Monday, August 4, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 415



সূচনাতে প্রেম পর্ব-০৩

0

#সূচনাতে_প্রেম
#নুসাইবা_রেহমান_আদর
#পর্ব৩

সাফোয়ানের কথা শুনে সানা আৎকে উঠলো।সাফোয়ান এই কথা বলতে তাহলে তাকে এখানে ডেকে নিয়ে আসছে? আসলে তাকে নিয়ে লাঞ্চে না নিজের সিদ্ধান্ত জানাতে নিয়ে এসেছে? পরিবারকে ছেড়ে যাওয়ার কথা শোনা মাত্রই সানার দিন দুনিয়ে বিষাদের দমকা হাওয়ায় ভেসে গেলো। এতোক্ষনে সব ভালো লাগা ক্ষনিকের মধ্যে উধাও হয়ে গেলো। সাফোয়ান কে নিয়ে তার মনের মধ্যে গড়া সদ্য অনুভূতিগুলো যেনো ডানা মেলে উড়ে গেলো। কেন যেন স্বার্থপর মনে হচ্ছে সাফোয়ান কে অনেক। তাকে লাঞ্চে নিয়ে এসে তার সিদ্ধান্ত জানানো কি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিলো? তবুও সানা সাফোয়ানের কোন প্রশ্নের জবাব দিল না। যতক্ষণ সাফোয়ানের সাথে বাহিরে ছিল চুপচাপ বসেছিলো। সাফোয়ানের করা প্রতিটা প্রশ্নের জবাব হুম আর না তে দিয়েছে।

খাওয়া শেষে যখন আবারো সানাকে প্রশ্ন করলো সাফোয়ান।

~আপনার কি মতামত এই বিষয়ে আপনি বললেন না তো সানা?

সানা যতোই এই প্রশ্নটাকে এড়িয়ে যেতে চাচ্ছিলো সাফোয়ান তখন বারবার একই প্রশ্ন করছে যাচ্ছিলো। সানা এবার সহ্য করতে পারলো না। আকস্মিক ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিয়ে টেবিলে রেখে দ্রুত ওখান থেকে বেরিয়ে গেলো। সানা যে এমন কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলবে তা সাফোয়ানের ভাবনার বাহিরে ছিলো। সাফোয়ানকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে সামনে রিকশা পেয়ে সেটাতে উঠে পরলো। আর সাফোয়ান সেখানেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কারন সে বুঝতে পারল না সানার এইরকম ব্যবহারের কারণ। প্রচন্ড আশাহত হলো সে। কি কারনে এসেছিলো আর হলো টা কি। সানার এইরকম ব্যাবহারে অনেক কষ্ট পেলো সাফোয়ান।

সানা তাদের বাসার সামনে দরজায় দাড়িয়ে আছে। কলিংবেল বাজানোর সাহস পাচ্ছেনা। কারন যদি সাফোয়ানের কথা জিজ্ঞেস করে সে কি উত্তর দিবে। রেষ্টুরেন্টে সাফোয়ান কে ফেলে সে চলে এসেছে। কেনো এসেছে এই কথার জবাব তার কাছে নাই। লোকটা কে ওভাবে ফেলে আসা কি তার উচিৎ হয়েছে এভাবে? না এতো কিছু ভাবতে হবেনা। একি তো তার কোনো ভাবনা ছিলোনা বিয়ে নিয়েম হুট করে হয়ে যাওয়া ওই অনাকাঙ্ক্ষিত বিয়েটা সে মেনে নিতে পারছে না। অথচ কি সুন্দর তাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। নিজের বাড়ি পরিবার ছেড়ে সে কেনো যাবে?

দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভোগে শেষমেষ সানা কলিং বেল বাজালো কাপাকাপা হাতে। ভাই যদি জানে সে একা একা এসেছে তাহলে কি হবে সে ভাবতে পারছেনা।

কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে সুমাইয়া এসে দরজা খুললো। আর সানাকে বলল,

~আমার ভাইজান ও না কি যে করে। হঠাৎ হঠাৎ তার জরুরী কাজ পরে যাবে। আমাকে মাত্রই ফোন দিয়ে বলল তোমাকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়েছে তার গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে তাই চলে গেছে। বলেছিলো সাইফকে দিয়ে দিতে কিন্তু সাইফ যেতে মানা করে দিয়েছে। আজ সাইফ এখানে থাকবে। তার কাজের জন্য তোমাদের ঘোরাফেরা হলো না ভিতরে আসো।

~কখন ফোন দিয়েছে তোমাকে তোমার ভাইজনা ভাবি?

~এই তো মাত্রই ফোনটা কেটে দিলো। আর তুমি কলিংবেল বাজালে ।

সাফোয়ান যে সুমাইয়াকে মিথ্যে কথা বলেছে সেটা সে বুঝতে পারছে।মিথ্যে কথার জন্যই সানাকে কোন জবাবদিহি করতে হবে না। কিভাবে তার মনের কথা সে বুঝে গেল আল্লাহ জানে । সানার মনের মধ্যে প্রচন্ড অনুশোচনা বোধ হতে লাগলো। সাফোয়ান তার কথা ভেবে আগেই বাড়িতে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিল যাতে বাড়ির কেউ সন্দেহ না করে। অথচ সে কিনা লোকটাকে ফেলে চলে এসেছে একা একা। লোকটা নিজের ইচ্ছার কথা জানিয়েছে সে তো পারতো চুপচাপ থেকে একসাথেই আসতে। অথচ অনিচ্ছাকৃতভাবে লোকটাকে সে অপমান করেছে। সুমাইয়ার পিছু পিছু সেও বাসায় ঢুকলো। সোফায় বসে বসে সাইফ কার্টুন দেখছে টিভিতে। ১৪ বছরের ছেলেটা বাচ্চাদের মত কাজ কারবার করে। আজ থেকে সাত বছর আগে তার বাবা-মা মারা গেছে।তখন থেকেই সাইফ সুমাইয়া আর সফোয়ানের এর কাছে বড় হয়েছে। দুই ভাই বোনের কলিজা সাইফ। সুমাইয়া এই বাসায় আসার পর থেকে সাইফ প্রচন্ড একলা হয়ে গিয়েছে। সাফওয়ান সারাদিন অফিস করে রাত আটটা নাগাদ বাড়ি ফিরে। পুরোটা সময় সাইফ বাড়িতে একা থাকতে থাকতে ডিপ্রেশনে পরে যাচ্ছে। সাইফের দিকে তাকালে প্রচন্ড মায়া হচ্ছে সানার। সেও তো মা ছাড়া মানুষ হয়েছে। মা ছাড়া বড় হতে কত কষ্ট লাগে সেও জানে। তবুও তো তার সাথে তার বাবার বড় ভাইয়া ছিল। কখনো কোনো কিছুর অভাব বুঝতে দেয়নি। অথচ ছেলেটা সারাদিন একা একা থাকে। সানাকে দেখে সাইফ হাসি মুখে বলে,,

~মিষ্টি ভাবি তুমি এত তাড়াতাড়ি চলে এলে তোমাদের ঘোরাফেরা শেষ হয়ে গেল?

সানা উত্তর দেওয়ার আগেই সুমাইয়া বলে উঠলো,,

~জানিস তো ভাইয়া কত কাজ পাগল। গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল তাই তোর ভাবিকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে।

~মিষ্টি ভাবির কপাল পুড়ছে ভাইয়ের মত একজন নিরামিষকে বিয়ে করে। সারাদিনরাত কাজকর্ম করবে ভাবীকে নিয়ে আর ঘুরতে পারবে না। তুমি চিন্তা করো না মিষ্টি ভাবি ভাইয়া না নিয়ে গেলেও আমি তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাব। তুমি আর আমি মিলে অনেক মজা করব বাড়িতে। তুমি তাড়াতাড়ি আমাদের বাড়িতে চলে এসো আমার একা একা ভালো লাগেনা।

~আচ্ছা যাবো তো। এখন তুমি টিভি দেখো আমি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসি।

সানা দ্রুত ওখান থেকে কেটে পরলো। সাইফের কথা শুনে তার মধ্যে অনুশোচনা বোধ দিগুণ বেড়ে উঠছে।উনিতো সাইফের কথা ভেবে সানাকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছে। অথচ সানা তাকে ভুল বুঝে চলে এসেছে। রাতে শুয়ে শুয়ে এইগুলোই ভাবছিল সানা।যেভাবেই হোক সাফোয়ান থেকে ক্ষমা চাইতে হবে তার। সারাদিন এই কথা ভাবতে ভাবতেই তার সময় কেটেছে। কি এক কাজ করল যার অনুশোচনার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে সে। কিন্তু সাফোয়ানের ফোন নাম্বার তার কাছে না থাকায় কল দিতে পারছেনা সে। সব ভাবনা বাদ দিয়ে ঘুমিয়ে পরলো সানা।

সেদিনের পর কেটে গেল আজ ৯ দিন।আর এই ৯ দিনে সানার সাথে কোন রকম যোগাযোগ করেনি সাফোয়ান। আচ্ছা সাফোয়ান কি তার উপর রাগ করে এভাবে আছে? এসব ভাবতে ভাবতেই কলেজের জন্য রেডি হচ্ছিলো সানা।আজ তার কলেজে গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে। রেডি হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল সানা। কলেজে গিয়ে সানার বেস্ট ফ্রেন্ড বৃষ্টিকে খুঁজতে লাগলো সানা। অনেকদিন যাবত বৃষ্টির সাথে তার কোনো রকম যোগাযোগ নেই। বৃষ্টির তার দাদু বাড়ি গিয়েছিল সেই থেকে তাদের যোগাযোগ বন্ধ। আশেপাশে তাকিয়ে তাকেই খোঁজার চেষ্টা করলো সানা। কিছু দূরে দাঁড়ানো ব্যক্তিকে দেখি সানার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।দৌড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো সে। সাডেন জড়িয়ে ধরায় সেই ব্যাক্তিও কিছুটা ভরকে যায়। সানা কে দেখে এরপর সেও জড়িয়ে ধরে। সানা তাকে দেখে উৎসাহিত গলায় বলে উঠে,

~জানিস জান তোকে এতদিন আমি কত মিস করেছি? কোন ভাবেই তোর সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে আমার কতটা খারাপ লেগেছিল। কিন্তু তোর সাথে যোগাযোগ আর করতে পারলাম না।

~,আমিও তোকে অনেক মিস করেছি সোনা।কিন্তু কি করবো বল গ্রামে যাওয়ার পর আমার আর আম্মুর ফোনগুলো চুরি হয়ে গেছে। তাই কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। কিছু সমস্যার মধ্যে থাকায় ঢাকায় এসে ফোন কিনবো ভেবেছি। আজ চল তুই আমি গিয়ে আমার ফোন কিনে নিয়ে আসি।

~আচ্ছা ক্লাস শেষে তুই আর আমি যাব নে। বাকি দুইজন কই?

~নীলিমা তো ওর বোনের শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে গেছে আসে নাই। আর লিসান তো ফাকিবাজ জানিস ভালোভাবে।

#চলবে?

সূচনাতে প্রেম পর্ব-০২

0

#সূচনাতে_প্রেম
#নুসাইবা_রেহমান_আদর
#পর্ব:২

তখন সুমাইয়া জহির কে বলে,,,,
~আসলে আজ ভাইয়া সানাকে নিয়ে বের হবে। লাঞ্চ তারা বাহিরে করবে তাই বাবা থেকেও পারমিশন নিয়ে নিয়েছে। আপনি আমি আর সাইফ একসাথে লাঞ্চ করে নিবো নে। সানা তো রেডি আছে এবার নাহয় তারা বের হোক।

জহিরের ব্যাপার টা ভালো লাগলো না। এই দুপুর বেলা রোদে বোনের বের হওয়াটা পছন্দ হচ্ছে না।সানার গরমে প্রচন্ড সমস্যা হয়। রোদে গেলে অতিরিক্ত গরমে মেয়েটার ঠান্ডা লেগে হাচি শুরু হয়ে যায়। এই কারনে বোন কে যে সে কত শাসনে রাখে তা সে ই একমাত্র জানে। ছোট বোনের গায়ে সামান্য আচর লাগলেও তার কলিজা ফেটে যায়। নতুন জামাইকেও না করতে পারে না। অনিচ্ছা থাকার পরেও সে যেতে বললো,

~ যাও তাহলে তোমরা।সাবধানে যেও সাফোয়ান সানার খেয়াল রেখো।

সাফোয়ান উপর নিচ মাথা দুলালো।এরমানে সে সানার খেয়াল রাখবে। সানা আর কি করবে রুমে গিয়ে ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে আসলো। সাফোয়ান ও কালো পাঞ্জাবিটি টেনে টুনে সোজা করে নিলো।গরমে ঘেমে পাঞ্জাবিটি শরীরের সাথে লেগে গিয়েছিলো তার। সাফোয়ানের দিকে এখন অব্দি সানা চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে নি। লজ্জা লাগছে অনেক তার তাকাতে। সানা আর সাফোয়ান বের হওয়ার সময় সাইফ ঢুকলো সানাদের ফ্লাটে।

~ জানো মিষ্টিভাবি ভাইয়া নিজে তো আগে শশুরবাড়ি ঢুকে গরম থেকে বাচলো অথচ আমাকে এই গরমে এতো কিছু কিনতে পাঠালো। এটা ঠিক কি ঠিক বলো?

সাইফের অভিযোগ শুনে সানা মুচকি হাসলো।

~ যাও গিয়ে ভাবিকে বলো ফ্রিজ থেকে শরবত বের করে দিতে।তোমার জন্য আমি বিটলবন মিশিয়ে আলাদাভাবে বানিয়ে রেখছি। গিয়ে খেয়ে নাও!

~ তুমি এতো ভালো কেনো মিষ্টি ভাবি?

~ এখানে না দাঁড়িয়ে থেকে, এবার যা আমাদের লেট হচ্ছে।

সাফোয়ানের গম্ভিরভাবে বলা কথাটা শোনা মাত্রই সাইফ সেখান থেকে কেটে পরলো। সাফোয়ান এবার ধীর গলায় সানাকে বললো,

~ দেরি হয়ে যাচ্ছে হাটুন।নিচে গিয়ে আবার রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।

সানা হাটা ধরলো আশে-পাশে না তাকিয়েই। সাফোয়ান ফোস করে নিশ্বাস নিলো।আজকাল এই মেয়েটাকে যা বলা হচ্ছে রোবটের মতো তাই করে যাচ্ছে। সাফোয়ান এবার দ্রুত পা চালালো। সানার সাথে নিচে গিয়ে দাঁড়ালো।দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাতেই দেখতে পেল একজন রিক্সাওয়ালা আসছে। রিক্সাওয়ালা কে হাত দিয়ে ইশারা করে থামিয়ে দিলো। রিক্সা ওয়ালার সাথে কথা বলে উঠে বসলো রিক্সায়। সানার দিকে হাত বাড়িয়ে রাখলো সাফোয়ান। যাতে তার হাত ধরে উঠতে পারে সানা৷ সানাও ইতস্ততভাবে সাফোয়ানের হাতে হাত রাখলো।সম্পূর্ণ ভার সাফোয়ানের হাতে দিয়ে রিক্সায় উঠে বসলো।

~রিক্সার হুডটা একটু টেনে নিবেন? রোদে আমার সমস্যা হচ্ছে।

সানার কথা শুনে সাফোয়ান রিক্সার হুড টেনে দিলো। নিজে যথাসম্ভব রিক্সার কোনায় চেপে বসলো যাতে সানার বসতে কোনো সমস্যা না হয়। রিক্সার মধ্যে এইভাবে আলাদা বসা যায় না তবুও সাফোয়ান চেপে আছে যাতে সানার কাম্ফোর্ট ফিল হয়। এই একজন মেয়ে তার সারাজিবনের দায়িত্বে আছে।পুরো রাস্তা জুরে কেবল নিস্তব্ধতা ঘিরে আছে দুইজন মানব মানবি কে৷ একজন বরাবরের গম্ভির তো আরেকজন শান্ত হয়ে আছে৷ দুই জনের মনের মধ্যে চলছে দুই রকম ভাবনা। তাদের এই চুপ থাকার মধ্যেই তারা রেস্টুরেন্টের সামনে চলে আসে। সানা রিক্সা থেকে নেম সাইডে দাড়ালো! সাফোয়ান রিক্সা ভারা মিটিয়ে দিয়ে সানার হাত নিজের হাতের মধ্যে মুষ্টিবদ্ধ করে ফেললো। আচমকা সাফোয়ান হাত ধরায় চমকে যায় সানা।সাফোয়ান নিজ থেকে কিভাবে তার হাত ধরলো?সানার কাপাকাপি শুরু হয় যায়। সানাকে এভাবে কাপতে দেখে হাল্কা হাসে সাফোয়ান।

~ রাস্তায় এভাবে কাপতে থাকলে লোকে ভাববে আপনার মৃগি রোগ আছে মিসেস সাফোয়ান।

সাফোয়ান যে আজ সানাকে লজ্জা দিতে চাচ্ছে। সানা এবার বলে উঠে,

~ আপনি আমার হাত ছেড়ে দিন তাহলে কাপবো না আর।

~ আমি আমার বিয়ে করা বৈধ স্ত্রীর হাত ধরেছি তাই আর ছাড়ছি না হাত।মৃত্যু অব্দি এই হাতের মালিকানা আমি ছাড়ছি না।

সাফোয়ানের এই কথা সানার মনের মধ্যে গেথে গেলো।হঠাৎ করেই সানার মনটা ভালো হয়ে গেল। তার কানের মধ্যে বারবার বেজে চললো সাফোয়ানের বলা কথাটা। সাফোয়ান তার উপর কতটা অধিকারবোধ দেখাতে পারলে এই কথাটি বলতে পারলো। অথচ সে নিজে বিয়ের এই কয়টা দিনের মধ্যে একবারও সাফোয়ানের কথা ভাবে নাই। তাকে নিয়ে একটুও চিন্তা ভাবনা তার মনের মধ্যে কাজ করে নাই।

সাফোয়ানের পায়ে পা মিলিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে চলল রেস্টুরেন্টের ভিতর সানা। আজ এতো গরমেও খারাপ লাগছে না তার। কেমন যেনো এক ফিলিংস হচ্ছে মনের মাঝে।মাথায় শুধু সাফোয়ানের বলা কথা গুলোই বেজে চলেছে।

রেষ্টুরেন্টে আজ মানুষের তেমন একটা ভীড় নেই। সাফোয়ান কাম্ফোর্ট অনুযায়ী যায়গা খুজে বের করলো। যাতে সানার খেতে অসুবিধা নাহয়। সানা যাতে নিজের মতো করে বসে খাবার খেতে পারে। সাফোয়ানের এই ছোট ছোট কেয়ার গুলোতে সানার মন মোমের মত গলে যাচ্ছে। সানা ভাবতেই পারছেনা কোন মানুষ তার ছোট ছোট দিকগুলোরও খেয়াল রাখছে। আর সেই মানুষটি হলো তার স্বামী।

সানার মন জানান দিচ্ছে যে তার জন্য হয়তো সাফোয়ানের মনে কোন অনুভূতি রয়েছে। কিন্তু সে এত তাড়াহুড়ো করে বিয়েটা হওয়ায় নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছে না।

~কি খাবেন বলুন? আপনার পছন্দের খাবার সম্পর্কে আমার কোন আইডিয়া নেই।

~সমস্যা নাই আপনার যা পছন্দ হয় আপনি অর্ডার করুন।

সাফোয়ানের কথায় নিচু কন্ঠে তাকে উত্তর দেয়স সানা। সানা গুলিয়ে যাচ্ছে এর আগে এমন পরিস্থিতিতে এসে পরেনি। নিজেকে যত শান্ত রাখতে চাচ্ছে তার মন ততই বিচলিত হয়ে যাচ্ছে। সানার উত্তর মোটেও পছন্দ হয়নি সাফোয়ানের। কারণ সানার পছন্দ অপছন্দ সম্পর্কে এখনো তার ধারণা হয়ে ওঠেনি। নিজের মন মত অর্ডার দেওয়া খাবারগুলো যদি সানা না খেতে পারে তাহলে?

~এটা সিনেমা নয় যে আমি আপনার সব পছন্দের খাবার বিষয়ক জ্ঞান রাখবো। আমি সত্যি বলতে কোন আইডিয়া নাই আপনার কোন ধরনের খাবার পছন্দ। অভুক্ত থাকতে না চাইলে নিজের পছন্দের খাবারগুলো অর্ডার দিয়ে দিন।

সানা বুঝতে পারলো যে সাফোয়ান হালকা রাগী কন্ঠে তাকে কথাটি বলল। তাই ওয়েটারকে ডেকে নিজের পছন্দমত কিছু খাবার অর্ডার দিল। সাফোয়ানো কিছু খাবার অর্ডার দিল নিজের মতো করে। খাবার আসতে এখনো ১০ থেকে ১৫ মিনিট সময় লাগবে। এই ১৫ মিনিট ধরে সানা কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। কোন বিষয়ে কথা বলবে সাফোয়ানের সাথে এটাও ভাবার বিষয়। সাফোয়ানের সাথে শুরু থেকে কেমন আছেন ভালো আছেন টাইপ কথাবার্তা হতো তার বেশি না। সাফোয়ান নিজ থেকে কখনো সানার সাথে কথা বলতে চায়নি আর না সানা চেয়েছে। ভাবির বিয়ের পর থেকে দুই একবার ছাড়া বেশি দেখা হতো না অনুষ্ঠান ছাড়া । তাই হঠাৎ কি বলে কথা শুরু করবে তারা দুইজনেই বুঝতে পারছে না। সাফোয়ান কাশি দিয়ে নিজের গলা ঝেড়ে নিল। পুরুষ মানুষেরও যদি কথা বলতে এরকম হ্যাজিটেশন হয় তাহলে সানা মেয়ে হয়ে কিভাবে নিজ থেকে কথা শুরু করবে?

~আমি চাচ্ছিলাম কি সানা সামনের সপ্তাহে আপনাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবো। আমি অফিস থাকাকালীন সময়টা যদি সাইফ আপনার সাথে থাকে তাহলে আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারবো।
এর আগে সুমাইয়া ওর খেয়াল রাখত কিন্তু এক বছর যাবত আমি সাইফের একা থেকে বিষন্ন হয়ে থাকার বিষয়টা সহ্য করতে পারছি না।সাইফ ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে, ও আপনাকে অনেক ভালোবাসে। আপনি ওর আশেপাশে থাকলে কতো খুশি থাকে ও আপনি দেখেছেন হয়তো।

চলবে?

সূচনাতে প্রেম পর্ব-০১

0

#সূচনাতে_প্রেম
#নুসাইবা_রেহমান_আদর
#সূচনা_পর্ব

থম মেরে বসে আছে সানা। তার পাশেই তার ভাবি মুচকি মুচকি হাসছে। ভাবির এই হাসি দেখে সানার মনের ভিতর রাগ বেড়ে উঠছে।

~বখাটে ছেলেদের মতো এইরকম হাসি কেনো দিচ্ছো আমাকে দেখে?

সানার কথায় এবার সুমাইয়া হাসি থামিয়ে ফেলে।অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে….

~ আমার হাসি তোমার বখাটেদের মতো লাগলো সানা?

~ তা নয়তো কি হ্যাঁ? এইভাবে হাসছো কেন?

সুমাইয়া জানে সানা রেগে আছে। রাগবেই না কেন? আজ যে সানার স্বামী আসবে এই বাসায়।এই নিয়ে সে সানাকে খোচাচ্ছে।

~যখন তোমার স্বামী তোমকে দেখে হাসবে তখন ঠিকি ভাল্লাগবে তাই না?রেডি হও রেডি হও স্বামী সোহাগে ভাসার জন্য রেডি হও।

কথাটি শেষ করেই জোরে হাসা ধরলো সুমাইয়া। এইবার খুব লজ্জা লাগলো সানার৷

~নিজের বড় ভাইকে নিয়ে এসব বলতে লজ্জা লাগছে না ভাবি? ছিহ কি অশ্লীল তুমি!

~ লজ্জা তখনি লাগতো যখন ভাইজান আমার সামনে থাকতো। এখন যেহেতু ভাইজান নাই সেহেতু আমি বলতেই পারি।

সানা আর কি বলবে সে যাই বলুক না কেন আজ তার ভাবী তাকে শরম দিতেই থাকবে। তাই সে ওখান থেকে উঠে গোসল করতে চলে গেল। সানার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সুমাইয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মেয়েটা আগে কত চঞ্চল ছিল এখন এত শান্ত দেখে ভালো লাগছে না তার । হয়তো বাবা-মা ভাই কে ছেড়ে চলে যাবে এই কারণে এতটা শান্ত এখন। সেও রুম থেকে বাহির হয়ে চলে যাওয়ার আগে সানাকে জোরে ডাক দিয়ে বলে গেল।

~আমি খাটের উপর শাড়ি রেখে চলে যাচ্ছি,রেডি থেকো কিন্তু।

গত পরশু সানার বিয়ে হয়ে গেল, বিয়েটা ছিল সম্পূর্ণই অনাকাঙ্ক্ষিত তার কাছে। বাবা যে তাকে হঠাৎ বিয়ে দিয়ে দিবে এই ভাবনা তার মাথায় আসেনি। বিয়েটা এমন এক লোকের হলো সাথে যাকে নিয়ে কোন চিন্তা ভাবনা মাথায় আসেনি।লোকটা কেমন যেন গুরু গম্ভীর প্রকৃতির
যার মুখ দিয়ে কখনো কথা বের হতো না। এমন চুপচাপ প্রকৃতির লোকজন সানার কোন কালেই পছন্দ ছিল না। তবুও আল্লাহ কেনো যে একে তার কপালে স্বামী হিসেবে রেখেছিলো উনিই ভালো জানেন।

গোসল সেরে এসে তার ভাবির রেখে যাওয়া হাল্কা গোলাপি রঙ্গের শাড়িটি পরে নিলো। আর যাইহোক বড় বোনের মতো ভালোবাসা দেওয়া মানুষটির কথা সে ফেলতে পারেবেনা। সানা রেডি হয়ে চলে গেলো তার বাবার রুমে। সাদিক সাহেব বসে বসে ম্যাগাজিন পড়ছিলেন। দরজায় টোকা পরতেই চোখ থেকে চশমা খুলে টি-টেবিলে রেখে, বলেন।

~ ভিতরে আসো, বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকলে হবে?

বাবার কথায় হাসে সানা। বাবা কিভাবে যেনো বুঝে যায় সে এসেছে। বরাবরের মত আবার জিজ্ঞেস করে সানা তার বাবকে।

~ আপনি কিভাবে বুঝলেন বাবা আমি এসেছি?

~ আমি বুঝে যাই যে আমার আম্মাজান এসেছেন। কারন বড় আম্মাজান তো একটু আগে এসে আমাকে চা দিয়ে গেছে। তাহলে এখন তো আমার ছোট আম্মাজান ই আসবে।

বড় আম্মাজান বলতে বাবা যে ভাবিকে বুঝিয়েছেন তা সে বুঝতে পেরেছে। ভাবিকে বাবা নিজের সন্তানের মতো স্নেহ করেন এইটা খুব ভালোভাবে বুঝতে পারে সানা। সে আল্লাহ এর কাছে সবসময় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এতো ভালো পরিবারে তাকে পাঠানোর জন্য।

~বাবা এই সময় চা খেলেন যে,খাবার খাবেননা?

~ আমি খেয়ে নিয়েছি আম্মাজান।তোমার ভাবি আমাকে খাইয়ে দিয়ে গেছে একটু আগে। মা শা আল্লাহ আমার আম্মাজান কে অনেক সুন্দর লাগছে।

বাবার কথায় সানা লজ্জা পেয়ে যায়। লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেলে।

~ আজ যে আপনি দুপুরে আমাকে ছাড়াই খেয়ে নিলেন বাবা?

প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে সাদিক সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছে সানা। অবাক হয়েছে সে কারন আজ তার বাবা তাকে ছেড়ে এই প্রথম খাবার খেলো।

~ আজ তো সাফোয়ান বাবা আসবে,বললো তোমাকে নিয়ে বাহিরে খেতে যাবে। এইজন্য আর ডাকি নি। ছেলেটা আমাকে ফোন দিয়ে পারমিশন চাইলো যে তোমাকে নিয়ে সে বাহিরে যেতে চায় তাই আর না করলাম না।

সাফোয়ান যে তার বাবার কাছে এভাবে পারমিশন চাইবে বাহিরে যাওয়ার জন্য তা কারো ভাবনায় আসবে না। যেই লোক সালাম দেওয়া আর কেমন আছেন এইটাইপ কথা ব্যাতিত মুখ দিয়ে আর একটা শব্দ ও ব্যাবহার করে না সে আজ কিভাবে পারমিশন চাইলো। আশ্চর্যজনক ব্যাপার স্যাপার ঘটে যাচ্ছে। বাবার সামনে তো আর কিছু বলতে পারবেনা সে তাই বাবার থেকে বিদায় নিয়ে ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসলো। ৩ টা বাজে এদিকে খুদায় সানার পেটে ইদুর লাফাচ্ছে। এই মেয়ে না খেয়ে একদম থাকতে পারে না। টাইম মতো তাকে খেতেই হবে। হাক ছেড়ে ভাবিকে ডাকা ধরলো।

~ ভাবি ও ভাবি কোথায় তুমি?

সানার ডাক শুনে ওর বড় ভাই চলে আসে। জহির বোনের ডাকে দেড়ি করেনি আর চলে আসতে।

~ কি হয়েছে এভাবে ডাকছিস? কিছু লাগবে তোর?

~ না ভাইয়া! আসলে আমার অনেক খুদা লেগেছে তাই ভাবিকে ডাকছিলাম। ভাবি কোথায়?

~ ওহ! তোর ভাবি তো গোসলে গেলো। আচ্ছা থাক তুই বস আমি আজ তোকে খাবার দেই।

ভাইয়ের কথায় অপ্রস্তত হয়ে যায় সানা। তার ভাইয়া হয়তো জানেনা আজ তার বাহিরে যাওয়ার কথা তাইতো কি অবলিলায় খাবার বেরে দিতে চাচ্ছে। তার নিজের বলতে কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে। তাই কথা ঘুরিয়ে বলে,

~ থাক ভাইয়া। ভাবি আসুক তো, আপনিও নিশ্চিত খান নাই? ভাবি আসলে খাইয়েন।

কলিংবেলের আওয়াযে বুঝে যায় সানা যে কে এসেছে।সানা চুপ চাপ বসে থাকলো, জহির দরজা খুলে মানুষ টি কে নিয়ে ভিতরে আসলো। যতোই হোক তার স্ত্রীর বড় ভাই আবার একমাত্র বোনের স্বামী। জহির বিব্রত হলো এটা ভাবতেই বোনের স্বামী।

~ আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন?

সাফোয়ান সালাম দিলো জহির কে। জহির সালাম শুনে নিজের সব ভাবনা ফেলে দিয়ে সালামের উত্তর দিলো।

~ ওয়ালাইকুমুস সালাম। ফ্যানের নিচে গিয়ে বসো ঘেমে কি নাজেহাল অবস্থা তোমার।

~ না সমস্যা নাই ভাইয়া! আপনি এতো ব্যাস্ত হবেন না আমি বসছি।

সাফোয়ান জহির কে ভাইয়া বলার কারন সানা। সানার বড় ভাই সে সম্পর্কেও বড়।

সানা দ্রুত সোফা ছেড়ে উঠে দাড়ালো। ফ্রিজের কাছে গিয়ে ঠান্ডা পানি বের করে নিয়ে লেবু দিয়ে শরবত বানালো। ফিরে এসে দেখতে পেলো সেখানে তার ভাই নাই। সাফোয়ান একা বসে খুব মনোযোগ দিয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে কি যেনো দেখে যাচ্ছে। সানা এবার শরবতের গ্লাস টা হাতে নিয়েই দাঁড়িয়ে থাকলো। দিবে কি না এই ভাবনা চিন্তায়।সানার ভাবনার মাঝেই সাফোয়ানের কথা কানে আসলো।

~ এইভাবে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে না থেকে গ্লাস টা যদি আমাকে দিতেন খুব উপকৃত হতাম।

সানা নিজের বোকামি তে লজ্জা পেলো। বোকাবোকা চাহনী দিয়ে কাপকাপা হাতে শরবতের গ্লাস টি সাফোয়ানের কাছে দিলো। সাফোয়ান শরবত খাচ্ছে আর ফোন চাপছে। নিরব সাফোয়ান কে দেখে আবারো সানার মন খারাপ হয়ে গেলো। লোকটি তার দিকে তাকালো না,বসতেও বললো না। এইদিকে সাফোয়ান কে একা ড্রয়িংরুমে রেখে নিজের রুমেও যেতে পারছে না। ব্যাপার টা দৃষ্টিকটু লাগে তাই। দাঁড়িয়ে থাকতেও সানার একদম ভালো লাগছে না।

সুমাইয়া রুম থেকে বেরিয়ে এসে সোজা ভাইয়ের সামনে চলে গেলো।বোন কে এভাবে এগিয়ে আসতে দেখে সাফোয়ান বললো।

~ সাইফ কে পাঠিয়েছি তোর চকলেট আনতে, বাকি জিনিশ নিয়ে চলে আসবে সে।

~ তুমি কিভাবে বুঝলে আমি এখন কি বলবো?

~ ভাইরা আসছে তাদের জন্য গিয়ে খাবারের ব্যাবস্থা করো।

জহির বউয়ের ব্যাবহারে বিরক্ত। ভাইদের সামনে গেলে নিতান্তই বাচ্চা হয়ে যায়। অথচ এমনি টাইমে কি ম্যাচুরিটি দেখায়।

চলবে।

আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-৫০ এবং শেষ পর্ব

0

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
শেষ পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz

অন্ধকার কমন রুমে একাকি বসে জানালার ফাঁক দিয়ে উষসীকে দেখার চেষ্টা করছে সাজিদ। এই কাজটা সে রোজই করে। এই সময় ব্রেকটাইমে কমন রুমের ব্যাকসাইডে দাঁড়িয়ে স্মোক করতে করতে তাকে দেখতে এতো ভালো লাগে যে এক মুহুর্তও চোখের পলক ফেলা যায় না।

সাজিদ মুগ্ধ হয়ে দেখে। একটা মেয়ে মানুষের শান্ত হয়ে বসে থাকার মধ্যেও কি করে এতো শৈল্পিক ভাব থাকতে পারে?

সাজিদের মনে উষসীকে নিয়ে একটা অদ্ভুত কল্পনার জগৎ তৈরী হয়েছে। এই উদ্ভট ভাবনাগুলো ভুল করেও যদি উষসী জেনে যায় তাহলে নিশ্চয়ই খুব হাসবে।সাজিদ তার প্রিয় রমণীর কাছে হাসির পাত্র হতে চায় না। কিন্তু আজ সে ধরা পড়ে গেল। তাও হাতে-নাতে ধরা।

” কিছু বলবেন সাজিদ ভাই?”

