Monday, August 4, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 416



আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-৩৮+৩৯

0

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৩৮
লিখা- Sidratul Muntaz

উষসীকে দেখে ইয়ামিনের ঠোঁট দু’টো হেসে উঠল। চোখের দৃষ্টি উজ্জ্বল হলো। হৃদয় থেকে নেমে গেল যেন এক আকাশসম পাষাণ ভার। ছাতা হাতে উষসী কাছে এসে দাঁড়ালো। কঠিন মুখে কণ্ঠে অনেকটা গম্ভীরতা ঢেলে বলল,” এতো দাঁত বের করে হাসার কিছু নেই। আমি এসব আম্মুর জন্য করছি। আপনি বৃষ্টিতে ভিজে অসুস্থ হলে আম্মু বাংলাদেশ থেকে দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠবেন। আমি আম্মুকে দুশ্চিন্তায় ফেলতে চাই না৷ এবার উপরে চলুন।”

ইয়ামিন হাসিমুখে উষসীর সাথে এগিয়ে গেল। এই অতি আকাঙ্খিত মুহূর্তটির জন্যই আজ সারাদিন অপেক্ষা করেছে সে। তার সব অপেক্ষা অবশেষে স্বার্থক! সে ধন্য।

উষসী রুমে এসে দরজা আটকাতেই পেছন থেকে ইয়ামিন শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরল তাকে। ঘাড়ে, পিঠে চুমু দিয়ে বলল,” আই মিসড ইউ।”

উষসী রাগে অঙ্গার হয়ে উঠল। ইয়ামিনকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে বলল,” খবরদার, আমার থেকে দূরে থাকুন। আপনাকে এই জন্য রাস্তা থেকে তুলে আনিনি বুঝেছেন? সীমা অতিক্রম করবেন না।”

ইয়ামিন কাছে এসে একহাতে উষসীর কোমর জড়িয়ে বলল,” সীমা অতিক্রম কোথায় করলাম? ইউ আর মাই ওয়াইফ। আই ক্যান ডু এনিথিং।”

উষসী চোখ বড় করে বলল,” আমি কিন্তু তৃষাণ ভাইয়াকে ডাকব।”

উষসীর ফাঁকা হুমকি ইয়ামিনকে হাসাল। সে অকপটে বলল,” পারবে না। সেটা করার হলে আগেই করতে পারতে। এভাবে লুকিয়ে আমাকে ঘরে নিয়ে আসতে না।”

এবার উষসীও হেসে উঠল। হাত ভাঁজ করে বলল,” আপনার সমস্যাটা কি জানেন? আপনি আমাকে টেকেন ফর গ্রান্টেড ভেবে রেখেছেন। আপনি ভাবছেন আপনার কিছু হলে আমি মরেই যাবো। কনফিডেন্টস থাকা ভালো কিন্তু ওভার কনফিডেন্টস মোটেও ভালো না। আপনি কি ভাবেন নিজেকে? আর আপনি আমাকেই বা কি ভাবেন? আপনাকে ছাড়া কি আমি সত্যি ম-রে যাবো? আমাকে টেকেন ফোর গ্রান্টেড ভেবে রাখলে আপনি বিরাট ভুল করবেন৷ এখন আর আমার কোনোকিছুই আগের মতো নেই। আপনার প্রতি আমার সব অনুভূতি শেষ হয়ে গেছে…”

উষসীর কথার মাঝেই ইয়ামিন হঠাৎ তার ঠোঁটের উপর আঙুল চেপে ধরে বলল,” আই লভ ইউ।”

উষসী দ্রুত পলক ঝাঁকালো। কান গরম হয়ে উঠল মুহূর্তেই। একবার সে ভাবল ভুল শুনেছে। তার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে ইয়ামিন পুনরায় বলল,” আই লভ ইউ। আই লভ ইউ, আই লভ ইউ, আই লভ ইউ।”

চোখ বন্ধ করে কেবল একটাই বাক্য সে আওড়ে গেল। তারপর চোখ খুলে বড় করে একবার শ্বাস নিয়েই বলল,” আই লভ ইউ, উষসী। মোর দ্যান মাই লাইফ, মোর দ্যান মাই পাস্ট, প্রেজেন্ট, ফিউচার এন্ড মোর দ্যান এনিথিং। ”

উষসী বিস্ময়ে হতবাক। তার হিঁচকি ওঠার উপক্রম হলো। তাদের বিবাহিত জীবনের দুইবছরে এই প্রথমবার ইয়ামিন ভালোবাসার কথা বলেছে তাকে। এর আগে কখনও, কোনো অবস্থাতেই সে বলেনি এমনকি উষসীও আশা করেনি যে ইয়ামিনের মুখ থেকে কখনও এমন কথা শুনবে সে। তাই এই অবিশ্বাস্য কান্ড ঘটায় উষসীর শরীর রীতিমতো ঝিম ধরে গেছে। সে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে।

ইয়ামিন ফিসফিস করে বলল,” হঠাৎ আমি রিয়েলাইজ করেছি আমার জীবনের সবকিছুই মিথ্যা ছিল একমাত্র তুমি ছাড়া। তুমি আমার জীবনের ধ্রুব সত্যি। তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি আমি, আই লভড ইউ উইথ মাই হোল হার্ট।”

নিজের অজান্তেই উষসীর চোখে জল চলে এলো। ভালোবাসার তৃষ্ণায় খা খা করা হৃদয়ে যেন বৃষ্টি নামল। সে কিছুটা পিছিয়ে এসে বিড়বিড় করে বলল,” মিথ্যা, আপনি মিথ্যা বলছেন।”

ইয়ামিন উতলা হয়ে বলল,” বিশ্বাস করো উষসী প্লিজ। আমি সত্যি বলছি। তুমি বিশ্বাস না করলে আমি মরে যাবো।”

“এখন আর আপনার কোনো কথাই বিশ্বাস করি না আমি।”

” কিন্তু এটা তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে। আই লভ ইউ।”

“না, আপনি আবারও মিথ্যা বলছেন।”

” উহুম। আমি এতো বেশি সত্যি কখনও বলিনি।প্লিজ আমার কথা একবার বিশ্বাস করো।”

উষসী ক্ষীপ্রতার সাথে দুইপাশে মাথা নাড়তে লাগল। ইয়ামিন হঠাৎ তার মুখটা চেপে ধরে রাগী স্বরে বলল,” কেন বিশ্বাস করবে না? আমি সত্যি বলছি!এতোদিন মিথ্যা বলেছি অথচ তুমি সব বিশ্বাস করেছো। আর এখন সত্যি বলছি তাহলে কেন বিশ্বাস করছো না? তোমাকে বিশ্বাস করতেই হবে আমার কথা। এছাড়া অন্যকোনো অপশন নেই তোমার কাছে। বুঝেছো?”

উষসী চুপ হয়ে গেল। তার চোখ এখনও ভেজা। টুপটুপ করে অশ্রু পড়ছে চোখ থেকে। ইয়ামিন শক্ত করে তার ঠোঁট দু’টো চেপে ধরতেই চোখ বন্ধ করে নিল উষসী। বাঁধা দেওয়ার বদলে দুইহাতে জড়িয়ে ধরল ইয়ামিনের পিঠ। ইয়ামিন নিচু হয়ে উষসীর কোমর চেপে ধরে তাকে উপরে তুলল। কোনো এক স্বর্গীয় অনুভূতির খোঁজে ভেসে যেতে লাগল দু’জনেই। হঠাৎ দরজায় তীক্ষ্ণ শব্দে করাঘাত হতেই তারা একে-অপরকে ছেড়ে দিল। লজ্জায় উষসী খুব অপ্রস্তুত হয়ে গেল।

দরজা খুলতে নিয়ে খেয়াল করল সে দরজা খুলতেই পারছে না। তার হাত চলছে না। লক ধরে সে ঘুরাচ্ছে, টানছে, কিন্তু কাজ হচ্ছে না। পেছন থেকে ইয়ামিন এসে লক টেনে খুলে দিতেই উষসী বিব্রত হয়ে তার দিকে তাকাল। দরজার ওইপাশ থেকে যুথি বলে উঠল,” কি হয়েছে মা? ঘুমুচ্ছিলি নাকি? দরজা খুলতে এতো সময় লাগল যে?”

ইয়ামিন দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে। উষসী মাথা নিচু করে বলল,”রেস্ট নিচ্ছিলাম। শরীরটা ভালো লাগছিল না।”

” সারাদিন শুয়ে-বসে থাকলে শরীর তো খারাপ লাগবেই। আমাদের সাথে বাইরে ঘুরতে যাবি, চল। তাহলে ভালো লাগবে।”

” আমি কোথাও যাব না, মা। বললাম তো আমার শরীর ভালো নেই।”

” সেকি, শরীর কি বেশি খারাপ নাকি? তাহলে অন্তত ডাক্তারের কাছে তো যাওয়া উচিৎ। ”

যুথি এই কথা বলে ভেতরে ঢুকতে নিলেই উষসী বাঁধা দিয়ে বলল,” সেরকম সিরিয়াস কিছু হয়নি। ঘুমালেই ঠিক হয়ে যাবে।”

” তৃষাণের ফ্রেন্ড এসেছিল। তোর সাথে দেখা করতে চাইছে।”

” আমার কারো সাথে এখন দেখা করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। সকালে দেখা করি?”

” কিন্তু ও তো আমাদের বাইরে ঘুরতে নিয়ে যেতে চাইছে। তুই না গেলে ভালো লাগবে, বল? তোর জন্যই তো আমরা আরও প্ল্যান-ট্যান করলাম। যাতে তোর মন ভালো হয়।”

উষসী হেসে বলল,” আমার মনখারাপ এই কথা কে বলল? আমি একদম ঠিকাছি। তোমরা যাও। শরীর ভালো লাগলে আমিও যেতাম। কিন্তু ভালো লাগছে না।”

” তুই কি নিশ্চিত? ঘরে একা থাকবি? আমিও বরং তোর সঙ্গে থেকে যাই।”

” না মা, প্লিজ। আমার সাথে কাউকে থাকতে হবে না বললাম তো। আমি সত্যি ঠিকাছি৷ তুমি যাও প্লিজ।”

উষসী এক প্রকার জোর করেই যুথিকে তাড়িয়ে দিতে চাইছে। মেয়ের এমন আচরণে যুথি কিছুটা অবাক হলো। মনখারাপ করে বলল,” তুই এমন করছিস কেন? জামাইকে বাড়িতে ঢুকতে না দেওয়ায় কি আমাদের উপর রাগ করেছিস মা?”

উষসী থতমত খেয়ে বলল,” মানে? আমি কেন রাগ করব এজন্য?”

” তুই যে জামাইকে কত ভালোবাসিস সেটা তো আমি বুঝি। যখন উষ্ণ আর তৃষাণ ওকে বের করে দিচ্ছিল… তুই একবারও বাইরে আসিসনি৷ ভেতরে বসে কাঁদছিলি। আমি দেখেছি।”

উষসী আঁড়চোখে ইয়ামিনের দিকে তাকাল। ইয়ামিন দেয়ালে মাথা ঠেঁকিয়ে হাসছে। লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়ে উঠল উষসীর মুখ। সে স্পষ্ট গলায় ঘোষণা দিল,” আমি তাকে মোটেও ভালোবাসি না। তুমি ভুল ভাবছো, মা।”

ইয়ামিন এক ভ্রু উঁচু করে ঠোঁটের ইশারায় বলল,” তাই?”

উষসী রূঢ় গলায় বলল,” একদম তাই।”

যুথি বলল,” হয়েছে আর মিথ্যা বলতে হবে না। আমি তোর মা। তোকে জন্ম দিয়েছি। তোর পেটের কথা আমার চেয়ে ভালো আর কে বুঝবে? আমি জানি তুই ভেতরে ভেতরে কত কষ্ট পাচ্ছিস। কিন্তু তৃষাণের ভয়ে কিছু বলতে পারছিস না। শোন উষু, তুই চাইলে কিন্তু আমি ইয়ামিনের সাথে তোর দেখা করার ব্যবস্থা করে দিবো।”

উষসী খুব বিরক্ত হয়ে বলল,” অসম্ভব। আমি ওর মুখও দেখতে চাই না। মা, তুমি যাওতো এখান থেকে প্লিজ। এমনিতেও আমার মাথা ব্যথা করছে। তোমার সাথে দাঁড়িয়ে বকবক করলে আরও মাথা ব্যথা বাড়বে।”

” আচ্ছা যাচ্ছি। কিন্তু আমি আবার আসব খোঁজ নিতে।”

উষসী দরজা আটকে হাঁফ ছাড়ল। তখনি দেখল ইয়ামিন তার একদম সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। উষসী ভয়ে আৎকে উঠল কিছুটা। ইয়ামিন দরজার উপর হাত রেখে ঝুঁকে এসে বলল,” আমি না হয় ওভার কনফিডেন্স দেখাচ্ছি। কিন্তু মাও কি ভুল বলছে?”

” হ্যাঁ অবশ্যই ভুল বলেছে। মায়ের কথা শুনে এতো খুশি হওয়ার কিছু নেই। আমার মা সবসময় দুই লাইন বেশি বুঝে। ”

” হুম। সবাই বেশি বোঝে। তুমি যে আমাকে একদম ভালোবাসো না, তার প্রমাণ তো একটু আগেই পেলাম।”

” মানে? কি প্রমাণ পেলেন আপনি?”

” আমাকে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখে তুমি ছাতা নিয়ে বাইরে এলে। সবার চোখের আড়ালে আমাকে ঘরে আনলে। তারপর… ”

ইয়ামিনকে থামিয়ে উষসী চটপটে গলায় বলল,” এসব আমি আম্মুর জন্য করেছি। সেটা আগেও বলেছি আপনাকে।”

” আচ্ছা? এটা না হয় আম্মুর জন্য। তাহলে বাকি গুলো কিসের জন্য?”

” বাকিগুলো মানে?”

” মানে আমি যখন তোমাকে টাচ করলাম, তখন তুমি সাথে সাথে আমাকে বের করে দিতে পারতে। কিন্তু তুমি করোনি। আমার মুখে আই লভ ইউ শুনে তোমার চোখে পানি এসে গেল। আর আমি যখন তোমাকে কিস করলাম তখন তুমি একবারও বাঁধা দিলে না।”

” কে বলেছে বাঁধা দেইনি? আমি বাঁধা দেওয়ার আগেই মা চলে এলো। নাহলে দেখতেন আমি আপনার কি অবস্থা করতাম।”

“ও তাই?”

পুনরায় দরজায় করাঘাত হলো। এবার এসেছে তৃষাণ। উষসী হাসিমুখে বলল,” কিছু বলবে ভাইয়া?”

” মায়ের কাছে শুনলাম, তোমার নাকি শরীর খারাপ?”

” ওই একটু মাথা ব্যথা আর কি…. তেমন কিছু না।”

” ও। আমাদের সাথে বাইরে চলো। তাহলে নিশ্চয়ই তোমার ভালো লাগবে।”

” আসলে মাকেও আমি বলে দিয়েছি। আমার বাইরে যেতে ভালো লাগছে না। তোমরা যাও প্লিজ। আমি ঘরেই থাকবো।”

” ঠিকাছে… তাহলে তুমি কি খেতে চাও বলো। তোমার জন্য ডিনারে নিয়ে আসব।”

“আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। যেকোনো কিছু আনলেই হবে।”

” ওকে।”

তৃষাণ চলে যেতেই উষসী দ্রুত দরজা আটকে দিল। সিঁড়ির কাছে উষ্ণতা দাঁড়িয়ে ছিল৷ তৃষাণকে দেখে প্রশ্ন করল সে,” কি বলল উষু? সে কি যাবে না?”

তৃষাণ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” না।”

“তোমার মাকে পাঠিয়ে একবার রিকয়েস্ট করাব?”

“লাভ নেই। এখন উষসী কোনো অবস্থাতেই বাইরে যেতে রাজি হবে না।”

” কেন?” উষ্ণতা ভ্রু কুঁচকালো। তৃষাণ সিঁড়ি ভেঙে নামতে নামতে অকপটে বলল,” ভেতরে ইয়ামিন আছে।”

উষ্ণতার চোখ দু’টো বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল,” তুমি এটা কিভাবে বুঝলে?”

তৃষাণ হাসল,” ছোট থেকে উষুকে বড় করেছি। ওর ব্যাপারে এই সামান্য বিষয় না বোঝার কিছু নেই।”

ইয়ামিন খুব জোরে একটা হাচি দিল। উষসী ব্যস্ত হয়ে তাকে বিছানায় বসালো। নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথা মুছে দিতে লাগল। ইয়ামিন হঠাৎ উষসীর কোমর জড়িয়ে ধরল। বুকে মুখ গুঁজে বলল,” বাড়ি চলো উষসী প্লিজ। তোমাকে ছাড়া সেখানে একদম শান্তি নেই।”

উষসী ঠান্ডা গলায় বলল,” সম্ভব না।”

” কেন?”

“যেখান থেকে একবার চলে এসেছি, সেখানে আবার ফিরে যেতে নেই।”

” চেষ্টা করলেই যাওয়া যায়।”

” আমি চেষ্টা করতে চাই না। সবাই যখন বাড়ি থেকে চলে যাবে, তখন আপনিও বের হয়ে যাবেন।”

ইয়ামিন চোয়াল শক্ত করে বলল,” তোমাকে নিতে এসেছি, না নিয়ে কোথাও যাবো না।”

উষসী কোনো উত্তর না দিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো। তার কান্না পাচ্ছে। দ্রুত চোখ মুছে নিল। নিচে সবাইকে দেখা যাচ্ছে৷ তারা গাড়িতে উঠছে। লম্বা করে ওই বাদামী চুলের মানুষটা সম্ভবত তৃষাণের বন্ধু। উষসী তাদের চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল। তারপর ভেতরে এসে ইয়ামিনকে বলল,” সবাই চলে গেছে। বাইরে বৃষ্টিও নেই। এবার আপনি নিশ্চিন্তে যেতে পারেন।”

ইয়ামিন মাথা নিচু করে বসে আছে। একধ্যানে মেঝের দিকে চেয়ে থেকে বলল,” তোমাকে ছেড়ে যাবো না, আগেও বলেছি।”

” জেদ করে লাভ নেই। আমি আপনার সাথে যাবো না।”

ইয়ামিন তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো এবার। আচম্বিতে উষসীকে পাজাকোলায় নিয়ে বলল,” দেখি কিভাবে না যাও।”

উষসী ডাঙায় তোলা মাছের মতো তড়পে উঠল,” কি করছেন? আমাকে ছাড়ুন, আমি কিন্তু চিৎকার করব। হেল্প, হেল্প মি।”

ইয়ামিন বিড়বিড় করে বলল,” শেষমেষ নিজের বউকে কিডন্যাপ করতে হচ্ছে। কত দূর্ভাগ্য আমার!”

চলবে
#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৩৯
লিখা- Sidratul Muntaz

মেঘলাটে আকাশ। ঘন অন্ধকারে ঢেকে আছে শহর। কৃত্রিম আলোয় ভরা সন্ধ্যাটা ঝলমল করছে। উষসী গাড়ির জানালা খোলার আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ। পেছন থেকে অনম বলল,” আপনি না থাকলে আমাদের স্যারের কি হবে ম্যাডাম?কেন আপনি স্যারকে ছেড়ে চলে যেতে চাইছেন? এটা তো খুবই নিষ্ঠুরতা।”

উষসী কর্কশ গলায় বলল,” ফালতু কথা বলবেন না। আমি না থাকলে আপনাদের স্যার বেশ ভালোই থাকবে। সব জানা আছে আমার।”

” আপনি আজও স্যারকে চিনতেই পারলেন না ম্যাডাম। আফসোস!”

” শাট আপ। স্যারের হয়ে ওকালতি না করে ভালো হয় যদি আপনি আমাকে এখান থেকে বের হতে সাহায্য করেন। নাহলে কিন্তু আপনাদের দু’জনের নামেই মামলা করব আমি। জোর করে আমাকে অপহরণ করা হচ্ছে।”

ইয়ামিন হেসে উঠল উচ্চ শব্দে। অনম বলল,”এভাবে বলবেন না ম্যাডাম। আপনি স্যারের স্ত্রী। কখনও কি শুনেছেন নিজের স্ত্রীকে কেউ অপহরণ করে? এই কথা কি মানুষ বিশ্বাস করবে?”

” আপনার স্যারের মতো রাক্ষস সব করতে পারে।”

ইয়ামিন ভ্রু উঁচু করে বলল,” উহুম পুরোটা বলো, শুধু রাক্ষস তো না। রাক্ষসমানব!”

” হেল্প, হেল্প, আমাকে কিডন্যাপ করা হচ্ছে। হেল্প মি।”

” চিৎকার করে লাভ নেই ম্যাডাম। এই হাইরোডে কেউ আপনার গলার আওয়াজ শুনবে না।”

উষসী কিড়মিড় করে বলল,” তৃষাণ ভাইয়া যখন বাড়ি ফিরে দেখবে আমি নেই তখন আপনার খবর আছে।”

” তাই নাকি? আচ্ছা। দেখা যাক তোমার তৃষাণ ভাই কি করে।”

পার্কিং লটে গাড়ি থামিয়ে ইয়ামিন নামল। উষসীকেও নামার জন্য দরজা খুলে দেওয়া হলো। কিন্তু উষসী নামবে না। শক্ত হয়ে বসে থেকে রক্তিম দৃষ্টিতে প্রায় কাঁপতে কাঁপতে বলল,” ভালোয় ভালোয় আমাকে ফেরত নিয়ে চলুন। তৃষাণ ভাই জানলে আপনাকে আস্তো রাখবে না।”

” তোমার তৃষাণ ভাইকে আমি ভয় পাই নাকি?

উষসী ছটফট করে বলল,” জোর করে কয়দিন আমাকে আটকে রাখবেন? সুযোগ পেলে আমি আবার পালাবো।”

” সেই সুযোগ তোমাকে আর দেওয়া হবে না।”

ইয়ামিন উষসীর হাত টেনে তাকে কোলে তুলতে উদ্যত হলো। ঠিক সেই মুহূর্তে উষসী খুব অদ্ভুত একটা কাজ করল। ইয়ামিনের হাতে কাম-ড় মেরে লাফিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। এক সেকেন্ডের জন্য ইয়ামিন ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলায় উষসীকে ধরতে সক্ষম হলো না। তবে সে চিৎকার করে বলল,” পাগলামি কোরো না উষসী৷ এটা কেমন ছেলেমানুষী? ”

উষসী মেইন গেইট ক্রস করে বের হতে পারল না। গেইট লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে দারোয়ানের উদ্দেশ্যে বলল,” আঙ্কেল প্লিজ গেইট খুলে দিন। আমি আপনাকে নগদ পঞ্চাশ ডলার দিবো। ”

দারোয়ান বলল,” স্যরি ম্যাম, গেইট খুললে আমার চাকরি চলে যাবে।”

উষসী তর্কে জড়াল না। পেছনে ইয়ামিন আসছে। যে কোনো সময় তাকে ধরে ফেলবে। উষসী উল্টো দিকে দৌড় দিল। সে জানে এখান থেকে পালানো সম্ভব নয়। তবুও এমন বৃথা চেষ্টা কেন করছে তা সে নিজেও বুঝতে পারছে না। এদিকে উষসীকে এমন উথাল-পাথাল দৌড়াতে দেখে ইয়ামিন ভড়কে গেল। মেয়েটা পাগল নাকি? এই অবস্থায় কেউ ওইভাবে দৌড়ায়? একটা আছাড় খেলেই তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। ইয়ামিন মিনতি করে বলল,” দোহাই লাগে উষসী, তুমি থামো প্লিজ।”

উষসী প্রাণপণে চেঁচিয়ে বলল,” আপনি আমাকে কোনোভাবেই ধরতে পারবেন না।”

” আচ্ছা আমি তোমাকে ধরব না, প্রমিস করছি। তবুও থামো প্লিজ।”

উষসী পেছনে তাকিয়ে দেখল ইয়ামিন আসলেই তাকে ধরতে আসছে না। দূরে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখেমুখে আতঙ্কের গভীর ছাপ। হঠাৎ একটা ভেজা স্যাতস্যাঁতে জায়গায় আসতেই উষসীর পা পিছলে গেল। ইয়ামিন ভয়ে চিৎকার করে উঠল,” সাবধানে…”

উষসী ধপ করে সুইমিংপুলে পড়ে গেল। ইয়ামিন মাথায় হাত চেপে ধরল। তারপর সেও দৌড়ে এসে সুইমিংপুলে ঝাঁপ দিল।

উষসী বিড়বিড় করে বলতে লাগল,” আমি ডুবে গেলাম, ডুবে গেলাম। আমি সাতার জানি না!”

ইয়ামিন তাকে দুইহাতে আগলে ধরে হেসে বলল,” তিন ফিট পানিতে তুমি ডুববে না, চিল।”

উষসী নিচে তাকিয়ে দেখল তার পা ভূমি স্পর্শ করছে। শুধু বুক পর্যন্ত ডুবে আছে শরীর। সে একটু লজ্জা পেয়ে গেল। নিজেকে বোকা বোকা লাগছে। ইয়ামিন বলল,” আগেই দৌড়াতে নিষেধ করেছিলাম। পানিতে আছাড় খেয়ে কেমন লাগছে এখন?”

ইয়ামিনের কটাক্ষ ভরা হাসি দেখে রাগে ছ্যাঁত করে উঠল উষসীর শরীর। ঝাঁকি মেরে তাকে সরিয়ে বলল,” সবকিছু অনেক মজা মনে হচ্ছে আপনার কাছে, তাই না? আমি কি শখ করে এই বাড়ি থেকে চলে গেছিলাম? জোর করে আমাকে উঠিয়ে এনে কি বোঝাতে চান আপনি? আমাকে ভালোবাসেন? এসবের নাম ভালোবাসা?”

ইয়ামিন আলতো করে উষসীর মুখটা আঁজলায় নিয়ে বলল,” উষসী, শোনো…”

” কিচ্ছু শুনবো না। আপনি শুনুন, সামান্য আই লভ ইউ বললেই আমি সবকিছু ভুলে আবার আগের মতো হয়ে যাব সেটা আপনি ভাবলেন কিভাবে? একবার মনে করে দেখুন যে আমার সাথে আপনি কি কি করেছিলেন। উত্তর পেয়ে যাবেন। আমি আপনার সাথে এক মিনিটও থাকতে চাই না এখানে।”

উষসী পাড়ে ওঠার জন্য স্টিলের উপর হাত রাখতেই ইয়ামিন ধাক্কা মেরে আবারও পানিতে ফেলে দিল তাকে। উষসীর গলা পর্যন্ত ডুবে গেল নীল জলে। হঠাৎ এমন আক্রমণে সে হতভম্ব। ইয়ামিন শক্ত করে তার বাহু চেপে ধরে তাকে উপরে তুলে বলল,” মানছি যে আমি ভুল করেছিলাম। আমি আমার অপরাধ বার-বার স্বীকার করেছি। কিন্তু তুমি নিজে কি করেছো? একবারও কি বিশ্বাস করেছো আমার কথা?”

” আপনাকে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। আপনি বিশ্বাসের যোগ্য না।”

” সেটা তোমার ধারণা। কিন্তু একবারও আমি নিজেকে সঠিক প্রমাণ করার সুযোগ পাইনি।”

” আপনি প্রতারণা করেছেন আমার সাথে। আপনার ভালোবাসার সেই মেয়েটি উষ্ণতা আপু ছিল। আপনি তা গোপন করেছেন দিনের পর দিন।”

“না কিচ্ছু গোপন করিনি। বিয়ের দিনই সব বলতে চেয়েছিলাম তোমাকে। মনে আছে সেই ভিডিওর কথা? সবকিছু সত্যি কনফেস করেছিলাম ভিডিওতে। বিয়ের আগেই চেয়েছিলাম তোমাকে সবকিছু জানিয়ে দিতে। বিশ্বাস না হলে তুমি তোমার পুরনো আইডি ঘেঁটে দেখতে পারো। সবকিছুতেই তো প্রুভ লাগবে তোমার, তাই না?”

উষসী বিস্ময় নিয়ে উচ্চারণ করল,” ওই ভিডিও আপনি আমাকে দেওয়ার জন্য শ্যুট করেছিলেন?”

” তা নয়তো কি?”

” তাহলে বিয়ের পরে একবারও বললেন না কেন?”

” তখন বলেও বা লাভ কি হতো? ডিভোর্স দেওয়া ছাড়া তুমি আর কি করতে পারতে? সেটা আমাদের কারো জন্যই ভালো হতো না, তাই বলিনি। ভেবেছিলাম যদি কখনও আমাদের ডিভোর্স হয় তাহলে তোমাকে সব জানাব।”

” তাহলে ডিভোর্স দিলেন না কেন আমাকে? সব সত্যি জানার পর তো আমি মুক্তিই চেয়েছিলাম আপনার কাছে। কেন আমাকে ডিভোর্স দেননি তখন? যার মনে কখনও আমি ছিলাম না তার জীবনেও আমি থাকতে চাই না। এই কথা বলিনি আপনাকে?”

ইয়ামিন গাঢ় স্বরে বলল,” হ্যাঁ বলেছো। কিন্তু এখন সবকিছু বদলে গেছে উষসী। বিশ্বাস করো, আমি আর আগের মতো নেই। আমি সত্যি সত্যি তোমাকে ভালোবাসি। এতটুকু মিথ্যা বলছি না, ট্রাস্ট মি।”

উষসী থমকালো। যন্ত্রের মতো আওড়াল,” কিভাবে এতো বদলে গেল সবকিছু? কি এমন হয়েছে যে আপনি এতোবছরের আবেগ ভুলে হঠাৎ আমাকে ভালোবাসতে শুরু করলেন?”

উষসী শেষ প্রশ্নটা করল শ্লেষাত্মক ভঙ্গিতে৷ ইয়ামিন নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলল,” আমার এক্সিডেন্টের পর থেকেই সবকিছু বদলানো শুরু হয়েছে। ”

উষসী তাচ্ছিল্য হাসল,” এক্সিডেন্ট তো আরও একবছর আগের কথা। এতোগুলো দিন তো কখনও ভালোবাসার কথা বলেননি আপনি৷ তাহলে আজ কেন বলছেন?”

উষসী নিজের পেট খামচে ধরে শুধাল,” বাবুর জন্য? ভাবছেন আপনার সন্তান জন্ম দিচ্ছি বলে এখন আমাকে গ্রহণ করতে আপনি বাধ্য? চিন্তা করবেন না, ডিভোর্সের পরেও আপনার সন্তান আপনারই থাকবে। আমি এতো সেলফিশ না যে বাবার থেকে বাচ্চাকে আলাদা রাখব।”

ইয়ামিন কাতর হয়ে বলল,”আবারও ভুল ভাবছো তুমি আমাকে। তুমি যে আমার জন্য কতোটা ইম্পোর্ট্যান্ট তা আমি বুঝতে পেরেছি এক্সিডেন্টের পর থেকে। তবে ভালোবাসাটা অনুভব করিনি তখনও। কিন্তু ওই রাতের পর সব বদলে গেছে। আমি আরও গভীরভাবে জড়িয়ে গেছি তোমার সাথে। এখন কোনো অবস্থাতেই আর তোমাকে হারাতে পারব না।”

উষসী এবার ভ্রু কুঁচকালো,” রাতের পর থেকে মানে?”

” সেদিন রাতে তুমি কি করেছিলে মনে করে দেখো! কোনো নরাধমের পক্ষেও সম্ভব হতো না তোমাকে অগ্রাহ্য করা। আর আমি তো সাধারণ মানুষ। এতো ক্ষমতা আমার নেই। আমি প্রেমে পড়ে গেছি উষসী, তোমার ভালোবাসা আমাকে আটকে দিয়েছে।”

উষসীর মুখ লালচে হয়ে উঠল। খানিক বিব্রত হয়ে বলল,” আমি কিছু মনে করতে চাই না। ছাড়ুন আমাকে।”

” তোমাকে অবশ্যই মনে করতে হবে। নাহলে তুমি এখান থেকে যেতে পারবে না।”

” আমার ঠান্ডা লাগছে।” উষসী জোর করে কাশার ভং ধরল। ইয়ামিন উদ্বিগ্ন হয়ে তাকে পাজাকোলায় নিয়ে সুইমিংপুল থেকে পাড়ে উঠে এলো। আয়শা তাদের দু’জনকে একসাথে ঢুকতে দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলল,” ম্যাডাম, আপনি ফিরে এসেছেন? শুকুর আলহামদুলিল্লাহ! কিন্তু কি হয়েছে আপনাদের? ভিজে এই অবস্থা কিভাবে হলো? ”

ইয়ামিন আর উষসী কেউই কোনো উত্তর দিল না। নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে গেল তারা। উষসী ঠান্ডায় থরথর করে কাঁপছে। ইয়ামিন বারান্দা থেকে তোয়ালে এনে বলল,” বেশি শীত লাগলে তুমি শাড়িটা খুলে ফেলতে পারো। আমি কিছু মনে করব না।”

উষসী রাগী দৃষ্টিতে তাকাল। দুইহাত সামনে তাক করে বলল,” আমি কিন্তু ইউটিউব থেকে ক্যারাটে শিখেছি।”

ইয়ামিন আরও জোরে হেসে উঠল। উষসী চোখ বড় করে তাকাল,” মজা না, সত্যি বলছি। কাছে এলেই আপনাকে একদম কুপোকাত করে দিবো। দেখবেন?”

ইয়ামিন বলল,” তোমার চুল থেকে পানি পড়ছে। কাছে আসার অনুমতি দিলে মাথাটা মুছে দিতাম।”

উষসী আবার ধরা খেল নিজের বেশি বোঝার প্রতিভার কারণে। অস্বস্তিতে কাঁচুমাচু হয়ে গেল তার মুখ। ফট করে ইয়ামিনের হাত থেকে তোয়ালে কেঁড়ে নিয়ে বলল,” আমি নিজেই মুছতে পারি আমার মাথা। সেজন্য আপনাকে লাগবে না।”

সে তোয়ালে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলেই পেছন থেকে শাড়ির আঁচল টেনে ধরল ইয়ামিন। স্বয়ংক্রিয়ভাবে থেমে গেল উষসীর পা। চোখ দু’টো বিস্ময়ে গোল হয়ে গেল। ইয়ামিন এক-পা, দু’পা করে কাছে আসছে তা অনুভব করতেই গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেতে লাগল তার। বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। ইয়ামিন একটু ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলল,” এখন কি করবে? সেদিনের মতো কি আবার শাড়ি ছেড়েই পালাবে?”

অতীতের কথা মনে পড়তেই উষসীর কান গরম হয়ে উঠল। মুখমন্ডল লাল হয়ে গেল। সে কনুই দিয়ে ইয়ামিনের পেটে ধাক্কা মেরে দৌড়ে বের হয়ে গেল।

চলবে

আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-৩৬+৩৭

0

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৩৬
লিখা- Sidratul Muntaz

বাংলাদেশে ছাড়া আর কোথায় যাবে উষসী? গতরাতে আয়েশাকে সে ফ্লাইটের টিকিট কেটে দেওয়ার জন্য বলেছিল। তাই ইয়ামিন সবার আগে অনমকে এয়ারলাইন্সে খোঁজ নেওয়ার জন্য পাঠিয়েছে।

কিন্তু তার মনে কিঞ্চিৎ সন্দেহ, উষসী প্রীতমের কাছে চলে যায়নি তো? এমন যেন না হয়৷ তাহলে ইয়ামিন রাগের মাথায় কি করবে তা সে নিজেও কল্পনা করতে পারছে না। গাড়ি নিয়ে সে প্রীতমের ইউনিভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। এই সময় তো প্রীতমের ভার্সিটিতেই থাকার কথা। কিন্তু সেখানে তাকে না পাওয়া গেলে ইয়ামিন তার অ্যাপার্টমেন্টের ঠিকানাও বের করেছে। প্রয়োজনে সেখানে যাবে।

মনে মনে সে প্রার্থনা করল উষসীকে যেন কোনোভাবেই প্রীতমের অ্যাপার্টমেন্টে পাওয়া না যায়। তাহলে ইয়ামিন যতটা না রাগান্বিত হবে তার চেয়েও শতগুণ বেশি আঘাত পাবে মনে! মাঝপথে অনম ফোন করে জানাল,” স্যার, ম্যামের খোঁজ পাওয়া গেছে। উনি এয়ারপোর্টেই আছেন। আজ বিকাল পাঁচটার ফ্লাইটে বাংলাদেশে যাওয়ার টিকিট কেটেছেন। ”

ইয়ামিন সাথে সাথে ঘড়ি দেখল। সকাল সাড়ে নয়টা বাজে। বিকাল হতে এখনও অনেক দেরি। এটুকু সময় উষসী কি করবে? এয়ারপোর্টে বসে থাকবে না নিশ্চয়ই। সে কি প্রীতমের বাড়িতে যাবে?

ইয়ামিন গাড়ি ঘুরালো না। যেখানে যাচ্ছিল সেখানেই যেতে যেতে ফোনে অনমকে বলে দিল” ঠিকাছে। পুরো এয়ারপোর্ট তল্লাশী করো। উষসীকে খুঁজে পেলে আমাকে সাথে সাথে জানাবে।”

” স্যার আপনি কি আসছেন?”

” না। আমি অন্য জায়গায় খুঁজছি।”

” ওকে স্যার।”

ওয়েটিংরুমে বিষণ্ণচিত্তে বসে আছে উষসী। স্টারবাকসের একজন ওয়েট্রেস বলল,” ম্যাম, উইল ইউ টেক সাম কফি টু কীপ ইউরসেল্ফ এনার্জাইজড এন্ড এন্টারটেইন্ড?”

উষসী হাসল। টারমিনালে আরও অনেক মানুষ আছে। কাউকে কফি অফার করা হয়নি। উষসীকে করা হলো কেন? তাকে দেখতে কি সত্যি অনেক দূর্বল লাগছে? ফোনের স্ক্রিনে নিজের মুখটা একবার দেখল উষসী। সত্যি খুব শুকনো লাগছে দেখতে। সে দুইদিন ধরে সে প্রায় না খেয়েই আছে। যে-কোনো সময় মাথা ঘুরে পড়ে গেলে কি হবে?

উষসী বলল,” ওকে।”

ওয়েট্রেস তাকে যত্ন করে কফি বানিয়ে দিল। সেই কফিতে চুমুক দিতে না দিতেই বিষম খেতে হলো তাকে। অনমকে দেখতে পেয়ে কোনোমতে হাতের ব্যাগ রেখেই দৌড়ে পাবলিক বাথরুমের কোণায় গিয়ে চোখমুখ খিঁচে লুকিয়ে পড়ল৷

অনেক মানুষ যাওয়া-আসা করছে এখানে। উষসী খেয়াল করেনি, ম্যানস টয়লেট আর উইমেনস টয়লেট আলাদা। সে এসে দাঁড়িয়েছে ম্যানস টয়লেটের সামনে। এজন্যই এখানে এতো পুরুষ! একটা ছেলে যাওয়ার সময় তাকে টিজ করল। বিরক্ত লাগলেও উষসী এখান থেকে নড়তে পারল না।যেহেতু অনম এখানে আছে, তার মানে ইয়ামিনও আসবে। উষসী কিছুতেই ধরা পড়তে চায় না।

হঠাৎই চারদিক কেমন ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল। অসুস্থ শরীর নিয়ে না খেয়ে থাকা, বৃষ্টিতে ভেজা, দূর্বল শরীর উপেক্ষা করে বাড়ি থেকে বের হওয়া… সব মিলিয়ে মোটামুটি ধরাশায়ী অবস্থা হলো তার। মাথা ঘুরছে ঘূর্ণিপাকের মতো। শক্ত করে দেয়াল ধরে রাখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো উষসী। আরেকটু হলেই সে মাথা ঘুরে ধপাশ করে পড়ে যেতো।

একজোড়া সবল হাত তাকে আগলে ধরতেই দুইচোখ মেলে তাকাল সে। অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখল না। তবে উষসীর মাথা গিয়ে ঠেঁকেছে মানুষটির বুকে। সুপরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে উষসী বিস্মিত হলেও কিছু বলার মতো অবস্থা তার ছিল না। বেশি কিছু বুঝে ওঠার আগেই উষসী জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।

অনম একটা ব্যাগ আর ব্যাগের ভেতর ভিসা-পাসপোর্ট দেখেই বুঝতে পারল টারমিনালের আশেপাশে কোথাও উষসী আছে। সে খুব দ্রুত ইয়ামিনকে ফোন করে ব্যাপারটা জানাল। ইয়ামিনও প্রায় ঝড়ের গতিতে এয়ারপোর্টে হাজির হয়েছিল৷ কিন্তু পরে সম্পূর্ণ এয়ারপোর্ট তন্ন-তন্ন করে খোঁজার পরেও উষসীকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

গতরাতেও একবার মাথা ঘুরে পড়ে গেছিল উষসী। আজকে আবারও একই কান্ড হয়েছে। সে বুঝতে পারছে তার শরীরটা সত্যি খুব দূর্বল। এক গ্লাস ফলের শরবত তাকে খেতে দেওয়া হয়েছে। জ্ঞান ফেরার পর ডোনাকে দেখে উষসী নিজেকে এক মুহূর্ত সামলাতে পারল না৷ কাঁদতে কাঁদতে অস্থির হয়ে উঠল।

তৃষাণ ভেতরে এসে উষসীর মাথায় হাত রাখতেই কান্নার বেগ আরও বেড়ে গেল তার। সে অনুতপ্ত কণ্ঠে আওড়াল,” আই এম স্যরি তৃষাণ ভাইয়া। আমি জীবনে অনেক ভুল করেছি। তোমার কোনো কথা শুনিনি। তুমি সবসময় আমার ভালো চেয়েছিলে কিন্তু আমি তোমাকে কখনও বুঝিনি৷ তোমার অবাধ্য হয়েছি, তোমাকে কষ্ট দিয়েছি অথচ তুমি তো আমাকে ছোটবোনের মতো আগলে রাখতে। আমি কখনও বুঝিনি তোমাকে। এসবের শাস্তিই হয়তো এখন পাচ্ছি। প্লিজ, আমাকে মাফ করে দাও তুমি।”

তৃষাণ বলল,” এখন এসব কথা বলার সময় না। তাছাড়া অল্প বয়সে আমরা সবাই ভুল করি। আমার দায়িত্ব ছিল তোমার ভুল শুধরে দেওয়া। কিন্তু আমি সেটা করতে পারিনি। উল্টা আমি নিজেও ভুল করেছি… ইয়ামিনের মতো থার্ডক্লাস ছেলেকে বিশ্বাস করে ফেলেছি। ডন্ট ওরি, এবার সবকিছু ঠিক করে দিবো। ঠিক করতেই আমি এসেছি। এখন থেকে আমাদের উষু আর কাঁদবে না।”

উষসী অবাক হয়ে বলল,” আমি তো জিজ্ঞেস করতে ভুলেই গেছি। তোমরা হঠাৎ লস এঞ্জেলসে কিভাবে এলে? মানে তোমাদের কি এখানে আসার কথা ছিল? কই আমাকে জানাওনি তো?”

তৃষাণ হাসল। ডোনা উষসীর কাঁধ চেপে ধরে হাসিমুখে বলল,” বোকা মেয়ে, তোকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যেই তো আমরা সেই কবে থেকে প্ল্যান করছিলাম যে আসব। কিন্তু এখানে আসার পর নিজেরাই চমকে গেছি। এ কি অবস্থা হয়েছে মা তোর! আর একা একা এয়ারপোর্টে কি করছিলি? তোর সাথে তো কাউকে দেখলাম না। আজকে মাথা ঘুরে পড়ে কি অনর্থটাই না হতে যাচ্ছিল। ভাগিস সময় মতো তৃষাণ তোকে ধরেছে।”

উষসী স্মিত হেসে বলল,” তৃষাণ ভাইয়া আমাকে ধরেছিল তখন? হ্যাঁ মনে পড়েছে… কিন্তু তোমরা কিভাবে জানলে যে আমি এয়ারপোর্টে আছি?”

ডোনা এবার না হেসে পারল না,” বোকা মেয়ের কথা শোনো! আরে আমরা জানবো কিভাবে? আমরা তো এয়ারপোর্ট থেকে বের হচ্ছিলাম। তৃষান বাথরুমে ঢুকেছে বলে সবাই অপেক্ষা করছিলাম। তারপর হঠাৎ দেখি তোকে অচেতন অবস্থায় কোলে করে নিয়ে আসছে। দেখে তো তখনি আমার দুশ্চিন্তায় মাথা খারাপ হয়ে গেছে। হসপিটালেও নিতাম। কিন্তু উষ্ণতা বলল তুই না খেয়ে আছিস। এজন্য তোর শরীর দূর্বল। তাই বাড়িতে নিয়ে এসেছি।”

উষ্ণতার নাম শুনেই মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে উঠল উষসীর। সে যে না খেয়ে আছে, এটা উষ্ণতা জানল কি করে? পর মুহূর্তেই উষসীর মনে পড়ল ইয়ামিনের কথা। সে ছাড়া উষ্ণতাকে এসব জানানোর মতো আর কে আছে? মুহূর্তেই রাগে মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। প্রচন্ড ঘৃণা হলো নিজের জীবনের প্রতি। নিজের আশেপাশের মানুষগুলোর প্রতিও। উষসী প্রসঙ্গ বদলানোর উদ্দেশ্যে বলল,” আচ্ছা, এটা কার বাড়ি?”

তৃষাণ জবাব দিল, ” আমার ফ্রেন্ডের বাড়ি এটা। ও রাতে আসবে। তখন পরিচয় করিয়ে দিবো তোমাকে।”

“এখানে এলে এই বাড়িতেই থাকবে, আমার কাছে আসবে না। এটাই কি প্ল্যান ছিল তোমাদের?”

ডোনা বলল,” আরে নারে পাগলি। তৃষাণ আসলে ইয়ামিনের বাড়িতে যেতে চায়নি। তাই বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে বন্ধুর সাথে কন্টাক্ট করে এসেছে। কিন্তু তোর সঙ্গে তো আমরা অবশ্যই দেখা করতে যেতাম।”

উষসী এবার অভিমানী দৃষ্টিতে তৃষাণের দিকে তাকাল,” আমি জানি, ওই বাড়িতে থাকলে তৃষাণ ভাইয়া আমার সাথে জীবনেও দেখা করতে আসতো না। ঠিক বলেছি না আমি?”

তৃষাণ মলিন মুখে বলল,” ফরগেট ইট। সেরকম কিছু তো হয়নি। ভাগ্যে ছিল বলেই আমাদের এয়ারপোর্টে দেখা হয়ে গেছে। যা হয় ভালোর জন্যই হয়।”

উষসী তাচ্ছিল্য হাসল৷ কে বলেছে যা হয় ভালোর জন্য হয়? কই, উষসীর জীবনে তো কিছুই ভালোর জন্য হলো না! সে বিরস মুখে বলল,” তুমি দেখো ভাইয়া, আমি আর জীবনে কখনও ওই বাড়িতে ফিরবো না। কখনোই না।”

তৃষাণ শক্ত মুখে বলল,” আমি তোমাকে ফিরতে দিলেই না ফিরবে। তুমি আমাদের সাথে এবার সোজা বাংলাদেশে যাবে । আর কোনো কথা নয়।”

উষসী স্বস্তিভরা হাসি হাসল। তারপর দ্রুত মাথা নাড়ল। বলল,” আমি এখন থেকে তোমার কোনো কথা অমান্য করব না ভাইয়া, তুমি যেটা বলবে শুধু সেটাই শুনবো। প্রমিস করছি।”

তৃষাণ হালকা হেসে বলল,” গুড গার্ল। এখন কি খাবে বলো?”

” আচ্ছা, আমার ব্যাগটা কই?”

উষসী আশেপাশে ব্যাগ খুঁজতে শুরু করল। মোবাইলটা তার হাতেই আছে। কিন্তু ব্যাগটা কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ডোনা চমকে উঠে বলল,” তোর সাথে আবার ব্যাগ ছিল নাকি কোনো?”

” হ্যাঁ অবশ্যই ছিল। ব্যাগে আমার পাসপোর্ট, ভিসা সব আছে। এসব ছেড়ে আমি বাংলাদেশে যাবো কি করে?”

তৃষাণের কপালে ভাঁজ সৃষ্টি হলো। ঠোঁট উল্টে শ্রাগ করে বলল,” কোথায়? আমি তো তোমার সাথে কোনো ব্যাগ পেলাম না। ফোনটা শুধু তোমার হাতে ছিল।”

উষসী আফসোসে কপালে হাত ঠেঁকাল। অনমকে দেখে সে ব্যাগ রেখেই টারমিনাল থেকে উঠে এসেছিল। আতঙ্কগ্রস্ত কণ্ঠে বলল,” হায় আল্লাহ, আমার ব্যাগ মনে হয় এয়ারপোর্টেই পড়ে আছে।”

তৃষাণ তাকে শান্ত করতে বলল,” আচ্ছা, এতো টেনশনের কিছু নেই। ব্যাগ পাওয়া যাবে। তুমি আগে কিছু খেয়ে নাও। আমি ব্যাগ আনার ব্যবস্থা করছি।”

উষসীর খুব অস্থির লাগছে। ব্যাগটা অনমের হাতে চলে গেলে ঝামেলা হবে। ইয়ামিন যদি তাকে আটকানোর জন্য ভিসা-পাসপোর্ট লুকিয়ে রাখে তখন কি হবে? উষসী জানে না কেন এমন অবান্তর চিন্তা তার মাথায় আসছে।

হঠাৎ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল যুথি আর উষ্ণতা। উষসীর জ্ঞান ফিরতে দেখে যুথি দ্রুত এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরল,” আমার মা, কেমন আছিস মা? কতদিন পর তোকে দেখলাম। সুন্দর চেহারাটার একি হাল হয়েছে! আহারে… মা তুই নাকি খাওয়া-দাওয়া করিস না? কথায় কথায় নাকি জামাইয়ের সাথে রাগ করে ঘর থেকে বের হয়ে যাস? এগুলো কেমন কথা বলতো? তোর কিছু হয়ে গেলে আমরা কি করব? আমি তো মরেই যাবোরে মা।”

যুথি উষসীকে চেপে ধরে কপালে আর গালে চুমু দিতে লাগল। উষসী নির্বিকার। তার চোখ দু’টো থমকে আছে উষ্ণতার দিকে। উষ্ণতাও অবাক হয়ে অনেকদিন পর দেখছে একমাত্র আদরের, কলিজার টুকরো ছোটবোনকে। আগে কত প্রাণবন্ত আর মিষ্টি ছিল উষসীর মুখটা। এখন যেন খুব শুকিয়ে গেছে সে। চোখের নিচে গাঢ় কালির দাগ। গালে চোখের পানির ছাপ। মনে হয় যেন নিয়মিত কাঁদে। ধারালো সূচের মতো অপরাধবোধ হানা দিচ্ছে উষ্ণতার হৃদয়ে। আজ উষসীর এমন দূরাবস্থার জন্য সে দায়ী! এমন বিশ্রী অপরাধবোধ নিয়ে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক সহজ!

