নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে শীতের প্রকোপ বেড়েছে খানিকটা, সাথে কুয়াশা ও একটু বেশিই মনে হচ্ছে।
গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে আরোহী, ঠান্ডায় বার বার নিজেকে হাত দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করছে কিন্তু হাত দিয়ে কি আর ঠান্ডা কমানো যায়।
শেষ মেস ঠান্ডার কারণে আরোহীর ঘুম ভেঙে যায়। চোখ খুলতেই আঁধারকে না দেখে অবাক হয় আরোহী। বেলকনির দরজা সামান্য খোলা দেখে আরোহীর আর বুঝতে বাকি নেই আঁধার কোথায় আছে!
দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সবে মাত্র রাত তিনটার ঘরে ঘড়ির কাটা এসে থেমেছে! ধির পায়ে এগিয়ে যায় আরোহী বেলকনির দিকে।
বেলকনিতে রাখা দোলনায় আঁধারকে অফিসের ফাইল নিয়ে ঘুমাতে দেখে আরোহী তপ্ত শ্বাস ছাড়ে।লোকটা যে অফিসের কাজ করতে করতেই ঘুমিয়ে গেছে দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
চঞ্চল পায়ে আবার ঘরে চলে যায় আরোহী! একটা বালিশ ও কম্বল দিয়ে এসে আঁধারের মাথাটা বালিশের উপর রেখে গায়ে কম্বল জড়িয়ে দেয়।হাত থেকে ফাইলটা নিয়ে পাশের চেয়ারের উপর রেখে নিজে ও আঁধারের সাথে লেপ্টে শুয়ে পড়ে।
সামান্য একটু জায়গা ও নেই আর ঐটুকু দোলনায় কি আর দুজন মানুষের জায়গা হয়!তবুও আরোহী চিপকে শুয়ে আছে,সামান্য নড়লেই যে সে পড়ে যাবে সেদিকে তার কোন খেয়াল নেই।
ঘুমের মাঝেই আঁধার দু’হাতে ঝাপটে ধরে আরোহীকে।এতে যেনো নিশ্চিত হয় আরোহী সে আর পড়বে না।তবুও নড়াচড়া করে আঁধারের সাথে আরও খানিকটা লেপ্টে শুয়ে থাকার চেষ্টা করে।
আরোহীর নড়াচড়ার কারণে এবার আঁধারের ঘুম ভেঙে যায়, পিটপিট করে যখন সে আরোহীকে ও খোলা আকাশের দিকে নজর দেয় ভ্রুকুঁচকে যায় তার।
আরোহীর সে দিকে কোন খেয়ালই নেই সে আঁধারের সাথে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
হঠাৎ করেই আঁধার আরোহীকে টেনে তার উপরে শুইয়ে দেয়,হঠাৎ করেই ঘটনাটা হওয়ার কারণে আরোহী ভয়ে আঁধারে দুহাত দ্বারা ঝাপটে ধরে।
নিজের ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য, আঁধার একটা হাত দোলনার ফাঁক দিয়ে বের করে দিয়ে দোলনার গ্রিল ধরে নেয়। আর একটা হাত দিয়ে আরোহীকে ভালো করে ধরে যেনো পড়ে না যায়।
আরোহী তখনো ভয়ে আঁধারকে ঝাপটে ধরেই আছে!
–‘আরুপাখির কি এখন আর আমায় ছাড়া একা থাকার ইচ্ছে করে না নাকি, যে এইটুকু দোলনায় ও লেপ্টে শুয়ে পড়েছো!’
হঠাৎ কানের কাছে ফিসফিস করে কথাটা বলে উঠে আঁধার। কথাটার মানে বুঝতেই কেঁপে উঠে আরোহী!আঁধারের বুকের সাথে লেপ্টে যায় আরও খানিকটা। চোখ বুঝে এবার মিনমিন করে বলে আরোহী,,,
–‘ঘুমান তো!’
–‘ঘুম নষ্ট করে এখন বলছো ঘুমাবো,হাহ্ আমি এতোটা ও আনরোমান্টিক নই আরুপাখি! ‘
আবার ফিসফিস করে বলে আঁধার,,, আরোহী মাথাটা সামান্য তুলেই চোখ পাকিয়ে তাকায় আঁধারের দিকে।আঁধার শয়তানি হাসি দিয়ে বলে,,,,
–‘আমার কি দোষ বলো,তুমি তো নিজেই চলে এসেছো!’ এখন বউয়ের আবদার কি আর ফেলে দেওয়া যায় বলো?
আরোহী আঁধারের মিথ্যে বলার ভঙ্গি দেখে হতভম্ব হয়ে যায়, সে কি আর সেই কারণে এসেছে নাকি!সে তো আঁধার একা থাকলে যদি কোনো পেতনী বা শাঁকচুন্নি এসে নিয়ে যায় তাই এসেছে।
কিন্তু এই অসভ্য লোকটার মাথায় সবসময় অসভ্য অসভ্য কথা বার্তা ঘুরে একে আর সে কিভাবে বুঝাবে।
আঁধার আরোহীর চোখের দিকে গভীর চাহনিতে তাকায়, আরোহী নিজেও আঁধারের চোখের চাহনিতে নিজেকে হারানো শুরু করে।
এক পর্যায়ে আঁধার ধিরে ধিরে আরোহীর দিকে ঝুঁকে যেতে শুরু করে,আরোহী নিজেও গভীর চাহনিতে আঁধারের দিকে তাকিয়ে থাকে।
আঁধার যখন আরোহীর ওষ্ঠের ভাজে নিজের ওষ্ঠের স্থাপন করবে, ঠিক সেই মুহূর্তেই আরোহী আঁধারকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।
আর নিজে উঠে দৌড়ে ভেতরে চলে যায়।আঁধার সামান্য ব্যাথা পায় মাথায়!তবে সে সবে মাথা না ঘামিয়ে সে ও আরোহীর পেছন পেছন ছুটে চলে যায় দেখার জন্য।
আরোহী ওয়াশরুমে ঢুকে ইচ্ছে মতো বমি করে ক্লান্ত হয়ে যখন ঢলে পড়বে, ঠিকে সেই মুহূর্তে আঁধার আরোহীকে ধরে ফেলে।আরোহীর নাজেহাল অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে যায় আঁধার।
–‘আরু, আরু তুমি ঠিক আছো?’ এই আরু,আরু?
আঁধারের বিচলিত কন্ঠে আরোহী পিটপিট করে চোখ খোলার চেষ্টা করে কিন্তু সফল হয় না!
আঁধার যেনো এবার একটু বেশিই ভয় পেয়ে যায়,,,
–‘এই আরু কথা বলছো না কেনো?’ আরু? প্লিজ কথা বলো আরুপাখি?
অনেক কষ্টে এবার চোখ খুলতে সক্ষম হয় আরোহী, ধির কন্ঠে বলে উঠে,,,
–‘আ-মি ঠি-ক আ-ছি! ‘
আরোহীর ভাঙ্গা কন্ঠেস্বর শুনে এবার আঁধার একটু হলেও শান্ত হয়।আরোহীকে ধরে চোখ মুখে পানি দিয়ে কোলে তুলে নেয়।
রুমে এসে শুয়ে দিয়ে একটা টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিয়ে, পাশে বসে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,,,,
–‘সারাদিন খাও নি তুমি?’ নাকি আজেবাজে কিছু খেয়েছো? হঠাৎ বমি হওয়ার কারন কি বলো তো?
–‘কি জানি, আমার খুব ঘুম পাচ্ছে আঁধার!’
ক্লান্ত কন্ঠ আরোহীর, আঁধার এবার নরম স্বরে বলে,,,
–‘আচ্ছা ঘুমাও তুমি!’
–‘একা?’
আরোহীর কথা শুনে আঁধার নির্দ্বিধায় তার পাশে শুয়ে আরোহীর মাথায় হাত বুলায়।আরোহী এবার আঁধারের একটা হাত শক্ত করে ধরে চোখ বুঝে ঘুমানোর চেষ্টা করে।
!
!
সকালে,,
ব্রেকফাস্টের জন্য টেবিলে সকলে একসাথে বসে আছে শুধু মাত্র আরোহী ও আঁধার বাদে।সকলে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে এরইমধ্যে আঁধারকে একা সিরি দিয়ে নামতে দেখে ভ্রুকুঁচকায় সকলে।
–‘আমি আমার চ্যাম্পদের নাম ঠিক করেছি,!’যে আগে হয়েছে মানে আমার কোলে যেটা আছে তার নাম হবে, তাহশিফ আফনান চৌধুরী, আর শিহাবের কোলে যে আছে তার নাম হবে তাহমিদ আদনান চৌধুরী।
–‘মাশাআল্লাহ!’
সকলে একসঙ্গে বলে উঠে। আঁধার নিজেকে নিজেই বাহবা দেয়। সকলে আঁধারের প্রশংসা করে, কারণ নামগুলো সকলের কাছেই ভালো লেগেছে।
!
!
নীলিমা,সোহেল,রাতুল, তরী সকলে একসাথে দেখতে এসেছে আলিশা ও আদরের ছেলেদের।
সাথে বিভিন্ন ধরণের খেলনা ও কাপড় নিয়ে এসেছে।আলিশার ছেলেদের জন্য চৌধুরী পরিবারে সকলে অনেক খুশি হয়ে আছে।
এরইমধ্যে সাহফিফের আগমন ঘটে, সে এসেই সকলের সাথে গল্পে মেতে উঠেছে।
চৌধুরী পরিবারে এখন সকলের মনে উৎসব লেগে রয়েছে, এই তো কখনো সকলে একসাথে গল্প করছে আবার কখনো একসাথে হেঁসে উঠছে,আবার কখনো বা সকলে একসাথে চেঁচামেচি করছে।
আরোহী, আঁধার ও রাহি-শিহাবের তো সবসময় ঝগড়া লেগেই রয়েছে। তারা বাচ্চার কে কি হবে চাচী হবে না খালামনি হবে আর ছেলেরা চাচ্চু হবে নাকি খালু সেটা নিয়ে।
তাদের ঝগড়া দেখে সকলেই অতিষ্ঠ হয়ে গেছে।
!
!
রাতে,,
আরোহীর আজকে সকাল থেকেই মাথা ঘুরছে, হঠাৎ করেই কালকের মতো বমি বমি পাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে আরোহী, এরইমধ্যে আঁধার রুমে ঢুকেই আরোহীকে শুয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়।
গোধুলির বিকেলে নীল শাড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে এক রমনী, ফাঁকা মাঠে সে ছাড়া হাতে গোনা কয়েকজনের অস্তিত্ব এতোক্ষণে দেখা না গেলেও এখন দেখা যাচ্ছে!
তবে সকলেই জোড়া জোড়া,হয়তো কেউ বয়ফ্রেন্ডের সাথে এসেছে নয়তো বা কেউ স্বামী কিংবা বন্ধু বান্ধবের সাথে এসেছে! পার্কের ছোট ছোট বসার স্থান গুলোর একটিতে বসে বার বার হাত ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে রমনীটি!
চোখ মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট তার! এরইমধ্যে কোথা থেকে একজন দৌড়ে এসে রমনীটির সামনে দাঁড়ায়, তবে রমনীটি অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আঁধার মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে ধপ করে আরোহীর পাশে বসে পড়ে।
আরোহী অভিমানে আবার অন্যদিকে ফিরে তাকায়।আঁধার নিজেকে স্বাভাবিক করে আরোহীর শাড়ির আঁচল টেনে নিয়ে নিজের মুখ ও গলার ঘামগুলো মুছে নেয়।
আরোহী ভ্রুকুঁচকে একবার তাকিয়ে শাড়ির আঁচল টেনে নিজের কাছে নিয়ে নেয়।আঁধার অবাক হয় না,আরোহী যে মুখ ফুলিয়ে রেখেছে তার কারণেই এমন ব্যাবহার করছে!
–‘সরি আরুপাখি!’
দু’হাতে কান ধরে মুখটা অসহায় করে কথাটা বলে আঁধার।
আঁধারের মুখ দেখে আরোহীর হাসি পেলেও হাসে না আরোহী, হাঁসি চেপে মুখটা অন্যদিকে করে বসে পড়ে।
–‘ও আরু, আরু!’আরে শুনো না!
আঁধারের আদরের ডাক শুনে আরোহীর পুরো শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে! আঁধারের ডাকে কিছু একটা ছিলো যেটা শুনে আরোহীর ভেতরের অভিমান সহ সবকিছু গলে যায়।নিজের অজান্তেই বলে উঠে,,,
–‘হুম!’
–‘আসলে রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিলো তাই এতো লেট হলো,জানোই তো ঢাকা শহরের জ্যাম!’
–‘এই নেন আপনার পাঞ্জাবি, আমি জানতাম আপনি ভুলেই যাবেন! ‘
একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলে আরোহী। আঁধার মাথা চুলকিয়ে বলে,,,
–‘ব্যাস্ততার কারণে মনে ছিলো না তো,আচ্ছা বাদ দাও চলো চলো লেট হয়ে যাচ্ছে তো!’ আমি গাড়িতে চেঞ্জ করে নিবো।
আরোহী গোমড়া মুখে খানিকটা হাসি ফুঁটিয়ে সম্মতি জানায়।আঁধার আরোহীর একটা হাত শক্ত করে ধরে এগিয়ে যায়।
–‘লাগিয়ে দাও!’
গাড়িতে বসেই শার্ট চেঞ্জ করে আরোহীকে বোতাম লাগানোর উদ্দেশ্যে কথাটা বলে আঁধার। আরোহী মুচকি হেসে এগিয়ে যায়।
–‘যদি কখনো আমি না থাকি তখন কে লাগিয়ে দিবে শার্টের বোতাম?’
আরোহীর কথা শুনে আঁধার ভ্রুকুঁচকে বলে,,,
–‘কোথায় যাবা?’
–‘বেঁচে যদি না থাকি!’
–‘তাহলে মরে যাবো!’
আঁধারের কথা শেষ হওয়ার আগেই মুখে হাত দিয়ে চেপে ধরে আরোহী। আঁধার আরোহী চেপে ধরা হাতেই চুমু দেয়,ফঁট করে হাত সরিয়ে নেয় আরোহী।
আরোহীর দুগালে নিজের দুই হাত দ্বারা আবদ্ধ করে আবেগি গলায় বলে উঠে আঁধার,,,,
–‘আরু আমি তোমার সাথে হাজার বছর বাঁচতে চাই না,যুগ যুগ বাঁচতে চাই না, তবে আমি তোমার সাথে আমার সুখ ও দুঃখের দিনগুলোতে বাঁচতে চাই। তোমায় নিয়ে স্বপ্নের শহরে যেতে চাই না তবে,নিজের এই শহরেই তোমায় নিয়ে স্বপ্নের দেশের মতো বাঁচতে চাই। আমার ভালোবাসায় তোমায় এমন ভাবে রাঙ্গাতে চাই।যেনো আমায় ছাড়া তোমার যেমন বেঁচে থাকতেও কষ্ট হয়,তেমনি আমায় ছাড়া যেনো তোমার মরতে ও কষ্ট হয়। আমি আমার ভাগের আয়ুগুলো দিয়ে তোমার দীর্ঘায়ু কামনা করতে চাই না রবের কাছে তবে আমি আমার ঐ রবের কাছেই তোমার সাথে বাঁচার জন্য দোয়া কামনা করি আরু।আমি তোমার সাথে বাঁচতে চাই,তুমিহীন আমি মরেও শান্তি পাবো না আরু।আরোহী হীন এই আঁধারের অস্তিত্ব কামনা করা ও যদি বোকামি হয়ে থাকে তাহলে আমি সেই বোকা আঁধারই থাকতে চাই আরুপাখি তবুও তুমিহীন আমার অস্তিত্ব ও অনুভব করতে চাই না!কখনোই না।
আঁধারের কথা শুনে আরোহীর চোখ দিয়ে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে! শক্ত করে আঁধারকে জড়িয়ে ধরে আরোহী, আঁধার নিজেও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আরোহীকে।
আরোহী হঠাৎ করেই কাঁধ ভেজা অনুভব করে,অবাক হয়ে সরে আসতে চেষ্টা করে কিন্তু আঁধার হাতের বাঁধন আরও শক্ত করে। আরোহী অস্ফুট স্বরে বলে,,,,
–‘কাঁ-দ-ছে-ন কে-কেনো আঁ-ধার?’
আরোহীর কথা স্পষ্ট বোঝা না গেলেও আঁধার একটু হলেও বুঝতে পারে তাই চোখের পানি মুছে নিয়ে বলে,,,
–‘কই না তো!’
–‘আমি…’
–‘হুস, আর কোনো কথা না!’
আরোহীকে ছেড়ে দিয়ে নিজের যায়গায় ঠিকঠাক মতো বসেই বলে আঁধার।
–‘কিন্তু… ‘
–‘হুস বললাম না আর একটা ও কথা না!’
একটু ঝুঁকে আরোহীর মুখে ফুঁ দিয়েই সরে গিয়ে গাড়ি স্টার্ট করে আঁধার। আরোহী না চাইতেও চুপ হয়ে যায়।
!
!
–‘আপনাকে এতো সহজে আমার বাবা মেনে নিলো কিভাবে?’
ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই রাহির এমন প্রশ্ন শুনে অবাক হওয়ার কথা হলেও অবাক হয় না শিহাব। ঠোঁটে রহস্যময় হাসি এনে বলে শিহাব,,,,
–‘আমার মতো এমন একটা হ্যান্ডসাম চাম্রিং বয়কে দেখলে যে কোনো মেয়ের মাথা নষ্ট হবে, আর সেখানে তো মেয়ের বাবা?’ তোমার বাবা ভাবছেন আমার মতো একটা শান্ত শিষ্ট ভদ্র ছেলেকে তার মেয়ের জামাই হিসেবে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।তাই আর কোনো কাহিনি করলেন না বুঝলে!
রাহি হা করে তাকায় শিহাবের দিকে,মানুষ এমনও হয়? নিজের প্রশংসা নিজেই করছে আর গর্বে আকাশে উড়া উড়ি করছে?
রাহির ভাবনার মাঝেই শিহাব রাহিকে ঘুরিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,,,
–‘খুব শখ না তোমার অন্যজনের বউ হওয়ার,অন্য ছেলের সামনে সেজেগুজে চেহারা পেট পিঠ দেখানোর জন্য বসে থাকো শাস্তি তো পেতেই হবে তাই না!’
রাহির কলিজা কেঁপে উঠে, শিহাব সম্পর্কে তার এই কয়েকদিনে একটু হলেও ধারণা হয়ে গেছে তাই মনে মনে ভয় পাচ্ছে সে।
গলায় শক্ত কামড়ের কারণে চোখ মুখ শক্ত করে চেঁচিয়ে উঠে রাহি।শিহাব মুখ চেপে ধরে রাহির,পরমুহূর্তেই কামড়ের জায়গায় ছোট ছোট চুমুর আভাস পেয়ে শরীর ঠান্ডা হয়ে যায় রাহির।
#চলবে?
#নীল_ডায়েরির_সেই_মেয়েটি
#আরদ্ধিতা_রুহি
#পর্বঃ৩৬
🍁
স্নিগ্ধ সকালে ছাঁদের রেলিং ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছে আরোহী!দৃষ্টি তার বরাবরের মতোই দূরে অজানা কোথাও একটা,তবে কোথায় সেটা হয়তো আরোহীর ও অজানা!
কিছুক্ষণ পরে দুটি পায়ের শব্দ এসে তারই পাশে স্থান দখল করলো,কিন্তু আরোহী নির্বিকার! গলা খেঁকারি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষন করার চেষ্টা করলো আদর, সফল ও হলো বটে!
আরোহী ঘুরে তাকিয়েই একটা স্নিগ্ধতার হাসি দিয়ে আগের মতোই অজানায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।আদরের বুকে চিন চিন একটা ব্যাথা শুরু হলো।একসময় এই হাসি দেখেই সে ঘায়েল হয়ে যেতো, কিন্তু এখন আর হয় না!
হলেও সেটা পাপ হবে তার জন্য কারণ আরো তো এখন তারই বড় ভাইয়ের বউ।কষ্ট হয় না এখন আর আদরের কারণ আরোহী তার ভাগ্যে ছিলো না।
তবে মাঝে মাঝে আরোহীকে তার ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে হয়, আজকে আরোহীর জন্যই হয়তো সে আলিশাকে পেয়েছে। মেয়েটা আগে যেমন ছিলো এখন শুধু মাত্র তার জন্যই নিজেকে বদলে নিয়েছে।
তবুও আরোহীকে সে ভালোবাসতো তাই মনের মধ্যে একটু হলেও ব্যাথা হয়।এইসব ভেবেই আদর চোখের কোণে জমা পানিটুকু নিঃশব্দে মুছে নিলো,সে চায় না তার ব্যাথাটা কাউকে দেখাতে।
পৃথিবীর কাউকেই তার মনের কথা জানাতে চায় না।থাক না কিছু কথা গোপনেই, থাক না কিছু ভালোবাসা দূর থেকেই।তবে সেটা শুধু মাত্র আরোহীর ক্ষেত্রেই আলিশার ক্ষেত্রে না।ভেবেই হেসে ফেলে সে!
সে মনে প্রাণে চায় আলিশার সাথে সুখে থাকতে তবে ভালোবাসা জিনিসটা অদ্ভুত! এই তো ধিরে ধিরে আলিশাও তার মনে একটা জায়গা করে নিচ্ছে। সেটাকে কি ভালোবাসা বলে?
হয়তো, আলিশাকে এক পলক না দেখলে তার মনে ব্যাথা শুরু হয়ে যায়,সে চায় তার সবটুকু ভালোবাসা আলিশাকে উজাড় করে দিতে, কিন্তু তবুও আরোহীর প্রতি তার মনে একটা কিছু রয়েই গেছে।
মাঝে মাঝে মনে হয় সে কি আলিশাকে সবটুকু দিয়ে ভালোবাসতে পারবে? মন থেকে কি আদোও ভালোবাসতে পেরেছে সে, হু পেরছে।
আলিশা মেয়েটা চমৎকার, হয়তো আরোহীর মতো না তবুও তাকে ভালো না বেশে থাকা কি আদোও যায়? উহু যায় না।আদর ও হয়তো পারছে না!
–‘কিছু বলবে ভাইয়া!’
নিরবতা ভেঙে আরোহী নিজে থেকেই বলে উঠে।
আদর চমকে তাকায় আরোহী দিকে,আরোহীকে নিজের দিকে তাকাতে দেখে মিষ্টি হেসে বলে,,,,
–‘এসেছিলাম একা কিছু সময় কাটাতে তবে তোমায় একা একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনে হলো দু’জন মিলে আড্ডা দেওয়া যাক!’
সকলে নিজ নিজ জীবন নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পরেছে।আঁধার ও আদরের অফিসের আজকে প্রথম দিন!
আঁকলিমা চৌধুরী সকাল থেকেই ব্যাস্ত সাথে আরোহী আর লিমাও টুকটাক সাহায্য করছে।আঁকলিমা চৌধুরীর মতে তার ছেলেদের অফিসের প্রথম দিন তিনি নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াবেন।
তাই তো সকাল সকাল তিনি কাজে লেগে পড়েছেন, আরোহী শাশুড়ীর বাচ্চামো দেখে মনে মনে হেঁসে লুটোপুটি খাচ্ছে! তার শাশুড়ী বর্তমানে একটা ছোট বাচ্চার মতো আচরণ করছে তার ছেলেদের প্রথম অফিস যাওয়া নিয়ে।
আঁকলিমা চৌধুরী আরোহীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,,,
–‘আরো মা তুই গিয়ে ফ্রেস হয়ে নে, ঘেমে নেয়ে এ কি অবস্থা হয়েছে তোর!’
আঁকলিমা চৌধুরীর হাত থেকে মরিচের বাটিটা নিতে নিতে বলে আরোহী।
–‘তা কি করে হয় মা আমি থাকতে তুই এসব করবি কেনো?’
–‘সেম কথা তো আমি ও তোমায় বলতে পারি আম্মু!’
আরোহীর কথা শুনে আঁকলিমা চৌধুরী এবার হেঁসে ফেলেন।
–‘আচ্ছা সব তো হয়ে গেছে, তুই এখন গিয়ে আঁধারের কি লাগবে না লাগবে সেটা দেখ না যা!’
–‘কিন্তু আমি তো সব রেডি করেই রেখে এসেছি!’
–‘আরু একটু উপরে এসো তো!’
আঁধারের চিৎকারে মুখটা ছোট হয়ে যায় আরোহীর।আঁকলিমা চৌধুরী এবার শব্দ ছাড়াই হেঁসে উঠেন।
–‘যা নাহলে আবার ডাকবে তো!’
–‘আরু!’
আঁকলিমা চৌধুরীর কথাটা শেষ হওয়ার সাথে সাথে আবার আঁধারের ডাক ভেসে ওঠে।
–‘কি হলো যা?’
আঁকলিমা চৌধুরীর জোড়াজুড়িতে বাধ্য হয়ে আরোহী উপরে আসে।রুমের ভেতরে ঢুকতেই দু’টো হাত তাকে টেনে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে।
আরোহী ভয় পেয়ে গেলেও মুখে প্রকাশ করে না কিছু!
–‘কখন থেকে ডাকছি?’
–‘আসছিলাম তো!’
আরোহীর ভাবলেশহীন উত্তর। আঁধার ছোট ছোট চোখ করে তাকায় আরোহীর দিকে।আরোহী ভরকে যায়,আমতা আমতা করে বলে,,,
–‘কি!’
–‘কতো বার ডাকতে হয়েছে তোমায় আর তুমি বলছো আসছিলে?’
–‘না মানে কাজ করছিলাম তো তাই আর কি!’
–‘হুম, এখন আমার শার্টের বোতাম গুলো লাগিয়ে দেও লেট হয়ে যাচ্ছে! ‘
আরোহীকে ছেড়ে কথাটা বলে আঁধার, আরোহী ভ্রুকুঁচকায়,,,
–‘কেনো আপনার হাতে কি হয়েছে?’
–‘আমার হাতে আবার কি হবে?’
ভ্রুকুঁচকে বলে আঁধার।
–‘তাহলে শার্টের বোতাম লাগানোর জন্য আমায় ডাকলেন যে?’
আরোহীর কথা শুনে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায় আঁধার তার দিকে। হঠাৎ আঁধারকে এভাবে তাকাতে দেখে ভড়কে যায় আরোহী!
–‘আগে দাও তারপর বলছি!’
আঁধারের কথা শুনে অগত্যা আরোহী বোতাম গুলো লাগানো শুরু করলো!
–‘বউয়ের দায়িত্ব বরের শার্টের বোতাম লাগিয়ে দেওয়া!’
প্রথম বোতামটা লাগানোর পর পরই আঁধারের মুখে এই ধরনের কথা শুনে হঠাৎ আরোহীর হাসি পায়,কিন্তু না হেসে নিজেকে স্বাভাবিক করেই দ্বিতীয় বোতাম লাগানো শুরু করতেই আঁধার সামান্য ঝুঁকে আসলো আরোহীর দিকে।
হঠাৎ হওয়াতে আরোহী ভয় পেয়ে দু কদম পিছনে পিছিয়ে যায়! আঁধার সামান্য হেঁসে আরোহীর কোমড় জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নিয়ে আসে।
–‘তুমি কন্টিনিউ করো! ‘
আরোহী আবার কাঁপা কাঁপা হাতে বোতাম লাগাতে শুরু করে,আঁধার টুপ করে পর পর দুবার আরোহীর গালে চুমু খায়।
আরোহীকে নিজের দিকে বাঁকা চোখে তাকাতে দেখে মাথা চুলকিয়ে বলে আঁধার,,,
–‘তোমার গাল গুলো না একদম টমেটোর মতো দেখলেই আদর আদর পায় আমার কি দোষ বলো আমি তো ইনোসেন্ট একটা বাচ্চা মাত্র!’
আরোহী কিছু না বলেই সব কয়টা বোতাম লাগানো শেষ করে,সরে আসতে গেলেই আঁধার চেপে ধরে। আরোহী একটা ভ্রু উঁচু করে বলে,,,
–‘আবার কি?’
–‘প্রথম দিন অফিসে যাচ্ছি মিষ্টি মুখ করবো না!’
–‘ফ্রিজে আছে আমি নিয়ে….. ‘
আর কিছু বলতে পারে না আরোহী, আঁধার তার মুখ বন্ধ করে দিয়েছে। প্রথমে হতবম্ভ হলেও পরে আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে যায় আরোহীর।
কিছুক্ষণ পরে আরোহী নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে কিন্তু আঁধার যেনো ততোই আরও খানিকটা আঁকড়ে ধরছে তাকে।
আরোহীর দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, নিশ্বাস নিতে পারছে না ঠিক মতো সে আর এদিকে আঁধার ছাড়ার নামই নিচ্ছে না।
আঁধারকে ছাড়ানোর জন্য ধাক্কাচ্ছে আরোহী, আঁধার এবার নিজে থেকেই ছেড়ে দেয়।আরোহী হাফাতে থাকে,বড় বড় দম ছাড়তে থাকে সে।
–‘এখনো ঠিক মতো কিস করতে শিখলে না!’
আরোহী কিছু না বলেই পাশের টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি ঢক ঢক করে খেয়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে।
!
!
আদর রেডি হচ্ছে আর আলিশা তাকে খুঁটিয়ে খাঁটিয়ে দেখছে।আদর রেডি হওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আলিশার দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছে, তবে আলিশা সেটা এখন অব্দি খেয়াল করে নি।
আদর রেডি হয়ে আয়নায় আর একবার নিজেকে ভালো করে দেখে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে আলিশার কাছে যায়।
আলিশা তখন ও একদৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আদর এভাবে আলিশাকে তার দিকে তাকাতে দেখে একটা শুকনো কাশি দেয়,আলিশা চমকে উঠে তবে বুঝতে না দিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।
–‘এভাবে কি দেখছিলে?’
–‘কই কিছু না তো!’
আলিশার আমতা আমতা করে কথা শুনে মনে মনে বাঁকা হাসে আদর।
–‘সত্যি কিছু না?’
–‘হ্যা হ্যা!’
–‘আমাকে আজকে ভিষণ সুন্দর লাগছে তাই না?’
আদরের কথা শুনে চোখ মুখ কুঁচকে বলে আলিশা,,,
–‘কঁচু লাগছে, একদম ভালো লাগছে না এই শার্টে তোমায়!’
–‘আমি কেনো জেলাস হতে যাবো?’ তোমায় দেখতে এতোই বাজে লাগছে না আদর মানুষ দেখলেই পালিয়ে যাবে তাই চেঞ্জ করতে বললাম।’ হে হে
সামান্য হাসার চেষ্টা করে বলে আলিশা।
–‘তাহলে আমি তো এটাই পরেই যাবো! ‘
–‘আদরের বাচ্চা! ‘
একটা বালিশ ছুঁড়ে মারে আদরের দিকে আলিশা।
!
!
গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাহি,তার পাশেই অগ্নিরুপে দাঁড়িয়ে আছে শিহাব! রাহি হতভম্বের ন্যায় সকলের দিকে তাকিয়ে আছে, তবে শিহাব ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে!সকলে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে!
–‘এই ছেলে তোমার সাহস হয় কি ভাবে আমার মেয়ের গায়ে হাত তোলার?’ কে তুমি?
–‘আমি কে সেটা নাহয় পরে জানবেন এখন বলেন তো এনারা কারা?’
–‘ওরা আমাদের আত্মীয় হয় আমার মেয়েকে দেখতে এসেছে, তুমি কে? ‘ ভারী বেয়াদব তো তুমি, আমারই বাড়িতে এসে আমার মেয়ের গায়ে হাত তুলছো?
ক্রোধের সহিত কথাটা বলেন রিয়াদ আজমল।
–‘আমি আপনার জামাই শশুর মশাই, আপনার একমাত্র মেয়ের জামাই।’
শিহাবের কথা শুনে সকলে অবাক হয়ে যায়।
–‘কি যা তা বলছো আপনি মাথা ঠিক আছে তো?’ রাহি আমার হবু বউ, এই ধরনের মজা কেনো করছেন ভাই?
মিলন অর্থাৎ রাহির হবু স্বামী কথাটা বলে,কিন্তু কথাটা বলার পর পরই রাহির গালে আবার একটা চড় পড়ে।রাহি টলমল চোখে শিহাবের দিকে তাকায় তবে শিহাবের মায়া হয় না।
#চলবে?
#নীল_ডায়েরির_সেই_মেয়েটি
#আরদ্ধিতা_রুহি
#পর্বঃ৩৪
🍁
ভালোবাসা ও মায়া এই দুটি শব্দ অনেক সাধারণ হলেও শব্দগুলো মূল্য অনেক! যারা মূল্য দিতে পারে তারা শব্দ দু’টি ভালো ভাবে উপলব্ধি করতে পারে!
আর যারা দিতে পারে না কিংবা দেয় না তারা হয়তো উপলব্ধি করতে পারে না।কেউ বা পরিস্থিতির কারণে মূল্য দিতে পারে না আর কেউ বা ইচ্ছে করেই দেয় না।
এই যেমন বর্তমানে শিহাবের কাছে মনে হচ্ছে রাহি ইচ্ছে করেই এমনটা করলো।তবে আসলেই কি তাই, মোটেও না! বাবার ভয়ে ছেলে পক্ষের সামনে এসেছিলো ঠিকই রাহি তবে তার মন পরে ছিলো শিহাব চৌধুরীর কাছেই।
মেহমান চলে গেলেই সে জানিয়ে দিতো তার বাবাকে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা তবে এতো কিছু যে ঘটে যাবে সেটাই বা কে জানতো।
ইতিমধ্যেই শিহাবের অনেক কয়টা থা’পড় খেয়েই ফেলেছে সে,অথচ শিহাবের মনে না আছে কোন অনুশোচনা আর না আছে প্রিয়তমার গায়ে হাত তুলার অভিমান কিংবা কষ্ট।
তার ভেতর হয়তো এখন দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে, তাই তো রাহিকে না কিছু বলতে দিচ্ছে নাই বা বাকি সবাইকে!
–‘কে এই ছেলে রাহিয়ানা?’ আর তুমিই বা কিছু বলছো না কেনো ওকে?
রাহির বাবা ক্রোধে চিৎকার করে বলে উঠেন,,,
রাহি শুঁকনো ঢোক গিলে কিন্তু কিছু বলতে পারে না।শিহাব শক্ত চোখে রাহির দিকে তাকায়।
–‘এই ছেলে হয়তো রাহিকে ডিস্টার্ব করে আঙ্কেল দেখছেন না বখাটেদের মতো এসে মারপিট করছে!’ একে বের করে দেন আঙ্কেল!
