Monday, August 4, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 412



মেহেরজান পর্ব-৪৫+৪৬

0

#মেহেরজান
#পর্ব-৪৫
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

★শমিতের সাথে কথা বলে মুঠোফোনটা রাখতেই পেছন থেকে আম্রপালি বললেন,

“পালাতে চাইছিস অর্ণব?”

আম্রপালির এখানে আসাটা টের পাননি অর্ণব। মনে হয় কিছুক্ষণ আগেই এসেছেন। শেষের কথাগুলো শুনেছেন নিশ্চয়ই। অর্ণব তার দিকে ঘুরে বললেন,

“মা!”

“সত্যের থেকে দূরে পালিয়ে গেলেই বুঝি সেটা মিথ্যে হয়ে যাবে? আর কাদের থেকে পালাতে চাইছিস? এরা সবাই তোরই আপনজন। দিনশেষে তোকে এখানেই ফিরে আসতে হবে।”

“আমি এসব চাই না মা। আপনারা জোর করে আমার ওপর একটা বোঝা চাপিয়ে দিয়েছেন। যেটা নিয়া চলা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়।”

“তুই ভাবছিস তাই বোঝা মনে হচ্ছে। কখনো এই বিয়েটা সহজভাবে নিয়েছিস? মেনে নিয়ে দেখেছিস?”

“মানতে চাইও না। আপনারাও জানেন আর আমিও জানি মেহের আমার জন্য কী। ওকে ছাড়া আমার জীবন মূল্যহীন।”

আম্রপালি তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসি দিয়ে বললেন,

“এখনো মোহিনীর কথাই ভাবছিস? আমাকে একটা কথা বল তো অর্ণব। মোহিনীর সামনে তুই কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াবি? ওর ভালোবাসার যে অমর্যাদাটা তুই করেছিস তারপরও ও তোকে মেনে নেবে?”

“মেনে নেবেন। সব মেনে নেবেন। আমি ক্ষমা চাইবো তার কাছে। তিনি আমাকে ফেরাতে পারবেন না মা।”

“ভুল ভাবছিস তুই। মিথ্যা বলে নিজের মনকে শান্তনা দিচ্ছিস মাত্র। ও তোকে কোনোদিন মানবে না। তুই এখনো ওকে চিনতে পারিসনি। আমি বড় করেছি ওকে। আমি জানি ও এসব মেনে নেবে না। ওর সাথে প্রতারণা করেছিস তুই। বারবার তোকে ক্ষমা করে, তোর প্রতি নিজেকে দুর্বল প্রমাণ করে নিজের আত্মমর্যাদায় কখনোই আঘাত হানতে দেবে না ও।”

বিছানায় ধপ করে বসে পড়লেন অর্ণব। আম্রপালি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

“অর্ণব, আমি তোর মা। তোর ভালো চাই সবসময়। বিয়েটা তুই যেমন নিজের অমতে গিয়ে আমার কথায় করেছিলি তেমন এবারও আরেকটা কাজ করবি?”

“কী?”

ছোট্ট একটা শব্দেও আম্রপালি বুঝতে পারলেন অর্ণব মাথা নিচু করে নিঃশব্দে কাঁদছেন। আম্রপালি তার মুখ দু’হাতে উঁচু করে ধরলেন। আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে দিয়ে বললেন,

“আমার সামনে কাঁদতে লজ্জা কীসের? নাকি ছেলে বলে লজ্জা পাচ্ছিস? ছেলেদের যে কাঁদতে নেই, এটা ভুল। আর মায়ের কাছে তার ছেলে-মেয়ে দুজনেই তার সন্তান। মায়ের কাছে মন খুলে কাঁদা যায়। তুইও আজ ইচ্ছেমতো কেঁদে নে। তাহলে বাকিটা জীবন অন্তত হাসিখুশি থাকবি।”

“কেন?”

“তোর আজ যত কষ্টই হোক অর্ণব, আমার আর মাত্র একটা কথা রাখ। মোহিনীকে ছেড়ে দে। ভুলে যা ওকে। তোর সামনে এখন দুটো দরজা আছে। এক দরজায় মোহিনী আর আরেক দরজায় পদ্মাবতী আর তোর সন্তান দাঁড়িয়ে। মোহিনীর দরজাটা ক্ষণিকের জন্য খোলা আর যে দরজায় পদ্মাবতী, সেটা চিরকাল খোলা থাকবে তোর জন্য। এবার বল, কার কাছে যাবি তুই?”

অর্ণব জবার দিলেন না। আম্রপালিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। আম্রপালি আবার বললেন,

“পদ্মাবতী আর মোহিনী, দু’জনকেই আমি বড় করেছি অর্ণব। একজন গড়তে ভালোবাসে তো আরেকজন ধ্বংস করতে। মোহিনী তোকে ধ্বংস করে দেবে। আর পদ্মাবতী সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে তোকে আবার গড়তে পারবে। তুই ওর সাথে খুব ভালো থাকবি।”

অর্ণব পাঞ্জাবীর হাতায় চোখ মুছে আম্রপালির দিকে তাকিয়ে বললেন,

“আমি পারবো না মা। আমি পারবো না। মেহেরকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। পদ্মাবতীকে আমি আমার জীবনে জায়গা দিতে পারবো না। তবে হ্যাঁ, একটা কাজ করবো।”

“কী?”

“মেহেরকে ছেড়ে দেব। ঠিক বলেছেন আপনি। কোন মুখে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াবো? আর কোনোদিন তার সামনে গিয়ে দাঁড়াবো না আমি। ছোটবেলা থেকেই নিজেকে খুব সাহসী দাবি করে এসেছি কিন্তু তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে কিছু বলার সাহস আর আমার মাঝে নেই। আর কোনোদিন আমার মুখ দেখাবো না তাকে।”★

ছেলের জীবন নিজ হাতে সুন্দর করে গড়ে দেবেন বলে ঠিক করেছেন আম্রপালি। তাতে ছলনার আশ্রয় নিতে হলে তা-ই সই। মোহিনীর জীবনে যে অর্ণবের জন্য আর কোনো জায়গা নেই, এটা সত্যি হোক আর মিথ্যে, তা অর্ণবকে বিশ্বাস করাতে পেরেছেন তিনি। অর্ণবকে আর কোনোকিছু নিয়ে জোর করেননি সেদিন। চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। সকালে হাসিমুখে বিদায় দিয়েছিলেন ছেলেকে। পানশালায় বসে পুরনো সেসব কথাই ভাবছিলেন অর্ণব। অভ্রবাবুর ডাকে স্মৃতিচারণে ব্যাঘাত ঘটলো তার। অভ্রবাবু জড়িয়ে আসা কণ্ঠে বললেন,

“শুনতে পাচ্ছো অর্ণব?”

“হু?”

“শুনতে পাচ্ছো আমি কী বলছি?”

অর্ণব নির্লিপ্তভাবে চেয়ে রইলেন। নেশা ধরে গেছে তার। অভ্রবাবু এতোক্ষণ কী বলেছেন তার কোনো কথাই কর্ণকুহর হয়নি অর্ণবের। অভ্রবাবু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,

“নিজেকে আয়নায় ভালো করে দেখেছো একবার? কী অবস্থা হয়েছে তোমার?”

অর্ণব ঘোরগ্রস্তের মতো জবাব দিলেন,

“হুম। মাথায় লম্বা চুল, বহুদিনের না কামানো খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি আর রাতে না ঘুমিয়ে থেকে থেকে চোখের নিচে কালি পড়ে যাওয়া সবসময় ঘুমাচ্ছন্ন থাকা রক্তবর্ণ দুটো চোখ। দেখেছি আমি নিজেকে।”

“তোমার মা তোমাকে এভাবে দেখলে খুশি হবেন না। তিনি তোমাকে এখানে আমার ভরসায় পাঠিয়েছেন। আমি চাই না তুমি এভাবে কষ্ট পাও।”

“আমি নিজের খেয়াল রাখতে জানি কাকু।”

“এতোমাস হয়ে গেল তুমি এখানেই আছো। তোমার একটু হাওয়াবদল প্রয়োজন। তুমি কিছুদিনের জন্য কুঞ্জনগরে ফিরে যাও অর্ণব। ঘুরেবেড়িয়ে এসো। তাছাড়াও তোমার স্ত্রী এখন সন্তানসম্ভবা। যেকোনো দিন তুমি বাবা হতে পারো। এখন ওর প্রয়োজন তোমাকে।”

“বাবা!”

“বাবা হওয়াটা মুখের কথা নয় অর্ণব। তোমার জীবন সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে দিতে পারে এই একটা শব্দ। তুমি এখন শুধু নিজের কথা ভাবছো। তুমি কিসে ভালো থাকবে সেটা ভাবছো। কিন্তু বাবা হওয়ার পর তোমাকে দেখতে হবে তোমার সন্তান কিসে ভালো থাকে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে তোমাকে সব কষ্ট সহ্য করতে হবে। নিজের কথা ভুলে তার ভালোর জন্য ভাবতে হবে।”

অর্ণব সামান্য হাসলেন। অভ্রবাবু বললেন,

“হাসছো? আমি তোমাকে এ-বিষয়ে উপদেশ দিচ্ছি বলে হাসি পাচ্ছে নিশ্চয়ই তোমার। আমি পারিনি অর্ণব। আমি একজন ভালো পিতা হতে পারিনি। কিন্তু আমি জানি তুমি পারবে।”

“বাবা হব আমি? একজন ভালো বাবা।”

“আমার মতো ভুল তুমি করো না অর্ণব। নিজের স্ত্রী, সন্তান নিয়ে সুখী থাকো। বিয়ের পরও অন্য নারীর সাথে সম্পর্ক রাখাটা কখনো ভালো কিছু বয়ে আনে না। কিন্তু এই সন্তান তোমার জীবনে নিশ্চয়ই ভালো কিছু নিয়ে আসবে।”

শেষের কথাগুলো খুব ভালোভাবে অর্ণবের মাথায় গেঁথে গেল। আশেপাশের লোকগুলো তাদের দুজনের সম্পর্ক জেনে প্রায়ই তাদের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। এজায়গায় মানুষ সচরাচর নিজের পরিবারের সাথে এসে একসাথে বসে মদ খায় না। গুরুজনদের সাথে তো একদমই নয়। বরং লুকিয়েই আসে। অভ্রবাবু এটা বুঝতে পেরে অর্ণবের পাশ থেকে উঠে কিছুটা দূরে গিয়ে বসলেন। অর্ণব এখনো অভ্রবাবুর বলা কথাগুলো ভাবছেন। বিড়বিড় করে বললেন,

“যে সন্তান জন্মাবার পূর্বেই আমাদের বিচ্ছেদ ঘটালো, সে সন্তান আর কী ভালো নিয়ে আসবে আমার জীবনে। আমি এখনো ভাবতে পারি না মেহের, যে আপনি আর আমার নেই। অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছি আপনাকে আমি। প্রায় আট মাস হতে চললো আপনাকে আমি দেখিনা মেহের। তবুও প্রতিটা মুহুর্ত আমার চোখের সামনে আপনার চেহারা ভাসে। দিনে যতবার শ্বাস নিয়েছি, তার থেকেও অধিকবার আপনার কথা ভেবেছি আমি। আমার প্রতিটা শ্বাস-প্রশ্বাসে আপনার নাম লেখা আছে মেহেরজান।”

বিড়বিড় করতে করতে অর্ণব তার একটু দূরেই একটা লোককে বসে থাকতে দেখলেন। বয়স পঞ্চাশের কোঠায় হবে। অর্ণব চেনেন না তাকে। কথা হয়নি কখনো। কিন্তু যতবার এখানে এসেছেন ততবারই ওই লোকটাকে দেখেছেন। হয়তো প্রতিদিনই আসেন এখানে। প্রতিবার নতুন নতুন মুখের সাথে এই একটা পুরনো মুখ দেখতে পান অর্ণব। তাই সহজে নজরেও এসে গেছে। অর্ণব গ্লাসে থাকা মদটুকু এক নিঃশ্বাসে গিলে উঠে তার পাশে গিয়ে বসলেন।
.
.
.
আয়নার সামনে বসে কান থেকে ঝুমকো দুটো খুলে পাশে রাখলেন মোহিনী। চুড়িগুলো খুলতেই হাত ফসকে সব নিচে ছড়িয়ে পড়লো। মোহিনীর চেহারায় বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠলো। ঊর্মিলাকে ডেকে বললেন,

“চিরুনীটা আমার হাতে দিয়ে চুড়িগুলো ওঠাতো ঊর্মিলা।”

ঊর্মিলা যথারীতি চিরুনীটা মোহিনীর হাতে দিয়ে চুড়িগুলো খুঁজতে লাগলেন। কাজ করতে করতে বললেন,

“আজ মনে হলো পদ্মাবতীকে দেখলাম ছাদে উঠেছে।”

মোহিনী চুল আঁচড়াচ্ছিলেন। হঠাৎ চুলে টান লাগতেই “আহ্” করে উঠলেন। এরপর বললেন,

“কীভাবে দেখলি? এখান থেকে ওতো ভালো করে মুখ বোঝা যায় নাকি?”

“দুপুরে লুকিয়ে লুকিয়ে আম্মার দূরবীক্ষণটা নিয়ে ছাদে উঠেছিলাম। আর মুখ দেখেও তো চিনতাম না। ওকে আগে কখনো দেখেছি নাকি আমি।”

মোহিনী সামান্য হাসলেন।

“তাহলে বুঝলি কী করে ওটা পদ্মাবতী?”

“পেট দেখে।”

মুহুর্তেই মোহিনী কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেলেন। চিরুনীটা সামনে রেখে বললেন,

“তা ওর শ্বাশুড়ি ওকে এই অবস্থায় ছাদে উঠতে দিলেন?”

“সে আমি জানি না।”

ঊর্মিলা সবগুলো চুড়ি উঠিয়ে রেখে দিয়ে বললেন,

“মোহিনী।”

“হুম।”

“তোর অর্ণবদার কথা মনে পড়ে না?”

“কার কথা?”

“অর্ণবদা।”

“অর্ণব চৌধুরী আবার তোর দাদা হলো কবে থেকে?”

“ঠিকাছে। এবার বল। অর্ণব চৌধুরীর কথা কখনো মনে পড়ে না তোর?”

“না, মনে পড়ে না। তার কথা আমার কেন মনে পড়তে যাবে? মনে রাখার মতো কোনো মানুষ সে?”

“কিন্তু তুই তো ভালোবাসিস তাকে।”

“ভালোবাসতাম। কিন্তু সে প্রতারণা করেছে আমার সাথে। তাই আমিও ভুলে গেছি তাকে।”

“সত্যিই ভুলে গেছিস?”

“ভুলে না যাওয়ার কী আছে? আর আমাদের জীবনে একাধিকবার প্রেম আসাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। একটা গেছে তো আরেকটা আসবে।”

“অন্যকারও জন্য না হলেও তোর জন্য অবশ্যই অস্বাভাবিক।”

“তুই এখন বের হ তো আমার ঘর থেকে। খুব ক্লান্ত লাগছে। আমি এখন ঘুমাবো।”

বলেই ঊর্মিলাকে বের করে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলেন মোহিনী। আলমারি থেকে খুব গোপনে রেখে দেওয়া একটা বাক্স বের করলেন। বাক্সে অসংখ্য না পাঠানো চিঠি, অর্ণবের দেওয়া নুপুর আর বালাটা রয়েছে।। সেগুলো পাশে রেখে মোহিনী আরেকটা চিঠি লিখতে বসে গেলেন।

“কেমন আছেন অর্ণব? সবাইকে মিথ্যে বললেও সত্যি এটাই যে আপনার কথা আমার সবসময় মনে পড়ে। কতমাস হয়ে গেল আপনাকে দেখি না। আপনাকে দেখতে যে বড্ড ইচ্ছে করে। কিন্তু তার সব রাস্তাই যে আপনি বন্ধ করে গেছেন। আমাকে একা ফেলে চলে গেছেন। জানেন অর্ণব, আপনাকে আমি যতটা না ভালোবাসতাম, তার থেকেও অধিক ঘৃণা করি এখন। আপনার কথা মনে পড়লে এখন আর ভালোবাসা নামক শব্দটা মাথায় আসে না। শুধু একটা শব্দই মনে পড়ে। সেটা হলো ‘প্রতারক’।”

চিঠিটা লেখা শেষ করে বাক্সে রেখে আবার তা আলমারিতে তুলে রাখলেন মোহিনী। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ বুজে বললেন,

“ঈশ্বরের কাছে আমার একটাই প্রার্থনা। ওদের সর্বনাশ।”

চলবে…

#মেহেরজান
#পর্ব-৪৬
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

গায়ে একটা ধবধবে সাদা শাড়ি জড়িয়েছেন মোহিনী। নিজের ঘরে বসে পায়ে আলতা দিচ্ছেন। আলতা লাগানো শেষ হতেই ঘুঙুর দুটো দু’পায়ে বেঁধে দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। চুপি চুপি ছাদে উঠে এলেন। আকাশে মস্ত বড়ো একটা চাঁদ উঠেছে। পূর্ণিমার আলোয় চারিদিক ঝলমল করছে। মোহিনী পুরো ছাদে হাঁটাহাঁটি শুরু করলেন। তার খোলা চুলগুলো বাতাসে সুতো কাটা ঘুড়ির মতো উড়ছে। ইশ! আজ যদি পূর্ণিমা না হয়ে অমাবস্যা হতো, তাহলে পরিবেশটা আরও বেশি ভয়ংকর লাগতো। রাতবিরেতে এমন দৃশ্য দেখলে যে-কেউ ভয় পাবে। মোহিনীও তাই চায়। কিছুক্ষণের মধ্যে হলোও তাই। একটা চিৎকার কানে আসলো। মোহিনী ওদিকে তাকাতেই কাউকে ছুটে চলে যেতে দেখলেন। খিলখিল করে হেসে ফেললেন তিনি। নিচে চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। মোহিনী ছাদের দরজার কাছে এসে কান পেতে শুনতে পেলেন,

“আমি বলেছিলেন এ-বাড়িতে ভূ’ত ঢুকেছে। কেউ বিশ্বাস করোনি আমার কথা। আজ নিজের চোখে দেখেছি। এতোদিন তো শুধু ঘুঙুর আর লাফালাফির আওয়াজ শুনেছি। আজকে নাচতেও দেখে এলাম। ও-মাগো, ও কি আমাকে দেখে ফেলেছে? আমাকে কি মে/রে ফেলবে এখন? আমার এখন কী হবে?”

“চুপ কর তো। আমাকে দেখতে দে।”

মুখ চেপে হাসি আঁটকানোর চেষ্টা করলেন মোহিনী। অন্যান্য মেয়েদের সাথে তারানার আওয়াজও শুনতে পেলেন। না, আর থাকা যাবে না এখানে। বেশিক্ষণ থাকলে ধরা পড়ে যেতে হবে। মোহিনী চলে যেতে উদ্যত হতেই দূরের বাড়িটার দিকে চোখ আঁটকে গেল তার। আলোকসজ্জায় সজ্জিত বাড়িটা। অজান্তেই মোহিনীর পা দুটো তাকে ছাদের কিনারায় নিয়ে এলো। না চাইতেও মোহিনী ভাবনায় ডুবে গেলেন। কিসের এতো আলো ও-বাড়িতে? আজ হঠাৎ আবার ও-বাড়ির সব খবর জানতে ইচ্ছে করলো মোহিনীর। ইশ! পূর্বাটা থাকলে ভালো হতো। কী হচ্ছে ওখানে সব জানা যেত। কিন্তু মেয়েটাও অর্ণব চলে যাওয়ার এক সপ্তাহের মাথায় কাজ ছেড়ে দিল। এতোদিন অবশ্য ওখানকার কোনো খবরাখবর জানারও প্রয়োজনবোধ করেননি মোহিনী। কিন্তু এখন কী করে জানবেন? এক কানে ব্যথা অনুভব করলেন তিনি। কেউ তার কান মুচড়ে ধরেছে। “আহ” শব্দ করে পেছনে ফিরতেই দেখলেন তারানা দাঁড়িয়ে আছেন।

“তারামা, ছাড়ো। ব্যথা লাগছে।”

“লাগুক। এসবের পেছনে তাহলে তুই ছিলি? আগেই বুঝে যাওয়া উচিত ছিল আমার।”

তারানা মোহিনীর কান ছেড়ে দিলেন। মোহিনী আবার সেদিকে ঘুরে তারানার উদ্দেশ্যে বললেন,

“ও-বাড়িতে এতো রাত পর্যন্ত আবার কিসের অনুষ্ঠান হচ্ছে তারামা? জানো কিছু?”

“জানি না। আর ও-বাড়িতে কী হয় না হয় তা জেনে তোর কী?”

“আমাকে কষ্ট দিয়ে ওরা কীভাবে এতো ভালো আছে? এতো আনন্দ কীভাবে করে ওরা? আমার যে সহ্য হয় না।”

“তাহলে শুধু শুধু এখানে দাঁড়িয়ে নিজের জ্বালা বাড়াচ্ছিস কেন? নিচে চল। ওদের বলতে হবে ওরা এতোদিন কোন ভূ’তকে ভয় পেত। না, ভূ’ত নয়, পে’ত্নী। পে’ত্নী ধরেছি আজ। চল আমার সাথে।”

মোহিনীকে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেলেন তারানা। কিন্তু মোহিনীর মনে এখনো একই চিন্তা চলছে।
.
.
.
সকাল সকাল শেফালীকে রান্নাঘরে দেখেই চেঁচিয়ে উঠলেন অনুরাধা। এক মুহুর্তে যেন পুরো বাড়িটাও মাথায় তুলে ফেললেন। মায়ের চেঁচামেচি শুনে শমিত দৌঁড়ে এলেন। কয়েকদিন আগেই এসেছেন তিনি। আজ আবার ফিরে যাবেন। গত সাত মাসে ইতোমধ্যে তাকে বহুবার আসতে হয়েছে শেফালীর জন্য। শমিতকে দেখে অনুরাধা বলে উঠলেন,

“এই তোর বউয়ের জন্য আমি কি কখনোই শান্তিতে থাকতে পারবো না? আর কত অশান্তি দিবি তোরা আমাকে?”

শেফালী চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। শমিত বললেন,

“আরে কী হয়েছে সেটা তো বলবেন মা। কী করেছে ও?”

“কে বলেছে ওকে? কে বলেছে এই সময়ে ওকে রান্নাঘরে এসে কাজ করতে? শুনে রাখ শমিত। তোর বউয়ের জন্য যদি আমার নাতি নাতনির কিছু হয় তো ওকে আর এ-বাড়িতে ঠাই দেব না বলে দিলাম।”

“শেফালী, তুমি রান্নাঘরে কী করছো?”

“আরে আমি তো জল খাচ্ছিলাম। তাছাড়া অন্যকিছু করিনি।”

অনুরাধা আবার চেঁচিয়ে উঠলেন।

“জল খেতে এখানে আসতে হবে কেন? ঘরে জল ছিল না? আর না থাকলে আমাদের কাউকে বলতে। আর তাছাড়া এ-বাড়িতে কি ঝি চাকরের অভাব আছে নাকি? একটা গেলে আরেকটা আসে।”

শমিত মুচকি হেসে শেফালীকে নিয়ে ঘরে চলে এলেন।

“তোমাকে কে বলেছিল ওখানে যেতে? শুধু শুধু মায়ের কথা শুনতে হলো।”

“আমার কী দোষ? তোমার মা-ই একটু বেশি বেশি করেন। আমার বাচ্চা আমার পেটে। এদিকে আমার থেকে ওনার চিন্তা বেশি।”

“চিন্তা তো একটু করবেনই। প্রথমবার দাদি হচ্ছেন।”

“প্রথমবার মা তো আমিও হচ্ছি। আমি তো এতো চিন্তা করছি না।”

“এটা ভালো। আর ডাক্তারও বলেছেন তোমাকে বেশি চিন্তা না করতে।”

“কিন্তু তোমার মা তো সে হতে দিচ্ছেন না। সবসময় আমার চিন্তা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছেন।”

“কী চিন্তা চিন্তা শুরু করলে বলো তো? আর মা তো তোমার জন্যই এতো চিন্তা করেন।”

শেফালী নিজের পেটে হাত রেখে বললেন,

“মা আমার জন্য নয়, তোমার সন্তানের জন্য চিন্তা করেন।”

“ওই একই হলো। এখন আর আমার সাথে ঝগড়া শুরু করো না। আমি বের হব এখন।”

“আজই চলে যাবে?”

“সময় পেলেই আবার চলে আসবো।”

শেফালীর কপালে চুমু খেয়ে শমিত নিজের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। তার পেছন পেছন শেফালীও গেলেন এগিয়ে দিতে।
.
.
.
বাজারের মাঝখানে মস্ত বড়ো একটা গয়নার দোকান। সন্ধ্যেবেলা এই একটা দোকানের আলোয়ই যেন পুরো বাজার ভরে ওঠে। এক মুহুর্তে সকলের নজর কাড়তে যথেষ্ট এই আয়োজন। অভ্রবাবু যে অল্প সময়েই ব্যবসায় অনেক উন্নতি করেছেন তা বেশ ভালোরকমই বোঝা যায়। এতে শ/ত্রুর সংখ্যাও যে বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এই উন্নতিতে শমিতের অবদানও কম নয়। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও এতোমাসে একদিনের জন্যও অর্ণবকে দোকানে বসাতে পারেননি। সে হিসেবে শমিত তাকে এ-কাজে বেশ সাহায্য করেছেন। দোকানের ভেতরেই অভ্রবাবুর একটা আলাদা কামড়া রয়েছে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। সেখানে বসেই বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তিনি। শমিতকে ঢুকতে দেখে বললেন,

“এসো শমিত এসো। তোমারই অপেক্ষায় ছিলাম। তোমাকে ছাড়া যে এসব কত কষ্টে সামলাই, সে যদি বুঝতে তুমি! তা সোজা এখানে এলে নাকি বাড়িতে গিয়েছিলে?”

শমিত বসতে বসতে বললেন,

“সোজা এখানেই এসেছি। দোকানের একটু খোঁজখবর নিতে। অর্ণব এলে বাড়িতে যাবো ওর সাথে।”

“অর্ণব তোমার আসার খবর পেয়েছে?”

“হ্যাঁ, জানিয়েছি।”

“তাহলে দেখো এইতো এলো বলে।”

কথা শেষ করতে না করতেই অর্ণব প্রবেশ করলেন ভেতরে। তাকে দেখে অভ্রবাবু বললেন,

“ওইতো এসে গেছে।”

শমিত উঠে গিয়ে অর্ণবের সাথে করমর্দন আর কোলাকুলি করে বললেন,

“ভালো আছিস?”

“হ্যাঁ। তোর খবর বল।”

“দেখেই তো বুঝতে পারছিস আমি কতটা ভালো আছি।”

“তা আমার বোনটার কী খবর? শেফালী ভালো আছে?”

“ঔ ভালো। শুধু মায়ের সাথেই যা একটু লাগে।”

বলেই দুজনেই হেসে উঠলেন। শমিত আর অর্ণব দু’জনে দুটো চেয়ার টেনে বসলেন। অভ্রবাবু একজনকে ডেকে তিনটে চা পাঠাতে বললেন। অর্ণব বললেন,

“শুধু শুধু এখানে আসতে গেলি কেন আবার? ওখানে আরও ক’টাদিন থাকলেও পারতি ওর সাথে। কষ্ট হলেও এদিকটা কাকু ঠিকই সামলে নিতেন।”

অভ্রবাবু জবাব দিলেন,

“সে নিতাম। কিন্তু তোমাকেও তখন শান্তিতে বসে থাকতে দিতাম না আর। আমার কষ্টটা তোমাকেও বুঝিয়ে ছাড়তাম।”

শমিত বললেন,

“এদিকে কাজটা আরেকটু গুছিয়ে আবার যাবো।”

চা চলে এলে অভ্রবাবু নিজের কাপটা এগিয়ে নিলেন। চায়ে চুমুক দিয়ে অর্ণবের উদ্দেশ্যে বললেন,

“শমিতের যাওয়া-আসা তো চলছেই ওখানে। এবার তোমারও একটু যাওয়া উচিত।”

অর্ণব ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে তুললেন। অভ্রবাবু আবার শমিতের দিকে ইশারা করে বললেন,

“আমি ঠিক বলেছি না শমিত? তুমি কী বলো?”

শমিত জবাব দিলেন না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজের চা খাওয়ায় মনোনিবেশ করলেন।

চলবে…

মেহেরজান পর্ব-৪৩+৪৪

0

#মেহেরজান
#পর্ব-৪৩
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

চোখ বুজে মাথায় হাত দিয়ে সিড়িতে বসে আছেন অর্ণব। শকুন্তলার কান্নার শব্দ কানে আসছে। করুণ সুরে কাঁদছেন তিনি। ব্রেন্ডার পরিচয় জেনে শকুন্তলা যেভাবে অর্ণবের দিকে তাকিয়েছিলেন তা কিছুতেই ভুলতে পারছেন না অর্ণব। নিজের কাছেই নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। কিন্তু তার উদ্দেশ্য তো খারাপ ছিল না। নিজের ছোটমাকে কষ্ট পেতে দেখতে চাননি বলেই সবটা লুকিয়েছেন। আর যা কিছু ছিল, সবটা তো পুরোনো কথা। ব্রেন্ডা যে এতো বছর পর এভাবে হঠাৎ করে ফিরে আসবেন তা-ই বা কে জানতো? মাথা তুলে সামনে তাকালেন অর্ণব। অভ্রবাবুও ঠিক তার মতোই মাথা নিচু করে বসে আছেন। না চাইতেও যত দ্রুত সম্ভব কলকাতা থেকে ফিরে আসতে হয়েছে তাকে। যে অঘটন ঘটা থেকে আটকাতে তিনি এতোদিন অর্ণবের ভরসায় ছিলেন, সেটাই ঘটেছে। একবার ভাবলেন বলবেন, “জমিদারের বংশধর আমরা। আমাদের জীবনে একাধিক নারী থাকা কোনো অস্বাভাবিক কিছু না। তোমরা এখন একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছো এ নিয়ে।” পরক্ষণেই কথাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলেন। এ কথা বলে নিজের পরিবারের কাছে আর ছোট হতে চান না তিনি। অন্তত এই বয়সে এসে শান্তি দেবীর হাতে মার খেতে চান না। এমনিতেই ছেলের এমন কাজে প্রচন্ড ক্রুদ্ধ তিনি। শকুন্তলার কান্নার শব্দে এখন বিরক্ত লাগতে শুরু করেছে অভ্রবাবুর। বিরক্তিমাখা কণ্ঠে বললেন,

“আহ, তুমি কান্না বন্ধ কর তো এখন। অনেক হয়েছে।”

অভ্রবাবুর কথায় শকুন্তলার কান্না থামার পরিবর্তে কয়েকগুণ বেড়ে গেল। আরও উচ্চস্বরে কাঁদতে শুরু করলেন তিনি। অর্ণব হাতঘড়ির দিকে তাকালেন। ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুইছুই। পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা অনুভব করছেন তিনি। আজ দুপুরে উনুনে হাড়ি চড়েনি। বাড়ির কারও তেমন খাওয়ার মন মেজাজ ছিল না। উপায় না থাকায় অর্ণবকেও বাকিদের মতোই অভুক্ত থাকতে হয়েছে। কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণ? মনে হচ্ছে পেটের ভেতর আগুন জ্বলছে। ক্ষুধার জ্বালা হচ্ছে সবথেকে বড় জ্বালা। এর আগে কিচ্ছু নয়। পূর্বাকে দেখলেন ড্যাবড্যাব করে সব দেখছেন। ইশারায় ডাকলেন তাকে অর্ণব। পূর্বা এলে বললেন,

“তোমাকে কি এখানে তামাশা দেখার জন্য রাখা হয়েছে? রাতের রান্না বসাওনি কেন এখনো?”

“কিন্তু…”

পূর্বা কথা শেষ করার আগেই অর্ণব বললেন,

“কিসের কিন্তু? তোমার কথা শোনার জন্য মাসে মাইনে দেবো না। এখুনি গিয়ে রান্না বসাও।”

পূর্বা দৌঁড়ে রান্নাঘরে গেলেন। কিন্তু কাজ করতে করতেও তার দৃষ্টি এদিকেই রয়েছে। পদ্মাবতী দূর থেকে বোঝার চেষ্টা করছিলেন অর্ণব কী বলছেন। নিচু স্বরে কথা বললেও রেগে কথা বলছিলেন এতটুকু বুঝতে পেরেছেন। পূর্বাকে রান্না ঘরে যেতে দেখে বাকীটাও বুঝতে পারলেন। অর্ণব একে একে ভালো করে সবাইকে দেখছেন। কার ভেতরে কী চলছে বোঝার চেষ্টা করছেন। ব্রেন্ডার দিকে চোখ যেতেই দেখলেন একদম শান্ত হয়ে বসে আছেন তিনি। তার মনে কী আছে বুঝতে পারছেন না অর্ণব। হঠাৎ এতোবছর পর কেন ফিরে এলেন? অর্ণব যতদূর জানতেন তার স্বামীর সাথে বেশ ভালোই ছিলেন ব্রেন্ডা। কিন্তু সেটাও সাত বছর আগের কথা। তারপর আর ব্রেন্ডার সাথে কোনো যোগাযোগ করেননি। এখন তাহলে কী চান তিনি?

ব্রেন্ডা এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলে উঠলেন,

“তুমি আমার সাথে ফিরে চলো অভ্র।”

শকুন্তলা কান্নার স্বর বাড়িয়ে আম্রপালিকে জড়িয়ে ধরে বললেন,

“ও দিদিগো, ও কি আমায় ছেড়ে দেবে এখন?”

“শান্ত হ তুই। কিচ্ছু হবে না এমন।”

অভ্রবাবু ব্রেন্ডার উদ্দেশ্যে বললেন,

“তুমি ফিরে যাও ব্রেন্ডা। আমি আসতে পারবো না তোমার সাথে। আর তাছাড়া তোমারও স্বামী আছে।”

“নেই আমার কোনো স্বামী। ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে আমার।”

অভ্রবাবু ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। এরপর বললেন,

“আমি তোমার সাথে ফিরবো না ব্রেন্ডা।”

“তাহলে আমাদের সন্তানের কী হবে? ও কি বাবা ছাড়া বড় হবে?”

ব্রেন্ডার কথা শুনে অর্ণবের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। সবাই কিছুক্ষণের জন্য পাথর হয়ে গেলেন। কেউ-ই যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। শকুন্তলার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। আম্রপালির ওপর ঢলে পড়লেন তিনি। সাথে সাথে পদ্মাবতী আর আম্রপালি তাকে ধরে বসিয়ে দিলেন।

“শেফালী, তাড়াতাড়ি জল নিয়ে আয়।”

পদ্মাবতী বলা মাত্রই শেফালী জল আনতে ছুটে গেলেন। অভ্রবাবু বললেন,

“আমাদের সন্তান?”

“হ্যাঁ, আমাদের ছেলে।”

“কী সব বলছো তুমি? আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলছো?”