সাজিদ চমকে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। উষসী তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একহাতে সিগারেট নিভিয়ে ছুঁড়ে ফেলল সে। কখন যে উষসী এখানে চলে এসেছে তা টেরও পায়নি সাজিদ। আমতা-আমতা করে বলল, “কিছু না, ম্যাডাম।”

” আপনার সমস্যা কি? আমাকে বলুন তো। সারাদিন দেখছি একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। প্রিভিয়াস মিটিং-এও খুব অন্যমনস্ক ছিলেন। আপনার মতো সিনসিয়ার ইমপ্লয়ির থেকে এমন আচরণ আশা করা যায় না।”

সাজিদ মাথা নিচু করে ভাবল, সেদিন প্রেজেন্টেশনে ছিল উষসী। সে একটা লেবুপাতা রঙের শাড়ি পরেছিল। কি অসম্ভব মিষ্টি লাগছিল তাকে! ওই মুহূর্তে উষসী ছাড়া অন্যকিছু চিন্তা করাই সাজিদের পক্ষে অসম্ভব ছিল। তাছাড়া সে আশেপাশে থাকলে সাজিদের কাছে এ পৃথিবী তুচ্ছ মনে হয়। ইচ্ছে করে ওই মুখের দিকে আজন্ম চেয়ে থাকতে।

উষসী দুঃখিত গলায় বলল,” কোনো ফ্যামিলি প্রবলেম?”

সাজিদ হাসতে চেষ্টা করল। উষসীর গাঁয়ে একরঙা শাড়ি। মুখে না আছে কোনো প্রসাধন আর গায়ে না আছে কোনো অলংকার। সে এভাবেই সাধারণ থাকে। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ খুব সাজে। সেদিন হাত ভরে এক ডজন চুড়ি পরে এসেছিল। কালো চুড়ি আর সোনালি শাড়িতে তাকে যে কি মানাচ্ছিল! সাজিদ সেদিনই ঠিক করেছে উষসীকে এক ডজন চুরি গিফট করবে। কিন্তু করলে কি সে সেটা পরবে? কে জানে? ব্যাপারটা হয়তো খারাপ দেখাবে। সে সাধারণ ইমপ্লয়ি হয়ে মেনেজারকে চুড়ি গিফট করতে পারে না।

উষসী বলল,” সাজিদ ভাই, আপনি অন্ধকারে একা বসে কি করছিলেন?”

” মঈনুলের জন্য অপেক্ষা করছিলাম ম্যাডাম। ও আমাকে এইখানে বসিয়ে রেখে বাথরুমে ঢুকেছে। এখনও আসছে না।”

উষসীর ভ্রু কুঁচকে গেল। হতাশ গলায় বলল,” আপনার কি হয়েছে সাজিদ ভাই? মিথ্যা কেন বলছেন? মঈনুলের সাথে আমার একটু আগেই তিনতলায় দেখা হয়েছিল। সে তো নিজেই আপনাকে খুঁজছে!”

এই কথার পর সাজিদের খুব অস্বস্তিবোধ করা উচিৎ ছিল। কিন্তু সে অস্বস্তি বোধ করল না৷ কারণ উষসী কথাটা বলে খুব সুন্দর করে হেসেছে। সাজিদের ধারণা এই মহিলা জাদুবিদ্যা জানে। তার অর্ধেক জাদু হাসিতেই লুকানো। কেউ যদি খুব জটিল কোনো সমস্যায় পড়ে আর এই মহিলা তার সামনে গিয়ে একবার হাসে তাহলে মুহুর্তেই সেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ম্যাজিকের মতো!

উষসীর বাড়ি ফিরতে আজ খুব রাত হয়নি। আজ-কাল সে দ্রুত বাড়ি ফেরার চেষ্টা করে। রাত যত গভীর হয় ততই বিপদের আশংকা বৃদ্ধি পায়। উষসী যতটা না বিপদের পরোয়া করে তার থেকেও পরোয়া করে নিয়ম-কানুনের। সে সময় সম্পর্কে সচেতন থাকতে পছন্দ করে।

সাতবছরে উষসীর জীবনে আরও অনেক পরিবর্তন এসেছে। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হলো সে এখন সাবলম্বী। বাড়িতে তার কথা ছাড়া একটা ধুলিকণাও কেউ সরাতে পারে না। এখানে সে নিজেই কর্তা আবার নিজেই কর্তী। উষসী কখনও চিন্তা করেনি তার জীবন এইভাবে বদলে যাবে। বাড়িতে ঢুকতেই আয়শা দরজায় দাঁড়িয়ে সালাম দিল,” আসসালামু আলাইকুম আপা, আজকে এতো দেরি করলেন? আপনার জন্য ডিনার নিয়ে বসে আছি। এখন খাবেন?”

উষসী আয়শার দিকে তাকিয়ে শুধু একটু হাসল।তারপর ভেতরের ঘরে চলে গেল। আয়শা তার পেছন পেছন আসছে। দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করল সে। ঘরটা হিমশীতল। এসি খুব জোরে চলছে। উষসী নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল,” এসি’র পাওয়ার এতো কম কেন?”

” মামণির নাকি সন্ধ্যা থেকে খুব গরম লাগছে।”

উষসী দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। হঠাৎ গরম, হঠাৎ ঠান্ডা… এসব তো কোনো ভালো লক্ষণ না। সে আস্তে আস্তে ভেতরে ঢুকল।

চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে মাইশা। ঘুমাচ্ছে নাকি জেগে আছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। উষসী তার একটা হাত আদরের মেয়ের কপালে রাখল। ওমনি মেয়েটি চোখ খুলে তাকাল। চোখ খোলার আগেই তার মুখে একটু হাসি ফুটেছিল। অর্থাৎ সে মায়ের স্পর্শ চেনে।উষসী মিষ্টি করে বলল,” কেমন আছে আমার আম্মু?”

” তুমি কখন এসেছো মাম্মা?”

” এইতো, মাত্রই এলাম।”

” ডিনার করেছো?”

” তোমার সাথে দেখা না করে আমি কখনও ডিনার করি?”

এই কথা বলেই মেয়ের কপালে চুমু দিল উষসী। মাইশা আহ্লাদী হাসল। উষসী বলল,” এইতো এখন যাবো। ফ্রেশ হয়ে ডিনার করবো। তুমি বলো। আজকে সারাদিন কি কি করেছো?”

” আয়শা আন্টি যা রান্না করে দিয়েছে তাই খেয়েছি। টিভি দেখেছি।”

” খাবার ভালো লাগে?”

” হ্যাঁ।”

” আয়শা, তোমাকে না বলেছি ওকে গল্পের বই পড়ে শোনাতে? শোনাও?”

” শোনাই তো আপা। আজকেও শুনিয়েছি৷ তিনটি বই পড়ে শুনিয়েছি। কিন্তু ও শুধু বাইরে যেতে চায়। ”

উষসী মেয়েকে আদর করে বুঝিয়ে বলল,” সবসময় বাইরে যেতে হয় না, মা।”

মাইশা মুখ গোমরা করে বলল,” কি করব? সারাদিন শুয়ে থাকতে আমার ভালো লাগে না।”

” ঠিকাছে, ছুটির দিন আমি তোমাকে অনেক দূরে ঘুরতে নিয়ে যাব। হ্যাপি?”

মাইশা মাথা নাড়ল। সে খুব খুশি।

” ওকে। আমি খুব টায়ার্ড মা। যাই খাওয়া-দাওয়া করি। তারপর এসে তোমাকে গল্প শোনাবো। আমি আজকেও তোমার সাথেই থাকবো।”

” থ্যাংকিউ।”

” আয়শা, আমি ফ্রেশ-টেশ হয়ে আসি। তুমি ততোক্ষণ মাইশার কাছে বসে থাকো। ওকে একা রাখার দরকার নেই।”

” আচ্ছা ভাবি।”

উষসী ঘর থেকে বের হয়েও উঁকি দিয়ে আবার ভেতরে তাকাল। তৃপ্তি নিয়ে নিজের মেয়েটাকে দেখল। মাত্র ছয় বছর বয়সী মেয়েটার জীবন একটা ছোট্ট ঘরে আটকে আছে। এই বয়সে বাচ্চারা কত চঞ্চল হয়। এই ঘর, সেই ঘর দৌড়ে বেড়ায়। অথচ তার মেয়েটা…. চাপা ব্যথায় বুক হু হু করে উঠল উষসীর। ছয়বছর আগে যখন মাইশার জন্ম হয়েছিল তখন সবাই ধরেই নিয়েছিল বাচ্চাটা মৃ”ত। প্রায় দেড় ঘণ্টা যাবৎ সে কোনো শব্দ করেনি। নড়াচড়াও না। কাঁদতে কাঁদতে সবাই অস্থির হয়ে পড়েছিল। সেই অভিশপ্ত দিনের কথা মনে পড়লে আজও উষসীর গা কাটা দেয়। তারপর হঠাৎ মাইশা কেঁদে ওঠে। উষসী তার মোমের মতো ফরসা পুতুলটাকে চোখের সামনে জীবন্ত হতে দেখে। তার প্রাণ ফিরে আসে। সেজন্যই ওর নাম রাখা হয়েছে মাইশা। যার অর্থ-জীবন্ত। হোক না সে প্রতিবন্ধী, দুই পা প্যারালাইজড। তবুও তো সে জীবন্ত। এটাই উষসীর কাছে বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ। জীবনের একমাত্র সুখ।

বেডরুমে এসে বিছানায় বসেছে মাত্র, ওমনি উষসীর মোবাইল বেজে উঠলো। সে জানে ইয়ামিনের ফোন এসেছে। উষসী এটাও জানে যে ঠিক এইসময় ফোনটা আসবে। উষসী যতক্ষণ ফোন না ধরবে ততক্ষণ বাজতেই থাকবে।

সাজিদ ক্যান্টিনে বসে আছে। তার থেকে দশফুট দূরত্বের একটি টেবিলে বসেছে উষসী। একহাতে ফোন টিপছে, অন্যহাতে খাবার খাচ্ছে। হঠাৎ সাজিদ নিজের টেবিল ছেড়ে উঠে উষসীর কাছে এসে বসল। ভদ্রতার খাতিরে মুচকি হাসল উষসী।

সাজিদ বলল,” ম্যাডাম, কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করতাম।”

সে রীতিমতো ঘামছে। উষসী হেসে বলল,” এতো হেজিটেড ফীল করার কিছু নেই। আপনি বলতে পারেন।”

” মানে… সেদিন আপনি আপনার হাজব্যান্ডের ব্যাপারে বলছিলেন। হঠাৎ আপনার জরুরী ফোন এসে গেল। মাইশা মামনির অসুস্থতার খবর শোনার পর আপনি দ্রুত বের হয়ে গেছিলেন। পুরো কাহিনীটা আর শোনা হয়নি। কিন্তু বাকিটা আমি জানতে চাই।”

উষসী মৃদু হেসে টোস্টে কামড় দিয়ে বলল,” ও আচ্ছা। তাই বলুন। কোথায় যেন ছিলাম আমরা?”

” ওইতো… প্লেন ক্র্যাশ করেছিল৷ তারপর পুলিশ এলো ডেডবডি আইডেন্টিফিকেশনের জন্য। আর আপনি জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন।”

উষসীর মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। কিছুক্ষণ থম মেরে স্বচ্ছ পানির গ্লাসের দিকে চেয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল একটা। ধরা গলায় বলতে লাগল,” সেদিনের কথা মনে করলেও আমার দম বন্ধ হয়ে আসে সাজিদ ভাই৷ ওই একটা ঘটনা আমার পুরো পৃথিবী বদলে দিতে পারতো।”

” কি হয়েছিল? ওই ডেডবডি আপনি কি পরে চিনতে পেরেছিলেন?”

উষসী ভ্রু কুঁচকে বলল,” একদম না। চিনতে পারার প্রশ্নই আসে না। কারণ ওটা ইয়ামিনের ডেডবডি ছিল না।”

” ছিল না?” সাজিদ হতভম্ব।

উষসী উৎফুল্ল চিত্তে বলল,” না। ইয়ামিন আসলে ওই প্লেনে ওঠেনি সেদিন। আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। হসপিটালের একটা কেবিনে নিয়ে আমাকে সেলাইন দেওয়া হলো। আমি পুরোপুরি সেন্সলেস ছিলাম। তারপর হঠাৎ ইয়ামিন আমার কেবিনে ঢুকল। তাকে দেখে প্রথমে মনে হলো আমি বুঝি স্বপ্ন দেখছি। তারপর সে যখন আমার কপালে হাত রাখল, আমি বুঝতে পারলাম ওটা স্বপ্ন ছিল না। সত্যি ছিল! আমি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম। তাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। ডাক্তার, নার্স এবং কেবিনের পেশেন্টরা আমার কান্ডে স্তম্ভিত। ইয়ামিন লজ্জা পেয়ে কি বলল জানেন? ‘ছাড়ো উষুপাখি, সবাই দেখছে তো। কি ভাববে? তুমি তো আমাকে লজ্জায় ফেলে দিচ্ছো।’ আমি বললাম,’যে যা খুশি ভাবুক। আমি আপনাকে ছাড়ব না। কখনও না। কথা দিন যে আমাকে ছেড়ে আর যাবেন না। কথা দিন। সে কথা দিয়েছিল। আর সে তার কথা রেখেছেও।’

উষসী হাসল। টিস্যু দিয়ে চোখের জল মুছল। সেই আনন্দময় মুহূর্তের কথা চিন্তা করে তার আবারও কান্না পাচ্ছে। সুখের কান্না। সাজিদ বলল,” স্যার এয়ারপোর্টে গিয়েছিলেন অথচ ফ্লাইটে উঠলেন না কেন?”

” জানি না। হয়তো শেষ মুহূর্তে তার মন সায় দেয়নি। সে বুঝতে পেরেছিল ফ্লাইটে উঠলে আমার সাথে আর দেখা হবে না। ভাগ্যিস সে ওঠেনি সেদিন। নাহলে আমি তাকে কোথায় পেতাম, বলুন?”

সাজিদ তাকিয়ে আছে হা করে। উষসী হাসিমুখে কাঁদছে। তার দেহ এখানে থাকলেও মনটা ফিরে গেছে সাতবছর আগের স্মৃতিতে। মেসেজ টোন বেজে উঠল হঠাৎ। উষসী ফোনটা হাতে নিয়েই হৃষ্টচিত্তে বলল,” এইতো, ও মেসেজ করছে। নিচে দাঁড়িয়ে আছে হয়তো। আজকে আমি হাফ ডে নিয়েছি। কারণ আমরা শপিং-এ যাবো। আচ্ছা, আমি উঠছি, হ্যাঁ? ওকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করানো ঠিক হবে না। ভালো থাকবেন সাজিদ ভাই। কাল দেখা হবে।”

সাজিদ কিছু বলল না। উষসীর চোখ ঝলমল করছে। সে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে চঞ্চল পায়ে হাঁটতে লাগল। তার চলে যাওয়ার দিকে বিষণ্ণ চোখে চেয়ে রইল সাজিদ। একহাতে চোখের জল মুছে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইয়ামিন। উষসী দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। আহ্লাদী কণ্ঠে বলল,” কেমন আছো তুমি? এতোক্ষণ পর মনে পড়ল আমার কথা? জানো আমি কত্ত মিস করেছি তোমাকে?”

ইয়ামিন হকচকিয়ে বলল,” সিরিয়াসলি? তুমি আমাকে মিস করেছো? কি সৌভাগ্য আমার!”

উষসী বামহাতে ইয়ামিনের বাহুতে চাপড় দিল। এবার ফিক করে হেসে উঠল সে। সেই হাসির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে উষসী বলল,” দুইদিন পর আমাদের মেয়ের জন্মদিন। মনে আছে?”

ইয়ামিন তার কোমর জড়িয়ে ধরে বলল,” নিশ্চয়ই মনে আছে মিষ্টি বউ। তার আগে তুমি বলোতো, এই অবস্থা কেন তোমার? দেখতে খুব পানসে লাগছে। একটুও সাজোনি৷ তোমাকে না বলেছি, সবসময় সাজ-গোজ করবে?”

” বুড়ো বয়সে এতো সাজলে মানুষ কি বলবে?”

” বুড়ো মানে? কে বুড়ো?”

” এখন আমি একবাচ্চার মা। ভুলে গেছো? বুড়োই তো। আগের মতো এতো সাজতে ভালো লাগে না।”

” ভালো না লাগলেও সাজতে হবে। আমার জন্য। আমি দেখব।”

উষসী লাজুক মুখে বলল,” আচ্ছা বাবা, ঠিকাছে৷ সাজবো৷ এবার চলোতো। তোমার মেয়ের জন্য একটা ইলেকট্রিক চেয়ার কিনবো আমি। পছন্দ করে রেখেছিলাম৷ মাইশার প্রিয় কালার।”

” তাই নাকি?”

” হুম। ওই চেয়ার পেলে আশা করি সে দ্রুত হাঁটতে শিখবে।”

” তুমি চিন্তা কোরো না উষু। ও আমার মেয়ে। অবশ্যই ও খুব দ্রুত হাঁটা শিখবে। তোমার সব কষ্টের অবসান হবে।”

উষসী ইয়ামিনের কাঁধে মাথা রেখে বলল,” আমার কোনো কষ্ট নেই বিশ্বাস করো। তুমি আমার পাশে আছো। এক জীবনে এর থেকে বেশি আমি আর কিছুই চাই না।”

উষসীর চোখে পানি জমে উঠল। ইয়ামিন আলতো হাতে সেই পানি মুছে দিয়ে আদুরে গলায় বলল,” আমার মিষ্টি বউ। একদম কাঁদে না।”

উষসী তখনি হাউমাউ করে কান্না শুরু করল।

আজ মাইশার সপ্তম জন্মদিন। বাড়ি ভর্তি মেহমান। উষসী একদম নিশ্বাস ফেলার ফুরসত পাচ্ছে না। খুবই ব্যস্ত সে। মাইশা হুইল চেয়ারে করে পুরো বাড়ি ঘুরছে। কোথায় কোন জিনিস লাগাতে হবে, কেমন ডেকোরেশন তার পছন্দ, এসবের তদারকি করছে।

” হ্যাপি বার্থডে মাই ডিয়ার সিস।”

পেছনে চাইতেই একগুচ্ছ সাদা গোলাপ আর একটা বড় র‍্যাপিং পেপারে মোড়ানো গিফট হাতে দেখা গেল তৃষ্ণাকে। মাইশা চেঁচিয়ে বলল,” তৃষ্ণা ভাইয়া, তুমি এসেছো? আমি তো ভেবেছিলাম আসবেই না!”

শেষ বাক্যে অভিমান প্রকাশ পেল। তৃষ্ণা নিচু হয়ে মাইশার গাল টেনে বলল,” তোর বার্থডেতে আমি আসব না মানে? পাগল হয়েছিস?”

” কিন্তু খালামণির কাছে শুনলাম তোমার নাকি এক্সাম?”

” এক্সাম চুলায় যাক। আমার বোনের হাসি সবার আগে।”

মাইশা খিলখিল করে হেসে উঠল। তার মন আজকে সারাদিন খারাপ ছিল। কিন্তু তৃষ্ণাকে দেখে এখন অসম্ভব ভালো লাগছে। তৃষ্ণা ওর হাতে গোলাপের বুকেট আর গিফট তুলে দিয়ে বলল,” এর মধ্যে কি আছে? গেস করতে পারবি?”

গিফটের সাইজ দেখেই মাইশা বুঝে গেল। চোখ ছোট করে সামান্য রহস্যের ভঙ্গিতে বলল,” গিটার নাকি?”

তৃষ্ণার চোখ বড় হয়ে গেল। বিস্ময় নিয়ে বলল,” বুঝলি কিভাবে তুই?”

” তুমিই একবার বলেছিলে… আমাকে জন্মদিনে গিটার গিফট করবে। আমি ভুলিনি।”

” ও এই ব্যাপার? এখন তাহলে গিটারটা বাজিয়ে দেখা।”

” না ভাইয়া। এটা আজকে তোলা থাকুক। আমি মাকে প্রমিস করেছিলাম, আজকে শুধু বাবার গিটার বাজাবো।”

” ওহ, ঠিকাছে।”

” আচ্ছা, তুমি একা কেন? নানুরা কোথায়?”

” আসছে সবাই। ওইতো।”

তৃষ্ণা মাইশার হুইল চেয়ার টেনে তাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেল। যুথি, ডোনা, উষ্ণতা আর তৃষাণের কাছে। সবাই মাইশাকে জন্মদিনের অভিবাদন জানিয়ে আদর করে দিল। তারপর মাইশা গিটার বাজিয়ে একটা গান ধরল।

রান্নাঘর থেকে সেই গানের সুর শুনে উষসী উত্তেজিত হয়ে উঠল হঠাৎ। ইয়ামিন বলল,” কে গান গাইছে?”

” কে আবার? তোমার মেয়ে! একদম তোমার মতো হয়েছে। কি সুন্দর গিটার বাজাচ্ছে দেখেছো?”

” হুম৷ তাইতো দেখছি। একদিন দেখবে ও আমাকেও ছাড়িয়ে যাবে।” ইয়ামিন গর্ব করে বলল। উষসীর চোখে আবার পানি চলে আসছে। সে দৌড়ে লিভিংরুমে গেল। মাইশাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। ছোট্ট হাতে গিটার বাজিয়ে কি সুন্দর গান গাইছে মাইশা। উষসী মুগ্ধ হয়ে দেখছে। মেয়ের মধ্যে বাবার ছায়া উপলব্ধি করে সে এক অকৃত্রিম শান্তি পায়। ইয়ামিন তার পাশে এসে দাঁড়াল হঠাৎ। কাঁধে হাত রাখল। ফিসফিস করে বলল,” আমার মেয়ে।”

উষসী বলল,” উহুম। আমাদের মেয়ে। আমাদের চোখের মণি।”

সাজিদ আশেপাশে উষসীকে খুঁজছে। কোথাও সে নেই। উষ্ণতা সবাইকে কোল্ডড্রিংক সার্ভ করছে। সাজিদের কাছে আসতেই সে বলল,” আপনি মনে হয়, তৃষাণ স্যারের ওয়াইফ। তাই না?”

” জ্বী। আপনি?”

” আমি উষসী ম্যাডামের কলিগ। অফিসে উনার আন্ডারেই কাজ করি।”

উষ্ণতা হেসে বলল,” ও আচ্ছা। তৃষ্ণার বাবার কাছে একবার শুনেছিলাম আপনার কথা।”

” আচ্ছা, ম্যাডাম কোথায়?”

উষ্ণতা আশেপাশে তাকাল। উষসী এখানে নেই। হয়তো রান্নাঘরে আছে। সে সবসময় একাই থাকে। ভীড়ের মধ্যে আসতে চায় না। কেক কাটার সময়ও তাকে পাওয়া গেল না। এদিকে মাইশা জেদ ধরে বসে আছে। মাকে ছাড়া সে কিছুতেই কেক কাটবে না।

যুথি ফিসফিস করে উষ্ণতাকে বললেন,” কোথায় আছে মেয়েটা? একটু খুঁজে দ্যাখ।”

উষ্ণতা মাথা নেড়ে উষসীকে খুঁজতে গেল৷ দুইতলার করিডোরে একা দাঁড়িয়ে আছে উষসী। তার হাতে এক মগ ধোঁয়া ওঠা গরম কফি৷ একই রকম আরেকটা কফির মগ সামনে। সেই মগের দিকে চেয়ে উষসী আপন মনে বিড়বিড় করছে। উষ্ণতা তার কাছে গিয়ে কাঁধ চেপে ধরল,” উষু, বোন আমার! নিচে সবাই তোর অপেক্ষায় আছে। তুই এখানে একা দাঁড়িয়ে কি করছিস বোন?”

উষসী গম্ভীর গলায় বলল,” অদ্ভুত কথা বলবে না আপু। আমি মোটেও একা দাঁড়িয়ে নেই। আমার সাথে ইয়ামিন আছে। তুমি কি দেখতে পাচ্ছো না ওকে?”

উষ্ণতার চোখ ভিজে এলো। দূর্বল গলায় বলল,”এসব কি বলছিস? এখানে তো কেউ নেই। আমার কথা বিশ্বাস কর লক্ষী বোন।”

” তুমি আমার কথা বিশ্বাস করো। প্লিজ, আমার সুখ নষ্ট কোরো না। যাও এখান থেকে। ”

উষসী উষ্ণতাকে ধাক্কা মারতে লাগল। উষ্ণতা সরল না। শক্ত হাতে বোনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল,” বোন আমার। প্লিজ তুই পাগলামিটা বন্ধ কর। তোর মেয়েটার কথা ভাব। তুই যদি এখনও এমন করিস তাহলে মাইশার কি হবে বল?”

উষসী পাথরের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল। কোনো কথা বলল না।

অনেকক্ষণ পর উষসীকে নিয়ে নিচে নামল উষ্ণতা। সবাই দেখল উষসীর মুখ শক্ত। অনুভূতিহীন মানুষের মতো হেঁটে আসছে সে৷ তৃষাণ কাছে গিয়ে উষসীর কাঁধে হাত রাখল। নরম কণ্ঠে বলল” কি ব্যাপার উষু? এতোক্ষণ কোথায় ছিলে? তোমার জন্য মাইশা অপেক্ষা করছে তো। এসো।”

উষসী শান্ত পায়ে হেঁটে গেল মেয়ের কাছে। মেয়ের মাথায় হাত রাখল। যুথি উষসীর অবস্থা দেখে চোখের জল মুছছেন। আয়শারও কান্না পাচ্ছে। বিগত সাত বছর ধরেই উষসীর এই হাল। সে চিকিৎসাধীন আছে। ডাক্তার বলেছেন সবসময় তাকে ব্যস্ত রাখতে হবে। তাই তৃষাণ নিজের অফিসের মেনেজারের পদে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছে উষসীকে। কিন্তু আফসোস, তার অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি।

মাইশা চারদিকে তাকিয়ে দেখল হঠাৎ করেই যেন সবার মনখারাপ হয়ে গেছে। খুশি খুশি পরিবেশটা আর নেই। সে দুঃখী দুঃখী পরিবেশেই কেক কাটল। মাকে কেক খাইয়ে দিল। উষসীও তার মেয়ের মুখে কেক দিল। তারপর এক টুকরো কেক নিয়ে সে ভীড় থেকে বের হয়ে এলো। তার চোখমুখ বিষণ্ণ লাল। তাকে কেউ বাঁধা দিল না।

সাজিদ উষসীর পেছনে আসতে আসতে বলল,” ম্যাডাম, কোথায় যাচ্ছেন?”

উষসী থামল। তার চোখ ভর্তি জল। সে অপরাধী কণ্ঠে বলল,” সাজিদ ভাই, আমাকে মাফ করে দিবেন।”

” এই কথা কেন বলছেন ম্যাডাম?”

উষসী কাঁদতে শুরু করল। সাজিদ তড়িঘড়ি করে পকেট থেকে রুমাল বের করল। উষসী অবশ্য রুমাল নিল না। শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে নিয়ে হতাশ গলায় বলল,” আমি আপনাকে মিথ্যা বলেছিলাম। সেদিন হাসপাতালে কেউ আসেনি। ডেডবডিটা ছিল ইয়ামিনের। কিন্তু আমি সেটা মানতে পারিনি। আজও মানতে পারিনি।”

উষসীকে অবুঝ শিশুর মতো কাঁদতে দেখা যাচ্ছে। সাজিদ ব্যথিত কণ্ঠে বলল,” আমি জানি ম্যাডাম। আপনি কষ্ট পাবেন না, প্লিজ।”

উষসী এই কথার জবাব দিল না। ধীরপায়ে হেঁটে যেতে লাগল বাইরে। বাগানে আসতেই ইয়ামিনের দেখা পাওয়া গেল। ছাতিম গাছের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে হাসি। আকাশের দিকে চেয়ে বলল,” আজকে কত সুন্দর জোৎস্না পড়েছে দেখেছো?”

উষসীও তাকাল আকাশের দিকে। মাথা নেড়ে বলল,” হুম৷ অনেক সুন্দর। কিন্তু তোমার চেয়ে সুন্দর কোনোকিছুই না।”

ইয়ামিন কাছে এসে দাঁড়ালো। উষসীর একহাত নিয়ে চুমু দিয়ে বলল,” আমাকে অনেক ভালোবাসো তাই না?”

” অনেক, অনেক, অনেক, অনেক! প্লিজ আমাকে ছেড়ে আর যেও না।”

ইয়ামিন হাসল। উষসী বলল,” দেখো, তোমার জন্য কেক এনেছি। তোমার মেয়ের জন্মদিনের কেক।”

” আমি কেক খাবো না৷ তুমি খাও। আমি দেখব।”

উষসী মাথা নাড়ল। ইয়ামিনের কোনো অনুরোধ সে ফেলতে পারে না। তাই নিজেই কেক খেল। ইয়ামিন উষসীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” নিজেকে ক্ষমা করো উষু। আমার মৃত্যুতে তোমার কোনো দোষ ছিল না৷ এটা আমার ভাগ্যেই ছিল।”

” কেন এমন হলো? আমি তোমাকে হারিয়ে ফেললাম। নিয়তি আমার সাথে এতোবড় নিষ্ঠুরতা না করলেও পারতো।”

ফুঁপিয়ে কাঁদছে উষসী। ইয়ামিন তার মুখটা উপরে তুলে বলল,” এই বোকা মেয়ে, এইভাবে কাঁদতে হয় না৷ তুমি এইভাবে ভেঙে পড়লে আমার মেয়ের কি হবে বলো?”

উষসী কাতর গলায় বলল,” ওর এই অবস্থার জন্যেও আমি দায়ী৷ তোমাকে হারানোর পর আমি যদি সুইসাইড এর চেষ্টা না করতাম, যদি ওই ঔষধগুলো না খেতাম, তাহলে আজকে আমার মেয়েটা সুস্থ-স্বাভাবিক হয়ে জন্মাতো।”

” না। যা হয় ভালোর জন্য হয়। এটাই হওয়ার ছিল।এসব ভেবে আফসোস কোরো না। তোমাকে সুস্থ হতে হবে উষুপাখি। তুমি এমন করলে আমি কিভাবে শান্তিতে থাকব? তোমাকে আবার আগের মতো হাসতে হবে। নিজেকে ভালো রাখতে হবে। আমার মেয়েকেও ভালো রাখতে হবে। তুমি ছাড়া তার কে আছে বলো?”

” আমি সুস্থ হতে চাই না। ডাক্তার বলেছে সুস্থ হয়ে গেলে আমি আর তোমাকে দেখব না। ক্ষণিকের এই সুখ থেকে আমাকে বঞ্চিত কোরো না প্লিজ। আমাকে আবার ছেড়ে চলে যেও না। কথা দিচ্ছি, আর কখনও তোমাকে কষ্ট দিবো না আমি। আর কখনও তোমার উপর রাগ করব না৷ তুমি যা বলবে শুধু তাই করব৷ প্লিজ, তবুও আমাকে ছেড়ে যেও না। আমি সহ্য করতে পারব না।”

দূর থেকে সাজিদ দেখল, জোৎস্না ঝরানো রাতে এক অমায়িক রূপবতী মেয়ে ছাতিম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। সে মেয়েটির নাম দিল-‘দুঃখবিলাসী কন্যা’।

সমাপ্ত

আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-৪৯

0

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৪৯
লিখা- Sidratul Muntaz

রাত গভীর হচ্ছে। ঘড়ির টিকটিক শব্দটা মাথা ব্যথার উদ্রেক করছে। সামান্য ঘড়ির শব্দও কি এতো বিরক্তিকর হতে পারে? ঘুম আসছে না একদম। উষসী বিছানা ছেড়ে নেমে গেল৷ বারান্দায় এসে দাঁড়াল।

রাতের শহরটাকে মনে হচ্ছে কোনো রহস্যপুরী। নক্ষত্রপুঞ্জের মতো ছোট ছোট আলো ভেসে আছে দূরের ওই পরিচ্ছন্ন হাইওয়েতে। তার পেছনেই বিশাল বিশাল এপার্টমেন্টের সারি। ওই ব্যস্ত শহরের মধিখানে উষসীদের বাগানবাড়িটা যেন সমাজ থেকে বিচ্যুত এক টুকরো সুখের নীড়।

ঘন সবুজাভ মাঠ। ভোর হলেই পাখিদের মিষ্টি কলকাকলি শোনা যায়। মাঝে মাঝে চোখে পড়ে কাঠবিড়ালি, খরগোশের মতো আদুরে কিছু জীব। দূর থেকে মিউজিকের শব্দ ভেসে আসছে। একটু খেয়াল করতেই উষসী বুঝতে পারল, মিউজিকের শব্দটা আসছে ইয়ামিনের ঘর থেকে। এতোরাতে সে না ঘুমিয়ে জেগে আছে কেন এখনও?

ধীরপায়ে হেঁটে পাশের ঘরে গেল উষসী। দরজাটা হাঁট করে খোলা। বাইরে দাঁড়িয়েই বিছানাটা নজরে পড়ছে। আশ্চর্য ব্যাপার! সে কি এভাবেই দরজা খোলা রেখে ঘুমায় নাকি প্রতিদিন? মানুষের প্রাইভেসি বলেও তো কিছু থাকা উচিৎ। আয়শা যদি কখনও উপরে আসে তাহলে কি হবে? উষসী কখনও চায় না সে ছাড়া অন্যকেউ ইয়ামিনকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখুক। এই অধিকার শুধুমাত্র তার।

বিছানায় ইয়ামিনকে দেখা যাচ্ছে না। সে স্টাডি টেবিলের উপরে বসে মনোযোগের সাথে গিটার বাজাচ্ছে। চোখ দু’টো বন্ধ। গুণগুণিয়ে গানও গাইছে বোধহয়। ঠোঁট নড়ছে। কি গান সেটা বোঝা যাচ্ছে না। তবুও শুনতে ভালো লাগছে। উষসীর এখন চোখ জুড়িয়ে ঘুম পাচ্ছে। মনে হচ্ছে সে এখানে বেশিক্ষণ থাকলে ঘোড়ার মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঘুমাতে শুরু করবে।

হঠাৎ মিউজিক থেমে গেল। ইয়ামিন শান্ত স্বরে বলল,” উষু, কিছু বলার থাকলে ভেতরে আসো। ”

উষসী চমকে উঠল। সে তো ঘাড় ঘুরিয়ে একবারও পেছনে তাকায়নি। তাহলে বুঝল কিভাবে পেছনে কেউ আছে? ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে উষসী প্রশ্ন করল,” বুঝলেন কিভাবে আমি?”

