Tuesday, August 5, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 418



আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-০৫

0

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৫
লিখা- Sidratul Muntaz

উষ্ণতা রান্নাঘরে সিংকের উপর সবজি রেখে ছুড়ি দিয়ে কাঁটছে। চুলার মৃদু আঁচে তার মুখটা গোলাপি হয়ে উঠেছে। শাড়ি পরে কাজ করতে বরাবরই অসুবিধা হয় তার। শরীরে ঘাম দিয়েছে। এমন সময় পেছন থেকে কেউ এসে শক্ত করে কোমড়টা জড়িয়ে ধরল। উষ্ণতা ধাক্কায় খানিকটা সামনে ঝুঁকে পড়ল।
” কে?”

তৃষাণ উষ্ণতার ঘাঁড়ে নাক ডুবিয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল। উষ্ণতা জড়োসড়ো হয়ে বলল,” রান্নাঘরে এসব কি? প্লিজ যাও। কেউ চলে আসলে?”

” আসুক। আমি কি কাউকে ভয় পাই?”

” ইশশ! এলেন আমার সাহসী বীরপুরুষ। সরো এখান থেকে। কেউ দেখবে। ”

তৃষাণ সরলো না। আরও ঘনিষ্ট হয়ে দাঁড়ালো। উষ্ণতা রাগান্বিত গলায় বলল,” ধ্যাত, কত কাজ বাকি পড়ে আছে। আর তুমি কি ঢং শুরু করেছো। ছাড়ো নাহলে…”

” নাহলে কি করবে?”

” এই গাজরের মতো তোমাকেও কুচি কুচি করে কাটবো।”

তৃষাণ কাতর গলায় বলল,” কাটো না প্লিজ, কুচি কুচি করে কাটো। কিন্তু ছুড়ি দিয়ে না। আমাকে কুচি কুচি করার জন্য এটাই যথেষ্ট।”

তৃষাণ উষ্ণতার ঠোঁট স্পর্শ করল।

” এহেম, এহেম।” উষসী শব্দ করল ক্ষীণ গলায়। তৃষাণ প্রায় ছিটকে সরে গেল। উষ্ণতার চেহারা অস্বস্তিতে কাঁচুমাচু হয়ে গেল।

” কিরে তুই?”

” আপু… তুমিই না বলেছিলে আজ ছুটির দিন আছে? আমরা আজ শপিং-এ যাবো? ”

” ও হ্যাঁ, অনু ঘুম থেকে উঠুক তারপর ওকে রান্নাঘরের কাজ বুঝিয়ে তুই আর আমি বের হবো।”

” ঠিকাছে।”

উষসী লজ্জায় দ্রুত সরে এলো। তৃষাণ রান্নাঘরে আছে জানলে তো সে আসতোই না। ছি, কি বিশ্রী একটা ব্যাপার হয়ে গেল। কিন্তু উষ্ণতা আপু হঠাৎ এই সকাল সকাল উঠে এতো রান্নাবান্না করছে কেন? বেডরুমে এসে বসতেই তৃষ্ণা তার গাঁয়ের উপর এক বোতল জল ঢেলে দিল। ঠান্ডায় কেঁপে উঠল উষসী। ধমকে বলল,” কিরে বান্দর?এটা কি করলি তুই?”

তৃষ্ণা আনন্দে লাফিয়ে লাফিয়ে বলল,”গোসল করিয়ে দিলাম৷ তোমাকে আজকে দেখতে আসবে না? সেইজন্য।”

” দেখতে আসবে মানে? কে দেখতে আসবে?”

তৃষ্ণা পানির বোতলটা নিজের মাথায় উঠিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে নাচতে নাচতে বলল,” মানুষ! ”

উষসী তৃষ্ণার পশ্চাৎদেশে থাপ্পড় দিয়ে বলল,” ওই বান্দর, আমি কি তোর মতো চিড়িয়াখানার বান্দর যে আমাকে মানুষ দেখতে আসবে?”

তৃষ্ণা জবাব না দিয়ে জিভ টেনে ভেংচি কাটল। তারপর দৌড়ে চলে গেল। দিন দিন ছেলেটা এতো অসভ্য হচ্ছে! উষসী ঠিক করেছে একে কোনোদিন বাঘে পেলে আচ্ছামতো পিটুনি দিবে। ঠিক এমন সময় উষ্ণতা ঘরে প্রবেশ করল,” রেডি হয়েছিস? চল যাই। ”

উষসী দেখল উষ্ণতা খুব সুন্দর করে শাড়ি পরেছে। গোসলও করেছে সকাল-সকাল। সাজ-গোজের কোনো কমতি নেই। উষসী প্রশ্ন করল,” আজকে কি কেউ আসবে আপু?”

” না তো, কে আসবে? তোর সাথে শপিং-এ যাবো না? সেজন্য সেজেছি৷ শোন, আজকে গাড়ি নিবো না৷ একটু রিকশায় চড়তে ইচ্ছে করছে। কতদিন রিকশায় ঘোরা হয় না।”

” ঠিক বলেছো৷ দাঁড়াও আমি রেডি হয়ে আসছি।”

দুইবোন একসাথে বের হলো। রিকশায় করে তারা চলে গেল বসুন্ধরা। আজ অনেক শপিং হবে। উষসী জানে না কি উপলক্ষ্যে এই শপিং! তবে তার শপিং করতে ভীষণ ভালো লাগে। সে জীবনে বেশিকিছু চায় না। শুধু চায় সপ্তাহে অন্তত একবার শপিং করতে। যে মাসে শপিং হয় না সেই মাসে উষসীর মন খুব খারাপ থাকে। আর উষ্ণতা হয়েছে একদম উষসীর বিপরীত। সে যত পারে তত কম শপিং করে। মেয়েদের অনেক শখ-আহ্লাদ থাকে। কিন্তু উষ্ণতার এসব কিছু নেই। সাজগোজের ব্যাপারে বিলাসী হলো উষসী। তার আলাদা একটা সাজঘর আছে। সেখানে মেকাপ থেকে শুরু করে সব জিনিসপত্র মার্জিতভাবে সাজানো থাকে সবসময়। এমন কোনো সাজের জিনিস নেই যা উষসীর কাছে পাওয়া যাবে না। উষ্ণতা মাঝে মাঝে বলে, তাকে নাকি বিয়ে দিতে হবে রাজার ছেলের সাথে। নয়তো তার এতো এতো শখ-আহ্লাদ তার স্বামী মেটাতে পারবে না।

আজকে শপিং করতে গিয়ে একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটল। উষসী আর উষ্ণতা শাড়ির দোকানে ঢুকেছে। কোথা থেকে একজন ভদ্রমহিলা এসে উষ্ণতার কাঁধে হাত রেখে পরম স্নেহের সাথে বললেন,” আরে উষ্ণতা না তুমি? কেমন আছো মা? আমাকে চিনতে পেরেছো? হায় আল্লাহ, কতবছর পর দেখা!”

উষ্ণতা আর উষসী দু’জনেই ভদ্রমহিলার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। ভদ্রমহিলা বেশ আন্তরিকভাবে হাসলেন। দেখতে খুব বড়লোক মনে হচ্ছে। ভীষণ স্টাইলিশ। এই বয়সেও চুলে কালার করেছেন। হাতাকা’টা ব্লাউজ পরেছেন। দূর থেকে দেখলে সাজ-পোশাকের কারণে যে কেউ তাকে অহংকারী ভাবতো। কিন্তু কথা বলার পর মনে হচ্ছে তিনি খুবই অমায়িক মানুষ।

উষ্ণতা ইতস্তত করে বলল,” স্যরি… আমি মনে হয় আপনাকে চিনলাম না।”

মিসেস শিমলা চোখ বড় তাকালেন,” আরে কি বলো? আমি তোমাকে দেখেই চিনে ফেললাম আর তুমি চিনতে পারছো না? আমি ইয়ামিনের মা। তোমার স্টুডেন্ট ছিল যে ইয়ামিন! নয়া পল্টনে তুমি ওকে পড়াতে আসতে। তখন কত ছোট ছিলে। আর এখন কতবড় হয়ে গেছো মাশআল্লাহ!”

উষ্ণতা কিছুই বুঝতে পারছে না। এদিকে উষসীর চোখমুখ ঝলমলিয়ে উঠেছে। সে আনন্দিত কণ্ঠে বলল,” শিমলা আন্টি, আপনি?”

সে উদ্ভট একটা কান্ড করে ফেলল। শিমলাকে কদমভুসি করল। উষ্ণতা এই অবস্থা দেখে অস্বস্তিতে পড়ে গেল। সে এখনও ভদ্রমহিলাকে চিনেনি। তাহলে উষসী কিভাবে চিনল? শিমলা প্রীত কণ্ঠে বলল,” আরে.. এটা তোমার পিচ্চি বোনটা না? সেই এইটুকু দেখেছিলাম ওকে। এখন কত বড় হয়ে গেছে। তোমার চেয়েও সুন্দরী হয়েছে। কেমন আছো মা?”

উষসী হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠে বলল,” ভালো আন্টি। আপনি কেমন আছেন?”

” খুব ভালো আছি। তোমাদের সাথে দেখা হয়ে অনেক ভালো লাগছে। আমার বাসায় চলো না।”

উষ্ণতা বলল,” আরেকদিন যাবো। আজকে আমাদের একটু তাড়া আছে।”

শিমলা মুখ মলিন করে বললেন,” তুমি মনে হয় আমাকে এখনও চিনতে পারোনি।”

উষ্ণতার দারুণ অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। সে কি বলবে খুঁজে পেল না। উষসী মিসেস শিমলার হাত ধরে একটু দূরে গিয়ে বলল,” আসলে আন্টি, আপু আপনাকে চিনবে না। ছোটবেলায় আপুর একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল। তারপর থেকে অনেক কিছুই সে ভুলে যায়।”

মিসেস শিমলা দুঃখিত কণ্ঠে বললেন,” হ্যাঁ মনে আছে। আমি এই বিষয়টাই ভাবছিলাম। ইয়ামিন বলেছিল আমাকে এক্সিডেন্টের ব্যাপারটা। আহারে… এখনও সুস্থ হয়নি তাই না?”

” না আন্টি। আপনি কিছু মনে করবেন না প্লিজ৷ আমার আপনাকে খুব মনে আছে। আপনাদের ম্যারেজ এনিভার্সেরীতে যে গিয়েছিলাম আমরা। আমি তখন এতো ছোট যে একা হাতে খেতেই পারছিলাম না৷ আপনি আমাকে খাইয়ে দিয়েছিলেন। মনে আছে?”

মিসেস শিমলা মিষ্টি করে হেসে উষসীর মাথায় হাত রেখে বললেন,” কেন মনে থাকবে না? খুব কিউট ছিলে তুমি। বাসায় এসো মা, প্লিজ?”

” নিশ্চয়ই আসবো আন্টি। আপনারা কি সেই আগের ঠিকানাতেই আছেন?”

” হ্যাঁ অবশ্যই। কিন্তু এখন ওখানের অনেককিছু বদলে গেছে। তুমি চিনবে না৷ তাই এড্রেস রেখে দাও।”

শিমলা তার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে উষসীর হাতে দিলেন। উষসী খুশি হয়ে কার্ডটা নিল৷ প্রচন্ড উত্তেজনায় তার হাত কাঁপছে। ইচ্ছে করছে এখনি মিসেস শিমলার সঙ্গে তার বাড়িতে চলে যেতে। কিন্তু ইয়ামিন বাংলাদেশে নেই৷ গেলেও দেখা হবে না। উষসী ভদ্রতা করে বলল,” আপনার হাতে দেখি অনেক ব্যাগ আন্টি। এতোকিছু নিয়ে হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে না? দিন আমি হেল্প করি।”

” আরে থাক, থাক, কোনো অসুবিধা নেই।”

” প্লিজ আন্টি। নিষেধ করবেন না।”

উষসী বিশাল বড় বড় দু’টি ব্যাগ হাতে নিল। যদিও ব্যাগের ওজন তার নিজের ওজনের থেকেও বেশি বলে বোধ হলো। মনে হচ্ছিল সে পড়েই যাবে। কিন্তু ক্রাশের মা বলে কথা! একটু কষ্ট তো করাই যায়। মিসেস শিমলা প্রশ্ন করলেন,” তোমার অসুবিধা হচ্ছে না তো? একটা বরং আমাকে দাও।”

” লাগবে না আন্টি। চলুন যাই। গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।”

” হাউ সুইট!”

উষসী মিসেস শিমলার সাথে একদম সড়কের মোড়ে গাড়ি পর্যন্ত গেল। তার সাহায্য করার মনোভাব দেখে মিসেস শিমলা খুবই মুগ্ধ হলেন। কণ্ঠে সন্তুষ্টি ঢেলে বললেন,” তুমি কিন্তু অবশ্যই একদিন আমার বাড়িতে আসবে। মনে থাকবে?”

উষসী মনে মনে বলল,” সারাজীবনের জন্যই তো আপনার বাড়ি চলে আসতে চাই আন্টি। দোয়া করবেন।”

মুখে বলল,” জ্বী নিশ্চয়ই আসব।”

উষসী ফিরে আসার পর উষ্ণতা বিচলিত গলায় বলল,” কই ছিলি এতোক্ষণ?”

উষসীর মুখে তখন লাজুক হাসি। সে মিসেস শিমলার দেওয়া কার্ডের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। ক্রাশের বাড়ির ঠিকানা এখন তার হাতের মুঠোয়। ইশ, ক্রাশটা যে কবে বাংলাদেশে আসবে! উষ্ণতা উষসীর মুখের কাছে চুটকি বাজিয়ে বলল,” কিরে, সমস্যা কি?”

” কিছু না আপু। চলো বাড়ি যাই?”

উষ্ণতা চোখ বড় করে বলল,” মানে? তুই শপিং রেখে বাড়ি যেতে চাইছিস? সিরিয়াসলি? ওই ভদ্রমহিলা তোকে কি এমন জাদু করল?”

” ভদ্রমহিলা জাদু করেনি। করেছে তার ছেলে।” উষসী কথাটা ফিসফিস করে বলল। উষ্ণতা শুনতে পেল না। ভ্রু কুচকালো, ” মানে?”

” মানে কিছু না। এখন আর শপিং করতে ইচ্ছে করছে না। চলো বাড়ি যাই।”

তারা বাড়ি ফেরার একটু পরেই অনুপমা হাতে শাড়ির প্যাকেট নিয়ে এসে উষসীকে বলল,” জলদি এই শাড়িটা পরে নাও তো উষু।”

” হঠাৎ শাড়ি কেন পরব? এটা তো উষ্ণতা আপু নিজের জন্য কিনেছে।”

অনুপমা হেসে বলল,” না, তোমার জন্যই কিনেছে। শাড়ির কালারটা অনেক সুন্দর। তোমাকে খুব ভালো মানাবে। অবশ্য সুন্দরীদের সব রঙেই মানায়। এসো পরিয়ে দেই।”

” আমি তো শাড়ি পরি না। উষ্ণতা আপু আমার জন্য হঠাৎ শাড়ি কেন কিনবে?আমার কি বিয়ে?”

অনুপমা মিষ্টি হেসে বলল,” অনেকটা সেরকমই।”

উষসী রাগী দৃষ্টিতে তাকাল,” ধূর, ঢং করো না তো!”

” আমি সত্যি বলছি,আজকে যে তোমাকে দেখতে আসবে এটা জানতে না তুমি?”

উষসীর চেহারাটা কেমন রঙহীন আর চুপসানো হয়ে গেল৷ ভারী কণ্ঠে বলল,” মানে?”

অনুপমার মুখের হাসিটাও মিলিয়ে গেল। তার মানে উষসী কিছুই জানে না। উষ্ণতা ভাবী কি তাহলে উষসীকে কিছু বলেনি? কি সর্বনাশ!

উষসী থমথমে কণ্ঠে বলল,” এগুলো মায়ের কাজ তাই না?”

” না, যুঁথি আন্টি এই ব্যাপারে কিছুই জানে না৷ তোমার বিয়ের সম্বন্ধ এনেছে তৃষাণ ভাই।”

উষসীর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। সে চিৎকার করে বলল,” তৃষাণ ভাইয়া আমাকে না জিজ্ঞেস করে এই কাজ কিভাবে করল?”

ধাক্কা মেরে শাড়ির প্যাকেট ছুঁড়ে ফেলল উষসী। অনুপমা ভয়ে কি করবে বুঝতে পারল না। কাঁপা কণ্ঠে শুধু বলল,” উষুমনি প্লিজ আমার কথা শোনো। লক্ষী না তুমি?”

” সরো আমার সামনে থেকে! আমি কোত্থাও যাবো না। কারো সামনে না।”

উষসী হাঁটুতে মুখ গুঁজে কান্না শুরু করেছে। উষ্ণতা ছুটে এলো। অনুপমা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বলল,” ভাবী, এখন কি করবো?”

” ও কাঁদছে কেন? এটা কি কাঁদার মতো কোনো ব্যাপার?”

উষ্ণতা এসে উষসীর মাথায় হাত রাখল,” এই পাগলী, উঠ। দেখতে আসলেই কারো বিয়ে হয়ে যায় না। তোর পছন্দ-অপছন্দ না শুনেই কি আমরা বিয়ে দিয়ে দিব? তুই শুধু সামনে গিয়ে একটু বসবি। ছেলের সাথে দেখা করবি। যদি ভালো না লাগে তাহলেই রিজেক্ট। ওকে?”

উষসী ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,” যার সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই তার সামনে আমি শাড়ি পরে কেন বসবো? কিছুতেই যাবো না আমি। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আরেকজনের সামনে সেজেগুজে বসে থাকতে পারবো না। আমি মানুষ। পুতুল না কোনো।”

” আচ্ছা বুঝেছি, তুই পুতুল না,মানুষ। কিন্তু এখন তো ওরা বাড়ি চলে এসেছে উষু। এখন তুই না গেলে ব্যাপারটা কেমন দেখায় বল? তোর তৃষাণ ভাইয়ার মান-সম্মানের প্রশ্ন।”

” তার মান-সম্মান ধূলোয় মিশে যাক। সে আমাকে জিজ্ঞেস না করে ওদের এনেছে কেন?”

এর মাঝেই তৃষাণ প্রবেশ করল। তার চোখমুখ শক্ত। শাড়ির প্যাকেটটা তুলতে তুলতে নির্লিপ্ত গলায় বলল,” দেরি হয়ে যাচ্ছে উষুমনি৷ যা বলা হচ্ছে দ্রুত করো।”

উষসী কড়া দৃষ্টিতে তাকালো। যার অর্থ সে কিছুতেই শাড়ি পরবে না। তৃষাণ ঠান্ডা গলায় বলল,” তোমরা যাও। আমি ওর সাথে কথা বলছি।”

উষ্ণতা আর অনুপমা নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। তৃষাণ দরজাটা বন্ধ করে উষসীর পাশে বসল। উষসী সাথে সাথে দুই কদম সরে গেল।

তৃষাণ মৃদু হাসল,” মনে আছে ট্যুরে যাওয়ার ব্যাপারে কি শর্ত রেখেছিলাম? আমি যা বলব তাই শুনতে হবে। তাহলে এখন শোনো আমার কথা। লক্ষীমেয়ের মতো শাড়িটা পরে তৈরী হয়ে যাও। আমাকে যেন আর বলতে না হয়।”

তৃষাণ কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়াল। উষসী জেদী গলায় বলল,” মরে গেলেও শাড়ি পরবো না আমি। আমাকে কেউ ওদের সামনে নিয়ে যেতে পারবে না।”

তৃষাণ ফিরে তাকালো উষসীর দিকে। তারপর হঠাৎ এমন জোরে একটা ধমক দিল যে উষসী প্রাণটা হাত নিয়ে দ্রুত শাড়ির প্যাকেট বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,” আমি আসছি।”

তৃষাণ বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই উষসী শাড়ি পরে বের হয়ে এলো। তার মুখে কোনো প্রসাধন নেই। শুধু ফেইস ক্লিনার দিয়ে মুখ ধুঁয়েছে। তাতেই তাকে এতো সুন্দর লাগছে! উষ্ণতা আর অনুপমা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। কেউ ভাবতেও পারেনি উষসীকে এতো সহজে রাজি করানো যাবে৷ তৃষাণ দরজা বন্ধ করে কি এমন বলল যে উষসী একদম ভদ্র মেয়ের মতো শাড়ি পরে তৈরী হয়ে গেল!

চলবে

আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-০৪

0

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব-৪
Sidratul Muntaz

ইয়ামিন বেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ হবে। এখন গভীর রাত। এই সময় মানুষটা কোথায় যেতে পারে? সত্যিই কি স্ট্রিট বেঞ্চে শুয়ে আছে? উষসীর ইচ্ছে হলো একবার উঠে দেখে আসে। কিন্তু গেল না। ইয়ামিন যা ইচ্ছা করুক। তার কিছু যায়-আসা উচিৎ না। মানুষটি তাকে কম কষ্ট দেয়নি বিয়ের পর থেকে।

আজও পরিষ্কার মনে পড়ে, তাদের বিয়ের প্রথম রাতে যা ঘটেছিল__সারারাত উষসী একলা বিছানায় বসে বাচ্চা শিশুটির মতো কেঁ’দে ভাসিয়েছে। অথচ ইয়ামিন একবারের জন্যেও তার দিকে ফিরে তাকায়নি। নিষ্ঠুরের মতো বারান্দায় বসে বসে রাত্রী যাপন করেছে। একটার পর একটা সিগারেট শেষ করেছে। যেভাবে পুড়েছে সিগারেটের কাগজি দেহ, ঠিক সেভাবে পুড়েছে উষসীর কোমল মন। বিয়ের পর প্রথম এক সপ্তাহ ইয়ামিন উষসীর সঙ্গে কোনোরূপ ব্যাক্যালাপও করেনি। যা একজন নববধূর জন্য চূড়ান্ত অসম্মানজনক। তবুও তো কখনও কোনো অভিযোগ করেনি উষসী। ইয়ামিনকে ভালোবাসতে চেয়েছে। সব ভুলে তাকে আপন করতে চেয়েছে। তার সাড়া পাওয়ার অপেক্ষায় থেকেছে। কিন্তু দিনশেষে পেয়েছে শুধুই অবহেলা। কি দোষ ছিল তার?

আজও জানে না উষসী। কোন দোষে সে এতোবড় শাস্তি পেল। মন-প্রাণ উজাড় করে শৈশব থেকে যাকে ভালোবেসেছে সে কখনও উষসীর ভালোবাসার মূল্য দেয়নি। আর আজ যখন উষসী পুড়তে পুড়তে নিঃশেষ হয়ে গেছে তখন ইয়ামিনের টনক নড়ে উঠল। এতোদিনের কষ্ট সে কি করে ভুলে যাবে এক নিমেষে?

