Sunday, August 17, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 447



এক মুঠো প্রণয় পর্ব-৩১+৩২

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_৩১
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

মাঝখানে কয়েকটা দিন কেঁটে গেল এভাবেই।জ্যোতির পা এখনও সারেনি তবে কাঁটা আঘাত গুলো সেরে উঠেছে। মেহেরাজের আচরণে এই কয়েকদিন স্পষ্ট অজানা অনিভূতির আভাস টের পেলেও জ্যোতি সরাসরি জিজ্ঞেস করে উঠতে পারেনি। সরাসরি জেনে নিতে পারে নি সে সব চাপা কথা, চাপা অনিভূতি আর জটিল স্বীকারোক্তি। পরনের ওড়নাটা মাথা অব্দি টেনে নিয়ে জানালা দিয়ে রাতের আকাশে চোখ রাখল জ্যোতি। নিঃশব্দে ভাবল কেবল একজনকে নিয়েই।হঠাৎই কি মনে করে মোবাইলটা হাতে নিয়ে একবার কল করে বসল মেহেরাজকে।মেহেরাজ কল তুলল না। পরক্ষনে কলও করল না। জ্যোতির মন হঠাৎ উদাস হলো। কয়েকটা দিন একইভাবে বসে, শুঁয়ে থেকে বিষন্ন অনুভূতিতে মনে বিষন্নতা বাঁধা বেঁধেছিলই।এই মুহুর্তে সেই বিষন্নতার সুর যেন গাঢ় হলো।জ্যোতি চোখ বন্ধ করে হেলান দিল বিছানার সাথে। জানালা দিয়ে আসা ফিনফিনে বাতাসে শীতল অনুভূত হলো শরীর।কিয়ৎক্ষন সেভাবেই কাঁটল বোধ হয়।তারপর হঠাৎ সে শীতল অনুভূতি কাঁটিয়ে তার কানে আসল মেহেরাজের জমাট গলা,

” তুই কি চোখ বুঝে রেখে ভুলবশত আমায় কল দিয়ে দিয়েছিস জ্যোতি?”

জ্যোতি সঙ্গে সঙ্গেই চোখ মেলে তাকাল। অফিস থেকে মাত্র ফেরা যুবকটিকে দেখে নিল সূক্ষ্ম চাহনিতে। ঘর্মাক্ত শার্ট আর ক্লান্ত মুখ থেকে নজর সরিয়ে বলল,

” ঠিকবশতই দিয়েছি।বিরক্ত হয়েছেন আপনি ? ”

মেহেরাজ এগিয়ে এল।জ্যোতির পাশে খাটের এককোণ বসে পায়ের মোজা খুলতে ব্যস্ত হয়েই ত্যাড়া গলায় জবাব দিল,

” তা জেনে কি করবি?”

জ্যোতির মুখের উদাস ভাব এবার আরো ঘন হলো। মনে মনে ভেবেই নিল মেহেরাজ বিরক্ত হয়েছে। বিরক্ত হয়েছে বলেই কল তুলে নি। স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠল,

” কিছুই নয়।বিরক্ত হলে পরে আর কল দিব না।তাই জিজ্ঞেস করছি।”

মেহেরাজ ভ্রু উঁচু করে একনজর তাকাল। মোজা জোড়া খুলে একপাশে রেখে হাত দিল গলার টাইয়ে। ভ্রু নাচিয়ে শুধাল,

” তুই তো দরকার ছাড়া কল দিস না।তো কি দরকারে কল দিয়েছিলি?”

জ্যোতি তাকাল। স্পষ্ট স্বরে প্রশ্ন ছুড়ল,

” দরকার ছাড়া কি আপনাকে কল করা যাবে না মেহেরাজ ভাই?”

মেহেরাজ খানিকটা ত্যাড়া গলায় দাঁতে দাঁত চেপ বলে উঠল,

” দরকার ছাড়া তুই কেন কল করবি?প্রেমালাপ করার জন্য?”

জ্যোতির মুখ থমথমে হয়ে গেল। উত্তর দিল না। কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে মেহেরাজকে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতে দেখেই গলা ঝাড়ল। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে উঠল,

” একটা প্রশ্ন করব মেহেরাজ ভাই?”

মেহেরাজ পেছন ঘুরে চাইল। গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,

” কয়েক মিনিট পর এসে শুনছি।”

কথাটা বলেই ওয়াশ রুমে ডুকল। বের হলো বেশ খানিকটা পর। চুলগুলো ভেজা৷ পরনের শার্টটার বোতাম গুলো লাগানো নেই, হাতাগুলোও গুঁটানো নেই। মুখে ফোঁটাফোঁটা পানির অস্তিত্ব।জ্যোতি একনজর তাকাতেই প্রথমে চোখে পড়ল বোতাম না লাগানো শার্টের মাঝের উম্মুক্ত পুরুষালি বক্ষ।মুহুর্তেই চোখ নামাল। মেহেরাজ তা খেয়াল করেই বোধহয় হালকা হাসল। হাত দিয়ে বোতাম লাগাল সময় নিয়ে।তারপর হাতাগুলো গুঁটিয়ে নিয়েই আচমকা ভেজা চুল নিয়ে জ্যোতির পাশের জায়গাটুকুতে গা এলিয়ে দিল।বালিশে মাথা রেখে চোখ বুঝে বলে উঠল,

” এবার বল, ভালো করে শুনব। ”

জ্যোতি প্রশ্নটা করতে পারল না।কেন জানি না গলা পর্যন্ত এসেও মুখ পর্যন্ত এসে পৌঁছাল না তার প্রশ্নটা।এই মুহুর্তে প্রশ্নটা কিভাবে করা উচিত তাও বুঝে উঠল না ঠিক। সবসময় স্পষ্ট ভাবে কথা বলে আসলেও এখন যেন প্রশ্নটা স্পষ্ট ভাবে করতে বাঁধল কোথাও। যার দরুণ চুপ হয়েই থাকল সে।মেহেরাজ সেই চুপ থাকার কারণেই চোখ মেলে তাকাল। জ্যোতি জড়োসড়ো চাহনী আর ভাবুক মুখ দেখে শান্ত স্বরে বলল,

” প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করে নিলে যদি অস্বস্তি কমে তো জিজ্ঞেস করে নেওয়া উচিত। বলে ফেল। ”

জ্যোতি মেহেরাজের মুখের দিকে তাকাল৷ ভেজা আর শীতল চাহনীতে চোখ রেখেই বলে উঠল,

” পরে করি?আমি ঠিক বুঝে উঠছি না কি প্রশ্ন করা উচিত।”

মেহেরাজ ভ্রু উচাল৷টানটান মুখে গম্ভীর অথচ দৃঢ় গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

” কেন? প্রশ্নগুলো প্রেমবিষয়ক? ”

মেহেরাজ প্রশ্নটা ছোড়া মাত্রই জ্যোতির মুখভঙ্গি ফ্যাঁকাসে হলো যেন। মেহেরাজ তা দেখেই মনে মনে হাসল। প্রশ্নটা সে যতোটা টানটান মুখ করে আর দৃঢ় ভাবে বলেছে ভেতরে ঠিক ততোটাই উৎফুল্ল অনুভব করল।ভ্রু নাচিয়ে ফের বলে উঠল,

” কি হলো?”

জ্যোতি অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠল,

” হ্ হু?”

মেহেরাজ আড়ালে চাপা হাসল। পরমুহুর্তেই গম্ভীর গলায় বলে উঠল,

” মানুষ প্রেম নিয়ে নিজের প্রেমময় মানুষের কাছে বলতে গেলে কিছুই বুঝে উঠে না, কিছুই খুঁজে পায় না বলার জন্য। ভুল না হলে তুইও প্রেমময় বাক্য ছুড়বি?”

তৎক্ষনাৎ জ্যোতির উত্তর এল,

” না, ঠিক তেমন নয়।”

মেহেরাজ অতি উৎসাহ নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,

” তাহলে কেমন? ”

মৃদু আওয়াজে জ্যোতি বলল,

” কৌতুহল। শুধুই কৌতুহল। ”

মেহেরাজ উঠে বসল। জ্যোতির চোখের দিকে কিয়ৎক্ষন তাকিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল।তারপর দাম্ভিক স্বরে বলে উঠল,

” তোর চোখ শুধুই কৌতুহল বলছে না। মিথ্যে বলতে ও পারিস না জ্যোতি?”

জ্যোতি চোখ তুলে তাকাল। নরম গলায় বলতে লাগল,

” তেমন নয় মেহেরাজ ভাই। কিছু কৌতুহল খুব আকাঙ্ক্ষার হয়। কিছু কৌতুহল খুব আশার হয়। আমার চোখে হয়তোবা সেই সুপ্ত আশা কিংবা আকাঙক্ষাটাই ফুটে উঠছে। ”

মেহেরাজ আর তাকাল না জ্যোতির দিকে।পা বাড়িয়ে যেতে যেতেই রুমের দরজার কাছে গিয়ে থামল। তারপর ভরাট গলায় শুধাল,

“হুট করে সেই আশা কিংবা আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়ে গেলে তোর প্রতিক্রিয়া কি হবে জ্যোতি?”

জ্যোতি স্তব্ধ হয়ে চাইল।মেহেরাজ অবশ্য ততক্ষনে আর রুমে দাঁড়িয়ে নেই।দরজা পার হয়ে চোখের অদৃশ্য হয়েছে মুহুর্তেই। জ্যোতি তখনও তাকিয়ে রইল সেদিক পানে৷ সত্যিই কি করবে? যদি সে আকাঙ্ক্ষা বা আশাটা ইতিবাচক উত্তর দিয়ে পূরণ হয়ে যায়? তখন তার প্রতিক্রিয়া আসলেই কি হবে?

.

মেহু বিছানায় গা এলিয়ে দিল মাত্রই। নাবিলাদের সাথে ফিরবে ভেবেও পরে জ্যোতির পায়ের অবস্থার কথা ভেবে আর যাওয়া হয়নি নিজ শহরে। জ্যোতির পা ঠিক হলেই একবার ঘুরে আসবে৷ পথে প্রান্তরে কোথাও সাঈদকে দেখার প্রার্থনাও বুকে পুষে নিয়ে যাবে। কথা না হোক, অন্তত একবার চোখের দেখা তো হোক।ক্ষতি তো নেই?বালিশে মাথা রেখে মোবাইল হাতে নিতেই চোখে পড়ল সাঈদের কিছু ছবি। সোশ্যাল মিডিয়ায আপলোড করা ছবি। সাঈদের পাশে অত্যন্ত সুন্দর এক রমণী। পরনে বিদেশিনীদের মতো লং শার্ট,জিন্স।চুলগুলো লালচে অনেকটা। দেখতে ধবধবে সাদা। মেয়েটার চোখ,মুখ, গায়ের রং,গড়নে সবকিছুতেই ফরেইনার ভাব স্পষ্ট আন্দাজ করা গেল। মেহু সুচালো চাহনীতে তাকাল ছবিগুলোর দিকে। দুয়েকটা ছবিতে সাঈদের সাথে একটু বেশিই ক্লোজ দেখাল যেন।লোকেশন আর ছবির দৃশ্য দেখে বুঝা গেল সাঈদ দেশে নেই। মেহুর বুকের ভেতর জ্বলে উঠল হঠাৎ। চোখ বুঝে নিয়ে বারকয়েক জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিয়ে হঠাৎই মোবাইল বন্ধ করে ছুড়ে রাখল একপাশে। জানালা মেলে অপর পাশের জানালাটায় তাকাতেই চোখে পড়ল বাচ্চা মতো একটা ছোট্ট ছেলে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে।মেহু অবাক হলো। ঘড়িতে রাত তখন এগারোটা।এতো রাত অব্দি একটা বাচ্চা জেগে থাকবে কেন? মেহু ভ্রু কুঁচকাল। কিয়ৎক্ষন একই চাহনীতে তাকিয়ে থাকতেই বাচ্চাটা লাফ দিয়ে নেমে গেল জানালা ছেড়ে৷ তারপর আর দেখা গেল না বাচ্চাটাকে। মেহু অবশ্য সেভাবেই তাকিয়ে থাকল ঘন্টার পর ঘন্টা।

.

জ্যোতির দিকে ফিরেই মেহেরাজ চোখ বুঝে আছে।অথচ পাশে শুঁয়ে থাকা জ্যোতির চোখে ঘুম নেই। চোখেমুখে শুধু ব্যাপক অস্থিরতা।পেটের উপর মেহেরাজের ভারী হাতটা বারকয়েক সরালেও মেহেরাজ সরিয়ে নিল না। একইভাবেই হাতটা দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে। জ্যোতি চোখ বুঝল। ঘুমানোর চেষ্টা চালাল। লাভ হলো না।প্রশ্নটা না করা পর্যন্ত অস্থিরতা মিলিয়ে যাবে না ভেবেই মৃদু আওয়াজে ডেকে উঠল,

” মেহেরাজ ভাই?”

মেহেরাজ চোখ মেলে তাকাল না৷ ঘুম জড়ানো গলায় শাসিয়ে বলে উঠল,

“উহ্ হাত সরানোর কথা বলবি? ”

জ্যোতি উত্তরে বলল,

” আমার কিছু কথা আছে মেহেরাজ ভাই৷ ”

মেহেরাজ শুনল ঠিক। তবে উত্তর দিল না সাথে সাথে। কিয়ৎক্ষন পর চোখজোড়া অল্প মেলে চাইল। ভরাট কন্ঠে শুধাল,

” ঘুমাবি না? ”

জ্যোতি স্বাভাবিক স্বরে উত্তর দিল,

” ঘুমাব।”

” তবে?”

জ্যোতি এবারে উত্তর দিল না। কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে কিছু ভবল। বার কয়েক শ্বাস ফেলে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজাল দ্রুত।তারপর মেহেরাজের চাহনীতে চাহনী রেখে শান্তস্বরে জিজ্ঞেস করল,

” ভালোবাসার আগমন কি জীবনে দুবার হতে পারে মেহেরাজ ভাই?”

মেহেরাজ এবার সচেতন হয়ে চাইল। শুধাল,

” এই প্রশ্ন?”

জ্যোতি এবার থামল না। সরাসরি বলে দিল,

” আপনি কি সত্যিই আমায় ভালোবাসেন?এতোটা সময় পর সত্যিই কি আমার প্রতি আপনার কোন অনুভূতি জম্মেছে মেহেরাজ ভাই?যদি না জম্মায় তবে নিশ্চয় আপনার ব্যবহার, আচরণে এসবে এমনকিছুর আভাস পাওয়া যেত না। ”

মেহেরাজের ঘুমঘুম ভাব যেন কেঁটে গেল। জ্যোতির দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে শুধাল,

” উত্তরটা ঠিক কি দেওয়া উচিত আমার? ”

জ্যোতির স্পষ্ট কন্ঠে ভেসে এল,

” যেটা সত্যি। ”

মেহেরাজ আড়ালে ঠোঁট চওড়া করে নিঃশব্দে হাসল। পরমুহুর্তেই মুখে গম্ভীরতা টেনে ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করল,

” তোর কি মনে হয়? উত্তরটা কি হবে?”

জ্যোতি মৃদু আওয়াজে বলল,

” আমার মন যা বলছে তা সত্য ভাবার সাহস করে উঠতে পারছি না৷ তা বাস্তব ভাবারও সাহস নেই। সত্যি বলতে আমি যা ভাবছি তা আমি বিশ্বাস করে উঠতে পারছি না।পরমুহুর্তেই যদি তা মিথ্যে প্রমাণিত হয়? আর আমার ভাবনাটা যদি শুধুই ভাবনা এটা প্রমাণিত হয়?”

মেহেরাজ এবার দৃঢ় স্বরে উত্তর দিল,

” হবে না। আমি তা প্রমাণিত হতে দিব না।”

জ্যোতি ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

” মানে?”

মেহেরাজ প্রশ্নটাকে অতোটা গুরুত্ব দিল না যেন।আকস্মিক আগের মতো চোখ বুঝে নিল। হাতের বাঁধনটা কিছুটা শক্ত করে নিজের শরীরটা আরেকটু এগিয়ে জ্যোতির গা ঘেষে রাখল।জ্যোতির কানের কাছে শীতল স্বরে সেভাবে চোখ বুঝে রেখেই বলল,

” ভেবে নে তা বাস্তব।চোখ বুঝে বিশ্বাস করে নে তোর ভাবনা গুলো সত্যি। এবার বল, এসব জেনে তোর ভেতর কেমন অনুভূতি কাজ করছে এখন?”

জ্যোতি চোখের চাহনী কিঞ্চিৎ বড় করল। এতোটা কাছে পুরুষালি অস্তিত্ব আর কানের কাছে উষ্ণ নিঃশ্বাস উপচে পড়তেই আঙ্গুল খিচে বিছানা জড়িয়ে ধরল। পরমুহুর্তেই কথাগুলো বোধগম্য হতেই বোধহয় বুকের ভেতর ছলাৎ করে উঠল। অস্ফুট স্বরে কেবল বলল,

” হ্ হু?”

মেহেরাজ দাঁতে দাঁত চাপল এবারে। গুরত্বপূর্ণ প্রশ্নের গুরুত্বপূর্ণ উত্তরের বিনিময়ে হুহ শব্দটা বলা নিঃসন্দেহেই রাগের কারণ হবে। বলল,

” শুনিস নি?”

জ্যোতি নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল।শান্ত কন্ঠে উত্তর দিল,

” শুনেছি।”

মেহেরাজ ত্যাড়া সুরে বলে উঠল,

” তবে?”

জ্যোতি ফের চোখের সামনে জ্বলজ্বল করা সত্যটাকে অবজ্ঞা করে শুধাল,

” আমার ভাবনাটা বোধ হয় আপনি বুঝে উঠতে পারেননি মেহেরাজ ভাই। ”

মেহেরাজ মুহুর্তেই জড়ানো স্বরে উত্তর দিল,

” যদি বলি তোর মনের সবটুকু ভাবনাই বুঝে নিয়েছি?”

জ্যোতি এবারে আর কিছু বলতে পারল না। অনাকাঙ্ক্ষিত অনুভূতিতে হৃদয়ে ছুুঁয়ে গেল খুব গভীরভাবে৷ এতোটাই গভীর ভাবে যে সে অনুভূতি শরীরের রক্তকণিকায় কণিকায় ছেয়ে গেল মুহুর্তেই। সুখ নাকি আনন্দ ঠিক বুঝা গেল না। বুঝা গেল না দুঃখ নাকি কষ্ট তাও। শুধু বোধ হলো পাশের পুরুষটির হৃদয়ে তার স্থান হয়েছে।পাশের পুরুষটির উপর তার অধিকারের স্বীকারোক্তি পেয়েছে। পাশের পুরুষটিকে স্বামী ভাবতে এবার বোধ হয় আর জড়তা নেই, শঙ্কা নেই, ভয় নেই। নেই তৃতীয় ব্যাক্তির সম্বোধন।

.

মেহুর ঘুম ধরল জানালার পাশে বসেই।জানালাটা খোলাই থাকল। মাথাটা জানালার গ্রিলে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে গিয়েছিল। আকস্মিক ঘুম ভাঙ্গল মাথায় কিছু একটার আঘাত পেয়ে। মেহু তৎক্ষনাৎ চোখজোড়া মৃদুভাবে মেলে তাকাল।ঘুমুঘুমু চোখে দেখল একটা স্টেথোস্কোপড! চোখজোড়ায় বিস্ময় টেনে তাকিয়ে থাকতে পরমুহুর্তেই আবারও ওপাশে জানালা থেকে কেউ ছুড়ে দিল একটা ঘড়ি। মেহু অবাক হলো। চোখ জোড়া দিয়ে ওপাশের জানালায় কাউকেই দেখা গেল না।মেহু বিরক্ত হলো। কিঞ্চিৎ গলা উঁচিয়ে বলে উঠল,

” কি আশ্চর্য! এসব এখানে ছুড়ে ফেলছেন কে?কেনই বা ছুড়ে ফেলছেন? ”

মেহুর কথায় দম মানল না ওপাশের ব্যাক্তিটি।আবারও ছুড়ে মারল একটা ব্রাশ আর টুথপেস্ট। টুথপেস্টটা ঠিক মেহুর কপালে এসেই লাগল। মেহুর বিরক্তি এবার তুঙ্গে উঠল। একে এসব করে ঘুম ভাঙ্গাল, দ্বিতীয়ত মাথায় আঘাত পাওয়া সব মিলিয়ে রাগে ঝাড়ি দিয়েই বলে উঠল,

” কথা বললে শুনতে পাননা? আপনাদের জন্য তো দেখা যাচ্ছে জানালা মেলে বসাই যাবে না।ভদ্রতার কিছু শিখছে বলেই মনে হচ্ছে না।”

এবারে মেহুর জোরালো আওয়াজ শুনেই বোধ হয় মুহুর্তেই এক যুবক ছুটে এল। যুবকটির অগোছাল চুল আর ঘুমঘুম চোখ-মুখ দেখে বোধ হলো মাত্রই ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে এসেছ। নিভু নিভু চোখে তাকিয়েই ঘটনা বুঝে উঠার চেষ্টা করে যুবকটি শুধাল,

” এক্সিউজ মি, আপনি কি আমাকেই বলছেন?”

মেহু চোখ তুলে তাকাল। পরমুহুর্তেই অবাক হলো।যুবকটিকে সে চেনে।অনেক আগে থেকেই চেনে। একমুহুর্তের জন্য অবাক হয়ে তাকালেও পরমুহুর্তেই ঝাঝালো স্বরে বলে উঠল,

” আপনার মধ্যে এখনো কোন ভদ্রতা তৈরি হয়নি? এখনো মানুষকে বিরক্ত করে বেড়ান আগের মতো?এভাবে সকাল সকাল মানুষের ঘরে জিনিসপত্র ছুড়ে মারছেন কোন আক্কেলে? শিক্ষিত হয়েছেন ঠিক তবে ভদ্রতা শিখলেন না।”

যুবকটির মুখ হঠাৎ থমথমে হয়ে গেল। গোল গোল চোখে কিয়ৎক্ষন মেহুর দিকে তাকিয়ে থেকেই জানালার পাশ থেকে সরে গেল। পরমুহুর্তেই চোখে চশমা পরে হাজির হলো।অবিশ্বাস্য চাহনীতে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে উঠল,

” তুমি? তুমি এখানে? ”

মেহু দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

” হ্যাঁ, আমি।মেহু। আমি বলেই আপনি এই বেয়দবিটা করার সাহস পেয়েছেন? ”

যুবকটি ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিল। বলল,

” কি বেয়াদবি?”

মেহু রাগ নিয়ে বলল,

” স্টেথস্কোপড ছুড়ে মেরেছেন কেন? আমি কি ডাক্তার আপনার মতো?ছেলেদের ঘড়ি পরে ও তো আমার কাজ নেই।সর্বশেষ, ব্রাশ আর টুথপেস্ট!আমার বাসায় কি ব্রাশ আর টুথপেস্ট নেই যে দাঁত ব্রাশ করতে পারব না?”

যুবকটি চমৎকার হাসল। বলে উঠল,

” নাও থাকতে পারে। তুমি তো দশটা এগারোটায় ঘুম ছেড়ে উঠতে। আধৌ ব্রাশ করো ততোক্ষনে ঘুম ছেড়ে উঠে? আমার সন্দেহ হয়।”

মেহু রেগে উঠল আবারও।বলল,

” আমাকে দেখে কি মনে হয় আমি দাঁত ব্রাশ করি না?”

” তোমাকে দেখে তো কতকিছুই মনে হয় না। অথচ অনেককিছুই তো করে বেড়াচ্ছো। তাই না?”

” আমি যাই করি, আপনার মতো মানুষের বাসায় জিনিস ছুড়ে ফেলছি না।”

যুবকটি হঠাৎ ত্যাড়া সুরে উত্তর দিল,

” বেশ করেছি ছুড়ে মেরেছি। কি করবে তুমি?”

মেহু অবাক হয়ে শুধাল,

” কোন অনুশোচনাবোধই নেই আপনার মাঝে। আশ্চর্য!”

” না, নেই। ”

কথাটা দাম্ভিক স্বরে বলেই যুবকটি ঝুকল জানালার নিচের দিকে। মুহুর্তেই একটা বাচ্চা ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে মেহুর মুখের উপর জানালাটা বন্ধ করে দিল। মেহু অবাক হলো। এই লোকের সাহস দেখে কিঞ্চিৎ রাগও হলো ভেতরে ভেতরে। একবারও স্যরি বলল না?

#চলবে…

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_৩২
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

আজ মেহেরাজ বাসায়ই থেকে গেল। নাস্তা করে গোসল সেরে ভেজা চুল নিয়ে বের হয়ে জ্যোতির সম্মুখে এসে দাঁড়াল।পরনে কালো রংয়ের একটা টাউজার থাকলেও বক্ষ উম্মুক্ত।ফোঁটা ফোঁটা পানি এখনো লেপ্টে আছে ফর্সা, লোমহীন বুকে । জ্যোতি একনজর সেদিক পানে তাকিয়েই দ্রুত নজর সরাল৷ বিছানায় হেলান দেওয়া ছেড়ে সোজা হয়ে বসল এবার। মুখচোখ কুঁচকে ওয়াশরুমের দরজার দিকে একনজর তাকিয়ে আবার তাকাল রুমের দরজার দিকে। মেহুকে ডাক দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেই ইতস্থত করে মেহেরাজকএ বলে উঠল,

” আজ কি আপনি ছুটি নিয়েছেন মেহেরাজ ভাই?যাবেন না? ”

মেহেরাজ এবারে একদম খাটের কিনারায় ঘেষে দাঁড়াল। জ্যোতির দিক একনজর তাকিয়ে নিজের ভেজা চুলগুলোতে হাত দিয়ে ঝাড়া দিল৷ সঙ্গে সঙ্গেই পানির ছিটে এসে পড়ল জ্যোতির চোখ মুখে।জ্যোতি চোখ তুলে মেহেরাজের দিকে তাকাতেই মেহেরাজের ভ্রু উঁচু করল। জিজ্ঞেস করল,

” না গেলে তোর কোন অসুবিধা হবে? ”

জ্যোতি সূক্ষ্ম চাহনীতে চেয়ে শুধাল,

“অসুবিধা কেন হবে?আপনার বাসা আপনি থাকবেন। আমার কেন অসুবিধা হবে ? ”

মেহেরাজ ত্যাড়া কন্ঠে শুধাল,

” তাহলে এভাবে মুখচোখ কুঁচকে আছিস কেন?”

নিরস কন্ঠে উত্তর আসল,

” কিছু নয়। ”

মেহেরাজ তাকাল।গম্ভীর স্বরে বল উঠল,

” অসুবিধা না হলেও তুই যে খুশি নোস তা বুঝা যাচ্ছে জ্যোতি।”

” তেমন কিছু নয়। ”

মেহেরাজ ভ্রু নাচিয়ে শুধাল,

” তাহলে কেমন? তুই কি খুশি হবি খুব? ”

জ্যোতি উত্তর দিল না। চুপচাপ বসে থাকল আগের ন্যায়। মেহেরাজ এবারে দু পা এগিয়ে নিজের হাতে টিশার্টটা নিল। পরতে যাবে ঠিক তখনই জ্যোতি বলল,

” মেহু আপুকে ডেকে দিতে পারবেন? প্রয়োজন আছে একটু।”

মেহেরাজ কপাল কুঁচকাল। পরমুহুর্তেই কিছু একটা বুঝে উঠতেই কপালের ভাজ মিলিয়ে গেল।হাতের টিশার্টটা বিছানার এককোণে রেখে পা এগিয়ে জ্যোতির সামনে এসে দাঁড়াল। বেশ খানিকটক ঝুঁকে জ্যোতির মুখপানে তাকাল। ভেজা চুলগুলো জ্যোতির কপালে ঠেকাতেই দুয়েকফোঁটা পানি গড়িয়ে গেল জ্যোতির কপালে। ফিসফিসিয়ে বলল,

” মেহু কি তোকে ওয়াশরুম পর্যন্ত কোলে করে নিয়ে যেতে পারবে?মেহুর থেকে ভালো সাহায্য আমি করতে পারব।
বুঝলি?”

কথাটা বলেই একহাত জ্যোতির কোমড়ে নিয়ে ঠেকাল খুব দ্রুত। এক মুহুর্তও অপেক্ষা না করে জ্যোতির একটা হাত নিজের কাঁধে রাখল।তারপর হাত দিয়ে শক্ত করে কোমড় আঁকড়ে ধরে কোলে তুলল জ্যোতিকে।মুহুর্তেই ভেজা উম্মুক্ত বুকের শীতল স্পর্ষে কেঁপে উঠল জ্যোতি। শরীরের লোমকূপ জুড়ে শিহরন বইল খুব দ্রুত। বার কয়েক ঘনঘন শ্বাস টেনেই অস্বস্তিতে মুখ কালো করল। মেহেরাজ চাপা হাসল৷ পরমুহুর্তেই স্বাভাবিক মুখ করে মৃদু আওয়াজে বলে উঠল,

” কি আশ্চর্য! এমন করার কি আছে? কিছু করেছি আমি?”

জ্যোতি তাকাল না। বিনিময়ে কোন উত্তর ও দিল না৷ হাত চেপে ধরে রাখল মেহেরাজের কাঁধের অংশটুকু। কিয়ৎক্ষন পর ওয়াশরুমের দরজার সামনেই নামিয়ে দিল মেহেরাজ। ফিসফিসিয়ে বলল,

” বাকিটুকু তুই এই ভাঙ্গা পা নিয়েই যা। ”

জ্যোতি পাশ ফিরে তাকাতেই মেহেরাজের মুখে সূক্ষ্ম হাসির রেশ দেখতে পেল। মুহুর্তেই কেমন এক লজ্জ্বা আর অস্বস্তিময় অনুভূতি অনুভব হলো।এভাবে মেহেরাজের কোলে উঠে সাহায্য নেওয়াটা বোধহয় আসলে তার বোকামো হলো ভেবে মনে মনে বারকয়েক ঝেড়ে নিল নিজেকে। নিরস মুখে বলে উঠল,

” ধন্যবাদ মেহেরাজ ভাই। ”

মেহেরাজ তাকাল। অন্যমনস্ক ভাবে মুখ ফসকেই বলে উঠল,

” তোকেও ধন্যবাদ।”

জ্যোতি সূক্ষ্ম চাহনীতে চাইল। প্রশ্ন ছুড়ল ক্ষনিকেই,

” কেন? ”

মেহেরাজ অপ্রস্তুত হলো। সেই অপ্রস্তুত ভাব আড়াল করতেই গম্ভীর কন্ঠে শুধাল,

” কিছু নয়। তুই যা, আমি মেহুকে পাঠাচ্ছি।”

কথাটুকু বলেই আর দাঁড়াল না মেহেরাজ। বিছানার উপর থেকে নিজের টিশার্টটা নিয়ে দ্রুত গায়ে জড়াল।তারপর খুব দ্রুতই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।মেহুর রুমে গিয়ে মেহুকে জ্যোতির কাছে পাঠিয়েই বাসা ছেড়ে বের হলো।

.

মেহেরাজ বাসায় ফিরল কিছুটা সময় পরই৷জ্যোতিকে আর মেহুকে একসাথে বিছনায় বসে থাকতে দেখে মৃদু হাসল৷ এগিয়ে এসেই শুধাল,

” কি করছিস তোরা?”

মেহু হাসল ঠোঁট চওড়া করে৷ বলে উঠল খুব দ্রুত,

” তুমি না আজ বাসায় থাকছো ভাইয়া? তো হঠাৎ বেরিয়ে কোথায় গেলে?”

মেহেরাজ উত্তরে বলল,

” তেমন কোথাও নয়। এখানে একজন জুনিয়র ভাই আছে। তাই ভাবলাম, দেখা করে আসি। ”

” ভালো করেছো।”

মেহেরাজ হাসল বিনিময়ে। বলল,

” মেহু? বেলিফুলের মালা লাগবে তোর?”

মেহুর মুখ চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল এক মুহুর্তেই।চকচকে চোখে তাকিয়ে মুহুর্তেই বলে উঠল,

” কোথায়? দাও জলদি। ”

মেহেরাজ আবারও হাসল। একহাতে এগিয়ে দুটো বেলিফুলের মালা এগিয়ে দিল মেহুর দিকে। ঠোঁট চওড়া করে বলল,

” আমি জানি, আমার বোন বেলিফুলের মালা কতোটা পছন্দ করে। তবে এটা আমি নই, অন্য কেউ পাঠিয়েছে। ”

মেহু ভ্রু কুঁচকে নিল। প্রশ্ন ছুড়ল,

” কে সে?”

” তোর চেনা। কিন্তু সে তার পরিচয় বলতে নিষেধ করেছে। ”

মেহু থমকাল। কিছু বলতে গিয়েও বলল না। আবার পরমুহুর্তেই হেসে বলে উঠল,

” তাকে আমার তরফ থেকে ধন্যবাদ জানিয়ে দিও ভাইয়া। সত্যিই অনেক পছন্দ করি। তাই পরিচয় না জানালেও নিয়ে নিচ্ছি। ”

কথাটুকু বলেই মেহু হেসে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। বিনিময়ে মেহেরাজ ও হাসল। পরক্ষনে মুখ ফিরিয়ে জ্যোতির দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকাল। নিরস গলায় বলে উঠল,

” কতদিন হলো চুল আঁছড়াস না তুই?কি অগোছাল হয়ে আছে তোর চুল!”

জ্যোতি অবাক হলো।কিছুটা সময় আগেই চুল বেঁধেছে সে। খোপা করে মাথায় ওড়না দিয়ে বসে ছিল এতক্ষন।হঠাৎ এমন প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকে বলল,

“অগোছাল? কিছুক্ষন আগেই চুল বেঁধেছি মেহেরাজ ভাই।”

মেহেরাজ এগিয়ে এল। হাত দিয়ে জ্যোতির মাথা থেকে ওড়নাটা সরিয়েই মুখ চোখ কুঁচকে নিল। এমন ভাব করল যেন জ্যোতির চুলের অবস্থা বিচ্ছিরি থেকেও বিচ্ছিরি অবস্থা। চাপাস্বরে বলল,

” তোর চুল দেখে তো তা মনে হচ্ছে না তা। ”

জ্যোতি পুনরায় অবাক হলো। হাত দিয়ে চুলে হাত রাখল মুহুর্তেই। খোঁপা করা চুলগুলো মোটেও তার কাছে অগোছাল বোধ হলো না। স্পষ্ট স্বরে বলল,

“আপনি কি মিথ্যে বলছেন মেহেরাজ ভাই?”

মেহেরাজ মুখ চোখ গম্ভীর করল। হাত দিয়ে জ্যোতির খোঁপা করা চুল খুলে দিতে দিতেই ধমকের সুরে বলে উঠল,

” তোর কি মনে হচ্ছে? আমি মিথ্যে কথা বলি? আমি মিথ্যুক?”

” তা বলিনি। ”

আবারো ধমকের সুরে বলল মেহেরাজ,

” তাহলে কি বলেছিস? ”

জ্যোতি উত্তর দিল না এবার। থমথমে মুখ করে বসে থাকল কেবল। মেহেরাজ অন্যপাশ ফিরে আড়ালে হাসল। বুক টানটান করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েই আদেশের সুরে বলল,

” সোজা হয়ে বস। তোর চুল সুন্দর করে বেঁধে দিব। ”

জ্যোতি যেমন ভাবে বসা তেমন ভাবেই থাকল। কয়েক পলক তাকিয়ে ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,

” আমি পারব মেহেরাজ ভাই।আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।”

মেহেরাজ শুনল না কথাটা।কড়া স্বরে বলে উঠল,

” তোকে কি জিজ্ঞেস করেছি তুই পারবি কি পারবি না? ”

কথাটুকু বলেই জ্যোতির পাশেই বিছানায় বসল মেহেরাজ। হাত এগিয়ে জ্যোতির ছেড়ে দেওয়া চুলগুলোতে স্পর্শ করাল।চিরুনি দিয়ে না আঁচড়িয়েই অদক্ষ হাতে বেনুনি গাঁথল অতি সাবধানে। তারপর বেনুনির শেষ প্রান্তের দিকে পেঁচিয়ে দিল একটা বেলি ফুলের মালা। অস্ফুট স্বরে বলল,

” পার্ফেক্ট! ”

কথাটা বলে উঠে যেতে নিয়েই আবার বসে গেল। জ্যোতির কানের কাছে মুখ নিয়েই ভরাট কন্ঠে বলল,

” এই মালাটা আমার আনা। চুল বাঁধা যেমনই হোক, মালাটা যদি খুলে নিয়েছিস তো ঠাস করে দোতালা থেকে নিচে ফেলে দিয়ে হাত, পা, কোমড় ভাঙ্গার ব্যবস্থা করে দেব কিন্তু ফ্রিতে।”

জ্যোতি নিশ্চুপ।চোখজোড়া বড় করে মেহেরাজের দিকে তাকাতেই মেহেরাজ বাঁকা হাসল। বসা ছেড়ে উঠে যেতেই চোখ পড়ল জ্যোতির পায়ে।তার দেওয়া নুপূর নেই দেখেই ভ্রু উঁচু করল সঙ্গে সঙ্গে। গম্ভীর স্বরে বলল,

” তোর পায়ে নুপূর নেই কেন জ্যোতি? ”

জ্যোতি অবাক হলো আবারও। নুপূর তো তার পায়ে এতদিনও ছিল না।বোধহয় মেহেরাজ খেয়াল করেনি এতগুলো দিন। পরমুহুর্তেই মনে পড়ল মেহেরাজের দেওয়া নুপূরের কথা।নুপূর গুলো সেদিনই সযত্নে তুলে রেখেছিল সে যেদিন মেহেরাজ পরিয়ে দিয়ে এসেছিল। শুধু নুপূর নয়, মেহেরাজের দেওয়া প্রত্যেকটা উপহারই সে তুলে রাখে। প্রিয় মানুষের উপহার ব্যবহার করলে যদি ফুরিয়ে যায়? তার থেকে ব্যবহার না করে সযত্নে, গোপনে তুলে রাখা ভালো নয়? অস্ফুট স্বরে বলল,

” নু্ ্পূর?”

মেহেরাজের কন্ঠ এবার কিছুটা দৃঢ় শোনাল। বলল,

” হ্যাঁ, শুনতে পাস না? ”

জ্যোতি গলা ঝাড়ল। তার পায়ে যে নুপূর নেই এটা বোধহয় মেহরাজ এতগুলো দিনে খেয়াল করেনি। তাই বলল,

” নুপূর তো আমি এতগুলো দিনও পরিনি । এই বাসায় আসার পরও ছিল না। আপনি বোধ হয় খেয়াল করেননি!”

মেহেরাজ মুখ টানটান হলো মুহুর্তেই। চোয়াল শক্ত হলো।দাঁতে দাঁত চেপে শীতল কন্ঠে রাগ নিয়ে বলে উঠল,

” তো ফেলে দিয়েছিস ওগুলো?আমি দিয়েছি বলেই তো খুলে নিয়েছিস তাই না? ”

জ্যোতি জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজাল।উত্তর দিল,

“ফেলে দিইনি।”

মেহেরাজ এবারেও রাগ ঝেড়ে বলে উঠল,

” তো?যত্ন করে নিজের সাথে সবসময়ের জন্য রেখেও তো দিসনি। তার থেকে ফেলে দিতি।”

” ড্রয়ারে রেখেছিলাম। আসার সময় তো রিতুরা ব্যাগ গুঁছিয়ে দিয়েছিল। তাই আর নেওয়া হয়নি। ”

দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

” আমি কি বলেছিলাম ড্রয়ারে তুলে রাখতে তোকে?”

জ্যোতি গলা ঝাড়ল। স্বাভাবিক স্বরে বলতে লাগল,

” আমার মন বলেছিল। চোখের সামনে তো আমাদের জীবন থেকে অনেকেই ফুরিয়ে যায়, অনেকেই হারিয়ে যায়। তাদের উপহার গুলো নাহয় ফুরিয়ে নাই যাক? তাই রেখে দিয়েছি।ফুরিয়ে গেলে যদি দ্বিতীয়বার না পাই?শুধু আপনার ক্ষেত্রে নয়, দাদীর দেওয়া বাটন ফোনটাও তুলে রেখেছি আমি। ”

মেহেরাজের মুখের টানটান ভাবটা এবার মিলিয়ে গেল। রাগটা এবার কমে আসল। ঠোঁট গোল করে লম্বা শ্বাস ফেলে আর কিছু না বলেই হঠাৎ বেরিয়ে গেল।

.

মেহু মন খারাপের সময়টায় শাড়ি পরতে ভালোবাসে। ছোটবেলা থেকে মা বাবা ছাড়া বড় হওয়া মেয়ে হিসেবে অধিকাংশ সময়ই তাকে একা কাঁটাতে হয়েছে। সে একাকীত্বতেই মূলত সেই শাড়ি আর সাঁজগোজকে সঙ্গী করেছিল। আজও ব্যাতিক্রম হলো না। পরনে লাল টকটকে শাড়ি, চোখে গাঢ় কালো কাজল আর চুলে বেলিফুলের মালা। হাত ভর্তি লাল আর কালো রাঙ্গা কাঁচের চুড়ি। সে চুড়িরই রিনিঝিনি আওয়াজ করল জানালার ধারে বসে। অপর প্রান্তের জানালায় আজও ছোট বাচ্চাটা ঝুলে আছে।বয়স হয়তো আনুমানিক চার বা পাঁচবছর হবে। ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকিয়েই আধো সুরে বলল,

” তুমি মেহু? ”

আকস্মিক মিষ্টি গলায় মেহু চমকাল। একনজর তাকিয়েই উত্তরে বলল,

” হ্যাঁ, তুমি কি করে জানলে? ”

বাচ্চাটা গম্ভীর ভাবে চাইল। বিনিময়ে বলল,

” বলা যাবে না। ”

মেহু পুনরায় চমকাল। এইটুকু বাচ্চার এমন গম্ভীর উত্তরে কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলেও পরমুহুর্তেই বলল,

” তোমার নাম?”

” সানশাইন। ”

মেহু ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ভাবল। সাইনশাইন? সুন্দর নাম। পরমুহুর্তেই বলল,

” কে রাখল এই নাম?”

” মেঘ। ”

ছোট বাচ্চাটার কন্ঠে মেঘ শব্দটা যতোটা দৃঢ় শোনাল ততোটাই দৃঢ় ভাবে মেহুর মস্তিষ্কে পৌঁছাল। অস্ফুট স্বরে ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,

” মে ্ ঘ?”

বাচ্চাটা এবারে উত্তর দিল না। মেহু মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করল বাচ্চাটাকে। চেহারাটা সেদিনকার সে যুবকের মতোই দেখতে। যুবকটির নাম আবিদ। ডাকনাম মেঘ। যুবকটির সাথে তার পরিচয় হয়েছিল কোন এক গ্রন্থাগারে সেই কিশোরী বয়সে।ছেলেটি তখন মেডিকেলে পড়ুয়া ছাত্র।তারপরের বার পরিচয় হয়েছিল একদম নতুনভাবে। তারই বান্ধবীর প্রেমিকের বন্ধু হিসেবে। বান্ধবী আর বান্ধবীর প্রেমিক প্রেমে মত্ত হতেই সে আর আবিদ নামক লোকটা অন্যপ্রান্তে এসে বসেছিল। তখন থেকেই টুকটাক কথোপকোথন, গল্প।প্রায়সই ঝগড়া আর একে অপরের পেঁছনে লেগে থাকা। কখনো সরাসরি দেখা হলে মেহুর চুল টানা অথবা পেঁছনে থেকেই মাথায় চাটি মারা। একবার বাদাম খাওয়ার পর বাদামের খোসা গুলো আড়াল করেই মেহুর ব্যাগে রেখে দিয়েছিল যুবকটি। মেহু সে বিষয়টা টের পেল একেবারে বাসায় পৌঁছে।আরো হরেক রকম কাহিনী আছে তাদের। এত এত কাহিনীর পরই ইন্টার্নী শেষে হঠাৎই আকস্মিকভাবে ছেলেটা হারিয়ে যায়।এরপর না তো মেহু কখনো খোঁজ করেছে ছেলেটার, আর না তো ছেলেটাও কোন খোঁজ নিয়েছে তার। মেহু ঠোঁট চওড়া করে কিঞ্চিৎ হাসল৷ বলল,

” মেঘ তোমার কি হয়? ”

বাচ্চাটা উত্তর দেওয়ার আগেই সেখানে উপস্থিত হলো মেঘ নামক যুবকটি। বলল,

” মেঘ ওর কি হয় তুমি জেনে কি করবে?”

মেহু চোখ তুলে চাইল। আকস্মিক চমকালেও ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

” আমি অতো বোকা নাকি?ও না বললেও আমি জানি ও আপনার কি হয়।”

যুবকটি ভ্রু নাচিয়ে শুধাল,

” কি হয়?”

মেহু উত্তরে বলল,

” ছেলে।বাবার সাথে ছেলের নাম কিন্তু দারুণ মানিয়েছে। মেঘ- রোদ। সুন্দর না?”

মেঘ হাসল। দাম্ভিক স্বরে বুক টানটান করে বলল,

” সুন্দর না হলে কি করে হয়?আমিই তো রাখলাম নামটা। তাই না?”

মেহু মাথা নাড়াল। বলল,

” চার বছর আগে হঠাৎ উধাও হয়ে গেলেন কেন? ভুল না হলে আপনার বাচ্চার বয়স পাঁচ বছর তো হবে।রাইট? আপনি আপনার বাচ্চার কথাটা লুকালেন কেন? আর বাচ্চার মা কোথায়? আলাপ করিয়ে দিন । আমি আপনার নামে কিছু সুবক্তব্য দিই। ”

মেঘ ত্যাড়া কন্ঠে শুধাল,

” বাচ্চার মাকে দিয়ে তুমি কি করবে?”

” আপনার মাথা করব। ডেকে দিন না। ”

” বাচ্চার মা পাশে রুমে। ”

মেহু ভ্রু কুঁচকাল। বলল,

” পাশের রুমে কেন থাকবে? হিসেব মতো বর বউ একরুমে থাকবেন না আপনারা? ”

মেঘ নামক যুবকটি হঠাৎই কেঁশে উঠল। গলা ঝেড়ে বলল,

” সেসব বাদ দাও।তুমি বিয়ে করলে না কেন? মাঝখানে এতবছর পেরিয়ে গেল। ”

মেহু নিরস গলায় বলল,

” সুপাত্র পাচ্ছি না। ”

মেঘ নামক যুবকটি মাথা নাড়াল৷ ছোট বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়ে মুখে চমৎকার হাসি ঝুলিয়ে বলল,

” তাহলে খুঁজে নাও। পেয়ে গেলে বিয়েটা করে বাচ্চাকাচ্চার মা হয়ে যাও দ্রুত।”

কথাটুকু বলেই পেঁছন ঘুরল। কিয়ৎক্ষনের মধ্যে চলেও গেল। মেহু তাকিয়ে থাকল। আসলেই কি সুপাত্র পেলে বিয়েটা করে নিতে পারবে সে? সাঈদ নামক ব্যাক্তিকে ভুলে অন্য কারো নামে নিজের জীবন লিখে দিতে পারবে? আসলেই কি পারবে? বিষয়টা কি এতটুকুই সহজ?

#চলবে…

এক মুঠো প্রণয় পর্ব-২৯+৩০

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_২৯
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

মেহেরাজের পরনে শুভ্র রাঙ্গা শার্ট,টাই আর কালো প্যান্ট।ফর্মাল ড্রেসাপে লম্বা চওড়া শরীরটা আরো সুদর্শন বোধ হলো। জ্যোতি এক নজর তাকিয়েই চোখ ফেরালো।ঘড়ির কাঁটা তখন নয়টার ঘরে। ছোট্ট শ্বাস ফেলে অগোছাল চুল গুলো নিজের হাতে করে খোঁপা করতে নিতেই মেহেরাজ এসে উপস্থিত হলো সম্মুখে। হুট করেই বলিষ্ঠ হাত বাড়িয়ে আটকে দিল জ্যোতির হাত।অগোছাল এলোমেলো চুলগুলো আগের ন্যায় খুলে দিয়ে গভীর চাহনীতে তাকাল জ্যোতির মুখপানে। জ্যোতির মুখ শুকনো।গালের ডানপাশে ঘষে যাওয়া দাগ কালচে হয়েছে।কপালের কোণায় ব্যান্ডেজের চিহ্ন।মুখে সদ্য ফুলে উঠা কয়েকটা লালচে ব্রনের অস্তিত্ব।চিকন ঠোঁট জোড়ায় ফোলা ভাবটা কমেছে।ঠোঁটের কোণায় আঘাতের চিহ্নটা শুঁকাতে শুরু করেছে।মেহেরাজ কিয়ৎক্ষন তাকিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল পুরো মুখ, মুখের ক্ষত আর ডাগর চোখজোড়া। জ্যোতি অস্বস্তিতে গলা ঝাড়ল এবার। হালকা স্বরে বলল,

” মেহেরাজ ভাই, কোন দরকার আছে কি?”

মেহেরাজ দৃষ্টি সরাল না। বুকে হাতজোড়া গুঁজে নিয়ে একইভাবে তাকিয়েই গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,

” হ্যাঁ, আছে।”

” কি দরকার?”

আগের ন্যায় গম্ভীর স্বরে উত্তর আসল,

” বলতে ইচ্ছুক নই তোকে।”

এবারের কথাটায় জ্যোতি ভ্রু কুঁচকে নিল। মুখ মলিন করে থমথমে চাহনী নিয়ে স্পষ্ট স্বরে বলে উঠল,

” এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন মেহেরাজ ভাই?”

মেহেরাজ ভ্রু উঁচু করল। চাহনীতে স্পষ্ট বোঝা গেল প্রশ্নটা তার পছন্দ হয়নি। কপাল কুঁচকে নিয়ে বিরক্তির সহিক বলে উঠল,

” তাকাচ্ছি তো আমি,তুই তো তাকাস নি। তোর অসুবিধা কোথায় তাই তো বুঝলাম না।”

জ্যোতির স্থির আর স্পষ্টভাবে তাকাল। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে সোজাসুজি উত্তরে বলে উঠল,

” অসুবিধাটা হলো আপনি আমারই দিকে তাকিয়ে আছেন।”

মেহেরাজের কপালের ভাজ ঘন হলো। ভ্রু নাচিয়ে শুধাল,

” তো? তাকিয়েছি কেবল, কিছু তো করে ফেলিনি যে অসুবিধা হবে।”

” তাকাবেন কেন? ”

মেহেরাজ দাঁতে দাঁত চাপল। মুখ টানটান করে দৃঢ় গলায় উত্তর দিল,

” তাকাব, তোর সমস্যা?”

” এভাবে একটা মেয়ের প্রতি একটা পুরুষ মানুষের নজর নিশ্চয় অস্বস্তির কারণ।আপনার উচিত নজর সরানো। ”

” তুই তো আর যেকোন একটা মেয়ে নোস। সাক্ষাৎ মেহেরাজের বউ বলেই মেহেরাজ তোর দিকে তাকিয়েছে। এবার বল অনুচিত হবে?”

মেহেরাজের কন্ঠে কিছু ছিল নাকি কথাগুলোতে বুঝে উঠল না জ্যোতি। তবে বুকের ভেতর কেমন জানি করে উঠল তার। ঠোঁট ভিজিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,

“অযথা কথা বাড়ছে। কিছু কি বলবেন মেহেরাজ ভাই?”

মেহেরাজ তাকাল। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে অন্যমনস্ক হয়েই বলল,

” না, কিছু একটা করব ভাবছি।”

জ্যোতি বুঝল না কি করবে। তাই ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

” কি করবেন?”

