Monday, August 4, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 417



আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-১৮+১৯

0

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ১৮
লিখা- Sidratul Muntaz

তৃষ্ণা ইয়ামিনের কোলে উঠে বসে আছে। তার বায়না হলো ইয়ামিনের কাছে গিটার বাজানো শিখবে। ইয়ামিনের ব্যাগে বড় গিটার দেখেই তার এমন ইচ্ছার উদয় হয়েছে। একটু পর পর শুধু গিটারটা ছুঁয়ে দিচ্ছে সে। তার দেখাদেখি যখন আইলাও ছুঁতে যাচ্ছে, সে তখন আইলাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিচ্ছে।

তৃষ্ণা ইয়ামিনের দিকে ঘুরে বলল,” তুমি আমার কি হও?”

ইয়ামিন হাসার চেষ্টা করে বলল,” আঙ্কেল।”

তৃষ্ণা এই উত্তর শুনে সন্তুষ্ট হলো না। কিছু একটা ভেবে বলল,”তোমাকে তো আঙ্কেলের মতো লাগে না! আর আঙ্কেলরা তো গিটার বাজায় না।”

” তাহলে কারা গিটার বাজায়?”

” যারা শিল্পী। তুমি কি শিল্পী?”

” হুম।”

” কোন গানের শিল্পী?”

” সবগানের।”

” এর মানে তুমি সব গান পারো?”

” মোটামুটি। তোমার কোন গান পছন্দ? ”

তৃষ্ণা ঠোঁটের নিচে আঙুল রেখে গভীর চিন্তায় মত্ত হলো। যেন খুব জটিল হিসাব মিলাচ্ছে। উষ্ণতা মনোযোগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছেলের দিকে। এর আগে এতো শান্ত সে তৃষ্ণাকে কোনোদিন দেখেনি। ছেলেটা যেখানেই যায় ঝড়-তুফান তুলে দেয়। অথচ আজ মনে হচ্ছে এমন লক্ষী বাচ্চা দ্বিতীয়টি নেই। ইয়ামিন জাদু করল নাকি?

উষ্ণতা হঠাৎ করেই বলল,” আচ্ছা ইয়ামিন, তোমার তো এখানে কাজ শেষ তাই না?তাহলে আমাদের সাথে বাংলাদেশ যাবে? ”

এমন প্রস্তাবে ইয়ামিন চমকে তাকাল। অনুপমা সায় দিয়ে বলল,” হ্যাঁ। অনেক ভালো হয়। তোমার ফ্যামিলিও তো বাংলাদেশে। এই সুবাদে ফ্যামিলির সাথেও দেখা করে নিলে?”

তৃষাণ বিরক্ত হয়ে আহমেদের দিকে তাকালো। আহমেদ চোখের ইশারাতেই তৃষাণের আদেশ বুঝে যায়। সে নিজের বউ অনুপমাকে ধমক দিল,” ধূর, কি বলছো এসব? উনি কি যেতে বললেই যেতে পারবে নাকি? তাদের কত শিডিউল মেইনটেইন করে চলতে হয়। হয়তো মুম্বাই ফিরে উনার আরও ইম্পোর্ট্যান্ট কাজ আছে।”

উষ্ণতা মরিয়া হয়ে উঠল,” প্লিজ ইয়ামিন, কোনোভাবে কি ম্যানেজ করা যায় না? তুমি গেলে আমাদের খুব ভালো লাগতো। আর তৃষ্ণাও খুব খুশি হতো। তুমি যদি রাজি থাকো তাহলে কালই আমরা টিকিট বুক করি। কি বলো তৃষাণ?”

তৃষাণ কোনো কিছু বলতে না পেরে নখ কামড়াচ্ছিল। উষ্ণতার প্রশ্ন শুনে খানিক হকচকিয়ে গেল। ঋনাত্মক মন্তব্য করার কোনো সুযোগ নেই। তাহলে উষ্ণতার সন্দেহ হবে। তাই শুধু বলল,” তোমার ইচ্ছা।”

উষ্ণতা হেসে ফেলল।অনুপমা চট করে বলে উঠল,”তাহলে তুমি আমাদের সাথে যাচ্ছো এটা কনফার্ম তাই না?”

ইয়ামিন বলার আগেই উষ্ণতা বলল,” অবশ্যই কনফার্ম!”

ইয়ামিন অপ্রতিভ স্বরে বলল,” আসলে নেক্সট মান্থের আগে তো আমার কোনো শিডিউল ফ্রী নেই। তাই ইচ্ছে থাকলেও যেতে পারছি না।”

উষ্ণতা ভাবল ইয়ামিন লজ্জায় নিষেধ করছে। তাই সে বার-বার অনুরোধ করতে লাগল। এক পর্যায় তৃষাণ অধৈর্য্য হয়ে বলল,” বাদ দাও না। ও যখন যেতে চাইছে না তাহলে কি তুমি জোর করে নিয়ে যাবে নাকি?”

” আমি জোর কোথায় করলাম? আমি তো শুধু অনুরোধ করছি!”

” অনুরোধ একবার দুইবার করা যায়। তাই বলে বার-বার?”

” আরে আজব! তুমি এতো হাইপার হচ্ছো কেন?”

” স্যরি।” তৃষাণ নিভল।

অনুপমা ফিসফিস করে ইয়ামিনকে বলল,” প্লিজ ভাই, তুমি রাজি হয়ে যাও। সবাই অনেক খুশি হবে।”

ইয়ামিন শুধু উষ্ণতাকে খুশি দেখতে চায়। তাই তার দিকে চেয়েই বলল,”ঠিকাছে আমি আরেকবার শিডিউল চেক করে জানাবো।”

” সত্যি?”

” হুম।”

উষ্ণতার মনে জেগে উঠা ভুল ধারণাটা এখন আরও পাকাপোক্ত রূপ ধারণ করল। উষসীর প্রতি আগ্রহ না থাকলে ইয়ামিন হঠাৎ যেতে রাজি হবে কেন? তাছাড়া ছোটবোনের বর হিসেবে ইয়ামিনকে তার মাথায় করে রাখার মতো ভালো লেগেছে। উষ্ণতার মন আনন্দে ভরে গেল!

_____________________
নিস্তব্ধ করিডোরে এলোমেলো পা ফেলে হাঁটছে ইয়ামিন।
দম আটকে আসার মতো কষ্ট অনুভব হচ্ছে তার।অতীতের স্মৃতি মস্তিষ্কে বিচরণ করছে৷ আটবছর আগের সেই অপ্রত্যাশিত ঘটনা, উষ্ণতার ভাইরাল ভিডিও, তার আর্তনাদ, আহাজারি, এসব মনে করে ইয়ামিনের দুঃসহ অনুভব হচ্ছে।

এখনও উষ্ণতার কান্নার তীক্ষ্ণ গর্জন যেন এখনও স্পষ্ট শুনতে পায় সে৷ তার হৃদয়ে সেই অসহ্য সুর দামামা বাজায়। নিজেরও আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করতে মন চায়। আটটি বছর ধরে অপরাধে দগ্ধ তার আত্মা। সে আজও নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না। মহান করুণাময়ের কাছে বার-বার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, ভাগ্যিস উষ্ণতা সব ভুলে গিয়েছিল। নয়তো উষ্ণতার সামনে কখনও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারতো না সে!

উষ্ণতা তো এক্সিডেন্টের পর সব ভুলে গিয়ে সুখেই আছে। ইয়ামিন তো এতোবছর চেষ্টা করেও ভুলতে পারল না। তাহলে সে কি করে সুখে থাকবে?

তৃষাণ অনেকক্ষণ ধরেই ইয়ামিনকে খুঁজছে। এতোক্ষণ সে শুধু অপেক্ষা করছিল ইয়ামিনকে কখন একা পাবে। ইয়ামিন যখন সবার মাঝ থেকে উঠে চলে গেল তখন তৃষাণও উঠে এসেছে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর সে ইয়ামিনকে পূর্ব পাশের করিডোরে দেখতে পেল।

আশেপাশে কেউ নেই। তৃষাণ শার্টের হাতা ভাঁজ করতে করতে আক্রমণাত্মক গতিতে ইয়ামিনের সামনে গেল। তার কঠিন চোখ দু’টি ক্রোধানলে জ্বলছে। ইয়ামিন হঠাৎ তৃষাণকে দেখে একটু হকচকিয়ে গেল। তারপর হাসল। তৃষাণ হঠাৎ শক্ত থাবায় ইয়ামিনের কলার চেপে ধরে ভারী গলায় জিজ্ঞেস করল,” সমস্যা কি?”

ইয়ামিন আচমকা আক্রমণের ধাক্কা সামলাতে না পেরে দুই কদম পিছিয়ে গেল। স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,” মানে?”

” বুঝতে পারছো না?”

ইয়ামিন নিজের কলার থেকে তৃষাণের হাত সরিয়ে বলল,” না, পারছি না। ঠিক করে বোঝান!”

ইয়ামিনের ঘাড়ত্যাড়া উত্তর শুনে তৃষাণের রাগের মাত্রা তুঙ্গে পৌঁছালো। কপালে একহাত ঠেঁকিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,” আমার পরিবার থেকে দূরে থাকো। তুমি কি ভেবেছো তোমার উদ্দেশ্য আমি বুঝি না? বোকা মনে হয় আমাকে?”

ইয়ামিন আবার হেসে ফেলল।আগুনে ঘি ঢালার মতো হাসি! তৃষাণের চোয়াল শক্ত হয়ে যাচ্ছিল ক্রমাগত। সে আবারও দুইহাতে ইয়ামিনের কলার টেনে ধরে হুমকি দিল,” একদম খু*ন করে ফেলবো কিন্তু।”

ইয়ামিনের চেহারার বিদ্রুপময় হাসি তখনও মুছে যায়নি। সে টিটকিরি মেরে বলল,” এতো ইনসিকিউরড কেন ফীল করছেন আপনি?”

তৃষাণের দৃষ্টি বিস্ফারিত হলো। মুখ দিয়ে খুব খারাপ একটা গালি বের হতে নিচ্ছিল। খুব কষ্টে গিলে নিল গালিটা। এইখানে বেশি ঝামেলা করা যাবে না। নিজের পরিবারকে সমস্ত বিপদ থেকে মুক্ত রাখতে চায় সে।

,” সাহস থাকলে আমার সাথে বাইরে দেখা করো।”

” কি করবেন? মারবেন?”

ইয়ামিন আবারও হাসল। তৃষাণের মাথা থেকে পা পর্যন্ত কাঁপছে। শরীর থেকে ক্রোধের আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে। মূলত উষসীর থেকে দূরে থাকার ব্যাপারেই বোঝাতে চেয়েছে সে ইয়ামিনকে। কিন্তু ইয়ামিন সেটা বুঝতে পারেনি। উষসীকে নিয়ে প্রেম সংক্রান্ত কোনো চিন্তা তার ধারণারও বাইরে! তার সমস্ত জগৎ জুড়ে তো শুধুই উষ্ণতা।

ইয়ামিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” মিস তো সবকিছু ভুলে গেছে। তাহলে আপনার ভয় কিসের? আমি এখানে আপনাদের আলাদা করতে আসিনি। হয়তো এটাই ভাগ্যে ছিল যে আমাদের আবার দেখা হবে। তাই দেখা হয়েছে…”

তৃষাণ ইয়ামিনকে ধাক্কা মেরে বলল,” আমি কিছু বুঝি না? আমাকে বোকা মনে হয়?”

” ভাইয়া… আপনি অযথাই রাগ করছেন।”

” চুপ। আর কখনও যেন তোমাকে আমার পরিবারের আশেপাশেও না দেখি। গেট আউট।”

ইয়ামিন হাসতে হাসতে বলল,” আপনাদের সাথে বাংলাদেশ যাবো বলেছি দেখে ভয় পেয়েছেন নাকি? এজন্য আমাকে তাড়াতে চাইছেন? চিন্তা করবেন না। সেটা এমনি বলার জন্য বলেছিলাম। আমি যাবো না।”

” তোমার ছায়াও যেন আমার পরিবারের উপর না পড়ে। তাহলে জানে খতম করে ফেলবো। এখন শুধু ওয়ার্ন করলাম। এরপর আর ওয়ার্ন করবো না! ”

ইয়ামিন প্রাণ খুলে হাসার চেষ্টা করল। ওই হাসি দেখে তৃষাণের হাত মুষ্টিবদ্ধ হলো। নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে ইয়ামিনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে হলো। কিন্তু হঠাৎ উষসীর আগমনে তারা দু’জনেই শান্ত হয়ে গেল।

“তোমার এখানে কি কাজ?”রোষপূর্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন করল তৃষাণ।

উষসী ভয়ে মাথা নিচু করে বলল,” কিছু না।”

ইয়ামিনের দিকে আঁড়চোখে চেয়েই তৃষাণ বলল,” যাও এখান থেকে।”

উষসী ভয়ে দ্রুত চলে গেল কিন্তু বার-বার পেছন ফিরে ইয়ামিনের দিকে তাকাচ্ছিল। তৃষাণ আঙুল উঠিয়ে বলল,” লাস্ট ওয়ার্ণিং।”

ইয়ামিন কোনো কথা বলল না। তৃষাণ চলে যাওয়ার পরেই সে উষসীর কাছে গেল। উষসী খোলা বারান্দার মতো একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। রেইলিং-এ হাত রেখে। নিচে দেখা যাচ্ছে শ্বেতাভ রাস্তা। হু হু করে ঠান্ডা বাতাস গা ছুঁয়ে দিচ্ছে। তাতেও তেমন কষ্ট হচ্ছে না। উষসী অন্য চিন্তায় মগ্ন। পেছন থেকে ইয়ামিন ডাকল,” এইযে, পিচ্চি।”

পিচ্চি ডাক শুনে চমকে পেছনে তাকাল উষসী। অভিমানে ঠোঁট ফুলে উঠল। আঠারো বছরে এসেও ক্রাশের মুখে পিচ্চি ডাক শুনতে হচ্ছে। কি ভাগ্য তার! ইয়ামিন বলল,” আমাকে কিছু বলতে এসেছিলে তখন?”

উষসী মাথা নাড়ল। তৃষাণের ভয়ে তখন বলতে পারেনি। ইয়ামিন এগিয়ে এসে বলল,” বুঝতে পেরেছিলাম। বলো।”

উষসী কথাটা বলতে নিয়ে কেঁদে ফেলছিল। ইয়ামিন তার মাথায় হাত রেখে বলল,” কাম ডাউন, প্লিজ। কথায় কথায় এতো কাঁদো কেন?”

উষসী খুব কেঁপে কেঁপে বলল,” আমি প্রীতমের সামনে যেতে পারছি না। কিন্তু ও আমার সাথে বার-বার দেখা করতে চাইছে। কিভাবে ওকে এড়িয়ে চলবো বলে দিন প্লিজ? আমার খুব খারাপ লাগছে। এতোটা অসহ্য আগে কখনও লাগেনি।”

” অসহ্য লাগছে কেন?”

” কেন লাগছে সেটা মেয়ে না হলে আপনি কোনোদিন বুঝবেন না!”

ইয়ামিন ভ্রু কুচকালো। কি এমন ব্যাপার যা বুঝতে গেলে মেয়ে হতে হবে? উষসী কাঁদতে কাঁদতে একটু পর নিজেই বলল, “ওর মধ্যে আমি যেই হিংস্র রূপটা দেখেছি সেটা আমার পক্ষে ভুলে যাওয়া সম্ভব না! যখনি ও আমার সামনে আসবে, আমার আজকে রাতের এই ভয়ংকর ঘটনাগুলো মনে পড়বে। আমি কিছুতেই ওই বাজে স্পর্শগুলো ভুলতে পারছি না।”

উষসী তার হাতের জখমের জায়গাটা চেপে ধরল। করুণ স্বরে বলল,” এই খারাপ স্মৃতি নিয়ে আমি কিভাবে ওর সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক রেখে চলবো? আমি পারবো না। খুব কষ্ট হবে আমার।”

ইয়ামিন প্রস্তুরীভূত হয়ে উষসীর কান্না দেখছে। ওই মুহুর্তে একটা ব্যাপার তার খুব করে উপলব্ধি হলো যে দুনিয়ার অন্যতম ভয়ানক বর্বরতা কোনো মেয়েকে সম্মতির বিরুদ্ধে স্পর্শ করা! কিন্তু এই জঘন্য অন্যায়টি প্রায় অনেকেই করে। তারা যদি বুঝতো তাদের একটা ভুল পদক্ষেপ মেয়েটির জীবনে কতবড় প্রভাব ফেলবে তাহলে কাজটি করার আগেই তাদের হৃদয় কাঁপতো!

যেমন ইয়ামিনের এখন হৃদয় কাঁপছে। ভয়ংকরভাবে কাঁপছে! কারণ ইয়ামিনও তো করেছিল…..আটবছর আগে, খোলা রাস্তায়, উষ্ণতার অনুমতির বিরুদ্ধেই তাকে কিস করেছিল। ভাগ্যিস সেই কালরাতের কথা উষ্ণতার এখন মনে নেই। নাহলে ইয়ামিন কি করে এই মুখ নিয়ে উষ্ণতার সামনে আবার দাঁড়াতো? নিজেকে চতুষ্পদ প্রাণীর চেয়েও নিকৃষ্ট মনে হচ্ছে তার। উষসী প্রশ্ন করল,” আমি এখন কি করবো বলে দিন প্লিজ?”

ইয়ামিন কোনমতে বলল,” জানি না।”

তারপর সে খুব দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। উষসী কান্না থামিয়ে ইয়ামিনের আচমকা চলে যাওয়া দেখল অবাক হয়ে!

_________________

উষসী, যুথি, ডোনা, অনুপমা, উষ্ণতা আর বাচ্চারা একটা ট্যাক্সিতে উঠেছিল। প্রীতম, তৃষাণ, আহমেদ, ইয়ামিন এরা সবাই অন্য ট্যাক্সিতে। এই রাতে ট্যাক্সি পেতে খুবই কষ্ট করতে হলো। উষসী তো পুরো সময় বিবশ হয়েছিল।ইয়ামিনের সাথে কাটানো শেষ মুহুর্তটুকু বার-বার অনুভব করছে। আবার কবে দেখা হবে কে জানে? উষসীর বিরহী মন আরও বিরহে কাতর হয়ে যাচ্ছে। সে এখনও জানে না যে ইয়ামিন তাদের সঙ্গে বাংলাদেশে যাবে। উষ্ণতাই তাকে জানায়নি। সারপ্রাইজ হিসেবে রেখেছে।

আজ ইয়ামিনের মুম্বাই ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু উষ্ণতা জোর করেই ইয়ামিনকে তাদের হোটেলে নিয়ে যাচ্ছে। তার পরিকল্পনা হচ্ছে আগামীকাল সবাই একসাথে বাংলাদেশের জন্য রওনা হবে। যদিও কাশ্মীরে আরও ঘোরা-ফেরা করার ইচ্ছে ছিল তাদের।কিন্তু ইয়ামিন ব্যস্ত মানুষ। সে নিজের কাজ ফেলে উষ্ণতাদের সাথে ঘোরাঘুরি করতে পারবে না। বাংলাদেশে সে যাবে সাতদিনের জন্য। উষ্ণতা চেষ্টা করছে এই সাতদিনেই চমৎকার কিছু ঘটিয়ে ফেলতে!

উষসী অনেক ভাবার পর অবশেষে সিদ্ধান্ত নিল প্রীতমের সাথে দেখা করবে। চাইলেই সব ভুলে থাকা যায়। এমনও হতে পারে যে প্রীতমের সাথে দেখা হওয়ার পর সে সত্যিই সব ভুলে গেল। এসব ভেবে উষসী হোটেলে ফিরে আসার পর রাতে প্রীতমের রুমের দরজায় গিয়ে কড়া নাড়ল। ভেতরে একদক ঢুকবে না সে। শুধু বাইরে থেকে কথা বলবে। একটু পর দরজা খুলেই দরাজ গলায় প্রীতম বলল,” তোর সমস্যা কি? খবরদার আমার সামনে আসবি না। যা এখান থেকে! ন্যাকা, ঢংগী!”

উষসী নিচু গলায় বলল,” দোস্ত রাগ করেছিস?”

প্রীতম চোখ গরম করে বলল,” কতবার ডেকেছি তোকে? একবারও আসলি না। আমার সাথে কথা বললে কি তোর মুখে বটগাছ উঠতো?”

” স্যরি।”
” এখন বল, আমি পাহাড় থেকে কিভাবে পড়লাম?”

উষসীর পেট গুলগুলিয়ে হাসি পেয়ে গেল। মিথ্যে ঘটনাটা তাহলে প্রীতমও বিশ্বাস করে নিয়েছে? হায় কপাল! উষসী মনে মনে হাসলেও তার মুখের বাহ্যিক অভিব্যক্তিতে কিন্তু তা প্রকাশ পেল না। ভ্রু কুচকে বলল,” তোর মনে নেই? আমার সাথে যে পাহাড়ে উঠলি?”

” মনে থাকলে তোকে জিজ্ঞেস করবো কেন? বিষয়টা যথেষ্ট গোল-মাল লাগছে। হাত-পা এমনভাবে ব্যথা করছে যেন কেউ মেরে হাড্ডি গুঁড়া করে দিছে। পাহাড় থেকে পড়লে এমন হয় নাকি?”

উষসী এইবার একটু শব্দ করেই হেসে ফেলল। বেচারা যে এমন বেরধক মার খেয়েছে সেটা কি আসলেই মনে নেই তার? নাকি নাটক করছে?

প্রীতম চোখ বড় করে বলল,” হাসছিস কেন শাকচুন্নি? আমার অবস্থা দেখে হাসি পায় কিভাবে তোর? বন্ধু নামের কলঙ্ক তুই। ঘোড়ায় উঠে আবেগের বশে কখন কি বলেছিলাম, সেটা ধরে এখনও মহারাণীর মতো ভাব নিয়ে বসে আছিস। যা, যা, তোর মতো ভাবওয়ালীকে আমার বুড়ো আঙুলও ভালোবাসবে না।”

ভালোবাসার কথা শুনে হালকা অস্বস্তিতে পড়ে গেল উষসী। প্রসঙ্গ বদলানোর জন্য বলল,” আসলে দোস্ত, আমি তোকে দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তুই যখন পাহাড় থেকে উল্টে পড়ে যাচ্ছিলি তখন আমি যা ভয় পেয়েছি! সেই ভয় থেকে আমি বেহুশই হয়ে যেতাম। যদি ইয়ামিন ভাই না আসতেন তাহলে এতোক্ষণে তুই আর আমি ওখানেই লটকে থাকতাম। আমি পাহাড়ের চূড়ায় লটকে থাকতাম, আর তুই নিচে পাহাড়ের পাদদেশে লটকে থাকতি।”

উষসীর কথা শুনে পেছনে থেকে কেউ হেসে উঠল। উষসী ঘাড় বাড়িয়ে দেখল ইয়ামিন বিছানায় বসে আছে। তার হাতে ফোন। তাকে দেখে উষসী হতভম্ব হয়ে গেল। আসলে সে হোটেলে ঢুকেই নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। ইয়ামিনও যে এসেছে সেটা দেখেওনি!

উষসী উত্তেজনায় স্থবির হয়ে আসা গলায় প্রশ্ন করল,” আপনি এইখানে কি করছেন?”

প্রীতম ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকালো ইয়ামিনের দিকে। তারপর বলল,” ইয়ামিন ভাই আজকে আমার রুমে থাকবে। আর খবরদার তুই আমার রুমে ঢুকবি না।”

উষসীর প্রচন্ড আনন্দ হলো। উৎফুল্ল হয়ে বলল ,” তোর ঘরে কেন থাকবে?”

” তাহলে কি তোর ঘরে থাকবে?”

” উফ, আমি শুধু কারণ জানতে চাইছি। উনি আমাদের সাথে হোটেলে কেন এলেন?”

” উষ্ণতা আপু রিকোয়েস্ট করেছিল সেজন্য এসেছে। সকালেই হয়তো চলে যাবে মুম্বাই।”

উষসী অবাক হয়ে তাকাল,” কই, আমাকে তো আপু কিছুই বলল না।”

তার মধ্যে সীমাহীন ভালোলাগা কাজ করছে। চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তাহলে কি আরও কিছু সময় ইয়ামিনের সাথে কাটানো যাবে? এই ভেবে উষসীর চোখ থেকে ঘুম-টুম সব উড়ে গিয়ে খুশিতে ঝুমঝুম করতে লাগল মন। প্রীতমকে ধরে বলল,” দোস্ত, চল আজ আমরা সারারাত আড্ডা দেই।”

কিন্তু প্রীতম তাকে ঘরে ঢুকতেই দিবে না। উষসী বলল,” প্লিজ দোস্ত, আমি একটু..”

প্রীতম বাঁধা দিয়ে বলল,” না, না, না! তোর আসা নিষেধ। চুপচাপ ঘরে যা। গেট আউট।”
মুখের উপর ধড়াম করে দরজা আটকে দিল প্রীতম। উষসী কোমড়ে হাত রেখে রাগে কাঁপতে লাগল। এই প্রীতমের পেটে এতো হিংসা! অবশ্য উষসীর একটা বিষয় ভেবে হাসিও পাচ্ছে। যার হাতে ধোলাই খেয়ে প্রীতম হসপিটালে গিয়েছিল এখন তার সাথেই এক বিছানায় ঘুমাবে। বাহ, একেই বলে নিয়তির উপহাস!

চলবে

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ১৯
লিখা- Sidratul Muntaz

প্রীতম দরজা আটকে ধপ করে বিছানায় বসল। বুকের বামপাশে হাত রেখে হাঁপাতে লাগল। ইয়ামিন বলল,” কি হয়েছে?”

প্রীতম ইয়ামিনের দিকে চেয়ে নরম গলায় বলল,” কি করবো ভাই? ওর সামনে দাঁড়ালেই নর্ভাস লাগে। এতো জোরে হার্টবিট বাড়তে থাকে যে সামলাতেই পারি না। এজন্যই ধমক-টমক দিয়ে কথা বলি। যেন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।”

বড় একটা নিশ্বাস ছাড়ল প্রীতম। যেন মাত্র কোনো ভয়ানক কোনো বিপদ থেকে পালিয়ে এসেছে।

ইয়ামিন হাসল। প্রীতমের ছেলেমানুষী তাকে হাসাচ্ছে। আসলে এখন বয়সটাই এমন! ইয়ামিন অবশ্য প্রীতমের বয়সে এমন ছিল না। সে খুব জেদী আর একরোখা ছিল। তার ভুলের জন্যই উষ্ণতাকে কষ্ট পেতে হয়েছে। ইয়ামিন তার অতীতের কথা ভেবে প্রতিনিয়ত কষ্ট পায়। নিজেকে কোনোদিন মাফ করতে পারবে কি সে?

ঠিক রাত বারোটায় তৃষাণ প্রীতমের রুমে এসে দরজায় কড়া নাড়ল। ইয়ামিন তখনও ঘুমায়নি। কিন্তু প্রীতম ঘুমে বিভোর। তাই বাধ্য হয়ে দরজা ইয়ামিন খুলল। তৃষাণকে দেখে সামান্য বিব্রত হয়ে পড়ল সে। রক্তলাল একজোড়া চোখ দিয়ে যেন গিলে খাবে তৃষাণ তাকে। উত্তপ্ত দৃষ্টিতে ইয়ামিনকে দেখতে দেখতে সে ডাকল,” প্রীতম!”

ইয়ামিন নিচু গলায় বলল,” ঘুমিয়েছে ও।”

তৃষাণ এমনভাবে তাকাল যেন ইয়ামিনের কথা বলাও অপরাধ। সে ইয়ামিনকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকল৷ ইয়ামিন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল নির্বিকার হয়ে। তৃষাণ তাকে সহ্য করতে পারছে না। কিন্তু উষ্ণতার অনুরোধ ঠেঁকিয়ে সে এখান থেকে যেতেও পারছে না। যাকে একবার দেখার জন্য এতো পিপাসার্ত ছিল, তার একটা অনুরোধ রাখবে না?

তৃষাণ প্রীতমকে ডাকার চেষ্টা করছে। তার গাল চেপে ধরে ঝাঁকি মেরে বলল,” ওঠো প্রীতম।”

প্রীতম ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে বলল,” উষু, তুই আবার এসেছিস?”

তৃষাণ রাগী কণ্ঠে বলল,” আমি উষসী না, আমি তৃষাণ ভাই।”

প্রীতম হঠাৎ চোখ খুলে তৃষাণের ক্রোধান্বিত চোখমুখ দেখে ভয়ে ঘাবড়ে গেল,” ভাই, ভাই, আপনি এখানে কি করছেন?”

তারপর আশেপাশে তাকিয়ে বলল,” ইয়ামিন ভাই কই?”

ইয়ামিন তখনও দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। তৃষাণ ভেতরে আছে বিধায় সে ঢুকছে না। প্রীতমের কানের কাছে মুখ নিয়ে তৃষাণ ফিসফিস করে বলল,” এটাকে ঘর থেকে বের করে দাও। সকালে উঠে যেন আমি ওর চেহারাও না দেখি।”

প্রীতম বিপর্যস্ত গলায় বলল,” মানে ভাই? কি বলছেন? আমি উনাকে কিভাবে বের করবো?”

” ও এখানে থাকলে ওর বিপদ আছে। নিজের ভালো চাইলে যেন সকালের মধ্যে এখান থেকে চলে যায়।”

প্রীতম কিছু না বুঝে তাকিয়ে রইল কেবল। তৃষাণ বলল,” কাজটা যদি করতে পারো তাহলে তোমার পুরষ্কার আছে। পাঁচহাজার টাকা দিবো।”

প্রীতম চোখ বড় করে ফেলল। তৃষাণ তার ওয়ালেট থেকে দুইহাজার বের করে প্রীতমের হাতে গুঁজে দিল। তারপর বলল,” বাকি টাকা কাজ শেষ হওয়ার পর পাবে। তোমার কাছে সকাল পর্যন্ত সময়৷ এর মধ্যেই লাথি মেরে এটাকে বের করবে। আমাদের আশেপাশেও যেন না থাকে। সবচেয়ে ভালো হয় এমন কিছু করলে যেন উষ্ণতা নিজেই ওকে বের করে দেয়। করতে পারবে না এমন কিছু?”

প্রীতম টাকা হাতে নিয়ে বোকার মতো বসে রইল। কি উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না। তৃষাণ প্রীতমের কাঁধে হাত রেখে বলল,” অবশ্যই পারবে। সকালে উঠে যেন এর চেহারাও না দেখি আমি।”

তৃষাণ হিংস্র দৃষ্টিতে ইয়ামিনকের দিকে তাকাল একবার। তারপর বের হয়ে গেল। দরজা আটকে ইয়ামিন বিছানায় এসে বসল। হাসিমুখে প্রশ্ন করল,” বড়ভাই কি বললেন?”

প্রীতম হতভম্ব কণ্ঠে বলল,” আপনাকে ঘর থেকে বের করে দিতে বললেন।”

ইয়ামিন হাসল। প্রীতম বলল,” কাজটা করতে পারলে নাকি আমাকে পাঁচহাজার টাকাও দিবেন। দুইহাজার এডভান্স করে গেছেন।”

ইয়ামিন এবার উচ্চশব্দে হেসে উঠল। প্রীতম চিন্তিত গলায় বলল,” ভাই, ব্যাপারটা সিরিয়াস লাগছে। তৃষাণ ভাই বলেছেন আপনি এখান থেকে চলে না গেলে আপনার নাকি বিপদ আছে।”

” তুমিও তো চাও যে আমি এখান থেকে চলে যাই, তাই না?”

প্রীতমের মুখ শুকিয়ে গেল। সে আসলেই ইয়ামিনকে সহ্য করতে পারছে না। কারণটা হলো উষসী। ইয়ামিন প্রীতমের কাঁধে হাত রেখে বলল,” ডন্ট ওরি। উষসীর মামলায় আমি সাহায্য করব তোমাকে।”

প্রীতম অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকাল,” জ্বী ভাই?”

” হুম৷ আমি উষসীকে বোঝালেই ও বুঝবে। আমার কথা ও শুনবে এটা তো তুমি জানোই। তুমি যদি উষসীকে গার্লফ্রেন্ড হিসেবে চাও তাহলে আমার হেল্প তোমার দরকার?”

” জ্বী ভাই, দরকার। অবশ্যই দরকার।”

” তাহলে আমি যা বলছি তা করতে হবে।”

প্রীতম এক নিশ্বাসে বলল,” আমি সব করব ভাই। আপনি আমার গুরু ভাই।”

সে দুইহাজার টাকা রেখে দিয়ে বলল,” আপনাকে বের করার জন্য ঘুষ নিয়েছি। আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি পাপী, আমি অধম।”

সে কান ধরে ফেলল। ইয়ামিন প্রীতমের কাঁধ চাপড়ে বলল,” গড ব্লেস ইউ।”

সকালে ব্রেকফাস্টের সময় ইয়ামিনকে দেখেই তৃষাণের মেজাজ সপ্তম আসমানে উঠে গেল। উষসী সেজেগুজে বের হয়েছে। ঠিক ইয়ামিনের পাশে এসেই বসেছে। অতি উৎসাহে আর আহ্লাদে ইয়ামিনকে সে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। এসব দেখে উষ্ণতা আর অনুপমা মুখ টিপে হাসলেও তৃষাণ রাগে ফুঁসছে। সে প্রীতমের দিকে চাইল কঠিন দৃষ্টিতে। ভয়ে প্রীতম ভয়ে চিমসে গেল। তৃষাণ বলল,” এদিকে এসো প্রীতম। তোমার সাথে কথা আছে।”

প্রীতম ইয়ামিনের দিকে তাকাল। ইয়ামিন চোখের ইশারা দিল। সাথে সাথেই প্রীতম বুঝল তাকে কি করতে হবে। সে পকেট থেকে দুইহাজার টাকা বের করে তৃষাণের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,”স্যরি ভাই। কাজটা আমি করতে পারলাম না।”

সবার সামনে প্রীতম টাকা ফেরত দেওয়ায় তৃষাণের মুখ অপমানে থমথমে হয়ে উঠল। উষ্ণতা ভ্রু কুচকে বলল,” কিসের টাকা এটা? প্রীতম, কি কাজের কথা বলছো?”

প্রীতম বলতে নিলেই তৃষাণ ব্যস্ত গলায় বলল,” তেমন কিছু না। ওই একটা জিনিস কেনার জন্য বলেছিলাম। ও মনে হয় খুঁজে পায়নি। ঠিকাছে প্রীতম। লাগবে না। টাকা তোমার কাছে রাখো।”

প্রীতম মুখ মলিন করে বলল,” না ভাই, আপনার টাকা আপনি রেখে দিন। আমি ঘুষ- টুষ রাখতে পারব না।”

ইয়ামিন অন্যদিকে চেয়ে হাসছে। সে যা বলেছিল ঠিক তাই করছে প্রীতম। তৃষাণের দৃষ্টি রক্তিম হয়ে এলো। রাগে ভেতরে ভেতরে ফুঁসলেও মুখে কিছু বলতে পারল না। উষ্ণতা তার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে আছে,” ঘুষ মানে? কিসের ঘুষ?”

প্রীতম সত্যি কথা বলে দিতেই নিচ্ছিল৷ তৃষাণ তাড়াহুড়ো করে বলল,” তেমন কিছু না। তোমরা বুঝবে না।”

উষ্ণতা হাসার ভাণ করে বলল,” তোমার আচরণ আসলেই আমি বুঝতে পারছি না। কাল থেকেই কেমন অদ্ভুত আচরণ করছো৷ রাতে তো ঘুমাতেও দেখলাম না তোমাকে। আমরা বরং বিকালের ফ্লাইটে যাই। তুমি এখন একটু ঘুমিয়ে নাও।”

তৃষাণ ইয়ামিনের দিকে চেয়ে চোয়াল শক্ত করে বলল,” না।”

যতক্ষণ ইয়ামিন এখানে থাকবে, সে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে না। উষ্ণতা বলল,” কেন?”

” সকালের ফ্লাইটের টিকিট কাটা হয়ে গেছে। আমরা একটু পরেই বের হবো।”

উষসী প্রথমে বিকালে থাকার ব্যাপারে খুশি হতে নিয়েছিল। কিন্তু তৃষাণের উত্তর শুনেই মনখারাপ হয়ে গেল আবার। ইশ, কেন সবসময় তৃষাণ এমন করে? তার খুশিতে বাগড়া দেওয়াই যেন তৃষাণের প্রধান কাজ।

ফ্লাইটে উঠার আগে উষসী জানতো ইয়ামিন শুধু তাদের সাথে দিল্লি পর্যন্তই যাবে। কিন্তু ফ্লাইটে উঠার পর অনুপমার কাছে শুনল, ইয়ামিন আসলে তাদের সাথে বাংলাদেশেই যাচ্ছে! উষসী অনেকক্ষণ থম মেরে তাকিয়ে রইল। তার দুনিয়া দোলনার মতো দুলছিল। সে কি আসলে স্বপ্ন দেখছিল? নিজের হাতে বড় করে একটা চিমটি কেটে দাগ বানিয়ে ফেলার পর বুঝলো, আসলে স্বপ্ন না! এই সুন্দর সকালটা বাস্তব।

হঠাৎ করেই উষসীর পুরো দুনিয়া অন্যরকম হয়ে গেল। ইয়ামিনকে ছেড়ে যাওয়ার বিষণ্ণতায় ডুবে ছিল সে। আর এখন সবকিছু স্বর্গীয় লাগছে। উষসী তো কিছুক্ষণ আগেও ভাবছিল, ইয়ামিন যখন দিল্লীতে নেমে যাবে তখন সে কাঁদতে কাঁদতে সাগর বানিয়ে ফেলবে। বিরহ বিলাস করবে। তবে এখন আর বিরহ বিলাস না। এখন শুধু হবে সুখ বিলাস। উষসী মনে মনে পাখির মতো ডানা মেলে উড়তে লাগল। যে পাখি কেবল ইয়ামিন নামক গাছের ডালেই বসতে চায়।

উষসী এতো পাগলামি করছিল যে অনুপমা ওর খুশি দেখে আসল কথাটাই আর বলার সাহস পেল না। এখন যদি সে বলে দেয় যে উষ্ণতা ইয়ামিনের সাথে তার বিয়ের কথা ভাবছে তাহলে মনে হয় এই মেয়ে খুশিতে বেহুশ হয়ে যাবে!

উষসীর পাশের সিটে হঠাৎ প্রীতম এসে বসে পড়ল। রেগে তাকাল উষসী,” খবরদার এখানে বসবি না তুই। যা বলছি!”

” আরে, এমন করছিস কেন? আমি না বসলে কি ইয়ামিন ইব্রাহীম আসবে তোর পাশে বসার জন্য?”

” অবশ্যই সে বসবে। তুই তৃষ্ণার সাথে গিয়ে বস।”

” না। আমি উঠবো না। এটাই আমার জায়গা।”

এবার উষসী নিজেই উঠে গেল। তার উড়ু উড়ু পাখির মতো মনটা শুধুই ইয়ামিন নামক গাছের ডালে ছুটে যেতে চাইছে। কিন্তু লজ্জায় এই কথা কাউকে বলতে পারছে না সে। তারপর উষ্ণতা নিজেই উষসীকে বলল,” উষু, তুই না উইন্ডো সিট চেয়েছিলি? আয় এখানে এসে বোস। উইন্ডো আছে।”

উষসীর হৃৎপিন্ড ছলাৎ করে উঠল। উষ্ণতা আপু কি বলে এইসব? সে তো প্লেনের উইন্ডো সিট ভয় পায়। জানালার দিকে তাকালেই ভয়ে প্রেশার বেড়ে যায় তার। আর এটা তো উষ্ণতা আপুর ভালো করে জানার কথা!তবুও কেন বলছে?

রহস্য জানতে উষসী এগিয়ে গেল। উষ্ণতা যেখানে বসেছে তার দুইধাপ পড়েই একটা উইন্ডো সিটে উষসীকে বসতে বলা হয়েছে। আর পাশেই বসে আছে ইয়ামিন। উষসী খুশিতে টইটম্বুর হয়ে তাকাল উষ্ণতার দিকে। উষ্ণতা তাকে চোখ মারল। উষসী নিজের খুশি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সারাজীবন প্লেনের উইন্ডো সিট ভয় পেয়ে আসা মেয়েটা ভালোবাসার টানে সেখানে গিয়েই বসল। মানুষ তো ভালোবাসার টানে অগ্নিপরীক্ষাও দেয়। আর উষসী সামান্য এইটুকু পারবে না?

প্লেন তখনও উড্ডয়ন করেনি। প্রীতম এসে দেখল উষসী ইয়ামিনের পাশে বসে গেছে। আজব তো! তবে একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। ইয়ামিন তো বলেছিল তাকে সাহায্য করবে৷ তাই ভয়ের কারণ নেই। সে নিজের সিটে ফিরে এসে ইয়ামিনকে মেসেজ লিখল,” ভাই।”

ইয়ামিন রিপ্লাই করল,”কি?”

” উষসী তো আপনার পাশে বসেছে। ওকে আমার সম্পর্কে একটু ভালো ভালো কথা বলেন। যেন একটু হলেও আমার প্রতি আগ্রহী হয়। মেয়েটা আজকাল আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না।”

” ঠিকাছে, বলে দিবো। নো টেনশন।”

প্রীতম স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল। ইয়ামিন ফোন রেখে উষসীর দিকে তাকাল। উষসী কেমন কাঁপছে। ইয়ামিন অবাক হয়ে বলল,” কি হলো তোমার?”

উষসী কিছু বলতে পারছে না। বিমান উড্ডয়নের পাঁচমিনিট পূর্বে সবার মোবাইল ফ্লাইট মোডে করতে হলো। তাই প্রীতম আর ইয়ামিনকে মেসেজ করার সুযোগ পেল না। যখন বিমান উড্ডয়নশীল, উষসীর হাত-পা তখন থরথর করে কম্পনশীল। চোখ বুঁজে সে বিভিন্ন দোআ পড়তে লাগল। তার ভয় লাগছে। ভয়ে একদম আধমরা অবস্থা। সে উচ্চতা ভয় পায়, আবার উইন্ডো সিটে উঠেছে।

ইয়ামিন মনে হয় বিষয়টা বুঝতে পেরেই উষসীকে নিজের সাথে চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল,” এতোই যখন ভয় তাহলে উইন্ডো সিটে কেন বসলে?”

