মাথায় কারো হাতের ছোয়া পেতেই আদরের ঘুম ভেঙ্গে যায়! পিটপিট করে চোখ খুলে তাকায় কিন্তু চোখ খুলতেই এক লাফে বিছানা থেকে নেমে যায়।তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে হয়তো এতো বড় একটা শক সে নিতে পারেনি, সেটাও আবার ঘুম এই ঘুম ঘুম চোখে। আর রমনীটি নিজেও ঝট করে উঠে দাঁড়িয়েছে, আদরকে এভাবে ভুত দেখার মতো চমকে যেতে দেখে সে নিজেও অনেকটা ভয় পেয়ে গেছে!আদর কয়েকবার চোখ পিটপিট করে তাকায় কিন্তু না সে ভুল দেখছে না! এরইমধ্যে আলিশা আদরের কাছে গিয়ে বলে,,,
আদরকে আমতা আমতা করতে দেখে আলিশা এগিয়ে গিয়ে নিজের ওরনা দিয়ে আদরের গলার কাছের ঘামগুলো মুছতে মুছতে বলে। কিন্তু আদর আবার এক লাফে পিছনে চলে যায়। আসলে তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে সব, কি হচ্ছে তার সাথে স্বপ্ন দেখছি না আমি!’ নাকি এটা কোনো ভুত জ্বীন ঢোক গিলে মনে মনে বলে আদর।
আলিশার গলায় আগের মতো তেজ শুনে আদর এবার স্বাভাবিক হয়! এইটায় তো তার বউ আশা তবে একটু আগে এতো সুন্দর ব্যাবহার করার মানে কি। প্রশ্নটা করবে না করবে করে ও করেই ফেলে প্রশ্নটা।
–‘একটু আগে তুমি এতো সুন্দর ব্যাবহার করলে কেনো?’
আলিশা হতাশ হয়,
–‘তুমি না কালকে বললে তুমি স্বাভাবিক সম্পর্ক চাও!’ আমি ও চাই আদর, তোমার আদর্শ স্ত্রী হওয়ার চেষ্টা করতে চাই, তোমার সাথে মেনে নিয়ে সম্পর্কটাকে এগিয়ে নিতে চাই আদর, তুমি কি আমায় একটা সুযোগ দিবে না বলো? আমি হাঁপিয়ে গেছি আদর আর পারছি না, তোমায় আর আমাদের বাচ্চাটাকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে চাই আদর।
মাথা নিচু করে কথাগুলো বলে আলিশা। কথাগুলো শুনে আদরের মুখে হাসি ফুটে উঠে, হাসিমুখে এগিয়ে এসে আলিশার থুতনিতে হাত দিয়ে মাথাটা উঁচু করে বলে,,
–‘আমি কিন্তু রোজ তোমায় দিয়ে হাত পাঁ টেঁপাবো, রাজি থাকলে বলো?’
বলেই চোখ টিপ দেয়। আলিশা শব্দ করে হেঁসে উঠে মাথা নারিয়ে আদরকে জড়িয়ে ধরে। আদর ও হেসে একটা হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,,
–‘এই ছাড়ো, এখনই তুমি আমার সুযোগ নিচ্ছো ছি ছি আমি একটা অবলা পুরুষ।’
আদরের কথা শুনে আলিশা একটা ধাক্কা দেয় আদরকে কিন্তু আদর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে।আলিশাও শক্ত করে ধরে। আদর বলে,,,
–‘আশা তুমি তো আমায় জিজ্ঞেস করলে না এতো সহজে আমি তোমায় মাফ করলাম কেনো?’ আর সবকিছু স্বাভাবিক করতে চাই কেনো?
আদরের কথা শুনে আলিশা চোখ তুলে আদরের দিকে তাকায় আর মনে মনে ভাবে,, আসলেই তো আমি তো এটা ভাবিনি! তবে কি আদর আমার সাথে নাটক করছে, প্রতিশোধ নিচ্ছে!
আলিশাকে চোখ মুখ অন্ধকার করে কিছু ভাবতে দেখে শব্দ করে হেসে উঠে আদর। আলিশা ভাবনা থেকে বের হয়ে এসে আদরকে দেখতে থাকে। আদর নিজের হাসি কন্ট্রোল করে বিছানায় বসে পড়ে আর আলিশাকে একটানে নিয়ে এসে কোলের মধ্যে বসিয়ে বলে,,
–‘রিল্যাক্স, তুমি তো দেখছি সিরিয়াস হয়ে গেছো!’ আমিও একটু সুখে থাকতে চাই আশা, আরো তো ভাইয়ের সাথে সুখেই আছে তাই না? আমার কি তাহলে সুখে থাকার অধিকার নেই বলো? আজকে থেকে সব বাদ শুধু তুমি, আর তুমি শুধু দিন রাত সবসময় আদর আদরই করবে বুঝলে।
আদর কথাগুলো শেষ করেই আলিশাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়, তারপর আলতো হাতে আলিশাকে সরিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।আলিশার মুখে আজকে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠে, মানুষ মাত্রই তো ভুল! আর যারা ভুল করার পর শুধরে নিয়ে আবার ভালোবাসতে পারে তারা কখনে ছেড়ে যায় না।এতোদিন যা হয়েছে সব বাদ এখন থেকে আদরের কথা মতো সে সবসময়ই আদর আদর করবে।
এরইমধ্যে ওয়াশরুম থেকে আদরের গলার স্বর ভেসে আসে, হাসে আলিশা ছেলেটা আসলেই পাগল। তবে রিলেশন চলাকালীন কখনো আদরকে এরকমটা দেখে নি। আদর যে অনেকটাই ফাজিল সেটা আজকেই বুঝতে পারলো আলিশা।
–‘আশা! ‘
আবার আদরের গলার স্বর শুনে হকচকিয়ে যায় আলিশা, নিজেও আদরের মতো চেঁচিয়ে বলে,,
–‘হ্যা বের করছি তুমি আগে বের হবে তো নাকি!’
ওপাশ থেকে আর আদর কিছু বলে না। আলিশা ও চুপচাপ আলমারি থেকে আদরের জন্য সুন্দর একটা কালো শার্ট বের করে, আজকে ভার্সিটিতে যাবে জনাব, ওই জন্য চেঁচিয়ে শার্ট বের করতে বললো।আলিশার অবশ্য ভালোই লাগলো নিজেকে আদরের বউ বউ মনে হচ্ছে! আদরের প্রয়োজনীয় সবকিছু রেডি করে, নিজের জন্য একটা কালো থ্রিপিস বের করে রাখে। সে ও আজকে আদরের সাথে ভার্সিটিতে যাবে ভেবেছে!আদর ওয়াশরুম থেকে বের হতেই আলিশাকে ছটফট করে কাজ করতে দেখে হাসে। আজকে নিজেকে তার বিবাহিত বলে মনে হচ্ছে। এইতো সকালে কতো ভয়ংকর ভাবে তাকে জাগিয়ে তুলতো এখন আবার সবকিছু রেডি করছে ছটফট করতে করতেই৷ আলিশার চোখ আদরের দিকে পড়তেই বলে উঠে,,,
–‘আঁধার ভাইয়া তোমাকে নিয়ে ছাদে যেতে বলেছে আগে দেখা করে এসে!’
আলিশার মুখে আঁধারকে ভাইয়া বলতে শুনে আদর অবাক হয়, পরক্ষণেই আবার সবকিছু মেনে নিতে চেষ্টা করছে আলিশা সেটা ভেবেই মুচকি হেসে বলে,,
–‘চলে!’
–‘তুমি যাও আমি কফি নিয়ে যাচ্ছি!’
আলিশার কথা শুনে হেসে মাথা নাড়িয়ে চলে যায় আদর।আলিশাও নিচে চলে যায় কফি আনতে।
আরোহী আর আঁধারকে একসাথে দেখে হেসে বলেন মিসেস আঁকলিমা চৌধুরী,,
–‘তোরা একসাথে তার মানে সব রান্না কি তোরাই করেছিস নাকি আরো মা একাই করেছে?’
আঁকলিমা চৌধুরীর কথায় আঁধার ও আরোহী ভ্রুকুঁচকায়।কিন্তু আলিশার কথা মনে হতে দু’জনে দুজনের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলে,,,
–‘ওইটা তো তোমার বউমা করেছে!’
–‘বউ মা মানেই তো আরো নিজেই, এতোকিছু তুই একাই কেনো করতে গেলি মা!’ আমায় ডাকতে পারিসনি?
–‘উফফ আম্মু, নিচে চলো আগে তারপর দেখবে কে করেছে!’
মিসেস আঁকলিমা চৌধুরীর গলা জড়িয়ে ধরে বলে আরোহী। আঁধার ও হেসে বলে,,,
–‘ যাও তোমরা আর হ্যা ছাদে যাচ্ছি কফি দিয়ে আসো ২ কাপ।’
আরোহী মাথা নাড়ায় । মুহুর্তের মধ্যেই মিসেস আঁকলিমা চৌধুরীকে নিয়ে নিচে চলে আসে সে।আর মিসেস আঁকলিমা চৌধুরী কিছুই বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে?
কিচেনের সামনে এসে আরোহী মিসেস আঁকলিমা চৌধুরীকে আঙ্গুল দিয়ে সামনের দিকে দেখিয়ে দেয়। আঁকলিমা চৌধুরী ভুত দেখার মতো চমকে যায় আলিশাকে খাবার সার্ফ করতে দেখে। তিনি আলিশার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আরোহীর দিকে তাকায়।
আরোহী চোখ দিয়ে ইশারায় বুঝায় আজকের সবকিছু আপুই করেছে৷ আঁকলিমা চৌধুরী সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আলিশার দিকে! আরোহী বুঝতে পারে কিন্তু কিছু বলতে পারে না, কি বলবে আলিশা যা করেছে আগে তাতে সবারই সন্দেহ করাটা জায়েজ! আরোহী নিজেও তো প্রথমে সন্দেহ করেছিলো কিন্তু আঁধার সবকিছু স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছে এমনকি বিনা সংকোচে আলিশাকে মাফ ও করে দিয়েছে!
আলিশা মিসেস আঁকলিমা চৌধুরীকে দেখতে পেয়েই মাথা নিচু করে নেয়, কি বলবে সে! এই লোকগুলোকে সে কতোটা কষ্ট দিয়েছে, কোন মুখে সামনে তাকাবে সে। আলিশাকে মাথা নিচু করতে দেখে আঁকলিমা চৌধুরী ও কিছু বলেন না গটগট পাঁয়ে উপরে চলে যান আবার।
আরোহী এগিয়ে এসে আলিশার কাঁধে হাত রাখে আলিশা অসহায় চোখে তাকায় আরোহীর দিকে! আরোহী হেসে বলে,,,
–‘সব ঠিক হয়ে যাবে আপু তুই চিন্তা করিস না, এখন চল আঁধার কফি নিয়ে যেতে বলেছে!’
আরোহীর কথা শুনে আলিশা বলে,,,
–‘এই রে আমি তো ভুলেই গেছিলাম, দাঁড়া আমি কফি ঢেলে নেই!’
আদর ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ, আঁধারের আসার অপেক্ষা করছে সে! কিনা আঁধার যে প্রায় অনেকক্ষণ যাবত তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে সেটা তার অজানা! কাঁধে কারো হাতের অস্তিত্ব পেতেই মুচকি হেসে বলে,,,
–‘ভাই তুমি না টাইম পাংচুয়াল, আজকে ২০ মিনিট লেট করে এসেছো!’
–‘আর তুই যে লেট লতিফ, আজকে ২০ মিনিট আগেই চলে এসেছিস বাহ!’
–‘তোমার মতো হওয়ার চেষ্টা করছি তো তাই! ‘
বলেই আঁধারকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে।
–‘এ কি রে তুই কাঁদছিস, ছ্যাহ্ ছেলে মানুষ আবার কাঁদে!’
মন খারাপ হলেও মজার ছলে কথাটি বলে আঁধার। কিন্তু আদর আর কিছু বলে না আগের মতো ঝগড়াও করে না! আঁধার এবার আদরের মাথাটা তুলে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলে,,,
–‘তুই দেখছি মেয়ে মানুষকেও ফেল করিয়ে দিবি,আরে মেয়েরা ও তো এভাবে কাঁদে না পাগল!’
–‘আই এ্যাম সরি ভাই,আমি আসলে…’
আদরকে বাকি কথা শেষ করতে দেয় না আঁধার তার আগেই বলে উঠে,,,
–‘কোনো পুরোনো কথা না আর সব ভুলে যা আমি ও ভুলে গেছি, নতুন করে সবকিছু শুরু কর! ‘ আলিশা কিন্তু ভালো মেয়ে পরিস্থিতির কারণে হয়তো এমনটা হয়ে গেছিলো।
আলিশা আর আরোহী ছাদের দরজার কাছেই কথাটা শুনে দাঁড়িয়ে যায়।আলিশা আরোহীর দিকে ঘোলাটে চোখে তাকায়। আরোহী মুচকি হেসে বলে,,,
–‘মন খারাপ করো না তো এখন আর কষ্ট পাবে না,কষ্ট পাওয়ার দিন শেষ আমাদের। ‘
আলিশা মাথা নাড়িয়ে বলে,,,
–‘আঁধার এতো ভালো কেনো বল তো আমি ওর সাথে তোর সাথে কতো কি করলাম কিন্তু তবুও আমায় ভালো বলছে সে!’
–‘উনি অনেক ভালো মনের মানুষ আপু! ‘
আঁধারের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে আরোহী। আলিশা আরোহীর মুগ্ধ দৃষ্টির মানে বুঝতে পারে কিন্তু এবার আর তার হিংসে হয় না। খুশি মনে সবটা মেনে নেয় সে, আর আদরের দিকে তাকিয়ে থাকে সে।
–‘তুমি বেস্ট জানো ভাই?’ তুমি আসলেই বেস্ট।
আঁধারকে আবার জড়িয়ে ধরে বলে আদর। আঁধার আদরের পিঠে একটা চাপড় মেরে বলে,,,
–‘ছেহ্ সর মেয়ে মানুষের মতে খালি কথায় কথায় গায়ে পড়ছিস কেনো?’ সর সর আমার বউ দেখলে আমাকে সন্দেহ করবে সর।
আঁধারের কথা শুনে আদর আর একটু আঁধারের কাছে গিয়ে বলে,,,
–‘ তোমায় না একটা চুমু খেতে মন চাচ্ছে খাই!’
আদরের কথা শুনে আঁধার এক লাফে দূরে গিয়ে বলে,,,
–‘তুই কি আমায় আলিশা ভাবছিস নাকি?’ ছেহ্ দিন দিন তোর হাব ভাব কিন্তু ওদের মতো হয়ে যাচ্ছে?
–‘কাদের মতো?’
প্রশ্নটা শুনে আঁধার ও আদর উভয়ই পেছনে তাকায়। প্রশ্নটা আরোহী মুখ ফসকে করে ফেলেছে। আর আলিশা তো এদের দুই ভাইয়ের কান্ড দেখে শুরু থেকেই হাসছে।
আরোহীর কথা শুনে আদর এবার ফিক করে হেসে দিয়ে আঁধারের উদ্দেশ্যে বলে,,,
–‘বলো বলো ভাই ওরাটা কারাাাা?’ আরে আরো জিজ্ঞেস করো তোমার বরকে।
আরোহী আদরকে এমন স্বভাবিক হতে দেখে অবাক হয়ে যায়, তবে তার অস্বস্তি ও হয় কিন্তু সবকিছু স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা করে সে। এরইমধ্যে আঁধার ধুম করে আদরের পিঠে একটা কিল বসিয়ে দিয়ে বলে,,,
–‘ওরা হচ্ছে কারা জানো আরু, এই যে আদরের মতো যারা কথায় কথায় ছেলেদের গায়ে পড়ে!’
আদর রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আঁধারের চুল ধরে টান দেয়, আর আঁধার ও যেনো সুযোগ পেয়ে যায়। টানাটানি করতে করতে ছুটাছুটি শুরু করে। পুরো ছাদে ছুটাছুটি করে না পেরে ছুটাছুটি করতে করতে দুই ভাইয়ে নিচে চলে যায়।আরোহী ভ্রুকুঁচকে তাকিয়ে আছে, ওরাটা কে সে এখন ও বুঝতে পারেনি কিন্তু আলিশা ওদের কান্ড দেখে হাসতে হাসতে পড়ে যাচ্ছে।
এই দুই ভাইয়ের এই রুপ তাদের কাছে অজানা ছিলো এতোদিন। আজকে ধিরে ধিরে সবকিছু প্রকাশ পাচ্ছে। সব সম্পর্কটা ঠিক হচ্ছে।
পরের দিন সকালে,, বুকের মধ্যে ভারী কিছু অনুভব করতেই আঁধারের ঘুম ছুটে যায়। ভ্রুকুঁচকে চোখ খুলতেই আরোহীকে বাচ্চাদের মতো তার বুকে গুটিশুটি মেরে ঘুমাতে দেখেই আঁধারের মন ভালো হয়ে যায়।
কালকে যখন আরোহীকে কোলে তুলে নিয়ে রুমে এসেছিলো,তখন আরোহী একদম নিশ্চুপ হয়েই ছিল! আঁধার আরোহীকে নামিয়ে দেওয়ার পর পরই আরোহী ওয়াশরুমে চলে গিয়েছিল, প্রথমে আঁধার অবাক হলেও পরে আরোহীকে কিছুক্ষণ একা থাকতে দেওয়া উচিত ভেবেই বাহিরে চলে গিয়েছিল।
পরে সোহেলদের সাথে আড্ডা দিতে দিতেই রাত হয়ে যায়।বাসায় আসার পর আরোহীকে আর রুমে আসতে দেখেনি।আরোহীর বাবা মা বিকেলের দিকেই চলে গিয়েছে।
আরোহী আঁধারের মায়ের রুমেই ছিল, শাশুড়ী বউমা মিলে কিসের জানি সিরিয়াস আলোচনা করছিলো।তাই আর কিছু বলেনি!আর বিরক্ত ও করেনি, কিন্তু আঁধার আরোহীর আসার অপেক্ষা করছিলো মূলত আরোহীকে কিছু কথা বলতে চেয়েছিলো।কিন্তু আরোহীর আসার আর সময় হচ্ছিল না তাই আঁধার কখন ঘুমিয়ে যায় বুঝতেই পারে না।
আঁধার হাসি মুখে আরোহীর কপালে একটা চুমু দেয়, আরোহী খানিকটা নড়ে ওঠে! আঁধার এবার আরোহীর বাম গালে একটা চুমু দেয় আবার আরোহী কিছুটা নড়ে ওঠে। আঁধার যেনো এতে অনেকটাই মজা পায় তাই সে আবার আরোহীর বাম গালে একটা চুমু দেয় আরোহী ঘুমের মাঝেই বিরক্ত হয় ।
আঁধার হেসে ফেলে আরোহীর কান্ডে, আর বিরক্ত করে না তাকে। আসতে করে বালিশে শুয়ে দিয়ে চোখমুখে একটা ফুঁ দেয় আরোহী বিরক্ত হয়ে উল্টো দিকে ঘুরে যায়।আঁধার এবার শব্দ করেই হেসে উঠে, আর বিরক্ত করে না কিন্তু আরোহীকে বিরক্ত করতে তার অনেক মজাই লাগছিলো। টাওয়াল নিয়ে হাসতে হাসতেই ওয়াশরুমে ঢুকে যায় সে।
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ও আরোহীকে ঘুমাতে দেখে কফি নিয়ে আসে উঠিয়ে সকাল বিলাস করবে, আরোহীর সাথে ভেবেই বেরিয়ে যায় কিচেনের উদ্দেশ্যে।
আলিশার কথা শুনে আরও বেশি অবাক হয়ে যায় আঁধার। এতো সকাল সকাল রান্না করছে আলিশা আবার তাকে ভাইয়া বলেও ডাকছে! আসলে সে কি সত্যিই দেখছে নাকি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে?
–‘ভাইয়া, এই নিন!’
আঁধারের অবাক হওয়ার মাত্রা আরও কয়েকগুন বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য আলিশা একটা কফির কাপ আঁধারের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে।
আঁধার এবার ভ্রুকুঁচকে তাকায় একবার আলিশার দিকে তো একবার তার বাড়িয়ে দেওয়া কফির দিকে! আলিশা উৎসুক দৃষ্টিতে আঁধারের দিকে তাকিয়ে আছে, মূলত আঁধার কি করে সেটাই দেখতে চাচ্ছে। আঁধার নিজের অবাকের মাত্রাটাকে প্রকাশ না করেই কফির কাপটা হাতে নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,,,
–‘থ্যাক্স,আর এক কাপ কফি দাও!’
আঁধারের কথাশুনে আলিশা খুশি হয়ে যায়,খুশি মনে আর একটা মগে কফি ঢালতে ঢালতে বলে,,,
–‘আরোর জন্য নিশ্চয়ই আর একটা কফি রাইট!’
–‘হুম!’
আলিশার হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলে আঁধার।
আলিশা হাসি মুখে কফির মগটি এগিয়ে দিয়ে বলে,,
–‘কিছু মনে না করলে একটা কথা বলতাম ভাইয়া!’
আঁধার ভ্রুকুঁচকে তাকায়। আলিশা উত্তরের অপেক্ষায় চেয়ে আছে তার পানে, বিরক্ত হয় আঁধার কিন্তু মুখে বলে,,
–‘হুম!’
–‘আসলে ভাইয়া আমি কালকে আরোহীর প্রতি সবার বিশ্বাস দেখার জন্যই আরোহীকে দোষারোপ করেছিলাম, তার জন্য আই এ্যাম এক্সট্রেমলি সরি!’ আমি জানি আপনি হয়তো আমার কথাগুলো শুনে অবাক হচ্ছেন, হওয়ারই কথা! তবে কালকের পর থেকে আমি মন থেকেই দুঃখিত, আমি অনেক ভুল করেছি জানি কিন্তু আমি সবার কাছে ক্ষমা চাইতে চাই। আমার ভুলের জন্য হয়তো কেউ আমায় মাফ করবে না তবে আমি সবার সাথে নতুন করে সব কিছু শুরু করতে চাই। নিজেকে শুধরে নিতে চাই ভাইয়া, আমায় কি একটা সুযোগ দেওয়া যায় না। আই প্রমিস কখনো কাউকেই আর অভিযোগের সুযোগ দিব না। আমি আপনাকে ও বড় ভাইয়ের মতো সন্মান করবো!
মাথা নিচু করে চোখের জ্বল ফেলতে ফেলতেই কথাগুলো বলে আলিশা।আঁধার আলিশার থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়, আলিশার কথাগুলো শুনে তার মনে হচ্ছে যে আলিশা সত্যি বলছে। কিন্তু এতোকিছু করার পর আসলেই কি আলিশা নিজেকে বদলিয়ে নিতে চায়? আঁধারের থেকে উত্তর না পেয়ে আলিশা চোখ মুছে আঁধারের দিকে তাকায়।
–‘থাক আর কিছু বলার দরকার নেই, তুমি ওকে উঠিয়ে নিয়ে একদম ছাদে নিয়ে আসো ঠিক আছে!’
আঁধারের কথা শুনে আলিশা অবাক হয়। আলিশাকে অবাক হতে দেখে আঁধার মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলে,,
–‘অবাক হওয়ার কিছু নেই, বড় ভাই বলেছো যখন তখন বড় ভাইয়ের সব কথা মানতে হবে তো!’
আলিশা তাকায় আঁধারের দিকে, কিন্তু যখন আঁধারের কথার মানে বুঝতে পারে নিজেও হেসে মাথা নাড়িয়ে বলে,,
–‘হুম ঠিক আছে!’
আঁধার মুচকি হেসে চলে যায়। আরোহী আঁধারকে যেতে দেখেই আড়াল থেকে বের হয়, এতোক্ষণ সে আঁধার আর আলিশার কথাগুলোই শুনছিলো! আঁধারকে বের হতে দেখে আড়ালে লুকিয়ে পড়ে সে, কারণ সে চায় না এইসময় আঁধার তাকে দেখুক।
আরোহীর চোখ মুখে আজকে আর অন্যদিনের মতো সন্দেহের আভাস নেই, আঁধার যে আলিশাকে পছন্দ করে না সেটা সে বুঝতে পারছে কালই। তবে এতোকিছুর পরও যে আঁধার আলিশাকে সহজে ক্ষমা করে দিবে সেটা আরোহীর ভাবনার বাহিরে ছিলো।
মুচকি হেসে আরোহী আলিশার দিকে তাকায়, তার বোনটা হয়তো এবার সত্যিই অনুতপ্ত কিন্তু আবার যদি আগের মতো ভালো মানুষের নাটক করে কথাটা ভাবতেই আরোহীর হাসি মুখ চুপসে যায়।সত্যিই কি আলিশা নিজেকে বদলাতে চায়, নাকি অন্য কিছু! এরইমধ্যে আলিশা আরোহীকে দেখে ডাকে,,,
–‘আরে আরো ওখানে কি করছিস এদিকে আয়?’
আলিশার ডাকে আরোহীর হুস ফিরে,মনে মনে ভাবে ডাকছে কেনো! এগিয়ে গিয়ে আলিশার কাছে এসে দাঁড়ায়। আলিশা মিষ্টি হেসে বলে,,,
–‘তুই নিচে কি করছিস, ভাইয়া যে কফি নিয়ে উপরে গেলো তোর জন্য!’
–‘হ্যা আমি ও উপরেই যাব তবে তোকে কিচেনে দেখে অবাক হয়েছিলাম আর কি।’
আরোহীর কথায় আলিশা আরোহীকে জড়িয়ে ধরে বলে,,
–‘হ্যা, এখন থেকে আমিই রান্না বান্না করবো বুঝলি!’ তুই আমায় সাহায্য করবি না?
–‘করবো না কেনো অবশ্যই করবো!’