মেহেরাজ একদৃষ্টিতে জ্যোতির ঠোঁটে তাকিয়ে থাকল।আকস্মিক খাটের একপাশে বসে ডান হাতটা ছুুঁয়ে দিল জ্যোতির কোমল ঠোঁটের কোণে। যেখানাটায় সেদনিকার রাস্তার খসখসে জমিতে লাঘা আঘাতটা মাত্রই শুঁকাতে আরম্ভ করেছে।মেহেরাজ আঙ্গুল ছুঁয়ে বুক টানটান করে মুহুর্তেই এক মিথ্যে বলে বসল দক্ষভাবে,

” তোর ঠোঁটটা এখনো ফুলে আছে।খেয়াল করিস নি তুই?”

জ্যোতির ভ্রু জোড়া কুঁচকে এল।আকস্মিক ঠোঁটে মেহেরাজের হাতের ছোঁয়া পেয়ে অবাক হলেও ঠোঁট ফোলার কথাটা মাথায় আসতে স্বাভাবিক ভাবেই নিল । সহসা হাত গেল নিজের ঠোঁটের কাছে।মনে হলো না ঠোঁট অতোটা ফোলা। তবুও মেহেরাজ মিথ্যে বলবে না ভেবে বিশ্বাস করে নিল। বলে উঠল,

” ফোলা তো কমে যাওয়ার কথা। দুদিন হয়ে গেল, এখনও ফোলা কমল না?”

মেহেরাজ মনে মনে চাপা হাসল। তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে আকস্মিক জ্যোতির কোমল ঠোঁটজোড়ায় বুলিয়ে মুখ এগোলো। মুহুর্তেই নিজের পুরু ওষ্ঠদ্বয় আলতো করে ছুঁয়ে দিল জ্যোতির ঠোঁটজোড়ায়। জড়ানো গলায় মৃদু আওয়াজে ঠোঁট নাড়িয়ে বলতে লাগল,

” কেঁটেছে না রাস্তার খসখসে জমিতে?তাই কমে নি।এবার আমার ঠোঁট ছুঁয়ে দিল তোর ঠোঁট। ফোলা কমে যাবে। ”

মেহেরাজ কথাগুলো বলার সময় বারংবার তার পুরু ঠোঁটের ছোঁয়া পড়ল জ্যোতির চিকন,কোমল ঠোঁটে।উষ্ণ নিঃশ্বাস উপচে পড়ল জ্যোতির মুখপানে।জ্যোতি এক মুহুর্তের জন্য স্তব্ধ হলো। পরমুহুর্তেই অনুভব করল শরীর জুড়ে তীব্র শিহরণ। যার দরুণ মুহুর্তেই কেঁপে উঠল সর্বাঙ্গ৷ কিঞ্চিৎ কাঁপতে লাগল নরম ঠোঁটজোড়া ও। স্পষ্টভাবে কথা বলা মেয়েটা স্পষ্টভাবে কথা বলা তো দূর, প্রথম পুরুষালি ওষ্ঠের উষ্ণ ছোঁয়ায় স্পষ্টভাবে তাকানোও দায় হয়ে পড়ল। তুমুল অস্বস্তিতে এবার হাত পায়ের আঙ্গুল খিচে এল। বার কয়েক শ্বাস টেনে কাঁপা স্বরে বলতে লাগল,

” ক্ কি.. ”

বাকিটুকু বলতে পারল না। মেহেরাজ ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসেই ফিসফিসিয়ে বলল,

” প্লিজ জ্যোতি, চুপ কর।মুহুর্তটাকে তোর উল্টাটাল্টা লজিক দিয়ে থামাবি না বললাম।”

এবারও ঠোঁটে ঠোঁট স্পর্শ হলো কয়েকবার। জ্যোতি থম মেরে গেল। ঘনঘন শ্বাস টেনে ক্ষীন চাহনিতে মেহেরাজের দিকে তাকাতেই মেহেরাজ ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে ঠোঁট ছোঁয়াল ডান গালের কালচে আঘাতের জায়গাটায়। ফিচেল স্বরে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,

” শখের পুরুষের ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়ায় নারীর আঘাত এক মুহুর্তেই সারে। তোর আঘাতগুলোও সেরে উঠবে।খুব শীঘ্রই।তখন আর ভেতর, বাহিরে কোন আঘাতই অবশিষ্ট থাকবে না। না মানে,এই যে ছুঁয়ে দিলাম তোর আঘাত গুলো।দেখবি খুব শীঘ্রই সেরে গেছে।”

জ্যোতির চাহনী তখনো স্থির।লজ্জ্বায় নাকি অস্বস্তিতে তা জানা না থাকলেও এটুকু টের পেল দুই কান উষ্ণ অনুভব হচ্ছে৷ বুকের ভেতর তোলপাড় কম্পন আরম্ভ হয়েছে।অস্থিরতায় নিঃশ্বাস ঘন হচ্ছে। যেন সবকিছুই জড়িয়ে যাচ্ছে। সবকিছুই আটকে যাচ্ছে। বার কয়েক শুকনো ঢোক গিলতেই মেহেরাজ ঠোঁট সরাল। জ্যোতির এমন চুপসে যাওয়া অবস্থা দেখেই এক পেশে হাসল। পরমুহুর্তেই মুখচোখ গম্ভীর করে বলে উঠলল,

” রোমান্টিকতা নেই বলে হাসফাঁস করছিলি বান্ধবীদের সামনে, অথচ রোমান্টিকতা দেখাতেও এমন ভাবে হাসফাঁস করছিস কেন?কিছু করেছি আমি?শুধু তোর আঘাত সারার জন্য ঠোঁটের স্পর্শ দিয়েছি, চুমুও তো খাইনি৷ ”

কথাগুলো মেহেরাজ এতোটাই গম্ভীর স্বরে বলল যেন সে বাধ্য হয়েই ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। আসলেই কি শখের পুরুষের ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়ায় নারীর আঘাত সারে? মেহেরাজ কি শুধু এই বাক্যটা মানতেই এই কাজটা করল? জ্যোতি বুঝে উঠল না। মেহেরাজ তখনও বসা ছেড়ে উঠল না।কানের কাছে মুখ নিয়ে পুনরায় ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,

” অল্প রোমান্টিকতা দেখাচ্ছি বলে কষ্ট পাস না আবার। তুই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেলে পুরোপুরি রোমান্টক হয়ে যাব। ”

কথাগুলো বলেই বাঁকা হেসে চোখ টিপল মেহেরাজ। সটান উঠে দাঁড়িয়ে বুক টানটান করে গম্ভীর চাহনী করে এমন ভাবে পা বাড়াল যে একটু আগে কিছুই হয়নি।যেন একটু আগে কিছুই ঘটেনি।

.

মেহু, নাবিলা, নাফিসা সবাই মিলেই সন্ধ্যার দিকে মেহেরাজের রুমে জ্যোতির সাথে আসর জমাল। সারাদিনে খাওয়া, ওয়াশরুম যাওয়া হতে বিভিন্ন কাজেই এই তিনজন সবরকম ভাবে সাহায্য করে গেছে জ্যোতিকে। অবশেষে চারজনে মিলেই আড্ডা জমাল। সে আড্ডার সময় এক ঘন্টা, দুই ঘন্টা করে অনেকটা সময় কেঁটে গেল৷আকস্মিক নাবিলা হেসে বলে উঠল,

” জ্যোতি?দুটো ইন্ট্রোভার্টের সংসার কেমন হয়? না মানে ইন্ট্রোভার্টরা কি নিজেদের একসাথে কাঁটানো মুহুর্ত গুলো ও এমন বোরিং ভাবেই গম্ভীর হয়ে কাঁটায়? কি বিরক্তিকর!এরা তো বোধহয় সবকিছুতেই গম্ভীর থাকে। যেমনটা তুই আর রাজ ভাইয়া।দুইজনই কেমন জানি ফাংসে! ”

কথাগুলো একটানে বলেই থামল নাবিলা। নাফিসা আর মেহু হাসল। নাবিলা পরমুহুর্তেই আবার কি ভেবে অতি উৎসাহী নজর ফেলে ভ্রু উঁচু করে শুধাল,

” আচ্ছা বাই এনি চান্স ইন্ট্রোভার্টরা প্রেম করতে পারে তো? তোদের মাঝে আসলে প্রেম ট্রেম কিছু ঘটেছে জ্যোতি? আমার তো রাজ ভাইয়াকে দেখে কিশোরীকাল থেকেই মনে হতো উনার বউ উনার প্রেমে পড়ে চুমু খেতে গেলেও রাজ ভাইয়া গম্ভীর গলায় আদেশ করে বলবে যে প্রেমে পড়া বারণ!এত বেশি গম্ভীর রাজ ভাইয়া।”

কথাগুলো শুনে হঠাৎ জ্যোতির মনে পড়ল সকালের ঘটনা। মেহেরাজকে উপর দিক দিয়ে যতোটা গম্ভীর দেখায় আসলেই কি অতোটা গম্ভীর? যতোটা প্রেমিক সত্ত্বা বিহীন বোধ হয় অতোটায় কি প্রেমিক সত্ত্বা বিহীন সে?নিশ্চয় নয়। যদি প্রেমিক সত্ত্বা তার মাঝে নাই থাকত তবে নিশ্চয় এতগুলো বছর সামান্তার সাথে প্রেম টিকত না তার।সামান্তা নামক রমণীটা পাগলের মতে আচরণ করত না এই যুবকের জন্য।নাবিলা ফের আবারও বলল,

” রাজ ভাইয়া আর সাঈদ ভাইয়া দুজনই বন্ধু। অথচ দুইজন দুই মেরুর। একজন ভীষণ প্রেমিক মানুষ, অন্যজন একদম প্রেমবিদ্বেষী। এদিক থেকে সাঈদ ভাইয়া দারুণ মানুষ কিন্তু।”

মেহু জ্বলে উঠল মুহুর্তেই। শুধাল,

” তুই কি করে বুঝলি সাঈদ ভাইয়া প্রেমিক মানুষ? প্রেম হয়েছে তোর উনার সাথে?”

নাবিলা ঠোঁট টিপে হাসল। বলল,

” উহ! কি যে বলো, উনার সাথে প্রেম হওয়া লাগে নাকি?উনার সাথে তো আমার সে জম্মকাল থেকেই প্রেম। ”

মেহু হাসার চেষ্টা করে বলে উঠল,

” বাহ! তো এতকাল প্রেম না করে বিয়েটা করে নিলেই তো পারিস। ”

নাবিলা হাসল।চোখ টিপে বলল,

” উহ আপু,কি যে বলো। আমি এসব বিয়ে টিয়ে তে নেই।তবে পৃথিবীর সব প্রেমিক পুরুষেরই প্রেমে পড়তে রাজি আছি। আর সাঈদ ভাইয়া তো সেখানে সাক্ষাৎ প্রণয়পুরুষ। প্রেমে না পড়ে পারি?একদম পিঁছলে পড়ে গিয়েছি।”

নাফিসাও সে সুরে তাল মিলিয়ে বলে উঠল,

” সত্যিই সাঈদ ভাইয়া মানেই ভালোবাসা। আমার সাথে সাঈদ ভাইয়ার বয়সের পার্থক্য আছে। তবে প্রেমের ক্ষেত্রে বয়স ডাজ’ন্ট ম্যাটার। তাই না মেহু আপু?”

মুহুর্তেই নাবিলা ক্ষেপে উঠল। নাফিসা, নাবিলা দুইজনই মুহুর্তে এক পুরুষ নিয়ে ঝগড়া বাঁধাল। মেহুর বুকের ভেতর জ্বলে উঠল হঠাৎ। মুখ হয়ে উঠল থমথমে। কেন সব মেয়েরা তার জন্যই পাগল হবে? কেন সবাই তাকে চাইবে?মেয়েদের সাথে এতোটা গভীরভাবে মেশারও কি প্রয়োজন? মুখ থমথমে করে আর বসে না থেকে নিজের রুমে গিয়ে গা এলিয়ে দিল মেহু। পরমুহুর্তেই কি বুঝে সাঈদকে কল করল। কল রিসিভড হতেই ঝাঝালো স্বরে বলে উঠল,

” আপনাকে আমার সহ্য হয় না সাঈদ ভাইয়া। জাস্ট হেইট ইউ।”

সাঈদের বোধ হয় আকস্মিক কথাটা বুঝে উঠতে সময় লাগল। পরমুহুর্তেই বলল,

” আমি আবার কি করেছি মেহু?এভাবে বউয়ের মতো রাগ দেখাচ্ছো কেন?পরে বউ ভেবে কিছু বলে ফেললে বা করে ফেলল তো দোষটা আমারই হবে।”

মেহুর রাগ বাড়ল। বলল,

” কল রাখুন, আপনার সাথে কথা বলার ইচ্ছে নেই।”

সাঈদ বোধহয় হাসল। বলল,

” কল কিন্তু তুমিও রাখতে পারো।”

” এসব কেন পাঠিয়েছেন আমায়? চিরকুটে কি লিখেছেন? আমি বলেছি পাঠাতে?এসব করেই মেয়েদের পটিয়ে নেন তাই না? ”

সাঈদ হাসল৷ ফিচেল স্বরে বলে উঠল,

” তুমি পটেছে কিনা তাই বলো প্রিয়। ”

মেহু দাঁতে দাঁত চেপে শুধাল,

“আমি আপনার পেছনে ঘুরঘুর করা সেসব মেয়েদের পর্যায়ে পড়ি না। আপনি একটা জঘন্য মানুষ সাঈদ ভাইয়া। জঘন্য! ”

সাঈদ প্রশ্ন ছুড়ল,

” কেন?”

” আপনি সবসময় মেয়েদের সাথেই ঝুলে থাকেন। অসহ্যকর একটা লোক আপনি। ”

সাঈদ পুনরায় প্রশ্ন ছুড়ল,

” তুমি জ্বেলাস?”

মেহু থমথমে কন্ঠে উত্তর দিল,

” না, একদমই নয়।তবে আপনি চতুর,চরিত্রহীন একটা মানুষ। মেয়েদের মনে জায়গা করতে দক্ষ।আমাদের নাফিসার বয়স কত?ওকে পর্যন্ত আপনি ছাড়লেন না?”

সাঈদ চুপসে যাওয়া কন্ঠে অতি নিরীহ ভাবে বলে উঠল,

” কসম মেহু, আমি নাফিসাকে ধরিওনি, ছাড়া তো দূর। তুমি উল্টাপাল্টা দোষ চাপাতে পারো এই নিরীহ মানুষটার উপর। ”

মেহু এবার হুট করেই কল রাখল। মোবাইলটা বিছানার এককোণে ফেলে রেখেই চোখ বুঝল। ওপাশ থেকে বারংবার কল আসল। মোবাইলের আওয়াজ হলো। কিন্তু মেহু কল তুলল না।কল তোলার নুন্যতম ইচ্ছাও হলো ন।

#চলবে…

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_৩০
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

মেহেরাজ বাসায় ফিরল একেবারে রাত আটটায়। ঘর্মাক্ত মুখ, আর ক্লান্ত চাহনী। একনজর জ্যোতির দিকে তাকিয়েই ওয়াশরুমে পা বাড়াল। মুখে চোখে পানি দিয়ে ফের ফিরেও এল কিয়ৎক্ষনের মধ্যে। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুঁছে জ্যোতির পাশে বসে হঠাৎ কপালে আসা ছোট ছোট চুল গুলো কানের পেছনে গুঁজে দিল। ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করল,

এখন কি অবস্থা পায়ের?ঠিকমতো ঔষুধ খেয়েছিস?”

জ্যোতি চোখ তুলে একবার মেহেরাজের দিকে চাইল। একই বিছানায় দিনরাত বসে থেকে কোমড় ব্যাথা করছে এখন।শরীর কেমন যেন ঝিমঝিম করছে।নিরস গলায় উত্তর দিল,

” খেয়েছি।”

মেহেরাজ সূক্ষ্ম চাহনি ফেলল। ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বলে উঠল,

” তোর ঠোঁটের ফোলা কমে এসেছে জ্যোতি। দেখলি আমার ঠোঁটের ছোঁয়া কতোটা কার্যকর!এবার থেকে আঘাত পেলেই বলবি। সব আঘাত ঠোঁটের ছোঁয়ায় সেরে যাবে।”

আকস্মিক কথাটায় জ্যোতি অস্বস্তিতে পড়ল। অপ্রস্তুত হয়ে গলা ঝাড়ল কিঞ্চিৎ।নড়েচড়ে বসে বার কয়েক ঢোকও গিলল। তারপর ঝিমঝিম করা মাথা আর কোমড় ব্যাথা নিয়ে প্রসঙ্গ বদলাতে বলে উঠল,

” আমার এইখানে এই বাসায় পড়ে থাকতে ভালো লাগছে না মেহেরাজ ভাই।”

মেহেরাজ ভ্রু উঁচু করল।বলল,

” বাসাটা তো তুই পছন্দ করেছিলি।এখন আর ভাল্লাগছে না?”

এই বাসাটা যে সে আর মেহেরাজ মিলে যে বাসাটা দেখে গিয়েছিল সে বাসাটাই তা জ্যোতি জানে। মেহু এই নিয়ে অনেক কিছু বলেছেও। মেহেরাজ নাকি তার সাথে সংসার করার জন্য এতদূর বাসা নিয়েছে, এতদূরে ছুটে এসেছে। আসলেই কি সত্য এই কথাগুলো? সত্য হলেও সংসার করাও কি মেহেরাজের কাছে কেবলই দায়িত্ব?আজকে সকালের আকস্মিক উদ্ভট কাজগুলোও কি কেবলই দায়িত্ব? মন বলছে এসব শুধুই দায়িত্ব নয়। তবুও দায়িত্বের উর্ধ্বে গিয়েও কিছু ভাবতে সংশয় হলো।আসলেই কি এতগুলো দিনে সত্যিই কিছু একটা তৈরি হয়েছে তাদের মাঝে?সত্যিই মেহেরাজের মনে এটুকু হলেও জায়গা হয়েছে তার?শুকনো ঢোক গিলল জ্যোতি। মৃদু আওয়াজ তুলে বলে উঠল,

” এভাবে সারাক্ষন শুয়ে বসে থাকাটা কেমন জানি। আপনাদের ঝামেলায় ফেলে দিলাম শুধু শুধু ।”

মেহেরাজের মুখের উৎফুল্ল ভাব হঠাৎ উধাও হলো।গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,

” কি বলতে চাইছিস খুলে বল।”

জ্যোতি ইতস্থত করে মৃদু আওয়াজে বলে উঠল,

” আমার পা ঠিক হতে বোধহয় বহু সময়। এতকাল এভাবে আপনার সাথে একঘরে থাকাটা অস্বস্তির নয়?তার উপর মেহু আপু আর আপনাকেও তো ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে।”

মেহেরাজ বুকে হাত গুঁজে টানটান গলায় ভ্রু উঁচিয়ে শুধাল,

” তো?তুই কি চাইছিস? ”

প্রশ্নটায় রাগ ছিল। বিনিময়ে জ্যোতি উত্তর দিল না।কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে স্পষ্টস্বরে বলল,

” মেহেরাজ ভাই? কিছু কথার উত্তর দিবেন আমায়? ”

মেহেরাজ আগের ন্যায় টানটান স্বরে উত্তর দিল,

” বলে ফেল।”

জ্যোতি বলতে লাগল,

” নিজ শহর ছেড়ে এতদূর কেন আসলেন? নিজের বাসা থাকতে এতদূর এসে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন কেন? আর সেদিন আমায় মিথ্যেই বা বললেন কেন?আপনি তো বলেছিলেন আপনার কোন এক বন্ধুর জন্য বাসা খুঁজছেন। তাই না?”

মেহেরাজের মুখের রাগ রাগ ভাব বোধ হয় কমে এল। তবুও গম্ভীর ভাব কমল না। শীতল গলায় বলল,

” প্রশ্ন গুলোর উত্তর তোর কাছেও থাকার কথা।তুই তো এত বোকা নোস যে উত্তরগুলো অজানা থাকবে।ভেবে দেখ, পেয়ে যাবি উত্তর।”

জ্যোতি ফের স্পষ্টস্বরে বলে উঠল,

” আমি আপনার থেকে জানতে চাইছি।”

” কি?”

” এই শহরে আসার সিদ্ধান্ত কেন নিলেন?”

মেহেরাজ চুপ থাকল কিয়ৎক্ষন। তারপর ঠোঁট গোল করে শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। বলল,

” শহরটা সুন্দর তাই । শহরের মানুষগুলোও সুন্দর।তবে সবথেকে সুন্দর হলো হৃদয় নিংড়ানো অনুভূতি।হৃদয়ের টানে চলে এসেছি।”

শেষের কথাটা শুনেই জ্যোতির বুকের ভেতর কেমন একটা অনুভব হলো। হৃদয়ের টানে? কার হৃদয়ের টানে?তবে কি মেহুর বলা কথা গুলো সত্যিই?এটুকু হলেও কি জ্যোতির জন্য কোন অনুভূতি তৈরি হয়েছে মেহেরাজের হৃদয়ে? জ্যোতি আর ভাবতে পারল না। অস্ফুট স্বরে বলল,

” হ্ হু?”

শীতল গলায় উত্তর এল,

” উত্তর বলেছি।আর কিছু?”

জ্যোতি ফের কিছু বলার সাহস পেল না৷ বুকের ভেতর কেমন জানি করছে তার। সত্যিই কি তাকে ঘিরে কোন অনুভূতি তৈরি হয়েছে মেহেরাজের হৃদয়ে?সত্যিই?এসব ভেবেই ইতস্থত বোধ করে নরম গলায় বলতে লাগল,

” মেহেরাজ ভাই?আরেকটা প্রশ্ন আছে।আপনার মনে কি আম্…”

বাকিটুকু বলা হলো না।তার আগেই মোবাইলের আওয়াজ শুনে চোখ ফিরিয়ে মোবাইলের দিকে চাইল৷ বাড়ি থেকে জ্যোতির বাবা কল করেছে।জ্যোতি বার কয়েক শুকনো ঢোক গিলে মোবাইল হাতে নিল। কল তুলে মৃদু আওয়াজে বলে উঠল,

” আসসালামু আলাইকুম আব্বা, কেমন আছেন?”

ওপাশ থেকে তার বাবার গম্ভীর স্বর ভেসে আসল,

“মেয়ে হয়ে সংসার ছেড়ে অতোদূরে পড়তে গেছিস, কিছু বলি নাই। কিন্তু তাই বলে এক্সিডেন্ট হয়েছে এইটা জানানোর প্রয়োজন মনে করিস না জ্যোতি?”

জ্যোতি অবাক হলো। সে তো জানায়নি। জিজ্ঞেস করল,

” আব্বা, আপনি কি করে জানলেন?”

তার বাবার তীক্ষ্ণ কন্ঠ ভেসে আসল মুহুর্তেই,

” মানছি আমার আর তোর সম্পর্কটা স্বাভাবিক বাবা মেয়ের সম্পর্ক ছিল না, নেইও। তবুও আমি কল করে খোঁজ নিই তো দুইতিনদিন পর পর।আমাকে জানালি না কেন? ”

” এমনিতেই। মনে হয়েছিল জানালেও যদি আপনার সময় হয়ে না উঠে , তাই বলা হয়নি আব্বা।”

” এবার আর আলাদা থাকতে যাবি না।বিয়ে হয়েছে তোর, সংসার আছে। রাজ যেহেতু ওখানেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এবার তোদের একসাথে থাকা উচিত জ্যোতি।অতোদূর একটা মেয়ে একা থাকা অতোটাও নিশ্চিন্ত হওয়ার মতো বিষয় নয়।”

জ্যোতড তাচ্ছিল্য নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

” মেয়ে বলে তুচ্ছ ভাবলেন আব্বা?”

ওপাশ থেকে শক্তপোক্ত জবাব এল,

” যাই ভাবি, যেটা বললাম সেটা মাথায় রাখবি।”

” মেহেরাজ ভাইদের বাসায় এভাবে পড়ে থাকাটা বিচ্ছিরি বোধ হবে আব্বা।”

” বেশি বুঝিস। তোকে তো অতো বুঝতে হচ্ছে না।”

” এই কথাটা বলেই বিয়ে দিয়েছিলেন। তখন নাহয় আপনার মতে আমার বুঝার বয়স ছিল না। এখনও কি নেই বুঝার বয়স?”

” না, নেই। ”

থমথমে কন্ঠে কথাটুকু বলেই কল কাঁটল জ্যোতির বাবা।জ্যোতি চোখ বুঝে তপ্তশ্বাস ফেলল।তার আব্বা এখনও আগের মতোই আছেন ভেবে বুকের ভেতর কষ্ট হলো। মেয়ের এক্সিডেন্ট হয়েছে অথচ একবারও জিজ্ঞেস করলেন না, সে কেমন আছে। এখন কি অবস্থা শরীরের। অথচ রাগ ঝেড়ে কয়েকটা আদেশ ঠিকই করতে পেরেছেন।একরাশ অভিযোগ নিয়ে মনে মনে কষ্ট পুষে কথা গুলো ভাবতেই চোখে পড়ল মেহেরাজকে। পরনে টাউজার আর ছাঁইরাঙ্গা শার্ট।শার্টের বোতামগুলো খোলাই রাখা।হাত দিয়ে একে একে বোতাম গুলো লাগাতে লাগাতেই এগিয়ে এল জ্যোতির সামনে। বুকের কাছে দুই তিনটে বোতাম খোলা রেখেই নজর ফেলল জ্যোতির দিকে। ধারালো চাহনী নিয়ে টানটান গলায় বলল,

” কি যেন বলছিলি চাচাকে? ”

জ্যোতি বুঝতে পারল না। ভ্রু বাঁকিয়ে শুধাল,

” কি?”

মেহেরাজ তপ্তশ্বাস ফেলল। চোখজোড়ায় রাগমিশ্রিত চাহনী নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল,

” এই বাসায় থাকাটা বিচ্ছিরি বোধ হবে?”

জ্যোতি বুঝতে পারল এবার।বলতে লাগল,

” আসলে,… ”

পুরো বাক্যটা সম্পূর্ণ করার আগেই মেহেরাজ রাগ ঝেড়ে বলে উঠল,

” ঠিকাছে, থাকতে হবে না তোকে।চলে যা।”

জ্যোতি তাকাল।কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে বলল,

” পা টা সুস্থ হলেই চলে যাব মেহেরাজ ভাই। এখন তো হেঁটে যেতে পারব না। ”

মেহেরাজের রাগ এবার তরতর করে বাড়ল। চোয়াল শক্ত করে, মুখ টানটান করে দাঁতে দাঁত চেপে শুধাল,

” আবার বল।”

জ্যোতি স্বাভাবিক গলায় বলল,

” পা সুস্থ হলেই চলে যাব।”

মেহেরাজের রাগটা বোধহয় আরো বাড়ল। সে রাগের বহিঃ প্রকাশ ঘটাতেই অত্যন্ত শীতল গলায় রাগ নিয়ে বলে উঠল,

” তোর পা পুরোপুরি সুস্থ হওয়া তো দূর, সুস্থ হওয়ার আগেই আবার পা ভেঙ্গে দিব। সবসময় এভাবে ভাঙ্গা পা নিয়ে পড়ে থাকবি এখানে। এবার বল, বাসাটা বিচ্ছিরি লাগবে নাকি লাগবে না?”

আকস্মিক হুমকিতে অবাক হলো জ্যোতি।অস্ফুট স্বরে বলল,

” হ্ হু?”

মেহেরাজ ফের বলল,

” শুনসিনি?এই বাসায় থেকে যাওয়ার কথা বললে হাত পা ভেঙ্গে এভাবেই রেখ দিব সবসময়।তাই দ্বিতীয়বার কথাটা বলার আগে ভেবে বলিস। ”

কথাগুলো বলেই পা বাড়িয়ে বেলকনিতে চলে গেল মেহেরাজ। জ্যোতি কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। এতোটা রাগ?এতোটা রাগ কি কেবলই তার চলে যাওয়ার প্রসঙ্গে?

.

জ্যোতি বিছানায় আলতো ভাবে শরীর এলিয়েই চোখ বুঝে নিয়েছিল। দুই রাত ঘুম না হওয়ার কারণেই শরীর ভেঙ্গে আসছে।ঘুম না আসলেও ক্লান্ত শরীরে চোখ মেলতে ইচ্ছে হলো না তার। কিয়ৎক্ষন পর আকস্মিক নিজের পাশে চেনা পুরুষের অস্তিত্ব টের পেয়ে নড়ে চড়ে উঠল জ্যোতি৷ চোখজোড়া মেলে ধরতেই দেখতে পেল নিজের দিকেই তাকিয়ে থাকা মেহেরাজকে।মেহেরাজের দৃষ্টির নড়চড় হলো না। বরং ভ্রু নাচিয়ে বলল,

” না ঘুমিয়ে জেগে থাকবি নাকি?”

” ক্লান্ত লাগছে, ঘুমও পাচ্ছে। কিন্তু চোখে ঘুম মিলছে না। ”

মেহেরাজ মাথা উঁচু করল। আকস্মিক জ্যোতির ঘন কালো চুলে হাত ডুবিয়ে বুলিয়ে দিতে লাগল। আদেশের সুরে বলে উঠল,

” চোখ বুঝ।”

জ্যোতি প্রথম দফায় স্তব্ধ হয়ে মেহেরাজের মুখপানে তাকিয়ে থাকলেও পরমুহুর্তেই চোখ বুঝে নিল। মুহুর্তেই মেহেরাজ অদ্ভুত এক কাজ করে বসল। জ্যোতির কপালে নিজের পুরো ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়া দিয়েই গভীর চুমু দিল। পরমুহুর্তেই নিজের মুখচোখ এতটাই স্বাভাবিক করে নিল যেন কিছুই করেনি সে।অপরদিকে জ্যোতি যেন থমকে রইল। চোখ বোঝা মাত্রই আকস্মিক এমন শীতল ছোঁয়ার অস্তিত্ব টের পেয়েই চোখজোড়া বড় বড় করে চাইল। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকল মেহেরাজের পানে।মেহেরাজ সেই চাহনী আমলে নিল না।স্বাভাবিক ভাবেই শীতল গলায় বলল,

” এবার ঘুম আসবে। ঘুমা। ”

জ্যোতি কি প্রতিক্রিয়া দিবে বুঝল না। আকস্মিক এমন একটা কাজ করে কেউ এতটা স্বাভাবিক থাকতে পারে? কেউ এতোটা নির্লিপ্ত হওয়ার ভান করতে পারে? জ্যোতির জানা নেই। মেহেরাজ ফের বলল,

” ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?কিছু করেছি তোকে?”

জ্যোতি বলতে পারল না মেহেরাজ কি করেছে। বলতে পারল না কি এক ভয়ানক আভা ছড়িয়ে দিল তার মাঝে। কি এক শীতল ছোঁয়ায় স্তব্ধ হয়ে রইল তার ভেতর বাহির।

.

মেহুর চোখে পানি।চোখের পানির মূল কারণ নাবিলার সাথে সাঈদের ঘন্টার পর ঘন্টা আলাপ।এখন প্রায় রাত বারোটা।প্রায় দুই ঘন্টা যাবৎই বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সে কথা বলছে সাঈদের সাথে।মাঝেমাঝেই আবার খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে। মেহুর যন্ত্রনা হলো৷ বুকের ভেতর জ্বলন্ত দুঃখ তরতাজা হয়ে উঠল। একপাশ হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে রাখলেও সচেতন কান তাকে ঘুমোতে দিল না।বার বার কানে আসল নাবিলার কথাগুলো।এতোটাই প্রেমবোধক কথা কেন হবে তাদের মাঝে? কি দরকার সাঈদের এতরাতে এতোটা প্রেম প্রেম ভাবে নাবিলার সাথে কথা বলার?মেহু আর শুঁয়ে থাকতে পারল না।অবশেষে উঠে দাঁড়িয়ে একবার বেলকনিতে উঁকি দিল। নাবিলাকে গলা উঁচিয়ে বলল,

” ঘুমাবি না?এভাবে হাসাহাসি করছিস কেন?আমার ঘুম আসছে না তোর এসব কথাবার্তার জন্য।”

কথাটা বলেই আবার পিঁছু ঘুরল। নিজের ঘরের জানালার পাশে হাঁটু গুঁজে বসে জানালাটা মেলে দিল। পাশাপাশি আরো একটা বিল্ডিং। দূরত্ব কয়েক হাত এর। মুখোমুখি অপর বিল্ডিংটার আরো একটা জানালা।জানালাটা এই পর্যন্ত সে কোনদিন খোলা দেখেনি। তবে আজ জানালাটার থাইগ্লাস একপ্রান্তে সরিয়ে রাখা।অপর প্রান্ত খোলা। স্পষ্ট চোখে পড়ল ঘরের আলো। ওপাশ থেকে কেউ একজন গিটারে সুর তুলে গান গাইছে,

” তুমি সুখ যদি নাহি পাও,
যাও সুখেরও সন্ধানে যাও,
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়ো মাঝে,
আরও কিছু নাহি চাই গো ।

আমি তোমারও বিরহে রহিব বিলীন,
তোমাতে করিবো বাস,
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী
দীর্ঘ বরষ্ মাস ।

যদি আরও কারে ভালোবাসো,
যদি আরও ফিরে নাহি আসো,
তবে তুমি যাহা চাও,
তাই যেন পাও,
আমি যত দুঃখ পাই গো ।…………”

মেহু গানটা এর আগেও বহুবার শুনেছে।কিন্তু পুরুষালি গলায় এই প্রথম শুনল। পুরুষালি গলায়ও গানটা এতোটা সুন্দর শোনায় তা এই মুহুর্তেই বোধ হলো।মেহুর কাছে গলাটা পরিচিত ঠেকল।যেন বহুকাল আগে সে কোথাও এই গলা শুনেছিল। বহুকাল আগে যেন কোন পুরুষ তীব্র আকুতি নিয়ে এই গলায় ছুড়েছিল আবেদন।মেহুর উৎসাহ বাড়ল। উৎসুক হয়ে সমস্ত গানটাই নিশ্চুপে শ্রবণ করল মেহু। অচেনা পুরুষ, অচেনা যুবকের গানটি তার কাছে মনোমুগ্ধকর বোধ হলো মুহুর্তেই।দুয়েক নজর তাকিয়ে চেষ্টাও চালাল অচেনা পুরুষটিকে দেখার জন্য। কিন্তু আপসোস! দেখা হলো না।

#চলবে….

এক মুঠো প্রণয় পর্ব-২৭+২৮

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_২৭
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

” হ্যাঁ জানি তো আমি।কোলে করে নিয়ে যাব।তোকে পা নাড়াতেও হবে না ”

আকস্মিক বলা কথাটা শুনে জ্যোতি অবাক হলো।কুঁচকে গেল ভ্রু জোড়া।চোখেমুখে খেলে গেল বিস্ময়। এমন একটা উত্তর সে মোটেও আশা করেনি। মোটেই ভাবেনি।স্থির চাহনীতে ভ্রু জোড়া কুঁচকে রেখে তাকিয়ে থাকল কেবল মেহেরাজের দিকে।
জ্যোতির মুখের চাহনী দেখেই মেহেরাজ ভ্রু উঁচু করল। সরু চাহনী ফেলে বলল,

” এবার সমস্যা হবে না আশা করি ”

জ্যোতির চাহনী এখনো বদলায়নি। চোখমুখে প্রশ্নময় দৃষ্টির বাহার নিয়ে একইভাবেই তাকিয়ে থাকল। উত্তরে কি বলা উচিত তাও যেন মস্তিষ্ক জানান দিল না। পাশ থেকে রিতু মিটমিট করে হেসে জবাব দিল,

” ভাইয়া, আপনি ওকে কোলে করে এখনই নিয়ে যেতে পারেন৷ আমি ব্যাগ গুঁছিয়ে দিচ্ছি। ”

মেহেরাজ রিতুকে চেনা না। গলা শুনে একনজর রিতুর দিকে তাকিয়ে দেখল জ্যোতির বিছানার পাশে চেয়ারটায় বসে মুচকি হাসছে। মুহুর্তেই গলা ঝেড়ে বলল,

” তবে গুঁছিয়ে দিন। আমি একটু পর আবার আসছি।”

কথাটা বলেই মেহেরাজ বের হলো। জ্যোতির পায়ের যা অবস্থা রিক্সায় নেওয়া যাবে না। আবার সারা রাস্তা কোলে করেও নেওয়া যাবে না। একটা গাড়ি খুঁজতে হবে। তাই মূলত বেরিয়ে গেল। অপরদিকে জ্যোতি হতবিহ্বল চাহনীতে মেহেরাজের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকল। পরমুহুর্তেই রুমে উপস্থিত আরো দুইজোড়া হাস্যোজ্জ্বল চোখের দিকে তাকিয়েই শ্বাস টানল।দরজার দ্বারে দাঁড়ানো মেয়েটির নাম তৃষ্ণা। বলা যায় রিতুর থেকেও দুয়েক ধাপ উপরে ঠাট্টা, মজা এসবে।দাঁড়িয়ে বুকে হাত গুঁজে ক্রমশ মুচকি হাসছে।হাসছে চেয়ারে বসে থাকা রিতুও। এগিয়েই এসেই রিতু চোখ টিপে বলল,

” কি সাংঘাতিক রেগে গেছেরে ভাইয়া? তোর মুখে কোনদিন উনার নামে কিছুই শুনিনি অথচ আজ এইটুকুতেই আমার মন বলছে উনি সাংঘাতিকভাবে ভালোবাসতে জানে। এমন একটা বর ফেলে কেউ একা একা পড়ে থাকে কিভাবে ভাই?”

রিতুর কথাটা শুনেই শব্দ করে হেসে উঠল তৃষ্ণাও। দুই পা এগিয়ে জ্যোতির কাছে এসেই বলল,

” ইশশ! দরজা খোলার পরই দেখি হ্যান্ডসাম একটা ছেলে।কোথায় ক্রাশ ট্রাশ খাব তা নয়, ছেলে গম্ভীর গলায় বলে উঠল,
‘ জ্যোতিকে একটু তাড়াতাড়ি আসতে বলবেন?’।প্রথমে না বুঝলেও পরে মনে পড়ল এটা জ্যোতির বর।মুহুর্তেই হৃদয়টা ভেঙ্গে খানখান হয়ে গেল। এমনভাবে বলল যেন বউকে দেখার জন্য কত যুগ ধরে তৃষ্ণার্ত। ”

রিতু ফের হেসে বলল,

“তাই নাকি? এখানে এসেই তো কি রাগ দেখাল। হাজব্যান্ড হলে এমন হওয়া উচিত।বুঝলি?বউ আঘাত পেলেই বউয়ের আগে বরের আঘাত লাগবে।কি বলিস তৃষ্ণা?”

তৃষ্ণা মাথা নাড়াল দ্রুত। ঠোঁট কাঁমড়ে বলল,

” একদম!এমন একটা জামাইয়ের অভাববোধ করছি খুব করে এই মুহুর্তে।”

রিতু আপসোসের সুরেই বলে উঠল,

” আমি তো এমন জামাইয়ের অভাবেই বিয়েটা করতে পারছি না। পাওয়া মাত্রই টুপ করে বিয়ে করে নিব।”

জ্যোতি সরু চোখে তাকাল দুইজনের দিকে৷ ছোট্ট শ্বাস টেনে স্বাভাবিক গলায় বলল,

” আচ্ছা বুঝলাম।”

রিতু প্রশ্ন ছুড়ল ভ্রু উঁচিয়ে,

” বুঝলি মানে? এত কেয়ারিং হাসব্যান্ড রেখে এতদূর কিভাবে মন টিকে তোর?”

জ্যোতি স্থির চাহনীতে তাকাল। সত্যিই মেহেরাজ অনেক কেয়ারিং আর দায়িত্ববান ছেলে। এই নিয়ে তার এইটুকুও সন্দেহ নেই। কিন্তু আধৌ কি মেহেরাজের মনে তার জায়গা হবে?জায়গা হওয়া তো দূর মেহেরাজ তাকে সম্পূর্ণ সম্পর্কটা থেকেই বের করে দিতে চায় এমনটা ভেবেই দুঃখ হলো। প্রিয়মানুষের সাথে অন্য কোন নারীকে সহ্য করার কষ্টে দহন ঘটল। চাপাস্বরে বলল,

” কেয়ারিং হলেই কি লাভিং পার্সন হওয়া যায়? একজনের প্রতি যত্নশীল হওয়া আর একজনকে ভালোবাসা এর মধ্যে তফাৎ নেই বলছিস? ”

রিতু নরম গলায় উত্তর দিল,

“থাকতে পারে। তবে আমার কিন্তু উনাকে দেখেই যথেষ্ট প্রেমিক পুরুষ মনে হয়েছে। লাইক এ কেয়ারিং এন্ড রোমান্টিক হাজব্যান্ড।”

জ্যোতি বলল,

” দ্বিতীয় সম্বোধনটা ভুল। তবে প্রথম সম্বোধনটা সঠিক। উনি যথেষ্ট কেয়ারিং , শুধু যে আমার প্রতি এমন নয়। সবার প্রতিই। ”

তৃষ্ণা অবাক হলো। গলাটা উঁচু করেই অবাক কন্ঠে বলে উঠল,

” উনি রোমান্টিক নয় বলছিস? ”

জ্যোতি নিরস গলায় উত্তর দিল,

” ঠিক জানা নেই।”

তৃষ্ণা জ্যোতির মাথায় চাটি মারল। দাঁত চেপে বলল,

” জানবি কি করে? জামাইকে ছেড়ে এতকাল এখানে পড়ে আছিস তো রোমান্টিকতার কি বুঝবি গর্দভ।তুই তো অদ্….”

কথাটুকু বলে শেষ না করতেই তৃষ্ণার চোখ গেল দরজার দ্বারে দাঁড়ানো মেহেরাজরন দিকে। তাদের কথোপকোতনের কতটুকু কি শুনেছে তা ভেবেই শুকনো ঢোক গিলল। ঠোঁট চওড়া করে মেকি হেসে বলল,

” একি ভাইয়া, এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসলেন? আপনার পায়ের আওয়াজও তো শুনতে পেলাম না। ”

জ্যোতি মুহুর্তে ফিরে চাইল। মেহেরাজের নিঃশব্দে চলনের সম্পর্কে জানা আছে বলেই চমকাল না। কপাল কুঁচকে ভাবল রিতু আর তৃষ্ণার কতটুকু কথা শুনতে পেয়েছে?সে যে বলেছে সেগুলোই বা কতটুকু শুনল? জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে স্পষ্টস্বরে মেহেরাজের দিকে তাকিয়েই বলল,

” এই অবস্থায় সে বাসায় যাওয়াটা কতটুকু ইম্পোর্টেন্ট মেহেরাজ ভাই। মেহু আপু চিন্তা করবে তাই বলা হয়নি পায়ের কথাটা৷ আপনি গিয়ে বুঝিয়ে বললে ঠিকই বুঝবে।”

মেহেরাজ এগিয়ে আসল। শার্টের হাতা গুলো গুঁটিয়ে নিয়ে ঝুঁকে গেল জ্যোতির সামনে। টানটান গলায় বলল,

” সেটা আমি বুঝব। তোর থেকে শুনতে চাইছি না সেসব।”

কথাটা বলেই আর দেরি করল না সে। বলিষ্ট হাতজোড়া ছুঁইয়ে মুহুর্তেই তুলে নিল সামনের রমণীকে।সযত্নে কোলে তুলে রিতু আর তৃষ্ণার দিকে তাকিয়েই নরম গলা বলল,

” কাইন্ডলি কিছু কাপড় আর ঔষুধপত্র গুঁছিয়ে দিলে উপকার হবে। দিবেন?আমি ফের এসে নিয়ে যাচ্ছি।”

রিতু আর তৃষ্ণা মুহুর্তেই মাথা নাড়াল।সমস্বরে বলল,

” অবশ্যই ভাইয়া। আপনি যান, আমরা নিচে নেমে ব্যাগ দিয়ে আসছি। ”

মেহেরাজ হাসল। ঠোঁট গোল করে শ্বাস ছেড়ে পা বাড়াল জ্যোতিকে নিয়ে। অপরদিকে জ্যোতি অনুভূতিহীন হয়ে জমে রইল।তার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে হয়তো প্রিয় পুরুষের এহেন কান্ডে লজ্জ্বায় নুঁইয়ে পড়ত। মুখটা হয়তো লজ্জ্বা রাঙ্গা রক্তিমতায় লালাভ হয়ে উঠত। কিন্তু তার মুখে খেলে গেল কেবল বিস্ময়। অবাক করা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল মেহেরাজের মুখপানে৷ কি হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই যেন বোধগম্য হলো না কিয়ৎক্ষনের জন্য। মেহেরাজ একনজর জ্যোতির দিকে তাকিয়েই চাপা হাসল। ধাপে ধাপে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসেই গাড়িতে জ্যোতিকে বসিয়েই ভ্রু উঁচু করল।তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল,

” এভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে কি দেখছিস?আগে কখনো দেখিসনি আমায়?”

মেহেরাজের এই কথাটা শুনেই জ্যোতির মুখটা অপমানে থমথমে হয়ে এল। মুহুর্তেই নজর সরিয়ে অন্যপাশে তাকাল৷ এতক্ষন সবকিছু জমাট বাঁধা স্থির অনু়ভব হলেও এই মুহুর্তে এসেই তীব্র অস্থিরতায় ছটফট করে উঠল মন৷ অস্বস্তিতে হাত পায়ের তালু ঘেমে উঠল তৎক্ষনাৎ। খেয়াল হলো কোলে তোলার সময় থেকে মেহেরাজের একটা হাত এতক্ষন তার পেটের উপরাংশেই চেপে রাখা ছিল। তার শরীরটা মেহেরাজের শরীরের সাথেই লাগোয়া ছিল এতোটা সময়। এসব ভেবেই ক্রমশ অস্বস্তি বাড়ল।অস্থির শিরশিরে অনুভূতি হলো সর্বাঙ্গে। সে অনুভূতি দমাতেই বারকয়েক শ্বাস ফেলল। মেহেরাজের দিকে চোখ তুলে তাকাতে নিতেই দেখল রিতু আর তৃষ্ণা এসে হাজির হয়েছে।তার ব্যাগ গাড়ির এককোণে রেখেই তৃষ্ণা চোখ টিপে ফিসফিস করে বলল,

” আমি আবেগে আপ্লুত দোস্ত।আই উইশ, আমারও পা ভাঙ্গুক। আমাকে আমার প্রেমিক এভাবেই যত্ন করে কোলে তুলে হাঁটুক। সুন্দর হবে না?”

জ্যোতির চাহনী ক্ষীণ হলো। তৃষ্ণা সে চাহনীকে পাত্তা দিল না। দাঁত কেলিয়ে হেসে মেহেরাজের দিকে তাকাল। বোকা বোকা হেসে বলল,

” ভাইয়া আপনি কিন্তু হাজব্যান্ড হিসেবে খুব ভালো। এমন হাজব্যান্ড কোথায় পাওয়া যাবে বলতে পারেন? ”

মেহেরাজ ভ্রু কুঁচকাল। রিতু আর তৃষ্ণা ততক্ষনে আর দাঁড়িয়ে রইল না।আকস্মিক কি বলে ফেলেছে তা বুঝতে পেরেই তৃষ্ণা লাজুক হেসে রিতুর হাত চেপে দ্রুত পা এগিয়ে সে স্থান ছেড়ে চলে গেল। মেহেরাজ চাপা হাসল৷বুক টানটান করে গাড়িতে উঠে বসেই তাকাল জ্যোতির দিকে। বলল,

” তোর উচিত ছিল এক্সিডেন্টের বিষয়টা জানানো৷ জানিয়েছিলি? আমাকে না হোক মেহুকে জানানো যেত না?”

মেহেরাজের শান্ত গলায় কথাগুলো শুনে জ্যোতি ফিরে তাকাল। মৃদুস্বরে বলল,

” এতকাল কিন্তু একা একাই সব ফেইস করেছি মেহেরাজ ভাই। কাঁটা ছেড়া হোক বা পা ভাঙ্গা। আজকে হয়তো এক্সিডেন্টের কথাটা কোনভাবে জেনে নিয়েছেন কিন্তু এতকাল তো আর জানতে পারেননি।এতকাল সবকিছু ঠিক সামলে নিতে পেরেছি। এখনও পারতাম। তাই আর জানাইনি।তাছাড়া এসব ছোটখাটো ঝামেলায় আপনাদের আর জড়াতে মন চায়নি।বেশিকিছু হলে আমি অবশই জানাতাম। ”

মেহেরাজের রাগ হলে। দাঁতে দাঁত চেপে তীক্ষ্ণ চাহনী ফেলে বলল,

” হ্যাঁ, ওপারে চলে গিয়ে জানাতি। রাইট? ”

জ্যোতি হাসল কিঞ্চিৎ। বলল,

” ওপারে চলে যাওয়ার মতো তো কিছু হয়নি। শুধু পায়ের একটা হাঁড় ভেঙ্গেছে।তেমন বিশিকিছু নয় এটা। ”

মেহেরাজ ফের রাগ দেখিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,

” আমার উচিত এখন তোর আরেক পাও ভেঙ্গে দেওয়া। তবেই বেশিকিছু হতো।”

বিনিময়ে জ্যোতি আর কিছু বলল না। মেহেরাজও আর কথা বাড়াল না।থমথমে মুখে অন্যপাশে ফিরে চাইল।

.

মেহুর মোবাইলে কাল রাত থেকেই অনেকগুলো কল করেছিল সাঈদ। একবারও কল তুলে নি সে। এখনও অনেকবার কল এসেছে। মেহু কল তুলল না। ছোট্টশ্বাস ফেলে মোবাইলটা বন্ধ করে দিল। কিয়ৎক্ষন পরই তাকে চমকে দিয়ে নাবিলা বলে উঠল,

” আপু, মোবাইল বন্ধ করে রেখেছো তুমি?সাঈদ ভাইয়া অনেকবার কল করেছে তোমায়। তুমি নাকি কল তুলোনি। সাঈদ ভাইয়া তোমাকে মোবাইল অন করে কল ব্যাক করতে বলেছে।”

মেহু ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিল৷ বিষয়টা নাবিলা পর্যন্ত যাবে ভাবে নি সে৷ মৃদু আওয়াজে বলল,

” কেন? ”

” সেটা জানা নেই, জরুরী দরকার আছে বলেছে। ”

মেহু ছোট্ট শ্বাস ফেলল। বেলকনিতে গিয়ে মোবাইল অন করে কল করল সাঈদকে। রিং হওয়ার পর অপেক্ষা করতে হলো না। কয়েক সেকেন্ডে কল তুলেই ওপাশ থেকে সাঈদ নরম গলায় বলল,

” এই কেমন অন্যায় শুনি ? কাল রাত থেকে কন্টিনিউ কল দিচ্ছি অথচ কল তুলছো না। অবশেষে ফোন সুইচড অফ করে রেখে দিয়েছো ? ”

মেহু মৃদু আওয়াজে জিজ্ঞেস করল,

” কিছু বলবেন?”

সাঈদ চুপ থাকল কিয়ৎক্ষন। তারপর বলল,

” জম্মদিনের শুভেচ্ছা নিও প্রিয়৷ ”

” ধন্যবাদ৷ ”

সাঈদ আবারও চুপ হয়ে গেল। তারপর হঠাৎই অভিমানী সুরে বলল,

” আমায় কি ভালোবাসো না আর? ”

মেহু অবাক হলো এরূপ কন্ঠস্বর শুনে।বলল,

” কাকে বলছেন?”

