এক মুঠো প্রণয় পর্ব-২৩+২৪

0
434

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_২৩
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

মেহেরাজ জ্যোতির প্রতি ভালোবাসাটা অনুভব করেছিল জ্যোতি চলে যাওয়ার পর। সুদূর চট্টগ্রামে পাড়ি জমানোর পর জ্যোতির সাথে তার যোগাযোগ হয়েছে খুবই কম।বলা যায় বরাবর জ্যোতিই স্বল্প কথায় কিংবা ব্যস্ততা দেখিয়ে এড়িয়ে গিয়েছে।আর সরাসরি দেখাসাক্ষাৎ বলতে দুইবার জ্যোতির হোস্টেলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে স্বল্প আলাপ আর মেহুর জম্মদিনে একবার জ্যোতির আগমন এই বাসায়। ব্যস!এই তিনবছরে এইটুকুই যোগাযোগ হয়েছে।এই স্বল্প যোগাযোগে কিংবা ক্ষনিকের কথোপকোতনে কখনোই জ্যোতিকে বিশেষ করে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করা হয়ে উঠেনি।অন্তর্মুখী মানুষরা বোধ হয় নিজের অনুভূতি এভাবে মুখে ভালোবাসি বলে স্বীকার করতে পারেও না।তাদের ভালোবাসা প্রকাশ পায় তাদের যত্নে, তাদের সঙ্গে, তাদের আগলে রাখা মুহুর্তগুলোতে।এই কারণেই বোধহয় অন্তর্মুখী মানুষদের ভালোবাসা ব্যাতিক্রমী সুন্দর!মেহেরাজ উঠে বেলকনিতে যায়।বছর দুয়েক আগেই চাকরীতে জয়েন করেছিল সে। তবুও মাথায় ছিল চট্টগ্রাম শিফট করার৷ এই বাসায় সামান্তার উপস্থিতিতে হয়তো বা জ্যোতি সবসময়ই কষ্ট পুষবে মনে মনে।যন্ত্রনা পাবে কখনো সখনো দুইজনকে একসাথে দেখলে।অন্যদিকে সুদূর চট্টগ্রামে জ্যোতি একা।যাকে একা থাকতে দিবে না বলেই প্রথম অস্থিরতা টের পেয়েছিল তাকে এভাবে একা ছেড়ে দেওয়াটা অযৌক্তিক!তবুও বাস্তবতার কাছে হার মেনে, জ্যোতির পড়ালেখা-ভবিষ্যৎ এর কথা ভেবে একা ছেড়েছে।এতগুলো দিন অপেক্ষায় ছিল একটা সুযোগের। অবশেষে সুযোগটা মিলেও গেল। চট্টগ্রামে একটা কোম্পানিতে ভালো পদে চাকরি পেল। জয়েনিং ডেইট পরের মাসে।মেহেরাজ ততদিন অপেক্ষা করতে পারল না।মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল পরশুই যাবে একবার।জ্যোতির সাথে দেখা করে বাসা দেখে আসবে।তারপর পছন্দ মতো একটা বাসা ভাড়া নিয়ে সুন্দর সংসার গোঁছাবে। আর পাঁচটা স্বামী স্ত্রীর মতো ঘর বাঁধবে।মেহেরাজ হাসে আনমনে এসব ভেবে। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে জ্যোতির নাম্বারটা খুঁজে কল দিল মুহুর্তেই।জ্যোতিকে সে শেষ কল দিয়েছিল দিন পনেরো আগে।এর মাঝে না তো জ্যোতি কল দিয়েছে আর না তো মেহেরাজ।জ্যোতি অবশ্য তাকে নিজ থেকে কল দেয় খুবই কম। অথচ মেহুর সাথে জ্যোতির প্রত্যেকটা দিন কথা হয়। প্রত্যেকটা দিন ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প জুড়ে। যখন মেহুকে পায়না কলে, কিংবা কোন বিশেষ প্রয়োজন হয় তখনই মেহেরাজকে কল দেয় জ্যোতি।মেহেরাজ মনে মনে এসব ভেবে অভিযোগ পুষে।ঠিক তখনই ওপাশ থেকে কল রিসিভড করে এক মেয়েলি স্বর বলে উঠল,

” আসসালামুআলাইকুম মেহেরাজ ভাই।”

মেহেরাজ এবার মুচকি হাসল। বুকের ভেতর অদ্ভুত শীতল অনুভূতি হলো মেয়েটার কন্ঠ শুনে৷ বুকের বা পাশটা চেপে ধরে কিয়ৎক্ষন থম মেরে চুপ করে থাকল। তারপর গলা ঝেড়ে সালামের উত্তর দিল গম্ভীর কন্ঠে। বলল,

” কেমন আছিস?”