হেসে বলে আরোহী। আলিশার আরোহীর কথা শুনে মন খারাপ হয়ে যায়,,,এতো কিছু করার পরও এরা সবাই কতো ভালো ব্যাবহার করছে ওর সাথে আর ও কি না এদের সাথে খারাপ ব্যাবহার করেছে, কষ্ট দিয়েছে! আর আরোহীকে তো সে নানান ভাবে অপমান করতে ও ছাড়েনি,সেসব ভেবেই কেঁদে ফেলে আলিশা!
আরোহী হঠাৎ করেই আলিশার কান্না দেখে ভরকে যায়।
–‘কি হলো আপু, তুই কাঁদছিস কেনো?’
আরোহীর কথা শুনে আলিশা আর নিজেকে সামলাতে পারে না, আরোহীকে জড়িয়ে ধরেই হুহু করে কেঁদে উঠে। আরোহী কি করবে ভেবে পায় না,,,
–‘আমায় ক্ষমা করে দে আরো,আমি তোর সাথে এতোদিন অনেক অন্যায় করেছি!’ তুই আমায় ক্ষমা করে দে বোন, আমি যে এতো পাপ আর অন্যায়ের বোঝা নিতে পারছি না রে। তোর সাথে আমি এতো অন্যায় করার পরও তুই আমায় সবসময় আগলিয়ে রেখেছিস, আমার সাথে ভালো ব্যাবহার করেছিস! আমায় ক্ষমা করে দে আরো, আমি ও নতুন করে বাঁচতে চাই সবকিছু নতুন করে শুরু করতে চাই।
এরই মধ্যে আলিশার কান্নারত অবস্থায় বলা কথা গুলো শুনে আলিশাকে জড়িয়ে ধরে আরোহী।আলিশার চোখের জ্বল মুছিয়ে দিয়ে বলে,,,
–‘আমি সেসব কিছুই মনে রাখিনি আপু,তুই ও ভুলে যা!’ নতুন করে সব কিছু শুরু কর আমি তোর পাশে আছি।
আরোহীর কথা শুনে আলিশার মনটা হালকা হয়ে যায়, তবুও অপরাধ বোধ যায় না! এই ছোট মেয়েটাই তাকে বলছে সে তার পাশে আছে কিন্তু আমি কি কখনো তাকে বলেছি যে আরো আমি তোর পাশে আছি। ভেবেই আলিশা মাথা নিচু করে নেয়!
আরোহী আলিশাকে বলে এবার,,,
–‘আপু তুই আমায় ক্ষমা করে দে প্লিজ, আমি ছোট হয়ে তোর গায়ে হাত তুলেছি!’ আমি..
আরোহীকে আর কিছু বলতে না দিয়েই আলিশা বলে,,,
–‘ধুর পাগলি আমি কিছু মনে করিনি রে,আমি ভুল করেছিলাম তাই তুই প্রতিবাদ করেছিস মন খারাপ করিস না!’ আমি ও তো তোকে কতো কিছু খারাপ খারাপ কথা বলছিলাম।
–‘আচ্ছা বাদ দাও তো, আজকে চলো একসাথে রান্না করবো!’
আরোহীর কথা শুনে আলিশা হেসেই বলে,,
–‘আমি তো সকালের ব্রেকফাস্ট বানিয়ে ফেলেছি রে! ‘
–‘তো কি হয়েছে দুপুরেরটা একসাথে করবো কেমন!’
আলিশা মাথা নাড়ায়।
এতোক্ষণ উপর থেকে দু বোনের দিকে তাকিয়ে ছিলো আঁধার।আরোহীকে রুমে না দেখে খুঁজতে এসেছিলো আঁধার কিন্তু উপর থেকে নিচে আসতেই দু’বোনের দিকে নজর যায় তার। আলিশার সাথে আরোহীর সবকিছু স্বাভাবিক হতে দেখেই মুচকি হেসে ঘরে চলে যায় সে।
কিছুক্ষণ পরেই আরোহীর উদ্দেশ্যে ডেকে ওঠে আঁধার। আলিশা আরোহীকে বলে,,
–‘চল তুই ও ঘরে যা,আমিও যাই! ‘
আরোহী মাথা নাড়িয়ে বলে,,
–‘চলো!’
আরোহী রুমে ঢুকতেই আঁধারকে দেখতে পায় না তাই সরাসরি বেলকনিতেই চলে যায়।আঁধার আরোহীকে পাশে বসতে বলে,আরোহী খুশি মনে পাশে বসে পড়তেই কফির মগটা এগিয়ে দেয় আঁধার। আরোহী হাতে নিয়ে একবার চুমুক দিয়ে আঁধারের দিকে তাকায়, আঁধার আরোহীর মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে। আরোহী অস্বস্তিতে পড়ে যায়, আঁধার ঠোঁট কাঁমড়ে হাসে।
হুট করেই আরোহীর হাত থেকে কফির কাপটা নিজের হাতে নেয় আঁধার। আরোহী ভেবাচেকা খেয়ে যায়! আঁধার কফির কাপে একটা চুমুক দিয়ে আরোহীর দিকে এগিয়ে দেয়। আরোহী অবাক হয়ে যায়,,,
–‘এই আপনি আমার খাওয়া কফিটা খেলেন কেনো?’
–‘কেনো খেলাম জানতে চাও নাকি?’
ঠোঁট কাঁমড়ে কথাটা বলে আঁধার। আরোহী বিরক্ত হয়ে বলে,,
–‘জানতে না চাইলে নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করতাম না তাই না!’
আরোহীর আর একটু কাছে এগিয়ে গিয়ে বসে আঁধার! আরোহী একটু অবাক হয় তবে প্রকাশ না করেই সরে বসে একটু।
আঁধার বাঁকা হেসে আর ও একটু এগিয়ে যায়, আরোহীর অসস্তি যেনো আরও কয়েকগুন বেড়ে যায়।আর একটু সরে বসলে হয়তো পড়েই যাবে সে, মনে মনে ভাবে এবার এগিয়ে আসলে উঠে দাঁড়িয়ে যাবে সে। কিন্তু তার ভাবনা আর বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারে না তার আগেই আঁধার তার কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের কাছাকাছি টেনে নিয়ে আসে।
আরোহী ভয়ে কাঁপতে শুরু করে, আর তার হাতের কফির মগের কিছু গরম কফি আঁধারের হাতে ছিটকে পড়ে। সামান্য আর্তনাদ করে ওঠে আঁধার, কিন্তু আরোহীকে ছাড়ে না! আরোহী আঁধারের আর্তনাদ শুয়ে তড়িঘড়ি করে তার হাতের দিকে তাকায়।কফির মগের প্রায় অনেকটা কফিই লোকটার হাতে ছিটকে পড়েছে কিন্তু তাকে দেখো নির্বাক হয়ে এক হাত দিয়ে কোমড় চেপে ধরে আছে।
–‘একি আপনার হাত তো পুড়ে গিয়েছে, দেখি ছাড়ুন!’
আরোহীর কথাতে আঁধারের কিছু যায় আসে বলে মনে হলো না, সে তো নির্বাক হয়েই আরোহীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
–‘কি হলো ছাড়ুন!’ জ্বালা করছে তো?
–‘প্রতিবারেই নিজে ব্যাথা দিয়ে নিজেই সারিয়ে দেন মিসেস চৌধুরী!’
আঁধারের কথা শুনে আরোহীর ভ্রু আপনা আপনি কুঁচকে যায়,,,
–‘এখানটায় ব্যাথা হচ্ছে মিসেস চৌধুরী, এখানের ব্যাথাটা কিভাবে সরাবেন?’
আরোহীর হাত থেকে কফির মগটা নিয়ে রেখে দেয়, আর আরোহীর হাতটা তার বুকের বাঁ পাশে রেখে কথাটি বলে আঁধার। আরোহী সামান্য লজ্জা পায়, কি করবে ভাবতে পারে না!
–‘আরো মা কোথায় তোরা!’
মিসেস আঁকলিমা চৌধুরীর গলা শুনে দু’জন দু’দিকে ছিটকে সরে যায়, এর আগের সেই ঘটনার জন্য এখন ও লজ্জা পায় আরোহী আঁকলিমা চৌধুরীকে দেখলে কিন্তু তিনি তো সব কিছু স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিয়েছেন। বুঝিয়েছেন তবে আরোহী কেনো জানি না এখন ও লজ্জা পায় সেটার উত্তর তার নিজের কাছেই নেই।
আমার এই বাচ্চাটা চাই না বাবা, এই বাচ্চাটা আমার জন্য অশুভ! কথাটা বলার সাথে সাথে সপাটে পর পর দু’টো চড় পড়ে আলিশার গালে। এবারের চড়টা আর কেউ নয় শাহানাহ শেখ নিজেই দিয়েছে।আরোহী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার মায়ের দিকে,এই মানুষটা কখনো তাদের গায়ে হাত তুলেনি কিন্তু আজকে পরিস্থিতির কারণে হাত তুলতে বাধ্য হলো হয়তো!
–‘বাচ্চারা কখনো অশুভ হয় না, অশুভ হয় তোদের মতো মা নামের কিছু অশুভ মেয়ে!’ তোকে জন্ম দিয়ে নিজেকে অনেক সার্থক ভাবতাম কিন্তু নিজেকে ধিক্কার দেওয়ার ইচ্ছে করছে,কেনো তোকে তখনই গলা টিপে মেরে ফেললাম না!
শাহানাজ শেখের চিৎকারে সকলের মনে কষ্টের পাহাড় বহিয়ে দেয়, একটা মার জন্য নিজের মেয়ের এমন কু কর্ম কতোটা কষ্ট দায়ক সেটা মা ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারে না।
–‘জানিস মায়েরা কতো কষ্ট করে একটা সন্তানকে মানুষ করে, জানিস তুই? ‘ কখনো আমায় জিজ্ঞেস করেছিলি, আম্মু তুমি আমাদের জন্য সারাদিন এতো কিছু করো তোমার কষ্ট হয় না? কখনো তোর বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলি, বাবা তুমি আমাদের জন্য এতো কষ্ট করে উপার্জন করো তেমার কষ্ট হয় না! বল করেছিলি। আরে তুই কি বুঝবি একটা মা বাবার কষ্ট, বুঝবি তো তখন যখন তুই নিজেও মা হবি? কিন্তু তুই তো মা না রে পিশাচিনী, না না তোর সাথে পিশাচিনীদের তুলনা করলে ও তারা কষ্ট পাবে কারণ তারা ও অনেক কষ্টে তাদের সন্তান মানুষ করে।
এক নিশ্বাসে কথা গুলো বলেই দম নেয়, মনে হয় অনেক কষ্টে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, পড়ে যেতে ধরলেই আঁধার এক হাতে আগলে নেয়! আরোহী দৌড়ে এগিয়ে আসে, আদর তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায়, আলিশা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।
আমজাদ শেখ বুকে হাত দিয়ে সোফায় বসে পড়ে, আঁধার আদরকে চিৎকার করে বলে ওনাকে বসিয়ে পানি দিতে। আদর ও দৌড়ে যায় পানি নিয়ে, আর আলিশা মূর্তির দাঁড়িয়ে আছে। আঁকলিমা চৌধুরী আর তারেক চৌধুরী গিয়ে আমজাদ চৌধুরীর পাশে বসে শান্ত হতে বলে। শাহানাজ শেখ নিজেকে শান্ত করে আঁধারকে ছেড়ে দিতে বলে, কিন্তু আঁধার ছেড়ে দেয় না।
আলিশার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে কিন্তু সেটা কিসের কেউ জানে না।এরইমধ্যে শাহানাজ শেখ আবার চিৎকার করে উঠেন,,,
–‘আঁধার ওকে বলো ও কেনো গিয়েছিল বাচ্চাটা নষ্ট করতে?’ কি রে তুই চুপ করে আছিস কেনো বল?
প্রথমের কথাটা আঁধারকে বললেও শেষের কথাটা শুনে কেঁপে উঠে আলিশা।আলিশাকে চুপ থাকতে দেখে আদর এগিয়ে এসে আলিশার বাহু চেপে ধরে শান্ত চাহনিতে তাকিয়ে বলে,,,
–‘কোন সাহসে তুমি আমার সন্তানকে মারতে গেছিলে বলো, আমি তোমার সাথে সম্পর্কটা স্বাভাবিক করতে গেছিলাম শুধু মাত্র এই বাচ্চাটার জন্য।’ কিন্তু তুমি এটা কি করতে গেছিলে বলো আলিশা! উত্তর দাও।
আদরের এই শান্ত চাহনিটাই আলিশার কাছে ভয়ংকর লাগছে আজকে, মনে মনে অনেক অনুশোচনা হচ্ছে আলিশার আসলেই তো কি করতে গেছিলো সে এটা! বাচ্চাটা তে তারই কিন্তু আবার পরক্ষনে মনে হচ্ছে, না আমি ঠিকই করতে গেছিলাম বাচ্চাটা চাই না আমার।
–‘ওকে কি জিজ্ঞেস করছিস আদর তুই, ও কি বলবে কালকেই কতো সুন্দর নাটক করে সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে ভালো সাজার নাটক করে আজকে এইসব করতে গেছিলো?’ আর আমি কি দেখে এই মেয়েটাকে মাফ করতে গেছিলাম।
শেষের কথাটা আপসোস স্বরে বলে আঁকলিমা চৌধুরী।
–‘আলিশা উত্তর দাও!’
এবার আদরের চিৎকারে সকলে কেঁপে উঠে। আদর যে এতোক্ষণ কি করে রাগ কন্ট্রোল করছে কেউ ভেবেই পাচ্ছে না।আদরের জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো এতোক্ষণ আলিশার লাশ পাওয়া যেতো।
আরোহী নিজের বোনের দিকে অপলক চেয়ে আছে, এইটা তার বোন হতেই পারে না তার বোন তো তাকে অনেক ভালোবাসতো কিন্তু ধিরে ধিরে সবকিছু কেমন উলট পালট হয়ে গেলো। এখন তার বোন তাকে সহ্য করতে পারে না ঠিকই তাই বলে এতো বড় একটা স্টেপ! আরোহী আঁধারের দিকে তাকিয়ে দেখে সে তখন ও আরোহীর দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখ নামিয়ে নেয় আরোহী।
–‘ওকে নিয়ে এসময় আমি গর্ব করতাম, কিন্তু আমি হয়তো ওদের মানুষ করতে পারিনি! ‘ মানুষ করতে পারিনি।
শান্ত ভাবে কথাটি বললেন এবার আমজাদ শেখ।
–‘তুই এভাবে বলিশ না আমজাদ, ওকে দেখেই মনে হচ্ছে সে অনুতপ্ত! ‘
আলিশার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বললেন তারেক চৌধুরী।
–‘আমি ওকে ডিভোর্স দিয়ে দিব বাবা, তুমি পেপার্স রেডি করো!’ আমার বাচ্চাটা যেদিন হয়ে যাবে সেদিন থেকে মুক্ত।
আদরের কথাটা বর্জ্যপাতের মতো আঘাত করে আলিশার মনে, কিন্তু সে তো আঁধারকে চায় তাহলে! আলিশা ভাবে আমার তো খুশি হওয়ার কথা আমি তো এই বাচ্চাটা চাই না তাহলে মনে হচ্ছে কেনো আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
–‘সেটাই ঠিক হবে বাবা,তুমি সেটাই ঠিক করো!’ আমি নিজ দায়িত্বে তোমার বাচ্চাটাকে তোমার হাতে তুলে দিব।
শাহানাজ শেখের কথায় সবাই অবাক হয়ে যায়,মায়েরা মেয়েদের সংসার বাঁচানোর জন্য কতো কি করে কিন্তু তিনি সংসার ভাঙ্গার কথা বলছেন।
আলিশা হতভম্বর মতো দাঁড়িয়ে তার মায়ের কথা শুনছে।
–‘আমি কিছু বলতে চাই!’
আরোহীর কথা শুনে সকলে তার দিকে তাকালেও আঁধারের কথা শুনে তার দিকে তাকায়।
–‘তুমি রুমে যাও, এসব ব্যাপারে তোমায় কিছু বলতে হবে না!’
–‘পরিবারের ব্যাপার যেহেতু, সবাই কথা বলছে তাহলে আমি বলবো না কেনো?’
ভ্রুকুঁচকে বলে আরোহী। আঁধার নিজেও ভ্রুকুঁচকে বলে,,,
–‘আমি কি ছোট নাকি!’ আর আপনি আমায় কথা বলতে দিচ্ছেন না কেনো বুঝতেছি না।
–‘আরু কথা শুনো আমার, ভালো ভাবে বলছি যাও রুমে যাও!’ রাগিয়ো না আমায় যেটা বলছি করো।
–‘আজব তো আপনি আমার সাথে এরকম করছেন কেনো, আমার কি নিজস্ব একটা মতামত থাকতে পারে না!’ নাকি আমি এই পরিবারের কেউ না?
আরোহীর কথা শুনে তারেক চৌধুরী বলেন,,,
–‘আহ্ আঁধার, ওকে বলতে দে কি বলতে চায় ও!’ তুই বল মা কি বলবি।
আরোহী এক পলক আঁধারের দিকে তাকায়, আঁধারের এই অগ্নি দৃষ্টি দেখে ভয় হচ্ছে তার কিন্তু কথাগুলো বলতেই হবে আজকে তার।
আরোহী গুটিগুটি পায়ে আলিশার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,,,
–‘আপু তুই কেনো এতো বড় একটা স্টেপ নিলি বল তো,তুই তো এমন ছিলি না, আমি এই মেয়েটাকে চিন্তে পারছি না তুই আমার আপু হতেই পারিস না?’ বল না রে, তুই একা একা কেনো কষ্ট পাচ্ছিস বল তো? সবার কাছে সবকিছু সেয়ার করছিস না কেনো, তুই নিদ্বিধায় বল কেনো গিয়েছিলি?
আলিশার কথাগুলো সবার ভেতরে বর্জ্য কন্ঠের মতো আঘাত করে, কি বলছে আলিশা! আরোহী হা করে তার বোনের দিকে তাকিয়ে আছে, অবাক হয়েছে সাথে ভয় ও পেয়েছে সকলে কি তাকে অবিশ্বাস করবে। আঁধার মিসেস শেখকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে আরোহীর দিকে এগিয়ে আসে।
–‘কি বলছিস তুই এসব, আমি আমি কখন তোকে বললাম এসব?’
–‘কেনো তুই না বললি কাল আপু তোকে এবাড়িতে কেউ ভালোবাসে না, তুই আর তোর বাচ্চাটাকে ও কেউ চায় না! ‘ এতো কষ্ট সহ্য না করে বাচ্চাটা নষ্ট করে চলে যা।
–‘তুই কি পাগল হয়ে গেছিস আপু, কি সব বলছিস তুই…
আর কিছু বলার আগেই আঁধার শক্ত করে আরোহীর দুই বাহু চেপে ধরে। আরোহী ছলছল চোখে আঁধারের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আঁধার অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
–‘আদর বিশ্বাস করো আমি সত্যি বলছি! ‘ আরো নিজেই এসেছিলো আমার কাছে, আমি…
–‘এই চুপ তোর ফালতু কথা শুনতে চাই না, আরো এমন মেয়েই না। ‘ লজ্জা করে না তোর নিজের বোনের ব্যাপারে এসব বলতে।
–‘আদর!’
–‘এই চুপ করো তোমরা।’
হঠাৎ আঁধারের চিৎকারে দু’জনে চুপ হয়ে যায়।
–‘তুই এখন চুপ করে আছিস কেনো?’ বল উত্তর দে,,,
আঁধারের ধমকে কেঁপে উঠে আরোহী। আরোহীর থেকে জবাব না পেয়ে চিৎকার করে বলে উঠে আঁধার,,,
–‘কি রে বল!’
কিন্তু আরোহী নির্বাক, আঁধার যে তাকে অবিশ্বাস করবে সেটা সে কখনো ভাবতেও পারেনি।
–‘আঁধার বাবা তুই আরোকে ভালো করে চিনিস, ও এমন নয় তুই…’
–‘আম্মু আমি ওর সাথে কথা বলছি আমি আশা রাখবো কেউ আমাদের মাঝখানে কথা বলবে না!’
–‘কিন্তু আঁধার! ‘
–‘বাবা প্লিজ! ‘
তারেক চৌধুরী এবার অসহায় দৃষ্টিতে আমজাদ শেখের দিকে তাকায়।তিনি চোখ দিয়ে শান্ত থাকতে বলেন তাকে।
–‘কি হলো তুমি এখন ও যে চুপ করে আছ, উত্তর নেই তোমার কাছে?’
আঁধারের কথা শুনে ঝরঝর করে কেঁদে দেয় আরোহী।আরোহীর কান্না দেখে আঁধার যেনো আরও ক্ষেপে যায়,,,,
–‘কাঁদছিস কেনো এখন তুই,এই একদম কাঁদবি না! ‘ কথা শুনিস আমার তুই, বল? আমি যে তোকে বার বার বারণ করলাম তুই কথা বলবি না এসব ব্যাপারে শুনলি না কেনো তুই?
আঁধারের চিৎকারে আরোহীর কান্নার বেগ আর ও বেড়ে যায়।
–‘ভাই তুই..’
–‘আমি কি বলেছিলাম মনে হয় তুই শুনতে পাস নি?’
আঁধারের শান্ত চাহনিতে বলা কথাটি শুনে আদর ঢোক গিলে,ছোট থেকেই তার ভাইটা রাগচটা! রেগে গেলে তার মাথা ঠিক থাকে না, ছোট থেকেই এসব দেখে অভস্ত্য আদর তাই যমের মতো ভয় পায় সে তার ভাইকে! তবুও বিয়ের দিন এসব ঘটনার কারণে আঁধার যে তাকে তেম কিছু বলে নি সেটাই তার ভাগ্য। অনেকটা ভয়ে ভয়ে ছিলো সেদিন সে, নাহলে আলিশাকে কখনোই বিয়ে করতো না!
–‘এই কারণেই আমি ওকে চুপচাপ ঘরে যেতে বলেছিলাম!’ তোর লজ্জা করে না নিজে যেচে এসব শুনতে যাস,তোকে প্রতিনিয়ত অপমান করে তবুও তুই বোন বেন করিস। শান্তি হয়েছে এবার সো আর কোন কথা বলবি না তুই বুঝতে পেরেছিস নাকি। আমি এখন ও কিছু বোঝাতে পারি নি!
আরোহী মাথা নিচু করে মাথা নাড়ায়, যার অর্থ হ্যা বুঝতে পারছি৷ আঁধার এবার আরোহীকে ছেড়ে দিয়ে আলিশার সামনে যায়।
–‘কি যেনো বললে তুমি একটু আগে?’
আঁধারের কথা শুনে আলিশা ভয় পেয়ে যায়। কি বলবে ভেবে না পেয়ে আঁধারের পায়ের কাছে বসে পড়ে,,,
–‘আঁধার প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দাও, আসলে আমি দেখতে চেয়েছিলাম তোমরা আরো কে কতোটা বিশ্বাস করো! তাই ও সব বলেছিলাম, আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। তোমরা আমায় ক্ষমা করে দাও।
হঠাৎ করেই পা ধরাতে সকলে অবাক হয়ে যায়,আঁধার নিজেও অসস্তিতে পড়ে যায় হাজার হোক তারই বউয়ের বড় বোন আবার তার ছোট ভাইয়ের বউ।
–‘আরে আরে কি করছো উঠো উঠো।’
কোন মতো নিজের পা ছাড়িয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়ায় আঁধার।
আরোহী মমে মনে ভাবে, মেয়ে জাতিকে আর কতো নিচে নামাবে আপু, যখন তখন পা ধরো আবার ভুল করতেই থাকো।
আলিশা এবার আমজাদ শেখ ও শাহানাজ শেখর কাছে যেতে ধরলেই তারা দুরে সরে যায় এবং তাদের মেয়ে নয় সে আজকে থেকে সেটাই বলে। আলিশা কি করবে ভেবে পায় না, তারেক চৌধুরীর কাছে গিয়ে আর একটা সুযোগ চায়,,,
–‘আঙ্কেল আমায় আর একটা সুযোগ দেন প্লিজ, মানুষ মাত্রই তো ভুল আমি ও করে ফেলেছি!’ নিজেকে বদলিয়ে নিবো প্লিজ আঙ্কেল!
–‘বাবা আর কিছু বলবে না, আমি যেটা বলেছি সেটাই ফাইনাল!’ বাচ্চাটা হলেই তুমি ডিভোর্স পেপার পেয়ে যাবে! ততোদিন এখানেই থাকবে তুমি শেষ আর কিছু বলার নেই কারো।
কথাগুলো বলেই উপরে চলে যায় আদর, আরোহীর বাবা মা ও উঠে দাঁড়ি বলে,,,
–‘আমরা আজকে যাই তারেক,তুই আমার ছোট মেয়েটার খেয়াল রাখিস!’
–‘একি এখন কিভাবে আপনারা যেতে পারেন! ‘
আঁকলিমা চৌধুরীর কথায় শাহানাজ শেখ বলেন,,
–‘আজকে আর জোড় করবেন না ভাবি, তবে আরোকে নিয়ে যেতে চাই আর কতো দিন সে এখানে থাকবে!’
আঁধার ভ্রুকুঁচকায়,আঁকলিমা চৌধুরী আঁধারের দিকে তাকাতেই তাকে ইশারায় না করে আঁধার। মিসেস চৌধুরী মুচকি হেসে বলে,,,
–‘আমি এই মূহুর্তে আমার মেয়েকে কোথাও যেতে দিচ্ছি না, সে আর কয়টাদিন থাকবে এখানে! ‘
–‘আর আমজাদ তোরা ও এখন যেতে পারবি না চল ফ্রেস হবি!’