শান্তস্বরে উত্তর এল,

” তোমাকে।”

“আমি আপনার বন্ধুর বোন হই সাঈদ ভাইয়া।এসব কি প্রশ্ন করছেন? ”

সাঈদের কন্ঠ মুহুর্তেই পরিবর্তন হলো। ফিচে গলায় বলল,

” হবু বউ হও তুমি।আপাতত সে সম্পর্কটাকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছি। ”

” আপনি যদি এসব বলার জন্যই কল দিয়ে থাকেন তবে রাখছি৷”

কথাটা বলেই কল রাখল মেহু।নরম মন হুহু করে কেঁদে উঠল যেন এবারে। চোখজোড়া দিয়ে বইল নোনা পানির ধারা। নারী মন সরল, নরম।পুরুষের মুখের দুয়েকটা শব্দই সে নারী মনে কান্নার ধারা বইয়ে দিতে পারে আবার সে নারী মনকেই এক মুহুর্তে শান্ত করতে পারে। নারীর জন্য সত্যিই পুরুষ মানুষ যাদুকর।

#চলবে…

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_২৮
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

রাত হলো বেশ।বিছানায় হেলান দিয়ে পা সোজা করেই ক্লান্ত চাহনী নিয়ে বসে রইল জ্যোতি।খাটের পাশেই জানালা খুলে রাখা। সে জানালা দিয়েই শীতল বাতাস ছুুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে শরীর। মেহেরাজদের নতুন বাসাটায় আসবাব পত্র বলতে দু রুমে দুটো খাট, দুটো আলমারি,টেবিল-চেয়ার আর বসার ঘরে একটা সোফা৷সাদামাটা গোছানো পরিপাটি বাসা। এই সাদামাটা বাসার ডানপাশের ঘরটাই কেবল চোখ ঘুরিয়ে দেখার সুযোগ পেল জ্যোতি। ঘরটা মেহেরাজের। আসার পর থেকে এ ঘরেই জ্যোতির অবস্থান। পায়ের বেহাল দশার কারণে উঠাও হলো না আর। এতক্ষন মেহু, নাবিলা, নাফিসা সবাই এ ঘরে থাকলেও এখন রুমটা শূণ্য। পায়ের তীক্ষ্ণ ব্যাথায় চোখ খিঁচে তপ্ত শ্বাস ফেলল জ্যোতি। চোখজোড়া বুঝে নিয়ে কিয়ৎক্ষন ঠোঁট চেপে বসে রইল। পরমুহুর্তে চোখ খুলতেই চোখে পড়ল মেহেরাজকে।বুকে হাত গুঁজে তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। চোখজোড়া খুলতেই চোখাচোখি হলো। মেহেরাজ নজর সরাল না। আগের মতোই স্থির দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,

” কয় রাত ঘুমাস না? ”

আকস্মিক প্রশ্নে চোখ তুলে তাকাল জ্যোতি। উত্তর দিল না। মেহেরাজ ফের দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল,

” চোখের নিচে এমন কালি ফেলেছিস কেন? কার বিরহে দিন কাঁটিয়ে এমন এক্সিডেন্ট করে শহীদ হয়ে যেতে চাইছিলি?”

জ্যোতির কপাল কুঁচকাল এবার। প্রশ্নময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই জিজ্ঞেস করল,

” মানে?”

মেহেরাজ জ্যোতির প্রশ্নের উত্তর দিল না।গম্ভীর কন্ঠে শুধাল,

“হাত অক্ষত আছে তোর? নাকি নিজে হাতে খাওয়ার অবস্থাও নেই?”

জ্যোতির মুখ থমথমে হয়ে এল। উত্তরে ভরাট গলায় বলল,

” হাত ঠিক আছে।”

” মেহু খাবার আনছে। চুপচাপ খেয়ে নিস। ”

শান্ত গলায় কথাটা বলেই মেহেরাজ ফের চলে গেল। মাঝখানে মেহু খাবার আনল। খাবার খাইয়ে, ঔষুধ খাইয়ে আবার প্লেট নিয়ে চলেও গেল। তারপর আরো অনেকক্ষন কেঁটে গেল। জ্যোতির চোখজোড়ায় ঘুম নামল না। তবে ক্লান্তি ভর করল ঠিক। সারা শরীর দুর্বল বোধ হলো। চোখজোড়া বুঝে নিয়ে হাত ভাজ করে খাটে হেলান দিয়ে রইল অনেকটা সময়। তারপর হঠাৎ দরজার আওয়াজ আসল কানে৷মুহুর্তেই চোখজোড়া মেলে তাকাতেই দেখল মেহেরাজ দরজা লাগিয়ে পা বাড়িয়ে ওয়াশরুমের দিকে গেল। মুখচোখে জল দিয়ে ফিরে এসে বিছানার এক পাশে সটান শুঁয়ে পড়ে জ্যোতির দিকে তাকাল। বলল,

” তোর বান্ধবীকে তখন কি বলছিলি তুই? আমি রোমান্টিক নই এটা বলেছিস?”

এমন একটা প্রশ্নে জ্যোতি অবাক হলো। কখন কোন বান্ধবীকে এমন কথা বলল স্মরনেও এল না৷ কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

“কখন? কোন বান্ধবীকে বলেছি? ”

” তখন তোর বান্ধবী অবাক হয়ে তোকে জিজ্ঞেস করল কেন, ‘উনি রোমান্টিক নয় বলছিস? ‘ তার মানে তুই এমনটা বলেছিস ওদের?”

কথাটা বলেই মেহেরাজ ভ্রু উঁচু করল।সঙ্গে সঙ্গে জ্যোতির উত্তর না পেয়ে ফের মুখচোখ কুঁচকে বলল,

” ছিঃ জ্যোতি,তুই আমাকে নিয়ে তোর বান্ধবীদের সাথে এসব শেয়ার করিস? ”

জ্যোতির মনে পড়ল তখনকার কথাগুলো।ইতস্থত গলায় বলল,

“আমি ঠিক এভাবে বলিনি। ”

মেহেরাজ সে উত্তরে দমে গেল না। রাগ রাগ গলায় বলে উঠল,

” তাহলে কিভাবে বলেছিস?”

জ্যোতি জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজাল। তারপর নরম গলায় বলল,

” আমি আপনাকে নিয়ে কোনদিনই কিচ্ছু বলিনি ওদের মেহেরাজ ভাই। এমনকি আমার যে বিয়ে হয়েছে এটাও ওরা জানত না মেহেরাজ ভাই। আগের বার আপনি নিতে আসাতেই জেনেছিল। আর আজ কথার কথাতে ওদের কথার উত্তরে বলে ফেলেছিলাম।তবে এভাবে বলিনি যে আপনি রোমান্টিক নন। ”

” তাহলে কি রোমান্টিক বলেছিস?”

জ্যোতি উত্তর দিল না।ইতস্থত বোধ করে চুপ করে থাকল। অপরদিকে মেহেরাজ মনে মনে হাসল।তবে সে হাসির প্রকাশ বাইরে এল না। বরাবরের মতো মুখ টানটান করে চেয়ে থাকল জ্যোতির পানে। পরমুহুর্তেই কিছু একটা ভেবে আবার ভরাট কন্ঠে বলল,

“এক মিনিট, তুই বিবাহিত এটা মানিস বলেছিস অথচ বিবাহিত এটা মানুষকে জানাতে তোর লজ্জ্বা লাগছে?”

জ্যোতি এতক্ষন ইতস্থত হয়ে চুপ করে থাকলেও এবার স্পষ্ট চাহনীতে তাকাল। বলল,

” লজ্জ্বা লাগবে কেন? ”

” তাহলে জানাসনি কেন? ”

জ্যোতি ছোট্ট শ্বাস ছাড়ল। বলতে লাগল,

” ওরা সবকিছুতেই বেশি বেশি কৌতুহলি মেহেরাজ ভাই। যদি জিজ্ঞেস করত আপনার সাথে আমার সম্পর্ক কেমন? এতদূর আমি একা কেন থাকি?বিবাহিত হয়েও আর বাকি দশটা বউয়ের মতো মাখোমাখো ফোনালাপ কিংবা প্রেমালাপে দেখা যায় না কেন আমাকে?এসবের উত্তর দিতে গিয়ে আমি অপ্রস্তুত হতাম।এসব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে চাইনি তাই বলিনি। ”

মেহেরাজ চুপচাপ কথা গুলো শুনল। নিরব হয়ে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল জ্যোতির দিকে। তারপর একদম ঠান্ডা গলায় বলে উঠল,

“এরপর থেকে আর কোন প্রশ্ন থাকবে না৷ ”

কথাটা বলেই মেহেরাজ অন্যদিকে মুখ করে ফিরে শুঁয়ে পড়ল। মনে মনে জ্যোতির কাছে নতুন সকালে নতুন মেহেরাজকে উপস্থাপনের প্রস্তুতি নিল৷

.

জ্যোতির চোখে ঘুম এসেছিল মধ্যরাতের দিকে। তাও বিছানায় হেলান দিয়ে সেভাবে বসে থাকা অবস্থাতেই। ঘাড়টা হালকা বাঁকা হতেই হঠাৎ ঘুম ছুটে গেল। কিঞ্চিৎ ব্যাথা অনুভব হলো ঘাড়ে।সাথে পায়ের সূক্ষ্ম ব্যাথা যেন চওড়া হয়ে উঠল।নিভু নিভু চোখে ঘড়িতে তাকাতেই বুঝল সকাল হয়েছে। হাত বাড়িয়ে খাটের পাশে থাকা জানালাটা খুলতে নিতেই কোমড়ে কিছুর বাঁধন টের পেতেই ঘুমঘুম চোখে দৃষ্টি নামিয়ে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে গেল। মেহেরাজের বলিষ্ঠ হাত জোড়ার বন্ধন আঁকড়ে আছে তার কোমড়। মুহুর্তেই ঘুমঘুম ভাব কেঁটে গেল। শিরদাঁড়া বেয়ে শিরশিরে অনুভূতি বয়ে গেল সর্বাঙ্গ জুড়ে। তুমুল অস্থিরতায় নড়েচড়ে বসল জ্যোতি। অস্বস্তিতে হাতে হাত ঘষতে লাগল অনবরত।ভাবতে লাগল, মেহেরাজ তো ঘুমের ঘোরে এমনটা করার মতো লোক নয়। এর আগেও একবার মেহেরাজ আর সে এক বিছানায় ঘুমিয়েছে গ্রামের বাড়িতে। সেই রাতে মেহেরাজ যে দিকে ফিরে,যেভাবে ঘুমিয়েছিল ঠিক সেভাবেই সকাল পর্যন্ত স্থির ছিল। এমনকি হাত পায়ের অবস্থানেরও পরিবর্তন হয়নি তার মনে আছে এখনও। তবে আজ?এই কয়বছরে মেহেরাজের অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটেছে নাকি সবটা ইচ্ছাকৃত? ইচ্ছাকৃত ভাবেই কি হাত দিয়ে আঁকড়ে আছে?প্রশ্নগুলো মনের ভেতর উঁকি দিতেই হৃদস্পন্দনের হার ক্রমশ বাড়ল। কাঁপা হাতে মেহেরাজের হাত জোড়া ছাড়াতে চেষ্টা করল। মেহেরাজ বোধ হয় সবটাই টের পেল। চোখ বুঝে রেখেই ঘুম জড়ানো গলায় বলে উঠল,

” উহ জ্যোতি,এমন হাসফাঁস করছিস কেন তুই? ”

মেহেরাজে কন্ঠে কি ছিল কে জানে জ্যোতির হাসফাঁস করা যেন দ্বিগুণ হলো। অস্বস্তি ক্রমশ বাড়তে লাগল। বুঝতে পারল সমস্তটাই মেহেরাজের ইচ্ছাকৃত কর্মকান্ড। মৃদু আওয়াজে অস্বস্তি কাঁটিয়ে স্পষ্ট গলায় বলল,

” হাতগুলো সরান মেহেরাজ ভাই। অস্বস্তি হচ্ছে।”

মেহেরাজ হাত সরাল না। হাতের বাঁধন শক্ত করে কোমড় চেপে ধরল। ঘুমঘুম কন্ঠে জবাব দিল,

” অস্বস্তি হলে হোক।”

” ছেড়ে দিন, পায়ে ব্যাথা করছে আমার। ”

মেহেরাজ এবার চোখজোড়া মেলে ধরল কিঞ্চিৎ। একনজর নিজের দিকে তাকিয়ে জ্যোতির দিকে তাকাল। বলল,

” কি আশ্চর্য ! আমি তো তোর পায়ের আশপাশেও গেলাম না।কাল রাতে যেখানটায় ঘুমেয়েছি সেখানটাতেই পড়ে আছি।ইভেন এখনো ভালো কর তাকিয়ে দেখ তোর আর আমার মধ্যে বেশখনিকটা দূরত্ব আছে।হাত বাড়িয়ে ধরলাম তোর কোমড়, আর ব্যাথা করছে পা?”

জ্যোতির চাহনী সূক্ষ্ম হলো। বলল,

” আমি কখন বললাম যে আপনার কারণে পায়ে ব্যাথা করছে?”

মেহেরাজ হাতজোড়া দিয়ে সেভাবেই আঁকড়ে রইল জ্যোতির কোমড়। ভ্রু নাচিয়ে বলল,

” তাহলে পায়ে ব্যাথার সাথে আমার হাত সরানোর কি সম্পর্ক? ”

জ্যোতি হঠাৎ চুপ হয়ে গেল। চোখজোড়া চাহনি কেমন ধারালো আর জ্বলন্ত হয়ে উঠল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

” কিছুদিন পর দ্বিতীয় বিয়ে করবেন অথচ অন্য একটা নারীর কোমড় আঁকড়ে রেখেছেন।বিষয়টা বিশ্রী দেখায় না?”

মেহেরাজের শক্ত জবাব,

” দেখালে দেখাক৷ ”

জ্যোতি ফের প্রশ্ন ছুড়ল,

” সামান্তা আপু ভুল বুঝবে না? ”

ভ্রু কুঁচকে নিল মেহেরাজ। শুধাল,

” সামান্তা কেন ভুল বুঝবে?”

” আপনার দ্বিতীয় স্ত্রী হবে সে, স্যরি আপনার ভালোবাসার মানুষ ও তো উনি।স্বাভাবিক ভাবেই ভুল বোঝার কথা।”

মেহেরাজ তীক্ষ্ণ চাহনিতে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,

” তো তোর কি কষ্ট হচ্ছে এই জন্য? ”

জ্যোতির কষ্ট হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। স্বামীর পাশে অন্য নারীকে সইতে কষ্ট কার না হবে?জ্যোতিরও হবে।তবুও তা স্বীকার করল না জ্যোতি।বলল,

” আমার কেন কষ্ট হবে ? ”

” সেটা তো তোর ভালো জানার কথা। তাই না?”

শেষের কথাটা ভ্রু নাচিয়েই বলল মেহেরাজ।পরমুহুর্তেই আর শুয়ে না থেকে উঠে বসল । আড়ালে মুচকি হাসল। তারপর জ্যোতির কানের কাছে মুখ নিয়েই অদ্ভুত স্বরে বলল,

” কষ্ট হলে বলে ফেল।হতেও পারে আমি তোর কষ্ট লাঘব করতে মরিয়া হয়ে উঠব?”

কথাটা বলেই মেহেরাজ উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল। জ্যোতি স্থির তাকিয়ে থাকল। কথাটায় কিংবা কন্ঠটায় কিছু তো একটা ছিল। যা তার সমস্ত শরীরে শিহরণ জাগাল। মনে মনে ভাবল,”আসলেই কি বলে ফেললে কষ্ট লাঘব করে দিবে মেহেরাজ ভাই?”

.

সকাল সকালই মেহুর নামে একটা পার্সেল দিয়ে গেল এক লোক। মেহু সে পার্সেলটা হাতে নিয়েই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকল। সঙ্গে তাকিয়ে রইল নাবিলা আর নাফিসাও। অনেক্ষন যাবৎ এই পার্সলের প্রেরকের নাম জানার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। অবশেষে নাবিলা আর ধৈর্য্য ধরে বসে থাকতে পারল না। অধৈর্য্য গলায় বলে উঠল,

” আপু?পার্সেলটা খুলেই দেখি না?তাহলে সব রহস্যের সমাধান হয়ে যাবে হয়তো।”

মেহু চোখ ছোট ছোট করে তাকাল।সে জানে পার্সেলটা সাঈদই পাঠিয়েছে৷ ম্যাসেজেই এমন কিছু বলেছিল সাঈদ। বিনিময়ে কোন রিপ্লাই না দিলেও এভাবে আজ সকালেই পার্সেলটা এসে হাজির হবে ভাবে নি সে। এদিকে নাবিলা নাফিসার সামনেও এ সত্যটা বলে উঠা যুক্তিযুক্ত বোধ হলো না। ইতস্থত বোধ অবশেষে একটা মিথ্যে বলল,

” কে পাঠিয়েছে তার নামই তো জানি না।পার্সেলের ভেতর কি না কি আছে তাও তো জানি না। পার্সেলটা খোলা উচিত হবে না। তার চেয়ে এভাবেই থাক।”

নাবিলার মুখটা চুপসে গেল মুহুর্তেই। ছোট্ট শ্বাস ফেলেই বলল,

” এই ব্যাক্তিটা কে তা জানার জন্য মনটা ছটফট করছে গো।কি যে করি!তোমার কোন প্রেমিক ট্রেমিক নয় তো আপু?”

মেহু চোখ গরম করল। বলল,

” প্রেমিক ট্রেমিক মানে?আমি কি প্রেম করে বেড়াচ্ছি?”

নাবিলা ঠোঁট চওড়া করে হাসল। ফিচেল গলায় বলল,

” তুমি কি আর ছোট আছো?প্রেম করতেই পারো।তাও আবার একটা না, তোমার যতোটা ইচ্ছে ততোটা প্রেম করতে পারো।কিন্তু তুমি মানুষটা কেমন জানি।প্রেম করার বয়স পার হয়ে বিয়ে করার বয়সও পার হয়ে যাচ্ছো, সে খেয়াল আছে তোমার?”

” তোর মাথা।তেমন কিছু নয়।আমি আসছি ”

কথাটা বলেই পার্সেলটা নিজের ঘরে নিয়ে এল। চুপচাপ দরজাটা বন্ধ করে পার্সেলটা খুলতেই চোখে পড়ল সর্বপ্রথম কালো রংয়ের শাড়ি।তার উপর ছোট্ট চিরকুট। যেখানে গুঁটিগুঁটি অক্ষরে লেখা,

” এই যে, হবু বউ শুনছো? জম্মদিনের উপহার গ্রহণের অনুরোধ রইল। তৈরি থেকো নতুন কিছুর জন্য৷আশা করি সে নতুন কিছু তোমার সম্মুখে পরের মাসেই হাজির হবে।খুব শীঘ্রই আমি তোমার আর তুমি আমার হবে।ভালোবাসায়-বাসায় রাঙ্গিয়ে দিব। সকল অভিযোগ মুঁছে দিব তখন।

ইতি
তোমার অপ্রিয় ব্যাক্তি!”

মেহু চোখ বন্ধ করল চিরকুটের লেখা গুলো পড়ে।লেখাগুলোর অর্থ বুঝেই এবার নিভে এল চাহনী। চুপ হয়ে বসে থাকল অনেকক্ষন। তারপর হঠাৎই শুনল মোবাইল বাঁজছে। চোখ ফেরাতেই মোবাইল স্ক্রিনে সাঈদের নাম্বারটায় দেখতে পেল। কল ধরল না মেহু। আগের ন্যায় চুপচাপ বসে থাকল কেবল।

#চলবে…

এক মুঠো প্রণয় পর্ব-২৫+২৬

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_২৫
লেখনীতেঃএকান্তিকা নাথ

” জ্যোতি?দ্বিতীয়বার বিয়ে করলে তোর মতামত কি?দ্বিতীয় বার বিয়েটা কিন্তু আগের বারের মতো আমার অনিচ্ছাতে কিংবা হুটহাট জোরজবরদস্তিতে হবে না।এবার আরামে বিয়ে করে সুন্দর একটা সংসার করব। তোর কিছু বলার থাকলে বলতে পারিস।”

টংয়র দোকানে কাঠের বেঞ্চে ধোঁয়া উঠা এক কাপ চা হাতে নিয়ে বসে ছিল জ্যোতি। পাশাপাশি বসে আছে মেহেরাজও।নির্লিপ্ত চাহনীতে চেয়ে ছিল পাশে থাকা রমণীর দিকে।ডাগর চোখজোড়ায় , শ্যামলা মুখে আজ ভিন্ন মায়া, ভিন্ন তৃপ্তি।মুখে সাঁজ নেই তবুও এই মুখে তাকিয়েই হৃদয় ক্রমশ শীতল হয়ে জমে উঠল তার।বুকের ভেতর সে জমাটবাঁধা হিম অনুভূতিরা জানান দিল পাশে থাকা নারীর গভীর মায়ায় ডুবে মরার যন্ত্রনা৷ নিজের করেও নিজের করে না পাওয়ার যাতনা। অনুুভূতির তীব্র অস্থিরতা সহ্য করেও অনুভূতিদের কথা সেই রমণীর সামনে জানান দিতে না পারার কষ্ট। মুহুর্তেই ঠোঁটে ঠোঁট চেপে শ্বাস ফেলল মেহেরাজ।তারপর কি মনে করেই ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই আয়েশ করে কথাগুলো বলে ফেলল সে।অন্যদিকে জ্যোতি সবেমাত্র চায়ের কাপে চুমুক দিতেই কানে পৌঁছাল মেহেরাজের আকস্মিক বলা কথাগুলো। মুহুর্তেই থমকে গেল তার চাহনী।চোখের সামনে ভেসে উঠল সমান্তার প্রতিচ্ছবি। মেহেরাজদের বাসা ছেড়ে আসার আগে মেহেরাজের সাথে সামান্তার হাত ধরার সেই দৃশ্য।বুক ভার হয়ে উঠল তৎক্ষনাৎ। মস্তিষ্কে গিয়ে সর্বপ্রথম গেঁথে গেল যে কথাটা তা হলো, মেহেরাজ দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে চাইছে।দ্বিতীয়বার কারো সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে চাইছে।কোন নারীর পক্ষেই বোধ হয় এমন একটা মুহুর্তকে আনন্দমুখর মুহুর্ত হিসেবে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। জ্যোতিও পারল না। মুখভঙ্গি বদলে গেল।তপ্তশ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবল মেহেরাজের এভাবে আকস্মিক ভোরে ভোরে এতদূর এসে হাজির হওয়ার পেছনে তাহলে এই কারণটাই লুকায়িত ছিল।অবশ্য মেহেরাজ যে তার কারণে কোনদিন দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবে না এমনও তো প্রতিজ্ঞা বদ্ধ ছিল না। তবুও সে মানতে পারল না।চাপা যন্ত্রনা ভেতরটা নড়বড়ে করে দিচ্ছে।জ্বলন্ত আগুনের শিখায় যেন ঝলসে গেল তার হৃদয়। ঠোঁট চেপে কিছুক্ষন নিশ্চুপ থম মেরে বসে থেকেই পরমুহুর্তে ভাবল, যে মানুষটা তার নয় কিংবা যে মানুষটা তার ছিলই না কোনদিন সে মানুষটা দ্বিতীয়বার বিয়ে করলে তার কি? সে তো অনেক আগেই মেহেরাজকে বলে এসেছিল সামান্তাকে বিয়ে করে সংসার গুঁছিয়ে নিতে। তখন কেন দ্বিতীয়বার বিয়ে করল না?আজ এতগুলো দিন, এতগুলো মাস পরই দ্বিতীয়বার বিয়ে করার কথা মাথায় আসল?জ্যোতি শ্বাসরুদ্ধকর সে মুহুর্তটায় নিশ্চুপে পাশ ফিরে তাকাল মেহেরাজের দিকে৷ এই প্রথম তার মধ্যে জ্বলন্ত স্ত্রী স্বত্ত্বা টের পেল। বুঝতে পারল কোন স্ত্রীই তার স্বামীকে ভাগ করতে পারে না। স্বামীকে অন্যের সাথে ভাগ করার অনুমতি ও দিতে পারে না।কোনকালেই পারে না। তবুও জ্যোতি বুকে পাথর চেপে অনুমতি দিল। উপরে উপরে নিজেকে একদম স্বাভাবিক দেখিয়ে বলল,

” আমার কিছু বলার থাকবে কেন মেহেরাজ ভাই? আপনি নির্দ্বিধায় বিয়ে করতে পারেন দ্বিতীয়বার। আমি তো আগেই বলেছিলাম কোন অধিকার নিয়ে আপনার সামনে যাব না।হ্যাঁ, আপনি যদি আমার আর আপনার বিয়েটা নিয়ে ইনসিকিউরড ফিল করেন তাহলে বরং খুব তাড়াতাড়ি ডিভোর্সের ব্যবস্থা করতে পারেন। আমি ডিভোর্সে অমত করব না।তাহলেই বোধহয় স্বাধীনভাবে,দ্বিধাহীনভাবে দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে পারবেন। এটাই তো চাইছেন রাইট?”

জ্যোতির স্পষ্ট ভাবে বলা কথা গুলোতে মুহুর্তেই মেজাজ বিগড়ে গেল মেহেরাজের। চোয়াল ও শক্ত হয়ে উঠল। রাগে, জেদে চোখমুখ টানটান করল মুহুর্তেই।তাদের বিয়েটা আর পাঁচটা বিয়ের মতো স্বাভাবিকভাবে হয়নি।কারণবশত সুন্দরভাবে সংসারও করা হয়ে উঠেনি তাদের। তাই মনে মনে ভেবে রেখেছিল সংসার শুরুর আগে আনুষ্ঠানিক ভাবে সবার উপস্থিতিতে আরো একবার বিয়ে নামক বিষয়টা সম্পন্ন করবে।দ্বিতীয়বার বিয়েটা সে অন্যকাউকে নয় বরং জ্যোতির সাথে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়েটা হবে ভেবেই বলেছিল।কিন্তু মেয়েটা বুঝল না। উল্টো “ডিভোর্স” নামক শব্দটা তুলে আনল যা আকস্মিক তার মেজাজ খারাপ করতে বাধ্য করল।লালাভ দৃষ্টিতে জ্যোতির দিকে তাকিয়েই শীতল গলায় বলে উঠল সে,

“ডিভোর্সের কথা আসছে কেন?তিনবছর আগে না আমাকে বলেছিলি, আমি সামান্তাকে বিয়ে করে নিতে পারি৷কিন্তু তোর সাথে যেন বিয়েটা ভেঙ্গে না দিই। সেসব এখন কোথায় গেল?”

মেহেরাজের মুখে সামান্তা নামটা আবারও শুনে জ্যোতি মনে মনে নিশ্চিত হলো বিয়েটা সামান্তার সাথেই হচ্ছে।মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে এক সমুদ্র যন্ত্রনা নিজের ভেতর চেপে রেখে স্থির ভাবে তাকাল মেহেরাজের চোখের দিকে। কি অমায়িক সুন্দর সেই চোখজোড়া। শুধু চোখজোড়া নয়, তার সামনে বসে থাকা আস্ত পুরুষটাই অমায়িক সুন্দর। এই অমায়িক সুদর্শন পুরুষটাই ভাগ্যক্রমে তার স্বামী হলেও বরাবরই এই পুরুষটা আর তার মাঝে ছিল বিস্তর দূরত্ব, অধিকারহীনতা আর দায়িত্বের সমীকরণ। জ্যোতি ঠোঁট এলিয়ে বলল,

” সত্যি বলতে কি, নিজেকে কারোর জীবনে এইটুকু সমস্যার কারণ হওয়া দেখাটাও অপমানজনক মেহেরাজ ভাই। বিশেষ করে বিয়ের মতো এমন একটা সাংঘাতিক সম্পর্কে। এটা ঠিক, আমি আপনাকে ভালোবেসেছি কিংবা ভালোবাসি। আপনার দায়িত্ব, আচার আচরণ, ব্যাক্তিত্ব সবকিছুতেই মুগ্ধ হয়েছিলাম। সত্যি বলতে আমি এখনও আপনার দায়িত্ব পালন, আচার আচরণ, ব্যাক্তিত্ব এসবকে সম্মান করি। আপনার সাথে বিয়েটা অনিচ্ছায় হলেও একটা সময় পর বোধহয় আমি তা মেনে নিয়েছিলাম নির্দ্বিধায়। এমনকি আজও আমি মানি যে আমি বিবাহিত। কিন্তু তাই বলে আপনার সুখে বাঁধা হবো কেন? আমার আর আপনার বিয়ে নামক সত্যটা যদি আপনাকে সুন্দর-সাবলীল জীবন শুরু করতে ভয় দেখায় তাহলে সত্যটা মুুঁছে ফেলাই বোধ হয় উচিত। তাই না মেহেরাজ ভাই?”

মেহেরাজের চোখজোড়ার রক্তিমতা গাঢ় হলো। হাতের চায়ের কাপটা আওয়াজ করেই টেবিলের উপর রেখে গম্ভীর কন্ঠে বলল,

” না, উচিত না।”

কথাটা শুনে জ্যোতির মুখে ফুটে উঠল তাচ্ছিল্যতা।বছর তিনেক আগে তার দাদীর আর আব্বার প্রশ্নের বিনিময়ে মেহেরাজের বলা উত্তরগুলো আবারও মনে করিয়ে দিল মস্তিষ্ক। সে উত্তরগুলোতে স্পষ্ট ছিল যে মেহেরাজ বাধ্য হয়েই বিয়েটা মেনেছিল। বাধ্য হয়েই জ্যোতির প্রতি দায়িত্ব পালনে রাজি হয়েছিল। সেসময়ে এত এত যত্ন, পাশে থেকে আগলে রাখা সবকিছুই যদি দায়িত্ব হয়ে থাকে তবে আজ বোধহয় সেই দায়িত্বটুকুও অবশিষ্ট নেই। তাই তো দ্বিতীয়বার বিয়ের কথা সুন্দর সাবলীল ভাবেই বলে নিয়েছে তার সম্মুখে।এসব ভেবে মেহেরাজের দিকে আগের মতোই স্থির তাকিয়ে থেকে বলল,

” উচিত না হলে তো এই ভোর ভোর আপনি অতোদূর থেকে এখানে ছুটে আসতেন না মেহেরাজ ভাই। আপনার যে দ্বিতীয় বিয়ের এত তাড়া এটা জানলে বিশ্বাস করুন, এত কষ্ট করে আপনার এতদূর আসারও প্রয়োজন ছিল না। আমি ডিভোর্সে একবারও অমত করতাম না। আমি সত্যিই চাই আপনি আর সামান্তা আপু সুখে সংসার করুন। সুন্দর ভাবে বাঁচুন।সুন্দর একটা জীবন উপভোগ করুন।সত্যিই চাই। ”

মেহেরাজ ক্ষ্রিপ্ত চাহনীতে তাকাল। ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়ে তপ্ত মেজাজে বলে উঠল,

“সামান্তা আসছে কেন এখানে?”

জ্যোতি নরম গলায় উত্তর দিল,

” সামান্তা আপুকেই তো বিয়ে করবেন।তাই না?ভালোবেসেছেন যখন নিজের ইচ্ছায় বিয়ে তো অবশ্যই তাকেই করবেন।এই বিষয়ে তো দ্বিধা নেই কোন। ”

উত্তর শুনে ভ্রু উঁচাল মেহেরাজ। প্রশ্ন ছুড়ল,

” যদি দ্বিধা থেকেও থাকে? ”

ফের নরম গলায় উত্তর দিল জ্যোতি,

” ভালোবাসায় অতো দ্বিধা কাজ করে না। দ্বিধা থাকলেও একটা সময় পর তা মুঁছে যায়। আপনাদের ক্ষেত্রেও তাই।আমি নামক দ্বিধাটা বোধহয় এতদিন আপনাদের মাঝে উপস্থিত ছিলাম। তবে আশা করি এই দ্বিধাটা খুব শীঘ্রই কেটে যাবে। আপনাদের নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা রইল মেহেরাজ ভাই।”

মেহেরাজের মেজাজ তুলনামূলক খারাপ হলো। তবুও নিজেকে স্থির, শান্ত রেখে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠল,

” ধন্যবাদ।”

সৌজন্যতামূলক হাসল জ্যোতি। হাতে থাকা চায়ের কাপটা রেখে দিয়ে বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েই বলল,

” তবে আসি?যে প্রয়োজনে এসেছিলেন তা নিশ্চয় শেষ।”

মেহেরাজ শীতল চাহনীতে তাকাল একনজর।উঠে দাঁড়িয়ে চা ওয়ালার দেওনা মিটিয়ে বুক টানটান করে সোজা হয়ে দাঁড়াল জ্যোতির সামনে। কপাল কুঁচকে নিয়ে ঠোঁটজোড়া গোল করে তপ্তশ্বাস ফেলল।তারপর শান্ত গলায়ে বলল,

” না শেষ হয় নি।”

জ্যোতি চোখ তুলে তাকাল। চোখজোড়া দিয়ে প্রশ্নময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শুধাল,

” আর কি প্রয়োজন?”

মেহেরাজ উত্তর দিল না। তপ্ত মেজাজে মুখ থমথমে রেখে হেঁটে গেল সামনের দিকে। জ্যোতি এগিয়ে গেল না। ঠাঁই সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে তাকিয়ে রইল মেহেরাজের যাওয়ার পানে।দেখতে পেল মেহেরাজ কিছুটা দূর গিয়েই থেমে দাঁড়িয়েছে। ঘাড় বাকিয়ে তার দিকে তাকিয়েই কপাল কুঁচকাল বিরক্তিতে। ভ্রু উঁচিয়ে ছুড়ে দিল প্রশ্নময় দৃষ্টি।জ্যোতি সেই দৃষ্টির প্রশ্ন বুঝতে পেরেই পা বাড়াল। এগিয়ে গেল অল্প দূরে দাঁড়ানো পুরুষটির দিকে।

.

সামান্তার পরনে লাল রাঙ্গা শাড়ি।চুলগুলো খুলে রাখা৷ কপালে ছোট্ট লাল টিপ।দুধে আলতা গায়ের রংয়ে এরূপ সাঁজে যে কোন পুরুষই প্রেমে পড়তে বাধ্য।অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটিও সে বাধ্যবাধকতায় নাম লিখাতে ভুলল না। অপলক তাকিয়ে থেকেই মুচকি হাসল। পা বাড়িয়ে এগিয়ে গেল সামনে থাকা সুন্দরী রমণীর দিকে। সামান্তা হাসল। এই ছেলেটার সাথে পরিচয় আরো বছর ছয় আগে থেকেই৷ সে কলেজ জীবনে প্রথম পরিচয়।প্রথমে তাদের সম্পর্কটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক থেকে শুরু হলেও এখনকার সম্পর্কটা কেবলই বন্ধুত্বে থেমে নেই৷ তা রূপ নিয়েছে প্রণয়ে৷ দ্বিতীয়বার দ্বিতীয় পুরুষের প্রণয়ে মেতে উঠা যাকে বলে৷ দ্বিতীয়বার বার দ্বিতীয় পুরুষের হাতে হাত রাখা, একসাথে পথচলার স্বপ্নদেখা যাকে বুঝায়৷ সামান্তা মুখে চঞ্চলতা ফুঁটিয়ে হাসল। দু পা এগিয়ে ছেলেটার সামনে দাঁড়িয়েই বলল,

” গোলাপ এনেছিস আরাব? ”

আরাব মুচকি হাসল এবারও। চোখের সামনে অসম্ভব রূপবতী মেয়েটাকে দুচোখে পরখ করে নিয়েই সেই হাসির উজ্জ্বলতা দ্বিগুণ হলো। প্যান্টের পকেটে গুঁজে রাখা গোলাপটা বের করে এনেই সামনে ধরল৷ বলল,

” আরাব কখনো আপনার আদেশ ভুলে নাকি?”

সামান্তা চমৎকার হাসল। হাত বাড়িয়ে গোলাপটা নিয়েই আরাবের হাতের ভাজে নিজের নরম হাতটা ডুবিয়ে দিল। চঞ্চল গলায় বলল,

” বাহ! একেবারে পার্ফেক্ট প্রেমিক! ”

আরাব এবারেও ঠোঁট চওড়া করে হাসল। নিজের ডান হাত দিয়ে সামান্তার নাকটা আলতো ছুঁয়ে দিয়ে বলল,

” এমন একটা সুন্দরী, রূপবতী প্রেমিকা থাকলে পার্ফেক্ট প্রেমিক না হয়ে উপায় কি শুনি?”

সামান্তা ভ্রু নাচিয়ে বলল,

” সুন্দরী না হলে পার্ফেক্ট প্রেমিকের রোল প্লে করতি না? ”

আরাব এবারও হাস্যোজ্জ্বল চাহনীতে জিজ্ঞেস করল,

” কি মনে হয় তোর?”

সামান্তার চাহনী হঠাৎ নিভে এল। কিয়ৎক্ষন নিরব থেকে নরম গলায় বলল,

” জানি না। শুধু জানি বছর দুয়েক আগে আমি দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়েছি কারোর। দ্বিতীয়বার কাউকে সারাজীবনের জন্য চাইছি আমার করে। এইবার আর নিজের ভুলে হারাতে পারব না ভালোবাসার মানুষকে। পার্ফেক্ট না হলেও হারাতে পারব না। ”

আরাব হেসে উঠল। সামান্তার হাতটা আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরেই অপলক তাকিয়ে থাকল মেয়েটার দিকে। এই মেয়েটা যে তাকে হারাতে চায় না তা তার চোখের চাহনীতে স্পষ্ট৷ মেয়েটাকে সে কলেজ জীবন থেকে ভালোবেসে আসলেও কখনোই ভাবেনি মেয়েটা একটা সময় তার হবে। কখনো তার দিকে প্রণয়ী হাত বাড়াবে। কখনো তার প্রেমে পড়বে এমনটা ভাবনার বাইরেই ছিল। ভাবনার বাইরে থাকার পেছনে অবশ্য কারণ ছিল। কারণটা হলো সামান্তার থেকে প্রত্যাখান।প্রথমবার নিজের ভালোবাসার অনুভূতি সামান্তাকে জানানো মাত্রই সামান্তা মেহেরাজের সাথে নিজের প্রেমের কথা নির্দ্বিধায় বলে দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিল আরাবকে।তারপর থেকে অবশ্য সামান্তার পাশে শুধু মাত্র বন্ধু হিসেবেই ছিল সে। এমনকি মেহেরাজের সাথে বিচ্ছেদের পরেও সর্বক্ষন বন্ধু হয়েই আগলে নিয়েছে এই মেয়েটাকে।অবশেষে সামান্তার পাগলামো, অস্থিরতা, যন্ত্রনা সবকিছুকেই লাঘব করতে সক্ষম হয়েছিল। বিনিময়ে পেয়েছিল মেয়েটার আস্থা, ভালোবাসা আর স্বচ্ছল প্রেম।

.

বিল্ডিংয়ের দোতালায় তিনরুম বিশিষ্ট ফাঁকা বাসাটা জ্যোতি ঘুরে ঘুরে দেখল। বসার ঘর,রান্না ঘর সহ বাসাটা ভালোই বোধ হলো৷ টুলেট দেখে দেখে এই নিয়ে চারটা বাসা দেখেছে দুইজনে।তার মধ্যে এই বাসাটাই উত্তম মনে হলো।তাই মেহেরাজের দিকে তাকিয়ে বলল,

” এই বাসাটা ঠিক আছে মেহেরাজ ভাই।আপনার বন্ধুকে ডিটেইলস বলে জিজ্ঞেস করে নিতে পারেন পছন্দ হবে কিনা।”

মেহেরাজ ঠোঁট গোল করে শ্বাস ছাড়ল।এখনও রাগ রাগ ভাব বর্তমান তার মুখে। পকেটে হাত গুঁজে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

“জিজ্ঞেস করতে হবে না, এই বাসাটা ঠিকই আছে।”

জ্যোতি ভ্রু কুঁচকে বলল,

” আপনার বন্ধুর যদি অপছন্দ হয়?”

শান্ত গলায় উত্তর আসল,

” হবে না। ”

” তাহলে ঠিকাছে। ”

মেহেরাজ বিনিময়ে কিছু বলল না। চুপচাপ হেঁটে গিয়ে দরজার দ্বারে দাঁড়ানো বাড়িওয়ালার সাথে কথা বলল। তারপর পা বাড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এল জ্যোতিও। এরপর অবশ্য মেহেরাজ আর জ্যোতির মাঝে তেমন একটা কথা হলো না। চুপচাপ পাশাপাশি চলল কেবল দুইজনে। মেহেরাজের মুখচোখ কঠিন। চাহনী থমথমে। তাই আর আগ বাড়িয়ে জ্যোতিও কথা বাড়াল না।মনে মনে মেহেরাজের আকস্মিক রাগের কারণ খুুঁজলেও ব্যর্থ হলো। এভাবেই নিশ্চুপতায় কাঁটল পুরোটা সময়। তারপর একটা সময় পর রিক্সায় উঠল দুইজনে। পাশাপাশি বসেও একে অপরের মাঝে একটা শব্দও বিনিময় হলো না।অবশেষে তার বাসার সামনেই রিক্সা থামিয়ে মেহেরাজ তাকাল তার দিকে। শান্ত গলায় বলল,

” নেমে যা। ”

জ্যোতি অবাক হলো। গলাটা শান্ত হলেও সে শব্দ দুটো যেন সহস্র রোষের প্রকাশ ঘটাল। চোখের সামনে তুলে ধরল যেন শীতল রাগ। নরম গলায় সে বলল,

” হ্ হু?”

মেহেরাজ ফের থমথমে গলায় বলল,

” কানে শুনিস না?”

জ্যোতি এবার আর বসে থাকল না। দ্রুত রিক্সা ছেড়ে নেমে পড়ল। একপাশে দাঁড়িয়ে অপমানে জর্জরিত হওয়া মুখখানা নিয়ে মেহেরাজের দিকে তাকাতেই দেখল মেহেরাজও নেমে পড়েছে। তারপর পকেট থেকে কি যেন বের করে হঠাৎই ঝুকে বসল। হাতজোড়া জ্যোতির পায়ের দিকে এগিয়ে নিতেই জ্যোতি সরে গেল। অবাক হয়ে বলল,

” কি করছেন মেহেরাজ ভাই?”

মেহেরাজ চোখ তুলে গরম চাহনীতে তাকাল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

” তোর পায়ে ধরে বসে থাকব না নিশ্চয়?”

মেহেরাজের ত্যাড়া কথা শুনে আবারও অপমানে জর্জরিত হয়ে থমথমে মুখে দাঁড়াল জ্যোতি। মেহেরাজ কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে আলতো হাতে তার পায়ে পরিয়ে দিল নুপূর।তারপর উঠে দাঁড়িয়ে একবারও আর জ্যোতির দিকে তাকাল না। রিক্সায় উঠে বসেই রিক্সাওয়ালার উদ্দেশ্যে বলে উঠল দ্রুত,

” চলেন মামা।”

মুহুর্তেই রিক্সাটা এগিয়ে গেল। চোখের সামনে থেকে কয়েক সেকেন্ডে বিলীন হয়ে গেল সে রিক্সা।তবুও জ্যোতি সেদিক পানেই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকল।মনে মনে আওড়াল,”একবারও ফিরে চাইল না? একবারও না। তাহলে এই নুপূরজোড় পরিয়ে কি বুঝাতে চাইল? এটাও দায়িত্ব? শুধুই দায়িত্ব?পরমুহুর্তেই আবার মস্তিষ্ক জানা দিল,দায়িত্ব না হয়ে অন্যকিছু হলে তো সে এতগুলো দিনে একবার হলেও ভালোবাসার কথা বলত। এতগুলো দিনে একবার হলেও কাছে টানত। শুধু দায়িত্ব না হলে তো সে দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে চাইত না। কখনোই চাইত না।

#চলবে….

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_২৬
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

জ্যোতি কথায় কথায় মেহুর কাছেই শুনেছে মেহেরাজরা যে চট্টগ্রামে বাসা নিয়েছে।সপ্তাহখানেক হলো চট্টগ্রামে শিফট করেছে।জ্যোতি সে খবরটা তিনদিন আগে শুনতে পেলেও এখন ও মেহুর সাথে দেখা করা হয়ে উঠেনি একবারও। মেহুই ব্যস্ত বাসা গোঁছাতে তাই আর দেখা করা হয়নি। জ্যোতি ও আর জোর করে নি। কিন্তু মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিল মেহুর জম্মদিনে অবশ্যই দেখা করবে।অবশেষে জম্মদিনের তারিখ এগিয়েই এল।আজ দিন শেষ হয়ে রাত বারোটা বাঁজলেই মেহুর জম্মদিন। তার কারণেই মেহুর জম্মদিনের উপহার দেওয়ার জন্য কিছু কিনতেি বের হয়েছিল জ্যোতি। কিন্তু পথেই বাঁধল বিপত্তি। রিক্সাটা সামনের গাড়িটার সাথে ধাক্কা খেয়েই সাংঘাতিকভাবে উল্টে পড়তে নিতেই জ্যোতি খসখসে রাস্তার জমিনে মুখ থুবড়ে পড়ল।মুহুর্তেই কপালের ডানপাশটায় কেঁটে জ্বালা ধরল। ঠোঁটের এককোণে রাস্তার খসখসে জমিতে কেঁটে রক্ত জমাট বাঁধল। গালের ডানপাশটাও ছিলে আছে। ডান পা টা কেঁটে গিয়ে বিচ্ছিরি রকম অবস্থা হলো।টের পেল ব্যাথায় টনটন করছে তার পা। এমনকি পা নাড়ানোতেও যন্ত্রনায় মুখ নীল হয়ে উঠছে ক্ষনে ক্ষনে। যন্ত্রনা তীব্র। ব্যাথায় জ্যোতির চোখ টলমল হলো। শুধু যে কাঁটার যন্ত্রনাই নয় এটা তা ঢের বুঝতে পারল।মুহুর্তেই লোকজন ঝড়ো হলো। তাদের সহায়তাতেই হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে। সেখানেই এক্সরে করার পর জানতে পারল ডান পায়ের পাতায় হাড় ভাঙ্গার ফলস্বরূপই এই অসহনীয় ব্যাথা। অসহ্যকর যন্ত্রনা।পায়ের পাতা ফুলে বিচ্ছিরি হয়ে উঠছে ক্রমশ। ততক্ষনে অবশ্য তার রুমমেট এসে পৌঁছেছে।মেয়েটার নাম রিতু। দেখতে অসম্ভব সুন্দরী হলেও মনটা খুব নরম। বলা যায় সরল মনের মেয়ে। জ্যোতিকে এমন অবস্থায় দেখেই যেন কেঁদে ফেলবে সে।জ্যোতি তাকে ফোন করে যতটুকু জানিয়েছিল তাতে তার মনে হয়েছিল খুবই সামান্য একটা এক্সিডেন্ট।খুবই সামান্য আঘাত পেয়েছে । কিন্তু এখানে এসেই সে ধারণা বদলে গেল। ডান পায়ের সাংঘাতিকভাবে জখম হওয়া,ফুলে যাওয়া, হাড় ভাঙ্গা, মুখের একপাশে ঘষে যাওয়া অংশ আর ফোলা ঠোঁটের কোণে জমাট রক্ত আর কপালের একপাশটায় কাঁটা দাগ সব মিলিয়ে বিধ্বস্ত দশা! রিতু ফুুঁপিয়ে কেঁদে দিল এবার ।দ্রুত এগিয়ে গিয়েই আবেগ আপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরল জ্যোতিকে। বলে উঠল,

” কি করলি এসব জ্যোতি? কতটা কেঁটেছে৷কতটা আঘাত পেয়েছিস। কি করে হলো এসব ? এতক্ষন হয়ে গেল অথচ কোন চিকিৎস করেনি কেন? ”

জ্যোতি অল্প হাসল। এই মেয়েটা খুবই নরম মনের মেয়ে। তার এভাবে কেঁদে ফেলাটা অস্বাভাবিক নয়৷ তবুও বলল,

” কাঁদছিস কেন? খুবই সামান্য তো। এক্সরে করে রিপোর্ট নিতে টাইম লেগেছে তাই। ”

রিতু ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,

” তুই বললে হলো?আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি কি সাংঘাতিক অবস্থা আর তুই বলছিস সামান্য?”

জ্যোতি এবারেও হাসল৷ ইতস্থত করে বলল,

” তোকে কিছু টাকা আনতে বলেছিলাম।আসলে সাথে করে অতো টাকা নিয়ে বের হইনি আর এমনটা হবে তাও জানা ছিল না রে। ”

” চুপ কর তো। এখন টাকা নিয়ে ভাবার সময়? ”

জ্যোতি বিনিময়ে কিছু না বলে চুপ করে থাকল। তারপর অনেকক্ষন পর ডক্টর দেখিয়ে,পর্যাপ্ত চিকিৎসা করিয়ে, ঔষুধপত্র নিয়েই রিতুর সাহায্য নিয়ে বাসায় পৌঁছাল। কিন্তু বাসার সামনে এসেই গাড়ি থেকে নেমে বাকি পথটা যাওয়া নিয়েই দুশ্চিন্তায় পড়ল। পায়ের যন্ত্রনাটা ক্রমশ বাড়ছে। কাঁটাছেড়ার যন্ত্রনাকে তেমন একটা পাত্তা না দিলেও হাঁড় ভাঙ্গার ব্যাথায় যেন কুঁকড়ে উঠছে সে। পা নাড়ানো নিষেধ। এদিকে সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় নিজের বাসায় পৌঁছানোটাও জরুরী। অবশেষে নিজের মনকে মানিয়ে নিয়েই রিতুর সাহায্য নিয়ে ভাঙ্গা পা উঁচু করে রেখেই দাঁতে দাঁতে চেপে এগিয়ে গেল। একেকটা পদক্ষেপে যন্ত্রনায় চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল জল।ব্যাথায় নীল হয়ে উঠল মুখ। এবার আর চোখের জল আড়াল করা গেল না। আড়াল করা হলো না ব্যাথায় নীল হয়ে উঠা মুখটা। আড়াল করা গেল না প্রতি পদক্ষেপে অস্ফুট স্বরে আর্তনাদ করে উঠা, ব্যাথায় কুঁকড়ে মরা।

.

মেহেরাজদের নতুন বাসায় দুপুরের দিকেই এসে উপস্থিত হলো নাবিলা, নাফিসা। মূলত মেহুকে সরাসরি জম্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর জন্যই প্লেন করে এতদূর ছুটে আসা।সামান্তা না আসলেও নাবিলার মধ্য দিয় পাঠাল উপহারস্বরূপ একটা ছোট বক্স। মেহু খুশি হলো। একে একে সবাই জম্মদিনের উইশ জানানোতে আনন্দে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

বসার ঘরে সোফায় বসেই সবাই আড্ডা দিচ্ছিল তখন। এমন সময়ই হঠাৎ মনে পড়ল জ্যোতির কথা। মেয়েটা নিয়ম করে রাতের বেলা তাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে ঠিক কিন্তু এত কাছে, একই শহরে থেকেও একবার দেখা করতে আসল না? অথচ বাকিসবাই অন্য শহর থেকে এই শহরে এতদূর পথ পাড়ি দিয়ে ছুটে এসেছে। মেহু ছোট শ্বাস টেনে মোবাইল হাতে নিয়ে কল দিল জ্যোতিকে। ওপাশ থেকে জ্যোতি প্রথমবার কল না তুললেও কিয়ৎক্ষন পর নিজেই কল করল।মেহু কল তুলেই বলল,

” কোথায় তুই? ”

জ্যোতির গলা নিস্তেজ শোনাল। উত্তরে বলল,

” রুমেই আপু। কেন? ”

মেহু তৎক্ষনাৎ বলে উঠল,

” আসতে পারবি? দেখা করবি বলছিলি না? আজ দেখা কর।বাসায় আয়।”

মেহুর কথা শুনে জ্যোতি বুঝে উঠল না কি বলবে। এতগুলো দিন যখন দেখা করার কথা বলেছিল মেহুই ব্যস্ত আছে বলেছিল। আর একদিনে পা ভেঙ্গে বিছানায় পড়ে থাকার মধ্যেই বলছে দেখা করতে। মুখটা চুপসে গেল মুহুর্তে। নরম গলায় বলল,

” আপু? আজ টিউশনি আছে। কিছুদিন পর দেখা করি?”

মেহু অভিমানী কন্ঠে বলল,

” আমার থেকে টিউশনি বেশি তোর কাছে?”

জ্যোতি বুঝল অভিমানটা।ঢোক গিলে বলল,

” না মানে, এখন তো রাত হয়ে গেছে আপু।একা একা তোমাদের বাসা কোথায় খুঁজব আমি?”

