-“ এরপর কি হলো ম্যাম? ইন্দু কি তার তুহিন কে পেয়েছিল?
পুরো ক্লাস জুড়ে চলছে নিস্তব্ধতা। সামনের এক কাঠের চেয়ারে বসে আছে চল্লিশ বছরের এক নারী। চোখে তার চিকন ফ্রেমের চশমা। মাথার চুল গুলো আধপাকা। চোখের নিচে কালো দাগ। চল্লিশ বছরের নারীর দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে ক্লাসের সকল স্টুডেন্ট। হ্যান্ড ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নিলো। গলা শুকিয়ে গেছে। পানি খাওয়া শেষে সে তার স্টুডেন্টের দিকে তাকিয়ে ফের বলা শুরু করে-
-“ মুহূর্তে ফকফকা রাস্তা টা লাল র’ক্তে ভিজে উঠলো। লোকজন দৌড়ে দৌড়ে আসলো দেখতে। ইন্দু পাগলের ন্যায় ছুটে গেলো দেহটার কাছে। সাদা গোলাপ এখনও তুহিনের হাতের মুঠোয়। রক্তে ভিজে লাল হয়ে গেছে। তুহিনের মাথাটা কোলের উপর নিলো, গালে আলতো থাপ্পড় দিয়ে বলল-
-“ এই তুহিন উঠুন না। কি হলো উঠছেন না কেনো, তুহিন এই তুহিন উঠেন,আমার কষ্ট হচ্ছে তো,শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আপনার ইন্দু কষ্ট পাচ্ছে খুব উঠুন না। আজ না আমাদের বিয়ে। দেরি হচ্ছে তো উঠুন।
কাজি অফিসের ভেতর থেকে ইন্দুর মা ও সবাই বেড়িয়ে আসলো হইহট্টগোল শুনে। কিন্তু বেরিয়ে এসে সামনে এমন কিছু দেখবে কল্পনা ও করতে পারে নি। মনোয়ারা বেগম ছুটে মেয়ের কাছে গেলো। সাথে তুহিনের ফ্রেন্ড গুলো ও। মনোয়ারা বেগম কে দেখে ইন্দু ডুকরে কেঁদে উঠল। কান্নারত গলায় বলল-
-“ ও মা মা তুমি তো বলছিলা তুহিন কে কষ্ট দিতে না আমি তো সেটাই করছি। তুহিন কে আর কষ্ট দেই নি তাহলে তুহিন কেনো এমন করতেছে। আমাকে কষ্ট কোনো দিচ্ছে।
তুহিনের ফ্রেন্ড সাগর তুহিনের কাছে গিয়ে পার্লস চেক করে দেখে তুহিন এখনও বেঁচে আছে। তাড়াতাড়ি করে লোকদের সাহায্য নিয়ে হসপিটালে এডমিট করে।
ইন্দু এখনও ভয়ে তার মায়ের হাত জাপ্টে ধরে আছে। তখন রোড পাড়ি দিতে গিয়ে ওপর পাশ থেকে একটা গাড়ি এসে তুহিন কে ধাক্কা মা’রে। তুহিন দিক বেদিক ভুলে গিয়েছিল। সে তাড়াতাড়ি ইন্দুর কাছে আসতে চাইছিল,আশে পাশে ভালো করে না দেখেই রোড পার হতে যাচ্ছিল।
তুহিনের মা পাগলের মত দৌড়ে এসেছে হসপিটালে। ছেলের এই অবস্থা মানতে পারছে না। বারবার নিজেকে দোষারোপ করছে। সে যদি ইন্দু আর তুহিনের সম্পর্ক মেনে নিত তাহলে এমন দিন আসতো না। হসপিটালে পাগলের মতো কান্না করছে তনয়া বেগম।
ইন্দু তনয়া বেগমের সামনে গিয়ে ধপাস করে বসে পড়ে বলে-
-“ ও আন্টি কাঁদছেন কেনো। তুহিন ঠিক হয়ে যাবে, হসপিটালে আনা হইছে তো। ও একদম ঠিক হয়ে যাবে।
তনয়া বেগম ইন্দুর পানে চাইলো। চুলগুলো এলোমেলো, মুখের সাজ লেপ্টে গেছে। পাগলের চেয়ে কম কিছু লাগছে না।
এরমধ্যে ডক্টর ওটি থেকে বের হয়ে জানায় চব্বিশ ঘন্টায় পেসেন্টের জ্ঞান না ফিরলে পেসেন্ট কমায় চলে যাবে। কারন মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়েছে। প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে।
কথাটা শুনে তনয়া বেগম সেন্সলেস হয়ে যায়। সাগর নার্স ডেকে এনে তনয়া বেগম কে কেবিনে নিয়ে যায়। ইন্দু পাথরের ন্যায় বসে রইলো। বারবার আল্লাহ কে ডাকলো তুহিনের যেনো জ্ঞান ফিরে আসে।
-“ তুহিনের কি জ্ঞান ফিরেছিল ম্যাম?
নারী টি ব্যাঘাত পেলো কথার মাঝে কথা বলায়। চেয়ার ছেড়ে উঠে বলল-
-“ না আল্লাহ সেদিন ইন্দুর সহায় হয় নি, ফিরে নি জ্ঞান তুহিনের,কমায় চলে গিয়েছিল। তার পনেরো দিন পর ইহকালের মায়া ত্যাগ করে তার ইন্দু কে একা ফেলে চলে যায়। ঐ পেনেরো টা দিন ইন্দু তুহিনের কাছ থেকে এক মিনিটের জন্য ও সরে নি। নামাজ কালাম যা যা করা যায় সব করেছে শুধু তুহিনের সুস্থতার জন্য কিন্তু আল্লাহ দিলো না তার তুহিন কে।
তুহিনের লা’শ ধরে সেদিন পাগলের মতো কেঁদেছিল ইন্দু। লোকটাকে একবার বলতে পারলো না তার ইন্দু তাকে ভালোবাসে। ভালোবাসি বলার আগেই কেঁড়ে নিলো তাকে। কেড়েই যখন নিবে তাহলে পাঠালো কেনো জীবনে। একটা সপ্তাহ ইন্দু পাগলের মতো বিহেভ করেছে। রোজ তুহিনের কবরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে।
-“ আচ্ছা ম্যাম এখন ইন্দুর কি খবর?
বাচ্চাটার কথা শুনে নারী টা স্মিত হাসলো। এর মধ্যে ছুটির ঘন্টা বেজে যায়। নারী টা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বলে-
-“ আছে ইন্দু কোনো এক ছদ্মবেশে এই পৃথিবীর এক কোনে।
-“ ম্যাম একটা বলি?
-“ হুম বলো।
-“ আপনার আর ইন্দু প্রভার নামের মধ্যে অনেক মিল। এই যেমন ইন্দুপ্রভা আর আপনার নাম প্রভা।
প্রভা নামের মেয়েটি হেঁসে উঠলো। বাচ্চা মেয়েটার মাথায় হাত দিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে বেরিয়ে গেলো।
ষোল বছর হয়ে গেলো তুহিন নেই। তুহিনের কবরের সামনে এসে দাঁড়ালো প্রভা। কবরের দিকে চেয়ে ব্যাগ থেকে তুহিনের ডায়রিটা বের করলো।
ডায়রিতে লিখা আছে ইন্দুর সাথে তার কাটানো প্রত্যেক টা মুহূর্ত। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,,আমার ইন্দুপ্রভা, ষোল বছর ধরে বইয়ে বেড়াচ্ছে এই ডায়েরি। মানুষ টা নেই কিন্তু তার স্মৃতি আজও তাড়া করে বেড়ায়।
❝ তুহিন দেখতে পারছেন?#যে_প্রেম_এসেছিল ধরণীর বুকে সেই প্রেমই আজ নিঃস্ব করে দিয়ে গেছে এই আমাকে।❞ সময় থাকতে আপনার হাত ধরতে পারি নি যখন ধরলাম তখন ছেড়ে চলে গেলেন আমাকে একা করে। পৃথিবী আবার প্রমাণ করে দিলো। যাদের স্বাভাবিক জীবন নেই তাদের স্বপ্ন ও দেখতে নেই। স্বপ্ন দেখতে গেলেই সে পৃথিবীর নিয়ম ব্রেক করে। আর তার শাস্তি স্বরূপ পৃথিবী তাকে একা করে দেয়। এখন থেকে না হয় পৃথিবীর নিয়মেই চলবো। আপনার শেষ স্মৃতি টুকু নিয়ে বাকি জীবন পাড় করে দিবো। আচ্ছা শুনুন না আপনাকে আজ একটা কথা খুব বলতে ইচ্ছে করছে। আপনি ডায়রিতে লিখে গেছেন আমার নামে অনেক অভিযোগ সেগুলো কি আস্তে আস্তে শুধরে নিতে পেরেছি? আপনি বলেছেন আমি আপনাকে ভালোবাসি না কখনও মুখে বলি নি। এই দেখুন রোজ এসে ভালোবাসি বলে যাই। আপনার সাথে কথা বলি। জানেন আপনাকে হারিয়ে রোজ হারানোর যন্ত্রণা ঢের উপলব্ধি করছি। পেয়েও হারানোর বেদনা অত্যাধিক পুড়ায় বুকের মধ্যে। আমি পরের জন্মে আবার আপনাকে চাই তুহিন,এই অভিশপ্ত জীবনে নয়। একটা সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে আমি আমার তুহিন কে ফেরত পেতে চাই।
যেই ছেলে রোজ ভালোবাসি ভালোবাসি বলে মাথা খেয়ে ফেলবে। রোজ স্কুল শেষে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। আসবেন তো পরের জন্মে ইন্দুর তুহিন হয়ে? আজ আসি বুঝলেন তো তুহিন বাসায় দুই দুইটা আম্মাজন অপেক্ষা করছে, চিন্তা করে আমায় নিয়ে অনেক। কাল আসবো আবার।
ইন্দু আর একবার তুহিনের কবরের দিকে তাকিয়ে থেকে চলে গেলো। তুহিনের সাথে তর সংসার আর হলো না। লোকটার মুখ থেকে আর কোনো শব্দ শুনতে পেলো না ইন্দু। তুহিন কি ভেবেছিল শেষ পরিনতটা এমন হবে? হঠাৎ করে জীবনের সব স্বপ্ন যেভাবে পূরণ হতে লাগলো এক নিমিষেই তা দুঃস্বপ্নে পরিনত হলো। কিছু মানুষ সুখের নাগাল পেয়েও সুখ ছুঁতে পারে না। আমরা মানুষ জাতি সময় থাকতে সময়ের মূল্য দিতে জানি না যখন দেই তখন আর সময় থাকে না। ইন্দুও তেমন প্রকৃতির মানুষ। সময় থাকতে হাত ধরলো না তুহিনের যখন ধরলো তখন ধরেও রাখতে পারলে না।
-“ মা উনার তো জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। এই মধ্য রাতে ডক্টর পাবো কোথায়?
মনোয়ারা বেগম ইন্দুর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। ইন্দুর কথা কর্ণকুহর হতেই এগিয়ে এসে তুহিনের কপালে হাত রাখে। আসলেই ছেলেটার শরীরে অনেক জ্বর। এই মধ্যে রাতে ডক্টর পাওয়া সম্ভব নয়। বাহিরে যে বৃষ্টি হচ্ছে। উপায়ন্তর না দেখে কিচেনে ছুটলো। ছোট বাটিতে পানি আর একটা ছোট কাপড় এনে ইন্দুর সামনে ধরে বলে-
-“ আপাতত মাথায় জল পট্টি দাও। আমি কিচেনে যাচ্ছি স্যুপ বানিয়ে আনছি,ঘরে মেডিসিন আছে। সেটা খাইয়ে দিলে কিছুটা কমে যাবে।
ইন্দু মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালে মনোয়ারা বেগম কিচেনে চলে যায়। ইন্দু কাপড় টা জলে ভিজিয়ে তুহিনের মাথায় দিতেই তুহিন কেঁপে উঠে। রুমে এনেই ইন্দু তার বাবার লুঙ্গি আর একটা টি-শার্ট তুহিন কে পড়তে দিয়েছিলো। তখন অবশ্য হুঁশে ছিলো কিন্তু এখন জ্বর তাকে পুরোপুরি কাবু করে ফেলছে।
লোকটার এই অবস্থার জন্য অবশ্যই ইন্দু দায়ী। জলপট্টি দেওয়ার মাঝে হঠাৎ ইন্দু খেয়াল করলো তুহিন কিছু বলছে বিরবির করে। ঠিক মতো শোনা যাচ্ছে না। কথাগুলো স্পষ্ট শোনার জন্য তুহিনের মুখের কাছে তার কান এগিয়ে নিলো। সহসা তুহিন জড়িয়ে ধরলো ইন্দুকে। এই প্রথম কোনো ছেলের সংস্পর্শে গেলো ইন্দু। মনের মধ্যে ভয় কাজ করছে। তুহিন খুব শক্তপোক্ত ভাবেই জড়িয়ে ধরেছে। আর এমন ভাবে বেকায়দায় আছে ইন্দু যে নিজের শক্তি ও খাটাতে পারছে না। বারবার দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে তার মা আসছে কি না। তার মা তাকে এই অবস্থায় দেখলে কি ভাববে সেটা মনে হতেই এবার নিজের হাত পা ছুঁড়ে কান্না করতে ইচ্ছে করছে।
ইন্দু তুহিনের গালে হাত রেখে বলে-
-“ তুহিন শুনতে পারছেন?
তুহিন চোখ বন্ধ রেখেই কপাল কুঁচকে জানান দেয় সে শুনতে পারছে। ইন্দু তপ্ত শ্বাস ফেললো তার মানে লোকটা সজ্ঞানে আছে।
-“ একটু হাতটা ঢিলে করুন আমি উঠবো।
তুহিন হাত ঢিলে করলো না। আরো চেপে ধরলো যাতে ইন্দু কোনো মতেই যেতে না পরে।
-“ আরে কি হলো আমি হাত ঢিলে করতে বলছি আপনি আরো চেপে ধরলেন কেনো?
তুহিন এবার বিরক্ত বোধ করলো।
-“ এই ইন্দুপ্রভা এমন বিরক্ত কেনো করছো। ও আমার ইন্দুপ্রভা ওকে আমি জড়িয়ে ধরেছি তুমি ছেড়ে দিতে বলার কে?
-“ আশ্চর্য আপনি আমায় ধরে রেখেছেন আর আমি বলবো না? প্লিজ ছাড়েন,আপনি অসুস্থ মা আপনার জন্য স্যুপ বানাতে গেছে, চলে আসলো বলে। এখন যদি এই অবস্থায় আমাকে দেখে কি ভাববে বুঝতে পারছেন?
-“ না ছেড়ে দিলেই ইন্দুপ্রভা হারিয়ে যাবে। জানো ইন্দু না আমাকে ভালোবাসে না। আমি অনেক ভালোবাসি তাকে। তার কি উচিত নয় আমার ভালোবাসা গ্রহন করা?
তুহিনের এমন বাচ্চমো কথা শুনে নৈঃশব্দ্যে হেঁসে দিলো ইন্দু।
-“ আচ্ছা ছেড়ে দিন ইন্দু আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। আর সেও আপনাকে ভালোবাসে। তার উচিত আপনার ভালোবাসা গ্রহন করা।
কথাটা তুহিনের কান অব্দি গেলো কি না জানা নেই কিন্তু তুহিনের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো, সাথে সাথে হাতের বাঁধন হালকা হলো। ইন্দু হাফ ছাড়লো। আর একটু হলে হার্ট অ্যাটাক করিয়ে ছাড়তো এই ছেলে।
মনোয়ারা বেগম স্যুপ এনে ইন্দুর সামনে রেখে বলে-
-“ খাইয়ে দাও একটু আমি মেডিসিন আনছি।
ইন্দু একবার তুহিনের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ মা ও তো শুয়ে আছে খাওয়াবো কিভাবে?
-“ ডেকে উঠাও।
মনোয়ারা বেগম চলে যেতেই ইন্দু আবার তুহিনের গালে হাত দিয়ে বলে-
-“ তুহিন একটু কষ্ট করে উঠুন না। কিছু খেয়ে মেডিসিন খেতে হবে।
তুহিনের কানে গেলো না কথাটা। ইন্দু আলতো করে তুহিনের গালে থাপ্পড় দেয়। তুহিন নড়েচড়ে উঠে। ইন্দু তুহিনের মাথার নিচ থেকে বালিশ টা নিয়ে খাটে সাথে হেলান দিয়ে রেখে বলে-
-“ একটু উঠে বসুন।
তুহিন পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। ইন্দু স্মিত হেসে বলে-
-“ কি হলো উঠুন খেতে হবে তো নাকি।
তুহিন পাশে তাকিয়ে দেখে স্যুপের বাটি। নাকমুখ কুঁচকে ফেলে।
-“ নাকমুখ কুঁচকে লাভ নেই খেতে হবে এটা।
তুহিন অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে-
-“ খাবো না আমি আপনি খান।
-“ আমার আপনার মতো পঁচা শরীর না যে বৃষ্টি তে ভিজলাম আর জ্বরে বাঁধিয়ে ফেললাম। জ্বর হেহে আপনার এসেছে সেহেতু আপনারই খেতে হবে।
-“ বললাম তো খাবো না আমি।
-“ আমি আপনার না হ্যাঁ শুনতে চাই নি। আমি বলেছি খেতে হবে। উঠুন না হলে এই গরম স্যুপ শরীরে ঢেলে দিবো।
-“ হ্যাঁ পারেন তো সেটাই, কাটা গায়ে ক্ষত দিতে। কখনও তো মলম দিতে দেখলাম না।
-“ হ্যাঁ আমি মলম দিতে জানি না,আপনি কেনো ক্ষত নিতে আসেন।
-“ ক্ষত টা অমৃত মনে হয় তাই নিতে আসি বারংবার।
– “ তাহলে মলম পাওয়ার বৃথা আশা কেনো করেন?