উষসী লজ্জায় একদম লালিমা হয়ে গেল। সে কেন এইখানে বসেছে সেটা ইয়ামিনকে কিভাবে বলবে? উষসীকে কাঁপতে দেখে ইয়ামিন খুব ভয় পাচ্ছে। সে উষসীকে সাহস দেওয়ার জন্য তার মাথা নিজের কাঁধে নিয়ে চেপে ধরল। উষসী চোখ বন্ধ করে ফেলল। মনে মনে বলল,” যেখানে আপনি আছেন, সেখানে আমার কোনো ভয় নেই। আপনার প্রত্যেকটা শব্দ আমার সাহস। আপনার শক্ত একজোড়া হাত আমার অবলম্বন। আর আপনার এই কাঁধটা আমার পরম সম্বল!”

উষসী থরথর করে কাঁপছিল আর ইয়ামিনের কাঁধে মুখ গুঁজে ছিল। ইয়ামিন তার কাঁপাকাঁপি দেখে খুব ঘাবড়ে গেছে। তাইতো আরও ভালো করে ধরে রাখল। যাদের উচ্চতাভীতি আছে তারা অনেক সময় ভয়ে অজ্ঞানও হয়ে যায়। ইয়ামিন উষসীকে সাহস দিতে বিভিন্ন কথা বলতে লাগল। তারপর হঠাৎ ভাবল, প্রীতমকে নিয়েই কিছু বলা যাক। উষসীর ভয়টাও কাটবে। ইয়ামিন ডাকল,” এই উষসী।”

উষসী জড়ানো গলায় শুধু বলল,” হু?”

ইয়ামিন বলল,” প্রীতমের থেকে দূরে থাকবে। বন্ধু হলেও কার মনে কি আছে তুমি কিন্তু জানো না….”

ইয়ামিন তার পরামর্শ দিচ্ছে। কিন্তু উষসী এসব শুনছে কই? সে তো বুদ হয়ে আছে ইয়ামিনের গলার কাছে লেগে থাকা পারফিউমের নেশা ধরানো ঘ্রাণে! প্রতিটি ক্ষণে ক্ষণে সে কাতর হয়ে পড়ছে। আহা,এই ঐশ্বরিক মুহুর্ত কোনোদিন শেষ না হোক!

চলবে

আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-১৬+১৭

0

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ১৬
লিখা- Sidratul Muntaz

এখন প্রায় নয়টা বাজে। ঘুটঘুটে অন্ধকার চারদিকে। নিজেকেই দেখা যাচ্ছে না, উষসী পানির দোকান কি করে দেখবে? আর আশ্চর্য ব্যাপার, যে লোক একটা মানুষকে মেরে অবস্থা খারাপ করে ফেলল উষসী তার জন্যই পানি খুঁজতে এসেছে! যদিও ইয়ামিন মেরে কোনো ভুল কিছু করেনি। প্রীতম যেটা করতে যাচ্ছিল সেটাই ভুল ছিল। ইয়ামিন যদি আজ না আসতো, তাহলে প্রীতমের জায়গায় হয়তো উষসীকেই হসপিটালে যেতে হতো! আরেকটু হলেই প্রীতমের অত্যাচারের ভয়ে উষসী বেহুশ হয়ে যাচ্ছিল।

উষসী দৌড়ে ইয়ামিনের কাছে গিয়ে বলল,” আমাদের দ্রুত ওকে হসপিটালে নিতে হবে। নাহলে ওর কিছু হয়ে গেলে আপনি ফেঁসে যাবেন। আমি চাই না এর জন্য আপনার কিছু হোক।”

ইয়ামিন তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো। উষসীকে এইবার ঘাড় উঁচু করতে হলো। ইয়ামিনের চেহারা ভালোমতো দেখার জন্য একটু পিছিয়েও যেতে হলো। লোকটা যে তার চেয়ে দ্বিগুণ লম্বা! ইয়ামিন ভ্রু কুচকে বলল, “পানি পেয়েছো?”

” পানির জন্য বসে থাকলে যদি কেউ দেখে ফেলে? আপনাকে তো পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে।”

” সেসব তোমার ভাবতে হবে না।”

” অবশ্যই আমার ভাবতে হবে।”

ইয়ামিন বিরক্ত গলায় বলল,” কেন?”

উষসীর দৃষ্টি মোহাচ্ছন্ন। সে বিভোর গলায় বলল,” কারণ আমি আপনাকে…” এক মুহুর্ত থামল সে। লম্বা শ্বাস টেনে নিয়ে আবার বলল,” আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন। তাই আমিও আপনাকে বাঁচাতে চাই।”

ইয়ামিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” লেটস গো দেন।”

রাস্তায় পড়ে থাকা ব্যাগটা কাঁধে নিল ইয়ামিন। উষসী এতোক্ষণে খেয়াল করল ইয়ামিনের সাথে ব্যাগও আছে। এতোরাতে ব্যাগপ্যাক গুছিয়ে কোথায় যাচ্ছিল সে?

প্রীতমকে হাসপাতালে নেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ এলো জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। উষসী আর ইয়ামিনকে ইন্সপেক্টরের সঙ্গে কথা বলতে হলো। ইন্সপেক্টর আফজাল প্রথমেই জানতে চাইলেন,” ছেলেটার এই অবস্থা কিভাবে হলো?”

ইয়ামিন সত্যিটাই বলতে নিচ্ছিল। কিন্তু উষসী তাড়াহুড়োয় উত্তর দিল,” পাহাড় থেকে পড়ে গেছিল ও।”

আফজাল চোখ বড় করে তাকালেন,” ও তাই? পাহাড় থেকে পড়েই এই অবস্থা?”

ইয়ামিন অবাক হওয়া দৃষ্টি নিয়ে তাকাল উষসীর দিকে। উষসী কনফিডেন্সের সাথে মিথ্যা বলল,” জ্বী। আমরা পাহাড়ে উঠেছিলাম। তারপরেই তো এই এক্সিডেন্ট…”

ইন্সপেক্টর আড়চোখে ইয়ামিনকে দেখে বললেন,” পেশেন্টের তাহলে গলায়, মুখে, হাতে স্ক্র্যাচ কিসের? পাহাড় থেকে পড়লে তো এমন হওয়ার কথা না। দেখে মনে হচ্ছে কেউ ইচ্ছে করে মে-রেছে।”

উষসী নিজের উপস্থিত বুদ্ধির প্রয়োগ করল,” কুকুরের ধাওয়া খেয়ে ও পাহাড় থেকে পড়েছে। স্ক্র্যাচগুলো তখনি হয়েছিল।”

ইয়ামিন রাগী দৃষ্টিতে তাকাল। শেষমেষ সে কি-না কুকুর হয়ে গেল? উষসী কোমল হাসি দিল যার অর্থ -” রাগ করবেন না প্লিজ। আপনাকে বাঁচানোর জন্যই তো সব করছি।”

ইন্সপেক্টর বললেন,” আপনি শিউর এগুলো কুকুরের স্ক্র্যাচ?”

উষসী একটু দ্বিধায় পড়ে গেল। মানুষের স্ক্র্যাচ আর পশুদের স্ক্র্যাচে কি পার্থক্য থাকে? পুলিশ তো বুঝেও ফেলতে পারে!

সে আমতা-আমতা করে বলল,” আমি কখন বললাম যে এগুলো কুকুরের স্ক্র্যাচ? মানে ওকে বাঁচাতে গিয়ে আমাদের হাত থেকেই স্ক্র্যাচ লেগেছে। ইয়ামিন ভাইয়া ওর কলার টেনে ধরেছিল উপরে তোলার জন্য। তাই ওর শার্ট ছিড়ে গেছে দেখুন! আর আমি হাত টেনে ধরেছিলাম। এইতো আমার হাতেও জখমের দাগ আছে!”

প্রথমে প্রীতমের সাথে ধস্তাধস্তি করার সময় উষসীর হাতে জখম হয়েছিল। সেই জখমের দাগটাই দেখানোর চেষ্টা করল সে। ইয়ামিন উষসীর চিকন বুদ্ধি দেখে হতবাক। আফজাল তখনও সন্দেহের দৃষ্টিতে বললেন,”আপনারা এতোরাতে পাহাড়ে কি করছিলেন?”

উষসী কোমড়ে হাত গুঁজে বলল,” আশ্চর্য ব্যাপার! কাশ্মীর তো আমরা ঘুরতে এসেছি, তাই না? দিনে ঘুরবো না রাতে ঘুরবো এটা তো আমাদের চয়েজ। আমরা নিশাচর প্রাণী। তাই রাতে ঘুরতেই বেশি ভালোবাসি। আর আপনি এতো কুয়েশ্চন করলে ডাক্তার ট্রিটমেন্ট করবেন কখন? পেশেন্ট ম-রে যাক সেটাই চান নাকি?”

ইয়ামিন অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে হাসল। বাচ্চা একটা মেয়ে, অথচ কেমন ননস্টপ মিথ্যা বলে যাচ্ছে। পুলিশকে পর্যন্ত কথার প্যাঁচে ধরাশায়ী করে দিচ্ছে। আফজাল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,” আচ্ছা, আগে ট্রিটমেন্ট হোক। এই বিষয়ে পরে আরও বিস্তারিত কথা হবে আমাদের। পেশেন্ট সুস্থ হলে আমি আবার আসব।”

উষসী খুব স্বাভাবিক মুখে বলল,” ওকে, আসবেন।”

পুলিশ চলে যাওয়ার পর ইয়ামিন উষসীর দিকে তাকিয়ে হাসল৷ তার খুব ছোটবেলার একটা কথা মনে পড়ে গেছে। তখন উষসীর কেবল আটবছর।ইয়ামিনের সতেরো। উষসীকে মাঝরাস্তায় গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েছিল সে। উষসী হারিয়ে গেছিল। তৃষাণ, উষ্ণতা, সবাই ছোট্ট উষসীকে তন্নতন্ন করে খুঁজছিল। পরে অবশ্য ইয়ামিনই তাকে খুঁজে বের করেছে। কিন্তু তখনও উষসী কাউকে বলেনি ইয়ামিনের জন্যই যে তার বিপদটা হয়েছিল। বরং সে এভাবেই মিথ্যা বলে ইয়ামিনকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। তখন তৃষাণের কাছে মিথ্যা বলেছিল উষসী। আর এখন পুলিশের কাছে বলেছে। প্রত্যেকবারই ইয়ামিনকে বাঁচানোর জন্য।

উষসী ভ্রু কুচকে বলল,” আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে কি ভাবছেন?”

” কিছু না তো!” কাঁধ ঝাঁকালো ইয়ামিন। উষসী চোখ মেরে বলল,” কেমন দিলাম বেটা পুলিশকে?”

ইয়ামিন বলল,” আরেকটু হলেই তো আমাকে কুকুর বানিয়ে দিচ্ছিলে।”

উষসী কানে হাত রেখে বলল,” স্যরি। আমি নর্ভাস হয়ে গেছিলাম। কিভাবে ম্যানেজ করব বুঝতেই পারছিলাম না। কুকুরের ব্যাপারটাই কেন যেন মাথায় আসল।”

” সত্যিটা বললেই হতো।”

উষসী জেদি গলায় বলল,” মোটেও হতো না। আপনাকে পুলিশ থানায় নিয়ে যেতো আর সেটা কি আমি তাকিয়ে দেখতাম?”

ইয়ামিন সামান্য হেসে বলল,” চলো।”

” কোথায়?”

” ক্যান্টিনে। পানি এখনও খাওয়া হলো না আমার।”

” ওহ, স্যরি! ভুলেই গেছিলাম। চলুন, চলুন।”

উষসী ক্যান্টিনে গিয়ে নিজের হাতে ইয়ামিনকে পানি ঢেলে খাওয়ালো। ইয়ামিন ততক্ষণে খাবার অর্ডার করে ফেলেছে। উষসীর নিজেরও খুব ক্ষিদে পেয়েছিল। মনে হচ্ছে কত বছর ধরে না খাওয়া! কাশমীরের কোনো খাবারই উষসীর পছন্দ হয়নি। সব খাবার অতিরিক্ত মশলাযুক্ত। কিন্তু সৌভাগ্যবশত এইখানে বিরিয়ানি পাওয়া গেছে।

ইয়ামিন উষসীকে জিজ্ঞেস করে বিরিয়ানিই অর্ডার করল। হসপিটালের ক্যান্টিনেও যে বিরিয়ানি পাওয়া যাবে উষসী চিন্তাই করেনি। কিন্তু খাওয়ার সময় বোঝা গেল, বাংলাদেশী বিরিয়ানি আর কাশ্মীরি বিরিয়ানির মধ্যে পার্থক্য কতটা!

ইয়ামিন মনে হয় সবকিছুতেই অভ্যস্ত। সে চুপচাপ খাচ্ছে। হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,” আচ্ছা, ছেলেটার সাথে তোমার ফ্রেন্ডশীপ কয়দিনের?”

” চার-পাঁচবছর!”

” যতই গভীর ফ্রেন্ডশীপ হোক, কাউকে এতোটা বিশ্বাস করা উচিৎ না যে রাতের অন্ধকারে একা রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হবে। তোমার নিজের উপর প্রটেক্টিভ হওয়ার দরকার ছিল। সাথে বড় কাউকে আনলে না কেন? ওই সময় আমি না এলে কি হতো তোমার?”

উষসী মাথা নিচু করে বলল,” আমি ওর সাথে রাস্তায় ঘুরে বেড়াইনি বিশ্বাস করুন। আমাদের হঠাৎ দেখা হয়েছে।”

” তুমি একা একটা মেয়ে মানুষ হয়ে এতোরাতে বের হলেই কেন? দেখছো না এলাকাটা কত নীরব? এটা মোটেও মেয়েদের জন্য সেইফজোন না।”

উষসী এবার কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,” আপনার জন্যই তো বের হয়েছি আমি। এখন আপনিই দোষ দিচ্ছেন?”

” আমার জন্য বের হয়েছো মানে? আমি বলেছি বের হতে?” রেগে তাকাল ইয়ামিন।

উষসী বলল,” আপনি আমাকে শ্যুটিং দেখার জন্য আসতে বলেছিলেন। সেজন্যই তো আমি কত কায়দা করে বের হয়েছিলাম হোটেল থেকে।”

” তাহলে তো তোমার আসার কথা ছিল বিকালে। তুমি সন্ধ্যায় আসবে কেন?”

উষসী চোয়াল শক্ত করে বলল,” আমি সময়মতোই এসেছিলাম। কিন্তু আপনি আমাকে দেখেননি।”

” মানে?”

” কিছু না। বাদ দিন।”

” বলো!”

উষসী অভিমানী গলায় বলল,” আমি আপনার সামনেই দাঁড়িয়েছিলাম। এমনকি কথাও বলেছি। আপনি না দেখেছেন আর না শুনেছেন!”

ইয়ামিন বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,” আই এম স্যরি। হয়তো আমি তোমাকে নোটিশ করিনি। তোমার মতো একহাজার মানুষ ছিল ওখানে।”

উষসী একটু আহত হলো। সে কি সবার মতো? একটুও আলাদা কেউ নয়? ইয়ামিন তাকে নোটিশই করল না!

হঠাৎ করেই হোটেলের কথা মনে পড়ল উষসীর। এখন রাত দশটা বাজছে। সবাই নিশ্চয়ই তাকে খুঁজতে খুঁজতে কাহিল! দ্রুত হোটেলে একটা ফোন করে জানানো দরকার। কিন্তু উষসীর সাথে মোবাইল নেই। সে ইয়ামিনকে বলল,” আপনার কাছে ফোন হবে?”

” হ্যাঁ।”

” আমি মাকে একটা ফোন করবো।”

” ফোন নাম্বার মুখস্ত আছে?”

হয়ে গেল না বিপদ! উষসীর আসলে কারো নাম্বার এই মুহুর্তে মনে পড়ছে না। চিন্তায় নখে কামড় দিয়ে বলল,” কারো নাম্বারই মুখস্ত নেই। এইবার কি হবে?”

উষসী অস্থির হয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। পায়চারী করতে করতে বলল,” সবাই টেনশনে মরে যাবে।”

” রিল্যাক্স! তোমরা যেই হোটেলে উঠেছো সেই হোটেলের নাম মনে আছে?”

” আছে।”

উষসী হোটেলের নাম বলল। ইয়ামিন গুগল সার্চ করে হোটেলের ফোন নাম্বার বের করে দিল। তারপর রিসেপশনে কল করা হলো। রিসিভ করলেন হোটেলের ম্যানেজার। উষসীরা যেই নাম দিয়ে টিকিট বুক করেছিল সেই নামের নাম্বারটা জানতে চাইল ইয়ামিন। ম্যানেজার বললেন,” আপনি কি তৃষাণ স্যারের নাম্বার চাইছেন? কি দরকার আমাকে বলুন?”

উষসী কণ্ঠ শুনেই বুঝে গেল এটা আরশোলা মুখো সেই ম্যানেজারের কণ্ঠ। ঝট করে ইয়ামিনের হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে বলল,” আমার মাকে ডেকে দিন। মায়ের সাথে আমার কথা আছে।”

” আপনি কি উষসী ম্যাম?”

” জ্বী।”

” আগে বলুন আপনি বের হলেন কিভাবে?আপনাকে সবাই কত খুঁজছে জানেন?” লোকটির কণ্ঠে আগুন সমান উত্তাপ।

উষসী ফিচেল হেসে বলল,” আপনিই তো আমাকে বের হতে সাহায্য করেছেন। মনে নেই?”

” হোয়াট? আমি?”

” হুম। আপনার কঠোর তত্ত্বাবধানে থাকার পরেও আমি কিভাবে বের হলাম বলেন তো? যদি না আপনি সাহায্য করেন?”

“মিথ্যে অভিযোগ লাগাবেন না।”

“নিশ্চয়ই লাগাবো। এই মিথ্যে অভিযোগেই আমি আপনাকে ফাঁসাবো যদি আপনি আমাকে হেল্প না করেন।”

” আমি আপনাকে কি হেল্প করবো?”

” সেটা সময়মতো জানবেন। আপাতত আমার পরিবারের মানুষদের জানিয়ে দিন আমি আল-বার্ক হসপিটালে আছি। তারাও যেন এখানে চলে আসে। আমার কিছু হয়নি। তবে প্রীতম একটু আহত হয়েছে।”

উষসী ফোন রেখে ইয়ামিনের উদ্দেশ্যে বলল,” আচ্ছা, আপনি ব্যাগ নিয়ে কোথায় যাচ্ছিলেন?”

“মুম্বাই।” ইয়ামিন ফোন পকেটে ভরে শান্ত স্বরে জবাব দিল।

উষসী চোখ বড় করে বলল,” মানে? ফিরে যাচ্ছেন নাকি?”

” হুম।”

” কিন্তু আমি তো জানি আপনি কাশ্মীর আরও অনেকদিন থাকবেন! এইখানে আপনার নতুন মিউজিক ভিডিওর শ্যুটিং হবে না?”

ইয়ামিন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” মানুষ যা পরিকল্পনা করে তা সবসময় হয় না। মাঝে মাঝে খুব অপ্রত্যাশিত কিছু হয়ে যায়।”

” কি হয়েছে?”

” কিছু না৷ এসব বিষয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না এখন। ”

” বলুন না, কামলা সিং এর সাথে কি আপনার শ্যুটিং হবে না? মেয়েটা তো খুব কিউট। জানেন, তাকে অনেকটাই উষ্ণতা আপুর মতো দেখতে লাগে।”

ইয়ামিন হেসে বলল,” তোমার আপুর কাছে কামলা কিছুই না। সে একটা ডিভা। শী ইজ কুইন!” মুগ্ধতা ঝরে পড়ল ইয়ামিনের কণ্ঠ থেকে।

উষসী মুচকি হেসে বলল,” আপনি আপুকে এতো পছন্দ করেন! অথচ আপু মনে হয় আপনাকে চিনতেও পারবে না। ”

উষসীর মনখারাপ হয়ে গেল। ইয়ামিন বিষাক্ত নিশ্বাস ত্যাগ করল। এটাই তো তার জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ যে উষ্ণতা কখনও তাকে চিনবে না!

উষসী হঠাৎ বলল,” আচ্ছা, কীর্তি ম্যাডামের সাথে আপনার একটা মিউজিক ভিডিও আসার কথা ছিল না?”

ইয়ামিন কেমন যন্ত্রের মতো বলল,” আসবে না। ”

” তাহলে কার সাথে আসবে?”

” কারো সাথেই না।”

” কেন?”

” কারণ আমি শপথ করেছি, এখন থেকে কোনো মেয়ে কো-আর্টিস্টের সাথে কাজ করবো না। মেয়েদের সংস্পর্শেও যাবো না। মেয়েজাতি বয়কট করলাম।”

উষসী এমন মজার কথা শুনে না হেসে থাকতেই পারল না। ইয়ামিন এমন সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছে তা সে জানে না। তবে তার অদ্ভুত শান্তি লাগছে। ইয়ামিনের পাশে তো এমনিও সে কোনো মেয়েকে সহ্য করতে পারে না৷ আর এখন মেয়েই বয়কট! ওয়াও! উষসী খোঁচানোর উদ্দেশ্যে বলল,” কিন্তু এখনও তো একটা মেয়ের সংস্পর্শেই আছেন আপনি।”

ইয়ামিন ‘চ’ এর মতো বিরক্তিসূচক শব্দ উচ্চারণ করল,” তুমি আর মেয়ে কি এক হলে?”

” মানে? আমাকে কি আপনার মেয়ে মনে হয় না?”

উষসীর কণ্ঠে বিস্ময়! ইয়ামিন হেসে বলল,” মনে হয়। কিন্তু তুমি তো ছোট। বাচ্চা মেয়ে!”

উষসী এই কথা শুনে হতভম্ব। বড় বড় চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ সামনে যেতে লাগল। ইয়ামিন বলল,” কোথায় যাচ্ছো?”

উষসী জবাব দিল না। থামলও না। অনেকটা দূর চলে গেল। একদম হসপিটালের করিডোরে এসে থামল। একবার একটা চেয়ার টেনে বসল৷ তারপর আবার দাঁড়াল। একটুও ভালো লাগছে না তার। আঠারো বছর বয়সেও কেউ বাচ্চা কিভাবে হয় উষসীর মাথায় ঢুকছে না। একটা লোক উষসীর কান্ডকারখানা অবাক হয়ে দেখছিল। উষসী তার কাছে গিয়ে বলল,” আচ্ছা একটা কথা বলুন তো?”

” কেয়া বাত হ্যায়?”

লোকটির মুখে হিন্দি শুনে উষসীও হিন্দিতেই বলল,” আমাকে দেখে আপনার কি মনে হয়? বলতে পারবেন আমার বয়স কত?”

লোকটা উষসীকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলল,” আপনি নিজে জানেন না আপনার বয়স কত?”

” জানি। কিন্তু আপনার কি মনে হচ্ছে? আমাকে দেখে কি বাচ্চা মনে হয়? আটবছরের পিচ্চির মতো লাগে?”

” আপনাকে দেখে আটবছর কেন মনে হবে? মনে হচ্ছে আঠারো-উনিশ বছর!”

উষসী স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,” এই কথাটা একজনকে বুঝিয়ে বলতে পারবেন, প্লিজ? সে আমাকে আটবছর বয়সে দেখেছিল। এখন আবার দেখা হয়েছে। কিন্তু সে এটাই বুঝতে পারছে না যে আমি এখন বড় হয়ে গেছি!”

লোকটা পলক না ফেলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কে জানে? মনে হয় উষসীকে পাগল ভাবছিল!

চলবে

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ১৭
লিখা- Sidratul Muntaz

হসপিটালে ঢুকেই যুথি উষসীকে জোরে একটা থাপ্পড় মা-রলেন। পরিবারের সবার সামনে এমনকি ইয়ামিনের সামনেও জোরালো চড় খেয়ে উষসীর তেমন কোনো ভাবান্তর হলো না। হোটেল থেকে পালিয়ে সে প্রায় চার-পাঁচঘণ্টা সবাইকে যে পরিমাণ হয়রানি করেছে সে তুলনায় এমন হালকা-পাতাল কয়েকটা চড় কিছুই না!

চড় খেয়ে গালে হাত রেখে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উষসী হাসল। উষ্ণতার দিকে ফিরে প্রশ্ন করল,” আপু, তোমরা না পেহেলগাম গিয়েছিলে? এতো জলদি ফিরে এলে কেন?”

উষ্ণতার গা জ্বলে যাচ্ছে রাগে। দুশ্চিন্তায় পাগল হয়ে গেছিল সেও। ফট করে চড় মারল উষসীর অন্যগালে। ধমক দিয়ে বলল,”সবকিছুই কি ফাজলামি পেয়েছিস তুই? কোন সাহসে হোটেল থেকে বের হলি?”

চড়ের ধাক্কায় উষসীর মুখ ঘুরে গেল তৃষাণের দিকে। এবার সে হেসে তৃষাণকে বলল, ” তৃষাণ ভাইয়া,আমাকে নিয়ে খুব টেনশনে পড়ে গিয়েছিলে নাকি তোমরা? অযথাই টেনশন করেছো। দেখো, আমার কিন্তু কিছুই হয়নি!”

তৃষাণের খুব মেজাজ খারাপ হলেও সবার মতো উষসীকে চড় মারল না সে। মেঘের মতো গম্ভীর কণ্ঠে বলল,” আমি এতো নিষেধ করার পরেও তুমি কোন সাহসে হোটেল থেকে বের হয়েছো? কিছু হয়নি বুঝলাম। কিন্তু যদি হয়ে যেতো?”

উষসী ফিক করে হেসে ফেলল। ওর আচরণে প্রত্যেকে বিস্মিত। সবচেয়ে বেশি ইতস্ততবোধ করছে ইয়ামিন।

উষসীকে পরপর দুইবার চড় খেতে দেখে কিছুটা ভড়কেও গেছে সে। তাছাড়া এমন পারিবারিক ব্যাপারের মধ্যে নিজেকে বিচ্ছিন্ন কোনো বস্তু মনে হচ্ছে। তার কি এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা উচিৎ? বার বার নজর চলে যাচ্ছে উষ্ণতার দিকে। হৃদয়ে শুরু হয়েছে অস্বাভাবিক আলোড়ন।

একবার সে ভাবল এখান থেকে সরে যাবে। কিন্তু এখনও কেউ তাকে লক্ষ্য করেনি। সরতে গেলেই বোধ হয় লক্ষ্য করবে। ইয়ামিন কারো নজরবন্দী হতে চায় না। তাই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল এক কোণায়। খুব সাবধানে নিজের গলায় ঝুলানো মাস্কটা মুখে পরে নিল। কেউ যাতে তার দিকে তাকালেও সে অস্বস্তিবোধ না করে।

ডোনা কাছে এসে উষসীর মাথাটা বুকে নিয়ে বললেন,” আহারে! আমার সোনা মেয়েটাকে এভাবে মারছো কেন তোমরা? ফরসা টসটসে গালে দাগ পড়ে গেলে কেমন হবে?”

তৃষাণের জিদ উঠে গেল মায়ের কথা শুনে। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,” তোমার আশাকারা পেয়েই ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।”

ডোনা অবাক হয়ে বললেন,” আজব! আমি কি করলাম? তোরা সবাই মিলেই না মেয়েটার উপর হামলে পড়েছিস। আচ্ছা ওর কি নিজের শখ-আহ্লাদ বলতে কিছু নেই? আমাদের দুই বুড়ির সাথে সারাদিন বসে বোর হচ্ছিল বলেই তো প্রীতমের সাথে একটু বাইরে গিয়েছিল।”

তৃষাণ চোখ ছোট করে বলল,” প্রীতমের সাথে বাইরে গিয়েছিল মানে? আব্দুল তো আমাকে অন্যকথা বলল! ”

” ওই মেনেজারের কথা কি তুই আমার চেয়ে বেশি বিশ্বাস করিস? আমি নিজের চোখে দেখেছি প্রীতম এসে উষসীকে নিয়ে গেছে। উষু তো যেতেই চায়নি।”

ডোনার মিথ্যা শুনে উষসী চোখ পিটপিট করে তাকাল। তার বিশ্বাস হচ্ছে না যে ভালো আন্টি তাকে বাঁচানোর জন্য আদরের ছেলের সাথে এই ভাবে মিথ্যা বলছে! কিন্তু তৃষাণও এতো সহজে মিথ্যা গেলার পাত্র নয়।

রাগী গলায় বলল,” তাহলে তুমি এতোক্ষণ এই কথা না বলে এখন বলছো কেন? আমরা সবাই যে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হলাম?”

” আমার মনে ছিল না। এখন উষুকে দেখে মনে পড়েছে।”

ডোনা কথা শেষ করে অন্যদিকে তাকাল। তৃষাণের সন্দেহী দৃষ্টি তার মায়ের মুখের দিকে। ছেলের চোখে চোখ মিলিয়ে মিথ্যে বলতে পারেন না ডোনা। ঠিকই ধরা পড়ে যাবেন।

উষসীর বেশ মজা লাগছে সিচুয়েশনটা। ডোনা আলগোছে উষসীকে ইশারাও দিলেন। উষসী সাথে সাথে ঘাড় নাড়িয়ে বলল,” হ্যাঁ, তাইতো। প্রীতম জোর করছিল বলেই না আমি বের হয়েছি। বিশ্বাস না হলে মেনেজার আব্দুল ভাইকে ফোন করে জিজ্ঞেস করো! উনি নিশ্চয়ই আমার সামনে তোমাকে মিথ্যে বলবেন না।”

তৃষাণ যেন তৈরীই ছিল।সে সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে ফোন নিয়ে আব্দুলকে কল দিল। ওই পাশ থেকে আব্দুল বলল,”হ্যালো স্যার।”

” আব্দুল, আমি কি শুনছি এসব? উষসী নাকি প্রীতমের সাথে বের হয়েছিল?”

” না তো স্যার!”

তৃষাণ কঠিন দৃষ্টিতে উষসীর দিকে তাকাল। উষসী ফোনটা তৃষাণের থেকে নিয়ে বলল,” মিথ্যে বলছেন কেন আব্দুল ভাই? হুম? আমি কিন্তু মিথ্যা অভিযোগ করিনি। আপনার অনুমতি নিয়েই বের হয়েছিলাম তাই না? বলুন, আপনার মনে নেই?”

” স্যরি ম্যাম। আমার মনে পড়ছে না।”

” তাহলে আপনার কি মনে পড়ছে বলুন? আমাকে একা বের হতে দেখেছেন আপনি? অথবা পালাতে দেখেছেন? প্রমাণ করতে পারবেন?”

আব্দুল চুপ হয়ে গেল। উষসীকে সে আটকাতে পারেনি এটা তার গাফিলতি। তৃষাণ বলল,” কি ব্যাপার আব্দুল? তুমি চুপ কেন?”

আব্দুল একটু পর বলল,” আমার এখন মনে পড়েছে স্যার। ম্যাম আসলে প্রীতম স্যারের সাথেই বের হয়েছিলেন। প্রীতম স্যার বললেন আপনিই নাকি বলেছেন উষসী ম্যামকে নিয়ে যেতে।”

তৃষাণ এবার চমকে গেল। আশ্চর্য! আব্দুল হঠাৎ এমন পল্টি খাচ্ছে কেন? সন্দিহান চোখে আবার উষসীর দিকে তাকালো তৃষাণ। উষসী চোখ পিটপিট করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। তৃষাণ রেগে বলল,” এই কথা তুমি এতোক্ষণ বলোনি কেন আব্দুল?”

” এক্সট্রিমলি স্যরি, স্যার। আমার মনে পড়ছিল না। এইমাত্র ম্যামের কথা শুনে মনে পড়েছে।”

” সবার কেন এখনি সব মনে পড়ছে? আশ্চর্য! ”

তৃষাণ ফোন রেখে উষসীর দিকে তাকাল,” যাই হোক, না বলে বের হয়ে একদম ঠিক করোনি তুমি। এই ব্যাপারে পরে কথা হবে। এখন বলো প্রীতমের কি অবস্থা?”

” ডাক্তার জানে!” উষসী দায়সারাভাবে উত্তর দিল। তৃষাণ আহমেদকে বলল,” চলো তো আহমেদ, শুনে আসি ডাক্তার কি বলে।”

যাওয়ার আগে তৃষাণ উষসীকে আরও একবার শাসিয়ে গেল,” তোমার সাথে এই ব্যাপারে পরে আবার কথা হবে। উষসী। সত্যিটা আমি বের করেই ছাড়ব।”

উষ্ণতা আফসোস করে বলল,” ছেলেটা আমাদের সাথে কেমন বিপদে পড়ল। ওর বাবা-মা জানলে কি ভাববে? ইশ…”

উষসী বলল,” আমার তো মনে হয় ওর সাথে ঠিকই হয়েছে। ও এটাই ডিজার্ভ করে।”

” একটা চড় মা-রব।” যুথি রেগে গেল উষসীর কথায়।

উষ্ণতা কঠিন গলায় বলল,” এটা কোনো মজা করার বিষয় না উষু। যদি আরও খারাপ কিছু হতো? ঘটনা ঘটল কিভাবে?”

উষসী সহজ গলায় বলল,” এক্সিডেন্ট হয়েছে। পাহাড় থেকে পড়ে গেছিল প্রীতম।”

” তোরা পাহাড়ে উঠেছিলি নাকি?” যুথি ভয়ে আৎকে উঠলেন। উষসী কিছু বলার আগেই অনুপমা চেঁচিয়ে উঠলো,” ওমা, এটা কে গো?”

সবার নজর এবার স্থির হলো ইয়ামিনের দিকে। ইয়ামিন কি বলবে বুঝতে না পেরে মাস্কটা খুলল। যেহেতু সবাই কৌতুহল নিয়ে তাকাচ্ছে, মাস্ক না খুললে অভদ্রতা হয়।

ইয়ামিন মাস্ক খোলা মাত্রই সবার কৌতুহল বিস্ময়ে পরিণত হলো। ইয়ামিন উদ্দেশ্যহীনভাবে সবাইকে সালাম দিল। অনুপমা তাক লেগে তাকিয়ে রইল। উষ্ণতা সামান্য হেসে বলল,” চেনা চেনা লাগছে। কে যেন তুমি?”

উষসী মাথা নিচু করে বলল,” একসময় তোমার স্টুডেন্ট ছিল আপু। কিন্তু এখন মুম্বাইয়ের পপুলার সিংগার। ইয়ামিন ইব্রাহীম।”

উষ্ণতা আশ্চর্য গলায় বলল,” তাই নাকি? আমার স্টুডেন্ট তুমি? মনে পড়েছে, প্রিয়ন্তী আপু তো প্রায়ই তোমার কথা বলে আমাকে। মা, আপনি চিনতে পেরেছেন?”

ডোনার দিকে প্রশ্ন নিয়ে তাকালো উষ্ণতা। ডোনা বললেন,” হ্যাঁ, হ্যাঁ! চিনতে পেরেছি তো। প্রিয়ন্তীর কাজিন হয়। শিমলা আপার ছেলে না তুমি?”

যুথি বেগম বললেন,” তুমি তো দেখছি আগের মতোই আছো একদম। শুধু এখন মনে হচ্ছে হাত-পা গুলো আগের চেয়েও লম্বা হয়ে গেছে!”

এই কথায় সবাই একসাথে হেসে ফেলল। ইয়ামিনের চোখেমুখে প্রকান্ড অস্বস্তি। উষ্ণতার সামনে এলে এমন একটু-আধটু অস্বস্তি লাগবে এটা সে আগেই জানতো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ব্যাপারটা এতো সহজ না। ক্ষণে ক্ষণেই পুরনো স্মৃতি সব মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। যা বেশিক্ষণ মোকাবিলা করা কঠিন! উষ্ণতা উষসীর উদ্দেশ্যে বলল,” তুই ওকে পেলি কোথায়?”

” এইখানে উনি মিউজিক ভিডিও’র শ্যুটিং এ এসেছিলেন। তারপর কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়ে গেছে।”

উষ্ণতা সন্দিহান গলায় বলল,” আসলেই কি কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়েছে? নাকি…”

উষসী লাজুক গলায় বলল,” মানে আমারও দেখা করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আসলেই কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়েছে বিশ্বাস করো।

উষ্ণতা ফিচেল হাসি দিয়ে বলল,” আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। উনার ছবিই তো তুই বালিশের তলায় নিয়ে ঘুমাস, তাই না?”

এই কথা শুনে উষসী লজ্জায় কোথায় মুখ লুকাবে বুঝতে পারল না। রেগে বলল,” আপু প্লিজ, এইসব মিথ্যা কথা।”

বাকিরা সবাই হাসছে। শুধু হাসল না ইয়ামিন। সে তো উষ্ণতার কথাটাও বোঝেনি। কেবল তৃপ্ত দৃষ্টিতে দেখছে উষ্ণতাকে, উষ্ণতার হাসি মাখা মুখ, কতদিন পর!

উষ্ণতা ইয়ামিনের উদ্দেশ্যে বলল,” আমার বোন কিন্তু তোমার বিগ ফ্যান! ও এমনিতেই একটু পাগল, তোমার জন্য পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছে।”

উষসীর এতো লজ্জা লাগছিল! উষ্ণতার বাহু খামচে ধরে বলল,” আপু প্লিজ তুমি চুপ করো, আল্লাহর দোহাই!”

অনুপমা টুশকি মেরে বলল,” উফ, দেখো উষুরানীর গাল কেমন লাল হয়ে যাচ্ছে!”

সবাই হাসতে লাগল। উষসীর লজ্জায় মরি মরি অবস্থা!তৃষাণ ডাক্তারের সাথে কথা বলতে বলতে করিডোরে আসছিল। তখনি উষ্ণতা তাকে ডাকল,” এই, এদিকে শুনে যাও প্লিজ।”

তৃষাণ এগিয়ে এলো। উষ্ণতার সামনে ইয়ামিনকে দাঁড়ানো দেখেই থমকে গেল তার পা। উষ্ণতা হাসি-খুশি কণ্ঠে বলল,” দেখোতো, চিনতে পারো কি-না! মনে আছে ওর কথা?”

“হু?” তৃষাণ অপ্রস্তুত হলো। যেন চিনতেই পারছে না।

অথচ সে প্রথম দেখাতেই চিনতে পেরেছে এবং খুব ভালোমতোই তার মনে আছে। সব মনে আছে। ভেসে উঠল সেই কালোরাত্রির স্মৃতি। যেই রাতে তৃষাণের পৃথিবী উলোটপালোট হয়ে গেছিল। নিজের চোখে ইয়ামিন আর উষ্ণতাকে কিস করতে দেখেছিল সে! তারপর আরও কত বীভৎস স্মৃতি! সেসব ভাবলেও গা কাটা দেয়।

কিছু মানুষ যতই চোখের আড়ালে থাকুক, তাদের কখনও ভোলা যায় না। ইয়ামিন হলো তৃষাণ-উষ্ণতার জীবনের এমন একজন মানুষ, যাকে কখনও ভোলা যায় না। উষ্ণতা ভুলে গিয়ে বেঁচে গেছে, কিন্তু তৃষাণ তো ভুলতে পারেনি।

উষ্ণতা খুব আত্মগৌরব নিয়ে বলল,” আমার ছোটবেলার স্টুডেন্ট ছিল ও। এখন বিখ্যাত সিংগার ইয়ামিন ইব্রাহীম হয়েছে। প্রিয়ন্তী আপু মাঝে মাঝে বলতো না?মনে নেই তোমার?”

তৃষাণ ঘাড় নাড়িয়ে বলল,” ও হ্যাঁ… মনে পড়েছে। কিন্তু ও এইখানে কিভাবে?” জোর করে মুখে হাসি এনে প্রশ্নটা করল তৃষাণ।

উষ্ণতা উষসীকে ইশারা করে বলল,” উষসীর সাথে কাশ্মীরে আসার পর ওর দেখা হয়েছে। উষু তো ওর বিগ ফ্যান! তুমি জানো নিশ্চয়ই? ”

তৃষাণ ঘাড় ঘুরিয়ে উষসীর দিকে তাকালো। সাথে সাথে উষসী ভয়ে উষ্ণতার পেছনে লুকিয়ে গেল। তৃষাণ নিজের রাগ সামলে মাথা দুলিয়ে বলল,” হ্যাঁ.. জানি।”

” শুধু হ্যাঁ হ্যাঁ করছো কেন? ওর সাথে পরিচিত হও। ইয়ামিন, এটা আমার হাসব্যান্ড।”

ইয়ামিন কৃত্রিম হাসি দিয়ে বলল,” ভালো আছেন?”

তৃষাণ শক্ত চোখে ইয়ামিনের দিকে তাকিয়ে থেকে উত্তর দিল,” হুম। নাইস টু মীট ইউ।”

তারপর হাত বাড়াল হ্যান্ডশেকের উদ্দেশ্যে। ইয়ামিনও হাত বাড়ালো। দু’জন হ্যান্ডেশেক করছিল ঠিকই, কিন্তু অদ্ভুতভাবে একে-অন্যের দিকে তাকিয়ে ছিল কয়েক সেকেন্ড। না ইয়ামিন কোনো কথা বলল আর না তৃষাণ! তবে মনে মনেই তাদের মধ্যে ভয়ানক প্রলয়ের ঘোষণা শুরু হয়ে গেল।

একজন নার্স এসে জিজ্ঞেস করলেন,” এইখানে উষসী কে আছেন?”

উষসী বলল,” এইতো আমি।”

” পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে। শুধুমাত্র আপনার সাথে দেখা করতে চাইছেন তিনি।”

উষসী কেমন আতঙ্কিত হয়ে ইয়ামিনের দিকে তাকালো। ইয়ামিন চোখের ইশারায় অনুমতি দিল। তখন উষসী যেতে রাজি হলো। এই ব্যাপারটা অনেকেই খেয়াল করল। বিশেষ করে তৃষাণের চেহারা গম্ভীরের চেয়েও গম্ভীর হয়ে এলো। ইয়ামিন আর উষসীর মধ্যে গোপন কি চলছে?