“না, মিথ্যে নয়। সত্যিটাই বলছি। তোমার থেকে চলে যাওয়ার কিছুদিন পর জানতে পারি আমি গর্ভবতী। আমি নিজের সংসার নষ্ট করতে চাইনি। আর তোমার ব্যবসার অবস্থাও ভালো ছিল না তখন। তাই আর তোমার কাছেও ফিরে আসিনি। আমার স্বামী ভেবেছিল এটা ওর সন্তান। এতোবছর সব ঠিকই ছিল। কিন্তু ছ’মাস আগে ও কোনোভাবে জানতে পারে সত্যিটা। এরপর ও আমাদের ছেড়ে চলে যায়। আমার সন্তানের পিতৃ পরিচয় দিতেও অস্বীকার করে।”

“সেদিন তুমি নিজের লাভের জন্যই আমায় ছেড়ে চলে গিয়েছিলে আর আজ এতোবছর পর আবার নিজের লাভের জন্যই আমার কাছে ফিরে এসেছো তাহলে।”

“না, আমি এসেছি আমার সন্তানের জন্য। আমি চাই না ও ওর বাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হোক। তুমি ফিরে চলো আমার সাথে। ওখানে তোমার ভবিষ্যৎ আছে। তোমার ছেলে আছে। এখানে কার জন্য পড়ে থাকবে তুমি? তোমার কোনো সন্তানও নেই এখানে।”

জল খেয়ে আর চোখেমুখে ছিটিয়ে শকুন্তলা কিছুটা শান্ত হয়েছেন। কিন্তু তার চোখের জলকে আটকাতে পারছেন না। পদ্মাবতীকে বললেন,

“আমাকে ঘরে নিয়ে চল, পদ্মা। আমি আর এখানে থাকতে পারছি না।”

পদ্মাবতী আর শেফালী মিলে শকুন্তলাকে ধরে দোতলায় নিয়ে এলেন। শকুন্তলা নিজের ঘরে না গিয়ে চিত্রার ঘরে ঢুকে ওদের চলে যেতে বললেন। এরপর দরজা আটকে মেয়ের জিনিসপত্র আঁকড়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।

শান্তি দেবী এককোনায় বসে ছেলে কী বলে তা শোনার অপেক্ষা করছেন। শুধু তিনি নন, অন্যরাও একই কথা শোনার অপেক্ষায় আছেন। অভ্রবাবু মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। কত বছর তিনি শুধু একটা ছেলে সন্তান চেয়েছিলেন। যাও পেয়েছিলেন, তাও জন্মানোর আগেই ভগবান নিয়ে নিলেন। একটা ছেলের জন্য নিজের মেয়েটাকে কতই না অবহেলা করেছেন। সেও চলে গেল। আর আজ সেই ছেলে পেয়েও খুশির বদলে কষ্ট বাড়ছে তার। যে সন্তানকে তিনি কখনো দেখেননি, স্পর্শ করেননি, যার সম্পর্কে কিছু জানতেন না পর্যন্ত, তার জন্য আজ সবাইকে ছেড়ে গেলে পুরোটা জীবন তাকে একটা পরিবারের কাছে অপরাধী হয়ে থাকতে হবে। তার অপরাধের শাস্তি গোটা পরিবার কেন ভোগ করবে?

“তুমি কিছু বলছো না কেন অভ্র? যাবে তো আমার সাথে?”

অভ্রবাবু হাত জোড় করে ব্রেন্ডার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,

“তুমি আমাকে ক্ষমা করো ব্রেন্ডা। আমি আমার স্ত্রী, পরিবার ছেড়ে যেতে পারবো না তোমার সাথে। আমার জীবনে তোমাকে কোনো জায়গা দিতে পারবো না। তবে আমার সন্তানের দায়িত্ব নিতে আমি রাজি। যদি তুমি চাও তো তার ভরণপোষণ দিতে রাজি আছি আমি। তুমি চাইলে ওকে আমার কাছে রেখে যেতে পারো।”

“অসম্ভব। আমার ও ছাড়া আর কেউ নেই। আমি ওকে এখানে রেখে যেতে পারবো না।”

অভ্রবাবু কী বলবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,

“তাহলে আমাকে ক্ষমা করে দিও।”

অভ্রবাবু ক্ষমা চেয়ে নিজের জায়গায় এসে বসে পড়লেন। এতোক্ষণ শক্ত হয়ে থাকা মানুষটাও আর নিজেকে আটকাতে পারলেন না। ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন ব্রেন্ডা। তার কান্নার শব্দ যেন অন্য সব আওয়াজে ছাপিয়ে গেছে। পুরো বাড়ির কানায় কানায় ভরে উঠেছে তার করুণ সুর। বেশ কিছুক্ষণ কাঁদার পর শান্ত হলেন ব্রেন্ডা। উঠে দাঁড়িয়ে নিজের যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। আম্রপালি তাকে থামিয়ে বললেন,

“আপনি থেকে যান আজ রাতটা। এতো রাতে যাবেন না।”

“এখন আর এখানে থাকার কোনো মানে নেই। আমাকে আটকাবেন না। আমি ঠিকই নিজের পথ খুঁজে চলে যেতে পারবো।”

অর্ণবের সামনে এসে দাঁড়ালেন ব্রেন্ডা। বললেন,

“বিয়ে করেছো দেখলাম। সেদিন একবারও বললে না যে। এখানে না আসলে তো জানতেও পারতাম না কোনোদিন। খুব মিষ্টি দেখতে তোমার বউটা। তোমার কাকুর মতো, ওকে ছেড়ে আবার অন্য কোনো মেয়ের সাথে জড়িয়ে পড়ো না কখনো। ওকে যেন কাঁদতে না হয়। এরকম দিন যেন তোমার জীবনে কোনোদিন না আসে। যাই হোক, বিবাহিত জীবনের জন্য শুভকামনা রইল।”

নিজের কথা শেষ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন ব্রেন্ডা। অর্ণব ভাবছেন ব্রেন্ডা এসব কী বলে গেলেন তাকে। বাকিরা এখনো যে যার জায়গায়ই বসে রয়েছেন। শান্তি দেবী এসে অভ্রবাবুর সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,

“ফিরিঙ্গি মাইয়া মানুষের কাছে তো ঠিকই ক্ষমা চাইবার পারস। নিজের বউয়ের কাছে চাইতে লজ্জা করে ক্যান? ওরে কম দুঃখ দিছস? ওর কাছে ক্ষমা চাইবার পারস না?”

তাচ্ছিল্যভরে কথাগুলো বলে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলেন শান্তি দেবী।
.
.
.
অন্ধকারে হাতে হ্যারিকেন নিয়ে একটা কাঁচা রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছেন পূর্বা। বাঁশঝাড়ের সামনে আসতেই কেউ ফিসফিস করে বললেন,

“পূর্বা দিদি, এদিকে এসো।”

পূর্বা ঝাড়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন,

“মোহিনী, তুই এখানে? আমি তোদের বাড়ির দিকেই যাচ্ছিলাম। ভালোই হয়েছে তোকে এখানেই পেয়ে গেলাম।”

“ওসব বাদ দাও। আগে বলো ও-বাড়িতে কী হলো।”

“বলছিরে বলছি। একটু গুছিয়ে নিতে দে।”

“বলো তাড়াতাড়ি।”

মোহিনীর চোখেমুখে তীব্র কৌতূহল প্রকাশ পাচ্ছিলো। কিন্তু কেন তা পূর্বা জানেন না। তার জানার প্রয়োজনও নেই। তিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা মোহিনীকে খুলে বললেন। সবকিছু শুনে মোহিনী অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। হাসতে হাসতেই বলবেন,

“আমি যা ভেবেছিলাম, এ তো তার থেকেও অনেক বেশি দূর এগিয়ে।”

পূর্বার কাছে খুব অদ্ভুত লাগছে ব্যাপারটা। তিনি মোহিনীর উদ্দেশ্যে বললেন,

“হ্যাঁ রে মোহিনী, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো তোকে?”

মোহিনী হাসি থামিয়ে বললেন,

“কী কথা?”

“কাল আমাকে বললি ও-বাড়িতে কাজের লোক লাগবে। আমাকে যেতে হবে। তুই যেতে বলেছিস একথাও গোপন রাখতে হবে। ওদের সব খবর এনে দিতে বললি। সবকিছু শুনে হাসার কথা নয় তবুও এমন পাগলের মতো হাসছিস। তা কেন? ও-বাড়িতে তুই আর যাস না?”

“এখন সব বলার সময় নেই দিদি। সময় হলে পরে জানাবো তোমাকে। তুমি আমায় বড় উপকার করেছো। এই নাও। এটা রাখো। বলেছিলাম তোমার মেয়ের চিকিৎসার সব খরচ আমি দেবো। ভালো একটা ডাক্তার দেখিও ওকে। তাড়াতাড়িই সুস্থ হয়ে উঠবে ও।”

কথাটা বলেই টাকার মোটা একটা বান্ডিল পূর্বার হাতে দিলেন মোহিনী। পূর্বার দু-চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো।

“তোর এই ঋণ আমি কোনোদিন ভুলবো না রে মোহিনী। সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো তোর কাছে।”

“এখন যাও তুমি। দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমিও আসি।”

বলেই মোহিনী বাড়ির পথে হাঁটা দিলেন। বাড়িতে ফিরে তারানাকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত কথা বললেন। বলেই আবার হাসতে শুরু করলেন। এই হাসি তারানার মোটেও পছন্দ হলো না। তিনি বললেন,

“এসবে তোর কী লাভ?”

“লাভ নেই তারামা। কিন্তু শান্তি আছে। আমি চাই আমাকে দেওয়া কষ্টের স্বাদ ওরাও গ্রহণ করুক। প্রিয়জন দূরে সরে গেলে কেমন লাগে সেটা ওরাও বুঝুক।”

মোহিনীর চোখে প্রতিশোধের আগুন স্পষ্ট দেখতে পেলেন তারানা। মনের মধ্যে এক অজানা ভয় মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো তার। এই আগুনে যে শুধু ওরা নয়, মোহিনীকেও পুড়ে ছাই হতে হবে তা দিব্যি বুঝতে পারছেন তিনি।
.
.
রান্না ঘরে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে কাজ করছিলেন পদ্মাবতী। হঠাৎ আলো জ্বলে ওঠায় চমকে উঠলেন। পেছনে ঘুরে দেখলেন শেফালী দাঁড়িয়ে আছেন। ঘুমঘুম চোখে শেফালী জিজ্ঞেস করলেন,

“রাতদুপুরে তুই রান্না ঘরে কী করছিস পদ্মা?”

“তেমন কিছু না। খিদে পেয়েছিল খুব। খিচুড়ি খেতে ইচ্ছে করছিল। তাই রাঁধছিলাম।”

“তাই বলে এখন?”

“হ্যাঁ, এখনই। এতোরাতে তুই এখানে?”

“জল খেতে উঠেছিলাম। আওয়াজ শুনে নিচে নেমে এলাম। ভেবেছিলাম বেড়াল-টেড়াল ঢুকেছে হয়তো। এসে দেখি তুই।”

পদ্মাবতী থালায় খিচুড়ি বেড়ে আচারের বৈয়াম খুলতে খুলতে বললেন,

“এতো সাবধানে কাজ করছিলাম যাতে কারও ঘুম না ভাঙে। কিন্তু তুই ঠিকই টের পেয়ে গেলি।”

“তোকে দেখে আমারও খিদে পেয়ে গেল মনে হচ্ছে।”

“খেতে না করেছে কে তোকে?”

“কিন্তু ঘুমও তো আসছে খুব। তুই আমার জন্য কিছুটা রেখে দিস। সকালে উঠে খাবো। এখন দাঁড়িয়ে থাকছে পারছি না।”

“ঠিকাছে। যা তাহলে তুই। আমি রেখে দেবো তোর জন্য।”

শেফালী চলে গেলে পদ্মাবতীও খাওয়া ছেড়ে হাত ধুয়ে নিলেন। আধখাওয়া খাবারটা ঢেকে রেখে আম্রপালির ঘরের দিকে চলে গেলেন।

চলবে…

#মেহেরজান
#পর্ব-৪৪
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

পেছন থেকে পা টিপে টিপে এসেই অর্ণবকে জড়িয়ে ধরলেন মোহিনী। অর্ণব বলে উঠলেন,

“এভাবে হুটহাট করে আমাকে জড়িয়ে ধরবেন না মেহের। আপনার স্পর্শে আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়।”

মোহিনী হি হি করে হেসে উঠলেন। অর্ণবের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,

“বাঃ রে, আপনাকে জড়িয়ে ধরবো না তো কাকে ধরবো?”

“কাউকেই না।”

“আর আমি আপনাকে জড়িয়ে না ধরলে কে ধরবে? পদ্মা?”

অর্ণব ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়লেন। পদ্মাবতীকে নিয়ে মোহিনীর বলা প্রতিটা বাক্য যে তার বুকে ছুরি চালায় তা কবে বুঝবেন মোহিনী? অর্ণবের নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হয়। তাকে কি সারাজীবন এই অপরাধবোধের বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে?

“আপনার সবসময় ওই একটাই নাম ঠোঁটের ডগায় থাকে। আমাকে না রাগালে, কষ্ট না দিলে আপনি শান্তি পাননা? সারাজীবন কি এভাবে কথা শোনাবেন এটা নিয়ে?”

“সারাজীবন আর কথা শোনাতে পারবো কই? আপনি তো অন্য কারও। একদিন না একদিন ঠিকই আমাকে ভুলে যাবেন।”

“উল্টোপাল্টা বলবেন না একদম। আমি অন্য কারও? তাহলে আপনি আমার সাথে আছেন কেন? চলে গেলেই তো পারেন।”

“আছি কারণ পরের জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেশি হয়। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়।”

“চুপ। এখন একটু বেশি বেশিই হয়ে যাচ্ছে।”

“ঠিকাছে। রাগবেন না। আর করবো না মশকরা। আমার ঘরে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী ভাবছিলেন?”

“আপনি যেন সারাজীবন আমাকে কথা শোনাতে পারেন, তার ব্যবস্থা করছি। সে ব্যাপারেই ভাবছিলাম।”

“কী ব্যবস্থা? বিয়ে করে নিয়ে বাড়িতে উপস্থিত হওয়ার কথা ভাবছেন নাকি আবার?”

“কেন? এতে কোনো অসুবিধা আছে নাকি আপনার?”

“আমার নেই। অসুবিধা তো আপনার বাড়ির লোকের। তারা মানবে কোনোদিন?”

“সেদিন আপনাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে বলেছিলেন না? কেউ না মানলে এবার সত্যি সত্যিই পালিয়ে যাবো আপনাকে নিয়ে। অনেক দূরে চলে যাবো আমরা। তারপর আপনি চিরদিনের জন্য শুধু আমার হবেন। আমার মেহেরজান।”

“দেখা যাবে কত পারেন।”

“কী?”

“পালাতে।”

“পালাতে যেন নাহয় তার জন্য এখন বাড়ি যেতে হবে।”

“সে কি! আমি তো মাত্রই এলাম। আপনি এখনই চলে যাবেন?”

“আমি আপনাকে একটা জিনিস দিতে এসেছিলাম।”

অর্ণব পকেট থেকে একটা মোটা একটা বালা বের করলেন। খুবই অদ্ভুত ও আকর্ষণীয় নকশা এর। বালার একপ্রান্তে ময়ূর, যার পেখমে ছোট ছোট গাঢ় নীল পাথর বসানো। আর সেই ময়ূরের গলা পেঁচিয়ে থাকা বালার অপরপ্রান্ত থেকে আসা এক সর্পিণী, যার মাথায় বড় একটা সবুজ রঙের পাথর বসানো। প্রথম দেখায়ই যে-কারও নজর কাড়তে সক্ষম এটি।

“এটা কার?”

“ঠাম্মার। জানেন, এই বালাটারও একটা গল্প আছে। বংশপরম্পরায় কিছু না কিছু শ্বাশুড়ির হাত থেকে বাড়ির বউদের কাছে আসে। কিন্তু আমাদের পরিবারেরটা অন্যরকম। আমাদের পরিবারে এই বালাটা ঠাকুমারা তার নাতবউকে দিয়ে থাকেন।”

“এটা আবার কেমন নিয়ম? নাতির বিয়ে হওয়া পর্যন্ত যদি ঠাকুমা না বাঁচেন?”

অর্ণব ভ্রু কুঁচকালেন। এরপর আবার স্বাভাবিকভাবে বললেন,

“সে আমি জানি না। এরকম আরও একটা ছিল। কিন্তু সেটা বহুবছর আগেই চিতায় উঠেছিল। যিনি প্রথম এগুলো বানিয়েছিলেন তার সাথে, তার ইচ্ছায়। আমার দাদার দাদার দাদার সময়েরও অনেক আগে। শুধু এটাই রয়ে গেছে। আর হাত বদলে এক জনের থেকে আরেকজনের কাছে আসছে। ঠাম্মা এটা আমার কাছে দিয়ে বললো আপনাকে পরিয়ে দিতে।”

বলেই অর্ণব বালাটা মোহিনীর হাতে পরানোর চেষ্টা করতে লাগলেন।

“আমাকে পরাতে বলেছে নাকি আপনার স্ত্রীকে?”

“আমি এটা ঠিক জায়গায়ই নিয়ে এসেছি।”

এতো চেষ্টার পরও অর্ণব বালাটা মোহিনীর হাতে ঢোকাতে পারছেন না। মোহিনী হেসে বললেন,

“আপনার এই বালা পরতে হলে আমাকে আরও শুকাতে হবে মনে হচ্ছে।”

অর্ণব হেসে ফেললেন।

“সেটা আপনার দ্বারা সম্ভব হবে না। এক ঘন্টা না খেয়ে থাকতে পারেন কিনা সন্দেহ।”

“আপনি বলছেন আমি বেশি খাই? অবশ্য বলতেই পারেন। মিথ্যে তো আর নয়।”

“তা বললাম কখন?”

অর্ণব এখনো বালাটা মোহিনীকে পরানোর চেষ্টা করেই যাচ্ছেন। মোহিনী বললেন,

“ছেড়ে দিন অর্ণব। এটা আমার হাতে লাগবে না। আর আমি পরবোও না।”

“কেন?”

“যেদিন মনে হবে আমি এটার সত্যিকার হকদার, সেদিন পরবো। আপনার হাতেই। এখন এটা ফিরিয়ে নিয়ে যান।”

অর্ণব নিজের বৃথা চেষ্টা বন্ধ করে বালাটা বিছানার ওপর ছুড়ে ফেললেন। বললেন,

“আমি এটা ফিরিয়ে নিয়ে যাবো না। আবার পরানোর চেষ্টা করবো। ততদিন যত্ন করে রেখে দেবেন।”

অর্ণব চলে যেতে উদ্যত হলেন।

“অর্ণব।”

“কী?”

“যখন তখন এ-বাড়িতে চলে আসতে আপনার ভয় করে না?”

“কীসের ভয়?”

“লোকলজ্জার।”

অর্ণব যেতে যেতে উত্তর দিলেন,

“না, করে না।”
.
.
.
কামিনী ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। অর্ণবের ঘরের বারান্দায় দাঁড়ালে গন্ধটা আরও ভালোভাবে পাওয়া যায়। পদ্মাবতী প্রাণভরে একটা শ্বাস নিলেন। শেফালী এসে বললেন,

“বড় মামী ডাকছেন তোকে।”

“কেন?”

“জানি না। বলেননি আমাকে। অর্ণবদাও আছেন ঘরে।”

“ওহ, বুঝতে পেরেছি। ঠিকাছে। আমি যাচ্ছি।”

আম্রপালির ঘরে ঢুকতেই দেখলেন অর্ণব বসে আছেন। পদ্মাবতীকে দেখে আম্রপালি তার হাতের কাগজটার দিকে ইশারা করে বললেন,

“আমার হাতে এটা কী জানিস? বুঝেছিস নিশ্চয়ই।”

পদ্মাবতী চুপ করে রইলেন। আম্রপালি আবার বলে উঠলেন,

“তোর আর অর্ণবের বিবাহবিচ্ছেদের কাগজ।”

দেখেই বোঝা যাচ্ছে আম্রপালি প্রচন্ড রেগে আছেন। অর্ণবের উদ্দেশ্যে বললেন,

“এসবের মানে কী অর্ণব?”

“এটাই তো হওয়ার কথা ছিল মা। নাকি আপনি ভেবেছিলেন আমি সবটা মেনে নিয়ে এভাবেই থাকবো?”

“কাকে ছাড়তে চাইছো তুমি? একটু পরিষ্কার করে বলো তো।”

“মানে?”

“মানে নিজের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নাকি তোমার অনাগত সন্তানের মাকে?”

আম্রপালির কথা শুনে অর্ণব কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল তার। তিনি বললেন,

“কী বলতে চাইছেন?”

“বুঝছো না আমি কী বলতে চাইছি? খুব শীঘ্রই তুমি একজন পিতা হতে চলেছো। তাই এসব উল্টাপাল্টা চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। কাল থেকে দূর্গাপূজো। অনেক কাজ। এসব ছাড়াছাড়ির কথা বাদ দিয়ে পূজোটা একসাথে উপভোগ কর। আশা করি সব বুঝতে পেরেছো। এখন যেতে পারো।”

অর্ণবের কাছে এখনো সবকিছু এলোমেলো লাগছে। নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না। তিনি কি ভুল শুনলেন? নাকি এটাই সত্যি? কিচ্ছু বুঝতে পারছেন না। কিছু না বলে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। এরপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। পদ্মাবতী আম্রপালির দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে আছেন। আম্রপালি চোখের ইশারায় তাকে কিছু বললেন। পদ্মাবতী কী বুঝলেন কে জানে। তারপর তিনিও চুপচাপ চলে গেলেন। অর্ণবের সামনে আসতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন,

“মা যা বললেন তা কি সত্যি?”

“মিথ্যে বলার কোনো কারণ আছে?”

“একদম হেঁয়ালি করে কথা বলবে না। তুমি জানো আমি মেহেরকে ভালোবাসি। তোমার সাথে সংসার করা অসম্ভব।”

“কেন? এতোদিন কি সংসার করেননি? তাছাড়া রাতের পর রাত যখন আমার সাথে কাটাতেন তখন মনে পড়েনি আপনি অন্য কাউকে ভালোবাসেন? তাহলে এখন হঠাৎ ছেড়ে দিতে চাইছেন কেন? নাকি মন ভরে গেছে?”

“একদম বাজে কথা বলবে না।”

“বড়মা মিথ্যে বলছেন এমন কেন মনে হচ্ছে আপনার? এমন তো নয় যে আপনার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। নাকি মোহিনীকে কী করে মুখ দেখাবেন সেটা ভেবে ভয় পাচ্ছেন?”

পদ্মাবতীর কোনো কথারই জবাব দিতে পারছেন না অর্ণব। কারণ মিথ্যে বলছেন না তিনি। শুধু নিজের ওপর রাগ, লজ্জা, ঘৃণায় চোখ লাল হয়ে উঠছে অর্ণবের।
.
.
.
“নোংরা লোক একটা। লজ্জা করলো না আমাকে ভালোবাসার কথা বলেও পদ্মার সাথে সম্পর্কে জড়াতে?”

“পদ্মাবতীর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই মেহের। আমি শুধু আপনাকে ভালোবেসেছি।”

“এখনো মিথ্যে বলছেন আমাকে? সম্পর্ক নেই তাহলে বাচ্চা আসলো কোথা থেকে?”

“মেহের, আমাকে আর একটা সুযোগ দিন। শেষবারের মতো ক্ষমা করে দিন।”

“কিসের ক্ষমা? এতোকিছুর পরও আপনি বলছেন আপনাকে আরও সুযোগ দিতে? লোকে আমাদের চরিত্রহীন ভাবে। আসল চরিত্রহীন তো আপনারা। মেয়ে দেখলে হুশ থাকে না, না?”

“মেহের, আমাকে অন্তত কিছুটা সময় দিন আপনাকে সব বুঝিয়ে বলার জন্য।”

“আর কী বোঝাবেন আমাকে? ভুল তো আমি করেছি, আপনাকে বিশ্বাস করে। আপনার মুখও আর কোনোদিন দেখতে চাই না আমি।”

“যাবেন না মেহেরজান। আমাকে ছেড়ে যাবেন না। মেহেরজান…”

বিড়বিড় করতে করতেই ঘুম থেকে ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়লেন অর্ণব। গায়ের পাঞ্জাবীটা ঘামে একদম ভিজে গেছে। প্রচন্ড হাঁপাচ্ছেন তিনি। গ্লাসে জল ঢেলে এক নিঃশ্বাসে ঢকঢক করে খেয়ে ফেললেন। দেওয়ালঘড়িতে দেখলেন রাত প্রায় তিনটে বাজে। কিছু ভেবে না পেয়ে শমিতকে কল করলেন। ওপাশ থেকে ঘুম ঘুম কণ্ঠে জবাব এলো,

“কে বলছেন?”

“শমিত, আমি অর্ণব।”

শমিতের উঠে বসার শব্দটা ওপাশ থেকে শোনা গেল।

“অর্ণব! তুই এতো রাতে?”

“আমি কলকাতায় যাবো। তোদের ওখানে।”

“কলকাতায় আসবি ভালো কথা। তাহলে সেদিন মামার সাথে চলে এলেই তো পারতি। আর তুই এটা বলার জন্য এতো রাতে আমার ঘুম ভাঙালি? ওখানে সব ঠিক আছে তো?”

“কিচ্ছু ঠিক নেই শমিত। কিচ্ছু ঠিক নেই এখানে।”

“অর্ণব, কী হয়েছে বলতো আমায়। আমার তো র’ক্তচাপ বেড়ে যাচ্ছে তোর কথা শুনে।”

“বলবো। সব বলবো তোকে। আমাকে আসতে দে আগে।”

“ঠিকাছে। তুই শিগগিরই চলে আয় এখানে।”

“কালই আসছি আমি।”
.
.
.
“মেহেরজান,

আপনার মুখোমুখি হওয়ার সাহস নেই আমার। আমার সব ভুল ক্ষমা করলেও এই ভুলটা হয়তো আপনি কোনোদিনও ক্ষমা করবেন না। আমি চেয়েছিলাম আপনার সাথে নিজের জীবনটা গুছিয়ে নিতে। কিন্তু আমিই আপনার আর আমার এক হওয়ার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছি। আপনাকে নিজের বলে দাবি করার অধিকারটাও হারিয়েছি। জগৎটা আমাদের ভালোবাসার বিরুদ্ধে কেন বলতে পারেন? আপনাকে যত পেতে চেয়েছি, তত হারিয়েছি। এখন আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে সবকিছু ঠিক করার উপায়টুকুও নেই। আপনাকে পাওয়ার শেষ আশাটাও নিঃশেষ হয়ে গেছে। আপনাকে হারিয়ে ফেলেছি আমি, চিরকালের জন্য। আমাদের ভালোবাসাটা নাহয় পরের জন্মের জন্যই তোলা রইলো। আবার যখন জন্মাবো তখন চিনতে পারবেন তো আমায়? ক্ষমা করবেন তো আমাকে? সে জন্মে আপনার আর আমার মাঝে অন্য কেউ থাকবে না। তখন আপনি শুধু আমার হবেন। আমার মেহেরজান। -অর্ণব।”

অর্ণবের পাঠানো চিঠিটা পড়া শেষ করে সামনে তাকালেন মোহিনী। এই চিঠির অর্থ তিনি বেশ বুঝতে পারছেন। কারণটাও জানেন। পূর্বার কাছে কাল রাতে শুনেছেন পদ্মাবতী অন্তঃসত্ত্বা। দূরের রাস্তাটা দিয়ে মাত্রই অর্ণবের গাড়িটা চলে যেতে দেখলেন। চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু এখন কপোল বেয়ে পড়ছে তার।

“কী অদ্ভুত দেখুন, অর্ণব। এক শরতে আমাদের প্রণয় হলো, পরের শরতেই বিচ্ছেদ। এক বছরের মধ্যে সব যেমনভাবে শুরু হয়েছিল, তেমনিই শেষ হয়ে গেল। আপনি বলেছিলেন আমাকে নিয়ে অনেক দূরে কোথায় চলে যাবেন। কিন্তু আপনি তো আমাকে ফেলে একাই চলে গেলেন।”

পেছন থেকে মোহিনীর কাঁধে হাত রাখলেন তারানা। মোহিনী পেছন ফিরতেই দেখলেন তার চোখে জল। তারানা জল মুছে দিয়ে বললেন,

“কাঁদিস না মেহের। তোর চোখে জল মানায় না। তুই তো সম্পূর্ণটাই আগুন। এই সামান্য জল সেটাকে নেভাতে অক্ষম। তাই অযথা কেঁদে এই জলকে বৃথা যেতে দিস না।”

“আমি আর কাঁদবো না তারামা।”

“ও-বাড়িতে পূজো শুরু হয়েছে। আজ অন্তত যা। দেখে আয়।”

“ও-বাড়ির দরজা আমার জন্য অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে তারামা। শুধু শুধু নিজের অপমান করতে কেন যাবো? ও-বাড়িতে আমার বলে যে ছিল, সেও চলে গেল। এখন কার ভরসায় যাবো আমি ওখানে?”

তারানা জবাব দিলেন না। মোহিনী বাক্স থেকে নিজের ঘুঙুরজোড়া বের করলেন।

“যার জন্য আমি তোদের ছাড়লাম, সে আমায় ছেড়ে গেল। কিন্তু তোরা ছাড়লি না। এখনো আমার সাথেই রয়ে গেলি।”

মোহিনীকে ঘর থেকে বের হতে দেখে তারানা বললেন,

“কোথায় যাচ্ছিস?”

“জলসাঘরে। অনেকদিক ধরে মুজরা করা হয়না। এখন আর নিষেধ করারও কেউ রইলো না।”

“আবার নাচবি তুই?”

“হ্যাঁ, নাচবো। আজ সন্ধ্যায় শহর থেকে অনেক বাবুরা আসবেন, না? আমি চাই না আমি ওদের সামনে ভুলভাল নাচি। তাই এখন তার প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছি। দেখো তুমি, আজ এই মোহিনীর ওপর থেকে কেউ নজর সরাতে পারবে না।”

চলবে…

মেহেরজান পর্ব-৪১+৪২

0

#মেহেরজান
#পর্ব-৪১
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

পদ্মাবতী চা দিয়ে গেলে অর্ণব খবরের কাগজ হাতে নিয়ে চা খেতে লাগলেন। শান্তি দেবী নিজের ঘর থেকে বের হয়ে সবাইকে একবার দেখে এসে অর্ণবের পাশে বসলেন।

“কী ঠাম্মা? চা খাবে নাকি খবর পড়বে?”

“ওসব দেশ বিদেশের খবর জেনে আমার কী লাভ?”

“তাহলে চা খাবে?”

“না, ওটা তুই-ই খা। তারচেয়ে খবরের কাগজটা পড়ে আমাকে বরং দুটো খবরই শোনা।”

“এই যে বললে এতে তোমার লাভ নেই?”

“শুনলে ক্ষতিও তো নেই। তুই শুরু কর বলা। আমি শুনি।”

অর্ণব পড়তে যাবেন তার আগেই শকুন্তলা বললেন,

“খবরের কাগজ থেকে আর কী খবর শুনবেন মা? ওর থেকে বড় খবর তো পাড়ায় হয়ে গেছে।”

“কী হয়েছে?”

ছাদে থেকে নেমে এলেন আম্রপালি। শকুন্তলার বলার আগেই তিনি প্রশ্ন করলেন,

“বাইরে পুলিশ দেখলাম। কেন এসেছে?”

শকুন্তলা বললেন,

“সেটাই তো বলছিলাম। আরে ওই রাঘব মাস্টার দুমাস আগে আরেকটা বিয়ে করলো না? তো ওর আগের বউ নতুন বউকে কাল রাতে মে/রে ফেলেছে। মে/রে ফেলেছে তো ফেলেছেই আবার আজ পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় বলছিল সতীনের সংসার করার চেয়ে ম/রে যাওয়া ভালো। নিজে তো ম/রতে পারবে না। ওতো সাহস নেই। তাই সতীনটাকেই মে/রে ফেলেছে।”

পদ্মাবতী নিজের কাজ ফেলে অবাক হয়ে শকুন্তলার কথা শুনছেন। শেফালীও নিজের কাজ থামিয়ে দিয়েছেন এ কথা শুনে। আম্রপালি বলে উঠলেন,

“কী সাংঘাতিক কান্ড!”

অর্ণব বলে উঠলেন,

“মানে কী? তাই বলে একেবারে খু/ন করে ফেলবে?”

শান্তি দেবী খিকখিক করে হেসে উঠলেন। তার হাসিতে সবাই ভ্রুকুটি করে চেয়ে রইলেন। তিনি বললেন,

“বেশ হয়েছে। উচিত শিক্ষা হয়েছে ওই রাঘব মাস্টারের। ঘরে বউ বাচ্চা থাকতে আরেকটা বিয়ে করতে গেল কেন? পুরুষ মানুষ বলে যা খুশি তাই করবে নাকি? এজন্যই বলে সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়। নিজের সুখের সংসার নিজেই নষ্ট করেছে। এখন এ-কূলও গেল, ও-কূলও গেল। বিয়ে করার স্বাদ একদম ঘুচে গেছে ব্যাটার। এবার থাকুক বউ ছাড়া। দেখুক কেমন লাগে।”

শান্তি দেবী হাসতে হাসতে নিজের ঘরে চলে গেলেন।
.
.
.
বাইরে দুটো বিড়ালছানা খেলছে। একদম বাচ্চা। আশেপাশে তাদের মাকে দেখা যাচ্ছে না। মোহিনী জানালায় দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে ওদের খেলা দেখছেন। আচ্ছা, ছানা দুটোকে কি তিনি বাড়ির ভেতরে নিয়ে আসবেন? একদম না, এরপর দেখা যাবে তারানা তাকেই বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন। বিড়ালছানা দুটোকে বাড়িতে আনার চিন্তা যেভাবে এসেছিল আবার সেভাবেই চলে গেল মাথা থেকে। পেছন থেকে ঊর্মিলা বললেন,

“তোর গয়নাগুলো তো খুব সুন্দর মোহিনী। এভাবে অযত্নে ফেলে রেখেছিস কেন?”

মোহিনী বাইরে দৃষ্টি রেখেই বললেন,

“তোর পছন্দ হলে রাখতে পারিস। আমি আর ওগুলো পরিনা এখন।”

“নুপুরও?”

“না। নুপুর নয়। ওগুলো অর্ণব দিয়েছিলেন আমায়। ওগুলো বাদে সব।”

“আচ্ছা। তুই তো এখন আর নাচ করিস না। তোর ঘুঙুরজোড়া আমাকে দিবি? আমার খুব পছন্দ ওগুলো।”

চকিতে পেছনে ঘুরলেন মোহিনী। চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,

“একদম না। ভুলেও ঘুঙুরের দিকে নজর দিবি না। ওগুলো শুধু আমার। এই তুই যা তো এখন ঘর থেকে। গোছাতে হবে না তোকে কিছু। আমার যা যা লাগবে না আমি পাঠিয়ে দেবো তোর ঘরে।”

“তুই রেগে যাচ্ছিস কেন?”

মোহিনীর নিজেরও মনে হলো তিনি অযথাই রাগারাগি করলেন। যে কথাগুলো শান্তভাবেই বলা যায় সেগুলো শুধু শুধুই রাগ দেখিয়ে বললেন। মোহিনী বসে পড়লেন। ঊর্মিলার সাথে পরীও ছিল। একদম চুপ করে বসেছিল মেয়েটা। ও কখন ঘরে এসেছে বুঝতেই পারেননি মোহিনী। পরীর উদ্দেশ্যে বললেন,

“আমাকে একটু জল খাওয়া তো পরী। দেখিস, আবার জল ভরতে গিয়ে মেঝেতে ফেলিস না যেন।”

পরী জল এনে মোহিনীকে দিয়ে তার কোলে চড়ে বসলেন। মোহিনী জল খেয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

“তুই কখন এলি?”

“তুমি ধমক দেওয়ার একটু আগে।”

মোহিনী হেসে বললেন,

“আমি কাকে ধমক দিলাম?”

“ঊর্মিলা দিদিকে।”

“তুই তো খুব দুষ্ট হয়েছিস পরী। কখন আসিস কখন যাস কিচ্ছু টের পাওয়া যায় না।”

পরী ভ্রু কুঁচকে মোহিনীর দিকে তাকিয়ে বললো,

“আমার দৌঁড়াদৌঁড়িতে যখন ঘুমাতে পারতে না তখনও দুষ্ট বলতে আর এখনও বলছো। হায় ভগবান, কোথায় যাবো আমি?”