– “ মাঝে মাঝে আশা করে ফেলি যদি ম্যাডামের মায়া দয়া হয় এই অধমের উপর।
– “ হবে না সারাজীবন ক্ষতই দিয়ে আসবে।
তুহিন অবাক হয়ে বলে-
-“ সারা জীবন!
ইন্দু স্যুপ খাইয়ে দিতে দিতে বলে-
-“ হ্যাঁ সারাজীবন যতদিন বেঁচে আছি ক্ষতই দিবো শুধু। আপনার ক্ষত পাওয়ার খুব ইচ্ছে না শখ মিটিয়ে দিবো।
তুহিন স্যুপ মুখে নিয়ে হাসি মুখে বলে-
-“ আমি অমৃত ভেবে সব সইয়ে নিবো।
-“ সইতে না পারলে খবর আছে তখন।
-“ ইন্দু পাশে থেকে যেই ক্ষত দিবে তা নির্দ্বিধায় আপন করে নিবে তুহিন।
কথার তালে তালে ইন্দু তুহিন কে স্যুপ খাইয়ে দেয়। মনোয়ারা বেগম মেডিসিন এনে ইন্দুর হাতে দিয়ে তুহিনের উদ্দেশ্যে বলে-
-“ ভালোবাসা ভালো কিন্তু অতিরিক্ত ভালোবাসা ভালো না। যেই ভালোবাসা তোমায় কষ্ট দেয় সেই ভালোবাস পাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠো কেনো?
তুহিন ইন্দুর দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ কি করবো আন্টি বলেন,কিছু মানুষের মন তো পাথরের মতো শক্ত, গলতে সময় লাগে। সেই সময়ের আগেই যদি ছেড়ে দেই তাহলে পাবো কি করে।
মনোয়ারা বেগম আর কিছু বললো না চোখের ইশারায় মেয়েকে নিজের রুমে যেতে বলে চলে গেলো। ইন্দু মেডিসিন টা তুহিন কে খাইয়ে দিয়ে বলে-
-“ এবার ঘুমান সকাল হতে হতে জ্বর চলে যাবে।
কথাটা বলে ইন্দু কাঁথা টা তুহিনের শরীরে দিয়ে দরজা চাপিয়ে চলে যায় মায়ের রুমে। মনোয়ারা বেগম বিছানায় বসে অপেক্ষা করছিলো ইন্দুর। ইন্দু আসতেই মনোয়ারা বেগম চোখের ইশারায় পাশে বসতে বলেন। ইন্দু বসে,মনোয়ারা বেগম কথাকে পেঁচিয়ে না বলে সোজা বলে উঠে-
-“ তুমি কি এখনও তুহিন কে ফিরিয়ে দিবে? দেখো ইন্দু নিজেকে তুচ্ছ ভেবো না। তুহিন যদি তোমার সব মেনে ভালোবাসতে পারে তুমি কেনো পারছো না? আমি মা হিসেবে সাজেস্ট করবো তুহিনের থেকে বেটার কাউকে পাবে না লাইফে।
ইন্দুর দৃষ্টি মেঝেতে। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে-
-“ তুমি ঠিকই বলেছো মা,তুহিন কে ছাড়া অসম্ভব। তার ভালোবাসার কাছে আমি মাথা নত। তার মতো আমিও হয়তো তাকে এতো ভালোবাসি নি।
মনোয়ারা বেগম ইন্দুর হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে বলে-
-“ তারমানে তুহিন কে ভালোবাসো?
-“ না বেসে কি উপায় আছে বলো? যেভাবে ভালোবাসি ভালোবাসি বলে মাথা খেয়ে ফেলতো,প্রতিদিন বাসা টু স্কুল অব্দি পেছন পেছন যেতো,না চাইতেও বেসে ফেলেছি ভালো।
-“ ছেলেটাকে আর কষ্ট দিয়ো না বলে দিয়ো নিকের মনের কথা।
-“ কিন্তু মা তুহিনের আম্মু তো আমায় মেনে নিবে না।
-“ চিন্তা করো না। দুজনে মিলে ঠিক মানিয়ে নিবে তাকে। মা তো রেগে বেশিদিন থাকতেই পারবে না।
-“আন্টি যতোদিন রাজি হবে না ততদিন আমি বিয়ে করবো না তুহিন কে।
-“ আচ্ছা বেশ,তবে তুহিন কে কষ্ট দিয়ো না। ছেলেটা তোমার জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে,এখন তুমিও যদি তাকে না বুঝো তাহলে কে বুঝবে তাকে?
-“ রাত তো অনেক হলো,ঘুমানো উচিত এখন।
মনোয়ারা বেগম হুম বলে মা মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
সকাল সকাল মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে তুহিন। মাথা টা ব্যাথা করছে। কাল রাতের সব কথাই তার মনে আছে। ইন্দু কফি হাতে করে রুমে প্রবেশ করে।
কফি টা তুহিনের সামনে ধরে বলে-
-“ কফি টা খেয়ে নিন মাথা ব্যাথা টা কমে যাবে।
তুহিন কফির মগ টা হাতে নিয়ে মুখে চুমুক দিতেই ইন্দু বলে উঠে-
-“ কিছু কথা বলার ছিলো।
-“ হু বলো শুনছি।
-“ আপনার মা তো আমাকে মেনে নিবে না।
-“ হ্যাঁ জানি,তবে একদিন ঠিক মেনে নিবে।
-“ কিন্তু আমি আপনার মায়ের দোয়া না নিয়ে বিয়ে করতে পারবো না।
কথাটা কর্ণকুহর হতেই মুখ থেকে কফি ছিটকে পড়ে যায় তুহিনের। বিষম খায়। ইন্দু তুহিনের মাথায় আস্তে করে থাপ্পড় দিয়ে বলে-
-“ আস্তে খাবেন তো।
তুহিন অবক হয়ে বলে-
-“ তুমি আমায় বিয়ে করতে রাজি!
-“ যদি আপনার মা কে রাজি করাতে পারেন তবেই আমি রাজি।
মুহূর্তে তুহিনের মুখ চুপসে গেলো। একে ওকে রাজি করাতে করাতেই তো যৌবন অর্ধের বেশি পেড়িয়ে গেলো। তুহিন কে চুপ থাকতে দেখে ইন্দু বলে উঠল-
-“ কি হলো পারবেন না রাজি করাতে?
-“ পারতে হবে,আমি মা কে রাজি করাবো।
-“ আচ্ছা তাহলে আমার আপত্তি নেই।
-“ আচ্ছা হঠাৎ করে তোমার সুবুদ্ধি উদয় হলো কোথা থেকে?
-“ মানে?
-“ না মানে এই যে রাজি হয়ে গেলে বিয়ে করতে?
-“ তার মানে রাজি না হওয়াই ভালো ছিলো? আচ্ছা বেশ আপনাকে আমি বিয়ে করবো না।
-“ এই না না না আমি ওভাবে বলি নি। প্লিজ মত পাল্টিয়ো না।
-“ আচ্ছা শুনুন ফ্রেশ হয়ে নিন। হসপিটালে যাবেন না?
-“ হ্যাঁ যাবো।
-“ বাসায় যাবেন কবে?
-“ উমম কয়েকদিন পর যাবো আপাতত আমার ফ্লাটে গিয়ে উঠবো।
ইন্দু কতক্ষণ চুপ থেকে বলে-
-“ আচ্ছা তাহলে উঠুন এক সাথে বের হই। আর আপনার জামাকাপড় ভেজা। ঐ যে প্যাকেটে আপনার জন্য টিশার্ট আর প্যান্ট আছে ওগুলো পড়ে রেডি হবেন।
তুহিন প্যাকেট টা হাতে নিয়ে বলে-
-“ এগুলো কই পেলে?
-“ মার্কেট থেকে এনেছি।
-“ বাহ বিয়ের আগেই আমাকে শপিং করে দিচ্ছো!
-“ বাজে কথা না বলে রেডি হয়ে আসুন।
-“ হ্যাঁ আসছি।
_________________________
-“ হ্যালো মা।
-“ ফোন দিয়েছিস কেনো?
তুহিন ভেবেছিল তার মা হয়তো জিজ্ঞেস করবে কেমন আছিস কিন্তু উল্টো এটা বলবে ভাবতে পারে নি। তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল-
-“ কেমন আছো?
-“ সেটা তোর না জানলেও হবে।
-“ এখনও এভাবে কথা বলবে? ইন্দুকে মেনে নিলে কি এমন ক্ষতি হবে?
-“ আমি বলেছি তো ওকে মানবে না। বারবার ফোন দিয়ে এ কথা কেনো বলিস।
-“ বাই এনি চান্স ধরো আমি ম/রে গেলাম তখন তোমার এই সমাজ স্ট্যাটাস কি তোমায় দেখে রাখবে?
-“ চড়িয়ে গাল লাল করে দিবো।
-“ ইন্দুকে মেনে নাও। মেয়েটা তোমার দোয়া ছাড়া আমাকে বিয়ে করবে না।
-“ না মানবো না ফোন রাখ।
তনয়া বেগম ফোন কেটে দেয়। আজ তিন দিন হলো তুহিন তনয়া বেগম কে রাজি করানোর চেষ্টা করছে কিন্তু তিনি তার কথার হেরফের করছেন না। নিজের মাথার চুল এখন নিজেরই টেনে ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। নিজেকে আয়নায় একবার দেখে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গেলো। তার মা রাজি হবে না বুঝে গেছে তুহিন। এখন ইন্দুকেও সেটা বুঝতে হবে। ইন্দুর স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তুহিন। স্কুল ছুটির শেষে ইন্দু স্কুল থেকে বেরিয়ে এসে সামনে তুহিন কে দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠে। এগিয়ে যায় তুহিনের দিকে।
তুহিন ইন্দুর হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলে-
-“ আজকাল কার মানুষ গুলো কেমন জানো?
ইন্দু তুহিনের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ কেমন?
-“ এই যে তারা হাজার টাকা হারিয়ে গেলে একশো বছর পর ও আফসোস করবে কিন্তু একটা মানুষ জীবন থেকে হারিয়ে গেলে আফসোস করবে না। সময়ের সাথে সাথে ভুলে যাবে। তুমিও কি তাদের দলের মাঝে?
-” চুপ করেন তো। শুধু বাজে কথা বলেন।
তুহিন বেশখানিকটা সময় চুপ থেকে আবার বলে-
-“ ইন্দু শুনো।
-“ হু শোনান শুনছি।
-“ মা রাজি হচ্ছে না।
সহা ইন্দুর পা থেমে গেলো।
-“ ছেড়ে চলে যাবেন আমায়?
তুহিন ইন্দুর গালে হাত দিয়ে বলে-
-“ না চলো বিয়ে করি। মায়ের মানতে সময় লাগবে কিন্তু ঠিক মেনে নিবে।
-“ কিন্তু…
-“ কোনো কিন্তু নয়। আমি কালই তোমায় বিয়ে করবো আর আন্টি তো আছেই।
-“ মায়ের সাথে কথা বলবেন না?
-“ আমি আসার আগে আন্টিকে বলে দিছি। আমরা এখন শপিং করতে যাবো। কাল কোর্টে গিয়ে বিয়ে করবো।
-“ ভুল করছি না আমরা?
-“ এখানে ভুল কোথায় করলাম?
-“ আচ্ছা চলুন।
ইন্দু আর তুহিন শপিং মলের সামনে এসে ইন্দুর জন্য একটা লাল টকটকে বেনারসি আর নিজের জন্য একটা সাদা পাঞ্জাবি কিনে নিলো। খুবই সিম্পল ভাবে বিয়ে করবে সে। সাথে টুকটাক জুয়েলারি কিনে চলে আসলো।
ইন্দুকে তার বাসায় দিয়ে ইন্দুর মায়ের সাথে টুকটাক কথা বলে চলে গেলো।
ইন্দুর মা মনোয়ারা বেগম খুব খুশি,কাল মেয়ের বিয়ে,তুহিন আগে থেকেই বলে রেখেছিল। তার ছোট্ট মেয়েটার কাল বিয়ে হয়ে যাবে। বাসা টা ফাঁকা ফাঁকা লাগবে। কথাটা ভেবে একটু খারাপ লাগলেও সেটা কে গাহ্য করলো না। বেনারসি শাড়ি টা মেয়ের মেয়ের শরীরে মেলে ধরলেন। ইন্দু লজ্জা পেলো। ইলিয়াস মা আর বোনের কার্যকলাপ দেখছে। ছোট্ট মন এইটুকু বুঝলো কাল তার বোনের বিয়ে। ইন্দু দের তেমন আত্নীয় স্বজন নেই বললেই চলে। বাবা মারা যাওয়ার কর সবার থেকে দুরত্ব বেড়েছে। নিজের এলাকা ছেড়ে এখানে এসে থেকেছে। যা আয়োজন করার তাকে একা হাতেই করতে হবে।
এরমধ্যে হঠাৎ ফোন বেজে উঠে ইন্দুর। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে স্মৃতি ফোন দিয়েছে। রিসিভ করে কানে নিতেই ওপাশ থেকে স্মৃতি উৎফুল্ল নিয়ে বললো-
-“ কংগ্রেস ইন্দু শাদি মোবারক হো। অবশেষে বিয়ে করতে রাজি হলি। তুহিন ভাইয়া না বললে মনে হয় বলতি না তুই যে কাল বিয়ে করতে যাচ্ছিস।
-“ আমি নিজেও জানতাম না। স্কুল থেকে ফেরার পরই তুহিন বলেছে। আমি তোকে ফোন করে বলতামই।
-“ হয়েছে থাক শাক দিয়ে মাছ ঢাকা লাগবে না।
-“ কাল তাড়াতাড়ি আসবি।
-“ তোর বলার অপেক্ষায় কে আছে৷ রাত এখন বেশি না হলে আমি এখনই ছুটে চলে আসতাম।
-“ পাগলি মেয়ে।
-“ হ্যাঁ রাখি কাল সক্কাল সক্কাল চলে আসবো।
—————-
-“ কি রে তুই আন্টির অনুমতি না নিয়েই বিয়ের করতে যাচ্ছিস!
হঠাৎ সাগর আর নীলা কে নিজের কেবিনে দেখে ভ্রুকুটি করে ফেলে তুহিন। ফাইল টা সাইডে রেখে বলে-
-“ কে বললো অনুমতি নেই নি? আমি বলেছি কিন্তু মা রাজি হয় নি তাই একাই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
-“ দেখছিস সাগর মেয়েটা কি রকম ব্রেণ ওয়াশ করেছে তুহিনের।
-“ জাস্ট শাট-আপ ও কেনো আমার ব্রেণ ওয়াশ করাবে।
তুহিনের ধমক শুনে সাগর বলে-
-“ আস্তে কথা বল। বিয়ে করছিস ভালো কথা, আন্টি কিন্তু বিষয় টা ভালো ভাবে নিচ্ছে না৷ এমনি ইন্দুকে সহ্য করতে পারছে না তার উপর এভাবে বিয়ে করলে আরো রেগে যাবে।
-“ প্যারা নিস না,বিয়ের পর আমি আর ইন্দু মায়ের সব রাগ ভেঙে দিবো।
-“ যা ভালো বুঝিস। তা কাল কখন যেতে হবে সাক্ষী হিসেবে?
-“ দুপুরের দিকে।
-“ বিয়ে করতে যাচ্ছিস ট্রিট তো পাই আমরা।
-“ হ্যাঁ দিবো বিয়ের পর এক বেলা বউয়ের হাতে রান্না খেতে দিবো।
___________
-“ এবার কি করবেন ভাবি? তুহিন তো ইন্দুকে কাল বিয়ে করবে। আপনি কি পারতেন না মেয়েটাকে মেনে নিতে? ছেলের সুখের জন্য তো বাবা মা কত কিছু করে।
-“ জেনেশুনে কি করে মেনে নিবো ইন্দুকে তুমিই বলো নিমির মা।
-“ মেয়েটা তো আগে থেকেই বলে দিলো,সে চাইলেই তো বিষয় টা লুকিয়ে রাখতে পারতো কই রাখছে নাকি আপনিই বলেন। সে তো তুহিন কেউ বুঝালো আপনার ছেলে তো বুঝলো না। আপনি ইচ্ছে করে আপনার আর ছেলের মাঝে দুরত্ব ক্রিয়েট করছেন।
-“ আমি কি করবো তাহলে?
