নির্বিকার চাহনী।একপলক আমার দিকে চেয়েই আমার হাতটা হাত দিয়ে চেপে ধরলেন।নিজের ঠোঁটজোড়া আমার হাতে ছুঁয়ে দিয়েই একটা বাটন ফোন ধরিয়ে দিলেন। স্পষ্ট গলায় বললেন,

” বাজার থেইকা একটা বাটন ফোন আনাইছি।ঐহানে গেলে রোজ মিনারের নাম্বারে সন্ধ্যার পর একটা কল দিস। নাইলে যে কইলজাটা বড্ড আনচান করব জ্যোতি।”

মুুহুর্তেই আমার কান্না পেল। ইচ্ছে হলো দাদীকে ঝাঁপিয়ে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিই।কিন্তু হলো না কান্না করা। একরাশ অভিমান আর অভিযোগ নিয়ে আমি জড়িয়ে ধরতে পারলাম না দাদীকে। শুধু সালাম করলাম।ঠোঁট কাঁমড়ে কান্না আটকিয়ে বললাম,

” কে এনে দিল ফোনটা?”

” মিনাররে দিয়া আনাইছি।”

উত্তর শুনে মিনার ভাইয়ের কথা মনে পড়ল।উনি আমার ফুফাত ভাই।ফুফুর ছোট ছেলে।কাল থেকে চোখেই পড়েনি মিনার ভাইকে।এই মানুষটার থেকেও বিদায় নেওয়া দরকার।বাড়ির এতগুলো মানুষের মধ্যে কেবল দাদী আর এই মানুষটাই আমাকে বুঝত।আজ এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি বলে ভুলে যেতে পারি না তার অবদান।অস্ফুট স্বরে জানতে চাইলাম,

” মিনার ভাই কোথায় দাদী?একবার দেখা করে যেতাম।”

দাদী এদিক ওদিক চাইলেন। বোধহয় খুঁজে পেলেন না মিনার ভাইকে।বললেন,

” ছিল তো এইহানে মাত্র।কই জানি চইলা গেছে।কইতাছিল বাজারে আড্ডা দিব।মনে হয় বাজারেই চইলা গেছে।”

আমি মনে মনে কষ্ট পেলাম।আমি চলে যাচ্ছি অথচ মিনার ভাই একবারও আমার সামনে এল না?একবার বিদায় জানাল না?বাজারে আড্ডা দেওয়ায় বুঝি বেশি হয়ে গেল? মিহি গলায় বললাম,

” ওহ।”

দাদী পুনরায় বলল,

” রাজরা মনে হয় এহনই চইলা যাইব।তোরে নিতে আইছিল কেউ? ”

” মেহেরাজ ভাই মাত্র ব্যাগ নিয়ে গেল।”

” ঐহানে ঠিকঠাক মতন খানা খাইবি।এইহানে আমি চিল্লাইয়া খাওয়াইতাম।ঐহানে কে খাওয়াইব শুনি? আর, পড়ালেহা করবি মন দিয়া। কাজকাম সাবধানে করবি কিন্তু।মনে থাকব?”

মাথা নাড়িয়ে বললাম,

” থাকবে দাদী।”

দাদী চুপ থাকলেন কিয়ৎক্ষন।তারপর আবারও বললেন,

” পরীক্ষার কয় মাস আছে আর তোগো?”

আমি হাসলাম।এটা যে শুধু একটা প্রশ্ন তেমন নয়। এটা আস্ত এক ভালোবাসা। আস্ত এক অস্থিরতা।কাছের মানুষকে পুণরায় দেখার আকাঙ্ক্ষা। মানুষটা আমার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে না তবুও আমি কি সুন্দর বুঝে যাই তার ভালোবাসা।এই যেমন এখন, পরীক্ষার কয়মাস আছে জানতে চেয়ে আসলে কয়মাস পর তার সাথে আমার আবার দেখা হবে তাই জানতে চাইল তা বুঝতে আমার এক সেকেন্ডও সময় লাগল না।আমি তাচ্ছিল্য করে বললাম,

” পরীক্ষা না দিলেই বা কি হয়?তোমাদের কাছে একটা বিয়েই সবকিছুর সমাধান দাদী।সে বিয়েটা তো দিয়েই দিলে।”

দাদী রেগে গেলেন।নিজের সে রাগরাগ ভাব বর্তমান রেখে তেজ নিয়ে বললেন,

” পরীক্ষা না দিলে এত বছর পড়াইলাম ক্যান তোরে?মাইর চিনস?ভালা কইরা পইড়বি ঐহানে। যদি কেউ নাও চায়,দরকার হইলে পরীক্ষার সময় আমি গিয়া নিয়া আমু তোরে । পরীক্ষা দিতই হইব।মাথায় থাকব?”

দাদীর কথায় হাসলাম।দাদী আর যায় হোক পড়ালেখার ব্যাপারে কখনো ছাড় দেয়নি।আমি মৃদু হেসে জড়িয়ে ধরলাম দাদীকে।ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠে জড়ানো গলায় বললাম,

” আমার যে বড্ড কষ্ট হইব দাদী।তোমারে ছাইড়া যে কোনদিন থাকিনি।কেমনে চলবে তোমারে ছাইড়া দাদী?”

দাদী কঠিন গলায় বললেন,

” আমারে মনে পরলেই মিনারের মোবাইলে ফোন দিবি।দাদী নাতনী মিইলা অনেক কথা কমু তহন। এহন আর মন খারাপ করিস না।”

আমি বিনিময়ে কিছু বললাম না। দাদীকে সেভাবেই জড়িয়ে রইলাম অনেকক্ষন।এত ভালোবাসা, এত যত্ন, এত শাসন! তবে কি এইবার ফুরিয়ে এল সব?দাদী কি আমাকে আগের মতোই ভালোবাসবে?ভুলে যাবে না তো?

.

