স্নেহা অনুপমকে সাথে নিয়ে চলে আসে প্রজ্ঞার দেওয়া ঠিকানাতে৷ এখানে এসে তারা প্রজ্ঞার কোন খোঁজ পায় না৷ স্নেহা ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সে উদ্বিগ্ন গলায় অনুপমকে বলে,
“প্রজ্ঞার কোন বড় বিপদ হয়ে গেল না তো? আমার কিন্তু খুব ভয় করছে।”
স্নেহা ও অনুপম প্রজ্ঞার খোঁজ অব্যাহত রাখে। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই তারা দুজনে রাস্তায় প্রজ্ঞাকে পড়ে থাকতে দেখে৷ প্রজ্ঞাকে একদম নিস্তেজ লাগছিল। তার সারা শরীরে ক্ষতচিহ্ন। প্রজ্ঞাকেই দেখেই স্নেহা বুঝতে পারে যা অঘটন ঘটার ইতিমধ্যে ঘটে গেছে। তাই স্নেহা প্রজ্ঞার পাশে বসে কাঁদতে শুরু করে। তার চোখ দিয়ে অনবরত অশ্রু পড়তে থাকে। সে প্রজ্ঞাকে ডাকতে থাকে কিন্তু প্রজ্ঞা কোন সাড়া দেয় না। স্নেহা অনুপমকে বলে,
“অনুপম চলো আমরা ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাই।”
“পাগল নাকি তুমি? আমি যেতে পারব না।”
“কেন পারবে না অনুপম? দেখছ না প্রজ্ঞার কি অবস্থা?”
“এজন্যই তো বলছি। ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওকে হয়তো রে*প করা হয়েছে। এখন আমি যদি ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাই পুলিশ তো আমাকেই সাহায্য করবে। তাই আমি যেতে পারবো না। তুমি অন্য কারো সাহায্য নাও।”
“কিন্তু এই মুহুর্তে কে সাহায্য করবে আমায়?”
হঠাৎ করেই স্নেহার মনে পড়ে যায় নিপুণের কথা। তাই সে নিজের ফোন করে এবং নিপুণকে ফোন দেয়। নিপুণ ফোন রিসিভ করলে সে বলে,
“আপু আমি অনেক বড় একটা বিপদে পড়েছি আপনার সাহায্য প্রয়োজন। দয়া করে পদ্মাঘাট এলাকায় চলে আসুন।”
“ঠিক আছে। তুমি ওখানেই থাকো আমি যাচ্ছি।”
এটুকু বলেই নিপুণ ফোনটা রেখে দেয়। স্নেহা ফোনটা রেখে দিয়ে অনুপমকে বলে,
“আমি নিপুণ আপুকে ফোন সাহায্য চেয়েছি। উনি আসছেন।”
“ঠিক আছে। তাহলে তুমি এখানে থাকো আমি আসছি।”
“তুমি আমাকে এভাবে বিপদে একা রেখে চলে যাবে অনুপম?”
“আমি কোথাও যাচ্ছি না। আমি আশেপাশেই আছি তোমার উপর নজর রাখব। তুমি ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করো স্নেহা। এই মুহুর্তে হঠাৎ কেউ চলে আসলে আমাকেই সন্দেহ করবে।”
স্নেহা আর কিছু বলে না। অনুপম বিদায় নেয়।
★★★
নিপুণের সহায়তায় প্রজ্ঞাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে স্নেহা। প্রজ্ঞার চিকিৎসা শুরু হয়ে গেছে। নিজের বান্ধবীর এহেন অবস্থায় ভীষণ ভেঙে পড়েছে স্নেহা। সে সমানে কেঁদে চলেছে। নিপুণ স্নেহাকে সামলাচ্ছে।
কিছু সময়ের মধ্যে একজন নার্স এসে বলেন,
“পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে। উনি অনেকটাই ভেঙে পড়েছেন। ওনাকে কিছুতেই সামলানো যাচ্ছে না।”
স্নেহা বলে,
“আমি কি ওর সাথে দেখা করতে পারি?”
“হ্যাঁ, অবশ্যই।”
স্নেহা ও নিপুণ দুজনেই প্রজ্ঞার সাথে দেখা করতে তার কেবিনে প্রবেশ করে। সেখানে প্রবেশ করতেই তারা দেখতে পায় প্রজ্ঞা কিরকম পাগলামী করছে। সে সমানে বলে চলেছে,
“ওরা আমার সর্বনাশ করে দিয়েছে…আমি সমাজে মুখ দেখাবো কি করে…আমি আর বাঁচতে চাই না। প্লিজ ডাক্তার আমাকে মে*রে ফেলুন।”
প্রজ্ঞাকে এরকম করতে দেখে স্নেহার ভীষণ খারাপ লাগে। সে নিজেকেই দোষ দিতে থাকে। সে সঠিক সময় পৌঁছে গেলে হয়তো আজ প্রজ্ঞার সাথে এরকম হতো না। স্নেহা প্রজ্ঞার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে,
“নিজেকে সামলা প্রজ্ঞা। তোর এখন এত ভেঙে পড়লে চলবে না।”
প্রজ্ঞা স্নেহাকে দেখে আরো বেশি ভেঙে পড়ে। সে বলতে থাকে,
“কি ভাবে নিজেকে সামলানো আমি স্নেহা? ঐ জানো*রগুলো আমার এত বড় ক্ষতি করে দিলো। আমি এখনো সেই বিভৎস সময়টা ভুলতে পারছি না।”
নিপুণ এবার এগিয়ে এসে বলে,
“তোমায় নিজেকে সামলাতে হবে প্রজ্ঞা। তোমার সাথে যারা এই অন্যায় করেছে তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য হলেও তোমায় নিজেকে সামলাতে হবে।”
স্নেহা প্রজ্ঞার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“উনি হলেন নিপুণ খান। উনি একজন উকিল। তুই নিঃসংকোচে তোর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা ওনাকে বলতে পারিস। উনি নিশ্চয়ই তোকে সাহায্য করবে।”
প্রজ্ঞা নিজের চোখ বন্ধ করে নেয়। তারপর বলে,
“ওদের সবাইকে আমি চিনি। আমাদের ভার্সিটির ছাত্রনেতা রাহাত আছে এসবের পেছনে। ঐ লোকটা কিছুদিন আগে আমাকে নোংরা প্রস্তাব দিয়েছিল৷ আমি সেইসময় ওনার মুখের উপর না করে দিয়েছিলাম৷ ওনাকে ভালো মন্দ অনেক কথাও বলেছিলাম। আর তাই উনি এভাবে….”
প্রজ্ঞা আর কিছু বলতে পারলো না। নিজের সাথে ঘটে যাওয়া বিভৎস ঘটনার স্মৃতি তার মানসপটে ভেসে ওঠে। সে নিজের মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করে দেয়।
স্নেহা আতংকমিশ্রিত গলায় শুধায়,
“রাহাত! উনি সংসদ সদস্য রুদ্র চৌধুরীর ভাই না?”
প্রজ্ঞা উত্তরে বলে,
“হ্যাঁ, ওনার আরো একটা পরিচয় হচ্ছে উনি সাবেক মন্ত্রী রাজীব চৌধুরীর ছেলে। ওনারা অনেক ক্ষমতাবান ব্যক্তি স্নেহা। আমি মনে হয় কোনদিনও ন্যায়বিচার পাবো না।”
নিপুণ দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলে,
“অপরাধী যতই ক্ষমতাবান হোক শাস্তি তাদের পেতেই হবে। আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়। তুমি কোন চিন্তা করো না প্রজ্ঞা, তোমায় ন্যায় বিচার পাইয়ে দিতে আমি তোমার পাশে থাকব।”
অতঃপর সে একজন ডাক্তারের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“আপনারা পুলিশকে খবর দেন নি?”
“হুম। জানিয়েছি।”
এরইমধ্যে প্রজ্ঞার বাবা মা চলে আসেন হাসপাতালে। স্নেহা তাদের ফোন করে বলেছিল স্নেহা হাসপাতালে ভর্তি। বিস্তারিত ভাবে কিছু সে বলেনি। এখানে এসে তাই তারা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে। প্রজ্ঞার কেবিনে প্রবেশ করেই তারা স্নেহাকে শুধায়,
“কি হয়েছে আমাদের মেয়ের?”
স্নেহা তাদের সব খুলে বলে। সব শুনে তাদের দুজনের অবস্থাই খারাপ হয়ে যায়। প্রজ্ঞার বাবা পারভেজ হোসেন একজন সাধারণ স্কুলশিক্ষক এবং তার মা মনিরা খাতুন একজন গৃহিণী। তারা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের। তাদের কাছে সম্মানটাই সব। মনিরা খাতুন তো আহাজারি করে বলতে শুরু করেন,
“এজন্যই তোমায় বলেছিলাম মেয়েটার এত পড়ানোর দরকার নাই। এখন দেখলা তো ওর কত বড় সর্বনাশ হয়ে গেল।”
পারভেজ ইসলাম একদম চুপ করে রইলেন। হঠাৎ করে এই আঘাতটা তিনি নিতে পারলেন না। ততক্ষণে পুলিশও এসে উপস্থিত হয়। পুলিশকে আসতে দেখেই নিপুণ এগিয়ে গিয়ে তাদের সাথে কথাবার্তা বলে। সে শক্তভাবে অবস্থান নেয় প্রজ্ঞার পক্ষে৷ অপরাধীও বিচারের দাবি করে। পুলিশ অফিসার নিপুণকে বলে,
“আমাদের কাজ আমরা ঠিকই করব। আমাদের আগে ভিকটিম ও তার পরিবারের সাথে আলাদাভাবে কথা বলতে দিন।”
পুলিশ প্রথমে প্রজ্ঞার সাথে কথা বলে। প্রজ্ঞা তো সহজে তাদের সামনে সব ঘটনা বলতে পারছিল না কিন্তু নিপুণ ভরসা দেওয়ায় সে সব ঘটনা খুলে বলে। সব শোনার পর তারা পারভেজ ইসলাম ও মনিরা খাতুনকে বলেন,
“আপনারা থানায় এসে এফআইয়ার দায়ের করুন। তারপর আমরা স্টেপ নেবো।”
পারভেজ ইসলাম তাই করতে চান। তখন মনিরা খাতুন বলেন,
“তুমি কি পাগল হয়ে গেছ নাকি? এমনিতেই মেয়েটার এত বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। এখন যদি থানা পুলিশ হয় তাহলে তো ব্যাপারটা লোক জানাজানি হয়ে যাবে। এমনিতেও ওত ক্ষমতাবান লোকের সাথে আমরা পারব না। এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি না করাই ভালো হবে।”
“আমি আমার মেয়ের জন্য ন্যায়বিচার চাই মনিরা। প্রয়োজনে নিজের যা আছে, যতটুকু আছে তাই দিয়ে লড়াই করব। তুমি একদম আমাকে বাঁধা দেবে না।”
মনিরা খাতুন আর কিছু বলতে পারেন না।
★★★
পারভেজ ইসলাম থানায় এফআইয়ার করতে গেলে একজন পুলিশ অফিসার তাকে বলেন,
“কি হবে খামোখা এসব এফআইয়ার করে? কার নামে এফআইয়ার করছেন জানেন তো? রাহাত চৌধুরী। এমপি রুদ্র চৌধুরীর ভাই। ওনাদের ক্ষমতার কাছে আপনারা ধোপে টিকবেন না। কি হবে শুধু শুধু ঝামেলা করে? তার থেকে ভালো হবে আপনারা নিজেরা নিজেরা সব মিটমাট করে নিন।”
পারভেজ ইসলাম নিদ্বিধায় বলেন,
“পুলিশের পোশাক পড়ে এমন কথা বলতে আপনার লজ্জা করছে না? আপনাদের কাজ কি নেতার চামচামি করা? আমাকে এসব কুপরামর্শ দিতে আসবেন না।”
পুলিশ অফিসার এবার থমথমে মুখে বললেন,
“দেখা যাক। আপনি কতদূর যেতে পারেন। আমরা এফআইয়ার তো নিলাম। কিন্তু সঠিক প্রমাণ ছাড়া এত বড় একজন লোকের বিরুদ্ধে স্টেপ নিতে পারব না।”
“আমার মেয়ে নিজের মুখে সব বলেছে সেটা কি যথেষ্ট নয়?”
“না। আইন প্রমাণে বিশ্বাসী।”
পারভেজ ইসলাম এবার রেগে যান। বলেন,
“আপনার কোন স্টেপ নেবেন না তাই তো? এবার দেখুন একজন বাবা তার মেয়েকে ন্যায়বিচার পাইয়ে দেওয়ার জন্য কত দূর যেতে পারে।”
স্নেহাকে নিজের বাসায় নিয়ে আসে নিপুণ। স্নেহা প্রথমবার নিপুণের বাসায় এসে একটু ইতস্তত বোধ করে। তবে নিপুণ স্নেহার হাত ধরে তাকে নিজের বাসার মধ্যে নিয়ে যায়। নিপুণের মা শাহিনা খাতুন স্নেহাকে দেখে ঠিক চিনতে পারেন না৷ তাই তিনি নিপুণকে শুধান,
“ও কে রে?”
“মা, ও হলো দীপের কাজিন। ওর নাম স্নেহা।”
“ওহ। এসো বসো তুমি।”
স্নেহা সৌজন্যমূলক হাসে। শাহিনা খাতুন স্নেহার সাথে টুকটাক আলাপ করে। নিপুণ স্নেহার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“আজ তোমার কত বড় বিপদ হয়ে যেতে পারত। ভাগ্যিস আমি একদম সঠিক সময় পৌঁছে গিয়েছিলাম।”
“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ নিপুণ আপু। আপনি না থাকলে যে আমার কি হতো!”
“আচ্ছা, তুমি একটা কাজ করো আমার নাম্বারটা নিজের কাছে রাখো। যখনই কোন বিপদে পড়বে আমাকে ফোন করবে। আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করব তোমাকে সাহায্য করার।”
এই বলে নিপুণ নিজের ফোন নম্বর স্নেহাকে দিয়ে দেয়৷ কিছুক্ষণ থেকে স্নেহা চলে যেতে চাইলে শাহিনা খাতুন তাকে আটকে দেয়। তিনি স্নেহাকে কিছু খেয়ে যেতে বলেন। স্নেহা প্রথমে তো খেতে চাইছিল না কিন্তু শাহিনা খাতুনের জোরাজুরিতে সে না খেয়ে আসতে পারল না। শাহিনা খাতুনকে দেখে তার ভীষণ ভালো লেগেছে। তাঁকে দেখে স্নেহার নিজের মায়ের কথাও মনে পড়ে যায়। স্নেহার মাও স্নেহাকে সবসময় খাওয়া নিয়ে এমন জোর করতো। খাওয়া দাওয়া শেষ করে স্নেহা আর বেশি সময় নষ্ট করলো না। সে দ্রুত হোস্টেলে ফিরতে চাইল। নিপুণ নিজের গাড়িতে করে স্নেহাকে হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে আসল।
★★★
নিপুণ আজ সকাল থেকে ব্যস্ত সময় পার করছে। আজ কোর্ট বন্ধ। তবে ছুটির দিন বসে থাকার মেয়ে নিপুণ নয়৷ সকাল থেকেই রান্নাবান্না করছে। ছোটবেলা থেকেই টুকটাক রান্না করতে পারে সে। রান্না করতে বরাবরই তার ভালো লাগে। সামনে যেহেতু তার বিয়ে তাই এই সময় বেশি বেশি করে রান্না শিখে নিতে চায়।
নিপুণ যখন রান্নায় ব্যস্ত ছিল ঠিক সেইরকম সময় পিছন থেকে কেউ এসে তার চোখ ঢেকে ধরলো। নিপুণ বলতে লাগল,
“কে?”
কোন উত্তর আসল না। নিপুণ এবার হাত দিয়ে স্পর্শ করল সেই ব্যক্তির মুখে। অতঃপর মৃদু হেসে বললো,
“দীপ তুমি!”
দীপ্র নিপুণের চোখ ছেড়ে দিয়ে বলে,
“তুমি সবসময় কিভাবে আমাকে স্পর্শ করেই বুঝে যাও যে এটা আমি?”
নিপুণ বেশ গর্ব করে বুক ফুলিয়ে বলে,
“এটাই তো আমার সিক্রেট পাওয়ার।”
দীপ্র নিপুণের কাঁধে হাত রেখে বলে,
“এই উপায় অবলম্বন করে তোমায় চমকে দিতে না পারলেও আমার হাতে অন্য উপায় কিন্তু আছে।”
“কি উপায়?”
“তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে। একটু গেস করার চেষ্টা করো তো এটা কি হতে পারে?”
“আই হ্যাভ নো আইডিয়া।”
“আরে একটু ভাবো।”
“আমি কিভাবে বুঝব দীপ? আমি কি অন্তর্যামী?”
“ওয়েল, তাহলে চোখ বন্ধ করো।”
“এসব কি ছেলেমানুষী?”
“আরে চোখটা বন্ধই করো না। সারপ্রাইজ পেতে চাইলে কিন্তু এমনটা করতেই হবে।”
“ঠিক আছে। আমি চোখটা বন্ধ করলাম।”
“আমি না বলা পর্যন্ত কিন্তু চোখ খুলবে না।”
দীপ্র নিজের ব্লেজারের পকেট থেকে কিছু একটা বের করে নিপুণের হাতের উপর রাখে। অতঃপর আদেশের সুরে বলে,
“এবার চোখ খোলো।”
নিপুণ আস্তে আস্তে চোখ খুলে পিটপিট করে তাকায়। নিজের হাতের দিকে তাকাতেই সে চমকিত হয়। সাথে সাথেই খুশিতে আপ্লুত হয়ে বলে,
“বিয়ের কার্ড!”
