হসপিটালে নিজের কেবিনে বসে ছিল তুহিন । মায়ের ফোন আসতেই ফোন রিসিভ করে কানে নিতেই কথাটা বলে উঠে তনয়া বেগম। তুহিন কাঁধের সাথে ফোন চেপে এক হাত দিয়ে ফাইল চেক করতে করতে বলে-“ মা তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো আসতে লেট হবে। আর দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়ো আমার কাছে এক্সট্রা চাবি আছে যাওয়ার জন্য। ”
“ প্রতিদিন রাতে এতো লেট করিস ক্যান বলতো? চিন্তা হয় বাপ বিয়ে টিয়ে করে নে আর এই চিন্তা থেকে মুক্তি দে আমায়।”
“ আশ্চর্য মা আমি এখনো ছোট বিয়ের বয়স হয় নি। আর তুমি বিয়ের কথা বলছো। এটা কোনো কথার কথা বললা তুমি?”
” মারবো এক চ’ড় বিয়ের বয়স হয় নি বলে ছেলের। এই শোন তোর যেই বয়স তখন তোর বাপ এক বাচ্চার বাপ ছিল।”
“ হয়েছে মা রাখো আমার কাজ আছে তুমি খেয়ে ঘুমায় পড়ো।”
কথাটা বলে তুহিন ফোন কে’টে দেয়। ফোনের স্কিনে মায়ের নাম্বারের নিচে ইন্দুর নাম্বার দেখে কোনো কিছু না ভেবে ফোন দিয়ে ফেলে।
ইন্দুপ্রভা বেলকনির রেলিঙে দু হাতে ভর দিয়ে রাতের আকাশে জ্বল জ্বল করতে থাকা তারা গুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। জীবনের হিসাব মিলছে না তার। জীবন তাকে কোথায় থেকে কোথায় নিয়ে আসলো দু বছরের মাথায়।
যেই মেয়ে কষ্ট কি সেই জিনিস টাই বুঝতো না। আর সেই মেয়ে আজ পুরো সংসারের বোঝা মাথায় নিয়ে চলে।
যে মেয়ে কখনো বাবা মা কে ছেড়ে বাড়ির বাহিরে বের হয় নি সেই মেয়ে সারাদিন বাহিরে কাজের সন্ধানে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করেছে।
আজ খুব বাবার কথা মনে পড়ছে। বাবা নামক ছায়াটা মাথার উপর না থাকলে বোঝা যায় জীবন কত কঠিন। বাবার মুখটা বড্ড ভেসে আসছে চোখের সামনে। এই তো সেদিন বুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমু খেয়ে বলল- “ দু দিন পরই ফিরে আসবো মা তখন তোমায় বই মেলায় নিয়ে যাবো।”
দু’দিন চলে গেলো বাবাও ফিরে আসলো কিন্তু জীবিত নয় মৃ’ত। গাড়ি এক্সসিডেন্ট কেঁড়ে নিল একটা সুখী পরিবারের সব সুখ এক মূহুর্তে।
কথাটা মনে পড়তেই শরীর কেঁপে উঠল ইন্দুর। গলা ধরে আসলো চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোটা অশ্রু। রাত অনেক হয়েছে কাল যেতে হবে স্কুলে কথাটা চট করে মাথায় আসতে রুমের দিকে পা বাড়াতেই হাতে থাকা ফোন টা বেজে উঠে ইন্দুর। ফোনের স্কিনে অচেনা নম্বর দেখে আর রিসিভ করলো না।
পরপর দুবার ফোন আসায় ফোন টা রিসিভ করে কানে নিতেই ওপাশ থেকে গম্ভীর কণ্ঠে ভেসে আসলো-“ ঘুমাও নি নিশ্চিত তাহলে ফোন ধরতে এতো দেরি হলো কেনো?”
ইন্দুপ্রভা কানের থেকে ফোন টা সামনে এনে নাম্বার টা ভালো করে দেখে। লোকটা তার নাম্বার কোথায় পেলো আবার? -“ আপনি আমার নাম্বার কোথায় পাইছেন?”
“ প্রশ্নকারী যখন প্রশ্ন করে তখন উত্তর দিতে হয় পাল্টা প্রশ্ন করতে হয় না। টিচার হয়েও এ কথা টা জানো না? ”
“ না জানি না। নাম্বার কই পাইছেন। আপনার জ্বালায় অতিষ্ঠ আমি বুঝতে পারেন না। আর কখনো ফোন দিবেন না বলে রাখলাম।”
“ এভাবে কথা বলো কেনো? একটু সফটলি কথা বলো আবেগ দিয়ে।”
“ আমার মনে এতো আবেগ নাই বুঝছেন। ফারদার আর কল দিবেন না।”
“ অবশ্যই কল দিবো। এবার যদি নাম্বার ব্লক করছো তো দেইখো কি করি।”
“ কি করবেন? ”
“ বেশি কিছু না তোমার বাসায় গিয়ে তোমার ফোন টা হাতে নিয়ে ব্লক টা ছুটায় আসবো আর তোমার আম্মুকে জিজ্ঞেস করবো তোমার কথা এতো তিতে কেনো ছোট বেলায় মুখে মধু কেনো দেয় নি।”
“ পাগল আপনি। আপনার মতো পাগলের সাথে কথা বললে আমিও পাগল হয়ে যাবো রাখেন ফোন।”
তুহিন ফোন টা কানে নিয়ে কেবিনের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশের থাকা চাঁদ টার দিকে তাকিয়ে থমথমে গলায় বলে-“পাগল ছেলেটাকে সামলাও না ইন্দু। সে যে দিনকে দিন পাগল হয়ে যাচ্ছে তোমার জন্য। চোখে কি দেখো না তোমার জন্য আমার মনে সঞ্চিত হওয়া ভালোবাসা। এতো অবুঝ কেনো তুমি? একটু বুঝো আমায়।”
“ দেখুন তুহিন আপনি শুধু শুধু সময় নষ্ট করছেন। আমি আপনাকে ভালোবাসতে পারবো না কতবার বলেছি বুঝেন না কেনো। আপনি তো ছোট বাচ্চা নন। আমার থেকেও বেটার সুন্দর শিক্ষিত মেয়ে ডিজার্ভ করেন।”
“ এই মেয়ে আমি কখনও বলছি তোমার থেকে বেটার সুন্দর শিক্ষিত মেয়ে চাই আমার। আমার শুধু এই ইন্দুপ্রভা কে চাই। তার মন আমি ঠিক জয় করে নিবো। ভালোবেসেছি তোমায় ছেড়ে দেওয়ার জন্য নয় বুঝলে? রাখি এখন কাল আবার ফোন দিব। রিসিভ করবে কেমনে শুভ রাত্রি। ”
কথাটা বলে তুহিন ফোন কে’টে দেয়। ইন্দু তপ্ত শ্বাস ফেলে নাম্বার টা ব্লক লিস্টে রেখে দেয়। এই ছেলের জন্য না জানি কি কি প্রবলেম তাকে ফেইস করতে হয় আল্লাহ ই জানে।
পরপর দুটো লম্বা শ্বাস নিয়ে বেলকনি থেকে রুমে চলে আসে। এবার না ঘুমালেই নয়,ভাই আর মায়ের জন্য অনেক কিছু করা বাকি। তাদের সুস্থ লাইফের জন্য নিজেকে ঠিক রাখতে হবে। উপরে চরকির মতো ঘুরতে থাকা ফ্যানের দিকে তাকিয়ে চোখ বুজে বলে-” ভুলভাল জিনিসের প্রতি ঝোঁকা যাবে না। এরা হচ্ছে ইন্দুপ্রভার জন্য নিষিদ্ধ। সবার জীবনে বিয়ে সংসার একমাত্র লক্ষ্য থাকে না। কারো কারো জীবনে এসব ব্যাতিত ও অন্য লক্ষ্য থাকে। তুহিন আপনি যে ফুল ভেবে কাটায় হাত দিচ্ছেন এটা আজ না বুঝলেও একদিন ঠিক উপলব্ধি করতে পারবেন। তখন নিজেকে কি করে ক্ষমা করবো,আপনাকে বারংবার বুঝাচ্ছি ইন্দুর জীবনে কোনো ছেলের প্রবেশ নিষিদ্ধ সে বিয়ে সংসার করতে পারবে না। এসব যে তার করতে নেই তবুও বুঝেন না কেনো আপনি?”
——————-
সকালের ঝলমলে রোদ জানালা ভেদ করে রুমে ঢুকে সোজা ইন্দুর চোখে মুখে উপচে পড়ছে। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে ইন্দু। চোখ বন্ধ রেখেই বলে-“ দেখ ইলিয়াস মাইর খেতে না চাইলে তাড়াতাড়ি জানালার পর্দা টা টেনে দে। আমি উঠলে কিন্তু মাইর দিবো।”
এখন ও পর্দা টা সরায় নি যার কারনে চোখ মুখে রোদ এখনো লাগছে-“ কি হলো ইলিয়াস বলছি তো পর্দা টা টেনে দিতে। সাত সকাল বেলা প্রতিদিন এমন করিস কেনো?” কথাটা বলে চোখ খুলে রেগে সামনে তাকাতেই দেখে তুহিন জানালার সামনে বুকে দু হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে।
তুহিন কে এই মুহূর্তে তার রুমে দেখে যেনো ইন্দু ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। চোখ দুটো ভালো মতো কচলে আবার সামনে তাকায়। সত্যি তুহিন এটা। সহসা বিছানা থেকে নামলো ইন্দু। তুহিনের সামনে দাঁড়িয়ে বলে-“ এই আপনি আমার বাসায় আসছেন কেনো?”
তুহিনের সোজাসাপটা কথা-“ ফোন কোথায় তোমার?”
“ আমার ফোন যেখানে খুশি সেখানে থাকুক আপনি আমার বাসায় এসেছেন কেনো তার উপর আমার বেডরুমে। ম্যানার্স শিখেন নি? মা, মা এই ছেলে আমার রুমে আসলো কি করে। বাসায় ঢুকতে দিছো কেনো অপরিচিত ছেলে কে?”
মেয়ের ডাক শুনে হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকে মনোয়ারা বেগম। মনোয়ারা বেগম কো দেখে তুহিন বলে-“ দেখছেন আন্টি বলেছিলাম ইন্দু আমার সাথে রুড ব্যাবহার করবে দেখলেন তো তাই করলো। এখন আবার বলছে আমি নাকি অপরিচিত! আন্টি আমি কি অপরিচিত আপনিই বলেন?”
মনোয়ারা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে-“ এমন ব্যাবহার করছিস কেনো ইন্দু তুহিনের সাথে। ছেলেটার নাম্বার তুই ব্লক লিস্টে রাখছিস কেনো? সেজন্য ছেলেটা সেই ভোর বেলা থেকে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
ইন্দু অবাক হয়ে তুহিনের দিকে তাকিয়ে বলে-“ আপনার কি মাথা খারাপ। এমন করতেছেন কেনো কি চান আপনি বলেন তো?
“ আপাততঃ চাইছি তুমি আমার নাম্বার টা ব্লক লিস্ট থেকে আনব্লক করো। আর আন্টির সামনে কথা দাও আমার নাম্বার আর জীবনেও ব্লক করবা না। আন্টি জানেন আপনার মেয়ের জন্য আমাকে কত গুলো সিম কিনতে হয়েছে? দশ দশ টা, আমার কার্ড দিয়ে সিম আর তুলা যাবে না সেজন্য মায়ের কার্ড দিয়ে তুলছি। এখন যদি এগুলোও ব্লক করে তাহলে আমি সিম কোথায় পাবো তখন কিন্তু আন্টি আমি আপনার কাছে আসবো বলে রাখলাম।”
“ এই আপনি থামবেন। ”
“ ইন্দু নাম্বার টা আনব্লক কর।”
ইন্দু অবাক হয়ে বলে-“ মা তুমি বলছো এই কথা!”
“ হুমম আনব্লক কর। এই যে ছেলে শুনো তোমায় বলছি আমার মেয়ে আর তোমার নাম্বার ব্লক করবে না। এবার নিশ্চিন্তে থাকতে পারো।
“ ধন্যবাদ আন্টি। আপনার মেয়ের মুখে একটু মধু দিয়েন। সবসময় তেঁতো কথা বের হয় আপনার মেয়ের মুখ দিয়ে। সেই অভ্যাস টা একটু বদলিয়ে ফেলতে বইলেন। এই যে ইন্দু আন্টি কিন্তু বলে দিছে নাম্বার ব্লক না করতে মনে যেনো থাকে। আসি আন্টি পরে আসবো আবার।”
কথাটা বলে তুহিন চলে যায়। ইন্দু তার মায়ের সামনে এসে বলে-“ এটা কি করলা মা তুমি। আমি বিভিন্ন উপায়ে ছেলেটার থেকে নিজের পিছু ছুটানোর চেষ্টা করছি আর তুমি আরো সুযোগ করে দিলে!”
“ তিন মাস ধরে তো চেষ্টা করলি পিছু ছোটাতে পারলি? তাই বৃথা চেষ্টা করে কি লাভ আছে বল? ছেলেটা তো ভালোবাসে তোকে। ভালোবাসা তো অন্যায় নয়। প্রায় দেখি ছেলেটা বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। ভালোবেসে দেখ ছেলেটা তো মন্দ নয়।”
“ মা! তুমি এসব বলছো? আর কেউ না জানুক তুমি তো জানো। এসব ভালোবাসা সংসার ইন্দুর জন্য নয় এসব নিয়ে অন্য কে মিথ্যা স্বপ্ন দেখানো মানে নিজের সাথে সাথে অন্য একটা মানুষ কে ঠকানো। আমি পারবো না এটা। প্লিজ মা তুমি এটা করতে বলো না আমায়।”
“ সব টা তুহিন কে খুলে বল সত্যি কারে অর্থে ভালেবাসলে তুহিন তোর সব জেনেই তোকে ভালোবাসবে।”
“ দুর্বল জায়গা মানুষ কে দেখাতে নেই মা। তাহলে তারা আরো বেশি করে সেখানে আঘাত করে। আমার স্কুলের সময় হয়ে এসেছে খাবার দাও আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
কথাটা বলে ইন্দু চলে যায় ওয়াশরুমে। মনোয়ারা বেগম অসহায় হয়ে মেয়ের যাওয়ার পানে চেয়ে থাকে। মেয়ে তার বাস্তবতা দেখতে দেখতে এখন সব কিছুতেই বাস্তবতা খুঁজে।
“সমস্যা কি আপনার? প্রতিদিন এভাবে ফলো করেন কেনো মেয়েকে? লোকে কি ভাববে? আপনার জন্য তো দেখছি এখন ঘর থেকে বের হওয়া ও দুষ্কর হয়ে উঠেছে। আগে আপনি নিমির বাসায় জ্বালাতেন আর এখন রাস্তাঘাটে!”
ইন্দুপ্রভার কথায় লোকটার মধ্যে কোনো ভাবান্তর হলো না বরং লোকটা ইন্দুপ্রভার হাতে থাকা বাজারের ব্যাগ টা নিজের হাতে নিয়ে ইন্দুপ্রভার হাত ধরে হাঁটতে থাকলো। ইন্দুপ্রভার রাগ সপ্তম আকাশে। এই লোক কি কিছুই বুঝে না? লোকজন কিভাবে আড় চোখে তাকিয়ে আছে সেদিকে কি লক্ষ আছে তার!
ইন্দুপ্রভা লোকটার থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো কিন্তু ফলাফল শূন্য। বাড়ির মোড়ে আসতেই লোকটা ইন্দুপ্রভার হাত ছেড়ে দিয়ে বলে- “ নাও এখন বাসায় যাও। আর হ্যাঁ বাসা থেকে একা-একা বের হবা না সাথে ছোট ভাই বা আন্টি কে নিয়ে আসবা। আর তা না হলে আমাকে ফোন দিবা। আমার ফোন নাম্বার আছে না তোমার কাছে? আরে ধূর আমিও না থাকবে কি করে কাল তো নতুন সিম কিনেছি। বাকি ১০ টা সিম তো তোমার ব্লক লিস্টে। এই তুমিও সিম চেঞ্জ করছো তাই না? হুমম তাই তো বলি নাম্বার বন্ধ কেনো?”
ইন্দুপ্রভার মাথা ধরে গেল লোকটার বকবক শুনতে শুনতে। কোন কুলক্ষণে যে এই লোকের সাথে তার দেখা হয়েছিল। সেই তিন মাস ধরে লোকটা ইন্দুপ্রভা কে পাগল বানিয়ে ছাড়ছে। ইন্দুপ্রভা কোনো কথা না বাড়িয়ে বাজারের ব্যাগ নিয়ে বাসার দিকে যেতে যেতে বলে- “আগে বাসায় যান ডক্টর দেখান । দিনকে দিন আপনার পাগলামি বেড়ে চলছে। আপনার আম্মা জানলে কি হবে ভেবে দেখেছেন।”
পেছন থেকে তুহিন কিছুটা জোরে বলে উঠে- “আম্মা জানলে জানবে সমস্যা কোথায়? আর হ্যাঁ আমার মনের ডক্টর তো আপনি। একটু চিকিৎসা করে দেখুন তো এই হৃদপিণ্ডটায় কি আছে যে সারাক্ষণ ইন্দুপ্রভা ইন্দুপ্রভা করে।”
ইন্দুপ্রভা দাঁড়িয়ে যায়-“ আপনার হৃদপিণ্ডটায় আস্ত গোবর ভরা আছে তাই ইন্দুপ্রভা ইন্দুপ্রভা করে। আর আসবেন না আমার সামনে।
তুহিনের এমন গা ছাড়া কথা দেখে ইন্দুপ্রভার রাগ হলো-“আপনার আম্মাকে কিন্তু আমি বলে দিব তার ছেলে শহর থেকে ডাক্তারি পড়ে গ্রামের মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে।”
তুহিন ভ্রুকুটি করে জিজ্ঞেস করে-“ আমি আর কাকে উত্ত্যক্ত করছি? ”
“ এই যে আমি আপনায় বারন করার পরও আমার পেছন পেছন রোজ আসেন। বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। আপনার জন্য যে গ্রামের সবাই আমাদের দিকে আঙুল তুলবে এটা কি ভেবে দেখেছন একবারও? ”
“ তাহলে আমার আম্মা কে তোমাদের বাসায় পাঠাই।”
“ আপনার আম্মা কে আমাদের বাসায় পাঠাবেন কেনো?”
“ কেনো আবার বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করার জন্য। ”
“ আমি অবাক হচ্ছি আপনার মতো পাগল কে ডাক্তার হবার জন্য সার্টিফিকেট কে দিলো? আপনি হসপিটালের রোগী রেখে একটা মেয়ের পেছন দিনরাত পড়ে থাকেন। চাকরি চলে যাবে না?”
“ তোমায় কে বললো আমি রোগী না দেখে শুধু তোমার পেছন পড়ে থাকি? রোগী দেখা শেষ করেই তোমায় দেখতে আসি। আবার যখন সময় হয় তখন চলে যাই।”
“ এতে কি লাভের লাভ কিছু হচ্ছে? ”
“ লাভ লোকসানের কথা এতো ভাবলে হয় না কখনো কখনো ক্ষতি করেও লাভ পাওয়া যায়। লাভ মিন’স লাভ।”
“ ক্ষতিই হবে শুধু লাভ কখনোই হবে না। ইন্দুপ্রভার থেকে পজিটিভ সারা কখনোই পাবেন না। তাই বলছি অযথা আমার পেছন ঘুরা বাদ দিন।”
“ আমি কার পেছন ঘুরবো কি ঘুরবো না সেটা কি তোমার থেকে শুনে করতে হবে। পুচকি একটা মেয়ে তার আবার এতো কঠিন মন! পুচকিদের থাকে নরম সফ্ট একটা মন। যাও বাসায় যাও।
ইন্দুপ্রভা তপ্ত শ্বাস ফেলে বাসায় চলে আসে। তুহিন যতক্ষণ ইন্দুপ্রভা কে দেখা যায় ততক্ষণই তাকিয়ে থাকে। ইন্দুপ্রভা চোখের আড়াল হতেই তুহিন চলে আসে।
ইন্দুপ্রভা বাসায় আসতেই তার মা মনোয়ারা বেগম মেয়ের হাত থেকে বাজারের ব্যাগ টা হাতে নিয়ে বলে- “ এতো দেরি হলো কেনো ইন্দু পাড়ার মোড়ের ছেলে গুলো কি আজও উত্ত্যক্ত করেছিল?
ইন্দুপ্রভা বারান্দায় থাকা বেঞ্চে বসে ওড়না দিয়ে শরীরের ঘাম মুছতে মুছে বলে-“ না মা এখন আর ছেলে গুলো উত্ত্যক্ত করে না। ভালো হয়ে গেছে।”
মনোয়ারা বেগম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে –
“ খুব কষ্ট হয় তোর তাই না ইন্দু এই সংসার চালাতে। আজ তোর বাবা বেঁচে থাকলে এতো কষ্ট আমাদের করতে হতো না।”
ইন্দুপ্রভা মাথা থেকে মায়ের হাত সরিয়ে হাতের উল্টো পিঠে চুমু খেয়ে বলে-“ না মা কোনো কষ্ট হয় না।”
“ মুখে যতোই বলিস কষ্ট হয় না আমি তো জানি আমি তো মা। তোর মনের কষ্ট টা তো বুঝি। সারাদিন স্কুলে ক্লাস করিয়ে আবার টিউশনি করানো। নিজের জন্য তো সময়ই নেই তোর।”
“ সময় নেই কে বলছে এই যে এখন সারাটা রাত তোমায় জড়িয়ে ধরে ঘুমাবো এটাই তো সারাদিনের ক্লান্তি এক নিমিষেই শান্তিতে পরিনত করে দিবে।”
“ আচ্ছা উঠ যা ফ্রেশ হয়ে আয় খাবার বাড়ছি খেতে হবে তো।”
ইন্দুপ্রভা মাথা নাড়িয়ে গোসল খানায় যায় গোসল করতে হবে সারাদিনের ধুলোময়লা সব উড়ে এসে শরীরে ভিড়েছে।
————————
“ এই স্মৃতি দাঁড়াও তো। তোমার কাছে ইন্দুর নাম্বার আছে দাও তো আমায়।”
হসপিটালে যাওয়ার পথে হঠাৎ রাস্তায় ইন্দুর ফ্রেন্ড স্মৃতি কে দেখে কথাটা বলে উঠে তুহিন।
স্মৃতি তুহিন কে দেখে স্মিত হেসে বলে-“ আসলে ভাইয়া ইন্দুর নাম্বার তো আমার কাছে নেই।”
তুহিন দু হাত বুকে গুঁজে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে বলে-“ দেখো স্মৃতি মিথ্যা বলো না। জানো না মিথ্যা বলা মহা পাপ। তোমার মতো এতো সুইট মেয়ে মিথ্যা বলবে আমি কল্পনাতেও ভাবতে পারি নি ছ্যা।”
“ ভাইয়া ইন্দু আপনাকে তার নম্বর দিতে না করছে। যদি জানে আমি আপনায় নম্বর দিয়েছি তাহলে আমার সাথে ফ্রেন্ডশিপ নষ্ট করে দিবে ইন্দু।”
“ আরে ছোট প্যাকেট জানবে না তুমি দিয়ে যাও। ইন্দু বুঝতে পারবে না যে নাম্বার তুমি দিছো।
“ সত্যি তো ভাইয়া?”
“ হুম সত্যি। ”
“ ০১৭৬******৯। এটা ইন্দুর নাম্বার। ভাইয়া ইন্দু যেনো ঘুনাক্ষরেও টের না পায় আমি দিছি।”
“ নিশ্চিন্তে বাড়ি যাও চিল করো ইন্দু জানবে না। ”
“ আচ্ছা ভাইয়া আমি আসি।
তুহিন নাম্বার টা ইন্দুপ্রভা লিখে ব্লাক ইমোজি দিয়ে সেভ করে। এবার জ্বালাতে পারবে ফোন দিয়ে। আর যদি এই নাম্বার ব্লক করছে তাহলে সোজা বাসায় গিয়ে ইচ্ছে মতো বকে আসবে হার্টলেস মেয়েটাকে।
ইরা মেয়েটি অত্যাধিক–অসভ্য–বর্বর–বাজে মেয়ে! দর্শিনীর সঙ্গে সেদিন নিকৃষ্ট ব্যবহারের পরে আবিদ তাকে দারুণ শিক্ষা দিয়েছিল। ইমান আবদুল্লাহ এবং সুফিয়া বেগম নিজেদের মেয়ের কুকীর্তি জানার পরে প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হন! পরবর্তীতে ইরাকে দর্শিনীর পা–ধরে মাফ চাইতে বলেন। আবিদ তার ছাত্রত্ব বাতিল করতে চেয়েছিল! কিন্তু ইমান চাচার মুখের দিকে তাকিয়ে অনিচ্ছাকৃত ভাবে থেমে যায়। তবে মেয়েটি যথেষ্ট পরিমাণে অসম্মানিত হয়েছে! বরং—পরিমাণটা বেশি ছিল! মাত্র অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে, ভার্সিটির সবাই জেনে গেছিল ইরার মিথ্যাচার। সে টপ–বিজনেস ম্যানের মেয়ে নয়। একজন প্রতারক! যে—গরিব বাবা-মার পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করে। এমন মেয়ে কতোটা নিকৃষ্ট ভার্সিটির সবাই উপলব্ধি করেছিল সেদিন। সবটা প্রকাশ হওয়ার পরে ইরাকে মিথ্যা পরিচয়ের জন্য প্রচুর ধিক্কার জনক কথা, অপমান সহ্য করতে হয়েছে! অবশেষে সকলের চাপে পড়ে ইরা দর্শিনীর পা–ধরে ক্ষমা চায়। দর্শিনী ভেতর থেকে বিরক্তবোধ করলেও, তাকে মাফ করে দিয়েছিল! সেদিন ইরার চোখে দর্শিনীর জন্য মৃদুমন্দ আক্রোশ ছিল। পরর্বতিতে ইরা কিছুদিন গায়েব ছিল! এখন স্বাভাবিক ভাবেই ভার্সিটি যায়, সব ক্লাস করে, সবার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলে! কিছুদিন আগে অবশ্য ইরা সুসাইড করতে চেয়েছিল! কারণ হিসাবে নিত্যদিন সহপাঠীদের বাজে কথা, অপমানে ডিপ্রেসড ছিল। সবার সমস্যা ছিল ইরার আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়াতে। ইরা বখাটে বড়লোক বন্ধুদের উসিলায় যত আরাম আয়েস করেছে সবটা লোক দেখানো ছিল! তাই সুযোগ পেলে সবাই তাকে কথা শোনাতো, অপমান করতো! সবার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলে প্রতারণা করেছিল বলেই‚ মেয়েটা আজ সবার কাছে অপমানিত হচ্ছে। তাই ইরা প্রতিজ্ঞা করেছে তাদের আর্থিক অবস্থা সফলতা দিয়ে বদলে ফেলবে! এজন্যই ভার্সিটিতে সহস্রবার অপমানিত হওয়া সত্ত্বেও পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। ইরার অদ্ভূত কর্মকান্ডের জন্য ইমান আবদুল্লাহ আর সুফিয়া বেগম মেয়েকে মাফ করেনি। তবে মেয়ের পরিবর্তনে নরম হয়েছেন কিছুটা। অতঃপর সেদিন থেকে ইরার সঙ্গে দর্শিনীর দ্বিতীয়বার কখনো দেখা হয়নি!