উষ্ণতা আর অনুপমা ব্যাপারটা খেয়াল করে একে-অন্যের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল। তারা নিজেদের মতো কিছু ভেবে খুশিও হয়ে গেল।

উষসী প্রীতমের কেবিনে ঢুকতে খুব ভয় পাচ্ছিল। ভয়ে তার পা কাঁপতে লাগল। প্রীতম যদি আবার তখনের মতো পাগলামি করে? একবার উষসীর ইচ্ছে করল নার্সের হাত ধরে বলতে,” সিস্টার, আপনিও আমার সাথে ভেতরে থাকবেন প্লিজ?”

উষসী কেবিনে ঢোকার আগেই ডাক্তার বের হলো।

” ওহ, আপনি পেশেন্টের কে হোন?”

উষসী নরম গলায় বলল,” বন্ধু।”

“আচ্ছা শুনুন, পেশেন্ট এক্সিডেন্টের আগে প্রচুর নেশাদ্রব্য পান করেছিল। এখন থেকে তার নেশা করা কিন্তু নিষেধ।”

উষসী যেন আকাশ থেকে পড়ল,” কি? প্রীতম নেশা করেছিল?”

” হ্যাঁ। বিশ্বাস না হলে এইযে দেখুন। অ্যালকোহল টেস্ট করানো হয়েছে। ” ডাক্তার একটা ফাইল এগিয়ে দিল। উষসীর মাথা ভনভন করছে। সে ফাইলটা হাতে নিয়ে কেমন স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইল। ডাক্তার আরও অনেক কথা বলছেন। কিন্তু উষসীর মস্তিষ্কে আটকে গেছে এই একটি কথাই। প্রীতম নেশা করেছিল! ওহ গড! এজন্যই বুঝি তার আচরণ তখন এতোটা অসংলগ্ন ছিল? অথচ উষসী ভেবেছিল প্রীতম ইচ্ছে করে তার সাথে অসভ্যতা করেছে। এখন নিশ্চয়ই প্রীতমের তখনের কথা কিছু মনে নেই। কিন্তু উষসী ভুলবে কি করে?

ডাক্তারের সাথে কথা শেষ করে উষসী চুপচাপ বেরিয়ে এলো। প্রীতমের সামনে যেতে ইচ্ছে করছে না তার। হঠাৎ খুব কান্না পেয়ে গেল। উষসী দৌড়ে একটা নীরব জায়গায় এসে স্থির হলো। বেশ কিছুক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল উষসী। হঠাৎ পেছন থেকে কারো আওয়াজ কানে এলো,” হোয়াট হ্যাপেনড?”

উষসী ঘুরে দেখল ইয়ামিন দাঁড়িয়ে আছে। তার কান্নার জোর এবার আরও বেড়ে গেল। ইয়ামিন ব্যগ্র কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,” কি হয়েছে উষসী? প্রীতম আবার কিছু করেছে তোমার সাথে?”

ইয়ামিন প্রচন্ড রেগে প্রীতমের কেবিনের দিকে যেতে নিচ্ছিল। উষসী তাকে থামিয়ে বলল,” দাঁড়ান। ও কিছু করেনি। আমি এখনও ওর সাথে দেখা করতেও যাইনি।”

ইয়ামিনের দৃষ্টি কোমল হলো। কণ্ঠ নরম হলো,” তাহলে কেন কাঁদছো?”

উষসী চোখের জল মুছতে মুছতে খুব শান্ত কণ্ঠে বলল,” ভেবেছিলাম, প্রীতমের সাথে দেখা হলেই তাকে একটা কষে চড় মারবো। ও যেই কাজ করেছে তারপরেও ওর সাথে কোনো বন্ধুত্ব রাখার রুচিই আমার হচ্ছিল না। কিন্তু ডাক্তার বললেন, এক্সিডেন্টের আগে নাকি সে নেশাক্ত ছিল। মানে আপনি বুঝতে পারছেন?”

” কি?”

” মানে প্রীতম নিজের ইচ্ছায় কিছু করেনি। তার বোধহয় এখন কিছু মনেও নেই। অর্থাৎ আমি চাইলেও তাকে এই বিষয়ে কিছু বলতে পারবো না।”

ইয়ামিন চুপ হয়ে গেল। সে বুঝতে পারছে উষসী এই বিষয়ে অনেকটাই বোকা। নেশা করলেই যে মানুষ খারাপ কাজ করে, এমন তো না। যার ভেতরটা আসলেই খারাপ, নেশা করার পর সেটা বের হয়ে আসে। প্রীতম তখন উষসীর সাথে যে অন্যায় করতে যাচ্ছিল সেটাই তার মানসিকতা। এটা উষসী বুঝতে পারছে না। যদি বুঝতো, তাহলে এভাবে বোকার মতো কাঁদতো না।

সে আলতো করে উষশীর কাঁধে হাত দিয়ে বলল,” তাহলে তো তোমার খুশি হওয়া উচিৎ। প্রমাণ হয়ে গেল যে প্রীতম জেনে-বুঝে অন্যায় করেনি। তুমি কাঁদছো কেন?”

হঠাৎ ইয়ামিন এতো কাছে আসায় উষসী এলোমেলো হয়ে গেল। তার মনখারাপ, কান্না, সব কোথায় যেন হারিয়ে গেল। মিষ্টি অনুভূতি আচ্ছন্ন করল তাকে। মোহগ্রস্ত হয়ে ইয়ামিনের দিকে তাকাল। ইয়ামিন তার চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,” ডন্ট ক্রাই। এখানে তোমার একদম দোষ ছিল না। যা হয়েছে ভুলে যাও। কিন্তু তবুও প্রীতমের থেকে সাবধানে থাকা ভালো। ”

উষসী কোনো কথা না বুঝেই শুধু মাথা নাড়ল। নিজের মনে বিভোর হয়ে বলল,” আপনি নিজের হাত দিয়ে আমার অশ্রু মুছে দিয়েছেন, তাই আমি আর কখনও কাঁদবো না! শুধু আমাকে কখনও ছেড়ে যেয়েন না, প্লিজ।”

চলবে

আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-১৪+১৫

0

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ১৪
লিখা- Sidratul Muntaz

উষসী কিছুতেই হোটেল থেকে বের হতে পারবে না। তাকে সত্যি ঘরবন্দী করে রাখা হয়েছে। ম্যানেজার আব্দুল একটু পর পরই এসে খোঁজ নিয়ে যাচ্ছেন। উষসী ঠিক করেছে আরেকবার যদি তিনি সামনে আসেন তাহলে লোকটার মাথায় গরম পানি ঢেলে দিবে। বদলোক একটা! তার ব্যবহার আরশোলার থেকেও খারাপ। আরশোলার মতো তাকেও যদি স্প্রে মেরে ভস্ম করে দেওয়া যেতো! পোকা-মাকড় দূর করার স্প্রে আছে তাহলে মানুষ দূর করার স্প্রে নেই কেন?

উষসী ঘরের এই মাথা থেকে ওই মাথা পায়চারী করছিল অস্থির ভঙ্গিতে। বিকাল পাঁচটা বাজতে যাচ্ছে তখন। ডোনা এবং যুথি অন্যরুমে গিয়েছিলেন নামায পড়তে। তারা নামায শেষে ঠিক করলেন হাঁটতে বের হবেন। উষসী এতোক্ষণে আশার আলো দেখতে পেল।

যুথি আর ডোনার কাছে হাতজোড় করে উষসী অনুরোধ করল, ” আমার মিষ্টি মা, আমার মিষ্টি ভালো আন্টি, প্লিজ আমাকেও তোমাদের সাথে নিয়ে যাও।”

ডোনা ও যুথি একে-অপরের দিকে চেয়ে হেসে ফেললেন। ডোনা বললেন,” তুই আমাদের সাথে গিয়ে কি করবি? আমরা দুই বেয়াইন সুখ-দুঃখের আলাপ করবো আর হাঁটবো। তুই বোর হবি আমাদের আলাপ শুনতে।”

উষসী মনে মনে বলল,” তোমাদের আলাপ শোনার ইচ্ছেও আমার নেই। আমাকে শুধু একবার এখান থেকে বের হতে দাও৷ আমার খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে তো!”

মুখে বলল,” কোনো সমস্যা নেই। ঘরে বসে আমি এমনিও বোর হচ্ছিলাম। বাইরে গিয়ে তোমাদের সাথে হাঁটবো৷ শরীর চাঙ্গা লাগবে।”

যুথি বললেন,” ভালো কথা। তোর না জ্বর? তুই বাইরে কিভাবে যাবি? এখন কত ঠান্ডা জানিস?”

” সমস্যা নেই। আমার জ্বর ভালো হয়ে গেছে। এই দেখো, কপাল ঠান্ডা, গলা ঠান্ডা, আমি ঠিক হয়ে গেছি মা। প্লিজ নিয়ে যাও না আমাকে! তোমার পায়ে পড়ি।”

উষসী সত্যি সত্যি পায়ে ধরার জন্য এগিয়ে এলো। ডোনা বাঁধা দিয়ে বললেন,” আরে, আরে, কি করে পাগলিটা? ঠিকাছে চল। আমরা দুইজন যে যাবো একটা পাহারাদারও তো দরকার। তুই না হয় আমাদের পাহারা দিবি। ঠিকাছে?”

কথা শেষ করে হেসে ফেললেন ডোনা। উষসী আনন্দে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,” ওকে।”
উষসী আবার আগের মতো নীল শাড়ি, গোলাপী ব্লেজার পরে সুন্দর করে সাজল। এবারের সাজটা আগের চেয়েও বেশি ভালো হলো। কিন্তু বের হওয়ার সময় আব্দুল নামের ম্যানেজার বাঁধ সাধতে এলেন। উষসীকে দেখেই তিনি সামনে এসে বললেন,” কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”

উষসী হাত ভাঁজ করে অন্যদিকে তাকাল। লোকটির আচরণ দেখে মনে হচ্ছে যেন তারা জেলখানার কয়েদী। এই মাথা থেকে ওই মাথায় যেতেও প্রধানমন্ত্রীর সিগনেচার করা অনুমতিপত্র লাগবে। কি আশ্চর্য!

ডোনা বললেন,” এইতো বাইরে যাচ্ছি ভাই। একটু হাঁটতে বের হতাম।”

আব্দুল ভাই বললেন,” আপনারা যান সমস্যা নেই। কিন্তু উনি কোথায় যাচ্ছেন? উনার তো বের হওয়া নিষেধ। ”

উষসী চোখ বড় করে বলল,” এক্সকিউজ মি, আমার মা মানে আমার গার্ডিয়ানের সাথে বের হচ্ছি। আপনি কে আমাকে আটকানোর?”

” নিষেধ আছে। শুধু গার্ডিয়ান কেন? গার্ডিয়ানের চৌদ্দ গুষ্টি এলেও বের হতে দেওয়া যাবে না। যতক্ষণ না স্যার পারমিশন দিচ্ছেন।”

” দেখেছো মা, কত্তবড় সাহস? একটা থাপ্পড় দাও। কষে একটা থাপ্পড় দাও এই অভদ্র লোককে!”

শেষ কথাটা উষসী ফিসফিসিয়ে যুথির কানে কানে বলল।

যুথি বেগম মুখে আঙুল ঠেকিয়ে বললেন,” চুপ, বেয়াদব! আসলে বাবা, আমরা তো জানতাম না। কে নিষেধ করেছে ওকে বের হতে?”

” তৃষাণ স্যার।”

উষসী কপালে হাত ঠেকালো। শেষ, খতম, ফিনিশ! তৃষাণের নাম বলা হয়েছে মানে এখন ভূমিকম্প হয়ে গেলেও মা অথবা ডোনা আন্টি উষসীকে হোটেল থেকে বের হতে দিবেন না। এতে যদি তার মৃত্যু হয়, তাও হোক!

ডোনা ও যুথি সম্মিলিতভাবে উষসীকে বোঝাতে শুরু করল। তৃষাণ যখন বলেছে, ভালোর জন্যই বলেছে। উষসীর জন্য বাইরে বের হওয়া ঠিক না। তারা উষসীকে রেখেই বের হয়ে গেল। মানে যেই লাউ সেই কদু। বিচার মানেই তালগাছ আমার!

উষসী তবুও হার মানার পাত্রী নয়। তার ভেতরে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ চলছে। হঠাৎ মাথায় একটা খুব সহজ-সরল বুদ্ধি এলো। আচ্ছা, এতো ভালো বুদ্ধিটা সে আগে ভাবেনি কেন?

যুথি বেগম সবসময়ই বোরখা পরেন। এবারও তিনি রঙ-বেরঙের বোরখা নিয়ে এসেছেন। সেই বোরখা আছে উষ্ণতাদের রুমের লাগেজে। উষসী যদি কোনোভাবে সেখান থেকে বোরখাটা চুরি করে নিজের গায়ে পরে তারপর হোটেল থেকে বের হয়, কেউ নিশ্চয়ই তাকে চিনতে পারবে না। ওই আরশোলা মুখো আব্দুল ভাইও দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করবে না, ” আরে, আরে, যাচ্ছেন কই? আপনার তো বের হওয়া নিষেধ! ”

যেই ভাবা সেই কাজ! যেহেতু কোনো চেষ্টাই কাজে লাগছে না, এই শেষ একটা ছোট্ট চেষ্টা করে দেখাই যাক! উষসী উষ্ণতাদের রুমে ঢুকে লাগেজ থেকে বোরখা চুরি করল। তারপর সেটা নিয়ে হোটেলের ওয়াশরুমে চলে গেল। সে চাইলে নিজের রুমে বসেই চেঞ্জ করতে পারতো। কিন্তু নিজের রুম থেকে বোরখা পরে বের হলে ম্যানেজার আব্দুল সন্দেহ করবে। তার শকুনি দৃষ্টি তো সর্বদা উষসীর রুমের দিকে নিবদ্ধ থাকে। উষসী বোরখা-নিকাব, হাতমোজা,পা মোজা পরে যখন বের হলো, তখন ম্যানেজার আব্দুল আশেপাশে কোথাও নেই৷ উষসী লম্বা লম্বা পা ফেলে এগোতে লাগল। তারপর আচমকা ধাক্কা খেল ম্যানেজার আব্দুলের সাথে। উষসীর হৃৎপিন্ড ছলাৎ করে লাফিয়ে উঠল।

আব্দুল ভাই উষসীকে ‘স্যরি” বলে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। অর্থাৎ চিনতেই পারলেন না৷ উষসী বড় করে একটা শ্বাস ছেড়ে আরও দ্রুত হাঁটতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে একেবারে হোটেলের বাহিরে চলে এলো। কেউ বাঁধাও দিল না আবার কিছু জিজ্ঞেসও করল না। সন্দেহী দৃষ্টিতে একবার তাকাল পর্যন্ত না! উষসীর ইচ্ছে করছে বোরখাটা খুলে এখানেই ধুম-ধারাক্কা নাচতে! কিন্তু এতো নিয়ন্ত্রণ হারালে তো চলবে না। উষসী বোরখা খুলবে একদম গন্তব্যে পৌঁছানোর পর। ফিরে আসার সময়ও বোরখা পরে আসবে৷

ইয়ামিন সারাদিন অপেক্ষায় ছিল। বার-বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিল কখন সন্ধ্যা হবে! উষ্ণতা যদি আসে, একবার যদি দেখা হয়! আর মাত্র কিছুক্ষণ! এর মধ্যেই তো তাদের চলে আসা উচিৎ। শ্যুটিং শুরু হতে যাচ্ছে। ইয়ামিনকে মেকাপ দেওয়া হয়েছে। রোহান মেকাপ দিতে দিতে বলল,” স্যার, আপনাকে ন্যাচরাল শেডের একটা লিপস্টিক লাগিয়ে দেই প্লিজ! এই লুকের সাথে আসলে লিপস্টিক না হলে যাচ্ছে না।”

ইয়ামিন কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো। রোহান নিচু গলায় বলল,” স্যরি স্যার।”

রোহান ইয়ামিনের পারসোনাল মেকাপম্যান। ও ছাড়া ইয়ামিন কারো থেকেই মেকাপ নেয় না। কিন্তু রোহানের কাছে আজও এই ব্যাপারটা ধোঁয়াশা! কেন তার স্যার লিপস্টিক নিতে চান না? অন্যসব মেকাপে তার সমস্যা নেই৷ শুধু লিপস্টিক নেওয়ার কথা বললেই রেগে যান। একেক মানুষের একেক ধরণের রোগ। ইয়ামিন ঘড়ি দেখতে দেখতে বলল,” মিস কামলার মেকাপ হয়েছে?”

রোহান এইবার অতি উৎসাহ নিয়ে বলল,” জ্বী স্যার। আমি একটু আগেই দেখে এলাম। ম্যাম নিজের মেকাপ নিজেই করে ফেলেছেন। তাকে যে কি সুন্দর লাগছে! কীর্তি ম্যাডামের থেকেও সুন্দর লাগছে স্যার।”

ইয়ামিন হাসল,কিছু বলল না। রোহান বলল,”স্যার, ম্যাডামকে আজ খুব প্রাণবন্ত লাগছে। তিনি হয়তো কোনো ব্যাপার নিয়ে অনেক খুশি!”

ইয়ামিনের কাছে অপেক্ষাটা আরও কঠিন লাগছে। উফফ, ঘড়ির কাটা এগোচ্ছে না কেন? হঠাৎ আরমান জোহারের চিৎকার শোনা গেল। তাদের শ্যুটিংস্পটে একজন অপরিচিত’র আগমন ঘটেছে। স্যুট টাই পরা বেশ সুদর্শন ভদ্রলোক। বয়স ত্রিশের উপরে হবে। আরমান ভাই তার সঙ্গে কোলাকুলি করে কথা বলছেন। এমনভাবে কথা বলছেন যেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি! ইয়ামিন ঠোঁটের নিচে আঙুল রেখে জিজ্ঞেস করল,” কে উনি?”

রোহান হাসিমুখে বলল,” উনি হচ্ছেন আর্জুন খান্না। কামলা ম্যামের স্পেশাল গেস্ট।”

” ও আচ্ছা।”

কামলার স্পেশাল গেস্ট শুনে লোকটার প্রতি ইয়ামিনের আচমকাই একটা বিরক্তিসূচক মনোভাব সৃষ্টি হলো। ঠিক বিশমিনিট পর কামলা ইয়ামিনকে ফোন করে ব্যালকনির পেছনে নিরিবিলি জায়গাটায় আসতে বলল। সেখানে ছোট-খাটো একটা লেক আছে।

ইয়ামিনের ভালো লাগছিল না তাও সে গেল। সেখানে আর্জুন খান্না আর কামলা একসাথে বসে ছিল। কামলার চোখমুখ ঝলমল করছে! ইয়ামিনকে দেখেই উঠে দাঁড়ালো কামলা।

লাজুক গলায় বলল,” ওহ মিস্টার সিংগার, এসো পরিচিত হও। আমার ফিয়্যান্সে। সামনের মাসের পাঁচতারিখ আমাদের বিয়ে হতে যাচ্ছে।”

আর্জুন খান্না ইয়ামিনকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। কামলা বলল,” আর তুমি তো ওকে চেনোই। আমার সিংগার, ইয়ামিন ইব্রাহীম।”

আর্জুন খান্না খুব বিনয়ের সাথে বললেন,” চিনি মানে? খুব ভালো করে চিনি। আরে আমি তো উনার বিগেস্ট ফ্যান। জানেন স্যার, আমার আজকে এখানে আসার প্ল্যানই ছিল না। শুধুমাত্র আপনার সাথে দেখা করতে আমি সেই দিল্লী থেকে এসেছি। আপনি তো আমার গুরু স্যার!”

এই কথা বলেই আর্জুন খান্না ইয়ামিনের সাথে হ্যান্ডশেক করতে আসলেন। ইয়ামিন হ্যান্ডশেক করল না। দুইহাত পকেটে গুঁজে রাখল। ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,” আমি আসছি।”

এইটুকু বলেই ইয়ামিন হেঁটে চলে যেতে লাগল। আর্জুন খান্নার চেহারা শুকিয়ে থমথমে হয়ে গেল। মনে মনে কিছুটা আঘাত পেলেন তিনি। ইয়ামিন ইব্রাহীমকে খুব সহৃদয়বান মানুষ ভেবেছিলেন অর্জুন। যে ভক্তদের সাথে বন্ধুর মতো মিশতে পারে! যার মধ্যে বিন্দুমাত্র অহংকার নেই। কিন্তু আজকে তাঁর এহেন ব্যবহারে প্রচন্ড অহংকারী বলেই মনে হলো। কামলাও কিছুটা অপ্রস্তুতবোধ করল।

শ্যুটিংস্পটে বেজায় ভীড়। মানুষ মানুষের মাথা খেয়ে নিচ্ছে। উষসী সবাইকে ঠেলে কিছুতেই ভেতরে যেতে পারছে না। এমন হলে সে ইয়ামিনের সাথে দেখা করবে কি করে? হঠাৎ উষসীর পা একটা সুন্দরী মেয়ের গাউনের উপর পড়ে গেল। মেয়েটা চেঁচিয়ে উঠল,” আউচ! হচ্ছেটা কি? ”

উষসী দ্রুত পা সরিয়ে বলল,” আই এম স্যরি আপু!”

মেয়েটার সাথে তার বন্ধুরাও ছিল। তাদের মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করল,” কি হয়েছে রে?”

মেয়েটা নাগিনের মতো ফুসতে ফুসতে বলল,” জানি না কোথ থেকে আসে এসব! ফালতু, মানে কোনো হুশ-জ্ঞান নেই।”

উষসীর এতো রাগ লাগল! দেখেই বোঝা যাচ্ছে এরা বাঙালী। কিছুক্ষণ আগে ইয়ামিন ইব্রাহীমকে নিয়ে আলোচনা করছিল। যেই মেয়েটার ড্রেসে উষসীর পা পড়ল, সে ইয়ামিনের অনেক বড় ভক্ত! কলকাতা থেকে কাশমীর এসেছে শুধু ইয়ামিনের সাথে দেখা করার জন্যই! উষসী মেয়েটাকে বেশি পাত্তা দিল না। কোথায় সে আর কোথায় উষসী! ইয়ামিনকে সে ব্যক্তিগতভাবে চেনে। ইয়ামিন তাকে এইখানে শ্যুটিং দেখার জন্য নিজে থেকে ইনভাইট করেছে। সে হচ্ছে ইয়ামিনের স্পেশাল গেস্ট। তার এসব ছোট-খাটো বিষয় নিয়ে ভাবলে চলবে না। উষসী ভীড় ঠেলে ভেতরে ঢুকতে গেলেই রোহান এসে বাঁধা দিল,” এক্সকিউজ মি, কোথায় যাচ্ছেন?”

রোহানের মুখে হিন্দি শুনে উষসীও হিন্দিতে উত্তর দিল,
” আমি ইয়ামিন ইব্রাহীমের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।”

” বললেই তো দেখা করা যায় না। এখানে একটু পর শ্যুটিং শুরু হবে। তাই প্লিজ আপনারা জায়গা খালি করুন।”

উষসীর সাথে আরও যারা সাধারণ জনতা ছিল সবাইকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। অপমানে উষসী ফুঁসে উঠলো,” আপনি জানেন আপনি কাকে কি বলছেন? আমি ইয়ামিন ভাইয়ার পরিচিত। তিনি নিজে আমাকে শ্যুটিং দেখার জন্য ইনভাইট করেছেন। আমি উনার গেস্ট!”

রোহানের পাশাপাশি অন্যসবাই অবাক হওয়ার দৃষ্টিতে তাকালো। যেই মেয়েটার ড্রেসে উষসীর পা পড়েছিল সেও বড় বড় চোখে তাকালো। উষসী ভাব নিয়ে সবার তাক খাওয়া দৃষ্টি উপভোগ করছে।

মেয়েটা হঠাৎ ফিসফিস করে বলল,” যত্তসব পাগল!”

উষসীর মেজাজ চড়ে গেল। এই মেয়েটা তাকে কি ভেবেছে? সমস্যা নেই, জবাবটা ইয়ামিন এলেই দেওয়া যাবে। যখন সবার সামনে ইয়ামিন উষসীর সাথে হাসিমুখে কথা বলবে, তখন দেখা যাবে এই সুন্দরীর মুখের অবস্থা কি হয়! রোহান সন্দেহী দৃষ্টিতে বললেন,” আপনি সত্যি বলছেন তো?”

” হান্ড্রেড পারসেন্ট সত্যি। বিশ্বাস না হলে নিজেই জিজ্ঞেস করুন ইয়ামিন ভাইয়াকে। আমার নাম উষসী। তিনি আমাকে খুব ভালো করে চিনেন।”

জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন হলো না। পকেটে হাত গুঁজে সাদা স্যুট পরিহিত ইয়ামিনকে এদিকেই আসতে দেখা গেল। সবাই হামলে পড়ল ইয়ামিনের সাথে কথা বলার জন্য। বড় বর্ডার দিয়ে তাদের আটকে দেওয়া হলো। কেউ ভেতরে ঢুকতে পারল না। কিন্তু চিৎকার-চেঁচামেচি করেই যাচ্ছে সবাই।

রোহান উষসীকে ভেতরে ঢুকতে দিল। উষসী দৌড়ে গেল ইয়ামিনের সামনে। লাজুকমুখে কাঁপতে কাঁপতে বলল,” ভাইয়া ভালো আছেন? আমি উষসী। আপনি আমাকে আসতে বলেছিলেন।”

ইয়ামিন উষসীর কথার কোনো জবাবই দিল না। এমনকি একবার তাকালো পর্যন্ত না৷ রোহানকে বলল,” রোহান,আমার ঘরে এক কাপ কফি দেওয়ার ব্যবস্থা করো। আজকে শ্যুটিং ইন্টেরাপ্ট। সবাইকে জানিয়ে দাও। আমি ভেতরে যাচ্ছি।”

” জ্বী স্যার, জ্বী স্যার।”

ইয়ামিন উষসীকে পাশ কাটিয়ে অবলীলায় চলে গেল। উষসী স্তম্ভিত, হতভম্ব! রোহান যাওয়ার সময় রাগী দৃষ্টিতে উষসীকে বলে গেল,” ভেতরে ঢোকার জন্য এতোবড় মিথ্যে না বললেও পারতেন। এখনি বের হোন আপনি।”

অপমানে উষসীর বামচোখ থেকে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল! প্রত্যেকে উষসীর দিকে তাচ্ছিল্যভরা দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। ওই মেয়েগুলোর মুখেও এখন পৈশাচিক আনন্দের হাসি ঝুলছে। এতো অপমান নিয়ে উষসী এক মুহুর্ত দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে গেল শ্যুটিংস্পট থেকে। বুকের মধ্যে অদ্ভুত চিনচিনে ব্যথাটা পুরো শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস নিতেও বুক ফেটে যাচ্ছে। কান্নারা বাঁধ মানছে না। উষসীর মন চাইছে চিৎকার করে কেঁদে ফেলতে!

চলবে

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ১৫
লিখা- Sidratul Muntaz

হঠাৎ করে শ্যুটিং স্থগিতের ঘোষণা শুনে সবাই বিরক্ত হলো। মিউজিক ডিরেক্টর আরমান জোহার মেজাজ খারাপ করে বললেন,” ছেলেটার যা মন চায় তাই করবে নাকি? এতোক্ষণ ধরে সবাই প্রস্তুতি কেন নিল তাহলে? ক্যামেরা, শট সবকিছু রেডি, মডেলের মেকাপও ডান, আর এখন ইচ্ছে হলো তাই শ্যুট ক্যান্সেল? বললেই হয়ে গেল? কোনো যথাযথ কারণ তো থাকতে হবে!”

ইয়ামিনের সাথে কথা বলার জন্য আরমান তার রুমে যাচ্ছিলেন। তখন রোহান আটকালো,” স্যরি আরমান ভাই, এখন যাওয়া যাবে না। স্যার কারো সাথে দেখা করতে চাইছেন না।”

আরমান জোহারের প্রচন্ড মেজাজ গরম হলেও তিনি রাগ দমন করলেন। বিখ্যাত শিল্পীদের নিয়ে এই একটা সমস্যা। তারা ক্ষমতার অপব্যবহারটা খুব ভালো জানে। এইযে বলা হলো শ্যুটিং স্থগিত! তার মানে স্থগিতই। মুখের উপর কথাও বলা যাবে না। শুধু শুধু এতোগুলা সময় নষ্ট হলো। এই তামাশা দেখার জন্যই কি মুম্বাই থেকে কাশ্মীর এসেছিলেন তিনি। রেগে-মেগে আরমান বললেন,” যা ইচ্ছা তাই হোক। আমি আর এইসবে নেই।”

সবকিছু গুছিয়ে ফেলা হচ্ছে। ক্যামেরা উঠিয়ে ঘরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যে মানুষরা শ্যুটিং দেখবে বলে ভীড় জমিয়েছে তারাও একে একে চলে যাচ্ছে। অর্জুন কামলার পাশে দাঁড়িয়ে চিন্তিত গলায় বলল,” মনে হচ্ছে ইয়ামিন ইব্রাহীমের কোনো পারসোনাল প্রবলেম হয়েছে। উনি কি কোনো কারণে ডিপ্রেসড? কামলা তুমি জানো কিছু?”

কামলা কোনো জবাব দিল না। আর কেউ না বুঝুক, অন্তত কামলা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে কেন ইয়ামিন এইরকম করেছে! অর্জুনকে দেখার পর তার প্রফুল্ল চেহারার ঋনাত্মক পরিবর্তন দেখেই কামলা বুঝে গেছে। কিন্তু অপরাধবোধে দগ্ধ হয়ে কিছু বলতে পারেনি তখন। তবে এখন মনে হচ্ছে বলতেই হবে!

ইয়ামিনের সাথে জরুরী ভিত্তিতে তার কথা বলা দরকার। কামলা বিচলিত কণ্ঠে বলল,” রোহান, আমি একটু ইয়ামিনের সাথে দেখা করতে চাই।”

” কিন্তু ম্যাম, স্যার এখন…

রোহানের অনুমতির অপেক্ষা করল না কামলা। ফট করে ঢুকে গেল ভেতরে। কিন্তু ঘরের কোথাও ইয়ামিনকে দেখতে পেল না সে। শুধু মেঝেতে তার সাদা স্যুট পড়ে আছে। কামলা সাদা স্যুটটা হাতে নিয়ে রুমের আরও ভেতরে ঢুকল। আশেপাশে ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিল। এবার ইয়ামিনকে খুঁজে পাওয়া গেল বারান্দায়। এলোমেলো ভাবে ডিভানে বসে থাকা অবস্থায়।

গাঁয়ের শার্টটা আগলা করে পরে আছে সে। শার্টের সামনের কয়েকটা বোতাম খোলা। মাথার রেশমী চুলগুলো এলোমেলো। হিমশীতল বাতাসে দুলছে। ইয়ামিন যে এইভাবে অবহেলায় বসে আছে, ঠান্ডা লেগে যায় যদি? আরেকটু এগোতেই কামলা খেয়াল করল ইয়ামিনের হাতে সিগারেট। এজন্যই ধূমায়মান হয়ে আছে পুরো বারান্দাটা। তার করা একটা ভুলের জন্য এতোবড় ঘটনা ঘটে যাবে এটা ভাবতেও পারেনি কামলা।

ইয়ামিনের পাশে বসে ক্ষমা চাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই ইয়ামিন অবাক হয়ে বলল,” কি ব্যাপার কামলা? নক না করে তুমি আমার ঘরে ঢুকেছো কেন?”

কামলার চোখে তখন অশ্রু। ইয়ামিন কাঁদছে না, কিন্তু কামলা কাঁদছে! ইয়ামিন অতি স্বাভাবিক কণ্ঠে আদেশ দিল,” যাও এখান থেকে।”

কামলা নম্র কণ্ঠে বলল,” আই এম স্যরি।”

এই কথা বলে ইয়ামিনের কাঁধে হাত রাখতে নিচ্ছিল সে। ইয়ামিন সরে গেল। কামলা বলল,” জানি আমি অন্যায় করেছি। সেদিন আমাদের ওই প্রাইভেট মোমেন্ট…”

“শাট আপ। আমি তোমার সাথে এই ব্যাপারে কোনো কথা বলতে চাই না। গেট আউট।”

” ইয়ামিন তুমি এখন আমাকে ভুল বুঝছো! অর্জুনের সাথে আমার ব্রেকাপ হয়েছে তিনমাস আগে। আজ সে হঠাৎ আমার সাথে প্যাচাপ করতে এসেছে। আমাকে বিয়ের জন্য প্রপোজ করেছে। তাই আমি ওকে নিষেধ করতে পারিনি। তাছাড়া আমি ভাবিনি তোমার মতো একটা ছেলে আমাকে নিয়ে এতো অবসেসড হবে! এগুলো তো তোমার কাছে খুব নরমাল বিষয়। তুমি ওই ব্যাপারটাকে…

ইয়ামিন রূঢ় স্বরে বলল,” আমি মোটেও তোমাকে নিয়ে অবসেসড না কামলা সিং। নিজেকে এতো ইম্পোর্ট্যান্ট ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই।”

” তাহলে তুমি শ্যুটিং কেন ইন্টারাপ্ট করলে? কেন অর্জুনের সাথে দেখা হওয়ার পরেই তোমার মুড চেঞ্জ হয়ে গেছে? কেন এভাবে অন্ধকার ঘরে.. ”

ইয়ামিন গর্জন করে বলল,” দ্যাটস নান অফ ইউর বিজনেস।

সে আচমকা ডিভানে একটা লাথি মারল। কামলা ভয়ে দাঁড়িয়ে গেল। ইয়ামিনকে থামানোর জন্য বড় করে শ্বাস নিয়ে বলল,” আমি চলে যাচ্ছি। কিন্তু তুমি শান্ত হও প্লিজ!”

ইয়ামিন শান্ত হয়ে বলল,” গেট লস্ট।”

কামলা বের হয়ে গেল। ইয়ামিন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিল না। ধপ করে বসে পড়ল মেঝেতে। আবার একটা সিগারেট ধরাল। সিগারেটে সুখটান দিতে দিতে নিজের মনেই হাসল একবার। কামলার ওই অপরাধী দৃষ্টি, ক্ষমা চাওয়া, মায়াকান্না, এসব দেখে অন্তত এইটুকু তো ধারণা করাই যায় যে সে ইয়ামিনকে নিয়ে শুধুই একটা খেলা খেলেছিল। তার কাছে নিজের প্রয়োজন মেটানোর মাধ্যম ছিল ইয়ামিন। আর যেই প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল, তখনি সে ইয়ামিনকে উপড়ে ফেলতে চাইল। পৃথিবীতে কত রকমের নারী আছে। উষ্ণতার মতো মায়াবতীও আছে আবার কামলা-কীর্তির মতো বিষধরীও আছে। ছাব্বিশ বছরের এই দীর্ঘ জীবনটা ইয়ামিনকে কতকিছুই না শেখালো! কিন্তু সে আটকে আছে তার সতেরো বছরের হওয়া প্রথম প্রেমেই। তার উষ্ণতা মিস!

সিগারেট ফেলে উঠে দাঁড়ালো ইয়ামিন। সিদ্ধান্ত নিল এখানে থাকবে না সে। কামলার সাথে কাজ করার প্রশ্নই আসে না। আজকের পর থেকে কখনও কোনো ‘মেয়ে’ নামক বস্তুকে নিজের জীবনে প্রবেশ করতে দিবে না সে।

_____________
উষসীর যেন আজ শুধুই কাঁদার দিন। জীবনে শেষ কবে এতো কষ্ট আর অপমান সইতে হয়েছিল মনে পড়ছে না। তবে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ খারাপ ঘটনাটি ঘটেছে আজকে! এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। চারদিকে এখন ঘুটঘুটে আঁধার! পাহাড়ী অঞ্চল হওয়ায় সূর্য ডুবলেই অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে প্রকৃতি। উষসী বিরাট একটা গাছের ছায়াতলে বসে ফুপিয়ে কাঁদছিল। হঠাৎ কেউ উষসীর কাঁধে হাত রাখল। উষসী ভয়ে চমকে গেল। তড়াক করে ঘাড় ঘুরাতেই দেখল প্রীতম, আকুতিভরা দৃষ্টি নিয়ে উষসীর দিকে তাকিয়ে আছে। উষসীর চোখে জল দেখে প্রীতমের ভ্রু কুচকে গেল,” তুই কাঁদছিস নাকি উষু?”

উষসী জবাব দিল না। প্রীতম এবার গাঁ ঘেঁষে ওর পাশে বসল। উষসীকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে তীব্র আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করল,” বল কি হয়েছে?”

কাঁদতে কাঁদতে প্রীতমের হাত নিজের বাহু থেকে সরালো উষসী। জেদী, একরোখা গলায় বলল,” কিছু হয়নি। তুই আমার সামনে থেকে প্লিজ চলে যা!”

প্রীতমের হৃদয় আরও বিচলিত, ব্যাকুল, অশান্ত হয়ে উঠলো! আজ সারাদিন এই অশান্ত মনের তোলপাড় নিয়ে রাস্তায় হেঁটে বেরিয়েছে সে। উষসীর সাথে অনেকবার কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সুযোগ হয়নি। তৃষাণ, আহমেদ, উষ্ণতা তাকে খুব অনুরোধ করেছিল ঘুরতে যাওয়ার ব্যাপারে। কিন্তু প্রীতম যায়নি। তার ধারণা উষসীও একই কারণে যায়নি। কালকের পর থেকে তাদের সহজ-সরল বন্ধুত্বের সম্পর্কে ভয়ানক ফাটল ধরেছে!

কি করলে তা আবার আগের মতো সম্পর্কটা জোড়া লাগবে প্রীতম জানে না। তবে এখন প্রীতমের চাহিদা আরও বেশি। সে শুধু বন্ধু হিসেবে না, উষসীকে প্রেয়সী হিসেবেও চায়!

আর যতদিন সেটা না হচ্ছে, ততদিন সে হার মানবে না। প্রীতমকে তখনও পাশে বসে থাকতে দেখে উষসী সিদ্ধান্ত নিল নিজেই উঠে চলে যাবে। এই মুহুর্তে তার ভীষণ একাকিত্ব প্রয়োজন। কাউকে সহ্য হচ্ছে না নিজের পাশে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে! অন্তত মনকে শান্ত করার জন্য হলেও তাকে কাঁদতে হবে। মনের আঘাত চোখের জলে মুছতে হবে! প্রীতম তাও উষসীর পেছন পেছন আসছিল। উষসী হঠাৎ খুব ক্ষেপে গেল।

পেছন ফিরে প্রীতমকে থাপ্পড় দেওয়ার জন্য হাত তুলে বলল,” আর একবার আমার পিছু নিলে কঠিন চড় খাবি তুই!”

প্রীতম উষসীর হাতটা নিয়ে নিজের গালের সাথে ঠেকিয়ে বলল,” নে মার চড়। প্লিজ মার! একটা চড় মেরে যদি তোর রাগ কমে তাহলে মার।”

উষসী হাত ছাড়িয়ে নিল। কিন্তু প্রীতম থামল না। কয়েক কদম এগিয়ে এসে বলল,” এরপর যদি আরও মারতে ইচ্ছে হয় তাহলে মারবি! প্রয়োজনে একশোটা চড় মারবি। তাও আমি কিছু মনে করবো না। যখন থেকে তোকে ভালোবেসেছি, আমার জীবনের সব অধিকার তোকে দিয়ে দিয়েছি! আমি পুরোটাই তোর। আমাকে তুই মারবি, কাটবি, যা মন চায় তাই করবি…”

প্রীতমের কথা শেষ হওয়ার আগেই চোখমুখ কুচকে ধিক্কার জানালো উষসী,” ছি! আমাকে এ ধরণের কথা বলতে তোর লজ্জা করল না? তোকে তো আমি ভাই ভেবেছিলাম।”

প্রীতম আহত দৃষ্টিতে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।’ ভাই’ শব্দটা তার কানে তীক্ষ্ণভাবে বাজতে লাগল। যন্ত্রণা দিতে লাগল! উষসী চলে যেতে নিচ্ছিল। প্রীতম তার হাত ধরে টেনে কাছে এনে বলল,” এই, যাচ্ছিস কোথায়? আগে উত্তর দিয়ে যা। ভাই মানে? কে তোর ভাই? আমি কি কোনোদিন বলেছি যে আমি তোর ভাই? তুই আমার বোন? কোন সাহসে আমাকে ভাই বললি তুই?”

প্রীতমের এতো আক্রমণাত্মক ব্যবহারে উষসী থতমত খেয়ে গেল। কথা বলার জন্য শব্দ খুঁজে পেল না। চিরপরিচিত বন্ধুটির হঠাৎ এই অপরিচিত ব্যবহারে উষসী স্তব্ধ হয়ে গেল! প্রীতম উষসীর কোমড় শক্ত করে চেপে ধরে নেশায় আসক্ত হয়ে যাওয়ার মতো বলল,” আমি তোকে খুব ভালোবাসি উষসী। তুই এটা কবে বুঝবি আমি জানি না। কিন্তু তোকে বুঝতেই হবে। আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারবো না। তুই যতই আমাকে চড় মার, লাথি মার, যা ইচ্ছা তাই কর, কিন্তু আমি তোকে ছাড়া আর কিচ্ছু ভাবতে পারছি না। আমি ভাবতে চাইও না!”

উষসী যথাসাধ্য চেষ্টা করছে ছাড়া পাওয়ার। কিন্তু প্রীতম যেন তার হুশে নেই। শরীরে অসুরের শক্তি ভর করেছে তার। যতই উষসী ছোটার চেষ্টা করছে ততই প্রীতমের স্পর্শ গাঢ় হচ্ছে। উষসীর মনে হচ্ছে অনেকগুলো বিষপোকা একসাথে তাকে কামড়ে ধরেছে! অসহ্য লাগছে সবকিছু!