আমরা যখন পৌছালাম তখন রাত।তবুও শহরের রাস্তায় আলোর অভাব নেই।সামনেই চোখে পড়ল তিনতালা বিল্ডিং।মেহু আপুর ভাষ্যমতে এটাই তাদের আবাসস্থল।নিচতলায় সামান্তা আপুদের পরিবার, দ্বিতীয় তলায় মেহেরাজ ভাইরা আর তার উপরে মেহেরাজ ভাইয়ের মেঝ চাচারা থাকেন।আমি একপলক চাইলাম তিনতালা বিল্ডিংটায়।তার পরপরই মেহু আপু আর মেহেরাজ ভাইয়ের পিছু পিছু সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম দোতালায়।দুইপাশে দুটো ফ্ল্যাট। মেহু আপুর কথানুযায়ী ডান পাশের ফ্ল্যাটটা ভাড়া দেওয়া।আমি বাম পাশেই তাকালাম তাই।দরজায় তালা ঝুলানো।মেহেরাজ ভাই পকেট হাতিয়ে চাবি নিয়ে তালা খুলতেই পাশের ফ্ল্যাট থেকে এক মহিলা এগিয়ে এলেন।মুখে হাসি হাসি ভাব বজায় রেখেই বলে উঠলেন,

” এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে মেহেরাজ?বিয়ের দাওয়াত শেষ নাকি?অবশ্য ভালোই হলো ফিরে এলে।পুরো বিল্ডিং নিস্তব্ধ হয়ে ছিল।”

মেহেরাজ ভাই একনজর চাইলেন ভদ্রমহিলার দিকে।ঠান্ডা গলায় বললেন,

” তেমন কিছু নয় আন্টি, পরশু চাকরির ইন্টাভিউ আছে তো। তাই।”

ভদ্রমহিলা মাথা নাড়ালেন।হেসে চলে যাবেন ঠিক সেই মুহুর্তেই আমার দিকে তাকালেন। পা থেকে মাথা অব্দি কিয়ৎক্ষন পর্যবেক্ষন করে নিয়েই জিজ্ঞেস করলেন,

” ওমাহ!অতিথি নাকি?তোমাদের কাজিন হয় বুঝি?”

আমি ইতস্থত বোধ করলাম। অস্বস্তিতে এপাশ ওপাশ চাইলাম৷ সেই মুহুর্তেই মেহেরাজ ভাই গমগমে স্বরে বলল,

” ওর নাম জ্যোতি।”

” তো বেড়াতে এল নাকি?আমাদের বাসায়ও নিয়ে এসো মেহেরিন। ”

মেহু আপু হাসলেন৷ জবাবে বলে উঠলেন,

” নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক সময় আছে আন্টি।ও এবার থেকে এখানেই থাকবে৷ ভাইয়ার সাথে ওর বিয়ে হয়েছে আজই।”

হঠাৎ এমন পরিচয়ে আমি স্বস্তি বোধ করলাম না।মেহেরাজ ভাই ব্যাগপত্র দরজার ভেতর ডুকাতে ব্যস্ত হলো মুহুর্তেই। ভদ্রমহিলা অবাক হলো।হতবিহ্বল চাহনি নিয়ে আবারও প্রশ্ন ছুড়ল,

” সে কি মেহেরাজ!না বলেই বিয়ে সেরে নিলে?বিয়ের দাওয়াত খেতে গিয়েই নিজেই বিয়ে করে চলে আসলে?”

বিনিময়ে উত্তর আসল না অপরপাশ থেকে।মেহু আপুও আর দাঁড়ালেন না।তোড়জোড় করে আমায় বাসায় ডুকিয়ে ভদ্রমহিলাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বিদায় দিলেন।আমি নিশ্চুপ থেকে শুধু সব শুনছিলাম। কি অদ্ভুত সবকিছু!মেহু আপু হাসলেন। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বললেন,

” ইনি হলেন ফাতেমা আন্টি। আমাদের একমাত্র খবর নেওয়ার লোক।সারাদিন আর কেউ খবর নিক বা না নিক ইনি অবশ্যই খবর নিবে বুঝলি।মানুষ হিসেবে বড়ই ভালো উনি তবে একটাই সমস্যা!এত বেশি কৌতুহল উনার, এত বেশি প্রশ্ন!আমিই মাঝেমাঝে ক্লান্ত হয়ে যাই।”

আমি বিনিময়ে হাসলাম শুধু।অপরিচিত জায়গায় এসে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পরখ করছিলাম সবটা।সাদামাটা ঘর।চোখে পড়ল তিনটে ঘর সহ প্রসস্থ বসার ঘর।মেহু আপু হাত চেপে এগিয়ে নিয়ে গেল এক ঘরে। তোড়জোড় করে ফ্লোরে আমার ব্যাগটা দেখিয়ে বলল,

” গিয়ে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয় জ্যোতি।জামা চেঞ্জ করে নিস।অনেকটা পথ,অনেকটা জার্নি।রেস্ট নিয়ে নে কিছুক্ষন।আমার তো এখনই হাত পা ভেঙ্গে আসছে।কি ক্লান্তি!”

আমি ছোট ছোট চোখে চাইলাম।আসলেই ক্লান্ত লাগছে।চোখ মুখ জ্বলছে গরমে।এতক্ষনের ভ্রমনে ঘামে চুপসে আছে শরীরও।মাথাটাও ঝিম ধরে আছে কেমন।তাই আর দেরি করলাম না।দ্রুত মেহু আপুর দেখিয়ে দেওয়া ওয়াশরুমটায় ডুকেই চোখে মুখে পানি দিলাম বেশকিছুক্ষন।ওড়নার একাংশে মুখটা মুঁছে নিয়েই দরজা খুলে রুমে আসতেই চোখে পড়ল মেহেরাজ ভাইকে।গম্ভীর, টানটান চেহারা।দরজার আওয়াজ শুনেই বোধহয় এদিকে চাইলেন।সঙ্গে সঙ্গে চোখাচোখি হলো দুইজনের দৃষ্টির। আর সে দৃষ্টিতেই কেন জানি না আমার ভেতরে জ্বলন্ত ঘৃণা জ্বলে উঠল।আত্নসম্মানের বিশাল দেওয়াল আরো মজবুত হলো।আমি দ্রুত নজর সরিয়ে এড়িয়ে গেলাম আস্ত মানুষটাকে।তৎক্ষনাৎ পা ফেলে বেরিয়ে এলাম ঘর ছেড়ে।মেহু আপু কি তবে মেহেরাজ ভাইয়ের ঘরেই রেখে গেল আমায়?এটা কি মেহেরাজ ভাইয়ের রুম ছিল?

#চলবে…

[ ভুলত্রুটি ক্ষমাস্বরূপ দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ।]

এক মুঠো প্রণয় পর্ব-০৩

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_০৩
লেখনীতেঃএকান্তিকা নাথ

দাদী বলে গেল, কিয়ৎক্ষন পরই নাকি মেহেরাজ ভাইয়ের সাথে বিয়ে হবে।আমি বিপরীতে কিছু বললাম না দাদীকে।আব্বার মতো দাদীর প্রতিও অভিমান আমার গাঢ় হয়ে কঠিনরূপ নিল। স্পষ্ট চাহনীতে কেবল একবার তাকিয়েই ঠাঁই বসে থাকলাম।পরনে আধভোজা নিত্যদিনের জামাটা।জানালা দিয়ে চোখে পড়ল উঠোনের অল্পকয়েক মানুষজনকে।পরমুহুর্তেই আটকে রাখা টিনের দরজায় টোকা পড়ল।আমি উঠে বসলাম।পা বাড়িয়ে দরজা খুলতেই চোখে পড়ল এক বিধ্বস্ত রমণীকে।ধবধবে সাদা মুখে বিষাদের খেলা।চুলগুলো যেন অনেকদিন আঁচড়ানো হয়নি এমনই অগোছাল লাগল।নাকের অগ্রভাগ লালচে হয়ে আছে।চোখজোড়াও লাল হয়ে ফুলে আছে।বুঝলাম যে, সামান্তা আপু অনেকক্ষন কান্না করেছে।আমি স্থির ভাবে চেয়ে বললাম,

” কিছু বলবেন আপু?”