“হ্যাঁ, ম্যাম। এটা আমাদের বিয়ের কার্ড। আগামী মাসের পাঁচ তারিখ আমাদের বিয়ে। আর এটা হলো বিয়েএ ইনভিটেশন কার্ড। জাস্ট ইমাজিন, আর মাত্র কিছু দিন। তারপরই আমাদের একটা সুখের সংসার হবে।”
নিপুণের মুখে হাসি তখনো অব্যাহত। সে বিয়ের কার্ডটা ভালো ভাবে দেখতে থাকে। দীপ্র নিপুণকে শুধায়,
“কার্ডটা পছন্দ হয়েছে তো? আমি চুজ করেছি।”
“খুব পছন্দ হয়েছে। তোমার পছন্দ কখনো খারাপ হতেই পারে না।”
“একদম ঠিক বলেছ তুমি। তোমাকে দিয়েই তো সেই প্রমাণ পেয়েছি। ইউ নো হোয়াট, আই থিংক আমরাই এই পৃথিবীর সবথেকে হ্যাপি কাপল হবো।”
নিপুণের মুখের হাসি হঠাৎ করে মিলিয়ে যায়। গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে পড়ে সে। নিপুণের এমন মুখভঙ্গি দেখে দীপ্র শুধায়,
“কি হলো? তোমার মুখটা চুপসে গেল কেন হঠাৎ?”
“আমি একটা কথা ভাবছি দীপ। এত সুখ কি আমার কপালে সইবে?”
“এসব কি বলছ তুমি? সইবে না মানে? অবশ্যই সইবে। এখন চলো আমরা একসাথে লাঞ্চ করব।”
“লাঞ্চ বলতে মনে পড়লো আমি না আজ বিরিয়ানি করেছি। খাবে তুমি?”
“বিরিয়ানীতে তো অনেক তেল মশলা থাকে। তুমি তো জানো আমি এসব ওয়েলি ফুড খাইনা। চলো কোন রেস্টুরেন্টে যাই।”
নিপুণ উত্তরে কিছু বলল না। নিজের মুখটা গোমড়া করে নিলো৷ দীপ্র বুঝল নিপুণের হয়তো খারাপ লেগেছে। তাই সে নিজের মত পালটে বলল,
“তুমি যখন নিজের হাতে রান্না করেছ তখন তো আমায় খেতেই হবে। এখন থেকেই তো দেখতে হবে আমার হবু বউ কেমন রান্না করে।”
নিপুণের গম্ভীর মুখশ্রী হাস্যজ্বল হয়। তারা এভাবে খুনশুটি চালিয়ে যায়।
★★★
সূর্য অনেক আগেই অস্তমিত হয়েছে। শীতকাল হওয়ায় খুব তাড়াতাড়ি আঁধার নেমেছে চারিদিকে।
স্নেহা তখন পড়ছিল। বর্তমানে তার এক্সাম চলছে। তাই এখন পড়াশোনায় বেশি মনোনিবেশ করতে হচ্ছে তাকে৷ স্নেহা ঘড়ির দিকে খেয়াল করে। প্রজ্ঞা কিছু জরুরি কাজে অনেক আগেই বেরিয়েছে। প্রজ্ঞা এখনো ফিরছে না জন্য ভীষণ চিন্তা হচ্ছে স্নেহার। হঠাৎ করেই স্নেহার ফোন বেজে ওঠে। স্নেহা ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে প্রজ্ঞা ফোন করেছে। স্নেহা ফোনটা রিসিভ করতেই বিপরীত দিক থেকে প্রজ্ঞার গলা শুনতে পায়৷ ভীষণ ভীত শোনাচ্ছে তার কন্ঠস্বর। প্রজ্ঞা হাফাতে হাফাতে বলে,
“স্নেহা কিছু ছেলে আমার পিছু নিয়েছে। আমার ভীষণ ভয় লাগছে রে!”
“হ্যালো, প্রজ্ঞা কোথায় তুই? আমাকে ঠিকানা বল।”
“আমি ** এলাকার পাশেই আছি।”
“তুই ওখানেই থাক আমি আসছি।”
স্নেহা হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যেতে নেয়। এমন সময় হঠাৎ করে অনুপমের আগমন ঘটে। অনুপমকে দেখেই স্নেহা বলতে শুরু করে,
“অনুপম প্রজ্ঞা অনেক বড় বিপদে পড়েছে। ওকে কিছু ছেলে ফলো করেছে। তুমি প্লিজ আমার সাথে চলো ওকে রেসকিউ করতে হবে।”
“আচ্ছা, চলো তাড়াতাড়ি।”
দুজনে আর কাল বিলম্ব না করে রওনা দেয়। স্নেহা চাইছিল পুলিশে ফোন করে ব্যাপারটা জানাতে কিন্তু সেই মুহুর্তে অনুপম তাকে বলে,
“এসব ব্যাপারে পুলিশকে জানাতে হবে না। শুধু শুধুই ঝামেলা হবে। আমরা দুজন মিলেই ওকে রেসকিউ করতে পারব।”
অনুপমের কথা শুনে স্নেহা আর পুলিশকে এই ব্যাপারে ইনফর্ম করে না।
★★★
প্রজ্ঞাকে কয়েকজন ছেলে তুলে নিয়ে এসেছে একটি পপরিত্যক্ত ভবনে। প্রজ্ঞা সমানে চিৎকার করে সাহায্য চাইছে, ছেলেগুলোকে অনুরোধ করে চলেছে যেন তার কোন ক্ষতি না করে কিন্তু তারা কোন কথা শুনছেই না। সবার লোলুপ দৃষ্টি প্রজ্ঞার উপর। এমন সময় হঠাৎ করে একটি ছেলে প্রজ্ঞার সামনে এসে বলে,
“অবশেষে আজ আমার স্বার্থ চরিতার্থ হতে চলেছে। তোকে আগেই বলেছিলাম ভালোয় ভালোয় আমার প্রস্তাব মেনে নে। যেই মেয়ের দিকেই আমার নজর গেছে সকলকেই তো আমি বিছানায় নিয়েছি তোকেও নাহয় নিতাম। বিনিময়ে তুইও অনেক লাভ পেতি। কিন্তু তুই তো আমার কথা শুনলি না। তাই আমাকে এই পথ অবলম্বন করতে হলো।”
প্রজ্ঞা ছেলেটির সামনে হাতজোড় করল এছাড়া আরো অনেক অনুনয় বিনয় করল কিন্তু কোন লাভ হলো না। একে একে সবগুলো জা**য়ার তাকে চিড়ে খে*তে লাগল। এত অত্যা*চার সইতে না পেরে একসময় নিস্তেজ হয়ে গেল প্রজ্ঞা। শয়তানগুলোও নিজের চাহিদা মিটিয়ে প্রজ্ঞাকে ছু’ড়ে ফেলে গেল রাস্তায়।
স্নেহাকে হোস্টেলের সামনে পৌঁছে দিয়ে ফিরে গেল অনুপম। অতঃপর স্নেহা গেল তার বান্ধবী প্রজ্ঞার হোস্টেল রুমে। প্রজ্ঞা তখন পড়াশোনায় ব্যস্ত ছিল৷ স্নেহা রুমে প্রবেশ করে বিছানায় বসে বলে,
“বাহ, আপনি তো দেখছি বেশ পড়াকু হয়ে গেছেন!”
প্রজ্ঞা পড়া থামিয়ে বলে,
“কি আর করবো বল! সারাবছর না পড়লে যা হয়। সামনে পরীক্ষা আর আমার এখনো পড়াই কমপ্লিট হয়নি। তাই তো এখন নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে পড়তে হয়েছে৷ তোর তো মনে হয় বই কমপ্লিট।”
“আমার অবস্থাও খুব বেশি ভালো না রে! আচ্ছা তোকে যে আমি আমার জন্য হোস্টেলে রুম দেখতে বলেছিলাম। তুই দেখেছিস তো?”
“তোর জন্য অনেক ভালো একটা খবর আছে। এখানে আমার যে রুমমেট ছিল সে হঠাৎ করে রুম ছেড়ে দিয়েছে। যার কারণে এখন তুই চাইলে এখানেই থাকতে পারিস।”
“বাহ, তাহলে তো ভালোই।”
“হুম। আমি হোস্টেল অথারিটির সাথেও কথা বলে নিয়েছি। তুই চাইলে আজ থেকেই আমার সাথে থাকতে পারিস।”
“আজ হবে না রে। আজ আমায় বাড়িতে যেতে হবে। বাড়ি থেকে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস আনতে হবে। কাল একেবারে সবকিছু নিয়ে আসব।”
“আচ্ছা।”
★★★
হোস্টেলে আজ স্নেহার দ্বিতীয় দিন। গতকালই সব জিনিসপত্র নিয়ে হোস্টেলে উঠেছে সে৷ প্রজ্ঞার সাথেই রুম শেয়ার করে আছে। দুই বান্ধবী মিলে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে৷ স্নেহা সারাবছর মোটামুটি পড়াশোনা করেছে, প্রজ্ঞা বই ছুঁয়েও দেখেনি৷ যার ফলে স্নেহাকে বেশি চাপ নিতে হচ্ছে না৷ আর প্রজ্ঞা তো দম নেওয়ার সময় পাচ্ছে না।
সন্ধ্যাবেলায় প্রজ্ঞা হঠাৎ করে স্নেহার সম্মুখে এসে বলে,
“একটা সাহায্য করতে পারবি রে বোন প্লিজ!”
“কি সাহায্য বল।”
“কি আর বলব দুঃখের কথা! আমার সাথে সাথে আমার স্টুডেন্টেরও পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। তুই তো জানিস আমি কয়েকটা বাচ্চাকে টিউশনি পড়াই। পরীক্ষার জন্য তো এখন সবার থেকে ছুটি নিয়ে নিয়েছি কিন্তু আমার এক ছাত্রর এখন পরীক্ষা চলছে। ছেলেটা আবার অংকে একেবারে দূর্বল। কাল ওর গণিত পরীক্ষা। ওর মা বারবার করে বলে দিয়েছে পরে না ফেলেও অন্তত আজকে ওকে পড়াতে যেতেই হবে। এদিকে আমার নিজের পড়ারই বাজে অবস্থা।”
“বুঝলাম। তো এখানে আমি কি করতে পারি?”
“এখন যদি কেউ কিছু করতে পারে তাহলে সেটা শুধু তুই পারবি বোন। তুই আজ গিয়ে ছেলেটাকে আমার বদল পরিয়ে আয় না।”
“এসব কি বলছিস তুই? এটা কিভাবে সম্ভব?”
“কেন সম্ভব নয়? তুই তো অংকে আমার থেকেও ভালো। তাছাড়া তোর এক্সামের প্রিপারেশনও তো অনেক ভালো। আর আমার অবস্থাটা তো তুই বুঝতেই পারছিস। এখন ওকে পড়াতে যাওয়া মানে আমার এক্সামে ডাব্বা মারা নিশ্চিত হওয়া। আবার না গেলেও ওর মা টিউশনিটা বন্ধ করে দেবে। তাহলেও আমার ক্ষতি। তুই তো জানিস আমার ফ্যামিলির অবস্থা। এখানে নিজের হাতখরচ আমাকে নিজেই চালাতে হয়।”
স্নেহা কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ভেবে বলে,
“কিন্তু তোর ছাত্রের মা কি তোর বদলে যদি আমি পড়াতে যাই তাহলে সেটা মেনে নেবে?”
“ওদের বাড়ি বেশি দূরে নয়। তোর ফোনটা দে আমি গুগল ম্যাপে ঠিকানাটা দেখিয়ে দিচ্ছি।”
প্রজ্ঞা স্নেহাকে ঠিকানাটা দেখিয়ে দেয়। স্নেহা আর দেরি না করে রওনা দেয়।
★★★
স্নেহা প্রজ্ঞার দেওয়া ঠিকানা মতো পড়াতে চলে এসেছে। স্নেহা যে ছেলেটাকে পড়াতে এসেছে তার নাম অভিক। ছেলেটা সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে কিন্তু সে গণিতে একেবারেই দূর্বল। অভিককে অংক বোঝাতে গিয়ে স্নেহার নিজেরই অংক ভুলে যাওয়ার জোগাড়। তবুও সে যথাসাধ্য চেষ্টা করে ছেলেটাকে অন্তত পাস মার্ক নিশ্চিত করে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে। অনেকাংশে সফলও হলো। অভিককে পড়িয়ে চলে আসতে যাবে এমন সময় অভিকের মা তাকে আটকে দিয়ে বলে,
“আপনি প্রথমবার আমাদের বাসায় এলেন। কিছু খেয়ে যান।”
“না, না। তার কোন দরকার নেই।”
“আপনি বসুন তো। আমি এক্ষুনি নাস্তা আসছি।”
স্নেহা আর না করতে পারে না। সে পড়ার টেবিলেই বসে থাকে। অভিকও তার সামনে বসে অংক করে যাচ্ছিল। আচমকা একজন তরুণী সেখানে চলে আসে। মেয়েটি কার সাথে যেন চিৎকার করে কথা বলছে। স্নেহা মেয়েটির দিকে তাকায়। অভিক নিচু কন্ঠে বলে ওঠে,
“উনি হলো আমার খালা। আজ দুপুরেই এসেছে। জানেন ম্যাম, উনি না আজ বোধহয় খুব রেগে আছে। এসেছে থেকেই কেমন রাগী রাগী ভাব।”
স্নেহা ব্যাপারটাকে আর তেমন গুরুত্ব দিলো না। তবে সে এটা বেশ বুঝল অভিক ছেলেটা বেশ সহজ সরল। এক দিনের পরিচয়েই ছেলেটা তাকে একদম আপন করে নিয়েছে।
হঠাৎ করেই একটি চিরচেনা কন্ঠস্বরে স্নেহার কান আটকে যায়। অভিকের খালার ফোনটা হয়তো স্পিকারে দেওয়া। ফোনে যেন স্পষ্ট অনুপমের কন্ঠস্বর শুনল স্নেহা। স্নেহার কেমন জানি খটকা লাগল। অভিকের খালা ততক্ষণে রুম থেকে বেরিয়ে গেছে। স্নেহা হতভম্ব হয়ে বসে রইলো। অভিক আবারো নিচু গলায় স্নেহাকে বলে,
“খালা মনে হয় আমার হবু খালুর সাথে কথা বলছিল। তাই তো এত রেগে আছেন।”
“তোমার হবু খালুর নাম কি?”
অভিক মাথা চুলকে বলে,
“নামটা ঠিক মনে পড়ছে না। একবারই শুনেছিলাম। তবে হ্যাঁ, আমার ফোনে খালার সাথে ওনার পিক আছে।”
“পিকটা একটু দেখাতে পারবে?”
“আপনি একটু বসুন। আমি ফোনটা নিয়ে আসছি।”
অভিক ফোনটা নিয়ে পড়ার টেবিলের কাছে আসতে যাবে তার আগেই তার মা তার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলে,
“কাল না তোমার পরীক্ষা আর তুমি এখন ফোন নিচ্ছ। মাইর চিনো মা*ইর? যাও পড়তে বসো।”
“তুমি আমায় ভুল বুঝছ মম। আমি তো আসলে..”
“কোন কথা না। চুপচাপ গিয়ে পড়তে বসো।”
অভিক চুপচাপ গিয়ে পড়তে বসে৷ অভিকের মা স্নেহাকে খেতে দেয়। স্নেহা খাওয়া দাওয়া শেষ করে উঠে পড়ে। তারপর বিদায় নেয়। রাস্তায় যাওয়ার সময় তার সেই কন্ঠস্বরের কথাই মনে পড়ে। তার মনটা এখনো কেন জানি খচখচ করছে৷ একবার মনে হচ্ছে হয়তো শুনতে ভুল হয়েছে আবার এটাও মনে হচ্ছে সে একদম ঠিক শুনেছে।
স্নেহার এমন ভাবনার মাঝেই হঠাৎ সে লক্ষ্য করে কয়েকটা ছেলে সামনে দাঁড়িয়ে আছে৷ ছেলেগুলো যে সুবিধার নয় সেটা বোঝাই যাচ্ছে। রাতও প্রায় হয়ে গেছে৷ স্নেহা ভয়ে ভয়ে সামনে এগোতে থাকে। এই গলিটা পেরিয়ে মেইন রোডে গিয়ে উঠলেই বাঁচে সে।
তবে বিপত্তি ঘটেই গেল! স্নেহার রাস্তা আটকে ধরল ছেলেগুলো৷ সাথে বিভিন্নরকম নোংরা কথাবার্তা বলা শুরু করল। ভয়ে স্নেহার গলা শুকিয়ে গেল৷ সে কোন কিছু না ভেবে দৌড় দিল। ছেলেগুলোও তার পেছনে দৌড়াচ্ছিল। স্নেহা প্রাণপনে ছুটতে থাকে। হঠাৎ করেই তার সামনে চলে আসে কেউ। স্নেহাকে আগলে নেয়। স্নেহা মুখ তুলে তাকিয়ে বলে,
“নিপুণ আপু আপনি!”
“হ্যাঁ, আমি। কি হয়েছে তোমার? এভাবে ছুটছ কেন?”
“ওরা..”