উষসী কাঁদতেও ভুলে গেছে। প্রীতম বলে যেতে লাগল, “কালরাতের পর থেকে আমি একটুও ভালো নেই বিশ্বাস কর! একফোঁটা ঘুমাতে পারিনি সারারাত। আজ সারাদিন আমার ভয়ংকরভাবে কেটেছে! কতবার গাড়ি এক্সিডেন্ট করতে নিয়েছিলাম জানিস? হয়তো আজই মরে যেতাম কিন্তু করুণাময় আমাকে তোর জন্য বাঁচিয়ে রেখেছে। তুই আমার উষসী, শুধুই আমার। এই কথাটা মেনে নে প্লিজ।”

” আমি কোনো সম্পত্তি না যে বললেই তোর হয়ে যাবো। তুই আমাকে ছাড় প্রীতম, বাড়াবাড়ি করিস না। খুব খারাপ হবে।”

” খারাপ হওয়ার বাকি কি আছে? যা খারাপ হওয়ার কালরাতেই হয়ে গেছে। যখন আমরা একসাথে ঘোড়ায় উঠলাম, তুই আমার হাতে হাত রাখলি, পড়ে যাওয়ার ভয়ে আমার বুকের টি-শার্ট খামচে ধরলি, আমি তোর চুলের গন্ধ নিলাম, সর্বনাশটা তখনি হয়ে গেল।”

” তার মানে আমি না, আমার শরীর তোকে আকর্ষণ করেছে।”

” না, এটা মিথ্যে! এতোটা নিচ ভাবিস না আমাকে প্লিজ! আমি তো তোকে ছোট্টবেলা থেকে ভালোবাসি উষসী। সেই ক্লাস নাইন থেকে তুই আমার স্বপ্নের প্রেয়সী!”

” তাহলে এতোদিন কেন বলিসনি? কেন কালই তোর বলতে হলো? এতোগুলো দিন যে ধৈর্য্য রাখতে পেরেছে সে এখন কিভাবে এতো ধৈর্য্যহারা হয়ে যাচ্ছে? আসলে তোর এটা ভালোবাসা না, শুধুই আকর্ষণ। এতোদিন তোর আমাকে ভালোলাগতো। কিন্তু এখন তুই আমাকে চাহিদা বানাতে চাইছিস। তোর এই আকাশচুম্বী চাহিদা তোকে এতোটাই হিংস্র বানিয়ে দিয়েছে যে নিজেও বুঝতে পারছিস না কতটা অন্যায় তুই করছিস এখন!”

” এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লভ এন্ড ওয়ার। যদি এটা অন্যায় হয়, তো হোক! আমি ভালোবাসা আদায়ের জন্য সব করতে পারি।”

” ভালোবাসা আদায়ের ব্যাপার না। অনুভবের ব্যাপার। আমি যতক্ষণ তোর জন্য অনুভব না করবো, তুই আমাকে জোর করে কিছুতেই অনুভব করাতে পারবি না!”

উষসী ছুটতে নিলে প্রীতম আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।।উষসী চোখমুখ খিচে প্রাণপনে বলল,” প্রীতম প্লিজ আমি ব্যথা পাচ্ছি! তোর কাছে নিজেকে সুরক্ষিত ভাবতাম। কিন্তু এখন তুই-ই আমার সবচেয়ে বড় ক্ষতি করতে চাইছিস? কেন?”

” আমার কাছে তুই অবশ্যই সুরক্ষিত। কিন্তু মানতে চাইছিস না বলে তোর ক্ষতি মনে হচ্ছে। একবার শুধু মেনে নে আমায়।”

” না, এ আমার জন্য অসম্ভব! আমি অন্যকাউকে ভালোবাসি।”

” তোর ভালোবাসা কি ওই ইয়ামিন ইব্রাহীম? ”

উষসী কেঁদে ফেলল এবার। পুনরায় কষ্টের কথা মনে পড়ে গেল। তাকে কেঁপে কেঁপে কাঁদতে দেখে প্রীতম শক্ত করে গাল চেপে ধরল,”একদম কাঁদবি না। আমার সামনে দাঁড়িয়ে তুই অন্য পুরুষের জন্য কাঁদবি এটা আমি সহ্য করবো না!”

ইয়ামিন ওই মুহুর্তে ওই রাস্তা দিয়েই উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটছিল। উষসীর গোঙানি শুনে তার দৃষ্টি সচকিত হলো। আশেপাশে খোঁজার চেষ্টা করল, শব্দটা কোথথেকে আসছে? কেউ কি কাঁদছে? হঠাৎ প্রীতমের গর্জনও শুনতে পেল সে। ঠিক তার পরের মুহুর্তেই বড় একটা গাছের পেছনে দুইজন ছেলে-মেয়েকে দেখতে পেল। দূর থেকে অন্তত এইটুকু বোঝা যাচ্ছে যে মেয়েটার উপর জুলুম করা হচ্ছে। মেয়েটার সম্মতি নেই তবুও ছেলেটা তাকে স্পর্শ করতে চাইছে! কান গরম হয়ে গেল ইয়ামিনের। রাক্ষুসে মেজাজ নিয়ে ছুটে গেল প্রীতমের দিকে।

প্রীতম উষসীকে চুমু দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছিল। কিন্তু উষসী বার-বার মুখ সরিয়ে নিচ্ছিল বিধায় সে সফল হচ্ছিল না। হঠাৎ কেউ একজন বিরাট থাবায় তার শার্টের কলার টেনে ধরল। এক থাবায় প্রীতমের গলার চামড়া মাংসসহ ছিড়ে গেল।

তারপর মনে হলো সে শূন্যে উঠে যাচ্ছে। দানবীয় এই শক্তির উৎস খুঁজতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই বিকট শব্দে চোয়াল ভেঙে গুড়িয়ে যাওয়ার মতো চার-পাঁচটা ঘুষি একাধারে খেল সে। তারপর আরও কঠিন মার খেল। প্রীতম নিঃশ্বাস নেওয়ারও সুযোগ পাচ্ছিল না। তার নাসারন্ধ্র গরম হয়ে সেখান থেকে গলগল করে উত্তপ্ত রক্ত বের হচ্ছে। ইয়ামিন বিস্ফোরিত চিৎকারে বলতে লাগল,” না বলার পরেও কেন ধরলি তাকে? কেন ধরলি বল!”

প্রীতম যে মরে যাচ্ছে সেদিকে হুশ নেই উষসীর। সে কান্ডজ্ঞান হারিয়ে বোকার মতো ইয়ামিনের কান্ড দেখছে। নিজের চোখকেও বিশ্বাস হচ্ছে না, কানকেও না! কয়েক মুহুর্ত স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর যখন উষসীর ধ্যান ভাঙল, তখনি প্রীতমের অবস্থা দেখে শিউরে উঠলো সে। এতো বেশি রক্তাক্ত হয়ে গেছে যে চেনাই যাচ্ছে না! উষসী চিৎকার করে উঠল,” থামুন, আল্লাহর দোহাই লাগে থামুন! মরে যাবে ও।”

উষসী ভয়ে কেঁদে ফেলল। কাঁপতে কাঁপতে কাঁদছিল সে। ওর ভয় পাওয়া দেখে ইয়ামিন ছেড়ে দিল। ছাড়ার সাথে সাথেই প্রীতম বেহুশের মতো ধপ করে পড়ে গেল রাস্তায়। তার মুখ নিঃসৃত দীর্ঘশ্বাস হতে হালকা ধুলো উড়লো। উষসী গলাকাটা মুরগীর মতো ছটফট করতে লাগল ভয়ে।প্রীতমের পাশে বসে ডাকতে লাগল,” দোস্ত, এই দোস্ত, উঠ না। তুই কি ঠিকাছিস?”

উষসীর গলা একদম শুকিয়ে গেছে। ইয়ামিন হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,” ঠিক নেই। ওকে হসপিটালে নেওয়ার ব্যবস্থা করো। আর আমাকে পানি দাও।”

কথাটা বলেই ধপ করে রাস্তার মধ্যে ডিভানের মতো সামান্য উঁচু জায়গায় বসে পড়ল ইয়ামিন। উষসী ওর কথা শুনে উঠে দাঁড়িয়ে গেল।হতভম্ব দৃষ্টি নিয়ে বলল,” এখন আমি পানি কোথায় পাবো?”

ইয়ামিনের নির্লিপ্ত উত্তর,” জানি না। তোমার জন্য এতো কষ্ট করে একজনকে মেরে বেহুশ বানালাম আর তুমি সামান্য পানি খাওয়াতে পারছো না?”

উষসী বাকরুদ্ধ! এখন কি রাত-বিরাতে সে রাস্তায় হেঁটে পানি খুঁজবে নাকি? ইয়ামিন আবারও বলল,” পানি খাবো। দ্রুত পানি দাও!”

চলবে

আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-১২+১৩

0

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ১২
(অতীত)
ইয়ামিন শান্ত হতে পারছে না কিছুতেই। রুমের এই মাথা থেকে ওই মাথা পায়চারী করে যাচ্ছে সে। তার দৃষ্টি এলোমেলো, মন অস্থির! মস্তিষ্কে অসামঞ্জস্য তোলপাড়। চোখ জড়িয়ে আসছে ঘুমে কিন্তু ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না। আশ্চর্যজনকভাবে চোখ বন্ধ করলেই ব্যালকনিতে ঘটে যাওয়া সেই অপ্রত্যাশিত ভুলটির কথা মনে পড়ছে। যদি হাবিলদার ওয়াকিল না আসতো তাহলে কি হতো? এই প্রথম, দীর্ঘ নয়বছর পর ইয়ামিন কোনো নারীর প্রতি আকর্ষণবোধ করছে। কি অবাক কান্ড! কামলার সাথে তার পরিচয় মাত্র একদিনের। এই একদিনে কি এমন হয়ে গেল যে মেয়েটাকে এতো বেশি আপন লাগছে?

কীর্তির সাথে তো চারবছর ধরে ইয়ামিনের ফ্রেন্ডশীপ। কিন্তু কখনও তো কীর্তির প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেনি সে। অথচ কীর্তি কামলার চেয়েও সুন্দরী, কয়েকগুণ আকর্ষণীয়। প্রেমে পড়ার মতো সব গুণ কীর্তির মধ্যে আছে। বরং কামলার মধ্যে এসব কিছুই নেই। কত সহজ-সরল একটা মেয়ে সে। ভীষণ সিম্পল! তাও কেন ইয়ামিন এইভাবে কামলার মোহে আটকে পড়ল? এ কেমন ফাঁদ? মুহূর্তেই উত্তরটা পেয়ে গেল ইয়ামিন। উষ্ণতা! সে ছাড়া এই আকর্ষণের অন্যকোনো কারণ নেই।ইয়ামিন আসলে কামলার মধ্যে উষ্ণতাকে পেতে চেয়েছে। যা কোনোভাবেই সম্ভব না।

মুম্বাই থাকা অবস্থায় ইয়ামিন তার বিশাল ফ্ল্যাটে যেখানে সে একাকিত্ব নিয়ে দিনের পর দিন কাটিয়েছে, এমন কোনো মুহুর্ত তৈরী হয়নি যখন তার উষ্ণতার কথা মনে পড়েনি। এইযে তার কণ্ঠের এতো সুর, শুধুই উষ্ণতার জন্য। তার প্রতিটি প্রেমের গান উষ্ণতাকে উৎসর্গ করে লেখা। তার আবেগ-অনুভূতি সবকিছুতে শুধু উষ্ণতার রাজত্ব।

ইয়ামিনের এতোবড় ক্যারিয়ারের পেছনেও উষ্ণতার অবদান মুখ্য। সে কিভাবে এতোবড় সিংগার হয়ে গেল? কেন মুম্বাই আসল? উষ্ণতার জন্যই তো! উষ্ণতার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর হৃদয়ের অসহ্য কষ্ট এড়াতে সে পড়াশুনার জন্য আমেরিকা চলে গিয়েছিল। উষ্ণতার সাথে কখনও দেখা না হলে ভেবেছিল আস্তে আস্তে তাকে ভুলে থাকবে। কিন্তু হলো বিপরীত। সে তো উষ্ণতাকে ভুলতে পারলই না বরং উষ্ণতার স্মৃতিগুলো আরও প্রকটভাবে তার মস্তিষ্কে হানা দিতে লাগল। কল্পনায় সে উষ্ণতাকে অনুভব করতো। প্রতিটি অনুভবে উষ্ণতা তার সামনে আসতো। ম্যাডাম হয়েই তাকে ধমকাতো, বোঝাতো, শেখাতো।

ইয়ামিন দৈনন্দিন জীবনে, লেখাপড়ায়, কোনোকিছুতেই কনসেন্ট্রেট করতে পারছিল না। তার গিটার বাজানোর প্রতি তীব্র শখ ছোটবেলা থেকেই। মাঝে মাঝে উষ্ণতাকে ভুলতে সুরের মাঝে ডুবে থাকতো। কখনও কখনও গিটার বাজিয়ে নিজের মতো গান গাইতো। নিউইয়র্কে যেই ছোট্ট ফ্ল্যাটে সে থাকতো সেখানে তার আশেপাশে বেশিরভাগ ছিল ইন্ডিয়ানরা। ইয়ামিন প্রায় প্রতিরাতেই ব্যালকনিতে বসে গিটারে গান করতো। সে গাইতো চোখ বন্ধ করে, উষ্ণতার স্মৃতিমন্থন করতে করতে। যখন গাইতো, তার দুইচোখের কিনারা দিয়ে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হতো। সেই অশ্রুময় বৃষ্টি শুকিয়ে চেহারায় দাগ রেখে যেতো। তাও ইয়ামিনের ঘোর কাটতো না৷ সে আপনমনে গাইতো।

কখনও গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে, কখনও বা মৃদু সুরে ভীষণ নীরবে! তার ইন্ডিয়ান প্রতিবেশীদের মধ্যে একজন ইনফ্লুয়েন্সার ছিল। সে ওই গান ভিডিও করে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপ্লোড করে দিয়েছিল ইয়ামিনের অজান্তেই। রাতারাতি ফেমাস হয়ে গেল ইয়ামিন। রাস্তায় বের হলেই দুয়েকজন তার সাথে সেলফি তুলতে চাইতো। প্রথম প্রথম ইয়ামিন পাত্তা দিল না। তখনও আসল ঘটনা জানতো না সে। জানার চেষ্টাও করেনি।

তারপর একদিন ভার্সিটির প্রোগ্রামে বন্ধুরা তাকে অনুরোধ করেছিল বাংলা গান শোনাতে৷ আবদ্ধ ঘরে নিজের মতো গান গাওয়া আর বাইরে এতো মানুষের মধ্যে গান গাওয়া;তফাৎ অনেক! তবুও ইয়ামিন সবার অনুরোধ রক্ষার্থে গান গেয়েছিল। সেই গানের জন্য ভার্সিটির ডিরেক্টর নিজের অফিসরুমে ডেকে নিয়ে তাকে পুরষ্কৃত করেছেন।

সেদিন থেকেই ইয়ামিনের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। আরও বাড়ে তার পরিচিতির প্রচার,প্রসার। তারপর হঠাৎ একদিন মুম্বাই থেকে একজন মিউজিক ডিরেক্টর ইয়ামিনকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ম্যাসেজ করে। তখন ইয়ামিন মোটামুটি জনপ্রিয় মুখ। ইয়ামিন ইব্রাহীম বলতেই অনেকে চিনে ফেলে! বিশেষ করে সুন্দর চেহারার জন্য মেয়েদের মধ্যে তাকে নিয়ে বেশি মাতামাতি ছিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় রীতিমতো তোলপাড়ের ঝড় তুলেছিল তরুণীরা।

সবাই জানে ইয়ামিনের একটা ‘সিকরেট লাভ’ আছে। কিন্তু কে সেই ভাগ্যবতী নারী তা সবার কাছেই ধোঁয়াশা। ইয়ামিন যত জায়গায় এই পর্যন্ত ইন্টারভিউ দিয়েছে সব জায়গায় এই প্রশ্নটির সম্মুখীন তাকে অবশ্যই হতে হয়েছে। কিন্তু ইয়ামিন ব্যাপারগুলো খুব কৌশলে এড়িয়ে যেতো। তাই বিষয়টা নিয়ে মানুষের আগ্রহেরও সীমা নেই। যাদের সাথেই ইয়ামিন কাজ করেছে, প্রায় সবাই ইয়ামিনকে সর্বপ্রথম এই প্রশ্নটি করেছে। কে মেয়েটি? ইয়ামিনের এমন কোনো কো-আর্টিস্ট নেই যে ইয়ামিনকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করেনি।

শুধুমাত্র কামলা ব্যতিক্রম। এই মেয়েটির আসলে সবকিছুই অন্যরকম। অদ্ভুত সুন্দর! কোনো ভাণ নেই, কাউকে মুগ্ধ করার চেষ্টা নেই। সে একদম নিজের মতো। সুন্দর, সুচালো,তীক্ষ্ণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। যেমনটা ছিল উষ্ণতা! এ কারণেই হয়তো আজ এতোবছর পর উষ্ণতাকে ছেড়ে ইয়ামিন অন্যকাউকে নিয়ে এতো গভীরভাবে চিন্তা করছে।

দরজায় কেউ কড়া নাড়ল। ইয়ামিন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখল কামলা। হৃদস্পন্দন ত্বরিত হলো। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করল সে। কামলা যদি মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতো তাহলেই বুঝতে পারতো ইয়ামিন তার মনের সুপ্ত অনুভূতিগুলো লুকানোর চেষ্টায় এমন বোকা বোকা হাসি দিচ্ছে। কামলা রুমে ঢুকে ইয়ামিনের পাশে বসতে বসতে বলল,” আমি ভেবেছিলাম তুমি ঘুমিয়ে পড়েছো।”

“না, ঘুমাইনি। একটা গান নিয়ে চিন্তা করছিলাম।”

” তাই? কি গান? শোনাও তো!”

হয়ে গেল না বিপদ? ইয়ামিন তো কোনো গান নিয়ে চিন্তাই করেনি। সে চিন্তা করছিল কামলার বিষয়ে।

ইয়ামিন ভ্রু কুচকে বলল,” স্পেশাল কোনো গান না! পরে শোনাবো কোনো একসময়। তুমি মনে হয় কিছু বলতে এসেছিলে?”

” হুম। মেয়েটার জ্ঞান ফিরেছে। ওর সাথে কথাও বলতে পেরেছি। আমরা যা ভেবেছিলাম তাই। ওরা ট্যুরিস্ট। মেয়েটার থেকে যতটুকু জানলাম, সম্পর্কে ছেলেটা তার বেস্টফ্রেন্ড। ফ্যামিলির সাথে ট্যুরে এসেছিল ওরা। রাতে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে হোটেল থেকে পালিয়েছে। তারপর নাকি পাগলা ঘোড়ায় চড়তে গিয়ে এই এক্সিডেন্ট হয়েছে।”

” লাভ কেইস নাকি?”

” আরে না, তেমন কিছু না। শুধু ঘুরতে বেরিয়েছিল। পালিয়ে যাওয়ার জন্য বের হয়নি।”

কামলা কেমন অদ্ভুতভাবে হাসছে। ইয়ামিনের চোখের চামড়া কুচকে গেল ওর হাসি দেখে।

” তুমি হাসছো কেন?”

” একটা মজার কথা ভেবে হাসছি।”

” কি কথা?”

” মেয়েটা সেকেন্ড টাইম কেন বেহুশ হয়ে গেছিল জানো?”

” কেন?”

” তোমাকে দেখে।”

কামলা কথাটা বলেই শব্দ করে হেসে উঠল। ইয়ামিন আশ্চর্য হয়ে বলল,” আমাকে দেখে মানে?”

” মানে তোমার ম্যাড ফ্যান! তোমাকে দেখেই উত্তেজনায় বেহুশ হয়ে গেছে মেয়েটা।”

” সিরিয়াসলি?”

এইবার ইয়ামিনও হেসে ফেলল। বদ্ধ ঘরে দুই মানব-মানবীর প্রাণখোলা হাসির অমায়িক শব্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল।

কামলা ঠাট্টার স্বরে বলল,” ভালোই তো ফেমাস আপনি মিস্টার সিংগার! যেখানেই যাচ্ছেন ফ্যানদের কুপোকাত করে দিচ্ছেন। মেয়েরা আপনাকে দেখে বেহুশ হয়ে যাচ্ছে। কেউ আবার জ্বর বাঁধিয়ে ফেলছে।”

” জ্বর কে বাঁধালো আবার?”

” নায়রা তো আপনাকে দেখার পর আর বাসাতেই এলো না। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম আপনি ওকে টেনে দাঁড় করিয়েছিলেন বলে খুশিতে জ্বর বাঁধিয়ে ফেলেছে পাগলিটা। আর এখন এই মেয়ের এই অবস্থা!”

ইয়ামিন লজ্জিত মুখে বলল,” এসব হলো ফ্যানদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ, কামলা সিং! তুমি বুঝবে না।”

” হুম অনেক বেশি ভালোবাসছে মেয়েরা আপনাকে।”

এই কথা বলে আবার হাসিতে ঢুলুঢুলু হলো কামলা। ইয়ামিন অবাক হয়ে দেখছিল। ঠিক যেন উষ্ণতা হাসছে। কতদিন পর উষ্ণতাকে এতো কাছ থেকে অনুভব করতে পারছে সে৷ হাসলে কামলাকে উষ্ণতার মতোই সতেজ লাগে! ইয়ামিন আবার ঘোরে ডুবে যাচ্ছে। ঘোর কাটাতে দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাল। প্রসঙ্গ পাল্টাতে প্রশ্ন করল,” আচ্ছা, ছেলেটা এখন কোথায়? ওদের হোটেলে পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে কিছু ভেবেছো?”

” হ্যাঁ। এই ব্যাপারেই তোমার সাথে কথা বলতে এসেছিলাম। ছেলেটা এখন ঘুমাচ্ছে। ওর ঘুমটা আগে ভাঙুক। আর মেয়েটা তো তোমার সাথে দেখা করতে চাইছে।”

ইয়ামিনের এখন কারো সাথে দেখা করতে একটুও মন চাইছে না। তাই অনিচ্ছার সুরে বলল,” এখন? তুমি কি বলেছো?”

” আমি বলেছি তুমি ঘুমিয়ে পড়েছো। সকালে দেখা করিয়ে দিবো।”

কামলার উপস্থিত বুদ্ধি দেখে খুব আপ্লুত হলো ইয়ামিন। মুচকি হেসে বলল,” গুড। এটা ভালো করেছো।”

” ঠিকাছে তুমি তাহলে এখন রেস্ট নাও মিস্টার সিংগার! আমি যাই।”

কামলা একহাত দিয়ে ইয়ামিনের মাথার চুল ঘেঁটে দিল। আবারও মনে পড়ল উষ্ণতার কথা। ইয়ামিনের মন গলে গেল অনুভূতির উত্তাপে। কামলা চলে যাওয়ার সময় ইয়ামিন বিবশের মতো ডাকল,” উষ্ণতা মিস!”

” কি বললে?”

ঘুরে তাকাল কামলা। ইয়ামিন অপ্রস্তুত হলো। কেন এই নামে ডাকল সে? আমতা-আমতা করে খুব অপ্রয়োজনীয় একটা প্রশ্ন করে ফেলল” ওদের নাম জিজ্ঞেস করেছিলে?”

” হ্যাঁ। মেয়েটার নাম লামিয়া ইমরোজ উষসী। আর ছেলেটা প্রীতম রহমান। ওরা বাংলাদেশী।”

ইয়ামিন উঠে দাঁড়াল,” মেয়েটার কি নাম বললে?”

” লামিয়া ইমরোজ উষসী৷”

ইয়ামিন হতবাক! যা ভেবেছিল তাই! মেয়েটাকে প্রথম দেখাতেই চেনা চেনা লাগছিল তার। কিন্তু উষ্ণতা মিসের ছোটবোন এখানে কিভাবে আসবে সেটা ভাবতে পারেনি।

কামলা বলল,” কেন কি হয়েছে?”

” না, কিছু না। তুমি বললে না মেয়েটা আমার সাথে দেখা করতে চায়? আমি দেখা করবো। ডাকো ওকে।”

” সিউর?”

” হুম।”

” ঠিকাছে, আমি এখনি ডেকে আনছি।”

চলবে

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ১৩
লিখা- Sidratul Muntaz

উষসীর ধারণা এই মুহুর্তে তার শুধু হাত নয়, হাতের শিরা-উপশিরাও কাঁপছে। শরীরের সব রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। সে শ্বাস নিতেও অক্ষম। মরা-মরা অবস্থায় মানুষটির সামনে সে দাঁড়িয়ে আছে,, মানুষটি কি তাকে বোকা ভাবছে? কিন্তু উষসী আর কি করবে? তার যে সবকিছুই স্বপ্ন মনে হচ্ছে!

ইয়ামিন কফিতে চুমুক দিয়ে বলল,” বসছো না কেন?”

ব্যালকনির গোল টেবিলের সাথে বসে আছে ইয়ামিন। তার মুখোমুখি চেয়ারটা ফাঁকা। উষসী বসছে না। ইয়ামিনের কথায় যখন তার সম্বিৎ ফিরল, তখন সে তাড়াহুড়ো করে বসতে নিয়েই চেয়ারসহ উল্টে পড়ে গেল। দেয়ালের সাথে মাথায় বারিও খেল। একহাত কপালে ঠেঁকিয়ে শব্দ করে বলল,” ইশ!”

ইয়ামিন উঠে এলো। সতর্কতার সাথে উষসীকে টেনে দাঁড় করিয়ে বলল,” বেশি লেগেছে?”

উষসী লজ্জায় দ্রুত সরে গিয়ে বলল,” না। আমি ঠিকাছি। এক্সট্রিমলি স্যরি, আমি পড়ে গেছি।”

ইয়ামিন হেসে ফেলল। তার হাসি দেখে উষসীর বুকের ধুকপুকানি এতো বেড়ে গেল যে সে কাঁপতে লাগল। ইয়ামিন বলল,” পড়ে যাওয়ার জন্য স্যরি বলছো কেন?”

উষসী বোকার মতো তাকিয়ে রইল। তার মস্তিষ্ক পুরোপুরি ফাঁকা। সে শুধু ইয়ামিনকে দেখছে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে। ইয়ামিন নীরবতা কাটাতে প্রশ্ন করল,” তোমরা কি এখানে শুধু ঘুরতে এসেছো নাকি অন্যকোনো পারপাস?”

উষসীর আবেগে আপ্লুত হয়ে বলতে ইচ্ছে করল,” আমার জীবনের সমস্ত পারপাস আপনি। সবঘটনা আপনাকে নিয়ে। যদি আপনি কাশ্মীরে না আসতেন তাহলে আমারও এতো উৎসাহ নিয়ে আসা হতো না। এখন আপনার সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পেরে নিজেকে আমার স্বার্থক মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, এই অবস্থায় মরে গেলেও আমার দুঃখ থাকবে না।”

উষসীর উত্তর না পেয়ে ইয়ামিন আবার বলল,”আর ইউ ওকে? দাঁড়িয়ে থাকতে অসুবিধা হলে বসতে পারো। আশা করি আমার পাশে বসতে তোমার প্রবলেম নেই।”

এবার দারুণ লজ্জা পেল উষসী৷ ইশ, সে এমন গাঁধার মতো আচরণ কেন করছে? একটু স্বাভাবিক হতে কেন পারছে না? সে অপ্রস্তুত গলায় বলল,”কি যে বলেন ভাইয়া…কিসের প্রবলেম? আমি এখনি বসছি। এইতো।”

উষসী পড়ে থাকা চেয়ারটা তুলতে গেল। তখন ইয়ামিন তাকে থামিয়ে নিজেই তুলে দিল সেই চেয়ার। এবার উষসী বসল। প্রায় দম আটকে আসা কণ্ঠে বলল,” আই এম স্যরি। আমার খুব নর্ভাস লাগছে একটু।”

” খুব নর্ভাস লাগছে নাকি একটু?” ইয়ামিন প্রশ্ন করল ঠাট্টার স্বরে।

উষসী এবার হেসে ফেলল। সে একদম আঁতেল হয়ে গেছে। কথাও বলছে ভুল-ভাল। সে আসলে নিজের মধ্যে নেই। আর কোনো বোকামি করে ফেলার আগেই দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। এক নিশ্বাসে বলল,” আমি এখন যাই।”

সে দৌড়ে পালাতেই নিচ্ছিল। ইয়ামিন তার হাত চেপে ধরে বলল,” আরে থামো, আমার কথা শোনো।”

উষসী তখন ঠকঠক করে কাঁপছে। তার কাঁপুনি থামছেই না। সে মনে হয় আবার বেহুশ হয়ে যাবে। ইয়ামিন কি সত্যি তার হাত ধরে আছে?

ইয়ামিন প্রশ্ন করল সাবধানে,” সবাই কেমন আছে?”

” কোন সবাই? কাদের কথা বলছেন?” উষসীর কণ্ঠ কম্পমান।

ইয়ামিন উদগ্রীব হয়ে বলল,” উষ্ণতা মিস কেমন আছে?”

” ভালো। আমরা এখানে ট্যুরে এসেছি। তৃষাণ ভাইয়া আর উষ্ণতা আপুর অষ্টম ম্যারেজ এনিভারসেরি উপলক্ষ্যে ট্যুর।”

অষ্টম ম্যারেজ এনিভারসেরি কথাটা শুনে ইয়ামিন দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল। আটবছর হয়ে গেছে উষ্ণতার বিয়ের! তাদের কয়টা বাচ্চা? ইয়ামিন জানতে চাইল,” কয়টা বাচ্চা তাদের?”

” একটাই।”

” ছেলে নাকি মেয়ে?”

” ছেলে। তৃষ্ণা নাম। সেও আপনার অনেক বড় ফ্যান।”

” তাই নাকি?”

” হুম।” উষসী লজ্জায় জুবুথুবু হয়ে যাচ্ছে। ইয়ামিন তার সঙ্গে এতো কথা কেন বলছে? তার মতো সেলিব্রিটি উষসীর মতো সাধারণ মেয়েকে হাত ধরে আটকে রেখে গল্প করছে! ব্যাপারটা কেমন? উষসীর এতো আনন্দ কেন লাগছে?

” তোমরা এখানে কয়দিন থাকবে?”

উষসীর হার্টবীট বাড়ছে ক্রমশ। নিজেকে সামলে বলল,” জানি না। ঘুরাঘুরি শেষ হলেই চলে যাবো।”

” গ্রেইট! ঘোরাঘুরির জন্য কাশ্মীর ইজ ফাবিউলাস। সুইজারল্যান্ডের বিকল্প কাশ্মীর। এখানে যত ঘুরবে ততই সেটিসফ্যাকশন বাড়বে।”

ইয়ামিন কথাগুলো বলছিল অন্যদিকে তাকিয়ে। যতবার সে অন্যদিকে তাকায় ততবার উষসী ইয়ামিনের চেহারার দিকে তাকায়। কিন্তু ইয়ামিন যখনি তার দিকে তাকায় তখনি সে মাথা নুইয়ে ফেলে লজ্জায়। শরীর আচমকা কেঁপে উঠে তার। কাশ্মীরের হিমশীতল বাতাসের চেয়েও যেন অধিকতর শীতল ইয়ামিনের ওই ধারালো দৃষ্টি!

ওই অসহ্য শীতল দৃষ্টিতে চোখ রাখার স্পর্ধা উষসীর নেই। একটু পর ইয়ামিন বলল,” ঠিকাছে যাও। হ্যাভ আ নাইস ট্রিপ।”

তারপর নিজেই হাত বাড়িয়ে দিল হ্যান্ডশেক করার জন্য। উষসীর হাত এতো কাঁপছিল!নিজের হাতটা কখনও এতো ভারী মনে হয়নি। হ্যান্ডশেক করার জন্য হাতটা ওঠাল সে। ইয়ামিনের সাথে হাতের স্পর্শ লাগতেই শরীরে লজ্জারাঙা স্রোত বয়ে গেল। অসীম ভালোলাগায় মন ছেয়ে গেল! এ যে তার অতি প্রিয় মানুষের হাত!

ইয়ামিন বলল,” ও হ্যাঁ, কালকে এখানেই মিউজিক ভিডিও শ্যুট হবে। চাইলে সবাইকে নিয়ে শ্যুটিং দেখতে আসতে পারো। দেখা হবে আবার।”

ইয়ামিন কথাটা বলেছে একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে। যদি এই সুযোগে উষ্ণতাকে দেখার ইচ্ছেটা পূরণ হয়। যদি দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান হয়! যদি তার মনটা যদি একটু তৃপ্তি পায়!

এদিকে উষসীর মন খুশিতে ঝুমঝুম করে উঠল। ইয়ামিন তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে ভেবে সে হাওয়ায় ভাসতে লাগল। উত্তেজনায় ঘাড় নেড়ে বলল,” আমি নিশ্চয়ই আসবো।”

হোটেল থেকে প্রীতম-উষসীকে বের হতে দেওয়া হয়নি, কিন্তু ঠিকই ঢুকতে দেওয়া হলো। গার্ড নিজে এসে মেইন গেইট খুলে দিলেন। হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলেন,” আপনারা এতো রাতে কোথা থেকে এসেছেন?”

প্রীতম ধমক মেরে বলল,” আপনার কি দরকার? নিজের কাজ করুন।”

উষসী গটগট করে হেঁটে রুমে চলে আসছিল। পুরো রাস্তায় প্রীতমের সাথে সে একবারও কথা বলেনি। উষসীর চলে যাওয়া দেখে প্রীতম চড়া মেজাজ দেখিয়ে বলল,” স্বার্থপর! তোর জন্য আমি এতো রিস্ক নিলাম, তোকে বাঁচাতে গিয়ে পাগলা ঘোড়ার লাথি খেলাম। তাও তোর কোনো গিল্টিনেস নেই? নবাবজাদীর মতো ড্যাঙড্যাঙ করে হেঁটে চলে যাচ্ছিস! এই তোর হৃদয়টা কি ইস্পাত দিয়ে তৈরী? একবার তো আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারিস যে আমি কেমন আছি? আমার মাথার আঘাতের কি অবস্থা?”

উষসী চোখ রাঙিয়ে বলল,” যদি লজ্জা থাকে তাহলে আর কখনও আমার সামনে আসবি না তুই।”

এই কথা বলেই উষসী ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিল। আর প্রীতম স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইল বন্ধ দরজার সামনে বেশ কয়েকমিনিট।

উষসীর কথাটার ধাক্কা সামলাতে তাকে বেশ বেগ পেতে হলো! সে কি বিরাট কোনো ভুল করেছে? শেষমেষ কি তাদের ফ্রেন্ডশীপটাই নষ্ট হয়ে যাবে? না,না, উষসী এটা কর‍তে পারে না। সে এখন রাগের মাথায় এসব বলেছে। কাল নিশ্চয়ই হাসিমুখে এসে প্রীতমকে স্যরি বলবে। সবকিছু আগের মতো হয়ে যাবে। উষসী হেসে হেসে আবারও বলবে,” দোস্ত, চল আমরা একসাথে হাঁটি। নে, আমার হাতটা ধর!”
প্রীতম এসব ভেবে মিথ্যামিথ্যিই নিজের মনকে সান্ত্বনা দিল।

উষসী দরজা আটকেই কাঁদতে বসে গেছে। প্রীতমকে সে ছোটবেলা থেকেই ভাইয়ের নজরে দেখে। উষসীর কাছে বন্ধু হিসেবে সবচেয়ে বড় বিশ্বাসের জায়গা ছিল প্রীতম! কিন্তু সে যে উষসীকে নিয়ে মনে মনে অন্যকিছু ভাবে তা উষসী কোনোদিন কল্পনা করেনি। কোথায় যেন শুনেছিল, ছেলে আর মেয়ে কখনও ভালো বন্ধু হতে পারে না। তাহলে কি কথাটা সত্যি? কেন সবছেলে একই রকম হয়? কেন কাউকে বিশ্বাস করা যায় না? শেষমেষ প্রীতমও উষসীর বিশ্বাসের অমর্যাদা করল। বন্ধুত্বের মতো সুন্দর একটা সম্পর্ক এইভাবে নষ্ট করল!

সারারাত ঘুম হলো না উষসীর। সে বারান্দায় আকাশের দিকে চেয়ে পুরো রাত্রি পার করল। বিছানায় ডোনা, যুথি আর তৃষ্ণা জড়াজড়ি করে ঘুমাচ্ছিল। শীতের রাতে ঠান্ডা বাতাসে উষসীর শরীর বরফের মতো জমে যাচ্ছিল। কিন্তু হৃদয়ের উত্তাপের কাছে শারীরিক এই শীতের অত্যাচার বিশাল কিছু মনে হলো না। ভোরে যখন সবার ঘুম ভাঙল, উষসী তখন জ্বরে কাতর। কেঁপে কেঁপে নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে। জ্বরের ঘোরে কথাও বলা যাচ্ছে না। অথচ সবাই তখন ঘুরতে বের হবে।

আজকের প্ল্যান পেহেলগাম ভ্রমণ। কিন্তু উষসী তো বিছানা ছেড়েই উঠতে পারছে না। উষ্ণতা বোনের এই অবস্থা দেখে ট্রিপ ক্যান্সেল করতে চাইল। কিন্তু উষসী বলল,” প্লিজ আপু, আমার জন্য তোমাদের আনন্দটা মাটি করো না। তোমরা ঘোরাঘুরি করো। কাশ্মীর ইজ ফাবিউলাস। সুইজারল্যান্ডের বিকল্প কাশ্মীর। যত ঘুরবে তত স্যাটিসফ্যাকশন বাড়বে। আর না ঘুরলে আফসোস। ”
উষ্ণতা ধমক মেরে বলল,” তুই চুপ করতো। আমার বোনের এই অবস্থা আর আমি ঘুরতে যাবো? এটা কিভাবে হয়?”

” মা তো থাকবে আমার সাথে। ডোনা আন্টিও আছেন৷ তাছাড়া আইলা কান্নাকাটি করছে। তৃষ্ণাও সকাল থেকে বের হওয়ার বায়না করছে। আমার জন্য ওদের আনন্দ নষ্ট হোক এটা আমি চাই না। প্লিজ তোমরা যাও। নাহলে আমার খারাপ লাগবে।”

” তুই সুস্থ হলে আমরা সব জায়গায় ঘুরবো।”

” আমি সুস্থ হলেও তোমাদের সাথে যাবো না আপু।পেহেলগাম আমার পছন্দ না। বরফের মধ্যে হাঁটতে বিশ্রী লাগে। যেদিকেই তাকাই শুধু সাদা পাহাড়।”

উষ্ণতা অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলল,” তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এতো সুন্দর জায়গা বিশ্রী বলছিস?”

তারপর সে উষসীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” পাগলি একটা! আমাদের পাঠানোর জন্য এসব বলছিস তাই না?”

” বুঝতেই যখন পারছো তাহলে বসে আছো কেন? যাও।”

” আচ্ছা যাবো। এখন বল তোর জন্য কি আনবো?”

” একটা কিউট দেখে আইসম্যান নিয়ে এসো।”

উষসী হেসে ফেলল। একটু পরেই তৃষাণ ঘরে ঢুকল। উষ্ণতা বলল,” দেখো তোমার শালিকা কি বলে। আমরা নাকি ওকে রেখেই ঘুরতে চলে যেতাম।”

” কেন? গেলে সবাই একসাথেই যাবো। আমাদের এতো তাড়া নেই। তুমি সুস্থ হও আগে উষু।”

” সমস্যা নেই তৃষান ভাইয়া। আমি মা আর আন্টির কাছে ভালো থাকবো। তোমরা ঘুরে এসো।”

তৃষান উষ্ণতার দিকে তাকালো,” তুমি কি বলো?”

উষ্ণতা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,” তোমার ইচ্ছা!”

তৃষান কাছে এসে বসল উষসীর। মাথায় হাত রেখে বলল,” জ্বর কেমন?”

” এখন একটু ভালো লাগছে। তবে বাইরে গেলে অবস্থা খারাপও হতে পারে।”

” এটা ঠিক বলেছো। তোমার বাহিরে যাওয়া ঠিক হবে না। আজকে অনেক ঠান্ডা।”

” এজন্যই তো বলছি। তোমরা যাও না। আমার সামনে মুখ ভোঁতা করে বসে থাকার চেয়ে ভালো ইঞ্জয় করো।”

” শিউর?”

” একদম শিউর।”

” ঠিকাছে, তুমি একা থাকতে পারলে আমাদের প্রবলেম নেই। মা আর আন্টি তো আজকে এমনিতেও বের হবে না। একদিন ঘুরেই তাদের অবস্থা খারাপ। আমাদের আজ ফিরতে রাত হবে। অথবা নাও ফিরতে পারি। পেহেলগামে রাতে থাকতে হবে পারে। অসুবিধা নেই তো?”

উষসী মিষ্টি হেসে বলল,” কোনো অসুবিধা নেই।”
” ওকে। সাবধানে থেকো। আর কোনো প্রবলেম হলে ফোন করো। বাহিরে বের হওয়ার দরকার নেই। হোটেলের ভেতরেই আমি সব ব্যবস্থা করে দিয়ে যাচ্ছি। সময়মতো খাবার পেয়ে যাবে। আর কিছু দরকার হলে আব্দুল নামের একজন ম্যানেজার আছে। ওকে ডাকবে।”

“ঠিকাছে ডাকবো।”
তৃষাণ যাওয়ার আগে আবারও রিমাইন্ডার দিল,” হোটেলের বাহিরে কিন্তু একদম বের হবে না উষু।”

উষসী বিরক্ত কণ্ঠে বলল,” এই অবস্থায় আমি কেন বের হবো তৃষাণ ভাইয়া? আর আমি কি আশেপাশের কিছু চিনি যে একা একা বাইরে যাব? এতো সাহস নেই আমার।”

তৃষাণ মনে মনে হাসল। উষসীর মিথ্যে বলার কৌশল সে জানে। মেয়েটা নিজেকে খুব চালাক মনে করে। এটাই তার সবচেয়ে বড় দূর্বলতা! গতরাতে তারা কয়টায় বাড়ি ফিরেছিল সেই সম্পর্কে তৃষাণ অবগত। অনেক আগেই তার খোঁজ নেওয়া হয়ে গেছে। প্রীতমের মাথার ব্যান্ডেজ দেখেই সে সন্দেহ করেছিল।

আজকে ব্রেকফাস্টের সময় তৃষাণ যখন প্রীতমকে ব্যান্ডেজের কথা জিজ্ঞেস করল, তখন প্রীতম বলেছে সে বাথরুমে স্লিপ খেয়ে পড়ে গেছে। তারপর মাথায় আঘাত পেয়েছে। হোটেল থেকে তাকে ফার্স্ট এইড বক্স দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তৃষাণ খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছে এমন কিছুই হয়নি। বরং কালরাতে প্রীতম আর উষসী হোটেল থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেছিল। যখন তাদের বের হওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো না, তখন তারা অন্য ব্যবস্থা করে দেয়াল টপকে পালিয়ে বের হয়েছিল।

সিসিটিবি ফুটেজও চেক করেছে তৃষাণ। এখন সে বাইরে বের হলে সর্বক্ষণ হোটেলে নজরদারি করবে। উষসীর যদি ভিন্ন পরিকল্পনা থাকে তাহলে তৃষাণ সেটা অনায়াসে জেনে যাবে। তাই উষসী যতই মিথ্যে বলুক, লাভ নেই। ধরা তো সে পড়বেই!

সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পর উষসীর নিজেকে মুক্তপাখি মনে হলো। এখন সে যা ইচ্ছা করতে পারে। তার জ্বর নিমেষেই উধাও হয়ে গেল!সে ইয়ামিনের গেস্ট হাউজে যাবে শ্যুটিং দেখতে৷ ইয়ামিন তাকে কত মিষ্টি করে আমন্ত্রণ জানিয়েছে! সে কি না গিয়ে থাকতে পারে?

লাঞ্চের পর ডোনা আর যুথি গল্প করতে করতে যখন ভাতঘুমে ঢুলে পড়লেন তখন উষসী চুপিচুপি বাইরে বের হওয়ার জন্য তৈরী হয়ে গেল। সবচেয়ে সুন্দর নীল রঙের শাড়িটা বের করে পরল।

তার একটা দারুণ রাণী গোলাপী রঙের ব্লেজার আছে। শাড়ির সাথে ব্রেজারটা বেশ মানিয়ে গেল। মাথায় পরল নীল কানটুপি। চুলগুলো ছেড়েই রাখল। ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক দিল। আর নিজের রূপে নিজেই মুগ্ধ হয়ে আয়নাতে অসংখ্যবার উড়ন্ত চুমু দিয়ে বলল,” মাশাল্লাহ!”

ব্লেজারের পকেটে হাত গুঁজে বেশ ফুরফুরে মন নিয়ে উষসী বাইরে বের হতে যাচ্ছিল। কিন্তু বাঁধ সাধলেন হোটেলের ম্যানেজার আব্দুল ভাই। বিশ্রী আরশোলার মতো চেহারা নিয়ে প্রশ্ন করলেন,” কোথায় যাচ্ছেন ম্যাডাম?”

উষসী বলল,” বের হচ্ছি।”

” কেন বের হচ্ছেন? কিছু লাগলে আমাকে বলুন?”

” কিছু লাগবে না। শুধু আপনি আমার সামনে থেকে সরুন।”

লোকটি সরল না। উষসীর সামনে বেরিকেডের মতো দাঁড়িয়ে থেকে বলল” স্যরি ম্যাডাম। আপনি এভাবে বের হতে পারবেন না।”

” মানে?”

” স্যারের নিষেধ আছে। আপনি পাঁচমিনিট ওয়েট করুন। আমি স্যারের থেকে পারমিশন নিয়ে তারপর আপনাকে জানাচ্ছি।”

” এক্সকিউজ মি, কোন স্যার? কার এতোবড় সাহস যে আমাকে বের হতে নিষেধ করে?”

” তৃষাণ স্যার নিষেধ করেছেন ম্যাডাম।”

উষসীর পিলে চমকে উঠলো। তৃষাণ ভাই? মুহূর্তেই শরীর তিরতির করে কাঁপতে লাগল। আব্দুল তৃষাণের সাথে দুইমিনিট ফোনে কথা বলে এসে উষসীকে জানাল,” আই এম স্যরি ম্যাম। স্যার আপনাকে ঘরে আটকে রাখতে বলেছেন। আমার কিছু করার নেই।”

উষসী অবাক হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। রাগে-দুঃখে কিছু বলতে না পেরে ঘরে চলে এলো। তার এখন ইচ্ছে করছে দরজা আটকে হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে।

চলবে

আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-১০+১১

0

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ১০
লিখা- Sidratul Muntaz

কামলা আর ইয়ামিন সারাদিন ঘুরা-ফেরা করে বেশ রাতে গেস্ট হাউজে ফিরে এলো। ইয়ামিন এরই মধ্যে অনেকগুলো মিউজিক ভিডিওর থিম খুঁজে পেয়েছে। সে থিম খুঁজে পায় প্রকৃতির সৌন্দর্য্যে। যেখানে যেই থিম পায় সেখানেই লিখতে বসে যায়। নয়তো পরে আর মনে থাকে না। কিন্তু আজকে ইয়ামিনের কাছে না মোবাইল ছিল আর না নোটপ্যাড! কামলা তার সবকিছু ছিনতাই করে রেখে দিয়েছিল। অবশ্য এইজন্য সে কামলার কাছে কৃতজ্ঞ। কারণ এতোদিন তার সমস্ত চিন্তা হতো কাজ কেন্দ্রিক। কিভাবে ভিডিও শ্যুট করবে, কিভাবে গান লিখবে, কোথায় কোথায় রেকর্ডিং করবে, এই সমস্ত একঘেয়েমি থেকে বের হয়ে ইয়ামিন যেন জীবনটাকে নতুন করে অনুভব করতে পেরেছে আজ।

ক্যারিয়ারের বাইরেও যে আলাদা একটা মনস্তাত্ত্বিক জগৎ আছে এটা বোধহয় ভুলতেই বসেছিল সে। কামলা তাকে সেই সত্যি অনুধাবন করিয়েছে। প্রকৃতির সাথে আসলে মানুষের মনের একটা আশ্চর্য মেলবন্ধন আছে। মানুষ যখন কোনো বিষয় নিয়ে খুব বেশি বিচলিত হয়, কোনো সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজতে খুঁজতে হাঁপিয়ে যায়, হতাশায় ডুবে যেতে থাকে, তখনি দরকার প্রকৃতির সাথে একটা উষ্ণ আলিঙ্গন। যা মনের সমস্ত হতাশা, অস্থিরতা, দুশ্চিন্তা এক নিমেষে দূর করে দিতে পারে। মন শান্ত হয়ে যায় মুহুর্তেই। যেমন ইয়ামিন এখন খুব শান্তি অনুভব করছে। এতোটা শান্তি শেষ কবে লেগেছিল মনে পড়ছে না তার।

কামলার গেস্ট হাউজের টিউলিপ-আপেল গাছে ঘেরা বিচ্ছিন্ন ব্যালকনির সেই আশ্চর্য সুন্দর জায়গাটিতে এখন বসে আছে ইয়ামিন। আকাশের দিকে চেয়ে সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো নক্ষত্ররাজি দেখছে। চাঁদশূন্য আকাশে এতো তারার সমারোহ আজ! চমৎকার লাগছে দেখতে! ইয়ামিন আগে এসব খেয়াল করতো না। কিন্তু আজ প্রকৃতির প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি বিষয় সে অনুভব করছে। বাতাসেও যেন একটা মায়াবী গন্ধ ছড়িয়ে আছে। এই গন্ধ কাশমীরি গন্ধ। ইয়ামিন মুম্বাই ফিরে গেলে গন্ধটা খুব মিস করবে।

একটু পর কামলা এলো। তার গাঁয়ে কালারফুল শাল, মাথায় কানটুপি। ইয়ামিনের পাশে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল,” কি ভাবছো?”

ইয়ামিন বড় করে একটা শ্বাস ছেড়ে বলল,” ভাবছি অনেককিছুই! কোনটা বলবো?”

” তুমি আজ সারাদিনে একবারও গান গাইলে না তো? মিউজিক প্র্যাকটিস করো কখন?”

” আমি সারাক্ষণই মিউজিক প্র্যাকটিস করি। কিন্তু আজকে সময় কোথায় পেলাম? সারাদিন তো তোমার সাথেই ছিলাম।”

” ঠিকাছে এখন একটা খালি গলায় একটা গান গাও তো, শুনি!”

কামলা গালে হাত রেখে একদম তৈরী হয়ে বসল গান শোনার জন্য। ইয়ামিন কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হেসে দিল। কামলা ভ্রু কুচকে বলল,” হাসছো কেন?”

” খালি গলায় আমি কখনও কারো সামনে গান গাইনি।”

” তো কি হয়েছে? আমার সামনে গাও। বাদ্যযন্ত্রে গান শুনতে আমার ভালো লাগে না। কেমন যেন মেকী মেকী লাগে। চলো, তোমার গান খালি গলাতেই শুনবো।”

ইয়ামিন কিছু একটা ভেবে বলল,” কি গান শুনবে?”

” তোমার যা ইচ্ছা।”

” ওকে..”

ইয়ামিন গান গাইতে শুরু করল। নিজের পছন্দের একটি বাংলা গান।

ইয়ামিন তার গানটা গাইছে একদম নিজের মতো, নিজের সুরে৷ যদিও তার কাছে কোনো বাদ্যযন্ত্র নেই। তাও মনে হচ্ছে কণ্ঠেই অনুভূতির বাদ্যযন্ত্র লাগানো আছে। সে যেমন টিউন বের করতে চাচ্ছে তেমনটাই বের হচ্ছে।

নিশিরাতের নীরব পরিবেশ আর হিমাচলের ঠান্ডা হাওয়া ইয়ামিনের মোহনীয় কণ্ঠস্বরের সাথে মিশে এক নৈসর্গিক মুহুর্তের সৃষ্টি করেছে। কামলা বাংলা ভাষা বোঝে না। এর আগে কখনও এতো মনোযোগ দিয়ে বাংলা গান শোনা হয়নি তার। তবুও আজ বাংলা ভাষায় এই গানটি শুনে অজান্তেই তার চোখে অশ্রু জমতে লাগল। এতো অনুভূতি দিয়ে বুঝি কেউ গাইতে পারে?আহা, আহা, একেই বলে গড গিফটেড ভয়েস! কামলা মন্ত্রমুগ্ধের মতো চোখ বন্ধ করে গান শুনতে লাগল এবং জীবনে প্রথমবারের মতো অনুভব করল, বাংলা ভাষার মতো শৈল্পিক ও চমৎকার ভাষা হয়তো বিশ্বে দ্বিতীয়টি নেই!

প্রীতম আর উষসী অনেক দূর পর্যন্ত হাঁটল। হঠাৎ একজন ঘোড়ার মালিককে ঘোড়া নিয়ে যেতে দেখে উষসী বায়না করল ঘোড়সাওয়ারী করবে। প্রীতম জানতো উষসীকে নিয়ে বের হলে সে হুটহাট এমন আবদার করবেই৷ তাই সাথে যথেষ্ট টাকা নিয়েই বের হয়েছিল। কিন্তু এইসময় যখন সব দোকানপাট বন্ধ তখন এই লোক ঘোড়া নিয়ে ঘুরছে কেন?

প্রীতমের একটু সন্দেহ হলো। জিজ্ঞেস করে জানা গেল তিনি পেহেলগাম ভিউপয়েন্টে ঘোড়ার গাড়ি চালান। আজকে একটা দূর্ঘটনাবশত বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেছে। উষসী আর প্রীতম ঘোড়ায় উঠলো।

নিস্তব্ধ রাতের শহরে ঘোড়সাওয়ারি! এতো সুন্দর সুখময় স্মৃতি নিয়ে প্রীতম বাঁচবে কি করে? তার ইচ্ছে করছে উষসীকে সাথে নিয়ে এখনি মরে যেতে। উষসী সামনে বসেছিল আর প্রীতম পেছনে। উষসী বার-বার শুধু পড়ে যাওয়ার ভয় পাচ্ছে। তাই প্রীতম শক্ত করে তার কোমড় ধরে রেখেছে। উষসীর লম্বা চুলের সুগন্ধ তার নাকে-মুখে প্রবেশ করছে। প্রীতম নেশায় হারিয়ে যাচ্ছে। বার-বার শুধু খেই হারাচ্ছে। উষসী এতো বকবক করছে কিন্তু এসব শোনার সময় কই তার? সে তো উষসীর লম্বা- কালো চুলের নেশায় ডুবে যাচ্ছে।

উষসীর শারিরীক মিষ্টি গন্ধ তার পুরো জগৎটাই আলোড়িত করে তুলছে। এক পর্যায় প্রীতম খুব দুঃসাহসিক একটা কাজ করে বসল। উষসী তখনও বকবক করে যাচ্ছিল। প্রীতম হঠাৎ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,” উষু আই লভ ইউ।”

উষসী গোল গোল চোখে চেয়ে কিছুক্ষণ পলক ঝাঁকালো। তারপর ঝারি মেরে প্রীতমের হাত সরিয়ে বলল,” কি বললি?”

প্রীতম বড় বড় নিঃশ্বাস ছাড়ছে। একবার ভয় ভেঙে গেলে আর সেটা ফিরে আসে না। সাহস শুধু বাড়তেই থাকে। প্রীতমেরও সাহস বেড়েছে৷ সে আগের মতোই জোরালো কণ্ঠে উচ্চারণ করল,” আই লভ ইউ।”

উষসী ফিক করে হেসে প্রীতমের মাথায় গাট্টা মারল,” ফাজলামি হচ্ছে?”

” না, সত্যি আই লভ ইউ। তুই বিশ্বাস কর! ”

উষসী বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। প্রীতম আবারও বলল,” সেই ক্লাস নাইন থেকে। তোকে যেদিন প্রথমবার দেখেছিলাম সেদিন থেকেই।”

প্রীতম তখনও বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছিল। তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না যে সে মিথ্যে বলছে। তাছাড়া প্রীতম এতো সিরিয়াস বিষয় নিয়ে ফান করার মতো ছেলে না। হঠাৎ প্রীতম খুব জোরে চিৎকার করে উঠল,” আই লভ ইউ উষসী! আই লভ ইউ মোর দ্যান মাই লাইফ!”

তার উচ্চারিত বাক্য পুরো এলাকা জুড়ে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল বার-বার। উষসী দুইহাতে কান চেপে ধরল। অস্থির গলায় বলল,” আমি নামবো।”

” তুই ঠিকাছিস?”

উষসী চিৎকার করল,” আমি নামতে চাই!”

প্রীতম ইতস্তত হয়ে ঘোড়ার মালিককে বলল,” এই মামা, ঘোড়া থামান।”

মামা ঘোড়া থামানোর আগেই উষসী ধস্তাধস্তি শুরু করে দিল। প্রীতম ওকে শক্ত করে চেপে ধরে বলল,” সাবধান উষু, পরে যাবি তো।”

উষসী রাগে তেতে উঠল,” খবরদার আমাকে ধরবি না তুই। ”

এর মধ্যে ঘটল আরেক কাহিনী। ঘোড়া আচানক লাফালাফি শুরু করেছে। একবার ডানে যাচ্ছে তো একবার বামে যাচ্ছে। আরেকবার সোজাপথে পাগলের মতো ছুটছে। প্রীতম রক্তহিম করা শীতল কণ্ঠে বলল,” ভাইরে ভাই, পাগলা ঘোড়ায় উঠলাম নাকি?”

উষসী ভয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। তার চিৎকার শুনে ঘোড়ার গতিবেগ আরও বেড়ে যাচ্ছে। এতোক্ষণে প্রীতম বুঝতে পারল ঘোড়ার মালিক কেন এতোরাতে ঘোড়া নিয়ে ঘুরছিলেন আর কি দূর্ঘটনা ঘটেছিল! এখন সেই একই দূর্ঘটনা তাদের সাথেও ঘটবে না তো? আর কিছু ভাবার সুযোগ হলো না। বিশাল একটা গাছের সাথে ধাক্কা লেগে ঘোড়া শরীর ঝাড়া দিতেই প্রীতম আর উষসী দুই দিকে ছিটকে পড়ল। উষসী সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।

ইয়ামিনের গান শেষ হয়েছে। এখন কামলা কবিতা বলতে শুরু করেছে। ইংরেজি সাহিত্যের কবি ইলিয়টের একটি বিখ্যাত কবিতা।

ইয়ামিন বিভোর হয়ে কবিতা শুনছিল। এতো সুন্দর হৃদয় দিয়েও কবিতা আবৃত্তি করা যায় তা ইয়ামিন কখনও জানতো না। মনে হচ্ছে প্রত্যেকটা শব্দ কামলা অন্তর থেকে বের করে উগড়ে দিচ্ছে৷ তার অন্য কোনো দিকে মনোযোগ নেই। শুধু কবিতায় মগ্ন সে।

আর ইয়ামিন মগ্ন কামলার আবৃত্তিতে। কবিতা শুনতে শুনতে কৈশোরের কিছু অবিস্মরণীয় স্মৃতি ভেসে উঠল মনে। সেই চমৎকার রাত। উষ্ণতার মায়াবী মুখ। ইয়ামিনের জীবনের প্রথম চুম্বন। সবচেয়ে মূল্যবান মুহূর্ত!

এক পর্যায় কামলার আবৃত্তি শেষ হলো। কামলা চোখ খুলতেই ইয়ামিনকে দেখল। ইয়ামিনের মনে হলো কামলা নয়, উষ্ণতা বসে আছে তার সামনে। তার ঘোর লাগা দৃষ্টিতে নেশা জড়ানো অনুভূতি। ঠান্ডা বাতাস শরীরে কাটার মতো হানা দিচ্ছে।

কিন্তু ওদের কারোই সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই৷ তারা জীবনের একান্ত সুন্দর মুহুর্ত বিচরণে ব্যস্ত। ইয়ামিন চেয়ে আছে কামলার ঘাঁয়েল করা দৃষ্টিতে, কামলা দেখছে ইয়ামিনের পুরু ভ্রুযুক্ত অপূর্ব দুইচোখ, ঘন পাপড়িতে ঘেরা গাঢ় কালো মণি যা তাকে ব্ল্যাকহোলের মতো আকর্ষণ করছে। নিজের দিকে টেনে নিতে চাইছে। ওই আহ্বানে সাড়া না দেওয়া যেন মস্ত অপরাধ!

কামলা অপরাধ করল না, সাড়া দিল। কয়েক মুহুর্ত খুব নিস্তব্ধতায় কাটল। শো শো বাতাসের শীতল শব্দ আর নিঃশ্বাসের উত্তপ্ত স্পর্শ দুইয়ে মিলে অনুভূতিরা হলো মুক্ত। কামলা ইয়ামিনের ঠোঁট ছুঁয়ে দিল পরম আবেশে।

ইয়ামিন তীব্র অনুভূতিতে ভেসে যাচ্ছিল। হঠাৎ দমকা শব্দে ছুটে এলো কামলার গেস্ট হাউজের হাবিলদার ওয়াকিল খান। কামলা আর ইয়ামিনের ঘোর কাটল। দুইজন দুইদিকে সটকে পড়ল মুহুর্তেই।

হাবিলদার ওয়াকিল ভীত সন্ত্রস্ত। তার কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। কাঁচুমাচু চেহারা নিয়ে বললেন,” সামনের বড় রাস্তায় দুইটা ছেলে-মেয়ের লাশ পড়ে আছে। রক্তাক্ত অবস্থা।”

ইয়ামিন আর কামলা তড়িৎ গতিতে ছুটে গেল। নীল রঙের হুডি গাঁয়ে একটা উনিশ-বিশ বছরের ছেলে আর প্রায় একই বয়সের সাদা-কালো শাড়ি পরিহিত একটি মেয়ে রাস্তায় পড়ে আছে। মেয়েটা বেহুশ অবস্থায় থাকলেও ছেলেটা নড়াচড়া করছে। তবে মাথায় প্রচন্ডরকম আঘাত পেয়েছে। এদের মধ্যে কেউই লাশ নয়। হাবিলদার ওয়াকিল দূর থেকে দেখে ভুল খবর দিয়েছিল। কামলা আর ইয়ামিন দু’জনকেই তাদের গেস্ট হাউজে তুলে আনল।

প্রীতমের মাথায় ব্যন্ডেজ আর উষসী চোখেমুখে পানির ছটা দেওয়া হলো। উষসী চোখ পিটপিট করে তাকাতেই কামলার চেহারা দেখতে পেল। ভ্রু কুচকে তড়াক করে উঠে বসল। ভয়ে ভয়ে বলল,, ” আপনি কে? আমি কোথায় এসেছি?”

কামলা হিন্দিতে বলল,” শান্ত হও। তোমার এক্সিডেবট হয়েছিল। আমরা তোমাদের রাস্তা থেকে তুলে এনেছি। তোমার নাম কি?”

উষসী আশেপাশে তাকালো। আতঙ্কিত অবস্থায় সে হিন্দি বুঝতে পারছে না। প্রীতমের কথা মনে পড়ছে তার। কামলা সেটা বুঝতে পেরে বলল,” তোমার সাথের ছেলেটিকে খুঁজছো? সে পাশের রুমেই আছে। ভয় পেও না। আমাকে তোমার নাম বলো।”

উষসী কিছু একটা বলতে নিচ্ছিল। এর মাঝেই ইয়ামিন ঘরে ঢুকল। সাথে সাথেই উষসীর কথা বন্ধ হয়ে গেল। সাথে বন্ধ হলো হৃৎস্পন্দন। কামলা ইয়ামিনকে জিজ্ঞেস করল,” ছেলেটার কি অবস্থা?”

ইয়ামিন জানাল, “ছেলেটা ভালো আছে। রক্তক্ষরণ বন্ধ করা গেছে। কিছুক্ষণ রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।”

এই কথা বলে ইয়ামিন উষসীর দিকে তাকালো। কামলা বলল,” মেয়েটারও জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু আমার কথার জবাব দিচ্ছে না। মনে হয় আমার ভাষা বুঝতেই পারছে না।”

উষসী নিষ্পলক তখনও তাকিয়ে আছে ইয়ামিনের দিকে। কয়েক মুহুর্ত অতিবাহিত হলো। এরপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে উষসী পুনরায় বেহুশ হয়ে গেল।

(বর্তমান)
সারারাত উষসী দরজা খোলেনি। রাতে না খেয়ে ঘুমিয়েছে। কিংবা আদৌ ঘুমিয়েছে কি-না কে জানে? ইয়ামিনের হঠাৎ করেই মনে পড়ল যে উষসী প্রেগন্যান্ট। এই অবস্থায় না খেয়ে থাকা একদমই উচিৎ নয়। সে দ্রুত উষসীর ঘরে গিয়ে দরজায় নক করতে লাগল। তখন সকাল ছয়টা বাজে। উষসী দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। একটা কাঠবিড়ালি অনেকক্ষণ ধরে ঘাসের উপর গড়াগড়ি করছে। দেখতে ভালো লাগছে। দরজায় ঠকঠক শব্দ শুনতে পেয়েও উষসী কোনো সাড়া দিল না। থম মেরে দাঁড়িয়ে সে দেখতে লাগল কাঠবিড়ালিটির কান্ড।

ইয়ামিন দরাজ গলায় বলছে,” উষসী, দরজা খোলো প্লিজ। আমি খুব স্যরি। আমার সব দোষ। তুমি যা শাস্তি দিবে তাই মানবো। তবুও প্লিজ দরজাটা খোলো।”

অনেক আকুতি-মিনতি করেও যখন কাজ হলো না তখন ইয়ামিন রেগে বলল,” দরজা খোলো নয়তো ভেঙে ফেলব। আর আমাকে যদি দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকতে হয় তাহলে কিন্তু সেটা তোমার জন্য একটুও ভালো হবে না।”

কড়া হুমকি শুনে উষসীর মেজাজ চড়ে গেল। খট করে দরজা খুলে সে রূঢ়ভাবে বলল,” আপনার কি সমস্যা? নিজেকে আপনি কি ভাবেন?”

ইয়ামিন উষসীকে ধাক্কা মেরে ঘরে ঢুকে পড়ল। শান্ত গলায় বলল,” রাতেও কিছু খাওনি৷ আগে খাওয়া, তারপর কথা।”

উষসী দেখল ইয়ামিনের হাতে প্লেট। প্লেটে দু’টো চকলেট ডোনাট আর এককাপ কফি। সে রাগে গজগজ করে বলল,” আমি কি আপনার খেলনা? যখন যেটা বলবেন সেটাই করব?”

” হ্যাঁ তুমি আমার খেলনা। আমি যা বলব তোমাকে তাই করতে হবে।”

উষসী রাগে ইয়ামিনের হাতের প্লেট নিয়ে আছাড় মারতে চাইল৷ কিন্তু পারল না। ইয়ামিন শক্ত করে প্লেট চেপে রেখে বলল,” খবরদার। এটা করলে খুব খারাপ হবে।”

উষসী চিৎকার করে বলল,” আমি খাবো না। এখনি আমার রুম থেকে বের হয়ে যান।”

ইয়ামিন চারিপাশে একবার চোখ বুলিয়ে বলল,” আমার বাড়ি। আমার রুম। এখানে সবকিছু আমার। এমনকি তোমার শরীরে যে আছে, সেও আমার।”

উষসী ত্বরিতে হাত রাখল নিজের পেটে। ইয়ামিন জানল কি করে? ইয়ামিন আরেকটু কাছে এসে বলল,” তাই তোমার শরীরও আমার। এই শরীরের খেয়াল রাখা আমার দায়িত্ব। এদিকে এসো।”

ইয়ামিন হাত ধরে টেনে উষসীকে বিছানায় বসালো। চামচ দিয়ে ডোনাটের ছোট অংশ কেটে তার মুখের সামনে ধরল। উষসী বাঁধা দিয়ে বলল,” খাবো না আমি।”

” তোমার মুখের অবস্থা দেখেছো? শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে গেছে। আর কিছুক্ষণ না খেয়ে থাকলে মনে হচ্ছে বেহুশ হয়ে যাবে।”

একটু থেমে ইয়ামিন মুচকি হেসে বলল,” কাশ্মীরে আমাদের প্রথম দেখার কথা তোমার মনে আছে উষসী? তুমি আমাকে দেখেই বেহুশ হয়ে গেছিলে, ওহ গড! সেদিন যা ভয় পেয়েছিলাম আমি!”

লজ্জায় উষসীর মুখ থমথমে হয়ে উঠল। সেদিনের কথা মনে পড়তেই কেমন শিরশির করে উঠল গা। ইশ, কতই না বোকা ছিল সে তখন। ইয়ামিন মাঝে মাঝেই তাকে সেই ঘটনা মনে করিয়ে খোচা মা-রতে ভোলে না। প্রীতম ঠিকই বলতো, সে একটা আস্তো আঁতেল!

চলবে

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ১১
লিখা- Sidratul Muntaz

ডোরবেল বাজছে। আয়শা ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিল। বাইরে লম্বা, রোগা-পাতলা দেহের একটা ছেলে দাঁড়িয়ে। সে বিনয়ের স্বরে বলল,” গুড মর্ণিং।”

” গুড মর্ণিং, কে আপনি?”

” উষসী বাড়িতে আছে? আমি প্রীতম চৌধুরী। উষসীর ফ্রেন্ড।”

আয়শা ভ্রু কুচকে তাকাল। তার মনে পড়ছে গতরাতের ঘটনা। প্রীতম নামটা স্পষ্ট মনে আছে। এই ছ্যাচরার জন্যই তো ঝগড়া লেগেছিল স্যার আর ম্যাডামের। হঠাৎ সকাল সকাল এই লোকটা এখানে কেন এসেছে? এখন একে দেখে আবার যদি ঝগড়া লাগে!

এমনিতেও বাড়িতে অশান্তির শেষ নেই। আয়শা কখনোই চায় না ইয়ামিন আর উষসীর ডিভোর্স হয়ে যাক। তাদের দু’জনকে একসাথে দেখতে কত সুন্দর লাগে! ঠিক যেন মেইড ফোর ইচ আদার। অথচ তাদের মধ্যে কখনও মিল-মোহাব্বত হয় না। তার উপর প্রীতমের মতো উটকো ঝামেলা যদি আসে তাহলে তো তারা আরও দূরে সরে যাবে।

আয়শার মন চাইল মুখের উপর দরজাটা বন্ধ করে দিতে। এই লোককে সে ঘরে ঢুকতে দেবে না। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে সেটা করতে পারল না। রুক্ষভাষায় বলল,” ম্যাডাম বাড়িতে নেই। আরেকদিন আসুন।”

পেছন থেকে উষসী তীক্ষ্ণ গলায় বলল,” কে বলেছে আমি বাড়িতে নেই? এইতো আমি।”

আয়শা ভয়ে জীভ কাটল। কাঁচুমাচু মুখ করে উষসীর দিকে ফিরে বলল,” স্যরি ম্যাডাম। আপনাকে সকাল থেকে দেখিনি তো, তাই মনে হচ্ছিল আপনি বুঝি বাড়িতেই নেই।”

উষসী কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল আয়শার দিকে। এই মেয়েকে সে নিষেধ করেছিল প্রেগন্যান্সির ব্যাপারটা ইয়ামিনকে না জানাতে। তাও সে জানিয়েছে। এখন আবার প্রীতমকেও মিথ্যা বলে বিদায় করতে নিচ্ছিল। এসব কি ইয়ামিন শিখিয়ে দিয়েছে তাকে? কেন সে ইদানিং এতো বাড়াবাড়ি করছে?

আয়শা ধীরপায়ে লাউঞ্জরুম থেকে চলে গেল। উষসী প্রীতমের দিকে চেয়ে বলল,” ভেতরে আয় দোস্ত।”

প্রীতম ঢুকতে ঢুকতে বলল,” আজ ইউনিভার্সিটিতে যেতে ইচ্ছে করছিল না। ভাবলাম তোর সাথে দেখা করি। রাতে তো তোর মন ভালো ছিল না। এখন মন ভালো হয়েছে?”

আপস্টেয়ার থেকে উষসীর বেডরুমের সামনে দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনা দেখছিল ইয়ামিন। তার চোখেমুখে উত্তাপ। উষসী বলল,” এতোক্ষণ মন ভালো ছিল না। কিন্তু তোকে দেখে খুব ভালো লাগছে। এসে খুব ভালো করেছিস।”

প্রীতম চমৎকার করে হাসল। উষসী উপরে চেয়ে কেমন ক্ষোভ নিয়ে বলল,” এই বাড়িতে আমার এমনিতেও দমবন্ধ লাগে। তুই এলে অন্তত নিশ্বাস নিতে পারব।”

এই কথা শুনে ইয়ামিনের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো। এই বাড়িতে দমবন্ধ লাগে মানে? সে কি সবসময় উষসীর গলা টিপে ধরে রাখে নাকি? আজব! আর প্রীতম এলেই কেন সে নিশ্বাস নিতে পারবে? প্রীতম কি তার অক্সিজেন? ইয়ামিনের ক্রমশ মেজাজ খারাপ হচ্ছে।

প্রীতম কাউচে বসতে বসতে বলল,” বাই দ্যা ওয়ে, আমি কিন্তু আজ ব্রেকফাস্ট করিনি। ভেবেছি তোর সাথেই করব। তাই আমাদের দু’জনের জন্য পিজ্জা এনেছি। তুই তো পিজ্জা অনেক পছন্দ করিস।”

কথা শেষ করে সেন্টার টেবিলের উপর দুইটা বড় বড় প্যাকেট রাখল প্রীতম। উষসীর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। খুশিতে কেমন গদগদ ভাব নিয়ে বলল,”থ্যাঙ্কিউ দোস্ত। আমার খুব পিজ্জা খেতে মন চাইছিল। তুই ছাড়া আমার মন আর কে বুঝবে, বল?”

প্রীতম উচ্চশব্দে হাসল। উষসীও হাসতে লাগল। তাদের হাসির শব্দ বিষের মতো বাজছে ইয়ামিনের কানে। সকাল সকাল প্রীতমকে দেখেই গায়ে আগুন জ্বলছে। তার উপর উষসীর এমন আদিখ্যেতা একটুও সহ্য করা যায় না। সে ক্রোধের সাথে চেঁচিয়ে ডাকল,” আয়শা।”

আয়শা রান্নাঘর থেকে ছুটে এলো, “জ্বী স্যার?”

ইয়ামিন প্রীতমকে শুনিয়েই গজগজ করে বলল,” দরজা কেন খুলেছো তুমি? লুকিং গ্লাসে না দেখে যাকে-তাকে বাড়িতে ঢুকতে দিবে না। আগেও নিষেধ করেছিলাম। তবুও ভুল কিভাবে হলো?”

প্রীতমের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। উষসী বলল,” এদিকে তাকা, কারো কথা শুনতে হবে না। তুই আমার কাছে এসেছিস৷”

ইয়ামিন দাঁতে দাঁত পিষে বলল,” এই বাড়ি আমার। তাই এখানে আমার পারমিশন ছাড়া কেউ ঢুকতে পারবে না। তোমার ম্যাডামকে এই কথা জানিয়ে দাও আয়শা।”

আয়শা কেবল ইতস্তত ভঙ্গিতে উষসীর দিকে তাকাল। উষসী রূঢ় কণ্ঠে বলল,” আপনি যদি আরেকটা সিন ক্রিয়েট করেন তাহলে আমি এখান থেকে বের হয়ে যাবো। আপনার বাড়ি আপনি কোলে নিয়ে বসে থাকুন, চিবিয়ে খান। যেখানে আমার কোনো স্বাধীনতা নেই, সেখানে আমি থাকব না।”

উষসী উঠে দাঁড়ালো। প্রীতম কি করবে বুঝতে না পেরে সে নিজেও দাঁড়ালো। সে খুব বিব্রতবোধ করছে। এখানে আসাটা ভুল হয়েছে তা বুঝতে পারছে। ইয়ামিন চোয়াল শক্ত করে বলল,”হেই ইউ, গেট আউট। আর কখনও তোমাকে এই বাড়ির আশেপাশে দেখলে খুব খারাপ হবে।”

প্রীতমের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছে ইয়ামিন। উষসী তীব্র রাগ নিয়ে প্রতিবাদ করল,” আপনার প্রবলেম কি? খবরদার ওকে ইনসাল্ট করার চেষ্টাও করবেন না। তাহলে খুব খারাপ হবে। ও আমার বেস্টফ্রেন্ড। ও যদি বের হয় তাহলে আমিও বের হয়ে যাবো।”

” তোমাকে বের হতে দিলেই তো তুমি বের হবে।আমার অনুমতি ছাড়া তুমি কোথাও যেতে পারবে না। আয়শা, গার্ডকে বলো এই লোককে বের করে মেইন গেইট বন্ধ করতে এখনি। ”

উষসীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত জ্বলছে। সে কাঁপতে কাঁপতে বলল,” ওভাবে উপরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অর্ডার না দিয়ে সাহস থাকে তো নিচে এসে কথা বলুন।”

ইয়ামিন প্রায় বাতাসের গতিতে নিচে নামল। তাকে এতো এগ্রেসিভ দেখাচ্ছে যে উষসী সামান্য ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল। ইয়ামিন প্রীতমের দিকে আগুন ঝরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। প্রীতমের কণ্ঠ কেমন শুকিয়ে এলো। কাশ্মীরে একবার উষসীকে টিজ করার জন্য সে ভয়ংকর মা-র খেয়েছিল ইয়ামিনের হাতে। সেই কথা এখন হঠাৎ কেন মনে পড়ল কে জানে? তখনকার পরিস্থিতি আর এখনকার পরিস্থিতি তো সম্পূর্ণ আলাদা! এখন তো সে জানে ইয়ামিন আর উষসীর ডিভোর্স হয়ে যাবে। অথচ ইয়ামিনের রিয়েকশন দেখে সেটা বোঝার উপায় নেই। যাকে ডিভোর্স দেবে তার প্রতি এতো অধিকার ফলানোর মানে কি? প্রীতম বুঝতে পারছে না ইয়ামিনের মতলব।

ইয়ামিন প্রীতমের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে উষসীর হাত চেপে ধরল৷ তারপর তাকে টেনে বাড়ির বাইরে একদম পার্কিং লটের দিকে নিয়ে যেতে লাগল। উষসী ছটফট করে বলল,”আরে, আশ্চর্য! আমাকে ছাড়ুন, আপনি আবারও হার্ট করছেন আমাকে। আমি হাতে ব্যথা পাচ্ছি।”

ইয়ামিন গাড়ির দরজা খুলে উষসীকে এক ধাক্কায় ভেতরে ঢোকাল। তার এমন আচরণে বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে গেল উষসী৷ ইয়ামিন ঝুঁকে এসে থমথমে গলায় বলল,” তুমি হার্ট করোনি আমাকে? সকালে উঠে এই প্রথম আমি তোমার জন্য ব্রেকফাস্ট বানিয়েছি। কিন্তু তুমি সেটা না খেয়ে প্রীতমের সাথে বসে হাসতে হাসতে পিজ্জা খাচ্ছো? আমি এসব টলরেট করব তুমি ভাবলে কি করে?”

উষসী কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে ক্ষীপ্ত কণ্ঠে বলল,” আপনি এই কথা বলছেন? আমার ভাবতেই হাসি পায় যে আপনি এসব বলছেন! সামান্য এইটুকু বিষয়ে এতো ইগো হার্ট হলো আপনার? তাহলে আমার কথা চিন্তা করুন, আপনি অন্য কাউকে ভালোবাসেন জেনে আমার কতটা রাগ দেখানো উচিৎ? ”

” আমি আগেও বলেছি, এটা আমার কন্ট্রোলে নেই। জোর করে ভালোবাসা হয় না। কিন্তু এখন…”

ইয়ামিনকে কথা শেষ করতে দিল না উষসী। এর আগেই গর্জে উঠল,” আপনার বেলায় জোর করে কিছু হয় না কিন্তু আমার বেলায় জোর করে সব হতে হবে তাই না?”

ইয়ামিন শান্ত হওয়ার চেষ্টা করল। নরম স্বরে কিছু বলার আগেই উষসী পুনরায় চেঁচিয়ে উঠল,” আপনি সকালে আমার জন্য কি ব্রেকফাস্ট বানিয়েছিলেন? চকলেট ডোনাটস! অথচ চকলেট আমি খাই না। আমাকে জীবনে চকলেট খেতে দেখেছেন আপনি? আমার পছন্দ-অপছন্দের বিষয়ে কখনও খেয়াল রেখেছেন? অথচ প্রীতমকে দেখুন৷ সে আমার হাজব্যান্ডও না, বয়ফ্রেন্ডও না। জাস্ট ফ্রেন্ড। তবুও আমার কত কেয়ার করে। আমার মনখারাপ জেনে সে আজ ভার্সিটি পর্যন্ত যায়নি। সরাসরি এখানে চলে এসেছে আমার মন ভালো করার জন্য। পিজ্জা নিয়ে এসেছে কারণ আমি পছন্দ করি…”

ইয়ামিন খুব তীব্র গলায় বলল,” শাট আপ।”

তারপর সে খুব জোরে গাড়ির ছাদে থাপ্পড় মা-রল। উষসী কেঁপে উঠল। সাথে সাথে চুপ করে গেল। ইয়ামিন আক্রমণাত্মক গতিতে ড্রাইভিং সিটে এসে বসল। এতো দ্রুত ড্রাইভ করতে লাগল যে উষসী ভয়ে শিটিয়ে গেল৷ যদি এক্সিডেন্ট হয়?

ইয়ামিন গাড়ি নিয়ে সরাসরি আমাজন ফ্রেশে চলে গেল। সারারাত ঘুম হয়নি তার। শরীর ক্লান্ত। এই অবস্থায় হাঁটতেও ইচ্ছে করছে না তবুও ইয়ামিন অনেক হাঁটল। একটা আলাদা উত্তেজনা তার শরীরে শক্তি যুগিয়ে দিয়েছে।

উষসীর যত ধরণের খাবার পছন্দ ছিল সব কিনে নিতে লাগল ইয়ামিন। এসব দেখে উষসী কি বলবে বুঝতে পারল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল পাগলের কান্ড।

উষসী কোল্ড্রিংক্স খেতে পছন্দ করে। ইয়ামিন অনেক ধরণের কোল্ড্রিংক্স এর বোতল নিল। এছাড়াও উষসীর পছন্দের চিপস, কুকিজ, আইসক্রিম কিনল। সে বোঝাতে চায় উষসীর পছন্দের ব্যাপারে খুব ভালো করেই তার জানা। একজন সেলস গার্ল ইয়ামিনকে এতো শপিং করতে দেখে প্রশ্ন করল,” আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি, স্যার?”

মেয়েটি কথা বলার সময় ইচ্ছাকৃত ইয়ামিনের বাহু ছুঁয়ে দিল। তাই দেখে উষসীর ব্রক্ষতালু জ্বলে উঠল ঈর্ষায়।

ইয়ামিন বলল,” হ্যাঁ নিশ্চয়ই। ”

উষসী বলল,” কোনো দরকার নেই।” এই কথা বলার পর সে নিজেই কেমন অস্বস্তিতে পড়ে গেল। মেয়েটি অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাচ্ছে। উষসী মাথায় হাত রেখে লজ্জিত স্বরে বলল,” স্যরি।”

মেয়েটি ইয়ামিনের দিকে ঘুরে বলল,” এতো খাবার কিনছেন… বাড়িতে কি পার্টি আছে?”

ইয়ামিন উত্তর দিল,” না। আসলে আমার ওয়াইফ প্রেগন্যান্ট। এই সময় মেয়েদের খুব মুড সুইং হয়। পছন্দের খাবার না পেলে বাড়ি থেকে বের হয়ে জাস্টফ্রেন্ডের কাছে চলে যেতে পারে। সেজন্য ওর পছন্দের সব খাবার কিনে স্টক করছি।”

উষসী রাগে আর অস্বস্তিতে কপালে হাত ঠেঁকালো। সেলসগার্ল মিষ্টি করে বলল,” সো সুইট! কংগ্রাচুলেশনস বোথ অফ ইউ।”

উষসী কোনো কথা বলল না। ইয়ামিন বলল,” থ্যাংক ইউ।”

” কিন্তু স্যার, আপনি ম্যামের জন্য এতো আনহেলদি খাবার কিনছেন… এটা তো ঠিক না। এতো সফট ড্রিংক্স এই অবস্থায় একদমই খাওয়া উচিৎ না।”

ইয়ামিন সিরিয়াস গলায় বলল,” তাই নাকি?”