যুথি আর ডোনা উষসীর সাথে গল্প করছিল। উষ্ণতা ঘরের একপাশে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে কেবল। একটু পর ডোনা উঠে বাইরে গেল। তৃষাণ অনেক আগেই বের হয়েছিল উষসীর জন্য খাবার আনতে। যুথি মেয়েকে ধরে বসে আছে। এই মুহূর্তে ঘরে শুধু তারা তিনজন।

উষ্ণতা খুব সাহস করে একটু এগিয়ে গেল। উষসী যুথির কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে। উষ্ণতা আলতো হাতে উষসীর মাথাটা স্পর্শ করে বলল,” কেমন আছিস,বোন আমার?”

উষসী সাথে সাথে সরে বসল। উষ্ণতার মনে হলো কেউ তার ভেতরটা দুইহাতে দুমড়ে-মুচড়ে দিচ্ছে। এতো কষ্ট হলো…. যেন হৃদয় ছিঁড়ে গেল। তৃষাণ পিজ্জা আর কোক নিয়ে ঘরে ঢুকেছে। উষসী পিজ্জা খুব পছন্দ করে। তৃষাণকে জায়গা দিতে উষ্ণতা একটু পিছিয়ে দাঁড়াল। যুথি হাসিমুখে বলল,” দাও, আমার মেয়েকে আমি নিজের হাতে খাওয়াবো।”

কিন্তু উষসী জেদ ধরে বলল,” রাখো তো মা, আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।”

যুথি এই কথা শুনে ধমক দিল,” এই অবস্থায় খাবি না মানে? একটা চড় দিবো। খা চুপচাপ।”

তৃষাণ বলল,” এমমিতেই তোমার শরীর ভালো নেই। আরও না খেয়ে থাকা ঠিক হবে না। কষ্ট হলেও খেয়ে নাও উষসী।”

” প্লিজ ভাইয়া, আমি খাবো না এখন। আমার একদম ভালো লাগছে না।”

তৃষাণ আঁড়চোখে উষ্ণতার দিকে তাকাল। উষ্ণতা কেমন পিপাসা ভরা দৃষ্টি নিয়ে দেখছে তার বোনকে। তৃষাণ উষ্ণতার কাছে গিয়ে বিড়বিড় করে বলল,” যদি কিছু মনে না করো.. এখান থেকে চলে যাও উষ্ণ। তোমাকে দেখেই উষসী খেতে চাইছে না হয়তো। ওর খাওয়া হয়ে গেলে না হয় আবার এসো! এখন যাও প্লিজ?”

উষ্ণতা টলমল দৃষ্টিতে চাইল। হৃদয়টা পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে তার। গলার কাছে আটকে আছে সহস্র ব্যথা। মুখ দিয়ে কিছু বলতে পারল না। শুধু মাথা নেড়ে উচ্চারণ করল,” হুম।”

যার অর্থ সে চলে যাচ্ছে। উষসীর দিকে আরও একবার তাকিয়ে খুব ভারী একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে স্থান ত্যাগ করল উষ্ণতা। ঘরের বাইরে পা রাখতেই তার চোখ দু’টো ভরে এলো অশ্রুজলে। মুখ ভেঙে এলো কান্নায়।

চলবে

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৩৭
লিখা- Sidratul Muntaz

ঘরে ঢুকেই উষ্ণতা কান্নায় ভেঙে পড়ল। ফ্লোরে বসে মাথায় দুই হাত জড়িয়ে সে পাগলের মতো কাঁদতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ পর তৃষাণ এসে এই অবস্থা দেখে তাকে সামলানোর জন্য হাঁটু গেঁড়ে বসল। তার কাঁধে হাত রেখে বলল,” ইটস অলরাইট। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে, উষ্ণ। কাম ডাউন!”

উষ্ণতা অপরাধে কাতর হয়ে বলল,” আমি আমার বোনের জীবনটা নষ্ট করে দিলাম, তাই না তৃষাণ?”

” না, এরকম কিছু না।”

” হ্যাঁ। আমার জন্যই আজকে ওর এই অবস্থা। সবকিছু আমার জন্য হয়েছে। আমি ওর ভালো করতে গিয়ে সবচেয়ে বড় ক্ষতি করে ফেলেছি।”

তৃষাণ উষ্ণতার মাথাটা বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,” তুমি নিজেকে শুধু শুধু ব্লেইম করছো। এখানে তোমার কোনো দোষ ছিল না। উষু এটা একদিন ঠিক বুঝবে। তারপর নিজের ভুলের জন্য তোমার কাছে ক্ষমাও চাইবে, দেখো।

উষ্ণতা আফসোস করে বলল,” তোমার কথা আমার শোনা উচিৎ ছিল। আমি কেন শুনিনি সেদিন? কেন এতোবড় ভুল করলাম? কেন? হায় আল্লাহ, এখন আমার উষুর কি হবে? ওর জীবনটা তো শেষ হয়ে গেল।”

উষ্ণতা হাউমাউ করে কান্না শুরু করেছে। তৃষাণ তাকে সামলাতে পারছে না। ফোন বেজে উঠল। সেদিকে তাদের কারো কোনো হুশ নেই। একটু পর উষ্ণতা ধাতস্থ হয়ে বলল,” তোমার ফোন বাজছে, তৃষাণ।”

তৃষাণ বলল,” থাকুক। পরে ধরব।”

” জরুরী কিছুও তো হতে পারে। ধরে দেখো।”

উষ্ণতা চোখের জল মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ালো। হাসার ভাণ ধরে বলল,” আমি ফ্রেশ হতে বাথরুমে যাচ্ছি।”

তৃষাণ আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। উষ্ণতা বোঝানোর চেষ্টা করছে যে সে একদম ঠিকাছে। কিন্তু তৃষাণ জানে, বাথরুমে গিয়ে সে আবার কাঁদবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে তৃষাণ বারান্দায় গেল৷ ফোন রিসিভ করতেই ওই পাশ থেকে এয়ারপোর্ট টারমিনালের একজন রিসিপশনিস্ট ইংরেজিতে বলল,” আপনি কি শাহবাজ তৃষাণ বলছেন? ”

” জ্বী, কি দরকার?”

” ইয়ামিন ইব্রাহীমের ওয়াইফ কি আপনার কাছে আছে?”

এবার চোয়াল শক্ত হলো তৃষাণের। রাশভারী কণ্ঠে বলল,” হ্যাঁ আছে। ও আমার শালিকা। নিজের ইচ্ছায় ও আমার কাছে এসেছে এবং আমার কাছেই থাকবে। ”

এবার ওই পাশের কণ্ঠস্বর বদলে গেল। একজন ভদ্রলোক রূঢ় স্বরে বললেন,”কিন্তু এয়ারপোর্ট থেকে আপনি উনাকে অচেতন অবস্থায় উঠিয়ে নিয়ে গেছিলেন। সিসিটিবি ফুটেজ সেটাই বলছে। এখন লোকেশন ট্র্যাক করে পুলিশ ফোর্স আপনার বাড়িতে উপস্থিত হবে। ঝামেলা না করে লামিয়া ইমরোজ উষসীকে তার হাজব্যান্ডের কাছে তুলে দেওয়ার অনুরোধ করছি।”

” স্যরি, আমি আপনার অনুরোধ রাখতে পারলাম না।”

” তাহলে কিন্তু আমরা উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবো।”

” যা ইচ্ছা করুন। আই ডন্ট কেয়ার।”

” ওকে। আমরা আসছি।”

তৃষাণ ফোন রাখতেই দেখল পেছনে উষ্ণতা দাঁড়িয়ে আছে। সে ভ্রু কুঁচকে কৌতুহলপূর্ণ গলায় বলল,” কি ব্যাপার?”

তৃষাণ তাচ্ছিল্য গলায় উত্তর দিল,” ইয়ামিন আসছে তাও পুলিশ ফোর্স নিয়ে। আমরা নাকি উষসীকে অপহরণ করেছি।”

উষ্ণতা ক্ষেপে উঠল,” হোয়াট? ওর সাহস কিভাবে হলো এতোকিছুর পরেও…”

তৃষাণ তাকে থামিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বলল,” শান্ত হও, আমি আছি। ও কিছুই করতে পারবে না।”

উষ্ণতা কিড়মিড় করে বলল,” আমি আজ ওকে ছাড়ব না তৃষাণ। ও উষুর জীবনটা শেষ করে দিয়েছে। আমিও ওর জীবন শেষ করে দিবো।”

একটু পর তৃষ্ণা ঘরে ঢুকল। মা আর বাবাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখে সে ভ্রু কুঁচকালো,” কি হয়েছে বাবা?”

তৃষাণ বলল,” কিছু হয়নি বাবা। তুই কি কিছু বলবি?”

মায়ের চোখে পানি দেখে তৃষ্ণা প্রশ্ন করল,” তাহলে মা কাঁদছে কেন?”

উষ্ণতা চোখের পানি মুছে বলল,” কাঁদছি না। বল, কেন এসেছিস?”

” সিংগার… মানে ইয়ামিন আঙ্কেল এসেছে সাথে পুলিশ। তারা নাকি এন্টসকে এখান থেকে নিয়ে যেতে চায়। দাদুন বাবাকে ডাকতে বলল।”

তৃষাণ উষ্ণতার দিকে চাইল। উষ্ণতা রাগে অস্থির হয়ে বলল,” আমি দেখছি।”

তৃষাণ বাঁধা দিয়ে বলল,” না, তোমার যাওয়ার কোনো দরকার নেই। তুমি থাকো, আমি দেখে আসছি।”

উষ্ণতা তৃষাণের কথার তোয়াক্কা না করেই বের হয়ে গেল। তৃষ্ণা কিছু বুঝতে না পেরে আবার জিজ্ঞেস করল,” বাবা, মায়ের কি হয়েছে?”

তৃষাণ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” জানি নাহ।”

লিভিংরুমে ইয়ামিনকে বসে থাকতে দেখেই রক্ত উঠে গেল উষ্ণতার মাথায়। সে কাছে গিয়ে ইয়ামিনের কলার টেনে তাকে দাঁড় করাল,” তোমার সাহস কিভাবে হয় এখানে আসার? গেট আউট। আই স্যায়, গেট আউট।’

ধাক্কা মেরে ইয়ামিনকে একদম দরজার বাইরে পাঠিয়ে দিল উষ্ণতা। অফিসার বললেন,” বিহেভ ইউরসেল্ফ, এসব কি হচ্ছে?”

ইয়ামিন অনুনয় করে বলল,” প্লিজ, আমি উষসীর সাথে শুধু একবার দেখা করব।”

উষ্ণতা আক্রোশে কেঁপে উঠল,” উষসীর নামও তুমি উচ্চারণ করবে না, খবরদার। এতোকিছুর পরেও তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি। কোন মুখে এখানে এসেছো? আবার পুলিশও সাথে নিয়ে এসেছো? আমাদের সবাইকে এরেস্ট করাবে নাকি?”

ইয়ামিন বলল,” একদম না। শুধু উষসীর খোঁজ পাওয়ার জন্য আমি উনাদের সাথে এনেছি। এর বেশি কিছুই না।”

” তোমার কোনো কথা আমি বিশ্বাস করি না৷ বের হয়ে যাও এই বাড়ি থেকে।”

ইয়ামিন দুই পাশে মাথা নেড়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,” না। উষসীর সাথে দেখা না করে আমি কোথাও যাবো না।”

” উষসী আসবে না। ও তোমার সাথে দেখাও করবে না। ইজ ইট ক্লিয়ার?”

পুলিশ অফিসার বললেন,” সেটা তো আমরা মিসেস উষসীর থেকে শুনবো। ডাকুন উনাকে।”

” ডাকা যাবে না। আপনারা বের হোন।”

” এভাবে বললে তো আমরা যাবো না। ”

তৃষাণ বের হয়ে এলো,” তাহলে কিভাবে বললে যাবেন?”

ইয়ামিন বিনীত কণ্ঠে বলল,” ভাইয়া, প্লিজ। আমাকে উষসীর সাথে শুধু একবার দেখা করতে দিন। ও রাগ করে বাসা থেকে চলে এসেছে।”

” শাট আপ, ইউ ইডিয়ট! আমি যে এখনও তোমার নামে মামলা দেইনি সেটাই তোমার ভাগ্য। নাউ গেট লস্ট। ”

অফিসার রাগী স্বরে বললেন,” এটা কি ধরণের অভদ্রতা? কারো ওয়াইফকে আপনারা এভাবে আটকে রাখতে পারেন না৷ উনার হান্ড্রেড পারসেন্ট রাইট আছে মিসেস উষসীর সঙ্গে দেখা করার।”

তৃষাণ হাত ভাঁজ করে বলল,” আমরা কাউকে জোর করে আটকে রাখিনি৷ উষসী নিজেই আমাদের কাছে এসেছে। ও ইয়ামিনের সাথে আর থাকবে না। ওদের ডিভোর্স হবে।”

” সেটা আগে মিসেস উষসীকে নিজ মুখে স্বীকার করতে হবে। তাহলেই আমরা মানব। কিন্তু আপনি তো দেখাই করতে দিচ্ছেন না।”

উষ্ণতা ক্ষীপ্ত গলায় বলল,” আমার বোন এখন কারো সাথে দেখা করার অবস্থায় নেই। তাছাড়া ও তো ইয়ামিনের মুখও দেখতে চায় না।”

” তাহলে আমরা এখান থেকে যাচ্ছি না। আগে মিসেস উষসী আসবে… তারপর।”

ইয়ামিন বলল,” থাক স্যার, আপনারা চলে যান।”

অফিসার বললেন,” কেন মিস্টার ইয়ামিন? আমরা আপনার সঙ্গে থাকলে আপনার ওয়াইফকে উদ্ধার করা বেশি সহজ হবে।”

” কিন্তু ওরা আমার শ্বশুর বাড়ির মানুষ। এভাবে ফোর্স নিয়ে বসে থাকলে সেটা খারাপ দেখাবে। আপনারা এতোক্ষণ যা হেল্প করেছেন সেজন্য থ্যাঙ্কিউ। বাকি কাজ আমি নিজে করতে চাই।”

” ওকে, অল দ্যা বেস্ট।”

” থ্যাঙ্কিউ স্যার।”

পুলিশরা চলে যাওয়ার পর ইয়ামিন আর অনম গাড়ি নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করতে লাগল৷ প্রায় সন্ধ্যার দিকে জানালা খুলে উঁকি দিল উষসী। তাকে দেখতে পেয়েই ইয়ামিন হাসল, হাত নাড়ল। কিন্তু উষসী হাসল না। কোনোরকম প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে সে খট করে আবার জানালা আটকে দিল।

অনম বলল,” স্যার, ম্যাডাম মনে হয় বেশি রেগে আছেন। আমরা আবার কালকে আসলে কেমন হয়?”

ইয়ামিন গাঢ় স্বরে বলল,” আমি এখান থেকে কোথাও যাবো না।”

” কিন্তু স্যার, আপনি এখানে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন? অন্ধকার হতে যাচ্ছে।”

” তুমি চাইলে চলে যেতে পারো।”

” আমি আপনাকে রেখে কিভাবে চলে যাবো স্যার?”

সন্ধ্যায় তৃষাণ বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় ইয়ামিনকে দেখতে পেয়ে প্রচন্ড রেগে গেল।

” তুমি এখনও যাওনি? কি সমস্যা তোমার?”

” উষসী আমার স্ত্রী। ওকে রেখে আমি কোথাও যাবো না।”

তৃষাণের মাথা গরম হয়ে গেল এমন কথা শুনে। কটমটে দৃষ্টিতে বলল,” কি বললে? আরেকবার বলো!”

ইয়ামিন কাঠ কাঠ গলায় একই কথা আবারও আওড়াতেই তৃষাণ সর্বশক্তি দিয়ে তার মুখে ঘুষি মারল৷ অনম এই অবস্থা দেখে তেড়ে যেতে নিলেই তাকে থামাল ইয়ামিন,” সাবধান অনম, উনি উষসীর কাছে বড় ভাইয়ের চেয়েও বেশি।”

” কিন্তু স্যার… আপনাকে যে মারল?”

” সেটা আমি বুঝব। তোমাকে কিছু করতে বলিনি।”

” স্যরি স্যার।” অনম মাথা নিচু করে দূরে সরে দাঁড়াল।

তৃষাণ আরেকবার ইয়ামিনকে আঘাত করতে নিলেই উষ্ণতা বের হয়ে এলো,” প্লিজ তৃষাণ, স্টপ।”

” উষ্ণতা, ওকে চলে যেতে বলো প্লিজ। আমি ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলছি।” তৃষাণ মাথায় হাত রেখে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল।

উষ্ণতা অনুরোধ করে বলল,” ইয়ামিন, প্লিজ এখান থেকে চলে যাও। উষসী তোমার সাথে দেখা করতে চায় না এটা কেন বুঝতে পারছো না তুমি?”

ইয়ামিন আকুতি নিয়ে বলল,” আপনি বুঝিয়ে বললে ও নিশ্চয়ই দেখা করবে।”

এবার উষ্ণতারও ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেল। সে উচ্চস্বরে বলল,” সেই অবস্থা কি তুমি রেখেছো? উষসী এখন আর আগের মতো নেই। তোমার জন্যই ওর এই অবস্থা। তুমি না কথা দিয়েছিলে যে আমার বোনকে ভালো রাখবে? এই তোমার ভালো রাখা? কাঁদতে কাঁদতে ওর চোখের নিচে দাগ পড়ে গেছে। আগে যেই মেয়ে কথায় কথায় হাসতো তার মুখে এখন হাসির লেশমাত্র নেই। এমন অবস্থা করে দিয়েছো তুমি ওর। আগে যে বোন আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না এখন সে আমার সাথে কথা পর্যন্ত বলছে না। তোমার জন্য সব হয়েছে, তবুও কোন মুখে তুমি ওর সাথে দেখা করতে চাও? এতোকিছু করেও কি আঁশ মেটেনি তোমার?”

ইয়ামিন ব্যথা যুক্ত গলায় বলল,” এরকম হোক তা আমি কখনও চাইনি।”

” তাহলে কে চেয়েছে? বলো কে চেয়েছে?”

ইয়ামিন মাথা নিচু করে বলল,” সেদিন আপনাকে আর আমাকে একসাথে দেখেছিল উষসী। তারপর থেকেই ও সন্দেহ শুরু করে। আর আস্তে আস্তে সবকিছু জেনে ফেলে।”

” সেটা কি আমার দোষ? তুমি আমার ঘরে এসেছিলে। আমি তো ডাকিনি তোমাকে। কে বলেছিল আমার পায়ের কাছে এসে শুয়ে থাকতে? আমি বলেছিলাম?তোমার উচিৎ ছিল ওকে বোঝানোর। সেটা না করে তুমিও স্বীকার করলে যে তুমি আমাকে ভালোবাসো! অথচ আমি কখনও এসব চিন্তাও করতে পারিনি তোমাকে নিয়ে। তুমি আমার বোনের চোখে আমাকে নিচে নামিয়েছো। জঘন্য তুমি। এজন্য আমি তোমাকে কখনও মাফ করব না।”

” বিশ্বাস করুন, আমি উষসীকে আপনার নামে নেগেটিভ কিছুই বলিনি। সব দোষ আমার ছিল তা আমি স্বীকার করেছি। কিন্তু উষসী ভুল বুঝেছে।”

” আর একটাও মিথ্যা কথা বলবে না তুমি। তোমার জন্য সব হয়েছে, তুমি চেয়েছো বলেই ও সব জেনেছো। আমার বোনের জীবন শেষ করে দিয়েছো তুমি। তোমাকে আমি ছাড়ব না ইয়ামিন।”

উষ্ণতা ক্রোধে প্রায় উন্মাদ হয়ে উঠল। তৃষাণ তাকে জোর করে ধরে ভেতরে নিয়ে যেতে লাগল। বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। ইয়ামিন দাঁড়িয়ে আছে নির্বিকার ভঙ্গিতে। অনম গাড়িতে উঠতে উঠতে বলল,” স্যার, বাড়ি চলুন স্যার। প্লিজ স্যার।”

ইয়ামিন যন্ত্রের মতো বলল,” আমি কোথাও যাবো না অনম। তুমি যাও।”

” কিন্তু স্যার, বৃষ্টির মধ্যে আপনি রাস্তায় কিভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন? এরা তো আপনাকে ভেতরেও যেতে দিবে না।”

” আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না৷ তোমাকে যেতে বলেছি।”

অনম চুপচাপ বসে রইল গাড়িতেই। উষসী অন্ধকার ঘরে শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে বালিশ ভিজিয়ে ফেলেছে। বৃষ্টির শব্দ শুনে সে আরেকবার বাইরে উঁকি দিল। দেখল ইয়ামিন এখনও দাঁড়িয়ে আছে। অবলীলায় বৃষ্টিতে ভিজছে। উষসী বাধ্য হয়ে তাকে ফোন করল।

উষসীর ফোন দেখে ঠোঁটে হাসি ফুটল ইয়ামিনের। সাথে সাথে মোবাইল রিসিভ করল। উদগ্রীব কণ্ঠে বলল,” হ্যালো।”

ওই পাশ থেকে উষসীর বিরক্তি ঝরা কণ্ঠ শোনা গেল,” আপনি চাইছেনটা কি?”

” তোমাকে।” ইয়ামিনের সহজ স্বীকারোক্তি।

উষসীর কান্না পেলেও সে নিজেকে সামলে নিল। ইয়ামিনের ছলা-কলায় সে আর ভুলবে না। শক্ত গলায় বলল,” এখান থেকে চলে যান। ”

” তোমাকে না নিয়ে যাবো না।”

” বাড়াবাড়ি করবেন না। সব শেষ হয়ে গেছে। আমি আর জীবনে কখনও আপনার কাছে আসব না।”

” পারবে না।”

” মানে?”

ইয়ামিন আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বলল,” আমার কাছে না এসে তুমি থাকতেই পারবে না!”

” ও তাই নাকি? আপনার এটা মনে হয়? ঠিকাছে, আপনি থাকুন আপনার অন্ধবিশ্বাস নিয়ে। আমি রাখছি।”

উষসী ফোন রেখে দিল। কিন্তু সে বেশিক্ষণ থাকতে পারল না। ইয়ামিনের কথাকে সত্য প্রমাণ করে ঠিকই কিছুক্ষণ পর ছাতা হাতে নিচে নেমে এলো।

চলবে

আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-৩৪+৩৫

0

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৩৪
লিখা- Sidratul Muntaz

(বর্তমান)
চোখ খুলে উষসী অনুভব করল, আলোকিত ঘরের বিছানায় শুয়ে আছে সে। তার মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে অনবরত। আয়শা আর অনম তার মাথার কাছেই বকবক করছে। যদিও উষসী তাদের দেখতে পাচ্ছে না। মাথা তুলে আশেপাশে তাকানোর শক্তিটুকুও তার নেই। সে শুধু কথা শুনতে পাচ্ছে।

আয়শার কণ্ঠ প্রায় কাঁদো কাঁদো,” অনম ভাই, ম্যাডামের গা তো কিছুতেই ঠান্ডা হচ্ছে না। এতো পানি ঢাললাম। জ্বরে পুড়েই যাচ্ছে শরীর। স্যারকে আবার ফোন করেন না!”

অনম হতাশ কণ্ঠে আওড়াল,” স্যারকে রিচ করা যাচ্ছে না। আমি কি করতে পারি, বলো। ম্যাডাম যে অসুস্থ এই খবরটা অন্তত জানাতে পারলেও স্যার দু’মিনিটে বাড়িতে চলে আসতো। যেখানেই থাকুক। কিন্তু খবরটা তো স্যারকে জানাতেই পারছি না।”

” হায় আল্লাহ, এর মধ্যে যদি ম্যাডামের কিছু হয়ে যায়? আমরা কি করব?”

” কিছু হবে না, আল্লাহ ভরসা। এটা শুধু ঠান্ডা জ্বর। সিরিয়াস কিছু তো না।”

” আপনি ধরে দেখেন, ম্যাডামের শরীর শুধু গরম হচ্ছে…”

আয়শা থামল। সে খেয়াল করল আগের চেয়ে উষসীর শরীর এখন কিছুটা স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এসেছে। তাছাড়া উষসী চোখ মেলেও তাকিয়েছে। সে স্বস্তিভরা কণ্ঠে বলল,”আলহামদুলিল্লাহ। ম্যাডাম আপনি ভালো আছেন? ”

উষসী আয়শাকে ধরে উঠে বসতে চাইল। আয়শা তাকে সাবধানে আর ধীরে উঠিয়ে বসিয়ে দিল। তার ভেজা চুলে একটা তোয়ালে পেঁচিয়ে দিল।

নিজের গায়ের পোশাক দেখে দূর্বল গলায় প্রশ্ন করল উষসী,” আমার ড্রেস কে বদলেছে আয়শা? তুমি?”

” জ্বী ম্যাডাম, আপনি তো হুশেই ছিলেন না। ভেজা কাপড়ে ঠান্ডা লেগে যেতো।”

” ধন্যবাদ আয়শা, তোমাকে অনেক কষ্ট দিলাম।”

” ছি, কি বলেন ম্যাডাম… আপনার জন্য কষ্ট না করলে কার জন্য করব?”

” তোমাকে আগেও একবার বলেছিলাম….আমাকে ম্যাডাম ডাকবে না। আমি তোমার ম্যাডাম না।”

আয়শা একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেল। উষসী নিজেকে ম্যাডাম ডাকতে নিষেধ করে। এই বুঝে আয়শা কয়দিন আপামনি ডেকেছে। ইয়ামিন একদিন এটা শুনতে পেয়ে ধমক দিয়ে বলল,” আমি তোমার কে হই?”

আয়শা ক্ষীণ গলায় বলেছে,” স্যার, আপনি আমার স্যার।”

” তাহলে আমার বউ তোমার কি হবে?”

” ম্যাডাম হবে। ”

” আর কখনও যেন ‘আপা-টাপা’ না শুনি।”

তারপর থেকে আয়শা খুব সাবধানে চলে। অনম হঠাৎ বলল,” ইয়েস! স্যারের ফোন রিচ করতে পেরেছি। রিং হচ্ছে।”

আয়শা উজ্জ্বল মুখে বলল,” বলুন ম্যাডাম খুব অসুস্থ। স্যারকে দ্রুত বাড়ি আসতে বলুন।”

” না, খবরদার! ” উষসী সু-উচ্চ স্বরে নিষেধ করে দিল। গম্ভীর হয়ে বলল,” আমার অসুস্থতার ব্যাপারে কিছুই যেন উনি না জানে।”

আয়শা আর অনম একটা দোলাচলে পড়ে গেছে। ইয়ামিন নির্দেশ দিয়েছে উষসীর প্রতিটি ছোট ছোট পদক্ষেপও যেন তাকে জানানো হয়। উষসী একটু বাথরুমে গেলেও যেন ইয়ামিন বাইরে থেকে সেই খোঁজ পায়। অথচ উষসী বলেছে, সে ম-রে গেলেও যেন ইয়ামিনকে জানানো না হয়। বরং ইয়ামিন আসার আগেই যেন তাকে দাফন করে ফেলা হয়!

দুইজনের এমন বিপরীতধর্মী আদেশ পালন করতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে আয়শা আর অনম।

অনম অবশ্য উষসীর কথা শোনে না। ইয়ামিনকে সবকিছু জানায়। আয়শা মাঝে মাঝে উষসীর কথাই শোনে। কিন্তু বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলো সে অবশ্যই ইয়ামিনকে জানায়।

এবারের ব্যাপারটাও গুরুত্বপূর্ণ। আয়শা বলল,” প্লিজ ম্যাডাম, স্যার এই কথা না জানলে দ্রুত বাড়ি আসবেন না। আর আপনার অবস্থা তো ভালো নেই।”

উষসী ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল,”তোমাদের স্যার এলেই আমি ভালো হয়ে যাবো কে বলল? সে কি ডাক্তার? তার বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে হয়নি, সে ফিরবে না। আমার তাকে কিছু জানাতে ইচ্ছে করছে না। আমি জানাবো না, ব্যস। তার ইচ্ছের দাম আছে। আমার নিজের ইচ্ছের কি কোনো দাম নেই?”

অনম অসহায় দৃষ্টিতে আয়শার দিকে চাইল। আয়শার চোখমুখ আরও করুণ। স্বামী-স্ত্রীর এই মান-অভিমানের খেলায় তারা দু’জন পিষ্ট হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অনম সেটাই করল, যেটা তার কাছে সহজ মনে হলো। ঘর থেকে বের হয়ে ইয়ামিনকে ফোন করতে গেল সে।

আয়শা উষসীর পাশে বসে বলল,” কিছু খেয়ে নিন, ম্যাডাম। আপনি সারাদিন প্রায় না খেয়েই আছেন।”

উষসী ত্যক্ত গলায় বলল,” এই বাড়ির কোনো খাবারই আমার গলা দিয়ে নামবে না আয়শা। আমি পারব না খেতে। তুমি কি আমাকে একটা হেল্প করতে পারবে?”

” অবশ্যই পারব ম্যাডাম! হেল্প কেন বলছেন? অর্ডার করুন শুধু।”

উষসী মেঝের দিকে চেয়ে কঠিন স্বরে বলল,” আমাকে বাংলাদেশ ফ্লাইটের টিকিট কেটে দিতে হবে। কিন্তু ইয়ামিন যেন জানতে না পারে।”

আয়শা থতমত খেল। তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। উষসী তাকাতেই মাথা নিচু করে ফেলল আয়শা।

মৃদু হেসে উষসী বলল,” অর্ডার করতে বললে না? করলাম তো অর্ডার। আমি নাকি তোমার ম্যাডাম? তাহলে আমি যা বলব, সেটাই তোমার করা উচিৎ। কিন্তু তুমি পারবে না, তাই না? দিনশেষে তোমার স্যারের অনুমতি ছাড়া কিছুই করবে না তুমি। এই এতোবড় বাড়িতে আমার ন্যূনতন স্বাধীনতাও নেই। বন্দিনীর মতো পড়ে থাকতে হয় সারাক্ষণ। তাহলে কেন আমাকে ম্যাডাম-ম্যাডাম করো? এখানে তো আমার কোনো ইচ্ছার কদর করা হয় না। আমিও তোমাদের মতো বাধ্য হয়ে এই বাড়িতে আছি। পার্থক্য শুধু তোমাদের বেতন দিয়ে রাখা হয়েছে,আর আমাকে বেতন দেওয়া হয় না। বন্দী আমি।”

” এভাবে বলবেন না, ম্যাডাম৷ আপনি বন্দিনী কেন হবেন? স্যার আপনাকে অনেক ভালোবাসে বলেই…”

আয়শা তার কথা শেষ করতে পারল না। উষসী পাশের টেবিল থেকে ছোট্ট কাঁচের বাক্সটি নিয়ে ছুঁড়ে মারল। তীক্ষ্ণ শব্দে ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল জিনিসটি। রাগে উষসী মাথায় দুই হাত চেপে কাঁদতে শুরু করল। তার অসহ্য লাগছে পুরো পৃথিবী।

আয়শা তার কাঁধে হাত রেখে কিছু বলতে নিতেই শরীর ঝাঁকাল উষসী। ক্ষীপ্ত হয়ে বলল,” বের হয়ে যাও। খবরদার আমার সামনে আসবে না কেউ। গেট লস্ট।”

উষসী আয়শাকে ধাক্কা মারতে লাগল। আয়শা দ্রুত ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। উষসীর ফোন বাজল এমন সময়। সে রাগে ফোনটাও আছাড় মারতে নিয়েছিল। তখন প্রীতমের নাম্বার দেখে তার হাত থেমে গেল স্বয়ংক্রিয়ভাবে।

আচ্ছা, প্রীতম কি তাকে বাংলাদেশে যাওয়ার ব্যাপারে কিছু সাহায্য করতে পারবে? এই বাড়িতে সে আর একদম থাকতে পারছে না। তার শ্বাস অবরুদ্ধ হয়ে আসছে। উষসী ফোন রিসিভ করে বলল,” হ্যালো প্রীতম, কেমন আছিস? আমি তোর কথাই ভাবছিলাম।”

প্রীতম বিরস কণ্ঠে বলল,” আমার কথা কেন?”

” তোর সাথে আমার জরুরী দরকার আছে।”

” তোর সাথেও আমার জরুরী দরকার।”

” তাহলে তো ভালোই। দেখা করতে পারবি?”

” অসম্ভব, যা বলার আমি ফোনেই বলব। তারপর আমাদের যোগাযোগ না রাখাই ভালো।”

” মানে?” উষসী ভ্রু কুঁচকালো। উৎকণ্ঠিত হয়ে শুধাল,” এমন কথা কেন বলছিস? এই ভিনদেশে তুই ছাড়া আমার কে আছে যে আমাকে একটু সাহায্য করবে? তুই তো জানিস, আমার পরিবারের কেউ এখন আর আগের মতো নেই। তৃষাণ ভাইকেও সত্যিটা জানাতে পারছি না। আমি কি করব, কি বলব…”

প্রীতম খুব রূঢ় ভঙ্গিতে বলল,” ইয়ামিন তোকে জীবনেও ডিভোর্স দিবে না৷ এটা নিশ্চয়ই তুই ভালো করে জানিস? তাই এসব নাটকের কোনো মানে হয় না।”

” মানে… আমি কিছু বুঝলাম না। আমি আবার তোর সাথে নাটক করলাম কিভাবে?”

” আজ সকালে ইয়ামিন ভার্সিটিতে এসে আমাকে সবার সামনে ইনসাল্ট করে গেছে। বলেছে তোর আশেপাশে কখনও গেলে নাকি আমার ঠ্যাং ভেঙে ফেলবে।”

উষসী ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল,” কি আশ্চর্য! উনি যে এসব করেছেন তা তো আমি জানিও না৷ তুই আমাকে কেন এর জন্য ব্লেইম করছিস? আমি কি ওকে পাঠিয়েছি? ”

“শোন উষসী, আমি তোর হাতের পুতুল না যে বার-বার আমাকে নিয়ে খেলবি৷ তোর বিয়ের পর তোকে পাওয়ার আশা আমি ছেড়েই দিয়েছিলাম৷ খুব কষ্টে তোকে ভুলতে চেষ্টা করেছি। আমি কিভাবে নিজের সাথে লড়াই করে বেঁচে আছি সেটা শুধু আমি জানি। কিন্তু লস এঞ্জেলসে দেখা হওয়ার পর… তুই যখন বললি তুই ইয়ামিনকে ডিভোর্স দিবি তখন সত্যি বলতে দ্বিধা নেই যে আমার মনে আবারও আশা জেগেছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমি বোকামি করছি। ইয়ামিন তোকে জীবনেও ডিভোর্স দিবে না৷ তাই তুইও আমার ফিলিংস নিয়ে খেলা বন্ধ কর, প্লিজ। রাখছি।”

প্রীতম এক নিঃশ্বাসে সবকিছু বলে ফোন রেখে দিল। উষসী তার এহেন আচরণে বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। তার মাথা ভনভন করতে লাগল। সে কল্পনাও করেনি যে প্রীতম তাকে নিয়ে এখনও এসব চিন্তা করে!

নিজের বোকামি দেখে প্রচন্ড বিরক্ত হলো উষসী৷ এই প্রীতমকেই সে আবার বিশ্বাস করতে চেয়েছিল। ভেবেছিল বন্ধু হিসেবে নিজের এমন বিপদের দিনে অন্তত প্রীতমকে সে পাশে পাবে! অথচ প্রীতম কি-না তার কাছে এসেছিল শুধুই স্বার্থের জন্য!

আর যখনি সে বুঝতে পারল ইয়ামিন উষসীকে ছাড়বে না, তখন সে নিজেই উষসীর হাতটা ছেড়ে দিল। সে আসলে কখনোই উষসীকে বন্ধু ভাবতে পারেনি। আহারে…উষসী তার এক জীবনে যত মানুষকে বিশ্বাস করেছিল, সবাই তাকে ঠকিয়েছে! এমন ঠকে যাওয়ার জীবন কারো না হোক!

________________
উষসীর সাথে অভিমান করে সারাদিন বাইরে ছিল ইয়ামিন। স্ট্রিট বেঞ্চে রাত কাটাবে বলেও ঠিক করেছিল। তবুও সে বাড়ি ফিরবে না। কিন্তু অনমের ফোন পেয়ে যখন জানতে পারল উষসীর অবস্থা… তখন আর এক মুহূর্ত মন স্থির থাকল না। সে খুব দ্রুত বাড়ি ফিরল।

আয়শা আর অনম ড্রয়িংরুমে উদাস মুখে বসে আছে। ইয়ামিন ঢুকেই প্রশ্ন করল,” উষসী কোথায়?”

আয়শা দাঁড়িয়ে বলল,” স্যার, ম্যাডাম প্রচন্ড রেগে গেছে। একটু আগে ভাঙচুর করছিল।”

” হোয়াট? ও যে সারাদিন খায়নি এই কথা কেউ আমাকে জানালে না কেন?”

আয়শা ভয়ার্ত গলায় বলল,” আমি ভেবেছিলাম… অনম আপনাকে জানিয়েছে”

অনম বলল,” স্যার… আমি তো সারাদিন আপনাকে রিচ করতে পারিনি। আপনার ফোন বন্ধ ছিল।”

ইয়ামিনের ইচ্ছে করল নিজের ফোনটাই আছাড় মেরে ভেঙে ফেলতে। কখন ফোন সুইচড অফ হয়ে গেছিল তা সে টেরও পায়নি। যখন বুঝতে পেরেছে… তখন সাথে সাথেই ফোন খুলেছে। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে।

সব রাগ ভুলে ইয়ামিন উষসীর ঘরের সামনে গিয়ে খুব জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগল। অস্থিরচিত্তে বলতে লাগল,” আই এম স্যরি। সব ভুল আমার ছিল। তুমি যদি বলো মাফ চাইতে তাহলে চাইবো। একশোবার বললে একশোবার। তবুও দরজা খোলো উষসী, প্লিজ!”

অনম আর আয়শা হাঁ করে ইয়ামিনের দিকে চেয়ে আছে। তারা বিস্ময় নিয়ে দেখছে ইয়ামিনের উন্মত্ততা।

ইয়ামিন হালকা অস্বস্তিবোধ করল। বিরক্ত গলায় বলল,” তোমরা আমার পেছনে কেন এসেছো? আমি কি ডেকেছি কাউকে? যাও এখান থেকে। ”

অনম-আয়শা দ্রুত সরে গেল। ইয়ামিন উতলা হয়ে বলল,” প্লিজ, প্লিজ দরজা খোলো উষু।”

তারপর হঠাৎ ইয়ামিনের মনে পড়ল, এই ঘরের ডুপ্লিকেট চাবি তার পকেটেই আছে। সবসময় উষসী দরজা বন্ধ করে রাখে বলেই সে চাবির ব্যবস্থাটা করেছিল। কিন্তু দুশ্চিন্তায় ব্যাপারটা মনেও ছিল না। এবার মনে পড়ায় চাবি দিয়ে অনায়াসে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে পারল । কিন্তু উষসীকে বিছানায় পাওয়া গেল না৷ অসুস্থ অবস্থায় তো তার শুয়ে থাকার কথাই ছিল। মেয়েটা কোথায় গেল? বাথরুমেও তো নেই।

ত্রস্ত পায়ে বারান্দায় যেতেই মাথা নষ্ট হওয়ার মতো দৃশ্য দেখল ইয়ামিন। উষসী বারান্দায় অচেতনের মতো পড়ে আছে৷ দুই চোখের কার্ণিশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে অশ্রুধারা। তার শরীর এতোটাই দূর্বল যে নড়াচড়াও করতে পারছে না। এমন ঠান্ডার মধ্যে অসুস্থ শরীরটা নিয়ে বারান্দায় শুয়ে থাকার কি মানে?

ইয়ামিন দুইহাতে উষসীকে তুলে বিছানায় এলো। খুকখুক করে কেশে উঠল উষসী। সে চোখ মেলে না তাকিয়েই বিড়বিড় করে বলল,” আমাকে আপনার থেকে মুক্তি দিন, প্লিজ। প্রয়োজনে মৃ-ত্যু দিন। তবুও মুক্তি দিন। আমি আর এভাবে থাকতে পারছি না।”

ইয়ামিনও একইভাবে বিড়বিড় করে বলল,” এভাবে শাস্তি দেওয়ার চেয়ে ভালো আমাকে একেবারে মে-রে ফেলো তুমি।”

তারপর শুধুই নীরবতা। কেউই কোনো কথা বলল না। অথচ দু’জনেই কাঁদছে নিঃশব্দে।

চলবে

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৩৫
লিখা- Sidratul Muntaz
( অতীত)
বিয়ের সাতদিনের মাথায় ইয়ামিন বিদেশ চলে যায়। উষসীকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহুর্তে উষসী জানায়, সে যাবে না।

তার এমন সিদ্ধান্তে আজগর সাহেব এবং মিসেস শিমলা খুবই বিরক্ত হোন। শিমলা উষসীকে শাসন করে বললেন,” যাবে না মানে? অবশ্যই যেতে হবে। আমার ছেলে বিদেশে গিয়ে একা থাকবে নাকি? আর তুমি আমাদের বুড়ো-বুড়ির সাথে এখান থেকে করবে কি?”

উষসী হাসিমুখে বলল,” ভুল বুঝবেন না, আম্মু। আমি আসলে যেতাম। কিন্তু আমার সামনে সেমিস্টার ফাইনাল। এই অবস্থায় বিদেশে ঘুরতে গেলে তো চলবে না।”

আজগর সাহেব বললেন,” আরে, বোকা মেয়ে! তোমার এসব নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই। পড়াশুনার ব্যাপার তুমি আমাদের উপর ছেড়ে দাও। তোমরা আমেরিকায় সেটেল হলে সেখানকার ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে যেও। পড়ালেখা, ক্যারিয়ার যেটাই হোক, স্বামী-স্ত্রী আলাদা থাকা ভালো ব্যাপার নয়।”

উষসী অনুরোধ করে বলল,” কিছু মনে করবেন না বাবা প্লিজ! আমি এখানেই থাকতে চাই। পরিবারের সাথে আরও কিছুদিন সময় কাটাতে চাই। আমেরিকা চলে গেলে সবার সাথে আবার কবে না কবে দেখা হয় তার ঠিক নেই। এর চেয়ে ভালো গ্র্যাজুয়েশন শেষ হলেই বিদেশে যাওয়ার কথা ভাববো। ততদিন আমি আপনাদের সাথে আর আমার পরিবারের সাথে থাকবো।”

শিমলা আর আজগর কিছুতেই মানতে রাজি নয়। তাছাড়া বউকে রেখে ছেলেকে বিদেশ পাঠালে মানুষ কি বলবে? মানুষ ভাববে শেষ বয়সে বউয়ের সেবা-শুশ্রূষা পাওয়ার আশায় ছেলেকে বিয়ে করিয়েছে তারা। পুত্রবধূর নামে বাড়িতে আয়া আনা হয়েছে বাড়িতে। ইয়ামিন এতো জনপ্রিয় যে তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। এসব নিয়ে দেখা গেল নিউজও তৈরী হয়ে যাবে। আর পাবলিকও সেটা গিলবে।

তাছাড়াও পুত্রবধূ শ্বশুর-শাশুড়ীর সাথে থাকার ব্যাপারটা দৃষ্টিকটূ দেখায়। স্বামী যেখানে থাকবে স্ত্রীও সেখানেই থাকবে। এটাই তো নিয়ম।

উষসী নিয়মের ধার ধারল না। সে জেদ করে থেকেই গেল। আর ইয়ামিনও তাকে রেখে চলে গেল বিদেশে। ধীরে ধীরে শিমলা আর আজগর বুঝতে পারলেন… উষসী আর ইয়ামিনের সম্পর্ক ঠিক নেই। তারা এই বিষয়ে একদিন উষসীকে প্রশ্নও করেছেন।

উষসী খুব অস্বস্তিতে পড়ে যায় সেদিন৷ সত্যি কথা সে বলতে পারবে না। কিন্তু সত্যিটা সে জানে! বিয়ের আগে ইয়ামিন কাউকে ভালোবাসতো। সেই মেয়েটা কে তা আজও জানে না উষসী। কিন্তু এতোটুকু নিশ্চিত যে ইয়ামিন এখনও সেই মেয়েকেই ভালোবাসে! এজন্যই সব ভুলে উষসীকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে পারছে না। কখনও হয়তো পারবেও না।

খুব আশ্চর্যের বিষয়, বিয়ের পর থেকে উষসীর সাথে ইয়ামিনের ভালো করে কোনো কথাই হয়নি৷ অনেক বেশি প্রয়োজন না হলে ইয়ামিন তার ঘরেই আসতো না৷ রাতের বেলা অবশ্য আসতো। তাকে আসতে হতো। অন্য ঘরে ঘুমাতে গেলে হয়তো মা অথবা বাবার কাছে জবাবদিহি করতে হবে।

উষসী এই ব্যাপারটা বুঝতো বলেই আগ বাড়িয়ে ইয়ামিনের সাথে এই নিয়ে কিছু বলতে যায়নি। কিন্তু একদিন রাতে ইয়ামিন নিজে থেকেই উষসীর সাথে কথা বলতে এলো। হয়তো বিবেকের তাড়নায়।

ভারী অপরাধী স্বরে সে বলল,” আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছি। এভাবে বিয়েটা করা আমার উচিৎ হয়নি। আমি জীবনে কখনও নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করিনি। একমাত্র এই বিয়েটা ছাড়া।”

উষসীর মাথায় যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো তখন। সে হতবাক চিত্তে বলল,” ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করেছেন মানে? কেন করেছেন? আমি বলেছিলাম যে আমাকে বিয়ে করুন? আপনি বিয়ে না করলে কি আমি ম-রে যেতাম? একবারও কি বলেছিলাম এরকম? নাকি আপনার পায়ে ধরেছিলাম, বলুন! আপনার মা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আমাদের বাড়ি এসেছিলেন। তাহলে এখন আপনি এসব কি কথা বলছেন? ”

ইয়ামিন কুণ্ঠিত গলায় বলল,” কাম ডাউন। বাইরে থেকে কেউ শুনে ফেলবে।”

উষসীর তখন মাথার ঠিক নেই৷ রাগে সে অন্ধকার দেখছে চোখে- মুখে। চেঁচিয়ে বলল,” শুনলে শুনবে। বিয়ের রাত থেকে শুরু করে গত তিনদিন যাবৎ আমরা অপরিচিত মানুষের মতো আচরণ করছি। আপনি এমন ভাব করছেন যেন আমাকে জোর করে আপনার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ বিয়ের আগে আমি বার-বার আপনার মতামত জানতে চেয়েছিলাম। প্রত্যেকবার আপনি পজিটিভ রেসপন্স করেছেন। তাহলে এখন এসব কি? আমার জীবন নিয়ে ছেলে-খেলা করার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে?”

এতো কথা শুনে ইয়ামিনও চুপ থাকতে পারল না। দ্বিগুণ তেজ নিয়ে সেও বলে উঠল,” আমাকে এতো কথা বলার আগে ভেবে দেখো, বিয়ের আগে তুমি নিজে কি করেছিলে? সেদিন যে তোমাকে হসপিটালে নেওয়া হলো.. ঘুমের ঔষধ খেয়ে সুইসাইড করতে চেয়েছিলে তুমি। সেটা কি আমার জন্য না?”

উষসী বিব্রত হলো। ইয়ামিন উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে আসতে আসতে বলল,” ওই দিন মায়ের অসুস্থতার ব্যাপারে মিথ্যা বলে আমাকে রসুলপুর নেওয়ার প্ল্যানটা কি তোমার ছিল না? রাতে আমাকে চা দিতে আসার অযূহাতে আমার পাশে ঘুমিয়ে যেতে কি আমি বলেছিলাম তোমাকে? এটাও তোমার ভুল ছিল। এতোকিছু করার পরেও তুমি বলছো তোমার জীবন নিয়ে আমি ছেলে-খেলা করেছি? তাহলে তুমি নিজে কি করেছো? উল্টা আমার ক্যারিয়ারটা ব্লেন্ডার করেছো৷ এখন আমার লাইফ কনফিউশনে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তোমার জন্যই আজকে আমার এমন অবস্থা। নিজের বাড়িকেও জাহান্নাম মনে হয়। আমি শাস্তিপ্রাপ্ত আসামীর মতো এখানে আটকে আছি, তোমার সাথে। ট্রাস্ট মি, আমি আর পারছি না।”

একসাথে এতো বিষাক্ত কথা শুনে উষসী নির্বাক হয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ নিজেকে সামলে, চোখের জল মুছতে মুছতে সে বলল,” মানছি যে আমি ভুল করেছি। আপনাকে ভালোবাসা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। ”

ইয়ামিন আঙুল তুলে বলল,” আর আমার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল তোমাকে বিয়ে করা!”