পরীর কথায় মোহিনী আর ঊর্মিলা দুজনেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। মোহিনী বললেন,

“আপনাকে কোত্থাও যেতে হবে না মালকিন। আপনার বাড়িতেই আপনি থাকবেন।”

পরী লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। বললো,

“আমার বাড়ি এটা?”

“হুম।”

“রজনী দিদি যে বলে তার কথা না শুনলে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে।”

ঊর্মিলা মুখ বাঁকিয়ে বললেন,

“ওর ওতো সাহস আছে নাকি? ওকেই তো সেদিন বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলাম। শুধু আম্মা দয়া করে আবার বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছে বলে। শয়তান মেয়ে একটা। এরপর তোকে কিছু বললে তুই চুল টেনে ছিড়ে দিয়ে বলবি তোকে এ-বাড়ি থেকে বের করে দেব।”

“রজনী দিদি শয়তান মেয়ে?”

“হ্যাঁ, তোর মোহিনী দিদির সাথে খুব খারাপ করেছে ও।”

এমন সময় রজনী পরীকে ডাকতে ডাকতে খাবারের থালা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। পরীকে দেখেই বললেন,

“চল তাড়াতাড়ি। তোকে খাইয়ে দেই। এতো সময় নেই। অনেক কাজ আছে আমার।”

“যাবো না তোমার সাথে। তুমি শয়তান মেয়ে।”

“কী বললি?”

“হ্যাঁ, তোমার হাতে খাবোও না আর। তুমি কষ্ট দিয়েছো আমার মোহিনী দিদিকে।”

রজনী কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। মোহিনী বললেন,

“খাবারের থালাটা রেখে যাও। পরীকে আমি খাইয়ে দেব।”

রজনী থালাটা রেখে চুপচাপ বেরিয়ে গেলেন। মোহিনী উঠে হাত ধুয়ে আসলেন। পরীকে খাওয়াতে খাওয়াতে বললেন,

“খাবার মুখে নিয়ে বসে থাকবি না বললাম। তাড়াতাড়ি খাবি।”

পরী ঘাড় কাত করলো। মোহিনীর পাশে বসে বললো,

“মোহিনী দিদি, আমাকে তোমার মতো নাচের পোশাক কবে বানিয়ে দেবে?”

“যখন তুই নাচ করবি।”

“আমি কবে নাচ করবো?”

“বড় হয়ে।”

“বড় তো হয়েছিই। আর কত বড় হবো?”

“আরও বড়। এখন শুধু নাচটা ভালো করে শেখ।”
.
.
.
মধ্যরাত…। অর্ণব ছাদে উঠে সবেমাত্র একটা সিগার জ্বালিয়েছেন। তবে তা শেষ করা হয়তো তার কপালে ছিল না। কিছুটা দূরেরই একটা দৃশ্য দেখে তার চোখ কপালে উঠে গেছে। যা বোঝার বুঝে গেছেন। আর দাঁড়াতে পারলেন না তিনি। সিগারটা ফেলেই চলে গেলেন সাথে সাথে। নিজের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে একই দৃশ্য দেখছেন আম্রপালি। ভয়ে পাথর হয়ে গেছেন তিনি। গলা শুকিয়ে গেছে তার। নিচে তাকাতেই অর্ণবকে দ্রুত গতিতে দৌঁড়ে যেতে দেখলেন।

বাইরে শোরগোল শোনা যাচ্ছে। পরী ভয়ে মোহিনীকে জড়িয়ে ধরে তার সাথে একদম মিশে আছে। তারানা সদরদরজা ভালো করে লাগিয়ে তার সামনে ভারী আসবাবপত্র এনে রেখেছেন। সেখানে আবার দু’জন মেয়েকেও দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন যেন কোনোমতেই কেউ দরজা ভেঙে ভেতরে না ঢুকতে পারে। রজনী বলে উঠলেন,

“ওরা মোহিনীকে মা/রতে এসেছে আম্মা। মোহিনীকে না পেলে আমাদের সবাইকে মে/রে ফেলবে। তুমি ওকে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছো না কেন? ওর জন্য কি আমরা ম/রবো?”

“সেদিনের মা/রের কথা ভুলে গেছিস না? আবার মা/র খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে তোর?”

“কেন? আমি ভুল তো কিছু বলিনি। আমি আগেই বলেছিলাম, এই মোহিনীর জন্য আমাদের সবাইকে একদিন বিপদে পড়তে হবে। এখন হলো তো। আরও পাঠাও ওকে অন্যের স্বামীর সাথে লীলাখেলা করতে। সবার চোখের সামনে ও অর্ণবের সাথে ঢলাঢলি করছে। কেউ দেখছে না মনে করছো? গায়ের লোক ওকে ছেড়ে দেবে ভেবেছো?”

রজনীর কথা শুনে আশেপাশের কিছু মেয়েও একই কথা বলা শুরু করেছে। তারানা ধমক দিতেই আবার সব শান্ত। রজনীর দু’গাল শক্ত করে চেপে ধরে বললেন,

“তোর মুখে খুব বুলি ফুটেছে যে আজ? একদিনেরই অপেক্ষায় ছিলি বুঝি? তুই করাচ্ছিস না তো এসব? শুনে রাখ রজনী, এসবে যদি তোর হাত থাকে তো গলা কে/টে এ-বাড়িতেই পুতে রাখবো তোকে।”

তারানার কথায় রজনী একদম চুপসে গেছেন। তারানা সকলের উদ্দেশ্যে বললেন,

“কাউকে যদি আমি কোনোরকম বাড়াবাড়ি করতে দেখি তো সবার আগে তাকে বাড়ি থেকে বের করবো। ওদের হাতে না ম/রলেও আমার হাতে নিশ্চিত ম/রবি।”

মোহিনী চোখ বন্ধ করে পরীকে জড়িয়ে ধরে আছেন। সকলের কথাই কানে যাচ্ছে তার। কিন্তু জবাব দেওয়ার ইচ্ছে করছে না। এসবের জন্য নিজেকেই দ্বায়ী মনে হচ্ছে তার। একমাত্র তার কারণেই সবার জীবন এখন ঝুঁকিতে পড়েছে। তারানা এসে জানালা সামান্য ফাঁকা করে বাইরে তাকালেন। লোকগুলোর হাতে মশাল। কয়েকজন বাড়ির চারদিকে কেরোসিন ঢালছে। তারানার মনে হলো অতীতের পুনরাবৃত্তি দেখছেন তিনি। একটা শুকনো ঢোক গিললেন তিনি। মুখ থেকে আপনা-আপনিই বেরিয়ে এলো,

“হে ঈশ্বর, রক্ষা করো আমাদের।”

মোহিনী চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,

“এসবের পেছনে জানো কে আছেন তারামা? তোমার মালকিন।”

“কী সব বলছিস মেহের? মাথা ঠিক আছে তোর?”

“আমি ঠিকই বলছি। তিনি যদি এসব না করান তো কার এতো সাহস যে আমাদের মা/রতে চাইবে?”

তারানা প্রত্যুত্তরে কী বলবেন বুঝে উঠতে পারলেন না। মোহিনী আবার বলে উঠলেন,

“তিনি এসব না করিয়ে থাকলেও, তিনি এটাই চান যে আমি ম/রে যাই। নয়তো কোথায় আজ তিনি? একবারও এলেন না আমাদের বাঁচাতে?”

পরী বলে উঠলো,

“মোহিনী দিদি, আমরা কি ম/রে যাবো?”

“কেউ ম/রবে না। অনেক হয়েছে। এবার যা করার আমিই করবো।”

পরীকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। কোনোমতে আসবাবপত্র সরিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন বাইরে। কেউ আঁটকাতে চেয়েও পারলেন না। মোহিনীর চোখে যেন আগুন জ্বলছে। যার তেজ এই শত মশালের চেয়েও বেশি। এখানকার সকল অপরিচিত মুখের মাঝে তার পরিচিত একটা মুখ ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে। একটা গাছের আড়ালে গিয়ে লুকিয়ে সবটা দেখতে লাগলেন। সেদিকে কারও খেয়াল নেই। মোহিনী চিৎকার করে বললেন,

“আমাকে পোড়াতে এসেছো না তোমরা? তাহলে পোড়াও আমাকে। আমিও দেখি কার এতো সাহস। আসো, সামনে আসো।”

মোহিনীর এমন কান্ডে লোকগুলো কিছুটা হকচকিয়ে গেছে। একজন মশাল নিয়ে ছুটে আসতেই মোহিনী তার বুকে স্ব-জোরে লাথি মে/রে ফেলে দিলেন তাকে। বাকিরা ক্রুদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসতেই কেউ একজন সামনে এসে দাঁড়িয়ে বাঁধা দিলেন তাদের। তাকে দেখেই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন মোহিনী।

“অর্ণব।”

“আপনি ভেতরে যান মেহের। এদিকটা আমি দেখছি।”

মোহিনী দৌঁড়ে বাড়ির ভেতরে চলে এলেন। অর্ণবকে দেখা মাত্রই গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ব্যক্তি দ্রুত সে জায়গা ছেড়ে চলে গেলেন।

আম্রপালি এখনো বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। কিছুক্ষণ বাদেই লোকগুলোকে ফিরে যেতে দেখলেন। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। বুঝলেন এখন সব ঠিক আছে। ঘরের ভেতরে যাবেন ঠিক এমন সময় কাউকে খুব সাবধানে বাড়ির দিকে আসতে দেখলেন। চোখ ছোট ছোট করে ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করলেন। চিনতে পেরেই বুকটা ধক করে উঠলো তার। অস্ফুট স্বরে বললেন,

“পদ্মা!”

অর্ণবকে দেখলেও পদ্মাবতীকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেননি আম্রপালি। তার মানে তিনি অনেক আগেই গেছেন বাইরে। অর্ণবের পেছন পেছন যে যাননি সে ব্যাপারে নিশ্চিত আম্রপালি। হোক না হোক কিছুক্ষণ আগের ঘটনার সাথে পদ্মাবতীই জড়িত। চিন্তাটা মাথায় আসতেই মাথা ভনভন করতে শুরু করলো আম্রপালির। সবকিছু ওলট-পালট মনে হতে লাগলো। দ্রুত ভেতরে চলে গেলেন তিনি। পদ্মাবতী নিজের ঘরে ঢুকতে যাবেন এমন সময় পেছন থেকে আম্রপালি বলে উঠলেন,

“দাঁড়া।”

চকিতে পেছনে ফিরলেন পদ্মাবতী। আম্রপালিকে দেখেই ঘামতে শুরু করলেন।

“কোথায় গিয়েছিলি তুই?”

“বাগানেই ছিলাম বড়মা। ঘরে ভালো লাগছিল না। তাই একটু হাঁটাহাঁটি করে এলাম।”

আম্রপালি স্ব-জোরে পদ্মাবতীর গালে চড় বসিয়ে দিলেন। বললেন,

“মিথ্যে বলিস আমাকে? আমি দেখেছি সবটা। একটু আগে যা যা হলো সবটা তুই করিয়েছিস পদ্মা। কী করে পারলি এটা করতে? ছিঃ। লজ্জা হচ্ছে আমার তোকে দেখে। তোর দ্বারা এমন কাজও সম্ভব!”

পদ্মাবতী আম্রপালির পা জড়িয়ে ধরে বসে পড়লেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

“আমাকে ক্ষমা করুন বড়মা। অনেক বড় ভুল করেছি আমি। কিন্তু আপনি তো বোঝেন আমাকে। আপনি তো জানেন আমি এসব কেন করেছি। শেষবারের মতো আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি আর কোনোদিনও এমন করবো না।”

“আমাকে ছাড় পদ্মা।”

আম্রপালি নিজের পা ছাড়িয়ে নিলে পদ্মাবতী সেখানে বসেই কাঁদতে লাগলেন। আম্রপালি চলে যেতে যেতে বললেন,

“যা করেছিস, করেছিস। ভুলে যা সব। ঘুণাক্ষরেও যেন কেউ জানতে না পারে। অর্ণব তো একদমই নয়। ও জানতে পারলে আমি আর তোকে বাঁচাতে পারবো না পদ্মা।”

চলবে…

#মেহেরজান
#পর্ব-৪২
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

“তুই কী চাইছিস আমি বুঝতে পারছি না মেহের। কোনো ভুল কিছু করিস না।”

“আমি কোনো ভুল করবো না তারামা। আমি শুধু অর্ণবকে চাই। আর ওই পরিবারের সর্বনাশ। ধ্বংস হোক ওরা।”

মোহিনীর কথা শুনে তারানার বুকটা কেঁপে উঠলো।

“তোকে খুব অচেনা লাগছে মেহের। তুই তো এমন মেয়ে না। এতটা নিষ্ঠুর তো তুই কখনোই ছিলি যে অন্যের অমঙ্গল কামনা করবি।”

“এখানে আমার দোষ নেই তারামা। শুরুটা ওরাই করেছিল। আমাকে আঘাত করেছে ওরা। এর ফল তো পেতেই হবে ওদের। আর অর্ণবকে ছিনিয়ে নেওয়ার মাধ্যমেই ওদের আঘাতের চেয়ে শতগুণ বেশি আঘাত ফেরত দেব আমি ওদের। অর্ণবও আমার হবে। ওরাও শেষ হয়ে যাবে।”

তারানা মোহিনীর কথার প্রত্যুত্তরে কিছু বললেন না। গলার স্বর উঁচু করে রজনীকে ডাকতে ডাকতে বললেন,

“আমার ঘর থেকে পানের ডালাটা এ ঘরে দিয়ে যা তো। কি রে, কোথায় ম/রলি? রজনী।”

ওপাশ থেকে জবাব এলো,

“আসছি আম্মা।”

রজনী পানের ডালা নিয়ে এসেই তারানাকে একটা পান সাজিয়ে দিলেন। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তারানা পান চিবুতে চিবুতে বললেন,

“দাঁড়িয়ে আছিস কেন এখনো এখানে? আমাদের কথা শোনার অপেক্ষায় আছিস? টাকা পেয়েছিস আবার এখানকার খবর ওখানে পৌঁছাবার জন্য?”

“কী বলছো আম্মা? আমি তো বাড়ি থেকেই বের হই না।”

তারানা পানের পিক ফেলে বললেন,

“তো আগে কি ওরা আসতো তোর সাথে দেখা করতে?”

রজনী চুপ করে রইলেন। সেদিনের পর থেকে সুযোগ না পেলে রজনী তারানার মুখে মুখে খুব একটা তর্ক করেন না। এ-বাড়িতে যে তার অবস্থানটা নড়বড়ে হয়ে গেছে তা বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছেন তিনি। এখন সকলের সাথে তাকে বুঝে শুনে কথা বলতে হয়। তাকে চুপ থাকতে দেখে তারানা বললেন,

“দ্বিতীয়বার আমার চোখ ফাঁকি দেবার চেষ্টাও করিস না রজনী। ভগবানের দিব্যি করে বলছি, একদম জানে মে/রে ফেলবো তোকে আমি। যাহ এখন।”

শেষের বাক্যটা তারানা ধমকের সুরে বলতেই রজনী দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। মোহিনী বলে উঠলেন,

“শোনো।”

রজনী থেমে জিজ্ঞেস করলেন,

“কী?”

“দরজাটা আগের মতো চাপিয়ে দিয়ে যেও।”

তারানা বললেন,

“কী হলো? দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কী বললো শুনিসনি?”

রজনী দরজা চাপিয়ে কটমট করতে কর‍তে চলে গেলেন। বাইরে এসে নিজের মনকে শান্তনা দিয়ে বললেন,

“তোদের দুটোকে একদিন বাগে পাই। দেখিস কী করি। আমাকে করা সব অপমানের বদলা নেব।”

হঠাৎ কোনো কিছুর বিকট শব্দে তারানা আর মোহিনী দুজনেই জানালার কাছে এসে দাঁড়ালেন। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার।

“কী হলো বলো তো তারামা।”

“দেখে মনে হচ্ছে দুর্ঘটনা।”

“আমাদের বাড়ির সামনেই?”

“হোকগে। তাতে আমাদের কী?”

“কী বলছো তারামা? রাত ক’টা বাজে দেখেছো? এরা এখানে ম/রে গেলেও কেউ দেখতে আসবে না।”

“কী করবি তাহলে?”

“নিয়ে আসি?”

কিছুক্ষণের মধ্যেই তারানা মোহিনী আর চরণকে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন। গাড়ির ভেতরে শুধু আহত অবস্থায় এক অচেতন মহিলাকে দেখতে পেলেন। এদিক-ওদিক তাকাতেই রাস্তার একপাশে গাড়ির চালককে দেখতে পেলেন। নিশ্চয়ই মদ খেয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল ব্যাটা। দেখে মনে হচ্ছে গাড়ি গাছের সাথে ধাক্কা লাগার আগেই সে লাফ দিয়ে বাইরে চলে গিয়েছিল। তাই তেমন কিছু হয়নি। মোহিনী আর চরণ ধরাধরি করে কোনোমতে সেই মহিলাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে এলেন। খালি পড়ে থাকা একটা ঘরে এনে শুইয়ে দিলেন। শুইয়ে দিয়ে মোহিনী আর তারানা একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। অন্য মেয়েরা কৌতূহলী হয়ে দরজার বাইরে ভীড় জমিয়েছিল। তারানা ধমক দিতেই জায়গাটা একদম ফাঁকা হয়ে গেল।
.
.
.
পরেরদিন সন্ধ্যেবেলা তার ঘরে চা নিয়ে ঢুকতেই মোহিনী দেখলেন তিনি উঠে বসার চেষ্টা করছেন। মোহিনী চা রেখে তাকে উঠে বসতে সহায়তা করলেন।

“আমাকে একটু জল দেবে?”

মোহিনী জল এনে তার পাশে বসে জিজ্ঞেস করলেন,

“এখন কেমন আছেন আপনি?”

গলাটা ভিজিয়ে মহিলাটি জবাব দিলেন,

“ভালো। মনে তোমাদের অনেক অসুবিধায় ফেলে দিয়েছি আমি।”

মোহিনী উঠতে উঠতে বললেন,

“ওতোটাও না। শুধু রাতে ডাক্তার খুঁজে আনতে একটু অসুবিধা হয়েছিল। আসলে এ-বাড়িতে কেউ ম/রতে বসলেও সহজে তাকে দেখতে কোনো ডাক্তার আসতে চায় না। যাদের মধ্যে মানবতা একটু বেশি, তারা আসে। অবশ্য এর জন্য অতিরিক্ত টাকাও দিতে হয় তাদের।”

“আমার জন্য তোমাদের যত টাকা খরচ হয়েছে, আমি তা ফেরত দিতে পারি।”

বলেই নিজের ব্যাগ খুঁজতে লাগলেন তিনি। মোহিনী বুঝতে পেরে বললেন,

“আপনার সব জিনিসপত্র আমার ঘরে রাখা আছে। আর টাকা লাগবে না। ওসবের অভাব নেই আমাদের।”

“তবুও।”

মোহিনী কাপে চা ঢালতে ঢালতে বললেন,

“আপনাকে এদেশের বলে মনে হয় না। বাংলাটা কিন্তু খুব সুন্দর বলেন। কার বাড়িতে এসেছেন আপনি?”

“অভ্র চৌধুরীকে চেনো? তার সাথেই দেখা করতে এসেছি আমি।”

চমকে উঠলেন মোহিনী। নিজের কাজ থামিয়ে দিলেন। পুনরায় স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন,

“আপনি ওনাকে কীভাবে চেনেন? কী হন আপনি ওনার?”

“তুমি চেনো ওকে?”

“হ্যাঁ।”

“আমার নাম ব্রেন্ডা। আমি অভ্রর বন্ধু। বিলেতে একসাথে থাকতাম আমরা।”

“একসাথে মানে একই বাড়িতে?”

“হ্যাঁ।”

“চায়ে চিনি কয় চামচ দেব?”

“এক চামচ।”

মোহিনী চা নিয়ে এসে ব্রেন্ডার সামনে বসলেন।

“আপনারা একসাথে থাকেন তবুও বন্ধু বলছেন? শুধু বন্ধু নাকি প্রেমিকা?”

ব্রেন্ডা চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,

“বললে ভুল হবে না।”

“কিন্তু আপনি যার সাথে দেখা করতে এসেছেন তিনি তো এখানে নেই। কলকাতায় আছেন।”

“জানি আমি। এজন্যই সোজা এখানে এসেছি। মাস দুয়েক আগেও এসেছিলাম আমি। কিন্তু খালি হাতে ফিরে যেতে হয়েছে। ওর বাড়ির লোক আমাকে দেখা করতে দেয়নি ওর সাথে।”

“ওনার বাড়ির লোক?”

“অভ্রর ভাইপো।”

“ভাইপো মানে…।”

“অর্ণব। দুমাস আগে দেখা হয়েছিল আমার ওর সাথে। ও গিয়েছিল কলকাতায়। কিন্তু অভ্রর সাথে দেখা করতে দেয়নি। ফিরে গিয়েছিলাম। আবার এসেছি। তবে এবার দেখা করেই ফিরবো।”

মোহিনী বুঝতে পারলেন অর্ণব একারণেই কলকাতায় গিয়েছিলেন। তিনি ব্রেন্ডার উদ্দেশ্যে বললেন,

“আপনি অভ্র চৌধুরীর সাথে দেখা করতে চান কেন? যার জন্য এতোদূর থেকেও বারবার ছুটে আসছেন।”

“সেটা আমি এখন তোমাকে বলতে পারবো না।”

“অসুবিধা নেই।”

“কিন্তু আমি এখন ওর বাড়িতে যাবো কী করে? আমি তো ওর বাড়ি চিনিই না।”

“এটা কোনো সমস্যা নয়। এ গ্রামের সবাই তার বাড়ি চেনে। যতই হোক, জমিদার বলে কথা।”

“তোমার নামটা আমার জানা হলো না এখনো।”

“সবাই মোহিনী বলেই ডাকে।”

“খুব সুন্দর নাম।”

তারানা একবার ঘরের ভেতরে উঁকি দিয়ে তাদের কথা বলতে দেখে চলে গেলেন। টকটকে লাল ঠোঁট, কপালে বড় একটা টিপ, চোখে মোটা করে দেওয়া কাজল, গায়ে ঝলমলে শাড়ি, গয়না। তারানার পুরুষালী দেহে এমন বেশভূষা বড্ড বেমানান লাগলো ব্রেন্ডার কাছে। গতবার কলকাতায় এমনই কয়েকজনের একটা দলের সাথে দেখা হয়েছিল তার। টাকার জন্য প্রচন্ড বিরক্ত করছিল তাকে। কিন্তু তারানা তাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, ভিন্ন একটা মানুষ বলে মনে হলো ব্রেন্ডার। মোহিনী বললেন,

“উনি আমার তারামা। উনিই আমাদের সবার মা এখানে। আমাদের দেখাশোনা করেন।”

“আচ্ছা। তোমরা এখানে কী করো? প্রস্টি’টিউশান?”

“ইংরেজি বুঝি না। আর ওতো কঠিন শব্দ তো একদমই না। চৌধুরী বাড়ির মালকিন আমাকে অনেক স্নেহ করতেন বলে বাংলা লিখতে পড়তে শেখার সুযোগটা হয়েছিল।”

“আমি বলতে চাইছিলাম তোমরা কি পতি’তা? দেহ’ব্যবসা করো এখানে?”

ব্রেন্ডার কথাটা মোহিনীর মনে প্রচন্ড আঘাত করলো। হাসিখুশি মুখটা মলিন হয়ে গেল। তবুও মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন,

“সবাই ভাবে এখানে দেহের ব্যবসা হয়। কিন্তু এখানে যে মনেরও ব্যবসা হতে পারে এটা কেউ ভাবে না। আমাদেরও মন আছে। সেটারও লেনদেন হয়। তবে আমরা দেহ’ব্যবসা করি না। এতটা খারাপ অবস্থা আমাদের হয়নি। এটা বাইজীবাড়ি। আমরা নাচ করি, গান করি। এসবের মাধ্যমেই এখানে আসা পুরুষদের মনোরঞ্জন করি।”

“আমাকে ভুল বুঝো না তুমি। তখন এ-বাড়িতে ডাক্তার না আসতে চাওয়ার কথাটা তুমি এমনভাবে বললে। আসলে আমি বুঝতে পারছিলাম না আমি কোথায় আছি। আর সকালের দিকে একবার যখন জ্ঞান ফিরেছিল তখন আশেপাশে অনেক মেয়েদের দেখলাম। কিন্তু কাউকে কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারিনি। তার আগেই আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। দুর্বল লাগছিল অনেক।”

“আমাদের পতি’তা ভাবার পরও আমাদের হাতের চা আপনার গলা দিয়ে নামলো?”

“অন্য কারও নামতো কি না জানিনা। কিন্তু আমার গলা দিয়ে নেমেছে।”

“বাদ দিন এসব কথা। আপনি না চৌধুরী বাড়িতে যাবেন?”

“হ্যাঁ, তুমি আমাকে একটু এগিয়ে দিয়ে আসতে পারবে?”

“এখন? বাইরে অন্ধকার হয়ে আসছে। এখন গিয়ে আর কী করবেন? আপনি বরং কাল সকালে যাবেন।”

“তাই ভালো হবে হয়তো।”

“ও-বাড়িতে গিয়ে নিজেকে কী বলে পরিচয় দেবেন? আপনাকে আগেই জানিয়ে দিচ্ছি। প্রেমিকা নামক কোনো বস্তুর ও-বাড়িতে কোনো মূল্য নেই।”

“তাহলে কী বলবো?”

মোহিনী স্মিত হাসলেন।
.
.
.
আম্রপালি একটা মেয়েকে বাড়ির সব কাজ ভালোভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। মেয়েটাও কৌতূহল নিয়ে একটার পর একটা প্রশ্ন করে যাচ্ছেন। আম্রপালি সব বোঝানো শেষ করার পর জিজ্ঞেস করলেন,

“বুঝতে পেরেছিস তো সব?”

“হ্যাঁ, সব বুঝে গেছি।”

“আর কোনো প্রশ্ন আছে?”

“শুনেছিলাম তোমাদের বাড়িতে নাকি কোনো মেয়েই বেশিদিন টিকতে পারে না। অনেক কাজ দাও। কই? আমার কাছে তো একটুও বেশি মনে হলো না। এসব তো রোজই করতে হয় আমাকে।”

“কিছুদিন কর। তখন বুঝবি। তারপর যদি থাকতে পারিস তো বলিস। আর প্রতিদিন এমন দেরি করে আসলে চলবে না। আজ এসেছিস তো এসেছিস। কাল থেকে আরও সকালে আসতে হবে। একদম ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে।”

মেয়েটা ঘাড় কাত করলেন।

“ওহহ, তোর নামটা যেন কী?”

“পূর্বা।”

“ঠিকাছে। তোর স্বামী কী করে?”

“কিছু করে না। খায় আর সারাদিন ঘুরে বেড়ায়। রাতে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরে। আমি ঢুকতে দেই না ঘরে। বাইরেই পড়ে থাকে সারারাত।”

অভিমানের সুরে কথাগুলো বললেন পূর্বা। পরক্ষণেই আবার অনুরোধ করে বললেন,

“মাসি, তোমাদের বাড়িতে তো অনেক কাজ। তুমিই এখানে কোনো একটা কাজে লাগিয়ে দাও না ওকে। ওই, তোমাদের ওই গেটের দারোয়ানের চাকরিটাই নাহয় দাও।”

“আচ্ছা। আমি দেখবো।”

“বাড়িতে কেউ আছেন?”

আম্রপালির কথা শেষ হতে না হতেই কেউ বলে উঠলেন কথাটা। আম্রপালি সদর দরজার দিকে তাকাতেই একজন মহিলাকে দেখতে পেলেন। পরনে শার্ট-প্যান্ট। মাথায় সোনালী চুল। চোখে চশমা। সাথে বড় একটা কাপড়ের ব্যাগ। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

“আপনাকে তো চিনলাম না।”

ব্রেন্ডা দু’হাত জোড় করে বললেন,

“নমস্কার। আমি ব্রেন্ডা। অভ্র চৌধুরীর স্ত্রী।”

চলবে…

মেহেরজান পর্ব-৩৯+৪০

0

#মেহেরজান
#পর্ব-৩৯
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

শেফালী টেবিলের ওপর দু’কাপ চা রাখলেন। পদ্মাবতীর কপালে হাত রেখে বললেন,

“বড় মামি বললেন তোর নাকি জ্বর এসেছিল রাতে। এখন কেমন আছিস?”

পদ্মাবতী চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,

“ভালো আছি এখন।”

শেফালী চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বললেন,

“এখনো ঘর থেকে বের হলি না তাই ভাবলাম জ্বর-টর আবার বাড়লোই নাকি। তাই এসে পড়লাম দেখতে।”

“চা এনে ভালোই করেছিস। মাথাটা ধরেছিল একটু। এখন ভালো লাগছে।”

“অর্ণবদা কোথায় জানিস?”

“না, জানি না। আমি কী করে জানবো? উনি আমাকে বলে যান নাকি? কোথায় গেছেন?”

“কলকাতা। সকালে খাওয়া-দাওয়া করেই বেরিয়ে গেছেন।”

“হঠাৎ ওখানে কেন?”

“জানিনা। বললেন কাজ আছে। মামা যেতে বলেছেন হয়তো।”

“ফিরবেন কবে জানিস?”

“তা বলেনি। তবে থাকবে কিছুদিন বোঝাই যাচ্ছিলো। সাথে কাপড়ের ব্যাগ ছিল।”

“ওহ।”

“তুই কি আমার সাথে একটু বের হতে পারবি? যদি যেতে পারিস তো?”

“পারবো। কোথায় যাবি?”

“আমাদের বাড়িতে। একা একা যেতে ভালো লাগছে না। সেদিন যেতে চেয়েও যাওয়া হয়নি। তাই ভাবলাম আজ যাবো। রাতের মধ্যেই ফিরে আসবো।”

“আচ্ছা।”

দু’জনের চা খাওয়া শেষ। শেফালী কাপ দুটো নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,

“ঠিকাছে। দুপুরের খাবার খেয়েই বের হবো। তৈরি থাকিস তুই।”

পদ্মাবতী ঘাড় কাত করলেন। শেফালী চলে যেতে যেতে বলে উঠলেন,

“ওহ। আরেকটা কথা।”

“কী?”

“সকালে অর্ণবদাকে এ-ঘর থেকে বের হতে দেখলাম। কাল রাতে তোরা একসাথে ছিলি?”

পদ্মাবতী মুচকি হাসলেন।
.
.
.
কলকাতার এক সনামধন্য রেস্তোরাঁয় বসে আছেন অর্ণব। তার সামনাসামনি বসেছেন মধ্যবয়সী এক বিদেশিনী। নাম ব্রেন্ডা স্মিথ। বেশ সুন্দর করে গুছিয়ে বাংলা বলেন তিনি। বিলেতে অভ্র বাবুর মাধ্যমে পরিচয় তার সাথে অর্ণবের। ছোটবেলায় এই মহিলার সাথে একটা সখ্যতা গড়ে ওঠে তার। কিন্তু বড় হতে হতে তাতেও মরিচা পড়েছে। ব্রেন্ডাকে কী বলে সম্বোধন করবেন তা ঠিক করতে না পেরে তাকে নাম ধরে ডাকাতেই অভস্ত্য অর্ণব। কোনোরকম ভনিতা ছাড়াই তিনি বললেন,

“আপনার এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত ব্রেন্ডা।”

“অসম্ভব অর্ণব। আমি এতোদূর থেকে এখানে এসেছিই শুধুমাত্র অভ্রর সাথে দেখা করতে। ওর সাথে দেখা না করে আমি কিছুতেই ফিরে যাবো না।”

“কাকুর সাথে দেখা করা সম্ভব নয়। উনি আপনার সাথে কোনোরকম যোগাযোগ রাখতে চান না।”

“এজন্যই তো আমি তোমার সাহায্য চাইছি অর্ণব। একমাত্র তুমিই বোঝাতে পারো অভ্রকে। বোঝাও ওকে। আমার সাথে দেখা করাও। কথা বলতে বলো।”

“কাকু আপনার সাথে যোগাযোগ রাখুক এটা আমিও চাই না ব্রেন্ডা।”

অর্ণবের কথায় এবার ব্রেন্ডা কিছুটা আশাহত হলেন। তার শেষ অবলম্বন ছিলেন অর্ণব। কিন্তু তিনিও এখন তাকে কোনো সাহায্য করবেন না বলে দিলেন। ব্রেন্ডা আকুতিভরা কণ্ঠে বললেন,

“দয়া করো অর্ণব। একটাবার আমাকে অভ্রর সাথে দেখা করাও।”

“দুঃখিত ব্রেন্ডা।”

এবার ব্রেন্ডা কিছুটা বিরক্ত হলেন। সাথে রাগান্বিতও। তার চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। কটমট করে জিজ্ঞেস করলেন,

“আমি কি জানতে পারি কেন? কেন তুমি চাইছো না আমাকে ওর সাথে দেখা করতে দিতে?”

“আমার কাকু আপনাকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন। অথচ আপনি ভালোবেসেছেন তার টাকাকে। লুটেপুটে খেয়েছেন তাকে। কাকু যখন একদম নিঃস্ব হয়ে গেলেন। দীর্ঘদিন সম্পর্ক থাকার পরও আপনি তাকে ফেলে চলে গেলেন। যখন কি-না তার আপনার সাহায্য বেশি প্রয়োজন ছিল। এরপরও আপনি ভাবছেন আমি আপনাকে সাহায্য করবো? তার সাথে দেখা করতে দেব?”

ব্রেন্ডা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বললেন,

“আমি আমার কাজের জন্য লজ্জিত। আমি জানি আমি ভুল করেছি। তবুও আমি একটাবার অভ্রর সাথে দেখা করতে চাই। আমাকে অন্তত তার কাছে ক্ষমাটা চাইতে দাও অর্ণব। একবার দেখা করাও।”

“আপনি এখন আসতে পারেন ব্রেন্ডা।”

কাজ হবে না বুঝতে পারলেন ব্রেন্ডা। তাই আর অযথা সময় নষ্ট করলেন না। একরাশ হতাশা নিয়ে উঠে চলে গেলেন। বড় একটা বোঝা যেন নেমে গেল অর্ণবের ঘাড় থেকে। অর্ণব চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিলেন। গতকাল এই মহিলাই চলে এসেছিলেন কুঞ্জনগড়ে। তাকে থামাতেই অর্ণব ছুটে ছিলেন রেলওয়ে স্টেশনে। কোনোরকম বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাকে পরের ট্রেনে উঠিয়ে দিয়েছিলেন। ভাগ্যিস অভ্র বাবু অর্ণবকে আগেই টেলিফোনে জানিয়ে দিয়েছিলেন সবটা। তা নাহলে উনি বাড়ি পৌঁছে গেলে কত বড় ঝামেলাটাই না হতো। মোহিনী শুধু শুধু তাকে ভুল বুঝলেন। বাড়ির কথা মনে পড়তেই অর্ণবের মনে পড়লো পদ্মাবতীর কথা। সেই সাথে কাল রাতের কথা। নিজের ওপর ঘেন্না হলো অর্ণবের। গা গুলিয়ে উঠলো। ব্রেন্ডা কোনোভাবে জানতে পেরে গিয়েছিলেন অভ্র বাবু কলকাতায় আছেন। তাই সরাসরি এখানে চলে এসেছেন। অভ্র বাবু এটা জানতে পেরে সকালে সাথে সাথে জানিয়েছিলেন অর্ণবকে। দ্রুত কলকাতাতে চলে আসতে বলেন তাকে। তখন বাড়ি থেকে এক প্রকার পালিয়েই এসেছিলেন অর্ণব। এখানে এসে যেন তিনি হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। কাল রাতের মতো একই ভুল যেন দ্বিতীয়বার না হয় তার জন্য একটা ব্যবস্থা করতে হবে দ্রুত। কিন্তু সেজন্য বাড়ি ফেরা জরুরি। তবে এখন বেশ কিছুদিনের জন্য আর বাড়িমুখো হবেন না-ই ঠিক করেছেন অর্ণব।
.
.
রাতের নিকষ কালো অন্ধকারে বাড়ি ফিরছেন পদ্মাবতী আর শেফালী। তাদের সামনে রামু হাতে হ্যারিকেন নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। আম্রপালি পাঠিয়েছিলেন রামুকে তাদের দু’জনকে সাবধানে নিয়ে আসতে। শেফালীর মা আজ খুব আপ্যায়ন করেছেন তাদের। বাপ মরা মেয়েটা শ্বশুরবাড়িতে কেমন আছে না আছে এটা ভেবেই রাতে ঘুম হতো না তার। কিন্তু যখন শেফালীর বেশভূষা দেখে বুঝলেন মেয়েটা খুব যত্নে আছে তখন তার চোখ থেকে আনন্দের অশ্রু ঝরতে লাগলো। বাইজীবাড়ির সামনে আসতেই পদ্মাবতী দাঁড়িয়ে পড়লেন। বাড়িটা সাজানো হয়েছে। জলসা হবে। নিশ্চয়ই অনেক জায়গা থেকে লোক এসেছে। পদ্মাবতী এই বাড়ির ভেতরে কোনোদিন যাননি। শকুন্তলার কড়া নিষেধ ছিল। বাইরে থেকেই কল্পনায় সাজাতে শুরু করলেন ভেতরের দৃশ্য। রামু আর শেফালী তার থেকে অনেকটা এগিয়ে গেছেন। পদ্মাবতী সবার পেছনে থাকায় কেউ খেয়াল করেননি। শেফালী খেয়াল করা মাত্রই আবার ফিরে আসলেন। বললেন,

“কি রে? দাঁড়িয়ে পড়লি যে। কী ভাবছিস?”