ইয়ামিন হাতের গিটার নামিয়ে রাখল। চেয়ারে মাথা এলিয়ে প্রগাঢ় শ্বাস টেনে বলল,” আই ক্যান ফিল ইউর প্রেসেন্স।”

উষসী অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে হাসল। ভ্রু নাচিয়ে বলল,” মিথ্যা কথা। আপনি নিশ্চয়ই অন্যকোনো ভাবে ইঙ্গিত পেয়েছেন। উম…. আমার পারফিউমের ঘ্রাণ পেয়েছেন, রাইট?”

” এতো দূর থেকে ঘ্রাণ কিভাবে পাবো? আমাকে কি তোমার কুকুর মনে হয়?”

উষসী না চাইতেও হেসে ফেলল। তারপর হঠাৎ খুব সঙ্গিন হয়ে বলল,” সবাই তো জানে আপনি গান ছেড়ে দিয়েছেন। অথচ মাঝরাতে প্রায়ই গিটার নিয়ে গুণগুণ করেন৷ এতোই যদি গানের প্রতি ভালোবাসা… তাহলে ছাড়লেন কেন?”

ইচ্ছে করেই ইয়ামিন প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল। ভিন্ন প্রসঙ্গ টেনে বলল,” তুমি এতোরাতে এখানে কি করছো? এখনও ঘুমাওনি কেন?”

” ঘুম আসছে না, মাথা ধরেছে আমার। ঘড়ির টিকটিক শব্দটা খুব বিরক্তিকর। মনে হয় যেন কেউ মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করছে।”

” এক কাজ করো, ঘড়ির ব্যাটারি খুলে ফেলো।”

আইডিয়াটা উষসীর পছন্দ হলো। মৃদু হেসে বলল,” ভালো বলেছেন। সেটাই করতে হবে।”

সে বের হয়ে যেতে নিয়েও আবার ফিরে এলো। কি একটা ভেবে জিজ্ঞেস করল,” আপনার কি কিছু লাগবে?”

ইয়ামিন হতবাক চিত্তে তাকাল। তাকে এমন অবাক হতে দেখে অপ্রস্তুত হলো উষসী। অস্বচ্ছন্দ কণ্ঠে বলল,” এভাবে তাকানোর কি আছে? কিছু লাগলে বলুন।”

ইয়ামিন নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,” হঠাৎ আমার প্রতি এতো দয়া?”

” দয়া হবে কেন? আয়শা মনে হয় ঘুমাচ্ছে, সেজন্য বললাম। যদি কিছু প্রয়োজন হয় তাহলে আমাকে বলতে পারেন। ”

ইয়ামিন উষসীর গলার নিচের কালো তিলটির দিকে চেয়ে বলল,”হুম, প্রয়োজন। অনেক।”

” কি প্রয়োজন?”

উষসী কাছে এগিয়ে আসতেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল ইয়ামিন৷ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” থাক, তুমি দিবে না।”

” দিবো না মানে? কি চান আপনি?”

ইয়ামিন তাকাল। নির্দ্বিধায় বলল,” চুমু, অনেকগুলো চুমু চাই আমি। দিবে?”

উষসী থমকে গেল। লজ্জায় হতবিহ্বল হয়ে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থাকল। তারপর দরজার দিকে পা বাড়িয়ে ফিসফিস করে বলল,” অসভ্য লোক।”

ঘরে এসে সর্বপ্রথম দেয়াল থেকে ঘড়িটা নামাল সে। ব্যাটারি খুলে ফেলল। এবার শান্তি লাগছে। টিকটিক শব্দটা আর নেই। কিন্তু মনটা দপ করে খারাপ হয়ে গেল তার। অতিরিক্ত নিস্তব্ধতার কারণে এখন আরও ঘুম আসছে না। উষসীর খুব মন চাইছে ইয়ামিনের কণ্ঠে একটা গান শুনতে। আগে সে নেশাগ্রস্তের মতো ইয়ারফোন কানে গুঁজে গান শুনতো। সেই ভয়ংকর নেশা এখনও কাটেনি।

হঠাৎই পাশের রুম থেকে শব্দ ভেসে এলো। ইয়ামিন গাইছে,” এখন অনেক রাত, তোমার কাঁধে আমার নিশ্বাস… আমি বেঁচে আছি তোমার ভালোবাসায়! ছুঁয়ে দিলে হাত, আমার বিদ্ধ বুকে তোমার মাথা চেপে ধরে টলছি কেমন নেশায়…”

উষসী মৃদু হাসল৷ ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে এখন। বহুদিন পর আবার সেই শান্তির ঘুম।

____________

উষসী এমনভাবে খাচ্ছে যেন সে বহুদিনের ক্ষুধার্ত। ইয়ামিন মনোযোগ দিয়ে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। হঠাৎ বলল,” আস্তে খাও উষু, খাবার কেউ নিয়ে যাচ্ছে না।”

আয়শা হেসে উঠল এই কথায়। উষসী গরম চোখে তাকাল,” আমি কিভাবে খাবো সেটা আমার ব্যাপার। আপনাকে দেখতে কে বলেছে?”

” তোমার শরীর কিন্তু আগের চেয়ে অনেক ভারী হয়ে যাচ্ছে।”

” আপনি কি আমাকে মোটা বলছেন?”

উষসী রেগে তাকাল। ইয়ামিন হাসল,” হ্যাঁ বলছি৷ কিন্তু তোমাকে এভাবেই ভালো লাগে। বেবি হওয়ার পরও তুমি এরকমই থেকো। স্লিম হওয়ার কোনো দরকার নেই।”

” সেটা আমার ব্যাপার। আমি বুঝবো যে আমি কিভাবে থাকব। আপনাকে ভাবতে হবে না।”

তারপর বিড়বিড় করে বলল,” বয়েই গেছে উনার জন্য মোটা হতে। তারপর আমাকে দেখতে বাজে লাগলে ফ্যান গার্লদের নিয়ে ফূর্তি করে বেড়ানোর জন্য?”

” কি বললে তুমি?”

” কিছু না।

ইয়ামিন জরুরী গলায় বলল,” শোনো, আমাকে কিছুদিনের জন্য স্টেটের বাইরে যেতে হবে। মিডিয়ায় আমার খুব ক্লোজ একজন ফ্রেন্ড অসুস্থ। সে আমার সাথে দেখা করতে চায়।”

” ও।”

” শুধু ও? তুমি কিছু বলবে না?”

” আমি আবার কি বলব?”

” মানে তুমি আমাকে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছো?”

উষসী অবাক হয়ে বলল,” আমি অনুমতি না দিলে কি আপনি যাবেন না?”

” অফকোর্স না।”

উষসী এবার হেসে বলল, ,” আপনার ইচ্ছা। আমি এই ব্যাপারে অনুমতি দেওয়ার কে? এমনিতেও মানুষ ভাবছে আমার জন্য আপনি গান ছেড়ে দিয়েছেন। এখন যদি বাড়ি থেকে বের হওয়াও বন্ধ করে দেন তাহলে নিশ্চিত সবাই ভাববে আমি আপনাকে কালোজাদু করেছি। হাহাহা!”

ইয়ামিন বলল,” তুমি কি এটাও জানতে চাইবে না যে আমি কাকে দেখতে যাব?”

” না, সেটা দিয়ে আমার কি কাজ? তাছাড়া আপনি তো বললেনই আপনার ক্লোজ ফ্রেন্ড। এর বেশি আমি জেনে আর কি করব?”

” আমি কীর্তির কথা বলছি।”

উষসী একটু থামল। কীর্তি মানে ইয়ামিনের প্রাক্তন। একসময় যার ছবি দেখলেও ঈর্ষায় পুড়ে যেতো সে। এখনও তাই হয়। কিন্তু এখন উষসী নিজের অনুভূতি লুকাতে জানে। সে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বলল,” ও আচ্ছা। তাহলে তো আপনার অবশ্যই তাকে একবার দেখতে যাওয়া উচিৎ। ”

” তুমি শিউর?”

” হুম, শিউর। তাছাড়া আমাদের এমনিতেও ডিভোর্স হবে। তাই আপনার ব্যাপারে আমার কিছু যায়-আসা উচিৎ না।”

” সবসময় ডিভোর্সের কথাটা না বললে কি হয় না?” ইয়ামিন ধাক্কা মেরে টেবিলের পাশের বড় ফ্লাওয়ার বাজটা ভেঙে ফেলল।

আয়শা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো,” কি হয়েছে স্যার?”

উষশী ঠোঁটে মুচকি হাসি এঁটে বলল,” তেমন কিছু না৷ তোমার স্যারের মাথা গরম হয়ে গেছে। উনাকে বরফ দিয়ে এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত দাও।”

উষসী তার ঘরে চলে এলো। আর ইয়ামিন রেগে-মেগে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। সারাদিন আর ফিরল না।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। একটু পর আয়শা লেবুর শরবত নিয়ে ঢুকল। উষসী সেই শরবত খ্যাক করে ফেলে দিয়ে বলল,” এতো টক কেন হয়েছে? এটা খাওয়া যায় নাকি? চিনি তো মনে হয় এক দানাও দাওনি।”

আয়শা বলল,” ম্যাডাম আপনিই না মোটা হয়ে যাচ্ছেন বলে চিনি দিতে নিষেধ করেছেন? সেজন্যই তো আমি চিনির জায়গায় লবণ দিয়েছি। ”

উষসী তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে বলল,” আমার সামনে থেকে যাও। আর কখনও আমার জন্য শরবত বানাবে না তুমি। গেট লস্ট।”

আয়শা ভ্যাবাচেকা খেয়ে দ্রুত বিদায় হলো। উষসী নিজেও বুঝতে পারল না কেন এতো রাগ উঠছে তার। ইয়ামিন কীর্তিকে দেখতে যাবে বলে? অসুস্থ মানুষকে দেখতে যাওয়া তো অপরাধ না। কিন্তু অসুস্থ অবস্থায় সে ইয়ামিনকেই কেন দেখতে চাইবে? অন্যের স্বামীকে দেখার এতো শখ কেন তার? ডাইনি যেন কোথাকার!

রাত অনেক হয়েছে। ইয়ামিন এখনও ফিরছে না। তার তো কাল যাওয়ার কথা ছিল। আজকেই চলে গেল না তো আবার? দুশ্চিন্তায় উষসী পায়চারী করতে লাগল এদিক-সেদিক। করিডোরে গাড়ি ব্রেক-এর শব্দ পেতেই দ্রুত ছুটে গেল বারান্দায়। ইয়ামিনকে গাড়ি থেকে নামতে দেখা যাচ্ছে। সে নিশ্চিন্ত হলো। একটু পরেই ইয়ামিন গুটুরগুটুর পায়ে হেঁটে তার ঘরে ঢুকল।

উষসী হকচকিয়ে বলল,” কি ব্যাপার? কিছু বলবেন?”

” হুম, বলব।”

ইয়ামিন দরজা বন্ধ করল। উষসী ভ্রু কুঁচকে তাকাল,” দরজা কেন বন্ধ করলেন? আজব!”

ইয়ামিন এগিয়ে আসতে আসতে বলল,” তুমি আমার বউ৷ তোমার ঘরে এসে আমি দরজা আটকাতেই পারি৷ এজন্য নিশ্চয়ই আমার ফাঁসি হবে না? বলো, ফাঁসি হবে?”

উষসী খেয়াল করল তার গলা শুকিয়ে আসছে। কণ্ঠ থেমে যাচ্ছে। অপ্রস্তুত হয়ে বলল,” কথা বলার জন্য দরজা বন্ধ করা জরুরী না।”

ইয়ামিন তার বাহু টেনে ধরল। তেজ নিয়ে বলল,” অবশ্যই জরুরী। তোমার কাছে জরুরী মনে না হলেও আমার কাছে অনেক বেশি জরুরী।”

” কি আশ্চর্য, আপনি চিৎকার করছেন কেন?”

ইয়ামিন আগের চেয়েও দ্বিগুণ তেজ নিয়ে বলল,”আমি আর সহ্য করতে পারছি না এই দূরত্ব। বার-বার ডিভোর্সের হুমকি দিয়ে তুমি আমাকে পাগল বানিয়ে দিচ্ছো। কেন এমন করছো উষসী? আর কতভাবে শাস্তি দিবে আমাকে? এসব না করে একেবারেই মে-রে ফেলো প্লিজ, কিল মি!”

ইয়ামিন উষসীর দুইহাত নিয়ে নিজের গলায় চেপে ধরল শক্তভাবে। উষসী কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,” প্লিজ ছাড়ুন আমাকে।”

ইয়ামিন করুণ গলায় বলল,”কেন তোমার কিছু যায়-আসে না? সত্যিই কি আমাদের বিচ্ছেদ এতো সহজ? দূরত্ব কি তোমার জন্য এতোই আনন্দের? কিভাবে এতোটা নিষ্ঠুর হলে তুমি? আমাকেও শেখাও প্লিজ। আমার দম বন্ধ লাগছে। আমি ম-রে যাচ্ছি। এভাবে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। প্লিজ হেল্প মি আউট।”

” আপনি নিজেই কীর্তির কাছে যেতে চেয়েছেন। এখানে আমি কেন বাঁধা দিবো আপনাকে?”

” কারণ আমি তোমার হাজব্যান্ড৷ ইউ হ্যাভ দ্যা রাইটস। ইউ শ্যুড বি পজিসিভ এবাউট মি। ইউ শ্যুড অউন মি।”

” না৷ আমি ইচ্ছে করলেই আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে চাইতে পারি না। আপনি কখনোই সাধারণ ছিলেন না। সেলিব্রিটি আপনি৷ আমি আপনাকে নিজের দখলে রাখতে পারি না।”

” কিন্তু আমি চাই। আমি তোমার দখলে থাকতে চাই। তুমি প্রশ্ন করেছো না কেন গান ছেড়েছি? কারণ আমি শুধু তোমার জন্য গান গাইতে চাই। আমার সবকিছু শুধু তোমার। তোমার ব্যক্তিগত। এভাবে নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছি তাও কেন তুমি গ্রহণ করতে চাইছো না? প্লিজ, বি মাই টিউন। আই উইল বি ইউর ওয়ার্ডস।”

উষসীর বাম চোখ থেকে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। ঝিম ঝরা কণ্ঠে বলল,” এর মানে শুধু আমার জন্যই গান ছেড়েছেন আপনি?”

” তুমিই একবার বলেছিলে, আমি যদি সাধারণ কেউ হতাম তাহলে আমাদের ছোট্ট একটা বাড়ি হতো, ছিমছাম সংসার হতো। তুমি সেই সংসারে বেশি সুখে থাকতে। একটা বিলাসবহুল জীবনের চেয়েও ভালোবাসাময় সাধারণ জীবন তুমি বেশি প্রেফার করেছিলে। আমি তো সেটাই করছি উষসী৷ তাহলে কেন তুমি আমাকে মানতে পারছো না এভাবে?”

” আমার নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। আমার জন্য আপনার স্বপ্ন শেষ হবে…”

ইয়ামিন উষসীর ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরে বলল,” আমার সবচেয়ে বড় স্বপ্ন তুমি। তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি এমন হাজারটা স্বপ্ন ছেড়ে দিতে পারি। কিন্তু সেটা তুমি বিশ্বাস করলে তো?”

” আপনি ছেলেমানুষী করছেন। ম্যাচিউর মানুষ কখনও এভাবে চিন্তা করে না।”

” আমি ম্যাচিউর হতে চাই না। আমি শুধু তোমাকে চাই। আই লভ ইউ উষসী।”

ইয়ামিন প্রচন্ড পিপাসা নিয়ে উষসীর ঠোঁটে চুমু দিতে শুরু করল। একপা, দুপা করে পিছিয়ে যেতে লাগল উষসী। দেয়ালে পিঠ ঠেঁকে গেল। ইয়ামিন তাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরল শক্ত করে। তীব্র স্পর্শে চুমু দিল গলার ওই কালো তিলে। উষসী চোখ বন্ধ করে বলল,” আমার ভালো লাগছে না। যান এখান থেকে। ”

ইয়ামিন আসক্ত কণ্ঠে শুধাল,” যদি না যাই?”

” তাহলে আপনার নামে মেরিটাল রেইপের কেইস করব আমি।”

কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। ইয়ামিনের কান ঝাঁ করে উঠল। বিস্ময়ে মূক হয়ে বলল,” হোয়াট?”

” ঠিক শুনেছেন। আপনি যদি আমার নামে এবোর্শনের কেইস করতে পারেন তাহলে আমিও আপনার নামে টরমেন্টিং এর কেইস করতে পারি। এটা আপনিই আমাকে শিখিয়েছেন, ইয়ামিন ইব্রাহীম।”

ইয়ামিন অনেকক্ষণ কিছু বলতে পারল না। উষসীকে ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়াল। স্তব্ধীভূত হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বলল,” তুমি এই কথা বলতে পারলে?”

” হ্যাঁ পারলাম। যেভাবে আপনি আমাকে বলতে পেরেছিলেন, সেভাবে আমিও পারলাম।”

ইয়ামিন কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। ক্রমশ তার নাক-মুখ লাল হয়ে উঠল। তারপর আচমকা ড্রেসিংটেবিলের কাছে গিয়ে লাথি মেরে আয়না ভেঙে ফেলল। উষসী ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেল। ইয়ামিন থামল না। শোপিস স্ট্যান্ডের কাছে গিয়ে সমস্ত কাঁচের জিনিস টেনে ফেলতে লাগল। বিছানার চাদর উল্টে ফেলল। বালিশগুলো ছুঁড়ে মারল। মুহূর্তেই পুরো ঘরটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো। উষসী এক কোণায় দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিল আবেগশূন্য দৃষ্টিতে।

ইয়ামিন বের হতে নিয়েও ফিরে এলো আবার। উষসীর সামনে দাঁড়িয়ে বলল,” আর কখনও তোমার সামনে আসব না। আই প্রমিস, ইউ উইল নেভার সি মাই ফেইস এগেইন।”

উষসী কিছু বলল না৷ ইয়ামিন চলে গেল। পরদিন একপ্রকার জেদ করেই সে এয়ারপোর্টে রওনা হলো। কীর্তিকে দেখতে যাওয়া শুধুই বাহানা মাত্র। আসলে সে রাগ করে চলে যাচ্ছে, এটা উষসী নিজেও বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু সে বাঁধা দেয়নি।

সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপারটা ঘটল সন্ধ্যায়।বিমান দূর্ঘটনার খবর দেখে আয়শা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো,” ভাবী, সর্বনাশ করেছে। আমি মাত্র খবরে দেখেছি ভাবী। স্যার যেই বিমানে উঠেছিল সেটা ক্র্যাশ হয়ে গেছে।”

উষসীর প্রথমে মনে হলো, এটাও একটা নাটক। কারণ কথায় কথায় নাটক সাজানোই ইয়ামিনের স্বভাব। কিন্তু ঘণ্টাখানেক পরেই বাড়িতে পুলিশ এলো। ডেডবডি শনাক্তকরণের জন্য উষসীকে হাসপাতালে যেতে হবে৷ এই কথা শোনা মাত্রই সে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলল।

চলবে

আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-৪৮

0

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৪৮
লিখা- Sidratul Muntaz

প্রেগন্যান্সির সময় কি মেয়েরা বেশি সুন্দর হয়ে যায়? উষসীকে আজ-কাল দেখতে একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। সকালে সে গোসল সেরে বারান্দায় চুল ঝারছিল, তখন ইয়ামিন বাগানের একপাশে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। স্বাস্থ্য কিছুটা বেড়ে যাওয়ার কারণে মুখটা ফোলা দেখায়। গাল দু’টো টসটসে লাল হয়ে থাকে সবসময় এতো মায়াবী লাগে দেখতে! হঠাৎ উষসী নিচে তাকাতেই ইয়ামিন দ্রুত সরে গেল। যেন চোর ধরা পড়ে গেছে। উষসী অবশ্য তা খেয়াল করল না। ইয়ামিন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। নিজের স্ত্রীকে দেখার জন্যেও কত লুকোচুরি করতে হচ্ছে। কি কপাল তার! একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে ঘরে ঢুকল।

দুপুরের রান্নাটা ইয়ামিন নিজের হাতেই করল। দীর্ঘদিন বিদেশে একা থাকার সুবাদে রান্না করার অভ্যাস তার আছে। রাতে উষসী মোমো স্যুপ খেতে চেয়েছিল। ইয়ামিন ঠিক করেছে নিজের হাতেই রান্নাটা করবে। উষসী ঝাল খেতে খুব পছন্দ করে৷ তাই অনেক বেশি ঝাল দিতে হবে৷ রান্না-বান্নার পর্ব শেষ করে ইয়ামিন বাইরে চলে গেল। ফ্রীজের খাবার সব শেষ হয়ে গেছে। উষসী আজ-কাল অনেক বেশি খাওয়া-দাওয়া করছে। তিনজনের খাবার সে একাই খেয়ে নিতে পারে। তাই ইয়ামিন উষসীর পছন্দের সব খাবার এনে ঘর ভরে রাখে।

দুপুরে খেতে বসে উষসী মুগ্ধ হয়ে গেল। এতো ভালো রান্না! ঝালটাও একদম পারফেক্ট হয়েছে। অনেক দিন পর খেতে বসে চোখে পানি চলে এসেছে। উষসী তৃপ্ত কণ্ঠে বলল,” রান্না খুব ভালো হয়েছে আয়শা। তুমি এতো মজা করে স্যুপ রান্না শিখলে কোথা থেকে? ”

” সত্যি ভালো লেগেছে ম্যাডাম?”

” হুম। আসলেই অনেক টেস্ট হয়েছে। এটা আবার রান্না করো৷ আমি রাতেও খাবো। ইশ, ইচ্ছে তো করছে সব আমি একাই খেয়ে ফেলি।”

“একাই খান ম্যাডাম। স্যার তো ঝাল খান না। সব আপনার জন্যই।”

” সত্যি?” উষসী আনন্দিত হয়ে প্যানের সবটুকু স্যুপ বাটিতে ঢেলে নিল। তাকে এতো আরাম করে খেতে দেখে আয়শা মুখ ফসকে বলেই ফেলল,” আজকে কিন্তু স্যুপ আমি রাঁধিনি ম্যাডাম। স্যার রান্না করেছেন। এজন্যই এতো মজা হয়েছে। আপনার টেস্ট স্যারের চেয়ে ভালো আর কে বুঝবে?”

উষসীর খাওয়া থেমে গেল। চোখমুখ শক্ত করে বলল,” তুমি এই কথাটা এতোক্ষণে কেন বললে?”

আয়শা সামান্য ঘাবড়ে গেল। আপস্টেয়ার থেকে উষসীর খাওয়ার দৃশ্য দেখছিল ইয়ামিন। কিন্তু আয়শার কথা শোনার পর সেও হকচকিয়ে গেল। এই মেয়ের জীবনে শিক্ষা হবে না। সবসময় সে ইয়ামিনকে ধরা খাওয়াবেই। কি দরকার ছিল এই কথা বলার?

” তাতে কি হয়েছে ম্যাডাম? স্যার কি আপনার জন্য রান্না করতে পারে না?”

” আমি কি তাকে একবারও বলেছি আমার জন্য রান্না করতে? তার রান্না করা জিনিস আমি খাবো এটা সে ভাবল কি করে? আমি খাবো না এই স্যুপ। এটা এখন আমার জন্য বিষ। ”

উষসী একবার উপরে তাকাল। ইয়ামিন অসহায়ের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। আয়শার চেহারায় অপরাধী ভাব। সে বিরাট ভুল করেছে। ইশ, কোনোভাবে যদি ভুলটা মুছে ফেলা যেতো! উষসী প্লাস্টিকের ব্যাগ নিল। সেই ব্যাগে স্যুপ ঢেলে, ব্যাগের মুখ বেঁধে সেটা ডাস্টবিনে ফেলে দিল। আয়শা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,” এটা কি করলেন ম্যাডাম? কি করলেন?”

উষসী উপরে দিকে চেয়ে কঠিন স্বরে বলল,” এখন থেকে আমার জন্য আর কাউকে রান্না করতে হবে না। নিজের রান্না আমি নিজেই করে খেতে পারি।”

এই কথা বলে নিজের ঘরে ঢুকে শব্দ করে দরজা আটকে দিল সে। আয়শা টলমল দৃষ্টিতে বলল,” স্যরি স্যার, আমি বুঝতে পারিনি যে ম্যাডাম এতো রেগে যাবে।”

ইয়ামিন হতাশ হয়ে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। একটা মানুষ এতো জেদি কি করে হতে পারে? অবশ্য গর্ভাবস্থায় নাকি এসব নরমাল। সে শুনেছিল এই সময় মেয়েদের ঘন ঘন মুড সুয়িং হয়৷ তাই ব্যাপারটা নিয়ে খুব বেশি ভাবল না ইয়ামিন। ধৈর্য্য ধারণ করল। সেও তো একসময় উষসীকে অনেক কষ্টে রেখেছিল।

মাঝরাতে ক্ষুধায় ঘুম ভেঙে গেল। এই রাতের বেলা হঠাৎ চীজকেক খেতে ইচ্ছে করছে কেন সে বুঝতে পারছে না। আশ্চর্য ব্যাপার! উষসী রুম থেকে বের হয়ে কিচেনে এলো। ঠান্ডা পানি নেওয়ার উদ্দেশ্যে ফ্রীজ খুলতেই দেখল ফ্রীজে এত্তোবড় একটা চীজকেক। উষসী হতভম্ব হয়ে গেল। মুখে উচ্ছল হাসি ফুটল। সে চীজকেক খেতে পছন্দ করে এটা তো ইয়ামিন জানে৷ সেজন্যই হয়তো আনিয়ে রেখেছে। মনে মনে সে অসম্ভব কৃতজ্ঞতাবোধ করল। কিন্তু এটা ইয়ামিনকে কোনোভাবেই বুঝতে দেওয়া চলবে না।

উষসী ছু/রি দিয়ে একপিস কেক কাটল। সেটা দেখে তার মন ভরল না। তাই গোটা কেকটাই প্লেটে তুলে নিল। খেতে খেতে তার মনে হচ্ছিল এতো মজার কেক জীবনেও খায়নি। আচমকা পেছন থেকে কেউ বলে উঠল,” সাবধানে খাও। গলায় আটকাবে তো।”

উষসী বিষম খেল। সত্যি তার গলায় খাবার আটকে গেল। জোরে কাশতে লাগল সে। ইয়ামিন পানি এগিয়ে দিল। তার হাসিমুখ দেখে উষসী লজ্জায় পড়ে গেল। সে ইয়ামিনের হাত থেকে পানির গ্লাস নিল না। নিজেই পানি ঢেলে খেল। ইয়ামিন তার পাশের চেয়ারে বসল। গালে হাত রেখে বলল,”তোমাকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছিল… চুরি করে কেক খাওয়ার সময়।”

উষসী কটমট করে তাকাল। তারপর হঠাৎ হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে সরাসরি ছুঁড়ে মারল ইয়ামিনের মুখে৷ তার এহেন আচরণে বিস্মিত ইয়ামিন। হতবাক হয়ে বলল,” নিজের দোষে ধরা খেয়েছো, সেই রাগও আমার উপর ঝারবে নাকি?এটা কেমন বিহেভিয়ার?”

উষসী বিড়বিড় করে বলল,” ফাজিল।”

সে রেগে-মেগে উঠে চলে যেতেই নিচ্ছিল, তখনি গিটারের টিউন বেজে উঠল। উষসীর পা স্বয়ংক্রিয়ভাবে থেমে গেল। পেছন ফিরে সে বিহ্বল হয়ে দেখল ভেজা চুল আর ভেজা মুখ নিয়েই ইয়ামিন হাসছে। তার দৃষ্টিতে অনুরাগ। হাত দিয়ে গিটারে সুর তুলছে অবলীলায়। হঠাৎই গাঢ় কণ্ঠে গেয়ে উঠল,

” দেখো, দেখো রাঙানো যে লালে তোমার ওই গালে… জমেছে কত না রাগ!

জানি মাফ করবে না, জানি জানি! তুমি অভিমানী, তবু দাও না আমায় এক ভাগ!”

তারপর সে উঠে দাঁড়ালো। হেঁটে আসতে আসতে গাইল,” তুমি বলো,’ দেবো না তোমায় পড়েছি কি দায় বলো জানো তুমি জানো কি?’

আমি বলি,’ যদি দূরে যাই, তোমায় ভুলে যাই, বাসবে ভালো তখনও কি?’

এবার সে কাছে এসে উষসীর কোমড় জাপটে ধরল। তাকে ঘুরিয়ে এনে চোখে চোখ রেখে ডান্স করতে লাগল। উষসী এতো অবাক হলো যে বাঁধাও দিতে পারল না। কিন্তু হুশ ফিরতেই সে ইয়ামিনকে সজোরে ধাক্কা মারল। ইয়ামিন গিটার হাতে নিয়ে আবার গাইতে লাগল,” তোমায় শোনাবো আমি গান, শোনো পেতে কান, কোরো না অভিমান আর।”

এটুকু গেয়েই সে কাছে এলো পুনরায়। উষসীকে জড়িয়ে ধরল। ধীর কণ্ঠে আবার গাইল,”জানি এ মনেরই ফুল, আজ করে ভুল, তবুও আমি শুধু তোমার!”

উষসী ইয়ামিনকে ছেড়ে লিভিংরুমের সোফায় গিয়ে বসল। ইয়ামিন গিটার হাতে নিয়ে বাজাতে লাগল। সেও হেঁটে এলো সোফার কাছে। উষসীর পাশে বসল। গানের সুরে বলল,” দেখো দেখো এসেছি তো কাছে, তোমারই পাশে, তবু কেন এতো অভিমান?”

উষসী দূরে গেল। ইয়ামিন আরও কাছে এলো। উষসী আরও দূরে যেতে নিলেই সে হাত টেনে ধরল। উষসীর মুখটা দুইহাতে নিল। তৃষ্ণার্তের মতো তার চোখ স্পর্শ করল। তারপর আবারও গান গাইতে লাগল,” ভেজা ভেজা চোখ, কেঁদে আঁকা মুখ, তবুও দাও না আমায় এক ভাগ! তুমি বলো,’ দেবো না তোমায় পড়েছি কি দায় বলো জানো তুমি জানো কি?’

আমি বলি, যদি দূরে যাই, তোমায় ভুলে যাই, বাসবে ভালো তখনও কি?”

উষসী উঠে দাঁড়িয়ে গেল। ইয়ামিন দরাজ গলায় বলল,” এনাফ উষসী। প্লিজ, আর কত শাস্তি দিবে? এবার অন্তত মাফ করো। আই এম স্যরি! কিভাবে মাফ চাইলে তুমি আমাকে মাফ করবে জানতে পারি?”

উষসী ডাইনিং টেবিলের কাছে গিয়ে ফট করে একটা কাঁচের গ্লাস ভেঙে ফেলল। তার কান্ডে আশ্চর্য হয়ে গেল ইয়ামিন। উষসী ক্রোধমাখা দৃষ্টিতে বলল,” এই গ্লাসটা আগের মতো জোড়া লাগাতে পারবেন আপনি? চেষ্টা করে দেখুন তো! যদি না পারেন… তাহলে আর কখনও ক্ষমা চাইতে আসবেন না আমার কাছে। যেভাবে এই কাঁচের গ্লাস ভেঙেছে তার চেয়েও জঘন্যভাবে আমার মন ভেঙেছেন আপনি। তাও একবার না, বার-বার!”

ইয়ামিন আর কোনো কথা বলার মতো খুঁজে পেল না এবার। উষসী হনহন করে তার ঘরে চলে গেল। আর ইয়ামিন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল অপরাধীর মতো।

পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট করতে এসেই উষসী একটা সারপ্রাইজ পেল। টেবিলে খুব সুন্দর করে তার প্রিয় লাল গোলাপ সাজিয়ে রাখা হয়েছে। একটা দারুণ ফ্লাওয়ার টবের উপর ফুলগুলি দেখতেও দারুণ লাগছে। সে হাতে নিয়ে টবটি নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল৷ রংতুলি দিয়ে চমৎকারভাবে আঁকা হয়েছে অপূর্ব নকশা। সে মুগ্ধ কণ্ঠে বলল,” ওয়াও, এটা কে এনেছে আয়শা?”

আয়শা টোস্টে মাখন লাগাতে লাগাতে বলল,” এটা হাতে বানানো জিনিস ম্যাডাম। সকালে স্যারকে দেখলাম ভাঙা গ্লাসের টুকরা দিয়ে কি যেন করছেন। আমি তো চেয়েছিলাম ফেলে দিতে। কিন্তু স্যার বললেন সব জিনিস ভেঙে গেলেই ফেলে দিতে হয় না। মন থেকে চেষ্টা করলে ভাঙা জিনিস দিয়েও অনেক সুন্দর কিছু তৈরী করা যায়। দেখেন, এখন গ্লাসটা দেখতে আগের চেয়েও অনেক সুন্দর লাগছে না? আপনি কি বুঝেছিলেন যে এই সুন্দর টবটা ভাঙা গ্লাস দিয়ে বানানো হয়েছে?”

উষসী নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল। না, সে একদম বুঝতে পারেনি যে এই সুন্দর ফুলের টব সেই ভাঙা গ্লাস দিয়ে তৈরী করা হয়েছে।

চলবে

আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-৪৬+৪৭

0

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৪৬
লিখা- Sidratul Muntaz

স্বয়ংক্রিয় ঘুম ছুটে যেতেই উষসী খেয়াল করল সে ইয়ামিনের ব্যান্ডেজ বাঁধা হাতের উপর ভর দিয়ে শুয়ে আছে। ইশ, এতোবড় ভুল কিভাবে হলো? আর ইয়ামিনও কি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। অন্যহাত দিয়ে উষসীকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। তার কি ব্যথাও অনুভব হচ্ছে না? খুব সাবধানে ইয়ামিনের হাতের উপর থেকে শরীরের ভর সরিয়ে উঠে বসল সে।

ইয়ামিন একটু নড়ে উঠল। মোবাইল হাতে নিতেই উষসী দেখল মিসেস শিমলার টেক্সট। তিনি এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করেছেন দশমিনিট হবে। এক থেকে দেড়ঘণ্টার মধ্যেই চলে আসবেন। হাতে বেশি সময় নেই। আয়শা কি ঘুম থেকে উঠেছে? ব্রেকফাস্ট বানাতে হবে। খুব দ্রুত গোসল সেড়ে উষসী তৈরী হয়ে গেল। রাতে ঘুম না হওয়ার কারণে চোখ একটু জ্বালা করছে। নিচে নেমে দেখল কীর্তি নামের মেয়েটি কোথাও নেই।

আয়শা বলল,” উনি চলে গেছেন ম্যাডাম। রাতেই চলে গেছেন। তার কোন আত্মীয়র বাসায় নাকি থাকবে।”

উষসী হাঁফ ছাড়ল। ভালোই হয়েছে যে ওই মেয়ে বিদায় হয়েছে। এখানে থেকে সে কি করতো ইয়ামিনকে উষ্কানো ছাড়া? অদ্ভুত মেয়ে মানুষ। গতরাতে উষসী না এলে কি হতো? সে কি এখানেই থেকে যেতো? সর্বনাশ! ভাগ্যিস উষসী ঠিক সময় এসেছিল।

আয়শা বলল,” বড় ম্যাডাম তো আসছে ম্যাডাম।”

” হ্যাঁ। একটু আগেই আম্মুর টেক্সট দেখলাম। সেটাই তোমাকে বলতে এসেছি। মায়ের পছন্দের ব্রেকফাস্ট বানাবো। আলু পরোটা বানালে কেমন হয়?”