বলেই পিছনে ফিরে তাকায় স্নেহা৷ ছেলেগুলো তার পেছন পেছন এখান অব্দি চলে এসেছে৷ নিপুণ বলে ওঠে,
“তুমি ভয় পেওনা। এদেরকে তো আমি দেখে নিচ্ছি।”
নিপুণ ছেলেগুলোর উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“আমি ৯৯৯ এ ফোন করে দিয়েছি। পুলিশকে আসতে দে৷ থানায় নিয়ে গিয়ে যখন দুই ঘা দেবে তখন মেয়েদের উত্তপ্ত করা বেরিয়ে যাবে।”
নিপুণের কথা শুনে ছেলেগুলোর চোখেমুখে ভয়ের দেখা মেলে। সকলে প্রায় একই সাথে দৌড়ে পালায়৷ স্নেহা হাফাতে থাকে৷ নিপুণ স্নেহাকে বলল,
“তুমি আমার সাথে চলো।”
স্নেহা নিপুণের সাথে যেতে থাকে। নিপুণ স্নেহাকে নিয়ে নিজের গাড়িতে উঠে পড়ে।
নিপুণ দীপ্রকে সাথে নিয়ে অনাথ আশ্রমে প্রবেশ করে। নিপুণকে আসতে দেখেই কয়েকজন বাচ্চা ছুটে চলে আসে। নিপুণ হাটু গেড়ে তাদের সামনে বসে পড়ে। বাচ্চাগুলো খুশি হয়ে বলে,
“তুমি এসেছ ভালো আন্টি? আমরা সবাই তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”
নিপুণ মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বলে,
“ওহ তাই বুঝি? আচ্ছা, এই নাও তোমাদের সকলের জন্য চকলেট আর খেলনা এসেছি।”
মুহুর্তেই সবার মুখের হাসি আর চওড়া হয়। এই এতিম বাচ্চাগুলোকে এভাবে খুশি হতে দেখে নিপুণের মনে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে যায়। দীপ্র নিপুণের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এই মেয়েটাকে যতো দেখে ততোই অবাক হয় সে। মাঝে মাঝে দীপ্রর মনে হয় তার জীবনের সবথেকে বড় স্বার্থকতা এটাই যে সে নিপুণের মতো একজন মেয়েকে নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে চলেছে।
★★★
অনুপমের সাথে রাজশাহী শহরের অন্যতম একটি সুন্দর পার্কে ঘুরতে এসেছে স্নেহা। দুজনে একসাথে পাশাপাশি হেটে চলেছে৷ হঠাৎ করেই অনুপম বলে ওঠে,
“তোমাকে একটা কথা বললে রাগ করবে না তো?”
“কি কথা?”
“আচ্ছা, কি হবে যদি আজ আমরা বিয়ে করে নেই?”
স্নেহা ভীষণ অবাক হয়ে যায়৷ অনুপম যে এমন কথা বলবে সেটা তার কল্পনাতেও ছিল না। স্নেহার বিস্মিত মুখ দেখে অনুপম ফিক করে হেসে দেয়৷ অতঃপর বেশ ভাব নিয়ে বলে,
“আমি তো এমনি মজা করছিলাম। এত দ্রুত বিয়ে করার ইচ্ছা আমার নেই।”
স্নেহা একটু ভেবে বলে,
“আমি ভাবছি এইবার সেকেন্ড ইয়ারের এক্সাম শেষ হলেই আব্বুকে তোমার কথা বলব।”
“এত তাড়াহুড়ো কেন?”
“আসলে আমার এভাবে আর প্রেম করতে ভালো লাগছে না অনুপম। তোমাকে একজন জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে চাই।”
অনুপম তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। চুপচাপ হেটে চললো। হঠাৎ করে অনুপমের ফোন বেজে উঠল৷ অনুপম ফোনটা রিসিভ করে একটু দূরে সরে গেল। স্নেহা সেই স্থানে দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। কিছুক্ষণ পর অনুপম ফিরল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে কোন কারণে ভীষণ রেগে গেছে৷ স্নেহা এই বিষয়ে কিছু প্রশ্ন করতে যাবে তার পূর্বেই অনুপম বলে,
“আমার খুব জরুরি একটা কাজ পড়ে গেছে স্নেহা৷ আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে।”
স্নেহা বললো,
“ঠিক আছে৷ চলো তাহলে। ”
এরমধ্যে আবার অনুপমের ফোনে কল আসে। অনুপম ফোনটা রিসিভ করেই বলে,
“আপনাদের আর কতবার বলব আমাকে আর ক’টা দিন সময় দিন? ১৫ লাখ টাকা তো মুখের কথা নয় তাইনা? এত টাকা একসাথে কোথায় পাবো আমি?”
বলেই ফোনটা কে’টে দেয় অনুপম। স্নেহা এবার আর থাকতে না পেরে অনুপমকে প্রশ্ন করেই ফেলে,
“তুমি কার সাথে কথা বলছিলে অনুপম? আর টাকার কথা কি যেন বলছিলে?”
“সেরকম কিছু নয়।”
“তুমি আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছ তাইনা? আমার থেকে কিছু লুকিও না অনুপম। তোমার জন্য তো আমার চিন্তা হয়।”
“আসলে স্নেহা তুমি তো জানো আমি নতুন একটা বিজনেস শুরু করেছি। সেইজন্যই একটা ব্যাংক থেকে টাকা লোন নিয়েছিলাম। সেখান থেকেই টাকা ফেরত চাইছে। বুঝতে পারছি না কি করব।”
“বড় কোন সমস্যা হতে পারে কি?”
“বিজনেসে আমি তেমন প্রফিট করতে পারিনি। এই মাসের এক তারিখের মধ্যে টাকা শোধ করে দেওয়ার কথা ছিল কিন্তু আমি এখনো তা পারিনি৷ এমন চলতে থাকলে ওরা আমার নামে কেইস করতে পারে!”
স্নেহার চোখেমুখে উদ্বিগ্নতা ফুটে ওঠে। অনুপম স্নেহার এই অবস্থা দেখে বলে,
“তুমি চিন্তা করো না আমি সব সামলে নেব।”
“হুম।”
“তুমি কি কিছু খাবে?”
“না৷ লাগবে না।”
“এটা বললে তো শুনব না। তোমাকে ঘুরতে নিয়ে এসে তো খালি পেটে ফেরত পাঠাতে পারব না। তুমি এখানে একটু দাঁড়াও, আমি তোমার জন্য কিছু নিয়ে আসছি।”
এই বলে স্নেহাকে ওখানে রেখে অনুপম চলে যায়। স্নেহা একাই দাঁড়িয়ে থাকে।
“স্নেহা তুমি!”
হঠাৎ চেনা একটি কন্ঠস্বর কানে আসতেই পেছনে ফিরে তাকায় স্নেহা। নিপুণকে এখানে দেখে বেশ অবাক হয়। সাথে দীপ্রকে দেখে বিব্রত বোধ করে। দীপ্রও বোধহয় স্নেহাকে দেখে খুশি হয়নি। যা তার চোখ মুখের অভিব্যক্তির দ্বারা ফুটে উঠেছে৷ নিপুণকে নিয়ে ঘুরতে এসে স্নেহাকে এখানে দেখাটা তার কাছে উটকো ঝামেলাই হয়তোবা মনে হচ্ছে।
নিপুণ স্নেহার কাছে গিয়ে বলে,
“তুমি একা এখানে দাঁড়িয়ে কি করছ?”
“আমি..না মানে…”
“বন্ধুদের সাথে ঘুরতে এসেছ বুঝি?”
“হ্যাঁ…আপনারাও মনে হয় ঘুরতেই এসেছেন?”
“ঠিক ধরেছ। আমি দীপের সাথে এখানে একটু ঘুরতে এসেছি।”
দীপ্র নিপুণের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“আমি একটু ঐদিকে যাচ্ছি। তোমার কথা বলা হয়ে গেলে তুমিও চলে এসো।”
স্নেহা বেশ ভালোই বুঝল দীপ্র তাকে পছন্দ করে না জন্যই তার সামনে থাকতে চাইছে না। ব্যাপারটায় যদিও স্নেহার কিছু যায় আসে না। কারণ গতকালের ঘটনার পর তার দীপ্র বা তার পরিবারকে নিয়ে কোন আগ্রহ নেই। সে নিজেও তাদের এড়িয়ে যেতে চায়। তবে চাইলেও নিপুণকে এড়িয়ে যেতে পারছে না সে। কারণ মেয়েটার ব্যবহার তাকে মুগ্ধ করে।
নিপুণ স্নেহার সাথে বেশ হাসিমুখেই কথা বলতে থাকে৷ একসময় সে বলে,
“দীপ্র বা ওর পরিবারের ব্যবহারে তুমি কিছু মনে করোনা। আমাদের বিয়েতে কিন্তু তোমায় দেখতে চাই।”
স্নেহা স্পষ্টভাবেই বলে,
“দুঃখিত আপু। কিন্তু আপনার এই কথাটা রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়৷ ওখানে বাজেভাবে অপমানিত হওয়ার পরও যদি আমি আবার আপনাদের বিয়ে খেতে যাই তাহলে আমার আত্মসম্মানবোধে আঘাত লাগবে। এতটাও আত্মসম্মানহীন নই আমি।”
নিপুণ স্নেহার কাঁধ চাপড়ে বলে,
“তোমার এই সিদ্ধান্তকে আমি সম্মান জানাই। তোমার যায়গায় আমি থাকলেও এই একই সিদ্ধান্ত নিতাম।”
আরো কিছু কথাবার্তা বলার পর নিপুণ বলে,
“আচ্ছা, তুমি তাহলে থাকো। আমি আসছি।”
নিপুণ চলে যেতে যাবে এমন সময় অনুপম বিরিয়ানির প্যাকেট নিয়ে সেখানে চলে আসে। অতঃপর প্যাকেটটি স্নেহার হাতে তুলে দিয়ে বলে,
“এই নাও স্নেহা। এটা তোমার জন্য।”
নিপুণ অনুপমের দিকে ভালো ভাবে খেয়াল করে। অনুপমকে আপাদমস্তক পরখ করে নেয় সে। অনুপমকে কেন জানি তার ভীষণ চেনা চেনা লাগছে। এদিকে অনুপমও নিপুণের দিকে খেয়াল করে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।
নিপুণ স্নেহাকে শুধায়,
“উনি কে?”
“ও আমার বন্ধু।”
“শুধুই বন্ধু নাকি আরো বেশি কিছু?”
স্নেহা কোন উত্তর দিলো না। সামান্য হাসল শুধু। তাতেই নিপুণের যা বোঝার বোঝা হয়ে গেল। নিপুণ অনুপমের কাছাকাছি এগিয়ে গিয়ে বলল,
“হ্যালো, আমি এডভোকেট নিপুণ খান। আপনাকে কেন জানি আমার খুব চেনা চেনা লাগছে। আমরা কি পূর্ব পরিচিত?”
অনুপম যে নিপুণের প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেছে সেটা তার চোখমুখের ছাপ দেখেই স্পষ্ট৷ তবে সে মুখে বলল,
“আমি অনুপম শিকদার। আমার হাউজিং বিজনেস আছে। বিজনেসের কাজে অনেকবারই কোর্টে যেতে হয়েছে। তখনই হয়তোবা দেখেছেন। তাছাড়া রাজশাহী তো খুব বড় একটা শহর নয়। অন্য কোন যায়গাতেও হয়তো দেখা হতে পারে!”
নিপুণের অনুপমের কথা কতটা কি বিশ্বাস হলো সেটা বোঝা গেল না৷ তবুও সে এ নিয়ে আর কথা বাড়ালো না। অনুপম আর স্নেহাকে বিদায় জানিয়ে সে প্রস্থান করল। হাঁটতে হাঁটতে অনুপমের কথাই ভাবতে থাকে। কেন জানি তার মনে হচ্ছে এই লোকটাকে আগে কোথাও দেখছে। খুব কাছ থেকেই হয়তো দেখেছে তাই বোধহয় এত চেনা চেনা লাগছে।
স্নেহা রওনা দিয়েছে তার ভার্সিটির উদ্দ্যেশ্যে। সে ভেবে নিয়েছে আজ প্রজ্ঞার সাথে হোস্টেলে থাকার ব্যাপারেও কথা বলবে। কাঙ্খিত বাস স্টপেজে পৌঁছে বাস থেকে নামল স্নেহা৷ অতঃপর এদিক ওদিক তাকালো৷ কিছু সময়ের মধ্যেই এক সুদর্শন যুবক তার সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
“তাহলে আমি একদম সঠিক সময়েই পৌঁছেছি।”
“জ্বি, আমি তোমাকে নিতেই এসেছি। তোমার বান্ধবী প্রজ্ঞার কাছে শুনলাম তুমি নাকি হোস্টেলে থাকতে চাইছ।”
“হ্যাঁ, আসলে সামনে এক্সাম তো তাই এত দূর জার্নি করা সম্ভব নয়। এজন্যই ভাবছি হোস্টেলে এসে উঠব।”
“আমাকে বলতে পারতে৷ আমি আমার ফ্ল্যাটে তোমার থাকার ব্যবস্থা করে দিতাম। এই শহরে তো আমার ফ্ল্যাটের অভাব নেই।”
“কি যে বলো না তুমি। আমি কিভাবে তোমার ফ্ল্যাটে থাকতে পারি?”
“কেন পারোনা? তুমি কি আমায় ভালোবাসো না স্নেহা?”
স্নেহা ত্বরিত উত্তর দিল,
“অনেক বেশিই ভালোবাসি৷”
“তাহলে অসুবিধা কোথায়? আমরা তো একসাথে ফ্ল্যাটে থাকব না৷”
“সেসব তুমি বুঝবে না। যাইহোক, তুমি চট্টগ্রাম থেকে কবে ফিরলে?”
“একটু আগেই।”
এরপর তাদের মাঝে আরো কিছু কথাবার্তা চলতে লাগল। একসময় অনুপম স্নেহাকে বলল,
“আজ তোমাকে আর ভার্সিটি যেতে হবে না। আজ অনেকদিন পর আমি রাজশাহীতে এলাম। চলো আজ ঘুরতে যাব।”
“না অনুপম। সামনে এক্সাম…”
“আমি কোন অযুহাত শুনব না। তুমি চলো তো আমার সাথে।”
অনুপম স্নেহার কোন বারণ শুনল না। একপ্রকার জোর করেই স্নেহাকে নিজের সাথে নিয়ে গেল।
★★★
নিপুণ সবেমাত্র কোর্ট থেকে বাড়িতে ফিরল। আজ সে অনেক খুশি৷ কারণ সে আজ একটা কেস জিতে গেছে৷ একজন অপরাধীকে সে শাস্তি দিতে পেরেছে। নিপুণের মনে এখন অদ্ভুত প্রশান্তি কাজ করছে৷ এটা নতুন কিছু নয় তার কাছে। যতবারই সে অপরাধীদের শাস্তি পাইয়ে দিতে সক্ষম হয় ততবারই এমন খুশি হয়। বাসায় এসেই সর্বপ্রথম নিজের বাবার ছবির সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সে। নিপুণ বাবা প্রয়াত এডভোকেট নজরুল খান। যিনি তার সততা এবং ন্যায়বিচারের জন্য আজো সমাদৃত। জীবনকালে যিনি কখনো অন্যায়ের সাথে আপোষ করেননি৷ সমাজের অত্যাচারিত, নিপিড়ীত মানুষের পাশে থেকেছেন সর্বদা৷ প্রভাবশালী, ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের যিনি পরোয়া করেন নি৷ আজ তার আদর্শেই বেড়ে উঠেছে নিপুণ। সেও তার বাবার মতো অসহায় মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করে। নিপুণ তার বাবার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে বলে,
“আজ আবারো আমি তোমার মুখ উজ্জ্বল করতে পেরেছি আব্বু। একজন নিপীড়িত নারীকে আজ আমি ন্যায়বিচার পাইয়ে দিয়েছি। আমি জানি তুমি যেখানেই থাক না কেন আমার এই সাফল্যে তুমি আজ অনেক খুশি হয়েছ৷”
এমন সময় কেউ নিপুণের কাধে স্পর্শ করে। নিপুণ পিছন ফিরে হালকা হেসে বলে,
“মা, তুমি!”
“বাবাকে কি বলছিস হ্যাঁ? আমার নাম্র বিচার দিচ্ছিস?”
“কি যে বলো না তুমি। বাবার কাছে তোমার নামে বিচার দেব কেন? বাবাকে আমার সাফল্যের কথা বলছিলাম। জানো মা কেসটা আমি জিতে গেছি।”
“আচ্ছা।”
নিপুণ খেয়াল করে তার মায়ের চেহারার উদ্বিগ্নতা। তাই সে তার মাকে শুধায়,
“তোমার মুখটা হঠাৎ এমন শুকিয়ে গেল কেন মা? তুমি কি আমার সাফল্যে খুশি হওনি?”
“না তেমনটা নয়৷ সব মায়েরাই তাদের মেয়ের সাফল্যে খুশি হয়। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। কিন্তু আমার যে অনেক চিন্তা হয় তোকে নিয়ে।”
“আমাকে নিয়ে চিন্তা হয় কেন?”
“এই যে তুই প্রতিদিন এই প্রভাবশালী মানুষের বিরুদ্ধে কেস লড়িস তারা যদি তোর কোন ক্ষতি করে দেয়?”