-“ ইন্দুকে মেনে নিন। বয়স হচ্ছে আপনার। শেষ বয়সে কি ছেলের সাথে এমন করলে চলে বলেন? আল্লাহ না করুক অসুস্থ হয়ে ঘরে পড়লে আপনাকে কে টানবে? আপনার স্ট্যাটাস সমাজ তো ঘুরেও তাকাবে না। আমি না হয় দু এক দিন করবো তারপর তো আমি নিজেও অতিষ্ঠ হবো। শেষ পর্যন্ত আপনার কিন্তু আপনার ছেলেকেই লাগবে।
-“ আচ্ছা তুমি তোমার বাসায় যাও একা থাকতে দাও আমায়। ভালো লাগছে না।
নিমির মা চলে আসে বাসা থেকে। ভালোই বুঝ দিয়েছে,কাজ হবে এতে।
_________
হঠাৎ মাঝরাতে ফোন বেজে উঠায় কিছু টা অবাক হয় তুহিন। কতক্ষণ আগেই ইন্দুর সাথে কথা বলেছে সে। এখন আবার কার ফোন। ফোন টা চোখের সামনে আনতেই দেখে তার মায়ের ফোন। ফোন রিসিভ করে কানে নিতেই ওপাশ থেকে গম্ভীর কন্ঠে ভেসে আসে-
-“ বিয়ে করছিস ভালো কথা। আমার পুত্র বঁধু কে জেনো আমি আমার বাসায় দেখি।
কথাটা সত্যি শুনলো নাকি তুহিন সেজন্য হাতে একটা চিমটি কাটে। না সত্যি শুনেছে।
-“ সত্যি বলতেছো?
-“ না মিথ্যা বলছি।
-“ জানি আমার মা মিথ্যা বলে না। আচ্ছা তোমাদের মেয়েদের মন এমন কেনো মা?
-“ কেমন?
-“ এই যে হুটহাট কখন মন বদলে ফেলো বুঝাই যায় না।
-“ বিয়ে করতেছিস কাল বিয়ের পর বুঝতে পারবি।
-“ হ্যাঁ তা ঠিক। একটা কথা বলি মা।
-“ কি?
-“ পৃথিবীর মধ্যে সবচাইতে সুখী মানুষ টা কে এখন জানো?
-“ কে?
-“ তোমার ছেলে তুহিন। আল্লাহ হঠাৎ করে জীবন টা পাল্টে দিলো। কয়েক দিনের ব্যাবধানে জীবনের সব ইচ্ছে গুলো একএক করে পূরণ করে দিচ্ছে। এটা মিরাক্কেল না বলো?
-“ মন থেকে আল্লাহর কাছে কিছু চাইলে তিনি কখনই খালি হাতে ফিরায় না। কাল বিয়ে এখন ঘুমা,বিয়ের শেষে এক মুহূর্ত দেড়ি না করে ইন্দুকে এ বাড়ি নিয়ে আসবি।
-“ খুব শীগ্রই দেখা হচ্ছে মা। ইন্দুকে নিয়ে ফিরছি কাল তোমার কাছে। ভালোবাসি মা।
-“ পাগল ছেলে।
উদাস মুখে বসে আছে ইন্দু, একটু পর বিয়ে করতে যাবে,অথচ কেমন যেনো লাগছে। ইন্দুর মা ইন্দুকে পর্যবেক্ষণ করে বলে-
-“ কি হলো এভাবে বসে আছিস কেনো?
ইন্দু নড়েচড়ে বসলো।
-“ মা আমার কেমন যেনো লাগছে। তুহিনের মা রাজি না বিয়েতে। তার অমতে বিয়ে মন সায় দিচ্ছে না।
মনেয়ারা বেগম হাসে মনে মনে। ইন্দুকে তুহিন বলতে নিষেধ করেছে যে তার মা রাজি হয়েছে। সারপ্রাইজ দিবে। মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে বলে-
-“ চিন্তা করো না সব ভালোই হবে। রেডি হয়ে নাও যেতে হবে তো।
ইন্দু মাথা নাড়িয়ে রেডি হয়ে নেয়। স্মৃতি হেল্প করলো সাজাতে। আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে বধূ বেসে নিজে কে দেখে অজানা এক শীতল ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেলো শরীর বেয়ে। কখনও ভাবে নি এভাবে বউ সাজবে সে তুহিনের জন্য। তুহিন কে ইন্দু কখনও পাঞ্জাবি পড়া অবস্থায় দেখে নি। আচ্ছা কেমন লাগবে তুহিন কে পাঞ্জাবি পড়া অবস্থায়। নিশ্চয়ই সুদর্শন লাগবে। কথাগুলো ভেবে আনমনে হেসে ফেলে ইন্দু। স্মৃতি ইন্দুর অকারণে হাসি দেখে বলে-
-“ বিয়ের আগেই এমন হাসি, বিয়ের পর কিভাবে হাসবি তাহলে। চল বের হতে হবে।
ইন্দু হ্যাঁ বলে হাতে ফোন টা নিয়ে তুহিন কে মেসেজ দেয়। কাল রাতে বলে দিয়েছিল তার জন্য এক গুচ্ছ কাঠ গোলাপ আনতে। সেটা যেনো ঠিক মনে করে আনে সেজন্য মেসেজ দেয়। মেসেজ টা দিয়ে স্মৃতি ইন্দু মনোয়ারা বেগম আর ইলিয়াস বেরিয়ে যায়।
উকিলের চেম্বারের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে তারা। তুহিনের আসার নাম নেই। মিনিট বিশেক পর তুহিন ও তার ফ্রেন্ড রা আসে। ছেললটাকে কল্পমায় ভাবার থেকে বেশি সুদর্শন লাগছে। তুহিন ইন্দুর মায়ের কাছে গিয়ে কুশলাদি করে তাদের ভেতরে যেতে বলে। সবাই ভেতরে গেলে তুহিন ইন্দুর সামনে দাঁড়িয়ে একপলকে তাকিয়ে থাকে ইন্দুর দিকে। মেয়েটার সৌন্দর্য দ্বিগুণ বেরে গেছে শাড়ি তে। কথাতেই আছে শাড়িতে নারী।
-“ সরি ইন্দু দেড়ি করার জন্য। আসলে মায়ের কাছে গিয়েছিলাম দেখা করতে।
ইন্দু মাথা তুলে তাকালো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে বলে-
-“ কি বললো আন্টি?
-“ বলে দিয়েছে তার ছেলের বউকে যেনো সোজা তার বাসায় নিয়ে যাই।
-“ সত্যি!
-“ হ্যাঁ সত্যি।
-“ আমার ফুল?
তুহিন একদম ভুলে গেছে ফুল আনতে। এই প্রথম তার ইন্দু একটা জিনিস চাইলে আর সে ভুলে গেলো। ভুলো মনটাকে ইচ্ছে মতে চড়াতে ইচ্ছে করলো তুহিনের। আশেপাশে তাকালো রাস্তার ওপাশে কয়েকটা ফুলের দোকান আছে। কিন্তু কাঠ গোলাপের দেখা পেলো না।
-“ ইন্দু কাঠ গোলাপ তো নেই। সাদা গোলাপে কি চলবে?
-“ হ্যাঁ চলবে।
-“ আচ্ছা তাহলে দাঁড়াও আমি এই যাবো আর আসবো তোমার ফুল নিয়ে।
-“ তাড়াতাড়ি আসবেন।
-“ হু।
কথাটা বলে তুহিন রাস্তার ওপাশে যায়। এক গুচ্ছ সাদা গোলাপ নিয়ে টাকা দেয় দোকানদার কে। এর মধ্যে এক পিচ্চি এসে বলে-
-“ ভাইয়া আমার ফুল গুলান নেন। বেশি দাম না মাত্র পঞ্চাশ টাকা।
তুহিন দেখলো ছেলেটার কাছে পাঁচটার মতন লাল গোলাপ। কিছু একটা ভেবে ফুল গুলো নিয়ে দুইশত টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বলে-
-“ বাকি টাকা লাগবে না তোমার কাছে রেখে দাও। আমার আর তোমার ঐ যে আপুটর(রাস্তার ওপর পাশে থাকা ইন্দুকে দেখিয়ে বলে) জন্য দোয়া করবে। আজ আমাদের বিয়ে।
ছেলেটা মাথা নাড়িয়ে চলে যায়। ইন্দু দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হলো। রোডের এপাশ থেকে হাত নাড়িয়ে বলে- আর কতক্ষণ।
তুহিন ফুল দেখিয়ে বলে- হয়ে গেছে আসছি আমি।
ইন্দু পাশে থাকা একটা গাছের নিচে বসার জায়গা দেখে সেদিকটায় যায় বসার জন্য। পেছন ঘুরে গাছের কাছটায় যেতেই এক শব্দ শুনতে পেয়ে পেছন ঘুরে। তুহিনের কন্ঠ ইন্দু বলে চিৎকার করলো। কিন্তু পেছনে ঘুরে এমন কিছু দেখবে তা কখনও কল্পনা করতে পারে নি ইন্দু। হাত পা কাঁপছে নিশ্বাস ফেলতে ভুলে গেছে মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। নড়ার শক্ত পাচ্ছে না। চোখের সামনে দৃশ্য টা বারবার ভাসছে। লোকজন জড়ো হচ্ছে। হঠাৎ কারো ধাক্কায় হুঁশ ফিরে ইন্দুর। তুহিন বলে চিৎকার দিয়ে উঠে। মাঝ রাস্তায় পড়ে আছে র’ক্তাক্ত এক নিথর দেহ। যার চোখ জোড়া তাকিয়ে আছে ইন্দুর পানে।
তনয়া বেগম সোফায় বসে ছিলেন, তার সামনা-সামনি বসে আছে তুহিন। তুহিনের এমন কথা শোনায় মুহুর্তে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো তনয়া বেগমের।
-“ ভুলেও ঐ মেয়েকে বিয়ে করার কথা মাথায় আনবে না তুহিন। ঐ মেয়ের সাথে তোমার বিয়ে ইম্পসিবল। ঐ মেয়ে কখনও মা হতে পারবে না জানো তো।
তুহিন সোফায় বসে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নিমির মায়ের দিকে তাকায়। ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ আগে ফোন দিয়ে জানিয়েছিল ইন্দু আর তার মায়ের কথা কাটাকাটি হয়েছে।
ইন্দু এসেছিল নিমি কে পড়াতে। তনয়া বেগম আগেই বসেছিল নিমি দের বাসায়। ইন্দুকে দেখে হাসি মুখে জিজ্ঞেস করে-
-“ কেমন আছো ইন্দু?
ইন্দু হাসিমুখে জবাব দেয়-
-“ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি,আপনি?
-“ আমিও ভালো আছি। তোমার সাথে কিছু কথা আছে।
ইন্দু ভ্রুকুটি করে।
-“ জ্বি বলুন আন্টি।
-“ অনেক তো হলো আমার ছেলেটা তো তোমায় ভালোবাসে, তুমি কি পারো না তার ভালোবাসা স্বীকার করতে?
সহসা ইন্দুর চোখ মুখে কালো আঁধার ঘনিয়ে আসলো। তনয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে বলে-
-“ আন্টি আমি আপনায় একটা কথা বলতে চাই।
তনয়া বেগম কিছুটা উৎফুল্ল হলো। আগ্রহ নিয়ে বললো-
-” হ্যাঁ বলো কি বলতে চাও।
-“ আন্টি আপনার ছেলেকে বুঝান,আমাকে বিয়ে করলে সে কখনও বাবা হতে পারবে না।
কথাটা শোনা মাত্রই তনয়া বেগম যেনো আকাশ থেকে টুপ করে পড়ে। ইন্দুর দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ বুঝলে কি করে তুহিন কখনও বাবা হতে পারবে না?
ইন্দু জিহবা দিয়ে ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে নেয়। পরপর দুটো ঢোক গিলে বলে-
-“ আন্টি মা হতে গেলে যেই এবিলিটি গুলো দরকার হয় সেই এবিলিটি আমার মধ্যে নেই। আমার আজ অব্দি পিরিয়ড হয় নি।
কথাটা যেনো ঝংকারের ন্যায় তনয়া বেগমের কানে ঢুকলো। পরমুহূর্তে মনে পড়লো সেদিন রাতে বলা তুহিনের কথা। তুহিন তার মানে ইন্দুর কথা বলেছিলো।
-“ তুমি কি তাহলে হি/জড়া?
কথাটা একদম বুকে গিয়ে বিঁধে ইন্দুর। নিমির মা তনয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ ভাবি কি বলছেন এটা। পিরিয়ড না হলেই যে সে হি/জড়া এটা কে বললো। ইন্দু এটার কি চিকিৎসা করাও নি,বুঝতে পারছো কত বড় সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছ তুমি।
ইন্দু স্মিত হেসে বললো-
-“ জ্বি চিকিৎসা করানো হয়েছে কিন্তু এটা ঠিক হবে না। আমি আমার বাস্তবতা কে মেনে নিয়েছি। তুহিন কে বুঝাবেন আন্টি সেও বুঝবে।
তনয়া বেগম হন্তদন্ত হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। নিমির মা ইন্দুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে –
-“ তুহিন কিন্তু তোমায় অনেক ভালোবাসে ইন্দু। ছেলেটা আমায় বলেছে সব তোমার ব্যাপারে। সে এই বিষয় টার জন্য মোটেও ছেড়ে দিবে না তোমায়।
ইন্দু কিছু না বলে চলে গেলো নিমি কে পড়াতে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই এলাকা তাকে ছাড়তে হবে। নিমির মা ইন্দুর যাওয়ার পানে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।
পরশু তুহিন জানিয়েছিল ইন্দুর ব্যাপার টা। ছেলেটার আকুতিভরা কন্ঠ বারবার জানান দিচ্ছিল সে কতটা ভালোবাসে ইন্দু কে। নিমির মা ফোন বের করে তুহিন কে ফোন দিয়ে সব বলে দেয়। তার মতে সামনে ভয়াবহ কিছু অপেক্ষা করছে।
-“ দেখো মা আমার ইন্দুকেই লাগবে বাচ্চা আমার চাই না। আমি বাচ্চা এডপ্ট করবো।
তনয়া বেগম ছেলের সামনে এসে হুংকার দিয়ে বলে-
-“ মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি তর। ঐ মেয়েকে তোর বিয়ে করতে হবে৷ মেয়েটা স্বাভাবিক হলে আমি নিজে হাতে পায়ে ধরে হলেও রাজি করাতাম কিন্তু এখন আমার হাতে পায়ে ধরলেও আমি তনয়া রাজি হবো না।
-“ বেশ রাজি হয়ো না,বাট আমার ইন্দুকেই চাই।
-“ তুই যদি ইন্দুকে বিয়ে করিস তাহলে আমার বাড়িতে তোর জায়গা নেই। আমরা একটা সমাজে বাস করি,আমাদের স্ট্যাটাস আছে একটা।
সহসা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো তুহিন।
-“ বেশ তবে তাই হোক। চলে যাবো তোমার বাড়ি থেকে। আমি না খেয়ে থাকলে তোমার সমাজ,স্ট্যাটাস আমায় প্লেটে ভাত বেড়ে দিয়ে যাবে না। সমাজের জন্য আমি আমার ইন্দুকে ছাড়তে পারবো না।
-“ তুই আবেগে ভেসে বেড়াচ্ছিস। কয়েকদিন গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ভুলে যা ইন্দু কে।
-“ ইহকালে পসিবল না মা। আই কান্ট লিভ উইদাউট সি।
-“ মায়ের থেকেও ঐ মেয়ে তোর কাছে বড় হয়ে দাঁড়ালো! বেশ যা কিন্তু মনে রাখিস জীবনে আমায় তোর এই মুখ দেখাবি না।
তুহিন অসহায় হয়ে পড়লো নির্নিমেষ মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো-
-“ ছেলে চাওয়ার মত কিছু চাইলে অবশ্যই দিতাম। কিন্তু না সে অবুঝের মতো আগুন নিয়ে খেলতে চাইছে। ইন্দুকে বিয়ে করতে চাইলে আমার বাসায় জায়গা নেই।
-“ আচ্ছা বেশ তুমি যখন আমার ভালোবাসা মানতে পারবে না, আমিও থাকবো না তোমার এই সোসাইটি সমাজে। ভালো থেকে।
কথাটা বলে তুহিন বেরিয়ে আসতে নিলে পেছন থেকে নিমির মা আটকানোর চেষ্টা করে তুহিন কে, কিন্তু তুহিন শুনে নি, ইশারায় বলে গেছে তার মায়ের খেয়াল রাখতে সে শীগ্রই ফিরবে।
নিমির মা তনয়া বেগমের কাছে এসে বলে-
-“ ভাবি ইন্দু তো মেয়েটা ভালো,ওর এই পরিস্থিতির জন্য তো ও দায়ী না,আপনি নিজে থেকেও তো ইন্দু কে পছন্দ করতেন৷ সামান্য একটা সত্যি শুনে এভাবে মুখ ফিরিয়ে নিলেন?
তনয়া বেগম নিমির মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলে-
-“ তোমার ছেলে এমন মেয়েকে বিয়ে করতে চাইলে তুমিও বাঁধা দিতে। যার পুড়ে সেই বুঝে জ্বালা।
কথাটা বলে তনয়া বেগম চলে যায়। নিমির মা তপ্ত শ্বাস ফেলে নিজের বাড়ি চলে যায়।
রাত বাজে নয়টা বেজে চব্বিশ মিনিট। এই হালকা শীতের মাঝেও আচমকা ঝড়ের আভাস টা ঠিক হজম হলো না ইন্দুর। কি প্রবল বাতাস বইছে। হঠাৎ হাতে থাকা মুঠো ফোন টা বেজে উঠায় সামনে এনে দেখে তুহিনের নম্বর জ্বল জ্বল করছে। ধরলো না পরপর দুবার কেটে যাওয়ায় আবার বেজে উঠল ফোন। ইন্দু রিসিভ করলো ফোন। হ্যালো বলার আগেই ওপাশ থেকে তুহিন বলে উঠল-
-“ আমি সব ছেড়ে ছুঁড়ে চলে এসেছি। আমি বিয়ে করতে চাই তোমায়।
কথাটা কর্ণকুহর হতে বিস্মিত হয় ইন্দু।
-“ আপনি সব ছেড়ে ছুঁড়ে চলে এসেছেন মানে?