অতীতের বিষাদময় স্মৃতিগুলো ভাবতে ভাবতে উষসীর চোখের কার্নিশ থেকে গড়িয়ে পড়া জল শুকিয়ে এলো!
______________________

(অতীত)

এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে তখন। রেকর্ড মার্কস নিয়ে মাত্র ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে উষসী। এডমিশনের প্রিপারেশন ভালো থাকলেও পাবলিকে চান্স পায়নি। বাধ্য হয়ে প্রাইভেটে ভর্তি হয়েছে। ছোট থেকেই তার বাবা নেই। মা আর বড় আপু উষ্ণতার কাছে সে মানুষ। উষ্ণতার বিয়ের পরেও সে চাকরি করে সাবলম্বী হয়েছে। মা আর বোনকে নিজের কাছেই রাখে। উষ্ণতার স্বামী তৃষাণের টাকা-পয়সার কোনো কমতি নেই। তবুও নিজের মা আর বোনের ভরণপোষণের দায়িত্ব কাঁধে নিতে সে চাকরি করে। আবার ঘরও সামলায়। উষসীর অন্যতম ভালোবাসার জায়গা তার আপু।

একদিন সে খুব আবদার করে বলল,

” উষ্ণতা আপু, আমি কলকাতা যেতে চাই।”

উষ্ণতা ড্রেসিং টেবিলের কাছে বসে চুলে চিরুনি দিয়ে আঁচড় কাটছিল। উষসীর কথা শুনে সে থমকে গেল। অবাক হয়ে পেছনে ফিরে জানতে চাইল,” মানে? হঠাৎ কলকাতা কেন যাবি?”

উষসী লাজুক কণ্ঠে বলল,” ট্যুর। ফ্রেন্ডরা মিলে ঠিক করেছি।”

উষ্ণতা দূর্বোধ্য হাসল,” ট্যুরে যাওয়ার আর জায়গা পেলি না? একেবারে কলকাতা? তুই সাজেক যাওয়ার কথা বললেও তো মা হার্ট অ্যাটাক করবে।”

” উফ, এজন্যই তো তোমাকে বলছি। প্লিজ ব্যবস্থা করে দাও না। তোমার কথা তো সবাই শোনে।”

উষ্ণতা নির্বিকার গলায় বলল,” আমার কথা কেউই শুনবে না। এই বাড়ির বস হলো তোর তৃষাণ ভাই। সে যদি অনুমতি দেয় তাহলে লন্ডনে গেলেও মা কিছু বলবে না।”

” সত্যি আপু? উষসী উত্তেজিত হয়ে উঠল। উষ্ণতা হেসে বলল,” পাগল।”

কিন্তু উষসীর খুব ভয়। তৃষাণের সামনে কলকাতার কথা উচ্চারণ করলেই সে ধমক খাবে। কিন্তু কিছু করার নেই। ইয়ামিনের সাথে দেখা করার জন্য হলেও তাকে কলকাতায় যেতেই হবে। সে জন্য উষসী সব ধরণের রিস্ক নিতে প্রস্তুত।

উষসী একদিন দুরু দুরু বুক নিয়ে তৃষাণের কাছে গেল। তখন অফিসের জন্য তৈরী হচ্ছে তৃষাণ। উষসী তৃষাণের পেছন পেছন ঘুরঘুর করছে। তৃষাণ ডানে গেলে সে ডানে যায়, তৃষাণ বামে গেলে সেও বামে। একটা পর্যায় তৃষাণ বিরক্ত হয়ে বলল,” কি চাই?”

উষসী মনখারাপ করা দৃষ্টিতে তাকালো। অসহায় স্বরে বলল,” আগে প্রমিস করতে হবে। যা চাইবো তাই দিবে তো?”

তৃষাণ গম্ভীর হয়ে বলল,” আগে বলো। দেওয়ার মতো জিনিস হলে নিশ্চয়ই পাবে।”

এই কথা বলেই সে ড্রেসিংটেবিলের সামনে চলে গেল। হেয়ার ব্রাশ দিয়ে চুল আঁচড়াতে লাগল। উষসী ধপ করে বিছানায় বসল। দুইহাতে কচলে বলল,” অনুমতি লাগবে।”

” কিসের অনুমতি?” তৃষাণ ভ্রু কুচকে তাকাল। তাই দেখেই উষসীর কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গেল। অনেক সাহস যুগিয়ে বলল,” ফ্রেন্ডসরা সবাই মিলে ঠিক করেছি কলকাতায় যাবো।”

তৃষাণ থামল। বিস্ময় ভাব নিয়ে প্রশ্ন করল,” হঠাৎ কলকাতা কেন? বাংলাদেশে কি জায়গার অভাব আছে।”

” ফ্রেন্ডরা মিলে ঠিক করেছি। আমার পাসপোর্ট তো রেডিই আছে। তুমি অনুমতি দিলেই ভিসার জন্য এপ্লাই করবো।”

” আমি না হয় অনুমতি দিলাম। কিন্তু তোমার আপু এতোদূর যেতে দিতে রাজি হবে?”

” আপুই আমাকে বলেছে তোমার সাথে কথা বলতে।”

” সত্যি? তোমার আপু বলেছে?”

” একদম সত্যি। বিশ্বাস না হলে ডেকে জিজ্ঞেস করো!”

উষ্ণতার কথা শুনে তৃষাণ একটু নরম হলো। গায়ে ব্লেজার জড়াতে জড়াতে বলল,” কবে যাবে?”

” উমম, সামনের মাসের উনিশ তারিখ।”

” তাহলে দেরি আছে। ”

” তুমি কি অনুমতি দিচ্ছো?” উষসী সাবধানে প্রশ্ন করল। তৃষাণ বলল,” যদি অনুমতি দেই তাহলে আমি কি পাবো?”

” যা চাইবে তাই পাবে।”

” শিউর?”

” একদম শিউর।”

” তাহলে ঠিকাছে। তোমরা চাইলে আমি প্লেনের টিকিটও এরেঞ্জ করে দিতে পারি। সাথে আমার একজন বডিগার্ডও যাবে।”

” সত্যি বলছো? থ্যাঙ্কিউ ভাইয়া। ইউ আর দ্যা বেস্ট জিজু ইন দ্যা হোল ওয়ার্ল্ড!”উষসীর কণ্ঠে খুশির ঢেউ। সে দৌড়ে এসে তৃষাণকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। তৃষাণ আলতো করে উষসীর মাথায় হাত রেখে বলল,” কিন্তু মনে থাকে যেন, আমি যা চাইবো তা।”

উষসী তৃষাণের দুইগাল টিপে বলল,
” অবশ্যই মনে থাকবে পেয়ারা জিজু। লাভ ইউ! এখনি সবাইকে ফোন করে গুড নিউজটা জানিয়ে দেই। সবাই অনেক খুশি হবে। আমারও ডিমান্ড বেড়ে যাবে। ভাবতেই মজা লাগছে।”

উষসী হৈহৈ করতে করতে বের হলো রুম থেকে। তৃষাণ সাথে সাথেই অনুপমাকে ডেকে পাঠালো। যতই সে উষসীর সামনে হাসুক। সন্দেহ মনে রয়েই যায়৷ উষসী কেন হঠাৎ কলকাতা যাওয়ার জন্য এতো হাংকিপাংকি শুরু করেছে? শুধুই কি ট্যুর নাকি অন্য কোনো গল্প আছে? অনুপমা রান্নাঘরে কাজ করছিল। তৃষাণের ডাক শুনে দ্রুত ছুটে এলো।

” কিছু লাগবে ভাইজান?”

” না, তুমি বসোতো। কথা আছে।”

অনুপমা বিছানায় বসল। শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ব্যস্ত স্বরে বলল,” বলেন ভাইজান।”

” উষসী হঠাৎ কলকাতা যেতে চাইছে কেন? তুমি জানো নিশ্চয়ই?”

অনুপমার মুখ শুকিয়ে গেল। চেহারায় নেমে এলো জড়তা। সে তৃষাণের সামনে একদম মিথ্যে বলতে পারে না। তৃষাণ গলার টিউন শুনেই বুঝে ফেলে কোনটা মিথ্যা আর কোনটা সত্যি। এর আগে অনেকবার তৃষাণের কাছে মিথ্যে বলে ধরা খেয়েছে সে। ডেঞ্জারাস মানুষ একটা! অনুপমাকে আকাশ-পাতাল ভাবতে দেখে তৃষাণ নিজে থেকেই বলল,” আমার কাছে লুকানোর কিছু নেই। একদম সত্যি কথা বলবে অনু। ঘটনা কি?”

অনুপমা মাথা নত করে বলল,” শুনেছিলাম সামনের মাসে নাকি কলকাতায় ইয়ামিন ইব্রাহীমের কনসার্ট আছে। আমার মনে হয় এজন্যই…”

অনুপমার আর কিছু বলতে হলো না। এর আগেই
তৃষাণের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। সে বুঝল উষসীকে কলকাতায় যাওয়ার অনুমতি দেওয়াটা বিরাট ভুল হয়েছে। তার উচিৎ ছিল রাজি হওয়ার আগেই অনুপমার সাথে কথা বলে নেওয়া। কিন্তু যা হওয়ার হয়ে গেছে। তৃষাণ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” বুঝেছি। তুমি যাও এখন।”

” ভাইজান, একটা কথা বলি?”

” বলো।”

অনুপমা উঠে তৃষাণের সামনে এসে দাঁড়ালো। কিছু বলার আগেই উষ্ণতাকে দেখে থেমে গেল সে। তৃষাণও খানিক অপ্রস্তুত হলো। উষ্ণতা সন্দেহী দৃষ্টিতে ওদের দু’জনকে দেখছিল। প্রায়ই অনুপমা আর তৃষাণকে এভাবে গুজুরগুজুর করতে দেখে সে। সন্দেহের বিষয় সেটা না, আসল সন্দেহের বিষয় হলো উষ্ণতাকে আসতে দেখলেই তারা থেমে যায়। কিন্তু কেন? তারা কি এমন বিষয় নিয়ে আলোচনা করে যা উষ্ণতার সামনে বলা যাবে না?
________________
তখন মাঝরাত। ঘুমের ঘোরে উষ্ণতা অনুভব করল কারো নরম স্পর্শ তার কপালে,গালে,নাকে প্রবাহিত হচ্ছে৷ সে চোখ পিটপিট করে তাকাতেই তৃষাণকে আবিষ্কার করল। জড়ানো গলায় কিছু বলতে নিলেই তৃষাণ তার ঠোঁটে আঙুল ঠেঁকিয়ে ফিসফিস করে বলল,” শশশ! বারান্দায় চলো। একটা জিনিস দেখাবো।”

” এতোরাতে বারান্দায়?” উষ্ণতার ঘুমের ঘোর কাটেনি তখনও। তৃষাণ জবাব না দিয়ে রহস্যময় হাসল। তার ওই হাসিটা যে উষ্ণতার কি ভীষণ পছন্দ! উষ্ণতা উঠতে দেরি করছিল বলে তৃষাণ আচমকাই তাকে পাঁজাকোলায় তুলে নিল। উষ্ণতা হকচকিয়ে বলল,” কি করছো তৃষাণ?”

তৃষাণ আবারও ফিসফিসানি উত্তর দিল,” বললাম না একটা জিনিস দেখাবো?”

উষ্ণতাকে আস্তে-ধীরে বারান্দায় এনে দাঁড় করালো তৃষাণ। লোডশেডিং এর কারণে পুরো শহর অন্ধকারে ডুবে আছে। যেন এ কোনো আঁধার রাজ্য! কালো আকাশে ঘন মেঘের উপস্থিতি পুরো শহর আরও অন্ধকার করে দিয়েছে।

উষ্ণতাদের বারান্দাটা বেশ বড়। চারদিকে বাউন্ডারি দেওয়া। ঝুলন্ত ফুলের টব আর রঙের-বেরঙের গাছ জায়গাটার সৌন্দর্য্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তৃষাণ হাঁটু গেঁড়ে বসেছে তার সামনে। ঘন পল্লবে আবৃত চোখ দু’টি চিকচিক করছে খুশির আমেজে। এলোমেলো চুলগুলো কপাল ঢেকে আছে, চাপদাড়ি ভরা গালে স্নিগ্ধ হাসি।

বিয়ের এতোবছর হয়ে গেল, তাও এই হাসি দেখলে উষ্ণতা তোলপাড় হয়ে যায়। তৃষাণ পরম আবেশ নিয়ে চুমু দিল উষ্ণতার হাতে। তারপর নরম কণ্ঠে বলল,” উপরে তাকাও।”

উষ্ণতা খোলা আকাশের দিকে তাকাতেই খেয়াল করল ফানুসে প্রজ্জলিত হয়ে উঠেছে নীল আকাশটা। শহরে এখন সোনালী আলোর রাজত্ব।কি অপূর্ব সেই দৃশ্য! উষ্ণতা তৃষাণের হাত ছেড়ে দৌড়ে কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়ালো। লম্বা করে শ্বাস টেনে দেখল ফানুসগুলো একে একে ভেসে যাচ্ছে আর দ্বীপশিখা দিয়ে সজ্জিত হচ্ছে কয়েকটি ইংরেজি অক্ষর,” Happy 8 years anniversary.”

উষ্ণতা দুইহাতে মুখ চেপে ধরল। তাদের বিয়ের আটবছর পেরিয়ে গেছে! সময় কত দ্রুত ধাবমান। অথচ চোখ বন্ধ করলেই মনে হয় এই বুঝি কিছুদিন আগে বিয়েটা হলো তাদের। উষ্ণতা হসপিটাল থেকে ফুলসজ্জিত গাড়িতে বসে তৃষাণের সাথে বাড়ি এলো। এখনও স্মৃতিপটে স্পষ্টভাবে জ্বলজল করে সেইদিন। কি ভীষণ সুন্দর ছিল তাদের বিয়ের প্রথম রাত, প্রথম রাতের মায়া ঝরানো বৃষ্টি। কত-শত স্মৃতি জমা হয়েছে এ যাবৎকালে।

সবচেয়ে সুন্দর সময় ছিল যখন তৃষ্ণা পেটে এসেছিল। উষ্ণতা হসপিটালের বেডে শুয়ে মরণব্যথায় ছটফট করছিল। আর তৃষাণ শক্ত করে চেপে রেখেছিল তার হাত। তৃষানের ফরসা মুখ ভয়ে গোলাপী রঙ ধারণ করল। প্রতি মুহুর্তে উষ্ণতাকে হারানোর ভয় হানা দিচ্ছিল তার মস্তিষ্কে। তারপর যখন তৃষ্ণা এলো, তাকে কোলে নিয়ে তৃষাণের সে কি আনন্দ! এক নিমেষে সব দুঃখ ভুলে সে হাসতে লাগল। এলোপাতাড়ি শুধু চুমু দিচ্ছিল ছেলের চোখেমুখে। সেদিন প্রথমবারের মতো উষ্ণতা তৃষাণকে এতো আনন্দিত দেখল। আনন্দের বর্ষন নামছিল তার চোখ বেয়ে। সব স্মৃতি ভাবতে ভাবতে উষ্ণতারও চোখ ভিজে এলো। অতীত বড়ই সুন্দর!

তৃষাণ পেছন থেকে জাপটে-জড়িয়ে ধরল তাকে। উষ্ণতার ঘাড়ের চুল সরিয়ে পিঠে নাক ঘষতে ঘষতে লম্বা শ্বাস নিল। উষ্ণতা সামনে ঘুরেই তৃষানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। তার খুশিতে কান্না পাচ্ছে। তৃষাণ কিছুক্ষণ উষ্ণতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” তোমার জন্য দু’টো গিফট আছে।”

উষ্ণতা মাথা তুলে তাকালো,” আজকের রাতটাই তো আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর গিফট। তুমি কিভাবে এতোকিছু মনে রাখো বলোতো? আমি ভুলেই গেছিলাম আজকের ব্যাপারে। আই এম স্যরি। আর থ্যাঙ্কিউ!”

তৃষাণ তার হাস্যজ্জ্বল চেহারাটা অন্ধকারে আচ্ছন্ন বানিয়ে বলল,
” শুধুই থ্যাংকস? আর কিছু না?”

উষ্ণতা পা উঁচু করে তৃষাণের গলা জড়িয়ে ধরে তার গালে চুমু দিল। তৃষাণ অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বলল,” এইটা হবে না। আমি কত কষ্ট করে সারারাত জেগে সব আয়োজন করেছি জানো? আর তুমি শুধু একটা চুমু দিয়েই খালাস?”

” তাহলে কি করবো?”

” অফিস থেকে ছুটি নাও সাতদিনের। আমরা কাশমীর যাচ্ছি।”

” ও, তাহলে এটাই এনিভারসেরি গিফট?”

” উহুম ফার্স্ট গিফট।”

” কিন্তু এতো ঘন ঘন ছুটি নিলে তো আমার চাকরি চলে যাবে ডিয়ার হাসব্যান্ড! তাছাড়া ছেলের সামনে পরীক্ষা। ওর এখন কিছুতেই স্কুল মিস করা ঠিক হবে না।”

” ডিয়ার ওয়াইফ, এটা আমাদের হানিমুন সিরিজের অষ্টম এপিসোড৷ এখানে ছেলেকে নেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। কিন্তু তুমি তো তাকে রেখেও যাবে না। তাই আমরা সবাই যাবো। হানিমুন ট্রিপ হয়ে যাবে ফ্যামিলি ট্রিপ।”

মিষ্টি করে হাসল উষ্ণতা। তৃষাণ তার কোমড় জড়িয়ে কাছে টেনে আনল। কপালে আলতোভাবে ঠোঁট ছুঁইয়ে একাধারে অনেকগুলো চুমু দিতে দিতে বলল,” বউয়ের আবদার বলে কথা। না রেখে পারি কিভাবে?”

উষ্ণতা হেসে বলল,” এবার বলো সেকেন্ড গিফট কি?”

” সেকেন্ড গিফট হচ্ছে…” তৃষাণ ট্রাউজারের পকেট থেকে একটা লম্বা খাম বের করল। খামটা উষ্ণতার হাতে তুলে দিয়ে বলল,” খুলে দেখো।”

উষ্ণতা মোবাইলের ফ্ল্যাশ অন করে খামটা খুলল। দেখল একটা ছেলের সিভি। ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করল,” কে এটা?”

” আমার ফ্রেন্ডের ছোটভাই। চমৎকার একটি ছেলে। পুলিশ অফিসার। উষসীর বিয়ে ঠিক করে ফেললাম।”

উষ্ণতা চরম অবাক হয়ে বলল,” মানে? ও তো এখনও ছোট তৃষাণ! ওর বিয়ের বয়স হয়েছে নাকি?”
” আঠারো না হয়ে গেল?”

উষ্ণতা চোখমুখ শক্ত করে বলল,
” আঠারো হলেই বিয়ে দিতে হবে? আমার বোনকে কি তোমার বোঝা মনে হচ্ছে?”

” এভাবে কেন বলছো? তুমি চাইলে বিয়ে না হয় কয়েক বছর পরে হবে। এখন দেখাদেখি আর এংগেজমেন্ট হয়ে থাকুক। আমি কাল-পরশুই ভাবছি ওদের আসতে বলবো।”

উষ্ণতা বিস্মিত না হয়ে পারল না। তৃষাণ তাকে না জানিয়েই এতোবড় একটা সিদ্ধান্ত কিভাবে নিল? উষ্ণতা স্পষ্ট স্বরে বলল,” আগে উষসীর সাথে কথা বলে দেখি। ও বিয়ে করতে কতটুকু প্রস্তুত সেটাও জানা দরকার।”

” আমি কথা দিয়ে ফেলেছি উষ্ণ। উষুমণিকে রাজি করানোর দায়িত্ব তোমার।”

উষ্ণতার বিশ্বাস হচ্ছে না। রুষ্টগলায় বলল,” আমাকে জিজ্ঞেস না করে তুমি কথা দিলে কিভাবে?”

তৃষাণ হাত থেকে সিভিটা নিয়ে ভাঁজ করতে করতে গম্ভীর স্বরে বলল,” আমার এটাই ঠিক মনে হয়েছে। আশা করি উষসীর জন্য এইটুকু করার অধিকার আমার আছে!”

অধিকারের প্রসঙ্গ আসতেই উষ্ণতা চুপ হয়ে গেল। তৃষাণের অবশ্যই উষসীর জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু তৃষাণ যে এইভাবে সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে এটা ভাবতে পারছে না উষ্ণতা। তৃষাণ তো আগে এমন ছিল না! আর উষসীর পাত্র হিসেবে এই ছেলেকে উষ্ণতার মোটেও পছন্দ হয়নি। পৃথিবীতে এমন সাধু পুলিশ খুব কমই আছে যে ঘুষ খায় না৷ এই ছেলেও যে ঘুষখোর না তার গ্যারান্টি কি? শুধু তৃষাণের মনখারাপ হবে ভেবে উষ্ণতা কিছু বলতে পারল না।

চলবে

আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-০৩

0

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৩
Sidratul Muntaz
(বর্তমান)
আয়েশা খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে অনেকক্ষণ ধরে। উষসী পুরনো ম্যাগাজিন ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ বলল,” আয়েশা, এখনও যাওনি তুমি? আমি একবার বলেছি খাবো না৷ এর মানে কেউ খাওয়াতে পারবে না। হাতে প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। নিজের কাজে যাও।”

অকপটে কথা শেষ করে উষসী ম্যাগাজিনে মনোযোগ দিল। তার অস্থির লাগছে। অস্থিরতা কমাতে সে নিজেকে কাজে ব্যস্ত রাখতে চায়। আগে প্রচুর রূপচর্চা করার অভ্যাস ছিল। ইদানীং কিছুই হয় না। তার নিখুঁত ফরসা চেহারায় দুইটা ব্রণ উঠে গেছে। উষসী একবার পুরনো ম্যাগাজিনে ব্রণ অপসারণ করার পদ্ধতি দেখেছিল। এখন সেই ম্যাগাজিনটিই খুঁজছে সে। আবার রূপচর্চা শুরু করবে। নিজেকে ভালোবাসবে। সারাক্ষণ নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। অন্যকারো করুণার অপেক্ষায় থেকে জীবন নষ্ট করবে না।

আয়েশা করুণ স্বরে বলল,” খেয়ে নিন, ম্যাডাম। আপনি না খেলে স্যার রাগ করবেন।”

” তোমার স্যার কিভাবে জানবেন আমি খেয়েছি কি খাইনি? যদি তুমি না বলো? তাছাড়া এই মুহূর্তে আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। যখন ইচ্ছে করবে তখন নিশ্চয়ই খাবো।”

” কিন্তু স্যার যদি ফোন করেন? আমি স্যারকে মিথ্যা বলতে পারবো না।”

” সেটা তোমার সমস্যা!”

আয়েশা হার মানল। তার ম্যাডাম ভীষণ জেদী। একবার যেটা বলবেন সেটা করেই ছাড়বেন। কিন্তু ম্যাডামের চেয়েও দ্বিগুণ জেদী হলেন স্যার। তিনিও যা বলবেন তাই করবেন। এই দুই জেদী মানুষের মাঝখানে পিষ্ট হয়ে আয়েশার অবস্থা নাজেহাল। সে মনে মনে বলল,” আল্লাহ, আমাকে ধৈর্য্য দাও।”

উষসী গাজর, মধু আর টকদই দিয়ে মুখের জন্য একটা ফেইস প্যাক বানালো। দুই টুকরো শসা চোখে লাগিয়ে মুখে প্যাক মেখে বসে রইল। তাকে খুব অদ্ভুত দেখাচ্ছে। কিন্তু উষসী এই সব করছে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার জন্য। সে ইয়ামিনকে বোঝাতে চায় যে সে ভালো আছে। ইয়ামিনের বিরহে ম’রে যাচ্ছে না। এটা যখন ইয়ামিন বুঝবে তখন এমনিই উষসীর গুরুত্ব বাড়বে। উষসী তার মনের ক্ষ’ত আড়াল করে ইয়ামিনের হৃদয়ের ক্ষ’ত গাঢ় করতে চায়।

প্রায় একঘণ্টা পর আয়েশা পুনরায় এলো। দরজায় নক করল। উষসী ভেতর থেকে বলল,”এসো।”

আয়েশা ভেতরে ঢুকে উষসীকে দেখেই বিকট এক চিৎকার দিল। উষসী না হেসে পারল না। চোখ থেকে শসা সরিয়ে প্রশ্ন করল,” ভয় পেয়েছো?”