” দারুণ হয় ম্যাডাম।”

” ঠিকাছে, তুমি সব রেডি করো। আমি আসছি।”

” ম্যাডাম, অসুস্থ শরীর নিয়ে আপনার রান্না করার কি প্রয়োজন? আমিই পারব।”

” সমস্যা নেই। আমি নিজের হাতে রান্না করতে চাই। আম্মু প্রথম এই বাড়িতে আসছে।”

” ঠিকাছে ম্যাডাম।”

ইয়ামিন এখনও বেহুশের মতো ঘুমাচ্ছে। উষসীর মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চাপল। ভেজা চুলের পানি আলতো করে ইয়ামিনের চোখেমুখে মেখে দিল। বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকালো ইয়ামিন। ঘুমো ঘুমো অসন্তুষ্ট গলায় বলল,” আরে, কি সমস্যা?”

উষসী খুব আদুরে গলায় বলল,” ওঠো না, জান!”

ইয়ামিন চোখ মেলে চাইল। উষসী খিলখিল করে হেসে উঠল। এক চোখ বন্ধ রেখে অন্য চোখ খোলা রেখে ইয়ামিন আগ্রহের সহিত প্রশ্ন করল,” কি বললে?”

উষসীর হাসির বেগ বাড়ল। লাজুক গলায় বলল,” ওঠো, ওঠো, আম্মু চলে আসছে। ফ্রেশ হয়ে নাও। আম্মুকে রিসিভ করতে যাবে না?”

ইয়ামিন বিশ্বাস করতে পারছে না। এই প্রথম উষসী তাকে “তুমি” করে বলছে। সে উষসীর হাত টেনে ধরল। গভীর কণ্ঠে বলল,” একটু আগে যেটা বললে, সেটা আরেকবার বলো। নাহলে উঠবো না”

উষসী আলতো গলায় বলল,” ওঠো না জান।”

ইয়ামিন মুচকি হেসে আওড়াল,” শুনিনি। আরেকবার।”

উষসী কপালে হাত ঠেঁকাল। সরু কণ্ঠে আওড়াল,” উফ আল্লাহ! জান, ঘুম থেকে ওঠো। হয়েছে?”

ইয়ামিন হাত টেনে তাকে কাছে এনে জড়িয়ে ধরল। ফিসফিসিয়ে বলল,” আরও একবার।”

” উফ, ওঠ শালা!”

ইয়ামিন হতভম্ব হয়ে উচ্চারণ করল,” হোয়াট?”

উষসী হাসতে হাসতে বলল,” ছাড়ুন। উঠুন এবার।”

” আগেরটাই তো ভালো ছিল৷ আবার আপনি কেন?”

” উফ, আপনি এতো ঢং করলে আমি ইজি হবো কিভাবে?”

ইয়ামিন কয়েক মুহূর্ত উষসীর মুখের দিকে চেয়ে থেকে শুধাল,” এতো সুন্দর লাগছে কেন? এই, তুমি কি গোসল করেছো?”

” হুম।”

” এতো দ্রুত কেন? কয়টা বাজে?”

” সকাল দশটা বেজে গেছে। আর আপনি বলছেন দ্রুত?”

“থাক, ব্যাপার না। আবার করবে।”

” মানে? কি আবার করব?”

” গোসল!”

অকপটে এই কথা বলেই উষসীর নাকে, ঠোঁটে আলতো চুমু দিল ইয়ামিন। উষসীর চোখ বড় হয়ে গেল। সজোরে, সবেগে ইয়ামিনকে ধাক্কা মারল সে। তিরিক্ষি স্বরে বলল,” অসম্ভব! সারারাত একফোঁটাও ঘুম হয়নি। এমনিতেও খুব ক্লান্ত আমি৷ এখন আবার আপনি বাজে মতলব আঁটছেন?”

” আউ…” ইয়ামিন কুঁকিয়ে উঠল ব্যথায়। ভুল করে তার ব্যান্ডেজের হাতে আঘাত করে ফেলেছে উষসী। নরম গলায় বলল,” আহা, বেশি ব্যথা পেয়েছেন?”

” হুম।”

” আমার খেয়াল ছিল না। স্যরি।”

” এতো মিষ্টি করে স্যরি বললে কোনো ব্যথাই ব্যথা মনে হয় না।”

ইয়ামিন অন্যহাত দিয়ে উষসীর কোমড় জড়িয়ে ধরল। তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে আতঙ্কিত হলো উষসী। দরজার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল,” আয়শা, এখানে কেন এসেছো?”

ইয়ামিন সত্বর উষসীকে ছেড়ে দরজার দিকে তাকাল। এই ফাঁকে বিছানা ছেড়ে নেমে দৌড়ে বাইরে চলে গেল উষসী৷ হাসতে লাগল শব্দ করে। ইয়ামিন উঠতে নিয়েও উঠতে পারল না। মনে পড়ল তার পায়ে ব্যান্ডেজ। এই নাটক তাকে আরও কিছুদিন চালিয়ে যেতে হবে। আফসোস!

সিঁড়ির গোঁড়ায় এসে থামল উষসী৷ হাসতে হাসতে চোখে পানি এসে গেছে। কাউকে বোকা বানালে এতো মজা হয়? আজকে উষসীর মনটা খুব ভালো। হাওয়ায় ভাসতে ইচ্ছে করছে সারাক্ষণ। ধীরুপায়ে রান্নাঘরের দিকে এগুলো সে। আয়শাকে ব্রেকফাস্টের জন্য সব রেডি করতে বলা হয়েছিল৷ তার কাজ কতদূর এগিয়েছে?

লিভিংরুমের কাছাকাছি আসতেই চলার গতি স্বয়ংক্রিয় স্থবির হয়ে এলো তার। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে আয়শার হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠ,” না অনম ভাই। স্যারের আসলেই কিছু হয়নি৷ ভাবী রাগ করে বাড়ি থেকে চলে গেছিল। এক্সিডেন্টের খবরটা না শুনলে কিছুতেই আসতো না৷ সেজন্য স্যার এতোবড় কান্ড করেছেন। আপনাকেও জানানো নিষেধ ছিল। কিন্তু আপনি দূর থেকে টেনশন করছেন বলে জানালাম। কিছু চিন্তা করবেন না। স্যারের কোনো এক্সিডেন্টই হয়নি আসলে।”

উষসীর মুখের হাসি উবে গেল চকিতে। চোখ টলমল করে উঠল অচিরেই। নিজের কানকে বিশ্বাস হলো না। বুকের উপর অসহনীয় একটা চাপ অনুভব করল। সেই চাপ আরও এক ধাপ বাড়ল যখন আয়শা বলল,” হ্যাঁ। স্যার নাটক করেছেন। নাহলে তো ভাবি এতো দ্রুত বাড়ি ফিরতেন না৷ রাতে ভাবিকে দেখে আমি যে কি খুশি হয়েছিলাম..।”

চোখের কোণ ঘেঁষে এবার অশ্রু ফেটে বেরিয়েই এলো উষসীর। রাগে রিরি করতে লাগল সমগ্র গা। ক্রোধে আগ্রাসী ঝড়ের মতো সে ওপরে উঠতে লাগল সিঁড়ি ভেঙে। বিরবির করে বলল,” এতোবড় প্রতারণা! আপনি আবারও আমার সাথে প্রতারণা করলেন? যতবার আমি ভাবি যে এইবার আপনাকে বিশ্বাস করব, ততবারই আপনি আমার মন ভেঙে দেন৷ এতো নীচ আপনি, এতো বাজে! এইভাবে আমার ইমোশন নিয়ে খেলা করলেন?”

বিছানায় পুনরায় গা এলিয়ে দিয়েছে ইয়ামিন৷ দুই চোখ বন্ধ তার। উষসী হিংস্র দৃষ্টিতে কিয়ৎক্ষণ তার ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে রইল। কত নিষ্পাপ লাগছে মুখটা। এই চেহারার দিকে চেয়ে কে বলবে যে এই মানুষটা কতবড় মিথ্যুক আর নাটকবাজ হতে পারে! হঠাৎ ক্ষুব্ধ স্বরে চেঁচাল উষসী,” উঠুন।”

ইয়ামিন থতমত খেয়ে উঠল,” কি ব্যাপার?”

উষসী ইয়ামিনের ব্যান্ডেজে বাঁধা হাতটা ধরে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁকিয়ে বলল,” অনেক নাটক হয়েছে। এবার বন্ধ করুন এসব।”

” মানে?”

” একদম মানে মানে করবেন না। কাল সারাটা দিন কত দুশ্চিন্তায় কাটিয়েছি আমি তার কোনো ধারণা আছে আপনার? এতোবড় নাটক কিভাবে করলেন? ছি! সব ভাণ।দেখি, ব্যান্ডেজ খুলুন। আপনার কোন কোন জায়গায় ব্যথা আমি দেখব।”

উষসী টেনে ইয়ামিনের মাথার ব্যান্ডেজ খুলতে শুরু করল। খুব হকচকিয়ে আস্তে-ধীরে উঠে বসল ইয়ামিন। উষসী কিভাবে বুঝল? কে বলেছে তাকে? আয়শা? মুখ পাতলা মেয়েটার পেটে একটা কথা যদি থাকতো! শিট!

উষসী দেখল ইয়ামিন সম্পূর্ণ সুস্থ। কপালে কিছুই হয়নি তার। হাতও ঠিকাছে। আয়শার কথাই সম্পূর্ণ ঠিক। নকল ব্যান্ডেজ লাগিয়ে সারারাত ভাণ করেছে সে। সন্দেহ করলেও মনে মনে উষসী চাইছিল এসব যাতে সত্যি না হয়। কিন্তু ঠিকই সত্যি হলো। ক্রোধে উন্মাদের মতো আবারও চেঁচিয়ে উঠল উষসী। ইয়ামিন তার দুই হাত ধরে কাতর গলায় বলল,” শান্ত হও প্লিজ৷ বসো, আমার কথা শোনো।”

উষসী ইয়ামিনের গালে চড় মাড়ল। চোখমুখ থেকে ঠিকরে আগুন বের হচ্ছে তার। উত্তপ্ত কণ্ঠে বলল,” আজ থেকে আমাদের মধ্যে সব সম্পর্ক শেষ। আমি ঘৃণা করি আপনাকে। আপনার মতো মিথ্যাবাদীর সাথে আমার কোনো কথা নেই।”

উষসী হড়বড় করে বের হয়ে যেতে নিচ্ছিল। ইয়ামিন তার পথরোধ করে দাঁড়াল। উষসী ক্ষীপ্ত হয়ে বলল,” আমার সামনে থেকে সরুন। নাহলে সত্যি সত্যি আপনার পা ভাঙব আমি।”

” আমার পা ভেঙে যদি তুমি শান্তি পাও তাহলে তাই করো। ”

” আর একটাও ফালতু কথা শুনতে চাই না। আমার সামনে থেকে সরে দাঁড়ান। আপনার চেহারাও আমি দেখতে চাই না। আই হেইট ইউ।”

ইয়ামিন সর্বোচ্চ শক্তিতে চেপে ধরল উষসীর বাহু। ঘাবড়ে তাকাল উষসী। দাঁত দাঁত চিবিয়ে ইয়ামিন রাগান্বিত গলায় বলল,” এতো সহজে আই হেইট ইউ বলে দিচ্ছো? তাহলে কাল সারারাত কি ছিল? ভালোবাসা না থাকলে কেন এতো আদর করলে আমাকে? কেন পাগলের মতো ছুটে এসেছো? বলো? এখন তুমি বললেই আমি বিশ্বাস করব যে তুমি ভালোবাসো না? প্রমাণ তো আমি পেয়েই গেছি। তুমি শুধু আমাকেই ভালোবাসো, পাগলের মতো ভালোবাসো। ”

ইয়ামিনের কণ্ঠে আত্মগৌরব। উষসী হতাশ স্বরে বলল,” আমার মন নিয়ে খেলেছেন আপনি। সবসময় প্রতারণা করেছেন। আফসোস!”

“উপায় ছিল না কোনো। পনেরো দিন ধরে তোমার দেখা পাচ্ছিলাম না। এ ছাড়া আর কি করতাম আমি বলো? কি করলে তুমি খুশি হতে?”

” তাই বলে মিথ্যা বলবেন? এতোবড় নাটক করবেন?”

উষসী চিৎকার দিয়ে উঠল। ইয়ামিন শান্ত গলায় বলল,” হ্যাঁ। যদি সেটাই একমাত্র উপায় হয় তাহলে অবশ্যই আমি করব। তোমাকে পাওয়ার জন্য সব করব।”

উষসী তাচ্ছিল্য হাসল,” আমাকে পাওয়ার জন্য আমাকেই ঠকাবেন? বাহ, এটা কেমন ভালোবাসা আপনার?”

” আমি তোমাকে ঠকাইনি উষসী। শুধু আমাদের দূরত্ব মেটানোর চেষ্টা করেছি। এই দূরত্ব আর সহ্য হচ্ছিল না, বিশ্বাস করো!”

উষসী ঝারি মেরে বলল,” আর বিশ্বাস করি না আমি আপনাকে। খবরদার, আমার আশেপাশে আসার চেষ্টা আর একবারও করবেন না। আমি আপনাকে আমার ত্রিসীমানায় দেখতে চাই না।”

সে কথা শেষ করে দরজার বাইরে পা রাখার আগেই ইয়ামিনের গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এলো,” খবরদার, এই বাড়ি থেকে বের হওয়ার সাহস দেখিও না। কারণ তুমি চলে যাওয়ার পর আমি দুইটা কাজ করব।”

উষসী থামল। ইয়ামিন এদিকে ফিরে ইস্পাতের মতো কঠিন গলায় বলল,” প্রথমে তোমার নামে এবর্শন কেইস করব। তোমাকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য এই কেইস তোমার পরিবারের বিরুদ্ধেও হতে পারে। তারপর কোর্টে যাবো। কেইসে জিতে তোমাকে আবার এখানেই ফিরিয়ে আনবো। শুধু শুধু তোমার পরিবারের মানুষ হেনস্তা হোক, এটা নিশ্চয়ই চাও না তুমি।”

উষসী ভ্যাবাচেকা খেল। বিস্ময়ে মূক হয়ে বলল,” এবোর্শনের কেইস মানে? আমি বাচ্চা এবোর্ট করব এই কথা আপনাকে কে বলেছে?”

” তুমিই একবার বলেছিলে। সেটার ফোন রেকর্ডিং আমার কাছে আছে। তুমি চলে গেলে এই নোংরা স্টেপটা নেওয়া ছাড়া আমার কাছে অন্যকোনো উপায় থাকবে না উষসী। তাই ভেবে দেখো, কি করবে?”

ইয়ামিন ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। উষসীও তাকিয়ে আছে, তার ঠোঁট কাঁপছে। সামনে দাঁড়ানো মানুষটিকে ভীষণ অচেনা মনে হচ্ছে এখন!

চলবে

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৪৭
লিখা- Sidratul Muntaz

টারমিনাল থেকে বের হতেই এয়ারপোর্টের করিডোরে বড় প্ল্যাকার্ড হাতে ইয়ামিনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। খুব সুন্দর করে প্ল্যাকার্ডে লেখা,” Dear Mom, Welcome.”

শিমলা ছুটে এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। বহুদিন পর একমাত্র ছেলেকে কাছে পেয়ে আপ্লুত হলেন।

ইয়ামিন মায়ের জন্য একতোড়া ডেইজি ফুল এনেছে। শিমলা ডেইজি পছন্দ করেন। ফুল দেখে তিনি আরও আবেগপ্রবণ হলেন। ইয়ামিন মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,” আই মিসড ইউ সো মাচ। কেমন আছো?”

শিমলার চোখ খুশিতে চিকচিক করছিল,” অনেক ভালো আছি বাবা। তোরা কেমন আছিস? ”

“তোমার দোয়ায় অনেক ভালো আছি। বাবা আসেনি?”

” কাজের জন্য আসতে পারেনি। বলেছে তোদের নিয়ে যেতে। আচ্ছা, আমার বউমা কোথায়? উষু আসেনি?”

ইয়ামিন মুখের হাসি একটু ম্লান হলো। সামান্য গম্ভীর গলায় বলল,” ওর শরীরটা ভালো লাগছিল না। তাই আমিই আনিনি।”

” ওহ, থাক ভালো করেছিস৷ এখন তাহলে দ্রুত আমাকে বাড়ি নিয়ে চল। কতদিন মেয়েটাকে দেখি না। উষসীর জন্য আমি অনেক গিফটস এনেছি। ওর তেতুলের আঁচার খুব ফেবারিট। বানিয়ে এনেছি।”

” শুধু ওর জন্যই? আমার জন্য কিছু আনোনি?”

” তোরটা সারপ্রাইজ। বাড়ি গিয়ে দেখাব। ”

ইয়ামিন মিসেস শিমলাকে নিয়ে গাড়িতে ওঠার আগেই হট্টগোল বেঁধে গেল। এয়ারপোর্টে বাঙালি অনেক বেশি। আর আজ-কাল তো ইউটিউবারের অভাব নেই। ধরতে গেলে সবাই সাংবাদিক। ইয়ামিন মাস্ক পরা অবস্থাতেও মানুষ তাকে চিনে ফেলেছে।

একে একে ছুটে এসে সবাই হৈচৈ শুরু করেছে। কয়েকজন অল্প-বয়স্ক ছেলে ক্যামেরা হাতে ভিডিও করছে৷ তাদের মধ্য থেকে একজন জিজ্ঞেস করল,” ভাইয়া, আপনি গান কেন ছেড়ে দিচ্ছেন? এর পেছনে কি বড় কোনো কারণ আছে? থাকলেও সেই কারণটা আমরা কবে জানতে পারব?”

অন্যজন প্রশ্ন করল,” এতোবড় ফ্যানবেজ আপনার। কারো কথা ভাববেন না? এভাবে সত্যি গান ছেড়ে দিবেন? শ্রোতাদের ভালোবাসার কি কোনো ভ্যালু নেই?”

একটা মেয়ে প্রশ্ন করল,” ভাইয়া, আপনি না এক্সিডেন্ট করেছিলেন? এতো দ্রুত সুস্থ কিভাবে হলেন? দিজ ইজ ভেরি স্ট্রেঞ্জ।”

এতো এতো প্রশ্নের তোপের মুখে পড়ে ইয়ামিনের অবস্থা নাজেহাল। সে কারো কোনো প্রশ্নের উত্তর দিল না৷ সবাইকে ঠেলে সরিয়ে কোনমতে গাড়িতে উঠে পড়ল। তার এমন আচরণের জন্য মিডিয়ায় অনেক ক্রিটিসিজম হতে পারে। কিন্তু এতে কিছুই যায়-আসে না। সে শুধু নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ভাবতে চায় এখন। বর্তমানে তার কাছে মুখ্য শুধুই উষসী৷ সেখানেই তার সমস্ত প্রশান্তি! বাইরের রঙ-চঙ মাখা চাকচিক্যময় ওই জীবনের অত্যাচারে সে হাঁপিয়ে উঠেছে। এসব থেকে দ্রুত নিস্তার পেতে চায়।

বাড়িতে আসার পর থেকেই শিমলা লক্ষ্য করছেন উষসীর মুখে হাসি নেই। সে নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর খুব চেষ্টা করলেও তার চোখের ভাষা পড়তে এতোটুকু অসুবিধা হচ্ছে না শিমলার। লম্বা পথ জার্নির কারণে তিনি ক্লান্ত ছিলেন। প্রথমেই ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে নিলেন। বের হতেই দেখলেন উষসী কফি নিয়ে হাজির।

শিমলা উষসীর চিবুক স্পর্শ করে বললেন,”তুমি কেমন আছো?”

” ভালো আম্মু। আপনি লাঞ্চে কি খাবেন? বিরিয়ানি করব নাকি সাদা পোলাও?”

” এতো হেভি কিছু খাব না। ভাত করো।”

” ঠিকাছে, তাহলে সাদা ভাত করছি।”

” হুম, বসো এখানে।”

শিমলা টেনে উষসীকে বিছানায় বসালেন। সংশয়ের দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করলেন,” সব ঠিকাছে তো? এখানে আসার পর থেকেই দেখছি তোমার মনখারাপ। সকালেও ফোনে যখন কথা বললাম তখনও কিন্তু হাসি-খুশি দেখাচ্ছিল তোমাকে। তাহলে এখন হঠাৎ কি হয়ে গেল মা? দু’জন কি আবার ঝগড়া করেছো?”

” না আম্মু। আসলে আমার শরীরটা ভালো নেই তো.. ”

” কোনটা শরীর খারাপের ক্লান্তি আর কোনটা মনখারাপের ক্লান্তি তা আমি বুঝি। সত্যি কথা বলো। ইয়ামিন কি করেছে আবার? এখন আমি এসে গেছি না? তোমার কোনো ভয় নেই। আমি নিজে ওর বিচার করব। আমাকে শুধু বলো ও কি নিয়ে তোমাকে কাঁদিয়েছে?”

উষসী মাথা নিচু করল। তার চোখে পানি। শিমলা দুইহাতে পুত্রবধূকে আগলে ধরলেন।স্নেহময় কণ্ঠে বললেন,” এক মুহূর্তের জন্য ভুলে যাও যে আমি তোমার শ্বাশুড়ি। মনে করো আমি তোমারই মা। এবার আমাকে সব সত্যি কথা বলো।”

আপনি আমার কাছে মায়ের থেকে কম না আম্মু।”

” তাহলে বলো, কেন তোমার মনখারাপ? ”

শাশুড়ীর আদুরে কণ্ঠে উষসী মোমের মতো গলতে শুরু করল। প্রথম থেকে একদম সবকিছু বলতে লাগল। সব শুনে শিমলা কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইলেন। তারপর হঠাৎ অট্ট হাসিতে ফেটে উঠলেন। তার এমন হাসি দেখে উষসী বিহ্বল হয়ে গেল। অভিমান মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,” আশ্চর্য, আপনি হাসছেন কেন আম্মু?”

শিমলা খুব কষ্টে হাসি থামিয়ে চোখের পানি মুছলেন। হাসতে হাসতে তার চোখ ভিজে এসেছে। তিনি উষসীর কাঁধে হাত রাখলেন। প্রফুল্লচিত্তে বললেন,” মা, এতো বোকা কেন তুমি? তোমার কি মনে হয় এই বাড়ি থেকে যদি সত্যি তুমি চলে যাও তাহলে ইয়ামিন আসলেই তোমার নামে মামলা করবে?”

” করবে না?”

” অবশ্যই না। ও তো শুধু তোমাকে ভয় দেখাচ্ছে। তোমার ইচ্ছে হলে তুমিও ওকে ভয় দেখাতে পারো।”

” আমি কিভাবে ভয় দেখাবো?”

” ও যেভাবে দেখিয়েছে সেভাবেই! এটাও কি আমাকে শিখিয়ে দিতে হবে?”

” কিন্তু উনি এরকম কেন করে আম্মু? উনি বোঝে না আমার যে কষ্ট হয়?”

” বোঝে মা, কিন্তু কি করবে? আমার ছেলেটাই যে এমন! এখন তোমাকে একটা গল্প বলি, শোনো। ছোটবেলায় একবার ইয়ামিনকে তোমার বাবা ভীষণ মার মেরেছিল। ছোট থেকেই তো ও খুব অবাধ্য। অল্প বয়সে স্মোক করতো, আজে-বাজে ছেলেদের সাথে মিশতো, অনেক বিগড়ে গেছিল। তখন সম্ভবত ক্লাস টেনে পড়ে৷ তিনদিন বাড়ি ফিরেনি। বোঝো অবস্থা! ওইটুকু বয়সী ছেলে যদি তিনদিন ধরে বাড়ি না ফেরে তাহলে কি বাবা-মা’র মাথা ঠিক থাকার কথা? তোমার বাবা তো খুব রেগে গেছিল। চতুর্থ দিন যখন ও ফিরল, তোমার বাবা রাগে ওকে এমনভাবে মার দিয়েছিল যে ও অজ্ঞান হয়ে যায়।”

” ওমা, তারপর?”

” তারপর কাঁদতে কাঁদতে তোমার বাবা যেন নিজেই স্ট্রোক করবেন, এমন অবস্থা। ছেলের গায়ে এতোটুকু আঁচড়ও সে সহ্য করতে পারে না। সেখানে এতো বীভৎসভাবে মেরেছে। এই আত্মগ্লানিতে সে নিজেও অসুস্থ হয়ে গেল। তখন ইয়ামিন কি করল জানো? সে বলল, ওইদিন নাকি মারের জন্য সে অজ্ঞান হয়নি। শুধু অজ্ঞান হওয়ার অভিনয় করেছে। তোমার বাবা এই কথা বিশ্বাস করে কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছিলেন। কিন্তু আমি তো মা, আমি সব বুঝি। ও আসলে মিথ্যা বলেছিল। বাবা মনে মনে নিজের ছেলেকে আঘাত করার জন্য যে অপরাধবোধে ভুগছিলেন সেই কষ্ট লাঘব করার জন্য ইয়ামিন মিথ্যা বলেছে। এবার তুমি বলো, এই গল্প আমি তোমাকে কেন শোনালাম?”

উষসী চুপ করে রইল। শিমলা মিষ্টি হেসে বললেন,” ইয়ামিন তার বাবাকে যেমন ভালোবাসে, তোমাকেও ভালোবাসে। তুমি ওকে ছেড়ে যাও এটা ও মানতে পারছে না৷ তাই তোমাকে আটকানোর জন্য মিথ্যা বলছে। আমি কিন্তু ওর মিথ্যাটাকে ডিফেন্ড করছি না। বলছি না যে এটা ভালো। শুধু তোমাকে বোঝাচ্ছি। ও তোমাকে ভালোবাসে মা।”

সম্পূর্ণ ঘর অন্ধকারে ছেয়ে আছে। একটা মানুষ কিভাবে এতো অন্ধকারে বসে থাকতে পারে? খুব সাবধানে সুইচবোর্ড হাতড়ে বাতি জ্বালিয়ে দিল ইয়ামিন। উষসী বালিশে মুখ গুজে শুয়ে ছিল। এবার উঠে বসল। চোখ কুচকে প্রশ্ন করল,” আপনি?”

ইয়ামিনের মনে কিঞ্চিৎ অপরাধবোধ। সকালের ওই ব্যবহারের জন্য এখন কিছুটা আফসোস হচ্ছে। কিন্তু সে কি করবে? উষসীকে আটকানোর অন্যকোনো বুদ্ধি মাথায় আসছিল না তখন। বাধ্য হয়ে তাকে হার্ট করতে হলো।

” এইভাবে অন্ধকারে শুয়ে আছো কেন?”

” আমার শরীর ভালো লাগছে না।” উষসীর কণ্ঠ গম্ভীর, দায়সারা। ইয়ামিন বিছানার কাছে এসে উদগ্রীব হয়ে বলল,” জ্বর এসেছে নাকি? দেখি!”

সে কপালে হাত রাখতে নিলেই উষসী সরে গেল। ইয়ামিনও তার বাড়িয়ে রাখা হাতটা গুটিয়ে নিল। উষসী শক্ত গলায় বলল,” তৃষাণ ভাইয়া ফোন করেছিল। আমাকে কখন নিতে আসবে জানতে চাইছিল। আমি বলে দিয়েছি আসতে হবে না। আমি এখানেই থাকব।”

” দ্যাটস গুড। বুদ্ধিমানের মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছো। এটাই তোমার জন্য ভালো।”

” কিন্তু আমারও একটা শর্ত আছে।”

” শর্ত?”

“হুম! বসুন, বলছি।”

ইয়ামিন কপালে গুরুতর ভাঁজ ফেলে বসল। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। উষসী বলতে লাগল,” আমি এখানে শুধু ততদিনই থাকব, যতদিন না আমার ডেলিভারি হচ্ছে। ডেলিভারির পর আমি আমার বাচ্চাকে নিয়ে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।”

ইয়ামিন প্রতিবাদ করতে উদ্যত হলেই উষসী তাকে থামিয়ে দিল,” আগে আমার কথা শেষ করতে দিন। জানি এই বাচ্চার উপর আমার যতটা অধিকার.. আপনারও ঠিক ততটাই অধিকার। তাই আপনার থেকে ওকে আমি আলাদা করব না। কিন্তু এই অযূহাতে আমি আপনার সঙ্গে থাকতেও পারব না। নবজাতক শিশু মা ছাড়া থাকে না। তাই প্রথম দুইবছর ও শুধু আমার কাছেই থাকবে। তারপর থেকে সপ্তাহে চারদিন আমার কাছে আর তিনদিন আপনার কাছে থাকবে। ওর বয়স নয় কিংবা দশ হলে থেকে মানে যখন ও মোটামুটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার বয়সে আসবে তখন আপনি কিংবা আমার মধ্যে যেকোনো একজনকে বেছে নিতে পারবে। আর তার সাথেই থাকবে। এটাই আমার শর্ত।”

ইয়ামিন শান্ত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ঠোঁট উল্টাল। হাত-তালি বাজিয়ে উপহাস করে বলল,” গ্রেইট। সব প্ল্যান তাহলে করে ফেলেছো? এর মানে আমাদের ডিভোর্সটা হচ্ছেই?”

” অফকোর্স হচ্ছে। কেন হবে না? আপনি ভাবলেন কিভাবে এতোকিছুর পরেও আমি আপনার সাথে থাকব?”

ইয়ামিনের এতো রাগ হলো! ইচ্ছে হলো আছাড় মেরে কিছু একটা ভেঙে ফেলতে। উষসীর সমস্যা কি? দাঁতে দাঁত চিপে নিজের মেজাজ দমন করল সে। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” মম তোমাকে খুঁজছে। নিচে আসো।”

ইয়ামিন বের হয়ে যেতেই উষসী মুচকি হাসল। ইয়ামিনকে সে এতো সহজে ছাড়বে না। আগামী ছয়মাস তাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে।

মিসেস শিমলা সাতদিনের মতো আমেরিকায় থেকেছেন। এর মধ্যে একবার উষসীর পরিবারের সবাইকে ডেকে গেট টুগেদারের আয়োজন করা হয়েছে। ফেরার সময় তৃষাণদের সাথেই বাংলাদেশ ফিরবেন। উষসী এখানেই থাকবে৷ তার অনাগত সন্তান হবে জন্মসূত্রে আমেরিকান। যদিও সেটা তার প্রধান উদ্দেশ্য নয়৷ ইয়ামিনের হুমকির কারণেই তাকে আমেরিকায় থেকে যেতে হচ্ছে। তাছাড়া তার পাসপোর্ট, ভিসাও ইয়ামিন সিস্ট করে রেখেছে। উষসী চাইলেও সবার সাথে দেশে ফিরতে পারবে না।

সেদিন শনিবার ছিল। সবাইকে বিদায় দিতে এয়ারপোর্টে এসেছে উষসীরা। যুথি যাওয়ার সময় খুব কান্নাকাটি করছিলেন। উষসীরও কান্না পেল। যুথি মেয়েকে শাসনের সুরে বললেন,” জামাইয়ের সাথে কিন্তু বেশি ঝগড়া করিস না।রাগ করে ঘর থেকে একদম বের হবি না কিন্তু।”

পরমুহূর্তেই আবার নরম হয়ে বললেন,” রাগের মাথায় তোকে অনেক মার-ধোর করেছি, বকা-ঝকা করেছি। আমাকে মাফ করে দিস মা।”

উষসী মাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে বলল,” তুমি আমাকে না বকলে কে বকবে মা? তোমাকে খুব মিস করব।”

উষ্ণতা বলল,” আমার মিষ্টি বোন, আসছি। সাবধানে থাকিস। কোনো অসুবিধা হলে আমাকে ফোন করবি। আমি আছি, তোর তৃষাণ ভাই আছে। কোনো ভয় নেই।”

সবশেষে তৃষাণ নির্জনে নিয়ে উষসীকে বলল,” তুমি হঠাৎ সিদ্ধান্ত কেন বদলালে তা আমি বুঝতে পারছি না। তোমার তো আমাদের সাথেই ফেরার কথা ছিল। কিন্তু যেহেতু তুমি নিজেই এখানে থাকতে চাইছো, তাহলে আমার কোনো প্রবলেম নেই। আমি যে কোনো অবস্থাতে তোমার পাশে থাকব বলেছিলাম৷ সবসময় আছি। ভালো থেকো উষুমনি।”

” থ্যাঙ্কিউ ভাইয়া, তুমিও ভালো থেকো। খুব মিস করব তোমাদের। ”

” যেমনটা তোমার আপু বলল, যেকোনো সমস্যায় ফোন করবে। প্রয়োজনে আমি আবার এখানে এসে তোমাকে নিয়ে যাবো। আর যদি সত্যিই ইয়ামিন শুধরে গিয়ে থাকে তাহলে আমার চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হবে না।”

উষসী মৃদু হাসল। দূর থেকে ইয়ামিনকে দেখা যাচ্ছে। মিসেস শিমলার সাথে হাসি মুখে কথা বলছে সে। সেদিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে উষসী ফিসফিস করে বলল,” সে শোধরায়নি তৃষাণ ভাইয়া। কখনও শোধরাবেও না। তবে এবার আমি তাকে শিক্ষা দিবো।”

সবাইকে সিঅফ করে এয়ারপোর্টে থেকে ফেরার সময় ইয়ামিন গাড়ির দরজা খুলে উষসীকে ওঠার জন্য ইশারা করল৷ উষসী বলল,” আমি আপনার সাথে যাবো না। ট্যাক্সি নিয়ে যাব।”

” মানে? দু’জন তো একই জায়গায় যাচ্ছি৷ তাহলে আলাদা গাড়িতে যাওয়ার কি হলো?”

” আমাদের রাস্তা ভবিষ্যতে এমনিতেই আলাদা হবে। এখন থেকেই প্র্যাকটিসে থাকা ভালো। ”

উষসী ট্যাক্সি নেওয়ার জন্য সামনে পা বাড়াতে নিলেই ইয়ামিন তার হাত চেপে ধরল। তীক্ষ্ণ গলায় বলল,” আবার কোন নতুন ড্রামা শুরু করলে তুমি?”