জ্যোতি উত্তরে মৃদু আওয়াজ তুলে বলে উঠল,

” আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?”

মেহেরাজ শুনল।দৃঢ় গলায় সরাসরি বলে উঠল,

” ভালো আছি, পরশু ফ্রি থাকবি?”

প্রশ্নটা শোনা মাত্রই উত্তর দিল না জ্যোতি।কিয়ৎক্ষন সময় নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ল,

” কেন?”

মেহেরাজের মুখভঙ্গি বদলাল না।গম্ভীর অথচ দৃঢ় গলায় বলে উঠল,

” দেখা করব তোর সাথে।”

আচমকা এমন এক প্রশ্নে চুপ থাকল জ্যোতি।শেষ তাদের দেখা হয়েছিল এগারো মাস আগে। বলা যায়, প্রায় এক বছর আগে তাও মেহুর জম্মদিন উপলক্ষ্যে সেই গিয়েছিল। এতগুলো দিন পর দেখা করার জন্য মেহেরাজের তরফ থেকে এই বাক্যটা শুনেই শরীর জুড়ে অদ্ভুত শিহরন হলো।অনুভব করল বুকের ভেতর তীব্র অস্থিরতা৷ জবাবে বলল,

” কখন? ”

মেহেরাজের মুখ টানটান হলো হঠাৎ। দাঁতে দাঁতে চেপে ত্যাড়া ভাবে উত্তর দিয়ে বলল,

” সারাদিন। কেন তুই কি ব্যস্ত থাকবি? ”

জ্যোতি স্পষ্ট কন্ঠে উত্তর দিল,

” আমার টিউশনি আছে, ক্লাস আছে মেহেরাজ ভাই। আপনি নির্দিষ্ট একটা সময় বললে সুবিধা হবে আমার।”

মেহেরাজ দমে গেল না জ্যোতির স্পষ্ট উত্তরে। ফের ভরাট কন্ঠে ত্যাড়াভাবেই উত্তর দিল,

” নির্দিষ্ট সময় না, অনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থাকব।সমস্যা আছে?আর ক্লাস, টিউশন পরশুদিনের জন্য বাদ। একদিন মিস দিলে তো সমস্যা হবে না। তাই না?”

ওপাশে জ্যোতি কথা গুলো শুনে থম মেরে চুপ হয়ে গেল। নির্দ্বিধায়, স্পষ্টভাবে মেহেরাজের এমন আদেশে তার ভালো লাগল কি খারাপ লাগল বুঝে উঠল না সে।তবে বুকের ভেতর কেমন কম্পন অনুভব হলো সেই মুহুর্তে। তবুও স্পষ্ট ভাবে বলল,

” না,সমস্যা হবে না। ”

মেহেরাজ এবার মুচকি হাসল। ঠোঁট চওড়া করে বলে উঠল,

” গুড!তাহলে পরশুদিনের জন্য তোর ক্লাস, টিউশন সব ক্যান্সেল। দেখা করছি পরশু। মনে থাকবে?”

” হ্যাঁ, থাকবে।”

মেহেরাজ আবারও হাসল।বলল,

” ওখানে গিয়ে কল করব তাহলে। ”

জ্যোতি বিনিময়ে উত্তর দিল না।চুপ থাকল কিয়ৎক্ষন।তারপর কি বুঝেই প্রশ্ন ছুড়ল,

” কোন দরকারে আসছেন এখানে? ”

মেহেরাজ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। হাত দিয়ে কপালে আসা চুল পেছনে ঠেলে দিয়ে বলল,

” হ্যাঁ, দরকার তো আছেই।তাই ভাবলাম তোর সাথেও দেখা করে আসি।কেন?”

জ্যোতি উত্তরে বলল,

” মেহু আপু বলেছিল আপনি নাকি কয়েকদিন আগেও এসেছিলেন এখানে কি প্রয়োজনে৷ তাই জিজ্ঞেস করলাম।”

মেহেরাজ ভ্রু কুঁচকাল। বলল,

” তুই কি মেহুর থেকে আমার খোঁজখবর নিস জ্যোতি?”