____________
দর্শিনীর প্রেগন্যান্সির খবর পেয়ে আশরাফ মুহতাসিম‚ প্রিয়মা বেগম খুবই খুশি হয়েছেন। তাছাড়া আহমেদ মুহতাসিম তো আছেন। তিনি সুখবর পাওয়া মাত্রই প্রিয় নাতনিকে দেখতে চেয়েছেন। দর্শিনীর বিয়ের পরে, দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ বোধ করছেন তিনি। এজন্যই আশরাফ সাহেব বাবাকে নিজের কাছে রেখে—আদর-যত্ন করছেন! প্রয়োজন মতো ডাক্তার দেখাচ্ছেন। অন্যদিকে প্রজ্জ্বলিনী সন্তান সহ বাবার বাড়িতে থাকার সুবাদে সেদিন আলাদা করে জানানো হয়নি। বোনের প্রেগন্যান্সির খবরে আনন্দিত প্রজ্জ্বলিনী! তবে দর্শিনীর এতো দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া দেখে কিছুটা চিন্তিত ছিল। আবিদ, দর্শিনী দুজনেই স্বহাস্যে—আত্মীয়স্বজনকে সুখবরটা দিয়েছে। সবাই খুশি ছিল তাদের অনাগত সন্তানের জন্য! আসফি খবরটা শুনে খুশি হয়েছে। ঈষদুষ্ণ কষ্টও পেয়েছে বটে! বেচারী সত্যিই আবিদ, দর্শিনীর ভালো চায়! কিন্তু কেনো জানি প্রিয়দর্শিনী নামক সুক্ষ্ম ব্যথাটা মাঝেমধ্যেই তীব্র হয়ে উঠে। তাই সেটা নির্মল করতে লাইফটাইম কানাডায় থাকার সিদ্ধান্ত। তবে এতবড় সত্যিটা কেউ জানেনা। জানবেও না!
আজকে আবিদ‚ দর্শিনীকে নিয়ে মুহতাসিম ভিলায় যাবে। আহমেদ মুহতাসিম বারবার করে আবিদকে বলে দিয়েছেন। উনার কথা রাখতে আবিদ আজকের জন্য যাবতীয় কাজ থেকে ইস্তেফা নিয়েছে! দর্শিনী আজকে বাবা-মার সঙ্গে খুশির সংবাদ ভাগ করে নিতে পারবে বলে অনেকটা এক্সাইটেড ছিল! দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষে আবিদ দর্শিনী দুজনেই রেডী হয়ে যায়। দর্শিনী খয়েরী-কালো সংমিশ্রণে একটা শাড়ি পড়েছে। গলায় আবিদের দেওয়া স্বর্ণের চিকন চেইন। কানে ছোট্ট দুল! মাথায় মসৃণ চুলগুলো ছেড়ে রাখা। ব্যস! দর্শিনী রেডী হয়ে গেলে, আবিদ তখন রুমে আসে। সে দর্শিনীর সামনে দ্রুত শার্ট চেন্জ করতে থাকে। দর্শিনী হতভম্ব হয় আবিদের কাণ্ডে! তৎক্ষণাৎ চোখ ঢেকে অন্যদিকে ফিরে যায়। সে আবিদকে ওয়াশরুমে গিয়ে—চেন্জ করতে বলে। আবিদ তার কোমড় আঁকড়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে,
আবিদের শেইমলেস কথায় দর্শিনী লজ্জা পেয়ে আবিদের ঠোঁটে হাত রেখে বলে,
‘ইশশ! আপনি চরম অসভ্য আবিদ!’
আবিদ দর্শিনীর দিকে একটু ঝুঁকে বাঁকা হেসে বলে,
‘সব পুরুষই নিজের বউয়ের কাছে বন্য, চূড়ান্ত অসভ্য হয়!’
দর্শিনী আবিদের থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করছে। আবিদ তার চুলের ফাঁকে হাত ডুবিয়ে, অন্যহাত আলতো করে গালে রেখে পুরুষালি ঠোঁট দিয়ে দর্শিনীর ঠোঁটে শব্দ করে চুমু খায়। দর্শিনীর যেন আচমকা নিঃশ্বাস আঁটকে যাওয়ার মতো অনুভব হলো। পরবর্তীতে আবিদ তাকে ছেড়ে বাঁকা হেসে ওয়াশরুমে ব্লেজার, প্যান্ট নিয়ে চলে যায়। এদিকে দর্শিনী বুকে হাত দিয়ে নিঃশ্বাস নেয়। তার দৃষ্টি তখনও ওয়াশরুমের দরজাতে নিবদ্ধ। দর্শিনী মনে মনে বলে,
‘আশ্চর্য্য, আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী আপনি স্বামী হিসেবে সত্যি আশ্চর্য্য!’
আবিদ‚ দর্শিনী রেডী হয়ে গাড়িতে উঠে বসে। অনুসা বেগম, শাহরিয়ার চৌধুরী দুজনকে গাড়িতে উঠিয়ে দেন। শাহরিয়ার চৌধুরী গাড়ির স্পীড কমিয়ে রাখতে বলেন। আবিদ সুন্দর ভাবে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। তারা রওনা হয়, মুহতাসিম ভিলার উদ্দেশ্যে। দর্শিনীদের বাড়ির সামনে গাড়ি পার্ক করতেই—কয়েকজন অনাথ পথশিশু দুজনকে ঘিরে ধরে। শরীরে তাদের জরাজীর্ণ ময়লা পোশাক! শিশুগুলোর শুকনো, ক্ষুদার্থ চেহারা দেখে দর্শিনীর ভিষণ খারাপ লাগলো। তারা দর্শিনীর শাড়ির আঁচল ধরে অশ্রুসিক্ত চোখে বলে,
‘আপা আমগোরে কিছু খাওন দিবেন? আজ তিনদিন আমরা পানি ছাড়া কিছুই খাইনি। জানেন কেউ আমগোরে কোন কাজ দেয়না। দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। পেটের দায়ে পড়ে ভিক্ষা করছি।’
দর্শিনীর ভেতরের কমল মনটা কেমন যেন শিউরে কেঁপে উঠল। আজ তিনদিন ধরে বাচ্চাগুলো পানি খেয়ে আছে! আশ্চর্য্য‚ কেউ কী তাদের খেতে দেওয়ার মতো সামর্থ্যবান ছিল না? নিষ্ঠুর এই সমাজে মানুষের মনোভাব নিকৃষ্ট কেনো? মানুষ ক্ষুদার্ত থাকলে অনুভব করতে পারে, কতটা কষ্ট হয়! সেখানে পথশিশুরা দীর্ঘদিন না খেয়ে পার করে। তাদের কষ্ট অনুভব করে দর্শিনীর চোখে পানি জমল। তৎক্ষণাৎ সে আবিদের দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকাল! আবিদ তার প্রিয়দর্শিনী কী চাইছে, মুহূর্তেই বুঝে গেছে! দর্শিনীর কমল, পবিত্র মনটা সর্বদা মুগ্ধ করে আবিদকে! সে ভাগ্যবান স্বামী কারণ দর্শিনী তার মনের মতো। আবিদ বাচ্চাগুলোর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘চলো আমাদের সাথে! বয়স কতো তোমাদের?’
একজন বলল পাঁচ বছর‚ একজন বলল তিন বছর‚ একজন ছয় বছর এভাবে সবাই নিজেদের বয়স বলল। পরবর্তিতে নাম জিগ্যেস করা হলে—সবাই নিজেদের নাম বলে মলিন হাসলো। তারা সবাই অনাথ! দর্শিনী ওদের পেছন পেছন হেঁটে আসছে। তাদের কথাবার্তা সবকিছু কর্ণগোচর হলো দর্শিনীর। মুহূর্তে মনে মনে বিস্তর পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেলল‚ এতিম পথশিশুদের নিয়ে! তাদের সবার জন্য কিছু করার উদ্যোগ নিবে দর্শিনী। সে ঠিক করলো আবিদকে জানাবে তার একান্ত পরিকল্পনা! এদের থাকার জন্য এতিমখানা তৈরির ব্যাপারে।
আমাদের দেশে প্রায় সহস্রাধিক পথশিশু ভাগ্যের পরিহাসে এভাবেই অনাহারে‚ আনাদরে রাস্তাঘাটে মৃত্যুবরণ করছে! তাদের পর্যাপ্ত খাবার পানি, বস্ত্রসমূহ, শিক্ষা, চিকিৎসার অভাব! সমাজে প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ তাদের জন্য এগিয়ে আসেনা। অথচ এটা প্রত্যেকটি ব্যক্তি, নাগরিকের কর্তব্য! সমাজের তথাকথিত ধনী–সম্প্রদায় সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে—এভাবে ফুলগুলো অকালে ঝরে পরতো না! দর্শিনী পথভ্রষ্ট সমাজের চিন্তাচেতনা তো বদলাতে পারবে না। কিন্তু চেষ্টা তো করতেই পারে! হয়তো চেষ্টার ফলে অনেকের জীবন বাঁচাতে সক্ষম হবে। ধীরে ধীরে মানুষ ভালো-মন্দ বুঝতে শিখবে।
কলিং বেল বাজতেই প্রিয়মা বেগম দরজা খুলে দেন। দরজা খোলার পরমুহূর্তেই, এতোগুলো বাচ্চাকে দেখে তিনি বিস্মিত হয়ে আবিদের দিকে তাকালেন। বাচ্চাগুলো সামনেই দাঁড়িয়ে আছে! আবিদ দর্শিনী তাদের পিছনে হাসিমুখে রয়েছে। অনাথ বাচ্চাগুলোর মলিন চেহারায়; নূরের মতো হাসি দেখে প্রিয়মা বেগমের হৃদয় জুড়িয়ে গেলো। আবিদ স্বহাস্যে শাশুড়িকে সালাম দেয়,
‘আম্মা তারা অনাথ পথশিশু! আজকের দিনটা আমাদের সঙ্গে থাকবে! কোন সমস্যা হবে না তো?’
প্রিয়মা বেগম নরম মনের মানুষ। তাছাড়া দর্শিনীর পরিবারের সবার মানসিকতা ভিষণ সুন্দর। এই বাচ্চাগুলোর জন্য তাদের অসুবিধা হবে তিনি এটা ভাবতেই পারলেন না। বাচ্চারা ফেরেস্তা সমতূল্য! তারা বাড়িতে সৌভাগ্য বয়ে আনে। প্রিয়মা বেগমের সবাইকে দেখে মায়া হলো। মনে হচ্ছে দীর্ঘদিন অভুক্ত রয়েছে সবাই! তিনি হাসিমুখে বলল,
‘কোন সমস্যা নেই বাবা! তোমরা সবাই ভেতরে আসো।’
আবিদ বাচ্চাগুলোকে ইশারা করে। সবাই শৃঙ্খলভাবে লিভিং রুমে প্রবেশ করে। আশরাফ সাহেব অনাথ পথশিশুদের সঙ্গে মেয়ে জামাইকে দেখে এগিয়ে আসলেন। আবিদ তখন ফোনে কাউকে কিছু আনতে বলছিল। সে শ্বশুরকে দেখে ফোন রেখে সালাম দেয়। দর্শিনী বাবা–মার সঙ্গে কুশল বিনিময় করে। আশরাফ সাহেব, প্রিয়মা বেগম দর্শিনীর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দেন! দর্শিনী বাবা–মাকে অনাথ বাচ্চাগুলোর অসহায়ত্ব সম্পর্কে বলে। এসব ভেবেই তার মন খারাপ ছিল। আশরাফ সাহেব বললেন, যতদিন পর্যন্ত এদের ব্যবস্থা না হবে তিনি সবাইকে বাড়িতে রাখবেন। আশরাফ সাহেবের কথায় সবাই খুশি হয়ে যায়। আবিদ খুশি হয় দর্শিনীকে খুশি হতে দেখে! কালকেই সবাইকে এতিমখানায় নিয়ে যাবে আবিদ। নিচে হৈ-হুল্লোর শব্দ শুনে প্রজ্জ্বলিনী প্রহরকে নিয়ে লিভিং রুমে চলে আসে। দর্শিনী বোনকে দেখে এগিয়ে যায়। প্রহরকে কোলে নিয়ে আদর করে দেয়। প্রজ্জ্বলিনী বাচ্চাগুলোর দিকে অবাক হয়ে তাকায়, দর্শিনী বোনকে সবটা খুলে বলে। প্রজ্জ্বলিনী ওদের জন্য ব্যথিত হয়! ততক্ষণে আবিদের লোকজন বসের শ্বশুরবাড়িতে বড় বাস্কেট ভর্তি বাজার, মাছ-মাংস নিয়ে এসেছে! তাছাড়া বাচ্চাগুলোর জন্য বেশকিছু কেনাকাটা করেছে। তাদের পরিধানের কাপড়সমূহ! আবিদের পরামর্শ অনুযায়ী লোকটা বাজারের ঝুঁড়িগুলো রান্নাঘরে সাজিয়ে রাখে। এতোসব দেখে আশরাফ সাহেব বলেন,
‘এসব কী আবিদ? এতো কিছু কেনো এনেছো? তুমি একদম ঠিক করোনি আবিদ!’
প্রজ্জ্বলিনী‚ দর্শিনী‚ প্রিয়মা বেগম অনেকদিন পরে একসঙ্গে হয়েছে। তারা আহমেদ মুহতাসিমের রুমে ছিল! তাই এতসব দেখেনি। আবিদ মৃদু হেসে শ্বশুরকে বলে,
‘আমি আপনার মেয়ে জামাই! এটা আমার কর্তব্য ছিল বাবা! তাছাড়া দাদুভাইয়ের কথা ভেবে অন্তত গ্রহণ করুন।’
আশরাফ সাহেব আর কথা বলতে পারলেন না। আবিদ লোক দুটোকে চলে যেতে নির্দেশ করে। পরবর্তীতে বাচ্চাদেরকে গোসল করিয়ে পরিপাটি করাতে, আবিদ আশরাফ সাহেবকে সাহায্য করে। অবশেষে মেয়েরা ডাইনিং টেবিলে খাবার রেডী করতে থাকে! সবাই ফ্রেশ হয়ে খেতে চলে এসেছে। সবশেষে উজান আসে সরাসরি অফিস থেকে। তারপর আহমেদ মুহতাসিমকে ধরে-ধরে ডাইনিং টেবিলে নিয়ে আসে আবিদ, দর্শিনী! অতঃপর সবাই খেতে বসেছে। বাচ্চাগুলো যেন পেট পুরে খেলো! আজকে, কালকে সারাদিন তারা এখানে থাকবে। আগামীকাল আবিদের তত্ত্বাবধায়ণে এতিমখানায় শিফট করা হবে তাদের। বাচ্চাগুলোকে রাতে গেস্টরুমে শুতে দেওয়া হয়েছে। তারা সামান্য যত্ন পেয়ে কেমন কৃতজ্ঞতা দৃষ্টিতে মাথানত করে রাখছিল। এমন শিশুদের প্রতি সমাজের তথাকথিত ভদ্রমানুষ রূপি অমানুষদের মায়া হওয়া উচিত। কিন্তু তারা এমন নয়! আবিদ, দর্শিনী দুজনই দাদুর সঙ্গে কথা বলে নিজেদের রুমে ফিরে আসে। দর্শিনী রুমে ফিরেই আবিদকে জড়িয়ে ধরে জিগ্যেস করে,
‘আপনার তত্ত্বাবধায়ণে কয়টি এতিমখানা চলে? কেউ জানেনা কেনো? আমি আজকে আপনার কথা না শুনলে, জানতেও পারতাম না আবিদ! আপনি আমার থেকে কথা লুকিয়ে অন্যায় করেছেন।’
আবিদ দর্শিনীর কপালে চুমু দিয়ে বলে,
‘আমি এটা গোপন রাখতে চেয়েছিলাম দর্শিনী। ভালো কাজ সবাইকে বলে করতে হয়না। তোমার অনাথ শিশুদের প্রতি দূর্বলতা দেখে বলতে চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু তুমি আগেই জেনে ফেলেছো। মানেটা পরিস্কার! আল্লাহ্‚ চাননি আমি স্ত্রীর কাছে বিষয়টি গোপন করি।’
‘আপনার টাকাই এতিমখানা চলে? এক্সাক্ট কয়টি?’
‘পাঁচ-ছয়টা! ভবিষ্যতে সংখ্যা বাড়বে। চিন্তা করোনা সমাজে অবহেলিত অনাথ শিশুদের নিয়ে ভালো চিন্তাভাবনা করেছি। তাছাড়া সরকার তাদের জন্য ব্যবস্থা নিচ্ছে। সবাইকে সুন্দর জীবন উপহার দেওয়া হবে। ইনশাআল্লাহ!’
‘আমাকে নিয়ে যাবেন প্লীজ? আমি তাদেরকে দেখতে চাই!’
‘এতিমখানায় বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বড়সড় অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। তখন সবাইকে এলাউ করে! তাছাড়া কালকে আমি ওদেরকে পৌঁছে দিতে যাবো। তখন আমার সঙ্গে যাবে সমস্যা নেই।’
‘আমি বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে কেমন অনুষ্ঠান হয় দেখতে আগ্রহী!
‘সবার জন্য বড়সড় খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয় বছর শেষে! তাছাড়া সবাইকে কম্বল‚ চকলেট-মিষ্টি‚ নানান উপহার সামগ্রী দেওয়া হয় এটাই।’
‘বাহ সুন্দর তো!’
‘ঠিক আছে! এবার বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠান হলে তোমাকে নিয়ে যাবো। এখন কথা নয় শুয়ে পড়ো!’
__________
পরেরদিন সময় মতো বাচ্চাগুলোকে এতিমখানাতে পৌঁছে দেয় আবিদ। দর্শিনী তার সঙ্গেই ছিল। বাগানের মধ্যে সুন্দর পরিবেশে এতিমখানা অবস্থিত! সেখানে উপস্থিত প্রতিটা বাচ্চা আবিদকে দেখে অনেক খুশি হয়। বাচ্চাদের পড়াশোনা করানোর জন্য টিচার, দেখাশোনা করার জন্য কেরানি গার্ডস ছিল! আবিদ আসার সময় সবার জন্য চকলেট নিয়ে এসেছিল। বাচ্চাগুলো দর্শিনীর সঙ্গে পরিচিত হয়! অনাথ শিশুদের দেখে দর্শিনীর কষ্ট হয়। সে তাদেরকে অবজার্ব করতে থাকে। তারা সবাই ভিষণ ট্যালেন্টেড। দর্শিনী অনাথ শিশুদের জন্য কিছু করতে চেয়েছিল। ভাগ্য হয়তো সুপ্রসন্ন ছিল তাই হয়তো আবিদের মাধ্যমে স্বপ্নটা বাস্তবায়িত হচ্ছে! আবিদ‚ দর্শিনী পুরো বিকেলটা এতিমখানায় কাটিয়ে দেয়। তারা পাঁচটি এতিমখানাতেই গেছিল। আরেকটি নতুন তৈরি হচ্ছে! কনসট্রাকশনের কাজ চলছে! প্রায় শেষের পথে! দর্শিনী আজকে অনেক খুশি কারণ হাফ পার্সেন্ট অনাথ বাচ্চাদের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। তারা এখন ভালো থাকবে। তাদের আর কখনো না খেয়ে কষ্ট পেতে হবে না। এতিমখানা ঘোরাঘুরি শেষে আবিদ‚ দর্শিনী দুজনেই চৌধুরী বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। আজকে দর্শিনীদের মতো প্রজ্জ্বলিনী আর উজান তাদের নিজেদের বাড়িতে রওনা দিয়েছে। প্রহরের জন্মের পরে প্রজ্জ্বলিনী অনেকদিন বাবা-মার সঙ্গেই ছিল। ফলে উজানকে এখানে আসতে হয়েছে! মাঝেসাঝে উজান অফিসে যাওয়ার পথে প্রজ্জ্বলিনী আর প্রহরকে রেখে আসতো। আবার বাসায় নিয়ে যেতো। আপাতত মুহতাসিম ভিলায় আশরাফ সাহেব‚ প্রিয়মা বেগম‚ আহমেদ মুহতাসিম এবং একটি মেইড আছে! মেইডকে আহমেদ মুহতাসিমের দেখাশোনা করার জন্য রাখা হয়েছে।
#চলবে
[ পরবর্তী পর্বে সমাপ্তি থাকবে! সমস্যা নেই স্যাড এন্ডিং দিবোনা। সবাই ভুলত্রু’টি মানিয়ে নিবেন প্লীজ ]
বাবা উঠে দেখো তোমার আম্মু তুমার পাশে” ঐ ডাক্তার টাও বলেছিলো ডাকতে, তারা তো সবটাই জানতো, কিন্তু উনি জুনিয়র হওয়ায় চাকরি হারানোর ভয়ে আর বলেনি। এদিকে আম্মু ধরতে চাচ্ছিল, নার্সরা দেয়না, তারপর অনেক রিকুয়েষ্ট করার পর আম্মু ওকে জড়ায়া ধরে, ঐদিন আর আম্মু এতো কিছু চ্যাক করে নাই, কারণ এমনেই অনেক্ষন পর ধরতে দিছে রুমে ঢুকতে দিছে তাই আর খেয়াল ছিলো না।
তারপর ৯ টার দিকে ঐ ডাক্তারের হয়তো খারাপ লেগেছিলো তাই আমার আব্বুকে বলে, আপনারে একটা কথা বলবো কিন্তু বড় স্যারকে এটা বলবেন না, আসলে আপনার মেয়ে আর নাই। এটা যখন একজন বাবা শুনে তখন তার কেমন লাগতে পারে! উনি বলেন আপনি বড় স্যারের কাছে যান, উনি স্বীকার করবে না যদিও, তারপর আমি গিয়ে বলবো।
এরপর আব্বু বড় ডাক্তারের চেম্বারে যায়, উনি বলেন টেনশন নাই আপনার মেয়ে আছে দোয়া করেন। তারপর ঐ ভালো ডাক্তার টা এসে বলে স্যার উনারা অনেক কষ্ট করে এখানে এতোটুকু এসেছে তারপর সব বলল। এরপর বড় ডাক্তার বলে সরি, আপনাদের বাকি সব কিছু শেষ করে আপনাদের মেয়ে নিয়ে যান (আল্লাহ ঐ ভালো ডাক্তারকে ভালো রাখুক)তারপর আব্বু তো আম্মুর সামনে কান্না করতে পারছেন।
তাই আমার নানাভাই কে কল দেয়, উনি তো প্রিতীর জন্য অনেক পাগল। ঐদিন নানাভাই নাকি আবার স্বপ্ন দেখছিলো ওর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, তারপর আব্বু নানাভাইকে বললে উনি বলে, আল্লাহ ভরসা আমারে নিয়া টেনশন করোনা, আমার প্রিতীরে আল্লাহর ভালো লাগছে, তাই নিছে। আসলে আব্বু নানাভাই, আম্মু আর আমাকে নিয়ে টেনশন করছিলো।
এদিকে নানভাই তখন বাসায় ছিলো, কান্না করতে করতে যখন বের হতে যাবে তখন দরজার সাথে বারি খায় আর অনেক কান্না করে প্রিতী আমার প্রিতী এরকম করে। আমরা তখন আমাদের বাসায় ছিলাম মানে নিচ তলায়। এগুলা পরে শুনেছিলাম। এদিকে এতোদিন আমার ছোট মামা বাসায় আসেনি ঐদিন এসে মাত্র ভাত খেতে বসেছিলো তখনি আব্বু মামাকে কল করে বলে আসতে, মামা যখন খাবার ছেড়ে জলদি উঠে যায় তখন নানুও বুঝতে পারে। কারণ নানাভাই, আব্বু কাউকে কিচ্ছু বলেনি।
তারপর নানু বুঝতে পেরে ৪ তলায় আন্টিকে ডাক দিতে যেয়ে মাথা ঘুরে পরে যায়! এদিকে বাড়ির সবাই জানে শুধু আমি আর আমার বোনেরা জানিনা। আমাদের শুনাতে বারণ করেছিল। আমার অবস্থা তো এমনিতেই খারাপ তার উপর আবার আব্বু আম্মু কেউ নাই তাই। আর মেডিক্যালে আম্মুও জানতো না। এজন্যই তারা সবাই প্ল্যান করে আম্মুকে বলে প্রিতীর জ্ঞান ফিরছে আর এরপরই আম্মু আমাকে বলে। এদিকে আম্মুকে আগে বাসায় আনতে হবে, নাহলে মেডিক্যালে শুনলে আম্মুকে সামলাতে পারবেনা কেউ।
তারপর সবাই আম্মুকে বলে যে প্রিতীকে এখন অন্য মেডিক্যালে ট্রান্সফার করাবে! তাই আম্মুকে বাসায় নিয়ে যাবে ফ্রেশ হয়ে সেখান থেকে আরেক মেডিক্যালে যাবে। আসলে এগুলা সব মিথ্যা কথা ছিলো। এদিকে আন্টি আসে আমাকে বলে তোর আম্মু আসতেছে!