উষসীর চোখ আবার ঝাপসা হয়ে উঠল। বাম চোখ থেকে অচিরেই গড়িয়ে পড়ল দু’ফোঁটা জল। ইয়ামিন সেটা লক্ষ্য করে নরম হলো কিছুটা। মেজাজ সামলে নিয়ে বলল,” স্যরি বাট… আই এম ফেড আপ।”

উষসী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” আমি আপনাকে বিয়ের জন্য জোর করিনি। আপনি চাইলেই এই বিয়ে ভেঙে দিতে পারতেন।”

” না, আমি পারতাম না। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি।”

উষসী এবার গর্জে উঠল,” আমার কষ্ট হলে আপনার কি? আমি মরে গেলেই বা আপনার কি? এতো মহান সাজতে আপনাকে কে বলেছে? দয়া দেখান আমার প্রতি? একটা অসহায় মেয়েকে বিয়ে করে মহাপুরুষ সাজতে চেয়েছিলেন নাকি?”

ইয়ামিন হৃদয়ের দহনে পুড়ছে। কিন্তু সত্যিটা সে কি করে বলবে? উষসীর কিছু হলে উষ্ণতা সহ্য করতে পারতো না। আর ইয়ামিন কোনো অবস্থাতেই উষ্ণতাকে কষ্ট দিতে পারতো না!

উষসী কাঁদতে কাঁদতে বলল,” এতোই যখন ফেড আপ আপনি, তাহলে আমাকে ডিভোর্স দিলেই পারেন। আমি জোর করে আপনার জীবনের সাথে জুড়ে থাকতে চাই না। কোনো অবস্থাতেই না!”

ইয়ামিন নির্বিকার চিত্তে বলল,” ডিভোর্স আমি তোমাকে দিতে পারব না। সেটা দুই পরিবারের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। তার চেয়ে ভালো উপায় আমরা আলাদা হয়ে যাই।”

” এর মানে?”

” আমি ক্যারিয়ারের কথা বলে বিদেশ চলে যাবো। আর তুমি পড়াশুনার দোহাই দিয়ে বাংলাদেশেই থাকবে। সিম্পল! কিছু বছর পর যখন সবাই আমাদের দূরত্ব মেনে নিতে শুরু করবে তখন আমরা একটা ফলস রিজন দেখিয়ে ডিভোর্স নিবো৷ এতো কারো কোনো অসুবিধাই হবে না। তুমি কি রাজি?”

উষসী মনে মনে বলল,” রাজি হওয়া ছাড়া আর কি কোনো উপায় রেখেছেন আপনি?”

মুখে বলল,” হ্যাঁ রাজি। আপনার মতো মানুষের সঙ্গে সারাজীবন থাকা আমার পক্ষেও সম্ভব না।”

ইয়ামিন বিদেশ যাওয়ার পরেও কিন্তু উষসী নিজের বাড়িতে ফিরে গেল না। এরপর শুরু হয়েছিল তার নতুন সংসার। মিসেস শিমলা আর আজগর সাহেবের সাথে তার খুব ভাব হয়ে গেল। উষসীর মনেই হয় না যে এই মানুষগুলোর সাথে মাত্র কিছুদিনের পরিচয়। মনে হয় যেন তারা কত আপন!

আট বছর বয়স থেকে বাবা ছিল না তার। আজগর সাহেবকে উষসী তাই বাবার চেয়েও বেশি যত্ন করতে লাগল।আর তিনি এতো ভালো মানুষ যে উষসীর নিজেকে প্রচন্ড ভাগ্যবতী মনে হয়। আর মিসেস শিমলা তো মায়ের মতোই মিষ্টি।

উষসী এমন এক বিবাহিত নারী যার জীবনে স্বামী ছাড়া সব আছে। সুখের কোনো কমতি নেই। কিন্তু সুখী হওয়ারও কারণ নেই।

এভাবেই কাটছিল সময়। দীর্ঘ এক বছর পর ইয়ামিন হঠাৎ দেশে ফিরল। উষসী ভেবেছিল এবার বুঝি সব ঠিক হয়ে যাবে। ইয়ামিন হয়তো নিজের ভুল বুঝতে পেরে উষসীর কাছে ক্ষমাও চাইবে। উষসী প্রথমে মানবে না। ইয়ামিনকে খুব শাস্তি দিবে। তারপর একদিন সেও সব মেনে নিবে। তাদের জীবনটায় কাল্পনিক রূপকথার মতো হ্যাপি এন্ডিং হবে।

অথচ উষসী জানতো না, বাস্তব জীবনে কখনোই হ্যাপি এন্ডিং হয় না। মানুষ যতদিন বেঁচে থাকে… দুঃখ তার চিরসঙ্গী হয়ে সবসময় পাশে থাকে। মাঝে মাঝে দমকা বাতাসের মতো জীবনে সুখ উঁকি দেয়। আবার তা মিলিয়ে যায়। উষসীর জীবনেও সুখ উঁকি দিয়ে আবার মিলিয়ে গিয়েছিল।

(বর্তমান)
রাতটা এভাবেই কাটল। উষসী বিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ল। ইয়ামিন তার হাত ধরে সারারাত বসে রইল। আলতো স্পর্শে উষসীর কপালে, নাকে চুমু দিল। একসময় তার চোখ লেগে আসায় সে নিজেও ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু এই ঘুমের জন্য যে এতোটা আফসোস করতে হবে তা কি সে জানতো? জানলে হয়তো কখনোই ঘুমাতো না।

সূর্যের তেজস্বী আলো চোখে লাগতেই ইয়ামিনের ঘুমটা ভেঙে যায়। বিছানায় এখনও উষসীর সুবাস লেগে আছে। আজকের সকালটা সত্যি সুন্দর। ইয়ামিন আড়মোড়া ভেঙে বিছানা থেকে নামল। উষসী এখানে নেই। পুরো রুমটা কেমন থমথম করছে। ইয়ামিন তার বুকের বামপাশে একটা হাহাকার টের পেল। কেমন অবিচ্ছিন্ন শূন্যতা ঘিরে ধরেছে যেন চারদিক থেকে। সকালে উঠেই মন বিষণ্ণ লাগার ব্যাপারটা কি ঠিক?

ইয়ামিন ভেবেছিল বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেই উষসীকে দেখবে। কিন্তু উষসী এখানেও নেই। মনটা কিঞ্চিৎ খারাপ হলো তার। নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে সে যখন ব্রেকফাস্ট করতে ডাইনিং টেবিলে এসেছে, তখনও সবকিছু নিশ্চুপ। ঘড়িতে সকাল আটটা বাজে। এই সময় তো আয়শার উঠে যাওয়ার কথা। সে আজ এতো সময় ধরে ঘুমাচ্ছে কেন? উষসীকেও দেখা যাচ্ছে না।

ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠল ইয়ামিনের মন। সে উষসীকে এদিক-ওদিক খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ খেয়াল করল স্টোর-রুম থেকে কারো গোঙানোর শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। অচিরেই ইয়ামিনের পা থেমে গেল। আশঙ্কায় বুক কাঁপল। সে ভেতরে ঢুকেই দেখল কালো কাপড়ে আয়শার মুখটা বাঁধা। সে নড়াচড়া করতে পারছে না। কারণ পুরো শরীর নাইলনের মোটা দড়ি দিয়ে চেয়ারের সাথে আবদ্ধ।

আতঙ্কে ইয়ামিনের ঘাম ছুটে গেল। আয়শার এই অবস্থা হলে উষসী কোথায়? সে দ্রুত হাতে আয়শার মুখের বাঁধন খুলল। আয়শা উৎপীড়িত গলায় বলল,” ম্যাডাম নেই স্যার। ম্যাডাম পালিয়েছে।”

ইয়ামিন বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। একটু পর চোখ-মুখ কুচকে উচ্চারণ করল,” হোয়াট?”

আয়শা ক্লান্ত স্বরে বলল,” সকালে ম্যাডামকে বের হওয়ার সময় দেখে ফেলেছিলাম আমি। অনেক চেষ্টা করেছি তাকে আটকানোর জন্য। চিৎকার করে আপনাকেও ডাকতেই নিয়েছিলাম। কিন্তু ম্যাডাম কান্নাকাটি করে আমাকে স্টোর-রুমে নিয়ে এসেছে। কিন্তু এখানে এনে যে আমাকে এভাবে বেঁধে রেখে চলে যাবে সেটা তো বুঝিনি।”

ইয়ামিন এখনও কথাটা বিশ্বাস করতে পারছে না। উষসী পালিয়েছে মানে? কোথায় পালাবে সে? আর কেনই বা পালাবে? তার ইচ্ছে করল পুরো বাড়ি তছনছ করে দিতে। উষসী এখানেই আছে। সে কোথাও যায়নি। এই ভেবে ইয়ামিন অগত্যাই সারাবাড়ি খোঁজাখুঁজি করল। আয়শা এই অবস্থা দেখে ঘরের এক কোণে বসে কাঁদতে লাগল। কারণ সে জানে… উষসী হয়তো আর কখনোই ফিরবে না। ফিরে আসার জন্য তো কেউ ছেড়ে যায় না।

যথারীতি উষসীকে কোথাও পাওয়া গেল না। কিন্তু টেবিলে পাওয়া গেল একটা ছোট্ট নোটবুক। উষসীর হাতের কিছু লেখা,”জীবনের গতিপথ পাল্টে যাওয়া আর মরিচীকায় ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হওয়া, উদ্দেশ্য হারিয়ে ব্যর্থ হওয়া তারপর নিজেকেও হারিয়ে ফেলা… এমন বিষাক্ত জীবন কারো না হোক!

আমি হেরে গেছি আমার কাছে। এখন আয়নায় তাকালে নিজেকে আর খুঁজে পাই না। হন্যি হয়ে খুঁজতে শুরু করি সেই অতীতের আত্ম সত্তাকে। অথচ খুঁজতে গিয়ে বারংবার হোঁচট খাই। অতীত আমাকে কটাক্ষ করে আর, আমি পথ হারিয়ে ফেলি।”

চলবে

আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-৩২+৩৩

0

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৩২
লিখা- Sidratul Muntaz

(বর্তমান)
সেদিন বিয়ের খুশিতে কত পাগলামিই না করেছিল উষসী। তৃষাণও কিভাবে যেন সব মেনে নিয়েছিল। উষসীর আনন্দের কোনো সীমা ছিল না। সেসব ভাবলে এখন নিজেকে বড্ড বোকা মনে হয়। ভীষণ আফসোস হয়। বিয়ের আগে যেই সময়টাকে শ্রেষ্ঠ বলে ভ্রম হয়েছিল… বিয়ের ঠিক পরের দিন থেকেই সেই ধারণা ভেঙে চুরচুর হয়ে যেতে লাগল। এখন আর উষসী স্বপ্ন দেখে না। ইয়ামিনের কথায় মনে আনন্দের উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়ে না।

তার জীবনে ইয়ামিন শুধুই একটা গিরগিটি। যে প্রতি মুহূর্তে রঙ বদলিয়েছে। যার প্রত্যেকটি পদক্ষেপ উষসীর জীবন তছনছ করে দিয়েছে!

উষসী এখন বড্ড ক্লান্ত। তার মনটাও ভাঙতে ভাঙতে পরিশ্রান্ত। এক চিলতে বিশ্বাসও অবশিষ্ট নেই সেখানে। হয়তো উষসী চাইলেও কখনও ইয়ামিনকে আগের মতো ভালোবাসতে পারবে না। তাদের সম্পর্কের সমীকরণ বড় জটিল রূপ ধারণ করেছে।

রাত এগারোটা বেজে পাঁচমিনিট। বাড়ি ফিরে ইয়ামিন আয়েশার কাছে প্রশ্ন করল,” উষসী কি করে, আয়শা? শুয়ে পড়েছে নাকি?”

আয়েশা মলিন মুখে বলল,” না স্যার। ম্যাম তো এতো তাড়াতাড়ি ঘুমায় না। কালরাতেও ঘুমায়নি।”

” কালকের কথা জানতে চাইনি। এখন কি করছে সেটা বলো। ”

” কে জানে? ম্যাডাম তো দরজাই খুলছে না। আর একটু আগে বড় ম্যাডাম ফোন করেছিল। আপনার সাথে কথা বলতে চান।”

ইয়ামিন ভুল করে মোবাইল বাড়িতেই ফেলে গেছিল। সেজন্যই হয়তো আয়েশা রিসিভ করেছে। এখন বাংলাদেশে নিশ্চয়ই সকাল! ইয়ামিন মোবাইল হাতে নিয়ে মাকে ফোন করল,” হ্যালো মম।”

ওই পাশ থেকে হুংকার ছাড়লেন শিমলা,” তুই নাকি আমার বউমার গায়ে হাত তুলেছিস? এই কথা কি সত্যি?”

ইয়ামিন অপ্রস্তুত হয়ে আয়েশার দিকে তাকাল। ভয়ে আয়েশা দ্রুত রান্নাঘরে চলে যাচ্ছে। ইয়ামিনের মেজাজ খারাপ হলো। এই মেয়ের পেটে একটা কথাও যদি থাকতো।

মিসেস শিমলা তেজ নিয়ে উচ্চারণ করলেন,” কথা বলছিস না কেন ? সত্যি হাত তুলেছিস?”

ইয়ামিন গম্ভীর স্বরে বলল,” রাগের মাথায় একটা চড় দিয়েছিলাম খালি। সাথে সাথে স্যরিও বলেছি।”

” মানে? স্যরি বললেই কি চড় মিথ্যা হয়ে গেল? কাউকে খু-ন করে যদি আমি বলি স্যরি তাহলে কি সে আবার জেগে উঠবে?”

” এখানে খু-নের প্রসঙ্গ আসছে কেন মম? আমি কি ওকে শাসন করতে পারি না?”

” এটা আবার কেমন শাসন? তুই আমার ছেলে হয়ে এমন বিশ্রী কাজ কিভাবে করলি? উষসীকে ফোন দে। আমি ভিডিওকল করছি। তুই আমার সামনে ওর পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবি। ”

” মানে?” ইয়ামিন বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ।

সে পায়ে ধরবে উষসীর! মগের মুল্লুক নাকি? তাছাড়া ছোটবেলায় একবার উষসীও তার গালে চড় মেরেছিল। সেই কথা অবশ্য কেউ জানে না। কই, সেজন্য তো উষসী কখনও ক্ষমা চায়নি! কিন্তু ইয়ামিন বাচ্চা মানুষ ভেবে নিজে থেকেই ক্ষমা করে দিয়েছিল। তার এই মহানুভবতার কথা কেউ কোনোদিন জানবে না।

তাছাড়া কাল যেটা ইয়ামিন করেছে সেটা ঠিকই করেছে। প্রীতমের সাথে যদি আরেকবার উষসী দেখা করে তাহলে এর চেয়েও ভয়ংকর কিছু হবে। ইয়ামিন প্রীতমের হাড়গোড় ভেঙে ফেলবে। প্রয়োজনে উষসীর হাতে-পায়ে শিকল পরিয়ে ঘরে বন্দী করে রাখবে।

শিমলা কড়া কণ্ঠে বললেন,” তুই যে অপরাধ করেছিস সেজন্য এটাও অনেক কম শাস্তি। আমার তো ইচ্ছে করছে এখনি লস এঞ্জলসে এসে তোর কান ধরে বউমা’র কাছে ক্ষমা চাওয়াই।”

” তোমার বউমা কি করেছে সেটা শুনলে তুমি আর এই কথা বলতে না।”

শিমলা শান্ত গলায় বললেন,” সে যা ইচ্ছা করুক, কিন্তু তুই ওর গায়ে হাত তুলবি কেন? তুই ধমকাতে পারিস, বোঝাতে পারিস, শাসন করতে পারিস, কিন্তু তাই বলে গায়ে হাত তুলবি?”

” আমি মানছি আমার ভুল হয়েছে। কিন্তু সেজন্য ক্ষমা চাওয়ার চান্সও তো তোমার বউমা দিচ্ছে না আমাকে। সারাদিন দরজা আটকে বসে আছে। কারো সাথে কথা বলছে না। খাওয়া-দাওয়াও করছে না।”

” একদম ঠিক করেছে। তোর সাথে এটাই হওয়া উচিৎ। ”

ইয়ামিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল,” কিন্তু এজন্য শাস্তি কে পাচ্ছে মম? কষ্ট তো ওরই হচ্ছে। এই অবস্থায় না খেয়ে থাকা কি ঠিক?”

” কোন অবস্থায়?”

” প্রেগন্যান্ট…” ইয়ামিন মুখ ফসকে কথাটা বলেই আফসোস করল। ওই পাশ থেকে মিসেস শিমলা তীব্র আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন,” কি বললি তুই? উষসী প্রেগন্যান্ট? সত্যি?”

ইয়ামিন লজ্জিত হলো। শিমলা খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন,” এতো দেরিতে এই কথা আমাকে জানতে হলো কেন?”

” আমি নিজেই জানতে পেরেছি কালরাতে।”

” আমি অনেক খুশি হয়েছি। অনেক এক্সাইটেড লাগছে আমার। শোন আমি কিন্তু এই সপ্তাহের মধ্যে ইউএসএ’তে আসব। বউমাকে জানিয়ে দে আমাকে এতোবড় সুসংবাদ দেওয়ার জন্য ওর স্পেশাল গিফট আছে। তুই কিন্তু বউমাকে একদম রাগাবি না। এখনি ওর রাগ ভাঙিয়ে ওকে খেতে বসা। ওর যত্নের যেন কোনো ত্রুটি না হয়। এই অবস্থায় তুই আবার ওর গায়েও হাত তুলেছিস। কি অসম্ভব ব্যাপার! আমার চিন্তা করতেই রাগ লাগছে। আর যদি কখনও আমি শুনেছি যে তুই ওর গায়ে হাত দিয়েছিস তাহলে তোর একদিন কি আমার…”

মিসেস শিমলা প্রায় আধঘণ্টা বকবক করে অবশেষে ফোন রাখলেন। মায়ের সাথে কথা শেষ করে ইয়ামিন একটা লম্বা দম ছাড়ল। যেন সে বড় কোনো ঝামেলা থেকে নিস্তার পেয়েছে।

উষসীর রুমের দরজায় ধাক্কা মা-রতেই খুলে গেল। হাত ভাঁজ করে ভারী মুখে বিছানায় বসে রয়েছে উষসী। ইয়ামিন খুব শান্তভাবে নিচু গলায় বলল,” মম ফোন করেছিল। মনে হয় এই সপ্তাহের মধ্যেই আসবে। তোমাকে জানাতে বলল।”

উষসী মনে মনে ভীষণ খুশি হলো। কতদিন পর শাশুড়ীর সাথে দেখা হবে তার! কিন্তু সেই খুশিটা সে প্রকাশ করল না। রূঢ় কণ্ঠে বলল,” তো এখন আমি কি করব? নাচবো?”

” মমকে তোমার গুড নিউজটা বলেছি। খুব খুশি হয়েছে মম।”

” কিন্তু আমি খুশি না। এটা আমার জন্য ব্যাড নিউজ। আর এই বাচ্চা তো আমি রাখব না। সে এসেছে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে।”

” ইচ্ছার বিরুদ্ধে ?”

উষসী ঝগড়ুটে হয়ে বলল,” হ্যাঁ অবশ্যই।”

ইয়ামিন চোখ ছোট করল। ঘুরে এসে বলল,” ব্যাক, তুমি কি সামহাউ এটা বলতে চাচ্ছো যে সেদিন তোমার কোনো কনসেন্ট ছিল না? আমি জোর করেছি?”

উষসী খানিক চুপসে গিয়ে বলল,” এতে কি কোনো সন্দেহ আছে? এটাই তো সত্যি!”

” আমার দিকে তাকিয়ে বলো, এটাই সত্যি?”ইয়ামিন এক ভ্রু উঁচু করে কটাক্ষ ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।

উষসী অন্যদিকে চেয়ে অপ্রতিভ স্বরে বলল,” তাকানোর কিছু নেই। এটাই সত্যি।”

ইয়ামিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মৃদু হাসল,” এতো কনফিডেন্টলি একটা মানুষ কিভাবে মিথ্যা বলতে পারে?”

উষসী জবাব দিল না। ইয়ামিন একটু সময় চুপ থেকে চিন্তিত গলায় বলল,” মম এখন সব জানে। বেবি না রাখলে মমকে কি বলবে?”

” যা সত্যি তাই বলব। আম্মুরও সব জানা উচিৎ।”

উষসীর কথায় ইয়ামিন বাকরুদ্ধ। চোখ বড় করে বলল,” মায়ের এসব জানা দরকার? সিরিয়াসলি? লজ্জা কি সব খেয়ে ফেলেছো? ”

“আমি কেন লজ্জা পাবো? আমি ভিক্টিম। আপনি হচ্ছেন ক্রিমিনাল। আমার সাথে যে অন্যায় করেছে লজ্জা তার পাওয়া উচিৎ।”

ইয়ামিন কিছুক্ষণ হা করে চেয়ে থেকে বলল,” তাহলে আমার সাথে যা অন্যায় হয়েছিল সেটাও আমার বলা উচিৎ।”

” মানে? আপনার সাথে আবার কবে অন্যায় হলো?”

” শুনতে চাও? তুমি আমাকে সেদিন কয়বার কিস করেছিলে সেটা..”

উষসী সাথে সাথে ইয়ামিনের মুখ চেপে ধরল। দরজার দিকে তাকিয়ে রাগী স্বরে বলল,”আয়েশা এসে শুনে ফেললে কি হবে? এতো জোরে কথা বলছেন কেন? আস্তে বললে কি আমি শুনতে পাই না?”

ইয়ামিন হাত সরিয়ে বলল,” না। সত্যি কথা জোরেই বলতে হয়। আর শুনলেও প্রবলেম কি? তোমার তো কোনো ভুল নেই। তুমি না ভিক্টিম?”

উষসীর মুখ লাল হয়ে এলো। কাঁচুমাচু গলায় বলল,”কিন্তু আপনার ভুল বেশি।”

” এখন আর সেটাকে ভুল মনে করি না আমি।”

” আমি মনে করি। আর সারাজীবন মনে করব। আরে আপনাকে বিয়ে করাটাই সবচেয়ে বড় ভুল ছিল আমার।”

ইয়ামিন গাঢ় স্বরে বলল,” আমরা ভুল করলেও ও নিষ্পাপ। এসবের জন্য ও কেন শাস্তি পাবে?”

সে আলতো করে উষসীর পেটের উপর হাত রাখল। রাগে ফুঁসে উঠল উষসী। হাত সরিয়ে বলল,” খবরদার,আপনি আমার বাবুকে ধরবেন না।”

” ও আমারও বাবু।”

” কিন্তু ও এখন ওর মায়ের পেটে আছে। তাই আপনি চাইলেই ওকে স্পর্শ করতে পারেন না।”

ইয়ামিন আর্দ্র কণ্ঠে বলল,” আমি চাইলে দু’জনকেই স্পর্শ করতে পারি। দু’জনেই আমার।”

উষসী অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো। হাত উঠিয়ে ঘুষি মারার ভঙ্গি করে বলল,” কি বললেন আরেকবার বলুন?”

ঘড়িতে ডং ডং করে ঘণ্টা বেজে উঠল হঠাৎ। ভয়ে চমকে তাকাল উষসী। ইয়ামিন ফিসফিস করে বলল,” লাউঞ্জরুমে এসো।”

এই কথা বলেই উঠে দাঁড়ালো সে। হাত বাড়ালো যাতে উষসী তার হাত ধরে উঠে আসতে পারে। কিন্তু উষসী উঠল না। ইয়ামিন হেসে বলল,” কোলে উঠতে চাইছো বললেই হয়।”

উষসী প্রতিক্রিয়া দেখানোর আগেই ইয়ামিন তাকে কোলে তুলে নিল।

উষসী কটমট করে বলল,” আমাকে নিচে রাখুন। নয়তো আপনার চুল ছিঁড়ে ফেলব।”

” তুমি কি চাও? আমাদের বাচ্চা পৃথিবীতে এসে বাবাকে টাকলু দেখুক?”

” একদম ফাজলামি করবেন না আমার সাথে…”

উষসীর কণ্ঠ স্বয়ংক্রিয়ভাবে থেমে গেল। লাউঞ্জরুম পুরোপুরি অন্ধকার। তারা প্রবেশ করতেই রঙিন আলো জ্বলে উঠল চারদিকে। দেয়ালের মাঝখানে উষসী আর ইয়ামিনের বিয়ের বিরাট একটা ছবি। সেই ছবিতে কত প্রাণবন্তভাবে হাসছে উষসী! অথচ ইয়ামিনের মুখ গম্ভীর। ছবিটি দেখেই কেমন স্মৃতিকাতরতায় বুঁদ হয়ে গেল উষসী। কত সুন্দর ছিল সেই সময়গুলো!

ইয়ামিন ফুড কার্টে করে কেক নিয়ে এসেছে। বড় বড় দু’টো ক্যান্ডেলস নিজের হাতে জ্বালল।

উষসী স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখছে। ইয়ামিন নরম কণ্ঠে বলল,” হ্যাপি টু ইয়ার এনিভার্সেরী, মাই কুইন।”

উষসী ভীষণ অবাক হয়ে গেল এবার। আজ তাদের এনিভার্সেরী নাকি? অথচ তার মনেও নেই!

উষসীর হাতে ছু*রি দিয়ে ইয়ামিন বলল,” তোমার মতো নিজের হাতে আমি কেক বানাতে পারিনি। কিন্তু কাস্টমাইজড অর্ডার করেছি। তোমার সবচেয়ে প্রিয় ফ্লেভার। খেয়ে দেখো।”

উষসী কোনো কথা বলছে না। তার বিস্ময় এখনও কাটেনি। ইয়ামিন অনুতপ্ত কণ্ঠে বলল,” আগে যা হয়েছে তার সবকিছুর জন্য আই এম এক্সট্রিমলি স্যরি।”

উষসী মুচকি হাসল। ইয়ামিন পেছন থেকে উষসীর ঘাড় জড়িয়ে ধরল। কপালে কপাল ঠেঁকিয়ে কাছে এসে বলল,”দুইবছর আগে ঠিক এই দিনে তুমি আমাকে একটা মেসেজ করেছিলে। মনে আছে? শর্ত ছিল সেই মেসেজটা যদি এনিভার্সেরীর দিনে দেখাতে পারি তাহলে সেদিন আমি যা চাইবো তাই পাবো।”

রুদ্ধ হয়ে এলো উষসীর নিঃশ্বাস। বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। মুহূর্তেই মনে পড়ে গেল গতবছরের অপমানের ঘটনা। সে এভাবেই কেক এনে ইয়ামিনকে উইশ করেছিল। অথচ ইয়ামিন তার বানানো কেক ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে বলেছিল, এসব এনিভার্সেরী পালন করা তার একদমই পছন্দ না।

এই ঘটনায় উষসীর ছোট্ট মন খুব আঘাত গ্রস্ত হয়েছিল। অথচ আজ ইয়ামিন নিজে থেকেই কেক নিয়ে উইশ করতে এসেছে। একবছরে কি কেউ সত্যি এতোটা বদলে যেতে পারে?

উষসী ধাক্কা মেরে ইয়ামিনকে সরিয়ে বলল,” পুরনো কথা আমার মনে নেই। আর মনে রাখতেও চাই না।”

ইয়ামিন আহত কণ্ঠে বলল,” আমি আমার ভুল স্বীকার করেছি। খুব বড় পারভার্ট আমি। আমাকে মাফ করে দাও… প্লিজ!”

উষসী কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে হঠাৎ ইয়ামিনের গালে একটা চড় মারল। আচমকা এহেন আচরণে ইয়ামিন কিংকর্তব্যবিমুঢ়।

উষসী কোমল গলায় বলল,” আই এম স্যরি… আমি আমার ভুল স্বীকার করছি। আমি খুব বড় ইডিয়েট। প্লিজ…আমাকে মাফ করে দিন। সবকিছু ভুলে যান। ”

ইয়ামিন স্থিরমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। এই মাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনাটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে তার। বিয়ের পর জীবনে এই প্রথমবার উষসী এমন আচরণ করল। যা ইয়ামিন কখনও আশা করেনি।

উষসী তাচ্ছিল্য হেসে বলল,” কি? পারবেন না, তাই না? মাত্র দুই সেকেন্ডের একটা চড় সাথে সাথে মাফ করা আপনার পক্ষে সম্ভব হলো না। অথচ দুইবছর ধরে যে আমার মনে আঘাত করে যাচ্ছেন আপনি? আমি কিভাবে একরাতেই সব ভুলে যাবো বলতে পারেন? ”

ইয়ামিন নিজেকে ধাতস্থ করল। কাছে এসে কাতর গলায় কিছু বলতে নিলেই উষসী সরে দাঁড়ালো। হাত দিয়ে বাঁধা প্রদান করে বলল,” আগের উষসী আর এখনের উষসীর মাঝে অনেক পার্থক্য, ইয়ামিন ইব্রাহীম। সেই সহজ-সরল বোকা মেয়েটি মরে গেছে। আপনি মেরে ফেলেছেন তাকে।”

ইয়ামিন জড়ানো গলায় বলল,” সবাই একটা সেকেন্ড চান্স ডিজার্ভ করে। অন্তত আজকের দিনে আমি তোমার খুশির জন্য কিছু করতে চাই, প্লিজ।”

” আমাকে একা থাকতে দিন। তাহলেই আমি খুশি হবো।”

এই কথা বলে সে ঘরে চলে যাচ্ছিল। ইয়ামিন ডাকল,”শোনো।”

উষসী থামল কিন্তু পেছনে তাকাল না। ইয়ামিন বলল,” তুমি কি আমার সাথে একবার বাইরে হাঁটতে যাবে? ”

উষসী শক্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করল,”না।”

_______________
সকালে উষসী যত্ন করে ইয়ামিনের জন্য ব্রেকফাস্ট বানাল। সব ইয়ামিনের পছন্দের খাবার। ঘুম থেকে উঠে ইয়ামিন টেবিলে গরম গরম খাবার সাজানো দেখে অবাক হয়। পরোটা, পায়েস, আলুর দম, মাংস কষা। খাবারের মেন্যু দেখে মায়ের রান্নার কথা মনে পড়ে খুব। বাংলাদেশে গেলে মা বেশিরভাগ এগুলোই রান্না করেন। উষসীও শাশুড়ীর থেকে শিখে নিয়েছে। যেন ইয়ামিন বিদেশে এসেও মায়ের হাতের রান্না মিস না করে।

ইয়ামিন খোশমেজাজে প্রশ্ন করল,” রান্না কে করেছে আয়েশা?”

আয়েশা হাসিমুখে উত্তর দিল,” এমন সুন্দর রান্না ম্যাডাম ছাড়া আর কে করবে স্যার? আজকে নাকি আপনাদের এনিভার্সেরী! হ্যাপি এনিভার্সেরী স্যার! আপনাদের বন্ধন চিরস্থায়ী হোক। আপনারা সারাজীবন হাসি-খুশি থাকেন এই কামনা করি”

এক পশলা শীতল বাতাস এসে যেন ছুঁয়ে গেল ইয়ামিনের মন। আজকের দিনটা এতো সুন্দর কেন? আকাশটা কি একটু বেশিই নীল লাগছে? বাতাসে যেন একটু বেশিই স্নিগ্ধতা। বাগানের গাছগুলোও বেশি সবুজ লাগছে। সবকিছু যেন আজ একটু বেশিই প্রাণবন্ত। ইয়ামিন বড় করে শ্বাস নিল। প্লেটে খাবার নিতে নিতে প্রশ্ন করল,” উষসী কোথায়?”

” ম্যাডাম গোসলে গেছে স্যার। আপনি খান।”

ইয়ামিন থেমে বলল,” থাক, ও এলে একসাথেই খাবো।”

” কিন্তু স্যার, ম্যাডাম বলেছে আপনাকে খেয়ে নিতে। তার আসতে দেরি হবে।”

” তাই? ওকে।”

ইয়ামিন পরোটা আর মাংস নিল। উষসী কি সত্যি নিজের হাতে এতোকিছু করেছে? বিশ্বাসই হচ্ছে না। কতদিন পর! পরম আবেশে খাবার মুখে দেওয়ার সাথে সাথেই ইয়ামিনের কান ঝাঁ করে উঠল। গিলতে পারল না সে।ঝালে ঝলসে উঠল চোখমুখ। চিৎকার করে বলল,” পানি, পানি…”

আয়শা দ্রুত পানি ঢেলে দিল। সেই পানি খেয়ে কিছুটা ধাতস্থ হলো ইয়ামিন। কিন্তু এতো ঝাল! মনে হচ্ছে যেন মুখ পুড়ে গেছে। জিহ্বা ঝলসে গেছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলছে। আয়শা তাড়াহুড়ো করে বলল,” একটু পায়েস খান স্যার। ঝালটা কম লাগবে।”

পায়েস মুখে দিয়ে ইয়ামিন আরও হতাশ হলো। চিনির জায়গায় লবণ দিয়ে ভর্তি করে রাখা হয়েছে। এই পায়েশ খাওয়ার চেয়ে বিষ খাওয়া অনেক ভালো।

আয়শা বলল,” স্যরি স্যার। আমি জানতাম না। এগুলো রাখুন। আমি এখনি আপনার জন্য অন্য কিছু বানিয়ে আনছি।”

ইয়ামিন গম্ভীর গলায় বলল,” লাগবে না।”

“কেন স্যার?”

” এমনি। তুমি যাও এখান থেকে। ”

আয়শা দাঁড়িয়েই রইল। ইয়ামিন চোখ বড় করে তাকাল,” যেতে বললাম না?”

এবার আয়শা মাথা নিচু করে চলে গেল। ইয়ামিন টেবিলে সাজানো খাবারগুলো দেখছে। উষসী সকাল থেকে সব রান্না করেছে। এতোদিন পর, এতো আগ্রহ নিয়ে সে ইয়ামিনের জন্য কিছু করেছে, তাদের এনিভার্সেরী উপলক্ষ্যে! অসুস্থ শরীর নিয়ে এতো রান্না করা তো চারটি খানিক কথা নয়। তবুও সে করেছে ইয়ামিনের খুশির জন্য! এগুলো ইয়ামিন কি করে ফেলে দিবে? উষসী নিশ্চয়ই ইচ্ছাকৃত বেশি মশলা মেশায়নি। ভুল তো হতেই পারে।

দেড়ঘণ্টা সময় নিয়ে উষসী শাওয়ার নিয়েছে।তার আজকে বেশ শান্তি লাগছে। এতোদিন গোসল করেও ফ্রেশ লাগতো না। কিন্তু আজ খুব ফ্রেশ লাগছে। আয়শা কফি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল। উষসী রিল্যাক্স হয়ে ইজিচেয়ারে বসেছে। ধোঁয়া ওঠা গরম কফিতে চুমুক দিল। তারপর আগ্রহভরা গলায় প্রশ্ন করল,” তোমার স্যার ব্রেকফাস্ট করেছে?”

আয়শা বিরস মুখে বলল,” করেছে ম্যাডাম।”

” কিছু বলেনি?”

” না। ”

উষসী চোখ প্রসারিত করে তাকাল,”আমি যা রান্না করেছি, সব দিয়েছো?”

” জ্বী দিয়েছি। স্যার সব খেয়েছেন।”

” সব খেয়ে ফেলেছে?” উষসীর বিস্ময় মাত্রা ছাড়ালো। এতো লবণ আর মরিচ মেশানো খাবার ইয়ামিন খেল কিভাবে? ওগুলো কি মুখে নেওয়া যায়?

” খাবারের টেস্ট সম্পর্কে কোনো অভিযোগ করেনি?”

আয়শা দুইপাশে মাথা নাড়ল,” না। খাবারে লবণ, মরিচ খুব বেশি হয়েছিল। স্যার ঝাল সহ্যই করতে পারেন না। তবুও জোর করে খেয়েছেন।”

” জোর করে খেয়েছে?” উষসী অবাক।

আয়শা বলল,” আপনি এতো কষ্ট করে রেঁধেছেন, এজন্য এই খাবার উনি ফেলতে দেননি। আমি এতো নিষেধ করলাম তাও শুনলেন না। একটু আগেই বমি করে ভাসিয়েছেন। তাও বলছেন সমস্যা নেই। ”

উষসী হতবিস্মিত! সে তো ইচ্ছে করেই ইয়ামিনকে শিক্ষা দিতে এভাবে রান্না করেছিল। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে একটু বেশিই হয়ে গেছে। এগুলো খেয়ে ইয়ামিনের শরীর খারাপ হোক… এটা সে চায়নি।

চলবে

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৩৩
লিখা- Sidratul Muntaz

বাইরে বৃষ্টি। ইয়ামিন এখনও বাড়ি ফেরেনি। উষসীর অবশ্য সেই খেয়াল নেই। সে ট্যারেসে দাঁড়িয়ে শহুরে বৃষ্টি উপভোগ করছে অন্যমনস্ক হয়ে। বাংলাদেশের সাথে এই বৃষ্টির অনেক তফাৎ। নিজের দেশের বৃষ্টির গন্ধ আলাদা, ছন্দ আলাদা, সৌন্দর্য্য আলাদা। এখানকার বৃষ্টিটা নিজস্ব লাগে না। সুন্দর, মসৃণ সড়কে বৃষ্টি স্নিগ্ধতা আনে ঠিক… কিন্তু মেঠোপথের সুপরিচিত গন্ধ পাওয়া যায় না। অবশ্য এই দেশের কোনোকিছুই উষসীর নিজস্ব লাগে না। যাকে একান্ত নিজস্ব মনে করার কথা ছিল, তাকেও না।

বিয়ের আগে উষসী ভাবতো তার নিজের মানুষটা হবে তার সবচেয়ে কাছের। সে হবে ওই মানুষটির হৃদয়ের একমাত্র রাণী! মানুষটি তাকে মন উজাড় করে ভালোবাসবে!

কিন্তু সব আশায় গুড়ে বালি। তার স্বপ্নের রাজমহল তৈরী হওয়ার আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে! একটা নিষ্ঠুর ধ্রুব সত্য এক নিমেষে ছাড়খাড় করে দিয়েছে উষসীর মন। এবার সে তিলে তিলে শেষ করছে প্রাণশূন্য দেহটাও।

যথেষ্ট রাত হয়েছে তখন। আয়েশা সারাবাড়ির কোথাও উষসীকে খুঁজে না পেয়ে ছাদে উঠল। বৃষ্টিতে ভিজে শাড়িটা গায়ের সাথে লেপ্টে আছে উষসীর। সে থরথর করে কাঁপছে ঠান্ডায়। তাও নিচে নামছে না।

আয়শা বলল,” ম্যাডাম, এতো রাতে বৃষ্টিতে ভেজা ঠিক নয়। নিচে নামুন।”

” আমি নামবো না আয়েশা। বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত আমি ভিজতেই থাকব। ”

উষসী কেমন যন্ত্রমানবীর মতো কথাটা বলল। সে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে ছাদের মাঝখানে। বৃষ্টির ফোঁটা তাকে স্পর্শ করলেও সে নির্বিকার! তার চোখ দুঁটো গাঢ় লাল। আবছা আলোয় আয়শা উষসীর লালচে চোখ দেখে ভয় পেয়ে গেল। এই অবস্থায় কি বৃষ্টিতে ভেজা ঠিক? তাও এমন অন্ধকারে? যদি জ্বর চলে আসে?

দুশ্চিন্তা হলেও উষসীকে শাসন করার অধিকার তাকে দেওয়া হয়নি। সে মিনমিন করে বলল,” স্যার যে সেই কখন বের হয়েছিলেন… এখনও তো ফিরলেন না ম্যাডাম।”

উষসী নিরুত্তর। ইয়ামিনের ফিরে আসা না আসায় তার এখন আর কিছু যায়-আসে না।

আয়েশা চিন্তিত স্বরে বলল,” স্যার তো অসুস্থ ছিলেন। এই অবস্থায় কোথায় উধাও হয়ে গেলেন, বলেন তো? আমার খুব টেনশন লাগছে।”

উষসী হাত দিয়ে ভেজা মুখটা মুছতে মুছতে সম্পূর্ণ নির্বিকারচিত্তেই বলল,” এতো টেনশনের কিছু নেই! তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো।”

” এভাবে কিভাবে শুয়ে পড়ব? স্যারকে ফোন করেছি। উনি ধরছেন না।যতক্ষণ না আসবেন… আমাকে তো জেগে বসেই থাকতে হবে।”

উষসী হাসল। তার মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি এলেই কেবল সে এমন করে হাসে। আয়শা উষসীকে হাসতে দেখে অবাক হলো। বহুদিন পর সে তার ম্যাডামকে এইভাবে হাসতে দেখছে।

উষসী কাছে এসে বলল,” এক কাজ করো।অনম ভাইকে আসতে বলো।”

” কেন ম্যাডাম? কোনো দরকার?”

” অবশ্যই। খুব জরুরী দরকার।”

আয়শা চলে যেতেই উষসী আজকে সকালের ঘটনাগুলোর স্মৃতিচারণ করতে লাগল।

ইয়ামিন অতিরিক্ত মশলা মেশানো খাবার খেয়ে বমি করে ভাসিয়ে দিয়েছে। উষসী ভদ্রতার খাতিরে তাকে দেখতে তার রুমে গেল। ইয়ামিন এতোদিন পর উষসীকে নিজের রুমে দেখে অবাক হলো এবং একই সাথে খুশিও। তড়াক করে শোয়া থেকে উঠে বসে নরম গলায় বলল,” হঠাৎ এইখানে?”

উষসী গম্ভীর স্বরে উচ্চারণ করল,” শরীর কেমন?”

” ভালো… মনে হয় অনেকদিন পর হেভি খাবার খাওয়ায় এসিডিটি হয়ে গেছে।”

” কে বলেছিল জোর করে খেতে? সব জায়গায় হিরোগিরি দেখাতে হয় না। এবার মজা বুঝুন।”

ইয়ামিন ভ্রু কুচকে বলল,”রান্না খুব ভালো ছিল। তাই বেশি খেয়ে ফেলেছি।”

উষসী কঠিনমুখে বলল,” আমাকে খুশি করার জন্য মিথ্যা বলার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি জানি রান্না কেমন হয়েছে। তাছাড়া আমি ইচ্ছে করেই ঝাল দিয়েছি, এক্সট্রা লবণ দিয়েছি যেন আপনার খেতে কষ্ট হয়। আমার ইচ্ছেটা আপনি পূরণ করেছেন। সব খাবার খেয়ে নিজের শাস্তি ভোগ করেছেন। সেজন্য ধন্যবাদ।”

ইয়ামিন হতবাক হয়ে বলল,” তুমি ইনটেনশনালি এটা করেছো?”

উষসী তাচ্ছিল্য হাসল,” অবশ্যই। আপনি কি মগা নাকি? ইচ্ছে করে কেউ পায়েসে চিনির জায়গায় লবণ দেয়! প্রয়োজনের অতিরিক্ত মরিচ কেউ রান্নায় মেশায়? এতোদিন ধরে রান্না করছি… কখনও দেখেছেন আমাকে ভুল করতে?”

ইয়ামিন সহজ গলায় বলল,” আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য তোমার এতো কষ্ট করার কোনো দরকার ছিল না। তোমার মন খারাপ দেখলে আমি এমনিই কষ্ট পাই।”

উষসী এবার হাসতে হাসতে অস্থির হয়ে উঠল। ইয়ামিন তার একহাত ধরে টেনে তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,” বিশ্বাস করো, তোমার চোখের পানি বুকের ঠিক এইখানে আঘাত করে।”

” তাই নাকি? আগে যখন আমি কাঁদতে কাঁদতে রাত্রী পার করতাম তখন তো আপনি ফিরেও তাকাতেন না। তখন বুঝি বধির ছিলেন? নাকি অন্ধ?”

ইয়ামিন পরাস্ত হলো। অতীত টেনে আনলেই তাকে নিশ্চুপ হয়ে যেতে হয়। সে অপরাধী। এটা সে কখনও অস্বীকার করেনি। কিন্তু প্রায়শ্চিত্তের কি কোনো উপায় নেই?

উষসী নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল এবং কটমট দৃষ্টিতে তিরস্কার মিশিয়ে বলল,” আপনাকে আমি কতটা ঘৃণা করি তা আপনি এখনও কল্পনাও করতে পারছেন না।”

” আমি বিশ্বাস করলাম না। তুমি আমাকে আগে যেমন ভালোবাসতে… এখনও তেমনি বাসো।”

” আপনার ভুল ধারণা। কল্পনার জগৎ থেকে বের হয়ে আসুন। বাস্তবতা খুব তিক্ত।”

ইয়ামিন তার টি-শার্ট খুলে ফেলল। এই অবস্থা দেখে উষসী দ্রুত অন্যদিকে ঘুরে তাকাল। ইয়ামিন হেসে বলল,” আমাকে দেখলে তোমার চোখ খসে পড়বে না।”

উষসী বিড়বিড় করে বলল,” আমি দেখতে চাই না তাকে, যে কখনও আমার ছিলই না।”

ইয়ামিন আলমারি থেকে ইস্ত্রি করা শার্ট বের করল। খুব আলগোছে শার্টের সবচেয়ে সামনের বোতামটা ছিঁড়ে পকেটে রাখল। তারপর সেই শার্ট পরতে পরতে হঠাৎ বলল,”যদি প্রমাণ করতে পারি, তুমি এখনও আমাকে ভালোবাসো তাহলে আমি কি পাবো?”

উষসী থতমত খেয়ে তাকাল,” মানে? কিভাবে প্রমাণ করবেন?”

ইয়ামিন বোতাম লাগাতে লাগাতে বলল,” ওহ শিট, শার্টের একটা বাটন খুলে গেছে। উষসী, প্লিজ হেল্প মি।”

উষসী দুই কদম পিছিয়ে রুক্ষ গলায় বলল,”আশ্চর্য! আয়েশাকে বলুন। এটা আমার কাজ না।”

ইয়ামিন এক ভ্রু উঁচু করে তাকাল। ঠাট্টার স্বরে বলল,” ও। তাহলে কি এটা আয়েশার কাজ? সে বেডরুমে এসে আমার শার্টের বোতাম লাগিয়ে দিবে?”

উষসী আমতা-আমতা করে বলল,” তাহলে অনম কিসের জন্য আছে? তাকে ডাকুন।”

” অনম? সে সুই ধাগা দিয়ে বোতাম সেলাই করবে? সিরিয়াসলি?”

উষসী হাত ভাঁজ করে বলল,” আপনার কি শুধু একটাই শার্ট? অন্যটা পরুন।”

” ছোট্ট একটা কাজ। এমন করছো কেন? সব কাজ সবাইকে দিয়ে হয় না, উষু। কিছু কাজের জন্য শুধু তোমাকেই লাগবে।”

ইয়ামিন দুই কদম এগিয়ে এলো। উষসী আরও পিছিয়ে গেল। সুই আর সুতার বাক্সটা ঠিক উষসীর সামনে রাখল ইয়ামিন।

দ্বিধায় পড়ে গেল উষসী। কিছু একটা চিন্তা করে বলল,” আপনার শার্ট খুলে দিয়ে দিন। আমি ঘর থেকে সেলাই করে আনছি।”

ইয়ামিন ঘড়ির দিকে চেয়ে বলল,” অনেক লেইট হয়ে গেছে অলরেডি। আমাকে পাঁচমিনিটে বের হতে হবে। যা করার দ্রুত করো।”

উষসী রেগে তাকাল। রূঢ় ভঙ্গিতে বলল,” এতো লেইট হলে নিজের কাজ নিজে করুন। আমি পারব না।”

এই বলে সে দরজার দিকে পা বাড়াল। ইয়ামিন দ্রুত সুইটা হাতে নিয়েই জোরে শব্দ করে বলল,” আউচ।”

উষসী থেমে গেল,” কি হয়েছে?”

” হাতে সুই ফুটল মনে হয়। ব্যাপার না।”

উষসী প্রায় তেড়ে এলো। ইয়ামিনের হাত ধরে ব্যাকুল হয়ে বলল,” ঢেড়স একটা! সামান্য সুই পর্যন্ত ধরতে পারেন না। কিভাবে এতো সহজে আঙুলে সুই ফুটে যায়? দেখি রক্ত বের হচ্ছে কি-না?”

ইয়ামিন হাসল। উষসী খুব বিরক্ত হওয়ার ভং ধরছে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে অস্থির! যেন সুই ইয়ামিনের আঙুলে ফুটেনি, ফুটেছে উষসীর হৃদয়ে।

উষসী ইয়ামিনের হাসি দেখে নিজেকে দ্রুত সামলানোর চেষ্টা করল। তাকে এতো উতলা হওয়া মানায় না এখন আর। কড়া গলায় সে বলল,” দিন সিলিয়ে দিচ্ছি। আমি অকৃতজ্ঞ না। শত হলেও আপনার বাড়িতে থাকছি, আপনার খাচ্ছি… তাই আপনার কাজ তো করতেই হবে।”

মুহূর্তেই ইয়ামিনের মুখের রঙ বদলে গেল। উষসীর হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল,” এসব কি ধরণের কথা আবার? এজন্য আমি তোমাকে দিয়ে কাজ করাচ্ছি?”

উষসী হাত ছাড়িয়ে বোতাম সেলাই করতে করতে বলল,” সত্যি কথাই তো।”

” ফালতু কথা। আর কখনও বলবে না।”

” কেন বলব না? আপনি আমার দায়িত্ব নিয়েছেন। আপনার জন্যই আমি ম্যারিকায় এমন গ্ল্যামারাস লাইফ লীড করতে পারছি। পৃথিবীতে ইয়ামিন ইব্রাহীমের স্ত্রী হিসেবে সবাই এখন আমাকে চিনে। এইসবের বিনিময়ে হলেও আমার উচিৎ আপনার আদেশ মেনে চলা। তাই নয় কি?”

” উষসী, স্টপ।”

” যদি স্টপ না করি?”