জ্যোতির স্পষ্ট উত্তর,

” নাহ তো।আমি আপনার সম্বন্ধে কিছুই জিজ্ঞেস করিনি।মেহু আপু নিজের থেকেই বলেছিল কথাটা।”

মেহেরাজ মুখ ভার করল এবার৷ চোখজোড়া বুঝে ভারী বুক হালকা করতে ছাড়ল দীর্ঘশ্বাস।শান্তস্বরে বলল,

” মেহুর সাথে এত কি কথা বলিস তাহলে প্রতিদিন ?”

জ্যোতি তাচ্ছিল্য নিয়ে বলল,

” আমার আর মেহু আপুর কথার বিষয়বস্তু কেবল আপনিই হবেন এমন কোথাও লিখা আছে নাকি মেহেরাজ ভাই?”

” নেই বলছিস?”

” না, নেই। সামান্তা আপু কেমন আছে? ”

মেহেরাজ চুপ থাকল। প্রত্যেকবার কল করলেই জ্যোতি আগ্রহ নিয়ে সামান্তাকে নিয়ে এই প্রশ্নটা করে তাকে।প্রশ্নটা করে যে চোখে আঙ্গুল দিয়ে তার আর সামান্তার সম্পর্কটাকেই জ্যোতি তুলে আনতে চায় তাও বুঝে মেহেরাজ। তবুও উত্তর দেয় না৷ এবারও ব্যাতিক্রম হলো না৷ গম্ভীর স্বরে উত্তর না দিয়েই বলল,

” রাখলাম। পরশু আসছি।”

কথাটুকু বলেই মেহেরাজ কল কাঁটল।মুখটা টানটান করে তাকিয়ে থাকল বেলকনির অপর প্রান্তে।

.

সন্ধ্যায় সাঈদ অফিস থেকে ফিরছিল রিক্সায় করে।কিছুটা দূরে রাস্তার একপাশে শুভ্রময়ী মেহু নামক মেয়েটিকে দেখেই হৃদয়ের ভেতর কম্পন অনুভূত হলো। রাতের আঁধার আর ল্যাম্পপোস্টের আলোতে গোলাপি রাঙ্গা জামা পরনে অদ্ভুত সুন্দর বোধ হচ্ছিল মেয়েটাকে।সাঈদ নিজেকে আর রিক্সায় বসিয়ে রাখতে পারল না। দ্রুত রিক্সা থামাতে বলে ভাড়া মিটিয়ে নিজেকে হাজির করল মেহুর সামনে।মেহু ভ্রু কুঁচকে তাকাল তার দিকে৷ চোখমুখে প্রশ্নময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই বলল,

” সাঈদ ভাইয়া আপনি?”

সাঈদ হাসল ঠোঁট চওড়া করে৷ ফিচেল গলায় বলল,

” তোমার আমার প্রেমের কতোটা টান দেখেছো? প্রেমের টানেই দুইজনের দেখা হয়ে গেল প্রিয়।তবুও তুমি এই প্রেমটা স্বীকার করতে নারাজ৷ কি এক যন্ত্রনা!”

শেষের কথাটা সাঈদ বুকের বা পাশে হাত রেখেই বলল।মেহু কপাল কুঁচকাল। বিরক্তি সমেত গলায় বলল,

” আপনাকে একবার বলেছি এসব ফ্লার্ট আমার সাথে করবেন না সাঈদ ভাইয়া৷ ”

সাঈদ থামল না। ফের ফিচেল গলায় বলে উঠল,

“ফ্লার্ট করব কেন? প্রেমিকার সাথে কেউ ফ্লার্ট করে নাকি? আমি একদমই ফ্লার্ট করছি না বিশ্বাস করো। ”

মেহু থমথমে গলায় উত্তর দিল,

” আমি আপনার প্রেমিকা নই। ”

” প্রেমিকা না? আচ্ছা ঠিকাছে। প্রেমিকা নাই হতে পারো, হবু বউ তো অবশ্যই। বলো?”

শেষ শব্দটা সাঈদ চোখ টিপেই বলল। মেহুর মুখভঙ্গি তাতে একটুও বদলাল না। আগের ন্যায় কপাল কুঁচকে বলল,

” আবোল তাবোল বকবেন না সাঈদ ভাইয়া।”

সাঈদ ভ্রু উঁচিয়ে বলল,

” আবোল তাবোল বকবো কেন? এই এক বছর আগে এত কষ্ট করে চাকরী জোগাড় করলাম। কেন করলাম?বিয়ে করার জন্যই তো। ”

” তো বিয়ে করতে নিষেধ করেছে কেউ আপনাকে?”