জ্যোতি ভেবেছিল এ অযুহাতে বেঁচে যাবে।কিন্তু পরমুহুর্তেই মেহুর চমৎকার কথাটা শুনেই মুখটা পুনরায় চুপসে গেল। মেহু বলল দ্রুত গলায়,

” সমস্যা নেই। ভাইয়া বাইরে থেকে ফিরলে ভাইয়াকে পাঠাব।ভাইয়ার সাথে আসতে পারবি না? এতে তো সমস্যা নেই।”

জ্যোতি দ্রুত গলায় বলে উঠল,

” না,উনাকে পাঠাতে হবে না। ”

” তাহলে? ”

” আসলেই আসতে পারব না আপু। একটু সমস্যায় পড়ে গিয়েছি।”

মেহু মানল না।বলল,

” জানি না আমি, ভাইয়া গেলে ভাইয়ার সাথে চলে আসবি। রাতে আমরা খুব আড্ডা দিব। আমি, তুই, নাবিলা, নাফিসা সবাই।”

তারপর আর কোন কথা না বলেই কল কাঁটল। ঠোঁট গোল করে শ্বাস ছাড়ল মুহুর্তেই। অপর পাশে থাকা জ্যোতির মুখটা শুকনো হয়ে উঠল। ব্যাথায়, যন্ত্রনায় কুঁকড়ে উঠার সাথে সাথে জড়ো হলো নতুন চিন্তা। মেহেরাজকে যদি পাঠায় ও এ পা নিয়ে কি যাওয়া সম্ভব? নিজের এই অবস্থার কথা জানানোটাও কি উচিত হবে?

.

বোনের আবদারে অবশেষে মেহেরাজকে আসতেই হলো জ্যোতিকে নিয়ে যেতে।শুধু যে বোনের আবদার তা বলা যায় না, মনে মন সেও অপেক্ষায় ছিল মেহুর জম্মদিনে জ্যোতির দেখা পাওয়ার। জ্যোতিদের বাসার সামনে এসে দাঁড়িয়েই লাগাতার কল দিল জ্যোতিকে৷ ওদিকে জ্যোতির কল তুলার কোন কথা নেই। এক পর্যায়ে বিরক্ত হলো মেহেরাজ। শেষবারের মতো কল দিতেই ওপাশ থেকে জ্যোতির ঘুমঘুম গলায় কথা আসল,

” মাত্রই ঘুমিয়েছিলাম, খেয়াল করিনি এতগুলো কল। দুঃখিত মেহেরাজ ভাই।”

মেহেরাজ কপাল কুঁচকাল। মাত্র নয়টা বাঁজে। এত তাড়াতাড়ি তো এই মেয়ে ঘুমানোর কথা নয়।এই নিয়ে কৌতুহল জাগলেও বিপরীতে প্রশ্ন করল না। বলল,

” বাসায় আছিস, রাইট?”

” হ্যাঁ।”

” পাঁচ মিনিটে নিচে আয়। আমি অপেক্ষা করছি।”

জ্যোতি ঘুমঘুম ভাব কেঁটে গেল মুহুর্তেই। গতরাতে ব্যাথায় ঘুম হয়নি, সারাদিনও তেমন একটা ঘুম হয়নি।অবশেষে এখন ঘুম পেলেও তা নিমিষেই মেহেরাজের কথা শুনে পালিয়ে গেল। তার মানে সত্যি সত্যিই তাকে বাসায় নিয়ে যেতে এসেছে? কিন্তু সে এই পা নিয়ে নিচে নামবে কি করে? বিনিময়ে কিই বা বলবে?ইতস্থত গলায় বলল,

” মেহেরাজ ভাই আমার আসলে…”

কথাটুকু বলেই থামল সে। একবার ভাবল কথাটা বলা উচিক হবে কিনা৷ অপরপাশে মেহেরাজ অপেক্ষা করল পুরো বাক্যটা শোনার জন্য। না শুনতে পেয়েই ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়ে বলল,।

” কি?

জ্যোতি দীর্ঘশ্বাস ফেলল।গলা ঝেড়ে উত্তর দিল,

” পাঁচ মিনিট নয়, আমি বোধহয় পাঁচদিনেও নিচে যেতে পারব না। আপনি দয়া করে ফিরে যান। ”

মেহেরাজের রাগ লাগল। দাঁতে দাঁত চেপে শুধাল,

” নাটক করছিস? দেরি হচ্ছে জ্যোতি। কথা না বাড়িয়ে নিচে আয় ”

জ্যোতি নত গলায় অপরাধীর মতো করে বলল,

” আমি সত্যিই দুঃখিত মেহেরাজ ভাই।যদি সমস্যা না থাকত আমি নিজেই চলে যেতাম মেহু আপুর সাথে দেখা করতে।”

মেহেরাজ ভ্রু উঁচিয়ে শুধাল,

” তো কি সমস্যা? ”

জ্যোতি এবারও বলল না। মৃদু স্বরে বলল,

” কিছু নয়।”

” তো ? ”

জ্যোতি হঠাৎই বলল,

” আপনি চলে যান। ”

মেহেরাজের রাগ এবার দ্বিগুণ হলো। শীতল গলায় রাগ মিশিয়ে বলে উঠল,

” নামবি কি নামবি না? ”

ওপাশ থেকে উত্তর আসল না। মেহেরাজ আর কিছু না বলেই কল কাঁটল। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল সামনের বিল্ডিংটার দিকে। তারপর গেইট পার হয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় গিয়েই কলিং বেল চাপল। বাসাটা চেনে কারণ গতবারও মেহুর জম্মদিনে জ্যোতিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য সেই এসেছিল।তাই চিনতে আর অসুবিধা হলো না৷ বারকয়েক কলিংবেল বাঁজাতেই দরজা খুলল একটা মেয়ে।মেয়েটাকে সে না চিনলেও একবার তাকিয়েই বলল,

” জ্যোতি বাসায় আছে না? ওকে একটু তাড়াতাড়ি বের হতে বলবেন? আমার হাতে বেশি সময় নেই। ”

মেয়েটা হতবাক হয়ে তাকাল মেহেরাজের দিকে। পরমুহুর্তেই মনে পড়ল বেলকনি থেকে এই ছেলেটাকেই সেদিন বাসার সামনে জ্যোতির পায়ে নুপূর পরাতে দেখেছিল সে।তাছাড়া একবছর আগেও একবার দেখেছিল এই ছেলেকে যখন ছেলেটা নিজেই জ্যোতির স্বামী হিসেবে পরিচয় দিয়েছিল। মেয়েটক হাসল কিঞ্চিৎ। বলল,

” জ্যোতির এক্সিডেন্ট হয়েছে কাল আর আপনি আসলেন আজ? ওয়াইফের অসুস্থতায় এত ব্যস্ততা দেখালে কি করে হবে ভাইয়া?হাতে সময় না থাকলে সময় করে নিতে হবে না? ”

মেহেরাজের ভ্রুজোড়া কুঁচকে গেল মুহুর্তেই। বলল,

“মানে? ”

মেয়েটা আবারও বলল,

” কি আশ্চর্য!আপনি জানেন না?আমি তো ভাবলাম আপনি এই কারণেই আসলেন দেখা করতে। ”

মেহেরাজ কিছুই বুঝল না। ভ্রু জোড়া আরো কুঁচকে নিয়ে শুধাল,

” জ্যোতি কোথায়? কি হয়েছে?”

মেয়েটা অবাক হলো। মেহেরাজ যে এই সম্বন্ধে কিছুই জানে না সে আসলেই ভাবেনি। তারপর পুরো ঘটনা খুলে বলল।মেহেরাজের মুখচোখ ততক্ষনে রাগে টানটান হলো।তবুও মেজাজ শান্ত রেখে বলল,

” বাসায় ডুকা যাবে? জ্যোতিকে নিয়ে যেতে চাইছি। ”

মেয়েটা মাথা নাড়িয়েই বলল,

” হ্যাঁ, অবশ্যই। জ্যোতি তো এমনিতেও হেঁটে এখানে আসতে পারবে না।”

মেহেরাজ আর অপেক্ষা করল না।সামনের মেয়েটার পিঁছু পিছু গিয়ে দাঁড়াল জ্যোতি যে রুমে থাকে সে রুমের সামনে। পাশাপাশি দুটো বেড রুমের ভেতর। টেবিলে বইয়ের স্তূপ। পাশাপাশি একটা চেয়ারে বসে আছে একটা মেয়ে আর তার পাশের বিছানাটায় চাদর মুড়িয়ে শুঁয়ে আছে জ্যোতি।কপালের দিকটায় ব্যান্ডেজ, ফোলা ঠোঁট আর ডান গালের ছিলে যাওয়া অংশটা মুহুর্তেই চোখে পড়ল মেহেরাজের।অপরদিকে জ্যোতি তখনও নিরস মুখে ফোনের দিকেই তাকিয়ে আছে। মনে মনে ভেবেছে মেহেরাজ কল কেঁটে দিয়ে ফিরে গেছে। সে ভাবনা মিথ্যে প্রমাণিত হলো যখন কানে আসল শীতল অথচ রাগী পুরুষালি গলা,

” নিজের খেয়াল নিজেই রাখতে পারবি, নিজের যত্ন নিজে করতে পারবি।যাদের খেয়াল রাখার কেউ থাকে না তাদের খেয়াল তারা নিজেরাই রাখে, যাদের যত্ন করার কেউ থাকে না তারা নিজেরাই নিজেদের যত্ন করে। এখন তোর সেসব বিখ্যাত বাণী কোথায় গেল?এই নমুনা নিজের খেয়াল নিজে রাখতে পারার?”

জ্যোতি অবাক হয়ে তাকাল। চোখের সামনে অপ্রত্যাশিত মুখটা ভেসে উঠতেই মুহুর্তেই শোয়া ছেড়ে লাফিয়ে বসল। ওড়নাটা ঠিকঠাক করে মাথায় টেনে চাইল ভালো করে। চোখের সামনে ভেসে উঠল মেহেরাজের লালাভ চোখ, শক্ত চোয়াল আর বুকে গুঁজা হাতজোড়া। বলল,

” আপনি?”

মেহেরাজ ভ্রু উঁচিয়েই বলল,

” হ্যাঁ, আমি।তো?”

জ্যোতি স্পষ্টভাবে বলল,

” কিছু নয়।”

মেহেরাজ তেঁতে উঠল।জোরে জোরে শ্বাস টেনে রাগ নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করে বলে উঠল,

” এই তোর সমস্যা? ”

জ্যোতি স্থির চাহনীতে তাকিয়ে উত্তর দিল,

” এটা একটা এক্সিডেন্ট ছিল মেহেরাজ ভাই। ”

“তুই তো নাকি নিজের খেয়াল নিজে রাখতে পারতি? ”

” আমার কোন দোষ ছিল না। ”

মেহেরাজ চুপ থাকল কিয়ৎক্ষন। তারপর দম ফেলে শক্ত গলায় বলল,

” মেহু অপেক্ষা করছে, জামাকাপড় কিছু গুঁছিয়ে নে। বাসায় ফিরছি। ”

” হ্ হু?”

দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

” বাসায় যাব।শুনিস না কানে? ”

” আমার পায়ের অবস্থা খারাপ মেহেরাজ ভাই।যেতে পারব না।”

মেহেরাজ শীতল চাহনীতে তাকাল। দৃঢ় গলায় বলল,

” সমস্যা নেই, তুই না যেতে পারলেও আমি নিয়ে যেতে পারব।”

” মিথ্যে বলছি না, সত্যিই পায়ের হাড় ভেঙ্গেছে। ”

মেহেরাজ বুক টানটান করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাতজোড়া পকেটে গুঁজল। তারপর ডান ভ্রুটা উঁচু করেই দৃঢ় গলায় বলল,

” হ্যাঁ জানি তো আমি।কোলে করে নিয়ে যাব।তোকে পা নাড়াতেও হবে না ”

আকস্মিক বলা কথাটা শুনে জ্যোতি অবাক হলো।কুঁচকে গেল ভ্রু জোড়া।চোখেমুখে খেলে গেল বিস্ময়। এমন একটা উত্তর সে মোটেও আশা করেনি। মোটেই ভাবেনি।স্থির চাহনীতে ভ্রু জোড়া কুঁচকে রেখে তাকিয়ে থাকল কেবল মেহেরাজের দিকে।

#চলবে…

[কেমন হয়েছে জানাবেন। ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।]

এক মুঠো প্রণয় পর্ব-২৩+২৪

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_২৩
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

মেহেরাজ জ্যোতির প্রতি ভালোবাসাটা অনুভব করেছিল জ্যোতি চলে যাওয়ার পর। সুদূর চট্টগ্রামে পাড়ি জমানোর পর জ্যোতির সাথে তার যোগাযোগ হয়েছে খুবই কম।বলা যায় বরাবর জ্যোতিই স্বল্প কথায় কিংবা ব্যস্ততা দেখিয়ে এড়িয়ে গিয়েছে।আর সরাসরি দেখাসাক্ষাৎ বলতে দুইবার জ্যোতির হোস্টেলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে স্বল্প আলাপ আর মেহুর জম্মদিনে একবার জ্যোতির আগমন এই বাসায়। ব্যস!এই তিনবছরে এইটুকুই যোগাযোগ হয়েছে।এই স্বল্প যোগাযোগে কিংবা ক্ষনিকের কথোপকোতনে কখনোই জ্যোতিকে বিশেষ করে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করা হয়ে উঠেনি।অন্তর্মুখী মানুষরা বোধ হয় নিজের অনুভূতি এভাবে মুখে ভালোবাসি বলে স্বীকার করতে পারেও না।তাদের ভালোবাসা প্রকাশ পায় তাদের যত্নে, তাদের সঙ্গে, তাদের আগলে রাখা মুহুর্তগুলোতে।এই কারণেই বোধহয় অন্তর্মুখী মানুষদের ভালোবাসা ব্যাতিক্রমী সুন্দর!মেহেরাজ উঠে বেলকনিতে যায়।বছর দুয়েক আগেই চাকরীতে জয়েন করেছিল সে। তবুও মাথায় ছিল চট্টগ্রাম শিফট করার৷ এই বাসায় সামান্তার উপস্থিতিতে হয়তো বা জ্যোতি সবসময়ই কষ্ট পুষবে মনে মনে।যন্ত্রনা পাবে কখনো সখনো দুইজনকে একসাথে দেখলে।অন্যদিকে সুদূর চট্টগ্রামে জ্যোতি একা।যাকে একা থাকতে দিবে না বলেই প্রথম অস্থিরতা টের পেয়েছিল তাকে এভাবে একা ছেড়ে দেওয়াটা অযৌক্তিক!তবুও বাস্তবতার কাছে হার মেনে, জ্যোতির পড়ালেখা-ভবিষ্যৎ এর কথা ভেবে একা ছেড়েছে।এতগুলো দিন অপেক্ষায় ছিল একটা সুযোগের। অবশেষে সুযোগটা মিলেও গেল। চট্টগ্রামে একটা কোম্পানিতে ভালো পদে চাকরি পেল। জয়েনিং ডেইট পরের মাসে।মেহেরাজ ততদিন অপেক্ষা করতে পারল না।মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল পরশুই যাবে একবার।জ্যোতির সাথে দেখা করে বাসা দেখে আসবে।তারপর পছন্দ মতো একটা বাসা ভাড়া নিয়ে সুন্দর সংসার গোঁছাবে। আর পাঁচটা স্বামী স্ত্রীর মতো ঘর বাঁধবে।মেহেরাজ হাসে আনমনে এসব ভেবে। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে জ্যোতির নাম্বারটা খুঁজে কল দিল মুহুর্তেই।জ্যোতিকে সে শেষ কল দিয়েছিল দিন পনেরো আগে।এর মাঝে না তো জ্যোতি কল দিয়েছে আর না তো মেহেরাজ।জ্যোতি অবশ্য তাকে নিজ থেকে কল দেয় খুবই কম। অথচ মেহুর সাথে জ্যোতির প্রত্যেকটা দিন কথা হয়। প্রত্যেকটা দিন ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প জুড়ে। যখন মেহুকে পায়না কলে, কিংবা কোন বিশেষ প্রয়োজন হয় তখনই মেহেরাজকে কল দেয় জ্যোতি।মেহেরাজ মনে মনে এসব ভেবে অভিযোগ পুষে।ঠিক তখনই ওপাশ থেকে কল রিসিভড করে এক মেয়েলি স্বর বলে উঠল,

” আসসালামুআলাইকুম মেহেরাজ ভাই।”

মেহেরাজ এবার মুচকি হাসল। বুকের ভেতর অদ্ভুত শীতল অনুভূতি হলো মেয়েটার কন্ঠ শুনে৷ বুকের বা পাশটা চেপে ধরে কিয়ৎক্ষন থম মেরে চুপ করে থাকল। তারপর গলা ঝেড়ে সালামের উত্তর দিল গম্ভীর কন্ঠে। বলল,

” কেমন আছিস?”

জ্যোতি উত্তরে মৃদু আওয়াজ তুলে বলে উঠল,

” আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?”

মেহেরাজ শুনল।দৃঢ় গলায় সরাসরি বলে উঠল,

” ভালো আছি, পরশু ফ্রি থাকবি?”

প্রশ্নটা শোনা মাত্রই উত্তর দিল না জ্যোতি।কিয়ৎক্ষন সময় নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ল,

” কেন?”

মেহেরাজের মুখভঙ্গি বদলাল না।গম্ভীর অথচ দৃঢ় গলায় বলে উঠল,

” দেখা করব তোর সাথে।”

আচমকা এমন এক প্রশ্নে চুপ থাকল জ্যোতি।শেষ তাদের দেখা হয়েছিল এগারো মাস আগে। বলা যায়, প্রায় এক বছর আগে তাও মেহুর জম্মদিন উপলক্ষ্যে সেই গিয়েছিল। এতগুলো দিন পর দেখা করার জন্য মেহেরাজের তরফ থেকে এই বাক্যটা শুনেই শরীর জুড়ে অদ্ভুত শিহরন হলো।অনুভব করল বুকের ভেতর তীব্র অস্থিরতা৷ জবাবে বলল,

” কখন? ”

মেহেরাজের মুখ টানটান হলো হঠাৎ। দাঁতে দাঁতে চেপে ত্যাড়া ভাবে উত্তর দিয়ে বলল,

” সারাদিন। কেন তুই কি ব্যস্ত থাকবি? ”

জ্যোতি স্পষ্ট কন্ঠে উত্তর দিল,

” আমার টিউশনি আছে, ক্লাস আছে মেহেরাজ ভাই। আপনি নির্দিষ্ট একটা সময় বললে সুবিধা হবে আমার।”

মেহেরাজ দমে গেল না জ্যোতির স্পষ্ট উত্তরে। ফের ভরাট কন্ঠে ত্যাড়াভাবেই উত্তর দিল,

” নির্দিষ্ট সময় না, অনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থাকব।সমস্যা আছে?আর ক্লাস, টিউশন পরশুদিনের জন্য বাদ। একদিন মিস দিলে তো সমস্যা হবে না। তাই না?”

ওপাশে জ্যোতি কথা গুলো শুনে থম মেরে চুপ হয়ে গেল। নির্দ্বিধায়, স্পষ্টভাবে মেহেরাজের এমন আদেশে তার ভালো লাগল কি খারাপ লাগল বুঝে উঠল না সে।তবে বুকের ভেতর কেমন কম্পন অনুভব হলো সেই মুহুর্তে। তবুও স্পষ্ট ভাবে বলল,

” না,সমস্যা হবে না। ”

মেহেরাজ এবার মুচকি হাসল। ঠোঁট চওড়া করে বলে উঠল,

” গুড!তাহলে পরশুদিনের জন্য তোর ক্লাস, টিউশন সব ক্যান্সেল। দেখা করছি পরশু। মনে থাকবে?”

” হ্যাঁ, থাকবে।”

মেহেরাজ আবারও হাসল।বলল,

” ওখানে গিয়ে কল করব তাহলে। ”

জ্যোতি বিনিময়ে উত্তর দিল না।চুপ থাকল কিয়ৎক্ষন।তারপর কি বুঝেই প্রশ্ন ছুড়ল,

” কোন দরকারে আসছেন এখানে? ”

মেহেরাজ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। হাত দিয়ে কপালে আসা চুল পেছনে ঠেলে দিয়ে বলল,

” হ্যাঁ, দরকার তো আছেই।তাই ভাবলাম তোর সাথেও দেখা করে আসি।কেন?”

জ্যোতি উত্তরে বলল,

” মেহু আপু বলেছিল আপনি নাকি কয়েকদিন আগেও এসেছিলেন এখানে কি প্রয়োজনে৷ তাই জিজ্ঞেস করলাম।”

মেহেরাজ ভ্রু কুঁচকাল। বলল,

” তুই কি মেহুর থেকে আমার খোঁজখবর নিস জ্যোতি?”

জ্যোতির স্পষ্ট উত্তর,

” নাহ তো।আমি আপনার সম্বন্ধে কিছুই জিজ্ঞেস করিনি।মেহু আপু নিজের থেকেই বলেছিল কথাটা।”

মেহেরাজ মুখ ভার করল এবার৷ চোখজোড়া বুঝে ভারী বুক হালকা করতে ছাড়ল দীর্ঘশ্বাস।শান্তস্বরে বলল,

” মেহুর সাথে এত কি কথা বলিস তাহলে প্রতিদিন ?”

জ্যোতি তাচ্ছিল্য নিয়ে বলল,

” আমার আর মেহু আপুর কথার বিষয়বস্তু কেবল আপনিই হবেন এমন কোথাও লিখা আছে নাকি মেহেরাজ ভাই?”

” নেই বলছিস?”

” না, নেই। সামান্তা আপু কেমন আছে? ”

মেহেরাজ চুপ থাকল। প্রত্যেকবার কল করলেই জ্যোতি আগ্রহ নিয়ে সামান্তাকে নিয়ে এই প্রশ্নটা করে তাকে।প্রশ্নটা করে যে চোখে আঙ্গুল দিয়ে তার আর সামান্তার সম্পর্কটাকেই জ্যোতি তুলে আনতে চায় তাও বুঝে মেহেরাজ। তবুও উত্তর দেয় না৷ এবারও ব্যাতিক্রম হলো না৷ গম্ভীর স্বরে উত্তর না দিয়েই বলল,

” রাখলাম। পরশু আসছি।”

কথাটুকু বলেই মেহেরাজ কল কাঁটল।মুখটা টানটান করে তাকিয়ে থাকল বেলকনির অপর প্রান্তে।

.

সন্ধ্যায় সাঈদ অফিস থেকে ফিরছিল রিক্সায় করে।কিছুটা দূরে রাস্তার একপাশে শুভ্রময়ী মেহু নামক মেয়েটিকে দেখেই হৃদয়ের ভেতর কম্পন অনুভূত হলো। রাতের আঁধার আর ল্যাম্পপোস্টের আলোতে গোলাপি রাঙ্গা জামা পরনে অদ্ভুত সুন্দর বোধ হচ্ছিল মেয়েটাকে।সাঈদ নিজেকে আর রিক্সায় বসিয়ে রাখতে পারল না। দ্রুত রিক্সা থামাতে বলে ভাড়া মিটিয়ে নিজেকে হাজির করল মেহুর সামনে।মেহু ভ্রু কুঁচকে তাকাল তার দিকে৷ চোখমুখে প্রশ্নময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই বলল,

” সাঈদ ভাইয়া আপনি?”

সাঈদ হাসল ঠোঁট চওড়া করে৷ ফিচেল গলায় বলল,

” তোমার আমার প্রেমের কতোটা টান দেখেছো? প্রেমের টানেই দুইজনের দেখা হয়ে গেল প্রিয়।তবুও তুমি এই প্রেমটা স্বীকার করতে নারাজ৷ কি এক যন্ত্রনা!”

শেষের কথাটা সাঈদ বুকের বা পাশে হাত রেখেই বলল।মেহু কপাল কুঁচকাল। বিরক্তি সমেত গলায় বলল,

” আপনাকে একবার বলেছি এসব ফ্লার্ট আমার সাথে করবেন না সাঈদ ভাইয়া৷ ”

সাঈদ থামল না। ফের ফিচেল গলায় বলে উঠল,

“ফ্লার্ট করব কেন? প্রেমিকার সাথে কেউ ফ্লার্ট করে নাকি? আমি একদমই ফ্লার্ট করছি না বিশ্বাস করো। ”

মেহু থমথমে গলায় উত্তর দিল,

” আমি আপনার প্রেমিকা নই। ”

” প্রেমিকা না? আচ্ছা ঠিকাছে। প্রেমিকা নাই হতে পারো, হবু বউ তো অবশ্যই। বলো?”

শেষ শব্দটা সাঈদ চোখ টিপেই বলল। মেহুর মুখভঙ্গি তাতে একটুও বদলাল না। আগের ন্যায় কপাল কুঁচকে বলল,

” আবোল তাবোল বকবেন না সাঈদ ভাইয়া।”

সাঈদ ভ্রু উঁচিয়ে বলল,

” আবোল তাবোল বকবো কেন? এই এক বছর আগে এত কষ্ট করে চাকরী জোগাড় করলাম। কেন করলাম?বিয়ে করার জন্যই তো। ”

” তো বিয়ে করতে নিষেধ করেছে কেউ আপনাকে?”

সাঈদ আপসোসের সুরে বলল,

” উহ, পাত্রী হিসেবে তো আমি তোমায় পছন্দ করেছি। কিন্তু তুমি তো নাকি পড়ালেখা শেষ না হওয়া অব্দি বিয়ে করবে না বলেছো।এখন তো পড়ালেখা কম্প্লিট?বিয়ে করবো চলো।দুদিন পর আবার তোমার ভাই তোমাকে চট্টগ্রাম নিয়ে চলে যাবে।তখন আমার কি হবে?”

মেহু এবার কিছুটা জোরেই বলল,

” সাঈদ ভাইয়া, আমি এসব মজা উপহাস পছন্দ করি না৷ আপনি আর যার সাথেই মজা করুন না কেন, আমার সাথে করবেন না।”

সাঈদ চুপ করল না।ঠোঁট বাকিয়ো হেসে বলল,

” আগে কিন্তু দিব্যি পছন্দ করতে এসব। চারবছর আগে একটা চুমুই সব পছন্দ অপছন্দ বদলে দিল? জাস্ট একটাই তো চুমু! ”

মেহু থমকাল।মনে পড়ে গেল সেই অনাকাঙ্খিত ঠোঁটের ছোঁয়া। অপ্রত্যাশিত মুহুর্ত!অপ্রত্যাশিত চুমু।মুহুর্তেই মুখচোখের ভঙ্গি পাল্টে গেল তার। চোখজোড়ায় ভর করল ঘৃণা আর টলমলে পানি। সেই টলমলের চোখের চাহনীতে একনজর তাকিয়েই সাঈদ আর দাঁড়াল না।বুক টানটান করে দ্রুত হেঁটে চলে গেল সেই স্থান ছেড়ে।

#চলবে….

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_২৪
লেখনীতেঃএকান্তিকা নাথ

এই তিনবছরে জ্যোতির পরিবর্তন খু্ব একটা চোখে পড়ে না।আগের মতোই সরাদিন সালোয়ার কামিজ পরনে মাথায় ঘোমটা টেনে রাখে। চুলগুলো কিঞ্চিৎ লম্বা হয়েছে।হাতের বাটন ফোনের বদলে স্মার্টফোন এসেছে। গ্রামীণ জীবনে অভ্যস্ত থাকা মেয়েটা শহুরে জীবনে মানিয়ে নিয়েছে।দাদীকে ছাড়া এক পাও না চলা মেয়েটা কোন সঙ্গবিহীনই জীবন গুঁছিয়ে নিয়েছে।জ্যোতি সেসব ভেবেই ছোট্ট শ্বাস ফেলল। হাতের স্মার্টফোনটা রেখে টেবিলের ড্রয়ার থেকে বাটন ফোনটা বের করল। ঠোঁটজোড়া আলতো করে সেই বাটন ফোনে ছুঁয়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

” তোমার দেওয়া শেষ স্মৃতি দাদী। সবসময় আগলে রাখব নিজের সাথে।মনে আছে দাদী?যখন গ্রাম ছেড়ে প্রথম মেহেরাজ ভাইদের বাসায় গেলাম। তখন এই ফোনে কত কত কথা হতো তোমার সাথে। কত কত বকা খেতাম তোমার থেকে। কত কত অপেক্ষা করতাম, তোমার সাথে কখন কথা হবে তার জন্য।আমি এখনও অপেক্ষা করি।ভাবি তুমি এই বাটন ফোনে কল করে খোঁজ নিবে।কথা বলবে।কিন্তু তুমি তো খোঁজ নাও না দাদী।আমাকে একবারও মনে করো না। দাদী?কত ভালো হতো যদি পরপারে চলে যাওয়ার পরও আমরা ফোনালাপ করতে পারতাম।আমি জানি, এইসব কিছুই সম্ভব না।তুমি কখনো এই ফোনে কল করে খোঁজ নিবে না।কখনো আর তোমার সাথে কথা হবে না।সবই জানি আমি। তবুও দেখো পাগলের মতো প্রলাপ বকছি। দাদী? মেহেরাজ ভাইদের বাসায় চলে যাওয়ার পরও কিন্তু তোমার সাথে অনেক দূরত্ব ছিল আমার। তবুও দিনশেষে কথা বলতাম।কিন্তু আজ দেখো।আজও তোমার আমার দূরত্ব বিস্তর।কিন্তু আজ আর আমাদের কথা হয় না দাদী। কোনদিন হবেও না৷ একটুও কথা হবে না দাদী। ”

কথাগুলো বিড়বিড় করে বলেই চোখ বুঝল জ্যোতি। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল দু ফোঁটা জল ও।মুহুর্তেই সে জল আবার মুঁছে নিল কেউ দেখে ফেলার ভয়ে।রুমে সে ব্যাতীত আরো একজন মেয়ে আছে।পাশাপাশি আরো একটা রুম আছে। দুইরুমের এই বাসাটায় সে সহ আরো তিনজন মেয়ে থাকে। হোস্টেল ছেড়ে এই বাসাটায় তারা চারজন প্রায় দেড় বছর আগেই উঠেছিল। মেহেরাজ এই বাসাটা চেনে মেহুর জম্মদিনে জ্যোতিকে নিতে এসেই।সেবারই প্রথম এই বাসার বাকি তিনজন মেয়ে জেনেছিল জ্যোতি বিবাহিত। জ্যোতি সে ভেবে সোজা হয়ে বসে ফের বাটন ফোনটা ড্রয়ারে রাখল।ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল রাত আটটা৷মুহুর্তেই মোবাইলের রিংটোন বাঁজল। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে দেখল মোবাইলের স্ক্রিনে “মেহেরাজ ভাই” নামটা। বুকের ভেতর অস্থিরতা অনুভব হলো। মনে মনে বলে উঠল,

” মেহেরাজ ভাইয়ের আসার কথা কাল।তবে আজ কল করল কেন?আজই চলে এসেছে?এখন কি নিচে নেমে দেখা করতে বলবে?”

মনের মধ্যে প্রশ্নগুলো উঁকি মারতেই তীব্র অস্থিরতা অনুভব হলো। অপ্রত্যাশিত কিংবা প্রত্যাশিত সাক্ষাৎয়ের পূর্বাভাসে শ্বাস ঘন হলো। পরমুহুর্তেই নিজেকে সামলে স্বাভাবিক করল।মোবাইলটা হাতে নিয়ে জানালার পাশে দাঁড়াল। মুহুর্তেই শীতল হাওয়া ছুঁয়ে দিয়ে গেল তাকে।কল রিসিভড করেই গলা ঝেড়ে সালাম দিয়ে বলল,

” আসসালামুআলাইকুম মেহেরাজ ভাই।”

মেহেরাজ সালামের উত্তর দিল। বিনিময়ে উদ্ভট এক প্রশ্ন করে বসল,

” তোর কাছে শাড়ি আছে জ্যোতি? ”

জ্যোতি অবাক হলো এমন প্রশ্নে।সঙ্গে সঙ্গে কপাল কুঁচকে গেল তার। এভাবে অপ্রত্যাশিতভাবে কল করে শাড়ি আছে কিনা জিজ্ঞেস করাটা অযৌক্তিক বোধ হলো। অস্ফুট স্বরে বলল,

” হ্ হু?”

মেহেরাজ বিরক্তি নিয়ে বলল,

“কানে শুনিস না?শাড়ি আছে তোর কাছে? ”

ফের একই প্রশ্নে জ্যোতির কপালের ভাজ মিলে গেল। শাড়ি তেমন একটা পরা হয়নি তার।বলা যায়, এক আধবার ছাড়া সে শাড়ি পরেইনি। এমনকি মেহেরাজের সাথে বিয়েটাও তার সালোয়ার কামিজ পরেই সম্পন্ন হয়েছিল। তবে মেহেরাজদের বাসায় থাকাকালীন সময়ে মেহেরাজ মেহুর সাহায্য নিয়ে তাকে কয়েকটা শাড়ি কিনে দিয়েছিল।এমনকি মেহেরাজ যে দুইবার এখানে এসে তার সাথে দেখা করে গিয়েছে সেই দুইবারও তার জন্য শাড়ি উপহার এনেছিল । সে শাড়িগুলো কখনো পরা না হলেও সযত্নে নিজের কাছেই রেখেছে।তবুও মেহেরাজের প্রশ্নটা অযৌক্তিক বোধ হলো!মেহেরাজ কি ভেবেছে তার দেওয়া শাড়িগুলো জ্যোতি ফেলে দিবে?জ্যোতি শ্বাস টেনে উত্তর দিল,

” আছে। আপনিই দিয়েছিলেন আগে। ”

মেহেরাজ ফের প্রশ্ন ছুড়লো

” ওসব রেখেছিস?”

” ফেলে দেওয়ার কথা ছিল নাকি মেহেরাজ ভাই?”

শান্ত গলায় উত্তর আসল,

” ফেলে দিলেও দিতে পারিস। আস্ত এক মানবকেই ফেলে দিয়েছিস শাড়ি তো ক্ষুদ্র তার তুলনায়।”

জ্যোতি তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসল। বলল,

” আস্ত মানব?আপনি?”

গম্ভীর স্বরে বলল মেহেরাজ,

” জানা নেই।”

জ্যোতি আবারও তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসল। বলল,

” আমি খুব তুচ্ছ মানবী মেহেরাজ ভাই।আপনার মতো মানবকে ফেলে দেওয়ার মতো যোগ্যতা আমার হয়ে উঠেনি। ”

মেহেরাজ অভিযোগের সুরে বলল,

“তোর জীবনে কোথাও রাখিস ও নি। ”

” রাখার কথা ছিল কি?”

” ছিল না বলছিস?”

জ্যোতি স্পষ্টগলায় উত্তর দিল,

” না, যে অন্যের তাকে আমার জীবনে রাখার কথা তো থাকতে পারে না মেহেরাজ ভাই। বাদ দিন সেসব, কিছু বলবেন?”

মেহেরাজ কিয়ৎক্ষন চুপ থাকল।তারপর বলল,

” রাতে রওনা দিচ্ছি।কাল সকালে কল করা মাত্রই দেখা করতে আসবি। দেরি করলে দেখা না করে চলে আসব।”

” আচ্ছা।”

মেহেরাজ হঠাৎ উদ্ভট প্রশ্ন ছুড়ল,

” ওখানে কি ছেলেমেয়ে বাসাভাড়া চাইলে ভাড়া দিবে বাসা?”

এমন উদ্ভট প্রশ্নে আবারও অবাক হলো জ্যোতি।ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়ে বলল,

“মানে?”

মেহেরাজ নির্বিকারভাবে উত্তর দিল,

” বাসা খুঁজব কাল এক বন্ধুর জন্য। এখন তোকে আর আমাকে দেখে প্রেমিক প্রেমিকা লাগলে কি বাসা ভাড়া দিবে?”

জ্যোতি বুঝল না কিছুই। বলল,

” বুঝলাম না।”

মেহেরাজ দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিল,

” গর্দভ, হাজব্যান্ড-ওয়াইফ ছাড়া এমনি দুটো ছেলেমেয়েকে কে বাসা ভাড়া দিবে?”

” বাসা তো আপনার বন্ধুর জন্য খুঁজবেন।”

“কিন্তু ও তো যাবে না।তুই যেহেতু ওখানে থাকিস এতবছর তোকে নিয়ে খুঁজব।”

জ্যোতি অবাক হয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,

” আমাকে নিয়ে?”

মেহেরাজ শান্তস্বরে আদেশের ন্যায় বলল,

” হ্যাঁ, আসার সময় শাড়ি পরে আসবি।একদম দেখতে যাতে পার্ফেক্ট বউ লাগে। তাহলে হাজব্যান্ড ওয়াইফ দেখামাত্রই বাড়িওয়ালা বাসাভাড়া দিয়ে দিবে।মনে করে শাড়ি পরেই আসবি। ”

শেষের কথাটুকু আদেশের সুরে বলেই মেহেরাজ কল কাঁটল।আর জ্যোতি চুপ থেকে মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকল।মেহেরাজের সবগুলো কথাই যেন তার বোধগম্য হলো না।বন্ধুর জন্য বাসা তার বন্ধু না খুুজে তাকেই কেন খুঁজতে হবে?তাও আবার বউ নিয়ে?কি আশ্চর্য!

.

অনেক রাত হওয়া স্বত্ত্বেও মেহু ঘুমাল না। মোবাইলের স্ক্রিনে স্পষ্ট ভাসছে সাঈদের ম্যাসেজ। এই পর্যন্ত বহুবার সাঈদ ম্যাসেজ দিয়েছে তাকে।তবে একবারও রিপ্লাই দেয়না সে। শুধু সিন করে রেখে দেয়। এবারও ব্যাতিক্রম হলো না। সাঈদের ম্যাসেজটা সিন করেই রেখে দিল সে।অথচ একটা সময় এই লোকটার একটা ম্যাসেজের জন্য ছটফট করত সে।এই লোকটার সাথে কথা বলার জন্য রাতভর অপেক্ষা করত।নাবিলার মতো তার কাছেও তখন মনে হতো, সাঈদ ভাই মানেই আগুন। সাঈদ ভাই মানেই অন্যকিছু। তখনকার মেহু বোকা ছিল।নরম মনের সরল মেয়ে ছিল। কিন্তু এই সহজ সরল মেয়েটা একটা সময় পর সাঈদ নামক মানুষটার থেকে মুখ সরিয়ে নিল কঠিনভাবে। কারণটা আধুনিকতার যুগে খুবই সামান্য হলেও মেহুর কাছে ছিল ঘোর অন্যায়।নাবিলা আর সামান্তার কাছে বরাবরই সে শুনেছিল সাঈদের অনেক মেয়ের সাথেই মেলামেশা।অনেক মেয়েকেই সে কথার জালে বশ করে ফেলতে পারে। সাঈদ অনেক মেয়েকে জড়িয়ে ধরেছে,চুমু খেয়েছে এসবও অজানা ছিল না। তবুও মেহু তখন মনেপ্রানে বিশ্বাস করত, সাঈদ এসব করতে পারে না। আড়ালে কোথাও না কোথাও সাঈদ নামক মানুষটার প্রতি ছিল তার ব্যাপক বিশ্বাস। কিন্তু একটা সময় পর সে বিশ্বাস ভেঙ্গে গেল। যেদিন নিজের চোখের সামনেই সাঈদকে দেখা গেল অন্য একটা মেয়েকে চুমু খেতে। অসহনীয় যন্ত্রনায় ছটফট করে সেদিন ঘরে এসে কান্না করেছিল। তার মাসখানেক পরই একদিন সাঈদের সম্মুখীন হয়ে বলে বসেছিল,

” সাঈদ ভাইয়া? আপনাকে আমি এতটা খারাপ ভাবিনি। আমি ভেবেছিলাম আপনি ফ্লার্ট পর্যন্তই আছেন, কিন্তু আপনি এতটা জঘন্য! এতটা! আমি ভাবিনি সাঈদ ভাইয়া।”

সাঈদ সেদিন হেসেছিল।আগে থেকেই এই মেয়ের আচার আচরণ দেখে বুঝে গিয়েছিল মেয়েটা তার প্রতি দুর্বল। শুধু দুর্বল নয়। চরম প্রকারে দুর্বল।সেদিন তা আরো পাকাপোক্তভাবে বুঝতে পেরেছিল তা। আলতো ঝুঁকে প্রশ্ন করেছিল,

” কি ভাবোনি?”

” আপনি সেদিন মেয়েটাকে লিপকিস… ”

বাকিটুকু না বলেই থেমে গিয়েছিল মেহু। চোখজোড়া বেয়ে টলমলে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। সাঈদ কিয়ৎক্ষন সে চোখের পানিতে তাকিয়েছিল। তারপর কি বুঝেই মেহুর কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়েছিল। অস্ফুট স্বরে বলেছিল সেদিন,

” সেদিনকার ছোঁয়ায় কামুক ছিলাম, সুযোগ পেয়ে লুফে নেওয়া ব্যাক্তি ছিলাম। আজকের ছোঁয়ায় কষ্ট আগলানোর যত্ন আছে।অশ্রু মোঁছার আবেদন আছে। অনুভ…”

সাঈদ বাকিটুকু সম্পন্ন করার সুযোগ সেদিন দেয়নি মেহু। তার আগেই মেহু ঠেলে দিয়োছিল তাকে।ছিঁটকে সরে গিয়েছিল অন্য প্রান্তে। দৃড় গলায় বলেছিল,

” আপনার সাহস কি করে হলো ঐ ঠোঁটে আমায় ছোঁয়ার? ছিঃ সাঈদ ভাইয়া!আপনি আমাকেও সুযোগ লুফে নেওয়ার বস্তু ভাবলে কি করে! ছিঃ!”

এতটুকুই! তারপর আর সাঈদের প্রতি দুর্বলতা প্রকাশ করেনি মেহু। সাঈদ নামক লোকটার দিকে সেদিন থেকেই তীব্র অবহেলা ঠেলে দিয়েছে সে।মেহু তপ্তশ্বাস ফেলল। ম্যাসেজটা আগের ন্যায় একবার দেখেই ঠেলে রাখল মোবাইল ফোনটা।

.

জ্যোতি ঘুম ছেড়ে উঠল সকাল সকালই।তখন ঘড়ির কাঁটায় সবে সাড়ে ছয়টা।জানালা দিয়ে বাইরের সুন্দর পরিবেশ পরখ করছিল।এর মাঝেই মোবাইলের রিংটোন বেঁজে উঠল। জ্যোতি সচেতন চোখে তাকাতেই ফের মেহেরাজের নাম দেখে চাহনী সরু করল। টের পেল তার বুক ঢিপঢিপ করছে।অবশেষে সে মুখ, সে মানুষ, সে চাহনীর সম্মুখীন হতে হবে ভাবতেই শরীরজুড়ে কম্পমান অনুভূতি হচ্ছে। তবুও সে অনুভূতির আভাস নিজের ভেতর আড়াল রেখে কল তুলল।ওপাশ থেকে মেহেরাজ ব্যস্ত কন্ঠে বলল,

” তোদের বিল্ডিংটার সামনেই দাঁড়ানো আছি।নেমে পড় তাড়াতাড়ি।”

জ্যোতি জানালা দিয়ে তৎক্ষনাৎ নিচে তাকাল। চোখে পড়ল লম্বা চওড়া সুদর্শন মেহেরাজকে। পরনে কালো শার্ট, হাতা গুলে গুঁটানো। একহাতে ফোন চেপে কানে ধরে দাঁড়ানো আছে একপাশে।জ্যোতি কয়েক পলক তাকালো স্থির ভাবে।তারপর ছোট শব্দে উত্তর দিল,

” আসছি।”

কথাটুকু বলেই কল কাঁটল। পা বাড়িয়ে একবার ভাবল, শাড়ি পরে যাওয়া উচিত কিনা।রুমমেটদের মধ্যে বাকি তিনজনকে প্রায়সই দেখেছে প্রেমিকের সাথে দেখা করতে শাড়ি পরে যায়।সেসব ভেবে তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসল। তাদের সম্পর্ক তো প্রেমিক প্রেমিকা জুটির মতো নয়। কিংবা স্বাভাবিক স্বামী স্ত্রীর মতোও নয় যে শাড়ি পরে যেতে হবে।জ্যোতি শাড়ি পরল না।মুখচোখ ধুঁয়ে ছাঁইরাঙ্গা একটা সালোয়ার কামিজ পরেই চুলে বেনুনি করল।তারপর মাথায় ঘোমটা টেনে মিনিট পাঁচের মধ্যে হাজির হলো মেহেরাজ সামনে। বহুদিন পর, বহুমাস পর মেহেরাজ নামক যুবকের সামনে নম্রভাবে দাঁড়াতেই মেহেরাজ গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন ছুড়ল,

“কাল রাতে কি বলেছিলাম আমি?”

” কি?”

মেহেরাজ চোয়াল শক্ত করল।মুখ টান টান করে বুকে হাত গুঁজে বলল,

” শাড়ি পরিসনি কেন?”

জ্যোতি স্পষ্ট কন্ঠে উত্তর দিল,

” শাড়ি পরতে অভ্যস্ত নই আমি মেহেরাজ ভাই। ”

মেহেরাজ ভ্র উঁচিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,

” তো?”

জ্যোতি শান্তস্বরে বলল,

” তো শাড়ি পরাটা কি উচিত হতো?”

ভ্রু উঁচিয়ে ফের প্রশ্ন করল মেহেরাজ,

” হতো না বলছিস? ”

স্পষ্ট উত্তর,

” না।”

” ওকে ফাইন।”

মেহেরাজ হাঁটা শুরু করল।পাশাপাশি হাঁটল জ্যোতিও।সুন্দর সকাল, শীতল বাতাস আর পাশাপাশি ভালোবাসার মানুষজোড়া।জ্যোতির মনে পড়ল কিশোরী বয়সের স্বপ্ন! সেসময়ে এমনই স্বপ্ন বুনত সে।এমনই এক শান্ত সকালে পাশাপাশি হাঁটার স্বপ্ন। এমনই এত শীতল বাতাস ময় পরিবরশে ভালোবাসার মানুষের সঙ্গ।

#চলবে…

এক মুঠো প্রণয় পর্ব-২১+২২

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_২১
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

মিনার ভাইয়ের অসম্পূর্ণ চিঠিটা হাতে রেখেই ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালাম মেহেরাজ ভাইয়ের দিকে।চাহনী তার তীক্ষ্ণ।ভ্রু জোড়াও কিঞ্চিৎ কুঁচকে রাখা। আমি কাগজটা উপরে তুলেই বললাম,

” একটা চিঠি।চিঠি তো ব্যাক্তিগত বিষয়াদি। তাই লুকিয়েই রাখছিলাম।”

আমার উত্তরে মেহেরাজ ভাইয়ের চাহনী বদলে গেল।ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,

” তোকে কে কে চিঠি লেখে?”

” তেমন কেউ নেই চিঠি লিখার।তবে এই চিঠিটা মিনার ভাই লিখেছেন। ”

মেহেরাজ ভাই আবার ভ্রু উঁচালেন।জিজ্ঞেস করলেন,

” তোকে?”

মৃদুস্বরে বললাম,

” হয়তো।”

মেহেরাজ ভাই এবার আর কোন আগ্রহ দেখালেন না চিঠিটা নিয়ে। পুনরায় কোন প্রশ্নও করলেন না।চোখমুখ থমথমে করে আবারও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।আমি সেদিক পানে তাকিয়ে ছোট্ট শ্বাস ফেললাম।মিনার ভাইয়ের লেখা অসম্পূর্ণ চিঠিটা ড্রয়ারের এককোণে তুলে রেখে নিশ্চুপে বসে থাকলাম নিজের ঘরে।হঠাৎ ঘরের বাইরে থেকে আব্বার গলা ভেসে আসল। দরজার কোণ থেকে একনজর তাকিয়ে দেখলাম মেহেরাজ ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন আব্বা। গলা ঝেড়ে বলে উঠলেন,

” রাজ,তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।শুনবা?”

মেহেরাজ ভাই শান্তভাবে তাকিয়ে হালকা হেসে বললেন,

” জ্বী চাচা,বলেন। ”

” বসে কথা বলি?চলো আম্মার ঘরেই বসি। কেউ তো নেই বোধহয়। ”

আব্বা বোধহয় জানতেন না আমি ঘরে আছি।ধুপধাপ পা ফেলে দাদীর রুমে গিয়ে বসলেন। মেহেরাজ ভাই কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলেন না।বোধ হয় ঘরে যে আমি আছি এটাই বলতে চেয়েছিলেন।পরমুহুর্তে আব্বার পিছু পিছু এসে দাদীর রুমে ডুকলেন। আব্বা চেয়ার দেখিয়ে বললেন,

” বসো।”

মেহেরাজ ভাই বসলেন চুপচাপ।আব্বা কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে এবার বললেন,

” রাজ? তুমি কি এখনো তোমার চাচাতো বোনকে ভালোবাসো?মানে সামান্তাকে কি এখনো ভালোবাসো?তোমার আর জ্যোতির বিয়েটা তোমাদের ইচ্ছাতে হয়নি বুঝলাম বিষয়টা। কিন্তু এতগুলো দিনেও কি তোমার আর জ্যোতির সম্পর্কটা কি স্বাভাবিক হয়নি?তুমি কি এখনও সামান্তাকে আঁকড়ে আছো?”

আব্বার কথায় মেহেরাজ ভাই মুখ তুলে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালেন।বললেন,

” মানে? ”

” তোমাদের মাঝে স্বামী স্ত্রী সম্পর্ক গড়ে উঠেছে কিনা তাই জিজ্ঞেস করছি।গড়ে উঠেছে?”

মেহেরাজ ভাই ভরাট গলায় উত্তর দিলেন,

” না, গড়ে উঠেনি।”

” সামান্তাকে আঁকড়ে আছো এখনো?”

” না।সামান্তা অতীত বলে সে ক্ষনেই মেনে নিয়েছিলাম যে ক্ষনে জ্যোতির সাথে বিয়েটা হয়েছিল।তবে এটা ঠিক, ভালোবাসা অতীত বর্তমান মানে।”

” এখনও ভালোবাসো ওরে?”

