Monday, August 4, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 413



মেহেরজান পর্ব-২৬+২৭

0

#মেহেরজান
#পর্ব-২৬
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

ঘুমের মাঝেই একপাশ থেকে অন্যপাশে ঘুরলেন মোহিনী। এর মাঝে দুচোখ একবার হালকা খোলায় কাউকে যেন দেখতে পেলেন। কিন্তু যাকে দেখলেন সে আদৌও কি এখানে নাকি মনের ভুল? আলসেমিতে চোখ খুলে উঠতে ইচ্ছে করছে না তার। চোখ বন্ধ রেখেই আবার সেদিকে ঘুরলেন তিনি। এক চোখ বন্ধ রেখে আরেক চোখ হালকা খুললেন। অর্ণব আয়েসি ভংগিতে পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছেন। তার ওষ্ঠাধর হাসছে। মোহিনীকে একচোখ খুলতে দেখে তার উদ্দেশ্যে হাত নাড়লেন অর্ণব। এক মুহুর্তেই উঠে বসলেন মোহিনী। চোখ দুটো বড় বড় হয়ে আছে। একবার ভালো করে কচলে নিলেন। চোখে এখন আর ঘুমের কোনো চিহ্নই নেই। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি। করবেনইবা কীভাবে? স্বপ্ন নাকি বাস্তব তা বোঝার জন্য নিজের হাতে জোরে চিমটি কাটলেন। ব্যথা অনুভব হওয়ায় মুহুর্তেই আবার হাত দিয়ে সে জায়গাটা ঘষতে লাগলেন।

“এবার বিশ্বাস হলো? স্বপ্ন দেখছেন না। বাস্তবই।”

মোহিনী অর্ণবের কাছে এসে তর্জনী দিয়ে তার দেহ ছুয়ে দেখলেন। অর্ণবের চোখ দুটো ছোট ছোট হয়ে গেল। চুটকি বাজাতেই তার চোখের দিকে তাকালেন মোহিনী। অর্ণব ভ্রু নাচিয়ে বললেন,

“এখনো বিশ্বাস হয়নি?”

“আপনি এবাড়িতে ঢুকলেন কীভাবে?”

“যেভাবে সবাই ঢোকে। দরজা দিয়ে।”

“মানে বাড়ির সীমানায় ঢুকলেন কীভাবে? দেওয়াল টপকে?”

“আমি কী চোর যে আমাকে দেওয়াল টপকে আসতে হবে?”

“কেউ আঁটকালো না আপনাকে? সবাই আসতে দিল?”

অর্ণব পেছনের দিকে হেলান দিয়ে আরেকটু আরাম করে বসলেন। বললেন,

“কার এতো সাহস যে আমাকে আঁটকাবে?”

রজনী ঘরে ঢুকলেন। হাতে এক কাপ চা। অর্ণবকে দিতেই তিনি বললেন,

“ধন্যবাদ।”

“আর কিছু প্রয়োজন পড়লে ডাকবেন।”

“এখন আর তার প্রয়োজন পড়বে না।”

মোহিনী ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন। রজনী চলে যেতেই ধপ করে অর্ণবের পাশে বসে পড়লেন। সামনে আগে থেকেই একটা খালি চায়ের কাপ রয়েছে। অর্ণব চায়ে চুমুক বসাতেই মোহিনী জিজ্ঞেস করলেন,

“কখন এসেছেন আপনি?”

“হবে একঘন্টার মতো।”

“এতোক্ষণ বসে ছিলেন! আমাকে ডাকতে পারতেন।”

“ইচ্ছে করলো না।”

“কেন?”

“আপনার ঘুমন্ত মুখটা দেখার সৌভাগ্য আগে কখনো হয়নি। অপরুপ সুন্দর লাগছিল আপনাকে। তাই আর ডাকিনি।”

“ঘুমিয়ে থেকে ফুলে যাওয়া তৈলাক্ত মুখটা সুন্দর?”

“আপনাকে তো তাই লাগছিল। একদম নিষ্পাপ একটা বাচ্চার মতো করে ঘুমাচ্ছিলেন। হা করে।”

মোহিনী সামান্য হাসলেন।

“কেন এসেছেন?”

“আপনার সাথে দেখা করতে কারণের প্রয়োজন? আর যদি কারণের কথাই বলেন তাহলে আপনি যদি এভাবে এতো বেলা ঘুমিয়ে থাকেন, আমার সাথে দেখা করতে এতো অনিয়ম করেন তাহলে আমাকে তো আসতেই হবে।”

“মোটেও আমি এতো বেলা ঘুমাই না। সকালে উঠেছিলাম। নাস্তা করে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আচ্ছা, আপনাকে এখানে আসতে কেউ দেখেনি তো?”

“আমি লুকিয়ে লুকিয়ে আসিনি। যারা দেখার দেখেছে।”

“সম্পর্কটা কেন এতো আগাচ্ছেন অর্ণব? যার পরিণতির কোনো নিশ্চয়তাই নেই।”

অর্ণব চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বললেন,

“পরিণতি কী হবে জানিনা। তবে আমি আপনার হাত কখনোই ছাড়বো না মেহেরজান।”
.
.
.
চৈত্রের কাঠফাটা রোদে বারান্দায় রাখা দোপাটি গাছটা নুয়ে পড়ছে একদম। তিনদিন আগেই গাছটা এনে বারান্দায় লাগিয়েছেন পদ্মাবতী। কিন্তু ঠিকমতো যত্ন না নেওয়ায় তার এই হাল। অন্যদিকে নীল অপরাজিতা আর কুঞ্জলতাটা এখনো বারান্দার শোভাবর্ধন করেই যাচ্ছে। পদ্মাবতী চায়ের জন্য কয়েকটা অপরাজিতা তুলে নিলেন। ঘরে এসে টেবিলের ওপর ফুলগুলো রাখতেই জানালার বাইরে চোখ পড়লো তার। মুহুর্তেই মনটা ভালো হয়ে গেল। জানালার একদম কাছের নিমগাছটায় পাখি বাসা বেঁধেছে। ক’দিন পর ডিম পারবে। তারপর সেই ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবে। সারাদিন কিচিরমিচির করবে। ভাবতেই খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে পদ্মাবতীর। কত শখ ছিল একটা পাখি পোষার। কিন্তু শকুন্তলার অনুমতি ছিল না বলে সে শখ আর পূরণ হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এখন ঘরে না পুষলেও জানালা দিয়ে তো প্রতিদিন দেখতে পারবেন। আচ্ছা, কী পাখির বাসা এটা? পদ্মাবতী আশেপাশে দেখতে লাগলেন। কিন্তু কোনো পাখি দেখতে পেলেন না। হয়তো খাবারের সন্ধানে কোথাও উড়ে বেড়াচ্ছে। পরে আসলেই দেখতে পারবেন।

“পদ্মা।”

চকিতে পেছনে ঘুরলেন পদ্মাবতী। মটরশুঁটির ডালা হাতে আম্রপালি দাঁড়িয়ে আছেন। পদ্মাবতী ঝটপট এগিয়ে গিয়ে তার হাত থেকে ডালাটা নিয়ে বসে পড়লেন খোসা ছাড়াতে। তার সাথে আম্রপালিও বসলেন। খোসা ছিলতে ছিলতে বললেন,

“খেয়েছিস?”

“হুম।”

“কী খেলি?”

পদ্মাবতী একটু ভেবে বললেন,

“ওইতো গরম ভাত, মাছ, ডাল আর…”

আম্রপালি থামিয়ে দিলেন।

“আর মিথ্যে বলিস না। এসবের কিছুই রান্না হয়নি আজ।”

“তাহলে?”

“যদি খেতি তাহলেই দেখতে পেতি। খিচুড়ি, মাংস আর ডিমের তরকারি করেছিল শকুন্তলা।”

পদ্মাবতী শুকনো ঢোক গিললেন। সকালে একবার মাংসের গন্ধ এসেছিস তার নাকে। আরেকটু ভেবে যদি উত্তর দিতেন তাহলে আর ধরা পড়তে হতো না। এ ভেবে আফসোস করতে লাগলেন তিনি।

“মিথ্যে বললি কেন?”

“সত্যি বললে বকুনি দিতেন।”

“বকেছি এখন?”

পদ্মাবতী দুদিকে মাথা নাড়লেন।

“তাহলে? আর খাসনি কেন এখনো?”

“ইচ্ছে করছিল না।”

“ইচ্ছে না করলেই খাবিনা? আয়নায় মুখটা দেখেছিস? আরও শুকিয়ে গেছিস। চোখ দুটো একদম কোটরে চলে গেছে। খাওয়াদাওয়ায় এতো অনিয়ম করছিস কেন?”

“কই অনিয়ম করলাম? আজ খাইনি শুধু।”

“না খেয়ে থাকতে থাকতে মাথা ঘুরে যখন পড়বি তখন টের পাবি কই অনিয়ম করেছিস।”

“আর করবো না।”

“সবসময় এক কথা। আর করবো না! ইদানীং তোকে প্রায়ই দেখি মনমরা হয়ে থাকিস। কেন বলতো?”

“কই? না তো।”

“বললেই হলো? আমার কি চোখ নেই? সত্যি করে বল তোর কী হয়েছে? চিত্রা, মোহিনীর সাথে ঝগড়া হয়েছে?”

“ওদের সাথে আমার ঝগড়া হতে পারে?”

“তাহলে?”

“কিছুই হয়নি।”

“আজ মায়ের ঘরে গিয়েছিলাম। তার কাছে শুনলাম তুই নাকি কতদিন আগে তার ঘরে গিয়ে কাঁদছিলি?”

এবার পদ্মাবতী বুঝতে পারলেন আম্রপালি কোন উদ্দেশ্যে তার ঘরে এসেছেন। কিন্তু তিনি যাই করুন না কেন, পদ্মাবতী মুখ খুলছেন না কিছুতেই।

“আমি কেন কাঁদতে যাবো? তাও দিদার ঘরে গিয়ে। আমার কি ঘর নেই? দিদার তো এমনিতেই মাঝেমাঝে মাথা ঠিক থাকে না। কী বলতে কী বলেছে কে জানে।”

“তুই তাহলে যাসনি তার ঘরে?”

“যাই তো। শুধু ওষুধ খাওয়াতে যাই। তাছাড়া তো তেমন যাওয়া হয় না দিদার ঘরে।”

আম্রপালি ভ্রু কুঞ্চিত করে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণের জন্য ঘরের মধ্যে পিনপতন নীরবতা নেমে এলো। নীরবতা ভেঙে আম্রপালি বললেন,

“অর্ণব যে কই গেছে। সকাল থেকে দেখছি না।”

“ওনাকে তো সকালে বাইরে যেতে দেখলাম।”

“কোন দিকে গেছে?”

“তা জানি না। শমিতদার সাথে গেছেন হয়তো।”

“কিন্তু শমিতকে তো ওর ঘরেই দেখে এলাম।”

পদ্মাবতী ঠোঁট উল্টে কাঁধ ঝাঁকালেন।

“তাহলে জানি না।”

“ইদানীং প্রায়ই ও যেন কই যায়। কিন্তু কই যায় তা দেখতে পারিনি।”

“কোনো কাজেই যায় নিশ্চয়।এতো চিন্তা করবেন না। সে তো আর বাচ্চা না।”

“বাচ্চা না তাতে কী? সন্তান ছোট হোক আর বড় হোক, সন্তানের জন্য মায়ের মন সবসময়ই চিন্তিত থাকে।”

পদ্মাবতী ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেললেন।

চলবে…

#মেহেরজান
#পর্ব-২৭
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

আম্রপালি আর শকুন্তলা সেই সকাল থেকে একটা কাজেই ব্যস্ত। বিভিন্ন রকমের আচার, মোয়া, নাড়ু বৈয়ামে ভরছেন। সাথে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের পিঠে আর মিষ্টির হাড়ি। রসগোল্লা, সরপুরিয়া, সীতাভোগ, বরফি, ছাড়াবড়া, পান্তুয়াসহ বাহারি সব মিষ্টি। তাদের সাথে পদ্মাবতীও বসেছেন। খালি বৈয়ামগুলো ভালো করে মুছে দিয়ে তাদের হাতে হাতে সাহায্য করছেন। তিনি এখন আগের থেকে অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছেন। কোনোকিছু নিয়ে এখন আর খারাপ লাগে না। সবসময় ঠোঁটের কোণে একটা হাসি লেগে থাকে। এই যেমন এখন লেগে আছে। শমিত আশেপাশেই ঘুরঘুর করছেন। নিজের উদরপূর্তির উদ্দেশ্যে। যখনই সুযোগ পাচ্ছেন, এসে একটা করে মিষ্টি পেটে চালান করে চলে যাচ্ছেন। ঠিক এমন সময় তিনি আবার এসে উপস্থিত হলেন। রসগোল্লার হাড়ির দিকে হাত বাড়াতেই আম্রপালি টান দিয়ে হাড়িটা সরিয়ে ফেললেন।

“উফ মামি, মোহিনী ছাড়া যেন আর কেউ-ই এসব খেতে পছন্দ করে না। আমাকে কি চোখে পড়ে না আপনাদের?”

“রান্নাঘরে আছে। ওখান থেকে খা। এগুলো খেতে হবে কেন? তোদের জন্য একটা হাড়ি রেখে দিয়েছি।”

“আগে বলবেন তো। আমি শুধু শুধু মোহিনীর ভাগেরটা খাচ্ছিলাম। ও জানলে তো আমাকে কাঁচা চিবিয়ে খাবে।”

পদ্মাবতী ফিক করে হেসে ফেললেন। শমিত রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই অর্ণব এসে উপস্থিত হলেন।

“বাহ! নববর্ষ উপলক্ষে এতো আয়োজন?”

শকুন্তলা বললেন,

“এগুলো নববর্ষের জন্য না তো।”

“তাহলে? এগুলো কার জন্য?”

“মোহিনীর জন্য।”

“মোহিনীর জন্য?!”

অর্ণব কিছুটা অবাক হলেন।

“কেন?”

“আজ জন্মদিন ওর।”

“শুধু ওর একার না। আমাদের পদ্মারও। দুটো তো একসাথেই হয়েছিল এই পহেলা বৈশাখের দিনে।”

মিষ্টি খেতে খেতে কথাটা বললেন শমিত। ইতোমধ্যেই রান্নাঘর থেকে একটা রসগোল্লার হাড়ি নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন তিনি। অর্ণবের উদ্দেশ্যে বললেন,

“এইনে, হা কর। মিষ্টি খা।”

কিছুটা জোরপূর্বকই অর্ণবের মুখে মিষ্টি ঢুকিয়ে দিলেন তিনি। অর্ণব একটা মোড়া টেনে ওখানে বসে পড়লেন। এরপর পদ্মাবতীকেও একই কথা বললেন শমিত। কিন্তু পদ্মাবতী খাওয়ার জন্য হা করতেই শমিত মুখের কাছে মিষ্টি নিয়ে আবার ফিরিয়ে নিয়ে নিজে খেয়ে ফেললেন।

“ধুর।”

“তুই খাবি কেন? তোরই তো জন্মদিন।”

“তাই বলে কি আমার খাওয়া বারণ নাকি? কই? মোহিনীর জন্য তো এতো কিছু ঠিকই যাচ্ছে।”

“সে তো মোহিনী এসব খেতে পছন্দ করে বলে বড় মামি ওর জন্য প্রতিবছরই পাঠান। তুই কি আর এতো খেতে পারবি?”

পদ্মাবতী শমিতের উদ্দেশ্যে ভেংচি কাটলেন।

“দেখেছো কত বড় বেয়াদব হয়েছে! বড় দাদাকে ভেংচি কাটে!”

আম্রপালি বললেন,

“তো তুই ওকে খোঁচাচ্ছিস কেন?”

“আমি আবার কই খোঁচালাম?”

“সেই ছোটবেলা থেকে মেয়েটাকে না কাঁদানো পর্যন্ত থামতি না। আর বলিস কই খোঁচালাম?”

“আর ও কেঁদে কেঁদে আপনাদের কাছে গিয়ে বিচার দিত। যার মিথ্যা সাক্ষী দিত মোহিনী। অথচ ঘটনাস্থলের আশেপাশেও ও থাকতো না। পদ্মা কেঁদে কেঁদে নাক টেনে বলতো মোহিনীকে আর সেও রাজি হয়ে যেত। তারপর…”

“তারপর আর কী? অনুরাধা ঝাড়ু নিয়ে সারা গ্রাম তোর পেছন পেছন দৌঁড়াতো।”

অনুরাধাও চলে এলেন। মুহূর্তেই যেন কয়েকজনের গল্পের আসর বসে গেল। অনুরাধা এসেই বললেন,

“আমাকে নিয়ে কথা হচ্ছিল?”

শকুন্তলা বললেন,

“তোমাকে নিয়ে না। পদ্মাবতীর কথা হচ্ছিল। সেই পুচকে মেয়েটা আজ কত্তো বড় হয়ে গেছে। আমার তো এখনো মনে পরে ওর এবাড়িতে আসার প্রথম দিনের কথা। অর্ণব কী কান্ডটাই না করেছিল।”

অর্ণবের চোখেমুখে কৌতূহল ফুটে উঠলো।

“কী করেছিল ও?”

“পদ্মাকে এবাড়িতে নিয়ে আসায় যা রেগে গিয়েছিল। ওকে তো থাকতেই দেবে না কিছুতে এখানে। এরপর দিদি বোঝানোর পরে রাজি হয়েছে। আবার তোমাদের বাড়ি থেকে যখন ছুটি কাটিয়ে এসে মোহিনীকে দেখলো তখন আবার সব উল্টো। তখন তো কেঁদেই ফেলেছিল এই বলে যে এখন ওরা সবাই আমার জিনিসে ভাগ বসাবে। মায়ের ঘরে গিয়ে কেঁদে কেঁদে আমার আর দিদির নামে সে কি নালিশ! তখন আবার মা বোঝানোর পরে সে শান্ত হলো।”

অর্ণব কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে এসব ঘটনা মনে করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে বললেন,

“আমি এমন করিনি।”

“বললেই হলো নাকি। আমাদের স্পষ্ট মনে আছে।”

অর্ণব একটু গলা খাঁকারি দিয়ে আম্রপালির উদ্দেশ্যে বললেন,

“মা, খিদে পেয়েছে।”

“একটু রান্নাঘরে গিয়ে নিয়ে নে না। ওখানে বেড়ে রাখাই আছে তোর জন্য। দেখছিস তো আমি কাজ করছি।”

অর্ণব আর কথা না বাড়িয়ে উঠে রান্নাঘরের দিকে গেলেন। খাবারের থালা বের করে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললেন,

“মা, এখানে তো পান্তা-ইলিশ আর কী কী ভর্তা যেন রয়েছে।”

“ওগুলোই তো।”

“মানে?”

“কী মানে?”

“পান্তা কেন?”

“বিলেতে থেকে কি সব ভুলে গেছিস? আজ পান্তা খাবি না তো কী খাবি? চুপচাপ খেয়ে নে।”

অর্ণব অন্য কোনো উপায় খুঁজে পেলেন না। বাড়িতে আর কিছু রান্না হয়নি আজ। ইশারা করে শমিতকে ডাকলেন সেখানে।

“কী হয়েছে বল।”

“মেহের কই জানিস?”

“মেহের?”

“মোহিনী।”

“ওহ। দু’ঘন্টা বাদে কবরস্থানে গিয়ে দেখিস। পেয়ে যাবি।”

“কবরস্থানে! কেন?”

“গেলেই বুঝতে পারবি।”

“ঠিকাছে। তুই যা এখন।”

শমিত চলে গেলে অর্ণব একবার হাতঘড়িতে সময়টা দেখে নিলেন।
.
.
.
কবরস্থানের বাইরে থেকেই মোহিনীকে একটা কবরের পাশে বসে থাকতে দেখলেন অর্ণব। কাছে গিয়ে পেছন থেকে বললেন,

“এখানে কী করছেন মেহের?”

অর্ণবের প্রশ্নে বিচলিত হলেন না তিনি। পেছনে না ঘুরেই জবাব দিলেন। যেন আগে থেকেই জানতেন অর্ণব আসবেন।

“এটা আমার মায়ের কবর। মুসলিম হওয়ায় কবর দেওয়া হয়েছিল তাকে এখানে। প্রতিবছর এই দিনটায় আসি তার সাথে দেখা করতে।”

“আমি দুঃখিত। আমি আপনার কষ্টটা বুঝি।”

“উঁহু। দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই। আর আমি যেমন আপনার বাবা হারানোর কষ্ট বুঝি না তেমন আপনিও আমার মা হারানোর কষ্ট বুঝবেন না। যদি কেউ বোঝে তাহলে সে শুধু পদ্মা।”

“হয়তো ঠিক বলেছেন আপনি।”

“পদ্মা আর আমার মাঝে আকাশপাতাল তফাৎ থাকলেও এই জিনিসটায় আমাদের খুব মিল। দু’জনে একই দিনে জন্মেছি আর একই দিনে মা হারিয়েছি।”

“হুম।”

“কিন্তু জানেন, আমার না একটুও কষ্ট লাগে না মায়ের জন্য।”

“কেন?”

“আপনার বাবা যখন মারা গেলেন তখন আপনি সব বুঝতেন। তার আদর স্নেহও পেয়েছিলেন। আর পদ্মা, সে বড়মার কাছে ওর মায়ের সব গল্প শুনেছে। কিন্তু আমি? আমি তো আমার মায়ের সম্পর্কে কিছু জানিই না। কে ছিলেন? নাম কী? কিছুই জানি না। জন্মের পর তার স্পর্শ পর্যন্ত পাইনি। শুধু তারামার কাছে জেনেছিলাম, তিনি নাকি পাকিস্তানি ছিলেন। উর্দু বলছিলেন। এখন আপনিই বলুন। একজন অপরিচিত মানুষের জন্য আমার কেন কষ্ট হবে? যাকে কখনো দেখিনি। চিনি না। তার সম্পর্কে কিছুই জানি না।”

“মায়ের সাথে তার সন্তানের সম্পর্ক জন্মের ন’মাস আগেই তৈরি হয়। আপনার যদি খারাপ না লাগতো, মায়ের প্রতি টান অনুভব না করতেন তাহলে কেন বারবার তার কবরের কাছে ছুটে আসতেন?”

এবার মোহিনী পেছনে ঘুরলেন। এতোক্ষণ শক্ত গলায় কথা বললেও অর্ণব দেখতে পেলেন মোহিনীর চোখ দিয়ে অনর্গল জল ঝরছে। আজ প্রথমবারের মতো তাকে কাঁদতে দেখলেন অর্ণব। মোহিনীর অশ্রুসিক্ত চোখের সাথে কিছুতেই নিজের চোখ মেলাতে পারছেন না অর্ণব। তার পাশে বসে জল মুছে দিয়ে বললেন,

“আমার বাঘিনীটা হঠাৎ এমন ভিজে বেড়াল হয়ে গেল কী করে?”

মোহিনী না চাইতেও তার কথায় হেসে ফেললেন।

“বাড়ি যান অর্ণব। আমি একটু পর আসছি।”

“আপনাকে একা রেখে যাচ্ছি না।”

“একসাথে যাওয়া ঠিক হবে না। আপনি আগে যান।”

অর্ণব জোরে একটা শ্বাস ছাড়লেন।

“ঠিকাছে। তাড়াতাড়ি আসবেন।”
.
.
.
হাতঘড়িতে বারবার সময় দেখছেন অর্ণব। অর্ণবকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেও মোহিনীর কোনো হদিস নেই। তিনি আর আসেননি। এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বারবার দেখছেন কেউ এলো কিনা। এমন সময় মোহিনীকে ঢুকতে দেখলেন গেইট দিয়ে। মেরুন রঙের আনারকলি পরা। অর্ণব তাড়াতাড়ি ভেতরে চলে গেলেন। নিচে আসতেই দেখলেন পদ্মাবতী, শমিত সবাই তৈরি হয়ে সেখানে বসে আছেন।

“তোরা কোথাও যাচ্ছিস?”

“মেলায়।”

“মেলায় মানে?”

“আরে এখানে খুব বড় করে বৈশাখী মেলা হয়। যাবি তুই আমাদের সাথে?”

“বাচ্চা পেয়েছিস নাকি আমাকে? মেলায় যাবো কী করতে?”

“মেলায় কী শুধু বাচ্চারা যায় নাকি?”

“তা নয়তো কী?”

“ধুর। যেতে হবে না তোকে।”

মোহিনী ভেতরে ঢুকেই বললেন,

“বের হবে তোমরা এখন?”

অর্ণব শমিতকে টান দিয়ে পাশে এনে নিচু স্বরে বললেন,

“মোহিনীও যাবে নাকি তোদের সাথে?”

“যাবে না আবার! ওকে ছাড়া চলবে নাকি?”

“আগে বলিসনি কেন? আমিও যাবো তোদের সাথে।”

“কেন? তুই কেন যাবি? ওখানে তো বাচ্চারা যায়। তাই না?”

অর্ণব জোরে চিমটি কাটতেই শমিত চিৎকার করে উঠলেন। উপস্থিত সবাই তাদের দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। শমিত গলা নিচু করে বললেন,

“আচ্ছা আচ্ছা। অভিনয় শুরু কর।”

“ঠিকাছে।”

শমিত এবার বাকিদের শুনিয়ে শুনিয়েই বললেন,

“অর্ণব, বলছিলাম কী। তুই তো আমাদের সাথে কোনোদিন মেলায় যাসনি। আজ চল তাহলে। দেখে আয় একটু।”

“না না। তোরাই যা। আমার এসব ভাল্লাগে না।”

শমিত আবার গলা নিচু করে বললেন,

“বেশি ভাব নিস না। নয়তো না নিয়েই চলে যাবো। চুপচাপ রাজি হয়ে যা।”

“আচ্ছা।”

শমিত আবার জোরে জোরে বললেন,

“আরে চল না। একদিন গেলে কিছুই হবে না। দেখবি ভালোই লাগবে।”

“ঠিকাছে। চল তাহলে। একটা দিনই তো।”

পদ্মাবতী বলে উঠলেন,

“তোমরা বারবার কানে কানে কী কথা বলছিলে শমিতদা?”

“কানে কানে কথা বলছিলাম? কই না তো। তুই ভুল দেখেছিস।”

“না, আমি স্পষ্ট দেখেছি।”

“আচ্ছা দেখেছিস ভালো করেছিস। বাদ দে তো। চল এবার।”

“চিত্রাও সাথে থাকলে ভালো হতো।”

“ও কী করে থাকবে? ও তো গেছে ওর মামার বাড়ি।”

মোহিনী বললেন,

“গিয়ে এসেও পড়েছে। ওই দেখো।”

হাত দিয়ে বাইরে ইশারা করলেন। ব্যাগবোঁচকা নিয়ে চিত্রা আসছেন। শকুন্তলা সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে চিত্রাকে আসতে দেখে বললেন,

“কি রে, তুই না একসপ্তাহর জন্য গেলি? দু’দিন বাদেই চলে এলি যে?”

“একটুও ভালো লাগছিল না। বিশেষ করে আপনার মায়ের জন্য। কী পরিমাণ যে কথা বলতে পারে না দেখলে বিশ্বাস করবেন না। বাপরে বাপ! কানটা ঝালাপালা হয়ে যায়। বুড়ি হয়ে গেছে অথচ এখনো চাপার জোর কমেনি।”

মোহিনী হেসে ফেললেন। পদ্মাবতী বললেন,

“তুই কি আমাদের সাথে যাবি?”

“কোথায়?”

“মেলায়।”

“না, তোরা যা। আমি অনেক ক্লান্ত এখন। একটু ঘুমাবো।”

শমিত বললেন,

“তাহলে আর কী করার। আমরা এখন বের হই চল।”

অর্ণব তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,

“দাঁড়া। আমি পোশাক পাল্টে আসছি।”

“এখন আবার পোশাক পাল্টাতে যাবি?”

“সমস্যা কই?”

“দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।”

“পোশাক পাল্টাবে আর কতই বা সময় লাগবে?”

“তবুও।”

“তোর এতো তাড়া কেন বলতো।”

“কই? আমার কোনো তাড়া নেই। তুই যা। পোশাক পাল্টে আয়। আমরা অপেক্ষা করছি।”

শমিত কথা শেষ করার আগেই অর্ণব দোতলায় চলে গেলেন। নববর্ষে পরার মতো একটা পাঞ্জাবি পরে কিছুক্ষণের মাঝেই ফেরত এলেন। তারা বের হয়ে কিছুদূর যেতেই সামনে শেফালীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। অর্ণব গাড়ি চালাচ্ছিলেন। শমিত তাড়াতাড়ি থামাতে বললেন। অর্ণব গাড়ি থামালে শেফালীও এসে যোগ দিলেন তাদের সাথে। এরপর একদম মেলার গেইটের সামনে গিয়ে গাড়ি থামালেন। সবাইকে নামিয়ে দিয়ে একটা নিরাপদ জায়গায় গাড়িটা রেখে এলেন। সবাই ইতোমধ্যেই ভেতরে চলে গেছেন। কিন্তু তাদের খুঁজে বের করতে খুব একটা সময় লাগলো না অর্ণবের। শমিত বললেন,

“অর্ণব, ও শেফালী।”

“দেখেছি তোর সাথে আগেও। এটাও জানি কে ও।”

“দেখলেও পরিচয় তো ছিল না। তাই পরিচয়টা করিয়ে দিলাম।”

পদ্মাবতীর উদ্দেশ্যে বললেন,

“ভালো করে শোন পদ্মা। এবারও যদি হারিয়ে যাস তো ঝালমুড়ির দোকানে বসে কাঁদবি না। একদম গেইটের সামনে চলে যাবি। আমরা খুঁজে নেবো তোকে।”

“উঁহু, আমি এবার হারাবোই না। সাথে সাথে থাকবো তোমাদের।”

“ঠিকাছে। মনে থাকে যেন।”

“থাকবে।”

শেফালী বলে উঠলেন,

“এই, হাতির পিঠে চড়বে?”

“হাতি কোথায় পেলে?”

“আরে ওইযে, সামনে দেখছো না। চলো না, আমার অনেকদিনের শখ।”

“উঠবে? চলো তাহলে। আমরা সবাই যাই।”

“তার আগে কুলফি কিনে দাও।”

শমিত পাঁচটা কুলফি নিয়ে আসলো। শেফালীর হাতে একটা দিয়ে পদ্মাবতী আর মোহিনীর দিকে বাড়ালে তারা বললেন,

“আমি খাবো না।”

“আমিও না।”

“খাবি না কেন?”

“নারকেল আছে এতে। মোহিনী আর আমি দুজনেই এটা পছন্দ করি না।”

“নারকেল ছাড়া তো নেই।”

“তাহলে থাক।”

“অর্ণব, তুই নে।”

“না, আমার ঠান্ডার সমস্যা আছে।”

“যাব্বাবা, তাহলে কিনলাম কেন?”

শেফালী বলে উঠলেন,

“রাখো তো, আমিই খেয়ে ফেলতে পারবো সব। চলো এবার।”

শেফালী আগে আগে হাতির পিঠের ওপরে করা আসনে উঠে বসলেন। মোহিনী এগিয়ে গেলে অর্ণব সবার অগোচরে তার হাত ধরে তাকে থামিয়ে দিলেন। এক হাতির উপর চারজন উঠতে পারবে দেখে বুদ্ধি করে আগেভাগেই মোহিনীকে সরিয়ে নিলেন। পদ্মাবতী আর শমিতও উঠে পড়লে অর্ণব মোহিনীকে নিয়ে আরেকটায় উঠলেন। হাতি উঠে দাঁড়ানোর সময় একটু হেলতেই মোহিনী অর্ণবের হাত একদম খামচে ধরলেন। খুব খুশি দেখাচ্ছে তাদেরকে। দূর থেকে দু’জনকে একসাথে এতো খুশি দেখে অজান্তেই পদ্মাবতীর ঠোঁটে একটা মলিন হাসি ফুটে উঠলো।

চলবে…

মেহেরজান পর্ব-২৪+২৫

0

#মেহেরজান
#পর্ব-২৪
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

প্রতিবারের মতো এবারও চৌধুরী বাড়িতে বেশ বড় করে দোল উৎসব হচ্ছে। পাড়াপ্রতিবেশি সবাই এসে জড়ো হয়েছে এখানে। বাতাসে মিশে আছে নানা রঙের আবির। পরনের সাদা পোশাকগুলো রঙ লেগে একাকার। বাইরে সবাই হৈ-হুল্লোড়ে ব্যস্ত। অথচ এই আনন্দের দিনটাই পদ্মাবতীর জন্য হয়ে উঠেছে কষ্টের একটা দিন। সবাই যখন আবির আর গুলাল নিয়ে রঙ খেলায় মেতে উঠেছে, তখন তিনি নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে বালিশে মুখ লুকিয়ে চাপাকান্নায় কাতর। হঠাৎ চিত্রা এসে দরজায় কয়েকটা ধাক্কা দিলেন।

“এই পদ্মা, সবাই বাইরে আর তুই ঘরে কী করছিস? তাড়াতাড়ি বের হ। সবাই নিচে কতো মজা করছে। আয় তাড়াতাড়ি।”

শোয়া থেকে উঠে বসলেন পদ্মাবতী। দুই গাল রঙে লাল হয়ে আছে। আর চোখ দুটো লাল হয়েছে কান্নায়। বিছানা থেকে নেমে চুল আর শাড়ি ঠিক করে নিলেন। বললেন,

“তুই যা। আমি একটু পরে আসছি। চোখে আবির ঢুকে গেছে। সেটাই পরিষ্কার করছি।”

“আচ্ছা। আমি গেলাম। আসিস কিন্তু তাড়াতাড়ি।”

স্নানঘরে ঢুকলেন পদ্মাবতী। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই চিনতে পারছেন না। কেঁদে চোখমুখ একদম ফুলিয়ে ফেলেছেন। এভাবে বাইরে গেলে যেকেউ বুঝে যাবে তিনি কান্না করেছেন। তারপর শুরু হবে হাজারো প্রশ্ন। কী হয়েছে, কেন কান্না করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। সত্যিই তো। কেন কান্না করেছেন তিনি? অর্ণব আর মোহিনীর কথা জানতে পেরে? অর্ণবের জন্য এভাবে কেঁদে চোখ ভাসিয়েছেন তিনি? হয়তো তাই। আজ সকালেও কী সুন্দর সবার সাথে আনন্দে মেতে ছিলেন। তার পাশে থেকেই অর্ণব যখন মোহিনীকে টেনে নিয়ে আবির লাগিয়ে ভালোবাসার কথা বললেন, নিজের চোখকান কোনোটাকেই বিশ্বাস করতে পারেননি তিনি। মুখে আবির লেগে থাকায় অন্যরা তাদের চিনতে পারেনি তাতে কী? তিনি তো ঠিকই চিনতে পেরেছেন তার ভালোবাসার মানুষটাকে। অথচ কালরাতেও কতটা আনন্দে ছিলেন অর্ণবের ফিরে আসা নিয়ে। আর ভাবতে পারলেন না তিনি। আবারও কেঁদে ফেললেন। চিৎকার করে। কিন্তু সেই চিৎকার কারও কানে পৌঁছালো না। কাঁদতে কাঁদতেই মুখে বারবার জলের ঝাপটা দিতে লাগলেন। কিন্তু সেই জলও তার চোখের জলকে ঢাকতে পারলো না। বহু কষ্টে নিজেকে শান্ত করলেন। হাতমুখ ধুয়ে স্নানঘর থেকে বের হলেন। গালে এখনো রঙের দাগ রয়েই গেছে। স্বাভাবিক হয়ে ঘর থেকে বের হতেই কই থেকে যেন মোহিনী এসে তার দুগাল আবার রঙে রাঙিয়ে দিলেন।

“সবার গালে আবির লেগে আছে। তোর গালে নেই কেন?”

“ধুয়ে ফেলেছিলাম।”

“কিরে, চোখ এমন লাল হয়ে আছে কেন? কেঁদেছিস নাকি?”

“কাঁদবো কেন? চোখে আবির ঢুকে গিয়েছিল। তাই জল পড়ছিল। এজন্যই তো চোখমুখ ভালো করে ধুয়ে আসলাম।”

“ব্যাপার না। বাইরে চল। আবার রঙ লাগাবো। ঘর নোংরা করলে তো বড়মা সেই তোকে আর আমাকে দিয়েই আবার সব পরিষ্কার করাবেন।”

“তুই যা। আমি আরও আবির নিয়ে আসছি। ছোটমার ঘরে রয়েছে।”

“ঠিকাছে। তাড়াতাড়ি আয়।”

“হুম।”

মোহিনী চলে যেতেই পদ্মাবতীর চোখ দুটো আবার ভরে উঠলো। কান্না দমিয়ে রাখতে গলায় কেমন যেন চাপ অনুভব করলেন। চোখ থেকে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তেই সাথে সাথে মুছে ফেললেন তিনি।

“কয়েক মাসের ভালোবাসার জন্য এতো বছরের বন্ধুত্ব নষ্ট করতে পারবো না আমি। ভাগ্যিস মনের সুপ্ত অনুভূতিটা কখনো প্রকাশ করিনি। তোদের মাঝে আমি কখনো ছিলামও না আর আসবোও না। তোর অর্ণব তোরই থাকলো। কিন্তু আমাকে তো অন্তত একবার জানাতে পারতিস। কেন লুকালি মোহিনী?”