এক প্রকার জোড় করেই টেনে নিয়ে যায় তারেক চৌধুরী তাকে। আঁকলিমা চৌধুরী ও শাহানাজ শেখকে ফ্রেস হতে নিয়ে যান।আঁধার যেতে ধরলেই আরোহীকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,,,
–‘কি হলো তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেনো চলে? ‘
আরোহী আমতা আমতা করতে, আঁধার ভ্রুকুঁচকে তাকিয়ে আসে পাশে তাকায়। সে, আরোহী ও আলিশা ছাড়া কেউ নেই। তাই চট করে কোলে তুলে নেয় আরোহীকে। হকচকিয়ে যায় আরোহী, ছটফট শুরু করে কিন্তু আঁধার ছাড়ে না।
আলিশা কি করবে ভেবে পাচ্ছে না, একা একা দাঁড়িয়ে ভাবছে তার আসলে কি করা উচিত? সবাই তো নিজেরের মতো চলে গেলো কেউ তাকে কিছু বলে ও গেলেও না! চোখের পানি মুছে নেয় সে।
ঘরের এক কোণে বসে চোখের জ্বল বির্সজন দিচ্ছে আলিশা, একটু দুরেই আদর ডিভানে বসে মাথা নিচু করে আছে! তাকে দেখে বুঝার উপায় নেই আলিশার এইসব ন্যাকামিতে সে আসলে বিরক্ত কি না, তবে চোখ মুখ তার শক্ত।
আলিশা এবার একটু শব্দ করেই কেঁদে উঠে, আদর চোখ তুলে আলিশার দিকে বিরক্ত হয়ে তাকায়।
মূলত দুপুরের পর থেকেই আলিশা কাঁদছে, এখন রাত ১ টা! আদর প্রথমে বিরক্ত হয়ে বাহিরে চলে গেয়েছিলো কিন্তু রাতে আসার পর থেকেই আবার একই ঘটনা দেখে কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না!আলিশা কি এবার ও নাটক করছে, কিন্তু এবার তার মনে হচ্ছে আলিশা আসলে নাটক করছে না।
কিন্তু আদর বুঝতে পারছে না আলিশার কান্না করার মানে! তার মনে হচ্ছে আলিশা হয়তো এতো অপমান সহ্য করতে পারেনি তাই কাঁদছে কিন্তু আবার মনে হচ্ছে অনুশোচনায় কাঁদছে। আদর নিজেও নিজের ভাবনায় কনফিউজড!
আদর এবার কিছু একটা ভেবে নিজের জায়গা থেকে আলিশার পাশে এসে বসে পড়ে।পাশে কারো অস্তিত্ব অনুভব করতেই আঁড় চোখে তাকায় আলিশা,কিন্তু আদরকে দেখে অবাক হয়ে যায়।
আলিশার অবাকের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে আলিশার চোখের পানি নিজের বলিষ্ঠ হাত দ্বারা মুছে দেয় আদর। আলিশা কান্না থামিয়ে হা করে তাকিয়ে থাকে আদরের দিকে, আদর আলিশার রিয়াকশন দেখে সামান্য হাসার চেষ্টা করে। এতে যেনো আলিশা আরও খানিকটা অবাক হয়ে যায়।
–‘আর কেঁদো না আশা,কেঁদে কি হবে বলো! ‘ আজকের সব কিছুর জন্য তো তুমি নিজেই দ্বায়ী তাই না, আর কেঁদো না।
আদরের কথা শুনে আলিশার বুকের ভিতর একটা ব্যাথা অনুভব হয়, কিন্তু কি সেটা সে বুঝতেই পারে না। আজকে কতোদিন পর আদর তাকে আশা বলে ডেকেছে, ভাবতেই তার আগের দিনের কিছু কথা মনে পড়ে যায়।
আদর তাকে একদিন বলেছিলো তার নামটা নাকি অজগরের মতো বড় তাই আদর তাকে বেবি বলে ডাকে! কিন্তু হঠাৎ করেই আদরের ইচ্ছে হচ্ছিলো তাকে আশা বলে ডাকতে। আলিশা বলে ডাকতে পারবে না সে তাই আলিশার মাঝখানের লি টা কাটা আর সামনের আ আর শেষের শা মানে আশা বলেই সে ডাকবে।
সেদিন আদরের কথায় আলিশা ভরা রাস্তায় হাসতে হাসতে উল্টে পড়েছিলো! আনমনে সে এসব ভাবছিলো এতোক্ষণ কিন্তু আদর আলিশার দিকেই তাকিয়ে ছিলো! হঠাৎ করেই আলিশার চোখ পড়ে যায় তার চোখে, ঝট করে চোখ নামিয়ে নেয় আলিশা।
পরক্ষণেই আদরের কথার মানে ভাবতে থাকে,, লোকটা তার স্বামী কিন্তু সে তার সাথে অন্যায় করছে আর বাচ্চাটা তো তার নিজের অস্তিত্ব তবুও সে তাকে মারতে গেছিলো! আসলেই তো সব কিছুর জন্য সে নিজেই দ্বায়ী, কিন্তু সে যে আঁধারকে ভালোবাসে। আসলেই কি সে আঁধারকে ভালোবাসে। আলিশার ভাবনার মাঝেই আদর আলিশার মাথায় হাত রাখে, চমকে উঠে আলিশা।
আদর আলিশার মুখের দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসে, হেসেই বলে,,
–‘আমি সত্যি সম্পর্কটাকে স্বাভাবিক করতে চাই আশা, তুমি হয়তো ভাবতে পারো এতোকিছু করার পরও কেনো আমি এই কথাটা বলছি তোমায়?’ কিন্তু আমি অনেক ভেবে দেখলাম আসলে দোষটা সম্পূর্ণ তোমার এমটা নয়! আমারও অনেক দোষ আছে, যার কারণে আজকে আমাদের এই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে।
আদরের কথা শুনে আলিশা খানিকটা না প্রায় অনেকটায় অবাক হয়, আদর যে এতো কিছুর পরও তার সাথে এভাবে কথা বলবে সেটা তার ধারণার বাহিরে ছিলো! আর আদর তার দোষ গুলোকে কেনো নিজের দোষ বলছে সেটা বুঝতে পারছে না আলিশা।এরইমধ্যে আবার আদরের কথা শুনে আলিশার চোখ দিয়ে আপনা আপনি পানি বের হতে থাকে। কি থেকে কি হয়ে গেলো ,,,
–‘দেখো আজকে নিজের কিছু ভুলের কারণে আমি কারো সাথে নজর মিলিয়ে কথা বলতে পারি না!’ আসলেই আমি দোষী,আমার সাথে তোমার বিয়ে না হলে হয়তো তুমিও ভালো থাকতে। তোমার সাথে প্রথমে যখন রিলেশনে জড়িয়েছিলাম তখন তোমায় আমার ভালো লাগতো, কিন্তু পরে তোমার ব্যাবহার আমার খারাপ লাগতে শুরু করে। একদিন তোমায় পার্কে একটা ছেলের হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি বুঝে যাই হয়তো তুমি আমার সাথে টাইম পাস করছো। দেন তোমার সাথে ব্রেকাপ করি কিন্তু আমাদের কিছু ভুলের কথা তখন আমি আর ভাবিনি। যখন আরোকে দেখি তখন অন্যরকম একটা ভালো লাগা কাজ করতো ধিরে ধিরে ওর প্রতি আসক্ত হয়ে গেলাম ।আমার মনে হলো হয়তো ওকে ভালোবেসে ফেলেছি আমি আসলেই সেটা ঠিক সময়ের সাথে সাথে বুঝতে পারলাম!
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে খানিকটা দম নিলো আদর! আলিশা আদরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, আরোহীর কথা বলার পর পরই আদরের মুখে একটা চমৎকার হাসি দেখতে পাচ্ছে সে। হয়তো আদর তার ছোট বোনকে সত্যিই অনেক ভালোবাসে। আদরের গলা শুনে ভাবনা থেকে বের হয়ে আসে সে,,,
–‘কিন্তু পরিস্থিতির কারণে তাকে হারিয়ে ফেললাম, আর দেখো আজকে সে আমার বড় ভাইয়ের স্ত্রী!’ জানো কতোটা কষ্ট হয় যখন তাদের একসাথে দেখি, একে অপরের প্রতি কেয়ার দেখি।
কথাটা বলার সময় আদর নিজের বুকের বা পাশটা চেপে ধরলো। আলিশা তখন ও তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আদর আবার বলা শুরু করলো,,,
–‘আমি যে পারি না আশা,পারি না সবকিছু সহ্য করতে! ‘ কিন্তু দেখো তবুও আমি চোখের সামনে ওদের দেখছি, সহ্য করছি তো! তাহলে তুমি কেনো পারছো না আশা কেনো পারছ না তুমি? কেনো বার বার নিজেকে ছোট করছো বলো তো? আমি আমার আরোকে ফিরে পাবো না যেনে তাকে ভুলার চেষ্টা করি, না পারলেও মেনে নিতে শিখে যাবো একসময় আশা।এই যে তুমি এখন আমার স্ত্রী! জানো তোমায় আমি পরিস্থিতির কারণে বিয়ে করেছিলাম কিন্তু মন থেকে মেনে নেইনি!তবে আমাদের যে বাচ্চাটা আসছে তার জন্য আমি তোমায় আর একটা সুযোগ দিয়েছিলাম। তবে তুমি যে নাটক করছিলে সেটাও আমি জানতাম আশা তবুও তোমায় সুযোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি কি করলে, আমাদের নিষ্পাপ এই বাচ্চাটাকে মারতে গেলে কেনো করলে আশা এমটা বলো? আমি তো আরোর পরে ওকে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম তুমি সেটাকেও আমার থেকে কেড়ে নিতে যাচ্ছিলে? আজকে যদি ওর কিছু হয়ে যেতো তাহলে আমি আর কি নিয়ে বাঁচতাম আশা বলো আমায়।
কথাগুলো বলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠে আদর।আলিশার বুকে ব্যাথা শুরু হয়, আদর যে এতোটা ভালোবাসে তার বোনকে সেটা সে কল্পনায় ও ভাবেনি। আচ্ছা আঁধার কে পাওয়ার জন্য যে এতো কিছু সে করলো আসলেই কি আঁধারকে সে ভালোবাসে।
উহু তার মন বলছে না আলিশা তুই আঁধারকে কখন ও ভালোবাসিস নি! কারণ আঁধার তোর ক্রাশ! আর বিয়ে ভাঙ্গার জন্য জেদটা তোর বেশি হয়ে গেছিলো তার উপর আবার তোকেই রিজেক্ট করে তোরই ছোট বোনকে বিয়ে করা। তুই আসলেই স্বার্থপর আলিশা, তা নাহলে ছোট বোনের বিয়ে করা বরকে তুই নিজের করতে চাইতেই পারিস না!
আলিশা চোখ মুছে আদরের দিকে তাকায়, তার বিবেক বার বার বলছে,, দেখ আলিশা দেখ তুই কতোগুলো মানুষকে কষ্ট দিয়েছিস, কাঁদিয়েছিস। তা নাহলে তোরই বর তোর ছোট বোনের জন্য তোর সামনে এভাবে কাঁদতে পারতো না।একেই বলে প্রকৃত ভালোবাসা!আর তুই তো ভালোবাসা নামক জিনিসটাই বুঝিস না, তাই তো একজন মা হয়ে নিজের সন্তানকে হত্যা করতে গিয়েছিলি।
আলিশার নিজেকে পাগল পাগল লাগা শুরু করে, তার জন্য আদর, আঁধার, তার বোন আরো এমনকি আজকে তার বাবা মা ও কষ্টে আছে। একসময় যে বাবা মা তাকে বুকে আগলে রেখেছিলো আজকে তারাই তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। আলিশা আর নিজেকে আটকাতে পারে না শব্দ করে কেঁদে দেয়।
আদরের হুস আসে, চোখের পানি মুছে আলিশার আর একটু কাছে এগিয়ে যায়।আলিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,,
–‘কাঁদছো কেনো এখন বলো তো, এখন কেঁদে কোনো লাভ নেই!’ এইসময় এভাবে কেঁদো না, বাবুর ক্ষতি হতে পারে। এখন থেকে আমি তোমার খেয়াল রাখবো আমার বাবুর যেনো কিছু না হয়।
আলিশা আদরকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে, আদর হতভম্ব হয়ে যায়।যদিও আলিশাকে সে অনেকবার জড়িয়ে ধরেছিলো কিন্তু আরোহীকে ভালোবাসার পর থেকে আর কাউকে নিজের কাছেও আসতে দেয়নি। আলিশা তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে, হয়তো ঘোরের মাঝেই কাঁদছে এভাবে।নাহলে সে তো আর আমায় পছন্দ করে না,কিন্তু হয়তো মেয়েটা নিজেকে অনেক একা ভাবে তাই এসব করে। ভেবেই আদর একটা হাত আলিশার পিঠে রাখে।
আলিশা অনেকক্ষণ কাঁদার পর ধিরে ধিরে কান্না থামিয়ে দেয়। আদর এবার আলিশার মাথায় হাত রেখে বলে,,,
–‘আচ্ছা আশা আমরা কি সবকিছু নতুন করে শুরু করতে পারি না?’ আমায় কি একটু ও কেউ ভালোবাসতে পারে না, সবাই দূরেই চলে যায় সবসময়। তুমি কি আমার হাত ধরে আবার আগের মতো হয়ে যেতে পারো না আশা৷ আঁধার ভাইয়া ও আরো নিজেদের লাইফে এগিয়ে গেছে, শুধু আমরা এগুতে পারছি না। আচ্ছা আমাদের কি ভালো থাকার অধিকার নেই আশা! আমি একটু ভালো থাকতে চাই আশা,সবকিছু নতুন করে শুরু করতে চাই। নতুন করে কাউকে ভালোবাসতে চাই আশা। আমার না দম বন্ধ হয়ে যায় আশা, আমি -আমি কি করবো বলো না প্লিজ। আরোকে চোখের সামনে দেখলে কষ্ট হয় আশা। আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম তো তাকে নিয়ে কিন্তু -কিন্তু আমি পারছি না….
আর কিছু বলার আগে আদর কেঁদে উঠে, আলিশার এবার খারাপ লাগে অনেক বেশিই খারাপ লাগে। সে তো জেদের বশে এসব করছিলো কিন্তু এই মানুষটা এতো কষ্টে আছে বুঝায় যায় না৷ স্বাভাবিক ব্যাবহার কি করে সবার সামনে দেখায়৷ ভাবতেই পারছে না আলিশা।বাচ্চাটা আগে আদর চাইতোই না আর এখন ওই বাচ্চাটার জন্য কাঁদছে মানুষ মাত্রই পরিবর্তনশীল ভেবেই আলিশা আদরের থেকে চোখ সরিয়ে নেয়।
হঠাৎ করেই আদর চুপ হয়ে যায়। আলিশাকে কোলে তুলে নেয়।আলতো হাতে বিছানায় শুয়ে দিয়ে, কাঁথা টেনে দিয়ে চোখের পানি মুছে দেয়।আলিশা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, একটু আগেই লোকটা বাচ্চাদের মতো করে কাঁদ ছিলো আর এখন তার সাথে স্বাভাবিক ব্যাবহার করছে। লাইট বন্ধ করে দিয়ে চুপচাপ বেলকনিতে চলে যায় আদর।
আলিশার কান্না পায়,এই মানুষগুলো এতো ভালো অথচ সে এদের এতো কষ্ট দেয়।কিভাবে পারলো সে!
বেলকনির দরজার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আলিশা, আসলেই সে আদর, আঁধার, আরোহী সবার সাথে অন্যায় করছে। কিন্তু সে কি করবে সে ও তো পরিস্থিতির স্বীকার! পরিস্থিতি তাকে আজকে এতোটা নিচে নিয়ে এসেছে,নিজের ছোট বোনকে ও নোংরা কথা বলতে ছাড়েনি সে।
আদর বেলকনি থেকে রুমে আসে আলিশাকে একদৃষ্টিতে বেলকনির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে,,
–‘কি হলো ঘুমাও, ওদিকে কি দেখছো!’
হঠাৎ আদরের কন্ঠস্বর শুনে হকচকিয়ে যায় আলিশা।
–‘হ্যা হ্যা!’
–‘কি হ্যা হ্যা করছো, ঘুমাও!’
–‘হ্যা!’
–‘আজব কি হ্যা!’
–‘আচ্ছা তুমি কিভাবে জানলে আমি হাসপাতালে গেছি,আর কিসের জন্য গেছি?’
আদরের কথা শুনে ফট করে প্রশ্ন করে আলিশা।
আদর শান্ত চোখে তাকায় আলিশার দিকে, আলিশার চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে কতোটা ক্লান্ত সে তাই আর আদর অন্য কিছু বললো না।
–‘হাসপাতালে একটা বন্ধুকে দেখতে গিয়েই তোমায় দেখতে পাই, তখন সন্দেহ হয় তাই পেছন পেছন গেছিলাম!’
কথাটা বলেই শুয়ে পড়ে আদর, আলিশা অবাক হয় না। কারণ আদরকে কেউ ইনফর্ম করলেও সে এতে জলদি সেখানে পৌঁছেতে পারবে না সেটা সে জানে। তবে তার গালগুলো ব্যাথা করছে, অনেকগুলো মা-র খেয়ে গালগুলো ও আজকে ক্লান্ত হয়ে গেছে।
আদরকে চোখ বন্ধ করে থাকতে দেখে আলিশা নিজেও চোখ বন্ধ করে নেয়। আর মনে মনে কিছু একটা ভাবতে থাকে।কাল সকাল থেকে অনেক কিছুই হবে এ বাড়িতে! তবে ভালোই যেনো হয় সব ভেবেই ঘুমানোর চেষ্টা করে আলিশা।
আরোহীর চোখে বিন্দু বিন্দু জ্বলের রেখা দেখা দিয়েছে, অনেক কষ্টে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে আরোহী কিন্তু না চাইতেও কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে নিচে পড়ে।
রাহি আঁধারের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আরোহীর দিকে তাকাতেই তার নিজের ও কান্না পায়। তার মতে আরোহী অনেক কষ্ট সহ্য করছে প্রথম থেকেই!
আদরের এতো কিছু করার পর যখন আরোহী বিয়েতে রাজি হয়, তখন বিয়ে ভাঙ্গা,বড় বোনের বিশ্বাস ঘাতকতা আবার বিয়ে হওয়া,সেটা ও আবার তারই বড় ভাইয়ের সাথে। আবার আলিশার বেয়াদবি আচরণ, আঁধারকে নিয়ে কাড়াকাড়ি, আঁধার আরোহীর ভুল বোঝা বুঝি, এখন আবার এই আপদ!
রাহির এবারের রাগটা আঁধারের উপরই হয়, কিন্তু আরোহীর মুখের দিকে তাকিয়ে সামলে নেয়। তার মতে আগে আরোহীকে সামলানো দরকার!
–‘তুই কাঁদছিস আরো,কাঁদিস না দোস্ত চল গিয়ে আঁধার ভাইয়াকে প্রশ্ন করি, ওই আপুটা কেনো ভাইয়াকে এভাবে জড়িয়ে ধরে আছে?’
কিছুটা হতাশার সাথে বলে রাহি।
–‘না, ওনারা জাস্ট ফ্রেন্ড’স আর কিছুই না!’ আমি বিশ্বাস করি আঁধারকে।
চোখের পানি মুছে বলে আরোহী।
রাহি আরোহীর কথায় অবাক হয়ে যায়, কিন্তু পরক্ষণেই খুশি হয়ে যায় এইটা ভেবেই যে অবশেষে আরোহী আঁধারকে বিশ্বাস করতে পারছে! কিন্তু আবার আরোহীর চোখের পানি দেখে খারাপ ও লাগে,,,
–‘চল না গিয়ে প্রশ্ন করি, তুই কষ্ট পাচ্ছিস তো?’ ওরা ফ্রেন্ড বলে তো আর এভাবে চিপকা চিপকি করে থাকবে না?
–‘না রে, আমি বার বার এভাবে আঁধারকে সন্দেহ করতে পারিনা!’ আমার সহ্য হয় না তাই বলে তো আর তাদের থেকে দূরে থাকতে বলে পারিনা, তার ও তো একটা লাইফ আছে!
মুচকি হেসে ধরা গলায় বলে আরোহী। রাহি আরোহীর কথায় থম মেরে যায়,এই মেয়ে কি এখন সবকিছু সহ্য করবে নাকি? এতোটা চেঞ্জ কি করে হলো তার আরো?রাহির ভাবনার মধ্যেই আরোহী তাকে অন্য দিকে যাওয়ার কথা বলে।
রাহি আরোহীর সাথে অন্যদিকে না গিয়ে গাছ তলা থেকে আর একটু সামনে টেনে নিয়ে আসে সে আরোহীকে, রাহির মতে সম্পুর্ন ঘটনা দেখতে চায় সে, আসলে ঘটনা কি! আরোহী বারণ করার সুযোগ ও পায় না, তাই চুপচাপ ঘাসের উপর বসে পড়ে৷ আসলে সে মুখে যতোই অস্বীকার করুক না কেনো কিন্তু মেয়েটি কেনো তার বরকে জড়িয়ে ধরে আছে সে ও দেখতে চায়।
আঁধার নীলিমাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আর বলে,,
–‘দেখ নীলি, সব ঠিক হয়ে যাবে এভাবে কাঁদিস না!’
–‘কিছুই ঠিক হবে না আঁধার,ওরা -ওরা আমার কথা ভাবে না রে, আমি কোথায় যাবো বল?’
অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বলে নীলিমা।শিহাব এগিয়ে এসে নীলিমার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলে,,
–‘হুস, কাঁদিস না, আমরা সবাই আছি তো? ‘ আমরা তো ভাবি তোর কথা, তুই আমাদের সাথেই থাকবি।
–‘হুম, আমরা কি মরে গেছি নাকি তুই এসব বলছিস নীলি?’
রাতুল এগিয়ে আসে বলে।
–‘তোরা সবাই আমায় ভালোবাসিস জানি, তোরা থাকতে আমার আর কোন সমস্যা ও হবে না জানি, কিন্তু সারাজীবন কি তোরা আমার দায়িত্ব নিবি?’ একা একটা মেয়ের বেঁচে থাকা এই সমাজে এতোটাও সহজ না।
সবার দিকে একপলক তাকিয়ে আঁধারের দিকে তাকিয়েই কথাগুলো বলে নীলিমা।
–‘তুই এভাবে কেনো বলছিস নীলি,আমরা আছি তো সারাজীবন তোর সাথে।’
নীলিমার কাঁধে হাত দিয়ে কথাটি বলে তরী৷ তরির কথা শুনে নীলিমা হাসে কিন্তু তার মনটা কেঁদে উঠে সে তো সবাই বলতে আঁধারকে মিন করেই কথাগুলো বললো অথচ আঁধার কিছুই বললো না।চোখ দিয়ে অনবরত পানি বের হয় নীলিমার।
–‘ তোর এক্সাক্ট কি হয়েছে একটু খুলে বলবি নীলি, ওনারা কি তোকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে? ‘
আঁধার ভ্রুকুঁচকে বলে,,
আঁধারের কথা শুনে নীলিমা চোখের পানি মুছে নিয়েই বলে,,
–‘না আমার কিছু হয়নি, সব ঠিক আছে আমার তোরা চিন্তা করিস না!’
শিহাব, রাতুল ও তরী একে অপরের মুখের দিকে তাকায় কিন্তু কিছু বলে না আঁধার ও সোহেলের অগোচরেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।সোহেল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নীলিমার দিকে, আর নীলিমা আঁধারের দিকে।আঁধার চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে আছে, তাকে দেখে বুঝার উপায় নেই তার মনে কি চলছে।
রাহি ও আরোহী ও নিচের দিকে তাকিয়ে আছে ঠিকই কিন্তু তাদের আলোচনার সম্পূর্ণটাই তাদের কানে আসছে।তারা কিছুই বুঝতে পারছে না, নীলিমা কিসের কথা বলছে বা কি হয়েছে?
–‘দেখ নীলি, তুই পুরো কথাটা আমাদেরকে না বললে আমরা বুঝবো কিভাবে বল তো? ‘
মাথাটা উঁচু করে কথাটি বলে আঁধার!
–‘সে কি আর আমাদের বলবে সব,সে তো শুধু সারাজীবন তার দায়িত্ব নেওয়ার লোক খুঁজছে! ‘
শক্ত কন্ঠে কথাটি বলে এবার সোহেল, নীলিমা অবাক হয়ে যায়,,,
–‘তুই আমায় এটা বলতে পারলি সোহেল,তার মানে তুই আমায় সেলফিশ বলছিস?’
–‘যে যেটা তাকে তো সেটাই বলবো তাই না! ‘
–‘সোহেল!’
–‘শাট আপ নীলি,চেঁচাবি না একদম!’ সত্যি কথা যারা বলে তারা কখনো চেঁচিয়ে কথা বলে না।
–‘তাহলে তুই চেঁচাচ্ছিস কেনো, ভদ্র ঘরের ছেলেরা চেঁচায় না!’ আমরা তো আর ভদ্র ঘরের না।
তাচ্ছিল্য হেসে কথাটি বলে নীলিমা।
–‘শাট আপ নীলি, আর একটা বাজে কথা বললে তোকে আমি!’
বলেই চুপ হয়ে যায় সোহেল।
সোহেলকে চুপ করতে দেখে আবার তাচ্ছিল্য করে বলে নীলিমা,,
–‘ কি করবি বল, কি রে চুপ হয়ে গেলি কেনো বল?’ আমাদের কি সন্মান নেই তাই না রে! আমাদের ভালোবাসা যায় না!
বলেই ঢুকরে কেঁদে উঠে নীলিমা।
আঁধার চুপ করেই আছে, আর বাকি সবাই কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। এরইমধ্যে আরোহীরা তাদের কাছে চলে আসে, আঁধার তবুও চোখ তুলে তাকায় না।
আরোহীদের দেখে সকলে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে শুধু মাত্র নীলিমা আর আঁধার বাদে! নীলিমার মুখ দেখেই মনে হচ্ছে আরোহীদের দেখে সে অসন্তুষ্ট, আরোহীদের আগমনে সে বিরক্ত! কিন্তু আঁধারকে দেখে বোঝার উপায় নেই সে আসলে কি ভাবছে।
–‘আরে ভা. না মানে ছোট আপু যে, তা কি মনে করে হঠাৎ! ‘
হেসে বলে সোহেল। আরোহী সামান্য হাসার চেষ্টা করে বলে,,
–‘ আসলে ভাইয়া আমার একটু ওনার সাথে দরকার ছিল!’