” জ্বী। আপনি ম্যামের জন্য ফলের জুস নিতে পারেন। অনেক টেস্টি। আর চিপস, কুকিজ, এইসব না নিয়ে হেলদি খাবার নিন। যেমন বিনস, চীজ, ফ্রুটস।”

” ওকে।”

ইয়ামিন খুব মনোযোগ দিয়ে শপিং শেষ করল। সেলসগার্ল সব প্যাক করে দিতে দিতে বলল,” আপনি অনেক কেয়ারিং হাসব্যান্ড। ম্যাম সত্যি খুব লাকি।”

উষসী এই কথা শুনে তাচ্ছিল্য হাসল। ফিসফিস করে বলল,” নিয়তির চরম নিষ্ঠুরতা যে এই লোক আমার কপালে জুটেছে।”

মানুষ অতিরিক্ত দুঃখ সহ্য করতে করতে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। উষসীর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। সে নিজের অজান্তেই ইয়ামিনের উপর প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে। ইয়ামিন তো তার উপর কম অন্যায় করেনি। অথচ সে, অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছিল ইয়ামিনকে। কাশ্মীরে তাদের সেই প্রথম দেখার কথা আবারও মনে পড়ছে। সেদিন থেকেই তো শুরু হয়েছিল উষসীর জীবনের সর্বনাশ!

চলবে

আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-০৯

0

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৯
লিখা- Sidratul Muntaz

কামলা সিংএর গেস্ট হাউজের ঠিক বরাবর একটি বিচ্ছিন্ন ব্যালকনিতে কালো জ্যাকেট আর মাফলার পরে ইয়ামিন বসে আছে। সুন্দর চেয়ার টেবিলের ব্যবস্থাসম্পন্ন শীতল, শ্বেত, শুভ্র আবহাওয়ায় আপেল- টিউলিপ গাছে ঘেরা ব্যালকনিটিতে এই মুহুর্তে হিমাচলের ঠান্ডা বাতাস হু হু করে প্রবেশ করছে। ইয়ামিনের কানে ধারালো ছুরির মতো আক্রমণ করছে সেই বাতাস। আজকে তাপাত্রা ১৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। গরমকালেই যদি এ অবস্থা হয় তাহলে শীতকালের পরিণতি চিন্তা করেই গাঁয়ে কাটা দিচ্ছে। এই শীতের মধ্যে শ্যুটিং করতে খুব কসরত পোহাতে হবে। হাত-পা এখনি জমে যাচ্ছে।

একটু পরেই একটা গোলাপী শাল গাঁয়ে জড়িয়ে অল্পবয়স্ক একটি মেয়ে দুই বেণী দুলাতে দুলাতে এগিয়ে এলো। মেয়েটার শরীর কাঁপছে। ঠান্ডায় কাঁপছে না উত্তেজনায় কাঁপছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ইয়ামিনের সামনে এসে দাঁড়াতেই মেয়েটা স্ট্যাচু হয়ে রইল। তার হাত-পায়ের সাথে সাথে এখন চোখের পলকও কাঁপছে। ইয়ামিন বুঝতে পারল শীতের জন্য না, এই কম্পনের উৎস উত্তেজনা! মেয়েটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মুচকি হেসে ফেলল ইয়ামিন। মেয়েটা সাথে সাথেই মাথায় হাত রেখে ভূমিতে বসে পড়ল। অস্পষ্ট স্বরে হিন্দি বলল,” কাহি ইয়ে কয়ি সাপ্না তো নেহি!”

ইয়ামিন উঠে দাঁড়ালো। সে বিনয়ের সাথে মেয়েটাকে দুইহাতে তুললো। মেয়েটা ভয়ানকভাবে কাঁপতে লাগল। তার ফরসা মুখ লজ্জায় লাল টুকটুকে হয়ে গেছে। ইয়ামিনের দিকে টলমল দৃষ্টি নিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে সে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে দ্রুত পালালো। অপরিচিতার এমন অদ্ভুত কান্ডে ইয়ামিন কি করবে খুঁজে পেল না। পুনরায় নিজের জায়গায় এসে বসে রইল।

তখনি আগমন ঘটল কামলা সিংএর। আঠাশ বছরের তরুণী কামলা সিংকে দেখে ইয়ামিন ভীষণ রকম একটা ধাক্কা খেল। কৈশোরের পুরনো আবেগ যেন নতুন করে উজ্জীবিত হয়ে ফিরে এলো। কামলাকে দেখতে যেন পুরোপুরি উষ্ণতার মতো। তার হাঁটার ভঙ্গি, চাল-চলন, হাসি, সবকিছুই যেন উষ্ণতারই কার্বন কপি। সে সামনে এসে যখন হঠাৎ হেসে উঠল, ইয়ামিনের বুক কেঁপে উঠল তীক্ষ্ণভাবে। এই শীতেও ভদ্রমহিলার গাঁয়ে স্লিভলেস টপ আর সফট টাইডস। ইয়ামিনের সামনে এসে হাসিমুখে বসল কামলা। খুব সপ্রতিভ স্বরে বলল,” হাই!”

ইয়ামিন কথা বলল না। স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।হিমাচলের রুক্ষ বাতাসে কামলার কোঁকড়া চুলগুলো উড়ছে।সৃষ্টি হয়েছে এক অন্যরকম স্নিগ্ধ পরিবেশের। ইয়ামিনের বুকের তোলপাড় বেড়ে গেছে বহুগুণে।

________________________
গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে বিমানে করে রওনা দিয়েছিল উষসীরা। আজ দুপুরের মধ্যে তারা দিল্লির ইন্ধিরা গান্ধী বিমানবন্দর হয়ে শ্রীনগর আসে। হোটেল আগে থেকেই বুকড ছিল। কিন্তু হোটেল অবধি যেতে আরও একঘণ্টার মতো লাগবে। সবাই খুব ক্ষুধার্ত ছিল তাই একটা রেস্টুরেন্টে লাঞ্চের জন্য ঢুকল। তৃষাণ আর আহমেদ খাবার অর্ডার দিয়ে ব্যাংকে চলে গেল। টাকা বদলে রুপিতে কনভার্ট করতে হবে। কার্ড থাকলেও হাতে কিছু ক্যাশ রাখা প্রয়োজন।

উষসী ভেবেছিল তারা কলকাতা হয়ে যাবে। কিন্তু সরাসরি দিল্লী হয়ে আসায় সে কিছুটা বিরক্ত! প্রীতমকে বলল,” দেখেছিস তৃষাণ ভাইয়া কত শয়তান? আমি কলকাতা যাবো বলেছিলাম, তাই উনি কলকাতা দিয়ে না এসে ডিরেক্ট দিল্লীতে নিয়ে এসেছেন। যাতে আমার কলকাতা দেখার ইচ্ছে পূরণ না হয়।”

প্রীতম অতি বিরক্ত গলায় বলল,” তুই শুধু আজাইরা চিন্তা করিস কেন? কলকাতা থেকে শ্রীনগরের সরাসরি কোনো ফ্লাইট নেই। তাই দিল্লী হয়ে আসতে হয়েছে। মূর্খ একটা!”

” এই তুই আমাকে মূর্খ বললি কেন? তোর কান টেনে ছিঁড়ে ফেলবো আমি।”

অনুপমা আইলাকে উষসীর কোলে দিয়ে বলল,” উষু, ওকে একটু রাখো তো। তোমার ভাইয়া থাকলে ওর কাছেই দিতাম। কিন্তু সে তো নেই। আমি ওয়াশরুম হয়ে আসছি।”

” ঠিকাছে যাও আপু।”

উষসী আইলাকে কোলে নিতেই সে কাঁদতে শুরু করল। উষসী বলল,” কি হয়েছে আইলামনি? তুমি কাঁদছো কেন?”

প্রীতম ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বলল,” কাঁদবে না? এমন ভূতের মতো হরিবল চেহারা দেখে যেকোনো বাচ্চারই আত্মা কেঁপে উঠবে। আচ্ছা, তুই হরর মুভির জন্য অডিশন দিচ্ছিস না কেন?”

” আমি ঘুষি মেরে তোর খাড়া নাকটা চ্যাপ্টা বানিয়ে দেই এটাই কি চাইছিস তুই?”

প্রীতম হু হা করে হেসে লুচি চিবোতে লাগল।

কাশ্মীর আসার পর থেকেই কীর্তি অবিরত ফোন করে যাচ্ছে ইয়ামিনকে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও আনব্লক করে ম্যাসেজ দিতে শুরু করেছে। অথচ সে নিজেই বলেছিল ইয়ামিনের সাথে যোগাযোগ রাখতে চায় না। এখন হঠাৎ করে কি হলো মেয়েটার? বার-বার কেটে দেওয়ার পরেও কল দিয়েই যাচ্ছে কীর্তি। এতো যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ইয়ামিন ফোনটা ধরল।

” হ্যালো।”

” ইয়ামিন, তুমি কি কাশ্মীর গিয়েছো?”

” হ্যাঁ এসেছি। তাতে আপনার কি?”

” তুমি আমাকে আপনি করে কেন বলছো? উই আর বেস্টফ্রেন্ডস, রাইট?”

” ছিলাম কিন্তু এখন নেই।”

” মানে?”

” যা বলার দ্রুত বলুন। আমার এখানে অনেক কাজ আছে।”

” তুমি আমাকে কাজ দেখিও না। এটলিস্ট আমার চেয়ে বেশি ব্যস্ত তুমি না। সাতটি বিজ্ঞাপনের শ্যুটিং বন্ধ রেখে আমি তোমার সাথে কথা বলছি।”

” এটা আপনার পারসোনাল প্রবলেম। কেন বলছেন?”

” ইয়ামিন, তুমি আমার সাথে এমন করতে পারো না। তুমি বলেছিলে তোমার নিউ গানের শ্যুটিংএ তোমার কো-আর্টিস্ট হিসেবে আমি থাকবো। এখন তুমি আমাকে বাদ দিয়ে কামলা সিংকে নিচ্ছো? সে কি আমার চেয়ে বেটার?”

” আমি আপনাকে বাদ দেইনি। আপনি নিজেই আমাদের মধ্যে যে ডিল হয়েছিল সেটা ভেঙে দিয়েছেন। একবারও চিন্তা করেননি এইজন্য আমাকে কতটা সাফার করতে হবে। আমাকে বিপদে ফেলে মজা দেখতে চেয়েছিলেন। লাকিলি সময়মতো আমি কামলা সিং এর সন্ধান পেয়েছি। তাই এ যাত্রায় উতরে যেতে পেরেছি। তিনি আমাকে নিজে ইনভাইট করেছেন। তাঁর গেস্ট হাউজে শ্যুটিং এর আইডিয়াও দিয়েছেন। সো, এখন আমার আপনাকে আর কোনো দরকার নেই মিস কীর্তি শর্মা। ভালো থাকবেন।”

” নো,নো,নো, তুমি এটা করতে পারো না ইয়ামিন।”

” আপনি যদি সামান্য একটা পারসোনাল প্রবলেমকে কেন্দ্র করে এতোবড় ড্রামা করে ফেলতে পারেন তাহলে এইটুকু তো আমাকে করতেই হবে।”

” সামান্য? এই প্রবলেম তোমার সামান্য মনে হচ্ছে? নিজের বুকে হাত রেখে বলতে পারবে যে তুমি আমার সাথে বিট্রে করোনি?”

” আমি আপনাকে কখনও ভালোবাসার কথা বলিনি। শুধু আপনার সাথে ফ্রেন্ডলি ছিলাম। এখন আমার এই ফ্রেন্ডলি বিহেভিয়ারের জন্য যদি আপনি অন্য কিছু ভেবে বসেন তাহলে আমার কিছু করার নেই। আই এম স্যরি।”

কীর্তির চোখ দিয়ে নিঃশব্দে জল পড়ল। ফোনের ওইপাশে অবস্থানরত ইয়ামিন তা জানে না। কীর্তি স্থবির হয়ে আসা কণ্ঠে বলল,” ফ্রেন্ডলি বিহেভ? রাতের পর রাত জেগে তুমি আমাকে প্রেমের গান লিখে পাঠিয়েছো। তোমার সব পারসোনাল প্রবলেম আমার সাথে শেয়ার করেছো। এমনকি লাস্ট ইয়ার যখন আমরা সিডনি গেলাম, তুমি আমার সাথে ওয়ান নাইট স্টে করেছো। এতোকিছু আমি কিভাবে ভুলে যাই?”

” সিডনিতে এমন কিছুই হয়নি মনে রাখার মতো। আমরা জাস্ট এক রুমে ছিলাম। ভুল কিছুই করিনি। বরং আপনি করতে যাচ্ছিলেন এবং সেটাও আমি সামলেছি। আর গান পাঠানোর কথা বলছেন? সেটা আমি সব কো-আর্টিস্টকেই পাঠাই। তাছাড়া আপনাকে ফ্রেন্ড ভেবে পারসোনাল প্রবলেমগুলো শেয়ার করতাম। আপনি এমন উল্টো ভেবে বসবেন জানলে কখনোই বলতাম না।”

” তুমি কি সারাজীবন সিঙ্গেল থাকবে? সালমান খান হতে চাও? একদিন না একদিন তোমাকে মুভঅন করতেই হবে ইয়ামিন। ছোটবেলায় কাকে না কাকে ভালোবেসেছিলে, যে তোমাকে এখন ভুলে পর্যন্ত গেছে, স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখে আছে, সেই তার কথা ভেবে কেন নিজেকে এতো কষ্ট দিচ্ছো? এটা পাগলামী ছাড়া আর কি?”

ওই পাশ থেকে জবাব এলো না৷ কীর্তি আবার বলল,” কাউকে না কাউকে তোমার বিয়ে করতেই হবে। মানুষ একা বাঁচতে পারে না। তুমিও পারবে না। নতুন কেউ তোমার জীবনে নিশ্চয়ই আসবে। আর সেই কেউটা যদি আমি হই, তাহলে প্রবলেম কি ইয়ামিন? বলো না!”

” এ বিষয়ে আমাদের মধ্যে অনেক আগেই কথা হয়ে গেছে। তাহলে আবার কেন পুরনো বিষয় তুলে আনা?”

” তুলে আনছি কারণ আমি আর পারছি না!আই এম ফেডআপ। নাউ আই নীড ইউ ব্যাডলি।”

ইয়ামিন বাধ্য হয়ে লাইন কেটে দিল। দু’ফোঁটা গাঢ়, উত্তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়ল কীর্তির মোবাইল স্ক্রিনে। নির্ণিমেষ সেদিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলল কীর্তি। ইয়ামিন কবে বুঝবে তাকে?

ইয়ামিন ফোন রেখে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছল। ক্লান্তি ভর করেছে শরীরে। গোসল শেষ করার পর এখন অনেকটাই চাঙ্গা লাগছে। একটু কফি পাওয়া গেলেই এখন ষোলকলা পূর্ণ হতো। কামলার গেস্ট হাউজটা অনেক বড়। ইয়ামিনকে যেই রুমে থাকতে দেওয়া হয়েছে তা দক্ষিণ দিকে। কাঁচের দেয়ালে ঘেরা পুরো ঘর। যেদিকেই চোখ যায় শুধু শুভ্র পাহাড়। অসাধারণ দৃশ্য! এ যেন কোনো স্বর্গলোক।

এখানে আপেল গাছের অভাব নেই। আর কিছুদিন পরেই গাছে গাছে রঙিন আপেল দেখা যাবে। কাঁচের দেয়ালে কুয়াশা জমে ঝাপসা আবরণ সৃষ্টি করেছে। ইয়ামিন পকেট থেকে টিস্যু বের করে ঝাপসা আবরণ টুকু মুছে নিল। এইবার ঝকঝকে শীতল পরিবেশ দেখা যাচ্ছে। এ ধরণের কাঁচ সূর্যের উত্তাপ ধরে রাখতে সহায়ক। তাই ঠান্ডা কম লাগে। তবে রাতের বেলা খবর হয়ে যায়। কারণ তখন সূর্যের উত্তাপ থাকে না। ইয়ামিন টি-শার্টের উপর হুডি, ট্রাউজার আর স্নিকার্স পরে তৈরী হচ্ছিল বাইরে বের হওয়ার জন্য। এমন সময় কেউ দরজায় কড়া নাড়ল। ইয়ামিন বলল,” কাম ইন। ”

কামলা একজন মেইডকে নিয়ে ঘরে ঢুকল। ইয়ামিনের জন্য ট্রে’তে করে কফি আর হালকা স্ন্যাকস আনা হয়েছে। মনে মনে ইয়ামিন কফিটাই চাইছিল। তার চেহারায় সন্তুষ্টির হাসি ফুটল। কামলা হিন্দিতে বলল,” কোথাও বের হচ্ছো?”

” হুম। এলাকাটা একটু ঘুরে আসি।”

” চলো আমিও যাবো।”

” তুমিও?”

” হুম। আগে কফি খেয়ে নেই তারপর।”

কামলা ইয়ামিনের হাতে কফির মগ দিয়ে নিজেও নিল। তারপর ইয়ামিনের বিছানায় বসতে বসতে বলল,” তুমি কাশ্মীরে ঘুরতে এসেছো কখনও?”

” এমনি ঘুরতে কখনও আসা হয়নি। কিন্তু শ্যুটিং এর জন্য বেশ কয়েকবার এসেছি।”

” শ্যুটিং এর জন্য আসা আর ঘুরতে আসা তো এক না। দুইটা ভিন্ন ব্যাপার।”

” শ্যুটে আসলে তো এমনিই ঘোরা হয়ে যায়।”

” উহুম। এটা একটা ভুল কথা। তখন মেইন ফোকাস শ্যুটিং এ থাকে, ঘোরাঘুরিতে না। ঘোরাঘুরি করতে হয় মন-প্রাণ উজাড় করে, প্রকৃতির সাথে নিজের অস্তিত্ব মিশিয়ে দিয়ে! আজকে আমরা শুধু ঘুরবো। নো কাজ, নো ক্যামেরা,নো শ্যুটিং। ওকে?”

” তাহলে শ্যুট?”

” কাল থেকে শুরু করবে।”

ইয়ামিন হেসে বলল,” ওকে!”

হোটেলে পৌঁছেই সবাই যার যার রুমে ঢুকে গেল। লম্বা জার্ণির পর সবার শরীরে ক্লান্তি ভর করেছে।এখন লম্বা একটা ঘুম প্রয়োজন। মোট চারটি রুম বুক করা হয়েছিল। উষসী, তৃষ্ণা, ডোনা আর যুথি চারজনের জন্য প্রথম রুম। প্রীতমের জন্য একাই দ্বিতীয় রুম! তৃতীয় রুমে উষ্ণতা আর তৃষাণ। আহমেদ,অনুপমা, আইলা চতুর্থ রুমে। দুপুরে অল্প-স্বল্প বিশ্রামের পর বিকালে সবাই ঘুরতে বের হলো। কাশ্মীর ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য স্বর্গ।

শ্রীনগর হচ্ছে কাশ্মীরের কেন্দ্র। এখানের মোঘল গার্ডেন, ডাল লেক, নাগিন লেক, শিকারা রাইড, হযরত বাল মসজিদ দর্শনের মতো উল্লেখযোগ্য জায়গা। তবে উষসীর মূল আকর্ষণ ছিল সোনামার্গের সিন্ধু নদী, ওয়াটারফল যেখানে বজরঙ্গী ভাইজান ও রাম তেরা গঙ্গা মেরে ছবির শ্যুটিং হয়েছিল। একদিনের মধ্যে এতো জায়গা ঘুরে বেড়ানো সম্ভব না। আজ তারা শুধু শ্রীনগরেই ঘুরে বেড়ায়। কাল সোনামার্গ যাবে। আর রাত ৮টার পর সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে পরিবেশ নীরব হয়ে যায়। তাই উষসীরা ঘুরাঘুরি শেষ করে ৮টার আগেই হোটেলে ফিরে আসে।

উষসী ভেবেছিল বন্ধুরা দলবেঁধে এলে ইচ্ছেমতো বাঁদরামি করা যাবে। বিভিন্ন জায়গায় নিজেদের মতো ঘোরা হবে। কিন্তু উষসীর বন্ধুরা কেউ এলো না। শুধু এসেছে প্রীতম। তাকে নিয়ে তো যেখানে-সেখানে ঘুরতে চলে যাওয়া যায় না। সারাক্ষণ তৃষাণ ভাইয়ের রেস্ট্রিকশনে থাকতে হচ্ছে। কি মুশকিল! আর প্রীতমও যা-ইচ্ছে তাই। উষসী তাকে একবার বলেছিল,” দোস্ত চল আমরা একসাথে নৌকায় উঠি।”

প্রীতম ধমক মেরে বলেছে,” তোর মতো ঢঙ্গীকে নিয়ে আমি নৌকায় উঠবো? খেয়ে কাজ নেই আমার? পরে দেখা যাবে লাফ-ঝাঁপ মেরে আমাকেই পানিতে ফেলে দিবি।”

ঘড়িতে এখন সাড়ে আটটা বাজছে। ডোনা আর যুথি গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে। তৃষ্ণা তার ট্যাবে গেমস খেলছে। আর উষসী একা একা বোর হচ্ছে। একবার প্রীতমের ঘর থেকে ঘুরে আসলে কেমন হয়? যেই ভাবা সেই কাজ! উষসী একটা কালো-সাদার মিশেলের শাড়ি পরল। লম্বা চুল পেছনে ছেড়ে কানের পাশে টিউলিপ ফুল গুঁজল। এই ফুলগুলো আজ প্রীতম তাকে টিউলিপ গার্ডেন থেকে চুরি করে এনে দিয়েছিল। উষসী ফুলগুলো নেওয়ার সময় দুষ্টুমির ছলে বলেছিল,” এসব আমাকে দিচ্ছিস কেন? আমি কি তোর গার্লফ্রেন্ড লাগি?”

প্রীতম মুখ গোমরা করে বলেছে,” গার্লফ্রেন্ড তো নেই। তাই তোকেই দিতে হচ্ছে। কি করবো বল?”

উষসী তখন বলেছিল,” ঠিকাছে, আমি তাহলে এগুলো নিজের কাছে গচ্ছিত রাখি। যদি কখনও তোর গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা হয় তাহলে দিয়ে দিব।”

উষসী খুব সুন্দর করে চোখে কাজল আর ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে সেজেগুজে রুম থেকে বের হলো। তাকে অস্বাভাবিক সুন্দর লাগছে দেখতে। উষসী খুব সাবধানে তৃষাণদের রুম এড়িয়ে প্রীতমের রুমে চলে গেল। প্রীতম আরাম করে বিছানায় শুয়েছিল। উষসীকে দেখে ভারী বিরক্ত গলায় বলল,” কিরে? এই রাত-বিরাতে তুই ফুলকুমারি সেজেছিস কেন?’

” ইচ্ছে হয়েছে তাই সেজেছি। এখন চল, আমার চা খেতে ইচ্ছে করছে। টং এর দোকান খুঁজি।”

” এটা কি বাংলাদেশ পেয়েছিস যে রাত বারোটা পর্যন্ত টং এর দোকান খোলা থাকবে? এখানে আটটার মধ্যে সব বন্ধ হয়ে যায়। আর রাত দশটা মানে নিশুতি রাত। কোথাও কিছু নেই। যা ঘুমিয়ে থাক। চা সকালে খাবি।”

” আমি এখনি বের হবো। আর তুই যদি আমার সাথে না আসিস তাহলে আমি একাই যাবো।”

” বাড়াবাড়ি করিস না উষু।”

” বাড়াবাড়ি তুই করছিস প্রীতি। কাশ্মীর আমি ঘুমাতে আসিনি। প্রথমবার এই জায়গায় এলাম। একটু ঘোরাঘুরি করবো না? প্লিজ চল দোস্ত।”

” বাইরে গিয়ে অপেক্ষা কর। আমি হুডি নিয়ে আসছি। আর তুই এই পাতলা শাল পরেছিস কেন? তাপমাত্রা দেখেছিস? পাঁচ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। বাহিরে তুষারপাত হচ্ছে।”

উষসী নিজের ঘরে গিয়ে জ্যাকেট নিয়ে এলো। কিন্তু হোটেলের বাইরে তারা বের হতে পারল না। গার্ড মেইন দরজা আটকে রেখেছে। উষসী মনখারাপ করে তাকাতেই প্রীতম একটা বুদ্ধি বের করল। একটা লোহার মোটা ড্রাম চুরি করল তারা। সেটির মাধ্যমে দেয়াল টপকে লাফিয়ে ওই প্রান্তে চলে গেল প্রীতম। কিন্তু উষসী তো শাড়ি পরে এতোবড় লাফ দিতে পারবে না।

অসহায়ের মতো বলল,” এবার কি হবে দোস্ত?”

” ভালো হয়েছে। ঢং করে শাড়ি পরতে গেছিলি কেন?”

উষসী কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,” কিছু একটা কর প্লিজ।”

” দাঁড়া দেখছি। ”

প্রীতম এইবার উবু হয়ে ঘোড়ার মতো বসল। উষসীকে নির্দেশ দিল তার পিঠে পা রেখে নেমে আসতে। উষসী প্রথমে রাজি হচ্ছিল না। প্রীতম বলল,” কাহিনি করিস না। এক চড় মেরে ঘরে দিয়ে আসবো। তখন কেঁদে কুল পাবি না।”

উষসী আর উপায়ন্তর না পেয়ে ওইভাবেই প্রীতমের পিঠে ভর দিয়ে দেয়াল টপকে ওই প্রান্তে পৌঁছালো। প্রীতম বলল,” দ্যাখ,,চারদিকে কেমন তুষারপাত হচ্ছে। রাস্তায় কোনো মানুষ নেই। কোথায় যাবো আমরা?”

উষসী প্রীতমের হাত ধরে মিষ্টি করে বলল,” চল হাঁটি।”

প্রীতম জানে কাজটা ঠিক হচ্ছে না। এইরকম জায়গায় অযথা ঘুরাঘুরি করলে যেকোনো সময় তারা বিপদে পড়তে পারে। কিন্তু উষসীর এমন মিষ্টি আবদার ফেলতেও মায়া লাগছে। মনে হচ্ছে থাক না, স্মৃতির ডায়েরীতে কিছু রোমাঞ্চকর অনুভূতি, মায়াবী রাতের হাসি-ঠাট্টা ভরা গল্প, কিছু একান্ত সুন্দর মুহুর্ত! হয়তো এমন একটা সময় আসবে যখন উষসী তার পাশে থাকবে না। থাকবে এই অন্ধকার শীতল রাতের পাগলামিভরা দুষ্টুমিগুলোই!

চলবে

আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-০৮

0

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব- ৮
লিখা: Sidratul Muntaz

তৃষাণ তার বাবার মৃ-ত্যুর পর বাবার অফিসেই এমডি হিসেবে জয়েন করেছে। কিন্তু সে নিয়মমাফিক জীবন পছন্দ করে না। চলতে চায় মুক্ত-স্বাধীনভাবে৷ ব্যবসা-বাণিজ্যও তার পছন্দ না। প্রথমে ইচ্ছা ছিল কোনো রেপুটেড ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার পদে জয়েন করবে। শত শত স্টুডেন্ট তার কথা শোনার জন্য মুখিয়ে থাকবে৷ সে নিজের হাতে গড়ে দিবে লক্ষ লক্ষ ছাত্রের ভবিষ্যৎ। ভাবতেই ভালো লাগতো। তৃষাণ লেকচারার হওয়ার অফারও পেয়েছিল। কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে এতোবড় কোম্পানীর মালিক হয়ে গেছে। সে ছাড়া আর কেউ নেইও যে এসব দেখাশুনা করবে। তাই নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে বাবার স্বপ্নের হালটাই ধরতে হয়েছে। মাঝখান থেকে উষ্ণতা হয়ে গেছে ইউনিভার্সিটির লেকচারার। তৃষাণ তবুও আনন্দিত। সে যেটা পারেনি তার অর্ধাঙ্গিনী সেটা পেরেছে।

তৃষাণ অফিসে থাকা অবস্থায় সচরাচর উষ্ণতা কখনোই ফোন করে না। লাঞ্চের সময় একবার করে। বাড়ি ফেরার আগে কিছু দরকার হলে তখন একবার করে। এছাড়া প্রতি ঘণ্টায় তৃষাণই উষ্ণতাকে ফোন দিয়ে বিরক্ত করতে থাকে। তবে আজ ঘটনা একটু অন্যরকম হলো। উষ্ণতা নিজে থেকেই ফোন করল তৃষাণকে।

” হ্যালো, মাই ডিয়ার হাসব্যান্ড!কি করছেন?”

” আপনার কথা চিন্তা করছি মাই ডিয়ার ওয়াইফ।”

” সত্যি?”

” একদম সত্যি। তারপর বলুন তো, হঠাৎ আমার প্রতি এতো দয়া হলো আপনার? নিজে থেকে ফোন করলেন?”

” ফোন করেছি আপনার ঘাড়ত্যাড়া ছেলের জন্য।”

” ছেলে আবার কি করল?”

” আজ ফাহাদ ভাইয়ের ছেলে ইউশানের বার্থডে না? সন্ধ্যায় পার্টি। আমাদের ফুল ফ্যামিলিকে যেতে বলেছে। এখন তোমার ছেলে মিনিসো’তে যাবে ইউশানের জন্য গিফট কিনতে। তাই কান্নাকাটি করছে।”

” মিনিসো’তে? মাত্র বিশমিনিটের রাস্তা। নিয়ে যাও না।”

” এতো সিম্পল? নিয়ে যাও বললেই হলো? দেখতে হবে না কার ছেলে? নাম্বার ওয়ান ঘাড়ত্যাড়া। সে শুধু বাবার সাথেই যাবে। কান্নাকাটি করে চোখ-মুখ ফুলিয়ে রেখেছে। এখন আসো তাড়াতাড়ি বাসায়, ছেলেকে মিনিসো’তে নিয়ে যাও।”

” ওকে! আমি ভাবছি আজকে ফুল ডে অফ নিয়ে নিবো। কি বলো?”

” ও। তা ফুল ডে অফ কার থেকে নিবে শুনি? তোমার উপরেও কি আরেকজন বস আছে নাকি?”

” অবশ্যই আছে। তুমিই তো আমার বস।”

” ইশশ ঢং! দ্রুত বাসায় এসো। ছেলে কাঁদতে কাঁদতে ঘর-বাড়ি উড়িয়ে ফেলছে। রাখি।”

ফোন রাখার আগ-মুহুর্তে উষ্ণতার কণ্ঠে আনন্দ ঝরে পড়ছিল। তৃষাণ ফোন রেখেই হেসে ফেলল।

ভরাট সন্ধ্যা। সবাই তৈরী হয়ে একে একে নিচে নামছে। তৃষাণ গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে অপেক্ষায় ছিল। উদ্দেশ্য আজ ইউশানের বার্থডে পার্টি এটেন্ড করা। সবার শেষে আইলাকে কোলে নিয়ে নামল অনুপমা। বাকি সবাই গাড়িতে উঠে গেছে। পেছনে ডোনা আর উষসী বসেছে। উষসীর কোলে তৃষ্ণা। চাপাচাপি করে উষ্ণতা আর অনুপমাও সেখানে বসবে। আহমেদ থাকবে তৃষাণের পাশে। উষ্ণতা এখনও নামেনি। তৃষাণ অধৈর্য্য হয়ে অনুপমাকে বলল,” উষ্ণতা কোথায় অনু?”

” ভাবী তো আমার সাথেই নামছিল। হঠাৎ আবার কেন যেন উপরে চলে গেল। ভাবীর মনে হয় শরীর খারাপ লাগছে। ”

” বলো কি?”

তৃষাণ সাথে সাথে গাড়ি থেকে নেমে গেল। তারপর দ্রুত বাড়িতে ঢুকল। বেডরুমে আসতেই দেখল উষ্ণতা মাথায় হাত রেখে বিছানায় বসে আছে। তৃষাণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো উষ্ণতার দিকে তাকাল। তাকে চমৎকার দেখাচ্ছে। এশ কালার শাড়ি পরেছে সে। সাথে চকচকে এশ কালার ব্লাউজ। চোখে দারুণভাবে গ্লিটার আইশেড লাগিয়েছে। আর ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক। উষ্ণতা কি পার্টি এটেন্ড করতে যাচ্ছে নাকি দুনিয়ার মানুষের হোশ উড়াতে যাচ্ছে? পাতলা শাড়ি ভেদ করে মেদহীন ফরসা পেট ঝিলিক দিচ্ছে। যা দেখে তৃষাণের নিজেরই মাথা ঘুরে যাচ্ছে। অন্যদের কি অবস্থা হবে কে জানে? উষ্ণতাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে সে আঠাশ বছর বয়সী এক বাচ্চার মা। মনে হচ্ছে ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট। বয়স সবে তেইশ কি চব্বিশ!

তৃষাণকে দেখেই উষ্ণতা বলল,” ভালোই হয়েছে তুমি এসেছো। শোনো না,আমার মাথা অনেক ব্যথা করছে। এতো অসহ্য যন্ত্রণা…ঔষধ খাওয়ার পরেও কমছে না।”

তৃষাণ বিচলিত হয়ে বলল,” দেখি… জ্বর আসেনি তো?”

” জ্বর কেন আসবে?”

উষ্ণতা উঠে ধীরপায়ে ড্রেসিংটেবিলের কাছে গেল। কানে দুল পরার চেষ্টা করতে করতে বলল,” তুমি যাও। আমি একটা টাফনিল খেয়ে আসছি।”

তৃষাণ তার হাত থেকে কানের দুল ছিনিয়ে নিল৷ উষ্ণতা ভাবল পরানোর জন্য নিয়েছে। তাই নিজের কান এগিয়ে দিল। কিন্তু অদ্ভুত, তৃষাণ উষ্ণতার এতো দামী কানের দুলটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। উষ্ণতা হতবাক,” আরে কি করলে? আমার শাড়ির সাথে একমাত্র ম্যাচিং রিং ছিল ওইটা। এখন আমি পরবো কি?”

” কিচ্ছু পরতে হবে না।”

” মানে?”

” মানে আমরা কোথাও যাচ্ছি না।”

উষ্ণতা তৃষাণের কথার আগা-মাথা খুঁজে না পেয়ে পুনরায় একই প্রশ্ন করল,” মানেটা কি?”

” তুমি অসুস্থ উষ্ণ। এই অবস্থায় তোমার কোথাও যেতে হবে না। আমরা বাড়িতে থাকব।”

তৃষাণ ব্লেজারের পকেট থেকে ফোন বের করল। উষ্ণতা দেখল সে আহমেদের নাম্বার ডায়াল করছে,” হ্যালো আহমেদ।”

” জ্বী ভাই।”

” শোন, তোমার ভাবীর শরীরটা তো ভালো নেই বুঝেছো? তাই আমিও ভাবছি যাবো না। তোমার ভাবীকে নিয়ে বাড়িতেই থাকব। তুমি সবাইকে নিয়ে চলে যেতে পারবে না?”

” জ্বী ভাই। অসুবিধা নেই।”

” আমি বারান্দা থেকে গাড়ির চাবি দিচ্ছি। তুমি এসে নিয়ে যাও।”

তৃষাণ ফোন রেখেই উষ্ণতাকে চোখ মারল। উষ্ণতা কোমরে দুইহাত রেখে বলল,” এইটা কি হলো তৃষাণ? আমি আমার ছেলেকে সবার সাথে একা ছেড়ে দিবো নাকি?”

তৃষাণ জবাব না দিয়ে বারান্দায় গিয়ে গাড়ির চাবিটা আহমেদের হাতে চালান করে এলো। তারপর রুমে ঢুকে ব্লেজার খুলতে খুলতে বলল,

” কাম ডাউন ডিয়ার ওয়াইফ। মা আছে, উষসী আছে। ওরা খেয়াল রাখবে তো তৃষ্ণার। তুমি এখন আমার খেয়াল রাখো তো। দেখো, জ্বরে কেমন পুড়ে যাচ্ছি আমি!”

” কোথায় জ্বর দেখি?”

উষ্ণতা কপালে হাত রাখল তৃষাণের,” একদম জ্বর নেই।”

” আছে তো। তুমি টের পাচ্ছো না৷ ”

তৃষাণ রুমের দরজা বন্ধ করতে করতে গুণগুণিয় উঠল,” কি নামে ডেকে, বলবো তোমাকে.. মন্দ করেছে আমাকে ওই দু’টি চোখে!”

উষ্ণতা লজ্জা পেয়ে বলল,” আমি না হয় অসুস্থ। কিন্তু তুমি কেন গেলে না?”

” তোমাকে অসুস্থ অবস্থায় রেখে আমি পার্টিতে যাবো? এটা কিভাবে হয়? এসো তোমার মাথা টিপে দেই। ফ্রেশ ঘুম হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

__________________
জীবনে শেষ কবে এতোটা খুশি হয়েছিল উষসী মনে করতে পারছে না। সে শুধু জানে, আজ তার জীবনের একটি শ্রেষ্ঠ দিন৷ একমাস আঠারোদিন হয়ে গেছে উষসী যে ইয়ামিনকে ম্যাসেজ দিয়েছিল। আর ইয়ামিন সেই ম্যাসেজের রিপ্লে আজকে দিয়েছে! উষসী লিখেছিল,” ভালো আছেন?”
ইয়ামিন উত্তর দিয়েছে,” আমি খুব ভালো আছি উষসী। তুমি কেমন আছো?”
উষসী ভাবতেই পারছে না। ইয়ামিন তার নামটা পর্যন্ত মনে রেখেছে! সে দেখল ইয়ামিন এখন অনলাইনেই আছে। দ্রুত ম্যাসেজ করল,” আমিও বেশ ভালো আছি ভাইয়া।”

ইয়ামিন সাথে সাথেই ম্যাসেজটা সীন করল। সে এখন টাইপিং এ। উষসীর উত্তেজনায় হাত-পা কাঁপছে।

ইয়ামিন লিখল,” আচ্ছা। বাড়ির সবাই কেমন আছে?”

উফফ, উষসী খুশিতে পাগলই না হয়ে যায়!

ইয়ামিন আরও লিখল,” তুমি কিসে পড়ো এখন?”

” অনার্স ফার্স্ট ইয়ার। ”

” বাহ, বেশ বড় হয়ে গেছো দেখছি। মন দিয়ে লেখাপড়া করো।”

” জ্বী ভাইয়া। আমার জন্য দোয়া করবেন।”

” অবশ্যই দোয়া করবো পিচ্চি।”

ইশশ, কতদিন পর আবার সেই পিচ্চি ডাক! উষসীর মনটা খুশিতে ঝুমঝুম করছে। আঙুলগুলো কাঁপছে ম্যাসেজ লিখতে গিয়ে। খুশিতে না শ্বাস আটকে যায়! উষসী বাকরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে বার-বার। সে এখন কি লিখবে? এতো নর্ভাস লাগছে কেন? অনেক ভেবে-চিন্তে লিখল,

” আপনার জন্য কি দোয়া করবো ভাইয়া?”

” কি জানি? আমার নতুন একটা গান রিলিজ হচ্ছে। সে জন্য দোয়া করতে পারো।”

” ঠিকাছে ভাইয়া! আপনার গান যেন বিশ্বসেরা হয়।”

” থ্যাঙ্কিউ! ”

” আচ্ছা ভাইয়া, সেদিনও দেখলাম আপনার টাইমলাইনে একটি সুন্দর পোস্ট লিখেছেন। ওইটা কি গানের লিরিক্স ছিল?”

” উমমম, মনে করতে পারছি না কোন পোস্টের কথা বলছো?”

” ভাইয়া, আপনি তো খুব ভালো স্কেচ করতেন। এখন কি ছেড়ে দিয়েছেন? দেখি না যে আর!”

” না ছাড়িনি। এখনও মাঝে মাঝে করি। কিন্তু তুমি জানলে কিভাবে?”

” ছোটবেলায় একবার শিমলা আন্টির সাথে আপনাদের বাড়ি এসেছিলাম। মনে আছে? আপনি স্কেচ করছিলেন, আমি দেখেছিলাম।”

ইয়ামিনের সাথে ম্যাসেজ করতে করতে উষসী গাড়িতে বসেই পাগলের মতো হাসছিল। আহমেদ ড্রাইভিং সিটের সামনে লাগোয়া আয়না থেকে পেছনের দৃশ্য দেখতে পাচ্ছে। ডোনা আর অনুপমা গল্পে ব্যস্ত। আর তৃষ্ণা আহমেদের পাশে বসে ফোনে গেমস খেলছে। তারা একটা পার্টি থেকে ফিরছিল তখন। আহমেদ হঠাৎ ভ্রু কুচকে বলল,” ভাবীর ছোটবোনের হলোটা কি? একা একা মুচকি মুচকি হাসছে কেন?”

আহমেদের টিটকিরি শুনে অনুপমা আর ডোনা তাকাল উষসীর দিকে। তৃষ্ণাও পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। সবার মনোযোগ পেয়ে উষসী খানিক ইতস্ততবোধ করল। এরই মাঝে তৃষ্ণা বলল,” মনে হয় এন্টসের জামায় ছাড়পোকা ঢুকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। তাই এমন কিটকিট করে হাসছে।”

উষসী চোখ বড় করে তাকাল। আহমেদ বলল,” আরে নাহ, মনে হয় আমাদের নয়া দুলাভাই ম্যাসেজ দিয়েছে।”

উষসীর মেজাজটা বিগড়ে গেল। নয়া দুলাভাই বলতে আহমেদ আসলে ইমনের কথা বুঝিয়েছে। ডোনা আর অনুপমাও এই কথা শুনে উৎসুক চোখে উষসীকে দেখছে৷ তারাও নিশ্চয়ই উল্টা-পাল্টা ভাবছে! উষসী এই অবস্থায় ফোন হাতে নিয়ে রাখতে পারল না। সে তো আর সবাইকে সত্যিটাও বলতে পারছে না। তাই বাধ্য হয়ে বুকে পাথর চেপে মোবাইল বন্ধ রাখল। আর চাতক পাখির মতো মোবাইল হাতে নিয়ে সে অপেক্ষা করতে লাগল, কখন বাড়ি পৌঁছাবে।

যখন গাড়ি তাদের ফ্ল্যাটের সামনে থামল, উষসী ঝড়ের বেগে নেমে লিফটে উঠে গেল সবার আগে। তার প্রাণপাখি ছটফট করছে। তড়াক তড়াক করে লাফাচ্ছে ইয়ামিনের ম্যাসেজ দেখার জন্য। ইচ্ছে হলো লিফটের মধ্যেই কথা বলা শুরু করে। কিন্তু লিফটে আবার নেটওয়ার্ক থাকে না। বাড়িতে ঢুকে উষসী চটজলদি নিজের রুমে চলে এলো। মোবাইল খুলতেই ম্যাসেঞ্জারে টুং করে বেজে উঠলো বহু প্রতীক্ষিত ম্যাসেজটি। ইয়ামিনের শেষ ম্যাসেজ ছিল,” ” ড্যাম! তোমার এতোকিছু মনে আছে?”