শকুন্তলার ঘরে এসে আবিরের থালা নিয়ে বাইরে চলে গেলেন পদ্মাবতী। কিন্তু এই ঘটনাটা শত চেষ্টা করেও কিছুতেই মন থেকে মুছতে পারছেন না তিনি। বারবার মনে হতেই কান্না উপচে আসছে।
.
.
.
নিজের ঘরে বসে পান সাজাচ্ছিলেন তারানা। রজনী ঢুকতেই জিজ্ঞেস করলেন,

“মেহের এখনো বাড়ি ফেরেনি রজনী? সেই কোন সকালে না গেল।”

“ফিরলে তো দেখতেই পেতে আম্মা। ওকি আর এখন এখানে থাকবে?”

পান মুখে দিয়ে চিবুতে চিবুতে জিজ্ঞেস করলেন,

“কেন? হঠাৎ এ কথা বলছিস কেন?”

“কাল রাতে তো ওই ছেলেটা গ্রামে ফিরেছে শুনলাম। মোহিনীকে এখন আর এবাড়িতে কিভাবে আটকে রাখবে বলো?”

“মানে? কোন ছেলে? কার কথা বলছিস তুই?”

“আমার কাছে আর কিছু লুকাতে হবে না আম্মা। আমি অন্ধ নই। দেখতে পাই সব। আর এটাই জানি যে তুমি ওদের ব্যাপারে সব জানো।”

“বেশি কথা বলিস না তো রজনী। চুপ থাক।”

“আমি নাহয় চুপ থাকবো। তাই বলে কি এসব লুকানো যাবে? সেদিন তুমি জেনেছো, আজ আমি জেনেছি, কাল ও-বাড়ির লোকজন জানবে। এরপর আস্তে আস্তে গ্রামের সবাই জেনে যাবে। তখন আমরা এখানে টিকে থাকতে পারবো ভাবছো?”

তারানা কোনো জবাব দিলেন না। রজনী আবার বললেন,

“এমনেই গ্রামের সবাই ভাবে ওদের ঘরের ছেলেরা আমাদের জন্য নষ্ট হচ্ছে। আমাদের জন্য ওদের সংসার ভাঙছে। আচ্ছা, ওদের পুরুষরা যদি বাড়িতে ঝগড়া করে এখানে এসে মদ খেয়ে পড়ে থাকে তাহলে সেটার দায় কি আমাদের? চরণ তো তাও ওগুলোকে বের করে দিয়ে আসে। আমরা তো শুধু পেট চালানোর দায়ে একটু নেচে পয়সা কামাই।”

“কী করতে বলছিস তুই সরাসরি বলতো। এতো কথার কী আছে?”

“আমি কী বলবো? শুধু সময় থাকতে মোহিনীকে একটু সামলাও আম্মা। নয়তো ওর জন্য আমাদের ভুগতে হবে। প্রমিতার কথা মনে নেই? ওকে মারার পর কিন্তু সব লোকজন মিলে আমাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে মারতে চেয়েছিল আমাদের। শুধু ওই জমিদারের বউ বাঁধা দিয়েছিল বলে পারেনি। প্রতিবারই যে পারবে না এমন তো নয়। তাই বলছি সময় থাকতেই কিছু একটা করো তুমি।”

তারানা এবারও নিরবতা পালন করলেন। কিছু একটা ভাবতে লাগলেন। রজনী বললেন,

“কী হলো? কী ভাবছো?”

“কিছু না। তুই কী বলতে এসেছিলি?”

“ওই পরী ছাদে থেকে দেখেছিল বাইরে লোকজন আবির মেখে ঘোরাঘুরি করছে। তাই বায়না করছিল বাইরে বের হওয়ার।”

“বাইরে বের হতে হবে কেন? চরণকে টাকা দিয়ে বল আবির এনে দিতে। কোথাও বের হবি না তোরা। যা করার ছাদে কর।”

“এই কথাগুলো যদি তুমি মোহিনীকেও বলতে পারতে আম্মা!”

“আমার মুখের ওপর কথা বলিস না তো। খুব বাড় বেড়েছিস তোরা। যা এখান থেকে।”

“যাচ্ছি।”

বলেই রজনী ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু তারানার মন থেকে চিন্তা দূর হলো না।
.
.
.
নিজের মনকে যতই শান্তনা দিক না কেন, তবুও আগের মতো স্বাভাবিক হতে পারছেন না পদ্মাবতী। কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছেন। আগের মতো সবার সাথে আনন্দ করছেন না। ব্যাপারটা মোহিনীর নজর এড়ায়নি।

“কী হয়েছে তোর বলতো আমাকে।”

মোহিনীর কথায় চমকে উঠলেন পদ্মাবতী। মোহিনী স্থিরদৃষ্টিতে পদ্মাবতীর দিকে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু পদ্মাবতী কিছুতেই তার চোখে চোখ রাখতে পারছেন না।

“কই? কিছু হয়নি তো। কী হবে আবার?”

“উহু, আমি খেয়াল করেছি। বাড়ির ভেতর থেকে বের হওয়ার পর থেকেই তুই যেন কেমন চুপচাপ মনমরা হয়ে আছিস। আনন্দ করছিস না আগের মতো। একা একা থাকার চেষ্টা করছিস। তাই বলছি ভালোয় ভালোয় আমাকে বলে দে কী হয়েছে।”

মোহিনীর কথায় পদ্মাবতী কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন। কিন্তু মোহিনীকে তা বুঝতে না দিয়ে হঠাৎ করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। হঠাৎ করে এভাবে হাসায় মোহিনী তাজ্জব বনে গেলেন।

“আজব তো। হাসছিস কেন গাধার মতো?”

হাসি থামিয়ে পদ্মাবতী বললেন,

“গাধাকে তুই কবে হাসতে দেখলি?”

“গাধাকে হাসতে দেখিনি কিন্তু তোকে দেখেছি। এবার বল হাসলি কেন ওভাবে?”

“তোর কথা শুনে। আজ-কাল কি চোখে বেশি দেখছিস নাকি তুই?”

“কেন?”

“তা নাহলে যা কেউ দেখছে না সেটা তুই কী করে দেখছিস?”

“তোকে কিছু জিজ্ঞেস করাই উচিত হয়নি। দাঁড়া, আমি বড়মাকে জানাচ্ছি। উনিই তোর পেট থেকে কথা বের করবেন।”

মোহিনী উঠে দাঁড়াতেই পদ্মাবতী তার হাত ধরে টান দিয়ে আবার বসিয়ে দিলেন।

“সবাই কি কম চিন্তায় যে তুই আবার তাদের নতুন করে চিন্তায় ফেলতে চাস? কিচ্ছু হয়নি আমার। ওসব তোর ভুল ধারণা। বস এখানে।”

পদ্মাবতী কিছু হয়নি বললেও মোহিনীর মন মানলো না। কিছু বলতে যাবেন তখনই শকুন্তলা দূর থেকে বললেন,

“রান্নাঘর থেকে মিষ্টির থালাগুলো নিয়ে আয় তো পদ্মা।”

“যাচ্ছি ছোটমা।”

পদ্মাবতী এক মুহুর্ত দেরি না করে চলে গেলেন। যেন মোহিনীকে এড়িয়ে যাওয়ারই একটা সুযোগ খুঁজছিলেন তিনি। মোহিনী আর কিছু বলতে পারলেন না। অর্ণবের দিকে তাকাতেই দেখলেন তিনি আগে থেকেই তার দিকে তাকিয়ে আছেন। একটা গাছের সাথে পা লাগিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কিছু একটা খাচ্ছেন। মোহিনীকে ইশারা করে ডাকতেই তিনি মুখ বাঁকিয়ে অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিলেন। ওদিকে পদ্মাবতীকেও মিষ্টির থালা নিয়ে আসতে দেখলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই মিষ্টিগুলো হাত থেকে পড়ে গেল তার। পায়ে হাতে দিয়ে চিৎকার করে বসে পড়লেন তিনি। সম্ভবত হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছেন। মোহিনী দৌঁড়ে কাছে যেতেই দেখলেন একটা গর্তে পা আঁটকে গিয়েছিল তার। পা’টা খুব বাজেভাবে মোচকে গেছে।

চলবে…

#মেহেরজান
#পর্ব-২৫
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

“চিত্রা, তোর কোনো কাজকর্ম নেই? কী বুঝে এখন রঙ্গোলি দিচ্ছিস?”

“রঙগুলো দেখে এমনিই একটু দিতে ইচ্ছে করলো মা। কোনো কাজ থাকলে বলুন। আমি করে দেবো।”

“স্নানঘরে দেখ কাপড় কেঁচে রাখা আছে বালতিতে। জলদি ওগুলো রোদে দিয়ে আয়।”

“আর একটু বাকি আছে মা। এটা শেষ করে এক্ষুনি যাচ্ছি।”

শকুন্তলা আর কিছু না বলে মাথা নাড়তে নাড়তে চলে গেলেন। চিত্রা পদ্মাবতীকে সিড়ি দিয়ে নামতে দেখে দৌঁড়ে গেলেন তাকে সাহায্য করতে। আজ অনেকদিন বাদে নিজের ঘর থেকে বেরোলেন পদ্মাবতী। ডাক্তারের কড়া নির্দেশ ছিল বিছানা থেকে ওঠা নিষেধ। তবে পা’টা এখন আগের তুলনায় ভালো আছে। বিশেষ করে শান্তি দেবীর বলে দেওয়া কৌশলে এক বিশেষ তেল মালিশ করার ফল এটা। আম্রপালি প্রতিরাতে তেলটা খুব যত্ন করে তার পায়ে মালিশ করে দিতেন।

“কী রে? কষ্ট করে উঠে এলি কেন? কিছু লাগলে আমাকে বলতি।”

“কিছু লাগবে না।”

“তাহলে?”

“আর কতদিন এভাবে বিছানায় শুয়ে-বসে থাকা যায় বল? কার ভালো লাগে?”

“পা ঠিক আছে?”

“আগের তুলনায় অনেক ভালো।”

“তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে গেলেই ভালো। আমরা সবাই যে ভয় পেয়েছিলাম যে আবার ভেঙে টেঙেই গেল নাকি।”

চিত্রা পদ্মাবতীকে নিচে নিয়ে এসে একটা মোড়ায় বসতে দিলেন।

“এখানে রঙ্গোলি কে দিল?”

“আমি দিয়েছি।”

“ওহহ। আজ মোহিনী আসেনি চিত্রা?”

“আসলে তো দেখতেই পেতি। তোর ঘরেই আগে যেত।”

“তাও ঠিক।”

“ওই দেখ, ওর কথা বলতে না বলতেই চলে এসেছে।”

মোহিনীকে আসতে দেখে বললেন চিত্রা। রঙ্গোলিতে পা ফেলার আগেই চিত্রা চিৎকার করে উঠলেন।

“দাঁড়া।”

মুহুর্তেই নিজের পা পিছিয়ে নিলেন মোহিনী।

“এই ভরদুপুরে এখানে রঙ্গোলি দিল কে?”

“চিত্রা দিয়েছে।”

“তোর কী আর কোনো কাজ নেই চিত্রা?”

চিত্রা জবাব দিলেন না। পদ্মাবতীর উদ্দেশ্যে বললেন,

“স্নানঘরে কাপড় কেঁচে রাখা আছে। তুই এখানেই বস। আমি ওগুলো ছাদে দিয়ে আসি।”

চিত্রা চলে গেলে মোহিনী ইশারায় পদ্মাবতীকে জিজ্ঞেস করলেন চিত্রার কী হয়েছে। জবাবে তিনি শুধু কাঁধ ঝাঁকালেন।

“তুই নিচে কী করছিস? পা ঠিক হয়ে গেছে?”

“আগের চেয়ে ভালো।”

মোহিনী পদ্মাবতীর গালে হাত রেখে বললেন,

“তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যা। কত্তোদিন আমরা একসাথে বের হই না।”

“আর ক’দিন বাদেই যেতে পারবো।”

“তুই থাক। আমি বড়মার সাথে দেখা করে আসি।”

পদ্মাবতী মাথা নাড়লেন। মোহিনীকে দোতলায় উঠে যেতে দেখলেন। এবাড়িতে শান্তি দেবী আর অনুরাধা বাদে প্রায় সবার ঘরই দোতলায়। তবে মোহিনীকে আম্রপালির ঘরের দিকে না গিয়ে তার উল্টো দিকে যেতে দেখলেন। বুঝতে অসুবিধা হলো যে মোহিনী আম্রপালির সাথে দেখা করার কথা বললেও এখন অর্ণবের সাথে দেখা করতে যাচ্ছেন। পদ্মাবতীর কেন যেন প্রচন্ড খারাপ লাগতে শুরু করলো। নিজেকে সামলাতে না যত দ্রুত সম্ভব ছুটে গেলেন শান্তি দেবীর ঘরে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। চোখে চশমা না থাকায় ঠিকমতো দেখতে পেলেন না শান্তি দেবী। “কে কে” বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। ফলস্বরূপ পদ্মাবতীর কান্নার গতি আরও বেড়ে গেল।

“কে কাঁদে? পদ্মা, তুই নাকি? ওমা, কাঁদছিস কেন ওভাবে? পায়ে কি আবার ব্যথা করছে নাকি?”

পদ্মাবতী জবাব দিলেন না। শান্তি দেবী আবার বললেন,

“কী হয়েছে বলবি তো?”

“কিছু হয়নি।”

“কষ্ট পেয়েছিস কারও কথায়?”

“না।”

“তবে?”

“চুপ বুড়ি। এতো কথা কেন বলিস? চোখ তো গেছেই, এবার কিন্তু ঠোঁট দুটোও সেলাই করে দেবো।”

“ওমা, রাগছিস কেন? কী হয়েছে বল আমায়।”

“বললাম না কিছু হয়নি।”

“তাহলে এমনি এমনিই কাঁদছিস?”

“হ্যাঁ, এমনি এমনিই কাঁদছি।”

“বুড়ি হয়ে গেছি বলে কি তোরা আমাকে পাগল ভাবিস নাকি? এমনি এমনি কেউ কাঁদে?”

“আমি কাঁদি। আর একবার যদি জিজ্ঞেস করো কেন কাঁদছি তাহলে আর কোনো দিনও মুখ দেখাবো না আমার।”

পদ্মাবতী দৌঁড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। তার দৌঁড়ে চলে যাওয়ার সময় নুপুরের আওয়াজটাই শুধু শুনতে পেলেন শান্তি দেবী।

“একি কথা মেয়ের? পদ্মা, কই গেলিরে? আরে ও পদ্মাবতীই।”

কারও সাড়াশব্দ পেলেন না শান্তি দেবী। কপালে কতগুলো চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো তার।
.
.
.
ছাদে থেকে নামার সময় অর্ণবের ঘর থেকে মোহিনীকে বের হতে দেখলেন চিত্রা। সামনে এগিয়ে গিয়ে বললেন,

“দাঁড়া মোহিনী।”

মোহিনী তৎক্ষনাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন।

“কিছু বলবি?”

“কই গিয়েছিলি?”

“বড়মার ঘরে যাচ্ছিলাম।”

“কই যাচ্ছিস জিজ্ঞেস করিনি। কই গিয়েছিলি জিজ্ঞেস করেছি।”

চিত্রার কণ্ঠটা একটু অন্যরকম শোনালো মোহিনীর কাছে।

“অর্ণবের ঘরে গিয়েছিলাম। শমিতদা একটা কাজে ডাকতে বলেছে ওনাকে।”

“কাকে বোকা বানাচ্ছিস তুই?”

“মানে?”

“আমার সামনে নাটক করিস না মোহিনী। দাদা আর তোর মাঝে কী চলছে খুব ভালোমতোই দেখতে পাচ্ছি আমি। শমিতদাকে দিয়ে তো চিঠিও আদান-প্রদান করিয়েছিস। কী ভেবেছিলি? কেউ জানবে না?”

মোহিনী কোনো জবাব দিলেন না।

“খুব ভালোই তো ফাঁসিয়েছিস আমার ভাইকে। তুই কী আর তোর যোগ্যতা কী সেটা ভুলে যাস না। তাই এখনই সাবধান হয়ে যা।”

মোহিনী চুপচাপ তার কথাগুলো শুনে গেলেন। চিত্রা চলে গেলেন কিন্তু তার বলা শেষের কথাগুলো হজম করতে পারলেন না মোহিনী। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নিচে নেমে এলেন। চলে যাওয়ার সময় সামনে চিত্রার করা রঙ্গোলিটা পড়লো। সাথে সাথে পা দিয়ে নষ্ট করে দিলেন পুরোটা। এতে যেন তার রাগ কিছুটা হলেও কমলো। মোহিনী চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে চিত্রা এসে দেখা মাত্রই চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিলেন।

“কে করলো এটা? কতো কষ্ট করে দিয়েছিলাম আমি। কার সাহস হলো এতো?”

তার চেঁচামেচি শুনে সবাই সেখানে উপস্থিত হলেন। শকুন্তলা বললেন,

“এতো চেঁচাচ্ছিস কেন? কী হয়েছে?”

চিত্রা চড়া গলায় জবাব দিলেন,

“দেখতে পারছেন না? কে যেন আমার দেওয়া রঙ্গোলিটা নষ্ট করে দিয়েছে।”

আম্রপালি ধমকের সুরে বললেন,

“চিত্রা, মায়ের সাথে কীভাবে কথা বলছিস?”

চিত্রা চুপ করে রইলেন।

“বেড়াল টেরাল ঢুকেছিল হয়তো। ওটায়-ই নষ্ট করেছে। তুই রাগ করিস না। আমি তোকে আবার দিয়ে দেবো সুন্দর করে।”

“লাগবে না। আপনার পছন্দের বেড়ালই করেছে এটা। আমি জানি কার কাজ এটা।”

“মানে? কে করেছে?”

“কে আবার? আপনার আদরের মোহিনী।”

“ও এমন করবে কেন শুধু শুধু?”

“সেটা ওকেই জিজ্ঞেস করবেন।”

চিত্রা রাগ দেখিয়ে চলে গেলেন। পদ্মাবতী সেখানেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। বললেন,

“আমি আবার দিয়ে দিচ্ছি বড়মা।”

“থাক। ওই পা নিয়ে তোকে আর কষ্ট করতে হবে না। একটু পরই দেখবি ওর রাগ চলে গেছে।”

দোতলায় চোখ পড়তেই দেখলেন অর্ণব দাঁড়িয়ে আছেন। পদ্মাবতীকে ইশারায় ওপরে আসতে বলে ঘরে গেলেন তিনি। এই পা নিয়ে বারবার সিড়ি বেয়ে ওঠানামা করাটা আসলেই কষ্টসাধ্য। তবুও পদ্মাবতী ধীরে ধীরে ওপরে উঠে এলেন। অর্ণবের ঘরে আসতেই দেখলেন অর্ণবের হাতে একটা ইংরেজি বই। ভাবলেন এই লোকটা কি সবসময়ই বই পড়েন? নাকি তিনিই এমন সময় এ ঘরে আসেন?

“চিত্রা আর মোহিনীর মাঝে ঝগড়া হয়েছে?”

“এমন কিছু তো দেখিনি। ঝগড়া হলে আমি নিশ্চয়ই জানতাম।”

“তাহলে চিত্রা মোহিনীর ওপর রেগে আছে কেন?”

“জানি না। আজ দুপুরেও ঠিকমতো কথা বলেনি।”

“কেন?”

“তাও জানি না।”

“তাহলে জানোটা কী?”

পদ্মাবতী মাথা নিচু করলেন।

“আচ্ছা, তুমি যাও এখন।”

“শুধু এটা জিজ্ঞেস করার জন্য ডেকেছিলেন?”

“আর কিছু জিজ্ঞেস করার মতো তো কিছু মনে পড়ছে না আমার। তোমার পড়ছে?”

পদ্মাবতী নাবোধক মাথা নাড়লেন। বললেন,

“নিচে থাকতেই তো জিজ্ঞেস করতে পারতেন। আমি এতো কষ্ট করে আবার সিড়ি দিয়ে উঠলাম।”

“নিজের ঘরে যেতে সেই সিড়ি দিয়েই উঠতে হতো তোমায়। এখন ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও।”

প্রতিত্তোরে পদ্মাবতী শুধু একদিকে মাথা কাত করলেন।

চলবে…

মেহেরজান পর্ব-২২+২৩

0

#মেহেরজান
#পর্ব-২২
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

প্রতিদিনের মতো আজও বিন্দু বিন্দু শিশির জমা দূর্বার ওপর থেকে শিউলি কুড়িয়ে নিচ্ছেন পদ্মাবতী। চোখ তুলে সামনে তাকাতেই দেখলেন কুয়াশার চাদর ভেদ করে ক্রমশ একটা অবয়ব এগিয়ে আসছে তার দিকে। উঠে দাঁড়ালেন তিনি। অবয়বটি ঘাসের ওপর পড়ে থাকা শিশিরভেজা শিউলিগুলো মারিয়ে একদম সামনে চলে আসতেই সেই চিরচেনা মুখটা ভেসে উঠলো পদ্মাবতীর সামনে। দিঘির জলের মতো শান্ত মনটা হঠাৎ করেই স্রোতস্বিনীর মতো অস্থির হয়ে উঠলো। মনে হাজারো কথা জমিয়ে রেখেও মুখে কিছু প্রকাশ করতে পারছেন না তিনি। অর্ণবকে স্পর্শ করার উদ্দেশ্যে হাত বাড়াতেই কোথা যেন বালতি ভরা জল এসে পড়লো তার ওপর। মুহুর্তেই সব ওলট-পালট হয়ে গেল। বিছানা থেকে “মাগো” বলে লাফিয়ে উঠলেন তিনি। গায়ে থেকে জল ঝারতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সামনে মোহিনীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সব পরিষ্কার হয়ে গেলো তার কাছে যে কী হয়েছিল কিছুক্ষণ আগে। গায়ে মোটা কম্বল জড়িয়ে বেশ আরাম করে ঘুমাচ্ছিলেন তিনি। মোহিনী এসে একটা পাত্র ভরে জল ঢেলে দিয়েছেন তার ওপর। গায়ের শাড়িটা খুব এলোমেলো হয়ে আছে। তা-ই ঠিক করতে করতে বললেন,

“কী করল তুই এটা?”

“আমার কোনো দোষ নেই। আমি তো আরও ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তুই মরে গেছিস ভেবে। জানিস কত্তোবার ডেকেছি তোকে?”

“তাই বলে এভাবে জল ঢেলে দিবি? তাও এমন শীতে?”

“এখন আর এমন কী শীত?”

পদ্মাবতী জানালা খুলে দিতেই একটা হিম করা শীতল বাতাস এসে গায়ে লাগলো তার। একে তো ভেজা গা, তার উপর এমন বাতাসে যেন জমে গেলেন তিনি। কয়েকবার দাঁতে দাঁত লেগে এলো। বাইরে তাকালেন তিনি। কুয়াশায় সব ঢেকে আছে। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না।

“বাইরে কিছু দেখা যাচ্ছে না আর তুই বলছিস শীত নেই?”

“আছে কিন্তু তেমন একটা না। এমনিতেই শীত চলে যাচ্ছে। তাই চল বাইরে গিয়ে পরিবেশটা একটু উপভোগ করে আসি।”

পদ্মাবতী ঘড়ির দিকে তাকালেন। ছয়টা বাজে। বললেন,

“তোর মেজাজ বেশ ফুরফুরে মনে হচ্ছে। ছয়টা বাজে কেবল। এতো সকালে কই যেতে চাস তুই?”

“যেখানে ইচ্ছে করবে। জায়গার অভাব নাকি এখানে?”

“আরেকটু ঘুমাতে দে না মোহিনী।”

“আচ্ছা, ঘুমা তুই।”

পদ্মাবতী অবাক হলেন। এতো সহজে মেনে নেওয়ার মেয়ে নয় মোহিনী। তাহলে কারণ কী? পদ্মাবতী বিছানার দিকে তাকাতেই দেখলেন শোয়ার জায়গাটা একদম ভিজে গেছে।

“বিছানা তো দিয়েছিস একদম ভিজিয়ে। এখন তো বলবিই ঘুমাতে। দাঁড়া একটু। আমি শাড়ি পাল্টে আসছি।”

পদ্মাবতী শাড়ি পাল্টে আসতেই দু’জনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন।

ঘন কুয়াশা ভেদ করে এগিয়ে চলেছেন দু’জনে। যতই এগুচ্ছেন, রাস্তা ততই দৃশ্যমান হচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে বাজারের দিকটায় চলে এসেছেন। বাজারের একদম মাঝখানে বিশাল বড় বটগাছটার চারপাশে গোল করে ইট-সিমেন্ট দিয়ে বাধাঁনো চত্বরের ওপর একটা পাগল শীতে কাচুমাচু করে শুয়ে আছে। সারাদিন বাজারেই ঘুরে বেড়ায় আর রাতে এই গাছটার নিচে ঘুমায়। দোকানপাট তেমন একটা খোলেনি এখনো। একটা টঙের দোকান আর একটা ভাপা আর চিতই পিঠার দোকান খুলেছে মাত্র। টঙের দোকানে বসে কতগুলা লোক চা খাচ্ছিলেন। মোহিনী আর পদ্মাবতীকে আসতে দেখে কিছু সময় তাদের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার নিজেদের কাজে মনোনিবেশ করলেন তারা। পিঠার দোকানে একজন বৃদ্ধা বসে বসে পিঠা বানাচ্ছেন আর পাশে বসে থাকা বৃদ্ধ লোকটা সেগুলো ক্রেতাদের দিকে এগিয়ে দিচ্ছেন। লোকজনগুলো সেখানে বসেই মরিচ, কালোজিরা, ধনিয়া, সরিষার মতো বিভিন্ন বাটা দিয়ে গরম গরম ভাপ ওঠা চিতই খেতে ব্যস্ত। পদ্মাবতী বললেন,

“ইশশশ, আগে জানলে সাথে করে টাকা নিয়ে আসতাম। খেতে ইচ্ছে করছে খুব।”

“উড়ে তো যাচ্ছে না কিছু। পরে এসে খাস।”

“তাও ঠিক।”

“দৌঁড় লাগাবি পদ্মা? আগে যেমন লাগাতাম?”

“এখন?”

“হ্যাঁ, সেই কৃষ্ণচূড়া গাছটা শেষ সীমানা।”

মোহিনী আর কথা না বাড়িয়ে দৌঁড়াতে শুরু করলেন। উপায় না পেয়ে পদ্মাবতীও তার পেছন পেছন দৌঁড় লাগালেন। শাড়ি পরে দৌঁড়ানোটা তার কাছে একটু কষ্টসাধ্যই বটে। বেশ অনেকটা রাস্তা দৌঁড়ে কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে এসে থেমে পড়লেন মোহিনী। প্রতিবারের মতো এবারও তিনিই জিতলেন। হাঁপাতে হাঁপাতে গাছের নিচে থাকা বাঁশের তৈরি বেঞ্চে বসে পড়লেন। কিছুক্ষণের মধ্যে পদ্মাবতীও চলে এলেন। থেমেই হাঁপাতে শুরু করলেন।

“তুই আমার সাথে কোনোদিনও পেরে উঠলি নারে পদ্মা।”

“তুই সবসময় আমার শাড়ি পরার সুযোগ নিস। এটা পরে এতো জোরে দৌঁড়ানো যায় নাকি?”

“থাক, আর অজুহাত দিস না।”

“একদম অজুহাত দিচ্ছি না।”

পদ্মাবতী মোহিনীর পাশে বসে পড়লেন। বসে বসে এদিক-ওদিক চোখ ঘোরাতে লাগলেন মোহিনী। কুয়াশা আগের তুলনায় এখন অনেকটা কমে গেছে। দূরে কতগুলো বাচ্চা গোল হয়ে বসে আগুন পোহাচ্ছে। উদাম গায়ে কাঁপতে কাঁপতে হাত দুটো গরম করে পুরো শরীরে উষ্ণতা ছড়ানোর বৃথা চেষ্টা করছে তারা। পদ্মাবতী বললেন,

“অনেক হাঁপিয়ে গেছি। জল খাবো।”

“এখন কোথায় জল পাবি তুই?”

পদ্মাবতী এদিক-ওদিক তাকালেন। কাউকে আসতে দেখলেন এদিকে। বললেন,

“জল না পেলাম। রস খেয়েই না হয় তৃষ্ণা মেটাই।”

লোকটা যখন আরেকটু কাছে আসলো, মোহিনী দেখলেন রোগাপটকা একটা ছেলে। তার চেয়ে ছোটই হবে। সামনে আসতেই পদ্মাবতী তার উদ্দেশ্যে বললেন,

“এখন নিয়ে আসলে গাছ থেকে?”

ছেলেটা পদ্মাবতীর চেনা। তিনি বললেন,

“হ্যাঁ, মাত্রই পেরে আনলাম হাড়ি দুটো।”

“আমাদের একটু দিয়ে যাও। অনেক তেষ্টা পেয়েছে।”

ছেলেটা তাদের হাতে মাটির পেয়ালায় খেজুরের রস এগিয়ে দিতেই দুজনে ঢকঢক করে খেয়ে ফেললেন। পদ্মাবতী বললেন,

“এখন সাথে করে টাকা আনিনি। বিকেলে বাড়িতে এসে তোমার দামটা নিয়ে যেও। পারবে তো?”

“আচ্ছা দিদি। আপনাদের তো আমি চিনিই। কোনো সমস্যা নেই।”

“ঠিকাছে।”

ছেলেটা চলে যেতেই মোহিনী উঠে দাঁড়ালেন।

“কী হলো?”

“বসে থাকতে ভাল্লাগছে না।”

“ফিরে যাবি?”

“কী করবো আর?”

“আমাকে নিয়ে এলি কেন তাহলে? জানতাম তুই এমনই করবি।”

“ঠিকাছে। আর রাগিস না। পরে যাবো বাড়িতে। চল নদীর দিকটায় যাই।”

পদ্মাবতী কিছু সময় মোহিনীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। এরপর চেঁচিয়ে বললেন,

“ভাল্লাগে না আমার। তোর সকাল সকাল কোনো কাজকর্ম নেই তাই এমন শুরু করেছিস। সাথে আমাকেও জ্বালাচ্ছিস। একবার এখানে যাই আবার ওখানে যাই। কোথাও একটু ঠিকমতো বসে থাকতেও দিচ্ছিস না। এখন নদীতে যাবি কী করতে?”

“তোকে মাঝ নদীতে ফেলে দিয়ে মেরে ফেলতে যাবো।”

মোহিনী পদ্মাবতীর হাত ধরে টানতে টানতে তাকে নিয়ে গেলেন।

নদীর জল অনেকটা কমে গেছে। জলে পা ভিজিয়ে ঘাটে বসে রয়েছেন মোহিনী। তার থেকে অনেকটা দূরে পদ্মাবতী বসে আছেন। ইচ্ছে করেই মোহিনীর থেকে দূরে বসেছেন তিনি। কারণ তিনি জানেন মোহিনী চাইলেই সত্যি সত্যি তাকে নদীতে ফেলে দিতে পারেন। মোহিনীর মধ্যে আজ একটা অস্থিরতা কাজ করছে। যা অন্যান্য দিনের থেকে আলাদা। পদ্মাবতীর চোখে সেটা ঠিকই ধরা পরেছে। কিন্তু এর কারণটা বুঝতে পারছেন না তিনি। মোহিনী পেছনে ঘুরে পদ্মাবতীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলেন। পদ্মাবতীও তার উদ্দেশ্যে একটা হাসি ফিরিয়ে দিলেন।
.
.
.
স্নান সেরে ছাদে বসে সকালের মিষ্টি রোদ পোহাচ্ছেন চিত্রা। শ্যামলের সাথে দেখা হয় না তাও অনেকদিন হলো। আজ যে করেই হোক দেখা করতে হবে। কীভাবে দেখা করা যায় তারই পরিকল্পনা করতে ব্যস্ত এখন তিনি। হঠাৎ শকুন্তলার ডাক শুনতে পেলেন। সেই ডাকে সাড়া দিলেন তিনি।

“আসছি মা।”

কথাটা বলেই উঠে পড়লেন চিত্রা। ছাদে থেকে নেমে শমিতের ঘরের সামনে দিয়ে আসতেই দরজার কোণায় একটা ভাজ করা কাগজ পড়ে থাকতে দেখলেন। সেটা তুলে নিয়ে খুলে পড়তেই চোখ বড় বড় হয়ে গেল চিত্রার। একটা চিঠি। মোহিনীর উদ্দেশ্যে লেখা অর্ণবের চিঠি। চিত্রার বুঝতে সমস্যা হলো না যে শমিত এব্যাপারে সব জানেন। বর্তমানে তাদের যোগাযোগের মাধ্যম শমিত। এভাবে আরও কত চিঠি শমিত আদান-প্রদান করেছেন তা জানেন না চিত্রা। তবে এটাই যে প্রথম নয় সে ব্যাপারে নিশ্চিত। সাথে সাথে কাগজটা আবার ভাজ করে নিজের কাছে লুকিয়ে ফেললেন তিনি। এটাই হয়তো ছিল আজ মোহিনীর এতো চঞ্চলতার কারণ। হয়তো মোহিনীর অজান্তেই চিঠিটা এখানে পড়ে গেছে।

চলবে…

#মেহেরজান
#পর্ব-২৩
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

গাছের ঝরা পাতাগুলো পাঁকা রাস্তার উপরে বেশ মোটা একটা আস্তরণ তৈরি করেছে। তার ওপর দিয়ে হাঁটলেই শুকনো পাতার মড়মড় আওয়াজ হচ্ছে। রাস্তার পাশের অধিকাংশ গাছগুলোতেই এখন একটা পাতাও নেই। কেমন একটা অপূর্ণ মনে হচ্ছে। তবে কিছু গাছের নতুন আসা কচি পাতাগুলো যেন তা কিছুটা হলেও আড়াল করতে পেরেছে। মোহিনী আর এদিক-ওদিক না তাকিয়ে দ্রুত পা ফেলে হাঁটতে শুরু করলেন। ওইতো, সামনেই অর্ণবদের বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। গেইটের দুই ধারের ফুলে হলুদ হয়ে যাওয়া রাধাচূড়া গাছ দুটো দেওয়ালের ওপার থেকে উঁকি দিচ্ছে। যেন কারও আসার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। মোহিনীর মনে হচ্ছে এবাড়িতে আসার রাস্তাটা যেন দিন দিন আরও দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। সে যতই কাছে আসে, বাড়িটা যেন আরও দূরে সরে যায়। রাস্তাটা শেষই হতে চায় না। বাগান অতিক্রম করে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই দেখলেন আম্রপালি যেন কার সাথে টেলিফোনে কথা বলছেন। মোহিনীকে দেখে মুচকি হাসলেন। মোহিনী কাছে আসতেই টেলিফোনটা নামিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে নিচু স্বরে বললেন,

“ঠিক সময় এসেছিস। রান্নাঘরে দেখ লাড্ডু বানিয়ে রেখেছি। ওটা নিয়ে সোজা পদ্মার ঘরে চলে যা।”

“কার জন্য রেখেছেন?”

“তোর জন্যই।”

“কিভাবে জানলেন আমি আজ আসবো?”

“ওইভাবেই। এখন যা।”

মোহিনী চলে গেলে আম্রপালি আবার টেলিফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মোহিনী রান্নাঘরে এসে দেখলেন আম্রপালি একটা থালা ভরে লাড্ডু রেখে দিয়েছেন। এরপর নিজেই বিড়বিড় করতে লাগলেন।

“এতোগুলো লাড্ডু আমার জন্য? মানলাম আমি খেতে পছন্দ করি তাই বলে এতোগুলো? বড়মা কি আমার খাওয়া নিয়ে খোঁটা দিলেন? ধুর, একটু বেশিই ভাবি আমি। কম রাখলে তো পরে আমি নিজেই বলতাম আরেকটু বেশি রাখতে পারলেন না?”