–‘ উনিটা কে জানি, মনে করতে পারছি না।’
মনে করার ভঙ্গিতে বলে রাতুল। রাতুলের মাথায় গাট্টা মেরে বলে শিহাব,,
–‘গাধা আঁধারের কথা বলছে! ‘
–‘আরে আঁধার তুই একটু সাইডে গিয়ে ওর সাথে কথা বল বেচারি হয়তো সকলের সামনে লজ্জা পাচ্ছে! ‘
হেঁসেই বলে উঠে তরী। মূহুর্তের মধ্যেই নীলিমা ও আঁধার বাদে সকলে উচ্চস্বরে হেঁসে উঠে!আরোহী অবাক হয়ে যায়, এই মানুষ গুলো সত্যিই অদ্ভুত! এই তো কিছুক্ষণ আগেও এরা কতো রাগারাগি, ঝগড়াঝাটি, ও চিন্তা করছিলো কিন্তু ওরা আসাতে এমন ব্যাবহার করছে মনে হচ্ছে সবকিছু স্বাভাবিকই ছিল।
রাহি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নীলিমাকে দেখছে, ফর্সা দেখতে মেয়েটা তবে তার মতে তার আরোর মতো সুন্দরী না মোটেও না৷ তার আরোর ধারের কাছেও এই মেয়ে যেতে পারবে না।
শিহাব রাহির দিকে তাকিয়ে নীলিমার দিকে তাকায়,রাহির যে নীলিমাকে ভালো লাগে নি সেটা শিহাব ভালো করেই বুঝতে পারছে৷ কিন্তু ভালো না লাগার কারণটা এখন ও আন্দাজ করতে পারেনি সে।
–‘কি সমস্যা? ‘
আঁধারের রাশভারি কন্ঠে কথাটি শুনতেই রাহি ও শিহাবের ধ্যান ভাঙ্গে, তরী,সোহেল ও রাতুলের কপাল চাপড়ানোর মতো অবস্থা।
শিহাব বিরক্ত হয় আঁধারের কথায়,তারা বুঝতে পারে না তাদের মতো এতো কিউট বন্ধুদের এমন একটা নিরামিষ বন্ধু হয় কিভাবে? মেয়েটা তার সাথে কথা বলতে এসেছে কিন্তু সে কি বললো ” কি সমস্যা?” হাহ্
আরোহী আঁধারের কথা শুনে পূর্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়। আঁধার যে আগে থেকেই তার দিকে তাকিয়ে আছে, সেটা সে আগেই আন্দাজ করেছিলো।কিছু না বলেই আঁধারের দিকে এগিয়ে যায়।
নীলিমার বিরক্তিকর দৃষ্টি এবার অবাকে পরিনত হয়, আরোহী আসলে কি করতে চাচ্ছে সেটা সে বুঝতে পারছে না!
আঁধার তখন ও আরোহীর দিকেই তাকিয়ে আছে, আরোহী কিছু না বলেই নিজের হাতের ফোনটায় কাউকে কল দিয়ে আঁধারের দিকে এগিয়ে দেয়।আঁধার ভ্রুকুঁচকে ফোনটা হাতে নেয়।
–‘হ্যালো?’
আরোহীর দিকে তাকিয়েই বলে উঠে,
——
–‘কোন হাসপাতালে?’
——–
–‘আসছি আমি! ‘
——
–‘হ্যা ঠিক আছে, ওকে নিয়েই আসছি আমি!’
———
–‘বাসায়ই আসছি, তুমি নিজেই আরুর বাবা মাকে ফোন করে আসতে বলো! ‘
———
–‘ওকে!’
ফোন কেটে একপলক সবার দিকে তাকাতেই দেখে সবাই উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ফোনটা আর আরোহীকে দেয় না আঁধার নিজের পকেটে ঢুকিয়ে, আরোহীকে বলে,,,
–‘তুমি জানতে?’
–‘কি! ‘
অবাক হয়ে বলে আরোহী। আঁধার ভ্রুকুঁচকে বলে,,,
–‘আম্মু তোমায় কিছু বলেনি? ‘
–‘না, শুধু বলেছে আপনাকে ফোনটা দিতে! ‘ আপনাকে নাকি ফোনে পাচ্ছে না তাই। কি হয়েছে বাসায়, আর আপনি আমার বাবা মাকেই বা কেনো আসতে বললেন এখন?
আরোহীর প্রশ্ন শুনে আঁধারের কুঁচকে যাওয়া ভ্রু স্বাভাবিক হয়ে যায়।কিন্তু উত্তর দেয় না।
–‘সোহেল আমাদের যেতে হবে ইয়ার, আমি পড়ে তোদের সাথে পড়ে এ বিষয়ে কথা বলছি!’ আর তরী বর্তমানে তুই নীলিকে তোর বাসায় নিয়ে যা কিছুদিনের জন্য।
প্রথমের কথাটি সোহেলের দিকে তাকিয়ে বললেও শেষের কথাটা তরীর দিকে তাকিয়ে বলে আঁধার।
আরোহী বিরক্ত হয় তার কথাটি ইগনোর করার জন্য কিন্তু কিছু বলে না। নীলিমা আঁধারের দিকে অস্রুশিক্ত চোখে তাকিয়ে বলে,,,
–‘আমি ম্যানেজ করে নিব তোদের ভাবতে হবে না!’
–‘তরী ওকে বলে দে আমি যেটা বলছি সেটাই, আমার কথার যেন একটু ও এদিক ওদিক না হয়!’
নীলিমার কথার প্রতিউত্তরে শক্ত চোখে তাকিয়ে বলে আঁধার। নীলিমা আর কিছু বলবে তার আগেই আরোহীর হাত চেপে ধরে যেতে যেতে বায় বলে চলে যায় আঁধার। আর রাহিকে শিহাব বা রাতুলের সাথে চলে যেতে বলে।
–‘ওই মেয়েটা আঁধারের সাথে যাচ্ছে কেনো?’ যাচ্ছেটা কোথায়, আঁধারের বাসায়?
নীলিমা তরীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে। সকলে একে অপরকে একবার দেখে নেয়, আসলেই তো! তার মানে তারা আগে থেকেই একে অপরকে চেনে?
ততোক্ষণে আঁধার চলে গেছে সকলের দৃষ্টির বাহিরে।
নীলিমা আঁধারের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলতে থাকে। কাঁধে কারো হাতের অস্তিত্ব পেতেই চোখ মুছে বলে,,,
–‘এক পক্ষিক ভালোবাসা এতোটা পোড়ায় কেনো বল তো তরী!’ সে কি কখন ও বুঝবে না আমি তাকে কতোটা ভালোবাসি, বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার ভয়ে এতোদিন বলিনি ঠিকই তবে এখন কেনো জানি না খুব করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে তাকে। আমি যে পারছি না তরী, পারছি না।
বলে আবার ও ঝরঝর করে কেঁদে উঠে নীলিমা।
সোহেলের বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে, সে ও তো এক পক্ষিক ভাবে ভালোবাসে। কিন্তু তার প্রেয়শী ও তো বোঝে না, তার বুকের ভেতরটা পুরে যাচ্ছে।কিন্তু সে তো নীলিমার মতো কাউকে বলতে পারছে না বা কারো সাথে সেয়ার করতে পারছে না!
নিজের অনুভূতি গুলো সে বরাবরই নিজের ভেতর রাখতে পছন্দ করে সে। তাই তো এতোটা কষ্ট পাচ্ছে সে, না পারছে কাউকে বলতে আর না পারছপ সহ্য করতে। তাই আর কাউকে কিছু না বলেই চলে যায় সে।
–‘সোহেল এভাবে চলে গেলো কেনো?’
তরী অবাক হয়ে প্রশ্ন করে। রাতুল ও শিহাব একে অপরকে দেখে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
–‘হয়তো কেনো কাজ আছে, বাদ দে তুই নীলিকে নিয়ে চলে যা!’
ছোট করেই বলে শিহাব।তরী মাথা নাড়িয়ে নীলির হাত ধরে বলে,,,
–‘চল! ‘
নীলিমা ও চোখের পানি মুছে তরীর সাথে চলে যায়।তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে শিহাব ও রাতুল এক ধ্যানে তাকিয়ে মনে মনে ভাবে,, ‘ না জানি এদের পরিনতি কি হয়!’
চৌধুরী বাড়িতে,,,
আমজাদ শেখ অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আর শাহানাজ শেখ মাথা নিচু করে বসে আছে, ঠিক তারই সামনে আলিশা গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে! তারেক চৌধুরী সোফায় বসে আছে তার চোখ মুখ রাগে লাল হয়ে আছে। আঁকলিমা চৌধুরী কটমট চাহনিতে ঠিক আলিশার দিকেই তাকিয়ে আছে। আদর নিচের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে আছে কিন্তু তার চোখমুখ ভয়ংকর রকমের লাল হয়ে আছে।
আঁধার দাঁড়িয়ে সকলের দৃষ্টির দিকে চোখ বুলিয়ে এক পলক তার সহধর্মিণীর দিকে তাকায়।মেয়টি এক কোণে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। এরইমধ্যে আমজাদ শেখ আবার গর্জে উঠেন,,,
–‘তোমার সাহস হয় কি করে বেয়াদব মেয়ে, নিজের বাচ্চার মতো একটা নিস্পাপ শিশুকে হত্যা করতে যাওয়া!’ এতো বড় কলিজা তোমার হয় কি করে?
আমজাদ শেখের গর্জনে সকলে কেঁপে উঠে, আলিশা ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে। তার বাবা সহজে রাগে না কিন্তু এক বার রাগলে তিনি নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারে না!
রাতে ডিনারের পর পরই আরোহী আগে আগেই রুমে চলে আসে, আঁধার অবাক হয় বটেই কিন্তু কিছু বলে না! আরোহীর অদ্ভুত ব্যাবহারের মানে সে বুঝতে পারছে, কিন্তু নিজে থেকে আর কিছু বলবে না বলে ঠিক করে।
আরোহী চুপচাপ গিয়ে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকে! আঁধার নিজেও চুপচাপ ডিভানে গিয়ে বসে কিছু কাগজ পত্র নিয়ে কাজ করা শুরু করে, আরোহী উঁকি দিয়ে একপলক আঁধারকে দেখে নেয়। আঁধার তাকে একা একা আসা দেখেও কিছু বললো না সেটা ভেবেই একটু অবাক হয়ে যায়।
বেলকনি থেকেই আরোহী আঁধারকে দেখতে থাকে আর আঁধার নিজের কাজ করতেই থাকে! দেখতে দেখতে ১ ঘন্টা পার হয়ে যায় কিন্তু আঁধারের উঠার কোন নাম নেই।আরোহী বিরক্ত হয়ে যায়, তার পা ব্যাথা করছে তবুও আঁধারের উঠার কোন নামই নেই।
আঁধার আড় চোখে আরোহীর দিকে তাকিয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিতে থাকে, আরোহীর রাগ হয় খুব। তার মতে আঁধার ইচ্ছে করেই তাকে অপেক্ষা করাচ্ছে! আঁধারের বোঝা উচিত আমি তার জন্য অপেক্ষা করছি কিন্তু সে বুঝেও যেনো বুঝছে না।
আরোহী বিরক্ত চোখে কিছুক্ষণ আঁধারের দিকে তাকিয়ে সোজা গিয়ে আঁধারের সামনে দাঁড়ায়। আঁধার আরোহীর অগোচরে বাঁকা হাসি দেয়! কিন্তু আরোহীর দিকে চোখ তুলে তাকায় না। আরোহী আঁধারের সামনের কাগজগুলো টেনে নিজের কাছে নিয়ে নেয়, আঁধার কিছু বলে না চুপচাপ বসে দেখতে থাকে আরোহী কি করে!
আরোহী টেবিলের উপর কাগজগুলো রেখে, লাইট বন্ধ করে দেয়! পুরো ঘরে অন্ধকারে ছেঁয়ে যায়,আঁধার এবার খানিকটা অবাক হয় ঠিকই তবে প্রকাশ করে না। আরোহী নিজের কাজ করেই উল্টো দিক ঘুরে সুয়ে পড়ে। আঁধারের অনেক হাসি পায়, উপায় থাকলে হয়তো সে উচ্চস্বরে হেঁসে ও উঠতো কিন্তু এখন হাসা যাবে না, তাই পরিস্থিতি বুঝে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নেয়।
আঁধার নিজেও চুপচাপ গিয়ে আরোহীর দিকে ঘুরে সুয়ে পড়ে, অনেকক্ষণ হয়ে যায় কিন্তু আরোহীর কোন সাড়া না পেয়ে আঁধার পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তাকে। আরোহী আঁধারের হাত সরিয়ে দেওয়ার জন্য আঁধারের হাতে হাত রাখতেই তার হাত ও আঁধারের শক্ত পোক্ত হাতের নিচে পড়ে যায়।হাত ছাড়ানোর জন্য ছটফট শুরু করে দিতেই আঁধার আরও খানিকটা আরোহীর কাছে চলে আসে।
–‘কি হলো এভাবে নড়াচড়া করছো কেনো?’
আঁধারের ফিসফিস করে বলার ধরন দেখে আরোহীর গাঁ শিউরে ওঠে।
–‘অসস্তি হচ্ছে আমার!’
কোন রকম বলে উঠে আরোহী। আরোহীর কথা শুনে আঁধার শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরেই বলে,,
–‘ তো?’
আরোহী ভেবাচেকা খেয়ে যায় আঁধারের তো বলাতে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। আরোহীকে আমতা আমতা করতে দেখে আঁধার হুট করেই আরোহীর ঘাঁড়ে মুখ গুঁজে নেয়। আরোহী চোখ মুখ শক্ত করে চেপে ধরে থাকে।কিন্তু আঁধার তাকে আরও খানিকটা অবাক করে দিয়ে আলতো করেই চুমু দেয় তার ঘাঁড়ে,আরোহী কেঁপে উঠে।
কাঁপা কাঁপা স্বরে কিছু একটা বলতে চাচ্ছে কিন্তু বলতে পারছে না সে। আঁধার আরোহীর থেকে নিষেধ বার্তা না পেয়ে পর পর আরও কয়েকটা চুমু খেয়ে নেয় সেখানে। আরোহী নিজেকে শক্ত করে ধরে রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না কেঁপে উঠছে বার বার। আঁধারকে থামতে না দেখে অনেক কষ্টে কিছু শব্দ বের করে মুখ দিয়ে বের করে,,,
–‘প্লি-জ আঁধা-র, আ-মি..’
আর কিছু বলতে পারে না সে, তার আগেই আঁধার আরোহীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,,,
–‘হুসসস,! ‘
আরোহীর বাকি কথাগুলো আর বলা হয় না সব কিছু গুলিয়ে যায়, আঁধার এবার আরোহীকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,,
–‘ তুমি কি আমায় সন্দেহ করছো বার বার আরুপাখি?’
আরোহী কিছু না বললেও মাথা নাড়িয়ে না বলে,,
–‘তাহলে তখন ওভাবে চলে আসলে কেনো?’
আঁধারের কথা শুনে আরোহী এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় আঁধারের দিকে আর বলে,,
–‘ খারাপ লাগছিলো,আমি আপনাদের একসাথে সহ্য করতে পারি না আঁধার।’ সন্দেহ করতে চাই না কিন্তু বার বার করে ফেলি, আমি মনে হয় ভালো না তাই না আঁধার? তাই তো আপনার সাথে এমন ব্যাবহার করি, আমি ভালো বউ, ভালো বোন হতে পারি না আঁধার! আমি..
আর কিছু বলতে পারে না আরোহী তার আগেই ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। আঁধারের খারাপ লাগে,আরোহীর কষ্টটা সে বুঝতে পারে। কিন্তু আরোহী ও যে পরিস্থিতির শিকার , হয়তো সহজেই সম্পর্কটাকে মেনে নিতে পেরেছে কিন্তু তবুও সে যে মেনে নিয়েছে সেটাই অনেক। আঁধার আরোহীর চোখের পানি মুছে দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,,
–‘ কে বলেছে শুনি, তুমি একজন অনেক ভালো স্ত্রী বুঝলে আর বোন হিসেবে ও বেস্ট বোন!’ তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো তোমার বোনের সাথে আর সম্পর্কই রাখতো না, কিন্তু তুমি একই বাড়িতে তাকে সহ্য করছো। এসব ব্যাপার নিয়ে মন খারাপ করবে না বুঝলে! আর তুমি মনে হয় আমায় নিয়ে জেলা’স তাই তো আলিশাকে আমার আসে পাশে সহ্য করতে পারো না। এতো হ্যান্ডসাম একজন বর থাকলে যে কেউ জেলা’স হবেই তাই না।
বলেই চোখ টিপ দেয়।
আঁধারের কান্ডে আরোহী হেসে ফেলে। শক্ত করে সে নিজেও আঁধারকে এবার জড়িয়ে ধরে।
আরোহীকে জড়িয়ে ধরতে দেখে আঁধার টুপ করে একটা চুমু খায় আরোহীর কপালে, আরোহীর এবার লজ্জা লাগা শুরু হয়। আঁধার আরোহীর লজ্জা পাওয়া দেখে এবার আরোহীর দুই গালে পর পর টুপ টুপ করে কয়েকটা চুমু খায়। আরোহী আঁধারের বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলে, আঁধার ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেলে আরোহীকে আরও শক্ত করে ধরে বলে,,
–‘ঘুমাও!’
আরোহী হুম বলে চোখ বন্ধ করে,,,
আলিশা আদরের ঘরে বসে আছে আদরের অপেক্ষায়, আদর ছাদে আছে এখন ও আসে নি। আলিশা মনে মনে ভাবে,, ধুর এতো এক্টিং করতে পারবো না আসলে আসুক না আসলে নাই। বিছানায় শুয়ে পরে সে,কিছুক্ষণ পরেই ঘুমিয়ে ও যায়। তার কিছুক্ষণ পরেই আদর রুমে আসে দেখে আলিশা ঘুমিয়ে গেছে। সে আর বিছানায় বসে ও না, আলিশার দিকে তাকিয়ে ভাবে,,,
কতো নিষ্পাপ দেখাচ্ছে এই মেয়েটিকে কিন্তু মেয়েটি যে কতোবড় একটা ফালতু মেয়ে সে ভালো করেই বুঝে গেছে। আদর ভালো করেই আলিশার অভিনয় বুঝতে পারছে, সে যে কিছু একটা করবে আদর সে ব্যাপারে একেবারে সিয়র। আলিশার নিষ্পাপ চেহারা দেখে সবাই গলে গেলেও আদর গলে যায় নি তার আগে থেকেই সন্দেহ হয়েছিলো কিন্তু প্রমাণ ছাড়া কিছু করতে পারবে না সে তাই চুপ করে আছে৷
আলিশার সাথে আদর সংসার করতে পারবে না সেটাও আদর ভালো করেই জানে, তাই সে ঠিক করেছে বাচ্চাটা হওয়া অব্দি অপেক্ষা করবে সে।
এতোদিন বাচ্চাটাকে না চাইলেও এখন মনে প্রাণে চায় বাচ্চাটা যেনো পৃথিবীতে আসে তাকে বাবা বলে ডাকে,ছোট ছোট হাত দিয়ে তার আঙ্গুল ধরে হাঁটে, আধো আধো গলায় আবদার করে। সে মনে মনে ঠিক করে নেয়, আর আরোহীর কথা ভাববে না এখন থেকে শুধু তার বাচ্চাটার কথায় ভাববে। আর আলিশা কি করে সেটা দেখার পালা এখন তার!
আর কিছু না ভেবে সোফায় শুয়ে পরে সে।
সকালে,,,
আরোহীর ঘুম ভাঙ্গতেই নিজের পাশে চোখ যায় তার আঁধার নেই, এমনকি ওয়াশরুমের দরজা ও খোলা তাই ঝটপট উঠে পরে সে। ঘড়ির দিকে চোখ যেতেই দেখে ৭ টা বাজে কেবল, অবাক হয়ে যায় আরোহী এতো সকালে আঁধার গেলটা কোথায়! বেলকনিতে ও দেখে আসে কিন্তু কোথাও দেখতে পায় না আঁধারকে, তাই ফ্রেস হতে চলে যায় সে।
আলিশা ঘুম থেকে উঠেই দেখে আদর সোফায় শুয়ে আছে, আলিশা অবাক হলে ও খুশি হয়ে যায় আদরের সাথে বেড সেয়ার করতে হবে না! আদরকে এক পলক দেখে ওয়াশরুমে চলে যায়।
আলিশা ওয়াশরুমে যেতেই আদর চোখ খুলে উঠে বসে, তার ঘুম অনেকক্ষণেই ভেঙে গেছিলো কিন্তু জীবনের কিছু হিসাব শুয়ে শুয়ে মিলচ্ছিল। আলিশাকে চোখ খুলতে দেখে চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান ধরে ছিলো সে। আদর অবাক হলো না আলিশাকে খুশি হওয়া দেখে, কারণ সে জানতো আলিশা অভিনয়ই করছে!
আদরের আপসোস হচ্ছে, তার কিছু ভুলের জন্য হয়তো সারাজীবন তাকে আপসোসই করতে হবে। আলিশা মেয়েটিকে সে অনেকটা ভালো ও ভদ্র ভাবতো তাই তো আলিশা যেদিন সবার সামনে প্রপোজ করেছিলো হাসি মুখে মেনে নিয়েছিলো।
কিন্তু দু’দিন যেতেই যখন আলিশাকে অন্য একটা ছেলের সাথে পার্কে দেখেছিলো তখনই ভেবেছিলো আলিশা যেভাবে ওকে ব্যাবহার করছে সে ও করবে কিন্তু আলিশার এতোটা কাছাকাছি যেতে চায়নি! বন্ধুর জন্মদিনের দিন অতিরিক্ত ড্রিংক করার ফল এটা যদি ও কিন্তু আলিশা তো হুসে ছিলো সে কেনো আটকায়নি!
এসব ভাবনার মধ্যেই ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ পায়, তাই আর কোন দিকে না তাকিয়ে নিজেও ওয়াশরুমে চলে যায়। আলিশার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আড় চোখে আলিশার দিকে একবার তাকিয়েই চলে যায় আদর।
ভার্সিটিতে,, ক্লাসে বসে আছে রাহি ও আরোহী। আরোহীকে আসার পর থেকেই অন্য রকম ভাবনায় বিভোর দেখে রাহি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। জিজ্ঞেস করবে করবে করেও করতে পারছে না, একটার পর একটা স্যার আসতেই আছে ক্লাসে। টানা ৩ টা ক্লাসের পর রাহি সস্থির নিশ্বাস ফেলে, আরোহীকে টেনে একপ্রকার বাহিরে নিয়ে আসে।
–‘আরো এয়ার কি হয়েছে তোর বল তো?’
রাহির কথায় আরোহী ভ্রুকুঁচকে বলে,,
–‘আমার আবার কি হবে, কিছুই হয়নি তো!’
–‘দেখ মিথ্যা বলার চেষ্টা ও করবি না, তোকে আসার পর থেকেই আমি অন্য রকম দেখছি।’ কি হয়েছে বল?
–‘কিছু হয়নি রে,,,’
আর কিছু বলতে পারে না আরোহী তার আগেই গাছ তলায় নীলিমার আঁধারকে জড়িয়ে ধরে থাকা দেখেই থেমে যায়। আরোহীর দেখা দেখি রাহি নিজেও তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়।আর বিরবির করে বলে,,একটাকেই এখন ও কিছু করতে পারলাম না এখন আর একটা এসে হাজির।
চোয়াল শক্ত করে গাড়িতে বসে আছে আঁধার, কিন্তু যার জন্য চোয়াল শক্ত করে আছে সে একদম নির্দ্বিধায় নির্বিকার ভাবে হেঁটে চলছে! আঁধারের রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে আছে কিন্তু সে কিছু বলতে পারছে না,তার মতে ভুলটা তারই কিন্তু আরোহী ওকে বলার সুযোগই দিচ্ছে না। গত ১ ঘন্টা থেকে সে হেঁটেই চলেছে তবুও আঁধারের গাড়িতে সে উঠবে না! আঁধার ও কিছু বলে নি চুপচাপ সে তবে এবার আর না বলে পারছে না।আরোহীর পেছন পেছন সে ও এতোক্ষণ ধিরে ধিরে ড্রাইভ করে আসছিল!
–‘আরু এবার কিন্তু বেশি বেশি হচ্ছে, গাড়িতে উঠো মেজাজ খারাপ হচ্ছে আমার!’
গাড়ি থেকেই চেঁচিয়ে বলে আধার,, আরোহী ঘুরেও তাকানোর প্রয়োজন মনে করলো না! আঁধার চেষ্টা করছে রাগটা যেন কমে যায়,কিন্তু পারছে না! তার রাগ বরাবরই একটু বেশি কিন্তু আরোহীকে সে সেটা একদম দেখাতে চায় না। তার মতে এমনিতেও সে আরোহীর সাথে সবসময় রাগা রাগিই করে!
–‘এই মেয়ে কি বলছি,কথা কানে যায় না তোমার?’
আঁধারের কথা কানে গেলেও কথাটা কানে না যাওয়ার মতো করেই হেঁটে চলেছে আরোহী! আঁধার গাড়ি থামিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে কিছুক্ষণ, চোখ খুলে আরোহীর দিকে তাকায়! তাকে দেখে মনে হচ্ছে না সে হাঁটছে কিন্তু সে আসলেই হাঁটছে, কচ্ছপের গতিতে হাঁটছে সে!
–‘আর একবার বলবো যদি গাড়িতে না উঠো সিরিয়াসলি একদম রেখেই চলে যাব!’