“ক্ষতি করে দেবে বললেই হলো? এত সোজা না। তুমি আমাকে নিয়ে একদম চিন্তা করো না।”
“মায়ের মন তুই বুঝবি না৷ তোর বাবাকে হারানোর পর থেকে আমার মনে ভয় জেকে বসেছে। আমার আজো মনে হয় তোর বাবার মৃত্যু কোন এক্সিডেন্ট ছিল না। তোর বাবাকে হয়তো কেউ পরিকল্পনা করেই…এখন তো তুই আমার সব নিপুণ। সামনে তোর বিয়ে। আমি বলি কি, বিয়ের পর তুই এসব ওকালতি ছেড়ে দিয়ে সংসারে মন দে৷ সেটাই হয়তো ভালো হবে।”
“এটা সম্ভব নয় মা। আমি বাবার আদর্শে বড় হয়েছি। বাবা আমাকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে শিখেছে। ভয় পিছিয়ে আসতে নয়।”
কথাটুকু বলেই নিপুণ নিজের রুমের দিকে চলে যায়। নিপুণের মা শাহিনা খাতুন সেদিকে সেদিকে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
★★★
নিপুণ ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখতে পায় তার ফোন বাজছে৷ সে ফোনটা রিসিভ করার আগেই কে’টে যায়। ফোনটা হাতে নিয়ে নিপুণ দেখতে পায় দীপ্র অনেকবার তাকে ফোন করেছে। তাই সে আর দেরি না করে কলব্যাক করে। দীপ্র ফোন রিসিভ করেই অভিমানী স্বরে বলে,
“আমায় এভাবে পর করে দিলেন মহারাণী নিপুণ? এতবার কল করলাম আর এতক্ষণ পর আপনি কলব্যাক করলেন?”
নিপুণ হেসে ফেলে দীপ্রর কথা শুনে। অতঃপর জবাব দেয়,
“আপনি ভুল ভাবছেন মহারাজ দীপ৷ আমি আপনাকে পর করে দেইনি। ওয়াশরুমে ছিলাম৷ এসেই দেখি আপনি কল দিয়েছেন।”
“আচ্ছা৷ ঠিক আছে, তাহলে তুমি দশ মিনিটে তৈরি হয়ে নাও৷ আমি বিশ মিনিটের মধ্যে তোমার বাসার সামনে যাচ্ছি।”
“আমার বাসায় হঠাৎ কেন আসছ তুমি?”
“কেন? নিজের হবু শ্বশুর বাড়িতে যেতে পারিনা?”
“অবশ্যই পারো। তবে তুমি তো সচরাচর খুব একটা আসো না। তাই আরকি প্রশ্নটা করা।”
“তোমাকে আজ ঘুরতে নিয়ে যাব।”
“সত্যি?”
“কেন বিশ্বাস হচ্ছে না?”
“আসলে তুমি যা বিজি মানুষ। সারাদিন নিজের বিজনেস নিয়েই পড়ে থাকো। ঘুরতে যাওয়ার সময় আছে নাকি তোমার?”
“আর তুমি বোধহয় খুব ফ্রি মানুষ? তুমিও তো নিজের কাজে ব্যস্ত। জানো, আমি আমাদের কলেজ লাইফকে খুব মিস করি। সেইসময় আমরা একসাথে কত ঘোরাঘুরি করতাম। মনে আছে তোমার?”
নিপুণ অতীতের কিছু মিষ্টি স্মৃতি মনে করে। কলেজ জীবন থেকেই তারা একে অপরকে চেনে৷ কলেজে থাকাকালীন অবশ্য তাদের মধ্যে প্রথমে বন্ধুত্বের মাধ্যমে সম্পর্কের সূত্রপাত হয়। তবে এরপর পরিস্থিতি বদলায়। একসময় তারা একে অপরের প্রতি নিজেদের অনুভূতি বুঝতে পারে। তবে তাদের মধ্যে কখনোই সেরকম লুতুপুতু টাইপ সম্পর্ক ছিল না৷ সম্পর্কের কারণে নিজেদের ক্যারিয়ারেও ক্ষতি হতে দেয়নি তারা। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ দিয়েই সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।
নিপুণকে চুপ থাকতে দেখে দীপ্র অধৈর্য্য হয়ে বলে,
“কি হলো নিপুণ? কোন উত্তর দিচ্ছ না যে?”
“কিছু না। তা তুমি কোথায় নিয়ে যাবে আমায়?”
“তুমি যেখানে যেতে চাও সেখানেই নিয়ে যাব।”
“আচ্ছা। তাহলে তুমি আসো। আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি।”
★★
গাড়িতে পাশাপাশি বসে আছে নিপুণ ও দীপ্র। দীপ্র গাড়ি ড্রাইভ করছে আর নিপুণ তার পাশের সিটে বসে তাকে বলছে কোন দিকে যেতে হবে। হঠাৎ করেই দীপ্রর কি হলো সে রেডিওতে একটা রোম্যান্টিক গান বাজিয়ে দিল। রেডিওতে বাজতে লাগল, “Hasi ban haye” গানটা। নিপুণ মুচকি হেসে বললো,
“বাহ, আজ তো মনে হচ্ছে সাহেব বেশ রোম্যান্টিক মুডে আছে!”
“আসলেই। সেজন্যই তো সাহেবাকে ডাকা। যাতে মুহুর্তটাকে রোম্যান্টিক করে তুলতে পারি।”
“ঐটা তো একটা অনাশ আশ্রম। এখন আবার তুমি বলো না অনাথ আশ্রমে যাবে।”
“ওখানেই তো যাবো।”
বলেই গাড়ি থেকে নেমে যায় নিপুণ৷ তারপর পেছনের ছিট থেকে বাচ্চাদের জন্য আনা চকলেট, খেলনার প্যাকেট তুলে নেয়।
দীপ্র বলে ওঠে,
“ওহ, তাহলে এইজন্যই এগুলো সাথে এনেছিলে। কাজটা কি ভালো করলে?”
“নিঃসন্দেহে। আর তুমি এতো রাগ করছ কেন? তুমিই তো বলেছিলে যে আমি যেখানে চাই সেখানে নিয়ে যাবে।”
“তাই বলে এখানে?”
দীপ্র রেগে নিজের মুখ ফুলিয়ে নেয়৷ নিপুণ দীপ্রর রাগী মুখের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলে,
“থাক দীপ। তোমাকে আর ছোট বাচ্চাদের নতো রাগ করতে হবে না। আমি জাস্ট এখানে বাচ্চাদের সাথে দেখা করে তাদের গিফটগুলো দেব৷ তারপর আমরা ঘুরতে যাব। এবার খুশি তো?”
স্নেহা দীপ্রদের বাসার মধ্যে এককোণে দাঁড়িয়ে ছিল৷ তখন ওতো বাজে ভাবে অপমানিত হবার পর সে নিজেকে একদম গুটিয়ে নিয়েছে। এখন সে অপেক্ষায় আছে যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য।
স্নেহা ভাবল দীপ্র নিপুণকে রিং পড়িয়ে দেবার পরই সে চলে যাবে। সেই ভেবেই দাঁড়িয়ে রইল সে। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল এমন সময় দিলারা খাতুন তার সম্মুখে এলো৷ তার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
“এই মেয়ে তোমার মধ্যে কি কোন লজ্জা নেই? এত অপমানিত হবার পরেও তুমি এখানে পড়ে আছ কেন?”
স্নেহা লজ্জা পেল খুব। উত্তরে কি বলবে ভেবে পেল না৷ দিশা পাশ থেকে বলে উঠল,
“নিশ্চয়ই গান্ডেপিন্ডে গেলার জন্য পড়ে আছে। বাড়িতে তো ভালোমন্দ খেতেই পায় না।”
স্নেহা এবার আর সহ্য করতে পারল না৷ এতক্ষণ নিজের বাবার কথা ভেবেই চুপ ছিল সে৷ কারণ তার বাবা তাকে বলেছিল কারো সাথে কোন খারাপ ব্যবহার না করতে। কিন্তু এবার তার সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেছে৷ স্নেহা দিশার মুখের উপর বলে দিলো,
“আমি এখানে খেতে আসিনি। তুমি ভুল ভাবছ দিশা আপু৷ আমাদের বাড়িতে না অনেক ভালো ভালো রান্না হয়। আমার আব্বু বাজার করে আর আমি নিজের হাতে সেসব খাবার রান্না করি। একদিন এসে খেয়ে দেখো।”
দিশা উপহাস করে বলল,
“তোদের বাড়িতে খেতে হবে এত দূর্ভাগ্য আমার আসে নি।”
“ভাগ্য বদলাতে কিন্তু সময় লাগে না৷ তোমরা যেমন আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়েছ তেমনি কিন্তু আল্লাহ চাইলে এক পলকে আবার রাস্তায় এসে নামতে পারো।”
“স্নেহা!!”
দিলারা খাতুন ধমকে উঠলেন। স্নেহাও দমে না গিয়ে বলল,
“আমাকে ধমকাবেন না চাচি৷ আমি ভুল কিছু বলিনি সেটা আপনিও জানেন। আপনারাও তো আগে গ্রামে আমাদের মতো সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তারপর হঠাৎ করে চাচা লটারি পাওয়ায় আজ আপনাদের ভাগ্য ঘুরে গেল। শহরে এসে ব্যবসা করে আজ আপনারা এত বড়লোক। শহরের চাকচিক্য বোধহয় আপনাদের নিজেদের শিকড় ভুলিয়ে দিয়েছে৷ তাই আমি মনে করিয়ে দিলাম।”
“তুমি এক্ষুনি বেরিয়ে যাও আমাদের বাসা থেকে। আর কক্ষনো এখানে এসো না।”
দিলারা খাতুনর এমন কথায় স্নেহা আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না। তবে যাওয়ার আগে দিলারা খাতুনকে বলে গেল,
“আমি আজ এখান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি। আর কখনো আসব না। কথা দিলাম। আপনারা চাইলেও আর আসবো না।”
দ্রুত তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে স্নেহা কাঁদতে থাকে৷ তার পুরো ২০ বছরের জীবনে এমনভাবে কখনো অপমানিত হয়নি সে। স্নেহার এই কান্নায় লুকিয়ে থাকা কষ্টগুলো আজ তাকে বুঝিয়ে দিলো অর্থ,সম্পদ মানুষকে কিভাবে বদলে দেয়। কিভাবে রক্তের সম্পর্ক হেরে যায় তথাকথিত স্ট্যাটাসের কাছে!
★★★
দীপ্রর সাথে নিপুণের এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে। অতঃপর নিপুণ ও দীপ্র একসাথে আলাদাভাবে সময় অতিবাহিত করছিল। দুজনে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ছিল। দীপ্র নিপুণকে নানারকম কথা বলছিল কিন্তু নিপুণ শুধু হা হু করছিল। দীপ্র বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে,
“তুমি আমার কথার গুরুত্ব দিচ্ছ না কেন নিপু?”
“আজ তোমাকে আমার ভীষণ বিরক্ত লাগছে!”
“তোমার কথার মানে কি?”
“তোমার এইরকম ব্যবহার দেখতে হবে সেটা ভাবিনি।”
দীপ্র এগিয়ে এসে নিপুণের হাতটা শক্ত করে ধরে বলে,
“এসব কথা না বললেই নয়৷ তুমি কেন ব্যাপারটা ভুলতে পারছ না?”
“কিভাবে ভুলব বলো? নিজের ভালোবাসার মানুষের এই রূপ তো আমার কাছে অচেনা। তুমি একটু রাগী, জেদি সেটা আমি জানি। তাই বলে তুমি একজনের সাথে এতটা খারাপ ব্যবহার করবে?”
“তুমি ঐ স্নেহার ব্যাপারে কিছু জানো না তাই এভাবে বলছ।”
“আমার কেন ওর ব্যাপারে জানতে হবে দীপ? আমার তো নিজের জীবনসঙ্গীর ব্যাপারে জানতে হবে। নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে আমি একজন ভালো মানুষকে দেখতে চাই। যে ইহকাল এবং পরকাল উভয় স্থানে আমার সঙ্গী হবে।”
“আমি তোমার যোগ্য জীবনসঙ্গী হবো নিপু। কথা দিলাম। আমি জানি আমার মধ্যে কিছু ভুল ত্রুটি আছে। কিন্তু তুমি তো আছ আমাকে ঠিক পথ দেখানোর জন্য। কি বলো তুমি আমাকে নিজের মতো করে গড়ে তুলতে পারবে না?”
নিপুণের গোমড়া মুখে এতক্ষণে হাসির দেখা মেলে। সে দীপ্রর চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
“কেউ কাউকে গড়ে তুলতে পারে না দীপ৷ কোন মানুষই পার্ফেক্ট নয়৷ মানুষের মধ্যে কিছু দোষ থাকবে এটা স্বাভাবিক। তবে আমাদের উচিৎ যথাসম্ভব ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করা। আমি যেহেতু তোমার জীবনসঙ্গী হতে চলেছি তাই অবশ্যই আমি তোমার পথপ্রদর্শক হবো। তোমাকে জীবনের সঠিক পথ দেখাবো৷ তবে সেই পথে কিন্তু তোমার নিজেকেই চলতে হবে।”
“আমি চেষ্টা করব।”
★★★
সন্ধ্যা নামার একটু আগে স্নেহা এসে পৌঁছায় তাদের গ্রামে। রাজশাহী শহরের বাঘা উপজেলার ছোট্ট একটি গ্রাম কুসুমপুর। সেখানেই স্নেহার পৈত্রিক আবাস। দীপ্ররা অবশ্য এখন রাজশাহী শহরে স্থায়ী হয়েছে। সেখানে দীপ্রর বাবা আজিজ চৌধুরীর বড় একটি শপিংমল রয়েছে। যার দরুণ আজ তারা এত ধনী হতে পেরেছে৷ অন্যদিকে, স্নেহার বাবা আহমদ আব্বাস খান শিকড়ের টানে গ্রামেই রয়ে গেছেন। গ্রামে কৃষিকাজ করেন এছাড়া তাদের একটি গরুর খামার আছে। সেখান থেকে যা রোজকার হয় তাতে তাদের বাবা-মেয়ের ভালোই চলে যায়৷ স্নেহার মা বছর দুয়েক আগে হঠাৎ করে স্টোক করে মারা যান৷ তারপর থেকে নিজের বাবার সাথে একাই থাকে স্নেহা।
স্নেহা যখন বাড়িতে গিয়ে পৌঁছালো তখন ঘড়ির কাঁ/টায় ৭ টা বাজে৷ স্নেহা বাড়িতে ঢোকামাত্রই দেখতে পায় তার বাবা আব্বাস খান চেয়ারে বসে টিভিতে নিউজ দেখছেন। স্নেহা পিছন থেকে নিজের বাবাকে জড়িয়ে ধরে। আব্বাস খান মৃদু হেসে বলেন,
“তুই এসেছিস মা? আমি তো ভাবলাম তোর চাচা আজ তোকে আসতেই দেবেন না।”
স্নেহার মুখে হঠাৎ আঁধার নেমে এলো। আব্বাস খান একদম মাটির মানুষ। তিনি এতটাই সহজ সরল যে তার যেই ভাই বছরে একবার তাদের খোঁজ নেয় না তার কাছ থেকে বেশি কিছু আশা করে ফেলছে। স্নেহার এখন আর বুঝতে বাকি নেই নেহাতই দায়িত্বের খাতিরে তাদের এনগেজমেন্টে দাওয়াত দিয়েছিল ওরা।
স্নেহা যখন প্রতিত্তোরে কিছু বলল না তখন আব্বাস খান পিছন ফিরে নিজের মেয়ের দিকে তাকালেন। স্নেহার মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“কিরে তোর মুখ এমন শুকনো লাগছে কেন? কিছু খাস নি নাকি?”
স্নেহার ইচ্ছা করলো তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে৷ বাবার বুকে লুটিয়ে পড়ে সব কথা তাকে জানাতে৷ কিন্তু স্নেহা নিজের সেই ইচ্ছাকে দমিয়ে রাখল৷ এমনিতেই আব্বাস খান একজন হার্টের পেশেন্ট। একবার হার্ট এট্যাক হয়েছে ওনার৷ ডাক্তার ওনাকে কোন স্ট্রেস নিতে মানা করেছেন। স্নেহাকেও সতর্ক করে দিয়েছেন যেন উনি এমন কোন কথা জানতে না পারেন যা ওনাকে আঘাত দেবে৷ তাই স্নেহা নিজের বাবার কাছ থেকে লুকিয়ে গেল সমস্ত কথা। মুখে মেকি হাসি ফুটিয়ে বলল,
“খাবো না কেন? খেয়েছি তো। অনেক কিছুই খেয়েছি। এত খেয়েছি আমার পেটে তো আর যায়গাই নেই৷ চাচা নিজে দায়িত্ব নিয়ে আমাকে খাইয়েছে। আচ্ছা, আমি অনেক ক্লান্ত। তুমি থাকো। আমি নিজের ঘরে যাচ্ছি। কাল আবার সকাল সকাল ভার্সিটি যেতে হবে।”
আব্বাস খান ভাবুক স্বরে বললেন,
“ভার্সিটি বলতে মনে পড়ল, তুই আর কতদিন এখান থেকে শহরে যাতায়াত করবি বল তো? সামনে নাকি তোর এক্সাম। তোকে না বলেছিলাম তোর চাচার সাথে কথা বলতে যে পরীক্ষার ক’দিন যদি ওখানে থেকে….”
“তার কোন দরকার নেই আব্বু। শুধু শুধু ওনাদের বিব্রত করতে যাব কেন? আমি বরং হোস্টেলেই উঠব। প্রজ্ঞার সাথে আমার কথা হয়েই আছে। ও বলেছে আমাকে হোস্টেলে একটা রুম ম্যানেজ করে দেবে।”
“আচ্ছা। যা ভালো ভাবিস কর৷ এখন যা বিশ্রাম নে।”
স্নেহা আর কথা না বাড়িয়ে কলতলায় গিয়ে পরিস্কার হয়ে নিলো। অতঃপর ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। ঘুম এলো না তার চোখে৷ অপমানের কথা ভেবে শুধুই অশ্রু এলো তার চোখে
১ .
“ছেঁ’ড়া শাড়ি পড়ে এত বড় অনুষ্ঠানে আসতে লজ্জা করল না তোর?”