আয়েশা মৃদু তালে মাথা নেড়ে বলল,” হুম।”

” হাতে করে কি এনেছো?”

” বিরিয়ানি। স্যার বললেন আপনার নাকি পছন্দ!”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল উষসী। আসলেই তার বিরিয়ানি ভীষণ পছন্দ ছিল। কিন্তু এখন বিরিয়ানিও বিরক্ত অসহ্য লাগছে। যেখানে তার জীবনটাই এলাচির মতো সেখানে বিরিয়ানি খাওয়া বিলাসিতা। উষসী শসার টুকরো চোখে গুঁজে বলল,” না, খাবো না। আমি ডায়েটিং এ আছি। বিরিয়ানি আমার জন্য নিষিদ্ধ।”

” তাহলে কি খাবেন ম্যাডাম?”

” আমার খাবার আমি নিজেই তৈরী করবো। তুমি শুধু আমাকে একটা ধারালো ছু-রি এনে দাও। তাহলেই হবে।”

আয়েশা কোনো জবাব না দিয়ে দ্রুত বের হয়ে গেল। উষসী ঠিক করেছে সে নিজের জন্য ফ্রুট সালাদ বানাবে। তার বেডরুমেই ফ্রীজ আছে। সেই ফ্রীজে ফল, টকদই, জুস সবকিছুই আছে। এজন্যই শুধু ছু-রি চেয়েছে। কিন্তু আয়েশা ব্যাপারটা বুঝল না। সে নিচে গিয়ে দ্রুত ল্যান্ড লাইন থেকে ইয়ামিনকে ফোন করে জানালো,” স্যার, ম্যাডাম আমার কাছে ধারালো ছু-রি চাইছেন।”

ইয়ামিন অফিসের মিটিং-এ ব্যস্ত। আয়েশার কথা শুনে সে মিটিং থেকে বের হয়ে এলো। ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল,” ভুল করেও দিও না। আমি এখনি বাসায় আসছি। ত্রিশ মিনিট লাগবে। তুমি সব ছু’রি লুকিয়ে ফেল। আর তোমার ম্যাডামকে পাহারায় রাখো।”

” ওকে স্যার।”

ইয়ামিন গাড়িতে উঠে দ্রুত ড্রাইভিং শুরু করল। তার হাতের আঙুল মৃদু কাঁপছে। চোখেমুখে যেন সে অন্ধকার দেখছে। সকালে উষসী বলেছিল, তাকে ঘর থেকে বের হতে না দিলে সে আত্মহ’ত্যা করবে। ইয়ামিন মনে মনে বলল,” আল্লাহ রক্ষা করো।”

অনেক সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও আয়েশা ছু’রি নিয়ে এলো না। উষসী মুখ ধুঁয়ে গোসল সেরে নিয়েছে। তার এখন ভীষণ ক্ষিদে পাচ্ছে। প্লেটে ফল, সবজি, সাজিয়ে রেখেছে। সাথে টকদই আর লবণ। সিদ্ধ মাংসও আছে। সব কে’টে একসাথে মিশিয়ে নিলেই সালাদ তৈরী। কিন্তু ছু’রি লাগবে। উষসী ঘর থেকে বের হতে নিলেই ধাক্কা খেল দরজার সাথে। পেছনে কেউ দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। উষসী বাইরে তাকাতেই দেখল আয়েশাকে। অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,” আয়েশা, তুমি এখানে কি করছো? তোমাকে না ছু’রি আনতে বললাম?”

আয়েশা কোনো জবাব দিল না। তার ঠোঁট কাঁপছে। দৃষ্টিতে ভয়। উষসী তাকে উপেক্ষা করে রান্নাঘরের দিকে যেতে লাগল। আয়েশা তড়িঘড়ি করে উষসীর কাছে এসে বলল,”আপনি ঘরে যান ম্যাডাম। আর মাত্র দশমিনিট প্লিজ। স্যার আসছে।”

” স্যার আসছে মানে? তোমার স্যার এই সময় কেন আসবে?”

আয়েশা কি উত্তর দিবে ভেবে পেল না। উষসী রান্নাঘরে ঢুকে ছু’রি খুঁজতে লাগল। আয়েশা একমনে দোয়া পড়ছে। এই বুঝি কোনো অঘটন ঘটল। উষসী ছু’রি নিয়ে বের হতেই সে খুব জোরে একটা চিৎকার দিল। উষসী অবাক হয়ে তাকাল। মেয়েটার কি হয়েছে? ইয়ামিন ঠিক তখনি বাড়িতে ঢুকল। আয়েশার চিৎকার শুনে সে বায়ুর গতিতে উপরে উঠল। উষসীর হাতে ছু’রি। আয়েশার চেহারা আতঙ্কে নীল। এই দৃশ্য দেখে ইয়ামিন দ্রুত উষসীর হাত থেকে ছু’রি কেড়ে নিল। চোয়াল শক্ত করে ধমকের সুরে বলল,

” ছেলেমানুষীর একটা সীমা থাকা উচিৎ। মৃ’ত্যুই কি সব সমস্যার সমাধান? তুমি এসব করে কি বোঝাতে চাইছো?”

উষসী থতমত খেয়ে তাকিয়ে রইল। কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টাও করল। যখনি বুঝতে পারল তখনি তার খুব হাসি পেল। ইয়ামিনের হন্তদন্ত হয়ে অফিস থেকে ছুটে আসার ব্যাপারটা আরও মজার। কিন্তু মজা পেলেও সে হাসল না। কঠিন মুখে বলল,” আমাকে নিয়ে এতো চিন্তা কেন আপনার যে একদম অফিস থেকে ছুটে এসেছেন?”

” তো আসবো না? এখনি তো একটা কেলেংকারী ঘটাতে যাচ্ছিলে।”

উষসী মাথা নেড়ে বলল,” হুম বুঝলাম। আমি সুইসাইড করলে তো আপনার প্রবলেম। পুলিশ এসে আপনাকে ধরবে! এই ভয়েই আমাকে বাঁচাতে এসেছেন তাই না?”

ইয়ামিন তার রাগ দমন করে নিল। ধাতস্থ হয়ে বলল,” আমাকে কি এতো স্বার্থপর মনে হয় তোমার?”

উষসী চোখ ছোট করে হাসল। রহস্যময় উত্তর দিল,” কি জানি!”

ইয়ামিনকে আরও একটু ঘাবড়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে সে ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিল। সাথে সাথে ইয়ামিনের চেহারা চুপসে গেল ফাটা বেলুনের মতো। এখন ভেতরে গিয়ে মেয়েটা কি করবে কে জানে? যদি ফ্যানের সাথে ওরনা বেঁধে ঝুলে পড়ে? ইয়ামিন জোরে দরজায় করাঘাত শুরু করল।

” উষসী, দরজা খোলো। দেখো এইভাবে টেনশন দেওয়ার কোনো মানেই হয় না। বেরিয়ে আসো। আমরা ঠান্ডা মাথায় কথা বলি,প্লিজ। তুমি যা চাও তাই হবে। হোটেলে থাকতে চাও? আমি নিজে তোমাকে হোটেলে রেখে আসবো। তবুও তুমি দরজা খোলো প্লিজ। উষসী!”

ইয়ামিনের আকুতি-মিনতি চলছেই। উষসী বিছানায় বসে আপেলে কা’মড় দিল। একটি পৈশাচিক আনন্দে তার মনে প্রশান্তি বিরাজ করতে লাগল। ইয়ামিন তাকে নিয়ে ভাবছে, চিন্তা করছে, অস্থির হচ্ছে, এই ব্যাপারগুলোই উষসীর মনকে শান্ত করতে যথেষ্ট।

এক সপ্তাহের জন্য অফিসে যাওয়া বন্ধ করল ইয়ামিন। এখন সে সারাক্ষণ বাড়িতে থাকে। অফিসের প্রায় সব কাজ ল্যাপটপ অথবা মোবাইলে করে। তার প্রধান কাজ উষসীর দিকে নজর রাখা। উষসী বাথরুমে গেলেও সে অস্থির থাকে। এই বুঝি কোনো অঘটন ঘটল। একটু দেরি হলেই চেঁচানো শুরু করে। উষসী ব্যাপারগুলো খুব উপভোগ করছে। ইয়ামিন তার মনোরঞ্জনের জন্য বিভিন্ন কৌশল বের করে। যেমন আজ সকালেই বলছিল,” চলো কোথাও ঘুরতে যাই।”

উষসী তেরছা দৃষ্টিতে চাইল। ত্যাড়া গলায় বলল,” হঠাৎ ঘুরতে যাবো কেন?”

” এমনিই। কতদিন হলো একসাথে ঘুরতে বের হই না। তাই মনে হলো, কোথাও যাওয়া উচিৎ। ”

” আগে তো আমাকে নিয়ে বের হওয়ার সময়ই ছিল না আপনার। অফিসে নাকি অনেক কাজ? এখন তো অফিসেও যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। হঠাৎ এতো পরিবর্তন কেন?”

ইয়ামিন কোমল স্বরে বলল,” তুমি আমার স্ত্রী। তোমাকে সময় দেওয়া আমার দায়িত্ব।”

” ও… তো বিয়ের দুইবছর পর আপনার দায়িত্বের কথা মনে পড়ল? ভেরি নাইস অফ ইউ।” উষসী কটাক্ষ করল।

ইয়ামিন মনখারাপ করা গলায় বলল,” প্লিজ উষসী, সব ভুলে আমরা আবার নতুন করে শুরু করি? অন্তত একবার ট্রাই করি?”

” আপনার কি মনে হয়? এতো সহজ সব ভুলে যাওয়া? আচ্ছা আপনি কি এতো বছরেও ভুলতে পেরেছেন উষ্ণতা আপুকে?”

ইয়ামিন নিশ্চুপ হয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত পর বলল,” যাই হোক, এখন আমি শুধু তোমার। এটা মেনে নাও। তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”

উষসী তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। মেনে নেওয়া বুঝি এতোই সহজ! উষ্ণতার প্রসঙ্গ তুললেই ইয়ামিন নিশ্চুপ হয়ে যায় অথবা এড়িয়ে যেতে চায়। চোখেমুখে বিষাদের ছাপ স্পষ্ট হয়। এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে সে উষ্ণতাকে এখনও ভোলেনি।যেদিন উষ্ণতার নাম শুনে ইয়ামিন স্বাভাবিক থাকবে এবং তার চেহারার উজ্জ্বলতায় ভাটা পড়বে না সেদিনই উষসী মেনে নিবে যে ইয়ামিন উষ্ণতাকে ভুলতে পেরেছে।

আর যেদিন সে মন থেকে উষসীর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাবে, যেভাবে উষ্ণতার দিকে তাকায় সেদিন উষসীও এটা মেনে নিবে যে ইয়ামিন শুধু তার। এর আগে ইয়ামিন হাজার বার, লক্ষ্য বার কিংবা কোটি বার বললেও উষসী মানবে না। কখনোই না।

ছিমছাম একটি রেস্টুরেন্ট। ক্যালিফোর্নিয়ার বিখ্যাত সব খাবার এখানে পাওয়া যায়। কাঁচের জানালা দিয়ে দেখা যায় অপূর্ব দর্শন। লাইট মিউজিক চলছে। কাস্টমারদের অবস্থান খুব দূরে দূরে। বেশ প্রাইভেসী সম্পন্ন আলিশান জায়গা। এতো মনোরম পরিবেশও উষসীর মন গলাতে পারছে না৷ সে মুখ ভার করে নিশ্চুপ বসে আছে। ইয়ামিন মেন্যুবুক তার সামনে দিয়ে বলল,” যা মন চায় অর্ডার করো।”

উষসী অন্যদিকে চেয়ে বলল,” আমার ক্ষিদে নেই। আপনি অর্ডার করুন।”

” কি আশ্চর্য! আমি একা খাবো আর তুমি সামনে বসে দেখবে নাকি?”

উষসী রূঢ় কণ্ঠে বলল,” ঠিকাছে তাহলে আমি উঠে অন্য জায়গায় গিয়ে বসছি। আপনি আরামে খান৷ এমনিতেও আপনার সাথে এভাবে বসে থাকতে আমার অসহ্য লাগছে।”

” আরে….” ইয়ামিন কিছু বলার আগেই উষসী উঠে দূরের একটা টেবিলে চলে গেল। অপ্রস্তুত দৃষ্টিতে ইয়ামিন আশেপাশে তাকাল। তারপর হতাশ হয়ে মেন্যুকার্ড রেখে দিল। তার আশা ছিল উষসী ফিরে আসবে। কিন্তু সে এলো না। বেশ কিছুক্ষণ পর কয়েকজন মেয়ে এলো। তারা ইয়ামিনের সাথে সেলফি তুলতে চায়। ইয়ামিন প্রথমে একটু চমকে গেল। বাংলাদেশ অথবা ইন্ডিয়াতে সে পরিচিত মুখ হলেও আমেরিকার মানুষ তাকে তেমন একটা চেনে না। আর চিনলেও খুব বেশি গোণায় ধরে না। তাই হঠাৎ এখানে এমন ফ্যান-ফলোয়ার পেয়ে সে হকচকিয়ে গেছে। মেয়েগুলো ইয়ামিনের সাথে দেখা করতে পেরে খুব এক্সাইটেড। তারা জায়গা খালি পেয়ে ইয়ামিনের সাথে তার টেবিলেই বসে পড়ল। মুহূর্তেই তার চারিপাশে ফ্যানদের একটা বলয় তৈরী হয়ে গেল। দূর থেকে উষসী গালে হাত রেখে এসব দেখছিল।

ইয়ামিন তার ফ্যানদের সাথে অস্বস্তি নিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। একবারও পেছনে তাকাচ্ছে না। সে হয়তো ভুলেই গেছে যে উষসী নামের কেউ তার সঙ্গে রেস্টুরেন্টে এসেছিল। ওয়েটার উষসীর সামনে এসে ইংরেজিতে প্রশ্ন করল,” ম্যাম, আপনি কিছু নিতে চান?”

উষসী গম্ভীর কণ্ঠে বলল,” এক বোতল রেড ওয়াইন নিয়ে আসুন।”

টি-শার্টের সাথে হাফপ্যান্ট পরা এক বিদেশী ছেলে উষসীর পাশে এসে বসল। খোশমেজাজে বলল,” হাই সুইটহার্ট। ”

উষসী ড্রিংক করছে৷ তার চারিপাশ দুলছে। লোকটি তাকে ‘সুইটহার্ট’ বলে সম্বোধন করতেই সে নড়ে উঠল,” কে আপনি? হু আর ইউ?”

লোকটি স্মিত হেসে বলল,” আমরা সেইম ড্রিংক পান করছি। লেটস চিয়ার্স। ”

উষসী ভাবল ইয়ামিনকে শিক্ষা দেওয়ার এটাই সুযোগ। সে লোকটির সাথে চিয়ার আপ করল। লোকটি আরও ঘনিষ্ট হয়ে বসতে চাইল। অস্বস্তি অনুভব হলেও উষসী কিছু বলল না। হঠাৎ ইয়ামিন পেছনে তাকাল। উষসী তখন লোকটির দিকে চেয়ে বলল,” সো সুইট অফ ইউ৷”

লোকটি এমন কথা শুনে খুশিতে ডগমগ হয়ে তার নিজস্ব ভাষায় বলল,” আপনি আমার সাথে ডান্স করবেন? প্লিজ।”

উষসী কিছু না বুঝেই মাথা নাড়ল,” ইয়েস।”

ছেলেটি উঠে দাঁড়ালো। হাত বাড়িয়ে দিল উষসীর দিকে। ইয়ামিনকে তাকিয়ে থাকতে দেখে উষসী ইচ্ছে করেই ছেলেটির হাত ধরল। ছেলেটি তাকে টেনে নিয়ে গেল স্টেজে। এই অবস্থা দেখে ইয়ামিন টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। সবাইকে ‘এক্সকিউজ মি’ বলে সে উষসীর কাছে গিয়ে বলল,” হোয়াটস গোয়িং অন? হাউ ডেয়ার ইউ টু টাচ মাই ওয়াইফ?”

ছেলেটি অবাক হয়ে তাকাল,” ইজ শী ইউর ওয়াইফ?”

উষসী সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করল,” একদম না। আমি তো এই লোককে চিনিই না।”

ইয়ামিন চোখ গরম করে তাকাল। উষসী সেসবের তোয়াক্কা না করে ছেলেটির হাত ধরে মিষ্টি হেসে বলল,” লেটস গো হানি।”

ইয়ামিন কঠিন গলায় বলল,” উষসী, তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছো।”

” আপনি তো আপনার ফ্যানদের সাথে আড্ডা দিচ্ছেন৷ আমার এখানে কি কাজ? প্লিজ, আমাকে আমার মতো ইঞ্জয় করতে দিন।”

” উষসী!” ইয়ামিন ধমক দেওয়ার চেষ্টা করল।

উষসী শুনল না। ছেলেটির সাথে স্টেজে গিয়ে ডান্স শুরু করল। ছেলেটি সুযোগ পেয়ে উষসীর কোমর স্পর্শ করছে, পিঠে হাত রাখছে, হাত ধরছে। এসব দেখে ইয়ামিনের মাথায় র-ক্ত চড়ে গেল। সে সবার সামনে স্টেজে উঠে উষসীর হাত ধরে তাকে টেনে-হিঁচড়ে নামাল। ছেলেটি রাগান্বিত গলায় বলল,” হোয়াটস রং উইদ ইউ ম্যান? লিভ হার!”

” শাট আপ।”

ইয়ামিন ধাক্কা মেরে ছেলেটিকে নিচে ফেলে দিল।পুরো রেস্টুরেন্টে হৈচৈ বেঁধে গেল। ইয়ামিন এই অবস্থায় উষসীকে নিয়ে বের হয়ে এলো। বাইরে আসতেই উষসী চিৎকার করে বলল,” এভানে সিন ক্রিয়েট করলেন কেন?”

” তুমি কি করছিলে? গতকাল এতোবড় একটা বিপদ হতে যাচ্ছিল তাও কি শিক্ষা হয়নি? এখন থেকে তোমার বাড়ির বাইরে যাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ”

” আমার বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ করার আপনি কে?”

” বার-বার মনে করাতে হবে কেন? আই এম ইউর হাজব্যান্ড।”

ইয়ামিন খুব অধিকার নিয়ে কথাটা উচ্চারণ করল। এর আগে এভাবে সে কখনও বলেনি। উষসী চুপ করে গেল। পুরো রাস্তা সে আর একটাও কথা বলল না। বাড়িতে ফেরার পরেও তাদের মধ্যে কথা হলো না। তবে রাতে খুব আশ্চর্য একটি ব্যাপার ঘটল। ইয়ামিন তার বালিশ নিয়ে উষসীর ঘরে চলে এলো। উষসী তখন বাথরুমে ছিল। বের হতেই নিজের বিছানায় ইয়ামিনকে শুয়ে থাকতে দেখে সে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। কিছুটা উচ্চ স্বরেই বলে ফেলল,” আপনি এখানে কি করছেন?”

” ঘুমাবো।” অকপটে উত্তর দিল ইয়ামিন। উষসী একটু কাছে এসে বলল,” এর মানে কি?”

” এতো অবাক হওয়ার তো কিছু নেই। আমি এখানে ঘুমাতেই পারি।”

” কিন্তু আপনি বলেছিলেন আমাকে ডিভোর্স দেবেন। যে সম্পর্ক দুই বছরেও স্বাভাবিক হয়নি, দুইদিনের জন্য জোর করে সেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে এসব নাটক করার কোনো দরকার নেই।”

” তোমার মনে হচ্ছে আমি নাটক করছি?”

” অবশ্যই করছেন। আপনি এখানে থাকতে পারবেন না।”

” কিন্তু আমি এখানে থাকতে চাই।”

” আমি চাই না।”

ইয়ামিন নীরব দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল। তারপর জেদী কণ্ঠে বলল,” হয় আজরাতে আমি এখানে থাকবো নাহলে স্ট্রিট বেঞ্চে। একেবারে রাস্তায়। এবার তুমিই সিদ্ধান্ত নাও। কি করবো আমি?”

উষসী বেপরোয়া কণ্ঠে জানাল,” আপনি রাস্তায় যান কি জাহান্নামে। আই ডোন্ট কেয়ার।”

তার এহেন উত্তর শুনে ইয়ামিনের মাথা গরম হয়ে গেল। রাগ আর অভিমান নিয়ে সত্যি সত্যি বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল সে।

চলবে

আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-০২

0

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ২
Sidratul Muntaz

ভোরের আকাশটা যতটুকু শ্বেত- শুভ্র আর শীতল, উষসীর মনের আবহাওয়া ঠিক ততটাই অন্ধকারাচ্ছন্ন, বিষণ্ণতায় উত্তপ্ত। সারারাত ঘুম হয়নি। চোখের পানি শুকিয়ে গালের চামড়ায় দাগ পড়ে গেছে। সে এই মুহূর্তে বসে আছে ছাদে। অনম পেছনে এসে দাঁড়ালো। গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের উপস্থিতির জানান দিল।

উষসীর বিষণ্ণ চেহারায় ফুটল বিষণ্ণ হাসি। বিষাদমাখা কণ্ঠে বলল,” আমাকে পাহারা দিতে এসেছেন নাকি অনম ভাই?”

অনম অসহায় চোখে তাকালো। মলিন কণ্ঠে বলল,” ঘরে চলুন ম্যাডাম৷ এখানে সারারাত ধরে বসে আছেন। আপনার ঠান্ডা লেগে যাবে।”

” আপনি কিভাবে জানলেন আমি যে সারারাত ধরে বসে আছি?”

” স্যার বলেছেন।”

উষসী আশেপাশে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজল। উপহাস করে বলল,” এখানেও সিসিটিবি লাগিয়েছে নাকি আপনার স্যার?”

অনমের মুখটা চুপসে গেল। নরম গলায় উত্তর দিল,” স্যারকে আপনি শুধু শুধুই ভুল বোঝেন ম্যাডাম। স্যার ভালোবাসেন বলেই আপনার কেয়ার করেন!”

ফিক করে হেসে ফেলল উষসী। তার হাসিতে দুঃখের পরশ মেশানো। অনমের খারাপ লাগছে। তার এতো ভালো স্যারকে কেউ কখনও বুঝতে পারে না কেন? স্যার কারো ভালোর জন্য কিছু করতে গেলে সবসময় খারাপ হয়ে যায়। অনম আল্লাহর কাছে শুধু প্রার্থনা করে যেন তার স্যারের কপালে সুখ আসে। স্যারকে সে কখনও প্রাণ খুলে হাসতে দেখেনি। উষসী এই বাড়িতে আসার পর সে ভেবেছিল এবার বুঝি স্যারের সুখের দিন শুরু হবে। কিন্তু হলো উল্টো। উষসীই যেন এখন স্যারের দুঃখের প্রধান কারণ। স্যারের সাথেই সবসময় এমন কেন হয়? উত্তরটা জানা নেই অনমের। আল্লাহ বুঝি ভালো মানুষদেরই বেশি পরীক্ষা নেন। ধৈর্য্যের পরীক্ষা, সহ্যের পরীক্ষা। উষসীর হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ায় সে উঠে দাঁড়ালো। অনম প্রশ্ন করল,

” কিছু লাগবে ম্যাডাম?”