সামান্তা আপু ভেতরে ডুকলেন।আমার ঘরে বসার জন্য আছে বলতে কাঠের পুরোনো চেয়ারটা।তাও এক পায়া নড়বড়ে।আমি সে চেয়ারটাই এগিয়ে দিয়ে বললাম,

” বসুন আপু।”

সামান্তা আপু বসলেন না।স্থিরভাবে আমার দিকে তাকিয়ে কি যেন পরখ করতে লাগলেন।যেন কোন ঘোরের মধ্যে আছেন।সে ঘোর নিয়েই এগিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়ালেন।মুখের উপর আলতো হাত রেখে অস্ফুট গলায় বললেন,

” তুমি কি আমার থেকেও সুন্দর জ্যোতি?এতটাই রূপবতী তুমি?তোমার চোখ,নাক, মুখ কি আমার থেকেও সুন্দর?তোমার চুল কি আমার থেকেও লম্বা? তুমি কি আমার থেকেও ফর্সা জ্যোতি?এতটাই সুন্দরী তুমি? ”

আমি তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসলাম।সামান্তা আপু কি আমায় নিয়ে উপহাস করার জন্যই প্রশ্নগুলো করলেন?বুঝলাম না।ঘরে টাঙ্গানো ছোট আয়নায় একনজর নিজেকে দেখে নিয়েই বললাম,

” আপনার গায়ের রং ধবধবে সাদা।আপনার চোখ, নাক সুন্দর।মুখ মায়াবী।কালো ঘন চুল হাঁটুর উপর অব্ধি লম্বা।উল্টোদিকে আমার গায়ের রং চাপা, মুখচোখের অতোটা ধাঁচ নেই। চেহারায় হাজারটা দাগ, ব্রন!চুলতো ঐ পিঠের মাঝখান পর্যন্তই।তবে? তুলনাগুলো কেমন অযৌক্তিক নয় আপু?”

সামান্তা আপু নিশ্চুপ থাকলেন। তারপর হঠাৎ চেয়ারে ধপ করে বসেই চোখ তুলে আমার দিকে চেয়ে থাকলেন কিয়ৎক্ষন।অস্ফুট গলায় বললেন,

” আমি জানতাম আমি সুন্দরী!কিশোরী বয়স থেকে প্রেমের প্রস্তাব আর প্রেমের চিঠি পেতে পেতে ধরেই নিয়েছিলাম প্রেম বিষয়টা আমাতে আটকায়।আর যায় হোক, নিজের প্রেমিক পুরুষ আমি বলতে অন্ধ থাকবে এমনটাই বিশ্বাস ছিল চিরকাল।কিন্তু কি হলো এটা?আমার সৌন্দর্য কি প্রেম আটকাতে পারল না জ্যোতি?”

আমি বুঝলাম না কি বলা উচিত।কিংবা কি বলা যায়।কিয়ৎক্ষন চুপ থাকলাম। সামান্তা আপু আবারও বললেন,

” আমি যা চাইলাম, যাকে চাইলাম তা তুমিই কেন পাবে?তোমাকেই কেন পেতে হবে তা?আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি সে আমার, কেবলই আমার।কেড়ে নিও না তাকে জ্যোতি।”

আমি আৎকে উঠলাম।আমি কি সত্যিই কেড়ে নিচ্ছি?দুইজন মানুষের মাঝে দেওয়ালের মতো বাঁধা হয়ে যাচ্ছি?আমি কি স্বেচ্ছায় ঘৃণার মানুষটির সাথে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখছি?মুহুর্তেই মন বিষিয়ে উঠল তিক্ত অনুভূতিতে।মেহেরাজ ভাই মানেই ঘৃণা!শুধুই ঘৃণা!আমি আর ভাবতে পারলাম না।সামান্তা আপুর দিকে তাকিয়েই বললাম,

” আমি কোনদিন কারো জিনিস কেড়ে নিই না আপু।”

” কেড়ে নিলে তো।আমার থেকে তো তাকে কেড়ে নিলে।কেড়ে যদি নাই নিতে, তবে তোমার সাথে কেন সে তেমন অবস্থাতে থাকত?”

আমি হাসলাম।সামান্তা আপু যথেষ্ট আধুনিক।বয়সও কম।তবুও উনার কথা গ্রামের মুরুব্বিদের মতোই বোধ হলো।এতকিছুর পরও উনি কাল রাতের ঘটনাটাতেই আটকে আছেন।কাল রাতের গুজবকেই সত্যি ভাবছেন।তফাৎ কোথায় উনার আর গ্রামের মুরুব্বিদের মধ্যে?আমি হেসে বললাম,

” ভালোবাসলে তো বিশ্বাস দৃঢ় হয়।বন্ধন মজবুত থাকে।আপনার ভালোবাসার বন্ধন এতোটাই ঠুনকো যে অন্য একটা মেয়ে আপনার থেকে আপনার ভালোবাসার মানুষকে কেড়ে নিবে?এই বিশ্বাস নিয়ে ভালোবাসা যায় আপু?”

সামান্তা আপু এবার আর কিছু বললেন না।কিয়ৎক্ষন অন্যমনস্ক হয়ে বসে থেকে চলে গেলেন।আমি চাইলাম সে যাওয়ার পথে।ভুল কিছু কি বলে ফেলেছি?সামান্তা আপু কি কষ্ট পেলেন আমার কথায়?জানি না।তার কিছুটা সময় পরই ডাক পড়ল আমার।মেহু আপু আর ছোট চাচী নিয়ে গেল আমায়।আর পাঁচটা বিয়ের কনের মতো আমি সময় নিলাম না।ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনেই স্পষ্ট গলায় উচ্চারণ করলাম কবুল!তাও আবার সবচেয়ে ঘৃণিত মানুষটার জন্যই।অল্পমুহুর্তেই বিয়ে সম্পন্ন হলো।মেহেরাজ ভাই আর দাঁড়ালেন না।দ্রুত প্রস্থান করে ত্যাগ করলেন সেই স্থান।আমি অবশ্য তাকালাম না।শুধু যন্ত্রমানবীর মতো সমস্ত ঘটনা মস্তিষ্কে তুলে রাখছিলাম।ধীরে ধীরে নিজের সব অনুভূতি, সব হাসি, সব আনন্দ যেন যন্ত্রাংশের ন্যায় নিশ্চিহ্ন হলো।এই জীবনটা কি আমারই?আমার হলে অবশ্যই আব্বা, দাদী আমার মতামত জানতে চাইত।আব্বার কথা নাহয় বাদ, তাই বলে দাদীও জানতে চাইল না?এই নিষ্প্রাণ জীবন আর কদ্দূর বয়ে নিব আমি?