“কিছু না। বাড়ি চল।”

পদ্মাবতী হাঁটতে শুরু করলেন। তার ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি। মোহিনীকে নিয়ে যেন তার আর দুশ্চিন্তা রইলো না। ভালোবাসা নামক খেলায় নিজেকে জয়ী মনে হচ্ছে তার। অর্ণবকে ঠিক এভাবেই ফেরাবেন তিনি নিজের কাছে। নিজের ভালোবাসা দিয়ে। তারপর অর্ণবের সবটা জুড়ে শুধু তিনি বিরাজ করবেন। মোহিনী নামে কারও অস্তিত্ব থাকবে না অর্ণবের জীবনে।

চলবে…
#মেহেরজান
#পর্ব-৪০
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

“রোজ রোজ এই এতো মানুষের জন্য আমি রান্না চড়াতে পারবো না বলে দিলাম। যার খিদে পাবে সে নিজে রেঁধে খাক। এই আমি শুধু নিজের জন্য উনুনে ভাত চাপিয়ে দিলাম।”

রান্নাঘর থেকে কথাগুলো বেশ জোরে জোরে বললেন অনুরাধা। যেন বাড়ির সকলেই শুনতে পায়। তার কথায় শকুন্তলা বা আম্রপালি কেউ-ই কান দিলেন না। যে যার মতো নিজের কাজে ব্যস্ত। পদ্মাবতী আর শেফালী একসাথেই বসেছিলেন। পদ্মাবতী ফিসফিসিয়ে বললেন,

“এই, কী হয়েছে বলতো? বাড়ির পরিবেশ এতো গম্ভীর কেন? আবার পিসিমা এসব বলছেন যে?”

“আরে দুপুরে ছোট মামির সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছে ওনার। তাই সবাই চুপচাপ।”

“কখন হলো? আমি তো দেখলাম না।”

“তুই ছাদে ছিলিস। মা আর ছোট মামি রান্নাঘরে ছিলেন। আমি আর বড় মামি এখানেই ছিলাম। হঠাৎ মা চেঁচিয়ে ওঠেন। দু’জনে গিয়ে দেখি এই অবস্থা। তারপর ছোট মামি কোনো কথা না বলে চুপচাপ চলে গেলেন। এরপর আর দু’জনে একটা কথাও বলেননি। তবে তখন কী নিয়ে কথা হয়েছিল বলতে পারলাম না।”

“সে কী! একমুহূর্তে এতোকিছু! আর তুই আমাকে এখন জানাচ্ছিস?”

“কী আর বলতাম। এসব একটু-আধটু তো হয়েই থাকে সব পরিবারে। এ আর এমন কী?”

“এটাও ভুল বলিসনি।”

“তবে দোষটা নিশ্চিত আমার শ্বাশুড়িরই। কী যে বলেছেন ওই মহিলা।”

“শেফালী! কীভাবে কথা বলছিস তুই ওনার ব্যাপারে?”

“কী? ভুল কিছু তো বলিনি। আমাকে জ্বালিয়ে মারেন ওই মহিলা। শুধু শ্বাশুড়ি বলে কিছু বলি না। এই আমি বলেই ওনার ছেলের সংসার করছি। অন্য কোনো মেয়ে হলে না এমন ষড়যন্ত্রী শ্বাশুড়ির কাছে একদিনও টিকতে পারতো না। কীভাবে আমাকে শমিতের সামনে খারাপ বানানো যায় সেই মতলব আঁটেন সবসময়।”

কিছুক্ষণের জন্য রেগে গেলেও শেফালীর বলা শেষ কথাগুলো শুনে না হেসে পারলেন না পদ্মাবতী। সব ভুলে ফিক করে হেসে ফেললেন।

“হাসিস না, হাসিস না। এমন শ্বাশুড়ি তো আর তোর কপালে জোটেনি। মায়ের মতো শ্বাশুড়ি পেয়েছিস। তুই কী বুঝবি আমার জ্বালা?”

“হয়েছে হয়েছে। আর বলতে হবে না।”

শকুন্তলাকে নিজের ঘরের দিকে যেতে দেখে শেফালী বললেন,

“ছোট মামি তো রাতে না খেয়েই ঘরে চলে গেলেন।”

পদ্মাবতী ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন।

“যাক। আমি বরং তার ঘরে খাবার দিয়ে আসবো। এমনিতেও মনে হয় না আজ পিসিমার সাথে এক টেবিলে বসে খাবেন।”

“রান্নাও বসানো হয়নি এখনো। মা তো শুধু নিজের জন্য করছেন বলেই দিলেন।”

“তুই যা রান্নাঘরে। আমি আসছি।”

শেফালী উঠে রান্নাঘরের দিকে গেলেন। অনুরাধা নেই এখানে। উনুনে ভাতের হাড়ি। রান্না করার সবকিছু গোছাতে গোছাতে একটা দুষ্টু বুদ্ধি উঁকি দিল তার মনে। আশেপাশে কেউ আছে কিনা ভালো করে দেখলেন। কাউকে দেখতে না পেয়ে উনুনের আঁচ ধীরে ধীরে বাড়িয়ে দিলেন।
.
.
দরজায় কেউ কড়া নাড়তেই শকুন্তলা চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

“কে?”

“আমি ছোট মা। দরজা খুলুন।”

পদ্মাবতীর আওয়াজ পেতেই শকুন্তলা দরজা খুলে দিলেন। পদ্মাবতীকে খাবারের থালা হাতে দেখে তার মনে শান্তি লাগলো। ক্ষুধার জ্বালায় পেটের মধ্যে যেন ইঁদুর দৌঁড়াচ্ছিল এতোক্ষণ।

“ভেতরে আয়।”

পদ্মাবতী ভেতরে ঢুকতেই দেখলেন শকুন্তলা ইতোমধ্যেই শোয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন। খাবারের থালাটা টেবিলের ওপর রেখে বললেন,

“না খেয়েই শুয়ে পড়ছিলেন?”

“যাক। এ-বাড়িতে কেউ তো আছে যার আমার জন্য চিন্তা হয়। আমার খোঁজ নিয়েছে। নাহলে আমি রাতে খাই আর না খাই, তাতে কার কী আসে যায়।”

“আসে যায়, আসে যায়। অনেককিছু আসে যায়। এজন্যই তো খাবার নিয়ে এসেছি।”

“এনেছিস ভালো কথা। কিন্তু আমি খাবো না। ওটা তুই ফেরত নিয়ে যা।”

“খাবো না বললেই হবে নাকি? খেতেই হবে। এখন নিজে খাবেন নাকি আমাকে খাইয়ে দিত হবে?”

“ঢং দেখো মেয়ের! আমাকে এসেছে খাইয়ে দিতে। না জানি কত বড় হয়ে গেছে। দু’দিন আগেও যে নাকি কেউ খাইয়ে না দিলে খাবার মুখে তুলতো না, সে এসেছে আমাকে খাইয়ে দিতে।”

পদ্মাবতী ভাত মাখাতে মাখাতে বললেন,

“আপনার ওই দু’দিন দশ বছর আগেই চলে গেছে ছোট মা।”

“সে যাক। তাতে কী হয়েছে? তুই তো আর বদলাসনি। আগে যেমন ছিলি, এখনও তেমনই আছিস। অল্পতেই কেঁদে ফেলিস।”

শকুন্তলার মুখে খাবার তুলে দিতে দিতে পদ্মাবতী বললেন,

“একদম না। কই কাঁদি আমি? পারলে দেখান।”

“আরেকবার কাঁদতে দেখি। তখন বলবো।”

“পিসিমার সাথে কী নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল ছোট মা?”

শকুন্তলা চুপ মেরে গেলেন। পদ্মাবতী উৎসুক দৃষ্টিতে উত্তরের অপেক্ষা করছেন। শকুন্তলা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,

“শমিত এখন আর বেকার বসে নেই। কাজ করে। নিজের মা আর স্ত্রীকে দেখার মতো সামর্থ্য আছে ওর। তাই দিদিকে বলেছিলাম কতদিন আর ভাইয়ের সংসারে থাকবে। এখন আলাদা হলেও তো পারে। তাতেই উনি এমন উত্তেজিত হয়ে গেলেন।”

পদ্মাবতী বলার মতো কোনো শব্দ খুঁজে পেলেন না। চুপচাপ শকুন্তলার কথাগুলো শুনলেন।

“তুই-ই বল। আমি কি ভুল কিছু বলেছি? যা বলেছি ভালোই তো বলেছি।”

পদ্মাবতী মুখ ফুটে বলতে পারলেন না, “হ্যাঁ, আপনি ভুল বলেছেন। এটা পিসিমারও বাড়ি। উনি নিজের ইচ্ছে মতো এখানে থাকতে পারেন।” আর যাই হোক, এভাবে মুখের ওপর বলাটা হবে চরম বেয়াদবি। মোহিনীর কথা মনে পড়তেই মনে মনে হেসে ফেললেন তিনি। মোহিনী হলে নিশ্চয়ই ছোট মার মুখের ওপর এসব বলে দিত। এতে তার কেমন লাগলো না লাগলো সেটা দেখার ওর প্রয়োজন নেই। শকুন্তলার খাওয়া শেষ হলে চুপচাপ চলে এলেন পদ্মাবতী।
.
.
.
মোহিনীর মুখোমুখি দাঁড়াতেও লজ্জা করছে অর্ণবের। মনের মধ্যে তীব্র অপরাধবোধ কাজ করছে। তার প্রতি মেয়েটার বিশ্বাস ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। রাগে দুঃখে নিজের চুল টেনে ছিড়তে ইচ্ছে করছে এখন তার। মোহিনী অনেক্ষণ ধরেই তার উদ্দেশ্যে কিছু বলে চলেছেন কিন্তু অর্ণবের সেদিকে মন নেই। শুধু হুম, হ্যাঁ তে জবাব দিচ্ছেন। মোহিনীর সাথে পরীও এসেছে আজ। সে অর্ণবকে চেনে। তাদের বাড়িতে দেখেছে। কৌতূহলী হয়ে দরজার কাছে এসে উঁকি দিয়ে দেখতো অর্ণবকে। কিন্তু কথা বলেনি কখনো নিজে থেকে। অর্ণব ডাকলে দৌঁড়ে পালিয়ে যেত। অর্ণবকে শুধু হুম, হ্যাঁ করতে দেখে পরী মোহিনীর কানের কাছে এসে বললো,

“ও তোমার কথা শুনছে না মোহিনী দিদি।”

মোহিনী ভ্রুকুটি করে অর্ণবের দিকে তাকালেন। বললেন,

“আমি কী বলছি শুনছেন আপনি?”

“হুম।”

মোহিনী অর্ণবের কাঁধে হাত রেখে ঝাঁকালেন।

“কী হয়েছে আপনার? কথা বলছেন না কেন ঠিক করে?”

“কিছু হয়নি মেহের।”

“রেগে আছেন আমার ওপর?”

“না, রেগে থাকবো কেন?”

“সেদিন আপনার সাথে ঝগড়া করলাম। তারপর থেকে তো আর একদিনও এলেন না। আমি প্রতিদিন আসতাম। আপনাকে না পেয়ে ফিরে যেতাম।”

“গ্রামের বাইরে ছিলাম এতোদিন। আজই ফিরেছি।”

“কোথায় ছিলেন?”

“কলকাতায়।”

“সেজন্যই তো বলি হঠাৎ করে এমন উধাও হয়ে গেলেন কী করে। জানেন আমি কত কষ্ট পেয়েছি?”

“আমি দুঃখিত মেহের। ক্ষমা করবেন না আমাকে?”

মোহিনী অর্ণবের কাঁধে মাথা রাখলেন। বললেন,

“ভালোবাসেন আমাকে?”

“হুম।”

“তাহলে আমিও ক্ষমা করে দিলাম। আপনার সব ভুল ক্ষমা করে দিলাম।”

পরী মোহিনীর উদ্দেশ্যে বললো,

“ও কী ভুল করেছে মোহিনী দিদি?”

মোহিনীর জবাব দেওয়ার আগেই অর্ণব পরীকে হাতে ধরে তার সামনে এনে দাঁড় করালেন। বললেন,

“এইযে তোমার মোহিনী দিদিকে কষ্ট দিয়েছি।”

“কাউকে কষ্ট দিলে ক্ষমা চাইতে হয়?”

“অবশ্যই।”

“মোহিনী দিদিকে তো আরও অনেকে কষ্ট দিয়েছে। তাহলে তারা কেন ক্ষমা চায় না?”

“কে কষ্ট দিয়েছে? নাম বলো আমাকে তাদের। আমি নিজে ওদের শাস্তি দেব।”

“তোমার বাড়ির লোকেরা।”

অর্ণব কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেলেন। কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। পরীর কথায় মোহিনী মনে মনে খুশিই হয়েছেন। তবুও ধমকের সুরে বললেন,

“পরী! তোকে এসব কে বলেছে?”

“ঊর্মিলা দিদি।”

“আজকাল তুই একটু বেশিই ঊর্মিলার সাথে থাকছিস। ওর সাথে এতো থাকা বন্ধ করতে হবে।”

অর্ণব বললেন,

“তারা এখনো নিজের ভুল বুঝতে পারেনি পরী। যখন বুঝবে তখন তারা নিজেরাই এসে তোমার মোহিনী দিদির কাছে ক্ষমা চাইবে। এখন এসব বাদ দাও। আমাকে বলো তো, তুমি আমাকে দেখলে ভয় পেয়ে পালিয়ে যাও কেন? আমি বাঘ না ভাল্লুক যে খেয়ে ফেলবো তোমাকে?”

পরী দৌঁড়ে এসে মোহিনীর পেছনে দাঁড়ালেন। উঁকি দিয়ে বললেন,

“আমি ভয় পাই না তোমাকে। আমি চিনি তোমাকে।”

“আচ্ছা! আমাকে চেনো তুমি? কীভাবে চিনলে?”

“দেখেছি আমাদের বাড়িতে।”

“দেখলে কী হবে? তুমি তো আমার সাথে কথাই বলোনি কোনোদিন।”

“বলেছি।”

“কবে বললে? আমার তো মনে পড়ছে না?”

“আরও অনেকদিন আগে। যখন তুমি আর তোমার বন্ধু এসেছিলে মোহিনী দিদির নাচ দেখতে।”

অর্ণব বিব্রতবোধ করলেন। এই বাচ্চা মেয়েটার যে এতো পুরনো কথাও মনে থাকবে তা বুঝতে পারেননি তিনি। মোহিনী বললেন,

“লুকিয়ে লুকিয়ে তাহলে নাচও দেখতে আসতেন আপনি! হাহ, আর মুখেই যত কথা। আপনি আর নাচবেন না মেহের। এটা করবেন না। সেটা করবেন না। আরও কত কী।”

অর্ণব একটা শুকনো ঢোক গিললেন।

চলবে…

মেহেরজান পর্ব-৩৭+৩৮

0

#মেহেরজান
#পর্ব-৩৭
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

দূর থেকে শেফালীকে দেখছেন আম্রপালি। দু’দিনেই কেমন শুকিয়ে গেছেন। সবসময় মনমরা হয়ে থাকেন। কিন্তু শমিত থাকা অবস্থায় এমন ছিলেন না। তখন সবসময় হাসিখুশি থাকতেন। ওদিকে কাজের চাপ বাড়ায় অভ্র বাবু বারবার তাড়া দিচ্ছিলেন শমিতকে ফেরার জন্য। তাই সময় পুরো হওয়ার দু’দিন আগেই ফিরে যেতে হলো ছেলেটাকে। তারপর থেকেই শেফালী যেন একদম চুপচাপ হয়ে গেলেন।

“এই শেফালী, এদিকে আয়।”

আম্রপালি ডাকা মাত্র দৌঁড়ে চলে এলেন শেফালী।

“বলুন।”

“বস এখান আমার পাশে।”

“কেন?”

“আহ! বস তো। এতো কথা বলিস কেন তুই?”

শেফালী তার পাশে বসে পড়লেন। আম্রপালি সুঁই সুতো দিয়ে কাপড়ে ফুলের নকশা তুলছিলেন। শেফালীকে দেখিয়ে বললেন,

“সেলাই পারিস?”

“হুম। ছোটবেলা থেকেই। মা শিখিয়েছিল আমায়।”

“এইনে। এটায় কর।”

শেফালী আম্রপালির হাত থেকে সুঁই সুতো নিয়ে নিজে সেলাই তুলতে লাগলেন।

“মায়ের কথা মনে পড়ে না তোর?”

“পড়বে না কেন? পড়ে তো। খুব মনে পড়ে। কিন্তু কী আর করবো?”

“তাহলে দেখা করতে যাস না কেন?”

“উনি যেতে দেবেন?”

“কে?”

“কে আবার? আমার শ্বাশুড়ি।”

“কেন যেতে দেবেন না? আর তুই-ই তো বলিস, উনি নাকি সবসময় তোকে এই বাড়ি থেকে বের করার ফন্দি আঁটেন।”

“আঁটেন না আবার?”

“তাহলে? তুই তোর মায়ের বাড়ি গেলে উনি খুশিই হবেন। বলবেন, যাক বাবা, বাঁচলাম অবশেষে এই মেয়েত হাত থেকে।”

শেফালী হেসে উঠলেন।

“কী করবো তাহলে? যাবো?”

“কাছেই তো। গিয়ে থেকে আয় দু’দিন। তোর মন ভালো হবে।”

“আমার মন খারাপ কখন হলো?”

“দেখছি তো আমি। শমিত যাওয়ার পর থেকে সবসময় মনমরা হয়ে থাকিস।”

“ঠিক তা নয়। কিন্তু মাকে বললে যদি যেতে নিষেধ করেন?”

“বলিস না ওনাকে। তুই চুপচাপ যা। আমি পরে জানিয়ে দেব।”

“যদি রেগে যান।”

“সামলে নেব আমি। চিন্তা করিস না।”

শেফালীর ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো।
.
.
বাইরে যাচ্ছিলেন অর্ণব। সদরদরজা দিয়ে বের হতেই কাউকে আসতে দেখলেন। হাতে মিষ্টির হাড়ি। অর্ণব সামনে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

“আপনি?”

অপরজন দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বললেন,

“নমস্কার। আমি শ্যামল। শেফালীর দাদা। ওকে নিয়ে যেতে এসেছি। ভালো আছেন তো আপনি?”

অর্ণবের মাথায় যেন রক্ত উঠে গেল একথা শুনে। কোনোদিন না দেখলেও ও কে তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি অর্ণবের। শ্যামল বললেন,

“শেফালী ভেতরে তো? আমি বরং ওকে নিয়ে আসি।”

অর্ণব কোনো জবাব দিলেন না। শ্যামল বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। হঠাৎ পেছন থেকে অর্ণব বলে উঠলেন,

“শেফালী ভেতরে নেই।”

দাঁড়িয়ে পড়লেন শ্যামল। অর্ণবের দিকে ঘুরে বললেন,

“ভেতরে নেই! তাহলে কোথায়?”

“বাগানে।”

“হ্যা?”

“বাড়ির পেছনের বাগানে। ওদিকেই যেতে দেখলাম কিছুক্ষণ আগে ওকে। আপনার জন্য ওখানেই অপেক্ষা করছে।”

শ্যামল কিছুটা অবাক হলেন।

“ওখানে যেতে বলেছে আমায়?

“হুম। চলুন আমি নিয়ে যাই।”

শ্যামলকে নিয়ে অর্ণব বাড়ির পেছন দিকে যেতে লাগলেন। কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে বাগানের পর দিঘি ছাড়িয়ে চলে এলেন। শ্যামল একটা শুকনো ঢোক গিললেন। অর্ণবের দিকে না তাকিয়েই বললেন,

“শেফালী কোথায়? ওকে তো দেখছি না।”

অর্ণবের কোনো জবাব এলো না। এখন ভয় লাগতে শুরু করলো শ্যামলের। কোনো ভূতপ্রেত এর পাল্লায় পড়লেন নাকি ভেবেই গলা শুকিয়ে গেল তার। এমনিতেই সন্ধেবেলা। এদিকটাও যেন দেখতে কেমন কেমন। এমন সময় একা এখানে আসলে ভয়ে যেকেউ অজ্ঞান হয়ে যেত। হাত দিয়ে কপালে জমে থাকা ঘাম মুছে অর্ণবের দিকে ঘুরলেন তিনি। সাথে সাথেই চোখদুটো বড় বড় হয়ে গেল। এরই মাঝে অর্ণব কোথা থেকে যেন একটা লাঠি নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। শ্যামল কিছু বলার সুযোগ পেলেন না। তার আগেই অর্ণব লাঠি দিয়ে ইচ্ছেমতো পেটাতে শুরু করলেন তাকে। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করে চলেছেন। মুখে শুধু একটাই কথা “আজ শুধু তোর জন্য আমার বোন আত্ম/হ/ত্যা করেছে। তুই মে/রে/ছিস ওকে, খু/নি তুই।” মাথায় জোরে আঘাত করতেই গলগল করে রক্ত পড়তে লাগলো শ্যামলের।

আম্রপালি বেশ জোরে দরজা খুলে শেফালীর ঘরে ঢুকে পড়লেন। তাকে দেখেই শেফালী বলে উঠলেন,

“দেখুন না বড় মামি। সেই কখন বাড়িতে খবর পাঠিয়ে বিকেল থেকে তৈরি হয়ে বসে আছি। দাদা নাকি নিতে আসবে। অন্ধকার হয়ে গেল কিন্তু এখনো নিতে এলো না কেউ।”

“যেতে হবে না তোকে। তোর দাদা আসবে না।”

“কেন?”

“কে যেন তোর দাদাকে মে/রে রক্তাক্ত করে ক্ষেতে ফেলে রেখেছিল। দু’জন জেলে ওই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় অচেতন অবস্থায় পেয়েছে ওকে। তারপর তোদের বাড়ি খুঁজে বের করে দু’জন ধরাধরি করে ওকে দিয়ে এসেছে।”

বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লেন শেফালী।

“কী!”

“হুম। চিন্তা করিস না তুই এখন আর। ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে শুনলাম।”

আম্রপালির কথাগুলো শুনে শেফালী একদম হা হয়ে গেছেন। বিশ্বাসই করতে পারছেন না কিছুতে।
.
.
.
বহুদিনের পুরনো ভাঙা পরিত্যক্ত এক শিবমন্দিরে বসে আছেন মোহিনী। তার একটু দূরেই অর্ণব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগার খাচ্ছেন। এর গন্ধ মোহিনীর সহ্য হয় না। তাই মোহিনীর সামনে সিগার না জ্বালানোর যথাসম্ভব চেষ্টা করেন অর্ণব। চাঁপা ফুলের তীব্র গন্ধ ভেসে আসছে। কাছেপিঠেই কোথাও চাঁপা ফুটেছে। কিন্তু মোহিনীর হাতে কদম। ফুলের সাদা অংশটা একটা একটা করে তুলে ফেলে দিচ্ছেন তিনি। তার মাথায় চলছে অন্য চিন্তা। মোহিনী নিজে যে কষ্টটা পেয়েছেন তার শতগুণ কীভাবে পদ্মাবতীকে ফিরিয়ে দেওয়া যায় তা-ই ভাবছেন। কিন্তু এর জন্য তার অর্ণবকে প্রয়োজন। অর্ণবের মাধ্যমেই তাকে নিজের কার্যসিদ্ধি করতে হবে। এতে অর্ণবের ওপর কী প্রভাব পড়বে তাতে মোহিনীর কিছু যায় আসে না। যার জন্য এতোকিছু হলো, সে কেন ছাড় পাবে? অর্ণব ফিরতেই মোহিনী বলে উঠলেন,

“আমায় বিয়ে করবেন অর্ণব?”

“করবো। কিন্তু তার আগে পদ্মাবতীকে ছাড়তে হবে।”

“আমি চাই আপনি এখনই আমাকে বিয়ে করুন।”

“সেটা সম্ভব নয় মেহের।”

মোহিনী উত্তেজিত হয়ে বললেন,

“কেন? পদ্মাকে তো ঠিকই বলার সাথে সাথে বিয়ে করে ফেলেছিলেন।”

“কতবার আপনাকে বলেছি মেহের? আর কতবার বলবো? বিয়েটা আমার ইচ্ছেতে হয়নি। তবুও আপনি কথায় কথায় এই বিষয়টা বারবার টেনে আনেন।”

অর্ণবকে ঠিক কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে তা বেশ ভালো করেই জানেন মোহিনী। উঠে অর্ণবের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,

“ঠিকাছে। অন্তত সিঁদুরটা তো পরিয়ে দিন। কিসের ভরসায় থাকবো আমি আপনার?”

অর্ণবের সামনে ছোট্ট একটা সিঁদুর কৌটা তুলে ধরলেন মোহিনী।

“বাচ্চাদের মতো আচরণ করবেন না মেহের। আর এটা আপনি কোথায় পেলেন?”

“যেখানেই পাই। আমাকে এটা পরিয়ে দিতে আপনার সমস্যাটা কোথায়? নাকি সাহস নেই?”

“আমার সাহস নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন না মেহের। আপনি জানেন আমি কী কী করতে পারি।”

“বেশ। এতোই যখন সাহস তাহলে সিঁদুরটা পরিয়ে দিন আমাকে। ভয় পাচ্ছেন কেন?”

“আমি ভয় পাচ্ছিনা।”

“পাচ্ছেন। আমাকে সিঁদুর পরানোর এতটুকুও সাহস নেই আপনার।”

অর্ণব আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারলেন না। মোহিনীর বলা কথাগুলোর একেকটা শব্দ যেন তার গায়ে এসে খোঁচা মেরে যাচ্ছে। অগত্যা সিঁদুরটা মোহিনীর সিঁথিতে পরিয়ে দিতে হলো তাকে।

“খুশি এবার?”

মোহিনীর চেহারায় হাসি ফুটে উঠেছে। কিন্তু অর্ণবের হাতে শুধু সিঁদুর পরাটা মোহিনীর উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য পূরণের জন্য পরবর্তী কাজটা করলেন তিনি। অর্ণবকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। তার সাদা পাঞ্জাবীতে সিঁদুরের দাগ লাগিয়ে দিলেন।

“অনেক খুশি।”

মোহিনীকে ছাড়িয়ে নিলেন অর্ণব। নিজের খুব একটা কাছে আসতে দেননা তিনি মোহিনীকে, যদি না মোহিনী নিজে থেকেই হঠাৎ করে এসে পড়েন তো। তার বিবেক তাকে বাঁধা দেয় এ কাজে।

“এখন আপনার বাড়ি ফেরা উচিত।”

“পৌঁছে দিয়ে আসুন। এতোরাতে একা যেতে পারবো না।”

অর্ণব অধর প্রশস্ত করলেন। তিনি জানেন মোহিনী একাই যেতে পারবেন। তবুও তাকে পৌঁছে দিতে বলছেন।

“চলুন।”

মোহিনীকে তার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে নিজে বাড়িতে ফিরলেন অর্ণব। ভুল করে নিজের ঘরে ঢুকে পদ্মাবতীকে দেখতেই আবার ঘুরে যাচ্ছিলেন অর্ণব। পেছন থেকে পদ্মাবতী ডেকে উঠলেন।

“শুনুন।”

না চাইতেও দাঁড়ালেন অর্ণব।

“কী সমস্যা?”

পদ্মাবতী অর্ণবের সামনে এসে কিছু বলতে যাবেন তখনই তার চোখ পড়লো পাঞ্জাবীতে লেগে থাকা সিঁদুরের ওপর। সবকিছু যেন মুহূর্তেই তালগোল পাকিয়ে গেল তার৷ উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন,

“আপনি বিয়ে করেছেন? ঘরে বউ থাকতে আরেকটা বিয়ে করেছেন আপনি?”

পদ্মাবতীর এমন আচরণে অর্ণবও কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেলেন। এরপরই এমন ব্যবহারের কারণ খুঁজে পেলেন। সিঁদুরের দাগটা আগে খেয়াল করেননি তিনি। কিছু বলতে যাবেন কিন্তু তাকে বলার সুযোগ না দিয়েই পদ্মাবতী আবার বলতে শুরু করলেন,

“ওই মেয়েটাকে বিয়ে করেছেন না? ওই মোহিনীকে বিয়ে করেছেন? কোন সাহসে? কোন সাহসে ওই নোংরা মেয়েটাকে বিয়ে করলেন আপনি?”

অর্ণব স্ব জোরে পদ্মাবতীর গালে চড় বসিয়ে দিলেন। এরপর নিজের ওপরই রাগ হলো তার। আগে কখনো কোনো মেয়ের গায়ে হাত তোলেননি তিনি। নিজেকে শক্ত রেখে বললেন,

“মেহেরের ব্যাপারে একটা খারাপ কথাও শুনতে চাই না আমি। তোমার এতো বড় স্পর্ধা হলো কী করে ওকে কিছু বলার? এতো সাহস কে দিল তোমায়? আর কোনোদিন তোমার মুখে ওর নামটাও শুনতে চাই না আমি। মনে থাকে যেন।”

পদ্মাবতীকে আঙুল তুলে শাসিয়ে গেলেন অর্ণব। গালে হাত দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন পদ্মাবতী। নিজের চোখের জলকে আটকাতে গিয়ে বারবার কেঁপে উঠছেন তিনি।

চলবে…

#মেহেরজান
#পর্ব-৩৮
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

জরুরী একটা কাজে যেতে হবে অর্ণবকে। কিন্তু মোহিনীকে কিছুতেই যাওয়ার কথা বলতে পারছেন না তিনি। বললে যে মোহিনী রেগে যাবেন তা নিশ্চিত। কিন্তু কাজটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। না গিয়ে উপায় নেই। একটু পর পরই হাতঘড়িতে সময় দেখছেন তিনি। বিরক্ত হয়ে মোহিনীই জিজ্ঞেস করলেন,

“আপনার সমস্যা কী বলুনতো? একটু পর পর সময় দেখছেন কেন?”

“আমার একটা ছোট্ট কাজ ছিল। যেতে হবে আমাকে।”

“কিসের কাজ?”

“সেটা বলা যাবে না এখন। একটু গোপনীয়। পরে জানতে পারবেন।”

অর্ণবের কথায় যেন মোহিনীর রাগ দ্বিগুণ বেড়ে গেল। চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,

“মিথ্যে বলছেন আপনি। আপনার কোনো কাজ নেই।”

“আশ্চর্য তো! আমার কোনো কাজ থাকতে পারে না?”

“কোনো চাকরি-বাকরি তো আর করেন না আপনি। বাড়িতেই থাকেন সবসময়। কিসের কাজ তাহলে আপনার? নাকি অন্য কিছু?”

মোহিনীর কথায় খোঁটা স্পষ্ট বুঝতে পারলেন অর্ণব। তার হাত শক্ত করে ধরে বললেন,

“অন্য কিছু মানে? কী বলতে চান আপনি?”

“বউয়ের কথা খুব মনে পড়ছে তাই না? পদ্মার কাছে যাবেন নিশ্চয়ই?”

“অনেক হয়েছে মেহের। আপনি এখন সীমা অতিক্রম করে ফেলছেন।”

মোহিনী ঝ্যাংটা দিয়ে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন,

“সীমা আমি না আপনি অতিক্রম করছেন। আপনার মধ্যে পরিবর্তন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমি।”

“চুপ করুন মেহের। অযথা বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলবেন না দয়া করে।”

“মিথ্যে বলছি না আমি। যা দেখতে পাচ্ছি সেটাই বলছি। আজকাল আপনার মন একটু বেশিই বাড়িতে পড়ে থাকে। কেন বলুন তো? নাকি পদ্মার প্রতি আপনার অনুভূতি তৈরি হচ্ছে?”