নিজের চাচাতো ভাইয়ের মুখে এমন অপমানজনক কথা শুনে স্নেহার চোখে জল চলে এলো। ঠোঁট কামড়ে নিজের কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করল সে। অপরদিকে উল্টো পাশে থাকা দীপ্রর যেন খুব ভালো লাগল স্নেহাকে এভাবে অপমান করে। তাই তো সে আরো বলতে লাগল,
“তোর বাবা যে এত গরীব হয়ে গেছে জানতাম না। জানলে আমরা নিশ্চয়ই সাহায্য করতাম। কিন্তু তাই বলে আমার এনগেজমেন্টে তোকে এমন ছেঁ’ড়া শাড়ি পড়ে পাঠালো। আমাদের বললে তো আমরা আরো অনেক সুন্দর শাড়ি পাঠিয়ে দিতাম। তাও আমাদের এভাবে অসম্মানিত হতে হতো না।”
স্নেহা ধরে আসা গলায় বললো,
“আমার শাড়িটা ঠিকই ছিল ভাইয়া। হয়তো কোনভাবে..”
“থাক। আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে হবে না।”
এমন সময় দীপ্রর ছোট বোন দিশা একটা শাড়ি নিয়ে এলো। স্নেহার দিকে শাড়িটা ছু’ড়ে দিয়ে বলল,
“এই নে। যা শাড়িটা পড়ে নে। এমনিতেই আমাদের যথেষ্ট অপমানিত হতে হয়েছে তোর জন্য। আমরা আর অপমান চাই না। এই শাড়িটা পড়ে আমাদের ধন্য কর।”
স্নেহা অপমানে একদম মিলিয়ে যেতে লাগল। আগে যদি জানত শহরে নিজের চাচার বাড়িতে এসে এভাবে অপমানিত হতে হবে তাহলে কখনোই আসত না সে। নেহাৎ তার অসুস্থ বাবা নিজের ভাইয়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে তাকে পাঠালো। কিন্তু সে তো আর জানত না এই যান্ত্রিক শহরে থেকে তার ভাই কতটা বদলে গেছে।
আজ তার এই অপমানে তার চাচি যে কিছু বলবে না সে জানে। কারণ তিনি এমনিতেই তাদের পরিবারের কাউকে পছন্দ করেন না। কিন্তু তার চাচা যে এভাবে নিশ্চুপ থাকবেন সেটা ভাবে নি।
স্নেহা মনে করে আজ তার সাথে কি কি হলো। দীপ্রর এনগেজমেন্টে আসার পথে তার শাড়ির আঁচলের দিকে একটু ছিড়ে যায়। স্নেহা এখানে শুধু আজকের দিনের জন্যই এসেছে তাই আর কোন ড্রেসও আনা হয়নি। এখন এতদূর এসে বাড়ি ফিরে যাওয়ারও উপায় নেই। তাই এই অবস্থাতেই সে দীপ্রদের বাড়িতে চলে আসে। আর এখানে আসার পর তার চাচা আজিজ খান বেশ আদর যত্নই করে। কিন্তু তার চাচী দিলারা খাতুন তাকে দেখেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল৷ যদিও এতে সে কিছু মনে করে নি। কারণ চাচির থেকে এর থেকে বেশি কিছু আশাও করা যায়না। কিন্তু যখন দেখল দীপ্র আর দিশাও তাকে এড়িয়ে চলছে তখন বেশ খারাপ লাগল। কারণ তাদের সাথে স্নেহার ছোটবেলায় অনেক ভালো সম্পর্ক ছিল। ওরা যখনই গ্রামে বেড়াতে যেত কত কথা হতো তাদের মাঝে৷ একসাথে কত খেলাধুলা করত তারা। আজ সবই শুধু অতীতের পাতায় সীমাবদ্ধ।
এতকিছুর পরে যখন এনগেজমেন্টে উপস্থিত সব গেস্টদের সাথে স্নেহার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন আজিজ খান, বিপত্তি বাঁধে তখনই। একজন মহিলা স্নেহার ছে’ড়া শাড়ি লক্ষ্য করে উপহাস করে বলেন,
“আপনার ভাতিজির শাড়িটা তো বেশ ইউনিক। এমন ডিজাইন কোথায় পাওয়া যায়।”
তখন সবাই শাড়ির আঁচলের দিকে খেয়াল করে ছেঁ’ড়া অংশটি দেখতে পায়। ব্যস, শুরু হয়ে যায় হাসাহাসি। সবার সামনে স্নেহা ব্যাপক লজ্জায় পড়ে। এত অপমানিত বোধ আগে কখনোই করে নি সে।
স্নেহার এসব ভাবনার মধ্যেই দীপ্র চিৎকার করে বলে উঠল,
“দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা শাড়িটা চেঞ্জ করে আয়। আমাদের এত অপমান করে কি তোর শান্তি হয়নি?”
এমন সময় হঠাৎ সেখানে উপস্থিত হলো দীপ্রর বাগদত্তা নিপুণ খান। নিপুণ এসেই দীপ্রকে উদ্দ্যেশ্য করে কড়া গলায় বলল,
“কি হচ্ছেটা কি দীপ্র? তোমার থেকে এরকম ব্যবহার আশা করিনি। ও তো তোমাদের গেস্ট। গেস্টের সাথে কেউ এমন ব্যবহার করে কখনো?”
দীপ্র কিছু বলতে যাবে তার আগেই দিশা বলে ওঠে,
“এ আবার কেমন গেস্ট? ওর জন্য আজ সবার সামনে আমাদের কত অপমানিত হতে হলো সেটা তো তুমি দেখলেই নিপুণ আপু। তারপরও এমন কথা বলছ কিভাবে?”
“আমি সবটাই দেখেছি দিশা। তাই এমন কথা বলছি। ওর তো এখানে দো”ষ নেই। দো’ষ হলো মানুষের চিন্তাভাবনায়। ও তো বলল শাড়িটা ছেঁ’ড়া ছিল না দূর্ঘটনাবশত ছিঁ’ড়ে গেছে। তারপরেও এত কথা হচ্ছে কেন আমি বুঝতে পারছি না।”
কথাটা বলতে বলতেই নিপুণ স্নেহার কাছে চলে আসে। স্নেহা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল৷ নিপুণ এসে তার মাথাটা আলতো করে তুলে ধরে বলে,
“মাথা নিচু করে থাকার মতো কাজ তুমি করো নি স্নেহা৷ তাই এভাবে একদম মাথা নিচু করে থাকবে না। সবসময় চুপ থাকা কোন সমাধান নয়৷ মাঝেমধ্যে একটু প্রতিবাদ করতেও জানতে হয়। নিজের সম্মানের জন্য কিন্তু লড়াইটা নিজেকেই করতে হয়।”
স্মেহা তাকালো নিপুণের দিকে। নিজের নামের মতোই নিপুণ মেয়েটা। দেখতে অসম্ভব সুন্দরী, ধবধবে ফর্সা গায়ের রং, টানা টানা চোখ, মুখে লেগে থাকা সুশ্রী হাসি সবমিলিয়ে সৌন্দর্য যেন উতলে পড়ছে। স্নেহা শুনেছিল দীপ্রর হবু বউ নাকি একজন উকিল। বেশ স্পষ্টভাষী, চাচা অনেক প্রশংসাও করত এই মেয়েটার। আজ সে বুঝল কোন প্রশংসাই মিথ্যা নয়। নিপুণ সত্যিই অনেক ভালো মেয়ে।
এতক্ষণ মৌন থাকা আজিজ খান এতক্ষণে মুখ খুললেন। নিপুণের উদ্দ্যেশ্যে তিনি বললেন,
“নিপুণ মা, দীপ্র তোমরা নিচে যাও। একটু পর তোমাদের এনগেজমেন্ট। আমি এদিকটা সামলে নিচ্ছি।”
“আমি তো এতক্ষণ এখানে ছিলাম না আঙ্কেল। তখন তো আপনি এখানে উপস্থিত ছিলেন। মাফ করবেন, একজন গুরুজন হিসেবে আপনি নিজের দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। আপনার সামনে আপনাদের বাড়ির গেস্টকে আপনার ছেলে-মেয়েরা কত অপমানজনক কথা বলল আর আপনি কোন প্রতিবাদ না করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখলেন! আপনার থেকে এটা আশা করিনি।”
দিলারা খাতুন নিপুণের এমন ত্যাড়া কথা শুনে রেগে গেলেন। মেয়েটাকে এমনিতেই ছেলের বউ হিসেবে তার বেশি একটা পছন্দ নয় এই স্পষ্টভাষী স্বভাবের কারণে। নেহাতই তার স্বামী ও ছেলের খুব পছন্দ নিপুণকে তাই কিছু বলতে পারেন নি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তিনি নিপুণের সব কিছু মেনে নেবেন। তাই তো তিনি নিপুণের মুখের উপরেই বলে দিলেন,
“এটা আমাদের ফ্যামিলি ম্যাটার নিপুণ। তুমি কিন্তু এখনো আমাদের পরিবারের কেউ হও নি। তাই আশা করব তুমি এর মধ্যে ইন্টারফেয়ার করবে না।”
নিপুণ মৃদু হেসে ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে বলল,
“একজনকে অপমান করা কারো ফ্যামিলি ম্যাটার হতে পারে না আন্টি। এভাবে একটা মেয়েকে অপমান করার কোন রাইট আপনাদের কারো নেই।”
দীপ্র এগিয়ে এসে নিপুণের হাত ধরে বলে,
“এই বিষয় নিয়ে আর কোন কথা নয়। চলো আমাদের এনগেজমেন্টের টাইম হয়ে যাচ্ছে।”
“কোন এনগেজমেন্ট হবে না।”
নিপুণের স্পষ্ট জবাব। বাড়ির সকলে তার কথায় প্রচণ্ড অবাক হলো৷ আজিজ খান উত্তেজিত হয়ে বললেন,
“এসব তুমি কি বলছ নিপুণ? এনগেজমেন্ট হবে না মানে!”
“হুম। ঠিক বলেছি। যতক্ষণ পর্যন্ত না দীপ্র স্নেহার কাছে ওর করা ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইছে ততক্ষণ পর্যন্ত কোন এনগেজমেন্ট হবে না।”
দীপ্র রাগী গলায় বলে ওঠে,
“ক্ষমা তাও আবার এই মেয়েটার কাছে! নো নেভার।”
” ঠিক আছে। তাহলে আমি চলে যাচ্ছি।”
বলে যেই না নিপুণ চলে যেতে নেবে ঠিক সেই সময়ই একদম দীপ্র বলে ওঠে,
“থামো। আমি ওর কাছে ক্ষমা চাইতে রাজি। তুমি প্লিজ যেও না।”
নিপুণ থেমে যায়। দীপ্র পকেটে হাত গুজে স্নেহার সামনে এসে দাঁড়ায়। বেশ দায়সারা ভাবে বলে,
“সরি।”
স্নেহা কিছু বলে না৷ দিলারা খাতুন ভীষণ রেগে যান এই দৃশ্য দেখে। নিজের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দিশার উদ্দ্যেশ্যে বলেন,
“এই মেয়েটা কি দিয়ে বশ করল আমার ছেলেটাকে? আমার যেই ছেলেটা এতটা দম্ভ নিয়ে চলে সে কিনা এই মেয়ের এক কথায় সরি বলে দিল! আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।”
দিশা ভাবলেশহীন ভাবে বলে,
“এজন্যই তো লোকে বলে, ভালোবাসা অন্ধ।”
চকিতে তাকাল সিমরান। অল্পসময়ের জন্য মুখ থেকে হাসি উধাও হলেও সে হাসি পুনরায় ফিরিয়ে আনল। মনে মনে ভাবতে লাগল, আশ্চর্য তো! সে তার বাড়িতে যাচ্ছে? তাও আবার শাশুড়ি, ঝুমায়না ভাবি, তাহানীকে নিয়ে? আজ কি কোনো স্পেশাল ডে আছে? সে কি ভুলে গেছে কোনো স্পেশাল দিনের কথা? ভাইয়ার জন্মদিন, আব্বু, আম্মুর জন্মদিন, তার জন্মদিন সব তারিখ মনে করল। অকস্মাৎ থরথর করে হাত, পা কেঁপে উঠল তার। এতজন নিয়ে বাবার বাড়িতে যাচ্ছে। তার তো আম্মু নেই। ভাইয়ের বউটাও নেই। আব্বু আছে কিনা সেটাও প্রশ্ন। আজ সেলিনা আপা এসেছে তো? ওহ-হো! গতকাল রাতে আব্বুকে ফোন করা হয়নি। সেই যে দুপুরে কথা হলো। সে না হয় করেনি। আব্বুও তো একবার ফোন করল না। তবে কী ভীষণ ব্যস্ত ছিল? এখন একবার ফোন করে জানিয়ে দেবে কি?
ভাবতে ভাবতেই মোবাইল ফোনটা বের করল সিমরান। আব্বুর নাম্বারে ডায়াল করতে উদ্যত হতেই অনুভব করল, আম্মা কাঁদছে। নিঃশব্দ কান্না। যা টের পেয়ে বুকের ভেতর মুচড়ে উঠল কেমন। স্তব্ধ হয়ে গেল নিমিষে। সে স্তব্ধ ভাবেই কল করল আব্বুর নাম্বারে৷ রিসিভ হলো না ফোনটা৷ কিঞ্চিৎ অস্থিরতা অনুভব করল। আড়চোখে তাকিয়ে দেখল, শাশুড়ি আম্মা নির্লিপ্ত ভাবে বসে আছেন। দৃষ্টি ছলছল। সে সচেতন ভাবে নিঃশ্বাস ফেলল। খচখচিয়ে উঠল মন। ফের কল করল আব্বুর নাম্বারে। রিসিভ হলো না। রাগ হলো ভীষণ, অভিমান করে, মেজাজ খারাপ করে ফোন পার্সে ঢুকিয়ে চুপটি মেরে বসে রইল। নির্বোধ মেয়েটা এখনো টের পায়নি। আজকের পর তার আব্বু আর কখনো ফোন রিসিভ করবে না।
গাড়ি যত এগুচ্ছে। পরিবেশ তত থমথমে হচ্ছে। সিমরান কিছু জানে না৷ তবু রক্তের টান, আত্মার টান বলেও পৃথিবীতে অদৃশ্য এক শক্তি বিরাজমান। তাই তো অস্থির অস্থির করছে মেয়েটা। কেন যেন রাগ হচ্ছে ভীষণ। সবকিছু ভাঙচুর করতে মন চাচ্ছে। এত হাসফাস কেন লাগছে? বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে প্রায়। তানজিম চৌধুরী তাকালেন পুত্রবধূর পানে। তার ছলছল দৃষ্টি দেখে সিমরান কেমন যেন হয়ে গেল। বুকের ভেতর কী যেন একটা ভয়ংকর কথা জানান দিল। নিমেষে গা থেকে চাদর ফেলে দিল সে। কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
‘ কী হয়েছে আম্মা? ‘
হাত বাড়ালেন তানজিম চৌধুরী। পুত্রবধূর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কাঁপা স্বরে বললেন,
‘ আমাদের জীবনে মৃত্যু এক অনিবার্য সত্যি মা। সব অস্বীকার করা যায় কিন্তু মৃত্যুকে অস্বীকার করার সাধ্য কারো নেই। সিনু মা.. ‘
বাকিটুকু বলতে দিল না সিমরান। ভ্রু কুঁচকে অস্থির হয়ে মোবাইল ফোন বের করল। আব্বুর নাম্বারে কল করল আবারো। রিসিভ হলো না। অবচেতন মন সম্পূর্ণ স্থিরতা হারাল এবার। গায়ের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে মোবাইল ফোনটা আছড়ে ফেলল। তানজিম চৌধুরী হতভম্ব হয়ে সিমরানকে জাপ্টে ধরতে চাইলেন। কিন্তু পারলেন না। সিমরান সরিয়ে দিল উনাকে। হতাশ হয়ে মাথা মেলে দিল সিটে। বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিতে নিতে অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল শাশুড়ির পানে। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,
‘ আমার কী আবার কোনো সর্বনাশ ঘটল আম্মা? ‘
.
পৃথিবীর দু’প্রান্তে দু’জন মানুষ। আলাদা শরীর, আলাদা দু’টো মন। তবু একজনের যন্ত্রণায় ক্রমশ আরেকজন কাতর হচ্ছে। উথাল-পাতাল করছে ভিনদেশে। এদিকের কোনো আপডেট আপাতত নিতে পারছে না সৌধ। মোবাইলটা হাতে নিয়ে হাসফাস করে যাচ্ছে ক্রমাগত। মন, মস্তিষ্ক, সর্বস্ব জুড়ে শুধুই সিনু, সিনু আর সিনু। নিজেকে কোনোভাবেই ঠিক রাখতে পারছে না। যদি কোনো দৈবশক্তি থাকত তার। তাহলে এক্ষুনি চলে আসত বাংলাদেশে। সিনুর কাছে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরত মেয়েটাকে। বুকের গহিন বনে লুকিয়ে রাখত। কোনো দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণাকে ছুঁতে দিত না। একদমই না।
.
.