উষসী শীতলভাবে হাসল,” ড্রামা তো আপনি শুরু করেছেন। এবার আমি শেষ করব। ওয়েট এন্ড ওয়াচ।”

ইয়ামিনের হাত ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেল উষসী। ইয়ামিন রাগে গাড়ির দরজায় একটা লাথি মারল। পরমুহূর্তেই সে চিন্তা করল, এভাবে মাথা গরম করা ঠিক নয়। উষসী এসব তাকে রাগানোর জন্য করছে। সে রেগে গেলে তো খেলাই শেষ। তাকে ধৈর্য্য ধর‍তে হবে। ইয়ামিন মাথা ঠান্ডা করে উষসীর পেছন পেছন হেঁটে গেল।

চলবে

আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-৪৪+৪৫

0

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৪৪
লিখা- Sidratul Muntaz

তৃষাণের উপস্থিতিতে ইয়ামিনের হাস্যজ্জ্বল- চকচকে মুখটা শুকনো আর খরখরে হয়ে উঠল নিমেষেই। কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে একবার উষসীর দিকে চাইল সে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে উষসী। ইয়ামিন প্রশ্ন করল নম্র গলায়,” ভাইয়া, কেমন আছেন?”

তৃষাণ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। পকেটে হাত গুঁজে বলল,” ভালো। ”

ইয়ামিন কিঞ্চিৎ ইতস্তত হয়ে বলল,” হঠাৎ আপনি এই সকাল সকাল? কি মনে করে?”

” তোমার এখানে আসার কোনো ইচ্ছাই আমার ছিল না। কিন্তু আমি এসেছি উষসীর জন্য।”

তৃষাণ উষসীর দিকে চেয়ে মুচকি হাসল। উষসীও হাসল। ইয়ামিনের মুখ গম্ভীর হলো। তৃষাণ আরও বলল,” ওকে আমার অনুমতি ছাড়া এখানে নিয়ে আসাটা তোমার একদম উচিৎ হয়নি।”

ইয়ামিনের বলতে মন চাইল,” আমার বউকে আমি যখন ইচ্ছা নিয়ে আসব, তাতে আপনার বাপের কি?”

ভদ্রতার খাতিরে সে অশোভন কথাটি বলতে পারল না। নিশ্চুপ রইল চোয়াল শক্ত করে। কিন্তু তৃষাণ যখন বলল,” উষুকে আমি নিয়ে যেতে এসেছি।” তখন আর চুপ করে থাকতে পারল না সে। ভ্রু কুটি করে শুধাল,” মানে? ”

” মানে উষসী এখন আমার সাথে বাসায় যাবে। ”

“অসম্ভব। উষসী কোথাও যাবে না।” কথাটা বলেই প্রাণপণ শক্তিতে উষসীর হাত চেপে ধরল ইয়ামিন। তৃষাণ অবাক হলো ইয়ামিনের ধৃষ্টতা দেখে। যথেষ্ট ধৈর্য্য ধারণ করে বলল,” উষসী, তুমি কি চাও?”

খুব নির্লিপ্তে ইয়ামিনের হাতটা ছেড়ে উষসী তৃষাণের সন্নিকটে গিয়ে দাঁড়াল। মাথা নিচু করে আওড়াল,” তোমার সাথে যেতে চাই তৃষাণ ভাইয়া।”

ইয়ামিনের বুকে পাহাড় ধ্বসে পড়ল। দিশেহারা হলো চিত্ত। তৃষাণ আলতো হেসে ইয়ামিনের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল,” তোমার কি আর কিছু বলার আছে?”

ইয়ামিন কাতরভাবে অনুরোধ করল,” উষসী প্লিজ, এইভাবে চলে যাওয়াটা কোনো সমাধান না। আমরা ভালোভাবে কথা বললেই সব ঠিক হয়ে যেতে পারে।”

অনুভূতিশূন্য কণ্ঠে উষসীর পক্ষ থেকে উত্তর এলো,” কথা বলে সমাধান করার মতো কিছু বাকি নেই আর। যা বলার আমি আপনাকে বলেই দিয়েছি। আপনি মানতে পারছেন না সেটা আপনার প্রবলেম… আমার না।”

ইয়ামিন এগিয়ে এসে উষসীর হাত ধরতে উন্মুখ হলেই বাঁধ সাধল তৃষাণ। বামহাতে তার কাঁধ চেপে ধরে কড়া গলায় বলল,” খবরদার, যা বলার দূর থেকে বলো। কাছে আসবে না।”

ইয়ামিন নিজেকে আর সামলাতে পারল না। ভীষণ ক্রোধে প্রতাপ নিয়ে বলল,” আমার স্ত্রীর সাথে আমি কিভাবে কথা বলব সেটা কি আপনি বলে দিবেন আমাকে? আমি আপনার কথা শুনবো কেন? হু দ্যা হেল আর ইউ?”

উষসী রোষাবিষ্ট দৃষ্টিতে চাইল,” ইয়ামিন,উনি আমার তৃষাণ ভাই।আপনি কার সাথে কিভাবে কথা বলছেন? ”

” যে-ই হোক, আই ডন্ট কেয়ার। তুমি আমার স্ত্রী। তোমার সাথে কথা বলতে কারো পারমিশন কিংবা সাজেশনের আমার কোনো দরকার নেই।”

তৃষাণ হেসে ফেলল। ঠান্ডা গলায় বলল,” তাই? তা কিসের এতো অধিকার দেখাচ্ছো শুনি? আজকে তোমাদের ডিভোর্স হলে কালকে তুমি ওর কেউ না। তাছাড়া ও তোমার সাথে থাকতেও চায় না। সেজন্যই সকাল-সকাল আমাকে ফোন করে এখানে ডেকে এনেছে। কারণ তুমি নাকি ওকে ঘর থেকেই বের হতে দিচ্ছ না। এইভাবে ফোর্স করলে তোমার নামে থানায় এলিগেশন দিতে বাধ্য হবো আমি।”

” আপনার যা ইচ্ছা করুন। উষসী আমার স্ত্রী। আমার সন্তানের মা। তাই ও শুধু আমার কাছেই থাকবে। কেউ ওকে নিয়ে যেতে পারবে না এখান থেকে। ”

তৃষাণ এক মুহূর্তের জন্য একটু চমকাল,” সন্তানের মা? মানে কি?”

ইয়ামিন স্পষ্ট করে বলল,” উষসী প্রেগন্যান্ট।”

কথাটা যেন বিশ্বাস করতে পারল না তৃষাণ। কৌতুহল নিয়ে উষসীর দিকে তাকাতেই নিস্পন্দ তালে মাথা নাড়ল উষসী। যার অর্থ ঘটনা সত্যিই। তৃষাণ ছোট্ট নিশ্বাস ছেড়ে বলল,” যাই হোক, আসল কথা হচ্ছে উষসী এখানে থাকতে চায় না। তাই আমি ওকে নিয়ে যাবোই।”

” উষসী, তুমি কোথাও যাবে না।”

উষসী রূঢ় কণ্ঠে বলল,” আমি কি করব আর কি না করব সেটা আপনি ঠিক করে দিবেন না।”

অতঃপর তৃষাণের হাত ধরে বলল,” ভাইয়া চলো।”

তৃষাণ আর উষসী সামনে হাঁটতে লাগল। ইয়ামিন তাদের পেছনে এলো। উষসীর হাত ধরে তাকে থামানোর চেষ্টা করল,” প্লিজ উষসী, আমার কথাগুলো শোনো।”

” আমার হাত ছাড়ুন। দোহাই লাগে।”

ইয়ামিন চিৎকার করে বলল,” ছাড়ব না। তোমাকে আমি যেতে দিবো না ড্যামেট।”

তৃষাণ সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ইয়ামিনকে ঘুঁষি মারতেই কাউচের ওপর উল্টে পড়ে গেল সে। তৃষাণ শার্টের হাতা গুটিয়ে বলল,” অনেক সহ্য করেছি, আর না।”

উষসী আতঙ্কে অস্থির হয়ে বলল,” প্লিজ ভাইয়া, এখান থেকে চলো।”

ইয়ামিনের ঠোঁট ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। তাই দেখে উষসীর বুক হু হু করে উঠলেও সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখল। তৃষাণের হাত ধরে চলে যেতে নিচ্ছিল। ইয়ামিন আহত অবস্থাতেই পুনরায় তেড়ে এলো। উষসীর পথ আটকে দাঁড়াল। তৃষাণ রেগে আবার কিছু করতে নিলেই উষসী থামাল তাকে,” প্লিজ, না।”

তৃষাণ থেমে গেল। উষসী নিষ্ঠুর কণ্ঠে বলল,” আমাকে যদি যেতে না দেন তাহলে আমি আত্মহত্যা করব। কি চান আপনি? আমার মৃত্যু?”

এই কথার পর ইয়ামিন থমকে গেল। অসহায় হয়ে বলল,” মোটেও না। তোমাকে নিয়ে বাঁচতে চাই।”

” আমি চাই না। সরে দাঁড়ান নয়তো খুব খারাপ কিছু হবে যা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না।”

” উষসী প্লিজ, আর পরীক্ষা নিও না আমার। তুমি চলে গেলে আমি আমাকে মাফ করতে পারব না। আমি থাকতে পারব না। তুমি আমার, শুধু আমার।”

” এসব আগে চিন্তা করা উচিৎ ছিল। এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমি আর এখানে এক মুহূর্ত থাকতে পারছি না। তৃষাণ ভাইয়া, চলো।”

নিঃস্ব, শূন্য, ভঙ্গুর ইয়ামিনকে পাশ কাটিয়ে তৃষাণের হাত ধরে উষসী বের হয়ে গেল অবলীলায়।

গাড়িতে বসেই উষসী কান্না শুরু করল। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার উদ্দেশ্যে মাথায় হাত রাখল তৃষাণ। উষসী অনুতাপ নিয়ে বলল,” আই এম স্যরি, আমার জন্য তোমাকে অপমানিত হতে হলো। ইয়ামিন যে এইভাবে তোমার সাথে বেয়াদবি করবে সেটা আমি বুঝিনি।”

” বাদ দাও ওর কথা। তুমি বলো উষু, কি চাও তুমি? ইয়ামিনের থেকে ডিভোর্স নিতে চাও?”

উষসী মাথা নাড়ল। তৃষাণ বলল,” ঠিকাছে তাহলে সেটাই হবে। বাকি কাজ তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও। আর কেঁদো না। ”

উষসী চোখের জল মুছল। তৃষাণ দ্বিধান্বিত হয়ে বলল,” কিন্তু এই অবস্থায় তো তোমাদের ডিভোর্স সম্ভব না। তুমি কি বাচ্চাটাকে রাখতে চাও? নাহলে আমি এবোর্শনের ব্যবস্থা….”

উষসী আৎকে উঠল। তৃষাণকে থামিয়ে বলল,” একদম না, ভাইয়া। ওর তো কোনো দোষ নেই। ও নিষ্পাপ। কিছুই জানে না। তাহলে আমাদের ভুলের শাস্তি ও কেন পাবে? আমি ওকে অবশ্যই পৃথিবীতে আনবো। যাই হয়ে যাক।”

” তুমি ভালো থাকলেই আমরা খুশি। তবে একটা কথা তুমি ঠিক বলেছো৷ বাচ্চাটার কোনো দোষ নেই৷ সে কিছু জানে না। তেমনি ইয়ামিনের অপরাধের জন্য উষ্ণতাকে শাস্তি দেওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে? সেও তো কিছু জানতো না এই ব্যাপারে।”

উষ্ণতা চুপ করে গেল। তৃষাণ কোমল গলায় বলল,” তোমার উচিৎ হবে ওকে ক্ষমা করে দেওয়া। খুব কষ্ট পাচ্ছে ও। সারাক্ষণ তোমার কথা ভেবে কাঁদে। প্লিজ উষু, তোমার আপুকে ক্ষমা করে দাও।”

সবাই চিন্তিত হয়ে অপেক্ষা করছিল। উষসী ফেরার পর তাদের অপেক্ষার অবসান ঘটল। ডোনা আর যুথি দুই দিক থেকে উষসীকে জড়িয়ে ধরল। যুথি বলল,” জামাইয়ের সাথে রাগ করে আবার চলে এসেছিস? নাকি এবার সে নিজের ইচ্ছায় আসতে দিয়েছে?”

তৃষাণ বলল,” আসতে দিচ্ছিল না। আমি জোর করে এনেছি।”

যুথি বলল,” ওমা, কি দরকার ছিল?”

ডোনা বলল,” অবশ্যই দরকার ছিল। উষসী তো ওখানে থাকতে চায় না। তাহলে কেন আসবে না?”

যুথি অসন্তুষ্ট হয়ে বলল,” সবকিছু কি ওর মর্জিমতো হতে হবে?”

শাশুড়ী মায়ের কথা শুনে তৃষাণ কিছুটা অবাকই হলো। তিনি এখনও ইয়ামিনের পক্ষ নিয়ে কথা বলছেন কোন হিসাবে? উষ্ণতা দরজার এক কোণায় মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। উষসী হঠাৎ সেদিকে এগিয়ে গেল। কোমল গলায় ডাকল,” আপু, কেমন আছো?”

উষ্ণতা কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল। অবাক হওয়া দৃষ্টিতে তাকাল তৃষাণের দিকে। তৃষাণ মুচকি হাসল। উষ্ণতার চোখ দু’টো অশ্রুতে ভরে এলো। উষসী সজোরে উষ্ণতাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল,” আই এম স্যরি আপু। প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও। প্লিজ।”

উষ্ণতা উষসীর কপালে গালে চুমু দিয়ে বলল,” আমার লক্ষী বোন, মিষ্টি বোন, তোর উপর আমি একদম রাগ করিনি। তাহলে ক্ষমা কেন করব?”

” আমি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি, ভুল বুঝেছি।”

” না, একদম না। আমার কোনো কষ্ট হয়নি৷ আমি জানতাম আমার বোন বেশিদিন আমার সাথে কথা না বলে থাকতেই পারবে না।”

দুইবোনের মিলন দেখে সবার মুখে হাসি ফুটল। বিকালে সবাই খোশমেজাজে চায়ের আড্ডায় বসল। ঠিক সেই সময় তৃষাণ ডিভোর্সের প্রসঙ্গটা তুলল। যা শুনে যুথির মুখ আঁধার হয়ে গেল। উষ্ণতা বলল,” উষু যখন চাইছে, তখন সেটাই হোক। ”

যুথি বলল” সেটাই হোক মানে? এটা কি কোনো সমাধান হলো? ইয়ামিন কি এমন অন্যায় করেছে যে জন্য ডিভোর্স দিতে হবে? আমি কিছুতেই এর অনুমতি দিবো না। আমার মেয়ের জীবনটা নষ্ট হবে।”

উষ্ণতা বোঝানোর চেষ্টা করল,” ডিভোর্স হওয়া মানেই জীবন নষ্ট হওয়া না মা।”

তৃষাণ বলল,” আমি তো এখনি ডিভোর্সের কথা বলছি না। আপাতত ওরা সেপারেশনে থাকুক৷ এই অবস্থায় ডিভোর্স হওয়াও অসম্ভব।”

ডোনা প্রশ্ন করল,” অসম্ভব কেন?”

তৃষাণ সবার অবগতির উদ্দেশ্যে জানাল,” উষু প্রেগন্যান্ট।”

এই কথা শুনে যুথি বেজায় খুশি হলো। কিন্তু অন্যরা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। যুথি হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল,” মাশআল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ। দেখলি মা, আল্লাহও চায় না যে তোদের ডিভোর্স হোক। নাহলে এই সময়ই কেন এমন সুসংবাদ আসবে বল? আমি তোকে বলি মা, সবকিছু ভুলে যা। সংসারটা নতুনভাবে শুরু কর। ডিভোর্স কোনো সমাধান না, এটা একটা সর্বনাশ। তুই ওই পথে যাস না মা। তুই না আমার লক্ষী মেয়ে?”

উষসী মায়ের কথার কোনো জবাব না দিয়ে বৈঠক থেকে উঠে চলে গেল। উষ্ণতা রেগে বলল,” তোমার কি দরকার ছিল এসব বলার মা? এমনিও মেয়েটা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। তোমার কথায় ও আরও আপসেট হয়ে যাবে। জীবনটা তো ওর নিজের। সিদ্ধান্ত ওকেই নিতে দাও।”

” ও নিজের ভালো কতটুকু বুঝে? আর ভুলটা কি বললাম আমি? শুধু আমার মেয়ের ভালো চাই এটাই কি আমার দোষ? তোরা কুবুদ্ধি দিয়ে ওর মাথা খাওয়া বন্ধ কর। কোনো ডিভোর্স হবে না। কেউ এই শব্দ আমার সামনে উচ্চারণ করবে না, বলে রাখলাম।”

যুথি এই কথা বলে উঠে চলে গেল। তৃষাণ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। উষ্ণতা বিরক্তিতে মাথায় হাত চেপে ধরল। ডোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলল,” মায়েরা এমনই হয়। উষু আমার মেয়ে হলে হয়তো আমিও একই কথা বলতাম। নিজের মেয়ের সংসার ভাঙুক এটা কোন মা চাইবে?”

এক সপ্তাহ কেটে গেল। এর মধ্যে ইয়ামিন অসংখ্যবার উষসীর সাথে দেখা করতে এসেছে। কিন্তু একবারও তাকে দেখা করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। উষসী নিজেই দেখা করতে চায়নি। সে এই কয়েকদিন একদম ঘর থেকে বের হয়নি। দেখতে দেখতে কেটে গেল পনেরো দিন। ইয়ামিনও বিরক্ত করা থামিয়ে দিল। উষসী খুব অবাক। কিছুদিন ধরে ইয়ামিন একদম আসছে না৷ দুই দিন আগে উষসী উষ্ণতার সাথে একটু শপিং এ বের হয়েছিল। ভেবেছিল মনটা ভালো হবে। উল্টা মন খারাপ হয়ে গেল। কারণ ইয়ামিনকে বাড়ির আশেপাশে কোথাও দেখা গেল না। এতোদিন সে সবসময় বাড়ির আশেপাশেই ঘুরঘুর করেছে৷ তাহলে এখন কোথায় গেল? উষসী মনের অজান্তেই ইয়ামিনকে মিস করছে। যা সে মানতে না চাইলেও ব্যাপারটা তাকে পীড়া দিচ্ছে। জড়তার কারণে মুখ ফুটে কাউকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেসও করতে পারছে না সে।

একদিন সকালে উষসী মাত্র ঘুমিয়েছে.. ইদানিং রাতে ঘুম হয় না তার। সকালে একটু চোখ লেগে এসেছিল। তখনি খটখট শব্দ হলো দরজায়। উষসী হাই তুলে দরজা খুলতেই যুথি সজোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল তার গালে।

হঠাৎ এমন আক্রমণে উষসী থতমত গেল। যুথি উত্তপ্ত স্বরে ধমক দিল,” তোর জন্য এসব হয়েছে, বেয়াদব মেয়ে! কি চাস তুই? ছেলেটার জীবন ধ্বংস করতে চাস?”

উষসীর বুক ধ্বক করে উঠল,” কি হয়েছে মা?”

” দ্যাখ কি হয়েছে।”

হাতের ফোন উষসীর দিকে বাড়িয়ে দিল যুথি। জনপ্রিয় ওয়েবসাইটের ব্রেকিং নিউজ, ইয়ামিন ইব্রাহীম গুরুতর এক্সিডেন্টে হাসপাতালে ভর্তি। জানা গেছে অতি শীঘ্রই গান ছেড়ে দিচ্ছেন তিনি। আর কখনোই গানের জগতে ফিরবেন না। কারণটা এখনও জানা যায়নি৷ অতিরিক্ত মানসিক বিষণ্ণতাও এমন সিদ্ধান্তের কারণ হতে পারে বলে ধারণা করছে নেটিজেনরা। সোশ্যাল মিডিয়ায় এসব নিয়ে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। উষসী বেশ কিছুদিন ধরে ফোন হাতে নেয় না বলে এসব কিছুই জানতে পারেনি।

যুথি বলল,” আমার সাথে চল, হাসপাতালে জামাইকে দেখে আসব।”

উষসী হাতের ফোন ফিরিয়ে দিয়ে বলল,” আমি কোথাও যাবো না। তোমার যেতে ইচ্ছে করলে তুমি যাও।”

যুথি এই কথা শুনে পুনরায় উষসীর গালে একটা কষে থাপ্পড় মেরে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

চলবে

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৪৫
লিখা- Sidratul Muntaz

খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে নীরবে চোখের জল ফেলছে উষসী। ইতোমধ্যে হৃদয়ে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। সময়টা কেমন বিষাক্ত বোধ হচ্ছে। নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। ডোরবেলের শব্দ কানে আসতেই সমস্ত অস্থিরতা নিয়ে প্রাণপনে ছুটে ঘরের বাইরে এলো উষসী।

যুথি আর ডোনা হাসপাতালে গিয়েছিল ইয়ামিনের সাথে দেখা করতে৷ তাদের সাথে ক্লাইভও ছিল। ক্লাইভ তৃষানের বন্ধু, এই বাড়ির মালিক। দিনের বেশিরভাগ সময় সে বাইরেই থাকে।

উষসী মায়ের সামনে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেল না। কিন্তু ডোনাকে একা পেতেই ব্যগ্র হয়ে জিজ্ঞেস করে ফেলল,” ভালো আন্টি, গিয়ে কি দেখলে তোমরা? উনি কেমন আছে?”

ডোনা দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বললেন,” সেটা শুনে তোর কাজ নেই মা।”

“আমার কাজ নেই মানে?”

” তোদের না ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে?” ডোনা ফোঁড়ন কাটলেন।

উষসী কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,” আরে, ডিভোর্স হচ্ছে বলে কি আমি কিছু জানতেও পারব না? অন্তত মানবতার খাতিরে তো জিজ্ঞেস করতেই পারি যে সে কেমন আছে?”

ডোনা চেয়ে দেখলেন উষসীর চোখ দু’টো জলে পরিপূর্ণ। আরেকটু হলেই মেয়ে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে ফেলবে। মেয়েটাকে আর জ্বালাতে ইচ্ছে হলো না। মুখের হাসি গোপন করে তিনি বললেন,” আছে… ভালোই আছে।”

উষসী উন্মুখ হয়ে শুধাল,” সত্যি ভালো আছে? তুমি এভাবে বলছো কেন? একটু ডিটেলস বলো না! এক্সিডেন্ট কিভাবে হলো?”

এমন সময় যুঁথি ঢুকলেন। রাগী স্বরে জবাব দিলেন,” কেন? তোর এতো ডিটেলস জানার প্রয়োজন কেন? যখন আমি যেতে বললাম তখন তো বললি তোর কোনো দরকার নেই। তাহলে এখন এতোকিছু জানতে চাইছিস কেন?”

ডোনা নরমভাবে বলল,” আহা আপা, বাদ দাও।”

” না। বাদ দিবো কেন? ছেলেটা প্রত্যি বাক্যে শুধু একটা কথাই জিজ্ঞেস করছিল। উষসী কোথায়, উষসী কোথায়? আমি কোনো উত্তর দিতে পারিনি৷ জামাইয়ের সামনে মাথা হেঁট হয়ে গেছে। শত্রু অসুস্থ হলেও তো মানুষ ভদ্রতার খাতিরে দেখা করতে যায়।”

উষসী চোখে পানি নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ডোনা বললেন,” বেশি হয়ে গেল না আপা?”

” এইটুকু বেশির প্রয়োজন ছিল। ও যেটা করেছে সেটাও অনেক বেশি। বেয়াই ফোন করে ওর কথা জিজ্ঞেস করেছিল। কত বিশ্বাস নিয়ে বলছিল উষসী থাকলে নাকি ইয়ামিনের দেখা-শোনার কোনো ত্রুটি হবে না৷ এখন আমি বেয়াইকে কিভাবে বলি যে আমার পাষাণ মেয়ে ওকে হাসপাতালে দেখতে পর্যন্ত যায়নি?”

ডোনা নিজেও উষসীর আচরণে অবাক হয়েছেন। বুকভরা মায়া যেই মেয়ের, সে এমন নিষ্ঠুর আচরণ কিভাবে করল? তবে এখন তিনি বুঝেছেন, উপরে যতই শক্ত খোলস ধারণের চেষ্টা করুক সে… ভেতরে এখনও নরম!

আজ সারাদিন তৃষাণ বাড়িতে ছিল না। রাতে সে ফিরলেই উষ্ণতা জানাল ইয়ামিনের এক্সিডেন্টের খবর। এসব শোনার পর থেকে উষসী শুধু কান্নাকাটিই করছে। সারাদিন কিছু খায়নি। সবকিছু শুনে উষসীর ঘরে খাবার নিয়ে গেল তৃষাণ।

তখনও উষসী বিছানায় বসে কাঁদছিল। তৃষাণকে দেখে দ্রুত হাতে চোখের জল মুছল।

” তোমার আপুর কাছে শুনলাম, সারাদিন নাকি কিছু খাওনি তুমি?”

” আসলে আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। খাবার মুখে দিলেই বমি আসছে।”

” এখন একবার চেষ্টা করো। খেতে তো হবেই।”

উষসী হাসার ভাণ করে বলল,” রেখে যাও। খেয়ে নিবো আমি।”

তৃষাণ যাওয়ার আগে বলল,” আমি তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারি, যদি তুমি চাও।”

এই কথা শুনে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল উষসী। নিজের কানকে বিশ্বাস হলো না। ভুল শুনেছে কি-না বুঝতে প্রশ্ন করল,” সত্যি?”

উষসীর উদ্দীপনা দেখে তৃষাণ বলল,” কিন্তু আগে খাবার শেষ করতে হবে।”

উষসী মাথা নাড়ল আর খুব দ্রুত খাওয়া শুরু করল। হাসপাতালে গিয়ে জানা গেল ইয়ামিনের রিলিজ হয়ে গেছে। এই কথা শুনে উষসীর মনটা খারাপ হয়ে গেল। কত আশা নিয়ে এসেছিল সে। অথচ দেখাটাই হলো না। তৃষাণ প্রশ্ন করল,” তুমি কি ওর বাসায় যেতে চাও?”

উষসী অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চাইল৷ তৃষাণ স্থির কণ্ঠে বলল,” এসেছোই যখন দেখাটা করেই যাও। মন শান্ত হোক।”

উষসী ঘাড় নাড়ল। তৃষাণ গাড়ি ঘোরাল। গাড়ি থামল একেবারে ইয়ামিনের বাড়ির সামনে। তৃষাণ বলল,” তুমি ভেতরে যাও। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।”

” আচ্ছা।”

উষসী গাড়ি থেকে নামতে নিয়ে থামল। পেছনে একবার চেয়ে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল,”থ্যাঙ্কিউ। ”

তৃষাণ মুচকি হাসল। উষসী বলল,” আমার বেশিক্ষণ লাগবে না। দশমিনিটের মধ্যে চলে আসব।”

” সমস্যা নেই। টেইক ইউর টাইম৷ আমি অপেক্ষা করব।”

কৃতজ্ঞতায় চোখ দু’টো ঝলমল করে উঠল উষসীর।দ্রুতপায়ে সে গাড়ি থেকে নামতে নিয়ে একবার হোঁচট খেল। তৃষাণ বলল,” সাবধানে!”

উষসী হেসে ফেলল। তার পায়ের জোর এতোটুকু কমল না। তাকে ঢুকতে দেখে আয়শা উত্তেজনায় চিৎকার দিয়ে বলল,” ভাবী, আপনি এসেছেন? আল্লাহ, আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না ভাবী।”

” ইয়ামিন কোথায়? ঘুমিয়ে গেছে নাকি?”

” না, স্যার তো জেগেই আছেন। ভাবী আপনি কি রাতে থাকবেন? ডিনার করবেন? কি রাঁধবো আপনার জন্য?”

উষসী হেসে ফেলে বলল,” এতো অস্থির হওয়ার কিছু নেই। আমি একটু পরেই চলে যাবো। রোগী দেখতে এসেছি। ”

আয়শার তুমুল আনন্দে ভাঁটা পড়ল। মুখ মলিন করে বলল,” ও। স্যার উপরের ঘরে আছেন। কিন্তু আপনি এখন যেয়েন না।”

” যাব না কেন?” উষসী ভ্রুকুটি করল। আয়শা অপ্রস্তুত হয়ে বলল,” মানে.. ওইযে, উপরে আর কি..”

আয়শার পুরো কথা শোনার ধৈর্য্য পেল না উষসী৷ ধুপধাপ শব্দে সিঁড়ি ভেঙে উপরে চলে গেল। ইয়ামিন তার বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় বসে আছে। মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। ডান হাতেও ব্যান্ডেজ। বামপায়েও ব্যান্ডেজ। আসলে কোন জায়গায় আঘাত লেগেছে তা ঠিক করে বোঝা সম্ভব নয়৷ শুধু ব্যান্ডেজের উপর ব্যান্ডেজই দেখা যাচ্ছে শরীরে।

কীর্তি বিরক্তিসূচক কণ্ঠে বলল,” ব্যাপারটা খুব সিলি, ইয়ামিন। তুমি কি সত্যি গান ছেড়ে দিবে?”

” এই বিষয়ে এখন কথা বলাটা কি খুব জরুরী, কীর্তি? আমি টায়ার্ড! ”

” আশ্চর্য! তোমার কাছে কি জরুরী মনে হচ্ছে না ব্যাপারটা? তোমার এতো সুন্দর বাঁধা ক্যারিয়ার শুধুমাত্র একটা মেয়ের জন্য নষ্ট হয়ে যাবে? তাও সেই মেয়ে, যে কোনোদিন তোমার মূল্যই বুঝল না?”

” উষসীর ব্যাপারে আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছি না, প্লিজ। তুমি ওকে চেনো না, কখনও দেখোনি৷ তাই ও কিরকম সেটা তোমার বোঝার কথা না। যাও এখান থেকে। লীভ মি এলোন। আমি ঘুমাবো। ”

ইয়ামিন তার মুখে মালিশ করল। যদিও সে ভালো করেই জানে তার ঘুম আসবে না। গত পনেরো দিন ধরে একটা রাতও ভালো করে ঘুমিয়েছে কি-না মনে পড়ছে না। চোখের নিচে গাঢ় দাগ পড়ে গেছে। দেখাচ্ছে অসুস্থ রোগীর মতো। উষসীর সাথেও দেখা হচ্ছে না।

মন-মেজাজ অত্যন্ত খারাপ। এই অবস্থায় মরার উপর খাড়ার ঘাঁ হয়ে জুটেছে কীর্তি। এক্সিডেন্টের খবর পেয়েই মুম্বাই থেকে ছুটে এসেছে। কে বলেছে তাকে আসতে? যার আসার দরকার সে তো আসে না!

বিরহে কাতর ইয়ামিনের মন৷ কবে শুধু একবার দেখবে উষসীকে! ব্রেকিং নিউজ ভাইরাল হওয়ার পর থেকেই ফ্যানদের যন্ত্রণায় টিকে থাকা মুশকিল হয়ে উঠেছে। ফুল দিয়ে হাসপাতালের কেবিন, ইয়ামিনের বাড়ি, গাড়ি ভরে যাচ্ছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ দেখা করতে আসছে। অথচ যার জন্য এতোকিছু সে-ই নেই। যেন তার কিছু যায়ই আসে না। এসব ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল ইয়ামিন। মেয়ে মানুষ বুঝি এতো নিষ্ঠুরও হয়?

কীর্তি ইয়ামিনের কাঁধে হাত রেখে বলল,” তোমাকে খুব আপসেট দেখাচ্ছে। উষসীকে তুমি খুব ভালোবাসো তাই না? ”

” হ্যাঁ। খুব ভালোবাসি।” ইয়ামিনের চোখ উজ্জ্বল দেখাল।

কীর্তি মনমরা হয়ে বলল,” কিন্তু সে তো তোমাকে ভালোবাসে না৷ ভালোবাসলে কি এভাবে ছেড়ে চলে যেতো? আর এতোবড় একটা নিউজ পেয়েও কি অন্তত একবার হলেও দেখা করতে আসতো না? কিন্তু সে কি এসেছে বলো? প্লিজ, ওর প্রতি তুমি এক্সপেক্টেশন কমাও। পরে নিজেই কষ্ট পাবে। গেট আ লাইফ। এইভাবে তোমাকে দেখতে আমার একদম ভালো লাগছে না।”

উষসী এই দৃশ্য দেখে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে রইল। ইয়ামিন চোখ বন্ধ করে বলল,” তোমাকে দেখতে কে বলেছে? না দেখলেই পারো।”

” ইয়ামিন, আমি কিন্তু মজা করছি না। আমি শুধু তোমাকে ভালো সাজেশন দিচ্ছি।”

” সেটাই তো৷ কেন দিচ্ছো?তোমার কাছে সাজেশন চাইনি আমি৷ এই ব্যাপারে আমার কারো সাজেশন প্রয়োজন নেই। এটা আমার খুব ব্যক্তিগত বিষয়। ”

” এর মানে কি তুমি ওই মেয়েটাকে ছাড়বে না? নিজের অবস্থা দেখেছো তুমি? রিলেশনে মানুষ রিফ্রেশমেন্টের জন্য যায়। আর সেই রিলেশনই যখন হয় ডিপ্রেশনের কারণ তখন সেটা আগলে ধরে বসে থাকার কি মানে? এইটা বোকামি ছাড়া আর কি?”

আয়শা খাবার হাতে ঘরে ঢুকতে নিয়ে দেখল উষসী বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে এখনও। সে অবাক হয়ে বলল,” ম্যাডাম…”

সাথে সাথে উষসী তাকে থামাল। চুপ হওয়ার নির্দেশ দিল। আয়শা ফিসফিস করে বলল,” স্যারকে দেখতে ভেতরে যাবেন না ম্যাডাম?”

” তোমার স্যার তো ব্যস্ত আছেন। আমি আর গিয়ে কি করব বলো?”

” ভুল বুঝবেন না ম্যাডাম। উনি স্যারের কলীগ হয়। এক্সিডেন্টের খবর শুনে দেখা করতে এসেছেন। ব্যস, এটুকুই।”

” ও। সেজন্যই বুঝি বেডরুম ঢুকে একদম গায়ের উপর হাত রেখে বসে আছে?” উষসীর মুখ দেখেই বোঝা গেল ঈর্ষায় পুড়ছে সে। যেই হাত দিয়ে কীর্তি ইয়ামিনের কাঁধ স্পর্শ করেছে, সেই হাতের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন হাতটাই ভেঙে ফেলতে চায়।

আয়শা বুদ্ধি করে বলল,” ম্যাডাম, একটা কাজ করুন। আপনি এই খাবার নিয়ে ভেতরে যান।”

” না থাক।”

” প্লিজ ম্যাডাম, যান। কীর্তি ম্যাডাম আপনাকে দেখলেই সরে যাবে। সকাল থেকে স্যারকে খুব বিরক্ত করছে। যান না ম্যাডাম!”