মোহিনী একটা লাড্ডু মুখে পুরে দিয়ে থালাটা নিয়ে সোজা দোতলায় চলে গেলেন।

পড়ন্ত বিকেলের আলো এসে লাগছে পদ্মাবতীর মুখে। চোখ দুটো ছোট ছোট করে জানালার পাশে রাখা টেবিল চেয়ারে বসে গাছে কয়টা নতুন পাতা এলো তা খুব মনোযোগ সহকারে গুনছেন তিনি। কাজকর্ম না থাকলে সময় পার করার একটা দারুণ পন্থা। বেশ কয়েকদিন ধরে মোহিনী আসছেন না। অবশেষে সময় কাটানোর জন্য এই রাস্তাটাই বের করেছেন পদ্মাবতী। সামনের শিমুল গাছটায় একটা বেনেবউ এসে বসেছে। অনেক সময় পরে এই পাখিটাকে আবার দেখলেন পদ্মাবতী। পরক্ষণেই ভাবতে লাগলেন কেউ কি আসবে বাড়িতে? কে আসতে পারে? অর্ণব? না, তিনি আসতেও এখনো অনেকদিন বাকি। তবে? হঠাৎ কেউ টেবিলে লাড্ডুর থালাটা রাখতেই চমকে উঠলেন পদ্মাবতী।

“লাড্ডু!”

উচ্ছ্বসিত হয়ে থালার দিকে হাত বাড়াতেই কেউ হাতে আঘাত করলেন। ঘুরে তাকাতেই দেখলেন মোহিনী।

“তোর জন্য নয় এগুলো।”

“মানে? তাহলে কার জন্য?”

“আমার জন্য।”

“তোর জন্য তাহলে তুই আমার ঘরে কেন নিয়ে এসেছিস?”

“বড়মাই তো বললেন।”

করুণ চোখে মোহিনীর দিকে তাকিয়ে বললেন,

“আমাকে রেখে একা একা খেতে পারবি তুই?”

মোহিনী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,

“এভাবে তাকাস না তো তুই। এভাবে তাকিয়ে তুই আমাকে দিয়ে যা খুশি তাই করাতে পারিস। এই যেমন এখন ইচ্ছে না থাকা স্বত্তেও তোর সাথে ভাগাভাগি করে খেতে হচ্ছে।”

মোহিনীর কথা শেষ হতে না হতেই পদ্মাবতী খাওয়া শুরু করলেন।

“খাচ্ছে কীভাবে দেখো। আস্ত একটা রাক্ষসী। আর সবাই বলে আমি নাকি বেশি খাই।”

“এসব কথা বাদ দে তো। আগে বল, বেঁচে আছিস তুই?”

“বেঁচে না থাকলে এখন কি আমার ভূতের সাথে কথা বলছিস তুই?”

“বেঁচে আছিস তাহলে। আমি তো ভেবেছিলাম মরেই গেছিস। একটা নয়, দুটো নয়, পুরো তেরোটা দিন! কোথায় ছিলি এতোদিন?”

“বাড়িতেই।”

“একবারে জন্যও আসলি না তাই? আমার সাথে কথা না বলে তুই থাকিস কী করে বলতো। আমার যে কী অবস্থা হয়েছিল জানিস তুই? কোনো কাজ-কর্ম নেই। বড়মার কাছে যাই, তিনিও কিছু করতে দেন না। ছোটমাও কিছু বলেন না। আর পিসিমা তো পিসিমাই। কারও সাথে ঠিক মতো কথা বলতে পারি না। চিত্রাকে খুঁজেও পাওয়া যায় না। শেষে উপায় না পেয়ে গাছের পাতা গুনতে শুরু করেছি।”

“ক’টা হলো?”

“কী ক’টা হলো?”

“গাছের পাতা?”

“গুনছিলামই তো। কিন্তু মাঝে তুই এসেই তো সব গুলিয়ে দিলি।”

“পরে আবার গুনে নিস। এখন চল ছাদে যাই। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ কর।”

দুজনে তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে দ্রুত ছাদে উঠে এলেন। ছাদে রাখা চন্দ্রমল্লিকার গাছগুলো ফুলে একদম ভরে গেছে। ছাদের এক কিনারে এসে বসলেন তারা। কোথায় থেকে কোকিলের কুহুতান ভেসে আসছে। সেই সাথে কোকিলের ডাক নকল করে আরও একটা আওয়াজ। বসন্ত যে এসে গেছে তা জানান দিতে কোকিলের ডাকটাই যথেষ্ট। দূর থেকে শমিতকে আসতে দেখে পদ্মাবতী বললেন,

“শমিতদা আর শেফালীর প্রেমতো ভালোই চলছে মনে হয়। এখন নিশ্চিত ওর সাথেই দেখা করে ফিরছে।”

“তুই কবে জানলি ওদের প্রেমের কথা?”

“অনেক আগেই।”

“জেনেছিস এটাই অনেক। তুই তো আবার চোখ থাকতেও অন্ধ। না বললে কিছু বুঝিসই না।”

“যাই হোক, খুব তাড়াতাড়িই মনে হয় একটা বিয়ের অনুষ্ঠান দেখতে পাবো আমরা।”

“কাদের বিয়ে?”

“কাদের আবার? শমিতদা আর শেফালীর।”

“তোর মনে হয় পিসিমা ওদের বিয়ে হতে দেবেন?”

“দেবেন না কেন?”

“তা জানি না। তবে আমার মনে হয় না হতে দেবেন। উনি তো পারলে শমিতদাকে কোনোদিন বিয়ে না করিয়ে নিজের আঁচলের সাথেই বেঁধে রাখেন।”

“হবে কি হবে না তা ভগবানই ভালো জানেন। আমরা শুধু ওদের জন্য প্রার্থনাই করতে পারি।”

“তাহলে তাই কর।”

হঠাৎ দূরে অনেক লোকজনকে একসাথে দেখে পদ্মাবতী বলে উঠলেন,

“ওখানে এতো লোকজন কেন?”

“কিজানি। দেখে তো মনে হচ্ছে শবযাত্রা।”

“কে মরলো আবার?”

“বুঝতে পারছি না।”

চিত্রা পেছন থেকে বললেন,

“তোরা এখানে দাঁড়িয়ে আছিস? আর আমি সারা বাড়ি খুঁজে মরছি। জেঠিমা ডাকছেন তোদের। নিচে চল।”

দ্রুত পেছনে ঘুরলেন দু’জনে। চিত্রা কখন এসেছেন তারা টেরই পাননি। হয়তো এইমাত্রই এসেছেন। পদ্মাবতী বললেন,

“কে মারা গেছেরে চিত্রা? তুই জানিস কিছু? কার যেন শবযাত্রা যাচ্ছে।”

“শেফালীর বোন আছে না মিতালি? ওরই শবযাত্রা।”

“কী?! মিতালি মারা গেছে? হঠাৎ? কীভাবে হলো?”

“এতো মায়া দেখাস না। মায়া দেখানোর মতো কোনো কাজ ও করেনি। পেটে বাচ্চা নিয়ে আত্মহত্যা করেছে।”

মোহিনী বললেন,

“মানে? কী বলছিস এসব?”

“ঠিকই বলছি। কে জানে কোন ছেলের সাথে ফষ্টিনষ্টি করে পেটে বাচ্চা এনেছে। এখন বিয়ে করেনি দেখে উপায় না পেয়ে বিষ খেয়েছে। নষ্টা মেয়ে একটা।”

পদ্মাবতী বললেন,

“তোরা যাবি আমার সাথে একবার দেখতে?”

চিত্রা উচ্চস্বরে বললেন,

“ভুলেও না। একদম যাবি না তোরা কেউ।”

“কেন?”

“শমিতদা গিয়েছিল। একটু আগে ওখান থেকেই এলো। পিসিমা খুব রেগে আছেন শমিতদার ওপর। কথাও শুনিয়ে দিয়েছেন কতগুলো।”

“তাহলে আর কী করার। ছেলেটার কোন খোঁজ খবর জানিস যে কে করলো এটা?”

“ও এই পাড়ার না। তাই চিনিও না তেমন।”

“কোনো শাস্তি হয়নি?”

“ছেলে তো সম্পুর্ণ অস্বীকার করে দিয়েছে। শেফালীর বাবা-মাও আর থানা-পুলিশের ঝামেলায় যেতে চায়নি বলে তাড়াতাড়ি লাশ নিয়ে যাচ্ছে শ্মশানে।”

পদ্মাবতী আফসোস করে বললেন,

“অল্পবয়সী একটা মেয়ে। কত বড় ভুলটাই না করলো।”

“তোরা নিচে চল এখন তাড়াতাড়ি।”

“তুই যা। আমরা আসছি।”

চিত্রা চলে যেতেই পদ্মাবতী বললেন,

“মিতালির জন্য আসলেই খারাপ লাগছে। একজন ভুলের মাশুল চুকাতে চিতায় উঠলো। আরেকজন দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। ক’দিন পর বিয়ে করে সুখে শান্তিতে সংসারও করবে।”

“ছাড়তো ওদের কথা। যেমন কর্ম তেমন ফল। পাপের শাস্তি দুজনেই পাবে দেখিস।”

“তা-ই ভালো। মাঝখান থেকে একটা নিষ্পাপ প্রাণ চলে গেল। বাচ্চাটার কী দোষ ছিল বলতো?”

“দোষ না থাকলেও ওকে সবাই পাপের ফলই বলতো। ভালোই তো হয়েছে, জন্মানোর আগেই মরে গেছে।”

“এমন ভাগ্য যেন আর কারও না হয়। শেফালী আর ওর বাবা-মায়ের কী অবস্থা এখন ভাব একবার।”

“পরে কোনো সময় গিয়ে একবার দেখা করে আসিস। এখন নিচে চল। কে জানে বড় মা কেন ডাকছেন।”

মোহিনী হাঁটতে শুরু করলেন। তার পেছন পেছন পদ্মাবতীও চলে এলেন। নিচে আসতেই আম্রপালি বললেন,

“মোহিনী, তোকে আমি বলেছিলাম তোর জন্য রান্নাঘরে লাড্ডু রেখে দিয়েছি আলাদা করে। তুই ওটা রেখে কোনটা নিয়েছিস?”

“কেন? আপনি যেটা বলেছিলেন সেটাই তো নিয়েছিলাম। বড় একটা থালায় করে সাজিয়ে রেখেছিলেন।”

“তুই ওই থালার সব খেলে ফেললি?”

“আমি একা খাইনি তো। পদ্মাও খেয়েছে আমার সাথে। কিন্তু কী হয়েছে সেটা তো বলুন।”

আম্রপালি মোহিনীকে একটা বাটি দেখালেন। সেখানে আরও বেশ কয়েকটা লাড্ডু রাখা।

“আমি এটার কথা বলেছিলাম তোকে। আর তুই এটা রেখে বাকি সব নিয়ে গিয়েছিস।”

“রান্নাঘরে তো ওই থালাটাই ছিল বড়মা।”

“ওটার পাশে এটাও ছিল। ঢেকে রেখেছিলাম। তোর মনে হয় ওতোগুলো লাড্ডু একসাথে একা একজন মানুষের পক্ষে খাওয়া সম্ভব যে আমি ওতোগুলো রাখবো?”

“একবার মনে হয়েছিল। কিন্তু অন্যের খবর জানি না, আমার পক্ষে তো সম্ভব। তাই ভেবেছিলাম ওটাই হয়তো। আমার কী দোষ?”

“উফ, তোকে নিয়ে আর পারলাম না। এখন আমাকে আবার সব বানাতে হবে।”

“আপনি এতো চিন্তা করবেন না তো বড়মা। পদ্মা আছে কী করতে? আপনাকে কিচ্ছু করতে হবে না। সব পদ্মা বানিয়ে দিবে।”

মুহুর্তেই পদ্মাবতীর চোখ বড় বড় হয়ে গেল। মোহিনীকে চিমটি দিয়ে কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন,

“এই, কী বলছিস তুই এসব? আমি এতোগুলো লাড্ডু কীভাবে বানাতে পারবো?”

“এমন ভাব করছিস যেন না জানি কতগুলো। কেন? খাওয়ার আগে মনে ছিল না? খাওয়ার সময় তো ঠিকই আমার সাথে পাল্লা করে খেলি।”

“তাই বলে এভাবে ফাঁসাবি?”

আম্রপালি বলে উঠলেন,

“তোরা ফিসফিস করে কী কথা বলছিস এতো?”

“তেমন কিছু না বড়মা। আজ পদ্মা বলছিল ওর নাকি কোনো কাজকর্ম নেই। আপনারা কেউ কিছু করতে দেন না। ওর এভাবে বসে থাকতে ভাল্লাগে না। তাই এখন একটা কাজ পেয়ে খুশিই হয়েছে।”

“তুই তাহলে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে যা পদ্মা। কিছু লাগলে বলিস আমাকে।”

“আচ্ছা বড়মা।”

পদ্মাবতী অসহায় এর মতো রান্নাঘরে চলে গেলেন। মোহিনী খুব কষ্ট করে নিজের হাসি চেপে রাখলেন। ওদিক থেকে চলে আসতেই শমিত ডাক দিলেন তাকে।

“এই মোহিনী, এদিকে আয়।”

মোহিনী আসতেই প্রশ্ন করলেন,

“কী হয়েছে বলো।”

“ব্যাপার কী তোর? আজ-কাল তো তোর দেখাই মেলে না। অর্ণব নেই বলে এখানে আসতেও মন চায় না নাকি?”

“এমন কিছুই না।”

“এই নে।”

মোহিনী শমিতের হাত থেকে একটা কাগজ হাতে নিতে নিতে বললেন,

“এটা কী?”

“কী আবার। তোর প্রেমিকের চিঠি। শালা খুব খাটায় আমাকে। এতো খাটাখাটুনি তো নিজের প্রেমেও করিনি। যাই হোক, আগের চিঠিটা রেখে দিয়েছিস তো সাবধানে? কেউ পায়নি তো?”

“উম, ওটা তো হারিয়ে ফেলেছি। কই যে পড়েছিল আর খুঁজেই পাইনি।”

“কারও হাতে না পড়লেই হলো। নয়তো তোদের সাথে আমি ফাঁসবো।”

“এতো চিন্তা করো না তো। কেউ পায়নি। পেলে অনেক আগেই জানাজানি হয়ে যেত সব। অনেকদিন তো হয়ে গেছে।”

“তাই যেন হয়। আমি আসি এখন।”

শমিত চলে যেতেই মোহিনী চিঠিটা খুললেন। আগের মতো এতো বড় চিঠি নয় এটা। শুধু দুটো বাক্য লেখা।

“প্রিয় মেহেরজান,
অতি শীঘ্রই আমাদের অপেক্ষার সময় শেষ হতে চলেছে। আমি ফিরছি, আপনার কাছে।”

চলবে…

মেহেরজান পর্ব-২০+২১

0

#মেহেরজান
#পর্ব-২০
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

“তোমাকে আরেক টুকরো মাংস দেবো পদ্মাবতী?”

“না না। আর দেবেন না। আমি এতো খেতে পারবো না।”

“আচ্ছা। আমার মেয়েটার যে আজ কি করে এতো সুমতি হলো কে জানে। যাকে হাজারবার বলেও রান্নাঘরে ঢোকাতে পারতাম না। সে আজ নিজেই এতোকিছু রান্না করেছে।”

শিউলি বলে উঠলেন,

“তোমার মেয়ে আজও রান্নাঘরে ঢোকেনি মা।”

“তাহলে? এতোকিছু কে রান্না করলো?”

“যাকে এতো আদর আপ্যায়ন করে খাওয়াচ্ছো সে-ই রেঁধেছে।”

“মানে? আমি সকালে বাড়িতে ছিলাম না বলে তুই মেয়েটাকে দিয়ে এতো কাজ করালি?”

“আমার কী দোষ? আমি তো করতে নিষেধই করেছিলাম। দিদিই তো শুনলো না আমার কথা।”

পদ্মাবতী বললেন,

“ওর দোষ নেই। আমিই জোর করেছিলাম। এমনিতেও এখানে আমার কোনো কাজ নেই। ঘরে বসে থাকতে থাকতে কার এতো ভালো লাগে। তাই ভাবলাম দুপুরের রান্নাটা আমিই করি।”

“তবুও। এটা কিন্তু একদম ঠিক হয়নি পদ্মাবতী। তুমি শুধু শুধু এতো কষ্ট করলে।”

“আমার কোনো কষ্ট হয়নি। এগুলো তো আমার বা হাতের খেল।”

“শিউলিকে সেদিন বলেছিলাম তোমাকে গ্রামটা ঘুরে দেখাতে। কেমন লাগলো?”

“যতটা শুনেছিলাম তার চেয়েও বেশি সুন্দর।”

তাদের কথার মাঝে শিউলি বলে উঠলেন,

“তোমাকে তো বলতেই ভুলে গেছি। জানো দিদি, আমরা যে মাঠে গিয়ে বসেছিলাম না? সেখানে অনেক বড় করে বৈশাখী মেলা হয়। তুমি এসো কিন্তু আবার নববর্ষে।”

“আসবো।”

“খাওয়া শেষ করে তুমি একবার আমার ঘরে এসো পদ্মাবতী। একটা কাজ আছে।”

“ঠিকাছে।”

পদ্মাবতী খাওয়া শেষ করে যথারীতি শর্মিলার সাথে তার ঘরে এলেন। শর্মিলা আলমারি থেকে কিছু একটা বের করে পদ্মাবতীর হাতে দিলেন।

“এটা কী?”

“খুলে দেখো।”

পদ্মাবতী খুলে দেখলেন একজোড়া বালা।

“এগুলো?”

“এগুলো তোমার মায়ের। এতো বছর আমার কাছেই ছিল। তাকে তো আর ফিরিয়ে দেওয়ার উপায় নেই। তাই তোমাকেই দিলাম।”

“কিন্তু..”

নিজের কথা শেষ করতে পারলেন না পদ্মাবতী। তাকে থামিয়ে দিয়ে শর্মিলা বললেন,

“কোনো কিন্তু নয়। এগুলো এখন তোমার। তুমি সাথে করে নিয়ে যাবে।”

“ঠিকাছে। আমি নিয়ে যাবো। কিন্তু যতদিন আমি এখানে আছি ততদিন আপনার কাছেই রাখুন। যাওয়ার সময় না হয় দিয়ে দেবেন।”

“আচ্ছা। তুমি যা বলবে।”

পদ্মাবতী শর্মিলার ঘর থেকে বের হয়ে শিউলির ঘরে ঢুকলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,

“মা কী বললো তোমাকে?”

“তেমন কিছু না।”

“আচ্ছা।”

শিউলি বিছানা ঠিক করতে লাগলেন। পদ্মাবতীর বুঝতে অসুবিধা হলো না যে তিনি এখন ঘুমাবেন।
.
.
.
রাস্তার পাশে সবুজ ঘাসের ওপর বসে আছেন মোহিনী। সামনেই নদী। দুপুরের কড়া রোদে কতোগুলো বাচ্চা নদীতে নেমে ঝাঁপাঝাপি করছে। হঠাৎ পেছন থেকে কারও ডাক শুনতে পেলেন তিনি।

“কিরে? এসময় এখানে বসে আছিস যে?”

চকিতে পেছনে তাকালেন মোহিনী।

“শমিতদা। তুমি। তেমন কিছু না। এমনিই বসে ছিলাম। তুমি এখানে কী করতে?”

“তোকেই খুঁজতে এসেছিলাম।”

উঠে দাঁড়ালেন মোহিনী। শমিতের সামনে এসে বললেন,

“আমাকে? কেন?”

“আজ বাড়িতে এলি না কেন?”

“এমনিই যাইনি।”

“এমনিই বাড়িতে যাসনি। এমনিই এখানে বসে আছিস। কী হয়েছে?”

“কিছুই হয়নি। তুমি কী বলতে এসেছো বলো।”

“অর্ণব খুঁজছিল তোকে। তাই বলতে এলাম।”

“উনি আমাকে কেন খুঁজবেন?”

“এমন ভাব করছিস যেন তোদের প্রেমকাহিনী সম্পর্কে আমি কিছু জানিই না। তুই আজ যাসনি বলে খুঁজছিল।”

“তুমি কী বললে?”

“বলেছি তুই ওর ওপর রেগে আছিস।”

“আমি কেন ওনার ওপর রেগে থাকবো? আমি তো রেগে নেই। তাহলে তুমি এমন কেন বললে?”

“এমনিই। তোদের মাঝে একটু ঝামেলা সৃষ্টি করার জন্য।”

“তারপর উনি কী বলেছেন?”

“জিজ্ঞেস করলো কেন রেগে আছিস। বললাম জানি না। তারপর ও বললো তোর সাথে রাতে দেখা করবে।”

“কখন? কোথায়?”

“সন্ধ্যার পর পরই। বাড়ির পেছনে বাগানে অপেক্ষা করিস।”

“ঠিকাছে।”

“শোন। আমি এখন যাই। তুই ঠিকমতো আসিস কিন্তু। নয়তো অর্ণব আবার আমাকে দোষ দেবে যে আমি তোকে বলিনি।”

“আচ্ছা। আমি আসবো।”
.
.
.
আম গাছতলায় দাঁড়িয়ে অর্ণবের জন্য অপেক্ষা করে করে চলেছেন মোহিনী। সূর্যাস্তের অনেক আগেই এখানে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন তিনি। অনেক্ষণ যাবৎ পায়চারি করে চলেছেন। এখন সন্ধ্যার আলোটুকুও মিলিয়ে গেছে। পেছন থেকে নিজের খোলা চুলে কারও স্পর্শ পেতেই তৎক্ষনাৎ পেছনে ঘুরলেন তিনি।

“অর্ণব।”

“সোজা হয়ে দাঁড়ান।”

হাতে থাকা নাগচাঁপাটা মোহিনীর চুলে গুঁজে দিয়ে বললেন,

“এবার বলুন।”

সামান্য হাসলেন মোহিনী।

“এটা আমার অনেক পছন্দের ফুল।”

“জানি। এজন্যই এনেছি। অনেক খুঁজে।”

“মিথ্যে বললেন। খোঁজার কী দরকার? বাগানেই তো আছে।”

“প্রেমে একটু-আধটু মিথ্যে বললে কোনো ক্ষতি নেই। উল্টো ভালোবাসা বাড়ে।আমার ওপর নাকি রেগে আছেন? কেন?”

“একদম না। শমিতদা মিথ্যে কথা বলেছে।”

“আগেই বুঝেছি। আপনাকে ডেকেছি অন্য কারণে।”

“কী কারণ?”

“কাল আমি চলে যাচ্ছি। এটা জানাতেই।”

“চলে যাচ্ছেন মানে? কোথায় যাচ্ছেন?”

“কলকাতায়। কাকু নতুন ব্যবসা শুরু করেছেন। কারও সাহায্যের প্রয়োজন। আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। এজন্যই যাচ্ছি ওনাকে সব গুছিয়ে দিতে।”

“আপনার যাওয়ার কী প্রয়োজন? শমিতদাকেই তো পাঠাতে পারেন।”

“বলেছিলাম। কিন্তু পিসিমা রাজি হননি।”

“ফিরবেন কবে?”

“দেরি হবে অনেক।”

“কতদিন?”

“কয়েক মাস।”

“স্বরসতী পূজোর আগে ফিরবেন তো?”

অর্ণব মোহিনীর মুখের ওপর থেকে চুল সরিয়ে দিয়ে তার গালে স্পর্শ করলেন।

“বলতে পারছি না। আরও দেরি হতে পারে। ভালো থাকবেন মেহেরজান।”

একটু দূর থেকে কারও চাপা কন্ঠ ভেসে এলো,

“চলে আয় অর্ণব। রামু কাকু আসছেন এদিকে।”

মোহিনী কৌতূহলী চোখে অর্ণবের দিকে তাকালেন। অর্ণব বললেন,

“শমিতকে সামনে রেখে এসেছি পাহারা দিতে।”

মোহিনী হেসে ফেললেন। অর্ণব শমিতের উদ্দেশ্যে বললেন,

“চলে যা তুই। আমি একটু পর আসছি।”

হাটু গেড়ে নিচে বসে পড়লেন অর্ণব। পকেট থেকে একজোড়া নুপুর বের করে মোহিনী পায়ে পরিয়ে দিলেন।

“আপনার পায়ে ঘুঙুর অপেক্ষা নুপুর বেশি শোভা পায় মেহের।”

কথাটা বলে মোহিনীকে নিয়ে পেছনের গেইট দিয়ে বেরিয়ে এলেন তিনি। মোহিনী বললেন,

“এদিকে কোথায় যাবেন?”

“চলুন আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।”

“আমি একা যেতে পারবো।”

অর্ণব গলার স্বর দৃঢ় করে বললেন,

“আমি বলেছি আমি পৌঁছে দেবো।”

“ঠিকাছে।”

রাস্তায় খুব একটা লোকজন নেই। একসাথে হাঁটতে হাঁটতে বাইজীবাড়ির সামনে এসে উপস্থিত হলেন তারা। দোতলায় জানালা থেকে তাদের একসাথে আসতে দেখলেন তারানা। আবছা আলোয় তাদের চিনতে অসুবিধা হয়নি তার।

“এতোটুকু পৌঁছে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। এবার আমি একাই যেতে পারবো। ভেতরে যাওয়াটা আপনার উচিত হবে না।”

“কেন?”

“এটা বাইজীবাড়ি। এখানে সচরাচর কোনো প্রেমিক তার প্রেমিকাকে পৌঁছে দিতে আসে না। সবার আসার উদ্দেশ্য একটাই। তাই আপনার না আসাই উচিত। লোকে জানলে কুৎসা রটাবে।”

“আমার পূর্বপুরুষ আসতে পারলে আমি কেন পারবো না? পার্থক্য কোথায়?”

“সময়ের পার্থক্য।”

বাড়ির ধূলো জমা নাম ফলকটা রুমাল দিয়ে মুছে দিলেন অর্ণব। একটা নাম ভেসে উঠলো “রঙ মহল”। নামটা যে অনেক আগেই মুছে গেছে তা বলা বাহুল্য। অর্ণব মুচকি হেসে মোহিনীকে বিদায় জানালেন। অর্ণব চলে গেলে মোহিনীও বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন। ভেতরে ঢুকতেই তারানার সামনে পড়লেন তিনি।

“কী করছিস মেহের?”

“তারামা।”

“প্রমিতার মতো সেই একই পথে হাঁটছিস? এসব প্রেম ভালোবাসা যে তোদের জন্য না। প্রমিতার পরিণতি কী হয়েছিল ভুলে গেছিস?”

“শান্ত হও তারামা। কিচ্ছু ভুলিনি আমি। প্রমিতাদির সাথে যা হয়েছিল তা আমার সাথে কখনোই হবে না। আমি এতো দুর্বল নই।”

“কী করতে পারবি তুই? গ্রামের লোকেরা পাথর ছুড়ে ছুড়ে মেরেছে ওকে। ভুলে গেছিস?”

“কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না আমাকে তারামা। কারোর এতো সাহস হবে না। তুমি অযথা চিন্তা করা বন্ধ করো।”

মোহিনী নিজের ঘরে ফিরে এলেন। বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন। রাতের খাবার খেতেও গেলেন না। রাত যত গভীর হলো, তার গায়ের তাপমাত্রাও তত বাড়তে থাকলো। বারবার কাঁপুনি দিয়ে উঠছেন তিনি। পাশে থেকে কাঁথা টেনে নিজের গায়ে দিলেন। জ্বরের সাথে তীব্র মাথাব্যথা। দুর্বলতা তার শরীরকে গ্রাস করে নিচ্ছে অথচ তীব্র মাথাব্যথায় ঘুমাতেও পারছেন না। উঠে ঔষধ খাওয়ার শক্তিটুকুও যেন নেই তার। লম্বা একটা নির্ঘুম রাত কাটানোর পর যখন সূর্য উঁকি দিল, একটা নতুন দিনের সূচনা হলো, তখন চোখে ঘুম নেমে এলো তার। কতক্ষণ ঘুমিয়েছেন, জানেন না তিনি। যখন চোখ খুললেন ততক্ষণে সূর্য মাথার ওপর। দরজায় কেউ বারবার কড়া নেড়ে যাচ্ছেন। সবকিছু বুঝে উঠতে একটু সময় লাগলো তার। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলে দিলেন তিনি। বাইরে রজনী দাঁড়িয়ে। মোহিনী দরজা খুলতেই তিনি ভেতরে ঢুকলেন। মোহিনী আবার আস্তে আস্তে বিছানায় গিয়ে বসলেন। শরীরের দুর্বলতা এখনো কাটেনি।

“কী হয়েছে তোর? এতো দুর্বল দেখাচ্ছে কেন?”

“রাতে জ্বর এসেছিল।”

“হঠাৎ জ্বর কেন এলো?”

“জানি না।”

“ওষুধ খেয়েছিস?”

“না। এখন জ্বর নেই। তুমি একটু আমাকে জল দাও না।”

রজনী মোহিনীকে জল এনে দিলেন। মুখে দিতেই তেঁতো স্বাদ অনুভূত হলো তার। চোখে মুখে জল দিয়ে রজনীকে জিজ্ঞেস করলেন,

“এখন ক’টা বাজে রজনীদি?”

“বাজে তো অনেক। সাড়ে এগারোটা হবে হয়তো।”

মূহুর্তেই তার অর্ণবের কথা মনে পড়লো। ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি। পেছন থেকে রজনী আওয়াজ দিলেন।

“এই শরীর নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস তুই?”

“আমি এখুনি এসে পড়বো রজনীদি। তারামাকে বলো না।”

দৌঁড়ে অর্ণবদের বাড়িতে এলেন তিনি। অর্ণবকে কোথাও পেলেন না। শমিতকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,

“অর্ণব কই শমিতদা?”

“তুই এতোক্ষণে এলি? অর্ণব তো সেই কোন সকালেই চলে গেছে। তোর জন্য অনেক্ষণ অপেক্ষাও করেছে। কিন্তু তুই এলি না বলে শেষে চলেই গেল। তুই এলি না কেন?”

অনুরাধার ডাক শোনা গেল। শমিত আর মোহিনীর উত্তরের অপেক্ষা করলেন না। সেদিকে চলে গেলেন। মোহিনী জ্বরে পড়ার জন্য বারবার নিজেকে দোষ দিতে লাগলেন। বাড়ির বাইরে এসে সিড়িতে বসতেই দেখলেন পদ্মাবতী আসছেন। কাছে এসে মোহিনীকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি।

“কত্তোদিন পর দেখলাম তোকে। অনেক মনে পড়েছে তোর কথা। তোদের সবার কথা। কেমন আছিস তুই?”

মোহিনী নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন,

“ভালো। তুই?”

“আমিও।”

“চলে এলি যে?”

“ভালো লাগছিল না তাই। কালও ভাবিনি আজ চলে আসবো। আজ সকালেই ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম।”

“একা আসতে পারলি?”

“দেখছিস না? আর যাওয়ার সময় তো রাস্তা দেখেইছিলাম। আর পিসিমা নদী পার করে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছিলেন।”

“তোর ঠাকুমা কেমন আছেন?”

“ভালো না। কোনোরকম বেঁচে আছেন আরকি।”

“ওহ।”

পদ্মাবতী বারবার এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। তার চোখ যেন অন্য কাউকে খুঁজছে। মোহিনীকে জিজ্ঞেস করলেন,

“বাড়ির সবাই কেমন আছে? বড়মা, ছোটমা, পিসিমা, চিত্রা, শমিতদা আর অর্ণববাবু?”

“সবাই ভালো আছে। আর অর্ণব বাড়িতে নেই।”

“কোথায় গেছেন?”

“কলকাতায়।”

“ফিরবেন কবে?”

“জানি না। অনেক দেরি হবে শুনলাম।”

“ওহ।”

পদ্মাবতীর মুখটা মলিন হয়ে উঠলো।

“তুই ভেতরে চল।”

“যাচ্ছি। তুই আমার ঘরে যা। আমি সবার সাথে দেখা করে আসছি। অনেক কথা জমে আছে তোকে বলার।”

চলবে…

#মেহেরজান
#পর্ব-২১
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

বিন্দু বিন্দু শিশির জমে থাকা ঘাসে পা রাখলেন মোহিনী। গায়ে মোটা শাল জড়ানো। সূর্য অনেক আগে উঠলেও তার দেখা এখনো মেলেনি। গাছের ঝুলে থাকা পাতার ডগায় জমে থাকা শিশির কণাগুলো যেন এখুনি একত্রিত হয়ে টুপ করে নিচে পড়বে। আশেপাশে বসার মতো কোনো জায়গা পেলেন না মোহিনী। সবই ভেজা। তবে এভাবে খালি পায়ে হাঁটতে মন্দ লাগছে না। একটা দুটো করে শিউলি কুড়িয়ে নিজের শাড়ীর আঁচলে রাখছেন পদ্মাবতী। এমন সময় যেন তার ওপর বৃষ্টির বর্ষণ হলো। গাছ ধরে কেউ ঝাঁকাতেই এই কান্ড। ফুলগুলো ফেলে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। পেছনে ঘুরতেই দেখলেন মোহিনী দাঁড়িয়ে হাসছেন। মোহিনী এখানে কখন এসে দাঁড়িয়েছেন, টেরই পাননি। একবার কেঁপে উঠে বললেন,

“এমনিতেই শীতে বাঁচি না। তার ওপর এভাবে আমার ওপর জল ঝরাতে পারলি?”

পদ্মাবতী আবার বসে শিউলিগুলো তুলতে লাগলেন। মোহিনী নিজের চাদরটা পদ্মাবতীর গায়ে দিয়ে তাকে ফুলগুলো তুলতে সাহায্য করলেন। ফুল কুড়িয়ে বাড়িতে ঢোকার সময় মোহিনী বললেন,

“আমাকে একটু জল এনে দে। পা ধুতে হবে।”

“জুতো কী করেছিস?”

“বাগানে ঢোকার আগেই খুলে রেখে এসেছি।”

“দাঁড়া। আমি নিয়ে আসছি।”

পদ্মাবতী এক ঘটি জল এনে মোহিনীকে দিলেন। মোহিনী পা ধুয়ে পদ্মাবতীর সাথে তার ঘরে ঢুকলেন। পদ্মাবতী সূঁচ আর সুতা নিয়ে এসে বিছানায় বসলেন। এরপর ফুলগুলো দিয়ে মালা গাঁথতে শুরু করলেন। মোহিনী তার পাশেই বসে রইলেন। এমন সময় চিত্রা ঢুকলেন তাদের ঘরে। হাতে একটা থালা, যার মধ্যে তিনটা ক্ষীরের বাটি। মোহিনী দেখেই চট করে একটা তুলে নিলেন। বললেন,

“সকাল সকাল ক্ষীর?”

চিত্রা একটা বাটি পদ্মাবতীর হাতে দিয়ে বললেন,

“এই নে খা।”

“কিসের জন্য এটা?”

“আমার জন্মদিনের।”

জিভ কাটলেন পদ্মাবতী।

“একদম মনে ছিল না।”

চিত্রা নিজেও খেতে খেতে বললেন,

“তা মনে থাকবে কী করে? তোদের দুই বান্ধুবীর মাঝে আমি কে? আমার কথা কারও মনে রাখার দরকার আছে নাকি?”

“মনে নেই তো কী হয়েছে? তোর জন্য উপহার ঠিকই এনেছি।”

“কই?”

পদ্মাবতী হাতে থাকা ফুলের মালাটা চিত্রার গলায় পরিয়ে দিলেন। মোহিনী হেসে ফেললেন। চিত্রার উচ্ছ্বসিত মুখটা মুহূর্তেই চুপসে গেল।

“এটা আমার উপহার? এখন আছে, একটু পরেই নেই। এটা না দিয়ে নিজের গলারটাও তো দিতে পারতি।”

মোহিনী বলে উঠলেন,

“এতো লোভ করিস না। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। ”

“তুই আর কিছু বলিস না তো। ইশশশ, দাদার কথা খুব মনে পড়ছে। দাদা থাকলে নিশ্চিত আমি যা চাইতাম তাই দিত।”

পদ্মাবতী বললেন,

“সত্যিই। সেই কবে গেলেন। কতমাস হয়ে গেল। পূজো শেষ করে দেখতে দেখতে দোলও চলে এলো। অথচ তিনি এখনো ফিরলেন না কেন?”

“মা তো বললেন দোলের দিন নাকি দাদা ফিরবেন।”

“তাই?”

“বললেন তো তাই। আমি জানি না।”

মোহিনী খাওয়া শেষ করে বললেন,

“আমার জন্য আরেকটু নিয়ে আয় তো। বড়মা বানিয়েছেন। অনেক মজা হয়েছে।”

“আমাদের কথা শেষ হলো না আর তোর খাওয়া শেষ?”