-“ আমি বাসা ছেড়ে চলে এসেছি।
-“ আপনি বাসা কেনো ছেড়েছেন, আমি কি ছেড়ে আসতে বলছি?
-“ তেমাকে পাবার জন্য ছেড়েছি।
-“ মানে?
-“ মানে মা আমার ভালোবাসার পূর্ণতা দিতে চাচ্ছিলল না তাই চলে এসেছি।
-“ আপনার কি মনে হয় আপনি সব ছেড়েছুড়ে চলে আসলে পূর্ণতা পাবেন? ভুল ভাবনা নিয়ে বাসা ছেড়েছেন। বাসায় যান। আচ্ছা আপনি এখন কোথায়?
-“ তোমার বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছি।
ইন্দু শোনা মাত্রই দৌড়ে জানালার কাছে গিয়ে দেখে ল্যাম্পপোস্টের আলোতে তুহিন কে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। বাহিরে যে বাতাস বইছে। ইন্দু তুহিনের পানে এক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে বলে-
-“ বাসায় যান। দেখছেন আকাশের অবস্থা ভালো না৷ ঝড় আসবে।
-“ না বাসায় ফেরা অসম্ভব।
-“ তাহলে কি সারা রাত দাঁড়িয়ে কাটাবেন?
-“ হ্যাঁ তুমি বললে দাঁড়িয়ে থাকবো।
-“ দেখেন বাড়াবাড়ি করবেন না বাসায় যান রাখি।
কথাটা বলে ইন্দু ফোন কেটে দিলো। মনেয়ারা বেগম ইন্দু কে ডিনার করার জন্য ডাক দিলো। ইন্দু তুহিনের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে খাবার খেতে দিলো। খাবার খেয়ে দেয়ে রুমে এসে ঘুমিয়ে পড়ে।
বাহিরে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে কেউ একজন এক দৃষ্টি তে কারো জানালার দিকে তাকিয়ে আছে সেটা দেখলো না। হঠাৎ মাঝ রাতে রুমে দরজা টোকা দেওয়ার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় ইন্দুর। ইন্দু আড়মোড়া ভেঙে বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে দেখে তার মা।
এতো রাতে মাকে দেখে অবাক হয় ইন্দু। ইন্দু কিছু বলার আগেই মনোয়ারা বেগম ইন্দুর হাত টেনে নিয়ে জানালার পাশে দাড় করিয়ে বলে-
-“ ছেলেটাকে আর কত কষ্ট দিবে তুমি? সেই কখন থেকে বৃষ্টি তে দাঁড়িয়ে ভিজছে। সে যদি তোমার সব মেনে নিয়ে সংসার করতে চায় তাহলে তোমার আপত্তি কোথায়?
ইন্দু ভাবতে পারে নি তুহিন এই বৃষ্টি তে দাঁড়িয়ে ভিজবে। সে ভেবেছিল বৃষ্টি নামলে তুহিন চলে যাবে। কিন্তু ছেলেটা এভাবে কতক্ষণ ধরে ভিজছে জ্বর আসবে তো। ইন্দু রুম থেকে ছাতা নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো।
তুহিনের সামনে দাঁড়িয়ে বলে-
-“ আপনি কি পাগল তুহিন৷ বৃষ্টি তে কেনো ভিজছেন?
তুহিনের সারা শরীর কাঁপছে, মুখে লেগে আছে মৃদু হাসি। ইন্দুর দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ আমি তো কবে থেকেই তোমার প্রেমে পাগল হয়েছি। পাগল টাকে ভরসা করে পাগলটার হাত ধরুন। ট্রাস্ট মি সব সুখ আপনার পায়ের কাছে এনে দিবো।
-” আমি পাগল হয়ে যাবো আপনাকে এই একটা কথা বলতে বলতে। আপনি আমাকে গ্রহন করলে জীবনেও সুখী হতে পারবেন না তুহিন।
-“ আমার সুখ কিসে হবে আমার থেকে বুঝি তুমি বেশি জানো? আচ্ছা ইন্দু তোমার হৃদয় এতো পাষাণ কেনো? একটা ছেলে তোমার ভালোবাসা পাবার জন্য মরিয়া হয়ে গেছে আর তুমি বারংবার তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছো। আচ্ছা এই আমি যদি তোমার ভালেবাসা না পেয়ে পৃথিবী ত্যাগ করি মায়া হবে না আমার জন্য?
সহসা ইন্দুর বুক কেঁপে উঠলো। তুহিনের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ আজেবাজে কথা কেনো বলছেন। পৃথিবী ছেড়ে কেনো যাবেন।
-“ এই যে তোমার ভালোবাসা না পাওয়ার এক মরণব্যাধি অসুখ নিয়ে। কষ্ট পাবে তখন?
-“ কিসব কথা বলছেন তখন থেকে চুপ করবেন? দেখছেন আপনি শীতে কিভাবে কাঁপছেন। বাসায় চলুন জামাকাপড় বদলে নিবেন।
-“ না যাবো না বাসায়।
-“ আমার বাসায় চলুন।
-“ না কোনো বাসায় যাবো না। এভাবেই এই বৃষ্টি তে দাঁড়িয়ে থাকবো। জ্বর বেঁধে মরণ হোক ঢের ভালো এমন জীবনের থেকে।
-“ আপনি ম’রলে কেউ একজন কষ্ট পাবে।
আনমনে কথাটা বলে ফেলে ইন্দু। তুহিন শুনে ফের বলে-
-“ কে কষ্ট পাবে আমার মৃ’ত্যুতে?
ইন্দু তুহিনের হাত ধরে। হাত গরম লোকটার জ্বর এসেছে। ইন্দু হাত টেনে বাসার ভেতর নিয়ে যেতে যেতে বলে-
-“ আছে একজন যার হৃদয় পুড়ে আপনার জন্য। জ্বর এসেছে শরীরে তাই আজেবাজে কথা বলছেন,মেডিসিন খেতে হবে।
তুহিন দাঁড়িয়ে যায়। ভাবান্তর হয়ে বলে-
-“ আচ্ছা সেই একজন কি ইন্দুপ্রভা?
-“ হয়তো। চলুন এবার।
কথাটা বলে টেনে নিয়ে যায় ইন্দু তুহিন কে।
মনোয়ারা বেগম ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে বাজারের দিক টায় আসে কিছু সবজি কিনতে। হঠাৎ পরিচিত কন্ঠ শুনে পেছন ঘুরে দেখে তুহিন। ছেলেটা তার দিকে এগিয়ে আসলো। চোখ মুখের হাল দেখে মনে হচ্ছে রাতে ঘুমায় নি। তুহিনের দিকে পলকহীন তাকিয়ে সালামের জবাব দিলেন মনোয়ারা বেগম।
তুহিন তার শুষ্ক ওষ্ঠ জিহবা দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে বলে-
-“ আন্টি আপনি কি ফ্রী আছেন, আসলে আমি একটু আপনার সাথে কথা বলতে চাই।
মনোয়ারা বেগম সবজির দোকান থেকে সবজি নিয়ে টাকা দিয়ে বলে-
-“ কি বলবে তুমি?
-“ আসলে আন্টি আমি ইন্দুর ব্যাপারে সবটা জানতে চাই।
মনোয়ারা বেগম ভ্রুকুটি করে জিজ্ঞেস করেন-
-“ যা বলার তো ইন্দু বলেই দিয়েছে তোমায়। আর কি জানতে চাও?
-“ তোমার কি মনে হয় আমরা চিকিৎসা করাই নি? ইন্দুর বাবা সব রকমের চিকিৎসা ইন্দুর করিয়েছে।
-“ ডক্টর কি বলছে আন্টি আর ওর রিপোর্ট কি বলে?
-“ এটা ঠিক হবে না। ওর সব কিছু মেয়েদের মতে স্বাভাবিক হলেও ও বাচ্চা দিতে অক্ষম।
-“ কিছুতো চিকিৎসা থাকবে আন্টি এটার।
-“ না ইন্দুর এই সমস্যার চিকিৎসা নেই। এটা পারিবারিক ভাবেই এসেছে।
-“ পারিবারিক ভাবে এসেছে মানে?
-“ ইন্দুর একটা ফুফু ছিলো যার ইন্দুর মতো সমস্যা ছিলো।
-“ উনি কি এখন সুস্থ আই মিন উনার এই সমস্যা কি ঠিক হয়েছে।
-“ না উনি ছাব্বিশ বছর বয়সেই গাড়ি এক্সিডেন্ট করে মা/রা যান। তারও এই পিরিয়ড হতো না।
-“ আন্টি আপনি কি আমায় ইন্দুর মেডিকেল রিপোর্ট গুলো দিতে পারবেন?
-“ তুমি রিপোর্ট নিয়ে কি করবা? দেখো তুহিন এসব নিয়ে আর ঘাটাঘাটি করো না এমনি আমার মেয়ে এখনও নিজেকে ঠিক রেখেছে বেশি ঘাটাঘাটি করলে ও একদম ভেঙে পড়বে।
-“ আন্টি ইন্দু জানবে না। আমি শেষ বারের মতো চেষ্টা করতে চাই।
-“ পারবে না তুহিন শুধু শুধু সময় নষ্ট, বড় বড় ডক্টর ফিরিয়ে দিয়েছে ইন্দুকে সেখানে এখন আশার আলো দেখা মানে মরীচিকার পেছনে দৌড়ানো।
কথাটা বলে মনোয়ারা বেগম চলে যায়। তুহিন তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে বলে-
-“ এভাবে আশা হারালে চলবে না। ভেঙে পড়লেও চলবে না।
কথাটা বলে হসপিটালে চলে যায়। ডক্টর সুমনের কেবিনে এসে দরজা নক করে বলে-
-“ স্যার আসবো?
ডক্টর সুমন এক পেসেন্টের রিপোর্ট দেখছিল তুহিনের আওয়াজ শুনে বলে-
-“ হ্যাঁ আসো।
তুহিন ভেতরে ঢুকে বলে-
-“ স্যার আপনাকে কাল যে বিষয়ে বললাম সেটা নিয়ে কথা বলতে চাই।
সুমন রিপোর্ট থেকে চোখ সরিয়ে বলে-
-“ হু আমিও কিছু বলতে চাই।
-“ জ্বি স্যার বলুন।
-“ তুমি বলেছিলে মেয়েটার একবারের জন্য ও পিরিয়ড হয় নি তাই তো?
-“ হ্যাঁ।
-“ তুমি হয়তো জানো যে মহিলাদের পিরিয়ডের বয়স 14 থেকে 16 বছরের মধ্যে। কিন্তু যদি দেরি হয় তাহলে সে অ্যামেনোরিয়ায় আক্রান্ত। উদাহরণ দিয়ে বলি,
এক বা একাধিক মাসিক না হওয়াকে অ্যামেনোরিয়া বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়। 15 বছর বয়সের মধ্যে প্রথম পিরিয়ড না পেয়ে থাকেন তবে এটি প্রাথমিক অ্যামেনোরিয়া হিসাবে পরিচিত।
অন্যদিকে, আগে পিরিয়ড হয়েছে এমন কারো দ্বারা পরপর তিন বা তার বেশি পিরিয়ড না হওয়াকে সেকেন্ডারি অ্যামেনোরিয়া বলা হয়। এটি মূলত প্রজনন বয়সের মহিলাদের ঋতুস্রাব বাদ দেওয়া।
যদিও কারণগুলি ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়, তবে সবচেয়ে সাধারণ কারণ হল হরমোনের ভারসাম্যহীনতা। এটি একটি চিকিত্সাযোগ্য অবস্থা, এবং চিকিত্সা কারণের উপর নির্ভর করে।
ঋতুস্রাবের জন্য দায়ী বা সম্পর্কিত অঙ্গ, হরমোন এবং গ্রন্থিগুলির পরিবর্তনের কারণে এটি ঘটে।
অ্যামেনোরিয়ার চিকিত্সা অ্যামেনোরিয়ার ধরণের উপর নির্ভর করে।
বয়সের উপর নির্ভর করে, প্রাথমিক অ্যামেনোরিয়া চিকিত্সা সতর্কতার সাথে অপেক্ষা করা শুরু হতে পারে, বিশেষ করে যদি দেরীতে ঋতুস্রাবের পারিবারিক ইতিহাস থাকে। প্রজনন অঙ্গ বা যৌনাঙ্গে কোনো গঠনগত সমস্যা থাকলে সার্জারি করা যেতে পারে।
তবে এটি স্বাভাবিক মাসিকের নিশ্চয়তা দেয় না।
-“ স্যার পারিবারিক ইতিহাস আছে কিছুটা।
-“ যেমন?
-“ আমি যার কথা বলেছি তার ফুফুর ও এমন প্রবলেম ছিলো তার ও পিরিয়ড হতো না
-“ তাহলে এটা ঠিক হবার চান্স ০%।
-“ কেনো স্যার বিজ্ঞান তো অনেক দূর এগিয়ে গেছে তাহলে এটার সলিউশন নেই কেনো?
-“ বিজ্ঞানের ও কিছু নিয়মবদ্ধ আছে বিজ্ঞান মানেই যে সে সব পারবে এটা কোনো কথা না। উপরেও একজন আছে যিনি সব পরিচালনা করেন। মেয়েটা চাইলে বাচ্চা এডপ্ট করতে পারে। সার্জারী করালেও যে পিরিয়ড হবে তার নিশ্চয়তা নেই।
-“ এটার জন্য বেস্ট চিকিৎসা কেন্দ্র কোথায়?
-“ তুমি বিড়লা ফার্টিলিটি এবং আইভিএফ-এ যাও এবং সেরা অ্যামেনোরিয়া চিকিত্সার জন্য ডাঃ রচিতা মুঞ্জালের সাথে একটি অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করো। তবে মনে হয় না সলিউশন বের হবে।রঞ্জন এবং ডাঃ গয়াল বলেছেন যে প্রাথমিক অ্যামেনোরিয়ার প্রধান কারণগুলির মধ্যে রয়েছে পারিবারিক ইতিহাস, জেনেটিক সমস্যা এবং লাইফস্টাইল। অ্যামেনোরিয়া বা প্রাথমিক মেনোপজের পারিবারিক ইতিহাস। জেনেটিক বা ক্রোমোসোমাল ত্রুটি। এগুলো আপনার ডিম্বাশয়ের কার্যকারিতা এবং মাসিক চক্রকে প্রভাবিত করে। তবে তুমি গিয়ে দেখতে পারো।
-“ ধন্যবাদ স্যার,আসি তাহলে।
তুহিন কেবিন থেকে বেরিয়ে সোজা ইন্দুর স্কুলের সামনে যায়। গেটের বাহিরে দাড়িয়ে থাকে। ইন্দুর স্কুল ছুটি হতে এখনও আধঘন্টা বাকি। আচ্ছা এই সমস্যার যদি কোনো সলিউশন বের না হয় তখন কি হবে? আমি তো ইন্দুকে ছেড়ে থাকতে পারবো না। প্রায় আধঘন্টা পর ইন্দু স্কুল থেকে বের হয়। কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা বাসার দিকে হাঁটা ধরে। পেছন থেকে তুহিন ডেকে চললো ইন্দু কে কিন্তু ইন্দু শুনলো না্ তুহিন দৌড়ে এসে ইন্দুর সামনে দাঁড়িয়ে বলে-
-“ সমস্যা কি তোমার ডাকছি শুনছো না কেনো?
ইন্দু তুহিনের দিকে না তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে তুহিন সহসা ইন্দুর হাত টেনে ধরে। ইন্দু সামনের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলে-
-“ হাত ছাড়ুন।
তুহিন ইন্দুকে টেনে নিজের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে বলে-
-“ হাত তো ছেড়ে দেওয়ার জন্য ধরি নি। এই যে শক্ত করে ধরেছি কখনও ছুটবে না।
ইন্দু চেষ্টা করলো তুহিনের থেকে নিজের হাত ছাড়ানের কিন্তু পারলো না। ইন্দুর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে বারংবার।
-“ প্লিজ তুহিন হাত ছাড়ুন আমার,আর দয়া করে আপনি আমার সামনে আসবেন না কখনো।
-“ হাত ও ছাড়বো না আর তোমার সামনে না এসেও থাকতে পারবো না। বিকজ আই লাভ ইউ,আই কান্ট লিভ উইথআউট ইউ।
ইন্দু তুহিনের দিকে তাকালো।
-“ এখনও এসব বলছেন। হাত ছাড়ুন বাসায় যাবো।
-“ ইন্দু চলো আমরা বিয়ে করি।
এবার ইন্দু তুহিনের হাতে শক্ত করে কামড় দিয়ে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়।
-“ নিজের স্বত্বা কে মানুষ কি করে ভুলে ইন্দু আমার তো জানা নেই। তুমি আমার স্বত্বা, তোমাকে ভুলে যাওয়া ইহকালে সম্ভব নয়।
-“ মানুষ চাইলে সব পারে। আপনি চেষ্টা করুন আপনিও পারবেন।
-“ তুমি পারবে আমায় ভুলতে ইন্দু?