উষসী দেখল ইয়ামিনের চোখমুখ লাল হয়ে উঠছে। সে আচম্বিতে উষসীর মাথার পেছনের চুল চেপে ধরল। তারপর গভীরভাবে তার ঠোঁট স্পর্শ করল। উষসী হতচকিত! তার হাত ইয়ামিনের বুকের মধ্যে দেবে গেল। সুইয়ের খোঁচায় রক্তাক্ত হতে লাগল ইয়ামিনের শক্ত বুক। তবুও সে নির্বিকার। গাঢ় আবেশে অমৃত সুধা পান করতে ব্যস্ত। উষসীর চোখে অশ্রু জমে উঠল।

” ম্যাডাম, ডেকেছেন?”

অনম ট্যারেসের সামনে এসে দাঁড়াতেই ভাবনার ঘোর কাটল উষসীর। সে মাথায় হাত রাখতেই অনুভব করল, তার মাথাটা ঘুরছে। প্রচন্ড মাথাব্যথা হচ্ছে। সকালে তাদের মধ্যে খুব বাজে একটা ঝগড়া হয়ে গেছিল। তারপর ইয়ামিন ঘর থেকে বের হয়ে গেছে। এখনও ফেরেনি। উষসী বৃষ্টিতে ভিজছে কেবল নিজের দুঃখ লুকানোর চেষ্টায়। বৃষ্টির পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে কাঁদলে কেউ আর তার চোখের পানি দেখবে না!

উষসী অনমের উদ্দেশ্য কিছু বলতে নিচ্ছিল। কিন্তু তার গলা দিয়ে শব্দ আসছে না। শরীর কেমন দূর্বল লাগছে। হঠাৎ উষসী মাথা ঘুরে পড়ে গেল মেঝেতে। অনম আর আয়েশা দৌড়ে এলো।

(অতীত)

বিয়ের কার্যক্রম শেষ করে ইয়ামিন ছাদে চলে গেল। তার দমবন্ধকর কষ্টটা আবার হচ্ছে। সারাজীবন অভিনয় করে কাটানো কি সম্ভব? ইয়ামিন যদি ক্লান্ত হয়ে যায়? তার জীবনটা বিরাট এক নাট্যশালা হয়ে যায়নি তো? যেখানে তার কাজ শুধু ভালোবাসার অভিনয় করে যাওয়া!

উষসীর হঠাৎ মনে হলো, আজ তাদের বিয়ের দিন। অথচ একবারও সে ইয়ামিনের মুখে হাসি দেখেনি। দেখেছে শুধু অস্থিরতা আর দুশ্চিন্তা! পালকিতে উষসী একাই বসেছিল। তার মনটা হঠাৎ বিষণ্ণ হয়ে উঠল। পালকির দরজা এতটুকু ফাঁক করতেই সে দেখল আঁধার রাত। তখনও উষসী জানতো না, নিজের জীবনটা নিয়ে সেও কোনো আঁধার-মিনারেই ডুব দিচ্ছে!

শ্বশুর বাড়ি পৌঁছাতেই উষসী চমক খেল। বিশাল বাড়িটি মরিচ বাতি আর ফুল দিয়ে এমনভাবে সজ্জিত যেন রাজপ্রাসাদ! দুইপাশে ব্যান্ড পার্টি সানাই বাজিয়েই চলেছে। ছেলে-মেয়েরা ফুল হাতে দাঁড়ানো। পালকি থেকে উষসী নামতেই অজস্র সাংবাদিক, ক্যামেরা, লাইট নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। গার্ড দিয়ে তাদের সরানো হচ্ছিল। যারা ফুল নিয়ে দাঁড়িয়েছিল তারা ফুল ছিটিয়ে উষসীকে স্বাগতম জানাতে লাগল। উষসীর এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো এটা আসলেই কোনো রাজপ্রাসাদ। আর সে হচ্ছে রাণী! এই রাজ্যের যুবরাণী হিসেবে বুঝি তার অভিষেক হচ্ছে আজ।

সারাদিনের ধকল শেষ করে রুমে আসতে খুব রাত হয়ে গেল। বিবাহিত জীবনের সূচনা পর্বের সবচেয়ে বিশেষ সময় এটা। উষসী ধীর পায়ে ইয়ামিনের বেডরুমে ঢুকল। ভাগ্যিস ইয়ামিন এই মুহুর্তে এখানে নেই। নয়তো উষসী বিছানায় বসতেও ইতস্তত বোধ করতো।

সে এখন রিল্যাক্সে বিছানায় বসল। চোখ ঘুমে জড়িয়ে এলেও বুকের ভেতরটা খুব দুরুদুরু করছে। এই বিশেষ রাতটি নিয়ে একসময় অনেক জল্পনা-কল্পনা এঁকেছিল সে। যে মানুষটিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতো তার সাথেই তো বিয়ে হলো। তবুও উষসীর কেন মনে হচ্ছে যে কিছু একটা নেই?

কেন মনে হচ্ছে যে তার বাসর রাত আর পাঁচটা সাধারণ বাসর রাতের মতো হবে না! স্বপ্নের মতো তো একদমই নয়। বিয়েটা যত জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে শেষ হয়েছে বাসর রাতে তার কিছুই পায়নি উষসী। মিসেস শিমলা জানিয়েছেন, ইয়ামিনের নাকি ফুলে এলার্জী। তাই সে বিছানা সাজাতে নিষেধ করে দিয়েছে।

রুমটা পরিপাটি করে গুছানো হলেও দেখে মনেই হচ্ছে না যে আজ একটি বিশেষ রাত। ফুলের সৌরভ ছাড়া কি এই বিশেষ রাতের আদৌ কোনো বিশেষত্ব থাকে?

আচ্ছা, ফুলের মতো এতো সুন্দর একটা জিনিসেও কি কারো এলার্জী থাকতে পারে? এটা কেমন কথা? একটু পর দরজায় আওয়াজ হলো। কেউ কি ভেতরে আসছে? উষসীর হাত-পা সংকুচিত হয়ে গেল। নিজেকে গুটিয়ে নিতে লাগল সে। আচ্ছা, ইয়ামিনের সাথে তো এটা তার প্রথম দেখা না। তবুও এতো ভয় কেন লাগছে? কেন গলা শুকিয়ে আসছে এভাবে?

উষসী সারারাত অপেক্ষা করল। ইয়ামিন নিজের ঘরে প্রবেশ করল ভোররাতে, গিটার হাতে। উষসী তখনও ঘুমায়নি। ইয়ামিনের সাথে কথা বলার স্পৃহা তাকে জাগিয়ে রেখেছে। কিন্তু ইয়ামিন তার সাথে কথাই বলল না৷ সরাসরি বারান্দায় গিয়ে বসল।

উষসী কিছু বলতে নিয়েও বলতে পারল না। অদ্ভুতভাবে তার সব কথাগুলো ব্যথা হয়ে গলার মধ্যে, বুকের কাছে জমাট বেঁধে রইল।

ডিভানে বসে গিটার বাজাতে শুরু করল ইয়ামিন। ভারী কণ্ঠে তাকে গানও গাইতে শোনা গেল। তার চোখের পাতা শুকনো ছিল না। গান গাওয়ার সময় কখনোই ইয়ামিনের চোখের পাতা শুকনো থাকে না। নিজের অজান্তেই কাঁদতে শুরু করে সে। আজও ইয়ামিন গান গাইতে গাইতে কাঁদছিল। জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল তাকে খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছিল।

এদিকে বিছানায় বসে অপেক্ষার দহনে ছাড়খাড় হয়ে কাঁদছিল উষসী নিজেও। কিন্তু তার কান্নায় সংগীতের মতো সুর ছিল না, ভাব প্রকাশের অর্থবোধক শব্দ ছিল না। কেবল ছিল নীরবতা! সেই নীরবতার কান্নার কথা, বুকভরা তীক্ষ্ণ ব্যথার কথা কেউ জানল না।

চলবে

আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-৩০+৩১

0

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৩০
লিখা- Sidratul Muntaz

ইয়ামিন বাড়িতে গিয়ে জানিয়ে দিল, সে বিয়ে করতে রাজি। প্রথমে শিমলা ভেবেছিলেন ছেলেকে রাজি করানোর জন্য অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হবে। তিনি আবার অসুস্থতার অভিনয় করবেন। প্রয়োজনে না খেয়ে থাকবেন। কিন্তু তার গুণধর ছেলে যে এতো সহজে রাজি হবে তা কে জানতো? বিস্ময়ে, আনন্দে শিমলা শুধু একটা কথাই জিজ্ঞেস করলেন,” হঠাৎ এতো সুবুদ্ধি হলো কিভাবে তোর?”

ইয়ামিন হেসে জবাব দিল,” যাকে ভালোবাসি তার ভালো’র জন্য সব করা যায়। তবে এটা সুবুদ্ধি না কুবুদ্ধি বলতে পারছি না মম।”

ছেলের উত্তর শুনে ভীষণ প্রফুল্ল হলেন শিমলা। খুশি মেশানো গলায় বললেন,” মাশাল্লাহ!”

ইয়ামিন উষসীকে ভালোবাসে, শিমলার কাছে এর চেয়ে ভালো খবর আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু আসল ব্যাপার তো ভিন্ন! ইয়ামিন বিয়ে করছে ভালোবাসার মানুষের খুশির জন্য…ভালোবাসার মানুষকে নয়!

_______________________
উষসী বাড়ি ফেরার পর তৃষাণ আছাড় মেরে তার মোবাইল ভেঙে ফেলল। তীক্ষ্ণ গলায় বলল,” মোবাইল নিয়ে বাইরে গেলে যদি সুইচড অফ করেই রাখতে হয় তাহলে মোবাইল রাখার কোনো প্রয়োজন আমি দেখি না। ”

রাগে আর ভয়ে উষসী কোনো জবাব দিল না। নিজের ঘরে ঢুকে দরজা আটকে ফেলল। তৃষাণ গজগজ করে বলল,” উষু, দরজা খোলো। খোলো বলছি।”

কোনো জবাব এলো না। ওই পাশ থেকে শুধু ফ্যাচফ্যাচ কান্নার শব্দ পাওয়া গেল। তৃষাণ ধৈর্য্য ধারণ করতে কপালে হাত রেখে সোফায় বসল। ডোনা নরম গলায় বললেন,” এতো রাগ দেখানোর কি দরকার ছিল? মেয়েটার ফোনটাই ভেঙে ফেললি?”

তৃষাণ তীক্ষ্ণ মেজাজে বলল,” একদম ঠিক করেছি যে ভেঙে ফেলেছি। ও আমার ফোন ধরবে না কেন? আবার সুইচড অফ করবে কেন? ওর হাতে ফোন দেওয়াটাই সবচেয়ে বড় ভুল ছিল।”

“ভার্সিটিতে পড়া একটা মেয়ে ফোন ছাড়া কিভাবে চলবে? তাছাড়া আমি জানি ও কেন বাইরে গিয়ে তোর ফোন ধরেনি। ও ইয়ামিনের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল।”

” হোয়াট?” তৃষাণ আরও রেগে গেল। তার চোখ দু’টো অগ্নিবলয়ের মতো উৎক্ষীপ্ত। ডোনা তোয়াক্কা না করে বললেন,” যার সঙ্গে বিয়ে হবে তার সঙ্গে আলাদা কথা বলবে, দেখা করবে, এসব তো স্বাভাবিক। আর উষ্ণতা বলেছে ইয়ামিন বিয়েতে রাজি। তুই কেন অযথা বাগড়া দিচ্ছিস বাবা? মেনে নে না!”

তৃষাণ কাঠ কাঠ গলায় বলল,” তুমি ভালো করেই জানো মা, এই বিয়ে আমি কোনো অবস্থাতেই মানব না।!

তৃষাণ উঠে নিজের বেডরুমে গেল। ডোনা উপায়ন্তর না পেয়ে উষ্ণতাকে ফোন করে পুরো ঘটনা জানালেন। এসব শুনে উষ্ণতা আতঙ্কিত হলো। তৃষাণ যদি এমন করতে থাকে তাহলে বিয়েটা কিভাবে হবে? ডোনা বললেন,” তুমিই একমাত্র ওকে সামলাতে পারবে মা। দ্রুত বাড়ি এসো।”

” আমি আসছি, মা। চিন্তা করবেন না।”

ডিনারে সবাই খেতে বসেছে। অনুপমা এসে বলল,” ভাবী, উষু এখনও বের হয়নি। ওর খাবার কি ভেতরে দিয়ে আসবো?”

উষ্ণতা আঁড়চোখে তৃষাণকে দেখল। অনুপমার কথা শুনে তৃষাণ রূঢ় আওয়াজে বলল,” খাবার ভেতরে দিয়ে আসতে হবে কেন? এখানে আসতে কি সমস্যা ওর?”

উষ্ণতা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” কি সমস্যা সেটা তুমিই জানো। ও সারাদিন ঘর থেকে একবারও বের হয়নি। কিছু খায়ওনি। মায়ের কাছে শুনলাম তুমি নাকি ধমক দিয়েছো?”

সবাই অবাক হয়ে তৃষাণের দিকে তাকাল। তৃষাণ অপ্রস্তুত হয়ে বলল,” আমি ধমক কেন দিবো? শুধু বলেছিলাম বাইরে থাকলে যেন ফোন সুইচড অফ না রাখে।”

উষ্ণতা মৃদু হেসে বলল,” এটা বলার জন্য আছাড় মেরে মোবাইল ভেঙে ফেলতে হবে?”

তৃষাণ রেগে তাকাল,” ওকে ফাইন। আমার জন্যই সব হয়েছে। আহ্লাদ মাখিয়ে ওকে খেতে বসাও এখন। মেয়েটা দিন দিন শুধু বেয়াদব হচ্ছে। ওর থেকে এসব দেখে আইলা আর তৃষ্ণাও শিখবে।”

উষ্ণতা অকপটে বলল,” লাভ নেই। যতই আহ্লাদ মাখানো হোক, ও খেতে বসবে না। অনশন জারি করেছে তোমার শালি। ”

” অনশন মানে? ”

” না খেয়ে থাকার অনশন।”

“ওর দাবিটা কি?”

” দাবি কি সেটা তুমি জানো। কিন্তু আমার মুখ থেকে শুনতে চাইলে বলতে পারি।”

” শুনি?”

ডোনা উষ্ণতার হাত চেপে ধরলেন। উষ্ণতা চোখের ইশারায় তাকে আশ্বস্ত করে সাবধানে বলল,” উষু বলেছে, যতক্ষণ তুমি বিয়ে না মানছো… ততক্ষণ ও কিছুই খাবে না। পানিও না।”

সবার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। তৃষাণের চোখমুখ ক্রমশ লাল হচ্ছে। সামনে থাকা পানির গ্লাসটা আছাড় মেরে ভেঙে বলল,” এসব কি ধরণের নাটক?”

তৃষ্ণা দুইহাত কানে লাগিয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বলল,”জানতাম এটাই হবে।”

তৃষাণ উঠে দাঁড়াল। অনড়ভাবে বলল,” ও না খেয়ে মরে গেলেও আমি বিয়ে মানবো না। ”

ডোনা জেদ করে বলল,” তাহলে আমিও কিছু খাবো না।”

” মানে? তুমি খাবে না কেন?”

” যেখানে আমার ভালো মেয়ে না খেয়ে আছে… সেখানে আমার গলা দিয়ে খাবার নামবে কি করে?”

তৃষাণ রাগ সংবরণ করে প্রশমিত গলায় বলল,” মা, তোমাকে নিয়মিত ঔষধ খেতে হয়। না খেয়ে থাকা তোমার জন্য রিস্কি।”

” অতশত বুঝি না। উষু না খেয়ে থাকলে আমি খাবো না। মানে কিছুতেই না।”

উষ্ণতা বলল,” মা, আপনি যদি না খান… তাহলে আমিও খাবো না।”

যুথি বলল,” ঠিকাছে, আমিও তাহলে খাবো না।”

তৃষাণ করুণ দৃষ্টিতে তাকাল,” মা, আপনিও এই কথা বলছেন?”

” যেই বাড়িতে আমার দুই মেয়ে উপোস থাকবে, সেই বাড়িতে আমি মা হয়ে কিভাবে খাবো?”

অনুপমা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে বলল,” ভাবী খাবে না, উষু খাবে না, খালাম্মারা কেউ খাবে না… সেখানে আমি কিভাবে খাই? না আমিও খাবো না।”

তৃষ্ণা বলল,” আমিও খাবো না। এই আলু, তুই খাবি?”

আইলা বড় বড় চোখে তাকাল। তৃষ্ণা ওকে কানে কানে শিখিয়ে দিল,” বল, আমিও খাবো না।”

আইলা আধো কণ্ঠে বলল,” আমিও তাবো না।”

তৃষাণ আহমেদের দিকে তাকাল। আহমেদ অসহায় কণ্ঠে বলল,” আমার বউ, আমার বাচ্চা মেয়ে যেখানে না খেয়ে থাকবে সেখানে আমি কিভাবে খাই,ভাই? এই খাবার কি আমার গলা দিয়ে নামবে?”

উষ্ণতা বলল,” ঠিকাছে.. অনু, শুধু তোমার ভাই ছাড়া আমাদের সবার খাবার নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দাও। আজকে আমরা সবাই উপোস থাকব। ”

” জ্বী ভাবী।”

অনুপমা খাবার তুলতে লাগল। তৃষাণ হার মানল না। কণ্ঠে উত্তাপ মিশিয়ে বলল,”আমারটাও নিয়ে যাও।কেউই যখন খাবে না তখন আমিও খাবো না। তবুও এই বাড়িতে কোনো বিয়ে হবে না। এন্ড দ্যাটস ফাইনাল।”

এই কথা বলে হনহন করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল তৃষাণ। সবাই একটা হতাশার নিশ্বাস ত্যাগ করল। ডোনা বললেন,” আমি আগেই বলেছিলাম। লাভ হবে না। ও মানবে না”

যুথি বললেন,” তাহলে এখন উপায়?”

উষ্ণতা সবাইকে আশ্বস্ত করে বলল,” অপেক্ষা করো। ওকে আমি চিনি। কিছুক্ষণ রাগ দেখাবে। কিন্তু পরে সব মেনে নিবে। এতোগুলো মানুষের অনুরোধ ও ফেলবে না।”

___________________
রাতেই তৃষাণ গাড়ি নিয়ে সোজা ইয়ামিনের বাড়ির দিকে রওনা হয়। তখন ঘড়িতে রাত সাড়ে এগারোটা বাজছে। গলিতে ঢুকেই তৃষাণ ফোন করে ইয়ামিনকে নিচে আসার জন্য বলে। ইয়ামিন চায় না বাড়ির ভেতরে সিন ক্রিয়েট হোক। এতোরাতে ছেলেকে বাইরে যেতে দেখে আজমল সাহেবও পিছু নেন। তিনি ড্রয়িংরুমে অন্ধকারে বসেছিলেন। ইয়ামিন সেটা খেয়াল করেনি।

তৃষাণ ইয়ামিনকে দেখেই তেড়ে এসে তার কলার চেপে ধরে গর্জে উঠল,” আমার ফ্যামিলি থেকে দূরে থাকতে বলেছিলাম না? তবুও কেন আসছো? উষসীকে বিয়ে করতে চাওয়ার পেছনে উদ্দেশ্য কি তোমার?”

ইয়ামিন শক্ত কণ্ঠে বলল,” আপনি এখানে এভাবে সিন ক্রিয়েট করবেন না, প্লিজ।”

তৃষাণ ঘুষি মেরে ইয়ামিনের নাক ফাটিয়ে দিল। র-ক্ত নির্গত হচ্ছে নাক থেকে। তৃষাণ উন্মত্ত কণ্ঠে বলল,” উষসীর জীবন নষ্ট করার সুযোগ তোমাকে দেওয়া হবে না।”

” কিন্তু আমি উষসীকেই বিয়ে করব।”

” আচ্ছা? এতো সাহস তোমার? কিভাবে বিয়ে করবে আমি যদি হতে না দেই?”

” উষ্ণতা মিস আমার উপর ভরসা করেছেন। আমি এই ভরসা ভাঙতে দিবো না। তাকে আমি কথা দিয়েছি, উষসীকে সবসময় ভালো রাখব।”

” তোমার উপর ভরসা? উষসীর নাম আরেকবার তোমার মুখে শুনলে…” তৃষাণ আবার হাত উঠিয়েছিল ঘুষি মারার উদ্দেশ্যে। তখনি পেছন থেকে আজমল সাহেব হুংকার ছাড়লেন,” থামো।”

বাবার কণ্ঠ শুনে ইয়ামিন চমকে উঠল। পেছন ফিরে দেখল সাদা পাঞ্জাবী পরিহিত বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। ইয়ামিন অস্বস্তি মাখা কণ্ঠে বলল,” বাবা… তুমি এখানে কেন এসেছো?”

আজমল সামনে এগিয়ে এলেন। ইয়ামিনের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে তৃষাণকে উদ্দেশ্য করে বললেন,” আমার ছেলে যখন বলেছে, সে উষসীকে ভালো রাখবে…তখন অবশ্যই রাখবে। ওর উপর তোমার ভরসা করা উচিৎ। ও কখনও কাউকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয় না।”

আজমল সাহেবের কথা শুনে তৃষাণের মন না গললেও ইয়ামিন হতভম্ব হলো। কতবছর হয়ে গেছে বাবা তার সঙ্গে ঠিক করে কথাই বলেন না। অথচ তাঁর মনে যে একমাত্র ছেলের জন্য এমন অগাধ বিশ্বাস রয়েছে সেটা আজকের এমন পরিস্থিতি তৈরী না হলে ইয়ামিন কখনও বুঝতো না।

তৃষাণ বলল,” উষসী শুধু আমার শালি না, ও আমার বোন। ছোট থেকে আপন বোনের চেয়েও বেশি আদরে মানুষ করেছি ওকে। ওর জীবনটা আমি কোনো অনিশ্চয়তায় ছেড়ে দিতে পারি না। দুঃখিত আঙ্কেল, কিছু মনে করবেন না। কিন্তু আপনার ছেলেকে আমি কোনোভাবেই বিশ্বাস করব না।”

” আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে। আমার কথার কোনো নড়চড় হবে না। উষসী এই বাড়িতে সবচেয়ে সুখে থাকবে। আমার ছেলে এই প্রথম কোনো মেয়েকে ভালোবেসেছে। তাই আমি চাই যেকোনো মূল্যে উষসীর সাথেই ওর বিয়েটা হোক।”

ইয়ামিন অবাক হয়ে তার বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। ঘুটঘুটে অন্ধকারের এই রাতে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আজমল সাহেব প্রায় আধাঘণ্টা তৃষাণের সঙ্গে তর্ক করলেন। অবশেষে তৃষাণ কিছুটা নরম হলো। ইয়ামিনের দিকে চেয়ে বলল,” যদি কখনও উষসীকে কষ্ট পেতে দেখি তাহলে তোমাকে আমি ছাড়ব না, ইয়ামিন ইব্রাহীম।”

আজমল আত্মবিশ্বাসের সাথে বললেন,” সেই সুযোগ তোমাকে দেওয়া হবে না। উষসী কখনও কষ্টে থাকবে না।”

” আমি আসছি।”

” ভেতরে বসো। অন্তত চা খেয়ে যাও।”

” আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে। এতোরাতে ভেতরে যাবো না। ভালো থাকবেন।”

” তুমিও ভালো থেকো।”

তৃষাণ যখন চলে যাচ্ছিল তখন আজমল ইয়ামিনের দিকে ফিরে বললেন,” যেই মেয়েকে তুমি বিয়ে করতে যাচ্ছো, সে শুধু একটা মেয়ে না৷ তার পরিবারের চোখের মণি। সবাই মিলে তাকে যত ভালোবাসা দিয়েছে এখন থেকে তোমাকে একাই সেই ভালোবাসা দিতে হবে। তুমি কি পারবে?”

এই কথা শুনে দূরে গিয়েও থামল তৃষাণ। ইয়ামিন তার সিক্ত হয়ে আসা দৃষ্টি মুছে বলল,” আমি চেষ্টা করব।”

” শুধু চেষ্টা করলেই হবে না। তোমাকে অবশ্যই পারতে হবে,বাবা। না পারলে মেয়েটার সাথে অন্যায় করা হবে। আর আমার ছেলে কখনও কারো সাথে অন্যায় করতে পারে না।”

ইয়ামিন তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল,” বাবা, আই লভ ইউ।”

আজমল ঝাপসা কণ্ঠে বললেন,” এন্ড আই এম প্রাউড অফ ইউ মাই সান।”

তৃষাণ নিঃশব্দে গাড়িতে এসে বসল। সে দ্বিধা কাটাতে পারছে না। ইয়ামিনকে মেনে নেওয়া তার পক্ষে সহজ না।

__________
সকালে ঘুম ভেঙে উষসী দেখতে পেল জানালার কাছে একটা নতুন হ্যান্ডসেট। সে দৌড়ে গিয়ে ফোনটা হাতে নিল। সাথে একটা রঙিন নোট-“‘I am sorry..
বিয়ের কনে হিসেবে না খেয়ে থাকার ব্যাপারটা একদম ভালো দেখায় না। তোমার জন্য বাড়ির সবাই অভুক্ত। খেয়ে নাও উষুমনি। Good night. ”

তৃষাণ নিশ্চয়ই রাতে এসব নিয়ে এসেছিল। কিন্তু দরজা তো বন্ধ ছিল। সে ভেতরে কিভাবে ঢুকল? নিশ্চয়ই ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে। কিন্তু এতো সহজে তৃষাণ বিয়ের জন্য রাজি হবে… উষসী ভাবতেও পারেনি এটা!

চলবে

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৩১
লিখা- Sidratul Muntaz

উষসীকে এইভাবে মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়ে বিয়ে করাটা কি ঠিক? যদি বিয়ের পর সে উষসীকে ভালোবাসতে না পারে… তখন কি হবে? তাছাড়া এভাবে বিয়ে হলে উষসীকে ঠকানো হবে। সে যদি কোনোভাবে সত্যি জানতে পেরে যায় তাহলে ব্যাপারটা আরও দুঃখজনক হবে। এসব চিন্তা ইয়ামিনকে খুব পীড়া দিচ্ছে।

সে তার বাবার কথাও ভাবছে। মনে মনে বাবা তার প্রতি এতোটা প্রত্যাশা রাখে তা সে জানতো না। বাবা বলেছেন নিজের ছেলের প্রতি তিনি গর্বিত। কিন্তু এই গর্হিত কাজের কথা জানলে তিনি কি লজ্জিত হবেন না?

বিয়ের সময় যেন খুব দ্রুত ঘনিয়ে আসছে। তাড়াহুড়োর মধ্যে বিয়ে হলেও আয়োজনে কোনো কমতি নেই। একমাত্র ছেলের বিয়েতে মিসেস শিমলা রাজকীয় আয়োজন করবেন। এটা তার কতদিনের স্বপ্ন!

বিয়ের এক সপ্তাহ আগে থেকে পুরো এলাকা সাজিয়ে রাখা হলো। রাস্তার চারদিকে আলোকসজ্জা, ফুল দিয়ে হুলুস্থুল করা হলো। শহরের অর্ধেক মানুষ দাওয়াত করা হলো। এমন বিশাল আয়োজনের বিয়ে সচরাচর দেখাই যায় না। সোশ্যাল মিডিয়াতেও চলছে তোলপাড়।

ইয়ামিন ইব্রাহীমের বিয়ে নিয়ে তরুণী, কিশোরী ভক্তদের যেন হাহাকারের শেষ নেই। উষসী সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিদিন মজার মজার পোস্ট দেখছে। পুরো দেশে একটা আলোড়ন তৈরী হয়ে গেছে।

উষসীও রীতিমতো ভাইরাল! ইয়ামিনের নামের পাশে তার নাম স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসছে আজ-কাল। সেও এখন সেলিব্রিটি। তার ফ্যানবেজ তৈরী হয়ে গেছে। ফেসবুকের ফলোয়ার হু হু করে বাড়ছে। ইন্সটাগ্রামে সে মেহেদী রাঙা হাতের ভিডিও পোস্ট করলে তাতে একদিনেই ওয়ান মিলিয়ন ভিউ হয়ে গেছে।

ছেলেদের কাছে উষসী ক্রাশ হলেও মেয়েদের কাছে যেন চক্ষুশূল। সেদিন একটা নিউজ দেখা গেল। হেডলাইনে বড় অক্ষরে লেখা,” হাজারো রমণীর মন ভেঙে ইয়ামিন ইব্রাহীম বিয়ে করে নিচ্ছেন লামিয়া ইমরোজ উষসীকে!”

নিউজটা সময় নিয়ে উষসী পুরোটা পড়ল। তার খুবই হাসি পাচ্ছিল। এইসব ছোট-খাটো ব্যাপারও তাকে খুব আনন্দ দিচ্ছে। হলুদে সে যেভাবে সেজেছে, বিউটি ভ্লগাররা সেই মেকাপের লুক ক্রিয়েট করে রিলস বানাচ্ছে। ঠিক উষসীর মতো শাড়ি পরে তার মতোই সাজছে। সে যেই শাড়ি পরেছে সেটা এখন লাখটাকায় বিক্রি করা সম্ভব।

মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে নিজের বিয়ের এতো এতো পাবলিসিটি এবার উষসীর বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রথম প্রথম বিষয়টা উপভোগ করলেও এখন তার খুব পেইন মনে হয়। সে ঘর থেকে পর্যন্ত বের হতে পারে না। স্কার্ফ দিয়ে মুখ ঢাকতে হয়। নয়তো মানুষ চিনে ফেলে। সেলফি তুলতে ছুটে আসে।

উষসী অতিষ্ট হয়ে উঠেছে। এভাবে চললে তো তাদের হানিমুনের ছবিও ভাইরাল হয়ে যাবে! ছি, সেলিব্রিটি বলে কি তাদের কোনো প্রাইভেসি নেই?

_______________
ঠিক রাত বারোটা বাজে। ইয়ামিন বারান্দার ইজি চেয়ারে বসে আছে। তার দৃষ্টি আকাশে। মৃদুমন্দ বাতাস চারদিকে। মেঘের ঘন আস্তরণে ঢাকা পড়েছে চাঁদ। তবুও ওই অন্ধকার আকাশ দেখতে ভালো লাগছে। ইয়ামিনের আকাশ দেখতে কখনোই খারাপ লাগে না। আকাশ আর সমুদ্র তার সবচেয়ে পছন্দের জিনিস। বিশালতার মাঝে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়।

ফোনের মেসেজ টোন বেজে উঠল। উষসী লিখেছে, “Happy marriage day to my beloved..”

ইয়ামিন অবাক হয়ে লিখল,” ম্যারেজ ডে মানে?”

” আজ থেকে এক বছর পর আমরা এই দিনেই ম্যারেজ এনিভার্সেরী পালন করব। কখনও ডিলিট করবেন না কিন্তু মেসেজটা আপনার ফোন থেকে। প্রত্যেকবছর আমি দেখতে চাইবো। মনে থাকবে?”

ইয়ামিন ঘড়ির দিকে তাকাল। ক্যালেন্ডার দেখল। কাল সকালেই তাদের বিয়ে। বারোটা বেজে গেছে। তার মানে বলা যায় আজকেই বিয়ে। অথচ ইয়ামিনের মনেও নেই। বিয়ে নিয়ে তার মধ্যে কোনো উৎসাহও নেই। সে শুধু চায় দ্রুত সব ঝামেলা মিটে যাক!

উষসী ভিডিওকল দিল। ইয়ামিন রিসিভ করতেই দুইহাত মেলে হাতের মেহেন্দী দেখালো উষসী। লাজুক মুখে প্রশ্ন করল,” কেমন লাগছে?”

ইয়ামিন নিরস কণ্ঠে বলল,” একবার তো বলেছিই… চমৎকার। আবার কেন জিজ্ঞেস করছো?”

উষসী মনখারাপ করে মনে মনে বলল,” আপনি এতো আনরোমান্টিক? ধূর…”

মুখে বলল,” পার্লারের ওই মেয়েটা আপনার নাম লিখতে ভুলে গেছিল। তাই বাসায় এসে আমিই লিখেছি। দেখুন।”

উষসী তার হাত ক্যামেরার সামনে ধরল। ইয়ামিন অনাগ্রহে উচ্চারণ করল,” ও আচ্ছা।”

উষসী আহত হলো। সে তার হাতের তালুতে লিখেছে,” রাক্ষসমানব।” ভেবেছিল ইয়ামিন এই নিয়ে প্রশ্ন করবে। অথচ সে কোনো প্রশ্নই করল না। আজব!

উষসী যে ছোটবেলায় তাকে ‘রাক্ষসমানব’ বলে ডাকতো এটা নিশ্চয়ই তার মনে নেই।ক্ষণিকের মনখারাপ ভাবটা চট করে মুছে ফেলল উষসী। চঞ্চল কণ্ঠে বলল,” আচ্ছা, কাল সকালে আপনি আমাদের বাড়িতে কখন আসবেন?”

” যখন আসার সময় হবে… আসব।”

” একটু দ্রুত আসবেন প্লিজ… আমার অপেক্ষা করতে একটুও ভালো লাগে না। আর শুনুন, আমার কাজিনরা কিন্তু অবশ্যই আপনার জুতো চুরি করবে। আপনি এক্সট্রা জুতো সাথে নিয়ে আসবেন কিন্তু। তাহলে সবাই চমকে যাবে আর বুঝবে আপনি খুব বুদ্ধিমান। কিন্তু কেউ জানবেই না যে আপনাকে বুদ্ধিটা কে দিয়েছিল। হাহাহা! কি ভাগ্য আপনার বলুন… আমার মতো বুদ্ধিমতী বউ পাচ্ছেন?”

উষসী হাসতে লাগল। ইয়ামিন তাকিয়ে রইল শান্তভাবে। সে নিজের বিয়ে নিয়ে এতোটুকু উত্তেজনা অনুভব করছে না। অথচ উষসীর দুই চোখ ভর্তি উচ্ছ্বাস!

তার এই হাসি, এই সরলতা.. ইয়ামিনের অপরাধবোধ বাড়িয়ে দ্বিগুণ করে তুলছে। সে অনুভব করছে ব্যথা। উষসীর সাথে অন্যায় হচ্ছে। বিরাট অন্যায়! এটা উচিৎ নয়। ইয়ামিন ক্লান্ত কণ্ঠে বলল,” এখন রাখি উষসী প্লিজ… আমার ঘুম পাচ্ছে।”

উষসী চোখ বড় করে তাকাল,” সত্যিই আপনার ঘুম পাচ্ছে? আপনি কি মানুষ? আমার তো এক্সায়েটমেন্টে ঘুমই উড়ে গেছে। বিয়ের আগের রাতেও কোন বলদে ঘুমায়?”

ইয়ামিন তাকাতেই উষসী জিভ কেটে বলল,” স্যরি… আপনাকে বলদ বলিনি।”

সে কানে ধরে অনুতপ্ত হওয়ার ভঙ্গি করল। ইয়ামিন নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল,” আমার সত্যিই ঘুম পাচ্ছে।”

” ওকে। গুড নাইট।”

উষসী হতাশ হয়ে ফোন রাখল। ইয়ামিন বড় করে নিশ্বাস ছাড়ল এবার। নাহ, এভাবে চলছে না। উষসীকে সত্যিটা জানাতে হবে।

মিথ্যা দিয়ে সম্পর্ক শুরু করার কোনো মানেই হয় না। কিন্তু সত্যি জানার পর উষসী হয়তো বিয়েটাই করতে চাইবে না। তাতে কি? বিয়ে না হলে আরও ভালো। ইয়ামিন শুধু নিজের মনের এই অশান্তি দূর করতে চায়।

মোবাইলের ভিডিও অন করে ইয়ামিন ক্যামেরা স্ট্যান্ডের সামনে বসল। তার মনের যতরকম কথা ছিল…. সবকিছু সাবলীলভাবে প্রকাশ করতে লাগল। উষ্ণতার ব্যাপারে, নিজের ব্যাপারে, নয়বছরে ঘটে যাওয়া সবকিছুর ব্যাপারে সত্যি স্বীকার করল। তারপর সেই ভিডিও ক্লিপটা উষসীকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠালো। কিন্তু এতো দীর্ঘ ভিডিও সেন্ড হচ্ছিল না। তাই ইয়ামিন ফেসবুক থেকে উষসীকে ট্যাগ দিয়ে ভিডিওটা অনলি মি করে আপ্লোড করল। তারপর উষসীর কাছে মেসেজ লিখল,” ফেসবুকে একটা ভিডিও দিয়েছি। আর্জেন্ট। এখনি চেক করো… তারপর সিদ্ধান্ত জানাও। আই এম ওয়েটিং।”

এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। ইয়ামিন দরজা খুলতেই মিসেস শিমলা হাসি মুখে বললেন,” এখনও ঘুমাসনি? ভালোই হয়েছে। তোর সঙ্গে একটা জরুরী ব্যাপার নিয়ে আলাপ করার ছিল, বাবা।”

কথা বলতে বলতে শিমলা বিছানায় এসে বসলেন। তিনি ঠিক করেছেন বরযাত্রী যাওয়ার জন্য ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করবেন। প্রাইভেট কার তো এখন কমন। রাজা-বাদশাদের মতো ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে গেলেই না মনে হবে রাজকীয় বিয়ে!

ইয়ামিন নিজের মনে বলল,” বিয়ে হয় নাকি আগে দেখা যাক। তারপর ঘোড়ার গাড়ির চিন্তা।”

কিন্তু মুখে বলল,” এটা মোটেও ভালো আইডিয়া না। আমাকে ঘোড়ার গাড়িতে দেখলে মানুষ সামনে এগোতেই দিবে না। যদি রাস্তা ব্লক করে ফেলে সেলফি তোলার জন্য?”

শিমলা উচ্চশব্দে হেসে উঠলেন,” সেটাও তো কথা। আমি ভুলেই গেছিলাম আমার ছেলে ফেমাস বয়।”

শিমলা আদর করে ইয়ামিনের নাক টেনে দিলেন।

” তুমি ঘুমাও তো মম। সারাক্ষণ খালি এসব নিয়েই চিন্তা করছো। সকালে কত কাজ, তার উপর তোমার ব্লাড প্রেশার বেড়ে গেলে কি হবে?”

” সেটাও ঠিক। তুইও ঘুমা বাবা। এতো রাত অবধি জেগে থাকলে সুন্দর চেহারাটা নষ্ট হয়ে যাবে না? যদি মুখ থেকে পিম্পল বের হয়? বিয়ের দিন বরের মুখে পিম্পল দেখলে মানুষ কি বলবে?”

শিমলা আবারও হাসছেন। ইয়ামিন মনখারাপ নিয়ে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। বিয়েটা ভেঙে গেলে সবচেয়ে বেশি আঘাত পাবেন মা! তার সব আনন্দে ভাঁটা পড়বে। তবু ইয়ামিন মনকে শক্ত করল। সে উষসীকে কোনো ধোঁকার মধ্যে রাখতে চায় না।

সব জানার পর হয়তো উষসী বিয়ে করতেই চাইবে না। কিন্তু কাউকে ধোঁকা দেওয়ার মতো অপরাধবোধ থেকে অন্তত ইয়ামিন নিস্তার পাবে।

শিমলা চলে যাওয়ার সাথে সাথেই ইয়ামিন মেসেজ চেক করল। কিন্তু উষসী অনলাইনে নেই। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। ইয়ামিন আর ফোন করতে গেল না। সকালে উঠেই না হয় দেখবে। এটা ভেবে সেও নিশ্চিন্তে ঘুমাতে গেল। কিন্তু সকালেও উষসীর কোনো মেসেজ এলো না।

অনেকক্ষণ ধরে ইয়ামিন অপেক্ষা করল। শিমলা তাগাদা দিয়ে ইয়ামিনকে গোসলে পাঠালেন। বরযাত্রী যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। বাতাসের গতিতে যেন সময় এগোচ্ছে।

ইয়ামিন অগত্যা শেরোয়ানি পরে তৈরী হলো। তার মন এখনও বলছে, বিয়েটা হবে না। কিন্তু উষসীর কোনো খোঁজই নেই। মিনিটে মিনিটে যেই মেয়ে ফোন করে সে সকাল থেকে একটা মেসেজ পর্যন্ত দেয়নি। ব্যাপারটা অদ্ভুত। আচ্ছা, ভিডিওটা দেখার পর সে আবার কান্নাকাটি করছে না তো?

বাধ্য হয়ে ইয়ামিন নিজেই ফোন করল উষসীকে। কিন্তু উষসীর ফোন রিসিভ করল অনুপমা,” হ্যালো।”

” হ্যালো, আপু উষসী আছে?”

অনুপমা ফিক করে হেসে উঠল। ইয়ামিন ধৈর্য্য ধরতে পারছে না। উষসী কোথায়? অনুপমা কেন তার ফোন ধরল? সেদিনের মতো ঔষধ খায়নি তো আবার? তাহলে তো অনুপমা এভাবে হাসতো না। উফ, কি টেনশন!

অনুপমা বলল,” পার্লারে আছে। খুব ব্যস্ত সে এখন। কথা বলা যাবে না। যা বলার আমাকে বলো। আমি মেসেজ ডেলিভারি করে দিবো।”

ইয়ামিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তার মানে উষসী এখনও ভিডিও দেখেনি। সে বলল,” থাক, আমিই পরে কথা বলে নিবো।”

অনুপমা ঠাট্টার স্বরে বলল,” বুঝেছি… পারসোনাল টকিং তাই না? সমস্যা নেই। এখানেই তো আসছো। দেখা হলেই কথা বলে নিও।”

কিন্তু উষসীকে এরপর একবারের জন্যেও একা পাওয়া গেল না। বিয়ের স্টেজ সাজানো হয়েছে বাড়ির বাগানে। বাড়ি ভর্তি মেহমান। গান-বাজনা, হৈ-হুল্লোড়, চিৎকার-চেঁচামেচিতে গিজগিজ করছে সারাবাড়ি।

ইয়ামিন সুযোগ খুঁজছিল উষসীকে একবার একা পাওয়ার। কিন্তু বিয়ে বাড়িতে সবার নজর শুধু বউয়ের দিকেই থাকে। তাই উষসীকে কেউ একা ছাড়ছিল না।

তবুও এক পর্যায় সুযোগ পাওয়া গেল। উষসী বাথরুমে যাওয়ার জন্য যখন করিডোর দিয়ে যাচ্ছিল তখন ইয়ামিন দৌড়ে এসে তার হাত ধরে তাকে একটা কোণায় নিয়ে এলো। হঠাৎ তার এমন আচরণে উষসী লজ্জায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। সংকোচ মেশানো গলায় বলল,” কি করছেন এসব? কেউ দেখলে কি বলবে?”

ইয়ামিন হাঁপাতে হাঁপাতে প্রশ্ন করল,” ভিডিওটা দেখেছো?”

” কিসের ভিডিও?”

” কালরাতে পাঠিয়েছিলাম।”

” আমি সকাল থেকে একবারও অনলাইনে যাইনি। আসলে নিজের বিয়েতে এতো ব্যস্ত যে সময়ই পাচ্ছি না। কিসের ভিডিও ওটা?”

” উফ… উষসী দ্রুত ওই ভিডিওটা দেখো প্লিজ। ইটস ভেরি আর্জেন্ট।”

ইয়ামিন আর কিছু বলতে পারল না। উষসীর কাজিনরা এসে ভীড় জমিয়েছে। তাদের এই অবস্থায় দেখে সবাই মজা নেওয়ার উদ্দেশ্যে নানান কথা বলতে লাগল। কেউ কেউ ছবি তুলছে। উষসী লজ্জায় মুখ লুকানোয় ব্যস্ত হলো আর ইয়ামিন বিরক্তিতে!

_________________
স্টেজে তাদের একসাথে বসিয়ে ছবি তোলার সময়ও ইয়ামিন ভিডিওর ব্যাপারে প্রশ্ন করল। ক্যামেরাম্যান বিভিন্ন পোজ দেখাচ্ছেন। অনেকরকম এংগেল থেকে ছবি তুলছেন। ইয়ামিন এই ফাঁকে ফিসফিস করে বলল,” তুমি কি ভিডিওটা দেখেছো উষসী?”

চারদিকে এতো গান-বাজনার আওয়াজ যে উষসী কিছু শুনল না।

” হুম? কি বললেন?”

” ভিডিওর কথা বলছি।”

“কোন ভিডিও?”

” আরে সকালে বলেছিলাম যে… মনে নেই?”

” ও ওইটা? হ্যাঁ দেখেছি।”

ইয়ামিন বিস্মিত কণ্ঠে বলল,” তারপর?”

” তারপর আর কি?”

” মানে তুমি পুরোটা দেখেছো? কিছু বুঝেছো?”

” বুঝবো না কেন? অনেক ফানি ছিল।”

ইয়ামিন আশ্চর্য হয়ে বলল,” ফানি মানে? এটা আমাদের সারা জীবনের প্রশ্ন। আর তোমার কাছে ফান মনে হচ্ছে?”

উষসী হাসতে হাসতে বলল,” এতো সিরিয়াস হচ্ছেন কেন? এই যুগে এসব কোনো ব্যাপারই না। আরও কত হচ্ছে!”

স্টেজ থেকে নেমে বান্ধবীদের সাথে ছবি তুলতে গেল উষসী। ইয়ামিন বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছে তখনও। মেয়েটা পাগল নাকি?

খাবার টেবিলে সবার মাঝখানে এই বিষয়ে কথা বলা সম্ভব না। উষ্ণতা যখন উষসীর পাশে বসতে গেল তখন ইয়ামিন ছুটে এসে বাগড়া দিয়ে বলল,” আমি এখানে বসি?”

সবার মুখে একটা চাপা হাসি খেলে গেল। উষ্ণতা খানিক বিব্রত হয়ে বলল,” তোমার প্লেট তো ওদিকে সাজানো হয়েছে। তোমার বন্ধুদের সাথে।”

অনুপমা বলল,” এটা তো আমাদের ভুল হয়ে গেল, তাই না ভাবী? বর আর বউকে একসাথে বসতে দেওয়া উচিৎ ছিল। চিন্তা কোরো না ইয়ামিন, তুমি এখানেই বসো। আমি তোমার প্লেট এনে দিচ্ছি।”

ইয়ামিন বলল,” জ্বী, প্লিজ। এটা করলেই ভালো হয়।”

সবাই এবার জোরেই হাসতে লাগল। একজন মুরব্বি তো বলেই বসলেন,” এমন বউপাগল বর হওয়াই তো ভালো।”

উষসীর মুখ আলতারাঙা হয়ে উঠল। ইয়ামিন আজ এমন কেন করছে সবার সামনে? খেতে বসার পর সে আবারও ফিসফিস করে বলল,” এতো ইজিলি কিভাবে মেনে নিচ্ছো সব?”

উষসী অবাক হয়ে তাকাল,”মানে? কি মেনে নিচ্ছি?”

” ভিডিওর কথা বলছি।”

” আপনি এখনও ওই ভিডিও নিয়ে পড়ে আছেন? উফ, আচ্ছা মেনে না নিয়ে উপায় কি বলুন? আমি না মানলেই কি মানুষ ট্রল করা থামিয়ে দিবে?”

” কিসের ট্রল? আমি কি বলছি আর তুমি কি বলছো?” ইয়ামিন হতভম্ব।

উষসী বলল,” আপনি ওই রোস্টিং ভিডিওটার কথা বলছেন না? আপনার আর আমার বিয়ে নিয়ে যে তৈরী হলো?”

ইয়ামিনের বিরক্তির মাত্রা চরমে পৌঁছে গেল এবার। ক্ষীপ্ত হয়ে বলল,” ড্যামেট… এসব স্টুপিড ভিডিওর কথা কেন বলব? তোমাকে কালরাতে আমি একটা ভিডিও পাঠিয়েছিলাম। সেটা দেখেছো কি-না? ”

” আপনি আমাকে আবার কখন ভিডিও পাঠালেন?”

” তার মানে তুমি এখনও দেখোনি?”

” আচ্ছা…চেক করব পরে।”

উষ্ণতা দুষ্টমি করে বলল,” খাওয়ার সময় এতো ফিসফিস করতে হয় না। গল্প করার জন্য সারারাত পড়ে আছে!”

টেবিল জুড়ে হাসির রোল পড়ে গেল। আবারও উষসী লজ্জায় আড়ষ্ট। ইয়ামিন বিরক্ত!

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ইয়ামিনের সব বন্ধুরা স্টেজে উঠে আড্ডা দিচ্ছে। কাজী সাহেব এখনও আসেননি। এতো দেরি হচ্ছে কেন কেউ বুঝতে পারছে না। কিন্তু ইয়ামিনের জন্য এটাই ভালো। কবুল বলার আগেই উষসীর ভিডিওটা দেখে ফেলার উচিৎ। কিন্তু তাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না কেন? ইয়ামিন স্টেজের কাছে গিয়ে বলল,” উষসী কোথায়?”

সোহানা উত্তর দিল,”আমরা এখানে বসে তোর বউয়ের নজরদারি করছি নাকি? নিজে খুঁজে দ্যাখ।”

ইয়ামিন চলে যেতে নিলেই ফাহিম ডাকল,” এই বউ পাগলা, এদিকে আয়। তুই কি? এতোবছর পর দেখা হলো অথচ আমাদের সাথে একবারও বসছিস না। খাওয়ার সময়ও বউয়ের সাথে। মানুষ তো বিয়ের পর বদলায়, তুই দেখি বিয়ের আগে থেকেই বদলে গেছিস।”

সোহানা টিপ্পনী কেটে বলল,” বাদ দে৷ ও এখন পুরোপুরি জরুকা গোলাম।”

সবাই হাসল। ইয়ামিন চোয়াল শক্ত করে বলল,” উষসীর সাথে আমার খুব জরুরী দরকার আছে। সেজন্যই খুঁজছি। কথা শেষ হলেই তোদের কাছে আসব।”

অভিমান করে অরণ্য বলল,” থাক, তোকে আর আসতে হবে না। বউয়ের কাছেই থাক।”

সোহানা বলল,” হুম সেটাই। এমনিতেও আমাদের তুই ভুলে গেছিস।”

ইয়ামিন হেসে বলল,” তোদের আমি কিভাবে ভুলি, বল?”