সাঈদ আপসোসের সুরে বলল,

” উহ, পাত্রী হিসেবে তো আমি তোমায় পছন্দ করেছি। কিন্তু তুমি তো নাকি পড়ালেখা শেষ না হওয়া অব্দি বিয়ে করবে না বলেছো।এখন তো পড়ালেখা কম্প্লিট?বিয়ে করবো চলো।দুদিন পর আবার তোমার ভাই তোমাকে চট্টগ্রাম নিয়ে চলে যাবে।তখন আমার কি হবে?”

মেহু এবার কিছুটা জোরেই বলল,

” সাঈদ ভাইয়া, আমি এসব মজা উপহাস পছন্দ করি না৷ আপনি আর যার সাথেই মজা করুন না কেন, আমার সাথে করবেন না।”

সাঈদ চুপ করল না।ঠোঁট বাকিয়ো হেসে বলল,

” আগে কিন্তু দিব্যি পছন্দ করতে এসব। চারবছর আগে একটা চুমুই সব পছন্দ অপছন্দ বদলে দিল? জাস্ট একটাই তো চুমু! ”

মেহু থমকাল।মনে পড়ে গেল সেই অনাকাঙ্খিত ঠোঁটের ছোঁয়া। অপ্রত্যাশিত মুহুর্ত!অপ্রত্যাশিত চুমু।মুহুর্তেই মুখচোখের ভঙ্গি পাল্টে গেল তার। চোখজোড়ায় ভর করল ঘৃণা আর টলমলে পানি। সেই টলমলের চোখের চাহনীতে একনজর তাকিয়েই সাঈদ আর দাঁড়াল না।বুক টানটান করে দ্রুত হেঁটে চলে গেল সেই স্থান ছেড়ে।

#চলবে….

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_২৪
লেখনীতেঃএকান্তিকা নাথ

এই তিনবছরে জ্যোতির পরিবর্তন খু্ব একটা চোখে পড়ে না।আগের মতোই সরাদিন সালোয়ার কামিজ পরনে মাথায় ঘোমটা টেনে রাখে। চুলগুলো কিঞ্চিৎ লম্বা হয়েছে।হাতের বাটন ফোনের বদলে স্মার্টফোন এসেছে। গ্রামীণ জীবনে অভ্যস্ত থাকা মেয়েটা শহুরে জীবনে মানিয়ে নিয়েছে।দাদীকে ছাড়া এক পাও না চলা মেয়েটা কোন সঙ্গবিহীনই জীবন গুঁছিয়ে নিয়েছে।জ্যোতি সেসব ভেবেই ছোট্ট শ্বাস ফেলল। হাতের স্মার্টফোনটা রেখে টেবিলের ড্রয়ার থেকে বাটন ফোনটা বের করল। ঠোঁটজোড়া আলতো করে সেই বাটন ফোনে ছুঁয়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

” তোমার দেওয়া শেষ স্মৃতি দাদী। সবসময় আগলে রাখব নিজের সাথে।মনে আছে দাদী?যখন গ্রাম ছেড়ে প্রথম মেহেরাজ ভাইদের বাসায় গেলাম। তখন এই ফোনে কত কত কথা হতো তোমার সাথে। কত কত বকা খেতাম তোমার থেকে। কত কত অপেক্ষা করতাম, তোমার সাথে কখন কথা হবে তার জন্য।আমি এখনও অপেক্ষা করি।ভাবি তুমি এই বাটন ফোনে কল করে খোঁজ নিবে।কথা বলবে।কিন্তু তুমি তো খোঁজ নাও না দাদী।আমাকে একবারও মনে করো না। দাদী?কত ভালো হতো যদি পরপারে চলে যাওয়ার পরও আমরা ফোনালাপ করতে পারতাম।আমি জানি, এইসব কিছুই সম্ভব না।তুমি কখনো এই ফোনে কল করে খোঁজ নিবে না।কখনো আর তোমার সাথে কথা হবে না।সবই জানি আমি। তবুও দেখো পাগলের মতো প্রলাপ বকছি। দাদী? মেহেরাজ ভাইদের বাসায় চলে যাওয়ার পরও কিন্তু তোমার সাথে অনেক দূরত্ব ছিল আমার। তবুও দিনশেষে কথা বলতাম।কিন্তু আজ দেখো।আজও তোমার আমার দূরত্ব বিস্তর।কিন্তু আজ আর আমাদের কথা হয় না দাদী। কোনদিন হবেও না৷ একটুও কথা হবে না দাদী। ”