উষসী জবাব না দিয়ে দ্রুত ছাদ থেকে নেমে গেল। বেডরুমে এসেই ব্যাগ গোছানো শুরু করল সে। অনম আর উষসীর বেডরুমের দিকে গেল না। আয়েশাকে রান্নাঘরে গিয়ে ডাকল। আয়েশা এই বাড়ির কাজের লোক। বয়স অল্প। মেয়েটার বুদ্ধিও কিছুটা কম। অনম এই মেয়ের কাজ-কর্মে প্রায়শই বিরক্ত হয়। কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার তাকেই দিতে হয়।

উষসী খুব বেছে বেছে জিনিসপত্র তুলছে ব্যাগে। আয়েশা ঘরে প্রবেশ করতেই উষসী তাকে আদেশ দিল তার জিনিসগুলো গুছিয়ে দিতে। আয়েশা আদেশ মতো কাজ করতে লাগল। সে কোনো প্রশ্ন করার সাহস পেল না। তবে তার জানার খুব কৌতুহল। ম্যাডাম এই সকালবেলা কোথায় যাচ্ছেন? তাও এতো আয়োজন করে ব্যাগ গুছিয়ে!

আলমারিতে এতো দামী জামা-কাপড়। কিন্তু উষসী ব্যাগে ভরল কয়েকটি পুরনো সেলোয়ার-কামিজ। এগুলো তার বিয়ের আগের কেনা। উষসী ইয়ামিনের দেওয়া একটা জিনিসও ব্যাগে নেয়নি। যাকে ছেড়ে চলে যাবে, তার দেওয়া জিনিস কেন নেবে? উষসী গুছানো শেষ করে সিঁড়ি ভে-ঙে নিচে নামল। তাদের এই বাড়িটা বিশাল বড়। অথচ সদস্য সংখ্যা মাত্র তিনজন। কাজের লোক হিসেবে আছে আয়েশা। তাকে সদস্য ধরেই হয় তিনজন।

এতো বিশাল বাড়ি থাকার পরেও উষসীর দম আ’টকে আসে। বিশাল বাগানের বিশুদ্ধ বাতাস তার নিঃশ্বাস স্বস্তিময় করতে পারে না। বাগান সংলগ্ন বিশাল সুইমিংপুলেও উষসী গা ভিজিয়ে শান্তি পায় না। টাকায় সুখ নেই। আসল সুখ মনের শান্তিতে। এই ধ্রুব সত্যি উষসী প্রতিদিন নতুনভাবে উপলব্ধি করে। তাইতো আজ এতোবড় সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে সে!

উষসীকে ব্যাগ নিয়ে নিচে যেতে দেখে অস্থির হয়ে উঠল অনম। আয়েশার কাছে এসে বিচলিত ভঙ্গিতে জানতে চাইল,” ম্যাডাম কোথায় যাচ্ছে?”

আয়েশা কাঁচুমাচু মুখে বলল,” আমি জানি না অনম ভাই।”

অনমের চোখের দৃষ্টি গরম হলো,” জানো না মানে? তোমাকে কেন পাঠিয়েছি? ম্যাডামকে একটু বুঝোনোর জন্য। তা না করে তুমি উল্টা তাকে সাহায্য করছো বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে?”

” আমি কি করবো স্যার? সামান্য কাজের লোক আমি। আমার কি স্পর্ধা আছে ম্যাডামকে থামানোর?”

” অন্তত বোঝাতে পারতে! মাথায় কি বুদ্ধিও নেই?”

” এতো বুদ্ধি আমার নেই।”

” ইডিয়েট!” অনম দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামল। স্যার দেখে ফেলার আগেই ম্যাডামকে আটকাতে হবে। অনমের দেখাদেখি আয়েশাও এলো।

ইয়ামিন ডাইনিং টেবিলে বসে ব্রেকফাস্ট করছে। তার একহাতে চামচ অন্যহাতে মোবাইল ফোন। উষসী দৃশ্যটা দেখেও সম্পূর্ণ অবহেলা করল। সে পা বাড়ালো সদর দরজার দিকে। ইয়ামিন মোবাইল থেকে চোখ না সরিয়েও উষসীর প্রতিটি পদক্ষেপ লক্ষ্য করছে। উষসী দরজার কাছে যাওয়া মাত্রই ইয়ামিন সশব্দে প্রশ্ন করল,

” আমি কি জানতে পারি, কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”

উষসী এমনভাবে শ্বাস ছাড়ল যেন খুব বিরক্ত সে। তার জায়গায় প্রশ্নের উত্তর দিল আয়েশা,” ম্যাডাম চলে যাচ্ছেন, স্যার।”

অনম চোখ পাকিয়ে তাকালো আয়েশার দিকে। হাতের ইশারায় চুপ থাকতে বলল। ইয়ামিন মোবাইল রেখে সোজা হয়ে বসল। তাকালো উষসীর দিকে। কিন্তু কথা বলল আয়েশার সঙ্গে, ” সেটা তো আমি দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু তোমার ম্যাডাম যাচ্ছে কোথায়?”

উষসী আয়েশার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,” আমি এই বাড়ি ছেড়ে হোটেলে শিফট হতে যাচ্ছি, আয়েশা। তোমার স্যারকে জানিয়ে দাও। আমি তার সঙ্গে থাকতে রাজি না। সে যেন আমাদের ডিভোর্স লেটার হোটেলের এড্রেসে পাঠিয়ে দেয়।”

অনম বড় বড় দৃষ্টিতে চাইল। আর্তনাদের সুরে বলল,” এসব কি বলছেন ম্যাডাম? প্লিজ আমাদের স্যারকে ছেড়ে যাবেন না। স্যার খুব একা হয়ে যাবেন।”

উষসী বিষাদসিক্ত দৃষ্টিতে মাথা নেড়ে বলল,” চিন্তা করবেন না অনম ভাই। আমি চলে গেলে আপনাদের স্যার একা হবেন না। বরং তিনি মুক্তি পাবেন।”

” ছি, ছি, ম্যাডাম, এসব কি বলছেন। আপনি হলেন স্যারের..”

চোখের ইশারায় অনমকে থামার নির্দেশ দিল ইয়ামিন। অনম অবিলম্বে নিশ্চুপ হলো। ইয়ামিন মুখে হাত রেখে একটু হাসার চেষ্টা করল। উষসীর গা জ্বলে উঠল সেই হাসি দেখে। সে কি তামাশা করছে নাকি সকাল সকাল? রেগে না থাকলে অবশ্যই ইয়ামিনকে প্রশ্ন করতো উষসী। ইয়ামিন আয়েশার উদ্দেশ্যে বলল,

” এই বাড়িতে কি খুব অসুবিধা হচ্ছে আয়েশা? হোটেলে থাকার দরকার পড়ল কেন?”

উষসী চোয়াল শক্ত করে উত্তর দিল,” এই বাড়ির মানুষের আমাকে নিয়ে বিরক্ত হওয়া চেহারা দেখার চেয়ে হোটেলে থাকা অনেক ভালো। আমি কারো বোঝা হতে চাই না।”

আয়েশা আর অনম যেন এই ঝগড়ার নীরব দর্শক। দু’জনেই বিরস দৃষ্টিতে নিচে তাকিয়ে আছে। ইয়ামিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ট্রাউজারের পকেটে মোবাইল গুজে বলল,” অনেক হয়েছে উষসী। ঘরে যাও। আমি আসছি।”

উষসী সাথে সাথে আয়েশার দিকে চেয়ে ক্রোধমিশ্রিত কণ্ঠে বলল,” আয়েশা তোমার স্যারকে বলে দাও আমি এই বাড়িতে অবহেলার পাত্রী হয়ে থাকতে পারবো না। যা-ই হয়ে যাক! আমাকে আটকানোর চেষ্টা যেন না করে৷ কারণ এতে কোনো লাভ নেই। আমি যখন বলেছি চলে যাবো, এর মানে অবশ্যই চলে যাবো।”

” তোমাকে কেউ অবহেলা করছে না। নিজেই এমন ভাবছো। ” ইয়ামিনের কঠিন গলা। উষসী জেদ ধরে দাঁড়িয়ে রইল। ইয়ামিন কিছুটা তেজ নিয়ে বলল,” তুমি কোথাও যাবে না। সোজা উপরে চলো।”

” আমাকে অর্ডার দেওয়া বন্ধ করুন। আপনার বেতনভুক্ত কর্মচারী না আমি। আর স্ত্রীও না। কারণ আজ থেকে আমাদের সব সম্পর্ক শেষ।”

অনম আর আয়েশা অবাক হয়ে চোখাচোখি করল। এসব কি হচ্ছে? ইয়ামিন কিছুক্ষণ থম ধরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল উষসীর দিকে। উষসীর চোখ থেকে ক্রোধের আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে। সে আজ নিজ সিদ্ধান্তে অবিচল।

ইয়ামিন হঠাৎ উষসীর কাছে এসে হাত চেপে ধরল। উষসী বিস্মিত হয়ে চাইল। ইয়ামিন গম্ভীর কণ্ঠে আবারও নির্দেশ দিল,” উপরে চলো।”

উষসী রাগান্বিত স্বরে আওড়ালো,” আমাকে ছেড়ে দিন। কোনোভাবেই আটকে রাখতে পারবেন না। আমি এই বাড়িতে থাকবো না মানে কোনোভাবেই থাকবো না।”

ইয়ামিন ঝট করে উষসীকে পাজকোলে তুলে নিল। হতভম্ব হয়ে উষসী তাকালো আয়েশা আর অনমের দিকে। তারা দ্রুত নিজেদের দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে। এমন ভাব, যেন তারা কিছু দেখেইনি।

উষসীর লজ্জার থেকেও রাগ বেশি হলো। সে তড়পাতে লাগল ডাঙায় তোলা মাছের মতো। ইয়ামিন তাকে নিয়ে সিঁড়ি ভে-ঙে উপরে চলে এলো। একদম বেডরুমের বিছানায় এনে বসালো। উষসী ছটফটিয়ে উঠে দাঁড়ালো,” আপনার প্রবলেম কি? এখন কি আমাকে বেঁধে রাখতে চান? এসব করে কোনো লাভ নেই। আমাকে বের হতে না দিলে আমি আত্ম/হত্যা করবো!”

ইয়ামিন সজোরে উষসীর মুখ চেপে ধরল। অন্যহাত দিয়ে চেপে ধরল তার দুইহাত। উষসীর ছটফটানি বন্ধ হলো। স্থির হয়ে দাঁড়ালো সে। ইয়ামিন অনুরোধ করে বলল,

” তোমাকে বেঁধে রাখতে চাই না। চলে যেতে চাইলে অবশ্যই চলে যেতে পারো। কিন্তু তার আগে আমাকে একটা সুযোগ অন্তত দাও। আমি তো বলছি, সব ঠিক হয়ে যাবে। শুধু একটু সময় প্রয়োজন আমার।”

উত্তরে উষসী কিছু বলতে পারল না। নির্ণিমেষ চেয়ে রইল ইয়ামিনের চোখের দিকে। ওই কঠিন দৃষ্টিতে টলমল অশ্রু। সে কি কাঁদছে? এক মুহূর্তের জন্য উষসী বিভ্রান্ত হলো। ইয়ামিন তাকে ছেড়ে চলে যেতেই বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল উষসী। একবার ভাবল, ইয়ামিনকে সে সুযোগ দিবে। কিন্তু পর মুহূর্তেই আবার মনে পড়ল সেই নিদারুণ দৃশ্য। উষ্ণতার পায়ের কাছে মাথা রেখে ইয়ামিন ঘুমিয়ে ছিল। উষসী আর ভাবতে পারছে না। তার মাথার শিরা দপদপ করতে লাগল। প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে মস্তিষ্কে। উষসী মাথা চেপে ধরল। এতো জঘন্য স্মৃতি সে কি করে ভুলবে?

(অতীত)
দুইবছর আগের কথা। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের প্রি-টেস্ট শেষ হয়েছে। উষসী কেবল সতেরো বছরের উচ্ছল কিশোরী। পড়ালেখাই তার ধ্যান-জ্ঞান। তবে মাঝে মাঝে শৈশবের সেই রাক্ষ’সমানবের কল্পনায় ডুবে যেতেও মন্দ লাগে না। কিশোরী উষসীর কল্পনা জুড়ে বিরাজ করে তার স্বপ্নের মানব। ইন্সট্রাগ্রাম, ফেসবুক সব জায়গায় ইয়ামিনকে ফলো করে সে। কতদিন আগে ইয়ামিনকে মেসেজ করেছিল। ইয়ামিন এখনও কোনো রিপ্লাই দেয়নি। অবশ্য দিবে কি করে? সেলিব্রিটি মানুষ। সে এখন গান গেয়ে মুম্বাই কাঁপায়। তার কনসার্টে দেশ-বিদেশ থেকে মানুষ ছুটে আসে। বিখ্যাত সিংগার বলে কথা! মেয়েদের মুখে মুখে যার জয়ধ্বনি সে কি উষসীর মতো অতি সাধারণ বাংলাদেশী মেয়েটির ম্যাসেজের রিপ্লাই দেওয়ার জন্য বসে আছে? কত সুন্দরী মডেলদের সাথে কাজ করে সে। গত সপ্তাহেই তো একটা রাশিয়ান মডেলের সাথে মিউজিক ভিডিও শ্যুট করল। কি হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছিল ওই ভিডিওতে তাকে! উষসী এখনও ওই গানের ট্রেলার দেখতে বসলে দিন-দুনিয়া ভুলে যায়। মাত্র পঞ্চাশ সেকেন্ডের ট্রেলারটি উষসী মনে হয় পঞ্চাশ হাজারবার দেখে ফেলেছে। নেভি ব্লু শার্ট পরিহিত, বুকের কাছে কয়েকটা বোতাম খুলে রাখা, সানগ্লাস চোখের চমৎকার হাসি দেওয়া হ্যান্ডসাম ছেলেটি যে কি আশ্চর্য সুন্দর! উষসী প্রতি মুহুর্তে প্রেমে পড়ে। কিন্তু লাভ কি? নিশ্চয়ই এতোদিনে গার্লফ্রেন্ড হয়ে গিয়েছে ইয়ামিনের। মডেল কীর্তি শর্মার সাথে তো প্রায়ই ইয়ামিনের প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে গুঞ্জন শোনা যায়৷ উষসী পরশুই এত্তোবড় একটা আর্টিকেল পড়লো ইয়ামিন আর কীর্তিকে নিয়ে। যদিও কীর্তি হিন্দু আর ইয়ামিন মুসলিম। তবুও সেলিব্রিটিদের কি আর ধর্ম নিয়ে এতো মাথাব্যথা আছে? এমনও হতে পারে যে ওই মেয়ে ইয়ামিনকে পাওয়ার জন্যই মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করে ফেলল। কতই তো হচ্ছে এসব। উষসী আর ভাবতে পারে না। সেদিন ফেসবুকে ওই বড় আর্টিকেলটা পড়ার পর উষসী আর কলেজে যেতে পারেনি। সারারাত শুধু কেঁদেছে। তৃষ্ণা বার-বার এসে জিজ্ঞেস করছিল,” এন্টস, তোমার কি হয়েছে? কাঁদছো কেন?”
উষসী চোখ মুছে মুচকি হেসে বলেছে,” কিছু না বাবা।”

তৃষ্ণা উষসীর ছোট্ট ভাগিনা৷ তার বড়বোন উষ্ণতার একমাত্র ছেলে। ক্লাস ওয়ানে পড়ে। সাত বছরের পাকনা একটা। এই বাড়ির সবচেয়ে আদুরে সদস্য। উষসীর কাছে তো সে কলিজার টুকরা। তৃষ্ণা আদর করে উষসীকে এন্টস বলে ডাকে। এর মানে পিঁপড়া নয়। খালামণির মতো এতোবড় নাম উচ্চারণ করতে তৃষ্ণার কষ্ট হয়৷ তাই ঠিক করেছিল ইংরেজিতে আন্টি ডাকবে। কিন্তু অপরিচিতদেরও তৃষ্ণা আন্টি বলে ডাকে। এটা উষসীর পছন্দ না। সবাইকে যা ডাকে তা উষসীকেও কেন ডাকবে? উষসীর জন্য থাকবে স্পেশাল নাম। তাই তৃষ্ণা ‘এন্টস’ নামটা খুঁজে বের করেছে। সবাই তার আন্টি হলেও উষসী শুধুই এন্টস!

____________________

কীর্তি আচমকা চড় মারল ইয়ামিনের গালে। ইয়ামিন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। বুঝতে পারল না তার অপরাধটা কোথায়! কীর্তি উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” এতোদিন শুধু সবার থেকে শুনেছি। কিন্তু আজকে প্রমাণ পেলাম, তুমি আসলেই একটা সাইকো! আই হেইট ইউ ইয়ামিন!”
কীর্তি কাঁদতে কাঁদতে রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। ইয়ামিন হতাশ হয়ে সিঙ্গেল সোফায় বসে রইল। একটু পর মাথায় হাত ঠেঁকিয়ে হতাশার নিঃশ্বাস ছাড়ল সে। ঘাপলাটা কোথায় হয়েছে সেটা বুঝতে বেশি সময় লাগল না। যদিও এইখানে ইয়ামিন নিজের দোষ খুঁজে পাচ্ছে না। কীর্তি নিজে থেকেই তাকে কিস করতে এসেছিল। ইয়ামিন চোখ বন্ধ করতেই উষ্ণতার চেহারাটা ভেসে উঠল। না চাইতেও মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো উষ্ণতার নাম। এজন্যই কীর্তি ক্ষেপে গিয়ে চড় মারে ইয়ামিনকে। কিন্তু ইয়ামিন তো কখনোই বলেনি যে সে কীর্তিকে ভালোবাসে। কারো সাথে মিষ্টি ব্যবহার করা মানেই যে তার প্রতি ইন্টারেস্ট আছে এমন তো নয়! কীর্তির মতো স্মার্ট মেয়ের এইটুকু বোঝা উচিৎ। আজকের পর থেকে মনে হয় না কীর্তি তার সাথে আর কোনো কাজ করতে চাইবে। নেক্সট মান্থে তাদের কলকাতায় যে কনসার্ট হওয়ার কথা ছিল সেটাও বোধহয় ক্যান্সেল হয়ে যাবে এই কারণে৷ হোক ক্যান্সেল! ইয়ামিনের কিছুই যায়-আসে না৷ ক্যারিয়ার নিয়ে সে কখনোই এতো চিন্তা করেনি। করুণাময় তাকে সব দিয়েছেন। শুধু একটা জিনিস ছাড়া। আর আশ্চর্যের বিষয়, সব থাকার পরেও শুধুমাত্র ওই একটা জিনিসের অভাব তার জীবনটা শূন্য বানিয়ে রেখেছে। নয় বছর ধরে সে উষ্ণতাকে সামনা-সামনি দেখেনি। শুনেছিল মানুষ চোখের আড়াল হলেই মনের আড়াল হয়। এই থিউরি কি তাহলে সম্পূর্ণ ভুল? উষ্ণতার স্মৃতি ভুলে থাকার জন্য মাতৃভূমি ছাড়ল সে, পরিবার ছেড়ে এই অচেনা শহরে একাকিত্বের জীবন বেছে নিল। তাও সবকিছু ছাপিয়ে আজ-কাল উষ্ণতাকে না পাওয়ার বিরহই তাকে সবচেয়ে বেশি পোড়ায়! কেন এমন হয়? যা কোনোদিন পাওয়া সম্ভব না তাই কেন বেহায়া মন বার-বার চেয়ে বসে! উত্তর পায় না ইয়ামিন। সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় এলো। আকাশের অবস্থা ভালো না। বৃষ্টি নামবে হয়তো। নামুক বৃষ্টি। অনেকদিন বৃষ্টিতে ভেজা হয় না। ইয়ামিন ঠিক করেছে আজ খালি গাঁয়ে বৃষ্টিতে ভিজবে৷ কিন্তু সমস্যাও আছে। তার জীবনটা এখন আর নিজের নিয়মে চলে না। কোনো কাজ করার আগে দশবার ভাবতে হয়। এই বুঝি কেউ আড়াল থেকে ভিডিও করল। ইয়ামিন এখন তরুণ শিল্পীদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয় মুখ। সে সিগারেট হাতে নিলেও সেই ঘটনা ভাইরাল হয়ে যায়। দেখা গেল বৃষ্টিতে ভিজতে ছাদে যাবে আর সেখানে আড়াল থেকে কেউ ভিডিও করে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপ্লোড করে দিবে। সেই পোস্ট রাতারাতি ভাইরাল উইদ অদ্ভুত ক্যাপশনস। ইয়ামিন নিজের মনেই হাসল। মোবাইলটা হাতে নিতেই কীর্তির ম্যাসেজ,” আই প্রমিস ইউ, উই উইল নেভার মীট এগেইন। আই এম ব্লকিং ইউ।”
কীর্তি সব জায়গা থেকে ব্লক করেছে ইয়ামিনকে। ইয়ামিনের তাতে কিচ্ছু যায়- আসে না। সে আরামে সিগারেটে টান দিতে লাগল একটার পর একটা। হঠাৎ ইন্সটা ফীডের একটা পোস্টে দৃষ্টি আটকে গেল,” তুমি যার কথা ভেবে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছো, সে এখন অন্যের বাচ্চা সামলানোয় ব্যস্ত।”
ইয়ামিন দুঃখে হেসে ফেলল। কিছু কিছু কথা জীবনের সাথে একদম মিলে যায়। ঠিক যেমন এই পোস্টটি। সিগারেটের সাথে দুঃখবিলাস করতে করতে ইয়ামিন নিজের টাইমলাইনে একটি পোস্ট লিখল,
” তোমার আমার শেষ দেখা হয়ে গেছে বহু আগে। মনের মধ্যে স্মৃতিগুলো রয়ে গেছে তবু জেগে। কিভাবে ভুলে যাই তোমায়?
আজ তুমি আছো শুধু নিকোটিনের ধোঁয়ায়। খুঁজে-ফিরি সেই অবয়ব।
যে ভালোবাসায় হারিয়েছিলাম নিজেকে স্বয়ং।
যদি আবার কখনও হয় দেখা,তোমাকে বিব্রত করবো না।
হয়তো মন বায়না করবে কাছে পাওয়ার, তোমার উষ্ণতায় ডুবে যাওয়ার।
ছলছল চোখ মানবে না বারণ।
তবুও বিব্রত করবো না। কথা দিচ্ছি, তুমি হয়ে থাকবে শুধুই আমার মনখারাপের কারণ।
সেদিন হয়তো আকাশে আলো থাকবে না, চাঁদ হাসবে না, বাতাসে উড়বে না তোমার চুল, আমার গলায় থাকবে না প্রেমের সুর।
তবু আমি দেখবো তোমায়, আমার চোখ বেহায়া হবে, বেপরোয়া মন তোমাকে চাইবে, তুমি কি থাকবে?
প্রিয়তমা, ভালোবাসার এই দহন বড্ড পোড়ায়। তুমি মানো আর না মানো, বেহায়া মন আজও তোমাকেই চায়।”

উষসী ইয়ামিনের পোস্টটা দেখে লাফিয়ে উঠলো। হাজার হাজার স্যাড রিয়েক্টের মাঝে তার দেওয়া কেয়ার রিয়েক্ট কারো চোখেই পড়বে না হয়তো। সে যদি একটা কমেন্ট করে, সেই কমেন্ট অনাদরেই পড়ে থাকবে মাসের পর মাস। কিছু খুচরা পাবলিক হয়তো মজা নেওয়ার জন্য রিপ্লাই দিবে। কিন্তু কাঙ্খিত সেই মানুষটির উত্তর আসবে না কখনোই। উষসী এজন্যই ইয়ামিনের পোস্টে কখনও কমেন্ট করে না। তবে তার জানার ভীষণ ইচ্ছা। কে সেই ভাগ্যবতী? কীর্তি শর্মা নয়তো?