“আরিশা যে এবসেন্ট সেটা একবারও খেয়াল করেছিস?”

ইয়ামিন চুপ হয়ে গেল। আরিশা তার বিয়েতে আসবে না এটা সে আগেই জানতো। তাই এই ব্যাপারে অবাক হওয়ার কিছু নেই। হঠাৎ উষসীকে দেখতে পেয়ে ইয়ামিন সেদিকে চলে গেল।

মিসেস শিমলা মাঝপথে তাকে থামিয়ে বললেন,” কোথায় কোথায় থাকিস বাবা? চেহারা ঘেমে কি অবস্থা হয়েছে! বেশি গরম লাগছে? চল এসির নিচে বসবি।”

ইয়ামিন ভাবল এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর হয় না। সে সবার সামনেই বলে ফেলল,” উষসীকেও নিয়ে যাই?”

সবাই চোখ বড় করে তাকালেন। শিমলা হাত দিয়ে ছেলের বাহুতে চাপড় মেরে চাপা স্বরে বললেন,” নির্লজ্জ!”

সবাই হাসতে শুরু করেছে। অনুপমা বিড়বিড় করে বলল,” এতো তাড়া কিসের? সবুর করো না ভাই। রাত তো পড়েই আছে।”

উষ্ণতা অনুর কাঁধ চেপে ধরে উচ্চারণ করল,” ধূর, তুমিও কম না।”

উষসী লজ্জায় মাথা তুলতে তাকাতে পারছে না। ইয়ামিন ইতস্তত করে বলল,” আসলে উষসীর সাথে আমার একটু জরুরী দরকার আছে।”

অনুপমা বলল,” হুম.. কি জরুরী দরকার সেটা আমরা বুঝি…”

উষসী হাত দিয়ে চোখ ঢাকল। ইয়ামিন নির্বিকার। সে উষসীর হাত ধরে অবলীলায় বলল,” প্লিজ একটু এদিকে এসো।”

মেহমানরা রসিকতার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। উষসীর কাজিন দুষ্টমি করে বলল,” আহারে, বেচারার মনে হয় ধৈর্য্য কুলাচ্ছে না। যা একটু।”

উষসী চোখ বড় করে চারপাশে তাকাল। ফিসফিস করে বলল,” প্লিজ…সবাই কি ভাববে?”

ইয়ামিন কর্ণপাত করল না। উষসীকে টেনে নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিল৷ তৃষাণ এইসব দেখে রাগান্বিত স্বরে বলল,”ম্যানারলেস ছেলে-মেয়ে। কোনো কমন সেন্স নেই।”

লজ্জায় মাথা হেঁট করে উষসী বিছানায় বসল। ইয়ামিন অস্থিরচিত্তে বলল,” ভিডিও দেখেছো?”

উষসী অবাক না হয়ে পারল না,” আপনি এই প্রশ্ন করার জন্য আমাকে সবার সামনে থেকে তুলে এনেছেন?”

” তুমি বুঝতে পারছো না যে ব্যাপারটা কত ইম্পোর্ট্যান্ট। এটলিস্ট কবুল বলার আগে তোমার এটা দেখা উচিৎ। ”

” কবুল বলার পরে দেখলে কি হবে?”

ইয়ামিন গরম দৃষ্টিতে তাকাল,”এটা কোনো মজা না।”

উষসী হেসে বলল,” ওকে বাবা, কাম ডাউন। আমি দেখছি।”

উষসী তার মোবাইল বের করল। কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপে কোনো ভিডিও পাওয়া গেল না।

” কোথায় আপনার ভিডিও?”

” এখানে না, মেসেঞ্জারে দেখো। মানে ফেসবুকে।”

উষসী তার কপাল চেপে ধরল। ইয়ামিন তার হাত টেনে উদগ্রীব কণ্ঠে বলল,” কি হয়েছে?”

” উফ, ছাড়ুন। হাতে ব্যথা লাগছে। একটা ভিডিওর জন্য এমন করতে হয়? আমি ভিডিও দেখতে পারব না।”

” কেন?”

উষসী মাথায় হাত রেখে বলল,” কপাল! আমি তো এক সপ্তাহ ধরে আমার আইডিতেই ঢুকতে পারছি না। তৃষাণ ভাইয়া আমার ফোন ভেঙে ফেলেছিল। তারপর ফেসবুক, জিমেইল, সবকিছুর পাসওয়ার্ড ভুলে গেছি। আর রিসেট করাও হয়নি। ভিডিওটা কি বেশি আর্জেন্ট ছিল?”

ইয়ামিন হতাশ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। মাথার পাগড়ি খুলে ফেলল। মুহূর্তেই তার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। উষসী তার পাশে এসে বলল,” আই এম স্যরি। আপনি আমাকে আগে বলবেন না? আচ্ছা আপনার ফোনে নিশ্চয়ই ভিডিওটা আছে… এখনি দেখব দিন।”

ইয়ামিন নিরস কণ্ঠে বলল,” দরকার নেই।”

” কেন দরকার নেই? আপনার কাছে যখন ভিডিওটা এতোই ইম্পোর্ট্যান্ট তখন দেখি আমি….”

” কোনো জরুরী ভিডিও না… এমনি। টাইম ওয়েস্ট।”

ইয়ামিন এই কথা বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। উষসী ঠোঁট উল্টে বলল,” অদ্ভুত! ”

এই ঘটনার পর থেকেই ইয়ামিনের আচরণ খুব বদলে গেল। সে খুব শান্ত হয়ে গেল। কারো সাথে কথা বলল না। কেমন নিষ্প্রভ একটা ভাব। সে প্রচন্ড সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে লাগল।

বিয়ের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ইয়ামিন আর উষসী বরাবর বসেছে। খিলখিল করে প্রতিটি কথায় হাসছে উষসী। এমন হাসি-খুশি আর প্রাণচঞ্চল বধূ বিয়ে বাড়িতে কমই দেখা যায়। ইয়ামিন নিষ্পলক উষসীর দিকে তাকিয়ে আছে।

তার দমবন্ধকর কষ্ট হচ্ছে। এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো, সে বিরাট ভুল করে ফেলেছে। উষসীর মুখের দিকে তাকাতেই নিজেকে নিকৃষ্ট অপরাধী মনে হচ্ছে। এই মেয়েটিকে সে কিভাবে ভালো রাখবে? তাকে দেওয়ার মতো ইয়ামিনের কাছে কিচ্ছু অবশিষ্ট নেই। না মন আর না ভালোবাসা!

সারাজীবন অভিনয় করে কাটানো কি সম্ভব? ইয়ামিন যদি ক্লান্ত হয়ে যায়? তার জীবনটা বিরাট এক নাট্যশালা হয়ে যায়নি তো? যেখানে তার কাজ শুধু ভালোবাসার অভিনয় করে যাওয়া!

কাজী সাহেব কাগজপত্র ঠিক করছিলেন এমন অবস্থায় ইয়ামিন হঠাৎ উঠে বলল,” আমি উষসীর সাথে আলাদা কথা বলতে চাই।”

ইয়ামিনের আচরণ দেখে বিয়ে বাড়িতে হাসির রোল পড়ে গেল এবার। এমন অদ্ভুত বর বোধ হয় কেউ দেখেনি। একটু পর পর যে শুধু বউয়ের সাথে আলাদা করে কথা বলতে চায়! একজন মুরব্বি বললেন,” শান্ত হও বাবা। আর মাত্র কয়েক মিনিট পরেই তোমাদের বিয়ে হয়ে যাবে। তারপর সারাজীবন তো আলাদাই কথা বলবে।”

হাসির শব্দ বৃদ্ধি পেল। উষসী লজ্জায় মুখ চেপে ধরে আছে। কিন্তু ইয়ামিন ঘামছে। ডোনা বললেন,” বসো বাবা। শুভকাজে বাগড়া দিতে হয় না। বিয়ে মিটে গেলে তোমাদের আলাদা ঘরে পাঠানো হবে। তখন যত ইচ্ছা কথা বলে নিও।”

যুথিও একই কথা বললেন। সবার অনুরোধ রক্ষার্থে ইয়ামিন বসতে বাধ্য হলো। তারপর তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল… তাদের বিয়েটা হয়ে গেল। এই ভুল শোধরানোর এখন আর কোনো উপায় নেই। ইয়ামিনের মনে হচ্ছে…জীবনের চলার পথ যেন আগের চেয়ে অনেকটা কঠিন হয়ে গেল।

চলবে

আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-২৮+২৯

0

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ২৮
লিখা: Sidratul Muntaz

উষ্ণতার ক্ষীপ্র ধাক্কায় উষসী হড়বড় করে জেগে উঠলো। তার শরীর তখন ইয়ামিনের বাহুতে বন্দী। ইয়ামিন ঘুমে বিভোর। উষসী চোখ খুলে সামনে তাকাতেই আত্মা নড়ে ওঠার মতো দৃশ্য দেখল। দরজার সামনে পুরো গ্রামবাসী ভীড় জমিয়েছে। রক্তিম চোখমুখ নিয়ে সবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে যুথি। তার চেহারাতে ঘৃণা, বিস্ময়, রাগের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। সারারাত কি হয়েছিল সেটা উষসী ছাড়া কেউ জানে না। কিন্তু সবার চেহারা দেখে বোঝাই যাচ্ছে যে তারা খুব জঘন্য কিছু কল্পনা করছে।

উষসীকে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হলো না। যুথি বেগম তেড়ে এলেন উষসীকে থাপ্পড় মারতে। উষ্ণতা দুইহাতে আটকে দিল। অস্পষ্ট স্বরে বলল,” মা, প্লিজ। ”

যুথি বেগম উন্মাদের মতো বললেন,” ছাড় আমাকে, ছাড়! এই কলংকিনীকে আজ খু*ন করবো আমি।”

এই কথা বলেই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন তিনি। উষসীর বুক জুড়ে তীক্ষ্ণ ব্যথা শুরু হলো। তীব্র শব্দে ইয়ামিনও জেগে উঠেছে। সে উষসীকে নিজের পাশে দেখে আর আশেপাশে এতো ভীড় দেখে ঘাবড়ে গেল। অবুঝ কণ্ঠে প্রশ্ন করল,” কি ব্যাপার?”

উষসীর লজ্জায় তখনি মন চাইল ম*রে যেতে। রাতে হাসপাতাল থেকে ফিরে সবাই যে যার মতো ঘুমিয়ে পড়েছিল। ইয়ামিনের আসার খবর কেউ জানে না। সকালে সর্বপ্রথম মাইমুনা উষসীর ঘরে এসে এই ইয়ামিন আর তাকে একসঙ্গে দেখতে পায়। তারপর সবাইকে ডেকে আনে।

উষ্ণতা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ইয়ামিনের দিকে তাকালো। তার ধারণা ইয়ামিন উষসীর আবেগী মনের ফায়দা লুটেছে। শুধু উষ্ণতা না ডোনার ধারণাও তাই। সে তেড়ে এসে ইয়ামিনের কলার ধরে তাকে উঠিয়ে জিজ্ঞেস করল,” কি করেছো তুমি আমার উষুর সাথে? এখন নাটক করা হচ্ছে?”

উষসী বিকট চিৎকার দিয়ে দৌড়ে এসে ডোনার হাত ধরে বলল,” ভালো আন্টি প্লিজ, উনার দোষ নেই। উনাকে কিছু বোলো না দোহাই লাগে।”

যুথি বেগম এই কথায় আরও রেগে গেলেন। চুলের মুঠি ধরে উষসীকে দাঁড় করালেন। একাধারে থাপ্পড় মারতে লাগলেন দুইগালে। ডোনা তাকে থামালেন। উষ্ণতার তখন মাথা ঘুরছে৷ সে দরজা ধরে খুব কষ্টে দাঁড়িয়ে রইল। ইয়ামিন ঘুম থেকে উঠে এমন পরিস্থিতি দেখে বাকরুদ্ধ। সে জানে না তার অপরাধ কোথায়! কিন্তু এইটুকু বুঝতে পারছে যে বিরাট কিছু ভুল হয়েছে।

উষসী ডোনার বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। হঠাৎ তার চোখ গেল মিসেস শিমলার দিকে। তিনি হতভম্ব হয়ে পুরো ঘটনা দেখছেন। নিজের ছেলের এতো অপমান মেনে নিতে পারছেন না।

উষসী মিসেস শিমলার কাছে গিয়ে হাত জড়ো করে বলল,” আমাকে মাফ করে দিন আন্টি। সব ভুল আমার। রাতে উনি আসার পর আমি আপনাকে জানাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনার ফোন বন্ধ ছিল। তারপর উনি ঘুমিয়ে গেলেন।আর উনার খুব জ্বর ছিল সেজন্য আমিও অন্যঘরে যাইনি। তারপর কখন চোখ লেগে এসেছিল বুঝতে পারিনি…”

উষসী থামল, ইয়ামিন যে ঘুমের ঘোরে তার হাত ধরে রেখেছিল আর সেজন্যই সে উঠে যেতে পারেনি সেই কথা আর বলল না সবার সামনে। পাশ থেকে মাইমুনার মা বললেন,” এটা আবার কেমন কথা? তুমি উপযুক্ত মাইয়া হয়া একটা পোলার পাশেই ঘুমায় যাইবা? কোনো হুশ থাকব না? এগুলাই কি তোমাগোর শহরের আদব-কায়দা! তওবা তওবা।”

যুথির চোখ দু’টো আগুন মতো ধিক ধিক করে জ্বলছে। পারলে তিনি উষসীকে এখনি খু*ন করে ফেলতেন।ডোনা খুব কোমল স্বরে বললেন,” আপনারা আমাদের মেয়েকে ভুল বুঝবেন না। ইয়ামিন তো ওর বড়ভাইয়ের মতো। আমাদের আত্মীয় হয়। ওদের মধ্যে কোনো খারাপ সম্পর্ক নেই বিশ্বাস করেন!”

উষ্ণতার চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ছে। নিজের পরিবারের মানুষদের এমন অসহায় অবস্থা দেখে নিজেকেও খুব অসহায় লাগছে। ইয়ামিন হঠাৎ ঘর থেকে বের হয়ে গেল। মিসেস শিমলা ছেলেকে কিছু বললেন না। উষসীর কাঁধে হাত রেখে শুধু বললেন,” এভাবে কেঁদো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

উষসী স্বস্তি পেল অন্তত এই ভেবে যে শিমলা আন্টি তাকে ভুল বোঝেননি। কিন্তু অন্যদের মুখ তো থেমে থাকবে না। তারা মেহমান দেখে কেউ কিছু বলছে না। কিন্তু এই খবর তো ঠিক রটিয়ে যাবে। একটা অবিবাহিত ছেলে আর মেয়েকে ফাঁকা বাড়িতে ঘনিষ্ট অবস্থায় শুয়ে থাকতে দেখা গেছে। এই ঘটনার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা থাকতে পারে না। সবাই সেটাই ভাববে, আপাতদৃষ্টিতে যেটা ভাবা উচিৎ!

সেদিনের পর থেকেই উষসীর জীবনটা নরক হয়ে গেছে। তারা ঘাটাইল থেকে ফিরে আসার পর সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে খবরের কাগজে পর্যন্ত এই ঘটনা প্রচার করা হচ্ছে। রসুলপুরে একজন নিউজ রিপোর্টার এই কাজ করেছেন। উষসী তার পরিবারকে বুঝাতে পারলেও বাইরে কাউকে বুঝাতে পারবে না যে তাদের মধ্যে সেদিন কোনো খারাপ সম্পর্ক হয়নি। বাইরে বের হলেই এখন মানুষ উষসীর দিকে আগ্রহ নজরে তাকায়। যেন চিড়িয়াখানার কোনো জন্তু দেখছে। মজার রসালো টপিক পেয়ে ফেসবুকে রীতিমতো তোলপাড় শুরু হয়েছে। মিমস শেয়ার হচ্ছে। রোস্টিং ভিডিও হচ্ছে, ট্রল হচ্ছে। যা ইয়ামিনের ক্যারিয়ারের জন্য মারাত্মক হুমকি এবং উষসীর পুরো জীবনের জন্যই!

উষসী নিজেকে ঘরবন্দী করে ফেলল। গুজব বাড়তে বাড়তে মহামারী আকার ধারণ করেছে। উষসীর ভার্সিটি যাওয়াও বন্ধ হয়ে গেল। কেউ কেউ আবার বলতে লাগল উষসী নাকি প্রেগন্যান্ট। কিছু কিছু বান্ধবীরা উষসীকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল। উষসী সবার ফোন ধরা বন্ধ করে দিল। একদম তিল থেকে তাল হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। যুথি বেগম তো একদিন বলেই দিলেন,” আমার সাথে ডাক্তারের কাছে চল। তোকে টেস্ট করাবো। বলা তো যায় না, যদি সত্যিই সর্বনাশ হয়ে থাকে! পেট থেকে পাপ সরাতে হবে না?”

উষসী মায়ের কথার কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। কিন্তু রুমে এসে মেঝেতে গড়াগড়ি খেয়ে কেঁদেছে। তার নিজের থেকেও বেশি খারাপ লাগছে ইয়ামিনের জন্য। নিষ্পাপ মানুষটা শুধুমাত্র উষসীর ভুলের জন্য সবার কাছে অপদস্থ হচ্ছে। উষসীকে কোন ভূতে পেয়েছিল যে সে সেদিন ইয়ামিনের ঘরে ঘুমিয়ে পড়ল? হায় আল্লাহ! এই কলংকের দাগ মুছবে কি করে?

তৃষাণের মনে পড়ে যায় নয়বছর আগের সেই অভিশপ্ত দিনগুলোর কথা।এইরকম একটা জঘন্য পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে উষ্ণতাকেও যেতে হয়েছিল। সেজন্যও ইয়ামিন দায়ী। আজকের এই ঘটনার জন্যেও দায়ী সেই একই ব্যক্তি! তাই ইয়ামিনের উপর তৃষাণের ক্রোধ সীমাহীন। সাধ্য থাকলে সে ইয়ামিনকে খু*ন করে ফেলতো। সত্যিই খু*ন করে ফেলতো।

একদিন মিসেস শিমলা উষসীদের বাড়িতে হাজির হলেন। তাকে দেখে সবাই খুব অবাক এবং একইসাথে অপ্রস্তুত হলো। শিমলা ইয়ামিন আর উষসীর বিয়ে দিবেন বলে মনস্থির করেছেন। রসুলপুরে প্রথমে এই প্রস্তাবটা তিনি ডোনার কাছেই দিয়েছিলেন। কিন্তু ডোনা জানতো তৃষাণ রাজি হবে না। তাই তিনি গোপনে নাকচ করে দেন। পরে কাউকে এই বিষয়ে কিছু জানাননি।

আজ শিমলা পুনরায় একই প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। তৃষাণ বাড়িতেই আছে। সে এসব শুনলে ভয়ংকর অবস্থা হবে। ডোনা ভয়ে চুপসে গেলেন। কিন্তু তৃষাণ খুব বেশি সিন ক্রিয়েট করল না। সে ঠান্ডা মাথায় নিষেধ করে দিল,”এমন কিছু হয়ে যায়নি যে বিয়ে দিতে হবে। মানুষের মুখ বন্ধ করা কোনো ব্যাপার না। তাছাড়া আমার শালিকার জন্য আমরা অনেক ভালো পাত্র পেয়ে যাবো। মেয়ে লাখে একটা। আপনি আর আপনার ছেলে নিশ্চিন্ত থাকুন।”

শিমলা অপমান গায়ে মাখলেন না। তিনি বুঝে নিলেন তৃষাণ একটু ঘাড়ত্যাড়া ধরণের। কিন্তু উষসীকে তিনি খুব পছন্দ করে ফেলেছেন। তাছাড়া ছেলের বিয়ের আশা তো তিনি ছেড়েই দিয়েছিলেন। এই উছিলায় যদি তাও বিয়েটা হয়! উষসীর মতো মিষ্টি একটা মেয়েকে পুত্রবধূ হিসেবে পাওয়ার সুযোগ তিনি হাতছাড়া করতেই চান না।

শিমলা আলতো হেসে বললেন,”আমি জানি, তোমাদের মেয়ে লাখে একটা। আমার ছেলের চেয়েও অনেক যোগ্য পাত্র তোমার সুন্দরী শালিকার জন্য পাওয়া যাবে। তবুও আমি একটা আবেদন নিয়ে এসেছি। এটা আমার একান্ত অনুরোধ। আমি উষসীর থেকে ভালো মেয়ে আমার ছেলের জন্য পাবো না। প্লিজ, একটু কনসিডার করো।”

তাঁর কণ্ঠের আর্দ্রতা দেখে যুথির মন সঙ্গে সঙ্গে ভিজে গেল। যে মহিলার কথা এতো কোমল আর আচরণ এতো নিরহংকারী; তাঁর বাড়ির বউ হয়ে গেলে নিশ্চয়ই উষসী অসুখী হবে না। কিন্তু ইয়ামিনকে নিয়ে একটা সমস্যা থেকেই যায়। আবার এতোবড় একটা ঘটনা ঘটার পর সেই সমস্যাকে বড় করে দেখারও মানে হয় না। যুথি ঠিক করে ফেললেন, এই বিয়ের প্রস্তাব তিনি গ্রহণ করবেন!

তৃষাণ সোজা-সাপটা জবাব দিল,” সম্ভব না আন্টি। আমরা মেয়ে দিবো না। কিছু মনে করবেন না।”

যুথি ড্রয়িংরুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ভেতরে এসে বললেন,” কিন্তু আমি আমার মেয়েকে দিবো।”

হঠাৎ যুথির এমন কথা শুনে তৃষাণ হতচকিত হলো। বিস্মিত দৃষ্টিতে শুধাল,” মা, এসব কি বলছেন?”

যুথি অনুভূতি শূন্য কণ্ঠে বললেন,” ঠিকই বলছি। আমার মেয়ের বদনাম হয়ে গেছে। বিয়ে না হলে ওর জীবন অর্ধেক শেষ হয়ে যাবে। তার চেয়ে ভালো বিয়ে হোক।”

তৃষাণ বোঝানোর চেষ্টা করল,” মা, এই সামান্য বিষয়ে উষুর জীবন নষ্ট হবে না। বোঝার চেষ্টা করুন। মানুষ কিছুদিন গেলেই সব ভুলে যাবে। কিন্তু এভাবে বিয়ে হলে সারাজীবন রিগ্রেট করতে হবে।”

শিমলা আত্মবিশ্বাসের সাথে বললেন,” কোনো রিগ্রেট করতে হবে না। আমি কথা দিচ্ছি, উষসীকে আমি সর্বোচ্চ যত্নে রাখবো। তোমাদের কাছে আমি অনুরোধ নিয়ে এসেছি। আপা প্লিজ, আপনি অন্তত নিষেধ করবেন না।”

যুথি বললেন,” আমি নিষেধ করছি না। আমিও চাই এই বিয়ে হোক। উষু আমার মেয়ে। ওর বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা আমার আছে।”

তৃষাণ রাগ করে উঠে চলে গেল। রান্নাঘরে উষ্ণতা শিমলার জন্য চা বানাচ্ছিল। তৃষাণ আচমকা সেখানে ঢুকে দাঁতে দাঁত চিপে বলল,” তোমার মাকে বোঝাও।”

উষ্ণতা আশ্চর্য হয়ে তাকাল। ‘তোমার মা’ এভাবে তৃষাণ আগে কখনও বলেনি। উষ্ণতা রাগী গলায় জানতে চাইল,”মানে? কি করেছে আমার মা?”

” শিমলা আন্টি ইয়ামিন আর উষসীর বিয়ের প্রস্তাবে নিয়ে এসেছে। সেই প্রস্তাবে তোমার মা আমার নিষেধ না শুনেই হ্যাঁ বলে দিয়েছে।”

এই কথা শুনে উষ্ণতা মনে মনে ভীষণ আনন্দিত হলেও সেটা তৃষাণের সামনে প্রকাশ করল না। ঢোক গিলে নিজেকে সামলে নিল। সে বিশ্বাসই করতে পারছে না। যদি এমন হয় তাহলে সত্যি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

যুথি আনন্দের সাথে মিসেস শিমলার প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন। শিমলা ‘আলহামদুলিল্লাহ’ উচ্চারণ করে যুথিকে জড়িয়ে ধরলেন খুশি হয়ে। উষসীও শোরগোল শুনে ড্রয়িংরুমে ঢুকল। মিসেস শিমলাকে দেখে তার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ছুটে এসে বলল,

” আন্টি, আপনি এসেছেন? কেমন আছেন আন্টি?”

শিমলা উষসীকে জড়িয়ে ধরে বললেন,” ভালো আছি মা। তুমি কিন্তু একবারও আমার বাসায় এলে না।”

” স্যরি আন্টি। একদিন নিশ্চয়ই আসব।”

” আর আসতে হবে না। তোমাকে পার্মানেন্টলি আমার বাড়িতে নেওয়ার ব্যবস্থা করছি।”

উষসী এই কথার অর্থ বুঝতে পারল না। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। সে আসলে চিন্তাও করতে পারেনি যে এতোকিছুর পরে শিমলা আন্টি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে তাদের বাড়ি আসবেন। যখন ডোনার কাছে সে বিস্তারিত সব শুনল, তখন না আনন্দিত হতে পারল আর না বিস্মিত। সে বুঝতেই পারল না যে তার কি করা উচিৎ। তাছাড়া একটা দ্বিধা এখানে থেকেই যায়। ইয়ামিন কি বিয়েতে রাজি? সে বাধ্য হয়ে বিয়েটা করছে না তো! উষসী এভাবে কখনও ইয়ামিনকে পেতে চায়নি।

চলবে

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ২৯
লিখা- Sidratul Muntaz

বিয়ের আগে ইয়ামিনের সাথে আলাদা কথা বলা জরুরী। কিন্তু উষসী এই আবদার করার সাহস পাচ্ছে না। উষ্ণতারও ব্যাপারটা নিয়ে খটকা লাগছে। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে মিসেস শিমলা একা এসেছেন। ইয়ামিন কেন আসেনি? তৃষাণও বেঁকে বসে আছে। সে কোনো অবস্থাতেই বিয়ে মানবে না।

উষ্ণতার মনে হয় মানুষ চেনার ক্ষমতা তার থেকে তৃষাণের অনেক বেশি। সে ইয়ামিনকে এতো অপছন্দ করে মানে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। উষ্ণতা ইয়ামিনের সাথে ঠান্ডা মাথায় কথা বলার সিদ্ধান্ত নিল। তবে এর আগে উষসীর মত জানাও জরুরী। প্রথমে সে উষসীর সাথেই কথা বলল। সবকিছু বিস্তারিত জানতে চাইল। তার প্রথম প্রশ্ন ছিল,” ইয়ামিনকে তুই বিয়ে করতে চাস?”

উষসী কেঁদে ফেলে বলল,” না৷ আমি তো আমার ছায়াও তার জীবনে পড়তে দিতে চাই না। আমি পাপী। খুব বড় পাপ করেছি।”

” তোর কাজ যদি পাপ হয় তাহলে সেও পাপী। তুই একা কেন শাস্তিভোগ করবি?”

” না আপু, উনার কোনো দোষ নেই। তুমি বিশ্বাস করো! উনি নির্দোষ। বরং আমার জন্যই উনার ক্যারিয়ারটা ধ্বংস হয়ে গেল।”

” কিভাবে সে নির্দোষ হয়? বল আমাকে!”

উষসী সেইরাতের ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা করল। সবকিছু শোনার পর উষ্ণতা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ল।

আসলেই কি এমন ঘটেছে? নাকি উষসী ইয়ামিনকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যে বানিয়ে বলছে? মেয়েটা খুব বোকা। সে এমন করতেই পারে।

সত্যতা যাচাই করতে উষ্ণতা চিন্তা করল ইয়ামিনের সাথেও একই বিষয় নিয়ে আলাদাভাবে কথা বলবে। যদি সেও একই স্টেটমেন্ট দেয় তাহলে বুঝতে হবে ঘটনা সত্যি। আবার এমনও হতে পারে যে সে উষসীকে বাঁচানোর জন্য নিজের ঘাড়ে সব দোষ নিতে চাইবে। যদি এটা হয়, তাহলে উষ্ণতা অন্তত এইটুকু নিশ্চিত হবে যে ইয়ামিন তার বোনকে সত্যিকার অর্থেই ভালোবাসে! তখন প্রয়োজনে তৃষাণের বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও উষ্ণতা তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করবে।

ইয়ামিনের সাথে উষ্ণতা দেখা করল তার ভার্সিটির ক্যান্টিনে। ইয়ামিনকে নির্দিষ্ট সময় আসতে বলা হয়েছিল। কিন্তু ইয়ামিন আরও একঘণ্টা আগেই এসে অপেক্ষা করছে। এর মাঝে পুরো ভার্সিটিতে ভীড় জমে গেল। ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে সকলে সেলফি, অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল। ইয়ামিনের একঘণ্টা সময় ফ্যানদের নিয়েই কেটে গেল।

তারপর উষ্ণতা ক্লাস নেওয়া শেষ করে বের হলো। তাকে দেখে ইয়ামিনের হৃদয় জুড়ে হু হু করে এক গাঢ় বেদনাময় বাতাস প্রবাহিত হলো। কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে উষ্ণতার চেহারাটা। দেখে বোঝাই যায় বোনের চিন্তায় অস্থির সে। ইয়ামিনের মনে অপরাধবোধ তৈরী হলো৷ সে আসলেই উষ্ণতার জীবনের অভিশাপ। যতবার সে উষ্ণতার জীবনে প্রবেশ করে ততবার উষ্ণতার গোছানো জীবন তছনছ হয়ে যায়!

ইয়ামিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নিজের ভালোবাসা নামক কালো ছায়া নিয়ে আর জীবনেও উষ্ণতার সামনে দাঁড়াবে না। কিন্তু উষ্ণতার আহ্বান তাকে নিজের কাছে করা প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে বাধ্য করেছে। উষ্ণতা ইয়ামিনকে বলল,” বসো।”

দুইজন দুইটি চেয়ার দখল করে বসল। উষ্ণতা কিছু অর্ডার করতে চাইল। কিন্তু ইয়ামিন খেতে চাইল না। তারপর শুধু কফি অর্ডার করা হলো। প্রথমেই উষ্ণতা কথা শুরু করল,” গতকাল আন্টি আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন, তোমার আর উষসীর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।”

ইয়ামিন কেমন অস্বস্তিবোধ করল। তার আর উষসীর বিয়ে… শুনতেই অদ্ভুত লাগছে। এটা সে কখনও কল্পনাই করতে পারে না।

উষ্ণতা বলল,” কাশ্মীরে তোমাদের দেখেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে তোমাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরী হয়েছে। কিন্তু সেই সম্পর্ক কতটা গভীর তা তো আমি জানি না। বিয়ের জন্য কি আসলেই তোমরা প্রস্তুত?”

ইয়ামিন এতো চমকালো যে প্রতিউত্তর করার জন্য শব্দ খুঁজে পেল না। এবার বুঝতে পারল যে কেন উষ্ণতা তাকে বার-বার বাড়িতে ডাকতো। অথচ ইয়ামিনের এটা একবারও মাথাতেই আসেনি। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুক চিরে।

উষ্ণতা বলল,” সে বিষয়ে কথা বলতেই তোমাকে সেদিন ডিনারে ইনভাইট করেছিলাম। কিন্তু এরপর যা হলো, বুঝতেই তো পারছো। তোমাদের সম্পর্কটা নিশ্চয়ই আগের মতো নেই। এমন অপ্রীতিকর অবস্থায় বিয়ে আমরা কেউই চাইনি। কিন্তু আমার বোনের বদনাম যে হলো, এর ক্ষতিপূরণ কি দিয়ে হবে বলো? মেয়েটা একদম পাগলের মতো হয়ে গেছে। সারাদিন দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকে। আমার এতো হাসি-খুশি বোনটার এমন মুষড়ে থাকা আচরণ ভালো লাগছে না। সবকিছু অসহ্য মনে হচ্ছে। তারপর ভাবলাম নিজেই ওর সাথে কথা বলি৷ সেদিন রাতে কি কি হয়েছিল উষু আমাকে সব বলেছে। কিন্তু তোমার থেকেও শুনতে চাই। তুমি আমাকে বড়বোন মনে করে নিঃসংকোচে বলতে পারো, সেদিন রাতে কি হয়েছিল তোমাদের মধ্যে? ”

ইয়ামিনের তখন দুনিয়া ঘুরছে। তার অগোচরে এতোকিছু হয়ে যাচ্ছিল অথচ সে একটুও বুঝতে পারেনি!

উষ্ণতা ইয়ামিনের চোখের দিকে চেয়ে বলল,” আমি বুঝেছি, তুমি হয়তো অস্বস্তিবোধ করছো। ঠিকাছে তোমাকে বলতে হবে না। কিন্তু ইয়ামিন, তোমাদের মধ্যে যে একটা সম্পর্ক ছিল এবং সেটা বিয়ে পর্যন্ত গড়ানো সম্ভব এটুকু তো নিশ্চিত তাই না? তুমি উষুকে বিয়ে করতে চাও না?”

” জ্বী?”

ইয়ামিন এমনভাবে জবাব দিল যেন তাকে বিষপান করতে বলা হয়েছে। উষ্ণতার চোখ দু’টো টলমলে হয়ে এলো। অজানা শঙ্কায় কেঁপে উঠল বুক। ভ্রু কুঞ্চিত করে বলল,” আমার বোনের লাইফটা শেষ হয়ে যাবে ইয়ামিন। তুমি ওর অবস্থা জানো না। ও যে কতটা মেন্টাল স্ট্রেসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সেটা আমি দেখেছি শুধু। যেকোনো সময় খারাপ কিছু করে ফেলতে পারে মেয়েটা। যদি সত্যিই ওর কিছু হয়ে যায় তাহলে আমি মরে যাবো।”

ইয়ামিন সাথে সাথে মাথা তুলে বলল,” ছি, কি বলছেন এসব?”

উষ্ণতা মুখে হাত দিয়ে নিজেকে সামলালো। ধাতস্থ হয়ে বলল,” আমার মনে হয় তোমাদের বিয়েটাই এসবের একমাত্র সমাধান। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি ইয়ামিন। সেদিনের ওই ঘটনায় সবাই তোমাকে ভুল বুঝলেও আমি ভুল বুঝিনি। আমি যেমন তোমাকে বিশ্বাস করি…তেমন আমার বোনকেও বিশ্বাস করি। তাই নিঃসন্দেহে ওর দায়িত্ব আমি তোমাকে দিতে চাইছি। তুমি কি দায়িত্বটা নিবে?”

ইয়ামিন ভাবল। কয়েক মুহুর্তেই অনেককিছু ভেবে ফেলল। উষ্ণতার কাছে সারাজীবন ঘৃণিত হয়ে থাকার চেয়ে একজন ভরসাযোগ্য পাত্র হতে পারা ইয়ামিনের জন্য অনেক বেশি সৌভাগ্যের!

উষ্ণতা একরাশ ভরসা নিয়ে ইয়ামিনের উত্তরের অপেক্ষা করছে। ইয়ামিন কি করে নিভে যেতে দিবে এই ভরসার আলো? সে কি পারে না সারাজীবনের জন্য উষ্ণতা মিসের ভরসার পাত্র হয়ে যেতে ? সেজন্য নিজের অস্তিত্ব বিসর্জন দিতে হলেও সে দিবে। তাও উষ্ণতা মিসকে ভালো রাখবে। ইয়ামিন সাথে সাথেই হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ল। বলল,” নিশ্চয়ই।”

উষ্ণতা হাসল। আনন্দের হাসি। তারপর হাত বাড়িয়ে বলল,” এভাবে বললে তো হবে না। আগে আমাকে কথা দাও, আমার বোনকে সবসময় খুশি রাখবে। ওর কোনো অযত্ন কখনও করবে না। ওকে আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসবে। প্রমিস করো।”

ইয়ামিন মিথ্যে কথা দিতে পারে না। সে উষসীকে কোনোদিন ভালোবাসতে পারবে কি-না সেটাও সে জানে না। তবুও সে উষ্ণতার হাত স্পর্শ করল। মনে মনে প্রমিস করল,” আপনাকে আমি সবসময় খুশি রাখবো মিস। শুধু আপনাকে খুশি রাখতে, পৃথিবীর সব পারব আমি।”

উষ্ণতা ইয়ামিনের মৌনতাকে সম্মতির লক্ষণ ভেবে নিল।খুশিতে ঝলমল করে উঠল তার চেহারা। সেই খুশি মাখা মুখ ইয়ামিন অবাক হয়ে দেখল। এমন খুশির জন্য সে নিজেকেও ভুলতে পারে। আর একটা বিয়ে কোনো ব্যাপার হলো?

ব্রেকটাইম শেষ হয়ে এসেছে। উষ্ণতা উঠতে উঠতে বলল,” তুমি সাথে গাড়ি এনেছো না?”

” জ্বী।” সে ভাবল উষ্ণতা বুঝি তার সঙ্গে গাড়িতে করে কোথাও যাবে। কিন্তু উষ্ণতা বলল,” তাহলে উষসীকে বাসায় ড্রপ করে দাও।”

” উষসী?” ইয়ামিন থমকালো।

মাথা নিচু করে ক্যান্টিনের বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে উষসী। আজকে উষ্ণতার সাথে সে কলেজে এসেছে একটাই কারণে। ইয়ামিনের সাথে আলাদা কথা বলবে। কিন্তু ইয়ামিনের সামনে যেতে লজ্জা লাগছে তার। উষ্ণতা বলল,” হ্যাঁ। তোমার সাথে দেখা করার জন্যই ও এসেছে। যেতে যেতে তোমরা রাস্তায় কোথাও থামতে পারো। কফিশপ বা রেস্টুরেন্টে যেতে পারো। আমি মাইন্ড করব না।”

উষ্ণতা হাসল৷ তার গেঁজ দাঁত ঝিলিক দিয়ে উঠল। সেই হাসি ইয়ামিনের হৃদয়ে এক টুকরো সাদা মেঘের পরশ মিশিয়ে গেল। উষ্ণতা ক্যান্টিন থেকে বের হতেই দেখল উষসী দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। তার কাঁধে হাত রেখে উষ্ণতা হাসিমুখে বলল,” সাবধানে যাস। তোর তৃষাণ ভাইকে ম্যানেজ করার দায়িত্ব আমার।”

” থ্যাঙ্কিউ আপু। কিন্তু আমার খুব নর্ভাস লাগছে।”

উষ্ণতা চোখ বড় করে বলল,” এখানে নর্ভাস লাগার কি আছে? পাগলি, যা তো!”

________________
পাশাপাশি বসেও নিশ্চুপ দু’জনেই। ইয়ামিন মনোযোগের সাথে ড্রাইভ করছে। উষসী কি বলে কথা শুরু করবে তা ভেবে পাচ্ছে না। খুব কষ্টে উচ্চারণ করল,” আই এম স্যরি।”

ইয়ামিন অন্যমনস্ক ছিল। উষসীর কথা সে শুনতেও পায়নি। উষসী আবার বলল,” আই এম স্যরি।”

ইয়ামিন একটু অবাক হয়ে তাকাল। অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলল,” স্যরি কেন?”

উষসী হতাশ সুরে বলল,” আমার ভুলের জন্যই সবকিছু হয়েছে। যদি সেদিন রাতে আমি ওই ঘরে না বসতাম…”

উষসী কথা শেষ করতে পারল না। তার গলা ধরে আসছে। ইয়ামিন ইতস্তত করে বলল,” এখানে দোষ শুধু তোমার না। আমারও আছে। আমি তোমার হাত ধরে রেখেছিলাম বলেই তুমি অন্যরুমে যেতে পারোনি।”

উষসীর চোখ দু’টো মার্বেলের মতো বড় হয়ে গেল। বিস্ময়ে অপ্রস্তুত হয়ে শুধাল,” আপনি ইচ্ছে করে আমার হাত ধরেছিলেন?”

ইয়ামিন অকপটে বলল,” হ্যাঁ। ”

তার দৃষ্টি সামনের দিকে। উষসী তার অবিশ্বাস্য চাহনী নিয়ে তাকিয়ে রইল। কয়েক মুহূর্ত পর প্রশ্ন করল,” কেন? আপনি এমন কেন করবেন?”

ইয়ামিন অস্বস্তির সাথে উচ্চারণ করল,” কারণ আমার তখন মনে হচ্ছিল…তুমি আমার পাশে থাকলে আমার ভালো লাগবে।”

উষসীর নিশ্বাস থেমে এলো৷ মস্তিষ্ক এতো চাপ নিতে পারছে না। সেদিনের মতো এটাও ধোঁকা নয়তো? একটু পর কি ইয়ামিন আবার বলবে যে সে অ্যাকটিং করেছি?

” তোমার ফোন।”

উষসী থম মেরে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইয়ামিন আবার বলল,” তোমার ফোন বাজছে উষসী।”

উষসী অন্যমনস্ক কণ্ঠে উচ্চারণ করল,” হ্যাঁ? ”

ইয়ামিন উষসীর ফোনটা তুলে তার সামনে ধরল। তৃষাণের নাম্বার দেখে উষসীর হুশ ফিরে এলো। ভয়ে জড়সড় হয়ে গেল মন। দ্রুত মোবাইল সুইচড অফ করে দিল। তৃষাণের সাথে এখন কথা বলা সম্ভব না। ইয়ামিনের সাথে দেখা করতে আসার ব্যাপারটা সে জানে না।

উষসীর লজ্জা লাগছে প্রচন্ড। ইয়ামিনের কথা শুনে এতো বোকা হয়ে গেছিল যে ফোনের রিংটোন পর্যন্ত শুনতে পায়নি। কত পাগল সে! ইয়ামিন কি ভাববে? উষসী আড়চোখে ইয়ামিনের দিকে চাইল।

বিষণ্ণ মনে ড্রাইভ করছে সে। উষসীকে মাত্রই একটা মিথ্যা বলা হয়েছে। সেই রাতে জ্বরের ঘোরে ইয়ামিন উষসীর হাত ধরেছিল। কিন্তু তখন সে স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল না। উষসীর হাত ধরলেও মনে মনে সে কামনা করেছিল অন্যকাউকে! এই সত্যি উষসীর জানার কোনো প্রয়োজন নেই। সবাইকে সব সত্যি বলা যায় না।

ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও ইয়ামিন একটা কফিশপ দেখে গাড়ি থামালো। গাড়ি থেকে নামার আগে সানগ্লাস আর মাস্ক পরে নিল। নাহলে আবার ফ্যানরা এসে হামলা চালাতে পারে। উষসী বলল,” আমরা কোথায় যাচ্ছি?”

” তুমি বলো, কোথায় যেতে চাও?”

উষসী বিস্মিত হয়ে শুধাল,” আমি যেখানে যেতে চাইবো, সেখানেই নিয়ে যাবেন?”

” অফকোর্স, এখন থেকে তুমি যা চাও তাই হবে।”

উষসীর বিস্ময়ের সীমা রইল না। এটা কি বাস্তব নাকি আবারও কল্পনা?

চলবে

আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-২৬+২৭

0

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ২৬
লিখা- Sidratul Muntaz

সকাল থেকে তৃষাণ উষ্ণতার সাথে কথা বলছে না। উষ্ণতারও এই বিষয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে মনের সুখে ব্রেকফাস্ট বানালো। তৃষ্ণাকে স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি করালো। ব্রেকফাস্টের সময় টেবিলে খাবার দিলে তৃষাণ নিজেও খেল না আর তৃষ্ণাকেও বলল,” চলো দেরি হয়ে যাচ্ছে। আজকে আমরা বাইরে খাবো, বাবা। বাড়ির খাবার পঁচা।”

তৃষ্ণা অবাক হয়ে বলল,” এতোদিন তো তুমি বলতে বাড়ির খাবার ভালো আর বাইরের খাবারে অসুখ হয়।”

উষ্ণতা কোমরে হাত গুঁজে বলল,” সমস্যা কি তোমার? ছেলেকে এসব কি শেখাচ্ছো? তোমার খেতে ইচ্ছে না করলে বের হয়ে যাও। আমার ছেলে আমার সাথে খাবে। ওকে আমি বাইরে খেতে দিবো না।”

তৃষাণ উষ্ণতার কথার কোনো জবাব না দিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল,” চলো বাবা।”

তৃষ্ণা ভয় ভয় দৃষ্টি নিয়ে মায়ের দিকে তাকাল। এখন কি আবারও ঝগড়া শুরু হবে? সে বাবা-মায়ের ঝগড়া দেখতে দেখতে ক্লান্ত। উষ্ণতা বলল,” ওকে স্কুলে আমি পৌঁছে দিবো। তোমার লেইট হলে তুমি চলে যেতে পারো।”

তৃষাণ এবারও কোনো কথা বলল না। চুপচাপ জুতো পরতে লাগল। তৃষ্ণা অসহায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। একবার মায়ের দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার বাবার দিকে। উষ্ণতা আদুরে কণ্ঠে বলল,” তৃষ্ণা, খেতে বসো বাবা।”

” আমার স্কুলে ক্লাস শুরু হতে আর মাত্র বিশমিনিট বাকি। এরপর গেইট লাগিয়ে দিবে। তোমার সাথে গেলে আমার লেইট হয়ে যাবে।”

” আমার সাথে গেলে লেইট হবে কেন?”

” তুমি রেডি হতে অনেক সময় নাও। এর মধ্যে আমি চারবার পাপার সাথে স্কুলে চলে যেতে পারব।”

উষ্ণতা ছেলের মুখে এমন কথা শুনে অপমানে হতভম্ব হয়ে গেল। তৃষাণ মৃদু হাসছে। ছেলের কথায় যেন সে খুব মজা পেয়েছে। উষ্ণতা রোষাবিষ্ট কণ্ঠে বলল,” এইসব শেখাচ্ছো তুমি ছেলেকে? তোমার সমস্যা কি?”

তৃষ্ণা এবার বলল,” আমি কি কিছু দেখি না? পাপা কেন শেখাবে? তোমার তো ড্রেস সিলেক্ট করতেই একঘণ্টা লাগে।”

উষ্ণতা ধমক মেরে বলল,” এতোই যখন প্রবলেম, যা তুই তোর বাপের সাথে। আমার এতো গরজ নেই যে সকালে উঠে তোর জন্য ব্রেকফাস্ট বানাবো, তোকে স্কুলেও দিয়ে আসবো আবার তোর চটাং চটাং কথাও শুনবো। যত্তসব!”

অনুপমা প্রায় দৌড়ে এলো। তাকে এমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে যে উষ্ণতা একটু ঘাবড়েই গেল,” কি হয়েছে অনু?”

” উষু… উষু…” অনুপমা কথাই বলতে পারছে না। খুব হাঁপাচ্ছে। তৃষাণ বলল,” রিল্যাক্স… আগে একটু দম নাও তারপর কথা বলো। কি হয়েছে?”

” একঘণ্টা ধরে দরজা ধাক্কাচ্ছি ভাইজান। কিন্তু উষু তো দরজা খুলছে না। আমি নিশ্চিত ভেতরে কিছু একটা হয়েছে। মেয়ের কোনো সাড়া নেই।”

এই কথার পর সবার চেহারায় একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। যদিও যুথি এবং তৃষাণ উষসীর উপর মারাত্মক রেগে আছে। কিন্তু এবার তারাও ভয় পেয়ে গেল।

অনেক দরজা ধাক্কানোর পরেও ভেতর থেকে কোনো সাড়া নেই। বাধ্য হয়ে তৃষাণ আর আহমেদ দরজার লক ভাঙল। সবাই ভেতরে গিয়ে দেখল উষসী বিছানায় এলোমেলো অবস্থায় শুয়ে আছে। তার কোনো হুশ নেই।

উষ্ণতা এই দৃশ্য দেখে চিৎকার করে উঠল। তৃষাণ দেখল উষসীর বিছানার পাশে ঔষধের বক্স। প্রচন্ড ঘাবড়ে গিয়ে সে উচ্চারণ করল,” ও মাই গড!”

অনুপমা বলল,” কি হয়েছে ভাইজান?”

তৃষাণ যন্ত্রের মতো আওড়াল,’ মায়ের ঔষধের বক্স এখানে কেন? গতকালই আমি ঔষধ এনেছিলাম। স্পষ্ট মনে আছে আমার। এখানে প্রায় দশটার মতো ট্যাবলেট মিসিং।”

যুথি এই কথা শুনে শব্দ করে কাঁদতে লাগল। ডোনা চেঁচিয়ে বলল,” আমি আগেই বলেছিলাম মেয়েটাকে জোর করার কোনো দরকার নেই৷ তোদের জন্য এসব হয়েছে। কি দরকার ছিল না বলে-কয়ে ইমনদের নিয়ে আসার?”

উষ্ণতা আক্ষেপ করে বলল,” বিয়েটা তো ভেঙে গেছিল। তবুও উষু এমন কেন করল?”

যুথি বলল,” আমার জন্য হয়েছে সব। গতরাতে রাগের মাথায় মেয়েটাকে কতকিছু বলে ফেলেছি। আর এখন এসব কি হয়ে গেল? হায় আল্লাহ! মেয়েটা যে এতো অভিমানী তা আমি আগে বুঝিনি।”

তৃষাণ কাঁপা হাতে উষসীর পালস রেট চেক করল। তারপর লম্বা শ্বাস টেনে বলল,” রিল্যাক্স হও সবাই। আমি এখনি এম্বুলেন্স ডাকছি। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

উষ্ণতার হঠাৎ মনে পড়ল ইয়ামিনের কথা। উষসীর পড়ার টেবিলে একটা ছোট্ট গিটার আর ইয়ামিনের অনেকগুলো ছবি লাগানো। সেটা দেখেই মনে পড়ল ইয়ামিনকে জানাতে হবে। তাদের মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু হয়েছিল নাহলে উষসী এমন একটা স্টেপ কেন নিবে?