মিলনের কথায় কড়া চোখে তাকায় তার দিকে রাহি!রাহিকে এভাবে তাকাতে দেখে ভড়কে যায় মিলন।রাহির বাবা অবাক হয় রাহিকে এভাবে তাকাতে দেখে।
–‘সুইটহার্ট বলো হু এ্যাম আই!’
বাঁকা হেসে বলে উঠে এবার শিহাব।
–‘বাবা ও শিহাব তোমাদের জামাই!’
কথাটা বলেই চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নেয় রাহি।
–‘কিহ!’
একসাথে সকলে চিৎকার করে উঠে! শিহাব নিজের কান চেপে ধরে ধপ করে পাশের সোফায় বসে পড়ে।
–‘এসব কি হচ্ছে এখানে ভাই আমরা কি এখানে তামাশা দেখার জন্য এসেছি!’
মিলনের বাবা রাগে ফুঁসে উঠে বললেন।
–‘আপনারা এখন আসতে পারেন ভাই!’
রাহির বাবার কথা শুনে সকলে অবাক হয়।
–‘মানে কি বলছেন আঙ্কেল? ‘
–‘তোমাদের যেতে বললাম তো!’
অপমানে আর একটা বাক্য ও ব্যায় করলো না তারা ফুঁসতে ফুঁসতে চলে গেলো।
–‘এই ছেলে এদিকে আসো!’
রিয়াদ আজমলের গম্ভীর কন্ঠে শিহাব ভদ্রতার সহিত উঠে তার কাছে চলে যায়।
–‘তুমি সত্যি আমার মেয়ের জামাই? ‘
–‘আসসালামু আলাইকুম বাবা আমি আপনার একমাত্র জামাই!’
শিহাবের কথা শুনে রিয়াদ আজমল উচ্চস্বরে হেঁসেই সালামের জবাব দেন।
–‘ওয়ালাইকুম আসসালাম!’ বসো বসো বাবা।
রাহি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার বাবা ও শিহাবের দিকে।শিহাব হেঁসে রিয়াদ আজমলের পাশের স্থান দখল করে নেয়।
–‘রাহিয়ানা একটা কাজ তুমি অনেক ভালো ভাবে করেছো এই যে শিহাবের মতো ছেলেকে বিয়ে করে!’ অবশ্য তুমি বিয়ে না করলেও আমি নিজেই বিয়ে দিতাম কি বলো বাবা শিহাব!
শেষের কথাটা শিহাবের কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন রিয়াদ আজমল। রাহি হাঁ করে তাকিয়ে আছে, সবকিছু তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
–‘ ওকে তোমার রুমে নিয়ে যাও ফ্রেস হতে বাকি কথা পড়ে হবে!’
রাহিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে কথাটা বললেন তার বাবা।শিহাব মুখ টিপে হেসে উঠে আসলো।রাহির পেছন পেছন উপরে উঠতে হলো শিহাবকে ও!
–‘এই যে ওইটা ওয়াশরুম!’
রুমে ঢুকে শিহাবকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো রাহি।শিহাব এক পলক রাহির দিকে তাকিয়ে এগিয়ে যায়! শিহাবকে হঠাৎ দরজার দিকে যেতে দেখে ভ্রুকুঁচকে যায় রাহির।
দরজা লাগাতে দেখে এবার রাহির বুকের ভেতর কাঁপতে শুরু করে,একটু আগেই তো এতোগুলো মারলো আর এখন দরজা লাগিয়ে কি ইচ্ছে মতো মারবে না।
কিন্তু রাহিকে ভুল প্রমাণ করে হঠাৎ ঝাঁপটে ধরলো শিহাব।রাহি সস্থির নিশ্বাস ছাড়লো মনে হলো! শিহাব কিছুক্ষণ পর রাহিকে ছেড়ে দিয়ে বললো,,,
–‘ফাস্টএইড বক্স নিয়ে এসো!’
রাহি একটু অবাক হলেও বটেই তবে কিছু না বলেই তার কথা মতো ফাস্টএইড বক্স এনে শিহাবের হাতে দিয়ে দিলো।
হঠাৎ গালে ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ পেতেই চোখ তুলে তাকায় রাহি,শিহাবকে কিছু একটা তার গালে লাগাতে দেখেও কিছু বলে না।নিজের কাজ শেষ করে শিহাব ওয়াশরুমে চলে যায়।
রাহি আবার অবাক হয়,শিহাব তার সাথে একটা বাক্য ও বিনিময় করলো না!এটা ও সম্ভব? আসলেই সম্ভব, তা না হলে কি আর এমনটা করতো শিহাব!
কিন্তু তার তো জানতে হবে তার বাবা এতো সহজে কি করে শিহাবকে মেনে নিলেন? রাহি বিয়ে করেছে শুনেও তেমন কিছু কেনো বললেন না? কিন্তু তার প্রশ্নের উত্তর কে দিবে শিহাব নাকি তার বাবা? কাকে জিজ্ঞেস করবে সে?বিছানায় বসে ভাবতে থাকে রাহি এসব!
!
!
বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে আরোহী, পাশেই আলিশা একটা চেয়ারা বসা!
–‘আরো আর একবার ফোন কর না ওরা কতো দূরে এখনো আসছে না কেনো?’
মুখ গোমড়া করে বলে আলিশা।
–‘উফফ আপু তুই একটু চুপ থাকবি ওরা সময় হলে চলে আসবে তো!’
আরোহীর উত্তরে মনে হলো না আলিশা খুশি হতে পারলো।সে আবার ঘড়ির দিকে তাকালো! প্রায় অনেকক্ষণ যাবতই আলিশা সেম কাজটিই করছে আরোহী আলিশার পাগলামিতে বিরক্ত হয়ে গেছে!
–‘এই আপু তুই এমন ব্যাবহার করছিস মনে হচ্ছে তোর একার বরই প্রথম অফিস গেছে!’
–‘তুই বুঝবি না রে আরো আমার অফিসে যাওয়ার জন্য চিন্তা হচ্ছে না!’
আঁধার এবার একটু শক্ত করে তার হাতের চাপ দেয় আরোহীর নরম পেটে।আরোহীর কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে,,,
–‘তুমিহীন অভ্যেস যে আমার চাই না বউ,যে অভ্যেসে তোমার অস্তিত্ব নেই সেই অভ্যেস এই তাশরিফ আঁধার চৌধুরীর চাই না মিসেস চৌধুরী!’ আমার সকল অভ্যেস গুলো তোমার অস্তিত্ব নিয়ে হোক,তাশরিফ আঁধার চৌধুরী সকল ভালোবাসা আপনার হোক! ভালোবাসাহীন কিংবা ভালোবাসা বিহীন সবকিছুতেই তোমার অস্তিত্ব মিশে থাক।আমার শরীরে মনে মস্তিষ্কে সবকিছুতেই আমার আরু থাক! আরুহীন যে আঁধার অসম্পূর্ণ বউ,তোমায় ছাড়া একটা মিনিট যেনো আমার একটা যুগের সমান কাঁটে! আচ্ছা তুমি কি আমায় জাদু টোনা করছো নাকি সত্যি করে বলো তো, নাহলে আমার মতো একটা ছেলে কি না বউ পাগল হয়ে যাচ্ছে এটা ও মানা যায়?
আঁধারের কথা শুনে আরোহীর নিজেকে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে, এতো ভালোবাসার যোগ্য কি সে আদোও!
ভালোবাসা শব্দটা অমূল্য, যে ভালোবেসেছে সে হয়তো সুখেই মরেছে নয়তো বা দুঃখেই! এখন যেমন আরোহী নিজেকে সুখের সাগরে ভাসানোর ভেলার মতো মনে করছে।
মিষ্টি রোদের ঝিলিক চোখে পড়তেই চোখ মুখ কুঁচকে নেয় আঁধার, একটা হাত চোখের উপরে দিয়ে রোদের ঝিলিক পরা থেকে বাঁচতে চাইলেও সেটা সম্ভব হয় না!
শেষ মেষ বিরক্ত হয়েই চোখ হালকা মেলিয়ে দেখার চেষ্টা করে, কিন্তু বুকের পাশটাতে ভারী কিছু অনুভব করতেই তৃপ্তি একটা হাসি চলে আসে মুখে।
চোখ আর খুলতে ইচ্ছে হয় না তার, তাই চোখ বন্ধ করেই দু-হাত দ্বারা ঝাপটে ধরে তার আরুপাখিকে।আরোহী একটু নড়েচড়ে আঁধারের সাথে আর একটু ঘেঁসে ঘুমিয়ে যায়।
আঁধার চোখ বন্ধ করেই সবকিছু অনুভব করে,তাই হাতের বাঁধন আর একটু দৃঢ় করে নেয়।আরোহী যেনো এতে আর ও একটু আড়াম পায়! কিন্তু আঁধারের মনে দুষ্টু বুদ্ধি আসে।
চোখ খুলে এক পলক তার আরুপাখিকে দেখে নেয়,পরম শান্তিতে তাকে ঘুমাতে দেখে আরোহীর মাথায় একটা চুমু দেয়।আরোহীর কোন সাড়াশব্দ নেই, আঁধার বাঁকা হেসে একটা হাত দিয়ে আরোহীর উমুক্ত পেটে স্লাইড করতে শুরু করে।
আরোহী এবার খানিকটা নড়ে ওঠে, আরোহী নড়ে উঠার সাথেই আঁধার আসতে করে হাত সরিয়ে নেয়।আরোহী যখন আবার নড়েচড়ে ঘুমিয়ে যায়, তখন আবার আঁধার তার একটা হাত দিয়ে আরোহীর পিঠে স্লাইড করতে শুরু করে।
কিন্তু এবার আর আরোহীর কোন সাড়াশব্দ পায় না! তাই আবার হাতটা দিয়ে তার পেটে স্লাইড করতে শুরু করে আঁধার।আরোহী বিরক্ত হয়ে আঁধারের হাতটা সরিয়ে দেয়। আঁধার হেঁসে ফেলে, তবে বিরক্ত করা ছাড়ে না।
আবার একই কাজ করতেই আরোহী বিরক্ত হয় শুধু বিরক্ত না যাকে বলে মহা বিরক্ত!
–‘উফফ আঁধার কি হচ্ছেটা কি?’
–‘কি আবার হচ্ছে যেটা হওয়ার সেটাই!’
আঁধারের কথা শুনে বিরক্ত হয়ে চোখ খুলে তাকায় আরোহী, কিন্তু আঁধারকে মিটমিট করে হাঁসতে দেখে যা বুঝার বুঝে যায়।
–‘ঘুমাবো প্লিজ!’
–‘তো ঘুমাও আমি কি তোমার ঘুম ধরে রাখছি নাকি?’
আঁধারের ভাবলেশহীন উত্তর শুনে চোখ মুখ কুঁচকে তাকায় এবার আরোহী।
–‘ডিস্টার্ব দিচ্ছেন কেনো!’
–‘হ আমি আর তোমায় ডিস্টার্ব করবো এটা ও সম্ভব নাকি?’
আঁধারকে ফাজলামো করতে দেখে আর কিছু না বলেই চোখ বন্ধ করে বলে উঠে আরোহী,,,
–‘আপনার হাত সামলিয়ে রাখুন আর দূরে যান ঘুমাবো আমি!’
–‘ছি আরু ছি তুমি কি মিন করতে চাচ্ছো বলো তো আমার হাতকে নিয়ে, আমার হাতের আর কি অপরাধ যখন এতো সুন্দর….’
আর কিছু বলতে পারে না আঁধার তার আগেই তার মুখ চেপে ধরেছে আরোহী।
–‘আর একটা ও কথা না, আপনি দিন দিন অসভ্য হয়ে যাচ্ছেন চরম অসভ্য!’
আরোহীর হাতটা সরিয়ে শব্দ করে হেঁসে দেয় এবার আঁধার।
–‘বউয়ের কাছে সকল পুরুষই অসভ্য হয় সেটা একটু আধটু হোক বা চরম!’ তবে আমি কিন্তু সাধু পুরুষ বুঝলে আরু নাহলে তো এখন এই অবস্থায় তোমায় দেখে রাতেরটায় আবার রিপিট করতাম।
আঁধারের কথা শুনে লজ্জায় আরোহীর কান দিয়ে ধোঁয়া বের হওয়ার মতো অবস্থা। হুট করে উঠে কোন রকম পালিয়ে ওয়াশরুম চলে যায় আরোহী, আঁধার হাবলার ন্যায় তাকিয়ে হু হা করে হেঁসে দেয়।
ওয়াশরুমের ভেতর থেকে আরোহী তার হাঁসির শব্দে “অসভ্য” বলে আর একবার গালি দেয়।
!
!
আদরের ঘুম ভেঙে যেতেই আজকে আর প্রতিদিনের মতো বুকের মাঝে আলিশার আভাস পায় না! ভ্রুকুঁচকে হাত দিয়ে পাশের জায়গায় আলিশাকে খোঁজার চেষ্টা করে!
কিন্তু পায় না,হঠাৎ আদরের ভয় হতে শুরু করে! এক লাফে উঠে দাঁড়ায়, ওয়াশরুমে চেক করে দেখে নেই ঘরের দরজা ও ভেতর থেকে বন্ধ করা তাহলে গেলো কোথায় মেয়েটা?
বেলকনিতে দেখার জন্য এগিয়ে যেতেই কলিজা ঠান্ডা হয়ে যায় আদরের।
হঠাৎ করে পেছন থেকে কেউ একজন ঝাপটে ধরতেই মুচকি হাসে আলিশা।আদরের হাতের উপর হাত রেখে বলে,,,
–‘কখন উঠলে?’
–‘ভয় পেয়ে গেছিলাম আমি আশা, তুমি এভাবে হুটহাট করে এখানে আসবে না ভয় পাই তো আমি!’
আদরের কন্ঠে কিছু একটা ছিলো যেটা শুনেই কেঁপে উঠে আলিশা।আলিশাকে চুপ করে থাকতে দেখে আদর এবার একটু নরম কন্ঠে বলে,,,,
–‘কখন উঠেছো?’
–‘ছয়টার দিকে!’
–‘ছয়টা,এখন তো আটটা বাজে?’ দু ঘন্টা আগে উঠেছো তুমি খিদে লাগে নি আর এভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেনো? বসবে চলো।
আদরের অস্থির কন্ঠ শুনে আলিশা হাসে! এই ছেলেটার ছোট ছোট কেয়ারগুলো তার অনেক ভালো লাগে।এই যে এখন যেমন লাগছে!
আলিশার আর কোন কথা না শুনে তাকে বেলকনিতে রাখা চেয়ারে বসিয়ে দেয় আদর।
–‘তুমি বসো আমি তোমার জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসি,একদম চুপ করে বসে থাকবে উঠার চেষ্টা করবে না একদমই!’
আলিশাকে বসিয়ে হুট করেই আদর কথাটা বলে চলে যায় ঠিকই তবে কিছুক্ষণ পরে হাতে করে দু’টো স্যান্ডউইচ দু’টো কলা আর ফল কেটে নিয়ে আসে সে।আলিশা অবাক হয় না,তার প্রতিদিনের খাবারের রুটিন এটা!
প্রথম প্রথম বাহানা করলেও এখন অভ্যেস হয়ে গেছে তার। আদরের এসব খাবারের অত্যাচারের সাথে আরও অনেক কিছুর অত্যাচার তার সহ্য হয়ে গেছে এখন।
!
!
সকাল সকাল ফোনের সাউন্ডে বিরক্ত হয় রাহি, ফোন হাতে নিতেই সাহফিফের নাম্বার দেখে অবাক হয় রাহি।এই লোকটার সাথে তার প্রথম দেখা বাজে ভাবে হলেও এর পর থেকে রাহির সাথে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে তার।কিন্তু এতো সকলে ফোন দেওয়ার কারণে ভাবছে রাহি, কেনো দিয়েছে ফোন? আবার একই ভঙ্গিতে ফোন বেজে উঠতেই রিসিভ করে কানে দেয় রাহি,,,
–‘হ্যালো মিস লম্বা চুল ওয়ালি!’
বিরক্ত হয় রাহি,মানছে তার চুল একটু লম্বা তাই বলে এভাবে তাকে বলবে লোকটা? বিরক্তের সহিত বলে রাহি,,,
–‘হুম!’
–‘তুমি কি আমার সাথে আজকে দেখা করতে পারবে, অনেক ইম্পরট্যান্ট কাজ ছিলো!’
–‘সেটা না হয় আসলেই দেখতে পারবে,আমি টাইম ও প্লেস টেক্সট করে দিয়ো দিবো !’ লেইট করবে না ঠিক সময়ে চলে আসবে কেমন।
কথাটা বলেই ফোন কেটে দেয় সাহফিফ, রাহি অবাকের সাথে হতবাক হয়ে যায়।নিজের কথা বলেই ফোন কেটে দিলো তার কথা শুনার প্রয়োজনই মনে করলো না বাহ।
!
!
বিকেলে সাহফিফের জন্য অপেক্ষা করছে রাহি একটা রেস্টুরেন্টে বসে।কিন্তু তাকে রেখে হঠাৎ করেই লোজটা উধাও হয়ে গেছে এখন অব্দি ফেরেনি।
বিরক্ত হয় রাহি,একটা মানুষকে এভাবে বসিয়ে রেখে বিরক্ত করার কোন মানেই হয় না।এরইমধ্যে তড়িঘড়ি করে সাহফিফ চলে আসে, বিরক্ত চোখে তাকিয়ে এবার বলে,,,
–‘কি বলবেন ভাইয়া এখন তো বলেন!’
–‘আসলে আমি না মিস তরীকে পছন্দ করি,আমার মনে হয় উনিও আমায় পছন্দ করেন বাট কিভাবে বলবো কি করবো বুঝতে পারছিলাম না!’ আর তোমায় ওর সাথে বেশি দেখে মনে হলো তোমার কাছে হেল্প নেওয়াই যায়,কি বলো?
আমতা আমতা করে কথাগুলো বলে সাহফিফ, রাহি ফিক করে হেঁসে দিয়ে বলে,,,
–‘এই কথাটা বলার জন্য এতোক্ষণ অপেক্ষা করায় কেউ, অবশ্যই হেল্প করবো আপনার যতোই হোক বিয়াই সাহেব বলে কথা!’
রাহির কথা শুনে মুচকি হাসে সাহফিফ।
#চলবে?
#নীল_ডায়েরির_সেই_মেয়েটি
#আরদ্ধিতা_রুহি
#পর্বঃ৩২
🍁
রৌদ্রময় দুপুরে, ক্লান্ত ধরনীতে ক্লান্ত মানব মানবীরা নিজ নিজ গন্তব্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে! সাথে যানবাহনের যাতায়াত তো আছেই।কেউ একজন নিষ্পলক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়েই মানুষের আনাগোনা দেখছে।
বাহিরের ঠান্ডা বাতাস সাথে তীব্র রৌদ্রের তাপ,কিন্তু মানবীটির শরীরে এসবের ইফেক্ট পরছে বলে মনে হচ্ছে না। সে এখনো নিষ্পলক চোখে তাকিয়েই আছে সেদিকে।
হঠাৎ ব্যাস্ত পায়ে গরমে ঘেমে নেয়ে আঁধার দৌড়ে এসে আরোহীকে এ অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হলেও চুপচাপ এগিয়ে যায়!
পেছন থেকে কেউ একজন ঝাঁপটে ধরতেই আরোহীর ধ্যান ভাঙ্গে,হাতের মালিক কে সে ভালো করেই চেনে তাই মুচকি হেসে নিজের সম্পূর্ণ ভর ছেড়ে দেয় আঁধারের বাহুডোরে।
–‘সরি!’
হাতের বাঁধন একটু মজবুত করে বলে আঁধার। আরোহী অবাক হয়,,,,
–‘কেনো?’
–‘এই যে আমি আসতে লেট করলাম, তুমি এখন ও না খেয়েই আছো আমার জন্য!’
হালকা হাসে আরোহী।
–‘কে বলেছে আমি না খেয়ে আছি!’
আরোহীর কথা শুনে আঁধার হালকা কেঁশেই বলে,,,
–‘আপনার বর বলেছে ম্যাডাম!’
–‘উনি তো এতোক্ষণ ছিলো না তাই আমি খেলাম কি না উনি কিভাবে দেখলো?’ উনি কি একটা চোখ বাসায় রেখে গেছিলেন নাকি?
আরোহীর কথা শুনে এবার শব্দ করে হেঁসে দেয় আঁধার।
–‘মনের চোখ দিয়ে ম্যাডাম,চলো এখন খাবে!’
আরোহী ছেড়ে দিয়ে কথাটি বলে আঁধার।
–‘ফ্রেস হয়ে নিন আগে তো!’
আরোহীর কথা শুনে বাঁকা হাঁসে আঁধার।
–‘তুমি থাকতে আমায় ফ্রেস হতে হবে কেনো!’
–‘তো আপনি কি চাচ্ছেন আমি আপনাকে ফ্রেস করিয়ে দেই!’
কথাটা বলেই জিহ্বায় কামড় দেয় আরোহী, আঁধার যেনো আরও সুযোগ পেয়ে যায়!
–‘দিতেই পারো আমি আবার এসবে মাইন্ড করি না।’
আরোহীর কোমড় জড়িয়ে টেনে নিজের কাছে এনে বলে আঁধার। আরোহী চোখ মুখ কুঁচকে “অসভ্য ” কথাটি উচ্চারণ করে।
–‘আমি তো অসভ্যই, তবে এখনো তেমন কিছু করিনি কিন্তু যে অসভ্য বলছো!’ তুমি চাইলে করেই অসভ্য উপাধিটা গায়ে লাগাতে পারি।
শেষের কথাটা আরোহীকে চোখ টিপ দিয়ে বললো আঁধার। আরোহী একটা ভেংচি কেটে আঁধারের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়।
–‘আপনি আর আপনার অসভ্যতামি,যান গিয়ে ফ্রেস হয়ে আসেন আগে।’
–‘এটা কিন্তু ঠিক না আরুপাখি, অন্যান্য বউয়েরা বর যখন বাহির থেকে আসে তখন পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়,জড়িয়ে ধরে গাঁয়ের সাথে লেপ্টে থাকে!’ আর তুমি দূর দূর করছো।
আঁধার ক্লান্ত চোখে এতোক্ষণ আরোহীর দিকে তাকিয়ে ছিলো,কিন্তু এখন আর নেই মুচকি মুচকি হাঁসছে সে! হুট করে আবার আরোহীর কোমড় জড়িয়ে ধরে বাঁকা হেসে বলে,,,
–‘এবার কোথায় পালাবে বউ!’
আরোহী হতভম্ব হয়ে যায়, বার বার এই লোকটার ফাঁদে সে না চাইতেও পাঁ দেয়।এবার ও তার ব্যাতিক্রম হয়নি,আঁধার যে এতোক্ষণ এক্টিং করছিলো সেটা তার ভোলা মন ধরতেই পারেনি।
–‘আপনি একটা বাজে লোক,ধূর ছাড়ুন তো।’
কটমট চাহনিতে আঁধারের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে উঠে আরোহী। আঁধার শয়তানি হাঁসি হেঁসে বলে,,,
–‘আই নো,নতুন কিছু বলো!’
আরোহী নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ছটফট শুরু করে, কিন্তু আঁধার আরও শক্ত করে ধরে থাকে।
–‘উফফ এভাবে ছটফট করো না তো, নাহলে কিন্তু আমি অন্য কিছু করতে বাধ্য হবো!’ তুমি কি চাও সেটা এখন।
ব্যাস আঁধারের একটা কথাতেই আরোহীর ছটফট করা বন্ধ হয়ে গেছে।সে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে আঁধারের দিকে,আঁধার মুচকি হেসে আলতো হাতে বুকে জড়িয়ে নেয় তার প্রেয়শীকে।আরোহী নিজেও মুচকি হেসে আঁধারকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
–‘এখন ভালো করে জড়িয়ে ধরো বুঝলে কাল থেকে আর সারাদিন কাছে পাবে না আমায়!’
আঁধারের কথায় অবাক হয়ে মাথা তুলে ভ্রুকুঁচকে তাকায় তার দিকে আরোহী। আঁধার হালকা হেঁসে বলে,,,
–‘কাল থেকেই অফিসে জয়েন করছি আমি আরু পাখি!’
–‘কিন্তু আপনার ভার্সিটি?’ আর ফাইনাল এক্সাম তো কিছুদিন পর?
–‘হুম জানি!’
আঁধারের কথায় অবাক হয় আরোহী, কি বলছে লোকটা?
–‘জানেন তাহলে তবুও…’
–‘হুস..’
আরোহীকে সম্পূর্ণ কথা শেষ করতে দেয় না আঁধার।
প্রায় অনেকটা সময় নিয়ে তার কপালে ওষ্ঠদ্বয় বসিয়ে রাখে আঁধার, আরোহী বিরক্ত হয় না তবে অবাক ও হয় না।হুট হাট আঁধারের এইসব কাজে এখন সে অভ্যাস্ত হয়ে গেছে।
চোখ বুঝে আরোহী ও কিছুক্ষণ অনুভব করে আঁধারের ভালোবাসার ছোঁয়া! কিছুটা সময় যাওয়ার পর আরোহী কপাল থেকে ওষ্ঠদ্বয় সরিয়ে নেয় আঁধার, তবে আরোহীর থেকে দূরে সরে না। আরোহীর চোখের দিকে তাকিয়ে এবার বলে উঠে আঁধার,,,
–‘আমার বউকে আর কতোকাল আব্বুর হোটেলে বসে খাওয়াবো বলো,নিজেকে ও তো কিছু একটা করতে হবে নাকি?’ লোকে যখন তোমায় জিজ্ঞেস করবে তোমার বর কি করে তখন কি বলবে বউ যে আমার বর সে তো বাবার হোটেলেই খায়।
আঁধারের কথা শুনে আরোহীর মুখের বুলি এবার ফুঁড়িয়ে যায়,আসলেই তো সে ব্যাপারটা ভেবে দেখেনি আগে।
আরোহীকে চুপ করে যেতে এবার তার দু’গাল নিজের দু-হাত দিয়ে আলতো করে ধরে বলে আঁধার,,,
–‘তুমি চিন্তা করো না,আমি ঠিক সামলিয়ে নিবো সব তবে সারাদিন তোমার থেকে দূরে থাকতে কষ্ট হবে আমার!’ তুমি না হয় হুট হাট ভার্সিটি থেকে আমাদের অফিসে গিয়ে আমায় চমকে দিয়ো আরুপাখি।
শেষের কথাটা উৎফুল্লের সহিত বলে আঁধার, আরোহী আঁধারকে যতোই দেখছে ততোই অবাক হচ্ছে।
একটা মানুষ এতোটা ভালো কি করে হতে পারে,এই যে সবসময় আরোহীর খেয়াল রাখা,পরিবারের সকলের খেয়াল রাখা,সকলের সাথে আড্ডা দেওয়া, ভার্সিটিতে যাওয়া,নিয়ম করে আরোহীকে নিয়ে যাওয়া নিয়ে আসা কখন কি লাগবে তার খেয়াল রাখা আবার এখন অফিস।
ছেলে মানুষের জীবনটাই হয়তো সকলকে সামলো থেকে শুরু করে সকলের প্রয়োজন হওয়া অব্দি সব করতে হয়।তাহলে তারা নিজেরা কখন নিজের কথা ভাববে?
এই তো আঁধার আগে বাবা মায়ের খেয়াল রাখতো এখন আরোহী এসে যুক্ত হয়েছে তাই তার দায়িত্ব আরও বেড়ে গেছে।যখন তাদের বাচ্চা হবে তখন আরও দায়িত্ব বেড়ে যাবে,বাচ্চা আদোও কি সেটা সম্ভব।
হু সম্ভব, তবে আঁধারের মতে তার বউ এখনো নিজেই বাচ্চা।
–‘কি ভাবছো আরু?’ যাবে না আমায় দেখতে?
–‘হু হু!’
–‘কি হু হু করছো?’
ভ্রুকুঁচকে বলে আঁধার।
–‘না কিছু না, কি বললেন আপনি?’
অদ্ভুত চোখে আঁধারকে তার দিকে তাকাতে দেখে ভড়কে যায় আরোহী।
–‘না মানে..’
–‘থাক কথা ঘুরাতে হবে না, তা কি এতো ভাবছিলেন ম্যাডাম?’
–‘কিছু না আঁধার চলুন ফ্রেস হবেন, খেতে হবে তো!’
আঁধার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নাড়ায়, আরোহী একটা টাওয়াল এনে আঁধারের হাতে ধরিয়ে দেয়।আঁধার একপলক আরোহীর দিকে তাকায়,আরোহী যখন তাকায় তখন আঁধার টুপ করে একটা চুমু দেয় আরোহীর গালে।
কারো উচ্চস্বরে হাসির আওয়াজে দু’জনে থেমে যায়,একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসির উৎস খুঁজতে দরজার কাছে আরোহীকে লেপ্টে হাসতে দেখে অবাক হয়ে যায় দু’জনে। কিন্তু আরোহী কি সে তো হাসতেই ব্যাস্ত।
হাঁসতে হাঁসতেই আরোহী এবার এগিয়ে আসে,আদরকে সরিয়ে দিয়ে আদরের যায়গায় নিজে বসে আবার হাঁসতে শুরু করে।আলিশা আদরের দিকে তাকায়, আদর আরোহীর দিকেই তাকিয়ে ভাবছে আসলে আরোহী হাসছে কেনো?
প্রায় অনেকক্ষণ পর আরোহী থেমে যায়,আলিশা ও আদরকে নিজের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাতে দেখে আবার হাসতে শুরু করে।আলিশা এবার একটা বালিশ ছুঁড়ে মারে আরোহী দিকে।আরোহী মনে হয় অনেক কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে নেয়!
–‘আরে ভাইয়া আপু তোমায় বেইবি ওরফে বেবি শব্দটা ইউস করতে বারন করেছে আর তুমি কি না ঘুরে ফিরে ওই এক কথাতেই আঁটকে আছো!’ আশা বেইবি…
শেষের কথাটা কিছুটা টেনে টেনে বলে আবার হাসিতে লুটোপুটি খায় আরোহী।
আলিশা এবার কড়া চোখে আদরের দিকে তাকায়, যার অর্থ “বলদ আমি এতোক্ষণ একজন্যই এমন করছিলাম”। আদর মাথা চুলকে সামান্য হাসার চেষ্টা করে। আরোহী নিজের হাসি থামিয়ে বলে,,,
–‘ভাইরে ভাই তোমাদের কাহিনি দেখে ভালোই মজা লাগে আমার, ফ্রিতে বিনোদনের জন্য তোমাদের তো অস্কার দেওয়া উচিত।’
–‘হ্যা ওই অস্কারটা আগে আপনার গলায় ঝুলানো উচিত ম্যাডাম!’
দরজার বাহির থেকে কথাটা বলে আঁধার, তিনজনেই এবার সেদিকে তাকায়।
–‘আরে ভাই তুই বাহিরে কেনো ভেতরে আয়!’
–‘হ্যা হ্যা ভাইয়া ভেতরে এসো না!’ তোমার বউ তো এতোক্ষণ হেঁসে লুটোপুটি খাচ্ছিল সে আর কি বলবো!
আলিশার কথা শুনে আরোহী চোখ মুখ কুঁচকে তাকায় আলিশার দিকে।
–‘এখন না পরে এসে আড্ডা দিবো, খিদে লেগেছে প্রচুর সকাল থেকে এখনো খাওয়া হয়নি!’
কথাটা বলেই চলে যায় আঁধার আর আঁধারের কথা শুনে তার পেছনে পেছনে ছুটে যায় আরোহী। ইনডাইরেক্টলি আঁধার যে তাকেই ডেকে গেলো সেটা কেউ না বুঝলেও সে বুঝেই পেছন পেছন চলে গেলো।
–‘এই যে বড় বউ রান্না বান্না কিছু পারো নাকি শুধু স্বামীকেই আঁচলে বাঁধতে পারো!’
আঁধারের জন্য পানি নিতে এসেছিলো আরোহী কিন্তু মাঝপথে বড় মামী শাশুড়ীর কথা শুনে পাঁ জোড়া থেমে যায় তার। ধির কন্ঠে বলে উঠে,,,
–‘টুকটাক পারি!’
–‘টুকটাক পারলে তো আর হবে না ভালো করে পারতে হবে,এখন আমায় বিরিয়ানি রান্না করে খাওয়াও তো দেখি!’
মামী শাশুড়ীর কথা শুনে শুকনো ঢোক গিলে আরোহী, বিরিয়ানি রান্না করবে সে এখন,,,,
–‘আচ্ছা!’
আরোহীর কথা শুনে সুরাইয়া বেগম অর্থাৎ তার মামী শাশুড়ী তার আগা গোড়া একবার পরক্ষ করে নেন। তার পর বলেন,,,
–‘আমি কি দাঁড়ায় দাঁড়ায় দেখবো বড় বউ! ‘
আরোহীর এবার ভয়ে হিচকি উঠে যায়,এই মহিলা এতো চালাক!এরইমধ্যে উপর থেকে আঁধারের চিৎকার আসে আরোহীর নাম ধরে।আরোহী তড়িঘড়ি করে গ্লাসে পানি ঢেলে উপরের দিকে ছুট লাগায়।সুরাইয়া বেগম চোখ মুখ কঠিন করে বিরবির করে বলেন,,,
–‘শিক্ষা দিক্ষা কিছুই নেই দেখছি এই মেয়ের, বড় ডেকে উঠলো ওমনি চলে গেলো!’ আমায় দেখছি মানলোই না।
–‘একা একা কি কথা বলছেন বড় ভাবি?’