সহসা উত্তর দিতে পারলো না ইন্দুপ্রভা। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বলে-
-“ হ্যাঁ পারবো। আপনাকেও পারতে হবে। সবার জীবনে প্রেম সুখের হয়ে আসে না, আপনার ও আসে নি,তাি এটাকে ভুলে যাওয়াই বেটার।
-“ তোমার মতো পাষাণ হৃদয় আমার না। তুমি পারলেও আমি পারবো না। আর পারতেও চাই না। আমি তোমার পাশে থেকে তোমাকে প্রতি মুহূর্তে অনুভব করতে চাই।
-“ আপনি ভুল মানুষের প্রতি ফিলিংস এনে ফেলছেন। আপনার তো আমার সত্যি টা জানার পরই উচিত ছিলো জীবনে আমার সামনে না আসা।
-“ সবাই তো সত্যি জানার পর চলে যায় আমি সত্যি জানার আগেও ছিলাম পরেও থাকবো। আমার তোমাকে চাই এট এনি কস্ট।আর আমার মাকে নিয়ে সমস্যা? ব্যাপার না ম্যানেজ করে নিবো। তখন তুমি না বললে খবর বানিয়ে ফেলবো।
-“ বড্ড বোকা আপনি জানেন সেটা?
-“ এই যে তুমি বললে আমি জানলাম।
-“ ভালো থাকবেন আসি।
কথাটা বলে ইন্দু চলে গেলো। তুহিন ইন্দুর যাওয়ার পানে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেললো।
চারদিকে আঁধার নেমে এসেছে। শীতকাল পাঁচ টা বাজতে না বাজতেই চারদিকে আঁধার ঘুনিয়ে আসে। মসজিদের মাইক থেকে আজান ভেসে আসছে। খোলা উদ্যান মাঠটায় বসে থাকতে থাকতে কখন যে সন্ধ্যা নেমে এসেছে বুঝতে পারে নি ইন্দু। কাঁধের ব্যাগ টা ভালো করে কাঁধে নিয়ে বাড়ির মুখে হাঁটা ধরলো।
হাঁটতে গিয়ে বুঝলো তার পা আর চলছে না,ক্রমশ দূর্বল হয়ে পড়ছে। হাঁটার শক্তি পাচ্ছে না। কোনো রকমে থেমে থেমে বাসা অব্দি চলে হেঁটে আসলো। সদর দরজায় আসতেই দেখে মনোয়ারা বেগম ইন্দু কে দেখা মাত্রই ছুটে চলে আসে। মেয়ের বিধ্বস্ত চেহারা দেখে বুকটা মুচড়ে উঠল। তাহলে কি সে ভুল ছিলো। চোখ ফুলে গেছে, দেখেই বুঝা গেছে অনেক্ক্ষণ কেঁদেছে মেয়েটা।
কথাটা বলে মনোয়ারা বেগম কে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে নিজের রুমে চলে যায় ইন্দু। মেয়েকে একা থাকতে দেওয়া শ্রেয় বলে আর আটকায় নি মনোয়ারা বেগম।
ইন্দু রুমে এসে ব্যাগটা টেবিলে রেখে ওয়াশরুমে ঢুকে। ক্ষনে ক্ষনে কান্না গুলো উপচে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। না এবার আর কাঁদল না ইন্দু। যথাসম্ভব নিজেকে আটকালো। ঘন্টাখানেক পর ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে সোজা বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। মাথা ধরছে খুব না ঘুমালে যন্ত্রণা গুলো তাড়া করে বেড়াবে। মনোয়ার বেগম রাতে দিকে মেয়ের রুমে আসেন খেতে ডাকার জন্য কিন্তু ইন্দু না করে দেয় তার খেতে ইচ্ছে করছে না।
মনোয়ারা বেগম তপ্ত শ্বাস ফেলে। মেয়েটার জীবনে সুখেরা ধরা দিবে কবে জানা নেই। তুহিনের চোখে অসীম ভালোবাসা দেখেছিলো ইন্দুর জন্য, সেগুলো মিথ্যা হয়ে গেলো সব তাহলে!
-“ মে আই কাম ইন স্যার?
ডক্টর সুমন নিজের কেবিনে বসে ছিলো। হঠাৎ তুহিন কে দেখে বলে-
-“ আচ্ছা স্যার যাদের শারীরিক গঠন মেয়েদের মতো সব কিছু সেম মেয়ে কিন্তু তার পিরিয়ড নামক জিনিস টা হয় না। এক্ষেত্রে কি কোনো সলিউশন আছে?
সুমন ভ্রুকুটি করলো। হাতে থাকা কলম টা ঘুরাতে ঘুরাতে বললো-
-“ ব্যাপার টা কি বলো তো?
-“ আসলে স্যার ব্যাপার টা হলো একটা মেয়ে বয়স যার বয়স চব্বিশ কিন্তু এখনো পিরিয়ড হয় নি।
-“ সে কি ডক্টর দেখানো উচিত ছিল তো।
-“ আমার মাথা কাজ করছিলো না তখন তাই ভ ক্রমে জিজ্ঞেস করতে পারি নি।
-“ আমার মনে হয় না মেয়েটা কোনো চেষ্টা বাকি রেখেছে। এই পিরিয়ড টা মূলত ১২-১৩ বছর থেকে শুরু হয়। তখন যদি না হয় তখন ডক্টর দেখাতে হয়। সেখানে মেয়েটার বয়স চব্বিশ হয়ে গেছে নিশ্চয়ই কোনো পথ নেই এখন আর।
-“ এটার কোনো চিকিৎসা নেই?
-“ আগে মেয়েটার থেকে সব বিস্তারিত জেনে আমাকে জানাও সলিউশন থাকলে অবশ্যই বলবো। এই পিরিয়ড প্রসেস টা সম্পূর্ণ আল্লাহ তায়ালার দান। এমন যদি হতো যে দু একবার হয়েছে দ্যান আর হয় নি তাহলে না হয় সলিউশন বের করা যেত। কিন্তু তার তো একবারের জন্য ও হয় নি।
-“ ঠিক আছে স্যার আমি আসি তাহলে।
তুহিন কেবিন থেকে বের হয় যেটুকু আশার আলো ছিলো এখন সেটাও নিভু নিভু। মেয়েটা এতো দিন নিজেকে কিভাবে সামলিয়ে এসেছে ভাবতেই তুহিনের বুক টা দুমড়ে মুচড়ে উঠল।
এই একটা কারনে মেয়েটা তাকে এভয়ড করলো। হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এক নির্জন রাস্তায় গিয়ে ধপ করে বসে পড়লো তুহিন। সে কোনো মতেই ইন্দুকে ছাড়তে পারবে না। সে তো ইন্দুকে ভালোবেসেছে মাঝ পথে ছেড়ে দেওয়ার জন্য না। কোনো একটা রাস্তা তার নিজেরই বের করতে হবে।
কথাগুলো ভেবে বসা থেকে উঠে বাসার দিকে হাঁটা ধরলো।
বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে মায়ের রুমে গেলো। তুহিনের মা বালিশে কাভার লাগাচ্ছিল। তুহিন পেছন থেকে মা কে জড়িয়ে ধরলো। হঠাৎ ছেলে কে জড়িয়ে ধরতে দেখে কিছু টা অবাক হয় তনয়া বেগম। ছেলের মাথায় হাত রেখে বলে-
-“ হঠাৎ আজ মা কে জড়িয়ে ধরলি।
তুহিন মাথা উঁচু না করেই বলে-
-“ কেনো আমি কি জড়িয়ে ধরতে পারি না?
-“ অবশ্যই পারিস। মন খারাপ?
-“ না। একটা সলিউশন খুঁজছি।
-“ কিসের সলিউশন?
তুহিন তার মাকে ছেড়ে দিয়ে বিছানায় বসলো। চোখের ইশারায় তার মাকেও বসতে বললো। তনয়া বেগম বসে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করলো।
তুহিন তার মায়ের হাত টা ধরে বলে-
-“ আচ্ছা মা একটা মেয়ের যদি পিরিয়ড না হয় তার কি সংসার করা বারন?
তনয়া বেগম অনেকটা অবাক হন ছেলের কথা শুনে। তার ছেলে কখনও এসব কথা বলে না। ছেলের দিকে পলকহীন ভাবে চেয়ে বলে-
-“ হঠাৎ এ কথা কেনো বলছিস?
-“ আচ্ছা তুমি তো মা তাই না,তোমার কি মনে হয় পিরিয়ড না হওয়ার পেছনে কি একটা মেয়ের হাত থাকে?
-“ অবশ্যই না। এটা সম্পূর্ণ আল্লাহর দান।
-“ তাহলে কি একটা মেয়ের বয়স চব্বিশ হওয়ার পর ও যদি এটা না হয় তাহলে কি তাকে বিয়ে করা বারন?
তনয়া বেগম সন্দেহজনক দৃষ্টি নিয়ে বলে-
-“ তুই কার কথা বলতে চাইছিস তুহিন?
-“ আমার এক পেসেন্টের মা। তার হয় নি পিরিয়ড কিন্তু তাকে একটা ছেলে পাগলের মতো ভালোবাসে,তার কাছে এটা কোনো বড় সমস্যা মনে হচ্ছে না। তাকে যদি ছেলেটা বিয়ে করে ঘরে নেয় তাহলে কি খুব অন্যায় হবে?
-“ ছেলেটা মনে হয় অনেক আবেগপ্রবণ। বাস্তবতা খুব কম জানে। কোনো মা বাবা চাইবে না ওমন মেয়ে ঘরের বউ করে নিতে যেখানে সেই মেয়েকে বিয়ে করলে তাদের বংশ বৃদ্ধি হবে না। তাদের অস্তিত্ব ওখানেই শেষ।
-“ কিন্তু ছেলেটা তো অনেক ভালোবাসে মা মেয়েটাকে। সে তো তার ত্রুটি গুলো না জেনেই তাকে ভালোবেসেছে,মেয়েটাকে ছাড়া অন্য কাউকে সে কল্পনাই করতে পারে না। বাবা মায়ের কি উচিত না ছেলেটার ইচ্ছে টাকে প্রাধান্য দেওয়া?
-“ ছেলে যদি জেনেশুনে বা না জেনেশুনে আগুনে হাত দিতে চায় তাহলে বাবা মা অবশ্যই আটকাবে। ছেলেটার উচিত মেয়েটাকে ভুলে যাওয়া।
তুহিন অবাক হয় মায়ের কথা শুনে।
-“ তুমি এ কথা বলছো মা! বাই এনি চান্স যদি আৃার ছোট বোন থাকতো আর তার এমন সমস্যা হতো তুমি কি করতা? তার দোষ দিতা?
-“ অবশ্যই না। তুই এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিস কেনো?
-“ এমনি মা। একটা কথা বলবো?
-“ হুমম বল।
-“ আজ তোমাকে অন্য রকম লাগলো মা।
-“ হঠাৎ এ কথা কেনো?
-“ এই যে কি নির্দ্বিধায় বলে দিলে ভুলে যেতে। একটু মেয়েটার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে ভাবতে। হয়তো এটা বলতে পারতে না।
কথাটা বলেই তুহিন চলে গেলো। তনয়া বেগম থম মেরে বসে রইলো। সত্যি কি সে বাস্তবতা বুঝাতে গিয়ে নিজের মেন্টালিটি কে ছোট করে ফেললো?
_________________
নতুন একটা সকাল,সবার জীবনে নতুন নতুন কিছু মোড় নিয়ে আসে রাত পোহানোর পর এই সকাল। ইন্দু সেই সন্ধ্যায় ঘুমিয়েছে কাল এখন ভোর পাঁচটা বাজে। আজানের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় তার। বিছানা থেকে উঠে ওজু করে নামাজে দাঁড়ায়। মন ভালো করার এই তো একটা মেডিসিন। তার মনের সব কথা নির্দ্বিধায় যাকে বলতে পারে। মোনাজাতে রবের নিকট বুকের মধ্যে রাখা চাপা কথা গুলো বলে মন টাকে হালকা করলো।
মোনাজাত শেষ করে রুমে থেকে বের হতেই দেখে রান্না ঘর থেকে টুকটাক আওয়াজ ভেসে আসছে। মনোয়ারা বেগম রান্না করছেন। ইন্দু সেদিকে একবার চেয়ে গায়ে চাদর টা জড়িয়ে বাহিরে বেরিয়ে যায়। প্রায় মিনিট বিশেকের মতো হাটাহাটি করে বাসায় ফিরে রেডি হয়ে খেয়ে দেয়ে স্বাভাবিক ভাবে স্কুলে চলে যায়।
মনোয়ারা বেগম অবাক হয় মেয়ের এমন স্বাভাবিক আচরণ দেখে। মেয়ে বের হলে ঘরের দরজা আটকিয়ে ইলিয়াস কে স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়ে।
তুহিন উপর থেকে নিচ অব্দি ইন্দুপ্রভা কে পরখ করে নিলো। বুকে হাত গুঁজে বলে-
-“ ডাকার সাথে সাথে চলে আসলে নট ব্যাড। একটু হলেও মনে জায়গা করে নিতে পেরেছি তাই তো?
ইন্দু বিরক্ত হলো নিজের করা কান্ডকারখানা দেখে। লোকটার কথায় এসেও বিপাকে পড়েছে।
-“ আচ্ছা তাহলে আমি চলে যাচ্ছি।
কথাটা বলে ইন্দু চলে যেতে নিলে তুহিন বলে উঠে-
-“ যেয়ো না ইন্দু,সাত টা দিন দেখি নি একটু দাঁড়াও তোমায় দেখে চোখের তৃষ্ণা মিটাই।
ইন্দু দাঁড়িয়ে গেলো। পেছন ফেরার সাহস হয় না। লোকটাকে সেদিন কত কিছু বললো তবুও লোকটা আবার এসেছে। নিজেকে শক্ত করলো ইন্দু পেছন ঘুরে তুহিনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে-
-“ আপনি কতটুকু ভালোবাসেন আমায়?
তুহিন হাসলো। নির্বিকারে জবাব দিলো-
-“ ভালোবাসা কি পরিমাপ করা যায় আদৌও! এই যে তুমি কি কখনও মাটি থেকে আকাশের মাঝে যে ব্যাবধান সেটা পরিমাপ করতে পারবে?
-“ এটার সাথে ওটার তুলনা কিভাবে হয়?
-“ এই যে তুমিই প্রশ্ন করছো তোমায় আমি কতোটা ভালোবাসি। মাটি থেকে আকাশের মাঝে যেটুকু ব্যাবধান আমি সেটুকুই ভালোবাসি তোমায়।
-“ শুনেন আমি আপনাকে একটা কথা বলবো,আমার মনে হয় কথাটা শুনলে আপনি আর আমার পেছন ঘুরে সময় নষ্ট করবেন না।
তুহিন ভ্রুকুটি করে।
-“ কি কথা?
-“ কাল ফ্রী আছেন?
-“ হ্যাঁ।
-“ তাহলে বিকেল তিনটায় আমার স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবেন,আমার ব্যাপারে আপনাকে আমি সব বলবো। এরপর আর জীবনেও আপনি আমার সামনে আসবেন না।
তুহিন মুখটা থমথমে করে বলে-
-“ তাহলে আর বলা দরকার নেই।
-“ দরকার আছে তাই বলতে চাইছি। আপনি চলে আসবেন ঠিক সময়ে,এখন আসি।
কথাটা বলে ইন্দু চলে যায়। শুধু শুধু ছেলেটাকে এভাবে কষ্ট দেওয়ার মানে হয় না। ছেলেটা সাময়িক কষ্ট পেলেও কিছু করার নেই।
তুহিন ঠাই দাঁড়িয়ে ইন্দুর যাওয়া দেখলো। ইন্দু চোখের আড়াল হতেই এলোমেলো পায়ে হেঁটে বাসায় আসলো। কাল কি এমন ইন্দুর ব্যাপারে সত্যি বলবে ইন্দু। এমন কোনো সত্যি শুনতে চায় না তুহিন যেটায় তাদের মাঝে দুরত্ব বাড়বে।
ইন্দু বাসায় আসতেই ইন্দুর মা মনোয়ারা বেগম বলে উঠে –
-“ বলে দিয়েছো সব?
ইন্দু সোফায় বসে পড়লো। সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বললো-
-“ সাহস পাই নি মা বলার। কাল আসতে বলেছি কাল যে করেই হোক বলতে হবে। উনার এমন পাগলামি ভালো লাগছে না। সামনে থাকলে দূরে সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে আবার চোখের আড়াল হলে পাগল পাগল লাগে। আমি বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেছি মা।
মনোয়ারা বেগম মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন। মেয়ে যে তুহিন কে ভালোবেসে ফেলছে এটা বুঝতে অসুবিধা হলো না। সামনে কি অপেক্ষা করছে কেউ জানে না।
-“ ভেঙে পড়ো না মা,সব ঠিক হবে। তুহিন বুঝবে তোমাকে। আমি দেখেছি ছেলেটা তোমায় কতোটা ভালোবাসে। এই তো সেদিন তার নম্বর ব্লক করছিলে দেখে ভোর বেলা থেকে তুহিন কে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম। অনেক্ষন দেখার পর আর না পেরে আমি নিজেই চলে যাই নিচে। তুহিনের সামনে দাঁড়িয়ে বলি-
-“ আসসালামু আলাইকুম আন্টি। আপনি ঠিক ধরেছেন আমিই তুহিন।”
-“ তুমি সেই ভোর বেলা থেকে এখানে দাঁড়ায় আছো কেনো? সমস্যা কি তোমার?”
-“ আসলে আন্টি আপনার মেয়েটা না আমায় বুঝতেই চায় না। কাল পইপই করে বলে দিয়েছি নাম্বার ব্লক করতে না তবুও ব্লক করে রেখে দিছে। সেজন্য দাঁড়িয়ে আছি।”
-“ ইন্দুকে ভালোবাসো?”