উষসী বাধ্য হয়ে খাবারের ডিস হাতে নিল। কীর্তি আফসোস করে বলছে,” নিজের ভালো তুমি কবে বুঝবে ইয়ামিন? আগের মেয়েটিও তোমার যোগ্য ছিল না। সে তোমার অর্ধেক জীবন নষ্ট করেছে। আর বাকি অর্ধেক নষ্ট করছে উষসী। এরা কেউই তোমাকে ডিজার্ভ করে না।নিজের ভালোবাসা তুমি অপাত্রে দান করছো।”

উষসী পেছনে এসে দাঁড়াল। হাসিমুখে বলল,” আচ্ছা তাই? আপনি এসব কিভাবে জানেন?”

কীর্তি চমকে উঠল। ইয়ামিন বিস্ময়াভিভূত হয়ে বলে উঠল,” তুমি এখানে?”

উষসী মৃদু হেসে খাবারের ডিসটা টেবিলে রাখল। তারপর কীর্তিকে পাশ কাটিয়ে বিছানায় ইয়ামিনের পাশে বসল। ইয়ামিন পলক না ফেলে উষসীকেই দেখছিল তৃষ্ণার্তের মতো। যেন প্রাণ ফিরে পেল বহুদিন পর। এক টুকরো সুখের মেঘ ছুঁয়ে গেল মন। বিষণ্ণ, মলিন মুখটা মুহূর্তেই প্রাণবন্ত আর ঝলমলে হয়ে উঠল।

কীর্তিকে কিছুটা বিব্রত দেখাচ্ছিল। উষসী বলল,” হায়, আমি লামিয়া ইমরোজ উষসী। যার সম্পর্কে এতোক্ষণ আপনি গসিপ করছিলেন!”

কীর্তি নিস্তরঙ্গ কণ্ঠে বলল,” জ্বী। চিনতে পেরেছি।”

” আমার মনে হয় আপনাকে এখন আর দরকার নেই। কারণ আমার স্বামীর খেয়াল রাখার জন্য আমি নিজেই এনাফ। ঠিক না?”

উষসী ইয়ামিনের দিকে তাকাল। ইয়ামিনের বিশ্বাস হচ্ছে না। পুরো বোকার মতো তাকিয়ে থেকে শুধু মাথা নেড়ে বলল,” হ্যাঁ। একদম ঠিক। ”

উষসী কীর্তির দিকে চেয়ে খিলখিল করে হাসল। কীর্তি একটা ভদ্রতার হাসি দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। উষসী নিজের মনে অসীম শান্তি অনুভব করল তখন। সে বের হয়ে যেতেই ইয়ামিন দুইহাতে তীব্রভাবে জড়িয়ে ধরল উষসীকে। তারপর উত্তালভাব গালে চুমু দিল।

” জানতাম তুমি না এসে থাকতে পারবে না। আমার উষুপাখি, আমার জান, আমার পরী, আই লভ ইউ।”

” ইশ, ছাড়ুন। মানবতার খাতিরে এসেছি৷ এটাকে ভালোবাসা ভাববেন না।”

” কেন ভাববো না? এটা তো ভালোবাসাই।”

” ঢং করবেন না। কীর্তিকে নিয়ে তো ভালোই ফূর্তিতে ছিলেন দেখলাম।”

ইয়ামিন হতভম্ব চিত্তে শুধাল,” মানে? আমি কীর্তিকে নিয়ে ফূর্তিতে ছিলাম?”

“অবশ্যই ছিলেন। ও আপনার বেডরুমে কেন এলো? আপনার কাঁধে হাত কেন রাখল? আপনি কিছু বললেন না কেন?”

” যা বলার তুমিই তো বলে দিলে। আমার কি আর কিছু বলার দরকার আছে?”

উষসী জবাব না দিয়ে খাবারের ডিশটা হাতে নিল। ঘড়ির দিকে চেয়ে বলল,” এতোরাত হয়ে গেছে, এখনও ডিনার করেননি কেন?”

” কিভাবে খাব? হাতে ব্যথা যে!”

ইয়ামিন তার ব্যান্ডেজ করা হাতটা দেখাল। উষসী ক্ষীপ্ত হয়ে বলল,” আমাকে জড়িয়ে ধরার সময় তো ব্যথা দেখলাম না। আর খাওয়ার সময়ই ব্যথা? বাহানা যত! হাঁ করুন। পাঁচমিনিটে খেতে হবে। তারপর আমি চলে যাব।”

” কোথায় যাবে?”

” নিচে তৃষাণ ভাই দাঁড়িয়ে আছে।”

ইয়ামিন বিষম খেল,” উনি তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছে? সত্যি?”

উষসী পানির গ্লাস এগিয়ে দিতে দিতে বলল,” এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই৷ ন্যূনতম মানবতাবোধ তারও আছে। আমি চেয়েছিলাম বলেই নিয়ে এসেছে।”

” বাহ, তোমরা শালি-দুলাভাই দু’জনেই দেখছি মানবতার ভান্ডার।”

উষসী তেরছা দৃষ্টিতে চাইল,” মজা করছেন আমাদের নিয়ে?”

” না। তুমি কি একটা রাতও থাকবে না? এসেই চলে যাবে?”

” আপনার সাথে আমি কেন থাকব শুনি? দুইদিন বাদে আমাদের ডিভোর্স হতে যাচ্ছে। এক্সিডেন্ট করেছেন মানেই যে সব বদলে যাবে এমন ভাববেন না আবার।”

ইয়ামিন বিরস মুখে খাবার খেতে লাগল। উষসী জিজ্ঞেস করল,” এক্সিডেন্ট কেন হলো?”

” ভালোর জন্য।”

ইয়ামিনের নির্লিপ্ত উত্তর শুনে উষসী চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,” মানে?”

” এক্সিডেন্ট না হলে তো তুমি এখানে আসতে না। এভাবে যত্ন করে খাইয়েও দিতে না। থ্যাংক গড যে আমার এক্সিডেন্ট হয়েছিল৷ তাই পনেরো দিন পর হলেও তোমার দেখা পেয়েছি। মানবতার জয় হোক। আর এমন এক্সিডেন্ট আমার প্রতিদিন হোক।”

” একটা চড় মারব ফালতু কথা বললে। এক্সিডেন্ট কিভাবে হয়েছিল সেটা জিজ্ঞেস করেছি আমি।”

” ব্রেইক ফেইল হয়ে গেছিল। গাড়ির ইঞ্জিন গরম হয়ে গাড়িতে আগুন লেগে গেল।”

” ওমা, তারপর?”

” তারপর আর কি? গাড়ি থেকে লাফ দিয়েছি।”

” ব্যথা লাগেনি?”

” লেগেছে তো। এইখানে, এইখানে তবে সবচেয়ে বেশি ব্যথা ছিল এইখানে।”

ইয়ামিন তার বুকের বামপাশে হাত রাখল। তারপর মুচকি হেসে বলল,” এখন সেরে গেছে। তোমাকে দেখে। ”

উষসী সজোরে একটা ঘুঁষি মারল তার বুক বরাবর। ইয়ামিন শব্দ করে হেসে উঠল। খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই ফোন বেজে উঠল উষসীর। তৃষাণের নাম্বার দেখে সে বলল,” এইতো, ভাইয়া মনে হয় নিচে নামার জন্য ফোন করছে।”

ইয়ামিন ফট করে উষসীর থেকে মোবাইলটা কেঁড়ে নিল। চোখ বড় করে তাকাল উষসী,”দেখুন,আমার ফোন দিন।”

” না। তুমি আজকে যেতে পারবে না।”

” অবশ্যই আমি যাবো।”

” উহুম। অসম্ভব।”

উষসী জোরাজুরি শুরু করলেই ইয়ামিন চেঁচিয়ে উঠল,” আউ, ব্যথা…”

” স্যরি…” উষসী নরম হলো।

ইয়ামিন এমন ভাব করল যেন হাতের ব্যথায় সে মরেই যাচ্ছে। এই ফাঁকে নিজের ফোন কেঁড়ে নিল উষসী। ইয়ামিন রেগে বলল,” এটা চিটিং। ”

উষসী জীভ বের করে মুখ ভেঙচাল। তারপর দূরে গিয়ে তৃষাণকে ফোন করল,” হ্যালো ভাইয়া।”

” উষু, কখন আসবে তুমি? আমি ওয়েট করব নাকি চলে যাবো?”

এই সুযোগে উষসী বলে ফেলল,” তোমার দাঁড়াতে বেশি কষ্ট হলে চলে যেতে পারো। সকালে না হয় এসো!”

এই কথা শুনে হাসল ইয়ামিন। তৃষাণ প্রশ্ন করল,” সকালে কখন?”

” আমি ফোন করব।”

” ঠিকাছে।”

ফোন রাখতেই সে দেখল ইয়ামিন বত্রিশ পাটি বের করে হাসছে। প্রাণ খুলে হাসলে যে কাউকে সুন্দর লাগে। কিন্তু ইয়ামিনকে চমৎকার লাগছে। উষসী বেশিক্ষণ তাকাল না। সে ধরা খেতে চায় না। এমনিতেও এই হাড় বজ্জাত লোকের বজ্জাতির প্রেমে পড়ে তার অর্ধেক জীবন শেষ। এখন আবার নতুন করে হাসির প্রেমে পড়ে সে বাকি জীবন শেষ করতে চায় না।

ইয়ামিন বলল,” থ্যাঙ্কিউ। ”

” এতো থ্যাঙ্কিউ বলার কিছু নেই। আমি আম্মুর জন্য এটা করছি। কাল আম্মু এখানে এসে যদি দেখে আমি নেই তাহলে কি ভাববে আমার সম্পর্কে? ”

ইয়ামিন আবারও হাসল। উষসী মুখ গম্ভীর করে বিছানায় বসেই সতর্ক সংকেত দিল,” খবরদার, কোনো উনিশ-বিশ করার চেষ্টা করলে কিন্তু ঘুষি খাবেন। আমরা একহাত দূরত্ব বজায় রেখে শোবো। আপনি খাটের ওই প্রান্তে আর আমি…”

উষসী তার কথা শেষ করতে পারল না। এর আগেই ইয়ামিন ‘উনিশ-বিশ’ টা করে ফেলল। হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরল তার কোমড়ে আর ঠোঁট দিয়ে ধরল ঠোঁট। ঘটনার আকস্মিকতায় উষসী ঝিম মেরে গেল একদম। গাঢ় অনুভূতিতে চোখে অশ্রু জমতে লাগল।

বেশ কিছুক্ষণ পর ইয়ামিন অনুভব করল উষসী কাঁদছে… তখন অচিরেই ছেড়ে দিল তাকে। অবাক হয়ে বলল,” কি হয়েছে উষুপাখি?”

কান্নামাখা গলায় খেঁকিয়ে উঠল উষসী,” আপনি একদম টাচ করবেন না আমাকে। একদম না।”

” ঠিকাছে।”

” ছাড়ুন আমাকে। ছাড়ুন।”

” কিন্তু আমি কিভাবে ছাড়ব? তুমিই না আমাকে ছাড়বে।”

উষসী খেয়াল করল ইয়ামিন তাকে বহু আগেই ছেড়ে দিয়েছে। বরং কঠিন হাতে ইয়ামিনকে ধরে আছে সে নিজেই! লজ্জা পেয়ে গেল উষসী। ইয়ামিন হেসে বলল,” দেখলে, তুমি নিজেই আমার আদর পেতে উন্মুখ হয়ে আছো। তবুও কেন অস্বীকার করছো উষুপাখি? নিজেও কষ্ট পাচ্ছো, আর আমাকেও কষ্ট দিচ্ছো।”

উষসী ইয়ামিনের মুখটা হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,”মোটেও না, আপনার আদর আমার একদম চাই না।”

এই কথা বলে উন্মাদের মতো ইয়ামিনের কপালে, নাকে, গালে চুমু দিতে লাগল সে। কাতর গলায় বলতে লাগল,” আমি আপনাকে একটুও ভালোবাসি না।”

তারপর গলায় চুমু দিতে দিতে বলল,” যদি আর কখনও আমাকে ছেড়ে যান অথবা আমার সাথে মিথ্যা বলেন, তাহলে আমি আপনাকে মেরে ফেলব। বুঝেছেন?”

ইয়ামিন শক্ত করে উষসীকে জড়িয়ে ধরে বলল,” বুঝেছি, কিন্তু তুমি তো আমার বুকে ঝড় তুলে দিলে একদম। এবার ঝড়ের পরিণাম সামলাতে পারবে তো জান?”

উষসী কাঁদতে কাঁদতে বলল,” আপনি একটা শয়তান, রাক্ষস।”

ইয়ামিন ঘোর মেশানো কণ্ঠে বলল,” আর তুমি আমার জান। আমার আদরের বউ, উষুপাখি।”

চলবে

আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-৪২+৪৩

0

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৪২
লিখা- Sidratul Muntaz

মৃদু শব্দে উষসী দরজায় কড়া নাড়তেই ইয়ামিনের ঘুম ভেঙে গেল। উষ্ণতাও চোখ পিটপিট করে তাকাল। নিজের পায়ের কাছে ইয়ামিনকে দেখে প্রথমেই কিছুটা ভড়কে গেল সে। গায়ের কাপড় ঠিক করার চেষ্টা চালালো। ইয়ামিনের সামনে সে কিভাবে শুয়ে ছিল আল্লাহ মালুম। কেমন অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে এলো শরীর।

” তুমি… এখানে কি করছ?”

উষ্ণতা প্রশ্নটা করেই ইয়ামিনের দিকে চেয়ে রইল।ইয়ামিন চোখ-মুখ কচলাতে লাগল। তারও খুব অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। এখানে সে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল তা খেয়ালই নেই। রাতে ওই কথা কাটাকাটি হওয়ার পর উষসী ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিয়েছে। ইয়ামিন অনেক বার দরজা ধাক্কানোর পরেও সে খোলেনি। তাই বাধ্য হয়ে এখানেই বসতে হয়েছে। কিন্তু এভাবে ঘুমিয়ে পড়া উচিৎ হয়নি।

উষসী নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বলল,” ও সারারাত এখানেই ছিল আপু। তোমার পায়ের কাছে ঘুমিয়েছিল।”

” ওমা, সেকি! কেন?”

” তোমার যদি কিছু প্রয়োজন হয়… সেজন্য হয়তো। যাইহোক, ভোর হতে যাচ্ছে। আমাদের এখন একবার হাসপাতালে যাওয়া উচিৎ। ”

উষ্ণতা অস্থির গলায় বলল,” হ্যাঁ তাইতো। আমি হাসপাতালে যেতে চাই। উষু, তোর তৃষাণ ভাইয়ের কোনো খবর পেয়েছিস?”

” এখনও পাইনি। হাসপাতাল থেকে কেউ ফোন করেনি। আমরা গেলেই জানতে পারব।”

উষ্ণতা হু হু করে কাঁদতে শুরু করল আবার। ইয়ামিন শুকনো মুখে উষসীর দিকে তাকাচ্ছে। উষসীর দৃষ্টিও ইয়ামিনের দিকেই নিবদ্ধ। তিনজনের মন তিন ধরণের ভিন্ন ব্যথায় কাতর। অথচ তারা কেউই তা জানে না।

ক্লায়েন্টের সাথে একটা জরুরী মিটিংয়ে আজ সকাল-সকাল নুহাশপল্লী যেতে হয়েছিল তৃষাণকে। তৃষ্ণার জন্য কেক আর গিফটস নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে পেছনের একটা ট্রাকের ধাক্কায় তার এক্সিডেন্ট ঘটে৷ সেই ট্রাক ড্রাইভার আপাতত পুলিশ কাস্টাডিতে আছে৷ তৃষাণের মাথায় অনেকটা আঘাত লেগেছে আর হাত-পায়ে ইনজুরি হয়েছে যদিও তেমন গুরুতর কিছু ক্ষতি হয়নি। কিন্তু উষ্ণতা হাসপাতালে এসে তাকে দেখেই খুব কান্নাকাটি শুরু করল।

তৃষাণ হাসার চেষ্টা করে বলল,” ধাক্কা খুব জোরে লেগেছিল৷ একটুর জন্য গাড়ি উল্টে যায়নি। যদি উল্টাতো তাহলে আজকে হয়তো আমাকে আর জীবিত দেখতে না।”

সে এমনভাবে কথা বলছে যেন এটা খুবই সাধারণ ব্যাপার। উষ্ণতা কটমট করে বলল,” চুপ, একটা থাপ্পড় দিবো এসব ফালতু কথা বললে।”

তারপর খুব শক্ত করে তৃষাণকে জড়িয়ে ধরল সে। অশান্ত মন কিছুটা হলেও সুস্থির হলো এতে। তৃষাণ মৃদু কণ্ঠে জানতে চাইল,” বেশি ভয় পেয়েছিলে?”

” আরেকটু হলে আমি মরেই যেতাম। ফোন কেন ধরোনি আমার?”

তৃষাণ দুইহাতে উষ্ণতাকে জড়িয়ে ধরতে নিলেই ডানহাতে ব্যথা অনুভব করল। “আহ” করে চেঁচিয়ে উঠতেই উষ্ণতা বলল,” কি হয়েছে? উফ, তোমার হাতটা নাড়ানোর কি দরকার?”

তৃষাণ বলল,” ফোনে চার্জ ছিল না। সেজন্যই সুইচড অফ হয়ে গেছিল বোধ হয়৷ স্যরি।”

” ইটস ওকে। এখন থেকে পাওয়ার ব্যাংক সাথে রাখবে। বাইরে থেকে তুমি ফোন না ধরলে আমি পাগল হয়ে যাই। তাই সবসময় ফোন ধরার চেষ্টা করবে।”

” যো হুকুম মহারাণী!”

উষ্ণতা হেসে ফেলল। তৃষাণও হাসছে৷ তাদের কত সুখী দেখাচ্ছে! কেবিনের বাইরে থেকে ঝাপসা দৃষ্টিতে এই দৃশ্য দেখছে উষসী। এই যাবৎকালে তার দেখা সবচেয়ে রোমান্টিক জুটি তার আপু আর দুলাভাই। ইশ, তাদের মতো যদি সবার সম্পর্ক হতো তাহলে এই পৃথিবীতে বিচ্ছেদ বলে কিছু থাকতো না।

ইয়ামিন পাশে এসে দাঁড়াতেই দ্রুত হাতে চোখের জল মুছল উষসী। ইয়ামিন খাবারের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল,” কালরাত থেকে না খেয়ে আছো তুমি। এখন একটু খেয়ে নিবে, এসো।”

উষসী ইয়ামিনের দিকে না তাকিয়েই দায়সারা গলায় বলল,” আমার ক্ষিদে নেই।”

তারপর কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করেই চুপচাপ জায়গাটা থেকে সরে গেল। ইয়ামিন তার আচরণে হতচকিত। উষসী কখনও এমন করে না। সে কি কিছু আঁচ করতে পেরেছে? নিজের করা ভুলের জন্য দেয়ালে মাথা ঠুঁকতে মন চাইল ইয়ামিনের।

বাড়ি ফেরার পর থেকে সারাদিন একবারও উষসী ইয়ামিনের সাথে কথা বলেনি। ইয়ামিন নানান বাহানায় তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু বিশেষ কোনো লাভ হয়নি। ইয়ামিন বুঝতে পারছে… কিছু একটা নিশ্চয়ই হয়েছে। আচ্ছা, উষ্ণতার ঘরে ঘুমিয়ে পড়ার ব্যাপারটা নিয়ে কি উষসী মাইন্ড করেছে? করারই কথা। কিন্তু সেটা তো তার ক্লিয়ারলি ইয়ামিনকে বলা উচিৎ। এভাবে রাগ দেখানোর কি মানে?

আয়শা বিছানা ঝারতে ঘরে এসেছিল৷ এই সুযোগে ইয়ামিন বলল,” উষসীকে গিয়ে বলো.. আমার খুব মাথা ব্যথা করছে। ও যেন একটু ঘরে আসে।”

” জ্বী স্যার। এখনি বলতাছি।”

” বলতাছি না, বলছি। তোমাকে শুদ্ধভাষা শেখার কথা কতবার বলতে হবে?”

আয়শা জীভ কেটে অপরাধের ভঙ্গিতে বলল,” স্যরি স্যার… এখনি বলছি।”

ইয়ামিন অপেক্ষায় রইল। একটু পর আয়শা গরম নারকেলের তেল নিয়ে ঘরে ঢুকল। ইয়ামিন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,” কি ব্যাপার?”

আয়শা হাসিমুখে জানাল,” ম্যাডাম বলছে, আপনার মাথায় গরম তেল মালিশ করে দিতে। তাহলেই মাথাব্যথা ঠিক হয়ে যাবে। আর শান্তির একটা ঘুম আসবে।”

ইয়ামিন রেগে গেল। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল,” আমি কখন বললাম যে ঘুমাতে চাই? উষসীকে আসতে বলো। এখনি।”

আজগর সাহেবের সাথে ড্রয়িংরুমে বসে দাবা খেলছে উষসী। আয়শা এসে বলল,” স্যার আপনাকে ডাকছে ম্যাডাম।”

” তোমাকে না বললাম তেল গরম করে নিয়ে যেতে? ”

“নিয়ে গেছিলাম তো। কিন্তু গরম তেল দেখে স্যার উল্টা আমার উপরেই গরম হয়ে গেছেন। বলেছেন আপনাকেই যেতে হবে।”

উষসী শ্বশুরের সামনে একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল,” আমি যেতে পারব না। এখন ব্যস্ত আছি। ওকে বলো একটা টাফনিল খেয়ে শুয়ে পড়তে।”

আয়শা পড়ল মহা মুশকিলে। এখন গেলে যদি আবার ধমক খায়? বিরক্ত গলায় বলল,” আমি পারব না। আপনিই গিয়ে বলেন।”

আজগর রাগী আওয়াজে বললেন,” পারবে না কেন? বউমা যা বলছে তাই করো। কথা বাড়িও না। যাও।”

বাধ্য হয়ে আয়শাকে যেতে হলো। মিসেস শিমলা গরম চা আর পাকোড়া নিয়ে খেলা দেখতে এসেছেন। তিনি উষসীর টিমে। চিয়ার করছেন উষসীকে। কিন্তু জেতার পথে আছেন আজগর সাহেব। শিমলা উষসীকে বিভিন্ন কৌশলে শিখিয়ে দিচ্ছেন কখন কিভাবে কিস্তিমাৎ চাল দিতে হবে। আজগর সাহেব খুবই অসন্তুষ্ট হচ্ছেন স্ত্রীর কাজে৷ টান-টান উত্তেজনার মুহুর্ত। উষসী গরম চায়ে চুমুক দিয়ে খেলায় মেতে উঠেছে। এমন সময় আয়শা ফিরে এসে বিরস মুখে বলল,” ভাবী, স্যার বলেছেন টাফনিলে কাজ হবে না। আপনাকেই লাগবে।”

উষসীর মুখ থেকে ছিটকে চা বেরিয়ে গেল। শ্বশুর-শাশুড়ীর সামনে লজ্জায় আটসাঁট হয়ে গেল তার মুখটা। মিসেস শিমলা অবাক হয়ে জানতে চাইলেন,” মানে?”

আয়শা কিছু বলার আগেই উষসী বলল,” তেমন কিছু না, আম্মু। আমি একটু উপরে যাচ্ছি। ”

” কি বলো? খেলার এমন ইন্টারেস্টিং মোমেন্টে তুমি চলে যাবে? আরেকটু পরে যাও।”

আজগর বললেন,” থাক, ওকে যেতে দাও৷ তোমার ছেলে নাহলে বিরক্ত করতেই থাকবে।”

শিমলা এবার মুচকি হেসে বললেন,” ঠিকাছে, যাও।”

উষসী মাথা হেঁট করে উপরে গেল। ইয়ামিনের উপর মনে মনে ভীষণ রাগ হলো তার৷ সে ঘরে ঢুকতেই ধপাশ করে দরজাটা আটকে দিল ইয়ামিন। উষসী রাগে কিড়মিড় করে বলল,” আপনার প্রবলেম কি?”

” তার আগে বলো, তোমার প্রবলেম কি? এতোক্ষণ ধরে ডাকছি, আসছিলে না কেন? কি এমন রাজকার্যে ব্যস্ত ছিলে?”

” আপনি ডাকলেই আমাকে আসতে হবে নাকি? আপনার কথা শোনা ছাড়া কি আমার কোনো কাজ নেই? আমি কি আপনার ক্রীতদাসী?”

ইয়ামিন বিস্মিত গলায় বলল,” এভাবে কেন কথা বলছো? হোয়াটস রং উইদ ইউ?”

উষসী ক্রোধ নিয়ে বলল,” আমার তো আপনার সাথে কথাই বলা উচিৎ না।”

” তাই? তাহলে বলছো কেন কথা?”

” কারণ আমি নির্লজ্জ, বেহায়া! তাই।”

” উষসী, ক্লিয়ারলি বলো। হোয়াট হ্যাপেন্ড?”

” হোয়াট হ্যাপেন্ড না। বলুন হোয়াট ডিডন্ট হ্যাপেন্ড?জানেন, সবচেয়ে বড় ভুল কি? আমাদের বিয়েটা। এর চেয়েও বড় ভুল কি জানেন? ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত বদলানোটা। যদি সেদিনই আমাদের ডিভোর্স হয়ে যেতো তাহলে আজকে আর এতোকিছু হতোই না। ”

” মানে কি এসবের?” ইয়ামিন শক্ত করে চেপে ধরল উষসীর বাহু৷ তার কপালের নীল শিরা ফুলে উঠেছে। চোখ লাল হচ্ছে।

” যদি তোমার ডিভোর্সই দরকার ছিল তাহলে আগে বললে না কেন? সেটাই তো করতে চেয়েছিলাম আমি।”

উষসী ঝারি মেরে বলল,” কারণ আমি ব্রেইনলেস ছিলাম। বোকার মতো বিশ্বাস করেছিলাম আপনাকে। কিন্তু আপনি শুধুই আমার বিশ্বাসের ফায়দা লুটেছেন। আমাকে হাতের পুতুল ভেবেছেন।”

” আমি তোমাকে হাতের পুতুল ভেবেছি?”

” হ্যাঁ ভেবেছেন। নেহায়েত আম্মু আর বাবা কষ্ট পাবে… তাই আমি তাদের কিছু জানাতে চাই না। আর মাত্র সাতদিন তো? এরপরেই লস এঞ্জেলসে চলে যাচ্ছি আমরা। সেখানে গিয়ে আপনি আপনার রাস্তায় চলবেন আর আমি আমার রাস্তায়।”

” তার মানে তুমি আমাকে ডিভোর্স দিতে চাও?”

” হ্যাঁ চাই।”

” আমি কি কারণটা জানতে পারি?”

উষসী অকপটে বলল,” না।” তারপর ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ইয়ামিন নিথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল অনেকটা সময়। উষসীর থেকে এমন আচরণ অপ্রত্যাশিত!

সকাল-সকাল আয়শা স্টোর-রুম পরিষ্কার করার কাজে লেগেছে। উষসী তাকে হেল্প করতে ঢুকেছিল। অনেক ধুলা-বালি থাকায় সে ভাবল চলে যাবে। তখনি তার পায়ের কাছে ঠেঁকল একটা কাঠের বাক্স। সেই বাক্স খুলতেই বের হয়ে এলো উষ্ণতার অল্প বয়সের কিছু ছবি। আর ইয়ামিনের হাতে আঁকা কিছু স্কেচ। কত যত্ন করেই না উষ্ণতার ছবি এঁকেছে সে। কাউকে গভীরভাবে ভালোবাসলেই হয়তো এইভাবে তার ছবি আঁকা যায়। এতোবছর আগের ছবি সংরক্ষণ করেও রাখা যায়! উষ্ণতার কিছু ছবিতে লালরঙা মার্কার দিয়ে হার্ট শেপ আঁকা হয়েছে। ছবির পেছনে লেখা হয়েছে প্রেমের আবেগময় গান, কবিতা। এসব দেখতে দেখতে উষসীর চোখ অজান্তেই ঝাপসা হলো। গলার কাছে এসে আটকাল তীব্র বিষব্যথা।

পেছন থেকে আয়শা বলল,” ম্যাডাম, কি দেখেন?”

উষসী দ্রুত বাক্সের জিনিসগুলো গুটিয়ে বলল,” কিছু না। আমি এই বাক্সটা নিয়ে যাচ্ছি।”

” এটা? আচ্ছা নেন। আমি তো ভাবছিলাম ফেলায় দিবো। আপনার ভালো লাগলে রাখেন।”

উষসী বাক্সটা নিয়ে ঘরে চলে এলো। কলিংবেল বাজছে। মিসেস শিমলা দরজা খুলতেই উষ্ণতাকে দেখলেন।

” আরে, মিষ্টি মেয়ে… কেমন আছো তুমি?”

” ভালো আছি আন্টি। উষসীর সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। ও তো কাল চলে যাচ্ছে…”

” ও হ্যাঁ… তুমি না এলে আমিই ওকে পাঠাতাম তোমাদের সাথে দেখা করার জন্য৷ ভেতরে আসো মা। বাসার সবাই কেমন আছে?”

” আলহামদুলিল্লাহ, আপনাদের দোয়ায় সবাই বেশ ভালো। ”

” তোমার হাজব্যান্ডের এক্সিডেন্ট হয়েছিল না? এখন কি অবস্থা?”

” আল্লাহর রহমতে ভালো আছে। মা উষসীর জন্য একটু পিঠা আর আঁচার বানিয়ে পাঠিয়েছিল৷ ”

” ওমা, তাই? উষসী উপরের ঘরে আছে। আমি ওকে ডাকব না তুমি যাবে?”

” আচ্ছা আমিই যাই।”

উষ্ণতা ঘরে ঢুকে উষসীকে কোথাও পেল না৷ হাতের জিনিসগুলো একপাশে রেখে বিছানায় বসল সে। উষসীর মোবাইল বেজে উঠল হঠাৎ। উষ্ণতা মোবাইল খুঁজতে গিয়ে দেখল ওয়্যারড্রপের উপর একটা কাঁঠের বাক্স। নিজের অল্পবয়সের একটা ছবি দেখে সেখানেই তার নজর আটকে গেল। কৌতুহলবশত বাক্সের আধখোলা ঢাকনাটি সরাতেই সে হতভম্ব!

চলবে

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৪৩
লিখা- Sidratul Muntaz

উষ্ণতা ওপরে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই মিসেস শিমলাও উঠে আসেন। বেডরুমে উষ্ণতাকে হতবিহ্বলের মতো বসে থাকতে দেখা যায়। শিমলা প্রশ্ন করলেন,” কি হয়েছে মা? উষসীকে পাওনি? ও মনে হয় নিচে আছে।”

হাতের কাঠের বাক্সটা উপরে তুলে কাঁপা কণ্ঠে জানতে চাইল উষ্ণতা,” এই জিনিসটা কার আন্টি?”

শিমলা ভ্রু কুঁচকে কয়েক মুহূর্ত বাক্সটির দিকে চেয়ে থেকে সহাস্যে বললেন,” এটা তো ইয়ামিনের ছোটবেলার বাক্স। তুমি কোথায় পেলে? দেখি তো…”

শিমলা এগিয়ে এসে উষ্ণতার হাত থেকে বাক্সটি নিতে উদ্যত হয় কিন্তু উষ্ণতা দ্রুত হাত সরিয়ে নেয়। চোখ-মুখ শক্ত করে বলল,” এটা ইয়ামিনের বাক্স? আপনি কি নিশ্চিত?”

” হ্যাঁ। ছোটবেলা থেকে তো এটা সবসময় ওর কাছেই দেখেছি। ও বিদেশ থেকে যখন ফিরল তখন ওর লাগেজেও আমি দেখেছিলাম। খুবই পারসোনাল জিনিস। কাউকে ধরতেও দেয় না। তুমি বরং আমার কাছে দিয়ে দাও… আমি রেখে দিচ্ছি।”

উষ্ণতা বলল,” এর ভেতরে কি আছে তা কি আপনি জানেন?”

” না৷ আমি জানব কেমন করে? বললাম তো ও নিজের জিনিস কাউকে ধরতেই দেয় না। আমার ছেলেটা খুব ইন্ট্রোভার্ট ছোট থেকেই।”

উষ্ণতার চোখের স্বাভাবিক রং বদলে গেছে। ক্রমশ লাল হচ্ছে চেহারা। গম্ভীর স্বরে বলল,” আপনি ভুল করেছেন আন্টি। আপনার দেখা উচিৎ ছিল যে এর মধ্যে কি আছে।”

উষ্ণতা তার কিছু ছবি শিমলার হাতে তুলে দিয়ে বাক্স নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। শিমলা প্রথমে কিছুই বুঝতে পারেন না। তারপর উষ্ণতার ছবিগুলো দেখে যেন আকাশ ভেঙে পড়ে তাঁর মাথায়। তিনি হতভম্বের মতো ছবিগুলো হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। ইয়ামিন ছোট থেকে একটা মেয়েকে ভালোবাসে। কিন্তু মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছিল। এইটুকু শিমলা জানতেন। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও কখনও কল্পনা করেননি যে সেই মেয়েটি উষ্ণতা হবে!

হায় আল্লাহ, এ কি সর্বনাশ হলো? উষসী এসব জানলে কি হবে? আর বাক্সটা যখন উষ্ণতার হাতে পড়েছে তার মানে উষসীরও জানতে দেরি নেই। শিমলা দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বের হোন। উঁচু স্বরে ডাকলেন,” উষ্ণতা, আমার কথা শোনো মা।”

উষ্ণতা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। সচল পায়ে সে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে আসে। তার দুই চোখ অস্থির হয়ে খুঁজছে ইয়ামিনকে। ব্যাকইয়ার্ডে পৌঁছাতেই তার দেখা পাওয়া গেল।

ইয়ামিনের হাতে ফোন। তখন থেকে উষসীকে ফোন করে নিচে আসার জন্য বলছে। কিন্তু উষসী তার ফোনটাই ধরছে না। হঠাৎ উষ্ণতার ক্ষীপ্র আগমন ইয়ামিনকে চমকে দিল। হাতের বাক্সটি দেখে সে আরও বড় ধাক্কা খেল।

উষ্ণতার চোখ-মুখ থেকে আগুন বের হচ্ছে। প্রায় উন্মতের মতো প্রশ্ন করল সে,” এসব কি ইয়ামিন? কি এগুলো? ”

ছবিগুলো বের করে ইয়ামিনের মুখে ছুঁড়ে মারল সে। অতঃপর আছাড় মেরে মেঝেতে ফেলে দিল বাক্সটি। শাণিত শব্দে ইতস্তত হলো ইয়ামিন। হকচকানো কণ্ঠে বলল,” এটা আপনি কোথায় পেলেন?”