জমিলা বেগমের কথা শুনে সুরাইয়া বেগম হতাশার স্বরে বলেন,,,
–‘বুঝলি মেঝো আঁধারের মতো হীরার টুকরা ছেলেটার বউয়ের কি না শিক্ষা দিক্ষাই নাই।’
–‘কি যে বলেন না বড় ভাবি, আরোহী নিজেও তো হীরার টুকরা একটা মেয়ে! ‘ কি সুন্দর তার ব্যাবহার, কথা বার্তা কতো সুন্দর।
–‘তোরা এতো বছরের ও মানুষ চিনতে শিখলি না রে জমিলা।’
কিছুটা আপসোস স্বরে কথাটি বলেই সুরাইয়া বেগম সোফায় গিয়ে বসে পড়ে, কিন্তু জমিলা বেগম অবাক হয়ে তাকায় তার যাওয়ার দিকে।
এই যে সুরাইয়া বেগম যিনি তার বড় জা,মানুষটি খিত খুঁতে স্বভাবের হলেও মনের দিক দিয়ে অনেক পরিষ্কার একজন মানুষ। সকলকে অনেক ভালোবাসে কিন্তু কোন এক কারণে আরোহী ও আলিশার ক্ষেত্রে তিনি একটু দৃঢ় ব্যাবহার করছেন।
তারা মোট তিন জা! এই তো সুরাইয়া বেগম বড় তিনি হলেন আঁধারের বড় মামা অর্থাৎ বাদল রাশেদিনের বউ, তারপর জমিলা বেগমের স্বামী বশির রাশেদিন আর তার পর আয়েশা বেগমের স্বামী বাঁধন রাশেদিন।
দুপুরে আরোহী রান্না করবে, তবে কিভাবে কি করবে বুঝতে পারছে মা।আঁকলিমা চৌধুরী বার বার বারণ করার পরও আরোহী শুনেনি! তার মতে বড় মামীকে প্রমাণ দেওয়ার এইটায় সুযোগ তবে, এখন নিজের কাজে নিজেই ফেঁসে গেছে।
সুরাইয়া বেগম ড্রয়িং রুমে বসে আছে, আঁধার কি একটা কাজে বাহির গেছে। তাই তিনি আরোহীকে দিয়ে রান্না করানোর সুযোগ পেয়েছেন।
আরোহী কি করবে ভেবে না পেয়ে যখন চালে হাত দেয় তখনই কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে যায়।ঘুরতেই লিমার হাসি মুখটা দেখে সামান্য হাসার চেষ্টা করে আরোহী।
লিমা খুব সাবধানে আরোহীকে একটা ছোট কাগজ দিয়েই চলে যায়।আরোহী খুলে দেখে কিভাবে কি করতে হবে সবটায় লেখা আছে। তাই খুব সাবধানের সহিত কাগজটা রেখে কাজে লেগে পড়ে।
পার্কে মাথা নিচু করে বসে আছে রাহি, আর তার সামনে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শিহাব।
–‘কাল রাতের ডোজ কি কম হয়ে গেছিলো যে আজকে আবার একই ভুল করছো!’
শক্ত কন্ঠে কথাটা বলেই ধপ করে রাহির পাশে বসে পড়ে শিহাব।রাহি একটু সরে বসে, কিন্তু শিহাবের মনে হয় সেটা সহ্য হয় না তাই একটা হাত রাহির কোমড়ে দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে গাঁ ঘেসে বসিয়ে দেয় তার।রাহির অসস্তি হয়,মেয়েটা এবার খানিকটা বিরক্ত ও হয় বটে।
–‘ছাড়ুন সবাই দেখছে!’
–‘কেউ দেখছে না, তোমার নিজের দোষের জন্যই আজকে এইসব সহ্য করছো তুমি!’
বিরক্ত হয়ে বলে শিহাব।রাহি মাথা নিচু করে নেয়,মিনমিন করে বলে,,
–‘আমার মনে হয় আমাদের সবকিছু এখান থেকেই শেষ করা উচিত শিহাব!’
শিহাব কিছু বলে না কিন্তু আরও খানিকটা শক্ত করে চেপে ধরে বলে,,,
–‘কারণ!’
–‘কোন কারণ নেই শিহাব, তবে সবকিছু শেষ করাই উচিত!’
–‘কারণ বল!’
চোয়াল শক্ত করে বলে শিহাব।
রাহি ধির কন্ঠে বলে,,
–‘জানিনা তবে আমার মনে… ‘
আর কিছু বলতে পারে না রাহি তার আগেই চিৎকার করে বলে উঠে শিহাব,,,,
–‘কারণ বলতে বলছি না তোকে,কারণ বল!’
একটু থেমে আবার বলে,,,
–‘একদম নাটক করবি না চুপচাপ কারণ বল!’
বলেই আসে পাশে তাকায়,অনেক মানুষ তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। রাহি চোখের জ্বল মুছে বলে,,,
–‘আমি আপনাকে ভালোবাসি না!’
ব্যাস একটা কথায় যথেষ্ট ছিলো শিহাবের রাগকে আকাশে তুলে দেওয়ার জন্য। শক্ত হাতে রাহির গালে একটা থাপ্পড় মেরে দেয়।রাহি সামান্য হেলে পড়ে,কিন্তু এক হাত দিয়ে শিহাব ধরে রাখার জন্য পড়ে যায়নি বেচারি। ঠোঁট কেটে রক্ত বের হয়ে গেছে অলরেডি তার।মাথা ঝিমঝিম করে উঠে তার।কিছু বোঝার আগেই শক্ত হাতে তার গাল চেপে ধরে বলে শিহাব,,,
–‘গেট রেডি,সামনে যেটা হবে সেটার জন্য তুই দ্বায়ি থাকবি!’
বলেই হাত ধরে হনহনিয়ে সামনে এগুতে থাকে, আর ফোনে কিছু একটা করতে থাকে।
শিহাবের ব্যাবহারে রাহি কষ্ট পায়, কিন্তু বলার মতো কিছু খুঁজে পায় না। হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায় শিহাব, ফোনে শুধু বলে,,
–‘সবকিছু রেডি কর কয়েক মিনিটের মধ্যে।’
বলেই ফোন কেটে, রাহিকে টেনে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে স্টার্ট করে। গাড়ির ইঞ্জিন চালু হওয়ার সাথেই হেলে পড়ে কিছুটা সামনের দিকে রাহি।ব্যাথা পায়,কিন্তু শিহাব ধরেও না কিছু বলেও না।
কয়েক মিনিটে গাড়িটি থেমে যায়,রাহি চোখ তুলে একবার শিহাবের দিকে তাকায় কিন্তু কিছু বুঝে উঠার আগে আবার তাকে বের করে টানতে টানতে সামনে নিয়ে যায়।সামনে নজর যেতেই কলিজা কেঁপে উঠে রাহির, সামনে বড় বড় অক্ষরে লেখা কাজি অফিস।
–‘ভেতরে গিয়ে নাটক করবি না, চুপচাপ কবুল বলে দিবি নাহলে আমি কি করতে পারি তোর নিশ্চয়ই ধারণা আছে!’
–‘অসম্ভব!’
–‘আর এক বার বল কি বললি?’
এবার সামান্য হাসার চেষ্টা করে রাহি কিন্তু কাজে দেয় না,ভেতরে নিয়ে গিয়ে তাকে বসিয়ে দেয়। রাহি এক পলক সকলের দিকে তাকায়,আরোহী বাদে আঁধার থেকে শুরু করে নীলি, সোহেল সবাই আছে। বাহ তার মানে এসবই রেডি করতে বললো তখন লোকটা বাজে লোক একটা।মনে মনে শ খানেক গালি দেয় শিহাবকে রাহি।কি আর করার বিয়েটা হয়ে যায়।আঁধার শিহাবের পিঠে চাপড় মেরে বলে,,
বিকেলে আঁধার বাড়ি ফিরতেই বাসার সবাইকে ড্রয়িং রুমে কাউকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রুকুঁচকে এগিয়ে যায়।
–‘কি হচ্ছে এখানে?’
আঁধারের গম্ভীর কন্ঠে বলা কথাটি যেনো সকলের কানের পর্দা ভেদ করে ঢুকতেই সকলের পিলে চমকে উঠে। আঁকলিমা চৌধুরী শুকনো ঢোক গিলে, তার যে ছেলে না জানি এখন কি করে ভেবেই তিনি বসা থেকে দাঁড়িয়ে আঁধারের কাছপ এগিয়ে যান, আঁধার তার মায়ের থমথমে গম্ভীর মুখ জোড়া দেখে ভ্রুকুঁচকায়।
–‘কি হয়েছে আম্মু!’ আর তোমরা এভাবে কাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছো?
আঁধারের কথা শুনে কিছুটা ঢোক গিলে আঁকলিমা চৌধুরী বলেন,,,
–‘দেখ আঁধার আমি এখন যেটা বলবো সেটা শুনে মাথা গরম করবি না, শান্ত থাকার চেষ্টা করবি।’
আঁধার সন্দেহের দৃষ্টিতে তার মায়ের দিকে তাকায় এবার, মিসেস আঁকলিমা চৌধুরী আমতা আমতা করে বলে,,,
–‘আরো মায়ের হাত পুড়ে গেছে!’
–‘কিহ!’ কোথায় ও এখন?
আঁধারের চিৎকারের ঢোক গিলে আঁকলিমা চৌধুরী বলেন,,,
–‘আঁধার!’
তার কথা আর শুনার প্রয়োজন মনে করলো না আঁধার, সামনে এগিয়ে আসলো, সামনে এগোতেই সোফায় গুটিশুটি মেরে ব্যান্ডেজ লাগানো হাতে আরোহীকে নজড়ে পরলো তার।
বুকের ভেতর চিনচিন ব্যাথার আভাস পেতেই কাউকে পড়োয়া না করেই ছুটে গিয়ে অস্থির হয়ে আরোহীর হাতটা ধরে অবাক হয়ে বললো,,,
–‘এতো বড় ব্যান্ডেজ কেনো?’ তার মানে হাতটা প্রায় অর্ধেকই পুরে গেছে,কিভাবে হলো? তুমি ঠিক আছো?
আরোহীকে মাথা নিচু করে থাকতে দেখে বিচলিত হয়ে যায় আঁধার।
–‘আরুপাখি তোমার হাতে কি অনেক বেশি পেইন করছে,ডাক্তার ডাকবো?’ কোথায় পেইন হচ্ছে বলো? চলো তোমায় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।
আঁধারকে দেখে প্রথমে আরোহী ভয় পেলেও এখন বুকটা প্রশান্তিতে ভরে যাচ্ছে। প্রিয় মানুষের একটু ভালোবাসায় নারীরা গলে যায় কথাটা এতোদিন শুনেছিলো আরোহী তবে আজকে বুঝতে পারছে কথাটার মর্ম।
এই তো আঁধার নামক শক্ত কঠিন মানুষটার ভেতরে তার প্রতি এতো অস্থিরতা দেখে অনেক ভালো লাগছে আরোহীর।মুচকি হাসে আরোহী, ভালোবাসার মানুষ হয়তো একেই বলে।
–‘কি হলো তুমি হাসছো কেনো,কিছু জিজ্ঞেস করছি না তোমায়?’
আরোহী এবার নিজের মুখটাকে একটু কাঁদো কাঁদো করার চেষ্টা করে, কিন্তু কেনো জানি না তার কান্না পাচ্ছে না!
কান্নারা ও হয়তো তাকে বলছে, ” আরোহী আজকের মতো আমাদের ছুটি, আজকে তুই বরং হাসিকেই ধরে রাখ!” স্বাভাবিক কন্ঠেই বলে উঠে আরোহী এবার,,,
–‘আমি ঠিক আছি ডাক্তার দেখে গেছেন তো!’
–‘সত্যি তুমি ঠিক আছো,আমার দিকে তাকিয়ে বলো তো?’
–‘হুম!’
আঁধারের দিকে এক পলক তাকিয়ে শুধু হুম বলে চুপ হয়ে গেলেও, আঁধার যেনো এতে সন্তুষ্টি পেলো না।তবে হঠাৎ করেই তার মনে হলো সকলে আছে এখানে তাই আর কিছু বললো না,তবে হুট করেই একটা প্রশ্ন করে ফেললো,,,,
–‘এক সেকেন্ড, হাতটা পুরলো কিভাবে?’
আঁধারের প্রশ্নে সকলে চুপসে গেলো,আলিশা কিছু একটা বলার জন্য উসখুস করছে তবে বড়দের জন্য সাহস পাচ্ছে না।
–‘কি হলো,কেউ কিছু বলছো না কেনো?’ আরু হাত পুরলো কিভাবে তোমার রান্না করছিলে তুমি?
আঁধারের কথায় জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয় আরোহী, আঁধার সন্দেহের দৃষ্টিতে সকলের দিকে তাকায়! কাউকে কিছু না বলতে দেখে হঠাৎ আঁধারের নজর যায় লিমার দিকে, সে কিছু একটা বলতে চাচ্ছে!
–‘এই লিমা এদিকে আয়!’
আঁধারের ডাকে লিমা এক ছুটে এসে আঁধারের সামনে দাঁড়ায়, মনে হয় এতোক্ষণ সে আঁধারের ডাকেরই অপেক্ষায় ছিলো।
–‘বড় ভাইজান বড় বউমনি রান্না করতে গেছিলো বিরিয়ানি, তবে সে নিজে থাইকা রান্নাঘরে যায় নাই আপনার বড় মামী তাকে রান্না করতে বলছিলো!’ বিরিয়ানি রান্না করতে বড় বউমনি পারে না আমি একটা চিরকুটে লিখে দিয়েছিলাম তবে সেডাও আপনার বড় মামী দেখে ফেলেছিলো তিনি বউমনির থাইকা চিরকুটটা কাইড়া লইয়া যান।আর বউমনি মনে করছিলো পানি দিয়েই রান্না করতে হবে,গরম পানি উঠাইতে গিয়া পানির পাতিল উল্টে হাতে পইড়া গেছে গাঁ।
এক নিঃস্বাসে কথা গুলো বলেই দম ছাড়ে লিমা।আঁধার চোয়াল শক্ত করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে।
আঁধারের বড় মামীর ভয়ে গলা শুকিয়ে যায়, আঁধার মানেই তার কাছে ভয়ংকর! একবার তার মেয়ে আঁধারকে শুধু বলেছিলো সে তাকে পছন্দ করে।
সাথে সাথেই আঁধার তাকে টানা তিনটা থাপ্পড় মেরে সকলের কাছে এনে ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিলো, এই ভুল যেনো দ্বিতীয় বার না হয়।তখন থেকেই তিনি মেয়েকে সাবধান করেছিলেন আর নিজেও সাবধানে থাকেন, কিন্তু আজকের ব্যাপারটা এতোটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে তার ধারণার বাহিরে ছিলো এটা।
আঁধার তার বড় মামীর দিকে তাকাতেই তিনি মাথা নিচু করে নেন,হয়তো অপরাধবোধে নয়তো বা লজ্জায়! আঁধার আর কাউকেই কিছু বলে না,শুধু মাত্র আলিশার দিকে তাকিয়ে একবার বলে,,,,
–‘আলিশা তোমার বোনকে ঘরে গিয়ে রেস্ট নিতে বলো,তার এখন রেস্টের প্রয়োজন!’
কথাটি বলেই গটগট করে উপরে চলে যায়,সবাই অবাক হয়।আঁধার যে ছেলে তার বর্তমানে বাড়ি মাথায় উঠানোর কথা কিন্তু সে কিছু না বলেই চলে গেলো? এটা ও কি সম্ভব!
রাহি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে, আর শিহাব বিরক্ত না হয়ে ড্যাব ড্যাব করে রাহির কান্না দেখছে।রাহি একবার শিহাবের দিকে আড় চোখে তাকায়,কিন্তু শিহাবকে এভাবে ড্যাব ড্যাব করে তার দিকে তাকাতে দেখে ঠোঁট উল্টে আবার ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কেঁদে উঠে।
কিন্তু শিহাব নামের পাষাণ লোকটার মায়া হয় না! সে তখন ও একইভাবে তার নতুন বউয়ের দিকে তাকিয়ে তাকে খুঁটিয়ে খাঁটিয়ে দেখতে ব্যাস্ত।রাহি নিজেই বিরক্ত হয়ে কান্না থামিয়ে কটমট চাহনিতে শিহাবের দিকে তাকিয়ে বলে,,,,
–‘তো কান্না কি দেখার জিনিস আজব,কান্না থামানোর চেষ্টা করবেন না?’
–‘না!’
শিহাবের নির্লিপ্ত শিকার রক্তি! রাহির এবার সম্পূর্ণ শরীর রাগে জ্বলে ওঠে।
–‘আমি থাকবো না আপনার সাথে, বিয়ে করেছেন দেখে ভাববেন না আমি মেনে নিয়েছি!’
–‘আচ্ছা!’
আবার একই ভঙ্গিতে যখন কথাটি বললো শিহাব রাহি হতভম্ব হয়ে যায়। একটু আগেই লোকটা তাকে জোড় করে বিয়ে করলো আর এখনই কি না বলছে আচ্ছা! এ তো গিরগিটির যমজ ভাই!
কটমট করে শিহাবের দিকে তাকিয়ে এবার উল্টো দিকে ঘুরে বসে রাহি,শিহাব সামান্য হেঁসেই পেছন থেকে রাহিকে জড়িয়ে ধরে। কেঁপে উঠে রাহি,বুকের ভেতর মনে হয় কেউ একজন ঢোল বাজাচ্ছে তার।
–‘ভালোবেসে ধরছি না তাই এতো কাঁপা কাঁপি বন্ধ করো,আমি ভুলিনি তুমি আমায় কি কি বলেছিলে সকালে!’
–‘তাহলে বিয়ে করলেন কেনো?’
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে রাহি।
–‘তোমায় নিজের করে নেওয়ার জন্য, পুরো তুমিটাকেই এই শিহাব চৌধুরীর নামে করার জন্য!’
হাতের বাঁধন শক্ত করে বলে উঠে শিহাব।
হালকা হাঁসে রাহি,হেঁসেই বলে,,,
–‘চৌধুরী?’
–‘ইয়েস ম্যাডাম,আই আ’ম সান অফ তৌহিদ চৌধুরী এন্ড শিরিন চৌধুরী।’ এন্ড ব্রার্দার অফ তাশরিফ আঁধার চৌধুরী এন্ড তৌহিদুল আদর চৌধুরী।
শিহাবের কথা শুনে রাহি অবাক হয়ে ঘুরে বসার চেষ্টা করে কিন্তু শিহাব সেটা করতে দেয় না।
–‘উহু নড়ে না,ওভাবেই যা বলার বলো!’
–‘এতোদিন বলেন নি কেনো আপনি আঁধার ভাইয়ের ভাই?’
–‘বলার প্রয়োজন মনে করি নি তাই,তবে বাকি সবাই জানে আমি ও আঁধার চাচাতো ভাই!’ তবে মজার ব্যাপার কি জানো আমাদের জন্ম দিন কিন্তু একসাথেই।তাই আমরা বেস্ট ফ্রেন্ড ও। এখন তোমার প্রশ্ন হতে পারে তাহলে একসাথে থাকি না কেনো? আব্বু আর বড় আব্বু মানে আঁধারের আব্বুর মাঝে কি নিয়ে জানি ঝামেলার কারণে আমরা চৌধুরী ভিলা থেকে বর্তমানে আমাদের ফ্লাটে থাকি।তবে তাদের মাঝের ঝামেলার কারণ এখন অব্দি কেউ খুঁজে বের করতে পারিনি।তবুও আঁধার আর আমার ভালোবাসা কখনো কমেনি, আমি আঁধারদের বাসায় গেলে বড় মা আমাকে যেমন ভালোবাসে আঁধার আমাদের বাসা গেলেও তেমন ভালোবাসায় পায়।আঁধার আর আমি ভাবছি এবার অন্তত্য আব্বুদের মাঝে সবঠিক করে দেওয়া উচিত।অনেক তো হলো আর কতো? তাই দেখি কি করা যায়।
–‘এখন আপনি বলেন তো ম্যাডাম আপনার কি কাহিনি,কেনো এমনটা করলেন আমার সাথে?’
শিহাবের কথা শুনে এবার রাহি চমকে উঠে, কিন্তু কিছু না বলেই শিহাবের দিকে ঘুরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে! শিহাব নিজেও আর কিছু না বলে প্রেয়শীকে শক্ত করে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে।
তার বুকের ভেতরটা অনেকটা শান্ত হয়ে যায়,এই যে তার বুকে থাকা মেয়েটা তার নিশ্বাসের সাথে জড়িত অথচ এই মেয়েটাকে সে আজকে মেরেছে।
টুপ করে একফোঁটা জ্বল গড়িয়ে পড়ে রাহির চুলে,সাবধানতার সহিত মুছে নিয়ে রাহির মাথায় একটা চুমু দিয়েই ভাবতে থাকে রাহির সাথে তার প্রেমের শুরুর সবকিছু।
অতীত,,,,
চার মাস আগে, একদিন রাহিকে রাস্তার পাশে একা মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখেছিলো তখন প্রথম বারের মতো শিহাবের কেনো জানি না রাহির মলিন মুখটি দেখে খারাপ লেগেছিলো।
সেদিন কিছু বলে নি কারণ এমনি তেও মেয়েটা যখনই তাকে দেখে তখনই কিছু না কিছু বলে জ্বালায় হয়তো সোয়ামী সোয়ামী করে আগে পিছে ঘুরঘুর করে শিহাবের বিরক্ত লাগতো আগে কিন্তু এখন বিরক্তের সাথে সাথে সে নিজেও রাহির সাথে কোমড় বেঁধে ঝগড়া করে।
চুপচাপ চলে যায় সেদিন শিহাব কিন্তু পরের দিন ও একই ঘটনা দেখে ভার্সিটিতে তাই নিজে থেকে রাহিকে একটু জ্বালাতে যায়,অবশ্য সে সফল ও হয় সেদিন।
রাহি মন খারাপ ছেড়ে কোমড় বেঁধে ঝগড়া করে, একসময় রাহি ঝগড়ায় না পেরে টুপ করে শিহাবের গালে একটা চুমু দিয়ে পালিয়ে যায়।হতভম্ব হয়ে যায় শিহাব,আঁধারা পুরোই হাঁ হয়ে যায়! রাতুল তো লাফিয়েই বলে ফেলে,,,
তারপর শিহাবের পিঠে চাপড় মেরে রাতুল আবার বলেছিলো,,,
–‘তোর মতো হ্যান্ডু হ্যান্ডু ছেলে ঘরে ঘরে হওয়া উচিত, তুই তো ছেলে জাতির নাম উঁচুতে নিয়ে যাবি!’ তার আগে তো আঁধার নিয়ে গেছেই,তাকে তো একেবারে আরোহী আফু প্রথম দিনেই খাইয়া লইছে!
সেদিন রাতুলের কথা শুনে সকলে নাক ছিটকিয়ে ছিলো,ছেলেটার কথা বার্তা তাদের কাছে অশ্লীল ছাড়া কিছুই মনে হয় না।তবে পড়ে ধিরে ধিরে রাহির করা কাজ গুলোতে শিহাব নিজেও আসক্ত হয়ে যায়।
অবশেষে বুঝতে পারে রাহির প্রতি তার ভালোবাসা।তবে রাহিকে প্রপোজ করা হয়নি তার! আর রাহি সে তো প্রথম দিন থেকেই শিহাবের উপর ক্রাশ খেয়ে বসে আছে,তাই তো শিহাবের আগে পিছে ঘুরাঘুরি করতো সবসময়।
এইতো চারমাস আগে যখন বুঝতে পারলো সে শিহাবকে ভালোবাসে তখন থেকেই শিহাবকে ইমপ্রেস করার মিশন স্টার্ট করেছিলো।
।
।
আরোহী রুমে আসতেই দেখে আঁধার চোখ বন্ধ করে আধ সোয়া হয়ে আছে,অবাক হয় আরোহী! ধিরে ধিরে আঁধারের মাথার কাছে গিয়ে বসে পড়ে, ভালো হাতটা দিয়ে আঁধারের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
ঝট করে চোখ খুলে তাকায় আঁধার, তবে আজকে আর আরোহী হাত সরিয়ে নেয় না।আঁধার এবার আলতো হাতে আরোহী নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে! আরোহী নিজেও চুপটি করে সুয়ে থাকে,আঁধার গম্ভীর কন্ঠে বলে,,,,
–‘তুমি কিছু বলো না কেনো মামী কে আরুপাখি?’
–‘উনি তো গুরুজন আঁধার! ‘
–‘তাই বলে এভাবে তোমায় কষ্ট দিবে?’ আজকে যদি তোমার কিছু একটা হয়ে যেতো?
–‘উনি জানতো না তো আমি রান্না পারিনা তাই,বাদ দেন না যেটা হওয়ার হয়ে গেছে!’
–‘হয়ে গেছে বলছো,তোমায় এই অবস্থায় দেখতে আমার যে কষ্ট হচ্ছে সেটা কি তুমি বুঝতে পারছো না আরুপাখি?’
আঁধারের কথা হাসে আরোহী, হেঁসে আরও শক্ত করে আঁধারকে জড়িয়ে ধরে, কিন্তু এবার আর আঁধার ধরে না।আরোহীকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,,,,
–‘রেডি হও তোমায় ও বাড়িতে রেখে আসবো!’
–‘মানে?’
–‘মানে মামী যতোদিন আছে তুমি ওই বাসায় থাকবে এটাই ফাইনাল!’
শক্ত কন্ঠে বলে আঁধার। আরোহী হতভম্ব হয়ে যায়, আঁধার হঠাৎ করেই এসব কি বলছে তাকে।
–‘আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে, উনি না জেনেই বলেছেন করতে আমায়!’ উনি শুনলে খুব কষ্ট পাবে আঁধার।
মলিন কন্ঠে কথাগুলো বলে উঠে আরোহী।
–‘সেটা তোমার ভাবতে হবে না যেট বললাম সেটাই করো,আমার কথার উপরে কথা বলবে না মেজাজ খারাপ হয়!’
–‘কিন্তু…’
–‘কথা কানে যায় না তোমার?’
আঁধারের চিৎকারে কেঁপে উঠে আরোহী, অজান্তেই চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি বের হয়ে যায় আরোহী। আঁধার যেনো দেখেও না দেখার মতো করে উল্টো দিকে ঘুরে কিছুটা নরম কন্ঠে বলে,,,
–‘চোখের পানি মুছে নেও,আগেই বলিনি আমার সামনে কাঁদবে না!’
আসলে আরোহীর কান্না দেখে আঁধারের ও কষ্ট হচ্ছে কিন্তু কিছু করার নেই এখন!
চোখের পানি মুছে নেয় আরোহী। ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে বলে উঠে,,,
–‘প্লিজ আঁধার!’
–‘রাগীয়ো না আমায় যেটা বললাম করো!’
শান্ত কন্ঠে বলে উঠে আঁধার। আরোহী আর কিছু বলে না, আঁধারের শান্ত কন্ঠ শুনেই বুঝতে পারছে আঁধার রেগে যাচ্ছে! উপায় না পেয়ে ওভাবেই পার্স নিয়ে রাগে, কষ্টে,দুঃখে বের হয় আরোহী।
গটগট পায়ে হেঁটে রুম থেকে বেড়িয়ে যায় সে,আঁধার আরোহীকে ওভাবে বের হতে দেখে চোয়াল শক্ত করে নিজেও এগিয়ে যায়।
আঁকলিমা চৌধুরী আরোহীকে এভাবে বের হতে দেখে বলেন,,,
–‘কি হয়েছে মা তুই এভাবে কোথায় যাচ্ছিস?’
–‘তোমায় পড়ে বলছি আম্মু, আরু চলো!’
নিচে নামতে নামতে কথাটা ব’লেই আরোহীর হাত ধরে বের হয়ে য়ায় আঁধার। আঁকলিমা চৌধুরী হতবাক হয়ে তাদের যাওয়া দেখে।
গাড়িতে আর কেউ কারো সাথে একটা কথাও বিনিময় করে না! বাসার সামনে গাড়ি থামতেই গটগটিয়ে চলে যায় আরোহী, আঁধারের দিকে একবার ঘুরেও তাকায় না।আঁধার হতাশার নিঃস্বাস ছেড়ে গাড়ি নিয়ে চলে যায়।
বাসায় গিয়ে আরোহী ঘুমাবে বলেই আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। শাহানাজ শেখ হতভম্ব হয়ে গেলেও পরে কি একটা মবে করে মুচকি হেসে চলে যান।
সারারাত কান্না কাটি করে ভোরের দিকে ঘুমায় আরোহী, কারো ধাক্কায় বিরক্ত হয়ে চোখ খুলতেই চেঁচামেচি শুনে ভালো করে চোখ মেলিয়ে তাকায়।
আরোহীকে বড় বড় চোখ করে নিজের দিকে তাকাতে দেখে ভড়কে যাওয়ার কথা হলেও ভড়কায় না রাহি!শয়তানি হাসি হেসে আরোহীকে টেনে বিছানা থেকে তুলে বলে,,,
–‘তাড়াতাড়ি কর, সময় নেই তো!’ আজকে রাতের মধ্যেই তুই নতুন শশুর বাড়িতে চলে যাবি।
–‘হোয়াট, কি আবল তাবল বলছিস তুই রাহি?’ মাথা ঠিক আছে তো তোর?
আরোহীর চিৎকারে রাহি নিজের কান চেপে ধরে বলে,,,
–‘চুপ হয়ে যা মেরি মা,অন্য কারো সাথে না তোর নামে রেজিস্ট্রি করা বরের সাথেই তোর বিয়ে!’
প্রথমে ক্ষিপ্ত চোখে তাকালেও রাহির কথাটা বোঝা মাত্রই আরোহী আবার চেঁচিয়ে ওঠে,,,
–‘কিহ!’
রাহি এবার অসহায় চোখে আরোহীর দিকে তাকিয়ে বলে,,
–‘আসতে চেঁচাতে পারিস না,তোর জন্য আমি কানে কালা হলে আমার বিয়ে করা বরের কি হবে!’
কথাটা ব’লেই জিহ্বায় কাঁমড় দেয় রাহি,ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে বুঝতে পেরেই এক পলক আরোহীর দিকে তাকায় সে।আরোহীকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবার অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় রাহি।আরোহী সন্দেহের চাহনিতে তাকিয়ে বলে,,,
রাহিকে আমতা আমতা করতে দেখে আরোহী এবার নিশ্চিত হয় যে আসলেই রাহির বিয়ে হয়ে গেছে।রাহিকে আর কিছু না বলেই মুখ ফুলিয়ে বসে থাকে আরোহী! রাহি অসহায় চোখে আরোহীর দিকে তাকায়,কিন্তু আরোহী মুখ ঘুরিয়ে নেয়! উপায় না পেয়ে একে একে সবটা আরোহীকে বলতে থাকে রাহি! সবটা শুনে আরোহী কিছুটা স্বাভাবিক হয়,তবে মন খারাপ করেই বলে,,,
–‘যাহ তোর বিয়ে নিয়ে কতো শখ ছিলো কিন্তু কিছুই হলো না!’
–‘আমার নিজের ও কতো প্লানিং ছিলো বিয়ে নিয়ে কিন্তু ওই শয়তান বেডার জন্য কিছুই হলো না!’ বাদ দে চল এখন তোর বিয়েতে মজা করি!
রাহির খুশি খুশি মুখ দেখে আরোহী ভ্রুকুঁচকে বলে,,,
–‘কিসের বিয়ে,কোনো বিয়ে হবে না!’ আমার বিয়ে তো একবার হয়েই গেছে, ওই লোকটা তো বুড়ো ও হয়ে গেছে আর কতো বার বিয়ে করতে হয়!
আরোহীর কথা শুনে রাহি শব্দ করে হেঁসে বলে,,,
–‘কিন্তু ভাইয়া তো বললো ওনার একমাত্র বউয়ের নাকি বিয়ে নিয়ে অনেক শখ ছিলো, তাই আবার বিয়েটা তার বউয়ের শখ পূরণের জন্যই হচ্ছে! ‘
–‘মানে?’
–‘মানে আপনাকে আমার বড় ভাসুর বুঝাবে মেডাম, এখন বর্তমানে আপনি ফ্রেস হয়ে এই নাস্তাটা খেয়ে এই যে, এই শাড়িটি পড়ে আমাদের উদ্ধার করুন!’
–‘কি হচ্ছে আপু এসব,আর তুমি এই অবস্থায় এতো সকালে এখানে কেনো?’ আর কিসের বিয়ে বিয়ে করছো?
–‘একি আরো এখন ও রেডি হসনি,ওরা চলে আসবে তো তাড়াতাড়ি কর!’
এবার আরোহীর মা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে তাড়াহুড়ো করে কথাটি আরোহীর উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেন।
–‘কিন্তু মা!’
–‘কোন কথা না তাড়াতাড়ি কর,এখন সাতটা বাজে আটটা তিরিশের মধ্যে নাহলে নয়টার মধ্যে ওরা চলে আসবে তো!’
আরোহী তার মায়ের কথা শুনে বিরক্ত হয় কিন্তু তার মায়ের চোখ রাঙ্গানো দেখে আর কিছু না বলেই চলে যায় ফ্রেস হতে। আরোহীর মা মুচকি হাঁসে,কিন্তু আলিশাকে দেখে মুখ গম্ভীর করে বলে,,,
–‘আর তুমি,এই শরীর নিয়ে উপরে এসেছো কেনো যদি পড়ে টরে যাও তখন!’ বাচ্চাটার দিকে ও তো খেয়াল রাখতে হবে নাকি?
আলিশার চোখ মুখ এবার উজ্জ্বল হয়ে যায়, ধির পায়ে উঠে তার মাকে হঠাৎ করেই জড়িয়ে ধরে। শাহানাজ শেখ কিছু বলে না কিন্তু ধরেও না।
–‘আমায় কি মাফ করা যায় না মা আমি কি এতোটাই খারাপ,তোমাদের সাথে কথা না বলে আমি ভালো নেই মা!’ সবার এতো ভালোবাসা পেয়েও আমি ভালো নেই, তোমরা আমায় ক্ষমা না করলে আমি কার কাছে যাবো বলো?
কেঁদে উঠে হঠাৎ করেই কথাগুলো বলে আলিশা,শাহানাজ শেখের ও মনটা গলে যায়! তিনি তো মা, আর মায়েরা সন্তান হাজার ভুল করলেও ক্ষমা করার ক্ষমতা রাখে।তিনি আলিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,,,
–‘আমি ক্ষমা তোকে অনেক আগেই করে দিয়েছি মা,কাঁদিস না বাচ্চার ক্ষতি হবে তো!’
আলিশা ও এবার চুপ হয়ে যায়, কিন্তু ওভাবেই তার মায়ের সাথে জড়িয়ে থাকে।
!
!
শাড়ি পড়ে দশ হাত ঘোমটা টেনে এক কোণে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরোহী তার হাত শক্ত করে ধরেই পাশেই রাহি দাঁড়িয়ে আছে। পাশের সোফায় আঁধারের বড় মামী সুরাইয়া বেগম, এক বৃদ্ধা মহিলা ও এক বৃদ্ধ লোক বসে আছে ।
আর তার সামনের সোফায় বসে আছে আঁকলিমা চৌধুরী, জমিলা বেগম ও আয়েশা বেগম আর তার পাশেই অন্য সোফায় এক সুন্দরী মহিলা বসে আছে, যাকে আরোহী চেনে না! তাদের সামনেই টেবিলে নানা ধরনের নাস্তা ও ফলমূল দিয়ে ভরা।
আরোহীদের হয়তো তারা দেখেননি তাই তো তারা নিজেদের মতো গল্প করছে শাহানাজ শেখ ও আমজাদ শেখর সাথে। এরইমধ্যে কোথা থেকে যেনো হুরমুর করে শিহাব,আঁধার ও আদর চলে আসে তারা ও যোগ দেয় তাদের সাথে।
–‘কোথায় আমাদের নাতবউ কে এবার তো নিয়ে আসুন!’