“খাওয়া বাদ দিয়ে এতো কথা বললে তো এমনই হবে। যা নিয়ে আয় আরেক বাটি।”

“আনছি।”

চিত্রা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মোহিনী আর পদ্মাবতী নিজেদের মতো গল্প করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
.
.
সকাল থেকেই আম্রপালি, শকুন্তলা, অনুরাধা তিনজনই রান্নাঘরে বসে আছেন। সাথে আরও দু’জন কাজের মেয়ে। বিভিন্ন ধরনের পিঠা তৈরিতে ব্যস্ত তারা। ভাপা, পাটিসাপটা, নকশি, পাক্কূণ, পুলিপিঠা, কী নেই সেখানে? সবই চিত্রার পছন্দের। সাথে ভালোমন্দ বিভিন্ন পদের রান্নাও রয়েছে। চিত্রার জন্মদিন উপলক্ষে আজ দুপুরে কিছু অনাথ শিশু আর গরীবদের খাওয়াবেন তারা। সেটারই প্রস্তুতি চলছে।

“আর পারছি না। সেই সকাল থেকে খেটে মরছি। এভাবে কী আর পারা যায়? দিদি, আমি বরং একটু ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিই। পরে আবার আসবো। তোমরা এদিকটা সামলে নিতে পারবে তো?”

আম্রপালি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। শকুন্তলা বেরিয়ে যেতেই অনুরাধা বললেন,

“পরে আসার কথা বললেও এদিকে আর ফিরে দেখবে না ও দেখো তুমি। খাটাখাটুনি করতে পারবে না তো এসব আয়োজন করার দরকারটা কী ছিল? আমাদের ছেলেমেয়ের বেলায় তো এতো রঙঢং করি না আমরা। তাহলে চিত্রার বেলায় হবে কেন?”

করতে দিন না দিদি। শখ যখন জেগেছে তাহলে সেটা একবার মিটিয়ে নিক।

“ওর মেয়ের জন্মদিন ও পালন করছে করুক। আমার আপত্তি নেই। কিন্তু আমাদের খাটিয়ে মারছে কেন বলো তো?”

আম্রপালি মুচকি হাসলেন। এমন সময় শান্তি দেবী ঢুকলেন রান্নাঘরে। নিজের লাঠিতে ভর দিয়ে, খুবই ধীরে ধীরে। সবকিছু একবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে ভাঙা গলায় বললেন,

“এগুলো কিসের জন্য?”

অনুরাধা বললেন,

“আপনার নাতনির জন্মদিনের জন্য। আপনার বউমা বাইরের কতগুলো লোককে এনে খাওয়াবে দুপুরে।”

“চিত্রার জন্মদিন? মেয়েটা অনেক বড় হয়ে গেল না? কয় বছরের হলো?”

“একুশ মনে হয়।”

“হবে হয়তো। ও তো আমার কাছে আসেই না। আমি জানবো কী করে কতটুকু হলো? পদ্মা ছাড়া তো আমার ঘরে ঢোকার সময়ই কারও হয় না।”

ফ্যাসফ্যাসে গলায় হাসলেন শান্তি দেবী। এরপর আবার নিজের লাঠিতে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে চলে গেলেন। বেশ কষ্টে দোতলায় উঠলেন তিনি। এই বয়সে এমন শরীর নিয়ে এতোগুলা সিড়ি বাওয়া আসলেই কষ্টসাধ্য। পদ্মাবতীর ঘরে এলেন তিনি। নিজের ঘর ছেড়ে অন্যের ঘরে বেশি প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা যাননা তিনি। বিগত দু’বছরে আজ তৃতীয়বারের মতো এই ঘরটায় এলেন তিনি। আসতেই দেখলেন ঘরে পদ্মাবতী ছাড়াও মোহিনীও আগে থেকে রয়েছেন। পদ্মাবতী শান্তি দেবীকে দেখা মাত্রই তাকে আসতে সাহায্য করলেন। শান্তি দেবী পদ্মাবতীকে ধরে ধরে এসে বিছানায় বসলেন। একদম মোহিনীর সামনে। মোহিনী বললেন,

“এখনো বেঁচে আছো বুড়ি? মরোনি?”

শান্তি দেবী ভেংচি কেটে বললেন,

“আমি ক্যান মরুমরে ছেমরি? তুই মর।”

মোহিনী হাসিতে ফেটে পড়লেন। মাঝেমাঝে শান্তি দেবীর মুখে এভাবে কথা বলা শুনতে ভালোই লাগে তার। রামু ছাড়া এভাবে কেউ কথা বলেন না। শান্তি দেবী বললেও খুব কম। মোহিনী হাসি থামিয়ে বললেন,

“বুড়ি হয়েছো তুমি আর মরবো আমি?”

“আমি বুড়ি হয়েছি তো কী হয়েছে? এখনই মরতে হবে নাকি? আমি মরলে মনে হয় তোরা বাঁচিস।”

“আমি বাঁচি বা না বাঁচি, পদ্মা তো বেঁচে যাবে। সারাদিন ওকে কতো খাটাও তুমি ভাবো একবার? সারাদিন শুধু ওকে এটা ওটা করার হুকুম দিয়েই যাও।”

“আমি হুকুম করবো না তো কী তুই করবি? জমিদার বাড়ির বউ আমি না তুই?”

“এখন তুমি। পরে নাহয় আমি হবো। তোমার বরের নাম যেন কী ছিল? দেখতে খুব সুদর্শন ছিলেন তাই না? বেঁচে থাকলে দেখতে তোমাকে ছেড়ে দিয়েছেন আমার জন্য। আমার রুপের কাছে যে-কেউ হার মানতে বাধ্য।”

“কোথাকার কোন রুপের রানী এলেনরে আমার! তুই কী জানিস আমার রুপের কথা? যৌবনে তোদের থেকে কত বেশি সুন্দরী ছিলাম আমি ভাবতেও পারবি না। এমনি এমনি জমিদার বাড়ির বউ হইনি। প্রথম দেখাতেই পছন্দ করে বিয়ে করে ওপাড় বাংলা থেকে এপাড়ে নিয়ে এসেছিলেন আমায়। আর তুই এসেছিস আমার মৃত স্বামীকে কেড়ে নিতে? হয়েছিস তো একদম কাঠির মতো। ফুঁ দিলেই উড়ে যাবি।”

শান্তি দেবী হাঁপিয়ে উঠলেন। মোহিনী ভ্রু নাচিয়ে পদ্মার উদ্দেশ্যে বললেন,

“বুড়ি খেপেছেরে পদ্মা।”

“উফফফ, কী শুরু করলে তোমরা? সবাই আমাকে বলো বাচ্চা অথচ এখন নিজেরাই বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করছো। দিদা, তুমি কী বুঝো না ও তোমাকে রাগাতে চাইছে। তাই এসব বলছে। আর তুমিও ওর কথায় কান দিয়ে রাগছো।”

“আমাকে রাগাতে কী মজা পায় ও?”

“সেটা আমি কী জানি? ওকেই জিজ্ঞেস করো।”

শান্তি দেবী মোহিনীর দিকে তাকালেন। মোহিনী বললেন,

“শান্তি পাই শান্তি দেবী। শান্তি পাই।”

পদ্মাবতী শান্তি দেবীর উদ্দেশ্যে বললেন,

“এবার বলো, কোনো দরকারে এসেছো?”

“কেন? এখানে কী দরকারেই আসতে হবে?”

“আমি তা বললাম কখন?”

“এমনিই এসেছি। গল্প করতে। ওরা তো সবাই রান্নাঘরে ব্যস্ত। আমার সাথে কথা বলার সময় কোথায়? চিত্রা কই গেছেরে? শুনলাম আজ ওর জন্মদিন।”

“এসেছিল তো। এখন কই গেছে কে জানে।”

মোহিনী বললেন,

“ওকে পাঠিয়েছিলাম আমার জন্য আরেক বাটি ক্ষীর আনতে। সেই যে গেল আর ফেরার খবর নেই।”

“এতো খাস কীভাবে তুই? খাবার যায় কই বলতো? সেই তো দেখতে একেবারে শুকনো কাঠি।”

মোহিনী পেটে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন,

“আমার পেট ছাড়া আর কই যাবে দিদা?”

“রান্নাঘরে দেখে এলাম। কতো রকমের রান্না হচ্ছে। আজ তো তোর জন্য উৎসব লেগে গেছে।”

“আগেই গন্ধ পেয়েছি আমি। এজন্যই তো সেই কখন থেকে এখানে বসে আসি।”

পদ্মাবতী বললেন,

“তুই যে তখন বললি তুই আমার জন্য বসে আছিস। আমার কাজ শেষ হলে আমাকে নিয়ে বাইরে যাবি।”

“সে তো যাবোই। কিন্তু দুপুরে খাওয়াদাওয়া শেষ করে।”

“কোথায় যাবি?”

“সেটা খাওয়ার পরে ঠিক করবো।”

“তারমানে তুই খাওয়ার জন্যই বসে আছিস। আমার কোনো দাম নেই তোর কাছে।”

“আরে যার জন্যই থাকি, একই তো হলো।”

“না, এক হলো না।”

“একই হলো। চুপ কর তুই।”

মুহুর্তেই যেন পদ্মাবতী খেপে গেলেন। শান্তি দেবী বললেন,

“এইতো একটু আগেই দু’জন একদম ঠিক ছিলিস। এক মুহুর্তে এমন ঝগড়া বাঁধিয়ে দিলি?”

“মোহিনীর জন্যই তো।”

“আমি কী করলাম? অযথা রাগ দেখাবি না একদম বলে দিলাম।”

“আমি অযথা রাগ দেখাই তাই না?”

“হ্যা, আমার সাথে কথা বলবি না একদম। তোর আমার কোনো সম্পর্ক নেই।”

পদ্মাবতী কেঁদে ফেললেন। হঠাৎ এভাবে কেঁদে ফেলায় মোহিনী কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পদ্মাবতী নিজের কান্নার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে মোহিনীকে জড়িয়ে ধরলেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

“আমি অযথা রাগ দেখাই না। তুই আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করবি না একদম। তোর সাথে কথা না বলে কীভাবে থাকবো আমি?”

মোহিনী বুঝতে পারলেন না কী বলবেন। পদ্মাবতীর হৃদয় অনেক কোমল। একটুতেই কষ্ট পায় এটা জানেন মোহিনী। তাই বলে এই সামান্য একটা ব্যপারে এভাবে কেঁদে ফেলবে বুঝতে পারেননি। তবে এমন যে প্রথমবার হয়েছে তাও নয়। প্রায়ই তাদের ঝগড়া হলে পদ্মাবতী কেঁদে ফেলতেন। তা সে যত ছোটখাটোই হোক না কেন। মোহিনী পদ্মাবতীর মাথায় হাত রেখে বললেন,

“ঠিকাছে। কথা বলা বন্ধ করবো না তোর সাথে। তুই আসলেই একটা বাচ্চা।”

মোহিনীকে ছেড়ে দিলেন পদ্মাবতী। কান্না থামিয়ে কিছুটা শান্ত হলেন। নাক টানতে টানতে বললেন,

“আর কখনো আমার সাথে এভাবে কথা বলবি না।”

“ঠিকাছে বলবো না।”

পুরো ঘটনাটা চুপচাপ দেখে গেলেন শান্তি দেবী। এরপর মুখ বাঁকিয়ে বললেন,

“তোদের ঢং দেখে আর বাঁচি না। তোদের বন্ধুত্বের কাছে দুই বোনও হার মানবে। দেখবোনি কতদিন টেকে এই বন্ধুত্ব। কারও নজর যেন না লাগে আবার।”

উঠে দাঁড়ালেন শান্তি দেবী। চশমাটা খুলে পাশে রেখেছিলেন তিনি। আবার চোখে দিয়ে বললেন,

“কিসের চশমা যে পরি আমি? চশমা পরার পরও সব সেই ঘোলাই দেখি।”

কথাটা বলতে বলতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন শান্তি দেবী। তার কথায় চোখ মুছতে মুছতে সামান্য হাসলেন পদ্মাবতী। বললেন,

“কারও নজর লাগবে না আমাদের।”

চলবে…

মেহেরজান পর্ব-১৯

0

#মেহেরজান
#পর্ব-১৯
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

আম্রপালি আর অনুরাধা একসাথে রান্না করছেন। পাশেই মোহিনী মনমরা হয়ে একটা মোড়ায় চুপ করে বসে আছেন। রান্না কতদূর এগোলো, একটু পর পর উঁকি দিয়ে দেখছেন। যেন খাবার হওয়ারই অপেক্ষায় আছেন।

“আপনাদের রান্না আর কতদূর বড়মা?”

“কেন? খিদে পেয়েছে?”

“পেয়েছে তো।”

“সকালে খাসনি তুই? না খাইয়েই তারানা ছাড়লো তোকে?”

“খাইয়েছে তো। জোর করে। কিন্তু পেট ভরেনি।”

“পেট না ভরলে জোর করে খাওয়ালো কেন?”

“কে রান্না করেছে জানেন? রজনীদি। তার রান্নায় আমি একবিন্দুও স্বাদ পাই না। তাই খেতে চাইওনি। কিন্তু তারামার কথায় খেয়েছি। এই অল্প একটু। পেটও ভরেনি। আপনার হাতের রান্না না খেলে পেট ভরে নাকি আমার?”

“রাঁধছি তো নিরামিষ। তোর অপেক্ষা দেখে মনে হচ্ছে সামনে বিরিয়ানি।”

“আপনার হাতের নিরামিষের মধ্যেও আমি মাংসের স্বাদ পাই। বিরিয়ানি না হোক কিন্তু আপনার সব রান্নাই খেতে অমৃত বড়মা।”

“তোর মতো তোষামোদকারী আমি আর একটাও দেখিনি। চুপ করে বস। রান্না হলে খেতে পাবি।”

অনুরাধা বলে উঠলেন,

“শকুন্তলার ঘুম কি এখনো ভাঙেনি? এতোবেলা করে কেউ ঘুম থেকে ওঠে? সকালে উঠে আমাদের একটু সাহায্যও তো করতে পারে। নাকি শুধু হুকুম চালাতেই জানে? নিজেকে কি রাজরানী ভাবে ও?”

আম্রপালি হেসে উত্তর দিলেন,

“রাজরানী না হলো। কিন্তু জমিদার বাড়ির বউ তো। একটু শৌখিন তো হবেই।”

“সে তো তুমিও জমিদার বাড়ির বউ। আমিও এই বাড়ির মেয়ে। আর এই জমিদারি না তোমার শ্বশুরের আমলেই শেষ হয়ে গেছে। এখন এতো বিলাসিতা মানায় না আমাদের।”

“বাদ দাও দিদি। শকুন্তলা তো এমনই। চেনোই তো ওকে।”

“বাপ মায়ের একমাত্র সন্তান যে। বেশি আদরে আদরে বাঁদর হয়েছে। তোমার শ্বাশুড়ি যে কী দেখে পছন্দ করেছিলেন কে জানে।”

আম্রপালি নিজের হাসি চেপে রাখলেন। মোহিনী বললেন,

“পিসিমা, আপনাদের সবারও তো একটাই সন্তান। অর্ণব, চিত্রা, শমিতদা। আপনারাও কি তাহলে তাদেরকে আদরে আদরে ছোটমার মতো বাঁদর বানাচ্ছেন?”

আম্রপালি আর হাসি চেপে রাখতে পারলেন না। উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। অনুরাধা বললেন,

“তুই চুপ কর। সবচেয়ে বড় বাঁদর তো তুই হয়েছিস। বড়দের মাঝে কথা বলিস। বসে না থেকে আমাদের কাজে সাহায্যও তো করতে পারিস। আর অর্ণব কী হ্যাঁ? অর্ণবদা বলতে পারিস না?”

মোহিনীর চোখ দোতলায় পড়তেই দেখলেন অর্ণব দাঁড়িয়ে আছেন। তাদেরকেই দেখছেন। মোহিনীকে ইশারা করে ওপরে আসতে বললে তিনি ইশারাতেই মানা করে দিলেন। উল্টো অনুরাধার উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললেন,

“না, পারি না। বাঁদর বলবো বাঁদর। আমার খাবারটা পদ্মার ঘরে পাঠিয়ে দিয়েন বড়মা। আমি গেলাম।”

কথাটা বলেই মোহিনী দৌঁড়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

“দেখলে আম্রপালি, দেখলে? কত বড় সাহস এই মেয়ের! এই তুমিই ওকে এতো ছাড় দিয়েছো।”

“আমি ওকে শাসন করার সুযোগ পাই-ই বা কোথায়?”

“শাসন করার সুযোগ না পেলে স্নেহ করার সুযোগটাও তৈরি করে দেওয়া উচিত হয়নি তোমার।”

আম্রপালির মুখ মলিন হয়ে উঠলো। অনুরাধার শেষ কথাগুলো খুব একটা পছন্দ হলো না তার। কথা না বাড়িয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন তিনি।
.
.
.
গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন পদ্মাবতী আর শিউলি। দুপাশে আবাদি জমি। শিউলিকে নিয়ে বিকেলবেলায় ঘুরতে বের হয়েছেন তিনি। হালকা বাতাসের মধ্যে হাঁটতে ভালোই লাগছে তার। সেদিন বিকেলে গ্রাম ঘুরে দেখতে চেয়েও পারেননি তিনি। পিতার অসুস্থতার খবর পেয়ে সেদিনই চলে গিয়েছিলেন শিউলি। শর্মিলা নিষেধ করেও আঁটকাতে পারেননি। তার সাথে তার শ্বশুরবাড়ির যোগাযোগ না থাকলেও ছেলেমেয়েদের সাথে ঠিকই আছে। আজ সকালেই ফিরেছেন শিউলি। ইচ্ছে না থাকা স্বত্তেও শর্মিলার আদেশে পদ্মাবতীকে নিয়ে বের হয়েছেন। এমন সময় পেটে ক্ষুধা অনুভব করলেন পদ্মাবতী। শিউলিকে বললেন,

“আর হাঁটতে পারছি না শিউলি। খিদেও পেয়েছে। চল কোথাও বসি।”

“সামনে একটা বড় মাঠ আছে। বিকেলবেলা অনেককিছু আসে। চলো ওখানে গিয়ে বসি।”

“অনেক লোকজন আছে ওখানে?”

“না। মাঠে কিছুই নেই। খাবারের দোকান সব রাস্তায় বসে। মাঠে মাঝেমধ্যে বাচ্চারা খেলে।”

“চল তাহলে।”

দুজনে দুটো ঘটিগরম নিয়ে মাঠে এলেন। এখানে কিছুটা রোদের তেজ থাকায় গাছের ছায়ার গিয়ে বসলেন তারা। একটু দূরেই বাচ্চারা খেলছে। খেতে খেতে পদ্মাবতী বললেন,

“প্রেম করিস শিউলি?”

পদ্মাবতীর কথা শুনে যেন শিউলি বিষম খেলেন।

“সাবধানে খা। পানি নেই আমার কাছে।”

নিজেকে সামলে শিউলি বললেন,

“কী বললে?”

“জিজ্ঞেস করেছি প্রেম করিস কীনা?”

“না।”

“ভালোবাসিস কাউকে?”

“একদম না। তুমি এসব কথা বলো না আমাকে। মা বকবে।”

“কিছু করিস না তো বকবে কেন?”

“তবুও বলো না। ভুল বুঝে আমাকে যদি এখনই বিয়ে দিয়ে দেয়।”

“আচ্ছা। বলবো না।”

“তুমি প্রেম করো?”

“না।”

“ভালোবাসো?”

“জানি না। আমার প্রশ্ন আমাকে করছিস?”

“জানো না কেন?”

“এমনিই।”

“তোমার সাথে যিনি এসেছিলেন তিনি দেখতে কিন্তু খুব সুদর্শন ছিলেন।”

পদ্মাবতীর কিছুটা হিংসা হলো।

“তোমার সাথে ভালোই মানাবে।”

শুরুতে হিংসা লাগলেও পরক্ষণেই শিউলির কথা তার ভালো লাগলো।

“আসলেই মানাবে?”

“তারমানে ওকেই ভালোবাসো।”

“একদম না। আমাকে কথার প্যাঁচে ফেলছিস? তুই আমার চেয়ে ছোট হলে কী হবে। খুব পাকনা। পিসিকে বলবো সত্যিই যাতে তোর বিয়ে দিয়ে দেয়।”

খাওয়া শেষ হতেই উঠে দাঁড়ালেন পদ্মাবতী।

“কী হলো? দাঁড়িয়ে পড়লে যে?”

“বাড়ি চল। এখানে ভালো লাগছে না আমার।”

শিউলি চটপট উঠে পড়লেন। যেন পদ্মাবতীর মুখে এমন কিছু শোনার জন্যই আশা করে ছিলেন তিনি।
.
.
.
অন্যমনস্ক হয়ে সামনে থাকা খাবারের থালায় শুধু আঙুলই ঘোরাচ্ছেন মোহিনী। মুখে কিছু তুলছেন না। তারানা সেটা দেখে বললেন,

“মন কোথায় তোর? খাচ্ছিস না কেন?”

মোহিনী জবাব দিলেন না। তারানা এসে ধাক্কা দিতেই ধ্যান ভাঙলো তার।

“কী হয়েছে তারামা?”

“সেটাই তো আমি তোকে জিজ্ঞেস করছি। কী হয়েছে তোর?”

মোহিনী আবার ভাবতে শুরু করলেন।

“কী করে বলবো তোমাকে তারামা। অর্ণবকে হারানোর যে ভয় আমার মনে আবির্ভূত হয়েছে, তা যে আমাকে প্রতিনিয়ত কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।”

তারানা আবার মোহিনীকে ধাক্কা দিলেন। বললেন,

“এই মেয়ে, কী হয়েছে তোর? আমার কথা কানে যাচ্ছে না? কিছু বলছিস না কেন?”

“কী হবে তারামা? কিছুই তো হয়নি।”

“তোকে আমি খুব ভালো করেই চিনি। আমার চোখ এড়ানো তোর দ্বারা সম্ভব নয়। সত্যি করে বল কী হয়েছে তোর?”

“সত্যিই কিচ্ছু হয়নি। আচ্ছা তারামা, তুমি আমাকে এখানকার সবার চেয়ে বেশি কেন ভালোবাসো?”

“একদম কথা ঘোরাবি না। আমার প্রশ্নের জবাব দে।”

“কথা ঘোরাচ্ছি না তারামা। বলো না, আমাকে সবার চেয়ে কেন বেশি ভালোবাসো?”

মোহিনীর মতো সেখানকার বাকি মেয়েরাও জানার জন্য উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। তারানা বললেন,

“কারণ তোর মধ্যে আমি আম্রপালিকে দেখতে পাই।”

“সত্যিই? সেটা কীভাবে?”

“হ্যাঁ, তোর মধ্যে সেই হারিয়ে যাওয়া চঞ্চল, দস্যি মেয়েটাকে দেখতে পাই। তোর বড়মা না আগে এমন শান্তশিষ্ট, কোমল আর নমনীয় ছিল না।”

“তারামা, বড়মা তো এই বাড়িতেই বড় হয়েছিলেন। ও-বাড়িতে বিয়ে হলো কী করে?”

“হঠাৎ এসব প্রশ্ন করছিস কেন?”

“হঠাৎ জানতে ইচ্ছে করলো তাই। ওনার তো প্রেমের বিয়ে ছিল। তাই না?”

“সে তো আদিত্য চৌধুরী প্রেমে পড়েছিল। আম্রপালি না।”

“তুমি গল্পটা শোনাও না।”

“এখন পারবো না।”

“একটু তো শোনাও।”

তারানা মানা করলেও মেয়েরা তাকে ছাড়লেন না। অবশেষে দীর্ঘ একটা শ্বাস নিয়ে তিনি বলতে শুরু করলেন।

“শোন তাহলে, আমি যখন এখানে এসেছিলাম তখন একটা শিশু ছিলাম মাত্র। তৃতীয় লিঙ্গের ছিলাম বলে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিলেন আমার বাবা-মা আমাকে। তাদের কোনো খোঁজ খবর আমি জানি না। কখনো জানার চেষ্টাও করিনি। আমাকে যিনি পেয়েছিলেন তিনি ছিলেন এ-বাড়ির কর্তৃ। ওনার নাম ছিল রানী। সবাই রানীবাই বলে ডাকতো। এসব কথা আমি বড় হওয়ার পর জেনেছিলাম। যাই হোক, তিনিই নিয়ে এসেছিলেন আমাকে এখানে। আম্রপালির মা এখানকার মেয়ে ছিল না। আমার যখন বারো বছর তখন সে আসলো এখানে। বয়স হবে উনিশ কি কুড়ি। ওর নাম ছিল মাধবীলতা। সবাই মাধবী বলে ডাকতো। ও যখন এলো তখন গর্ভবতী ছিল। ওর অতীত সম্পর্কে কেউ কিচ্ছু জানতো না। কাউকেই বলেনি ও। আমি ছোট হলেও আমার কাজ ছিল সব মেয়েকে দেখে রাখা। আমার সাথে খুব ভালো সখ্যতা হলো ওর। এরপর আম্রপালি এলো। মাধবী নাচ শিখলো। অন্যন্য মেয়েদের মতো নাচতে শুরু করলো। আম্রপালিকে ও বেশির ভাগ সময় আমার কাছেই রাখতো। তবে এসব কিছু থেকে মাধবী আম্রপালিকে দূরে রাখতো। কিন্তু মেয়েটা বেশিদিন বাঁচলো না। আম্রপালির যখন সাত বছর তখন হঠাৎ করেই ও অসুস্থ হয়ে পড়ে। ও বুঝে গিয়েছিল ওর শেষ সময় এসে গেছে। আমাকে বললো আম্রপালিকে যেন সব কুনজর থেকে বাঁচিয়ে রাখি। এসব কিছু থেকে যেন দূরে রাখি। আমি তখন খুব একটা গুরুত্ব দিইনি। তারপর হঠাৎ একদিন মাধবী চলে গেল। আর আম্রপালিকে রেখে গেল আমার ভরসায়।”

তারানা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। একটা মেয়ে বললেন,

“উনি তো তাহলে তোমার অনেক ছোট, আম্মা। তাহলে ওনাকে আপনি করে কেন ডাকো?”

তারানা মুখ বাঁকিয়ে জবাব দিলেন,

“ছোট তো কী হয়েছে? এখন ও যেখানে গেছে না, সম্মান না দেখিয়ে উপায় নেই। এ-বাড়িটা দেখছিস না? এখানে আগে তোদের মতো ষোল সতেরোটা মেয়ে ছিল না। দু’শ দাসী থাকতো এখানে মনোরঞ্জনের জন্য। কতো জায়গার জমিদারদের আনাগোনা ছিল এখানে জানিস? যদিও এসব আমার শোনা কথা। ওই চৌধুরীদের বাগানবাড়ি ছিল এটা। ওরাই চালাতো সব। যদিও ওদের জমিদারি ওই প্রতাপ চৌধুরীর সময়ই উঠে গেছে।”

একজন বলে উঠলেন,

“প্রতাপ চৌধুরী কে আম্মা?”

“কে আবার? আম্রপালির শ্বশুর। ওর বাবা মারা যাওয়ার পর আর জমিদারি ধরে রাখতে পারেনি। সম্পদও কমতে শুরু করে। তখনও এখানে ওদের যাওয়া আসা ছিল।”

“তুমি এতোকিছু জানো কী করে?”

“বললাম না শুনেছি।”

মোহিনী বললেন,

“তুমি গল্পের বাকীটা বলো তারামা। তারপর কী হলো?”

“তারপর আর কী হলো। আমি আর কিছু আঁটকে রাখতে পারিনি। আম্রপালির যখন ষোল বছর তখন সে নাচা শুরু করে। একদিন আদিত্য চৌধুরী এলো এখানে। আম্রপালির প্রেমে পড়লো। আর একবছর পরই বিয়ে করে নিয়ে গেল।”

“মেনে নিলো সবাই তাকে?”

“ততদিনে প্রতাপ চৌধুরী মরে ভূত। শুধু শান্তি ছিল। সে প্রথমে না মানলেও পরে আস্তে আস্তে মেনে নিয়েছিল। তারপরই তো ওরা ওই জমিদার বাড়ি বিক্রি করে এখন যে বাড়িতে আছে সেখানে উঠলো। এখন তো শান্তি খুব পছন্দ করে আম্রপালিকে।”

রজনী বললেন,

“রানীবাই এর কী হলো আম্মা?”

সবাই হেসে উঠলেন। তারানা বললেন,

“আমি তোদের এতো বড় একটা গল্প বললাম। আর তুই সেই রানীবাইকে নিয়েই পড়ে আছিস? সে আর বেঁচে আছে নাকি এখনো। গাড়ি দুর্ঘটনা করে সেই কবেই মরে গেছে। এখন আর একটা কথাও বলবি না কেউ। খাওয়া শেষ করে সবাই যে যার ঘরে যাবি। দেখ, তোদের আগে পরীর খাওয়াও হয়ে গেছে। সব কথা তোদের শুধু খাওয়ার সময়ই মনে পড়ে।”

“একমাত্র খাওয়ার সময় ছাড়া আমরা এভাবে একসাথে হই-ই বা কখন। খাওয়ার সময়ই তো সবাই এমন আড্ডা দিতে পারি আম্মা। অন্য বাইজীবাড়ির খবর জানি না। তবে তুমি আমাদের এখানে একটা পরিবারের মতো রেখেছো। নাহলে এখন তো কোনো সাধারণ মানুষের ঘরেও পরিবারের সবাই এমন একসাথে বসে খায় না।”

“অনেক কথা বলেছিস। এখন চুপচাপ খা আর আমাকেও খেতে দে।”

সবাই খাওয়ায় মনোযোগ দিলেন। এরপর খাওয়া শেষ করে নিজেদের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। শুধু মোহিনী বাইরে বেরিয়ে গেলেন। তাকে যেতে দেখে তারানা বললেন,

“তুই এই সময় কোথায় যাচ্ছিস মেহের?”

“তাড়াতাড়ি এসে পড়বো তারামা। চিন্তা করো না তুমি।”

চেয়ার টেবিলে বসে কিছু একটা করছিলেন অর্ণব। ঘরের দরজা জানালা সব খোলা। জানালা দিয়ে হু হু করে বাতাস ঘরে ঢুকছে। হঠাৎ দরজায় চোখ পড়তেই দেখলেন মোহিনী দাঁড়িয়ে আছেন। এক দৃষ্টিতে তাকে দেখছেন। অর্ণব দাঁড়িয়ে পড়লেন। মোহিনী ভেতরে এসে তার সামনে দাঁড়ালেন।

“আপনি এ সময় এখানে কী করছেন মেহের?”

“সকালে ডেকেছিলেন?”

“সেটা সকালের কথা ছিল। তবে হিসেবটা এখনো চুকেনি।”

চট করে মোহিনীর হাত ধরে ফেললেন অর্ণব। এবার আর মোহিনীর মাঝে আগের মতো ভয়ডর নেই। না আছে কোনোরকম ছটফটানি। অর্ণব বললেন,

“সকালে কী যেন বলছিলেন আমাকে?”

“কী?”

“বাঁদর বলেছিলেন। তাই না?”

“তো কী বলতাম? অর্ণবদা?”

“কী বললেন?”

“আর বলবো না।”

“শাস্তি তো পেতেই হবে আপনাকে।”

“কী শাস্তি দেবেন?”

মোহিনী খুব শান্ত গলায় কথা বলছেন। অন্যান্য সময়ের মতো তেজ নেই। অর্ণবের কাছে কিছুটা অদ্ভুত লাগছে। এমন মোহিনীর সাথে পরিচয় তার সচরাচর নেই। অর্ণব খেয়াল করলেন মোহিনী তার অনেকটাই কাছে চলে এসেছেন। আমতাআমতা করে বললেন,

“নারীরা সত্যিই মায়াবিনী হয়।”

“আমার শাস্তি দেবেন না?”

“কাল দেবো।”

“কেন?”

“আর কতো রুপ দেখাবেন আপনি?”

“আমি কী করলাম?”

“আপনার এভাবে এ সময় এখানে আসাটা ঠিক হয়নি মেহের। কেউ দেখে ফেললে সমস্যা হবে।”

এবার যেন মোহিনী নিজের আগের বৈশিষ্ট্যে ফিরে এলেন। ভ্রুকুঞ্চন করে বললেন,

“কী সমস্যা হবে?”

“আপনার এখন এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত মেহেরজান।”

“আবার ডাকুন।”

“মেহেরজান।”

“কার কাছে শুনেছিলেন এ নাম?”

“আপনার আগমন আমার জীবনে শরৎকালে হয়েছিল। তাই ডেকেছিলাম মেহেরজান। পরবর্তীতে আপনিই জানিয়েছেন আপনার এ নাম।”

মোহিনী হেসে উঠলেন।

“আমি চিরকাল আপনার মেহেরজান হয়েই থাকতে চাই অর্ণব।

চলবে…

মেহেরজান পর্ব-১৭+১৮

0

#মেহেরজান
#পর্ব-১৭
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

ব্যাগবোঁচকা সাথে নিয়ে তৈরি হয়ে বসে আছেন পদ্মাবতী। অর্ণব এলেই বের হবেন তারা। আম্রপালি অনেক্ষণ যাবৎ বুঝিয়ে অর্ণবকে যাওয়ার জন্য রাজি করিয়েছেন। শমিতকে সাথে যেতে হতে পারে এমনটা আন্দাজ করে তিনি অনেক আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছেন। তাই ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও উপায়ন্তর না পেয়ে অর্ণবকেই যেতে হচ্ছে পদ্মাবতীকে দিয়ে আসার জন্য। মোহিনী পদ্মাবতীর পাশেই বসে ছিলেন। পদ্মাবতী তার উদ্দেশ্যে বললেন,

“তুই আমার সাথে যাবি মোহিনী?”

“ধুর। আমি কী করে যাবো?”

“চল না। আমি ওখানে কাউকেই চিনি না। একা একা কী করে থাকবো? আর কোনোদিন তো তোদের ছাড়া একা গিয়ে কোথাও থাকিওনি। আমার একা ভয় করছে।”

“কিসের ভয়? ওরা বাঘ না ভাল্লুক যে তোকে খেয়ে ফেলবে?”

“তবুও তুই চল আমার সাথে।”

“আবোলতাবোল কথা বলিস না। অর্ণব এলে সাবধানে যাস ওর সাথে।”

“আচ্ছা, তুই অর্ণববাবুকে নাম ধরে ডাকিস কেন?”

“তো কী বলে ডাকবো?”

“শমিতদার মতো তাকেও তো অর্ণবদা বলতে পারিস।”

“কী! অর্ণবদা? আর কিছু পেলি না খুঁজে?”

মোহিনী উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। বললেন,

“তুইও তো তাকে অর্ণবদা বলিস না।”

“ওটা তো আসেই না মুখে। যাকে তাকে কি আর দাদা বানানো যায়?”

“এটাই হলো কথা।”

“তুই যা ইচ্ছে তাই বল। কিন্তু আমার কেন যেন নাম ধরে ডাকতে কেমন একটা লাগে। তাই অর্ণববাবু বলি।”

অর্ণব তৈরি হয়ে নিচে আসতেই সুন্দরপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন তারা। মোহিনী দূর থেকে অর্ণবকে বিদায় জানালেন। তারা চলে গেলে সবাই আবার যে যার কাজে চলে গেলেন। মোহিনীর আর সেখানে মন টিকলো না। তিনি ফিরে এলেন তার বাড়িতে। নিজের আলোকসজ্জায় সজ্জিত ঘর দেখে কেন যেন অস্বস্তি বোধ করলেন মোহিনী। ঘরের জানালাগুলো খুব একটা খোলা হয় না। আজ এক এক করে সবগুলো জানালাই খুলে দিলেন তিনি। মখমলের বিছানায় গা ছেড়ে দিয়ে চোখ বুজতেই অর্ণবের মুখ ভেসে উঠলো। ঠোঁটে স্মিত হাসি ফুঁটে উঠলো তার। আবার পরক্ষণেই মিলিয়ে গিয়ে কপালে চিন্তার রেখে দেখা গেল। চোখ খুললেন তিনি। বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে নিজের ঘুঙুর জোড়া পায়ে বেঁধে নিলেন। নৃত্যের অনুশীলনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ বাদে তারানা ঢুকলেন ঘরে। বললেন,

“নাচ নাচ। ভালো করে নাচ। আজ শহরের এক বাবু আসবে সন্ধ্যায় তোর নাচ দেখতে। একবার ভালো লাগলে টাকায় ভরিয়ে দিয়ে যাবে তোকে।”

মুহূর্তেই থেমে গেলেন মোহিনী। তারানার উদ্দেশ্যে বললেন,

“তারামা, আমি নাচি কেন?”

তারানা অবাক হলেন। বসতে বসতে বললেন,

“নাচবি না তো কী করবি? বাইজীবাড়িতে জন্মেছিস। নাচতে তো হবেই। নাচ ছাড়া আর আছে কী তোর জীবনে?”