কথাগুলো বিড়বিড় করে বলেই চোখ বুঝল জ্যোতি। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল দু ফোঁটা জল ও।মুহুর্তেই সে জল আবার মুঁছে নিল কেউ দেখে ফেলার ভয়ে।রুমে সে ব্যাতীত আরো একজন মেয়ে আছে।পাশাপাশি আরো একটা রুম আছে। দুইরুমের এই বাসাটায় সে সহ আরো তিনজন মেয়ে থাকে। হোস্টেল ছেড়ে এই বাসাটায় তারা চারজন প্রায় দেড় বছর আগেই উঠেছিল। মেহেরাজ এই বাসাটা চেনে মেহুর জম্মদিনে জ্যোতিকে নিতে এসেই।সেবারই প্রথম এই বাসার বাকি তিনজন মেয়ে জেনেছিল জ্যোতি বিবাহিত। জ্যোতি সে ভেবে সোজা হয়ে বসে ফের বাটন ফোনটা ড্রয়ারে রাখল।ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল রাত আটটা৷মুহুর্তেই মোবাইলের রিংটোন বাঁজল। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে দেখল মোবাইলের স্ক্রিনে “মেহেরাজ ভাই” নামটা। বুকের ভেতর অস্থিরতা অনুভব হলো। মনে মনে বলে উঠল,

” মেহেরাজ ভাইয়ের আসার কথা কাল।তবে আজ কল করল কেন?আজই চলে এসেছে?এখন কি নিচে নেমে দেখা করতে বলবে?”

মনের মধ্যে প্রশ্নগুলো উঁকি মারতেই তীব্র অস্থিরতা অনুভব হলো। অপ্রত্যাশিত কিংবা প্রত্যাশিত সাক্ষাৎয়ের পূর্বাভাসে শ্বাস ঘন হলো। পরমুহুর্তেই নিজেকে সামলে স্বাভাবিক করল।মোবাইলটা হাতে নিয়ে জানালার পাশে দাঁড়াল। মুহুর্তেই শীতল হাওয়া ছুঁয়ে দিয়ে গেল তাকে।কল রিসিভড করেই গলা ঝেড়ে সালাম দিয়ে বলল,

” আসসালামুআলাইকুম মেহেরাজ ভাই।”

মেহেরাজ সালামের উত্তর দিল। বিনিময়ে উদ্ভট এক প্রশ্ন করে বসল,

” তোর কাছে শাড়ি আছে জ্যোতি? ”

জ্যোতি অবাক হলো এমন প্রশ্নে।সঙ্গে সঙ্গে কপাল কুঁচকে গেল তার। এভাবে অপ্রত্যাশিতভাবে কল করে শাড়ি আছে কিনা জিজ্ঞেস করাটা অযৌক্তিক বোধ হলো। অস্ফুট স্বরে বলল,

” হ্ হু?”

মেহেরাজ বিরক্তি নিয়ে বলল,

“কানে শুনিস না?শাড়ি আছে তোর কাছে? ”

ফের একই প্রশ্নে জ্যোতির কপালের ভাজ মিলে গেল। শাড়ি তেমন একটা পরা হয়নি তার।বলা যায়, এক আধবার ছাড়া সে শাড়ি পরেইনি। এমনকি মেহেরাজের সাথে বিয়েটাও তার সালোয়ার কামিজ পরেই সম্পন্ন হয়েছিল। তবে মেহেরাজদের বাসায় থাকাকালীন সময়ে মেহেরাজ মেহুর সাহায্য নিয়ে তাকে কয়েকটা শাড়ি কিনে দিয়েছিল।এমনকি মেহেরাজ যে দুইবার এখানে এসে তার সাথে দেখা করে গিয়েছে সেই দুইবারও তার জন্য শাড়ি উপহার এনেছিল । সে শাড়িগুলো কখনো পরা না হলেও সযত্নে নিজের কাছেই রেখেছে।তবুও মেহেরাজের প্রশ্নটা অযৌক্তিক বোধ হলো!মেহেরাজ কি ভেবেছে তার দেওয়া শাড়িগুলো জ্যোতি ফেলে দিবে?জ্যোতি শ্বাস টেনে উত্তর দিল,

” আছে। আপনিই দিয়েছিলেন আগে। ”

মেহেরাজ ফের প্রশ্ন ছুড়লো

” ওসব রেখেছিস?”