ইয়ামিনকে মেসেজ দিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারলে হতো।কিন্তু কখনও সাহস হয়নি। উষসীর একটাই ভয়, ইয়ামিন কি তাকে চিনতে পারবে? তাদের শেষ দেখা হয়েছিল নয় বছর আগে। এতো বছর ধরে নিশ্চয়ই উষসীকে মনে রেখে বসে নেই সে। অথচ উষসীকে দেখো, নিজের ধ্যান-জ্ঞান বানিয়ে বসে আছে মানুষটিকে। ইয়ামিন সে কথা হয়তো জানবেও না কোনোদিন।

চলবে

আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-০১

0

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব- ১
লিখা- Sidratul Muntaz

গভীর রাত। বারে মানুষ জন কমতে শুরু করেছে। মেয়েটির সেই খেয়াল নেই। সে আপনমনে মদ্যপান করে চলেছে। একের পর এক বোতল খালি হয়ে যাচ্ছে।কিছুক্ষণ পর অচেতন শরীরটা নিয়ে টেবিলেই মাথা এলিয়ে দিল মেয়েটি। বারের পরিচালক এসে ইংরেজিতে জানালেন,” ম্যাম,আমরা দোকান বন্ধ করে দিবো। আপনি আর কতক্ষণ বসবেন?”

উষসী মাথা তুলে তাকাল। ভেসে উঠল ভীষণ কোমল, মায়াবী একটি মুখ। গায়ে সুন্দর ফুলতোলা প্রিন্টের শাড়ি। ঢেউ খেলানো লম্বা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পেছনে ছড়িয়ে আছে। পোশাকে অশ্লীলতার কোনো ছোয়া নেই। দেখে মনে হচ্ছে ভদ্র ঘরের সুশীল মেয়ে। এখানে এই প্রথম এমন কাস্টমার এসেছে। লোকটি অবাক হয়ে উষসীর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।

উষসী রূঢ় স্বরে বলল,” কেন? আমি কি টাকা দিচ্ছি না আপনাদের? আমার কোনো দাম নেই? জানেন, আমার হাজব্যান্ড চাইলে আপনাদের এই পুরো বার কিনে নিতে পারে। আর আপনি আমাকে উঠতে বলছেন? এতো সাহস আপনার?”

কথাগুলো বলেই উষসী মিইয়ে গেল। হতাশ কণ্ঠে উচ্চারণ করল,” না, স্যরি। ভুল বলে ফেললাম। আমার তো হাজব্যান্ডই নেই। তাকে তো আমি ডিভোর্স দিয়েছি। ”

উষসী হেসে উঠল। কিন্তু তার চোখ দু’টো অশ্রুপূর্ণ। তীব্র বেদনায় জর্জরিত মুখ। সে আক্ষেপে ক্লিষ্ট কণ্ঠে বলল,” আমি এখন রাস্তার ফকির। আমার কোনো দাম নেই। আসলেই কোনো দাম নেই….” সে কথা শেষ না করেই ঝিমিয়ে পড়ল।

লোকটি আলতো স্বরে বলল,” স্যরি ম্যাম। আর কিছুক্ষণ পরেই ভোর হয়ে যাবে। কোনো মানুষও এখানে নেই। আপনার জন্য একা বসে থাকা রিস্কি। আপনি মেয়ে মানুষ দেখেই বলছি। ম্যাম?”

উষসী কোনো জবাব দিল না। পাশের টেবিলের একজন দীর্ঘকায় লোক অনেকক্ষণ ধরে উষসীর দিকে নজর রাখছে৷ তার দৃষ্টিতে লিপ্সা। হঠাৎ সে উঠে এসে উষসীর পাশে বসে গেল। পরিচালক লোকটি বলল,” স্যার, কি করছেন?”

দীর্ঘকায় লোকটি হাতের ইশারা করে বলল,” এখান থেকে যান। আমি উনাকে চিনি।” সে উষসীর পিঠের উপর হাত রাখতেই কেঁপে উঠল উষসী। অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল,” কে আপনি?”

” মনে হচ্ছে আপনার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। আমার সাথে চলুন। আমি আপনাকে ডলার দিবো। যত আপনি চান।”

” না, আমার গা থেকে হাত সরান। আমাকে টাচ করবেন না।”

উষসী তার দূর্বল বাহু দিয়ে লোকটিকে ধাক্কা দিল। দীর্ঘকায় লোকটি শক্ত করে চেপে ধরল উষসীকে। একপ্রকার জোর করেই তাকে নিজের সাথে উঠিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। অন্যান্য স্টাফরা ভয়ে কিছু বলছে না। লোকটিকে মাফিয়া ধরণের কেউ মনে হচ্ছে। তার কাছে ছু*রি-চা*কু থাকতেও পারে। কিন্তু পরিচালক বলল,” স্যার, এভাবে কনসেন্ট ছাড়া আপনি কাউকে ফোর্সফুলি নিয়ে যেতে পারেন না। আমরা কিন্তু পুলিশ কল করব।”

দীর্ঘকায় সেই লোক রক্তচক্ষু নিয়ে তাকাল। পরিচালক ভয়ে চুপসে গেল। অনম দূর থেকে সম্পূর্ণ ঘটনা দেখছে। সে ইয়ামিনকে একটা ফোন করল। ইয়ামিন উষসীর স্বামী। আর অনম তার এসিস্ট্যান্ট। অনমের প্রধান দায়িত্ব হলো উষসীর প্রতিটি পদক্ষেপ ইয়ামিনকে মেসেজ অথবা কলের মাধ্যমে জানানো। দিনের চব্বিশ ঘণ্টা সে উষসীর আশেপাশেই থাকে। আজ উষসী তার চোখে ধুলো দিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছে। তাকে খুঁজে পেতে সারারাত লেগে গেল।

” স্যার, ম্যাডামকে খুঁজে পাওয়া গেছে। একটা ফালতু লোক ম্যাডামের সাথে অসভ্যতা করার চেষ্টা করছে। আপনি দ্রুত এখানে আসুন স্যার। আমি আপনাকে এড্রেস টেক্সট করছি।”

ইয়ামিন আশেপাশেই ছিল। হন্যি হয়ে উষসীকে খুঁজছিল সে। বারে আসতে তার বেশি সময় লাগল না।

উষসী দীর্ঘকায় লোকটির উদ্দেশ্যে বলল,” ছাড়ুন, কোথায় নিচ্ছেন আমাকে? আমি আপনার সাথে যাবো না।”

” এতো নাটক করার কি আছে? মাঝরাতে কোনো ভালো মেয়ে এখানে আসে না। অযথা সতী সাজার চেষ্টা করো না।”

ইয়ামিন এই অবস্থা দেখে এগিয়ে গেল। লোকটির হাত উষসীর কোমরের উপর৷ এই দৃশ্য দেখে ইয়ামিন তার মেজাজ ঠিক রাখতে পারল না। টগবগ করে উঠল তার শরীরের র-ক্ত। তীব্র ক্রোধ নিয়ে সে লোকটিকে থাপ্পড় মা*রল কঠিন হাতে। মুহূর্তেই দীর্ঘকায় লোকটি তার বিশাল দেহ নিয়ে কয়েকটি চেয়ারসহ উল্টে পড়ল। একটা সরগরম পরিবেশের সৃষ্টি হয়ে গেল। স্টাফরা ভয়ে থম মেরে গেল। অনম লোকটির কলার চেপে ধরে বলল,” সাহস কিভাবে হলো তোর? আমাদের ম্যাডামের গায়ে হাত দেওয়ার? শা’লা!”

সে লোকটিকে লাথি মা-রতে শুরু করল। উষসী আবছা দৃষ্টিতে ইয়ামিনের চেহারা স্পষ্ট দেখতে পেল না। কেবল লম্বা অবয়ব লক্ষ্য করল। অভিমান মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,” এখানে আপনি কেন এসেছেন? আমি তো আপনাকে ডিভোর্স দিয়েছিলাম। আপনি আমার কেউ না। চলে যান এখান থেকে। যান।”

ইয়ামিন গম্ভীর কণ্ঠে বলল,” বাড়ি চলো উষসী। যথেষ্ট পাগলামি হয়েছে।”

” না, আমি যাবো না ওই বাড়িতে। আমাদের তো ডিভোর্স হয়ে গেছে। তাহলে আপনার বাড়িতে আমি কেন যাবো?”

” তোমার মুখের কথায় আমাদের ডিভোর্স হয়ে যাবে না। চুপচাপ বাড়ি চলো। নাহলে কিন্তু ওই লোকটার হাতে তুলে দেবো তোমাকে।”

উষসী ভয় পেয়ে বলল,” না।”

ইয়ামিন হাসল। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে রইল উষসী। তারপর হঠাৎ ঢলে পড়ল। ইয়ামিন কাছে এসে দুইহাতে জাপটে ধরল তার কোমল শরীর। পাজকোলে তুলে নিল।

অনম গাড়ি ড্রাইভ করছে। ইয়ামিন উষসীকে নিয়ে পেছনের সিটে বসেছে। গাড়ি চলছে ব্যস্ত রাস্তায়। উষসী পিটপিট করে তাকাচ্ছে আশেপাশে। তার বমি পাচ্ছে। মদ খাওয়ার বদভ্যাসটা কোনোদিন ছিল না। ইদানীং শুরু হয়েছে। গত এক সপ্তাহ ধরে উষসী প্রচুর ড্রিংক করছে।

ইয়ামিন বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল,” আর কখনও যাতে বাড়ির বাহিরে বের হতে না পারো সেজন্য তোমার পায়ে শে’কল পরাবো আমি।”

উষসী সহাস্যে জবাব দিল,” শি’কল দিয়ে কয়দিন আট’কে রাখবেন? যেখানে ভালোবাসা নেই সেখানে শি’কল দিয়ে বুঝি সম্পর্ক বেঁধে রাখা যায়?”

” কে বলেছে ভালোবাসা নেই?”

” আমি জানি।”

” ঠিকাছে মানলাম। আমার পক্ষ থেকে ভালোবাসা না থাকুক তোমার পক্ষ থেকে তো আছে। তুমি তো আমাকে ভালোবাসো। এটা নিশ্চয়ই মিথ্যে নয়?”

উষসীর ঠোঁটে ফুটে উঠল তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসি। প্রত্যেকবার এই কথার দ্বারাই ইয়ামিন তাকে ত’র্কে হারিয়ে দেয়। আর হারাবেই তো। উষসীর সবচেয়ে বড় দূর্বলতাটুকুই যে সে জেনে গেছে! নিজের বিশ বছরের জীবনে উষসী একটা ব্যাপার খুব ভালো ভাবে উপলব্ধি করেছে। কখনও কাউকে দূর্বলতার মাত্রা বুঝিয়ে দিতে নেই। কেউ যদি একবার বুঝে ফেলে কারো দূর্বলতা, তাহলে সেই দূর্বল জায়গায় বার-বার আঘা’ত করে মানুষটিকে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়। যেমনটা ইয়ামিন করছে। উষসী গাড়ির সিটে মাথা ঠেঁকালো। বুক চিরে বেরিয়ে আসছে ক্লান্তিময় দীর্ঘশ্বাস। চোখের কার্ণিশ ভরে আসছে দুঃখের জলে।

বাড়ি ফিরে উষসী সত্যি সত্যি একগাদা বমি করে ভাসালো। নোংরা জামা-কাপড় ছাড়তে গোসল করল। তারপর ভেজা চুল নিয়েই শুয়ে পড়ল বিছানায়। ইয়ামিন হেয়ার ড্রায়ার নিয়ে কাছে এলো। বিরক্ত কণ্ঠে বলল,” দিন দিন খুব কেয়ারলেস হয়ে যাচ্ছো তুমি। তোমার কি হয়েছে?”

” কি হয়েছে আপনি জানেন না বুঝি?”

উষসীর বিরস কণ্ঠ। ইয়ামিন লম্বা শ্বাস ছেড়ে বলল,” হ্যাঁ জানি। আর আমার মনে হয় তুমিও জানতে। আরও আগেই জানতে।”

” কি জানতাম আমি?”

ইয়ামিন নিষ্ঠুর কণ্ঠে বলল,” আমি তোমাকে কোনোদিন ভালোবাসিনি, এটা জানতে না আগে? কখনও কি নিজ মুখে বলেছি তোমাকে ভালোবাসার কথা? ”

উষসীর চোখ ছলছল করছে। গলার কাছে আট’কে এলো তীক্ষ্ণ ব্যথা। কেঁ’দে ফেলতে নিয়েও কাঁ’দল না। ইয়ামিনকে সে এতো বেশি ভালোবাসে সে তার এতটুকু প্র’ত্যাখ্যানও স’হ্য হয় না। সব সত্যি জানার পরেও এমন নিগূঢ় বাক্য ইয়ামিনের মুখে শুনলে কা’ন্না পেয়ে যায়। এখনও পাচ্ছে।

ইয়ামিন কঠোর ভঙ্গিতে বলল,”আমার এই মনে সবসময় শুধু উষ্ণতা ছিল। কখনোই তুমি ছিলে না। উষ্ণতার ব্যাপারটা তুমি জেনেছো মাত্র কিছুদিন আগে। আর আমি যে তোমাকে ভালোবাসি না, এটা তুমি জানো বিয়ের আগে থেকেই। তাহলে কি আমি ধরে নিবো উষ্ণতার জায়গায় অন্যকাউকে ভালোবাসলে তোমার অসুবিধা হতো না? আমার ভালোবাসার মেয়েটি উষ্ণতা হলো বলেই এতো সমস্যা তোমার?”

ইয়ামিন হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে উষসীর চুল শুকিয়ে দিচ্ছিল এতোক্ষণ। উষসী কথাটা শোনার পর তাকে থামানোর উদ্দেশ্যে হাত চেপে ধরল।

” পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে আপন মানুষ ছিল উষ্ণতা আপু। দ্বিতীয় আপন মানুষ ছিলেন আপনি। দু’জন একসঙ্গে প্র’তারণা করেছেন।”

” সেটাও তো তোমার ভালোর জন্যই।”

” এখানে আমার কিসের ভালো বলতে পারেন? কেন করেছেন আপনারা এমন? আমি তো কখনও বলিনি দয়া দেখিয়ে আমাকে বিয়ে করুন। কখনও বলেছিলাম আপনাকে? তাহলে কেন করলেন আমাকে বিয়ে?”

উষসী চেঁচিয়ে উঠল। ইয়ামিন কোমল স্বরে বলল,

” উষসী, প্লিজ শান্ত হও। রোজ রোজ একই বিষয় নিয়ে সিন ক্রিয়েট করছো তুমি। না নিজে শান্তি পাচ্ছো আর না আমাকে দিচ্ছো। কি লাভ এসব করে? আমি তো বলেছি, আমাকে একটু সময় দাও৷ সব ঠিক হয়ে যাবে।”

” কিভাবে ঠিক হবে সব? জো’র করে আমাকে ভালোবাসার চেষ্টা করবেন? করেছেন তো দুইবছর যাবৎ। কোনো লাভ হয়েছে? ভুলতে পেরেছেন উষ্ণতা আপুকে?”

ইয়ামিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্দেশ্যে আঙুল ঠেঁকালো উষসীর কোমল ঠোঁটে,” শশশ, এই বিষয়ে এখন আর একটাও কথা না। ঘুমাও।”

তারপর সে পরম স্নেহে চুমু এঁকে দিতে চাইল উষসীর কপালে। তখনি উষসী বাঁধ সেধে বলল,” না। আসবেন না।”

বিস্মিত হলো ইয়ামিন। আগে যে মেয়ে তার একটু স্পর্শের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতো এখন সেই নিষেধ করছে তাকে স্পর্শ করতে। ইয়ামিন কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করল,” কেন?”

” যে জিনিস আমার নয় সেই জিনিস আমি পেতেও চাই না।” উষসীর স্পষ্ট জবাব। ইয়ামিন স্বীকারোক্তি প্রদান করল,” আমি এখন তোমার উষসী।”

উষসী মানল না, ” উহুম। আপনি আমার না। শুধু শরীর দিয়েই কি ভালোবাসা প্রমাণ করা যায়? ভালোবাসতে মন দিতে হয়৷ যা আপনি আমাকে কোনোদিন দিতে পারবেন না।”

” তুমি কি চাও উষসী? কেন এমন করছো?”

” যা চাই তাই কি দিতে পারবেন আমাকে?”

ইয়ামিন ঢোক গিলে বলল,” আগে শুনি কি চাও?”

উষসীর কণ্ঠ ক্রমশ শীতল হয়ে এলো,” ডিভোর্স চাই। পারবেন দিতে? ”

ইয়ামিনের চোখে অবিশ্বাস খেলা করছে। কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল,” ওকে। তবে তাই হোক!”

উষসীকে নিজের বাহুডোর থেকে মুক্ত করে উঠে দাঁড়ালো ইয়ামিন।তারপর হনহন করে চলে গেল ঘরের বাইরে। হতাশ দৃষ্টিতে তার যাওয়ার পথে উষসী চেয়ে রইল নিষ্পলক। একদম স্থিরচিত্রের মতো বসে রইল অনেকটা সময়। তারপর হঠাৎ করেই কান্না পেল ভীষণ। মানুষটি কখনোই তাকে ভালোবাসবে না, আজ যেন তা আবার প্রমাণ হয়ে গেল। উষসী ঠিক করল সে সত্যিই ডিভোর্স নেবে। ইয়ামিনকে মুক্তি দেবে চিরকালের জন্য।

চলবে
🍁

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৭৯

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৭৯|
জেনেভাতে সকাল দশটা। হসপিটাল থেকে সুহৃদকে নিয়ে বাসায় ফিরল নামী৷ সঙ্গে অ্যালেন। সুহাস ফিরে গেছে হোটেলে। লম্বা একটি শাওয়ার নিয়ে চটজলদি ছেলের কাছে ফিরবে। এদিকে সৌধর মন বিচলিত হয়ে আছে খুব৷ পরশু রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেছিল সে৷ সিমরানকে নিয়ে। তীব্র জ্বরে বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে সিমরান। সুশ্রী মুখটা বিবর্ণা। সুগঠিত দেহে করুণ ভাঙন। যে রূপে অর্ধাঙ্গিনীকে দেখে ঘুমের ঘোরেই হৃৎস্পন্দন থেমে গিয়েছিল সৌধর। হাসফাস করতে করতে ঘুম ভেঙে বসেছিল সটান৷ উদ্ভ্রান্তের মতো ফোন করেছিল বউকে। সে কী আবেগঘন মুহুর্ত!

সুহাস শাওয়ার নিয়ে রুমে এলো। দেখল চিন্তিত মুখে বসে আছে সৌধ। ঘড়ি দেখছে বারবার। ঘড়ির কাঁটা নির্দিষ্ট একটি সময়ে গেলেই ফোন করবে সিনুকে। জানে সুহাস। তাই মলিন মুখে মৃদু হাসি টেনে বলল,

‘ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট করে নে সৌধ। আমি বেরুবো।’

গায়ে শার্ট চাপাতে চাপাতে কথাটা বলল সুহাস৷ সৌধ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। চিন্তিত ভঙ্গিতে এসে দাঁড়াল সুহাসের সম্মুখে। দু-হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল সুহাসের কাঁধের দু’পাশ। এরপর ঠোঁটে অল্পখানি হাসি টেনে বলল,

‘ বউ, বাচ্চার পাশে থাক। আগলে রাখ ওদের। এতদূর এসে বিফল হয়ে যেন ফিরতে না হয়। ‘

বন্ধুর কথায় স্মিত হাসল সুহাস৷ দৃষ্টি দৃঢ় করে তাকাল সৌধর মুখপানে। বলল,

‘ টেনশনে আছিস মনে হচ্ছে? কাকে নিয়ে টেনশন করছিস সুহৃদ না সিনু? ‘

মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল সৌধর৷ সুহাসকে ছেড়ে সরে দাঁড়াল। দু’টো হাত পকেটে গুঁজে দিয়ে বুক টানটান করে শ্বাস নিল। অন্যরকম গলায় বলল,

‘ পরশু সিনুকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম। মনটা অশান্ত ছিল। এখন সুহৃদের এই বিপদ স্বপ্নটাকে ভাবাচ্ছে নতুন করে। ‘

ভ্রু কুঁচকে গেল সুহাসের। আশ্চর্য হয়ে এসে দাঁড়াল সৌধর সামনে৷ বলল,

‘ কিরে ভাইই, আজকাল তুইও দুঃস্বপ্ন টুঃস্বপ্ন মানিস? ‘

সম্বিৎ ফিরে পেল যেন সৌধ। সত্যি তো! এমনটা সত্যি তার ব্যক্তিত্বে যায় না। তবু কেন এত অস্থির অস্থির লাগছে? বিষয়টা সিনুকেন্দ্রিক তাই কী?
নিজের ভেতরে চলা অশান্তি আর চেপে রাখতে পারল না সৌধ। অন্যমনস্ক হয়ে বলে ফেলল,

‘ সিনুকে নিয়ে আমার এত ভয় লাগছে কেনরে সুহাস? ডোন্ট মাইন্ড ব্রো। কিন্তু কথাটা না বলে থাকতে পারছি না। নিধি আমার জীবন থেকে চলে যাওয়ার পর যে অনুভূতিটা হয়েছিল। সেই অনুভূতিটাই যেন আরো গভীর হয়ে দানা বেঁধেছে বুকে। এমনটা কেন লাগছে সুহাস? সিনু তো আমারি বল। তবু কেন এই ফিলিংসে অসহনীয় হয়ে উঠছি আমি? ‘

আকস্মিক বুক কেঁপে উঠল সুহাসের। পরোক্ষণেই আবার স্বাভাবিক হয়ে বলল,

‘ আ’ম সিয়র সিনুর প্রতি এতদিন তোর ভালোবাসা টালোবাসা কিচ্ছু ছিল না৷ এখন দূরে এসে ওকে মিস করছিস। ভালোবাসাও তৈরি হয়ে যাচ্ছে ওর জন্য। ‘

সুহাসের বোকা বোকা মন্তব্যে নিমেষে পরিবেশ বদলে গেল। সৌধ চোখ দু’টো ছোটো ছোটো করে বিড়বিড় করে বলল,