আমি তো ভীষন খুশি, তারপর বলি তো তুমি কান্না করছো কেন.? বলে অনেকদিন পর তোর আম্মুর সাথে কথা বলছি তাই কান্না করতেছি। এরপর মামানি আসে তখন আবার মামানি প্রেগন্যান্ট। উনার অবস্থাও অনেক খারাপ। ডেলিভারির ডেইট সামনেই। উনি আসে আমাকে খাওয়াতে, কারণ জানে এগুলা শুনলে আমি আর খাবো না। তারপর আমি বলি, মামানি আম্মু আসতেছে আম্মুর সাথে খাব।
তারপর আম্মুকে আনার সময় সি,এন, জিতে আব্বু নাকি সহ্য করতে না পেরে অনেক কান্না করছিল, প্রিতী,প্রিতী বলে চিৎকার দিচ্ছিলো। ঠিকমতো নিজের মনের কষ্ট কমাতেও পারছিলো না আম্মু সামনে থাকায়, কারণ আম্মু তো জানেনা। আর আম্মুকে অনেক কষ্ট করে আনা হইছে। তারপর আম্মুকে যখন বাসার সামনে আনা হয় সবাই গেছে আম্মুকে দেখতে, আমিও আনতে গেছি আজকে ১০ দিন আম্মুকে দেখিনা। এদিকে সবাই তো জানে খালি আমি আর আম্মু বাদে।
তারপর আমার খালামনি বলে আমরা গ্রামে যাবো, আমি বলি কেন? বলে প্রিতী বলছে। তখন আমি বলি প্রিতী সুস্থ হইছে? বলে হুম, আসলে তখন আমার হিতাহিত জ্ঞান কাজ করছিলো না,সবই আল্লাহর ইচ্ছা। তারপর আম্মু কিন্তু বুঝে যায় সবাই এরকম আসার কারণে তখন অনেক কান্না করে, আমি তো কিছুই বুঝতেছিলাম না। মানে কেমন জানি লাগছিলো। অনেকে হয়তো বলতে পারেন না বুঝার কি আছে! আসলে যার পরিস্থিতি সে ই বুঝতে পারে।আমি তো জানতাম আমার বোন সুস্থ হয়ে গেছে আর কল্পনাও করিনাই যে ও মারা যাবে।
তারপর আম্মুর কান্না করায় বুঝতে পারছি, তখন আমার কি কান্না! আমার আম্মুরে জড়ায়া ধরে এতো কান্না করছি কেউ আমাকে আর আম্মুকে ছুটাতে পারছিলো না। একেতো এতোদিন পর আম্মুকে পাইছি তাও আবার যেই আশা নিয়ে ছিলাম সেই আশাও শেষ। আসলে এই অনুভূতি বুঝানোর মতো না! এদিকে আস্তে আস্তে সবাই জানাজানি হওয়ার পর সবাই আসে। আমার বোনের বেস্ট ফ্রেন্ড বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলো।
আমার সো কলড ফ্রেন্ডরাও এসেছিলো আমার আম্মু আমার সামনে কান্না করতে পারছিলোনা, কারণ তখন আমার যেই অবস্থা ছিলো, তাই সবাই আমাকে বুঝাচ্ছিলো তুই এমন করলে তোর মার কি হবে? তোকে সামলাতে হবে যেহেতু তুই সবার বড়! কিন্তু কে শুনে কার কথা, তারপর আম্মু আমাদের ৩ বোনকে খাওয়ায় নিজ হাতে। তারপর আমাদের বলে কান্না না করতে এরপর উনি আমার থেকে দূরে গিয়ে আরেক রুমে গিয়ে ইচ্ছামতো কান্ন করে, আমাকে ঐ রুমে যেতে দেয়না। কারণ ঐসময় আম্মুর কান্না করার দরকার ছিলো। আমি সন্ধ্যা পর্যন্ত বাইরে বসেছিলাম। ঐদিন শবে বরাতের চাঁদ উঠছিলো।
আমি শুধু কান্না করছিলাম বাইরে বসে। তারপর আমার বোনকে আনা হয়। গোসল করানো হয়, আর সবার কি কান্না। যারা গোসল করাইছে তারাও কাঁনছে, ওরে যখন গোসল করানো হয় দেখে নাকি বুঝাই যাচ্ছিলো না ওর যে এতো বড় অপারেশন হইছে এতোদিন মেডিক্যাল ছিলো।
তারপর আমার ফুফাতো বোন বলে তুই দেখিছ না সহ্য করতে পারবিনা। মাথায় নাকি জাস্ট পিন মেরে দিছে! আমি বলি যে না এটাই লাস্ট আমি দেখবো। তারপর সবার প্রথমে আমি গিয়ে ওর মুখে হাত দিলাম। এতো সুন্দর এতো স্নিগ্ধ লাগছিলো মা শা আল্লাহ।
তারপর আম্মুকে ডাক দেয় আম্মুকে ধরতে দেয়না। আমি আবার আম্মুকে দেখে এতো কিছু সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারাই। হায়রে মানুষ, আমার আম্মুকে তখন অনেকে বলে তোর এইটাও মারা যাবে। তখন আম্মুর কি অবস্থা হইছে বুঝেন! আম্মু আমাকে কোলে নিয়ে কান্না করতে করতে শেষ সবাই হাতে পায়ে তেল দিচ্ছিলো। আসলে আমি সব শুনছিলাম তবে চোখ খুলতে পারছিলাম না। সবাই তো ভাবছে আমিও শেষ আম্মুর কি কান্না! এদিকে পরে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, পুরুষেরা সবাই যাবে গ্রামে, আমাদের নিবেনা।
কারণ আমার জ্ঞান তখনো ফিরে নি,আর এরপরের দিন ছিলো হরতাল। এই অবস্থায় আমাকে বা আম্মুকে নেয়া রিস্ক হয়ে যাবে। তারপর জ্ঞান ফিরলে আবার কান্না শুরু করি আর বলি আল্লাহ আমারে নাও আমার বোনরে দাও। তারপর ওকে নেয়া হয় গ্রামে, এই যে তখন এতো সমস্যা দেশে, পরেরদিন হরতাল আবার লাশের গাড়ি নিতে লাগে অনেক টাইম, রাস্তায় জ্যাম কিন্তু আল্লাহর রহমতে খুব তাড়াতাড়ি প্রিতীকে নিয়ে গ্রামে পৌঁছায় সবাই আল্লাহর ইচ্ছায়।
এদিকে গ্রামে ও সবাই অনেক কান্না করছে। আর আমার দাদা বাড়িতে আমরা ২ বোন যাইনা। আমার দাদা দাদি নাই , আর ভালো লাগতো না তাই। একদিন ও বলছিলো যে, ও মারা গেলে যাতে ওকে নানাভাইয়ের বাড়িতে কবর দেয়া হয়! তাই নানাভাই বলে আমার প্রিতীর শেষ ইচ্ছা পূরণ করবো ইন শা আল্লাহ। সেজন্য নানাভাইয়ের বাড়িতে কবর দেয়া হয় রাত ১ টা ১৩ মিনিট।
তখন আমার ছোট মামা আম্মুকে ফোন দিয়ে যেই কান্না! এই যে এতো কিছু হলো ও কান্না করেনি, সবাইকে সামাল দিছে এরপর আর না পেরে আম্মুকে ফোন দিয়ে অনেক কান্না করছে, তারপর আম্মু ওর কান্না দেখে ওকে শান্ত্বনা দেয়। কারণ তার ভাইকে সে এমন অবস্থায় কখনো দেখেনি, তারপরের দিন আমি ওর ঐযে নতুন জামাগুলা নিয়ে বসে বসে শুধু কান্না করছিলাম, ঐগুলা ও শুধু একবার করে পরতে পারছে। আহারে আমার বোনরে।
এখনো পাশে যখন তাকাই ওকে না দেখতে পেলে কলিজা ফেটে যায়। আমাদের একি রকম জামা কাপড়, আমার গুলা যখন নিতে যাই ওর গুলা দেখলেই মনে পরে, আশে পাশে সব ওর স্মৃতি, ওর বই খাতা, ওর জিনিসপত্র সব আছে শুধু ও নাই। ঘুমাতে গেলে পাশে ওকে না দেখলে খারাপ লাগা,কান্না করা, এগুলা তো আছেই।
আমার ছোট ২ বোনদের যখন দেখি একসাথে তখন আমার বুক ফেটে কান্না আসে, কারণ আমি তো এখন প্রায় একা, ওদের মতো আমারও তো একজন ছিলো যার সাথে হাসি, তামাশা,দুঃখ, কষ্ট সব শেয়ার করতাম। আসলে যাদের পিঠাপিঠি বোন আছে তারাই বুঝবেন।অনেক কষ্ট করছে আমার কলিজার বোনটা, সবাই আমার বোনটার জন্য কান্না করেই চলছে। তখন থেকে এভাবেই দিন চলছে আমাদের, তবে ভুলতে পারিনা।
আল্লাহ ওকে জান্নাতবাসি করুক আমিন,সবাই দুয়া করবেন আমার কলিজার টুকরা বোনটার জন্য।
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠলো সবাই। ততোদিনে ও কেমন যেনো চুপ হয়ে গেলো কারো সাথে কথা বলে না তেমন একটা। এমনকি আমার নানু নানা ভাইয়ার সাথেও না। তারপর ঐ যে জামা কিনেছিলো সেখান থেকে একটা পরলো, আর আম্মু বললো ছবি তুলতে কারণ, এই চুল ফেললে আবার কবে না কবে এমন বড় হবে তাই! (আমরা তো আর ওতো কিছু বুঝিনি যে ও আর আসবেনা) আর তাছাড়া এর আগে ও ওর সব ছবি ডিলেট করে দিয়েছিলো, কেনো করেছে জানিনা, হয়তো আল্লাহর ইচ্ছায়।
তারপর আমি ব্রাশ করছিলাম ও আমাকে না বলেই চলে গিয়েছিলো, আমি তাড়াতাড়ি করে বের হয়ে জাস্ট ওর পিছনের অংশ দেখেছিলাম, আমি যদি জানতাম আমার বোন আর ফিরবে না তাহলে তো যেতেই দিতাম না। নানু, আম্মু অনেক কান্না করতেছিলো, নানু বারবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো, সাহস দিচ্ছিলো কিন্তু সে আর ফিরেও থাকায় নি আমাদের কারো দিকে! সোজা হেঁটে চলে গেছে।
হয়তো আল্লাহ আস্তে আস্তে সবার থেকে মায়া উঠিয়ে ফেলেছিলো! এদিকে অন্য সবাই নাকি বুঝতে পেরেছিলো যে ও হয়তো আর থাকবে না, কারণ কিছু কিছু লক্ষন প্রকাশ পায় সেগুলা দেখে, কিন্তু আমরা কেউ বুঝিনি। ওর চেহারা ভেংগে গিয়েছিলো, একদম শুকনা হয়ে গেছিলো, আর চোখ ঘোলাটে হয়ে গিয়েছিলো।
যাই হোক, আমার আম্মুও আমাদের আদর করে বুঝিয়ে দিয়ে গেলো, এই জীবনে কোনোদিন আমাদের ছাড়া কোথাও এক রাত ও থাকেনি আমার আম্মু, ঐ জায়গায় অনিশ্চিতভাবে কতো দিনের জন্য প্রিতীর সাথে থাকবে তাতো আর জানেনা তাই। আমি আবার খাওয়া দাওয়ায় প্রচুর অনিয়ম করি, আম্মু খাইয়ে না দিলে খেতাম না এরকম ছিলাম, সেজন্য আম্মু বারবার আমাকে বলেছিলো যাতে ঠিক মতো খাই, ছোট বোন ২ টার খেয়াল রাখি। তারপর তারা মেডিক্যাল গেল।
কেবিন নিয়েছিলো যাতে ওর কষ্ট না হয়, আর প্রাইভেট মেডিক্যাল এর কেবিন ভাড়া কতো তাতো সবাই ই জানেন!
১৮ তারিখ রাত ১২ টা পর্যন্ত আমি ওর সাথে কথা বলছি, বুঝাইছি নিজে কান্না করছি। তখন আম্মু, আর আমার ২ মামা মেডিক্যাল ছিল। মামারাও অনেক কষ্ট করছে,আম্মু ওর রুমে সোফায় ঘুমাতো মামারা মেডিক্যালের মসজিদে, আমার আব্বু তখন বাসায় আমাদের সাথে ছিল। তো রাত ১২ টা বাজে ও বলে আপু রাখ, নার্স আসছে চুল কাটতে। আমি বলেছিলাম তুই টেনশন করিছ না তুই ফালা আমিও ফালায়া দিবো, তারপর হাসলো আর বললো ঠিকাছে।
আবার বললো,”জানোছ আমার কেবিনে টিভি, ফ্রিজ সব আছে, আর তুই কালকে আসিস না তুই তো জার্নি করতে পারোছ না। “আহারে আমার বোন রে! ১৯ তারিখ সকাল ৯ টায় ওর অপারেশন। পরে সকালে আমি নানু, নানাভাই যাই ৭ টায়। ও তখন বেডে শুয়ে ছিলো, আম্মু বলছিলো সব আয়না সরিয়ে ফেলেছে যাতে ও নিজেকে এই অবস্থায় দেখতে না পারে, নাহলে তো অনেক কান্না করবে। কিন্তু ওয়াশরুমে আয়না থাকায় ও নাকি ওর মাথার চুল নাই এটা দেখে কান্না করছে অনেক আর বমিও করছে, তো আমরা যাওয়ার পর আমি ওর পায়ে শুরশুরি দিছিলাম কারণ ও খেয়াল করেনি আমরা যে আসছি।
তারপর আমার দিকে ফিরে যেই একটা হাসি দিছে গো আপুরা, আমি এখনো ভুলতে পারিনা। আমি বলছিলাম তোরে অনেক সুন্দর লাগতাছে, একটা ছবি তুলি একটু হাস! তারপর ও হেঁসে আমাকে বললো ঐখানে পিজ্জা আছে তুই আর নানু খা, আমার ছোট বোনটার কতো খেয়াল ছিলো। এরপর আমি অসুস্থ হয়ে গেছিলাম, জার্নি করায়। তাই আমি শুয়ে ছিলাম তখন ওরে রেডি করায় নেয়ার আগে আব্বু বলছিল, তুমি আমার আব্বা। টেনশন করিওনা।নতুমি না আমার সাহসী মেয়ে। আল্লাহ ভরসা সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার আব্বু আম্মু সহ সবাই অঝোরে কাঁদছিলো।
পরে ওরে অনেক সাহস দিল। আমি যে চোখ খুলবো ঐ এনার্জি টুকুও পাচ্ছিলাম না, আমি শুধু শুনছি। তারপর ওকে হুইল চেয়ারে করে নিয়ে যাচ্ছিলো, আমাকে কেউ উঠায় নি,নভাবছে সহ্য করতে পারবোনা তাই। কিন্তু আমি তাও উঠে গিয়েছিলাম, কিন্তু এবারও ওকে সামনা সামনি দেখতে পারিনি শুধু ওকে নিয়ে যাচ্ছে এটুকুই দেখছিলাম আর কাঁদছিলাম। আহারে আমার বোন রে আমার কলিজার টুকরা রে! আহারে আল্লাহ।
পরে ওকে ওটিতে নেয়া হয় আমরা বাইরে সবাই কাঁদছিলাম আর দোয়া করছিলাম। এই যে আমি এরকম সিচুয়েশনে ছিলাম আমার ২ টা ফ্রেন্ড ছাড়া একজন ও আমার খোঁজ নেয়নি! প্রায় ১২ ঘন্টা পর মানে রাত ৯ টায় ওকে ওটি থেকে বের করে একটা রুমে রাখে! ডাক্তার রা বলে অপারেশন সাক্সেস্ফুল।
আমরা সবাই তো খুশি, আমরা কি আর জানতাম যে এক অংশ ও তারা বের করতে পারেনাই। এরপরও আমি নির্লজ্জের মতো ফ্রেন্ডসদের গ্রুপে বলতাম তোরা সবাই দুয়া করিছ, কে জানে কার দোয়ার উছিলায় আমার বোনটা ভালো হয়! কিন্তু তারা আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে নিজেদের আলাপ চালিয়ে যেতো! আহারে! তারপর আমি ভাবলাম আমি মেডিক্যাল থাকবো কিন্তু আম্মু বললো বাসায় বাকি বোনেরা একা আমি যাতে চলে যাই।
পরে আমার মামার রিকুয়েস্ট এ আমাকে ওকে দেখতে দেয়া হয়! যদি বিশ্বাস করতে আপুরা পুরা শরীরে মনে হয় তার দিয়ে ছিদ্র করে রাখছে.। আহারে আমার বোনরে কতো কষ্ট সহ্য করছে! আমি তো দেখেই কান্না শুরু করছি, ও তখন চোখ খুলে আমাকে ডাকতে শুরু করলে ডাক্তার রা আমাকে বের করে দেয়, কারণ মাত্র এতো বড় অপারেশন হইছে এখন কথা বললে স্ট্রোক করতে পারে! আর স্ট্রোক করলেই শেষ।
পরে আমি বাসায় চলে আসলাম নানুদের সাথে। আর তো মেডিক্যাল যাইনি!
প্রতিদিন আম্মুর সাথে কথা বলতাম, কি অবস্থা ওর, আম্মুর কি খবর এইসব ব্যাপারে। আর আমার আব্বু মেডিক্যাল টু বাসা, বাসা টু মেডিক্যাল যেহেতু সবাই একই বাসায় তাই নানুদের বাসায় খেতাম! তো ২ দিন পর প্রিতীকে বেডে আনা হয়, আমরা ভাবি যাক আলহামদুলিল্লাহ ও হয়তো সুস্থ।
তারপর আস্তে আস্তে কথা বলতো আমার সাথে, মানে আমি যদি জিজ্ঞেস করতাম কেমন আছত? ২ মিনিট পর আস্তে আস্তে বলতো ভালো আছি। কথা বলতে পারতো না, মাথার চারপাশ খুলে সেলাই করে ব্যান্ডেজ করে রাখছিলো। তো আম্মু সারাদিন বরখতমের দোয়া পড়তো, আর ও হিসাব রাখতো আম্মু কতোবার পড়ছে।
এদিকে আমার অবস্থা খারাপ সবাই বলছিলো তোর বড়টার তো অবস্থা খারাপ বাসায় আয়, আম্মু বলে অইগুলারে আল্লাহর কাছে রাইখা আসছি, আমার আল্লাহ দেখবো, এদিকে আমি এই মেয়ের কাছে থাকি,যদি আমারে দেখতে চায় তখন আমি এতো দূরে কেমনে আসমু। তো সবাই আম্মুকেও বাসায় আনতে চাইছিলো কিন্তু পারেনাই। এরপর আস্তে আস্তে ও একটু সুস্থ হইছে, মানে বসতো আর খালি হাসতো। মানুষ বলে না যে মরার আগে মানুষ সুস্থ হয়।
আমরা তো বুঝিনাই, আমার মামারা শয়তানি করতো খালি ওরে হাসাতো, যাতে ওর কষ্ট না হয়। আমার বড় মামা বলতো তুমি বাসায় গেলে মুনত্বাহা, মরিয়ম(আমার কাজিন)সবাইর চুল ফেলে দিবো তখন ও খালি হাসতো।আমার মামারা বলতো যেনো নিষ্পাপ হাসি।
আমার আব্বু ততোদিনে মেডিক্যালেই থাকত, মেডিক্যাল থেকে বাসা দূরে হওয়ায় আসা যাওয়ায় প্রব্লেম হত, আর আব্বুর মন মানতো না! হয়তো আল্লাহ তাই চাইছে যে তার মেয়ের লাস্ট সময় গুলাতে যাতে বাবা মায়ের কাছে থাকে।
আমার আব্বু নিচে শুইতো, আম্মু থাকতো সোফায় প্রিতী তো ওর বেডে আর মামারা মসজিদে। ও আবার বলতো আধো আধো গলায় যে কতো কষ্ট হইতাছে সবার আমার জন্য! এদিকে বাসায় শুধু আমরা ৩ বোন।
তো মেডিক্যাল যাওয়ার ৫ দিনের মাথায় ও যখন একটু সুস্থ হইছে তখন আমার একদম ছোট বোন দেখা করতে গেছে, প্রিতী নাকি ওকে দেখেই কান্না করে দিছে। হয়তো বুঝতে পারছে যে আর থাকবে না, এরপর ওকে যখন ফলের রস খাওয়ানো হতো ও নাকি খেতে চাইতো না, আম্মু যখন বলতো বাবা তাড়াতাড়ি খাও, তাইলে দ্রুত সুস্থ হইবা, নইলে তোমার আব্বুর কষ্ট হইয়া যাইবো এতো টাকা দিতে, তখন ও খাইত।
কারণ ও অনেক চিন্তা করতো এসব নিয়ে,তাই আম্মুও এগুলা বলে খাওয়াইত। এর মাঝে মেডিক্যালের ৬ দিনের দিন ডাক্তার এসে আম্মুরে বলে আল্লাহর কাছে শোকর আদায় করেন, এসব রোগী অপারেশনের পর হয় প্যারালাইসিস /মারা যায় আপনার মেয়ে তো দিব্যি সুস্থ, আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু এই সুখ বেশিক্ষন আর সয় নি !