” জ্যোতিকে বিয়ে করেছি হিসেবে সামান্তাকে ভালোবাসাটা অযৌক্তিক।তবে সত্যি কথাটা হলো,সামান্তাকে অতীত হিসেবে মেনে নিয়েছি বাস্তবতার কারণে।আজও হয়তো আমার মনে সামান্তার জন্য জায়গাটার পরিবর্তন হয়নি।”

মেহেরাজ ভাইয়ের উত্তরটা এমনকিছুই হবে জানা ছিল। তবুও আমার হঠাৎ কষ্ট হলো। মিথ্যে মায়ায়, মিথ্যে যন্ত্রনায় বুক ভার হয়ে উঠল। বারকয়েক শ্বাস টেনে নিজের কষ্ট আড়াল করে চলে আসতে নিতেই আব্বার গলা শোনা গেল।গলাটা আগের থেকেও গম্ভীর! আব্বা বললেন,

” তোমাকে কিছু কথা বলি রাজ?কথাগুলো খুব গুরুত্বপূর্ন।বলা যায় আমার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ তোমায় শেয়ার করতে চাইছি। মন দিয়ে শুনবে। ”

মেহেরাজ ভাই বললেন,

” বলেন চাচা।”

আব্বা কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে গলা ঝেড়ে বলতে লাগলেন,

” জানো রাজ?জ্যোতির আম্মার সাথে আমার পরিচয় বিয়ের পর থেকে নয় বরং বিয়ের অনেক আগ থেকেই ছিল। জ্যোতির আম্মাকে তখন আমি প্রাইভেট পড়াতাম। মনে মনে ভালো লাগত তাকে। পছন্দও করতাম। আমি কিন্তু বিয়ের আগে থেকেই জানতাম যে জ্যোতির আম্মার সাথে চেয়ারম্যানের ছেলে রিয়াদের সম্পর্ক ছিল।তাও যে সে সম্পর্ক নয় সম্পর্কটা ছিল প্রেমের সম্পর্ক।তারা দুইজন আবার সমবয়সী ছিল।আমি ভেবেছিলাম ওটা তাদের সে বয়সের আবেগ হবে। অতোটা সিরিয়াস সম্পর্ক বোধহয় তাদের মাঝে নেই ধরে নিয়েছিলাম।সব জেনেবুঝেই আমি তাকে মন থেকে পছন্দ করতাম, ভালোবাসতে শুরু করলাম।একটা সময় পর স্কুলের চাকরিটাও পেয়ে গেলাম।জ্যোতির আম্মা তখন এসএসসি পাশ করেছে মাত্র।মনে মনে রাখা সে ভালো লাগা, ভালোবাসাটা এবার প্রকাশ করার মোক্ষম সুযোগ পেয়েই গেলাম আমি।এর আগে তাকে হারানোর ভয় হতো।সে অন্য কাউকে ভালোবাসে জেনেও নিরবে কষ্ট পেতাম। ভেবেছিলাম একবার আমার সাথে বিয়েটা হয়ে গেলে সে ভুলে যাবে তার প্রথম ভালোবাসাকে। মন থেকে উঠে যাবে তার জীবনের প্রথম পুরুষটি।তাকে এতটাই ভালোবাসতাম আমি। তাই চাকিরটা পাওয়া মাত্রই আম্মাকে দিয়ে তাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাই। তার মা বাবা প্রস্তাব পাওয়া মাত্রই রাজি হয়ে গেল।কিন্তু সে রাজি হলো না।তার প্রেমিকসমেত আমার কাছে এসে বিয়েটা ভাঙ্গার অনুরোধ করেছিল। আমি তখন তা পাত্তাই দিই নি।তাদের ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর জ্যোতির আম্মার সাথে আমার বিয়েটা হলো।সংসার হলো। একটা সময় পর জ্যোতি জম্মাল, মিথি জম্মাল। আমি ভেবেছিলাম ততগুলো দিনে সে তার জীবনের প্রথম পুরুষকে ভুলে গিয়েছে।ভুলে গিয়েছে তার জীবনের প্রথম অনুভূতিকে।কিন্তু, আমি ভুল ছিলাম রাজ।জ্যোতির আম্মা আমাকে ঠকিয়ে একটা সময় পর ঠিকই ঐ রিয়াদের সাথে পালিয়ে গেল।দুটো বাচ্চা মেয়ের কথাও একবারটি ভাবেনি সে।”

আব্বার ব্যাথাতুর গলায় কথাগুলো শুনে বুকের মধ্যে অস্থিরতা কাজ করল।আব্বা কি এখনও ততোটুকুই ভালোবাসেন আম্মাকে?এখনো ততোটুকুই অনুভূতি পুষে রেখেছেন হৃদয়ে?হ্যাঁ রেখেছেন।নয়তে আব্বার গলা এতটা ব্যাথাতুর বোধ হতো না।কন্ঠে সবসময় তেজ, ক্ষোভ প্রকাশ করা মানুষটার গলা এতটা নম্র,শান্ত শুনাত না কখনো। আমি আগ্রহ নিয়ে কান খাড়া করলাম আব্বার কন্ঠে আরো কিছু শোনার জন্য।আব্বা আবারও বলে উঠলেন,

” জ্যোতির আম্মাকে আমি এতটাই ভালোবাসতাম যে ওর ঠকানোটা আমি আজ ও মেনে নিতে পারি না।তাকে জড়িত সবকিছুকেই আমি ঘৃণা করি।তাকেও ঘৃণা করি।এমনকি জ্যোতি আর মিথির মধ্যে তার রক্ত আছে বলে জ্যোতি আর মিথিকেও ঘৃণা করে এসেছি। তবে এর আড়ালেও একটা সত্য আছে রাজ।প্রকাশ্যে আমি জ্যোতিকে ঠিক যতটুকু অবহেলা, যতটুকু ক্ষোভ দেখাই আড়ালে আমি ওকে সন্তান হিসেবে ততটুকুই ভালোবাসি।জ্যোতি আমার মেয়ে হওয়া স্বত্ত্বেও ওর সাথে আমার সম্পর্কটা বাকি দশ জন বাবা মেয়ের মতো কোনকালেই ছিল না। তবুও আমি ওর ভালে চাই সবসময়। সবসময়ই ওর মঙ্গল কামনা করি।তাই আমি চাই না, জ্যোতির জীবনের পরিণতিও আমার মতোই হোক।জ্যোতিকেও জীবনে কেউ আমার মতোই ক্রমশ ঠকিয়ে যাক চাই না আমি।যদি আগেই জানতাম তোমার প্রেম সম্বন্ধে তাহলে সেদিন কোনভাবেই অতোটা রাগ, অতোটা ক্ষোভ নিয়ে ওকে বিয়ে করতে জোর করতাম না আমি ।”

এবার কানে আসল মেহেরাজ ভাইয়ের গলা।গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,

” আমি কি জ্যোতিকে ঠকিয়ে যাচ্ছি?এটাই বলতে চাইছেন চাচা?”

আব্বা থমথমে গলায় বলে উঠলেন,

” ঠকাচ্ছো নাকি ঠকাচ্ছো না সেটা তো তুমিই খুব ভালো জানো রাজ। তবে এটুকু অনুরোধ জ্যোতিকে মিথ্যে মায়ায় বেঁধে পরে ঠকাবে না দয়া করে।বাবা হিসেবে এটুকু আমি চাইতে পারি বলো।আর যদি ঠকানোর উদ্দেশ্য থেকেই থাকে। তবে আমি বলব, এখনই এ সম্পর্কটা ভেঙ্গে দাও।একসঙ্গে দুইজনার বাস এক হৃদয়ে হয় না।”

মেহেরাজ ভাইয়ের উত্তর আসল একটু পর।বললেন,

” সম্পর্ক ভাঙ্গার হলে আমি ওকে আবার বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতাম না। শুরু থেকেই বিয়েটা মেনে চুপ করে থাকতাম না।এমনকি ধীরে ধীরে সামান্তার থেকে দূরে সরার ও চেষ্টা করতাম না চাচা।”

আব্বা তৎক্ষনাৎ প্রশ্ন ছুড়লেন,

” কিন্তু সামান্তাকে ভুলেও তো যাওনি? ”

মেহেরাজ ভাই পাল্টা উত্তরে বললেন,

” ভালোবাসা অতো সহজে ভুলা যায় না চাচা।আপনি পেরেছেন চাচীকে ভুলতে?এই যে বলেছেন চাচীকে আপনি ঘৃণা করেন।ঘৃণাটা আসলে ভালোবাসারই অন্য রূপ।আমরা কাউকে ভালো না বেসেই শুরু থেকে ঘৃণা করে আসতে পারি না।”

” কি বলতে চাইছো?”

” আপনার মনে যেমন চাচীর জন্য জায়গাটা সবসময় আছে। তেমনই সামান্তাকে জীবনে প্রথম ভালোবাসা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছি বলেই ওর জায়গাটা এখনও মন থেকে একেবারের জন্য মুঁছে দিতে ব্যর্থ আমি।”

মেহেরাজ ভাইয়ের এই কথাটা শোনার পরপরই চোখ বুঝে নিলাম।নিঃশ্বাস ঘন হলো। আবারো টের পেলাম আমি মেহেরাজ ভাইয়ের ঘাড়ে আস্ত এ বোঝা। আমার প্রতি মেহেরাজ ভাইয়ের সমস্ত যত্ন, সমস্ত শাসন শুধু এবং শুধুই দায়িত্ব।শুধু মাত্র একটা মানুষের দায়িত্ব হিসেবে তার ঘাড়ের উপর চেপে থাকাটা কি ভীষণ লজ্জ্বাজনক বিষয় তা এই মুহুর্তে খুব করে টের পেলাম।অপমানে জর্জরিত হলে হৃদয়। চাপা কষ্ট আর আশাহত মন নিয়ে এবার দরজা লাগালাম।খাটে শরীর এলিয়ে চোখ বুঝলাম দ্রুত। চোখের উপর ভেসে উঠল একের পর এক স্মৃতি।

.

মেহেরাজ ভাইের দেখা মিলল আবার রাতে। ফের বাসায় ফেরার উদ্দেশ্যে খাবার খাওয়ার পর কাপড় গুঁছাতে বলতেই আমি বলে উঠলাম,

” মেহেরাজ ভাই? আমি বরাবরই আপনার দায়িত্বে মুগ্ধ হয়ে এসেছি।সত্যিই আপনি একজন দায়িত্ববান পুরুষ। কিন্তু আমি চাইছি না যে দায়িত্বরূপী আমি আপনার জীবনে বাঁধা হয়ে দাঁড়াই। আমার জন্য দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কেন শুধু শুুধু নিজের ভালোবাসা বিসর্জন দিবেন?একটা সম্পর্কে তৃতীয় ব্যাক্তি হয়ে থাকাটা খুবই লজ্জ্বাজনক!আপনার উচিত আমাকে দয়া না করে আমাকে আমার মতো বাঁচতে দেওয়া।আমি আপনার দয়া চাই না।লোক দেখানো দায়িত্বও পালন করবেন না দয়া করে। এতে আপনি লোকের চোখে মহান হতে পারলেও আমি নিজের কাছে খুব ছোট হয়ে যাব।”

মেহেরাজ ভাই থমথমে গলায় বললেন,

” লোক দেখাচ্ছি আমি এসব করে?”

” তা ছাড়া আর কি হতে পারে? ”

” কিছুই নয়।ব্যাগ গুঁছিয়ে নে। কাল ফিরে যাব।”

আমি শ্বাস টানলাম। মৃদু আওয়াজে বললাম,

” একটা অনুরোধ রাখবেন মেহেরাজ ভাই? আমাকে আর দায়িত্বের বেড়াজালে জড়াবেন না প্লিজ।তবে হ্যাঁ, দায়িত্ব হোক বা দয়া যায় হোক না কেন। এই কয়টা দিন এভাবে আমার পাশে থাকার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমি আপনার এইটুকু সহানুভূতি কখনো ভুলব না।তবে নতুন করে আর সহানুভূতি দেখাবেন না দয়া করে।”

মেহেরাজ ভাই চোয়াল শক্ত করে লালাভ চোখে তাকালেন।গমগমে স্বরে বলে উঠলেন,

” তোর অনুরোধটা রাখতে পারছি না।কাল ফিরে যাচ্ছি এইটুকুই শেষ কথা। হোক সেটা দায়িত্বের জন্য বা সহানুভূতির জন্য। ”

” দায়িত্ব, সহানুভূতির থেকে একা থাকা ভালো নয়?”

” এখন তোকে একা ছেড়ে যাওয়াতে মন সায় দিচ্ছে না।যদি কোনদিন সত্যিই প্রয়োজন পড়ে তোকে একা ছাড়ার তখন বাঁধা দিব না।তুই তখন বাঁচতে পারবি নিজের মতো।”

মেহেরাজ ভাই কথাগুলো বলেই বিছানায় সটান শুঁয়ে পড়লেন। আমিও আর দাঁড়ালাম না।দাদীর ঘরে এসে খাটে শরীর এলিয়ে দিলাম।চোখজোড়া মেলে উপরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম নির্বিকারভাবে।কেন জানি না মেহেরাজ ভাইয়ের বলা শেষ কথাগুলো একেবারেই পছন্দ হলো না আমার।

.

সেদিন মেহেরাজ ভাইয়ের মতই অবেশেষে জিতে গেল। আমাকে ফের ফিরে আসতে হলো মেহেরাজ ভাইদের বাসায়। তবে এই এক মাসেও মেহেরাজ ভাই যথেষ্ট যত্ন নিয়েছেন।যথেষ্ট আগলে রেখেছেন অভিভাবকের ন্যায়। আপন মানুষের ন্যায় শাসনও করেছেন।কখনও বা আবার রক্তলাল চোখ দেখিয়ে রাগও দেখিয়েছেন।আমি এখন এসবে অভ্যস্ত!বলা যায় মেহেরাজ ভাই মানুষটাই অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।তবুও নাকে অভ্যাসরূপে মেনে নিতে মন সায় দেয় না।ফের যদি অভ্যাস ভেঙ্গে যায়?ফের যদি মানুষ হারিয়ে যায়?ছাদের এককোণে দাঁড়িয়ে কথাগুলো ভেবেই ফের পা বাড়ালাম বাসার উদ্দেশ্যে।সিঁড়ি বেয়ে বাসায় যেতেই চোখে পড়ল নাফিসার কাঁটা হাত।ফিনিক রক্ত বের হচ্ছে। মেহেরাজ ভাই সেই কাঁটা হাত হাতে নিয়েই রাগ নিয়ে বললেন,

” চুরি ধরতে কে বলেছিল তোমায়?আর ধরবে চুরি?এতটুকু মেয়ের চুরি দিয়ে কি কাজ থাকে?এখন কাঁটল তো হাত? ”

নাফিসা ঠোঁট উল্টে রেখেছে।যেন একটু হলেই কেঁদে দিবে।মেহু আপু পাশে বসেই মুচকি হাসছে।নাফিসা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,

” আর ধরব না রাজ ভাইয়া।”

মেহেরাজ ভাই আবারো গম্ভীর গলায় বললেন,

” যদি বেশি কেঁটে যেত কি হতো তাহলে?”

মেহেরাজ ভাইয়ের কথাটা শুনেই মনে পড়ল আমার কাঁটা হাতে মেহেরাজ ভাইয়ের সেই ঔষুধ লাগানোর দৃশ্য।মাঝে মাঝেই এভাবেই সতর্ক করে শাসন করেন মেহেরাজ ভাই। সেই শাসনকেই অস্পষ্ট ভাবে অন্য কিছু ভেবে নিয়েছিলাম আমি।তবে এই যত্নটা মেহেরাজ ভাই সবাইকেই করে থাকেন। যেমন নাফিসাকেও শাসন করলেন।আমি মনে মনে তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসলাম।ভালোবাসা না পাওয়া মানুষ গুলে আসলেই অদ্ভুত। অল্প একটু ভালোবাসা পেলেই ভেবে নেয় অনেককিছু। যেমন আমি!ভাবনা গুলো ভেঙ্গেছিল সেদিন আব্বার প্রশ্নের বিনিময়ে মেহেরাজ ভাইয়ের উত্তরে।আজকাল আর এসব যত্ন, শাসন বিশেষ বোধ করি না।এসবে মেহেরাজ ভাইয়ের অন্য অনুভূতি জড়িত আছে এমনটাও ভাবি না।আমি এগিয়ে গেলাম আরো কয়েক পা। নাফিসা নরম গলায় বলল,

” আর ধরব না তো। ”

মেহেরাজ ভাই শুনলেন।তারপর হাতে ঔষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,

” আর কখনো ধরবে না চুরি।মনে থাকবে?”

নাফিসা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়াল।তারপর ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল বাসা থেকে।আমি একনজর তাকিয়ে নিজের রুমে গিয়েই ড্রয়ার খুললাম।মেহেরাজ ভাই এই কয়েকদিন চাকরীর পরীক্ষার জন্য অনেক ব্যস্ত ছিলেন।তাই উনাকে সামনাসামনি পাওয়া হয় নি বলেই আব্বার পাঠানো হাত খরচের টাকাটা আর দেওয়া হয়নি।এর আগেরবার যখন একমাস থেকেছিলাম এই বাসায় তখন হাতখরচের টাকাটা দেওয়ার কথা মাথায়ই আসেনি৷ তবে এবার মাথায় এসেছে।এবার টাকাটা না দিতে পারলে আস্ত এক বোঝা বোধ হবে নিজেকে।নিজের কাছে নিজেরই অস্বস্তি লাগবে এভাবে এই বাসায় পড়ে থাকতে। হাত বাড়িয়ে আব্বার পাঠানো টাকাটা নিয়ে দ্রুত মেহেরাজ ভাইয়ের সামনে দাঁড়ালাম।ততক্ষনে মেহু আপু নিজের রুমে চলে গিয়েছে।আমি টাকাটা এগিয়ে দিয়ে ইতস্থত করে বললাম,

” মেহেরাজ ভাই? আব্বা প্রতিমাসেই আমার জন্য কিছু টাকা দেয়। সেই ছোটকাল থেকেই।তখন টাকাটা দাদীকে দিতাম কারণ আমার দায়িত্ব পুরোপুরি ভাবে দাদীর উপরই ছিল।এখন এই টাকাটা আপনাকে দেওয়া উচিত।কারণ আমার খাওয়া, পড়ানো সবটা তো আপনিই দেখছেন।তাই টাকাটা নিন।”

মেহেরাজ ভাই শান্ত হয়ে সবটা শুনলেন।ভ্রু জোড়া কুঁচকে শান্তস্বরে বললেন,

” তুই আমায় টাকা দেখাচ্ছিস?”

মৃদু আওয়াজে বললাম,

” না।তবে এমনভাবে আপনাদের ঘাড়ের উপর বসে খাওয়াতে আমার নিজেরই খারাপ লাগবে মেহেরাজ ভাই।দায়িত্ব পালন করছেন ভালো।তবে এতোটা বোঝা হিসেবে অন্যের ঘাড়ে পরে থাকাটা আমাকে স্বস্তি দিবে না।আব্বা টাকাটা আমার থাকা খাওয়ার জন্যই দিতেন।থাকা, খাওয়াটা যেহেতু আপনাদের এখানেই হচ্ছে তাই ভাবলাম আপনাকেই টাকাটা দেওয়া উচিত
এডমিশনের জন্য তো আবার নাবিলার সাথে কোচিংয়েও ভর্তি করিয়েছেন।সেখানেও অনেক টাকা লেগেছে জানি।আপনি আবার এমন ভাববেন না যে, আমি আপনাকে ছোট করছি মেহেরাজ ভাই।”

মেহেরাজ ভাই মুখ চোখ কঠিন করলেন।চোয়াল শক্ত করে বললেন,

” আমি বেকার বলে তুই আমায় এখন এসব বলছিস?তোর কি মনে হচ্ছে বেকার বলে বউ খাওয়ানোর ক্ষমতা নেই আমার?এখন তোর বাবার টাকা নিতে হবে আমায়?শোন, বাসা ভাড়া আর টিউশনি মিলিয়ে যথেষ্ট চলে আমাদের।তোর থেকে টাকা নেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না আমার।”

কথাটা থমথমে মুখে বলে দিয়েই মেহেরাজ ভাই চলে গেলেন। আমি স্থির দাঁড়িয়ে থাকলাম।ভুল কিছু করেছি?উনি স্বামী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ঠিক আছে কিন্তু দায়িত্ব দিয়ে কি স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক হয়? এভাবে দায়িত্ব হিসেবে থাকাটাও যে ব্যাপক অস্বস্তির!

#চলবে…

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_২২
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

সেদিনকার মিনার ভাইয়ের চিঠিটা মেহেরাজ ভাই দেখতে পেল আরো মাস কয়েক পরে।ততদিনে ভর্তি পরীক্ষা শেষ হলো। ভাগ্যক্রমে ভালো সাবজেক্ট সমেত নাম এল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে । অবশেষে ভর্তি হতে হলে সুদূর চট্টগ্রামে। এতদিনের বসবাস ছেড়ে হুট করেই নতুন শহরে পাড়ি জমানো, নতুন পরিবেশে মানানো নিয়ে অল্প সংকোচ থাকলেও তখন আমার চট্টগ্রামে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে সেদিনই ছাদের কার্নিশ ঘেষে মেহেরাজ ভাই আর সামান্তা আপুকে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখলাম আমি।শুধু যে দাঁড়ানো ছিল এমন নয়, মেহেরাজ ভাইয়ের হাতটাও সামান্তা আপুর হাতের মুঠোয় ছিল।প্রেমিক প্রেমিকা হিসেবে বিষয়টা বোধহয় তাদের ক্ষেত্রে অতি স্বাভাবিক! কিন্তু এই স্বাভাবিক বিষয়টাই আমি স্থির দাঁড়িয়ে থেকে দেখতে পারলাম না বেশিক্ষন।এক দৌড়ে আবারও সিঁড়ি বেয়ে নিচে এলাম তৎক্ষনাৎ।উনাদের মাঝে কি কথা হলো, পরে আর উনাদের মাঝে কি ঘটল কিছুই আর দেখার ইচ্ছা জাগল না।চোখে উপর ভাসল কেবল সামান্তা আপুর হাতের মুঠোয় থাকা মেহেরাজ ভাইের হাতটা। কেন জানি না, আমার মন মেহেরাজ ভাইয়ের থেকে এরূপ আচরণ আশা করেনি। মেনেও নিতে পারল না এরূপ আচরণ।মনে মনে ভাবলাম, চট্টগ্রামে চলে যাওয়াটাই একমাত্র মুক্তি!একটা সম্পর্কে তৃতীয় ব্যাক্তি হিসেবে ঝুলে থাকার অপমান থেকে মুক্তি মিলবে অন্তত।এসব ভাবতে ভাবতেই দুপুর কেঁটে সন্ধ্যে হলো। আমি বসার ঘরে মেহু আপুর সাথে বসে কথা বলছিলাম।সেসময় মেহেরাজ ভাই উপস্থিত হলেন তার টানটান বদন নিয়ে। খেয়াল করলাম উনার মুখচোখ লাল হয়ে আছেন।রেগে থাকলে যেমনটা হয় সাধারণত। তবে উনার রাগের কারণটা বুঝে উঠলাম না আমি।মেহেরাজ ভাই বুকে হাত গুঁজে বলে উঠলেন আমায়,

” জ্যোতি? উঠ।তোর সাথে কিছু কথা আছে আমার।”

আমি অবাক হয়ে তাকালাম।আমার সাথে বিশেষভাবে কথাবলার মতো কিছুই নেই উনার।তবুও বললাম,

” বলুন মেহেরাজ ভাই। ”

মেহেরাজ ভাই কপাল কুঁচকালেন।ভ্রু উঁচিয়ে রাগ নিয়ে বলে উঠলেন,

” উঠতে বললাম না?”

আমি উঠলাম।ছোট্ট শ্বাস ছেড়ে বললাম,

” উঠেছি।কি বলবেন?”

মেহেরাজ ভাই গম্ভীর গলায় বললেন,

” আমার পিছু পিছু আয়।”

এই বলে মেহেরাজ ভাই নিজের ঘরের দিকে হাঁটা ধরলেন।পিছু পিছু গেলাম আমিও।মেহেরাজ ভাই নিজের ঘরে গিয়ে চেয়ার টেনে বসলেন এবার।চোখমুখ গম্ভীর করে প্রশ্ন ছুড়লেন,

” তুই কি মিনারকে ভালোবাসিস? তোদের মাঝে কি সম্পর্ক আছে জ্যোতি?”

আকস্মিক এমন একটা প্রশ্ন শুনে হতবিহ্বল হয়ে তাকালাম আমি। মেহেরাজ ভাই ফের তাড়া দেখিয়ে বলে উঠলেন দাঁতে দাঁত চেপে,

” কিছু জিজ্ঞেস করেছি আমি তোকে।উত্তর না দিয়ে ওভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ”

আমি তাকালাম স্থির হয়ে।বললাম,

” প্রশ্নটা আবার করুন।”

মেহেরাজ ভাই সরু চাহনী তাকালেন।হাতজোড়া বুকে গুঁজে নিয়ে মুখ টানটান করলেন।বলে উঠলেন গম্ভীর স্বরে,

” তোর আর মিনারের রিলেশন চলছে?নাকি আগে রিলেশন ছিল?”

মেহেরাজ ভাইয়ের থেকে পুনরায় এরূপ প্রশ্ন শুনে মনে মনে রাগ অনুভব হলো। বিয়ের পর সামান্তা আপুকে প্রকাশ্যে বহুবার মেহেরাজ ভাইকে জড়িয়ে ধরতে দেখেছি। আমি তো কখনো মেহেরাজ ভাইয়ের বিষয়ে এভাবে প্রশ্ন ছুড়িনি। এই যে, আজও এতগুলো মাস পরও মেহেরাজ ভাই ছাদে দাঁড়িযে সামান্তা আপুর হাত ধরে গল্প করছিলেন। একবারও তো একটা প্রশ্ন করিনি। তাহলে উনি কেন এভাবে ইঙ্গিত করে প্রশ্ন করছেন?মিনার ভাইকে ছোটবেলা থেকে সরল নজরে দেখে এসেছি। ভাই হিসেবে আপন ভেবেছি৷ এখও ভাবি।কিন্তু তাই বলে মিনার ভাইকে প্রেমিক হিসেবে ভালোবাসব এই প্রশ্নটা উদ্ভট নয়?কাঠ কাঠ গলায় উত্তর দিলাম,

” যদি রিলেশন থেকে থাকেও, কি করবেন?”

মেহেরাজ ভাই ভ্রু উঁচালেন।বললেন,

“তার মানে কি বলতে চাইছিস? রিলেশন আছে তোদের?”

দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিলাম,

” ধরে নিন আছে।কি করবেন?”

মেহেরাজ ভাই এবার রাগে মাথা চেপে ধরলেন নিজের।চোখজোড়া বুঝে ঘনঘন শ্বাস ফেললেন দ্রুত। পরমুহুর্তেই একদম শান্ত, শীতল, লালাভ চাহনীতে তাকালেন।আমি তাকিয়ে অবাক হলাম। কি ভীষণ লাল দেখাচ্ছে উনার চোখজোড়া।চেহারা শান্ত দেখালেও জ্বলন্ত রাগের উপস্থিতি স্পষ্ট! উনি শান্ত কন্ঠে একরাশ ক্রোধ নিয়ে বলে উঠলেন,

” খু’ন করব।প্রথমে তোকে তারপর তোর মিনার ভাইকে। আমি তোর আব্বার মতো অতোটা সহজ সরল নই যে স্ত্রীকে চোখের সামনে অন্য একটা ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়াতে দেখব চুপচাপ।”

মেহেরাজ ভাইয়ের এই কথাটাতে স্পষ্ট অথবা স্পষ্টভাবে আম্মার সাথে আমার তুলনা পেয়েই তিক্ত এক অনুভূতি হলো।আম্মার চলে যাওয়া নিয়ে সারাজীবন সবার থেকে কথা শুনে আসলেও মেহেরাজ ভাই ও যে আম্মার মতোই আমাকে চরিত্রহীন ভেবে কথা বলবেন ভাবিনি আমি।বারকয়েক নিঃশ্বাস ফেলে মনের ভেতর জড়ো হওয়া সকল রাগ জেদ নিয়ে বলে উঠলাম এবার,

” আমি কখনো আপনার মতো বিয়ে করে স্বামীর দায়িত্ব পালন করে সবার সামনে মহান সেজে প্রেমিকাকে বুকে জড়িয়ে রাখিনি স্ত্রীর সামনে। আমি কখনো প্রেমিকার হাত ধরে ছাদে গল্পও করিনি মেহেরাজ ভাই।আপনি আমায় চরিত্রহীন বললেন কোন কারণে?আর শুনুন, আমার সাথে কিন্তু মিনার ভাইয়ের তেমন কোন নোংরা সম্পর্ক নেই যেমনটা আম্মার ছিল ঐ লোকটার সাথে।একটা বিষয়ে না জেনেশুনে কথা বলবেন না।”

আকস্মিক আমার রাগ নিয়ে বলা কথাগুলোতে বোধ হয় মেহেরাজ ভাই কিঞ্চিৎ অবাক হলেন।চেহারায় রাগ রাগ ভাবটা কিঞ্চিৎ মিইয়ে গেল।কিয়ৎক্ষন আমার দিকে স্থির চেয়ে থেকে শীতল কন্ঠে বললেন,

“ভালোবাসা কখনো নোংরা হয় না।আমি তোদের সম্পর্কটাকে নোংরা বলিনি।আর হ্যাঁ, আমি কিন্তু তোকে চরিত্রহীন ও বলিনি জ্যোতি।”

তাচ্ছিল্য নিয়ে বলে উঠলাম,

” চরিত্রবান ও তো বলেননি। হ্যাঁ, আমার আম্মা অন্য পুরুষের সাথে পালিয়ে গেছেন আমায় রেখে।এই নিয়ে আমি সবসময়ই কথা শুনে এসেছি।সবসময়ই অবহেলা পেয়েছি সবার থেকে।তার মানে এই নয় যে আমি আমার আম্মার মতোই চরিত্রহীন হবো।আপনি কিন্তু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমার আম্মার তুলনাটাই এনেছেন মেহেরাজ ভাই।”

মেহেরাজ ভাই উত্তরে কিছু বললেন না এবার।কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে হাতের দুই আঙ্গুলে কপালে নাড়াতে লাগলেন।তারপর হঠাৎ বললেন,

” মিনার তোকে চিঠি কেন লিখে? তোকেও অনেকবার ওর সাথে কথা বলতে দেখেছি আমি।আবার সাঈদের কথানুযায়ী তুই বইতে লাভ এঁকে তার মধ্যে এম লিখেছিলি।মিনারের নামের প্রথম অক্ষরও এম। এই সবকিছু যা বুঝাচ্ছে, আর আমি এতদিন যা ভেবে এসেছি তা সম্পূর্ণ ভিন্ন!সত্যিটা জানতে চাইছি কেবল৷ মিনার তোকে ভালোবাসে তা জানি, তুইও কি ভালোবাসিস ওকে?তোদের মাঝে সম্পর্ক..”

মেহরাজ ভাই দ্বিতীয়বার সেই একই প্রশ্নটা ছুড়ার আগেই উত্তর দিলাম,

” মিনার ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক সে ছোটবেলা থেকে। আমি তাকে তখন থেকেই ভীষণ আপন ভাবতাম,এবং এখনও ভাবি।সবসময় বড় ভাইয়ের মতোই দেখে এসেছি তাকে।আর কিছু?”

মেহেরাজ ভাই হাসলেন এবার।উঠে দাঁড়িয়ে ঠোঁট চওড়া করে বললেন,

“গুড!এটাই জানতে চেয়েছিলাম।সমস্যা হলো, মিনার তোকে বোনের মতো দেখে না। এই চিঠিতে তা স্পষ্ট লেখা আছে।”

মেহেরাজ ভাই চিঠিটা এগিয়ে ধরলেন। আমি সরু চাহনীতে তাকিয়ে থেকে দেখলাম মিনার ভাইয়ের সে চিঠিটাই এটা। সে মাস কয়েক আগেই একবার পড়েছিলাম। তারপর যে কোথায় রেখেছিলাম নিজেরও খেয়াল ছিল না। মেহেরাজ ভাই কি করে ফেলেন চিঠিটা তা নিয়ে ভেবেই বললাম,

” চিঠিটা আপনার কাছে কি করে মেহেরাজ ভাই?”

মেহেরাজ ভাই ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন ছুড়লেন,

” কেন?চিঠি ব্যাক্তিগত বিষয়াদি বলে দেখা উচিত হয়নি?”

শক্ত গলায় বল উঠলাম আমি,

” যদি বলি উচিত হয়নি?”

মেহেরাজ ভাই অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন,

” আমি মনে করছি উচিত হয়েছে।আর কিছু?”

আমি বিনিময়ে উত্তর না দিয়ে নির্লিপ্ত ভাবে চেয়ে তাকলাম। মেহেরাজ ভাই নরম গলায় আবার বললেন,

“তোর ব্যাক্তিগত চিঠি পড়ে নেওয়ার জন্য রাগ করেছিস? নাকি কষ্ট পেয়েছিস? কোনটা?”

আমি উত্তর দিলাম না।কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে বললাম,

” আমি কিন্তু কখনো আপনার বিষয়ে প্রশ্ন করিনি মেহেরাজ ভাই। আপনার কিংবা সামান্তা আপুকে এতকাল চোখের সামনে দেখেও কোন নোংরা ইঙ্গিত করিনি।”

কথাটা বলেই আর দাঁড়ানোর ইচ্ছা হলো না আমার।দ্রুত চলে এলাম নিজের ঘরে।

.

একে একে ডায়েরীর প্রত্যেকটা পাতা পড়েই তপ্তশ্বাস ফেলল মেহেরাজ। ডায়েরীর পরের পৃষ্ঠাগুলো খালি।এই পর্যন্ত লিখে হয়তো ডায়েরীটাতে আর লেখা হয়ে উঠেনি জ্যোতির। মেহেরাজ গাঢ় শ্বাস ফেলে আরো একবার কালচে রাঙ্গা ডায়েরীর পৃষ্ঠাগুলো উল্টিয়ে বিছানার একপাশে রাখল।ঘড়ির কাঁটায় তাকিয়ে দেখল সকাল দশটা।পুরো একটা নির্ঘুম রাত কেঁটে গেল তার। শুধুমাত্র একটা ডায়েরী পড়তে গিয়ে। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার সে জ্যোতির ব্যাক্তিগত ডায়েরী পড়েছে।প্রথমবার পড়েছিল যখন জ্যোতি কিশোরী!প্রথম প্রণয়ের আবেগ, অনুভূতি সম্পুর্ণটাই সেবার সে ডায়েরীতে রাঙ্গিয়ে তুলেছিল সে। দ্বিতীয় বার পড়ল আজ।যে ডায়েরীটাতে তার আর জ্যোতির আকস্মিক বিয়ে হতে প্রায় বছর খানেকর গল্প সাঁজানো।তবে সে গল্পটায় তাদের দুইজনের প্রণয় নেই, ভালোবাসা নেই।মেহেরাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। বেলকনিতে গিয়ে গ্রিল ধরে ভাবতে লাগল এক মায়াবী প্রতিচ্ছবিকে।ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা টানা, মুখে তীব্র রাগ কিংব জেদ আর চোখজোড়ার ধারালো স্পষ্ট চাহনী।মুহুর্তেই বুকের ভেতর ছিনছিন করে উঠল কেমন। প্রতিচ্ছবিটা অবশ্য আর কারো নয়।জ্যোতিরই প্রতিচ্ছবি।যার প্রতি শুরু থেকেই কেবল সম্পূর্ণটা দিয়ে দায়িত্ব পালনে আগ্রহী ছিল মেহেরাজ৷ দায়িত্ব কর্তব্য পালন করতে করতেই একটা সময় এল, যখন মেয়েটা পৃথিবীতে সম্পূর্ণ নিঃস হয়ে গেল!সম্পূর্ণ একা হয়ে পাথরের মতো জমে গেল।মেয়েটার সবথেকে কাছের মানুষ, সবথেকে প্রিয় মানুষ যে সে হলো মেয়েটার দাদী। সে দাদীকেই মেয়েটা চিরকালের জন্য হারিয়ে ফেলল।মেহেরাজ সেইবার দায়িত্ব কর্তব্য ভুলে প্রথমবার অনুভব করল মেয়েটার প্রতি তার মায়া জম্মেছে। দাদী চলে যাওয়ার সে মুহুর্তে মেয়েটাকে ওভাবে নিস্তেজ আর কঠোর দেখেই বুকের ভেতর চাপা কষ্ট অনুভব করল সে।অস্থিরতায় ছটফট করল নিরবে।সে অস্থিরতা আড়ালে রেখেই সেদিন থেকে মেয়েটাকে আগলে নিতে চেষ্টা চালাল সে। মেয়েটার আপন মানুষ হয়ে উঠার চেষ্টা করল প্রাণপনভাবে। মেয়েটাকে সবসময়ের জন্য সঙ্গ দিয়ে পাশে থাকার চেষ্টা করল।সে যে সূচনা হলো মায়ায় জড়ানোর তার আর সমাপ্তি খুঁজে পাওয়া গেল না৷ ক্রমশ সে মায়ার জালে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেল। ছিন্নভিন্ন হলো মেয়েটার ধারালো ব্যাক্তিত্বে। ধারালো চাহনী, স্পষ্ট জবাব আর একরাশ জেদ!সেসব ভেবেই আনমনে হাসল মেহেরাজ। বুকের বা পশে হাত চেপে মৃদু স্বরে বলল,

” এতকাল ধরে এক তিক্ত অনুভুতি বয়ে নিয়ে যাচ্ছি নিজের ভেতর।আজ সে অনুভূতির তিক্ততা দশগুণ হলো তোর ডায়েরী পড়ে।এতকাল তুই আমায় স্বার্থপর বললেও আজ আমি বলব, তুই স্বার্থপর জ্যোতি।অপর পাশের লোকটাকে বুঝার চেষ্টাই করিস নি কখনো।”

#চলবে

এক মুঠো প্রণয় পর্ব-১৯+২০

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_১৯
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

রাত অনেক হলো। আমি তখনও সেভাবেই বসা থাকলাম মাটিতে। মেহু আপু নিজেদের বাড়িতে না গিয়ে আমার পাশেই বসে থাকল এতটা সময়৷মাথায় আলতোভাবে হাত বুলিয়ে কত কিছু বলে চলেছে অনেক্ষন ধরে।আমি শুনছি ঠিক সেসব কথা, তবে মস্তিষ্কে বোধগম্য হচ্ছে না তার কিছুই৷ একদৃষ্টিতে নির্বিকার ভাবে তাকিয়ে থাকলাম একইভাবে। এভাবেই বোধ হয় অনেকটা সময় গেল। হঠাৎ মেহেরাজ ভাই এলেন।মেহু আপু বলে উঠলেন সঙ্গে সঙ্গে,

” দেখো না ভাইয়া, রাত একটা বাঁজতে চলল।ও একইভাবেই মাটিতে বসে আছে।কিছু খাচ্ছে না। এমনকি ঘুমাচ্ছেও না।”

মেহেরাজ ভাই কিয়ৎক্ষন চুপ থাকলেন।তারপর হাঁটু গেড়ে আমার সামনে বসলেন। গম্ভীর স্বরে মুখ টানটান করে বলে উঠলেন,

” এভাবে না খেয়ে, না ঘুমিয়ে কাটালে দাদী ফিরে আসবে না জ্যোতি।”

আমি জানি দাদী ফিরে আসবে না।না খেলেও বকবে না আগের মতো।না ঘুমালেও আগের মতো শাসন করে তাড়াতাড়ি ঘুমোতে বলবে না।দাদী আর কিছুই করবেন না আমার সাথে।কখনোই ফিরে আসবে না আমার কাছে।জ্যোতি বলে ডাকও দিবে না।সবটা জেনেই স্পষ্ট কন্ঠে বললাম,

” জানি আমি।”

মেহেরাজ ভাই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।নিভু নিভু ক্লান্তিমাখা চাহনিতে কিছুটা সময় তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে।পরমুহুর্তেই চোখমুখ টানটান করে দৃঢ় গলায় বলে উঠলেন,

” জানলে না খেয়ে, না ঘুমিয়ে এভাবে মূর্তির মতো বসে আছিস কেন?কাল পরীক্ষা আছে তোর, ভুলে গিয়েছিস? পরীক্ষা দিতে গিয়ে ওখানে অসুস্থ হয়ে গেলে কি করে পরীক্ষা দিবি?এভাবে চললে তো শরীর অসুস্থ হবেই এটুকু সেন্স নেই তোর?”

আমি চোখ তুলে তাকালাম। মেহেরাজ ভাই ভ্রু উঁচিয়ে আবার প্রশ্নময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন।আমি নড়েচড়ে বসলাম। উত্তরে বললাম,

” অসুস্থ হবো না আমি।এটুকু মানানোর অভ্যাস আছে আমার মেহেরাজ ভাই।”

মেহেরাজ ভাই সে উত্তরে দমে গেলেন না।বরং দ্বিগুণ রাগ দেখিয়ে দৃঢ় গলায় বললেন,

” তুই বাচ্চা না জ্যোতি।আমি তোকে যথেষ্ট ম্যাচিউরড ভাবতাম এতকাল।অথচ ইমম্যাচিউরডদের মতে বিহেভিয়ার করছিস। এভাবে কাটালে অসুস্থ হবি না তো সুস্থ থাকবি?এখন রাত সাড়ে বারোটা।সকাল থেকে কিছু খাস নি।ঘুমাস নি।এসবের পরও অসুস্থ হবি না?”

স্থিরভাবে একইরকম বসে থেকে দৃঢ় গলায় উত্তর দিলাম,

” সমস্যা হবে না।”

মেহেরাজ ভাই উঠে দাঁড়ালেন।পাঞ্জাবির হাতা গুঁটিয়ে বুক টানটান করে দাঁড়ালেন আমার সম্মুখেই।দাম্ভিক গলায় বললেন,

“সকালে কি বলেছিলি? নিজের খেয়াল নিজে রাখতে পারিস। এই নমুনা নিজের খেয়াল নিজে রাখার?”

আমি কপাল কুঁচকে তাকালাম।কিঞ্চিৎ বিরক্তিবোধও কাজ করল। জীবনে কিছু কিছু সময় আসে যখন কারোর সঙ্গই আর ভালো লাগে না।কাউকেই আর জবাবদিহি করতে মন চায় না।কারোরই সম্মুখীন হতে মন চায় না। শুধু একটা বিষয় মনে হয় তখন, একা থাকা শান্তির।চরম শান্তির!এই মুহুর্তটাও বোধহয় তেমনই। মৃদু গলায় বললাম,

” আপনি শুধু শুধু কথা বাড়াচ্ছেন মেহেরাজ ভাই।এসবে আমার কিছুই হবে না।আমার শরীর অতোটা আহ্লাদী নয় যে একটু থেকে একটু হলেই অসুস্থ হয়ে মূর্ছা যাব।”

মেহু আপু মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।আহ্লাদী গলায় বলে উঠলেন,

” আর জেদ করিস না বোন।খেয়ে নে প্লিজ।আমি মানলাম তুই অসুস্থ হবি না। তবুও সাবধানতা বজায় রাখলে ক্ষতি কি?এটা তো যে সে পরীক্ষা নয়।বোর্ড পরীক্ষা জ্যোতি।নিজের খেয়াল রাখা উচিত নয়? নিজের অসুস্থতার জন্য পরীক্ষায় খারাপ করলে তখন তো তোর নিজেরই ক্ষতি হবে।বুঝার চেষ্টা কর প্লিজ।”

আমার প্রতি সবার উদ্বিগ্নতা দেখে তাচ্ছিল্য জমল মনের ভেতর।কত কত চিন্তা আমার জন্য।কতজন এসে বুঝিয়ে যাচ্ছে।অথচ এই আমিটার এই মুহুর্তে বাঁচার ইচ্ছেটাই নেই।ক্রমশ টের পেলাম আমার বেঁচে থাকার ইচ্ছে ক্ষীণ হয়ে আসছে।মেহেরাজ ভাই বোধ হয় ঠিকই বলেছিলেন, মানুষ একা বেঁচে থাকতে পারে না।আসলে পারে না।আপন মানুষের অভাবে ছটফট করে।এই মুহুর্তে আমিও ছটফট করছি।বোধ হলো, আমার আপন মানুষরা সবাই আমায় একে একে ছেড়ে গিয়েছে।সবাই!আর কেউ নেই অবশিষ্ট।মিনার ভাইও আজকাল বদলে গিয়েছে বেশ।আগের মতো আর সে মিনার ভাই নেই। আজকাল নিয়ম করে আমায় এড়িয়েও চলে।তবে আপন মানুষ আর কে?আপন বলতে বাকি যারা ছিল সবাই পৃথিবী ছেড়ে, আমায় ছেড়ে, সবাইকেই ছেড়ে চলে গিয়েছে।বাকিটা জীবন আমি এভাবে একা একা বাঁচতে পারব?আপনমানুষ বিহীন একটা পুরো জীবন! ভাবতেই শ্বাসরুদধ হয়ে আসল।অসহনীয় বোধ হলো দাদীর মৃত্যুযন্ত্রনা। দাদীর এমনটা করা উচিত হয়নি।আমাকে ছেড়ে যাওয়া উচিত হয়নি।দাদী কেন করল এমনটা?কেন?সবটা জেনে আমায় এভাবে মাঝপথে ছেড়ে গেল কেন দাদী?

ভাবনা ছেড়ে বেরিয়েই অস্ফুট স্বরে উত্তর দিলাম,

” রেখেছি তো মেহু আপু।”

মেহু আপু ফের নরম গলায় প্রশ্ন করলেন,

” কিভাবে রেখেছিস?সকাল থেকে তো কিছু মুখে তুলিসনি।”

” খাবার খাওয়াকেই কি কেবল খেয়াল রাখা বলে মেহু আপু? ”

মেহু আপু বোধ হয় হতাশ হলেন।মলিন মুখে একবার আমার দিকে তো একবার মেহেরাজ ভাইয়ের দিকে তাকালেন।তৎক্ষনাৎ মেহেরাজ ভাই পকেটে হাত গুঁজে বলে উঠলেন,

” মেহু, ওকে বল খেয়ে তারপর ঘুমাতে।খাবার পাঠাতে বলছি। খাবার খেয়ে যাতে ঘুম দেয়।”

মেহেরাজ ভাইয়ের কন্ঠে রাগের আভাস স্পষ্ট।আমি চোখ তুলে তাকালাম। বললাম,

” লাভ নেই মেহেরাজ ভাই।খাব না আমি।ঘুমও হবে না।আপনি চলে যান। রাত তো অনেক হয়েছে।আমার জন্য না ভেবে ঘুমিয়ে পড়ুন।”

মেহেরাজ ভাইয়ের রাগটা বোধহয় এবার কিঞ্চিৎ বাড়ল।চোখমুখ শক্ত করে আমার দিকে তাকালেন সেই রাগের আভাস দেখাতেই।শীতল কন্ঠে রাগ মিশিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

” এভাবে কয়দিন অনশন করবি?কয়দিন চলবে এভাবে?পরে অসুস্থ হলে?”

প্রশ্নগুলো শুনে ছোটশ্বাস ফেললাম।স্পষ্ট কন্ঠে বললাম,

” চিন্তা নেই মেহেরাজ ভাই। আমি অসুস্থ হয়ে কাউকে ঝামেলায় ফেলব না।সে মানসিকতা নিয়ে আহার -নিদ্রা বাদ দিয়েছি এমনটা ভাববেন না।না খাওয়া, না ঘুমানো এগুলো কিন্তু কোনটা আমার ইচ্ছাকৃত নয়। ক্ষিধে নেই তাই খাচ্ছি না, ঘুম পাচ্ছে না তাই ঘুমাচ্ছি না।আমার ক্ষিধে পেলে খেয়ে নিব, ঘুম পেলে ঘুমিয়ে যাব।”

মেহেরাজ ভাই বোধ হয় এবার চরমভাবে রেগে গেলেন।ধুপধাপ পা ফেলে আবারও সকালের মতোই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।মেহু আপু সেদিক পানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।মলিন মুখে বসে থাকল পুরোটা সময় আমার পাশেই।

.

একটা নির্ঘুম রাত কাঁটল। প্রতিদিনের মতো আজ সকালে দাদী ঘুম ছেড়ে উঠে আমাকে ডাকল না। প্রতিদিনের মতো দাদীর সকাল বেলার চা খাওয়ার অভ্যাসের তাড়া দেখিয়ে চা বসাতে বলল না।ছোটবেলা থেকে ” দাদীর ঘর ” বলে জেনে আসা পরিচিত ঘরটায় আজ দাদী নেই।কোথাও নেই!আমার বুক ভার হয়ে আসল। নিঃশ্বাস আটকে আসল।বসা ছেড়ে উঠে মেহু আপুর দিকে তাকাতেই দেখলাম হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছেন।খারাপ লাগল।আমার জন্য শুধু শুধু উনি সারারাত এখানে বসে থাকলেন।পাশে বসে আগলে রাখলেন পুরোটা সময়। মৃদু গলায় ডাক দিলাম মেহু আপুকে,

” আপু?উঠে বিছানায় ঘুমাও। ঘাড়ে ব্যাথা করবে।”

মেহু আপু চোখ মেলে চাইল।ঘুমঘুম কন্ঠে বলল,

” সকাল হয়ে গিয়েছে জ্যোতি?”

উত্তরে বললাম,

” হ্যাঁ।তুমি উঠে বিছানায় ঘুমাও। ”

কথাটা বলেই বের হলাম ঘর ছেড়ে।শান্ত দৃষ্টিতে চারপাশের নিরব পরিবেশ একবার খেয়াল করেই পুকুর পাড়ে গেলাম।পুকুর পাড়ের রাস্তার ওপাশে কিছুটা দূরে কবরস্থানে চোখে পড়ল সদ্য মাটি চাপা কবরটা। চোখ টলমল করল আমার।অস্ফুট স্বরে বলে উঠলাম,

” কেন করলে এমনটা দাদী?আমায় ছেড়ে যাওয়াটা কি খুব জরুরী ছিল?তোমাকে ছাড়া কি করে কাটাব পুরো একটা জীবন? কি করে?”

কথাগুলো বলতে বলতেই চোখ বেয়ে গাল গড়িয়ে পড়ল নোনতা পানি। নিচের ঠোঁট কামড়ে সেই নোনতা পানির স্রোত থামানোর চেষ্টা চালালাম।মৃদু আওয়াজে বললাম,

” এটা তুমি ঠিক করলে না দাদী।একদমই না।তুমি খুব স্বার্থপর!খুব বেশি স্বার্থপর তুমি।তোমরা সবাই স্বার্থপর। তুমি, মিথি সবাই।আমার কথা একবারও ভাবোনি। একবারও না।আমি কি করে থাকব? কাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচব আমি?আমি যে পারছি না এ কষ্…”

বাকিটুকু বলা হলো না আমার।তার আগেই শুকনো পাতার মড়মড়ে আওয়াজে কারোর পায়ের আওয়াজ শুনলাম।মুহুর্তেই চোখের পানি মুঁছে নিলাম ওড়নার কোণায়।চোখমুখ আগের ন্যায় স্বাভাবিক রেখে স্থির হয়ে দাঁড়ালাম।কানে আসল পুরুষালি কন্ঠ,

” নানীর জন্য কষ্ট হচ্ছে না তোর জ্যোতি?”

মিনার ভাইয়ের কন্ঠ শুনেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম।বিধ্বস্ত চাহনী। চুল গুলো অগোছাল।চোখমুখ শুকনো। আমি একনজর তাকিয়েই উত্তরে বললাম,

” তোমার কি মনে হয় মিনার ভাই?”

মিনার ভাই বলে উঠলেন,

” আমি জানি তোর অসহনীয় কষ্ট হচ্ছে।হয়তো বা নিঃশ্বাসও বন্ধ হয়ে আসছে ক্ষনে ক্ষনে।তবুও এতটা স্বাভাবিক হয়ে কেন আছিস?গুমড়ে না মরে কষ্টগুলো প্রকাশ করছিস না কেন?”

হৃদয়ে তাচ্ছিল্য উপচে পড়ল মিনার ভাইয়ের কথা শুনে।সবার কি আর কষ্ট প্রকাশ করার অধিকার থাকে?কষ্ট পেলেই কি আর সবাইকে সামলানোর জন্য আপন মানুষ থাকে? থাকে না তো।যাদের কষ্ট সামলানোর মানুষ থাকে না তাদেরকে নিজের কষ্ট নিজেকেই সামলাতরে হয়।নিজের ব্যাথা নিজেকেই হজম করতে হয়। কাঁতরাতে হয় নিঃশব্দে। ক্রমশ গুঁড়ে মরতে হয়।তুও কষ্ট প্রকাশ করা যায় না।বলা যা না হৃদয়ের গোপণ ব্যাথার গল্প।উত্তরে বললাম,

” স্বাভাবিক না থেকে অন্যদের মতো বিলাপ ধরে কান্না করলে তুমি সামলাবে মিনার ভাই?দুঃখ মনে করে ঘন্টায় ঘন্টায় মূর্ছা গেলে তুমি আগলে নিবে? যাদের দুঃখ সামলানোর কেউ থাকে না তাদেরকে দুঃখ চাপিয়ে রাখতে হয় মিনার ভাই।ব্যাথা লুকাতে হয় হৃদয়ের গহীনে।”

মিনার ভাই বুকে হাত গুঁজে বললেন,

” আমার সামনে তো তুই আগে এভাবে সব লুকিয়ে রাখতি না জ্যোতি।বদলে গেছিস অনেকটা।”

তাচ্ছিল্য নিয়ে বললাম,

” তুমিও বদলে গেছো অনেক মিনার ভাই। আগে আমায় এড়িয়ে চলতে না।এখন তো এড়িয়ে চলো। ঠিকঠাক কথাও বলো না।”

মিনার ভাই কিয়ৎক্ষন চুপ থাকলেন।তারপর কি বুঝেই বলে উঠলেন,

” ওসবের পেছনে কারণ আছে কিছু।”

মৃদু গলা জিজ্ঞেস করলাম আমি,

” কি কারণ?”