আঁধারের কথাতে আরোহীর কোন ভবাবেগ হলো না উল্টো হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো। আঁধার একপলক তাকালো ঠিকই তবে গাড়ি থামালো না উল্টো স্পিড বোটের গতিতে গাড়ি টেনে চলে গেলো।
আরোহী হা করে তাকিয়ে আছে আঁধারের যাওয়ার দিকে, তার ধারণার বাহিরে ছিলো এটা।সে কখন ও স্বপ্নেও ভাবেনি তার এক মাত্র স্বামী, তাশরিফ আঁধার চৌধুরী তাকে রেখে এভাবে চলে যাবে।
হঠাৎ করে আরোহীর অনেক কান্না পায়, আঁধারের উপর অভিমাননের পাহাড় বেড়ে যায়! তখন ঠিক ওর পাশে দিয়ে একটা রিকশা যায়, কি আর করার চেঁচিয়ে ডাকে।
রিকশায় উঠে বসে চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে ভাবে,,,, লোকটা এতোই নিষ্ঠুর আমায় একবার জোর ও করলো না। জোর করলে কি আর আমি যেতাম না নাকি! ওনার সাথে আর কথা বলবো না, আজই বাড়ি চলে যাব। থাকবো না আর ওনার সাথে! ভাবনায় এতোটাই মগ্ন ছিলো আরোহী, আঁধারের গাড়ি যে দাঁড়িয়ে সেটা ও আর দেখতে পায় না।আঁধার মুচকি হেসে আরোহীর রিকশার দিকে তাকিয়ে থাকে।
কিছু একটা ভেবে গাড়ি ড্রাইভ করা শুরু করে, আরোহীকে ক্রস করে যাওয়ার সময় আর চোখে একবার তাকায় কিন্তু আরোহীর কোন দিকেই খেয়াল নেই।
চৌধুরী বাড়িতে পৌঁছেই আরোহী কাউকে দেখতে পায় না তাই সোজা আঁকলিমা চৌধুরীর ঘরে চলে যায়। আঁকলিমা চৌধুরী বসে বসে বই পড়ছিলেন,,
–‘আম্মু আসব!’
আরোহীর কন্ঠস্বর শুনে বই থেকে চোখ সরিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে হেসে বলেন,,,
–‘ আমার ঘরে আসার জন্য আবার তোকে পারমিশন নিতে হবে নাকি পাগল?’ আয়
আরোহী ভেতরে ঢুকতেই তিনি আবার বলেন,,
–‘বোস এখানে, ইসস এতো ঘেমে গেছিস কিভাবে বল তো?’
–‘বাহিরে অনেক গরম আম্মু তাই, একটা কথা বলার জন্য এসেছিলাম।’
–‘বল অনুমতি নেওয়ার দরকার নেই তো!’
আঁকলিমা চৌধুরীর কথায় ধিরকন্ঠে বলে আরোহী,,,
–‘আমি ও বাড়ি যেতে চাই আম্মু। ‘
আঁকলিমা চৌধুরী ভ্রুকুঁচকে তাকায় আরোহীর দিকে, কিন্তু আরোহীর মাথা নিচু করে বসে আছে ।
–‘তোর কি এ বাড়িতে কোন সমস্যা হচ্ছে মা?’ আমরা কি তোর ভালো করে খেয়াল রাখতে পারছি না!
আরোহী থতমত খেয়ে যায়,,
–‘আরে না না সেটা কেনো হবে আম্মু, আসলে ৪ দিন হলো তো এ বাড়িতে আসার তাই!’ পাড়া প্রতিবেশী কি বলবে?
ধির কন্ঠে কথাগুলো বলেই লম্বা দম নেয় আরোহী।
–‘এটা কি অন্যের বাড়ি নাকি পাগল মেয়ে, এটা তো তোরই বাড়ি! ‘ ৪ দিন হোক কিংবা ৪০ দিন তোর বাড়িতে তুই থাকবি তাতে কে কি বলবে? আর প্রতিবেশীরা কে কি বললো সেসব কথায় কান দিলে হবে নাকি!
আঁকলিমা চৌধুরী শক্ত কন্ঠে বলেন।
আরোহী চোখ তুলে তাকায় কিন্তু কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না, আঁকলিমা চৌধুরী আরোহীর মুখের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবেন তার পর বলেন,,
–‘ আঁধার কি তোকে কিছু বলেছে, নাকি আদর বলেছে?’ আর তুই কি আদরের জন্যই এ বাড়িতে থাকতে চাচ্ছিস না?
আঁকলিমা চৌধুরীর কথায় আরোহী তড়িঘড়ি করে বলে,,
–‘ আম্মু সেটা না, আর আদরের কথা তুলছো কেনো উনি এখন আমার দেবর হন আমি আগের সবকিছু ভুলে গেছি!’
–‘তোর থেকে এটাই আশা করেছিলাম মা, তবে আজকে কি হয়েছে জানিস!’
তারপর তিনি আলিশার করা সব কথাগুলো আরোহীকে বলে, আরোহী চমকায় না, কারণ সেদিন রাতে আলিশা তাকে ডেকে মাফ চেয়েছে সবকিছুর জন্য।
আরোহীর ও পায়ে হাত দিতে গেছিল সে দেয় নি, তারই তো বোন তাই ক্ষমা করে দিয়েছে।তবে হঠাৎ করে আলিশার বদলে যাওয়ার কারণটা তার কেমন জানি লাগছিল কিন্তু আজকের সব কথা শুনে মনে হচ্ছে আলিশা সত্যি অনুতপ্ত।
তবে সেদিন আলিশা তার কাছে আবদার করেছিলো যে রাতটা তাকে ওর কাছেই থাকতে হবে! আরোহী নিজেও বারন করেনি থেকেছিল তবে সকাল বেলা আঁধারের রুমেই নিজেকে আবিষ্কার করেছিল,আঁধারকে জিজ্ঞেস করার আগেই তো সে ওভাবে বের হয়ে যায়! তারপর তো আর কথায় হয়নি তাই পরে আলিশাকে জিজ্ঞেস করতে আঁধার নিয়ে এসেছিল বলেছে তাকে।
–‘কিরে কি এতো ভাবছিস?’
আঁকলিমা চৌধুরীর কথায় আরোহী ভাবনা থেকে বের হয়ে আসে।
–‘কিছু না আম্মু আপুর কথায় ভাবছিলাম,তুমি কি মাফ করে দিয়েছ?’
–‘প্রথমে ব্যাপারটা ভালো লাগেনি তবে আদর যখন বলেছে সবটা নতুন করে শুরু করবে তাই আমি ভাবলাম আমি আর রাগ করে থেকে কি করবো!’ দোষ তো ও একা করেনি আমার ছেলে ও সমান দোষী তাই মাফ করে দিয়েছি।
আঁকলিমা চৌধুরীর কথা শুনে আরোহী খুশি হয়ে যায়,মনে মনে ভাবে এই লোকগুলো কতোটা ভালো!
–‘ তই কিন্তু এখন এখান থেকে যেতে পারবি না, আরও কিছুদিন থাকতে হবে?’
–‘ কিন্তু আম্মু.. ‘
আরোহীর কথা শেষ হওয়ার আগেই আঁকলি চৌধুরী বলেন,,,
–‘কোন কিন্তু না, আমি যেটা বললাম সেটাই যা ফ্রেস হয়ে আয় খেতে হবে তো নাকি?’
আরোহী আর কিছু না বলেই মাথা নাড়িয়ে চলে যায়।
আঁকলিমা চৌধুরী বইটা বন্ধ করে রেখে খাবার সাজাতে চলে যান।
রুমে ঢুকতেই কিছুটা অবাক হয়ে গেলাম, সম্পূর্ণ রুম ফাঁকা পড়ে আছে। তহলে আঁধার কোথায়? ভাবনার মধ্যেই ওয়াশরুম থেকে খালি গায়ে উদম শরীরে নিচে একটা টাওয়াল পেঁচিয়ে চুল ঝারতে ঝারতেই বের হলেন জনাব! তার শরীরে বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটা এখন লেগে আছে!
হঠাৎ করে কেনো জানিনা লজ্জা লাগতে শুরু করলো সাথে সাথেই আমি উল্টো দিকে ঘুরে গেলাম,এই লোকটা এমন কেনো? উনি কি সবসময় ভুলে যান যে রুমে আমি নামক ও কোন রমনী থাকে! ভাবলাম আর ওনার দিকে তাকাবো না, নিচের দিকে তাকিয়ে ওয়াশরুমে চলে যাব।
ঘুরতেই মনে হলো একটা লম্বা খাম্বার সাথে ধাক্কা খেলাম,আর খাম্বাটা যে স্বয়ং আমার বর তাশরিফ আঁধার চৌধুরী সেটা আমি না দেখেই বলতে পারি কারণ একটু আগেই তো এখানে কোন খাম্বা ছিলই না।হঠাৎ করে তো আর খাম্বার হাত পা উদয় হবে না যে আমার সামনেই এসে দাঁড়িয়ে যাবে! যাই হোক উনি আবার কোন খাম্বার চেয়ে কম।
পাশ কাটিয়ে ওয়াশরুমে যাব তার আগেই খাম্বা অর্থাৎ আঁধার আমার হাত টেনে তার অনেকটা কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে দাড় করিয়ে দিলেন।আমি ভ্রুকুঁচকে তাকাতেই,
কোমড়ে তার শীতল হাতের ছোঁয়া অনুভব করলাম।কিন্তু তার হাতটা আমার কেন জানি স্বাভাবিকের চেয়েও একটু বেশিই ঠান্ডা লাগছিল।মনে হচ্ছে আমি কোন বরফের পাহাড়ের চুরায় বসে আছি,কিন্তু জনাবের তাতে কোন যায় আসে বলে মনে হলো না! তিনি এবার দু’হাত দিয়ে আমার কোমড় চেপে ধরলেন। ঠান্ডায় কেঁপে উঠলাম আমি,
–‘হেঁটে হেঁটে এতো তাড়াতাড়ি চলে আসলেন যে ম্যাডাম?’ আমি তো ভেবেছিলাম আজকে আর আপনার দেখাই পাওয়া যাবে না!
চোখ তুলে তার দিকে তাকাতেই তার ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসির রেশ দেখতে পেলাম । তখনকার করা তার নিষ্ঠুরতার কথা মনে পড়তেই, মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো! ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট শুরু করে দিলাম কিন্তু তার হাতের চাপ আরও খানিকটা শক্ত হয়ে আসলো।
–‘ছাড়ুন! ‘
–‘ছাড়িয়ে নেও!’
আরোহীর কথা শুনে আঁধার হেসেই কথাটি বললো,,,
আরোহীর রাগ হলো, কিন্তু এ দানবীয় শক্তির সাথে তার মতো চুনোপুঁটি কি আর পারে!
–‘উফফ এভাবে ছটফট করো না তো,ব্যাঙের মতো লাফালাফি করছো কেনো? ‘ এক মিনিট শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারো না?
হঠাৎ করে আঁধারের ধমকে শান্ত হয়ে দাঁড়ায় আরোহী। মনে মনে ভাবছে লোকটা আসলেই অদ্ভুত, নাহলে কোথায় ধমক দেওয়ার কথা আরোহীর দু’দিন বাসায় না আসার জন্য, উল্টো আরও উনি নিজেই ধমক দিচ্ছেন! মন খারাপ হয়ে যায় আরোহীর, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ।
আঁধার শান্ত চোখে আরোহীর দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে যায়, একটু ধমকেই এতোটা মন খারাপ বাপ রে আর চোখ তুলে তার দিকে তাকাচ্ছে ও না৷ কেনো জানি আরোহীর বাচ্চামিতে আঁধারের হাসি পায়, কিন্তু না হেসে মুখটা সিরিয়াস করে বলে,,,
–‘আমি যা বলছি মন দিয়ে শুনবে, হুদাই রাগ না করে শান্ত ভাবে শুনো কি বলি!’
আঁধারের কথা শুনে আরোহীর ভ্রু আপনা আপনি কুঁচকে যায়, অর্থাৎ মহাশয় জানেন সে রাগ করে আছে কিন্তু উল্টো তিনি নিজেই রাগ দেখাচ্ছেন বাহ্।
–‘সেদিন আমি বাসা থেকে বের হই ঠিকই কিন্তু সোহেলদের কাছে পৌঁছাতে পারি না।’ তার আগেই আব্বু ফোন দিয়ে বলেন, যে আমায় এই মুহুর্তে অফিসে যেতে হবে। তাই সোহেলদের সাথে আর দেখা করতে পারিনি, অফিসে যাওয়ার পর পরই আব্বু কিছু ইম্পরট্যান্ট কাজে আমায় ঢাকার বাহিরে পাঠায় সাথে ম্যানেজার আঙ্কেল ও ছিলো। রাতে যেহেতু ফোনে চার্য এ দেইনি তাই বন্ধ হয়ে গেছিলো আর আমি মনে করেছিলাম তুমি জানো হয়তো! কিন্তু আজকে ফেরার পর আম্মু বললো হয়তো জানো না, আমি ও তোমার ব্যাবহার দেখে সিয়োর হয়ে যাই।এখন বলো আমার দোষ কোথায়? দোষ তো তোমার নিজেরই, কারণ তোমার বর দু’দিন থেকে বাড়ি ফেরেনি কিন্তু তুমি একবার খোঁজ ও নেওনি।
আঁধারের সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনার পর শেষের কথাটাতে মনে হলো একপ্রকার অভিমান করেই কথাটা বললেন উনি।
আমি চোখ তুলে ওনার দিকে তাকাতেই উনি হুট করে আমার কোমড় থেকে হাত সরিয়ে নিলেন। আর চুপচাপ কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলেন! আমি হাবলার মতো তাকিয়ে দেখলাম শুধু।
আসলেই তো সব দোষ আমার, উনি তো ঠিকই বলেছেন! আমি একবার কাউকে জিজ্ঞেস অব্দি করিনি। তবে টেনশনে তো ঠিকমতো খেতে অব্দি পারিনি আর না পারছি ঘুমোতে কিন্তু তবুও কাউকে জিজ্ঞেস করিনি।আমি কি সম্পর্কটাকে নিজেই এগোতে দিচ্ছি না, কিন্তু কেনো? আঁধার নামের এই লোকটার মায়ায় অনেক আগেই পড়ে গেছি, কিন্তু ভালোবাসা? রাহির মতে তো আমি ওনার প্রেমে পড়েছি তবে ভালোবাসা? উফফ মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে,কি করবো আমি?
আমার এসব ভাবনার মধ্যেই আঁধারকে বের হতে দেখলাম তবে উনি শার্টের বোতামগুলো খুলে রেখেছেন কেনো? ভ্রুকুঁচকে গেলো আমার, জানি না আমার কি হলো তবে নিজে থেকেই আঁধারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
উনি ভ্রুকুঁচকে তাকিয়ে আছে আমার দিকে,ওনাকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ করেই ওনার শার্টের বোতামে হাত দিলাম। থমকে গেলেন উনি, থমকে গেলো ওনার দৃষ্টি! শুধু মাত্র থমকালাম না আমি এমনকি থামলাম ও না, নিজের মতো করে কাঁপা কাঁপা হাতে ওনার সবগুলো শার্টের বোতাম লাগিয়ে দিয়ে ঝট করে সরে আসলাম।উনি তখন ও অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন।
হঠাৎ করেই আমার লজ্জা লাগতে শুরু হলো, ইসস কি করলাম আমি এটা নিজে থেকেই ওনার এতোটা কাছে গেলাম।এসব ভাবতে ভাবতেই লজ্জায় মাটির নিচে ঢুকে যাওয়ার ইচ্ছে হলো, তবে সেটা না করে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম। দরজা বন্ধ করার আগে আর একবার উঁকি দিয়ে ওনাকে দেখতে ইচ্ছে হলো, কিন্তু উঁকি দিতে গিয়েই ওনার চোখে চোখ পড়ে গেলো!আর কিছু না ভেবেই লজ্জায় দরজা লাগিয়ে দিলাম।
আরোহীর কান্ডে আঁধার এতোটাই অবাক হয়েছে যে, এখন অব্দি বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ কিছু পড়ার শব্দে তার অবাকের মাত্রা শেষ হয়ে যায়।ঘুরে দেখে একটা বিড়াল ফুলদানি মেঝেতে ফেলে দিয়েছে। ফুলদানিটা উঠিয়ে রেখে দেয় নিজ স্থানে! তখনই পেছন থেকে কারো ডাকে ফিরে তাকায়।
–‘আসব আঁধার? ‘
পেছনে ফিরতেই তার মাথা গরম হয়ে যায়, এই আলিশাকে দেখলেই তার মাথা এমনিতেই গরম হয়ে যায়!আঁধার ভেবে পায় না, আরোহীর মতো একটা মেয়ের এমন ছেঁচড়া বোন হয় কি করে!
–‘আঁধার! ‘
–‘হুম ! ‘
আলিশা আর কোন দিকে না তাকিয়ে আঁধারের পাশে এসে দাঁড়ায়। আঁধার বিরক্ত হলেও কিছু বলে না, কি আর করবে তারই ভাইয়ের বউ আবার তার বউয়ের বড় বোন হয়।
–‘তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো! ‘
–‘হুম আপু বলেন!’
আঁধারের হঠাৎ আপু বলাতে আলিশা ভেবাচেকা খেয়ে যায়,আবার আপনি করে ডাকাতে রাগ ও হয়।
–‘আপু, কে আপু?’ আমি ছোট না তোমার থেকে,আর আপনি করে ডাকছ কেনো আগে তো তুমি বলেই ডাকতে।
–‘বউয়ের বড় বোন তো আপুই হয় তাই না!’আর আগে তো বউয়ের বোন ছিলেন না তাই আপনি ডাকা হয়নি।
আঁধারের ঠেঁস মারা কথা শুনে আলিশার চোয়াল শক্ত হয়ে যায়।নিজেকে শান্ত করে বলে,,
–‘তবুও, আমায় নাম ধরে ডাকলে খুশি হব! ‘ নাহলে নিজেকে বড় বড় লাগবে,আর আমি তো তোমার ছোট ভাইয়ের বউ।
–‘বিয়েটা মানেন তাহলে, যাক শুনে খুশি হলাম!’
–‘আসলে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছিলাম,আমি অনেক অনুতপ্ত আঁধার! ‘ আমি যা করেছি সব তোমার জন্যই করেছিলাম তোমায় ভালোবাসি আমি।
আঁধার আলিশার কথা শুনে চোখ তুলে তার দিকে তাকায়, আলিশার চোখে পানি দেখে বুঝার উপায় নেই সে আসলে অনুতপ্ত কি না! আঁধারের জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো মায় দেখাই মাফ করে দিত কিন্তু সে কিছুই বললো না আবার চুপ করেও থাকলো না!
–‘ভালোবাসা কিসের ভালোবাসা?’ একজনের বাচ্চা পেটে নিয়ে আর একজনের সাথে বিয়ের পিরিতে বসাকেই কি আপনার ভালোবাসা বলা হয় আপু?’
–‘আঁধার বিশ্বাস করো..’
–‘সরি আপু আমি আর কিছু বিশ্বাস করতে পারবো না,এবার আপনি আসতে পারেন?’
আলিশার কথা শেষ হওয়ার আগেই দরজার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে উক্ত কথাগুলো বলে আঁধার। আলিশা অবাক হয়ে যায়, সে হয়তো ভেবেছিলো আঁধার তার কান্না দেখে তাকে সান্ত্বনা দিবে।
–‘আঁধার আমি সত্যি অনুতপ্ত, বিশ্বাস করো আমি এখন আর তোমায় নিয়ে ভাবতে চাই না এসব বলার জন্যই এসেছিলাম!’ আমি নতুন করে আদরের সাথে সবকিছু শুরু করতে চাই।
আলিশার কথা শুনে আঁধার কিছু একটা ভেবে বলে,,
–‘ইটস ওকে, আমি মাফ করে দিয়েছি তোমায়, তবে হ্যা আমায় ভাইয়া বলবে আমি সম্পর্কে তোমার বড় ভাসুর হই।’ আই হোপ ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড।
–‘হুম! ‘
বলেই আলিশা চুপচাপ চলে যায়, আঁধারের আলিশার কথাগুলো কেন জানি বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে! তবে আর কিছু ভাবতে চায় না সে এই মেয়েকে নিয়ে তাই ওয়াশরুমের দরজার দিকে একপলক তাকায়। আরোহীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে বলে,,
–‘নিচে আসো আম্মু খেতে ডাকে!’
বলেই চলে যায়।আরোহী অবাক হয়ে আঁধারের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে, বলেই চলে গেলো। আর সে যে এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে একসাথে তাদের দেখলো সে ব্যাপারে প্রশ্ন করবে তো আরোহী! আলিশার হুম কথাটি ছাড়া অন্য কোন কথা সে শুনতে পায়নি। তাই তাদের মধ্যে কি কথা হলো সেটাই ভাবছে সে।
ভার্সিটির গাছতলায় বসে আছি আমি ও রাহি, দু’জনে বসে আছি ঠিকই কিন্তু গভীর ভাবনা নিয়ে! ভাবনাটা মূলত আঁধারকে ঘিরেই, উনি সেদিন সকালে বের হয়ে এসেছিলেন তারপর থেকে আর বাড়ি ফেরেননি !
আজকে দু’দিন ধরে বাসায় যাননি উনি, আছে কোথায় সেটাও জানি না। সেদিন ওনার অপেক্ষায় ছিলাম সারাদিন কিন্তু ওনার কোন খবর ছিলো না, ফোন দিতে গিয়ে দেখি এখন ও নাম্বার ব্লক করা তার মানে খুলতে সময় পাননি হয়তো নাহলে মনে নেই।
রাগ উঠছিল অনেক তবে রাগ দেখানোর মতো লোকটা তো বাসায় থাকার লাগবে, সেই লোকটাই আজ দু’দিন ধরে নিখোঁজ! আম্মু আব্বুকে তাকে নিয়ে চিন্তা করতে দেখিনি, কি জানি বাবা তারা কেমন নাকি আঁধারের সাথে তাদের কথা হয়েছে সেটাও ঠিক জানি না।
লজ্জায় কাউকে জিজ্ঞেস করতে ও পারিনি। আঁধারের জন্য চিন্তা হচ্ছে অনেক, তবে রাহির মতে আমিই কিছু একটা করেছি তাই আঁধার রেগে আর বাসায় আসেননি! কিন্তু এই মেয়েকে ৩০ মিনিট যাবত বুঝাতে বুঝাতে হাফায় গেছি ভাই তবুও বুঝাতে পারিনি।
কি আর করার ভাঙ্গা মন নিয়ে বসে আছি,তবে আঁধারকে ছাড়া এই দু’টো দিন আমার দুই বছরের সমান কেটেছে। না পারি ঠিক মতো ঘুমাতে, আর না পারি ঠিক মতো খেতে। এমনকি বসে, শুয়ে হাঁটে ও শান্তি পাইনা।
এই দুই দিনের সব ঘটনা রাহিকে বলার পর তার মতে আমি প্রেমে পড়েছি সেটাও আবার আঁধারের, শুধুই প্রেমে না একদম হাবুডুবু খাচ্ছি ওয়ালা প্রেম! রাহির কথা শুনে বরাবরের মতো বিরক্ত হলেও আমার ও কেন জানি মনে হচ্ছে রাহির কথাটা কি সত্যি! আবার কখন ও মনে হচ্ছে না স্বামী হয় তাই হয়তো চিন্তা হচ্ছে! বাসায় ভালো লাগছে না তাই সময় কাটানোর জন্য আজকে ভার্সিটিতে আসা আমার।
নিজের উপর নিজেই বিরক্ত আমি,আঁধার নেই আমার তো ভালো থাকার কথা কিন্তু আমি ভালো থাকতে পারছি না কেনো? হোয়াই?
এরইমধ্যে হেমাদের দলকে আমাদের দিকে আসতে দেখে আত্মা কেঁপে উঠে আমার।রাহিকে হাত দিয়ে গুতাগুতি করছি কিন্তু সে ভাবনায় এতোই মগ্ন যে আমার গুতাগুতিতে তার কিছু যায় আসছে না।
–‘রাহি ওই দিকে দেখ না একবার প্লিজ? ‘ এই মেয়ে,,
আরোহীর দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সামনে তাকাতেই রাহির কলিজা হাতে চলে আসে। হেমা ও তার দল তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে! রাহি কাঁপা কাঁপা দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকায়, সেদিনের ঘটনা তার চোখের সামনে ভাসতে শুরু করে!
ভয়ে কাঁপতে শুরু করে রাহি,রাহির অবস্থা দেখে আরোহীর দম ফাটানো হাসি পাচ্ছে। এই মেয়ে তার সামনে বাঘ আর এদের সামনে বিড়াল!
হেমা আরোহীর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে রাহির দিকে তাকিয়ে বলে,,
–‘এই মেয়ে অনিল তোমায় পছন্দমতো করে, সো তুমি আজকে থেকে ওর গার্লফ্রেন্ড!’
রাহির কাপাসিয়া কাঁপি বন্ধ হওয়ার জন্য এই একটি কথায় যথেষ্ট ছিলো, আরোহী হা করে তাই আছে! আর অনিল মুচকি হেসে রাহির দিকে তাকিয়ে আছে, রাহি একপলক অনিলের দিকে তাকিয়ে আরোহীর দিকে তাকায়। মুখে তার অমায়িক হাসি, রাহির হাসির মানে আরোহীর কাছে অস্পষ্ট।
আরোহী এক পলক হেমাদের দলকে ভালো করে পর্যাবেক্ষণ করে, হেমা নামের মেয়েটি ঠিক তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আর লিমা নামের মেয়েটি রাহির দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে, সাদ নামের ছেলেটি অনুপস্থিত অর্থাৎ আসেনি সে সাথে ভেবেই সস্থির নিশ্বাস ছাড়ে আরোহী, ছেলেটা অনেক বেয়াদব। সাথে আরও দুই একটা ছেলে মেয়ে আছে তাদের সাথে কিন্তু এদের কাল আরোহী হেমাদের সাথে দেখেনি তাই বুঝতে পারছে না এরা কে!