#আমার_বোন_প্রীতি
#পর্ব_০৩
লেখক:_ #সানি_আহমেদ
দুপুরের দিকে ওর মাথার সেলাই খুলে যায় আর পানি বের হতে থাকে বালিশ পুরা ভিজে যায়। আর আমার বোন তাও কিচ্ছু বলেনা যে ওর কষ্ট হইতাছে, তারপর আম্মু দেখে চিৎকার দিয়ে কান্না করতে করতে নার্সকে ডাক দেয় উনারা আবার ডাক্তার কে ডাকে তখন তিনি বলে আবার অপারেশন করাতে হবে।
এদিকে ওর বমিও বেড়ে যায়! বুঝতেই তো পারতেছো মাথার সেলাই ছুটে গেছে তার মধ্যে বমি ডাক্তার বলে ইমার্জেন্সি অপারেশন করাতে হবে নইলে শেষ! পরে আমার আম্মু তো কান্না করতে করতে শেষ যে দিবেই না, কারণ ডাক্তার আজকেই বলে গেছে যে এসব অপারেশনের পরে কি হয়! এদিকে সবাই সিদ্ধান্ত নেয় আর অপারেশন করাবে না! যদি বিপরীত কিছু হয়।
কিন্তু এদিকে আমি বাসায় সবাইকে বুঝাই ঐদিকে আমার ছোট মামা মেডিক্যালে সবাইকে বুঝায় যে দেখেন এখন অপারেশন না করাইলে ও আমাদের সামনে কষ্ট পাইতে পাইতে শেষ হয়ে যাবে, আবার ভাববে যে টাকার দিকে তাকিয়ে হয়তো ওরে আমরা অপারেশন করাইতাছি না।
এখন অপারেশন করাই, আল্লাহ চাইলে হয়তো সুস্থ ও হতে পারে! তখন সবাই রাজি হয়। ঠিক করা হয় ৭ দিনের দিন অর্থাৎ ২৪ তারিখ সন্ধ্যা ৬ টায় ওর আবার অপারেশন হবে। তাই অপারেশনের আগে খাবার দেয়া যাবেনা। এদিকে আমার আম্মু তখনো তেমন একটা রাজি হয়নাই।
তাই আমরা ডাক্তারকে বলে স্পেশাল ভাবে আলাদা নার্স রাখি গার্ড দেয়ার জন্য যদি আম্মু কিছু খাইয়ে দেয় আমার বোনক, কারণ মায়ের মন ত, পরে তো অপারেশনের সময় ওর সমস্যা হবে।
এদিকে আমার বোনকে আম্মু জিজ্ঞেস করে বাবা বাড়ি যাবা না, ও বলে না। এতোদিন বলতো যাবে ঐদিন বলে যাবেনা, আমার বোন হয়তো বুঝতে পারছে। এতোদিন আম্মু আধা ঘন্টা /১ ঘন্টা পরপর ওকে জুস খাওয়াতো যেহেতু অন্য কিছু খেতে পারবেনা! আজকে আমার বোন নাকি মেডিক্যাল থাকা অবস্থায় ঐ প্রথম আম্মুকে আম্মু বলে ডাক দেয়।
তখন আম্মু নামাজ পড়ছিলো আম্মু তো অবাক হয়ে যায়, কারণ ও ঠিকমতো কথা বলতে পারতো না! ও ২ বার ডাক দিছে আম্মু তাকাইছে ও বলে আম্মু খুধা লাগছে জুস খাওয়াও! আম্মু তখন অঝোরে কান্না করা শুরু করে কারণ ওরে আর বলে নাই যে সেকেন্ড টাইম অপারেশন হবে, এদিকে আম্মু ট্রাই করছে খাওয়ানোর জন্য কিন্তু মামা আর নার্সদের জন্য পারেনাই।
আব্বুও গেছিলো খাওয়াইতে যখন শুনছে ও নিজের মুখে খাইতে চাইছে। এতো বড় শরীরে কি আর ফলের রসে পেট ভরে! তাও আজকে দিতেছে না দেখে ও বলছে তখন আম্মু বলে বাবা তোমার মাথার সেলাই খুলছে তো ড্রেসিং করানো লাগবো তাই খাওয়ানো যাবেনা। কারণ মিথ্যা বলা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না, নইলে ও অনেক হাইপার হয়ে যেতো।
তারপর ও এইটা শুনে নাকি কিচ্ছু বলেনাই উল্টো ঘুরে শুইয়ে পরছে। তো ওটিতে নেয়ার আগে আম্মু ওরে দোয়া দরুদ পড়াইতাছে। আম্মু কালেমা পড়াইতে গিয়ে তখন ভুলে বরখত্মের দুয়া পড়ায়া ফেলছিলো(যেহেতু ২ টার শুরুতেই সেইম,আর আম্মু এতো দিন শুধু বরখতমের দুয়ায় পড়ছে কয় লাখ যেনো, তাই বারবার ঐটাই মুখ দিয়ে বের হচ্ছিল) তখন ও নাকি হেসে বলে নিজে পারেনা আসছে আমারে পড়াইতে, তারপর নাকি নিজে নিজে কালেমা পড়ছে।
এরপরই ওকে ওটিতে নেয় আবার ঠিক ১২ ঘন্টা পর মানে ২৫ তারিখ সকাল ৬টায় ওর অপারেশন শেষ হয়। ওকে আবার আগের রুমে নেয়া হয় মানে ও এখন সেইফ, কিন্তু! এর কিছুক্ষনের মধ্যেই ওর খিচুনি উঠে চোখ বড় করে ফেলে। আমার আব্বু এইটা দেখে সহ্য করতে পারেনা বের হয়ে আসে।
তারপর সব ডাক্তার রা ওর ঐ রুমে যায়, এদিকে এসব দেখে আম্মুরা তো কান্না করতে করতে শেষ, তারপর ওকে আই.সি.ইউ তে রাখে ৩ ঘন্টা, ওর অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যাওয়ায় নেয়া হয় লাইফ সাপোর্টে।
আহারে আমার ছোট বোনটারে! তারপর টানা ৩ দিন লাইফ সাপোর্টে, ওর ব্রেইন ডেথ হয়ে গেছিলো। একদম জ্ঞান নেই, এদিকে আমি এগুলা শুনে তো কান্না করতে করতে শেষ, আমার আম্মু খালি ওর রুমের বাইরে গিয়ে বসে থাকতেো আর কান্না করতো, ডাক্তার রা বলছিলো যাতে আম্মুর কেবিনটা ছেড়ে দিতে কারণ অনেক খরচ উঠছিলো, কিন্তু আম্মুর এক কথা উনি বাসায় যাবেননা, প্রিতীর জ্ঞান ফিরলে যদি আম্মুকে দেখতে যায় তখন কি হবে! এদিকে আম্মু নিজেকে অনেক দোষ দিতে থাকে, যে আম্মু কেন রাজি হইলো, কেন প্রিতীরে খাওয়াইলো না।
আম্মু পরে খালি বলছিলো আমি কেমন মা, যে আমার মেয়ে খাইতে চাইছে শেষবার আমি খাওয়াইতে পারিনাই। ওরে মিথ্যা কথা বলছি, যখন আবার ঐ রুমে ওরে ঢুকাইছে না জানি ওর কেমন লাগছে যে ওর আম্মু ওরে মিথ্যা বলছে! এগুলা ভেবে ভেবে আম্মু তো শেষ।
এদিকে ২৭ তারিখ আমার যে ২টা বান্ধুবী খবর নিতো তার মধ্যে একটা আসে, এসে রুটি বানিয়ে আমাকে আর আমার বোনদের খাওয়ায় তারপর বলে আবার বিকালে আসমু। এদিকে আম্মু আমাকে তখন বলে প্রিতীর নাকি জ্ঞান ফিরছে, আমি তো খুশিতে শেষ, সবাইকে ফোন দিয়ে বলছি। আমি কি আর জানতাম যে আমার বোন আর নাই।
আমার আম্মুও জানতো না, ২০২১ সালের মার্চের ২৭ তারিখ ভোর ৫ টায় রোজ শনিবার আমার ময়না টা, আমার বোনটা আমাদের ছেড়ে আল্লাহর ডাকে সাড়া দেয়, এই দুনিয়াবি ঝামেলা থেকে মুক্তি পায়, এই পাপের দুনিয়া থেকে রেহাই পায়। এই ক্ষনস্থায়ী জীবন থেকে হাজার কষ্ট নিয়ে দূরে চলে যায়।
আমার এই ছোট বোনটার ১ মাস ২১ দিন পর ১৫ তে পা দেয়ার কথা ছিলো অথচ এর আগেই সে পাখি হয়ে উড়ে যায় মুক্ত আকাশে।
২৭ তারিখ সকালে আমার ফ্রেন্ড যখন আমাদের বাসায় ছিলো তখন ই আম্মু ফোন দিয়ে বলেছিলো যে প্রিতীর নাকি জ্ঞান ফিরছে, আসলে আমাদের যেই ডাক্তার উনি প্রিতীর অপারেশনের পর আবার নোয়াখালী চলে গিয়েছিলো, আরেকটা সার্জারি করাতে। তাই সবকিছু এতো সহজ ছিলো না।
২৭ তারিখ প্রিতী মারা যায় ভোর ৫ টায়, অথচ উনারা আমাদের বলে ওর নাকি জ্ঞান ফিরছে। আসলে মানুষের বিবেক সম্পর্কে কি আর বলবো! ডাক্তাররাও মরা মানুষ নিয়ে ব্যবসা করে।
প্রতিদিন আমার আম্মু তাহাজ্জুদ পড়তো, যিকির করতো, কিন্তু ২৭ তারিখ আম্মু ঘুমিয়ে গিয়েছিলো। আল্লাহ হয়তো এটাই চেয়েছে। এর আগে আবার ওর হাত, পা বেঁধে রাখছিলো। যদি ওর জ্ঞান ফিরে এরপর যদি হাত পা ছড়াছড়ি করে তাই। আমার বোনটা কতো কষ্ট করছে কতো কষ্ট পাইছে। এছাড়া সবাই যে বলে লাইফ সাপোর্টে মরা মানুষ রেখে বলে বেঁচে আছে টাকা খাওয়ার জন্য, এজন্য প্রিতী যেই ৩ দিন ছিলো ২ দিন ই আম্মু যখন যেতো তখন ই ওর বুকে তারপর পেটে, মেশিনে লক্ষ্য রাখতো।
কিন্তু যেদিন মারা যায় ঐদিন আম্মু যে ঘুমিয়ে পরেছিলো, ফজরের সময় উঠছে তারপর আম্মুর নাকি কেমন জানি লাগছিলো, সেজন্য নামাজ পড়ে দৌঁড়ে গেলো ওর রুমের বাইরে। নরমালি ৮ টায় ঢুকতে দেয়, আর অন্য সময় আম্মুরা ঐ টাইমেই যায়। কিন্তু আজকে আম্মুর খারাপ লাগায় ৫ টায় ওর রুমের বাইরে বসে কান্না করছিলো। তখন ই তো আমার বোনের প্রান যায়।
তারপর আম্মু দেখে তারা ছোটাছুটি করছে, আম্মুকে এভাবে বসে বসে কান্না করতে দেখে একটা জুনিয়র ডাক্তার এর মায়া হয়, উনি প্রিতীর ব্যাপারে সব জিজ্ঞেস করে, তারপর বলে সমস্যা নাই আল্লাহ ভরসা।
তারপর ৩ ঘন্টা বাইরে বসে থাকার পর ৮ টা বাজে আম্মুকে ঢুকতে দেয়া হয় ততোক্ষনে তো আমার বোন আর নাই! তাও তারা ঢুকতে দিচ্ছিলো না ঐ ভালো ডাক্তারের কথায় আম্মু যেতে পারে।
তারপর অনেক কান্না করে বলে,”প্রিতী, বাবা উঠো আম্মুরে ডাক দাও.!
আমার আব্বু আম্মুর বিয়ের ৪ বছরের মাথায় আমি হই, যেহেতু অনেক প্রব্লেমের মাঝে আমি হই তাই সবারই আদরের। তারপর আমার জন্মের ঠিক ১ বছর ৩ মাস ১৫ দিন পর আমার একটা ছোট বোন হয়।
তো আমরা পিঠাপিঠি হওয়ায় আম্মুর অনেক কষ্ট হয়ে যেতো, এরপর আমার বোনের ৪ বছরের মাথায় আমার ২ টা জমজ বোন হয় আলহামদুলিল্লাহ, মানে টোটাল আমরা ৪ বোন। তো বুঝতেই পারতেছো আমার আম্মু অনেক কষ্ট করছে!
আমার ছোট বোনেরা যখন হইছে সবাই ভাবছে আমার আব্বু মনে হয় রাগ করছে মেয়ে হওয়ায়, কিন্তু আমার আব্বু বলছে রাগ করার কি আছে আমার তো খুশি লাগতেছে আল্লাহ আমার ঘরে ৪ টা জান্নাত দিছে আলহামদুলিল্লাহ, এভাবেই আস্তে আস্তে আমরা ৪ বোন বড় হতে থাকি।
তাছাড়া আমরা ৪ বোন অনেক লাকি ছিলাম যে এরকম আম্মু আব্বু পেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ। আমরা আব্বু আম্মুর সাথে সব শেয়ার করি, তাই ফ্যামিলিতে আমরা সবাই বন্ধুর মতো।
যাক এভাবে দিনগুলো ভালোই যাচ্ছিলো। আমি আর আমার মেজো বোন পড়ালেখায় অনেক ভালো ছিলাম। তারপর যখন ইন্টারে উঠি তখন ই আসল সমস্যা দেখা দেয়। আমাদের ফ্যামিলিটা পুরো উলোট পালোট হয়ে যায়, আমার যে মেজো বোন ওর ব্রে*স্ট টিউমার দেখা দেয়, আমার ফুপ্পির এই সমস্যা ছিলো পরে উনি মারা যায়।তো আম্মুও ভয় পেয়ে যায় এবং ডিসিশন নেয় অপারেশন করাবে! কিন্তু আমার বোন লজ্জায় বলতো ডাক্তারের কাছে যাবেনা। অনেক বুঝানোর পর গেলো ২০২১ এর জানুয়ারিতে ওর ব্রেস্টের অপারেশন হলো।
বলে রাখি আমাদের ৪ বোনের মধ্যে ওর চেহারা ছিলো সবচেয়ে সুন্দর মা শা আল্লাহ। আমরা যেহেতু পিঠাপিঠি তাই ও বেশিরভাগ আমার নানুদের কাছেই থাকতো।তো অপারেশনের সময় আম্মু ডাক্তার কে বলেছিলো ওর পুরো শরীর যখন চেকআপ করবে যে অন্য কোথাও টিউমারটা ছড়িয়েছে কিনা, তখন আম্মু বলেছিলো মাথাও যাতে সিটি স্ক্যান করে। কারণ ওর অনেক মাথা ব্যাথা ছিলো তখন।
কিন্তু ডাক্তাররা বলেছিলো চিন্তার কিছু নেই অল্প বয়সে এমন রোগ হয়েছে তাই টেনশনে এমন হয়েছে। তাও উনারা চেকাপ করে নাই আমার বোনের বয়স তখন ১৫ হয় নাই। তো এক মাস খুব ভালো ছিলো। ফেব্রুয়ারীর লাস্ট এর দিকে ওর বমি, চোখ ট্যারা +মাথা ব্যাথা দেখা দেয়! ও নাকি ডাবল ডাবল দেখতো।
তারপর এক রাতে ওর এতো বমি হয় যে তাড়াতাড়ি ডাক্তার এর কাছে নিলে উনি একজন নিউরোলজিস্ট সাজেস্ট করেন। উনি পরীক্ষা করার পর দেখলেন আমার বোনের ব্রেইন টিউমার হয়েছে
রিপোর্ট হাতে নিয়ে সেদিন আমার আম্মু আর প্রিতী(আমার বোন)গিয়েছিলো ডাক্তার এর চেম্বারে। আম্মু তখন বুঝছিল যে খারাপ কিছু হইছে তাই ওরে বাইরে বসিয়ে রেখে আম্মু চেম্বারে ঢুকলো। তারপর ডাক্তার বললো আপনার সাথে আর কেউ আসেনাই? কারণ মায়ের সামনে মেয়ের এই অবস্থার কথা কিভাবে বলবে তিনি তাই, তো আম্মু বলে আমাকে বলেন স্যার সমস্যা নেই।
এদিকে আম্মু তো কেঁদেই যাচ্ছে পরে ডাক্তার বললো প্রিতীর নাকি ব্রেইন টিউমার হয়েছে আর এটা প্রায় ২/৩ বছর যাবৎ, ওর ব্রেইন থেকে ব্রেস্টে ছড়িয়েছে। ও অনেক সাহসী ছিলো কখনো অসুস্থতার কথা আম্মুকে বলতেন না, সহ্য ক্ষমতা ছিলো অনেক। নাহলে কি আর এই বয়সে এতো ধকল সহ্য করতে পারে! তো ব্রেস্ট তো দেখলে বুঝা যেতো তাই সেটার অপারেশন আগে করে ফেলেছিলাম। আমরা তো কেউ জানতাম না যে ব্রেইন থেকে ব্রেস্টে ছড়িয়েছে।
এরপর ডাক্তার বললো ওকে ইমিডিয়েটলি অপারেশন করাতে সরকারি হাসপাতালে। তখন আম্মু কেঁদেই যাচ্ছিলো, আর বলেছিলো কতো লাগতে পারে, পরে উনি বলেন সরকারি তে করলে ৩/৪ লাখে হয়ে যাবে। তারপর আম্মু নিজেকে একটু ফ্রেশ করে আমার বোনের হাত শক্ত করে ধরে বের হলো, রাস্তায় নাকি ও অনেক বার আম্মুকে জিজ্ঞেস করেছিলো ওর কি হয়েছে, কিন্তু আম্মু বলছে কিছু হয়নাই। কারণ মনোবল যাতে নষ্ট না হয় তাই আম্মু একথা বলেছিল।
আমরা সবাই আবার এক বাসায় থাকি, আমার নানুরা থাকে ৩ তলায় আমরা নিচ তলায়, খালামনিরা ৪ তলায়। তো আম্মু আর ঘরে আসলো না নানুরদের বাসায় চলে গেলো আর আমার বোন বাসায় আসলো, তো আমি জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে তো? বলে তেমন কিছুনা। পরে ও খেতে বসেছিলো তার মধ্যেই আমার খালাতো ভাই (বয়স ১০) ও এসে বলে প্রিতী আপু তোমার মনে হয় বড় কিছু হইছে, নানু, নানাভাই, মামারা সবাই কান্না করতাছে।
এইটা শুনে ও অনেক কান্না করা শুরু করে, আমি দৌঁড়ে নানুর বাসায় গেলাম গিয়ে দেখি সবাই কান্না করতেছে, যেহেতু আগেই বলেছি ছোট থেকে ও বেশিরভাগ নানুদের কাছেই থাকতো তো নানাভাই তো অস্থির হয়ে গেছিলো। পরে আমাকে বললো যাতে ওরে না বলি। এদিকে ঐ ডাক্তার এর কাছে আর আমরা যাইনি, উনি সরকারি হাসপাতালের কথা বলেছিলেন কিন্তু আমরা প্রাইভেটে দেখলাম যাতে ওর কষ্ট না হয়। তবে সেখানে তো খরচ আরও বেশি তবে কিভাবে যেনো এতো গুলা টাকা ১ সপ্তাহের মধ্যে জোগাড় হয়ে গেল! যিনি অপারেশন করবেন উনি আমাদের আত্মীয়।
যাক সব ঠিকঠাক ২০২১ সালের মার্চের ২১ তারিখ ওর অপারেশন হওয়ার কথা।
এদিকে ও শুধু রিপোর্ট দেখতে চাইত, সাইন্সের স্টুডেন্ট হওয়ায় জীববিজ্ঞান বইয়ে ওর লক্ষনগুলো মিলানোর ট্রাই করে, তখন ক্লাস 9 এ ছিলো। ঐসময় ও সারাদিন পড়ত ঘরে বসেই। আর শুধু কান্না করতো আমারে বলতো আপু আগে একবার পড়লেই মুখস্থ হতো এখন বারবার পড়ি তাও হয়না কেন! আর ওর বেস্ট ফ্রেন্ডকে বলছিলো ক্লাসে যা যা পড়ায় সব নোট যাতে ওরে দয়ে যায়, নইলে তো ও পিছিয়ে যাবে।
আমার বোন কি জানতো যে তার আর পড়ালেখা করা হবেনা! তারপর আস্তে আস্তে সময় ঘনাতে থাকে আমি শুধু কান্না করতাম আর ওর দিকে চেয়ে থাকতাম আর হাত ধরে রাখতাম, যেহেতু বুঝতেই পারছো পিঠাপিঠি বোন হওয়ায় সবসময় একসাথেই থাকতাম।
ও শুধু আমাকে জিজ্ঞেস করতো তুই এতো কান্না করোছ কেন, কি হইছে আমার বল! আমি বলতাম কিছু হয়নাই এমনেই কান্না করি। এরপর অপারেশনের কিছুদিন আগে আম্মু আমাকে বলে এখন ওরে বল, যেহেতু আমি ওর সবচেয়ে কাছের তাই আম্মু আমাকেই বলতে বলেছিল। তারপর আমি বললাম, তোর ব্রেইনে টিউমার হয়েছে অপারেশন করাতে হবে।
ও তো চিৎকার করে কান্না করা শুরু করে আর বলে আমারে কি রোবট পাইছোত ?
দেড় মাসও হয়নাই একটা অপারেশন হইছে আবার কিসের অপারেশন। তখন ওরে বুঝালাম আর বললাম চুল ফেলতে হবে, এটা শুনে তো ও আরও রেগে যায়, কারণ মেয়েদের কাছে চুল জিনিসটা কি সবাই তো জানোই, আরও ওর ছিলো ঘন, সিল্কি চুল তারপর আমি বলি আমিও ফেলে দেবো চুল সমস্যা নাই, তখন ও রাজি হয়। তারপর বলে কয় টাকা লাগবে, আমি তখন মিথ্যা বলেছিলাম যে ১/১.৫ লাখ লাগবে, কারন এতো টাকা লাগবে শুনলে কখনো অপারেশন করাবে না। অনেক বুঝদার ছিলো যে! তারপরও বললো, এতো টাকা লাগবে!
আব্বুর টাকা দিয়ে আমি অপারেশন করাবো না, এমনেই অনেক টাকা খরচ হইছে আমার পিছনে, আর তোরা পরে আমারে যদি বলোছ যে আব্বুর সব টাকা আমি শেষ করে ফেলেছি,, তখন আমি বললাম সমস্যা নেই বড় হলে চাকরি পেলে সব শোধ করে দিছ, আর আমরা এগুলা কেন বলবো তুই আমাদের বোন না! যাক তারপর রাজি হলো, আমার ১৪ বছরের বোনটার মাথায় যে কতো চিন্তা ছিলো।
এর মধ্যে ও অনেক শপিং করে, ওর যা যা মন চেয়েছে সব কিনেছে হাসপাতালে পরার জন্য, তারপর আবার নিজ হাতে সবাইকে খাইয়ে দিয়েছিলো, সবাই কান্না করতে করতে শেষ, এরপর হঠাৎ ১৭ তারিখ ওর অনেক বমি হয়।
আম্মুকে একটুও কষ্ট দিতো না, নিজের বমি নিজেই সাফ করতো ঐ অবস্থাতেও। তারপর নানাভাই ডাক্তার কে কল দেয় উনি বলে কালকেই তারাতাড়ি যেনো মেডিক্যাল নিয়ে আসে কারণ বেশি বমি করলে এখন স্ট্রোক করতে পারে তারপর ১৮ তারিখ সকাল সকাল ওকে মেডিক্যাল নেয়ার জন্য প্রিপারেশন নিচ্ছিল। আমারা কেউ কি আর জানতাম যে আমার বোন আর আসবেনা !
সময় কীভাবে চলে যায় সহজে বোঝা যায় না। দেখতে দেখতে দু’মাস হয়ে গেছে। আবিদ দর্শিনীর জীবন আগের ন্যায় সুন্দর ভাবেই চলছে। কোন পরিবর্তন নেই! সেদিনের পর থেকে এই দু’মাসে দর্শিনীর ভার্সিটি লাইফে কোন সমস্যা হয়নি। আবিদ তার সেফটির জন্য সব উপায় অবলম্বন করেছে। তবে চৌধুরী বাড়ির পরিবেশ আগের চেয়ে অনেকটা বদলে গেছে এখন। কেমন যেন নিঃশব্দ অবস্থা! এইতো গত মাসেই আসফি ভিসা পেয়ে কানাডা চলে গেছে। অন্যদিকে শবনম চৌধুরী চলে গেছেন অস্ট্রেলিয়া। শেষ পযর্ন্ত আবিদ ফুপিকে আঁটকাতে চেয়েছিল। কিন্তু চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি! আসফি আর শবনম চৌধুরী কেউই দেশে থাকতে রাজী নন। তাদের চলে যাওয়ার কথা শুনে শত অনুরোধ করা সত্ত্বেও দুইজনে সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। তারপর থেকেই বাড়িতে কেমন নিশ্চুপ অবস্থা বিরাজমান। বাড়ির চঞ্চল ছেলেটা কেমন যেন বদলে গেলো! আবার সবাইকে ছেড়ে চলেও গেলো। অনুসা বেগম, শাহরিয়ার চৌধুরী নিজেদের ছোট ছেলে, বোনকে মনে করে কষ্ট পায়। চৌধুরী বাড়িতে এখন শুধু আরহান আর আবিদ আছে। অবশ্য শবনম চৌধুরী মাঝে-মধ্যেই ভিডিও কলে কথা বলে সবার সঙ্গে। কিন্তু আসফি সেভাবে কথা বলেনা। তবে সপ্তাহ পরপর বাবা-মার খোঁজখবর নেয়!
অনুসা বেগম এবং শাহরিয়ার চৌধুরী আসফিকে মনে করে কষ্ট পায় তবুও সবটা মেনে স্বাভাবিক থাকতে চেষ্টা করছেন প্রতিনিয়ত।
মাসখানেক আগেই প্রজ্জ্বলিনী এবং তার বেবিকে ডিসচার্জ করে দেওয়া হয়েছে। দর্শিনী সেই সময় বোনের আদুরে ছেলেকে নিয়ে মেতে থাকতো। প্রজ্জ্বলিনীকে যখন মুহতাসিম ভিলায় নিয়ে আসা হয় তখন দর্শিনী অনেকদিন আবিদকে ছাড়া বোনের কাছে থেকেছে। বলা বাহুল্য আবিদের মতো দর্শিনীও বাচ্চা পছন্দ করে। আজকে অফিসে থাকা অবস্থায় আবিদ বাসা থেকে খবর পায় দর্শিনী রান্নাঘরে সেন্সলেস হয়ে পরে গেছে। শাহরিয়ার চৌধুরী তৎক্ষণাৎ পারিবারিক ডাক্তারকে ডেকে এনেছেন। পরবর্তীতে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানা যায় দর্শিনী প্রেগন্যান্ট। প্রেগন্যান্সির সময়টা খুবই স্বল্প ছিল! আবিদ নিউজটা পেয়ে বিস্মিত হয়েছে! বলতে গেলে নিজের বাবা হওয়ার সংবাদ পেয়ে তার অবস্থা হতবিহ্বল প্রায়! খবরটা পেয়ে আবিদ রিয়্যাক্ট করতে ভুলে গেছে। এতো তাড়াতাড়ি বাচ্চা চায়নি আবিদ! তাই জন্য দর্শিনীকে বারবার পিল নিতে বলতো। কিন্তু দর্শিনী তার কথা শোনেনি। আবিদের আনন্দ, দুঃশ্চিন্তা দুটোই একসঙ্গে হচ্ছে। আনন্দ হচ্ছে বাবা হবে ভেবে। অন্যদিকে দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে দর্শিনীর বয়স কম চিন্তা করে। আবিদ জানে প্রেগন্যেন্সিতে অনেক কম্পলিকেশন থাকে। সবচেয়ে বড় কথা দর্শিনীর বয়স উনিশ বছর সামথিং চলছে। বিশ বছর পূর্ণ হয়নি। আবিদের ভয়টা মূলত এখানেই! নিঃসন্দেহে দর্শিনী পিল না নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেছে। খবরটা পাওয়া মাত্র আবিদ বাসায় চলে আসে। বাসায় ফিরে দেখে সবাইকে মিষ্টি মুখ করানো হচ্ছে। শাহরিয়ার চৌধুরী সহ বাড়ির সবাই আনন্দে মিষ্টি মুখ করছে। পুস্পিতার যেহেতু আট মাস চলছে! তাই সে আনন্দে যোগ দিতে পারেনি। তবে খবরটা শুনে পুস্পিতা প্রচণ্ড খুশি হয়েছে। আগে-পরে বাড়িতে দুইজন অতিথি আসতে চলেছে। তাই আনন্দের মাত্রাটা যেন বেশি! শাহরিয়ার চৌধুরী তৎক্ষণাৎ শবনম ফুপিকে ভিডিও কলে খুশির খবরটা দেয়। শবনম চৌধুরী আবিদের জন্য ভিষণ খুশি। তিনি দর্শিনীকে ভিডিও কলে দোয়া করলেন। আবার সবার সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নিলেন। তিনি জানিয়েছেন, আবিদের সন্তানকে দেখতে তিনি ইন-ফিউচার বাংলাদেশে ব্যাক করবেন। চৌধুরী বাড়িতে সকলে আনন্দে আত্মহারা। বিশেষ করে দর্শিনী! একটা ছোট্ট প্রাণ তার ভেতরে বেড়ে উঠছে। খবরটা শোনার পর থেকেই মেয়েটা আনন্দে বারবার অশ্রুসিক্ত হচ্ছে। সেই ছোট্ট প্রাণটা আবিদ আর দর্শিনীর অংশ! বাচ্চাটা আবিদের জন্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ দর্শিনী উপলব্দি করতে পারছে। বাড়িতে ফিরেই আবিদ দর্শিনীর মুখোমুখি হয়। দর্শিনী তখন আবিদের মাত্রাতিরিক্ত গম্ভীর মুখ দেখে চুপসে যায়। ভাবতে থাকে আবিদ তার উপর রাগ করেছে কি? তাদের ছোট্ট বেবি হবে শুনে আবিদ নিশ্চয়ই খুশি হয়নি! নাহলে আবিদকে আনন্দিত লাগছেনা কেনো? অজানা আতঙ্কে দর্শিনী নীল হয়ে যায়। পরক্ষণেই আবিদের দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে থাকে। আবিদের মতিগতি বোঝা যাচ্ছে না। দর্শিনী মনে মনে ঠিক করে নেয় আবিদ বেবি না চাইলে সে একমুহূর্ত এখানে থাকবে না। এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবে। তবুও বেবিকে জন্ম দিবেই! দরকার পড়লে দর্শিনী একাকী মানুষ করবে তার সন্তানকে। আবিদের সাহায্যের প্রয়োজন নেই!