-“ ভীষণ ভালোবাসি আন্টি।”
-“ এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে বাসায় চলো। ”
-“ আপনাদের বাসায় আন্টি? ”
-“ হুম।”
-“ আন্টি ইন্দু রাগ করবে।”
-“ করলে আমি আছি তো। সামলে নিবো।”
-“ শিওর। ”
-“ হুমম।”
ইন্দু মাথা তুলে তাকায়। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ মা তুহিন যদি আমায় ঘৃণা করে তখন কি করবো আমি।
-“ ঘৃণা কেনো করবে? আর ঘৃণা করলে বুঝবি তোর মা মিথ্যা ছিলো।
-“ কেউ কি চাইবে মা সে বাবা মা না হয়ে সারাজীবন পাড় করতে? সবার ভেতরই বাবা মা হবার ইচ্ছে থাকে তুহিনের ও আছে।
-“ কাল বলে দেখ সত্যি টা। আর এসব নিয়ে টেনশন করবি না একদম যা হবে ভালোর জন্য ই হবে। যা রুমে গিয়ে রেস্ট নে।
ইন্দু তপ্ত শ্বাস ফেলে নিজের রুমে চলে গেলো।
এদিকে তুহিন একদণ্ড স্থীর হয়ে বসে থাকতে পারছে না। ইন্দু কি এমন বলতে পারে কথাটা বারবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সময় টা মনে হচ্ছে যেতেই চাচ্ছে না।
কোনো রকমে রাত টা পার করলো তুহিন, সকালে তড়িঘড়ি করে কিছুটা মুখে নিয়ে হসপিটালে গেলো সেখানে হাতের কাজ সেরে দুপুরেই বেড়িয়ে পড়ে। ইন্দুর স্কুলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রায় ঘন্টা দুয়েক পর স্কুলের ছুটির ঘন্টা বাজতেই যেনো তুহিনের হৃদপিণ্ড টা কেঁপে উঠলো আচমকা। সামনে তাকাতেই দেখে ইন্দু আসতেছে।
তুহিন এক ঢোক গিলে। ইন্দু তুহিনের সামনে এসে দাঁড়ায়। একপলক তুহিনের দিকে তাকিয়ে চোখ নিচে নামায়।
-“ চলুন স্কুলের পাশে যে খোলা উদ্যান আছে ওখানে।
ইন্দু সামনে হাঁটে আর তুহিন ইন্দুর পেছনে। খোলা উদ্যানের সামনে এসে একটা বেঞ্চে বসে পড়ে ইন্দু। তুহিন দাঁড়িয়ে ইন্দুকে দেখে। ইন্দু কাঁধে থাকা ব্যাগটা থেকে পানির বোতল বের করে পানি খেয়ে নেয়। ইশারায় তুহিন কে পাশে বসতে বলে।
-“ তুহিন আমি আপনাকে আমার ব্যাপারে কিছু বলতে চাই। আপনি তো জানেন মেয়েদের বিষয়ে সব। পিরিয়ড নামক শব্দটার সাথে তো আপনি পরিচিত।
তুহিন মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে। ইন্দু তপ্ত শ্বাস ফেলে আবার বলতে লাগে-
-“ আমার বয়স চব্বিশ হতে চললো আমার এখনও পিরিয়ড হয় নি। আই থিংক আপনি বুঝতে পেরেছেন। আমি আর চার পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মত না। আমাদের সমাজে যাদের পিরিয়ড হয় না তাদের কিসের সাথে তুলনা করে আপনি তো জানেন। বাংলা ভাষায় বলতে গেলে হি/জড়া। আমি আপনাকে শুরু থেকেই বুঝিয়ে এসেছি। আপনি বুঝলেন না তাই আমাকেই বলতে হলো। আমাকে বিয়ে করলে কখনও বাবা হবার স্বাদ গ্রহন করতে পারবেন না। আর আমি চাইবো না আমার জন্য আপনার ক্ষতি হোক। এই পিরিয়ড ই একটা মেয়ের বাচ্চা হওয়ার সক্ষমতা প্রুফ করে। আমার হয় নি পিরিয়ড, আমি মা হতে অক্ষম। আপনি চাইবেন না এমন একটা মেয়েকে ভালোবাসতে বা জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে।
তার থেকে পালাতে মিথ্যা বলছে ইন্দু। স্মিত হেসে বললো-
-“ মিথ্যা কেনো বলছো ইন্দু? আমার থেকে পালাতে? দেখো আমি তোমাকে ভালোবাসি মিথ্যা বলো না প্লিজ।
ইন্দু বসা থেকে উঠে দাড়ালো।
-“ আমি মিথ্যা বলছি না তুহিন। আমি সত্যি বলেছি। আপনাকে মিথ্যা বলে আমার কি লাভ? আমি সত্যি মা হতে অক্ষম। মা হবার মতো এবেলিটি আমার নেই। সৃষ্টি কর্তা সেই সুযোগ আমায় দেয় নি।
তুহিন নির্বাক, কি বলা উচিত মাথায় আসছে না। মেয়েটা মা হতে অক্ষম! পিরিয়ড না হলে তো মা হওয়া ইম্পসিবল। এমনি অন্য সমস্যা থাকলে চিকিৎসা করে না হয় সারানো যেতো কিন্তু পিরিয়ড এটা কি করে ঠিক করা যায়!
-“ আমরা না হয় বাচ্চা এডপ্ট করবো ইন্দু।
তুহিনের চোখ মুখে অসহায়ত্ব।
ইন্দু তাচ্ছিল্যর হাসি মুখে এনে বলে-
-“ জীবন টা কোনো সিনেমা বা গল্প না তুহিন। আবেগ দিয়ে জীবন চলে না। বাচ্চা এডপ্ট আর নিজের বাচ্চা এক হয় কখনও? আমার সমস্যা আপনার তো না। আপনি অন্য কাউকে বিয়ে করলে বাবা হতে পারবেন। আর আমাকে করতে চাইলে সারাজীবন আফসোস করতে করতে পার করতে হবে।
-“ লাস্ট বারের মতো কিছু চাইবো দিবে ইন্দু?
ইন্দু ভ্রুকুটি করে বললো-কি?
-“ একটু খানি জড়িয়ে ধরতে চাই। প্লিজ না করো না।
কথাটা বলে তুহিন ইন্দুর উত্তরের অপেক্ষা করলো না। ইন্দুকে জড়িয়ে ধরলো। ইন্দু চোখ বন্ধ করে ফেললো। দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো চোখের কার্নিশ বেয়ে। মিনিট পাঁচেক পর তুহিন ইন্দু কে ছেড়ে দিলো। ইন্দুর চোখ মুখে আছড়ে পড়া চুল গুলো আলতো হাতে কানের পেছন গুঁজে দিয়ে কপালে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিয়ে বলে-
-“ সাবধানে বাসায় যাবে। ভালো থেকো।
কথাটা বলে তুহিন চলে যায়। তুহিনের যাওয়ার পানে ইন্দু তাকিয়ে থাকে। নিজের ভাগ্য নিয়ে আজ নিজেরই উপহাস করতে ইচ্ছে করছে। খুব কান্না করতে ইচ্ছে করছে ইন্দুর। চিৎকার করে কান্না করলে হয়তো মনের ভেতরে থাকা কষ্ট গুলো একটু বেড়িয়ে আসতো। আর পাঁচ টা মেয়ের মতো স্বাভাবিক হলেও তো পারতো। তুহিন ও বুঝলো না,মা তার মানে ভুল ছিলো। তুহিনের ভালোবাসা কর্পূরের মতো উবে গেছে সত্যি টা শোনার পর। কোনো ছেলের পক্ষে তো সম্ভব না এমন মেয়ে বিয়ে করা। তুহিনের দোষ নেই এখানে।
কথাগুলো আনমনে ভেবে এলোমেলো পায়ে বাসার পথে হাঁটা ধরলো ইন্দু। কয়েকদিন কষ্ট হবে তারপর সব ভুলে আবার নতুন ভাবে বাঁচবে সবাই।
আকাশ টা আজ মেঘলা। কালো মেঘগুলো উড়ে চলছে আকাশ জুড়ে। দুদিন আগেও তো আকাশ ঠিক ছিলো,সব স্বাভাবিক ছিলো আজ হঠাৎ কেনো যে সকাল টা এভাবে শুরু হলো কে জানে। ইন্দু রেডি হয়ে নিলো। ডাইনিং টেবিলে গিয়ে খাবার টা চটপট খেয়ে কাঁধে ব্যাগটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো। হেঁটে যেতে বেশু সময় লাগে না স্কুলে তাই ইন্দু হেঁটে যাচ্ছে। হাঁটার মাঝে বারবার মনে হচ্ছে এই বুঝি কোথাও থেকে হুট করে তুহিন এসে ইন্দুর পাশে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটবে।
বারংবার আশেপাশে তাকালো। ফলাফল শূন্য। তুহিনের ছিটেফোঁটা ও নেই। নিজের কাজকর্ম দেখে নিজেই বিরক্ত ইন্দুপ্রভা। লোকটাকে মিস করতে শুরু করলো নাকি ইন্দু। হাতে থাকা ফোন টায় একবার সময় দেখে তাড়াতাড়ি হাঁটা ধরলো।
স্কুলে এসে নিজের ক্লাসে চলে গেলো ক্লাস নিতে।
ক্লাসে মন বসছে না ইন্দুর। কিছু একটার শূন্যতা অনুভব করছে। কালো আকাশ টার মতো তার মনটাও কেমন যেনো হয়ে যাচ্ছে।
ক্লাস থেকে বেরিয়ে করিডরে এসে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালো। তিনতলার উপর থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে কিছু দেখতে লাগলো।
এরমধ্যে কখন যে পাশে তার কলিগ সিয়াম এসে দাঁড়িয়েছে ইন্দু বুঝতে পারে নি। হঠাৎ কাশির আওয়াজে ইদুর ধ্যান ভাঙে। পাশে তাকিয়ে সিয়াম কে দেখে ভরকে যায়। ইন্দুকে ভরকে যেতে দেখে সিয়াম বলে-
“ রিলাক্স ইন্দু। তুমি এখানে অন্যমনষ্ক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলে তাই আসলাম। কোনো কিছু নিয়ে কি চিন্তিত তুমি?
ইন্দু মুচকি হেঁসে বলল-
“ না না তেমন কিছু না আসলে মাথা টা ধরেছে অনেক তাই আর কি…
সিয়াম কিছুক্ষণ চুপ রইলো। কিছু একটা ভেবে বলল-
“ একটা কাজ করা যায় ইন্দু,পাশেই একটা ক্যাফে আছে ওখানে দারুন কফি পাওয়া যায়। তোমার মাথা ব্যাথা গায়েব হয়ে যাবে।
সিয়ামের কথাটা মন্দ লাগলো না ইন্দুর কাছে এখন একটা কফির ই ভীষণ দরকার। ইন্দু ক্লাস থেকে নিজের ব্যাগটা নিয়ে ক্যাফের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরলে পেছন থেকে সিয়াম ডেকে উঠে। ইন্দু পেছন ঘুরে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টি তে তাকালে সিয়াম গাল ভরা হাসি উপহার দিয়ে বলে-
“ তোমাকে এটার সন্ধান দিলাম আমি আর আমাকে না নিয়েই চলে যাচ্ছো?
ইন্দু স্মিত হেসে বলে-
“ সরি আসলে ভুলে গেছি আপনাকে ডাকতে।
“ হুমম সেটাই দেখলাম। তাই নিজেই পিছু ডেকে চলে আসলাম। তাহলে যাওয়া যাক ক্যাফে তে।
ইন্দু মাথা নাড়িয়ে হাঁটা ধরলো। বুকের মাঝে কেমন যেনো চিনচিন ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। কাজে মন বসলো না। এখন অর্ধেক রাস্তায় এসে আর ক্যাফেতে যেতে ইচ্ছে করছে না। কাউকে ভীষণ মিস করছে। কিন্তু কাকে? আনমনে হাঁটতে হাঁটতে ক্যাফে অব্দি চলে আসলো। ক্যাফের সবার লাস্টে থাকা একটা ফাঁকা বেঞ্চে গিয়ে বসে পড়লো সিয়াম আর ইন্দু। সিয়াম ওয়েটার কে ডেকে দুটে কফি অর্ডার দিয়ে বকবক করতে লাগলো। ইন্দুর বিরক্ত লাগছে তবুও ভদ্রতার খাতিরে চুপ রইলো। ওয়েটার কফি দিয়ে গেলে ইন্দু সেটা মুখে নিয়ে সামনে তাকাতেই তুহিন কে দেখতে পেয়ে মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে। কিন্তু পরক্ষণেই হাসি টা মিলে যায় ঘন অন্ধকার হয়ে যায় মুকখানা। তুহিনের পাশে অতি সুন্দর একটা রমণী বসে আছে। তুহিন মুখ নাড়িয়ে কিছু বলছে আর মেয়েটা এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে তুহিনের দিকে। ইন্দুর এটা সহ্য হলো না।
মেয়েটার উপর না চাইতেও রাগ হলো। কফি আর খাওয়া হলো না ইন্দুর। সিয়াম কে রেখেই হনহন করে বেড়িয়ে গেলো ক্যাফে থেকে। তুহিন এতোটাই মগ্ন ছিলো রিপোর্ট টার দিকে যে এখানে যে কেউ একজন তাকে জেলাস হয়ে রেগে তারই পাশ কাটিয়ে চলে গেছে সে বুঝতেও পারলো না।
রিপোর্ট থেকে মুখ সরিয়ে সামনে থাকা লামিয়া নামের মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলে-
“ চিন্তা করবেন না রিপোর্ট টা আমি ভালোমতো ই দেখেছি। আপনার বাবার তেমন সমস্যা নেই আপনি অযথা টেনশন করছেন।
লামিয়া নামের মেয়েটা তুহিনের থেকে রিপোর্ট টা নিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি উপহার দিয়ে টুকটাক কথা বলে চলে যায়।
তুহিন তপ্ত শ্বাস ফেলে। একটা সপ্তাহ ধরে তার উপর দিয়ে কাজের প্রেশার যাচ্ছে অনেক। তার উপর এই মেয়ে বারবার ফোন দিয়ে বাবা কে অযৌক্তিক টেনশন সময় বের করে এসে বুঝিয়ে বলতে হলো শুধু শুধু টেনশন করছে।
ইন্দুকে দেখা হয় না সাতটা দিন ধরে। মেয়েটা নিশ্চয়ই খুশি হচ্ছে। এদিকে তুহিন যে ইন্দুকে দেখতে না পেয়ে দহনে পুড়ছে সেটা যদি মেয়েটা একটু জানতো।
ইন্দু আর স্কুলে গেলো না। বাসা যাবের পথে একটা খোলা প্রান্ত মাঠ পড়ে। সেই উদ্যান মাঠে গিয়ে একটা গাছের তলায় বসলো। ফোন বের করে সময় দেখে নিলো। স্মৃতি কে বলেছিলো এখান টায় আসতে মেয়েটা আসছে না দেখে বিরক্ত লাহছে।
মিনিট দশেক বসে অপেক্ষা করলো এরমধ্যে স্মৃতি ও চলে আসলো। স্মৃতি ইন্দুর পাশে বসে বলে-
-“ আজ তুহিন নামের ছেলেটার সাথে একটা মেয়েকে দেখে বুকের ভেতর টায় কেমন যেনো ব্যাথা করলো।
স্মৃতি স্মিত হাসলো ইন্দুর কথা শুনে। ইন্দুর পিঠে হাত দেয়, স্মৃতি ইন্দুর ভাবসাব দেখে কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে বলে-
-“ মানুষ বড়ই বিচিত্র প্রাণী। এদের মনে কি থাকে এরা নিজেরাই বুঝতে পারে না। তবে যাই বলিস তুহিন ছেলেটা কিন্তু দারুন। অন্যান্য ছেলের থেকে ব্যাতিক্রম কিছুটা।
মূহুর্তে ইন্দুর মুখের ভাবভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে যায়। মনে পড়ে ক্যাফের ঘটনা। বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। কাঁধের ব্যাগটা শক্ত করে ধরে বলে-
-“ সব ছেলে এক। পাত্তা না পেলেই নতুন মেয়ের পেছন ঘুরা শুরু করে। তুই বাসায় চলে যা।
কথাটা বলে ইন্দু হাঁটা ধরে। হঠাৎ রেগে যাওয়ার বিষয় টা বুঝলো না স্মৃতি। ❝এই যে আমরা মানুষ কে ভালোবেসে গ্রহণ করতে পারি না আবার তাদের কে অন্য কারো সাথে দেখলে রাগ করে বসি।❞এই মেয়ে কবে যে নিজের ভালো বুঝবে কে জানে।
————————–
তুহিন আজ তাড়াতাড়ি কাজ সেরে বিকেলেই হসপিটাল থেকে বেড়িয়ে পড়ে। ফোনের লক খুলে সোজা ইন্দুর নাম্বারে কল লাগায়৷ মেয়েটাকে দেখে না দুটো দিন ধরে। ইন্দু বিছানায় অন্যমনষ্ক হয়ে বসে ছিলো। ফোনের রিংটোন বেজে উঠায় ফোনের স্কিনে নাম্বার টা ভালোমতো না দেখেই ফোন রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে তুহিন বলে উঠে-
-“ ইন্দু তুমি কি একটু নিচে আসতে পারবা, আমি তোমার বাসার নিচে দাঁড়িয়ে।
ইন্দু বিছানা থেকে উঠে হন্তদন্ত হয়ে বেলকনি তে আসে। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে তুহিন ফোন কানে নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
-“ আপনি আসছেন কেনো আমার বাসার সামনে? বলেছিলাম না না আসতে।
-“ পাগল পাগল লাগবে কেনো ক্যাফেতে কি ভালো লাগে নি, সুন্দরী রমণী সামনে বসে ডেঁপ ডেঁপ করে তাকিয়ে ছিলো ভালো লাগে নি?