অর্ণব ধমকের সুরে বলে উঠলেন,

“ব্যস মেহের। অনেক বেশি বলে ফেলেছেন। আর একটা শব্দও উচ্চারণ করবেন না আপনি।”

মোহিনী ভয়ে একবার কেঁপে উঠলেন। কিছু বলতে গেলে অর্ণব তাকে থামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। অনুশোচনায় নিজের দু’গালে দুটো চড় মে/রে বসে পড়লেন মোহিনী। প্রচুর রাগ হতে লাগলো নিজের ওপর। অর্ণবকে সবসময় একটা অপরাধবোধে রেখে তার থেকে আরও বেশি ভালোবাসা পেতে চান মোহিনী। কিন্তু আজ মনে হয় একটু বেশিই বলে ফেলেছেন তিনি। প্রচন্ড রেগে গেছেন অর্ণব। আগে কখনো এভাবে রাগতে দেখেননি তাকে। এমনকি উচ্চস্বরে তার সাথে কথা পর্যন্ত বলেননি কখনো। রাগে টেনে টেনে নিজের চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে মোহিনীর।
.
.
.
মেঘলা আকাশ। যেকোনো সময়ই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামবে। সাদা কালো মেঘের মাঝেই উড়ছে রঙ-বেরঙের ঘুড়ি। দূরে একদল বাচ্চারা ওড়াচ্ছে। পদ্মাবতীর হাতেও একটা রয়েছে। ঘুড়ির লাটাই হাতে নিয়ে ছাদের কোণায় দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু তিনি ঘুড়ি ওড়াতে জানেন না। মোহিনী জানতেন। সবসময় তিনিই ওড়াতেন। পদ্মাবতী তার সাথে থাকতেন। তাদের ঘুড়িটা উড়তো সবচেয়ে উচুতে। সবার ঘুড়ি ছাড়িয়ে। মোহিনীর কথা মনে পড়লেই অর্ণবের দেওয়া সকল যন্ত্রণার কথা মনে পড়ে যায় পদ্মাবতীর। প্রথমবার কেউ হাত তুলেছে তার গায়ে। তার ভালোবাসার মানুষটাই। যাকে কি-না সবথেকে বেশি ভালোবাসেন তিনি। যার জন্য মোহিনীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে দু’বার ভাবেননি তিনি। সেই মোহিনীর জন্যই অর্ণব তাকে চড় মা/রলেন। মনের মধ্যে একটা তীব্র ব্যথা অনুভব করলেন পদ্মাবতী। ভেতরে ভেতরে প্রলয় বয়ে গেলেও বাইরে থেকে সবসময় নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছেন। অর্ণবকে বাড়িতে ফিরতে দেখলেন ওপর থেকে। কিছুক্ষণ বাদেই আবার দ্রুত বেরিয়ে যেতে দেখলেন। গায়ে জ্বলুনি উঠে গেল তার। ছাদের কিনারা থেকে ধাক্কা দিয়ে একটা ফুলের টব নিচে ফেললেন। বিকট শব্দে টবটা পড়ে ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে তা থেকে সব মাটি ছড়িয়ে পড়লো। অর্ণব ফিরেও তাকালেন না। নিজের মতো চলে গেলেন। কিন্তু রামু আওয়াজ পেয়ে দৌঁড়ে এলেন। নিচে ভালো করে দেখে ওপরে তাকালেন। পদ্মাবতীকে দেখতেই ডাক দিলেন। কিন্তু পদ্মাবতী কোনো উত্তর না নেওয়ায় তিনি আবার চলে গেলেন। পদ্মাবতী অপলকভাবে সামনে তাকিয়ে রইলেন। রাগ, দুঃখ, অনুশোচনা একত্রে গ্রাস করছে তাকে। তবুও নিজের মনকে বুঝ দিতে লাগলেন তিনি। নিজের মনেই বিড়বিড় করতে লাগলেন,

“আমি নিজের সিদ্ধান্তে অনুতপ্ত নই। উনি আমাকে ভালোবাসেন না তাতে কী? আমি তো বাসি। এতে আমার কোনো অনুশোচনা নেই। মোহিনী ওনাকে যতটা ভালোবাসে, তার চেয়েও হাজার গুন বেশি আমি ভালোবেসেছি ওনাকে। তাকে পাওয়ার অধিকারও একমাত্র আমার। শুধু আমার।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার বলতে লাগলেন,

“তুই দেখিস মোহিনী, উনি ভুলে যাবেন তোকে। চিরকালের জন্য ভুলে যাবেন। আমি ভুলিয়ে দেব। তারপর উনি শুধু আমাকে ভালোবাসবেন।”

অসতর্কতাবশত ঘুড়ির সুতোয় আঙুল কেটে গেল পদ্মাবতীর। অজান্তেই “আহ” করে চেঁচিয়ে উঠলেন। আঙুল থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। সাথে সাথে আঙুল মুখে নিয়ে চেপে ধরলেন। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন তিনি। দেওয়ালে পিঠ লাগিয়ে নিচে বসে পড়লেন কাঁদতে কাঁদতে। মেঘ গর্জে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটায় ভিজে যাচ্ছে তার শরীর। কিন্তু বর্ষার এই বারিধারা তার দেহের উত্তাপ কমাতে পারলেও অনুশোচনার অনলে পুড়তে থাকা তার হৃদয়কে রক্ষা করতে ব্যর্থ।
.
.
.
একশো দুই ডিগ্রি জ্বর। আম্রপালি ওষুধ খাইয়ে দিলেন পদ্মাবতীকে। একবার কপালে আর গালে হাত রাখলেন। বললেন,

“ভিজেছিস কেন বৃষ্টিতে?”

“এমনি ইচ্ছে করলো একটু ভিজতে।”

“ঠিকই জ্বর বাঁধিয়ে ফেলেছিস। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে একদম। ওষুধটাও খাসনি। ভাগ্যিস আমি এখনো জেগে ছিলাম। এদিকে না আসলে তো জানতেও পারতাম না।”

“আমি কি জানতাম নাকি যে এই অল্পতেই জ্বর আসবে? আর ভিজবো না বৃষ্টিতে।”

“জ্বর বাঁধিয়ে বলছিস আর ভিজবো না। এজন্যই বলে চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে।”

পদ্মাবতী বিছানায় শুয়ে পড়লেন। আম্রপালি তার গায়ে একটা কাঁথা টেনে দিয়ে বললেন,

“ঘুমিয়ে পড়। আমারও ঘুম পাচ্ছে প্রচুর।”

পদ্মাবতী হালকা ঘাড় কাত করলেন। আম্রপালি দরজা ভেজিয়ে চলে গেলেন। চোখ বুজে রইলেন পদ্মাবতী। কিন্তু ঘুম আসলো না তার। সময় গড়াচ্ছে। রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। ঘামতে শুরু করেছেন তিনি। জ্বর ছাড়ছে। গরম লাগছে এখন। গা থেকে কাঁথা সরিয়ে দিলেন। ঘড়ির দিকে তাকালেন। ঘড়ির কাঁটা তিনটা ছুই ছুই। বাইরে বৃষ্টির শব্দ কানে আসছে। উঠে গিয়ে জানালাটা খুলে দিয়ে আবার শুয়ে পড়লেন। ঠান্ডা বাতাস আসছে। সাথে হালকা বৃষ্টির ছিটা এসেও মুখে লাগছে তার। ভালো লাগছে এখন।

গভীর রাত। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। ক’টা বাজে খেয়াল নেই অর্ণবের। মদের নেশায় চূড় হয়ে এলোমেলো পা ফেলছেন তিনি। এরই মাঝে দু’বার পিছলে পড়েছেন কাদায়। এবার তৃতীয়বারের মতো পড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন,

“ধুর সালা। কোথাও দু’দন্ড শান্তি নেই। না বাইরে, না বাড়িতে। বাইরে প্রেমিকা অবিশ্বাস করে আর বাড়িতে বউয়ের যন্ত্রণা। বউ! ওই একটা জিনিসই তো সব নষ্টের গোড়া। ওই একটা মেয়েই আমার জীবনটা তছনছ করে দিয়েছে। আর আমি অর্ণব, কিচ্ছু করলে পারলাম না। আমার জীবনের ওপর আমারই কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যে যেমন পারছে চালাচ্ছে। আর আমি কাঠেরপুতুলের মতো তাদের ইশারায় চলছি।”

বলতে বলতে নিজেই হেসে উঠলেন অর্ণব। বাড়িতে চলে এসেছেন তিনি। কিন্তু চারিদিক অন্ধকার। বিদ্যুৎ নেই। ঝড়-বৃষ্টিতে এই এক যা সমস্যা। একটু হাওয়া বইলেই বিদ্যুৎ চলে যায়। এতোক্ষণে নিশ্চয়ই বাড়ির সবাই ঘুমিয়েও পড়েছে। ধীরে ধীরে সিড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আসলেন তিনি। বহুদিনের অভ্যেস। সহজে বদলায় না। তাই নেশার ঘোরে ভুল করে নিজের ঘরেই চলে আসলেন। দরজা খুলতেই দেখলেন পদ্মাবতী গুটিসুটি মে/রে উল্টোদিকে ঘুরে বিছানায় শুয়ে আছেন। কোমরে একটা গভীর ভাজ পড়েছে তার। শাড়িটা এলোমেলো হয়ে কোনোরকম গায়ে জড়িয়ে আছে। ঠান্ডায় একটু পরপর কেঁপে উঠছেন তিনি। অর্ণব আরেকটু ভালো করে দেখতেই বুঝলেন কাঁপছেন না তিনি। কাঁদছেন! নিঃশব্দে কাঁদছেন। আর একটু পরপর পিঠটা ফুলে ফুলে উঠছে। অর্ণবের হাতের ধাক্কায় কিছু একটা পড়ে যেতেই তার শব্দে চমকে উঠে দাঁড়ালেন পদ্মাবতী। সামনে এসে দাঁড়ালেন অর্ণবের। ভেজা সাদা পাঞ্জাবী ভেদ করে বুকের কালো তিলটা দৃশ্যমান তার। পদ্মাবতী না চাইতেও সেদিকে চোখ চলে গেল। সাথে সাথে আবার নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন তিনি। চোখের দিকে তাকালেন তার। অর্ণব মাতাল চোখে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। পদ্মাবতীর পদ্মপাপড়ির মতো, দীর্ঘপল্লববিশিষ্ট চোখ দুটো জলে টলমল করছে। ঠোঁট দুটো মৃদু কাঁপছে। যেন কিছু বলতে চাইছে। মনে হচ্ছে বারবার সামনে মোহিনীকে দেখছেন অর্ণব। ভুল দেখছেন না সঠিক দেখছেন তা পরখ করার মতো অবস্থায় নেই তিনি। কী ভেবে কে জানে, পদ্মাবতীকে কাছে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলেন তিনি। নিজের অধরদ্বয় মিশিয়ে দিলেন তার অধরে।

চলবে…

মেহেরজান পর্ব-৩৫+৩৬

0

#মেহেরজান
#পর্ব-৩৫
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

বাড়ির সদরদরজার সামনে পায়চারি করছেন শমিত। আর একটু পর পরই বাইরে উঁকি দিয়ে দেখছেন। অবশেষে অর্ণবকে আসতে দেখেই এগিয়ে গেলেন সেদিকে। তার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন তিনি। শমিতের আসার খবর পেয়ে অর্ণবও আর সেখানে বসে থাকতে পারলেন না। চলে এলেন ভাইয়ের সাথে দেখা করতে। কোলাকুলি করে শমিত বললেন,

“কী খবর বন্ধু?”

“খবর তো দেখতেই পারছিস।”

“এতোদিন পর দেখা হলো। চল ছাদে গিয়ে আড্ডা দেই। বাজার থেকে বড় বড় মিষ্টি আম আনিয়েছি তোর আর আমার জন্য। শেফালীকে বলে রেখেছি তুই এলে কেটে দিতে। হয়ে যাক আবার তোর আমার সেই ছেলেবেলার মতো আম খাওয়ার প্রতিযোগিতা।”

“দাঁড়া তাহলে। আমি ঘরে গিয়ে একটু হাতমুখ ধুয়ে আসছি।”

“আরে আমার ঘরে চল। একই তো হলো।”

শমিত অর্ণবকে তার ঘরে নিয়ে এলে অর্ণব চোখে মুখে জল ছিটিয়ে নিলেন। দুপুরে খাওয়ার পর লম্বা একটা ঘুম দিয়েছিলেন অর্ণব। ঘুম ভেঙেছে রামুর ডাকে। এরপর মোহিনীকে কোনোরকম জানিয়ে ঘুম ঘুম চোখেই চলে এসেছেন তিনি। তাকে বাড়ি পর্যন্ত দিয়ে রামুও নিজের কাজে চলে গেছেন। হাতমুখ ধুয়ে শমিতের সাথে ছাদে চলে গেলেন তিনি। কারও সাথে দেখা করার প্রয়োজনবোধ করলেন না।

“এবার বল। এসব হলো কী করে? মানে এমন কী হলো যে তোর আর পদ্মার বিয়ে হয়ে গেল?”

“তুই যাওয়ার পরে এখানে অনেককিছুই ঘটেছে। হঠাৎ করে মা যেন কেমন পাল্টে গেলেন। মোহিনীকে দেখতেই পারেন না একদম। পদ্মাবতীর সাথে বিয়ের জন্য চাপ দিতে লাগলেন। যেদিন বিয়েটা হলো সেদিন সকালে ঠাম্মা অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করাই। ঠাম্মার অসুস্থতাকেই কাজে লাগিয়েছেন মা। আসলে সবই ছিল ছোটমার মায়ের বুদ্ধি। কে জানে কীভাবে কী বুঝিয়েছেন মা আর ঠাম্মাকে। প্রথমে তো শুধু মা ছিলেন। এরপর হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ঠাম্মাও একই কথা শুরু করলেন। বাধ্য হয়েই বিয়েটা করতে হয় আমাকে।”

“তার মানে সবকিছুর পেছনে ছিল ছোটমার মা। এই বুড়িটা তো দেখা যায় সুবিধার না একদমই। উনিই কিন্তু বলেছিলেন তোকে আর আমাকে মামার কাছে পাঠাতে। শুধু মা বাঁধা দিয়েছিলেন বলে আমাকে পাঠাতে পারেননি। তোকে একাই যেতে হয়েছে।”

“আছে নাকি এখনো বাড়িতে?”

“ছোটমার মা।”

“নাহ। আমি এসে তো দেখিনি। চলে গেছেন বোধহয়।”

“ঠাম্মাকে দেখেছিস? কেমন আছেন এখন?”

“হ্যাঁ, ঘরেই আছেন। দেখে তো সুস্থই মনে হলো। আদৌও কি অসুস্থ হয়েছিলেন নাকি এখানেও তোকে বোকা বানানো হয়েছে?”

শমিতের প্রশ্নে তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন অর্ণব। তার কথা একদম ফেলে দেওয়ার মতো না। আগে এটা কেন মাথায় আসেনি অর্ণবের? শেফালী বড় একটা থালায় আম নিয়ে ছাদে আসলেন। তাদের সামনে থালাটা রেখে বললেন,

“কী খবর অর্ণবদা? আমাদের সবাইকে তো একদম ভুলেই গিয়েছিলেন মনে হয়। জানেন বড় মামি কত্তো দুশ্চিন্তা করছিলেন আপনার জন্য?”

“এইতো। আছি কোনরকম। ভালো আছিস তুই?”

শেফালীর দ্বিতীয় প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলেন অর্ণব।

“হ্যাঁ, অনেক ভালো আছি।”

“পিসির সাথে ঝগড়া করিস না তো আবার?”

“না না, উনিও আমাকে এড়িয়ে চলেন আর আমিও ওনাকে।”

তার কথায় অর্ণব, শমিত দু’জনেই হেসে উঠলেন। শেফালী চলে গেলে শমিত বললেন,

“তারপর, এখন কী করবি ঠিক করলি?”

“কোন বিষয়ে?”

“আরে তোর বিয়ের কথা বলছি। একদিকে মোহিনী আরেকদিকে তোর বউ। ইয়ে মানে পদ্মা। কী করবি তুই?”

“জানি না। তবে শীঘ্রই এর একটা সমাধান বের করবো।”

শমিত এ-বিষয়ে অর্ণবকে কোনো পরামর্শ দিতে পারলেন না। কারণ তিনি জানেন অর্ণবের জীবনে মোহিনীর গুরুত্ব ঠিক কতটা। আবার পদ্মাবতীকে ছেড়ে দিতেও বলতে পারেন না। যতই হোক, পদ্মাবতীকে নিজের বোনের থেকে কম মনে করেন না তিনি।
.
.
.
সাদা রঙের ফুলগুলো যেন একটু বেশিই প্রিয় পদ্মাবতীর। তাই বাড়ির সামনে গন্ধরাজ, টগর, শিউলি, হিমচাঁপা, বেলী আর কামিনীর চারা লাগিয়েছিলেন তিনি। সারাবছরই যখন কোনো না কোনো ফুল ফুটে থাকে,তখন মন আসলেই খুশিতে ভরে ওঠে তার। তবে আজ সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছটা দেখতেও মন্দ লাগছে তার। ফুলে কেমন লাল হয়ে আছে গাছটা! মোহিনীর পছন্দে একটা নাগচাঁপা গাছ লাগিয়েছিলেন তিনি। এখন আর গাছটার যত্ন নেন না একদমই। তবুও দিব্যি কী সুন্দর ফুল দিয়ে যাচ্ছে গাছটা। বেলীর একটা চারা তুলে অর্ণবের ঘরে নিয়ে এলেন পদ্মাবতী। এ-ঘরের বারান্দাটা বড় হওয়ায় অর্ণবের অনুপস্থিতিতে টবে করে বেশ কিছু গাছ লাগিয়েছিলেন এখানে। বেলীর চারাটা ভালো করে পুতে জল দিয়ে হাত ধুয়ে নিলেন তিনি। এরপর অর্ণবের বইগুলো মুছে আবার গুছিয়ে তাকে রাখতে লাগলেন। বেশ ধুলো পড়ে গেছে বইগুলোর গায়ে। অর্ণব নিজের ঘরে ঢুকতেই স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। পদ্মাবতীকে এখানে আশা করেননি তিনি। মাত্র কয়েকদিনে ঘরের নকশাই পাল্টে গেছে একদম। এবার বুঝতে পারলেন শমিত কেন তাকে তার ঘরে আসতে দিচ্ছিলেন না। জোর করে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন।

“তুমি এ-ঘরে কী করছো?”

“মানে? আমার তো এ-ঘরেই থাকার কথা। তাই না? অবাক হওয়ার তো কিছু নেই।”

অর্ণবের কথা বাড়াতে একদমই ইচ্ছে হলো না। পদ্মাবতী যে তার ঘরটা দখল করে নিয়েছেন তা বেশ ভালোই বুঝতে পারছেন। পোশাক বের করতে গিয়ে আলমারি খুলতেই আরেক দফা ধাক্কা খেলেন তিনি। এখানে শুধু পদ্মাবতীর শাড়ি। অর্ণবের একটাও পোশাক নেই। রাগান্বিত স্বরে বললেন,

“আমার জামাকাপড় কই? ওগুলো কী করেছো তুমি?”

“এতোক্ষণ ছাদে ছিলেন দেখেননি? ধুয়ে শুকোতে দিয়েছি ওগুলো। নিজের কাপড়-চোপড় ঠিক মতো ধুতে দেন না কেন আপনি? ঘামের গন্ধ আসছিল ওগুলো দিয়ে।”

“তাহলে এখন আমি কী পরবো?”

“নিচের তাকে দেখুন। আরও অনেকগুলো রাখা আছে। ওখান থেকে নিন। আমি ছাদে থেকে ওগুলো নিয়ে আসছি।”

অর্ণব দেখলেন তার সব পোশাক ধুয়ে ইস্ত্রি করে ভাজ করে রাখা আছে নিচের তাকে। ধুতি পাঞ্জাবী বের একটা তোয়ালে নিয়ে স্নানঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন,

“আমার জিনিসপত্র ধরবে না তুমি।”

পদ্মাবতী মুচকি হেসে ছাদে চলে গেলেন। অর্ণব স্নান করে বের হতেই দেখলেন ছাদে থেকে আনা তার সব কাপড় বিছানায় রেখে দিয়েছেন পদ্মাবতী। এতে কিছুটা বিরক্তও হলেন তিনি।

“আপনি আপনার জিনিস আমাকে ধরতে মানা করেছেন তাই এনে ওভাবেই রেখে দিয়েছি কাপড়গুলো। নিজে ভাজ করে রাখবেন।”

“নিজেকে খুব চালাক ভাবো তুমি?”

“কেন?”

“কী ভেবেছো? তোমার এই হাসিখুশি চেহারা দিয়ে বশ করে ফেলতে পারবে সবাইকে? মায়ায় জড়িয়ে ফেলবে? সুন্দর মুখটার আড়ালে লুকিয়ে থাকা তোমার কুৎসিত মনটা কেউ দেখতে পারবে না ভেবেছো?”

অর্ণবের বলা কথাগুলো যেন পদ্মাবতীর হৃদয়ে তীরের মতো বিঁধলো। তার ব্যথা এই নরম মনটা নিতে না পারায় অশ্রু হয়ে ঝরছে।

“কী করেছি আমি? এভাবে কেন কথা বলছেন?”

“এতোকিছু করার পরও বলো কী করেছো? আফসোস। বিশ বছর একসাথে থাকার পরও মেহের তোমাকে চিনতে পারেননি।”

“কোথায় যাচ্ছেন?”

“সে কথা তোমাকে বলতে হবে এখন?”

ঘর থেকে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলেন অর্ণব। নিজের বাবার খালি পড়ে থাকা বন্ধ ঘরে ঢুকলেন। ঘরটা বন্ধ থাকলেও একদম পরিষ্কার। অর্ণব জানেন তার মা প্রতি সপ্তাহে ঘরটা পরিষ্কার করে যান। মায়ের কথা মনে পড়তেই মনে হলো তার ঘরে এখনো যাওয়া হয়নি। দেখা করা হয়নি এখনো তার সাথে। যাবেন কি যাবেন না একবার ভেবে আবার মাথা থেকে চিন্তাটা ঝেরে ফেললেন অর্ণব। দরজা আটকে জানালা খুলে দিলেন। এ ঘরে কোনো বারান্দা নেই। জানালা খুলতেই চোখে পড়লো বাড়ির পেছনের বাগান আর দিঘিটা। বাগানটা কোনো জঙ্গলের থেকে কম মনে হয় না। কেমন একটা গা ছমছমে পরিবেশ। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার নেমে আসবে। তখন এই বাগানটাই জোনাকির আলোয় ভরে উঠবে। বিছানায় এসে গা এলিয়ে দিতেই যেন চোখে ঘুম চলে এলো। আজকাল ঘুমটা যেন হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে তার। দিনের বেশিরভাগটাই কাটে ঘুমিয়ে। তবুও যেন চোখে সবসময় ঘুম লেগে থাকে তার।

________________________

পাখির কলরবে ঘুম ভাঙলো শেফালীর। শমিতের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছেন তিনি। ঘুম ঘুম চোখে শমিতের দিকে তাকালেন। নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন তিনি।

“দেখ কেমন কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাচ্ছে!”

শমিতের নাক চেপে ধরলেন শেফালী। মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করে উঠলেন শমিত। নাক ছেড়ে দিয়ে হাসলেন শেফালী। বিছানা ছেড়ে উঠে জানালা খুলে দিতেই ভোরের আলো এসে লাগলো তার মুখে। শমিত আগের মতোই ঘুমাচ্ছিলেন। চোখে আলো লাগতেই উল্টো ঘুরে গেলেন। বাগানে অর্ণবকে হাঁটতে দেখলেন শেফালী। কাল অনেক রাতে দেখেছিলেন হাতে বেলীফুলের গোড় নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে। নিশ্চয়ই মোহিনীর কাছে গিয়েছিলেন। একটা শাড়ি নিয়ে স্নানঘরে চলে গেলেন শেফালী। এরপর পূজো করে রান্নাঘরে যাবেন।

চলবে…

#মেহেরজান
#পর্ব-৩৬
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

“শুকনো মরিচের ডালাটা ঘরে নিয়ে যা তো, পদ্মা। দুপুরে যাও একটু রোদ ছিল। এখন তো একদম মেঘে ঢেকে গেছে আকাশ।”

শকুন্তলা বলতে না বলতেই পদ্মাবতী মরিচের ডালা নিয়ে চলে গেলেন। ছাদে শীতলপাটি বিছিয়ে বসেছেন আম্রপালি আর শকুন্তলা। বহুদিন হয়ে গেছে এভাবে ছাদে এসে বসা হয় না তাদের। তাই আজ একটু সুযোগ পেতেই চলে এসেছেন।

“অর্ণবটা এখনো আমার সাথে কথা বলে না।”

“সবুর করো দিদি। ক’দিনই বা রাগ করে কথা না বলে থাকবে? সবটা হচ্ছে মোহিনীর জন্য। অর্ণব প্রতি রাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। নিশ্চিত মোহিনীই আমাদের নামে ওর কানে বিষ ঢালছে।”

“বিয়েটা দিয়ে আমি আবার কোনো ভুল করলাম না তো?”

“কী সব যা-তা বলছো? ভুল করবে কেন? তুমি একদম ঠিক করেছো। অর্ণবও এটা তাড়াতাড়িই বুঝতে পারবে।”

“কিচ্ছু ঠিক লাগছে না। সব কেমন ওলট-পালট হয়ে গেল মনে হচ্ছে। যে মেয়েটাকে আমি এতো ভালোবাসতাম। তাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি।”

“মোহিনী তোমার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য ছিল? তোমার বিশ্বাসের অমর্যাদা করেছে।”

“তবুও। কিচ্ছু ঠিক যাচ্ছে না শকুন্তলা। মনটা সবসময় কেমন অশান্ত হয়ে থাকে। কিচ্ছু ভালো লাগে না।”

“তুমি চিন্তা করো না বেশি। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। ভুলে যাও পুরনো সব কথা।”

“কত দিন হয়ে গেল মেয়েটাকে দেখিনা! ওকে বড্ড দেখছে ইচ্ছে করছেরে।”

“তুমি কি পাগল হয়ে গেলে দিদি? এখনও ওই মেয়েটার কথাই ভাবছো? ও তোমার ছেলের সংসার ছারখার করে দিচ্ছে সেটা দেখছো না?”

শকুন্তলা উঠে দাঁড়ালেন। ছাদের গাছগুলোতে জল দিতে লাগলেন। হলদে কবরীতে ভরে গেছে একটা গাছ। জল দিতে দিতে বললেন,

“ফুলগুলো দেখছো দিদি? যতটা সুন্দর তার চেয়েও বেশি বিষাক্ত। মোহিনী হলো ঠিক এমন। ওপরটা সুন্দর হলেও ভেতরটা বিষে ভরা।”

“কবরী যতই বিষাক্ত হোক। তবুও তো মানুষ গাছ লাগায়।”

শকুন্তলা বিরক্তি নিয়ে বললেন,

“আমাদের পরিবারটা ধ্বংস করে দিতে ওই একটা মেয়েই যথেষ্ট। এখন না বুঝলেও যেদিন আমাদের একটা বড় কোনো ক্ষতি করে দেবে, তখন বুঝবে।”

আম্রপালি জানেন শকুন্তলা ভুল কিছু বলেননি। এই পরিবারটা ভেঙে ফেলতে মোহিনীই যথেষ্ট। অর্ণবকে যেন তিনি একদম নিজের বশে নিয়ে ফেলেছেন। মোহিনীকে ছাড়া যেন অর্ণব আর কাউকে চেনেন না। এ-বাড়ির লোক যেন তার কেউ-ই নয়।
.
.
.
“ঠাম্মা।”

অর্ণব দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ডাক দিতেই শান্তি দেবী মুচকি হাসলেন। হাত দিয়ে ইশারা করে কাছে ডাকলেন তাকে। অর্ণব যেন এরই অপেক্ষায় ছিলেন। দ্রুত ভেতরে আসলেন তিনি। হামানদিস্তায় পান-সুপারি পিষছেন শান্তি দেবী। তাতেই ঠকঠক শব্দ হচ্ছে। দাঁতে আর আগের মতো জোর নেই এখন তার। শান্তি দেবীর সাথে কথা বলার সময় অর্ণবের মুখে সবসময় একটা হাসি লেপ্টে থাকে। তার পাশে এসে বসে বললেন,

“ভালো আছো তো ঠাম্মা?”

শান্তি দেবী পান মুখে দিতে দিতে বললেন,

“আমি তো ভালোই। তুই ভালো আছিস নতুন বউ নিয়ে?”

“আমার জীবন এলোমেলো করে দিয়ে এখন জিজ্ঞেস করছো ভালো আছি কিনা?”

পদ্মাবতী, শান্তি দেবীর ঘরে ঢোকার সময় অর্ণবের কথার আওয়াজ পেতেই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পড়লেন। দেওয়ালে কান লাগিয়ে চুপচাপ মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলেন।

“এলোমেলো করেছি? কই?”

“এইযে পদ্মাবতীর সাথে বিয়ে করিয়ে।”

শান্তি দেবী ইতোমধ্যেই আরেকটা পান সাজাতে শুরু করেছেন।

“কেন? পদ্মা তো ভালো মেয়ে।”

“ভালো না ছাই। আমি মেহেরকে ভালোবাসি জেনেও মায়ের কথায় আমাকে বিয়ে করতে রাজি হলো।”

“মেহের আবার কে? আগে তো শুনিনি এ নাম।”

“তোমাদের মোহিনী।”

“ওকে মেহের ডাকিস?”

“হ্যাঁ, ওর নাম মেহেরজান। ওর মায়ের দেওয়া নাম। যেটা আমার মা ছিনিয়ে নিয়েছিলেন।”

“তুই ভালোবাসতিস ওকে?”

অর্ণব মুচকি হেসে বললেন,

“এখনো বাসি। তুমি জানতে না? মা বলেননি তোমাকে?”

শান্তি দেবীর কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো। কিছু একটা ভাবতে লাগলেন তিনি।

“ঠাম্মা?”

“হুম।”

“সেদিন হঠাৎ করে অসুস্থ হলে কীভাবে তুমি?”

“কোন দিন?”

“আমার বিয়ের দিন।”

শান্তি দেবী কোনো উত্তর দিলেন না। অর্ণবের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন।

“বাদ দাও। আয়ায়া।”

অর্ণব বড় করে হা করতেই শান্তি দেবী সাজানো পানটা তার মুখে ঢুকিয়ে দিলেন। অর্ণব পান চিবুতে চিবুতে দু’হাত মাথার নিচে রেখে শুয়ে পড়লেন। শান্তি দেবীর এখনো মনে আছে অর্ণব ছোটবেলায় প্রায়ই তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়তেন গল্প শোনার জন্য। তিনি মাঝেমাঝে এভাবেই পান সাজিয়ে তার মুখে দিয়ে দিতেন। পান চিবুতে চিবুতেই ঘুমিয়ে যেতেন অর্ণব। ঠোঁট দুটো একদম লাল টকটকে হয়ে যেত তার।
.
.
.
অন্ধকারে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন পদ্মাবতী। বারান্দার কোণায় রাখা বেলীফুলের গাছটা থেকে কী সুন্দর মিষ্টি গন্ধ ছড়াচ্ছে। সন্ধ্যে থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিল। এখন মেঘ কেটে গিয়ে আকাশে মস্ত বড়ো একটা চাঁদ উঠেছে। তার রূপোলী আলোয় সাদা সাদা ফুলগুলো দেখা যাচ্ছে। কোথাও ঝিঁঝি পোকা ডেকে চলেছে একনাগাড়ে।

“অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কী করছিস পদ্মা?”

“এখানে আসুন বড়মা। আকাশে কত বড় চাঁদ উঠেছে দেখে যান।”

আম্রপালি পদ্মাবতীর পাশে এসে দাঁড়ালেন।

“আগেই দেখেছি আমি।”

“আপনি এখানে যে?”

“মাথাটা খুব ধরেছে। ঘরে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম তোকে একটু দেখে যাই।”

“চা খাবেন? আঁদা চা? দাঁড়ান, আমি বানিয়ে আনছি। এখানেই থাকুন।”

পদ্মাবতী আম্রপালির উত্তরের অপেক্ষা করলেন না। দৌঁড়ে চলে গেলেন। সামান্য হাসলেন আম্রপালি। বিড়বিড় করে বললেন,

“মেয়েটার ছটফটানি এখনো গেল না।”

আম্রপালি সামনে তাকালেন। বাগানে হালকা আলো জ্বলছে। ওপর থেকে দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে। সাজানো গোছানো পরিপাটি একটা বাগান। আগে বাগানটা ছিল না। পদ্মাবতীর দীর্ঘদিনের পরিশ্রম এটা। গাছ লাগাতে খুব ভালোবাসেন তিনি। ছোটবেলায় মেয়েটা যেখানে যে গাছ দেখতেন তা-ই তুলে সাথে করে নিয়ে আসতেন। খুব যত্ন করে লাগাতেন। অবশেষে আম্রপালি তাকে সাথে করে নিয়ে গিয়ে তার পছন্দ মতো সব গাছ কিনে এনে দিয়েছিলেন। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই পদ্মাবতী দু কাপ চা নিয়ে চলে এলেন। আম্রপালি চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,

“অর্ণব কোথায়রে?”

পদ্মাবতীর মুখটা মলিন হয়ে গেল। মাথা নিচু করে বললেন,

“জানি না।”

“তুই ভালো আছিস তো পদ্মা?”

“ভালো না থাকার কী আছে?”

“আমার প্রতি তোর মনে রাগ পুষে রাখিসনি তো?”

“ছিঃ! তা হতে যাবে কেন?”

“এইযে নিজের ছেলের ভালোর জন্য তোর সাথে ওর বিয়ে দিয়ে দিলাম। তুই ভালো থাকবি না জেনেও।”

“আপনি তো আমাকে সবটা জানিয়েছিলেনই। তবুও আমি বিয়েতে রাজি ছিলাম। এখন ভালো থাকি আর খারাপ থাকি, তার দায়ভার তো আমারই।”

“বাদ দে এখন এসব কথা।”

পদ্মাবতী চায়ে চুমুক দিতে লাগলেন। কোথাও থেকে গানের সুর ভেসে আসছে ধীরে ধীরে। কেউ গান গাইছে।

“চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো।
ও রজনীগন্ধা তোমার, গন্ধসুধা ঢালো।”

“শকুন্তলা গান ধরেছে।”

“হুম। শুনছি।”

“খুব মিষ্টি গলা মেয়েটার। ভালো গায়।”

“আগে আমরা সবাই একসাথে বসে ছোটমার গান শুনতাম। আমি, চিত্রা, মোহিনী। এখন কেউ নেই।”

“ভুলে যা আগের কথা।”

“বড়মা, আমার জায়গায় মোহিনী বউ হয়ে আসলে কী হতো? উল্টো আজ সবকিছু আগের মতোই ভালো থাকতো।”

আম্রপালি পদ্মাবতীর মাথায় হাত রেখে বললেন,

“কী ভালো থাকতো, কী খারাপ থাকতো তা আমি জানি না। কিন্তু তুই এসেছিস, এর চেয়ে বেশি ভালো আর কিছু না।”

আম্রপালি কী বলছেন সেদিকে খেয়াল নেই পদ্মাবতীর। বাইরে থেকে শমিতকে আসতে দেখলেন। হাতে কাগজে মোড়ানো জুঁই ফুল। শেফালী ফুলগুলো পেয়ে খুব খুশি হবেন। শমিত বাড়ির সামনে আসতেই শেফালীকে দৌঁড়ে এগিয়ে যেতে দেখলেন। নিশ্চয়ই সদরদরজায় দাঁড়িয়ে শমিতের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। একইভাবে অপেক্ষা তো পদ্মাবতীও করে একজনের জন্য। পার্থক্য শুধু একটাই, একজনের অপেক্ষা শেষ আর আরেকজনের অপেক্ষার সময় কোনোদিন ফুরোবে না।

চলবে…

মেহেরজান পর্ব-৩৩+৩৪

0

#মেহেরজান
#পর্ব-৩৩
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

গাছ থেকে ধপ করে নামলেন মোহিনী। নিজের ওড়নাটা মেলে ধরতেই কতগুলো কাঁচা আম বেরিয়ে এলো।

“ধ্যাৎ! কাপড়ে কষ লেগে গেছে।”

“বলেছিলামই তো সোজা নিচে ফেল। আমি ধরে ফেলবো।”

“তুই যে কত ধরতে পারবি তা আমার জানা আছে। শেষে আমাকেই পাঠাতি আবার আমগুলো ধুয়ে আনতে। তার ওপর আবার একটা এসে যদি তোর মাথায় পড়তো, কী কান্ডটাই না করতি তখন।”

পদ্মাবতী নিজের আঁচলে একটা আম ভালো করে মুছে নিলেন। এরপর কামড় বসাতে বসাতে বললেন,

“বললেই হলো? উফ! নুন, তেল, লংকা ছাড়া এভাবে খাওয়া যায় নাকি। এত্তো টক! দাঁত তো একদম টকে গেল।”

“এখন ওসব কে এনে দেবে তোকে?”

পদ্মাবতী গাছে টাঙানো দোলনায় বসে বললেন,

“ধাক্কা দে।”

মোহিনী ধাক্কা দিতে লাগলেন।

“থাক, হয়েছে। আর দিতে হবে না। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। আমি বরং এখন যাই।”

“ইশ, বস তো দু’দন্ড। কতদিন হয়ে গেল কথাই হয় না তোর সাথে ঠিকমতো।”

“তুই বাড়িতে না এলে কথা হবে কী করে? আজও তো এলি না। এখন চল যাই।”

“উঁহু। সময় হলে আসবো।”

“বাড়িতে আসতেও আবার সময় হতে হবে? হ্যাঁ রে, আজ হঠাৎ এভাবে ডেকে পাঠালি যে?”