বৃদ্ধা মহিলাটির কথায় শাহানাজ শেখ উঠে আসতেই আরোহীদের দিকে চোখ যায়,তিনি রাহিকে ইশারায় আরোহীকে এগিয়ে নিয়ে আসতে বলেন।
আরোহীরা এগিয়ে আসতে সকলে তাদের দিকে তাকায়,আঁধার, আদর ও শিহাব যেনো আরোহীকে এতো বড় ঘোমটা টেনে আসতে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে যায়। ঘোমটার আড়াল থেকে আরোহী সেটা দেখে ঠোঁট উল্টে তাকায়!
সুরাইয়া বেগম আরোহীকে বৃদ্ধাদের মাঝে বসিয়ে দেয়! আরোহী তার মায়ের শেখানো হিসেবে সালাম দেয়! বৃদ্ধা আরোহী ঘোমটা তুলে বলেন,,
–‘মাশাল্লাহ, চান্দের মতোন বউ আমাদের!’
আরোহী লজ্জায় মাথা নত করে নেয়,এবার বৃদ্ধ লোকটি বলে,,,
–‘আমি কিন্তু তোমার নানা শশুর হই, আর এই বুড়িকে দেখছো না এ হলো তোমার সতীন মানে আমার বউ!’
আরোহী এক পলক তাকিয়ে হেঁসে আবার মাথা নত করে।
–‘তা আপনাদের মেয়ে কি রান্না বান্না সব পারে,আর ঘরের কাজ কর্ম?’
–‘মেয়ে তো দেখি মুখে মুখে তর্ক ও করে,তবে বড় জা হিসেবে আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে!’ এমন একটা বড় জা থাকলে সারাদিন ঝগড়া করতে পারবো আমার আবার ঝগড়া করার খুব শখ!’
–‘আপনি নিজেও তো বড় জা এর মুখে মুখে কথা বলছেন, না এ বিয়ে আমি করবো না!’
এবার আঁধারের মুখটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যায়, সে এতোক্ষণ দু’বোনের কথা শুনে হাসছিলো!
–‘তা বললে তো হয় না বড় জা,বিয়ে তো আপনাকে আমার ভাসুরকেই করতে হবে!’ যান এখন সবার জন্য ফটাফট চা বানিয়ে নিয়ে আসুন তো!
আরোহী এবার মুখ বাঁকিয়ে বলে,,,
–‘আপনার চা এ নিশ্চয়ই চিনি দেব না তাই না ছোট জা,এমনিতে ও মিষ্টি কথা আর বলেনই বা কখন!’
আলিশা কটমট চাহনিতে আরোহীর দিকে তাকায়,কিন্তু ততক্ষণে তার বোন রান্নাঘরে চলে গেছে।আরোহী যেতেই সকলে উচ্চস্বরে হেঁসে ফেলে।আলিশা নিজেও হাঁসে তবে আদরের ধমকে চুপ হয়ে যায়।
–‘এই মেয়ে এভাবে হাসছো কেনো বেবির কষ্ট হবে না!’
আলিশা এবার অসহায় চোখে সকলের দিকে অভিযোগের সাথে তাকায়,সকলে আর এক দফা হাসাহাসি করে।শাহানাজ শেখ ও আমজাদ শেখ মুগ্ধ চোখে তাকায় আদরের দিকে।তাদের মেয়েরা যে নিসন্দেহে ভালো আছে সেটা তারা প্রতিটি কদমে বুঝতে পারছেন।
সকলে চা দেওয়ার পর আরোহী জানতে পারে, আজকে দুপুর বারোটার দিকে তার হলুদ, বিকেল চারটার দিকে মেহেন্দি আর রাত আটটার পর তার বিয়ে। সব প্ল্যান যে আঁধারের সেটা ও সে জানতে পারে।
সেই অচেনা মহিলাটি এবার আরোহীর কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে নিজের পরিচয় দপয়,তিনি শিহাবের আম্মু আর তারেক চৌধুরীর ছোট ভাইয়ের বউ যেটা আরোহী আগে জানতেই পারেনি। এরইমধ্যে শিহাব গলা খেঁকারি দিয়ে বলে,,,
–‘নানুমা তোমার এই নাতিটার ও কি তোমার বিয়ে দিতে ইচ্ছে করে না?’
বিউটি বেগম হেঁসে বলেন,,,
–‘তোর বিহা করার ইচ্ছে থাকলে বল মেয়ে দেখি,কি কস শিরিন!’
শিহাবের আম্মু এবার ভ্রুকুঁচকে তাকায় তার ছেলের দিকে।
শিহাব আমতা আমতা করে বলে,,
–‘আম্মু তোমার ছেলের জন্য ঐ যে আরোর পাশের মেয়েটাকে ভালো মানাবে মেয়েটা ঝগরুটে হলেও বউ হিসেবে ভালোই!’
শিহাবের হাতের দৃষ্টি অনুযায়ী সকলে এক পলক রাহির দিকে তাকায়,বেচারি লজ্জা পেয়ে রান্না ঘরে চলে যায়।শিরিন চৌধুরী মুচকি হেসে গিয়ে শিহাবের মাথায় গাট্টা মেরে বলে,,
–‘ফাজিল, এভাবে কেউ বলে মেয়েটা লজ্জা পেয়েছে তো!’
–‘বাট আমি সিরিয়াস আম্মু!’
–‘নাতি চিন্তার কিছু নেই তোমার এই নানুভাই আছে কিসের জন্য! ‘
–‘মেয়ে মানুষের মতো কথায় কথায় গায়ে পরিস কেনো,আমার তো মাঝে মাঝে তোর উপর ডাউট হয়!’
আদর ফিঁক করে হেঁসে দেয়,তার পাশে আলিশার ও একই অবস্থা। শিহাব এবার অসহায় চোখে আরোহীর দিকে তাকায়।
যার অর্থ,বোন এটাকে নিয়ে কিভাবে সংসার করিস তুই! কিন্তু আরোহী একটা ভেংচি কেটে চলে যায়,শিহাবের এবার হিচকি উঠে যায়! এক চোরের কাছে আর এক চোরকে নিয়ে বিচার দেওয়ার মতো তার অবস্থা হয়েছে।
!
!
হলুদের জন্য তৈরি হয়ে কখন থেকে বসে আছে আরোহী কিন্তু রাহি ঐ যে তাকে বসিয়ে রেখে গেছে এখনো তার আসার নাম নেই। কি জানি কোন মেহমানের পাল্লায় পরেছে সে এখন, এইটুকু সময়ের মাঝে সকল আত্নীয় স্বজনদের দাওয়াত করেছে তার বাবা ও আঁধাররা!
আরোহী অবাকের উপর অবাক হচ্ছে, সব কিছু তার স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে! তার ইচ্ছে ছিলো এভাবে বিয়ে করার সত্যি যে তার ইচ্ছে পূরণ হবে সে কল্পনায় ও ভাবেনি।
এরইমধ্যে দরজা বন্ধ করার শব্দে চোখ তুলে তাকায় আরোহী, কিন্তু হঠাৎ আঁধারকে দেখে অবাক হয়! তবে তার অবাক হওয়া আর বেশিক্ষণ থাকে না আঁধারকে ভালো করে লক্ষ করতে তার নজর আঁটকে যায়!
হলুদ একটা পাঞ্জাবি পরেছে আঁধার সাথে সাদা পায়জামা আর গলায় একটা সবুজ ওরনা টাইপ কিছু একটা হবে যেটা সে গলায় ঝুলিয়ে রেখেছে।তার ফর্সা শরীরে মনে হচ্ছে হলুদ আর সবুজ রংটা একটু বেশিই মানিয়েছে।আরোহীর তো মনে হচ্ছে রংটা আঁধারের জন্যই তৈরি!
প্রতিদিনের মতোই হাতে ব্যান্ডের ঘড়ি,চুলগুলো সবসময়ের মতো স্পাইক করা তবে আজকে একটু ব্যাতিক্রম! কিছু কিছু চুল এসে কপালে পরছে, এতে যেনো আঁধারকে আরও বেশি সুদর্শন লাগছে।আরোহী তো হাঁ করে তাকিয়ে আছে, এই ছেলেটা যে তার নামে রেজিস্ট্রার করা সেটা সে ভুলেই গেছে।
আরোহীকে এভাবে তাকাতে দেখে আঁধার বাঁকা হাঁসে!আরোহীকে সে অনেকক্ষণ থেকেই খুঁটিয়ে খাঁটিয়ে দেখছিলো দরজায় দাঁড়িয়ে, তার এই পিচ্চি বউটাকে হলুদ পরির থেকে কম লাগছে না অবশ্য!
এই যে হলুদ আর সবুজ রংয়ের মিশ্রণের শাড়িটাতে তার বউকে অপ্সরীর মতোই তো লাগছে তার কাছে! মুখে হালকা মেকাপ, তাজা ফুলের গহনা, কমোড়ে কোমড় বন্ধনী! চুলগুলো খোঁপা করে মাথায় ফুলের টায়রা!
আঁধার আর এক দফা ক্রাশ খায় তার আরুপাখিকে দেখে।ইচ্ছে করছে ঝাপটে ধরে বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখতে। মুখের উপর গরম নিশ্বাস পরতেই আরোহী চোখ বন্ধ করে নেয়!
আঁধার একটা হাত দিয়ে এবার আরোহীর কোমড় জড়িয়ে ধরে, আর একটা হাত দিয়ে আরোহীর শাড়ি ভেদ করে উমুক্ত পেটে হাত রাখে!নিজের পেটে ঠান্ডা কোন কিছুর আভাস পেতেই শিউরে উঠে আরোহী, আঁধার আরোহীর শিউরে ওঠা দেখে হেঁসে বলে,,
–‘Happy six months Anniversary Arupakhi !’
আরোহী চমকে চোখ খুলে তাকায় আঁধারের দিকে,আজকে তাদের ছয় মাস পূর্ণ হলো বিয়ের তার তো মনেই ছিলো না! এইতো সেদিনই সে আঁধারকে বললো ছয় মাস হতে চললো তবে সেটা যে আঁধার মনে রাখছে তার ধারনার বাহিরেই ছিলো।
আরোহীর ভাবনার মাঝেই আঁধার টুপ করে তার গালে একটা চুমু খায়,আরোহী হেঁসে আঁধারের দিকে তাকায়।আঁধার আবার একই কাজ করে, আরোহী এবার লজ্জা পায়!
–‘তোমায় সর্বপ্রথম আমি হলুদ লাগিয়ে দিলাম কিন্তু এখন পাওনা হিসেবে আমায় একটা ঝটপট চুমু দিয়ে দাও তো!’
আঁধারের কথা শুনে আরোহী লজ্জায় মাথা নিচু করে নেয়। আঁধার এবার আরোহীর গালে আর একটা চুমু দিয়ে বলে,,,
–‘একি তুমি লজ্জা পাচ্ছো,যে মেয়ে ভড়া মাঠে আমার ঠোঁটে চুমু খেতে পারে সে এখন লজ্জা পাচ্ছে এটা ও সম্ভব!’
আরোহী এবার আঁধারের দিকে তাকিয়ে আবার লজ্জায় মাথা নিচু করে নেয়।আঁধার বাঁকা হেসে বলে,,,
–‘দিস ইজ নট ডান আরুপাখি, তুমি আমায় আমার পাওনা দিচ্ছো না আমি কিন্তু পাওনা না পেলে ওই যে তোমার লাল গোলাপি ঠোঁট জোড়ায় কামড়ে দিবো!’ তখন মানুষের সামনে কি ভাবে যাবে বলো,বিয়ে শাদির ব্যাপার লোক জনের কাছে লজ্জায় পরতে হবে না।
আঁধারের বলতে দেরি হলেও আরোহীর তার গালে চুমু দিতে দেরি হয়নি।আঁধার মুচকি হেঁসে আরোহীকে জড়িয়ে ধরে বলে,,,
–‘আরুপাখি!’
–‘হুম!’
–‘আজকের দিনটি তোমার ও আমার জন্য অনেক স্পেশাল, আজকের দিনে ছয় মাস আগে ভাগ্য আমাদের একসাথে জড়িয়েছিলো।’ আর আজকের দিনেই দেখো আবার আমরা এক হতে যাচ্ছি, তোমার জন্য অনেক কিছু অপেক্ষা করছে আজকে রাতে! বি রেডি।
আরোহী আঁধারের কথা শুনে কিছু বলতে যায় তবে আঁধার বলতে দেয় না,আরও শক্ত করে ধরে বলে,,,
–‘হুস,নো মোর ওয়াড!’
আরোহী চুপ করেই পরে থাকে তার রাগি বরের বুকে,কিছুক্ষণ ওভাবেই কেটে যায়! আঁধার এবার আরোহীর কপালে শব্দ করে একটা চুমু খেয়ে বলে,,,
–‘এখন আমি আসি নাহলে আমি নিজেকে আর কন্ট্রোল করেতে পারবো না বউ!’ তুমি লজ্জা পেয়ো না আর রাতের জন্য রেডি থেকো।
আর দাঁড়ায়নি আঁধার, দরজা খুলেই চলে গেছে, আরোহী লজ্জায় মুখ ঢেকে নিয়েছে আর মনে মনে বলছে,” লোকটা এমন কেনো!”
রাহি ঢুকেই আরোহীকে লাল বেগুনি হতে দেখে বলে,,,
–‘কি ব্যাপার আরো মেডাম,স্যার কি একটু বেশি ডোজ দিয়ে গেলো নাকি?’
–‘তুই… ‘
–‘আমি আর রাহিই তো পাহারাদার হিসেবে ছিলাম আর আমরা জানবো না!’
আলিশা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসতে আসতে বলে।আরোহীর লজ্জা যেনো আরও কয়েকগুন বেড়ে যায়।এরইমধ্যে নিচে থেকে আওয়াজ আসে আরোহীকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আলিশা আর রাহি দেরি না করে নিয়ে যায়।
হলুদের স্টেজ করা হয়েছে আলিশাদের বাসার সাথে বাগান বাড়িতে! আরোহীকে স্টেজে বসানো হয়, সকলে এক এক করে হলুদ লাগানো শুরু করে!
আলিশার ফোনে কল বেজে ওঠে, আদরের কল দেখতেই আলিশা এক পলক সকলের দিকে তাকায়,এতো আওয়াজের মধ্যে কথা বলতে সমস্যা হবে ভেবেই বাড়ির ভেতরে চলে যায় আলিশা।
ফোন কানে ধরতেই কোথা থেকে দুটো ঠান্ডা শীতল হাত আলিশার শাড়ি ভেদ করে পেট স্পর্শ করে।চমকে ওঠে আলিশা কিন্তু পরক্ষণেই স্পর্শের মালিককে চিনতে পেরে হাফ ছেড়ে বলে,,
–‘তুমি এখানে কখন আসলে,ভয় পেয়ে গেছিলাম তো!’
আদর এবার আলিশাকে ঘুরিয়ে দু’হাতে আবদ্ধ করে বলে,,,
–‘তোমায় ও বাবুকে মিস করছিলাম বউ,তাই তোমার টানে ছুটে আসলাম!’
আলিশা হাঁসে আদরের কথায়,ছেলেটা যে এখন ধিরে ধিরে তার প্রতি আসক্ত হয়ে যাচ্ছে সেটা তার কাজেই বুঝিয়ে দিচ্ছে আলিশাকে।আলিশা নিজেও এই ছেলেটাকে এখন অনেক ভালোবেসে ফেলেছে, তাই তো চোখের আড়াল হলে অন্তরটা পুরে যায় তার।
–‘আমি না দিনে দিনে কেমন বউ পাগল হয়ে যাচ্ছি আশা,সবাই কিছুদিন পরে আমায় বউ পাগল বলে বসবে!’ আমি কি করবো বলো তোমার নেশা যে আমায় ধিরে ধিরে তোমার প্রতি আসক্ত করে নিচ্ছে! এই আসক্ত থেকে মুক্ত হওয়ার উপায় কি তুমি বলতে পারবে বউ।
আলিশা এবার লজ্জা পায়,পরক্ষণেই তার লজ্জারা ছুটে পালায় যখন হাত ভর্তি হলুদ তার গালে লাগিয়ে দেয় আদর।আলিশা চোখ মুখ কুঁচকে বলে,,,
–‘এটা কি করলে তুমি হলুদ আমার একদম পছন্দ না!’
আলিশাকে মুখ ফুলিয়ে থাকতে দেখে শব্দ করে হাঁসে আদর! আলিশার মন ভালো হয়ে যায় আদরকে হাসতে দেখে,সে মুগ্ধ চোখে তার প্রেমিক পুরুষ নামক বরটাকে দেখতে থাকে।
ফুলের ডালা নেওয়ার জন্য আসছিলো রাহি, কোথা থেকে দু’টো হাত তাকে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে। রাহি ভয় পেয়ে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়।
শিহাব হালকা হেসে রাহির মুখের উপর ফুঁ দেয়,হালকা কেঁপে উঠে রাহি।চোখ খুলেই শিহাবের মুখ দেখে সস্থির নিশ্বাস ছাড়ে রাহি।কিন্তু পরক্ষণেই শিহাব যখন নিজের গালে হলুদ লাগায় অবাক হয় রাহি।
কিন্তু তার অবাক হওয়া লজ্জায় পরিনত হয়ে যায়, যখন শিহাব নিজের গালের সাথে তার দু গালে পর পর ঘসে দেয়।রাহিকে লজ্জা পেতে দেখে শিহাব বাঁকা হেসে বলে,,,
–‘এভাবে লজ্জা পেয়ো না জানেমান খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে!’
রাহি এবার আরও বেশি লজ্জা পায়, শিহাবকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে দৌড়ে চলে যায়। আর শিহাব চেঁচিয়ে বলে উঠে,,,
–‘এর পরের সিরিয়াল কিন্তু আমাদের সো গেট রেডি মিসেস রাহিয়ানা রাহি চৌধুরী!’
রাহি ঘুরেও তাকায় না,তবে মেয়েটা লজ্জায় লাল হয়ে যায়।
অক্টোবরের শেষের দিকে হালকা ঠান্ডার প্রকোপ সাথে রয়েছে হালকা ঠান্ডা বাতাস! একটু বাতাস গায়ে লাগলেও গায়ের লোম দাঁড়া হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
কিন্তু এই ঠান্ডার মধ্যেও রাতের অন্ধকারে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে গুনগুনিয়ে গান গাচ্ছে এক অদ্ভুত রমনী।
কিছুক্ষণ ওভাবেই কেটে যাওয়ার পর দুটি শীতল হাতের স্পর্শ কোমড়ে পেতেই শিউরে ওঠে আরোহী । না দেখেই ঠান্ডা স্বরে বলে,,,,
–‘ঘুম ভেঙ্গেছে আপনার?’
আরোহীর করা প্রশ্নে আঁধার উত্তর না দিয়ে পেছন থেকে আর একটু শক্ত করে জড়িয়ে নেয় আরোহীকে।কিন্তু আরোহী যখন তার হাতের উপর হাত রাখে কেঁপে উঠে আঁধার।
আরোহীকে তড়িঘড়ি করে ছেড়ে দিয়ে কন্ঠে রাগ নিয়ে বলে,,,,
–‘এই ঠান্ডার মধ্যে এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?’ শরীর তো পুরোই ঠান্ডা হয়ে গেছে।
আঁধারের করা প্রশ্নে আরোহী হালকা হাঁসে, কিন্তু কিছু বলে না।আঁধারের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, চুপচাপ ঘরে চলে যায়,একটা শাল নিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রবেশ করে।
বিনা বাক্যে শালটা আরোহীর গায়ে জড়িয়ে দেয়,আরোহী নিজেও নিশ্চুপ হয়ে দূরে ফাঁকা রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। আঁধার আবার শক্ত করে তার প্রেয়শীকে জড়িয়ে ধরে বলে,,,,
–‘কি হয়েছে বউ, মন খারাপ কেনো? ‘
আরোহীকে আগের মতোই নিশ্চুপ দেখে আঁধার নিজে ও আরোহীর দৃষ্টিকে অনুসরণ করে ফাঁকা রাস্তার দিকে তাকায়।কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না সে আসলে কেনো তার বউ ওদিকে তাকিয়ে আছে।
এবার আরোহীকে ছেড়ে দিয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় আঁধার, কিন্তু তাকে সামনে দাঁড়াতে দেখে মাথা নিচু করে নেয় সে।আঁধার আরোহীর দুই গালে হাত দিয়ে মুখটা উঁচু করে বলে,,,,
–‘আরুপাখি, কি হয়েছে জান আমায় বলবে না!’
আঁধারের আদুরে ডাকে এবার হয়তো তার আরুর মন গলে যায়,দু’হাতে ঝাপটে ধরে আরোহী তাকে।আঁধার অবাক হয় না বরং হেঁসে ফেলে!
মেয়েটি ও যে তাকে প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলেছে সেটা এখন আঁধার তার প্রতিটা পদক্ষেপেই বুঝতে পারে।
–‘আমার ও বাচ্চা চাই মিস্টার চৌধুরী !’
হঠাৎ করেই আরোহীর এই কথাটা শুনে কিছুটা চমকে যায় আঁধার! অবাক হলেও শান্ত কন্ঠে আরোহীকে জড়িয়ে ধরে বলে,,,
–‘সময় হলে বাচ্চা ঠিকই হয়ে যাবে, তুমি আর একটু বড় হও!’
–‘আর কতো বড় হবো বলেন তো, বিয়ের ছয় মাস হয়েই যাচ্ছে!’
–‘শুধু বিয়ের ছয় মাস হয়ে যাচ্ছে বললে তো আর হবে না, বাসরটা ও তো করতে হবে নাকি!’
আঁধারের ফিসফিস কন্ঠে কেঁপে উঠে আরোহী, আঁধারকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,,,
–‘আমার বাচ্চা চাই!’
–‘হুম!’
এবার আঁধার কিছুটা নরম কন্ঠে বলে,,
–‘কি হুম!’
–‘এই যে তোমার বাচ্চা চাই।’
আঁধারের দায়সারা কন্ঠে আরোহী হঠাৎ রেগে যায়,আঁধারের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে শক্ত কন্ঠে বলে,,,
–‘আপনার বাচ্চা চাই না,আপনি বাবা হতে চান না?’
–‘আমি কখন বললাম চাই না রে বাবা, চাই তো!’ কিন্তু মিসেস চৌধুরীর মাথায় হঠাৎ এইসব কে ঢুকালো শুনি?
আরোহীকে টেনে আবার বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে বলে আঁধার। আরোহী হাসফাস করতে করতে বলে,,
–‘বড় মামীরা এসেছিলেন না আজকে তারাই বলছিলেন যে আপুর বিয়ের আট মাস কিন্তু বাচ্চা তাড়াতাড়ি নিয়ে নেওয়ার কারণে বাচ্চার বয়স ও তো সাত মাসই।’ কিন্তু আমি বড় জা হয়ে এখন ও বাচ্চা নিতে পারলাম না,আমায় ডাক্তার দেখানোর কথা বলেছেন উনি আঁধার!’ বলেছেন আমার হয়তো কোন সমস্যা আছে।
কথাগুলো বলতে বলতে আরোহীর চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে আঁধারের শার্টে পড়ে।আঁধার চোয়াল শক্ত করে আরোহীকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দেয়।
–‘তার মানে তুই মানুষের কথায় বাচ্চা নিতে চাস,নিজের ইচ্ছেতে না!’ তাই তো বলি ভুতের মুখে হঠাৎ রাম রাম কেনো।
–‘উনি তোকে ওইসব বলছিলো আর তুই চুপচাপ শুনতেছিলি,মুখ নেই তোর উত্তর দিতে পারিস না!’ ওনাকে তো আমি দেখছি দাঁড়া, আর পরে তোকে দেখছি।
আরোহীর কথা শেষ হওয়ার আগে আঁধার শক্ত করে তার দু’বাহু চেপে ধরে বলে।আরোহী ভয় পেয়ে দু’কদম পেছনে চলে যায় ঠিকই কিন্তু আঁধারের আক্রমণে হতভম্ব হয়ে যায়।
আঁধার যে এতোটা রেগে যাবে সেটা তার ধারণার বাহিরে ছিলো। আর কোন কিছু না ভেবেই শক্ত করে আঁধারকে জড়িয়ে ধরে আরোহী। মুহুর্তেই যেনো আঁধারের সব রাগ উড়ে চলে যায়।
–‘উনার সাহস কি করে হয় আরু তোমায় এসব বলার,উনি আমার বউয়ের মাতৃত্বের উপর আঙ্গুল তোলার কে?’ উনি জানে না তুমি কার বউ।
–‘মানুষ কি আর আমাদের ঘরের ভিতরের খবর জানে বলেন, তাই হয়তো বলেছে।’
আঁধার নিজেও চুপ হয়ে যায়,আসলেই তো তাদের বিয়ের ছয় মাস হয়ে যাচ্ছে কিন্তু তাদের মধ্যে তেমন কোন সম্পর্কই হয় নি।আঁধার অনেক কয়েকবার কন্ট্রোলেস হলেও, অনেক কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে নিয়েছিলো শুধু মাত্র আরোহীর সম্মতির জন্য। কিন্তু বোকা আরোহী এখন অব্দি সেটা বুঝতেই পারেনি।
–‘জানেন আঁধার আমার না বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিলো, কিন্তু ভাগ্যে খেলা দেখেন বিয়ের দিন কতো কিই না ঘটে গেলো!’
–‘হুম যাও ঘুমাও!’
হঠাৎ করেই আঁধারের গম্ভীর কন্ঠে আরোহী খানিকটা অবাক হয়, কিন্তু যায় না।আঁধার এবার আর কোন কথাই বলে না, আরোহীকে ঝট করে কোলে তুলে নেয়।আঁতকে উঠে আরোহী! আঁধার আরোহীর মুখের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলে,,,
–‘আপনার না বাচ্চা চাই মিসেস চৌধুরী, তো এবার…’
আরোহী লজ্জায় লাল হয়ে যায়, কিন্তু তার লজ্জারা বিরক্ততে ছুটে পালায়, যখন আঁধার তাকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে বলে,,,
–‘চুপচাপ ঘুমাও আমি এসে যেনো দেখি তুমি ঘুমিয়েছো। ‘
–‘আর আপনি!’
বিরক্ত হয়ে বলে আরোহী! আরোহীর রিয়াকশন দেখে আঁধার হেঁসে বলে,,,
–‘তোমার না বাচ্চা চাই তারই প্লানিং করতে যাচ্ছি!’
–‘এ্যাঁ!’
–‘এ্যাঁ নয় মিসেস চৌধুরী হ্যা!’
আরোহী কিছু না বুঝে লজ্জায় উল্টো দিকে ঘুরে সুয়ে পড়ে আর আঁধার দরজা খুলে সোজা বাহিরে চলে যায়। এক পলক তাকায় আরোহী, কিন্তু আঁধারকে আবার ফিরে আসতে দেখে চোখ বন্ধ করে নেয়।আঁধার হেঁসে বলে,,,
–‘তুমি যদি এবার না ঘুমিয়েছো তাহলে কিন্তু আমি আমার টেকনিক ইউসড করবো,দেন জানোই তো!’
–‘অসভ্য!’
বিরবির করে বলেই চোখ বন্ধ করে নেয় আরোহী। আঁধার এবার নিশ্চিন্তে চলে যায়।
রাহির ফোন অনবরত বাঁজছে, কিন্তু মেয়েটা ঘুমে এতোটাই বিভোর সে যেন শুনছেই না।কিন্তু কলদাতা যেনো থামার নামই নিচ্ছে না।বার বার ফোনের আওয়াজে এবার বিরক্ত হয়ে রাহি ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরতেই তার ঘুম ছুটে যায়।
–‘ভুলেও ফোন কাটার চেষ্টা করবে না, নাহলে আমি কিন্তু বেলকনিতে টপকে উপরে চলে আসবো সেটা কিন্তু তোমার জন্য সুবিধে হবে না!’
রাহি ফোনটা কান থেকে সরিয়ে একপলক দেখে আবার কানে দেয়, কিন্তু আবার একটা রাম ধমকে তার সব ঘুম ছুটে যায়।
–‘তোমার সাহস হয় কি করে আমায় ইগনোর করার,দুই ফুটের একটা মেয়ে হয়ে আমায় ইগনোর করছো ইডিয়েট!’
–‘আমি…’
রাহির কথা শেষ হওয়ার আগেই লোকটি গম্ভীর কন্ঠে বলে,,,
–‘নিচে আসো ইমিডিয়েটলি!’
–‘এতো রাতে নিচে আমি কিভাবে যাব,পাগল আপনি কেউ দেখে নিলে কি হবে!’
রাহির একটা কথায় যথেষ্ট ছিলো লোকটির রাগ বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য।
–‘তুই যদি পাঁচ মিনিটের ভেতরে নিচে না আসিস আমি কিন্তু কলিং বেল বাজিয়ে দিবো! ‘ সেটা কিন্তু তোর জন্য ভালো হবে না।
রাহি এবার ভয়ে জমে যায়,এই লোকের যে রাগ কখন না জানি সত্যি সত্যি বেল বাজিয়ে দেয়।ভয়ে ভয়ে এবার বলে উঠে রাহি,,,
–‘আসছি!’
রাহির কথা শুনে লোকটা এবার প্রসস্ত হেসে ধির কন্ঠে বলে,,,
–‘সাবধানে আসো!’
ব’লেই ফোন কেটে দেয় লোকটি।রাহির রাহি হয় অনেক,এই লোকটার প্রেমে যে কেনো পড়তে গেলো মনে মনে নিজেকে শ খানিক গালি দিয়ে বলে,,,
–‘ইইই ঢং,নিজেই পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসতে বলে এখন নিজেই বলছে সাবধানে আসো!’
বিরক্তির সহিত কথাটা বলেই, গায়ে ভালো করে ওরনা জড়িয়ে পাঁ টিপে টিপে এগিয়ে যায়।ড্রয়িং রুমে সাবধানতার সহিত টেবিলর উপর থেকে চাবির গোছাটা তুলে দরজা খুলে এগিয়ে যায়।দুইতলায় থাকে তারা, সেই হিসেবে তাকে এখন সাবধানতার সহিত যেতে হবে ভেবেই এক পলক আসে পাশে তাকায়!
না সব ফ্লাটের দরজা বন্ধ! কিন্তু নিচে এসে আর কাউকে দেখতে পায় না,তবে দারোয়ান ঠোঁট উল্টে ঘুমিয়ে আছে দেখেই শব্দ করে হেঁসে ফেলে রাহি।পরমুহূর্তেই নিজের মুখ চেপে ধরে একটু পিছিয়ে যায় যেনো ঘুম ভাঙ্গলে ও দারোয়ান তাকে দেখতে না পারে।
হঠাৎ করেই দু’টি হাত তাকে টেনে নিয়ে পাশের গাছের সাথে চেপে ধরে বলে,,,,,
–‘এবার দেখি কি করে ইগনোর করেন!’
রাহি ভয়ে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নিলেও কন্ঠে মালিকে চিনতে পেরেই হাফ ছেড়ে বাঁচে মনে হয়! কিন্তু পরক্ষণেই কিছু একটা মনে হতেই ভয়ে কেঁপে উঠে।
–‘তোমার সাহস দেখে আমি রীতিমতো অবাক হচ্ছি,প্রথমে আমায় নিয়ে এতো মাতামাতি করলে,প্রেমে ফেললে আর এখন রাত দিন তোমার পেছনে ঘুরচ্ছ!’ টাইম পাস করতে চেয়েছিলে নিশ্চয়ই, বাট ইয়োর ব্যাড লাক সুইটহার্ট! তুমি নিজেও ভালো করে জানো তুমি কার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছো,চাইলেও তুমি আর আমার থেকে দূরে যেতে পারবে না!
বলেই লোকটি একটু ঝুকে রাহির গলায় শক্ত করে একটা কামড় বসিয়ে দেয়।
সকালে,,,,,
আরোহী ঘুম থেকে উঠে ও আঁধারকে পাশে পায় না অবাক হয় সে,মনে মনে ভাবে,,, “তাহলে কি রাতে আঁধার আর ঘরেই আসে নি!”
ফ্রেস হয়ে নিচে যেতেই আঁধারের বড় মামী, তার সাথে মেজো ও ছোট মামীকে বসে থাকতে দেখে কিন্তু আঁধারকে না পেয়ে হতাশ হয়। এরইমধ্যে আঁধারের বড় মামী বলে,,,
–‘কি গো বড় বউ, এতো বেলা অব্দি ঘুমানোটা কেমন অভ্যেস শুনি!’ তুমি থাকতে আপাকে কেনো রান্না করতে হবে সকাল সকাল, বাপের বাড়ি থেকে কি কিছু শিখে আসো নি! আর এ কি সকাল সকাল গোসল না করে চলে আসলে যে, বলি আজকালকার মেয়েরা তো লজ্জা সরমের মাথা খেয়ে বসে আছে! কি দেখে যে তোমায় আঁকলিমা বড় ছেলের বউ করে নিয়ে এসেছে সেটাই বুঝতে পারছি না।
বড় মামী শাশুড়ীর কথা শুনে আরোহীর লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে,কিন্তু বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছে না সে।এরইমধ্যে আলিশা সাত মাসের পেটটা ধরে ধিরে ধিরে নিচে নেমে আসে।
ভদ্রমহিলা এবার আলিশাকে দেখে নাক মুখ কুঁচকিয়ে কিছু বলবেন তার আগেই আঁকলিমা চৌধুরী হতদন্ত করে ছুটে এসে আরোহীকে জড়িয়ে ধরেন। আরোহী অবাক হয়ে যায়, উনি যে কিচেন থেকেই এসেছেন সেটা তার হাতের আটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
–‘আপা আপনি মনে হয় ভুলে যাচ্ছেন ওরা আমার ছেলের বউ না মেয়ে, আর আপনার বাড়ির মেয়েরা যদি বেলা দশটা অব্দি ঘুমাতে পারে আমার বাড়ির বউরা কেনো সকাল আটটা অব্দি ঘুমাতে পারবে না!’ আর বাপের বাড়ি থেকে শিখে আসেনি না তাদের এই মা তাদের হাতে কলমে সবকিছু শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে। এরপর থেকে আপনি আমার মেয়েদের সাথে এভাবে কথা বলবেন না অনুরোধ রইলো।
–‘কিন্তু তাই বলে গোছল করে আসবে না এটা কেমন কথা আঁকলিমা,সকাল সকাল যে গোছল করতে হয় এটা তুই ওদের শিখাসনি!’