দর্শিনী বিছানায় অর্ধশোয়া হয়ে বসে আছে। আবিদের নিস্তব্ধতা তাকে কাবু করে ফেলেছে। সে আবিদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরক্ষণেই মাথা নিচু করে ফেলে। আবিদ কেঁপে উঠল মনে হয়! পরক্ষণেই দর্শিনীর পাশে বেডেই বসে পড়ে। অনেকটা সময় নিস্তব্ধ হয়ে বসেছিল দুজন। আবিদ হঠাৎ-ই ইমোশনাল হয়ে দর্শিনীর নরম হাত আঁকড়ে অনেক গুলো চুমু খায়। তার চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে! আবিদ একদমই কাঁদতে পারেনা। এই প্রথম তাকে কাঁদতে দেখল দর্শিনী! আনন্দে কাঁদছে নাকি অন্য কারণে দর্শিনী কিছুক্ষণ ড্যাবড্যাব করে চেয়ে বুঝতে চাইলো। তাদের অংশ পৃথিবীতে আসতে চলেছে! বাবা হিসাবে আবিদ ভিষণ আনন্দিত। আজকে সন্তানের সুবাদে আবিদের চোখে পানি দেখল দর্শিনী। স্বামী-স্ত্রী দুজনই নিঃশব্দে কাঁদছে। আবিদ তৎক্ষণাৎ দর্শিনীকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে চুমু খায়। কিছুক্ষণ পর দর্শিনীকে ছেড়ে আলতো হাতে চোখের পানি মুছিয়ে দেয়। দর্শিনী শোয়া অবস্থাতেই আবিদকে জড়িয়ে ধরে থাকে। আবিদ তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘আজকে আমি কতোটা খুশি হয়েছি, বলে বোঝাতে পারবো না বউ! বাবার কাছে খবরটা শুনে প্রথমে আমি বড়সড় বিষম খেয়েছিলাম। কেমন যেন বিশ্বাস করতে মন চাইছিল না। ভেবেছিলাম বাবা হয়তো মজা করছে! পরবর্তীতে ডাক্তার আঙ্কেলের থেকে শিয়র হলাম। তিনি জানালেন সত্যিই আমি নাকি বাবা হচ্ছি! কথাটা মাথায় ক্যাঁচ করার পরপরই তোমার কাছে ছুটে এসেছি।’
আবিদের বুকের বাঁ-পাশে মাথা রেখে দর্শিনী বলে,
‘আমি আপনার গম্ভীর মুখশ্রী দেখে ভয় পেয়েছিলাম আবিদ! ভেবেছি আপনি খুশি হননি। হয়তো পিলের ব্যাপারটা নিয়ে আমার উপর ভিষণ রেগে আছেন। আপনি বাচ্চা চান না!’
‘দর্শিনী, পুরুষ কিংবা নারী তখনই পরিপূর্ণ হয়, যখন তাদের সন্তান পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়! আদুরে স্বরে বাবা-মা বলে ডাকে! আজকে আমি তুমি দুজনেই পরিপূর্ণ হওয়ার পথে। আমি ভিষণ খুশি হয়েছি দর্শিনী! কতোটা খুশি হয়েছি বলে বোঝাতে পারবো না। তবে…!’
দর্শিনী তৎক্ষণাৎ মুখ তুলে তাকায়। আবিদকে জিগ্যেস করে,
‘তবে কী?’
‘আমি ভয় পেয়েছিলাম দর্শিনী! সেটা তোমার বয়সের জন্যই! বেবিকে প্রপারলি ক্যারি করার জন্য তোমাকে নূন্যতম বিশ বছর বয়সী হতে হবে। তাছাড়া প্রেগন্যন্সির জন্য পড়াশোনাতে সমস্যা সৃষ্টি হবে! তোমার এভাবে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হয়নি দর্শিনী। প্রেগন্যান্সিতে অনেক কম্পলিকেশন থাকে! মানে আমি বলতে চাইছি, এতো পেইন সহ্য তুমি করতে পারবে না। তোমার সময় নেওয়া প্রয়োজন ছিল!’
‘ব্যাস আবিদ, অনেক বলেছেন আপনি! আমি আমার নিজের অংশকে ক্যারি করতে পারবো না এমন ভ্রান্ত ধারণা আপনার কী থাকা উচিত? কম বয়সে অনেক মেয়ের বেবি হয়েছে! তারা সবাই কী পেইন সহ্য করতে না পরে মারা গেছে? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আমার বয়স বিশ বছর হতে দেরী নাই! বেবি হওয়ার পরেও পড়াশোনা করা যায়। যত কম্পলিকেশন, পেইন আসুক না কেনো আমি ঠিক পারবো! আপনি শুধু আমার পাশে থাকবেন কথা দিন। আপনি সারাজীবন আমার পাশে থাকলে মৃত্যু চলে আসুক, আফসোস করিনা। আপনার খুশির জন্য আমি সবকিছু করতে পারি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব!’
আবিদের হৃদপিণ্ড সর্বোচ্চ জোরে বিট করতে শুরু করেছে। দর্শিনীর মুখে মৃত্যুর কথাটা শুনে আবিদ তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। দর্শিনী মৃদু ব্যথা পায় তবুও আবিদকে কিছু বলেনা। হিসেব অনুযায়ী দর্শিনীর মনোবল বাড়ানো উচিত আবিদের! অথচ আবিদের নিজেরই মনোবল শূন্যের কৌঠায়! আবিদ তার দর্শিনী নামক স্বপ্নকন্যাকে ভালোবাসে। ভালোবাসার পরিমানটা নিজের থেকেও বেশি! দর্শিনীর কষ্ট মানে আবিদের নিজের কষ্ট। তবুও দর্শিনীর দৃঢ়চেতা মনোভাবে আবারো হার মেনে নিলো আবিদ! আবিদ দর্শিনীকে বুকে জড়িয়ে আশ্বস্ত করলো সর্বদা তার পাশে থাকবে। তাকে ছেড়ে কখনো যাবে না! দর্শিনীর মুখে তৎক্ষণাৎ কিঞ্চিৎ হাসি ফুঁটে ওঠে। চোখে স্বচ্ছ পানি চিকচিক করছে! আবিদ তার কপালে অধর ছুঁয়ে বলে,
‘ভয় নেই দর্শিনী! আমি সর্বদা তোমার পাশে থাকবো! যদি কখনো মৃত্যু আমাদের মাঝে চলে আসে। আমি ঢাল হয়ে তোমাকে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করবো। আমার পূর্বে মৃত্যু যেন তোমাকে ছুঁতে না পারে। আল্লাহর কাছে এটাই চাওয়া আমার!
দর্শিনী আবিদকে জড়িয়ে বলে,
‘আপনি ছাড়া আমার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে, আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী! দয়া করে এমন কথা কখনো বলবেন না। আপনার আমার পথচলা লম্বা সময়ের জন্য হোক! ইনশাআল্লাহ আল্লাহ চাইলে আমরা দীর্ঘ সময় একসঙ্গে থাকবো।’
” হাত ছাড়ুন মেহেরাজ ভাই। খাবার বাড়ছি, রাত হয়েছে। আসুন।”
মেহেরাজ হাত ছাড়ল না। জ্যোতিকে উল্টো ঘুরিয়ে নিজের সম্মুখে দাঁড় করাল। কোমড় আঁকড়ে ধরে ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমি মাখা হাসি নিয়ে বলল,
” উহ, তোর তো আমার বউ ছাড়াও অন্য কোন সম্বোধন চাই? বললি না মাত্র? ”
জ্যোতির অস্থির লাগল। এমন একটা কথা আসলেই বলা উচিত হয়নি তার। কথাটার বিনিময়ে এই চরম বাক্য গুলো মেহেরাজ ফিরিয়ে দিবে জানলে সে কখনোই কথাটা বলত না। মাথা দুই পাশে দুলিয়ে বলে উঠল,
” না, আমি তেমনটা বুঝাইনি। ”
ভ্রু নাচিয়ে মেহেরাজ বলল,
” কেমনটা বুঝিয়েছিস তাহলে? ”
জ্যোতি বুঝে উঠল না কি বলবে। করুন চোখে মেহেরাজের দিকে তাকিয়েই ইতস্থত স্বরে বলল,
” হুশশশ!তোর প্রতি এই মুহুর্তে আমার বোন বোন ফিলিংস আসছে না জ্যোতি। ভাই বলে ডাকবি না বলে দিলাম।”
জ্যোতি বিনিময়ে উত্তর দিতে পারল না।থতমত খেয়ে বোকার মতো তাকাল। মেহেরাজ সেই দৃষ্টি দেখেই বাঁকা হাসল। কিছুটা ঝুঁকে গিয়ে জ্যোতির কানের কাছে বলল,
” বউ বউ ফিলিংস আসছে তোর প্রতি। আমার কিন্তু দোষ নেই জ্যোতি। সমস্ত দোষ তোর। কি দরকার ছিল শাড়ি পরে বউ বউ হয়ে সামনে ঘুরপাক খাওয়ার? প্রয়োজন ছিল? এখন তোকে বউ টউ ভেবে বসে কিছু করে ফেললে? দোষ কার?”
জ্যোতি তৎক্ষনাৎ দুই পা পিঁছিয়ে দাঁড়াল। কথাগুলোতেই নাকি কন্ঠের মধ্যে কি জানি ছিল। যা মুহুর্তেই বুকের ভেতর কম্পন উঠাল। অস্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন আর শ্বাস প্রশ্বাস টেনে অস্ফুট স্বরে বলল,
” শাড়ি চেঞ্জ করে নিচ্ছি তাহলে।”
মেহেরাজ গম্ভীর স্বরে বলল,
” আসলেই কি তুই অতোটা অবুঝ? কি বুঝাতে চাই কি বুঝে থাকিস।”
জ্যোতি ছোটশ্বাস টানল। নিজেকে স্বাভাবিক করে প্রসঙ্গ পাল্টানোর উদ্দেশ্যে স্বাভাবিক গলায় শুধাল,
” তুই যতটুকু পরিপক্ব ভাবতাম এখন দেখছি ততটুকুই চতুর! প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করছিস? কিন্তু আজ তো প্রসঙ্গ পাল্টাবে না। একেবারেই পাল্টাবে না। তোর সব চতুরতা ধরে ফেলেছি জ্যোতি। ”
” অন্য কিছুর সম্বোধন পেতে চাইলে এই সম্পর্কের পূর্ণতা দিতে হবে। পূর্ণতা দিয়ে দিই? ”
জ্যোতি উত্তর দিল না৷ সহসা কেঁপে উঠল।সর্বাঙ্গ কাঁপছে কেমন অদ্ভুত ভাবে। সে কম্পন অনুভব করল নিবিড়ে জড়িয়ে রাখা মেহেরাজও। নিরবতাকে সম্মতি হিসেবে ধরে নিয়েই কৌতুক স্বরে ফিচেল গলায় বলে উঠল,
” এইটুকুতে এমন করছিস কেন? কিছু করেছি আমি?”
জ্যোতি উত্তর দিল না। মেহেরাজ আবার গম্ভীর স্বরে বলল,
” পূর্ণতাপ্রাপ্তি ঘটুক তবে? ”
জ্যোতি ফের লজ্জ্বায় লালাভ হলো। অন্ধকারে সেই লজ্জ্বারাঙ্গা রং চোখে না পড়লেও মেহেরাজ তা উপলব্ধি করল বেশ করে। উত্তরটুকু মুখে বলা না হলেও বেশ করে বুঝতে পারল উত্তরটা।মুহুর্তেই ঠোঁটের কোণে ফুটল বাঁকা হাসি।
.
অন্ধকার ঘরে দুইজন যুবক যুবতীর শ্বাসপ্রশ্বাসের আওয়াজ দৃঢ় হলো ক্রমশ।সেই সাথে উষ্ণ শ্বাস ছুঁয়েও গেল একে অপরকে। বন্ধন গভীর হলো। গভীর হলো দুইজনার স্পর্শ। নিরব, স্তব্ধ, আঁধারে ঘেরা বদ্ধ ঘরে একে অপরের দেহ-মন একত্রিত হয়ে জানান দিল এক সমুদ্র ভালোবাসার৷
.
সকাল সকালই মেহেরাজের ঘুম ভাঙ্গল। পাশে থাকা ঘুমে আচ্ছন্ন মেয়েটার দিকে তাকিয়েই ঠোঁটে ফুটল হাসির রেখা। সতর্ক ভাবে শোঁয়া ছেড়ে উঠে বসল সে।হেসে জামাকাপড়, তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াল। কিয়ৎক্ষন পর গোসল সেরে এসে জ্যোতিকে একই ভাবে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে বিছানার এসে কোণে বসল। ঝুঁকে গিয়ে ভেজা চুলগুলো জ্যোতির মুখের সাথে স্পর্ষ করিয়েই ফিসফিসিয়ে বলল,
” আরো ঘুমাবি জ্যোতি? ”
জ্যোতি প্রথম দফায় সাঁই দিল না। মেহেরাজ এবারে নিজের ঠোঁটজোড়ার উষ্ণ চুম্বন আঁকল জ্যোতির কপালে। পরপরই জ্যোতি চোখ ছোট ছোট করে চাইল। কপাল কুঁচকে তাকাল মেহেরাজের দিকে। শরীর ব্যাথায় টনটন করছে। সদ্য ঘুম ছেড়ে উঠায় প্রথম দফায় কিছু বুঝে উঠতে না পারলেও পরমুহুর্তেই মেহেরাজের ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসি মনে করিয়ে দিল সমস্ত কিছু।সঙ্গে সঙ্গে লজ্জ্বায়, অস্বস্তিতে মরে যেতে মন চাইল তার।আর শুয়ে থাকতে পারল না। ব্যাথাময় শরীর নিয়েই দ্রুত উঠে পড়ল।বিছানা ছেড়ে উঠে যেতেই মেহেরাজ গম্ভীর স্বরে শুধাল,
জ্যোতি লজ্জ্বায় মেহেরাজের সম্মুখীন হতে পারল না।অন্যপাশ ফিরে মাথা নাড়াল কেবল। মেহেরাজ আলতো হেসে বেরিয়ে গেল। মুহুর্তেই জ্যোতি জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে পা বাড়াল। গোসল সেরে এসে আয়নায় মুখ দেখতে গিয়েই চোখে পড়ল গলার কাছে দুটো লালচে ছোট দাগ।দাগগুলোর জন্য সম্পূর্ণ মেহেরাজ দায়ী তা স্মরণ হলো সঙ্গে সঙ্গেই৷ মুহুর্তেই অস্বস্তিতে হাসফাঁস করল সে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ক্ষীন চাহনিতে তাকিয়ে থাকল সে লালচে দাগের দিকে। ঠিক তখনই রুমে এল মেহেরাজ। তার পাশে এসেই বলে বসল,
” খাবার গরম করেছি। ক্ষিধে পেয়েছে, আয় খেয়ে নিই।”
জ্যোতি সরাসরি তাকাল না। শুধু মাথা নাড়িয়ে বুঝাল আসছে সে। মুহুর্তেই কোন কিছু লুকানোর প্রবণতা দেখিয়ে দ্রুত গলায় ওড়না জড়িয়ে নিল।অস্বস্তিতে উঁশখুশ করল কিয়ৎক্ষন। এমন ভাবে ওড়না দিয়ে গলা ডেকে নিয়ে হাত দিয়ে চেপে রাখল যে স্পষ্টই বুঝা গেল সে কোনকিছু আড়াল করছে। মেহেরাজ ভ্রু কুঁচকাল। কিয়ৎক্ষন তাকিয়ে বলল,
” এমন উশখুঁশ করছিস কেন অসুস্থ রোগীদের মতো?”
পরমুহুর্তেই কি যেন ভেবে গলার স্বর নরম হলো।কাল রাতের মুহুর্ত মনে করেই শীতল স্বরে বলল,
মেহেরাজ ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিল। জ্যোতি আর এক সেকেন্ড ও দাঁড়াল না। দ্রুত পায়ে রুম ছেড়ে গিয়ে খাবার বাড়তে লাগল প্লেটে৷ মেহেরাজ সেসব শুধু চেয়ে থেকে খেয়াল করল সূক্ষ্ম চাহনীতে। জ্যোতি যে একবার ও তার দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছে না সেটাও খেয়াল করল ভীষণ করে। খেয়াল করল প্লেটে খাবার রাখার সময় অল্প করে ওড়না সরে যাওয়া গলায় লালচে দাগ।এতক্ষনে বুঝে উঠল জ্যোতি কি লুকোতে চেয়েছিল। ঠোঁট বাকিয়ে হেসেই বলে উঠল,
” গলার দাগটার জন্য আমিই দায়ী। দাগটা আমার থেকে লুকানোর মতো কিছু দেখছি না কিন্তু। ”
” ভাইয়া, আমি আজই ফিরে আসছি। আর আজই বিয়ে করব। তুমি ছেলেপক্ষকে বলো বিয়ে হলে আজই হবে। নয়তো হবে না বিয়ে। ”
মেহেরাজ কপাল কুঁচকাল। ছোট শ্বাস ফেলে বলল,
” আমি তোকে জোর করিনি মেহু। তোর বিয়ে নিয়ে এতোটা তাড়াহুড়ো আমি কখনোই চাইনি। আগে ছেলেটার সাথে পরিচিত হবি,চিনবি, জানবি, তারপর বিয়ে হবে। ”
মেহু জেদ করে বলল,
” না, আমি এক্ষুনিই বিয়েটা করতে চাইছি। তুমি কি বলবে তাদের? ”
মেহেরাজ গম্ভীর স্বরে শুধাল,
” এটা কি পাগলামো মেহু? ছেলেটার সাথে পরিচিত হওয়ার প্রয়োজন নেই তোর? ”
মেহু ফের বলল,
” না নেই।তুমি নিশ্চয় আমার জন্য খারাপ ছেলে পছন্দ করবে না। তাই না? ”
“তুই কি রাগ করে আছিস মেহু? যদি তুই না চাস আমি এক পা বাড়াব না৷ এ মুহুর্তেই কল করে না করে দিব। ”
মেহু শান্তস্বরে বলল,
” না ভাইয়া, আমি সত্যিই বিয়েটা করতে চাইছি। আজই।সকালের বাসে উঠেছি।সন্ধ্যার মধ্যে পৌঁছে যাব। রাতে ঘরোয়া ভাবে বিয়েটা হয়ে যাক৷ তারপর চেনা, জানা, আনুষ্ঠানিক বিয়ে সবটা হবে। ”
মেহেরাজ লম্বাশ্বাস ফেলল,
” এমন সিদ্ধান্তি কেন? ”
মৃদু আওয়াজে মেহু উত্তর দিল,
” আমি চাইছিনা এমন কারো প্রতি অনুভূতি জম্মাক যার সাথে আমার বিয়ে হবে না। তাই বিয়ে করে তারপরই তার প্রতি আমার অনুভূতি সৃষ্টি হোক এমনটা চাইছি। ”
” এটা পাগলামো, বড়দের কাউকেই জানাইনি। চাচা চাচীদের পছন্দ হবে কিনা সেই বিষয় ও তো ভেবে দেখতে হবে। ”
” আমার কাছে সবার আগে তুমি ভাইয়া। চাচা চাচীদের থেকেও তুমিই কিন্তু আমার বেশি ভালো চাইবে।”
মেহেরাজ চাপা স্বরে বলল,
” কিন্তু এটা তো জোঁকের বশে কাজ হয়ে যাচ্ছে মেহু। ”
মেহু ফের জেদ নিয়ে শুধাল,
” অতোকিছু জানি না, আমি আজই বিয়েটা করতে চাইছি।নয়তো বিয়ে করব না। বলা যায় এটা সে ছেলের পরীক্ষাও। ছেলে যদি আমায় ভালোবাসে তাহলে নিশ্চয় সেই মুহুর্তেই বিয়ে করতে হাজির হবে তাই না?”
মেহেরাজ ঠোঁট গোল করে শ্বাস ফেলল।আরো কিয়ৎক্ষন বুঝাল মেহুকে। মেহু বুঝল না। অবুঝ বাচ্চার ন্যায় জেদ ধরে বসে আছে বিয়েটা সে করবেই করবে।তাও আজ। আজ মানে আজই।
.
সন্ধ্যায় মেহু বাসায় ফিরল।অবশেষো তার জেদের কাছে হার মেনে রাজি হতে হলো সবাইকে৷ রাজি হতে হলো ছেলেপক্ষকেও।লাল টকটকে শাড়িতে সাঁজানো হলো মেহুকে। খোঁপাতে বেলিফুলের মালা সহ, হাতে চুড়ি, কানে দুল সহ সুন্দর করেই সাঁজাল জ্যোতি। একবার মৃদু স্বরে বলে বসল মেহুকে,
” এভাবে বিয়ে করাটা কি উচিত মেহু আপু? তুমি তো একজনকে ভালোবাসতে। বাসতে না? তুমি অস্বীকার করলেও আমি তা জানি মেহু আপু। ”
মেহু তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসল। জ্যোতিকে শুরু থেকে সবটাই খুলে বলল। টলমলে চোখে ঠোঁট কাঁমড়ে বসে থাকল কেবল। শেষ মুহুর্তে বলল,
” ভাইয়া যেহেতু বলেছ ছেলেটা আমায় ভালোবাসে, ভালো রাখবে।তার মানে ছেলেটা সত্যিই আমায় ভালোবাসে। আর জীবনসঙ্গী তাকেই করা উচিত যে আমাদের ভালোবাসে। যে আমাদের ভালো চায়। ”
জ্যোতি দীর্ঘশ্বাস ফেলল।বলল,
” আমি চাই তুমি সুখী হও। খুব খুব সুখী হও মেহু আপু। ”
মেহু হাসল। চুপচাপ বসে আয়নায় দেখতে লাগল নিজেকে। এই সাঁজটাতো সাঈদের জন্যও হতে পারত? পারত না? খুব বেশি কি ক্ষতি হতো সাঈদের সাথে বিয়েটা হলে? মস্তিষ্ক তৎক্ষনাৎ উত্তর দিল, “হ্যাঁ। ক্ষতি হতো। খুব ক্ষতি হতো।”
কিয়ৎক্ষন পরই জ্যোতি এসে নিয়ে গেল মেহুকে। বসার ঘরে বসে থাকা ছেলেপক্ষের পাঁচজন ব্যাক্তি মেহুর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। মেহু অবশ্য তা খেয়াল করল না।টলমলে চোখে নিচের দিকেই তাকিয়ে থাকল সে। জ্যোতি আলতো পায়ে গিয়ে মেহুকে সোফায় বসাল। সম্মুখে বৃদ্ধ মতো কাজী শুরু করলেন নিজে কাজ। মেহু কোনদিক না তাকিয়েই মাথা নত করে বসে থাকল পুরোটা মুহুর্তে। কান সজাগ হলো শুধু কাজীর কন্ঠে আবিদ হাসান মেঘ নামটা শুনেই। চোখজোড়া মুহুর্তেই বিস্ময়ে বড়বড় হয়ে এল। তার মানে মেঘই সেই ব্যাক্তি? মেঘই সেই ছেলে? মেহু বিশ্বাস করে উঠতে পারল না। আড়ষ্ট স্বরে তিনবার কবুল বলেই চুপ থাকল সে।কিয়ৎক্ষন পরই বিয়ে সম্পন্ন হলো। মেহুকে আবারও নিয়ে যাওয়া হলো নিজের ঘরে। তখনই ছোট বাচ্চা ছেলেটা মেহুর সামনে এল। ঠোঁট উল্টে বলল,
” তুমি তবে মেঘের বউ? ”
মেহু তাকাল। এটা সানশাইন। সে চেনে। মৃদুস্বরে বলল,
” তোমরা তো ঠকালে আমায়। তোমার বাপ যে বলল সে বিয়ে করে নিয়েছে ? অথচ আজ আমায় বিয়ে করে বসল?”
বাচ্চা ছেলেটা উত্তর দিল না। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকল কিয়ৎক্ষন। তারপর দৌড়ে চল গেল ফের। মেহু ছোটশ্বাস ফেলল কেবল।জানালার ধারে দাঁড়িয়ে রইল উদাস চাহনীতে ঘন্টার পর ঘন্টা।
.
এখন রাত হলো বেশ। সন্ধ্যার দিকে হসপিটালের সবকাজ ফেলে এসেই বিয়েটা করতে হলো মেঘকে। পরিবারে বাবা-মা , ভাইয়া- ভাবীকে বিষয়টা বুঝিয়ে অতি কষ্টেই রাজি করাতে হয়েছিলো তাকে।তারপর রাজি করিয়েই পরিবার সমেত মেহুদের বাসায় উপস্থিত হয়ে ঘরোয়া ভাবে বিয়েটা সেরে নিল। অবশেষে বিয়েটা হয়ে গেলে ভাবতেই ঠোঁটে হাসি ফুটল। যেভাবেই হোক, আজ থেকে মেহু নামক মেয়েটা যে কেবলই তার সে বিষয়ে সন্দেহ নেই ভেবেই তৃপ্তির শ্বাস ফেলল। জানালাটা মেলতেই চোখে পড়ল ওপাশের জানালায় থাকা মেহুর মুখ।মেঘ হাসল। বলল,
” আপনি আমার সম্বন্ধে কিছুই জানেন না৷ নেচে নেচে বিয়ে করতে চলে এলেন কেন হুহ?”
মেঘ ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
” যদি বলি সবটুকুই জানি? ”
মেহুর গলাটা হঠাৎ নিভে এল। ভরাট স্বরে শুধাল,
” কিচ্ছু জানেন না। আমি আপনাকে ঠকিয়েছি। আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি মেঘ। ”
মেঘ ঠোঁট চওড়া করে হাসল। বলল,
” সমস্যা নেই, প্রথম ভালোবাসা না হলে ও আমি তোমার শেষ ভালোবাসা অবশ্যই হবো মেহু। ভালোবাসা দিয়ে ঠিক সব ভালোবাসা আদায় করে নিব একদিন। ঐ যে বলে না?ভালোবাসা দ্বারা সব সম্ভব? একদিন ঠিক জায়গা হয়ে যাবে তোমার মনে। ”
মেহু অবাক হলো। তাকিয়ে থাকল কেবল ছেলেটার দিকে।এতোটা আত্মবিশ্বাস? এতোটা দৃঢ়তা?সত্যিই জায়গা করে নিতে পারবে? সত্যিই সবটুকু ভালোবাসা আদায় করে নিতে পারবে? এতোটাই সহজ?