বাড়ির সামনে অ্যাম্বুলেন্স আর মানুষের ভীড় দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল সিমরান। অনড় দৃষ্টিতে একবার তাকাল শাশুড়ির পানে। তানজিম চৌধুরী তাকে ধরতে গেলে সে সুযোগ দিল না৷ হাতের পার্স, গায়ে জড়ানো চাদর সবকিছু ফেলে একছুটে বাড়ির ভেতর চলে গেল। দেখতে পেল, সুহাস ভাইয়ার কাছের কয়েকজন বন্ধু, অর্পণ স্যার আর সুলল কাকুকে। শরীর ঘামছিল সিমরানের৷ সেই ঘাম ঝড়া থেমে গেল, পরিচিত একটি দৃশ্য দেখে। যে দৃশ্যটা দেড় বছর আগে দেখেছিল। পার্থক্য এতটুকুই সেদিন এই জায়গায় তার আম্মু ছিল। আজ আব্বু। সর্বাঙ্গ শিউরে উঠল মুহুর্তে। অবিশ্বাস্য, অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্যটি দেখে অসাড় হয়ে গেল পা দু’টো। চোখ গলে রক্তের ফোয়ারা বেরুনোর অপেক্ষা। বুক ফেটে বেরুনোর অপেক্ষা বীভৎস আর্তনাদ। অসাড় হয়ে উঠা পা দু’টো আগাতে উদ্যত হলো সিমরান৷ তক্ষুনি
কাঁধে অনুভব করল পরিচিত কারো স্পর্শ। চকিতে তাকাতেই দেখতে পেল নিধি আপু! নিজেকে এবার ধরে রাখা দায় হয়ে পড়ল। বীভৎস এক চিৎকার করে আব্বুর নিথর দেহে আঙুল তুলে ইশারা করে বলল,
ঝটকায় নিধির হাত সরিয়ে দিয়ে ছুটে আব্বুর কাছে চলে এলো সিমরান। দু-হাত বাড়িয়ে আব্বুর শরীর ছুলো। কখনো মাথায়, কখনো মুখে বা বুকে বুলিয়ে দিতে দিতে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করল,
‘ আব্বু, ও আব্বু তুমি উঠো। উঠে বসো। কিচ্ছু হয়নি তোমার। কোথ্থাও যেতে পারো না তুমি। আমি এটা মেনে নিব না আব্বু। না, না, না। ‘
বলতে বলতে আব্বুর বুকে মাথা রেখে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল সিমরান। তানজিম চৌধুরী এলেন। নিধি এসে ধরল ওকে। বলল,
‘ সিনু আংকেলের কষ্ট হচ্ছে। সিনু.. ‘
তানজিম চৌধুরীও ওকে সামলানোর চেষ্টা করলেন।
কারো কথা শুনল না সিমরান। সবাইকে তুচ্ছ করে নিজের মতো আব্বুকে ডেকে গেল। উঠে বসত বলল। তাকে বুকে নিতে বলল। মাথায় হাত রেখে আদর করতে বলল৷ কতশত আবদার করল আর কাঁদল লিখে প্রকাশ করা যাবে না৷ সোহান খন্দকার উঠলেন না। দিলেন না সাড়া। চিরতরে নিথর হয়ে গেছে মানুষটা। হাত, পা ছুঁড়ে কাঁদল সিমরান৷ ভাঙা কণ্ঠে বারবার বলল,
‘ তুমিও, তুমিও চলে গেলে আব্বু? আমার ভাই, আমার ভাইটা কোথায়! ‘
আকস্মিক সুহাসের কথা মনে পড়তেই বাবার মুখপানে বড়ো বড়ো করে তাকাল। হাত বাড়িয়ে দাঁড়ি ভর্তি গাল দু’টো অঞ্জলিতে নিয়ে বলল,
আব্বু কথা শোনে না। নড়ে না, শ্বাস নেয় না৷ আম্মুর মতো পাথর হয়ে আছে৷ ইশ হাত, পা কেমন ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। তোমার কি শীত লাগছে আব্বু? নাকে লালচে হয়ে আছে কেন? কী এটা রক্ত? নাকে স্পর্শ করল। রক্তের দাগ লাগল হাতে। টের পেল আব্বুর শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে না। হৃৎস্পন্দন থমকে গেল সিমরানের। এক টানা হুহু করে কাঁদল। আশপাশে তাকাল বিধ্বস্ত মুখে। কেউ নেই, কেউ রইল না। আম্মি নেই, সুহাস নেই, সৌধ নেই। আব্বুও থাকবে না। আপন বলতে আর কেউ নেই। এখানে যারা দর্শক হয়ে এখন আছে। সবাই দায়িত্বশীল। কর্তব্য পালনে তৎপর। তার বলতে কেউ নেই, কেউ না। কান্না থেমে গেল সহসা। পাশে নিধিকে পেয়ে একটু শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘ নিধি আপু, তোমরা তো সবাই ডাক্তার। এতগুলো ডাক্তার থাকতে আমি এত তাড়াতাড়ি কীভাবে এতিম হয়ে গেলাম? ‘
নিধি কাছে এলো আরোও। জড়িয়ে ধরল মেয়েটাকে শক্ত করে। একটা বুক সত্যি প্রয়োজন ছিল ওর। নিধি পেতে দিল তার বুক৷ সিমরানের নিঃশ্বাস আঁটকে এলো। নিধি আপুর বুকে মাথা রেখে চিৎকার করে কাঁদল আর বলল,
‘ ভাইয়া আর সৌধভাইকে একবার ফোন করো নিধি আপুউউ। ওরা এলে ঠিক আব্বুকে সারিয়ে তুলবে। আমরা একেবারে এতিম হবো না। ‘
কথাটা বলতে বলতেই জ্ঞান হারাল মেয়েটা। নিধি টের পেয়ে চ্যাঁচিয়ে উঠল৷ তানজিম চৌধুরীকে বলল,
‘ আন্টি, আন্টি! সিনু জ্ঞান হারিয়েছে। মাথায় পানি দিতে হবে৷ হেল্প মি. ‘
.
আত্মীয়, স্বজনে ভরপুর বাড়ি৷ চারিদিকে কান্নার রোল। আইয়াজ, আজিজ এলো তখন৷ সোহান আংকেলকে শেষ গোসল করানোর প্রস্তুতি চলছে। তার জন্য গ্রামের বাড়িতে, গোরস্থানে উদয়িনীর কবরের পাশে কোবর কাটা হয়েছে। সিমরান এখন আব্বুর কাছে নেই৷ সে ঘরে স্তব্ধ মুখে বসে আছে। পাশে নিধি, তানজিম চৌধুরী। ওর বান্ধবীরা এসেছে। দরজার পাশে কান্নারত মুখে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। কারো দিকে ফিরেও তাকাল না সিমরান৷ ওর মামার বাড়ির লোকজন এলো, সোহান খন্দকারের গোসল শেষে৷ কাফনের কাপড় পরানো হয়েছে সুহাস, সিনুর আব্বুকে। শেষ দেখার জন্য সিমরানকে নিয়ে আসতে বলল ওর মামা। সিমরান এলো। তানজিম চৌধুরী আর নিধি ধরে আনল ওকে। একা হাঁটার শক্তি নেই মেয়েটার। আব্বুকে শেষ দেখা দেখল সিমরান৷ এখন আর কাঁদছে না৷ ওর বৃদ্ধা নানুমনিও এসেছেন। বসে আছেন একটু দূরে হুইলচেয়ারে। বৃদ্ধা এখন ঠিকঠাক হাঁটতে পারে না। লাঠি ভর করেও হাঁটতে কষ্ট হয় তার। সিমরান নানুমনির দিকে একবার তাকাল। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকাল আব্বুর পানে। মুখ বাড়িয়ে চুমো খেল আব্বুর কপালে। এরপর সারা গায়ে একটু হাত বুলিয়ে চারপাশে তাকাল। দৃষ্টি অসহায়। অকস্মাৎ মনে পড়ল ভাইয়াকে, সুহৃদকে। সবশেষে স্বামী সৌধকে। বুকের বা পাশটায় কেমন করে যেন মুচড়ে উঠল একবার৷ এরপর নিঃশ্বাস আঁটকে পুরো পৃথিবী অন্ধকার করে জ্ঞান হারাল। পুরোপুরি জ্ঞানশূন্যের পূর্বে নিধি ওকে অস্পষ্ট স্বরে বলতে শুনল,
‘ নি-ধি আ-পু আমার দ-ম বেরিয়ে যাচ্ ‘
সোহান খন্দকারকে গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হলো। জানাজা পড়ে তার খাটিয়ার সামনে দাঁড়াল, আইয়াজ আর অর্পণ স্যার। সুলল কাকু আর সিমরানের মামারা পেছনে ধরলেন। এরপর সবাই চিরবিদায় দিল সোহান খন্দকারকে। এদিকে আধাঘন্টার মতো সিমরানের জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো নিধি৷ তানজিম চৌধুরী সমানে হাত, পা ডলে দিলেন। মামিরা মাথায় পানি দিলেন৷ নিধি হার্টবিট চেক করে সুবিধা না পেয়ে কল করল অর্পণকে। অর্পণ স্যার ইমিডিয়েটলি হসপিটাল এডমিট করতে বলল ওকে। সবাই মিলে সিমরানকে হসপিটালে ভর্তি করাল। অর্পণ আর আইয়াজ বাইকে করে চলে এলো হসপিটালে। জ্ঞান ফিরলেও শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে দেখে চটজলদি সিমরানকে অক্সিজেন দিল অর্পণ স্যার৷ মেয়েটা হা করে বড়ো বড়ো শ্বাস নিল৷ দু-চোখের পাতায় ভেসে উঠল কাফনের কাপড়ে জড়ানো বাবার ফ্যাকাশে মুখ। নিমেষে কার্ণিশ বেয়ে অশ্রু ঝড়ে পড়ল। অর্পণ স্যার খেয়াল করলেন। কাছে এসে কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন,
‘ বি স্ট্রং সিমরান। আমরা সবাই তোমার পাশে আছি। সবচেয়ে বড়ো কথা সৌধ চৌধুরী মতো হাজব্যন্ড তোমার পাশে আছে। তার সঙ্গে বাঁচতে হবে তোমাকে। তাকে পাশে রেখে আর পাশে থেকে সুন্দর একটা জীবন কাটাতে হবে। তুমি কি শুনতে পাচ্ছো আমার কথা? ‘
একটুক্ষণ থামল অর্পণ। সুক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে কিছু একটা পরোখ করল। এরপর ডাকল, নিধিকে। এরপর পুনরায় সিমরানকে বলল,
‘ আমাদের জীবন থেকে সৃষ্টিকর্তা যদি একটা প্রাণ নিয়ে নেয় তাহলে একাধিক প্রাণ দানও করেন। আমি বাবা হারিয়েছি বহু বছর আগে। আজ এত বছর পর আল্লাহ তায়ালা অনির মাধ্যমে আমার বাবা হারানোর যন্ত্রণা মলিন করে দিয়েছে। সিমরান, আজ তুমি যা হারালে একদিন সৃষ্টিকর্তা দু-হাত ভরে তা ফিরিয়েও দেবেন। ‘
নিধি এলো ভেতরে। অর্পণ স্যার বললেন,
‘ সৌধর মা আর তুমি ওর পাশে থাকতে পারবে। দুজন ছাড়া ভেতরে আর কাউকে এলাউ করা যাবে না। ‘
নিধি মাথা নাড়লো। মুহুর্তেই বেজে উঠল ফোন। স্ক্রিনে বাইরের দেশের নাম্বার! তবে কি সৌধ? কিছুতেই রিসিভ করা যাবে না৷ সিমরানের এই অবস্থা কিছুতেই জানানো যাবে না। ভেবেই ফোন সাইলেন্ট করে দিল। সৌধ নিধিকে না পেয়ে ছটফট করতে করতে আইয়াজকে কল করল। এতক্ষণে নিশ্চয়ই সোহান আংকেলের দাফন হয়ে গেছে?
শোকের বশে সিমরানের অবস্থা দেখে আবেগি হয়ে সৌধকে সবটা বলে দিল আইয়াজ। সিমরান ভয়াবহ অসুস্থ হয়ে পড়েছে! দীর্ঘক্ষণ জ্ঞান হারা ছিল৷ কোনোভাবেই জ্ঞান ফিরছিল না৷ তাই হসপিটালাইজড করে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে। বাকিটা আল্লাহ ভরসা।
আইয়াজের এই বোকামি, ও দেশে সৌধর অবস্থা কতটা বিধ্বস্ত করে তুলল সে এক উপরওয়ালা আর সৌধই জানে৷ এদিকে নিধি সবটা শুনে আইয়াজকে কম বকাঝকা করল না। আইয়াজও বুঝতে পারল, এভাবে সৌধকে আতঙ্কিত করে দিয়ে সে একদম ঠিক করেনি। তারা এতজন ডাক্তার থাকতে ভরসাদায়ক কিছু না বলে ভয় দেখানো একদম উচিত হয়নি। এবার সৌধকে কে সামলাবে? কে? সে কতক্ষণই বা টিকতে পারবে ও দেশে? আর সুহাস!
সকাল থেকেই পদ্মাবতীর মাঝে একটা ভয় কাজ করছিল। বেলা যত গড়াতে থাকলো, ভয়টা যেন আরও জেঁকে বসলো। সন্ধ্যেবেলা থেকে অস্থির হয়ে উঠলেন। কোথাও একবিন্দু স্থির থাকতে পারছিলেন না। এই বুঝি অর্ণব তাকে ছেড়ে চলে গেলেন। সময় গেলেও তার অস্থিরতা সহজে গেল না। ঘড়ির কাঁটা এখন এগারোটা ছুইছুই। অর্ণবকে দেখলেন সিড়ির কাছে বসে অরণ্যর সাথে খেলছেন। এতোক্ষণে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন তিনি। আম্রপালি বললেন,
“নিচের সব বাতি নিভিয়ে দে তো পদ্মা। তার আগে গিয়ে বাইরের বাতিটা নিভিয়ে আয়।”
পদ্মাবতী ছুটে গেলেন বাইরের আলো নেভাতে। কিন্তু সদরদরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন। বাড়ির সামনে একটা গাড়ি এসে থেমেছে। কেউ একজন নামলেন গাড়ি থেকে। অন্ধকারে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। পদ্মাবতী চোখ ছোট ছোট করে বোঝার চেষ্টা করলেন আর বিড়বিড় করে বললেন,
“এতো রাতে আবার কে এলো?”
আম্রপালি পেছন থেকে তাড়া দিতে লাগলেন।
“কী হলো পদ্মা? দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বাতিটা নিভিয়ে ঘরে চলে যা তাড়াতাড়ি।”
“কে যেন এসেছেগো বড়মা।”
“সে কি! এখন আবার কে আসবে।”
লোকটা আরেকটু কাছে আসতেই পদ্মাবতী বলে উঠলেন,
“শমিতদা এসেছে বড়মা।”
আম্রপালি এগিয়ে এলেন। শমিতকে ভেতরে ঢুকতে দেখে বলে উঠলেন,
“এই তোর আসার সময় হলো শমিত?”
“আমার কী দোষ মামী। ট্রেনটাই তো দেরি করলো। এক নয়, দুই নয়, পুরো চারটা ঘন্টা দেরি করে এলো।”
“ঠিকাছে। তুই ভেতরে আয়। হাতমুখ ধুয়ে নে। আমি খাবারের ব্যবস্থা করছি। দিদি তো ঘুমিয়ে পড়েছেন মনে হয়। নয় উনিই করতেন।”
“থাক। মাকে আর ডাকতে হবে না। আর আপনাকেও নতুন করে কিছু রাধতেও হবে না। এখন যা আছে তাই দিন আপাতত। খুব খিদে পেয়েছে।”
“আহারে। কতটা সময় না খেয়ে ছিলিস। গরমে ঘেমে তো একদম ভিজে গেছিস। তুই বরং স্নানই করে নে।”
“হ্যাঁ, তাই করছি।”
আম্রপালির চলে গেলে পদ্মাবতী বললেন,
“ভাইপোকে দেখার এতোদিনে সময় হলো তোমার শমিতদা?”
“আর বলিস না। কাজের এতো চাপ।”
“থাক আর অজুহাত দিতে হবে না।”
“সত্যি রে। অজুহাত দিচ্ছি না। তা আমাদের নতুন সদস্য কই?”
পদ্মাবতী সিড়ির দিকে ইশারা করে অর্ণব আর অরণ্যকে দেখিয়ে দিলেন। শমিত সেখানে আসতেই অর্ণব বললেন,
“এতোক্ষণে তোর আসার সময় হলো?”
“আরে ওই ট্রেনটাই তো। থাক, বাদ দে। আমার ভাইপোকে দেখতে তো দে।”
“কোলে নিবি নাকি এখনো ভয় পাস বাচ্চা বলে?”
“ভয় পাই না আর। তবে এখন কোলে নেব না। বাইরে থেকে এসেছি। গায়ে ধুলোবালি লেগে আছে। আমি স্নানটা সেরে আসি।”
বলেই শমিত দোতলায় চলে যাচ্ছিলেন। শেফালী নিচে থেকে বলে উঠলেন,
“ওদিকে কোথায় যাচ্ছো? এঘরে এসো।”
শমিত শেফালীকে একটা ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। বুঝলেন চলাচলে সুবিধার জন্য দোতলার ঘরটা ছেড়ে নিচের ঘরে এসেছেন তিনি। শমিতও নিজের পথ পাল্টে সেখানে চলে গেলেন। অর্ণবও অরণ্যকে নিয়ে ঘরে চলে এলেন। পদ্মাবতী গিয়েছিলেন আম্রপালিকে সাহায্য করতে। কাজ শেষ করে ঘরে এসে দেখলেন বাপ-বেটা দুজনেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
.
.