–‘আপনার কথার ভিত্তিতে যেটা আপনি বুঝচ্ছেন সেটা হয়নি বড় মামী তাই গোছল করার ও প্রয়োজন নেই আমার বউয়ের!’
বাহিরে থেকে আসতে আসতে কথাটি বলে আঁধার।মুলত সে ওইটুকুই শুনেছে বাহির থেকে আসার সময়। ভদ্রমহিলা চুপ হয়ে যান, আঁধার বরাবরই টেরা কথা বলে তার সাথে তাই তিনি আঁধারকে একটু ভয় পান।আঁকলি চৌধুরী নিজেও আলতো হাসেন। তাকে ঘটনাটা লিমা গিয়ে বলতেই তিনি ওভাবেই ছুটে এসেছেন।
আলিশা মুখ চেপে হেসে ফেলে, আঁধারকে তার বরাবরই মুখের উপর জবাব দেওয়ার কারণে ভালো লাগে। সে তো নিজেও ভয়ে ভয়ে ছিলো এই মহিলার জন্য না জানি কি থেকে কি বলে।কালকেও তাকে ও আরোহীকে অনেক কথা শুনিয়েছে কিন্তু সকলের আড়ালে।
সেসব যদি আজকে আঁধার শুনে তো মহিলার চাটনি বানিয়ে দিবে বুঝতেই পারছে আলিশা।তবে আঁধারের মেজো ও ছোট মামী খুবই নমনীয়, তারা আলিশা ও আরোহী উভয়কেই অনেক আদর করেছে কালকে।
–‘আর বড় মামী, একটা ছেলের বাচ্চার জন্য খুশি না হয়ে আপনি আর একটার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন!’
সোফায় আরাম করে বসতে বসতে বলে কথাটি আঁধার। সকলে অবাক হয় আঁধারের কথায়,শুধু মাত্র আলিশা ও আরোহী ছাড়া। ভদ্রমহিলা শুকনো ঢোক গিলে আরোহীর দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকায়।
–‘কি বলছিস তুই এসব আঁধার! ‘
–‘উফফ মা তুমি তো দেখছি কিছুই জানো না, বড় মামীর মনে হয়েছে আমার বউয়ের সমস্যা আছে তাই এখনো তার বাচ্চা হচ্ছে না!’ তাই তো উনি আমার বউকে ডাক্তার দেখানোর পরামর্শ দিয়েছেন।
–‘বাবা আঁধার তুমি ভুল বুঝছো,আমি তো বলেছি আজকালকের যুগে বাচ্চা নিতে সমস্যা হয় তাই বউমাকে ডাক্তার দেখানের কথা বলেছিলাম।’
মিনমিন করে কথাটি বলেন ভদ্রমহিলা।আঁকলিমা চৌধুরী চোয়াল শক্ত করে মনে মনে তারেক চৌধুরীকে সবকিছু জানানোর সিদ্ধান্ত নেন।
–‘আপনার কি মনে হয় বড় মামী আপনি কি গুনিক যে গুনেই বলছেন ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা,তবে একটা কথা শুবে রাখেন।আল্লাহ যেদিন আমাদের বাচ্চা দিবেন সেদিনই আমাদের বাচ্চা হবে! ‘ আর আপনার কথায় আমরা বাচ্চা নিতে যাব না,দয়া করে এ-সব আর আমার বউয়ের মাথায় ঢুকানের চেষ্টা করবেন না নাহলে ফল খুব একটা ভালো হবে বলে মনে হয় না! আর হ্যা আমার বউ আপনাকে সন্মান করে তাই কিছু বলতে পারে না সো সাবধান।
“তুই তো জানিস আমি মা ছাড়া বড় হয়েছি,কিন্তু সবকিছু তোদের বলা হয়নি রে! জানিস ছোট বেলায় যখন আমি কোনো ভুল করতাম আম্মু আমায় সবসময় হাসিমুখে শিখিয়ে দিতো সঠিকটা। আর বলতো,,’ নীলি মা সবসময় সঠিকটা তোকে শিখিয়ে দেওয়ার জন্য কিন্তু আমি থাকবো না, তাই ভুলগুলোকে এখন থেকে শুধরে নেওয়ার চেষ্টা কর!’ তখন আমি কেবল ক্লাস ফাইভে পড়ি, একটু হলেও বুঝতাম মায়ের কথার মানে তবে ওতোটা ও বুঝতাম না। তাই তো আম্মুকে সবসময় জড়িয়ে ধরে বলতাম,,, ‘তুমি থাকতে আমায় আর কোনো কিছু শিখতে হবে না আম্মু।’ আম্মু হাসিমুখে বলতো,, ‘ পৃথিবীটা বড্ড কঠিন রে মা, তুই এতো সহজ সরল তোর জন্য আমার ভয় হয়, আমি যদি না থাকি তোর আব্বু তোকে আগলিয়ে রাখবে !’ আর দেখ সেই দিনটা আসলো কিন্তু আব্বু আমায় আর আগলিয়ে রাখলো না রে আঁধার, রাখলো না।হঠাৎ করেই একদিন সকালে আম্মুরগলায় দড়ি দেওয়া লাশটা আমাদের বাসার সামনের বট গাছে ঝুলতে থাকতে দেখলাম আর সে দিন থেকেই আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেলো।আম্মুকে কবর দেওয়ার পরপরই আব্বু তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে ঘরে তুলে নিয়ে আসলো। আত্মীয় স্বজনরা সবাই অবাক হলো তাদের মনে হলো আমার মায়ের মৃত্যুর মূল কারণ এটাই হয়তো, তবে স্বাভাবিক থাকলাম আমি খুশি হলাম এটা ভেবে আমার আম্মু হয়তো ওই মহিলার ভেতরে ঢুকে এসেছে,কথাটা হাস্যকর তাই না, তবে আমার ছোট মস্তিষ্কে কেনো জানি না এটাই মনে হয়েছিলো। তারপর থেকেই শুরু হলো আমার নতুন মায়ের আমার প্রতি আদর! উহু সেই আদর না যেটা তোরা তোদের মায়ের কাছে পাস, সৎ মায়ের আদর। সেদিনের মতো কিছু না বললেও কিছুদিন পর থেকেই আমায় কারণ ছাড়া মারতো, অথচ আমার বাবা কিছুই বলতেন না তার চোখের সামনেই আমাকে দিয়ে বাড়ির সব কাজ করানো থেকে শুরু করে একটু ভুলের জন্য মারা, দুদিন অব্দি না খেয়ে রাখা সব করতো কিন্তু বাবা সে ছিলো নির্বাক। তখন থেকে আমার বাবার উপর অভিমান জমতে শুরু করলো আর সেই অভিমান যেটা এখন অব্দি আছে। আমাদের বন্ধুত্বর প্রথম দিনের কথা মনে আছে তোর, যেদিন তুই, সোহেল, শিহাব ও রাতুল মিলে এই ছোট আমিটাকে বাঁচিয়েছিলি। সেদিন ও ছোট মায়ের অত্যাচারে রাস্তায় এসেছিলাম মরার জন্য কিন্তু তুই নিজের জীবনের বিনিময়ে আমায় বাঁচিয়েছিস অথচ নিজেই মৃত্যুর সাথে লড়াই করে বেঁচে ফিরতে পারলি। তখন থেকেই আমার মনে তোর জন্য আলাদা একটা ভালোলাগা কাজ করতো বড় হওয়ার সাথে সাথে সেটা ভালোবাসায় পরিনত হয়ে গেলো কিন্তু সেটা একতরফা! বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার ভয়ে তোকে বলিনি, তবে যেদিন আরোহীকে নিজের বউ হিসেবে পরিচয় দিলি সেদিন থেকেই আমার পাগলামি বাড়তে শুরু করলো। আজকে যখন আমি তোর বাসায় আরোহীর সাথে কথা বলার জন্য গেলাম,আরোহীর কথা শুনে মনে হলো সে আসলেই মিসেস তাশরিফ আঁধার চৌধুরী হওয়ার যোগ্য। আর আমার মতো হতভাগির তার নখের যোগ্য হওয়ার ও দাম নেই রে! তোর আরু তোকে অনেক ভালোবাসে আর মেয়েটা অনেকটা সহজ সরল জানিস তো,নাহলে দেখ একজন অপরিচিত মেয়ের কান্না দেখে কেউ কাঁদতে পারে। আমি যখন কান্না করছিলাম মেয়েটা আমায় টেনে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলো ঠিক আমার আম্মুর মতো,আমার আম্মু ও আমি কাঁদলে ওভাবেই আমায় জড়িয়ে ধরে নিজেও কাঁদত রে। আরোহীর মাঝে আমি আমার মায়ের প্রতিছবি দেখেছি আজকে তাই তো কাঁদতে কাঁদতে চলে এসেছিলাম।আরোহীর মতো করে হয়তো কখনো আমি তোকে ভালোবাসি নি রে তাইতো স্বার্থপরের মতো ওকে আমাদের জীবন থেকে চলে যেতে বলেছিলাম, কিন্তু মেয়েটা আমায় বুকে টেনে নিয়ে আমার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো আমি কতোটা বাজে।আসলেই আমি বাজে আঁধার, অনেক বাজে আমি তোর সাথে এতোদিন যা কিছু করেছি সবকিছুর জন্য সরি রে পারলে আমায় মাফ করে দিস! এই জীবন রাখার ইচ্ছে আর করছে না,হয়তো আর কিছুক্ষণ পরই আমি তোদের সকলকে মুক্তি দিয়ে চলে যাবো। আমার ও তো কারো ভালোবাসা পেতে ইচ্ছে করে আঁধার, কেউ কেনো আমায় ভালোবাসে না রে।জানিস আসার পথেই আমার বাবা আর ছোট মায়ের সাথে দেখা হয়েছিলো কিন্তু তারা আমার কান্না দেখে ও আমায় আপন করে নিলো না রে তারা ভেবেছে আমায় হয়তো কোন ছেলে ইউস করে ছেড়ে দিয়েছে তাই হয়তো আমি এভাবে কেঁদে কুটে বেড়াচ্ছি। জানিস যখন আমি তাদের দেখে রিকশা থেকে নেমে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলাম,,,’বাবা আমি মা.. ‘ ছোট মা আর আমায় বাকি কথা বলতেই দেয় নি কি বলেছে জানিস,,,,’ছি ছি তোমার মেয়ে কি না মা হতে যাচ্ছে, আরেতোমার মানসম্মান কিছুই রাখলো না এই অলক্ষী।’ আমায় কিছু বলতে না দিয়েই বাবা আমায় পর পর কয়েকটা চড় মের বললো আমি যেনো তাদের কাছে না যাই, তারা আমার বা আমার বাচ্চার দায়িত্ব নিতে পারবেন না।আমি কান্না ভুলে অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছিলাম তাদের। আমি মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে এটাই বলতাম রে অথচ ওরা আমায় চরিত্রহীন উপাধি দিয়ে দিলো। আমায় পতিতার সাথে তুলনা করলো অথচ আমি কিছুই বলতে পারলাম না! কষ্ট হচ্ছিল আমার, তবে কিছু করার ছিলো না। তখনই মরার কথা আমার মাথায় আসলো কিন্তু আরোহীর মুখটা ভেসে উঠলো হঠাৎ তখন আমার মনে হলো সবাইকে ছেড়ে তো চলেই যাবো কিছুক্ষণ পরেই না হয় যাই তাই তরীর বাসায় এসে এই চিঠিটা লেখা। আমি চরিত্রহীন নইরে, আমি তো শুধু একজনকেই মন দিয়ে ভালোবেসে ছিলাম। আর তোরা সবাই ছোট থেকে আমার জন্য যা করেছিস ভালোবেসেই করেছিস জানি, আমিও তোদের ভালোবাসি রে।আরোহীকে ভালো রাখিস আঁধার আর ওকে বলিস নীলি নামের এই অভাগা মেয়েটাকে যেনো মাফ করে দেয়।এই চিঠিটা যতোক্ষণে তুই পাবি ততোক্ষণে হয়তো আমি আর এই পৃথিবীতে থাকবো না, আমার মৃত্যুর জন্য কাউকে দ্বায়ি করিস না আঁধার তবে ওদের বলে দিস আমি চরিত্রহীন নয় রে,আমি পতিতা নয়, আমি আমার মায়ের মেয়ে। আমি এইসব অপবাদ নিয়ে বাঁচতে পারবো না আঁধার, যেখানে কাল অব্দি ও ভেবেছিলাম আরোহীকে একটু পরীক্ষা করে ওর ভালোবাসা দেখবো তবে তোকে ভুলে যাব। তাই আজকে তরীকে নিয়ে গেছিলাম, আরোহী তোকে এতোটাই বেশি ভালোবাসে যে সেখানে আমার মতো দশটা নীলিমা ও সেই ভালোবাসা দিতে পারবে না রে। আমার ভালোবাসাটা এক তরফাই সুন্দর আঁধার, আমি তোকে ছাড়াই বাঁচতে চেয়েছিলাম কিন্তু ওরা আমায় বাঁচতে দিলো না রে। আমার নিজের বাবাই যেখানে অন্যের কথা শুনে বিশ্বাস করে নিলো আমায় একবার জিজ্ঞেস অব্দি করার প্রয়োজন মনে করলো না সেখানে বাহিরের কেউ শুনলে কি বলবে বল। আমি তো পবিত্র আঁধার, আমি কিভাবে প্রমাণ করতাম বল, কেনো করতাম তাই এই সিদ্ধান্তটা নিতে বাধ্য হলাম রে। তোরা সকলে পারলে আমায় ক্ষমা করে দিস রে তোদের নীলি চরিত্রহীন নয়।
ইতি
তোদের সকলের ভালোবাসার নীলি।
চিঠিটা পড়েই ঢুকড়ে কেঁদে উঠলো আরোহী, একটা মেয়ে কতোটা কষ্ট নিয়ে চিঠিটা লিখেছে সেটা পড়েই আরোহী বুঝতে পারছে। সোহেল ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো, তার চোখে পানির কণাদ্বয় স্পষ্ট। আঁধার নিচের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, রাতুল ও শিহাব নিচের দিকে মাথা চেপে ধরে বসে আছে।
আলিশা ও আদর হতভম্ব হয়ে আছে, মূলত তারা সকলেই মনে করেছিলো আঁধারের জন্যই হয়তো নীলিমা সুইসাইড করেছে কিন্তু বর্তমানে সকলের কাছে নীলিমার সুইসাইড করার কারণ স্পষ্ট।
আরোহী এবার আঁধারের কাছে এগিয়ে গিয়ে আঁধারের বুকে পড়েই কাঁদতে শুরু করে, আঁধার দু’হাতে আগলে নেয় তার প্রেয়শীকে কিন্তু মাথা তুলে তাকায় না।
আরোহীর কান্না দেখে আলিশার ও চোখে পানি চলে আসে, মেয়েটাকে নিয়ে সে মনে মনে কতো কিই না আজে বাজে কথা ভাবছিলো।তরী নিজেও ডুকরে কেঁদে উঠে।
–‘এক্সকিউজ মি,এটা হসপিটাল! এখানে এভাবে নয়েজ করবেন না প্লিজ।’ আপনাদের জন্য অন্য রোগীদের প্রব্লেম হচ্ছে!
সামনের কেবিন থেকে একটা ডাক্তার বের হয়ে কথাটি বলেন।
তরী চুপ হয়ে যায়,আরোহীর কান্নার গতি ও কমে যায়,কিন্তু তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছিলো।
টানা ছয় ঘন্টা থেকে নীলিমাকে নিয়ে ওটিতে আছে ডাক্তার, বিষাক্ত পয়জন খাওয়ার কারণে নীলিমার শরীর অবনতির দিকে চলে যাচ্ছে। আঁধার হাসপাতালে চলে আসার পর পরই আরোহী উঠে আঁধারকে দেখতে না পেয়ে নিচে যায়।তখনই আলিশা ও আদরের মুখে ঘটনা শুনে সে আদর ও আলিশাকে সাথে নিয়ে চলে আসে।
নীলিমা পয়জন খাওয়ার পর পরই তরী বাসায় গিয়ে দরজা ধাক্কাছিলো বাসায় কেউ ছিলো না দেখে কেউ বুঝতে ও পারেনি। তবে নীলিমা যখন দরজা খুলছিলো না তরীর মনে ভয়ের সৃষ্টি হয়েছিলো তাই সে শিহাবকে ফোন করে আসতে বলছিলো।
দরজা ভেঙে ফেলার পর পরই নীলিমার মুখ দিয়ে ফেনা বের হওয়ার পরিমাণ ও বাড়ছিলো। তরী ভয়ে কেঁদে দিয়েছিলো,শিহাব নিজে ও হতভম্ব হয়ে গেছে।
মূলত শিহাব আর সে ই মিলে নীলিমাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে আর শিহাবই আঁধার ও বাকি সবাইকে খবর দিয়েছে।
নীলিমাকে ওটিটে নেওয়ার পর নার্স নীলিমার হাতের মুঠ থেকে চিঠিটা পেয়েছে তাই তিনি বাহিরে এসে দিয়ে গেলেন কিন্তু নীলিমার উন্নতির কথা আর বললেন না।
অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে যখন ডাক্তার বের হলেন, সোহেল দৌড়ে চলে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,,,
–‘ডাক্তার আমার নীলি,আমার নীলি।’
–‘রিলাক্স মিস্টার, সি ইজ আউট ওফ ডেঞ্জার!’
ডাক্তার হাসি মুখে কথাটি বলেই সোহেলের কাঁধে হাত দিয়ে আবার বললেন,,,
–‘ অনেক ভালোবাসেন পেসেন্ট কে তাই না,তবে উনি এতো কঠিন একটা স্টেপ কেনো নিতে গেলেন বলেন তো?’
ডাক্তাররে প্রথম কথায় সকলের মুখে হাসি ফুটে উঠলেও পরের কথায় সকলের মুখে আঁধার নেমে আসে। ডাক্তার হয়তো ব্যাপারটা কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেন,তাই আর বেশি কিছু না বলে বললেন,,,,
— ‘ওনাকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেন আর বেশি বেশি খেয়াল রাখবেন, অল্পের জন্য বেঁচে ফিরতে পেরেছেন উনি। ‘
সোহেল মাথা নাড়িয়ে বলে,,,
–‘ওর সাথে কি দেখা করা যাবে?’
ডাক্তার সোহেলের দিকে তাকিয়ে হেসে বলেন,,,
–‘ওনাকে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে, তবে দেখা করতে পারেন আপনারা।বাট ওনাকে উত্তেজিত করা যাবে না!’
ডাক্তারের কথা শুনে সোহেল দৌড়ে চলে যায় তার প্রেয়শীকে দেখে কলিজা ঠান্ডা করতে। পেছন পেছন বাকিরা ও চলে যায়।
গভীর রাতের দিকে নীলিমার ঘুম ভাঙ্গে, চোখ খুলতে কষ্ট হলেও পিটপিট করে চোখ খুলে তাকায়। নিজেকে হাসপাতালের কেবিনে দেখেই হতভম্ব হয়ে যায়, এখানে কি করছে সে! বাম হাতের মাঝে কারো হাতের অস্তিত্ব পেতেই চোখ ঘুরিয়ে তাকায় নীলিমা।
সোহেলকে তার হাত ধরে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে যায়,কিন্তু মাথার ঘুরিয়ে তাকাতে পারে না মনে হচ্ছে মাথার পাশে কেউ মাথা দিয়ে আছে।অনেক কষ্টে একটু সরতে চেষ্টা করে কিন্তু ডান পাশে হাতের কাছে শিহাব আর পায়ের কাছে রাতুলকে দেখে আরও খানিকটা অবাক হয় সে।
মাথার কাছে কে দেখার জন্য চেষ্টা করতেই একটু দূরে সোফায় আরোহী ও তরীকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে।তড়িৎ গতিতে মাথার কাছের মানুষটাকে দেখতে চেষ্টা করে সফল ও হয়, আঁধারই তার মাথার কাছে ঘুমিয়ে আছে হাসে নীলিমা।
ধিরে ধিরে মনে করার চেষ্টা করতেই সবকিছু মনে পড়ে যায় তার, চোখ দিয়ে অনবরত পানি বের হয়ে বালিশে পড়ছে কিন্তু মুছে নিতে পারছে না সে কারণ সোহেল ও শিহাব দু’জনে দু’টো হাত ধরে আছে। মুহুর্তেই নীলিমার মনটা ভালো হয়ে যায়,এতোগুলো মানুষ তার পাশে আছে, এতো ভালোবাসে তারা তাকে অথচ সে কি করলো একবার ও এদের কথা ভাবলো না।
আপসোস হচ্ছে নীলিমার, কিন্তু পরক্ষণেই আবার মুখে হাসি ফুটে উঠছে। এতো বড় একটা স্টেপ না নিলে হয়তো সে বুঝতেই পারতো না এরা সকলে তাকে এতোটা ভালোবাসে। মুচকি হেসে নীলিমা একটু নড়ার চেষ্টা করে।
সোহেলের ঘুম ভেঙ্গে যায়, সোহেল খুশিতে চিৎকার করে উঠে,,,, নীলিমা তাকে চোখের ইশারায় শান্ত থাকতে বলে কিন্তু ততোক্ষণে সকলে উঠে পড়েছে।
নীলিমা ঠোঁট উল্টে তাকায় সোহেলের দিকে কিন্তু সোহেল মুখ ঘুড়িয়ে নেয়।নীলিমা অবাক হয় না, সে জানতো এমটা হবে। আরোহী দৌড়ে এসে নীলিমাকে জড়িয়ে ধরে বলে,,,
–‘কেমন আছ এখন আপু,জানো আমরা কতোটা চিন্তিত ছিলাম! ‘
আরোহীর কান্ডে নীলিমা হাসে,কে বলবে বিকেলেই এই মেয়েটাকে সে এতোকিছু বললো আর মেয়েটা ও তার সাথে তর্ক করলো কিন্তু এখন এই মেয়েটিই তার জন্য এতো বিচলিত হচ্ছে। নীলিমা একটা হাত আরোহীর মাথায় রেখে আসতে আসতে বলে,,,
–‘আ’ম সরি আরোহী,আমি…’
নীলিমাকে আরোহী বাকি কথা বলতে না দিয়েই বলে,,,
–‘পুরোনো সব বাদ আজকে থেকে তুমি ও আলিশা আপুর মতো আমার বড় বোন কেমন!’ আলিশা আপুর থেকে ও বেশি ভালোবাসতে হবে আমায় বুঝলে।
আরোহীর কথায় নীলিমার চোখ দিয়ে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে, আরোহী আলতো হাতে সেগুলো মুছে দেয়।নীলিমা মন থেকে হাসে।কিন্তু তার মন খারাপ হয়ে যায়, কারণ বন্ধুরা সবাই তার থেকে দুরে দাঁড়িয়ে আছে কেউ তার কাছে ও আসছে না কথা প বলছে না।
–‘আরো ওকে বলে দেও কাল সকালে ওর সাথে আমার বিয়ে, চুপচাপ যেনো বিয়েটা করে নেয়।’
সোহেলের কথাটা বর্জ্য কন্ঠের মতো বেজে ওঠে সকলের কানে, সকলে চমকে ওঠে। সোহেল যে নীলিমাকে ভালোবাসে সকলে জানে কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি, মোট কথায় এই মুহুর্তে বিয়ের কথা বলবে এটা কেউ আশা করেনি।
নীলিমা এবার সোহেলের দিকে তাকিয়ে আরোহীকে বলে,,,
–‘আঁধারের আরু,ওকে বলে দাও সে যদি আমায় সব থেকে বেশি ভালোবাসতে পারে তাহলে কাল কেনো আজকেই আমি ওকে বিয়ে করবো।’
এবার সকলে বড় বড় চোখ করে তাকায় নীলিমার দিকে,তারা একটার পর একটা ঝটকা খেতেই আছে, নীলি কি না সোহেলকে বিয়ে করতে রাজি এটা ও সম্ভব কেমনে?
সোহেল নীলিমার দিকে ঘুরে হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকায়।সোহেলের দৃষ্টি দেখে নীলিমা হাসে সাথে সকলের দৃষ্টি দেখেও। কিন্তু আঁধার নির্বাক যেনো সে আগে থেকেই জানতো এমনটা হবে, আরোহী আঁধারকে স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সোহেলের দিকে আবার তাকায়।সোহেলের মুখে প্রাপ্তির হাসি দেখতে পাচ্ছে সে আর নীলিমার মুখ লাজুক হাসি। আরোহী নীলিমার দিকে তাকিয়ে বলে,,,,
–‘সত্যি বলছো আপু, কিন্তু তুমি এসব কি ভাবে বলছো?’
–‘আমি জানি সোহেল আমায় ভালোবাসে কিন্তু আমি এতোদিন বুঝেও না বুঝার চেষ্টা করতাম তবে যখন আমি সুইসাইড করার চেষ্টা করছিলাম কেনো জানি না আমার বার বার সোহেলের কথা মনে পড়ছিলো।’ আর সোহেলর কথা শুনে আমি সাথে সাথে হ্যা বলার কারণ সেই সময়ই আমার মনে হচ্ছিলো আমায় যদি কেউ একজন ভালোবাসে আগলিয়ে রাখে ক্ষতি কি,আমার ও তো ভালো ভাবে বাঁচতে ইচ্ছে করে সেই মানুষটা যদি সোহেল হয় তাহলেই বা ক্ষতি কিসে।
#চলবে?
#নীল_ডায়েরির_সেই_মেয়েটি
#আরদ্ধিতা_রুহি
#পর্বঃ২৮
🍁
হাসপাতালে আজকে নীলিমার চতুর্থ দিন! এই চার দিনে নীলিমা সকলকে নতুন করে আবিষ্কার করেছে, সকলের ভালোবাসা নতুন করে পেয়েছে আর আরোহীকে নতুন করে আবিষ্কার করেছে!
আরোহীর প্রতি এখন নীলিমার মন থেকে ভালোবাসা আসে, আর সোহেল তার সাথে কথা বলতেও এখন নীলিমার লজ্জা লাগে।
সেদিন সকাল ৯ টার দিকে নীলিমা চোখ খুলে দেখে তার পাশে সোহেল বসে আর সোহেলের মা-বাবা। সোহেলের মা বাবাকে দেখে নীলিমা যতোটা না অবাক হয়েছিলো তার থেকে বেশি অবাক হয়েছিলো কেবিনের ভেতর টুপি পড়া এক বয়স্ক ভদ্রলোক কে দেখে।
যখন জানতে পারলো ইনিই কাজি আর ওনাকে সকাল সকাল সোহেল নিজ দায়িত্বে নিয়ে এসেছে তখন কেনো জানি না নীলিমা না চাইতেও লজ্জা পায়,আর সেই লজ্জা পাওয়া এখন অব্দি যায়নি নীলিমার।
আর তার বন্ধুরা প্রথমের দিকে তার সাথে রাগ অভিমান করলেও পরে সবাই সবকিছু ভুলে গেছে। বাঁধাহীন ভাবে নীলিমা ও সোহেলের বিয়ে হাসপাতালেই সম্পন্ন হয়ে যায়। ডাক্তার নার্সরা অবাক হয়ে তাকিয়েছিলো তারা হয়তো এমন বিয়ে কোথাও দেখেনি।
আজকে নীলিমাকে ডিসচার্জ দিয়ে দিলো ডাক্তার সবাই অনেক খুশি তবে সবার থেকে বেশি খুশি হয়েছে আরোহী। নীলিমাকে রীতিমতো সে কখনো আপু আবার কখনো ভাবি ভাবি বলে মুখে ফেণা তুলছে!
আরোহীর কান্ডে আঁধার নিজেও অবাক এই মেয়ে যে এতো বিচ্ছু সেটা সে এই চার দিনে ভালো করে বুঝে গেছে।এতোদিন আরোহীর এই রুপ থেকে বঞ্চিত ছিলো আঁধার কিন্তু এখন আরোহীকে প্রাণোচ্ছল দেখে তার কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেছে।
সোহেলদের বাড়িতে সকলে একসাথে প্রবেশ করে, সোহেলের মা নীলিমাকে রুমে নিয়ে যেতে বললে নীলিমাকে নিয়ে ভেতরে যায় সকলে।কিন্তু রুমের অবস্থা দেখে ও সাথে আদর ও আলিশাকে দেখে সকলের চক্ষু চড়াগাছ, তবে শুধু মাত্র আরোহী হেসে বলে,,,
–‘সারপ্রাইজ!’
সকলে আরোহীর দিকে তাকায়, আরোহী ঠোঁট টিপে হেসে বলে,,,
–‘আজকে নীলি আপু ও ভাইয়ার ফাস্ট নাইট এই বাড়িতে তাই আমি, আদর ভাইয়া ও আলিশা আপু মিলে সাজিয়ে দিলাম নীলি আপুর বাসর!’
–‘বুঝলি শিহাব আমি ভাবছি ওকে আজকে নীলিদের রুমের সামনে সারারাত পাহারাদার হিসেবে রাখবো, যেনো তার বাসর নিয়ে এতো এক্সাইটমেন্ট হাওয়া হয়ে যায়!’ কিরে ব্যাটা কি বলিস?
প্রথমের কথাটা সিহাব কে উদ্দেশ্য করে বললেও শেষেরটা রাতুলের পিঠে জোড়ে একটা থা’বা মেরে বলে আঁধার।
সোহেল এবার শব্দ করে হেসে দেয়, সাথে বাকিরা ও হাসে।
রাতুল ভোতা মুখ করে আঁধারের দিকে তাকায়, আঁধার ভাবলেশহীন ভাবে রাতুলের দিকে তাকায় যেনো সে কিছুই জানে না! রাতুল এবার আঁধারের দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলে,,,
–‘তুমি মামা আগেই বাসর সেরে এখন আমার পেছনে লাগছো তো, খুব শিগ্রই আমি ও বিয়ে করে আমার বাসর ঘরে তোমায় পাহারাদার হিসেবে রাখবো!’
রাতুলের কথায় আঁধার এবার শব্দ করে হেঁসে বলে,,,
–‘সে তুই রাখতেই পারিস, তবে তোর যে বাসর করার সাধ জন্মের মতো ঘুচিয়ে দেব সেটা কিন্তু তোর জন্য ভালো হবে না!’
আঁধারের কথায় আর এক দফা হাসাহাসি করে সবাই, কিন্তু রাতুল অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় আরোহীর দিকে।রাতুলের দৃষ্টির মানে আরোহী বুঝতে পেরেই হাসি থামিয়ে দিয়ে সকালের উদ্দেশ্যে বলে,,,
–‘আরে এখন চলো চলো ওদের একটু একা থাকতে দাও!’
সকলে চলে যায়, কিন্তু আরোহী সবার পেছনে বের হয় আর তার পেছনে আঁধার।
হঠাৎ করেই আরোহীর হাঁটার গতি থেমে যায়,ততোক্ষণে সকলে নিচে চলে গেছে।কেঁপে ওঠে আরোহী, আরোহীকে কাঁপতে দেখে হাতের বাঁধন আরও দৃঢ় করে আঁধার। আরোহীর হাসফাস লাগা শুরু হয়,আঁধার আরোহীর অবস্থা দেখে হালকা হাসে।
–‘অন্যের বাসর নিয়ে এতো এক্সাইটমেন্ট মেডাম যে বাসর ঘর অব্দি সাজিয়ে দিলেন কিন্তু আমার বিয়ের যে তিন মাস হয়ে গেলো তার কি খবর আছে?’
আঁধারের কথায় লজ্জা পায় এবার আরোহী, লোকটা তাকে কি ভাবছে সে তো নীলি ও সোহেলকে সারপ্রাইজ করার জন্য বাসর ঘর সাজালো!এখানে এক্সাইটমেন্ট এর কি আছে!তবে আঁধারকে সেটা মুখে বলার সাহস নেই এই লোক যে নিলজ্জ না জানি উল্টো পাল্টা কিছু বলে দেয়।কিন্তু আঁধার কি আর থেমে থাকার লোক, আরোহী ঘাড়ে হালকা করে একটা চুমু দিয়ে বলে,,,,
–‘বউ আমাদের বাসর কবে হবে?’
আরোহী এবার চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়,এই লোক না জানি কবে তাকে লজ্জা দিতে দিতেই শহিদ করে দেয়।
–‘কিরে তোরা করিডরের মাঝে রোমান্স করছিস, রুমে কি করিস তাহলে সারারাত?’
হঠাৎ রাতুলের কথা শুনে আঁধার আরোহীকে ছেড়ে দাঁড়ায়, আরোহী নিচের দিকে তাকিয়ে আছে! আঁধার বিরক্ত চোখে রাতুলের দিকে তাকিয়ে বলে,,,,
–‘ব্যাটা সারারাত রুমে নাচ গান করি দেখে আসিস, মুড টায় নষ্ট করে দিলি!’ আসলি তো আসলি কয়েক মিনিট পড়ে আসতে পারলি না?
আঁধারকে বিরক্ত হয়ে দেখে রাতুল দাঁত কেলিয়ে বলে,,,
–‘তোদের এতো সুন্দর রোমান্সটা মিস করতে চাইনি তাই এগিয়ে গিয়েও আবার চলে এসেছি!’
আরোহী বাকি কথা না শুনেই দৌড়ে নিচে চলে যায়,আঁধার কটমট চাহনি নিক্ষেপ করে নিজেও হনহনিয়ে চলে যায়।রাতুল এতে যেনো বেশ মজা পায়,আঁধারকে জ্বালানোর উপায় এখন সে পেয়ে গেছে ভেবেই গাঁ কাঁপিয়ে হেসে উঠে।
নীলিদের বাসা থেকে এসে আঁধার আগে ফ্রেশ হতে যায়,পরে আরোহী ফ্রেশ হয়ে আসে। আঁধার তখন সোফায় বসে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। আঁধারকে গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখে আরোহী একবার তাকিয়েই নিজের কাজে মন দেয়।
আঁধার একটু পর পর যখন আরোহীর দিকে তাকাচ্ছিল আরোহী তখন এগিয়ে যায়।আঁধারের পাশে শব্দ করে বসে পড়ে কিন্তু এবার আর আঁধার তাকায় না।আরোহী আঁধারের চুলের ভাজে হাত গলিয়ে দিয়ে বলে,,,,
–‘কি হয়েছে জনাব?’
আঁধার এবার আরোহীর দিকে এগিয়ে বসে একটু, আরোহী অধীর আগ্রহে আঁধারের দিকে তাকায় কিন্তু আঁধার তাকে অবাক করে দিয়ে অসহায় চোখে তাকিয়ে বলে,,,
–‘আমি কি একবার তোমার কোলে মাথা দিতে পারি আরু!’