.

আমার হাতে মিথির হাস্যোজ্জ্বল এক ছবি।ধবধবে ফর্সা মুখে টোলপড়া হাসি।পরনে লালরাঙ্গা জামা।ছোটবেলায় সবাই বলত আমরা দুইবোনই নাকি দাদীর মতোই হয়েছি।স্বভাব চরিত্র হতে চেহারা সবটাই নাকি দাতীর মতোই পেয়েছি।বড়বেলায় এসে বুঝতে পারলাম যে সত্যিই তাই!ছবিতে মিলালেই মিথির সাথে আমার চোখমুখের স্পষ্ট মিল পাওয়া যায়।শুধু গায়ের রংটাই আলাদা ছিল আমাদের।বাকি সবই এক!রাগ, জেদ, অভিমান, এমনকি হাসিও।আমি মিথির ছবির দিকেই চেয়েই ফিসফিসিয়ে বললাম,

” মিথি?তোর যতি কি কারো জিনিস কেড়ে নিতে পারে?কখনো কি কারো জিনিস কেড়ে নিয়েছি আমি?আমার উপর কারো প্রিয় মানুষ কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠল।কিন্তু সত্যি বলতে আমার সে অভিযোগে কিছুই যায় আসল না।শুধু ঘৃণা হচ্ছে।অসহ্য লাগছে সবকিছু।সবথেকে বেশি অসহ্য লাগছে ঐ মানুষটাকে!আমার এই বিয়েটা মানতে খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে মিথি।নিজেকে আত্নসম্মানহীন বোধ হচ্ছে!”

বিনিময়ে মিথির উত্তর আসল না।আমি ছবিটা আগের মতোই তুলে রাখলাম।তারপর পরপরই দাদী ঘরে আসলেন।রুমের নড়বড়ে চেয়ারটায় আরাম করে বসেই বলে উঠলেন,

” বিয়াটাতে যে তোর মত ছিল না এইডা জানা ছিল আমার।কিন্তু বিয়াডা যদি নাই হইত তয় তোরে নিয়াই মানুষ কানাঘেষা করত।কথা চালাইত। রাজরে নিয়া কিন্তু কেউ এক কথাও উঠাইত না জ্যোতি।সমাজ! সমাজের কাঁটাতারে মাইয়ারাই আঘাত পাইতে থাকে।”

আমি কাঁটকাঁট চাহনীতে চাইলাম দাদীর দিকে।স্পষ্ট গলায় বললাম,

” এসব এখন বলে লাভ কি দাদী?হয়ে গেল তো বিয়েটা।সমাজের আগে দিয়ে তোমার আর আব্বার দায়ভারও তো হালকা হলো।আঠারোটা বছর আমাকে না চাইতেও নিজেদের কাছে রেখেছো।বোঝা হয়েই তো ছিলাম আমি এতকাল।অবশেষে স্বস্তি পেলে বলো?”

দাদী রেগে গেলেন।সঙ্গে সঙ্গেই রাগ দেখিয়ে বললেন,

“জ্যোতি, যা জানস না তা কইবি না।তোরে যদি বোঝাই ভাবতাম তাইলে এতকাল তোর বাপের থেকে আগলাইয়া রাখতাম না।তোর বাপের ঘর থেইকা আমার ঘরে আলাদা কইরা এতকাল বড় কইরতাম না।সৎমায়ের হাতেই ছাইড়া দিতাম তাইলে। ”

” এই যে এতকাল আগলে রাখলে, এই কারণে আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতাম তুমি আমায় ভালোবাসো। কিন্তু সেই তো কালরাতে বুঝিয়ে দিলে তুমি আসলে আমায় ভালোবাসো না দাদী! বিশ্বাস নাহলে এখনো আমার গালে তাকিয়ে দেখো।পাঁচ আঙ্গুলের লালচে ছাপ জ্বলজ্বল করছে। ”

দাদী চুপ থাকলেন।তার শক্তপোক্ত চড়ের জন্য হাত বুলিয়ে আদর করলেন না।অথচ আগে কখনো দাদী মারলে অনুতপ্ত হতো।কাছে টেনে আদর করত। এবার তার কিছুই হলো না।দাদী শুধু এইটুকুই বলল,

” গোঁছগাছ কইরা লও।রাজরা নাকি আজই চইলা যাইব।”

আমি চমকালাম।এবার কি তবে চিরপরিচিত জায়গাটাও ছেড়ে যেতে হবে?কাঠের চৌকি, মাটির স্যাঁতস্যাতে মেঝে আর টিনের ঘর!চিরপরিচিত সবুজে ঘেরা পুকুরপাড়টা, যেখানে প্রায়শই আমি দুঃখযাপন করি।সরুমাঠের ঐ উঁচুনিচু রাস্তাটা, যে পথ মাড়িয়ে আমি কলেজ যাই রোজ।এমনকি, চিরপরিচিত মানুষকেও?ছোট্ট মিথি,দাদী?এতটা কাছের মানুষ, এতটা ভালোবাসার মানুষ।দাদীকেও ছেড়ে যেতে হবে আমায়?সব, সব!সব ছেড়ে যেতে হবে আমায়?আমার নিঃশ্বাস ঘন হলো।বুক ভার হলো।অস্ফুট স্বরে বললাম,

” দাদী? সামনে না আমার পরীক্ষা?বাবা আমায় পড়তে দিবে না বলল, তোমারও কি তবে সেই একই মত দাদী?”