অনিল নামের ছেলেটি রাহির দিকে এগিয়ে আসে বলে,,
–‘ তুমি আমার হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকা হলুদপরি।’
রাহির কপাল আপনা আপনি কুঁচকে যায়, আরোহী অনেক কষ্টে নিজের হাসি কন্ট্রোল করে আছে। রাহি অনিলের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এক পলক নিজের দিকে তাকায়, সে আজকে হলুদ জামা পড়ে এসেছে তাই তাকে হলুদ পরি বলে সম্মোধন করলো বেয়াদব ছেলেটি। রাহির মনে হচ্ছে সে আর এই বেয়াদবের দলকে ভয় পাচ্ছে না!
–‘হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকা মানে?’
হাসি কন্ট্রোল করে কোন মতো প্রশ্নটি করে আরোহী।
–‘আরে সাত দিন আগে রাস্তায় এক হলুদ পরিকে দেখেছিলাম কিন্তু হঠাৎ হারিয়ে ফেলি আর আজকে হলুদ জামা পড়ে দেখে চিনতে পারলাম।’ ছরি হলুদ পরি কালকের জন্য।
প্রথমের কথাটা আরোহীর দিকে তাকিয়ে বলে পরের কথাগুলো রাহির দিকে তাকিয়ে বলে।আরোহী তো মনে মনে হেসেই যাচ্ছে ফ্রিতে বিনোদন পাচ্ছে সে! রাহি হাবলার মতো তাকিয়ে আছে, হেমা আরোহীর দিকে তাকিয়ে বলে,,,
–‘আঁধার কালকে তোমায় কিছু বললো না কেনো?’
আরোহী শুনেও না শোনার মতো করে অনিলকে প্রশ্ন করে,,
–‘তাহলে প্রেমিকা হলো কিভাবে ভাইয়া,প্রেম তো হয়নি?’
হেমা রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়,তার কথা এড়িয়ে গেলো এই মেয়ে এতো সাহস, তবে সাহস তো আছেন না হলে কাল এতো বড় একটা ঘটনা সে ঘটাতে পারতো না!
–‘মনে মনে প্রেম করে নিয়েছি তো।’
বোকা হাসি দিয়ে বলে অনিল, আরোহী এবার আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে না জোড়েই হেসে দেয়। কিন্তু তার মনে হয় তার সাথে আরও কয়েকজনের হাসির শব্দ আসছে। হেমারা ও অবাক হয়ে তাকায়, পাশেই সোহেল, রাতুল,নীলিমারা হাসছে। তারা তাদের থেকে মাত্র কয়েকহাত দুরে বসে আছে, তাই ওদের সব কথায় তারা শুনতে পেয়েছে। একমাত্র শিহাব ভ্রুকুঁচকে তাকিয়ে আছে।
আরোহী নিজের হাসি থামিয়ে তাদের দিকে দৃষ্টি দেয়, সবাই উপস্থিত আছে শুধুমাত্র আঁধার ছাড়া! আবার মন খারাপ হয়ে যায় আরোহীর। সোহেলরা গড়াগড়ি করে হাসছে, রাহির প্রচুর লজ্জা লাগছে এমন পরিস্থিতিতে পড়বে সেটা কল্পনায় ও ভাবেনি সে। অনিলের দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচি দেয় সে, ছেলেটাকে তার মোটেও ভালো লাগে না আর তার সাথে প্রেম করবে সে কখনো না।
রাহির মথায় চট করে একটা বুদ্ধি চলে আসে, হুট করে সে সোহেলদের দিকে যায়। আরোহী ভ্রুকুঁচকে বুঝার চেষ্টা করছে রাহির কর্মকান্ড! সোহেলরা তখন ও হাসছে,
–‘ভাইয়া একটু সাইড দিবেন প্লিজ?’
কারো কন্ঠে ভাইয়া ডাক শুনে রাতুল গর্বের সহিত একটু না প্রায় অনেকটাই সরে গিয়ে বসে, আর রাহি গিয়ে সোহেল ও শিহাবের মাঝখানে বসে পড়ে৷ চট করে তাদের হাসি থেমে যায়, বুঝার চেষ্টা করছে তারা আসলে হচ্ছেটা কি!
হেমারা নিজেরা ও অবাক হয়ে যায় সাথে অনেকটা ভয় ও পেয়ে যায়,রাহি সোহেলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,,
–‘আচ্ছা ভাইয়া,ওই যে ওরা কোন ইয়ারে পড়ে!’ আই মিন আপনাদের থেকে সিনিয়র নাকি জুনিয়র।
আঙ্গুল দিয়ে হেমা ও তার দলকে দেখিয়ে বলে।
–‘বুদ্ধু আপু আমাদের থেকে সিনিয়র নেই এখানে আমরাই সিনিয়র, আর ওরা ৩য় বর্ষে পড়ে! বুঝলে?’
আপু বলাতে রাহির মুখ চুপসে যায় সে এসেছিলো একটা কাজ করতে এখন সোহেল তো তাকে আপু বললো তার মানে ছোট বোন বললো এখন কি করা যায়, ফট করে অনিলসহ সকলকে তাদের কাছে ডাকে রাহি।
–‘এদিকে এসো সবাই, সিনিয়রদের সন্মান দিতে শিখ নি? ‘
রাহির কথায় হেমাদের সকলের চোখ মুখ শক্ত হয়ে যায় অনিল ছাড়া,কিন্তু সিনিয়ররা আছে আর সব থেকে বড় কথা এদের রাগ বেশি তাই তারা চুপচাপ ভয় ভয় করেই চলে আসে। হেমা অনিলের কানে কানে বলে,,
–‘তোর হলুদ পরিকে পড়ে যদি শিক্ষা না দেই, আমাদের শিখাচ্ছে সে!’ এতো সাহস।
অনিল হেমার দিকে রাগ নিয়ে তাকিয়ে বলে,,
–‘ভুলে ও ওই ভুল করিস না, নাহলে আমি ভুলে যাব তুই আমার ফ্রেন্ড।’
আরোহীর কথা শেষ হওয়ার আগেই রাহি উক্ত কথাটি বলে উঠে। আরোহী রাহিকে চোখ রাঙ্গায়! কিন্তু রাহির তাতে কিছু যায় আসে না,তার একমাত্র লক্ষ এখন অনিলকে ছেঁকা দেওয়া। মারাত্মক ছেঁকা যাকে বলে!
–‘আঁধার ও একটু বিজি আছে আর কি,কেনো বলো তো? ‘
নীলিমার কথা শুনে রাহি ভ্রুকুঁচকে তাকায়,সে তো সোহেলকে জিজ্ঞেস করলো কিন্তু এই মেয়েটা কেনো উত্তর দিলো।রাহির মুখ দেখেই মনে হচ্ছে নীলিমার উত্তর দেওয়া তার পছন্দ হয়নি,সে ঘুরে আরোহীর দিকে তাকায়! আরোহীকে তীক্ষ দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকাতে দেখে রাহি কিছুটা স্বাভাবিক হয়।
–‘ কি ব্যাপার তোমরা ওদের কিসের কথা বলছিলে, কে কার গার্লফ্রেন্ড? ‘
তীক্ষ দৃষ্টিতে হেমাদের দিকে তাকিয়ে বলে শিহাব।
হেমারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে,ভার্সিটিতে সবাই আঁধার ও তার বন্ধুদের ভয় পায়!তারা যেমন ভালো,তেমনি ফাজিল ও আবার অনেক রাগি ও সবাই তাদের যেমন সন্মান করে তেমন ভয় ও পায় হেমারা ও তার ব্যাতিক্রম নয়। অনিল এতোক্ষণ যতো সহজে রাহির সাথে কথা বলছিলো এখন ততোটাই ভয়ে সিটিয়ে আছে।
–‘আসলে ভাইয়া, আমরা তো এম. এমনি মজা করছিলাম আর কি হে হে।’
তোঁতলানোর স্বরে বলে হেমা, অনিল শুঁকনো ঢোক গিলে।শিহাব ভ্রুকুঁচকিয়ে তাকায় তাদের দিকে।হেমাকে তোঁতলাতে দেখে আরোহী আর রাহি হা করে তাকিয়ে আছে, এই মেয়ে ও যে কাউকে ভয় পায় সেটা আজকে বুঝতে পারছে তারা।
–‘আরে কি মজা করছিলে বলো তো, এইসব আবার মজা নাকি হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকা,স্বপ্নে প্রেম হাউ কিউট!’
সোহেলের কথা শুনে অনিল ভয়ে মাথা নিচু করে নেয়।
–‘আরে ভাই হলদিয়া পরি বাদ দিলি কেনো?’ হায় গো হলদিয়া পরি, তোমার রুপের আগুনে যখন তখন পিছলাইয়া পড়ি।
রাতুলের কথা শুনে নীলিমা, তরি ও সোহেল উচ্চস্বরে হেসে দেয় শুধু মাত্র শিহাবের মুখ গম্ভীর। রাহি রাতুলের ছন্দ শুনে চোখ মুখ কুঁচকে বসে আসে, আর আরোহী মুখ চেপে হেঁসেই যাচ্ছে।
–‘ আরে কি যে বলেন না রাতুল ভাই,আমরা তো…
–‘স্টপ!’
অনিল আর কথা শেষ করতে পারে না তার আগেই গম্ভীর কন্ঠে কথাটি বলে শিহাব।
–‘ এই মেয়েটি যে তোমার প্রেমিকা নয় সেটা তোমার কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে, ডু ইউ লাইক হার?’
রাহির দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে কথাটি বলে শিহাব!
অনিল সহ বাকি সবাই হা করে তাকিয়ে আছে তার দিকে!
কপাল কুঁচকে অনিলের দিকে তাকায় এবার শিহাব,অনিল তাড়াহুড়ো করেই বলে,,
–‘আসলে, হুম ভাই!’
অনিলকে মাথা নিচু করতে দেখে বাঁকা হেসে শিহাব বলে,,
–‘তাহলে পঁটিয়ে নেও, বোকার মত থাকলে হবে! ‘
শিহাবের কথা শুনে সবাই অনেকটা অবাক হয়ে যায়, তাদের মনে একটাই জথা ঘুরছে, কি বলছে এই ছেলে পাগল টাগল হয়ে গেল নাকি!
–‘এই এই কি বললেন, আমাকে পঁটিয়ে নিবে মানে!’
শিহাবের কথা শুনে সকলে চুপ করে থাকলেও উত্তেজিত হয়েই রাহি কথাটি বলেই ফেলে।
–‘ছেলে তো ভালোই সমস্যা কি তাহলে!’কি রে সোহেল বল।
শিহাবের কথা শুনে রাহির এবার রাগ হয়,,
–‘ ছেলে ভালো মানে, কখন ও দেখেছিলেন কেউ বান্ধবী কে দিয়ে বলায়, ” ওর তোমায় পছন্দ হয়েছে আজকে থেকে তুমি ওর গার্লফ্রেন্ড!” কি ভাই এগুলো কোন কথা মনে তো হলো যে আমরা ওদের কেনা গোলাম ওনারা যেটা বলবেন সেটায়।
–‘ তো নিজে প্রপোজ করতে বলছ ওকে!’
ভ্রুকুঁচকে বলে শিহাব।
রাহির মাথায় এবার দুষ্ট বুদ্ধি আসে, এক লাফে শিহাবের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,,
–‘ ও গো, তুমি রাগ করে এসব বলছো, এভাবে বলো না চুমু টুমু দিয়ে রাগ ভাঙ্গিয়ে দেই।’
সবার হা করে থাকা মুখশ্রী হা এ রয়ে যায়, সোহেল তো খুঁক খুঁক করে কেশে উঠেছে! রাতুল এতোটাই অবাক হয়েছে যে রীতিমতো সোহেলের কোলে শুয়ে পড়েছে! শিহাব নিজেও ভেবাচেকা খেয়ে গেছে, তার মারাত্মক হারে হিঁচকি উঠে গেছে। আসতে ধিরে রাহির হাত গুলো তার গলা থেকে সরিয়ে দেয়। নীলিমা আর তরি দু’জন দাঁড়িয়ে পড়েছে। হেমারা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, আরোহী নিজেও বড় একটা হা করে দাঁড়িয়ে আছে। অনিলের মুখ চুপসে গিয়েছে!
–‘ আরে আপনারা সবাই এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো, আরে আমি আপনাদের ভাবি হই তো!’ এই যে উনি, উনি আমার ও গো হন।
স্বাভাবিক ভাবে কথাগুলো বলে হাত দিয়ে শিহাবের দিকে দেখিয়ে লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে বলে রাহি।
শিহাবের হিঁচকি মনে হয় বেড়ে যায়, সোহেল ঝট করে রাতুলে কে ফেলে দাঁড়িয়ে যায়। রাতুল ব্যাথা পেলে ও তার মনের ব্যাথার কাছে এ ব্যাথা কিছুই না মনে করে উঠে রাহির কাছে বসে ভাবি ভাবি বলে মুখে ফেণা তুলা শুরু করে! রাহি হাসি মুখে রাতুলের সাথে গল্প করা শুরু করে,, অনিল রাহির দিকে তাকিয়ে বলে,,
–‘হলুদ পরি তুমি এসব কি বলছো?’
–‘ ওই মিয়া ওই, আ’ম ইয়োর ভাবি নট হলুদপরি! ‘ ও গো আপনি চুপ করে আছেন কেনো, আপনার সামনে আমায় এভাবে বলছে।
অনিলের রাগে কটমট করে তাকিয়ে বলে,অনিলের অসহায় ফেস দেখে শিহাবের সামনে গিয়ে কান্নার ঢং করে বলে রাহি।
–‘ ভাইয়া, আপনি ওদের বলেন না আমি আপনাদের ভাবি হই, আমার ও গো তো লজ্জায় কাউকে বলতেই পারছেন না। ‘
রাতুলের দিকে তাকিয়ে কান্নারত স্বরে বলে রাহি।রাতুল বেচারার মায়া হয়,,
–‘ এই ও আমাদের ভাবি হয় তার মানে তোমাদের ও ভাবি, আজকে থেকে ওকে ভাবির নজরে দেখবে! ‘ এই শিহাব তুই চুপ করে আছিস কেনো বল কিছু একটা?
শিহাব হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে যায়, কি হচ্ছে এসব তার সাথে! কিন্তু সে অবাক হচ্ছে, তাকে নিয়েই সবকিছু হচ্ছে কিন্তু তার রাগ হচ্ছে না কেনো জানি!
অনিল এগিয়ে এসে রাহির হাত ধরার চেষ্টা করতেই রাহি শিহাবের পেছনে চলে যায়,,
–‘ প্লিজ ভাইয়া রাগ করবেন না, এরা অনেক বিরক্ত করে তাই আপনার সাথে এমন একটা নাটক করতে হলো! ‘ প্লিজ এদের কিছু বলে বিদায় করুন ন প্লিজ!
রাহি শিহাবের অনেকটা কাছে গিয়ে ফিসফিস করেই কথাটা বলে, শিহাব শিউরে ওঠে, রাহির কন্ঠস্বর এতোটাই আবেদনময়ী শোনায় যে শিহাবের শরীরের লোমকূপ সহ কেপে উঠে!
–‘প্লিজ! ‘
রাহির করুন কন্ঠ শুনে শিহাবের মায়া হয় না, কিন্তু অন্যকিছু অনুভূতি দেখা দেয়! গলা খেঁকারি দিয়ে অনিলের উদ্দেশ্যে বলে,,
–‘ ওকে আর যেন ডিস্টার্ব করার কথা না শুনি, তুমি এবং তোমার দল ওদের থেকে দূরে থাকবে!’ আঁধার এমনিতেও তোমাদের উপর ক্ষেপে আছে, ছুটির পড়ে প্রিন্সিপাল রুমে চলে যাবে সকলে, ইস দ্যাট ক্লিয়ার!
কাঠকাঠ গলায় কথাগুলো বলেই নিজেদের ডিপার্টমেন্টের দিকে চলে যায়।হেমারা ভয়ে শুঁকনো ঢোক গিলে! অনিল রাহির দিকে তাকিয়ে আছে, তার চোখ মুখে বেদনার ছাপ স্পষ্ট কিন্তু রাহি নিজেও না দেখার ভান করে আরোহীর হাত ধরে সামনের দিকে এগোয়!
ক্লাস শেষ করে বের হতেই সামনের একটা ছেলে হুট করে মুখে হাসি ফুটিয়ে আরোহীদের দেখে বলে,,
–‘ আসসালামু আলাইকুম ভাবি, আঁধার ভাই আপনাদের প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে যেতে বলেছে!’
রাহি ওকে বলে আরোহীর হাত ধরে টানটে টানটে হাটা শুরু করে, আরোহী আর চুপ করে থাকতে পারলো না,,
–‘ রাহি আমি যাব না!’
–‘কেনো যাবি না?’
–‘দেখ ওনার সামনে আমি যেতে চাচ্ছি না বর্তমানে, উনি দুটো দিন কোথায় ছিলো? ‘ আমি যাব না তুই যা।
আরোহীর কথা শুনে রাহি মুখ চেপে হেসেই বলে,,
–‘ তুই না ভাইয়াকে ভালোবাসিস না তাহলে এখন অভিমান করছিস কেনো?’ দেখ যেখানে ভালোবাসা নেই সেখানে অভিমান কারা বিলাসিতা মাত্র।
–‘ তবুও আমি যাব না!’
–‘আরে আয় তো!’
রাহির জোড়াজুড়িতে বাধ্য হয়েই আরোহীকে যেতে হয়।
প্রিন্সিপাল স্যারের পার্মিশন নিয়ে ঢুকতেই আঁধারের গম্ভীর মুখশ্রী নজরে আসে আরোহীর। আঁধারের থেকে চোখ সরিয়ে পুরো রুমে নজর বুলাতেই হেমা ও তার দলের সবাইকে সাথে আঁধারের বন্ধুদের ও নজরে আসে তার।
আঁধার আরোহীকে সেদিনের সব ঘটনা খুলে বলতে বলে,আরোহী নিচের দিকে তাকিয়েই সবকিছু খুলে বলে। সব কথা শুনে প্রিন্সিপাল হেমাদের অনেক বকাঝকা করেন কালকে গার্ডিয়ানহস আসতে বলেন। আরোহীদের কাছে ক্ষমা চায়,নেক্সটে এমন কিছু হলে সরাসরি তার কাছে অভিযোগ করতে বলেন তিনি।
আরোহীরা বের হয়েই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হবে, তার আগেই আঁধার আরোহীকে তার জন্য অপেক্ষা করতে বলে গাড়ি আনতে যায়।আরোহী অভিমানী দৃষ্টিতে তাকিয়ে একা একা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তাই আঁধার আসার আগেই হুরমুর করে বেড়িয়ে যায়।
আদরের পায়ের কাছে বসে আছে আলিশা, সামনে মিসেস আঁকলিমা চৌধুরী ও তারেক চৌধুরী দাঁড়িয়ে আছে। আলিশার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে, সে মূলত আদরের কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্যই তার পায়ের কাছে বসে আছে,,,
–‘প্লিজ আদর আমায় ক্ষমা করে দেও, যা হয়েছে ভুলে যাও দোষ আমাদের উভয়েরই ছিলো! ‘ আমি অনুতপ্ত আদর, সবটা নতুন করে শুরু করি না প্লিজ।
বলেই আলিশা হু হু করে কেঁদে উঠে। আদরের মায়া হয় কিন্তু সে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না, এক পলক মা বার দিকে তাকায়! তারা তাকে সম্মতি দেয় আলিশাকে মেনে নিতে।
–‘আদর এই বাচ্চাটার জন্য হলেও সবকিছু নতুন করপ শুরু করো প্লিজ, বাচ্চাটা তো তোমার তাই না! ‘
বলেই আলিশা আদরের দিকে তাকায়।
–‘ঠিক আছে চেষ্টা করবো, তুমি উঠো এখন।’
আদরের বলতে দেড়ি কিন্তু আলিশার উঠতে দেড়ি হয়নি।আদরের বাবা মায়ের কাছে গিয়ে ক্ষমা চায় সে।
–‘দেখ মা, তোমরা ভালো থাকলে আমরা ভালো থাকবো, আগের সবকিছু ভুলে আদর ও ছোট প্রাণটার জন্য নতুন করপ সবকিছু শুরু করো! ‘ আমরা ও সেটাই চাই কিন্তু এক ভুল আর দ্বিতীয় বার করতে যেও না।
আঁকলিমা চৌধুরী মুখ কালো করে কথাগুলো বলেন। আলিশার মুখে হাসি ফুটে উঠে, কিন্তু তারেক চৌধুরী বিচক্ষণ মানুষ তিনি ঠিক আছে বলেই চলে যান।
একটি সুন্দর ভোরের সূচনা দিয়ে আজকের দিনটি শুরু হয়, পাখির কিচিরমিচির ডাকে আঁধারের ঘুম ভাঙ্গে! বুকে ভারী কিছু অনুভব করতেই মুখে মিষ্টি একটা হাসি চলে আসে আঁধারের।
চোখ মেলে তাকাতেই আরোহীর মায়াভরা মুখটি সামনে ভেসে ওঠে,আরোহীর কপালে চুমু দেওয়ার ইচ্ছে হয় হঠাৎ করেই আঁধারের। তাই ইচ্ছেটাকে দমিয়ে না রেখে আরোহীর কপালে একটা চুমু দিয়ে নেয়!
আঁধারের কাছে আজকের ভোরটি অন্যরকম ভাবে শুরু হলো, তার নিজেকে অনেক সুখী মনে হচ্ছে! এই যে তার প্রিয় মানুষটির তার বউ তারই সাথে তারই বুকে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে।
আরোহীকে বালিশে শুয়ে দিয়ে আঁধার ফ্রেস হওয়ার জন্য ওয়াশরুমে যায়,ওয়াশরুম থেকে ওযু করে বের হতেই আরোহীকে এক পলক দেখে নেয়। ডাকবে কি ডাকবে না ভেবে আর ডাকে না কেনো জানি আরোহীর এতো সুন্দর ঘুমটা ভাঙ্গাতে ইচ্ছে হলো না তার। জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ আদায় করে নেয় সে।
নামাজ শেষ করে সালাম ফেরাতে পাশেই আরোহীকে নামাজ পড়তে দেখে অবাক হয়ে গেলো আঁধার, কিন্তু কিছু না বলেই বাহিরে চলে যায়।
কিছুক্ষণ পড়ে ২ মগ কফি হাতে রুমে প্রবেশ করে আঁধার, আরোহীকে জায়নামাজ ভাজ করতে দেখে কফি নিয়ে বেলকনিতে চলে যায় সে।
আরোহী আঁধারকে এভাবে বেলকনিতে যেতে দেখে খানিকটা অবাক হয়, সে কি যাবে নাকি নিচে যাবে বুঝতে পারে না।
বেলকনিত থেকে আরোহীকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আঁধার বলে,,,
–‘আরু?’
ভাবনার মাঝেই আঁধারের ডাকে হকচকিয়ে যায় আরোহী।
–‘হুম।’
–‘ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছ, এদিকে এসো!’
আঁধারের কথামতো আরোহী গিয়ে তার সামনে দাঁড়ায়।
–‘আজকের সকালটা অনেক সুন্দর তাই না!’
এক কাপ কফি এগিয়ে দিয়ে বলে আঁধার। আরোহী মুচকি হেসে কফিটা নিয়ে বলে,,,
–‘আচ্ছা আরু তোমার আর আমার সম্পর্ক কি?’ আই মিন আমি কি হই তোমার?
–‘স্বামী!’
আরোহীর ছোট উত্তরে আঁধার সন্তুষ্ট হতে পারে না মুখটা কালো করে নেয়। তবুও নিজেকে সামলে প্রশ্ন করে,,
–‘তুমি কি আমায় তোমার স্বামী হিসেবে মানো!’
আঁধারের প্রশ্নে আরোহী যেনো থমকে যায়,, আসলেই তো সেটা তো কখন ও ভাবেনি সে।
আরোহীকে চুপ করে থাকতে দেখে আঁধার বলে উঠে,,
–‘কি হলো বলো,নাকি এখন ও হ্যা না নাহ নিজেই জানো না!’
–‘মানি!’
ছোট উত্তর আরোহীর,আঁধার মনে মনে অনেকটা শান্তি পায়,, স্বামী হিসেবে তো মানে এটাই অনেক।
–‘আমায় ভালো করে চেনো কতোদিন ধরে? ‘
আঁধারের প্রশ্নে আরোহী চোখ তুলে আঁধারের দিকে তাকায়, তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে এমন প্রশ্ন করবে আঁধার হয়তো সে স্বপ্নেও ভাবেনি।
–‘কি হলো বলো?’
–‘বিয়ের ২/৩ দিন আগে থেকে।’
আরোহীর উত্তরে হাসে আঁধার,,
–‘সিরিয়াসলি আরু তার মানে তুমি আমায় মাত্র ৩৪/৩৩ দিন ধরে চেনো?’
–‘এ মা না না তা কেনো হবে,আপনাকে তো আমি যখন ১১বছর তখন থেকেই চিনি বাট, সরাসরি দেখিনি কখনো বিয়ের ২/৩ দিন আগে একবার আমাদের বাসায় এসেছিলেন তখন দেখেছিলাম আর কি।’
আঁধারের প্রশ্নে তড়িঘড়ি করে বলে আবার মাথা নিচু করে নেয় আরোহী,,
আঁধার সামান্য হাসে,হেসেই বলে উঠে,,
–‘আর আমি তোমায় চিনি কতোদিন থেকে জানো?’