উষসী জামা-কাপড় না বদলেই বিছানায় সটান করে শুয়ে পড়ল। । ইয়ামিনের প্রত্যেকটা ম্যাসেজ এতো মধুর কেন? মন চাইছে প্রিন্ট করে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখতে। উষসী রিপ্লেতে লিখল,

” মনে থাকবে না আবার? সবকিছু ঝকঝকে তকতকে ভাবে মনে আছে। আচ্ছা আপনার মনে আছে? যেদিন আমাদের লাস্ট দেখা হলো, আকাশে খুব বৃষ্টি ছিল। আপনি আমাকে বললেন অনেক দূরে চলে যাচ্ছেন। আমি বিশ্বাস করলাম না। ভেবেছিলাম হয়তো মজা করছেন। কিন্তু প্রিয়ন্তী আপুর কাছে যখন সত্যিটা জানলাম তখন খুব মনখারাপ হলো। আমি ভাবিনি যে আপনি এইভাবে সত্যি সত্যি চলে যাবেন।”

উষসী কথাগুলোর মাধ্যমে যেন একগুচ্ছ অভিমানী পরশ ছুড়ে দিল। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত ম্যাসেজটা আর সীন হলো না। ইয়ামিন অনলাইন থেকে চলে গেছে। উষসী গভীর করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আবার কবে তাদের কথা হবে কে জানে!

উষসী এবার ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নিল। ভারী জামাটা ছেড়ে সুতির ফতুয়া আর ট্রাউজার পড়ল। এবার একটু রেস্ট নেওয়ার পালা। আজ তৃষ্ণা নাকি তার দাদীর সাথে ঘুমাবে। গাড়িতেই বলে দিয়েছিল। তাই উষসী একটু শান্তিতে থাকতে পারবে। ছেলেটা এতো বিচ্ছু, ঘুমের মধ্যে কাবাডি খেলে। উষসীর শরীরের হাড়গোড় ভেঙে অর্ধেক হয়ে যায়। এই কথা যখন সে উষ্ণতাকে জানিয়েছিল, উষ্ণতার জবাব ছিল,” তুইও ছোটবেলায় এমন করতি। তোর ভাগিনা তোর মতোই হয়েছে।”

উষসী একদম বিশ্বাস করেনি৷ সে মোটেই ঘুমের মধ্যে হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে না। কি শান্তভাবে ঘুমায়, যেভাবে রাতে শোয় সকালে উঠে নিজেকে সেই সেইম পজিশনে আবিষ্কার করে। উষসী আবার ফোনটা হাতে নিল। কেউ একজন ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। মনটা তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো। ইয়ামিন নয়তো? ম্যাসেঞ্জারে ঢুকতেই উষসী দেখল ম্যাসেজ এসেছে ইমনের থেকে। মনটা বিষণ্ণতায় ভরে গেল। ইমনরা যেদিন তাকে দেখতে এসেছিল সেদিন রাতেই ফ্রেন্ড রিকয়েস্ট পাঠিয়েছিল। উষসী অনাগ্রহ নিয়ে এক্সেপ্ট করেছে। এখন আবার ম্যাসেজও দিচ্ছে,” কেমন আছেন?”

উষসী লিখল,” বিন্দাস।”

” তাই? আপনি কি সবসময় বিন্দাস থাকেন?”

” উহুম। সবসময় না। তবে যেদিন থেকে আপনার সাথে বিয়ে ঠিক হলো সেদিন থেকে খুব বিন্দাস আছি।”

” আরে বাহ, তার মানে বিয়েতে আপনি খুশি?”
” অবশ্যই খুশি। কারণ এই বিয়ের মাধ্যমে আমি আমার বয়ফ্রেন্ডকে পাবো।”

” সেটা কিভাবে? বিয়েটা তো আপনার আমার সাথে হচ্ছে।”

” সেটা আপনি আর আমার বাড়ির লোক জানেন। কিন্তু আমি জানি, আমার বিয়ে আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথেই হবে। ”

” হাউ?”

” সিম্পল! বিয়ের দিন রাতে আমি পালাবো।”

” রিয়েলি?”

” একদম।”

” ঠিকাছে, আমি তাহলে আপনাকে পালাতে হেল্প করবো। ব্যাপারটা কেমন হবে বলুন তো? বিয়ের রাতে বউকে বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালাতে পূর্ণ সহযোগিতা করল জামাই। ইন্টারেস্টিং না?”

উষসী রাগের ভঙ্গিতে লিখল,” ভেরি ফানি! হুহ!”

” হাহাহা! কি করছেন?”

” নৃত্য। বিয়ের খুশিতে নৃত্য করছি।”

” বাহ, আমার হবু বউ নৃত্যও পারে নাকি?”

উষসীর খুব রাগ হলো। আর কোনো রিপ্লে কর‍তে ইচ্ছে হলো না। তার শুধু ইয়ামিনের কথা ভাবতে ভালো লাগছে। আচ্ছা, কেমন হয় যদি উষসী প্রীতমকে ফোন করে ব্যাপারটা জানায়? প্রীতম নিশ্চয়ই শক খাবে।

উষসী তৎক্ষণাৎ প্রীতমকে ফোন করল। প্রীতম উষসীর এমন একজন বন্ধু যার সাথে মনের সব কথা শেয়ার না করলে তার ভালো লাগে না। দুইবার রিং হতেই প্রীতম রিসিভ করল,” হ্যালো।”

” দোস্ত, জানিস আজকে কি হয়েছে?”

” না বললে জানবো কিভাবে?”

” আচ্ছা শোন বলছি, ইয়ামিন ইব্রাহীম আমার ম্যাসেজের রিপ্লাই দিয়েছে। ”

” এহ, আন্দাজি।”

” সত্যি দোস্ত, ইনবক্সে আয়। তোকে এখনি স্ক্রিনশট দেই।”

” আগেই উড়িস না বেশি৷ ফেইক আইডিও হতে পারে।”

” না দোস্ত, এটা জীবনেও ফেইক আইডি না। তুই ম্যাসেজগুলো পড়লেই বুঝতে পারবি। দাঁড়া তোকে পাঠাচ্ছি।”

উষসী একে একে সবগুলো চ্যাটের স্ক্রিনশট দিল। প্রীতম বলল,” বাহ, ভালোই তো চলছে।”

” তুই ভাবতেও পারবি না আমার কত্ত বেশি ভালো লাগছে। মন চাইছে খুশিতে মরে যেতে।”

” তাহলে বসে আছিস কেন? যা মর!”

” সত্যি সত্যি মরে যাবো নাকি? এখনও তো কলকাতা যাওয়া বাকি! ইয়ামিন ইব্রাহীমের অটোগ্রাফ নিবো, সেলফি তুলবো, তার ছোঁয়ায় নিজেকে ধন্য করবো! কত কাজ বাকি! কিন্তু একটা সমস্যা হয়ে গেছে।”

” কি?”

” তৃষাণ ভাইয়া বেঁকে বসেছে। সে এখন কাশমীর যাওয়ার তাল করছে।”

” ওয়াও, ওয়ান্ডারফুল!”

” আরে, তুই এতো খুশি কেন?”

” খুশি হবো না কেন? কাশমীর তো দারুণ জায়গা। একদম স্বর্গ।”

” সে যতই স্বর্গ হোক, আমি যাওয়ার আগ্রহ পাচ্ছি না।সেখানে গেলে ইয়ামিনের সাথে দেখা করব কি করে? প্লিজ কিছু একটা কর প্রীতি। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না।”

উষসী প্রীতমকে মজা করে মাঝে মাঝে প্রীতি বলেও ডাকে। প্রীতম রুক্ষ গলায় বলল,” আমি কি করব এই ব্যাপারে?”

” আশ্চর্য, তুই কি ইয়ামিন ইব্রাহীমের সাথে দেখা করতে চাস না?”

” মোটেও না৷ সে কোথাকার কে?”

” কোথাকার কে মানে?” উষসী ভীষণ রেগে গেল। ইয়ামিনের নামে একটা উল্টো কথাও সে সহ্য করে না। প্রীতম ঝাঁজালো স্বরে বলল,” আমার এতো শখ নেই যে কোথাকার কোন সেলিব্রিটি রিপ্লে দিল আর সেজন্য আমি খুশিতে মরে যেতে চাইলাম। যত্তসব আঁতলামি।”

এ কথা বলেই প্রীতম ফোন কেটে দিল। অদ্ভুত তো! ছেলেটা এতো রেগে গেল কেন? প্রীতম কি তাকে হিংসা করছে নাকি? ইয়ামিনের মতো বড় একজন সেলিব্রিটি উষসীর সাথে সুন্দর করে কথা বলেছে এটা দেখে কি সে জ্বলছে? তা জ্বলুক, উষসী এখন অন্যকিছু নিয়ে ভাবতেও চায় না। তার টার্গেট শুধু কলকাতা যাওয়া।

_______________

উষসীর মা যুথি বেগম এতোদিন নারায়ণগঞ্জ বোনের বাড়িতে বেড়াচ্ছিলেন। আজ সকালেই আহমেদ গিয়ে তাকে সেখান থেকে নিয়ে এসেছে। উষসী ঘুম থেকে উঠেই মায়ের মুখ দেখল। আনন্দে চিৎকার দিতে মন চাইল তার। মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,” মা, আমার মা। তোমার জন্য কত অপেক্ষা করেছি জানো? এতো দেরি করলে কেন মা? আর তোমার ফোন কোথায়? একবারও ফোন দিয়ে তোমাকে পাওয়া যায়নি কেন?ফোন বন্ধ করে ছিলে নাকি? খালি নেওয়ার্ক বিজি।”

” তোর খালার বাসাটা একটু গ্রামের দিকে তো, তাই নেটওয়ার্ক ঝামেলা করে। তোরা ফোন দিলে আসে না। কিন্তু আমি দিলে আবার যায়।”

” তাহলে তুমি একবার আমাকে ফোন দিতে পারলে না? আপুকে তো রোজ ফোন দিতে। ”

” উষ্ণর থেকেই তোর সব খবর পেতাম। তাহলে আলাদা করে তোকে ফোন দেওয়ার দরকার কি?”

” আমার তো কিছু বলার থাকতে পারে তাই না?যাইহোক, এখন তো এসেছো। এখন কথা শোনো, বাড়িতে কত বড় ঘটনা ঘটে গিয়েছে জানো কিছু? খবর রেখেছো?”

” হ্যাঁ রেখেছি তো। আমার ছোটমেয়ের বিয়ের খবর আমি রাখবো না তো আর কে রাখবে?”

উষসীর চোখগুলো কোটরাগত করে বলল,” এর মানে তুমি বিয়েতে রাজি? ”

” রাজি না হওয়ার কি আছে? এতো ভালো পাত্র কি হাত ছাড়া করা যায় নাকি? ছেলে আবার সাব-ইন্সপেক্টর। আমার তো দেখেই পছন্দ হয়ে গেছিল।”

” তুমি দেখলে কিভাবে?”

” কয়দিন আগেই তো তৃষাণ তোর খালার বাসায় এসে আমাকে পাত্রের ছবি আর বায়োডাটা দেখিয়ে গেল। আমি পছন্দ করলাম বলেই না বিয়ে পাকাপোক্ত হলো।”

উষসীর গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। তলে তলে তাহলে এতোকিছু? মা সব জানতেন! অথচ উষসী আশায় ছিল মা এলেই যেভাবে হোক বিয়েটা আটকাবে৷ এখন সেই আশাতেও গুঁড়েবালি! উষসীর মুড অফ দেখে যুথি প্রশ্ন করলেন,”তোর কি হয়েছে? ছেলে পছন্দ না?”

উষসী অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালো। তারপর হঠাৎ মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভেউভেউ করে কাঁদতে শুরু করল।

” ওমা, ওমা, কাঁদছিস কেন?”

উষসী কাঁদতে কাঁদতে বলল,” তুমি এর একটা বিহিত করো মা। আমি কিছু জানি না। সবাই আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে-পরে লেগেছে। অথচ আমার এখনও বিয়ের বয়সটাই হলো না।”

যুথি মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে নরম সুরে বললেন,” বিয়ে করতে বয়স লাগে নারে মা, লাগে ভাগ্য। তোর অনেক ভাগ্য ভালো বলেই এমন একটা পাত্র পেয়েছিস। আর তৃষাণ কি তোর জন্য খারাপ সম্বন্ধ আনবে? তোর মনে হয়?”

” তোমরা দুইজনই আসলে একরম। যেমন তুমি তেমন ভালো আন্টি। একজন জামাই পাগল আরেকজন ছেলে পাগল। তৃষাণ ভাইয়া তোমাদের দু’জনেরই ব্রেইন ওয়াশ করে রেখেছে। তাই এখন আমার কথা মাথায় ঢুকছে না।”

” ব্রেইন ওয়াশ করে রেখেছে মানে? কি বলছিস এসব আবোল-তাবোল?”

” ঠিকই বলছি। আচ্ছা মা তুমিই বলো, আমার বয়সী কয়টা মেয়েকে তুমি বিয়ে করতে দেখেছো? এখন আমার পড়াশুনার বয়স৷ বিয়ে নিয়ে মাথা ঘামিয়ে আমি লেখাপড়ায় কনসেনট্রেশান ব্রেক করতে চাই না।”

” তোকে কনসেন্ট্রেশন ব্রেক করতে কে বলল? তুই তোর মতো পড়। আর বিয়ে কি এখনি হয়ে যাচ্ছে নাকি? এখন শুধু এংগেজমেন্টটা হয়ে থাকবে।”

” যাইহোক, আমি এখন এসব নিয়ে ভাবতেও চাই না। আমার বিয়ে ছাড়াও অনেক স্বপ্ন আছে। তাছাড়া বিয়ে হয়ে গেলে কি আমি ঘর সামলাবো নাকি পড়াশুনা?”

” তোর আপুরও কিন্তু প্রায় তোর মতো বয়সেই বিয়ে হয়েছিল। সে কি লেখাপড়া আর ঘর একসাথে সামলায়নি? এখন কি সে পিছিয়ে আছে? উষ্ণ যদি পারে তাহলে তুই কেন পারবি না মা?”

” তুমি বুঝতে পারছো না মা। আপুর মতো সোনার কপাল তো সবার না। সবাই তৃষাণ ভাইয়ার মতো বউকে রাণী বানিয়েও রাখবে না। বেশিরভাগ পুরুষ বউ হিসেবে খুঁজে দাসী। আমি কারো দাসত্ব করতে চাই না।”

” ঠিকাছে তোকে দাসত্ব করতেও হবে না। তুই যখন চাইবি তোর তখন বিয়ে হবে। এখন শুধু এংগেজমেন্ট হয়ে থাকবে। হয়েছে?”

” সত্যি বলছো?”

” হ্যাঁ সত্যি। এখন এই বিষয়ে কথা বলা বন্ধ কর। ভালো লাগছে না তোর এতো ঘ্যানঘ্যানানি। ”

” তাহলে তৃষাণ ভাইয়াকেও রাজি করাবে তুমি। যতদিন আমি না বলব ততদিন যাতে বিয়ের কথা না বলে। প্রমিস করো!”

” আচ্ছা যা, প্রমিস করাবো।”

” ইয়ে… আমার লক্ষী মা।” উষসী মাকে জাপটে ধরে চুমু দিল।

কাশ্মীর যাওয়ার ব্যাপারে উষসী একদম আগ্রহী ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করেই যখন জানতে পারল ইয়ামিন ইব্রাহীম এখন কাশ্মীরেই আছে এবং সেখানেই তার নেক্সট গানের শ্যুটিং স্পট ঠিক করা হয়েছে তখনি আনন্দে ঝুমঝুম করে উঠল তার মন। সবার চেয়ে বেশি তার নিজের উৎসাহই বেড়ে গেল। কাশ্মীর যাওয়ার জন্য এক সপ্তাহ আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে শুরু করল সে।

প্রীতম এসব শুনে বলল,” ভালোই হয়েছে। যা গিয়ে কোলাকুলি কর। পারলে বিয়ে করে সারাজীবন কাশ্মীরেই থেকে যা। ফিরে আসার দরকার নেই।”

” উফফ, তুই একদম আমার মনের কথা বলেছিস দোস্ত৷ এজন্যই তোকে এতো পছন্দ করি। কিন্তু বিয়ে তো আমি একা করতে পারবো না। তোরও সাহায্য লাগবে।”

” বয়েই গেছে তোকে সাহায্য করতে আমার। এসব বেআইনি কাজে আমি নেই।”

” বেআইনি বলছিস কেন?”

” অবশ্যই বেআইনি। ওই ইয়ামিন ইব্রাহীম হচ্ছে একটা দেশদ্রোহী,গাদ্দার। নিজের দেশের মাটি ছেড়ে যে অন্যদেশে গিয়ে প্রতিভা বিকাশ করে, অন্যদেশের সেবা করে, তার মতো বেঈমানকে তুই আবার বিয়ে করতে চাইছিস! এটা বেআইনি নয়তো কি? আমার তো মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে তোকেও কিক মেরে বাংলাদেশ বর্ডারের বাহিরে পাঠিয়ে দিতে। বাংলাদেশে থাকার অযোগ্য তুই।”

” এসব কি বলছিস তুই? পাগল হয়ে গেলি নাকি? মাথার কয় নাম্বার তার ছিঁড়েছে শুনি?”

” আমার মাথার তার ঠিকই আছে। বরং তোর মাথায় গন্ডগোল দেখা দিয়েছে। শোন, তুই সুস্থ হওয়ার আগে আমাকে আর একবারও ফোন করবি না৷ এ ধরণের উল্টা-পাল্টা কথা বলার জন্য আবার ফোন করলে বাড়ি এসে তোর চুল ছিঁড়বো আমি।”

” মানে?”

প্রীতম খট করে লাইন কেটে দিল। ছেলেটা ইদানীং এমন করছে কেন উষসী বুঝতে পারছে না। একটু পর প্রীতমকে ম্যাসেজ করল,” আচ্ছা, কাল বাসায় কখন আসছিস তুই? আমাদের ফ্লাইট কিন্তু সন্ধ্যায়। মনে আছে তোর?”

” আমি যাবো না।”

” মানে?”

প্রীতম কোনো রিপ্লে করল না। কিন্তু পরদিন ঠিকই সঠিক সময়ে ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে এসে হাজির হলো। উষসী হাসতে হাসতে বলল,” কিরে, আসবি না বলেও এলি যে?”

প্রীতম আশেপাশে খুঁজতে খুঁজতে বলল,” বুড়োটা কোথায়?”

” কোন বুড়ো?”

” তোর বর বুড়ো। পুলিশম্যান।”

উষসী খিলখিল করে হেসে উঠল,” বুদ্ধুরাম, এটা ফ্যামিলি ট্রিপ। ওই বেটাকে কেন নিয়ে যাবো?”

” তাহলে তুই যে কালরাতে বললি?”

” ওইটা তো তোকে রাগানোর জন্য বলেছি।”

” উষুর বাচ্চা, আজকে সত্যিই তোর চুল ছিঁড়বো আমি।”

উষসী হাসতে লাগল আকাশ-পাতাল কাঁপিয়ে। আজ সে ভীষণ খুশি! কতদিন পর ইয়ামিনের সাথে দেখা হতে যাচ্ছে। সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছে তার।

চলবে

আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-০৭

0

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৭
লিখা- Sidratul Muntaz

জানালায় মাথা ঠেঁকিয়ে উদাস ভঙ্গিতে বসে আছে উষসী। পৃথিবী অসহ্যবোধ হচ্ছে তার। প্রীতম দুই মগ ব্ল্যাক কফি এনে তার সামনে রাখল। আগ্রহী কণ্ঠে বলল,” তারপর? কি খবর, বল।”

উষসী বাইরে দৃষ্টি ন্যস্ত রেখে নিরস কণ্ঠে বলল,” আমি প্রেগন্যান্ট। ”

প্রীতমের হাত থেকে কাঁচের কফি মগ দু’টো পিছলে পড়ে গেল। একটা ভাঙল অন্যটা সে ধরে ফেলল। উষসী তার এহেন কান্ডে হেসে উঠল খিলখিল করে। কতদিন পর হাসল সে! প্রীতম অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে হঠাৎ শুধাল,” মানে কি? এসব কিভাবে সম্ভব? ইয়ামিন ভাই আর তুই…. মানে তোদের মধ্যে তো স্বাভাবিক সম্পর্কই ছিল না কখনও।”

উষসী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আবারও মনে পড়ে যায় সেই অভিশপ্ত রাতটির কথা। যে রাত তার জীবন বদলে দিয়েছে। কৈশোর থেকে মনের মধ্যে যত্ন করে পুষে রাখা স্বপ্ন এক নিমেষে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে৷ ভাবতেই কেমন দমবন্ধ বোধ হলো। ওদিকে প্রীতম প্রশ্ন করেই চলেছে৷ এক মুহূর্তও শান্ত হয়ে বসতে পারছে না সে। তার চেহারায় তীব্র কৌতুহল,” উষু, এটা কিভাবে সম্ভব? তুই কি শিউর যে তুই প্রেগন্যান্ট?”

উষসী তার প্রেগন্যান্সি রিপোর্টটা বের করে সরাসরি প্রীতমের হাতে দিল। প্রীতম খুঁটিয়ে দেখতে লাগল রিপোর্ট। উষসী যন্ত্রের মতো বলল,” গত কয়েকদিন ধরেই সন্দেহ হচ্ছিল। প্রচুর বমি হয়। মাথা ঘুরায়। আর সব খাবারেই কেমন আঁশটে গন্ধ। তাই কনফার্ম হওয়ার জন্য টেস্ট করিয়েছিলাম। সেই রিপোর্ট আজ হাতে পেয়েছি। বড্ড খারাপ লাগছে৷ এই অবস্থাতেও আমি অতিরিক্ত ড্রিংক করেছি। বাচ্চার কি কোনো ক্ষতি হবে?”

” তুই তোর বাচ্চার ক্ষতি নিয়ে ভাবছিস? এই বাচ্চা কি আদৌ ইয়ামিন ভাইয়ের? নাকি তুই প্রতারণা করেছিস তার সঙ্গে? ”

উষসী মুচকি হেসে বলল,” তোর কি তাই মনে হয়? আমি আগের চেয়ে অনেক বদলে গেছি ঠিক, কিন্তু এতোটাও বদলে যাইনি যে ক্যারেক্টারলেস হয়ে যাব।”

প্রীতম দিশেহারার মতো জানতে চাইল,” তাহলে বাচ্চা? এটা কিভাবে এলো?”

” বাচ্চা কিভাবে এলো সেটাও কি তোকে এক্সপ্লেইন করতে হবে এখন?”

উষসীর স্পষ্ট প্রশ্নে প্রীতম অপ্রস্তুত হলো। হকচকানো কণ্ঠে বলল,” স্যরি… মানে আমি কখনও চিন্তা করিনি যে তোদের সম্পর্ক এতো সহজে স্বাভাবিক হয়ে যাবে।”

উষসী বেদনাতুর কণ্ঠে বলল,” আমাদের সম্পর্ক কখনোই স্বাভাবিক ছিল না। আর হওয়ার প্রশ্নও আসে না৷ এটা একটা এক্সিডেন্ট বলা যায়। আমি এই বাচ্চা রাখতে চাই না৷ কিন্তু ফেলতেও পারব না৷ তাই ঠিক করেছি, ইয়ামিনকে ওর কথা জানতেই দিবো না৷ এর আগেই আমি ইয়ামিনের থেকে ডিভোর্স নিবো।”

” কি বলছিস তুই? আসলেই ডিভোর্স নিবি?”

” তোর কি মনে হয়, এতোকিছুর পরেও ওর সঙ্গে আমার সংসার করা উচিৎ? ”

প্রীতম নিশ্চুপ হয়ে গেল। মনে মনে সে বলল কিছু একটা। যা উষসী ভাবতেও পারবে না। ঘড়ির দিকে চাইতেই টনক নড়ল উষসীর। অনেক দেরি হয়ে গেছে৷ রাত সাড়ে আটটা বাজে। প্রীতম তার এপার্টমেন্টে ছিল না। উষসী অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করেছে। কিন্তু এতোরাত হয়ে যাবে এটা সে ভাবেনি।

ইউএসএ’তে স্কলারশিপ পেয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার একটা ইউনিভার্সিটিতে ভতি হয়েছে প্রীতম। উষসীর সাথে তার মাত্র কয়েকদিন আগে যোগাযোগ হয়েছে৷ এতোদিন বাড়ি থেকে বের হওয়ার ফুরসত পায়নি সে। তাই আজ সুযোগ পেয়েই প্রীতমের সঙ্গে দেখা করতে চলে এসেছে। জীবনের সমস্যাগুলো নিয়ে যদি বিশ্বস্ত কারো আলোচনা করা যায় তাহলে মন অনেকটা হালকা হয়। উষসী জানে না, তার মন হালকা হয়েছে কি-না! সে হতাশ কণ্ঠে বলল,” অনেক দেরি হয়ে গেছে। এবার বরং উঠি।”

” মাত্রই তো আসলি। ঘণ্টা দুয়েক বস।”

” আমি মাত্র আসিনি। সেই বিকাল থেকে এখানে এসে অপেক্ষা করেছি। তুই মাত্র আসলি সেটা বল।”

” বলিস কি? এতোক্ষণ ধরে অপেক্ষা করেছিস? আমাকে ফোন করলেই তো পারতি।”

” ইচ্ছে করেই ফোন করিনি। মোবাইল সুইচড অফ রেখেছি। নাহলে দেখা যাবে ইয়ামিন লোকেশন ট্র্যাক করে এখানেও চলে এসেছে!” উষসী উপহাস করল।

প্রীতম ভ্রু কুচকে বলল,” ভাই মনে হয় তোর ব্যাপারে খুব সিনসিয়ার!”

তাচ্ছিল্য হাসল উষসী। ম্লান কণ্ঠে বলল,” এটাকে আগে আমি ভালোবাসা ভেবে ভুল করতাম। কত বোকাই না ছিলাম আমি! এসব সিনসিয়ারিটি, দায়িত্ববোধ, সবই ছিল উষ্ণতা আপুর জন্য। উষ্ণতা আপুকে দেওয়া কথা রাখার জন্য। তার ধ্যান-জ্ঞান সবসময়ই ছিল শুধু উষ্ণতা আপু। এখানে আমি কোথাও নেই। কখনও ছিলামই না।”

উষসীর দৃষ্টি টলমল করছে। সে চোখ মুছল মাথা নিচু করে। প্রীতম বুঝতে পারছে না, তার কি সান্ত্বনা দেওয়া উচিৎ? কেবল আফসোস করে বলল,” সত্যি…. তৃষাণ ভাই কত ভালো মানুষ। অথচ উষ্ণতা আপু তার সঙ্গে কি কাজটাই না করল। আর তুই তো তার একমাত্র ছোটবোন। জেনে-শুনে কেউ কিভাবে পারে নিজের বোনের জীবন নষ্ট করতে?”

উষসী দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,” এই ব্যাপারে আমি আর কথা বলতে চাচ্ছি না। অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরতে হবে।”

” ডিনার করে যা।”

” সময় নেই।”

প্রীতম উতলা গলায় বলল,” ঠিকাছে, অন্তত তোকে পৌঁছে দেই?”

” আমি একা যেতে পারব।” উষসীর কণ্ঠ নির্বিকার।

প্রীতম দৃঢ়চিত্তে বলল,” আমি তোকে একা যেতে দিবো না।”

______________
উষসীকে খুঁজতে আবার বের হয়েছিল ইয়ামিন। তখনি দেখল বাইরে বড় একটা কালো রঙের মার্সিডিজ এসে থেমেছে। সে কৌতুহল নিয়ে দেখল, মার্সিডিজ থেকে বের হচ্ছে উষসী। তার দুই সেকেন্ড পরেই প্রীতমকে বের হতে দেখা গেল। উষসীর কাঁধে হাত রেখে কি যেন বলছে সে। উষসীর ঠোঁটে মৃদু হাসি। ইয়ামিনের মুখের পেশি ক্রমশ শক্ত হয়ে গেল। তীব্র মেজাজ নিয়ে সে এগিয়ে গেল মেইন গেইটের সামনে। তাকে দেখতে পেয়েই উষসী তার মুখ গম্ভীর করে ফেলল। প্রীতম ভদ্রতার খাতিরে সালাম দিল ইয়ামিনকে। কিন্তু ইয়ামিন তার দিকে ফিরেও তাকাল না। সে উষসীর দিকে চেয়ে ধারালো কণ্ঠে বলল,

” কোথায় ছিলে এতোক্ষণ? এটা কি বাড়ি ফেরার সময়? ঘড়িতে কয়টা বাজে খেয়াল আছে?”

সে খুব রূঢ় কণ্ঠে কথাগুলো বলছিল। উষসী তোয়াক্কা না করেই প্রীতমের দিকে ফিরে বলল,” থ্যাংকস দোস্ত। আজকে আমার অনেকটা হালকা লাগছে। আবার দেখা হবে। বায়।”

প্রীতম বলল,” বায়।”

সে গাড়িতে উঠে বসল। উষসী ইয়ামিনকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। ইয়ামিন অচিরেই তার হাত চেপে ধরল। এতো শক্ত করে ধরল যে উষসী মোটামুটি ঘাবড়ে গেল। আশেপাশে চেয়ে বলল,” সমস্যা কি আপনার? ”

” আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তুমি ভেতরে যেতে পারবে না।”

উষসী বিরক্ত হয়ে বলল,” রাস্তার মাঝে সিন ক্রিয়েট করবেন না। আমার হাত ছাড়ুন।”

সে ঝারি মেরে নিজের হাত ছাড়িয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। ইয়ামিন তার পেছনে যেতে যেতে ক্রুদ্ধ গলায় বলল,” সিরিয়াসলি উষসী? তুমি প্রীতমের সাথে দেখা করতে গেছিলে?তাও এভাবে কাউকে কিছু না জানিয়ে?”

উষসী ত্যাড়া জবাব দিল,” আপনি কখনও আমাকে কিছু জানিয়ে করেছেন যে আমি আপনাকে জানাবো?”

তারা লাউঞ্জরুমে চলে এসেছে। ইয়ামিন রুক্ষভাবে উষসীর হাত চেপে ধরল আবারও। তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে তেজ নিয়ে বলল,” তাই বলে প্রীতম? তুমি খুব ভালো করেই জানো যে ওকে আমার একদম পছন্দ না। তুমি কোন সাহসে ওর সঙ্গে দেখা করেছো? এনসার মি।”

উষসীও সমান তালে তেজ দেখালো,” আর আপনি কি করেছেন? নিজের বেলায় সাত খু’ন মাফ। শুধু আমার বেলাতেই সর্বনাশ?”

” কি এমন করেছি আমি?”

উষসী বিস্মিত নয়নে বলল,” আবার প্রশ্ন করছেন? আপনি জানেন না আপনি কি করেছেন? আমার অগোচরে উষ্ণতা আপুর সঙ্গে দেখা করেননি? তার জন্য আমাকে ধোঁকা দেননি? দিনের পর দিন প্রতারণা করেননি আমার সাথে?”

ইয়ামিন তার মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করে ঠান্ডা গলায় বলল,” সেটা আলাদা বিষয়। তখন পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল।”

” এখনও পরিস্থিতি অন্যরকম। তখন হয়তো আপনি পরিস্থিতির স্বীকার ছিলেন আর এখন আমি পরিস্থিতির স্বীকার।”

ইয়ামিন কঠিন গলায় বলল,” তুমি আর কখনোই প্রীতমের সঙ্গে দেখা করবে না।”

উষসী জেদ ধরে বলল,” আমার যতবার মন চাইবে আমি প্রীতমের সঙ্গে দেখা করব।”

,” না, তুমি দেখা করবে না।” ইয়ামিনের কণ্ঠ আরও কঠিন হলো।

” আমি অবশ্যই দেখা করব।” উষসী আরও জেদ দেখালো।

” তুমি দেখা করবে না উষসী!”

” একশোবার করব, হাজারবার করব।”

ইয়ামিন সটান করে উষসীর গালে চড় মারল। সিঁড়ির গোঁড়ায় দাঁড়ানো অবস্থায় অনম এবং আয়শা স্পষ্ট শুনতে পেল সেই চড়ের শব্দ। দু’জনেই মুখ চেপে ধরল। আতঙ্কে চুপসে গেল তাদের চেহারা। আর উষসীর মনে হলো সে বুঝি দুঃস্বপ্ন দেখছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য সে চিন্তা করতেও ভুলে গেল। একদৃষ্টিতে মেঝের দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ মাথা তুলে তাকাল সে। তার গালের একপাশ অসাড় হয়ে এসেছে। টনটন করছে তীব্র ব্যথায়। ইয়ামিনের চোখ দু’টো ক্রোধের অনলে দপদপ করে জ্বলছে। যেন এখনি কোটর থেকে বেরিয়ে এসে উষসীকে ভস্ম করে দিবে।

উষসী একরাশ অবিশ্বাস নিয়ে চেয়ে আছে। সে ভাবতেই পারছে না যে ইয়ামিন তার গায়ে হাত তুলেছে। হঠাৎ ইয়ামিনের সম্বিৎ ফিরে এলো। রাগের মাথায় যে কত ভয়ংকর ভুল সে করে ফেলেছে সেই চেতনা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতেই অপরাধবোধে দগ্ধ হলো মন। সে ফ্যাকাশে কণ্ঠে উচ্চারণ করল,” আই এম স্যরি।”

উষসী এক পা পিছিয়ে গেল। ইয়ামিন এগিয়ে এসে তাকে ধরতে নিলেই দুইহাতে বাঁধা প্রদান করল সে। তীব্র ঘৃণা ভরা একটা বিতৃষ্ণাময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে গেল নিজের ঘরে। ধড়াস করে আটকে দিল দরজা। সেই শব্দে কেঁপে উঠল পুরো ভবন।

ইয়ামিন একহাত মাথায় ঠেঁকালো। আফসোসের ভঙ্গিতে বলল,” শিট!”

উষসী ড্রেসিংটেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো। গালের একপাশ কি বিশ্রীভাবে লাল হয়ে গেছে। চার আঙুলের দাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। এতোদিন ইয়ামিন শুধু তার মনেই আঘাত করেছে। আর আজ শরীরেও আঘাত করল! উষসী বিছানার বালিশ ছুঁড়ে মারতে লাগল। চাদর উলোটপালোট করে ফেলল। ড্রেসিংটেবিলের সমস্ত কসমেটিক্স ভেঙে ফেলল। তাতেও রাগ এতোটুকু কমল না। এক পর্যায় সে মেঝেতে বসে কাঁদতে কাঁদতে নিজেকেই প্রশ্ন করল,” আমি কি এমন অন্যায় করেছিলাম? কি অন্যায় করেছিলাম আমি?”

________________
(অতীত)
একদিন সকালে ব্রেকফাস্টে বসে উষসী খুব কায়দা করছিল কিভাবে তৃষাণকে কলকাতা যাওয়ার ব্যাপারটা বলা যায়। আগেও একবার বলেছিল। কিন্তু উষসীর ধারণা তৃষাণ ভুলে গেছে। তাকে আবার মনে করাতে হবে। আগে-ভাগেই সবার অনুমতি নিয়ে রাখা প্রয়োজন। নাহলে দেখা যাবে ঠিক যাওয়ার আগ মুহুর্তে কেউ একজন বেঁকে বসল। এমন সুযোগ দেওয়া যাবে না। সে কোনো প্রকার রিস্ক নিতে চায় না।

একটু পর ড্রয়িংরুমে অনুপমা আইলাকে খাওয়াতে নিয়ে গেল। আইলার অভ্যাস টিভি দেখে খাওয়া। আহমেদ ব্রেকফাস্ট শেষ করে গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করতে গেছে। উষ্ণতা তৃষ্ণাকে রেডি করাতে বেডরুমে নিয়ে গেছে। আর উষ্ণতার শাশুড়ী ডোনাও খাওয়া-দাওয়া করে উঠে গেছেন। তৃষাণ একাই টেবিলে বসে খেতে খেতে মোবাইল দেখছে।

উষসীও এই সুযোগটাই খুঁজছিল। কখনও তৃষাণকে একা পাওয়া যায় না। উষসী টেবিল থেকে উঠল না। তৃষাণের পাশে বসে অনেক পায়তারা করে বলল,” ভাইয়া, একটা কথা ছিল।”

তৃষাণ মোবাইলের দিকে চেয়ে ঠান্ডা কণ্ঠে জবাব দিল,” বলো।”

” আমি যে বন্ধুদের সাথে কলকাতা যাওয়ার ব্যাপারে বলেছিলাম সেটা মনে আছে তোমার?”

তৃষাণ ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,” ও হ্যাঁ, ভালো কথা মনে করিয়েছো। এই ব্যাপারে তোমার সাথে আমিও কথা বলবো ভাবছিলাম।”

উষসীর ভেতরটা খুশিতে ঝলমল করে উঠল। তৃষাণ নিশ্চয়ই প্লেনের টিকিটের ব্যাপারে বলবে। কিন্তু তৃষাণ বলল উল্টো কথা,” আমরা নেক্সট মান্থ কাশমীর যাচ্ছি৷ তুমি চাইলে তোমার ফ্রেন্ডদেরও বলতে পারো।কলকাতার চেয়ে কাশমীর অনেক সুন্দর জায়গা। সবাই খুশি হবে। ”

উষসীর চেহারার সব আনন্দ উধাও হয়ে গেল। চুপসানো কণ্ঠে বলল,” কিন্তু ভাইয়া, আমরা তো কলকাতা যাওয়ার প্ল্যান করেছিলাম। আর তুমিই না বললে আমাদের প্লেনের টিকিট কেটে দিবে?”

” হ্যাঁ! আমি তো সেটাই করছি। কাশমীর তো আমরা প্লেনে করেই যাবো। শুধু ডেস্টিনেশনটা চেঞ্জ হয়েছে। তাছাড়া ট্যুরের জন্য কাশমীরের কথা বললে কেউ নিশ্চয়ই মনখারাপ করবে না। বরং সবার ভালো লাগবে।”

উষসীর চোখ ছলছল করে উঠলো। তৃষাণ এক চুমুকে কফিটা শেষ করে উঠে গেল টেবিল থেকে। উষসী বসে রইল স্ট্যাচুর মতো। তার এতোদিনের সমস্ত প্ল্যান এইভাবে চপট হয়ে যাবে এইটা সে কল্পনাও করেনি। তার প্রায় কান্না পেয়ে গেল। এতোদিনের সব পরিশ্রম কি তাহলে বৃথা? ইয়ামিনের সাথে কি দেখা করা হবে না তাহলে!