মেহেরাজ অনেকটা রাত পর্যন্ত বেলকনিতেই কাঁটাল। বাবা মাকে হারানোর পর থেকেই মেহুকে নিজের হাতে মানুষ করেছে সে। সবসময়ের মতো আগলে রেখেছিল প্রিয় বোনটাকে। এভাবে হুট করেই বোনের বিয়ে নিয়ে এগোতে চায়নি সে। তবুও হুট করেই সম্পন্ন করতে হলো বিয়েটা। সেই ছোট মেহু আজ কারোর স্ত্রী, কারোর পুত্রবধূ! মেহেরাজ লম্বা শ্বাস টানল। পাশাপাশি বাসা হওয়ায় মেহুকে সবসময় দেখতে পাবে বলে মনে মনে স্বস্তিও মিলল৷ অবশেষে বেলকনি ছেড়ে রুমে পা ফেলতেই চোখে পড়ল রুমের মৃদু আলোতে ঘুমন্ত জ্যোতিকে। কি নিষ্পাপ চাহনী! অগোছাল চুল আলগোছে হয়ে পড়ে আছে চোখে মুখে। মেহেরাজ আলতো হেসে এগিয়ে গেল। বিছানার কোণে বসেই হাত ছোঁয়াল জ্যোতির গালে। পরমুহুর্তেই ঝুঁকে গিয়ে উষ্ণ চুম্বন আঁকল ডান গালে। গতরাতের স্মৃতিচারণ করেই মেহেরাজের আলতো হাসিটা চওড়া হলো। ঠোঁট বাঁকিয়ে বিছানায় জ্যোতির দিকে ফিরে শুঁয়ে পড়ল। পুরুষালি হাত দিয়ে জড়িয়ে নিল সম্মুখে থাকা ঘুমন্ত রমণীকে। গুঁছিয়ে দিল মধ্যকার দূরত্ব। আলতোভাবে পুরু ঠোঁটজোড়া ছোঁয়াল জ্যোতির কপালে।ঠোঁট বাঁকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
” সারাদিন লজ্জ্বারাঙ্গায় লালাভ হয়ে মুখোমুখিই হোসনি তুই। আর এখন কিন্তু দিব্যি মুখোমুখি হয়ে ঘুমিয়ে আছিস জ্যোতি।এখন লজ্জ্বা হচ্ছে না?”
ঘুমন্ত জ্যোতি বোধহয় টের পেল এবারে।শুনলও বোধহয় পুরুষালি কন্ঠে ফিসফিসিয়ে বলা কথাগুলো। তবুও বুঝতে দিল না। অল্প নড়চড় করলেও চোখ মেলে চাইল না একবারও। চোখ মেলে চাইলেই বোধহয় সম্মুখ পুরুষের নেশাময় দৃষ্টি তাকে জব্দ করত। নুঁইয়ে পড়ত সে মোহনীয় নজরে এক মুহুর্তেই। জড়িয়ে পড়ত ভিন্ন আবেশে। তার থেকে চোখ বুঝে ঘুমিয়ে থাকার ভান করা ভালো নয়?
.
মেহুর ঘুম ভাঙ্গল মোবাইলের রিংটোনের আওয়াজ পেয়েই।সাঈদের কল। মেহুর নিঃশ্বাস আটকে আসল। মনে পড়ল সেদিনকার মেয়েটার সমস্ত কথা। সেই সাথে মনে পড়ল গতকালের সকল কথা, সকল ঘটনা। এখন থেকে সে অন্যের স্ত্রী৷ এখন থেকে সে বিবাহিত। সাঈদ এখন কেবলই অতীত। শুধু এবং শুধুই অতীত। মেহু কল তুলল না। স্বার্থপরের মতো মোবাইলটা একপাশে ঠেলে রেখে উঠে বসল। পা বাড়িয়ে জানালা মেলেই অপর পাশের জানালায় একনজর তাকাল। মুহুর্তেই চোখে পড়ল ছোট বাচ্চাটাকে। আলতো হেসে বলল,
” গুড মর্নিং সানশাইন। ভালো আছো? ”
বাচ্চাটা ড্যাবড্যাব করে চাইল ঠিক তবে উত্তর দিল না৷ মেহু আবারও শুধাল,
” কথা বলবে না আমার সাথে?”
বাচ্চাটা শুধাল,
” আম্মু বলে অপরিচিতদের সাথে বেশি কথা না বলতে। ”
মেহু ভ্রু কুঁচকাল। বলল,
” আমি অপরিচিত? এক মিনিট, তোমার আম্মুটা কে?”
এবারে পেঁছন থেকে মেঘ এগিয়ে আসল। ভ্রু বাঁকিয়ে শুধাল,
” কি আশ্চর্য!জানতে চাইব না? যাকে বিয়ে করলাম সে যদি আগে আরো দশ পাঁচটা বিয়ে করে বসে থাকে তাহলে? আমি এই দশ- পাঁচ বিষয়টা সহ্য করতে পারিনি বলেই আপনাকে বিয়ে করেছি। এখন আপনিও যদি আরো দশ- পাঁচজনের সাথে জড়িয়ে থাকেন তাহলে দ্বিতীয়বার পা বাড়াব না। ”
মেঘ বাঁকা হাসল। সানশাইন ততক্ষনে দৌঁড়ে রুম ছেড়ে গিয়েছে। মেঘ একনজর পিছুঁ ফিরে সানশাইনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আবার মেহুর দিকে ফিরল। বলল,
” পা বাড়াতে চাইছো তার মানে? ”
” না! ”
বাঁকা হেসে আবারও বলল,
” চাইলেও সমস্যা নেই। বাড়াতে পারো নিশ্চিন্ত মনে।সানশাইন হলো ভাইয়ার ছেলে। ভাইয়া ভাবিকে দেখেছো আশা করি বিয়ের দিন?তাই সানশাইনের আম্মুকে নিয়ে আতংকে থাকতে হবে না।আর শোনো,আমার জীবনে প্রথম নারীটিও তুমি, শেষ নারীটিও তুমিই হবে।এর মাঝে অন্য কোন নারী আসবে না।”
মেহু দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ভারী গলায় বলে,
“শুনুন ডক্টরসাহেব, পৃথিবীতে সবকিছুই বদলায়। সবকিছুই! এই কথাটাও বদলে যেতে দুই সেকেন্ড সময় নিবে না। এতটা দৃঢ়ভাবে বলবেন না। পরে যদি বদলে যায় কথাটা?”
দৃঢ়গলায় উত্তর আসল,
” বদলাবে না। আমার নিজের প্রতি আমার এইটুকু বিশ্বাস আছে। ”
” কিন্তু আমি যে বিশ্বাস করতে পারছি না।তবে আমি মনে প্রাণে চাইছি আপনার সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে। আচ্ছা মেঘ?কতোটা ভালোবেসেও ব্যর্থ হলে, কতোটা যন্ত্রনায় ছটফট করলে মানুষ দ্বিতীয়বার কাউকে ভালোবাসতে ভয় পায়?কতোটা আঘাতে জর্জরতি হলে মানুষ দ্বিতীয়বার কারোর সাথে নিজেকে ভাবতে গিয়ে ভয় পায়?কতোটা?”
মেঘ আলতো হাসে। বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে বলে,
” জানো মেহু?একটা কথা আছে, এই পৃথিবীতে আমরা কাউকে যতোটা কষ্ট দিই ততোটাই কষ্ট আবার ঘুরেফিরে আমরা পাই।আমি জ্বলেছিলাম তোমার দহনে, তুমি জ্বলেছিলে অন্য কারো দহনে। আবার তোমাকে যে জ্বালিয়েছে?সেও জ্বলবে। কয়েক দিন, কয়েক মাস কিংবা কয়েক বছর পর হলেও জ্বলবে।এটাই বাস্তবতা।”
কিছুটা থেমে আবারও বলল,
“জানো মেহু? চারবছর আগে চোখের সামনে তোমার কপালে কাউকে চুম্বন আঁকতে দেখেছিলাম।লোকটা সাঈদ নামক ব্যাক্তিটাই, যাকে তুমি ভালোবাসতে। উহ!কি অসহনীয় যন্ত্রনায় আমি পুড়েছিলাম সেই ক্ষনে।এই সত্যটা জানার পর যেন বুকের ভেতর উত্তপ্ত আগুনে ছারখার করছিল সবকিছু।আমি মুখ ফিরিয়ে সরে আসলাম, যেভাবেই হোক না কেন নিজেকে গুঁছিয়ে নিলাম। তবুও দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আমি জ্বলেছি। শুধুই জ্বলেছি। ”
মেঘ আবারও বলল,
” আমি জানি, এখনো তুমি তাকে ভালোবাসো। হয়তো অনেকটা বেশিই ভালোবাসো। তাই না? তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস সে অনেকটা ভালোবাসা একদিন ফিকে হয়ে যাবে, আর আমার প্রতি তোমার ভালোবাসাটা সেদিন গাঢ় হয়ে যাবে। ঐ যে, নারী ভালোবাসায় আটকায়?আমি তোমায় ভালোবাসাতেই আটকাব মেহু।এতোবেশি আমার ভালোবাসা উপলব্ধি করবে যে একদিন তুমি আমায় ভালোবাসবেই! বাসতেই হবে। ”
মেহু কিছু বলল না। শুধু নিস্তব্ধ চাহনীতে তাকিয়ে রইল মেঘের দিকে। আসলেই ভালোবাসতে পারবে সে?সেও তো চায় সবটা ভুলতে। সেও চায় নতুন করে জড়াতে কারোর সাথে। সেও চায় সাঈদকে শুধু এবং শুধুই অতীত হিসেবে মেনে নিতে।
.
সাঈদ মেহুর বিয়ের বিষয়টা জানতে পারে সকালেই। মেহেরাজের থেকে। তখন থেকেই এক নাগাড়ে কল দিয়েছে মেহুকে। মেয়েটা কল তুলেনি। অবশেষে ম্যাসেজ করে জানিয়েছে, অন্তত একবার হলেও দেখা করুক।শেষবারের মতো হলেও একবার সম্মুখীন হোক তার। মেহু রাজি হলো। রেস্টুরেন্টে চেয়ার টেনে বসতেই চোখে পড়ল এক অগোছাল সাঈদকে।চুল উষ্কুখুষ্কু অগোছাল। চোখমুখে কেমন অদ্ভুত ভাব স্পষ্ট। পরনে একটা টিশার্ট আর টাউজার যা সাধারণত বাসায় তার পরনে থাকে। মেহু অনেকক্ষন যাবৎ পরখ করল সামনে বসে থাকা সাঈদকে।রক্তরাঙ্গা চোখ আর শক্ত চোয়ালে একইভাবে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে ছেলেটা।অবশেষে চোখ তুলে চাইল মেহুর দিকে। বলল,
” খুব বেশি অযোগ্য ছিলাম আমি মেহু? এমনটা কেন করলে? তুমি জানতে না আমি তোমায় ভালোবাসতাম?কি হলো?জানতে না তুমি?”
মেহু জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজাল। মৃদু স্বরে বলল,
” এটা কেমন ভালোবাসা?যে ভালোবাসায় অন্য নারীর দিকে ঝুঁকতে হয়?এটা কখনো ভালোবাসা হতে পারে না।”
সাঈদ হাসল। ব্যর্থ হাসি। মৃদু আওয়াজে বলে উঠল,
” সেদিন যে মেয়েটাকে দেখেছিলে? সে আমার ভার্সিটিতে থাকাকালীন ফ্রেন্ড।ওর সাথে মাস তিনেকের পরিচয় ছিল। তারপরই ও ফেমিলিসহ অন্য দেশে শিফট করে।তবে এটা ঠিক যে আমার সাথে ফিজিক্যালি সম্পর্ক হয়েছিল ওর। একবার দেশের বাইরে ট্যুরে গিয়েই মাথায় ভুত চেপে গেল।দেখা হলো ওর সাথে৷ মেয়েটা কেমন জানি। নিজ থেকেই প্রস্তাব রাখল ফিজিক্যাল রিলেশনের। আমি প্রথমবারে এমন প্রস্তাবে না করলেও পরেরবার আমিও মজা লুফে নিতে রাজি হয়ে গেলাম একপ্রকার। ঐ যে প্লে বয় ছিলাম? সেই সম্মোধনের জেরেই বোধ হয় এই বিষয়টা ঘটে গিয়েছিল তখন। তারপর ওর সাথে আমার আর যোগাযোগ ছিল না। কিছুদিন আগেই বিজন্যাসের একটা মিটিংয়ে দেশের বাইরে যেতে হলো।তারপর তারসাথে আমার আবারও দেখা। এবারে আমি তার সাথে সহজভাবেই বন্ধুর ন্যায় কথা বললাম।গল্প করলাম। কিন্তু ভাবিনি সে উম্মাদের ন্যায় আচরণ করবে। ইভেন এখনও পিঁছু পিঁছু ঘুরে জ্বালাচ্ছে! এতে কি আমার দোষ আছে মেহু? ওর সাথে যা করেছি সবটা অনেক আগের ঘটনা!অনেক অনেক আগের। তোমায় ভালোবাসার পর আমি আর কারোর দিকে টান উপলব্ধি করিনি মেহু। না শরীরের দিক দিয়ে আর না তো মনের দিক দিয়ে। ”
সাঈদ থামল। একবার মেহুর দিকে তাকিয়েই আবারও ভরাট গলায় বলে উঠল,
” তোমায় ভালোবাসি এটা উপলব্ধি করার পর তো আর ঝুঁকিনি কারোর দিকে মেহু। কারোর দিকেই ঝুঁকিনি। চারবছর আগে একটা মেয়েকে কিস করেছিলাম। আর সে দৃশ্য দেখেই তুমি এড়িয়ে চলতে শুরু করলে আমায়। আমি জানতাম তুমি আমার প্রতি দুর্বল। আমার প্রতি তোমার প্রচন্ড দুর্বলতা আছে। তবুও তুমি আমার কাছে আমার বন্ধুর বোন হিসেবেই ছিলে মেহু।এর আগে মুখে মজা করলেও কখনো অন্য নজরে তাকিয়েছিলাম তোমার দিকে? তাকাইনি। কিন্তু সেদিন মেয়েটাকে কিস করার পর যখন বুঝলাম তুমি দেখে নিয়েছিলে?তোমার মুখের অসহায়ত্ব যখন দেখেছিলাম?হুট করেই অপরাধ বোধ জাগল। অনুভব করলাম তোমার অসহায়ত্ব, চোখের পানি আমার দুর্বলতার একাংশ। তবে হ্যাঁ, তখনও বুঝে উঠিনি আমি তোমায় ভালোবাসি। বুঝলাম তখন, যখন তুমি ক্রমশ এড়িয়ে চলতে শুরু করলে। ক্রমশ বুঝিয়ে দিতে লাগলে তুমি আমার থেকে সরে যাচ্ছো। অনেকটুকু দূরে সরে যাচ্ছো। তার মাস খানেক পরই তোমার টলমল চোখের জলের সম্মুখীন হলাম আবারও। সেদিন কেন জানি সে অশ্রু, সে কষ্ট আগলে নিয়ে মুঁছে নিতে মন চাইল। তাই তো তোমার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালাম। আর তুমি ভাবলে আমি সুযোগ নিলাম।অথচ তুমি জানলে না, তোমার অশ্রু আমায় কতোটা যন্ত্রনা দেয়। আর সে কারণই তোমার অশ্রুসিক্ত নয়নে আমি দ্বিতীয়বার তাকিয়ে দেখতাম না।বরাবরই এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছি তোমার কান্নামাখা মুখকে।”
মেহুর চোখ টলমল করল। আসলেই কি এই লোকটাকে আপন না করে সে ভুল করে ফেলেছে? মুহুর্তেই মস্তিষ্ক জানাল, সে বিবাহিত। সে এখন অন্য কারো। সাঈদের দিকে ঝুঁকলে এখন ঐ লোকটার প্রতি অন্যায় হবে।লম্বা শ্বাস ফেলল মেহু। সাঈদ আবারও ব্যাথাময় স্বরে শুধাল,
” মেহু?আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মেহু। একবার বলো না সবটা মিথ্যে। একবার বলো প্লিজ!আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তোমাকে অন্য কারোর সাথে মেনে নিতে। ”
মেহু উঠে দাঁড়াল এবারে। এর চেয়ে বেশিক্ষন থাকলে হয়তো সে আর স্থির থাকতে পারবে না। সত্যিই পারবে না। শক্ত গলায় শুধাল,
” এসব সত্যি। আপনি ফিরে যান।ফিরে যান সাঈদ ভাইয়া। আমি আর কিছুই শুনতে চাই না। আপনার কষ্ট, কৈফিয়ত কিছুই জানতে চাই না। ”
কথাটুকু বলেই পা বাড়াল মেহু।সাঈদ তাকিয়ে থাকল কেবল সেদিক পানে। বুকের ভেতর বিষাক্ত দহনে জ্বলছে সমস্ত কিছু। অস্ফুট স্বরে বলল,
” আমার হৃদয়ে তোমার নামে এক মুঠো প্রণয় ছিল মেহু। আপসোস! আমি সেই প্রণয়ে তোমায় জড়িয়ে নিতে পারলাম না। জীবনে অসংখ্য নারীর সন্নিকটে থাকলেও প্রথম প্রণয়টা তুমিই মেহু। আমি সেই প্রণয়ে আর কাউকে জড়াব না। কাউকেই না। তুমি আমার না হয়েও আমারই রবে। আমার শেষ নিঃশ্বাস অব্দি থাকবে।আমার কল্পনায়।”
.
সপ্তাহখানেক পরই মেহু আর মেঘের বিয়ের অনুষ্ঠানটা আনুষ্ঠানিভাবে করা হলো। সেই সঙ্গে বড়দের নির্দেশ অনুযায়ী মেহেরাজ আর জ্যোতির বিয়েটাও আনুষ্ঠানিক ভাবে সম্পন্ন হলো। মেহেরাজদের গ্রামের বাড়িতেই সব করা হলো।জ্যোতি আনমনে ভাবল দাদীর কথা, ছোট্ট মিথির কথা।ভাবল মিনারের কথাও। সেই চিঠিটার পর থেকে মিনারের সাথে খুব কমই যোগাযোগ হয়েছে। শুনেছে ঢাকায় কোথাও চাকরী করে এখন সে। আচ্ছা, সে মানুষটা এখন কেমন আছে?পরমুহুর্তেই ভাবল দাদীর কথা।এই দিনটাতে নিশ্চয় তার দাদী খুব খুশি হতো? নিশ্চয় নিজের প্রিয় নাতনির সুখে ভীষণ সুখী হতো?ভাবতেই চোখজোড়া টলমল করল। সেই টলমলে দৃষ্টিতে, ফুলে ফুলে সজ্জ্বিত ঘরে ফুলের সুভাসে হঠাৎই দেখা মিলল পুরুষালি মুখয়ব। মেহেরাজের উপস্থিতি। মুহুর্তেই বুকের ভেতর অদ্ভুত অনুভূতি হলো।সপ্তাহখানেক আগের সেই রাত, সেই অনাকাঙ্ক্ষিত মুহুর্ত গুলোর কথা আবারও স্মরনে এল। মুহুর্তেই অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসল সে। মেহেরাজ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। কাছাকাছি এসে ঝুঁকে গিয়ে বলল,
” এমন ছটফট করছিস কেন জ্যোতি?আচ্ছা, তুই কি মনেমনে বাসরটাসর নিয়ে ভেবে বসে আছিস জ্যোতি? ছিঃ!”
জ্যোতি বোকার মতো চাইল। স্বাভাবিক ভাবে ফুলশয্যার রাতে,ফুলে ফুলে সজ্জ্বিত এমন একটা ঘরে থাকলে যা ভাবার তাই ভেবেছে সে।ছিঃ এর কি আছে?মেহেরাজ আরেকটু ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে শুধাল,
” তুই যা ভাবছিস তা যদি আবারো সেদিনের মতো সত্যি হয়ে যায়?আমার কিন্তু দোষ নেই জ্যোতি। ”
জ্যোতির নিঃশ্বাস এবারে ঘন হলো। আর একবারও তাকাল না মেহেরাজের দিকে। লোকসম্মুখে ভদ্র, গম্ভীর মেহেরাজই সুযোগ ফেলে যে অভদ্র হয়ে যায় তা তার জানা হয়ে গেছে। তাই চুপ থাকল। অন্য দিকে ফিরে নিজের অস্বস্তি লুকানোর চেষ্টা চালাল। মেহেরাজ এবারে নেশাময় কন্ঠে শুধাল,
মেহুর চেহারা মলিন।সে জানে অন্য সব বর বউয়ের মতো তাদের বিয়ের রাতটা স্বাভাবিক হবে না। তবুও মনে মনে কোথাও অপরাধবোধ হচ্ছে৷ সে কি মেঘকে আসলেই ঠকাচ্ছে?আসলেই মেঘকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে? সে তো মনেপ্রাণে চায় মেঘকে ভালোবাসতে।হৃদয়ের সমস্ত অনুভূতি কেবলই মেঘের নামে করে দিতে। তবুও কেন পারছে না? ভাবতেই লম্বা শ্বাস ফেলল। মেঘ কাছে এসে বসল। মেহুর একহাত নিজের হাতে নিয়েই শুধাল,
” মন খারাপ?”
উত্তর আসল না। মেঘ কিছুটা থেমেই মেহুকে নিজের মুখোমুখি করল।মেহুর কপালে আলতো করে ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে বলল,
“আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা না জম্মানো অব্দি তোমার কাছে ভালোবাসার আবদার রাখব না মেহু।তোমায় স্ত্রীর ন্যায় গভীর ভাবে ছোঁব ও না। যেদিন তুমি ভালোবাসবে সেদিনই তোমায় পরিপূর্ণভাবে স্ত্রী হিসেবে কাছে টানব। ভয় নেই।আমার প্রতি এইটুকু বিশ্বাস রাখতে পারো।”
মেহু মৃদু গলায় বলল,
” আমি আপনাকে বিশ্বাস করি মেঘ, ভয় পাচ্ছি না।”
মেঘ হাসল। বলল,
” বিশ্বাস ভালোবাসার গভীরতম ধাপ। যেখানে বিশ্বাস আছে সেখানে ভালোবাসা অবশ্যই জম্মাবে মেহু।”
মেহু শান্ত কন্ঠে শুধাল,
” তাই যেন হয়। ”
.
এর মাঝে কেঁটে গেল প্রায় আঠারোটা মাস। এতগুলো দিনে মেহু বারংবার মুগ্ধ হয়েছে মেঘের ভালোবাসায়। খুব করে এই মানুষটার মায়ায় পরেছে। নারী সত্যিই ভালোবাসায় আটকায়। প্রিয় পুরুষের যত্নে আটকায়, আগলে রাখাতে আটকায়, অনুভূতিতে আটকায়।আজকাল সাঈদের প্রতি অনুভূতিটা যতোটা ফিকে হয়েছে মেঘের প্রতি অনুভূতিটা ততোটাই দৃঢ় হয়েছে। গভীর হয়েছে! সাঈদ আজ সত্যিই অতীত।হয়তো মাঝেমাঝে ওক আধটা দীর্ঘশ্বাসে মনে পড়ে সেই অতীতকে। এর থেকে বেশি না। মেহু মলিন হাসল।
মেঘ যখন ফিরল তখন রাত বারোটা। ক্লান্ত শরীরে বাসায় এসে রুমে প্রবেশ করতেই সর্বপ্রথম চোখে পড়ল মেহুকে। লাল টকটকে শাড়ি, সাথে মোহনীয় সাঁজ। মেঘ আড়চোখে কয়েকবার তাকিয়ে শুধাল,
” হঠাৎ এই সাঁজ?”
” বরের জন্য বউয়ের সাঁজ নিষেধ নাকি?একটা গোপণ কথা শুনবেন? সাঁজটা আসলে আমার নয়, আপনার স্ত্রী মেহুর।শুধু এবং শুধুই আপনার স্ত্রী। স্ত্রী রূপে কাছে টেনে নিবেন? ”
মেঘ দ্বিধান্বিত চাহনীতে চাইল। বলল,
” কিসব বলছো মেহু?”
” যেটা বুঝেছেন সেটাই বলছি। বয়সতো কম নয় আমার। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক আমি বুঝি মিঃ মেঘ।তাই জেনেশুনেই বলছি সমস্তটা।জ্যোতি বয়সে আমার চেয়ে ছোট হয়ে এক মেয়ের মা হয়ে যাচ্ছে। আমি মা হবো না? ”
মেঘ চোখ বড়বড় করল। জ্যোতি সাতমাসের প্র্যাগনেন্ট! আল্ট্রাসোনোগ্রাফির রিপোর্ট অনুযায়ী অনাগত সন্তান মেয়ে। কিন্তু এই নিয়ে মেহু এভাবে ফট করে একটা কথা বলে বসবে ভাবেনি সে।ধীরপায়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেষ হয়ে আসতেই তার বিস্ময়ের মাত্রাকো দ্বিগুণ করে এবার মেহু জড়িয়ে ধরল। বুকে মুখ গুঁজে বলে উঠল,
” ভালোবাসি আপনাকে মেঘ।অনেকটুকু! ”
মেঘ গম্ভীর গলায় শুধাল,
” আমার তবে অবশেষে এক মুঠো প্রণয়ের প্রাপ্তি হলো?আমি আমার জায়গাটা তবে করে নিতে পেরেছি মেহু?”
” পারতে তো হতোই।এতো ভালোবাসার বিনিময়ে আমি কি এতোটুকুও ভালোবাসা দিতাম না? ”
মেঘ কিছুই বলল না।শুধু নিঃশব্দে হাসল।মেহু আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
” এবার পুরোপুরি স্ত্রীরূপে ধরা দিলাম। আমায় পুরোপুরি স্ত্রীরূপে কাছে টানবেন না মেঘ?”