আরোহী ডানে বামে মাথা নাড়ায়, যার অর্থ সে জানেনা।
–‘ এক বছর, এক মাস, দুই দিন ধরে চিনি তোমাকে।’
ফট করে চোখ তুলে তাকায় আঁধারের দিকে আরোহী। তার দৃষ্টিতে অনেকটা অবাকের রেশ দেখা যাচ্ছে যেটা দেখে আঁধার মুচকি হাসে।
–‘কি অবাক হলে তো,হওয়ারই কথা! ‘ তখন তুমি ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের মাঝামাঝি ছিলে,কলেজ ড্রেসে অনেকটা পিচ্চি পিচ্চি লাগতো তেমায়।
বলেই জোড়ে হেসে দেয় আঁধার।
আঁধারের কথা শুনে যতোটা না আরোহী অবাক হয়েছে তার থেকে অনেকটা রাগ হচ্ছে তার তাকে পিচ্চি বলাতে।
আরোহীর মুখের অবস্থা দেখে আঁধার হাসি কন্ট্রোল করে বলে,,
–‘ওকে কুল কুল তোমায় পিচ্চি বলছি না আর,আচ্ছা আমি যে সারাদিন তোমায় এতো জ্বালাই, আমার জন্য তোমায় লজ্জার সম্মুখীন হতে হয় এতে কি তোমার খারাপ লাগে?’
আঁধারের কথা শুনে এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় আরোহী তার দিকে।আঁধার নিজেও তাকায় আরোহীর দিকে,কিন্তু আরোহীকে চুপ করে থাকতে দেখে তার মনটা অনেকটা খারাপ হয়ে যায় তাই আর কিছু না ভেবেই বলে দেয়,,
–‘ডু ইউ ওয়ান্ট ডিভোর্স? ‘
আঁধারের কথা শুনে আরোহীর বুকের ভেতর ধ্বক করে ওঠে, মনে হয় কথাটা তার বুকে গিয়ে আঘাত করছে, নিজের মনে মনেই কথাটা দু’বার উচ্চারণ করে আরোহী। ঠিক যতবার কথাটা উচ্চারণ করে ততোবারই তার কলিজা কেঁপে উঠছে।
চোখের কোণে সামান্য জ্বলের রেখা দেখা যায় তার, আঁধারকে আরোহীর বর্তমানে অসহ্য লাগছে! কেনো লাগছে আরোহী নিজেই জানে না।
–‘কি হলো বলো,আমি কি ডিভোর্স ফাইল করবো?’
আঁধারের কথাটা শেষ হওয়া মাত্রই আরোহীর চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি বের হয়, নিচে পড়ার আগেই কারো হাতের তালুতে পানিগুলো অস্তিত্ব খুঁজে নেয়।
আঁধার অনেক যত্ন সহকারে পানিগুলোকে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আরোহীর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। আরোহীকে মাথা নিচু করে থাকতে দেখে বলে,,
–‘চোখের জ্বলকে এতোটা সস্তা করে তুলো না সে যে কারো জন্য ঝরে পড়ে,চোখের জ্বল অনেক সচ্ছ জিনিস বুঝলে তাকে সবার জন্য ঝরাতে নেই।’
আঁধারের কথা শুনে আরোহী চোখের পানি মুছে নেয়। কিন্তু আবার কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরে।
–‘কাঁদছ কেনো আরুপাখি,তুমি তো সম্পর্কটাকে চাও না তাই তো ডিভোর্সের কথা বললাম।’ তার মানে কি ধরে নেব তুমিও সম্পর্কটাকে চাও,আমার সাথে থাকতে চাও!
আঁধারের কথা শুনে আরোহীর অনেকটা অভিমান হয়, কেমন স্বামী সে স্ত্রীকে ডিভোর্সের কথা বলে। থাকবে না আরু তার সাথে! মনে মনে কথাগুলো ভেবেই পেছন ঘুরে চলে যেতে নেয় আঁধার হাত ধরে আঁটকে দেয়।
–‘তুমি চলে যাচ্ছো কেনো, আমি তো তোমার সাথে কথা বলার জন্য তোমায় ডেকে ছিলাম। ‘
–‘কি বলবো আমি হ্যা, যে মানুষ সম্পর্কটাকে শুরু হওয়ার আগেই শেষ করে দিতে চায় তাকে কি বলবো আমি! ‘ বলবো যে হ্যা আমি থাকতে চাই না আপনার সাথে ডিভোর্স দিয়ে দেন আমায়।আপনি যদি ডিভোর্সই দিবেন তাহলে বিয়ে করেছিলেন কেনো আমায় সেদিন বলেন, জবাব দেন?
ক্ষোভ মিশ্রিত কন্ঠে কথাগুলো বলেই দম নেয় আরোহী, আঁধার অবাক হলেও খুশি হয়ে যায় আরোহীর কথা শুনে। কিন্তু আরোহীকে আর একটু টেস্ট করে দেখতে চায় সে তাই বলে,,
–‘তুমি তো সম্পর্কটাকে স্বাভাবিক করতে চাও না, আমার টাচ তোমার খারাপ লাগে।’
–‘দেখুন মিষ্টার তাশরিফ আঁধার চৌধুরী আই ডোন্ট ওয়ান্ট ডিভোর্স, আমি আপনার সাথে থাকতে চাই, এই সম্পর্কটাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।’ আপনাকে সব কথা মুখে বলতে হবে কেনো, আপনি বুঝতে পারেন না! আমি আপনার সব কাজেই সাড়া দেই কখন বলেছি যে আমার খারাপ লাগে, সহ্য করতে পারি না।
–‘তো তুমি বলতে চাচ্ছো তোমার ভালো লাগে আমি কাছে আসলে,আমি টাচ করলে?’
শয়তানি হাসি দিয়ে বলে আঁধার। আরোহী ভরকে যায়, ঝোঁকের বসে কি থেকে কি বলে দিয়েছে ভাবতেই তার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে হয়।
আরোহীকে আমতা আমতা করতে দেখে আঁধারের মুখে বাঁকা হাসি ফুটে উঠে, আরোহীর দিকে এক পাঁ এক পাঁ করে এগুতে শুরু করে। আরোহী ভয়েই পেছাতে থাকে, কিন্তু বেলকনিতে যাওয়ার জায়গায় না থাকায় দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তার। দেওয়ালের সাথে লেপ্টে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাতে শুরু করে আরোহী।
আঁধার সেটা দেখে আরও খানিকটা এগিয়ে গিয়ে সামান্য দূরত্ব রেখে দাঁড়ায় আরোহীর থেকে,কিন্তু দু’হাত দ্বারা আঁটকে নেয় তাকে।
–‘তো মিস উপস সরি,মিসেস চৌধুরী তখন কি যেনো বললেন,আমি কি একবার ও বলেছি আমার খারাপ লাগে।’ উফফ তার মানে…
আর বাকিটা উচ্চারণ করে না আধার, শয়তানী হাসি দিয়ে আরোহীর দিকে ঝুঁকে পড়ে। চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নেয় আরোহী, আঁধার আরোহীর অবস্থা দেখে হেসেই বেশ কয়েক মিনিট ধরে তার ঠোঁট জোড়া চেপে ধরে থাকে আরোহীর কপালে।
নিজের কপালে শীতল কিছুর স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠে আরোহী, আঁধারের নিশ্বাস তার চোখ মুখে আঁছড়ে পড়ছে। আরও খানিকটা শক্ত হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে আরোহী।
কিন্তু আঁধার তাকে অবাক করে দিয়ে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে। আরোহীর চোখ মুখ এবার স্বাভাবিক হয়।
আরোহীকে নিজের সাথে চেপে ধরেই একটা মোড়ায় বসে পড়ে আঁধার, আবার কি মনে করে আরোহীকে সোজা করে দাঁড় করায়, আবার হুট করে টেনে কোলের মধ্যে বসিয়ে দিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে।
আরোহী হাসফাস করতে শুরু করে, যেটা দেখে আঁধার হাসে কিন্তু আর ফাজলামো করে না আরোহীর সাথে৷
–‘জানো আরুপাখি স্বামী- স্ত্রীর বন্ধনটা অনেক মজবুত হয়,সেটা চাইলেও যে কেউ সহজে ভাঙ্গতে পারে না।’কেনো জানো কারণ সেটা আল্লাহর তরফ থেকে হয়।আবার স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটাকে চাইলেই খুব সহজে ভাঙ্গা যায় কিন্তু সেটা শয়তানের চেষ্টায়। আবার অনেক সময় খুব সহজে কেউ মানিয়ে নিতে পারে না যেমনটা তোমার বোন আলিশা করছে। সেটা কিন্তু নিজ ইচ্ছেই করছে,এখন তুমি কি করবে সেটা কিন্তু তোমার উপর ডিপেন্ড করে! আমি যখনই স্বাভাবিক করতে চাই তুমি আলিশার কথা বলে বার বার আমায় রাগিয়ে দেও, তুমি নিজেই ভেবে বলো তো তুমি কি সেটা ঠিক করো? স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা যেমন অনেক মজবুত হয় হাজার ঝড় ঝাঁপটা পার করে ও একে অপরের পরিপূরক হয়ে থাকা যায়,তেমনি অনেকটা নাজুক ও হয়। সামন্য একটু আঘাতেই ভেঙ্গে গুরিয়ে যেতে পারে।
আঁধারের কথাগুলো আরোহীর মন ছুঁয়ে যায়,নিজেকে অনেক ভাগ্যবতী মনে হয় তার।
আরোহীকে চুপ করে থাকতে দেখে আঁধার বলে,,
–‘কি হলো আমার কথাগুলো কি তোমার খুব খারাপ লাগছে?’
–‘না আসলে আপনি অনেক ভালো করো সবকিছু বুঝিয়ে দিতে পারেন!’
ব’লেই লাজুক হাসে আরোহী,,
–‘তাহলে তো আমার একটা মিষ্টি পাওনা থাকে কি বলো?’
–‘হুম, এনে দিচ্ছে ফ্রিজে আছে দাঁড়ান! ‘
আরোহীকে আরও খানিকটা চেপে ধরে আঁধার আর ফিসফিস করে বলে,,
–‘ওই মিষ্টি এখন আপনার কাছেই আছে মেডাম, যেটা কাল ভার্সিটিতে পেয়েছিলাম!’ এই একটা কথা বলো তো, কাল তুমি সবার সামনে ওভাবে আমায় কিস করলে কেনো? না মানে তুমি তো ওমন মেয়ে না।
প্রথমের কথাটা ফাজলামো করে বললেও শেষের কথাগুলো অবাক হয়ে বলে আঁধার।
আরোহীকে চুপ করে থাকতে দেখে আবার জিজ্ঞেস করে আঁধার। উপায় না পেয়ে আরোহী আঁধারকে শুরু থেকে সবটা বলে দেয়। মুহুর্তের মধ্যে আঁধারের চোখজোড়া লাল হয়ে যায়, কপালের রগ ফুলে যায়। আরোহীকে দাঁড় করিয়ে রাগে ফুঁসতে থাকে আঁধার,আরোহী ভয় পেয়ে যায় আর মনে মনে ভাবে সবটা না বললেও হতো কেনো বললাম।
কিন্তু আঁধার ততোক্ষণে গর্জে উঠেছে,,
–‘এই মেয়ে, ওরা তোমায় বললো তুমি রাজি হয়ে গেলে যদি আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকতো?’ তুমি জানতে না আমি ওই ভার্সিটিতে আছি, আমায় ফোন করলে না কেনো?
আঁধারের ধমকে কেঁপে উঠে আরোহী, শব্দ করেই কেঁদে ফেলে। আঁধার যেনো এবার আরও বেশি রেগে যায়,,,,
–‘কাঁদবি না এখন তুই, বল আমি না হলে অন্য কেউ যদি হতো তখন কি করতিস? ‘ ওদের এতো বড়ো সাহস আজকেই একটা ব্যাবস্থা করছি আমি।
রেগে সামনে থাকা ফুলের টবে লাথি মারে আঁধার,, সেখানে আর দাঁড়ায় না, হনহনিয়ে রুমে চলে যায়। ফোন খুঁজে কাউকে একটা ফোন দেয় সে,,,
–‘হ্যালো সোহেল, এখনই তোরা সবাই আমার সাথে দেখা কর ভার্সিটির সামনে রাইট নাও।’
বলেই কেটে দেয়, আরোহী যেনো আরও ভয়ে সিটিয়ে যায়।আঁধার এবার আরোহীকে দেখে রাগ কমানোর চেষ্টা করে,সে তো উপায় না পেয়েই কাজটা করেছে,,,,
–‘এই তুমি কাঁদছ কেনো? ‘ একদম কাঁদবে না, আর শুনো আমি একটু বাহিরে যাচ্ছি তুমি নাস্তা করে নিয়ো কেমন!
আরোহীর চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলে আঁধার।
আরোহী এবার বেশ শব্দ করে কেঁদে দেয়।
আঁধার উপায় না পেয়ে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।কিন্তু আরোহীর কান্না থামার কোন নামই নেই, তাই আঁধার আরোহীকে শান্ত করার জন্য বলে,,
–‘আচ্ছা বলো তো আমি তোমায় আরু পাখি বলছিলাম কেনো?’ কারণ কি? আর তোমায় কিভাবে চিনি আগে থেকে?
এবার আরোহীর কান্না অটোমেটিক বন্ধ হয়ে যায়,মাথা নাড়িয়ে না বুঝায় সে যার মানে সে জানে না।
আঁধার হাসে, হেসেই বলে,,
–‘কারণ তোমার সাথে আমার প্রথম দেখা…’
আর কিছু বলতে পারে না ফোন বেজে ওঠে, এক হাত দিয়ে আরোহীকে আগলে আরেক হাত দিয়ে ফোন রিসিভ করে,,
–‘আমার যেতে হবে এখন, আমি পড়ে তোমার সাথে কথা বলবো কেমন!’
–‘কোথায় যাবেন?’
–‘কাজ আছে একটু।’
আরোহীকে আর কিছু বলতে না দিয়েই গাড়ির চাবি নিয়ে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে যায় আঁধার।
আরোহী ভালো করেই বুঝতে পারছে হয়তো হেমাদের টাইট দিতে যাচ্ছে সে, একটু টাইট দেওয়া দরকার তাদের কিন্তু আঁধারকে যে পরিমাণ রেগে থাকতে দেখলাম যদি বেশি কিছু করে ফেলে। মনে মনে ভাবছে আরোহী!
ফোন কেটে আঁধার ভ্রুকুঁচকে তার বাবার দিকে তাকায়!কিন্তু তারেক চৌধুরীর চোখ মুখ দেখে অবাক হয় আঁধার, তার হাসি-খুশি বাবাটা আজকে মুখ গোমড়া করে কি যেনো ভাবছে।
আঁধারের মনে প্রশ্ন জাগে, তার বাবা তো এমন নয়! সিরিয়াস ব্যাপারেও কখন ও সে তার বাবার মুখ গোমড়া দেখেনি, ছোট থেকেই সে আর আদর তার বাবা মায়ের কাছে বন্ধুর মতো আচরণ পেয়েছে। তাই তার বাবা মায়ের সব ব্যাপারই তাদের জানা!আঁধার কৌতুহল দমিয়ে না রাখতে পেরেই একপ্রকার বাধ্য হয়েই জিজ্ঞেস করে,,
–‘এনি প্রব্লেম আব্বু?’ তোমায় অনেক চিন্তিত দেখাচ্ছে যে?
ছেলের কথায় অসহায় দৃষ্টিতে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকান তারেক চৌধুরী, আঁধার তার বাবার অসহায় দৃষ্টি দেখে ভড়কায় আর মনে মনে ভাবে সিরিয়াস ব্যাপার হয়তো!
–‘কি হলো আব্বু বলো?’ আমার সাথেও সেয়ার করবে না!
–‘বাপরে তোর মা মনে হয় প্রেমে পড়েছে!’ আমাকে এখন আর তার ভালো লাগে না, আমার কথার উত্তর দেওয়ার ও প্রয়জোন মনে করে না তোর মা।
আঁধার থমকায়, হতবাক হয়,অবাক হয় কিন্তু পরক্ষণেই ফিঁক করে হেসে দেয়।আদরের ছেলের এমন হাসি দেখে তারেক চৌধুরীর গাঁ জ্বলে যায়, রাগ হয় কিন্তু কিছু বলে না।
কারণ তার এই আদরের ছেলেটাই এখন একমাত্র ভরসা, তিনি যদি কিছু বলেন পরে যদি তাকে আর সাহায্য না করে তাই তিনি চুপ হয়ে যান,একেবারে মুখে কুলুপ এঁটে চুপকরে থাকেন।
আঁধার হাসি থামিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে তার বাবার দিকে তাকায়, তার বাবার আঁধার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার ফিক করে হেসে দেয়, এবারের হাসিটা একটু জোড়েই হয়ে যায়।তাই তো রেস্টুরেন্টের সবাই আঁধার ও তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে।
তারেক চৌধুরী এবার বিরক্ত চোখে ছেলের দিকে তাকায়, আঁধার তার বাবার দৃষ্টি দেখেই বুঝতে পারে যে তার বর্তমানের হাসিটা তার বাবার পছন্দ হচ্ছে না। অনেক কষ্টে নিজের হাসি থামিয়ে আঁধার এবার সিরিয়াস হওয়ার ভান করেই বলে,,
–‘বলো আব্বু কে সেই ছেলে যার এতো বড় সাহস তাশরিফ আঁধার চৌধুরীর মায়ের সাথে প্রেম করে?’
তারেক চৌধুরী এবার অসহায় কন্ঠে বলেন,,
–‘জানি না রে বাপ, তাই তো তোর কাছে আসলাম সমাধান নিতে!’
আঁধারের হাসি পেলেও আর হাসে না, অনেক কষ্টে হাসি আটকিয়ে মুখটা গম্ভীর করার চেষ্টায় আছে বেচারা। তবুও কোন রকম বলে,,
–‘আচ্ছা মানলাম, তা আম্মু কি নিজে থেকে তোমায় বলেছে সে প্রেমে পড়েছে? ‘
–‘তা বলেনি ঠিকই কিন্তু আমি বুঝতে পারছি, একসময় তো আমিও তো প্রেম করেছি।’
–‘তা করেছ আবার তোমার প্রেমিকার বিয়েও তো হয়ে গিয়েছে, বেচারির এখন ২ টা সন্তান আহা!’
কিছুটা দুঃখ প্রকাশ করে বলে আঁধার,,
তারেক চৌধুরী ভ্রুকুঁচকে বলে,,,
–‘আমি তোর বাপ সেটা কি তুই ভুলে গেছিস,বাপেরই সামনে তার গার্লফ্রেন্ড নিয়ে মজা করছিস?’
–‘হুর কি যে বলো না, তুমি তো আমার বন্ধু তাই না!’
চোখ টিপ দিয়ে বলে আঁধার,,
তারেক চৌধুরী চোখ রাঙ্গিয়ে তাকায় ছেলের দিকে,,
–‘ও হো আব্বু আমি তো ভূলেই গেছিলাম তোমার গার্লফ্রেন্ড তো আবার আমার আম্মু নিজেই।’
মজার ছলে কথাটি বলেই হেসে দেয় আঁধার, তারেক চৌধুরী নিজেও হেসে ফেলে।তার এই এক ছেলে যাকে সবাই গম্ভীর, রাগী, ও বদ মেজাজি বলেই চিনে শুধু মাত্র এই বাবা-মায়ের কাছে ও বন্ধুদের কাছেই সে ফাজিলের ও বদের হাড্ডি।
কিন্তু ছোট থেকে বড় হয়েছে আঁধার তার তেমন কোন বন্ধু বান্ধব ও নেই এই হাতে গণা কয়েকজন বাদে।সবার সাথে সহজে মিশতে পারলেও কোন এক কারণে মেশে না আঁধার, সে কারণ তারেক চৌধুরী ও আঁকলিমা চৌধুরী ও এতোদিন খুঁজে বের করতে পারেনি।
আঁধার যেমন ঠিক আদর তার বিপরীত চঞ্চল, সে সবার সাথেই চঞ্চলতা করে। তার বন্ধু ও অনেক, কিন্তু আঁধারের মতো প্রকৃত বন্ধু পায়নি এখন অব্দি সে। কিন্তু দুই ভাই দু’জনের জান।
তারেক চৌধুরীকে গভীর ভাবে কিছু একটা ভাবতে দেখেই আঁধার আবার ভ্রুকুঁচকায়।
আঁধারের প্রশ্নে তারেক চৌধুরী চোখ তুলে তাকায় তার ছেলের দিকে আর বলেন,,
–‘তোদের দুই ভাইয়ের কথা ভাবছিলাম!’ আগে তোরা একে অপরকে ছাড়া বুঝতি না এখন তোরা কেউ কারো সাথে কথায় বলিস না।
আঁধার তার বাবার কথার মানে ভালো করেই বুঝতে পারে কিন্তু ঐ প্রসঙ্গে কথা বলতে চায় না এখন সে,,
–‘তুমি বললে না তো তোমার বউয়ের প্রেমিকের কথা কিভাবে জানলে?’
আঁধারকে অন্য প্রসঙ্গে কথা বলতে দেখে তারেক চৌধুরী ভালোই বুঝতে পারলেন যে তার ছেলে এ ব্যাপারে কথা বলতে নারাজ এখন তাই তিনিও ছেলের প্রশ্নের উত্তর দিলেন,,,
–‘আমি সিড়ি দিয়ে নামছিলাম তখন তোমার মা নিচে একা একা দাড়িয়ে হাসছিল, লজ্জা পাচ্ছিল আমি প্রশ্ন করাতেই মুখের উপর ঝামটা মেরে চলে গেলো!’
আঁধার তার বাবার দুঃখী দুঃখী ভাবে কথাগুলো শুনে নিজেও কিছুটা দুঃখী হবার ভান করে বলে,,
–‘ আহা আব্বু আম্মুটা তোমার সাথে খুব অন্যায় করে ফেলছে তাই না!’ ইসস,
আঁধারের মজার ছলে বলা কথাটি শুনে তারেক চৌধুরী শক্ত চোখ মুখ করে তাকায় আঁধারের দিকে।
–‘উফফ আব্বু আমি ভয় পেয়ে যাচ্ছি তো এভাবে কেউ তাকায় নাকি,যাই হোক শুনো আম্মু হয়তো তোমার কথায় ভেবে লজ্জা পাচ্ছিল। ‘ আম্মুর ব্যাপারে আগের প্রেমিকের মতো সন্দেহ করা বন্ধ করো, আম্মু শুনলে তোমার খবর আছে!
আঁধার কিছুটা ভয় পাওয়ার ভঙ্গিতে বলে উক্ত কথাগুলো।
তারেক চৌধুরী ভাবে কিছুক্ষণ তারপর আঁধারকে বলে,,
–‘খেয়ে নে এবার, ভেবে দেখবো ব্যাপারটা আমি!’
আঁধারও আর কিছু বলে না চুপচাপ খেয়ে নেয়। ডিনার শেষে বাবা ছেলে মিলে গল্প করতে করতেই বাসায় চলে আসে, তখন রাত ১১টা বাজে ৪৫ মিনিট।
কলিং বেল বাজাতেই কাজের মেয়ে মিলি এসে দরজা খুলে দেয়।যদিও তাকে কাজের মেয়ের মতো কেউ ট্রিট করে না, পরিবারের সদস্যই মনে করে বাকি সবাই।
সে গ্রামে গেছিলো হয়তো আঁধাররা বের হয়ে যাওয়ার পর পরই চলে এসেছে তাই এখন কেবল দেখলো।আঁধার সামান্য হাসে মিলিকে দেখে, তারেক চৌধুরী ও হেসে মিলিকে জিজ্ঞেস করে,,
–‘মিলি মা কেমন আছিস?’ এতোদিন পর বুঝি আমাদের কথা মনে পড়লো?
–‘ভালা আছি আব্বা, আফনে কেমন আছেন?’
বোকা হেসে উত্তর দেয় মিলি।
–‘আমি তো অনেক ভালো আছি,বাকি সবাই কই?’
–‘ঘরে আছে আব্বা, আমি আফনাদের খাবার দিমু?’
–‘আরে না তোকে কষ্ট করতে হবে না আমরা খেয়ে এসেছি।’ তুই ঘুমা গিয়ে।
মিলি মাথা নেড়ে চলে যায়,আঁধার ও তারেক চৌধুরী ও নিজ নিজ কক্ষে চলে যায়।
আঁধার রুমে ঢুকতেই চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার দেখে ভ্রুকুঁচকায়।বেডের দিকে চোখ যেতেই পুরো বেড ফাঁকা দেখে কুঁচকানো ভ্রুদ্বয় আরও একটু কুঁচকে নেয়।
লাইট জ্বালিয়ে পুরো ঘরে চোখ বুলায়, কিন্তু আরোহীর দেখা পায় না। তাই বেলকনিতে, ওয়াশরুমে সবখানে দেখে নেয় কিন্তু না তার বউটা কোথাও নেই। অন্যরুমে চলে যায়নি তো ভেবেই আঁধারের হঠাৎ করেই রাগ হয়। তাই আগে ফ্রেস হতে চলে যায়।
২০মিনিট ধরে ফ্রেস হয় আঁধার, শুধু ফ্রেসই হয়নি রাগটাকে ও কন্ট্রোল করে এসেছে সে। কিন্তু বাহিরে এসে আরোহীকে না দেখেই রাগটা আবার মাথা চড়া দিয়ে ওঠে।
হনহনিয়ে রুমের বাহিরে চলে যায় আরোহীকে দেখার উদ্দেশ্যে।আগে তার মা-বাবার রুমে দেখে কিন্তু না আরোহী নেই, আদরের রুমে তো থাকবে না সিয়র,তাই গেস্ট রুমগুলোতে দেখে কিন্তু না আরোহী নেই।
আঁধার সেখানেই দাড়িয়ে যায়, মনে মনে ভাবে তখনার ঘটনার জন্য আবার চলে যায়নি তো! নিজেই নিজেকে হাজারটা গালি দেয় আঁধার কি দরকার ছিল তখন ঝোঁকের বসে ওইসব করার,এখন যদি আরোহী তাকে খারাপ ভাবে আরও দূরে সরে যায়।
নিজের উপরই বিরক্ত হয় আঁধার, এতো দিনের পরিকল্পনা কি তাহলে তার নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পারার জন্য শেষ হয়ে যাবে।না সেটা তো আঁধার হতে দিতে পারে না। এতো কষ্টের ফল এক নিমিষে শেষ হয়ে যাবে।
আঁধারের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়, অস্থিরতা এসে গ্রাস করছে তাকে, কি করবে কিছুই মাথায় আসছে না।আচ্ছা আরু কি তাহলে আমার সাথে আর সংসার করবে না, একটু ছোঁয়াতেই যদি চলে যেতে পারে তাহলে না না এসব কি ভাবছি আমি!