তুহিন ইন্দুর কথার মানে বুঝলো না। ক্যাফের কথা মনে হতেই কালকের কথা মনে পড়লে। কাল লামিয়ার নামের মেয়েটার সাথে ক্যাফেতে ছিলো। তারমানে ইন্দু ও সেখানে ছিলো। আচ্ছা মেয়েটা কি কোনো ভাবে জেলাশ? কথাটা মনে আসতে মুখে হাসি ফুটে উঠলো। যাক এবার তাহলে একটা পথ পেয়েছে।
-“ হ্যাঁ মেয়েটা বেশ সুন্দরী ছিলো,আচ্ছা তোমার যেহেতু আসতে সমস্যা তাহলে লামিয়া কে ডেকে নিয়ে যাচ্ছি। মেয়েটা হেল্প করতে পারবে আমার,তোমার তাহলে আসতে হবে না।
-“ কি হেল্প বলেন করে দিচ্ছি।
-“ নিচে না আসলে বলবো কিভাবে। রেডি হয়ে আসবে।
-“ আমি রেডিই।
-“ আচ্ছা নিচে আসো।
ইন্দু আচ্ছা বলে ফোন কেটে দেয়। তুহিন হাসে। মেয়েটা আপন করে নেয় না আবার কারে সাথে দেখলে মেনেও নিতে পারে না। মেয়েদের জাতীয় স্বভাব বুঝি এটাই।
“ এই মেয়ে আমার মায়ের কাছে এটা বলেছো কেনো যে তুমি আমায় বিয়ে করতে পারবে না।”
ইন্দু স্কুলে যাচ্ছিল হেঁটে। হঠাৎ এমন কথা কর্ণকুহর হতে থেমে যায়। পেছন ঘুরে তুহিনের দিকে চেয়ে বলে-“ যা সত্যি সেটাই বলেছি। আপনাকে কেনো আমি বিয়ে করতে যাবো? আই ডোন্ট লাইক ইউ।”
তুহিন দু হাত কোমড়ে দিয়ে ভ্রুকুটি করে বলে-“ আই ডোন্ট লাইক ইউ কথাটাকে কি অন্য ভাবে বলা যায় না। ডোন্ট টা বাদ দিয়েও তো বলতে পারতা যে আই লাইক ইউ।”
ইন্দু আর কথা বাড়ালো না সামনে ঘুরে হাঁটতে লাগলো। তুহিন ইন্দুর পেছন পেছন হাঁটতে লাগলো। ইন্দু বুঝেও কিছু বললো না চুপচাপ চলতে লাগলো।
স্কুলের সামনে আসতেই ইন্দু পেছন ঘুরে বলে-“ এবার চলে যান আমি স্কুলের সামনে এসে গেছি।”
তুহিন মুচকি হেসে ইন্দুর হাত ধরে বলে-“ আম্মাকে আবার পাঠাবো এবার আর না করো না প্লিজ ইন্দু।”
কথাটা কানে আসতেই ঝড়ের বেগে তুহিনের থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিলো ইন্দু। মূহুর্তে মুখের ভঙ্গিমা চেঞ্জ হয়ে গেলো। তুহিনের দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠল-“ আপনি কি বেহায়া? সামান্য লজ্জা নেই আপনার, গন্ডারের চামড়া নাকি আপনার শরীরে? আপনার মা’কে কাল আমি বলে দিয়েছি না আপনায় বিয়ে করতে পারবো না তবু বেহায়ার মতো পেছন ঘুরেন। বাসা থেকে কি এটাই শিখিয়ে দিছে আপনার মা। বেহায়া ছ্যাচড়া ছেলে একটা। মিনিমাম লজ্জা থাকলে আমার সামনে আর আসবেন না প্লিজ এই রিকুয়েষ্ট টা অন্তত রাখবেন।”
কথাটা বলে ইন্দু স্কুলের ভেতর ঢুকে যায়। তুহিন অবাক হয়ে ইন্দুর যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। কোথায় যেনো পড়েছিল তুহিন ❝ যা তোমার তা তোমারই থাকবে দিনশেষে। আর যা তোমার না সেটা শিকলে বেঁধে রাখলেও দিন শেষে তা তোমার হবে না❞
“কথাটা তাহলে হুবুহু মিলে যাচ্ছে! ইন্দু কি তাহলে দিনশেষে আমার হবে না? কথাটা মনে আসতেই বুকটা বিষাদে ভরে গেল তুহিনের। ইন্দুকে ছাড়া বেঁচে থাকা ইম্পসিবল❝ মানুষ যদি ভালোবাসা দিয়ে পাথরে ফুল ফোটাতে পারে তাহলে আমি ও আমার ভালোবাসা দিয়ে ঠিকই তোমার মন জয় করতে পারবো ইন্দু। ভালোবেসেছি তোমায় নিজের করেই ছাড়বো।❞
কথাটা বলে হসপিটালে চলে যায় তুহিন। হসপিটালে এসে নিজের কেবিনে যেতেই দেখে তার ফ্রেন্ড সাগর বসে আছে। নিজের কেবিনে সাগর কে দেখে ভ্রুকুটি করে ফেলে তুহিন। চেয়ারে বসতে বসতে বলে-“ কি ব্যাপার আমার কেবিনে তুই?”
সাগর হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলে-“ কয়টা বাজে দেখতো।”
তুহিন হাত ঘড়িটায় টাইম দেখে বলে-“ দশ-টা বাজে।”
“ ডিউটি কয়টায় আরম্ভ? ”
“ এক ঘন্টা লেট হয়েছে।”
“ স্যার আজ রেগে গেছে এভাবে তুই যদি প্রতিদিন লেট করিস তাহলে স্যার তোকে ডাক্তারি ছেড়ে দিতে বলছে।”
তুহিন চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলে-“ হুমম ছেড়ে দিব।”
সাগর চেয়ার ছেড়ে উঠে বলে-“ মাথা খারাপ তোর! এমন জব কেউ ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা মাথায় আনে কি করে?”
“ ইন্দু মেয়েটা যে ওর মাথা চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেলছে তাই সুখে থাকতে ভূতে কেলাচ্ছে।”
কথাটা বলতে বলতে তুহিনের কেবিনে ঢুকে নীলা। তুহিন চোখ বন্ধ রেখেই মুচকি হেসে বলে-“ মেয়েটা যদি মুখ ফুটে বলতো চাকরি কেনো তোমার জান টা আমায় দিয়ে দাও আমি হাসতে হাসতে আমার জান টা তাকে দিয়ে দিতাম। কিন্তু আফসোস মেয়েটা তেমন কিছুই আমায় বলেনি। চাকরি আমি আমার নিজের ইচ্ছেয় ছাড়ছি। আর স্যার নিজেও তো বলেছে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। ”
সাগর টেবিলের উপর এক হাত ভরে দিয়ে বলে-“ স্যার এমনি এমনি বলে নি তুহিন। তোর অনিয়ম স্যারের চোখে পড়ছে বারংবার। একটা মেয়ের পেছন পড়ে কি থেকে কি হয়ে গেছিস একবার নিজেকে আয়নায় দাঁড় করিয়ে ভাব তো। ভালোবাসা অন্যায় নয়। কিন্তু একপাক্ষিক ভালোবাসা মারাত্মক ক্ষতি করে। এই যেমন তুই একপাক্ষিক ভালোবেসে যাচ্ছিস ইন্দুকে। মেয়েটা তো তোকে ভালোবাসে না তাহলে কেনো মেয়েটার পেছন পড়ে নিজের ফিউচার নষ্ট করছিস। আন্টির কথা ভাব আন্টি তোকে এতো টাকা পয়সা খরচ করে ডাক্তারি পড়িয়েছে কি এই দিন দেখার জন্য? ”
তুহিন বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। নিজেকে দেখিয়ে বলে-“ আচ্ছা দেখতো আমি কি দেখতে শুনতে খারাপ? চেহারা বাজে? ”
“ এটা কেমন কথা বলতেছিস তুই? আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের মধ্যে সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ তুই।”
“ তাহলে ইন্দু কেনো ভালোবাসে না আমায়?”
নীলা অন্যমনষ্ক হয়ে বলে-“ তোর চেহারা ব্যাক্তিত্ব সব সুন্দর কিন্তু যারা ❝ভালোবাসা’ পাওয়ার জন্যে মানুষের কাছে ছ্যাচড়া বেহায়া হয়ে যায়, তাদেরকে মূলত বেহায়া হওয়ার কারণেই ভালোবাসে না মানুষ!❞ উদাহরণ নিশ্চয়ই দিতে হবে না।”
কথাটা বলে নীলা বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে। সাগর তুহিনের কাঁধে হাত রেখে বলে-“ একটা ভুল ডিসিশানের উপর কিন্তু তোর পুরো লাইফ নির্ভর করছে। সো ভেবে চিন্তে ডিসিশন নিস।”
কথাটা বলে সাগরও চলে যায়। তুহিন তপ্ত শ্বাস ফেলে। ❝কেউ কারো পরিস্থিতি বুঝতে পারে না যতক্ষণ না সেই ব্যাক্তি, ওপর ব্যাক্তির মতো সেম পরিস্থিতিতে পড়ে। ❞
——————————-
বিকেলের দিকে আকাশটা কালো মেঘে ঢেকে গেছে। চারিদিক দিয়ে বইছে বাতাস। বাতাসের সাথে যুক্ত হয়েছে রাস্তার ধুলোবালি। এই বাতাস গুলো সংকেত দিচ্ছে গর্জে বৃষ্টি বা ঝড় আসবে। ইন্দু স্কুল থেকে বেরিয়ে তাড়াতাড়ি বাসার উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরে। বৃষ্টি নামার আগেই বাসায় যেতে হবে। আজ আর নিমি কে পড়াতে যাবে না। বাসার কাছে আসতে আসতেই গর্জে বৃষ্টি নামা ধরলো। ইন্দু আর না হেঁটে রাস্তার পাশে দোকানের সামনে গিয়ে আশ্রয় নিলো।
বেশখানিকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকার পরও বৃষ্টি থামার নাম গন্ধে নেই। বৃষ্টির ফোঁটা গুলো বাতাসের কারনে ইন্দুর শরীর কে ভিজিয়ে দিচ্ছে। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে বাসায় আর সন্ধ্যার আগে ফিরতে পারবে না। ইন্দু বৃষ্টি মাথায় নিয়েই হাঁটা ধরলো। কয়েক কদম যেতেই হঠাৎ নিজের উপর বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে না দেখে উপর তাকিয়ে দেখে তার মাথার উপর ছাতা।
পাশে ঘুরতেই দেখে তুহিন ইন্দুর মাথায় ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর সে বৃষ্টি তে ভিজছে। ইন্দু ছাতার নিচ থেকে সরে যেতে চাইলে তুহিন বলে-“ সরে যেও না বৃষ্টি তে ভিজলে জ্বর আসবে।”
ইন্দু বিরক্তি নিয়ে বলে-“ আপনি আবার আসছেন কেনো? আপনি যে ভিজছেন আপনার জ্বর আসবে না? ছাতাটা আপনার আপনি কেনো ভিজছেন? আমার বাসা কাছেই চলে যেতে পারবো আমি।”
তুহিন কথা না বাড়িয়ে ছাতা টা ইন্দুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে-“ চুপচাপ বাসায় যাও। আন্টি হয়তো চিন্তা করছে। আর আমাকে নিয়ে তোমার টেনশন করতে হবে না। কিন্তু তোমাকে নিয়ে আমার টেনশন করতে হবে।”
কথাটা বলে তুহিন পেছন ঘুরে বাসার দিকে চলে যায়। ইন্দু তুহিনের যাওয়ার পানে তাকিয়ে বলে-“ আমায় কেনো ভালোবাসতে গেলেন তুহিন। আমার সত্যি টা জানলে মানতে পারবেন তো? তখন কষ্ট ঘৃণা লাগবে না?”
মনোয়ারা বেগম দরজায় কলিং বেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুলেই সামনে তুহিনের মা দেখে থমকে যায়। প্রথমত চিনে নি তাকে পরিচয় দেওয়ার পর চিনেছে। মনোয়ার বেগম সালামের জবাব দিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি উপহার দিয়ে দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ায় তুহিনের মা কে ভেতরে ঢুকতে দেয়ার জন্য। তুহিনের মা ভেতরে ঢুকে। মনোয়ারা বেগম তনয়া বেগম কে সোফায় বসতে বলে কিচেন রুমে গিয়ে হালকা নাস্তার ব্যাবস্থা করতে নিলে তনয়া বেগম বাঁধা দেয়। মনোয়ারা বেগমের হাত ধরে বলে-“ আপা আপনার সাথে আমি কিছু কথা বলতে এসেছি।
মনোয়ারা বেগম বলে-“ হুমম বলুন কি কথা আপা।”
তনয়া বেগম কিভাবে শুরু করবেন বুঝতে পারছেন না বেশ খানিকটা সময় হাসফাস করে বলে-“ আপা ইন্দুপ্রভা কে আমি আমার তুহিনের জন্য নিতে চাইছি। আপনি প্লিজ আপা অমত করবেন না।”
মনোয়ারা বেগম আন্দাজ করেছিলেন যে তনয়া বেগম এমন কথাই বলবেন। কিন্তু এই কথার প্রেক্ষিতে মনোয়ারা বেগমের কি বলা উচিত সেটা তার সত্যি জানা নেই। অতঃপর কিছু বলার জন্য উদ্যত হলে রুম থেকে ইন্দু বেরিয়ে এসে বলে-“ মাফ করবেন আন্টি আপনার ছেলেকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আপনার ছেলেকে আগেই বলে দিয়েছি তবুও যে কেনো বেহায়ার মতো আপনাকে পাঠালো আমার মাথায় আসছে না।”
কথাটা তনয়া বেগমের গায়ে লাগলেও ছেলের জন্য সয়ে নিলো। মুখে হাসির আভা ফুটিয়ে বলে-“ আমার ছেলে কে বিয়ে করতে তোমার অসুবিধে কোথায় ইন্দু? একটা ছেলে কে বিয়ে করতে হলে যা যা গুন থাকা লাগে সেসবই তো আমার ছেলের আছে। ”
ইন্দু তনয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে-“ আপনার ছেলে কে আমার পছন্দ না আন্টি। আপনি প্লিজ এটা নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করবেন না। আপনার ছেলেকে আমি বিয়ে করবে না। আই হোপ আপনি আপনার ছেলেকে বুঝাবেন আমাকে যেনো আর বিরক্তি না করে। কারন ব্যাবহারেই বংশের পরিচয় আন্টি আশা করি বুঝতে পারছেন কি মিন করছি।”
তনয়া বেগম তব্দা খেয়ে যায়। “ আমার ছেলেকে কেনো পছন্দ না তার একটা রিজন দাও ইন্দু যদি যুক্তিসঙ্গত হয় তাহলে আমি তোমায় কথা দিচ্ছি আর কখনো আমার ছেলে তোমার সম্মুখে আসবে না।”
ইন্দু ভরকে যায়। কি রিজন দিবে? তুহিন যথেষ্ট ভালো ছেলে তাকে অপছন্দ করার রিজন নাই বলতে গেলে। ইন্দুকে চুপ থাকতে দেখে তনয়া বেগম ফের বলে উঠে -“ কি হলো চুপ হয়ে গেলে যে? রিজন দাও। ”
ইন্দু তার মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে ফের তনয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে-“ আন্টি রিজন নেই আমার কাছে এটা সত্যি। কিন্তু ফোর্স করে তো আর সংসার বিয়ে হয় না। আমি মন থেকে আপনার ছেলেকে বিয়ে করতে চাইছি না। আপনি তো চাইবেন না আপনার ছেলে বৈবাহিক জীবনে অখুশি থাকুক। আপনি অন্য কোনো মেয়ে দেখুন আপনার ছেলের জন্য। আমি পারবো না আপনার ছেলে কে বিয়ে করতে।”
কথাটা বলে ইন্দু নিজের ঘরে চলে আসে। তনয়া বেগম মনোয়ারা বেগমের দিকে তাকাতেই মনোয়ারা বেগম বলে উঠে -“ আপা তুহিন কে আমার মেয়ের জামাই হিসেবে ভালোই লাগে। কিন্তু ভালো শুধু আমার লাগলেই তো চলবে না। সংসার তো করবে আমার মেয়ে সে যদি এখন বিয়ে করতে না চায় তাহলে আমি তো জোর করতে পারি না।”
“ আপনার কথায় সহমত পোষণ করছি আমি আপা। কিন্তু আমার ছেলেটা তার বাবা মা’রা যাওয়ার এতো গুলো বছর পর মুখ ফুটে এই প্রথম কিছু চেয়েছে আমার কাছে। আমি আস্বস্ত ও করেছি ইন্দুকে রাজি করাবো কিন্তু আপনার মেয়ে তো রাজি হচ্ছে না।”
“ আপা সময় দিন আরো দুজন কে। আমি চেষ্টা করবো ইন্দুকে রাজি করানোর।”
“ হুমম আপা একটু দেখবেন এই ব্যাপার টা।আজ আসি।”
কথাটা বলে তনয়া বেগম উঠে চলে যায়। মনোয়ারা বেগম ইন্দুর ঘরে গিয়ে দেখে ইন্দু বেলকনিতে বসে আছে। মনোয়ারা বেগম এগিয়ে গিয়ে ইন্দুর কাঁধে হাত রাখতেই ইন্দু তড়িঘড়ি করে বা হাত দিয়ে চোখের কোণে লেগে থাকা অশ্রু মুছে ফেলে। মনোয়ারা বেগম ইন্দু কে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে-“ আর কত অশ্রু লুকানোর চেষ্টা করবি। ভালোবেসে ফেলছিস ছেলেটাকে স্বীকার করে নিচ্ছিস না কেনো?”