তখন সকাল সাড়ে নয়টা বাজছে। ইয়ামিন মর্ণিং ওয়াক থেকে এসে গোসল সেরে নিয়েছে। এখন মাত্র ব্রেকফাস্টে বসবে। মিসেস শিমলা পরম স্নেহে ছেলের জন্য খাবার বেড়ে দিচ্ছেন। ইয়ামিন অভিযোগের স্বরে বলল,” প্রবলেম কি মা? তোমাকে একবার না বলেছি আমি পরোটা খাবো না? শুধু টোস্ট দাও।”

শিমলা আহত কণ্ঠে বললেন,” ছোটবেলায় তুই পরোটা খেতে কত ভালোবাসতি। একদম তোর পছন্দ মতো বানিয়েছি। একটু খেয়ে দ্যাখ না বাবা।”

ইয়ামিন দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল। মা বোঝে না যে সে আর আগের মতো নেই। এখন তার নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে খুব সচেতন থাকতে হয়। পরোটা, বিরিয়ানি, পোলাওয়ের মতো ভারী খাবার তার জন্য বিষাক্ত! কিন্তু মাকে খুশি করার জন্য জোর করে খেতে হয়। তাছাড়া সে এখানে থাকবেই আর ক’দিন? দুইদিন পরেই আবার চলে যেতে হবে মুম্বাই।

ইয়ামিন খাবার মুখে তুলবে ঠিক এমন সময় উষ্ণতার ফোন আসে। ইয়ামিন মায়ের সামনে কথা বলতে পারবে না সেজন্য উঠতে নিলেই শিমলা ছেলের হাত ধরে বললেন,” উফ, এখন রাখতো। খবরদার ফোন ধরবি না। আগে খাওয়া শেষ কর।”

ইয়ামিন বলল,” ইমারজেন্সী কল মা। ধরতেই হবে।”

শিমলা বেশ বিরক্ত হলেন। কি এমন ইমারজেন্সী যে ধরতেই হবে! কিন্তু ইয়ামিনের জীবনে তো উষ্ণতার চেয়ে বড় ইমারজেন্সী আর কিছু নেই।

” হ্যালো মিস।”

” ইয়ামিন কোথায় তুমি? দ্রুত বাসায় আসো?”

উষ্ণতার বিচলিত কণ্ঠ ইয়ামিনকে অস্থির করে তুললো। উৎকণ্ঠায় উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করল সে,” কি হয়েছে মিস?”

উষ্ণতা কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল,” উষসী সুইসাইড এটেম্পট করেছে। ”

” হোয়াট?”

” হ্যাঁ। ওকে এখন আমরা হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। তৃষাণ গেছে এম্বুলেন্স ডাকতে। তুমি যত দ্রুত পারো চলে এসো।”

” কিন্তু ও এমন একটা কাজ কেন করল? কাল তো সব ঠিক হয়ে গেছিল৷ তাই না?”

” সেটাই তো আমি ভাবছি। ও এমন কেন করবে? আচ্ছা, তোমাদের মধ্যে আবার কিছু হয়নি তো?”

ইয়ামিন এই প্রশ্ন শুনে অবাক হলো। তাদের মধ্যে আবার কি হবে? উষ্ণতা তাড়াহুড়ো করে বলল,” আচ্ছা যাইহোক, তুমি আসো। আমি রাখছি।”

ইয়ামিন ঘরোয়া পোশাক বদলে দ্রুত তৈরী হয়ে নিল। তাকে বের হতে দেখে মিসেস শিমলা দৌড়ে এলেন,” আরে, আরে, কোথায় যাচ্ছিস?”

” কাজ আছে মা। এখনি যেতে হবে।”

” মানে? এখানে তোর কি কাজ? কোথায় যাচ্ছিস?”

” ফিরে এসে সব বলব। এখন বলারও সময় নেই।”

ইয়ামিন বের হয়ে গেল। মিসেস শিমলা বিস্ময় নিয়ে ছেলের চলে যাওয়া দেখলেন। ইদানীং ইয়ামিন এতো অদ্ভুত আচরণ কেন করছে?

এম্বুলেন্স ডাকা হলো। উষসীকে অচেতন অবস্থায় এম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে। এমন সময় ইয়ামিন হাজির হলো। তাকে দেখে তৃষাণের রুক্ষ মেজাজ আরও রুক্ষ হয়ে গেল। ক্ষীপ্ত হয়ে সে বলল,” এটাকে কে খবর দিয়েছে?”

অনুপমা ভীত কণ্ঠে বলল,” উষ্ণতা ভাবী।”

তৃষাণ রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালালো। উষ্ণতা আজ-কাল তার কোনো কথাই শুনছে না। সে ঠিক সেটাই করবে যাতে তৃষাণ সবচেয়ে বিরক্ত হয়। উষ্ণতা ইয়ামিনকে দেখে আনন্দিত কণ্ঠে বলল,” তুমি এসে গেছো? থ্যাঙ্কিউ এতো দ্রুত আসার জন্য।”

ইয়ামিন হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে রইল। সে এই প্রথমবার উষসীর ঘরে এসেছে। চারদিকে নিজের ছবি, গিটার, মিউজিক ইন্স্ট্রুমেন্টস দেখে সে প্রস্তুরীভূত। সবাই বের হয়ে যাওয়ার পরেও ইয়ামিন সেই ঘরে একা দাঁড়িয়ে রইল। উষসীর পড়ার টেবিলের কাছে যেতেই একটা ফটো ফ্রেম নজরে এলো। একটা ফ্রেমে উষসীর নিজের ছবি, অন্য ফ্রেমে ইয়ামিনের ছবি। ফ্রেমটা হাতে নিয়ে ইয়ামিনের হাত কাঁপতে লাগল। এমন পাগলামি আটবছর আগে সেও করেছিল। উষ্ণতার ছবি এঁকে নিজের ঘর ভরে ফেলেছিল।

” ইয়ামিন।”

উষ্ণতার ডাকে ইয়ামিনের হুশ ফিরল। দ্রুত ফটো ফ্রেমটা রাখতে নিয়ে শেলফ থেকে ভুল করে একটা ডায়েরী ফেলে দিল সে। সেই ডায়েরী থেকে বের হয়ে এলো একটা লকেট। বেশ পুরনো জিনিসটা। কিন্তু ইয়ামিন চিনতে ভুল করল না। আটবছর আগে এই লকেট সবসময় তার গলায় থাকতো। উষসী একদিন এটা ছিঁড়ে ফেলেছিল। তারপর বলেছিল জিনিসটা সে ঠিক করে আনবে।

ইয়ামিন লকেটটা তুলে ডায়েরীতে রেখে দিতে নিলেই ঝরঝর করে গড়িয়ে পড়ল কতগুলো গোলাপের পাপড়ি৷ সেই সাথে একটা চিরকুট। ইয়ামিনের লেখা- ভালো থেকো।

এই চিরকুট দেখার পর ইয়ামিনের বুঝতে বাকি নেই যে ফুলের পাপড়িগুলো তার বুকেটের। সেই দিল্লীতে রেখে যাওয়া বুকেট আর চিরকুট। এগুলো সে উষ্ণতার উদ্দেশ্যে রেখে গিয়েছিল। যদিও সে জানতো যে এগুলো উষ্ণতা কখনও পাবে না। পেলেও তার কাছে এসবের কোনো মূল্য থাকবে না। কিন্তু উষসী যে সবকিছু এতো যত্ন করে তুলে রাখবে তা কে জানতো? ইয়ামিন তার নিজের ছোটবেলার একটা ছবিও পেল। রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। ছবির পেছনে উষসী লিখে রেখেছে,” আমার রাক্ষসমানব,

তার বড় বড় ওই আগুনের চোখে তাকানোই ভুল।

আমার মনে তবু কেন ঝরে ফাগুনের ফুল? ”

এটা দেখার পর ইয়ামিন হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছিল না।

উষ্ণতা ইয়ামিনকে ডাকতে ডাকতে পুনরায় ঘরে ঢুকেছে তখন। ইয়ামিনকে সে দেখে বলল,” তুমি এখনও দাঁড়িয়ে আছো? কি করছো?”

ইয়ামিন তার হাতের ডায়েরী দ্রুত ভাঁজ করে রেখে দিল। উষ্ণতা এই দৃশ্য দেখে মৃদু হাসল। ইয়ামিনের কাঁধে হাত রেখে বলল,” উষসী কেন এমন করল ইয়ামিন? তোমাদের মধ্যে কি ঝগড়া হয়েছিল?”

ইয়ামিন আশ্চর্য হলো। সে কি করে জানবে উষসী কেন এমন করেছে? আর তাদের মধ্যে ঝগড়া হবেই বা কেন? বিস্মিত গলায় বলল,” আমাদের মধ্যে তো কিছুই হয়নি।”

” তাহলে? রাতেও সে এতো খুশি ছিল। হঠাৎ কিছু একটা নিশ্চয়ই হয়েছে। তুমি চলে যাওয়ার পর ও ঘর থেকে একবারও বের হয়নি। তারপর সকালে এই কান্ড… তোমার সাথে ওর লাস্ট কবে কথা হয়েছিল?”

ইয়ামিন মনে করার চেষ্টা করল। উষসী তার কথার জবাব না দিয়ে মুখের উপর দরজা আটকে দিয়েছিল। তারপর তো তাদের আর দেখাও হয়নি। পর মুহূর্তেই তার মনে হলো… উষসী কি কোনো কারণে তার জন্যই এমন করেছে? এই কথা মনে হতেই অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে এলো শরীর। এটা অসম্ভব। যদি সত্যি এরকম কিছু হয় তাহলে ইয়ামিন আর কখনও উষসীর সামনে যাবে না।

চলবে

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ২৭
লিখা- Sidratul Muntaz

হাসপাতাল থেকে সুস্থভাবেই উষসী বাড়ি ফিরেছিল। কিন্তু এরপর থেকে সে কেমন বদলে গেছে। প্রথমদিকে খুব মনমরা থাকতো। কিন্তু আজ-কাল সে খুব বেশি কথা বলে। অকারণেই হাসে। একটা সাধারণ ঘটনা নিয়ে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি মাতামাতি করে। তার এমন অস্বাভাবিক আচরণ সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে।

সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, উষসী যেদিন হাসপাতালে ছিল সেদিন তার জ্ঞান ফেরার কিছুসময় পরেই ইয়ামিন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। একবারের জন্যেও উষসীর সাথে দেখা করতে কেবিনে যায়নি সে। তাদের মধ্যে প্রণয়ের সম্পর্কের ব্যাপারে তারা নিজেরাই স্বীকার করেছিল। কিন্তু তাদের ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল যেন কখনোই কিছু ছিল না তাদের মাঝে। কেউ উষসীকে জোর দিয়ে কিছু জিজ্ঞাসাও করেনি এই ব্যাপারে। তাকে নিজের মতো ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

ইয়ামিনেরও কোনো খোঁজ নেই। উষ্ণতা বুঝতে পারছে যে তাদের মধ্যে বড় কোনো ঝামেলার সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু এবার সে ঠিক করেছে আর তাদের মাঝে ঢুকবে না। তারা নিজেদের সমস্যার সমাধান নিজেরাই করুক। সে আগ বাড়িয়ে কিছু করতে গেলে অযথাই তৃষাণের সাথে ঝগড়া হবে। উষ্ণতা তার সংসারের অশান্তি আর বাড়াতে চায় না। কিন্তু প্রিয় ছোটবোনের মনের অশান্তিও তাকে ভীষণভাবে পীড়া দিচ্ছে। আর কেউ না বুঝলেও উষ্ণতা ঠিকই বুঝে উষসীর হাসি মুখের আড়ালে তীব্র ব্যথা লুকিয়ে আছে। যেটা সে প্রকাশ করছে না।

গতরাতে উষ্ণতার ঘুম আসছিল না। সে গল্প করার জন্য উষসীর ঘরে গেছিল। তখন জানালা দিয়ে দেখল উষসী মেঝেতে বসে হাউমাউ করে কাঁদছে। কান্নার দমকে পুরো শরীর কাঁপছে তার। দুই হাতে মাথা চেপে সে নিজেকে সামলাতে চাইছে। কিন্তু পারছে না। এই অবস্থা দেখে উষ্ণতা হতভম্ব। সাবধানে উষসীর ঘরের দরজায় টোকা মারল সে।

উষসী কান্না থামিয়ে কণ্ঠ স্বাভাবিক রেখে প্রশ্ন করল,” কে?”

” উষু আমি। দরজা খোল।”

উষসী চটজলদি বিছানায় উঠে মুখে বালিশ চেপে ধরে ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলল,” শুয়ে পড়েছি আপু। সকালে এসো। এখন যাও।”

উষ্ণতা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তার ছোটবোন কবে থেকে এতো অভিনয় শিখে গেছে? সে বুঝতেও পারল না! সবার সামনে হাসি-খুশি থাকার ভাণ করে অথচ মাঝরাতে ঠিকই সে নিঃশব্দে কাঁদে!

উষসীর মন ভালো করার নিমিত্তে উষ্ণতা সিদ্ধান্ত নিল তারা কিছুদিনের জন্য গ্রামের বাড়ি ঘুরতে যাবে। বুদ্ধিটা তৃষাণেরও খুব ভালো লাগল। তবে সে কাজের জন্য যেতে পারবে না। উষ্ণতা আর উষসীর সাথে যুথি আর ডোনাকে পাঠানো হবে। তৃষ্ণা অনুপমার কাছেই থাকবে। তার স্কুলে পরীক্ষা চলছে। ডোনা তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তাব দিল। এই মাসেই নাকি ওই বাড়ির মেয়ের বিয়ে। এই ফাঁকে বিয়েও খাওয়া হবে আবার ঘুরাঘুরিও হবে। উষসী খুব আনন্দিত হওয়ার ভাণ করল বেড়াতে যাবার কথা শুনে। তবে আনন্দ ছিল না তার মনে। ঠিক যাওয়ার আগের দিন রাতে উষসী বিরস মুখে বলল,” আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। সামনে আমার পরীক্ষা।”

ডোনা প্রতিবাদের সুরে বললেন,” এটা কেমন কথা? যাবি না মানে? তোর জন্যই তো যাওয়ার এতো আয়োজন। ঘুরতে গেলে তোর মন ভালো হবে।”

উষসী ভ্রু কুচকে বলল,” আমার মন খারাপ এই কথা তোমাকে কে বলল?”

উষ্ণতা চোখের ইশারা দিল ডোনাকে। ডোনা চুপ হয়ে গেল।

উষসী বলল,” আমি একা থাকলে সমস্যা কি? বরং আমার তো একা থাকতেই ভালো লাগে।”

সবার মধ্যে ভীতি সৃষ্টি হলো। যেই মেয়ে হৈ-হুল্লোড় ছাড়া দুই মিনিট থাকতে পারে না সে এখন একা থাকতে চাইছে। কি আশ্চর্য পরিবর্তন! যুথির চোখে জল চলে এলো। তার প্রাণচঞ্চল মেয়েটা এমন নিষ্প্রাণ কেন হয়ে গেল? কার কুনজর লাগল?

উষ্ণতা উষসীর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলল,” ওইখানে আমাদের একটা পাকা বাড়ি আছে। তোর ইচ্ছা করলে পুরো বাড়িতে একা থাকিস। কোনো সমস্যা নেই। তবুও চল। তোকে যেতেই হবে। যদি তুই না যাস তাহলে আমরা কেউ যাবো না। তোর জন্য আমরা সবাই না গিয়ে মনখারাপ করে বসে থাকি এটাই কি চাস তুই?”

উষসী বাধ্য হয়ে যেতে রাজি হলো। উষ্ণতা একবার ভেবেছিল উষসীকে প্রশ্ন করবে যে কি এমন হয়েছে ইয়ামিন আর তার মধ্যে? কেন ইয়ামিন সেদিন হাসপাতাল থেকে চলে গেল? তারপর আর কোনো যোগাযোগ নেই! কিন্তু এই প্রশ্নটা উষসীকে জিজ্ঞেস করলে সে আহত হতে পারে ভেবে উষ্ণতা কখনও কিছু জিজ্ঞেস করেনি।

ঘাটাইল উপজেলার রসুলপুরের গ্রামটি ভীষণ সুন্দর। সবুজ গাছপালায় ঘেরা একটা মায়া মায়া পরিবেশ। শহর থেকে মেহমান এলে গ্রামের মানুষ যারপরনাই খুব ব্যস্ততা দেখায়। অনেক আপ্যায়নের চেষ্টা করে। এবারও তাই হলো। তৃষাণ- উষ্ণতার বিয়ের পর একবার তারা এই গ্রামে এসেছিল। তখন উষসীর বয়স মাত্র আটবছর। সেই সময় যাদের সাথে দেখা হয়েছিল তারা এখন খুব বড় হয়ে গেছে। রোগা-পাতলা একটা ছেলে হাতে ম্যাজিক পাউডার নিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে সামনে এসে দাঁড়ালো। উষসীর দিকে চেয়ে লাজুক মুখে বলল,” ভালো আছেন? আমারে চিনছেন?”

উষসী ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। কে এই ছেলে? সে চিনতে পারেনি। ডোনা বলল,” আমার খালার বড় ছেলে এটা। মুরাদ। তোর মনে নেই? আগেরবার এসে যখন তুই আমগাছে পা আটকে বসেছিলি তখন ও-ই তোকে কোলে করে আমগাছ থেকে নামিয়েছিল।”

এই কথা বলতে বলতে ডোনা হেসে দিল। ছেলেটিও ফিক করে হাসল। একটা অদ্ভুত অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে গেল উষসীর শরীর। কি আশ্চর্য বিরক্তিকর ব্যাপার। এতো বছর আগের কথা সে মনে রেখে বসে আছে নাকি? আর তখন সে ছোট ছিল৷ ভালো আন্টি কেন তাকে এই কথা বলে অস্বস্তিতে ফেলছে? রাগ লাগল উষসীর। সে আলোচনা সভা থেকে উঠে ভেতরে চলে গেল।

ঘরের ভেতর বসেছিল মুরাদের বোন মাইমুনা। তার বিয়েতেই সবাই এসেছে এই গ্রামে।মেয়েটির গায়ের রঙ কালো। মাথাভরা চুল। আর চেহারা খুব মায়াবী। উষসী স্বাভাবিক থাকলে এই মেয়েটার সাথে তার ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যেতো। কিন্তু উষসীর আজ-কাল মানুষের উপস্থিতিই বিরক্ত লাগে। তাই কাউকে সহ্য হচ্ছিল না।

মাইমুনা উষসীর সাথে নানান গল্প করতে লাগল। ছোটবেলায় নাকি তারা একসঙ্গে খেলেছে। উষসীর আবছা আবছা মনে আছে। মাইমুনা খুব ভালো দৌড়াতে পারতো। একজন বৃদ্ধা মহিলা এসে উষসীর মাথায় হাত বুলিয়ে খুব আদর করতে লাগলেন। এমনভাবে জড়িয়ে ধরলেন যে উষসীর নিশ্বাস আটকে যাওয়ার যোগাড়।

দূর সম্পর্কের সব মামী, খালারা এসে খুব আহ্লাদ শুরু করল৷ অথচ উষসী কাউকেই চিনতে পারছে না। উষ্ণতা সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। তবুও উষসীর কিছু মনে পড়ল না। মুরাদ নামের ছেলেটি শুধু তাদের আগে-পিছেই ঘুরাঘুরি করছে। তার মনে হয় কোনো কাজ নেই। হঠাৎ মুরাদ মাইমুনাকে ডেকে তার কানে কানে কি যেন একটা বলল। ব্যাপারটা উষসী খেয়াল করেছিল। একটু পরেই মাইমুনা এসে বলল,” ঘুরতে যাইবা?”

“কোথায়?”

” এইতো, আশেপাশেই। গ্রাম ঘুরায় দেখামু তোমারে। লও যাই।”

উষ্ণতা আগ্রহ নিয়ে বলল,” যা, ঘুরে আয়। ভালো লাগবে।”

উষসী দেখল মুরাদ দরজার পেছনেই দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে। নিশ্চয়ই সে মাইমুনাকে এখানে পাঠিয়েছে। উষসী বলল,” আমার ভালো লাগছে না। খুব টায়ার্ড আমি। একটু ঘুমাবো।”

মাইমুনা উষসীর হাত টেনে বলল,” আরে অনেক ঘুমাইতে পারবা। এহন চলোতো।”

উষসী কিছুতেই গেল না। উষ্ণতা বলল,” থাক, ও যখন যেতে চাইছে না… ওকে জোর কোরো না।”

ওদিকে মুরাদের মন খুব খারাপ হয়ে গেল৷ বেচারা হয়তো ভেবেছিল উষসীকে গ্রাম ঘুরিয়ে দেখাবে। তার মনের আশা পূরণ হলো না। উষসী উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” আমাকে একটা খালি ঘর দেখিয়ে দাও মাইমুনা। আমি শান্তিতে ঘুমাতে চাই।”

” আইচ্ছা আসো।”

মাইমুনা উষসীকে একটা বড় ঘরে নিয়ে এলো। সেই ঘরের বিছানায় আগে থেকেই একজন শুয়ে আছে। উষসী বলল,” আমি কি উনার সাথে ঘুমাবো?”

” ঘুমাইতে পারো। উনি খুবই ভালো। খাড়াও ডাকতাছি।”

মাইমুনা ভদ্রমহিলাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। তাকে দেখে উষসীর বিস্ময়ের সীমা রইল না। মিসেস শিমলা! উষসী শুনেছিল ইয়ামিনদের সাথে তাদের একটা পারিবারিক যোগসূত্র আছে। তৃষাণের সৎবোন প্রিয়ন্তীর কাজিন হয় ইয়ামিন। সেই দিক বিবেচনায় ডোনা মিসেস শিমলার আত্মীয়। তাই মাইমুনার বিয়েতে তারা আসবে এটা তো স্বাভাবিক! কিন্তু ইয়ামিনকে তো কোথাও দেখা যায়নি। তাছাড়া সে এই গ্রামে এলে তো শোরগোল পড়ে যেতো। নিশ্চয়ই সে আসেনি। এই ভেবে উষসীর কেন মনখারাপ হলো? সে তো ইয়ামিনকে ভুলতেই চায়। তার সঙ্গে দেখা না হওয়াই তো ভালো। কিন্তু উষসীর অবচেতন মন সবসময় চায়, ইয়ামিনকে দেখতে।

মাইমুনা মিসেস শিমলার সাথে উষসীর পরিচয় করালো। অবশ্য শিমলা উষসীকে চিনতে একদম ভুল করলেন না। তাদের একবার শপিংমলে দেখা হয়েছিল। শিমলা বললেন,” তুমি বলেছিলে আমার বাড়িতে আসবে। এলে না কেন?”

উষসী হেসে বলল,” স্যরি আন্টি। ভুলে গেছিলাম। আপনি কেমন আছেন?”

” খুব ভালো। তোমার আপু এসেছে?”

” জ্বী এসেছে। দেখা করবেন?”

” পরে করবো।”

তাদের বেশ ভালো গল্প হলো। এর মাঝে একবার ইয়ামিন ফোন করেছিল। মিসেস শিমলা উষসীর সামনে বসেই ইয়ামিনের সাথে কথা বলেছেন। পুরোটা সময় উষসীর বুক কাঁপছিল তখন। কেমন একটা টনটনে ব্যথা সৃষ্টি হচ্ছিল গলার কাছে। চোখ ভরে আসছিল অশ্রুজলে। ইয়ামিন নাকি কালকের ফ্লাইটেই মুম্বাই চলে যাবে। এই কথা শুনে শিমলা খুব রাগারাগি করে ফোন কেটে দিলেন।

উষসী হাসার ভাণ ধরে জানতে চাইল,” কি হয়েছে আন্টি?”

শিমলা অভিযোগের স্বরে বলতে লাগলেন,” আর বোলো না… ছেলেটা এতো বছর পর বাড়ি ফিরেছে। কোথায় আমি ভাবলাম তিন-চারমাস থাকবে। তা না, সে এখনি ফ্লাইটে ওঠার জন্য পাগল হয়ে গেছে। আর একবার বিদেশ গেলে বছরের পর বছর কেটে গেলেও আসার নাম নেয় না। এতো পাষাণ ছেলে। আমি তো মা হই ওর, আমার কষ্ট হয় ওকে ছাড়া থাকতে। কিন্তু এটা ও বুঝলে তো! এতোদিন আটকে রেখেছিলাম। কারণ আমি জানতাম আমি বাড়ির বাইরে গেলেই সে দেশের বাইরে চলে যাবে। এখন আমি দুইদিনের জন্য এসেছি আর সেও পালাতে চাইছে।কি করি বলোতো!”

উষসী মুচকি হেসে বলল,” আপনি চাইলেই উনার যাওয়াটা ক্যান্সেল করতে পারেন।”

” মারে,তুমি আমার ছেলেকে চেনো না দেখেই এই কথা বলছো। ও জীবনেও আমার কথা শোনেনি। এবারও শুনবে না। ওকে আটকানোর জন্য আমাকে মনে হয় আজকেই ঢাকা ফেরত যেতে হবে।”

” ঢাকা যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আপনি চাইলে আপনার ছেলেই এখানে চলে আসবে।”

উষসী তার বিখ্যাত দুষ্ট বুদ্ধির ঝুলি বের করে হাসল।শিমলা বিস্মিত কণ্ঠে বললেন,” সেটা কিভাবে সম্ভব?”

“বুদ্ধি থাকলে সবই সম্ভব আন্টি।”

ঠিক সন্ধ্যা সাতটায় ইয়ামিনের কাছে খবর গেল মিসেস শিমলা মেঠোপথে হাঁটতে গিয়ে উষ্টা খেয়েছেন। কোমরের হাড় ভেঙে ফেলায় তাকে জিলা হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। এই খবর শুনে ইয়ামিন রাত সাড়ে দশটার মধ্যে ঘাটাইল হাজির হলো। তখন বাইরে অনেক বৃষ্টি। রীতিমতো ঝড় হচ্ছে। ঘরে বিদ্যুৎ নেই। মাইমুনার দাদী ঔষধ খেয়ে শুয়ে পড়েছেন। গ্রামের মানুষ একটু দ্রুতই ঘুমায়। তবে আজ সবাই জাগ্রত ছিল। কারণ রাত নয়টায় মাইমুনার চাচী আম্মার প্রসব বেদনা ওঠে। তাকে নিয়ে সবাই হাসপাতালে গেছে। উষসী ঘুমিয়ে ছিল বিধায় যেতে পারেনি।

তার ঘুম ভাঙল দরজা ধাক্কানোর শব্দে। উষসী ভাবল সবাই চলে এসেছে বুঝি। কিন্তু দরজা খোলার পর ইয়ামিনকে দেখে স্তম্ভের ন্যায় স্তব্ধীভূত হয়ে গেল সে। ইয়ামিনের পুরো শরীর ভেজা। সরু রাস্তা দিয়ে গাড়ি ঢোকানো যায়নি। আর অন্ধকার বৃষ্টির রাতে রিকশা-ভ্যানও খুঁজে পায়নি। তাই ভিজে ভিজেই চলে এসেছে।

তাকে এভাবে দেখে উষসী কি বলবে বা করবে বুঝতে পারল না। ব্যালকনি থেকে তোয়ালে এনে দিল মাথা মোছার জন্য। ইয়ামিন প্রশ্ন করল,” মা কোথায়?”

উষসী কথা বলতে নিয়ে দেখল তার গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। অদ্ভুতভাবে সব কথা গলার কাছে এসেই জড়িয়ে যাচ্ছে। কি আজব! উষসী বহু কষ্টে উচ্চারণ করল,” হাসপাতালে।”

” হাসপাতালে কেন? মা তো বলেছিল বাড়িতে এসে গেছে।”

উষসী মোমবাতি জ্বালতে জ্বালতে বলল,” আন্টির কিছু হয়নি। চিন্তা করবেন না। মাইমুনার চাচী অসুস্থ। বাচ্চা হবে। তাই সবাই হাসপাতালে গেছে।”

” ও। ” ইয়ামিন চেয়ারে বসল। মিসেস শিমলা তাকে মিথ্যা বলে এখানে আনিয়েছেন। এটা বুঝেই ভীষণ বিরক্ত লাগল তার। সে আবার উষসীর মুখোমুখি হতে চায়নি। কিন্তু নিয়তির পরিহাসে তাদের দেখা হয়েই গেল।

উষসী বলল,” আপনাকে চা দিবো?”

” লাগবে না।”

ইয়ামিন তোয়ালেটা ফেরত দিল। অন্ধকারে কেউ কারো মুখ দেখতে পাচ্ছে না। তোয়ালে নেওয়ার সময় ইয়ামিনের হাতের সাথে স্পর্শ লাগল উষসীর হাতে৷ সে কেঁপে উঠল আচমকা। এতো ঠান্ডা কেন ইয়ামিনের হাত? যেন হিমালয় থেকে এসেছে সে। উষসী কৌতুহলবশত ইয়ামিনের কপালে হাত রাখল।

ইয়ামিন বিস্মিত হয়ে বলল,” কি করছো?”

উষসী আৎকে ওঠা কণ্ঠে উচ্চারণ করল,” আপনার তো দেখছি ভীষণ জ্বর!”

ইয়ামিন একটু সময় চুপ থেকে বলল,” বৃষ্টিতে ভেজার কারণে হয়তো।”

” আপনি ভেতরে চলুন। এখানে অনেক ঠান্ডা বাতাস। ভেতরে গিয়ে শুয়ে থাকবেন।”

” দরকার নেই। মা কখন আসবে জানো?”

” আমি এতোকিছু জানি না। আপনাকে ভেতরে যেতেই হবে। উঠুন বলছি।”

ইয়ামিন জোরে একটা হাচি দিল। উষসী শিউরে উঠল,” আরে, আবার ঠান্ডাও লেগেছে দেখছি। আদা চা খেলে ঠিক হয়ে যাবে। আপনি বিছানায় শুয়ে পড়ুন। আমি এখনি চা নিয়ে আসছি।”

বিছানায় না যাওয়া পর্যন্ত মনে হচ্ছে উষসী শান্ত হবে না। তাই বাধ্য হয়ে ইয়ামিনকে উঠতে হলো। এমনিতেও তার খুব শীত লাগছে। ঠান্ডার কারণে সে সবকিছু ঝাপসা দেখতে পাচ্ছে। উষসী ইয়ামিনকে বিছানায় শুয়িয়ে একটা মোটা কাঁথা তার গায়ে টেনে দিল। কিছুক্ষণ আগে উষসী এই বিছানাতেই শুয়েছিল। এই বালিশেই মাথা রেখেছিল। তার শ্যাম্পুর গন্ধ লেগে আছে বালিশে। যা ইয়ামিনের অস্বস্তির মাত্রা আরও বাড়িয়ে তুলছে। নিজের প্রতি উষসীর এমন বাড়াবাড়ি রকমের ব্যস্ততা তাকে সহজ হতে দিচ্ছে না। ক্ষণে ক্ষণেই তার মনে হচ্ছে সে অপরাধী। তার উষসীর থেকে দূরে যাওয়া উচিৎ।

উষসী চা বানাতে রান্নাঘরে গেল। একটু পর যখন সে চা নিয়ে ফিরল তখন ইয়ামিন ঘুমিয়ে পড়েছে। চারদিকে ঘোর অন্ধকার। মোমবাতি নিভে গেছে। উষসী আলতো হাতে আবার মোমবাতি জ্বালল।

বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। ঠান্ডা বাতাসের শীতল পরিবেশ। গ্রামের আবহ একটা মোহঘোর সৃষ্টি করেছে। এই মন তোলপাড় করা অন্ধকার রাতে মোমের সোনালি, নরম আলোয় উষসী তার প্রিয়তমের ঘুমন্ত সুন্দর মুখটি দেখছে মুগ্ধ হয়ে।

এতো সুন্দর লাগছে ইয়ামিনের ঘুমন্ত মুখটা! উষসী আবছা একটা ঘোর নিয়ে তাকিয়ে রইল। ইয়ামিনকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে তার ভীষণ ভালো লাগছে। এতো সাহস তার কিভাবে এলো সে জানে না। কিন্তু ইয়ামিনের মাথায় সে হাত বুলাতে লাগল। ইয়ামিন নড়েচড়ে উঠল। উষসী কেঁপে উঠে হাত সরাতে নিলেই ইয়ামিন তার হাতটা ধরে ফেলল। বিড়বিড় করে কিছু বলতে লাগল যেন। যদিও ইয়ামিন এসব ঘুমের ঘোরে করছে। তবুও উষসীর কান্না পেয়ে গেল। ইয়ামিন তার হাতটা ছাড়েনি। উষসীও ছাড়ানোর চেষ্টা করেনি। এভাবেই ভোর হয়ে গেল। কখন যে উষসী ইয়ামিনের পাশে একই বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ল তা সে নিজেও জানে না। কিন্তু যখন তার ঘুম ভাঙল, তখন পুরো দুনিয়া বদলে গেছে!

চলবে

আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-২৪+২৫

0

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ২৪
লিখা- Sidratul Muntaz

মুহূর্তেই মধ্যেই ঘটে গেল বড় অপ্রত্যাশিত কান্ড। তৃষাণ আর ইয়ামিনের মতো দু’জন পূর্ণবয়স্ক মানুষ লড়াই শুরু করেছে যেন শিশুদের মতো। ক্রোধে ফেটে পড়ছে উভয়ের শরীর। কেউ কারো কাছে হারতে রাজি নয়। তৃষাণ ইয়ামিনের হাঁটুতে লাথি মেরে ভূমিতে ফেলল। পরমুহূর্তেই ইয়ামিন উঠে দাঁড়িয়ে তৃষাণের চোয়ালে ঘুষি মারল। ভয়ংকরভাবে তারা আঘাত করছে একে অন্যকে। তৃষ্ণা আড়াল থেকে সবকিছু দেখে প্রচন্ড ঘাবড়ে গেল।

ইয়ামিন এই বাড়িতে আসার পর থেকে সর্বক্ষণ তার পেছনেই ঘুরঘুর করছে তৃষ্ণা। ফলশ্রুতিতে ইয়ামিন যে তার বাবাকে টেনে-হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে সেই অস্বাভাবিক দৃশ্য তার নজর এড়ায়নি৷ সে সহসা ভেতরে গিয়ে উষ্ণতাকে ডেকে আনল,” মাম্মা দ্রুত আসো। সিংগার আঙ্কেল আর পাপা মা-রামারি করছে। ঢিসুম, ঢিসুম।”

উষ্ণতা গোমরা মুখে অতিথিদের খাবার পরিবেশনে ব্যস্ত ছিল৷ রান্নাঘরে তখন শুধু সে আর অনুপমা। তৃষ্ণার কথা শুনে অনপনা মজা ভেবে হেসে উড়িয়ে দিল। কিন্তু উষ্ণতার ভ্রু কুঁচকে এলো। তৃষ্ণা সব বিষয়ে একটু বাড়িয়ে কথা বলে এটা ঠিক। কিন্তু কখনও মিথ্যা বলে না৷ আর তৃষাণের সাথে একটু আগেই তার কথা কাটাকাটি হয়েছে। সেই রাগে আবার তৃষাণ ইয়ামিনকে কিছু বলেনি তো? উষ্ণতা তৃষাণের স্বভাব ভালোমতোই জানে। সে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে তৃষ্ণাকে প্রশ্ন করল,” কি হয়েছে বাবা?”

তৃষ্ণা দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলল,” সিংগার আঙ্কেল পাপাকে বাগানে নিয়ে এইভাবে ডিসুম, ডিসুম করে মারছে। পাপাও মারছে।”

উষ্ণতা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার নয়বছরের ছেলের বড় বড় চোখের দিকে। ছেলেটা আতঙ্কে কেমন কাঁপছে। নিশ্চয়ই ভয়ংকর কিছু হয়েছে। নয়তো তৃষ্ণা ভয় পাচ্ছে কেন? এহেন অদ্ভুত কথা বিশ্বাসযোগ্য না হলেও উষ্ণতাকে বিশ্বাস করতে হলো। তৃষ্ণা উষ্ণতার হাত ধরে বলল,” আমার সাথে আসো মাম্মা। তোমাকে দেখাই।”

উষ্ণতা ধারণা করেছিল তৃষাণ আর ইয়ামিনের মধ্যে হয়তো কোনো বিষয় নিয়ে তর্ক চলছে। সেটাকেই তৃষ্ণা বাড়িয়ে বলছে মারামারি! কিন্তু বাগানে গিয়ে সে যেই দৃশ্য দেখল তা যেকোনো মানুষকে বাকশূন্য করার জন্য যথেষ্ট। ইয়ামিনের ঠোঁটের কোণে রক্ত, তৃষাণের কপালে আঘাতের চিহ্ন। তারা এখনও সর্বশক্তি দিয়ে একে অন্যকে আঘাত করেই যাচ্ছে। কি ভয়ংকর প্রতিহিংসা দু’জনের চোখেমুখে! উষ্ণতা স্তব্ধীভূত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর ছুটে গেল। চিৎকার করে বলল,” স্টপ ইট, তৃষাণ স্টপ! তোমরা কি শুরু করেছো এসব?”

উষ্ণতার আগমনে যেন বজ্রপাত হলো। তার গলা শুনে এবং তাকে দেখে দু’জনে নিমেষেই একে-অন্যকে ছেড়ে ছিটকে দূরে সরে দাঁড়ালো। যেন এতোক্ষণ কিছুই হয়নি। উষ্ণতা হা করে তাদের দিকে ক্ষণমুহূর্ত চেয়ে থেকে শ্লেষ মাখা কণ্ঠে উচ্চারণ করল,” তোমরা এমন অস্বাভাবিক মানুষের মতো আচরণ করছো কেন? কি হয়েছে তোমাদের?”

প্রচন্ড লজ্জায় মাথা নিচু করে রইল ইয়ামিন৷ তৃষাণও বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। উষ্ণতাকে দেখে দু’জনেই চরম অপ্রস্তুতবোধ করছে। যদি উষ্ণতা তাদের লড়াইয়ের কারণ জানতে চায়, তাহলে সত্যিটা কেউই বলতে পারবে না। তাদের চুপসে যাওয়ার মূল কারণ এটাই।

উষ্ণতা তৃষাণের দিকে তাকিয়ে কৈফিয়ৎ চাইল,” বলো, কি প্রবলেম? কেন এমন উন্মাদের মতো আচরণ করছিলে তোমরা? আমি বিশ্বাস করতে পারছি না…. তোমরা কি পাগল? বাড়িতে এতো মানুষ, কেউ যদি দেখে ফেলতো? কি হতো? ”

তারা নিরুত্তর। উষ্ণতা আবার বলল,” কি এমন হয়েছে যে তোমাদের এইসব করতে হবে? জানো আমি কার কাছে এই খবর পেয়ে এইখানে এসেছি? তৃষ্ণা! ও ভয় পেয়ে গেছে তোমাদের আচরণ দেখে। যেখানে আমারই বুক ধুকপুক করছে সেখানে ওর কি অবস্থা হওয়া উচিৎ? তৃষাণ আমি তোমার সাথে কথা বলছি। আমার কথার উত্তর দাও প্লিজ। এগুলো কি দেখলাম আমি?”

তৃষাণ আঁড়চোখে ইয়ামিনের দিকে চাইল। ইয়ামিনের অবাধ্য নজর উষ্ণতার দিকে বিচরণ করছে। চোখ দিয়েই যেন সে উষ্ণতাকে শুষে ফেলবে। পুনরায় মেজাজটা মাথায় চড়ে উঠল তৃষাণের। সে উষ্ণতার হাত শক্ত করে ধরে তাকে ভেতরে নিয়ে যেতে যেতে বলল,” এখান থেকে চলো।”

উষ্ণতা নাছোড়বান্দা। সবকিছু না জেনে সে যাবে না। তৃষাণকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে বলল,” ছাড়ো আমার হাত। আগে তোমাদের বলতে হবে তোমরা এমন কেন করছিলে? কি হয়েছিল? ইয়ামিন, তুমি অন্তত আমাকে বলো।”

উষ্ণতা ইয়ামিনের দিকে এগোতে নিলেই তৃষাণ বাধা হয়ে দাঁড়ালো। তাদের দু’জনের মাঝখানে সে যেন কোনো শক্ত প্রাচীর। শক্ত গলায় বলল,” যাবে না ওদিকে। ঘরে চলো।”

” আমি ঘরে যাবো না। তুমি ইয়ামিনের সাথে কেন এমন ব্যবহার করলে সেটা আমাকে জানতে হবে। আর ইয়ামিনই বা কেন তোমার গায়ে হাত তুলল? তুমি কি করেছো? আমার মাথায় কিছু আসছে না। তোমরা এসব কেন করেছো?”

তৃষাণ জোরপূর্বক উষ্ণতাকে ধরে ভেতরে নিয়ে গেল। তাই দেখে ইয়ামিন আরও রাগল। গর্জন করে বলল,” খবরদার, আপনি যদি আরেকবার ওর গায়ে হাত তুলেছেন তাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না, মিস্টার তৃষাণ।”

তৃষাণ ইয়ামিনের কথার তোয়াক্কাই করল না। তাকে বাইরে রেখে মুখের উপর দরজা আটকে দিল। উষ্ণতা হতভম্ব হয়ে বলল,” কি বলছিল ও?”

তৃষাণ ক্রুদ্ধ স্বরে বলল,” কিছু না।”

” তুমি এইভাবে ওকে অপমান করতে পারো না তৃষাণ। দরজা খোলো। আমি ওকে ইনভাইট করেছি। তাহলে তুমি কেন এমন করছো?”

” ও এখানে থাকবে না। ও থাকলে সবকিছু স্পয়েল হয়ে যাবে উষ্ণ। আমি ওকে আমার বাড়িতে আর এক মুহূর্তের জন্যেও এলাউ করব না।”

উষ্ণতা বিস্মিত নয়নে বলল,” কেন এতো ক্ষোভ তোমার ওর প্রতি? ও, এইবার বুঝেছি আমি।”

তৃষাণ ভয় পেল। চুপসে যাওয়া কণ্ঠে বলল,” মানে? কি বুঝেছো তুমি?”

উষ্ণতা হাত ভাঁজ করে বলল,” ও উষসীর গায়ে হাত তুলতে নিষেধ করছিল, তাই না?”

তৃষাণ বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। এখানে উষসী কোথ থেকে আসল? উষ্ণতা হাসিমুখে বলল,” তুমি যে জোর করে উষুকে বিয়ে দিতে চাইছো এটা নিশ্চয়ই ইয়ামিন বুঝে গেছে। তাই তোমাদের মধ্যে ঝামেলা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে আমি ইয়ামিনকেই সাপোর্ট করব। কারণ ও উষুকে ভালোবাসে। ”

তৃষাণ উষ্ণতার কথা শুনে পুরোপুরি বিপর্যস্ত। রাগী কণ্ঠে বলল,” কি উল্টা-পাল্টা ভাবছো?ও কেন উষুকে ভালোবাসবে? ও কাউকেই ভালোবাসার যোগ্য না।”

” এটাই তো তোমার প্রবলেম তৃষাণ। তুমি বিশ্বাসই করতে পারছো না যে ওর মতো একজন মানুষ আমাদের উষুর মতো সাধারণ একটা মেয়েকে এতো ভালোবাসতে পারে। তুমি ভাবছো উষু ওর কাছে ভালো থাকবে না। ও হয়তো উষুর যোগ্য না। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে একমাত্র ও-ই উষুর যোগ্য। আচ্ছা তৃষাণ, তোমার মনে আছে বিয়ের আগে আমার দিকে কেউ নজর দিলেই তুমি মেরে তার হাত-পা ভেঙে দিতে? একই কাজ এখন ইয়ামিন করছে। তুমি উষুকে জোর করে বিয়ে দিতে চাইছো বলেই ও তোমাকে সহ্য করতে পারছে না। ও হয়তো ভাবছে তুমি উষুর উপর টর্চার করছো। সেজন্য ও এমন করেছে। আমি ঠিক বলেছি না?”

তৃষাণ ভ্যাবাচেকা খেল। সত্যি কথা জানার চেয়ে ভালো উষ্ণতা এখন যেটা ভাবছে সেটাই ভাবুক। সে মাথা নেড়ে বলল,” হুম।”

উষ্ণতার চোখ উজ্জ্বল দেখালো। সে হাসিমুখে বলল,” আমি এতোদিন শুধু এটাই চেয়েছি। তুমি আমাকে যেমন করে ভালোবাসো, তেমন আরেকজন আসুক যে আমার উষুকেও একইভাবে ভালোবাসবে। ঠিক তোমার মতো করে। আমার মনে হয় সেই একজন এসে গেছে।”

” ফালতু কথা এসব।”

” তোমার কাছে ফালতু হলেও আমার কাছে এসব ফালতু না। এটা আমার একমাত্র ছোটবোনের জীবনের প্রশ্ন। আমি এতোটুকু কমপ্রোমাইজ করব না।”

” কি করবে তুমি?”

” আমি ইয়ামিনের সাথে কথা বলবো।” উষ্ণতা উৎফুল্ল হয়ে উঠল। তৃষাণ ভয় পেল এবার। শক্ত করে উষ্ণতার হাত চেপে ধরে কঠিন গলায় বলল,” খবরদার উষ্ণ, তুমি ওর সামনেও যাবে না। যদি যাও তাহলে…”

তৃষাণকে থামতে হলো। পেছনে ইমন এসে দাঁড়িয়েছে। সে ভদ্রগলায় ডাকল,” ভাইয়া, আপনার সাথে আমার একটু কথা ছিল। যদি আসতেন…”

ইমনকে দেখেই উষ্ণতার মনখারাপ হয়ে গেল। সে এই ছেলের সঙ্গে উষসীর বিয়ে কোনোভাবেই মানতে পারবে না। তৃষাণ উষ্ণতাকে ছেড়ে ইমনের সাথে গেল। এই মুহূর্তে ইমনকে হাতে রাখা সবচেয়ে জরুরী। উষসীর বিয়েটা হলেই চিন্তামুক্ত হবে তৃষাণ। তাহলে উষ্ণতাও আর কোনো বাহানায় ইয়ামিনকে বাড়িতে ডাকতে চাইবে না। তৃষাণ চলে যেতেই উষ্ণতা দরজা খুলে বাইরে এলো।

ডিভানের মতো জায়গায় চুপচাপ বসে আছে ইয়ামিন। তার মুখে গাঢ় বিষণ্ণতার ছাপ। উষ্ণতা তার কাঁধে হাত রেখে কোমল স্বরে বলল,” আই এম স্যরি, ইয়ামিন।”

ইয়ামিন একটা অসহ্য শীতলতা অনুভব করল হৃদয়ে। তার চেহারা থেকে বিষণ্ণতা সরে গিয়ে ঠোঁটে ফুটে উঠল হাসি। সে উদগ্রীব কণ্ঠে শুধাল,” উষ্ণতা মিস, ইজ এভরিথিং ওকে?”

উষ্ণতা ইয়ামিনের পাশে বসতে বসতে বলল,” কিছুই ওকে নেই। তৃষাণ উঠে-পরে লেগেছো উষুর বিয়ে দেওয়ার জন্য।”

তারপর ইয়ামিনের দিকে চাইতেই তার ঠোঁটের কোণে রক্ত দেখে উষ্ণতা আফসোস করে বলল,” ইশ, কি অবস্থা হয়ে গেছে তোমার। ভেতরে চলো, স্যাভলন লাগিয়ে দিচ্ছি।”

” লাগবে না। আগে বলুন, আপনি ঠিকাছেন তো?”

উষ্ণতা চোখ বড় করে বলল,” এই অবস্থায় আমি কিভাবে ঠিক থাকবো যেখানে আমার বোন ঠিক নেই? উষুর মত ছাড়াই তৃষাণ ওকে বিয়ে দিচ্ছে। এটা আমিও মানবো না।”

ইয়ামিন নিচু গলায় বলল,” ও… তাহলে এসব নিয়েই আপনাদের ঝগড়া হয়েছে?”

” হ্যাঁ এসব নিয়েই ঝগড়া হয়েছে। কিন্তু তৃষাণকে তুমি যত খারাপ ভাবছো ও কিন্তু ততটাও খারাপ নয়।”

ইয়ামিন কিড়মিড় করে বলল,” খারাপ না হলে এমন একটা জঘন্য কাজ কিভাবে করলেন উনি?”

ইয়ামিন উষ্ণতার গায়ে হাত তোলার ব্যাপারটা ইঙ্গিত করেছে। কিন্তু উষ্ণতা বুঝল অন্যকিছু। সে ভাবল উষুকে জোর করে বিয়ে দেওয়ার কথা বলছে ইয়ামিন। সে হেসে বলল,” তুমি চাইলেই সব ঠিক হতে পারে।”

” আমি অবশ্যই চাই যে সব ঠিক হয়ে যাক।”

” তাহলে এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে তো চলবে না। কিছু একটা করো। এই বিয়েটা তো ভাঙতে হবে।”

ইয়ামিন অবাক হয়ে বলল,” শুধু বিয়ে ভাঙলেই কি সব ঠিক হয়ে যাবে?”

উষ্ণতা অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলল,” বোকা নাকি তুমি? বিয়ের জন্যই তো সব ঝামেলা হচ্ছে। বিয়ে না ভাঙলে প্রবলেম কিভাবে সোলভ হবে?”

ইয়ামিন এবার উঠে দাঁড়িয়ে খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,” আপনি কিছু ভাববেন না মিস। এই বিয়ে আমি কোনোভাবেই হতে দিচ্ছি না।”

উষ্ণতা তার কথায় খুশি হয়ে বলল,” আমি জানি সেটা। তোমার উপর আমার বিশ্বাসও আছে। ”

ইয়ামিন উষ্ণতার হাসি মাখা মুখের দিকে চেয়ে বিভোর হয়ে গেল। এই হাসির জন্য সে দুনিয়া ভাসিয়ে দিতে পারে। উষ্ণতার সুখের জন্য সব করতে পারে। সেখানে সামান্য একটা বিয়ে ভাঙা কি এমন কঠিন কাজ?