আঁধারের কথায় আরোহী অবাক হয়, আঁধার অনুমতি নিচ্ছে কোলে মাথা দেওয়ার জন্য এটাও সম্ভব? আঁধার অনুমতি কোন কালেই নেয় না আরোহী থেকে তবে আজকে কেনো? আরোহীর ভাবনার মাঝেই ধপ করে আরোহীর কোলে শুয়ে পড়ে আঁধার।
আরোহী চোখ মুখ কুঁচকে তাকায় আর মনে মনে বলে,,,” ব্যাটা অনুমতি নিলি আমি কি তোরে অনুমতি দিয়েছি আমার কোলে শোয়ার জন্য, সেই তো আমার বলার অপেক্ষা করলিই না তাহলে অনুমতি চাইলি কিসের ঢং করে।তাই তো বলি ভুতের মুখে রাম রাম কেনো!”
আরোহীকে চোখ মুখ কুঁচকাতে দেখে আঁধার টুপ করে তার গালে একটা চুমু দিয়ে বলে,,,
–‘মিসেস চৌধুরী কি এতো ভাবেন বলেন তো সবসময়?’ আপনার ভাবনায় সবসময় আমায় ও তো রাখতে পারেন নাকি?
–‘আপনাকে কেনো রাখবো আমার ভাবনায় শুনি?’
–‘কেনো রাখবেন জানেন না,আমি আপনার পাঁচটা নয় দশটা নয় একটা মাত্র বর বলে কথা!’
আরোহীর গাল টেনে বলে আঁধার। আরোহী এবার বিরক্ত হয়,গাল টানা জিনিসটা তার ছোট থেকেই পছন্দ নয়,ছোট বেলায় এই একটা জিনিসের জন্য কতো ঝগড়া করেছে মানুষের সাথে! একবার তো এলাকার একটা বড় ভাই তার গাল টেনে বলেছিলো,,,
–‘এই পিচ্চিটা এতো কিউট কেনো তুমি!’
আরোহী কোন কিছু না ভেবেই ছেলেটার পায়ে হাঁটুর নিচে কামড়ে ধরেছিলো। কামড় দিয়েই দৌড়ে পালিয়ে গেছিলো আরোহী।
সেদিন ছেলেটা কামড় খেয়ে আরোহীর থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলা শুরু করেছে,ওই ঘটনা তাদের এলাকায় ও ছড়াছড়ি হয়ে যায়। ছেলেটার মা পরের দিন আরোহীদের বাসায় এসে আরোহীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে হেসে বলেছিলেন,,,
–‘তুমি আর কামড় দেওয়ার জায়গাই পাও নি মা!’
আরোহী বোকার মতো তাকিয়ে ছিলো সেদিন।
তারপর থেকেই ভয়ে আর কেউ তখন থেকে আরোহীর গাল টেনে দেয়নি।
আরোহী এবার ও একই ঘটনা রিপিট করে অর্থাৎ সে মাথাটা ঝুঁকিয়ে আঁধারের ডার্ক রেড ঠোঁটজোড়ায় জোড়ে একটা কামড় বসিয়ে দেয়।
আঁধার ব্যাথায় আর্তোনাদ করে ওঠতেই। কোনো মতো তাকে সরিয়ে আরোহী এক ছুটে বাহিরে চলে যায়।আঁধার হতভম্বের ন্যায় বসে থাকে।
কেটে গেছে বেশ কয়েকদিন,, এরই মধ্যে আরোহী তার বাবার বাসায় গিয়ে ও ঘুরে এসেছে। ঘুরে এসেছে বললে ভুল হবে, আঁধার অনেক হুমকি ধমকি দিয়েই তার বাবা মাকে দিয়ে নিয়ে এসেছে!
যদিও কথা ছিলো বিয়ের এক বছর অব্দি আরোহী তার বাসা থেকেই পড়াশোনা করবে কিন্তু আঁধারের কথা বিয়ে করেছি কি আর বউকে বাবার বাসায় রাখার জন্য! আঁধার জনসম্মুখে যখন এভাবে বলেছিল আরোহীর তখন লজ্জায় মাটি ফাঁক করে ঢুকে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল।
কিন্তু আঁধার আরোহীকে আরও কয়েকগুন লজ্জা দেওয়ার জন্য বলেছিলো,,,” নাহলে ফিউচার প্লানিং করতে দেরি হয়ে যাবে তো!” আঁধারের কথা শুনে তারেক চৌধুরী কেশে উঠেছিল!
আঁকলিমা চৌধুরী চুপচাপ রান্নাঘরে চলে যান, আর আরোহী চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়।
কিন্তু আঁধার তার সিদ্ধান্তে অনড়! তারেক চৌধুরী কি করবেন ভেবে না পেয়ে আরোহীকে জিজ্ঞেস করেন,,,”আরোহী মা তুমি কি চাও বলো তো!”
আরোহী একপলক আঁধারের দিকে তাকিয়ে বলে,,,”আপনারা যেটা বলবেন সেটাই আমি মানবো বাবা।”
“কি বললে তুমি,ওরা যেটা বলবে সেটাই মানবে আর আমি যে তোমার বর সে কথা কি তুমি ভুলে গেছো আরু!”
আঁধার প্রথমে চিৎকার করে কথাগুলো বললেও পরের কথাটা নরম সুরে মায়া মায়া চোখে আরোহীর দিকে তাকিয়ে বলে।
এতে যেনো আরোহীর একটু মায়া হয়, কিন্তু তারেক চৌধুরী তার বড় ছেলের ছেলেমানুষী দেখে বলে,,,”একদম ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করবে না ওকে।”
আঁধার কিছু বলবে তার আগেই তার ফোন বেজে ওঠে, বিরক্ত হয়ে রিসিভ করে বাহিরে চলে যায়। কিন্তু যাওয়ার আগে আরোহীর দিকে একপলক তাকিয়ে চলে যায়।
আর আলিশা বেচারির তো হাসতে হাসতে শুয়ে পড়ার মতো অবস্থা হয়েছিল! আরোহী বিরক্ত হয়ে আঁধারকে মনে মনে গালি দিচ্ছিল,তার মতে আঁধার দিন দিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে,চরম বেয়াদব!
এরপর আঁধার নিজ দায়িত্বে আরোহীকে তার বাবার বাসায় পৌঁছে দিয়ে এসেছিল ঠিকই তবে তিন,চার দিনের দিন তার বাবা মাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করে আরোহীকে নিয়ে এসেছে।
কিন্তু আরোহীর বাবা শর্ত জুড়ে দিয়েছেন তাদের ধুমধামে বিয়ে দিবেন কিছুদিন পরেই , আঁধার ও বিনাবাক্যে রাজি হয়েছে!
তবে শর্ত হিসেবে সেও বলেছে বিয়ের আগেও তার বউ তার কাছেই থাকবে। কি আর করার সকলে বিরক্ত হলেও মেনে নিয়েছে।
বিকেলে বসে বসে এসব ভাবছিলো আরোহী! আঁধার নেই, বাহিরে গেছে আর যাওয়ার আগে বলে গেছে ফিরতে রাত হবে। আরোহী নিজেও আর কিছু জিজ্ঞেস করে না, তবে মন খারাপ হয়ে আছে তার নীলিমার জন্য।
নীলিমা তার পর থেকেই স্বাভাবিক ব্যাবহার করেছে সকলের সাথে এমনকি আরোহীর সাথেও।
কিন্তু সেদিনের পর থেকেই সে যখনই সময় পায় আঁধারের সাথে চিপকে থাকার চেষ্টা করে, যেটা আরোহীর মোটেও সহ্য হয় না।
আরোহী বুঝতে পারে মেয়েটা আঁধারকে অনেক ভালোবাসে কিন্তু আঁধার বিবাহিত সেটা ভুলে যায় হয়তো। তবে সে আঁধারকে কখনো কিছু বলে নি তাই আঁধার ও আরোহীকে এসব ব্যাপারে ভাবতে বারণ করেছে।
সে নীলিমাকে বন্ধু ছাড়া কিছুই ভাবে না সেটাই বলেছে। কিন্তু আরোহীর কেনো যেনো এখন আর আগের মতো নীলিমাকে সহ্য হয় না। আঁধার যদিও মাঝে মাঝে নীলিমার উপর বিরক্ত হয় কিন্তু কোন এক কারণে কিছু বলতে পারে না।
আরোহীর ইচ্ছে করে নীলিমাকে কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে দিতে কিন্তু কি করবে সে ও তো একটা মেয়ে! একটা মেয়ে হয়ে আর একটা মেয়েকে কি করে বাজে কথা বলবে সে।
পেছন থেকে কেউ কাঁধে হাত রাখতেই চমকে পেছনে তাকায় আরোহী,আলিশাকে দেখে মলিন হেঁসে বলে,,,
–‘ভয় পেয়ে গেছিলাম! ‘
–‘তুই কি নিয়ে এতো চিন্তা করছিলিস বল তো?’ কয়েকবার ডেকেছি পেছন থেকে শুনতেই পাসনি?
–‘এমনি আপু বস!’
–‘তোর কি হয়েছে আরো,সত্যি করে বল তো?’
আরোহীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে আলিশা।
আলিশাকে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকাতে দেখে আরোহী একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সব বলতে শুরু করে। আরোহীর কথা শুনে আলিশার চোয়াল শক্ত হয়ে যায়,নীলিমার প্রতি ক্ষোভ জমে যায় অন্তরে।
–‘চল নীলিমার সাথে দেখা করবো,ওকে সাবধান করতে হবে!’ ও কি করে পারে এমনটা করতে বল তো? ও জানে না আঁধার বিবাহিত।
রাগে চোয়াল শক্ত করেই কথা গুলো বলে আলিশা।আরোহী অবাক হয় না, এই মেয়েটিই কয়েকদিন আগে তাকে আর আঁধারকে আলাদা করার জন্য কতো কি করলো আর আজকে নিজেই এসব বলছে? আসলেই মানুষ যখন বদলে যায় তার সবকিছুই বদলে যায়।
–‘না আপু, আমার মনে হয় না সেটা ঠিক হবে, আবার মনে হচ্ছে দেখা করে কিছু কথা বলা উচিত!’
–‘তুই পাগল আরো কথা বলা উচিত না বলা দরকার, আর আঁধারই বা কিছু বলছে না কেনো বুঝতেছি না?’
–‘বাদ দাও, আর তুমি বলো আমাদের পুঁচু সোনা কেমন আছে? ‘
আরোহীর কথায় লজ্জা পায় আলিশা,,,,
–‘ও তো এখন ভালোই আছে, কিন্তু পুঁচু সোনা তার খালামনির জন্য চিন্তিত! ‘
আলিশার কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আরোহী। তখনই লিমা এসে বলে,,,
–‘আফা আপনাগো ডাহে, ছোড ভাইজান নিচে!’
আরোহী ও আলিশা একে অপরের দিকে তাকায়, হঠাৎ আদর ডাকছে কেনো? সেটা ও আবার দু’জনকে একসাথে?
–‘কেনো রে লিমা? ‘
আলিশার কথায় লিমা হতাশার সাথে বলে,,,
–‘আঁধার ভাইজানের বন্ধুরা আইছে!’
আঁধারের বন্ধুদের কথা শুনে ভ্রুকুঁচকায় আরোহী।
–‘চল!’
বলেই নিচের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে আসে তারা।
তরী ও নীলিমা এসেছে,আরোহী অবাক হয় বটেই! সকালেই তো এদের সাথে দেখা করে আসলো তাহলে এখন এরা কেনো?আলিশা তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়, এদের সে ভালো করেই চেনে নীলিমা ও তরী। কিন্তু এরা হঠাৎ একা কেনো?
আরোহীকে নিচে নামতে দেখে তরী হাসার চেষ্টা করে কিন্তু নীলিমা কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরোহীর দিকে! আরোহী তরীর দিকে তাকিয়ে হালকা হাসার চেষ্টা করে, তরী নিজেও হাসার চেষ্টা করে বলে,,,
–‘আরোহী ভাবি আমরা তোমার সাথে একটু কথা বলতে এসেছি!’
আরোহী তরীর হঠাৎ ভাবি ডাকার কারণে একটু অবাকই হয় বটে তবে তেমন কিছু বলে না শুধু মাথা নাড়ায়! আলিশা আদরের দিকে তাকায়, আদর সন্দেহের চোখে সবাইকে পর্যবেক্ষণ করছে!
কারণ আঁধার ছাড়া কখনো এরা তাদের বাসায় আসেনি, তাহলে আজকে কেনো?
–‘ভাইয়া কিন্তু বাসায় নেই, তোমরা বসো আমি আম্মুকে ডাকছি!’
তরী মনে মনে ভাবছে,,,”এটা কি করলাম আমি, বাধ্য হয়ে তো এই পাগলের সাথে আসলাম এখন না জানি আরোহীকে কি থেকে কি বলে ফেলে! আঁধারটা ও বাসায় নেই, এতোবার ফোন দিচ্ছি ফোনটা ও ধরছে না। উফফ ভাল লাগে না!”
আর আরোহী ভাবছে,,,” কি এমন দরকার এদের যে আঁধার বাসায় নেই জেনেও আমার সাথে দেখা করতে এসেছে!
–‘আমি কি তোমার সাথে একটু একা কথা বলতে পারি?’
তরীর কথা শুনে আরোহী মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়, কিন্তু নীলিমা তরীর হাত চেপে ধরে। তরী একটু হাসার চেষ্টা করে নীলিমার দিকে তাকায়,নীলিমা তরীকে অবাক করে দিয়ে বলে,,
–‘আরোহী আসলে তরী ভুলে নিজের কথা বলে ফেলেছে, আমি একটু একা তোমার সাথে কথা বলতে চাই এটাই বলতে চেয়েছিলো সে।’
আরোহী ভ্রুকুঁচকে তাকায়, আলিশা চোখ মুখ কুচকে তাকায় নীলিমার দিকে তার মনে সন্দেহ হচ্ছে নীলিমাকে নিয়ে? সে একা কেনো আরোহীর সাথে কথা বলতে চাচ্ছে?
তরী অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় এবার নীলিমার দিকে,,,”মনে মনে বলে উল্টা পাল্টা কিছু বলিস না বইন, পরে না জানি তোর সাথে সাথে আঁধার আমাকে ও ডিটার্জেন্ট ছাড়া ধুইয়ে দেয়! ”
তরী মনে মনে খুব করে চাচ্ছে আরোহী যেনো না বলে,নাহলে কেউ একজন এসে বাঁধা দেয়। কিন্তু তরীর ভাবনার মাঝের আরোহী রাজি হয়ে যায়।তরী অসহায় চোখে সবার দিকে তাকায়, আলিশা চোখ মুখ শক্ত করে আরোহীকে বলে,,,,
–‘আরো তুই কি বলছিস এসব?’ তুই….’
–‘আপু প্লিজ! ‘
আরোহী আলিশাকে চোখ দিয়ে কিছু একটা ইশারা করে কথাটি বলে। আলিশাও চুপ হয়ে যায়! আরোহী নীলিমাকে তার সাথে আসতে বলে নিজেও উপরে চলে যায়, নীলিমা আরোহীর পিছু পিছু এগিয়ে যায়।
তরী ধপ করে সোফায় বসে পড়ে! এতে যেনো আলিশা কিছুটা অবাকই হয়, আলিশাকে অবাক করে দিয়ে তরী আলিশাকে বলে,,,
–‘এক গ্লাস পানি হবে!’
আলিশা মাথা নাড়িয়ে পানি আনতে চলে যায়, তরী গালে হাত দিয়ে ভাবতে থাকে কি হতে চলেছে এরপর!
–‘তোমাদের ব্যাপারটা আসলে কি বলো তো তরী আপু?’ তোমরা আসলে করতে চাচ্ছোটা কি? আর নীলিমা আপু আরোহীর সাথে একা কথা বলতে চাচ্ছে কেনো? এভরিথিং ইজ অলরাইট!
আদরের কথা শুনে তরী ভয়াক্রান্ত মন নিয়ে বলে,,,
–‘এতোক্ষণে তো সব ঠিকই ছিলো রে আদর কিন্তু এখন যে আসলেই সব ঠিক থাকবে কি না বলতে পারছি না!’
এরইমধ্যে আলিশা পানির গ্লাস এগিয়ে দেয় তরীর দিকে। তরী গ্লাসটা হাতে নিয়েই এক নিস্বাসে সবটুকু পানি খেয়ে আলিশার দিকে ফাঁকা গ্লাসটা এগিয়ে দেয়।
আদর অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায় তরীর দিকে,কিন্তু তরী সে দিকে পাত্তা না দিয়ে বলে,,,
–‘আঁধারকে ফোন দে তো আমার ফোন ধরছে না, না জানি বালডায় কোথায় আছে! ‘
আদরকে তখনো তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবার বলে উঠে তরী,,,
–‘কি রে,ফোন দে!’
আদর এবার আর কোন কথা না বলে উঠে এসে তীর পাশের সোফায় বসে পড়ে, তারপর আঁধারের নাম্বারে ফোন দেয়।কিন্তু ফোন বন্ধ বলতেই সে তরীর দিকে নিরাশার দৃষ্টিতে তাকায়।
–‘তার মানে ফোন এখন ও বন্ধ, এখন কি হবে রে আদর!’
–‘কি হয়েছে আপু,একটু বললে ভালো হতো!’
আলিশার কথায় তার দিকে তাকায় তরী,একটা হাত দিয়ে আলিশাকে তার পাশে টেনে বসিয়ে দেয়।আদর আঁতকে উঠে বলে,,,
–‘এই আপু এই আস্তে লেগে যাবে ওর, বাবুর ক্ষতি হতে পারে তো!’
–‘থাক আর বলতে হবে না, তবে তুই যে এতো ফাস্ট সেটা তো বুঝতেই পারিনি রে!’ তবে ফাস্ট তো হওয়ারই কথা আঁধারকে টপকে আগে বিয়ে করে নিয়েছিস।
তরীর কথায় হালকা হাসার চেষ্টা করে আদর। আলিশা লজ্জায় মাথা নিচু করে নেয়।
–‘বাদ দাও সেসব এখন, আসল কাহিনি বলো!’
আদরের কথায় তরীর মনে ভয়ের বাসা বাধা শুরু হয়,ভয়ে ভয়ে সে আদর ও আলিশাকে সবকিছু শুরু থেকে বলা শুরু করে। সব শুনে আদরের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতো অবস্থা।আলিশা তো নির্বাক কারণে তাকে আরোহী আগে থেকেই সব বলেছিল।
–‘নীলিমা আপু তো জানে ভাইয়া বিবাহিত এটা এখন আর সম্ভব নয়, তাহলে তবুও এসবের মানেটা কি বুঝলাম না ভাই!’
আদরের কথা শুনে তরী হতাশার সাথে বলে,,,
–‘বিশ্বাস কর আদর আমি ওকে হাজার বার বুঝিয়েছি কিন্তু সে হ্যা না কিছুই বলে না!’ তবে আঁধারের আসে পাশে থাকার চেষ্টা করে সবসময়। আর আজকে তো আমায় ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করে নিয়ে আসলো।
–‘কি করবো এখন আমরা, সে যদি আরো কে উল্টা পাল্টা কিছু বলে বসে তখন কি করবো আমরা?’
মাথায় হাত দিয়ে বলে আদর!
–‘আঁধার ভাইয়া এই মেয়েটাকে কিছু বলে না কেনো বুঝি না?’
আলিশার কথা শুনে তরী তার দিকে ভ্রুকুঁচকে তাকায়।তরীর দৃষ্টি দেখে আলিশা আমতা আমতা করে বলে,,,
–‘না মানে নীলিমা আপুর কথা বলছিলাম আর কি হে হে! ‘
আলিশাকে এভাবে কথা বলে হাসার চেষ্টা করতে দেখল আদর মুখ চেপে হাসে। তরী এবার স্বাভাবিক হয় বলে,,,
–‘নীলিমার মা নেই, এমন কি তার কেউই নেই তাই আঁধার তাকে কিছু বলতে পারে না!’ আমাদের তো সবকিছু সেয়ার করার মতো মা আছে, বাবা আছে কিন্তু ওর বাবা তে থেকেও নেই। ওকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে কয়েকদিন আগে ওর সৎ মা। মেয়েটা একটু ভালোবাসার পাগল জানো তো আলিশা, হয়তো আঁধারকে এই জন্যই ভালোবেসেছিলো সে।
ধরা গলায় কথাগুলো বলে তরী।আলিশার খারাপ লাগে, মা-বাবা না থাকার কষ্ট তারা বুঝে না ঠিকই তবে এই কয়েকদিনে অনেকটায় বুঝে গেছে আলিশা মা বাবা আসলে কি জিনিস।
–‘বলেন কি বলবেন?’
রুমের ভেতরে ঢুকেই উক্ত কথাটি নীলিমার দিকে ছুঁড়ে দেয় আরোহী।
–‘বসে বলি!’
–‘জ্বি! ‘
সোফায় বসে আরোহী জন্য জায়গা করে দেয় নীলিমা। আরোহী নিজেও বসে পরে নিচের দিকে তাকিয়ে।
–‘আরোহী, উপস সরি আরু! এই নামেই তো ডাকে আঁধার তোমায় তাই না?’
কিছুটা তাচ্ছিল্য সহিত কথাটি বলে নীলিমা। আরোহী এবার চোখ তুলে তাকায়, বাঁকা হেঁসে বলে,,,
–‘হ্যা,তবে আরও অনেক কিছুই বলে ডাকে! ‘
আরোহীর কথায় ভ্রুকুঁচকে বলে নীলিমা,,,
–‘আমি ও আঁধার একে অপরকে অনেক ভালোবাসি সেটা কি তুমি জানো?’ আঁধার বলে নি তোমায়?
–‘আপনি আঁধারকে ভালোবাসেন আর আঁধার শুধু তার একমাত্র বউকে মন প্রাণ উজার করে ভালোবাসে সেটা আমিও জানি।’ আর আমার বর ও এটাই বলেছে আমাকে।
শক্ত কন্ঠে কথাগুলো বলেই শেষ করে আরোহী।নীলিমা নিজেকে স্বাভাবিক করেই বলে উঠে,,,
–‘সবই জানো দেখছি, তাহলে সরে যাচ্ছো না কেনো আমাদের লাইফ থেকে?’ আমার আঁধারকে আমার করে কেনো দিচ্ছে না?
–‘আমি আপনাদের মাঝে নেই এমনকি আপনার লাইফের এক কোণায় ও নেই আমি, আমি শুধু আমার বরের লাইফেই আছি!’ এন্ড মোস্ট ইম্পরট্যান্ট টপিক, সেম কথা তো আমিও আপনাকে বলতে পারি সরে যাচ্ছেন না কেনো আমাদের লাইফ থেকে? আর রইলো কথা আঁধারকে আমার করে দেওয়ার সেটার আর দরকার নেই কারণ আমার বর আমারই।
নীলিমার কন্ঠে কিছু একটা ছিলো যেটা আরোহীকে নীলিমার প্রতি সহানুভূতি দেখাতে বাধ্য করলো।
–‘হুম, তবে হয়তো আপনার থেকে কম না!’
আরোহীর নরম কন্ঠে এবার যেনো নীলিমা ও একটু নরম হলো।
–‘জানো তো আরোহী আমিও আঁধারকে অনেক ভালোবাসি, তবে আঁধার আমাকে ভালোবাসে না!’ কেনো আরোহী, আমায় কি একটু ও ভালোবাসা যায় না?
আরোহী একটু চেপে বসে নীলিমার কাঁধে হাত দিয়ে বলে,,,
–‘ভালোবাসার জন্য সঠিক মানুষ দরকার হয় আপু আর আপনার ভালোবাসার মানুষটি সঠিক নয় সে অন্য কারো স্বামী!’
এবার নীলিমা আর নিজেকে আটকাতে পারে না হু হু করে কেঁদে দেয়।
আরোহী কি করবে বুঝতে না পেরে নীলিমাকে জড়িয়ে ধরে, এতে যেনো নীলিমার কান্নার বেগ বেড়ে যায়।আরোহীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,,,,
–‘সবাই কেনো আমায় অবহেলা করে আরোহী বলো না, যার কাছেই একটু ভালোবাসার জন্য যাই সেই আমায় দূর ছাই করে তাড়িয়ে দেয়! ‘ আমি,আমি মায়ের ভালোবাসা পাই নি, বাবার ভালোবাসা পাইনি,ছোট মায়ের ভালোবাসা পাইনি, এমনকি আঁধারের ভালোবাসা ও পেলাম না।
নীলিমার জড়িয়ে যাওয়া কথাগুলো আরোহী অনেক কষ্টে বুঝতে পারে,তার ও বুকটা কেঁপে উঠে। এই মেয়েটি যে ছোট বেলা থেকেই অবহেলিত সেটা আজকে সে বুঝতে পারছে। আঁধার কেনো নীলিমার হলো না সেটা ভেবছে আরোহী, কিন্তু পরমুহূর্তেই বুকটা কেঁপে উঠছে,, আঁধার যদি নীলিমার হতো তাহলে আরোহীর কি হতো।
নীলিমার হঠাৎ হুস আসে, আরোহীকে ছাড়িয়ে ঠিক মতো বসে চোখ মুছে নিয়ে বলে,,,
–‘আমি আসছি, ভালো থেকো আর তোমাদের মাঝে আসবে না!’
আরোহীকে কিছু বলতে না দিয়েই এক ছুটে বেরিয়ে যায় নীলিমা।আরোহীর নিজের চোখ দিয়ে ও টপটপ করে পানি পড়ছে।
নীলিমাকে এভাবে নিচে আসতে দেখে সবাই অবাক হয়ে যায়, নীলিমার চোখের পানি দেখেই সকলে আন্দাজ করতে পারে হয়তো ভালো কিছু হয়নি।
চোখ মুছার যতোই চেষ্টা করছে নীলিমা ততোই যেনো বৃষ্টির ফোঁটার ন্যায় তার চোখের পানি পড়ছে। তরীকে আসতে বলে নীলিমা বেরিয়ে যায়,সামনেই আঁধারকে দেখতে পেয়ে তার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠে আবার চোখের জ্বলেরা বৃষ্টির মতো ঝড়তে শুরু করে।
আঁধার অবাক হয়ে নীলিমার দিকে তাকায়,কিন্তু নীলিমা তাকে অবাক করে দিয়ে ছুটে চলে যায়।আঁধার পেছন থেকে নীলি নীলি করে ডাকতে ডাকতে এগিয়ে যায় কিন্তু নীলিমা ততোক্ষণে একটা রিকশা নিয়ে উঠে বসে পড়ে।
আঁধার চিন্তিত হয়ে পেছনে ঘুরতেই তরীকে দেখতে পায়।
–‘তোরা এখানে আর নীলি এভাবে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলো কেনো?’
–‘পরে বলবো সব, পারলে তুই আরোহীর কাছে সব শুনে নিস, আর এতোবার ফোন করেছি বন্ধ কেনো?’
আরোহীর কথা শুনেই আঁধারের কপালে চিন্তার ভাজটা আর একটু বেড়ে যায়।হঠাৎ তার ফোনের কথা মনে পড়তে দেখে চট করে পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে বন্ধ হয়ে আছে। আঁধার বিরক্ত হয়ে “সিট ” কথাটা বলেই তরীর দিকে তাকায়।
–‘আচ্ছা থাক, পড়ে কথা হবে এখন আমি যাই!’
আঁধার অবাক চোখে তরীর যাওয়া দেখে,হচ্ছেটা কি সবাই এভাবে চলে যাচ্ছে কেনো? আর আরুর কাছেই বা কি শুনতে বললো! ভেবেই বাড়ির ভেতরে চলে যায় আঁধার
ড্রয়িংরুম সম্পূর্ণ ফাঁকা পড়ে আছে অথচ দরজা খোলা,আঁধার আর কিছু না ভেবেই এক প্রকার দৌড়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যায়।
আদর ও আলিশা দু’জনেই আরোহীকে তখন থেকে বলছে কি হয়েছে, কিন্তু আরোহী চুপচাপ মাথা নিচু করে আছে! আলিশা এবার অধৈর্য হয়ে আরোহীর পাশে বসে আরোহীকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়।
আরোহীর চোখে পানি দেখে আরও হতভম্ব হয়ে যায় আলিশা। আদরের কলিজাটা মনে হয় মোচড় দিয়ে উঠে, যতোই মুখে সব কিছু ঠিক করার চেষ্টা করুক না কেনো কিন্তু মনের এক কোণে আরোহীর জন্য হয়তো এখন ও কিছু একটা অনুভব করে। তাই তো আরোহীর চোখের জ্বল দেখে আজ ও কলিজাটা মোচড় দিয়ে উঠছে।
–‘আরো কি হয়েছে বোন বল আমায়,ওই নীলিমা কি তোর সাথে খারাপ ব্যাবহার করেছে? ‘ কি রে চুপ করে আছিস কেনো বল?
আরোহীকে চুপ থেকে দেখে উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বলে আলিশা।কিন্তু আরোহী নিশ্চুপ হয়ে থাকে,আদর এবার আলিশার মাথায় হাত দিয়ে বলে,,
–‘তুমি হাইপার হয়ো না, আরো বলো না কি হয়েছে আমরা সকলে তোমার জন্য চিন্তা করছি তো?’
শেষের কথাটা আরোহীর দিকে তাকিয়ে কিছুটা নরম সুরে বলে আদর। এরই মধ্যে আঁধারকে তড়িঘড়ি করে রুমে ঢুকতে দেখে আদর ও আলিশা অবাক হয়ে যায় কিন্তু আরোহী নির্বাক হয়ে নিচের দিকেই তাকিয়ে আছে।
–‘কি হয়েছে এখানে বল তো নীলি ওভাবে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলো কেনো?’
আদরকে প্রশ্নটা করে আরোহীর দিকে তাকাতেই যেনো আঁধারকে কলিজা কেঁপে উঠে।
–‘এই আরু এই কি হয়েছে তোমার কাঁদছো কেনো?’
আরোহীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলে আঁধার। আরোহী এবার চোখ তুলে তাকায় আঁধারের দিকে, এতে যেনো আঁধার আরও বিচলিত হয়ে যায়,,,,
–‘আরুপাখি কি হয়েছে জান কাঁদছো কেনো?’ ইসস কাঁদে না।
আরোহীর চোখের পানি মুছে দিয়ে টেনে তার আরুপাখিকে বুকে নিয়ে কথাটি বলে আঁধার। আলিশা উঠে দাড়িয়ে আদরকে চোখের ইশারায় আসতে বলে নিজেও চলে যায়,আর আদর ও এক পলক আরোহী ও আঁধারকে দেখে তার পেছন পেছন চলে যায়।
কেনো তার এতো কষ্ট? এতোদিন তো আরোহী তাকে সুখী একজন মানুষ মনে করতো কিন্তু আজকে নীলিমার কান্না দেখে নতুন ভাবে সবকিছু আবিষ্কার করছে আরোহী।
ছোট বেলা থেকেই সে অন্যের কষ্ট সহ্য করতে পারে না। আর আজকে তো এতো কাছ থেকে দেখলো কিভাবে সহ্য করবে আরোহী? আসলেই কি সহ্য করার মতো ব্যাপারটা?
আঁধার আরোহীকে নিজের বুকে এভাবে কাঁদতে দেখে বারণ করলো না তবে মাথায় চুমু দিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছে।
এক ঘন্টা হয়ে গেলো কিন্তু আরোহীর কান্না থামার কোনো নামই নেই। একসময় আরোহী শান্ত হলো ঠিকই তবে আঁধারের খটকা লাগলো ব্যাপারটা, মাথাটা হাত দিয়ে একটু উঁচু করতেই আরোহীকে ঘুমাতে দেখে হেঁসে ফেললো।
একটু আগেও মেয়েটা তাকে আঁকড়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কান্নাকাটি করছিলো আর এখন পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে গেলো।আরোহীকে কোলে তুলে আসতে করে বিছানায় শুয়ে দিলো আঁধার!
এক হাত দিয়ে শুকিয়ে যাওয়া চোখের জ্বলগুলো মুছতে চেষ্টা করলো তার প্রেয়শীর কিন্তু শুকিয়ে যাওয়া চোখের জ্বল কি আর মুছিয়ে দেওয়া যায়,উঁহু যায় না তাই আঁধার ও পারলো না।
আরোহীর কপালে সময় নিয়ে একটা চুমু দিয়ে বের হয়ে গেলো সে।তার এখন আলিশা আর আদরের কাছে শুনতে হবে বাড়িতে কি হয়েছে।
করিডর থেকেই ড্রয়িংরুমে আদর ও আলিশাকে বসে থাকতে দেখে সোজা নিচেই আসলো আঁধার।আলিশা অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলো,,,,,
–‘ভাইয়া আরো,,,,,’
–‘ও ঠিক আছে ঘুমিয়ে গেছে, এখন তোমরা বলো তো কি হয়েছে আর আম্মুই বা কোথায়?’
আঁধারের গম্ভীর কন্ঠে মিইয়ে গেলো আলিশা, মিনমিন করে উত্তর দিলো,,,
–‘আম্মু একটা বান্ধবীর বাসায় গেছে! ‘
–‘নীলি কেনো এভাবে চলে গেলো,আর আরুই বা কি হয়েছে সব বলো?’ সব বলতে বুঝো এ টু জেড।
ঝাঁঝালো গলায় কথাগুলো বললো আঁধার। আলিশা ভয় পেয়ো যায়,এমনিতে ও সে আঁধারকে অকারণেই এখন ভয় পায় তার উপর এমন ঝাঁঝালো গলা।আদর আলিশার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নিজেই শুরু থেকে সবটা বলা শুরু করলে এমনকি তরী যেসব বললো সেসব ও বললো সে।
সবকিছু শুনে আঁধারের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো, নীলিমার প্রতি এই প্রথম তার রাগ হলো! তার পাগলামি দিন দিন বাড়ছে ভেবেই আঁধার মনে মনে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়।
আদর ও আলিশাকে আর কিছু না বলেই উপরের দিকে চলে যেতে গেলেই তার ফোন বেজে ওঠে৷ পকেট থেকে ফোন বের করে কানে দিতেই চমকে যায় আঁধার। অস্থির কন্ঠে বলে,,,,
–‘কি বলছিস নীলি সুইসাইড করেছে, তুই ওকে হাসপাতালে এডমিড করানোর ব্যবস্থা কর আমি আসছি!’
বলেই ওভাবেই দৌড়ে বাড়ির বাহিরে চলে যায় আঁধার। আদর ও আলিশা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে।
একটা তিন তলার ফ্লাটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আঁধার ও আরোহী। আঁধার কলিং বেল টিপ দিয়ে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও আরোহী বিরক্ত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে!