রাত প্রায় তিনটা বাজে। বাইরে প্রচন্ড জোরে হাওয়া বইছে। জানালার একটা কপাট ভুলবশত খোলা থাকায় তা বারবার বারি খেয়ে শব্দ হচ্ছে। অর্ণব বিছানা ছেড়ে উঠে জানালা বন্ধ করে দিলেন। পদ্মাবতী বেঘোরে ঘুমোচ্ছেন। হাতটা এখনো অরণ্যর দোলনা স্পর্শ করে আছে। গরমে একদম ঘেমে গেছেন তিনি। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে তার। অর্ণব তার হাতটা ঠিক করে দিলেন। এরপর বৈদ্যুতিক পাখা চালু করে নিঃশব্দে দরজা খুলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। তার যাওয়া মাত্রই পদ্মাবতী উঠে বসলেন। একটা শুকনো ঢোক গিলে হ্যারিকেনটা জ্বালিয়ে তিনিও বেরিয়ে পড়লেন।
খুব সাবধানে অর্ণবের পিছু নিয়েছেন তিনি। এর মাঝেই কয়েকবার ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গেছেন। এখন তিনি শুধু একটাই প্রার্থনা করছেন, তিনি যেন ভুল প্রমাণিত হন। তিনি যা ভাবছেন তা যেন কখনোই সত্যি না হয়। অর্ণব সেখানে কিছুতেই যেতে পারেন না। নিশ্চয়ই অন্য কোথাও যাচ্ছেন। কোনো গোপন একটা কাজে। তাই এসময় এভাবে যাচ্ছেন তিনি। কিন্তু কোথায়? কোথায় যেতে পারেন? কিছুর সাথে লেগে হোঁচট খেলেন তিনি। সাথে সাথেই অর্ণব ফিরে তাকালেন। কিন্তু তার আগেই নিজেকে গাছের আড়ালে লুকিয়ে ফেললেন পদ্মাবতী। এবারও একটুর জন্য বেঁচে গেলেন। অর্ণব চলতে শুরু করলে পদ্মাবতী আবারও তার পিছু নিলেন। অর্ণব বাইজীবাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন। পদ্মাবতীর হৃদস্পন্দন যেন ক্ষণিকের জন্য থেমে গেছে। এতো বাতাসের মধ্যেও আরও বেশি ঘামছেন তিনি। শুধু প্রার্থনা করছেন অর্ণব যেন ভেতরে না যান। কিন্তু তার সব প্রার্থনা বৃথা করে দিয়ে অর্ণব বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লেন পদ্মাবতী। তার শেষ আশাটাও আজ নিঃশেষ হয়ে গেল। আজ চোখে এক বিন্দুও জল জমেনি তার। যেন বহু আগেই সব জল শুকিয়ে চোখজোড়া মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। ঘুরে দাঁড়ালেন পদ্মাবতী। ফিরে আসতে আসতে বারবার পেছন ফিরে বাড়িটা দেখতে লাগলেন। বাড়িতে ফিরে এসে লুকিয়ে দ্রুত ঘরে চলে আসলেন। শান্তি দেবী তখনও সজাগ ছিলেন। নুপুরের আওয়াজ পেয়ে একবার ঘরের বাইরে উঁকি দিয়ে দেখলেন। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না। পদ্মাবতী ঘরে আসা মাত্রই দেখলেন অরণ্য জেগে উঠে কাঁদছে। দৌঁড়ে এসে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিলেন পদ্মাবতী। খাইয়ে অনেক্ষণ ভরে হেঁটে হেঁটে আবার ঘুম পাড়ালেন। অরণ্যকে দোলনায় শুইয়ে দিয়ে আলমারি থেকে নিজের বিয়ের শাড়িটা বের করে পরলেন তিনি। আয়নার সামনে বসে খুব সুন্দর করে সাজলেন। কপালে আর হাতে কলকা আঁকলেন। পায়ে আলতা পরলেন। একদম বিয়ের কনের মতো সাজলেন তিনি। সাজ শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে অরণ্যর দিকে তাকালেন। পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছে বাচ্চাটা। কী মায়াবী মুখ! কারও হৃদয় পাথরের তৈরি হলেও যেন এ-মুখ দেখে তা মোমের মতো গলতে বাধ্য। কিন্তু পদ্মাবতীর আজ কেন যেন তার প্রতি কোনো মায়া হলো না। না কাজ করলো কোনো স্নেহ-মমত্ববোধ। এর কারণ কী? হাসপাতালে থাকাকালীন যখন মাথায় কারও হাতের শীতল স্পর্শ পেয়ে চোখ খুলেছিলেন, দেখেছিলেন পাশে অর্ণব বসে। তখনই ভেবে নিয়েছিলেন এই সন্তান তার ভাগ্য বদলাতেই এসেছে। তার জীবন সুখ-শান্তি, আনন্দ আর ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে এসেছে। কিন্তু তাও আজ মিথ্যা প্রমাণিত হলো। বারবার চোখের সামনে এভাবে সকল আশা ধূলিসাৎ হয়ে যেতে দেখলে কারই বা ভালো লাগে? পদ্মাবতীরও লাগেনি। ভেতর থেকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছে তাকে। তাই তো আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি।
.
.
ভেতরের কথা শোনার জন্য দরজায় কান পাতলেন রজনী। কিন্তু কিচ্ছু শোনা যাচ্ছে না। তাই নিজের ঘুম নষ্ট করে আর বৃথা চেষ্টা করলেন না। চলে গেলেন সেখান থেকে। ঘরে ম্রিয়মাণ আলো জ্বলছে। মোহিনী আরও কয়েকটা মোমবাতি জ্বালিয়ে দিলেন। লাল, নীল, হলুদ, সবুজসহ বিভিন্ন রঙের কাঁচের ভেতর থেকে আলো ঠিকরে বের হচ্ছে। সম্পূর্ণ পরিবেশ জুরে একটা মাদকতা বিরাজ করছে। মোহিনী আলো জ্বালাতে জ্বালাতেই বললেন,
“আমি জানতাম অর্ণব। আপনি ঠিক আসবেন।”
“কেন ডেকেছেন বলুন।”
“আসতে বলেছিলাম তো সন্ধ্যেবেলায়। জলসা দেখতে। আপনি নিজেই তো এমন একটা সময় এসেছেন অর্ণব।”
অর্ণব জবাব দিলেন না। মোহিনী এসে দু’হাতে অর্ণবের দু’গাল আলতো করে স্পর্শ করে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। আলোক বর্ণালী এসে তার মুখে খেলা করছে। একটা সাদা আনারকলি পরেছেন তিনি। ওড়নাটা সুন্দর করে মাথায় দিয়েছেন। সাদায় যেন তাকে আরও শুভ্র, কোমল আর পবিত্র মনে হচ্ছে। এই ভ্রমরকৃষ্ণ মায়াবী চোখের মধ্যে অর্ণব নিজেকে বারবার হারিয়েছেন। শত চেষ্টা করেও এই মুখ থেকে চোখ ফেরাতে পারেন না তিনি। আজও যেন এর ব্যতিক্রম ঘটছে না। তবুও নিজেকে সামলানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছেন তিনি। মোহিনী অর্ণবের চোখে চোখ রেখে বললেন,
“অর্ণব, আপনি আমাকে নাচতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু আপনি নিজেই আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন। আপনি আর নাচ ছাড়া আর কিইবা আছে আমার? তাই তো আবার নাচতে শুরু করলাম। শত শত পুরুষ এখানে আসে। লোলুভ দৃষ্টিতে তাকায় আমার দিকে। তাদের চোখে কামনা স্পষ্ট। এসব ভেবে কি আপনার রাগ হয় না অর্ণব?”
অর্ণব নিরুত্তাপ। এবারও কিছু বললেন না তিনি। তার এমন মৌনতা মোহিনীকে আরও উতলা করে তুলছে। মোহিনী দৃষ্টি নত করলেন। পরক্ষণে দৃষ্টি তুলতেই দেখা গেল চোখ থেকে উপচে পড়া অশ্রুধারা তার কপোল বেয়ে গড়াচ্ছে। প্রতিটি ফোঁটা থেকে যেন হীরের মতো আলোর বিচ্ছুরণ ঘটছে। যার ঔজ্জ্বল্যের তীব্রতায় অর্ণবের চোখ জ্বলসে যেতে বাধ্য। নিজেকে শক্ত রেখে অর্ণব মোহিনীর আঙুলগুলো নিজের দু’হাতের মুঠোয় পুড়ে নিলেন। মোহিনী সেদিকে দৃষ্টিপাত করে শান্ত কণ্ঠে বললেন,
“কেন চলে গেলেন অর্ণব? আমার কথা একবারও ভাবলেন না? একবার দেখা পর্যন্ত করলেন না আপনি। সামান্য একটা চিঠির মাধ্যমে সবকিছু শেষ করে চলে গেলেন আমায় ছেড়ে! বললেন, আমি নাকি কখনো ক্ষমা করবো আপনাকে। কেন? আমি কি এতোটাই নিষ্ঠুর? একটাবার অন্তত বলে দেখতে পারতেন অর্ণব। আপনার সব ভুল ক্ষমা করে দিতাম আমি। সবকিছু ভুলে আবার নতুন করে ভালোবাসতাম আপনাকে। কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন আপনি?”
কথার মাঝেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন মোহিনী।
“আপনি চুপ করে কেন অর্ণব? কিছু তো বলুন। আমি বলি? ফিরে আসুন অর্ণব। আপনাকে আমি ক্ষমা করে দিলাম।”
“কিন্তু আমি যে আপনাকে ক্ষমা করতে পারবো না মেহের।”
অবশেষে অর্ণব কিছু বললেন। কিন্তু তার কথা বোধগম্য হলো না মোহিনীর। তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বললেন,
“মানে?”
“আমি আপনাকে ক্ষমা করতে পারবো না কোনোদিন।”
“কী করেছি আমি?”
“খু/ন করেছেন। একটা নিষ্পাপ প্রাণকে। আমার সন্তানকে।”
“কী বলছেন আপনি এসব? আপনার সন্তান তো ঠিকই আছে। আমি ওকে কেন খু/ন করবো?”
“আমার একটা মেয়ে হয়েছিল মেহের। একদম পরীর মতো। কিন্তু মৃ/ত। পদ্মাবতী সিড়ি থেকে পড়ে যাওয়ায় মাথায় আঘাত লেগে বাচ্চাটা ওর গর্ভেই মা/রা গেছে। আমার ছেলেটাও মৃ/ত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফিরেছে।”
মোহিনী স্থির দাঁড়িয়ে অর্ণবের কথাগুলো শুনছেন। এমন কিছু যে হয়েছে তা ঘুণাক্ষরেও জানেন না তিনি। অর্ণব পুনরায় বললেন,
“সেদিন পদ্মাবতী সিড়ি থেকে পড়ে যায়নি মেহের। আপনি ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন। আর এ কথা পদ্মাবতী ভুলেও কাউকে বলেনি। আমাকেও না। আমি কী করে জানতে পারলাম জানেন?…আপনার তারামা জানিয়েছেন আমাকে সবটা।”
মোহিনী ছুটে এসে অর্ণবের দু পা জড়িয়ে ধরলেন। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন,
“দয়া করুন অর্ণব। আমাকে ক্ষমা করুন। আমি কখনো আপনার সন্তানের ক্ষতি চাইনি। আমি এসব কিছু জানতাম না। আমি কখনো এমনটা চাইনি। সেদিন পদ্মা আমার সাথে এমনভাবে কথা বলেছিল যে…। আমি নিজেকে আঁটকাতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করুন আপনি।”
“পা ছাড়ুন মেহের।”
“আগে আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন তারপর।”
অর্ণব মোহিনীকে উঠিয়ে বললেন,
“আপনাকে আমি আমার হৃদয়ে স্থান দিয়েছিলাম মেহের। তাহলে এখন পা কী করে ধরতে দেই? তবে কী জানেন? আপনাকে আর আগের স্থানে কখনো বসাতে পারবো না আমি। আপনি তো এমন ছিলেন না মেহের। আমি যাকে ভালোবেসেছিলাম তার আর আপনার মাঝে অনেক তফাৎ। নাকি আমিই চিনতে ভুল করেছিলাম আমার মেহেরজানকে?”
.
.
শান্তি দেবী ঘরে বসে জপ করছিলেন। কিন্তু একটু পর পরই কিছু একটার বিকট শব্দ ভেসে আসছে। বেশ বিরক্ত হলেন তিনি। এতো রাতে বারবার এমন শব্দ হচ্ছে। অথচ কেউ একবার উঠে দেখার প্রয়োজনবোধও করছে না। ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। শব্দের উৎস খুঁজতে খুব একটা সময় লাগলো না তার। ছাদের দরজাটা খোলা। সেটাই বারবার বাতাসে ধাক্কা খেয়ে এমন শব্দ করছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লাঠিতে ভর দিয়ে ধীর পায়ে ছাদে উঠে এলেন। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। তিনি দরজাটা লাগাতে যাবেন ঠিক তখনই কিছু একটা চোখে পড়লো তার। ভালো করে তাকাতেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি। চিৎকার করে বলতে লাগলেন,
পদ্মাবতী ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন। শান্তি দেবী ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগলেন। কিন্তু কিছু করার আগেই পদ্মাবতী তার দিকে দৃষ্টি রেখেই নিজের দেহ নিচে ছেড়ে দিলেন। শান্তি দেবী চিৎকার দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব ছাদের কিনারায় এসে দাঁড়ালেন। নিচে তাকাতেই পদ্মাবতীর নিথর দেহটা চোখে পড়লো তার। বিদ্যুৎ চমকানোর সাথে সাথে দেখতে পেলেন নিচে র/ক্তে ভেসে যাচ্ছে। আর্তনাদ করে মাথা চাপড়াতে চাপড়াতে বসে পড়লেন তিনি। চিৎকার করে বিলাপ করছেন। কিন্তু আফসোস! এই ঝড়বৃষ্টির শব্দে তার চিৎকার কারও কানে পৌঁছুবার ছিল না। ধীরে ধীরে উঠে সিড়ি দিয়ে নেমে গেলেন তিনি।
.
.
বাইরে আবছা আবছা আলো ফুটতে শুরু করেছে। তবে বৃষ্টি এখনও একেবারে থামেনি। গুঁড়িগুঁড়ি পড়ছেই। কিন্তু শেফালীর ঘুম প্রতিদিনের মতোই এ-সময় ভেঙেছে। ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে উঠে জানালা দরজা খুলে দিলেন তিনি। ঘর থেকে বেরিয়ে সবার আগেই সদরদরজা খুলে দিলেন। চলে যাবেন এমন সময় তার চোখে পড়লো সামনের জায়গাটা র/ক্তে ভেসে গেছে। র/ক্তের উৎসের দিকে তাকাতেই চিৎকার করে উঠলেন তিনি। তার চিৎকার শুনে সবার আগে শমিত ছুটে এলেন। এমন দৃশ্য দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারছেন না শেফালী। চোখের সামনে সবটা কেমন যেন অন্ধকার হয়ে আসছে। শমিতকে ধরে নিচে বসে পড়লেন ধীরে ধীরে। শমিত শেফালীর চিৎকারের কারণ জিজ্ঞেস করতেই শেফালী ইশারা করে সামনে দেখালেন তাকে। পদ্মাবতীর লা/শের শিয়রে বসে আছেন শান্তি দেবী।
গাছের পাতা থেকে এখনো টুপটাপ ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরছে। রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় জল জমেছে। অর্ণব জল ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে চলছেন। বাগানের কাছে আসতেই বাড়ির সামনে একটা জটলা দেখলেন। কিছু একটা হয়েছে বুঝতে পারছেন। কেমন একটা থমথমে পরিবেশ। অর্ণব কাছে আসতেই হতভম্ব হয়ে গেলেন সে দৃশ্য দেখে। আম্রপালি অভিমানী সুরে অর্ণবের উদ্দেশ্যে বললেন,
“এসেছো তুমি? তা কোথায় গিয়েছিলে শুনি? ওই মেয়েটার কাছে নিশ্চয়ই। তা ফিরতে গেলে কেন? থেকে গেলেই পারতে ওর সাথে। এখন কি নাটক দেখতে এসেছো?”
“মা।”
আম্রপালি আর নিজেকে আঁটকে রাখতে পারলেন না। হুহু করে কেঁদে উঠলেন। বললেন,
“দেখ অর্ণব, মেয়েটা শেষ পর্যন্ত ম/রেই গেল। তবুও তুই বুঝলি না। আর কবে বুঝতে পারবি? আমি যে অনেক বড় একটা ভুল করেছিলাম তোদের বিয়েটা দিয়ে, তুই সত্যিই আজ সেটা প্রমাণ করে দিলি।”
অর্ণব ধপ করে পদ্মাবতীর লা/শের পাশে বসে পড়লেন। এক ধ্যানে চেয়ে রইলেন। আম্রপালি শমিত আর রামুর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,
“দেহ সৎকারের ব্যবস্থা কর। আর রাখা যাবে না এখানে।”
প্রবল হরিধ্বনিতে শবযাত্রা যাচ্ছে। এতে মোহিনী কিছু যায় আসতো না। কিন্তু পেছনে নিজের সন্তানকে কোলে নিয়ে অর্ণবকে চলতে দেখে শিউরে উঠলেন তিনি। ভালো করে খেয়াল করতেই বাড়ির অন্য সদস্যদেরও দেখতে পেলেন। ছাদে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে এসব দেখছিলেন মোহিনী। ঊর্মিলা ছুটে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে পেছন থেকে বললেন,
“কাল রাতে নাকি ছাদে থেকে লাফ দিয়ে আ/ত্ম/হ/ত্যা করেছে। মোহিনী, কাল তো অর্ণব এখানে এসেছিলেন। তাই না?”
ঊর্মিলার কথায় স্তব্ধ হয়ে গেলেন মোহিনী। এরপর ছুটে চলে গেলেন। শ্মশানের কাছে এসে অর্ণবকে দেখতে পেলেন। পেছন থেকে বললেন,
“অর্ণব।”
অর্ণব মোহিনীর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,
“চলে যান মেহের। আপনার এখানে থাকাটা ঠিক হবে না। কেউ কিছু বলে দিতে পারে আপনাকে যা আপনার শুনতে ভালো লাগবে না।”
“এসবের জন্য আমি দ্বায়ী। তাই না অর্ণব?”