মোহিনী ঘুঙুর খুলতে খুলতে জবাব দিলেন,

“আমার মা তো বাইজী ছিলেন না। আমি কেন হলাম?”

“তোর কপালে লেখা ছিল তাই। সবাই কী আর নিজে থেকে এই জগতে আসে না সবার মা এখানে ছিল? ভাগ্য তোদের নিয়ে এসেছে।”

“দোষটা তাহলে আমার মায়েরই। উনি আমাকে এখানে জন্ম না দিলে হয়তো আমাকে এভাবে নেচে পয়সা কামাতে হতো না।”

“নিজের জীবন নিয়ে আফসোস করছিস? আগে তো করতি না। তাহলে এখন কেন?”

“আচ্ছা তারামা, একটা কথা বলবে?”

“কী?”

“বড়মা আমাকে আর পদ্মাকে সমান ভালোবাসেন?”

“হঠাৎ এমন কথা বলছিস কেন? তুই নিজেও খুব ভালো করেই জানিস উনি তোকে কতটা ভালোবাসেন।”

“দুজনকে সমান?”

“কেন নয়?”

“তাহলে আমাকে নিয়ে যাওয়ার পরও আবার এখানে রেখে গেলেন কেন? চাইলেই তো উনি আমার ভাগ্যটা বদলে দিতে পারতেন। তখন আমার জীবন এমন হতো না। আমিও পদ্মার মতো হতাম।”

“ভাগ্য বদলানোর ক্ষমতা কারও হাতে নেই মেহের। তুই যদি জানতি আম্রপালি তখন কোন পরিস্থিতিতে ছিল তাহলে আজ এ কথা বলতি না।”

“জানি আমি। আরেকটা বাচ্চা পালা কী এতোই কঠিন ছিল?”

“ছিল না হয়তো। কিন্তু ওই শকুন্তলা মায়ের কথাতেই তো…”

মোহিনী উঠে দাঁড়ালেন। নিজের কথা শেষ করতে পারলেন না তারানা। তার আগেই মোহিনী বললেন,

“ওই বুড়িটা তাহলে ছোটবেলা থেকেই আমার পেছনে লেগে আছে?”

তারানা অট্টহাসি দিয়ে বললেন,

“এখন এসব চিন্তা বাদ দে। সন্ধ্যার জন্য তৈরি থাকিস। যত ভালো নাচবি, তত কামাবি। আর দু’হাতে ওড়াবি। একদম রানীর মতো থাকবি। নিজের জীবন নিয়ে আফসোস করিস না। হয়তো এর থেকেও খারাপ হতে পারতো।”

তারানা চলে গেলেন। মোহিনী নিজে নিজেই বিড়বিড় করে বললেন,

“এই জীবনযাত্রাই যদি কখনো অর্ণব আর আমার মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় তাহলে এর চেয়ে খারাপ আর কী হবে তারামা?”
.
.
.
গাড়ি থামতেই অর্ণব নেমে গেলেন। পদ্মাবতী হাই তুলতে তুলতে চোখ খুলে এদিক ওদিক দেখে বাইরে এলেন। চোখ ডলতে ডলতে অর্ণবের উদ্দেশ্যে বললেন,

“এসে গেছি আমরা? কোন বাড়ি?”

“এসে গেছি বললেই আসা যায় নাকি? আরও অনেক রাস্তা বাকি।”

“তাহলে গাড়ি এখানে থামালো কেন?”

“চোখে ছানি পড়েছে? দেখছো না সামনে নদী? নৌকা দিয়ে পার হতে হবে।”

“নৌকা?”

“চলো।”

অর্ণব সামনে এগিয়ে গেলেন। পদ্মাবতী নিজের ব্যাগ নিয়ে আস্তে আস্তে আসছেন। অর্ণব পেছনে ফিরে বললেন,

“তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারো না?”

“হাঁটছি তো।”

“ব্যাগে কি পুরো সংসার নিয়ে এসেছো নাকি?”

পদ্মাবতী জবাব দিলেন না। অর্ণবকে অতিক্রম করে গিয়ে নৌকায় উঠলেন। অর্ণব নৌকায় উঠে একটা সিগার ধরিয়ে বললেন,

“এবার জলে পরলে আর ওঠাবো না।”

“পরবোও না। ওটা ডিঙি নৌকা ছিল। আর এটা তো অনেক বড় নৌকা। এবার আর জলে পরছি না।”

অর্ণব স্মিত হাসলেন। নৌকা ছাড়লো। পদ্মাবতী বললেন,

“আচ্ছা, আপনি বাড়ি চেনেন কি করে? এসেছিলেন আগে?”

“চিনিও না, আসিও নি।”

“তাহলে যাচ্ছেন কিভাবে?”

“মা ঠিকানা বলে দিয়েছেন আমাকে।”

“আমাকে তো বললেন না।”

“কারণ তিনি জানেন তোমার ওই মোটা মাথায় ঢুকবে না।”

পদ্মাবতী মুখ গোমড়া করে বসে রইলেন। নৌকায় তাদের সাথে আরও কিছু লোকজন উঠেছে। পদ্মাবতী চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবাইকে দেখছেন। কালো রোগা একটা লোক বড় বড় চোখে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। পদ্মাবতী তাকে দেখে একটু নড়েচড়ে বসলেন। অর্ণবের শার্ট ধরে হালকা টান দিলেন তিনি।

“কী হয়েছে?”

“সামনে ওই লোকটাকে দেখুন। চোখগুলো কেমন লাল হয়ে আছে। আমার সাথে কি ওর কোনো শত্রুতা আছে? দেখে মনে হচ্ছে পারলে এখনই আমাকে মেরে ফেলবে।”

অর্ণব দেখে বুঝতে পারলেন লোকটা পদ্মাবতীর গায়ের গয়নার দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো ছিঁচকে চোর টোর হবে হয়তো। পদ্মাবতীর উদ্দেশ্যে বললেন,

“এতো গয়না পরে আসার কি খুব দরকার ছিল?”

“মানে? এতো গয়না কই পরলাম? হাতে দুটো চুড়ি, গলায় একটা মালা আর কানে দুটো কানেরদুল। এখানে এতো গয়না কই পেলেন আপনি? এগুলো তো আমি বাড়িতেই পরে থাকি সবসময়। আর এসবের সাথে ওই লোকের কী সম্পর্ক?”

“না, কোনো সম্পর্ক নেই। যখন চুরি করতে এসে তোমাকে মেরে ফেলবে তখন স্বর্গে বসে চিন্তা করো কী সম্পর্ক।”

“মানে?”

“এই তুমি সোজা কথা বুঝতে পারো না? দেখে বুঝতে পারছো না লোকটা একটা চোর।”

এতোক্ষণে যেন পদ্মাবতীর টনক নড়লো। নিজের গয়না শাড়ীর আঁচল দিয়ে ঢেকে ফেললেন। মুহুর্তেই লোকটাও অন্যদিকে চোখ ঘোরালেন। নৌকা ঘাটে এসে থামলো। তারা উঠে দাঁড়ালেন। একে একে সবাই নেমে যাওয়ার পর তারা নামলেন। নৌকা থেকে নামতেই পদ্মাবতী বললেন,

“এখন কীভাবে যাবেন? গাড়ি তো আমাদের ওপারে রেখেই চলে গেল।”

“কেন? তুমি আছো কী করতে? এপাড় থেকে সাঁতরে গিয়ে গাড়িটা মাথায় করে নিয়ে আসো আবার।”

একটু দূর থেকে এক লোক বললেন,

“এখানে এই গরুর গাড়ি ছাড়া আর কিছু পাবেন না দাদা। এতে করেই যেতে হবে। কোথায় যাবেন আপনারা?”

“অমলেন্দু বসাকের বাড়ি চেনেন?”

“তিনি তো অনেক আগেই মারা গেছেন।”

“জ্বি। আমরা তার বাড়িতেই যাবো।”

“আপনারা ওনার কী হন?”

“দূরসম্পর্কের আত্মীয়।”

“ওহ। উঠে বসেন আমার গাড়িতে। আমি পৌঁছে দেবো আপনাদের।”

তারা গাড়িতে উঠে বসলেন। গাড়ি চলতে শুরু করলো। পদ্মাবতী চারদিকে চোখ ঘোরাচ্ছেন। মোহিনী ঠিকই বলেছিলেন। গ্রামটা আসলেই অনেক সুন্দর। গাড়ির লোকটা বললেন,

“অমলবাবু অনেক ভালো একটা মানুষ ছিলেন। মারা গেছেন একুশ বছর হলো। তবুও গ্রামের প্রায় সব লোক তাকে এক নামেই চেনে। অনেক দয়ালু ছিলেন। দানও করেছেন অনেক।”

নিজের বাবার প্রসংশা শুনে বেশ খুশি হচ্ছেন পদ্মাবতী। অর্ণব লোকটির উদ্দেশ্যে বললেন,

“সামনে কোনো মিষ্টির দোকান থাকলে দাঁড়াবেন একটু।”

পদ্মাবতী বললেন,

“আপনি এখন মিষ্টি খাবেন?”

“না।”

“তাহলে কী করবেন?”

“খালি হাতে আত্মীয়ের বাড়ি যাবে?”

“বুঝেছি।”

একটা মিষ্টির দোকানের সামনে এসে গাড়ি থামলো। অর্ণব মিষ্টি কিনে এনে পদ্মাবতীর কাছে রাখলেন। গাড়ি চলতে শুরু করলে লোকটা আবার বলতে শুরু করলেন।

“এতো ভালো মানুষ হয়েও বেশিদিন বাঁচলেন না। অল্প বয়সেই সংসার ত্যাগ করলেন। কিন্তু ওনার বউটা নাকি খুব একটা ভালো ছিলেন না।”

পদ্মাবতী সাথে সাথেই বলে উঠলেন,

“কেন?”

“তার মৃত্যুর কয়েকদিন পরেই নাকি অন্য পুরুষের সাথে পালিয়েছেন।”

মাথায় যেন রক্ত উঠে গেল পদ্মাবতীর। ইচ্ছে করছে এখনই ফিরে যেতে। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

“পরপুরুষের সাথে পালিয়েছেন এটা কে বলেছে?”

“কে আবার, অমলবাবুর বাড়ির লোকেরাই জানিয়েছেন। মানে তার মা বোন আরকি।”

“এখন কী অবস্থা ওনার মা বোনদের?”

“ওনার মা এখন বেশ অসুস্থ। বাঁচবেন বলে মনে হয় না। আর ওনার বোন এখানেই আছেন স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর থেকে।”

পদ্মাবতী বিড়বিড় করে বললেন,

“বেশ হয়েছে। বুড়িটা যেন এবার মরেই যায়।”

জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন পদ্মাবতী। অর্ণব ব্যাপারটা বুঝতে পেরে লোকটার উদ্দেশ্যে বললেন,

“তাদের খবর তো ভালোই রাখেন দেখছি।”

“এক গ্রামে থাকি আর খবর রাখবো না?”

“আপনার না রাখলেও চলবে। আপনি গাড়ি চালান ঠিকমতো তাহলেই হবে।”

গাড়িটা একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। লোকটা বললেন,

“এসে গেছি।”

পদ্মাবতী নেমে বললেন,

“এই বাড়ি? আপনি না বললেন অমলেন্দু বসাক অনেক দানশীল ছিলেন। তাহলে তার বাড়ির এমন দশা কেন?”

“তখন তো তারা অনেক বড় পাকাবাড়িতেই থাকতেন। আর্থিক টানাপোড়েনে পড়ে পনেরো আগে তার মা আর বোন ওই বাড়ি বিক্রি করে এবাড়িতে এসে উঠেছেন।”

অর্ণব তার পয়সা মিটিয়ে দিলেন। পদ্মাবতী ভাঙা টিনের দরজায় ধাক্কা দিতেই তা বিকট শব্দ করে খুলে গেল। ভেতর থেকে এক মেয়ে কে কে বলে দৌঁড়ে এলেন। অর্ণব আর পদ্মাবতীর উদ্দেশ্যে বললেন,

“আপনারা কারা?”

“আমি পদ্মাবতী। কুঞ্জনগর থেকে এসেছি।”

পেছন থেকে আওয়াজ এলো,

“কে এসেছেরে শিউলি?”

মেয়েটা চেঁচিয়ে বললেন,

“চিনি না মা। কুঞ্জনগর থেকে এসেছে বললো।”

ভেতর থেকে এবার এক মহিলা দৌঁড়ে এলেন। পদ্মাবতী তার উদ্দেশ্যে বললেন,

“নমস্কার। আমি পদ্মাবতী।”

মুহুর্তেই মহিলাটির মুখে হাসি ফুঁটে উঠলো। তিনি অর্ণব আর পদ্মাবতীকে নিয়ে ভেতরে বসতে দিলেন। পদ্মাবতী মিষ্টির থলেটা তার হাতে দিলেন।

“এসবের আবার কি দরকার ছিল বলো তো।”

“না না ঠিক আছে।”

“এই নাও। শরবত খাও। অনেকটা রাস্তা এসেছো। কান্ত হয়ে গেছো নিশ্চয়ই।”

মহিলাটি বেশ সুন্দর করে কথা বলেন। পদ্মাবতীর খুব ভালো লাগলো। মুখে হাসি নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

“আপনি কে?”

“আমি শর্মিলা। আমি তোমার পিসি হই।”

পরক্ষণেই পদ্মাবতীর সব হাসি যেন মিলিয়ে গেল।

“ওহ।”

“পদ্মাবতী, ও কি তোমার বর? বিয়ে করেছো?”

তার প্রশ্ন শুনে অর্ণব, পদ্মাবতী দু’জনেই খুব বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়লেন। অর্ণব বললেন,

“না, এমন কিছু নয়। আমি শুধু ওকে এখানে পৌঁছে দিতে এসেছি।”

“তোমাকে তো চিনলাম না বাবা।”

“আমি আদিত্য চৌধুরীর ছেলে।”

“ও তুমি আদিত্য আর আম্রপালির ছেলে। আগে বলবে তো। তা শুধু পৌঁছে দিতে এসেছো মানে? থাকবে না?”

“না, আমি এখনই চলে যাবো।”

“এখনই চলে যাবো মানে? কোত্থাও যেতে দিচ্ছি না এখন। গেলে যাবে কিন্তু দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর। বিকেলে রোদটা কমলে যেও।”

শর্মিলা কাউকে রান্না বসানোর জন্য তাগাদা দিতে লাগলেন। অর্ণব বললেন,

“আপনি আমাদের জন্য এতো ব্যস্ত হবেন না। আমরা খেয়েই বের হয়েছি। নতুন করে কিছু রান্না করবেন না আমাদের জন্য। আর যা করার ধীরে সুস্থে করুন। কোনো তাড়া নেই।”

“আচ্ছা। তাই-ই করবো। তোমরা মায়ের সাথে দেখা করবে না?”

পদ্মাবতী হ্যাঁবোধক মাথা নাড়ালেন।

“চলো তাহলে। এখনই দেখা করে নাও।”

অর্ণব আর পদ্মাবতীকে নিয়ে ছোট্ট একটা ঘরে ঢুকলেন শর্মিলা। সেখানে ছোট্ট একটা খাট পাতা। তাতেই এক বৃদ্ধা শুয়ে আছেন। গায়ে যেন একবিন্দুও মাংস নেই। কুঁচকে যাওয়া চামড়া হাড়ের সাথে লেগে গেছে। চোখদুটো কোটরে চলে গেছে। মাথায় চুল নেই বললেই চলে। জীর্ণশীর্ণ শরীরে একটা মলিন কাপড় জড়ানো। পদ্মাবতী বুঝতে পারলেন ইনিই তার দিদা। এতোকিছুর পরও হঠাৎ করেই পদ্মাবতীর যেন তার প্রতি মায়া লাগতে শুরু করলো।

চলবে…

#মেহেরজান
#পর্ব-১৮
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

কনক দেবীর মাথার কাছে এসে বসলেন পদ্মাবতী। ঘুমাচ্ছেন তিনি। শর্মিলা তাকে আস্তে করে ডাকলেন। পদ্মাবতী তাকে ডাকতে মানা করলেন।

“জাগাবেন না ওনাকে। এখন ঘুমাচ্ছেন, ঘুমাতে দিন।”

“তা কী করে হয়? উনি দেখতে চেয়েছেন বলেই তো তুমি এসেছো। কয়দিন বাঁচবেন ঠিক নেই। এখনই দেখে নিতে দাও তোমাকে।”

পদ্মাবতী মানা করার পরও শর্মিলা তাকে ডাকতে লাগলেন।

“মা, ও মা। উঠে দেখুন কে এসেছে।”

ধীরে ধীরে চোখ খুললেন কনক দেবী।

“দেখুন তো চিনতে পারেন নাকি।”

অস্পষ্ট স্বরে কনক দেবী বললেন,

“পদ্মাবতী।”

“ঠিক ধরেছেন একদম। আপনার পদ্মাবতী এসেছে আপনার সাথে দেখা করতে।”

অর্ণব তার পরিচয় দিয়ে কনক দেবীকে প্রণাম করে শর্মিলার সাথে বেরিয়ে গেলেন। পদ্মাবতী একা সেখানেই বসে রইলেন কনক দেবীর সাথে।

“পদ্মাবতী, তুই যে আসবি আমি কল্পনাও করিনি। একদম তোর মায়ের মতো হয়েছিস। দেখতেও আর মন থেকেও।”

পদ্মাবতী কিছু বললেন না। চুপচাপ বসে রইলেন। কনক দেবীর চোখ ভরে উঠলো। জল গড়িয়ে পড়তেই পদ্মাবতী মুছে দিলেন।

“ক্ষমা করে দিস আমাকে পদ্মাবতী। অনেক অবিচার করেছি তোর মায়ের ওপর। ওর কাছে ক্ষমা চাওয়ার কোনো সুযোগ নেই এখন। তুই-ই ক্ষমা করে দে আমাদের।”

পদ্মাবতী তার মাথায় হাত রাখলেন। কনক দেবী আর্তনাদ করে কেঁদে উঠলেন। পদ্মাবতীর হাত বুকে নিয়ে দু’হাতে চেপে ধরলেন তিনি।
.
.
অর্ণব মানা করার পরও খাবারের অনেকগুলো পদ সাজিয়ে টেবিলে রাখলেন শর্মিলা। শিউলি তাদের খাবার বেড়ে দিচ্ছেন। অর্ণব বললেন,

“আর দেবেন না দয়া করে। আমি এতো খেতে পারবো না।”

শর্মিলা বললেন,

“তা বললে কি হয়? আত্মীয়ের বাড়ি এসেছো। একটু বেশি না খেলে চলে নাকি? ও শিউলি, আরও দু’টুকরো মাংস দে ওকে।”

অর্ণব মানা করার আগেই শিউলি বাধ্য মেয়ের মতো অর্ণবের পাতে মাংস বেড়ে দিলেন। পদ্মাবতীর সামনে এসে বললেন,

“তোমাকে আরেকটু দেবো দিদি?”

শর্মিলা বললেন,

“জিজ্ঞেস করছিস কেন? দে দে। বেশি করে দে।”

পদ্মাবতী বললেন,

“না, আর দিস না শিউলি। খাবার বেশি হবে।”

শিউলি মেয়েটা খুব মিশুক হওয়ায় কিছু সময়ের মধ্যেই পদ্মাবতীর সাথে তার সম্পর্ক অনেক গভীর হয়েছে। শর্মিলা আবার বললেন,

“বেশি হবে কেন? তুমি কি ঠিকমতো খাও না? এতো শুকনো কেন? আমার কাছে কয়েকদিন থাকলেই দেখবে কেমন মোটাতাজা হয়ে গেছো।”

“আমি সত্যিই এতো খেতে পারবো না। পরেরবার এলে সাথে করে মোহিনীকে নিয়ে আসবো। ও একাই এর দ্বিগুণ খেয়ে ফেলতে পারবে।”

“মোহিনী কে?”

“আমার বান্ধবী।”

“এবার নিয়ে এলে না কেন সাথে করে?”

“বলেছিলাম তো। ওই তো এলো না।”

“পরের এলে নিয়ে আসবে কিন্তু।”

“আনবো।”

অর্ণবের দিকে তাকালেন শর্মিলা। বেচারা খুব কষ্ট করে আস্তে আস্তে খাচ্ছেন।

“খাচ্ছো না কেন অর্ণব? খাবার ভালো লাগেনি?”

“এমন কিছু না।”

“তাহলে তাড়াতাড়ি খাও। এরপর তো মিষ্টিও আছে।”

“একদম পারবো না মাসিমা। এটাই খুব কষ্ট করে খাচ্ছি।”

“তোমার সমান আমার একটা ছেলে আছে। তোমার থেকে কয়েক বছর বড় হতে পারে। খেতে খুব পছন্দ করতো। আর আমি খাওয়াতে।”

“এখন কোথায় সে?”

“তিন বছর আগে বিয়ে করেছে। এক বছরের একটা বাচ্চাও আছে। বউ বাচ্চা নিয়ে কলকাতায় থাকে। এখানে আসে মাঝেমধ্যে। ওই বছরের এক দুইবার।”

খাওয়া দাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে নিলেন তারা। অর্ণবের জন্য শর্মিলা তার ছেলের ঘরটা খুলে দিয়েছেন। অর্ণব সেখানে চলে গেলেন বিশ্রাম নিতে। পদ্মাবতী শিউলির সাথে তার ঘরে গেলেন। শিউলি বিছানা গোছাতে গোছাতে বললেন,

“দিদি, তুমি কি থাকবে আমাদের সাথে ক’দিন?”

“হ্যাঁ, তুই কি এখন ঘুমাবি নাকি?”

“হ্যাঁ, ঘুমাবো। দুপুরে খাওয়ার পর একটা ভাতঘুম না দিলে চলে নাকি?”

“আমি কী করবো তাহলে?”

“তুমি ঘুমাবে না?”

“না, আমার অভ্যেস নেই এমন সময় ঘুমানোর।”

“ওহহ।”

“আমি বরং বাইরে একটু ঘুরতে যাই।”

“এই রোদে বাইরে যাবে ঘুরতে? এখন এখানেই থাকো। বিকেলে আমি নিয়ে যাবোনি গ্রাম ঘুরে দেখাতে। এখন তুমি একা গেলে মা আমাকে বকবে।”

“তাহলে কী করবো?”

“বই পড়বে? কিন্তু বই তো সব দাদার ঘরে।”

“কোন দাদা?”

“আমার দাদা। যার ঘরে এখন অর্ণবদা রয়েছেন।”

“ওহহ। তুই ঘুমা তাহলে। আমি গিয়ে বই নিয়ে আসি।”

“আচ্ছা।”

নিজেদের ঘর থেকে বের হয়ে অর্ণবের ঘরে এলেন পদ্মাবতী। দরজার কাছে আসতেই দেখলেন অর্ণব আগে থেকেই একটা বই পড়ছেন। বললেন,

“আসবো?”

“কী দরকার?”

“বই নিতে এসেছি।”

“কার জন্য?”

“কার জন্য আবার। নিজের জন্য।”

“তুমি বই পড়বে?”

“হ্যাঁ, তাতে কী?”

অর্ণব বিড়বিড় করে বললেন,

“ভূতের মুখে রাম নাম।”

“কিছু বললেন আপনি?”

“না, কিছু বলিনি। এসো। নিয়ে যাও যা লাগবে।”

পদ্মাবতী ভেতরে এসে বুকশেলফ থেকে খুঁজে খুঁজে শরৎচন্দ্রের একটা বই নিয়ে আবার চলে গেলেন। শিউলির ঘরে এসে দেখলেন তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। মেয়েটাকে পদ্মাবতীর খুব পছন্দ হয়েছে। খুব শান্তশিষ্ট একটা মেয়ে। পদ্মাবতীর চেয়ে কিছুটা ছোট। পদ্মাবতী মানা করার পরও তিনি তাকে দিদি বলেই ডাকেন। এবাড়ির কাউকেই পদ্মাবতীর অপছন্দ হয়নি। অথচ তার ভাবতেই অবাক লাগে এরাই তার মায়ের সাথে এমন অবিচার করেছিলেন। সত্যিই, সময় মানুষকে কতটা পাল্টে দেয়। অনেক্ষণ যাবৎ পদ্মাবতী বই নিয়ে বসে আছেন। এখন তাতেও বিরক্ত লাগতে শুরু করেছে। অভ্যেস না থাকলে যা হয় আরকি। শর্মিলা এসে দরজায় কড়া নাড়লেন। পদ্মাবতী দরজা খুলে দিলে তিনি বললেন,

“চলো। অর্ণব চলে যাচ্ছে।”

পেছনে শিউলিকে দেখে আবার বললেন,

“ও এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি? হায় ভগবান, এই মেয়েকে নিয়ে যে কি করি আমি।”

শর্মিলা ভেতরে গিয়ে শিউলিকে ডেকে তুললেন। পদ্মাবতী বাইরে এলেন। শিউলি আর শর্মিলা এলে অর্ণব কনক দেবীর সাথে দেখা করে তাকে আর শর্মিলাকে প্রণাম করে বিদায় নিলেন।
.
.
.
সন্ধ্যা হয়েছে অনেক্ষণ আগেই। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। জোৎস্নার আলোয় চারদিকের অন্ধকার ঢাকা পড়ে গেছে। মোহিনী জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছেন। খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে তাকে। সাথে এই বাড়িটাও আজ আলোকসজ্জায় সজ্জিত। দূরের রাস্তাটা দিয়ে একটা গাড়িকে চৌধুরী বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে দেখলেন। বুঝলেন অর্ণব ফিরে এসেছেন। রজনী এসে বললেন,

“নিচে চল মোহিনী। লোকজন চলে এসেছে সব। শহর থেকে অনেক বড় বড় লোক এসেছে। জলসা শুরু হবে এখন।”

“আমি না গেলে শুরু হবে কী করে?”

“এতো অহংকার ভালো না বুঝলি। নাচি তো আমরাও।”

“আসে তো ওরা আমার নাচই দেখতে।”

“তোর রূপের অবদান। অথচ কেউ আজ পর্যন্ত ছুয়েও দেখতে পারলো না।”

“জানো রজনীদি, আমার একটা সীমা আছে। যেটা আমি নিজেও লঙ্ঘন করি না। আর কাউকে করতেও দিই না। আর এজন্যই আমি তোমাদের থেকে আলাদা। এজন্যই ওরা আমাকে দেখতে আসে।”

“মধু থাকলে মৌমাছি তো আসবেই। তুই কি নিচে যাবি এখন?”

“তুমি যাও। আসছি আমি।”

রজনী চলে গেলেন। বাক্স থেকে বিভিন্ন অলংকার বের করে পরে নিলেন মোহিনী। সাথে পায়ে বেঁধে নিলেন নিজের ঘুঙুরজোড়া।

চলবে…

মেহেরজান পর্ব-১৫+১৬

0

#মেহেরজান
#পর্ব-১৫
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

সবেমাত্র তৈলচিত্রটা আঁকানো শেষ করেছিলেন পদ্মাবতী। এক নজর সেটার দিকে ভালো করে দেখতেই পেছন থেকে রঙের ছিটা এসে লাগলো তৈলচিত্রের গায়ে। সাথে সাথেই মেজাজ চরমে উঠে গেল তার। অগ্নিমূর্তি হয়ে পেছনে ঘুরতেই অর্ণবকে দেখতে পেলেন। মিটিমিটি হাসছেন তিনি। এ দেখে পদ্মাবতী আরও রাগান্বিত হয়ে বললেন,

“আমার কাজ নষ্ট করা ছাড়া কি আপনার আর কোনো কাজ নেই?”

“আমার তো খেয়েদেয়ে কাজ নেই যে তোমার কাজ নষ্ট করতে যাবো।”

“দেখতেই তো পারছি কতো কাজ আছে। সারাদিন শুয়ে-বসে থাকলে এমনই। কাজ থাকলে এসব দুষ্টু চিন্তা মাথায় আসতো না।”

পদ্মাবতী ঘুরে রঙ ঠিক করতে লাগলেন। অর্ণব এক ঝটকায় আবার তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললেন,

“এই মেয়ে, কাজ নেই মানে? কী বলতে চাও তুমি?”

“কাজ থাকলে কী আর সারাদিন বাড়িতে থাকতেন? কাকুকে দেখলেন না কাজের জন্য আজ সকালে কলকাতা চলে গেলেন। আপনার কাজ থাকলে তো আপনিও চলে যেতেন। বাড়িতে বসে থাকতেন না।”

“তুমি যে আমাকে এসব বলছো, তুমি জানো আমি কত শিক্ষিত? এইসব ছোটখাটো ব্যবসা আমার দ্বারা হবে না।”

পদ্মাবতী আবার উল্টো দিকে ঘুরে রঙ ঠিক করতে লাগলেন। বললেন,

“শিক্ষিত না ছাই। সেই তো কাজ নেই। থাকেন শুয়ে-বসে। কী লাভ হলো তাতে? অথচ বয়স তো কম হলো না।”

অর্ণব আর নিতে পারছেন না। অন্তত এভাবে তাকে কেউ কখনো কাজ আর বয়সের খোটা দেয়নি। এমনকি দিবে তা ভাবতেও পারেননি তিনি। না পারছেন কিছু বলতে, না পারছেন কিছু সহ্য করতে। নিজেকে শান্ত রেখে বললেন,

“বয়সের খোটা দিচ্ছ মেয়ে? দাও দাও। তা আমি নাহয় কিছু করি না। তুমি কী করো?”

পদ্মাবতী সামনে ইশারা করে দেখালেন,

“দেখতে পারছেন না?”

অর্ণব হেসে উঠলেন।

“তা রোজ কত টাকা আয় করো?”

“আয় করি না ঠিকই কিন্তু এটার মধ্যে যে আনন্দটা পাই সেটা তো আর বিক্রি করা সম্ভব নয়।”

“কী সব ছাইপাঁশ ছবি যে আঁকো।”

“মোটেই না। আমি যথেষ্ট ভালো আঁকি। আপনার ছবিও এঁকে ফেলতে পারবো। বুঝেছেন?”

“বুঝেছি।”

হঠাৎ করেই পদ্মাবতীর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সহাস্যে বললেন,

“এই, আপনি আমার আঁকানো চিত্রগুলো দেখবেন?”

এতোক্ষণের সব ঘটনা যেন মেয়েটা একমুহূর্তে ভুলে গেছে। কেউ দেখলে বুঝবেই না যে তাদের মাঝে এতোক্ষণ ঝগড়া হচ্ছিল। অর্ণবের তেমন ইচ্ছে করলো না। তবে হাতে কোনো কাজ না থাকায় সময় ব্যয় করার এরচেয়ে ভালো কিছু খুঁজে পেলেন না। তাই রাজি হয়ে গেলেন। পদ্মাবতী এক এক করে অর্ণবকে নিজের আঁকানো সব চিত্র দেখাতে লাগলেন। হঠাৎ একটা চিত্রে চোখ আঁটকে গেল অর্ণবের। এটা যে মোহিনীর নৃত্যরত ছবি তা বুঝতে সময় লাগলো না। বেশ ভালোই এঁকেছেন পদ্মাবতী। সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে আরেকটা চিত্র থেকে পর্দা উঠাতে যাবেন ঠিক তখনই পদ্মাবতী খপ করে তা নিয়ে নিলেন।

“কী হলো এটা?”

“কই?”

“ওটা নিয়ে নিলে কেন?”

“আপনি এটা দেখতে পারবেন না।”

“দেখতে পারবো না মানে? কেন দেখতে পারবো না? তুমিই নিয়ে এসেছো আমাকে এগুলো দেখাতে। এখন এ কথা বললে তো শুনবো না। দেখাও বলছি।”

“এখন আমিই বলছি যে দেখতে পারবেন না আপনি এটা।”

“কী এমন আছে ওতে যে দেখতে পারবো না?”

“বলতে পারবো না।”

হঠাৎ অর্ণবের উদ্দেশ্যে আম্রপালির ডাক শোনা গেল। অর্ণব তার ডাকে সারা দিয়ে আসছি বলে আবার পদ্মাবতীর উদ্দেশ্যে বললেন,

“যা বলেছিলাম তাই-ই ঠিক। আঁকাও তো সেই ছাইপাঁশই। অথচ এমন ভাব করছো যেন কোথাকার কোন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী তুমি। তোমার থেকে ভালো আঁকতে তো আমি ছোটবেলায়ই পারতাম। তোমাকে তো পরে দেখে নেব।”

অর্ণব চলে গেলেন। যেতে যেতে মোহিনীর চিত্রটাও নিয়ে গেলেন। পদ্মাবতী অর্ণবের কথায় তেমন পাত্তা দিলেন না। এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিলেন। এতোদিনে অর্ণবের এসব আচরণে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন তিনি। স্মিত হেসে চিত্রটা থেকে ধীরে ধীরে পর্দা উঠাতেই সুদর্শন এক যুবকের মুখ ভেসে উঠলো। ব্যক্তিটি আর কেউ নন বরং অর্ণব।
.
.
.
শমিত চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে মুখে দিতেই মিতালি বললেন,

“দাদা।”

“কী হয়েছে?”

“আজ একটু তাড়াতাড়ি ছেড়ে দাও না।”

“কেন?”

“মাথাটা না প্রচন্ড ব্যথা।”

“মাত্রই তো পড়া শুরু করলি। আগে যেই অংকটা করতে দিয়েছি ওইটা কর। প্রতিদিন তোর একই বাহানা।”

“একই কই হলো? একদিন মাথাব্যথা তো একদিন পেটে ব্যাথা বলি। তাহলে এক কিভাবে হয়?”

“হ্যাঁ, আরও কত অজুহাতই তো আছে তোর কাছে। এসব অজুহাত দেওয়া বাদদে। এবার ভালো করে পড় একটু। নয়তো এবারও আর উপরের শ্রেণীতে উঠতে পারবি না। সেই একই শ্রেণীকক্ষে থেকেই বুড়ি হবি। শেফালীকে দেখেও তো শিখতে পারিস কিছু। সব পরীক্ষায় কত ভালো ফলাফল করে দেখেছিস। তোরা তো দু’বছরের ছোট বড়। কিন্তু দেখ শেফালী কত উপরে উঠে গেল আর তুই ফেল করতে করতে নিচেই পড়ে রইলি। অংকটা তাড়াতাড়ি কর দেখি।”

“আমি তো তোমার ভালোর জন্যই তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিতে বলেছিলাম।”

“এখানে আমার কী ভালো?”

“শেফালী দিদিই তো বললো।”

“কী বললো?”

“একটু আগে ছেড়ে দিলে তোমারও পরিশ্রম কম হয় আর কোনো দরকারি কাজ থাকলে সেটাও করে নিতে পারো।”

“এটা শেফালী বলেছে নাকি তোর বানানো কথা তা খুব ভালোই বুঝতে পারছি। কোনো তাড়াতাড়ি ছুটি হবে না।”

“ঠিকাছে। আমি তাহলে দিদিকে বলে দেব যে তুমি দেখা করতে পারবে না।”

“কোন দিদি?”

“কোন দিদি আবার? আমার তো একটাই দিদি। শেফালী দিদি।”

“কী বলেছে শেফালী?”

“বলতে তো চেয়েছিলাম কিন্তু বলেই বা কী হবে। তুমি তো আমাকে পড়াচ্ছো। যেতেই পারবে না।”

“দেখ মিতালি। মাথা গরম করিস না। এভাবে ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা না বলে ঠিকমতো খুলে বল পুরোটা।”

“আগে ছুটি দাও।”

“ঠিকাছে। আজ ছুটি।”

“আজ সন্ধ্যার আগে দিদি দেখা করতে বলেছে তোমাকে।”

“কোথায়?”

মিতালি একটা চিঠি বের করে শমিতের হাতে দিলেন।

“এই নাও। দিদির চিঠি। এতে সব লেখা আছে।”

শমিত চিঠিটা নিয়ে পড়তে শুরু করলেন। মিতালি উঠে যেতে যেতে আবার দাঁড়িয়ে পড়লেন। বইয়ের ভাজ থেকে টাকা বের করে শমিতের দিকে এগিয়ে দিলেন। বললেন,

“তোমার এ মাসের বেতন। মা আমার কাছে দিয়ে রেখেছিল তোমাকে দেওয়ার জন্য।”

মিতালি চলে গেলেন। শমিত পুনরায় চিঠি পড়তে মনোনিবেশ করলেন।
.
.
অর্ণবদের বাড়ির ছাদ থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। ছাদে দাঁড়িয়েই শমিত আর শেফালীকে হাত ধরাধরি করে যেতে দেখছেন তিনি। একটু পরপর হেসে উঠছেন তারা। কী সুন্দরই না লাগছে তাদের দেখতে। শমিত শেফালীর কানের পেছনে একটা জবা ফুল গুঁজে দিলেন। এরপর মাঠের মাঝখানে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে গিয়ে বসলেন তারা। পদ্মাবতী এসে অর্ণবের পাশে দাঁড়ালেন। অর্ণবের উদ্দেশ্যে বললেন,

“কী দেখছেন?”