মূলত আঁধার তাকে এক প্রকার টেনে হিচরেই নিয়ে এসেছে এখানে।কিন্তু কেনো নিয়ে এসেছে বা বাসাটা কার সেটাও বলেনি।
আরোহী অনেকবারই জিজ্ঞেস করেছে এই এক প্রশ্ন কিন্তু আঁধার উত্তর দেওয়ার দরকার মনে করেনি আর করার প্রয়োজন ও হয়তো পড়েনি তার।
এরই মধ্যে একটা পিচ্চি মেয়ে দরজা খুলে দেয়,কিন্তু ভালো করে লক্ষ করে দেখে আসলে পিচ্চিটা দরজা খুলেনি একটা বড় মেয়েই দরজাটা খুলে দিয়েছে। কারণ এটুকু একটা বাচ্চা মেয়ে তো আর দরজা খুলতে পারবে না,বয়সই বা কতো হবে তিন কি চার।
আরোহী হা করে তাকায় পিচ্চিটার দিকে! কতো সুন্দর গোলগাল মুখশ্রীর একটা পুতুলের মতো দেখতে মেয়ে। মেয়েটি আরোহীর দিকে বড় বড় চোখ করে তাকায় কিন্তু হয়তো ঠাওর করতে পারে না, যে মেয়েটি কি।
এরইমধ্যে আঁধারকে দেখে পিচ্চিটার মুখে বিশাল আকারের একটা হাসি ফুটে উঠে! আঁধার ও কিছুটা প্রশস্ত হাসে।
–‘কি ব্যাপার তিথিমনি কেমন আছে?’
আঁধারের কথা শুনে পিচ্চি তিথি কোলে উঠার জন্য দুহাত বাড়িয়ে দেয়।বিনা সংকোচে কোলে তুলে নেয় আঁধার!
–‘ভালো নেই বাইয়া, কিন্তু তোমায় দেখে অনেক ভালো হয়ে গেছি!’
আঁধারের গলা জড়িয়ে ধরে বলে ছোট তিথি।আঁধার হেঁসে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে,,,
–‘সবই তো ঠিক আছে কিন্তু ওটা বাইয়া নাহ ভাইয়া হবে তো!’
আরোহী ও আঁধারের পেছন পেছন ভিতরে ঢুকে যায়।
–‘একই তো!’
আঁধারের গালে একটু চুমু দিয়ে বলে তিথি।
–‘আচ্ছা হোক, বাসার বাকি সবাই কোথায়?’
–‘আসলে ভাইজান বাসায় তেমন কেউ নেই, শুধু আমি, তিথি,নীলিমা আপা আর তরী আপাই বাসায়! ‘
বড় মেয়েটা উত্তর দেয়। আরোহী অবাক হয়, তার মানে আঁধার তাকে নীলিমাদের বাসায় নিয়ে এসেছে। কিন্তু এই পিচ্চি বাচ্চাটা আর বড় মেয়েটাই বা কে?
আরোহীর ভাবনার মধ্যেই আঁধার আরোহীর দিকে তাকায়।বড় মেয়েটা মূলত এতোক্ষণ হা করে আরোহীকেই দেখছিলো।আরোহীকে তার কাছে ভাড়ী সুন্দরী মনে হচ্ছে, কতো সুন্দর টানা টানা চোখ, সুন্দর মুখশ্রী, দেখতে ওতোটা ফর্সা না হলেও মোটামুটি ফর্সা।তবে আঁধারের কি হয় সেটা সে বুঝতে পারছে না কারণ এর আগে কখনো আঁধার বা বাকি সবার সাথে দেখেনি তাকে।
আঁধার হয়তো মেয়েটির মনের ভাব বুঝতে পারে, তাই বিনা সংকোচেই বলে,,
–‘সুমি ও হচ্ছে তোর ভাবি, আর আরু ও হচ্ছে সুমি তরীর চাচাতো বোন!’
ভাবি কথাটা শোনার পর পরই সুমির মুখটা অনেকটা উজ্জ্বল হয়ে যায়, আঁধারের বউ মানে তার ভাবিকে ভাবি হিসেবে তার অনেক পছন্দ হয়েছে। এগিয়ে গিয়ে বলে,,,
–‘কেমন আছেন ভাবি?’
–‘আলহামদুলিল্লাহ, আপনি?’
হালকা হেসে বলে আরোহী।
–‘আলহামদুলিল্লাহ, আপনি আমায় তুমি করে বলতে পারেন!’ আমি কিন্তু আপনার পর না।
সুমির কথা শুনে আরোহী মিষ্টি হেসে মাথা নাড়ায়। আঁধার এক পলক ওদের দেখে সুমিকে বলে,,,
–‘তরী আর নীলিকে একটু ডেকে নিয়ে আয় তো যা।’
সুমি “আচ্ছা” বলেই দৌড়ে চলে যায়।
আঁধার আরোহীকে বসতে বলে নিজেও পাশের সোফায় বসে পড়ে। ঠিক তখনই তিথির প্রশ্নে ভড়কে যায়।
–‘বাইয়া ভাবি কি?’
–‘ভাবি মানে ভাইয়ের বউ পিচ্চি! ‘ এই যে ওকে দেখছো না, ও হচ্ছে আমার বউ।
প্রথমের কথাটা তিথির দিকে তাকিয়ে হেসে বললেও শেষেরটা আরোহীকে দেখিয়ে বলে।
–‘বউ কি বাইয়া?’
আঁধার এবার ভেবাচেকা খেয়ে যায়, কি বলবে সে এখন। আরোহী তিথির কথা শুনে ফিঁক করে হেসে দেয়।আঁধার চোখ পাকিয়ে তাকাতেই চুপ হয়ে যায়।কিন্তু তিথি চুপ হয় না সে আবার প্রশ্ন করে,,,
–‘বাইয়া বউ কি?’
–‘বউ হচ্ছে মানুষ, এই যে যেমন ধরো ও আমার বউ!’ তোমার আম্মু তোমার বাবার বউ, তোমার বড়আম্মু তোমার বড় বাবার বউ।
–‘তাহলে আমি কার বউ?’
ভাবুক দৃষ্টিতে আঁধারের দিকে তাকিয়ে বলে তিথি।
আঁধার ও তিথির মতো ভাবুক হয়ে বলে,,
–‘আসলেই তো তুমি কার বউ?’
তিথি ঠোঁট উল্টিয়ে আঁধারের দিকে তাকালে আঁধার বলে,,
–‘আরে আমাদের তিথিমনি তো একটা সুন্দর রাজকুমারের বউ৷’ লাইক সিন্ডারেলার গল্পের মতো।
আঁধারের কথা শুনে তিথি খুশি হয়ে যায়।কিন্তু পাল্টা প্রশ্ন করতে ভুলে না,,,
–‘কিন্তু বউ দিয়ে কি হয় বাইয়া?’
“বউ দিয়ে বংশবিস্তার হয়, বংশবৃদ্ধি হয়,তোকে আর কি বুঝাই আমি বললেই তো বলবি তাহলে তোমার হয়নি কেনো? আরে ভাই আমার সেই সৌভাগ্য হয়নি এখন ও ”
বিরবির করে কথাগুলে বলে আঁধার।
আঁধারকে বিরবির করতে দেখে আরোহী কান খাঁড়া করে শুনতে চেষ্টা করে কিন্তু শুনতে পায় না।
–‘বউ দিয়ে কিছু হয়না আপি, তবে বউ চাইলে আবার অনেক কিছু হয়।’ যেমন তুমি হয়েছো এরপর আমাদের পিচ্চি হবে।
তিথি হয়তো আঁধারের কথা বুঝতে পারে না, কিন্তু বুঝার চেষ্টা করে। আরোহী লজ্জায় মাথা নিচু করে নেয়, আর মনে মনে আঁধারকে বকতে থাকে।
তিথি আর কিছু বলার আগেই হুরমুর করে নিচে নামে তরী,আঁধার চমকে যায় সাথে আরোহী ও৷ সুমি নিজেও অবাক হয়ে যায় তার বোনের এভাবে নামা দেখে, তবে সে স্বাভাবিক ভাবেই নেমে আসে৷ তরী একেবারে আঁধারের সামনে এসে দাঁড়ায়।
–‘এভাবে দৌড়ে আসলি কেনো তুই? ‘
–‘আরে তোরা এসেছিস দৌড়ে আসবো না তা কি,হুর তোর সাথে কথা বলে লাভ নেই। ‘
বলেই তরী আরোহীকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,,
–‘একি আরোহী কেমন আছো তুমি?’ অবশেষ এ এই গাধাটা তোমায় নিয়ে আসলোই এখানে।
আরোহী আঁধারের দিকে কোণা চোখে তাকিয়ে বলে,,
–‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আপু তুমি কেমন আছো?’
কিন্তু আঁধার একদম স্বাভাবিক হয়ে আছে, তার হয়তো এসবের অভ্যেস আছে।
–‘আলহামদুলিল্লাহ বসো তুমি, এই সুমি চল তো কিছু রান্নার ব্যবস্থা করি।’
আরোহী কে বসতে বলেই সুমির উদ্দেশ্যে কথাটা বলে তরী।
–‘তরী এসবের কোন দরকার নেই, আমরা একটু পরই চলে যাবো!’ আর নীলি কোথায়?
আঁধারের কথা শুনে তরীর মুখটা ফেকাসে হয়ে যায়।
–‘রুমে আছে! ‘ তুই যা উপরে, আমি এমনি কিছু নাস্তার ব্যাবস্থা করি।
আঁধার মাথা নাড়িয়ে আরোহীর হাত ধরে বলে,,
–‘চলো।’
আরোহী আর কি করবে আঁধারের সাথে সাথে পাঁ মিলিয়ে চলা শুরু করে।
আচ্ছা নীলিমা আপু যদি আমায় দেখে রাগ করে, আমার কি আঁধারের সাথে যাওয়া ঠিক হবে! নাকি আমি তরী আপুর সাথে নিচেই থেকে যাব, না না আঁধার তো আমার বর আর নিজের বরকে কেউ অন্য মেয়ের সাথে একা ছাড়ে নাকি যতোই সে ফ্রেন্ড হোক না কেনো। আমি কি ঠিক করছি নাকি নিচেই থেকে যাবো। আরোহীর এসব ভাবনার মাঝেই আঁধারের কথায় তার ভাবনার সমাপ্তি ঘটে।
–‘কি এতো ভাবছো বলো তো?’
–‘কই কিছু না তো!’
আরোহীকে আমতা আমতা করতে দেখে আঁধার সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায়! আরোহী আঁধারের তাকানো দেখে বলে,,
–‘এইটা কি নীলিমা আপুর ঘর?’
আঁধার এক পলক তাকায়, কিন্তু ভেতর থেকে দরজা বন্ধ দেখে ভ্রুকুঁচকায়।
–‘না তরীর ঘর, নীলি বর্তমানে তরীর বাসায়ই আছে।’
বলেই দরজায় নক করে,,,
–‘কে?’
ভেতর থেকে গলার আওয়াজ পেয়ে, আঁধার আরোহীর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলে,,
–‘দরজাটা খুলে দে।’
আঁধারের গলার আওয়াজ পেয়ে নীলিমার ভেতরটা কেঁপে উঠে, আজকে তিন দিন পর এই কন্ঠটা শুনতে পেলো সে। আগে একদিন আঁধারের গলার স্বর না শুনলে নিজেকে পাগল পাগল লাগতো তার কিন্তু আজকে তিন দিন ধরে সেই পাগলামি মধ্যেই আছে সে।
–‘নীলি!’
এরইমধ্যে আঁধারের মুখে তার নামটি শুনে কলিজা ঠান্ডা হয়ে যায় নীলিমার। চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়তে থাকে,পুরো শরীর অবস হয়ে আছে তার। কি করবে দরজাটা খুলবে, নাকি খুলবে না। খুলে এক পলক দেখার জন্য তার মনটা ছটফট করছে, নিজেকে শান্ত করে চোখের পানি মুছে নেয় নীলিমা।
আয়নার সামনে দাঁড়ায়, নিজের অবস্থা দেখে তাচ্ছিল্য হাসি দেয়। দিয়েই হাসি মুখে দরজাটা খুলে দেয়,কিন্তু দরজা খোলার পর পরই চোখ মুখে বিষাদের হাসি ফুটে উঠে।
আরোহীকে নিয়ে আসার কি খুব দরকার ছিলো আঁধারের, তার তো কষ্ট হচ্ছে! কিন্তু আঁধার কি বুঝবে তার কষ্টটা? না আঁধার বুঝতে পারছে না, আগেও বুঝে নি আজকে ও বুঝছে না হয়তো। আচ্ছা তাকে ভালোবাসলে কি খুব একটা ক্ষতি হয়ে যেতো আঁধারের? সে তো আরোহীর মতোই সুন্দর কিন্তু তবুও আঁধার আরোহীর যায়গায় তাকে মেনে নেয়নি তো?
কি করবে এতো সৌন্দর্য আর রুপ দিয়ে, যেখানে আঁধারের ভালোবাসা পাওয়া তার ভাগ্যে থাকলো না! আচ্ছা ভালোবাসা নাহয় নাই বা পেলাম কিন্তু আঁধারকে পেলে কি খুব একটা ক্ষতি হয়ে যেতো? কতো মানুষ আছে পৃথিবীতে যারা ভালোবাসা ছাড়াই সংসার করে, করে তো? কিন্তু সে তো না পেলো আঁধারের ভালোবাসা আর না পেলো ভালোবাসাহীন আঁধারের সংসার।
একদৃষ্টিতে তাকিয়ে নীলিমা এতোক্ষণ আরোহীর দিকে তাকিয়েই এসব ভাবছিলো। আরোহী নিজেও নীলিমার দিকে কষ্ট ভড়া নয়নে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে কতোটা কষ্টে আছে সে?
এই তিন দিনেই নিজের চেহারার অবস্থা কি করেছে,আগের মতো উজ্জ্বলতা নেই মুখে,নেই কোন প্রশাধনির ব্যাবহার। চোখের নিচের কালো দাগ দেখেই বোঝা যাচ্ছে হয়তো তিন দিনে একবার ও চোখের পাতা এক করতে পারেনি।
নীলিমার ভেতরটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে, কিন্তু তার এই কষ্ট আঁধার নামক পুরুষটির কাছে ছেলেখেলা মাত্র।তাইতো তার জায়গায় আজকে আরোহী,কিন্তু সে তো বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার ভয়ে কিছু বলেনি কখনো। তবে আঁধারের মনে জায়গায় করে নেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছে সে কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে।
সে ভেবেছিলো আঁধার নামক এই পুরুষটি হয়তো কখনো কেনো মেয়েকে ভালোবাসতেই পারবে না, যেমনটি আগেও পারতো না নাহলে কি আর তাকে গ্রহন করতো না নাকি!
আঁধার আরোহীর হাত ধরেই ভেতরে প্রবেশ করে,,নীলিমা তাদের হাতের দিকে তাকায় কিন্তু তার সহ্য ক্ষমতা লোপ পেয়ে যায়।এক ছুটে বাহিরে চলে যায় সে। আঁধার ভ্রুকুঁচকে তাকায়, আরোহী হতভম্ব হয়ে যায়।
আরোহীর হাত ছেড়ে দিয়ে নীলিমার পেছন পেছন আঁধার চলে যায়, আরোহী নিজেও এগিয়ে যায় কিন্তু ততোক্ষণে নীলিমা অন্য রুমের ভেতর গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।
দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ এতোটাই জোড়ে ছিলো যে নিচ থেকে তরী ও সুমি দৌড়ে চলে এসেছে।
আঁধার দরজায় টোকা দিয়ে নীলিমাকে ডাকে কিন্তু নীলিমা দরজা খুলে না। তরী অস্থির হয়ে যায়, আরোহী কি করবে বুঝতে পারে না।
#চলবে?
#নীল_ডায়েরির_সেই_মেয়েটি
#আরদ্ধিতা_রুহি
#পর্বঃ২৪
🍁
আঁধার দরজায় নক করে, তরী অস্থির হয়ে দরজায় নক করতে থাকে কিন্তু নীলিমা দরজা খুলে না! আরোহী একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে সবটা, তার পাশেই সুমি তিথিকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এরই মাঝে দরজার ওপাশ থেকে আওয়াজ আসে নীলিমার,,,
–‘তরী, আমি একা থাকতে চাই প্লিজ সবাইকে চলে যেতে বল!’
আঁধার হতাশ হয়ে তরীর দিকে তাকায়, তরী চোখ দিয়ে তাকে চিন্তা করতে বারন করতে বলে। আঁধার সরে আসে দরজার কাছ থেকে! সুমি এখন ও কিছু বুঝছে না আসলে হচ্ছেটা কি তাই সে আরোহীর কাছে একটু চেঁপে গিয়ে বলে,,,
–‘কি হয়েছে ভাবি?’ নীলি আপু হঠাৎ এরকম করছে কেনো?’
আরোহী এতোক্ষণ একদৃষ্টিতে আঁধারের দিকে তাকিয়ে ছিলো, সুমির কথায় আঁধারের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সুমির দিকে পূর্ণঙ্গ দৃষ্টিতে তাকায়। মেয়েটি কৌতুহল নিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
আরোহী কি বলবে ভেবে পায় না, কারণ সে তো বুঝতে পারছে নীলিমা তাকে আর আঁধারে একসাথে দেখেই সবটা করছে। তবে নীলিমার দোষ নেই, সে তো ভালোবেসে কাউকে! আর সেই ভালোবাসাটা হয়তো একপক্ষীক ভালোবাসা।
আচ্ছা এই ভালোবাসার পরিনতি কি হবে? নীলিমা ও কি তাকে আর আঁধারকে আলাদা করার জন্য চেষ্টা করবে? নাকি আলাদা করেই ফেলবে? আঁধার কি নীলিমার এসব দেখে নীলিমার প্রতি দূর্বল হয়ে যাবে তাকে কি ছেড়ে দিবে?
আরোহী সুমির দিকে তাকিয়েই এসব ভাবছিলো হঠাৎ সুমির ধাক্কা হকচকিয়ে যায়।
–‘কি হয়েছে আপু?’
–‘তোমার কি হয়েছে ভাবি?’ কি এতো ভাবছিলে কতক্ষণ ধরে জিজ্ঞেস করছি উত্তর দিচ্ছো না?
–‘না না কিছুই না, নীলিমা আপু কি দরজা খুলেছে?’
আরোহীর প্রশ্নে হতাশ হয়ে মাথা নাড়ায় সুমি যার অর্থ না। আরোহী সুমির হতাশ ভরা মুখের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আঁধারের দিকে তাকায়, সে এক দৃষ্টিতে বন্ধ দরজার দিকেই তাকিয়ে আছে।
আর তরী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, শেষ মেশ নীলিমা দরজা খুলে দেয়।
তরী হতদন্তর করে ঢুকে যায়, সুমি দৌড়ে চলে যায় দেখার জন্য আর আঁধার গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায়। কিন্তু এগোয় না আরোহী, সে ভাবছে এখন কি আঁধার নীলিমাকে বলবে আমি তোকেও বিয়ে করতে চাই, তোর এসব পাগলামিতে আমার মন গলে গেছে।
এরইমধ্যে ভেতর থেকে নীলিমার ডাক শুনতে পায়, আরোহীর কলিজাটা ধক করে উঠে। তাহলে কি তার ভাবনাটাই ঠিক, সে কারণেই নীলিমা এখন তাকে ডাকছে?আরোহীর হঠাৎ করেই কান্না পায়, চোখ ঝাপসা হয়ে আসে!
গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায় সে কিন্তু দরজার কাছে গিয়ে আর এগোতে পারে না, নীলিমা তার আগেই তার কাছে চলে এসে মিষ্টি একটা হাসি দেয়। এতে যেনো আরোহীর ভয় আরও কয়েকগুন বেড়ে যায়! আঁধারের দিকে একপলক তাকায় আরোহী, আঁধার তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
–‘আরে কি হলো এসো ভেতরে এসো?’
আরোহীকে টেনে ভেতরে নিয়ে যেতে যেতে কথাটা বলে নীলিমা।আরোহী পুতুলের মতো নীলিমার সাথে ভেতরে ঢুকে ঠিকই তবে আঁধারের থেকে দৃষ্টি সরায় না।
–‘সরি আসলে আমি একটু ডেস্পারেট ছিলাম তাই এমন ব্যাবহার করে ফেলেছি, তুমি কিছু মনে করো না কেমন?’
নীলিমার কথায় সামান্য হাসার চেষ্টা করে বলে আরোহী,,,
–‘সমস্যা নেই আপু আমি কিছু মনে করিনি!’
–‘আচ্ছা তোমরা গল্প করো আমি একটু ফ্রেস হয়ে আসি কি বলো?’
–‘তার দরকার নেই নীলি, আমরা তোর সাথে দেখা করতেই এসেছিলাম কিন্তু এখন আর দেরি করবো না রে!’ এখনই ফিরতে হবে আমাদের।
আঁধার আরোহী দিকে তাকিয়েই কথাটা বলে।
–‘সে কি রে এখনই যাবি কেনো? ‘
–‘একটু কাজ আছে, প্লিজ তোরা আটকানোর চেষ্টা করবি না আশা রাখি!’
নীলিমা চুপ হয়ে যায়।
আরোহী মাথা নিচু করে আছে, আসলে তার নিজেরও এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না! কিন্তু আঁধারকে বলার সাহস পাচ্ছে না, মূলত এখানের পরিবেশটা নীলিমার জন্যই তার কাছে বিরক্ত লাগছে আবার নীলিমার কথা ভেবেও খারাপ লাগছে।
কিন্তু বাঙ্গালি নারী তো, সবকিছুর ভাগ দিতে রাজি শুধু মাত্র স্বামীর ভাগ ছাড়াই।তার ক্ষেত্রে ও সেটার ব্যতিক্রম না, তাইতো এখান থেকে যাওয়ার জন্য তার মনটা ছটফট করছে। ভয় হচ্ছে যদি তার আঁধারকে তার কাছ থেকে কেড়ে নেয়, তখন কি করবে আরোহী৷
আঁধার তরীর দিকে তাকিয়ে বলে,,
–‘আসি রে, পরে আবার আসবো!’
তরী বলার মতো কিছু খুঁজে পায় না, আরোহীর ব্যাপারটা সে নিজেও আন্দাজ করতে পারছে। সে ও তো একটা মেয়ে? মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,,,
–‘আচ্ছা, তবে আরোহীকে নিয়ে আসবি কিন্তু কেমন!’ আর আরোহী আবার এসো ঠিক আছে?
আরোহী মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলে আঁধারের পেছন পেছন চলে যায়। আর তরী হতাশার সাথে তাকিয়ে থাকে তাদের যাওয়ার দিকে, নীলিমা বিষাদের সাথে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়।কিন্তু তিথি কেঁদে উঠে, আঁধার তাকে যাওয়ার সময় বললো না কেনো এই নিয়ে তার কষ্টের শেষ নেই।
গাড়িতে চুপচাপ বসে আছে আরোহী, আঁধার হয়তো ব্যাপারটা ধরতে পেরেছে কিন্তু কিছু বলছে না। তার নিজেরই নীলিমার কাহিনি দেখে খারাপ লাগছে। তাই আর আরোহীর সাথে কথা বললো না বাসায় গিয়ে বলবে ভেবে নিয়েছে।
চৌধুরী বাড়িতে,,,,
আদর আলিশার দিকে কটমট চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে, আর আলিশা ইনোসেন্ট ফেইস নিয়ে আদরের দিকে তাকিয়ে আছে। আলিশার উদ্দেশ্য হচ্ছে তার ইনোসেন্ট ফেইস দেখিয়ে আদরের হাত থেকে বাঁচবে কিন্তু আদর সে তো আদরই! বউয়ের ইনোসেন্ট ফেইস দেখে সে গলে গেলো না বরং আরও কঠোর দৃষ্টিতে আলিশার দিকে তাকিয়ে থাকলো।
আলিশা ভরকে গেলো, চুপচাপ একটা ফলের পিস উঠিয়ে মুখে ঢুকিয়ে চোখ বন্ধ করে বিরক্তের সহিত খেয়ে ফেললো। এবার আদর স্বাভাবিক দৃষ্টিতে আলিশার দিকে তাকায়, আলিশাকে ওভাবে খেতে দেখে ফিঁক করে হেঁসে ফেললো।
আলিশা বিরক্ত হয়ে বললো,,
–‘ভুতের মতো যখন তখন হাঁসবে না তো একদম বিরক্ত লাগে!’
আলিশার কথা শুনে আদরের খারাপ লাগলো না বরং সে আলিশার কাছাকাছি গিয়ে বসলো।আলিশা বিরক্ত নিয়ে আবার বললো,,,
–‘কি হলো এভাবে এগিয়ে আসছো কেনো?’ দূরে যাও, একদম কাছে আসার চেষ্টা করবে না বলে দিলাম।
আলিশাকে পাত্তা না দিয়ে আদর এবার আলিশার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লো। আলিশা আর কিছু বলতে পারলো না! এই ছেলেটা কয়েকদিনের মধ্যেই তার মনের অনেকটা জুড়ে জায়গা করে নিয়েছে৷
তাদের সম্পর্কের উন্নতি ও ঘটেছে বটেই। এই যে প্রতিদিন আদরের বুকে মাথা দিয়ে ঘুমানো! যখন তখন তাকে জ্বালানো, রাতের আঁধারে বেলকনিতে বসে আদরের বুকে মাথা দিয়ে চাঁদ দেখা।নিয়ম করে খাইয়ে দেওয়া। আদরের সাথে বসে বসে গল্প করা। আদরের জামা কাপড় নিজ দায়িত্বে গুছিয়ে দেওয়া।
আগের মতো আদর আর তেমন ভার্সিটিতে যায় না, আলিশা হাজার বলেও নিয়ে যেতে পারেনি এমনকি আলিশাকেও যেতে দিবে না সে।
আলিশা রাগ করলে এইভাবেই কোলে মাথা দিয়ে আলিশাকে বলে,,,”তুমি যদি রাস্তায় মাথা ঘুরে পড়ে যাও কিংবা বমি করো তখন কে ধরবে শুনি?”
আলিশা আর কি করবে সে ও তো কেয়ারিং একজনকে চেয়েছিলো, একটা ভালোবাসার মানুষ চেয়েছিলো পেয়েছে যেহেতু তাই আর আদরের কথার অবাধ্য হয়নি। আদরের মনে হয়তো আরোহীর জন্য আগের মতোই ভালোবাসাটা আছে কিন্তু আদর প্রকাশ করে না! আলিশা বুঝতে পারে, তবুও সে চেষ্টা করে যেনো আদর আরোহীকে ভুলে গিয়ে তাকে ভালোবাসতে শুরু করে৷
এরইমধ্যে একটা আপেলের পিস আলিশার মুখের সামনে ধরে আদর, আলিশা এবার আর বাহানা করে না হাঁসি মুখেই খেয়ে নেয়।
–‘এটা কি হলো! এতোক্ষণ তো খাবে না খাবে না করে চেঁচামেচি করছিলে, এখন আবার বিনা বাক্যে খেয়ে নিচ্ছো? ‘
আদরের কথা শুনে আলিশা হাঁসিমুখে বলে,,
–‘কেউ ভালোবেসে কোন কিছু দিলে সেটা গ্রহন করতে হয় জানো না তুমি?’
আদর গম্ভীর স্বরে বলে,,
–‘আচ্ছা তাই নাকি!’ তা সবাই ভালোবেসে দিলে সবার ভালোবাসাই গ্রহন করবে তাহলে?
–‘সবার ভালোবাসা কি আর গ্রহন করা যায়, নির্দিষ্ট কারো ভালোবাসা গ্রহন করতে হয়!’
–‘তাহলে আমি কি তোমার সেই নির্দিষ্ট কেউ? ‘
কৌতুহলের সহিত জিজ্ঞেস করে আদর।
–‘হয়তো!’
–‘তোমার হয়তো মানে আমার হ্যা।’
আদরের কথা শুনে আলিশা হেঁসে ফেলে, এই ছেলেটা একদম অদ্ভুত! না বলতেই অনেক কিছু বুঝে যায়।
–‘আমি ভালোবেসে দিলে তুমি গ্রহন করবে?’
আদরের কথা শুনে আলিশা হেঁসে বলে,,,
–‘তা আপনি কি দিবেন শুনি জনাব?’
–‘আমি আমাকে দিবো!’
দুষ্টুমির স্বরে বলে আদর। আলিশা হাবলার মতো তাকিয়ে থাকে, আলিশাকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আদর বাঁকা হাসি দেয়। তার বউ যে এতো বোকা সে জানতোই না,,,
–‘দেখতে চাও? ‘
আলিশা মাথা নাড়ায়, যার অর্থ হ্যা আমি দেখতে চাই৷ আদর শয়তানি হাসি দিয়ে আলিশার ড্রেসের এক সাইড হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়ে তার ফর্সা পেটে পরপর কয়েকটা চুমু দেয়।আলিশা কেঁপে উঠে, কিন্তু আদর থেমে থাকে না।
অন্যরকম অনুভূতির মাঝে আলিশা নিজেকে আবিষ্কার করে। চোখ বন্ধ করে জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিতে শুরু করে সে, আদর আলিশার পেটে হাত ছুঁয়ে দিয়ে আলিশার দিকে তাকায়। আলিশাকে চোখ বন্ধ করে জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিতে দেখে, হালকা হেঁসে ফিসফিস করে বলে,,,
–‘দেখলে তো?’ নাকি আরও দেখাবো?
আদরের কথা শুনে আলিশা চোখ খুলে আদরকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়, আদর হেঁসে ওঠে। আলিশা একটা বালিশ হাতে নিয়ে মুখ ঢেকে নেয়। আদর যেনো আলিশাকে লজ্জা পেতে দেখে মজা পায়, আবার ধপ করে কোলে শুয়ে পড়ে।
–‘এক বাচ্চার মা হচ্ছো তবুও এতো লজ্জা আসে কোত্থেকে?’
আদর নিজের কথায় নিজেই হতভম্ব হয় কি বললো সে এটা,আলিশার লজ্জা পাওয়া মুখশ্রী মূহুর্তের মধ্যেই কেমন ফেঁকাসে হয়ে যায়।উঠে জড়িয়ে ধরে আলিশাকে,কিন্তু আলিশা নির্বাক। তবে আদর যে ভুল করে বলেছে এটা মনে হতেই আর কিছু বলে না, ওভাবেই পরে থাকে আদরের বুকে।
রাস্তায় আনমনে হাঁটছে রাহি,তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে কোন কিছু নিয়ে হয়তো অনেকটা চিন্তিত সে,তাই তো বেখেয়ালে রাস্তায় হাঁটছে। পেছন থেকে কেউ একজন অনবরত হর্ণ দিচ্ছে কিন্তু তার সেদিকে একদমই মন নেই। শেষ মেশ লোকটা বিরক্ত হয়ে গাড়ি থেকে নেমে রাহিকে কয়েকটা কড়া কথা শুনানোর জন্য এগিয়ে যায়।
–‘এই যে মিস বেখেয়ালি, চোখ কি আকাশে নিয়ে ঘুরেন নাকি?’ আকাশ পথ দিয়ে একটা রাস্তা বানিয়ে নিলেই তো পারেন। আজাইরা লোক জন, এসব কোথা থেকে যে আসে।
কারো কর্কশ কন্ঠে রাহি পেছনে ঘুরে তাকায়, একটা লম্বাটে ফর্সা ছেলেকে দেখে চোখ পিটপিট করে তাকায়।
রাহিকে এভাবে তাকাতে দেখে ছেলেটা ভারী বিরক্ত হয়,,,
–‘এই মেয়ে কথা বুঝতে পারেন না আপনি?’ বোবা নাকি রে ভাই?
রাহিকে আগের মতোই তাকিয়ে থাকতে দেখে, লোকটা কিছু একটা ভাবে তারপর মায়া মায়া চোখে তাকিয়ে বলে,,,
–‘আপনি কিছু মনে করবেন না, একটু রেগে ছিলাম তো তাই এভাবে বলে ফেলেছি!’ আসলে আমি অনেক দুঃখিত, তবে এভাবে রাস্তায় হাঁটবেন না সবাই তো আর আমার মতো ভালো হবে না তাই না।
রাহি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ছেলেটার দিকে,এই ছেলেটাকে সে কোথাও একটা দেখেছে কিন্তু মনে করতে পারছে না!
–‘আমি কিন্তু সাহফিফ আহমেদ, এদিকে একটা আত্মীয়ের বাসায় এসেছিলাম!’
বলেই রাহির হাত ধরে রাস্তার সাইডে নিয়ে দাঁড় করিয়ে বলে,,,
–‘আপনার জন্য আমার অনেক খারাপ লাগছে, এতে সুন্দর একটা মেয়ে কি না কথা বলতে পারে না ভাবতেই খারাপ লাগছে!’
সাহফিফের কথা শুনে রাহির মেজাজটায় খারাপ হয়ে যায় তাকে লোকটা বোবা বললো? কিন্তু তার কিছু বলার আগেই ছেলেটার ফোনে কল বেজে ওঠে, আর ছেলেটা রাহিকে বলে,,,
–‘সাবধানে থাকবেন, দেখে শুনে রাস্তায় চলাচল করবেন কেমন?’
বলেই গাড়িতে বসে চলে যায় সাহফিফ। রাহি হাঁ করে তাকিয়ে আছে, লোকটা তাকে বোবা মনে করে নিশ্চয়ই এসব বলে গেলো।
কথাটা বর্জ্য কন্ঠের মতো আঘাত করে আলিশার বুকে, চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। আদর আলিশার চোখে পানি দেখে কষ্ট পায়! কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারে না! আরোহীর বুকটাও ধক করে ওঠে, হাজার হোক বোন তো! এতো বড় একটা কথা বোনের বিরুদ্ধে শুনে তার নিজের ও চোখে পানি চলে আসে, মাথাটা নিচু করে নেয় সে! আঁধার সবে মাত্র খাবার টেবিলে এসে বসবে এমন কথা শুনে সে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে যায়!কিন্তু তারেক চৌধুরী নির্বাক।
–‘কি হলো কাঁদছ কেনো, আমি কি ভুল কিছু বললাম!’ তোমার কাছে তো সেসব কোন ব্যাপারই নয়।
আঁকলিমা চৌধুরী চোখ মুখ শক্ত করে আবার বলেন উক্ত কথাটি,,,
আলিশা নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করে, কিন্তু আজকে সে ব্যর্থ! চোখের জ্বলগুলো ও আজকে মনে হয় পণ করেছে একটু কথার আঘাতেই গড়িয়ে গড়িয়ে পড়বে!