” ফেলে দেওয়ার কথা ছিল নাকি মেহেরাজ ভাই?”

শান্ত গলায় উত্তর আসল,

” ফেলে দিলেও দিতে পারিস। আস্ত এক মানবকেই ফেলে দিয়েছিস শাড়ি তো ক্ষুদ্র তার তুলনায়।”

জ্যোতি তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসল। বলল,

” আস্ত মানব?আপনি?”

গম্ভীর স্বরে বলল মেহেরাজ,

” জানা নেই।”

জ্যোতি আবারও তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসল। বলল,

” আমি খুব তুচ্ছ মানবী মেহেরাজ ভাই।আপনার মতো মানবকে ফেলে দেওয়ার মতো যোগ্যতা আমার হয়ে উঠেনি। ”

মেহেরাজ অভিযোগের সুরে বলল,

“তোর জীবনে কোথাও রাখিস ও নি। ”

” রাখার কথা ছিল কি?”

” ছিল না বলছিস?”

জ্যোতি স্পষ্টগলায় উত্তর দিল,

” না, যে অন্যের তাকে আমার জীবনে রাখার কথা তো থাকতে পারে না মেহেরাজ ভাই। বাদ দিন সেসব, কিছু বলবেন?”

মেহেরাজ কিয়ৎক্ষন চুপ থাকল।তারপর বলল,

” রাতে রওনা দিচ্ছি।কাল সকালে কল করা মাত্রই দেখা করতে আসবি। দেরি করলে দেখা না করে চলে আসব।”

” আচ্ছা।”

মেহেরাজ হঠাৎ উদ্ভট প্রশ্ন ছুড়ল,

” ওখানে কি ছেলেমেয়ে বাসাভাড়া চাইলে ভাড়া দিবে বাসা?”

এমন উদ্ভট প্রশ্নে আবারও অবাক হলো জ্যোতি।ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়ে বলল,

“মানে?”

মেহেরাজ নির্বিকারভাবে উত্তর দিল,

” বাসা খুঁজব কাল এক বন্ধুর জন্য। এখন তোকে আর আমাকে দেখে প্রেমিক প্রেমিকা লাগলে কি বাসা ভাড়া দিবে?”

জ্যোতি বুঝল না কিছুই। বলল,

” বুঝলাম না।”

মেহেরাজ দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিল,

” গর্দভ, হাজব্যান্ড-ওয়াইফ ছাড়া এমনি দুটো ছেলেমেয়েকে কে বাসা ভাড়া দিবে?”

” বাসা তো আপনার বন্ধুর জন্য খুঁজবেন।”

“কিন্তু ও তো যাবে না।তুই যেহেতু ওখানে থাকিস এতবছর তোকে নিয়ে খুঁজব।”

জ্যোতি অবাক হয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,

” আমাকে নিয়ে?”

মেহেরাজ শান্তস্বরে আদেশের ন্যায় বলল,

” হ্যাঁ, আসার সময় শাড়ি পরে আসবি।একদম দেখতে যাতে পার্ফেক্ট বউ লাগে। তাহলে হাজব্যান্ড ওয়াইফ দেখামাত্রই বাড়িওয়ালা বাসাভাড়া দিয়ে দিবে।মনে করে শাড়ি পরেই আসবি। ”

শেষের কথাটুকু আদেশের সুরে বলেই মেহেরাজ কল কাঁটল।আর জ্যোতি চুপ থেকে মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকল।মেহেরাজের সবগুলো কথাই যেন তার বোধগম্য হলো না।বন্ধুর জন্য বাসা তার বন্ধু না খুুজে তাকেই কেন খুঁজতে হবে?তাও আবার বউ নিয়ে?কি আশ্চর্য!

.