অর্ণব মুখে কিছু বললেন না। সামনে ইশারা করে দেখালেন। পদ্মাবতী কিছুটা সামনের দিকে ঝুঁকে চোখ ছোট ছোট করে দেখার চেষ্টা করলেন। এরপর অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে বললেন,

“ওটা শমিতদা আর শেফালী না?”

“এমন ভাব করছো যেন কিছু জানোই না।”

“ভাব করছি মানে? আমি আসলেও এ ব্যাপারে কিছু জানতাম না। জানলে তো পিসিমাকে সেই কবেই বলতাম।”

অর্ণব ভ্রুকুটি করে বললেন,

“জানতে না মানে? কোন জগতে থাকো তুমি? চোখের সামনে কী হয় তা দেখো না? দেখে কিছু বুঝতে পারো না? আর পিসিকে বলবে মানে? পিসিকে কে বলতে বলেছে তোমাকে?”

“তো জানাবো না?”

“কেন জানাবে? প্রেম করছে ওরা। তোমার কী সমস্যা? জানালে ওরা নিজে জানাবে। তুমি কেন জানাতে যাবে? এখম যদি আমি প্রেম করি তাও তুমি আমার মাকে গিয়ে জানাবে? আচ্ছা, তুমি প্রেম করলে জানাবে?”

“জানাবোই তো।”

“আবার!”

“না না না। কাউকে কিচ্ছু জানাবো না আমি। সত্যি বলছি। একদম চুপ থাকবো।”

অর্ণব নিজের হাত ঘড়ির দিকে তাকালেন। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চললো। আর কিছুক্ষণ বাদে অন্ধকারও নেমে আসবে। মোহিনী আজ সারাদিন একবারও এলেন না। অর্ণব পদ্মাবতীর উদ্দেশ্যে বললেন,

“আরেকজন কই? এলেন না আজ সে?”

“কে?”

“তোমার সাথে যে থাকে।”

“ওহহ, মোহিনী। ওর পায়ে চোট লেগেছে। তাই আসতে পারেনি। আপনি কেন জিজ্ঞেস করছেন?”

“ভাবছিলাম তুমি আজ আমার পেছনে কেন পড়ে আছো। এখন বুঝতে পারলাম বিরক্ত করার মানুষ পাওনি আজ। তাই আমাকে জ্বালিয়ে মারছো।”

“আপনার সাথে আমার কথা বলতে আসাটাই ভুল হয়েছে। ক্ষমা করুন।”

“বুঝতে যখন পেরেছো তো যাও এখান থেকে।”

“আমি কেন যাবো? আপনি যান।”

অর্ণবের কথা বাড়াতে ইচ্ছে করলো না। তাই তিনি সিড়ির উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেলেন।
.
.
.
রাতের খাবার শেষ করে অনেক্ষণ আগেই নিজের ঘরে এসেছেন অর্ণব। টুকটাক কাজ করে আলো নিভিয়ে শুয়েও পড়েছেন। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না তার। এরইমধ্যে বিদ্যুৎ চলে গেলে বিরক্ত হয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলেন তিনি। ঘরের মধ্যেই কিছুক্ষণ পায়চারি করে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। হাজারো জোনাকির আলো যেন রাতের অন্ধকারকে ঘুচিয়ে দিয়েছে। অর্ণবের ঘরে আর মন টিকলো না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি। এসে আবার সেই নদীর পাড়ে বসলেন। আজ মোহিনী আসবে কীনা তা জানা নেই। এ বিষয়ে কোনো কথা হয়নি তার সাথে। তবুও কেন যেন বারবার এখানে আসতে ইচ্ছে করছিল অর্ণবের। বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেল। অর্ণব একটা সিগার জ্বালালেন। প্রথম টান দিতেই পাশের রাস্তা দিয়ে কাউকে আসতে দেখলেন তিনি। হাতে হ্যারিকেন। অর্ণব সিগারটা ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। অন্ধকারে চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। আরেকটু কাছে আসতেই তাকে চিনতে পারলেন। কিন্তু যার আশা অর্ণব করেছিলেন, সে তিনি নন। তাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে পদ্মাবতী এসে দাঁড়ালেন তার সামনে। হ্যারিকেনটা উঁচু করে ধরতেই তার আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠলো পদ্মাবতীর মায়া মাখা মুখাবয়ব। অর্ণব এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সেদিকে।

চলবে..

#মেহেরজান
#পর্ব-১৬
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

আজ প্রচন্ড রোদ ওঠায় দুপুরের কড়া রোদে ছাদে আচার আর শুকনো লঙ্কা শুকাতে দিয়েছেন শকুন্তলা। পাহারা দেওয়ার জন্য রেখে গেছেন পদ্মাবতীকে। শকুন্তলার আদেশ মানতেই বিগত দেড় ঘন্টা যাবৎ পদ্মাবতী লাঠি হাতে নিয়ে ছাদে বসে আছেন। ঘেমে-নেয়ে একদম একাকার অবস্থা। একটা দুটো কাক এলেই লাঠি নিয়ে তাড়া করছেন যাতে কোনোকিছু নোংরা না করতে পারে। ছাদের দরজা দিয়ে মোহিনীকে খোড়াতে খোড়াতে ঢুকতে দেখে বললেন,

“সাবধানে আয়।”

মোহিনী এসে পদ্মাবতীর পাশে বসলেন।

“পা কাটলো কী করে তোর?”

“দেখতে পাইনি। ভুল করে ভাঙা কাঁচে পা রেখেছিলাম।”

“দেখতে পাসনি মানে? কোন দিকে তাকিয়ে হাঁটছিলি?”

মোহিনী জবাব দিলেন না। পদ্মাবতী মোহিনীর পায়ের দিকে একবার দেখে আবার বললেন,

“তুই শুধু শুধু আসতে গেলি কেন আজ? আর দু তিনদিন বিশ্রাম নিলেই পারতি।”

“তিনদিন তো ছিলামই। আর কতদিন থাকবো? তুই তো মনে হয় ভালোই ছিলি আমাকে ছাড়া।”

“একদম না।”

“আচারের বৈয়ামটা নিয়ে আয় তো।”

“এখনও খাবি?”

“সমস্যা কোথায় খেতে?”

“দাঁড়া। এনে দিচ্ছি।”

পদ্মাবতী আচারের বৈয়াম এনে মোহিনীর হাতে দিলেন। মোহিনী একবার খেয়েই রেখে দিলেন। পদ্মাবতী বললেন,

“কী হলো? রেখে দিলি কেন? আর খাবি না?”

“উহু।”

“কেন?”

“শুধু মিষ্টি। টক ঝাঁল কিছুই নেই। নিশ্চয় তুই বানিয়েছিলি।”

পদ্মাবতী হ্যাঁবোধক মাথা নাড়লেন। মোহিনী বললেন,

“এরপর বড়মার থেকে ভালো করে শিখে তারপর বানাবি।”

হঠাৎ করেই আকাশের অবস্থা পাল্টে গেল। মুহুর্তেই চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। পদ্মাবতী সব গোছাতে শুরু করলেন। চিত্রাও দৌঁড়ে ছাদে এসে পদ্মাবতীর সাহায্য করতে লাগলেন। দু’জনে মিলে সবকিছু চিলেকোঠায় নিয়ে রাখলেন। একটা, দুটো, তিনটা করে বৃষ্টির অসংখ্য ফোঁটা মোহিনীর হাতে মুখে পড়তে লাগলো। পদ্মাবতী তাকে ডাক দিলেন।

“এই মোহিনী, ভেতরে আয়। ভিজে যাবি তো।”

মোহিনী উঠে তাদের কাছে গেলেন। সেখানে রাখা ছোট্ট একটা খাটে বসতেই মুষলধারে বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করলো। চিত্রা বললেন,

“একটু আগেই কী সুন্দর রোদ ছিল। এক মুহুর্তে সব বদলে গেল। দেখবি একটু পরই চলে যাবে।”

তারা সেখানে বসেই কিছুক্ষণ গল্পগুজব করলেন। কিন্তু মোহিনী শুধু শুনেই গেলেন। কিছু বললেন না। পদ্মাবতী মাঝে একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন সে এতো চুপচাপ কেন। মোহিনী এমনি বলে প্রশ্নটা কাঁটিয়ে নিয়েছেন। কিছুক্ষণ পরেই বৃষ্টি একদম থেমে গেল। চিত্রা বললেন,

“দেখেছিস? বলেছিলাম না একটু পরই চলে যাবে।”

“কিন্তু ছাদ তো একদম ভিজিয়ে দিয়ে গেল। শুকাতে দেব কোথায় আবার?”

“শুকাতে দিতে হবে না আর। রোদও নেই এখন। নিচে নিয়ে চল।”

চিত্রা পদ্মাবতী একটা একটা করে সব জিনিসপত্র নিয়ে নিচে নেমে এলেন। তাদের পেছন পেছন মোহিনীও এলেন। হঠাৎ কেউ তার হাত ধরে হেঁচকা টানে সরিয়ে নিয়ে এসে মুখ চেপে ধরলেন। চিত্রা পদ্মাবতী নিজেদের মতো চলে গেলেন। পেছনে কী হয়েছে তারা তা টেরই পাননি। শঙ্কিত চোখে অর্ণবকে দেখে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলেন মোহিনী। তবে অর্ণব তাকে বেশ শক্ত করেই ধরে রেখেছেন। মুখ চেপে ধরায় কিছু বলতেও পারছেন না। অর্ণব ধমকের সুরে বললেন,

“নড়বেন না একদম।”

মোহিনী শান্ত হয়ে দাঁড়ালেন। অর্ণব তার মুখ ছেড়ে দিলেন।

“কী হয়েছে?”

“ইদানীং আপনি একটু বেশিই অনিয়ম করছেন কিন্তু। অনিচ্ছায় নাকি ইচ্ছে করেই?”

“কী অনিয়ম করলাম?”

“এতোদিন পরপর আসছেন কেন? পায়ে ব্যথা?”

“হ্যাঁ। দেখছেন না?”

অর্ণব পায়ের দিকে তাকালেন। সুন্দর করে পট্টি বাঁধা। মনে পরলো সেদিন পদ্মাবতী একবার বলেছিলেন মোহিনীর পা কেটে গেছে।

“কাটলো কী করে?”

“তা আপনার না জানলেও চলবে।”

“সেদিন আমাকে আমাকে অপেক্ষায় রেখে আপনি আসেননি। এটা তারই শাস্তি ছিল। এলেন না কেন?”

“এসেছিলাম।”

“মিথ্যে বলবেন না একদম।”

“আমি মিথ্যে বলি না। আপনি যে গাছের নিচে বসে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিলেন তা খুব ভালোভাবেই দেখেছি। আর পা না আপনার সাথে দেখা করতে গিয়েই কেটেছে।”

“আবার মিথ্যে বললেন। আমি নাক ডাকি না।”

“ডাকেন।”

“আমাকে ওঠালেন না কেন ঘুম থেকে?”

“প্রয়োজন বোধ করিনি।”

“তো ডেকেছিলেন কেন?”

“যার জন্য ডেকেছিলাম তা তো বলেই দিয়েছি। আর কী?”

“আমার জবাব কই?”

মোহিনী এবার অর্ণবকে ধাক্কা দিয়ে তার থেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে দিলেন। চলে যেতে যেতে বললেন,

“সেদিন যেন কোন পাঞ্জাবীটা পরেছিলেন আপনি? গিয়ে ওটার পকেটে খুঁজে দেখুন।”

অর্ণব আর এক মুহুর্তও দাঁড়ালেন না। নিজের ঘরে এসে পাঞ্জাবী খুঁজতে লাগলেন। পাঞ্জাবীর পকেটে হাত দিতেই একটা চিরকুট পেলেন। যার মধ্যে গোঁটা গোঁটা করে লেখা “অর্ণব চৌধুরী, আমি আপনার প্রস্তাবে রাজি আছি।”
.
.
.
নিজের ঘরেই ব্যস্ত ভঙ্গিতে পায়চারি করছেন আম্রপালি। হাতে একটা খাম। খামের ওপর লেখা ঠিকানাটা দেখেই আঁতকে উঠেছেন তিনি। চিঠিটা সুন্দরপুর থেকে এসেছে। চিঠিটা খুলবেন কী খুলবেন না তা নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছেন তিনি। পাত্রে জল ভরে ঢকঢক করে খেয়ে নিলেন। শান্ত হয়ে খাটে বসে খাম থেকে চিঠিটা বের করে পড়তে শুরু করলেন।

“সুজনীয়াসু,
আশা করি ভালো আছো। তুমি বয়সে আমার ছোট হবে। তাই তুমি করেই বলছি। আমাদের মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই। তাই হয়তো চিনতে পারছো না। তবে আমি তোমাকে খুব ভালো করেই চিনি। আমি পারমিতার স্বামী অমলেন্দু বসাক এর দিদি। এবার চিনতে পেরেছো হয়তো। জেনেছি অমলেন্দু আর পারমিতার সন্তানকে মমতায় জড়িয়ে রেখেছো তুমি। সুন্দর একটা নামও দিয়েছো ‘পদ্মাবতী’। হয়তো ভাবছো হঠাৎ এতো বছর পরে আমার চিঠি তোমার কাছে কেন। আমি বেশি কথা বাড়াবো না। তাই সোজাসুজিই বলছি। আমার মা অর্থাৎ পদ্মাবতীর দিদিমা মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে এখন মৃত্যুশয্যায়। যেকোনো দিন গত হতে পারেন। তার শেষ ইচ্ছা তিনি একটিবারের জন্য পদ্মাবতীকে দেখবেন। তার শেষ ইচ্ছা রাখতেই তোমার কাছে আমার এ চিঠি লেখা। আমি তোমার কাছে মিনতি করছি, পুরনো সব কথা ভুলে যত শীঘ্রই পারো পদ্মাবতীকে এখানে কয়েকটা দিনের জন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করো। সম্ভব হলে চিঠি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই।

ইতি,
শর্মিলা”

চিঠিটা রেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন আম্রপালি। কিন্তু এখন তার কী করা উচিত তা বুঝে উঠতে পারছেন না। পদ্মাবতীকে পাঠাবেন নাকি পাঠাবেন না, এ নিয়ে যেন আরও চিন্তায় পড়ে গেলেন। নিজেকে আর এতো প্রশ্নের সম্মুখীন না করে পদ্মাবতীকে ডেকে পাঠালেন। তিনি এলেন।

“আমায় ডেকেছিলেন বড়মা?”

“ভেতরে আয়।”

পদ্মাবতী আম্রপালির সামনে এসে বসলেন। আম্রপালি পুনরায় চিঠিটা পড়ে তাকে শোনালেন। জিজ্ঞেস করলেন,

“কী করবি? যেতে চাস নাকি চাস না? তুই যা বলবি তাই হবে।”

পদ্মাবতী নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললেন,

“আমি যাবো না।”

“কেন?”

“আমার বাবা মারা যাওয়ার পর যারা কীনা গর্ভবতী অবস্থায় আমার মাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। বিন্দুমাত্র মায়াও দেখাননি। এতো বছর আমার কোনো খবর রাখেননি। আর আজ বিশ বছর পরে মৃত্যুশয্যায় এসে তার আমাকে দেখতে ইচ্ছে হলো? সত্যি বলতে তার এই অবস্থায় আমারও একবিন্দু মায়া হচ্ছে না। তাহলে শুধু শুধু কেন যাবো?”

“এভাবে বলিস না। মানুষ মৃত্যুকে নিজের সামনে না দেখলে পাপের কথা চিন্তা করে না। অনুতপ্তও হয় না। হয়তো আজ এতো বছর পর এসে সে নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত। তোর কাছে ক্ষমা চান। তোরও উচিত ক্ষমা করে দেওয়া।”

“সত্যিই ক্ষমা করে দেবো?”

আম্রপালি পদ্মাবতীর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। পদ্মাবতী আবার বললেন,

“আমার মায়ের সাথে কী হয়েছিল তা তো আপনিই আমাকে জানিয়েছেন। যেখানে আমি শুধু শুনেই তাদের জন্য নিজের মনে এতো ঘৃণা পুষে রেখেছি সেখানে আপনি সবটা দেখেও আমাকে ক্ষমা করে দিতে বলছেন?”

“কারও জন্য মনে ঘৃণা পুষে রাখিস না পদ্মা। সুখী হতে পারবিনা। কুরে কুরে খাবে তোকে। ক্ষমা করে দেখিস কতো শান্তি লাগে। মনের বোঝা হালকা হয়।”

“আমি যাবো না। আপনিই বলেছেন আমি যা চাইবো তাই হবে। আর আমি যেতে চাই না।”

পদ্মাবতী দৌঁড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। কয়েকবার ডেকেও তাকে থামাতে পারলেন না আম্রপালি। মোহিনী আম্রপালির ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,

“ও ওভাবে দৌঁড়ে চলে গেল কেন?”

“সুন্দরপুর যেতে বলেছি বলে।”

“কেন যাবে?”

“চিঠি এছেসে। ওর দিদিমা অসুস্থ। ওকে একটাবার দেখতে চেয়েছে। তাই বলেছি ওদের ক্ষমা করে দিয়ে ওনাকে একবার দেখে আয়।”

“কেন ক্ষমা করবে? আর দেখতে চেয়েছে বলেই যেতে হবে নাকি?”

“তোর মধ্যে কি মায়াদয়া একদমই নেই? এই তোর সাথে থেকে থেকে মেয়েটা এমন নির্দয়া হয়েছে। কোথায় ওকে একটু বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ওখানে পাঠাবি। তা না করে কেন কেন করছিস।”

“তাহলে আপনি কী চাইছেন? আমার এখন কী করা উচিত?”

আম্রপালি মোহিনীর হাত ধরে অনুরোধের সুরে বললেন,

“ওকে একটু বোঝা না যেন ওখানে যায়।”

“যখন আমি ওর যাওয়া নিয়ে নিজেই রাজি নই তাহলে আমি এটা কেন করবো?”

আম্রপালি মোহিনীর হাত ছেড়ে দিলেন। উচ্চস্বরে বললেন,

“আমার জন্য করবি। এখনও আপত্তি আছে? যদি থাকে তাহলে পরে আসিস আমার কাছে কিছু চাইতে। দেখবো কে দেয়।”

“ঠিকাছে। রাগ করবেন না। আমি ওকে বোঝাবো।”

আম্রপালির মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

মোহিনী আম্রপালির ঘর থেকে পদ্মাবতীর ঘরে আসতেই পদ্মাবতী বলে উঠলেন,

“আমাকে একদম কিছু বোঝাতে আসবি না।”

“আমি কী বোঝাবো তোকে?”

“ওইযে বড়মা এতোক্ষণ যা বোঝালেন। একে ক্ষমা করে দে, ওকে ক্ষমা করে দে। আমি কি দয়ার পাহাড় নাকি?”

“আমার তো খেয়েদেয়ে কাজ নেই যে তোকে ওসব বোঝাতে আসবো।”

“তাহলে কী করতে এসেছিস?”

“তুই সুন্দরপুর যাবি এটা বলতে এসেছি।”

“একদম না। সেই তো তুই একই কারণে এসেছিস এখানে।”

“একই কোথায়? আমি কী বলেছি ক্ষমা করে দে?”

“তাহলে?”

“শুনেছি ওই গ্রামটা নাকি অনেক সুন্দর। তুই ঘুরতে যা না।”

“মানে?”

“মানে তুই ক’দিন ওখানে ঘুরে বেড়িয়ে আয়। বড়মাও খুশি হবেন আর তোর মনটাও ভালো হয়ে যাবে।”

“ধুর। একটা মানুষ অসুস্থ। সেখানে থাকলে কখনো মন ভালো হবে?”

“ওই বুড়িটা এমনেও মরবে ওমনেও মরবে। তাতে তোর কী? মনে করবি তোর কেউ হয়ই না। তুই থাকবি তোর মতো।”

পদ্মাবতী কতক্ষণ মোহিনীর দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলেন। এরপর বললেন,

“এসব চিন্তাভাবনা শুধু তোর মনেই আসা সম্ভব।”

“যাবি কিনা বল?”

পদ্মাবতী কিছু সময় ভেবে উত্তর দিলেন,

“ঠিকাছে। আমি যাবো।”

“তাহলে বড়মাকে জানিয়ে আয়।”

অন্য ঘর থেকে আম্রপালি যেন শুনতে পান সেজন্য পদ্মাবতী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মোহিনীর উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললেন,

“আমি কাল সুন্দরপুর যাচ্ছি। কিন্তু শুধু তোর কথা রাখতে মোহিনী।”

চলবে…

মেহেরজান পর্ব-১৩+১৪

0

#মেহেরজান
#পর্ব-১৩
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

খাবার টেবিলের ওপর গামলা ভর্তি লুচি দেখে লোভ সামলাতে পারলেন না মোহিনী। খাওয়ার জন্য হাতে নিতেই বুঝতে পারলেন এইমাত্রই ভাজা হয়েছে। প্রচন্ড গরম। কিন্তু তিনি তা উপেক্ষা করলেন। ফুঁ দিয়ে কয়েকবার হাত বদল করেই খাওয়া শুরু করে দিলেন। এরমধ্যেই পদ্মাবতী আর শকুন্তলা এসে উপস্থিত হলেন সেখানে। পদ্মাবতীর হাতে আলুরদম আর শকুন্তলার হাতে আরও এক গামলা লুচি। পদ্মাবতী আলুরদমটা মোহিনীর সামনে রেখে বললেন,

“এই নে। এটা দিয়ে খা।”

মোহিনী খাবার মুখে নিয়েই কিছু একটা বললেন। স্পষ্ট বোঝা গেল না।

“কী?”

মোহিনী এবার খাবার গিলে বললেন,

“আগে দিয়ে যেতে পারলি না। শুধু শুধু শুকনো লুচি খাচ্ছিলাম।”

“হলোই তো মাত্র।”

মোহিনী আলুরদম দিয়ে একটা আস্ত লুচি মুখে পুড়ে নিলেন। শকুন্তলা বলে উঠলেন,

“আস্তে খা মোহিনী। মুখ পুড়বে তো।”

“পুড়বে না ছোটমা, পুড়বে না। এখন শান্তি মতো খেতে দিন তো।”

“তুই যে এতো কী করে খাস। মাঝেমাঝে আশ্চর্যই লাগে।”

শকুন্তলা চলে গেলেন। পদ্মাবতী জল এনে মোহিনীর সামনে রাখলেন। কপালে হাত দিয়ে বললেন,

“এখন কেমন আছিস? জ্বর কমেছে?”

“একদম। না কমলে কি আর আসতে পারতাম।”

“কত্তোদিন পর দেখলাম তোকে। এই ক’দিনেই একদম শুকিয়ে গেছিস। সত্যিই, জ্বর কখনো এতোদিন থাকে নাকি।”

“আমি তো ভেবেছিলাম এবার ঈশ্বরের দর্শন পেয়েই যাবো।”

“যাহ। কি বলিস এসব।”

“তুই খাচ্ছিস না কেন?”

“খাবো। পরে।”

মোহিনী পদ্মাবতীর মুখের সামনে খাবার ধরে বললেন,

“এই নে। আমি খাইয়ে দিচ্ছি। খা এবার।”

“হুহ, ঢং দেখে আর বাঁচি না। এতোদিন আমার হাতে খেয়ে এসে আজ এসেছিস আমাকে খাইয়ে দিতে।”

পদ্মাবতী খেতে যাবে তখনই মোহিনী হাত সরিয়ে নিয়ে নিজে খেয়ে ফেললেন।

“থাক। খেতে হবে না তোকে। এমন ভাব করছিস যেন রোজ রোজ খাইয়ে দিস।”

“তাই বলে মুখের থেকে খাবার কেড়ে নিলি এভাবে?”

“যাহ তো।”

মোহিনী বিষম খেতেই পদ্মাবতী তার দিকে জল এগিয়ে ধরলেন।

“আস্তে খা না। খাবার তো আর উড়ে যাচ্ছে না। সাবধানে খা।”

মোহিনী একাধারে ষোলটা লুচি খেয়ে ফেললেন। এরপর একটা লম্বা ঢেকুর তুলে আয়েস করে বসলেন। পদ্মাবতী হা করে মোহিনীর খাওয়া দেখছিলেন। তার উদ্দেশ্যে মোহিনী বললেন,

“এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? নজর লাগছে না? আমার যদি পেট ব্যথা হয় তো তোর দোষ।”

“হবে না পেট ব্যথা। খাওয়া শেষ তোর নাকি আরও খাবি? এবার চল আমার সাথে।”

“কই যাবো?”

“চল।”
.
.
.
নিজের সব শাড়ি গয়না বের করে বিছানায় ছড়িয়ে ফেলেছেন পদ্মাবতী। একটার পর একটা শাড়ি মোহিনীর গায়ে রেখে দেখে চলেছেন তিনি। মোহিনী বিরক্তির সুরে বললেন,

“কি করছিস বলতো?”

“দাঁড়া সোজা হয়ে। দেখতে দে।”

“না। বল আগে।”

“তোকে সাজাবো আজ। একদম বউয়ের মতো। দেখবো তোকে বউ সাজলে কেমন লাগে।”

“ধুর। পাগলামি করিস না তো।”

“পাগলামি কিসের? বউ তো তুই সাজবিই একদিন। তোর বিয়ের দিন।”

মোহিনী উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। বললেন,

“আমি কই থেকে এসেছি ভুলে গেছিস তুই? দেখেছিস কারও বিয়ে হতে বা কেউ করেছে কখনো বিয়ে এমন মেয়েদের?”

“এমন মেয়ে মানে কী? কেমন মেয়ে? তুই ওদের মাঝে পড়িস না। তুই আলাদা। কারও বিয়ে হয়নি তাতে কী? তোর হবে।”

“তোকে বোঝানোর ক্ষমতা আমার নেই।”

“এইতো বুঝেছিস। এবার তাড়াতাড়ি এই শাড়িটা পরে নে।”

মোহিনী শাড়ি পরতেই পদ্মাবতী গয়না দেখতে শুরু করলেন। নিজের পছন্দ মতো সব গয়না একটা একটা করে মোহিনীকে পরাতে শুরু করলেন। শেষে মোহিনীর চুলগুলো সুন্দর করে খোপা করে ফুল লাগিয়ে দিলেন। মাথায় ঘোমটা তুলে দিয়ে বললেন,

“দেখেছিস? কত্তো সুন্দর লাগছে তোকে?”

মোহিনী নিজেকে আয়নায় দেখলেন। নিজেকে একটা নতুন রুপে দেখতে পেলেন তিনি। যা কখনো বাস্তবে পরিণত হবে কিনা তা নিয়েও সংশয় রয়েছে৷

“বড়মাকে বলবো তোকে আর আমাকে যেন একই বাড়িতে বিয়ে দেয়।”

“যেন বিয়ের পর ঝগড়া করতে পারিস?”

“ঝগড়া কেন করবো? বড়মা আর ছোটমাকে দেখিস না কেমন বোনের মতো থাকে। আমরাও এমন হবো।”

“তা ঠিক। ভাগ্যিস সংসারে অশান্তি তৈরির জন্য ছোটমার মায়ের মতো তোর বা আমার মা নেই। বুড়িটা যখনই আসে এবাড়িতে তখনই কিছু না কিছু অশান্তি করেই যায়। আমাকে তো সহ্যই করতে পারে না।”

“এমন করে বলিস না মোহিনী। উনি যেমনই হোক। আমাদের গুরুজন।”

“ঠিকাছে। বলবো না। আর সে বাড়িতে দু’জন ছেলে না থাকলে কি করবি? তখন সতীন বানাবি আমাকে?”

“যাহ। তাই আবার হয় নাকি?”

“কেন হবে না? তুই চাইলেই হবে।”

“না বাবা না। আমি এটা করতে পারবো না।”

“কেন?”

হঠাৎ অর্ণবের চেঁচামেচি শোনা গেল। মোহিনী বললেন,

“কী হয়েছে? উনি চেঁচাচ্ছেন কেন?”

“চা দিইনি আজ ওনার ঘরে। এজন্য মনে হয়।”

“দিস নি কেন?”

“কাল আমাকে বলে কিনা আমি জগতের সবচেয়ে জঘন্য চা বানাই। তিনি ভালো মানুষ বলে নাকি কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ খেয়ে নিচ্ছেন।”

পদ্মাবতীর ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন অর্ণব। মোহিনীকে দেখতেই তার উপর চোখ আঁটকে গেল অর্ণবের। পদ্মাবতী বললেন,

“খবরদার। আমার অনুমতি ছাড়া আমার ঘরে ঢুকবেন না আপনি।”

“আমাকে বলছো?”

“আপনি ছাড়া ওখানে আর কেউ নেই অর্ণববাবু।”

“সাহস তো কম নয় তোমার।”

“এখানে সাহসের কি আছে? আমার ঘরে কতো মূল্যবান জিনিস রয়েছে দেখছেন না আপনি? এখন আপনার মনে কি আছে তা তো আর আমি জানি না।”

“নিজের সীমার মধ্যে থাকো মেয়ে। এবার কিন্তু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে।”

“ঠিকাছে ঠিকাছে। কি সমস্যা বলুন?”

“ভাব দেখো মেয়ের, যেন সব সমস্যার সমাধান নিয়ে বসে আছে। চা দাওনি কেন এখনো?”

“আমার হাতের চা আপনার গলা দিয়ে নামবে?”

“উপায় নেই।”

পদ্মাবতী উঠে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে গেলেন। মোহিনী ইতোমধ্যে নিজের গা থেকে গয়না খুলে ফেলেছেন। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় অর্ণব তার পথ আঁটকে ধরলেন।

“পথ আঁটকালেন কেন?”

“আপনি কোথায় পালাচ্ছেন?”

“সমস্যা কী আপনার?”

“এতোদিন এলেন না কেন?”

“পথ ছাড়ুন। যেতে দিন আমাকে।”

“আগে আমার কথার উত্তর দিন।”

“আসতে ইচ্ছে হয়নি তাই আসিনি।”

“উহু। এটা নয়।”

“তাহলে?”

“অন্য কথা। সেদিন যে বললাম আপনার প্রেমে পড়েছি।”

“এতে আর এমন কি বড় কথা। আমার প্রেমে পড়েনি এমন পুরুষ খুব কমই আছে।”

মোহিনীর হাত শক্ত করে চেপে ধরলেন অর্ণব। হাতের সাহায্যে খোপা খুলে দিতেই ঘন কালো চুলে পিঠ ঠেকে গেল মোহিনীর।

“আমাকে তাদের কাতারে ফেলবেন না মেহেরজান। ভুল করেও না।”

“লাগছে আমার। হাত ছাড়ুন।”

“যতক্ষণ না উত্তর দিচ্ছেন, আমি ছাড়বো না।”

“কাল বারোটায় দেখা করুন। উত্তর দিয়ে দেব।”

“কাল ভাইফোঁটা। বের হতে পারবো না তখন। কাজ আছে।”

“এইমাত্র বললেন না আমার প্রেমে পড়েছেন? কী করতে পারবেন আমার জন্য?”

“শুরু হয়ে গেল ন্যাকামি। কী করতে হবে?”

“বললাম তো। কাল দেখা করুন।”

“আমি তখন ব্যস্ত থাকবো মেহের।”

“আমি আপনাকে রাত বারোটার কথা বলেছি অর্ণব।”

মোহিনীর হাত ছেড়ে দিলেন অর্ণব।

“কিহ?”

“আসতে হলে আসুন নয়তো দ্বিতীয়বার আমাকে ভালোবাসার কথা বলতে আসবেন না।

চলবে…

#মেহেরজান
#পর্ব-১৪
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

কড়ে আঙুলের সাহায্যে অর্ণবের কপালের একদম মাঝখানে চন্দনের ফোঁটা দিতেই উলুধ্বনি আর শঙ্খধ্বনি বেজে উঠলো। কতোগুলা বাক্য বেরিয়ে এলো চিত্রার মুখ থেকে।

“ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা।
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাই ফোঁটা।
যমুনার হাতে ফোঁটা খেয়ে যম হল অমর।
আমার হাতে ফোঁটা খেয়ে আমার ভাই হোক অমর।”

ধান আর দূর্বা অর্ণবের মাথায় রাখলেন তিনি। এরপর মিষ্টি খাইয়ে প্রণাম করলেন। অর্ণব তাকে আশীর্বাদ করে জিজ্ঞেস করলেন,

“এবার বল, কি উপহার চাস তুই?”

“এখন না দাদা। পরে বলবো। সময় হলে চেয়ে নেবো। তখন দেবে তো?”

“তুই যা চাইবি তাই পাবি।”

চিত্রা হাসি দিয়ে শমিতের সামনে গেলেন। পুনরায় শমিতের কপালে ফোঁটা দিতেই আম্রপালি, শকুন্তলা আর অনুরাধা উলু দিয়ে উঠলেন। একইভাবে শমিতকেও ফোঁটা দিলেন তিনি। এরপর পদ্মাবতী এসে শমিতকে ফোঁটা দিয়ে উঠে যেতে নিলেই শকুন্তলা বলে উঠলেন,

“কিরে পদ্মা? শুধু শমিতকে ফোঁটা দিলি যে? অর্ণবকে দিবি না?”

শকুন্তলার মুখ থেকে এমন কথা শুনে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল পদ্মাবতীর। কেন তা তিনি জানেন না। শুধু মনে হচ্ছে এখান থেকে পালাতে পারলেই বাঁচেন। শকুন্তলা আবার ডাকলেন তাকে।

“কি হলো? আয়।”

অর্ণব শমিতকে খোঁচা দিতেই শমিত চেঁচিয়ে উঠলেন। বললেন,

“ও কেন ফোঁটা পরাবে অর্ণবকে? পদ্মার ভাই তো শুধু আমি। আর তাছাড়া অর্ণব মানে নাকি ওকে বোন হিসেবে? ফোঁটা পরাবে বললেই হলো।”

“তোর আবার কি হলো?”

“কি হবে। কিছু হয়নি তো মামী।”

এই ফাঁকে পদ্মাবতী দৌঁড়ে এক প্রকার পালিয়েই এলেন সেখান থেকে। কিছুটা দূরে আসতেই স্বজোরে ধাক্কা খেলেন মোহিনীর সাথে। আকস্মিক ধাক্কা লাগায় নিজেকে সামলাতে পারলেন না মোহিনী। ধপ করে নিচে পড়ে গেলেন।

“চোখে কি ছানি পড়েছে তোর? দেখছিস না আমি আসছিলাম।”

পদ্মাবতী দ্রুত মোহিনীকে উঠতে সাহায্য করলেন। এখনো হাঁপাচ্ছেন তিনি।

“কি হয়েছে তোর? এভাবে হাঁপাচ্ছিস কেন? বাঘ তাড়া করেছে নাকি সিংহ।”

“কিছু তাড়া করেনি। তার চেয়েও বেশি কিছু।”

“কী?”

“ছোটমা আমাকে বলে কিনা অর্ণববাবুকে ফোঁটা দিতে। কী সাংঘাতিক ব্যাপার দেখেছিস।”

“সাংঘাতিক এর কী আছে এখানে? দিয়ে দিতি।”

“ধ্যাত। দিয়ে দিতি বললেই কি দেওয়া যায় নাকি?”

“কেন? দিতে কি সমস্যা?”

“তুই বুঝবি না। এতো প্রশ্ন করিস না তো। পারলে তুই দিয়ে আয়। আমি কেন দেব?”

পদ্মাবতীর কথায় মোহিনী উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। বললেন,

“আমি দেবো ফোঁটা? তোর অর্ণববাবু জানতে পারলে মাথা ঘুরে পরবেন।”

মোহিনী বাড়ির ভেতরের দিকে এগিয়ে গেলেন। তবে তিনি কী বলে গেলেন তা ঠিক বোধগম্য হলো না পদ্মাবতীর। এখন আবার সেখানে যেতে মন সায় দিল না তার। নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিলেন তিনি। তার ঠিক কিছুক্ষণ বাদে ঘরের দরজায় কেউ কড়া নাড়লেন। পদ্মাবতী ভেতর থেকেই বললেন,

“আমি ফোঁটা পরাতে পারবো না।”

বাইরে থেকে জবাব এলো,

“ফোঁটা পরাতে হবে না তোকে। দরজাটা খোল। আমাকে আসতে দে ভেতরে।”

গলাটা মোহিনীর। পদ্মাবতী তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিলেন। মোহিনী ভেতরে ঢুকলেন। হাতে বেশ বড়সড় একটা থালা। পদ্মাবতী জিজ্ঞেস করলেন,

“এটায় কি?”