–‘একদিন বিশ মেশানো খাবার খেলে কিছুই হবে না আম্মু, বরং কয়েকদিনের জন্য সবাই রেস্ট নিতে পারবো কি বলো?’
চেয়ার টেনে বসতে বসতে কথাটি বলে আঁধার। আরোহীর মুখ হাসি ফুটে উঠে, এই লোকটা আসলের অন্যরকম! আলিশা আঁধারের দিকে অবাক হয়ে তাকায়। আঁকলিমা চৌধুরী চোখ মুখ শক্ত করে আঁধারের দিকে তাকায়!
–‘আরে খিঁদে পেয়েছে আলিশা দেখি কি ব্রেকফাস্ট বানিয়েছো!’
বলেই টেবিলের উপরে রাখা সবগুলো খাবারের দিকে নজর দেয়। আদর হাসে তার ভাইয়ের কান্ডে, যেখানে তার বউয়ের হয়ে সে কিছুই বলতে পারলো না অথচ তার ভাই ঠিকই তার হয়ে উত্তরটা দিয়ে দিলো! মনে মনে ভাবছে আমাকে ও শক্ত হতে হবে, আলিশাকে বদলাতে সাহায্য করতে হবে। মেয়েটা সবে মাত্র নিজেকে বদলানো শুরু করেছে এরই মাঝে এমন পরিস্থিতি আসলে সে হয়তো নিজেকে একা ভাববে।
–‘আরে কি হলো আলিশা দাঁড়িয়ে আছো কেনো, দাও সবাইকে নাস্তাগুলো!’
আঁধার আবার কথাটি বলে নিজে নাস্তা উঠিয়ে আরোহীর প্লেটে দেয়। আরোহী মুচকি হেসে আলিশার দিকে তাকিয়ে ইশারায় দিতে বলে। আলিশা চোখের পানি মুছে তারেক চৌধুরীকে নাস্তা দেয়, তিনি কি মনে করে জানি আলিশার মুখের দিকে তাকায়।আলিশার চোখ মুখে তিনি সত্যিকারের অনুশোচনা দেখতে পারছেন! তার মায়া হয়, তিনি আলিশাকে নিজের পাশের চেয়ারে বসতে বলেন।
–‘না না আঙ্কেল আমি ঠিক আছি, আমি পরে খাব!’
আদরকে খাবার দিতে দিতেই বলে আলিশা। কিন্তু তারেক চৌধুরীর কথাটি পছন্দ হয়নি তিনি চোখ মুখ শক্ত করে বলেন,,,
–‘আঁধার ও আদরের কাছে শুনলাম তুমি অনুতপ্ত তাই আমি ও তোমায় ক্ষমা করে দিয়েছি এমনটা ভাবাটা তোমার বোকামি!’ তবে হ্যা বন্ধুর মেয়ে হিসেবেই বসতে বলেছি।
আঁধার এক মনে খেয়েই চলেছে, আদর ও আরোহী খাবার নাড়াচাড়া করছে কিন্তু খেতে পারছে না! আঁকলিমা চৌধুরী আলিশার বানানো খাবার খায় না তিনি নিজেই ফল কেটে নেন খাওয়ার জন্য! যদিও তিনি সচারাচর সকালে ফল খান না তবে আজকে আলিশার বানানো খাবার খাবে না তাই ফলই খাচ্ছেন তিনি। আলিশা কি করবে ভেবে পাচ্ছে না! এরই মধ্যে আদর বলে উঠে,,,
–‘আমি অকালে মরতে চাই না!’ মোট কথা আমি এক বিন্দু ও এই মেয়েটাকে বিশ্বাস করি না।
আঁধার খাওয়া থামিয়ে আদরের দিকে তাকায়, আদরকে অসহায় চোখে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাসে আঁধার। আরোহীকে ইশারায় আলিশাকে বসিয়ে দিতে বলে।আরোহী আঁধারের ইশারা বুঝতে পেরে আলিশাকে টেনে বসিয়ে দেয়।
আঁকলিমা চৌধুরী শক্ত চোখে এবার আরোহীর দিকে তাকায়!কিন্তু আরোহী সে দিকে খেয়াল নেই, সে আলিশাকে এক চামচ নুডলস খাইয়ে দেয়। আলিশা পরে খাবে বললেও আরোহীর জোড়াজুড়িতে খেয়ে নেয়।
আরোহী চোখ ঘুরিয়ে তাকাতেই আঁকলিমা চৌধুরীর দিকে চোখ যায় তার। ইনোসেন্ট একটা হাসি দিয়ে খাওয়ার মনোযোগ দেয় সে, কিন্তু আঁকলিমা চৌধুরী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আলিশার দিকে তাকিয়েই খাবারটা শেষ করে।
তারেক চৌধুরী খাওয়া শেষ করে আঁকলিমা চৌধুরীকে ঘরে আসতে বলে! স্বামীর পেছন পেছন তিনিও চলে যান। এতোক্ষণে যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচে সকলে। আদর ও আঁধারর সস্থির নিশ্বাস ছাড়ে!আরোহী হাফ ছেড়ে বাঁচে, কিন্তু আলিশা নির্বাক হয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে! আরোহী আলিশার কাঁধে হাত রেখে বলে,,
–‘মন খারাপ করিস না আপু সব ঠিক হয়ে যাবে!’
আলিশা মাথা নাড়ায়। আদর আলিশার হাতে হাত রাখে, আলিশা চোখ তুলে তাকায় তার দিকে। আদর আলিশার চোখের পানি হাত দিয়ে মুছে বলে,,
–‘ডোন্ট ক্রাই আশা,সব ঠিক হয়ে যাবে তুমি শুধু চেষ্টা করো! ‘ আমরা সবাই তোমার সাথে আছি।
আলিশার কান্না পায়,এই মানুষগুলো তার জন্য সবকিছু করছে! তার হয়ে প্রতিবাদ ও করছে অথচ সে একসময় এদের সাথে কতো কি করেছে। কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে আলিশা আদরের দিকে তাকায়।
আদর চোখ দিয়ে আস্বস্ত করে, আঁধার উঠে দাঁড়িয়ে বলে,,
–‘তবে হাল ছেড়ে দিলে হবে না, চেষ্টা চালিয়ে যেতেই হবে!’
আলিশা মাথা নাড়িয়ে আঁধারকে ধন্যবাদ বলে। আঁধার হেসে চলে যায়।
ভার্সিটির গেইটের কাছে একে একে দুইটা গাড়ি এসে থামে, সকলে এক পলক তাকিয়েই বুঝে যায় কারা এসেছে! তবে নীলিমা দৌড়ে চলে আসে একটা গাড়ির সামনে, ততোক্ষণে আঁধার নেমে দাঁড়িয়েছে। নীলিমাকে এভাবে দৌড়ে আসতে দেখে ভ্রুকুঁচকায় আঁধার!
নীলিমা হাসি মুখে আঁধারকে কিছু বলবে তার আগেই পাশের দরজা খুলে আরোহীকে বের হতে দেখেই অবাক হয়ে যায় সে।আরোহীকে দেখেই মেজাজটা তার খারাপ হয়ে যায়।কিছু বলবে তার আগেই তাকে অবাক করে দিয়ে আরোহী চুপচাপ সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
নীলিমার সাথে তরী ও বাকি সবাই ও অবাক হয়ে যায়, কিন্তু শিহাব,সোহেল ও রাতুল স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। ততোক্ষণে আদর ও আলিশা ও গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে যায়।আরোহীকে চলে যেতে দেখে আদর ডাকে,,
–‘আরে আরো তুমি চলে যাচ্ছো কেনো দাঁড়াও!’
আরোহী পেছনে ঘুরেতেই হাতের ইশারায় ডাকে আবার আদর। আরোহী এক পলক সবার দিকে তাকিয়ে আবার আদরদের দিকে এগিয়ে যায়, কিন্তু মাঝ পথে নীলিমার একটা প্রশ্ন শুনে দাঁড়িয়ে যায়।
কিছুই না বোঝার মতো করে বলে আঁধার। নীলিমার রাগ হয় কিন্তু সেটা প্রকাশ করে না।মুখে মিথ্যে হাসি ফুঁটিয়ে বলে,,
–‘আরোহী!’
আঁধার মুচকি হেসে বলে,,,
–‘এবার ঠিক আছে, ওকে আর ওই মেয়েটা বলে ডাকবি না সুন্দর একটা নাম আছে ওর সেটা বলে ডাকবি!’ আর সেটাও না পারলে তুই ওকে সবার মতো আরো বলেই ডাকতে পারিস।
রাতুল ফিঁক করে হেসে দেয়। তরী মুখ চেপে হেসে ওঠে, কিন্তু সোহেল ও শিহাব গম্ভীর হয়েই থাকে।নীলিমা চোখ মুখ শক্ত করে হাত দিয়ে নিজের জামা চেপে ধরে রাগ কমানোর চেষ্টা করে! আলিশা ও আদর সবার দিকে তাকায় একবার আবার আঁধারের দিকে তাকায় তারা কিছুই বুঝতে পারছে না।
আরোহী আঁধারের রসিকতায় হাসে ও না রাগেও না তবে তার অভিমান হয়, লোকটা তাকে বউ বলে পরিচয় দেয়নি এখন ও তাহলে!
আঁধার আরোহীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,,
–‘তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেনে এদিকে আসো!’
আরোহী তবুও এক পাঁ এগোচ্ছে না দেখে আঁধার বিরক্ত হয়ে আরোহীর হাত টেনে তার সামনে নিয়ে আসে। আরোহী অসস্তিতে পড়ে যায়, হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে কিন্তু আঁধার হাত ছাড়ে না উল্টো শক্ত করে ধরে নীলিমার দিকে তাকায়।
নীলিমার চোখ মুখ অন্ধকার হয়ে আছে, সে একবার আরোহী ও আঁধারের হাতের দিকে তাকায় তো একবার আঁধারের দিকে।
আঁধার সোহেলের দিকে তাকায়, সোহেল নীলিমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঠিকই কিন্তু তার চোখমুখে বিষাদের ছায়া।হয়তো প্রেয়শীর মনে অন্যকারোর জন্য কঠিন অনুভূতি দেখেই সেটা প্রকাশ পাচ্ছে।
–‘ওকে তুই নাম ধরে না ডাকলে ও ভাবি বলে ডাকতে পারিস!’
আঁধারের কথাটা শুনে নীলিমা অবুঝের মতো তাকায় তার দিকে।
–‘ভাবি মানে!’
–‘ভাবি মানে ও হলো আমাদের প্রাণপ্রিয় বন্ধুর একমাত্র বউ!’
নীলিমার কথার উত্তর হিসেবে রাতুল হেসে কথাটি বলে।
নীলিমা হতবাক হয়ে তাকায় শিহাব ও সোহেলের দিকে। সোহেল মনে মনে হাসে, তার প্রেয়শী এতোটাই বোকা যে রাতুলের কথার মানে এখন ও বুঝতেই পারেনি! হয়তো সোহেল কিংবা শিহাবের বউ ভেবেছে।
–‘ভাবছিস কার বউ তাইতো?’
শিহাবের কথায় তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় নীলিমা।তরী এবার মুখ খুলে,৷
–‘ওয়াও, আরোহী ওরফে আরো আমাদের ভাবি?’ এই তুমি আগে বলোনি কেনো বলো তো তোমায় কিন্তু ভাবি হিসেবে আমার দারুণ পছন্দ হয়েছে তুই ও তো আগে বলিস নি আঁধার।
তরী উৎফুল্লের সাথে প্রথমের কথাটি আরোহীর একটা হাত ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললেও শেষের কথাটি আঁধারের উদ্দেশ্যে বলে।আরোহী মিষ্টি একটা হাসি দেয় তরীর দিকে তাকিয়ে।
–‘আঁধার বলবে মানে, কি বলছিস তুই তরী?’
নীলিমার কথায় তরীর মনে পড়ে যায় তার প্রাণ প্রিয় বান্ধবী যে আসলে আঁধারকে অনেক বেশিই ভালোবাসে। এখন কি হবে? কিভাবে সহ্য করবে সে এই কথাগুলো?
–‘কারণ ও তাশরিফ আঁধার চৌধুরীর একমাত্র বউ আলিনা সিরাতুল আরোহী!’
–‘ভালোই মজা করতে পারিস সোহেল তুই কিন্তু আমি মজার মুডে নেই এখন!’
সোহেল হাসে কিন্তু দৃষ্টি কঠিন করে তার কথাটা তার প্রেয়শীর মজা বলেই মনে হলো হাহ্।
–‘সোহেল মজা করছে না নীলি, আরোহী ইজ মাই ওয়াইফ! ‘
আঁধারের কথাটি বার বার নীলিমার কানে বাজতে থাকে, আরোহী ইজ মাই ওয়াইফ! কতো সহজেই বলে দিলো আঁধার অথচ নীলিমার কাছে কথাটি বিশ বাক্যের ন্যায় লাগছে! চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে আসছে, কি বললো আঁধার এটা,কেনো বললো!
অশ্রু সিক্ত চোখে আঁধারের দিকে তাকায় নীলিমা, আঁধার হতাশার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তারই দিকে।নীলিমা কি বলবে কি করবে ভাবতে পারছে না। আরোহী নীলিমার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আঁধারের দিকে তাকায়। আঁধারকে হতাশার দৃষ্টিতে নীলিমার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বুকে চিনচিন ব্যথার আভাস পায় সে। তৎক্ষনাৎ মাথা নিচু করে নেয় সে।
আঁধারের দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যায় নীলিমা, আঁধার আরোহীর দিকে তাকায়! আরোহীকে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আর কিছু বলে না।কিন্তু নীলিমা আঁধারের কাছে গিয়ে বলে,,
–‘বিয়ে করেছিস, আমাদের জানাসনি!’
–‘আসলে হঠাৎ করেই হয়ে গেছে রে বিয়েটা!’ তোদের জানাবো জানাবো করে আর জানানো হয়নি।
–‘ভালোবাসিস তোর বউকে?’
নীলিমার প্রশ্নে আঁধার হেসে আরোহীর হাতটা আরও খানিকটা শক্ত করে ধরে বলে,,
–‘জানিনা রে তবে ওকে ছাড়া অন্য কাউকে জীবনে ভাবতেও পারি না! ‘
নীলিমা আঁধারের কথা শুনে ব্যথাতুর হাসি দেয়, আর কিছু বলে না কিন্তু রাতুলদের বলে,,
–‘তোরাও আগে থেকেই জানতিস সব!’
–‘কাল বিকেলের দিকে আঁধার বলেছে!’
শিহাব উত্তর দেয়। নীলিমা হেসে বলে আচ্ছা। সকলে নীলিমার দিকে অসহায় চোখে তাকায়! নীলিমা যে আঁধারকে ভালোবাসে তারা জানে তবে আঁধার কখনো তাকে ওই নজরে দেখেনি সেটাও তারা জানতো। নীলিমার ভালোবাসাটা যে একপক্ষীক, আর ওয়ান সাইড লাভ যে বড়ই ব্যথাদ্বায়ক!
নীলিমার কষ্টটা তারা সকলে বুঝতে পারছে কিন্তু কি করবে ভালোবাসা তো আর সবার প্রতি আসে না!
–‘আচ্ছা আমি যাই রে পরে তোদের সাথে কথা বলবো কেমন!’
কথাটি বলেই নীলিমা আর দাঁড়ায় না, এক ছুটে ভার্সিটির বাহিরে চলে যায়। তরী ও নীলিমার পেছন পেছন যায়।আরোহী বুঝতে পারছে নীলিমার না বলা অনুভূতিগুলো, হয়তো সে ও আঁধারকে ভালোবাসে!
–‘আপুটা আপনাকে ভালোবাসে তাই না!’
এতোক্ষণ নীলিমার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলো আঁধার, হঠাৎ আরোহীর প্রশ্নটি শুনে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। আদর ও আলিশা ও ঘটনাটা বুঝতে পারে।
–‘হুম!’
আঁধারের কথা শুনে আরোহীর মন আর ও খারাপ হয়ে যায়।
–‘একমাত্র বউ বাদে সবাই আমাকে ভালোবাসে কি কষ্ট কি কষ্ট! ‘
আরোহীকে মন খারাপ করতে দেখে বলে আঁধার। আরোহী হেসে ফেলে। আর সোহেল,রাতুল ও শিহাব একসাথে সুর দিয়ে বলে উঠে,,
–‘আহারে কি কষ্ট কি কষ্ট! ‘
আরোহী লজ্জা পায়, আর কোনো দিকে না তাকিয়ে ক্লাসের দিকে ছুট লাগায়।এতোক্ষণের মন খারাপ সব বিষাদের ছায়া কেটে গিয়ে লজ্জায় লাল নীল হতে শুরু করে অনুভূতি গুলো সব।
#চলবে?
#নীল_ডায়েরির_সেই_মেয়েটি
#আরদ্ধিতা_রুহি
#পর্বঃ২২
🍁
কেটে গেছে ৩ দিন, এই ৩ দিনে আরোহী একবারের জন্য ও নীলিমাকে কোথাও দেখেনি৷ এমনকি আঁধারকে জিজ্ঞেস করবে সেটাও পারছে না, আঁধার নিজেও ওই ব্যাপারে আর কথা তুলেও না বলেও না!
আরোহী ভাবছে নীলিমা কি আঁধারের শোকে নিজের সাথে কিছু করেছে নাকি সে ভালো আছে! কেনো জানি না তার অনেকটা চিন্তা হচ্ছে নীলিমা নামক রমনীটির জন্য! আসলে তার চিন্তা করাটাও শোভা পায় না,কারণ নীলিমা তো তারই স্বামীকে ভালোবাসে।তবে আরোহীর হিংসে হয় না, অবশ্য না হওয়ারই কথা আঁধার তাকে বোনের নজরেই দেখে।
তবে এই কয়েকদিনে বাকি সবার সাথে অনেক ভালে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে আরোহীর। সবাই তাকে ছোট বোনের মতো ভালোবাসে আগলে রাখে।সোহেল, শিহাব ও রাতুল তো আরোহী বলতে পাগল! তারা ভাবতেও পারেনি এমন একটা ছোট বোন পাবে কখনো তারা।
আরোহী নিজেও ওদের মতো ভাই পেয়ে অনেক খুশি, আরোহীর এখন মনে হয় আঁধার তার কেউ না ওরা তার নিজের ভাই! আঁধার এই কয়েকদিনে অনেকবার কথাটি বলেছে ও অবশ্য। কিন্তু বরাবরের মতো গম্ভীর কন্ঠে বলেছে,, “আরু পাখি আমার নিজেকে এখন তোমার বডিগার্ড ছাড়া কিছুই মনে হয় না!”
আরু তখন প্রথমবারের মতো আঁধারের কথায় ভয়, লজ্জা, সংকোচ ছাড়াই বলেছিলো,,” কেনো,আমি কি আপনাকে আমার পেছন পেছন ঘুরাই।”
আঁধার তখন মুখ গোমড়া করে বলেছিলো,,”তা নয়তো কি,আমি তোমার সাথে সাথে থাকি কিন্তু তুমি আমার সাথে একটা বাক্য ও ব্যায় করো না! উল্টো সোহেলদের সাথে কথার উপর কথা বলতেই থাকো, লাইক হাঁসের মতো প্যাক প্যাক করো। কিন্তু আমার সাথে বডিগার্ডের মতো হু হা তেই কথা বলো!”
আঁধারের কথাশুনে সেদিন প্রথমবারের মতো আরোহী মন খুলে হেঁসেছিলো। আর আঁধার মুগ্ধ হয়ে তার বউয়ের হাসি দেখছিলো। তবে তার মুগ্ধতা বেশিক্ষণ টেকে নি, কারণ আরোহী তৎক্ষনাৎ মনে পড়ে যায় আঁধার তাকে হাঁসের সাথে তুলনা করেছিলো! আঁধারের দিকে কটমট চাহনিতে আরোহী যখন বলেছিলো,,,”আপনি আমায় ইন্ডাইরেক্টলি হাঁস বললেন!”
আঁধার তখন মুচকি হেঁসে আরোহীকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো,,,”ইন্ডাইরেক্টলি কখন বললাম আরুপাখি, আমি তো তোমায় ডাইরেক্টলি হাঁস বললাম!”
আরোহী তখন রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলেছিলো,,, ” আমি হাঁস হলে আপনি কি, গন্ডার একটা!”
আঁধারকে গন্ডার বলার সাথে সাথে, আঁধার আরোহীকে ছেড়ে দিয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে আরোহীকে বলে,,,” আমাকে কোন দিক দিয়ে তোমার গন্ডার মনে হয়।”
আরোহী তখন হতাশার সাথে বলেছিলো,,,” যে দিক দিয়ে আমায় হাঁস মনে হয় ওই দিক দিয়ে।”
ওইদিন দু’জনে বচ্চাদের মতো ঝগড়া করেছিলো, একসময় আরোহী আঁধারের গায়ে এক গ্লাস পানি ঢেলে দিয়ে এক ছুটে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়।ঘটনা এতো দ্রুত ঘটে যে আঁধার হতভম্ব হয়ে যায়। কিন্তু একটু পরেই শব্দ করে হেঁসে দেয়! তার বউ যে এখন ও বাচ্চা এইটা তারই প্রমাণ!
ছোট বাচ্চারা যখন ঝগড়ায় পারে না তখন থু থু দিয়ে পালিয়ে যায়,ঠিক তেমনি আরোহী যখন ঝগড়ায় পারলো না পানি দিয়ে পালিয়ে গেলো!
এরপর থেকেই আঁধার আরোহীকে ছোট বাচ্চা বলে খেপাতে থাকে, আর আরোহী ও ছোট বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করতে থাকে।
আরোহী এইসব ভেবেই আনমনে হেঁসে দেয়,আঁধার গাড়ি থামিয়ে ভ্রুকুঁচকে আরোহীর দিকে তাকায়! কিন্তু আরোহীর কি আর সে খেয়াল আছে, সে নিজের মতোই ভাবনা গুলো নিয়ে হাঁসছে।
–‘এই তুমি একা একা হাঁসছো কেনো?’
আঁধারের গলা শুনে হকচকিয়ে যায় আরোহী! ভাবনার মাঝে সে এতোই ব্যস্ত ছিলো আঁধার যে তার সাথে আছে সেটা তার মনেই ছিলো না।
–‘কি হলো কথা বলছো না কেনো?’
আরোহীর মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলে আঁধার। আরোহী আমতা আমতা করে কিন্তু কি বলবে সে এখন, যে আপনার সাথে আমার খুনসুটি গুলোর কথা মনে করে হাসছি! আঁধার তখন কি মনে করবে আমাকে বেহায়া, না না তা কি করে হয় আমি তো ওনার বউ! কিন্তু বলা টা কি ঠিক হবে।
আরোহীর এসব ভাবনার মাঝেই আঁধার আবার তার সামনে তুড়ি বাজায়।আরোহী তৎক্ষনাৎ ভাবনা থেকে বের হয়ে আসে।আসে পাশে তাকিয়ে দেখে ভার্সিটির সামনে গাড়ি থামিয়েছে আঁধার।
–‘আরে ওই যে দেখেন ওইদিকে!’
আঙ্গুল দিয়ে গাড়ির বাহিরে দেখিয়ে দেয় আঁধারকে আরোহী। আঁধার সিরিয়াস কিছু মনে করেই তাকায়। কিন্তু কাউকে দেখতে না পেয়ে আবার আরোহীর দিকে তাকিয়ে দেখে আরোহী নেই, ততোক্ষণে গাড়ি থেকে বাহিরে চলে গেছে!
চোয়াল শক্ত করে বসে থাকে আঁধার, কারণ সে খুব বুঝতপ পারছে তাকে কথাটা বলবে না তাই এভাবে বোকা বানিয়ে চলে গেলো মেয়েটা! একবার শুধু হাতের কাছে পাই তারপর বুঝাবো তাশরিফ আঁধার চৌধুরীকে বোকা বানানোর শাস্তি কি?
আরোহী তড়িঘড়ি করে দৌড়ে আসতে গিয়ে কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে উল্টে পড়ে যায়! মেজাজটাই খারাপ হয়ে যায় তার, না দেখেই হাতের বইটা ছুঁড়ে মারে! কিন্তু লোকটা বইটা হাত দিয়ে ক্যাচ ধরে ফেলে।আরোহীর দিকে ভ্রুকুঁচকে তাকিয়ে বলে,,,
–‘এই তুই এই অভ্যাসগুলো চেঞ্জ করবি না,সবসময় যার তার সাথে ধাক্কা খেতেই থাকিস দেখি!’
পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে আরোহী চোখ তুলে তাকায়, কিন্তু ছেলেটাকে দেখে লাফিয়ে ওঠে! আরোহীকে লাফাতে দেখে ছেলেটা দু কদম পেছনে চলে যায়।আরোহী খুশিতে গদগদ হয়ে ছেলেটাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। ছেলেটার মুখেও এবার হাঁসি ফুঁটে উঠে। আরোহীকে জড়িয়ে ধরে বলে,,,
–‘কেমন আছিস বুড়ি!’
আরোহীকে বুড়ি বলাতে আরোহী ক্ষেপে যায়,ছেলেটাকে ছেড়ে দু কদম পেছনে চলে যায়। ছেলেটা হাবলার মতো দাঁত বের করে হেসে বলে,,,
–‘রাগ করে লাভ নেই তুই আমার কাছে সারাজীবন বুড়িই থাকবি!’
–‘তোমার সাথে কথা বলবো না আমি তুমি আমায় বুড়ি বলেছো আবার সাহফিফ ভাইয়া!’
আরোহীর অভিমানী কন্ঠস্বর শুনে সাহফিফের হাসি পায় কিন্তু হাসে না। এখন হাসলে আরোহী আরও রেগে যেতে পারে, তাই ঘুর্ণঝড়কে নিজে থেকেই আর নিমন্ত্রণ করলো না সাহফিফ।
–‘আচ্ছা -আচ্ছা বলিস না কিন্তু এখানে কি করছিস।’
–‘আমি তো এই ভার্সিটিতেই পড়ি কিন্তু তুমি এইখানে কেনো?’
আরোহী প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় সাহফিফ।আরোহী সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায় সাহফিফের দিকে।আরোহীর দৃষ্টি দেখে ভড়কে যায় সাহফিফ। আমতা আমতা করে বলে,,,
–‘ওই একটা কাজে এসেছিলাম আর কি,বাদ দে তবে আমি কিন্তু এখন তোদের বাসায়ই যাচ্ছি!’ আজকে অনেক আড্ডা দিবো কি বলিস?
সাহফিফের কথা শুনে আরোহী লাফিয়ে ওঠে কিন্তু পরমুহূর্তেই তার মনটা খারাপ হয়ে যায়। আরোহীকে মন খারাপ করতে দেখে সাহফিফ বলে,,,
আঁধার কঠিন চোখে তাকাতেই আরোহী গড়গড় করে বলতে শুরু করে,,,
–‘উনি আমার মামাতো ভাই সাহফিফ ভাইয়া!’
আঁধার এবার স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকায় সাহফিফের দিকে। সালাম দিয়ে হাত মেলায় আঁধার। সাহফিফ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,,,
–‘কিন্তু আপনাকে তো চিনলাম না?’
আঁধার আরোহীর দিকে তাকাতেই আরোহী চটপট বলতে শুরু করে,,,
–‘উনি আমার বর ভাইয়া,আসলে ব্যাপারটা এখন ও কাউকে তেমন জানায়নি বাবা হঠাৎ করেই আরকি!’
–‘কি বলছিস বুড়ি তুই বিয়ে করেছিস অথচ আমি জানি না,হাউ ইজ দ্যাট পসিবল এয়ার?’ তোরা কেউ আমায় একটা বার কিছু বলার প্রয়োজন মনে করিস নি? আমার বোনের বিয়ে হয়ে গেছে কিন্তু আমি ভাই হয়ে কিছুই জানি না।
কিছুটা আক্ষেপের স্বরে কথাগুলো বলে সাহফিফ। আঁধার ভ্রুকুঁচকায়, তার মানে তাদের বিয়ের ব্যাপারটা এখন ও তেমন কেউই জানে না।আর সেখানে তো আরোহীর মামাতো ভাই নিজেও জানে না, তাহলে জানেটা কে?
আরোহী কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না, তার বাবা হয়তো এখন কাউকেই এই ব্যাপারে জানাতে চায় না।
–‘আসলে ভাইয়া!’
–‘থাক আর তোকে কিছু বলতে হবে না, আমার কাজ আছে আমি যাই সময় পেলে চলে আসিস তোদের বাসায়।’
আরোহীকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কথাগুলো বলে সাহফিফ। আঁধার সাহফিফের ব্যাবহারে অবাক হয়, কিন্তু তাদের ভাই বোনের ব্যাপারে তার কথা বলাটা ঠিক মনে হয় না তাই চুপ করেই থাকে।
সাহফিফ আঁধারের কাছ থেকে সুন্দর করে বিদায় নিয়ে চলে যায়।আরোহী মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, সে বুঝতে পারছে সাহফিফ অনেক কষ্ট পেয়েছে!
আঁধার সাহফিফের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আরোহীর দিকে তাকায়, কিন্তু আরোহীকে মন খারাপ করতে দেখে খারাপ লাগে তার। পরক্ষণেই কিছু একটা মনে পরতে আরোহীর হাতের ভাজে নিজের হাত ঢুকিয়ে দেয়! আরোহী ছোট ছোট চোখ করে তাকায়,আঁধার হেসেই বলে,,,
–‘একটু আগে না আমায় বোকা বানিয়ে আসলে এখন কি করবে শুনি?’
আঁধারের কথা শুনে আরোহী কিছুক্ষণ আগে নিজের করা কাজের কথা মনে হতেই আত্মা কেঁপে উঠে। এখন কি করবে সে!
আরোহীকে ভয় পেতে দেখে আঁধার একটা বাঁকা হাসি দিয়ে আরোহীর হাত ধরেই হাঁটতে শুরু করে। আরোহীর ভয় যেনো আর ও দ্বিগুণ হয়! ঢোক গিলে কিছু বলবে তার ও সুযোগ দিচ্ছে না আঁধার, সে নিজের মতো করেই হেঁটে চলেছে।
গাড়ির কাছে নিয়ে আসতেই ভয়ে আরোহী চোখ মুখ শুকিয়ে যায়।তাকে গাড়িতে উঠতে বললে ও উঠবে না জানে আঁধার, তাই ঠেলে তাকে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে দরজা লক করে দেয়।
আরোহী আঁধারের কান্ডে অবাক হয়ে যায়, আঁধার কি তাকে গাড়িতে লক করে চলে যাবে। এটাই কি তাহলে আঁধারের দেওয়া শাস্তি! আরোহী যখন এসব ভাবতে ব্যস্ত ছিলো ঠিক তখনই নিজের পাশে কারো অস্তিত্ব পেতেই চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়।
গলার কাছে গরম নিশ্বাস এতোটাই জোড়ে পড়ছে যে সে বার বার শিউরে উঠছে! আঁধার যে তার খুব কাছে সেটা আরোহী না দেখেও তার নিঃস্বাসের শব্দে বুঝতে পারছে।আরোহীর দিকে চোখ যেতেই আঁধার বাঁকা হাসি দিয়ে আরোহীর মুখের দিকে ঝুঁকে যায়।এবার আরোহী আরও খানিকটা শিউরে ওঠে, আঁধার আরোহীর মুখের দিকে তাকায়।
মেয়েটা চোখ বুঝে আছে কিন্তু তার মনে হচ্ছে এভাবে মেয়েটার সৌন্দর্য আরও কয়েকগুন বেড়ে গেছে। কথায় আছে না,ভালোবাসার মানুষের সবকিছুই সুন্দর লাগে!
আঁধারের মনে হচ্ছে কথাটা আসলে তার জন্যই তৈরি হয়েছে,এই যে এই মেয়েটি যাকে দেখলে তার মনের ভিতরের সব ঝড় থেমে যায়।যাকে একবার জড়িয়ে ধরলে তার সব কিছু শান্ত হয়ে যায়। এই মেয়েটিকে সে ভালোবাসে, সত্যিই ভালোবাসে।
যদিও সেটা কাল অব্দি কি ছিলো যানে না তবুও সে এই মেয়েটিকেই ভালোবাসে। আঁধার আরোহীর অবস্থা দেখে তার চোখ মুখে একটা ফুঁ দেয়। এতে যেনো আরোহীর মাথা থেকে পায়ের পাতা অব্দি শিউরে ওঠে। চোখ আরও একটু চেপে বন্ধ করে নেয়।
আঁধার সরে আসে, গাড়ি স্টার্ট দেয়। সে তো এগিয়ে গিয়েছিল আরোহীর সিট বেল্ট লাগানোর জন্য কিন্তু মেয়েটা কি না কি ভেবে বসে আছে! হাসতে ইচ্ছে করছে তার আজকে প্রাণ খুলে কিন্তু হাসি কন্ট্রোল করে ড্রাইভিং এ মনোযোগ দেয় সে।
আলিশা সকাল থেকে অনেকবার বমি করেছে, আদর এখন তার খেয়াল রাখে নিজেই। আলিশা আদরের ব্যাবহারে দিনদিন মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে!
আদর যে এতো কেয়ার করতে পারে সেটা হয়তো আদরের সাথে তার বিয়ে না হলে জানতেই পারতো না।সে নিজেও এখন চেষ্টা করে আদরের খেয়াল রাখতে তাই তো আলিশার ছোট বড় সবকিছুর যেমন আদর নিজে থেকে খেয়াল রাখে, তেমনি আলিশা নিজেও আদরের সবকিছুর খেয়াল রাখে।
তবে সে এখন ও আঁকলিমা চৌধুরীর মন জয় করতে পারেনি। তিনি আগের থেকে ও বেশি খারাপ ব্যাবহার করেন এখন আলিশার সাথে। আলিশার মাঝে মাঝে মন খারাপ হলেও মানিয়ে নিতে চেষ্টা করে।
কিন্তু কষ্টটা একটু কম পায় কারণ তারেক চৌধুরী তাকে ক্ষমা না করলেও কটু কথা শোনান না আঁকলিমা চৌধুরীর মতো৷ আর না খারাপ ব্যাবহার করেন, আরোহীর মতোই আলিশার সাথে ব্যাবহার করেন তিনি।
আর আদর তো আছেই, এই তো একটু আগেও সে আলিশার সব বমি গুলো পরিষ্কার করেছে নিজেই।আবার আলিশাকে একটু সুপ বানিয়ে খাইয়ে মুখ মুছিয়ে দিয়েছে। এমনকি আলিশাকে শুইয়ে দিয়ে গেছে, আর লিমাকে বলেছে তার পাশে বসে থাকতে।