দাদী আমার দিকে চাইলেন একপলক।যেতে যেতেই বললেন,

” রাজরা পড়াইব তো।পড়াইব না কইছে একবারও?পরীক্ষার সময় আইসা পরীক্ষা দিয়া যাইবি।এইহানে পড়ার থেইকা ঐহানে ভালোই পড়তে পারবি।”

আমি হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে থাকলাম।হুট করেই উপলব্ধি করলাম আমার কষ্ট হচ্ছে ভীষণ!দমবন্ধ লাগছে।ছোটবেলা থেকে যে মানুষটার সাথে আমার দিন থেকে রাত পর্যন্ত কাঁটত।যে মানুষটা আমার এইটুকু ব্যাথায়ও ছুটে আসত।যে মানুষটা আমায় শাসন, ভালোবাসা সবকিছু দিয়ে ছোট থেকে বড় করে তুলল।যে মানুষটা আব্বার বলিষ্ঠ হাতের চড় থেকে সৎমায়ের তিক্ত কথার ঝাঁঝ থেকে আগলে রাখত।সেই মানুষটাকেই ছেড়ে কি করে থাকব আমি?কি করে চলবে আমার?দাদী কি তা একবারও বুঝল না?নাকি বুঝেও বুঝল না?আচ্ছা, দাদীর কি কষ্ট হবে না আমার জন্য?আমার কথা মনে পড়বে না একবারের জন্যও? আমি কি এতটাই পর ছিলাম দাদীর কাছে?

.

জামাকাপড় গোছানো শেষ হলো।ছোটখাটো ব্যাগটা ভরে উঠল মুহুর্তেই।আমি হাতে করে ব্যাগটা নিয়ে ঘর ছেড়ে বের হলাম।অন্যসব নতুন বউদের মতো আমার অতো সাঁজগোজ নেই।নিত্যদিনের সুতি জামা, আর মাথায় ঘোমটা টানা।পিঠের মাঝখান অব্ধি চুলগুলো বেনুনি করা।আমি বের হয়ে ব্যাগটা দরজার দ্বারে রেখে আব্বাকে খুঁজলাম।এই মানুষটাকে জবাব দিয়ে না যেতে পারলে শান্তি লাগবে না আমার।পা বাড়িয়ে বাড়ির উঠোনে যেতেই আব্বাকে দেখলাম। কাছাকাছি গিয়ে সালাম করলাম।শক্ত কন্ঠে বললাম,

” ভালো থাকবেন আব্বা।আপনার এতকালের ভালো থাকা আমি কেড়ে নিয়েছিলাম।আজ এক সমুদ্র ভালো থাকার পথ দিয়ে গেলাম।আপনি মুক্ত আজ থেকে। মিথি তো সেই কবেই আপনারে মুক্তি দিয়ে গেল।থাকার মধ্যে আমি ছিলাম।আজ আমিও মুক্তি দিলাম। আপনার ঘৃণা, রাগ সবকিছু থেকে মুক্তি দিলাম আব্বা।খুব বেশি ভালো থাকবেন আব্বা।যতটুকু ভালো থাকা কেড়ে নিয়েছিলাম সেটুকুও পুষিয়ে নিবেন।”

আব্বা আমার দিকে চাইলেন।বোধহয় কিছু বলতেও চাইলেন।কিন্তু আমি আর ফিরে চাইলাম না।সেই সাহস বোধহয় আমার নেই।দ্রুত পায়ে বাড়ি ছেড়ে বের হয়েই পুকুর পাড়ে দাঁড়ালাম।মনেমনে মিথির থেকে বিদায় নিলাম।আমি জানি না আমার ভাগ্য আমায় কি উপহার দিবে।জানি না,ভবিষ্যৎ এ কি অপেক্ষা করছে আমার জন্য।শুধু জানি, যে মানুষটার জন্য ঘর ছাড়ছি সে মানুষটার প্রতি আমার এক সমুদ্র ঘৃণা!কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই কানে এল গ্রামের এক চাচীর কন্ঠ,

” আরে এই মাইয়ারে দেইখা লাগে এই মাইয়া এমন কইরব?আনোয়ার মাস্টারের মাইয়া বইলা কথা!ভাবতাম কত ভালা।এহন দেখি তলে তলে অন্য কিছু!আর রাজ পোলাডারে তো যে ভদ্র ভাবতাম।”

আমি শুনলাম।শুনেও চুপ থাকলাম।আসলেই সমাজ অদ্ভুত!রটে যাওয়া ঘটনা মিথ্যে কি সত্য তা একবার ও যাচাই করল না অথচ সমালোচনায় একধাপ পিছিয়েও থাকল না।কি চমৎকার সমাজ!

#চলবে…

এক মুঠো প্রণয় পর্ব-০২

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_০২
লেখনীতেঃএকান্তিকা নাথ

” রাজ আর জ্যোতি যদি সত্তই রাইতে একঘরে খারাপ কিছু কইরা থাকে তবে তার লাইগা ব্যবস্থা নেওন হইব।কানাঘেষা না কইরা হগ্গলে চুপ করো।”

দাদীর কঠিন গলায় এতক্ষন সবাই গুনগুন করলেও মুহুর্তেই চুপ হয়ে গেল।এই সাতসকালেই উঠোনে গোল করে চেয়ার পাতানো হলো। আমাদের বাড়ি আর মেহেরাজ ভাইদের বাড়ির সব মুরুব্বিরাই মোটামুটি উপস্থিত হলো সেখানে। আমি মাথায় ঘোমটা দিয়ে মাথা নিচু করে থাকলাম। দুই হাত দূরে মেহেরাজ ভাইও দাঁড়ানো।বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ দাঁড়ানোর পর একপর্যায়ে দাদী গম্ভীর গলায় মেহেরাজ ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলল,

” রাজ,তোমার কিছু বলার থাকলে বলো।”

মেহেরাজ ভাই মুখ তুলে তাকিয়েই কিছুক্ষন চুপ থাকল। তারপর গমগমে স্বরে স্পষ্ট গলায় বলল,

” জ্যোতির সাথে আমার এমন ঘনিষ্ঠ কোন সম্পর্ক কখনোই ছিল না, নেইও।কাল যেটা চাচী বলেছেন সেটা নিতান্তই একটা দুর্ঘটনা ছিল। অন্ধকারে কিছুর সাথে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছিলাম।আর যেহেতু সামনে জ্যোতি ছিল।ওর দিকেই হোঁচট খেয়ে পড়তে হলো।আর তাই ও সহ মেঝেতে পড়ে গেলাম।বিষয়টা এতটুকুই।”

মেহেরাজ ভাইয়ের কথা শেষ হতেই উনার চাচা রাগমিশ্রিত গম্ভীর গলায় শুধাল,

” তুমি জ্যোতির কাছে কেন গিয়েছিলে? অন্ধকারে এত রাতে একটা জোয়ান ছেলে হয়ে তোমার কি এত দরকার ছিল ওর কাছে যাওয়ার?বলো।”