চলবে

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ২৫
লিখা- Sidratul Muntaz

“আমি উষসীকে বিয়ে করতে পারব না ভাইয়া, আমাকে মাফ করে দিবেন।” অনেক উশখুশ করে অবশেষে আসল কথাটা বলেই ফেলল ইমন। সে মাথা নিচু করে রেখেছে।

তৃষাণ বুঝতে পারল না, আজকের দিনটা এতো খারাপ কেন? সকাল থেকে একটার পর একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। সকালে উষ্ণতা ইয়ামিন আর উষসীর বিয়ে কথা বলল। সন্ধ্যায় ইয়ামিন স্ব-শরীরে এই বাড়িতে এসে হাজির। তারপর হঠাৎ তার উপর আক্রমণ। আর এখন ইমনের মত বদল। তৃষাণের মনে হচ্ছে তার মাথা ফেটে যাবে। বিরক্তিতে চোখমুখ কুচকে এলো। সামান্য রাগ নিয়ে বলল,” এসবের মানে কি?”

ইমন ইতস্তত গলায় বলল,” আমাকে ভুল বুঝবেন না ভাইয়া। কিন্তু যথাযথ কারণ আছে বলেই আমি বিয়েটা ভাঙতে চাইছি। এই বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না।”

” কারণটা কি আমাকে বলা যাবে?” তৃষাণের কণ্ঠ গম্ভীর।

ইমন খুব অপ্রস্তুত হলো,” ভাইয়া আপনি আমার উপর রাগ করবেন না প্লিজ। আমার মনে হচ্ছে উষসী এই বিয়েতে রাজি না। ওর মতের বিররুদ্ধে আমি বিয়ে করতে চাই না।”

তৃষাণ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। হতাশা মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,” উষসী বাচ্চা মেয়ে। তুমি ওর কথা শুনে এমন একটা সিদ্ধান্ত কিভাবে নিচ্ছো?”

ইমন সামান্য অবাক হয়ে তাকাল,” যে বিয়ে করবে তার মতামত জানা কি জরুরী না?”

তৃষাণ রূঢ় স্বরে বলল,” কোনটা জরুরী আর কোনটা অ-জরুরী সেটা আমি বুঝি ইমন। উষুকে তোমার চেয়েও ভালো আমি চিনি। ও অন্যকাউকে ভালোবাসে সেজন্য তোমাকে বিয়ে করতে চায় না।”

ইমন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। তৃষাণ তাহলে সত্যিটা আগেই জানে। যাক, তাকে এখন আর কসরত করে মিথ্যা বানিয়ে বলতে হবে না। আলোচনা সহজ হয়ে গেল। সে বলল,” এক্সাক্টলি ভাইয়া। ও যেহেতু অন্যকাউকে চায় তাহলে আমার শুধু শুধু ওর জীবনে জোর করে হস্তক্ষেপ করা ঠিক হবে না। আপনারা ওর সম্পর্ক মেনে নিন।”

” কিসের সম্পর্কের কথা বলছো তুমি? কোনো সম্পর্ক নেই। উষু তোমাকে মিথ্যা বলেছে। ও শুধু এখন বিয়ে করতে চায় না। কিন্তু আমি জানি ওর জন্য কি ভালো হবে। তুমি যদি বিয়েতে রাজি না হও তাহলে আমি অন্য পাত্র ঠিক করব। কিন্তু উষুর বিয়ে হবেই। এবার তুমি ঠিক করো, কোনটা ভালো? আমি যতটুকু জানি তুমি উষসীকে অনেক পছন্দ করেছিলে। এখন কি এই সামান্য কারণে ওকে হারাতে চাও?”

তৃষাণের রাশভারী দৃষ্টির দিকে চেয়ে ইমন বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল মুহূর্তেই। উষসী কি সত্যি তাকে মিথ্যা বলেছে? কিন্তু তার চোখের জল দেখে আর তার কথা শুনে তো একবারও সেটা মনে হয়নি! ইমন মনখারাপের সুরে বলল,” আপনি যদি একবার ওর সাথে কথা বলে নিতেন… তাহলে ভালো হতো ভাইয়া। আমার মনে হচ্ছে ওর কারো সাথে অবশ্যই সম্পর্ক আছে। আপনাকে লজ্জায় বলতে পারছে না হয়তো…”

তৃষাণ তাচ্ছিল্যের সাথে বিড়বিড় করল,” হুহ….লজ্জা থাকলে কি আর নির্লজ্জটার জন্য পাগল হতো?”

” ভাইয়া কি বললেন? আমি শুনিনি।”

” শোনার দরকার নেই। তুমি বিয়ে করতে চাও না তো? ওকে ফাইন। আমি তোমার চেয়ে হাজার গুণ ভালো পাত্র ঠিক করব উষুর জন্য।”

ইমন হকচকিয়ে গেল। তৃষাণ যে এতোটা রেগে যাবে সে ভাবতেও পারেনি। উষসীর অন্যকারো সাথে বিয়ের কথাও সে ভাবতে পারছে না৷ তাই তাড়াহুড়ো করে বলল,” স্যরি ভাইয়া, আমার ভুল হয়ে গেছে।”

তৃষাণ ঘুরে তাকাতেই ইমন মাথা নিচু করে বলল,” আমি বিয়ে করব।”

তৃষাণ ইমনের কাঁধ চাপড়ে বলল,” সাবাশ।”

___________________
ইমনের বাবা-মায়ের সাথে বসে হাসিমুখে গল্প করছে উষসী। তার এই মুহূর্তে কিছুটা হালকা বোধ হচ্ছে। অন্তত ইমনকে সে সবকিছু জানাতে পেরেছে। আশা করা যায় ইমন কিছু একটা করবে। সে মনে হয় তৃষাণের সাথেই কথা বলতে গেছে। কিন্তু উষসীর ভয় তৃষাণকে নিয়ে। সে এসব শুনে কেমন ব্যবহার করবে কে জানে?

” তোমার প্রিয় কাজ কি? মানে তুমি কি কি করতে পছন্দ করো?”
ইমনের মা প্রশ্ন করলেন স্নেহমাখা কণ্ঠে। উষসী মুচকি হেসে ইয়ামিনের গিটারের দিকে চেয়ে বলল,” আমার গিটার বাজানো শুনতে খুব ভালো লাগে, আন্টি।”

ইমনের বাবা এবং মা অবাক হয়ে তাকালেন। মা বললেন,” শুধু গিটার? আর কিছু ভালো লাগে না?”

উষসী বলল,” হ্যাঁ লাগে তো। গান শুনতেও আমার ভালো লাগে।”

ইমনের বাবা বললেন,” গান, গিটার… এসবের বাইরে তোমার কি পছন্দ?”

উষসী মুখ গোমরা করে বলল,” জানি না।”

তৃষাণ আর ইমন ড্রয়িংরুমে ঢুকল এমন সময়। তাদেরকে দেখে উষসীর মনে কিঞ্চিৎ আশার আলো জেগে উঠল। ইমন নিশ্চয়ই কিছু করেছে। উষসীর বুক দুরুদুরু করতে লাগল। এখন কি হবে? ধামাকা!

তৃষাণ খুব জরুরী আলোচনায় আসার মতো ভঙ্গি করে বলল,” আন্টি, আঙ্কেল, আপনাদের ছেলের সাথে আমার কথা হয়েছে। সে আপনাদের দোয়া নিয়ে উষসীকে সবার সামনে আংটি পরাতে চায়৷ আর আমি ঠিক করেছি আজকেই বিয়ের ডেইট ফিক্সড করে ফেলবো। সবাই যখন রাজি… দেরি করে লাভ কি?”

ইমনের বাবা-মা একসাথে উচ্চারণ করল,” শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। ”

উষসী ইমনের দিকে তাকিয়ে আছে বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে। অথচ ইমন তার দিকে তাকাচ্ছে না। এভাবে বেইমানি করতে পারল সে! ঘরের ভেতরে তো বলেছিল এই বিয়ে সে করবে না। অথচ এখন সবার সামনে এসে অন্যকথা বলছে কেন? সবাইকে সুখবর জানানো হলো। যুথি আর ডোনা মুখে হাসি নিয়ে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করলেন। অনুপমা, আহমেদ, আইলা, তৃষ্ণা, উষ্ণতা এক কথায় বাড়ির সবাই উপস্থিত। এখন সকলের সামনে ইমন উষসীকে আংটি পরাবে।

উষসীর হাত কাঁপছে। চিৎকার করে সবার সামনে বলতে মন চাইছে,” থামো তোমরা। আমি বিয়ে করব না। অসম্ভব।”

কিন্তু বুক ফাটলেও কথা বলার সাহস তার নেই। সে বাধ্য হয়ে নিজের হাত এগিয়ে দিল। উষ্ণতা রাগী দৃষ্টিতে তৃষাণের দিকে তাকাচ্ছে। সে ঠিকই উষসীর এংগেজমেন্ট করিয়েই ছাড়ল। কারো নিষেধ শুনল না। হঠাৎ দরজার সামনে থেকে ভেসে এলো একটি ভরাট কণ্ঠ,” প্লিজ থামুন, এসব কি হচ্ছে?”

ইয়ামিনের কণ্ঠ শুনে সবার নজর গিয়ে স্থির হলো দরজার সামনে। তৃষাণ ক্রুদ্ধ গতিতে এগিয়ে যেতে নিল তখনি উষ্ণতা হাত ধরে থামালো তাকে। অনুপমা হাসছে। যুথিও তৃষাণের মতো বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে রইলেন। ইমনের বাবা এবং মা কিছু বুঝতে পারল না। ইমনও হতবাক। আর উষসীর চেহারায় বিস্ময়। ইয়ামিন কাছে এসে উষসীর হাত টেনে ধরে বলল,” তুমি এটা করতে পারো না। আমাদের আট বছরের সম্পর্ক। এক নিমেষে শেষ হয়ে যাবে? তুমি আমাকে ছেড়ে একটা অপরিচিত ছেলেকে বিয়ে করে ফেলবে? হাউ কুড ইউ ডু দ্যাট?”

সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। ইমনের মা আশ্চর্য হয়ে গালে হাত রাখলেন। ইমনের বাবার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। ইমন অসহায়ের দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকাচ্ছে। আর উষসীর মনে হচ্ছে সে বেহুশ হয়ে যাবে। তৃষাণ থমথমে কণ্ঠে বলল,” হোয়াট ডু ইউ মিন? এসব কি ধরণের কথা? তুমি এখান থেকে… ”

উষ্ণতা তৃষাণের হাত টেনে এনে ফিসফিস করে বলল,” একদম চুপ। আমি ইয়ামিনকে বলেছি এসব করতে। খবরদার আমাদের প্ল্যান চপট করবে না তুমি।”

” আর ইউ ক্রেজি উষ্ণ?”

” হ্যাঁ। তুমি আমার কথা না শুনলে এমনই হবে।”

রাগে আর বিরক্তিতে তৃষাণ বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। ইয়ামিন সবার উদ্দেশ্যে বলল,” এমন অদ্ভুত একটা সিচুয়েশন ক্রিয়েট করার জন্য আমি স্যরি। কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। আমি উষসীকে প্রচন্ড ভালোবাসি। তাই অন্যকেউ ওর আঙুলে আংটি পরাচ্ছে দেখে আমি সাইলেন্ট থাকতে পারিনি।”

অনুপমা খুশিতে গদগদ হয়ে উচ্চারণ করল,” ইয়েস!”

আহমেদ কড়া দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকাল। অনুপমা নিজেকে সামলে নিল। এদিকে ইয়ামিনের কণ্ঠে এসব শুনে উষসীর দুনিয়া দুলছে। সে যেন হাওয়ায় ভাসছে। এটা নির্ঘাত তার স্বপ্ন। কিন্তু আবার ঘুমটা ভেঙে যাবে না তো?

ইমনের বাবা যুথির দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলেন,” এই ছেলে কি বলছে এসব? কে এই ছেলে?”

যুথি কিছু বলার আগেই ইয়ামিন দরাজ কণ্ঠে বলল,” আমি উষসীর বয়ফ্রেন্ড। আমাদের আটবছরের সম্পর্ক। কিন্তু এই কথা কেউ জানতো না। অন্যকাউকে প্রশ্ন করে লাভ নেই। আপনার যা প্রশ্ন করার আমাকে করুন। আমি সবকিছুর উত্তর দিবো। এখানে উষসীর পরিবারের কারো কোনো দোষ নেই। সব দোষ আমার। তাই আপনাদের যদি রাগ ঝারতে হয়… আমার উপর ঝারবেন।”

ইমনের মা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,” এই গিটার তোমার, তাই না?”

” হ্যাঁ, কেন?”

” এবার বুঝলাম। উষসীর কেন গিটার আর গান ছাড়া অন্যকিছু পছন্দ নয়। আর তোমাদের সম্পর্ক কয়বছরের? আটবছর আগে তো উষসীর দুধের দাঁতও পড়েনি। ওই বয়সে প্রেম করতো? ছি… কেমন পরিবার…”

ইয়ামিন সাথে সাথে বলল,” প্লিজ, ওর পরিবার তুলে কথা বলবেন না। আমি আগেই বলেছি কারো কোনো দোষ নেই এখানে। সব দোষ আমার। কারণ আমি উষসীকে ভালোবাসি।”

ইয়ামিন উষসীর হাতের উল্টোপিঠে চুমু দিল। এবার উষসীর চোখ দু’টি বন্ধ হয়ে গেল। সে নির্ঘাত মরে যাচ্ছে। এতো খুশির ঘটনা সব একসাথে ঘটছে কেন? ইমন উষসীর দিকে চেয়ে দুঃখী গলায় প্রশ্ন করল,” ছেলেটা কি ঠিক বলছে উষসী? তুমি সত্যি ওকে ভালোবাসো?”

উষসী উত্তর দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই। সে দুনিয়ার জগৎ ছেড়ে আলাদা হয়ে গেছে অনেক আগেই। বিচরণ করছে এক অন্যরকম সুখময় স্বপ্নের জগতে। তৃষাণের গর্জনে তার হুশ ফিরল,” আর একটা ফালতু কথা বললে আমি তোমাকে খু’ন করে ফেলব, স্কাউন্ড্রেল।”

উষসী ঝটপট বলল,” না, তুমি ওকে কিছু করবে না। তাহলে আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবো।”

ইমনসহ তার পরিবার হতভম্ব হয়ে গেল উষসীর প্রতিবাদে। উষসী এক নিশ্বাসে বলল,” আমি ইয়ামিনকে ভালোবাসি। কিন্তু ভয়ে বাড়িতে বলতে পারিনি। সেজন্য বিয়েতে রাজি হয়েছি। কিন্তু এখন ইয়ামিন সবার সামনে সাহস দেখিয়ে সত্যিটা বলে দিয়েছে। তাহলে আমি কিভাবে নীরব থাকব? এটা অন্যায়! আমি ইয়ামিনকে ভালোবাসি, বাসি, বাসি। প্রচন্ড ভালোবাসি।”

তৃষাণ এই কথা শুনে আর রাগল না। ভীষণ হতাশ হয়ে মনে মনে আওড়াল,” নিজের ভালো পাগলেও বোঝে কিন্তু উষসী বোঝে না।”

যুথি উঠে এসে উষসীর গালে ঠাটিয়ে চড় মারলেন। উষসী ছিটকে এসে ইয়ামিনের বুকের উপর পড়ল।

ইয়ামিন তাকে দুইহাতে আগলে ধরল। এরপর কিভাবে কি হলো উষসীর কিছুই মনে নেই৷ সে শুধু জানে তার বিয়েটা ভেঙে গেছে। ইয়ামিন তাকে ভালোবাসে। আজ থেকে তার স্বপ্নে আর বাস্তবে কোনো পার্থক্য নেই। তার স্বপ্নটাই বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছে। সে পৃথিবীর একমাত্র সুখী মেয়ে।

বাড়িজুড়ে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে তখন। যুথি বেগম বলেছেন উষসী যেন এখনি বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। উষ্ণতা আর তৃষাণের মধ্যে ঝগড়া চলছে। ডোনা আর অনুপমাই শুধু খুশি। তারা উষসীর খুশিতে সবসময়ই খুশি হয়। কিন্তু উষসী এখনও স্বাভাবিক হতে পারছে না। করিডোরে দাঁড়িয়ে সে মুহূর্তগুলো আবার কল্পনা করছে। ইয়ামিন নিজের মুখে উচ্চারণ করেছে ভালোবাসার কথা। তাও সবার সামনে! উষসীর পাগল হওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। হঠাৎ ইয়ামিন পেছনে এসে বলল,” দারুণ অ্যাকটিং করেছো তুমি।”

উষসী কেঁপে উঠল। অবাক হয়ে বলল,” অ্যাকটিং মানে?”

” ড্রয়িংরুমে সবার সামনে যা করলে… সেটার কথা বলছি। তুমি তো আমার চেয়েও ভালো একটিং করো। কংগ্রাচুলেশনস। এখন তোমার বিয়ে ভেঙে গেছে। তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আর কিছু হবে না। তোমার আপুও খুব খুশি।”

উষসী দিশেহারার মতো প্রশ্ন করল,” আপনি তখন সবার সামনে অ্যাকটিং করেছেন?”

” অ্যাকটিংটা না করলে তোমার বিয়ে এতো সহজে ভাঙতাম কি করে? অবশ্য আন্টি একটু রেগে গেছেন। তাকে সামলাতে হবে। বাই দ্যা ওয়ে, তুমি কি খুশি হওনি?”

উষসী কয়েক মুহূর্ত ইয়ামিনের দিকে চেয়ে থেকে ঘরে চলে গেল। ইয়ামিন ঠোঁট উল্টে বলল,”এতোকিছু করলাম আর একটা থ্যাংকস পর্যন্ত দিয়ে গেল না? স্ট্রেঞ্জ!”

ইয়ামিন জানে না, দরজার আড়ালে নিজের ঘরের ভেতরে উষসী বিছানায় ঝাপিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদছে এখন। নিজের অজান্তেই সে একটা মেয়ের বহু বছরের আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন জঘন্যরূপে তছনছ করে দিয়েছে! এতোবড় ধোকা খেয়ে বিধ্বস্ত হওয়ার মতো শাস্তির পাওয়ার চেয়ে উষসীর পক্ষে ইমনকে বিয়ে করাই ঢের ভালো ছিল।এসব কিছুই জানে না ইয়ামিন। হয়তো জানবে না কখনোই।

চলবে

আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-২২+২৩

0

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ২২
লিখা: Sidratul Muntaz

উষ্ণতার মাথা ঝিমঝিম করছে। তৃষাণের ফোন সকাল থেকে সুইচড অফ। প্রথম প্রথম বিষয়টা একদম পাত্তা দেয়নি সে। কারণ আজ সকালেই তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছিল। ঝগড়ার বিষয়-বস্তু খুব একটা জটিল না৷ উষ্ণতা ভাবতেও পারেনি যে এইরকম একটা কারণে তৃষাণ ঘর থেকে বের হয়ে যাবে এবং দুপুর ঘনিয়ে বিকাল হওয়ার পরেও ফিরে আসবে না। আজ সকালে তৃষাণের মন-মেজাজ ভালোই ছিল। গোসল সেরে বের হয়ে তৃষ্ণার মাধ্যমে উষ্ণতাকে ডেকে পাঠাল সে। তৃষ্ণা এসে বলল,” মা, বাবা তোমাকে ডাকছে। খুব জরুরী কথা আছে। ”

উষ্ণতা খুব ভালো করেই জানে তৃষাণের জরুরী কথার মানে। যদি আসলেই জরুরী কথা হতো তাহলে নিজেই আসতো। ছেলেকে দিয়ে বেডরুমে ডেকে পাঠাতো না।

উষ্ণতা কাজ ফেলে বেডরুমে ঢুকতেই দেখল তৃষাণ ভেজা গায়ে গলায় তোয়ালে ঝুলিয়ে শুধু একটা ট্রাউজার পরে দাঁড়িয়ে আছে। উষ্ণতা জিজ্ঞেস করল,” ডেকেছো?”

তৃষাণ বলল,” হ্যাঁ, আমার কমলা টি-শার্ট খুঁজে পাচ্ছি না।”

উষ্ণতা দেখল কমলা টি-শার্ট হ্যাঙ্গারেই ঝুলানো আছে। একদম চোখের সামনে। বিরক্ত ভঙ্গিতে সেটা এগিয়ে দিয়ে বলল,” এইতো, এটাই খুঁজছো নাকি?”

তৃষান একটু অপ্রস্তুত হলো। তারপর হেসে বলল,” হ্যাঁ। আরে, এটা আমার চোখে পড়ল না কেন?”

” মন দিয়ে খুঁজলেই না চোখে পড়বে। যাইহোক, ব্রেকফাস্ট করতে এসো।”

” উষ্ণ, শোনো না।”

” বলো।”

তৃষাণ কাছে এসে উষ্ণতার কপালে পড়ে থাকা চুল সরিয়ে দিল। তারপর কপালে চুমু দিতে নিলেই উষ্ণতা বিড়বিড় করে বলল,” দরজা খোলা। ছেলে যেকোনো সময় চলে আসবে।”

তৃষাণ তাতেও দমল না। ছোট্ট করে কপাল বরাবর একটা চুমু দিয়ে বলল,” চলো না, আমরা কোথাও ঘুরতে যাই৷ এবার শুধু তুমি আর আমি। মালদ্বীপ গেলে কেমম হয়?”

উষ্ণতার কথাটা শুনেই ক্লান্তি চলে আসল৷ তারা মাত্র কিছুদিন হলো কাশ্মীর থেকে ফিরেছে। বিশ্রামের সময় পেল না আর তৃষান আবার ঘুরতে যাওয়ার কথা বলছে? এতো এনার্জি কই পায় এই লোক?

উষ্ণতা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইল। তৃষাণ হাসি মুখে বলল,” এটা তো ফ্যামিলি ট্রিপ ছিল। আমি হানিমুন ট্রিপের কথা বলছিলাম ডিয়ার ওয়াইফ।”

উষ্ণতা হাসি দমিয়ে গম্ভীর মুখে বলল,” ডিয়ার হাজব্যান্ড, এসব চিন্তা বাদ দিয়ে খেতে এসো। তোমার মতো এতো আজাইরা সময় আমার হাতে নেই। অনেক কাজ আছে।”

তৃষাণ উত্তরে খুব দুষ্ট একটা কথা বলল৷ উষ্ণতা তৃষাণের পেট বরাবর জোরালো একটা ঘুঁষি মারল এবার। তৃষাণ মুখ কুচকে শব্দ করল,” আউচ!”

উষ্ণতা দৌড়ে দরজার কাছে চলে এলো। তৃষান ভেবেছিল উষ্ণতা বুঝি পালিয়েই যাবে। কিন্তু না, সে দরজা বন্ধ করে আবার তৃষাণের কাছেই ফিরে এলো। তৃষাণ হতবাক! উষ্ণতা তৃষাণের গলা থেকে তোয়ালে খুলে নিল৷ তারপর সেই তোয়ালে দিয়ে তৃষাণের পিঠের সাথে আটকে তাকে কাছে টেনে আনল। তৃষাণ বিস্ময়ের সীমা পাচ্ছে না। যে কাজগুলো তার করার কথা সেগুলো উষ্ণতা করছে! হঠাৎ কি হলো মহারাণীর? উষ্ণতা খুব রোমান্টিক মুডে বলল,” তোমার সাথে আমার ইম্পোর্ট্যান্ট কথা আছে।”

তৃষাণের নজর তখন উষ্ণতার কোমল ঠোঁটে, ফরসা গলায়। সে ঘোর লাগা কণ্ঠে বলল,” বলো না।”

উষ্ণতা এই সময়টারই অপেক্ষা করছিল। তৃষাণের মেজাজ এখন উষ্ণতার নিয়ন্ত্রণে। সে চাইলেই ইয়ামিন-উষসীর ব্যাপারটা বলে তৃষাণকে রাজি করিয়ে ফেলতে পারে৷ এর থেকে ভালো সুযোগ আর হয় না। উষ্ণতা বলল,” উষসীকে নিয়ে আমি এই কয়েকদিন অনেক ভেবেছি। তারপর একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

তৃষাণ উষ্ণতার গলায় নাক ঘষতে ঘষতে আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করল,” কি সিদ্ধান্ত?”

” ইমনকে আমার পছন্দ হয়নি। উষসীরও পছন্দ নয়৷ তাই ওদের বিয়েটা ভেঙে দিলেই ভালো হয়।”

তৃষাণ ভ্রু কুচকে তাকালো। উষ্ণতা বলল,” দেখো তুমি যা-ই বলো, আমার কাছে আমার বোনের সুখ আগে৷ ও যেটা চায় না সেটা আমি ওকে জোর করে করাতে পারবো না।”

” তাহলে আগে নিষেধ করোনি কেন? কথা-বার্তা ফাইনাল হয়ে গেছে। কিছুদিন পর এংগেজমেন্ট হবে। এখন কি এসব কথার মানে হয়?”

উষ্ণতা তৃষাণের ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরল। কোমল গলায় বলল,” এংগেজমেন্ট হয়েছে এখনও হয়নি৷ উষসীর একটা দোষ দেখিয়ে দিবো৷ ব্যাস, বিয়ে ভেঙে যাবে।”

তৃষাণ ত্যাড়া গলায় বলল,” খুব সুন্দর আইডিয়া৷ তোমার কি মনে হয়? দোষ দেখিয়ে বিয়ে ভেঙে দিলে উষসীর জন্য সেটা ভালো হবে? অনেক বড় প্রবলেম হয়ে যাবে।”

” উহুম। কোনো প্রবলেম হবে না। এর থেকেও ভালো ব্বে। আমার কাছে উষুর জন্য অনেক ভালো পাত্র রেডি আছে।”

তৃষাণের চেহারায় বিস্ময় খেলে গেল,” তাই নাকি? তাহলে এটা আমাকে আগে বললেই হতো। এতো দেরিতে কেন বলছো?”

” আগে তো আমি পাত্রের সন্ধান পাইনি। বলবো কিভাবে?”

” আচ্ছা, কে পাত্র? কি করে?”

উষ্ণতা খুশি খুশি কণ্ঠে বলল,” সিংগার।”

তৃষাণের চোখ দুটি ধ্বক করে জ্বলে উঠল। কি হলো উষ্ণতা কিছুই বুঝল না। তৃষাণ এতোক্ষণ তাকে জড়িয়ে ধরেছিল৷ এইবার ছেড়ে দিল। গম্ভীরমুখে আয়নার সামনে গিয়ে চুল আঁচড়াতে লাগল। কমলা টি-শার্ট পরল। উষ্ণতা বুঝে গেল তৃষাণ মুখে না বলেই বুঝিয়ে দিতে চাইছে যে তার উষ্ণতার প্রস্তাব পছন্দ হয়নি।

উষ্ণতা শক্ত কণ্ঠে বলল,” আমি আজকে ইয়ামিনকে ডিনারে ইনভাইট করেছি। উষসীও ওকে পছন্দ করে। আর আমার মনে হয় ইয়ামিনেরও ওর প্রতি ইন্টারেস্ট আছে। তাহলে ওদের মধ্যে যেহেতু সবকিছু ঠিক তাহলে আমরা কেন শুধু শুধু বাঁধা দিবো? আমি আমার বোনের ভালো চাই।”

তৃষাণ উষ্ণতার একটা কথারও জবাব দিচ্ছে না। উষ্ণতা রাগে বলল,” উষু আমার বোন। ওর ভালো-মন্দ বোঝার দায়িত্ব আমার। তুমি মানো আর না মানো ইয়ামিনের সাথেই বিয়ে হবে।”

তৃষাণ এতোক্ষণে কথা বলল,” যা ইচ্ছা তাই করো। কিন্তু আজকে থেকে এইটা ভুলে যেও যে আমি তোমার হাসব্যান্ড। ”

উষ্ণতা বাকরুদ্ধ! তৃষাণ এটা কেমন কথা বলল? এবং এই কথা বলেই সে ঘর থেকে বের হয়ে গেল৷ এরপর আর ফিরে আসেনি। উষ্ণতা আজ সারাদিন অপেক্ষা করেছে। তৃষাণের মেজাজ একটু বেশি। সে ভেবেছিল রাগ কমলেই তৃষাণ বাড়ি ফিরে আসবে। সবকিছু মেনেও নিবে। কিন্তু তৃষাণ এখনও আসেনি৷ এদিকে ইয়ামিনকে ডিনারের দাওয়াত করা হয়ে গেছে। সে চলেও আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে। অথচ তৃষাণের খোঁজ নেই। উষ্ণতার এখন ভয় লাগছে। সে আবার তৃষাণের নাম্বারে ফোন করল। এখনও সুইচড অফ। উষ্ণতা অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারী করতে লাগল।

উষসী বিছানায় শুয়ে পড়ল। শক্ত করে একটা বালিশ চেপে ধরে ভেতরের অস্থিরতা কমানোর বৃথা চেষ্টা চালালো। এই অবস্থাতেই তার ঘুমে চোখ লেগে এলো। সে এক প্রশান্তির ঘুম!
দরজার খটমট শব্দে ঘুম ভেঙে গেল উষসীর। অনুপমা তাড়াহুড়োয় বলল,” সন্ধ্যা হয়ে গেছে আর তুই এখনও ঘুমাচ্ছিস? ওদিকে ইয়ামিন তো এসে গেছে।”

” এসে গেছে মানে? কোথায় উনি?” উষসীর গলা কাঁপছে। সীমাহীন ভালোলাগায় মন আবেশিত হচ্ছে। অনুপমা দুষ্ট হেসে বলল,” করিডোরের দিকে আছে। যা,যা, দ্রুত যা। আর একটু সেজেগুজে যাস!”

এই কথা বলেই চোখ মারল সে। লজ্জায় উষসীর গাল লালচে দেখালো। সে ড্রেসিংটেবিলের সামনে এসে কাঁপা হাতে চিরুনি নিল। খুব বুক কাঁপছে। কতদিন পর আবার দেখা! আয়নায় নিজের চেহারাটা কেমম অদ্ভুত দেখাচ্ছে। ইয়ামিন তার নর্ভাসনেস বুঝে ফেলবে না তো? উষসী তার চুলটা আঁচড়ে চোখে হালকা কাজল লাগিয়ে নিল। লিপস্টিক দিতে গিয়েও দিল না। বেশি সাজলে বাড়াবাড়ি হয়ে যায়।

উষসীদের বাড়ির করিডোরের মতো জায়গায় একহাতে গিটার নিয়ে চেয়ারে বসে রয়েছে ইয়ামিন। তার গাঁয়ে ফুলহাতা ফোল্ড করা এশ কালার শার্ট। ঠোঁটে মৃদু হাসি। ইয়ামিনকে বরাবরের মতোই হ্যান্ডসাম লাগছে। উষসী তাকে দেখা মাত্রই কেমন এলোমেলো হয়ে পড়ল। ধীরপায়ে এগিয়ে যেতে লাগল তার কাছে। ইয়ামিন অবশ্য তাকে তখনও দেখেনি। সে নিজের মনে গিটার বাজিয়ে গান গাইছে,

” বলতে গিয়ে মনে হয়…
বলতে তবু দেয় না হৃদয়, কত তোমায় ভালোবাসি!
চলতে গিয়ে মনে হয়…
দূরত্ব কিছু নয়, তোমারই কাছে ফিরে আসি!”

উষসী মন্ত্রমুগ্ধের গান শুনতে শুনতে একরাশ বিভোরতা নিয়ে এগিয়ে গেল।

ইয়ামিন হঠাৎ গান গাওয়া থামিয়ে উঠে দাঁড়ালো। উষসীর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,” কেমন আছো?”

উষসী উতলা কণ্ঠে বলল,” আমি ভালো আছি। কিন্তু আপনি থামলেন কেন? প্লিজ, গানটা শোনান। প্লিজ?”

ইয়ামিন ভ্রু কুচকে বলল,” কেন?”

যদিও তার মুখে তখন হাসি লেগে আছে। উষসী লজ্জামাখা গলায় বলল,” আপনার কণ্ঠে ওই গানটা শুনতে আমার খুব ভালো লাগছিল।”

” তাই? কিন্তু এই গানটাই কেন? অন্য গান ভালো লাগবে না?”

“লাগবে তো। কিন্তু আমার মনে হয়….” নিশ্বাসে টান পড়ায় থামল উষসী। ইয়ামিন বলল,” বলো, কি মনে হয়?”

উষসী লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে বলে ফেলল,” এই গানের প্রত্যেকটি শব্দ আপনি আমাকে ইঙ্গিত করে গাইছেন। এটাই মনে হয়।”

উষসী দুইহাতে নিজের মুখ ঢেকে ফেলল তীব্র লজ্জায়। ইয়ামিন হেসে বলল,” তোমাকে কেন ডেডিকেট করবো? এটা তো প্রেমের গান।”

” উফফ, আপনি কি কিছুই বোঝেন না? ” এবার একটু বিরক্তই হলো উষসী। ইয়ামিন রসিক কণ্ঠে বলল,” বুঝি না যখন বোঝাও।”

উষসী চোখমুখ খিচে বলল,” আপনি বুঝেন না?আমি আপনাকে কত ভালোবাসি?”

উষসী আবারও মুখ ঢাকল। বড় শ্বাস ছাড়তে লাগল এবার। হৃদযন্ত্রটা যেন বিকল হয়ে যাবে। এদিকে ইয়ামিনের পক্ষ থেকে কোনো আওয়াজ আসছে না। উষসী একটু পর মুখ থেকে হাত সরিয়ে উপরে তাকাল। দেখল ইয়ামিন নিষ্পলক তার দিকেই তাকিয়ে আছে। পেছনে দুইহাত গুটিয়ে হালকা নিচু হয়ে তাকে দেখছে৷

মুহূর্তেই উষসীর হৃৎপিন্ড হাজার গতিতে ছুটতে লাগল। বিবশের মতো সেও তাকিয়ে রইল ইয়ামিনের দিকে। কেউ কিছু বলছে না, শুধু হৃদয়ের আলোড়ন বেড়ে চলেছে। উষসী বাঁধা পড়ল ইয়ামিনের কালো বলের মতো ওই চমৎকার চোখ দু’টির কৃষ্ণগহ্বরে! ঘোর লেগে আসছিল তার। হঠাৎ ইয়ামিন নিচু গলায় বলল,” আমিও তো।”

উষসী সম্বিৎ ফিরে পেলো। অপ্রস্তুত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,” মানে?”

” মানে আমিও….ভালোবাসি!”

উষসীর আনন্দে কান্না পেয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। ঘুমের মধ্যেই বালিশ জড়িয়ে সে কাঁদতে লাগল৷ খুশির কান্না! এরই মাঝে দরজায় খটখট আওয়াজ শোনা গেল। উষসীর ঘুম ভাঙল আচম্বিতে। এ কেমন সুখ স্বপ্ন দেখল সে? কেন এই স্বপ্ন ভাঙল? সুখের স্বপ্ন ভাঙলে বড় কষ্ট হয়! উষসীর বুক চিনচিনে ব্যথায় ভরে উঠল।

সে নিরাশ মনে দরজা খুলতেই অনুপমা তাড়াহুড়ো করে বলল,” সন্ধ্যা হয়ে গেছে আর তুই এখনও ঘুমাচ্ছিস? ওদিকে ইয়ামিন তো এসে গেছে।”

” এসে গেছে মানে? কোথায় উনি?” উষসীর গলায় সীমাহীন কৌতুহল। এই দৃশ্যটা যেন ঠিক তার স্বপ্নের দৃশ্য! অনুপমা বলল,” করিডোরের দিকে আছে। যা,যা, দ্রুত যা। একটু সেজেগুজে যাস!”

ঠিক স্বপ্নের মতোই অনুপমা দুষ্টমি করল। উষসী বাকরুদ্ধ। এবার আর তার লজ্জা লাগল না। বরং বিস্ময়ে সে হতবাক। সবকিছুই স্বপ্নের মতো ঘটছে কেন? তাহলে কি… উষসীর বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল প্রবল উত্তেজনায়। সে চুল আঁচড়ে চোখে কাজল দিয়ে নিল। লিপস্টিক ইচ্ছে করেই দিল না। সবকিছু স্বপ্নের সাথে মিল থাকা চাই।

বাড়ির করিডোরের মতো জায়গায় উষসী গিয়ে থামল। কারণ স্বপ্নে ইয়ামিন এখানেই ছিল। ওইতো, চেয়ারে একহাত গিটার নিয়ে বসে রয়েছে ইয়ামিন। তার গাঁয়ে ফুলহাতা ফোল্ড করা এশ কালার শার্ট। স্বপ্নে উষসী শার্টের রঙ বুঝতে পারেনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এই রঙের শার্টই তার গায়ে ছিল। একদম স্বপ্নের দৃশ্যপট। উষসী কি এগিয়ে যাবে? এরপর কি হতে চলেছে? ইয়ামিন নিশ্চয়ই তার দিকে ঘুরে মৃদু হাসবে এখন? তারপর গান গাইতে শুরু করবে? ভাবতেই উষসীর লজ্জায় মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম হলো।

উষসী কাছে গিয়ে ইয়ামিনের কাঁধে হাত রাখল। তখনি ঘুরে তাকাল মানুষটা। উষসীর ভুবন কেঁপে উঠল এবার। আহত মনে দুই পা পিছিয়ে এলো সে। কারণ তার সামমে দাঁড়ানো মানুষটি ইয়ামিন নয়, ইমন!

চলবে

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ২৩
লিখা- Sidratul Muntaz

“কেমন আছেন, মিস উষসী?” ইয়ামিনের গিটার হাতে দাঁড়িয়ে প্রশ্নটা করল ইমন। তার চোখে মুগ্ধতা।

সদ্য ঘুম থেকে জেগে ওঠা উষসীর চেহারা কিঞ্চিৎ ফ্যাকাশে লাগছে। তার বড় বড় দুই চোখে কাজলটা দারুণভাবে মানিয়ে গেছে। এতো সুন্দর কেন এই রমণী? ইমন প্রচন্ড মিস করছিল উষসীকে। তাই তৃষাণ বলা মাত্রই পরিবার নিয়ে অনতিবিলম্বে চলে এসেছে।

উষসী ইমনের প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না। তার মন ভেঙে গেছে। কেমন বিষাক্ত একটা অনুভূতি হচ্ছে। এতোদিন তো সে ভুলেই গেছিল নিজের বিয়ের কথা। ইমনকে দেখে আবার তা মনে পড়েছে। ইমন যেন তার সুখময় স্বপ্নের জগতে দুঃখ হয়ে ঢুকে গেছে। উষসী সেটা মেনে নিতে পারছে না। সে পিছিয়ে এলো। তারপর হঠাৎ দৌড়ে চলে গেল।

ইমন তার আচরণ দেখে কিছুটা বিস্মিত। কিছু একটা ভেবে সে হেসে ফেলল। উষসী এতোদিন পর দেখা হওয়ায় লজ্জা পেয়েছে হয়তো। গিটার হাতে নিয়ে গান গাওয়ার ভং ধরল ইমন,” তুমি এসেছিলে পরশু… কাল কেন আসোনি.. আমায় ভালোবাসোনি!”

উষসী পাগলের মতো ছুটে ঘরের দিকে যাচ্ছিল তখনি ধাক্কা খেল কারো সাথে। সামনের মানুষটি নরম গলায় বলল,” আরে, সাবধানে!”

উষসী উপরে চাইতেই ইয়ামিনের মুখ দেখল। সাথে সাথেই চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। ইচ্ছে করল ইয়ামিনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলতে। ইয়ামিন অবাক হয়ে বলল,” কি ব্যাপার?”

উষসী চোখের জল মুছতে মুছতে প্রশ্ন করল,” আপনি কেমন আছেন?”

” ভালো… কিন্তু তোমার কি হয়েছে? চোখে পানি কেন?”

” স্বপ্ন ভেঙে গেলে চোখে পানি তো আসবেই।”

এই কথা বলে উষসী হাসল। কিন্তু বুকের চিনচিনে সূক্ষ্ম ব্যথাটা যেন সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। ইয়ামিনকে সে কোনোদিনও পাবে না এই কথা ভাবতেই পৃথিবী অর্থহীন মনে হচ্ছে। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না উষসী। তার হাউমাউ করে কান্না পাচ্ছে। দৌড়ে ঘরে ঢুকে দরজা আটকালো। তার হাব-ভাব কিছুই বুঝল না ইয়ামিন। কিন্তু সে খুব একটা ভাবলও না এই নিয়ে। তার চোখ দু’টো উষ্ণতাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে সেই কখন থেকে!

আজ উষসীর এংগেজমেন্ট হবে। ইমনের পুরো পরিবার এসেছে। বাড়িতে বিরাট হৈচৈ বেঁধে গেল। যুথি বেগম মহাভোজের আয়োজন শুরু করেছেন। তৃষাণ বাড়ি ফিরেছে ইমনদের সাথে নিয়ে। এই সব কিছু তারই পরিকল্পনা। সে অনুপমাকে আদেশ দিল উষসীকে নিয়ে পার্লারে যেতে। অনুপমা ক্ষীণ গলায় বলল,” উষসী তো ইমনকে দেখার পর থেকেই কাঁদছে।”

তৃষাণ গম্ভীর গলায় বলল,” কাঁদুক। এই সময় মেয়েরা একটু-আধটু কাঁদেই। তোমাকে যা বলা হয়েছে তাই করো।”

উষ্ণতা কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল,” আমার বোন কাঁদলে তোমার কোনো সমস্যা নেই, তাই না? ”

তৃষাণ শান্ত গলায় বলল,” আমাকে ভুল বুঝো না উষ্ণ। আমি ভেবে-চিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুমি ভালো করেই জানো উষসী কখনও আমার শালিকা ছিল না, সে সবসময় আমার ছোটবোন। আর আমি আমার বোনের জন্য কখনও খারাপ সিদ্ধান্ত নিবো না।”

” তাই?” উষ্ণতা তাচ্ছিল্য হাসল। উত্তপ্ত কণ্ঠে বলল,”তুমি শুধু নিজের মান-সম্মানের কথা ভাবছো। সেজন্য উষুর জীবন নষ্ট হলে হোক, তোমার কি? ”

” মানে?” তৃষাণ সামান্য অবাক হলো উষ্ণতার কথায়।

উষ্ণতা ক্রোধান্ধ কণ্ঠে বলল,” তুমি টক্সিক গার্ডিয়ানের মতো আচরণ করছো তৃষাণ। উষু বিয়েতে রাজি না এইটা জানার পরেও তুমি কিভাবে ওদের এইখানে নিয়ে এলে? হোয়াটস রং উইদ ইউ? তুমি কি চাও?”

তৃষাণ প্রশমিত গলায় বলল,” আমি শুধু সবার ভালো চাই।”

” ভুল। তুমি শুধু নিজেকে উপরে রাখতে চাও। বিয়ের কথা হয়ে যাওয়ার পর তা ভেঙে গেলে ওদের কাছে তোমার সম্মান নষ্ট হবে। সেজন্য উষসীর মত নেই জানার পরেও জবরদস্তি ওকে এংগেজমেন্ট করাতে চাইছো। আমি এটা মানবো না। এই এংগেজমেন্ট হবে না। যেভাবে পারো ওদের বিদায় করো। ”

” বিদায় করবো?” তৃষাণ হতবাক। উষ্ণতা রোষ সিক্ত কণ্ঠে বলল,” অবশ্যই করবে।”

তৃষাণ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,” সম্ভব না। আজকেই এংগেজমেন্ট হবে।”

” তুমি যা চাও তাই হবে নাকি? আমার বোনের জীবনের সিদ্ধান্ত তুমি নিবে?”

তৃষাণ হতভম্ব হয়ে তাকাল,” তোমার বোন মানে? উষসী শুধু তোমার বোন? আমার কেউ না!”

উষ্ণতা মুখের পেশি শক্ত করে উত্তর দিল,” তোমার কাছে আমার বোনের মতামতের কোনো মূল্য নেই, তুমি ওর কেউ না।”

তৃষাণ অনেকটা আহত হলো। রাগান্বিত ভঙ্গিতে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,” তোমার বোন কি নিজের ভালো বুঝে? সেই বয়স হয়েছে ওর? তাহলে ওর মতামতের গুরুত্ব কেন দিবো আমি?”

” ও না বুঝলেও আমি তো বুঝি। আমি চাই না যে ইমনের সাথে বিয়ে হোক।”

” কেন? ইমনের মধ্যে খারাপ কি আছে? জাস্ট একটা নেগেটিভ সাইড দেখাও। আমি এখনি বিয়ে ভেঙে দিবো।”

উষ্ণতা চুপ করে রইল। তৃষাণ কাছে এসে কিড়মিড় করে বলল,” আসল প্রবলেম হচ্ছে ওই ইয়ামিন ইব্রাহীম। তাই না?”

” উষসীর যদি তাকেই পছন্দ হয় তাহলে তোমার কি প্রবলেম?”

” আমার অনেক বড় প্রবলেম।” তৃষাণ চেঁচিয়ে উঠল। উষ্ণতা সামান্য হকচকিয়ে গেল তার আচরণে।

তৃষাণ ক্রোধসিক্ত কণ্ঠে আওড়াল,” এই ব্যাপারে কথা এখানেই শেষ। আর ভুলেও ইয়ামিনের নাম যেন তোমার মুখে না শুনি আমি। ”

উষ্ণতা জেদ নিয়ে বলল,” শুনলে কি করবে তুমি?”

” আমি এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবো।”

উষ্ণতা আশ্চর্য হয়ে গেল। বিস্মিত গলায় বলল,” তুমি এমন কেন করছো তৃষাণ? জোর করে উষুর বিয়ে দেওয়ার কোনো মানেই হয় না। তোমার জেদের জন্য আমি আমার বোনের জীবন নষ্ট করব নাকি? ইয়ামিনকে তোমার পছন্দ হয়নি বুঝলাম। কিন্তু ইমনকেও তো আমার পছন্দ হয়নি। তাও কেন তুমি জোর করে…”

উষ্ণতাকে থামিয়ে তৃষাণ প্রশ্ন করল তীব্র কণ্ঠে,” ইমনকে তোমার কেন পছন্দ হয়নি? কারণ দেখাও।”

উষ্ণতা এবার পাল্টা প্রশ্ন করল,” ইয়ামিনকে তোমার কেন পছন্দ হয়নি? আগে সেই কারণ দেখাও।”

তৃষাণ কিছু বলতে না পেরে রেগে ড্রেসিংটেবিলের উপর থেকে পারফিউমের বোতল ধাক্কা মেরে ভেঙে ফেলল। উষ্ণতা কেঁপে উঠল। তৃষাণও কাঁপছে রাগে। হঠাৎ কি হলো তার? বাইরে থেকে উঁকি দিল ইমনদের সাথে আসা কাজের মেয়েটি। উষ্ণতার মুখ অপমানে থমথম করছে। কি ভাববে এখন সবাই? তৃষাণ সামান্য বিষয় নিয়ে এমন সিন ক্রিয়েট না করলেও পারতো। রাগে উষ্ণতা ঘর থেকে বের হয়ে গেল। তৃষাণ হতাশ ভঙ্গিতে বসল সোফায়। উষ্ণতাকে সে একদম রাগাতে চায়নি। একবার যদি কোনো কারণে উষ্ণতা রেগে যায় তাহলে সেই রাগ ভাঙাতে খুব কষ্ট হয়।

উষসীর গাঁয়ে চমৎকার লাল রঙের একটা শাড়ি। হাতে লাল চুড়ি, কানে দুল, গলা খালি কিন্তু মাথায় ছোট্ট একটা টিকলি। ন্যাচরাল মেকাপে উষসীকে একটু অন্যরকম লাগছে। তবে দারুণ সুন্দর লাগছে। উষসী এমনই একটা মেয়ে যাকে বিনা প্রসাধনীতেও রাজকন্যা লাগে। ইমন উষসীর বেডরুমে এসেছে অনেকক্ষণ হলো। উষসী নিজেই তাকে ডেকেছিল। কিন্তু এখন কোনো কথা বলছে না সে। ইমন বেশ কিছুক্ষণ বসে থেকে এক পর্যায় অধৈর্য্য গলায় বলল,” আপনার কি মনখারাপ?”

উষসীর শান্ত, স্থির দৃষ্টি জানালার দিকে। ইমনের প্রশ্ন সে শুনেছে কি-না বোঝা গেল না। তবে এতোক্ষণ পর কিছু একটা বলল, ” আচ্ছা, আপনি কখনও কাউকে ভালোবেসেছেন?”

হঠাৎ এমন প্রশ্নে ইমন একটু অপ্রস্তুত হলো। কলেজ লাইফে তার একটা প্রেম ছিল বটে। কিন্তু একসময় মেয়েটার বিয়ে হয়ে যায়। হবু বউয়ের সাথে এসব নিয়ে আলোচনা করতে সংকোচ লাগছে ইমনের।

উষসী হঠাৎ তার প্রেমের বিষয়ে জানতে চাইল কেন? ইমন হ্যাঁ বা না উত্তর দেওয়ার আগেই উষসী বলে উঠল,

” ভালো করে ভেবে বলবেন। প্রেম আর ভালোবাসা দু’টো ভিন্ন জিনিস। প্রেম সবার জীবনেই হয়তো আসে। কিন্তু ভালোবাসা পাওয়ার সৌভাগ্য সবার হয় না! প্রেমের সম্পর্কগুলো হয় ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু ভালোবাসা হলো এমন এক অনুভূতি যা একবারই হয় এবং চিরস্থায়ী ভাবে হয়। যার হয়, তার সবকিছু বিনাশ করে ছাড়ে। ছাড়খাড় করে নিঃশেষ বানিয়ে দেয়। এমনকি তাতেও ক্ষান্ত হয় না। যতদিন মানুষটি বেঁচে থাকে ততদিন পুড়ে যাওয়া হৃদয় ভালোবাসা নামক অগ্নিদাহে জ্বলতেই থাকে। আর সবচেয়ে অবাক কান্ড কি জানেন? কোনো জিনিস পুড়ে গেলে জ্বলে যায়। কিন্তু ভালোবাসায় যে মন পোড়ে তা কখনও জ্বলে যায় না বরং খাঁটি হয়। যে হৃদয় যত ভালোবাসার দহন সহ্য করতে পারে সেই হৃদয় তত খাঁটি!”