” উহ!স্ত্রী রূপে কাছে টানতে গিয়ে অসভ্য হয়ে গেলে দোষ দিবে না মেহু। ”
উত্তরে মেহু কিছুই বলল না। হাতজোড়া দিয়ে মেঘকে আঁকড়ে রাখল ঠিক আগের মতোই। মেঘ আরো গভীরে জড়িয়ে নিল মেহুকে। কিয়ৎক্ষন জড়িয়ে রেখে উষ্ণ চুম্বনে,উষ্ণ স্পর্শে উম্মাদনায় মত্ত করল তারই প্রিয়তমাকে।
.
জ্যোতি সাতমাসের ভরা পেট নিয়েই বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। অন্ধকার আকাশে জ্বলমলে চাঁদটার দিকে তাকিয়েই ঠোঁটে ফুটে উঠল হাসি। বাইরের মৃদু শীতল হাওয়াটা ভালোই বোধ হলো তার কাছে। এর মাঝেই নিঃশব্দে বেলকনিতে উপস্থিত হলো মেহেরাজ। পেঁছন থেকে জ্যোতিকে জড়িয়ে নিয়েই হাত রাখল জ্যোতির পেটে৷ ঘাড়ের কাছে চুমু দিয়ে বলল,
” আমার ঘুমের বারোটা বাঁজিয়ে ,একা আমায় রেখে এসে এখানে সময় কাঁটানোর মানে কি?”
জ্যোতি কিছু বলল না উত্তরে। মেহেরাজ ফের বলল,
” তুই এখানে থাকলে থাকতেই পারিস আমার থেকে দূরে দূরে।কিন্তু আমার প্রিন্সেস কেন থাকবে আমার থেকে দূরে? ”
জ্যোতি এবারে উত্তর দিল,
” উহ, ঘুম হচ্ছে না। আপনি ঘুমিয়ে ছিলেন, তাই ডাকিনি আর। ”
মেহেরাজ ত্যাড়া স্বরে শুধাল,
” তো লাভটা কি হলো?তুই আসামাত্রই তো ঘুম ভেঙ্গে গেল। কিসব জাদুটাদু করে রেখেছিস আমার উপর বলতো?”
জ্যোতি অস্ফুট স্বরে শুধাল,
” আমি?”
মেহেরাজ সতর্ক করল।হুশিয়ারি দিয়ে বলে উঠল,
” হুশশশ!ও নড়াচড়া করছে।আমার আম্মুটা!”
জ্যোতি চুপ হয়ে গেল।যখনই মেহেরাজ থাকাকালীন বাচ্চাটা এভাবে নড়াচড়া করে তখনই মেহেরাজ এভাবে অনুভব করে। এটা নতুন নয়৷ কিয়ৎক্ষন পর বাচ্চার নড়াচড়া আবার থেমে গেল। জ্যোতি হাসল। বলল,
” জানেন?আমি চাই না ও আমার কিংবা আপনার মতো গম্ভীর হোক। আমি চাই ও মিথির মতো চঞ্চল হোক। মিথি যখন ছোটবেলায় হঠাৎই অসুস্থ হয়ে গেল? চলে গেল আমায় ছেড়ে?আমার সে মুহুর্তটা মনে পড়লে আজও কান্না আসে। আমি চাই ওর মাধ্যমেই মিথি ফিরে আসুক আমার কাছে৷ সেই ছোট্ট মিথি। আমার মিথি! ”
মেহেরাজ ঠোঁট চওড়া করে হাসল।ভরাট গলায় বলল,
” খুব শীঘ্রই আসবে। ”
জ্যোতিও এবারে হাসল। মেহেরাজের হাত আঁকড়ে ধরে বলতে লাগল,
” মেহেরাজ ভাই..”
বাকিটুকু বলা হলো না। মেহেরাজ দৃঢ় কন্ঠে রাগ দেখিয়ে বলে উঠল,
” হুশশ!ভাই? কিসের ভাই?তোর ভাই হই আমি?তুই তো সাংঘাতিক মহিলা জ্যোতি। এসব ভাইটাই বলে আমাকে কি আমার বাচ্চারই মামা বানানোর প্ল্যান করে রেখেছিস?”
” এভাবে তাকাবি না৷ আমার বাচ্চার আম্মু হওয়ার দাবি করে আমার সরল মনে জায়গা করে কতকিছু করে ফেললি আমার সাথে৷ শেষমেষ আমার বাচ্চার আম্মুও হয়ে বসে আছিস৷ আর এখনও আমায় ভাই বলিস?খবরদ্দার!আমার বাচ্চার সামনে আমাকে ভাই-টাই ডাকলে সোজা আঁছাড় মারব দোতালা থেকে।”
কথাটা বলেই জ্যোতিকে নিজের দিকে ঘুরাল। ঝুঁকে গিয়ে জ্যোতির পেটে পরপর কয়েকটা চুমু দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,
” শোনো প্রিন্সেস, তোমার আম্মুকে কখনো বলা হয়নি। তবে তোমায় বলছি, তোমার বাবা তোমায় অনেকটা ভালোবাসে।এতটুকু ভালোবাসা তোমার আম্মুকেও বাসে না। তোমার আম্মুর ভাগে কেবল এক মুঠো প্রণয়ই আছে। বাকিটুকু সব তোমার। ”
#সমাপ্ত
[ বিদায়! ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।শেষটুকুতে কেন জানি আমারই তৃপ্তি হলো না। জানি না আপনারা কেমর তৃপ্তি পাবেন। ]
মেহেরাজ মেহুর সাথে কথা বলার জন্যই পা বাড়িয়ে বাইরে গেল। জ্যোতি সেদিক পানে তাকিয়েই ছোট শ্বাস টানল। কফির মগে মেহেরাজের জন্য কফিটুকু ঢেলে নিয়ে মৃদু পায়ে পা বাড়াল। মেহেরাজ রুমে আছে এমনটা ভেবে নিয়েই রুমে গেল। কিন্তু রুমে দেখতে পেল না। ভ্রু জোড়া কুঁচকে আয়নায় নিজেকে শাড়িতে একনজর চাইল।খুব নজরকাড়া সুন্দরী না লাগলেও স্নিগ্ধ লাগছে তাকে।ঘরোয়া বধূ বধূ অনুভব হচ্ছে নিজের প্রতি। দুয়েকবার নিজের দিকে তাকাতেই পর পরই চোখ গেল টেবিলের উপর পড়ে থাকা লাল গোলাপ গুচ্ছের দিকে। অবাক হয়ে সেদিকে গিয়ে গোলাপ গুলো ছুঁয়ে দেখার জন্য হাত বাড়াতেই মেহেরাজ ছিনিয়ে নিল তা। কপাল কুঁচকে বলল,
” কি আশ্চর্য! বাচ্চা নাকি তুই? অন্যের জিনিসে অনুমতি না নিয়ে হাত দিচ্ছিস কেন?”
মেহেরাজ ত্যাড়া চাহনীতে তাকাল। খোঁচা মেরে বলে উঠল সঙ্গে সঙ্গে,
” অন্যকারোর জিনিস দেখবিই বা কেন? এগুলো কি তোর জন্য এনেছি? ”
জ্যোতি মৃদু আওয়াজে জিজ্ঞেস করল,
” সামান্তা আপুর জন্য এনেছেন ? ”
কথাটা অন্যমনস্ক হয়ে বলে ফেলেই ইতস্থত বোধ করল জ্যোতি। অন্যের ব্যাক্তিগত বিষয়বস্তু নিয়ে আগ্রহ দেখানো বোধ হয় অপর ব্যাক্তিটা পছন্দ নাও করতে পারে। এভাবে প্রশ্ন ছোড়াটাও বোধহয় উচিত হয়নি ভেবে নিয়েই বলে উঠল,
” এভাবে বলতে চাইনি আসলে। দুঃখিত। সামান্তা আপুর জন্য আপনি ফুল আনতেই পারেন।উনার জন্য আনা ফুলগুলো হাত বাড়িয়ে দেখতে যাওয়ার জন্যও দুঃখিত। অন্যের জন্য রাখা জিনিসে হাত দেওয়া উচিত নয়। দাদী শিখিয়েছেন আমায়। ”
মেহেরাজ ঠোঁট গোল করে শ্বাস ফেলল। গম্ভীর স্বরে শুধাল,
” এটাকে কাছে আসা বলে? কাছে আয়।”
জ্যোতি আর এক পাও এগিয়ে গেল না। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানটাতেই দাঁড়িয়ে রইল৷ ছোট ছোট চোখ করে চেয়ে থাকল মেহেরাজের দিকে। মেহেরাজ সে দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়েই ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” আমি কাছে টেনে আনব? ”
কথাটুকু মুখ দিয়ে জিজ্ঞেস করে অনুমতি চাইলেও অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না মেহেরাজ। জ্যোতির নরম হাতটায় এক টান দিয়ে নিজের সম্মুখে একদম কাছে দাঁড় করাল। গোলাপ গুচ্ছ থেকে একটা লাল টকটকে গোলাপ হাতে নিয়ে অন্য হাতে জ্যোতির খোঁপা বাঁধা চুল মুহুর্তেই ছাড়িয়ে দিল। খোলা চুলগুলো এলোমেলো করে পিঠে পড়তেই চমৎকার হাসল মেহেরাজ। দুয়েক নজর মোহনীয় নজরে তাকিয়ে সাবধানে একটা গোলাপ গুঁজে দিল জ্যোতির কানের পেছনে।শুধাল,
” ফুলগুলো মেহেরাজের অর্ধাঙ্গিনী, এক এবং একমাত্র স্ত্রী আর সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা শাড়ি পরিহিত স্নিগ্ধময়ী রমণীকেই প্রদান করলাম। গ্রহণ করুন মিসেস জ্যোতি। আপাতত শুদ্ধতম সূচনার প্রথম সাক্ষী হোক এই লাল গোলাপই।”
কথাগুলো বলেই ঠোঁট টিপে দুষ্টুমি মাখা হাসি হাসল মেহেরাজ।আরো একবার গভীর চুম্বন আঁকল জ্যোতির কপালে।পরমুহুর্তেই মুখ সরিয়ে জ্যোতির দিকে একটু ঝুঁকে ঠোঁট গোল করে ফু দিল তার মুখে। মুহুর্তেই জ্যোতির কপালে পড়া ছোট ছোট চুলগুলো নড়ে উঠল। জ্যোতি জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজাল। আকস্মিক জিজ্ঞেস করল,
” ফুলগুলো সামান্তা আপুর জন্যই যদি আনেন তাহলে আমায় দেওয়ার মানে কি মেহেরাজ ভাই?হাত বাড়িয়ে দেখছিলামই জাস্ট। নিয়ে নেওয়ার ইচ্ছা ছিল না আমার। ”
মেহেরাজ দাঁতে দাঁত চাপল।তীক্ষ্ণ চাহনী ফেলে বলল,
” সুন্দর মন চটিয়ে দিবি না এই মুহুর্তে।তুই আস্ত একটা বোকা জ্যোতি।তোকে আমি এতোটাও বুদ্ধিহীন ভাবতাম না। ”
জ্যোতি সহসা প্রশ্ন ছুড়ল,
” কেন?”
মেহেরাজ হতাশ হলো। ইচ্ছে হলে সম্মুখে থাকা মেয়েটাকে এক চড় দিয়ে সব দাঁত ফেলে দিতে। এ বাসায় সে ব্যাতীত অন্য কোন মেয়ে আছে? তাহলে এই বাসায় আর কার জন্য আনবে ফুল? এইটুকু বোঝারও ক্ষমতা নেই? গর্দভ একটা! সামান্তা থাকে দূর শহরে। দূর শহরের সামান্তার জন্য এই সতেজ ফুল কিনে সে কি বাসি ফুল নিযে যাবে? দাঁতে দাঁত চেপে পুনরায় শুধাল,
” এই বাসায় আমি আর তুই ব্যাতীত কেউ আছে? সামান্তা আছে এখানে? সামান্তাকে অন্য শহরে গিয়ে ফুল না কিনে দিয়ে এখান থেকে বাসি,পঁচা ফুল নিয়ে যাব আমি? কি পরিমাণ গর্দভ তুই! ”
জ্যোতি শুকনো ঢোক গিলল।ফুলগুলো তার জন্য? সত্যিই তার জন্য? মন মস্তিষ্কে ঝংকার উঠল। এক পলকে মেহেরাজের দিকে তাকিয়েই থাকতে মেহেরাজ তার হাতে হাত রাখল।দৃঢ়ভাবে কোমল হাতজোড়া আঁকড়ে ধরে শান্ত, শীতল গলায় শুধাল,
জ্যোতি অবাক হলো। এই প্রশ্নে বিনিময়ে কি উত্তর দেবে?কতটুকু ভালোবাসে সে? জ্যোতি উত্তর দিল না। চুপ হয়ে বসে থাকতেই মেহেরাজ হাত নাড়াল। পুনরায় শান্ত গলায় শুধাল,
জ্যোতি এবারেও কোন উত্তর দিল না। মেহেরাজ শ্বাস টানল এবারে।কোমল হাতজোড়া আরেকটু দৃঢ়ভাবে নিজের হাতে মুঠোয় নিয়ে বলল,
” ওকে, ফাইন। বলতে হবে না। আমি জানি সবটুকু। এবার তোর জানার সময় সবটুকু। ”
জ্যোতি এতক্ষনে ঠোঁট নাড়াল। শুধাল,
” মানে? ”
মেহেরাজ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল কেবল। ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠল,
” প্রথমে সামান্তার বিষয়টা বলি? সামান্তার বর্তমানে একজন প্রেমিক আছে জ্যোতি। আমার জীবনে প্রথম নারী সে। এমনটা নয় যে আমার মন থেকে তার সবকিছুই মুঁছে গেছে।আমি আজও তাকে আমার জীবনের প্রথম নারী বলেই সম্বোধন করি। তবে এমনটাও নয় যে আমি তার মাঝেই আটকে আছি। তাকে ভালোবেসেছিলাম বলেই হয়তো পুরোপুরি মুঁছে ফেলিনি আমি। আমি তাকে সম্পর্ক থাকাকালীন যতটুকু সম্মান দিয়েছি এখনও ততটুকুই সম্মান দিই। সামান্তা সবসময়ই ছিল অনেকটা ইমম্যাচিউরড। অনেকটা তোর বিপরীত চরিত্র ওর। এই কারণেই মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়েছে। ওকে ওর মামার বাসায় পাঠানোর পরও পাগলামো কমল না। বাসায় ফিরে ফের একই পাগলামীই করছিল ও। এদিক আমার দ্বারাও সম্ভব ছিল না তার সাথে দ্বিতীয়বার জড়ানো। বলা যায়, পরকিয়ায় জড়ানো। ঘরে স্ত্রী রেখে অন্য একজনের সাথে সম্পর্ক চালিয়ে যাব কাপুরুষের মতো তেমন সাহস কিংবা রুচি কোনটাই আমার ছিল না। তুই বাসা ছেড়ে চট্টগ্রাম আসার পূর্বে ছাদে আমাকে আর সামান্তাকে যখন হাত ছুঁয়ে কথা বলতে দেখেছিস সেটাতে সত্যিই কোন প্রেমের ইঙ্গিত ছিল না।ততদিনে তার প্রতি আমার প্রেমের ইতি ঘটেছে। মনের কোণে অজান্তেই নতুন এক অদৃশ্য অনুভূতি জম্ম নিচ্ছিল।সেদিন আমি শুধু ওকে বাস্তবটা বুঝাতে চেয়েছিলাম, বুঝাতে চেয়েছিলাম ও যেভাবে আবার ফিরে আসতে চাইছে তা সম্ভব নয়। কোনভাবেই সম্ভব নয়। এটা শুধু সেদিনই নয়, আমি বহুবার ওকে তোদের আড়ালে বুঝিয়েছি। তাই বলে ভেবে নিবি না আমি তার সাথে প্রেম বিনিময় করেছি তোদের আড়ালে।”
জ্যোতি ফিরে চাইল।মনে পড়ল সেই দৃশ্য। আজও সেই দৃশ্য তার মনে আছে। খুব ভালো করেই মনে আছে। শুধাল,
” আপ্ আপনি জানলেন কি করে মেহেরাজ ভাই? আমি তো সেদিন নিশব্দেই ছাদ ছেড়ে নেমে এসেছিলাম। ”
মেহেরাজ বাঁকা হাসল। পা বাড়িয়ে রুমে গিয়ে ফের ফিরে এল একটা ডায়েরী নিয়ে। জ্যোতির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে উঠল গম্ভীর স্বরে,
” পুরো ডায়েরী জুড়ে তো আমার দায়িত্ব নিয়েই লিখে গিয়েছিস। জীবনে প্রেম-ভালোবাসা সম্বন্ধে কিছু জেনেছিস? নাকি বুঝেছিস? গর্দভ!আবার প্রথম ডায়েরীতে কিশোরী বয়সের সকল আবেগ অনুভূতি ঢেলে দিয়েছিল। কিছু না বুঝে, না জেনেই কিশোরী বয়সেই ভালোবেসে ফেলল নাকি আমায়! ”
জ্যোতি উত্তর দিল না। থম মেরে বসে থাকল। মেহেরাজ ফের গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠল,
” বলেছিলাম না ভালোবাসা মানে জ্বলন্ত অগ্নিতে দগ্ধ হওয়া। আমাদের কাছে আলোর ফুলকিটা যতটুকু ভালো লাগা, আগুনের শিখায় পুড়ে দগ্ধ হওয়াটাও ঠিক ততটুকুই যাতনার, কষ্টের। আর সে কষ্টটুকুকেই বলা হয় ভালোবাসা জ্যোতি। ভালোবাসলে অপরজনের সুখ ভাগ করার আগে আমরা কষ্ট ভাগ করে নিতে চাই। কষ্ট লোপের সমগ্র চেষ্টা চালিয়ে যাই।সদা সর্বদা আমরা তাকে উজ্জ্বল আলোর ফুলকির ন্যায় দেখতে চাই হাস্যোজ্জ্বল!তোর কিশোরী বয়সের সে ডায়েরী পড়ে আমি সমগ্রটুকুই তখন ধরে নিয়েছিলাম তোর আবেগ। তোর কিশোরী বয়সের নড়বড়ে অনুভূতি ভেবেছিলাম। তাই পরীক্ষা করছিলাম, আসলেই ভালোবাসা কিনা। কারণ মস্তিষ্ক এগুলোকে আবেগ বলে ধরে নিলেও তোর এই সুন্দর সুমধুর অনুভূতি গুলোতে আমার মন কোনভাবেই আবেগ হিসেবে ধরে নিতে পারছিল না। আর মন মস্তিষ্কের যুদ্ধে আমি এক অদ্ভুত কাজ করলাম। তোর লেখাগুলোকে আমি আগুনে দগ্ধ হওয়া আর আগুনের ফুলকির উজ্জ্বলতার সাথে তুলনা করেই পুকুর পাড়ে একটা কাঁচের টুকরোতে হাঁটার শাস্তি দিলাম ভালোবাসা প্রমাণের স্বার্থে। আশ্চর্যজনক ভাবে তুই আগুনে দগ্ধ হওয়াটা বেঁছে নিলি। বেঁছে নিলি রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত হওয়া পরিস্থিতি। ভেবেছিলাম শেষ মুহুর্তে হলেও তুই মত বদলাবি। ক্ষতবিক্ষত তীক্ষ্ণ ব্যাথা ছেড়ে ফুঁফিয়ে কেঁদে বলে উঠবি, আমাকে নিয়ে লেখা সবকিছুই তোর মাথার ঝোঁক।অথচ তুই তেমন কিছুই করলি না। তোর এই ডায়েরীতে এর জন্য আমার উপর তীব্র ঘৃণাও পোষণ করেছিস। আমি তাতে অসন্তুষ্ট নই। ঘৃণা করাই যায়। তবে এটুকু শুধুমাত্র তোর নিজের স্বার্থেই করেছিলাম আমি। বুঝাতে চেয়েছিলাম ভালোবাসা কি। ভেবেছিলাম ভালোবাসা কি তা বুঝতে পেরেই তুই ঝরে পরবি এই ভালোবাসা থেকে। কিন্তু ঐটুকু বয়সেও তুই দৃঢ় থাকলি জ্যোতি।”
জ্যোতি হাসল। বলল,
” আমি অতো সহজে কোনকিছু থেকে ঝরে পরতে পারি না মেহেরাজ ভাই৷ ঝরে গেলে তো আম্মা চলে যাওয়ার পরপরই আব্বার তীব্র অবহেলায় ঝরে যেতাম পৃথিবী থেকে মিথির মতোই। সেসময় যখন অতো কঠিন মুহুর্তেও ঝরে যাইনি, এখনও যে কোন বিষয়ে অতো সহজে ঝরে যাব না।”
মেহেরাজ ত্যাড়া সুরে বলল,
“ঝড়ে যেতে চাইলে পারবি নাকি?অতো সহজ ? ”
জ্যোতি তাকিয়ে বলল,
” কঠিন? ”
” না, তবে অসম্ভব! ”
” কেন? ”
মেহেরাজের দৃঢ় স্বর,
” কারণ আমি মেহেরাজ। আর তুই আমার বিয়ে করা বউ। ”
জ্যোতি ছোট শ্বাস ফেলল।মৃদু আওয়াজ তুলে বলে উঠল,
” বিয়ে করা বউই তো! এর বেশি তো কোন পরিচয় নেই। ”
মেহেরাজ বাঁকা হাসল। ঝুঁকে গিয়ে জ্যোতির দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচাল। কানের কাছ মুখ নিয়েই জ্যোতিকে ভয়ানক লজ্জ্বায় ফেলতে শুধাল,
” এর বেশি কি পরিচয় চাস? আমার বাচ্চাকাচ্চার মা হতে চাস? সুন্দর তো! বিয়ে করা বউ উইথ বাচ্চাকাচ্চার আম্মু।পরিচয়টা সুন্দর না? ”
জ্যোতির কান হঠাৎ উষ্ণ হয়ে উঠল।গাল আরক্ত হলো । সে মোটেই সেভাবে কিছু বোঝায়নি। জানতে চেয়েছিল, বিয়ে করা বউয়ের পাশাপাশি সে কি ভালোবাসার মানুষও হয়ে উঠতে পেরেছে? মেহেরাজ তা শুধাল না। সবটুকু বুঝেও সে জানাল না তার কতখানি ভালোবাসার মনুষ হয়ে উঠেছে জ্যোতি। কারণ সে মুখে বলা কথিত ভালোবাসায় বিশ্বাসী না। সে বিশ্বাসী ভালোবাসার উপস্থিতি জানান দেওয়াতে। যত্ন,আগলে নেওয়া ইত্যাদির মাঝে বুঝিয়ে তুলতে যে সে কতখানি ভালোবাসে। তাই এড়িয়ে গিয়ে সে কথাটা বলল না।বরং ভয়ানক, সাংঘাতিক কিছু কথা শুনিয়ে মনে মনে আনন্দ লুটল ৷ সম্মুখে জ্যোতির জড়োসড়ো অবস্থা দেখে মুখ চেপে হাসল। ঠোঁট বাঁকিয়ে, চোখ টিপ দিয়ে বলে উঠল,
” মুখে বললেই তো পারতি যে তুই আমার বাচ্চাকাচ্চার আম্মু হতে চাস। আমি কি নিষেধ করতাম? নিঃস্বার্থে, স্বেচ্ছায় তোকে হেল্প করতাম আম্মু হতে। দরকার পড়লে বছর বছরই বাচ্চা… ”
বাকিটুকু বলার আগেই জ্যোতি উঠে দাঁড়াল। কান দিয়ে উষ্ণ ধোঁয়া বের হচ্ছে তার। লজ্জ্বায় অস্বস্তিতে বুকের ভেতর কেমন কেমন যেন করে উঠছে। কথাগুলো ব্যাপক সাংঘাতিক লজ্জ্বার বোধ হলো তার কাছে৷ সত্যিই বোধহয় কথাগুলো সাংঘাতিক লজ্জ্বার!
জ্যোতির পা এখন ঠিক হয়েছে৷ এতগুলো দিন পর নিজের পায়ে হাঁটাচলা করতে পেরে মনে মনে তৃপ্তি ও পেল। এতদিন ভার্সিটিতে যায় নি ভেবেই সিদ্ধান্ত নিল আজ যাবে। সকাল সকাল ঘুম ছেড়ে উঠতেই টের পেল মেহেরাজের বাহুবন্ধন।আলতো হাতে পুরুষালি হাতটা সরাতে নিতেই বন্ধন আরো দৃঢ় হলো। কানে আসল মেহেরাজের ঘুমঘুম জড়ানো স্বর,
” উহ, ঘুমাচ্ছি তো জ্যোতি। ”
জ্যোতির কপাল কুঁচকে নিল। হাত সরালে ঘুমোতে পারবে না এমন তো কোথাও লেখা নেই? হাত সরানোর সঙ্গে ঘুমানোর কি সম্পর্ক। মৃদু আওয়াজে তা বলেও নিল,
” হাত সরালে ঘুমোতে পারবেন না? ”
মেহেরাজ কিছুটা নড়চড় করল। হাত দিয়ে জ্যোতিকে জড়িয়ে রেখেই হঠাৎ মুখ গুঁজল জ্যোতির চুলে। কানের কাছে ভরাট গলায় শুধাল,
” হাত সরানোর বিনিময়ে কয়েকটা চুমু দিতেই পারিস।আমার নিষেধ নেই। কেউ দেখবেও না।আমি চোখ বুঝেই আছি, আমিও দেখব না৷ তুই লোকলজ্জ্বার ভয় না পেয়ে দুয়েকটা চুমু দিতে পারিস জ্যোতি। ”
কথাগুলো এতোটাই গম্ভীর স্বরে শুধাল যেন খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে ফেলল সে। অপর দিকে সে কথাগুলো শুনেই জ্যোতির কৃষ্ণবর্ণীয় মুখে হঠাৎই লাজুকতা এসে ভর করল।আরক্ত হলো মুখ।কান জোড়া উষ্ণ অনুভব হলো মুহুর্তেই। লজ্জ্বায় অস্বস্তিতে জড়োসড়ো হয়েই তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে বসল। মেহেরাজের দিকে আর একনজরও না তাকিয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়াতে নিতেই হাতে টান পড়ল সঙ্গে সঙ্গে। কানে এল জড়ানো গলার স্বর,
” কি বললাম আর কি করছিস? ”
জ্যোতির সারা শরীর এবার কেঁপে উঠল আকস্মিক। লোমকূপ জুড়ে সারা শরীরে শিহরন বইল।সর্বাঙ্গে কেমন শিরশিরে অনুভূতিতে কম্পন উঠল।বুকের ভেতর যেন কেমন কেমন করে উঠল। মেহেরাজ সে সবটাই খেয়াল করল ঘুমুঘুমু চোখে তাকিয়ে। পরমুহুর্তেই হাতটা ছেড়ে দিয়ে নিঃশব্দে ঠোঁট চওড়া করে হাসল। বলল,
” ছেড়ে দিলাম। কিন্তু তুই চাইলেই… ”
মেহেরাজের কথাটুকু শেষ হওয়ার আগেই জ্যোতি অস্বস্তি আর লজ্জ্বারত কন্ঠে কোনভাবে বলল,
” চাই না। ”
তারপর আর সেখানে বসে থাকতে পারল না। দ্রুত পা চালিয়ে ওয়াশরুমে এগিয়ে গেল৷ ঘনঘন শ্বাস ফেলেই মুখচোখে পানি দিল দ্রুত৷ কিয়ৎক্ষন ওয়াশরুমেই থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল কেবল। আর ভাবল একটু আগের সে কথাগুলো। বারংবার যেন কথাগুলো কানে বাঁজল। বারংবার!