“ওইযে বললাম। তোর সাথে কথাই হয় না ঠিকমতো।”

পদ্মাবতী উঠে দাঁড়ালেন।

“না, আর দেরি করতে পারবো না। বড়মা খুব বকবেন। এখন আমি যাই।”

মোহিনী পদ্মাবতীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন।

“তোকে খুব মনে পড়বেরে পদ্মা।”

মোহিনীর আচরণ ঠিক লাগছে না পদ্মাবতীর। নিশ্চয়ই তার মাথায় কিছু একটা ঘুরছে। তবে এসব নিয়ে পদ্মাবতীর কোনো দুশ্চিন্তা নেই। মোহিনীর কোনো পরিকল্পনাই যেন সফল না হয় তার ব্যবস্থা তিনি আগেই করে রেখেছেন। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন,

“এমন বলছিস কেন? আমি তো এখানেই আছি। মনে পড়ার আবার কী আছে? যখন ইচ্ছে তখন দেখতেই তো পারছিস।”

“তবুও।”

“এখন যাই।”

মোহিনী মুচকি হেসে পদ্মাবতীকে বিদায় দিলেন। একদৃষ্টিতে তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করতে লাগলেন,

“আমাকে ক্ষমা করিস পদ্মা। এতো বড় একটা পদক্ষেপ নিচ্ছি কিন্তু তোর থেকে লুকোচ্ছি। কারণ আমি জানি তুই আমাকে কোথাও যেতে দিবি না। হয়তো আজই আমাদের শেষ দেখা ছিল বা আবার কোনোদিন দেখা হবে। ভালো থাকিস তুই।”
.
.
.
দেওয়ালঘড়ির দিকে তাকালেন মোহিনী। অনেক দেরি হয়ে গেছে। ঝটপট নিজের কয়েকটা পোশাক ব্যাগে ভরে নিলেন।

“সত্যিই চলে যাবি মেহের?”

চকিতে পেছনে ঘুরলেন মোহিনী। তারানাকে দেখে ভয়ে একদম কাঠ হয়ে গেলেন।

“তারামা!”

“কী ভেবেছিলি? তুই পালাবি আর আমি জানতেও পারবো না? মা ডাকিস তুই আমাকে। তারামা। মা আর মেয়ের সম্পর্ক হলো সবচেয়ে কাছের। মেয়ের মনে কী চলছে তা মা বুঝতে পারবে না ভেবেছিস?”

মোহিনী দৌঁড়ে এসে তারানার হাত ধরে ফেললেন।

“আমাকে আটকিও না তারামা। আমার কাছে যে আর কোনো উপায় নেই।”

“আটকাবো না।”

মোহিনী কিছুটা অবাক হলেন।

“কি রে? অবাক হচ্ছিস? ভুল কিছু শুনিসনি তুই। এখান থেকে পালিয়ে গিয়ে যদি তুই ভালো থাকিস তাহলে তুই পালিয়েই যা। শুধু এই বুড়িটাকে ভুলে যাস না। এই নে, এটা তোর মায়ের। অনেক পুরনো। কিন্তু এখনো ভালো রয়েছে। আমি যত্ন করে তুলে রেখেছিলাম।”

মোহিনীর দিকে একটা থলে এগিয়ে দিলেন তারানা। থলেটা খুলতেই একটা বোরকা বের হয়ে এলো মোহিনীর হাতে।

“এটা পরে নে। কেউ দেখে ফেললেও চিনতে পারবে না। আর এতে তুই নিরাপদও থাকবি। আমি নিজে তোকে ঘাটে দিয়ে আসবো।”

মোহিনী তারানাকে জড়িয়ে ধরলেন। এরপর তাড়াতাড়ি বোরকাটা পরে নিলেন। দু’জনকে ঘর থেকে বের হতে দেখেই আড়ালে লুকিয়ে পড়লেন রজনী। তাদের কথা আড়ি পেতে শুনছিলেন তিনি। তারানা আর মোহিনী বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেই তাদের পেছন পেছন রজনীও বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু তার পথ আলাদা। তিনি চলে এলেন পদ্মাবতীর সাথে দেখা করতে। ভাগ্যিস বাইরে দারোয়ানটা ঘুমাচ্ছিল। তাই এতো সহজেই বাড়ির ভেতর ঢুকতে পেরেছেন তিনি। কিন্তু এখানেও ঘটলো আরেক বিপত্তি। এ বাড়ির কিছুই তিনি চেনেন না। পদ্মাবতীর ঘর কোনটা সেটা কিভাবে খুঁজে বের করবেন?

“এই মেয়ে, কে তুমি?”

একেই বলে ‘যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যে হয়।’ এতো রাতে যে কেউ জেগে আছে তা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি রজনী। আর তিনি যে তার সামনে এসেই পরবেন এটাই বা কে জানতো। তার থেকেও বড় কথা, যার সামনে পরেছেন, তিনি আর অন্য কেউ নন বরং আম্রপালি স্বয়ং। আম্রপালিকে দেখে রজনীর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। আম্রপালি আবার বলে উঠলেন,

“কী হলো? বলছো না কেন কে তুমি? মুখ থেকে চাদরটা সরাও তো দেখি।”

আম্রপালি টান দিয়ে চাদরটা সরিয়ে নিলেন। সাথে সাথেই রজনীর মাথায় একটা বুদ্ধি উঁকি দিল। যে কথাটা তিনি পদ্মাবতীকে জানাতে এসেছেন তা আম্রপালিকে জানালেও মন্দ হয় না। উল্টো দেখা গেল দুজনেই খুশি হয়ে তাকে কিছু দিয়ে দিলেন।

“তুমি! তোমাকে তো আমি সেদিন ও-বাড়িতে দেখেছিলাম। তুমি এখানে এসেছো কোন উদ্দেশ্যে? মোহিনী পাঠিয়েছে তোমায়? কী হলো? কথা বলছো না যে?”

রজনী কাঁপা কাঁপা গলায় জবাব দিলেন,

“না, আমাকে কেউ পাঠায়নি। আমি নিজে থেকেই এসেছি। আপনার সাথে দেখা করতে।”

“আমার সাথে! কেন?”

“ওই মোহিনী আর আপনার ছেলে আজ পালাবে। মোহিনী ঘাটে অপেক্ষা করছে তার জন্য। আপনাকে এটা জানাতেই এসেছি।”

“তোমার কথা আমি কেন বিশ্বাস করবো?”

“এখন বিশ্বাস না করলেও একটু পর ঠিকই বুঝতে পারবেন। তখন আফসোস করবেন না আবার।”

“বের হও বাড়ি থেকে। এখনই বেরিয়ে যাও।”

রজনী চলে যেতে উদ্যত হতেই আম্রপালি বললেন,

“দাঁড়াও।”

নিজের গলা থেকে একটা হার খুলে রজনীর হাতে দিয়ে বললেন,

“এটা রাখো। আর এই কথা যেন কেউ না জানে।”

রজনী বাঁকা হেসে বিনা বাক্যব্যয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ বাদেই সিড়ি দিয়ে অর্ণবকে নামতে দেখলেন আম্রপালি। পেছন থেকে বললেন,

“পালাচ্ছিস অর্ণব?”

আম্রপালির কথায় অর্ণব দাঁড়িয়ে পড়লেন। পেছনে ঘুরে শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন,

“না।”

“মিথ্যে বলছিস আমাকে? পালানোর কথা চিন্তা করার আগে একবার আমার কথা মনে পড়লো না তোর?”

“আমাকে দেখে কি মনে হয় আমি পালাচ্ছি?”

আম্রপালি ভালো করে একবার অর্ণবকে দেখে নিলেন। সাথে ব্যাগবোঁচকা কিছুই নেই।

“আমি পালাচ্ছি না মা। মেহেরকে বোঝাতে যাচ্ছি। উনি অপেক্ষা করছেন আমার জন্য।”

“কোথাও যাবি না তুই। আর ওই মেয়ের সাথে দেখা করতে তো একদমই না। ও তোকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ঠিকই দূরে কোথাও নিয়ে চলে যাবে।”

“আপনার কথা ভেবে যখন আমি পালাবো না বলেছি তেমন মেহেরের কথা ভেবেও তার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। আমি তাকে বলেছি, আমি আসবো।”

“তোকে আমার দিব্যি অর্ণব। তুই যাবি না।”

“আমাকে কোনো দিব্যি দেবেন না মা। এসব বলে আমাকে আটকাতে পারবেন না।”

অর্ণব দরজার দিকে ঘুরলেন। আম্রপালি বলে উঠলেন,

“এ-বাড়ির চৌকাঠ পেরোলে তুই আমার মরা মুখ দেখবি অর্ণব। বিষ খাবো আমি। চাস চিত্রার পর আবার আমার লাশ দেখতে?”

অর্ণব আম্রপালির দিকে ঘুরলেন।

“কী চান আপনি?”
.
.
.
দিগন্তের আড়াল থেকে উঁকি দেওয়া সূর্যের আলো এসে লাগছে মোহিনীর গালে। মাঝি একবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললেন,

“কি রে মা, সেই ওতো রাইতের বেলায় আমারে বাড়ি থেইকা ডাইকা নিয়া আইলি নদী পার হওনের লাইগা। সারারাইত বইয়া রইলাম, সূর্যও উইঠা গেল। কেউ তো আইলোনা। কই যাবি তুই?”

মোহিনীর শান্ত চোখ দুটো চঞ্চল হয়ে উঠেছে। ভাষায় প্রকাশ করতে না পারা হাজারো বুলি যেন এই চোখ দিয়ে প্রকাশ করতে চাইছেন। কিন্তু পারছেন না। মাঝি মোহিনীকে আপাদমস্তক ভালো করে দেখে বললেন,

“বাড়ি থেইকা পালাইছিস?”

মোহিনী দুবার উপরনিচ মাথা নাড়লেন।

“আমিও পালাইছিলাম। তোর চাচিরে নিয়া। ওপার থেইকা পালাইয়া এপারে আইছিলাম দুইজনে। তারপর বিয়া কইরা এইহানেই থাইকা গেছি। আর ফিরা যাই নাই। তুই কার লগে পালাইছিস মা? হে কই?”

মোহিনী জবাব দিলেন না। মাঝি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,

“ওহ, বুঝছি। হে আহে নাই। কথা তো সবাই দেয়। তাই বইলা সবাই কি আর কথা রাহে রে মা? তুই বাড়ি ফিরা যা।”

মোহিনী উঠে দাঁড়ালেন। নৌকা থেকে নেমে বললেন,

“চাচা, আপনার পয়সা।”

মাঝির দিকে টাকা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন মোহিনী। মাঝি হেসে উত্তর দিলেন,

“কিয়ের পয়সা দিবি? তোরে তো নদী পার কইরা দিলামই না। এই পয়সা আমি নিবার পারমু না। তোর কাছেই রাখ।”

মাঝি নৌকার দড়ি খুলে জলে বৈঠা বাইতে শুরু করলেন। নদীর ওপারে যেতে যেতে গান ধরলেন,

“নদীর এ-কূল ভাঙে ও-কূল গড়ে
এইতো নদীর খেলা।।”

দরজায় ধাক্কা দিতেই তারানা এসে দরজা খুলে দিলেন। মোহিনীকে দেখে তার চক্ষু চড়কগাছ। কিছু বলতে গিয়েও আশেপাশে মেয়েরা থাকায় চুপ করে গেলেন। মোহিনী নিঃশব্দে ওপরে চলে গেলেন। নিজের ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিলেন। এক মেয়ে বলে উঠলো,

“মোহিনী এখান থেকে পালিয়েছিল। তুমি ওকে কিছুই বললে না আম্মা?”

রজনী বললেন,

“আম্মা আর কী বলবে? আম্মা নিজেই তো ওকে পালাতে সাহায্য করেছিল। তাই না আম্মা?”

তারানার চোখ রাঙানিতে সবাই চুপ হয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে বেলা গড়াতে শুরু করলো। সকাল গড়িয়ে দুপুর। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। এখন পশ্চিমাকাশে সূর্যের লাল আভাটাও আর দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু মোহিনী এখনো ঘর থেকে বের হননি। মাঝে তারানা নিজে গিয়েও কয়েকবার ডেকে এসেছেন। হঠাৎ দরজায় কেউ জোরে জোরে কড়া নাড়তে শুরু করলেন। রজনী দৌড়ে এসে দরজা খুলে দিলেন। এক মেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢূকলেন। গায়ে দামী শাড়ী, গয়না। সিঁথিতে সিঁদুর। তাকে দেখে সবাই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন। কিন্তু কেউ-ই তাকে চিনতে পারছেন না। পেছন থেকে চরণ বললেন,

“ম্যানে বহুত সমঝয়া ইসকো। লেকিন ইয়ে মানেই নেহি। সিধা অন্দর চলি আয়ি।”

তারানা বলে উঠলেন,

“তুমি কে? কী চাই তোমার?”

“মোহিনী কই?”

তারানা হাত দিয়ে দোতলার একটা ঘর দেখিয়ে দিলেন। মেয়েটা কিছু না বলে সোজা সেদিকে চলে গেলেন। গায়ের সব জোর দিয়ে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছেন আর মোহিনীকে ডাকছেন।

“এই মোহিনী, মোহিনী। দরজা খোল। তাড়াতাড়ি দরজা খোল। এই মোহিনী।”

মোহিনী দরজা খুলে দিলেন।

“শেফালী!”

“সর্বনাশ হয়ে গেছে। যাকে তুই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতিস, সেই তোর পিঠে ছুরি মেরেছে।”

“কী বলছিস তুই? কার কথা বলছিস?”

“অর্ণবদা আর পদ্মার বিয়ে হচ্ছে। পদ্মা তোর আর অর্ণবদার ব্যাপারে সব আগে থেকেই জানতো। সব জানার পরও বিয়ে করছে। আমি অনেক কষ্টে বাড়ি থেকে লুকিয়ে এসেছি এখানে। তুই চল তাড়াতাড়ি।”

মোহিনী একদম পাথর হয়ে গেলেন। অর্ণব আর পদ্মাবতী বিয়ে করছেন এটা ছাড়া যেন তিনি আর কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছেন না। যত দ্রুত সম্ভব দৌড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন মোহিনী। তার পেছন পেছন শেফালীও। অর্ণবদের বাড়ির সামনে পৌঁছুলে রামু তাকে আটকে ফেললেন।

“আমাকে যেতে দাও কাকু।”

“মাফ কইরেন মোহিনীমা। কিন্তু আপনেরে আমি ভিতরে যাইতে দিতে পারুম না। মালকিনের কড়া নিষেধ। আপনেরে বাড়ির সীমানায় ঢুকতে দিতে মানা করছেন।”

মোহিনী বুঝতে পারলেন এদিক দিয়ে তিনি ঢুকতে পারবেন না। দৌড়ে বাড়ির পেছনের দিকে যেতে লাগলেন। ওটাই একমাত্র রাস্তা। এদিকে এসেও দেখলেন দু’জন টহলদার টহল দিচ্ছেন। কিন্তু তাদের চোখ এড়িয়ে আম বাগানের ভেতর দিয়ে আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি মোহিনীর। বাড়ির সদরদরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই দেখলেন পদ্মাবতী দাঁড়িয়ে আছেন। সিঁথিতে সিঁদুর পরা। কত সুন্দর করে বউ সাজানো হয়েছে তাকে! আরও অনেক লোকজন রয়েছে তার আশেপাশে। কিন্তু অর্ণবকে দেখতে পেলেন না। কেউ একজন বলে উঠলেন, “আমাদের নতুন বর অর্ণবটা কই গেল রে? বিয়ে করে আবার বউয়ের ভয়ে পালালো নাকি ছেলেটা?”। এতোটুকুই কানে এলো মোহিনীর। আর কিছু শুনতে পেলেন না। আর শোনার প্রয়োজনও নেই। যা বোঝার এতেই বুঝে গেছেন। শেফালী মিথ্যে বলেনি। অর্ণব আসলেই বিয়ে করেছেন। আর দাঁড়িয়ে না থেকে সামনের পথ দিয়েই চলে গেলেন মোহিনী। তাকে ভেতর থেকে আসতে দেখে অবাক হলেন রামু। বাড়ি ফিরে এসে মাথায় এক ঘটি জল ঢেলে দরজার চৌকাঠেই বসে পড়লেন মোহিনী। তারানা এসে তাকে ধরতেই বলে উঠলেন,

“আমি যাদের আমার সবথেকে আপন ভাবতাম, তারাই আমাকে পর করে দিয়েছে তারামা। বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।”
.
.
.
রজনীর কাছে সোনার হার দেখেই গালে চড় বসিয়ে দিলেন তারানা। সবকিছু যেন একমুহূর্তেই বুঝে ফেলেছেন তিনি।

“কোথায় পেয়েছিস এটা? বল কোথায় পেয়েছিস?”

রজনীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চুলের মুঠি ধরে ক্রমাগত চড় মারতে লাগলেন তারানা।

“এসব তাহলে তুই করেছিস? কার কথায় করেছিস বল। কে করতে বলেছে? এসবের লোভে পড়ে মোহিনীর সাথে এমন করেছিস? ও-বাড়িতে সব খবর তাহলে তুই পৌঁছুতিস। শয়তান মেয়ে, কী ভেবেছিলি? আমি জানতে পারবো না কিছু? তুই আমার খেয়ে, আমার পরে, আমার বাড়িতে থেকে কিনা আমার সাথেই বেইমানি করেছিস।

“ও মাগো। মরে গেলামগো। আর মেরো না আম্মা। মরেই যাবো। এবার ছাড়ো আমাকে।”

তারানা এবার হাতে লাঠি তুলে নিলেন। লাঠি দিয়ে আবার মারতে শুরু করলেন। আর সহ্য করতে পারলেন না রজনী। এক ধাক্কায় তারানাকে ফেলে দিলেন।

“যা বুড়ি। কিছু বলছি না বলে যা খুশি তাই করবি? বয়স ভুলে গেছিস? বুড়ি হয়েও গায়ের জোর দেখাতে এসেছিস? সেই তো এক ধাক্কায় পড়ে গেলি। ও মাগো! গা ব্যথায় জ্বলে যাচ্ছে আমার।”

সবাই এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেই যাচ্ছিলেন। তারানাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতেই এক মেয়ে দৌড় এসে তারানাকে ওঠালেন। এরপর রজনীর গালে চড় মেরে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিয়ে চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে বাড়ি থেকে বের করে দরজা লাগিয়ে দিলেন।
.
.
“ভুল করলেন মা। অনেক বড় ভুল করলেন আপনি। আজ না বুঝলেও একদিন ঠিক বুঝতে পারবেন। আমি প্রমাণ করে দেব যে আপনি কত বড় ভুল করেছেন।” বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে এটাই ছিল অর্ণবের বলা শেষ কথা, যা এখনো কানে বাজছে আম্রপালির। পদ্মাবতী, আম্রপালি, শকুন্তলা আর অনুরাধাসহ আরও কয়েকজন মহিলা বসে আছেন ঘরে। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও শেফালীকেও থাকতে হচ্ছে সেখানে। খোশগল্পে ব্যস্ত তারা। অনুরাধা বলে উঠলেন,

“এতো রাত হয়ে গেল, অর্ণব তো এখনো এলো না আম্রপালি।”

শকুন্তলা জবাব দিলেন,

“আজ তো কালরাত্রি। আজ ওর কী দরকার? সকাল হোক। নিজেই চলে আসবে।”

একজন ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন,

“অর্ণব ওভাবে বেরিয়ে গেল কেনগো আম্রপালি? ছেলের বিয়েতে মত ছিল না নাকি?”

এবারও শকুন্তলা বললেন,

“মত থাকবে না কেন? আসলে হুট করে বিয়ে হয়ে গেল তো। তাই আর কী।”

আম্রপালির দিকে আসা সব প্রশ্নের উত্তর যেন শকুন্তলা আগেই তৈরি করে রেখেছিলেন। এখন শুধু ঠিকমতো বলার পালা।

“অনেক রাত হয়ে গেছে। আমাদেরও এখন ওঠা উচিত।”

আম্রপালি বলে উঠলেন,

“সেকি! এখনই চলে যাবেন আপনারা?”

“যেতে তো হবেই। আমাদেরও তো ঘর সংসার আছে।”

“আসলে বিয়েটা এমন হঠাৎ করে হবে আমরা কেউ ভাবিনি। তাই খুব একটা আয়োজনও করা হয়নি। কোনো আত্মীয়স্বজনও আসতে পারেনি। আপনারা তো আশেপাশেরই লোক। তাই অল্প সময়ে আপনাদের জন্য যা একটু করার চেষ্টা করেছি।”

“তাও অনেক করেছো আম্রপালি। আশীর্বাদ করি যেন সবসময় ভালো থাকো।”

“আশীর্বাদ পদ্মাকে করুন। এখন ওর এটা বেশি প্রয়োজন।”

“ওর জন্য তো আমাদের আশীর্বাদ সবসময়ই আছে।”

সবাই একে একে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। আম্রপালি, শকুন্তলা আর অনুরাধাও গেলেন তাদের এগিয়ে দিতে। পদ্মাবতী খাটে বসে একদৃষ্টিতে হাতে আঁকা কলকার দিকে তাকিয়ে আছেন। পাশে থেকে শেফালী বলে উঠলেন,

“কী ভাবছিস? অর্ণবদা তোকে এতো সহজে মেনে নেবেন?”

“কথা শোনানোর অপেক্ষায় ছিলি বুঝি?”

“কথা শোনাচ্ছি না। বাস্তবটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছি। কে জানে কোন স্বপ্ন দেখে তুই এই কাজ করলি। হ্যাঁ রে, মোহিনীর সাথে এমনটা করতে তোর একবারও বুক কাঁপলো না?”

পদ্মাবতী দু’দিকে মাথা নাড়লেন। বললেন,

“কাঁপলো না।”

“তুই তো এমন ছিলি না পদ্মা। কত ভালোবাসতিস মোহিনীকে। শেষে কিনা ওর সাথেই এমন করলি? এতোটা স্বার্থপর কবে হলি?”

“কেন করলাম বলতে পারিস?”

“সে তুই-ই ভালো জানিস। আমি শুধু একটা কথাই বলতে চাই তোকে। যা পেছনে ফেলে এসেছিস, তা ফিরে পাওয়ার সব রাস্তাই বন্ধ। তাই আর ফিরে তাকাস না। সামনে এগিয়ে চল। নিজের সংসারটাকে এখন কিভাবে বাঁচাবি সেটা ভাব। মোহিনী এসব এমনি এমনি যেতে দেবে না। বাকিটা তুই দেখ।”
.
.
মশায় একদম ঝেঁকে ধরেছে রজনীকে। চৌকাঠের বাইরে সিড়িতে বসেই দরজা খোলার অপেক্ষা করছেন তিনি। সেই কখন বের করে দিয়েছে তাকে। এতোগুলা ঘন্টা হয়ে গেল তবুও কেউ দরজা খুললো না।

“ধুর, এভাবে আর কতক্ষণ মশার কামড় সহ্য করবো? এর চেয়ে তখন আম্মার মারগুলো সহ্য করে নিলেও ভালো হতো। অন্তত এভাবে বাইরে বসে মশার কামড় তো খেতে হতো না। কেন যে তখন আম্মাকে ধাক্কা দিতে গেলাম। সত্যি সত্যিই আবার তাড়িয়ে দিল না তো আমাকে? এভাবে কোথায় যাবো আমি? না আছে কাপড়চোপড় আর না আছে টাকাপয়সা। গয়না আর টাকাগুলো হাতে থাকলেও একটা কথা ছিল। এক মুহূর্তও দাঁড়াতাম না এখানে। অন্য কোথায় চলে গিয়ে মানুষের বাড়ি কাজ করে খেতাম। তাও ভালো ছিল।”

নিজের মনেই বিড়বিড় করছিলেন রজনী। হঠাৎ বাইরের গেইট জোরে খুলে যাওয়াতে ছিটকে উঠলেন। ওদিকে ভালো করে তাকাতেই দেখলেন কেউ এলোমেলো পায়ে ঢুলতে ঢুলতে এদিকেই এগিয়ে আসছেন। আরেকটু কাছে আসতেই বুঝতে পারলেন ওটা অর্ণব। মদ খেয়ে মাতাল হয়ে আছেন তিনি। সিড়িতে পা লেগে হোঁচট খেয়ে দরজার সামনে পড়ে যেতেই রজনী লাফ দিয়ে সরে গেলেন। মাতাল কণ্ঠে বারবার মেহেরজান বলে ডেকে চলেছেন অর্ণব। জানালা খুলে বাইরে তাকালেন মোহিনী। এমন সময় হঠাৎ করে দরজাটা খুলে গেল।

চলবে…

#মেহেরজান
#পর্ব-৩৪
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

“বাড়ি চলেন অর্ণব বাবা। মালকিন আপনের লাইগা অনেক চিন্তায় আছেন। খাওয়াদাওয়াও ছাইড়া দিছেন। একদম অসুস্থ হইয়া পড়ছেন।”

বেশ মনোযোগ দিয়ে মোহিনীর সাথে দাবা খেলছিলেন অর্ণব। নিজের চালটা চেলে জবাব দিলেন,

“আসলেই অসুস্থ নাকি আমাকে বাড়ি ফেরানোর জন্য আবার কোনো নতুন নাটক করছেন উনি? যেমনটা বিয়ে করানোর জন্য করেছিলেন।”

“আসলেই তার শরীলডা তেমন ভালা না। আটদিন হইয়া গেল আপনে বাড়িতে নাই। আপনের চিন্তায় চোখের নিচে কালি পইড়া গেছে একদম। উপায় না পাইয়া সেই আবার আমারেই পাঠাইছেন আপনেরে নিয়া যাওনের লাইগা।”

“কেন? ওনার আসতে কী অসুবিধা ছিল?”

রামু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,

“ওইযে কইলাম না? তার শরীলডা ভালা না তেমন। তাই আমারেই পাঠাইছে।”

মোহিনী বলে উঠলেন,

“বাড়ি ফিরে যান অর্ণব। আপনার মা, স্ত্রীসহ সকলে অপেক্ষা করছেন আপনার জন্য। এভাবে আর কতদিন?”

‘স্ত্রী’ শব্দটা বেশ জোর দিয়েই বললেন মোহিনী। অর্ণব চোখ তুলে তার দিকে তাকালেন। মোহিনীর দিকে দৃষ্টি রেখেই বললেন,

“আপনি চলে যান কাকু। আমার যখন মনে হবে তখন আমি নিজেই ফিরে যাব।”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন রামু। আজ তৃতীয়বারের মতো অর্ণবকে বোঝানোর জন্য এসেছিলেন তিনি। কিন্তু এবারও তাকে খালি হাতেই ফিরতে হবে। নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি।

“এখানে থেকে কী বোঝাতে চাচ্ছেন আপনি? আমাকে খুব ভালোবাসেন?”

“আপনাকে ভালোবাসি তা আবার বোঝানোর প্রয়োজন আছে?”

“সেদিন বললাম পালিয়ে যেতে। আপনি এলেন না। কখনো ভাবিওনি এভাবে বিয়ে করে ফেলবেন।”

“আমি আপনাকে তখনই বলেছিলাম যে পালানো কোনো সমাধান নয়।”

“তাহলে সমাধান কী ছিল? পদ্মাকে বিয়ে করা?”

“আমি আপনাকে আগেও বলেছি আর আবারও বলছি। বিয়েটা আমার ইচ্ছেতে হয়নি। তাই এটা নিয়ে বারবার কথা শোনাবেন না।”

“এমনভাবে বলছেন যেন কিছুই হয়নি। বাচ্চা নাকি আপনি যে আপনার ইচ্ছে না থাকলেও ধরে বেঁধে বিয়ে করিয়ে দেবে?”

“মনে করুন তাই-ই। বাচ্চা না হলেও বিয়েটা আমাকে ধরে বেঁধেই করানো হয়েছে। আমি তখন কোন পরিস্থিতিতে ছিলাম তা আপনি জানেন না মেহের। তাই বুঝতেও পারবেন না।”

“তো এখন যান না নিজের বউয়ের কাছে। এখানে এসে পড়ে আছেন কেন?”

“যাবো না। আপনার কাছেই থাকবো। কী করবেন আপনি?”

মোহিনী মুখ বাঁকা করে বসে রইলেন। তার এমন কান্ড দেখে মুচকি হাসলেন অর্ণব। খুব খাটাখাটুনির পর মোহিনীর রাগ গলাতে পেরেছেন তিনি। দ্বিতীয়বার আর তার ক্রোধের অনলে পুড়তে চান না।
.
.
.
রামুকে এবারও খালি হাতে ফিরতে দেখে হতাশ হলেন আম্রপালি। সেসময় অর্ণবের চলে যাওয়াটায় তেমন একটা গুরুত্ব না দিলেও এখন বুঝতে পারছেন বিষয়টা বেশ গুরুতর। নিজের সিদ্ধান্তের ওপরই সংশয় হচ্ছে তার। আদৌও কি তিনি সঠিক নাকি অনেক বড় ভুল করে ফেললেন। দেওয়ালের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন পদ্মাবতী। কপোল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো তার। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে তা মুছে নিয়ে নিজের মনকে শক্ত করলেন। সবে তো শুরু। কে জানে কপালে কী আছে তার। সোজা রান্নাঘরে চলে এলেন তিনি। দেখলেন শেফালী কলার মোচা কাটছেন। শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে তিনিও কাজে লেগে পড়লেন।

“অর্ণবদা এবারও এলেন না?”

“না।”

নিচু স্বরে বললেন পদ্মাবতী।

“তুই কী আশা করেছিলি? আসবেন উনি? মেনে নেবেন সব?”

“আশা করা ছেড়ে দিয়েছি আমি। ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।”

“এখন সব ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিলে হবে না পদ্মা। কই? বিয়ের আগে তো ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিসনি। বুদ্ধি দিয়ে নিজের করে নিয়েছিস অর্ণবদাকে।”

“নিজের করতে পারলাম কই? উল্টো জোর করে ঘাড়ে চেপে বসেছি বলতে পারিস। কাঁটার মতো বিঁধে আছি ওনার গলায়। না পারছেন গিলতে আর না পারছেন উগলে দিতে। সব ছেড়ে ছুড়ে নিজের প্রেমিকার কাছে গিয়ে পড়ে আছেন।”

“শোন পদ্মা, এসব এতো ছোট করে দেখিস না। মোহিনী অর্ণবদার প্রেমিকা ছিল। আর এখন তুই অর্ণবদার বউ। কীভাবে মেনে নিচ্ছিস এসব? আমি হলে তো পারতাম না শমিতকে অন্য কোনো মেয়ের সাথে দেখতে।”

“তোদের বিষয়টা ভিন্ন। তোরা ভালোবাসতিস একে অপরকে। আমাদের তো আর তা নয়।”

“তাতে কী? পুরুষ মানুষের মন বলে কথা। কখন কার ওপর আসে বলা যায় না। বিয়ের আগে ভালোবাসেনি বলে বিয়ের পরে বাসবে না এটা কী করে বলিস? সবাই কি আর প্রেম করে বিয়ে করে নাকি?”

“কী বলতে চাস তুই?”

“মোহিনীর প্রতি অর্ণবদার যে ভালোবাসাটা ছিল সেটা নিজের জন্য অর্জন কর। সরিয়ে দে মোহিনীকে তোদের জীবন থেকে। একদম ভুলিয়ে দে ওকে।”

তাচ্ছিল্যভরে হাসলেন পদ্মাবতী।

“হাসছিস কেন? ভুলটা কী বলেছি আমি?

“যার ভালোবাসার ধারের কাছেও আমি নেই, তার ভালোবাসা নাকি আবার অর্জন করবো!”

“তা নয়তো কী?”

“যার জন্য এসব করবো সে নিজেই তো এখানে নেই। করবো কী করে?”

“চিন্তা করিস না। আজ রাতে শমিত ফিরবে। ওকে আমি আগেই টেলিফোনে বলেছি তোদের বিয়ের কথা। এলে আবার খুলে বলবো পুরোটা। ও ঠিকই অর্ণবদাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ফিরিয়ে আনবে দেখিস তুই।”
.
.
.
শমিত স্নানঘর থেকে হাতমুখ ধুয়ে বের হতেই শেফালী তার দিকে একটা তোয়ালে এগিয়ে দিলেন। মুখ মুছে শমিত বললেন,

“জানো, আমার এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে অর্ণব আর পদ্মার বিয়ে হয়ে গেছে।”

“বিশ্বাস না করে উপায় নেই। তাই কষ্ট হলেও বিশ্বাস করে নাও।”

“অর্ণব আছে কই এখন?”

“মোহিনীর ওখানে।”

“কী! তুমি তো আমাকে বলেছিলে অর্ণব বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু মোহিনীর ওখানে যে গেছে, এটা তো বলোনি।”

“ওভাবে কী আর এতোকিছু বলা যায়? এখন তুমি এসেছো। আস্তেধীরে আবার শুরু থেকে বুঝিয়ে বলবো সব।”

“তা বলো। কিন্তু এখন খেতে দাও। এতোটা রাস্তা এসেছি। আসতে আসতে খিদে পেয়েছে খুব। পেটে খিদেই চো চো করছে।”

“অপেক্ষা কর কিছুক্ষণ। রান্না বসিয়ে এসেছি। তুমি এতো তাড়াতাড়ি চলে আসবে তা তো আর আগে জানতাম না। ভেবেছিলাম রাত হবে অনেক।”

“আমিও তো তাই-ই ভেবেছিলাম।”

“ব্যবসা কেমন চলছে?”

“সে চলছে বেশ।”

“মামা এলেন না?”

“দু’জনই চলে আসলে ওদিকটা কে দেখবে? ওখানেও তো কাউকে থাকতে হবে নাকি?”

“তাও ঠিক।”

“বাদ দাও ওসব। আগে বলো তুমি কেমন আছো?”

“যেমনটা ছেড়ে গিয়েছিলে।”

“আমি কি আর ইচ্ছে করে গিয়েছি নাকি? কতদিন তোমাকে দেখিনি। মনে হচ্ছে যুগ পেরিয়ে গেছে।”

“কী করবে বলো? তোমার মা তো আমাদের আলাদা করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। রাতে একঘরে থাকতে দেন কিনা দেখ।”

“ধুর। আবোলতাবোল বলো না তো। মা এতোটাও খারাপ না যতটা তুমি ভাবো।”

“কেন? ভুল তো বলিনি। বিয়ের পর তুমি যতদিন বাড়িতে ছিলে, তোমার ধারের কাছেও থাকতে দেননি উনি আমাকে। রাতে পদ্মার ঘরে ঘুমোতে হতো। এরপর জোর খাটিয়ে এ-ঘরে ঢুকতে হয়েছে আমাকে। আমার স্বামীর ঘরে আমি থাকবো না তো কে থাকবে?”

শেফালীর কথা শুনে সামান্য হাসলেন শমিত। বললেন,

“তুমিই থাকবে। কার এতো সাহস যে তোমাকে এ-ঘরে থাকতে দেবে না।”

“থাকবে কয়দিন এখানে?”

“এসেছি তো দু’সপ্তাহের জন্য। এখন দেখি ক’দিন থাকতে পারি। যতদিনই আছি, তোমাকে খুব আদর করবো। কতদিন পর বউটাকে কাছে পেলাম আমার।”

হাত ধরে এক টানে শেফালীকে কাছে টেনে নিলেন শমিত। চেঁচিয়ে উঠলেন শেফালী।

“এই কী শুরু করলে? ছাড় আমাকে। দরজা খোলা আছে। কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ।”

“কিসের সর্বনাশ? আমার বউকে আমি আদর করছি। তাতে কার কী?”