” আমি তো সামান্তাকে খুঁজতে এসেছিলাম এ বাড়িতে।এসে দেখি ও কল থেকে মুখ ধুঁয়ে এগিয়ে আসছে।চাচীরা বাইরে কথা বলছিল।সামান্তাকে বলল দাদীর পানের বাটাটা এনে দিতে।সামান্তা তো ছোট থেকে এ বাড়িতে তেমন আসেনি।তাই দাদীর ঘর ও চিনে না।তাই আমাকেই যেতে হলো।বিশ্বাস না হলে জ্যোতির ফুফুকে জিজ্ঞেস করো। উনিই বলেছিল দাদীর রুমে পানার বাটা আছে।”

দাদী এবার ফুফুকে জিজ্ঞেস করলেন।ফুফু ও স্বীকার করল।আমি স্বস্তির শ্বাস ফেললাম কেবল।তবুও স্বস্তি পেলাম না।দাদী এবার সেঝ চাচীর উদ্দেশ্যে বলল,

” সেঝ বউ,তুমি কও এইবার। ”

সেঝ চাচী নরম গলায় বললেন,

“আমি তো আলো জ্বালিয়ে রাজকে খুঁজতে গেলাম।গিয়ে দেখি দুইজন একসাথে জড়াজড়ি অবস্থায়।জ্যোতির শাড়িও তো অগোছাল ছিল।ছিঃ ছিঃ ছিঃ।”

কথাগুলো শুনেই মাটি খি’চে ধরলাম পায়ের নখ দিয়ে।এতগুলো মানুষের সামনে এই কথাটা এইভাবে চাচী বলতে পারল? চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস ছাড়লাম।আরো খারাপ কিছু শোনার অপেক্ষায় ছিলাম।ঠিক সেই মুহুর্তেই মেহেরাজ ভাই বললেন,

” ছিঃ ছিঃ করার মতো কোন কিছু দেখেছেন আপনি?আমি জ্যোতির উপর হেলে পড়ে গিয়েছিলাম।ওর শাড়ি একটু অগোছাল ছিল।এইটুকুই ছিঃ ছিঃ এর কারণ?এটা এক্সিডেন্টলি ঘটতে পারে না?”

মেহেরাজ ভাই কথা গুলো বলার পরই উনার চাচা ধমকে উঠলেন ।চোখ রাঙ্গিয়ে বললেন,

” আহ রাজ, থামো।মুখে মুখে তর্ক করে বেয়াদবি করো না।এমনিতেই পুরো গ্রাম জানাজানি হয়ে গেছে এই বিষয়টা।সকাল থেকে এইসবই শুনতে হচ্ছে সবার কাছে।আমার সম্মান কতটুকু রইল বুঝতে পারছো?”

মেহেরাজ ভাই আর কিছু বললেন না।এরপর আরো অনেকক্ষন বড়দের মাঝে কথাবার্তা হলো।এই এতটুকু সময়ে আমাকে কেউ কিছুই জিজ্ঞেস করল না। কিছুই জানতে চাইল না।নিজেকে কেমন ঠুনকো মনে হলো।দোষটা তো আমার নামেই রটানো হলো।অথচ আমার কথা শোনার এইটুকুও প্রয়োজন পড়ল না কারোর?আমি অসহায়ের মতো মাটির দিকে তাকিয়ে রইলাম পুরোটা সময়।তারপর হঠাৎই দাদী আর মেহেরাজ ভাইয়ের চাচা এক কঠিন সিদ্ধান্ত আমাদের জানালেন।আজ দুপুরেই নাকি আমার আর মেহেরাজ ভাইয়ের বিয়ে হবে।আমি চমকালাম। থমকে গিয়ে চোখ তুলে চাইতেই মেহেরাজ ভাইয়ের ক্ষ্রিপ্ত গলা শোনা গেল,

” কি সব বলছেন আপনারা?এতক্ষন ধরে কি বললাম আমি?এটা শুধুই একটা দূর্ঘটনা।আমাদের মাঝে তেমন কিছুই ছিল না।তবুও এই সিদ্ধান্ত আসবে কেন?”

মেহেরাজ ভাইয়ের চাচা রাগে চোখ লাল করলেন।উঠে দাঁড়িয়ে ক্ষ্রিপ্ত গলায় দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

” তোমার কথায় তো আর সব হবে না রাজ।তুমি কিছু করো কিংবা না করো, গ্রামজুড়ে যা রটে গিয়েছে মানুষ তাই সত্যি মনে করছে।বিয়েটা যদি নাই করো তবে আমার থেকে খারাপ কেউই হবে না বলে দিলাম।আর যায় হোক আমি আমার সম্মান নষ্ট হতে দেব না।”

কথাগুলো শুনে মেহেরাজ ভাইয়ের মুখচোখও লাল হলো।রাগে ফোঁসফাঁস শ্বাস ছেড়েই পা ফেলে চলে গেলেন উনি।আমি একপলক চাইলাম শুধুু সেদিকে তাকিয়ে।মেহেরাজ ভাইয়ের প্রতি আমার প্রখর অনুভূতি আছে ঠিক, তবে এমন নয় যে আমি উনাকে পেতে চেয়েছি কখনো।উনাকে স্বামী হিসেবে ভাবতেই আত্নসম্মানে আঘাত হানল। জ্বলন্ত ঘৃণায় দগ্ধ হলো হৃদয়।আমি দাদীর দিকে চাইলাম।সাহস করে মিনমিনে গলায় বললাম,

” দাদী? এই ঘটনায় তো কারোরই দোষ ছিল না।তুমি তো জানো আমি নির্দোষ।তবে এই কঠিন সিদ্ধান্ত কেন?আমি এক্ষুনিই বিয়ে করতে চাই না দাদী।”

আমার কথাটা শেষ হতে না হতেই আব্বা চেয়ার ছেড়ে উঠলেন।রাগে কাঁপতে কাঁপতে আমার সামনে এগিয়ে এসেই চিৎকার করে বললেন,

” তোরে এত বুঝতে কে বলছে?কেউ তোরে কিছু জিজ্ঞেস করছে?তোর এত কথা বলার সাহস হয় কি করে?মেয়ে মানুষের অতো পড়ালেখার দরকার নেই। যতটুকু দরকার তা যথেষ্ট হয়েছে।আর না করলেও চলবে পড়ালেখা!”