না চাইলেও ওকে আমার সাথে থাকতে হবে। নিজে নিজে কথাগুলো ভাবতেই হঠাৎ আঁধারের আলিশার ঘরের কথা মনে পড়ে,একবার কি যাবে,কিন্তু আলিশা তো আরোহীকে সহ্য করতে পারে না তাহলে ওর কাছে কি করে থাকবে, পরক্ষনেই আবার ভাবে একবার দেখে আসতেই বা কি সমস্যা!
না চাইতেও আলিশার রুমের সামনে চলে যায় আঁধার, দরজাটা খানিকটা চাপানো, অনেক দ্বিধা নিয়ে হালকা করে ধাক্কা দেয় এতেই যেনো পুরোটা খুলে যায় দরজাটা।নীল ড্রিম লাইটের আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দুই রমনী দুদিকে ফিরে শুয়ে আছে। আঁধার হাফ ছেড়ে বাঁচে, আরোহী যায়নি তাহলে!
কিন্তু আলিশা আর আরোহী একসাথে কি করে থাকতে পারে,তারা তো কেউ কাউকে দেখতেই পারেনা!অনেক প্রশ্ন জমে আধারের মনে কিন্তু এখন আরোহীকে নিয়ে যাবে কি করে সেটা ভাবে।ধির পায়ে এগিয়ে যায় বেডের বাম পাশে, আরোহীর চোখ মুখ দেখেই আঁধার অবাক হয়!
মনে হচ্ছে অনেক সময় ধরে কান্না করার ফলে এমনটা হয়েছে, কিন্তু কাঁদবে কি কারণে! নিজের মনের প্রশ্নগুলোকে আটকিয়ে রেখে আসতে করে আরোহীকে কোলে তুলে নেয় আঁধার।
আরোহী খানিকটা নড়েচড়ে উঠে আবার ঘুমিয়ে যায়,এতে সস্থির নিশ্বাস ছাড়ে আঁধার। না জানি কোলে দেখে আবার কি ভাবতো! দরজাটা হালকা করে চাপিয়ে দিয়ে আরোহীকে নিয়ে চলে যায় আঁধার। আলিশা ফট করে চোখ খুলে, আঁধারকে যেতে দেখে রহস্যময় হাসি দিয়ে ব’লে উঠে,,
–‘কাল থেকে দেখো কি কি হয় আঁধার।’
বলেই চোখ মুখ করে করে দরজার দিকে তাকায়।
আরোহীকে রুমে নিয়ে এসে এমন ভাবে শুইয়ে দেয় যেনো একটু ও ব্যাথা না পায় সে।আরোহী ঘুমে বুদ হয়েই আছে দেখে রুমের লাইট বন্ধ করে আরোহীর পাশে শুয়ে পড়ে। কিন্তু ঘুমায় না, আরোহীকে বুকের সাথে চেপে ধরে বলে,,
–‘তুমি আমার অনেক কষ্টে পাওয়া ফল আরু, ভুলেও কখনো আমার বিরুদ্ধে যেয়ো না! ‘ আমি তোমায় হারাতে পারবো না। তোমাকে পাওয়ার জন্য আমার অনেক কিছু করতে হয়েছে,যেসব আমার ব্যাক্তিত্বের সাথে যায় না!
বলেই চোখ বুজে নেয় সে।আরোহী হয়তো জেগে থাকলে আজকে অনেক কিছুর উত্তর পেয়ে যেতো , কিন্তু ঘুমে বুদ হওয়া আরোহী বুঝতেই পারলো না তার অগচরে কতো কি হচ্ছে তার সাথে।
মাঝরাতে অসস্তিতে আরোহীর ঘুম ভেঙে যায়, মনে হয় কেউ একজন শক্ত করে চেপে ধরে আছে আরোহীকে।চোখ মুখে কারো গরম নিশ্বাস নির্বিঘ্নে আছড়ে পড়ছে। নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে তার, ঘুম ঘুম চোখে অনেক কষ্টে চোখ মেলে তাকিয়ে আঁধারের ক্লান্ত মুখশ্রী দেখতে পায়।একদম বাচ্চাদপর মতো করে ঠোঁট উল্টে ঘুমাচ্ছে সে। আঁধারকে দেখেই আরোহীর আদুরে ভাব চলে আসে,,,
কিন্তু আরোহীকে শক্ত করে চেপে ধরার কারণে নড়তে ও পারছে না আরোহী! অনেক কষ্ট হাতটা বের করতে সক্ষম হয় সে, আঁধারকে ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করেও সফল হয় না সে। আঁধারের কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য ছোটাছুটি শুরু করে দেয় কিন্তু আঁধার সে আদৌও কি বুঝতে পারছে কিছু, সে তো গভীর ঘুমে মগ্ন!
একসময় আরোহী নিজেই হাপিয়ে যায়, ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছে সে, মনে হয় আজকে আমি দম বন্ধ হয়েই মরে যাব। বিরবির করতে করতে আরোহীর মাথায় একটা বুদ্ধি চলে আসে, মুখে হাসি ফুটিয়ে আঁধারের পুরো মুখে তার হাত দিয়ে ছুয়ে দিতে শুরু করে। একসময় ধিরে ধিরে আঁধারের গলার দিকে মুখটা নিয়ে যায়,,,
ব্যাথায় আর্তনাদ করে ওঠে আঁধার, গলায় হাত বুলিয়ে চোখ খুলে আরোহীর দিকে রাগি দৃষ্টিতে তাকায়।তার ঘুম অনেক আগেই ভেঙ্গেছে, আরোহী কি করে সেটা দেখার জন্যই মূলত সে ঘুমের ভান করে ছিলো। কিন্তু আরোহী যে এভাবে তাকে কামড়াবে সেটা স্বপ্নেও ভাবেনি সে।
আরোহীকে মিটমিট করে হাসতে দেখে রাগী দৃষ্টিতে তাকায় আরোহীর দিকে সে।আরোহী এবার চোখ মুখ কুঁচকে বলে,,,
–‘ছেড়ে দিন এবার।’ এভাবে কেউ ধরে দম বন্ধ করে মেরে ফেলতে চান নাকি!
আঁধারের মাথায় শয়তানী বুদ্ধি চলে আসে আরোহীর কথা শুনে,,,
আরোহী আঁধারকে বাঁকা হাসতে দেখে অবাক হয়, কিন্তু আঁধারকে তার দিকে মুখ এগিয়ে নিয়ে আসতে দেখে আঁতকে উঠে।কিন্তু ততোক্ষণে আঁধার তার কাজ শেষ করে দিয়েছে। ব্যাথায় আরোহীর চোখ মুখ নীল হয়ে যায়,,,
আঁধার বাঁকা হাসি দিয়ে সরে এসে বলে,,,
–‘কি হলো সুইটহার্ট, একটু কামড়েই দম শেষ তোমার!’
আরোহী তখনও গলায় হাত বুলচ্ছে, আঁধারের এবার একটু মায়া হয় তাই আরোহীর হাত সরিয়ে ফট করে একটা চুমু দিয়ে দেয় তার কামড় দেওয়া জায়গাতে। আরোহী কেঁপে উঠে, আঁধার ফট করে সরে এসে আরোহীর মুখের দিকে তাকায়।আরোহীকে লজ্জা পেতে দেখে বলে,,
–‘ঘুমাও নাহলে এই প্রক্রিয়ায় চলবে সারারাত!’
আরোহী চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে ঘুমের ভান করে পড়ে থাকে।আঁধার আরোহীর কান্ডে হেসে আবার আগের মতো জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে নেয়। তার হার্ট-বিট অনেক ফাস্ট চলাচল করছে, মনের মধ্যে হাজারো অনুভূতিরা উঁকি দিচ্ছে কিন্তু আঁধার চায় না এখনই সেসব বাহিরে চলে আসুক। আরোহীকে আরও কিছুদিন সময় দিতে চায় সে, আরোহীর তার প্রতি অনুভূতিগুলো জানতে চায়!
আঁধার বাসায় আসে একদম রাত ৮টার দিকে!ক্লান্ত শরীরটা ড্রয়িং রুমের সোফায় এলিয়ে দিতেই নজর যায় রান্নাঘরের দিকে।মূহুর্তের মধ্যেই তার সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়,মুখে চমৎকার একটা হাসি নিয়ে ক্লান্ত পায়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায় আঁধার।
আরোহী একটা কালো রংয়ের শাড়ি পড়ে পাক্কা গৃহিনীদের মতো শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুজে রান্না করছে। আঁধার মুগ্ধ চোখে তাকিয়েই আছে।
কালো শাড়ি,ঢিলে ঢালা চুলের খোঁপা। আবার কিছু কিছু চুল কপালে ও ঘাঁড়ে ঘামের কারণে লেপ্টে গেছে। মুখে বিন্দু বিন্দু ঘামের আভাস,দুই হাতে দু’টো মোটা মোটা স্বর্ণের বালা,গলায় ছোট একটা স্বর্ণের নেকলেস, চোখে গাঢ় কাজল দেওয়া। একদম অপরুপ সুন্দর লাগছে আরোহীকে,, আঁধারকে দেখেই যে কেউ বলে দিতে পারবে যে আরোহীকে দেখার পর,, এক বারের জন্যও সে চোখের পলক ফেলে নি কিংবা ঝাঁপটায় নি!
আঁধার যেনো একটা ঘোরের মধ্যেই চলে গেছে,আরোহীকে যে কেউ একজন খুঁটিয়ে খাঁটিয়ে দেখছে সেটা সে এখন অব্দি বুঝতেই পারেনি।
আঁধার ঘোরের মাঝেই আরোহীর পেছনে সামান্য দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে যায়।
হঠাৎ করেই দুটো হাত আরোহীর কোমড় জড়িয়ে ধরে আরোহী প্রথমে ভয় পেলেও পরে আঁধারের স্পর্শ চিনতে পেরেই থমকে যায়।ততোক্ষণে আঁধার আরোহীর চুলের খোঁপা খুলে দিয়েছে। আরোহীর হঠাৎ করেই হাসফাস লাগে, কিন্তু আঁধার তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তার খোলা চুলের ভাঁজে নিজের মুখ ডুবিয়ে দেয়।
আরোহী যেনো অনেকটাই কেঁপে উঠে, আঁধারকে কিছু বলবে বলবে করেও কিছু বলতে পারে না। তার মুখ দিয়ে শব্দগুলো আর উচ্চরণই হয় না,মনে হয় কন্ঠনালীতে কথাগুলো সব আঁটকে গেছে।
কিন্তু আঁধারের সে দিকে কোনো খেয়াল নেই। সে তার নাক মুখ অনবরত আরোহীর চুলের ভাঁজে স্পর্শ করতেই থাকে।আরোহী হাসফাস করতে করতে কোন রকম বলে উঠে,,
–‘ আ-আঁধার,’
–‘হু’
ঘোরের মধ্যেই আঁধার জবাব দেয়,,
আরোহী কি বলবে, কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। কোনো রকম থেমে থেমে বলে,,
–‘ছে-ড়ে দি-দি-ন না প্লি-জ।’
কিন্তু আঁধার আরোহীর কথা শুনতেই পারেনি। এরইমধ্যে আঁধারের হাতের বাঁধন আরও দৃঢ় ও শক্ত হয়।এতেই যেনো আরোহীর অজ্ঞান হওয়ার মতো অবস্থা! আঁধার আরোহীর অসস্তি আরও কয়েকগুন বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য আরোহীর চুলগুলো সরিয়ে ঘাঁড়ে ছোট ছোট চুমু দিতে শুরু করে।আরোহী এবার মনে হয় বরফের মতো জমে যায়, শাড়ির আঁচল শক্ত করে দু’হাত দিয়ে চেপে ধরে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়।
আঁধার যেনো ধিরে ধিরে আরোহীতেই মিসে যেতে চাচ্ছে, আরোহীর মনে হয় তার নিজের ও নিজের অনুভূতিগুলোকে সামলাতে কষ্ট হচ্ছে । ঠিক সেই মুহূর্তেই, আঁকলিমা চৌধুরীর গলা কানে ভেসে ওঠে আরোহী,,,
–‘আরো মা সব হয়ে গেছে তো?’
আরোহী এবার ভয়ে সিটিয়ে যায়, আঁধারের হাত সরাতে চেষ্টা করে,আঁধারকে ধাক্কা দিতে চেষ্টা করে কিন্তু বরাবরের মতোই ব্যর্থ হয়।
–‘আঁধার প্লিজ ছাড়ুন আম্মু আসছে,আঁধার? ‘
ভয়ে আঁধারের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে চেষ্টা করে কিন্তু আঁধারের কোন ভবাবেগ লক্ষ করে না আরোহী এতে।আঁধার যেনো আরও খানিকটা শক্ত করে চেপে ধরে আরোহীকে।
–‘উফফ আঁধার, এই আঁধারের বাচ্চা! ‘
আরোহীরে চেঁচিয়ে বলাতে আঁধারের খানিকটা হুস আসে কিন্তু আরোহীকে ছাড়ে না,,
–‘কি হয়েছে, সমস্যা কি তোমার?’
আঁধারের বিরক্তি নিয়ে বলা দেখে আরোহী নিজেও বিরক্ত হয়।
–‘আরো মা..’
আঁকলিমা চৌধুরী আরোহীর কথার উত্তর না পেয়ে আরোহীর কিছু হলো নাকি দেখার জন্য আসতেই আঁধার আর আরোহীকে এতো কাছাকাছি দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। তাই বাকি কথা সম্পূর্ণ না করেই উল্টো দিকে ঘুরে চলে যান।
আঁধার নিজেও মায়ের কন্ঠ পেয়ে তড়িঘড়ি করে আরোহীকে ছেড়ে উল্টো দিকে ঘুড়ে যায়, আর আরোহী বেঁচারি লজ্জায় নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। আঁকলিমা চৌধুরী চলে যেতেই আরোহী আঁধারের দিকে কঠিন চোখে তাকায়।
আঁধার বোকার মতো একটা হাসি দিয়ে কিছু বলবে তার আগেই আরোহীর রাশভারী কন্ঠে থেমে যায়।
–‘আপনি একটা অসভ্য, শুধু অসভ্য না লুচ্চা।’ আজকে আপনার জন্য শুধু মাত্র আপনার জন্য আম্মুর সামনে আমি আর লজ্জায় যেতে পারবো না! হায় আল্লাহ এই মুখ আমি কিভাবে দেখাব এখন।
কিছুক্ষণ হায় হুতাস করে আরোহী চুলাটা অফ করে,কঠিন চোখে আঁধারকে দেখে হনহনিয়ে চলে যায়,শুধু হনহনিয়ে না এক প্রকার দৌড়ে চলে যায়। ড্রয়িং রুমে আর আঁকলিমা চৌধুরী বা কাউকেই দেখতে পায় না। এতে সস্থির নিশ্বাস ছাড়ে আরোহী এতোক্ষণ যেনো দম বের হয়ে যাচ্ছিল তার।
কিন্তু আঁধার বেচারা কি করবে ভেবে পায় না।নিজেই নিজেকে ১০০ টা গালি দেয়,,, কি দরকার ছিলো এদিকে আসার, এখন আরোহী না জানি তাকে ডিটারজেন্ট ছাড়া ধুইয়ে দেয়! দুপুরে ঝগড়া করে বের হয়ে গিয়ে কি করলি আঁধার তুই এটা,নিজেই হেরে গেলি তো!
নিজের সাথে কিছুক্ষণ বকাবকি করে রুমের দিকে চলে যায়।কিন্তু রুমের সামনে গিয়েই দেখে দরজা বন্ধ, অবাক হয় না আঁধার কারণ সে জানতো আরোহী লজ্জা পেয়েছে প্রচুর। আজকে যে তার সামনে আসবে কি না এটাই সন্দেহের বিষয়! তবুও আরোহীকে কয়েকটা ডাক দেয়।
–‘আরু দরজা খুলো আমি ভিতরে যাব?’
–‘ভুলেও এ কথা স্বপ্নেও ভাববেন না আজকে আপনি,এ ঘরে তো আসার চেষ্টা ও করবেন না। ‘ আমি দরজা খুলবো না আপনি অন্য রুমে যান।
কঠিন কন্ঠে উত্তর দেয় আরোহী, আঁধার আর কি করবে চুপচাপ নিচে চলে যায়।কিন্তু নিচে গিয়ে আবার অসস্তিতে পড়ে যায়,সামনেই তার মা দাড়িয়ে আছে।
খানিকটা ঢোক গিলে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে আঁধার, কিন্তু মিসেস আঁকলিমা চৌধুরী চুপচাপ কিচেনে চলে যান। আঁধার সস্থির নিশ্বাস ফেলে সোজা বাহিরে চলে যায়, আর যাওয়ার আগে চেঁচিয়ে বলে যায়,,
–‘আম্মু বাহিরে যাচ্ছি আমি ফিরতে অনেক রাত হবে।’
আঁকলিমা চৌধুরী উত্তর দেন না৷ কারণ তিনি নিজেও অসস্তিতে পড়ে গেছিলেন ছেলে আর ছেলের বউকে ঐ অবস্থায় দেখে।তবে তিনি একটা ব্যাপার ভেবেই হেসে ফেললেন,
তার ছেলে যে বাবার কার্বণ কপি সেটা তিনি আগে থেকেই জানতেন কিন্তু আজকে একেবারে সিয়র হয়ে গেলেন।একই ঘটনা তার সাথেও ঘটেছিলো বিয়ের পর, সেটা মনে করেই তিনি শব্দ করে হেসে ফেললেন৷ আরোহী যে বর্তমানে আঁধারকে ঘরে ঢুকতে দেননি সেটা উনি ভালো করেই বুঝতে পারছেন কারণ তিনিও একসময় লজ্জায় এভাবে তারেক চৌধুরীকে ঘরে ঢুকতে দেননি!
স্ত্রীকে একা একা হাসতে দেখে তারেক রহমানকে ভ্রুকুঁচকে তাকিয়ে থাকেন, মূলত তিনি নিচেই নামছিলেন কিন্তু হঠাৎ সহধর্মিণীকে একা একা হাসতে দেখে তিনি অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকেন।
–‘কি ব্যাপার তুমি প্রেমে ট্রেমে পড়েছ নাকি?’
তারেক চৌধুরীর কন্ঠ শুনে পেছনে ঘুরে আঁকলিমা চৌধুরী দেখেন, তারেক চৌধুরী ভ্রুকুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে আছেন উত্তরের আশায়।
–‘কি যা তা বলছেন আপনি?’
বিরক্ত হয়েই বললেন আঁকলিমা চৌধুরী ।
–‘তাহলে একা একা এভাবে হাসছিলে কেনো?’মানুষ প্রেমে পড়লে তো একা একা কথা বলে হাসে কষ্ট পায় আমি নিশ্চিত তুমিও প্রেমে পড়েছ?
আঁকলিমা চৌধুরীর কথায় তারেক চৌধুরী এবার ছোট ছোট চোখ করে তাকায় ওনার দিকে আর বলে,,
–‘তুমি আমার কথা এড়িয়ে যাচ্ছো আঁকলি, তার মানে ডাল মে যারুল কুছ কালা হে!’ তুমি এই বয়সে এসে প্রেমে পড়েছ,আমার মতো একজন ভালোবাসার মানুষকে ভুলে অন্য করো প্রেমে তুমি পড়তে পারো না আঁকলি।একবার শুধু নামটা উচ্চারণ করে দেখো তার লাশ ফেলে দিবো আমি তোমার সামনে..
আর কিছু বলার আগেই আঁকলিমা চৌধুরী হনহন করে চলে যান উপরে, আর তারেক চৌধুরী বোকার মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন কিন্তু তার মনের সন্দেহ দূর হয় না তিনি ভাবেন,,
–‘সত্যি মনে হয় প্রেমে পড়েছে আমার বউটা, তাইতো কিছু না বলেই চলে গেলো!’ কে সেই লোক আমার খুঁজতে হবে আমার বউয়ের সাথে প্রেম করার শখ বের করবো তার আমি।
রাগে ফুঁসেতে ফুঁসতে তিনি ও বাহিরে চলে যান।বাহিরে গেলেও তার মূল উদ্দেশ্য হলো তার বউয়ের প্রেমিককে খুঁজে বের করা৷
আঁকলিমা চৌধুরী গিয়ে আরোহীর দরজায় নক করেন,,
–‘আরো মা, দরজা খুল একটু? ‘
মূহুর্তেই আরোহীকে অসস্তি ও লজ্জারা সব ঘিরে ধরে, কি করবে ভেবে পায় না সে।শাশুড়ী মা হয় তার আঁকলিমা চৌধুরী, দরজাটা না খুললে খারাপ দেখায় কিন্তু আর কিছু ভাববে তার আগেই আবার ডাক পড়ে তার,,
আরোহী আর কোন কিছু না ভেবেই দরজাটা খুলে দেয়,কারণ আঁকলিমা চৌধুরী তার গুরুজন দরজাটা না খুললে বেয়াদবি হবে। আর উনি যতোই না দেখার কথা বলুক কিন্তু আরোহী তো জানে উনি দেখেছে।
মিসেস আঁকলিমা চৌধুরী আরোহীকে দরজা খুলতে দেখেই হাফ ছেড়ে বাঁচেন, তিনি তো মনে করেছিলেন আজকে আর আরোহী দরজায় খুলবে না। আরোহীকে মাথা নিচু করে থাকতে দেখেই হাসেন উনি।
হেঁসেই বলেন,,
–‘জানিস এইরকম একটা পরিস্থিতিতে আমিও একসময় পড়েছিলাম,আর ঠিক তোর মতোই ঘরে দরজা দিয়ে বসে ছিলাম।’
নিজের শাশুড়ীর মুখে এমন ধরনের কথা শুনে আরোহী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
–‘কি রে অবাক হচ্ছিস যে,আমি কি টিপিকাল শাশুড়ীদের মতো তোর সাথে ব্যাবহার করি, যে তোর সাথে আমার এইসব কথা বার্তা বলা যাবে না!’
আরোহীকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখেই উক্ত কথাটি বলেন আঁকলিমা চৌধুরী।
আরোহী ডানে বামে মাথা নাড়ায় যার অর্থ না,মিসেস আঁকলিমা চৌধুরী এবার শব্দ করেই হেসে ফেলেন আর বলেন,,
–‘আমার শাশুড়ী মা ছিলেন খুব কড়া মানুষ তাই ভয়ে আমি দু’দিন ঘর থেকে বের হইনি জানিস, তখন আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার শাশুড়ী মা আমার ঘরে এলেন।’ আমি তো প্রথমে ভয়ে শেষ, কিন্তু তিনি আমার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এসব কোন ব্যাপার না।আর আমি তো তোমার শাশুড়ী মা, আমার কাছে কিসের লজ্জা বলো তো! আমি তো তোমার মা তাই না, মায়েদের কাছে লজ্জা পেতে নেই মা।
আরোহী অবাকের সাথে শুনছে তার শাশুড়ীর কথা আর ভাবছে,,
–‘আসলেই তো।’কিন্তু এমন শাশুড়ীও কি হয় পৃথিবীতে,কই সবাইতো বলে শাশুড়ীরা অনেক হিংসুটে হয়,রাত দিন কাজ করায়,খোঁটা দেয়?’
–‘জানিস সেদিন থেকেই আমি আমার শাশুড়ীর কাছে একদম নিজের মেয়েই হয়ে উঠলাম।’ ঠিক যেমনটা তুই আমার কাছে।
আরোহীর ভাবনার মাঝেই আঁকলিমা চৌধুরী কথাটি বলেন।
আরোহী একপ্রকার মুগ্ধ হয়েই তার শাশুড়ীকে জড়িয়ে ধরে। আঁকলিমা চৌধুরীর মনটাও অনেকটা হালকা হয়, তিনি নিজেকে এতোক্ষণ অপরাধী ভাবছিলেন।তার জন্য বেচারি মেয়েটা ঘরে দরজা আঁটকে বসে আছে।
–‘চল মা খেয়ে নিবি?’
–‘হুম চলো।’
এরইমধ্যে আঁকলিমা চৌধুরী আদর ও আলিশাকে ও ডেকে নিয়ে আসে। আরোহী আঁধারকে না দেখে ভ্রুকুঁচকায়,কিন্তু লজ্জায় কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারছে না।আঁকলিমা চৌধুরী আরোহীর কান্ডে হেসে দেয় আর বলে,,
–‘তুই যাকে খুঁজছিস সে বাহিরে গেছে ফিরতে রাত হবে বলে গেছে, তুই আয় বস খেয়ে নে।’
আরোহী লজ্জা পায় তার শাশুড়ীর কথায় তাই মাথা নিচু করে বসে পড়ে।তারেক চৌধুরীকে না দেখে এবার আঁকলিমা চৌধুরীর ভ্রুটা কুঁচকে যায়।তখনই ল্যান্ড লাইনে ফোন আসে,, আঁকলি চৌধুরী নিজেই রিসিভ করে,,
–‘হ্যালো?’
–‘আম্মু আমি আঁধার, আব্বু আর আমি একসাথে বাহিরে লাঞ্চ করবো!’
আঁধার আর কিছু বলতে দেয় না তার মাকে তার আগেই ফোন কেটে দেয়।আঁকলিমা চৌধুরী অবাক হলেও কিছু বললেন না,কারণ এমনটা প্রায় হয়ে থাকে।