” তোমাদের ঘরে।”

বিস্ময়ে ইয়ামিন ভ্রু কুঁচকাল। এই বাক্সটি তো গতকালই সে ফেলে দিয়েছিল স্টোর-রুমে। উষসীর হাতে যেন কখনোই এগুলো না পড়ে। তাই এতোবছরের সব স্মৃতি মুছে ফেলতে চেয়েছিল জীবন থেকে। কিন্তু সে যা চায় সবসময় তার উল্টোটাই কেন হয়? কেন এই বাক্স উষ্ণতার হাতেই পড়তে হলো? কেন? কেন? কেন?

লজ্জা আর জড়তায় ইয়ামিন মাথা তুলে তাকাতেই পারল না। কোনো জবাব দেওয়া তো দূর। উষ্ণতা দুই কদম এগিয়ে এসে পুনরায় প্রশ্ন করল স্ব- প্রকোপে,” আমি জানতে চাই, এসব কি? উত্তর দাও ইয়ামিন। আমি যা ভাবছি, যা দেখছি… সব কি সত্যি?”

উষ্ণতা চূড়ান্ত উত্তেজিত। ইয়ামিন অসাড় গলায় উচ্চারণ করল,” সত্যি।”

রাগ দমন করতে না পেরে উষ্ণতা সবেগে ইয়ামিনের গালে চড় মারল। গর্জন করে বলল,” তুমি আমার বোনের জীবন কেন নষ্ট করলে? কোন সাহসে? উষসী এসব জানতে পারলে কি হবে?”

ক্রোধে ফেটে পড়ছে উষ্ণতার শরীর। ইয়ামিন মাথা নিচু করে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বলল,” ও এসব কখনও জানবে না।”

” আমার তো মাথাতেই আসছে না এগুলো কিভাবে সম্ভব? এই ভোলাভালা চেহারার আড়ালে যে এমন কুৎসিৎ রূপ লুকিয়ে আছে তা যদি আমি বুঝতাম তাহলে কখনও উষুর সাথে তোমার বিয়ে দিতাম না। আমার বোনের জীবনটা মনে হচ্ছে নিজের হাতেই শেষ করে দিলাম আমি। ছি!”

” উষসীর জীবন শেষ হয়নি। আমি আপনাকে কথা দিয়েছিলাম যে ওকে সবসময় ভালো রাখব। আর আমি আমার কথার খেলাফ করব না।”

” চুপ করো তুমি। মিথ্যাবাদী, প্রতারক! এখনও কথা বলতে তোমার লজ্জা করছে না? ”

উষ্ণতা এই পর্যায় তেড়ে এসে ইয়ামিনের কলার টেনে ধরল। ক্রুর দৃষ্টিতে প্রশ্ন করল, “অ্যাই, তোমার মনে যে এইসব ছিল তা আগে কেন বলোনি? বিয়ের আগে কেন বলোনি? উষুকে কেন বিয়ে করলে তুমি?”

ইয়ামিন উত্তর দিল না। বামপাশে নজর পড়তেই থমকে গেল সে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে উষ্ণতা সেদিকে তাকাতেই দেখল উষসী দাঁড়িয়ে আছে। আতঙ্কে স্তব্ধ হলো এবার উষ্ণতা নিজেও। ত্বরিতে ইয়ামিনের কলার থেকে হাত সরিয়ে নিল। উষসীর দুই চোখ ভর্তি অশ্রু। বেদনাভরা দৃষ্টি। একটা কথাও সে বলল না। একহাতে চোখের জল মুছে সামনে হাঁটতে শুরু করল হঠাৎ। যেন সে সবকিছু বুঝে নিয়েছে, সবকিছু মেনে নিয়েছে।

উষ্ণতা সবেগে দৌড়ে গিয়ে টেনে ধরল বোনের হাত। বেদনায় সিক্ত হয়ে বলল,” উষু, আমার কথাটা শোন৷ আই এম স্যরি। আমি কিছু জানতাম না… বিশ্বাস কর! আমাকে তুই মাফ করে দে।”

নিষ্ঠুরের মতো নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল উষসী। উষ্ণতার দিকে একটা তাচ্ছিল্য ভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই ভেতরে ঢুকে গেল। প্রচন্ড আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল উষ্ণতার মন। সে দাঁড়িয়ে রইল অসহায়ের মতো৷ পুরো পৃথিবী আঁধারে ঢেকে গেল যেন। এটা কোনো দুঃস্বপ্ন নয়তো?

ইয়ামিন দ্রুত বেগে উষসীর পেছনে গেল। উষ্ণতাও যাওয়ার জন্য কদম বাড়ালে মিসেস শিমলা তাকে আটকে দিলেন। কোমল গলায় বললেন,” ওদের মধ্যকার ঝামেলা ওদেরকেই সামলাতে দাও। এখানে তোমার কোনো দোষ নেই। সবই ভাগ্যের খেলা।”

উষসী ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ঢুকে যেতে নিচ্ছিল। ইয়ামিন তীব্র গতিতে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল শক্ত হাতে। উষসীর কান্নার বেগ বৃদ্ধি পেল আরও। কান্নার সাথে প্রবল শব্দে সে চেঁচাতেও শুরু করল এবার। ছাড়া পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টায় ছটফট করতে লাগল। ইয়ামিন ছাড়ল না তাকে। বলিষ্ঠ আলিঙ্গনে বন্দী রেখেই কাতর গলায় বলল,” আই এম স্যরি… স্যরি!”

” আমাকে ছাড়ুন৷ আমি আপনার থেকে কোনো এক্সপ্লানেশন শুনতে চাই না। লীভ মি এলোন।”

ইয়ামিন অধীর হয়ে উষসীর মুখটা আঁজলায় নিল৷ আবেগকম্পিত কণ্ঠে বলল,” প্লিজ, আমাকে একটা সুযোগ দাও। আমি সব ঠিক করে দিবো৷ তুমি আমার নতুন স্বপ্ন। আমি তোমাকে আর একবারও হারাতে চাই না।”

ছলছলে দৃষ্টি মেলে উপরে চাইল উষসী। ইয়ামিনের দৃষ্টিতে দৃষ্টিপাত করে বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল,” কিন্তু আমি আপনাকে আর একবারও পেতে চাই না। আপনি আমার সব স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছেন। আফসোস!”

এই কথা শোনার পর ইয়ামিন থমকে গেল, স্তম্ভিত হলো। তার শরীর নিষ্ক্রিয় হয়ে গেল। উষসী তাকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকল। তুমুল শব্দে বন্ধ করল দরজা। সেদিন শুধু ওই কাঠের দরজাটাই বন্ধ হয়নি…একই সাথে ইয়ামিনের জন্য উষসী মনের দরজাও বন্ধ হয়েছিল।

আমেরিকায় আসার পর উষসী আলাদা এপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়ে চলে যেতে চায়। কিন্তু ইয়ামিন তাকে ডিভোর্স দিতে প্রস্তুত না। উষসী ডিভোর্সের জন্য পাগলামি শুরু করে। একটা দূর্দমনীয় প্রতিশোধ স্পৃহা জেগে তাকে উন্মাদ বানিয়ে দেয়। তারপর হঠাৎ যখন তার প্রেগন্যান্সির খবর জানা গেল, তখন ইয়ামিন যেন আরও বেশি ডমিনেটিং হয়ে গেল তার প্রতি। সে খুব ভালো করেই জানে যে জোর করে কখনও একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায় না। তবুও ইয়ামিন কেন এমন করছে তা জানে না উষসী।

(বর্তমান)
ভেজা শাড়িতেই ফ্লোরে বসে ঠকঠক করে কাঁপছে উষসী। ঠান্ডায় তার শরীর প্রায় অবশ হয়ে এসেছে। গায়ের জ্বরটা যেন আরও একধাপ বেড়ে গেছে। চোখেমুখে অন্ধকার দেখতে পাচ্ছে সে। মাথায় কি প্রচন্ড ব্যথা!

ইয়ামিন ঘরে ঢুকে এই অবস্থা দেখে খুব ঘাবড়ে গেল। ভেজা শাড়িটা এখনও বদলানো হয়নি। উষসীকে দেখে মনে হচ্ছে সে অর্ধ অচেতন। ইয়ামিন নিজেই তার শাড়ি বদলে দিল। তাকে বিছানায় শোয়ালো। তার কপালে জ্বরপট্টি দিয়ে দিতে লাগল৷ একসময় উষসী চোখ মেলে তাকাল।

ইয়ামিন হাসল তার দিকে চেয়ে। খানিক ঝুঁকে এসে মৃদু গলায় বলল,” এখন কেমন লাগছে? ক্ষিদে পেয়েছে? কিছু নিয়ে আসি?”

দূর্বল কণ্ঠে উষসী বলল,” না।”

তারপর হঠাৎ ইয়ামিনের কলার টেনে ধরে প্রশ্নবিদ্ধ কণ্ঠে শুধাল,” কেন এসব করছেন? এসব করে কোনো লাভ নেই।”

” লাভ-ক্ষতির হিসাব পরে৷ আগে তুমি সুস্থ হও। আমাদের বাবু সুস্থভাবে পৃথিবীতে আসুক। ”

উষসী আহত কণ্ঠে বলল,” আপনি শুধু বাবুর জন্য আমাকে আটকে রাখতে চাইছেন?”

” না, আমি নিজের জন্য তোমাকে আটকে রাখতে চাইছি৷ আমি তোমাকে ভালোবাসি৷ তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অধ্যায় উষসী। তোমাকে হারালে আমি ধ্বংস হয়ে যাব।”

তৃষ্ণার্তের মতো উষসীর কপালে চুমু দিল সে।

” আমি তো আপনাকে ছেড়ে যেতে চাইনি কখনও। কিন্তু আপনি আমাকে বাধ্য করেছেন। আমি কি করব?”

ইয়ামিন ঠোঁট দিয়ে উষসীর চোখের জল মুছে দিল। ব্যাকুল গলায় বলল,” আমাকে ভালোবাসো আগের মতো আবার। আর কিচ্ছু করতে হবে না।”

উষসী দুই পাশে মাথা নাড়ল। গাঢ় ব্যথায় টনটনে কণ্ঠ নিয়ে উচ্চারণ করল,” আমি পারব না, এটা অসম্ভব। আপনি আবার আমাকে ছেড়ে যাবেন না তার কি গ্যারান্টি আছে?”

” আমি আর কখনও তোমাকে ছেড়ে যাবো না।”

” ছাড়ুন আমাকে। চলে যান এখান থেকে। আমি আপনার কোনো কথা বিশ্বাস করি না। চলে যান। ”

এই কথা বলেও দুই হাতের মুঠিতে ইয়ামিনের টি-শার্ট চেপে ধরে রাখল সে। অর্থাৎ মুখে তিরস্কার করলেও মন থেকে সে কোথাও যেতে দিতে চায় না ইয়ামিনকে। সেটা বুঝতে পেরেই প্রশ্রয়ের হাসি ফুটল ইয়ামিনের ঠোঁটে। উষসীর সারা মুখশ্রীতে সে চুমু দিল। এমনভাবে আদর করতে লাগল যেন উষসী কোনো ছোট্ট শিশু।

উষসী ব্যগ্র কণ্ঠে বলল,” ছাড়ুন নয়তো আপনাকে আমি খু-ন করব।”

” তোমার হাতে খু-ন হতেও আমার আপত্তি নেই।”

উষসী অসহায় হয়ে বলল,” কেন এমন করছেন? আমাকে কষ্ট দিতে ভালো লাগে আপনার?”

” তুমিও কি কষ্ট কম দিচ্ছো আমাকে? আমার জীবনে আরও আগে কেন এলে না উষসী?”

” আমি এসেছিলাম। কিন্তু আপনি আমাকে গ্রহণ করেননি।”

” আমার ভুল হয়েছে। ক্ষমা করে দাও।”

” সব ভুলের সত্যিই কি ক্ষমা হয়?”

” কেন হয় না?”

প্রশ্নগুলো ঢাকা পড়ল রাতের অন্ধকারে। গোপন হলো দীর্ঘশ্বাস। একটা নতুন সূর্যোদয়ের আশায় কাটল রাত্রী।

সকালে উষসীকে পাশে না পেয়ে তড়াক করে জেগে ওঠে ইয়ামিন। উষসী কোথায়? সেদিনের মতো আবারও পালিয়ে যায়নি তো? সেটা সম্ভব না। মেইন গেইট ক্রস করে উষসী বের হওয়ার আগেই গার্ড তাকে আটকাবে।

তবুও ইয়ামিনের ভয় হচ্ছে। উষসীকে হারিয়ে ফেলার তীব্র ভয় ধারালো খঞ্জরের মতো খুঁড়ে খাচ্ছে তার ভেতরটা। সচল পায়ে সে পুরো ঘর তল্লাশী করল। তার হৃৎস্পন্দন সর্বোচ্চ উর্ধ্বসীমায়। উষসীকে না দেখা পর্যন্ত এতোটুকু শান্ত হবে না মন।

লিভিংরুমে পা রাখতেই প্রাণ ফিরে পেল ইয়ামিন। উষসী পিলারের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ তার পেছন দিকটা দেখা যাচ্ছে শুধু। ইয়ামিন ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে।

গভীর উচ্ছ্বাস নিয়ে ঠোঁটে কিস করল। সঙ্গে সঙ্গেই দুইহাতের ধাক্কায় দিয়ে তাকে শান্ত হতে ইশারা করল উষসী। ইয়ামিন শান্ত হলো। সামনে তাকাতেই দেখল সোফায় তৃষাণ বসে আছে।

চলবে

আমি পথ হারিয়ে ফেলি পর্ব-৪০+৪১

0

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৪০
লিখা- Sidratul Muntaz

(অতীত)
বিয়ের সাতদিনের মাথায় ইয়ামিন নববধূ রেখে বিদেশ চলে যাওয়ায় সবার মধ্যে একটা চাপা গুঞ্জন শুরু হয়ে গিয়েছিল। এমনকি ইয়ামিনের বাবা-মা পর্যন্ত সন্দেহ করতে ছাড়ল না। তারা তো উষসীকে এই বিষয়ে প্রায়ই জিজ্ঞাসাবাদ করতো। উষসী বহু কষ্টে নিজের মধ্যে সব চেপে রেখেছে। কাউকে কখনোই কিছু বুঝতে দেয়নি।

দীর্ঘ এক বছর পর ইয়ামিন হঠাৎ দেশে ফিরে আসে। উষসী ভেবেছিল এবার বুঝি সব ঠিক হয়ে যাবে। ইয়ামিন হয়তো নিজের ভুল বুঝতে পেরে উষসীর কাছে ক্ষমাও চাইবে। উষসী প্রথমে মানতে চাইবে না। ইয়ামিনকে শাস্তি দিবে। তারপর একদিন সব মেনে নিবে।

অথচ উষসীর ভাবনার মতো কিছুই হলো না। ইয়ামিন বিন্দুমাত্র বদলালো না। দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে সে বলেছিল ফিরে এসে উষসীকে ডিভোর্স দিবে। তারপর পরিবারের সবাইকে একটা বানোয়াট কারণ দেখিয়ে বোঝাবে যে তারা সুখে নেই। সবাই তাদের বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত সহজেই মেনে নিবে। দেশে ফিরে সত্যি সেটাই করল ইয়ামিন। একদিন রাতে সে বলল,” আগামীকাল সকালে ডিভোর্সের জন্য কোর্টে যাবো আমরা। তৈরী থেকো।”

উষসী নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ওই একটি কথায় তার দুনিয়া উলোটপালোট হয়ে গেল। অথচ ইয়ামিন কেমন নির্বিকার! যেন সকালে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার কথা বলছে সে। একটা বিয়ে ভাঙা বুঝি এতোই সহজ তার কাছে!

তারপর সারারাত উষসীর ঘুম এলো না। ডিভোর্সের পর বাড়িতে সবাইকে কি জবাব দিবে এই নিয়ে চিন্তা করতে করতে তার মাথা ব্যথা হয়ে গেল। একবার তো ভীষণ কান্নাও পেল। অথচ ইয়ামিনের পাষাণ হৃদয় এতোটুকু গললো না।

সকালে উষসী পাথুরে মূর্তির মতো ইয়ামিনের সব কথা মেনে তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। কিন্তু নিয়তির ইচ্ছেটা হয়তো অন্যরকম ছিল। ইয়ামিন কি মনে করে যেন তার কিশোর বয়সের বাইক নিয়ে সকালে বের হয়েছিল। তখনি এক্সিডেন্টটা হয়। উষসী কোর্টে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়েছিল। কিন্তু তাকে যেতে হলো হাসপাতালে।

গুরুতর এক্সিডেন্টে ইয়ামিনের পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায়। এছাড়াও অনেক মেজর ইনজুরি হয় পায়ে। আর্থোপেডিক্স আশংকা করেছিলেন, হয়তো ইয়ামিনের ডান পা আর কখনোই ঠিক হবে না। এই ঘটনার পর হাহাকার নেমে আসে তাদের বাড়িতে। পুরো দেশজুড়ে খবরটি নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়।

নিজের এহেন করুণ অবস্থাতেও ইয়ামিন কিন্তু ডিভোর্সের কথা ভুলে যায়নি। সে নির্দ্বিধায় উষসীকে প্রস্তাব দিল,” তুমি চাইলে মুক্তি নিয়ে চলে যেতে পারো। আমি সুস্থ থাকলে এতোদিনে আমাদের ডিভোর্স হয়েই যেতো। অসুস্থতার বাহানায় তোমাকে আমি আটকে রাখতে চাই না।”

উষসী মুখ ভার করে বলে ফেলল,” আমি তো এই অবস্থায় আপনাকে ডিভোর্স দেবো না!”

ইয়ামিন তাচ্ছিল্য হেসে শুধাল,” কেন? দয়া দেখাতে চাও নাকি?”

উষসীও হেসে ফেলল। গভীর হতাশাময় নিশ্বাস ছেড়ে বলল,” আপনাকে দয়া দেখানোর আমি কে বলুন? আমি আপনাকে ছেড়ে গেলেও আপনার জন্য মেয়ের অভাব হবে না। আপনি হলেন বিখ্যাত ইয়ামিন ইব্রাহীম, সবার চোখের মণি। ভক্তকূল আপনার জন্য প্রাণ নিবেদন করতেও প্রস্তুত। সেখানে আমার স্পর্ধা কিভাবে হবে আপনাকে দয়া দেখানোর? কিন্তু আপনাকে ছেড়ে গেলে যে আমি সবার কাছে দোষী হবো! আপনি অসুস্থ, এই অবস্থায় আপনাকে ছেড়ে গেলে মানুষ আমাকে স্বার্থপর ভাববে। কেউ তো আর জানবে না যে আমাদের আগেই ডিভোর্স হওয়ার কথা ছিল। বরং সবাই ভাববে… এক্সিডেন্টে আপনার পা ভেঙে যাওয়ার কারণে আমি আপনাকে ডিভোর্স দিয়েছি। শুধু শুধু নিজের এতোটা বদনাম আমি করতে চাই না৷ যখন আপনি সুস্থ হবেন… ডিভোর্স তখনি হবে। ততদিন না হয় আমি অপেক্ষা করব।”

ইয়ামিন উষসীর কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে ভাবল। এক পর্যায় মাথা নেড়ে বলল,” ভালোই বলেছো। এই অবস্থায় ডিভোর্স হলে মানুষ তোমাকে স্বার্থবাদী ভাববে আর আমাকে সিমপ্যাথি দেখাবে। অথচ ব্যাপারটা তো উল্টো হওয়ার কথা ছিল, তাই না? নিজের স্বার্থের জন্য আমিই তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি। স্বার্থবাদী তো আমিই হলাম।”

” সেসব কথা থাক। আপনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন এই কামনা করি।”

ইয়ামিন প্রথমে উষসীর কথা বিশ্বাস করেছিল। সে ভেবেছিল হয়তো সত্যিই উষসী নিজের বদনাম হওয়ার ভয়ে ডিভোর্স নিতে চাইছে না। কিন্তু ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারল, উষসীর উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ আলাদা। সে ইয়ামিনের অসহায় অবস্থায় তাকে ছেড়ে যেতে চায়নি বলেই ডিভোর্স নেয়নি। নিজের ইমেজ খারাপ হওয়ার ভয়ে না। উষসীর মতো মেয়েরা কখনও নিজেকে নিয়ে এতো ভাবে না৷ তারা যাকে ভালোবাসে, মন উজাড় করে বাসে। খুব সরল মনে, নিজের অস্তিত্ব বিলীন করে সে ইয়ামিনকে ভালোবেসেছিল। পৃথিবীর শুদ্ধতম ভালোবাসা।

টানা ছয়মাস ইয়ামিনকে বিছানায় পড়ে থাকতে হয়। এই এতোগুলো দিন শিমলাও হয়তো মা হিসেবে নিজের ছেলের এতোটা যত্ন করতে পারেননি, যতটা যত্ন উষসী করেছে। ইয়ামিনের বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন হবে ভেবে সে সারারাত জেগে থাকে। মুখ দিয়ে ডাকার আগেই হাজির হয়ে যায়। কখন কোন ঔষধ খেতে হবে, কয়ঘণ্টা হাঁটতে হবে, কয়ঘণ্টা ঘুমাতে হবে… সব উষসীর নখদর্পনে চলে আসে মাত্র কয়েক দিনেই। এমনও হয়েছে ইয়ামিন বাথরুমে যাওয়ার জন্য ওঠার চেষ্টা করছে তখন স্বয়ংক্রিয় উষসীর ঘুম ভেঙে যায়। সে আন্তরিক হেসে বলে,” আরে, আমাকে ডাকবেন না?”

তারপর অতি যত্নে ইয়ামিনের হাত নিজের কাঁধে নিয়ে তাকে ধীরে ধীরে বিছানা থেকে ওঠায়। সুস্থ হলেই যাকে ডিভোর্স দিতে হবে তার জন্য এতো কষ্ট, এতো ত্যাগ কোনো সাধারণ নারীর পক্ষে করা কি সম্ভব?

ইয়ামিন ক্লান্ত হয়ে একদিন জিজ্ঞেস করেই ফেলল,” এসব করে তোমার কি লাভ হয় উষসী? আমাকে ঋণী বানাতে চাও?”

উষসী উচ্চশব্দে হেসে বলল,” এটা ঋণ হবে কেন? আমি আপনার স্ত্রী৷ এসব আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আর আমি কখনও নিজের দায়িত্বের অবহেলা করি না।”

ইয়ামিন অবাক চোখে তাকাতেই উষসী বলল,”মজা করলাম। আসলে আমি এসব না করলে মা-বাবা কি ভাববে বলুন? ভাববে তাদের ছেলের প্রতি আমার কোনো ভালোবাসাই নেই। আমি নিজের ইমেজ তাদের কাছে খারাপ করতে চাই না। যা করছি সব নিজের জন্যই করছি। আপনি ভাববেন না যে আপনার জন্য করছি। এখানে আপনার গিল্টি ফীল করারও কিছু নেই।”

মুখে এসব বললেও উষসী মন থেকে যে কি চায় তা ইয়ামিন বেশ ভালোই জানে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে সেই চাওয়াটা সে কখনোই উষসীকে দিতে পারবে না। নিজের প্রতি উষসীর ভালোবাসা সম্পর্কে সে আগেই অবগত ছিল। কিন্তু কখনও উপলব্ধি করেনি। ছয়মাস বেডরেস্টে থাকা অবস্থায় সেই ভালোবাসার উত্তাপ উপলব্ধি করার সুযোগ হয়৷ তখন সে নিজের কাছে অপরাধী হতে শুরু করে আর উষসীর কাছে অতি নগন্য!

মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙলে সে দেখে উষসী নামাযে বসে ফুপিয়ে কাঁদছে, তার চোখ ফুলে যাচ্ছে, মগ্ন হয়ে সে এবাদত করছে। দোয়া পড়ে ইয়ামিনের গায়ে এসে ফু দিচ্ছে আবার কখনও কাতর হয়ে কপালে দিচ্ছে চুমু। ফজরের নামায শেষ করে উষসী ঘুমাতে আসে রোজ। অথচ ইয়ামিন সারারাত জেগে থাকে। এতোটুকু ঘুমাতে পারে না। তার বিবেক তাকে জাগিয়ে রাখে প্রতিটি রাত। দিনের পর দিন তার উষসীর প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ে আর নিজের প্রতি বাড়ে তীব্র ঘৃণা।

ভাগ্যের জোরেই হোক কিংবা উষসীর দোয়ার জোরেই হোক, ইয়ামিন সুস্থ হতে পেরেছিল অবশেষে। তাদের পুরো পরিবার অপারেশনের জন্য কানাডায় যায়। তার সুস্থতা উপলক্ষ্যে সবার মাঝে আনন্দের ঢেউ পরিলক্ষিত হয়। ইয়ামিনের মনে হয়, সে একটা নতুন জীবন পেয়েছে। তার দূর্ভাগ্য বদলে গেছে। এই পুরো ক্রেডিট শুধু উষসীর। সবার সামনে ইয়ামিন ঘোষণা করে যে সে কতটা ভাগ্যবান বলে উষসীর মতো স্ত্রী পেয়েছে! তাকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য ইয়ামিন চেরি গার্ডেনে একটা পার্টির ব্যবস্থা করে।

তাদের জুটি দেখে মানুষ ঈর্ষান্বিত হয়। শিমলা আর আজগর দোয়া করেন যেন কখনোই তাদের সম্পর্কে নজর না লাগে। অথচ আড়ালের খবর তো কেউই জানে না। তবে এতোকিছুর পরে উষসী আবারও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। ভেবেছিল এবার বুঝি ইয়ামিন তার ভালোবাসা বুঝবে। আর কখনও ডিভোর্সের কথা বলবে না।

কিন্তু সবই মিথ্যা ছিল। ইয়ামিন তৃতীয়বারের মতো উষসীর স্বপ্ন ভঙ্গের কারণ হলো। তাকে চোখে আঙুল দিয়ে পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিল যে সবার জন্য সবকিছু না। বাংলাদেশে ফিরেই ইয়ামিন ডিভোর্সের প্রসঙ্গ তুলে। কানাডায় সবার সামনে সে যা কিছু বলেছিল তা সব যেন মুহূর্তেই বদলে যায়।

ইয়ামিন একদিন তাকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছে। উষসীর ধারণা ছিল ইয়ামিন তার কাছে ক্ষমা চাইবে। নিজের ভুল স্বীকার করে সারাজীবন একসাথে থাকার অঙ্গীকার করবে। রূপকথার গল্পের মতো হ্যাপি এন্ডিং হবে। কিন্তু হলো সব উল্টা। ইয়ামিন ভালোবাসার কথা বলার পরিবর্তে বলল অন্যকথা,” তুমি খুব ভালো মেয়ে উষসী। কিন্তু আমি তোমার যোগ্য না। তুমি আমার চেয়ে অনেক ভালো কাউকে ডিজার্ভ করো। তাই আমাদের ডিভোর্স হওয়াই ভালো।”

উষসীর কণ্ঠে কান্নারা এসে আটকে যায়। চোখে অশ্রু টলমল করে। সে আলগোছে চোখের পানি মুছে সায় দিল। এছাড়া অন্যকোনো উপায়ও তার কাছে নেই। ছেলে হলে বোধহয় সে ইয়ামিনের পায়ে ধরতো। আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে ভালোবাসা ভিক্ষা চাইতো। ভালোবাসা পাওয়ার লোভে বেহায়া হতো। কিন্তু মেয়ে হওয়ায় সে ঠেঁকে গেছে। মেয়েরা চাইলেই বেহায়া হতে পারে না। মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা স্বীকার করতেও তাদের অনেক দ্বিধা!

ইয়ামিন বলল,” তাহলে আমি ডিভোর্সের ব্যবস্থা করি। তুমি তোমার বাড়িতে কি বলবে ঠিক করেছো?”

উষসী শক্ত কণ্ঠে বলল,” সেসব নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। আমি সব সামলে নিবো।”

” শিউর?”

” হুম।”

“ওকে।”

উষসী বাড়ি ফিরে সারারাত হাউমাউ করে কাঁদল। এবার বুঝি তাদের ডিভোর্সে আর কোনো বাঁধা নেই। এতোদিন তো ইয়ামিনের অসুস্থতার বাহানার ডিভোর্স ঠেঁকিয়ে রাখা গিয়েছে, কিন্তু এবার কি হবে? ইয়ামিনকে হারানোর ভয় এমনভাবে তাকে জেঁকে ধরে যে একবার মনে হয়, কখনও ইয়ামিন সুস্থ না হলেই বুঝি ভালো ছিল।

নিজের স্বার্থপর মনোভাবের জন্য উষসী নিজেকে ধিক্কার দেয়। কিন্তু তার ভীষণ কষ্ট হয়। এতোকিছুর পরেও কেন ইয়ামিন তাকে বুঝল না? কেন তাকে ছেড়ে চলে যাবে? সে ভালো কাউকে ডিজার্ভ করে এটা কত সহজেই বলে দিল। অথচ উষসীর মন কি চায় তা একবারও জানতে চাইল না! এতো নির্দয় সে, এতো পাষাণ!

প্রতিদিন ইয়ামিনের যত্ন নেওয়া তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। উষসী পারবে না বাকি জীবন ইয়ামিনকে ছাড়া কাটাতে। কিন্তু এখন তো ইয়ামিন সুস্থ হয়ে গেছে। তার আর উষসীর সাহায্যের প্রয়োজন নেই। এবার সে উষসীর থেকে শুধু ডিভোর্স চায়। উষসী ঠিক করল সে ইয়ামিনকে মুক্তি দিবে।

গভীর রাতে শিমলা দরজায় নক করলেন। উষসী কান্না মুছে মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে দরজা খুলল।স্বাভাবিক স্বরে বলল,” কিছু বলবেন আম্মু?”

” রাত বারোটা বাজে। ছেলেটা কি এখনও ফেরেনি মা?”

উষসী ভুলেই গেছিল যে ইয়ামিন এখনও বাড়ি ফিরেনি। সে বিচলিত গলায় বলল,” না তো মা। টেনশন করবেন না। সে মাঝে মাঝে একটু রাত করেই ফেরে।”

” সেজন্য বলছি না। আসলে আমি আর তোমার বাবা একটু ঢাকার বাইরে যাচ্ছি। ইয়ামিন এলে ওকে ব্যাপারটা জানিয়ে দিও। ও ফোনটাও ধরছে না।”

” এতোরাতে আপনারা কোথায় যাচ্ছেন আম্মু? সব ঠিকাছে তো?”

” আসলে আমার খালা খুব অসুস্থ। তাকে দেখতেই গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি। ওই… মাইমুনার কথা মনে আছে না তোমার?”

” জ্বী।”

” মাইমুনার নানী।”

” আচ্ছা আম্মু। সাবধানে যেয়েন। পৌঁছে কিন্তু ফোন করবেন।”

” ঠিকাছে। ছেলেটা ফিরলে খেতে দিও। খাবার ফ্রীজে আছে। আয়শাকে বললেই গরম করে দিবে।”

” আচ্ছা।”

ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে সাথে লোডশেডিং। জেনারেটরের অবস্থা ভালো নেই। অন্ধকার বাড়িতে উষসী কেবল মোমবাতি জ্বেলে রেখেছে। এমন ঘন আঁধারে প্রায় দু’বছর আগের সেই অভিশপ্ত রাতটির কথা মনে পড়ল। যে রাতের কারণে আজ তাদের সম্পর্ক এতোদূর গড়িয়েছে। একটা ভুল সবকিছু বদলে দিয়েছে। কিন্তু ভুলের পরিণাম কখনোই ভালো হয় না। সেজন্যই বুঝি আজ তাদের সম্পর্কের পরিণতি এরকম! এসব চিন্তা করে উষসী একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

নিজের করা কাজগুলোর জন্য ইয়ামিন সারাক্ষণ হীনমন্যতায় ভুগছে। তার বার-বার মনে হয় সে উষসীর অযোগ্য। তাই নিজের কাছে উষসীকে বেঁধে রাখতে চায় না। উষসীর মতো মেয়ে অনেক ভালো জীবন ডিজার্ভ করে। যা ইয়ামিনের কাছে থাকলে সে পাবে না৷ তাই বাধ্য হয়ে ইয়ামিন ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু এতোদিন একসাথে থাকার পর একটা অকৃত্রিম মায়া সৃষ্টি হয়ে গেছে উষসীর প্রতি। ইয়ামিন সেই মায়ার বাঁধন ছেড়ে বের হতে পারছে না। তার নিজেকে শূন্য লাগছে।

ডিভোর্সের কথা বলার সময় সে ভেবেছিল উষসী নিষেধ করবে। কিন্তু সে এতো সহজে মেনে গেল যে ইয়ামিন এখন নিজেই সেটা মানতে পারছে না। উষসীকে ছেড়ে থাকতে হবে এটা চিন্তা করেই কেমন দমবন্ধ লাগছে। এমন কেন হচ্ছে? এমন হওয়ার তো কথা ছিল না কখনোই। কিন্তু পরিস্থিতিই এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে ইয়ামিন চাইলেও আর উষসীকে নিজের কাছে রাখতে পারবে না। সেটা করতে গেলে স্বার্থপরতা হবে। ইয়ামিন নিজের স্বার্থের জন্য উষসীকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। সে আর স্বার্থপর হতে চায় না। এবার উষসীকে মুক্তি দেওয়া বাঞ্চনীয়।

ঘরে ঢুকে উষসী চমকে উঠল ইয়ামিনকে দেখে। বুকে হাত চেপে বলল,”ওমা, আপনি কখন এলেন?”

ইয়ামিন যন্ত্রের মতো জবাব দিল,” এইতো, একটু আগে।”

” ঠিকাছে বসুন। আসলে বাড়িতে কেউ নেই। আম্মু আর বাবা কিছুক্ষণ আগে বের হয়েছেন। তারা টাঙ্গাইল যাচ্ছেন। আপনাকে জানাতে বলল।”

“ও।”

” আপনার নিশ্চয়ই ক্ষিদে পেয়েছে? আমি আয়শাকে বলে দিয়েছি ও খাবার গরম করছে। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন।”

ইয়ামিন খেয়াল করল উষসীর মধ্যে ডিভোর্স নিয়ে কোনো উদ্দীপনা নেই। সে যথেষ্ট স্বাভাবিক আছে। অথচ ইয়ামিন নিজের সিদ্ধান্তে খামোখাই কষ্ট পাচ্ছে। সে ডাকল,” শোনো।”

” জ্বী, বলুন?”