.
মেহেরাজ বিছানা ছেড়ে উঠে আলতো পায়ে বোনের রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।জ্যোতির পা ভালো হওয়ার কারণেই মেহু নিজ শহরে গিয়ে ঘুরে আসার সিদ্ধান্ত নিল। মেহেরাজকে কাল রাতে তা জানিয়েছেও। কিয়ৎক্ষন পরই রওনা দিবে। যার কারণে সকাল সকালই ঘুম ছেড়ে উঠেছে মেহু। মেহেরাজ দরজায় টোকা দিল। ভেতর থেকে মেহুর গলা শুনেই ধীর পায়ে এগিয়ে ডুকল৷ মেহুকে হাস্যোজ্জ্বল চাহনীতে তাকাতে দেখেই গলা ঝাড়ল। গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,
” মেহু?তোর সাথে আমার কিছু জরুরী কথা আছে। মনোযোগ দিয়ে শুনবি। হুহ?”
আকস্মিক প্রশ্নে চমকে উঠল মেহু। ভালোবাসে? হ্যাঁ বাসে তো।সাঈদকে। সবটুকু অস্বীকার করলেও সে যে সাঈদকে ভালোবাসে এইটুকু অস্বীকার করার সাধ্য তার নেই।কিন্তু মুখে বলা গেল না তা। ছোট্ট শ্বাস ফেলে উত্তর দিল,
” হঠাৎ এমন প্রশ্ন ভাইয়া? ”
মেহেরাজ শান্ত গলায় শুধাল,
” কাউকে ভালোবাসলে ভাইয়াকে বলতে পারিস।ভাইয়া সর্বপ্রথম তোর পছন্দকেই গুরুত্ব দিবে মেহু৷ বল, ভালোবাসিস কাউকে?”
মেহু তাকিয়ে থাকল। কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে শুধাল,
” না, ভালোবাসলে তোমায় জানাতাম ভাইয়া।”
” সত্যিই?”
মেহু প্রসঙ্গ পাল্টাতেই বলল,
” হ্যাঁ, সত্যিই ভাইয়া।কি যেন বলবে বলছিলে? বলে ফেলো।”
” একটা ঘটনা বলি। মনোযোগ দিয়ে শুনবি হুহ?”
মেহু মাথা নাড়াল। মেহেরাজ অল্প হেসে গম্ভীর স্বরে বলতে লাগল,
” একটা কমবয়সী ছেলে আরো প্রায় বছর পাঁচেক আগে আমায় জানিয়েছিল সে আমার বোনকে ভালোবাসে। সে আমার বোনকে পছন্দ করে। বলতে গেলে আমার আর সে ছেলেটার বয়সের পার্থক্য খুব একটা ছিল না।হয়তো দুয়েকবছরের পার্থক্য।ছেলে হিসেবেও মন্দ ছিল না। পেশা, শিক্ষা, সৌন্দর্য সবই ছিল সন্তোষজনক। তবুও আমি তার সামনে বড়দের মতো গম্ভীরস্বরে বলেছিলাম, সে যদি চায় প্রেমে না এগিয়ে আমার বোনের জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে পারে। আজকাল প্রেম আর টেকে কত? সে যেন একা প্রস্তাব না রেখে তার পরিবার সমেত প্রস্তাব আনে। ছেলেটা তার মা বাবাকেও দূর শহরে নিয়ে এসেছিল সে পাঁচবছর আগে। তাও আমার বোনের জন্য প্রস্তাব রাখতে। শেষমুহুর্তে আমিই না করে দিয়েছিলাম প্রস্তাবটা। কারণ নিজের বোনকে অতোটা তাড়াতাড়ি নিজের থেকে আলাদা করতে চাইনি আমি।কতই বা বয়স ছিল তখন আমার বোনের?”
মেহু সবটাই শুনল মনোযোগ দিয়ে।ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলল,
” তারপর? ”
মেহেরাজ আবারও শান্ত গলায় বলল,
” ছেলেটার সাথে আমার এর পরেও বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎই নিখোঁজ হয়ে গেল ছেলেটা। তবে আজ এতগুলো দিন পর আমি সত্যিই ভাবিনি ছেলেটা আবারও একই প্রস্তাব নিয়ে হাজির হবে। ”
মেহুর এবারে বাকি কথা বুঝতে দেরি হলো না। মৃদু আওয়াজে শুধাল,
” বিয়ের প্রস্তাব ? ”
মেহেরাজ হাসল এবারে। ঠোঁট চওড়া করে নরম গলায় বলল,
“হ্যাঁ মেহু। ভাই হিসেবে এটুকু বলব, যে ছেলেটা একপাক্ষিক ভাবে এতগুলো বছর একটা মেয়েকে ভালোবাসতে পারে সে নিশ্চয় আমার বোনকে অল্পস্বল্প ভালোবাসে না? অনেকটুকু ভালোবাসে। তাই না?যদি অনেকটুকু ভালো না বাসত তবে সে একপাক্ষিকভাবে এতগুলো দিন অনুভূতি পুষে রাখত না।আর আমার দৃঢ় বিশ্বাস সে ছেলেটা আমার বোনকে সবসময় সুখে রাখবে।সবথেকে বেশি সুখে রাখবে।সবসময় ভালো রাখবে।একদম জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অব্দি নিজের সবটুকু দিয়ে আগলে রাখবে।ছেলেটার চোখে সে পরিমাণ ভালোবাসা দেখেছি আমি। ভাই হিসেবে বোনের জন্য আমি নিশ্চয় এমনই একটা ছেলে চাইব যে আমার বোনকে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অব্দি ভালো রাখবে, ভালোবাসবে। তাই না মেহু?বাকিটা তোর ইচ্ছে। যদি তুই রাজি হোস, তবেই হ্যাঁ বলব। নয়তো না। ”
মেহুর আগ্রহ জাগল৷ছেলেটা কে হতে পারে তা নিয়ে ভাবলও গভীরভাবে। কিন্তু উত্তর পেল না। কিশেরী বয়স থেকেই বহুবার বহু ছেলের কাছ থেকে প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছে সে। তাদের মধ্যে কোন ছেলেটা এতগুলো দিন তাকে ভালোবাসে বুঝে উঠল না সে। প্রশ্ন করল,
” ছেলেটা কে ভাইয়া? ”
মেহেরাজ চমৎকার হেসে উত্তর দিল,
” ছেলেটা তোর পূর্ব পরিচিত।আমি চাই না তুই তাড়াহুড়ো করে কোন সিদ্ধান্ত নে। বা তাড়াহুড়ো করে তোর জীবনের কোনকিছু সম্পন্ন হোক। জোর ও করছি না। তুই ভেবে দেখতে পারিস বিষয়টা। ভেবে যদি হ্যাঁ মনে হয় আমাকে জানাবি। আমি সাক্ষাৎ এর ব্যবস্থা করে দেব ছেলেটার সাথে। তবে কেন জানি না আমার ছেলেটাকে বেশ পছন্দ হয়েছে মেহু।আমি জানি, তোরও পছন্দ হবে।”
কথাটুকু বলেই মেহেরাজ উঠে দাঁড়াল। বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসবে এই উদ্দেশ্যে আলতো হেসে বের হয়ে গেল রুম ছেড়ে।যেতে যেতে বাসার দরজা লাগানোর কথাও বলে গেল। মেহু আনমনে সেদিক পানে তাকিয়েই ভাবতে লাগল, আসলেই কি ছেলেটাকে পছন্দ হবে?যে মনের পছন্দ, ভালো লাগা, ভালোবাসা একজনের নামে ইতোমধ্যেই বিলিয়ে দিয়েছে সে মনে দ্বিতীয় পুরুষের ঠাঁই হবে ? আসলেই কি সাঈদ ব্যাতীত দ্বিতীয় কোন পুরুষের সাথে সে মানিয়ে নিতে পারবে? দ্বিতীয় কোন পুরুষকে ভালোবাসতে পারবে কি?পরমুহুর্তেই মনে পড়ল সামান্তা আর তার ভাইয়ার পুরাতন সম্পর্কের কথা৷ সামান্তা আর তার ভাই যদি এক মনে দ্বিতীয় মানুষকে জায়গা দিতে পারে সে কেন পারবে না? অবশ্যই পারবে। পৃথিবীতে অসম্ভব কিছুই নেই। সব কিছুই চাইলেই সম্ভব। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল জল। সে চায় না তার মনে দ্বিতীয় কারো বাস হোক, কিন্তু প্রথম জনের দিকে হাত বাড়ানোরও যে সাহস নেই। যার প্রতি একপাক্ষিক অনুভূতি পুষে এতগুলো দিন এতোটা কষ্ট পেল তার সাথে জড়ালে আরো কতোটা দগ্ধ হতে হবে তাকে কে জানে। সে কি এই দহন সহ্য করতে পারবে? অতোটুকু সহ্যক্ষমতা কি আছে তার?
.
জ্যোতি গোসল সেরে বের হলো কিয়ৎক্ষন পর।পরনে একটা গাঢ় সবুজ রংয়ের গোল জামা আর পায়জামা।গলায় ওড়না পেঁছানো থাকলেও অন্যদিনের মতো মাথায় ঘোমটা দেওয়া নেই। পা এগিয়ে তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুলগুলো মুঁছড়ে নিয়ে মুঁছেই ঝাড়া মারল। রুমে একবার দৃষ্টি ঘুরাল। সারা রুমে তাকিয়ে কোথাও মেহেরাজকে দেখা গেল না। তারপর দু পা বাড়িয়ে বেলকনিতে গিয়ে দড়িতে ঝুলিয়ে রাখল তোয়ালেটা।কিয়ৎক্ষন সেখানে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকল। ফের রুমে ফিরে আসতেই চোখে পড়ল বিছানায় বসে থাকা মেহেরাজকে। বুকে হাত গুঁজে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। জ্যোতি ভ্রু কুঁচকাল। বিনিময়ে মেহেরাজ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। উঠে দাঁড়িয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠল,
” তুই চুমু দিসনি ভালো, এখন আমি চুমু দিয়ে দিলে ক্ষতি হবে না নিশ্চয়?”
জ্যোতি কপাল কুঁচকাল। অস্ফুট স্বরে বলল,
” জ্ জ্বী?”
” কানে না শোনার নাটক করলে দ্বিগুণ চুমু প্রাপ্য। অধিকার আছে কিন্তু আমার। ”
” বলবি তোর দ্বিগুণ চুমুই চাই।স্ত্রী হিসেবে স্বামীর চুম্বনে তোর অধিকার আছে না? ”
আকস্মিক বলা কথাগুলো কানের সামনে বাঁজতেই জ্যোতি ঠোঁটে ঠোঁট চাপল।ভয়ানক অস্বস্তি থেকে নিজেকে স্বাভাবিক করে স্পষ্ট স্বরে বলে উঠল,
” অধিকারের বশে স্বামীর চুম্বন তো সকল স্ত্রীই পেতে পারে মেহেরাজ ভাই। অধিকারের বশে সকল স্বামীও সকল স্ত্রীকে চুম্বন দিতে পারে। কিন্তু অধিকার দিয়ে কি আসলে পরিপূর্ণতা আসে শেষ পর্যন্ত ? আসে না।”
মেহেরাজ মাথা উঁচু করে চমৎকার হাসল। হাত বাড়িয়ে হঠাৎ আঁকড়ে ধরল জ্যোতির কোমড়। এক টানে সবটুকু দূরত্ব গুঁছিয়ে নিজের সম্মুখে এনে দাঁড় করাল জ্যোতিকে।ঝুঁকে গিয়ে জ্যোতির কপালে নিজের উষ্ণ ঠোঁটজোড়ার ছোঁয়া দিয়ে বলতে লাগল,
কথাটার অর্থ অজানা নয় জ্যোতির কাছে। তাই অর্থটা বুঝতে দেরিও হলো না। মুহুর্তেই বুকের ভেতর অদ্ভুত রকমের অস্থিরতা টের পেল।লজ্জ্বায় লালাভ রংয়ে আরক্ত হয়ে উঠল তার কৃষ্ণবর্ণীয় মুখ। কানজোড়া উষ্ণ থেকেও উষ্ণ অনুভব হলো। বাক্যটা বলার সময় প্রতিটা শব্দে শব্দে তার কপালে বারংবার যখন মেহেরাজের ঠোঁট ছুঁয়ে গেল বুকের ভেতর তখন বারংবার যেন ঝড় উঠল। পরপরই মেহেরাজ একটা গভীর চুম্বন আঁকল কপালে।সে চুম্বনই যেন মুহুর্তে বুকের ভেতরের সে ঝড় থামিয়ে শীতল করে দিল সর্বাঙ্গ, সর্বত্র। কিয়ৎক্ষন সেভাবেই থেকে পরমুহুর্তেই মেহেরাজ ঠোঁট নামিয়ে ডান গালের লালচে ব্রনের উপরাংশে ঠোঁট ছোঁয়াল। ঘোর লাগা কন্ঠে বলল,
“চুম্বন আঁকছি তোর গালে..”
পরপরই আবারও গভীর চুম্বন দিল ডান গালে। জ্যোতির সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল।বুকের ভেতরের হৃদস্পন্দন দ্রুততর ভাবে বাড়ল যেন। নিঃশ্বাসের গতিও ঘন হলো। সেই গতিটা ঘন থেকে ঘনতর করতেই মেহেরাজ ঠোঁট নামিয়ে নিজের ঠোঁট স্থির রাখল জ্যোতির ঠোঁটে।নেশাক্ত জড়ানো গলায় শুধাল,
” সর্বশেষ ঠোঁটে চুম্বন দিলাম। ”
কথাটুকু বলতে দেরি হলেও মেহেরাজের ঠোঁটজোড়া জ্যোতির কোমল ঠোঁটজোড়া আঁকড়ে ধরতে দেরি করল না।আকস্মিক এহেন কান্ডে জ্যোতির কি প্রতিক্রিয়া করা উচিত বুঝে উঠল না সে। শুধু টের পেল সম্মুখ পুরুষের মাতাল করা উষ্ণ আবেশ আর উম্মাদময় পুরুষালি অধরের স্পর্শ। টের পেল কোমড়ে শক্ত করে খিঁচে ধরা বলিষ্ঠ হাতের বন্ধন। মুহুর্তেই চোখ বুঝে এল। শ্বাস বন্ধ হয়ে এল। অবশেষে কিয়ৎক্ষন পর শ্বাসরুদ্ধকর সে চুম্বনের স্থায়িত্বের অবসান ঘটল। জ্যোতি আর দাঁড়াতে পারল না। জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতেই দ্রুত প্রস্থান করল সে স্থান ছেড়ে। বুকের ভেতর ভয়ঙ্কর অস্থিরতা ততক্ষনে তান্ডব আরম্ভ করেছে। একছুটে গিয়ে পৌঁছাল মেহুর ঘরে।
.
মেহু আজ সন্ধ্যায় এসে পৌঁছাল নিজ বাসায়। সামান্তার সাথে কিছুক্ষন আড্ডা দিয়েই বের হয়েছিল বান্ধবীদের সঙ্গে দেখা করতে। বহুদিন বান্ধবীদের সঙ্গে একসাথে ঘোরা হয়নি। অবশেষে বান্ধবীদের সাথে রেস্টুরেন্টে যেতে হলো। কোনার দিকে একটা টেবিলে সবাই মিলে বসতেই কয়েক টেবিল পর চোখে পড়ল সুদর্শন সাঈদকে। কালো রংয়ের শার্ট পরনে। দেখতে মারাত্মক সুদর্শন বোধ হলেও পরমুহর্তেই মেহুর মুখটা কালো হয়ে গেল। দৃশ্যমান হলো সাঈদের হাত জড়িয়ে বসে এক আধুনিক, সুন্দরী রমণীকে। রমণীর পরনে ও কালো রংয়ের লেডিস শার্ট আর জিন্স। মেহুর চিনতে দেরি হলো না। মেয়েটাকে সাঈদের সাথে ছবিতে দেখেছে। সাঈদের সোশ্যাল সাইটে বাইরের কোন এক দেশে তোলা ছবিতেই দেখেছিল। মেহুর চোখ টলমল করল মুহুর্তেই।বান্ধবীদের বুঝাল তার বের হওয়াটা জরুরী। অবশেষে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠে দাঁড়াল। পা বাড়িয়ে সাঈদদের টেবিল অতিক্রম করতেই কানে এল মেয়েলি কন্ঠে বলা কথাগুলো,
” ভার্সিটি লাইফে তোমার আর আমার ফিজিক্যাল রিলেশনও ছিল সাঈদ। তুমি ভুলতে পারো না সেসব৷ তুমি আমায় ঠকাচ্ছো সাঈদ বেইবি।”
মেহুর পা থমকে গেল৷ আকস্মিক বলা কথাগুলোতে বুক কেঁপে উঠল তার। কান্নারা এবার দম মানল না। মুহুর্তেই ঝরে পড়ল গাল বেয়ে। পাশ ফিরে সাঈদের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল সাঈদের শক্ত চোয়াল আর রাগান্বিত চাহনী। মেয়েটার হাত ছাড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই চোখে পড়ল মেহুর অশ্রুমিশ্রিত চাহনী। সাঈদ দ্বিতীয়বার মেহুর চোখের দিকে তাকাল না। অন্যপাশে তাকিয়ে উঠে গিয়ে মেহুর সম্মুখীন হয়ে দাঁড়াল।বলল,
” মেহু? কাঁদছো কেন? ”
মেহু সে প্রশ্নের উত্তর দিল না।স্পষ্ট স্বরে বলে উঠল,
” একটুও না। আজকের পর থেকে আমার মধ্যে আপনার জন্য কোন অনুভূতি থাকবে না। কোন অনুভূতিই না। ”
সাঈদ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। বলল,
” দেখা যাক তবে। ”
মেহু তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। বলল,
” দেখবেন, খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করবেন তা। আমি কোন চরিত্রহীন লোককে ভালোবাসতে পারি না। আপনি সত্যিই চরিত্রহীন, প্লে বয়, মেয়েদের শরীরে আসক্ত পুরুষ। আমার আপনাকে চাই না।”
কথাগুলো বলেই দ্রুত বেরিয়ে গেল মেহু। অশ্রুতে চোখজোড়া ভিজে লাল রক্তিম হয়ে উঠেছে। এই অল্পক্ষনেই কেমন বিধ্বস্ত রূপ ধারণ করল তার চোখ মুখ।
# চলবে…
#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_৩৪
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ
চুলায় তরকারির কড়াই। জ্যোতি মনোযোগ দিয়ে সেদিক পানেই খেয়াল করল।বাসায় মেহু, মেহেরাজ কেউ না থাকাতে রাতের রান্নাটা সেই করার সিদ্ধান্ত নিল। হঠাৎই কলিং বেল বাঁজায় কান সচেতন হলো৷ তিন চারবার বাঁজতেই দ্রুত পায়ে এগিয়ে দরজা খুলতেই মেহেরাজকে দেখতে পেল। মেহেরাজের মুখে প্রথম দফায় হাসির রেশ দেখা গেলেও পরের দফায় হঠাৎই মুখটা গম্ভীর দেখাল।জ্যোতি একনজর চাইল। সকালের চুম্বনের কথা মনে উঠতেই দ্রুত পা সরিয়ে প্রস্থানের জন্য প্রস্তুতি নিল। ঠিক তখনই মেহেরাজ বাসায় ডুকে দরজা লাগাল। চাপা স্বরে বলল,
” এভাবে আর দরজা খুলতে আসবি না। মাথায় থাকবে? ”
জ্যোতি বুঝল না কথার অর্থ। পেছন ফিরে ভ্রু কুঁচকে নিতেই মেহেরাজ তাকাল। আবার বলল,
” যদি আমার জায়গায় অন্য কোন পুরুষ থাকত? এভাবে আসবি না দরজা খুলতে। ”
জ্যোতি এবারেও বুঝল না। প্রশ্নটা ছুড়েই দিল এবারে,
” কিভাবে এসেছি? ”
মেহেরাজ থমথমে স্বরে উত্তর দিল,
” কিভাবে এসেছিস জানিস না? ”
জ্যোতি স্পষ্ট স্বরে বলে উঠল,
” না বললে বুঝব কি করে? ”
মেহেরাজ এবারে গলা ঝাড়ল হালকা। শাসানি সুরে বলল,
” ওড়না কোথায় তোর?”
আকস্মিক প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেল জ্যোতি। নিজের দিকে তাকিয়েই বুঝতে বাকি রইল না যে তার বুকে ওড়না নেই। রান্নাঘরে কাজের ফাঁকে গরম লাগছিল বলই একপাশে খুলে রেখেছিল। কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে এতোটা তাড়াহুড়োয় ছুটে এসেছে যে খেয়ালই করা হয় নি গায়ে ওড়না না থাকার বিষয়টা। মুখ কালো করল জ্যোতি।অস্বস্তিতে হাত পায়ের তালু ঘেমে উঠল। এভাবে ওড়না হীন সম্মুখ পুরুষটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে ভাবতেই দ্রুত পা বাড়িয়ে গিয়ে থামল রান্নাঘরে। একপাশে রাখা ওড়নাটা তাড়াতাড়ি বুকে জড়িয়ে মাথায় ঘোমটা টানল৷ আর একবারও মেহেরাজের সামনে না গিয়ে ওখানেই ঠাঁই বসে রইল। ছিঃছিঃ! কি লজ্জ্বাকর পরিস্থিতি।মেহেরাজ কি এটা জ্যোতির ইচ্ছাকৃত কাজকর্ম ভাবছে? কথাটা ভাবতেই চোখ বুঝে নিল জ্যোতি।অনেকক্ষন সেভাবেই বসে বারকয়েক শ্বাস টানল৷ নিজেকে স্বাভাবিক করে চুলায় ভাত বসাল মুহুর্তে।রান্নাঘরে আরে গোছগাছ সহ টুকটাক কাজে ব্যস্ত হলো। তার কিছুক্ষন পরই বুক টানটান করে টাউজারের পকেটে হাত গুঁটিয়ে হাজির হলো মেহেরাজ। কিঞ্চিৎ গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,
” কি আশ্চর্য! তুই কি আজ সারারাত রান্নাঘরেই কাঁটিয়ে দিবি নাকি জ্যোতি? ”
জ্যোতির অস্বস্তি আবার বাড়ল। অস্ফুট স্বরে উত্তর এল,
” হ্ হু?”
মেহেরাজের মেজাজ কিঞ্চিৎ চটে গেল। এতক্ষন যাবৎ রুমে বসে থেকেএ জ্যোতির উপস্থিতি না পেয়ে এখানে এসেছিল। এখানে এসে প্রশ্ন শুধানোর পর ন শোনার ভান করে হু শোনাটা ব্যাপক বিরক্তিকর। দাঁতে দাঁত চেপে শুধাল,
” হু কি? তোর কানে সমস্যা আছে? ”
জ্যোতি গলা ঝেড়ে বলল,
” না,রান্না করছিলাম তো।তাই।”
মেহেরাজ ফের ত্যাড়া স্বরে প্রশ্ন শুধাল,
” রান্না করতে কে বলেছে?”
জ্যোতি তাকাল৷স্বাভাবিক স্বরে বলল,
” কেউ বলতে হবে কেন? এটা তো আমার দায়িত্ব মেহেরাজ ভাই। তাছাড়া এতক্ষনে বাইরে থেকে ফিরে আপনি রান্না করতেন? ”
মেহেরাজ এবারে চুপ হয়ে গেল। মনে মনে কেবল হাসল। কি চাই তা মুখে বললে সম্মুখ নারীটি কিভাবে নিবে? লজ্জ্বায় কুঁকড়ে মরবে? নাকি অস্বস্তির চরম শীর্ষে পৌঁছিয়ে মুখ নত করবে?ভেবেই উত্তরটা আড়াল করল। জ্যোতি ফের আবার বলল,
” ক্ষিধে পেয়েছে? খাবার বাড়ব মেহেরাজ ভাই? ”
মেহেরাজের দাঁতে দাঁত চাপল। বলল,
” বলেছি আমি?”
জ্যোতি কি বলবে বুঝে উঠল না। অপরদিকে ঠিক তখনই মেহেরাজের ফোনটা বেঁজে উঠল। মুহুর্তেই জ্যোতিকে ছেড়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করল মেহেরাজ। মেহুর নাম্বার দেখে দ্রুত কল রিসভিড করতেই ওপাশ থেকে মেহু বলে উঠল দ্রুত,
” আমি ভেবে দেখেছি ভাইয়া। সে ছেলের বিয়ের প্রস্তাবে আমি রাজি।তুমি যদি চাও বিয়েতে এগোতে পারো।”