অনেক রাত হওয়া স্বত্ত্বেও মেহু ঘুমাল না। মোবাইলের স্ক্রিনে স্পষ্ট ভাসছে সাঈদের ম্যাসেজ। এই পর্যন্ত বহুবার সাঈদ ম্যাসেজ দিয়েছে তাকে।তবে একবারও রিপ্লাই দেয়না সে। শুধু সিন করে রেখে দেয়। এবারও ব্যাতিক্রম হলো না। সাঈদের ম্যাসেজটা সিন করেই রেখে দিল সে।অথচ একটা সময় এই লোকটার একটা ম্যাসেজের জন্য ছটফট করত সে।এই লোকটার সাথে কথা বলার জন্য রাতভর অপেক্ষা করত।নাবিলার মতো তার কাছেও তখন মনে হতো, সাঈদ ভাই মানেই আগুন। সাঈদ ভাই মানেই অন্যকিছু। তখনকার মেহু বোকা ছিল।নরম মনের সরল মেয়ে ছিল। কিন্তু এই সহজ সরল মেয়েটা একটা সময় পর সাঈদ নামক মানুষটার থেকে মুখ সরিয়ে নিল কঠিনভাবে। কারণটা আধুনিকতার যুগে খুবই সামান্য হলেও মেহুর কাছে ছিল ঘোর অন্যায়।নাবিলা আর সামান্তার কাছে বরাবরই সে শুনেছিল সাঈদের অনেক মেয়ের সাথেই মেলামেশা।অনেক মেয়েকেই সে কথার জালে বশ করে ফেলতে পারে। সাঈদ অনেক মেয়েকে জড়িয়ে ধরেছে,চুমু খেয়েছে এসবও অজানা ছিল না। তবুও মেহু তখন মনেপ্রানে বিশ্বাস করত, সাঈদ এসব করতে পারে না। আড়ালে কোথাও না কোথাও সাঈদ নামক মানুষটার প্রতি ছিল তার ব্যাপক বিশ্বাস। কিন্তু একটা সময় পর সে বিশ্বাস ভেঙ্গে গেল। যেদিন নিজের চোখের সামনেই সাঈদকে দেখা গেল অন্য একটা মেয়েকে চুমু খেতে। অসহনীয় যন্ত্রনায় ছটফট করে সেদিন ঘরে এসে কান্না করেছিল। তার মাসখানেক পরই একদিন সাঈদের সম্মুখীন হয়ে বলে বসেছিল,

” সাঈদ ভাইয়া? আপনাকে আমি এতটা খারাপ ভাবিনি। আমি ভেবেছিলাম আপনি ফ্লার্ট পর্যন্তই আছেন, কিন্তু আপনি এতটা জঘন্য! এতটা! আমি ভাবিনি সাঈদ ভাইয়া।”

সাঈদ সেদিন হেসেছিল।আগে থেকেই এই মেয়ের আচার আচরণ দেখে বুঝে গিয়েছিল মেয়েটা তার প্রতি দুর্বল। শুধু দুর্বল নয়। চরম প্রকারে দুর্বল।সেদিন তা আরো পাকাপোক্তভাবে বুঝতে পেরেছিল তা। আলতো ঝুঁকে প্রশ্ন করেছিল,

” কি ভাবোনি?”

” আপনি সেদিন মেয়েটাকে লিপকিস… ”

বাকিটুকু না বলেই থেমে গিয়েছিল মেহু। চোখজোড়া বেয়ে টলমলে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। সাঈদ কিয়ৎক্ষন সে চোখের পানিতে তাকিয়েছিল। তারপর কি বুঝেই মেহুর কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়েছিল। অস্ফুট স্বরে বলেছিল সেদিন,

” সেদিনকার ছোঁয়ায় কামুক ছিলাম, সুযোগ পেয়ে লুফে নেওয়া ব্যাক্তি ছিলাম। আজকের ছোঁয়ায় কষ্ট আগলানোর যত্ন আছে।অশ্রু মোঁছার আবেদন আছে। অনুভ…”

সাঈদ বাকিটুকু সম্পন্ন করার সুযোগ সেদিন দেয়নি মেহু। তার আগেই মেহু ঠেলে দিয়োছিল তাকে।ছিঁটকে সরে গিয়েছিল অন্য প্রান্তে। দৃড় গলায় বলেছিল,

” আপনার সাহস কি করে হলো ঐ ঠোঁটে আমায় ছোঁয়ার? ছিঃ সাঈদ ভাইয়া!আপনি আমাকেও সুযোগ লুফে নেওয়ার বস্তু ভাবলে কি করে! ছিঃ!”