আব্বা বেশ শিক্ষিত মানুষ।গ্রামের হাই স্কুলের গণিতের শিক্ষক।অথচ আব্বার মতো শিক্ষিত মানুষও কি সুন্দর বলে দিলেন মেয়েদের অতো পড়ালেখা করা লাগে না।আমি কিছুই বললাম না।শুধু দাদীর দিকে একবার চাইলাম।তারপর আবার মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকাতেই মেহেরাজ ভাইয়ের চাচী এগিয়ে এলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

” জ্যোতি শোন,মেয়েমানুষের চরিত্র হয় সাদা কাপড়ের মতো।সাদা কাপড়ে যেমন অল্প ময়লা জমলেও বিচ্ছিরি লাগে?মেয়ে মানুষের চরিত্র নিয়েও অল্প একটু কথা উঠলে তা বিশাল রূপ নেয়।মেয়েদের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সমাজ ছেড়ে দেয় না মা। নিশ্চয় তুই তোর মায়ের উদাহরণ পেয়ে এতগুলো দিনে বুঝে গিয়েছিস সেটা।বিয়েটা না হলে রাজের কোন ক্ষতি হবে না।রাজ দিব্যি স্বাচ্ছন্দ্যে বাঁচতে পারবে। কিন্তু তুই?তুই পারবি না ওভাবে বাঁচতে।তোর অনেক বড় ক্ষতি হবে।গ্রামের মানুষজন তো চিনিস।বিষয়টাকে খুব খারাপ বানিয়ে ছাড়বে পরে।বিয়েতে রাজি হয়ে যা,হু?তোর সমস্যা পড়ালেখা নিয়ে তো?তোকে পড়াবে এতটুকু নিশ্চায়তা আমি দিচ্ছি। এবার রাজি হয়ে যা মা।”

আমি টলমলে চোখে চেয়ে রইলাম।এবার মেহু আপুও পাশে এসে দাঁড়ালেন।নরম গলায় বললেন,

“আমরা সবাই জানি তুই নির্দোষ।তুই কিছু করিস নি।ভাইয়াও ইচ্ছাকৃতভাবে কিছুই করে নি।কিন্তু সমাজ যা একবার বিশ্বাস করে নিয়েছে তা কি শুধু মুখের কথায় মুঁছে দেওয়া যাবে?বলবে আমরা বাড়ির সম্মান বাঁচাতে মিথ্যে বলছি।বুঝতে পারছিস তো তুই? ”

আমি কিছু বললাম না। চুপচাপ মাথা নাড়িয়ে পা বাড়িয়ে ঘরে আসলাম।আসার সময় এক সমুদ্র অভিমান নিয়ে দাদীর দিকে আরেক পলক চাইলাম শুধুু।তারপর দ্বিতীয়বার আর ফিরে চাইলাম না।ঘরে এসে দরজা জানালা বন্ধ করে ডুকরে কেঁদে উঠলাম।যে মানুষটাকে ভালোবাসার অপরাধে সে আমায় এতটা অপমান করেছিল , এতটা উপহাস করেছিল ঘুরেফিরে তার সাথেই নিয়তি আমাকে জুড়ে দিবে? যার বিশালতায় আমার জন্য একমুঠো প্রণয় নেই তার স্ত্রী হিসেবেই বেঁচে থাকতে হবে? স্বামী স্ত্রীর মাঝে প্রণয় ছাড়া সংসার হয়? হয়তো হয়!কিন্তু আত্মসম্মান?যে আত্মসম্মান নিয়ে এতগুলো দিন আমি এড়িয়ে গিয়েছি এই মানুষটাকে,সেই আত্মসম্মানের কোন মূল্য রইল না?এই জঘন্য মানুষটার সাথেই পুরো একটা জীবন কাঁটাতে হবে আমায়?

.

আকাশে কালো মেঘ।ভ্যাপসা গরমে ঘেমে উঠলাম দ্রুত।এখন দুপুর বেলা।তবুও আশপাশে এতটাই আঁধার যে মনে হলো কিয়ৎক্ষন পরই বুঝি সন্ধ্যা নামবে।আমি একপলক জানালা দিয়ে চাইলাম বাইরে।নিস্তব্ধ,থমথমে পরিবেশ।বোধহয় কিছুটা সময় পরই ভারী বৃষ্টিপাত হবে।চারপাশে গুমোট আবহাওয়া অনুভব হতেই মনে পড়ল ছোট্ট মিথির কথা।কল্পনায় মুহুর্তেই ফুঁটে উঠল মিথির প্রানবন্ত হাসি।ইশশ!আজ যদি মিথি থাকত?ও নিশ্চয় আমার পাশে থাকত?আধো আধো গলায় নিশ্চয় বলত,” না, যতি কিছু করেনি।” আমি হাসলাম আনমনে।সঙ্গে সঙ্গে আকাশের কালো মেঘের মতো মন খারাপের কালো মেঘে ছেঁয়ে গেল আমার মন।কষ্টরা তীব্র থেকে তীব্র বোধ হলো হৃদয়ে।নিঃশ্বাসরা যেন নাসারন্ধ্রে আটকে রইল।বিধাতা এতোটাই স্বার্থপর কেন?কেন সব প্রিয় মানুষকে আমার থেকে কেড়ে নিলেন উনি?কি এমন পাপ করেছিলাম আমি?ভাবতে ভাবতেই আমার চোখ বেয়ে টসটসে পানি গড়াল।ঠোঁট কাঁমড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা চালাতেই ঘরে ডুকল মেহু আপু।আমার দিকে এগিয়ে এসেই হালকা গলায় বলল,

” জ্যোতি?ঘন্টাখানেক পর বোধহয় বিয়ে পড়াবে।ডাকবে। তৈরি হতে হবে তো?”

আমি মেহু আপুর দিকে চাইলাম।অস্ফুট স্বরে বললাম,

” তৈরি হবো মানে?”

” শাড়ি, শাড়ি পরতে হবে না?এভাবেই বিয়েতে বসবি?দাদী বললেন তোকে শাড়ী পরিয়ে তৈরি করতে। ”

আমি কিয়ৎক্ষন চুপ থাকলাম।তারপর বললাম,

” শাড়ি পরতে হবে না আপু।এভাবেই যাব। বাইরে তে মানুষজন নেই তেমন।সবাই তো আরমান ভাইয়ের বিয়েতে গেছে, তাই না?”

মেহু আপু ইতস্থত বোধ করে আবারো বললেন,

” তবুও।দাদীও বললেন তোকে শাড়ি পরাতে।”

“দাদীকে আমি বলব আপু।”

মেহু কাছে আসলেন।নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন,

” আচ্ছা, কিন্তু কান্না করছিলি কেন?”

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।মস্তিষ্কে প্রশ্নটা ঘুরতে সঠিক কোন উত্তর পেলাম না।আসলেই তো,কান্না কেন করছি?মিথির জন্য?মিথির সাথে তো প্রায় প্রতিদিনই কবরের সামনে কথা হয়।তবে?ভাগ্যের জন্য?ভাগ্যে যা আছে তা তো ঘটবেই।ভাগ্যের জন্য কান্না করে বিশেষ লাভ হয় নাকি? তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে উত্তর দিলাম,

” তেমন কিছু নয় মেহু আপু।তুমি একবার দাদীকে ডেকে দেবে আপু?”

মেহু আপু ডেকে দিলেন না।আমার দিকে এগিয়ে এসে হাতে হাতে রাখলেন।তারপর নরম গলায় মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগলেন,

” জ্যোতি শোন, ভাইয়া একটু রাগী, একটু জেদী।ভাইয়া সামান্তাকে ভালোবাসে এটাও সঠিক।কিন্তু ভাইয়া অতোটাও খারাপ নয় জ্যোতি।তোর সাথে ভাইয়ার বিয়ে হলে আমি এইটুকু নিশ্চায়তা দিতে পারি যে, তুই ঠকে যাবি না। ভাইয়া ভীষণ দায়িত্ববান আর যত্নশীল।তুই দেখিস ভাইয়া নিজের দিক থেকে সবসময়ই সঠিক থাকবে।কোনদিকে অভিযোগ রাখতে দিবে না মিলিয়ে নিস।যদি তোর কান্নার কারণ ভাইয়ার সাথে বিয়েটাই হয়। তবে আমি এটা বলব যে, এই বিয়েটাই একদিন তোর চোখে অশ্রু আসা নিষিদ্ধ ঘোষণা করবে।”

আমি শুনলাম সবগুলো কথা।কিন্তু বিনিময়ে কিছু বললাম না।মেহু আপু পরক্ষনে উঠে চলে গেল।তার কিয়ৎক্ষন পর দাদী আসল।দাদী আজ কঠোরতা দেখাল না।শাসনও করল না।শাড়ি পরার জন্য গলা উঁচিয়ে জোরও করল না।শুধু মাথায় হাত বুলিয়ে নিজের সাথে জড়িয়ে নিল।ভরাট গলায় বলল,

” একবার কি মিথির লগে কথা কইয়া আইবি বিয়ার আগে?”

আমার কান্নার বেগ এবার বেড়ে গেল।এই মানুষটা এত কেন বুঝে আমায়?মুহুর্তেই চোখজোড়া দিয়ে স্রোত নামল।মাথা উপর নিচ নাড়িয়ে কেবল বুঝালাম, ” হ্যাঁ, মিথির সাথে কথা বলাটা খুব বেশি দরকার। ” দাদী নিষেধ করল না।যাওয়ার জন্য অনুমতি দিয়ে দিলেন সঙ্গে সঙ্গে।তবে অল্প সময়ের জন্য। আমি আর এক মুহুর্তও দাঁড়ালাম না।মাথায় ঘোমটা টেনে ঘর ছেড়ে বের হলাম দ্রুত।উঠোনে তেমন মানুষজন নেই।থাকার কথাও নয়।সবাই এখন আরমান ভাইয়ের বিয়েতে বরযাত্রী হিসেবে গিয়েছে।আমি পা বাড়িয়ে পুকুর পাড়ের বিপরীতে হাঁটলাম।মিনিট পাঁচ হাঁটতেই নিস্তব্ধ কবরস্থান চোখে পড়ল।এখানে মেহেরাজ ভাই আর আমাদের বাড়ির অনেকেরই কবর।আমি চোখ মেলে এদিক ওদিক চাইলাম।মুহুর্তেই কাঙ্ক্ষিত কবরটায় চোখ গেল।ইশশ!তাকাতেই মনে হলো আমার মিথিটা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।কল্পনায় ভেসে উঠল মিথির আধো আধো পায়ে হাঁটা, মাঝেমাঝেই চঞ্চল হাসিতে মেতে লাফিয়ে উঠা, কিংবা কখনো হুট করেই পেছন থেকে এসে আমার চোখে হাত রাখা ।মিথি বড্ড চঞ্চল আর ছটফটে ছিল।ঘুম বাদে ওকে কখনো স্থির থাকতে দেখা যেত না। আর সেই মিথিই এখন চিরতরে স্থির হয়ে শুঁয়ে আছে।আমার কষ্ট হলো ঠিক। তবে কাঁদলাম না।মিথির সামনে কখনোই কাঁদি না আমি।মন খুলে কথা বলি।পুরোটা দিনে কি কি করেছি, কি কি ঘটেছে সব বলি।মিথিও বেশ মনোযোগ নিয়ে শোনে সেসব।আমি হেসে পা বাড়ালাম।হাঁটু ঘেষে বসেই বললাম,

” এই মিথি?চারদিক কি অন্ধকার! বৃষ্টি নামবে বোধহয় এক্ষুনিই।দাদীর থেকে এইটুকু সময় নিয়েই তোর কাছে আসলাম।আজ বোধহয় বেশি গল্প করা হবে না, বুঝলি?”

মিথি জবাবে কিছু বলল না।আমি জানি ও কিছুই বলবে না।তবুও উত্তরের আশায় কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে বসে রইলাম।তারপর আবারও বললাম,

” মিথি?আমার বিয়ে আজ।কার সাথে জানিস?ঐ যে তুই ‘ লাজ’ নামে ডাকতি একটা ছেলেকে?ঐ ছেলেটার সাথেই। চিকন হ্যাংলা পাতলা ছেলেটা?মনে আছে তোর?এখন কিন্তু অনেক বদল হয়েছে বুঝলি?একদম লম্বা চওড়া যুবক।তুই নির্ঘাত এখন দেখলে আর চিনবি তোর লাজকে।”

বলেই খিলখিলিয়ে হাসলাম।পরমুহুর্তেই কানে আসল শুকনো পাতার মড়মড়ে শব্দ।কারো পায়ের আওয়াজের প্রতিধ্বনি।তৎক্ষনাৎ মুখ ফিরিয়ে চাইলাম।চোখে পড়ল মেহেরাজ ভাইকে।উনার বাবা মায়ের কবরও এখানেই। বোধহয় উনার বাবা- মায়ের জন্যই এসেছেন।আমি একপলক তাকালাম তার গম্ভীর মুখ,অগোছাল চুল, আর লালচে চোখজোড়ার দিকে।মেহেরাজ ভাইও কি কেঁদেছেন?চোখজোড়া এত লাল কেন তবে?মস্তিষ্ক উত্তর পাঠাল, জানে না।আমি আর ভাবলাম না।ঝুঁকে মিথির কবরে নিজের কোমল ঠোঁট ছোঁয়ালাম।নরম গলায় বললাম,

” আজ আসি রে মিথি।”

কথাটা বলেই উঠলাম।পা বাড়িয়ে মেহেরাজ ভাইকে কাঁটিয়ে বেরিয়ে এলাম খুব দ্রুত।

#চলবে….

[ ভুলত্রুটি ক্ষমাস্বরূপ দেখার অনুরোধ।কোথাও ভুল হলে জানাবেন।]