” থাক না সেসব কারণ তোর অজানা।জানলে হয়তো ভুল বুঝবি। ”

আমি আর কথা বাড়ালাম না।পুকুর পাড়ের একপাশটায় গিয়ে বসলাম।তাকালাম পুকুরের স্থির হালকা সুবজ রাঙ্গা পানিগুলোর দিকে।ততক্ষনে মিনার ভাইও অপর পাশে আমার সামনাসামনি হয়ে বসলেন।নিশ্চুপ থেকে বোধ হয় দাদীর কথাই মনে করছিল আমার মতো।আমি কিছুটা সময় বসে থেকে উঠে দাঁড়ালাম।পুকুর পাড় ছেড়ে হেঁটে আসতেই চোখে পড়ল উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা মেহেরাজ ভাইয়ের উপর।চোখমুখ টানটান করে এদিকটায় তাকিয়েই দাঁড়িয়ে ছিলেন উনি।কেমন যেন থমথমে চাহনী।অস্পষ্ট রাগ রাগ ভাব।আমি তাকানো মাত্রই উঠোন ছেড়ে হেঁটে অন্যদিকে চলে গেলেন দ্রুত।সে চলে যাওয়াতে কি ছিল জানা নেই। তবে দৃষ্টিতে ভেসে উঠল মেহেরাজ ভাইয়ের মুখচোখে রাগ রাগ ভাব।বোধ হয় রাতে না খাওয়ার বিষয়টা নিয়েই এই রাগ। আমি সে রাগ আমলে নিলাম না।মৃদু পায়ে হেঁটে বাড়িতে যেতে লাগলাম আবারও।

#চলবে…

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_২০
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

কাটল আরো দুই সপ্তাহ। এই কয়েকটাদিন প্রত্যেকটা রাত আমার নির্ঘুমই কাটল। অসহনীয় যন্ত্রনায় তপ্ত হৃদয় যেন দগ্ধ হয়ে আছে।জীবন্ত প্রাণ এখন আর জীবন্ত বোধ হয় না আমার কাছে।নির্জীব!নিজেকে কোন এক নির্জীব, অনুভূতিহীন, যন্ত্রমানবী বোধ হয়।যার ব্যাথা নেই, দুঃখ নেই, কষ্ট নেই। আছে শুধু নিঃশ্বাস!যে নিঃশ্বাস বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আমি বাদবাকি সকল মানুষের কাছে তাদের মতোই জীবন্ত মানুষ, জীবন্ত প্রাণী!আসলেই কি আমি জীবন্ত?মনের ভেতর উদ্ভট প্রশ্নটা জেগে উঠতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম।টিনের জানালাটা মেলে দিতেই চোখে পড়ল কি ভীষণ ঘনকালো অন্ধকার।ওপাশ থেকে ঝি ঝি পোকার আওয়াজও ভেসে আসছে।সেদিক পানে তাকিয়েই আমি নিশ্চুপে কাঁদলাম। এই সময়টা আমার কান্না করার উপযুক্ত সময়।আশপাশে কেউ নেই, কোন কোলহল নেই, কোন প্রশ্নও নেই।নেই দুঃখ প্রকাশ পাওয়ার ভয়ও।আমি নিশ্চিন্তে কাঁদতে পারি এ সময়টায়।কিয়ৎক্ষন সেভাবেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে অশ্রুতে চোখ ভিজালাম।পরমুহুর্তেই দরজার আওয়াজ হলো। এই সময়টায় অন্যদিন সাধারণত মেহেরাজ ভাই খাবার নিয়ে আসেন।কিন্তু যতদূর জানা উনি আজ আসবেন না।

মেহেরাজ ভাই বা মেহু আপু কেউই আর শহরে ফিরেননি। মেহু আপু সারাদিন এখানে কাঁটালেও রাতে উনাদের বাড়িতে ঘুমানোর বিষয়টা অনেক কষ্টেই বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম। কিন্তু মেহেরাজ ভাইকে বুঝানো দায়!এই দুই সপ্তাহে প্রত্যেকটা দিন নিজেদের বাড়িতে রান্না করে রোজ রোজ খাবার দিয়ে যাওয়া হতে নির্ঘুম রাত্রিতে আমায় সঙ্গ দেওয়া কোনটাই বাদ দেননি। মাঝে মাঝে অবাক হই মেহেরাজ ভাইয়ের অস্পষ্ট যত্নে অথবা দায়িত্বে৷ মাঝে মাঝে ভাবি, আসলেই কি সবটা কেবল মেহেরাজ ভাইয়ের দায়িত্ব? দায়িত্বের জন্য কেউ এতটুকু করে?আবার দায়িত্বের থেকে বেশিকিছু ভাবার ও সম্ভাবনা নেই। হতে পারে সহানুভূতি। কিংবা হতে পারে শুধুই দায়িত্ব। ছোটশ্বাস ফেলে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম।অন্যদিন খাবার নিয়ে এই সময়টায় মেহেরাজ ভাই আসলেও আজ তার সম্ভাবনা ক্ষীণ।দুপুরে মেহেরাজ ভাইয়ের পরিবর্তে আজ মেহু আপু খাবার নিয়ে এসেছিলেন। বলেছিলেন মেহেরাজ ভাই আজ সকালেই বাসায় ফিরে গিয়েছেন।মেহেরাজ ভাই নেই দেখে রান্নাটাও নাকি চাচীই করেছিলেন আজ।তাই মনে মনে ধরেই নিয়েছিলাম মেহেরাজ ভাই আজ রাতে আসবেন না খাবার নিয়ে।চোখের জল মুঁছে ধীর পায়ে গিয়ে দরজা খুললাম।সঙ্গে সঙ্গে মেহেরাজ ভাইকে দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হলাম।সকালে বাসায় গিয়ে আবার আজই গ্রামে ফিরে এসেছেন?অস্ফুট স্বরে প্রশ্ন ছুড়লাম,

” আপনি?”

মেহেরাজ ভাই টিফিন বক্স হাতে করে ঘরে ডুকলেন।একপাশে কাঠের চেয়ার টেনে বসে বললেন,

” কেন? অন্য কেউ আসার কথা ছিল? ”

আমি ছোট ছোট চোখে তাকালাম।মৃদু গলায় বললাম,

” না, আপনার তো আজ এই সময়ে আসার কথা ছিল না। ”

মেহেরাজ ভাই ভ্রু কুঁচকালেন।বললেন,

” প্রতিদিনই তো এই সময়ে আসি।আজ কথা নয় কেন তাহলে?”

” বাসায় ফিরে গিয়েছেন বলেছিল মেহু আপু। তাই আপনাকে এই সময়ে আশা করিনি।”

মেহেরাজ ভাই মাথা নাড়ালেন। গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন,

” এত দেরিতে দরজা খুললি কেন?”

আমি মুহুর্তেই একটা মিথ্যে বলে বসলাম,

” ঘুমাচ্ছিলাম।খেয়াল করিনি তাই। ”

মেহেরাজ ভাই এবারও মাথা নাড়ালেন।জিজ্ঞেস করলেন,

” কাল শেষ না পরীক্ষা?”

” হ্যাঁ।”

” দুপুরে খেয়েছিস?”

” খেয়েছি। মেহু আপু খাবার দিয়ে গিয়েছিল।”

মেহেরাজ ভাই হাতের টিফিন বক্সটা এগিয়ে ধরলেন আমার দিকে।বলে উঠলেন,

” গুড। এখনও খেয়ে নে দ্রুত।”

আমি এগিয়ে নিলাম না উনার হাতের টিফিন বক্সটা।কিয়ৎক্ষন উনার দিকে স্থির তাকিয়ে থাকলাম।উনার চোখেমুখে ক্লান্তির চাপ স্পষ্ট। চুলের একাংশ কপালে ঝুঁকে আছে।স্থির চাহনীতে আরো কিছুক্ষন সেভাবে তাকিয়ে থাকাতেই মেহেরাজ ভাই ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্নময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন।আকস্মিক আমি সেই দৃষ্টির বিনিময়ে বলে উঠলাম,

” আমার জন্য এতকিছু কেন করছেন মেহেরাজ ভাই?এই যে আজ বাসায় গেলেন, আবার ফিরে এলেন।এতোটা জার্নি করে ফিরে আসার তো দরকার ছিল না আজ।আমার জন্য রোজ রোজ কষ্ট করে খাবার রান্না করে খাবার আনার ও তো দরকার নেই৷ এত কষ্ট করে নিজেদের বাসা ছেড়ে এখানে থাকারও কি দরকার আছে?নেই।তবুও বাসায় না ফিরে আমার জন্য আপনারা ভাইবোন দুইজনই গ্রামে পড়ে আছেন, রান্না করে দিয়ে যাচ্ছেন, জোর করে খাওয়াচ্ছেন।কেন করছেন এতসব?”

মেহেরাজ ভাই গম্ভীর চাহনীতে চাইলেন। বললেন,

” তুই হলে কি কি করতি?পাশে না থেকে ছেড়ে চলে যেতি এমন একটা সময়ে?”

শান্ত গলায় উত্তর দিলাম,

” জানা নেই।”

মেহেরাজ ভাই গলা ঝাড়লেন।একদম শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলতে লাগলেন,

” হিসেব মতো তোর আর আমার বিয়েটা হয়েছে।চাই বা না চাই আমরা একটা বন্ধনে জড়িয়েছিলাম জ্যোতি।এটা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতই হোক,তবুও দিনশেষে এটা সত্য।একজন স্বামী কখনো তার স্ত্রীকে এমন দুর্দশায় ছেড়ে যায় না।স্ত্রীর পাশে থাকাটা স্বামীর দায়িত্ব, রাইট?দ্বিতীয়ত স্বামী না হলেও, একজন মানুষ হিসেবে হলেও আমার মনে হয়েছে এটা আমার দায়িত্ব জ্যোতি।একজন মানুষ হিসেবেই হোক কিংবা একজন স্বামী হিসেবেই হোক, তোকে এই মুুহুর্তে এভাবে একা রেখে ছেড়ে গেলে নিজেকে মনুষ্যত্বহীন বোধ হবে।আমি অতোটা মনুষ্যত্বহীন নই।”

মেহেরাজ ভাইয়ের উত্তরে আবারও দায়িত্ব শব্দটাই উঠে আসল দৃঢ় ভাবে৷ উত্তরটা হয়তো আমার জানাই ছিল।তবুও কেন জানি না মেনে নিতে পারলাম না।ভেতরে ভেতরে কষ্ট অনুভব করলাম।এতগুলো দিনের যত্ন, শাসনে একটু হলেও বোধহয় আমার মন অন্য ধারণা পুষে নিয়েছিল। যদিও মস্তিষ্ক জানত এই ধারণা মিথ্যে। তবুও কেন জানি না আমি সহ্য করতে পারলাম না কথাগুলো।থম মেরে চুপ করে থাকলাম আরো কিছুক্ষন।তারপর স্বাভাবিক হয়ে মেহেরাজ ভাইয়ের হাত থেকে টিফিন বক্সটা নিয়ে স্পষ্ট কন্ঠে বললাম,

” একটা অনুরোধ রাখবেন মেহেরাজ ভাই?দায়িত্বের জন্য আমায় মায়া দেখাবেন না। আমার জীবনে বহুবার মায়া ভেঙ্গেছে। বহুবার আমি মানুষ হারিয়েছি।বহুবার আমি একা অনুভব করেছি। তাই এখন আর মানুষের মায়া জড়াতে চাই না।আসলে মানুষের মায়ায় জড়াতে ভয় পাই।ভয় পাই কাউকে অভ্যাসে পরিণত করতে।এই ধরুন, দাদী।দাদী তো আমার সকাল হতে রাত হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেকটা মুহুর্তের সঙ্গী ছিল, অভ্যাস ছিল।দিনশেষে সেই অভ্যাসও ভেঙ্গেছে।তাই আজকাল নতুন করে কাউকে পাশে পেলে ভয় হয়। তাই অনুরোধটা রাখবেন দয়া করে। মিথ্যে মায়ায় জড়াতে চাই না। পুনরায় এই মায়া ভাঙ্গার কষ্ট কিংবা মানুষ হারানোর কষ্ট সইতে চাওয়াটা আমার জন্য বেমানান।আমি সে কষ্টটা পুনরায় চাই না।কখনোই না।আপনি বরং ফিরে যান। ”

মেহেরাজ ভাই শুনলেন সবগুলো কথা।তারপর শান্তস্বরে বললেন,

” তোর পরীক্ষা শেষ হলে পরশুই ফিরব। তুই, মেহু, আমি তিনজনই।”

” আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়াটাও তো আপনার দায়িত্ব।”

মেহেরাজ ভাই ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন ছুড়লেন,

” মানে?”

ছোট শ্বাস ফেললাম।উত্তরে বললাম,

” আমার ফেরাটা জরুরী নয়।কিন্তু আপনাদের ফেরাটা জরুরী মেহেরাজ ভাই।মেহু আপুর ভার্সিটি। আপনার চাকরীর ইন্টার্ভিউ, পড়া সবকিছুতেই আমার জন্য ব্যাঘাত ঘটছে।আমার জন্য অতোটা ভাববেন না।আমি এই ঘরে থাকতে সে ছোটকাল থেকেই অভ্যস্ত। এই বাড়িটাও আমার ছোটকাল থেকে চেনা। এখানে আমার একা থাকাটা খুব বেশি ভয়ানক কিছু নয়। আমি ছোটকাল থেকে রান্নাও করতে পারি মেহেরাজ ভাই।দাদীর আর আমার রান্নাটা কিন্তু আমিই করতাম এতকাল।তাই খাবার নিয়েও চিন্তা করবেন না।আমি ভালো থাকব। আপনি ফিরে যেতে পারেন।”

মেহেরাজ ভাই বোধ হয় বিরক্ত হলেন।কপাল কুঁচকে নিলেন। ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,

” তোর সব কথা শুনব এমনটাই বা ভাবছিস কেন?”

” মানে?”

মেহেরাজ ভাই কন্ঠে শীতল রাগ মিশিয়ে বলে উঠলেন,

” মানে পরশু ফিরব। তুইও ফিরবি সাথে। ”

” আপনি খুব দায়িত্ববান পুরুষ মেহেরাজ ভাই। এটা আমি নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করি।আমি নই শুধু, সবাই বিশ্বাস করে। কিন্তু তার জন্য…”

আমি বাকিটা বলতে পারলাম না। তার আগেই মেহেরাজ ভাই বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলেন,

” তুই খুব বেশি কথা বলিস জ্যোতি।বিরক্তিকর লাগে। চুপচাপ খেয়ে নে। আমি আসছি বাইরে থেকে।”

কথাটা বলেই মেহেরাজ ভাই বসা ছেড়ে উঠে বুক টানটান করে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন।পা বাড়িয়ে টিনের দরজাট পেরিয়ে বাইরে চলে গেলেন খুব কম সময়ে। আমি একনজর তাকিয়েই টিফিন বক্স খুলে খাবার নিলাম থালায়। কিয়ৎক্ষন পর খেয়ে হাত ধুঁয়ে উঠতেই মেহেরাজ ভাই হাজির হলেন আবারো। ভ্রু কুঁচকে টিফিন বক্সের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,

” প্রতিদিন খাবার থেকে যায় কেন? ”

” মানে?”

মেহেরাজ ভাই মুখটা গম্ভীর করে তাকালেন। ভরাট কন্ঠে রাগসমেত বলে উঠলেন,

” কষ্ট করে রান্না করি। তুই খাবার এভাবে রেখে দিস কেন বক্সে?পুরোটা খাওয়ার জন্য নিয়ে আসিনি?”

উত্তরে কি বলব বুঝে উঠলাম না আমি।মেহেরাজ ভাই আগের মতোই গম্ভীর স্বরে বললেন,

” কাল থেকে খাবার রেখে দিলে খাবারই আনব না বলে দিলাম।”

মৃদু স্বরে বললাম,

” আমি তো আপনাকে খাবার আনার জন্য জোর করিনি মেহেরাজ ভাই।”

মেহেরাজ ভাই থমথমে চাহনীতে তাকালেন। কিছু না বলে সোজা হেঁটে চলে গেলে খাটের সামনে। মুহুর্তেই সটান হয়ে খাটের একপাশে গা এলিয়ে দিলেন। কপালে হাত রেখে চোখ ও বুঝে নিলেন। আমি কেবল তাকিয়ে থাকলাম।

.

পরীক্ষা দিয়ে যখন ফিরলাম তখন ফুফু ডেকেছিলেন।গোসল সেরে তাই ফুফুদের ঘরে গিয়েছিলাম ফুফুকে খুঁজতে।না পেয়ে আরমান ভাইকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন ফুফু মিনার ভাইয়ের ঘরে আছেন।আমিও কথামতো মিনার ভাইয়ের ঘরে গেলাম।দেখলাম ফুফু মিনার ভাইয়ের আলমারির কাপড়চোপড় গুলো গুঁছিয়ে রাখছে।খাটের এককোণায় বসে সেই দৃশ্যই পর্যবেক্ষন করতে লাগলাম আমি। কিছুক্ষন পর ফুফুর সাথে অল্প কথা বলে চলে আসতে নিতেই মিনার ভাইয়ের টেবিলের সাথে ধাক্কা খেলাম ভয়ানকভাবে।মুহুর্তেই মিনার ভাইয়ের টেবিলের কিনারা ঘেষা বইগুলো সব মাটিতে পড়ে গেল।সঙ্গে পড়ল একটা সাদা কাগজ আর কলম।ধাক্কা খাওয়ার কারণে ব্যাথায় পা টনটন করে উঠাতে হাত দিয়ে পা চেপে ধরলাম সঙ্গে সঙ্গেই।অন্য হাতে কাগজটা সামনে নিতেই চোখে পড়ল কাগজটার উপর দিকে আমার নাম।আমি ভ্রু কুঁচকালাম।মিনার ভাই কি আমার নামেই চিঠি লিখেছেন বা লিখছিলেন?কিন্তু কেন?আগ্রহ নিয়ে কাগজটা ওড়নার এককোণায় লুকিয়েই বইগুলো টেবিলের উপরে আগের মতোই তুলে রাখলাম। পরমুহুর্তেই দ্রুত পা চালিয়ে নিজের ঘরে গেলাম।কাগজখানা মেলে ধরলাম চোখের সামনে। মুহুর্তেই চোখে পড়ল গুঁটি গুঁটি অক্ষরে লেখা,

জ্যোতি,

তোকে সম্বোধন করার মতো নির্দিষ্ট কোন শব্দ আমার কাছে নেই জ্যোতি।থাকলেও এখন আর সেসব সম্বোধন তোর সাথে দেওয়া যায় না।বড্ড বেমানান ঠেকবে যে তাহলে।তোর প্রতি আমার ভালোলাগা, ভালোবাসা কবে তৈরি হয়েছিল আমার সত্যিই জানা নেই।শুধু জানতাম আমি তোকে আগলে রাখার চেষ্টা করতাম।তুই যাতে কষ্ট না পাস সে চেষ্টা করতাম। একটা সময় পর উপলব্ধি করলাম সে আগলে রাখার নাম ভালোবাসা।এই ভালোবাসার কথাটা প্রকাশ করার সাহস কোনকালেই আমার মাঝে ছিল না।সেই সাহস না থাকার কারণেই বোধহয় তোকে নিরবে অন্যের হয়ে যেতে দেখতে হলো।চোখের সামনে থেকে দূরে যেতে দেখতে হলো।তোকে এড়িয়ে চলতে শুরু করাটা মূলত তখন থেকেই।সেদিন যখন বললি আমি বদলে গেছি?আমি এখন এড়িয়ে যাই তোকে? অপরাধবোধে জর্জরিত হচ্ছিলাম কেবল। তবুও এর পেছনে কারণটা আর বলা হলো না।বলতে পারলাম না।পারলাম না দাদীর চলে যাওয়ার কারণে কষ্টে জমে থাকা তোকে আগের মতো ভাঙ্গতে,আগলে নিতে।পারলাম না আগের মতো তোর দুঃ

এরপর আর কিছু লেখা নেই।বোধহয় ব্যস্ততায় আর লিখেনি।কিংবা কোন কারণে লেখাটা থামাতে হয়েছিল। আমি লেখাগুলোর দিকে আরো একবার তাকালাম। স্পষ্ট বোধ হলো এগুলো মিনার ভাইয়েরই লেখা ।অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থাকলাম আরে অনেকক্ষন।মিনার ভাই আমায় ভালোবাসতেন?যাকে ছোট থেকে ভাই হিসেবে দেখে এসেছি, এত এত আপন ভেবেছি সে আমায় অন্য নজরে দেখতেন এমনটা ভাবতেই পারলাম না।কপাল কুঁচকে এল।ঠিক সে সময়েই চোখের সামনে মেহেরাজ ভাইকে ঘরে ডুকতে দেখলাম।কাগজটা দ্রুত টেবিলের ড্রয়ারে লুকাতে গিয়েই সম্মুখীন হলাম মেহেরাজ ভাইয়ের কড়া প্রশ্নের,

” এতোটা তাড়াহুড়ো করে কি লুকোচ্ছিস তুই?”

#চলবে….

এক মুঠো প্রণয় পর্ব-১৭+১৮

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_১৭
লেখনীতেঃএকান্তিকা নাথ

রাতে মেহেরাজ ভাইয়ের থাকার ব্যবস্থা হলো আমার ঘরেই।আব্বা অনেকবার আমাকে আর মেহেরাজ ভাইকে তার বিলাশবহুল ইটপাথরের ঘরটায় থাকতে বললেও রাজি হতে পারলাম না৷ টিনের ঘরে ঘুমোতে মেহেরাজ ভাইয়ের অসুবিধা হতে পারে ভেবে উনাকে অবশ্য বলেছিলাম আব্বাদের ঘরেই রাতে ঘুমোতে।কেন জানি না উনি সেই প্রস্তাবে মত দিলেন না। খাওয়া শেষ করে আব্বাদের ঘর ছেড়ে দাদীর ঘরে এসে খাট গোঁছালাম সর্বপ্রথম। বাকি সব অগোছাল জিনিস গোছালভাবে রেখে দাদীর রুমে গেলাম। দাদী আর মেহেরাজ ভাই তখনও আব্বাদের ঘরে কথা বলছে।হঠাৎ মনে পড়ল মিনার ভাইয়ের কথা।আসার পর থেকে একবারও চোখে পড়ে নি।একবারও কথা বলা হয়নি।একটা সময় মিনার ভাই আমার অধিক খেয়াল রাখতেন। যখন কেউই আমাকে পছন্দ করত না, তখন একমাত্র মিনার ভাইই আমার পাশে ছিলেন।চাচাতো, জেঠাতো ভাইবোনদের মাঝে মিনার ভাই ব্যাতীত বাকি সবাই আমায় খুব একটা পছন্দ করত না।কেন করত না জানা নেই।তবে মিনার ভাই আমার আপন মানুষ।এই মানুষটা যা যা করেছেন আমার জন্য তা অস্বীকার করলে হয়তোবা নিজেই নিজের কাছে ছোট হয়ে যাব।আমি আগ বাড়িয়ে ফুফুদের ঘরে গেলাম।ফুফুদের ঘরে আরমান ভাই আর তার সদ্য বিয়ে হওয়া সুন্দরী বউ।মিনার ভাই নাকি বিকালেই ফুফুকে নিয়ে কোন এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছেন।আমি হতাশ হলাম। পা চালিয়ে আবার নিজের ঘরে আসতেই চোখে পড়ল মেহেরাজ ভাইকে।বিছানায় সটান শুঁয়ে আছেন।কপালে হাত রাখা।দৃষ্টি কেমন ক্লান্ত ঠেকাল।আমি ছোট্ট শ্বাস ফেলে বের হয়ে দাদীর ঘরে গেলাম।দাদী তখন পানের বাটা থেকে পান গালে নিয়ে চিবুতে ব্যস্ত।আমাকে দেখেই প্রশ্ন ছুড়লেন,

” কই ছিলি এতক্ষন?”

জবাবে নরম গলায় বললাম,

” মিনার ভাইকে খুুঁজে আসলাম। আসার পর থেকে দেখিনি তো তাই।কিন্তু গিয়ে দেখি মিনার ভাই নেই।”

দাদী পান চিবানোতে ব্যস্ত থেকেই বললেন,

” মিনার তোর ফুফুরে নিয়া গেছে। রাইত অনেক হইছে। যা ঘুমাইয়া যা।”

” এখানে ঘুমাব না?”

দাদী বোধহয় অবাক হলেন।ভ্রু কুঁচকে সরু চাহনীতে তাকালেন আমার দিকে।তারপর গলা ঝেড়ে বললেন,

” এইহানে ক্যান ঘুমাইবি?তোর ঘরে ঘুমাবি। ”

ইতস্থত বোধ করে উত্তর দিলাম,

” না মানে, ওখানে তো মেহেরাজ ভাই ঘুমাবে দাদী।”

দাদী এবারও ভ্রু কুঁচকে নিলেন।জিজ্ঞেস করলেন,

” রাজ ঘুমাইলে তুই ঘুমাইতে পারবি না ক্যান?বর বউ একলগে একঘরে ঘুমায় এডায় তো দেইখা আইছি আজীবন।তোরা কি আলাদা ঘুমাস?”

আমি চুপ হয়ে গেলাম দাদীর প্রশ্নে।দাদী তো জানে না মেহেরাজ ভাইয়ের সাথে একঘরে থাকা হয়নি।দাদীকে কি বলা উচিত কথাটা?বোধ হয় না বলাটাই ঠিক হবে।দাদী যদি আবার মেহেরাজ ভাইকেই অপরাধী বানিয়ে উনার সামনে প্রশ্নগুলো তুলে?কতটা নিচ মানসিকতার বোধ হবে তখন নিজেকে।আমি পিঁছু ঘুরে বললাম,

” কিছু না।ঘুমাও তুমি দাদী।”

বলেই আবারও নিজের রুমে হাজির হলাম।পড়ার টেবিলের সামনে কাঠের চেয়ারটায় বসে থেকে খাটের দিকে তাকালাম। মেহেরাজ ভাই তখনও কপালে হাত রেখে শুঁয়ে আছেন।তবে এবারে উনার চোখ বুঝে রাখা।ভাবলাম উনি ঘুমিয়ে গেছেন।কিন্তু না।কিছুক্ষন পরই চোখ বুঝে রেখেই বলে উঠলেন উনি,

” তোর কি সমস্যা হচ্ছে জ্যোতি?আনকম্ফোর্টেবল ফিল করছিস?”

আচমকা প্রশ্নে অবাক হলাম আমি।চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম সঙ্গে সঙ্গে। মেহেরাজ ভাই চোখ মেলে চাইলেন এবার।ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়ে আবারও বলে উঠলেন,

” একঘরে অসুবিধা হচ্ছে?আনকম্ফোর্টেবল ফিল করলে বলে ফেলা উচিত। অন্য কোথাও ঘুমানোর ব্যবস্থা করা যাবে।”

আমি মিনমিনে চোখে চেয়ে বললাম,

” না, তেমন কিছু নয় মেহেরাজ ভাই।আপনি ঘুমান।”

মেহেরাজ ভাই কথা বাড়ালেন না। চোখ বুঝে নিয়ে বলে উঠলেন,

” ওকে ফাইন।তুইও ঘুমিয়ে পড়িস।”

কথাটা বলেই মেহেরাজ ভাই আবারও চোখ বুঝে নিলেন।আমি আরো কিছুক্ষন পায়চারি করলাম পুরো ঘর জুড়ে।এতদূর বাসে করে আসায় নাকি কিজানি, আমার শরীরটা যেন ক্রমশ ভেঙ্গে আসল।ঘুমে চোখজোড়া নিভু নিভু হয়ে আসল দ্রুত। তবুও বুঝে উঠতে পারলাম না কি করা উচিত। ঘুমানো উচিত? নাকি নির্ঘুম থাকা উচিত।অবশেষে অনেকক্ষন সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগে খাটের একপাশে শুঁয়ে শরীর এলিয়ে দিলাম। যতটুকু সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে খাটের একদম কিনারা ঘেষেই শুঁয়ে পড়লাম।তার কিয়ৎক্ষনের মধ্যেই ঘুমে তলিয়ে গেলাম।

.

আমার ঘুম ভাঙ্গল খুব ভোরে। স্বভাবসুলভ ছোটকাল থেকে একা একা খাটজুড়ে ঘুমানোয় অভ্যস্ত থাকায় নিজেকে আবিষ্কার করলাম মেহেরাজ ভাইয়ের শরীর ঘেষেই।মুহুর্তেই চমকে গিয়ে দূরত্ব বাড়ালাম।খাটের কিনারা ঘেষে বসে খেয়াল করলাম, মেহেরাজ ভাই কাল রাতে যেভাবে ঘুমিয়েছিলেন ঠিক সেভাবেই সটান শুঁয়ে আছেন।হা, পা কোনকিছুর অবস্থানেরই পরিবর্তন ঘটেনি।এতটা স্থির থেকে ঘুমানে যায়?বিপরীত ভাবে, আমার কথা ভাবতে গিয়েই অস্বস্তিতে মাথা নত হয়ে আসল। অন্যদের মতো হাত পা ছড়ানো অভ্যাস না থাকলেও স্বল্প জায়গায় মানিয়ে ঘুমানোর অভ্যাস নেই।তাই হয়তো খাটের কিনারা ঘেষে ঘুমানো আমি ঘুমন্ত অবস্থাতে বাকি জায়গাটুকু ও দখল করে নিলাম।ভুলেই গেলাম খাটে অন্য আরেকজন মানুষ ও আছেন।তাও পুরুষ মানুষ। ফলস্বরূপ ভোরে ভোরে নিজেকে আবিষ্কার করলাম মেহেরাজ ভাইয়ের দেহ ঘেষেই।বিষয়টা ভাবতেই খারাপ লাগার উদ্ভব হলো মনের ভেতর।দ্রুত বসা ছেড়ে উঠে গিয়ে বাইরে গেলাম।মুখচোখ ধুঁয়ে এদিক ওদিক হাঁটলাম।কিছুক্ষন বসলাম পুকুর পাড়টাতেও। প্রায় ঘন্টা দুয়েক এভাবেই কাঁটল।তারপর উঠে গিয়ে ঘরে যেতেই দেখলাম মেহেরাজ ভাই উঠে পড়েছেন। চোখমুখ ভেজাও দেখাল।কপালে আসা চুলের একাংশও ভিজে লেপ্টে আছে।আমি স্বাভাবিক হয়ে সামনে গেলাম।একটু আগের অস্বস্তিকে কাঁটিয়ে প্রশ্ন ছুড়লাম,

” মেহু আপুর সাথে কথা হয়েছে আপনার?রাতে কোন সমস্যা হয়নি তো?”

মেহেরাজ ভাই তাকালেন । গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন,

“রাতে নাফিসাকে পাঠিয়েছে চাচী।আশা করি সমস্যা হবে না।এখন কল দিলে কল তুলবে না। হয়তো ঘুমোচ্ছে। ”

বললাম,

” আচ্ছা।”

.

মেহেরাজ ভাইয়ের সাথে আমার কথা ততটুকুই হলো সেদিন।তারপর উনি রওনা হলেন নিজস্ব গন্তব্যে৷ সেদিনের পর সপ্তাহ খানেক আমার কিংবা মেহেরাজ ভাই কারোরই আর যোগাযোগ হলো না।যোগাযোগ হলো হঠাৎ এক সপ্তাহ দুই-তিনদিন পার হওয়ার পর।

সেদিন কোন এক প্রয়োজনেই ব্যাগটা খুলতে চোখে পড়ল ছোট বাটন ফোনটা।বাড়িতে আসার পর থেকে তেমন একটা প্রয়োজন পড়ে না বলেই মোবাইলটা আর বের করা হয়নি। ওভাবেই ব্যাগের মধ্যে পড়ে ছিল। হঠাৎ মোবাইলটা হাতে নিয়ে আগ্রহ জাগল মেহেরাজ ভাই কল দিয়েছিল কিনা তা দেখার।কিন্তু আমি হতাশ হলাম। দেখলাম মোবাইল বন্ধ হয়ে আছে।মেহেরাজ ভাইয়ের কল এসেছে কিনা তা দেখার আগ্রহ থাকলেও মোবাইল চার্জে বসানোর জন্য ব্যাকুল হলাম না।এমনিতেও উনার জীবনে খুব একটা বিশেষ গুরুত্ব নেই আমার।আহামরি ভাবে আমাকে স্মরন করে কল করবেন রোজ এমনটা হওয়ারও সম্ভাবনা নেই।হয়তো বা দায়িত্ব পালন করার জন্য দুয়েকবার কল দিলে দিতে পারেন।ভেবেই মোবাইলটা আবারও আগের মতোই ব্যাগে রেখে দিলাম।কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে সেদিন বিকেল বেলায়ই জানতে পারলাম আব্বার মাধ্যমে মেহেরাজ ভাই আমার খোঁজ নিয়েছেন।বিষয়টা কতটুকু দায়িত্বের জন্য, কতটুকু কর্তব্যের জন্য তা জানা নেই।তবে আমার ভেতরে সুপ্ত ভালো লাগা কাজ করল।সেই ভালো লাগা প্রকাশ না করার জন্যই আব্বার সামনে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে ছিলাম।আব্বা গলা উঁচিয়ে আবারও বললেন,

” কি হলো কি বলতেছি ?রাজের সাথে যাওয়ার পর থেকে যোগাযোগ করেছিস?তোর মোবাইল আছে। আম্মা তো মোবাইল দিয়েছিল তোকে। যোগাযোগ করিস নি কেন?তা না করে মোবাইল বন্ধ করে রেখেছিস?”

এক নজর তাকিয়ে বললাম,

” উনাদের বাসায় মোবাইলটা হাতে হাতে রাখতাম। কারণ দাদীর কল আসবে এই ভেবে।দাদীর সাথে কথা হবে এই ভেবে সারাদিন অপেক্ষা করতাম।এখন তো সেই অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই আব্বা।তাই মোবাইলটা ব্যাগের ভেতরেই পড়ে আছে।তার উপর পরীক্ষা চলছে।পরীক্ষার পড়া, কাজকর্ম সব মিলিয়ে মোবাইলের কথা খেয়ালই নেই আমার।মেহেরাজ ভাইকে আমার তরফ থেকে বলে দিবেন, আমি দুঃখিত। ”

আব্বা এবারও রাগ ঝাড়লেন।চাপাস্বরে বললেন,

” আমি কেন জানাব?”

” না, আবার কল দিলে জানাবেন আরকি।যদিও জানি,উনি আর কল দিবেন না।”

বাবা চোখ গরম করে তাকালেন।বললেন,

” রাজ এই নিয়ে তিনবার কল দিয়েছে আমায়।তোর মোবাইল বন্ধ বা তোর সাথে যোগাযোগ হয়নি এটা আগের দুবার না বললেও আজই বলেছে। এটা তো তোর উচিত হয় নি।”

আমি ছোট শ্বাস ফেললাম।জানতে চাইলাম,

” উনি কি আমার সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েছেন আব্বা?”

আব্বা চুপ থাকলেন কিছুটা সময়।তারপর একই রকম গম্ভীর থেকে বললেন,

” মোবাইল চার্জে বসিয়ে রাজকে কল দিস। ”

আমি মাথা নাড়িয়ে বুঝালাম, হ্যাঁ দিব।তারপর আব্বা আর দাঁড়ালেন না। চলে গেলেন নিজের ঘরে।আমি ঠাঁই উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকলাম।মেহেরাজ ভাই আব্বাকে তিনবারই আমার খোঁজ নেওয়ার জন্য কল দিয়েছেন? তিনবার!প্রথম দফায় কিছুটা বিস্ময় কাজ করলেও পরমুহুর্তেই মস্তিষ্ক বলে উঠল, অতোটা আহামরি খুশি হওয়ার বিশেষ কারণ নেই।দায়িত্ব পালনের জন্য উনি তিনবার কল দিতেই পারেন। আমি পা চালিয়ে ঘরে এলাম।দেখলাম বিদ্যুৎ নেই। পুনরায় হতাশ হলাম।বিদ্যুৎ এল একেবারে রাত আটটার পর।তখনই মোবাইল চার্জে বসালাম।চার্জ হতেই মোবাইল অন করে চমকে গেলাম।দু দুটো নাম্বার থেকে কল এসেছে।একটা মেহেরাজ ভাইয়ের নাম্বার অপরটা মেহু আপুর নাম্বার।নাম্বারগুলো আমার চেনা। মেহেরাজ ভাই মোট মিলে আঠারোবার কল করেছেন আর মেহু আপু সাতবার।আমি শুকনো ঢোক গিললাম। পড়া ফেলে জানালার কাছ ঘেষে প্রথমেই কল দিলাম মেহু আপুকে।মেহু আপু প্রথমে কল রিসিভড না করলেও পরমুহুর্তেই নিজ থেকে কল দিলেন।আমি কল তুলে কানের সামনে ধরলাম মোবাইল। তারপর কথা হলো প্রায় আধ ঘন্টারও বেশি।মেহু আপুর সাথে কথা শেষে করার পর সময় দেখলাম।সাড়ে নয়টা।কাঁপা কাঁপা হাতে কল দিলাম মেহেরাজ ভাইকে।মেহেরাজ ভাইয়ের নাম্বারে প্রায় পাঁচবার কল দিয়ে থেমে গেলাম। উনি কল তুললেন না।হতাশ হয়ে মোবাইলটা একপাশে রেখেই পড়ায় মন দিলাম।ঠিক তখনই মোবাইলটা বেঁজে উঠল।বুকের ভেতর অদ্ভুত কম্পন টের পেলাম। অনুভূতিদের একপাশে ঠেলে রেখেই মোবাইলটা হাতে নিয়ে স্বাভাবিক হলাম। কল তুলে গলা ঝেড়ে সালাম দিলাম।বললাম,

” কেমন আছেন মেহেরাজ ভাই? ”

মেহেরাজ ভাই গম্ভীর স্বরে স্বল্প শব্দে উত্তর দিলেন,

” ভালো আছি।”

আমি চুপ থাকলাম। ভেবেছিলাম উনিও পাল্টা প্রশ্ন করে কেমন আছি তা জিজ্ঞেস করবেন।কিন্তু না, জিজ্ঞেস করলেন না।চুপচাপ সেভাবেই কয়েক সেকেন্ড কাঁটল।কথারা যেন বিলীন হয়ে গেল। অনেক খুঁজেও কি বলব বুঝে উঠলাম না।অবশেষে অনেক ভেবে বললাম,

” আব্বার কাছে কল দিয়েছিলেন? ”

মেহেরাজ ভাই শান্তস্বরে বললেন,

” হ্যাঁ দিয়েছিলাম। কেন?”

আমি স্পষ্টভাবে জানতে চাইলাম,

” আমাকে কি কল করতে বলেছেন?”

” না, কেন?”

” না এমনিতেই। আব্বা বিকালে বলল আপনাকে কল দিতে তাই কল দিয়েছি। আপনি কি বিরক্ত হয়েছেন?”

মেহেরাজ ভাই চাপা কন্ঠে শুধালেন,

” যদি হ্যাঁ বলি?”

ইতস্থত বোধ করে বলে উঠলাম,

” দুঃখিত।আব্বা বিকালে বলেছে বলেই কল দিয়েছিলাম আপনাকে।”

মেহেরাজ ভাই চুপ থাকলেন কিয়ৎক্ষন। তারপর প্রশ্ন ছুড়লেন শীতল অথচ দৃঢ় কন্ঠে,

” তো বিকাল পেরিয়ে রাত হওয়ার পর তোর কল দেওয়ার কথা মনে পড়েছে?”

মেহেরাজ ভাইয়ের শীত কন্ঠে রাগ ছিল কি ক্রোধ ছিল বুঝে উঠলাম না। তবে সেই কন্ঠে আমি কেঁপে উঠলাম।বললাম,

” না আসলে, মোবাইলে চার্জ ছিল না মেহেরাজ ভাই।”

মেহেরাজ ভাই শাসনের সুরে একরাশ রাগ নিয়ে বলতে লাগলেন,

” তোর উচিত ছিল আমি কল দেওয়া মাত্র কল তোলা।কিন্তু না, তুই আমার কল এড়িয়ে গেলি।টানা তিনদিন কল দেওয়ার পর দেখি তোর ফোন সুইচড অফ।আমার কল না তুলে তুই ফোন সুইচড অফ করে রাখলি?এটা কোন ধরণের বিহেভিয়ার জ্যোতি?”

মেহেরাজ ভাইয়ের চাপা রাগের সম্মুখীন হয়েই থম মেরে গেলাম।মেহেরাজ ভাই ছোটকাল থেকেই দম্ভে পরিপূর্ণ। নিজেকে কোথাও দ্বিতীয় হিসেবে মেনে নিতে পারেন না হয়তো।ছোটবেলায় একবার ক্লাসে ফার্স্ট হতে পারেনি বলে কি ভীষণ রাগ দেখিয়েছিলেন সবার উপর। এমনকি টানা এক সপ্তাহ স্কুলেও যায় নি।দম্ভে পরিপূর্ণ সে মেহেরাজ ভাইয়ের বোধহয় ইগোতে লাগল এই বিষয়টা। তার কল না উঠানোটা বোধহয় চরম বেয়াদবিও মনে হলো উনার কাছে।কিন্তু এটা তো ইচ্ছাকৃত নয়।আমি তা বুঝাতেই বলে উঠলাম,

“এর জন্যও দুঃখিত মেহেরাজ ভাই।আমি ইচ্ছাকৃত ভাবে আপনার কল এড়িয়ে যাইনি।সত্যি বলছি।বাড়িতে আসার পর মোবাইলটার কথা মনেই ছিল না আমার।আজই ব্যাগ থেকে বের করেছি ফোনটা।”

মেহেরাজ ভাই আবারও চাপা কন্ঠে রাগ দেখিয়ে বললেন,

” আওয়াজ হয়নি ফোনের?”

শান্ত স্বরে উত্তর দিলাম,

” আমি খেয়াল করিনি হয়তো।”

” আগে কি করে খেয়াল করতি?আগে তো দেখতাম সারাক্ষন ফোন নিয়ে বসে থাকতি।”

ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,

” মানে?”

গম্ভীর স্বরে বললেন,

” নাথিং।পরীক্ষা কেমন চলছে তোর?”

“ভালো।”

” ওকে।পরীক্ষা শেষে কোনদিন আসবি জানিয়ে দিস।গিয়ে নিয়ে আসব।”

আমি থামলাম।কাঁপা গলায় বললাম,

” আমি আর ওখানে যাব না মেহেরাজ ভাই।বাড়ির অবস্থা এখন স্বাভাবিক।আমি বাড়িতেই থেকে যাব।আপনাকে একটা কথা বলি?”

মেহেরাজ ভাই আমার কথার বিপরীতে বিশেষ কোন উত্তর করলেন না।বললেন,

” বল।”

শান্ত কন্ঠে বলতে লাগলাম,

” সামান্তা আপুর সাথে সবটা মিটিয়ে নিন মেহেরাজ ভাই।আমি চাই না আমার জন্য একটা সম্পর্ক ভেঙ্গে যাক।আপনারা আগের মতোই সম্পর্কটা গড়ে নিন।যেমনটা স্বপ্ন দেখেছেন তেমনই পূরণ করুন সবটা।আমি বাঁধা হয়ে থাকব না।সব ছেড়ে এসেছি।আমি আর আপনাদের মাঝে যাব না সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি মেহেরাজ ভাই।তবে একটা অনুরোধ রাখবেন?সব ছেড়ে দিলেও বিয়েটা ছাড়তে পারব না আমি।এমনটা ভাববেন না যে টিপিক্যাল বাঙ্গালি মেয়েদের মতো বলব, আমাকে আপনার পায়ে একটু জায়গা দেন। তেমন কিছুই বলব না।তবে আমি চাই বিয়েটা না ভাঙ্গুক।আমার আপনার বিয়েটা হয়েছে।আমি এই বিয়েটা মানিও খুব করে।বিয়েটা ভাঙ্গবেন না দয়া করে৷ ”

মেহেরাজ ভাই শান্তস্বরে ছোট শব্দে উত্তর দিলেন,

” আচ্ছা।”

আমি আবারও বললাম,

” এমনটা ভাববেন যে বিয়েটা ভাঙ্গতে নিষেধ করার পেছনে অন্য কারণ আছে। আমি বিয়ের অধিকার নিয়ে আপনার সামনে হাজির হবো এমনটাও ভাববেন না।”

মেহেরাজ ভাই বোধ হয় বিরক্ত হলেন।কিঞ্চিৎ বিরক্তি দেখিয়ে বললেন,

“বারবার একই কথা ভালো লাগে না জ্যোতি। আর কিছু বলবি?”

” না।”

মেহেরাজ ভাই আদেশের সুরে বলে উঠলেন এবার,

“আচ্ছা, এর পর থেকে ফোন বন্ধ রাখবি না।কল দিলে কল তুলবি।রাখলাম।”

কথাটা বলেই মুখের উপর কল রাখলেন মেহেরাজ ভাই। আমি হতবিহ্বল চাহনীতে তাকিয়ে থাকলাম ফোনের দিকে।মেহেরাজ ভাই কি এসব আদেশ করলেন?কিন্তু কেন?আমার সাথে যোগাযোগ না হলেও বা কি হবে মেহেরাজ ভাইয়ের?

#চলবে….

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_১৮
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

সময় চলে গেল খুব দ্রুত। মেহেরাজ ভাইয়ের সাথে প্রতি সপ্তাহে এক দুইবার করে কথা হয়েছে এই কয়েকমাস।সে কথোপকোতনে কখনো বা মেহেরাজ ভাইয়ের রাগ রাগ কন্ঠ , আবার কখনো বা গাম্ভীর্যের সম্মুখীন হতে হয়েছে আমায়।উনাদের বাসায় না যাওয়ার বিষয়টা দাদীকে এই সেই বুঝিয়েই রাজি করিয়েছিলাম।ফরস্বরূপ দাদীর আদেশ শুনে মেহু আপু বা মেহেরাজ ভাইও খুব একটা জোর করেননি।এর মাঝেই এইচ এস সি পরীক্ষা প্রায় শেষ হতেই চলল । আরো পাঁচটা পরীক্ষা বাকি।ব্যবহারিক পরীক্ষাও বাকি আছে।কাল বন্ধ। পরীক্ষা নেই।সেই জন্যই রাত প্রায় তিনটে পর্যন্ত জেগে থেকেই ঘুমোতে গেলাম।সকালে উঠতে কিঞ্চিৎ দেরিও হলো আমার।তখন সকাল সাতটা।দাদী আজ এখনও ঘুম ছেড়ে উঠেনি দেখে অবাক হলাম।এমনিতেই এই কয়েকমাস দাদীর শরীরের অবনতি বাদে উন্নতি চোখে পড়েনি আমার।প্রত্যেকটা দিন কেঁটেছে অসুস্থতায়।কখনো প্রেসার লো, কখনো বা হাঁটু ব্যাথা, কখনো কোমড় ব্যাথা,কখনো বা জ্বরে অসাঢ় অবস্থা।এই তো সাতদিন হলো তীব্র জ্বর দাদীর শরীরে।এই যায় তো এই আসে।আব্বা আর চাচারা ডাক্তার দেখিয়ে এনেছেন।নিয়মমতো ঔষুধ চলছে।তবুও দাদীর জ্বর সারছে না।কাল আবারও ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে বলেছিল আব্বা। এর মাঝেই অজানা চিন্তায় মুহুর্তেই বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম।দাদী যেমনই অসুস্থ হোক না কেন, শুঁয়ে থাকার মানুষ নয়।তীব্র অসুস্থতায় ও তার হাত পায়ের চলন তাকে সচল রাখতেই হয়।আমি দ্রুত দাদীর রুমে গেলাম। দেখলাম ওপাশ করে শুঁয়ে আছে।বালিশটা তেলে চিপচিপে হয়ে আছে।কাল রাতেই দাদীর মাথায় তেল দিয়ে দিয়েছিলাম।সেজন্যই সব তেল বালিশে লেগেছে।আমি এগিয়ে ডাক দিলাম,

” দাদী?ঘুম ছেড়ে উঠোনি যে?সকাল তো হয়ে গেল।”

দাদী উত্তর দিল না।আমি ফের বললাম,

” দাদী?কি হলো শুনছো না?উঠছো না কেন ঘুম থেকে আজ?”

দাদী এবার ও কোন উত্তর দিলেন না।আমি হতাশ হলাম।পা বাড়িয়ে বিছানার এককোণে বসেই বলে উঠলাম,

” দাদী?জ্বরটা কি বেড়েছে?খারাপ লাগছে তোমার ভীষণ?

কথাটা বলেই হাতটা এগিয়ে ছুঁয়ে দিলাম দাদীর কপাল।দাদীর কপালে উষ্ণতা অনুভব হলো না।অনুভব হলো শীতলতার।কি ভীষণ শীতল অনুভব করলাম দাদীর শরীর।আমি হাতটা সরিয়ে নিলাম দ্রুত।অবিশ্বাস্য চাহনী রেখেই আবারও কপালে ছুঁয়ে দিলাম হাতের তালু।এবারে ও বোধ করলাম যে, দাদীর কপাল ঠান্ডা।ভীষণ ঠান্ডা।আমি অস্ফুট স্বরে বললাম,

” দাদী?তোমার জ্বর কি কমে গিয়ে….”

বাকিটুকু আর বলতে পারলাম না আমি । অজানা শঙ্কায় হাত পা কাঁপতে লাগল আমার।নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসল মুহুর্তেই।মনে পড়ল মিথির মৃত চেহারা।মিথির শীতল শরীর। মিথির সেই নিশ্চুপ থাকা মুহুর্ত। মিথির সেই নিথর শরীর।আমার শরীর অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপতে লাগল।খেয়াল করলাম আমার ভেতরকার অস্থির উত্তেজনা। কাঁপা স্বরে বললাম,

” দা.. দাদী কথা বলো দয়া করে।”

“দা্ দী?”

” এই দা্ দা্ দী?”