নিজের থেকে কমপক্ষে দশ বছরের ছোট মেয়েটির মুখে এমন ভারী ভারী কথা শুনে স্বভাবতই ইমনের ভ্রু খানিক কুচকে গেল। উত্তর দেওয়ার জন্য শব্দ পেল না সে। মুহুর্তেই এলোমেলো হয়ে পড়ল।মেয়েটা হঠাৎ এমন সিরিয়াস কথা কেন বলছে? অনেক হম্বিতম্বি করে ইমন শেষমেষ জিজ্ঞেস করল,” আপনি কি কাউকে ভালোবেসেছেন?”

উষসী মুচকি হাসল৷ তার নজর তখনও জানালার দিকে। ওইতো করিডোরে ইয়ামিনকে দেখা যাচ্ছে। তার কানে ফোন। উষসী তার চোখে মুগ্ধতা আর কণ্ঠে আক্ষেপ মিশিয়ে বলল,” ভালোবাসা এমন এক জিনিস, যা সৌভাগ্য এবং দূর্ভাগ্য দু’টোই বয়ে আনে। তবে আমার ক্ষেত্রে দূর্ভাগ্যের পাল্লাটা একটু বেশিই ভারী।”

” এ কথা কেন বলছেন? আপনি কাকে ভালোবাসেন?”

উষসী আবারও হাসল। ওর হাসিটা এতো আশ্চর্য সুন্দর কেন? ইমন বার-বার আটকে যাচ্ছে ওই অলীক সৌন্দর্য্যে। ওই ঠোঁটে, চোখে, মুখে!

” কাকে ভালোবাসি সেটা বড় কথা না। কতটা ভালোবাসি সেটাই বড় কথা। আমার ভালোবাসার পরিমাণ যত, আপনার পরিশ্রমও তত। যতদিন না আমার মনে গড়ে উঠা এই অনুভূতির পাহাড় আপনি টলাতে পারছেন ততদিন আমি আপনার হবো না। হয়তো আমার শরীর আপনার কাছে থাকবে কিন্তু মনের অস্তিত্ব আপনি খুঁজেও পাবেন না।”

উষসীর চোখ টলমল করছে। সে মনের ব্যথায় সিক্ত হয়ে বলল,” তবে আপনার কাছে যদি পাওয়া মানে শুধুই শারীরিক চাহিদা হয় তাহলে ভিন্ন কথা! আমি নির্দ্বিধায় নিজেকে আপনার কাছে সঁপে দিতে রাজি।”

এই কথার পর কোনো সত্যিকারের পুরুষ হয়তো প্রতিবাদ না করে থাকতে পারবে না। ইমনও প্রতিবাদ করল। দুর্ধর্ষ প্রতিবাদে তার কণ্ঠ গর্জে উঠল,” আমার কাছে বিয়ে মানেই শুধু শারীরিক চাহিদা না উষসী। যাকে আমি বিয়ে করবো সে হবে আমার অর্ধাঙ্গিনী অর্থাৎ আমার জীবনের অর্ধেক। আমি তার মনের রাজা হয়ে রাজত্ব করবো। আর যদি সেটা না পারি, যদি সে আমাকে নিজের মনের মালিক হওয়ার সুযোগ না দেয় তাহলে আমিও তাকে মিথ্যে সম্পর্কের বেড়াজালে আটকে রাখতে চাইবো না।”

” তাই যদি হয়, তাহলে সম্মতি নেই জানার পরেও কেন আমাকে জোর করে বিয়ে করছেন?”

ইমন অপ্রস্তুত হলো। উত্তর দেওয়ার মতো কিছু পেল না। মুখ ফুটে না বললেও মনে মনে ঠিক বলল,” আপনাকে আমার অসম্ভব ভালো লেগে গেছে মিস উষসী৷ আপনার মতো মেয়েকে ভালো না বেসে থাকাই যায় না! কোনো সাধারণ পুরুষের পক্ষে এটা অসম্ভব!”

ইমন উষসীর দিকে চেয়ে আছে। কিন্তু উষসীর দৃষ্টি ইয়ামিনের দিকে নিবদ্ধ।

করিডোরের সামনে দাঁড়িয়ে মায়ের সাথে ফোনে কথা বলছিল ইয়ামিন। তখনি খেয়াল করল ব্যালকনিতে উষ্ণতা দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে পানি। ইয়ামিনের মনোযোগ সেদিকে আটকে গেল। ওই পাশ থেকে মিসেস শিমলা কথা বলে যাচ্ছেন,” কখন ফিরবি, বাবা? হ্যালো।”

ইয়ামিনের খেয়াল নেই মায়ের কথায়। সে অবাক হয়ে দেখছে উষ্ণতার চোখের বড় বড় ফোঁটার অশ্রু। কে কাঁদালো উষ্ণতাকে? কেন কাঁদছে উষ্ণতা? ইয়ামিনের হৃদয়ে অবাধ তোলপাড় শুরু হলো। পৃথিবীর সকল নির্মম দৃশ্য সহ্য করতে পারলেও উষ্ণতার চোখের পানি সে সহ্য করতে পারবে না।

তৃষ্ণা ইয়ামিনের হাত টেনে বলল,” শিল্পী আঙ্কেল, তোমার গিটার কই? গান বাজাবে না? এদিকে এসো। এসো না!”

ইয়ামিন তৃষ্ণাকে থামালো। তাকে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসল। উদগ্রীব গলায় প্রশ্ন করল,” তোমার আম্মুর কি হয়েছে তৃষ্ণা? তুমি কি জানো?”

তৃষ্ণা ব্যালকনির দিকে তাকাল। একটু আগেই উষ্ণতা আর তৃষাণকে ঝগড়া করতে দেখেছিল সে। তাই ফিসফিস করে বলল,” পাপা আমার মাম্মাকে মেরেছে। এজন্য মাম্মা কাঁদছে।”

“হোয়াট?” ইয়ামিনের আহত হৃদয় আরও আহত হলো। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল ক্রোধে,” তুমি শিউর? তোমার পাপা তোমার মাম্মাকে মেরেছে? ”

” হ্যাঁ। ” ইয়ামিনের চোখ দু’টো জ্বলে উঠল। বাচ্চা মানুষ নিশ্চয়ই মিথ্যা বলবে না। সে যা দেখেছে সেটাই বলছে। কিন্তু তৃষাণের সাহস কিভাবে হলো উষ্ণতার গায়ে হাত তোলার? ইয়ামিনের চোখের সাদা অংশ নিমেষেই রক্তিম হয়ে গেল। শিরা-উপশিরা কাঁপতে লাগল দূর্দমনীয় রাগ আর হিংস্রতায়।

তৃষাণকে করিডোরে আসতে দেখে সে আচম্বিতে আক্রমণ করে বসল। দুই হাতে তৃষাণের কলার ধরে তাকে টেনে নিয়ে গেল বাইরে। ভেতরে সবাই ইমন আর উষসীর এংগেজমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত। এই ঘটনা কেউ দেখল না। বাইরে এসেই তৃষাণ ইয়ামিনকে ধাক্কা মেরে সরালো। কুঁচকে যাওয়া শার্ট ঠিক করতে করতে হতভম্ব গলায় বলল,” এটা কি করছো তুমি? মাথা ঠিকাছে?”

ইয়ামিন তেড়ে এসে আবারও চেপে ধরল তৃষাণের কলার। রাগে উন্মত্ত সে। গর্জে উঠে বলল,” আপনার সাহস কি করে হয় উষ্ণতা মিসের গায়ে হাত তোলার? আপনার হাত আমি ভেঙে ফেলবো। আপনাকে আমি খু’ন করে ফেলবো।”

চলবে

আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-২০+২১

0

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ২০
লিখা- Sidratul Muntaz

উষ্ণতা ঠিক করেছে, ইমনের সাথে বিয়েটা ভেঙে দিবে। তারপর ইয়ামিনের সাথেই বিয়ে দিবে নিজের আদরের বোনকে। তার কাছে নিজের বোনের খুশি সবার আগে। ইয়ামিনকেও তার অনেক পছন্দ হয়েছে। ছেলেটা ডিসেন্ট, হ্যান্ডসাম, বাচনভঙ্গিও সুন্দর, বড়দের সম্মান করে, বিনয়ী। সেলিব্রিটি হয়েও বিন্দুমাত্র অহংকার নেই। এমন হীরের টুকরোকে হাতছাড়া করা তো বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না।

গতকাল সারারাত উষ্ণতা জেগে থেকে এসব চিন্তা করেছে। ইমনকে উষসী পছন্দ করে না। আর পুলিশ পাত্র উষ্ণতারও পছন্দ না। তবুও তৃষাণের কথায় সে সায় দিয়েছিল। তখন তো হাতের কাছে অন্য ভালো কোনো পাত্র ছিল না। কিন্তু এখন আছে! তাই উষ্ণতা অবশ্যই বোনের সুখের জন্য লড়বে। যুথির পাশে গিয়ে উষ্ণতা খুব আগ্রহ নিয়ে বলল,” মা, ইয়ামিনকে তোমার কেমন লেগেছে?”

যুথি বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলেন,” কেন?”

উষ্ণতা হাসি মাখা মুখে বলল,” আমি ঠিক করেছি উষসীর সাথে ওর বিয়ে দিবো।”

যুথি হতবাক হয়ে উষ্ণতার দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর কাশতে লাগলেন। দ্রুত উষ্ণতা মাকে পানি ঢেলে খাওয়ালো। যুথি কোনমতে নিজেকে সামলে বললেন,” তোর কি মাথাখারাপ হয়ে গেছে?”

কথাটা একটু জোরেই বলে ফেলেছিলেন যুথি।আশেপাশের মানুষ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল।

উষ্ণতা ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল,” মাথা খারাপ হবে কেন? ইমনকে আমার এমনিও পছন্দ ছিল না। উষসীও বিয়েটা নিয়ে খুশি না। তুমি নিজের মেয়ের খুশি দেখতে চাও না?”

যুথি অবলীলায় বললেন,”না।”

উষ্ণতা আশাহত হলো মায়ের কথায়। যুথি খুব রেগে গেছে। তার মুখ পাথরের মতো শক্ত। ইয়ামিনের কাজগুলো আজও ভুলতে পারেননি তিনি। তখন ইয়ামিন অনেক ছোট ছিল। না বুঝে ভুল করেছে, এসব কথা তিনি মানতে চান না। তিনি কখনও ইয়ামিনকে ক্ষমা করতে পারবেন না। থমথমে কণ্ঠে বললেন,” এটা অসম্ভব উষ্ণ। এই বিষয়ে আমি তোর সাথে কোনো কথা বলব না। আমার উত্তর একটাই, না মানে না।”

যুথিকে রাগান্বিত দেখাচ্ছে। তিনি যেন এই বিয়ের ঘোর বিরোধী। উষ্ণতা ভড়কে গেল। মা এতো তেঁতে উঠলেন কেন বিয়ের কথা শুনে? ইয়ামিনের দোষ কোথায়? পাত্র হিসেবে সে কোনদিক দিয়ে খারাপ! যুথি একটু পর প্রশ্ন করলেন,” তৃষান এসব জানে?”

উষ্ণতা গম্ভীর গলায় উত্তর দিল,” না। এখনও ওকে জানাইনি।”

” তাহলে জানাও আগে। ”

” সে যদি রাজি হয় তাহলে কি তুমি রাজি হবে?”

তৃষাণ মরে গেলেও রাজি হবে না সেটা জেনেই যুথি ভর্ৎসনার সাথে বললেন,” হ্যাঁ। তৃষাণ রাজি হলে আমিও রাজি।”

উষ্ণতা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল এবার। সে তো ভেবেছিল মাকে কোনোভাবেই রাজি করানো যাবে না। হয়তো ইয়ামিন মিডিয়া জগতের মানুষ বলে মা তাকে খারাপ ভাবছেন। কিন্তু তৃষাণ যদি রাজি হয়, তাহলে তিনিও রাজি হবেন। তৃষাণকে রাজি করানো উষ্ণতার কাছে চুটকির ব্যাপার। সে কিভাবে তৃষাণকে রাজি করাবে সেটা নিয়ে ভেবে একটা উপায় বের করে ফেলল। তখনি হাজির হলো তৃষাণ। তীক্ষ্ণ মেজাজ নিয়ে প্রশ্ন করল,” উষু কোথায় উষ্ণ? ওকে দেখছি না কেন?”

উষ্ণতা চোখের ইশারায় উষসীকে দেখিয়ে দিল। অনেকটা পেছনে ইয়ামিনের সাথে বসে গল্প করছে উষসী। ইয়ামিন কথা বলছে আর উষসী হাসিতে ঢুলে পড়ছে। চেহারায় তার লাজুক আভা। তৃষাণ কটমট করে বলল,” ওকে ওখানে কে বসিয়েছে?”

উষ্ণতা হেসে বলল,” আমি। কেন, কোনো সমস্যা?”

তৃষাণ তুমুল গতিতে সেদিকে এগিয়ে গেল। উষ্ণতা আশ্চর্য হলো। এতো রেগে যাওয়ার কি হলো এখানে? তৃষাণ এতো কনজার্ভেটিভ হচ্ছে কেন? উষসীদের সামনে গিয়ে তৃষাণ বলল,” তোমার না উইন্ডো সিট ভয় লাগে? তাও এখানে কেন বসেছো? যাও, সামনে গিয়ে অনুপমা আপুর সাথে বসো।”

উষসীর হাসি মাখা মুখ গেল শুকিয়ে। কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে সে উঠে দাঁড়ালো। বিমানের অনেকেই তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। উষসী কাঁপা কণ্ঠে বলল,” ভাইয়া আমাকে এখানে উষ্ণ আপু বসতে বলেছে।”

” এখন আমি বলছি উঠে যেতে। যাও।”

” ভাইয়া প্লিজ…”

” যাও।” তৃষাণ একটা কঠিন ধমক দিল।

উষসীর ছোট্ট আত্মা কেঁপে উঠল। অপমানে চোখে পানি চলে এলো। বিমানের সবাই তামাশা দেখছে কৌতুহল নিয়ে। সে দ্রুত হেঁটে সামনে চলে গেল। ইয়মিন শান্ত হয়ে বসে আছে চুপচাপ। তার হাতে একটা কোল্ড্রিংকের গ্লাস। উষসী চলে যেতেই তৃষাণ ইয়ামিনের পাশে বসল। এমনভাবে তাকাল যেন চোখ দিয়েই ভস্ম করে ফেলতে চায় তাকে। ইয়ামিন মৃদু হেসে বলল,” মাথা ঠান্ডা করুন ভাইয়া। কোল্ড্রিংক্স নিন?”

ইয়ামিন তার গ্লাস এগিয়ে দিল। তৃষাণ সেই গ্লাস নিয়ে পুরোটা তরল ইয়ামিনের মুখে ছুড়ে মারল। কিছু মানুষ অদ্ভুত দৃষ্টিতে এই দৃশ্য দেখে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি শুরু করেছে। কিন্তু ইয়ামিন অপমান গায়ে মাখল না। সে পকেট থেকে টিস্যু বের করে নিজের মুখটা মুছল। হতাশ কণ্ঠে খুব বিনয়ের সাথে বলল,” দিজ ইজ নট ফেয়ার, ভাইয়া।”

তৃষাণ ধারালো গলায় বলল,” এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লভ এন্ড ওয়ার।”

ইয়ামিন অবাক হয়ে তাকাল,” লভ না ওয়ার? ”

তৃষাণ হালকা ঝুঁকে এসে বলল,” দিজ ইজ থার্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার, ইয়ামিন ইব্রাহীম। বি প্রিপেয়ারড। মনে রেখো আমি কখনও তোমাকে আমার পরিবারের ক্ষতি করার সুযোগ দিবো না। উষসীকে টোপ বানিয়ে তুমি যদি মনে করো উষ্ণতার সান্নিধ্য হাসিল করতে পারবে… তাহলে আনফরচুনেটলি ইউ আর আ ডে ড্রিমার। আমি বেঁচে থাকতে সেটা কখনোই সম্ভব না। মাইন্ড ইট।”

ইয়ামিন হাসল। তৃষাণ গা শীতল করা দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে জায়গা ত্যাগ করল।

দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দরে বিমান অবতরণ করে। তৃষাণের ধমক খেয়ে উষসী একদম চুপ হয়ে গেছে। এয়ারপোর্টে নেমে তৃষাণ তাকে বলল,” তোমার আপু কোথায় উষু?”

উষ্ণতা উষসীর কাছে ব্যাগ, ফোন আর তৃষ্ণাকে রেখে বাথরুমে গেছে। সেই কথা উষসী বলল না। অভিমানে সে কোনো জবাবও দিল না। তৃষাণের সঙ্গে কথাই বলতে চায় না সে। এটা বুঝতে পেরে তৃষাণও তেমন পাত্তা দিল না। অন্যসময় হলে উষসীর মান ভাঙানোর চেষ্টা করতো। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। সে উষসীর আচরণে মারাত্মক বিরক্ত হয়েছে। আর যতক্ষণ ইয়ামিন এখানে থাকবে, তৃষাণের আচরণ স্বাভাবিক হবে না!

তৃষাণ আরেকটু সামনে যেতেই দেখল ইয়ামিন এয়ারপোর্টের সুপার শপের সামনে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। তখন সামান্য নিশ্চিন্ত হলো তৃষাণ। ইয়ামিন এখানে আছে মানে সে উষ্ণতার সাথে নেই। এটাই স্বস্তির বিষয়। কিন্তু উষ্ণতা গেল কই?

ইয়ামিন ফোন রেখে তৃষাণের দিকে হেঁটে এলো,” ভাইয়া, কাউকে খুঁজছেন? উষ্ণতা মিস ওয়াশরুমে আছেন।”

তৃষাণ ভ্রু কুচকে তীক্ষ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করল,” তুমি জানলে কিভাবে?”

” আপনার নজর তো সারাক্ষণ আমার দিকেই থাকে। আর আমার নজর থাকে মিসের দিকে… এজ ইউ নো।”

তৃষাণ ঝট করে ইয়ামিনের কলার চেপে ধরল। আশেপাশের কিছু মানুষ অবাক হয়ে চাইতেই নিজেকে ধাতস্থ করল সে। ইয়ামিনের কাঁধে হাত রেখে ধীরে তবে রূঢ় কণ্ঠে বলল,” আমি চাই না বাচ্চাদের সামনে তোমাকে নিয়ে ঝামেলা করতে। আমি কন্ট্রোলের বাইরে কিছু করার আগে ভালো হয় তুমি এখান থেকে চলে যাও। নিজের ভালো পাগলেও বোঝে। তুমি কেন নিজের ভালো বুঝতে পারছো না? এখান থেকে চলে যাও ইয়ামিন।”

ইয়ামিন মধুর কণ্ঠে বলল,” আপনি এমনিতেও সিন ক্রিয়েট করতে পারবেন না ভাইয়া। কারণটা হলো উষ্ণতা মিস।”

ঠিক সেই সময় উষ্ণতা ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছে। তাদের সামনে এসে বলল,” কি ব্যাপার? তোমরা দু’জন একটু পর পর একে-অন্যের সাথে কি এতো আলাপ করো?”

তৃষাণ থতমত খেল। ইয়ামিন হাসিমুখে বলল,” কিছু না মিস। ভাইয়া আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন আপনি কোথায়? খুব ভয় পেয়ে গেছিলেন আপনাকে না দেখে। হি রিয়েলি মিসড ইউ।”

ইয়ামিনের থেকে এমন কথা শুনে লজ্জায় চোখমুখ ছোট হয়ে উষ্ণতার। সে দেখল তৃষাণেরও ফরসা মুখ লাল হয়ে আছে। নাকের ডগা ফুলে গেছে। সে হেসে তৃষাণের বাহু ধরে নরম কণ্ঠে বলল,” ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম, বাবা! এটা নিয়ে এতো অস্থির হওয়ার কি আছে? তুমিও না… চলো।”

উষ্ণতা লাজুক হাসছে। সে ভেবেছে তৃষাণ তাকে মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য দেখতে না পেয়েই অস্থির হয়ে উঠেছে। কিন্তু তৃষাণের অস্থিরতার কারণ ভিন্ন। সে উষ্ণতার সাথে হাঁটছে ঠিকই কিন্তু কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইয়ামিনের দিকে।

সবাই খুব ক্লান্ত আর পরিশ্রান্ত অবস্থায় হোটেলে পৌঁছালো। উষসীর মুড অফ। ক্ষণে ক্ষণেই সে বিরক্ত হচ্ছে। তৃষাণ জিজ্ঞেস করল,” সবার নিশ্চয়ই ক্ষিদে পেয়েছে? কে কি খেতে চাও, বলো। আমি অর্ডার দিতে যাচ্ছি।”

উষসী বলল,” আমি কিছু খাবো না।”

এই বলে সে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। তৃষাণ চোয়াল শক্ত করে চুপ রইল। উষ্ণতা রাগী দৃষ্টিতে তাকাল,” উষু তোমার উপর রেগে আছে কেন? তুমি আবার ওকে বকেছো তাই না?”

তৃষাণ বলল,” বাদ দাও ওর কথা। এমনি ঠিক হয়ে যাবে।”

উষ্ণতা বাদ দিল না। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” কিচ্ছু ঠিক হবে না। ইয়ামিনের জন্য এমন করছো তুমি তাই না?”

তৃষাণ জবাব দিল না। উষ্ণতা কাছে এলো। তৃষাণের গালে হাত রেখে একটু বোঝানোর উদ্দেশ্যে বলল,” আমি জানি তুমি উষুর ভালো চাও। কিন্তু ইয়ামিন ছেলে হিসেবে অনেক ভালো। তুমি শুধু শুধু কেন ওকে অপছন্দ করছো? শুরু থেকেই দেখছি, তোমার ব্যবহার ইয়ামিনের প্রতি খুব রুড। জোর করে ওকে আমাদের সাথে এনেছি। ও নিজে কিন্তু আসতে চায়নি। তুমি যদি এমন করো তাহলে ছেলেটা কি ভাববে? তুমি তো প্রীতমের সাথেও এতো রেগে কথা বলো না। তাহলে ইয়ামিনের সাথে কেন?”

তৃষাণ শক্ত মুখে বলল,” আমি যেটা জানি, তুমি সেটা জানো না উষ্ণ।”

” মানে? আমি কি জানি না?”

” কিছু না।”

তৃষাণ ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আশ্চর্য, এতো অদ্ভুত আচরণ কেন তার? উষ্ণতা বুঝতে পারল না। মিনিট পাঁচেক পরেই উষসী দৌড়ে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলল,” ইয়ামিন চলে গেছে, আপু!”

উষ্ণতা হতবিহ্বল হয়ে শুধাল,” মানে? কোথায় গেছে?”

” জানি না। ও নাকি আমাদের সাথে বাংলাদেশেও যাবে না। অনুপমা আপুর থেকে বিদায় নিয়ে গেছে। ”

” বলিস কি? আমাকে না জানিয়েই চলে গেল? নিশ্চয়ই তৃষাণ ওকে কিছু বলেছে। উফ, তোর তৃষাণ ভাই এমন করছে কেন? কি শুরু করল সে? আচ্ছা, তুই কাঁদিস না। আমি দেখছি….ইয়ামিনের ফোন নাম্বার আছে?”

” না নেই। কিন্তু ইন্সটাগ্রাম আছে।”

উষ্ণতা খুব দুশ্চিন্তায় পডে গেল। তার অস্বস্তিও লাগছে। কি এমন হলো যে ইয়ামিন এভাবে কাউকে না জানিয়ে চলে গেল? উষ্ণতা বলল,” অনুপমাকে ডাক তো।”

উষসীর কিছু ভালো লাগছে না। সে কাঁদতে কাঁদতে ছুটল অনুপমাকে ডাকার জন্য। মাঝপথে দেখা হলো প্রীতমের সাথে। সে উষসীর হাত ধরে আটকে বলল,” শোন উষু, আমি বাইরে যাচ্ছি। চল আমার সাথে।”

উষসী খিটমিট করে বলল,” আমার হাত ছাড়।”

” কেন ছাড়ব? এতো সহজ? চল আমার সাথে।”

উষসী সজোরে প্রীতমের গালে চড় মারল৷ হোটেলের স্টাফরা এই ঘটনায় মজা পেয়ে খুব উদগ্রীব হয়ে তাকাল। প্রীতম অপমানে কিছুক্ষণের জন্য নির্বাক রইল। ততক্ষণে উষসী নিজের হাত ছাড়িয়ে চলে গেছে।

অনুপমা রিসিপশন থেকে একটা লাল গোলাপের বুকেট রিসিভ করেছে। সেটাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছে। কি সুন্দর আর যত্নে সাজানো হয়েছে জিনিসটা। রিসিপশনিস্টের ভাষ্যমতে ইয়ামিন এই বুকেট রেখে গেছে। কিন্তু কার জন্য রেখে গেছে সেটা বলেনি। উষসী দৌড়ে এসে বলল,” অনু আপু, তোমাকে উষ্ণ আপু ডাকছে। বলো না ইয়ামিন কখন গেছে? সে কি কিছু বলে গেছে? সে কি আর আসবে না? তৃষাণ ভাইয়ের আচরণে কি সে রাগ করেছে?”

উষসী তার কান্না থামাতে পারছে না। অনুপমা তাকে শান্ত করে বলল,” চুপ কর পাগলি। এই দ্যাখ, ইয়ামিন তোর জন্য কি রেখে গেছে। এরপরেও এভাবে কাঁদবি?”

উষসী এতোক্ষণ খেয়াল করেনি। অনুপমার হাতে ফুলের বুকেট দেখেই তার দৃষ্টি চকচক করে উঠল। হাসিমুখে ফুলের বুকেট নিল সে। এর মধ্যে ছোট্ট একটা নোটও পেল,” ভালো থেকো।”

উষসী আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ল৷ ইয়ামিন কিভাবে বুঝল যে তার লাল গোলাপ পছন্দ? মানুষটা কি তাকে এতো ভালোভাবে অবজার্ভ করেছে যে তার মনের কথাও বুঝে গেছে! প্রবল আনন্দে উষসীর আবার কান্না পেল। সে ফুলের বুকেট জড়িয়ে ধরে কেঁপে কেঁপে কাঁদছে। অথচ তার মনে নেই, উষ্ণতারও যে লাল গোলাপ খুব পছন্দ…

চলবে

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ২১
লিখা- Sidratul Muntaz

দীর্ঘ পাঁচবছর পর বাংলাদেশে ফিরে আসতে পেরে সবকিছু অন্যরকম ঠেঁকছে ইয়ামিনের। আচ্ছা, দেশটা কি বদলে গেছে? নাকি সে বহুদিন পর এসেছে বলে এই দেশ তাকে পর করে দিয়েছে? কেমন আছে তার মা-বাবা,পরিবার, পরিজন, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনেরা? কতদিন দেখা হয় না সবার সাথে!

ভাবতেও অবাক লাগে যে বছরের পর বছর ফুরানোর পরেও ইয়ামিন এক মুহুর্তের জন্য শেকড়ের টানে ফিরে আসার প্রয়োজন অনুভব করেনি। বাংলাদেশ মানেই ইয়ামিনের চোখে ভেসে উঠতো উষ্ণতার সুখময় স্বপ্নের সংসার। যে স্বপ্নে, যেই সুখে ইয়ামিনের কোনো হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। ইয়ামিন তার ভালোবাসা নামক কালো ছায়া নিয়ে কখনও উষ্ণতার স্বপ্নময় জীবনে অবতরণ করতে চায়নি। তাইতো পালিয়ে গিয়েছিল নিজের আপন মানুষদের ছেড়ে।

আজ, এতোদিন পর মা কি ইয়ামিনকে দেখে অবাক হবেন? নিশ্চিত জড়িয়ে ধরে কাঁদতে বসবেন। আর বাবা? তিনি কি বলবেন?

এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে না হতেই ফ্যানেরা এসে হামলে পড়ল ইয়ামিনের উপর। সবার ছবি তোলার প্রয়াস, উত্তেজনার প্রকাশ , অতি আবেগী কেঁদে ফেলার চেষ্টা, এসব ইয়ামিনকে বিব্রত করল খুব। সে দ্রুত ট্যাক্সিতে উঠল। তার বাড়ির কেউই জানে না যে ইয়ামিন ফিরেছে। কিন্তু এই ঘটনা নিশ্চয়ই এতোক্ষণে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার হয়ে যাবে। ইয়ামিন তার মাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল। সেটা বুঝি আর সম্ভব হলো না।

ইয়ামিনদের বাড়িতে অনেককিছুই পরিবর্তন হয়েছে। পুরনো দারোয়ান বদলে গেছে। এই নতুন দারোয়ান ইয়ামিনকে চিনতে পারল না। তাই তাকে সদর দরজায় আটকে দিল। ভ্রু কুঞ্চিত করে বলল,” কি চাই? আপনি কে?”

ইয়ামিন নিজের পরিচয় দিল না। দিলেও দারোয়ান নিশ্চয়ই ইন্টারকমে ফোন করতে পারে। সেক্ষেত্রে মা আগেই জেনে যাবেন। তাই সে বলল,” মিসেস শিমলার সাথে দেখা করতে এসেছি। ম্যাডাম কি বাড়িতে আছেন?”

” হো আছে। আপনার নাম কি?”

ইয়ামিন তার এক বন্ধুর নাম বলল,” ফাহিম।”

দারোয়ান ইন্টারকমে ফোন করে অনুমতি নিল। তারপর গেইট খুলে দিল। ইয়ামিন ভেতরে প্রবেশ করে চারপাশ দেখল। সবকিছু আগের মতো আছে। বাড়ির পেছনে খোলা মাঠ, ছোট্ট বাগান, দরজার সামনে বড় বকুলফুলের গাছটা। কত মায়াময় স্মৃতি বিজড়িত এই ঘর। ইয়ামিন কিভাবে পারল এতোদিন নিজের বাড়ি ছেড়ে ভিনদেশে পড়ে থাকতে?

ভালোবাসার সুখ যেমন মানুষকে নরম করে তেমনি ভালোবাসা থেকে পাওয়া কষ্টও কি মানুষকে পাষাণ বানিয়ে দেয়? যেমন ইয়ামিন পাষাণ হয়েছে। তার হৃদয় গলানোর চেয়ে পাথর গলানোও অনেক সহজ!

ইয়ামিন বেল চাপলো। দরজা খুলল অল্পবয়সী একটি মেয়ে। দেখে বোঝাই গেল মেয়েটা এই বাড়ির নতুন গৃহকর্মী। সে প্রশ্ন করল কর্কশ গলায়,” কেডা আপনে?”

” মিসেস শিমলা আছেন?”

” ও, খালাম্মার কাছে আইছেন? ভেতরে আহেন।”

ইয়ামিন ভেতরে ঢুকল। মেয়েটি দরজা আটকাতে আটকাতে বলল,” আপনের নাম কি ফাহিম?”

” আমার নাম পরে বলবো। আগে তুমি তোমার খালাম্মাকে ডেকে আনো।”

মেয়েটা কোমড়ে হাত রেখে বলল,” আমারে আপনে চিনেন?”

” না৷ কি করে চিনবো?আমি তো তোমাকে এই প্রথম দেখলাম।”

” তয় আমিও তো আপনেরে প্রথম দেখলাম। কিন্তু মন কইতাছে আগেও কই জানি দেখছি। আচ্ছা, অপরিচিত মানুষরে ভদ্রতা কইরা আপনে ডাকতে হয়। তাই আমি ভদ্রতা করছি। আপনিও করেন।”

” মানে? আমাকেও কি তোমাকে আপনি ডাকতে হবে?”

” অবশ্যই হবে। আপনেরা শিক্ষিত মানুষ হইয়াও ভদ্রতা শিখেন নাই?”

ইয়ামিন বুঝল মেয়েটা অপ্রয়োজনীয় কথা একটু বেশিই বলে। সে বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল,” মম কোথায়?”

” মোম মানে?”

” মানে মিসেস শিমলা। ”

” উনি আপনার মোম?”

ইয়ামিন কিছু বলল না।মেয়েটা ইয়ামিনকে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে চলে গেল। একটু পর মেয়েটা আবার ফেরত এসে বলল,” চলেন। খালাম্মা আপনেরে নিয়া যাইতে কইছে।”

ইয়ামিন মেয়েটার সাথে ডাইনিংরুমে ঢুকল। তখন দুপুর হয়েছে। শিমলা আর আজমল ডাইনিং টেবিলে খেতে বসেছেন। ইয়ামিনকে দেখে কয়েক মুহুর্তের জন্য দু’জনেই স্তব্ধ হয়ে গেলেন। ইয়ামিন যে এইভাবে না বলে-কয়ে চলে আসবে আর একটা খবরও পাঠাবে না এইটা কেউ চিন্তাও করতে পারেনি।

যে ছেলে সপ্তাহে একবার ফোন পর্যন্ত করে না সে হুট করে মা-বাবাকে দেখতে বাংলাদেশ চলে এলো? এ স্বপ্ন না সত্যি? বেশ কিছুক্ষণ নীরবতায় কাটল। একটু পর মিসেস শিমলা খাবার মাখা এঁটো হাতেই দৌড়ে এলেন। ডানহাতটা গুটিয়ে রেখে শুধু বামহাত দিয়েই ছেলেকে জাপটে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন।

ইয়ামিন আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গেল। এমন ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিল সে। কিন্তু এখন কেন যেন লজ্জা লাগছে। মিসেস শিমলা কাঁদতে কাঁদতে বিলাপ শুরু করলেন,” আমার বাবা, এতোদিন পর মায়ের কথা মনে পড়ল তোর? কেমন আছিস? কিভাবে ছিলি এতোদিন আমাদের ছাড়া? এতো নিষ্ঠুর তুই? একটাবার বাড়ি আসা যেতো না? ছয়টি বছর আমি কিভাবে কাটিয়েছি তোর কোনো ধারণা আছে? এমন কোনো দিন নেই যে তোর কথা মনে করে আমি চোখের জল ফেলিনি। আয়শাকে জিজ্ঞেস কর, ও তো আমাকে প্রতিদিন কাঁদতে দেখে। আর প্রতিদিন বকে। বলে, ছেলে কি আপনার একলারই আছে?”

শিমলা কান্নামাখা মুখেও হাসলেন। ইয়ামিনের চেহারা হাতড়ে মালিশ করে দিতে লাগলেন। স্নেহময় পরশ! ইয়ামিন কি বলবে বুঝতে পারল না। মা’কে জড়িয়ে ধরে তারও কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু লজ্জায় পারছে না। আয়শা নামের মেয়েটা তার দিকে ড্যাব ড্যাব তাকিয়ে আছে। একটু পর বলল,” আপনেই তাইলে ছোটভাইজান? হায় হায় ভাইজান! আমি আপনেরে ক্যান চিনলাম না? আমি যে আপনের কতবড় ফ্যান তা তো আপনি জানলেন না। প্রতিদিন টিকটকে আমি আপনের গান শুনি। আপনি যে কি ফেমাস! এল্লিগাই তো কই, ক্যান এতো পরিচিত লাগে?”

শিমলা ধমক দিলেন,” তোর ফালতু কথা রাখ। আমার ছেলে এতোবছর পর আমার কাছে এসেছে। ওর খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে না? ফ্রীজে কি আছে জলদি বের কর। প্রয়োজনে বাজারে চলে যা। আমি লিস্ট লিখে দিচ্ছি। এই, তুমি কিছু বলছো না কেন? এখনও বসে আছো যে? দেখো তোমার ছেলে ঘরে ফিরেছে!”

আজমল সাহেব কোনো কথা বললেন না। তিনি খাওয়া শেষ করে আয়শাকে বললেন,” কফিটা আমার বেডরুমে পাঠিয়ে দিও।”

এতোই গম্ভীরভাবে আদেশ জারি করলেন যে আয়শা প্রতিউত্তরে ভিন্ন কিছু বলতে পারল না। শুধু ঘাড় হেলিয়ে বলল,” জ্বী খালুজান।”

আজমল সাহেব নিজের বেডরুমে চলে গেলেন। মিসেস শিমলা হতবাক হয়ে সেই চলে যাওয়া দেখলেন। ইয়ামিনের চেহারায় মনখারাপের ছায়া গাঢ় হলো। বাবা তার উপর রেগে থাকবেন এটা সে জানতো। কিন্তু তাই বলে এতোবছর পর দেখা হওয়ার পরেও কথা বলবেন না? মিসেস শিমলা ঘটনাটা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য অন্য গল্প শুরু করলেন৷ কিন্তু ইয়ামিনের মনখারাপ তাতে বাড়লো বৈ কমলো না।

___________________
উষসীরা কাশ্মীর ভ্রমণ করে ফিরেছে প্রায় পনেরো দিন হবে। এর মাঝে একবারও উষসীর মুখে হাসি দেখা যায়নি। সে অন্যরকম হয়ে গেছে। যেন সম্পূর্ণ বদলে গেছে। সারাক্ষণ একা একা থাকে। মনখারাপ নিয়ে ইউনিভার্সিটিতে যায়। আগে প্রীতমের সাথে তার মেলা-মেশা ছিল। দুইদিন পরপরই প্রীতম বাসায় আসতো। এখন প্রীতমের কোনো হদিশও নেই। উষসীই তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রেখেছে। ইউনিভার্সিটিতে দেখা হলেও এড়িয়ে যায়।

আগে যেই মেয়ে প্রজাপতির মতো সারা বাড়ি উড়ে বেড়াতো, সে এখন দিনের পুরোটা সময় অন্ধকার ঘরে কাটায়। এসব দেখে উষ্ণতা তৃষাণের সাথে রোজ ঝগড়া করে। কি দরকার ছিল সেদিন ইয়ামিনের সাথে খারাপ ব্যবহার করার? এরপর থেকে ইয়ামিন তাদের সঙ্গে আর যোগাযোগ করেনি। উষসী ইন্সটাগ্রামেও কত মেসেজ দিয়েছে, ইয়ামিন রিপ্লে করেনি। এই ব্যাপারগুলো উষসীকে যেন একটা ট্রমার মধ্যে নিয়ে গেছে। সে সহ্য করতে পারছে না ইয়ামিনের শূন্যতা। কাশ্মীরের যে সময়টুকু ইয়ামিন তার সঙ্গে ছিল, সেটা তার জীবনের সেরা সময়!

তৃষাণ উষসীর আচরণ পর্যবেক্ষণ করেছে। তার ধারণা আর কয়দিন গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। যুথিও মেয়ের অবস্থা দেখে কিছু বলছেন না। যেন এটাই স্বাভাবিক। উষ্ণতা ভেবে পায় না তার মা আর স্বামী এতো পাষাণ হৃদয়ের মানুষ কবে থেকে হয়ে গেল? তারা তো উষ্ণতার চেয়েও উষসীর বেশি খেয়াল রাখতো। তৃষাণ তো ছোট থেকে কখনও উষসীর কান্না সহ্য করেনি। উষসীর একটু মনখারাপ হলেও উষ্ণতার আগে সে নিজেই পাগল হয়ে যায়। সেই তৃষাণ এখন উষসীর এমন কঠিন অবস্থাতেও এতোটুকু নরম হচ্ছে না। তার প্রবলেম কি?

উপায়ন্তর না পেয়ে উষ্ণতা তার শাশুড়ীর কাছে গেল। ডোনা উষ্ণতাকে বেশ ভালো একটা পরামর্শ দিলেন। প্রিয়ন্তী ডোনার সৎমেয়ে। তৃষাণের সৎবোন। সে আবার সম্পর্কে ইয়ামিনের কাজিন হয়। বিদেশে থাকে। তার কাছে ইয়ামিনের নাম্বার সহজেই পাওয়া যাবে। উষ্ণতা আর দেরি করল না। তখনি প্রিয়ন্তীর সাথে যোগাযোগ করল।

প্রিয়ন্তীর থেকে জানা গেল, ইয়ামিন নাকি বাংলাদেশেই আছে। তার ব্যক্তিগত নাম্বার উষ্ণতাকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দিল প্রিয়ন্তী। উষ্ণতা সেদিনই ইয়ামিনকে ফোন করল।ইয়ামিন তখন ভরপেট খেয়ে ভাতঘুম দিয়েছে।এতোবছর পর একমাত্র ছেলেকে কাছে পেয়ে মিসেস শিমলা যেন পাগল হয়ে গেছেন। প্রায় সাত পদের খাবার রান্না করেছিলেন আজ। সব জোর-জবরদস্তি ইয়ামিনকে খাইয়েছেন তিনি। ইয়ামিনও বাধ্য হয়েছে খেতে।

ফোনের আওয়াজে আরামের ঘুম নষ্ট হলো। কিন্তু উষ্ণতার গলা শুনে সব ঘুম যেন নিমেষেই উধাও হয়ে গেল। ইয়ামিন তড়িঘড়ি করে উঠে বসল। উষ্ণতা বলল,” কেমন আছো ইয়ামিন?”

ইয়ামিন শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে বলল,” ভালো। আপনি?”

উষ্ণতা অপরাধী স্বরে বলল,” একদম ভালো নেই।”

ইয়ামিনের আত্মা ছলাৎ করে উঠল,” কেন? কি হয়েছে মিস?”

” আমার বোন যেখানে ভালো নেই, সেখানে আমি কি করে ভালো থাকি বলো?”

” আপনার বোনের কি হয়েছে?”

” এটাও কি আমাকে বলতে হবে? তুমি জানো না?”

ইয়ামিন কিছুই বুঝতে পারছে না। সে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। তার অস্থির লাগছে। উষ্ণতা কেন ভালো নেই? কেন ভালো থাকবে না? শুধু উষ্ণতার ভালোর জন্য সে তার পুরো জীবন দান করতে পারে। তবুও উষ্ণতা ভালো থাকুক। তার মুখের উষ্ণ হাসি অম্লান হোক!

উষ্ণতা বলল,” আমি জানি না তোমাদের মধ্যে কি হয়েছে… কেন সেদিন তুমি দিল্লী থেকে কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে গেছিলে? আমি ধরে নিলাম তোমার সাথে এমন কিছু হয়েছিল যে কারণে তুমি হয়তো এই কাজ করতে বাধ্য হয়েছো৷ তাই না?উষসী তোমার ফুলের বুকেট পেয়ে খুব খুশি হয়েছিল সেদিন। কিন্তু বিশ্বাস করো, এরপর থেকে একবারও ওর মুখে আমি হাসি দেখিনি। খুব মনখারাপ করে আছে মেয়েটা। ”

উষ্ণতার গলা ধরে এলো। ইয়ামিনের বুক কেঁপে উঠল। উষ্ণতা কি কাঁদছে? সে ব্যাকুল হয়ে বলল,” আই এম স্যরি। আমার ভুল হয়ে গেছে। আপনাকে জানিয়ে আসা উচিৎ ছিল।”

“ইটস ওকে… তুমি চাইলেই এখন সব ঠিক করে দিতে পারো।”

” অফকোর্স। আমি সব ঠিক করে দিবো।” মুখে এই কথা বললেও ইয়ামিন মনে মনে বলল,”আপনার সুখের জন্য ছোটবেলায় দেশত্যাগ করেছিলাম মিস, এখন যদি প্রয়োজন হয় পৃথিবীও ত্যাগ করব। তবুও আপনার এতোটুকু কষ্ট হতে দিবো না।”

উষ্ণতা হাসিমুখে ইয়ামিনকে তাদের বাড়িতে ডিনারের দাওয়াত করল। এই কথা শুনে তৃষাণ নিশ্চয়ই একটু রাগ দেখাবে। কিন্তু তাতে কি? উষসী তো খুশি হবে! উষ্ণতা বোনের খুশির জন্য সব করতে পারে!

সে বেশ কড়াভাবে বলে দিল,” তোমাকে আসতে কিন্তু হবেই সিংগার। নাহলে আমি খুব রাগ করব।”

ইয়ামিন হাসার চেষ্টা করে বলল,” আপনাকে রাগ করার সুযোগটাই দিবো না, মিস। আমি নিশ্চয়ই আসবো। সন্ধ্যার মধ্যেই পৌঁছে যাবো।”

” তোমার গিটারও নিয়ে এসো কিন্তু। আমরা সবাই তোমার গান শুনবো। সন্ধ্যার আসর জমে যাবে।”

ইয়ামিন মিষ্টি করে হাসল৷ আনন্দের ঢেউয়ে তার মন উদ্বেলিত হচ্ছিল৷ আচ্ছা, তার কি সত্যি যাওয়া উচিৎ? উষ্ণতা কেন তাকে নিজের পরিবারের সাথে এতো জড়াতে চাইছে?

আচ্ছা, উষ্ণতার যদি সবকিছু মনে থাকতো তখনও কি সে ইয়ামিনের সাথে এমন ব্যবহার করতো? না, তখন হয়তো ঘৃণায় কথাই বলতে চাইতো না! আর উষ্ণতার চোখের দিকে চোখ রাখার ক্ষমতাও ইয়ামিনের থাকতো না। এখনও নেই। যতবার ওই উজ্জ্বল দৃষ্টি সে দেখে, ততবার নিজেকে ভয়ংকর অপরাধী মনে হয়। কিন্তু তবুও ইয়ামিন উষ্ণতার কথায় আজ ডিনারের আমন্ত্রণে যাবে৷ উষ্ণতা যদি তাকে মরে যেতে বলে, সে তাও রাজি। আর ডিনার কি এমন বড় বিষয়?

উষসী মনমরা হয়ে জানালায় তাকিয়ে ছিল। তার আজ শুধু প্লেনের ঘটনাগুলো মনে পড়ছে। উড্ডয়নের সময় ইয়ামিন তাকে কত গভীরভাবে ধরেছিল। দিল্লীর হোটেলে রেখে যাওয়া ইয়ামিনের ফুলের বুকেটের সব ফুল শুকিয়ে গেছে। উষসী সেই শুকনো পাপড়িগুলোও অতি যত্নে সংরক্ষণ করেছে নিজের কাছে। এতো ভালোবাসাময় একটা চিরকুট দিয়েছে ইয়ামিন। মাত্র দু’টি শব্দ লেখা। তাও কেমন মন উতলা করা অনুভূতি! সে কেন চলে গেল? দীর্ঘশ্বাসে বুক ভারী হয়ে আসছে উষসীর। ইয়ামিনের সাথে আবার কবে দেখা হবে?

অনুপমা হঠাৎ উষসীর মুখের কাছে এসে অদ্ভুত শব্দে বলল,” ভাউউ!”

উষসী চমকে উঠলো। তারপর অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বলল,” বিরক্ত করো না তো অনু আপু।”

” আরে পাগলী, এমন গুড নিউজ নিয়ে এসেছি না? একবার যদি বলি তাহলে তুই নিজেই আমার পেছন পেছন ঘুরে আমায় বিরক্ত করা শুরু করবি।”

” মানে?”

” ভাবী তোর সিংগারকে আজকে ডিনারের ইনভাইট করেছে আমাদের বাসায়।”

” আমার সিংগার?”

অনুপমা চোখ মেরে বলল,” ইয়ামিন ইব্রাহীম। সে তো বাংলাদেশেই আছে। খবর কি কিছুই রাখিস না? আমি মাত্র ইউটিউবে দেখলাম। এয়ারপোর্ট থেকে সে বের হওয়ার সময় ফ্যানরা ছবি তুলছিল। এইযে দ্যাখ!”

উষসী অস্থিরচিত্তে বলল,” সে যে বাংলাদেশে আছে এটা আমিও জানি। কিন্তু সে কি সত্যি আমাদের বাড়ি আসবে?”

” অবশ্যই আসবে। উষ্ণতা ভাবী বলেছে। সে কি মিথ্যা বলবে, তোর মনে হয়?”

উষসীর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। উত্তেজনা আর উদ্দীপনার হাসি ফুটল ঠোঁটে। অনুপমা বলল,” এইতো, কতদিন পর মেয়েটা হেসেছে! হাসলে কি মিষ্টি দেখায় তোকে। আমার কি মনে হয় জানিস উষু? তোর উপর নিশ্চয়ই ইয়ামিনের আকর্ষণ আছে।”

এই কথা শুনে উষসী বুকের মধ্যে এক লজ্জাময় অপ্রতিরোধ্য চাপ অনুভব করল। কিন্তু মুখে বলল,” ধ্যাত! আজাইরা।”

” সত্যি বলছি। নাহলে দাওয়াত করার সাথে সাথেই কেন আসতে রাজি হয়ে গেল? তার মতো এতোবড় সিংগার কি আমাদের বাড়িতে এসে ডিনার করার মানুষ? আর আমাদের কথাতেই তো সে বাংলাদেশে এলো। যেখানে তার আসার কোনো প্ল্যানই ছিল না। তবুও কেন এলো বলতো? কিসের টানে?”

উষসী ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল অনুপমার দিকে। অনুপমার চেহারায় দুষ্টু হাসি। উষসী লজ্জায় জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,” উফফ, আপু তুমি যাও তো। আমার ভালো লাগছে না।”

মুখে এই কথা বললেও উষসীর অন্তরের ভেতর-বাহিরে তখন সুখের বাতাস বইছে। অনুপমা নিজের কাঁধ দিয়ে উষসীকে একটা ধাক্কা মেরে বলল,” কুচ কুচ হোতা হ্যায় পাগলী। তু নেহি সামজেহগী।”

উষসী চোখ রাঙিয়ে তাকালো। তারপর জোরপূর্বক অনুপমাকে ঘর থেকে বের করে দরজা আটকে দিল। মনে মনে বলল,”পাগল।” অথচ সে নিজে দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে তখন। উফফ, বুকের মধ্যে যেন কেউ দামামা বাজাচ্ছে। এতো অস্থির কেন লাগছে?

চলবে