‘ আসছে আমার বুদ্ধিজীবী। ‘

সুহাস বলল,

‘ কিছু বললি? ‘

‘ না, বুঝলাম। ‘

‘ কী? ‘

‘ তুই বুঝবি না। ‘

‘ দূর শা’লা। ‘

‘ আমি তোর শা’লা নাকি তুই আমার। ‘

আচমকা সৌধর কলার চেপে ধরল সুহাস। খোঁচা দিয়ে বলল,

‘ তোর বউয়ের বড়ো ভাই আমি। সম্মান দিয়ে কথা বল। ‘

একই ভঙ্গিতে সৌধও কলার টেনে ধরল ওর। দর্পের সঙ্গে বলল,

‘বোন জামাইয়ের সঙ্গে মেপেঝেপে কথা বলতে হয় বুঝলেন আমার বউয়ের ভাই?’
.
.
বৃহস্পতিবারের গোধূলি বিকেল। ননদ, ভাবি মিলে ব্যাডমিন্টন খেলায় মগ্ন। দীর্ঘদিন বাবার বাড়ি থাকার পর গতকাল শশুর বাড়িতে এসেছে সিমরান। শাশুড়ি আর দাদি শাশুড়িকে সময় দিয়েছে বেশ। এবার ননদের সঙ্গে বিকেলটা উপভোগ করার জন্য বাড়ির সামনে লনে ব্যাডমিন্টন খেলছে৷ বাড়ির ভেতর থেকে তখন ঝুমায়না ওর ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে এলো। সিমরান আর তাহানীকে দেখে গা জ্বলে উঠল খুব। সে বাংলাদেশে এসেছিল খুবই অল্প সময়ের জন্য। কিন্তু অল্প সময়টা দীর্ঘ হয়ে উঠল শুধুমাত্র জায়ের প্রতি তীব্র ঈর্ষা থেকে। এতদিন এ সংসারে একমাত্র বউ সে ছিল। এখন এসেছে আরেকজন। অল্প সময়েই মেয়েটা সবার মন জয় করে নিয়েছে। এ বাড়িতে ঝুমায়নার নাম কেউ একবার নিলে সিনুর নাম নেয় দশবার। এতদিন সিমরান বাবার বাড়িতে ছিল। উঠতে, বসতে সকলে এতভাবে সিনু সিনু করেছে, যে ঝুমায়নার ঈর্ষা প্রগাঢ়ত্বে রূপ নিয়েছে। শশুর বাড়িতে না থেকে, সংসারে মন না দিয়ে সে কতবড়ো ভুল করেছে। এবার হারে হারে টের পাচ্ছে। বরাবরের মতো এবার তাই অতিথির মতো এসেই চলে যায়নি। নিজের জায়গা, নিজের অধিকার বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এ বাড়ির বড়ো বউ সে অথচ সবকিছুতে আধিপত্য থাকবে দুদিন আসা সিমরানের? এমনটা কক্ষনো হতে দেবে না৷ তাই স্বামী সৌরভ কানাডা চলে গেলেও ছেলেকে নিয়ে সে একাই থেকে গেছে বাংলাদেশে৷

সুশ্রী, প্রান চঞ্চল মেয়ে সিমরান। এ বাড়ির সুখী বধূ৷
ছেলেকে নিয়ে হাঁটছিল ঝুমায়না৷ আর তাকিয়ে দেখছিল দেবরের বউকে। ভাবছিল তাকে ঘিরে নানাবিধ ভাবনা। হঠাৎ খেলা থেমে গেল ওদের। তাহানী ছুটে গিয়ে পানির বোতল নিয়ে এলো। সিমরান কপাল আর মুখের ঘাম মুছে পানি খেল। খেলায় বিরতি দিল ওরা। তাহানী গিয়ে ধরল সুরের হাত। ঝুমায়না কিছু বলল না। বরং তাহানীর কাছে ছেড়ে দিল ছেলেকে। এরপর সে গেল সিমরানের কাছে। লনের একপাশে বেঞ্চিতে ক্লান্ত সিমরান বসেছে মাত্র। পরনে জিন্স প্যান্টের সাথে সূতি গাউন। গাউনের একপাশে পকেট সিস্টেম। পকেট থেকে সেলফোন বের করে ক্লান্ত মুখে কয়েকটা সেলফি তুলছিল। এমন সময় ঝুমায়না এসে বসল পাশে। বলল,

‘ কী খবর সিনু? সৌধ আসবে কবে? ‘

মন থেকে ঝুমায়নাকে একটুও পছন্দ করে না সিমরান। সেই তিক্ত মুহুর্তটুকু আজো তার মন থেকে মুছে যায়নি। যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে এই মানুষটাকে। ঝুমায়নাও যে তাকে পছন্দ করে না। জানে সে। তাই আজ হঠাৎ আগ বাড়িয়ে কথা বলতে আসাতে অবাক হলো। মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলল,

‘ খবর ভালো ভাবি৷ সৌধ ছুটি শেষ হতে হতেই এসে যাবে। ‘

সৌধভাই থেকে শুধু সৌধ সম্বোধন। স্বামী, স্ত্রীর সম্পর্কের গাঢ়ত্ব নিয়ে সংশয় থাকে না৷ ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল ঝুমায়না। প্রশ্ন করল,

‘ তোমার ভাবি আসবে? ‘

‘ হুম, আসবে। ‘

আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠস্বর। সিমরানের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ঝুমায়না খেয়াল করল, বিয়ের সময়ের সিমরান আর এই সিমরানে বিস্তর ফারাক। মেয়েটা তখন কেমন স্বাস্থ্যহীন ছিল। এখন স্বাস্থ্য ঘুরেছে। পরিপূর্ণা যুবতী দেহ। আলাদা এক সুবাস ছড়ানো সর্বাঙ্গে। চোখে লাগার মতো উদ্ভাসিতা। মুখশ্রী, দেহের গড়ন, স্মার্টনেস। সবকিছু মিলিয়ে এই মেয়েটা ঈর্ষা করার মতোই। নিঃসন্দেহে তার প্রতিদ্বন্দ্বী। আপাদমস্তক সিমরানকে এমনভাবে দেখছিল আর ভাবনায় মশগুল ছিল ঝুমায়না যে সিমরান অস্বস্তি অনুভব করল। তার অস্বস্তি টের পেয়ে ঝুমায়না বলল,

‘ তুমি কিন্তু বেশ সাহসী। আমি বাইরের দেশে, বাইরের কালচারে বড়ো হয়েই এ বাড়িতে জিন্স পরার কথা ভাবতে পারি না। ‘

খোঁচাটা টের পেল সিমরান৷ তাই বলল,

‘ আমি আগে থেকেই কেয়ার করি না টাইপের মেয়ে ভাবি৷ তবে শশুর বাড়ির সবাইকে রেসপেক্ট করি৷ সবার পছন্দকে গুরুত্বও দিই। তাছাড়া আমি জিন্স পরব না পাজামা পরব এটা ফ্যাক্ট না। আমি কতটা শালীনতা মেইনটেইন করব এটাই ফ্যাক্ট। এই মেইনটেইন শুধু এ বাড়িতে করি না। সব জায়গাতেই করি। ‘

এমন স্পষ্ট সত্য, সরাসরি উত্তর পছন্দ করল না ঝুমায়না। এ যেন সৌধর ফিমেল ভার্সন তার ঈর্ষান্বিতা মনকে দুমড়েমুচড়ে দিল। পরোক্ষণেই সামলে নিল নিজেকে। বলল,

‘ ঠিকই বলেছ। ওই দাদুনি এসব পছন্দ করে না তো। সেই বলল, সৌধর বউ ব্যাটাছেলেদের মতো কী সব পরে। লাফিয়ে লাফিয়ে খেলাধুলা করে। বাড়ির বউ তো নয় যেন উড়নচণ্ডী। ‘

মহা অবাক ভঙ্গিতে সিমরান গালে হাত রাখল। বলল,

‘ তাই, দাদুনি বলল এটা? ‘

ঝুমায়না মাথা দুলালো। সিমরান মুচকি হেসে বলল,

‘ শশুর বাড়িতে সবাই ভালোবাসা, আদর দিলে জমে না ভাবি। এক দুইজন শাসন করবে, বাঁকা চোখে তাকাবে। খোঁচা মেরে কথা বলবে, হিংসেই জ্বলেপুড়ে নিজের আগুনে পুড়াতে আসবে। তবেই না শশুর বাড়ি, শশুর বাড়ি ফিলিংস হবে। আমার তো বেশ ভালোই লাগে এসব। ভেরি এঞ্জয়েবল। ‘

অপমানে মুখ থমথমে হয়ে গেল ঝুমায়নার। নিমেষে ফোন বেজে উঠল সিমরানের। স্ক্রিনে ভেসে উঠল টগবগে যুবক সৌধ চৌধুরীর ছবি৷ ঝুমায়না উঠে পড়ল ত্বরিত। সিমরান ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সৌধ বলল,

‘ কী করা হচ্ছে মিসেস? ‘

‘ ব্যাডমিন্টন খেলছিলাম। এখন রেস্ট নিচ্ছি। তুমি কী করছ? সুহৃদ কোথায় আজ যাওনি ওর কাছে। ‘

সুহৃদের অ্যাকসিডেন্টের বিষয়েটা কেউ জানায়নি সিমরানকে। অযথা মন খারাপ করবে। দুঃখে হয়তো কেঁদেও ফেলবে। তাই সৌধ বলল,

‘ না যাইনি। সুহাস গেছে। ওরা ওদের মতো সময় কাটাক এখন। তুমিও ফোন টোন করো না। একা ছেড়ে দাও। ওরা ওদের মতো থাকুক৷ ভুল বুঝাবুঝি, দূরত্ব মিটিয়ে নিক। তারপরই ফেরার পালা। ‘

সৌধ কথা বলছিল। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে ছিল সিমরান। সুহৃদের প্রসঙ্গ আপনাআপনিই বদলে গেল। ওরা তাকিয়ে ছিল দু’জন দু’জনের পানে। হঠাৎ লজ্জায় আরক্ত হয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিল সিমরান। উঠে হাঁটতে হাঁটতে বলল,

‘ জানো ফারাহপুকে আচার করে পাঠিয়েছি আমি। তোমার জন্যও রেখেছি। কবে আসবে বলো তো? ‘

একটু মরিয়া স্বর। সৌধ বুঝল তা। নির্নিমেষে তাকিয়ে নিজের আকুলতা গোপন করল। এরপর জিজ্ঞেস করল,

‘ খুব শিঘ্রই আসব। কিন্তু বউটির জন্য কী নিয়ে আসব ভেবে পাচ্ছি না। ‘

লাজুক ভঙ্গিতে মৃদুস্বরে সিমরান জবাব দিল,

‘ বর এলেই চলবে আর কিচ্ছু চাই না। ‘

নিঃশব্দে হাসল সৌধও। বলল,

‘ কিছু তো লাগবেই। কী লাগবে বলো। ‘

আকস্মিক আশপাশে তাকিয়ে চুপিচুপি সিমরান বলল,

‘ কিছু লাগবে নিশ্চয়ই। সেটা ওদেশ থেকে আনতে হবে না৷ তুমি এসো তারপর নিয়ে নিব। ‘

দৃষ্টি গাঢ় করল সৌধ। কৌতূহলে ভরপুর। সিমরান সে গাঢ়তা মিশানো কৌতূহল দেখে তীব্র লজ্জায় পড়ল। শীতল প্রকৃতিতে উষ্ণ পরিস্থিতি বদলাতে বলল,

‘ শোনো? ‘

‘ ইয়েস? ‘

‘ এক বাক্স বরফ টুকরো এনো। ‘

‘ বরফ? কী হবে তা দিয়ে? ‘

‘ বরফস্নান করব। ‘

শব্দ করে হেসে ফেলল সৌধ। লাজুকতা ভরে মৃদু হাসিতে টলমল হয়ে রইল সিমরানও। একটুখানি দূরে ঝুমায়না দাঁড়িয়ে। বকুলফুল গাছের পানে তাকিয়ে। শুনছিল সিমরান, সৌধর কথোপকথন। এত সুখ, আহ্লাদের কথা শুনে মুখ ভেঙচাল। বিড়বিড় করে বলল,

‘ ন্যাকা বউয়ের সঙ্গে থেকে থেকে এই সৌরভের ভাইটাও ন্যাকা হয়ে উঠছে দেখি! ‘

ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে প্রতিটি মানুষই নিষ্পাপ, বাচ্চাসুলভ হয়ে যায়৷ এই সুন্দর, মিষ্টি, আদুরে অনুভূতি কি ঝুমায়নারা বুঝে?
.
.
কে’টে গেল বেশকিছু দিন৷ আজ সুহৃদের সেলাই কা’টা হয়েছে। কান্নাকাটি করেছে খুব। বাবা, মা মিলে আগলে রেখেছে সম্পূর্ণ সময়। ছেলে সামলাতে গিয়ে নাওয়াখাওয়া হয়নি কারো। দুপুর পরে সুহৃদ ঘুমালো। বাবার বুকে। সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে ছেলেকে ঘুম পাড়িয়েছে সুহাস৷ নামীও নিজের সব কাজ ফেলে সুহাসের পিছু পিছু ঘুরেছে। না জানি কখন তার প্রয়োজন পড়ে৷ কিন্তু নাহ। প্রয়োজন পড়েনি মায়ের। বাবাই সামলে নিয়েছে। তাই সে গিয়ে বিছানা ঠিকঠাক করল। সুহাস এসে শুইয়ে দিল সুহৃদকে। নামীকে বলল,

‘ ফ্রেশ হয়ে নাও। লম্বা সময় ঘুমাবে এখন। ‘

নামী সম্মতি দিয়ে প্রশ্ন করল,

‘ তোমার খিদে পেয়েছে তো? তুমিও ফ্রেশ হয়ে নাও। খেতে দিচ্ছি। ‘

‘ দরকার নেই। আমি রিসোর্টে ফিরে খেয়ে নিব। ‘

এই নিয়ে কতবার যে ব্যর্থ হলো নামী। সুহৃদ অসুস্থ হয়েছে অবধি সারাদিন সুহাস এখানে থাকে। কখনো মধ্যরাতও হয়ে যায়। বাচ্চাটার অভ্যেস খারাপ হয়ে গেছে। বাবা ভক্ত হয়েছে ভীষণ। না ঘুমোনো পর্যন্ত সুহাস যেতে পারে না৷ চোখের সামনে চলে গেলে কান্নাকাটি করে। অমন কাঁদিয়ে যেতে কষ্ট হয় সুহাসের৷ নামীরও খারাপ লাগে সুহৃদ এভাবে কাঁদলে। মূলত বাচ্চার কারণেই এখন দীর্ঘসময় থাকতে হয়। নিজের কাছে নিয়ে রাখলে নির্দিষ্ট একটা সময় পর আবার মায়ের জন্য কাঁদে। তাই দু’জন মিলেমিশেই সময় দিচ্ছে বেবিকে। কিন্তু সুহাস এ বাড়িতে একবেলাও খাবার খায় না৷ রাতে থাকেও না৷ মধ্যরাত হোক তবু ফিরে যায়। বিশেষ জোর করে না নামীও৷ সে সম্পূর্ণভাবে সুহাসকে গ্রহণ করেনি বলেই হয়তো এখানে থাকতে, খেতে আত্মসম্মানে লাগে সুহাসের। দীর্ঘশ্বাস ফেলল নামী। চলে গেল ফ্রেশ হতে৷ কেন জানি নিজেরও খেতে ইচ্ছে করল না। অ্যালেনের স্ত্রী উইরা খেয়াল করল বিষয়টা। লাঞ্চ করবে কিনা জিজ্ঞেস করলে মিথ্যা বলে দিল,

‘ আমরা বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি। ‘
.
অন্যদিনের তুলনায় আজ তাড়াতাড়িই চলে গেল সুহাস৷ সুহৃদ ঘুম থেকে উঠে মায়ের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছিল। কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকে কী হলো কে জানে? কান্নাকাটি শুরু করল। অ্যালেন এসে থামাল একবার। ঘুরল বাড়িজুড়ে। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে আবার কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেল। রাত বাড়ল। ঘুম থেকে একবার উঠল সুহৃদ। নামী রাতের খাবার তৈরি করে চেষ্টা করল খাওয়াতে। একবার মুখে দিয়ে ফেলে দিল। বিরক্ত হলো নামী। একটু ধমক দিল। ঠোঁট উল্টে কেঁদে ফেলল ছেলেটা। অভিমান করে দূরে বসে রইল নামী৷ কিছুক্ষণ পর অভিমান সরিয়ে কাছে টেনে নিল বুকের ধনকে। শরীরটা নরম, ঈষৎ উষ্ণ। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই উষ্ণতা বৃদ্ধি পেল। থার্মোমিটারে জ্বর মেপে দেখল, ১০১ ডিগ্রি। চমকে উঠল মায়ের মন। এসব কেন হচ্ছে? এত ধকল যাচ্ছে কেন বাচ্চাটার ওপর? মনটা অশান্ত হয়ে উঠল খুব৷ সৃষ্টিকর্তা কেন বারবার তার মাতৃহৃদয়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে? এ কিসের ইঙ্গিত? বুকের মাঝে ছেলেকে জড়িয়ে মোবাইল ফোন হাতে নিল নামী। কল করল সুহাসকে। জেনেভায় সময় তখন রাত বারোটা পঁয়ত্রিশ মিনিট৷ দুই বন্ধু সন্ধ্যায় বেরিয়েছিল। ফিরেছে এগারোটার দিকে। ঘুমানোর উদ্দেশ্যে বিছানায় এসেছে বারোটায়। অর্থাৎ এখন সবে চোখ লেগেছে ওদের। এমন সময় ফোন বেজে উঠতেই চমকে চোখ খুলল সুহাস। সৌধ নড়েচড়ে ফিরে তাকাল। স্ক্রিনে নামীর নাম দেখেই সটান উঠে বসল সুহাস। বুকটা ধক করে উঠেছে নাম দেখেই। সামান্য কাঁপল হাতটাও৷ শুকনো একটা ঢোক গিলে ফোন রিসিভ করতেই নামী রুদ্ধশ্বাসে বলল,

‘ সুহৃদের জ্বর এসেছে। একবার আসতে পারবে? ‘

‘ এক্ষুনি আসছি। ‘

বলেই ফোন কেটে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল সুহাস। এপাশে স্থবির হয়ে গেল নামী। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এমন ছেলেমানুষী সে কেন করে ফেলল? সুহৃদের জ্বর হয়েছে। সে কি একা সামলাতে পারত না? তবে কেন এতটা ভেঙে পড়ল? কেন এভাবে সঙ্গ চাইল ওই মানুষটার? পরোক্ষণেই নিজেকে করা প্রশ্ন গুলোর উত্তর নিজেই দিল, আর কত রাগ, জেদ ধরে থাকবে? এভাবে সত্যি দম বন্ধ লাগছে। এবার একটু হাঁপ ছাড়া উচিত। বাঁচা উচিত মুক্ত শ্বাসে। এভাবে ক্লান্ত লাগছে। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে।

সুহাস এসে দেখল, নামীর মুখ বিধ্বস্ত। কান্না করেছে টের পেল। সুহৃদের জ্বর মাপল নিজহাতে। কী মেডিসিন দিয়েছে দেখে নিল একবার। এরপর ডাক্তার বাবা, মা মিলে এফোর্ট দিয়ে বাচ্চার জ্বর কমাতে সফল হলো। ঘড়িতে সময় তখন তিনটা বিয়াল্লিশ মিনিট। জ্বর ছাড়ার পর বাবার বুকে খচমচ করছিল সুহৃদ। নামী পাশেই শোয়া। টের পেল মায়ের বুক খুঁজছে। তাই হাত বাড়াল। সুহাস আলতোভাবে ছেলেকে তার কাছে দিলে সে মৃদুস্বরে বলল ওপাশ ফিরো। বুঝে উঠল না সুহাস৷ নামী দ্বিতীয়বার বোঝালও না৷ ছেলেকে কৌশলে নিজের বা’পাশে নিয়ে সে নিজেই পিছু ফিরল। দীর্ঘক্ষণ পর মায়ের দুগ্ধপানে শান্ত হলো সুহৃদ। সুহাস স্তব্ধ দৃষ্টিতে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে রইল ওদিকে। পুরো বিষয়টা বুঝে নিয়ে হাসল কিঞ্চিৎ। বুকের ভেতর জেগে উঠল অদ্ভুত এক শিহরণ। অচেনা এক আনন্দ ভরে উঠল মন। আলগোছে চিত হলো সে। চোখ বুজে শ্বাস টানল বড়ো করে। ঠোঁটে লেগে রইল অমায়িক এক হাসি।

সুহৃদ ঘুমিয়ে গেলে আবার সুহাসের দিকে ফিরল নামী। সুহৃদকে মাঝখানে শুইয়ে দিয়ে গায়ের উপর কম্বল টেনে দিল। ছেলের পানে স্নেহভরে তাকিয়ে সুহাস বলল,

‘ তুমিও ঘুমাও এবার। সারারাত ধকল গেছে খুব। ‘

কথাটা বলে উঠতে উদ্যত হলে গম্ভীর কণ্ঠে নামী বলল,

‘ উঠছ কেন? তোমারও ঘুম প্রয়োজন। ‘

চোখে বিস্ময় খেলে গেল সুহাসের। এ প্রথম একসঙ্গে ঘুমানোর ইশারা করল নামী। প্রশ্ন করল,

‘ সিয়র? ‘

‘ মাইকিং করে বলতে পারব বা। ‘

কথাটা বলেই গায়ে ভালো করে কম্বল চেপে চোখ বুজল নামী। সুহাস মৃদু হাসতে হাসতে সুহৃদের সঙ্গে ঘেঁষে শুয়ে রইল। সময় গড়াল। ভারী নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করল নামী। সুহাস বুঝল বউ বাচ্চা দু’টিই গভীর ঘুমে তলিয়ে। সুযোগ পেয়ে একটুও অপেক্ষা করল না। মুখ বাড়িয়ে বউয়ের কপালে আলতো এক চুম্বন করল। বলিষ্ঠ, লম্বা হাতটি দিয়ে আগলে ধরে সুখের ঘুম ঘুমালো সে নিজেও। অথচ টের পেল না। অনাকাঙ্ক্ষিত এই মুহুর্তটুকুর সুখে বদ্ধ চোখ বেয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে নামীর।
.
.
ভোরবেলা। ফোনের শব্দে ঘুম ছেড়ে গেল সৌধর। নাম না দেখেই রিসিভ করল। ভেবেছিল, সিনুর ফোন৷ কিন্তু ওপাশ থেকে ক্রন্দনরত কণ্ঠ ভেসে এলো। আশ্চর্য! সিনু নয়। কণ্ঠের মালিককে চিনতে পেরে মস্তিষ্কে ঝংকার দিয়ে ঘুম ছেড়ে গেল। মুখে অস্ফুটে উচ্চারণ করল,

‘নিধি!’

চলবে!
®জান্নাতুল নাঈমা।

রৌদ্র মেঘের জুড়ি পর্ব-১৬ এবং শেষ পর্ব

0

#রৌদ্র_মেঘের_জুড়ি(সমাপ্ত পর্ব)

দরজা খুলে দিতেই মৈএী অবক হয়ে যায়। মিজানুর, রাবেয়া,ময়নুল,মজনু, মুহিব, মোহ, সুমনা সহ দাঁড়িয়ে আছে। সবার মুখেই হাসিঁর ছোঁয়া লেগে আছে। সেই যে মুহিব আর মোহন মৈএীকে এখানে অনলের সাথে রেখে গেলো এরপর আর ভাইদের, বাবাকে দেখেনি মৈএী যদও কলে যোগাযোগ রাখতো মৈএী কার কাছে আগে যাবে?ভাইদের কাছে নাকি বাবার কাছে? নাকি সুমনা আর রাবেয়ার কাছে।
মিজানুর এগিয়ে এলেন মৈএীকে বুকে নিয়ে কপালে চুমুঁ আকঁলেন। তার মেয়ে।

বাবা কেমন আছো তুমি?এতো শুকিয়ে গেলে কেন?খাওয়া দাওয়া করতেনা নিশ্চয়ই? ভাবীর একটা কথাও নাকি তুমি শুনতে না?এরকম অবহেলা করলে কেন আমার ছেলের সাথে?তোমার একবার ও মনে হলো না? তোমার মা তোমায় নিয়ে কত চিন্তায় থাকে?