আমার বুকের কম্পন অস্বাভাবিক ভাবে বাড়ল। কথারা গলায় আটকে রইল এবার।হাত পা কেমন জমে এল দ্রুত।তবুও চেষ্টা চালালাম নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রাখার।হাতটা বাড়িয়ে দাদীর নাসারন্ধ্রের সামনে ধরতেই আমি চমকে উঠলাম।দাদীর নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের অস্তিত্ব টের না পেয়েই আমি দমে গেলাম এবার।হাত সরিয়ে আবারও হাত রাখলাম একইভাবে৷ এবারেও একই উত্তর।দাদীর নিঃশ্বাস চলছে না।অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থাকলাম দাদীর ঘুমন্ত চেহারায়।মস্তিষ্ক পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে গেল।এক মুহুর্তের জন্য যেন সব থমকে গেল।বুকের ভেতর অদ্ভুত যন্ত্রনাময় কষ্ট অনুভব করলাম।তবে কান্না পেল না আমার।চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল না নোনতা পানি।শুধু স্থির চেয়ে থাকলাম দাদীর দিকে।কঠিন সত্যটা মানতে কষ্ট হলে ও কঠিন সত্যটা আমার অজানা নয়।তবুও সেই কঠিন সত্যটা আমি বিশ্বাস করে উঠতে পারলাম না মনপ্রাণ থেকে।উঠে গিয়ে আব্বাকে ডেকে এনে বললাম,

” আব্বা?দাদী আজ ঘুম ছেড়ে উঠছে না কেন?দাদীকে বলুন না ঘুম থেকে উঠতে।”

আব্বা আসলেন।একে একে বাড়ির সবাই আসলেন। এমনকি ডাক্তারও আসলেন।এসে শুধালেন, দাদী আর জীবিত নেই।দাদী আর এই পৃথিবীতে নেই।দাদী আর আমার সাথেই নেই।কোথাও নেই!কোথাও না।দাদী আমাকে ছেড়ে চলে গেছে এটা মানতে কতোটা কষ্ট হলো জানা নেই, তার থেকে বেশি অভিমান হলো দাদীর উপর।দাদী জানত, এই পৃথিবীতে আমার আপন কেউ নেই তেমন।থাকার মধ্যে শুধু দাদীই ছিল।তবুও কিভাবে পারল আমায় ছেড়ে যেতে?একবারও কি বুক কাঁপল না?একবারও আমার মুখটা মনে পড়ল না দাদীর?সবাই স্বার্থপর।সবাই!আমি যাকেই ভালোবাসি, সেই আমাকে ছেড়ে চলে যায়।আম্মা ছেড়ে গেল, মিথি ছেড়ে গেল, অবশেষে দাদীও ছেড়ে গেল।এই নিয়ে বিশেষ দুঃখ হলো না নাকি দুঃখ সইতে সইতে এই দুঃখটা বিশেষ বোধ হলো না আমার কাছে তা বুঝে উঠলাম না।একদম স্বাভাবিক থেকে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকলাম ঘরের এককোণে।একে একে মানুষের ভীড় জমল। কেউ বিলাপ করল, কারো বা চোখজোড়া দিয়ে অঝোরে পানি ঝড়ল।আমি সবাইকেই খেয়াল করলাম। নিশ্চুপে দেখে গেলাম সবার বাহ্যিক দুঃখ। কিন্তু কাউকেই দেখাতে পারলাম না নিজের অন্তরের দুঃখটা।কি ভীষণ যন্ত্রনা হচ্ছে সে অন্তরে।কি ভীষণ জ্বালা ধরেছে।

.

সন্ধ্যা হলো।ততক্ষনে দাদীর দাফন সম্পন্ন হয়ে গেছে।আমার পাশে ফুফু, মেহু আপু,ছোট আম্মা সহ অনেকেই উপস্থিত তখন। মেহু আপু বিকালেই এসেছেন৷ সঙ্গে উনার চাচা চাচীরাও খবর পেয়ে বিকালের দিকেই বাড়ি এসেছেন।শুনেছি মেহেরাজ ভাইও এসেছেন।তবে দেখিনি। আসার পর থেকেই মেহু আপু আমার পাশে বসা।মাথায় হাত বুলিয়ে ক্রমশ সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছে।আসলেই কি আমার সান্ত্বনার প্রয়োজন আছে?আমি তো জানি দাদী আর ফিরবে না। দাদীকে চাইলেও আমি আর কখনো সামনে পাব না।হাত দিয়ে দাদীর চুলে সিঁথি কেটে দিতে পারব না, মাথায় তেল দিয়ে দিতে পারব না।সকাল সকাল চা বানিয়ে চা খাওয়াতে পারব না।দাদীর হাঁটুতে, কোমড়ে মলম দিয়ে মালিশ করে দিতে পারব না।কিছুই পারব না।কিছুই না!সবকিছু জেনেবুঝেও অবুঝের মতো সান্ত্বনা পাওয়ার জন্য দুঃখে নেতিয়ে থাকাটা হাস্যকর।তবুও আমাকে সবাই মিলে বুঝাতে লাগল।ফুফু বলল,

” জ্যোতি, জানি তুই আম্মারে অনেক ভালোবাসতি। এমন পাথরের মতো জমে থাকিস না। একটু তো কান্না কর।নিজেকে এমন পাথর বানিয়ে রাখিস না জ্যোতি।”

মেহু আপু বলল,

” এভাবে দুঃখ পেয়ে নিজেকে গুঁটিয়ে রাখিস না জ্যোতি।মানুষের জম্ম মৃত্যু তো আমাদের হাতে নেই। দাদী আর নেই এটা কঠিন সত্য হলেও আমাদের মেনে নিতে হবে।এভাবে নিজের হৃদয়কে শক্ত করে রাখিস না।কান্না পেলে কান্না কর।দেখবি হালকা লাগবে।”

ছোট আম্মাও বলল,

” দেখো তোমার দাদী আর বেঁচে নেই। কোন মানুষই তো সারাজীবন বেঁচে থাকে না।তোমাকে তো এটা মেনে নিতে হবে। এভাবে স্থির হয়ে বসে থেকো না।নিজেকে স্বাভাবিক করো। ”

সবার এত এত কথায় বিরক্তবোধ করলাম আমি।আমি কি স্বাভাবিক নেই?আমি কি মেনে নিই নি যে দাদী আর নেই?তাহলে অহেতুক আমাকে এসব বলার মানে কি?

সবাই আমাকে আরো অনেকক্ষন বুঝাল।এক পর্যায়ে হতবিহ্বল চাহনীতে সবার দিকে একনজর তাকিয়ে বলে উঠলাম,

” আমি একটু একা থাকতে চাই।একা থাকতে দাও একটু।”

আমার বলা কথাটার পরপরই সবাই একে একে চলে গেল।মেহু আপু কাঁধে হাত রেখে ভরসা দিলেন।তারপর চলে গেলেন।আমি হাঁটু ভাজ করে হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলাম হাঁটু।তারপর হাঁটুর উপর মুখ রেখে স্যাঁতস্যাঁতে মাটিতে নিরবে একা বসে থাকলাম।বুকের ভেতরটায় অদ্ভুত কষ্ট হলো। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম যেন। চেষ্টা করলাম সেই কষ্ট নিজের মাঝেই দমিয়ে রাখতে। হাঁটু আঁকড়ে ধরে তাকিয়ে থাকলাম স্যাঁতস্যাঁতে মাটির দিকে। সেভাবে কত সময় গেল আমার জানা নেই।আকস্মিক কানে এল পরিচিত এক কন্ঠস্বর,

” জ্যোতি?আসলে অসুবিধা হবে তোর?”

কন্ঠস্বরটা আমার চেনা। মেহেরাজ ভাইয়ের কন্ঠ।উনার কন্ঠস্বর শুনে ও আমি চোখ তুলে তাকালাম না। আগের মতোই তাকিয়ে থাকলাম মাটির দিকে।মাথা ডানে বামে নাড়িয়ে উত্তর দিলাম,অসুবিধা হবে না।মেহেরাজ ভাই পা বাড়িয়ে এগিয়ে আসলেন।হাঁটু ভেঙ্গে আমার সামনে স্যাঁতস্যাঁতে মাটিতে বসেই বলে উঠলেন,

” কষ্ট হচ্ছে?”

আকস্মিক আহ্লাদী প্রশ্নে ভেতরের কষ্টগুলো যেন উগড়ে আসতে চাইল। কিন্তু উগড়ে আসল না।উনার কথার উত্তর দিলাম না আমি।চুপচাপ সেভাবেই বসে থাকলাম।মেহেরাজ ভাই আবারও বললেন,

” জ্যোতি? তাকা আমার দিকে। এভাবে অনুভূতিহীন হয়ে থাকবি না।ভেতরে ভেতরে গুমড়ে মরবি না প্লিজ।”

আমি এবার স্থির চাহনীতে তাকালাম মেহেরাজ ভাইয়ের দিকে।পরনের সাদা পাঞ্জাবি।হাতাগুলো কনুই অব্দি গুঁটানো আছে। স্নিগ্ধ লাগছে উনাকে।কিন্তু আমার কাছে আজ মেহেরাজ ভাইকে অতোটা নজরকাড়া সুন্দর বোধ হলো না।শুধু সৌন্দর্যই নয়, মেহেরাজ ভাইকে এতমাস পর, এতটা কাছে দেখেও আমার ভেতরে কোন অনুভূতি কাজ করল না আজ।না প্রেম, না ভালোবাসা, আর না তো ভালোলাগা।জীবনের কঠিন বাস্তবতা গুলোর কাছে বোধহয় সকল অনুভূতিই ফাংসে হয়ে যায়।কথায় আছে, অভাবে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালায়।হয়তো অভাবটাও জীবনের কঠিনতম এক বাস্তবতা বলেই ভালোবাসার মতো তীব্র অনুভূতিকেও হারিয়ে দিয়ে যায়।আমিও এই মুহুর্তে তেমনই এক কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন।যে বাস্তবতা আমার হৃদয় থেকে প্রেমানুভূতি, ভালোবাসার অনুুভূতি সবকিছুই নিংড়ে চুষে নিয়েছে।অসার করে দিয়েছে আমার সমস্ত অনুভূতিকে।আমি টের পেলাম, আমি সত্যিই অনুভূতিহীন হয়ে গেছি।আমার নিজের ভেতর কোন অনুভূতিই আর কাজ করছে না এই মুহুর্তে। না দুঃখ, না সুখ! না খারাপ লাগা, না ভালো লাগা।শুধু নির্লিপ্ত ভাবে চেয়ে থাকলাম আমি।মেহেরাজ ভাই আমার কাঁধ ঝাকানোতেই সে তাকানোর অদলবদল হলো।সচকিত হয়ে তাকাতেই মেহেরাজ ভাই বললেন,

” দাদী আর নেই। এ কঠিন সত্যিটা মেনে নেওয়ার ক্ষমতা তোর আছে আমি জানি।কিন্তু এতটা স্বাভাবিক থাকা কি উচিত জ্যোতি?সব দুঃখ নিজের ভেতর রেখে দুঃখ জমানো উচিত? ”

অস্ফুট স্বরে বললাম,

” কি করা উচিত আমার? বিলাপ ধরে কান্না করা?”

মেহেরাজ ভাই আমার দিকে তাকালেন।শান্তস্বরে বলে উঠলেন,

” পৃথিবীতে সকল কষ্ট লুকাতে নেই জ্যোতি।কিছু কষ্ট প্রকাশ পেলে বিশেষ ক্ষতি হয় না।কষ্ট ভাগ করলে কষ্ট কমে।আমার সাথে তোর কষ্টটা ভাগ করবি?”

মেহেরাজ ভাইয়ের কন্ঠ শান্ত, নরম।শেষের কথাটা যেন হৃদয়ের আকুতি নিয়েই বললেন।আমি স্পষ্টভাবে তাকালাম মেহেরাজ ভাইয়ের চোখজোড়ায়। দেখলাম আশাহত দৃষ্টি, দীর্ঘশ্বাসের অস্তিত্ব আর একরাশ চিন্তা।অস্ফুট স্বরে বললাম,

” না।”

মেহেরাজ ভাই ফের প্রশ্ন ছুড়লেন,

” কেন?”

নির্লিপ্তভাবে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলাম আমি,

” প্রথমে সবাই কষ্টের ভাগ নেয় মেহেরাজ ভাই। আগলেও রাখে। পাশেও থাকে। কিন্তু একটা সময় পর আর কেউই থাকে না।কঠিন হলেও এটাই বাস্তব সত্য।”

মেহেরাজ ভাই আকস্মিক আমার হাতজোড়া নিজের হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলেন।শীতল চোখে তাকিয়ে আশ্বাস দিয়ে দৃঢ় গলায় বললেন,

” মেহেরাজ থাকবে।মিথ্যে নয়, সত্যিই থাকবে।”

মেহেরাজ ভাই এই প্রথম আমার হাত ছুঁয়েছে এভাবে।যাকে প্রণয় বুঝে উঠার পর থেকেই মনে জায়গা দিয়েছি সেই মানুষটাই পরম যত্ন করে আমার হাতজোড়া আগলে ধরেছে।যে মানুষটাকে কিশোরী বয়স থেকে ভালোবেসেছি, যে মানুষটাকে জীবনে প্রথম ভালোবাসা হিসেবে স্বীকার করেছি সে মানুষটাই আমার হাত আগলে ধরে শীতল কন্ঠে বলছে, সে আমার পাশে থাকবে।সত্যিই থাকবে।এসবে বোধ হয় আমার আবেগে আপ্লুত হওয়া উচিত।খুশিতে মূর্ছা যাওয়া উচিত।সুখ সুখ অনুভূতিতে চোখ টলমল করে উঠা উচিত।কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো আমার মধ্যে কোন অনুভূতিই কাচ করল না ।কোন বিশেষ প্রতিক্রিয়াই হলো না মেহেরাজ ভাইয়ের হাতের আলতো ছোঁয়ায়। আমি আগের মতোই নির্লিপ্ত হয়ে তাকিয়ে থাকলাম।স্পষ্টভাবে বললাম,

” আমি চাই না আর কেউ থাকুক আমার পাশে।আমি একা, সম্পূর্ণ একা থাকতে চাই মেহেরাজ ভাই।”

মেহেরাজ ভাই হাতজোড়া আরেকটু চেপে ধরলেন।গম্ভীর অথচ দৃঢ় কন্ঠে জবাব দিলেন,

” আমি চাইছি না তুই একা থাক।”

“কেন?”

” এতটা স্বাভাবিক থাকার কারণে ভয় হচ্ছে।এতটা স্বাভাবিক থেকে পরে অস্বাভাবিক কিছু করে পেলবি না তো জ্যোতি?আমি চাই এই প্রশ্নের উত্তরটা না হোক।তুই অস্বাভবিক কিছু করার কথা মাথায় আনবি না।”

আমি শান্তস্বরে বললাম,

” আমি বাচ্চা নই মেহেরাজ ভাই। কোনটা করা উচিত আর কোনটা অনুচিত তা জানি।”

মেহেরাজ ভাই শীতল কন্ঠে বলতে লাগলেন,

” সব উচিত অনুচিত আমরা জম্মের পর থেকেই শিখে ফেলি না জ্যোতি।আমাদের জীবনে উচিত অনুচিত শিখানোর জন্য একজন মানুষ থাকা প্রয়োজন।নিজের সুখগুলো ভাগ করার জন্য একজন মানুষ থাকা প্রয়োজন।নিজের মনের ভেতরের ব্যাথা গুলো বলার জন্য একজন মানুষ থাকার প্রয়োজন।সবশেষে নিজের খেয়াল রাখার জন্যও একজন মানুষ থাকা প্রয়োজন জ্যোতি।এই পৃথিবীতে কেউই একা একা বেঁচে থাকে না।বাঁচতে পারে না।”

দ্বিধান্বিত চাহনীতে তাকিয়ে আকস্মিক প্রশ্ন ছুড়লাম আমি,

” তাহলে কি মরে যাওয়া উচিত আমার?”

মেহেরাজ ভাই শীতল অথচ দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে।চোখজোড়া দেখাল রক্তলাল।মুখ দেখাল টানটান। চোয়ালও বোধহয় শক্ত হলো।আকস্মিক আমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।পকেটে হাত গুঁজে দৃঢ় কন্ঠে বললেন,

” এজ ইউর উইশ!”

অস্ফুট স্বরে বলে উঠলাম,

” মরব না। মরতে তো পারব না মেহেরাজ ভাই। আমি একা বেঁচে থাকতে পারব।পারতে হবে।”

মেহেরাজ ভাই কিছু বললেন না।শুধু তাকিয়ে থাকলেন জমাট রাগ নিয়ে।আমি ফের বললাম,

” আমি মনের ব্যাথা মনে রাখতে অভ্যস্ত মেহেরাজ ভাই। ”

মেহেরাজ ভাই এবারেও উত্তর দিলেন না।আমি আবারও বললাম,

” আমার সুখে কোন মানুষই হয়তো অতোটা খুশি হবে না যে সুখগুলো ভাগ করার প্রয়োজনীয়তা পড়বে মেহেরাজ ভাই।”

ফের আবার বললাম,

” সবশেষে আমি নিজের খেয়াল নিজে রাখতে পারি মেহেরাজ ভাই।এসবের পরও একা বেঁচে থাকতে পারব না? ”

মেহেরাজ ভাই আগের মতোই রক্তলাল চক্ষু নিয়ে তাকালেন।গম্ভীর স্বরে বললেন,

” না, পারবি না।”

কথাটুকু বলেই আর দাঁড়ালেন না মেহেরাজ ভাই।ধুপধাপ পা ফেলে চলে গেলেন দ্রুত।আমি অবশ্য তাকালাম না সেদিক পানে।

#চলবে…

এক মুঠো প্রণয় পর্ব-১৫+১৬

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_১৫
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

এই কয়দিনে মেহেরাজ ভাইয়ের সাথে বহুবার কথা হলেও বরাবরই স্বল্প শব্দে উত্তর দিয়েছি।রান্নার কাজ সহ, খাওয়ার সময়ে প্রায়সময় আমি, মেহু আপু, মেহেরাজ ভাই একসাথেই কাজ করেছি।সময়ের ব্যবধানে এই একসাথে কাজ করা কিংবা অল্প সময় কাছ থেকে দেখাতে আমি বারবারই মুগ্ধ হলাম মেহেরাজ ভাই নামক মানুষটাতে।এই মানুষটার ব্যাক্তিত্বের মতোই মানুষটার মধ্যে যত্ন, ভালোবাসা কোনকিছুরই কমতি নেই।এ কয়দিনে কতটুকু কি বুঝেছি জানা নেই, তবে এইটুকু বুঝেছি মেহেরাজ ভাই মানুষটা ভীষণ যত্নশীল।এই তো সেদিন শিমা আপা নেই বলে ভাতের মাড় ফেলার জন্য পাতিলটা হাতে নিতেই ছোঁ মেরে কেড়ে নিলেন মেহেরাজ ভাই।শাসনের সুরে বলে উঠলেন,

” বলেছি না কাজ করবি না?এক্ষুনি যা।হাত পুড়ে গেলে তখন?”

মেহেরাজ ভাইয়ের এমন অনেক শাসানো বাণীই এই কয়েক দিনে শুনতে হয়েছে।প্রথম প্রথম কোন অনুভূতি না হলেও একটা সময় পর আমার কাছে এই বাণীগুলোই চমৎকার বোধ হলো।আজকাল কেমন জানি অদ্ভুত আলাদা ভালো লাগা হৃদয় ছুুঁয়ে যায় উনার এসব সচেতন বাক্য শুনে।সেদিনে পর হঠাৎ একদিন মেহেরাজ ভাই একসাথে অনেকগুলো জামাকাপড় কিনে আনলেন।শুধু জামা নয় অবশ্য, শাড়িও এনেছিলেন।মেহু আপু বলেছিল এসব নাকি মেহু আপুকে নিয়েই কিনেছিলেন।আমি সেইবার আপত্তি জানালেও মেহেরাজ ভাই রাগে টানটান মুখ আর শক্ত চোয়ালেই থামিয়ে দিলেন।এর কিছুদিন পর একদিন রাতে ক্লান্তিতে শরীর নুইয়ে আসতেই রাতের বেলা না খেয়েই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।মেহু আপু অনেক ডাকাডাকি করলেও কেন জানি না তখন ঘুমই আমার কাছে বেশি গুরুত্ব পেল। সেইদিন আমার বাটন ফোনে টানা ত্রিশবার কল দিলেন মেহেরাজ ভাই।বাসায় একা থাকি বলে নাম্বারটা একদিন মেহেরাজ ভাইই নিয়েছিলেন।তাই বলে এভাবে নাম্বারটাকে কাজে লাগাবেন আমি কখনোই ভাবিনি।মোবাইলের আওয়াজে শেষমেষ বিরক্ত হয়ে চোখ মেলে তাকাতেই হলো আমায়। কল রিসিভড করতেই ওপাশ থেকে মেহেরাজ ভাই গম্ভীর গলায় শুধালেন,

” দরজা খুল। খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।”

মেহেরাজ ভাইয়ের সে কথাটাও কেন জানি না আমার ভালো লাগল সেদিন।কিয়ৎক্ষন তব্দা মেরে বসে থেকে উঠে গিয়ে দরজা খুললাম।দেখলাম মেহেরাজ ভাই হাতে খাবার প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।মুখটা টানটান করা।চিবুক শক্ত!কপালে বিরক্তির ভাজ।চোখমুখে একবার তাকিয়েই বুঝলাম উনি রেগে আছেন। কেন জানি না সেইদিন এই রাগটাও আমার ভালো লাগল।তবে ভালো লাগাটা প্রকাশ করলাম না অবশ্য।মেহেরাজ ভাই খাবারের প্লেট সমেত ঘরে ডুকলেন।চেয়ারের উপর প্লেটটা রেখে গিয়েই আবারও বের হয়ে বাইরে গেলেন।তারপর হাতে করে এক গ্লাস পানি এনে পাশে রেখে ক্ষোভ নিয়ে গম্ভীর আওয়াজে বললেন,

” চুপচাপ খেয়ে নিবি জ্যোতি।তুই বাচ্চা নোস যে তোকে জোর করে খাওয়াতে হবে।”

কথাটুকু বলেই উনার দাম্ভিক চেহারায় রাগ ফুটিয়ে চলে গেলেন।আমি অবশ্য সেদিন চুপচাপ খেয়ে নিয়েছিলাম।এরপরও অনেকবার মেহেরাজ ভাই শাসন করেছেন, সচেতন করেছেন।আজকাল এসব ভালো লাগায় পরিণত হয়েছে।পৃথিবীতে নিজের খেয়াল রাখার মতো কাউকে পেলে নিঃসন্দেহে সবারই ভালো লাগে।আমার ক্ষেত্রেও ব্যাতিক্রম হলো না।এই যেমন পরশু যখন ছাদে গিয়েছিলাম তখন ছাদে মেহেরাজ ভাইও ছিলেন।উনাকে দেখে বেশিক্ষন না থেকে ছাদ ছেড়ে চলে আসতে নিতেই ছাদের দরজায় পা লেগে সাংঘাতিক ভাবে পড়ে গেলাম।হাতের তালুর দিকটা ছাদের খসখসে ফ্লোরে ঘষা খেয়ে বেশ খানিকটা কেঁটে গেল।সঙ্গে সঙ্গে ফিনিক রক্ত বের হলো। মেহেরাজ ভাই তা খেয়াল করেই রাগ ঝেড়ে চাপাস্বরে বললেন,

” দেখেশুনে হাঁটিস নাকি চোখ কপালে রেখে হাঁটিস?এত বড় মেয়ে হয়ে পড়ে যায় কিভাবে মানুষ?”

মেহেরাজ ভাইয়ের কথাটা চরম অপমানিত বোধ হলেও কেন জানি না আমার ভালো লাগল। নিজের দোষ স্বীকার করে স্পষ্টভাবে বলে বসলাম,

” খেয়াল করিনি। ”

মেহেরাজ ভাই ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন ছুড়লেন,

” কি খেয়াল করিসনি?”

নিরস গলায় বললাম,

” এভাবে পড়ে যাব বুঝে উঠিনি।”

” পড়ে গিয়ে হাত কেঁটে বুঝে উঠিনি বললে লাভ আছে?”

আমি একপলক তাকিয়ে গলা ঝেড়ে বললাম,

” কেউ পড়ে গেলে এভাবে রাগ ঝেড়ে কথা বললেও তো বিশেষ লাভ নেই মেহেরাজ ভাই।”

মেহেরাজ ভাই আমার কথাটায় বিরক্ত হলেন।কপাল কুঁচকে ঝুঁকে দাঁড়ালেন আমার দিকে। নিজের বলিষ্ঠ হাতটা বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে।তারপর শান্তভাবে বললেন,

” উঠ। ”

আমি উনার দিকে চাইলাম।হাতটা না ধরেই উঠে দাঁড়িয়ে পড়লাম।মেহেরাজ ভাই বুক টানটান করে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। হাত দুটো টাউজারের পকেটে গুঁজে সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতেই বললেন,

” গুড!নিজে নিজে যেমন দাঁড়ালি?ঠিক তেমনই নিজেকে নিজে সেইফ রাখাটাও শিখ।”

কথাটুকু বলে মেহেরাজ ভাই নেমে গেলেন।পিঁছু পিঁছু নামলাম আমিও।বাসায় পা রাখতেই দেখলাম মেহেরাজ ভাই সোফায় বসে আছেন।আমাকে দেখেই বলে উঠলেন,

” এদিকে আয়।”

আমি না গিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে থাকলাম। কেন ডাকছেন তা বুঝার চেষ্টা করলাম।কিন্তু বুঝে উঠার আগেই মেহেরাজ ভাই দ্বিতীয়বার রাগ ঝেড়ে বলে উঠলেন,

” কি হলো কথা শুনতে পাসনি?”

মাথা নাড়িয়ে বললাম,

” পেয়েছি।”

উনি ডান ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

” তো দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”

আমি এবার কথা বাড়ালাম না।উনার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মেহেরাজ ভাই মাথা তুলে তাকালেন একবার শীতল চাহনীতে। এরপর বললেন,

” কোন হাত কেঁটেছে?”

” ডান হাত।”

” হাত দে।”

আমি এবারও উনার কথা শুনলাম না।হাত না বাড়িয়ে দিয়ে সূক্ষ্ম চোখে উনাকে খেয়াল করলাম। মেহেরাজ ভাই বোধহয় এবারও বিরক্ত হলেন।ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

” কি হলো?”

বললাম,

” না মানে, কেন? ”

মেহেরাজ ভাই এবার জবাব দিলেন না।নিজ থেকেই আমার ডান হাতটা টেনে নিলেন।কাঁটা জায়গাটা পরিষ্কার করে মলম লাগিয়ে দিলেন।তারপর আর কোন কথা না বলে উঠে চলে গেলেন।আমি পুরোটা সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম আর সবকিছু খেয়াল করে গেলাম।একটা মানুষ এতটা যত্ন করতে পারে?ছোটবেলা থেকে যত্ন না পাওয়া আমার কাছে এইটুকু যত্নই বিশাল মনে হলো।এইটুকু খেয়াল রাখাও অনেক বেশি বোধ করলাম।মনে মনে মুগ্ধ হলাম।ভালোবাসার মানুষ থেকে স্বল্প যত্নও বৃহৎ খুশির কারণ হয়।মাঝে মাঝে আপসোস হয় কেন উনার ভালোবাসা পেলাম না।যদি উনার ভালোবাসা পেতাম তবে নাজানি কতোটা যত্নে আগলে রাখতেন উনি?আচ্ছা, সামান্তা আপুকে কতোটা যত্নে রাখতেন উনি?ইশশ!আমার ভাগ্যে যদি উনার ভালোবাসাটুকু জুটত?আনমনে এসব অহেতুক ভাবনা ভেবেই আবার সেই ভাবনাকে তীব্র জেদের অন্তরালে লুকিয়ে রাখি।

.

হঠাৎ হওয়া সেই সাদামাটা, যন্ত্রনাময় বিয়ের পর সেই বিধ্বস্ত রূপে এই বাসায় আসার পর মাস পার হলো।ধীরে ধীরে সময় কাঁটল।বাড়ি যাওয়ার সময় হয়ে আসল যেন খুব দ্রুত।টেস্ট পরীক্ষার এক সপ্তাহ আগেই বাড়ি যাওয়ার সময় ঠিক হলো।আমি ব্যাগ গুঁছিয়ে রাখলাম রাতেই।সকালে উঠে হাত মুখ ধুঁয়ে রুম ছেড়ে বের হয়েই মেহু আপুর ঘরে গেলাম।মেহু আপু তখনও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে দেখে আবারও ফেরত আসলাম নিজের ঘরে।জানালা দিয়ে কয়েক পলক তাকিয়েই ভাবলাম, এটাই হয়তো এই বাসায় কাটানো শেষ দিন।বাড়িতে যাওয়ার পর দাদীকে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে বুঝাতে হবে যাতে আমাকে আর এখানে ফেরত না আসতে হয়।বাড়িতে যন্ত্রনা, কষ্ট, অপমান যাই থাকুক তবুও একজনের ঘাড়ে দায়িত্ব হয়ে পড়ে থাকার থেকে স্বস্তি আছে।কথা গুলো ভাবতে ভাবতেই ঘন্টা পার হলো।জানালার ওপাশে তাকানো অবস্থাতেই কানে এল মেহেরাজ ভাইয়ের গলা ঝাড়ার আওয়াজ। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম মেহেরাজ ভাই আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছেন।মেহেরাজ ভাইয়ের নিঃশব্দে চলন সম্পর্কে জানা আছে বলেই অবাক হলাম না আর।বলল,

” কিছু বলবেন মেহেরাজ ভাই?”

মেহেরাজ ভাই তাকালেন। বুকে হাত গুঁজে বললেন,

” বিকালে রওনা দিব।ব্যাগ গুঁছিয়ে নিস। ”

” ব্যাগ গুঁছিয়ে ফেলেছি রাতেই।”

” এত তাড়া?”

” তাড়া তো একটু থাকবেই মেহেরাজ ভাই।ওখানে দাদী আছেন, মিথি আছে, মিনার ভাই আছে।সব আপন মানুষদের রেখে এসেছি ওখানে। তাড়া থাকবে না?”

মেহেরাজ ভাই ঠোঁট চওড়া করে কিছু বলতে নিতেই মোবাইলে আওয়াজ হলো। আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। মিনার ভাই নামটা জ্বলজ্বল করছে বাটন ফোনের চারকোনা স্ক্রিনে।বোধহয় দাদীই কল দিতে বললেন।যাওয়ার কথা শোনার পর থেকেই কাল থেকে এই পর্যন্ত বেশ কয়েকবার কল দিয়ে ফেলেছেন দাদী। যেন অধীর আগ্রহে আমার যাওয়ার অপেক্ষা করে আছেন।আমি হাসলাম হালকা। মোবাইলটা তুলে নিতে নিতেই মেহেরাজ ভাইকে বললাম,

” কিছু বলবেন মেহেরাজ ভাই?বলে ফেলুন। ”

মেহেরাজ ভাই একনজর মোবাইলের দিকে তাকিয়েই বললেন,

” তেমন কিছু নয়।তুই কথা বলে নে। আর হ্যাঁ, বিকালে তৈরি হয়ে থাকিস।”

কথাটুকু বলেই চলে গেলেন উনি।আমি একনজর তাকিয়ে মিনার ভাইয়ের কল উঠালাম।বললাম,

” মিনার ভাই,এত সকালে কল দিয়েছো?দাদী বলল বুঝি?”

মিনার ভাই কয়েক মিনিট চুপ থাকলেন।তারপর বলল,

” না, দাদী বলেনি।”

ফের প্রশ্ন করলাম,

” তবে?তুমি কল দিয়েছো?”

” কেন?আমি বুঝি কল দিতে পারি না তোকে? ”

” তেমন ভাবে বলিনি মিনার ভাই।”

মিনার ভাই প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করল,

” কখন আসছিস?”

জবাবে বললাম,

” মেহেরাজ ভাই বলেছে বিকালে রওনা দিবে। আসতে আসতে রাত হবে। ”

” ওহ।আচ্ছা রাখছি।”

মিনার ভাই কথাটা বলেই কল রাখলেন।আমি ছোট্ট শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালাম।মেহু আপুর ঘরে গিয়ে মৃদু আওয়াজে ডাকলাম,

” আপু?উঠবে না?”

মেহু আপু চোখমুখ কুঁচকে তাকালেন।ঘুমজড়ানো কন্ঠে বললেন,

” জ্যোতি?এত তাড়াতাড়ি কি করে উঠিস ঘুম থেকে?”

কথাটা বলেই আপু আবারও চোখ বুঝে নিলেন। আমি হাসলাম কেবল। মেহু আপু বয়সে আমার থেকে বড় হলেও মাঝে মাঝে কেন জানি না আমার কাছে আপুকে বেশ প্রাণবন্ত তরুণী বয়সের কোন মেয়ে মনে হয়।যে হাসতে জানে, গাইতে জানে, মজা করতে জানে, আবার গম্ভীরভাবে কথাবার্তাও বলতে পারেন।কোন সময় বেশ প্রাণবন্ত তো কোনসময় বেশ গম্ভীর।

.

বিকাল হলো।মেহু আপুকে বিদায় দিয়ে রওনা হলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। রিক্সায় মেহেরাজ ভাই আর আমি পাশাপাশি একসাথেই বসলাম।মাঝেমাঝে রাস্তার আঁকেবাঁকে রিক্সার ঝাকড়ানোতে মেহেরাজ ভাইয়ের শরীর আর আমার শরীর মিলিয়ে গেল।সেই অপ্রত্যাশিত শরীরের ছোঁয়ায় তীব্র অস্বস্তিতে আমি আড়ষ্ট হয়ে থাকলেও মেহেরাজ ভাইয়ের মুখভঙ্গিতে তেমন কোন আড়ষ্টতার ছাপ পড়ল না।উনি বেশ স্বাভাবিক ভাবেই টানটান চাহনী নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।একপর্যায়ে রিক্সা থামল। মেহেরাজ ভাই নামার আগেই আমি নামলাম দ্রুত।এক হাতে ব্যাগটা নিতেই মেহেরাজ ভাই নামলেন।ভাড়া মিটিয়ে শীতল চাহনীতে এক নজর আমার দিকে তাকিয়েই ব্যাগটা কেড়ে নিলেন।পা বাড়াতে বাড়াতে বললেন,

” রিক্সা থেকে ওভাবে লাফিয়ে নামলি কেন?পড়ে গেলে কি হতো? তোর কাঁটাছেড়া হাত পা সমেত তোকে তোর দাদীর কাছে পৌঁছে দিয়ে আসতাম?”

আমি শুনলাম। পা চালিয়ে বললাম,

” আমাকে যথাযথ সুস্থ আর আঘাতবিহীন হিসেবে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন?”

মেহেরাজ ভাই আমার দিকে তাকালেন।ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠলেন,

” তো তোকে আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত করে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলাম?”

তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসলাম।বললাম,

” আজকের পর তো শেষই আপনার দায়িত্ব।এতদিন সুসম্পন্ন ভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারলে শেষ একদিনে আর এমন কি হয়ে যাবে?”

আমার কথার বিনিময়ে মেহেরাজ ভাই উত্তর দিলেন না।আমিও আর আগ বাড়িয়ে কথা বললাম না। অল্প সময় পর বাসে উঠলাম। পাশাপাশি বসলেন মেহেরাজ ভাইও।বাসের সিটে দুইজনের মাঝে অল্প দূরত্ব থাকায় এবার আর অস্বস্তি হলো না।চার কোণা জানালার ওপাশে চোখ রেখেই দৃষ্টি স্থির করলাম।যাত্রাপথের অর্ধেকটা পথই কাঁটল জানালার ওপাশের বাইরের দৃশ্যপট দেখতে দেখতেই।

#চলবে….

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_১৬
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

ঘুম ভাঙ্গল মেহেরাজ ভাইয়ের কাঁধে মাথা রেখেই।এপাশ ওপাশ তাকিয়ে জানালার ওপাশটায় চোখ পড়তেই বুঝলাম রাত হয়েছে।বাসে কখন যে চোখ লেগে এসেছিল বুঝেই উঠিনি আমি।তারপর ঘুমের ঘোরেই বোধহয় মেহেরাজ ভাইয়ের কাঁধে হেলে পড়েছিলাম।মেহেরাজের ভাই নির্ঘাত বিরক্ত হয়েছেন এই ব্যাপারে?বিষয়টা ভেবেই নিজের প্রতি রাগ জম্মাল।একটা মেয়ে হয়ে একজন পুরুষ মানুষের কাঁধে নিজ থেকে ঢলে পড়াটা নিশ্চয় খুব একটা ভালো দেখায় না।বরং চমৎকার বেহায়াপনা বোঝায় এতে।নিজেকে এই মুহুর্তে জঘন্যতম বেহায়া মানুষ বোধ হলো আমার।দ্রুত মেহেরাজ ভাইয়ের কাঁধ থেকে মাথা সরিয়ে সোজা হয়ে বসলাম।জানালার অপর প্রান্তে তাকাতে নিতেই মেহেরাজ ভাই নড়েচড়ে বসলেন। আমি এক পলক তাকালাম উনার দিকে।সঙ্গে সঙ্গেই মেহেরাজ ভাই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

” ঘুম শেষ? ”

আমি ইতস্থত বোধ করলাম উত্তর দিতে।পরমুহুর্তেই স্বাভাবিক হয়ে স্পষ্ট গলায় বলে উঠলাম,

” মেহেরাজ ভাই, আমি দুঃখিত।বিশ্বাস করুন আমি ইচ্ছে করে আপনার কাঁধে মাথা রাখিনি।বোধহয় ঘুমের ঘোরেই মাথা রেখেছিলাম।এমনটা হবে জানলে আমি সর্বোচ্ছভাবে সচেতন থাকতাম যাতে চোখে ঘুম না নামে।”

মেহেরাজ ভাই কুঁচকানো ভ্রু আরো কুঁচকে নিলেন।জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে উঠলেন,

” রাতে ঘুমাসনি?নাকি বাড়ি যাওয়ার আনন্দে সারারাত ঘুম হয়নি তোর?”

মেহেরাজ ভাই প্রশ্নটা অতি স্বাভাবিক ভাবে করলেও এই প্রশ্নটা দ্বারাই বুঝতে পারলাম উনি বিরক্ত হয়েছেন।শুধু বিরক্ত নয়, চরম বিরক্ত হয়েছেন।সহসা নিজের মধ্যে খারাপ লাগা কাজ করল।একটা মানুষ বিরক্ত হচ্ছে আমার কারণে বিষয়টাতে অবশ্যই খারাপ লাগার কথা। আমি চোখ ছোট ছোট করে আড়ষ্ট গলায় বলে উঠলাম,

” ঘুমিয়েছি।তবুও বাসে উঠার পর ঘুম আসল কেন জানা নেই।”

মেহেরাজ ভাই বিনিময়ে বললেন,

” ঝিমুতে ঝিমুতে তো তোর ঘাড়টা ভেঙ্গে জানালার অপর প্রান্তে যাচ্ছিল আরেকটু হলে।তার কিছুক্ষন পরে দেখি ঘুমিয়েই গেছিস।তাও আবার জানালা ঘেষে মাথা রেখে। কয়েকবার ঠাসঠাস করে মাথায় লাগল ও তোর।কিন্তু তোর ঘুম দেখি ভাঙ্গলই না।তখনই বুঝলাম গভীর ঘুম!তাই জিজ্ঞেস করলাম রাতে ঘুম গিয়েছিলি কিনা।”

মেহেরাজ ভাই বোধ হয় আমার আড়ষ্টতা কাঁটাতেই কৈফিয়তের সুরে কথাগুলো বললেন।তবুও আমার খারাপ লাগা কাঁটল না।মনে মনে নিজেকে হাজারবার সচেতন করলাম আর যাতে ঘুম না পায়।আর যাতে উনার কাঁধে ঘুমন্ত অবস্থায় হেলে পড়তে না হয়।পরমুহুর্তেই মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগল।মেহেরাজ ভাই মাত্রই বললেন ঘুমিয়েছিলাম জানালা ঘেষে মাথা রেখে।তার মানে উনার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাইনি।তবে?উনিই কি আমার মাথাটা উনার কাঁধে রেখেছেন?বিষয়টুকু ভেবেই সঙ্গে সঙ্গে মন থেকে মুঁছে নিলাম ভাবনাটা।এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীন।হয়তো ঘুমের ঘোরে আমিই মাথা রেখেছিলাম।বললাম,

” খেয়াল করিনি মেহেরাজ ভাই।আপনাকে ইচ্ছে করেই শুধু শুধু বিরক্ত করিনি।এটা সম্পর্ণ অনিচ্ছাকৃত।”

মেহেরাজ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন ছুড়লেন,

” কি?”

বললাম,

” আপনার কাঁধে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তাই।”

মেহেরাজ ভাই এবার আর কিছু বললেন না।কাঁধ ঝাকিয়ে সোজা হয়ে বসলেন। আমি ও আর তাকালাম না উনার দিকে। বাকিটা পথ জানালার ওপাশে অন্ধকার পথ দেখেই কাঁটালাম।

.

আমরা বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত নয়টা কি দশটা বাঁজল। দাদী তখনও ঘরের সামনে কাঠের চেয়ারে বসা।বোধ হয় আমাদেরই অপেক্ষা করছিল।বাড়িতে পৌঁছানো মাত্রই উঠোনে দাদীকে বসা অবস্থায় দেখে খুশিতে চকচক করে উঠল আমার চোখজোড়া।এগিয়ে গিয়ে সালাম দিয়েই জড়িয়ে ধরলাম দাদীকে।দাদীর শরীরে সেই পান চিবানো স্যাঁতস্যাঁত ঘ্রাণটা নিয়েই তৃপ্ত হলো মন।কতক্ষন জড়িয়ে রাখলাম জানি না।এক পর্যায়ে দাদীই ধমক দিয়ে বলে উঠলেন,

” হইছে তোর? আইয়াই এমনে ঝাপটাইয়া ধরছস ক্যান?ছাড়।দমবন্ধ হইয়া আইতাছে আমার।”

দাদী যে এটা সম্পূর্ণ মিথ্যে বলছে তা আমার জানা। তবুও ছেড়ে একপাশে দাঁড়ালাম।বলে উঠলাম,

” কেমন আছো দাদী? এত রাতে উঠানে চেয়ার নিয়ে বসে আছো যে?আমাদের অপেক্ষায়?”

দাদী নিখুঁত ভাবে গোপন রাখলেন নিজের ভালোবাসা।বললেন,

” বাইরেডায় বাতাস আছে দেহস না?তার লাইগাই বইসা ছিলাম।সর, রাজের লগে কথা কই।”

আমি সরে দাঁড়ালাম।দাদী দু পা এগিয়ে মেহেরাজ ভাইয়ের সামনে দাঁড়াতেই মেহেরাজ ভাই ঠোঁট চওড়া করে হেসে সালাম দিলেন। দাদী বোধহয় খুশিই হলো।সালামের উত্তর দিয়েই বলে উঠলেন,

” আইতে আইতে এত রাইত করলা।আরো তাড়াতাড়ি বাইর হইতে পারতা তো।”

মেহেরাজ ভাই ভদ্রভাবে উত্তর দিলেন,

” বিকালের বাসে উঠেছিলাম।রাস্তায় হালকা জ্যামও ছিল তাই দাদী।ভালো আছেন আপনি? ”

” হ, ভালাই আছি।চলো, ঘরে চলো।টিনের ঘরে ঘুমাইতে পারবা তো?নাকি তোমাগো বাড়ির চাবি আনছো?”

মেহেরাজ ভাই পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়ালেন।বললেন,

” আসলে দাদী, আমি তো থাকার প্রস্তুতি নিয়ে আসিনি।তাই বাড়ির চাবিও আনিনি।রাতের বাসেই ফেরত যাব।”

দাদী মুহুর্তেই ক্ষেপে উঠলেন।কিঞ্চিৎ গলা উঁচিয়ে বলে উঠলেন,

” তা কি কইরা হয়?আইছো যহন রাইতটা থাইকাই যাইবা।এই কথায় শেষ কথা।”

দাদীর কথায় মেহেরাজ ভাই চুপ থাকল কিয়ৎক্ষন।তারপর নিজ উদ্যমে বুঝাতে লাগলেন যে উনার রাতে ফিরে যাওয়াটাই উচিত কাজ হবে।মেহু আপুও বাসায় একা।কিন্তু দাদী মানতে নারাজ।অবশেষে ঠিক হলো মেহেরাজ ভাই রাতে থাকবেন।উঠোনে এই নিয়ে সিদ্ধান্ত ঠিক করে তবেই ঘরে ডুকলেন দাদী। পিঁছু পিঁছু আমি আর মেহেরাজ ভাইও গেলাম।স্যাঁতস্যাঁতে মাটির মেঝেতে পা রেখে মেহেরাজ ভাইয়ের কিরুপ প্রতিক্রিয়া হলে জানা নেই।তবে জুতোজোড়া খুলতে নিতেই আমি বলে উঠলাম,

” জুতো না খুললে কিছু হবে না মেহেরাজ ভাই।আপনার পায়ে ময়লা লাগবে নয়তো।”

মেহেরাজ ভাই একবার তাকালেন। কি বুঝে জুতা না খুলে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন।দাদী উনাকে বসালেন আমার ঘরের কাঠের খাটটায়।কিছুক্ষন সেখানেই গল্পগুজব করলেন দাদী আর মেহেরাজ ভাই। আমি ততক্ষনে দাদীর ঘরে নিজের পরনের জামাটা পাল্টে সুতির সালোয়ার কামিজ পরলাম।মাথায় ঘোমটা টেনে বের হয়েই বাইরের আলোটা জ্বালিয়ে কলে গিয়ে চোখমুখে পানি দিলাম।একবার চারপাশে তাকিয়ে অন্ধকারে গাছ গাছালিগুলো দেখলাম।কতদিন পর আবার সেই গ্রামে। আবার সেই প্রশান্তির বাতাস। আবার সেই গাছাগাছালি নড়েচড়ে উঠা সবুজ পাতার সান্নিধ্যের ছোঁয়া।চোখ বুঝে একবার অনুভব করলাম আশপাশের ঠান্ডা হাওয়া।তারপর আবারও ঘরে গেলাম।নিজের রুমের দরজা ঘেষে দাঁড়াতে কানে এল দাদীর গম্ভীর স্বর,

” হুনো রাজ, তোমারে ভালা ছেলে জানি বইলাই তোমার লগে ঐ দুর্দশায়ও বিয়া দিতে আমি এক মুহুর্তেই মত দিয়া ফেলছিলাম। রাইতের বেলায় ঘুমাইতে আইলে অন্তত এইটুকু বিষয় ভাইবা স্বস্তি পাইতাম যে জ্যোতিরে একজন ভালা মানুষের হাতে তুলে দিতে পারছি।জ্যোতিরে ছোড থেইকা বড় আমিই করছি।শরীরের অবস্থা এহন আমার ভালা যায় না।কয়দিন বাঁচি তারও ঠিক নাই।শরীর দুইদিন ঠিক থাহে যদি তো তিনদিন থাহে বেঠিক।ভাবছিলাম মইরা গেলেও স্বস্তি পামু।জ্যোতিরে অন্তত তোমার মতো একডা ভালা পোলার হাতে তুইলা দিছি। কিন্তু হাছা কইতে এহন আর সেই স্বস্তি পাই না যেইদিন থেইকা হুনছি তোমার লগে সামান্তার ভালোবাসার সম্পর্ক আছে।”

কথাগুলো শুনেই আমার পা থেমে গেল মুহুর্তেই। তারমানে দাদীও সবটা জানে?মেহেরাজ ভাই যে সামান্তা আপুকে ভালোবাসে এটা দাদীও জানে বোধ হতেই মস্তিষ্ক শূণ্য অনুভব করলাম।দাদী কি করে জানে?কে বলল?আব্বা এসেই কি দাদীকে বলেছে এসব?এসব ভাবতে ভাবতেই আঙ্গুলে ওড়না পেঁচিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকলাম সেখানে। মেহেরাজ ভাই গলা ঝাড়লেন। উত্তরে বলে উঠলেন,

” দাদী,এটা তো সত্যিই যে জ্যোতির সাথে আমার বিয়েটা স্বাভাবিক ভাবে হয়নি।তাই সংসারটাও স্বাভাবিক ভাবে হবে আশা করাটা বোকামো নয়?বিয়েটা আকস্মিক ভাবেই হয়েছে।তো আমার আগে একটা সম্পর্ক থাকা, কিংবা তখন অন্য কাউকে ভালোবাসাটা তো অস্বাভাবিক ছিল না দাদী।তাই না?আপনারা তো তখন খোঁজ নিলেন না আমি কাউকে ভালোবাসি কিনা।জোর করেই একটা সিদ্ধান্ত ছাপিয়ে দিলেন।তাও বিয়ের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে।”

দাদী প্রশ্ন ছুড়লেন,

” ভুলটা আমগোরই কইতে চাইতাছো তুমি?তার মানে তুমি এহনও ঐ সামান্তারেই ভালোবাসো?জ্যোতিরে মানবা না তাই তো?”

মেহেরাজ ভাই নরম গলায় বললেন,

” আমি এমন কোন কথা উল্ল্যেখ করিনি দাদী।বিষয়টা ভুল ভাবে নিচ্ছেন আপনি।আমার সাথে সামান্তার সম্পর্ক ছিল।কিন্তু এখনও সম্পর্ক আছে এমনটা বলিনি তো।জ্যোতির সাথে বিয়েটা আমি অস্বীকার করি না।জ্যোতিকেও অস্বীকার করি না।আর এমনও বলিনি যে আমি জ্যোতিকে মানব না বা মানি না।”

দাদী বলল,

“তো কি কইতে চাও?দুইজনরেই তুমি জীবনে রাখতাছো?একজনরে ভালোবাসতা, অন্যজন কেবল চাপাইয়া দেওয়া সিদ্ধান্ত হইয়াই থাকব গোটা জীবন?”

মেহেরাজ ভাইয়ের গলাটা এবার আরো শান্ত শুনালো।নরম কন্ঠে অল্প আওয়াজে বলতে লাগলেন,

” ভালোবাসা বিষয়টা তো অতোটা স্বস্তা নয় দাদী।একজনকে ভালোবেসেছিলামই যখন তখন তাকে সারাজীবন পাওয়ার স্বপ্নও দেখেছিলাম।তাকে মনে জায়গাও দিয়েছিলাম।সেসব কিছু কি এক মুহুর্তেই মুঁছে দেওয়া যায়? ভালোবাসা তো অতোটা ঠুনকো নয়।তবে এমনটাও নয় যে জ্যোতির প্রতি আমার কোনদিন অনুভূতি জম্মাতে পারে না।পারে, অবশ্যই পারে।তবে সেটা সময় সাপেক্ষ!ভালোবাসা কখনো কয়েক মুহুর্তেই সৃষ্টি হয় কখনও বা কয়েক যুগ লেগে যায়।কখনো একজনেই সীমাবদ্ধ থাকে, কখনো বা নতুন করে অন্য কাউকেও ভালোবাসা যায়।”

দাদী চুপ থাকলেন কিছুক্ষন। তারপর অনুরোধের সুরে বললেন,

” তোমারে ভরসা করি রাজ।ভরসাডা ভাইঙ্গা দিও না দয়া কইরা।জ্যোতির জীবনডা শেষ করার দায়টা বয়ে বেড়াইতে যে পারুম না আমি।”

মেহেরাজ ভাই গম্ভীর স্বরে বলল,

” আশা করি আপনার ভরসা ভাঙ্গবে না।”

তারপর আর কোন কথা আসল না ও ঘর থেকে।কয়েক মুহুর্ত পর দাদী বের হলেন ঘর ছেড়ে। আমায় ঘরের সামনে দেখে বলে উঠলেন,

” আজ তোর আব্বাগো ঘরে খাবি।তোর ছোট আম্মায় রান্না করতাছে কইয়া গেছিল আনোয়ার ঘন্টা দুই আগে।”

আমি চোখ ছোট ছোট করে তাকালাম। আব্বাদের ইটের প্রাচীরের ঘরে সেই ছোটবেলায় আম্মা চলে যাওয়ার পর দুয়েকটা বছর কেঁটেছে আমার।সেই দুয়েকটা বছর ছিল আমার কাছে অসহনীয় যন্ত্রনার। আম্মার প্রতি আব্বার তীব্র রাগ, ক্ষোভ আর ক্রোধের স্বীকার হতাম তখন আমি আর মিথি।মিথি তখন ছোট্ট শিশু।নরম তুলতুলে ঠোঁট উল্টে আওয়াজ তুলে কান্না করে উঠত আব্বার ধমকে।আর আমি নিরবে চোখের পানি ফেলতাম।কখনো বা আম্মুর প্রতি তীব্র অভিমান নিয়ে অনশন করতাম। আম্মার কাছে কি সেই অভিমান পৌঁছাত? পৌঁছাত না। আমার আম্মা আব্বা দুইজনই নিষ্ঠুর। একজন সন্তানের কথা না ভেবে অন্য পুরুষকে আপন করেছে। অন্যজন চিরকাল কেবল আমায় ধমক, চড়- থাপ্পড় আর অবহেলা দিয়েছেন।সেই চড়- থাপ্পড় থেকে বাঁচাতেই মূলত দাদী আমাদের এই টিনের ঘরে আনলেন।তারপর থেকে অবশ্য আর কখনো পা রাখা হয়নি আব্বার সেই ঘরে।সেই যে দাদীর এই টিনের ঘরে থাকা শুরু করেছিলাম। এখন পর্যন্তও সেই ঘরই আমার বাসস্থান।দাদীরও এই টিনের ঘরটা ভীষণ প্রিয়।কারণ এই ঘরটা দাদার থাকাকালীন ঘর।আব্বা, ফুফু সহ দাদা-দাদীর দাম্পত্য জীবন এই ছোট্ট টিনের ঘরেই কেঁটেছে।আব্বা, ফুফুরা সবাই ছোট থেকে বড় হয়েছেও এই টিনের ঘরটাতেই।মাঝেমাঝে টিন পাল্টানো হলেও দাদী নাকি এই ঘরে দাদার অস্তিত্ব খুঁজে পায়।খুঁজে পায় দাদার ভালোবাসা ও।তাই তো এই ঘর ছাড়া, এই বাড়ি ছাড়া দাদীকে কখনো একরাতও অন্য কোথাও থাকতে দেখিনি।ভাবনা ছেড়ে বেরিয়ে দাদীর কথায় মাথা নাড়ালাম।জিজ্ঞেস করলাম,

” উনাদের আবার এসব করার কি দরকার ছিল দাদী?তুমি যা রান্না করতে তাই নাহয় খেয়ে নিতাম।”

দাদী হালকা হাসলেন।বললেন,

” তুই যাওয়ার পর থেইকা তোর ফুফুই রাইন্ধা দিয়া যায়।আইজকা ও নাই বাড়িতে। তাই তোর ছোট আম্মায় খাবার দিয়া গেছে।”

দাদীর কথায় কষ্ট হলো।মানুষটার বয়স হয়েছে।চোখমুখ কেমন আগের থেকে শুকিয়ে গেছে।চোখের দৃষ্টিও কেমন ফাংসে হয়ে এসেছে যেন।আমার না থাকাকালীন না জানি কতোটা কষ্টে কেঁটেছে।আচ্ছা, দাদীর যে সকালে চা খাওয়ার অভ্যাস।সকাল সকাল চা করে দিত কি ফুফু?দাদীর যে মাথায় তেল দেওয়ার অভ্যাস আছে প্রতিদিন।প্রতিদিন তেল দিয়ে দিত কেউ?দাদীর যে প্রায়সই কোমড় ব্যাথায়, হাঁটু ব্যাথায় মলম লাগাতে হতো। কে লাগিয়ে দিত?দাদীকে যে প্রতিবেলায় বেলায় ঔষুধ দিতে হতো।কে দিত প্রতিবেলায় ঔষুধ?দাদীর মাথা ব্যাথা করলে যে উঠোনে বসে দাদীর চুলে সিঁথি কেঁটে দিতাম।কে দিত?আমি বিহীন দাদীর সময়গুলো কি আসলেই খুব ভালো কেঁটেছে?জানা নেই।মুহুর্তেই দাদীকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলাম।অস্ফুট স্বরে বললাম,

” এবার আর তোমায় ছেড়ে যাব না দাদী।রান্না, চলাফেরা সব আগের মতো খেয়াল রাখব। ”

দাদী ধমক দিয়ে বললেন,

” হ, তুই এহন পরীক্ষার পড়া ফালাইয়া আমার পেঁছনে পইড়া থাইকবি?”