মোহিনী থালার ওপর থেকে ঢাকনা সরালেন। থালায় বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি খুব সুন্দর করে সাজানো। এতো রকমের মিষ্টি দেখেই পদ্মাবতীর জিভে জল চলে এসেছে। ঢোক গিলে বললেন,

“এতো মিষ্টি কই পেলি?”

“বড়মা আলাদা করে রেখেছিলেন আমার জন্য। যেতেই দিয়ে দিলেন। বললেন তোর ঘরে এসে খেতে।”

“এতোগুলো মিষ্টি কি তুই একা খাবি মোহিনী?”

“কেন? সন্দেহ আছে কোনো?”

“না। কোনো সন্দেহ নেই। তুই যে একবারেই পুরোটা খেতে পারবি তা আমি খুব ভালো করেই জানি।”

“তুই যদি চাস তো তোকেও দিতে পারি কিছুটা।”

“দে তাহলে।”
.
.
.
খুব সাবধানে সদরদরজা খুলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন চিত্রা। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দীপের সাহায্যে সামনে এগুচ্ছেন তিনি। আজ আর বাড়ির আশেপাশে ডাকেননি শ্যামল তাকে। বেশ দূরেই ডেকেছেন। তাও আবার সবাই যখন ঘুমিয়ে যাবে তখন। বাড়ি থেকে অনেকটা দূরেই চলে এসেছেন চিত্রা। হঠাৎ জোরে হাওয়া বইতেই দীপের শিখাটা ধপধপ করে উঠলো। চিত্রা অন্য হাতের সাহায্যে তা আড়াল করে নিভে যাওয়া থেকে আঁটকালেন। আরেকটু সামনে এগুতেই শ্যামলকে দেখতে পেলেন। সামনে গিয়ে বললেন,

“তুমি আমাকে সবসময় এমন শুনশান জায়গায় ডাকো কেন বলো তো। আমার আসতে কত সমস্যা হয় জানো?”

“আরে এমন জায়গায় না ডাকলে ধরা খেয়ে যাবো না?”

“ধরা খাওয়ার যখন এতোই ভয় তাহলে আমাকে তাড়াতাড়ি বিয়েটা করে নিলেই তো পারো। তখন অন্তত এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করতে হবে না। সবার থেকে লুকিয়ে এভাবে তোমার সাথে দেখা করতে আমার কতটা খারাপ লাগে জানো তুমি?”

চিত্রা নাক টানলেন।

“আরে কাঁদছো কেন তুমি? আর সবসময় এতো বিয়ে বিয়ে করো কেন বলো তো। আমি কি কোনোদিন বলেছি যে বিয়ে করবো না?”

“তবুও। শোনো শ্যামল, তুমি যদি বিয়ের প্রস্তাব না পাঠাও তাহলে আমি আর এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করবো না তোমার সাথে।”

“পাঠাবো তো। আর চারটা মাস অপেক্ষা করো। তারপরই আমার বাবা-মাকে নিয়ে তোমার বাড়িতে যাবো।”

“সত্যি?”

“সত্যি, সত্যি, সত্যি। তিন সত্যি। এবার খুশি?”

“অনেক। জানো আজ ভাইফোঁটায় দাদার কাছে কী বলেছি?”

“কী বলেছো?”

“দাদা যখন জিজ্ঞেস করেছে কী উপহার চাই তখন বলেছি পরে চাইবো। এবার বলো তো আমি পরে কী চাইবো?”

“সেটা আমি কি করে বলবো বলো তো?”

“আরে বুদ্ধু, তোমাকেই তো চাইবো। দাদাকে রাজি করানোর এর চেয়ে ভালো উপায় আমার কাছে ছিল না।”

“বাহ! বেশ বুদ্ধি তো তোমার।”

“তা নয়তো আবার কি।”

শ্যামল চিত্রাকে জড়িয়ে ধরতেই চিত্রা নিজেকে ছাড়িয়ে নিলেন। বললেন,

“আমি এখন আসি শ্যামল। পরে আবার আসবো।”

“সবসময় এতো চলে যাবো চলে যাবো কর কেন তুমি? এইমাত্রই তো এলে।”

“উহু। তুমি আর আঁটকিয়ো না আমাকে। যাই এবার।”

“আরে চিত্রা দাঁড়াও। চিত্রা। সত্যি সত্যিই চলে যাচ্ছো নাকি? কী হলো? চিত্রা।”

চিত্রা দাঁড়ালেন না। চলতেই থাকলেন। ধীরে ধীরে রাতের আঁধারে মিলিয়ে গেলেন। শ্যামলের অভিব্যক্তিতে বিরক্তি প্রকাশ পেল। নিজে নিজেই বিড়বিড় করে বললেন,

“ধুর। আজও চলে গেল। গেলে যাক। একদিন না একদিন তো তোকে বাগে পাবোই চিত্রা। আর ক’টাদিন নাহয় অপেক্ষা করি।”

বাড়িতে ঢোকার পথেই কারও আসার শব্দে নিজেকে আড়ালে লুকিয়ে ফেললেন চিত্রা। দীপটা ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিলেন। একটু পরই দেখতে পেলেন অর্ণব বাড়ির বাইরে যাচ্ছেন। ভ্রুকুটি করে ফেললেন তিনি। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলেন,

“দাদা এতো রাতে কই যাচ্ছে?”

শকুন্তলাকে জল নিয়ে রান্নাঘর থেকে বের হতে দেখতেই চোখ কপালে উঠে গেল তার।

“মা এখনো জেগে আছেন!”

মনের মধ্যে উঁকি দেওয়া হাজারো প্রশ্ন সরিয়ে দিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন চিত্রা।
.
.
অকেক্ষণ যাবৎ নদীর পাড়ে বড় একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন অর্ণব। মোহিনীই তাকে এখানে অপেক্ষা করতে বলেছিলেন। তবে মোহিনী এখনো আসেননি। অনবরত হাই তুলছেন অর্ণব। ঘুমে বারবার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে তার। অবশেষে গাছের নিচেই বসে পড়লেন। বসে ঝিমুতে ঝিমুতে কখন যে চোখ লেগে গেল তার, টেরই পেলেন না। যখন ঘুম ভাঙলো, চোখ খুলে দেখলেন চারদিক একদম পরিষ্কার। সূর্যের আলো এসে চোখে লাগছে তার। সবকিছু বুঝে উঠতে কিছুটা সময় লাগলো। মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এলো,

“আপনি তাহলে এলেন না মেহের।”

চলবে….

মেহেরজান পর্ব-১১+১২

0

#মেহেরজান
#পর্ব-১১
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

আজ চারদিন যাবৎ অর্ণব সকালে চা পান না। উপায়ন্তর না পেয়ে আজ শকুন্তলাকে বলে রেখেছেন যাতে সকালে চা দিয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই চা নিয়ে চিত্রা এলেন তার ঘরে।

“আসবো দাদা?”

“ভেতরে আয়।”

চিত্রা এসে চায়ের কাপটা অর্ণবকে দিয়ে বললেন,

“আপনার আর কিছু লাগবে?”

অর্ণব চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন,

“আমাদের সম্পর্কটা এতোটাও দূরের নয়। তুই আমাকে তুমি করে বলতে পারিস।”

“আচ্ছা দাদা। আমি তা-ই বলবো।”

আজকের চায়ে সেদিনের মতো মজা পাচ্ছেন না অর্ণব। দ্বিতীয়বার আর খাওয়ার রুচি হলো না তার।

“আজকের চা’টা কে বানিয়েছে?”

“আমি বানিয়েছি। কেন? ভালো হয়নি?”

“হয়েছে। সবার চা তো পদ্মাবতী বানায়।”

“হ্যাঁ। ও-ই বানায়। কিন্তু ও তোমার ঘরে চা দেবে না বলেছে। তুমি নাকি আসতে বারণ করেছো ওকে?”

“অনুমতি ছাড়া ঘরে ঢুকতে বারণ করেছি। চা পাঠাতে বারণ করিনি।”

“আচ্ছা। আমি বলে দেব ওকে যেন রোজ তোমার ঘরে চা দিয়ে যায়।”

“বলিস।”

হঠাৎ অর্ণবের নাকে একটা গন্ধ এসে ঠেকলো। তার বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে এটা কিসের গন্ধ। তিনি চিত্রার উদ্দেশ্যে বললেন,

“শুটকি মাছের গন্ধ আসছে না?”

“হ্যাঁ তো।”

“এ বাড়িতে শুটকি কে খায়?”

“পদ্মা।”

“ওর এই অভ্যেস হলো কি করে?”

“জেঠীমা বলেছিল দিদা আর রামু কাকু দুজনেই তো পূর্ব বঙ্গের। সে সূত্রে দুজনেই নাকি শুটকির জন্য পাগল ছিল। দাদু মারা যাওয়ার পরে আর দিদা খায়নি এসব। এখন শুধু রামু কাকুই খায়। আর তার থেকেই পদ্মা শিখেছে। শুধু পদ্মা নয়, মোহিনীরও এই অভ্যেস আছে। কিভাবে যে খায় ওরা। পদ্মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে শুটকির সব পদের নাম গড়গড় করে বলে দিতে পারবে।”

“এই ব্যাপার তাহলে।”

“মা তো পদ্মাকে কতবার বলেছে এখানে রান্না না করতে। গন্ধে থাকা যায় না বাড়িতে। কে শোনে কার কথা।”

“ঠিকাছে। তুই এখন যা। আর শমিতকে পাঠিয়ে দিস তো আমার ঘরে।”

“আচ্ছা।”

কিছুক্ষণ বাদে অর্ণবের ঘরে আসতেই তাকে বই নিয়ে বসে থাকতে দেখলেন শমিত। বললেন,

“কিরে? সবসময় বইয়ে এতো কি পড়িস বলতো?”

“কেন? কিছু বলবি?”

“আমি কি বলবো। তুই-ই তো আমাকে ডেকে পাঠালি চিত্রাকে দিয়ে। কি বলবি বল।”

“তেমন কিছু না।”

“বলছিলাম যে এখানে এসেছিস পর থেকে তো বাইরে তেমন বেরই হোসনি। চল আজকে একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি।”

“এই কথাটা তুই আমাকে সেদিনও বলেছিলি কাশফুল দেখতে যাওয়ার জন্য। আর কেন যেতে চাইছিলি তা বেশ ভালোই বুঝেছি।”

সেদিন শমিতের বলাতেই অর্ণব তার সাথে গিয়েছিলেন। যদিও সেখানে দুজনেরই স্বার্থ নিহিত ছিল।

“কখন বললাম?”

অর্ণব ঘুরে শমিতের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তার ভাবসাব খুব একটা সুবিধার নয়। অন্তত এই বয়সে শমিত আবার অর্ণবের হাতে মার খেতে পছন্দ করবেন না। যা মারপিট হতো তা ছোটবেলা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকা ভালো। অবস্থা বেগতিক দেখে শমিত বললেন,

“এই দাঁড়া দাঁড়া। এভাবে তাকাস না। আমি মনে করছি।”

কথাটা বলেই শমিত ভাবতে শুরু করলেন।

“তুই তো এখানে আসার পর তেমন একটা বেরই হোসনি বাড়ি থেকে। চল আজকে কোথাও ঘুরে আসি।”

“কই যাবি?”

“নদীর মাঝে চর উঠেছে। কাশফুলে একদম ভরে গেছে। চিত্রারা সবাই গেছে ওখানে। চল আমরা যাই।”

“মেয়েদের মাঝে গিয়ে তুই কি করবি?”

“ধুর। মেয়েদের মাঝে যেতে যাবো কেন? আমরা তো যাচ্ছি কাশফুল দেখতে।”

“কাশফুল দেখতেই যাচ্ছিস নাকি অন্য কোনো ফুল আছে?”

শমিত আমতা আমতা করে বললেন,

“অন্য কোনো ফুল মানে? কিসের অন্য কোনো ফুল? তুই যাবি কিনা বল।”

“না। কাশফুল নাকে মুখে গেলে প্রচুর হাঁচি আসে।”

“ঠিকাছে। না গেলি। পদ্মা, মোহিনী, চিত্রারা নাহয় একাই চলে আসবে। মাঝে পথে বিপদাপদ হলে কার কি। আমাদের তো আর কোনো দায়িত্ব নেই।”

“ঠিকাছে ঠিকাছে। মেয়েদের মতো ন্যাকামি করিস না। যাচ্ছি।”

“এইতো বললি যাবি না। এখন আবার যেতে চাওয়ার কারণ কি বলতো।”

“তাহলে তুই চাস আমি না যাই। আচ্ছা, তাই হবে।”

শমিত বাহু দ্বারা অর্ণবের ঘাড় জাপটে ধরে বললেন,

“আরে আমি তো মজা করছি বন্ধু। রাগ দেখাস না। চল।”

অর্ণব হাতে থাকা বই দ্বারা শমিতকে আঘাত করতেই তার ভাবনায় ছেদ ঘটলো।

“মনে পড়েছে?”

“হ্যাঁ পড়েছে পড়েছে। থাক, কোথাও যেতে হবে না আজ তোকে। আমিও যাবো না। আপাতত চল ছাদে যাই।”

“ছাদে?”

“হ্যাঁ, ছোট মামি বীণা নিয়ে বসেছে। সবাই ওখানেই আছে।”

সবাই বলতে কারা অর্ণব তা জানেন না। তবুও একটা আশায় তিনি শমিতের সাথে যেতে রাজি হলেন।
.
.
.
ছাদে বসে বীণা বাজাচ্ছেন শকুন্তলা। চিত্রা আর মোহিনীও সেখানে রয়েছেন। অর্ণব এসে মোহিনীর সাথে একদম ঘেঁষে বসে পড়লেন। মোহিনী দ্রুত তার থেকে সরে বসলেন। অর্ণবের এমন ব্যবহারে প্রচন্ড বিরক্ত সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পদ্মাবতী আসলেন সেখানে। জায়গা না পেয়ে একদম অর্ণব আর মোহিনীর মাঝখানে বসে পড়লেন সে। অর্ণব পদ্মাবতীর কান্ড দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। না, এই মেয়েটা কখনোই তার কোনো কাজ ঠিকমতো হতে দেবে না। তবে অর্ণব যেন তাকে জ্বালানোর আরেকটা সুযোগ পেয়ে গেলেন। আর যাই হোক, পদ্মাবতীকে বিরক্ত করতে বেশ মজা পান অর্ণব। একটু নড়েচড়ে বসলেন তিনি। উঁকি দিয়ে এক নজর মোহিনীকে দেখে পদ্মাবতীর শাড়ির আঁচল নিয়ে নিজের আঙুলে প্যাচাতে লাগলেন তিনি। চিত্রা ভ্রকুটি করে তা দেখছেন। শমিত মিটিমিটি করে হাসছেন। পদ্মাবতী তা খেয়াল করে নিজের শাড়ির আঁচল টান দিতেই কতোগুলো সুতো এলোমেলো হয়ে গেল। বড় বড় চোখ করে অন্যদিকে তাকালেন অর্ণব। রাগে ফুঁসছেন পদ্মাবতী। তাকে বিরক্ত করে অর্ণব কি পান কে জানে। কিন্তু সুযোগ পেলে তা ছেড়ে দেন না তিনি। পদ্মাবতী উঠে দাঁড়াতেই তার শাড়ির নিচের বেশ খানিকটা ছিড়ে গেল। শমিত হো হো করে হেসে উঠলেন। এবার আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না পদ্মাবতী।

“দিলেন তো আমার শাড়ি ছিড়ে। আপনি সরে বসতে পারলেন না? এসে আমার শাড়ির উপরেই বসতে হলো আপনার?”

“তুমি পরে এসে বসেছো। আমি কিভাবে তোমার শাড়ির উপরে বসবো। পুরনো শাড়ি ছিল। তোমার নিজের পায়ের সাথে লেগেই ছিড়েছে আর দোষ চাপাচ্ছো আমার ঘাড়ে।”

পদ্মাবতী না পারছেন সইতে আর না পারছেন কিছু বলতে। শকুন্তলা বললেন,

“তোরা কি ঝগড়া করবি এখন? পদ্মা, তুই গিয়ে শাড়িটা পাল্টে নে না। তাহলেই তো হয়।”

“তুমি কিছু বলবে না ছোটমা? একে তো উনি আমার শাড়ি ছিড়েছেন। তার উপর বলে কি না আমার শাড়ি পুরনো?”

অর্ণব বললেন,

“তা নয় তো আবার কি?”

“কে বলেছে আপনাকে এটা পুরনো শাড়ি। এটা আমাকে বড়মা দিয়েছিলেন পূজোতে।”

অর্ণব পদ্মাবতীকে আরেকটু বিরক্ত করতে বললেন,

“দেখি তো শাড়িটা। আরে, এটা তো মায়ের শাড়ি। মা তো এখন এসব শাড়ি পরেন না। তার মানে সেই বিশ বছর আগের। মা পরেন না বলেই তোমাকে দিয়ে দিয়েছেন।”

“আমি নালিশ করবো আপনার নামে বড়মার কাছে।”

পদ্মাবতী দৌঁড়ে চলে গেলেন। শকুন্তলা বললেন,

“এতো জ্বালাস কেন মেয়েটাকে?”

“আমি কোথায় জ্বালালাম? প্রতিশোধ নিলাম মাত্র।”

অর্ণবও উঠে চলে গেলেন। শকুন্তলা শমিতের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন,

“ও কিসের প্রতিশোধের কথা বলে গেল?”

“ঠান্ডা জলে স্নানের।”

“মানে?”

“আপনি বুঝবেন না।”

“কি বললি তুই?”

“না না। এটা বলতে চাইনি। মানে আপনি জানেন না এ ব্যাপারে কিছু তাই আর বললে বুঝতে পারবেন না।”

একে একে সবাই সবাই উঠে গেলেন সেখান থেকে। মোহিনী তখনও সেখানে বসে আছেন। ভাবনার সাগরে ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছেন তিনি। নিজের চারপাশের সবকিছুই কেমন যেন অন্যরকম লাগছে তার কাছে। একদম নতুন অনুভূতি, যার সাথে পূর্বে কোনোদিন পরিচয় হয়নি তার। হঠাৎই আম্রপালির ডাকার শব্দ ভেসে এলো।

“মোহিনী, খেতে আয় নিচে।”

মোহিনী ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখলেন। আশেপাশে আম্রপালি নেই। বাড়ির ভেতর থেকে ডেকেছেন তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যে আবারও তার ডাকার শব্দ ভেসে এলো।

“কিরে? জলদি আয়।”

মোহিনী চেঁচিয়ে বলে দিলেন,

“আসছি।”

চলবে…

#মেহেরজান
#পর্ব-১২
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

গুলির বিকট শব্দে কতোগুলো পাখি উড়ে গেল। গাছে থাকা কামরাঙাটা টুপ করে মাটিতে পড়লো। শমিত গিয়ে ঝটপট তা তুলে ফেললেন। বললেন,

“তোর নিশানা তো খুব তীক্ষ্ণ অর্ণব। এক গুলিতেই কামরাঙাটা কেমন পেরে ফেললি।”

পদ্মাবতী দৌঁড়ে এসে উচ্চস্বরে হাসতে লাগলেন। হাতে কিছু একটা রয়েছে তার। শমিত বললেন,

“হাসছিস কেন তুই?”

পদ্মাবতী হাসি থামিয়ে বললেন,

“তোমাদের কান্ড দেখে। কামরাঙা পারতে বন্দুক লাগে নাকি। যেন মশা মারতে কামান।”

পদ্মাবতী আবার হাসতে শুরু করলেন।

“এই, তোর কোনো কাজ নেই? এখানে কি করছিস?”

“সব কাজ সেরে ফেলেছি। গুলির আওয়াজ শুনতে পেয়েই তো এদিকে এলাম। দাঁড়াও। তোমাদের আগে দেখিয়ে দেই কিভাবে কামরাঙা পারতে হয়।”

হাতে থাকা গুলতি দিয়ে নিশানা তাঁক করলেন পদ্মাবতী। পরক্ষণেই আরেকটা কামরাঙা মাটিতে পড়লো।

“দেখেছো? এবার থেকে পারবে আশা করি।”

“এই তুই যা তো। অর্ণব, তুই ওর কথায় কান দিস না। আমরা আমাদের কাজ করি।”

“যাচ্ছি যাচ্ছি। আমি তো শুধু একটু শেখাতে এসেছিলাম।”

পা বাড়াতেই হোঁচট খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পরার আগেই পদ্মাবতীর বেণি ধরে টান দিলেন অর্ণব। আর্তনাদ করে উঠলেন পদ্মাবতী।

“মা গো! আমার সব চুল ছিড়ে ফেললো গো।”

অর্ণব বিদ্রুপ করে বললেন,

“এসেছেন আমার কোথাকার কোন চুলওয়ালী। যেই না মাথার কেশ, অল্প দিনেই হবে শেষ। দু’দিন বাদেই তো মাথায় টাক পরবে। তখন সবাই বলবে টাকওয়ালী।”

“বললেই হলো? আমার চুলের মতো ঘন আর লম্বা চুল এ গ্রামে আর কারও মাথায় আছে নাকি? দেখাতে পারবেন? আর আমার না হাত আছে। হাত ধরে টানতে পারতেন। চুল টানার কোনো দরকার ছিল না।”

কথাটা বলেই দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে অর্ণবের সামনে ধরলেন পদ্মাবতী। অর্ণব পুনরায় নিশানা তাক করতে করতে বললেন,

“আমি যার তার হাত ধরি না।”

পদ্মাবতী চলে যাবেন এমন সময় আবার গুলির বিকট শব্দ কানে এলো। দু’হাতে কান চেপে ধরলেন পদ্মাবতী। কিন্তু এবার গাছ থেকে কোনো ফল পড়লো না। পরিবর্তে গাছের মগডালে বসা টিয়াপাখিটা পড়লো। একটা বিরক্তিভরা শব্দ বেরিয়ে এলো অর্ণবের মুখ থেকে। পদ্মাবতী দৌঁড়ে এসে পাখিটা তুলে নিলেন।

“ইশশশ। কি করলেন আপনি এটা? মেরে ফেললেন পাখিটাকে?”

“ওটাকে মারার উদ্দেশ্য ছিল না আমার।”

“অনিচ্ছাকৃতই হোক কিন্তু মেরেছেন তো।”

পদ্মাবতী পাখিটা ওখানেই রেখে উঠে এলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে মোহিনীও এলেন সেখানে। পদ্মাবতীর উদ্দেশ্য বললেন,

“কি হয়েছে এখানে?”

পদ্মাবতী জবাব দিলেন না। শমিত বললেন,

“দেখছিস না কি হয়েছে। অর্ণব ভুল করে গাছে থাকা পাখিটা মেরে ফেলেছে।”

মাটিতে পড়ে থাকা পাখিটা দেখে সামান্য হাসলেন মোহিনী। সকলে ভ্রুকুটি করে তার দিকে তাকালেন।

“কি হয়েছে তোর? হাসছিস কেন?”

“গাছে বসে থাকা পাখি কে না গুলি করে মারতে পারে। পারলে উড়ন্ত কিছুতে গুলি করে দেখাতে বলো।”

পদ্মাবতী বললেন,

“পাগল নাকি তুই? শমিতদা তো বললোই উনি ভুল করে মেরেছেন। আবার মারতে যাবেন কেন?”

“উনি তো তোদের নিজের বন্দুক চালানোর দক্ষতা দেখাচ্ছিলেন। এখন গাছে বসে থাকা পাখিকে গুলি করলে তো এটা বোঝা যাবে না যে উনি উড়ন্ত পাখিকে গুলি করতে পারবেন কিনা। আর উনি এমনিতেও লক্ষ্যচ্যুত হয়েই পাখিটাকে মেরেছেন। তাহলে উড়ে যাওয়া পাখি আর কিইবা মারবেন।”

আকাশে একঝাঁক শালিক উড়ে যাচ্ছিলো। অর্ণব সাথে সাথে বন্দুকে ভরে নিশানা তাক করলেন। গুলি ছুড়তেই একটা শালিক মাটিতে পড়লো। পদ্মাবতী চিৎকার করে উঠলেন। অর্ণবের উদ্দেশ্যে বললেন,

“কেমন মানুষ আপনি? আপনার মধ্যে কি এক বিন্দু পরিমাণও দয়ামায়া নেই? তখন না হয় ভুল করে মেরেছেন। কিন্তু এখন?”

“তোমার বান্ধুবীই তো বললো।”

“ও বললো আর আপনাকে মারতে হবে?”

“আমার দক্ষতা আর সাহসের ওপর কেউ আঙুল তুললে আমি দেখতে পারি না।”

“নীড়ে থাকা ওদের ছানাগুলোর কি হবে ভেবে দেখলেন না একবারও? ওরা এখন কি খাবে? বাঁচবে কিভাবে? মা ছাড়া বাঁচা কতটা কঠিন জানেন আপনি?”

অর্ণব তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন। পদ্মাবতীর চোখ ভরে উঠেছে। হাতের উল্টোপিঠ দ্বারা কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়া জল মুছে নিলেন তিনি। অর্ণব একটা সিগার জ্বালালেন। একবার টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তেই মোহিনী বললেন,

“ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এটা তো আপনার জানার কথা?”

“জানি। পুরনো দিনের অভ্যেস। এতো সহজে ছাড়বে না। বৃথা চেষ্টা না করে এটার সাথে বাঁচাই ভালো।”

“আমি ছাড়ার একটা সহজ উপায় বলবো?”

“কি?”

মোহিনী অর্ণবের হাত থেকে সিগারটা নিয়ে নিলেন। এরপর জ্বলন্ত সিগারটা তারই হাতে চেপে ধরলেন। অর্ণবের মুখের অভিব্যক্তি বিন্দুমাত্রও পরিবর্তন হলো না। পদ্মাবতী দ্রুত মোহিনীর হাত থেকে সিগারটা নিয়ে ফেলে দিলেন।

“কি করছিস তুই মোহিনী? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর?”

অর্ণবের হাত ধরে বললেন,

“ইশশশ। কতটা পুড়ে গেছে।”

পদ্মাবতী দৌঁড়ে বাড়িতে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আবার একই গতিতে ফিরে এলেন। হাতে করে কিছু একটা নিয়ে এসেছেন তিনি। অর্ণবের উদ্দেশ্যে বললেন,

“হাত দিন।”

“কেন?”

“ওষুধ লাগাবো।”

পদ্মাবতী ভালোভাবে অর্ণবের হাতে ওষুধটা লাগিয়ে দিলেন। মুহুর্তেই হাতের জ্বালাটা কমে ঠান্ডা অনুভূতি হচ্ছে অর্ণবের। এখন বেশ আরাম লাগছে তার। দূর থেকে চিত্রা ডাকতেই পদ্মাবতী আসছি বলে আবার দৌঁড়ে চলে গেলেন। মোহিনী যেতে যাবেন ঠিক তখনই একই জায়গায় হোঁচট খেলেন যেখানে পদ্মাবতী খেয়েছিলেন। অর্ণব মোহিনীর হাত ধরে ফেললেন। এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিলে মোহিনী।

“বাঃ বাহ। হাতের জোর দেখছি এখনো কমেনি। আগের মতোই রয়েছে।”

মোহিনী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ড্যাবড্যাব করে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

“মানে?”

শমিত এতোক্ষণ শুধু দেখে যাচ্ছিলেন। এবার বললেন,

“তুই আর পদ্মা যখন ছোটবেলায় আমাদের কোলে থাকতি তখন প্রচুর খামচাতিস। এর জন্য তো আমি তোকে কোলেও নিতাম না খুব একটা।”

অর্ণব বললেন,

“আমার গালে খামচি দিয়ে দাগ বসিয়ে দিয়েছিলেন আপনি। জানেন?”

মোহিনী যেন কিছুটা লজ্জা পেলেন। চোখগুলো বড়ো বড়ো হয়ে গেছে তার। শমিত আবার বললেন,

“ভাগ্যিস তোর তখন দাঁত ছিল নারে মোহিনী। নয়তো কি যে হতো।”

“এখন দাঁত আছে। দেখাবো?”

কথাটা বলেই অর্ণবের হাতে কামড় বসিয়ে দিলেন মোহিনী। এবার আর অর্ণব শান্ত থাকতে পারলেন না। আর্তনাদ করে উঠলেন। এক ধাক্কায় মোহিনীকে কিছুটা দূরে সরিয়ে দিলেন। মোহিনী গিয়ে পাশে থাকা দীঘিতে পরবেন এমন সময় অর্ণব নিজেই আবার তার হাত ধরে ফেললেন। মোহিনী যেন আরও শক্ত করে তাকে ধরলেন। অর্ণব বললেন,

“তখন তো হাত ছাড়িয়ে নিলেন। এবার ধরলেন কেন? ছাড়ুন।”

“না। জলে পড়ে যাবো তো নইলে।”

“আমি ছাড়বো?”

“না না।”

“আপনি তো আবার সাঁতার জানেন। কেউ জলে পড়লে আগে আগে তাকে বাঁচাতে যান নিজের সাহসিকতার প্রমাণ দিতে। তো এবার নাহয় নিজেকেই বাঁচান।”

“দয়া করে এমন করবেন না।”

“লভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট।” অর্থ বোঝেন কথাটার? “প্রথম দর্শনে প্রেম।” এটা আপনাকে কেন বলছি জানেন?”

“কেন?”

“আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি মেহেরজান। যেদিন প্রথম দেখেছি আপনাকে, সেদিনই। তখন থেকেই আপনার প্রেমে জ্বলেপুড়ে ছারখার হচ্ছি আমি।”

“হা?”

বলতে বলতে মোহিনীর হাত ছেড়ে দিলেন অর্ণব। মুহুর্তেই দীঘির জলে তলিয়ে গেলেন মোহিনী।

—————————————

ভেজা গায়ে কাঁপতে কাঁপতে বাড়িতে ঢুকতেই তারানার সামনে পড়লেন মোহিনী। তারানা চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,

“তুই আজও ভিজে বাড়িতে ফিরেছিস। সেদিন জ্বর বাঁধিয়ে সাধ মেটেনি তোর? জ্বর কমেওনি তেমন। তার আগেই আজ আবারও বাইরে গেলি। ইশশশ! কিভাবে থরথর করে কাঁপছিস।”

তারানা একটা চাদর দিয়ে মোহিনীকে পেঁচিয়ে ধরলেন। কপালে হাত রেখে বললেন,

“জ্বরে গা এখনো পুড়ে যাচ্ছে।”

“তুমি আমার জন্য এতো কেন ব্যস্ত হচ্ছো তারামা? ঠিক আছি আমি।”

“চুপ। একদম কথা বলবি না। কই ঠিক আছিস তুই? এবার শুধু জ্বর বাড়ুক আরও। আমি ধারের কাছেও যাবো না তোর। জ্বরে মরে গেলেও তো ডাক্তারের থেকে ওষুধ এনে খাওয়াবো না তোকে। এতো পয়সা নেই অযথা তোর পেছনে ভাঙার জন্য।”

“সেদিনও একই কথা বলেছিলে। কাল তো সারারাত জেগে ঠিকই জলপট্টি দিলে।”

“প্রতিদিন এভাবে ভিজিস কিভাবে তুই?”

“প্রেমের জলে ভিজিগো তারামা, প্রেমের জলে।”

“মানে?”

মোহিনী কিছু বলবেন তার আগেই দোতলা থেকে রজনীর চিৎকার ভেসে এলো। সকলে দৌঁড়ে সেখানে গেলেন। তারানা বললেন,

“কি হয়েছে? চিৎকার করলি কেন?”

রজনী হাত দিয়ে সামনে ইশারা করলেন। সেদিকে তাকিয়ে সকলেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। উপরে বৈদ্যুতিক পাখার সাথে ঝুলে আছে সৌদামিনীর নিথর দেহ।
.
.
.
চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাত খুব একটা হয়নি। তবে গ্রাম হওয়ায় বাইরে তেমন লোকজন নেই। এই অন্ধকারেই খড়ের গাদার পেছনে একসাথে খুবই কাছাকাছি বসে আছেন চিত্রা আর শ্যামল। লোকচক্ষুর নজর এড়াতেই এভাবে দেখা করেছেন। খুবই নিচু স্বরে কথা বলছেন তারা।

“আমাকে এখন যেতে হবে শ্যামল। মা যদি দেখেন আমি বাড়িতে নেই তবে কেলেংকারী হয়ে যাবে।”

“মাত্রই তো এলে। এতো তাড়াতাড়ি যাবে কেন? আর কিছুক্ষণ থাকো।”

“না, আর এক মুহুর্তও দেরি করলে চলবে না। এখনই যেতে হবে।”

“ঠিকাছে। যাও তাহলে। আবার কবে আসবে?”

“সময় হলে জানাবো।”

“শোনো?”

“কী?”

“যাওয়ার আগে একটা চুমু খাবো তোমাকে?”

“একদম না।”

“না করো না তো। একটা চুমুই তো মাত্র।”

“বলেছি না একদম না।”

“কেন?”

“বিয়ের আগে আমি এসব একদম করবো না।”

“আমি কি বিয়ে করবো না বলেছি তোমাকে? আর কি এমন করতে বলেছি তোমাকে? একটা চুমুই তো খেতে চেয়েছি। এমন ভাব করছো যেন একটা চুমুতেই তুমি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে যাবে।”

“ধ্যাত।”

শ্যামল জোর করে চিত্রাকে চুমু খেয়ে নিলেন। চিত্রা আঁটকাবার জন্য তাকে ধাক্কা দিতেই শ্যামলের পায়ের সাথে লেগে একটা কলসি গড়িয়ে পরলো। মুহুর্তেই কতোগুলো বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলে উঠলো বাইরে। কলসি পড়ার শব্দ পেয়ে রামু কে কে বলে দৌঁড়ে যাচ্ছেন সেদিকে। বাইরে থেকে চৌকিদারও দৌঁড়ে আসছেন দেখতে। শ্যামল বলে উঠলেন,

“ধুর। এখানে কলসি রেখেছে কে?”

“ওরা দেখে ফেলার আগে তুমি তাড়াতাড়ি পালাও এখান থেকে।”

রামু আর চৌকিদার দুজনেই চোর চোর বলে চেচাচ্ছেন। পালানোর রাস্তা না পেয়ে শ্যামল গাছগাছালির মাঝখান দিয়ে দৌঁড় দিতেই গাছের শেকড়ের সাথে তার ধুতি আঁটকে গেল। উপায়ান্তর না পেয়ে নিজের ধুতি ফেলেই দেওয়াল টপকে পালালেন তিনি। বাইরে শোরগোল শুনে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন অর্ণব। বারান্দায় আসতে না আসতেই চিত্রাকে ঘোমটা দিয়ে বাইরে থেকে বাড়িতে ঢুকতে দেখলেন তিনি। রামুর উদ্দেশ্যে কিছুটা চেঁচিয়ে বললেন,

“কি সমস্যা কাকু? রাতেরবেলায় এমন চেঁচামেচি কিসের?”

“বাড়িতে মনে হয় চোর ঢুকছিল অর্ণব বাবা। কিন্তু কাউরেই তো খুঁইজা পাইলাম না। পালাইছে মনে হয়।”

“তোমার হাতে ওটা কি?”

“ধুতি। আমাগোর আসার শব্দ পাইয়া চোরে ধুতি খুইলা পালাইছে।”

কথাটা বলেই উচ্চস্বরে হাসতে লাগলেন রামু।

“ঠিকাছে। আপনি ওটা আমাকে দিয়ে যান।”

রামু একবার ধুতির দিকে তাকালেন, আবার অর্ণবের দিকে তাকালেন। এরপর বললেন,

“আপনে পরবেন এইডা?”

“আমি পরতে যাবো কেন?”

“তাইলে আপনে এইডা দিয়া কি করবেন?”

“চোরের ধুতি চোরকে ফেরত দেব।”

“অ্যা?”

“কি হলো? দিয়ে যান আমাকে।”

“ঠিকাছে। আসতাছি।”

বাইরে ঠিক কি চলছিল তা না জানলেও চিত্রাকে দেখে কিছুটা ধারণা করতে পেরেছেন অর্ণব। একবার এ বিষয়ে চিত্রার সাথে কথা না বললেই নয়।
.
.
.
ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই অর্ণবের ঘরে এসে উপস্থিত হয়েছেন চিত্রা। অর্ণব নিজেই তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।

“আসবো দাদা?”

“হ্যাঁ আয়।”

“কিছু বলবে? লাগবে তোমার কিছু?”

“না। তোকে কিছু দিতে ডেকে পাঠিয়েছি।”

“আমাকে? কি দেবে?”

অর্ণব ধুতিটা বের করে চিত্রার সামনে ধরলেন। ধুতিটা চিনতে ভুল হয়নি চিত্রার। কাল শ্যামল এটাই পরেছিলেন। একটা শুকনো ঢোক গিলে কাঁপা গলায় বললেন,

“এটা কি?”