মিজানুর এর চোখ ভিজেঁ ওঠে সত্যই লোকের মুখের কথা নয় এটা মেয়েরা আসলেই বাবা দের কে মায়ের ভালো বাসা দেয়।

মিজানুর মৈএীর মাথায় হাত রেখে বলেন ,
আমার কলিজার মা ছাড়া আমি কিভাবে ভালো থাকি?ছেলেরা কি মায়ের থেকে দূরে ভালো থাকতে পারে?তাই তো সবাই চলে এলাম।

খুব ভালো করেছো বাবা।

মুহিব অনলকে কল করে বাসায় আসরে বলে আজ আর ক্লাস করাতে হবে না।অনল ও চলে আসে। সবার সাথে ভাব বিনিময় করে নেয়। রাবেয়া আর সুমনা এগিয়ে এসে মৈএীর সাথে গল্প জুড়ে দেয়।

দুপুরের দিকে মৈএীর সাথে ওরা দুজনে কিচেন সামলায়। কত রকমের রান্না শিখেছে মৈএী অনলের থেকে তার সব ভাই ও বাবার জন্য রান্না করে ফেলে।
খাবার টেবিলে সকলেই এক সাথে বসে।
মিজানুর বলেন,

মৈএী, অনল…আমরা আসলে তোমাদের বিয়ের নেমন্তন্ন করতে এসেছি।

বিয়ে? কার বাবা?

অনলের প্রশ্নে ময়নুল বলে,
এক সাথে তিনটে বিয়ে হবে অনল!কার বিয়ে বলবো?

অনলের সাথে সাথে মৈএীও অবাক হয়। এত কার বিয়ে?
রাবেয়া বলে,
তুমি তো মৈএী চারটে বিয়ের নেমন্তন্ন পাবে! তোমার তিন ভাই ও এক মাত্র বান্ধুবীর বিয়ে।

কি??

হ্যাঁ। মজনু,মুহিব আর মোহনের বিয়ে।

আমাকে ছাড়াই তোমরা ভাইয়াদের বিয়ে ঠিক করে ফেললে?

নারে মা!তুই আর অনল আজকে যাবি আমাদের সাথে। আমরা মেয়ের বাসাতে গিয়ে দিন তারিখ দিয়ে আসবো।

অনল বলে , মজনু ভাইয়া কি ওই পাঠানদের বাসার মেয়ের সাথে বিয়ে করবে?

হ্যাঁ।
আমি দেখেছি মেয়ে সুন্দরী। এছাড়া আমরাও চাই এই শত্রুতার শেষ হোক যদি বিয়ে দিয়ে হিয় তাহলে তাই হোক ওদের মেয়ে আমাদের বাসায় আসবে আমাদের ছেলের বউ হয়ে। এছাড়া মজনুর ও সম্মতি রয়েছে।

ওহ ভাইয়া রাজি থাকলে তো আর কোনো সমস্যা নেই।

হ্যাঁ।

বিকেলে অনল শশুড় এর সাথেই চলে আসে। একটু পরেই মৈএীকে ও অনলকে সাথে নিয়ে মিজানুর ও ময়নুল রাবেয়া চলে আসে পাঠান বাড়িতে।
কথা বার্তা বলে দিন ঠিক করে নেয়।

সামনে শুক্রবারেই তিন ভাইয়ের বিয়ে হবে। ছয় দিন সময় আছে মাত্র। এর মাঝেই সব কাজ ঠিক করতে হবে। অনলকে দিয়ে মৈএী গ্রাম থেকে শাশুড়ী কে নিয়ে আসে। মৈএীকে ছেলের বউ হিসেবে পেয়ে উনিও খুব খুশি। বড় লোকের মেয়ে হলেই যে বউ কথার বাউরে যাবে বা অশান্তি নিয়ে আসবে এরকক নয়। ভালোবাসাই সবার উপরে।
অনল ও লহুব সহজেই সবার সাথে মিশে যেতে শুরু করে। মোহন বা মুহিবের উপর কখনোই রাগান্বিত হয়নি অথচ ওরা কি আ*ঘাত ই না করেছিলো অনলকে।

অনল মৈএীকে দেখে দিন দিন ভালোবাসার পরিমান বাড়িয়ে দেয় এই মেয়েটা কিভাবে অনলকে ভালো বাসে কত ভাবে ভালো বাসে ভাবলেই অনলের বুক কেঁপে ওঠে। একটু অসুস্থতা দেখা দিলেই মৈএী অস্থির হয়ে পরে। অনলের ছোটে বাসাতেও নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে কত দারুণ ভাবে। আবার অনল যদি সামান্য কারণে ও চুপ করে থাকে মৈএীর উপর অভিমান করে তাহলে মেয়েটা কান্নাঁ করতে করতে সমুদ্র বানিয়ে ফেলে। এই তো সেদিন অনল কলেজ থেকে একটু লেট করে বাসায় ফেরে…..
দরজা খুলেই মৈএী অনলের বুকেঁ ঝাপিয়ে পরে… কান্নাঁ ভেজা গলায় বলে,

আজ এতো সময় লাগলো কেন অনল?আমি কত ভয় পেয়েছিলাম তুমি জান? তুমি একদম আমার কথা ভাবো না অনল…. তুমি একটুও ভালো না একবার ও মনে হয়নি আমার কথা?

অনল মনে মনে হাসে মেয়েটা তাকে নিয়ে আসলেই নানা রকম চিন্তা করে। অনলের ইচ্ছে করে মৈএীকে জাদু দিয়ে ছোটে বানিয়ে পকেটে নিয়ে ঘুরতে।
অনল মৈএীর সাথে ফাজলামো করতেই বলে,

মনে পরবে কি করে?কলেজ এ আমার জন্য কত মেয়েরা প্রেম প্রস্তাব দেয় প্রতিদিন তুমি জানো?
নুসরাত তো আজকেও আমাকে….

মৈএী নুসরাত ম্যামের কথা শুনেই অনলের বুক থেকে মাথা তুলে কঠিন গলায় বলে,
ওই ম্যামকে আমি তো খু**নই করে ফেলবো…. সব সময় আমার অনলের দিকে নজর দেওয়া বের করবো……..

অনল হেসে ফেলে মৈএীর কথা শুনে এরপর আবার বলে,

তুমি জানো মৈএী রেবেকা ম্যাম ও আমার সাথে খুব সুন্দর করে কথা বলে আজকাল।

মৈএী এবার বোম হয়ে যায় জ্বলন্ত চোখে বলে,
ওটারও একটা ব্যাবস্থা করবো আমি আজকেই বাবা কে কল করে বলবো….. তোমার আর কলেজ যেতে হবে না…..
আমি আজকেই বাবাকে বলে অন্য কলেজ এ জয়েন করতে বলবো…..
আর তুমি ও কেন কথা বলবে নুসরাত চু*ন্নির সাথে?
অনলকে ধমকাতে ধমকাতেই কান্নাঁ করে ফেলে মৈএী… অনল এবার মৈএীকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে দরজা লক করে মৈএীর কপালে চু*মু আকে ও বলে,

আমি তো তোমারই আছি মৈএী! কেউ আমাকে তোমার থেকে আলাদা করতে পারবে না। হোক না তোমার আমার রৌদ্র মেঘের জুড়ি তবুও আমরা এক হয়েছি আর হয়েই থাকবো।

তুমি একদম আমার সাথে কথা বলবেনা অনল…. সব সময় আমাকে কাদাঁও কি পাও কি তুমি একদম কথা বলতে আসবেনা।

অনল ও মৈএীর কথায় সায় দিয়ে একটু সময় চুপ করে থাকে ব্যাস আরেক দফা
কান্নাঁয় ব্যাস্ত হয়ে পরে।

———

দেখতে দেখতে মৈএীর তিন ভাইয়ের বিয়ের দিন এগিয়ে আসে। অনেক ধুমধামে বিয়ে ও হয়ে যায়। অনলের আজকাল কলেজের কাজের চাপ বেড়ে যাচ্ছে সবার পরিক্ষা এগিয়ে আসছে কি না!কত রকম প্রশ্ন তৈরি করতে হচ্ছে নোটস বানিয়ে দিতে হচ্ছে।

এত কিছুর মাঝেও মৈএীকে সময় দিতে হচ্ছে। মেয়েটার ফাইনাল এক্সাম ও হয়ে গেছে। এখন বাসায় অনলের মায়ের সাথেই থাকে। অনল প্রতিদিনের ন্যায় আজকেও অনেক রাত করে বাসায় ফিরেছে। কিন্তু আজ আর মৈএী অনলকে কোনো রকম বকাঝকা করেনি। প্রতিদিন লেট করে আসায় মৈএী আর অনলের মা দুজনেই বকাবকি করে অনলকে। কিন্তু আজ এই নিয়ম ব্যাতিক্রম অনল ভাবে আজকে আবার দুজনেই এত শান্ত রয়েছে কেন?অনলের মা আজকে আগেই নাকি ঘুমিয়েছে। মৈএী নিজেই খাবার এগিয়ে দিচ্ছে। অনল খেয়াল করে মৈএী আজ শাড়ি পরেছে দুই হাতে অনলের মায়ের দেওয়া সোনার মোটা বালা দুটো পরেছে। সেই সাথে অনলের গত মাসে দেয়া চেইন ও কানের দুল ও রয়েছে। ঠোঁট জুড়ে হাসির মেলা বসেছে একটু পর পর মৈএী অনলকে দেখছে আর খাবার এগিয়ে দিচ্ছে।

কি হয়েছে আজ?

মৈএী অনলের চোখে চোখ রেখে বলে,
কি হবে?দ্রুত খাও অনল।

কেন? সারপ্রাইজ দিবে?

সেরকমই!

অনলের মনে কৌতুহল দেখা দেয়… খাবার শেষ করে রুমে আসে একটু পর মৈএীও আসে হাতে চায়ের কাপ নিয়ে।
অনল তা নিয়ে টেবিলে রাখে মৈএীকে টেনে কাছে নিয়ে আসে। কোমড়ে হাত রেখে বলে,
বলোনা মৈএী……

কি ভাবে বলবো?

অনল বলে , কেন লজ্জা লাগছে নাকি তোমার?

হ্যাঁ লাগছে।

তাহলে আস্তে আস্তে বলো মানে কানের কাছে মুখ নিয়ে…..

মৈএী একটু সময় নেয় এরপর সত্যই অনলের কানের কাছে , মুখ নিয়ে বলে ,
তুমি বাবা হতে চলেছো অনল….
অনলে সাথে সাথেই মৈএীকে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। কপালে গাঢ় করে চুমুঁ একে বলে,
ধন্যবাদ আমার জান!আমাকে এমন একটা উপহার দেয়ার জন্য…..
আমার পৃথিবী সাজিয়ে দিলে তুমি মৈএী….বলোনা আমি কিভাবে তোমার পৃথিবী সাজাবো মৈএী?

অনলের বুকে মাথা দিয়েই মৈএী বলে,
তোমার সাজানো পৃথিবীতে আমায় একটু জায়গা দিও অনল…কথা দিলাম আমি আর কিছুই চাইবোনা।

অনল প্রশান্তিতে চোখ বন্ধ করে নেয় এই মৈএীকে কি কোনো ভাবে এই বুকের মাঝে ঢুকিয়ে ফেলা যায় না??

সমাপ্ত

রৌদ্র মেঘের জুড়ি পর্ব-১৫

0

#রৌদ্র_মেঘের_জুড়ি(১৫)

মৈএী আর অনলের সংসারের তিন মাস হয় । সেদিন যখন প্রথম হাসপাতালে মৈএীকে অনল নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নেয় তখনই অনল বলে

আমার না ভালোবাসা তুমি মৈএী। আমি তোমাকে ভালোবাসবো এই চিন্তা কখনোই মনে আনিনি। তুমি বার বার আমার কাছে এলে ভালোবাসতে বললে আমি চুপ ছিলাম মৈএী আমি চাইনি তোমার বাবার আদরের মেয়েকে আমার জীবনে নিয়ে এসে আমার মতো সাধারণ জীবন ধারণের
সহিত মিলিয়ে দিতে। তুমি তো বিলাসবহুল জীবন পাড় করে এসেছো।
আমার কাছে এসে তুমি সেভাবে থাকতে পারবেনা। আমার সবটার সাথে তুমি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবেনা। আমি চাইনা আমাকে ভালো বেসে আমার বউ হয়ে তুমি রাজকন্যা থেকে……..যাই হোক ভালো থেকে মৈএী। বাবা যেখানে চাইছে সেখানেই বিয়ে করে নাও…. আমারা এক সাথে কখনোই ভালো থাকবো না মৈএী। তোমার বাবা চায়না আমি তোমায় বিয়ে করি তুমি আমার বউ হও।
আমার তো বাবা নেই মৈএী তোমার বাবা তোমায় অনেক ভালোবাসে সে তে রাজকুমার এর সাথে বিয়ে দিবে তুমি সেখানে রানী হয়ে থাকবে মৈএী….তুমি….

আর তুমি অনল?তুমি কিভাবে থাকবে……
অনল হাসেঁ মৈএীর কপালে ছোটো করে চুমু আকেঁ ও বলে….

আমি সব সময় তোমার মনে থাকবো মৈএী এখন যাও….. পরে না ভাইদের চোখে পরে যাও আমি চাইনা তা…….. সাবধানে যাও মৈএী……..

মৈএী অনলকে শক্ত করে ঝাপটে ধরে কান্নাঁ করতে করতে নাক টেনে বলে,
আমি যাবো না অনল! আমি তোমার বউ হতে চাই শুধু তোমার বউ,আমি অন্য কাউকে কিভাবে এখন বিয়ে করবো অনল যখন আমি জানি তুমিও আমাকে অনেক ভালোবাসো আমাকে চলে যেতে বলো না অনল আমায় তোমার সাথে নিয়ে যাও অনেক দূরে নিয়ে যাও যেখানে…….

মৈএী কিছু বুঝে উঠার আগেই ওকে কেউ হেচকাঁ টান দিয়ে অনলের থেকে সরিয়ে নেয় পর পর দুটো শক্ত হাতের থা প্প ড় পরে ডান গালে। স্তব্ধ হয়ে যায় মৈএী সামনের মানুষ কে দেখে আর ও অবাক হয় যখন দেখে ওর পরিবার সহ হবু স্বামীর পরিবারের ও সকলেই রয়েছে।
মোহন মৈএীর হাত ধরে অনলের সামনে থেকে নিয়ে এসে বাবার পাশে দাঁড়িয়ে পরে। মৈএীর হবু স্বামী বলে ,

আংকেল আজ রাতেই আমার আর আপনার মেয়ের বিয়ের ব্যাবস্থা করুন। আপনার মেউএর সাহস কি করে হয়?আমার সাথে বিয়ে হওয়ার কথা চলাকালীন সময়ে একটা ছেলের সাথে ফস্টি নস্টি করতে চলে আসার?বিয়ে টা হোক হাত পা ভেংগে রেখে দেব! এমন অবস্থা করবো যে ভুলেও বাইরে বের হতে চাইবে না…..
না জানি এই ছেলের সাথে কত কিছু করে ফেলেছে! এই ওই ছেলের হাত পা গুড়ো করে দে তোরা….

মৈএী মোহন কে ছেড়ে মিজানুর সাহেব এর পায়ের কাছে বসলো,
পায়ে হাত দিয়ে বলল,

না বাবা ওকে আর মে*রোনা আমি কথা দিচ্ছি আমি বিয়ে করে নেবো ওওই ছেলেকে আমি ওনার সব কথা শুনে যাবো বাবা উনি যদি আমায় মে*রেও ফেলতে চায় তবু ও আমি ওনার কথার বাইরে যাবো না তুমি শুধু অনলকে আর আঘা*ত দিও না বাবা আমার এই কথাটা শুধু রাখো…. কথা দিলাম আমি আর তোমার কাছে কখনোই কিছুই চাইবো না বাবা…….
প্লিজ…..

মিজানুর সাহবে মোহন কে থামালেন অনলের দিকে একবার পুর্ন চোখে দেখলেন ছেলেটা এখনো সুস্থ হয়নি এর মাঝে মৈএীর এখনের অবস্থা দেখে আর ও ভেংগে পরছে চোখ মুখ শুকনো শরীরে বিভিন্ন জায়গায় ব্যান্ডেজ করা।
তিনি খেয়াল করলেন অনল মৈএীর দিকেই তাকিয়ে রয়েছে চোখে পানি চিকচিক করছে নিশ্চয়ই মৈএীর জন্য??
মিজানির সাহেব মেয়েকে তুলে কাধেঁ হাত রেখে কাছে আনলেন তারপর বললেন ,
সবাই বাসায় যাও। আর আপনারাও নিজেদের বাসায় চলে যান আগামীকাল সকালেও আমি কল দিয়ে জানিয়ে দেব সব।

ওনারাও চলে গেলেন,মৈএীকে নিয়েও মিজানির সাহেব চলে গেলো অনল বেড এর পাশেই ফ্লোরে বসে পরলো কিছুই করতে পারলো না নিজের ভালোবাসার জন্য??এভাইবেই মৈএীকে পাওয়া হলো না?

পরের দিন সকালেও মিজানুর সাহে ছেলের বাসায় কল দিয়ে জানালেন,
মৈএী পালিয়ে গেছে। বাসায় নেই মৈএী।
তারপর থেকেই ওদের পরিবার মৈএীকে খুঁজে চলেছে। এদিকে মিজানুর সাহেব নিজেই মেয়ের কথা চিন্তা করে ও ছেলের মানসিক চিন্তা ভাবনা আর হাসপাতালে মৈএীকে নিয়ে বলা কথা গুলো ভেবে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে অনলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিলেন সেই রাতেই নিজেই অনলকে হাসপাতাল থেকে মোহনকে দিয়ে নিয়ে এলেন ছেলেদের ও সব বুঝালেন ওই খানে বিয়ে দিলে তাদের মেয়ে কখনোই ভালো থাকতে পারবনা হয়তো বিয়েটা দিলে ওদের পুর্ব শত্রুতা শেষ হবে কিন্তু মেয়ের ভালো থাকা ভালো লাগা নিয়ে কেউ ভাববেনা না মৈএী নিজেই ভালো থাকবে। ওরা চায় মৈএী ভালো থাকুক। অনলের সাথেই থাকুক।
————-

মৈএী অনলকে বকা বকি করতে করতেই খাবার সাজিয়ে দিচ্ছে টেবিলে। এই নতুন বাসা থেকে অনলের কলেজ বেশ কিছুটা দূরে হয়ে যায়। মৈএীর ভয় হয় কখন না ওরা অনলের খোজঁ পেয়ে যায় ওরা তো জানেনা অনল কোন কলেজ বা কিসের চাকরি করে!যদি জেনে যায়?কি হবে?

অনল ফ্রেয়াহ হয়ে এসে টেবিলে বসে মৈএী এই বাসাটা নিজের হাতে সাজিয়েছে। অনল এখন কিছুই সচ্ছল জীবন পার করছে গ্রামের সবাটr ঋণ শেষ করে ফেলেছে মিষ্টিকেও বিয়ে দিয়েছে ওর বাবা। অনলের মা এখানে আসতে চায় না। গ্রামেই নাকি ভালো থাকবেন তিনি অনল আর জোড় করে না।
প্রতি সপ্তাহেই সম্ভব হলে গিয়ে দেখা করে আসে।

মৈএী অনলের সামনে প্লেট সাজিয়ে নিজেও পাশের চেয়ারে বসে।
খাইয়ে দাও।

মৈএী অনলের চোখে চোখ রাখে….. অনল কাউকে এত রকম ভাবে জ্বালাতে অয়ারে?জানাই হতো না অনলের বউ না হলে…. বিয়ের পর থেকেই অনল মৈএীকে বিরক্ত করা শুরু করে দিয়েছে অবশ্য মৈএী বিরক্ত হয় না ভালো লাগে অনলের এরকম করাতে।

তোমার হাত কই অনল?

নেই।

নেই মানে?

নেই মানে নেই….

তাহলে কি আছে তোমার?

একটা সুন্দরী বউ আছে……

ওহ আচ্ছা তাই না?

হ্যাঁ। সুন্দরী বউ আমাকে রোজ সকালে খাবার খাইয়ে দেয় ……..

হ্যাঁ পেয়েছো তো আমার মতো ভালো একটা বউ!

আহা মৈএী খাইয়ে দাও না প্লিজ সময় নেই আমার আবার ক্লাস শুরু হবে। তোমার না সামনে ফাইনাল……, পড়াশোনার খবর নেই না?সব সময় আমাকে জ্বালাতন করার ফন্দি আঁটতে ব্যাস্ত থাকেন তাই না?

কি?

হ্যাঁ! রোজ সকালে তোমার জন্য কলেজ যেতে লেট হয় আমার । কাউকে তো আর বলতে ও পারিনা বাসায় বউ রয়েছে সে আমাকে একদম আসতে দিতে চায় না।

মৈএী অনলের শার্ট খামচে ধরে বলে,

আমি যেতে দেই না?

হ্যাঁ তুমি কিন্তু বিয়ের পর খুব দুষ্ট হয়েছো মৈএী………

এই আমি না তুমি?

তুমি।

না তুমি।

না তুমিইই!

আচ্ছা আচ্ছা তুমিই?

এখন খাইয়ে দাও….

মৈএী আর কথা বাড়ায় না…. প্লেটের খাবার খাইয়ে দেওয়া শুরু করে মৈএী।
অনল এরপর কলেজ যায়। অনল বের হয়ে যেতেই কেউ আবার আসে দরজা নক করে….. মৈএী এগিয়ে যায় সেদিকে কে এসেছে এই সময়?

চলবে
#মিশকাতুল

রৌদ্র মেঘের জুড়ি পর্ব-১৪

0

#রৌদ্র_মেঘের_জুড়ি(১৪)

মৈএী দাঁড়িয়ে আছে হাসপাতালে অনলের কেবিনের সামনে। কেউ তাকে ভেতরে যেতে দিচ্ছেনা। অনলের মা আর মিষ্টি এসেছে অনলের এরকম খবর শুনে তিন দিন হয়। এই তিন দিন কি মৈএী ভালো ছিলো? ওর কথা কেউ ভাবললোনা । এই যে অনলকে দেখতে এসেছে সে কি বাবা ভাইদের বলে এসেছে?না। ওদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এসেছে। শুধু একবার অনলকে দেখবে বলে। বাবা আর ভাইয়েরা না জানুক সে তো জানে! অনল তাকে ভালো বাসে না।তাহলে কেন মৈএীর ভুলে অনলকে আঘা*ত করলো এভাবে?অনল কি ওকে ক্ষমা করবে এর জন্য?

বাসায় কি হচ্ছে না হচ্ছে এখন মৈএীকে না পেয়ে?তিন দিন হয় চেষ্টা করে মৈএী বাসা থেকে বের হওয়ার কিন্তু পারছিলো নায়াজ সুযোগ পেতেই চলে এসেছে ভাইয়দের কড়া পাহারায় ছিলো এ কয়েকদিন ।

অনল দেখেছে সকাল ১০ টা হতে মৈএী এই বিকেল পর্যন্ত বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অনল ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে ,।
মৈএীকে ভেতরে আসতে বলো মা….