শেফালীর গাল দুটো লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছে। শমিতের চোখে চোখ মেলাতে পারছেন না তিনি।

“ছাড় আমাকে। রান্না পুড়ে যাবে। তুমি না বললে তোমার খিদে পেয়েছে। নিচে আসো। আমি খাবার বাড়ছি।”

নিজেকে কোনোমতে ছাড়িয়ে দৌঁড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন শেফালী।

চলবে…

মেহেরজান পর্ব-৩১+৩২

0

#মেহেরজান
#পর্ব-৩১
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

বাড়ির পেছনের দিঘির পাশে সিড়িতে বসে আছেন অর্ণব আর মোহিনী। হাতে সামান্য জল নিয়ে অর্ণবের দিকে ছুড়ে মারতেই অর্ণব খপ করে তার হাত ধরে ফেললেন। দূরে বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে তাদের দেখে চলেছেন সাবিত্রী। কথাবার্তা না শোনা গেলেও দেখে কিছু বুঝতে বাকি নেই তার। এরপর দ্রুত পায়ে শকুন্তলার ঘরে চলে এলেন।

“আজকালকার ছেলেমেয়েরা যে কী শুরু করেছে। নিজেদের কী মনে করে কে জানে।”

“কার ছেলেমেয়েরা কী করলো না করলো তাতে তোমার কী মা? যে যা খুশি করুক।”

“বাইরের কেউ হলে বলতাম না। কিন্তু এরা তো নিজের ঘরেরই।”

“মানে?”

“ছাদে থেকে দেখলাম অর্ণব আর মোহিনী দিঘির পাশে বসে আছে। জল ছোড়াছুড়ি, হাত ধরাধরি আরও কত কী।”

শকুন্তলা কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বললেন,

“এখানে আমরা কী করবো? কিছু বললে দিদি নিজেই বলবে। অর্ণব তো আর আমার সন্তান না।”

চিত্রার মৃত্যুতে একদম চুপচাপ হয়ে গেছেন শকুন্তলা। আগের মতো চঞ্চলতা আর নেই তার মাঝে। সাবিত্রী কিছুক্ষণ আমতাআমতা করে বললেন,

“আচ্ছা তোকে একটা কথা বলবো?”

“কী?”

“তোর মেয়ের সাথে কারও সম্পর্ক ছিল?”

“না।”

“ছিল। তুই জানিস না। তোর মেয়ে পোয়াতি ছিল।”

“কী সব যা-তা বলছো তুমি?”

“ও যখন আমাদের বাড়িতে এসেছিল তখন ওর মাঝে আমি অনেক লক্ষণ দেখেছি। একে জিজ্ঞেসও করেছিলাম। কিন্তু অস্বীকার করেছে। তারপরের দিনই তো কিছু না বলেই চলে এলো এখানে। আমার মনে হয় চিত্রা এই জন্যই আত্মহত্যা করেছে।”

শকুন্তলা সাবিত্রীর মুখ চেপে ধরলেন।

“এসব কথা আর বলবে না মা। ভুলেও আর কোনোদিন মুখে আনবে না। কেউ যেন না জানে এসব।”

আম্রপালি ঘরে আসতেই শকুন্তলা সাবিত্রীর মুখ ছেড়ে দিলেন।

“ভুল সময় এসে পড়লাম কী?”

“না না। ভুল সময় আসবে কেন? আমি আর মা দু’জনে বসে গল্পই করছিলাম। তুমিও এসো।”

আম্রপালি ভেতরে এসে বসার কিছুক্ষণ পরেই পদ্মাবতী আসলেন। ওষুধ বের করে শকুন্তলাকে খাইয়ে দিলেন। তাদের উদ্দেশ্যে বললেন,

“দুপুরে আপনারা কী খাবেন বলুন। আমি রান্না বসিয়ে দেব।”

আম্রপালি বললেন,

“তোর যা ইচ্ছা তাই রান্না কর।”

“যা ইচ্ছা তাই করবো মানে? আপনারা কী খাবেন তা আমি কী করে জানবো?”

“আরে বাবা বললাম তো তোর ইচ্ছে মতো রাঁধ। তুই যা রাঁধবি তাই খাবো। তোর সব রান্নাই তো অনেক সুস্বাদু হয়।”

“তাহলে পরে কিন্তু আবার বলবেন না এটা রেঁধেছি কেন? ওটা রেঁধেছি কেন?”

“বলবো নাহ। যা তুই।”

“ঠিকাছে। মনে থাকে যেন।”

“থাকবে।”

পদ্মাবতী চলে যেতেই আম্রপালি বললেন,

“মেয়েটা কত বড় হয়ে গেছে! পুরো বাড়িটা এখন একাই সামলাচ্ছে।”

সাবিত্রী বললেন,

“সত্যিই। ক’দিন পরে বিয়েও দিয়ে দিতে হবে।”

“আমার ভাবতেই অবাক লাগে পদ্মাটার বিয়ে হয়ে গেলে ওকেও এ-বাড়ি থেকে চলে যেতে হবে।”

“চাইলে বিয়ের পরও এখানেই রেখে দিতে পারো।”

শকুন্তলা বললেন,

“তা আবার কীভাবে হবে? বিয়ের পর তো শশুরবাড়ি যেতেই হবে ওকে।”

“আরে হবেরে হবে।”

আম্রপালি আর শকুন্তলা দু’জনেই কৌতূহলী দৃষ্টিতে সাবিত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন। আম্রপালি বললেন,

“কীভাবে?”

“তুমি কী ভুলে যাচ্ছো আম্রপালি বাড়িতে বিয়ের উপযুক্ত তোমারও একটা ছেলে আছে? ওকে তো আর সারাজীবন বিয়ে না করিয়ে রাখবে না।”

এই প্রথম যেন এই মহিলার কোনো উপদেশ আম্রপালির পছন্দ হলো। ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো তার। পরক্ষণেই কপালে চিন্তার রেখা ফুটিয়ে তুলে জিজ্ঞেস করলেন,

“কিন্তু অর্ণব? ও কি মানবে? আর পদ্মা কী বলবে?”

“পদ্মাকে একবার বলেই দেখো না। আর রইল কথা অর্ণবের। ও তোমার কথা মানবে না? প্রথমে না করলেও তুমি বুঝিয়ে বললে ঠিকই মেনে নেবে দেখো।”

“তবুও। কেন যেন মনে হচ্ছে অর্ণব…।”

আম্রপালির কথা শেষ করার আগেই সাবিত্রী বললেন,

“তোমাকে একটা কথা বলি আম্রপালি। জানি না তুমি কীভাবে নেবে কিন্তু তোমার জানা উচিত এটা।”

“কী ব্যাপারে?”

“অর্ণবের ব্যাপারেই।”

“অর্ণবের?!”

“হ্যাঁ।”

“কী কথা?”

“কীভাবে যে বলি তোমাকে? শোনো তাহলে। অর্ণবের সাথে মোহিনীর মেলামেশাটা তোমার চোখে পড়েছে কিনা জানি না। কিন্তু আমার চোখে ব্যাপারটা ঠিক লাগছে না।”

সাবিত্রীর কথা শুনে যেন আম্রপালি আকাশ থেকে পড়লেন।

“মোহিনী!”

“আমার মনে হয় ওদের মাঝে কোনো সম্পর্ক আছে।”

“মোহিনীর সাথে যদি অর্ণবের সম্পর্ক থাকে তাহলে আপনি অর্ণব আর পদ্মার বিয়ের কথা বলছেন কেন?”

“তুমি কি বোকা আম্রপালি? মোহিনীর মতো একটা মেয়ের সাথে নিজের ছেলের বিয়ে দেবে? গাঁয়ের লোক কী বলবে ভেবে দেখেছো? তুমি মাত্র একটা বছর নেচেছিলে। তাতেই তোমার এ-বাড়িতে বিয়ে হওয়ায় লোকে কম নিন্দে করেনি এ-বাড়ির। এমনকি এখনো করে। আর মোহিনী, সে সেই কবে থেকে নেচে চলেছে। গাঁয়ের কম লোক যায় না সেখানে। লোকে একটা বিয়ের কথা ভুলতে না ভুলতেই আরেকটা করাতে চাও? আর তাছাড়াও তোমার জন্য তোমার মা ছিলেন। ওনার পর তারানা আগলে রেখেছিল তোমাকে। আর মোহিনীর তো কোনো পরিচয়ই জানা নেই। মা কে? বাবা কে? কিচ্ছু না। মোহিনীকে যে এখনো কোনো পুরুষ ছোঁয়নি সেটা কীভাবে বলছো?”

“মোহিনী একদমই এমন মেয়ে নয়। আর ওকে আগলে রাখার জন্যও তারানা আছে সেখানে।”

“তবুও আম্রপালি। লোকে তো আর এসব দেখবে না। আর ঐ মেয়ে তো আমাদের ধর্মেরও না। ও কী বুঝবে শাখা সিঁদুর এর মূল্য?”

আম্রপালি চুপ করে রইলেন।

“আমার কথাগুলো একটু ভেবে দেখো আম্রপালি। তোমাদের পরিবারের ভালোর জন্যই বলছি আমি।”

“ঠিকাছে। আমি অর্ণব আর পদ্মাবতীর সাথে কথা বলবো। তুই কিছু বলছিস না যে শকুন্তলা?”

শকুন্তলা ম্লান হেসে বললেন,

“আমার মেয়েটা মরার একমাস হতে না হতেই নিজের ছেলের বিয়ের আনন্দে মেতে উঠতে চাইছো দিদি?”

“এভাবে কেন বলছিস শকুন্তলা? আমি চিত্রাকে ততটাই ভালোবাসতাম যতটা ভালোবাসি অর্ণবকে। চিত্রা আমার কাছে নিজের সন্তানের থেকে কম ছিল না।”

“কিছু মনে করো না দিদি। কিছুক্ষণের জন্য একটু স্বার্থপর হয়ে গেছিলাম। তুমি বিয়ের ব্যাপারটা দেখো।”

“তুই নিশ্চিত তো?”

“হ্যাঁ, এই ফাঁকে হয়তো আমার মনটাও কিছুটা ভালো হয়ে যাবে।”

“বেশ। তাই করবো।”

“ভিতরে আসমু মালকিন?”

রামুর ডাক শুনতেই আম্রপালি পেছনে ঘুরলেন। বললেন,

“রামু, কিছু বলবি? আয়, ভেতরে আয়।”

“আপনে নতুন যেই মাইয়ারে কামের লিগা রাখছিলেন না? ও ঘর ঝাড়ু দিবার যাইয়া এইডা পাইছে অর্ণব বাবার ঘর থিকা। আইনা আমারে দিল তাই আমি আপনের কাছে দিয়া গেলাম।”

আম্রপালির হাতে একটা কানের দুল ধরিয়ে দিয়ে রামু চলে গেলেন। আম্রপালি ভালো করে দেখে বললেন,

“এমন গয়না তো আমাদের বাড়ির কেউ পরে না। দেখে তো মনে হচ্ছে ও-বাড়ির কারও। কার এটা?”

সাবিত্রী বললেন,

“মোহিনী ছাড়া এ-বাড়িতে আর কে যাওয়া আসা করে? ও ছাড়া আর কার হবে? আমি তো তোমাকে আগেই বলেছি। সকাল সকাল শ্বেতকাঞ্চন পাওয়ার দিন অনেক আগেই ফুরিয়েছে তোমার। চুলে পাঁকও ধরেছে। এবার নিজের ছেলের প্রতি একটু নজর দাও। আজ শমিত এমন একটা কান্ড করেছে। কাল অর্ণব যে এমন কিছু করবে না তার তো কোনো ভরসা নেই। এখন তুমিই সব সামলাও আম্রপালি।”
.
.
.
নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন আম্রপালি। সামনে শেফালীকে দেখে বললেন,

“এই শেফালী, এদিকে শোন তাড়াতাড়ি।”

শেফালী দৌঁড়ে আম্রপালির সামনে এলেন।

“আস্তে আস্তে। বিয়ে হয়ে গেল অথচ বুদ্ধি হলো না। বাচ্চাদের মতো বাড়ির ভেতরে ওভাবে দৌঁড়াতে বলেছে কে?”

“আপনিই তো বললেন তাড়াতাড়ি আসতে। তাই-ই তো দৌঁড়ে এলাম।”

“আচ্ছা ঠিকাছে। এখন যেমন দৌঁড়ে এলি তেমন দৌঁড়ে ছাদেও যা। বাইরের অবস্থা তেমন ভালো না। পদ্মা ছাদে গেছে কাপড় আনতে। ওর সাথে কাপড়গুলো নিয়ে আয়। আর পদ্মাকে ওর ঘরে যেতে বল। আমি আসছি একটু পর।”

“আপনার ঘরেই পাঠিয়ে দিই?”

“না থাক। আমিই যাবো। তুই শুধু ডেকে বলে দিস ওকে।”

“আচ্ছা।”

শেফালী দৌঁড়ে ছাদের দিকে চলে গেলেন। আম্রপালি নিজের ঘরে যাওয়ার রাস্তা বদলে অর্ণবের ঘরের দিকে গেলেন। কিন্তু ঘরে এসে কাউকে দেখতে পেলেন না। ফিরে আসার সময় টেবিলের ওপর চোখ পড়তেই থমকে দাঁড়ালেন তিনি। এগিয়ে এসে ঘুঙুরটা হাতে তুলে নিলেন। কিছুক্ষণ ভেবে ঘুঙুরটা নিজের শাড়ির আঁচলের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে চলে গেলেন।

বাইরে প্রচন্ড জোরে বাতাস বইছে। আকাশে কালো মেঘ ঘনিয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে খুব বড় ঝড় উঠবে আজ। সামনের সুপারি গাছগুলো খুব জোরে জোরে এদিক-ওদিক দুলছে। পদ্মাবতী এক এক করে তার থেকে কাপড়গুলো তুলে নিচ্ছেন। শেফালী এসে তাকে সাহায্য করতে লাগলেন। এতো বাতাসের মধ্যে চোখ খুলে রাখা মুশকিল। ধুলো বালি উড়ে চোখে ঢুকে যাচ্ছে। কোনো রকম দু’জনে নিজেদের চোখ দুটো খুলে রেখেছেন। কাপড়গুলো নিয়ে শেফালী বললেন,

“এই পদ্মা, তাড়াতাড়ি ঘরে যা নিজের। বড় মামি ডেকেছেন তোকে।”

“কী? বড়মার ঘরে যাবো? আবার বল। শুনতে পাইনি ঠিকমতো।”

“আরে না না। তোর নিজের ঘরে যা। বড় মামি ওখানেই আছেন।”

“ঠিকাছে যাচ্ছি।”

পদ্মাবতী কাপড়গুলো শেফালীর কাছে দিলেন। চলে যাওয়ার সময় গাছে একটা অলকনন্দা ফুটে থাকতে দেখলেন। বাতাসে খুব জোরে জোরে দুলছে গাছটা। ফুলটা ছিড়ে নিজের কানের ওপরে গুঁজে নিলেন। শেফালীকে দেখিয়ে বললেন,

“কেমন লাগছেরে?”

“আরে কেমন লাগছে ওটা বাদ দিয়ে ঘরে যা না। বললাম বড় মামি ডেকেছেন।”

পদ্মাবতী ছুটে চলে গেলেন। ঘরে ফিরতেই দেখলেন আম্রপালি বসে আছেন।

“ডেকেছেন বড়মা?”

“হ্যাঁ। বস আমার পাশে।”

পদ্মাবতী তার সামনে এসে বসলেন।

“কিছু বলবেন?”

“হ্যাঁ, কিন্তু কীভাবে যে বলি সেটাই বুঝতে পারছি না।”

পদ্মাবতী ভ্রুকুটি করলেন।

“কী হয়েছে বড়মা?”

“দেখ, আমি সোজাসাপটাভাবেই বলছি। অর্ণবকে তোর কেমন লাগে বলতো। সত্যি করে বলবি কিন্তু।”

আম্রপালির কথায় পদ্মাবতী কিছুটা হকচকিয়ে উঠলেন।

“মানে?”

“আমি তোকে নিজের থেকে দূরে করে দিতে চাই না। আমি অর্ণবের বিয়েটা তোর সাথে দিয়ে দিতে চাই। করবিরে?”

আম্রপালি পদ্মাবতীর হাত ধরে ফেললেন। পদ্মাবতী সাথে সাথে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

“কেন? আমি আপনার থেকে দূরে যাবো কেন যে যার জন্য অর্ণববাবুকে বিয়ে করতে হবে?”

“ওমা। বড় হয়েছিস তুই। বিয়ে করবি না? একদিন তো বিয়ে করে শশুরবাড়ি যেতেই হবে তোকে। তাহলে অর্ণবকে বিয়ে করে এ-বাড়িই থেকে যা না একেবারে।”

“কেন? আমাকে বিয়ে দিতে হবে কেন? আমি কী খুব বেশি খাই? নাকি অনেক খরচা করি? এমনিই রেখে দিলে কী সমস্যা? তার জন্য বিয়ে কেন করাতে হবে? মেয়ে বানিয়ে রেখে দিন না। বউ কেন বানাতে হবে?”

পদ্মাবতীর চোখ ইতোমধ্যেই জলে ভরে গেছে। আম্রপালি তার মাথায় হাত রেখে বললেন,

“ধুর পাগলি। তোকে চাইলে তো সারাজীবনই রেখে দিতে পারি। কিন্তু বিয়ে তো করতেই হবে তোকে। তখন চলে যাবি না? এজন্যই তো অর্ণবের সাথে তোর বিয়েটা দিতে চাইছি যাতে তুই বিয়ের পরও আমাদের সাথেই থাকিস।”

পদ্মাবতী কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। হঠাৎ নিজের মনটা কেমন যেন কঠিন হয়ে এলো। একটা শয়তানি বুদ্ধি খেলে গেল তার মনে। আম্রপালি আবার বললেন,

“কি রে? করবি বিয়েটা? রাজি হয়ে যা না। থেকে যা সারাজীবন আমাদের কাছেই।”

“আপনি যা চাইবেন তাই হবে বড়মা। আমি রাজি।”

আম্রপালি খুশিতে আত্মহারা হয়ে পদ্মাবতীকে জড়িয়ে ধরলেন।

“আমি অর্ণবের সাথে কথা বলে তাড়াতাড়িই তোদের বিয়ের ব্যবস্থা করবো। এখন আসি। বাকিদের সাথেও কথা বলতে হবে।”

আম্রপালি বেরিয়ে গেলেন। আয়নায় নিজেকে দেখে জগতের সবচেয়ে বড় স্বার্থপর মনে হচ্ছে পদ্মাবতীর। মোহিনী আর অর্ণবের ব্যাপারে সবটা জানার পরও কীভাবে রাজি হয়ে গেলেন তিনি বিয়েতে? যদিও বিয়েটা হবে কি হবে না তা তিনি জানেন না। অর্ণব নিশ্চয়ই বিয়ের প্রস্তাবটা নাকোচ করে দেবেন। তবুও অর্ণবকে পাওয়ার একটা শেষ সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন পদ্মাবতী। হয়তো অর্ণবের প্রতি সুপ্ত ভালোবাসাটাই আজ তাকে এতোটা স্বার্থপর হতে বাধ্য করেছে। কিন্তু কিছুতেই নিজের মনের মধ্যে শান্তি খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। মোহিনীর সাথে এতো বড় বিশ্বাসঘাতকতা করে ভালো থাকতে পারবেন তিনি? না শান্তিতে বাঁচতে পারবেন? হঠাৎ বিকট শব্দ করে একটা গাছের ডাল ভেঙে পড়লো। দৌঁড়ে জানালার কাছে গেলেন তিনি। জানালার কাছের নিমগাছের একটা ডাল ভেঙে পড়েছে। পদ্মাবতী দৌঁড়ে নিচে চলে এলেন। বাড়ির বাইরে এসে দেখলেন গাছের ডালটায় থাকা পাখির বাসাটাও পড়ে সেখানে থাকা পাখির ডিমগুলোও ভেঙে গেছে। একটা দুটো ফোঁটা পড়তে পড়তে ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমে পড়লো।

চলবে…

#মেহেরজান
#পর্ব-৩২
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

অর্ণবের দেওয়া নুপুরজোড়া পায়ে পরছিলেন মোহিনী। হঠাৎ সামনে ঘুঙুর এসে পড়তেই চমকে উঠলেন। কেউ ছুড়ে মেরেছে। চকিতে দরজার দিকে তাকাতেই দেখলেন আম্রপালি দাঁড়িয়ে আছেন। বহুবছর পর এ-বাড়িতে পা পড়েছে তার।

“নর্তকীর পায়ে ঘুঙুর মানায়, নুপুর নয়।”

আম্রপালির কথায় বিস্মিত হলেন মোহিনী। প্রতিত্তোরে কী বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। কী হচ্ছে তাও তার বোধগম্য হচ্ছে না। ঘুঙুরটার দিকে ভালো করে তাকাতেই মনে পড়লো এটা অর্ণবকে দিয়েছিলেন তিনি ঠিক করে দেওয়ার জন্য। এবার ঘটনা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছেন তিনি।

“বড়মা…।”

হাত উঁচু করে তাকে থামিয়ে দিলেন আম্রপালি।

“আমাকে আর ভুলেও কখনো বড়মা বলে ডাকবে না। সেই অধিকার হারিয়েছো তুমি। আমার খেয়ে, আমার পড়ে, আমার পিঠেই ছুরি মেরেছো।”

মোহিনী বুঝলেন নরমভাবে কথা বললে কিছুই হবে না। কিছু মুহূর্তের ব্যবধানেই আম্রপালির থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছেন তিনি। নিজেকের শক্ত করলেন। উঠে আম্রপালির সামনে এসে বললেন,

“আপনার ছেলে তো তাহলে একদম আপনার বিপরীত হয়েছেন।”

“কী বলতে চাইছো?”

“অর্ণব বলেছিলেন আমার পায়ে নাকি ঘুঙুরের চেয়ে নুপুর বেশি মানায়। আর আপনি বলছেন ঠিক তার উল্টোটা। তাই বললাম আপনার ছেলে একদম আপনার বিপরীত হয়েছেন। কার মতো হয়েছেন বলুন তো? নিশ্চয়ই নিজের বাবার মতো। নাহলে এতো মেয়ে ছেড়ে একটা নর্তকীকে কেন পছন্দ করবেন?”

“নিজেকে আমার সাথে তুলনা করছো? এতো বছর নেচেও আমার নখের কাছেও আসতে পারনি তুমি। একটা বছর নেচেছিলাম শুধু। তাতেই পুরো গ্রাম আমাকে এক নামে চিনতো। কত দূর থেকে লোকজন ছুটে আসতো শুধু আমায় এক ঝলক দেখার জন্য জানো তুমি? প্রতি সন্ধ্যায় আলোকসজ্জায় ভরে উঠতো এই রঙ মহল।”

মোহিনী মলিন হেসে জবাব দিলেন।

“আপনার সমকক্ষ হওয়ার যোগ্যতা আমার কোনোদিনও ছিল না আর হবেও না। আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা, ভালোবাসা অতীতে যেমন ছিল, ভবিষ্যতেও তেমনই থাকবে। কিন্তু এতোগুলো বছর আপনার আমার প্রতি যে স্নেহ-মমতা ছিল তা এক নিমিষেই শেষ হয়ে গেল? কেন?”

“তখন তো আর বুঝিনি যে দুধকলা দিয়ে কালসাপ পুষছি। যেটা বড় হয়ে আমাকেই ছোবল দেবে।”

আম্রপালি চলে যেতে উদ্যত হতেই মোহিনী পেছন থেকে বললেন,

“আমি আপনার ছেলেকে নয়, আপনার ছেলে আমাকে ভালোবেসেছিল। আমি তাকে বাধ্য করিনি আমাকে ভালোবাসতে।”

আম্রপালি ঘুরে দাঁড়ালেন।

“আফসোস। যদি তুমি বলতে পারতে তোমরা দু’জন দু’জনকে ভালোবেসেছিলে। কিন্তু তুমি সব দোষটা শুধু অর্ণবের ওপর দিয়ে দিলে।”

আম্রপালি আর একমুহূর্তও দেরি না করে চলে গেলেন। তারানাসহ বাকি সবাই সেদিকে হা করে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। মোহিনী স্বজোরে নিজের ঘরের দরজা লাগিয়ে দিলেন। রাগে কাঁপছেন তিনি। সেই সাথে দুঃখও হচ্ছে। কী থেকে কী হয়ে গেল এসব। কে জানে আর কতকিছু হারাতে হবে তাকে। সামনে অর্ণবের দেওয়া মুঠোফোনটা দেখতে পেলেন। এটা ব্যবহার করা এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেননি মোহিনী। নিজের রাগ কমানোর জন্য এটাই তুলে এক আছারে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেললেন।
.
.
.
বেশ রাগান্বিত ভঙ্গিতে আম্রপালির ঘরে প্রবেশ করলেন অর্ণব। অর্ণবকে এভাবে আসতে দেখে আম্রপালি ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। অর্ণব উচ্চস্বরে বললেন,

“আমি যা শুনছি তা কি সত্যি মা?”

“আস্তে অর্ণব। এতো জোরে কথা বলছিস কেন? কী শুনেছিস তুই?”

“আপনি আমার আর পদ্মাবতীর বিয়ে দিতে চাচ্ছেন?”

আম্রপালি আবার নিজের কাজে মনোনিবেশ করতে করতে বললেন,

“হ্যাঁ। কী এমন হয়েছে তাতে?”

“কী এমন হয়েছে মানে? আপনি একবারও আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন এব্যাপারে?”

“জিজ্ঞেস করার কী আছে। তোর বিয়ে। তুই তো জানতেই পারবি।”

“জানতে পারা না পারার বিষয় না। আমি এই বিয়েতে রাজি নই।”

“কেন? মোহিনীর জন্য?”

আম্রপালির কথায় কিছুটা অবাক হলেন অর্ণব।

“ওহ, আপনি তাহলে জানেন এব্যাপারে। আমিও অবশ্য আপনার থেকে কিছু লুকোতে চাইনি। তা আপনি কি এজন্যই পদ্মাবতীর সাথে আমার বিয়ে দিতে চাচ্ছেন?”

“মোটেও না।”

“তাহলে সবকিছু জানার পরও মোহিনীর সাথে বিয়ে ঠিক করলেন না কেন আপনি?”

“কারণ ওকে আমার পছন্দ না। আমি পদ্মাবতীকে এ-বাড়ির বউ করতে চাই।”

“কাল পর্যন্তও তো দুটো মেয়ে আপনার কাছে সমান ছিল। আজ এমন কী হলো আপনার যে মোহিনীকে পছন্দ না আপনার? যার জন্য আপনি পদ্মাবতীর সাথে বিয়ে ঠিক করলেন? তাহলে আমার এটা বলা কি ভুল হবে যে আপনি মোহিনীকে সরানোর জন্যই পদ্মাবতীর সাথে আমার বিয়ে দিতে চাইছেন?”

“সে তুই যা খুশি ভাব। তোর বিয়ে পদ্মার সাথেই হবে এটা জেনে নে।”

“তাহলে আপনিও এটা ভালো করে জেনেনিন মা, আমি শমিত নই যে তার মায়ের সব অন্যায় আবদার মেনে নেবে। আমি অর্ণব। মোহিনীকে আমি ভালোবাসি আর চিরদিন ওকেই ভালোবাসবো। ওকে ছেড়ে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”

দরজার বাইরে কান পেতে সবকিছু শুনছিলেন পদ্মাবতী। এমনটা হবে তা তিনি আগে থেকেই জানতেন। কিন্তু এতো সহজে হার মানতে পারেন না তিনি। কিছু একটা তো করতেই হবে তাকে।
.
.
.
“কী চাই তোমার? এতো রাতে আমাকে এখানে ডেকে পাঠিয়েছো কেন? জানো এভাবে এখানে আসতে কতটা অসুবিধা হয়েছে আমার? আমি এখানে এসেছি আম্মা জানলে জানে মেরে ফেলবে আমাকে।”

“এতো কথা কেন বলছো? যে জন্য ডেকেছি সেটা শোনো।”

“কী?”

“মোহিনীর ওপর নজর রাখো। ওর সব খবরাখবর আমাকে দেবে। বিয়ে আঁটকানোর জন্য ও যেকোনো কিছু করতে পারে। ওর আর অর্ণবের করা সব পরিকল্পনা নষ্ট করবে তুমি।”

উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন রজনী।

“আস্তে। এতো জোরে হাসার জন্য তোমাকে এভাবে আসতে বলেছি আমি? যাতে সবাই জেনে যায়।”

রজনী হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

“এখানে আমার কী লাভ?”

পদ্মাবতী এবার নিজের কাছে লুকোনো থাকা একটা খাম বের করলেন। রজনীর হাতে দিয়ে বললেন,

“এটা রাখো। আশা করি এখন বুঝতে পারবে এতে তোমার কী লাভ।”

খাম খুলে দেখতেই টাকার কতগুলো কড়কড়ে নোট বের হলো। রজনীর চোখ চকচক করে উঠলো।

“এতো টাকা!”

“আস্তে কথা বলো। কাজ ঠিকমতো করতে পারলে আরও পাবে।”

টাকাগুলো আবার খামের ভেতরে ভরে রজনী বললেন,

“তোমাকে এতোদিন যতটা সহজ-সরল আর বোকা ভাবতাম, তুমি ঠিক ততটা সহজ-সরল বা বোকা নও। আসলে বোকাই নও। প্রচন্ড চালাক একটা মেয়ে। ধারণার বাইরে। নিজের বোনের মতো বান্ধুবীর সাথে এভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করতে বিবেকে বাঁধবে না তোমার?”

মুহুর্তেই পদ্মাবতীর বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। নিজেকে শক্ত করে পদ্মাবতী বললেন,

“এতোকিছু তোমার না ভাবলেও চলবে। তোমাকে যা বলা হয়েছে সেটা করো।”

পদ্মাবতী গায়ের চাদর টেনে ভালো করে মুখ ঢেকে চলে গেলেন। রজনী নিজের লাভটা দেখে বেশ খুশিই হয়েছেন। সেখান থেকে ফেরার সময় সামনে মোহিনীকে দেখে দ্রুত অন্ধকারে ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে পড়লেন। মোহিনী অর্ণবদের বাড়ির দিকে চলে গেলে তিনিও সেখান থেকে বের হয়ে চলে গেলেন।

সবার অগোচরে খুব সাবধানে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করেছেন মোহিনী। ভেতরে এসে সোজা অর্ণবের ঘরে চলে এসেছেন। মাত্রই স্নান করে বের হয়েছেন অর্ণব। এতোরাতে মোহিনীকে দেখে বেশ অবাক হলেন।

“মেহেরজান! আপনি এতোরাতে?”

“আমাকে এভাবে দেখে অবাক হওয়ার তো কিছু নেই। আমি আগেও এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে এসেছি এখানে। আপনি এতোরাতে স্নান করলেন কেন?”

“গরম পড়েছে প্রচুর।”

“সে যাই হোক। আমার কথা শুনুন এবার।”

“কী কথা?”

নিজের সর্বশক্তি দিয়ে অর্ণবকে জড়িয়ে ধরলেন মোহিনী। জড়িয়ে ধরেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। খুব কমই মোহিনীকে কাঁদতে দেখেছেন অর্ণব। সহজে মেয়েটার চোখ দিয়ে জল পড়ে না। তাই বুঝতেই পারছেন বিষয়টা গুরুতর।

“কী হয়েছে মেহের? কাঁদছেন কেন এভাবে?”

“আজ বড়মা গিয়েছিলেন আমার সাথে দেখা করতে। তার কথায় আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। আমাকে অনেক দূরে করে দিয়েছেন তিনি।”

অর্ণব এর কারণটা সহজেই বুঝতে পারলেন। তাই মোহিনীকে আর দ্বিতীয়বার কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। নিজের আর পদ্মাবতীর বিয়ের ব্যাপারে ওঠা কথাটাও চেপে গেলেন। অযথা মোহিনী আর পদ্মাবতীর সম্পর্ক নষ্ট করতে চান না তিনি।

“মন খারাপ করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে। মা আবার আপনাকে আগের মতোই ভালোবাসবেন।”

মোহিনী নিজের চোখ মুছে বললেন,

“উঁহু। আমি বড়মাকে চিনি। উনি একবার যখন আমার দিক থেকে মুখ সরিয়ে নিয়েছেন, আর ঘুরেও তাকাবেন না কোনোদিন। দূরে সরিয়ে দেবেন আপনার থেকে।”

অর্ণব একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। মোহিনী আবার বললেন,

“আমার একটা কথা রাখবেন অর্ণব?”

“কী?”

“পালাবেন আমাকে নিয়ে?”

“বাচ্চামো করবেন না মেহের। পালিয়ে যাওয়া কোনো সমাধান হতে পারে না।”

“পারে। অবশ্যই হতে পারে। আমি আপনার জন্য আমার সবকিছু ছাড়তে রাজি আছি তাহলে আপনি কেন পারবেন না অর্ণব?”

“আপনাকে যে কীভাবে বোঝাই।”

“আমি কিচ্ছু বুঝতে চাই না। আপনি আমাকে এখান থেকে দূরে নিয়ে চলুন। এরা সবাই আমাদের বিরুদ্ধে। আমাদের আলাদা করে দিতে চায়।”

“মেহের, শান্ত হন আপনি। শুধু শুধু ভয় পাচ্ছেন। কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না আমাদের।”

“আপনি কিচ্ছু জানেন না অর্ণব। প্রমিতাদিকে সবাই মিলে মেরে ফেলেছিল। আমাদের সবাইকেও মেরে ফেলতে চেয়েছিল। তখন বড়মা বাঁচিয়েছেন আমাদের। কিন্তু এখন তো তিনিই আমাদের বিরুদ্ধে অর্ণব। আপনি আমার কথা বোঝার চেষ্টা করুন। পালিয়ে চলুন এখান থেকে।

মোহিনীকে শান্ত করার জন্য অর্ণব বললেন,

“ঠিকাছে। পালিয়ে যাবো আমরা। এখান থেকে অনেক দূরে চলে যাবো। শান্ত হন আপনি।”

অর্ণবের কথায় যেন মোহিনী কিছুটা স্বস্তি পেলেন। মোহিনীকে এতোটা অস্থির হতে আগে কখনো দেখেননি অর্ণব। মোহিনী বললেন,

“কাল রাত দুটোর সময় আমি অপেক্ষা করবো আপনার জন্য নদীর পাড়ে। আপনি আসবেন তো?”

“আমি আসবো। আপনি যা বলবেন তাই হবে। এখন নিজের কান্না থামান।”

মোহিনী নিজের কান্না থামিয়ে নাক টানতে লাগলেন। অর্ণব তাকে নিয়ে সাবধানে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন।

চলবে…

মেহেরজান পর্ব-৩০

0

#মেহেরজান
#পর্ব-৩০
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

নদীর পাড়ে একটা গাছের ছায়ায় বসে আছেন অর্ণব। হঠাৎ মাথায় কারও কোমল হাতের আলতো স্পর্শ অনুভব করলেন। অপার দিগন্তে আবদ্ধ দৃষ্টি সরিয়ে চোখ বন্ধ করলেন তিনি। মুচকি হেসে মোহিনী হাত ধরে ঘুরিয়ে সামনে নিয়ে এলেন। চোখ খুলে মোহিনীকে একনজর দেখে টান দিয়ে নিজের পাশে বসালেন।

“হঠাৎ এতো ভালোবাসা দেখাচ্ছেন কেন মেহের?”

“আপনাকে দেখাবো না তো আর কাকে? এখানে এভাবে একা একা বসে আছেন কেন?”

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন অর্ণব। বললেন,

“চিত্রার মৃত্যুটা আমি এখনো মেনে নিতে পারছি না মেহেরজান। তার ওপর বাড়িতেও কিছু ঠিক নেই। পিসি এখনও রেগে আছেন।”

“চিন্তা করবেন না অর্ণব। আপনি কোনো ভুল করেননি। যা করেছেন ঠিক করেছেন। দেখবেন খুব তাড়াতাড়িই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।”

“তাই যেন হয়।”

“এটা আমার খুব পছন্দের। কিন্তু ছিড়ে গেছে। আপনি ঠিক করে এনে দেবেন?”