“চিনতে পারছিস না?”

“আমি কি করে চিনবো?”

“যাত্রাপালায় নাম দিয়েছিস নাকি? ভালোই তো অভিনয় করতে জানিস।”

“মানে?”

“আমার সামনে নাটক করিস না চিত্রা। তোকে আমি কাল রাতে চুপি চুপি বাড়িতে ঢুকতে দেখেছি।”

“মাকে বলো না দাদা।”

“ছেলেটা কে?”

“ও শেফালীর ভাই। মানে ওর জেঠুর ছেলে। নাম শ্যামল। ও খুব ভালো ছেলে দাদা।”

“কেমন ভালো দেখাই যাচ্ছে। ভালো ছেলেরা রাত-বিরেতে প্রেমিকাকে চুপিচুপি দেখা করতে ডাকে না। আর প্রেমিকার সাথে দেখা করতে এসে ধুতি খুলে পালায়, এমন আনাড়ির সাথে তুই প্রেম করলি কিভাবে?”

“তুমি যেমন ভাবছো ও তেমন নয় দাদা। তুমি ওর সাথে দেখা করলেই বুঝতে পারবে।”

“যা বোঝার বুঝেছি। আমাকে আর কিছু বুঝতে হবে না। ছেলেটার থেকে দূরে থাকাই তোর জন্য ভালো হবে। বিষয়টা আমি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলেই ভালো। আশা করি তুই চাস না এ ব্যাপারে ছোটমা কিছু জানুক।”

চিত্রা হ্যাঁবোধক মাথা নাড়ালেন।

“যা এবার। আর শোন। ধুতিটা নিয়ে যাস। যার ধুতি তাকে ফিরিয়ে দিয়ে সম্পর্কটা শেষ করে আসিস।”

চিত্রা ধুতি হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। নিজের ঘরে এসে রাগে ফুঁসতে লাগলেন তিনি।

“হাহ, আমাকে কিনা বলে সম্পর্ক শেষ করতে। কি ভুল করেছি আমি? নিজে যে দু’দুটো মেয়েকে নিজের পেছনে ঘোরাচ্ছে সেটা যেন কারও চোখে পড়ে না ভেবেছে। আর আমি একজনের সাথে থাকতে চাইলেই দোষ। আমিও দেখে নেবো কি করতে পারো তুমি।

চলবে…

মেহেরজান পর্ব-৯+১০

0

#মেহেরজান
#পর্ব-৯
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগার টেনে চলেছেন অর্ণব। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই এভাবে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগার খান তিনি। আম্রপালি তার ঘরের দরজায় চায়ের কাপ হাতে নিয়ে এক দৃষ্টিতে অর্ণবকে দেখে চলেছেন। হয়তো ভাবছেন ছেলেটাকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। হাতের বাইরে বেরিয়ে গেছে একদম।

“অর্ণব।”

আম্রপালিকে দেখে অর্ণব দ্রুত সিগারটা ফেলে বললেন,

“ভেতরে আসুন মা।”

আম্রপালি চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে অর্ণবের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন,

“শুভ জন্মদিন।”

“ধন্যবাদ মা।”

আম্রপালি অর্ণবের মাথায় হাত রাখলেন। চুলগুলো কেমন অগোছালো উষ্কখুষ্ক হয়ে আছে। হাত দিয়ে ঠিক করে দিতে দিতে বললেন,

“বাড়ির সবার সাথে তো ঠিকমতোই কথা বলিস। আমার সাথে এমন কেন করছিস?”

অর্ণব খেয়াল করলেন আম্রপালি তাকে তুই বলে সম্বোধন করছেন। যা আগে কখনো করেননি। বুঝতে পারলেন বিশ বছরের দূরত্ব ঘোচানোর একটা প্রয়াস।

“কি করেছি?”

“মনে হয় আমার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিস। সবসময় দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করিস।”

“এরকম কিছু নয় মা। এটা আপনার ভুল ধারণা।”

“তাই যেন হয়। কতো বছর পর তোকে ফিরে পেয়েছি। মায়ের ওপর আর অভিমান করে থাকিস না বাবা।”

“আমি আপনার ওপর অভিমান করে নেই মা।”

“আচ্ছা? তাহলে এতোগুলো বছর আসিসনি কেন? আমার কথা কি একবারও মনে পড়েনি তোর?”

“পড়েছে মা। আপনার কথা আমার সবসময় মনে পড়েছে। আপনাকে কি করে ভুলে থাকতে পারি আমি? আপনি মা হন আমার, যাকে আমি পৃথিবীর সবকিছুর চেয়ে, নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। আপনার ওপর অভিমান করে থাকা আমার সাধ্যে নেই।”

অর্ণবের কথা শুনে আম্রপালির মনে যেন এক শান্তি অনুভূত হলো।

“তোর জন্য ক্ষীর বানিয়েছি। খাবি?”

“আমার জন্য বানিয়ে আবার আমাকেই জিজ্ঞেস করছেন?”

আম্রপালি সামান্য হাসলেন।

“দাঁড়া। পদ্মাকে দিয়ে পাঠাচ্ছি।”

আম্রপালি চলে যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার বললেন,

“চিড়ের পোলাও খুব পছন্দ করিস না তুই? আজ অপেক্ষা কর। কাল বানিয়ে দেবো।

আম্রপালি চলে গেলে অর্ণব চায়ের কাপ নিয়ে আবার বারান্দায় এলেন। কাপে চুমুক দিতে দিতে চারদিক পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। বাড়ির চেহারা আর আশেপাশের সব অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বাড়িতে এখন সবকিছুর দায়িত্ব শকুন্তলার এবং সে বেশ ভালোভাবেই সব সামলাচ্ছেন। বাড়িতে নতুন রঙ করা হয়েছে। মনে হয় তার আসার কারণে। বাড়ির পেছনে একটা অর্জুনগাছ, গগণশিরীষ গাছ আর কিছু ফলের গাছ ছাড়া বাড়ির আশেপাশে তেমন একটা গাছগাছালি ছিল না। তবে এখন বাড়ির সামনে বিশাল বড় একটা ফুলের বাগান হয়েছে। শমিতের থেকে জেনেছেন এইসব পদ্মার বোনা। বাড়িতে আগের মতো কাজের লোকজন তেমন নেই। শুধু রামু ছাড়া, যিনি এখন ফুলগাছে পানি দিচ্ছেন। চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা রাখতেই দেখলেন বাড়ির গেইট দিয়ে মেরুন রঙের আনারকলি পরা এক মেয়ে ঢুকছেন। মোহিনীকে চিনতে অর্ণবের অসুবিধা হয়নি। সেদিন প্রথম দেখার পর আবার বিজয়াতে দেখেছিলেন তাকে। কিন্তু সামনাসামনি কথা হয়নি। বাড়ির ভেতরে ঢোকার সময়ই রামু এক বালতি পানি ঢেলে দিলেন তার সামনে। মোহিনী চেঁচিয়ে উঠলেন।

“দিলে তো ভিজিয়ে।”

রামু দাঁত দিয়ে জিভ চেপে ধরলেন। বললেন,

“ভুল হইয়া গেছে মোহিনী মা। আমি দেখছিলাম না।”

“এতো বড় একটা শরীর নিয়ে হাঁটছি তাও দেখতে পাও না হুহ?”

“আর হইবো না। এইবারের মতোন মাফ কইরা দেন।”

“মাফ চাইতে হবে না। বাদ দাও। পদ্মা কোথায় কাকু?”

“মালকিনের সাথেই তো দেখছিলাম।”

“কোথায় দেখেছিলে? বড়মা কোথায়?”

“ঠিক মনে পরতাছে না কইযে দেখলাম।”

“থাক। আর বলতে হবে না। আমিই খুঁজে নেবো।”

বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচে ঘটা সম্পূর্ণ বিষয়টা দেখলেন অর্ণব। মুচকি একটা হাসি দিয়ে ঘরের ভেতরে এসে বুকশেলফ থেকে একটা বই হাতে হাতে নিতে দেখলেন পদ্মাবতী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ঘরে উঁকিঝুঁকি মারছেন। অর্ণবকে ঘরে দেখতে পাননি হয়তো তাই এভাবে খুঁজছেন।

“ঘরে এভাবে উঁকি মারছো কেন? কিছু চুরি করার মতলব নাকি? ভেতরে এসো।”

“ইশ,,এভাবে বলতে পারলেন? আপনি যেন কেমন একটা মানুষ। যা মুখে আসে বলে দেন। একটুও ভেবে দেখেন না সামনের মানুষটার কেমন লাগতে পারে।”

“এমনভাবে উঁকিঝুঁকি মারছিলে, আমি তো ভাবলাম চুরি করতেই এসেছো। আমার ঘরে কতো দামি দামি জিনিসপত্র আছে জানো?”

“আপনার ব্যবহার একদম ভালো না।”

“ঠিক আছে। ভালো করে জিগ্যেস করছি। কেন এসেছো?”

পদ্মাবতী ক্ষীরের বাটিটা উঁচু করে অর্ণবের সামনে ধরলেন।

“বড়মা ক্ষীর পাঠিয়েছে আপনার জন্য।”

“জানি। টেবিলে রেখে যাও।”

পদ্মাবতী বাটিটা টেবিলে রেখে বললেন,

“চায়ের কাপটা দিন।”

“চা খেয়েছি কি খাইনি তুমি কি করে জানো?”

“আমিই রেখে গিয়েছিলাম সকালে আপনার ঘরে। বাড়ির সবার জন্য চা আমিই বানাই। আর না খেলেও এতোক্ষণে ঠান্ডা হয়ে গেছে। ওটা আর খাবেন না নিশ্চয়ই।”

“ওখানে রাখা আছে নিয়ে যাও।”

পদ্মাবতী এগিয়ে কাপটা নিয়ে দেখলেন অর্ণব চা খেয়েছেন। চলে যেতে নিলে অর্ণব বললেন,

“শোনো, আমার অনুমতি ছাড়া আমার ঘরে আর ঢুকবে না।”

“শয়তান একটা। এতো কথা শোনানোর পরও আর কোনোদিন চা দেব নাকি আপনাকে।”

পদ্মাবতীর বলা কথাগুলো কর্ণকুহর হয়নি অর্ণবের। জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,

“আমাকে কিছু বললে তুমি?”

“না। আপনাকে বলিনি কিছু। আর হ্যাঁ, দিদা সকালে একবার আপনার কথা জিজ্ঞেস করছিল।”

“কখন?”

“যখন খাবার খাওয়াতে গিয়েছিলাম।”

“ঠিকাছে। আমি যাচ্ছি একটু পর। তুমি এবার যেতে পারো।”

পদ্মাবতী একটা ভেংচি দিয়ে চলে গেলেন। সে চলে গেলে অর্ণবও একটা তোয়ালে নিয়ে স্নান করতে চলে গেলেন।
.
.
.
“চিত্রা, পদ্মা কইরে?”

“ওকে তো দাদার ঘরের দিকে যেতে দেখেছিলাম।”

“তোর দাদার ঘর কোনটা?”

“দোতলার ডান দিকের শেষ ঘরটা।”

মোহিনী কথা না বাড়িয়ে সিড়ি দিয়ে উপরে চলে গেলেন। সোজা অর্ণবের ঘরে ঢুকে গেলেন। কিন্তু পদ্মাবতীকে পেলেন না। ফিরে আসার সময় চোখ পরলো টেবিলে রাখা ক্ষীরের বাটিটার উপর। ঢাকনা উঠিয়ে দেখে কোনো রকম ভাবনাচিন্তা না করে চামচ দিয়ে খাওয়া শুরু করলেন। এরই মাঝে মাথা মুছতে মুছতে স্নানঘর থেকে অর্ণব বেরিয়ে এলেন। মোহিনীকে পেছন থেকে দেখেও তাকে দিব্যি চিনতে পেরেছেন অর্ণব।

“অন্যের জন্য রাখা ক্ষীর চুরি করে খেতে লজ্জা করে না?”

চকিতে পিছনে ঘুরলেন মোহিনী। সুঠাম দেহি এক যুবক দাঁড়িয়ে আছেন। দেখতে কিছুটা উত্তম কুমারের মতো। মুখে থাকা খাবারটুকু গিলে বললেন,

“নাম লেখা আছে নাকি এতে? যার ভাগ্যে ছিল তার পেটেই গেছে। এখনো অর্ধেক বাকি আছে। আপনি চাইলে আপনাকেও দিতে পারি একটু।”

“লাগবে না। অন্যের এঁটো করা খাবার আমি খাইনা।”

“আপনার ইচ্ছা।”

মোহিনী গপগপ করে পুরোটা খেয়ে নিলেন। অর্ণব এক দৃষ্টিতে তার খাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

“আমার খাওয়ায় নজর দিচ্ছেন নাকি?”

“না। খেতে বোধহয় একটু বেশিই পছন্দ করেন আপনি। অথবা খিদে পেয়েছে।”

“দুটোই। আপনি কে?

“অর্ণব চৌধুরী।”

“ওহহহ। বড়মার ছেলে।”

“হুম।”

“আপনি নাকি রাগ করে বিলেত চলে গিয়েছিলেন?”

“আমি রাগ করে যাইনি আর যেতেও চাইনি। পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমার মায়ের ওপর রেগে থাকা যায় না।”

“এটা ঠিক বলেছেন। বড়মার ওপর রেগে থাকা যায় না। এতো সহজ-সরল মানুষ এর ওপর আবার রাগ কিসের? আপনি তো অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন।”

“কোনোটাই নয়।”

“আপনি স্বীকার করতে চান না।”

“বড্ড বেশি কথা বলেন আপনি।”

“এতোটাও না। যাই হোক, এখানে এসেছিলাম পদ্মাকে খুঁজতে। ও যেহেতু নেই, আমারও কোনো কাজ নেই এখানে।”

“দাঁড়ান মেহেরজান।”

“আপনি আমার নাম জানলেন কি কিভাবে?”

“জেনেছি কোনোভাবে।”

“উহু। মোহিনী বলে ডাকলে জিজ্ঞেস করতাম না। কারণ এখানে এমন কেউ নেই যে আমাকে চেনে না। কারও না কারও কাছে নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন আমার নাম। কিন্তু মেহেরজান বলে আমাকে কেউ ডাকে না। একমাত্র আমার তারামা ছাড়া। তবুও বেশিরভাগ সময় ছোট করে মেহের ডাকেন। আচ্ছা, আপনি গিয়েছিলেন সেদিন নাচ দেখতে?”

“গিয়েছি কি যাইনি সেটা কোনো বড় বিষয় নয়। চিড়েও পোলাও খেতে পছন্দ করেন?”

হঠাৎ অর্ণবের এহেন প্রশ্নে অবাক হলে মোহিনী। তবুও চেহারার ভাব স্বাভাবিক রেখে বললেন,

“হ্যাঁ, অনেক পছন্দ করি।”

“ঠিকাছে।”

মোহিনী আর কথা না বাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই অর্ণবও বের হয়ে আসলেন। নিচে নেমে দু’জন দু’দিকে চলে গেলেন। অর্ণব এসে শান্তি দেবীর ঘরে ঢুকলেন।

“ঠাম্মা।”

শান্তি দেবীর পূর্বের মতোই নিজের চশমা খুঁজতে লাগলেন। অর্ণব এসে নিজেই চশমাটা তাকে পরিয়ে দিলেন। শান্তি দেবী আলতো করে অর্ণব এর গালে হাত রাখলেন।

“কেমন আছো ঠাম্মা?”

অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়ে জবাব দিলেন শান্তি দেবী।

“এতোদিন পর মনে পরেছে তোর ঠাম্মার কথা?”

“তোমার কথা তো আমার সবসময় মনে পরে ঠাম্মা।”

“কবে এসেছিস?”

“কয়েকদিন আগেই তো এলাম।”

“আমার সাথে দেখা করলি না কেন? এতোদিন পর আসলি কেন?”

অর্ণব কিছুটা অবাক হলো।

“ঠাম্মা, আমি এসেই তো আগে তোমার ঘরে এসেছিলাম। কালও তো তোমার কাছে এসেছিলাম ঠাম্মা। মনে নেই তোমার?”

শান্তি দেবী নির্বাক। এক ধ্যানে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে আছেন। অর্ণব বুঝতে পারলেন তার কিছু মনে নেই। পেছন থেকে এক মেয়েলি কন্ঠ ভেসে এলো।

“দিদার কিছু মনে থাকে না। এই মনে আছে তো এই ভুলে গেছে। আবার পরে মনেও পরে। একটু আগে কিন্তু নিজেই আপনার কথা বলছিলেন।”

শান্তি দেবী বলে উঠলেন,

“পদ্মা, এসেছিস তুই?”

“হ্যাঁ, এসেছি আমি। সাথে তোমার ওষুধ নিয়ে।”

অর্ণব উঠে চলে গেলেন। পদ্মাবতী শান্তি দেবীকে ওষুধ খাইয়ে দিয়ে তার কোলে মাথা রেখে শুইয়ে পরলেন।

চলবে…

#মেহেরজান
#পর্ব-১০
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

পরী দৌঁড়াচ্ছে। তার পেছন পেছন রজনী দৌঁড়াচ্ছেন। হাতে খাবারের থালা। রজনীর হাতে খেতে কিছুতেই রাজি হচ্ছে না মেয়েটা।

“দেখ পরী, আমি এভাবে খাবার নিয়ে তোর পেছনে দৌঁড়াতে পারবো না। চুপচাপ খেয়ে নে বলছি। নয়তো না খেয়ে থাকবি।”

“উহু। আমি তোমার হাতে খাবো না রজনী দিদি। সবসময় তো তুমি আর মোহিনী দিদি খাইয়ে দাও। আজ আম্মা খাইয়ে দিক। তাহলে খাবো।”

“মার খেতে খুব মন চাচ্ছে বুঝি তোর? আম্মা খাইয়ে দেবেনা তোকে। চুপচাপ খেয়ে নে।”

“আমি খাবো না।”

সামনেই তারানা বসে ছিলেন। সবকিছুই নিরবে দেখে চলেছেন তিনি। রজনী তারানার দিকে তাকালেন। তারানা ইশারা করলে রজনী খাবারের থালাটা তার হাতে দিয়ে গেলেন।

“পরী, এদিকে আয়।”

মেয়েটা চুপচাপ এসে তারানার পাশে বসল। তারানা পরীর মুখে খাবার তুলে দিতে দিতে বললেন,

“আজ খাইয়ে দিচ্ছি বলে রোজ রোজ দেবো এটা ভাবিস না পরী। রজনীর হাতে না খেলে নিজের হাতে খাবি। তাও যদি না পারিস তাহলে না খেয়ে মরবি।”

“কেন? মরবো কেন? তুমি খাইয়ে দেবে না কেন?”

“মেহের এর সাথে থাকতে থাকতে তুইও বড্ড বেশি প্রশ্ন করা শিখেছিস আজকাল। তোকে খাইয়ে দেওয়ার কাজ আমার নয়। বুঝলি?”

“হুম। বুঝেছি।”

দোতলায় দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনাটা দেখে বিদ্রুপাত্মক হাসি হাসলেন সৌদামিনী। নিজের ঘরে এসে হাঁসতে হাঁসতে হঠাৎ করে কাঁদতে লাগলেন।

“রজনী?”

“বলো আম্মা।”

“ওই মেয়েটাকে খেতে দিয়েছিলি দুপুরে কিছু?”

“এখনো তো না।”

“দিয়ে আয় তাহলে।”

পরী বলে উঠলো,

“আমি দিয়ে আসি আম্মা?”

“না, রজনী যাচ্ছে দিতে।”

“না, আমি দিতে যাবো।”

কথাটা বলেই খাওয়া থেকে উঠে পড়লো সে। রজনীর কাছে এসে বলল,

“চলো খাবার বেড়ে দাও। আমি নিয়ে যাবো।”

“মার খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে তোর পরী? এখন কিন্তু বেশি বেশি শুরু করেছিস তুই। সবটা হচ্ছে মোহিনীর সাথে থাকার ফল।”

“ওকে নিয়ে যেতে দে রজনী।”

“আম্মাও বলে দিয়েছে এখন। এবার চলো।”

রজনী আর কিছু না বলে পরীকে নিয়ে চলে গেল। কিছুক্ষণ বাদে সৌদামিনীর ঘরে খাবার নিয়ে ঢুকলো পরী। তার সামনে খাবার রেখে বললো,

“এই নাও দিদি। তোমার খাবার নিয়ে এসেছি। আম্মা পাঠিয়েছে। তুমি তো দুপুরে কিছু খাওনি। খিদে পেয়েছে না তোমার?”

সৌদামিনী জবাব দিলেন না। পরী আবার বললো,

“আমি চলে গেলাম। তুমি তো বড়। নিজের হাতে খেয়ে নিও। নইলে আম্মা খুব বকবে।”

“দাঁড়াও।”

“কি হলো?”

“ওই তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিটাকে তোমরা আম্মা ডাকো কেন? ও তোমাদের মা নাকি ওর মধ্যে কোনো মমতা আছে।”

রজনী এসে ঠাস করে সৌদামিনীর গালে চড় বসিয়ে দিলেন। পরীর পেছন পেছনই এসেছিলেন তিনি।

“নিজে তো মা হতে পারিসনি। শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। বাপের বাড়িতেও জায়গা হয়নি। তুই এতো কথা বলিস কিভাবে? আমরা কাকে কি ডাকবো, তোকে ঠিক করতে হবে না। আমাদের জন্য উনিই আমাদের মা।”

কথাটা বলেই পরীর হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেলেন রজনী। রাগে-দুঃখে থরথর করে কাঁপছেন সৌদামিনী। নিজের রাগ খাটাবার মতো কিছু না পেয়ে সামনে থাকা খাবারের থালাটাই ছুড়ে ফেলে দিলেন তিনি।
.
.
.
দুপুরের খাওয়া শেষ করে বিকেলের দিকে একত্র হয়েছেন কিছু লোকজন। মধ্যবয়সী থেকে শুরু করে বৃদ্ধরাও রয়েছেন সেখানে। গোল হয়ে বসে হুক্কা খেতে খেতে খোশগল্পে মগ্ন তারা। তাদেরই মাঝে একজন হলেন অভ্র বাবু। বিলেতে থাকার নিজের বাইশ বছরের অভিজ্ঞতা শোনাচ্ছেন সবাইকে। হুক্কার ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন,

“না চাচা। কোথাও-ই একটু শান্তি পাই না। এতোদিন হয়ে গেলো নিজের দেশে, নিজের গ্রামে, নিজের পরিবারের কাছে ফিরেছি। তবুও মনে যেন কিসের একটা অশান্তি লেগেই আছে।”

পাশে থেকে একজন বৃদ্ধ বলে উঠলেন,

“বিলেতের হাওয়া গায়ে লেগেছে। এখানে এসে শান্তি পাবে কিভাবে?”

“কি যে বলেন চাচা। ওখানকার চেয়ে হাজার গুণ ভালো আছি এখানে।”

“তাও তো বাইশটা বছর ঠিকই কাঁটিয়ে এলে সেখানে।”

“কাঁটিয়েছি কি আর সাধে? যা করেছি সব তো নিজের পরিবারের জন্যেই করেছি।”

“তা ফিরে যাবে নাকি আবার?”

“না চাচা, অনেক হয়েছে টাকা কামানো। এখন বাকী সময়টা নিজের পরিবারের সাথেই থাকতে চাই। ভাবছি এখানেই নাহয় কলকাতায় একটা ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করবো।”

“এখানে আর কি করবে? করলে ওই কলকাতাতেই যেতে হবে।”

“তাই-ই হয়তো।”

পাশে থেকে আরেকজন বললেন,

“ব্যবসা যখন করবেই তাহলে সাথে ওই শমিত আর অর্ণবকেও নাও। কম তো বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ালে না তাদের। তোমার বোনই বা কি বলো তো। এত বড় একটা ছেলেকে নিজের আঁচলের সাথে বেঁধে রেখেছে একদম। বেকার তো বেকারই, তোমার বোন বিয়েটাও করতে দেয়নি এখনো অব্দি তাকে। শুনেছি গোবিন্দ দাসের মেয়ের সাথে নাকি সম্পর্ক আছে ওর। ওই মেয়ের পেছন পেছন ঘুরে। আবার একসাথেও নাকি দেখা গেছে তাদের। তোমার বোন তো এসব দেখেও না দেখার ভান করে থাকে। তাই তোমাকে বলছি, কোনোকিছু ঘটার আগেই একটা ব্যবস্থা করে ফেলো।”

“তাই নাকি! তাহলে আমি কথা বলবো অনুরাধার সাথে এ বিষয়ে। আর ব্যবসার ব্যাপারেও বলবো। আপনি আমাকে জানিয়ে ভালোই করেছেন।”

প্রথম বৃদ্ধ আবার বললেন,

“আর অর্ণবের কি হবে? সেও তো তোমার মতো বিলেত ফেরত। আবার পড়ালেখাও করেছে অনেক। সে কি আর ছোটখাটো ব্যবসা করতে চাইবে?”

“বলে দেখবো। যদি না করে তো করলো না। জোর করবো না। সেখানে থাকতে তো খুব বড় একটা কোম্পানিতে চাকরি করতো। মাস গেলে বেশ মোটা অঙ্কের মাইনেও পেত।”

“বলো কি! তাহলে ছেড়ে চলে এলো কেন?”

“আমিও তো তাই ভাবি। একসময় তো আসতেই চাইতো না। হঠাৎ করে যে কি হলো। সবকিছু একদম ছেড়ে ছুড়ে এখানে ফেরার জন্য উতলা হয়ে উঠলো ছেলেটা। আমিও আর না করলাম না।”

“যাই হোক। অর্ণব শমিত দুজনেই তোমার সন্তানের মতো। বড় হয়ে গেছে মানে এই না যে সব বুঝে গেছে। দুজনেই বাবাহারা। এখন মায়েরা যদি তাদের ব্যাপারে উদাসীন হয় তাহলে আর কি করার। ওদের ভালোটা তোমাকেই দেখতে হবে।”

“সেটাই।”

টুকটাক এ বিষয়ে আরও কিছু কথা বলে প্রসঙ্গ পাল্টালেন তারা। বিভিন্ন আলাপ-আলোচনা, হাসি-তামাশায় ভরে উঠলো তাদের আসর।
.
.
.
গাঢ় নীল আকাশে পেজা তুলোর মতো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। বাতাসে শুভ্র সাদা কাশফুলগুলো বারবার দোল খেয়ে উঠছে। মাঝি নৌকা পারে এনে ভীড়াতেই অর্ণব চিত্রা আর পদ্মাবতীসহ আরও কয়েকজন মেয়েকে দেখতে পেলেন। তবে তার চোখ খুঁজছে মোহিনীকে। একটু খোঁজাখুঁজি করতে মোহিনীকেও দেখতে পেলেন তিনি। অর্ণব আর শমিত চটপট নৌকা থেকে নেমে গেলেন। শমিত নৌকা থেকে নামা মাত্রই একটা মেয়ে তার দিকে এগিয়ে এলে তিনি মেয়েটার সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। অর্ণব সেদিকে খুব একটা তোয়াক্কা না করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। পদ্মাবতী এক গুচ্ছ কাশফুল নিয়ে ছোটাছুটি করছিলেন। অর্ণবকে দেখে তার দিকে দৌঁড়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন,

“আপনি এখানে কি করছেন?”

“কেন? আসতে পারি না এখানে? নাকি কাশফুল দেখতে শুধু মেয়েরা আসে। কই লেখা আছে এটা?”

মুহুর্তেই পদ্মাবতীর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। মনে মনে অর্ণবকে হাজারটা কথা শুনিয়ে বললেন,

“সব কথার টেরা জবাব না দিলে আপনার পেটের ভাত হজম হয়না না? নাকি শুধু আমার সাথেই এমন করেন?”

“তোমার সাথে এমন করার আলাদা কোনো কারণ নেই অন্তত। আমি সবসময় এভাবেই কথা বলি।”

পদ্মাবতীর আর আগ বাড়িয়ে কোনো কথা বলার ইচ্ছে হলো না। মোহিনী এসে বললেন,

“বাড়ি চল পদ্মা। অনেক্ষণ তো হলো এসেছি।”

“হুম। আপনি কি আমাদের সাথেই যাবেন অর্ণববাবু নাকি আলাদা?”

অর্ণবের উদ্দেশ্যে শেষবারের মতো প্রশ্ন করে নৌকায় উঠে বসলেন পদ্মাবতী। মোহিনী বললেন,

“যেতে চাইলে বলতে পারেন। আমরা তিনজন মাত্র। আপনারা দুজন মিলে পাঁচজন। এক নৌকাতেই হয়ে যাবে।”

অর্ণবের মনে হলো পদ্মাবতী এই প্রথম কোনো ভালো কাজ করলেন। তাছাড়া সবসময় অকাজ করে বেড়ান।

“ঠিকাছে।”

অর্ণব হাত দিয়ে ইশারা করে শমিত আর চিত্রাকে ডাকলেন। তারা এক নৌকায় উঠলেন না। চিত্রা বললেন,

“আমি তো শেফালীর সাথে এক নৌকায় এসেছিলাম। পরে পদ্মা আর মোহিনী এসেছে। আমি শেফালীর সাথেই যাবো।”

তার দেখাদেখি শমিত বললেন,

“ওরা দুজন একা যাবে নাকি। আমি নাহয় ওদের সাথেই যাই। তোরা এক কাজ কর। তুই, পদ্মা, মোহিনী তিনজন এক নৌকায় ওঠ আর আমি, চিত্রা, শেফালী এক নৌকায় উঠি।”

অগত্যা তারা আলাদা দুটো নৌকায় চড়ে যাত্রা শুরু করলেন। শমিতের হাবভাব অর্ণবের কাছে আগে থেকেই সন্দেহজনক ছিল। এখন ব্যাপারটা তার কাছে পরিষ্কার। নৌকার এক কোণায় মোহিনী আর আরেক কোণায় অর্ণব বসেছেন। শরতের শেষ বিকেলের রোদ এসে লাগছে মোহিনীর মুখে। কি মায়াবিনী লাগছে তাকে দেখতে! অর্ণব অপলক মোহিনীর দিকে তাকিয়ে আছেন। এমনকি মোহিনীর সাথে চোখাচোখি হওয়ার পরও নিজের নজর সরাননি তিনি। ব্যাপারটা মোহিনীর যতটা না অদ্ভুত লাগছে, তার থেকে বেশি অস্বস্তিকর মনে হচ্ছে। এই দৃষ্টিতে আজ পর্যন্ত অন্তত কেউ তাকায়নি তার দিকে। এমন চাহনির সাথে পরিচিত নন তিনি। নৌকার একদম মাঝখানে বসেছেন পদ্মাবতী। নৌকা ছোট হওয়ায় হাত বাড়িয়ে মোহিনীর হাত শক্ত করে ধরে আছেন তিনি।

“আমাকে শক্ত করে ধর মোহিনী। পড়ে যাবো তো।”

“পড়বি না তুই। ধরেছি শক্ত করে। বেশি চেঁচাবি তো ধাক্কা মেরে ফেলে দেবো।”

“ভয় দেখাস না মোহিনী।”

“এই তুই ছাড় তো আমাকে। আসতে যেতে সবসময় তোর এক নাটক।”

“মোটেই নাটক না। সত্যিই ভয় পাই তো।”

চারদিক কিছু সময়ের জন্য নিরব হয়ে গেল। নদীর কলধ্বনি ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না। শমিতদের নৌকাটা অর্ণবদের নৌকার থেকে বেশ কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে। হঠাৎই কারও চিৎকার আর নদীতে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ শোনা গেল। চিত্রা দূর থেকে চেঁচিয়ে বললেন,

“ওকে ধরো। ও সাঁতার জানে না।”

মোহিনী পদ্মা বলে চিৎকার দিয়ে নদীতে ঝাপ দিলেন। তার পেছন পেছন অর্ণবও নদীতে ঝাপিয়ে পড়লেন। দুজনে মিলে পদ্মাবতীকে দ্রুত নৌকায় তুললেন। বেশ খানিকটা জল খেয়ে ফেলেছেন তিনি। অনবরত কেঁসে চলেছেন। অর্ণব মোহিনীকেও নৌকায় উঠতে সাহায্য করে নিজেও উঠে এলেন।

“আপনাকে কেও নামতে বলেনি নদীতে। পদ্মাবতীতে আমিই তুলতে পারতাম।”

“কিন্তু আপনার আগে আমি ঝাপ দিয়েছিলাম।”

পদ্মাবতী বললেন,

“দেখলি তো। বলেছিলাম আমাকে শক্ত করে ধর। তুই ধরলি না। তাই-ই তো আমি পড়ে গেলাম।”

“এখন সব দোষ আমার?”

“নয়তো কার?”

পদ্মাবতী অর্ণবের দিকে তাকালেন। চুলগুলো মুখের সামনে এসে গেছে তার। মাথা থেকে জল ভ্রুজোড়া হয়ে কপোল বেয়ে চিবুক থেকে টপটপ করে পড়ছে। এক নজর অর্ণবকে দেখে মাথা নামিয়ে মুচকি হাসলেন পদ্মাবতী। নৌকা ঘাটে এসে থামাতেই সবাই নেমে পড়লেন। চিত্রা দৌঁড়ে এসে পদ্মাবতীকে ধরে বললেন,

“তুই ঠিক আছিস তো পদ্মা?”

“হ্যাঁ। কিছু হয়নি আমার। তবে মোহিনী আর অর্ণববাবু না তুললে নিশ্চিত মরতাম।”

“বাজে কথা বলিস না। বাড়ি চল।”

আম্রপালি ঘষে ঘষে পদ্মাবতী আর মোহিনী মাথা মুছে দিচ্ছেন। ইতোমধ্যে পদ্মাবতী হাঁচি দিতে আরম্ভ করে দিয়েছেন। চুলে টান পড়তেই বললেন,

“আহ। আস্তে।”

“চুপ মেয়ে। নৌকার মাঝখানে বসে তুমি নদীতে পড়ে যাও আবার কথা বলো।”

“ইচ্ছে করে পড়েছি নাকি আমি?”

কথাটা বলেই পদ্মাবতী আবার হাঁচি দিলেন। আম্রপালি আলমারি থেকে দুটো শাড়ি বের করে বললেন,

“তাড়াতাড়ি দু’জনে কাপড় পাল্টে নে।”

“আমি শাড়ি টারি পরতে পারবো না বড়মা।”

“চুপ কর মোহিনী। আমি যা বলেছি তাই করবি।”

“জানেনই তো আমি শাড়ি পরলে হোঁচট খেতে খেতে জান যায়।”

“একদিন শাড়ি পরলে হোঁচট খেয়ে মরে যাবি না তুই।”

“বড়মার কথা শোন মোহিনী। পরে নে।”

অগত্যা তাকে শাড়ি পরতে রাজি হতে হলো। একটা লাল হলুদ রঙা শাড়ি নিলেন তিনি। আম্রপালি বললেন,

“বাহ! কি সুন্দর লাগছে তোকে। কেন যে পরতে চাস না।”

মোহিনী ভেজা কাপড় হাতে নিয়ে বললেন,

“আমি এখন বাড়ি যাই বড়মা।”

“কাপড় গুলো রেখে যা। ধুয়ে শুকিয়ে রাখবোনি। পরে নিয়ে যাস।”

মোহিনী ঘর থেকে বের হতেই পেছন থেকে অর্ণব ডাকলেন তাকে।

“পদ্মাবতী।”

মোহিনী দাঁড়িয়ে পড়লেন। অর্ণব যে তাকে পদ্মাবতী ভেবে ডেকেছেন তা বুঝতে পারছেন। পেছনে ঘুরে বলতেই যাবেন তার আগেই অর্ণব আবার বললেন,

“মোহিনীকে দেখেছো কোথাও?”

ঘুরতে গিয়েও ঘুরলেন না মোহিনী।

“ডাকো তো ওকে।”

এবার পেছনে ঘুরলেন তিনি।

“কি দরকার বলুন।”

মোহিনীকে দেখে বড়সড় একটা ধাক্কা খেলেন অর্ণব। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে মোহিনীর দিকে একটা পাত্র এগিয়ে দিলেন।

“ধরুন।”

মোহিনী ঢাকনা খুলে দেখলেন চিড়ের পোলাও। অর্ণবের উদ্দেশ্যে বললেন,

“পদ্মা আমার থেকে লম্বা আর ওর চুলও কোমড় ছাড়িয়ে। আমার চুল এতো বড় না। এছাড়াও আরও অনেক পার্থক্য আছে। খুব একটা মিল নেই আমাদের মাঝে। পেছন থেকে দেখলেও চেনা যায়। একদিন শাড়ি পরলেই তো আর পদ্মা হয়ে যাবো না। চিড়ের পোলাও এর জন্য ধন্যবাদ।”

চলবে…