ইয়ামিন যা ভেবেছিল তাই হয়েছে। কীর্তি ওই ঘটনার পর ইয়ামিনের সাথে আর কোনো রেকর্ডিং করতে চাইছে না। তাদের মিউজিক ডিরেক্টরকেও এই কথা জানিয়ে দিয়েছে। মিউজিক ডিরেক্টর আরমান জোহার কিছুক্ষণ আগেই ইয়ামিনকে ফোন করে ব্যাপারটা জানিয়েছেন। এমনকি তাদের যে নতুন মিউজিক ভিডিওটার শ্যুট বাকি ছিল সেটাও কন্টিনিউ করতে নাকচ করেছে কীর্তি।

ইয়ামিন সব শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ব্যক্তিগত বিষয় কীর্তি প্রফেশনাল লাইফেও টেনে আনছে কেন বুঝতে পারছে না সে। এইটা কীর্তির থেকে আশা করেনি ইয়ামিন। তবে সে জানে কীর্তি কি চাইছে। তার মতো গ্ল্যামারাস, ট্যালেন্টেড একজন মডেলের প্রেম ইয়ামিন এতো সহজে প্রত্যাখ্যান করেছে এটা তার পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন! সে হয়তো চাইছে ইয়ামিন নিজে থেকে তাকে কল দিক। স্যরি বলে সবকিছু সমাধান করুক। অথবা হাতে-পায়ে ধরে অনুরোধ করুক। কারণ চলমান মিউজিক ভিডিওটা নিয়ে ইয়ামিনের অনেক স্বপ্ন ছিল।

ইয়ামিন তার ক্যারিয়ারে একটা মাইলফলক তৈরী করতে যাচ্ছে এই গানের মাধ্যমে। নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে সে গানটা তৈরী করেছে। রাতের পর রাত জেগে গানের প্রত্যেকটি লিরিক্স লিখেছে। কীর্তি সবকিছু এইভাবে ভেস্তে দিয়ে ইয়ামিনের দূর্বলতা আদায় করতে চাইছে। কিন্তু সে হয়তো জানে না, ইয়ামিন মরে গেলেও কখনও তার কাছে মাথা নোওয়াবে না। একটা কীর্তি গেলে হাজারটা কীর্তি আসবে। তার জন্য ইয়ামিন ইব্রাহীমের কণ্ঠ থেমে থাকবে না। ইয়ামিন কীর্তিকে অবশ্যই দেখিয়ে দিবে তার থাকা না থাকায় ইয়ামিনের কিছুই যায় আসে না৷ ইয়ামিন একাই পরিপূর্ণ।

সে আরমান জোহারকে নির্দেশ দিল নতুন কোনো মডেল খুঁজে বের করতে। পরদিন সকালেই আরমান জোহার ইয়ামিনকে গুড নিউজ জানালেন। কাশ্মীরের একজন নামকরা মডেল কামলা সিং ইয়ামিনের সাথে কাজ করতে রাজি হয়েছে। তার ইয়ামিনের গানও খুব পছন্দ হয়েছে। খুব দ্রুতই ইয়ামিনকে সাক্ষাতের জন্য নিজের গেস্ট হাউজে আমন্ত্রণ জানিয়েছে সে৷ কাশ্মীরের নাম শুনে ইয়ামিনের মাথায় নতুন আরেকটা গানের প্লট চলে আসল৷ সে আনন্দের সহিত আমন্ত্রণ গ্রহণ করল এবং দ্রুতই কাশ্মীর যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করল।

চলবে

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-৮০

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৮০|
মুরুব্বিরা বলেন, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে খুব বেশি মিল, মহব্বত থাকলে তাদের মধ্যে একজন যদি আল্লাহর ডাকে পরপারে চলে যায়। তাহলে অপরজনের স্থায়িত্বও এই পৃথিবীতে খুব বেশি দীর্ঘ হয় না। এমনটা তারা বলেন, তাদের অভিজ্ঞতা থেকে। উদয়িনী চলে গেছে আজ দেড় বছর। আজ আকস্মিকভাবে সোহান খন্দকারও পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করল। তবে কি তাদের মধ্যেও ছিল নিগূঢ় মহব্বত? নাহ, এমনটা কখনো পরিষ্কার করে বোঝা যায়নি। জানতে পারেনি কেউ। তবে নিঃসঙ্গতায় ভুগছিল সোহান খন্দকার। শেষ কিছুদিন উদয়িনীর সঙ্গে তার যে আন্তরিকতা তৈরি হয়েছিল। সেই অল্প সময়ের অল্প অনুভূতিটুকুর জন্যই আফসোস করত। হতাশায় ভুগত। কথার ছলে একদিন হেসে হেসে সিমরানকে বলেছিলও,

‘ সিনু মা, তোমার আম্মু আর কিছুদিন আমাদের সাথে থাকলে ক্ষতি হতো না বলো? ‘

‘ তুমি আম্মুকে খুব মিস করছ তাই না আব্বু। ইশ, আম্মু যদি একটিবার এ কথা জানত। কী যে খুশি হতো! ‘

এরপর খুব বেশিদিন গড়াল না। সিমরান শশুর বাড়ি চলে গেল। সেও ব্যস্ত হয়ে পড়ল নিজের কাজে। গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে শরীর খারাপ লাগছিল। তার চারটা ক্লিনিক। তন্মধ্যে একটিতে গিয়ে নিজের পার্সনাল কেবিনে আরাম করছিল। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীর বেশি খারাপ লাগলে নার্স ডেকে প্রেশার মাপায়। এরপর ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে উদ্যত হতেই আকস্মিক নাক, মুখ দিয়ে র’ক্ত এসে তৎক্ষনাৎ মৃত্যুকে বরণ করে। গ্লাস পড়ে যাওয়ার বিকট শব্দ, গোঙানি শুনে দু’জন নার্স ছুটে আসে। রাত দশটার পর ক্লিনিকে ডাক্তার থাকে না। অবস্থার ভয়াবহতা দেখে তাই ওরা সোহান খন্দকারকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। অর্পণ শিকদার ডিউটিতে ছিল। সদ্যই দু’টো সিজার করে বেরিয়েছে। এমতাবস্থায় সোহান খন্দকারকে নিয়ে এলে চেকআপ করে দেখল, হি ইজ নো মোড়! তীব্র উত্তেজনা নিয়ে সেই মুহুর্তেই নিধিকে ফোন করে অর্পণ৷ ছেলেকে শাশুড়ির দায়িত্বে রেখে হসপিটালে ছুটে আসে নিধি। চোখের সামনে সোহান খন্দকারের মৃত দেহ দেখে ভেঙে পড়ে ভীষণ। মনে পড়ে যায় অতীতের মধুর স্মৃতিগুলো।

চারপাশে এত মানুষ। অথচ সোহান খন্দকারের আপন বলতে কেউ উপস্থিত নেই। নিধির বুক কেঁপে উঠে। কাঁপা হাতে নাম্বার খুঁজে সিমরানের ফোনে কল দিতে গিয়েও থেমে যায়। আশপাশে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘ উনার বাড়ির লোককে খবর দিয়েছেন আপনারা? ‘

একজন নার্স কান্না বিগলিত কণ্ঠে বলে,

‘ উনার মেয়ের শশুর বাড়িতে খবর দেওয়া হয়েছে। ‘
.
শুরু থেকেই সৌধর বন্ধুমহলের স্বয়ংক্রিয় একটি অভ্যেস। ওদের যে কারো বিপদ ঘটুক। সর্বপ্রথম যে নামটি মাথায় আসবে সে হলো সৌধ। এই মানুষটা যেন ওদের জীবনে গোড়া থেকেই জাদুর মতো অবস্থান করছে। মানুষটা তার অসাধারণ জাদুবলে বন্ধুদের সব সমস্যার সমাধান এনে দেয়। তাই আজ সোহান আংকেলের নিথর দেহের পাশে বসে, চোখে অশ্রু বিসর্জন দিতে দিতে হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকল নিধি। সৌধর নাম্বারে কল করেই ভেঙে পড়ল কান্নায়। ওপাশে কল রিসিভ করতেই জানিয়ে দিল, ‘সোহান আংকেল আর নেই। ‘

অ্যাম্বুলেন্সের বিকট শব্দ। আর নিধির কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলা অনাকাঙ্ক্ষিত বাক্য। দুইয়ে মিলে নিস্পন্দ হয়ে গেল সৌধ। নিঃশ্বাস আঁটকে, অবিশ্বাস্য স্বরে শুধাল,

‘ তুই কোথায়? ‘

ক্রন্দনরত নিধি থামল হঠাৎ। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

‘ হসপিটালে, ডিউটি ছিল অর্পণের। ওই ফোন করে জানাল আমাকে। সুহাস কোথায় সৌধ? ‘

অস্থিরচিত্তে উঠে দাঁড়িয়েছে সৌধ। একটি হাত দিয়ে মাথার চুল খামচে ধরা। অপর হাতে ফোন ধরে আছে কানে। চোখ দুটো পলকহীন। ধীরেধীরে লালচে বর্ণে রূপ নিচ্ছে। কণ্ঠস্বর রুদ্ধ প্রায়। তবু ক্ষীণ গলায় উত্তর দিল,

‘ সুহাস এখানে নেই। ও নামীর কাছে। ‘

কথাটা বলেই ফোন কেটে দিল সৌধ। ধপাস করে বসে পড়ল বিছানায়। সে কি আবারো দুঃস্বপ্ন দেখল? স্থবির হয়ে তাকাল ফোনের স্ক্রিনে। এ তো স্বপ্ন নয় সত্যি! হৃৎপিণ্ড ছটফটিয়ে উঠল নিমেষে। অন্তঃকোণে ভেসে উঠল সেদিনের দেখা সেই স্বপ্ন। রুগ্নদেহী সিমরান। আকস্মিক দাঁড়িয়ে পড়ল দীর্ঘদেহী, বলিষ্ঠ মানুষটা। জেনেভার তীব্র শীতে শরীর বেয়ে দরদরিয়ে ঘাম নেমে গেল। না পারে এক্ষুনি ছুটে যায় বাংলাদেশে। সোহান আংকেল আর নেই এই খবর লুকিয়ে সিমরানকে নিয়ে চলে যায় বহুদূর। কিন্তু হায়! নিরুপায় হয়ে ঠাঁই বসে পড়ে আবার। বিধ্বস্ত হয়ে উঠে চোখমুখ। কাঁপতে শুরু করে বুক, হাত, পা সর্বদেহ। জীবনে এতকিছু ঘটে গেল। কত মানুষ হারাল। কখনো এতটা অসহায় অনুভব করেনি। এতটা ভীতিগ্রস্ত হয়নি। এই মুহুর্তে সুহাসকে নিয়ে ভাবছে না সে। খবরটা সুহাসের কান পর্যন্ত এক্ষুনি যেতে না৷ যত ভাবনা সিমরানকে নিয়ে।
তার সিনুর কী হবে? কে সামলাবে তার নরম হৃদয়ের মানুষটাকে।

কাঁপা হাতে, রুদ্ধশ্বাসে, শূন্য মস্তিষ্কে আম্মাকে ফোন করল সৌধ। ফোন ধরলেন না তানজিম চৌধুরী। আম্মাকে না পেয়ে আব্বাকে কল দিল। একই অবস্থা রিসিভ হলো না৷ একে একে বাড়ির প্রত্যেককে কল করল নিরুপায় সৌধ। ব্যর্থ হলো বারংবার। শেষে ভয়ে ভয়ে কল করল, সিনুর ফোনে। মুহুর্তেই কলটা রিসিভ হলো। উৎকণ্ঠিত গলায় সিমরান বলল,

‘ তুমি ফোন দিয়েছ! কী ব্যাপার? এত্ত সকালে উঠেছ আজ। ‘

হতভম্ব সৌধ। কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। ঢোক গিলল সচেতন ভাবে। সিমরান ফের বলল,

‘ শুনছ? হ্যালো। ‘

গলা দিয়ে স্বর বেরুচ্ছে না সৌধর৷ অস্থিরতা অনুভব করছে খুব৷ তার বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ছাড়ার শব্দ শুনতে পেল সিমরান৷ বিচলিত হয়ে বলল,

‘ হ্যালো, কথা বলছ না কেন? কী অদ্ভুত! আম্মা এসে তৈরি হতে বলল। সকাল সকাল কোথায় যাব সেটাই বুঝতে পারছি না৷ আর তুমি ফোন করে কথা বলছ না। আমার কিন্তু রাগ হচ্ছে এখন। এই শীতেও আমার গরম গরম অনুভব হচ্ছে জানো? কেন হচ্ছে বুঝো? টেনশন লাগছে, টেনশন। হঠাৎ এত টেনশন লাগছে কেন বলো তো? এই প্রথম আম্মা কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাবে তাই কী? ‘

সাধারণত সৌধর সঙ্গে কখনো এমন অস্থির অস্থির আচরণ করে না সিমরান। একদমে এতবেশি কথাও বলে না। আজ করছে, বলছে। যতটুকু বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা কিছু জানে না এখনো। তবু এমন হাসফাস করছে? করবে নাই বা কেন? সকাল সকাল বিনা নোটিশে শাশুড়ি এসে বেরুবার জন্য তৈরি হতে বললে বুঝি দুঃশ্চিন্তা হয় না?

সৌধ তার লাল টকটকে চোখ দু’টো বুজে ফেলল আচমকা। চোয়াল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল এক ফোঁটা নোনাপানি। এপাশে সিমরান অধৈর্য্য হয়ে ফোন কে টে দিতে উদ্যত হলো। তক্ষুনি সে ভরাট স্বরে বলে উঠল,

‘ সিনুপাকনি, আমি আসব। খুব তাড়াতাড়ি আসব তোমার কাছে। তুমি প্লিজ প্রমিজ করো আমাকে। নিজেকে সামলে রাখবে। অন্তত আমি না আসা পর্যন্ত। তোমার ভাবি, ভাইয়া, তোমার সৌধ আর ছোটো আব্বু সুহৃদ আসছে তোমার কাছে। খুব শিঘ্রই আসছে। ‘

‘ তোমার কণ্ঠ এমন লাগছে কেন সৌধভাই? ‘

সহসা সিরিয়াস হয়ে প্রশ্নটি করল সিমরান। অতীতের অভ্যেস মতো তাই কখন সোধভাই বলে ফেলল টেরও পেল না৷ সৌধও অতিরিক্ত চিন্তায়, আবেগপ্রবণ হয়ে কী করবে দিশা পেল না। এদিকে তানজিম চৌধুরী দরজায় টোকা দিচ্ছেন। বেদনার্ত কণ্ঠে বললেন,

‘ সিনু মা হলো তোমার? ‘

পরিস্থিতি ঘুরে গেল ত্বরিত। সিমরান বলল,

‘ হ্যালো, ডক্টর শুনছ? আমি তৈরি হচ্ছি। পরে ফোন করব তোমাকে। তুমি আরেকটু ঘুমাও বা ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট করে নাও কেমন। ‘

কথা শেষে ফোন রেখে দিল সিমরান। সৌধ হাত, পা ছেড়ে বসে রইল ফ্লোরে। দীর্ঘক্ষণ থম মেরে বসে থাকার পর আকস্মিক আইয়াজের কথা মনে পড়ল। অনুভব করল ওকে এক্ষুনি ফোন করার। ফোন করে জানতে পারল আইয়াজ রওনা দিয়েছে। ইতিমধ্যে খবর পৌঁছে গেছে তার কাছে। তাই আর দেরি করেনি। আইয়াজকে ফোন করার পরই মনে পড়ল ফারাহ প্র্যাগনেন্ট। এই অবস্থায় সে নিশ্চয়ই আসবে না। একমাত্র আম্মা ছাড়া তেমন কোনো শুভাকাঙ্ক্ষী নেই। অসহ্য এক যন্ত্রণা হলো বুকে। নিরাসক্ত হয়ে কল করল নিধির ফোনে। সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ হলো কলটা। নিধি বলল,

‘ সুলল কাকু এসেছে সৌধ। আমি আর অর্পণ যাচ্ছি সুহাসদের বাড়ি। তুই টেনশন করিস না৷ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশে ফেরার চেষ্টা কর। ‘

‘ নিধি.. ‘

আকুল স্বর সৌধর। চুপ হয়ে গেল নিধি৷ এই আকুলতা কিসের? বুঝে নিল সে। তাই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, ভাঙা কণ্ঠে বলল,

‘ আমি আছি সৌধ। তোরা না আসা পর্যন্ত আমি তোর বউয়ের পাশে আছি। টেনশন করিস না। এমন সিচুয়েশনে যদিও সান্ত্বনা বাণী দিয়ে লাভ নেই৷ তবু মেয়েটাকে সামলানোর জন্য কাউকে না কাউকে দরকার। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ তুই আর সুহাস। তোরা যখন নেই তোদের এই খারাপ, অপরাধী বন্ধুকে কষ্ট করে হলেও একটু ভরসা কর। ‘

না চাইতেও এক চিলতে ভরসা পেল সৌধ। ফোন কেটে দিল নিঃশব্দে। সময়ের স্রোতে আজ পরিস্থিতিটা এমনই দাঁড়াল যে, সৌধ ভুলে গেল এক সময়ে নিধির প্রতি থাকা প্রগাঢ় অনুভূতিটুকুর কথা। নিধি ভুলে গেল অতীতের তিক্ত স্মৃতি। অতীত যেন অতীতেই রয়ে গেল। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল কেবল বর্তমান। বন্ধুদের প্রতি ভালোবাসা এবং দায়বদ্ধতা থেকে তৎপর হয়ে উঠল নিধি৷ সুহাস নেই, সৌধ নেই। কিন্তু ওদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, আপন আর আদরনীয় মানুষটি রয়েছে। সোহান আংকেল বিয়োগের শোকে শোকাহত মেয়েটার পাশে থাকতে হবে তাকে। থাকতেই হবে।

চলবে!
®জান্নাতুল নাঈমা

আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-০৬

0

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব_৬
লিখা: Sidratul Muntaz

ড্রয়িংরুমের উত্তর পাশের প্রত্যেকটি সোফা দখল করে বসে আছে পাত্রপক্ষরা। দক্ষিণ পাশে তৃষাণের মা ডোনা, তৃষাণ আর উষ্ণতা বসেছে। উষসীকে বসানো হয়েছে একদম পাত্রের বরাবর। উষসী মাথা উঁচু করলেই পাত্রকে দেখতে পাচ্ছে। লম্বা-চওড়া, শ্যামবর্ণের বেশ সুন্দর একটা মুখ। অনুপমা উষসীর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল।

উষশী ফিসফিস করে বলল, ” এই অনু আপু, তুমি না বলেছিলে ছেলে পুলিশ অফিসার?”

অনুপমা উষসীর মুখের কাছে কান এনে বলল,” হ্যাঁ। পুলিশ অফিসারই তো। ”

” কই? আমার কাছে তো চোরের মতো লাগছে।”

অনুপমার বিষম খাওয়ার উপক্রম হলো। সাথে সাথেই পাত্রের মুখের দিকে তাকালো সে। বেচারা সরল দৃষ্টি নিয়ে তাদেরকেই দেখছে। আহারে, শুনে ফেললে কি ভাববে? অনুপমা বলল,” ধূর, কে বলেছে? কত মিষ্টি দেখতে একটা ছেলে। তোমার জায়গায় আমি হলে এখনই তিন কবুল বলে বিয়ে সেরে ফেলতাম।”

” আচ্ছা তাই নাকি? আহমেদ আঙ্কেল আসুক আজকে বাসায়। সব বলবো আমি।”

” বলো না! কে বারণ করেছে? ওকে কি আমি ভয় পাই?”

আহমেদ অনুপমার হাসব্যান্ড। তৃষাণের বহুবছরের সঙ্গী। তাদের সম্পর্ক বন্ধুত্বের নয়। বরং তার চেয়েও বেশিকিছু। সম্পর্কে আহমেদ উষসীর ভাইয়ের মতো হলেও উষসী তাকে মজা করে আঙ্কেল ডাকে। তাদের ছোট্ট একটা মেয়েও আছে। নাম আইলা হলেও সে খুব শান্ত, নীরব। কেউ বুঝতেই পারে না যে এই বাড়িতে একটা ছোট্ট বাচ্চার অস্তিত্ব আছে। আর তৃষ্ণা হয়েছে একটা টর্নেডো। যেখানেই যাবে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হবে৷ এইতো কিছুক্ষণ আগেও হুড়োহুড়ি করে একটা কাঁচের প্লেট ভেঙে ফেলল। তৃষাণের ধমক খেয়ে এখন ভেতরের রুমে গিয়ে বসে আছে। সর্বোচ্চ পাঁচমিনিট শান্ত হয়ে বসবে। এরপর আবার যে কে সেই!

উষসীর এভাবে পুতুল সেজে বসে থাকতে খুবই অস্বস্তি লাগছে।তার উপর পাত্রের লাগামহীন চাহনি। উষসী যতবার ছেলেটার দিকে তাকায় ততবারই দেখে ছেলেটা তার দিকে চেয়ে আছে। যেন চোখ দিয়ে গিলে ফেলবে। কি হ্যাংলা! তবে একটা বিষয় উষসীর ভালো লেগেছে৷ এখন পর্যন্ত পাত্রপক্ষের কেউ উষসীকে কাজ সংক্রান্ত কোনো প্রশ্ন করেনি। শুধু পাত্রের বাবা জানতে চেয়েছেন উষসী কেমন আছে। মা জিজ্ঞেস করলেন উষসীর পুরো নাম কি। আর পাত্র জিজ্ঞেস করলেন উষসী কোন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ব্যস, এটুকুই!

তারা চলে যাওয়ার পর উষ্ণতা উষসীর বেডরুমে এলো। তার মতামত জানতে চাইল

” ছেলেকে কেমন লেগেছে তোর?”

উষসী জানে। সে নিষেধ করলেও কাজ হবে না। তৃষাণ ঠিকই উষ্ণতাকে ভংচং বুঝিয়ে তাকে রাজি করিয়ে ফেলবে। তাছাড়া বিয়েতে অমত করলে যদি তৃষাণ সত্যি কলকাতা যাওয়া বন্ধ করে দেয়? সেই ভয়ে উষসী বলল,” ভালো, খুব ভালো। ”

উষ্ণতা বিস্মিত হলো,” সত্যি? তুই কি বিয়েতে রাজি?”

” হুম। বলতে পারো নিমরাজি। ”

উষ্ণতা বোনের উত্তর শুনে কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ হলো। সে ভাবেনি উষসী যে এতো সহজে রাজি হবে। এতো দ্রুত সে নিজেই উষসীর বিয়ে দিতে চায় না। কিন্তু যেখানে উষসী রাজি হয়ে গেছে সেখানে আর কি করার? তবে উষসী একটা শর্ত রাখল,” আমাকে একবার পাত্রের সাথে আলাদা দেখা করানোর ব্যবস্থা করো দিতে হবে আপু। কিন্তু তৃষাণ ভাইয়া যাতে না জানে। পারবে?”

” তৃষাণ জানলে কি সমস্যা?”

” সমস্যা আছে। তুমি পারবে কি-না বলো।”

” হ্যাঁ পারব।”

উষসী অনেক খুশি হলো। একদিন শুক্রবারে একটা রেস্টুরেন্টে উষসী আর তার হবু বরের এপয়েন্টমেন্ট ঠিক করা হলো। উষসী একঘণ্টা আগেই পৌঁছে গেছিল৷ সাথে ছিল তার ঘনিষ্ট বন্ধু প্রীতম।

উষসী আক্ষেপ করে বলল,” দ্যাখ দোস্ত, ভাইয়া আমার জন্য কি বুড়া পাত্র ঠিক করেছে!”

প্রীতম ভর্ৎসনার সুরে বলল” ইয়ামিন কি কম বুড়া ছিল?”

” মানে? তুই ইয়ামিনের সাথে একে মেলাচ্ছিস কেন? কোথায় ইয়ামিন আর কোথায় এই বুইড়া।”

প্রীতম পাত্রের বায়োডাটা ঘাঁটতে ঘাঁটতে বলল,” ছেলের বয়স দেখি ২৯। ইয়ামিনের যেন কত?”

” দুইমাস পর ২৬ হবে।”

” তোর বয়স কত?”

” আটমাস পর উনিশ হবে।”

” আটমাস পর কত হবে সেটা জানতে চাইনি। এখন কত?”

” আঠারো।”

” তাহলে তোর প্রসপেক্টে কি ইয়ামিন বুড়া না?”

” একদম না। মাত্র আটবছরের ডিফারেন্স। এইটা তো নরমাল।”

” ছেলের নাম রবীউল হাসান ইমন। উচ্চতা ছ’ফুট এক। মাশাল্লাহ!আর এক ইঞ্চি হলেই ইয়ামিনের সমান হয়ে যেতো। প্রক্সি হিসেবে ঠিকাছে। ”

” দ্যাখ ফালতু কথা বলবি না।”

” গাঁয়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা। কিন্তু ইয়ামিন তো হলদে ফরসা। ইমনের চোখের রঙ বাদামী। ইয়ামিনের চোখের রঙ গাঢ় কালো। ”

উষসী এইবার রেগে বলল,” এই তোর প্রবলেম কি? ইমনের সাথে তুই ইয়ামিনের তুলনা করছিস কেন? আমি কি ইমনকে বিয়ে করবো? কক্ষনও না। তাই ইয়ামিনের সাথে তুলনা করে লাভ নেই। তোকে যা করতে বলেছি তাই করবি চুপচাপ।”

” দ্যাখ দোস্ত, আমার মনে হচ্ছে কাজটা ঠিক হবে না। তুই বড়সড় একটা কট খাবি।”

” আমার ব্যাপার আমি বুঝে নিব। তোকে যতটুকু করতে বলেছি ততটুকুই করে দে বাপ!”

” ওকে।”

একটু পর ইমনকে রেস্টুরেন্টে ঢুকতে দেখা গেল। উষসী ফিসফিস করে বলল,” ওইতো আসছে। জলদি যা এখান থেকে। ”

প্রীতম দূরের একটা টেবিলে গিয়ে বসল। ইমন খুব ফিটফাট সেজে এসেছে। কড়া পারফিউম দিয়েছে।উষসী জানে যাদের গায়ে ঘামের গন্ধ বেশি তারাই এমন কড়া পারফিউম ইউজ করে। ছি, ভাবতেই কেমন গা গুলিয়ে উঠল তার। ইমন উষসীকে সালাম দিল। সেই সালামের উত্তর নিয়ে উষসী বিনীত কণ্ঠে বলল,” বসুন প্লিজ।”

ইমন বসল। হাসিমুখে জানতে চাইল,” কেমন আছেন?”

” ভালো। ”

তাদের মধ্যে টুকটাক আলাপ শুরু হলো। উষসী খুঁজে পাচ্ছে না কি বলবে! ইমনই নানান প্রশ্ন করছে তাকে। উষসী ধৈর্য্যের সাথে উত্তর দিচ্ছে। এভাবে কিছু সময় কাটল। অবশেষে প্রীতম নিজেকে প্রস্তুত করে তাদের সামনে। বেশ রাগী রাগী ভাব নিয়ে বলল,” আরে উষসী, তুমি এখানে কি করছো?”

তারপর ইমনের দিকে চেয়ে আৎকে ওঠার মতো বলল,” কে এই লোক? তুমি এর সাথে কি করছো?”

উষসী ভয় পাওয়ার ভং ধরে বলল,” আরে ভাইয়া…. তুমি?”

” ও। এখন আমি ভাইয়া হয়ে গেলাম? লজ্জা করে না নতুন বয়ফ্রেন্ড পেয়ে ছাইয়াকে ভাইয়া বানাতে? তোর চরিত্র এতো খারাপ?”

উষসী কঠিন গলায় বলল,” মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ। উনি আমার বয়ফ্রেন্ড না। ফিয়্যান্সে। আমাদের বিয়ে ঠিক হয়েছে।”

” ও। এটাই তাহলে তোর সেই হবু বর? ভাই শুনেন, এই মেয়েকে খবরদার বিয়ে করবেন না। গতরাতেও আমাকে ন্যুড পাঠিয়েছে। খুবই বাজে মেয়ে চরিত্রহীন।”

প্রীতম আর উষসীকে হতভম্ব করে দিয়ে ইমন বলল,” কোথায় সেই ন্যুড? দেখি!”

উষসী বিপাকে পড়ে গেল। বেটা তো দেখা যায় খুবই ফাজিল। প্রীতম ইতস্তত হয়ে বলল,” ডিলিট করে দেওয়াটাই ভুল হয়েছে৷ এসব জিনিস তো আর ফোনে রাখা যায় না। আগে যদি জানতাম যে আপনার সাথে দেখা হবে তাহলে প্রুভ হিসেবে ফোনেই রেখে দিতাম। এই ক্যারেক্টারলেস মেয়ের আসল চেহারা দেখিয়ে দিতাম।”

উষসী মনে মনে বলল,”ফাটিয়ে দিয়েছিস দোস্ত। চালিয়ে যা।”

কিন্তু মুখে বলল,” প্লিজ থামো। আমার নামে এমন মিথ্যা অপবাদ দিও না।”

” কেন? হবু বরের সামনে লজ্জা পাচ্ছো?সে কি জানে আমাদের মধ্যে মোট কয়বার হয়েছে? গতবছরও তো আমরা সিলেট গিয়ে রিসোর্টে দশরাত থেকেছি। এতো স্মৃতি আমি কিভাবে ভুলবো? হায় আল্লাহ!”

উষসী মুখ টিপে হাসি আটকালো।প্রীতমের মতো ভদ্র ছেলে এ ধরণের কথা বলতে পারে সে তো ভাবতেই পারছে না। খুব তো ভদ্র সেজেছিল। আর এখন বোম ব্লাস্ট করে উড়িয়ে ফেলছে। ফাজিল একটা! উষসী বহু কষ্টে হাসি সামলে বলল,” কি হচ্ছে এটা? আপনার সামনে একটা অপরিচিত ছেলে আমাকে যা নয় তাই বলছে আর আপনি কিছু বলছেন না কেন?”

প্রীতম ফুঁসে উঠল,” উনি আর কি বলবে? বলবো শুধু আজকে আমি৷ ভাই, এই মেয়েকে খবরদার বিয়ে করবেন না। ও একটা বিষধরী নাগিন। আমার জীবন তো নষ্ট করেছে। আপনারটাও করবে।”

উষসী রেগে বলল,” এখান থেকে যা৷ নাহলে আমি পুলিশ ডাকব। মিথ্যুক, বদ!”

উষসী প্রীতমকে ইশারা করল যাওয়ার জন্য৷ কারণ কাজ যতটুকু দরকার ছিল তা হয়ে গেছে। ইমনের মুখ গম্ভীর দেখাচ্ছে। প্রীতম বলল,” আমি যাচ্ছি, কিন্তু যাচ্ছি না। আবার আমি আসব। তুই আমার সাথে যা যা করেছিস সবকিছুর প্রমাণ নিয়ে তোর বিয়ে ভাঙতে আমি আসবই।”

প্রীতম চলে যেতে লাগল। উষসী চেঁচিয়ে বলল,” হ্যাঁ যা,যা। আমিও দেখবো তুই কি কি করতে পারিস। যত্তসব।”

উষসী শান্ত হয়ে চেয়ারে বসল। ইমন মুখে হাত রেখে খুব সহজ ভঙ্গিতে বলল,” কে ছেলেটা? আপনার বয়ফ্রেন্ড?”

উষসী মাথা নিচু করে বলল,” হুম। বয়ফ্রেন্ড ছিল। কিন্তু বিয়ে ঠিক হওয়ার পরই ব্রেকাপ করে দিয়েছি। সেজন্য প্রতিশোধ নিতে এসেছে। আপনি ওর কথায় কিছু মনে করবেন না, প্লিজ।”

ইমন হাসল। উষসী তার হাসি দেখে থম মেরে গেল। ইমন দীর্ঘ দম নিয়ে খুব স্পষ্ট গলায় বলল,” মিস উষসী,আমি একজন পুলিশ অফিসার। আপনার বয়ফ্রেন্ডের মতো গরুদের পিটিয়ে আমরাই মানুষ করি। ব্যাপারটা হয়তো আপনি জানেন না৷ এসব ছোট-খাটো কেইস বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয় না।”

উষসী খানিক ভ্যাবাচেকা খেল। ঢোক গিলে বলল,” মানে?”

ইমন মুচকি হেসে বলল,” মানে কিছু না৷ আপনার সাথে দেখা করে আমার খুব ভালো লেগেছে। আপনি দেখতে ভীষণ মিষ্টি। ছবির থেকেও মিষ্টি।”

উষসী হতভম্ব! ছেলেটা সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে খাবার অর্ডার করল। যেন কিছুই হয়নি। কি আশ্চর্য! সে কি তাহলে প্রীতমের অভিনয় বুঝে ফেলল?

উষসী তীব্র হতাশা আর মনখারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরল। ইমনই তাকে পৌঁছে দিয়েছে। সে বাড়ি ফিরে দেখল সবাই খুব খুশি। পুরো বাড়িতে একটা উৎসব উৎসব ভাব চলে এসেছে। তৃষাণ মিষ্টি কিনে এনেছে। অনুপমা জানাল, ছেলের বাড়ি থেকে ফোন এসেছিল। তারা বিয়েতে রাজি। সামনের শুক্রবার পাকা কথা আর এংগেজমেন্টের জন্য আবার আসবে। সর্বনাশ! উষসী মাথায় হাত দিয়ে বিছানায় বসে রইল। তার পুরো দুনিয়া দুলছে। এমন সময় প্রীতমের ফোন। উষসী অনিচ্ছা সত্ত্বেও রিসিভ করে নিস্তরঙ্গ কণ্ঠে বলল,” হ্যালো।”

” তারপর বল, কেমন দিলাম? ওই পুলিশ অফিসার লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে তাই না?”প্রীতমের কণ্ঠে আত্মগৌরব।

উষসীর এতো রাগ উঠলো! খট করে ফোনের লাইনটা কেটে দিল সে। ঠিক এমন সময় তৃষাণ ঘরে প্রবেশ করল। হাতে মিষ্টির প্যাকেট। উষসী তৃষাণকে দেখেই উঠে দাঁড়াল। ভয়ে আত্মা কাঁপছে দুরু দুরু। ইমন নিশ্চয়ই এতোক্ষণে তৃষানকে সব বলে দিয়েছে! তৃষাণ কাছে এসে বলল,” মিষ্টিমুখ করবে না উষুমনি?”

উষসী ভীত দৃষ্টিতে তাকালো। তৃষাণ তার স্বভাব সুলভ চমৎকার হাসি দিল। আগে এই হাসি ছিল উষসীর কাছে ভরসার নাম। কিন্তু এখন এই হাসিটাই আতঙ্ক লাগে। তৃষাণ উষসীকে জোর করেই মিষ্টি খাওয়ালো। উষসী মিষ্টি মুখে নিল ঠিকই, কিন্তু তার গলা দিয়ে এই বিষ কিছুতেই নামবে না। চোখ ফেটে অশ্রু বেরিয়ে এলো।

তৃষাণ গম্ভীর স্বরে বলল,” এখন থেকে তোমার উচিৎ ভেবে-চিন্তে কাজ করা উষু। অনেক তো বড় হয়েছো, ভার্সিটিতে উঠে গেছো, এখনও বাচ্চাদের মতো আচরণ তোমাকে মানায় না। আরেকটা কথা, নিজেকে সবচেয়ে বুদ্ধিমান যারা মনে করে তারাই জগতের আসল বোকা।”

উষসীর শরীর তিরতির করে কাঁপছে। মা অথবা আপু এইখানে উপস্থিত থাকলে সে নিশ্চিত শব্দ করে কেঁদে ফেলতো। কিন্তু তৃষাণ ভাইয়ের সামনে কাঁদার জন্যেও সাহস দরকার। সেই সাহস আপাতত উষসীর নেই৷ সে চোখ মুছে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে রইল। তৃষাণ ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই উষসী কাঁচের গ্লাস হাতে নিল ছুঁড়ে মারবে বলে। তৃষাণ আচমকা পেছন ফিরে তাকাল। উষসী দ্রুত কাঁচের গ্লাস নামিয়ে রাখল। বিছানায় বসল মাথা নিচু করে৷

(বর্তমান)
উষসীর এখন খুব আফসোস হয়৷ কেন সেদিন পুলিশ অফিসারের সাথে বিয়েটা হলো না তার? সেই বিয়ে হলেই বুঝি ভালো ছিল। অন্তত প্রতারিত হওয়ার দুঃখ থাকতো না জীবনে। উষ্ণতাও তার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। যে বোনকে হৃদয়ের সবচেয়ে উপরে স্থান দিয়েছিল সেও যে দিনশেষে উষসীর মন ভাঙার কারণ হবে তা কে জানতো?

এখন উষসী বুঝতে পারে, তৃষাণই ঠিক ছিল। সব ব্যাপারে, সবসময় সে উষসীর ভালো চেয়েছে। তার কথা না শুনেই বিরাট ভুল হয়ে গেছে৷ সেই ভুলের মাশুল এখন তিলে তিলে দিতে ইচ্ছে।

ইয়ামিন সারারাত বাড়ি ফিরেনি। সকালে ঘুম থেকে উঠে উষসী তৈরী হয়ে গেল। দেনমোহরে সে যে টাকা পেয়েছিল সেগুলো এখনও তার কাছেই আছে। একটু একটু করে সে টাকাগুলো খরচ করছে। মনখারাপ হলেই শপিং-এ চলে যায়। আজও যাবে৷ তবে আজ বিশেষ একটা জায়গাতেও যেতে হবে তাকে। রাতে ভালো ঘুম হয়নি৷ অর্ধেক রাত তো দুশ্চিন্তা করতে করতেই কেটেছে। মাথার ব্যথা উপশমের জন্য উষসী একটা টাফনিল খেয়ে নিল।

আয়শা সকালের নাস্তা নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল। উষসীকে সাজ-গোজ করতে দেখে একটু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল,” কোথাও যাচ্ছেন নাকি ম্যাডাম?”

” হ্যাঁ বের হচ্ছি। আর তুমিও আমার সঙ্গে যাবে।”

আয়েশা খুশি হয়ে বলল,” ঠিকাছে ম্যাডাম। কিন্তু কোথায় যাবো?”

” প্রথমে যাবো হসপিটালে। আমার কিছু রিপোর্ট আনতে হবে। তারপর শপিং- এ…”

রিপোর্টের কথা শুনে আয়শা উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল,” কোনো গুড নিউজ আছে নাকি?”

উষসী কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। আয়শার মুখ চুপসে গেল। মাথা নিচু করে বলল,” স্যরি ম্যাডাম। স্যরি।”

উষসী শান্ত হয়ে প্রশ্ন করল,” তোমার স্যার কি রাতে ফিরেছে?”

” স্যার তো বেরই হয়নি৷ রাতে লাউঞ্জ রুমে ঘুমিয়েছিলেন।”

উষসীর হাসি পেল। রাগ দেখিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার মতো ছেলেমানুষী যে ইয়ামিন করবে না এটা তার আগেই বোঝা উচিৎ ছিল। অযথাই সারারাত দুশ্চিন্তা করেছে সে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” অনম ভাইকে বলো গাড়ি বের করতে। কিন্তু সে আমাদের সাথে যাবে না। শুধু তুমি আর আমি যাবো।”

” ওকে ম্যাডাম।”

উষসী আয়শাকে নিয়ে বের হওয়ায় ইয়ামিন কিছু বলল না। অনমও তাদের সঙ্গে আসতে চাইল না। প্রথমে উষসী হসপিটালে গেল। তার রিপোর্ট চলে এসেছে। সেই রিপোর্ট হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে রইল সে৷ যে ভয়টা পাচ্ছিল তাই হয়েছে। প্রেগন্যান্সির রেজাল্ট পজিটিভ এসেছে। সে প্রেগন্যান্ট! আয়শা আনন্দিত কণ্ঠে বলল,” স্যার জানতে পারলে যে কি খুশি হবে ম্যাডাম! আমারই তো খুশিতে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।”

উষসী উত্তপ্ত কণ্ঠে বলল,” খবরদার, এই কথা যাতে তোমার স্যার কোনোভাবেই জানতে না পারে।”

আয়শা হতভম্ব হয়ে বলল,” কেন ম্যাডাম? আপনি কি স্যারকে খুশি দেখতে চান না?”

উষসী তাচ্ছিল্য হাসল। বাচ্চার খবর শুনলে সে খুশি তো হবেই না উল্টা বিরক্ত হবে। এতোদিন শুধু উষসী ছিল তার বোঝা, এখন নতুন করে আরেকজন আসছে। এই খবর শুনে ইয়ামিনের খুশি হওয়ার প্রশ্নই আসে না। তাদের ডিভোর্সটা এখন আরও জটিল হয়ে গেল।

ঘড়িতে রাত সাড়ে আটটা। পাগলের মতো পায়চারী করছে ইয়ামিন। উষসী এখনও বাড়ি ফিরেনি। বিকাল পাঁচটায় কাঁদতে কাঁদতে আয়শা ফিরে এসেছে একা। তারা শপিংমলে ঘুরছিল। হঠাৎ করে লিফটে উঠল। উষসী বলল তার নিচে একটা কাজ আছে। আয়শাকে উপরে পাঠিয়ে সে নিচে নামল। ব্যস, তারপর আয়শা আর কোথাও উষসীকে খুঁজে পেল না। উষসী তার চোখে ধুঁলো দিয়ে পালিয়েছে। কিন্তু কোথায় গেছে? নিজের অপরাধবোধের কারণে আয়শার কান্না পেল। এখনও সে কাঁদছে৷ তার কান্না ইয়ামিনের মেজাজ আরও বাড়িয়ে দিল। সে রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,

” একদম সাইলেন্ট। তোমার ইরেসপন্সিবিলিটির জন্য এসব হয়েছে। এখন আমার সামনে থেকে যাও। গেট লস্ট।”

আয়শা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,” ম্যাডাম অসুস্থ, তার জন্য আমার খুব চিন্তা হচ্ছে। কোথায় গেল সে?”

ইয়ামিন ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করল,” অসুস্থ ছিল মানে? ওর কি হয়েছিল?”

আয়শা কিছুক্ষণ থেমে থেকে বলল,” ম্যাডাম প্রেগন্যান্ট।”

ইয়ামিন স্তব্ধীভূত হয়ে তাকিয়ে রইল। পাশের রুম থেকে ফোনের তীক্ষ্ণ শব্দ শোনা যাচ্ছে৷ তাতেও ইয়ামিনের কোনো ভাবান্তর হলো না। সে দাঁড়িয়ে আছে স্থাণুর মতো। তাকিয়ে আছে শূন্যে। হয়তো ফোনের রিংটোনও তার কানে যাচ্ছে না। এ জগৎ থেকে সে কয়েক মুহূর্তের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে পুরোপুরি। অনম ফোন রিসিভ করল। ওই পাশ থেকে উষসীর মা যুথি কথা বললেন,” হ্যালো বাবা ইয়ামিন, উষসীকে সকাল থেকে ফোনে পাচ্ছি না। অনলাইনে তো একবারও আসেনি। কি হয়েছে তুমি জানো? আবার কি ঝগড়া হয়েছে তোমাদের?”

অনম বলল,” আমি স্যারের এসিসট্যান্ট বলছি আন্টি।ইয়ামিন স্যার এখানে নেই। উনি ম্যাডামকে খুঁজতে বের হয়েছেন। ”

যুথি অস্থিরচিত্তে বললেন,” খুঁজতে বের হয়েছে মানে? উষসী কোথায়?”

” এখনও ম্যাডামের খোঁজ পাওয়া যায়নি। খোঁজ চলছে। চিন্তা করবেন না, ম্যাডামকে দ্রুত পাওয়া যাবে।”

” হায় আল্লাহ, কি সর্বনাশের কথা! কখন থেকে নিখোঁজ মেয়েটা?”

অনম কিছু বলার আগেই ইয়ামিন ঘরে প্রবেশ করল। অসম্ভব শান্ত গলায় জানতে চাইল,” কার ফোন?”

অনম একটু হকচকিয়ে গেল। বিকাল থেকে ইয়ামিন বাইরে ছিল। উষসীকে তন্ন-তন্ন করে খুঁজে বেরিয়েছে। সে কখন ফিরে এসেছে সেটা অনম জানে না। সে বলল,” ম্যাডামের বাড়ি থেকে ফোন এসেছে স্যার।”

ইয়ামিন এসে ফোনটা ধরল। ওই পাশ থেকে শোনা গেল তৃষাণের ধারালো কণ্ঠ,” উষসী কোথায়?”

ইয়ামিন ঠান্ডা স্বরে বলল,” আমি জানি না।”

তৃষাণের চোয়াল শক্ত হলো। রাগে গজগজ করে বলল,” তুমি জানো না মানে? এই কথা বলার সাহস তোমার কিভাবে হলো?”

ইয়ামিন বলল,” আমি তাকে খোঁজার চেষ্টা করছি।”

তৃষাণ তীক্ষ্ণ হুমকি দিল,”আমাদের উষুর যদি কিছু হয় তাহলে তোমার কপালে দুঃখ আছে ইয়ামিন ইব্রাহীম। মাইন্ড ইট।”

ইয়ামিন চোয়াল শক্ত করে ফোনের লাইন কাটল। অসম্ভব ক্লান্ত লাগছে তার। নিয়তির নিষ্ঠুরতা সহ্য করে সে অভ্যস্ত। তবুও আজ যেন বড্ড ক্লান্তবোধ হচ্ছে। উষসী কোথায়?

চলবে