মিষ্টি বাধাঁ দেয়…. সে বলে,
না অনল আমি জানি তুমি আমায় বিয়ে করবেনা। আমি এরপরেও চাইনা ওই মেয়ে এখানে আসুক। আমরা তোমার ভালো চাই তুমি ওই মেয়ের জন্যই আজ এখানে এভাবে…….ও দুরেই থাক না।

এসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না।ওকে নিয়ে আয়।

মৈএীকে নিয়ে ভেতরে আসে গিয়ে। মৈএী অনলের শুকনো মুখ দেখেই কান্নাঁর মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
তবে মুখে কিছুই বলেনা।

অনল বলে,

দেখা শেষ?

মৈএী অনলের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে।।

এখন চলে যাও মৈএী। তুমি বুঝলে তো! তোমার আমার মাঝের ব্যাবধান কোথায়? চলে যাও মৈএী……আমার সাথে যা হয়েছে আমি চাই না আমার মায়ের সাথেও সেরকম হোক আমি চাইনা আমার পরিবারের ক্ষতি হোক তোমার ভালোবাসার জন্য।

মৈএী অনলের কথায় মনে আঘা*ত পায়। অনলের সাথে দেখা হলো এই তো অনেক

চলে যাচ্ছি স্যার। আর আসবো না।আজকের পর আর কখনো আপনার সামনে ভালোবাসার কথা নিয়ে হাজির হবো না কথা দিলাম । আমি শুধু ক্ষমা চাইতেই এসেছি। আজ আপনি আমার জন্যই এত কিছু সহ্য করেছেন। আপনি তো আমাকে ভালো না বেসেই আমার ভাইদের কাছে প্রহার পেলেন। আমায় ক্ষমা করে দিবেন স্যার।

অনল মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো। মৈএী তা খেয়াল করে আবার বলে ,
আমার দিকে চোখ রেখেই থাকুন না স্যার প্লিজ একটু সময়…. চলেই তো যাবো আমি একটু পর। আর আসবো না স্যার! ভুলেও না। এটুকু সময় আমি আপনাকে দেখতে চাই নয়ন ভড়ে প্লিজ স্যার মুখ ফিরিয়ে নিবেন না।

মিষ্টি বাইরে চলে যায়। অনলকে সে ভালোবাসে এখন মৈএীর এসব কথা শুনতে ইচ্ছেও করছেনা।অনলের মা ও উঠে ওর সাথে যায়।

অনল তবুও মুখ সামনে ফিরিয়ে দেখেনা। অনলের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে মৈএী। অনল আধঁশোয়া হয়ে রয়েছে বিছানায়।

বিরক্ত হচ্ছেন স্যার?
এও শেষ বার বিরক্ত করতে চলে এসেছি। আগামীকাল আমার বিয়ে।

অনলের বুকে ধাঁক্কা লাগে এই কথাটা। মৈএীর বিয়ে?তার না বলা ভালোবাসার মানুষ টাকে ভালোবাসার কথা বলাও হলো না।তার আগেই সব শেষ হবে?
মৈএী অন্য কারো হয়ে যাবে?তখন আর মৈএী যখন তখন ওকে ভালোবাসার কথা বলে পাগোল বানাবেনা। উতলা মৈএী আর আসবেনা ওর কাছে?

অনল……

অনল এবার চোখ বন্ধ করে নেয়। অনলের মুখের এক পাশ দেখছে মৈএী। সেভাবেই বলে আবার,
অনল একবার আমি তোমায় ছুঁয়ে দিতে চাই ছুঁতে দিবে?প্লিজ!
না করো না……..

অনল কিছুই বলতে পারেনা কি বলবে?খুঁজেও পাচ্ছেনা এই মুহুর্তে।
মৈএী উত্তর পাওয়ার জন্য দাঁড়িয়েই থাকে। একসময় বুঝতে পারে অনল ওর সাথে কথাও বলতে ইচ্ছুক না যেখানে সেখানে ছুঁয়ে দেখার অনুমতি ও দিবেনা। তাই আর কোনো কথাই বলে না মৈএী। ঘন্টা চলে যায়। নার্স আসে। মৈএী পেছন ফিরে চলে আসতে নেয়। পা এগুচ্ছে না দরজা পর্যন্ত আসতেই বুঝতে পারে পেছনে অনল ওড়না টেনে রেখেছে। চকিতে পেছন ফিরে দেখে অনল ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
অনলের মুখের দিকে মাথা তুলে দেখে মৈএী।
অনল ওড়না ছেড়ে মৈএীকে দুই হাতে বুকের সাথে মিশিয়ে জাপটে ধরে রাখে। মৈএী ও হাত বাড়িয়ে অনলের বুকের সাথে মিশে যায়।

——————–
তিন মাস পর,

মৈএী কই তুমি?হলো তোমার? বিয়ের পর তুমি এতো অলস হয়েছো না!ইচ্ছে করে নিয়ে বাবার বাড়ি রেখে আসি গিয়ে।

মৈএী কিচেন থেকে দ্রুত পায়ে বেডরুমে চলে আসে। মহারাজ এখনো বিছানাতেই শুয়ে রয়েছেন ব্রাশ টাও করেনি আর উল্টো ওকেই অলস বলা হচ্ছে? রে*গে অস্থির হয়ে বলে,

আমি অলস?আর তুমি?এখনো নির্লজ্জের মতো সাওয়ার না নিয়ে বিছানাতেই পরে রয়েছো! ব্রাশটাও করোনি। আমি এক্ষুনি শাশুড়ী মায়ের কাছে কল করে তার অতি ভালো ছেলের গোপন তথ্য ফাসঁ করে দেবো বলে দিলাম।
সব সময় আমাকে বাবার কাছে রেখে আসার ভয় কেন দেখাও অনল??আমার তোমাকে নিয়ে কত ভয় হয় তুমি জানো??

অনল কম্বলের ভেতরে থেকে মুখ বের করে মৈএীকে দেখে। বেগুনী সুঁতির শাড়ি পরে হাতে সেম রঙ এর কাচের চুড়ি পরে গলায় সিম্পল চেই কানে দু ল পরে সকালের পাখি দাঁড়িয়ে রয়েছে এই পাখি একান্তই অনলের। পাখি এখন রে*গে আছে চুল হতে তোয়ালেও ছাড়িয়ে নেয়নি এখনো ওভাবেই কিচেনে চলে গিয়েছে।
মৈএীর দিকে এগিয়ে এসে ওর নরম কোমল কোমড়ে দুই হাত দিয়ে কাছে নিয়ে আসে। টেনে কম্বলের মাঝে নিয়ে আসে।
মৈএীর রা*গ এবার সপ্তম আকাশে উঠে যায়।

হচ্ছে কি এসব?সব সময় তাকে জ্বা*লা*নো হয়!আর এই মহান কাজটা করে কে?অনল! একদম শান্তি দেয় না তাকে। অনলের থেকে নিজেকে ছুটিঁয়ে নিতে চেষ্টা করে বলে ,

আমি কিন্তু এই শীতের সকালে একবার সাওয়ার নিয়েছি অনল আমাকে একদম বিরক্ত করবেনা তুমি! চুলায় রান্না বসিয়ে এসেছি আমাকে যেতে দাও….

অনল মৈএীর গলা থেকে ঠোঁট সরিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
তোমার রান্না চুলোয় যাক!! এই শীতের সকালে আমি একা সাওয়ার নেব না। তুমিও আমার সাথে নেবে।

আমি আগেই নিয়েছি।
সেজন্যই আবার যেনো নাও সেই ব্যাবস্থা করছি।

মিজানুর সাহেব আজকাল খুবই ব্যাস্ত সময় পার করছেন । মজনু ওনার রুমে এসেই পাশে বসলেন। মিজানুর সাহেব মুখ তুলে বলেন ,

অনলের কি অবস্থা?আমার মেয়েকে কি সুখ দিতে পেরেছে?

হ্যাঁ বাবা। আমাদের বোন ওর সাথেই ভালো আছে কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গা ওরা মৈএীর খোজঁ এখনো করছে!

খুব শিঘ্রই আমাকে এর একটা ফয়সালা করতে হবে..!!

চলবে
#মিশকাতুল

রৌদ্র মেঘের জুড়ি পর্ব-১২+১৩

0

#রৌদ্র_মেঘের_জুড়ি(১২)

অনল বলছিলাম যে বিকেলে তোর চাচার সাথে দেখা করতে যাবি?সব দেনা পাওনা তো পরিশোধ করা হয়েছে এবার তোর চাচার সাথে কথা বলে দুজনের বিয়ের কাজটা শেষ করলে কেমন হয়?তোর বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে তো।

আমার বিয়ে?

হ্যাঁ। আমি মিষ্টি মাকে তোর জন্য এত দিন বিয়ে দেই নি। আমার ছেলের বউ করতে চাই ওকে। ও নিজেও তাই চায়। আর আমি জানি তুই আমার পছন্দ কখনো অপছন্দ করতেই পারিস না।

কিন্তু মা আমি ওকে বিয়ে করতে পারবো না।

কেন?

ওকে আমি ছোটো থেকে নিজের বোনের নজরে দেখেছি। ও কে কিভাবে বিয়ে করতে পারি?

সেসব আমি জানিনা। এখন নিজেদের মাঝে এরকম হাজার হাজার বিয়ে হচ্ছে। এ আর এমন কি?

কিন্তু মা আমি মিষ্টি কে বিয়ে কখনোই করতে পারবো না।তুমি এ রকম চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে দাও প্লিজ।

না না। অনল আমি কি তোর মা হয়ে নিজের ছেলের বউ কাকে করবো না করবো পছন্দ করতে পারি না?এই দিন দেখার জন্য আমি আমার ছেলেকে নিয়ে বেঁচে আছি?

মা দয়া করে এসব বলা বন্ধ করো। আমি…… আমি….(মৈএীকে ভালোবাসি)

তুই কি বাবা?তুই কি কাউকে পছন্দ করিস?

অনল ওর মায়ের চোখের দিকে চোখ রাখে। বলতে চায় না অনল যে ও মৈএীকে ভালোবাসে…… তবুও মায়ের মোন ছেলের চোখ মুখ দেখে নিয়েই বলে,
তুই কি ওই মেয়েটাকে পছন্দ করিস?

অনল আর শক্ত থাকতে পারেনা । মায়ের বুকে মাথা রাখে। এই স্থান যে সব সন্তানকে শান্তি দিতে পারে।
অনলের মাথায় হাত রেখে উনি বলেন,

আমার ছেলের প্রতি আমার বিশ্বাস রয়েছে। আমি আমার ছেলেকে খুবই ভালোবাসি। তুই যদি ওই মেয়েটাকে বিয়ে করতে চাস আমি না করবো না।

****
রাবেয়া একটা ব্যাগ নিয়ে মৈএীর রুমে এসেছে। চারদিন হয় মৈএী অনলের গ্রাম থেকে ফিরে এসেছে। আসার পর থেকেই একদম চুপ চাপ রয়েছে আগের মতো আর গল্প করতেও আসেনা রাবেয়ার কাছে। ভাইদের সাথে সকালেই এক দফা ঝগড়া করেছে মৈএী । সে কিছুতেই ওই লম্পট ছেলে কে বিয়ে করবেনা। শত্রুতা শেষ করতে এখন তাকে দুশ্চরিত্র ছেলেকে বিয়ে করতে হবে?বাবাও কিছুই বলছে না।কই আগে তো বাবাও চাইতেন মৈএীর হ্যাঁ বা না বলা। আর এখন কেউ কোন কথা কেন শুনছেনা?

মৈএী তৈরি হয়ে নাও। শাড়ি আর গহনা দিয়ে গেলাম। নিচে এসো আজ শুধু দেখে যাবেন ওনারা। বিয়ে নয়। আমি যে করেই হোক এই বিয়ে আটকাবো।

মৈএী আশা খুজেঁ পায় রাবেয়াকে জড়িয়ে ধরে চোখের জল ফেলে।

কাউকে পছন্দ করো মৈএী?

হ্যাঁ।

কাকে?

যাকে পছন্দ করি সে আমায় পছন্দ করে না ভাবী। যাই হোক আমি এই ছেলেকে বিয়ে করতে পারবো না।

আচ্ছা।

মৈএী তৈরি হয়ে নিচে নেমে আসে। দুইজন মহিলার সাথে একজন পুরুষ ও এসেছে মৈএীকে দেখে ওনারা চলে যায়।

পরের দিন বিকেলে অনল আসে মৈএীর বাসায়। মিজানুর সাহেব নিচেই ছিলেন অনলকে দেখে বলেন,

ফিরল্ব গ্রাম থেকে?

জ্বি আংকেল।

মিজানুর সাহেব পকেট থেকে টাকা বের করলেন অনলকে পাশে বসতে বললেন। অনল বসার পর মিজানুর কয়েকটা হাজার টাকার নোট দিয়ে বলেন,

আজ থেকে আর তোমাকে কষ্ট করে আমার মেয়েকে সময় দিতে হবে না।ওর নাকি সিলেবাস শেষ হয়েছে শেখা?

অনল অবাক হয় মৈএী ওর বাবাকে অনলকে না আসতে বলেছে?এমন কেন করছে মৈএী? ওর থেকে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা!!

জ্বি আংকেল।

আচ্ছা।রাবেয়া…..

রাবেয়া আসতেই উনি নাস্তা দিতে বলেন অনলকে। অনল আনতে নিষেধ করে।

মিজানুর সাহেব বলেন,
অসংখ্য ধন্যবাদ তোমায় বাবা আমার কথায় আমার মেয়েকে সময় দেওয়াফ জন্য। গত কাল রাতে মৈএী আমায় বলেছে ওর নাকি সব শেখা শেষ এখন নিজেই পারবে। তোমার এখানে এসে সময় দিতে নাকি অসুবিধেই হয়।

জ্বি আংকেল আম তাহলে আসছি।

অনল উপরের দিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে দেখে মৈএী ওর কথা শুনেও একবারের জন্য বাইরে এলো না?

অনল বাসার বাইরে এসে আবারও পেছন ফিরে বাড়িটা দেখে নেয়। এতদিন মৈএীকে পড়ানো শেষ করে বাইরে এলে অনল দেখতো মৈএী দাঁড়িয়ে আছে ওর দিকে চোখ রেখে আর আজ?কেউ নেই বেলকুনি শুন্য।

অনল লম্বা করে শ্বাস নেয়। এরপর রিক্সা পেতেই চলে আসে। আজ আর রান্না করতে ও ইচ্ছে করছেনা সেভাবেই শুয়ে রইলো।

মৈএী রুমে বিছানায় শুয়ে আছে। ইচ্ছে করছে ম*রে যেতে পৃথিবী এত বিষাদ কেন লাগছে? মৈএীর জীবনে প্রেম কেন এলো?ওই অনলের সাথেই কেন??অনল কে কি ভুলতে পারবে কোন দিন??

চলবে
#মিশকাতুল

#রৌদ্র_মেঘের_জুড়ি(১৩)

মৈএী ঘুমিয়েছিলো সকাল সকাল কেউ ওকে ধাক্কা দিয়ে বিছানা থেকে নিচে ফ্লোরে ফেলে দেয়। মৈএী প্রচুর ব্যাথা পায় শরীরে। প্রবল ধাক্কা তে ঘুম ঘুম ভাব উড়ে যায়। মাথা উচিয়ে খেয়াল করে মোহন দাঁড়িয়ে আছে চোখে মুখে হিংস্রতা দেখা যাচ্ছে। ওভাবেই মৈএী উঠতে চেষ্টা করে। মোহন এগিয়ে এসে মৈএীর চুলের মাঝে দানবীয় হাত ঢুকিয়ে চুল প্যেঁচিয়ে ধরে। মৈএী এবার প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করে। মোহন ওর সাথে এমন করছে কেন?

ছাড় আমাকে ভাইয়া লাগছে আমার।

মোহন অত্যন্ত রুক্ষ্ণ গলায় বলে,
লাগুক। লাগার জন্যই চাপ দিচ্ছি……তোর সাহস কি করে হয়?আমাদের সন্মান নিয়ে খেলা করার? আজ তোর সাহস আমি বের করছি!

মৈএীকে টেনে হিচঁড়ে নামিয়ে আনে মোহন নিচ তলায়। রাবেয়া এক পাশে দাঁড়িয়ে মুখে কাপড় গুজিয়ে কান্নাঁ করছে। মিজানুর সাহেব সোফায় গম্ভীর হয়ে বসে রয়েছে। ময়নুল রাবেয়ার পাশেই চোখ মুখ লাল বানিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মজনু বাবার পাশে বসা আর মুহিব?মুহিব এক পাশে দাঁড়িয়ে মৈএীকে আহত অবস্থায় দেখছে।

মৈএী ভেজাঁ গলায় বলে,
আমাকে এভাবে ব্যাথা দিচ্ছিস কেন?ভাইয়া লাগছে আমার!!

রাবেয়া পাশে থেকে বলে,
ওকে এভাবে আঘা*ত দিওনা মোহন দোহাই লা…..

সেই মুহুর্তে রাবেয়ার গাল চে*পে ধরে ময়নুল। এই প্রথম স্ত্রীর গা*য়ে হাত তুলছে সে। রা*গা*ন্বীত স্বরে বলে,
তোর জন্যই আজ ও এই কাজ করার সাহস পাচ্ছে! এই করিস কি তুই সারা দিন?একটা মেয়েকে পর্যবেক্ষণ করতে পারিস না?কি করিস কি তুই বল…….

অনল!অনলের মতো একটা এ*তিম,অসহায় ছেলের জন্য আমার বোন পাগো*ল হয়?কি ভেবেছিলি সবাই আমি বুঝবো না?

রাবেয়া নিজেকে ছাড়িয়ে বলে,
সব মিথ্যা কথা অনলের সাথে আমাদের মৈএীর কোনো সম্পর্ক নেই।

আহ্ বউমা! কেন এসব কথা বলে আমাদের সামনে নিজেকে হাসির খোরাক বানাচ্ছ?মুহিব দেখেছে ওর ডায়েরি সেই ডায়েরি বাবা হয়ে আমি দেখবো না বলে
মোহন, মজনু আর ময়নুল ও দেখেছে এই মোহন তুই বল কি সম্পর্ক ওই ছেলের সাথে?

মোহন মৈএীকে ফ্লোরের সাথে ধাক্কাঁ দিয়ে ফেলে বলে,
হ্যাঁ ভাবী। তোমার আদরের ননদ ওই অনলের সাথে প্রেম করে তাহলে কি করে ও আমাদের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করবে? ওখানে ওই অনলকে নিয়ে হাজার হাজার প্রেম বাক্য লিখে রেখেছে। আমাদের চোখের সামনে এসে আমাদেরকেই ফাকিঁ দিয়েছে এত দিন?
এই আজ থেকে তোর কলেজ প্রায়ভেট সব বন্ধ!মেয়েদের এত পড়াশোনার দরকার নেই!বিয়ে দেব মোন দিয়ে সংসার করবি কিসের এত সাইজ বাইজ!!
বাবা তুমি কালকেই ওনাদের সাথে কথা বলবে….. যত দ্রুত সম্ভব এই বিয়ে হয়ে যায় ততই ভালো আমাদের জন্য।

মিজানুর সাহেব চুপ করে থাকলেন। মৈএী কাঁন্না করেই যাচ্ছে। গত কাল রাতে ডায়েরিটা বের করেই ঘুমিয়ে পরেছিলো কে জানতো মুহিব তখন ওর রুমে যাবে?সেখানে অনলকে ঘিরে কত অনুভূতি লেখা রয়েছে।

বাবা আমি যাচ্ছি আজ ওই অনলকে আমি দেখে নেবো…….

না…………..

মৈএী মোহনের দিকে তাকিয়ে বলে,
ওনাকে কিছুই করবি না ভাইয়া। আমার দোহাই লাগে……

এই তোর সাহস দেখে আমি অবাক না হয়ে পারছিনা!

উনি আমাকে ভালোবাসেন না আমই ওনাকে ভালোবাসি তুই ওনাকে কিছুই বলবি না ভাইয়া………..

ওর জন্য এখন চিন্তা করছিস?ওকে নির্দোষ সাজাতে চাইছিস?

না….

কি না?এই মুহিব ভাইয়া তারাতাড়ি চলো আজ ওকে এমন অবস্থা করে দেব যে ভুলেও আমার বোনের দিকে নজর দিবেনা……

মৈএী উঠে মোহনের পা ধরে জড়িয়ে বলে,

সত্যই বলছি ভাইয়া উনি আমাকে একটুও ভালোবাসেন না।ওনার ক্ষতি করিস না।

মোহন পা দিয়ে ধাক্কাঁ দেয় মৈএীকে এরপর গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যায়……….

—-
মৈএী বসার রুমে সোফায় শুয়ে আছে। এখনো ওরা ফিরে আসেনি। রাবেয়া কিচেনে দুপুরের রান্না শুরু করে দিয়েছে। মিজানুর অফিসে চলে গেছেন আজ আর কেউ মৈএীর র*ক্ত দেখেও সোহানুভুতি প্রকাশ করেনি।
আজ কি ওর জন্য কারো মায়া হচ্ছেনা?বাবাও ওর মাথায় হাত রাখেনি ভালো করে দুটো কথাও বলেনি…. মৈএীর আবদার কেন অনুরোধ ও কেউ রাখেনি….. না জানি অনলের সাথে ওর তিন ভাই কি করেছে?অনল কি ঠিক আছে?মৈএীর মোবাইল ও বাবা নিগে রেখেছে। খবর নেবে কি করে ও?

সুমনা আসে সেই সময় আজ কয়েক দিন হলেই মৈএী অনলের সামনে যেতে চায়না বলে কলেজ এ যায়নি। সুমনা মৈএীর অনুভূতি শুরু থেকেই জানে আর আজ তো অনলকে কলেজের মাঠে ওর তিন ভাই মিলে যা মে*রে*ছে! এ নিয়ে নিশ্চিত কিছি হয়েছে।

সুমনাকে দেখেই মৈএী ওকে জড়িয়ে ধরে।

এ কি অবস্থা তোর মৈএী?

ভাইয়া করেছে! অনল?আমার অনল কে দেখেছিলি কলেজে?

হ্যাঁ।

উনি ঠিক আছে?

সুমনা মৈএীকে দেখেই কান্নাঁ শুরু করে দিয়েছে এরপর চোখে ভাসে অনলের রক্তা*ক্ত মুখটা।

অনল স্যার ভালো নেই মৈএী!!

ভালো নেই?কি করেছে ওর সাথে?বেচেঁ আছে তো?

সুমনার আর ও কান্নাঁ পাচ্ছে। ছোটো থেকে যে মৈএীকে ও দেখেছে সে আর এই মৈএী এক নয়। মৈএী কাউকে নিয়ে এত চিন্তা করে?মৈএী কাউকে এত ভালোবাসতে জানে?

ও শুনেছলো গত কাল মৈএীর কলে অনল নিজের চাচাতো বোনকে বিয়ে করতে চায় তাই তো মৈএী নিজেকে সরিয়ে আনতে চাইছে অনলের ভালোবাসা থেকে। আর আজ এসব কি? মৈএী ওকে সব খুলে বলে।

সুমনাও জানায়…. অনল স্যারকে কলেজের মাঠে নিয়ে খুব আঘা*ত করেছে তোর তিন ভাই মিলে! স্যারের অবস্থা খুবই খারাপ জানি না কি হবে………

চলবে
#মিশকাতুল