অন্ধকারে ইয়ামিনের রক্তিম দৃষ্টি উষসীর নজরে পড়ল না। তাই তার ভাঙা কণ্ঠের আর্তনাদও টের পেল না। ইয়ামিন বলল,” আমাদের ডিভোর্সের ব্যাপারটা নিয়ে মনে হয় আরেকবার আলোচনা করা উচিৎ। ”

সে এই কথাটা বলেছিল ডিভোর্স নিয়ে উষসীর মনোভাব জানার উদ্দেশ্যে। কিন্তু উষসী ভাবছিল অন্যকিছু। ডিভোর্স তো ঠিক হয়েই গেছে। এখন সেটা নিয়ে কথা বাড়িয়ে নিজেকে কষ্ট দেওয়ার মানেই হয় না। সে বলল,” এই ব্যাপারে আলোচনার আর কিছু নেই। আপনি ডিভোর্সের ব্যবস্থা করুন। আমার কোনো সমস্যা নেই।”

এইটুকু বলে উষসী ঘর থেকে বের হয়ে গেল। তার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। যা অন্ধকারে ইয়ামিন দেখল না। এদিকে তার উত্তর শুনে ইয়ামিনের হৃযয়ে হু হু করে বয়ে যাচ্ছে অবাধ ঝড়। তা উষসীর পক্ষেও টের পাওয়া সম্ভব নয়।

টেবিলে খাবার সাজিয়ে উষসী আবার ঘরে এলো ইয়ামিনকে ডাকতে। সে তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টির তীব্র ছাঁট এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে তার পুরো শরীর। অথচ সে কত নির্বিকার! উষসী বিস্ময় নিয়ে বলল,” পাগল হয়েছেন? বৃষ্টির মধ্যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভিজছেন কেন? ভেতরে চলুন।”

ইয়ামিন কোনো জবাব দিল না। উষসী বারান্দায় এসে ইয়ামিনের হাত ধরল। তখনি ইয়ামিন গাঢ় কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল,” উইল ইউ মিস মি?”

উষসী হতচকিত হলো,” মানে?”

” ডিভোর্সের পর কি আমাকে মিস করবে তুমি?”

” হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?”

” উত্তর দাও।”

উষসী অভিমান নিয়ে বলল,” কি যায়-আসে? আমার উত্তরে তো কোনোকিছু বদলাবে না, তাই না?”

ইয়ামিন ক্রোধে কিড়মিড় করে বলল,” হেয়ালি করবে না একদম। আমার প্রশ্নের উত্তর দাও উষসী। তুমি কি চাও?”

উষসীর চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল, শুধু আপনাকে চাই। আমি আমার এক জীবনে শুধু আপনাকেই চাই। যদি মৃত্যুর পর আরেকটা জীবন পাওয়ার সুযোগ হয়… তাহলে সেই জীবনেও শুধু আপনাকেই চাইব আমি।”

কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বলা সম্ভব হলো না। বজ্রপাতের ঝলকে এক মুহূর্তের জন্য আলোকিত হলো আকাশ। সেই তীব্র আলোয় ইয়ামিন দেখল উষসীর চোখে অশ্রু। সে আশ্চর্য হয়ে বলল,” কাঁদছো কেন?”

উষসী ভাঙা গলায় বলল,” জানি না।”

সে যেতে নিলে ইয়ামিন বারান্দায় দরজা আটকে দিল। পুনরায় প্রশ্ন করল,” বলো, কেন কাঁদছো? না বললে যেতে দিবো না।”

উষসী এবার সবচেয়ে অদ্ভুত কাজটা করল। ঝটিতে ইয়ামিনের ঠোঁটে তীব্র চুমু আঁকল। বিবাহিত জীবনের পর তাদের প্রথম স্পর্শ। একটা স্বর্গীয় মুহূর্তের সৃষ্টি হলো। চিরায়ত ঘোরে ডুবে গেল দু’জনেই। হঠাৎ উষসীর হুশ ফিরতেই সে ছিটকে সরে গেল। ভুলটা করে ফেলার পর মন চাইল হাওয়ায় মিশে যেতে। আবেগের বশে সে যেটা করেছে সেজন্য নিজের গালেই থাপড়াতে মন চাইল। ইয়ামিন কেমন বিভ্রম নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। লজ্জায় উষসী দৌড়ে পালাতে নিলেই ইয়ামিন টেনে ধরল তার হাত। উষসী ঝাঁকি মেরে হাত সরিয়ে ছুটতে চাইল। তখন ইয়ামিন টেনে ধরল শাড়ির আঁচল।

উষসী লজ্জায় দিশেহারা। এমন একটা ভুল করার পর কোনো অবস্থাতেই আর ইয়ামিনের মুখের দিকে তাকানোর সাহস নেই। সে নিজেকে মুক্ত করতে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে গা থেকে শাড়ি খুলেই পালিয়ে গেল। তার এমন আচরণে ইয়ামিন কিংকর্তব্যবিমুঢ়। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। উষসী দরজার কাছে গিয়ে থেমে দাঁড়ালো। এই অবস্থায় সে ঘরের বাইরে যেতে পারবে না। অথচ ভেতরেও থাকতে পারবে না। কি অদ্ভুত দোটানা!

উষসী দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে রইল। বড় বড় শ্বাস নিতে লাগল। তার পুরো শরীর কাঁপছে। ইয়ামিন এসে দরজা আটকে দিতেই আত্মা কেঁপে উঠল তার। সে আর্তনাদ করে বলল,” প্লিজ, আমাকে যেতে দিন।”

ইয়ামিন এগিয়ে বলল,” এতো সহজে?”

উষসী মাথায় হাত রেখে বেহুশ হয়ে গেল। হঠাৎ এমন ঘটনায় থতমত খেল ইয়ামিন। উষসীকে কোলে চড়িয়ে বিছানায় আনল। তার গালে, হাতে মালিশ করতে লাগল। কিন্তু উষসী কোনো সাড়া প্রদান করল না। দাঁত-মুখ খিচে বেহুশের মতো পড়ে রইল। লজ্জা থেকে বাঁচতে এর চেয়ে ভালো পদ্ধতি আর মাথায় আসছিল না। কিন্তু ইয়ামিন কিভাবে যেন বুঝে গেল ব্যাপারটা।

সে আলতো করে উষসীর কোমরে সুরসুরি দিতেই নড়েচড়ে চোখ মেলে তাকাল উষসী৷ ইয়ামিন হেসে ফেলল। উষসী অস্বস্তিতে পুনরায় চোখ বন্ধ করে অপরাধীর মতো বলতে লাগল,” আই এম স্যরি। আমাকে মাফ করে দিন। আমার ভুল হয়ে গেছে। আর কখনও এমন হবে না…”

ইয়ামিন উষসীর ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে কঠিন গলায় বলল,” শশশ, এতোবড় ভুল করে আবার কথা বলছো, লজ্জা নেই তোমার?”

উষসী চুপসে গেল। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠল।অনুনয়ের স্বরে বলল,” আমার শাড়িটা দিয়ে দিন, প্লিজ।”

” শাড়ি পেলেই তো তুমি আবার পালাবে।”

” না৷ সত্যি বলছি পালাবো না। প্লিজ, শাড়িটা দিন।”

” উহুম। আগে শাস্তি, তারপর শাড়ি।”

উষসী বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চাইল,” শাস্তি মানে?”

” ভুল যখন করেছো… শাস্তি তো পেতেই হবে। তাই না?”

উষসীর মুখ কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। তীব্র লজ্জায় উচ্চারণ করল,” কি শাস্তি দিবেন?”

” সেটা তো আমি বুঝবো। আমার ব্যাপার। ”

উষসীর গলা শুকিয়ে গেল। অপমানে আর লজ্জায় খুব কাঁদতে মন চাইল। চোখ থেকে গড়গড় করে অশ্রু ঝরতে লাগল। ইয়ামিন আলতো হাতে সেই অশ্রু মুছে ফিসফিসিয়ে বলল,” কাঁদছো কেন বোকা মেয়ে? এখনও তো কিছুই করলাম না।”

” আমার ভুল হয়ে গেছে। আমাকে মাফ করে দিন।”

” মাঝে মাঝে ভুল ভালোর জন্য হয়।”

” মানে? আমার এই ভুলে কি ভালো হলো?”

” আমার ভালো হলো।”

” কিভাবে.. ” উষসী তার কথা শেষ করতে পারল না। ইয়ামিন ফট করে তার ঠোঁটে দীর্ঘ, প্রলম্বিত আর গাঢ় চুমু দিল। উষসীর চোখ দু’টো বিস্ময়ে যেন ফেটে বেরিয়ে আসবে কোটর থেকে। কাঁপতে লাগল হাত-পা। বাইরে থেকে আয়শা আওয়াজ দিল,” আপা, খাবার তো ঠান্ডা হয়া গেল। কই আপনারা?”

উষসী কাঁপা স্বরে বলল,” আয়শা… ডাকছে।”

ইয়ামিন দায়সারা উত্তর দিল,” ডাকুক।”

সে অবলীলায় উষসীকে জড়িয়ে ধরল শক্ত হাতে। উষসীর প্রাণস্পন্দন থেমে আসতে চাইল। বুকে কি অবাধ্য তোলপাড়! গলায় ঠোঁটের স্পর্শ অনুভব হতেই বিছানার চাদর খামচে ধরল উষসী। এই অসহ্য সুখব্যথা অনুভব করার চেয়ে ভালো তার মৃ*ত্যু হোক!

চলবে

#আমি_পথ_হারিয়ে_ফেলি
পর্ব ৪১
লিখা- Sidratul Muntaz

” তুই কেমন আছিস, বোন আমার?” উষসীর চিবুকে হাত রেখে প্রশ্নটা করল উষ্ণতা।

” খুব, খুব, বেশি ভালো আছি আপু৷ তুমি কেমন আছো?”

হলুদ রঙা শাড়িতে বেশ প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে উষসীকে। চেহারায় স্নিগ্ধতার আভা। চোখ-মুখ বেশ উজ্জ্বল। বিয়ের পর বোধ হয় এই প্রথমবার বোনকে এতো হাস্যোজ্জ্বল দেখছে উষ্ণতা। সে হাসিমুখে বলল,” আমিও ভালো আছি। তুই একা এলি যে? ইয়ামিন আসেনি কেন?”

” জানি না আপু…. ওর নাকি কি জরুরী কাজ আছে।”

” তোদের মধ্যে সবকিছু ঠিক চলছে তো?”

উষসী লাজুক হাসল। এটা ঠিক যে বিয়ের পর থেকে প্রায় দেড়বছর তাদের মধ্যে কিছুই ঠিক চলছিল না৷ তারা তো ডিভোর্সের সিদ্ধান্তেই অটল ছিল। কিন্তু এখন আর সেই ভয় নেই। তারা সত্যি অনেক ভালো আছে। শুধু একটাই সমস্যা। উষসী ইয়ামিনকে বুঝতে পারছে না। মাঝে মাঝে মনে হয়, ইয়ামিন তাকে ভালোবাসে। আবার কখনও মনে হয় বাসে না! সে নিজের মুখে এখনও ভালোবাসার কথাটা স্বীকার করেনি।

উষ্ণতা বলল,” ইয়ামিন এতো লম্বা সময়ের জন্য বিদেশ ছিল… তোর খারাপ লাগেনি?”

” খারাপ কেন লাগবে?”

উষসী মিথ্যা বলল৷ তার আসলে অনেক খারাপ লেগেছে। উষ্ণতা বলল,” অদ্ভুত মানুষ তোরা। তোর তৃষাণ ভাই দুইদিনের জন্য ঢাকার বাইরে গেলেও আমার অস্থির লাগে। আর তোরা মাসের পর মাস একজন-অন্যজনকে না দেখে কিভাবে থাকিস?”

উষসী মিষ্টি হেসে উষ্ণতাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ” সবাই তো আর তোমার লাকি না।”

” লাকি না বলতে?”

” তুমি যদি তৃষাণ ভাইয়াকে আদেশ করো সারাজীবন তোমার সামনে বসে থাকতে তাহলে সে বিনা প্রশ্নে সেটাই করবে। কিন্তু ইয়ামিন এরকম না। সবাই তো আর তৃষাণ ভাইয়ার মতো হয় না।”

উষসীর কণ্ঠের বেদনা উষ্ণতা অচিরেই টের পেয়ে গেল। উষসীর গালে হাত রেখে সে আশঙ্কাভরা কণ্ঠে শুধাল,” তুই কি সুখে আছিস ইয়ামিনের সাথে?”

” অবশ্যই আছি। কেন সুখে থাকব না?”

” এবার কিন্তু ইয়ামিনকে কোনোভাবেই বিদেশ যেতে দিবি না। স্বামী-স্ত্রী আলাদা থাকা উচিৎ না৷ তুইও ওর সঙ্গে যাবি।”

” যাবোই তো আপু। আমার ভিসা-পাসপোর্ট সব রেডি আছে। তাছাড়া ইয়ামিন এবার আমাকে রেখে কোনোভাবেই যাবে না বলেছে।”

” সত্যি?”

” একদম সত্যি।”

” যাক, এটাই ভালো। ” উষ্ণতার ফোন বেজে উঠল। তৃষাণের নাম্বার। উষসী বলল,” দুইমিনিটও কথা না বলে থাকতে পারে না দেখছি৷ মাত্র কিছুক্ষণ হলো বাইরে গিয়েছে৷ এর মধ্যেই ফোন?”

উষ্ণতা বলল,” আরে… কোনো দরকারে ফোন দিয়েছে বোধ হয়।”

” হুম, বুঝি তো কি দরকার!”

উষসী খিলখিল করে হাসছে। উষ্ণতা মুগ্ধ চোখে তাকাল। এই প্রথম উষসীকে এতো খুশি দেখাচ্ছে। সে সবসময় এভাবে হাসি-খুশি থাকুক মনে মনে শুধু এটাই প্রার্থনা করে উষ্ণতা।

আজ উষ্ণতাদের বাড়িতে অনুষ্ঠান৷ তৃষ্ণার জন্মদিন। উষসী সকাল-সকাল সেজে-গুজে হাজির হয়েছে। ইয়ামিন তাকে ড্রপ করে দিয়েছে ঠিক, কিন্তু ভেতরে আসেনি। কেন যে সে এই বাসায় আসতে চায় না তা বোঝেনা উষসী। অথচ তাকে দেখলে সবাই কত খুশি হতো!অবশ্য আজ এখানে আসার পর থেকে উষসী ইয়ামিনকে একটু একটু মিস করছে। সে ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে ইয়ামিনকে ফোন করল।

” হ্যালো, কি করছেন?”

” গাড়িতে আছি।”

” কোথায় যাচ্ছেন?” উষসী খুব উদ্বেগের সাথে প্রশ্নটা করল। যেন ভয়ংকর কিছু আশংকা করে ফেলেছে। ইয়ামিন বলল,” তোমাকে ড্রপ করে একটু সুপার শপে গিয়েছিলাম… এখন বাসায় ফিরছি।”

” ও আচ্ছা… তাই বলুন।”

” তুমি কি ভেবেছো? কারো সাথে পালাচ্ছি?”

উষসী হেসে বলল,” হুম, বলা তো যায় না। পালাতেও পারেন! ”

” পালিয়ে আর কোথায় যাবো বলো? দিনশেষে তো তোমার কাছেই আসতে বাধ্য আমি।”

” আচ্ছা, তাই? বাধ্য না হলে বুঝি আসতেন না?”

” কি জানি? সেটা তো ভেবে দেখিনি।”

উষসী আশাহত হলো। সে নানান কৌশলে ইয়ামিনের মুখ থেকে শুধু একটা কথাই বের করতে চায়। সেটা হলো,” ভালোবাসি।”

কিন্তু ইয়ামিন মনে হয় না কখনও মুখ ফুটে সেই কথা বলবে। উষসী হঠাৎ খুব অন্যমনস্ক হয়ে বলল,” মাঝে মাঝে আমার কি মনে হয় জানেন?”

” কি?”

” আপনি যদি সাধারণ কেউ হতেন… তাহলেই আমাদের জীবনটা বেশি সুন্দর হতো।”

” মানে? বুঝলাম না।”

” এইযে দেখুন না…আপনি বাইরে বের হলেই কত ক্রেজ শুরু হয় মানুষের মধ্যে। আপনার সামান্য পোস্ট নিয়েও শোরগোল পড়ে যায়। মেয়ে ভক্তদেরও অভাব নেই আপনার। মাঝে মাঝে তাদের কমেন্ট পড়লে আমার কত ঈর্ষা হয় জানেন? ইচ্ছে করে তাদের চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলি।”

ইয়ামিন হেসে উঠল। উষসী ম্লান কণ্ঠে বলল,” এসব না থাকলে জীবনটা কত সহজ হতো, তাই না? আপনি যদি খুব সাধারণ একটা চাকরি করতেন আর আমরা ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকতাম। সারাদিন আমি ঘরের কাজ করতাম আর রাতে আপনার বাড়ি ফেরার অপেক্ষা করতাম। আপনি ফিরলে আমরা একসাথে খাবার খেতাম। বৃষ্টি হলেই ছাদে চলে যেতাম। একসাথে ভিজতাম। মাঝে মাঝে ছুটির দিন আপনার সাথে রিকশায় করে ঘুরতাম। ভাবতেই কত মজা লাগছে, তাই না?”

” হুম, শুধু ভাবতেই মজা লাগছে। ”

উষসী চোখের জল মুছে বলল,”আচ্ছা আমি রাখছি। পরে কথা বলব।”

ফোন রেখে উষসী কিছুক্ষণ কাঁদল। সে ইয়ামিনকে যতটা ভালোবাসে… ইয়ামিনও কি তাকে ততটা ভালো কোনোদিন বাসবে?

সন্ধ্যায় কেক কাটার কথা। কিন্তু তৃষাণ এখনও বাড়ি ফিরেনি। ফোনটাও বন্ধ দেখাচ্ছে। উষ্ণতা দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠল। ক্রমাগত পায়চারী করছে সে। যুথি আর ডোনা তাকে সামলানোর চেষ্টা করছে। উষসী তৃষ্ণার সাথে মোবাইলে গেইমস খেলায় ব্যস্ত। এমন সময় ইয়ামিনের ফোন এলো। সে উষসীকে বলেছে নিচে নামতে। হঠাৎ ইয়ামিনের আগমন একেবারেই প্রত্যাশা করেনি উষসী। সে খুব খুশি মনে নিচে নেমে দেখল, ইয়ামিন পার্কিং সাইডে গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷

উষসী কাছে যেতেই ইয়ামিন তাকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে কিস করল। লজ্জায় গুটিয়ে গেল উষসী। কাঁচুমাচু হয়ে অপ্রস্তুত গলায় বলল,” হঠাৎ এইসময়? আপনি তো আসবেন না বলেছিলেন। ”

” আই ওয়াজ মিসিং ইউ অল দ্যা টাইম।”

খুশির একটা মাতাল ঢেউ বয়ে গেল সারা শরীর বেয়ে। আজ সারাদিন অযথাই কষ্ট পেয়েছে সে। ইয়ামিন যখন তার সঙ্গে এই বাড়িতে আসতে রাজি হলো না, তখন খুব মনখারাপ হয়েছিল উষসীর। মাঝে এটাও মনে হয়েছিল যে ইয়ামিন বুঝি তাকে একদম ভালোবাসে না। কিন্তু এখন সেই ধারণা ভুল মনে হচ্ছে। ভালো না বাসলে মিস করবে কেন?

উষসী হেসে বলল,” সত্যি মিস করেছেন?”

” হুম।”

” তাহলে উপরে চলুন।”

ইয়ামিন দ্বিধা নিয়ে বলল,”এখন না, আমাকে আসলে একটা ফ্রেন্ডের বাসায় যেতে হবে। এই রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলাম তাই মনে হলো তোমার সাথে দেখা করি।”

উষসীর হৃদয়ে বয়ে চলা কলকলে খুশির ঢেউয়ে ভাটা পড়ল এবার। সে ভেবেছিল ইয়ামিন শুধু তার সঙ্গে দেখা করতে এতোদূর এসেছে। তাকে মিস করছিল বলে! কিন্তু এখন বোঝা গেল সে এমনি এসেছে। কারণ এই রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিল তাই।

উষসী মলিন মুখে বলল,” অন্তত সবার সাথে দেখা করে যান। আপনাকে দেখে সবাই খুব খুশি হবে।”

” দেরি হয়ে যাবে। নাহলে যেতাম। প্লিজ ডন্ট মাইন্ড। হুম?”

উষসী হাসার ভাণ করে মাথা দুলাল। ইয়ামিন তার কপালে চুমু দিয়ে বলল,” আসছি, হুম?”

উষসী ভাঙা গলায় বলল,” আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

” বলো।”

অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ কাটিয়ে অবশেষে প্রশ্নটা করেই ফেলল সে,” আপনি কি আমাকে ভালোবাসেন?”

ইয়ামিন সামান্য অবাক হলো। হাসার চেষ্টা করে বলল,” এটা কেমন প্রশ্ন?”

উষসী নিশ্বাস আটকে চোখ-মুখ খিচে বলল,” উত্তর দিন, প্লিজ।”

ইয়ামিন চুপ করে তাকিয়ে রইল। তার মনে অপরাধবোধের তীব্র দহন শুরু হলো হঠাৎ। সে কি ধোঁকা দিচ্ছে উষসীকে?এখনও সে সত্যিটা জানাতে পারেনি। অথচ সবকিছুর আগেই তো তার উচিৎ ছিল আসল সত্যি উষসীকে জানানো। ইয়ামিন ভুল করেছে। কিন্তু সত্যিটা উষসী কতটুকু মানবে সেটাও একটা প্রশ্ন। যদি মানতে না পারে? যদি কষ্ট পায়? ইয়ামিন উষসীর মন ভাঙতে চায় না।

উত্তরের আশায় উষসী অধৈর্য্য হয়ে উঠেছে। ভারী নিশ্বাসে তার বুক কাঁপছে। সে তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন করল,” কথা বলছেন না কেন? সামান্য একটা উত্তর দিতে এতো সময় লাগে?”

ইয়ামিনের কাছে এসে তার পাঞ্জাবীর কলার ধরে ঝাঁকাতে লাগল উষসী,” বলুন না, প্লিজ।”

ইয়ামিন অকপটে বলল,” আমি আসলে কনফিউজড।”

রাগে কপালের শিরা ফুলে উঠল উষসীর। খিটমিট করে বলল,” মানে?”

” মানে অন্য সময় বলব।”

উষসী হিংস্র হয়ে বলল,” এখনও আপনি ওই মেয়েটিকেই ভালোবাসেন, তাই না? তাকে ভুলতে পারেননি। সেজন্যই এতো কনফিউজড আপনি।”

” ওকে ভুলে যাওয়া সম্ভব না। কিন্তু তোমার জায়গা আলাদা।”

উষসী এই উত্তরে সন্তুষ্ট হলো না। কেঁদে ফেলল ঝরঝর করে। ইয়ামিন তার মাথাটা বুকে নিয়ে হাত বুলিয়ে বলল,” আই এম স্যরি। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না৷ কিন্তু ওর কথা আমাকে আর কখনও জিজ্ঞেস কোর না।”

” আমি মানতে পারছি না… আমি তো আপনাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছিলাম। তাহলে আপনি কেন ভালোবাসলেন না? কি দোষ ছিল আমার?”

” তোমার কোনো দোষ নেই৷ সব দোষ আমার।”

উষসী হাউমাউ করে কান্না শুরু করল। ইয়ামিন আশেপাশে চেয়ে বলল,” কেউ দেখলে কি ভাববে? কান্না থামাও, প্লিজ।”

উষসী নিজেকে শান্ত করতে পারছে না৷ ইয়ামিন তাকে নিয়ে গাড়ির ভেতরে ঢুকল। মনে হচ্ছে আর দেরি করা ঠিক হবে না। উষসীকে সত্যি জানানোর সময় এবার এসে গেছে। যা হওয়ার হবে… কিন্তু ইয়ামিন আর উষসীর থেকে কিছু গোপন করবে না। তাই সে বলল,” তোমাকে অনেক কথা বলার আছে। প্রথম দিনই এসব বলা উচিৎ ছিল৷ আমি বলতে পারিনি, এটা আমার ব্যর্থতা। কিন্তু তোমার সব জানার অধিকার আছে।”

উষসী বাচ্চা শিশুর মতো কেঁদে যাচ্ছে। ইয়ামিন শান্ত গলায় বলল,” আমি যাকে ভালোবাসি… তাকে তুমি চেনো। সে আমার ছোটবেলার প্রেম। তখন ভালোবাসা কি সেটাও বুঝতাম না। কিন্তু তার জন্য পুরো দুনিয়া তোলপাড় করতে প্রস্তুত ছিলাম।”

উষসী সহ্য করতে না পেরে বলে উঠল,” প্লিজ চুপ করুন। আমি শুধু একটা কথাই জানতে চাই… আপনি তাকে এখনও ভালোবাসেন কি-না?”

” প্লিজ আমার পুরো কথা আগে শোনো। তারপর তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিবো।”

উষসী আর্তনাদ করে বলল,” না… আগে আপনি আমার এই প্রশ্নের উত্তর দিন। তারপর আমি বাকি কথা শুনবো। এখনও ভালোবাসেন আপনি তাকে? এখনও চান?”

” তাকে পাওয়া তখনও সম্ভব ছিল না… আর এখনও সম্ভব না।” ইয়ামিনের কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়ল গাঢ় আক্ষেপ।

উষসীর বুক ছিঁড়ে যাওয়ার মতো ব্যথা হচ্ছে। বেদনায় সিক্ত হয়ে আসা দৃষ্টিতে বলল,” যদি পাওয়া সম্ভব হয়… তাহলে?”

ইয়ামিন বিপর্যস্ত গলায় বলল,” আমি এসব ভাবতেই চাই না, প্লিজ।”

” আপনাকে বলতে হবে।”

” শী ওয়াজ মাই ফার্স্ট লভ। কখনও ভুলতে পারব না তাকে আমি।”

উষসীর হৃদয় ছিন্ন হয়ে গেল এক নিমেষে। কিয়ৎক্ষণ ইয়ামিনের মুখের দিকে আহত দৃষ্টিতে চেয়ে থেকেই গাড়ি থেকে নামার জন্য উদ্যত হলো। ইয়ামিন তার হাত চেপে ধরে বলল,” উষসী প্লিজ, তুমি কিন্তু এখনও আমার পুরো কথা শোনোনি।”

উষসী তীব্র কণ্ঠে উচ্চারণ করল,” আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না। আমার হাত ছাড়ুন আপনি।”

ইয়ামিন ছাড়ল না। শক্ত করে ধরে থেকে বলল,” এভাবে অর্ধেক কথা শুনে আমি তোমাকে যেতে দিবো না। সবটা তোমাকে শুনতেই হবে আর বুঝতেও হবে।”

” আমি কিছু বুঝতে চাই না। কিছু শুনতেও চাই না। প্লিজ আমাকে এভাবে শাস্তি দেওয়া বন্ধ করুন।”

তাদের বাক-বিতণ্ডার মাঝেই বাইরে থেকে বিকট চিৎকার ভেসে এলো। ইয়ামিন-উষসী ভয়ে তটস্থ হয়ে সেদিকে গেল। উষ্ণতা মেঝেতে বসে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। তার সাথে কাঁদছেন ডোনাও। যুথি দুইহাতে মেয়েকে সামলে রেখেছেন।

ইয়ামিন উতলা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,”কি হয়েছে?”

অনুপমা বলল,” এক্সিডেন্ট করেছে তৃষাণ ভাই।”

এই কথা শুনে উষসী ছুটে গিয়ে আরেকপাশ থেকে উষ্ণতাকে ধরল। উত্তেজিত গলায় বলল,” আপু, তুমি এভাবে ভেঙে পড়ো না। প্লিজ শান্ত হও। ভাইয়ার কিছু হবে না, দেখো!”

উষ্ণতা দূর্বল গলায় আওড়াল,” সকাল থেকে তোর তৃষাণ ভাইয়ের ফোন সুইচড অফ। এখন ওর নাম্বার থেকে একজন ফোন দিয়ে বলছে, ও নাকি এক্সিডেন্ট করেছে। রক্তাক্ত অবস্থা!”

উষ্ণতা এটুকু বলেই অজ্ঞান হয়ে গেল। তার মাথা ঢলে পড়ল উষসীর বুকে। এবার যেন উষসীর নিশ্বাস আটকে আসার উপক্রম হলো। দুইহাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগল সে।

ইয়ামিন উচ্চশব্দে একবার ডাকল,” উষ্ণতা মিস!” তারপর দ্রুত উষ্ণতাকে পাজাকোলায় নিল সে। উষসী মেঝেতে নিথর হয়ে বসে আছে তখনও। ধাক্কাটা সামলাতে সময় লাগছে তার।

অনুপমা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইল ইয়ামিনের দিকে। সে এক্সিডেন্টের বিষয় নিয়ে অস্থির না হয়ে উষ্ণতার প্রতি ইয়ামিনের ব্যাকুল আচরণ দেখে অস্থির হয়ে পড়ল।

দুইঘণ্টা পর, ইয়ামিন বারান্দায় এসে সিগারেট ধরিয়েছে। বিছানায় উষ্ণতা শায়িত। তার শরীর খুব দূর্বল। জ্ঞান এখনও ফিরেনি। এতোক্ষণ উষ্ণতার হাত ধরে পাশেই বসেছিল ইয়ামিন। বাড়ির বাকি সবাই হসপিটালে চলে গেছে। উষসী উষ্ণতাকে দেখা-শুনা করার জন্য এখানেই থেকে গেছে। কি থেকে কি হয়ে গেল। সকালেও কত খুশি ছিল সবাই। আজকের দিনেই কেন এমন একটা কান্ড হতে হলো?

বারান্দা থেকে ইয়ামিন উষসীকে ডাকল। মাথা নিচু করে এগিয়ে গেল উষসী। ইয়ামিন ঠান্ডা গলায় জানতে চাইল,” এখনও কি রেগে আছো?”

” এই বিষয়ে কথা বলার সময় এটা না। আমি শুধু উষ্ণতা আপুকে নিয়ে চিন্তা করছি।”

” ভালো। আর টেনশনের কিছু নেই। রেস্ট করলেই ঠিক হয়ে যাবে তোমার আপু।”

উষসী টলমল দৃষ্টিতে বলল,” রেস্ট করলে শরীরটা না হয় ঠিক হবে… কিন্তু মন? সেটা কি এতো সহজে ঠিক হবে?”

উষসীর কথার ইঙ্গিত বুঝতে অসুবিধা হলো না ইয়ামিনের। সে হাতের সিগারেট ফেলে উষসীকে কাছে টেনে বলল,” আই এম স্যরি।”

” আপনি কেন স্যরি বলছেন? এটা আমার বলা উচিৎ। ভুল করে আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি আমি, স্যরি।”

” তুমি ভুল করে ভালো না বাসলে আমার জীবনটা সবসময় ভুলের মধ্যেই থেকে যেতো উষসী। তুমি ভুলের পরে ফুল হয়ে এসেছো। তোমার সুগন্ধে আমার জীবন পরিপূর্ণ হয়েছে। আমি আর তোমাকে হারাতে চাই না।”

উষসী স্তব্ধ হয়ে আসা কণ্ঠে বলল,” কিন্তু আপনি অন্যকাউকে ভালোবাসেন।”

ইয়ামিন তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,” সে আমার অতীত। আর তুমি বর্তমান, ভবিষ্যৎ…সবকিছু। তাই এবার থেকে শুধু তোমাকে ভালোবাসব। কথা দিলাম।”

” জোর করে ভালোবাসতে হবে না, ছাড়ুন আমাকে।”

উষসী বারান্দা থেকে বের হয়ে গেল। ইয়ামিন একটা চেয়ার টেনে উষ্ণতার বিছানার কাছে বসল৷ তার ঘুমন্ত মুখের দিকে নির্ণিমেষ চেয়ে থেকে হঠাৎ ফিসফিস করে বলল,” থ্যাংকস।”

নিজের বেডরুমে এসে দরজা আটকে দিল উষসী। উষ্ণতাকে তার দেখে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। ইয়ামিন নিজেই সব করছে। উষসী খুব অবাক হয়েছে। তৃষাণ ভাই থাকলে তার আপুর অসুস্থতার জন্য যা যা করতো ইয়ামিনও ঠিক তাই করছে।

সে চিন্তায় অস্থির, চোখ ভরা ক্লান্তি নিয়েও দিব্যি বসে আছে উষ্ণতার সামনে। এক মুহুর্তের জন্যেও সরছে না। এসব দেখে ক্ষণে ক্ষণেই বিস্মিত হচ্ছে উষসী। তার ধারণাই কি তবে সঠিক?

ছোটবেলার কথাগুলো সবই স্পষ্ট মনে আছে তার। ইয়ামিনের ভুলের জন্য একসময় উষ্ণতা আপুকে কতই না সাফার করতে হয়েছিল। বিদায়ের সময় ইয়ামিন উষসীকে বলেছিল, সে যেন উষ্ণতার খেয়াল রাখে।

তখনি উষসীর ধারণা হয়েছিল তৃষাণ ভাইয়ের মতো তার রাক্ষসমানবও বুঝি তার উষ্ণতা আপুকে ভালোবাসে। কিন্তু সে কখনও ভাবেনি এভাবে তার ধারণা সত্যি প্রমাণ হবে। ইয়ামিনের ভালোবাসার সেই মেয়েটি যে উষ্ণতাই হবে! আচ্ছা, উষ্ণতাও কি এই ব্যাপারে জানে? তার তো কিছু মনে থাকার কথা নয়।

তবুও নিজের আপন বোনের প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টি হলো উষসীর৷ অকারণেই মনে হতে লাগল, তার এই দুঃখময় জীবনের পেছনে কোনো না কোনোভাবে উষ্ণতাই দায়ী৷ নিজের এমন অন্যায় ভাবনার জন্য নিজেকেই ধিক্কার জানাল উষসী। তবুও এমন চিন্তা থেকে বের হতে পারল না সে। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে উঠল সে। তারপর কখন জানি তার চোখ লেগে এলো। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ছুটে গেল তার। সে যখন ঘর থেকে বের হয়ে উষ্ণতার বেডরুমে ঢুকল… তখনি দেখল, ইয়ামিন উষ্ণতার পায়ের কাছে মাথা রেখে শুয়ে আছে। এমন দৃৃশ্য দেখে উষসীর গায়ের শক্তি ক্ষয়ে গেল। দম বন্ধ একটা কষ্টময় যন্ত্রণা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল হঠাৎ।

নেক্সট পর্বে অতীতের আরও কিছু অংশ থাকবে। তারপরেই বর্তমান। কি মনে হয় আপনাদের? এখানে কার দোষ বেশি? উষসীর কি ইয়ামিনকে ক্ষমা করা উচিৎ?

চলবে