অর্ণবের সামনে একটা ঘুঙুর উঁচু করে ধরলেন। অর্ণব ঘুঙুরটা হাতে নিয়ে সামান্য হেসে বললেন,

“দেবো। তবে একটা শর্তে।”

“কী শর্ত?”

“এটা আর কোনোদিন আপনি পায়ে পরবেন না।”

“মানে?”

“নাচ ছেড়ে দিন।”

মোহিনী নিশ্চুপ হয়ে গেলেন।

“কী হলো? পারবেন না?”

“কিন্তু হঠাৎ করে…।

“আমি বাড়তি কোনো শব্দ শুনতে চাই না। আমি আমার শর্ত রেখেছি। এবার আপনি এক শব্দে জবাব দিন। পারবেন কিনা?”

মোহিনী আবারও কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,

“পারবো। আপনার জন্য সব করতে পারবো। আপনি যা বলেছেন তাই হবে। আর নাচবো না আমি।”

“বাড়িতে গিয়ে কী বলবেন?”

“যেটা সত্যি সেটাই। আর তারামা আমার কথা ঠিকই রাখবেন। তার মুখের ওপরে কিছু বলার কারও সাহস হবে না। আপনি এটা নিয়ে ভাববেন না।”

মোহিনী গালে একহাতে আলতোভাবে স্পর্শ করলেন অর্ণব।
.
.
.
রান্নাঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন শেফালী। গায়ে ঝলমলে রঙ্গিন শাড়ি। গা ভরা গয়না। চেহারায় হালকা প্রসাধনীর ছাপ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে নতুন বউ। তাকে দেখেই অনুরাধা রান্নাঘরের কাজ ফেলে উঠে যাচ্ছিলেন। শেফালী তার পথ আঁটকে বললেন,

“আপনার আমাকে নিয়ে এখনো এতো কিসের সমস্যা মা? আমি আপনারই ছেলের বউ।”

“এই মেয়ে, খবরদার। একদম মা ডাকবে না আমাকে।”

“শাশুড়ীকে মা ডাকবো না তো কী ডাকবো? শাশুড়ী, ও শাশুড়ী?”

“তুমি আসলেই নির্লজ্জ একটা মেয়ে।”

অনুরাধা চলে যাওয়ার চেষ্টা করতেই শেফালী তার বাহুতে ধরে ঝাঁকিয়ে আবার নিজের সামনে দাঁড় করালেন।

“এই মেয়ে, হচ্ছেটা কী? ছাড়ো আমাকে।”

“কোথায় যাচ্ছেন? দাঁড়ান এখানে। চুপচাপ দাঁড়ান বলছি। আমার কথা এখনো শেষ হয়নি।”

অনুরাধা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। শেফালী তাকে ছেড়ে দিয়ে চোখ রাঙিয়ে বললেন,

“আপনার কী মনে হয়? আপনার ছেলের প্রেমে পাগল হয়ে আমি এবাড়িতে এসেছি?”

“নাহ। একদম না। তুমি তো এসেছো লোভে পড়ে। এতো বড় বাড়ির বউ হওয়ার লোভ সামলাতে পারোনি। তাই আমার ছেলেটাকে ফাঁসিয়ে উঠে এসেছো এবাড়িতে। তোমাকে আমি চিনি না ভেবেছো?”

শেফালী সামান্য হেসে বললেন,

“আপনি আসলেই আমাকে চেনেন না মা। আমি এখানে প্রেমের টানেও আসিনি আর লোভে পড়েও আসিনি। এসেছি আপনাদের জীবন দূর্বিষহ করে তুলতে। আপনার আর আপনার ছেলের জন্য আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি। এখনো ভালোবাসা থাকবে ভেবেছেন? দেখুন না, আপনাদের মা, ছেলের জীবনটা কীভাবে বিষিয়ে দিই আমি। আর আপনি কিচ্ছু করতে পারবেন না।”

“তোমার চাওয়া কোনোদিনও পূরণ হবে না। আমি হতে দেব না। আজ রাতে অভ্র কলকাতায় ফিরছে। ওর সাথে জানো আর কে যাচ্ছে? শমিত। যাও, ঘরে গিয়ে নিজের স্বামীর ব্যাগ গোছাও। আর দেখেও এসো ভালো করে। আবার কবে দেখতে পারবে তার তো ঠিক নেই। হয়তো আর দেখতেই পারবে না। কারণ দেখার জন্য তুমি নাও থাকতে পারো।”

“এসব হুমকি অন্য কাউকে দেবেন। আমাকে না। আমাকে এসব বলে আঁটকানো যাবে না।”

কথাটা বলেই শেফালী চলে গেলেন। অনুরাধা বড় বড় চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। ঘরে এসেই দেখলেন মোহিনী আগে থেকেই তার ঘরে এসে বসে আছেন।

“কিরে? তুই কখন এলি?”

“কিছুক্ষণ আগে। তুই ছিলি না। কোথায় গিয়েছিলি?”

শেফালী একটা ব্যাগ আর শমিতের জামাকাপড় বের করলেন। মোহিনীর সামনে বসে সেগুলো ভাজ করে ব্যাগে ভরতে ভরতে বললেন,

“রান্নাঘরে। মায়ের সাথে কথা বললাম।”

“মা?”

“আমার শাশুড়ী।”

“আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তুই বিয়েটা করেছিস। যাদের জন্য নিজের বাবাকে হারালি, তাদেরই আপন করে নিলি।”

“বিশ্বাস না করে তো উপায় নেই। বিয়ে তো করেছিই। কিন্তু কেন করেছি? কী মনে হয় তোর?”

“সে তোর নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য আছে। এতোটুকু তো তোকে আমি চিনিই।”

“ঠিক বলেছিস। একটু আগে মাকেও সেই কথাই বললাম।”

“কী বললি?”

“বলেছি আপনাদের মা ছেলের জীবন বিষিয়ে দিতে এসেছি।”

মোহিনী উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,

“তারপর?”

“তারপর আর কী? আমাকে এটা ওটা কথা শোনালেন। হুমকি-ধমকি দিলেন। আর সবথেকে বড় কথা কী জানিস?”

“কী?”

“শমিতকে মামার সাথে কলকাতায় পাঠিয়ে দিচ্ছেন আজ। এজন্যই তো ওর কাপড়চোপড় গোছাচ্ছি। উনি ভেবেছেন এতে আমার কিছু যায় আসে। কিন্তু জানিস, শমিতকে আমি যেমন ঘৃণা করি তেমন ভালোওবাসি। যতই হোক, পুরোনো স্মৃতি তো আর ভোলা যায় না। এজন্য অর্ণবদার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। তুই অনেক ভাগ্য করে অর্ণবদার মতো একজনকে পেয়েছিসরে। যে কাপুরুষের মতো তোকে কখনো ছেড়ে যাবে না। দুঃসময়ে শমিতের মতো পিছিয়ে যাবে না।”

মোহিনী ফ্যালফ্যাল করে শেফালীর দিকে তাকিয়ে আছেন।

“কিরে? ওভাবে কী দেখছিস? ওহ, বুঝেছি। ভাবছিস আমি কী করে জানলাম?”

মোহিনী হ্যাঁবোধক মাথা নাড়লেন।

“শমিত আমার কাছে কিচ্ছু লুকোয় না। ও-ই বলেছিল।”

“কে জানে আর কে কে জেনে গেছে। আমি তো এখনো পদ্মাকেও কিছু বলিনি। কিন্তু দেখ, ওর আগে তুই ঠিকই জেনে গেছিস।”

“পদ্মা এতোটাও বোকা না যে না বললে বুঝবে না। আমার তো মনে হয় ও জানে। শুধু ও কেন? এপাড়ার সবাই জানে। প্রায়ই তো অনেকেই দেখেছে তোদের একসাথে। কানাঘুঁষাও শুনেছি আমি। এবাড়ির মানুষ জানতেও দেরি নেই বোধহয়।”

“জানলে জানবে। বেশিদিন লুকিয়ে রাখা তো সম্ভব নয়।”

“সাবধানে। এখানে তো সবাই মুখোশ পরে থাকে মনে হয়। বাইরে এক আর ভেতরে আরেক।”

“এমন বললি কেন?”

“তেমন কিছু না। সময় হলেই বুঝবি।”

চলবে…

মেহেরজান পর্ব-২৮+২৯

0

#মেহেরজান
#পর্ব-২৮
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

“এটা কী জিনিস?”

হাতের জিনিসটা উল্টেপাল্টে দেখে অর্ণবের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন মোহিনী।

“মুঠোফোন। কলকাতায় নতুন এসেছে। তাই আনিয়েছি আপনার জন্য।”

“মুঠোফোন! সেটা আবার কী জিনিস?”

“দূরাভাষ যন্ত্র।”

“মানে?”

“এটা দিয়ে আপনি যেকোনো জায়গায় যোগাযোগ করতে পারবেন। আপনি যত দূরেই থাকুন না কেন, চাইলেই এটার সাহায্যে কথা বলতে পারবেন আমার সাথে।”

“আপনাদের বাড়িতে যে আছে টেলিফোন। ওটার মতো?”

“কিছুটা।”

“যেকোনো জায়গায় যোগাযোগ করতে পারবো?”

“হ্যাঁ। তবে অপরজনের কাছেও এটা থাকতে হবে।”

“যাহ। তা কী করে সম্ভব? এটায় তো তারই নেই।”

“এটায় তারের প্রয়োজন পড়ে না। বেতার।”

“কীভাবে? এ আবার হয় নাকি?”

অর্ণব নিজের কাছে থাকা আরেকটা মুঠোফোন দিয়ে মোহিনীর হাতে থাকাটায় কল করতেই সেটা বেজে উঠলো। অর্ণব ইশারা করে মোহিনীকে কলটা ধরতে বললেন। সবুজ বোতামটা চেপে কানে ধরতেই অর্ণব বললেন,

“কী? এবার বিশ্বাস হলো তো?”

মোহিনী অর্ণবের দিকে তাকিয়ে দু’বার ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকালেন।
.
.
.
বাড়ি ফিরতেই একটা শোরগোল কানে এলো অর্ণবের। বাড়ির সবাই উপস্থিত সেখানে। কেউ বাদ নেই। অতিরিক্ত আরও তিন-চারজনকে দেখলেন। তাদের মধ্যে একজন শেফালী। বউয়ের সাজে এককোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে কাঁদছে মেয়েটা। অর্ণব সেখানে দাঁড়িয়েই ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলেন যে কী হয়েছে। একজন ভদ্রলোক হাত জোর করে অনুরাধার কাছে আকুতি করছেন। কথা শুনে বোঝা যাচ্ছে উনি শেফালীর বাবা।

“দয়া করুন। গ্রামে আমাদেরও একটা মান সম্মান আছে। আমাদের বিষয়টা একটু বোঝার চেষ্টা করুন।”

অনুরাধা চড়া গলায় বললেন,

“মান সম্মান? কিসের মান সম্মানের কথা বলছেন? আপনার ছোট মেয়ে কেন মরেছে তা বুঝি কেউ জানে না ভেবেছেন? এরপরও মান সম্মানের কথা বলছেন?”

“আমার মেয়ে যে লগ্নভ্রষ্টা হয়ে যাবে। পরে কে বিয়ে করবে ওকে?”

“সেটা তো আমাদের দেখার বিষয় না। আপনার উচিত ছিল নিজের মেয়েকে ধরে রাখা। আপনি পারেননি সেটা আপনার ব্যর্থতা।”

পাশে থেকে আরেকজন লোক উচ্চস্বরে বলে উঠলেন,

“দেখুন, আপনার ছেলের জন্য আমার ভাইঝির বিয়ে ভেঙেছে। ও রাস্তায় বরের গাড়ি থামিয়ে হুমকি-ধমকি দিয়ে তাদের ফেরত পাঠিয়েছে। তা নাহলে ঠিক হয়ে যাওয়া বিয়ে কেন ভাঙতে যাবে? আপনি যদি শমিতের সাথে শেফালীর বিয়ে না দেন তবে কিন্তু আমরা পুলিশের সাহায্য নিতে বাধ্য হব। পুরো গ্রাম জানে আপনার ছেলে আমাদের মেয়ের পেছনে ঘোরে।”

“হুমকি দিচ্ছেন আমাকে আপনি? হুমকি দিচ্ছেন? যা পারেন করেন। আমি আমার ছেলেকে এমন পরিবারের এমন একটা মেয়ের সাথে কখনোই বিয়ে দেব না। আমার ছেলেকে আমি নিজের পছন্দ মতো বিয়ে করাবো। আপনারা বের হন বাড়ি থেকে। নাহলে দারোয়ান ডেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করাবো।”

শেফালী অনর্গল কেঁদেই চলেছেন। অনুরাধা তার সামনে গিয়ে বললেন,

“এই মেয়ে, লজ্জা বলতে কিছু নেই তোমার? আমার ছেলেকে ফাঁসিয়ে ওর ঘাড়ে চেপে বসতে চাইছো? লজ্জা করে না? নির্লজ্জ বেহায়া মেয়ে কোথাকার।”

শেফালী আরও জোরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। শেফালীর বাবা তার হাত ধরে বললেন,

“চল এখান থেকে।”

“বাবা।”

স্ব জোরে শেফালীর গালে চড় বসিয়ে দিলেন তিনি। এরপর টানতে টানতে তাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। মেয়েটা করুণ চোখে একদৃষ্টিতে শুধু শমিতের দিকেই চেয়ে রইলো। অর্ণব শমিতকে দেখে বেশ অবাক হলেন। এতোকিছু হয়ে গেল, তার মা তার প্রেমিকা আর প্রেমিকার পরিবারকে এতোকিছু বললেন, অপমান করলেন অথচ তিনি একবারও এর প্রতিবাদ করলেন না। অনুরাধার রাগ দেখে আজ কেউ আর তাকে থামায়নি। চাইলেও পারতো না। অর্ণব নিজেও তো শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেই গেলেন। আচ্ছা, এমনটা যদি মোহিনীর সাথে হতো তাহলে তিনি কি পারতেন চুপ থাকতে? একদমই না। অবশ্যই এসবের প্রতিবাদ করতেন। সবাই চলে গেলে অর্ণব শমিতকে তার ঘরে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

“তুই সত্যিই শেফালীর বিয়ে ভেঙেছিস?”

“হ্যাঁ।”

“কেন?”

“ভালোবাসি ওকে। কী করে বিয়ে হয়ে যেতে দিতাম?”

“সত্যিই ভালোবাসিস? তাহলে নিচে কিছু বললি না কেন? পিসির কথার প্রতিবাদ করলি না কেন?”

“বিশ্বব্রহ্মাণ্ড উল্টে গেলেও মায়ের মুখের ওপর কথা বলার, তার অবাধ্য হওয়ার, বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস আমার নেই।”

“কেন?”

“তার প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর ভয়।”

“নিজের মাকে ভালোবাসিস আর ওই মেয়েটার সাথে শুধু ভালোবাসার নাটক করে গেছিস এতোদিন?”

“এমনটা নয় অর্ণব। তুই আমার পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা কর। আমার জায়গায় যদি তুই থাকতিস, মা আর শেফালীর জায়গায় যদি বড় মামি আর মোহিনী থাকতো তাহলে তুই পারতিস বড়মার বিরুদ্ধে যেতে?”

অর্ণব কিছু সময় চুপ রইলেন। এরপর বললেন,

“অবশ্যই পারতাম। মা যদি ভুল করতেন তাহলে আমি অবশ্যই তার প্রতিবাদ করতাম।”

“বলা সহজ অর্ণব। করা নয়। মায়ের আমি ছাড়া কেউ নেই। আমি তাকে কষ্ট দিতে পারবো না।”

“তাহলে তুই এখন কী করবি?”

“জানি না। যাই করি, তার অবাধ্য হয়ে তাকে কষ্ট দেওয়া সম্ভব নয়। তুই আমাকে এ নিয়ে এখন আর কিছু বলিস না। আমার মাথা ঠিক নেই। পরে কথা বলবো।”

শমিত চলে গেলেন। পুরো বাড়িটায় একটা নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। ধীরে ধীরে আবার সব স্বাভাবিক হয়ে গেল। যেন কিছুই হয়নি। কিন্তু এসবের মাঝে নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে অস্থির হয়ে উঠেছেন চিত্রা। প্রচন্ড ঘামছেন তিনি। একটা ভয় তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। হাত দিয়ে নিজের পেট চেপে ধরে বসে পড়লেন তিনি।
.
.
.
“তুমি কথা দিয়েছিলে শ্যামল। তুমি বলেছিলে তুমি আমাকে বিয়ে করবে। যে করেই হোক মা-বাবাকে বোঝাবে। তাহলে এখনো আসছো না কেন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে?”

“তোর কী মনে হয়? আমি এখনো তোকে বিয়ে করবো? তোর ভাইয়ের জন্য আমার বোনের জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে। এরপরও ভাবলি কী করে যে আমি তোকে বিয়ে করবো?”

“তুমি এভাবে কথা বলছো কেন আমার সাথে?”

“তো কীভাবে কথা বলবো? তোকে আমি বিয়ে করবো না। বুঝেছিস?”

“করবে না মানে? তাহলে আমার সাথে সম্পর্ক করলে কেন? তোমার বাচ্চা আছে আমার পেটে। বিয়ে না করলে সবাইকে বলে দেব।”

এতোক্ষণ কেঁদে কেঁদে করুণ স্বরে কথা বললেও এবার চিত্রা শাসিয়ে উঠলেন। তার কথায় কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন শ্যামল।

“বাচ্চা মানে? কার বাচ্চা? আমি কিছু জানি না। এর দায় আমি নিতে পারবো না।”

চিত্রা দু’হাতে শ্যামলের পোশাকের কলার টেনে ধরলেন।

“কুত্তারবাচ্চা। নিবি না মানে? আমার জীবন নষ্ট করে তুই বেঁচে যাবি ভেবেছিস? ভুলে গেছিস আমি কোন বাড়ির মেয়ে? আমি মুখ খুললে সবাই একদম পিষে ফেলবে তোকে।”

নিজেকে ছাড়িয়ে নিলেন শ্যামল।

“যাকে যা খুশি বল। প্রমাণ করবি কী করে এটা আমার বাচ্চা? আর করলেও লোকে তোকে দোষ দেবে। তুই হবি সবার চোখে দুশ্চরিত্রা।”

নিজের কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বসে পড়লেন চিত্রা।

“ভুল তো আমি করেছি। তোর মতো একটা কাপুরষকে ভালোবেসেছিলাম। দাদার কথা শুনে যদি তোর থেকে দূরে থাকতাম তো আজ আমার এই সর্বনাশ হতো না। হায় ভগবান! এ কী করলাম আমি? সমাজে মুখ দেখাবো কী করে?”

হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন চিত্রা। অবস্থা বেগতিক দেখে শ্যামল দৌঁড় লাগালেন। পেছন থেকে চিত্রা চোর চোর বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। দেওয়াল টপকাতে যাবেন ঠিক এমন সময় কেউ শ্যামলের পা টেনে ধরলেন। চিত্রা দূর থেকে দেখলেন রামু শ্যামলকে ধরে ফেলেছেন। চৌকিদারও দৌঁড়ে আসছে। তাকে কেউ দেখে ফেলার আগেই অন্ধকারে সেখান থেকে পালিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে কয়েকজনের ভীড় হয়ে গেলে। সবার হাতেই লাঠি। যে যেমন পারছে ইচ্ছেমতো পেটাচ্ছে শ্যামলকে। ঘরে ফিরে ভালো করে দরজা বন্ধ করে দিলেন চিত্রা। থরথর করে কাঁপছেন তিনি। টেবিলের ওপর থেকে কাগজ কলম নিয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তার হাত কাঁপছে বিধায় ঠিকমতো লিখতেও পারছেন না। ভাঙা ভাঙা কয়েকটা শব্দে লেখা শেষ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি।
.
.
প্রতিদিনের মতো একটা নতুন সূর্যের উদয় হলো। একটা নতুন দিন। কিন্তু এই দিনটাই পুরো বাড়িতে কালো মেঘের ছায়ার মতো ঘনিয়ে এলো। কারও চিৎকার কানে আসছে অর্ণবের। চোখ খুললেন তিনি। আড়মোড়া ভেঙে উঠে এসে ঘর থেকে বের হতেই চিৎকারটা আরও স্পষ্ট শুনতে পেলেন। শকুন্তলা ডাকছেন চিত্রাকে। চিত্রার ঘরের দরজার সামনে কয়েকজনের ভীড় হয়ে গেছে। তার চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আম্রপালি আর নিচ থেকে অনুরাধাও চলে এলেন। অর্ণব এগিয়ে গেলেন সেখানে।

“কী সমস্যা এখানে?”

“পদ্মাকে পাঠিয়েছিলাম চিত্রাকে ডাকতে। দরজা খোলেনি। এখন আমি এসে সেই কখন থেকে ডাকছি তাও দরজা খুলছে না।”

শকুন্তলা আরও কয়েকবার দরজায় ধাক্কা দিলেন। অর্ণব বললেন,

“আপনি একটু সরুন। আমি দেখছি।”

শকুন্তলা সরে গেলে অর্ণব দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে চিত্রাকে ডাকলেন কয়েকবার। কিন্তু কাজ না হওয়ায় দরজা ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলেন। দরজায় জোরে একটা লাথি দিলেন। কিন্তু কিছুই হলো না। আবারও দিলেন। এবারও ভাঙলো না। এবার আরেকটু জোরে লাথি দিতেই দরজাটা খুলে গেল। মেঝেতে চিত্রার নিথর দেহটা পড়ে আছে। মুখ দিয়ে সাদা ফেনার মতো কী যেন পড়ে দাগ হয়ে আছে। হাতের কিছুটা দূরেই বিষের শিশিটা। শকুন্তলা ভেতরে ঢুকেই আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে ধপ করে নিচে বসে পড়লেন। এক মুহূর্তেই চারদিক একদম নীরব হয়ে গেল। পদ্মাবতী দৌঁড়ে চিত্রার কাছে গিয়ে ওকে ডাকতে লাগলেন। সবার আগে ওর কান্নার শব্দটাই কানে ভেসে এলো সকলের। চিত্রার বা’হাতে একটা ভাজ করা কাগজ দেখতে পেলেন অর্ণব। তার হাত থেকে নিয়ে খুলে পড়তে শুরু করলেন। এমন সময় শকুন্তলা চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন।

চলবে…

#মেহেরজান
#পর্ব-২৯
লেখাঃ সাদিয়া আফরিন

“মরা ছাড়া আমার সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না। অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি যে আমি। জানি আমার মৃত্যুতে সবাই অনেক কষ্ট পাবে। মা কাঁদবে অনেক। কিন্তু বেঁচে থাকলে হয়তো তিনিই আফসোস করতেন এমন মেয়ে জন্ম দেওয়ার জন্য। দাদা আমাকে সাবধান করেছিল। কিন্তু আমি তার কথায় কান না দিয়ে নিজের সর্বনাশ নিজেই করেছি। একবার যদি শুনতাম দাদার কথাগুলো তাহলে আজ আমাকে এভাবে বিষ খেয়ে মরতে হতো না। তবুও একটা আশা ছিল। হয়তো বেঁচে থাকতাম। কিন্তু আজ পিসি যখন শেফালী আর ওর পরিবারকে অপমান করে বের করে দিল, সে আশাটাও সেখানেই ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। শ্যামল শুধু একটা অজুহাত খুঁজছিল আমাকে ছাড়ার। আর সেটা পেয়েও গেল। আমি যে ভুল করেছি তা যেন আর কেউ না করে।”

চিঠিটা পড়ে পাশে রাখলেন শমিত। অনেকদিন পর ছাদে দুই ভাই মদ আর সিগার নিয়ে বসেছেন। অর্ণবের দিকে হাত বাড়াতেই অর্ণব মদের বোতলটা এগিয়ে দিলেন তার দিকে। বোতলে যতটুকু বাকি ছিল শমিত পুরোটা ঢকঢক করে খেয়ে ফেললেন। আজ প্রথমবারে মতো মদে হাত লাগিয়েছেন শমিত। পাঞ্জাবির হাতায় দু-চোখ মুছে নিয়ে বললেন,

“কাল রাতে শেফালীর বাবাও মারা গেছেন। ফাঁসি দিয়ে। আর আমাদের বোনটা…।”

কথা সম্পূর্ণ করলেন না শমিত। অর্ণবও কোনো জবাব দিলেন না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে শমিত আবার বললেন,

“কিছু সময়ের ব্যবধানে দুটো পরিবারের দু’জন মারা গেল। এর জন্য আমিই দায়ী। তাই না রে অর্ণব?”

অর্ণব এবারও চুপ রইলেন।

“দোষ করলাম আমি আর শাস্তি পাচ্ছে অন্যরা। মা ভুল ছিলেন। তবুও আমি চুপ রইলাম। আমি এভাবে চুপ করে না থাকলে আজ হয়তো তারা দু’জনেই বেঁচে থাকতো।”

চিত্রার চিঠিটা ছিড়ে ফেলে দিয়ে অর্ণব বললেন,

“তুই নিজের ভুল বুঝতে অনেক দেরি করে ফেলেছিস। এখন আর কিছুই করার নেই।”

আবারও কিছু সময় দু’জনেই চুপ রইলেন। এরপর শমিত বললেন,

“শেফালীর বাবা আর চিত্রাকে তো ফেরাতে পারবো না কিন্তু…।”

“কিন্তু?”

“আমি নিজের ভুলটা শোধরাতে চাই অর্ণব। তুই আমার সাথে থাকবি তো?”

“কাল সকালে দেখা যাবে। আজ বাড়ির কারও মন ভালো নেই। তুই ঘুমাতে যা।”

“উঁহু। যা করার আজই করবো।”

অর্ণব কিছুসময় শমিতের দিকে চেয়ে রইলেন। এরপর কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা একটা বাড়ির উঠোনে উপস্থিত হলেন। তিনদিকে তিনটা বড় বড় টিনের ঘর। আর অন্যদিকে ছোট্ট একটা রান্নাঘর। মাঝখানে বেশ বড় একটা উঠোন। বাড়ির ভেতর থেকে শেফালীর মা আর তার পেছন পেছন শেফালীও বের হয়ে এলেন। শমিত হাত জোর করে তাদের সামনে দাঁড়ালেন।
.
.
.
শমিতের হাত আঁকড়ে ধরে তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন শেফালী। অনুরাধা রক্তবর্ণ চোখ নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে অর্ণবের উদ্দেশ্যে বললেন,

“এসব হচ্ছেটা কী অর্ণব?”

অর্ণব চেয়ারে আয়েসি ভংগিমায় বসে বললেন,

“দেখতেই তো পারছেন পিসি। বিয়ে করেছে ওরা।”

“বিয়ে করেছে বললেই হলো? আমি মানি না এই বিয়ে।”

“এখন আর আপনার মানা না মানায় কিছু যায় আসে না। এর চেয়ে ভালো আপনি বরং ওদের মেনেই নিন।”

সাবিত্রী সেখানে দাঁড়িয়েই সব শুনছেন। চিত্রার মৃত্যুর খবর পেয়ে কাল যতদ্রুত সম্ভব ছুটে এসেছেন এখানে। অর্ণবের উদ্দেশ্যে বললেন,

“কাল তোমার বোনটা মারা গেল। আর আজই তুমি এমন একটা কাজ করলে? তোমাকে দিয়ে এটা আশা করিনি।”

“ক্ষমা করবেন কিন্তু আপনার এই বিষয়ে কিছু না বলাই ভালো।”

সাবিত্রী চুপ হয়ে গেলেন। আম্রপালি বলে উঠলেন,

“অর্ণব, কীভাবে কথা বলছিস তুই?”

“আমি দুঃখিত মা। তবে আপনিও দয়া করে এব্যাপারে জড়াবেন না। আমি পিসির সাথে আলাদাভাবে কথা বলতে চাই। শুধু শমিত আর শেফালী থাকবে এখানে।”

অর্ণবের কথা শুনে আম্রপালি আর সাবিত্রী বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। কিন্তু কোণায় পদ্মাবতী আগের মতোই দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তার উদ্দেশ্যে অর্ণব বললেন,

“তোমাকে কি আলাদা করে বলতে হবে?”

পদ্মাবতী নাবোধক মাথা নাড়লেন।

“তাহলে?”

অর্ণব প্রশ্ন করা মাত্রই পদ্মাবতী দৌঁড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। উঠে দাঁড়ালেন অর্ণব। বললেন,

“জানেন পিসি, এ বাড়ি থেকে চিত্রার লাশ ওঠার আগে শেফালীদের বাড়ির একজনের লাশ উঠেছিল। কে জানেন? শেফালীর বাবা। যাকে আপনি যা-তা বলে অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। অথচ দোষটা কিন্তু আপনার ছেলেরই ছিল। আর যে দু’জন মারা গেল, তাদের মৃত্যুর জন্য কে দায়ী জানেন? আপনি।”

“আমি কীভাবে? চিত্রা কেন মরেছে সেটা আমি কীভাবে জানবো?”

“সেটা আমি এখন আপনাকে বোঝাতে পারবো। আসলে জানাতেই চাই না। কিন্তু শেফালীর বাবার মৃত্যুর জন্য আপনিই দায়ী এটা কি মানেন?”

অনুরাধা জবাব দিলেন না। অর্ণব আবার বললেন,

“না মানলেও কিছু করার নেই। এতে সত্য বদলাবে না। এবার বলুন, দু’জনের মৃত্যুর বোঝা মাথায় নিয়ে বাঁচতে পারবেন শান্তিতে?”

পাশে থেকে শমিত তাকে ডেকে উঠলে হাতের ইশারায় শমিতকে থামিয়ে দিলেন তিনি। অনুরাধার উদ্দেশ্যে আবার বললেন,

“পারবেন না পিসি। তাই ওদের বিয়েটা নিয়ে আর অশান্তি বাড়াবেন না। আর মেয়েটাকেও এবাড়িতে শান্তিতে বাঁচতে দিন।”

অনুরাধা শমিতের উদ্দেশ্যে বললেন,

“কিরে? কিছু বলবি না তুই? ও আমাকে এসব মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছে আর তুই চুপ করে আছিস?”

“অর্ণব কিছু ভুল বলছে না মা। আর আমিও কোনো ভুল করিনি। তাই আমাদের বিয়েটা আপনার মেনে নেওয়াই ঠিক হবে।”

অনুরাধা হতভম্ব হয়ে শমিতের দিকে তাকিয়ে রইলেন। পেছনে শেফালীর অশ্রুসিক্ত চোখ দুটো কেমন যেন চকচক করে উঠেছে। ঠোঁটে বাঁকা হাসি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। এরপর অর্ণবের দিকে তাকালেন। তার শান্ত চেহারার ঠোঁটে হাসির স্মিত রেখা ফুটে উঠছে। অনুধারার চোখ জলে ভরে গেল। আবার শমিতের দিকে ঘুরে বললেন,

“এইদিন দেখার জন্য তোকে পেটে ধরেছিলাম আমি? আমার ভালোবাসার এই প্রতিদান দিলি তুই?”

শমিত কিছু বলতে যাবেন তার আগেই অনুরাধা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। শমিত তাকে আঁটকাতে যাবেন তখনই অর্ণব থামিয়ে দিলেন তাকে।

“দাঁড়া।”

“কিন্তু মা?”

“পিসি নিজেই শান্ত হয়ে যাবেন। তুই চিন্তা করিস না।”
.
.
.
“অর্ণব এটা কেমন কাজ করলো আম্রপালি? চিত্রাটা মারা গেল দু’দিনও হলো না আর ও শমিতকে নিয়ে এমন একটা কাজ করলো। তুমি আগে থেকেই জানতে এসব। তাই না?”

“বিশ্বাস করুন মাসিমা। আমি এসবের কিচ্ছু জানতাম না। অর্ণবের মধ্যে আজ যে পরিবর্তনটা দেখলাম তা আগে কখনো দেখিনি।”

“কাল সারারাত ছেলে দু’টো বাড়িতে ছিল না। মন মেজাজ ভালো নেই বলে সেদিকে তেমন একটা খেয়াল ছিল না কারও। কিন্তু ওরা যে এমন একটা কাজ করে বসবে তা ঘুণাক্ষরেও কেউ টের পায়নি।”

কথা বলতে বলতে দু’জনে শকুন্তলার ঘরে ঢুকলেন। খাটের ওপর উল্টো দিকে ঘুরে শুয়ে রয়েছেন শকুন্তলা। একদম ভেঙে পড়েছেন তিনি। একদিনেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। পদ্মাবতী আগে থেকেই সেখানে ছিলেন। শকুন্তলাকে উঠিয়ে ওষুধ খাইয়ে দিলেন। সাবিত্রী তার পাশে বসে আম্রপালি আর পদ্মাবতীর উদ্দেশ্যে বললেন,

“তোমরা কাল থেকে ওর সাথেই আছো। এখন নিজেদের ঘরে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে নাও। তাছাড়াও তোমাদের অন্যান্য কাজও আছে। আমি আছি শকুন্তলার সাথে। তোমরা যাও।”

“কিছু লাগলে আমাদের জানাবেন মাসিমা।”

“ঠিকাছে।”

আম্রপালি আর পদ্মাবতী চলে গেলে শকুন্তলা বললেন,

“বাড়িতে তখন কিসের চেঁচামেচি হলো মা?”

“শমিত বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছে।”

শকুন্তলা তাচ্ছিল্যের সুরে হেসে বললেন,

“এদিকে আমার মেয়ে মরলো আর ওদিকে ওরা বিয়ে করছে।”

“আরে ওই অর্ণব করিয়েছে ওদের বিয়ে।”

“অর্ণব?!”

“হ্যাঁ।

“অভ্র আসেনি মা?”

“এখনো তো না।”

“আসবেও না দেখে নিও তুমি। ও কখনো চিত্রাকে নিজের মেয়ে ভেবেছে নাকি? জন্মের সময়ও আসেনি আর এখন মরেছে তবুও আসবে না।”

“আহ। এমন কথা বলছিস কেন? যতই হোক চিত্রা ওর মেয়ে। তখন না হয় সেই বিলেতে ছিল বলে আর আসতে পারেনি। তাই বলে কি এখনো আসবে না?”

“কী করবে ও এসে? চিত্রা কি এখনো আছে নাকি? সারাজীবন যে নিজের মেয়েকে একবার ভালোবেসে বুকে জড়িয়ে নেয়নি, এখন সে মেয়ে মরার পর কী দেখতে আসবে? তুমি খুঁজে খুঁজে আমাকে এমন একটা লোকের সাথে বিয়ে দিলে যার কাছে নিজের স্ত্রী আর মেয়ের কোনো মূল্যই নেই।”

“এসবে তোর তো কোনো দোষ নেইরে মা। অভ্র ছেলে চেয়েছিল। হয়েছিলোও তো। কিন্তু মরা বাচ্চা হলে সেখানে তোর কী দোষ? দেখিস, ও ঠিক একদিন তোর কষ্টটাও বুঝবে।”

“ওর আর ওর সহানুভূতির কোনো প্রয়োজন আমার নেই। আমার যা ছিল সব চিত্রাই ছিল। আর সেও নেই এখন। সব শেষ হয়ে গেল। দোষ তো আমার মেয়েটারও ছিল না মা। ও কেন মরলো?”

সাবিত্রীর গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন শকুন্তলা। নিজের ভেজা চোখ দুটো মুছে তার মাথায় হাত রাখলেন সাবিত্রী। কী একটা বলতে গিয়েও কেন যেন বললেন না। হঠাৎ-ই বাইরে থেকে অভ্র বাবুর কণ্ঠ ভেসে এলো।

চলবে…