বললাম,

” থাকলে কি সমস্যা?”

দাদী আমাকে অনুকরন করেই ব্যঙ্গ করে বললেন,

“এ্যাঁ,থাকলে কি সমস্যা? বহুত সমস্যা।তোরে কইত হইব ক্যান?”

দাদীর কথা শুনে আমি হেসে দিলাম আওয়াজ করে।কতদিন পর এভাবে আওয়াজ তুলে হাসলাম জানা নেই।কিয়ৎক্ষন সে হাসিতে মেতে থাকতেই চোখে পড়ল মেহেরাজ ভাইয়ের অদ্ভুত দৃষ্টি। মুহুর্তেই আমার হাসিটা থেমে গেল।

#চলবে…

এক মুঠো প্রণয় পর্ব-১৩+১৪

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_১৩
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

সকাল সকালই সামান্তা আপু আর ছোট চাচী সামান্তা আপুর মামাবাড়িতে রওনা দিলেন।মেহেরাজ ভাই সে খবর পেয়েই বোধ হয় বেলা বারোটা পর্যন্ত ঘুমোলেন।তখন শিমা আপা ও রান্না করে চলে গিয়েছেন।মেহু আপু বেরিয়েছেন আরো ঘন্টা দুয়েক আগে।বাসায় কেবল আমি আছি বলেই চা টা নিয়ে মেহেরাজ ভাইয়ের ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম।ঘরে ডুকে দেখলাম মেহেরাজ ভাই গম্ভীর মুখ করে বসে আছেন।সামান্তা আপুকে তার মামাবাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শটা উনিই দিয়েছিলেন।তাই বোধহয় প্রিয়মানুষের চলে যাওয়ার কারণেই মলিন হলো উনার মুখ।আমি পা বাড়িয়ে সামনে গেলাম।নিজ থেকে বললাম,

” একটা জটিল সম্পর্ক বয়ে নেওয়ার থেকে একটা সহজ সম্পর্ক বয়ে চলা সহজ মেহেরাজ ভাই।”

মেহেরাজ ভাই আমার দিকে চাইলেন।বিছানা ছেড়ে উঠে কপালে পড়া অগোচাল চুলগুলো পেছনে ঠেলে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। গলা ঝেড়ে বললেন,

” সামান্তার সাথে সম্পর্কটা আগে সহজ ছিল।এখন ক্রমশ জটিলই হবে। ”

আমি চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বললাম,

” উল্টোটা ভাবলে?আমার আপনার সম্পর্কটা জটিল ছাড়া সহজ হবে বলে মনে হয় না।তার থেকে বরং যা সহজ আছে তাকে জটিল না করাই ভালো নয়? আমি দুদিনের অতিথি মেহেরাজ ভাই।বাড়ির অবস্থা স্বাভাবিক হলে ফিরে যাব।তারপর ভাগ্যে থাকলে এডমিশনে কোথাও চান্স মিললে বাড়ি ছেড়ে সেখানে চলে যাব।শুধু শুধু দায়িত্বের কথা ভেবে আমার বিষয়টা না ভাবলেও চলবে মেহেরাজ ভাই।”

মেহেরাজ ভাইয়ের চোয়াল শক্ত হলো।মুখ টানটান করে গম্ভীর স্বরে ধমকের ন্যায়ই জবাব দিলেন,

” আমাকে কি মেরুদন্ডহীন মনে হয় তোর?”

“না,তবে এমন একটা সম্পর্ক বয়ে ও কি লাভ আছে মেহেরাজ ভাই?আপনি বরং আমার বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন।ভাবুন মাঝখানে কোন ঘটনাই ঘটেনি, কোন দায়িত্বই আপনার কাঁধে নেই। আপনার জীবনে শুধু সামান্তা আপুই আছে এটাই কল্পনা করুন। ”

মেহেরাজ ভাই কিয়ৎক্ষন চুপ থাকলেন।হাত থেকে চায়ের কাপটা এগিয়ে নিতে নিতেই শান্তস্বরে বললেন,

” শোন জ্যোতি, আমি মেরুদন্ডহীন নই।স্বার্থপর ও নই।দায়িত্বজ্ঞানহীনও নই।এরপর থেকে কথাগুলো ভেবে বলবি।”

ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটল আমার।শান্তস্বরে বললাম,

” দায়িত্ব নিয়ে আর যায় হোক সম্পর্ক টেনে নেওয়া যায়না মেহেরাজ ভাই।আব্বাও আমার প্রতি ছোট থেকে দায়িত্ব দেখিয়েছেন কিছু টাকার বিনিময়ে। আপনার কি মনে হয়?আব্বার আর আমার সম্পর্ক স্বাভাবিক?স্বাভাবিক নয়।আব্বার সাথে আমার নামমাত্র সম্পর্ক।সত্যি বলতে বাবা মেয়ের সম্পর্কের সেই সুখ, হাসি, স্নেহ কোনটার সাথেই আমি পরিচিত নই। এমন সম্পর্ক বয়ে চলার থেকে সূচনাতেই সমাপ্তি ঘটানো ভালো।”

মেহেরাজ ভাই শুনলেন।কিন্তু উত্তর দিলেন না।চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কিছুক্ষন পর বললেন,

” তোকে তো কেউ সম্পর্ক নিয়ে ভাবতে বলেনি এখন।বলেছে?তোর তো পড়ায় ফোকাস করা প্রয়োজন।”

উত্তর দিলাম,

” একটা সম্পর্কের ভাঙ্গনের জন্য ডিরেক্টলি বা ইনডিরেক্টলি আমিই কেন দায়ী হবো?একটা সম্পর্কে তৃতীয় ব্যাক্তি হয়ে থেকে নিজেকে এতটা স্বস্তা কেন বানাবো আমি?আমি মোটেই অতোটা স্বস্তা নই যে একটা সম্পর্কে তৃতীয় ব্যাক্তি হয়ে আজীবন ঝুলে থাকব মেহেরাজ ভাই।”

মুহুর্তেই মেহেরাজ ভাই বলে উঠলেন,

” থাকিস না।”

মেহেরাজ ভাইয়ের স্পষ্ট বলা কথাটাই বুকে গিয়ে লাগল।লম্বা শ্বাস টেনে বলে উঠলাম,

” সেদিন মুক্ত হবো আমি। ”

কথাটা বলেই পা বাড়াতে নিলেই মেহেরাজ ভাই গলা ঝাড়লেন। বলে উঠলেন,

“চায়ের কাপটা নিয়ে যা।”

উল্টো ঘুরে তাকালাম।চায়ের কাপে এখনো অর্ধেকের বেশি চা।তাকিয়েই বললাম,

” মেহু আপু বলল ঘুম ছেড়ে চা লাগে আপনার?তাই নিজ থেকে করে এনেছিলাম।আমি করেছি বলেই রেখে দিলেন?”

মেহেরাজ ভাই শান্ত চাহনীতে তাকালেন।কপালের ভাজে হাত বুলিয়ে শান্তস্বরে বললেন,

” মাথা ধরেছে,তাই।মেহু থাকলে মাথা টিপে দিতে বলতাম। ও তো নেই।তাই বের হবো।”

মাথা ধরাটা স্বাভাবিক।উনার থম মেরে বসে থাকা, কপালে ভাজ দেখেই বুঝা যায় উনার মন মস্তিষ্কের অবস্থা ভালো নয়।
হঠাৎ আমার কি হলো কিজানি।একপলক উনার ক্লান্ত চেহারায় তাকিয়েই বলে উঠলাম,

” আমি দিব?”

ছোট দুই শব্দের বাক্যটা বলে ফেলেই তীব্র অস্বস্তিতে ছটফট করলাম।মনে মনে নিজেকে হাজার ভাবে শাসালাম।কি দরকার ছিল নিজ থেকে বলার?উনি কি ভাববেন আমি গায়ে পড়া মেয়েদের মতো গায়ে পড়ার চেষ্টা করছি?এইটুকু ভাবতেই চোখের সামনে চকচক করে উঠল দুইবছর আগের মেহেরাজ ভাইয়ের করা অপমান গুলো। অনুভূতি জম্মেছে বলে এত অপমান করেছিলেন সেদিন।আজ কি তবে আরো এক ধপা অপমানের সম্মুখীন হবো আমি?উহ!আমি আসলেই বেহায়ার মতো কাজ করে বসলাম। নিজের আত্মসম্মানের হেলাফেলা করে মোটেই এই প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি আমার।এইটুকু ভেবেই উনার হাত থেকে চায়ের কাপটা নিলাম।উল্টোঘুরে আবারও চলে আসতে নিতেই মেহেরাজ ভাই আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠলেন,

” চলে যাচ্ছিস যে?মাথা টিপে দিবি না?”

আমার পা থমকাল।অবাক করা বাক্যটা শুনেই বুকের ভেতর ধুপধুপ আওয়াজ হলো। এতকাল সকল দুঃখ কষ্টে স্থির থাকা আমি আজ হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠলাম এক মুহুর্তে।কেন জানি না হাত পা কাঁপতে লাগল।ঘনঘন শ্বাস ফেললাম।যথাসম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক করে বললাম,

” চায়ের কাপটা রেখে আসতেই যাচ্ছি।”

কথাটা বলে ধুপধাপ পা ফেলে রান্নাঘর পর্যন্ত পৌঁছালাম।বুকের ভেতর তখনও শিহরনের ছোঁয়া জ্বলন্ত।চায়ের কাপটা রেখে সেই জ্বলন্ত শিহরণ বয়ে নিয়েই ফের মেহেরাজ ভাইয়ের ঘরে গেলাম।উনি চোখ বুঝে ততক্ষনে পিঠে বালিশ ঠেকিয়ে খাটে হেলান দিয়ে আছেন।আমি ইতস্থত বোধ করে খাটের পাশে দাঁড়ালাম।কিয়ৎক্ষন তাকিয়ে থাকলাম উনার স্নিগ্ধ মুখের দিকে।বন্ধ রাখা চোখের পাতা, ভ্রু জোড়া, পুরু ঠোঁট, এমনকি মুখের খোঁচা দাঁড়ি সবই খুব কাছ থেকে স্থির চাহনী রেখে দেখলাম।তারপর হঠাৎই কাঁপা হাতে হাতটা বাড়ালাম উনার কপাল ছোঁয়ার জন্য।উনি চোখ খুললেন।আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

” পাঁচ মিনিট হলেই হবে।তারপর পড়তে যাবি।”

মুহুর্তেই স্পষ্টগলায় বললাম,

” আচ্ছা।”

মেহেরাজ ভাই পুনরায় চোখ বুঝলেন।আমি কাঁপা হাতটা এগিয়ে স্পর্শ করলাম মেহেরাজ ভাইয়ের কপাল।আলতো হাতে মাথা টিপে দিতে লাগলাম এক অজানা স্পন্দন হৃদয়ে স্থাপন করে।এক মিনিট, দুই মিনিট করে বোধহয় মিনিট দশ-পনেরো শেষ হওয়ার পরই আমি হাত সরালাম।মেহেরাজ ভাই চোখ বুঝে আছেন ভেবে ভেবেছিলাম ঘুমিয়ে আছেন।কিন্তু না।পুনরায় আমাকে অবাক করে দিয়ে উনি চোখ বুঝে রেখেই বললেন,

” এবার পড়তে যা।”

আমি আর দাঁড়ালাম না।মনে মনে ভাবলাম,মেহেরাজ ভাইয়ের প্রতি আমার অনুভূতি আছে।তবে সে অনুভূতি বিশেষ পরিণতি পাবে এমন কোন আশা দেখা অযৌক্তিক!সুখময় মিথ্যে স্বপ্নের থেকে দুঃখময় বাস্তব শতগুণে ভালো।কয়েক মুহুর্তের জন্য হৃদয়ের ভেতর সেই জ্বলন্ত শিহরন শুধুই মরিচীকাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা।এর বাইরে কিচ্ছুই নয়।ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।পা বাড়িয়ে নিজের ঘরে এসে চেয়ার টেনে আরাম করে বসলাম।কেন জানি না ঐ মুহুর্তে দাদীর কথা মনে পড়ল ভীষণ করে।দেরি না করে বাটন ফোনটা নিয়ে কল দিলাম মিনার ভাইকে। মিনার ভাই কল তুললেন কিছুক্ষন পর।বোধ হয় কল তুলেই দাদীকে মোবাইলটা ধরিয়ে দিলেন।সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে দাদীর উঁচু গলা ভেসে আসল,

” জ্যোতি? আনোয়ার গিয়া এহন এমন থমথমে হইয়া আছে ক্যান? কিছু কইছস ওরে?কিছু হইছে ঐহানে?”

প্রথম ধপায় দাদীর এমন কথা শুনে মলিন হলো মুখ। নরম গলায় বললাম,

” না, আব্বাকে তেমন কিছু বলিনি আমি দাদী।তুমি কেমন আছো?”

দাদী আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ফের প্রশ্ন ছুড়লেন,

” কিছু হইছে কি ঐহানে?আনোয়াররে জিগাইলাম তুই কেমন আছস, কইল না কিছুই।সহাল থেইকা দেহি মুখ ভার কইরা আছে।”

আমি বললাম,

” আব্বাকে জিজ্ঞেস করোনি কিছু ঘটেছে কিনা?আব্বাকে জিজ্ঞেস করে নিও বরং। বলো, কেমন অবস্থা তোমার?”

দাদী এবারও আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না।ফের নিজের গলা চালিয়ে বললেন,

” ভালা আছস তুই ঐহানে? ক্যান জানি মনে হইতাছে আনোয়ার কোন অন্যায়ের লাইগা অপরাধবোধে ভুগতাছে।”

আমি হেসে বললাম,

” ওসব তোমার মনের ধারণা দাদী।শরীর ঠিক আছে?”

” হ,ঠিক আছে।তোর পরীক্ষা না কবে থেইকা শুরু হইব? কহন হইব পরীক্ষা?”

আমি আবারও হাসলাম।দাদী পরীক্ষার কথা কেন জিজ্ঞেস করছে বুঝতে পেরেই বললাম,

” বাড়ি যাওয়ার জন্য দাদী?”

” না, এমনেই জানার লাইগা । ”

” বাড়ির অবস্থা স্বাভাবিক দাদী?আমি বাড়ি যেতে চাই।এখানে আর থাকব না।নিয়ে যেতে পারবে?”

দাদী মুহুর্তেই যেন চমকে গেলেন।আওয়াজ তুলে বললেন,

” কি কস? এহন বাড়ি ফিইরা আইলে মানুষ কইব কি?মানুষ কি দুইদিনেই ভুইলা গেছে সব?এহন আবার নতুন কইরা সমালোচনার আসর জমাইব।”

তাচ্ছ্যিলতায় ভরে গেল হৃদয়ের আনাচ কানাচ।আমি কি কোন অন্যায় করেছি?দাদী তবে এভাবে বলল কেন?জিজ্ঞেস করলাম,

” তুমি কি আমায় লুকিয়ে রেখেছো দাদী?তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমিই কোন বিশাল বড় অন্যায় করে ফেলেছি দাদী।আমি কি আসলেই অন্যায় করেছি?আমার কি লুকিয়ে থাকা প্রয়োজন?”

” লুকাইয়া রাখি নাই।এহন বাড়ি ফিরলে মানুষ জিগাইবে না কেন আইল? তহন তো পরীক্ষার কথা কওয়া যাবে।”

তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসলাম।দাদীর যুক্তিটা যুক্তিযুক্ত বোধ হলো না।ছোট্ট শ্বাস ফেলেই বললাম,

” আচ্ছা দাদী।ভালো থেকো।নিজের যত্ন নিও।ঔষুধ খেও ঠিকঠাক মতো।”

দাদী ভীত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,

” তুই কি ভালা নাই ঐহানে?”

” আছি।রাখছি।”

তারপর কল কাঁটলাম।মোবাইলটা টেবিলের এককোণে রেখে চোখ রাখলাম সাদা খসখসে খাতার পাতায়। কলম নিয়ে উল্টাতে লাগলাম বইয়ের পৃষ্ঠা।পড়ার জন্য নির্দিষ্ট অধ্যায়ে পৌঁছাতেই খেয়াল করলাম একটা পৃষ্ঠায় ছোট করে লাভ আকৃতির ভেতর ইংরেজী অক্ষর এম লেখা।অবাক হলাম। নিঃসন্দেহে বলা যায় লেখাটা আমি লিখিনি।তবে?খেয়াল হলো, পরশু এই অধ্যায়টা সাঈদ ভাই পড়িয়েছিলেন।অন্যমনস্ক হয়েই কি লেখাটা লিখে ফেলেছেন?কিন্তু এম দিয়ে কি নাম?মেহেরিন?মানে, মেহু আপু?ভাবনাটা ভাবতেই চোখ চকচক করে উঠল।হতেই পারে!সাঈদ ভাইয়ের চোখে মেহু আপুর প্রতি কিছু একটা থাকে আমি খেয়াল করেছি।আবার মেহু আপুর চোখেও কেমন জানি এক ধারালো আঘাত থাকে সাঈদ ভাইয়ের সামনে।কি আশ্চর্য!উনাদের মধ্যে কিছু ছিল?বা আছে?নাকি ভবিষ্যৎ এ তৈরি হবে?

.

সাঈদ ভাই নিয়ম মতো পড়াতে আসল রাতে।মেহু আপু, মেহেরাজ ভাই বসার ঘরেই বসে আছেন। পড়ার একপর্যায়ে সাঈদ ভাইকে বইয়ের সেই পৃষ্ঠায় লাভ আকৃতি আর এম অক্ষরটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম আমি,

” সাঈদ ভাই?আপনি লিখেছেন না এটা?”

সাঈদ ভাই বোধহয় থতমত খেয়ে গেলেন।দুয়েকবার বইয়ের দিকে তাকিয়েই আমার দিকে তাকালেন। বললেন,

” ধুররর!আমি কেন এসব লিখতে যাব মেয়ে?আমি লিখলে পুরো একটা প্রেমকাব্য লিখে ফেলব।শুধু একটা লাভ চিহ্ন এঁকে কোন লাভ আছে?”

আমি জোর দিয়ে বললাম,

” এটা আপনারই লেখা সাঈদ ভাই।আপনি পরশুদিন পড়িয়েছিলেন অধ্যায়টা।”

সাঈদভাই ফের অস্বীকার করে বলে উঠলেন,

” আরেহ, না না!তুমিই লিখেছো হয়তো জ্যোতি।তোমার বয়সটা প্রেমের বয়স মানছি।আমি বকা দিব না।বলো তো কার প্রেমে পড়েছো? কার নামের প্রথম অক্ষর লাভ শেডের ভিতর লিখে ফেলেছো বইয়ের পাতায়?ট্রাস্ট মি,আমি বকা দিব না।আমি তেমন টিচারই নই।বরং আমার স্টুডেন্টরা প্রেম করলে আমি প্রাউড ফিল করি। ”

আমি হতাশ হয়ে বললাম,

” আপনি মিথ্যে বলছেন সাঈদ ভাই।”

সাঈদ পাত্তা দিলেন না।দক্ষ ভাবে মিথ্যে বললেন,

” ধুররর!আমি এসব লাভ টাভ আঁকতেই পারি না।আমি আঁকলে সোজা হৃৎপিন্ড আঁকব। তারপর হৃৎপিন্ডে তার নামের অক্ষর স্থাপন করব।”

আমি গম্ভীর মুখচাহনী নিয়ে বসে থাকলাম।সাঈদ ভাই স্পষ্টভাবেই মিথ্যে বলছে।কি মিথ্যুক!ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে বললাম,

” বোন হিসেবে জিজ্ঞেস করছি সাঈদ ভাই।বোনকে বিশ্বাস করে সত্যিটা বলতে পারেন।”

সাঈদ ভাই বোকা বোকা হাসলেন।কিছু একটা বলার জন্য প্রস্তুতি নিলেন কিছুক্ষন। তারপর মুখ খুলে সেই কথাটা বলবেন ঠিক সেই মুহুর্তেই আমার পেঁছনে কিছু দেখে বদলে গেল উনার মুখ চাহনী।আমি ঘাড় ঘুরালাম তৎক্ষনাৎ।দেখলাম, দরজায় দাঁড়িয়ে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছেন মেহেরাজ ভাই। ভ্রু উঁচিয়ে সাঈদ ভাইয়ের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়লেন ইশারায়। সাঈদ ভাই মুহুর্তেই চুপসে গেলেন।দাঁত কেলিয়ে হেসে নিজের সমস্ত দোষ আমার উপর চাপিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন,

” আরেহ, কি যে বলি তোকে।ছাত্রী হলো একটা পিচ্চি মেয়ে।প্রেম ভালোবাসার বয়স তার।এই বয়সে কাকে না কাকে ভালোবেসে বইয়ে পড়তে পড়তে কখন জানি লাভ এঁকে তার মধ্যে এম লিখে ফেলেছে।আমি চিন্তা করছি এম দিয়ে কোন কোন ছেলের নাম হতে পারে।ওয়ান মিনিট, তোর নামও তো এম দিয়েই তাই না?মেহেরাজ!হ্যাঁ, এম দিয়েই তো।”

সাঈদ ভাইয়ের আকস্মিক ডাহা মিথ্যে কথায় মস্তিষ্কে দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে লাগল আমার।ছিঃ!মেহেরাজ ভাইয়ের সামনে আমার আত্নসম্মানের আ টাও রাখলেন না?আমি কখনোই এমন ইমম্যাচিউরডের মতো লাভ এঁকে ভালোবাসার মানুষের নামের অক্ষর লিখতাম না।জীবনেও না।মেহেরাজ ভাই কি ভাবছেন এখন?আমি তার প্রতি দুর্বল?দিনরাত তার কথা ভেবে ভেবে মরে যাচ্ছি?তার কথা ভেবে ভেবে পড়ালেখায় মন বসছে না আমার?বই, খাতায়,টেবিলে সবজায়গায় উনার নাম লিখে বেড়াচ্ছি?কথাগুলো ভেবেই মেজাজ খারাপ হলো।রাগ লাগল। মেহেরাজ ভাইয়ের মুখের প্রতিক্রিয়া বুঝার জন্য আবারও ঘাড় ঘুরাতেই দেখলাম মেহেরাজ ভাই টানটান মুখ করে এক পলক তাকালেন। তারপর পা ঘুরিয়ে চলে গেলেন।আর আমি সেই যাওয়ার দিকেই তাকিয়ে থেকে একরাশ রাগ -জেদ পুষলাম অন্তরে।

#চলবে…..

[ কেমন হয়েছে?ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।]

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_১৪
লেখনীতেঃএকান্তিকা নাথ

” আবেগ আর ভালোবাসা দুটো জিনিস কিন্তু এক নয় জ্যোতি।তোর বয়সটা আবেগের। তবে আমার কেন জানি মনে হয়েছে তুই কখনোই অতোটা ইমম্যাচিউরড না যে আবেগে আপ্লুত হয়ে জীবনের সর্বনাশ ঘটাবি।আবেগ আমাদের মুগ্ধ করে, বিভোর করে।যেমনটা আমরা মরিচীকার পেছনে দৌঁড়াই?আবেগেও আমরা ঠিক সেভাবেই বিভোর হয়ে ছুটে যাই।কিন্তু যখনই দেখি সেটা মরিচীকা তখনই আমার ভুল ভাঙ্গে। তখনই বুঝতে পারি, আমাদের ধারণা ভুল ছিল।আবেগটাও তেমন।সাময়িকভাবে আমরা আবেগকে ভালোবাসা বলে দাবি করে।তবে একটা সময় পর ঠিকই বুঝতে পারি তা কেবলই আবেগ!আমরা জোনাক পোঁকার আলো দেখে মুগ্ধ হই। বিভোর হই।কাছে ছুটে যেতে চাই।ছুঁতে চাই সেই জোনাক পোঁকার আলোকে।কিন্তু আগুনের আলোককে কি ঠিক সেভাবেই ছুঁতে চাই?আগুনের আলোক দেখে কি ঠিক সেরকমই মুগ্ধ হই?হই না।ভালোবাসা হলো জ্বলন্ত আগুনের ন্যায় যাতনা।কাউকে ভালোবাসলে নির্দ্বিধায় সেই জ্বলন্ত আগুনে ঝাপ দেওয়া যায়।সেই আগুনে পুড়ে দগ্ধ হওয়া যায়। কিন্তু আবেগে তা কখনোই করা যায় না জ্যোতি।আবেগ হলে তা আগুনের স্বল্প তাপ অনু়ভূত হতেই লোপ পায়।আর ভালোবাসায় মানুষ বারংবার দগ্ধ হয়েও ভালোবেসে যায়।এটাই পার্থক্য!”

বিছানা গুঁছিয়ে রাখিলাম।ঠিক সেসময়ই কথাগুলো কানে আসল।নিরবে শুনে গেলাম সবগুলো কথা।তারপর জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে উঠলাম,

” এসব কথা আমাকে বলার মানে কি মেহেরাজ ভাই?”

মেহেরাজ বুকে হাত গুঁজে দাঁড়ালেন। বললেন,

” কথাগুলোর মানে এটাই যে, তোর এই বয়সটা যেমন আবেগের? তেমনই জীবনের মেইন পয়েন্টটা হচ্ছে এই বয়সটা।এই বয়সে তুই কতটুকু ভুল করবি, কতটুকু পরিশ্রম করবি, কতটুকু অর্জন করবি তার সমস্তটুকুর ফলই তোকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।শুধু এই কথাটা মাথায় রাখতে পারবি?”

মাথা নেড়ে বললাম,

” পারব।”

মেহেরাজ ভাই ঠোঁট চওড়া করলেন।নিঃশ্বাস ছেড়ে আবারও বললেন,

” গুড!নিজের জীবনটা নিজের স্বপ্ন অনুযায়ী সাঁজানোর জন্য সর্বোচ্ছ চেষ্টা কর জ্যোতি।সো কল্ড আবেগ কিংবা রিলেশন এসবের পেছনে সময় ব্যয় না করে নিজের জীবনে ফোকাস কর। সত্যি বলছি,বাস্তবতা কঠিন। ভয়ংকর কঠিন!পরে দেখা যাবে সবকিছুর পেছনেই সময় ব্যয় করলি কিন্তু নিজের জীবন গুঁছাতে পারলি না।”

আমি চুপ থাকলাম।বুঝলাম, মেহেরাজ ভাই কেন কথাগুলো বলছেন।সাঈদ ভাই মানুষটার প্রতি তীব্র বিরক্তি ভর করল।কি দরকারে এত বড় মিথ্যেটা বলে দিলেন উনি?মেহেরাজ ভাই সত্যি সত্যিই ভাবছেন আমি উনার প্রতি দুর্বল? আমি উনার প্রেমে হাবুডুবু খেয় সাঁতার কাঁটছি?ছিঃ!একবার পুকুরঘাটে চরম অপমান করার পরও বেহায়ার মতো এখনও আমি উনাকে ভালোবাসি কথাটা ভেবে আমার প্রতি উনার কেমন ধারণা জম্মাল?নির্ঘাত পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যাক্তিত্বহীন আর বেহায়া মেয়েটা আমায় ভেবে নিয়েছেন। আমি ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লাম।স্পষ্ট গলায় বললাম,

” সাঈদ ভাই মিথ্যে বলেছেন। আমি আপনার নামের অক্ষর লিখিনি মেহেরাজ ভাই।”

মেহেরাজ ভাই ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,

” আমি তো বলিনি তুই আমার নামের অক্ষর লিখেছিস। ”

জিজ্ঞেস করলাম,

” তবে এসব বলছেন যে?”

মেহেরাজ ভাই ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললেন,

” অক্ষর লেখায় কতটুকু কি প্রকাশ পায় জানা নেই, তবে চোখের ভাষাতে অনেককিছুই বুঝা যায় জ্যোতি।তাই বলছি, অসময়ে অনুচিত বিষয়ের পেছনে সময় না ব্যয় করে পড়ায় মনোযোগ দে।পড়ালেখার বিষয়ে হেলাফেলা করিস না।পরে নাহলে আপসোস করবি।”

মেহেরাজ ভাইয়ের কথার মানেটা বুঝতে পেরেই প্রবল অপমানে অপমানিত হলাম আমি।অনুচিত?হ্যাঁ অনুচিতই তো। অন্যের প্রেমিককে নিয়ে ভাবনা অনুচিতই হবে।তবে তা এভাবে মুখের সামনে বলে অপমান করে কি উনি মহান হয়ে গেলেন?হয়তো হয়ে গেলেন মহান।আমি অপমানে জর্জরিত মুখখানা নিয়ে পিছু ঘুরলাম।মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম মেহেরাজ ভাইকে এবার থেকে শুধুই এড়িয়ে যাব।জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অব্দি এড়িয়ে যাব।এমনকি চোখ তুলেও উনার দিকে আর তাকাব না আমি।উনার প্রতি এইটুকু অনুভূতিও আর জমা রাখব না নিজের মধ্যে।

.

সেদিনকার সেই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হলো আরো দুই সপ্তাহ পর।এই দুই সপ্তাহ প্রয়োজন ছাড়া মেহেরাজ ভাইয়ের সামনেই যাইনি।ঘরে পড়লেও দরজা লাগিয়ে পড়েছি।কথা হলেও টুকটাক প্রয়োজনীয় কথা।ব্যস এইটুকুই!কিন্তু ঝামেলাটা বাঁধল শিমা আপাকে নিয়ে।শিমা আপা উনার গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য এক সপ্তাহের ছুটি নিয়েছেন।সকাল থেকে মেহু আপু আর আমি এই খবর জানতাম না।জানা থাকলে রান্নার কাজ অনেকটাই হয়ে যেত এতক্ষনে।জানলাম তখনই, যখন মেহেরাজ ভাই ঘুম থেকে উঠলেন।কপালে আসা এলোমেলো চুল আর সদ্য ঘুম ভাঙ্গা ফোলাফোলা চোখে পুরো রান্নাঘরে একবার তাকিয়েই বললেন,

” শিমা আপা বলেছে এক সপ্তাহ আসবে না।তোরা কি খাবি বলে ফেল। মুখ ধুঁয়ে এসে রান্না করব।”

আমি আর মেহু আপু দুইজনই চোখ ছোটছোট করে তাকালাম।মেহু আপু প্রশ্ন ছুড়লেন,

” কেন আসবে না শিমা আপা?”

উত্তরে মেহেরাজ ভাই বললেন,

” গ্রামের বাড়ি যাবে তাই ছুটি চেয়েছে।”

কথাটুকু বলেই থমথমে মুখে আবারও নিজের ঘরে চলে গেলেন।মেহু আপু আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন।বললেন,

” আজ সবাই বাসায়ই আছি।আমিও ভার্সিটিতে যাব না।আজ সবাই একসাথে রান্না করি জ্যোতি?মনে আছে তোর ছোটবেলার চড়ুইবাতির কথা?সবাই মিলে জমিয়ে রান্না করতাম না তখন?”

মেহু আপুর কথাতে হালকা হাসলাম।স্মৃতিতে ভেসে উঠল ছোটবেলার সেই প্রাণবন্ত স্মৃতি।মিথি, আমি, মেহু আপু, নাবিলা, নাফিসাসহ সব ক্ষুদে বাচ্চারাই উঠোনে ইট দিয়ে চুলা বানানোয় ব্যস্ত হতো।কেউ চাল, কেউ তেল, কেউ বা নুন আনত!রান্নার দায়িত্বে থাকত বড় কেউ।আমরা ছোটরা সব সাহায্য করতাম রান্নার কাজে।কেউ কেউ আলু কাঁটত, কেউ বা পেয়াজ কাঁটত।তখন মিথিও থাকত আমার আশপাশে।ছোট ছোট তুলতুলে হাত পা নাড়িয়ে নেচে নেচে বেড়াত চারপাশটায়।কি সুন্দর স্মৃতি!ইশশ!আবারও যদি ফিরে যেতে পারতাম সেই সুন্দর শৈশবকালে?কত সুন্দর হতো।মিথিকেও ফেরত পেতাম তাহলে আবার।পরমুহুর্তেই নিজের অবাস্তব ভাবনায় নিজেই হাসলাম।একবার মেহু আপুর দিকে তাকিয়ে বললাম,

” হ্যাঁ আপু।সুন্দর ছিল তখনকার দিনগুলো।”

” অনেক সুন্দর ছিল রে জ্যোতি।এবার বাড়ি গেলে আবারও আগের মতো চড়ুইবাতি করব কেমন?সুন্দর হবে না?”

আমি আবারও হাসলাম।বললাম,

” হ্যাঁ,আপু।সুন্দর হবে।”

মেহু আপু হাসলেন।ততক্ষনে উপস্থিত হলেন মেহেরাজ ভাই।চোখমুখে আবছা পানির ছোঁয়া।চুলও পরিপাটি।পরনে কালো টিশার্ট।টাউজারের পকেটে হাত ডুকিয়ে টানটান বুক করে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন উনি।মেহু আপু ঠোঁট চওড়া করে বলে উঠলেন,

” ভাইয়া?আমি আর জ্যোতিও হেল্প করব।ঠিকাছে?”

মেহেরাজ ভাই ভ্রু উঁচু করলেন।একনজর আমার দিকে তো একনজর মেহু আপুর দিকে তাকিয়েই গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন,

” কেন?”

মেহু আপু হেসে হেসেই বললেন,

” আমি তো কাজ পারি।মন চাইছে কাজ করতে তাই। নুডুলস খাব।চলো রান্না করে ফেলি।”

মেহেরাজ ভাই তাকালেন শীতল চাহনীতে।তারপর যেতে যেতেই বললেন,

” আয়।”

মেহু আপু লাফিয়ে উঠলেন।শুধু যে নিজেই লাফিয়ে উঠলেন তা নয়।আমার হাতটাও চেপে ধরে টেনে নিয়ে গেলেন রান্নাঘরে।একপাশে দাঁড়িয়ে হুট করেই হাতে চুরি নিয়ে বলে উঠলেন,

” কি করতে হবে ভাইয়া?”

মেহেরাজ ভাই ছোট ছোট চোখ করে তাকালেন।পেয়াজ কাঁটার কাজটা আমাদের দিয়ে চুলায় কড়াই বসালেন।আমি আড়চোখে দেখে গেলাম উনাকে আর উনার কাজকর্মগুলোকে।ছেলেমানুষ হিসেবে কাজকর্ম খুব একটা গোছাল না হলেও রান্নাটা দক্ষ ভাবেই চালিয়ে গেলেন।কিন্তু হঠাৎই বাঁধল বিপত্তি।অসাবধানতা বশত মেহু আপুর হাত কেঁটে বসল চুরির ধারালো আঘাতে।মেহেরাজ ভাই ব্যস্ত হলেন মেহু আপুর কাঁটা হাত নিয়ে।দুয়েকটা বকাবকি করে টেনে নিয়ে গেলেন রান্নাঘর থেকে।আমি একপলক তাকিয়ে চুলার দিকে তাকালাম।চুলায় তখনও কড়াই বসানো।ধীর পায়ে এগিয়ে দেখলাম রান্না প্রায় হয়েই এসেছে।বাকি রান্নাটাও সম্পন্ন করে কড়াই নামালাম চুলা থেকে। আশপাশে তাকিয়ে দেখলাম রান্নাঘরের অবস্থা বেহাল!মেহেরাজ ভাই মনোযোগ দিয়ে রান্না করেছেন ঠিক তবে আশেপাশে আর খেয়াল রাখেননি।সব জিনিসপত্র অগোছাল করে খুশিমনে রান্না করেছেন।পরে অবশ্য গুঁছিয়ে নিতেন।উনার মতো গোছাল মানুষ অগোছাল জিনিস অগোছালই রেখে দিবেন ভাবা বোকামো।আমি ধীরে ধীরে সব জিনিস গুঁছিয়ে রাখতে লাগলাম।তার মধ্যেই মেহেরাজ ভাই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন রান্নাঘরে।একপলক তাকিয়ে বলে উঠলেন,

” শেষ রান্না?”

আমি শুধু উত্তরটুকুই দিলাম,

” হ্যাঁ।”

মেহেরাজ ভাই চুলায় তাকিয়ে বলে উঠলেন,

” কড়াই তুই নামিয়েছিস?”

আবারও কেবল উত্তরটুকুই বললাম,

” হ্যাঁ।”

মেহেরাজ ভাই এবার সামনে এসে দাঁড়ালেন।কিঞ্চিৎ রাগ ঝেড়ে বললেন,

” কে বলেছে নামাতে?হাত টাত পুড়ে গেলে তখন দোষ তো আমারই হতো। আর কখনো নিজ থেকে চুলায় কাজকর্ম করতে আসবি না।”

মেহেরাজ ভাইয়ের কথায় ব্যাপক হাসি পেল।যার শৈশব থেকে রান্না করার অভ্যাস আছে তাকে এসব বলা কেমন জানি হাস্যকর ঠেকায়।যদি রান্নায় অপটু হতাম তবে বোধহয় এসব শাসন আমার ভালো লাগত।আহ্লাদে খুশিও হয়ে উঠত বোধহয় আমার মন। দাদী বলত,প্রিয় মানুষের শাসনেও ভালো লাগা অনুভব হয়।কিন্তু তার কিছুই আমি অনুভব করলাম না।মেহেরাজ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,

” পুড়ত না।পুড়লেও আপনার উপর দোষ দিতাম না মেহেরাজ ভাই।”

মেহেরাজ ভাই বিনিময়ে বললেন,

” মেহুর কাছে যা।”

আমি অগোছাল ঘর গুঁছিয়ে নিতে নিতেই বললাম,

” গুঁছিয়েই যাচ্ছি।অল্প বাকি।আপনি বরং যান।”

মেহেরাজ ভাই কিঞ্চিৎ শাসিয়েই বললেন,

” যেতে তোকে বলেছি।আর তুই আমাকে বলছিস?”

মেহেরাজ ভাইয়ের গম্ভীর আওয়াজে এক পলক তাকালাম উনার দিকে।উনার ভ্রু কুঁচকানো। মনে মনে ভাবলাম এভাবে
” আপনি বরং যান ” কথাটা বোধহয় বলা উচিত হয়নি।মৃদু গলায় বললাম,

” আপনার তো কাজ নেই আর।তাই বললাম যেতে।আমি একেবারে নাস্তা নিয়েই আসছি।”

” আমি আনছি।তুই যা।”

আমি মাথা নাড়ালাম।গোঁছানোর কাজটুকু শেষ করার জন্যই চুলার পাশ থেকে হলুদের বক্সটা নিয়ে অন্যপাশে রাখতে যেতেই মেহেরাজ ভাই ধরে নিলেন বক্সটা।আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়েই চাপাস্বরে বললেন,

” বললাম না তোকে যেতে? দুপুরের রান্না করতে আবারও এসব অগোছাল হবে।একেবারে রান্না শেষে সব গোছালভাবে রাখব।”

আমার দৃষ্টি ক্ষীণ হলো।মেহেরাজ ভাই দাম্ভিক চেহারায় অন্যদিক ফিরে হলুদের বক্সটা আগের মতোই রেখে দিল।আমি আগ বাড়িয়ে আর কিছু বললাম না।বেরিয়ে এলাম দ্রুত।

.

দুপুরের খাবার রান্না হওয়ার পরপরই মেহেরাজ ভাই রান্নাঘর ছেড়ে বের হলেন।চোখমুখে ঘামের আবছা ছাপ।রুমালের একাংশে সে ঘাম মুঁছতে মুঁছতেই আমার আর মেহু আপুর সামনে এসে দাঁড়ালেন।একনজর কাঁটা হাতের দিকে তাকিয়েই বললেন,

” কি দরকার ছিল রান্নার কাজে হাত লাগানোর মেহু?”

মেহু আপু ভাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়েই হেসে দিল। কাঁটা আঙ্গুলটা দেখেিয়ে বলল,

” উহ!আমি তো টুকটাক রান্না পারিই ভাইয়া। এইটুকু কাঁটাতে এত চিন্তার কি আছে বলো তো?ঠিক হয়ে যাবে।অল্প একটুই তো কেঁটেছে।”

মেহেরাজ ভাই বিনিময়ে কিছু বললেন না।শুধু একবার তাকিয়েই নিজের ঘরে পা বাড়ালেন।আমি তখনও মেহু আপুর সাথে বসে টুকটাক কথা বলছিলাম।তার কিছুক্ষন পরই নাবিলা আসল বাসায়।পাশে বসেই চঞ্চল গলায় বলে উঠল,

” হোস্টেল থেকে মাত্রই ফিরেছি।শুনলাম মেহু আপুও আজ বাসায় থাকবে?জ্যোতির সাথেও অনেক গল্প বাকি।তাই চলে এলাম।”

আমি হাসলাম।নাবিলার কথাগুলো সুন্দর।ছোটবেলার বন্ধু বলেই কিনা কিজানি তবে আমার কেন জানি না মনে হয় ও আমার আপন মানুষ।হোস্টেলে থাকে বিধায় তেমন একটা সময় কাঁটানো হয়ে উঠেনি ওর সাথে।তবে যখনই আসে তখনই ও খুব আপনভাবেই কথা বলে। আমি ঠোঁট চওড়া করে হেসেই বললাম,

” কেমন আছিস?”

নাবিলা হেসেই উত্তর দিল,

” ভালো ছিলাম না।তোদের দেখে ভালো হয়ে গেছি।শুনেছি তুই নাকি কার প্রেমে পড়েছিস জ্যোতি?তার নামের প্রথম অক্ষর নাকি এম?সাঈদ ভাইয়া না বললে তো জানতেই পারতাম না আমি।আরো একটা কথা, তুই সাঈদ ভাইয়ার কাছে পড়িস এটা জানার পর থেকেই চরম আপসোস হচ্ছে আমার। সাঈদ ভাইয়া মানেই কিন্তু আগুন!”

নাবিলা কথাটা বলার সাথে সাথেই মেহু আপুর চোখ ছোট ছোট হলো।মুহুর্তে বলে উঠল,

” আগুন মানে?উনার গায়ে কি আগুন জ্বলে জ্বলে উঠে নাকি? ”

নাবিলা হেসে উঠল।বলল,

” তা কেন হবে।দেখো না সাঈদ ভাইয়ার কথায় সব মেয়েই কেমন সম্মোহিত হয়ে যায়।উনার কথায় একটা জোস জোস ব্যাপার আছে না আপু?”

মেহু আপুর মুখভঙ্গি পাল্টাল।ভ্রু উুচিয়ে বলে উঠল,

” জোস জোস ব্যাপার আবার কেমন?আমার তো কোনদিন উনার কথায় কিছু মনে হয়নি।”

নাবিলা মুখ বাঁকিয়ে বলল,

” তুমি মানুষটা কেমন জানি মেহু আপু।সাঈদ ভাইয়ার কথায় প্রেম প্রেম ব্যাপার আছে।আমার তো উনার কথা শুনলেই বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করে।কেমন একটা অনুভূতি হয়।কেমন জানি ফিল করি মেহু আপু। ”

মেহু আপু ফের ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,

” তো উনি তোকে এইসব প্রেমময় বাক্য বলে শোনায় কখন?”

নাবিলা উত্তর দিল,

” যখন দেখা হয় তখনই তো কথা হয়৷ আজ থেকে জ্যোতির সাথে সাথে আমিও পড়ব সাঈদ ভাইয়ার কাছে বুঝলে?ভাইয়াকে অবশ্য বলেছিও আমি।”

মেহু আপু জিজ্ঞেস করল,

“কখন বলেছিস?”

নাবিলা স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলেন,

“ম্যাসেজে বলেছি। জ্যোতির কথাটাও তো সাঈদ ভাইয়া ম্যাসেজেই বললেন।”

মেহু আপুর মুখখানা নিভে গেল কেমন।আমি চুপচাপ দুইজনের কথা শুনছিলাম।মেহু আপুর মুখাবয়ব লক্ষ্য করেই প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলে উঠলাম,

” নাফিসা কোথায়?ওকে আনলি না যে?”

নাবিলা মুখ কুঁচকে উত্তর দিল,

” ও কোথায় জানি না৷ হোস্টেল থেকে ফিরলামই তো মাত্র৷ দেখিনি রে।”

কথাটা শুনে সৌজন্যতামূলক হাসলাম ।আরো কিছুক্ষন গল্পগুজব চলল তিনজনের।

.

রাতে সাঈদ ভাইয়া পড়াতে আসলেন ঠিক তবে আজ পড়ার থেকে কথায় বেশি চলল।নাবিলার সাথে সাঈদ ভাইয়ের প্রেম প্রেম বার্তা শুনে মস্তিষ্ক তিক্ত হয়ে উঠল।এতদিনের কথাবার্তায় সাঈদ ভাই সম্পর্কে কতটুকু কি ধারণা করেছিলাম জানি না। তবে আজকের কথাবার্তায় বুঝতে পারলাম সাঈদ ভাই কোন পর্যায়ে গিয়ে ফ্লার্ট করতে পারেন।আর নাবিলা যেন সেইসব কথাবার্তায় আপ্লুত হয়ে আত্মহারা হয়ে পড়ল।মাঝেমাঝেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠে পুরো ঘর মাথায় তুলছে।আমি বিরক্ত হলাম সাঈদ ভাইয়ের প্রতি।এক পর্যায়ে সেই বিরক্তি আকাশ ছুঁয়ে গেল।ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়ে স্থির হয়ে বসে থাকলাম আর দুইজনের কথোপকোতন শুনতে লাগলাম।ঠিক সে সময়ই টেবিলের সামনে এসে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়ালেন মেহেরাজ ভাই।শীতল চাহনী ফেলে ভরাট গলায় বলে উঠলেন,

” সাঈদ!তোকে পড়াতে বলেছিলাম নাকি হাসাতে বলেছিলাম?এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার হাসাহাসির আওয়াজ শুনেছি।। ”

সাঈদ ভাই মুহুর্তেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন।নিভু নিভু দৃষ্টি ফেলে বলে উঠলেন,

” তুই বাসায় আছিস?জানতাম না তো।”

মেহেরাজ ভাইয়ের চাহনী পাল্টাল।গরম চোখে তাকিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,

” মানে আমি বাসায় না থাকলে তুই সবসময় এমন ফ্লার্টিং চালিয়ে যাস জ্যোতির সাথে?”

সাঈদ ভাই মুহুর্তেই উঠে দাঁড়ালেন।মাথায় হাত দিয়ে দ্রুত বলে উঠলেন,

” সত্যি বলছি মামা!আজই করেছি কেবল।জ্যোতির সাথে সেভাবে কোনদিনই কিছু বলিনি। তুই ওকে জিজ্ঞেস কর।”

মেহেরাজ ভাই পাত্তা না দিয়ে বললেন,

” তোকে বিশ্বাস নেই।”

সাঈত ভাই চুপসে যাওয়া মুখ করে বললেন,

” ধুরর!জ্যোতিকে বোন বলছি আমি।ওর দিকে সে নজরে তাকানো নিষেধ।তাছাড়া তোরা ভাইবোন প্রথমেই যেভাবে শাসিয়ে বলেছিস আমি জীবনেও ওর সাথে ফ্লার্ট করতাম না বন্ধু।বিশ্বাস কর।”

মেহেরাজ ভাই বুক টানটান করে শ্বাস ফেললেন।বললেন,

” করলাম।এবার জ্যোতিকে যে নজরে দেখছিস নাবিলাকেও সে নজরেই দেখবি।বন্ধুর বোন মানে তোরও বোন।মনে থাকবে?”

নাবিলার মুখটা মুহুর্তেই চুপসে গেল কেমন।সঙ্গে সাঈদ ভাইয়ের মুখটাও নিভু নিভু হলো।তবুও দমলেন না সাঈদ ভাই।মুখে চমৎকার বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বলে উঠলেন,

” তুই বললেই হলো নাকি?বন্ধুর বোন মানে আমার বউ।দেখিস না তোকে কত শ্রদ্ধা করে শালা ডাকি।”

মেহেরাজ ভাই পাত্তা দিলেন না।বললেন,

” এটা স্বপ্নতেই সম্ভব।তোকে আমার কোন বোনকেই দিচ্ছি না। তুই যে লেভেলের খেলোয়াড়!”

সাঈদ ভাই বাঁকা হেসে শুধালেন,

” তুই দেওয়া লাগবে না।তোর বোনই চলে আসবে রে বন্ধু।”

কথাটা বলেই সাঈদ ভাই হাসলেন।ঘাড় বাঁকিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়েই বলল,

” আসি তাহলে বাচ্চারা?”

কথাটা বলতেই নাবিলা নাজুক হাসল।মুখ নত করে লজ্জ্বায় লাল করল ওর দুই গাল।আমি সবই খেয়াল করলাম।হতাশ চাহনীতে ফের উপরের দিকে দৃষ্টি ফেলতেই দেখলাম মেহেরাজ ভাই আর সাঈদ ভাই দুজনই বেরিয়ে গেছেন।থেকে গেল কেবল নাবিলার লজ্জ্বায় লাল হওয়া মুখ।

#চলবে…