ইন্দু মনোয়ারা বেগমের থেকে নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বলে-“ কিসের অশ্রু মা। আমি কেনো অশ্রু লুকানোর চেষ্টা করবো? আর ঐ ছেলেকে আমি ভালোবাসি! নাইস জোক্স মা।”
মনেয়ারা বেগম স্মিত হাসে। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে-“ মা কে মিথ্যা ও বলা শিখে গেছিস। আমি তোর মা হই তুই না। জন্ম আমি তোকে দিয়েছি তুই না। কোনটা সত্যি বলছিস আর কোনটা মিথ্যা সেটা আমি খুব ভালো মতোই টের পাই। ভালোবাসা অপরাধ না ইন্দু। ছেলেটা তোকে ভালোবাসে। ভালোবাসে বিধায় তার মা কে আজ বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে পাঠিয়েছে।”
ইন্দু তাচ্ছিল্যের সুরে বলে-“ সত্যি টা জানলে মা কখনো আর তার মা কে পাঠাতো না। ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালাতো।”
“ সবাই এক না ইন্দু। তুহিন কে বলে দেখ বিষয় টা। ”
ইন্দু কাট কাট গলায় বলে-“ কোনো দরকার নেই মা। ”
“ তাহলে কি এভাবেই চলতে থাকবে জীবন?”
“ যেভাবে চলছে চলুক না মা যখন জীবনের মোড় আসবে তখন আপনা-আপনিই জীবন থেমে যাবে।”
মনোয়ারা বেগম ইন্দুর দু গাল ধরে বলে-“ এভাবে জীবন চলে না মা। মেয়ে হয়ে জন্মেছো বিয়ে করতেই হবে আজ না হোক কাল।”
ইন্দু তার গাল ধরে রাখা মায়ের হাত দুটোর উপর হাত দিয়ে ছলছল চোখে বলে-“ যে মেয়ে না তার আবার কিসের সংসার কিসের বিয়ে মা? ভুলে গেছো আমি কি। আমি একটা ….
পুরো কথাটা আর শেষ করতে দেয় না মনোয়ারা বেগম মেয়েকে বুকে চেপে ধরে। ইন্দু মায়ের বুকে ঠাই পেয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। মেয়েকে কি বলে শান্তনা দিবে তার জানা নেই। একটা ভুলকে আঁকড়ে ধরে আছে। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে-“ তুই ওটা নস ইন্দু। কতবার বলবো? তোর সব কিছুই তো আর সব মেয়েদের মতোন তাহলে কেনো বারবার নিজেকে ওটা বলিস?”
ইন্দু মায়ের বুক থেকে মাথা সরিয়ে স্মিত হেসে বলে-“ আমাকে স্বান্তনা দিচ্ছো মা? বিশ্বাস করো আর স্বান্তনা নিতে ইচ্ছে করে না। আমি যদি সত্যি মেনে নিতে পারি তুমি কেনো মেনে নিচ্ছো না। আমার যেসব কান্ডিশন তাতে ওটার সাথে তুলনা করা। আর আমি জেনে শুনে একটা ছেলেকে ঠকাতে পারবো না মা।”
কথাটা বলে ইন্দু আকাশের পানে চায়। পাশের রুম থেকে হঠাৎ ইলিয়াসের ডাক আসতেই মনোয়ারা বেগম শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছে মেয়ের পানে চেয়ে চলে যায়।
ইন্দু বেলকনির রেলিং ধরে নিচে বসে পড়ে। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। আর পাঁচটা মেয়ের মতো স্বাভাবিক জীবন দিলে কি এমন ক্ষতি হতো স্রষ্টার। যতোই নিজেকে শক্ত করে গড়তে চায় ততোবারই তুহিন নামক ঝড় এসে তাকে নড়বড়ে করে দিয়ে যায়। লোকটার ভালোবাসা স্বীকার করার ক্ষমতা তার নেই। আর লোকটাকে সত্যি বলে দিলে লোকটা নিশ্চয়ই ঘৃণা করবে আর সবার মতো।
কথাগুলো ভেবে ইন্দু নিরবে অশ্রু বিসর্জন দেয়। না জানি আর কত কি সহ্য করতে হবে।
তনয়া বেগম সোফা থেকে উঠতে উঠতে বলে -“ রাজি হয় নি ইন্দুপ্রভা। সে বিয়ে করবে না তোকে।”
মুহুর্তে চোখ মুখে আধার নেমে আসে তুহিনের। মেয়েটা এমন কেনো? মুখে তবুও হাসি এনে তুহিন বলে-“ আমি বলেছিলাম না মা ইন্দু রাজি হবে না। রাজি করাতে হবে।”
তনয়া বেগম ঘুরে ছেলের পানে চেয়ে নির্বিকারে বলে-“ জোর করে রাজি করানো যায় না তুহিন। ইন্দু ডিরেক্টলি বলে দিছে সে তোকে ভালোবাসা না আর বিয়ে তো দূরে থাক।”
“ কিন্তু মা আমি তো ইন্দুকে ভালোবাসি। আমার ভালোবাসার কি মূল্য নেই?”
তনয়া বেগম ছেলের কাঁধে হাত রেখে বলে-” একতরফা ভালোবাসার মূল্য নেই তুহিন। তুই ভালোবাসলেও ইন্দু ভালোবাসে না। ভালোবাসা না থাকলে তো আর সংসার হয় না।”
তুহিন সোফায় থেকে উঠতে উঠতে কাট কাট গলায় বলে-“ দেখো মা আমি ঠিক ইন্দুর মন জয় করে নিবো। তাকে ঠিক রাজি করাবো আমায় ভালোবাসার জন্য। একদিন সে নিজের মুখে বলবে সে আমায় ভালোবাসে,দেখে নিও।”
“ আর কোনো মেয়ে নেই পৃথিবীতে? ইন্দুকেই কেনো ভালোবাসতে হলো?”
“ ভালোবাসা কি আর বলে কয়ে আসে মা? আমার শুধু ইন্দুকেই চাই অন্য কাউকে না।”
কথাটা বলে তুহিন চলে যায় নিজের রুমে। তনয়া বেগম ছেলের যাওয়ার পানে চেয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে।
“ একটা মেয়ের পেছন আর কত ঘুরবি তুই। এখন যা শুরু করছিস সেটা কে তো ছ্যাচড়ামি বলে তুহিন। মেয়েটা তোকে ভালোবাসবে না বুঝিস না কেনো?”
হসপিটালের নিজের কেবিনে বসেছিল তুহিন হঠাৎ এমন কথা শুনে সামনে তাকিয়ে দেখে তার ফ্রেন্ড নীলা। ভ্রু কুঁচকে বলে-“ নক করে আসতে হয় জানিস না?”
নীলা তুহিনের সামনে গিয়ে বলে-“ না জানি না। তুই যা শুরু করছিস এবার অন্তত থাম।”
“ কি শুরু করছি?”
“ তিন তিনটা মাস ধরে একটা মেয়ের পেছন পরে আছিস এবার মেয়েটাকে রেহাই দে। ও ছাড়া কি আর মেয়ে নেই দুনিয়ায়। ওকেই পছন্দ করতে হলো তোর?”
“ আমি কাকে পছন্দ করবো না করবো সেটা তোর দেখার বিষয় না। কাজে ফোকাস কর।”
“ সেম টু ইউ। কাজে ফোকাস কর ঐ মেয়ের পেছন না ঘুরে।”
“ ঐ মেয়ে ঐ মেয়ে কি ওর নাম আছে। নাম ধরে ডাকতে না পারলে ঐ মেয়ে ঐ মেয়ে ও বলবি না।”
“ মাথাটা একদম খেয়ে ফেলছে ঐ মে.. ঐ ইন্দুপ্রভা তাই না। এর জন্য ফ্রেন্ডদের কেউ সময় দিতে পারিস না। কাল সন্ধ্যায় তোর জন্য আমরা ওয়েট করছিলাম রেস্টুরেন্টে তুই না এসে কি করলি ইন্দুর কাছে চলে গেলি বাহ!”
“ আমি আগেই বলেছিলাম যেতে পারবো না।”
“ কেনো যাবি না। ওর মধ্যে কি এমন আছে যা আমার মধ্যে নেই।”
নৈঃশব্দ্যে হাসলো তুহিন-“ এই তো লাইনে এসেছিস ইন্দুর সাথে কখনো নিজেকে কম্পেয়ার করিস না। ইন্দুকে কারো সাথে কম্পেয়ার করা যায় না। সে আমার ইন্দু একান্তই আমার। আর তোকে আগেও বলছি তুই জাস্ট ফ্রেন্ড আমার এর থেকে বেশি আমার কাছে কিছু আশা বা এক্সপেকটেশন রাখিস না। সবুজ তোকে খুব ভালোবাসে ছেলেটাকে বুঝার চেষ্টা কর।”
“ আমি ও তো তোকে ভালোবাসি আমাকে একটু বুঝার চেষ্টা কর।”
“ আমি ইন্দু কে ভালোবাসি।”
“ আর আমি তোকে।”
“ তুই যদি এমন করতে থাকিস নীলা সত্যি হসপিটাল টা ছাড়তে হবে আমার। আমি চাই না তোর সাথে খারাপ ব্যাবহার করতে। আশা করি তুই চাইবি না আমি হসপিটাল টা ছেড়ে চলে যাই।”
কথাটা বলে তুহিন কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। একটা অপারেশন আছে। অপারেশন টা তার হাতেই হবে।সেজন্য প্রিপেয়ার্ড হতে হবে।
“ আমরা এমন মানুষকে ভালেবেসে ফেলি যাদের মনে অন্যের বসবাস থাকে। ভালেবাসায় এতো কষ্ট কেনো? এতো পিড়া দেয় কেনো? সহ্য হয় না।”
———————
আজ স্কুল অন্যান্য দিনের চাইতে তাড়াতাড়ি ছুটি দেওয়া হয়েছে। কাল এক্সাম সিট ফেলাবে সেজন্য। ইন্দু স্কুল থেকে বেরিয়ে সোজা নিমির বাসায় চলে যায়। নিমি এবার ক্লাস ফাইভে পড়ে। নিমিদের বাসায় গিয়ে কলিং বেল বাজাতেই নিমির মা দরজা খুলে দেয়। ইন্দু সৌজন্যের একটা হাসি দিয়ে বলে-“ নিমি কোথায়?”
নিমির মা নীলিমা হেসে বলে-“ সে তোমার জন্য পড়ার টেবিলে বসে অপেক্ষা করছে।”
ইন্দু নিমির রুমে ঢুকে দেখে নিমি খুব মনযোগ সহকারে কিছু একটা আকার চেষ্টা করছে। ইন্দু এগিয়ে গিয়ে দেখে ইন্দু তার ম্যাম কে আকার চেষ্টা চালাচ্ছে।
ইন্দু হেসে নিমির থেকে ড্রয়িং খাতা টা নিয়ে বলে-“ নিমি আমি দেখতে কি এমন? ”
নিমি উৎফুল্ল নিয়ে বলে-“ ম্যাম সুন্দর হয়েছে না?”
“ হুমম অনেক সুন্দর হয়েছে তবে আমার পাশে এই লোক টা কে?”
নিমি ড্রয়িং খাতা টা ইন্দুর হাত থেকে নিয়ে বলে-“ এটা তো তুহিন ভাইয়া।”
মুহূর্তে ইন্দুর মুখে রাগ স্পষ্ট হলে। ড্রয়িং খাতা টা শব্দ করে বন্ধ করে বলে-“ বই বের করো।”
নিমি বই বের করলে ইন্দু তাকে পড়াতে আরম্ভ করে।
তিন মাস আগে নিমি কে পড়ানোর জন্য এসেছিল এই এলাকায়। তখন চিনতো না ইন্দু কোনটা নিমিদের বাসা। ফ্রেন্ডদের থেকে জেনেছিল যে নিমির টিউটর লাগবে। ঠিকানা ও নিয়েছিল কিন্তু নিমি আর তুহিন দের বাসা পাশাপাশি হওয়ায় ভুল করে তুহিন দের বাসায় নক করে ফেলেছিল ইন্দু।
হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে তুহি এগিয়ে এসে দরজা খুলে সামনে অপরিচিত একটা মুখ দেখে থমকে যায়। গোল জামা পরিহিত মেয়ে চুল গুলো খোঁপা করা। কপালের মাঝ বরাবর কালো তিল। মুখে রয়েছে ঘামের ছিটেফোঁটা। এতেই যেনো মেয়েটাকে লাগছে অপ্সরি। মেয়েটার থেকে চোখ সরানো যেনো দুষ্কর হয়ে যায়।
তুহিন কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইন্দু গলা ঝেড়ে কেশে নেয়-“ এটা কি নিমিদের বাসা?”
তুহিন চোখ বন্ধ করে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলে-“ এটা নিমিদের বাসা না। পাশের বাসা টা নিমিদের। কিন্তু আপনি কে?”
“ ওহ্ সরি আসলে আমি বুঝতে পারি নি দুঃখিত।”
“ কিন্তু আপনি কে?”
“ নিমির নতুন টিউটর। ”
“ নাম কি আপনার?”
“ জ্বি?”
“ কানে কম শুনেন নাকি? বলেছি আপনার নাম কি?”
“ সেটা আপনায় কেনো বলবো?”
“ আচ্ছা না বললেন জেনে নিবো। পড়ালেখা করেন কোন ক্লাসে?”
ইন্দুর রাগ উঠে গেলো। লোকটা এতো কথা জিজ্ঞেস কেনো করছে। ইন্দু প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে সোজা নিমিদের বাসায় চলে আসে।
সেই থেকে রোজ নিমিদের বাসায় আসার সময় গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো। কথা বলার জন্য চেষ্টা করতো কিন্তু ইন্দু তুহিন কে ইগনোর করে চলে আসতো।
কাছের কিছু ফ্রেন্ড আর নিমির থেকে বাসার ঠিকানা,নাম, কি করে সব জেনেছে।
সেই থেকে লোকটা পেছনে পড়ে আছে। ভালোবাসি বলে বলে পাগল করে ফেলছে। কত বার ইন্দু বলেছে সে তাকে ভালোবাসে না,এমন কি মিথ্যা ও বলেছে যে ইন্দু অন্য কাউকে ভালোবাসে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। ছেলেটা সেই মিথ্যাও ধরে ফেলছে।
“ ম্যাম অংক করা শেষ।”
হঠাৎ নিমির কথায় ঘোর ভাঙে ইন্দুর। খাতা টা নিয়ে অংক গুলো দেখে আর কিছুক্ষণ পড়িয়ে বাসায় চলে আসে।
——————
“ আজকাল তোকে এতো অন্যমনস্ক লাগে কেনো তুহিন কিছু হয়েছে?”
তুহিন ডাইনিং টেবিলে বসে ভাত না খেয়ে অনেকক্ষণ যাবৎ ভাতের প্লেটে হাত নাড়াচ্ছিল। সেটা দেখে তুহিনের মা তনয়া বেগম কথাটা বলে উঠে।
তুহিন মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে-“ আচ্ছা মা তোমার ইন্দুপ্রভা কে কেমন লাগে?”
তনয়া বেগম ভ্রুকুটি করে বলে -“ নিমির টিউটর? ”
“হুম।”
“ বেশ ভালোই তো মেয়েটা। গোছগাছ পরিপাটি। কিন্তু তুই হঠাৎ ইন্দুপ্রভার কথা বলছিস কেনো?”
“ তাকে তোমার ছেলের বউ করলে কেমন হবে?”
তনয়া বেগম আশ্চর্য হয়-“ মানে কি? ইন্দুপ্রভা কে তুই বিয়ে করতে চাইছিস? ”
“ হুমম মা। আই থিংক তোমার আপত্তি থাকার কথা নয়।”
“ আমার আপত্তি নেই। ”
“ তাহলে মা ইন্দুর বাসায় প্রস্তাব নিয়ে যাও।”
“ সে না হয় যাবো। কিন্তু…
“ কোনো কিন্তু নয় মা। দেখতেছো তো আমি ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করি না। অন্যমনস্ক হয়ে থাকি তুমিই তো বললা। দেখো চোখের নিচে মেয়েদের মতো ডার্ক সার্কেল হয়ে গেছে। তুমি না সেদিন বললা বিয়ে দিবা তাহলে?”
“ আচ্ছা বাপ আমি কালই যাবো ইন্দুর বাসায়।”
“ শুধু গেলেই হবে না মা ইন্দু কে রাজি ও করাতে হবে তোমার।”
“ সেকি আমি কেনো রাজি করাবো?”
“ ইন্দু আমায় বিয়ে করতে রাজি না মা। তুমি তাকে বুঝাবা রাজি করাবা। আমি কিন্তু ইন্দুকে না পেলে দেবদাস হয়ে যাবো মা। তখন কিন্তু কেঁদে কেটেও আমায় রোমিও বানানো যাবে না।”