এতটুকুই! তারপর আর সাঈদের প্রতি দুর্বলতা প্রকাশ করেনি মেহু। সাঈদ নামক লোকটার দিকে সেদিন থেকেই তীব্র অবহেলা ঠেলে দিয়েছে সে।মেহু তপ্তশ্বাস ফেলল। ম্যাসেজটা আগের ন্যায় একবার দেখেই ঠেলে রাখল মোবাইল ফোনটা।

.

জ্যোতি ঘুম ছেড়ে উঠল সকাল সকালই।তখন ঘড়ির কাঁটায় সবে সাড়ে ছয়টা।জানালা দিয়ে বাইরের সুন্দর পরিবেশ পরখ করছিল।এর মাঝেই মোবাইলের রিংটোন বেঁজে উঠল। জ্যোতি সচেতন চোখে তাকাতেই ফের মেহেরাজের নাম দেখে চাহনী সরু করল। টের পেল তার বুক ঢিপঢিপ করছে।অবশেষে সে মুখ, সে মানুষ, সে চাহনীর সম্মুখীন হতে হবে ভাবতেই শরীরজুড়ে কম্পমান অনুভূতি হচ্ছে। তবুও সে অনুভূতির আভাস নিজের ভেতর আড়াল রেখে কল তুলল।ওপাশ থেকে মেহেরাজ ব্যস্ত কন্ঠে বলল,

” তোদের বিল্ডিংটার সামনেই দাঁড়ানো আছি।নেমে পড় তাড়াতাড়ি।”

জ্যোতি জানালা দিয়ে তৎক্ষনাৎ নিচে তাকাল। চোখে পড়ল লম্বা চওড়া সুদর্শন মেহেরাজকে। পরনে কালো শার্ট, হাতা গুলে গুঁটানো। একহাতে ফোন চেপে কানে ধরে দাঁড়ানো আছে একপাশে।জ্যোতি কয়েক পলক তাকালো স্থির ভাবে।তারপর ছোট শব্দে উত্তর দিল,

” আসছি।”

কথাটুকু বলেই কল কাঁটল। পা বাড়িয়ে একবার ভাবল, শাড়ি পরে যাওয়া উচিত কিনা।রুমমেটদের মধ্যে বাকি তিনজনকে প্রায়সই দেখেছে প্রেমিকের সাথে দেখা করতে শাড়ি পরে যায়।সেসব ভেবে তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসল। তাদের সম্পর্ক তো প্রেমিক প্রেমিকা জুটির মতো নয়। কিংবা স্বাভাবিক স্বামী স্ত্রীর মতোও নয় যে শাড়ি পরে যেতে হবে।জ্যোতি শাড়ি পরল না।মুখচোখ ধুঁয়ে ছাঁইরাঙ্গা একটা সালোয়ার কামিজ পরেই চুলে বেনুনি করল।তারপর মাথায় ঘোমটা টেনে মিনিট পাঁচের মধ্যে হাজির হলো মেহেরাজ সামনে। বহুদিন পর, বহুমাস পর মেহেরাজ নামক যুবকের সামনে নম্রভাবে দাঁড়াতেই মেহেরাজ গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন ছুড়ল,

“কাল রাতে কি বলেছিলাম আমি?”

” কি?”

মেহেরাজ চোয়াল শক্ত করল।মুখ টান টান করে বুকে হাত গুঁজে বলল,

” শাড়ি পরিসনি কেন?”

জ্যোতি স্পষ্ট কন্ঠে উত্তর দিল,

” শাড়ি পরতে অভ্যস্ত নই আমি মেহেরাজ ভাই। ”

মেহেরাজ ভ্র উঁচিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,

” তো?”

জ্যোতি শান্তস্বরে বলল,

” তো শাড়ি পরাটা কি উচিত হতো?”

ভ্রু উঁচিয়ে ফের প্রশ্ন করল মেহেরাজ,

” হতো না বলছিস? ”

স্পষ্ট উত্তর,

” না।”

” ওকে ফাইন।”

মেহেরাজ হাঁটা শুরু করল।পাশাপাশি হাঁটল জ্যোতিও।সুন্দর সকাল, শীতল বাতাস আর পাশাপাশি ভালোবাসার মানুষজোড়া।জ্যোতির মনে পড়ল কিশোরী বয়সের স্বপ্ন! সেসময়ে এমনই স্বপ্ন বুনত সে।এমনই এক শান্ত সকালে পাশাপাশি হাঁটার স্বপ্ন। এমনই এত শীতল বাতাস ময় পরিবরশে ভালোবাসার মানুষের সঙ্গ।

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে