Monday, August 4, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 414



মেহেরজান পর্ব-৭+৮

0

#মেহেরজান
#পর্ব-৭
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

কিছুক্ষণ আগেই শ্মশানে নিজের বাবাদের মুখাগ্নি করে এসেছে অর্ণব আর শমিত। একদিকে আম্রপালি একদম নিস্তব্ধ হয়ে গেছেন। চোখ থেকে অবিরাম অশ্রু ঝরছে। আরেকদিকে অনুরাধা বিলাপ করে কাঁদছেন। খবর পেয়েই চলে এসেছেন তিনি। শকুন্তলা তাকে সামলাতে ব্যস্ত। কেউ যেন তাকে ধরে রাখতে পারছেন না। একটু পর পরই জ্ঞান হারাচ্ছেন তিনি। নিজের মায়েদের এমন অবস্থায় কি করবে তা নিজেরাই বুঝতে পারছে না অর্ণব শমিত। দুজনের চোখই অশ্রুসিক্ত। অর্ণব একটু পর পর পাঞ্জাবীর হাতায় চোখ মুছে নিচ্ছে। কাল পর্যন্ত হেসেখেলে বাড়ানো ছেলে দু’টো যে আজ এমন কঠিন সময়ের সম্মুখীন হবে তা কেইবা জানতো। শমিত দৌঁড়ে অনুরাধার কাছে গেল। রানী আর তরু মিলে বাচ্চাদের সামলাচ্ছেন। তরু এসে শকুন্তলাকে বললেন,

“ওর তো মনে হয় খিদে পেয়েছে ছোট বউদি। তাই এতো কাঁদছে। কি করবো?”

“আমার কাছে দে।”

চিত্রাকে নিয়ে শকুন্তলা তার ঘরে চলে গেলেন। অর্ণব এসে আম্রপালির কাছে বসল। সবাই অনুরাধাকে সামলাতে ব্যস্ত। আম্রপালির খেয়াল যেন কারও নেই। সে একা এক কোণায় বসে আছেন। অর্ণব আম্রপালির চোখের জল মুছে দিতে দিতে বললো,

“মা, কেন কাঁদছেন আপনি? একদম কাঁদবেন না। আপনার একেকটা অশ্রুকণা যে আমার বুকের উপর বিশাল একেকটা পাথর হয়ে পরে।”

অর্ণবের এমন কথা তার দিকে ঘুরে তাকালেন আম্রপালি। এই ছোট্ট ছেলের মুখ দিয়ে এমন কথা কিভাবে বের হলো? এতো বড় কবে হয়ে গেল সে? নাকি পরিস্থিতি বানিয়ে দিল?

“আপনি কাঁদবেন না মা। বাবা চলে গিয়েছে তাতে কি? আপনার খেয়াল রাখার জন্য আমি তো আছি।”

আম্রপালি অর্ণবকে বুকে জাপ্টে ধরে আর্তনাদ করে উঠলেন।

চিত্রাকে খাইয়ে ঘুম পারানো মাত্রই সাবিত্রী শকুন্তলার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

“মা, তুমি কখন এলে?”

“এইমাত্রই এসেছি।”

“বাবা কই?”

সাবিত্রী খাটে বসতে বসতে বললেন,

“তোর বাবা নিচে আছে। একটু বসতে দে তো এখানে আরামে। সারা বাড়ি ভরা লোকজন। এই গরমে আর কিছুক্ষণ ওখানে থাকলে মরেই যেতাম।”

“তুমি তাহলে বসো এখানে। আমি নিচে যাই।”

“তুই কই যাচ্ছিস? বস না এখানে। এতোদিন পর মায়ের সাথে দেখা হলো আর তুই চলে যাচ্ছিস?”

“কি করবো তাহলে? ওদিকে হয়তো দরকার পরতে পারে আমার।”

“বাকিরা সামলে নিবে ওদিক। তুই এখানে বস কিছুক্ষণ। তা হ্যা রে, জামাই আসবে না?”

“খবর পাঠানো হয়েছে। আসবে কিনা জানি না।”

“আসবে আসবে। সেই বিলেত বলে কথা। আসা যাওয়া কি মুখের কথা নাকি যে হুটহাট করে চলে আসবে? মেয়ের জন্মের খবর শুনে আসেনি তো কি হয়েছে, ভাইয়ের মরার খবর শুনে ঠিকই দৌঁড়ে আসবে।”

দরজায় কারও কড়া নাড়ার শব্দ হলে শকুন্তলা গিয়ে দরজা খুলে দিলেন।

“কি হয়েছে রানী?”

“ওই শ্মশানের লোকেরা এসেছে টাকা নিতে। কি করবো?”

“দেরাজের চাবি তো দিদির কাছে। তার কাছে গিয়ে চা।”

“এখন বড় বউদির কাছে চাইবো?”

“ঠিক আছে। তুই গিয়ে ওদের বসতে বল। আমি আসছি।”

“আচ্ছা।”

শকুন্তলা দরজা লাগিয়ে এসে নিজের আলমারি থেকে কিছু টাকা বের করলেন। সাবিত্রী বলে উঠলেন,

“দেরাজের চাবি এখনো আম্রপালির কাছে কেন?”

“মানে? বড় বউদের কাছেই তো থাকে।”

“তা থাকে। কিন্তু তার জন্য বড় বউদের দায়িত্বও পালন করতে হয়।”

“দিদি করেনি?”

“করেছে কিন্তু এক বছর ধরে যে স্বামী বিছানায় পরা ছিল, সংসারের কোনো খরচ চালিয়েছে? পুরো সংসার তো তোর বরের টাকায় চলে। এখন তো আবার আরও কতগুলো এসে জুটেছে। অনুরাধা আর ওর ছেলে। আর ওই বাচ্চা দুটোকে কই থেকে এনেছেরে? এটা বাড়ি নাকি অনাথাশ্রম? বাচ্চা তুলে এনে ঘরে তুললেই হলো। ওদের খরচ কি আকাশ থেকে পরবে?”

“তুমি বসো। আমি টাকাটা দিয়ে আসি।”

“কিরে? এতগুলো কথা বললাম কিন্তু তুই কানেই তুললি না কিছু?”

“কি বলবো আবার?”

“তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। আমাকেই কিছু একটা করতে হবে।”

“আমার সংসারটা নাহয় আমাকেই দেখতে দাও মা।”

শকুন্তলা চলে যেতে উদ্যত হলে সাবিত্রী তাকে আঁটকালেন।

“আরে দাঁড়া না। পুরো কথা তো শোন। এতোক্ষণ যা বলেছি ভুলে যা। এখন যা বলি মন দিয়ে শোন। আম্রপালি ওই বাচ্চা দুটোকে কই থেকে এনেছেরে?”

“পদ্মা দিদির কোনো এক বান্ধুবীর মেয়ে। কেউ নেই তাই নিয়ে এসেছে। আর মোহিনীকে বাগানবাড়ি থেকে এনেছে।”

“বাগানবাড়ি মানে ওই বাইজীবাড়ি?”

“হ্যাঁ।”

“ছিছিছি। আম্রপালির মাথা কি গেছে নাকি যে ওখান থেকে বাচ্চা নিয়ে এসেছে? শোন আমি কি বলি।”

“কি?”

“বাড়িতে পাঁচ পাঁচটা বাচ্চা। সবার ভরণপোষণের দায়িত্ব তো তোর বরকেই নিতে হবে। তাই বলছি কি পারলে এদের বিদায় কর। পদ্মাকে আম্রপালি কোথাও যেতে দেবে না। মোহিনীকে বের করতে হবে। কিছু একটা করতে হবে যেন যেখান থেকে নিয়ে এসেছিল সেখানেই দিয়ে আসে।”

“যদি না দেয়?”

“দেবে দেবে। আর…”

“আর?”

“তোর বর তো বিদেশে একা থাকে। তা এবার এলে অর্ণব আর শমিতকে পাঠিয়ে দে না তার সাথে।”

“পাগল নাকি? দিদি কখনো মানবে না।”

“আরে আমি তো ওদের ভালোর জন্যই বলছি। এখানে থাকলেও ওদের দায়িত্ব তোর বরের আর ওখানে থাকলেও তাই। এতে তোরও ভালো।”

“আমার কি ভালো?”

“ভালো নয় তো কি? বরকে একা ছেড়ে দিয়েছিস। যদি ওখানে কিছু করে বসে?”

শকুন্তলা একটু ভেবে বললেন,

“দিদি মানবে না। অর্ণবকে কখনো দূরে যেতে দেবে না তার থেকে।”

“মানবে। আমি বোঝাবো।”

“কিভাবে?”

“পরেই দেখিস।”
.
.
নিস্তব্ধ রজনীতে অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে বিছানায় বসে আছেন আম্রপালি। নিজের শাঁখা, সিঁদুর, রঙিন শাড়ী ছেড়ে গায়ে সাদা থান জড়িয়েন তিনি। পাশেই মোহিনী আর পদ্মাবতী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। খোলা জানালা দিয়ে জোৎস্না এসে বাচ্চা দুটোর মুখে লাগছে। আম্রপালি অপলক দৃষ্টিতে দেখে চলেছেন তা। সামনে কি হবে জানা নেই আম্রপালির। তবে এইকয়দিনেই বাচ্চা দু’টোর প্রতি অসম্ভব পরিমাণে মায়া জন্মে গেছে তার। টেবিলে রাখা হ্যারিকেন এর আলোও নিভু নিভু পর্যায়ে। আম্রপালি উঠে গিয়ে বোতল থেকে কেরোসিন ঢেলে দিলেন।

“আসবো আম্রপালি?”

“মাসিমা, আপনি? ভেতরে আসুন।”

সাবিত্রী ভেতরে এসে ঘুমন্ত বাচ্চা দুটোকে একবার দেখলেন।

“এতো রাতে? এখনো ঘুমাননি আপনি।”

“ঘুমাওনি তো তুমিও। আমি ঘুমাইনি তারও কারণ আছে। এই গরমে কি আর ঘুম আসে। তার উপর বিদ্যুৎ-ও নেই। ঘরে আর কতক্ষণ থাকা যায়। তাই বের হলাম। দেখলাম তোমার ঘরের দরজা খোলা। আবছা আলো জ্বলছে। বুঝলাম তুমি জেগে আছো।”

আম্রপালি কোনো উত্তর দিলেন না। হাতজোড়া একত্র করে দাঁড়িয়ে রইলেন।

“তুমি কি এখন ঘুমাবে?”

“না।”

“বসো তাহলে। তোমার সাথে দুটো কথা বলি।”

আম্রপালি এসে তার সামনে বসলেন।

“আমি জানি এখন তোমার মনের অবস্থা কেমন। তোমার বয়সও বেশি না। চাইলেই আবার বিয়ে করতে পারবে।”

সাবিত্রী এমন কথায় কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পরলেন আম্রপালি। তিনি যে এরকম কিছু বলবেন তা আন্দাজ করেননি আম্রপালি। সকালে বিধবা হওয়া মেয়েকে যে রাতেই এমন কথা শুনতে হবে তা ভাবতেও পারেননি তিনি। সাবিত্রী বিষয়টা বুঝতে পেরেই প্রসঙ্গ পাল্টালেন।

“কিন্তু তুমি তা করবে না আমি জানি। দ্বিতীয় বিয়ে করার মেয়ে তুমি নও। তোমাকে এখন এই কথাটা বলা ঠিক হবে কিনা জানি না তবুও বলছি।”

আম্রপালি কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলেন,

“কি কথা?”

“শুনলাম দুটো মেয়েকে নিয়ে এসেছো। ওরাই বোধহয়?”

মোহিনী আর পদ্মাবতীর দিকে ইঙ্গিত করে কথাটা বললেন সাবিত্রী।

“হ্যাঁ।”

“খুব মিষ্টি দেখতে। দুজনেই। ওরা দুজনই কি এখন থেকে তোমার কাছে থাকবে?”

“হ্যাঁ। আমার কাছেই থাকবে ওরা।”

“ভরণপোষণ করতে পারবে দুজনের?”

“মানে?”

“আমার কথা খারাপভাবে নিও না আম্রপালি। আমি সবার ভালোর জন্যই বলছি। আমি এটা বলছি না যে তুমি আমার মেয়ের সংসারে বসে বসে খাচ্ছ। এটা তোমারও সংসার। কিন্তু একা চলার সামর্থ্যটা তোমার নেই। একবছর ধরে তোমার স্বামী শয্যাশায়ী ছিল। তখন সবটা তোমার দেবরকেই দেখতে হয়েছে। কিন্তু এযাবৎ বাড়িতে মাত্র ছ’জন মানুষ ছিলে। এখন তো অনুরাধা আর ওর ছেলেও আছে। তার উপর তুমি দুটো বাচ্চাকে নিয়ে এসেছো। কি লাভ বোঝা বাড়িয়ে?”

চোখদুটো অশ্রুপূর্ণ হয়ে উঠেছে আম্রপালির। সাবিত্রী কি বলতে চাচ্ছেন বুঝতে কোনো প্রকার সমস্যা হচ্ছে না তার। তিনি ঘুরিয়ে পেচিয়ে কিছু বলছেন না। সোজাসাপটাভাবেই বলছেন। যতটা বলছেন তা কথার সৌজন্যতা বজায় রাখতে। কিছু সময়ের ব্যবধান কতটা অসহায় করে দিয়েছে তাকে। একটা মানুষের চলে যাওয়া তাকে কোথায় থেকে কোথায় নামিয়ে দিয়েছে তা হারে হারে টের পাচ্ছেন আম্রপালি।

“আমি বলছি না দুজনকেই রেখে আসতে। পদ্মাবতীর যে তুমি ছাড়া আর কেউ নেই, যাওয়ার জায়গা নেই তা আমি ভালো করেই জানি। কিন্তু মোহিনীর তো আছে। ওকে তো যেখান থেকে এনেছো সেখানে রেখে আসতে পারো।”

“আমি বুঝতে পেরেছি।”

“আরেকটা কথা বলবো?”

“বলুন।”

“অভ্র তো অর্ণবের বাবার মতোই। ও এবার এলে অর্ণবকেও ওর সাথে পাঠিয়ে দিলে পারো। শুধু অর্ণব না, শমিতের কথাও বলছি আমি।”

চোখে জমিয়ে রাখা অশ্রুর বাঁধ ভেঙে গেল আম্রপালির।

“কেন? ওকে বড় করার মতো সামর্থ্যও কি আমার নেই? এতোদিন কি আমি ছিলাম না?”

“আমি সেটা বলিনি আম্রপালি। বাড়িতে একটা পুরুষ মানুষ নেই একমাত্র তোমাদের ওই চাকর রামু ছাড়া। ওদের কাছে বড় হবে? এতোদিন বাবা নামক বটবৃক্ষের ছায়া ছিল। এখন তো তাও নেই। একবছর তোমার সামলানো আর বাকী জীবন তোমার কাছে বড় হওয়ার মাঝে অনেক পার্থক্য।”

কিছু মুহূর্তের ব্যবধানে এমন পরিস্থিতির শিকার হতে হবে তা ভাবতেও পারেননি আম্রপালি।

“আমি ওদের ভালোর জন্যই বলছি আম্রপালি। অর্ণব আর শমিত অভ্রর কাছে ভালোই থাকবে। আমার বলা কথাগুলো একবার ভেবে দেখো।”

সবেমাত্র আম্রপালির ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল অর্ণব। সাবিত্রীর বলা শেষের দুই বাক্য ভালোমতোই কর্ণকুহর হয়েছে তার। আর্তনাদ করে বলে উঠলো,

“বাবা চলে যেতে না যেতেই আপনি আমাকে দূরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন মা?”

অর্ণবের করা প্রশ্নে হতবাক হয়ে গেলেন আম্রপালি। অর্ণব যে এখনো জেগে আছে তা জানতেন না তিনি। আর কখনই বা এখানে এসে দাঁড়ালো? পদ্মাবতী চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। অর্ণব আবার বলে উঠলো,

“সেদিন দোষ করেছিলাম বলে আপনি আমাকে এতোদিন নিজের থেকে দূরে পিসির বাড়িতে রাখলেন। এবার কি দোষ করেছি যে একেবারের জন্য কাকুর কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছেন?”

আম্রপালি অর্ণবের করা কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারছেন না। অর্ণব নিজের মতো বলে গেল,

“আপনি যদি আমাকে আবার আপনার থেকে দূরে পাঠিয়ে দেন, আমি আর কোনোদিনও আপনার কাছে ফিরবো না মা। মনে রাখবেন, আমি আর কখনো আপনার কাছে ফিরবো না।”

চলবে…

#মেহেরজান
#পর্ব-৮
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

চারদিকে একটা উৎসব উৎসব ভাব বিরাজ করছে। করবে নাই বা কেন। দূর্গাপূজো বলে কথা। আজ অষ্টমীর শেষ। কিছুক্ষণ বাদেই সন্ধিপূজো। সকলের মনই আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠেছে। তবে তাদের মধ্যে ব্যতিক্রম আছেন একজন। আম্রপালি, যার আনন্দের কারণটা সবার থেকে ভিন্ন। তার খুশির বাঁধ ভেঙেছে আজ। আজ বিশ বছর পর নিজের ছেলেটাকে দেখবে সে। অর্ণবের সেদিন এর বলা কথাগুলো এখনো কানে বাজে তার। অর্ণব বারবার চিৎকার করে বলছিল “আমি আর আপনার কাছে ফিরবো না মা”। হলোও তাই। অভ্র বাবু দেশে ফেরার একমাসের মাথায় অর্ণবকে নিয়ে বিলেত চলে গেলেন। আম্রপালির ওপর অভিমান করে জেদ ধরেই চলে গেল সে। অর্ণব নিজের কথা রেখেছে। বিগত বিশ বছরে না ফিরেছে, না কোনোরকম যোগাযোগ করেছে আম্রপালির সাথে। এতোগুলো বছরে অসংখ্য চিঠি পাঠিয়েছেন আম্রপালি। কিন্তু প্রতিবারের মতো কখনোই তার জবাব আসেনি। ইশশশ! ছেলেটাকে যদি সেদিন একবার আঁটকাতে পারতেন তিনি। নিজেকে বড্ড বেশি বোকা মনে হয় আম্রপালির। শেষ মূহুর্তে সেও যদি অনুরাধার মতো বেঁকে বসতেন, শমিতের মতো অর্ণবকেও যেতে না দিতেন তাহলে আজ তার ছেলে তার কাছে থাকতো। কেমন মা সে? নিজের ছেলেকে নিজের থেকে দূরে করে দিলেন। ভেবেছিলেন আর কোনোদিন হয়তো নিজের ছেলেকে দেখতে পারবেন না তিনি। কিন্তু ঈশ্বর তার প্রার্থনা শুনেছেন। তাই তো এতোগুলো বছর পর নিজের ছেলেকে ফিরে পাচ্ছেন। সেদিন দুঃখে তার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়েছিল, আজ আনন্দে হচ্ছে। মনে মনে অসংখ্য কথা চিন্তা করতে করতে তার ধ্যান ভাংলো দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে।

” ডেকেছিলেন মামী?”

“হ্যাঁ, ভেতরে আয়। পদ্মা কইরে?”

শমিত ভেতরে না এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়েই উত্তর দিলেন।

“পদ্মা তো বাড়িতে নেই।”

“কই গিয়েছে সে?”

“গিয়েছে হয়তো কোথাও। মোহিনীর সাথে।”

“খুঁজে নিয়ে আয় তো।”

“বাচ্চা নাকি ও? খুঁজতে যাবো কেন?”

“আহ। এতো কথা বলিস কেন? বাচ্চা নয়তো কি হয়েছে? কাজকর্ম তো সব বাচ্চাদের মতোই করে। এখন কথা না বাড়িয়ে ডেকে আন ওকে। শকুন্তলা সেই সকাল থেকে খুঁজছে ওকে।”

“আচ্ছা।”

“ওমা, ওমন হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? জলদি যা।”

শমিত একপ্রকার দৌঁড়ে চলে গেলেন।
.
.
.
আলতা রাঙা নিটোল পায় নুপুরের রুনুঝুনু ধ্বনির আলোড়ন তুলে গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে দৌঁড়ে চলেছে পদ্মাবতী। পরনে লাল পাড়ের সাদা শাড়ী। মাঠের মাঝখানে একটা আমগাছ। তাতে দোলনা পাতা। পদ্মাবতী দৌঁড়ে গাছের নিচে এসে ধপ করে দোলনায় বসে পরলেন। হাঁপাতে হাঁপাতে পদ্মাবতী বললেন,

“সেই সকালে ছোটমা বলে রেখেছিল শ্বেতপদ্ম নিয়ে আসতে। কম পরেছে ক’টা। তখন থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। কখন থেকে তোকে খুঁজছি জানিস? ক’টা পদ্ম তুলে এনে দে না।”

উপর থেকে জবাব এলো না। পরিবর্তে তেঁতুলের কতোগুলো বিচি এসে পরলো পদ্মাবতীর উপর। চকিতে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।

“কিরে? কি বলছি তোকে শুনেছিস? কথা কানে যাচ্ছে না? কি খাচ্ছিস? দে তো আমাকে। এই মোহিনী।”

মোহিনী কতোগুলো তেঁতুল পদ্মাবতীর দিকে ছুড়ে মারতেই পদ্মাবতী খপ করে তা ধরে ফেললেন।

“আমগাছে চড়ে বসে তেঁতুল খাচ্ছিস? আর কোনো কাজ নেই তোর?”

এবার জবার এলো।

“না।”

“তাহলে আমাকে ক’টা পদ্ম তুলে দে?”

কথাটা বলেই পদ্মাবতী আবার দোলনায় বসে পরলেন।

“পারবো না।”

“কেন পারবি না? তুই জানিস আমি সাঁতার জানি না। এমন করছিস কেন মোহিনী? দে না একটু এনে।”

“তোর সব কাজ কি আমাকে করতে হবে? মাসে কত টাকা বেতন দিস আমাকে?”

“আমার কাছে টাকা চাইছিস তুই? আমার যা আছে সবই তো তোর। যা নিতে মন চাইবে নিয়ে নিস।”

“গাছে উঠে আয়।”

“পাগল নাকি? গাছে উঠবো তাও আবার শাড়ী পরে? আমি গাছে উঠতে পারি না জানিস না? তুই নিচে আয়।”

মোহিনী লাফ দিয়ে নিচে নামলেন।

“কি আছে তোর?”

“কিছুই না।”

“এখন নেই তো কি হয়েছে। যখন হবে তখন ছিনিয়ে নিবো দেখিস।”

“কি নিবি?”

“তোর সব।”

“আচ্ছা নিস। এখন ফুল এনে দে।”

এমন সময় দূর থেকে কারও ডাক কানে আসলো তাদের।

“এই পদ্মা মোহিনী।”

এদিক ওদিক তাকাতেই দেখতে পেলেন দূরে দাঁড়িয়ে শমিত হাত নেড়ে ডাকছেন তাদের।

“সেরেছে। শমিতদা খুঁজতে খুঁজতে চলে এসেছে এখানে। ফুল না নিয়ে বাড়ি গেলে ছোটমা অনেক বকবে।”

“বকবে না। চল আমার সাথে।”

মোহিনী পদ্মাবতীর হাত ধরে উল্টো দিকে দৌঁড় লাগালেন। শমিত দূর থেকে তা দেখে হতবিহ্বল হয়ে গেলেন।

“এদিকে কোথায় যাচ্ছিস?”

“বাড়ির পেছন দিক দিয়ে ঢুকে দিঘি থেকে পদ্ম তুলে দেব। চল এবার।”
.
.
.
ঘাট বাধানো জল ভরা দিঘি। অসংখ্য পদ্ম ফুটে আছে। একগুচ্ছ শ্বেতপদ্ম নিয়ে দিঘি থেকে উঠে এলেন মোহিনী। সারা গা আর চুল থেকে টপ টপ করে পানি ঝরছে। মোহিনী এসে দাঁড়াতেই পদ্মাবতী তৎক্ষনাৎ পদ্মগুলো নিজের হাতে নিয়ে নিলেন। এমন সময় সেখানে উপস্থিত হলেন চিত্রা।

“কিরে পদ্মা? তুই এখানে কি করছিস? মা কখন থেকে তোকে খুঁজছে জানিস।”

“পদ্ম তুলতে এসেছিলাম।”

“হ্যা রে মোহিনী, মা তো পদ্মাকে পাঠিয়েছিল পদ্ম আনতে।”

“আমিই তো এনেছি।”

“তাই তো জল মোহিনীর গা থেকে ঝরছে। তাই না?”

পদ্মাবতী মোহিনীর দিকে এক নজর তাকিয়ে আবার চিত্রার উদ্দেশ্যে বললেন,

“ছোটমাকে কিছু বলিস না চিত্রা। জানিসই তো ছোটমা কেমন। খুব বকবে।”

“আচ্ছা বলবো না। বাড়িতে চল।”

“মোহিনী, তুইও চল আমার সাথে। ভিজে গেছিস একদম। আমার একটা শাড়ি দেবো বের করে। ভেজা জামা ছেড়ে ওটা পরে নিস।”

“না, তুই আর চিত্রা যা। আমি এখন আর বাড়িতে যাবো না। পরে আসবো।”

“সন্ধ্যায় আসবি তো?”

“না, আজ আর যাবো না। বাড়ির সামনের দিকে এতো ভীড় কেনরে?”

পদ্মাবতী আর চিত্রা তাকিয়ে দেখলেন আসলেই ভীড়। চিত্রা বললেন,

“দাদা এসেছেন মনে হয়।”

“শমিতদা?”

“না, অর্ণব দাদা।”

পদ্মাবতী বললেন,

“আরে বড়মার ছেলে। আজ বিশ বছর পর এসেছে। কাকুর মাঝেমধ্যে আসা যাওয়া থাকলেও সে কোনোদিন আসেনি এখানে। দেখবি নাকি?”

“না। তোরা দেখেছিস?”

“কিভাবে দেখবো? আজই তো এলো।”

“আচ্ছা। তোরা দেখ। আমি পেছনের দিক দিয়েই চলে যাচ্ছি।”

চিত্রা আর পদ্মাবতী চলে গেলেন। মোহিনী কিছুদূর গিয়ে দাঁড়িয়ে পরলেন। কি ভেবে যেন ঘুরে আবার বাড়ির সামনের গেইটের দিকে যাওয়া শুরু করলেন।

মোহিনী উঁকিঝুঁকি দিচ্ছেন। না, কিছুতেই দেখা যাচ্ছে না। এতো ভীড়! একটামাত্র মানুষ এর জন্য এতোগুলো মানুষের দেখতে আসার কি দরকার ভেবে পেলেন না মোহিনী। কিন্তু তিনি নিজেও তো দেখতে এসেছেন। হয়তো তার মতো বাকিরাও একই কৌতূহল মেটাতে এসেছেন। মোহিনী পায়ের গোড়ালি উঁচু করে আরেকবার দেখার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ উঁকিঝুঁকির পর দেখতে পেলেন গেইটেই বাইরে একটা সাদা গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনেই কালো স্যুট পরিহিত এক যুবক। দেখে অনেক লম্বা মনে হচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই চেহারা দেখতে পাচ্ছেন না। যুবকটি লম্বা হলে কি হবে, তিনি নিজে তো খুব একটা লম্বা নন। তাই এতো উঁকিঝুঁকির পরও দেখতে পাচ্ছেন না। মোহিনী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আর বৃথা চেষ্টা করলেন না।

বাড়িতে ফিরতেই মোহিনী দেখলেন এক মেয়েকে অন্য দুজন মেয়ে ধরে রেখেছে জোর করে। দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটি বিবাহিত। চিৎকার করে কাঁদছেন আর বলছেন,

“থাকবো না আমি এখানে। তোদের মতো মেয়েদের সাথে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো। বিয়ে কি, সংসার কি এসবের তোরা কি জানিস? তোরা তো শুধু নেচে দু পয়সা কামাতে জানিস। ছাড় বলছি আমাকে। তোদের ওই নোংরা হাত দিয়ে ছুবি না আমাকে।”

রজনী মোহিনীকে আসতে দেখে ওর কাছে এগিয়ে গেল। রজনী তারানার খাস মেয়ে। প্রমিতা এখন নেই। তার জায়গাটা এখন রজনীই নিয়েছে।

“কিরে? এমন ভিজলি কি করে?”

“দিঘিতে নেমেছিলাম পদ্ম তুলতে। এই মেয়ে কে?”

“সৌদামিনী।”

“কোথায় পেলে?”

“নদীতে ডুবে যাচ্ছিল। তুলে নিয়ে এসে শুনি মরতে গিয়েছিল।”

“কেন?”

“বাচ্চাকাচ্চা হয়না তাই স্বামী নতুন আরেকটা বিয়ে করে একে ছেড়ে দিয়েছে। তাই গিয়েছিল নদীতে ঝাপ দিয়ে ডুবে মরতে।”

“দিতে তাহলে মরে যেতে।”

“কি করবো বল। এতো কঠিন হতে তো পারি না। আমাদের মনে যে তোর থেকে মায়াদয়া একটু বেশিই। তুই আর ভেজা কাপড়ে থাকিস না। ঠান্ডা জ্বর বাঁধিয়ে বসলে আম্মা রেগে যাবে। দ্রুত গিয়ে শুকনো কাপড় পরেনে। আজ জলসা হবে মনে আছে তো?”

“হ্যাঁ।”
.
.
.
এখন সন্ধ্যেবেলা। চারদিকে শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি, কাশরঘন্টা আর ঢাকের ঢ্যাং কুর কুর শব্দ। সাথে ধূপের গন্ধ। এরই মাঝে ছাদে মদের বোতল আর সিগার নিয়ে বসেছেন অর্ণব। সাথে বসেছেন শমিত। দেশে ফিরে নিজের সেই পুরনো সাজ পোশাক ধুতি-পাঞ্জাবীতে ফিরলেও স্বভাবের পরিবর্তন হয়নি। বিলেতে থাকতে হয়তো প্রতিদিনের সন্ধ্যার সব কাজের তালিকায় এটাই থাকতো। পেয়ালায় মদ ঢেলে এক চুমুকে খেয়ে আবার সিগারে টান দিলেন অর্ণব। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক পুরনো অভ্যেস।

“মদের নেশায় পেলো কিভাবে তোমাকে?”

অর্ণব আরেকটা পেয়ালা শমিতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,

“বিশ বছরে দূরত্ব কি এতোটাই বেড়ে গেছে যে তুই থেকে তুমিতে চলে গেছিস?”

“আমরা তাহলে আগের মতোই বন্ধু বল?”

“এই নে। খা।”

“আমি এসব খাই না।”

“খাস না? ভালো তো। আমার সাথে তুই বিলেতে গেলে কাকুর চক্করে তোরও এসবের অভ্যেস হয়ে যেত।”

“ছোট মামা এসব খায়?”

“সেও খাওয়া শিখেছিল এক বিদেশিনীর চক্করে পরে।”

“বলিস কি? ওখানে অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্কও ছিল মামার? তোর কারও সাথে হয়নি সম্পর্ক?”

“অর্ণব বিদ্রুপসূচক হাসলেন। উঠে ছাদের কিনারে গিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে দূরে কোথাও ইশারা করে বললেন,

” ওখানে এতো আলোকসজ্জা কেন? আর গ্রামের অন্যান্য বাড়িগুলো থেকে এতো দূরে কেন ওই বাড়িটা?”

শমিত উঠে এসে অর্ণবের পাশে দাঁড়ালেন।

“ওটা বাইজিবাড়ি। আজ জলসা হবে সেখানে। অন্যান্য গ্রাম, শহর থেকে মানুষ আসবে অনেক। শুনেছি ওখানকার মেয়েরা নাকি অনেক রূপবতী হয়।”

“গেছিস কখনো?”

“উহু।”

“তাহলে বলিস কিভাবে যে অনেক রূপবতী হয়?”

“শুনেছি। আর আমি ওখানে গিয়েছি জানলে মা বাড়ি থেকে বের করে দেবে।”

“আর কতদিন মায়ের আঁচল ধরে থাকবি? এখন মায়ের আঁচল ধরে আছিস, বিয়ের পর বউয়ের আঁচল ধরবি। নিজে কি করবি?”

“ব্যাপার আঁচল ধরার না। তবুও আমি যাইনি। আর মোহিনী কম কিসে? সেও তো অনেক সুন্দরী।”

“মোহিনী কে?”

“পদ্মার বান্ধবী। মোহিনীই তো ওখানকার একমাত্র মেয়ে যে সারা গ্রাম চড়ে বেড়ায়। কারও সাহস নেই আঁটকানোর। অন্য মেয়েদের তেমন একটা দেখা যায় না। কিন্তু মোহিনীকে সবাই চেনে।”

“ওহহহ।”

“তুই কি ওখানে যাওয়ার কথা ভাবছিস নাকি? কি রে, যাবি নাকি একবার?”

অর্ণব পুরো মদের বোতল শেষ করে বললেন,

“চল।”

বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই অর্ণবের চোখ পরলো ঘুঙুর পায়ে নৃত্যরত এক নর্তকীর উপর। তবলার সাথে তাল মিলিয়ে নেচে চলেছে। গা ভরা গয়না আর ভারি ঘাগড়া পরা। অর্ণব ভেবে পেলেন না এতো ভারি পোশাক সে সামাল দিচ্ছে কি করে। সাত বছর বয়সী এক মেয়ে এসে অর্ণবের হাত ধরে তাকে ইশারায় নিচু হতে বললো। অর্ণব নিচু হলে সে জিজ্ঞেস করলো,

“তোমরা এখানে মোহিনী দিদির নাচ দেখতে এসেছো না?”

অর্ণব একটু ভেবে উত্তর দিলেন,

“হ্যাঁ। নাম কী তোমার?”

“আমি পরী। এসো। এখানে বসো।”

মেয়েটি অর্ণব আর শমিতকে টেনে নিয়ে এসে এক জায়গায় বসিয়ে রেখে চলে যেতেই শমিত বললো,

“উঠে আয়। পেছনের কোণায় চল। এখানে বসলে কেউ চিলে ফেললে মায়ের কাছে খবর পৌঁছাতে দেরি হবে না।”

অর্ণব বিনাবাক্য ব্যয়ে উঠে শমিতের সাথে পেছনে গিয়ে বসলেন।

“যে মেয়েটাকে নাচতে দেখছিস, ওই মোহিনী।”

অর্ণব এবার ভালো করে মোহিনীর দিকে তাঁকালেন। শমিত ঠিকই বলেছিলেন। মেয়েটা দেখতে আসলেই অনেক রূপবতী।

“বড় মামী মানে তোর মা ওকে অনেক আদর করেন। হ্যাঁ রে, মোহিনীকে তো তোর চেনার কথা। তুই চলে যাওয়ার আগে একমাস তো ও আমাদের বাড়িতেই ছিল। পরে বড় মামী ওকে রেখে গেছেন এখানে। আমরা দুজন পদ্মা আর মোহিনীর সাথে কত্তো খেলতাম। ছোটবেলার কথা মনে নেই তোর?”

শমিতের এমন কথায় হঠাৎ করেই অর্ণবের ছোটবেলার অনেক স্মৃতিই মনে পরে গেল। আসলেই তো সে মোহিনীকে চেনে। কি জোরেই না অর্ণবের গালে খামচে ধরেছিল সে। অর্ণবের চুল টেনে ধরা, গাল খামচে ধরা তো তার নিত্যদিনকার কাজ হয়ে উঠেছিল। পদ্মা এমন ছিল না। সে ছিল খুব শান্ত। কিন্তু মোহিনী একদমই তার উল্টো। প্রচন্ড চঞ্চল একটা মেয়ে। কথাগুলো মনে পরতেই অর্ণব অজান্তেই হাত দিয়ে নিজের গাল স্পর্শ করে বললেন,

“মনে আছে।”

চলবে…

মেহেরজান পর্ব-৫+৬

0

#মেহেরজান
#পর্ব-৫
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

বৈশাখ মাসের অর্ধেক আজ। পড়ন্ত বিকেলের রোদে ছাদে বসে আড্ডা দিচ্ছেন কিছু মহিলা। বাড়ির ঝিঁ থেকে শুরু করে বউরাসহ আশেপাশের দু তিন বাড়ির মহিলারাও রয়েছে। আশেপাশে কোনো পুরুষের নামগন্ধও নেই। কেউ নিজের কাজ করছেন তো কেউবা বসে বসে গল্প করতে ব্যস্ত। দূর থেকে একটা দূরবীন এর সাহায্যে অনেক্ষণ ধরে তাদের লক্ষ্য করছেন তারানা। এতো পাড়াপড়শির ভীড়েও শকুন্তলাকে ঠিকই চিনতে পারছেন তিনি। ওইতো, আয়েশ করে বসে আছেন শকুন্তলা। একজন তার মাথায় তেল মালিশ করে দিচ্ছে তো আরেকজন পা টিপে দিচ্ছে। মেয়েটাকে অন্য এক মহিলার কোলে দিয়ে রেখেছেন। এতো বিলাসিতা ওর ব্যতীত ও বাড়িতে আর কারও নেই তা তারানা ভালো করেই জানেন। একমাত্র ওই এতো হুকুম চালায়। বাড়ির কর্তৃ আম্রপালি হলেও তার মধ্যে এতো শৌখিনতা নেই। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার দেখা পাচ্ছেন না তারানা। পেছন থেকে এসে কানের কাছে হঠাৎ করে কেউ বলে উঠলেন,

“কি দেখছো আম্মা?”

তারানা চমকিত হয়ে পেছনে ঘুরলেন। প্রমিতাকে দেখে বললেন,

“কানের গোড়ায় টেনে এক যখন মারবো তখন বুঝবি। শয়তান মেয়ে কোথাকার। যখনই আসিস একদম জানপ্রাণ বের করে দিস।”

“আহ। রাগছো কেন? বাদাম খাবে?”

প্রমিতা তারানার দিকে হাতে থাকা বাদাম তুলে ধরলেন। তারানা সেদিকে তোয়াক্কা না করে পুনরায় নিজের কাজে মননিবেশ করলেন।

“তুই খাচ্ছিস খানা। আমাকে জ্বালাস না তো।”

প্রমিতা বাদামের খোসা ছাড়িয়ে ঘষে ফুঁ দিয়ে তা মুখে পুরে নিয়ে বললেন,

“দেখছো কি ওদিকে এতো মনোযোগ দিয়ে?”

“জানিস না কি দেখছি? আম্রপালি সেই যে মেয়েটাকে নিয়ে গেল। এতোদিন হয়ে গেল অথচ এখনো দিয়ে যাবার খবর নেই।”

“ওমা! তিনি এখনো মোহিনীকে দিয়ে যাননি?”

তারানা প্রমিতার দিকে ঘুরে তাকালেন।

“কই ছিলি এতোদিন তুই?”

“মানে? আমি আবার কই যাবো? বাড়ির বাইরে যাওয়ার অনুমতি আছে নাকি আমাদের?”

“বাড়িতেই যখন ছিলি তাহলে এটা জানিস না মোহিনী বাড়িতে নেই?”

“উফফফ। জানবো না কেন? আমি তো মজা করে বলেছি।”

তারানা এসে প্রমিতার একদম সামনে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঠাস করে গালে থাপ্পড় দিয়ে চুলের মুঠি ধরে বললেন,

“আমার সাথে মজা করার সাহসও করিস না প্রমিতা। মেরে ফেলবো একদম। তোর সাথে আমার মজা করার সম্পর্ক না।”

তারানা তাকে ছেড়ে দিলেন। গালে হাত দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন প্রমিতা। আর জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলেন। তারানা চলে যেতে নিলে পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,

“মোহিনীকে মনে ধরেছে তোমার ওই মালকিনের। তাই নিজের কাছেই রেখে দিতে চাইছেন। বড় হলে দেখবে ছেলের বউ করে নিয়ে যাবেন। যতই হোক, তিনিও একসময় এখানকার মেয়ে ছিলেন। অতীত ভুলবেন কি করে। শেকড়ের টানে বারবার ফিরে আসেন।”
.
.
.
ধীর পায়ে সিড়ি ভেঙে ছাদে উঠে এলেন শান্তি দেবী। শ্বাশুড়িকে আসতে দেখে মাথায় ঘোমটা টেনে উঠে দাঁড়ালেন শকুন্তলা। শান্তি দেবী তাকে ব্যস্ত না হয়ে বসতে ইশারা দিলেন। নিজেও এসে একপাশে বসলেন। নিচে পাটিতে বসে রানী চিত্রাকে নিয়ে খেলছে। শকুন্তলার উদ্দেশ্যে বললেন,

“মেয়েটাকা সবসময় কাজের লোকের কাছে না রেখে একটু নিজের কাছেও তো রাখতে পারো।”

“ও তো বেশিরভাগ সময় আমার কাছেই থাকে মা। এখন একটু রানীর কাছে দিয়েছি।”

শান্তি দেবী জবাব দিলেন না। শকুন্তলার এমন কথায় কথায় জবাব দেওয়া খুব একটা পছন্দ করেন না তিনি। প্রসঙ্গ বদলাতে জিজ্ঞেস করলেন,

“আম্র কোথায়?”

“দিদি তো মনে হয় নিজের ঘরে আছেন।”

“সেদিন যে বাচ্চাটাকে নিয়ে এসেছিল সে রয়েছে এখনো?”

“কে? মোহিনী? হ্যাঁ, ওই বাচ্চাটা তো এখনো দিদির কাছেই রয়েছে। দিদি তো এখন ওর আর পদ্মার সাথেই বেশি সময় কাঁটায়।”

“ওহ।”

“দিদি কিন্তু কাজটা একদম ঠিক করেনি মা।”

“কোন কাজ?”

“ওইযে ওখান থেকে বাচ্চাটাকে নিয়ে এলো। দিদি ওদের খোঁজখবর নিতে মাঝেমাঝে ওখানে যায় যাক। কিন্তু বাচ্চা তুলে আনার কি দরকার ছিল। এমনিতেই বাড়িতে দু দুটো বাচ্চা। আরেকটার বোঝা না বাড়ালেই নয়।”

শান্তি দেবী ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন।

“আম্র যখন বাচ্চাটাকে এ বাড়িতে এনেছে তাহলে ভেবেচিন্তেই কাজটা করেছে। তোমার এতো না ভাবলেও চলবে।”

চশমা ঠিক করতে করতে ছাদের কিনারায় আসতেই দেখলেন সামনের রাস্তাটা দিয়ে পালকি করে বউ আসছে। সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে কিছু দূরের একটা জমিদার বাড়ির দিকে তাকালেন। দূর হলেও এখান থেকে বাড়িটা স্পষ্ট দেখা যায়। বাড়ির দেওয়ালে শ্যাওলা পড়ে গেছে। অথচ একসময় কতই না জাঁকজমকপূর্ণ ছিল। সেদিকে হাত দিয়ে ইশারা করে পুনরায় বলতে শুধু করলেন।

“ওইযে জমিদার বাড়িটা দেখছো না শকুন্তলা? ওইটা ছিল আমার শ্বশুর বাড়ি। বিয়ে করে ওই বাড়িতেই উঠেছিলাম আমি। আমার শ্বশুর বেশ প্রতাপশালী জমিদার ছিলেন। আর পাশের ওই বাগানবাড়িটা দেখছো? যেটা এখন বাইজীবাড়ি বলে জানে সবাই। যদিও আগেও ওখানে বাইজীরাই থাকতো তবুও সবাই বাগানবাড়িই বলতো। ওখানেই সবাই যেত নাচ দেখতে। এখন না আছে জমিদারী আর না আছে জমিদারবাড়ি।”

এসব কিছুই অজানা নয় শকুন্তলার। শ্বাশুড়ির থেকে বারবার এসব শুনতে একদম ভালো লাগে তার। তবুও তিনি প্রায়ই বলেন তাকে।

“দিদিও তো ওখানেই থাকতো তাই না মা। ছোট থেকে তো ওখানেই বড় হয়েছে। দাদা তো ওবাড়িতে গিয়ে তার নাচ দেখেই প্রেমে পরেছিলেন।”

শান্তি দেবী পেছনে ঘুরে দাঁড়ালেন।

“আম্রর মতো লক্ষী মেয়ে আমি দুটো দেখিনি শকুন্তলা। সেই স্বাধীনতার আগে বিয়ে হয়েছিল আমার। ওই বাড়িতে একদম রানীর মতো থাকতাম। আম্রও বউ হয়ে ও বাড়িতেই এসেছিল। কিছুদিনের জন্য হলেও ওখানকার পরিবেশ দেখেছে। যদিও তখন আমাদের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। তারপর যখন ওবাড়ি ছেড়ে এখানে এসে উঠলাম, আমার তো প্রাণ যায় যায়। এরকম জায়গায় থাকা যায় নাকি। যেখানে আগে সব কাজ করতে চাকরদের হুকুম করতাম সেখানে আমিই হয়ে গেলাম কাজের লোক। এসব কাজ করার একদম অভ্যেস ছিল না আমার। এইযে এখন বাড়ি ভর্তি লোক দেখছো, তখন আমরা চারজন ছাড়া কেউ ছিল না। সব কাজ আম্র একা হাতে করতো। ওই সামলে রেখেছে সবকিছু। তুমি তো এবাড়িতে এসেছো মাত্র দু’বছর হলো। তাই কিছু জানো না তুমি।”

শান্তি দেবী আরও কিছু বলতে যাবেন তার আগেই রুমকি এসে শকুন্তলাকে বললেন,

“বড় বউদি ডেকেছে তোমাকে। নিচে যেতে বললো এক্ষুনি।”

শ্বাশুড়ির কথা শোনা থেকে বাঁচতে শকুন্তলা বিনাবাক্য ব্যয়ে সেখান থেকে দ্রুত চলে গেলেন।
.
.
.
ঘুম থেকে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল অর্ণব। খাটে থেকে নেমে টেবিলের কাছে এসে গ্লাসে পানি ঢেলে ঢকঢক করে খেয়ে নিল। দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো ভোর পাঁচটা বাজে। বাইরে পাখির কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে কিছু কিছু। বিছানার কাছে এসে নিচু স্বরে শমিতকে ডাকতে লাগলো।

“শমিত এই শমিত, ওঠ। তাড়াতাড়ি ওঠ। কিরে? ওঠনা।”

শমিত উঠে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বললো,

“কি হয়েছে? ডাকছিস কেন? এখনো তো সময় হয়নি ওঠার।”

“হুশ…আস্তে বল। আমি চলে যাচ্ছি।”

“চলে যাচ্ছিস মানে? কই চলে যাচ্ছিস?”

“চলে যাচ্ছি মানে পালাচ্ছি। বাড়িতে।”

“সকাল সকাল আমার ঘুম ভাঙিয়ে মজা করছিস?”

“উহু। সত্যিই যাচ্ছি।”

বলেই নিজের কাপড়চোপড় বের করে ব্যাগে ভরতে লাগলো।

“এই অর্ণব, পাগল হলি নাকি রে? কই যাবি তুই? কেন যাবি আর কি করেই বা যাবি?”

“বললাম তো বাড়ি যাবো। মায়ের কাছে। মায়ের জন্য খারাপ লাগছে।”

“আর ক’টা দিনেরই তো ব্যাপার। তারপর বাবা তোকে দিয়ে আসবে। থেকে যা না।”

“উহু। এখনই যাবো। তুই বলেছিলি আমি এখানে দু’সপ্তাহের জন্য এসেছি। সে হিসেবে আমার গতকালই চলে যাওয়ার কথা ছিল।”

“সকালে বাবাকে বলবো তোকে দিয়ে আসতে। এখন একা যাস না। তুই গেলে আমি অনেক বকা খাবো। আর তুই যাবি কি করে?”

“হেঁটে হেঁটে।”

“পাগল হয়েছিস? এতো দূর হেঁটে যাওয়া যায় নাকি?”

অর্ণব শমিতের কাঁধে হাত রেখে বললো,

“আমি যাচ্ছি। বেশি দেরি করলে আবার পিসির কাছে ধরা পরে যাবো। ভালো থাকিস বন্ধু।”

“তুই সত্যিই যাবি?”

অর্ণব কথা না বাড়িয়ে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পরলো। এখনো চারদিক বেশ অন্ধকার। বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছু দূর আসতেই পেছন থেকে কারও ডাক শুনতে পেল। পেছনে তাকাতেই দেখলো শমিত তাকে ডাকতে ডাকতে দৌঁড়ে আসছে। অর্ণবের সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,

“এই নে। আমার কিছু জমানো টাকা ছিল। সামনে যাওয়ার জন্য কিছু না কিছু পেয়ে যাবি। এতে হয়ে যাবে। সাবধানে যাস।”

অর্ণব শমিতকে জড়িয়ে ধরে বললো,

“ভালো থাকিস। আর আমার জন্য বকুনিটা হজম করে নিস।”

অর্ণব আবার হাঁটা শুরু করলো। যতক্ষণ তাকে দেখা যায় ততক্ষণ শমিত ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। ধীরে ধীরে আঁধারে মিলিয়ে গেল অর্ণব।
.
.
.
বাড়ির গেইটের সামনে এসে দাঁড়াতেই বাইরে থেকে কাউকে দৌঁড়ে আসতে দেখলেন রামু। কিছুটা কাছাকাছি আসতেই অর্ণবকে দেখে তার চক্ষু চড়কগাছ। অর্ণব তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে ব্যাগটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“মা কই?”

“বড় মালকিন তো তার ঘরে। আপনে তো পিসির বাড়ি গেছিলেন। এইহানে কেমনে আইলেন অর্ণব বাবা?”

“পরে বলছি।”

অর্ণব দৌঁড়ে বাড়ির দিকে চলে যায়। পেছন থেকে রামু তাকে দাঁড়ানোর জন্য বলতে থাকেন। অর্ণব তা কর্ণকুহর না করে নিজের মতো বাড়ির ভেতরে চলে যায়। আম্রপালিকে ডাকতে ডাকতে তার ঘরে এসে কাউকে না পেয়ে ফিরে যেতে নিলেই তার চোখ পড়ে খাটের উপর। দুটো বাচ্চা শুয়ে আছে। অর্ণব তাদের কাছে এসে বসলো। একজন ঘুমাচ্ছে তো আরেকজন চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিক দেখছে। অর্ণব তাকে কোলে তুলে নিলো। বাচ্চাটা ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এমন সময় জানালা দিয়ে বাইরে নজর যেতেই চোখে পড়লো শকুন্তলা চিত্রাকে কোলে নিয়ে কার সাথে যেন কথা বলছেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।

“পদ্মা তো ঘুমিয়ে আছে। চিত্রা ছোটমার কোলে। আর এটা চিত্রা হতেই পারে না। এটা কে তাহলে?”

বাচ্চাটা নিজের ছোট্ট হাত দিয়ে অর্ণবের গাল চেপে ধরেছে। না, ছোট্ট হলেও বেশ জোরেই চেপে ধরেছে।

“অর্ণব।”৷

আম্রপালি এসে ডাক দিতেই অর্ণব পেছনে ঘুরলো।

“মা।”

“তুমি এখানে কি করে এলে?”

মোহিনীকে কোলে থেকে নামিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো অর্ণব।

“কি হলো বলো? এখানে কি করে আসলে তুমি? তোমার পিসেমশাই এসেছেন সাথে? কোথায় উনি?”

“কেউ আসেনি।”

“তাহলে? কি করে এলে তুমি?”

“পা..পা..পালিয়ে এসেছি।”

চলবে…

#মেহেরজান
#পর্ব-৬
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

চায়ের কাপে চুমুক বসিয়ে সৌরভ বাবু বললেন,

“আর বলবেন না বউদি। শমিত যখন বললো অর্ণব চলে গেছে, আমি আর অনুরাধা তো প্রচন্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এইটুকু একটা ছেলে একা গেল কি করে। ঠিকমতো পৌঁছোতে পারলো কিনা। তাই তো শমিতকে নিয়ে পেছন পেছন আমিও বেরিয়ে পরলাম।”

আম্রপালি কোনো জবাব না দিয়ে সামান্য অধর প্রশস্ত করলেন।

অর্ণব এসে তার মায়ের পাশের দাঁড়িয়ে শমিতকে ইশারা করতেই শমিতও তাকে ইশারায় দাঁড়াতে বললো।

“এসেই যখন পরেছি তাহলে কাজটা ফেলে না রেখে আজই সেরে ফেলি বউদি? দাদাকে তাহলে নিয়ে যাই।”

“মা, পিসো বাবাকে কই নিয়ে যাবেন?”

“এখানে ভালো ডাক্তার নেই তাই তোমার পিসেমশাই ওনাকে শহরে নিয়ে যাবেন।”

“আমিও যাবো।”

“না। তুমি যাবে না।”

“কেন?”

“তুমি গিয়ে কি করবে? ওনারা তো ব্যস্ত থাকবেন। তোমার একা একা ভালো লাগবে না। আর শমিত তো এখানে আছে। তুমি চলে গেলে ও একা থাকবে নাকি এখানে?”

“আচ্ছা যাবোনা।”

“হুম।”

“আমি আর শমিত খেলতে যাই?”

“আচ্ছা যাও।”

শমিতকে ডাকতেই সে উঠে দাঁড়ালো। এরপর দুজনে তড়িঘড়ি করে সেখান থেকে চলে এলো। যেন এখান থেকে সরে পরলেই বাঁচে।

“আমি চলে আসার পর কি হয়েছে? পিসি বকেছে তোকে?”

“বকেনি আবার। মা তো ঝাড়ু নিয়ে এসেছিল মারার জন্য। বাবা থামিয়েছে। তারপরই তো আমাকে নিয়ে এখানে চলে আসলো।”

“আমাকেও অনেক বকেছে মা। এখানে কি থাকবি কয়দিন?”

“হ্যাঁ। যতদিন না বাবা মামাকে নিয়ে ফিরে আসে।”

“পিসি বাড়িতে একা রয়েছে না?”

“উহু। রাশমণি দিদি এসে থাকবে রাতে এ কয়দিন।”

“সেদিন যার বাড়িতে গিয়েছিলাম সে?”

“হ্যাঁ।”

হাঁটতে হাঁটতে দুজনে আম্রপালির ঘরে চলে এলো।

“এরা কারা অর্ণব?”

“ও হচ্ছে পদ্মাবতী। বলেছিলাম না তোকে?”

“ওহহহ। আর এটা?”

“ও মোহিনী।”

“কে ও? তুই না বলেছিলি মামি একটা বাচ্চাকে নিয়ে এসেছে। এখানে তো দুটো।”

“জানি না। মা নিয়ে এসেছে। আমি তো প্রথমে দেখে ভেবেছিলাম পদ্মা দুটো হয়ে গেছে। কোলে নিবি ওদের?”

“না থাক। যদি পড়ে যায়?”

“ঠিকাছে না নিলি। তোর অভ্যেস নেই। আমার আছে। চিত্রাকে নিতাম তো কোলে।”

“তুই বুঝি সারাদিন এদের সাথে খেলিস? ইশশশ… আমার যদি একটা বোন থাকতো! তোর তো তিনটা বোন এখন।”

“অর্ণব রাগান্বিত হয়ে বললো,

“এরা আমার বোন নয়।”

শমিত কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।

“নিজের বোন না তাতে কি? বোন বলতে সমস্যা কোথায়?”

“নিজের বোন না হলে কেন বলবো এরা আমার বোন?”

শমিত কিছু বলার আগেই রামু এসে বললেন,

“অর্ণব বাবা, বড় মালকিন আপনাগোর দুইজনরে ডাকতাছে। নিচে আহেন তাড়াতাড়ি।”

“কেন ডাকেছে রামু কাকু?”

“বড় মালিকরে নিয়া আপনার পিসেমশাই যাইতাছে।”

“আচ্ছা তুমি যাও। আমরা আসছি।”

নিচে নেমে আসতেই সৌরভ বাবু তাদের উদ্দেশ্যে বললেন,

“আমরা এখন বের হবো। তাড়াতাড়িই চলে আসবো। ভালো থেকো তোমরা। আর শমিত, একদম দুষ্টুমি করবে না এখানে।”

শমিত তার বাবার কথায় হ্যাঁবোধক মাথা নাড়ালো। সৌরভ বাবু আম্রপালির সামনে এসে বললেন,

“আসি বউদি। বাইরে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। এখন আর দেরি করা ঠিক হবে না। ভালো থাকবেন।”

“জ্বি। আপনারাও ভালো থাকবেন। সাবধানে যাবেন।”

সৌরভ বাবু বেরিয়ে গেলেন। তার এরকম হঠাৎ করে এসে আদিত্য বাবুকে নিয়ে যাওয়া একদমই ভালো লাগছে না তার। কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। যদিও চারদিন পর তাদের যাওয়ার কথা ছিল। তবুও আজ হঠাৎ করে তাদের চলে যাওয়া বার বার খোঁচাচ্ছে আম্রপালির মনে।
.
.
.
সবেমাত্র রাতের খাবার শেষ করে যে যার যার ঘরে এসে বসেছে। অর্ণব আর শমিত নিজের ঘরে এসে কিছু একটা করছিল। আর ওদিকে আম্রপালি পদ্মা আর মোহিনীকে খাইয়ে দোলনায় ঘুম পারাচ্ছিলেন। বাইরে প্রচন্ড জোরে হাওয়া বইছে। মনে হচ্ছে ঝড় উঠবে। বলতে না বলতেই বিদ্যুৎ চলে গেল। আম্রপালি উঠে এসে একটা মোমবাতি জ্বালালেন। এমন সময় রামুর ডাকাডাকির শব্দ কানে এলো। সাথে সাথেই সে ছুটে নিচে চলে গেলেন। একে একে সবাই চলে আসলেন। শকুন্তলা কোলে করে চিত্রাকে নিয়ে এসে বললেন,

“কি হয়েছে রামু? এতো চেঁচাচ্ছিস কেন? মাত্রই মেয়েটাকে ঘুম পারিয়েছিলাম। দিলি তো ভেঙে।”

রামু কাঁদতে শুরু করে দিল। আম্রপালি তার উদ্দেশ্যে বললেন,

“কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন? কিছু বলবি তো নাকি।”

রামু হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে বললেন,

“সর্বনাশ হইয়া গেছে মালকিন। সব শেষ হইয়া গেছে।”

অর্ণব আর শমিত একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না। আম্রপালি আবার প্রশ্ন করলেন,

“কি শেষ হয়ে গেছে? খুলে বলবি তো আগে।”

রামু কান্নার গতি বাড়িয়ে দিলেন। বললেন,

“বড় মালিক আর সৌরভ বাবুর গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটছে। তারা গাড়ির চালকসহ তারা দুইজনেই মইরা গেছে। পুলিশ নিয়া আইতাছে তাগোর লাশ।”

চলবে…

মেহেরজান পর্ব-০৪

0

#মেহেরজান
#পর্ব-৪
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

শেষরাতে আবারও একদফা বৃষ্টি হয়ে গেছে। রাস্তাঘাটে জল জমে আছে। সূর্যের আলো ফুঁটতে শুরু করেছে। এখনো আবছা অন্ধকার। আম্রপালি সবেমাত্র স্নান সেরে ছাদে উঠেছে। ছাদটা এখনো ভেজা। হালকা হালকা জল জমে থাকা ভেজা ছাদে খালি পায়ে হাঁটতে ভালোই লাগছে তার। প্রতিদিন ঠিক আলো ফোঁটার আগে ছাদে আসা একপ্রকার অভ্যেস আম্রপালির। তার মতে প্রকৃতির কাছে আসার জন্য এই সময়টা সবচেয়ে ভালো। পাখির কলকলানি ছাড়া কোনো বাড়তি শব্দ নেই যা শব্দদূষণ ঘটাতে পারে। শান্ত প্রকৃতির সাথে নিজের মধ্যে নিজের হারিয়ে যাওয়ার জন্য এই সময়টাই সেরা। আম্রপালি ধীরে ধীরে ছাদের কিনারায় এসে দাঁড়ালেন। অহনার রশ্মি এসে তার গায়ে লেগে খেলা করতে লাগলো। তার চোখ পরলো নিচে কিছুটা দূরে আবছা আলোয় দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তির উপর। পরনে ধূসররঙের পাঞ্জাবী। সাথে একটা কালো চাদর। উষ্কখুষ্ক চুল, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। বরাবরের মতোই হাতে একটা শ্বেতকাঞ্চন। লোকটা একনজরে আম্রপালির দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। এরপর ফুলটা মাটিতে রেখে চলে গেলেন। এতোক্ষণে সূর্য পুরোপুরি উঠে গেছে। আম্রপালি দ্রুতপদে ছাদ থেকে নেমে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসলেন। ফুলটা তুলে নিলেন। পুরনো দিনের স্মৃতিগুলো দোলা দিয়ে উঠলো তার মনে।

রাস্তার পাশেই একটা বিশাল বটগাছে। তার ছায়ায়ই বসে আছে আম্রপালি। একটা ছেলে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে আসছে তার দিকে। এসেই বললো,

“দেখ তোর জন্য কি এনেছি।”

নিজের পোশাকে করে আনা সবগুলো ফুল ঢেলে দিলো আম্রপালির সামনে।

“এতো রকমের ফুল! কই পেলি?”

“পেয়েছি।”

“চুরি করেছিস?”

“ওই আরকি।”

“চুরি করেও কোনো লাভ হলো না। আমার পছন্দের ফুলই তো নেই এখানে।”

“তোর পছন্দের ফুল কি?”

“শ্বেতকাঞ্চন।”

“শ্বেতকাঞ্চন! এটা তোর সবচেয়ে পছন্দের ফুল? সবার তো গোলাপ, বেলি এসব ফুল পছন্দ হয়। আর তোর কিনা শেষে শ্বেতকাঞ্চন পছন্দ। হাহাহা।”

“তুই যা ইচ্ছে তাই বল। আমার ওটাই পছন্দ। তোর যখন এতই সমস্যা তাহলে কথা বলিস না আমার সাথে হুহ। গেলাম আমি।”

“এই আম্র, দাঁড়া। কই যাচ্ছিস। আমি তো এমনিই বলছি। দাঁড়া।”

ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলেন আম্রপালি। নিজের ঘরে এসে টেবিলের উপর ফুলটা রেখে দিলেন। বিছানায় চোখ যেতেই মনটা ভালো হয়ে গেলো একদম। দুটো ছোট্ট পরী ঘুমিয়ে আছে বিছানায়। আম্রপালি দুজনের কপালে চুমু খেয়ে চারদিকে ভালো করে বালিশ দিয়ে দিলেন। নিজের খোলা চুল হাত খোপা করে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন।
.
.
নিজের শ্বাশুড়ির জন্য আলাদাভাবে রান্না করেন আম্রপালি। খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে শান্তি দেবী খুবই বাছ বিচারী মানুষ। নিজের খাবারের আশেপাশেও আমিষের ছোঁয়া লাগতে দেন না। তার খাবার রাঁধার জন্য আলাদা হাড়ি-পাতিলের ব্যবস্থা নিজেই করেছেন। আর রান্নার দায়িত্ব দিয়েছেন আম্রপালিকে। আম্রপালি এখন তা-ই পালন করতে ব্যস্ত। পাশে রুমকি আঁশবটি নিয়ে বসেছেন সবজি কাঁটতে। আম্রপালি তার উদ্দেশ্যে বললেন,

“তাড়াতাড়ি হাত চালা রুমকি। আরও কতো কাজ বাকি রয়েছে। জলদি সবজিগুলো কাঁট। তরকারি করতে হবে।”

“কাঁটছি তো। এর চেয়ে বেশি যে আর হাত চলে না।”

“তরু কইরে?”

“ও ঘর ঝাড় দিচ্ছে।”

“আর রানী?”

“ওর জ্বর হয়েছে। ঘরে শুয়ে আছে। আর রামু কই গেছে তা জানি না।”

“ওকে আমি বাজারে পাঠিয়েছি দুধ আনতে। রানী ওষুধ খেয়েছে?”

“বলেছিল তো খেয়েছে।”

“বাড়িতে এতোগুলো লোক অথচ কাজ শেষ হয় না।”

“মাছও কি কাঁটতে হবে?”

“তা নয়তো কি আস্ত খাবো?”

রুমকি সবজি কাঁটা শেষ করে মাছের আঁশ ছাড়াতে শুরু করলেন। বেশ ঝটপট মাছগুলোকে কেঁটে ধুঁয়ে পরিষ্কার করে রাখলেন। শকুন্তলা রান্নাঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,

“তুই বাচ্চাদের কাছে যা রুমকি। এদিকে বাকিটা আমি আর দিদি সামলে নেবো।”

“ঠিকাছে। ভাত বসিয়েছি। হয়ে গেলে নামিয়ে নিও।”

রুমকি চলে গেলে শকুন্তলা ভাতের হাড়ি নামিয়ে নিলেন। এক চুলায় গরম পানি আর অন্য চুলায় তরকারি বসিয়ে দিলেন। আম্রপালি শ্বাশুড়ির জন্য রান্না করা খাবার নামিয়ে আলাদা করে ঢেকে রেখে দিলেন। মাছে মসলা মাখিয়ে তেলে দিতেই হাঁচি চলে এলো।

“ময়দাটা মেখে রাখিস শকুন্তলা। লুচি আর পায়েসও করবো। আর তরকারি হয়ে গেলে মাংসটাও রেঁধে ফেলিস।”

“আজ কেউ আসবে দিদি?”

“না তো। কেন?”

“এতোকিছু রাঁধছো যে তাই জিজ্ঞেস করলাম।”

আম্রপালি মাছ ওল্টাতে ওল্টাতে বললেন,

“ভালো মন্দ রাঁধার জন্য অতিথি আসতে হবে কেন? এমনিই তো করা যায়। আজ ভালো লাগছে তাই করছি।”

“ইশশশ। অর্ণবকে শুধু শুধু পাঠালে। কবে থেকে তোমার হাতের লুচি পায়েস খেতে চাইছিল। আর আজ যখন বানাবে তখন ও-ই নেই।”

“জানতে পারলে বলবে, -আমি না থাকলেই আপনারা সব মজার মজার রান্না করেন। কই, আমি থাকলে তো করেন না।”

কথাটা বলেই দু’জনে উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। কিছুক্ষণ নিরব থেকে শকুন্তলা বলে উঠলেন,

“ওই লোকটা কে গো দিদি?”

“কোন লোকটা?”

“ওইযে সেই লোকটা যে কয়েকমাস পর পরই আসে বাড়ির সামনে। হাতে একটা শ্বেতকাঞ্চন নিয়ে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফুলটা রেখে আবার চলে যায়। তোমার জন্যই তো আসে। তাই না?”

আম্রপালির বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো। শকুন্তলার দিকে না তাকিয়েই বললেন,

“জানি না তুই কার কথা বলছিস?”

“মিথ্যা বলবে না। আমি জানি সে তোমাকে দেখতে আসে। আর তোমাকে দেখেছিও ফুলটা তুলে আনতে। আমি জানি সে কে?”

“কে?”

“খোঁজ নিয়েছি। ওর নাম রুদ্র। তোমার ছোটবেলার বন্ধু।”

“জানিসই যখন তাহলে আবার জিজ্ঞেস করলি কেন? আমাকে আর কোনদিন এই বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করবি না।”

“চাইলেই তো নিজের জীবনটা আবার নতুন করে সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে পারো দিদি।”

“মাথা ঠিক আছে তোর? কি বলছিস ভেবে বলছিস তো? সতেরো বছর বয়সে এই বাড়ির বউ হয়ে এসেছিলাম। বছর পেরতে না পেরতেই মা হয়ে গেছি। দোতলার ঘরে যে লোকটাকে শুয়ে থাকতে দেখছিস না? দশ হয়ে গেছে তার সাথে আছি। তার ভালো সময়ে থাকবো আর খারাপ সময়ে ছেড়ে যাবো তা তো হয় না। আর কখনো এইসব উল্টোপাল্টা কথা বলবি না।”

“কিন্তু তাকে তো তুমি ভালোবাসো না।”

“চুপ কর শকুন্তলা। আর একটা কথাও শুনতে চাই না এ ব্যাপারে।”

রামু এসে ডাকাডাকি শুরু করলে আম্রপালি চুলার আঁচ কমিয়ে রান্নাঘর থেকে বাইরে এলেন। শকুন্তলাও তার পেছন পেছন আসলেন। দুধের কলসি রেখে মাথার উপর থেকে বাজারের ডালা নামাতে নামাতে বললেন,

“সবকিছু ঠিকমতো নিয়া আইছি। মিলাইয়া দেইখা নেন।”

“কিরে? তোকে তো আমি পাঠালাম শুধু দুধ আনতে। তুই এতো বাজার করে এনেছিস কেন?”

“খালি দুধ আনতে কইছিলেন?”

“তা নয় তো কি?”

“বাজার এগুলা দরকার নাই?”

“না।”

রামু মাথা চুলকাতে-চুলকাতে বললেন আবার বললেন,

“একটু দেইখা কন। যদি লাগে?”

আম্রপালি দুধের কলসি তুলে নিয়ে যেতে যেতে বললেন,

“লাগবে না।”

“আরেকটা জিনিস আনছি।”

“আবার কি এনেছিস?”

“এইডা আপনের জন্যে না। এইডা ছোট মালকিনের জন্যে আইছে।”

“আমার জন্য? কি এসেছে?”

রামু পকেট থেকে কিছু একটা বের করে শকুন্তলার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন,

“চিঠি।”

“চিঠি! কে পাঠিয়েছে?”

“তা তো জানি না। আপনে খুইলা দেখেন না।”

শকুন্তলা চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করলেন। পড়া শেষ করে বড় করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লেন।

“কার চিঠি শকুন্তলা?”

“তোমার দেবরের।”

“কি লিখেছে?”

“এখন আসতে পারবেন না বললেন। কিসের কাজে যেন আঁটকে গেছেন।”

“তুই মন খারাপ করিস না। হয়তো জরুরি কোনো কাজে আঁটকে গেছে।”

“কি এমন কাজ বলো তো দিদি। মেয়েটা হওয়ার পরেও এখনো একবার দেখতে আসার সুযোগ পেল না?”

“বললাম তো মন খারাপ করিস না। আমি খাবার বেড়ে দিচ্ছি। তুই গিয়ে মায়ের ঘরে দিয়ে আয়।”
.
.
.
জানালার ধারে টেবিলে বইপত্র নিয়ে একসাথে পড়তে বসেছে অর্ণব আর শমিত। বাইরে গাছের ডালে বসে কাঁকভেজা দুটো শালিক এখন রৌদ্রস্নানে মত্ত। অর্ণব কলম কামড়াতে কামড়াতে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে সেদিকে। কিছুক্ষণ আগেই এখানে বৃষ্টি হয়ে গেছে। এখন আবার রোদে চারদিক ঝলমল করছে।

“কিরে? অংক কষা বাদ দিয়ে তুই ওদিকে তাকিয়ে কলম কামড়াচ্ছিস কেন?”

এমন সময় পেটে ক্ষুধা অনভব করলো অর্ণব। শমিতের প্রশ্নের উত্তরে বললো,

“ধুর। খিদে পেয়েছে তো। খালি পেটে এতো পড়া যায় নাকি। সেই সক্কালে পিসি কিসের যেন একটা তেঁতো কি খেতে দিল।”

“নিমপাতার রস ছিল ওটা। আমি রোজ সকালে খাই। পেট ভালো থাকে।”

“তোর তো অভ্যেস আছে। আমার তো আর নেই। এখানে ঘুরতে আসতে খুব ভালো লাগে কিন্তু পিসির এসব নিয়ম একটুও ভাল্লাগে না। আগে তো কয়েকদিন থাকতাম তাই মানা যেত। এবার তো পুরো একমাস।”

“মা তো বললো দু’সপ্তাহ।”

“তুই ঠিক শুনেছিস পিসি বলেছে এমন?”

“হ্যাঁ।”

“কখন বলেছে?”

“আজ সকালে।”

“সত্যি বলছিস তো? পিসি সত্যিই তাই বলেছে?”

“ধুর। আমি মিথ্যে বলবো কেন তোকে? বিশ্বাস করলে কর না করলে না কর। এখন চুপচাপ পড়।”

“খিদে পেয়েছ আমার। আমি পড়তে পারবো না। দু’ঘন্টা হয়ে গেল পড়তে বসেছি। এখন তো ছুটি। ছুটিতে এতো কিসের পড়ারে?”

“কিছু করার নেই। এখন আটটা বাজে। মা ন’টায় খেতে দেবে।”

“তুই কিছু একটা কর।”

শমিত দু’বার এদিক ওদিক তাকালো। তারপর বললো,

“দাঁড়া দেখছি।”

“কি দেখবি?”

শমিত হাত দিয়ে জানালার বাইরে ইশারা করে দূরে একটা আমগাছ দেখিয়ে বললো,

“কাঁচা আম খাবি? নুন তেল দিয়ে মাখিয়ে খেতে দারুণ লাগবে। আমার তো এখনই জিভে জল চলে এসেছে।”

“খালি পেটে টক খাবো?”

“তুই না বললি তোর খিদে পেয়েছে।”

“হ্যাঁ, বলেছি তো।”

“চল তাহলে। রবিদের গাছে এবার প্রচুর আম এসেছে। আমরা কয়টা নিলে কিছুই বলবে না।”

“পিসি যদি বকে?”

“মা মনে হয় এখন ঠাকুরঘরে। আরতি করছে। উঠতে উঠতে আমরা বেরিয়ে যাবো।”

“আচ্ছা চল তাহলে।”

সব বইপত্র ওভাবেই ফেলে দু’জনে পা টিপেটিপে সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলো। কোনো রকম শব্দ না করেই দরজা সামান্য খুলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।

এক দৌঁড়ে বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছে অর্ণব আর শমিত। আমগাছ তলায় এসে দুজনেই হাঁপাতে লাগলো। শমিত বললো,

“নে। এবার গাছে ওঠ।”

“আমি কেন উঠবো? তুই ওঠ।”

“তুই ওঠ।”

“উহু। তুই আম খাওয়ার কথা বলেছিস। তাই তুই উঠবি।”

“ঠিক আছে। আমিই উঠছি।”

শমিত গাছে উঠতে গিয়ে বললো,

“এইরে, গাছ তো ভেজা। যদি পিছলে পরে যাই।”

“পরবি না। আস্তে আস্তে ওঠ। আর আমি এখানেই আছি।”

“ঠিকাছে। এখানেই থাকিস কিন্তু।”

শমিত ধীরে ধীরে গাছে উঠে গেল। অর্ণব পাশেই কিছুটা সামনে একটা কুয়ো দেখতে পেল। এক মেয়ে কুয়ো থেকে জল তুলছে। গায়ে কমলা রঙের শাড়ী, মাথায় ঘোমটা দেওয়া, হাতে শাখা-পলা, সিঁথিতে লম্বা করে সিঁদুর দেওয়া আর গায়ে সামান্য গয়না। দেখেই বোঝা যাচ্ছে নববধূ। মেয়েটা দূর থেকে তাকে ইশারায় ডাকলেন। অর্ণব সেদিকে পা বাড়াতেই পেছন থেকে শমিত বলে উঠলো,

“কিরে? কোথায় যাচ্ছিস আমাকে একা রেখে?”

“তুই থাক এখানে। আমি এক্ষুনি চলে আসবো।”

কথা না বাড়িয়ে অর্ণব দৌঁড়ে মেয়েটার সামনে এসে দাঁড়ালো। মেয়েটা তার দিকে একটা জল ভর্তি কলসি এগিয়ে দিয়ে বললেন,

“ধরো।”

অর্ণব তার থেকে কলসিটা নিয়ে নিল। মেয়েটা নিজে আরেকটা কলসি তুলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করলেন,

“নাম কি তোমার?”

“তুমি আমাকে চেনো না?”

“ওমা। আমি তোমাকে কি করে চিনবো?”

“আমাকে তো এখানে সবাই চেনে। আমি প্রতিবছরই এখানে আসি। তোমাকে তো আগে দেখিনি। তুমি এখানে নতুন এসেছো?”

“ঠিকই ধরেছো। আমি এখানে নতুনই এসেছি। বিয়ে করে। তোমার নাম বললে না যে?”

“অর্ণব চৌধুরী।”

“কার বাড়িতে এসেছো?”

“আমার পিসির বাড়ি।”

“তোমার পিসির নাম কি?”

“অনুরাধা। তোমার নাম কি?”

“রাশমণি।”

অর্ণব তার সাথে তার বাড়িতে চলে এলো। উঠোনে বসে এক বিধবা মহিলা চাল থেকে পাথর বাছছেন। গায়ে সাদা থান জড়ানো। মাথায় ছোট ছোট আধাপাকা চুল। অর্ণবকে দেখেই মাথায় ঘোমটা তুলে আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে নিলেন। অর্ণব বুঝলো না তিনি এমন কেন করলেন। কিন্তু তাকে দেখে তার নিজের দিদিমার কথা মনে পরলো। রাশমণি কলসি দুটো রান্নাঘরে রেখে বললেন,

“তুমি আমগাছ তলায় কি করছিলে?”

“খিদে পেয়েছিল। তাই শমিত আম পারতে গাছে উঠেছিল। আর আমি নিচে ওর জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম।”

“তুমি তোমার বন্ধুকে ওখানে একা ফেলে চলে এলে?”

“তুমি ডাকলে যে।”

“মোয়া খাবে?”

“হ্যাঁ।”

রাশমণি অর্ণবের হাতে মোয়া দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

“তোমার বাড়ি কই?”

“কুঞ্জনগর।”

“ওহহহ। দু’গ্রাম পরেই তো।”

“হ্যাঁ।”

“কে কে আছে বাড়িতে?”

“মা, বাবা, দাদিমা, ছোটমা, কাকু, ছোটবোন,পদ্মা আরও অনেকজন।”

“তোমার পরিবার তো তাহলে অনেক বড়। পদ্মা কে?”

“ওইযে মা সেদিন যে মেয়েটাকে বাড়িতে নিয়ে এলো ওই পদ্মা। ওর জন্যই তো এবার শাস্তি পেয়ে এখানে এসেছি। এমনিতে তো আমি প্রতিবছরই পিসির বাড়ি ঘুরতে আসি। কিন্তু এবার এসেছি শাস্তি পেয়ে।”

“শাস্তি পেয়ে! কেন?”

“পদ্মার জন্য ফুল চুরি করতে গিয়ে ধরা পরেছিলাম। তাই মা শাস্তি দিয়েছেন।”

“হাহাহা। আহারে। পদ্মা কি হয় তোমার?”

অর্ণব কিছু বলার আগেই সেখানে শমিত চলে এলো।

“কিরে অর্ণব? তুই এখানে কি করছিস? তাড়াতাড়ি বাড়ি চল। আর একটু দেরি করলে মা না খাইয়ে রাখবে।”

অর্ণব শমিতকে আপাদমস্তক দেখে বললো,

“তোর এই অবস্থা কেন শমিত? জামায় কাদা লাগালি কি করে?”

“গাছ থেকে নামতে গিয়ে পিছলে কাদায় পড়ে গিয়েছি।”

“আম এনেছিস?”

“না। বাড়ি চল এবার।”

অর্ণব ঘুরে রাশমণির দিকে তাঁকালো। তিনি বললেন,

“তোমার বন্ধু?”

“হ্যাঁ। ভাইও। আমি তাহলে আসি।”

“ঠিক আছে। আবার এসো কিন্তু তোমার এই দিদির বাড়িতে।”

“আসবো।”

অর্ণব আর শমিত দুজনে ছুটে চলে গেল।
.
.
বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই অনুরাধার সামনে পরলো তারা। বেশ রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে আছেন তিনি। ভয়ে দুজনেই সেখানে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো। একে অন্যের দিকে তাকিয়ে ঢোঁক গিললো। অনুরাধা জিজ্ঞেস করলেন,

“কই গিয়েছিলি তোরা?”

শমিত বললো,

“এখানেই ছিলাম মা। বাইরে একটু খেলছিলাম।”

“তোর জামায় কাদা লাগলো কি করে?”

“পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম।”

“জামা বদলে হাতমুখ ধুয়ে খেতে আয় দুজনে। আমি খাবার বাড়ছি।”

কথাটা বলেই অনুরাধা চলে গেলেন। তার এমন ব্যবহারে দুজনেই বেশ অবাক হলো। শমিত বললো,

“বাবা এসেছে মনে হয়।”

“কি করে বুঝলি?”

“বাবা থাকলে মা বেশি বকাবকি করে না।”

কথা শেষ করে দুজনেই হেসে উঠলো।

চলবে…

মেহেরজান পর্ব-২+৩

0

#মেহেরজান
#পর্ব-২
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

রাতের ঝড়-বৃষ্টিতে চারপাশ ধুঁয়ে একদম চকচকে ঝকঝকে করে দিয়ে গেছে। এখনও গাছের পাতা বেয়ে বেয়ে টপটপ করে বৃষ্টির পানি ঝরছে। ভেজা মাটির একটা আলাদা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। চারদিকে পাখিদের কলরব শোনা যাচ্ছে। ভোরের আলো ফুঁটতে না ফুঁটতেই আম্রপালি পদ্মাবতীকে নিয়ে বাগান বাড়িতে এসেছে। নিজের কোলে থেকে নামিয়ে অন্য একটা মেয়ের কাছে পদ্মাকে দিলে তারানা তার কোলে আরেকটি ঘুমন্ত শিশু তুলে দিয়ে বললেন,

“মুসলিম ঘরের মেয়ে। কালরাতে হয়েছে। চরণ বললো যে মা’টা পাকিস্তানি ছিল। কিজানি এখানে কি করে পৌঁছালো।”

আম্রপালি বাচ্চাটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

“এর মা কই?”

তারানা কিছুটা তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,

“ওর জন্মের কিছুক্ষণ পরেই মারা গেছে। হুহ, কি মেয়ে! আসতে না আসতেই নিজের মা’টাকে খেয়ে নিলো।”

আম্রপালি চোখ রাঙিয়ে তারানার দিকে তাঁকালে তিনি কিছুটা চুপসে গেলেন। আমতা আমতা করে বললেন,

“না মানে মা’টা মরার আগে একটা নামও রেখে গেছে।”

“কি নাম?”

“মেহেরজান।”

“মেহেরজান? উহু। ওর নাম হবে মোহিনী।”

“কিন্তু…”

“আমি বলে দিয়েছি না একবার? আর কোনো কিন্তু নেই।”

“আচ্ছা।”

বাচ্চাটাকে তারানার কোলে ফিরিয়ে দিতে নিলে সে আম্রপালির আঁচলের একটা অংশ নিজের ছোট্ট হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে কেঁদে উঠলো। আম্রপালির বড্ড ইচ্ছে করলো বাচ্চাটাকে আরও কিছুক্ষণ তার কাছে রাখতে। কিন্তু তিনি অনেক্ষণ যাবৎ এখানে এসেছেন। এবার বাড়ি ফিরতে হবে। তাই নিজের ইচ্ছেকে মাটিচাপা দিয়ে বাচ্চাটাকে তারানার কাছে দিয়ে দিলেন আর ঠিক মতো খেয়াল রাখতে বললেন। পদ্মাবতীকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালে তারানা বললেন,

“আপনি কি এখন বাড়িতে যাচ্ছেন?”

“না। এখান থেকে মন্দিরে যাবো একটু।”

“কিন্তু মন্দিরের রাস্তা তো বন্ধ।”

“কেন?”

“কালরাতের ঝড়ে রাস্তায় নাকি বিশাল বড় গাছ ভেঙে পরেছে। এখনো সরায়নো হয়নি। কাজ চলছে।”

“ওহহহ। কি আর করার তাহলে। বাড়িতেই ফিরে যাই নাহয়।”

আম্রপালি আর দেরি না করে বেরিয়ে গেলেন। এখান থেকে তার বাড়ির দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। দশ মিনিটের হাটা পথ। তাদের বাড়িটা বেশ বড়। কিছুটা পুরনো কিন্তু তা দেখে বোঝার উপায় নেই। এখনো বেশ চাকচিক্যময়। আর বাড়ির সামনে আর পেছনে কিছুটা জায়গা রেখে চারদিকে দেওয়াল তোলা। একদম পরিপাটি একটা দোতলা বাড়ি। বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই দেখলেন অর্ণব চুপচাপ কান ধরে মাথানিচু করে এককোণে দাঁড়িয়ে আছে আর শকুন্তলা বেশ জোরে জোরেই একটা লোকের সাথে কথা বলছেন। আম্রপালি সামনে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন,

“কি হয়েছে শকুন্তলা?”

অর্ণব চোরাচোখে নিজের মা’কে একবার দেখে নিল।

“দেখো দিদি। তোমার গুণধর ছেলে কি করেছে।”

অর্ণব চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

“আমি কিছু করিনি।”

“তুমি চুপ করে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকো।”

লোকটি বলে উঠলেন,

“আমি বলছি ও কি করেছে। আজ সকালে আপনার ছেলে আমার বাগানে ঢুকে এত্তগুলো ফুল ছিড়েছে। সাথে গাছ যে কতগুলো নষ্ট করেছে গুণে শেষ হবে না। হায় হায় হায়! আমার কত টাকার লোকসান হয়ে গেল।”

“আমি এমন করিনি। এই লোকটা মিথ্যে বলছে।”

“তুমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো। দোষ করেছো আবার কথা বলছো।”

আম্রপালি ঘরের ভেতরে গিয়ে কিছু টাকা নিয়ে ফিরে আসলেন। টাকাগুলো লোকটির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,

“আশা করি এতে আপনার ক্ষতিপূরণ হয়ে যাবে।”

টাকাগুলো দেখে লোকটির চোখ চকচক করে উঠলো। তাড়াতাড়ি করে আম্রপালির হাত থেকে তা লুফে নিয়ে গুনতে গুনতে বললেন,

“হ্যাঁ হ্যাঁ। হয়ে যাবে। আপনি যখন ক্ষতিপূরন দিয়েই দিয়েছেন তাহলে আর কি বলি। আমি বরং এখন আসি।”

লোকটি চলে গেলে আম্রপালি অর্ণবের সামনে এসে দাঁড়ালেন। বললেন,

“কান ছাড়ো এখন। এমন করেছো কেন?”

অর্ণব কান ছাড়তে ছাড়তে বললো,

“বলবো না।”

“কেন?”

“তখন বলতে চাইলাম কিন্তু আপনি শুনলেন না আমার কথা। উল্টো ওই লোকটাকে টাকা দিয়ে দিলেন। এখন বলে কি হবে?”

“তবুও বলো।”

“আমি ওর বাগান নষ্ট করিনি। ও মিথ্যে বলেছে। আমি মাত্র দুটো ফুল ছিড়েছিলাম। তাও ওই লোকটা নিয়ে নিয়েছে।”

“ফুল কেন ছিড়েছিলে?”

অর্ণব তার মায়ের কোলের দিকে ইশারা করে বললো,

“পদ্মার জন্য। ওকে সাজাবো বলে।”

“হাহাহা। দেখেছো দিদি। এই ছেলের এখনই এই হাল। বলি অর্ণব, তুমি তো চিত্রার জন্য কখনো ফুল আনোনি।”

অর্ণব শকুন্তলার কথার জবাব না দিয়ে শুধু ঠোঁট কাঁমড়ালো। আম্রপালি বললেন,

“যাই হোক। দোষ তো তুমি করেছো। আর তার জন্য শাস্তিও পাবে।”

“আপনি তো ওই লোকটাকে তার ক্ষতির বেশিই টাকা দিয়েছেন। তাহলে আবার আমাকে শাস্তি দেবেন কেন?”

“ওটা তার ক্ষতিপূরণ ছিল। তোমার শাস্তি নয়। আর ওই টাকাটা তোমার উপার্জিতও নয়। তাই তোমাকে আলাদা শাস্তি দেবো।”

“কি শাস্তি?”

“তুমি তোমার পিসির কাছে যাবে।”

“অসম্ভব। আমি যাবো না।”

“তোমাকে যেতে হবে।”

“একদম না। পিসি এতো এতো আজেবাজে নিয়ম বানিয়ে রেখেছে। ওখানে গেলে আমাকেও তা মানতে হবে। আমি পারবো নাহ। তাই আমি যাবো না পিসির বাড়িতে।”

“তুমি যাবে। আর গিয়ে একমাস ওখানেই থাকবে। এটাই তোমার শাস্তি। কাল দুপুরে তোমার পিসেমশাই আসবেন তোমাকে নিতে।”

অর্ণব রাগে আগুন হয়ে মুখ ফুলিয়ে চোখ বড় বড় করে আম্রপালির দিকে তাঁকালো। ছেলের এমন মুখভঙ্গি দেখে মুচকি হাসলেন তিনি।

চলবে…

#মেহেরজান
#পর্ব-৩
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

চল্লিশ বছর বয়সী এক পুরুষ শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে আছেন। আম্রপালি ধীরে ধীরে চামচ দিয়ে তুলে তরল জাতীয় একটা খাবার তাকে খাইয়ে দিচ্ছেন। আরেক চামচ খাবার তার মুখে দেওয়ার সাথে সাথে তিনি তা মুখ থেকে বের করে দিলেন। আম্রপালি বুঝতে পারলেন তিনি আর খেতে ইচ্ছুক নন তাই জোরজবরদস্তি না করে খাবারের বাটিটা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক কাজের লোকের হাতে দিয়ে পানি খাইয়ে মুখ মুছে দিলেন। ঘরে এতোক্ষণ বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছিল। আম্রপালি তাঁকিয়ে দেখলেন ঘরের জানালাগুলো সব এখনো বন্ধ। পাশে থাকা কাজের লোকের উদ্দেশ্যে বললেন,

“দুপুর হয়ে গেছে এখনো ঘরের জানালা বন্ধ কেন?”

“এ ঘরে আজকে আপনিই প্রথম এসেছেন মালকিন।”

“মানে?”

“কালরাতে আপনি বড় মালিককে খাইয়ে যাওয়ার পর আর কেউ আসেননি এখানে।”

“তাহলে ওনাকে সকালে খাবার কে খাইয়েছে?”

লোকটি আম্রপালির দিকে কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে থেকে মাথা নিচু করে ফেললেন। মুহুর্তেই আম্রপালির বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। মানুষটা যে এতো সময় অনাহারে ছিল তা বুঝতে আর বাকি নেই। মানুষটার খেয়াল রাখার দায়িত্ব মনে হয় শুধু তার একার। এ বাড়িতে যে একজন মানুষ না খেয়ে আছে তাতে যেন কারও কিচ্ছু যায় আসে না। কিন্তু তার যে অনেক কিছু যায় আসে। কারণ এই মানুষটার সাথেই সে এতো বছর ধরে সংসার করে আসছে। তার দেখভালের দায়িত্ব তো তাকে পালন করতেই হবে। পরক্ষণেই নিজেকে দোষ দিতে লাগলেন আম্রপালি। তিনি নিজে কেন এতো সময় তার খোঁজ নিলেন না? এটা তো তারই দায়িত্ব ছিল। আম্রপালি ছলছল চোখে উঠে গিয়ে সব জানালা খুলে দিলেন। বাড়ির পেছনে বিভিন্ন ফল, বড় বড় গাছের বাগান আর দিঘি থাকায় কাঠফাটা রোদের মধ্যেও একটা শীতল বাতাস হনহনিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকলো যা মুহুর্তেই সব ক্লান্তি দূর করে দিতে পারে।
.
.
.
মুখ গোমড়া করে খাটের কোণায় বসে আছে অর্ণব। আম্রপালি নিজের মতো অর্ণবের কাপড় ভাজ করে ব্যাগে ভরছেন। অর্ণব শেষবারের মতো আবার বললো,

“আমি যাবো না।”

কথাটা বলে অর্ণব উৎসুক দৃষ্টিতে আম্রপালির দিকে তাঁকিয়ে রইলো উত্তরের অপেক্ষায়। আম্রপালি একবার চোখ তুলে ছেলের দিকে তাঁকালেন। কিন্তু কোনো উত্তর দিলেন না। অর্ণব এটা আশা করেনি। ভেবেছিল কিছু হয়তো বলবে। কিন্তু আম্রপালির কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে সোজা দৌঁড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

“তোমার বৌমাকে কিছু বলবে না? ছুটি শুরু হতে না হতেই আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছে।”

নিজের দিদিমার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে কথাগুলো চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো অর্ণব। দরজার সামনে সাদা ধুতি পাঞ্জাবী পরা একটা ছেলেকে ঝাপসা দেখতে পেলেন শান্তি দেবী। কণ্ঠ শুনে চিনতে ভুল হয়নি তার।

“কেন রে? কি হলো আবার? কি করেছে আম্র?”

“আমাকে পিসির বাড়ি পাঠাচ্ছে।”

“ওহহহ। এই কথা। তা একবার ঘুরেই আয় না।”

“এক মাসের জন্য।”

“এতোদিন গিয়ে কি করবি ওখানে?”

“তোমার ছেলের বৌকেই জিজ্ঞেস করো। সে-ই তো বলেছে।”

“ও আম্র এমনি বলেছে। এতোদিন তোকে ছাড়া থাকতে পারবে নাকি বল?”

“তুমি কিছু বলো মাকে।”

“আমি আবার কি বলবো? আমার চশমাটা যে কই রাখলাম। কিছু দেখতেও পাচ্ছি না। একটু খুঁজে দে না।”

“ধুর বুড়ি। তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না।”

কোনো কাজ হবে না ভেবে ঘর থেকে দৌঁড়ে বেরিয়ে গেল অর্ণব। শান্তি নিজের স্বর একটু উঁচু করে বললেন,

“কিরে? চলে গেলি নাকি? আমার চশমাটা খুঁজে দিয়ে যা।”

বাইরে থেকে শব্দ ভেসে এলো,

“নিজে খুঁজে নাও বুড়ি।”
.
.
.
গাড়ি বাড়ির সীমানার বাইরে চলে যেতেই শকুন্তলা বললেন,

“ছোট্ট একটা ভুলের জন্য এতো বড় শাস্তি দিলে? যাওয়ার সময়েও মুখ ভারী করে চলে গেল।”

“শাস্তি না দিলে আবার এমন করতো।”

“তাই বলে এক মাসের জন্য? লেখাপড়ার ক্ষতি হবে না?”

“একমাস তো নয়। দু’সপ্তাহের জন্য পাঠিয়েছি। ছুটি পেতে না পেতেই ওর দুষ্টুমি শুরু হয়ে গেছে। ওখানে থাকলে তাও একটু নিয়মকানুনের মধ্যে থাকবে।”

“তবে যে বললে একমাস?”

“ওটা এমনি বলেছি। ঘর থেকে আমার ব্যাগ একটু নিয়ে আয় না শকুন্তলা। একটু বাগান বাড়িতে যাবো।”

“কালই না গিয়েছিলে? আজ আবার যাবে?”

“হ্যাঁ। তাতে কি?”

“কিছুনা। তুমি দাঁড়াও, আমি ব্যাগ নিয়ে আসছি।”
.
.
.
সেই বিকেলের দিকে এসেছেন আম্রপালি। এখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেছে। আম্রপালির ভাবসাব কিছুই বুঝতে পারছেন না তারানা। এসে থেকেই মোহিনীর সাথে একদম লেগে আছেন। এক মুহূর্তের জন্যও নিজের থেকে আলাদা করেননি। একটা মেয়ে তারানার কানে ফিসফিসিয়ে বললো,

“কি হলো বলো তো আম্মা। এক দিন যেতে না যেতেই আবার চলে এলেন। ইনি হঠাৎ মোহিনীকে নিয়ে পরলেন কেন?”

“আমিও সেটাই ভাবছি। একদম আঠার মতো সেঁটে আছে।”

“তারানা।”

আম্রপালির ডাকে হকচকিয়ে উঠলেন তারানা। তারপর বোকার মতো মুখ করে বললেন,

“হা?”

“রাত হয়ে গেছে। আমি এখন উঠি।”

“এখনই চলে যাবে? আর কিছুক্ষণ ওর সাথে থাকলে পারতে। দেখো কি সুন্দর চুপচাপভাবে ড্যাবড্যাব করে দেখছে তোমাকে।”

“আমি ওকে আজ আমার সাথে নিয়ে যাবো।”

“হঠাৎ?”

“কেন? কোনো সমস্যা আছে?”

“না না। কি সমস্যা হবে আবার? আগে তো কখনো কাউকে এ বাড়ি থেকে নিয়ে যাওনি তাই জিজ্ঞেস করছি আরকি। কোনো সমস্যা হবে না। তুমি নিয়ে যাও।”

“ঠিক আছে।”

আম্রপালি মোহিনীকে নিয়ে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে মেয়েটি তারানার উদ্দেশ্যে বললো,

“আম্মা, আগে কখনো দেখেছো এরকম? হঠাৎ কি হলো বলো তো।”

“আমি কি জানি। কত মেয়েই তো এলো। কিন্তু আগে কোনোদিন এই দৃশ্য দেখিনি। যাই হোক, তাতে তোর কি রে প্রমিতা? ওই বাচ্চাটাকেও খুব হিংসে হয় তোর? যা নিজের কাজ কর।”
.
.
.
জলের ভেতর থেকে উঠেই অর্ণব বড় বড় শ্বাস নিতে লাগলো। ঠান্ডায় থরথর করে কাঁপছে। পাশে তার সমবয়সী আরেকটি ছেলে উঠে এলো জল থেকে। অর্ণবের দিকে তাঁকিয়ে বললো,

“কিরে? একটা ডুব দিয়েই এই অবস্থা তোর। চিন্তা করিস না। একমাস তো আছিসই। ততোদিনে অভ্যেস হয়ে যাবে।”

কাঁপতে কাঁপতে অর্ণব বললো,

“লাগবে না আমার এমন অভ্যেস করা। আমি শুধু বাড়ি যাবো। এখানে থাকলে তোর মা আমাকে এসব করাতে করাতেই মেরে ফেলবে।”

“এখন স্নান করলে দেখবি সারাদিন কত ভালো লাগে।”

“দরকার নেই ভালো লাগার। দেখছিস না ঠান্ডায় কাঁপছি আমি।”

“একটা ডুব দিয়েছিস তাই এতো ঠান্ডা লাগছে। আরেকটা ডুব দে। দেখবি ঠান্ডা কমে গেছে। যা, আর দুটো ডুব দিয়ে চলে যাবো।”

কথাটা বলেই ছেলেটা আবার জলের ভেতর চলে গেল। অর্ণব দাঁতে দাঁত চেপে কটমট করতে করতে বললো,

“পদ্মারে, আজ শুধু তোর জন্য ফুল আনতে গিয়ে আমাকে সূর্য ওঠার আগে নদীর এই ঠান্ডা জলে স্নান করতে হলো। একবার শুধু বড় হ তুই। এর খেসারত সুদে আসলে উশুল করবো তোর থেকে।”

চলবে…

মেহেরজান পর্ব-০১

0

#মেহেরজান
#পর্ব-১
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলেন নারী বেশভূষায় থাকা এক তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি। মুখে প্রসাধনীর মোটা আস্তরণ একদম লেপ্টে আছে। মুখ বাঁকিয়ে বাঁকিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করছেন। হাত দিয়ে মেয়েটার দুই গাল চেপে ধরে বললেন,

“খুব রঙ লেগেছে না মনে? রাত করে বৃষ্টিতে ভেজা হচ্ছে? বৃষ্টিতে যে ভিজলি এখন জ্বর আসলে নাচবি কি করে? তোর মা এসে নেচে যাবে?”

“ভুল হয়ে গেছে আম্মা। ক্ষমা করে দাও।”

“হুহ। ক্ষমা করে দাও! তোর মায়ের মনেও এমন রঙ লেগেছিল। তাই তো তুই এখন এখানে। তোর মা ভুল না করলে তোকে এখানে থাকতে হতো না।”

“বার বার মাকে কেন টানছো তুমি?”

তারানা মেয়েটির গালে আবারও স্বজোরে চড় মেরে বললেন,

“মায়ের জন্য দরদ উথলে উঠছে একদম তাই না? তোর কোন মা এসে পেলে তোকে এতো বড় করেছে? একদিনের বাচ্চা ছিলি যখন তোকে এখানে ফেলে গিয়েছিল তোর মা।”

মেয়েটি আর কিছু বলার সাহস পেলো না। তারানা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললেন,

“এই কে কোথায় আছিস? এটাকে নিয়ে যা তো এখান থেকে। আর ছাদের দরজায় এখনই তালা দে। কোনো মেয়ে যেন ছাদে যেতে না পারে।”

তারানা পুরো বাড়ি দৌঁড়াদৌঁড়ি করে সবাইকে দরজা জানালা বন্ধ করার তাগাদা দিয়েই চলেছেন। এদিকে হঠাৎই বিদ্যুৎ চলে গেল। এমন সময় এক ব্যক্তি হাতে হ্যারিকেন নিয়ে ছুটে আসলেন। আর জোরে জোরে তারানাকে ডাকতে লাগলেন।

“আম্মাজি। জলদি আইএ।”

“কি হয়েছে চরণ? এতো চেঁচাচ্ছিস কেন? কানের পোকা তো বের করে ফেললি।”

“বাহার তুফান ম্যে পেড়কে নিচে এক অওরাত পরি হ্যে। পাকিস্তানসে হ্যে শায়াদ। লগতা হ্যে বচ্চা হোনেওয়ালি হ্যে।”

“বলিস কি! চলতো তাড়াতাড়ি।”

তারানা সাথে দুটো মেয়েকে নিয়ে ছুটে বাহিরে আসলেন। দেখলেন সত্যিই গাছের নিচে শুয়ে এক মহিলা ব্যথায় কাতরাচ্ছে।

“তোরা তাড়াতাড়ি ধর একে আমার সাথে। বাড়ির ভেতরে নিয়ে চল। আর চরণ, তুই গিয়ে দাইকে ডেকে নিয়ে আয়।”
.
.
.
বাইরে একটু পর পর বজ্রপাতের বিকট শব্দ হচ্ছে। হাসপাতালের বেঞ্চে বসে আছেন দুজন নারী। একজনের কোলে দুমাসের বাচ্চা। বজ্রপাতের শব্দের বাচ্চাটা বারবার কেঁদে ওঠায় সে তাকে সামলাতে ব্যস্ত। অপর দিকে আরেকজন চিন্তিত হয়ে বসে আছেন। বাচ্চাটাকে বারবার কেঁদে উঠতে দেখে বললেন,

“তুই বাড়ি যা শকুন্তলা। ও ভয় পাচ্ছে। আর আমার সাথে তো এখানে রামু আছেই।”

“না দিদি। তোমাকে একা রেখে আমি এখান থেকে এক পাও নড়ছি না।”

বৃষ্টিতে কাঁকভেজা হয়ে একটা লোক দ্রুত পা চালিয়ে আসছে তাদের দিকে। হাতে দু কাপ চা। দু’জনের দিকে দুটো কাপ এগিয়ে দিয়ে বললেন,

“এই নেন চা। দুইজনে খাইয়া নেন আগে।”

“তুই এই বৃষ্টিতে ভিজে চা আনতে গিয়েছিলি?”

“হ।”

“এই ঝড়ের মধ্যে দোকান খোলা ছিল?”

“ছিল তো একটা। হাসপাতালের বাইরেই তো। দূরে না বেশি। ওইখান থিকাই নিয়া আইছি।”

“রেখে দে নাহয় তুই খেয়ে নে। আমি খাবো না।”

তার কথার জবাবে রামু আর কিছু বললো না। কারণ সে জানে তিনি যখন একবার খাবেন না বলেছেন তো কখনোই খাবেন না। হঠাৎ এক শিশুর কান্নার আওয়াজ ভেসে আসলো। নার্স এসে বাচ্চাটিকে মহিলাটির কোলে দিতে দিতে বললেন,

“মেয়ে হয়েছে আম্রপালি। দেখো কি মিষ্টি দেখতে।”

“একদম মায়ের মতো হয়েছে। পারমিতা কেমন আছে?”

“ওকে বাঁচানো যায়নি। তুমি ডাক্তারের সাথে বলো।”

আম্রপালির চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো। বললেন,

“তার দরকার নেই। শকুন্তলা, তাড়াতাড়ি বাড়ি চল এখন। মৃতদেহটা সৎকারের ব্যবস্থাও করতে হবে।”

কাউকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দুজনেই সেখান থেকে চলে গেলেন। বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই বাড়ির কয়েকজন কাজেরলোক ছুটে আসলো। আর নয় বছর বয়সী বাচ্চা একটা ছেলে দৌঁড়ে এসে আম্রপালিকে আঁকড়ে ধরলো। তার কোলে আরেকটা বাচ্চা দেখে ভ্রুকুঞ্চিত করে বললো,

“চিত্রা তো ছোট মায়ের কোলেই মা। আপনার কোলে এটা কে?”

তার কথা শুনে শকুন্তলা উচ্চস্বরে হেসে উঠে বললেন,

“তোমার মা তোমার জিনিসে ভাগ বসানোর জন্য আরেকটা বোন নিয়ে এসেছে অর্ণব।”

শকুন্তলার কথা শুনে অর্ণব তীব্র আক্রোশ নিয়ে আম্রপালির দিকে তাঁকালো।

“কেন? চিত্রা কি কম পরে গিয়েছিল নাকি? আমার আর কোনো বোন চাইনা। আপনি তাড়াতাড়ি এটাকে বিদায় করুন। আমার বাড়িতে আমি ওকে থাকতে দেবো না।”

অর্ণবের কথায় আম্রপালি সামান্য হাসলেন। নিচু হয়ে বসে বললেন,

“ওকে যদি আমরা তাড়িয়ে দিই তাহলে ও থাকবে কার কাছে? ওর তো বাবা-মা নেই।”

“ওর বাবা-মা নেই?”

“উহু।”

“ঠিকাছে। তাহলে ওকে আমি আমার বাড়িতে থাকতে দেবো। কিন্তু একটুখানি।”

“হাহাহা। আচ্ছা। তুমি যা বলেছো তাই হবে। ও একটুখানিই থাকবে। কিন্তু এতো রাত হয়ে গেছে আর তুমি এখনো ঘুমাওনি কেন?”

“ঘুম আসেনি তাই। আপনি ঘুম পাড়িয়ে দিবেন। ওর নাম কি মা?”

পাশে থেকে শকুন্তলা বলে উঠলেন,

“সত্যিই তো দিদি। ওর নাম কি রাখবে? কিছু ঠিক করেছো?”

“হুম। পারমিতা বলেছিল আমাকে একবার। ওর মেয়ে হলে নাকি নাম রাখবে পদ্মাবতী। তাই ওর নাম হবে পদ্মাবতী।”

“বাহ। খুব সুন্দর নাম। অর্থ কি গো?”

“পদ্মে আরোহন করে যিনি অর্থাৎ দেবী লক্ষী।”

চলবে…

সূচনাতে প্রেম পর্ব-০৮ এবং শেষ পর্ব

0

#সূচনাতে_প্রেম
#নুসাইবা_রেহমান_আদর

পর্ব৮_অন্তিম পর্ব

রিক্সা থেকে নামতেই সাফোয়ানের দেখা পেলো তারা। কালো জিন্সের প্যান্টের সাথে হাল্কা ক্রিম কালারের শার্ট ইন করে পরা৷ শ্যাম বর্নের এই পুরুষ টিকে দেখে সানার মনের মধ্যে প্রেম প্রজাপতির মতো পাখনা মেলে উড়ছে। হাতে ঘড়ি, বারবার সেই ঘরির দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকানো সব কিছুই ভালো লাগছে সানার। এই প্রথম ভালবাসার নজরে তাকালো সানা সাফোয়ানের দিকে। লোকটি দেখতে মোটামোটি সুদর্ষন বলা যায়। সাফোয়ানের দিকে এভাবে সানাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সুমাইয়া বলে ফেলে।

~ এভাবে একনজরে তাকিয়ে দেখলে ভাইজানের নজর লাগবে সানা। চোখের পলক তো ফেলো একবার। দূর থেকে দেখলেই হবে চলো ভাইয়ার কাছে যাই। হয়তো আমাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছে সে।

~ কি যে বলো না ভাবি। তুমি সবসময় আমাকে এইভাবে লজ্জায় ফেলে দেও।

সানা লজ্জায় সুমাইয়কে অন্যকথা বলে কথা ঘুরানোর চেষ্টা করলো। তারা দিয়ে সাফোয়ানের কাছে গেলো সুমাইয়াকে নিয়ে। সাফোয়ানের ওখানে যেতেই ভদ্র মেয়ের মতো চুপচাপ হয়ে গেলো।

~ ভাইজান!

সুমাইয়ার চিৎকারে সাফোয়ান পিছু ফিরে দেখে তার বোন আর স্রী এসে দাঁড়িয়ে আছে৷

~ এতো লেট হলো যে?

~ জ্যামের কারনে ভাইজান।

~ আচ্ছা। সাবধানে আয়।

সানা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। সানাকে দেখেই সাফোয়ানের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। আজকাল এই মেয়েকে দেখলেই মন ভালো হয়ে যায় তার। প্রেম-ভালোবাসা একজন মানুষ কে ঠিক কতোটা বদলে দিতে পারে বলার মতো না।

~আপনি কি সানার দিকেই তাকিয়ে থাকবেন ভাইজান? নাকি যেই কাজের জন্য এসেছি সেই কাজের জন্য যাবেন?

সুমাইয়া যে কিভাবে সাফোয়ান কে লজ্জা দিয়ে দিবে তা কি সে ভেবেছে? অথচ বাদর মেয়ে বড় ভাইকেও লজ্জা দিতে ছাড়েনা।তবুও হাল্কা কেশে গলা ঝেড়ে নিলো সাফোয়ান।

~পাকামি না করে তোরা ভিতরে যা আমি তো আর এসবের কিছু বুঝবো না। তাই তোদের পছন্দ মত কেনাকাটা করা শুরু করে দে।

~না এটা হবে না ভাইজান। তোমার বিয়ের জামা কাপড় সব তোমার আর সানার পছন্দ মত নিবো। তানাহলে পরে বলবা নিজেদের পছন্দ মতো কিছু হয় নাই।

~ কি যে বলিস না তুই। তোর পছন্দ অনেক ভালো আমি জানি।

~ এই সানা তুমি বুঝাও তোমার জামাই কে। কেনো সে কথা শুনে না আমার?

~ আমি কি বলবো ভাবি?

~দেড়ি হচ্ছে তোমরা কি যাবে?

সুমাইয়াকে রেগে যেতে দেখে সাফোয়ান আর সানা কথা বাড়ালো না তার সাথে শপিং মলের ভিতরে যেতে লাগলো। কারণ সুমাইয়া রেগে গেলে আজকে আর শপিং করাই হবে না। সুমাইয়া নিজের পছন্দমতো শপিং করছে আর এই সুযোগে সাফোয়ান সানার হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো।সানা তাকিয়ে আছে সাফোয়ানের দিকে বিনা সংকচে কি সুন্দর তার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সানার লজ্জা লজ্জা লাগতেছে। সানাকে লজ্জা পেতে দেখে মিটিমিটি হাসছে সুমাইয়া।

~ এইযে শুনছেন আপনি আমার হাত টা ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।

~ কেনো আমি হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকলে তোমার কোন সমস্যা আছে?

~ সবার সামনে আমার লজ্জা লাগছে সাফোয়ান।

সাফোয়ান তাকালো তার স্ত্রীর পানে। কেমন লজ্জাবোধ করছে মেয়েটি। ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে। সানাকে এভাবে লজ্জা পেতে দেখে সাফোয়ানের ভালোই লাগছে। সানার হাতটি কে আরো জোড়ালোভাবে আটকে ধরলো সানা৷ এভাবে খুনসুটির মধ্যে দিয়ে সপিং শেষ করলো তারা।

দেখতে দেখতে বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসলো। সানাকে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। বৃষ্টি তাকিয়ে আছে সানার দিকে। সানা নিজের বিয়েতে এত পরিমান খুশি যা বলার মত নয়।তা দেখে বৃষ্টি বললো।

~ এই খুশিটা চেপে যা মেরি আম্মা নিজের ই না নজর লেগে যায়।

বৃষ্টির কথা শুনে নিজেকে কান্ট্রোল করলো সানা।

~ আরে কি বলবো তোকে কিরকম যেনো খুশি খুশি লাগছে আমার।

~ এই মেয়ে নাকি বিয়েতে রাজি ছিলো না ভাবা যায়। দেখে কেউ বুঝবে রাগ করে কার সাথে কথা বলে নাই যেই মেয়ে। শশুরবাড়ি যাওয়ার কথা শুনে রেগে গিয়ে জামাইকে একা ফেলে চলে আসছে আর সে এখন বিয়ে নিয়ে কি পরিমান এক্সাইটেড।

~ এভাবে বলছিস কেনো হ্যাঁ? আমি এত অল্প সময়ে ওই লোকটাকে কীভাবে যেনো ভালোবেসে ফেললাম। নিজের অনুভূতি আমি তোকে বলে বোঝাতে পারবো না। কখন কিভাবে এরকম হলো আমি নিজেও জানিনা। তাই বলেছি পুরনো কথা নেই তুই এখন আমাকে খোঁচা দিবি ?

সানার কোথায় হেসে ফেলল বৃষ্টি।হাসি থামিয়ে বলে উঠলো।

~আরে চিল আমি মজা করতেছি।

ওদের কথার মাঝে কাজি সাহেব চলে আসছে সানার নিতে। সানাকে যখন কবুল বলতে বলা হলো তখন সানা নিজের বাবাকে দেখে কেদে উঠলো।সানার এরকম কান্না দেখে বৃষ্টি আর সুমাইয়া ও কেদে ফেললো। সানার বাবা সানাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করল।বয়ষ্ক লোকটাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে সে কতোটা কষ্টে নিজেকে শক্ত রেখেছে মেয়ের সামনে।
সানাকে দিয়ে অনেক কষ্টে কবুল বলানো হলো।

বিদায়ের সময় সবার কান্নাকাটি দেখে সাফোয়ান ভাবছে এর থেকে বউ এখানে রেখে গেলেই ভালো হতো।নিজের বোন,শশুর,বউ মেবি এবার অজ্ঞান হবে।জহির কোনোরকম বাবা থেকে সানাকে ছাড়িয়ে নিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে আসলো সানাকে।সাফোয়ান কে বললো।

~সানা আমার অনেক আদরের। ওকে দেখে রেখো। ওর যেনো কোনো সমস্যা না হয়।

~ যেদিন থেকে ও আমার স্ত্রী হয়েছে সেদিন থেকে ওর যাবতীয় সমস্যা আমি নিজের মনে করা শুরু করেছি। তাই আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। আর আমার বোনের প্রতি একটু নজর দিন।

জহির চমকে তাকালো সাফোয়ানের দিকে। সাফোয়ানের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে সেখান থেকে চলে গেলো।সাফোয়ান গাড়িতে উঠে দেখলো তার স্ত্রী কাদতে কাদতে ঘুমিয়ে গেছে। আনমনে হেসে ফেললো দেখে।

সাফোয়ানের বাড়ি সম্পূর্ণ খালি। নিজের বেডরুম সাজিয়ে বিদায় নিয়েছে তার বন্ধুরা। নিজের জীবন সঙ্গিকে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলো সাফোয়ান। সানা ভাবতেও পারেনি যে বাড়িতে এতো দিন সে বেড়াতে আসতো সেই বাড়িটিই তার নিজের ঠিকানা হবে।

~ আমাদের কোনো আত্মীয়-স্বজনের সাথে আমাদের সম্পর্ক না থাকার কারণে তোমার বরণ করে ঘরে তোলার হলো না।

~প্রয়োজন নেই আমি এসব মানিনা আমার কাছে এসব কুসংস্কার লাগে।

~আজ রাতে একটু কষ্ট করে এডজাস্ট করে নিয়ো আমার সাথে।আগামীকাল সকালেই তোমার ভাবি বান্ধবিরা সবাই চলে আসবে।

~ আপনি থাকলে সাথে একা কোথায়।

সাইফ ওদের মাঝে বলে উঠলো:

~ ভাইয়া তুমি কিন্তু ভাবিকে কোলে নিয়ে নিজের রুমে যাবে।

সাইফের কথায় লজ্জা লাগলো সানার। সাফোয়ানের কাছে সাইফের প্রস্তাব মন্দ লাগলো না। কোলে তুলে নিলো সানাকে। সানা টাইটলি সাফোয়ানের গলা জড়িয়ে ধরলো।সাইফ এসব ভিডিও করতে লাগলো। সাফোয়ান সানাকে তার রুমে নিয়ে ফুলে সাজানো সুন্দর বিছানায় বসালো। অনেক সুন্দর করে সাজানো হয়েছ্ব তার রুমট। গাধা আর গোলাপ দিয়ে সাজানো ঘরটিতে গাধা ফুলের গন্ধ তে ভরে আছে।

সানাকে ফ্রেশ হতে বলে সাফোয়ান আর সাইফ বেড়িয়ে গেলো কোথাও। এই ফাকে সানাও ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে একটি লাল রঙ্গের শুতির শাড়ি পড়ে নিলো। সাইফ আর সাফোয়ানের হাতে খাবারের প্লেট দেখে বুঝতে পারলো দুই ভাই খাবার আনতে গিয়েছিলো।

~ খাবার গুলো ভাইয়া গরম করে এনেছে।

~ চুপ করে খা তুই।

সাফোয়ানের ধমকে চুপ করে গেলো সাইফ। সানা ওদের দিকে না তাকিয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিল। খুদা লেগেছে অনেক,বাসায় খাওয়া হয় নাই তার।খাবার খাওয়া শেষ করে সাইফ প্লেট নিয়ে চলে গেলো ভাই ভাবিকে গুড নাইট জানিয়ে।

সানা আর সাফোয়ান খাটে বসে আছে। সানার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। নিজের প্রিয়তমা কে কত সাধনার পর পেলো সে।এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সানা বললো।

~ এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো?

~ আমার সুন্দরী বউকে দেখছি।কত সাধনার পরে পেলাম তোমাকে।

~ আপনি আমাকে এতো ভালোবাসেন আগে কেনো বলেন নাই।

~ সব কথা সবসময় বলতে হয়না। হালাল ভাবে পেতে চেয়েছিলাম তোমাকে। আল্লাহ এর দয়ায় পেয়েছি। আজ আমার থেকে বেশি সুখী কি কেউ আছে?

~ আপনাকে আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি তাইনা? সব কিছুর জন্য আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন।

~ উহুম এক শর্তে করতে পারি।

~ কি শর্ত?

~ আমাকে অনেক ভালোবাসতে হবে। নামাজ পড়বে না?

নামাজের কথায় সানা হাসফাস করে তাকালো। সানার এরকম ভাব ভঙ্গি দেখে বুঝলো সাফোয়ান তাই আর প্রশ্ন না করে ঘুমাতে বললো। সানা নিজ থেকেই সাফোয়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। একে অপরকে দেখতে দেখতে তারা ঘুমিয়ে পড়লো।

সমাপ্ত।

সূচনাতে প্রেম পর্ব-০৭

0

#সূচনাতে_প্রেম
#নুসাইবা_রেহমান_আদর
#পর্ব৭
সানার মনের মাঝে অদ্ভুদ এক অনুভূতি কাজ করছে। এর আগে এমন অনুভূতির সাথে সে পরিচিত ছিলো না। সাফোয়ান তার জিবনে আসার পর থেকে নিত্যনতুন এইসব নাম না জানা অনুভূতির সাথে পরিচিত হচ্ছে সে। আর মাত্র কিছুদিন এরপর বিয়ে। চলে যবে শশুর বাড়ি। যেই লোককে সে পছন্দ করতো না সেই লোককে নিজের অজান্তে ভালোবেসে ফেলা আর তার সাথে গোটা জীবন পার করে দেওয়ার ভাবনা। একা একা বসে এসব ভাবছিলো তখন সানার মোবাইলে টুংটাং শব্দ বেজে উঠলো। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখতে পেলো সাফোয়ানের ম্যাসেজ।

~ প্রিয়,প্রিয়তমা,,

এই অধমের জিবনে এসে সাদাকালো রঙ দূরে সরিয়ে দিয়ে নানান রঙ্গে তাকে রাঙ্গিয়ে দেওয়ার জন্য আপনাকে এক সমুদ্র ভালোবাসা। আপনাকে ভালো না বাসলে হয়তো এতো সুন্দর জিবন হতে পারে আমি ভাবতেই পারতাম না। অনেক কিছু নিজের মাঝে চেপে আছি। আমার মনের সব কথা আপনাকে জানাতে চাই। অধির আগ্রহে সেইদিনের অপেক্ষায় থাকলাম। প্রিয়তমার অপেক্ষায় এই অধম প্রেমিক পুরুষের হৃদয়ের যে কি হাল হচ্ছে বুঝাতে পারবো না। নিজেকে সেই অষ্টাদশীর আবেগে ভরপুর পাগল প্রেমিক মনে হচ্ছে। নিজের ভালোবাসা কে দেখার জন্য বারবার ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে। এই যে নিজের বয়সের ব্যাপারটা আমি কি সুন্দরভাবে ভুলে গেছি তাই না? আমার এই ব্যাবহার বাচ্চামো লাগছে হয়তো আপনার কাছে? তবুও বলবো নিজের বিবাহিত বৈধ প্রিয়তমার জন্য এমন হাজারো বাচ্চামো করতে রাজি আছে। আমি যে শুধুমাত্র নিজের এই প্রিয়তমাতে মজেছি।

ওহ হ্যাঁ যার জন্য মোবাইল হাতে নেওয়া,সুমাইয়া কে নিয়ে জলদি চলে আসুন অপেক্ষায় আছি।

~ইতি আপনার ব্যাক্তিগত প্রেমিক পুরুষ~

সাফোয়ান যে এতো সুন্দর ভাবে লিখতে পারে ব্যাপারটা সানার অজানা। কি সুন্দর ভাবে নিজের অনুভুতির একাংশ তাকে লিখে পাঠালো। সানার পালটা ম্যাসেযে লিখতে ইচ্ছা করলো, আপনার এই ব্যাক্তিত্বের প্রেমে পরেছি আমি প্রেমিক পুরুষ। আপনাকে ধীরে ধীরে নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসতে শুরু করেছি।

কিন্তু নিজের মনের ইচ্ছা মনের মাঝে চেপে রেখে ম্যাসেজ দিলো টাইম মতো পৌছে যাবে তারা।

অন্যদিকে আবান চিন্তায় মরে যাচ্ছে সে কিভাবে আবার বৃষ্টির দেখা পাবে। সেই এক পলকে এক মেয়ের চাহনী যে এখোনো তার মনের মাঝে গেথে আছে। কাউকে না দেখে কারো কথা না শুনে যে তাকে ভালোবাসা যায় এই ব্যাপারে আবান আগে বিশ্বাস করতো না। অথচ নিজের সাথে আজ সেই ব্যাপারটি ঘটে গেলো। তখন সাফোয়ান আসায় তাকে জিজ্ঞেস করলো।

~ তোর বিয়েতে কি ভাবির বেষ্টফ্রেন্ড আসবে?

~ হ্যাঁ বৃষ্টি আর ওর মা আসবে। তোর ভাবি নিজে গিয়ে নিয়ে আসবে। কারন তাদের যে কি ভালোবাসে তোর ভাবি আমি বোঝাতে পারবো না। আর মামনিও মানে বৃষ্টির আম্মাও তোর ভাবিকে অনেক ভালোবাসে।

~ তুই কখোনো বৃষ্টি কে দেখোস নাই?

আবানের প্রশ্নে সাফোয়ান হাল্কা হাসে। এরপর জবাব দেয়,,,

~না দেখি নাই। আমি তোর ভাবিদের বাসায় বেশি যাই নাই। বৃষ্টির ব্যাপারে এইটুকুই জানা যা সুমাইয়ার থেকে শুনেছি। মেয়েটি কে জহির ভাইয়া ও মেবি ৪-৫ বছর হবে দেখে নাই৷ সেই ছোট থেকে না কি ওরা বেষ্টফ্রেন্ড৷ যবে থেকে বৃষ্টি পর্দা শুরু করলো তবে থেকে ননমাহরাম মানুষের সাথে দেখাও করে না আর কথাও বলে না।

~ ভাবি কেনো বৃষ্টির মতো চলেন? বৃষ্টি কি তার বেষ্টফ্রেন্ড কে এসব নিয়ে বলেনা?

~ এসব নিয়ে জানিনা আমি ঠিক। ওদের ব্যাপার ওরা বুঝে নিবে৷ আমি এতো কথা এখনো বলি নাই। তাই জানিনা ঠিক। এতো আগ্রোহ কেনো ওর ব্যাপারে তোর?

~ সেটা সময় হলে জানতে পারবি তুই। এখন যা ভাবি অপেক্ষা করবে আবার। তোর কাজ এখন আমার করতে হবে। নিজের বিয়ের জন্য আমার ঘাড়ে কাজ চাপানো হয়েছে। আমি বলে দিলাম এটাই আমার করা শেষ কাজ হবে সাফোয়ান এরপর আমাকে আর ডাকবি না। আমি জানি বস আমাকে আনার জন্য তোকে ব্যাবহার করে। কিন্তু এরপর ইমোশোনাল ব্লাকমেইলেও কাজ হবে না।

~ রাগছিস কেন? এই কাজ কি আমার একার? এই কাজের পর তুই যা আমার সমস্যা নাই। আমি আর ডাকবো না বস যা করার করবে নে।

~ পরের চাকরি করার এই এক সমস্যা রে ভাই। আমি তো শখের বসে করতেছি আর তোর তো এটা প্যাশন।

~ অনেক সময় ইচ্ছা হয় ছেড়ে দেই নিজে কিছু করি।এরপর নিজের এতো কষ্টের কথা মাথায় আসে। এটা আমার স্বপ্ন ছিলো। এই কাজের জন্য আমি জানি আমি কতো স্যাক্রিফাইস করেছি।

~ এইবার আমিও এসেছি দুইজন মিলে এসব ঠিক করে নিবো এবার। দেখবি সব আমাদের মতে হবে।

~ আশা করি ভাই তাই হোক। আচ্ছা গেলাম থাক।

সাফোয়ান চলে গেলো শপিংমলের উদ্দেশ্যে। আজ তার প্রিয়তমা কে নিজের পছন্দমতো শাড়ি কিনে দিবে। ভাবতেই মন ভালো হয়ে গেলো তার। সুমাইয়া আর সানাও রিক্সায় বসে বসে কথা বলছে। তারাও নিজের গন্তব্যের জন্য বের হয়েছে।

~ আচ্ছা সানা একটা কথা বলো আমাত ভাইয়ার জন্য কি তোমার মনে কোনো ভালোবাসা নাই?আমি জানি প্রথমে ভাইয়াকে তোমার অপছন্দ ছিলো। ভাইয়া যে প্রচুর ইন্ট্রোভার্ট একজন মানুষ। উনি সহযে কারো সাথে মিশতে পারে না। কিন্তু যখন মিশে তার মতো অসাধারন ব্যাক্তি আর একজন পাবেনা জিবনে। আমার সেই ভাই তোমাকে কিভাবে ভালোবেসে ফেললো আমি জানিনা। প্রথমে প্রচুর ভয়ে ছিলো তোমাদের বয়সের ব্যাবধান নিয়ে। তুমি ২২ বছরের আর আমার ভাই ৩১ বছরের। বিয়েতে যদি বাবা আর তোমার ভাই অমত দেয়। কিন্তু বাবা সাফোয়ান ভাইজানের ভালোবাসা বুঝেছেন। সে বুঝতে পেরেছিলেন তার রাজকন্যাকে একজন ভালো পাত্রের হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন। তোমার ভাইজান ও কিন্তু এই বিয়তে রাজি না বা এখোনো হয়তো রাজি হতে পারেন নি। কিন্তু বাবার উপর যে সে কথা বলতে পারেন না। তাই চুপচাপ আছেন। কিন্তু বিশ্বাস করো ভাইজানের মতো করে এতো ভালো তোমায় অন্যকেউ বাসতে পারবেনা সানা।

~ ভাবি আমি প্রথমে ওনাকে অন্যভাব্র জাজ করেছিলাম আর প্রতিনিয়ত আমি অন্য এক সাফোয়ান কে দেখতে পাই। নিজের বোকামির পরিচয় দিচ্ছি। আমি জানিনা আমি ওনার যোগ্য কি না কিন্তু আমি চেষ্টা করবো সবটা দিয়ে ওনার উপযোগী হওয়ার।

~ দেখো বোন খুব একটা কম সময় হয়নি আমি তোমাদের বাড়িতে এসেছি। আমি জানি সংসার ধর্ম এতোটা সহয না। সব কিছু বুঝে উঠতে সময় লাগে৷ কিন্তু দেখো প্রতিটি পদে তুমি সাফোয়ান ভাইজান কে নিজের পাশে পাবে। আমিও রান্না জানতাম না ঘরের কাজ জানতাম না। ভাইজান নিজের হাতে আমাকে সব শিখিয়েছেন। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর একমাত্র ভাইজান ছিলেন আমাকে আর সাইফকে সামলানোর জন্য। আমাদের দিকে কোনো আত্মীয়ের থেকে সাহায্যের হাত আসে নি। ভাইজান বাবা-মা কে প্রচন্ড ভালোবাসতেন। বাবা-মা কে হারিয়ে সে অনেক ভেঙ্গে পরেছিলো কিন্তু আমাদের সামলাতে সে নিজের সব অনুভুতি চাপা দিয়ে দেয়। আমাদের দেখভাল শান্তনা সব ভাইজান করেছেন। নিজের দুঃখ কষ্ট প্রকাশ করেন নি যদি আমরা কষ্ট পাই। সেই ভাইজান যখন তোমাকে ভালোবেসে ফেললো আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম যেভাবেই হোক আমার ভাইজানের ভালোবাসা তাদের মিলিয়ে দিবো।

ভাবির মুখে এতো কথা শুনে কান্না চলে আসছে সানার। সানার থেকেও বেশি সাফার করেছে সাফোয়ান আর সুমাইয়া। বাবা-মা একত্রে হারানোর শোক যে পেয়েছেন।

~ আচ্ছা ভাবি ভাইজান তো তোমাকে অনেক ভালোবাসে তাই না?

~ হ্যাঁ তোমার ভাইজান ও আমাকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু আমার ভাইজান আর তোমার ভাইজানের ভালোবাসার মধ্যে আকাশ – পাতাল তফাৎ রয়েছে। সবার প্রকাশের ধরন আলাদা আলাদা৷

সুমাইয়ার কথায় এক রহস্য প্রকাশ পেলো। কেমন উদাসীন ভাবে বললো সে৷এভাবে তো সে কখোনো কথা বলেনা।

~ ভাবি?

~ থাক সানা আজ আর না। অন্যএকদিন ব লবো এই বিষয়ে কথা। আমরা তো চলে এসেছি তাইনা?

সুমাইয়া সানার কথা এড়িয়ে গেলো। হয়ত বাব-মায়ের কথা মনে পরায় খারাপ লাগছে। তাই আর প্রশ্ন করে ডিস্টার্ব করলো না সুমাইয়াকে । সুমাইয়াও নিজের মনের কথা চেপে গেলো। কিছু কথা অপ্রকাশিত থাকলেই জিবন সুন্দর থাকে।

#চলবে?

সূচনাতে প্রেম পর্ব-০৬

0

#সূচনাতে_প্রেম
#নুসাইবা_রেহমান_আদর
#পর্ব৬

সুমাইয়ার কথা শুনে বৃষ্টি বুঝতে পারে যে সুমাইয়া নিজেও দ্বিধায় ভুগছে।সে যে বাড়ির বউ তাকে বেশি কথা বলা মানায় না। সুমাইয়া হয়তো তাই এই কথা তোলার সাহস পাচ্ছে না।

~আমি বুঝতে পারছি আজকে বড় ভাইয়া আসলে তুমি একটু কথা বলে দেখিও এই বিষয়ে। সাফোয়ান ভাইয়া নাকি বলেছে যে তাড়াতাড়ি তাকে উঠিয়ে নিয়ে যেতে চায় সে রাজি কিনা।

বৃষ্টির কথা শুনে সুমাইয়া সানাকে বলে,,

~তুমি যদি রাজি থাকো তাহলে ভাইয়ার সাথে এই নিয়ে কথা বলো। ভাইয়া এসে তারপরে তোমার বাবা আর ভাইয়ের সাথে কথা বলবে নে।তাহলে তো কোন সমস্যা হবে না। বুঝতেই পারছ আমি যদি বেশি কথা বলি ব্যাপারটা খারাপ দেখা যায় ।

রাতে সুমাইয়ার থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে আসে বৃষ্টি।আজ রাতে সানার সাথে সে ঘুমাবে। সানা মোবাইল হাতে নিয়ে বসে আছে।

~এভাবে মোবাইল হাতে নিয়ে বসে না থেকে কল দিয়ে কথা বলে নে। এই যে নাম্বার ভাইয়ার।

সানা বৃষ্টি থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে কল দেয় সাফোয়ান কে।প্রায় ২-৩ বার রিং হওয়ার পর কল কেটে যায়। কল কেটে যাওয়ায় সানার মন খারাপ হয়ে যায়।এখন তার ফোন তুলবে না এটা ভেবে। পরক্ষণে তার ফোন বেজে ওঠে। ফোনের দিকে তাকিয়ে সানার মুখে হাসি ফুটে উঠে। সাফোয়ান তাকে কল ব্যাক করেছে। কাঁপা কাঁপা গলায় সাফোয়ানকে সালাম দেয়,,,

~আসসালামু আলাইকুম। আপনি কেমন আছেন?

~ওয়ালাইকুম আসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো, আপনি?

~আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আমি কল দিয়েছিলাম তো আপনি কেটে দিলেন যে।

~হ্যাঁ আমি তো বুঝতে পেরেছিলাম যে কলটা আপনি দিয়েছেন তাই কেটে ব্যাক করলাম। আপনার স্বামীর লক্ষ লক্ষ টাকা না থাকলেও এইটুকু আছে যে নিজের টাকা খরচ করে স্ত্রীকে ফোন করতে পারবে।

সানার মনের মধ্যে অনেক ভালোলাগা কাজ করলো।সাফোয়ানের বলা এই ছোট ছোট কথাগুলো ও অনেক আবেগপ্রবণ হয়।

~তারমানে আপনি আমার ফোন নাম্বার চিনেন। আপনার কাছে ছিল, তাহলে এতদিন আমাকে কল করলেন না কেন আপনি?

~আপনি তো আমাকে পছন্দই করেন না। তাহলে ফোন দিলে যদি রেগে যান এইভেবে দেই নাই।

~আমাকে ক্ষমা করবে না আসলে ওই দিনের জন্য। আমি বুঝতে পেরেছি আমি অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি আপনার সাথে । আমার ওই ভাবে রিয়্যেক্ট করা উচিত হয় নাই।

~সমস্যা নাই। আমি কিছু মনে করি নাই।

~আপনি যদি কিছু মনেই না করতেন তাহলে ৯ দিন আমার সাথে যোগাযোগ না করে থাকতেন না।

সানার এই কথাটাই বুঝা যায় সে অনেক অভিমান করেছে সাফোয়ানের উপর।

~অভিমান হয়েছি বুঝি আমার উপর?

~আপনার উপর আমার অভিমান কেন হবে বলেন তো?

এতক্ষণ ধরে বৃষ্টি তাদের কথাবার্তা শুনে হাসছিলো। এরপর সানার হাতে চিমটি মেরে বলে আসল কথা বলতে।

~আসলে সাফোয়ান আমি আপনাকে একটা কথা বলতে ফোন দিয়েছিলাম।

~কি বলবেন বলুন?

~ঐদিন যে আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন না আমি রাজি কিনা? আপনার সেই প্রস্তাবে আমি রাজি।আপনি বাড়িতে এসে আব্বু আর ভাইয়ের সাথে কথা বলুন।

সাফোয়ান অনেক অবাক হয়ে যায় যে সানা রাজি হয়ে গিয়েছে তার কথায়। সানার ও এখন একটু ভালো লাগছে সাফোয়ানের এর সাথে কথা বলতে পেরে।

বৃষ্টি এইবার ঘুমিয়ে পরলো তার পক্ষে আর সম্ভব না রাত জেগে সানার কথা শোনার। সানা আর সাফোয়ানের এই কথোপকথন অনেক রাত পর্যন্ত চললো। ভোর রাতের দিকে সানা ঘুমালো।

পরের দিন সাফোয়ান সত্যিই তাদের বাসায় এসে সানাকে নিয়ে যাবার কথা জানালো। প্রথমে সবাই অবাক হলেও পরে বুঝিয়ে বলে সুমাইয়া তাদের। কারন বাড়িতে সাইফ একা থাকে এই এক কারনেই তো মেয়ে দিয়েছিলো তিনি৷ মেয়ে যেহেতু বিয়ে দিয়েছেন তখন মেয়েকে শশুর বাড়িও পাঠাতে হবে৷ সাদিক সাহেবের মনের মধ্যে প্রচন্ড ঝড় বয়ে যাচ্ছেন। মেয়েকে না দেখে কিভাবে থাকবেন? একমাত্র এই মেয়ের মুখ দেখেই সে বেচে ছিলেন। সানাকে জন্ম দিতে গিয়েই তো তার স্ত্রী শারমিনের মৃত্যু হলো। সেই থেকেই মেয়ে তার স্ত্রীর রেখে যাওয়া আমানত, কখোনো ভুলের টোকাও লাগতে দেয় নাই। নিজেকে অনেক কষ্টে শান্ত করে বললো।

~তাহলে আগামী বুধবার তোমাদের অনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে পড়িয়ে উঠিয়ে দিবো সানাকে।

জহির তার বাবার কথার উপরে কোন কথা বলার সাহস পেল না। কিন্তু ভেবে পাচ্ছে না তার বাবা কিভাবে এত সহজে সানাকে তুলে দেওয়ার জন্য মেনে গেল। আসলেই কি সাফোয়ান কোন জাদু জানে নাকি?নিজের কথায় সবাইকে যেভাবেই হোক কামভেন্স করে ফেলে।

~জি আচ্ছা আঙ্কেল তাহলে আজ আমি উঠি।

~কিছু মনে করবেন না বাবা আমি বলি কি ভাইয়া আর সানার গায়ে হলুদ আমাদের বাড়ি থেকেই হোক।আর বিয়ের সব অনুষ্ঠান কারণ আমাদের বাড়িতে তো কেউ নেই গুরুজন। আমাদের কোন আত্মীয়-স্বজনের সাথেও আমাদের যোগাযোগ নাই।সাইফ আর ভাইজান এখানে থাকুক। আমরা এখান থেকেই সব অনুষ্ঠান পালন করি?

~যা ভালো বুঝো মা তাই করো তুমি।

জহিরের ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও সে চুপচাপ বসে আছে। কেন জানিনা আপনাকে বাড়ি থেকে যেতে দিতে চায়না। হয়তো নিজের হাতে লালন পালন করা বোন কে বিদায় দিতে পারবে না তাই।

~আচ্ছা যেহেতু আপনাদের এইরকম ইচ্ছা আজ আমি উঠি। সাইফ কে নিয়ে চলে আসবো আমি। আর কেনাকাটার জন্য কল দিলে সুমাইয়া আর সানাকে পাঠিয়ে দিবেন ভাইয়া। আমার প্রচুর ইম্পোর্টেন্ট মিটিং আছে নাহলে আমি নিজেই নিয়ে যেতাম।

~ ঠিক আছে।

মুখে ঠিক আছে বললেও জহির মনেমনে ভাবে কাজ তো সে একাই করছে। জহির নিজের সালাকে শত্রু ভাবছে। কি যে হিংসা আসলো শালা-দুলাভাইদের সম্পর্কে। অন্যদিকে দরজার আড়ালে সানা আর বৃষ্টি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনছিলো। সানা লাজুক ভাবে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে আর বৃষ্টি তাকে ক্ষেপাচ্ছে।

~আহা বৃষ্টি থাম না এবার? আর কত লজ্জা দিবি আমাকে? যা ঘরে গিয়ে বসে থাক।

~ সত্যি কথা বললেই দোষ। যাইহোক আজ আমার যেতে হবে রে। আম্মাকে বাসায় একা রেখে এতোক্ষন থাকা উচিৎ হচ্ছেনা। যতোই আম্মা বলুক না কেন আমি জানি ওনার রান্না করতে সমস্যা হবে।

~ এখোনি চলে যাবি? থাক না আমার কাছে তুই।

~ তোর বিয়েতে আম্মাকে নিয়ে চলে আসবো। এখন যেতে হবে রে আমার। আম্মাকে নিয়ে আসবো আবার কথা দিচ্ছি।

~ আমি যাবো তোদের আনতে। আন্টি আর তুই ছাড়া এই অনুষ্ঠান আমার কাছে অসুসম্পূর্ণ হবেরে। নাস্তা তো করে যাবি?

~ লেট হচ্ছে আর ভাইয়ারাও কথা বলছেন বাহিরে। এখন না আমি যেতে পারবো আর না এই সময় বড়দের মাঝে তোর যাওয়া ঠিক হবে। এক কাজ করি চলে যাই বাহির থেকে নাস্তা কিনে বাসায় গিয়ে আম্মাকে নিয়ে খাবো।

~ আচ্ছা আমি তোকে রিক্সাত তুলে দিয়ে আসি।

~আচ্ছা।

বৃষ্টির চলে যাওয়াতে অনেক কষ্ট হচ্ছে সানার। বৃষ্টির ও কিছু করার নাই। তার বাবা একজন প্রবাশি। প্রবাশে একা থাকেন তার বাবা।আর বৃষ্টি তার মায়ের সাথে থাকেব। বৃষ্টির বড় ছোট ভাই -বোন নাই। বৃষ্টি একমাত্র মেয়ে তাদের। মায়ের জন্য মন আনচান আনচান করছে তার।সানা ওকে এগিয়ে দিয়ে আসে বৃষ্টিকে। তখন ভাবি এসে জানায়,,

~ বিকেলে রেডি থাকিস। আমরা শপিং এ যাবো, ঘুমিয়ে থাকিস না।ভাইজান বারবার বলেছে যাতে কিছু মিস না যায়। তোর জন্য লেইট হলে আমি ঝাড়ি খাবো এবার। বিয়ের সব কেনাকাটা আজকেউ সেরে ফেলতে চাইছে।

#চলবে?

সূচনাতে প্রেম পর্ব-০৫

0

#সূচনাতে_প্রেম
#নুসাইবা_রেহমান_আদর
#পর্ব৫
প্রায় আধা ঘণ্টা পর সাফোয়ান আর আবান ফিরে আসলো। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল দুই তরুণীকে । আবান প্রথমে বোরখা পরা নারীটিকে সানার কোনো আন্টি হবে ভেবেছিলো।কারণ বৃষ্টি কালো বোরখা নিকাব হাত +পা মুজা পরা ছিল দেখে।
পরে যখন এটা তার বেস্ট ফ্রেন্ড নিজেই একা একা লজ্জা পেয়েছিল নিজের ভাবনার জন্য।

~আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে বলতে চাচ্ছিলাম কি আমরা আপনাদের সাথে যেতে পারবো না। আসলে বৃষ্টি তো পর্দা করে মানুষের সামনে কথা বলা উচিত না আর না থাকা। এই দিকটা ভেবে আমি চাচ্ছিলাম ওকে নিয়ে আমি আলাদা চলে যাই আপনারা নাহয় আজ একা চলে যান।

সাফোয়ান কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভাবল, এরপর রিক্সা ডেকে সানা আর বৃষ্টিকে উঠিয়ে দিলো।

~আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড কে আপনাদের বাড়িতে নিয়ে যান। যেহেতু আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড পর্দা করে তা আমি সম্মান করি।আমি চাচ্ছি আজ প্রথম আমার শালির সাথে পরিচয় হলো ট্রিট না দিলে দুলাভাই হিসেবে আমার বদনাম হবে। আমি প্যাক করে বাড়িতে দিয়ে আসবো আপনার রুমে বসে খাবেন দুজন । সাবধানে যাইয়েন আপনারা।

সানা আর বৃষ্টিকে বিদায় দিয়ে আবার আবানের কাছে ফিরে এলো সাফোয়ান। সানার ব্যবহারের আবানের কিছু সন্দেহ জাগে মনে।

~ভাবি আর তোর মধ্যে কি সবকিছু ঠিকঠাক হচ্ছে না? এমন চুপচাপ তোর সাথে বেশি কথা বলল না?

~ও এইরকমই চুপচাপ থাকে বাহিরের মানুষের সামনে। বাড়িতে একদম পুরাই উল্টো চঞ্চল। আর আজ আবার বৃষ্টি ছিল তাই চুপচাপ। ও আমার সাথে থাকলে মেয়েটা আবার একা হয়ে যেতো। সানা বৃষ্টিকে নিজের বোনের মতো ভাবে সুমাইয়া বলছে আমাকে।

~ওহ আচ্ছা। কিন্তু ভাবির ফ্রেন্ড অন্যরকম আই লাইক ইট।

বৃষ্টির কথায় আবানের মুখে অন্যরকম এক হাসির রেখা দেখা যায়। তা দেখে সাফোয়ানের খটকা লাগলো তাই সাফোয়ান বলে,

~ওর দিকে তাকিয়ে লাভ নেই। ও যেরকম মেয়ে হাজবেন্ড ও খুঁজে সেই রকম।। ও আর দশটা মেয়ের মত না। আর তোর ভাবীর ইমোশন ওকে ঘিরে তাই বাদ দে তোর ভাবনা। চল তুই যা এখন নিজের কাজে আমি খাবার দিয়ে আসি৷

সাফোয়ান যত যাই বলুক না কেন তার কথা কানে নেয় নাই।সে তো নিজের ভাবনায় ব্যাস্ত। একবার যখন নিজের পছন্দ হয়েছে তো হয়েছেই।

অন্যদিকে রিক্সায় বসে বৃষ্টি বললো,

~দেখ ভাইয়া তোকে কত ভালোবাসে। তুই একবার বলেছিস আর ভাইয়া বুঝে নিয়েছেন আমাদের কথা চিন্তা করেই বাসার মধ্যে খাবারের ব্যবস্থা করতেছে।

~আমি জানি উনি একজন দায়িত্ববান মানুষ। কিন্তু আমাকে ভালবাসে কিনা আমি জানিনা। আমি নিজে ওনাকে ভালোবাসি না। উনার প্রতি আমার এক ভালো লাগা কাজ করে।

~এখন ভালবাসিস না তো কি হয়েছে? একদিন না একদিন ঠিকই বাসবি,হালাল সম্পর্কের জোর ই অন্যরকম ।

হ্যাঁ হালাল সম্পর্ক গুলোর মধ্যে টান আলাদা। দুজন অপরিচিত মানুষ গুলো কি সুন্দর সারা জীবনে একসাথে থেকে যায় একে অপরের পাশে।

~আমি জানিনা ঠিক ভবিষ্যতে কি হবে বা না হবে। কিন্তু এখন যা হচ্ছে তা আমার খুব ভালো লাগছে । উনাকে আমি যতই দেখছি অবাক হচ্ছি।এই যে কি সুন্দর আমাদের সাথে কথা বললো দেখলি না? কারো সাথে ভুলেও কথা বলতেন না। কেমন যেনো অনেক গম্ভীর ভাব ধরে থাকতে। এত রাগী মনে হতো যে ভয়ে তার আশেপাশ যেতাম না ভুলেও।কিন্তু এখন লোকটা আমার সাথে সম্পূর্ণ আলাদা ব্যবহার করে।

~এটাই হয়তো স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা। এখন এসব কথা বাদ দিয়ে বাসায় যাই অনেকদিন হচ্ছে ভাবির সাথে দেখা হয় না আমার।

বাসায় বসে সানা সুমাইয়া এবং বৃষ্টি আড্ডা দিচ্ছে। বৃষ্টির আম্মুকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে আজ বৃষ্টি এবাড়িতেই থাকবে।সানার কথা শুনে তিনি আর আপত্তি করেননি ৷ সাফোয়ান ড্রয়িংরুমে বসে আছে। অফিসে আর যায়নি আজ তাকে বড্ড ক্লান্ত লাগছে। ফ্রেশ হওয়া দরকার।

বৃষ্টিকে রুমে থাকতে দেওয়া হয়েছে। সেখানেই হয়তো সে নামাজ আদায় করছে। সানা ড্রয়িংরুমে গিয়ে সাফোয়ান কে বলে।

~আপনি এক কাজ করুন আমার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন।

সানা যযে তকে তার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হবার অফার দেবে তো সাফোয়ান ভাবেনি। ভাবার কথাও না কারণ সানা তার আগের ব্যাবহারে বুঝিয়েছে সে সাফোয়ান কে পছন্দ করেনা।

~ না থাক সমস্যা নাই আমি এখানেই ঠিক আছি। বাসায় ফিরবো এখন।

সাফোয়ানের এর প্রত্যাখ্যানের মন খারাপ হয়ে যায় সানার।সাফোয়ান তার মুখের উপর এভাবে না করে দিবে সে ভাবে নাই। সাফোয়ান হয়তো সেদিনের কথা রেস ধরেই তার ওপর এখনো অভিমান করে আছে। থাকারই কথা।

কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলল না সানা। সাফোয়ান খাবার গুলো টেবিলের উপর সানাকে দেখিয়ে দিল।

~এখানে আপনাদের জন্য খাবার এনেছি খেয়ে নেবেন। আসি ভালো থাকবেন নিজের খেয়াল রাখবেন।

~আপনি না হয় বসুন একসাথে খাব সবাই আমরা ।

~না সাইফ বাসায় একা তাই ওকে ছাড়া খাওয়া সম্ভব না।

সাফোয়ান আর দেড়ির করলো না চলে গেল বাড়ি থেকে । সানা সেখানে যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। ড্রয়িং রুমে এসে দেখে সানা দরজার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাফোয়ান মনে হয় চলে গিয়েছে। তাই সুমাইয়া মশকরা করে বলে ওঠে,

~এভাবে খালি রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকলে কি হবে ননদিনী? যার যাওয়ার সে তো চলেই গেছে।

সুমাইয়ার কথায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় সানা। ভাবির কাছে যে এভাবে ধরা খেয়ে যাবে বুঝিনি আগে। এখন তো সব সময় তাকে এই একটা কথা নিয়ে ক্ষেপাবে।।

~কি যা তা বলতেছ আমি তো তাকিয়ে আছি দরজাটা খোলা নাকি বন্ধ বোঝার জন্য।

~ তা কি বুঝলে দরজা খোলা নাকি বন্ধ?

ততোক্ষনে সেখানে বৃষ্টি এসেও হাজির হয়। ভাবিকে হাসতে দেখে জিজ্ঞেস করে,,

~ কি নিয়ে হাসছো তুমি ভাবি? আর ভাইয়া কি চলে গেছে?

~হ্যাঁ একটু আগেই চলে গেল। আর সে দরজার দিকে তাকিয়ে চেক করছে দরজা খোলা না বন্ধ। আর আমি হাসলে দোষ হয়ে যায়।

বৃষ্টি ও সুমাইয়ার কথায় হেসে ফেলে। ওইদিকে সানা মুখ গুমরো করে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে নিয়ে মজা করে এই ব্যাপারটা তার ভালো লাগেনা। সব সময় তাকে লজ্জায় ফেলে।

~ভাবি আর বৃষ্টি তোমরা সবসময় আমার পিছে কেন লাগো ওইভাবে হ্যাঁ, আমি কি করেছি?

~তুই আর কি করবি? আজ আমার কেউ নাই দেখে এভাবে দরজা বন্ধ কিনা দেখতে পারি না।

বৃষ্টির কথায় জোরে হেসে ফেলে সুমাইয়া।

~আমাকে খ্যাপানো হলে এবার দেখো তোমার ভাই কি নিয়ে এসেছে সার্ভ করে দেও খুদা লেগেছে ।

সুমাইয়া সব খাবার প্লেটে সাজিয়ে বৃষ্টি আর সানা কে দিল। তখন বৃষ্টি সুমাইয়াকে বলল,

~ভাবি সাফোয়ান ভাইয়া ফোন নাম্বার কি আপনার কাছে আছে? তাহলে দয়া করে আপনার ননদিনীকে দিন। তার কাছে কিন্তু সাফোয়ান ভাইয়ের নাম্বার নাই।

~তারা একসাথে এত ঘুরে ফিরে আসলো কিন্তু ফোন নবার এক্সচেঞ্জ এখনো করেনি?

~জানো না ভাবি তোমার ননদিনী কত পরিমাণের আনরোমান্টিক একজন মেয়ে। যাইহোক বাড়ির গুরুজনদের সাথে কথা বলে তারিখ ঠিক করে ফেলো কবে ননদেকে ন তোমার ভাইয়ের বাড়ি পাঠাবে। সাইফের যে বাড়িতে একা কষ্ট হয় থাকতে জিনিসটা ভুলে গেছো?

~নাগো বোন ভুলি নাই। আমরা জানি মা-বাবাকে ছাড়া সাইফকে এত বড় কিভাবে করেছি আমি আর ভাইয়া।আমি চলে আসার পর ও প্রচন্ড একা হয়ে গেছে বাড়িতে। কিন্তু আমি ভাবলাম সানাকে যদি এত তাড়াতাড়ি তুলে দেওয়ার কথা বলি তাহলে যদি আমার শ্বশুরমশাই হাজবেন্ড ভুল বুঝে। হাজার হোক সানা তাদের বাড়ির একমাত্র মেয়ে।

#চলবে?

সূচনাতে প্রেম পর্ব-০৪

0

#সূচনাতে_প্রেম
#নুসাইবা_রেহমান_আদর
#পর্ব৪

সানা আর বৃষ্টি নিজেদের মাঝে কথা বলা শেষে সানা উশখুশ করতে লাগলো বৃষ্টি কে কিছু জানানোর জন্য। কিন্তু কিভাবে কি বলবে সে ভেবে ভেবে পাচ্ছে না। বৃষ্টি সানার এই অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করে,,

~কিছু কি তুই আমাকে জানাতে চাচ্ছিস তা বলতে পারছিস না?

বৃষ্টি সানাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোভাবে চিনে জানে।তাইতো সে সানার এইরকম অবস্থা দেখে সে বুঝে ফেলল। সানা এবার চুপচাপ বৃষ্টিকে সব কথা খুলে বলতে লাগলো। সব কথা শুনে বৃষ্টিও শকড হয়ে গেলো।সানার বিয়ে হয়ে গেছে এই কথাটা সে জানে না এটা ভেবে আর খারাপ লাগতে শুরু করলো। বেস্ট ফ্রেন্ড বোন সবকিছুই তারা একে অপরকে মানে অথচ এমন দিন এসে সানার পাশে থাকতে পারলো না। সানার কাছে সব ঘটনার বর্ণনা পেয়ে বৃষ্টি নিজেকে শান্ত করতে লাগলো। এমন পরিস্থিতিতে সে সানাকে বেস্ট উপদেশ দেওয়ার চেষ্টা করবে। যেহেতু বিয়ে হয়ে গিয়েছে সেহেতু উচিত ভালোভাবে সংসার করা।

~দেখ সানা আজ আমি তোকে কিছু কথা বলব, তুই যদি আমাকে ভুল বুঝিস তাহলে আমার কিছু করার নাই। আমি সব সময় চাই তোর ভালো হোক। তোকে হাসি খুশি দেখতে চাওয়াটাই আমার সবচেয়ে বড় ইচ্ছা। তাই আমি যা বলব তুই মন দিয়ে শোন।

বৃষ্টির এমন গম্ভীর কথার মানে বুঝতে পারল না সানা।এতটা সিরিয়াস ভাবে বৃষ্টি কখনো সানার সাথে কথা বলেনি।

~তুই জানিস আমি তোর প্রতিটা কথা শুনি। তোর বলা কথা মানার চেষ্টা করি। আমি জানি তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসোস।

~তাহলে আমার কথা মেনে নে।তোর তো অন্য কোথায় কোন সম্পর্ক নাই সানা।আঙ্কেলের কথা শুনে যখন বিয়েটা করে নিয়েছিস তখন এরকম বাচ্চামো তোকে মানায় না। সাফোয়ান ভাইয়ার কথাও বোঝার চেষ্টা কর। উনি সারাদিন অফিস করেন ব্যাচেলার মানুষ রান্না করতে কষ্ট হয় তার উপর সাইফের দেখাশোনা। যেহেতু তুই তার বউ এইসব দায়িত্ব তোর। তোদের বিয়ের আজ ১৬ দিন হতে চললো অথচ তোর সাথে তার কোন যোগাযোগ নেই। এভাবে চলতে থাকলে তো হবে না। ভাইয়া যেভাবে তোকে বুঝবে সে ভাবে তাকেও তোর বোঝার চেষ্টা করতে হবে। আবার যদি কথা উঠে তোকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার তখন দ্বিমত পোষণ করিস না । বিয়ের বন্ধন অনেক পবিত্র একটা জিনিস। নিজেদেরই সম্পর্ককে আর হেলাফেলা করিস না। মানার চেষ্টা কর। এমন তো না যে তুই অন্য কাউকে ভালবাসতিস তাই তাকে মেনে নিতে পারছিস না।

বৃষ্টির প্রতিটা কথা যুক্তিপূর্ণ। বৃষ্টি যে সব সময় তাকে ভালো বুদ্ধি দেবে তা সানা খুব ভালোভাবে জানে। এই একটা মেয়েকে পেয়ে এসে সব সময় ব্লেসড ফিল করে।

~আমি এই জিনিসগুলো নিয়ে দোটানায় ভুগছিলাম এতদিন। ঠিকঠাক ভাবে নিজের প্রশ্নগুলোর উত্তর পাচ্ছিলাম না। আমি জানতাম একমাত্র তুই আমাকে রাস্তা দেখাতে পারবি।

~তা ভাবছিস এখন তুই কি করবি?

~কিন্তু আমি যা ভাবলাম সেই কথা কিভাবে বলব?

~তার কথা পরে আগে তো আমাকে বল কি ভাবলি তুই?

~আমি উনার সাথে তাদের বাসায় যেতে রাজি। কিন্তু এই কথা আমি মুখ ফুটে কিভাবে বলব বল? আমার লজ্জা করছে। তারপরে আবার উনি আমার উপর রাগ করে নয় দিন যাবত কোন যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি। আর আমিও চেষ্টা করিনি অপরাধবোধ থেকে।

~বাসায় যাবি গিয়ে সুমাইয়া ভাবীর সাথে আলোচনা করবি এবং উনাকে দিয়ে সবাইকে বলাবি। যেহেতু ভাইয়ার বাবা-মা নেই এই সংসারের দায়িত্ব এখন তোর। কারণ তুই তাদের বাড়ির একমাত্র বউ।

~আচ্ছা আমি করবো নে। যাওয়া যাক তোর জন্য ফোন কিনতে আজ আর ক্লাস করা হবে না।

~আচ্ছা চল যাও যাক।

বৃষ্টির কোথায় সানার মন অনেক ভালো হয়ে গিয়েছে। মনের মধ্যে চলা সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব মুক্তি পেয়েছে । সে বুঝে গিয়েছে এখন তার কি করতে হবে । তাই সে বৃষ্টিকে আজ ট্রিট দিবে।

বৃষ্টি কে নিয়ে চলে গেল একটা মোবাইল শপে। সেখানে তারা মোবাইল চুজ করছিল। তখন পাশে কারো আওয়াজ পেয়ে সানা চমকে যায়। কারণ আওয়াজটি আর কারো নয় স্বয়ং সাফোয়ান শিকদারের। সানা যখন পাশে তাকিয়ে দেখে তখন সেখানে সাফোয়ান এর সাথে আরো একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। সাফোয়ান মাত্রই খেয়াল করলো সানাকে এই দোকানে। সেও অবাক, কারন সানার আজ না কি দরকারি ক্লাস ছিলো তাই কলেজ গিয়েছে। এমনটাই শুনেছিলো সে। সাফোয়ানের সাথে থাকা ছেলেটা সানাকে চিনতে পেরেছে। বিয়েরদিন সে ছিলো সাফোয়ানের সাথে। সানা তো নিজের ভাবনায় ব্যাস্ত থাকায় কিছুই খেয়াল করেনি সেদিন।

~আসসালামু আলাইকুম ভাবি! কেমন আছেন আপনি?

লোকটির সালামে অপ্রস্তুত হয়ে যায় সানা। সে তো সাফোয়ানের দিকে তাকিয়ে ছিলো।

~ ওয়ালাইকুমুস সালাম!আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি কেমন আছেন?

~ আলহামদুলিল্লাহ ভাবি। আপনি যে এখানে আসবেন সাফোয়ান তো জানায় নি আমাকে।

~ উনি জানতেন না যে আমি আসবো। আমার বেষ্টফ্রেন্ড ফোন কিনতে হবে তাই আসা।

~ওহ আচ্ছা। আমি আবান আহমেদ আরিজ। সাফোয়ানের বেষ্টফ্রেন্ড।

বৃষ্টি এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবার কথা শুনছিল কোন কথা বলছিল না। সাফোয়ান আর বৃষ্টি এরা দুইজনে নির্বাক শ্রোতা সানা আর আবানের কথার মধ্যে। এদের কথা থামিয়ে সাফোয়ান বলে ওঠে,

~যেই কাজের জন্য আসে সেই কাজ কর তুই। আর আপনারা মোবাইল কিনে নেন এরপর আমরা একসাথে বের হব।

কথা শেষ করে বৃষ্টি আর সানাকে রেখে সাফোয়ান আবান কে নিয়ে চলে যায় ম্যানেজারের কাছে। সাফোয়ানের মুখটা প্রচন্ড গম্ভীর ঠেকছে কথাগুলো কেমন রুড লেগেছে তার কাছে।

~ভাই তোর জামাই তো মাশাল্লাহ অনেক সুন্দর । এমন জামাই থেকে দূরে দূরে কিভাবে থাকোস বইন?

~ছি বৃষ্টি কি ধরনের কথাবার্তা হ্যাঁ? তুই না ছেলেদের দিকে তাকাস না।আজ আমার জামাইর দিকে তাকালি কাহিনী কিতা?

বৃষ্টি সব সময় পর্দা মেইনটেইন করার চেষ্টা করে। কলেজে গেলেও কখনো তার চেহারা কেউ দেখেনি। একমাত্র কয়েকজন মেয়ে ফ্রেন্ড ছাড়া। কয়েক বছর যাবত বৃষ্টি এই ইসলামিক জীবনযাপন করা শুরু করেছে। তাই সানাও সর্বদা চেষ্টা করে তেমন পরিবেশ দেওয়ার। যাতে বৃষ্টির কোন হেজিটেশন না হয়। এই কারণে যখন আবান আর সানা কথা বলছিল তখন বৃষ্টি চুপ ছিল। যাতে তার আওয়াজ তারা শুনতে না পারে ।

~শোন ভাই ভুলে একবার তাকিয়ে ফেলেছিলাম আর এটা জায়েজ আছে। তোর জামাইয়ের দিকে ভুলে তাকিয়েছি হ্যাঁ? যদি কোন ছেলের দিকে প্রথমবার ভুলে চোখ যায় তাহলে সেই টুকু আল্লাহ মাফ করে দিবেন। কিন্তু দ্বিতীয় বার যদি নিজে ইচ্ছাকৃতভাবে দেখি তাহলে সেটা জিনা হিসেবে ধরা হবে ।আচ্ছা বাদ দে এসব এখন। আমি তো ভাইয়াকে বলতে পারবো না যে তাদের সাথে আমি গিয়ে কথা বলতে পারব না তাদের সামনে খেতে পারবো না। আমি জানিনা কিভাবে ভাইয়াকে না করবি তুই যে আমি তাদের সাথে যেতে পারবো না।

~আমি কিভাবে না করব? যদি কিছু মনে করে।তারা নিজ থেকে বলেছে তাহলে একটু চল।তাদের সামনে নিকাব খোলাও লাগবে না আর কথা বলাও লাগবেনা। আমি আর তুই আলাদা বসবো তার আলাদা বসাবো এইটুকু করতে পারব।

~বুঝেশুনে করিস কিন্তু আমি বারবার বলছি। বুঝার চেষ্টা করিস আমাকে। তোর কথার উপর বিশ্বাস করে কিন্তু আমি রাজি হচ্ছি যাওয়ার জন্য

সানা আর বৃষ্টির ফোন কেনা হয়ে গেলে তারা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো কখন সাফোয়ান রা আসবে।

#চলবে.?