“শুধু নিজেকে দোষারোপ করবেন না মেহের। এসবের জন্য যেমন আমরা দ্বায়ী। তেমন পদ্মাবতী নিজেও দ্বায়ী। আমরা সবাই সবার কাছে অপরাধী। আমাদের কী হতভাগ্য দেখুন। না পদ্মাবতী আমাদের কাছে ক্ষমা চাইলো আর না আমরা ওর কাছে ক্ষমার চাওয়ার সুযোগ পেলাম।”
মোহিনী করুণ সুরে কেঁদে উঠলেন। অর্ণব বললেন,
“মেহেরজান, আপনি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দরতম একটা ভুল ছিলেন। আমাদের ভালোবাসার শুরুটা যতটা বেশি সুন্দর ছিল, শেষটা তার চেয়েও বেশি তিক্ত। আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি মেহের। পারলে আপনিও আমাকে ক্ষমা করে দেবেন সবকিছুর জন্য। আজকের পর থেকে আমি ভুলে যাবো আমি মেহেরজান বলে কাউকে ভালোবেসেছিলাম। আপনিও যত তাড়াতাড়ি ভুলতে পারবেন ততই ভালো। আমাদের সফর এপর্যন্তই ছিল।”
মোহিনী অশ্রুসিক্ত চোখে শুধু চেয়ে রইলেন। বলার মতো একটা শব্দও নিজের শব্দভান্ডারে খুঁজে পেলেন না। আম্রপালির সাথে চোখাচোখি হতেই ম/রে যেতে ইচ্ছে করলো তার। যে চোখে সারাজীবন তার জন্য স্নেহ মমতা দেখে এসেছেন, শেষবার সেই চোখে দেখতে পেয়েছিলেন রাগ আর অভিমান। কিন্তু আজ সে চোখে ঘৃণা ব্যতীত কিচ্ছু দেখতে পেলেন না মোহিনী। অর্ণব সামনে এগিয়ে চললেন। মোহিনী দূরেই একটা গাছের পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। অর্ণব মন্ত্রভুত অগ্নি অরণ্যর হাতে ছুঁইয়ে চিতায় দিতেই দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো। মোহিনী চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন। ওদিকে পদ্মাবতীর চিতা জ্বলছে। এদিকে মোহিনী পুড়ে ছারখার হচ্ছেন। কারণ প্রতিশোধের অনলের চেয়ে অনুশোচনার অনল মানুষকে বেশি পোড়ায়। আর সে অনলে তাকে চিরকাল পুড়তে হয়। মোহিনীর প্রতিশোধের স্পৃহা আজ অনুশোচনায় পরিণত হয়েছে। তাই তিনিও পুড়ছেন। নদীর ওপার থেকে আসা শীতল সমীরণ চিতার অনলে উত্তপ্ত হয়ে মোহিনীকে স্পর্শ করে যাচ্ছে। যা তার জ্বালাকে আরও তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুলছে। শেষবারের মতো অর্ণবকে এক নজর দেখে গুটিগুটি পায়ে ফিরে গেলেন তিনি।
_________________________
চৌধুরী বাড়িটা এখন একদম নিস্তব্ধ। অভ্রবাবু শকুন্তলা আর শান্তি দেবীকে নিয়ে কলকাতায় চলে গিয়েছেন। শেফালীর নাকি একটা ফুটফুটে ছেলে হয়েছে। নাতির মুখ দেখে বউ শ্বাশুড়ির মাঝের দ্বন্দ্বটা যেন একটু হলেও হ্রাস পেয়েছে। তারাও এ-বাড়ি ছেড়ে শমিতের বাপ-দাদার ভিটায় ফিরেছেন। শমিতও সেখানেই একটা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেছেন। আর অর্ণব? সেও নিজের মা আর সন্তানকে নিয়ে বিলেতে পাড়ি দিয়েছেন। মোহিনী সেদিন খুব কেঁদেছিলেন। পদ্মাবতী চলে যাওয়ার তিনমাসের মাথায় বাড়িটা একটা শুনশান অট্টালিকায় পরিণত হয়েছে। একটা কাকপক্ষীর টিকিও দেখা যায় না সেখানে। আসলেই কি কেউ-ই থাকে না আর সেখানে? ওই বাড়িটার দিকে তাকালে মোহিনীর আজও মনে হয় পদ্মাবতী ছাদে দাঁড়িয়ে হাত নাড়িয়ে তাকে ডাকছেন।
“রোজ রোজ ছাদে দাঁড়িয়ে ও-বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকিস কেন মোহিনী?”
হঠাৎ করে পেছন থেকে প্রশ্ন করায় কিছুটা চমকে উঠলেন মোহিনী। পেছন ফিরে বললেন,
“কষ্ট লাগলে তাকাবি না। আর তুই নিজেকে কেন দোষারোপ করিস?”
“আমিই তো সবসময় ঈশ্বরের কাছে ওদের অমঙ্গল কামনা করতাম।”
“তাতে কী? ওরা তোর সাথে যা করেছিলো তাতে এটাই স্বাভাবিক। তুই শুধু নিজেকে দোষ দিচ্ছিস। ওরা সব দোষ তোর ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা ঠিকই ভালো আছে। শান্তিতে আছে। এদিকে তুই-ই কিছু ভুলতে না পেরে জ্বলেপুড়ে ম/র/ছি/স।”
ঊর্মিলা কথাগুলো বলতে বলতে চলে গেলেন। মোহিনী কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজের ঘরে চলে এলেন। অর্ণবের উদ্দেশ্যে লেখা নিজের শেষ চিঠিটা লিখতে বসলেন তিনি।
“কালবৈশাখীর ঝড়ে জন্মানো সেই মেয়েটাই যে সবার জীবনে কাল হয়ে আসবে, এটা যদি আমার মা জানতেন তবে জন্মানোর পরই হয়তো আমাকে গলা টিপে হ/ত্যা করতেন। ওরা বলে এসবের জন্য নাকি আমি একটুও দ্বায়ী নই। শুধু শুধু নিজেকে দোষারোপ করছি। আদৌও কি তাই? আপনারা নাকি আমার ওপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা শান্তিতে আছেন। ভুল বলে ওরা। আমি বিশ্বাস করি না। আপনি সেদিন বলেছিলেন আপনি সবকিছু ভুলে যাবেন। আমাকে ভুলে যাবেন। আমিও যত দ্রুত সবকিছু ভুলে যেতে পারবো। আমার জন্য ততই ভালো। কিন্তু আপনি কি সত্যিই ভুলতে পেরেছেন? তবে আমি ভুলে যাবো। নিজের জীবনের একটা কালো অধ্যায় ভেবে সবটা ভুলে আবার নতুন করে বাঁচবো। অনুশোচনার এই অনলে নিজেকে আর পোড়াবো না। দ্বিতীয়বার কাউকে ভালোবাসার মতো ভুল আর করবো না। তবে আপনাকে হারানোর আফসোস চিরকাল থেকে যাবে অর্ণব। অধিকার খাটিয়ে আমার মেহেরজান বলে ডাকার মতো আমার আর কেউ রইলো না।
ইতি
আপনার মেহেরজান”
চিঠিটা লেখা শেষ হতেই দরজায় কেউ কড়া নাড়লেন। মোহিনী বলে উঠলেন,
“কে?”
“আমি রজনী। শহর থেকে বাবুরা সব চলে এসেছে। নিচে আয় তাড়াতাড়ি।”
“আসছি।”
মোহিনী দ্রুত নিজের ঘুঙুরগুলো পায়ে বেঁধে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
পেট নিয়ে দোতলায় ওঠা নামা করা শেফালীর জন্য আসলেই কষ্টসাধ্য। তাই নিচতলার ঘরটায় চলে আসতে হয়েছে। এখানে সে একা নয়। পদ্মাবতীও রয়েছেন। অনেক আগেই তিনিও এই ঘরটায় চলে এসেছিলেন। একা থাকতে হচ্ছিলো বলে শেফালীও আর অন্য কোনো ঘরে যাননি। রামুকে বলে এঘরেই আরেকটা খাট পাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। জানালার বাইরে দৃষ্টি রেখে দাঁড়িয়ে ছিলেন পদ্মাবতী। কিন্তু এতো শোরগোলে আর শান্তি মতো দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। নিজের প্রকাণ্ড পেটে হাত রেখে খুব সাবধানে খাটে এসে বসলেন তিনি। নয়মাসের বেশিই চলছে তার। যেকোনো দিন সন্তানের মুখ দেখতে পাবেন। তাই খুব সাবধানে চলতে হচ্ছে এখন তাকে। অন্যদিকে শেফালীর এখনো আরও দুমাস বাকি। বাড়িতে এক সঙ্গে দুজন পোয়াতি নিয়ে শ্বাশুড়িরাও বেশ বিপাকে পড়েছেন। এক্ষেত্রে শকুন্তলা খুব সাহায্য করছেন তাদের। দু’জনেরই দেখভালের দায়িত্ব তিনি নিয়েছেন। সকাল থেকেই তিনি পদ্মাবতীর সাথে এঘরে রয়েছেন। এটা ওটা নিয়ে গল্প করেই চলেছেন। এমন সময় হাতে একটা খাম নিয়ে বিমর্ষ মুখ নিয়ে আম্রপালি এলেন ঘরে। কিছুটা চিন্তিতও। তাকে দেখেই শকুন্তলা বললেন,
“কী হয়েছে দিদি? মুখটা ওমন হয়ে আছে কেন? আর তোমার হাতে ওটা কী?”
পদ্মাবতীও কৌতূহলী হয়ে তাকালেন তার দিকে। আম্রপালি জবাব দিলেন,
“চিঠি। পদ্মার গ্রাম থেকে এসেছে। ওদিক থেকে একজন এসেছিলেন এখানে। তার হাতেই পাঠিয়েছেন। তিনি দিয়ে গেলেন এখন আমাকে।”
পদ্মাবতী বলে উঠলেন,
“কে পাঠিয়েছেন বড়মা? আর কী লেখা আছে ওতে?”
“তোর পিসি পাঠিয়েছেন। তোর ঠাকুমা মা/রা গেছেন। তাই তোকে একবার হলেও যেতে বলেছেন দ্রুত।”
পদ্মাবতীর মুখ দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বেরিয়ে এলো,
“ভগবান ওনার আ’ত্মাকে শান্তি দিক।”
শকুন্তলা একবার আম্রপালি আরেকবার পদ্মাবতীকে দেখে বলে উঠলেন,
“সে কী! পদ্মা এই অবস্থায় কী করে যাবে ওখানে? সম্ভব নাকি এটা? উনি কি পদ্মার ব্যাপারে জানেন না? কী বুঝে যেতে বললেন?”
“তার মা মা/রা গেছেন। তিনি কি আর এতোকিছু ভেবে লিখেছেন? কিন্তু এখন কী করবো? পদ্মাকে যে যেতে বললেন।”
“যেতে হবে না এখন ওকে। পরে নাহয় সময় করে একবার যাবে। তুমি এতো ভেবো না। উনি ঠিকই বুঝতে পারবেন।”
“হুম। হয়তো ঠিকই বলেছিস তুই।”
শকুন্তলার সাথে কথা বলে আম্রপালির চিন্তা যেন কিছুটা হলেও কমলো।
.
.
.
“আজ কোনো কবিতা শোনাবেন না স্যার?”
“স্যার বলো না অর্ণব। নিজেকে কেমন যেন ইংরেজ কর্তা ইংরেজ কর্তা বলে মনে হয়। তুমি বিলেতে বড় হতে পারো। কিন্তু আমি এদেশেই জন্মেছি আর এদেশেই ম/র/বো। তুমি আমাকে নাম ধরেই ডাকবে।”
“ঠিকাছে। আপনার কোনো কবিতা শোনাবেন না রুদ্র?”
“আমার কবিতা? আমি কবি নই। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে প্রেমিকার উদ্দেশ্যে দুটো বাক্য বলি। আর সেটাকেই তোমরা কবিতা বলে ধরে নাও।”
“সে যাই হোক। আজ বলবেন কিনা বলুন।”
“না, আজ কবিতা বলবো না। গল্প বলবো একটা। গল্প না অবশ্য। আমার প্রথমবার চুরি করার অভিজ্ঞতা। শুনবে?”
অর্ণব সামান্য হাসলেন। রুদ্র পেশায় একজন লেখক। তবে টুকটাক কবিতাও লেখেন। সেদিন এই পানশালায়ই তার সাথে পরিচয় হয়েছিল অর্ণবের। দুজনের মাঝে বেশ ভালো সখ্যতাও গড়ে উঠেছে কিছুদিনের মাঝেই। রুদ্রর সাথে কথা বললে তাদের মাঝের বয়সের দীর্ঘ তফাৎটা খুঁজে পান না অর্ণব। আর এটাই হয়তো তাদের বন্ধুত্বের সবচেয়ে বড় কারণ। অর্ণব ঠোঁটে হাসি রেখেই বললেন,
“বলুন তাহলে।”
অর্ণবের জবাব পেয়ে রুদ্রও বলতে শুরু করলেন।
“আমি তখন সবে মাত্র কলেজ পাড় করে ছুটিতে গ্রামে এসেছি। তখন আম কাঁঠালের দিন। গাছ ভরা কাঁচা পাকা মিষ্টি আম। তো আমাদের বাড়ির কয়েক বাড়ি পরেই ছিল আম বাগান। কিন্তু বাগানের মালিক একটা আমও ছুয়ে দেখতে দিত না কাউকে। আমরাও কম কিসে? সব বন্ধুবান্ধব মিলে একদিন ঠিক করেই ফেললাম ওই বাগানের আম খাবোই খাবো। তা সে চুরি করে হলেও। যেই ভাবা সেই কাজ। সেদিন সব পরিকল্পনা করে রাখলাম। পরেরদিনই সন্ধ্যে নামতে না নামতেই চলে এলাম বাগানে। গাছে আমি উঠলাম। একটার পর একটা আম নিচে ফেলেই চলেছি। এমন সময় কই থেকে যেন বাগানের মালিক চলে এলো। আমার বন্ধুরা নিচে দাঁড়িয়ে আম কুড়িয়ে বস্তায় ভরতে ব্যস্ত ছিল। মালিকের আসার শব্দ শুনে সা/লা/রা সব আমাকে রেখেই আম নিয়ে পালালো। আমার অবস্থা এমন হলো যে গাছ থেকে নামতে গেলেও ধরা পড়বো। আর না নামলেও নিচ থেকে ঠিকই গাছে দেখা যাবে আমাকে। কী করবো বুঝতে না পেরে গাছেই বসে রইলাম। গাছে থেকে তাকে আসতে দেখলাম। মালিক নয়। অন্য একটা মেয়ে। এসেই বললো,
“গাছে লুকিয়ে থেকে লাভ নেই। আমি দেখে ফেলেছি সব।”
আমিও গাছ থেকে নেমে পড়লাম। বললাম,
“এই, তুই কে? আর কী দেখেছিস?”
“তোমাকে আম চু/রি করতে দেখেছি।”
“আম কে চু/রি করেছে?”
“তুমি চু/রি করেছো।”
“এই যে বললি তুই দেখেছিস সব। এটা দেখিসনি যে ওরা আমের বস্তা নিয়ে পালালো?”
“কারা পালালো? আমি তোমাকেই দেখেছি চু/রি করতে। আর বলেও দেব মালিককে।”
“কী বলবি?”
“বলবো যে তুমি আম চু/রি করেছো।”
আমি কী করবো বুঝতে পারলাম না। শেষ পর্যন্ত কিনা আম চু/রি করতে গিয়ে ধরা পড়লাম! শেষে আবার গাছে উঠে দুটো আম পেড়ে এনে ওর দিকে বাড়িয়ে বললাম,
“এই নে ধর। কাউকে কিছু বলবি না তুই।”
ও কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইলো। এরপর বললো,
“তুমি শহর থেকে এসেছো না?”
“হ্যাঁ, তো?”
“এজন্যই তো সামান্য আমটাও চু/রি করতে পারলে না।”
“এই, মা/র খেতে চাস তুই?”
“সাহস কত! আমাকে মা/র/বে! নিজে আম চু/রি করতে পারে না আবার মা/র/তে এসেছে আমাকে।”
“কী চাই তোর? আম দিচ্ছি হচ্ছে না এতে?”
“চুক্তি যখন করতেই চাও তাহলে সেটা আমিই ঠিক করবো। তুমি না।”
“আচ্ছা, তুই-ই বল। কী চাস?”
“তুমি আমাকে লিখতে পড়তে শেখাবে।”
ওর কথা শুনে একটু অবাক হলাম। তারপর বললাম,
“আমার কি খেয়েদেয়ে আর কাজ নেই নাকি যে এখন তোকে লেখাপড়া শেখাবো।”
“জিজ্ঞেস করিনি। আমার দাবি রেখেছি। হয় লেখাপড়া শেখাবে নয়তো সব বলে দেব। আরও বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলবো।”
“বাচ্চা একটা মেয়ে। তার আবার তেজ কত! ঠিকাছে। পড়াবো তোকে। কিন্তু মুখ বন্ধ রাখবি।”
আমার বাবা খুব কড়া লোক ছিলেন। তার কানে একথা গেলে আমাকে আস্ত রাখতেন না। তাই মেনে নিলাম ওর কথা। এভাবেই আমাদের মাঝে একটা চুক্তি হলো। কিন্তু একটু পর যা হলো তা সত্যিই আমার ভাবনার বাইরে ছিল। কোত্থেকে যেন বাগানের মালিক এলো লাঠি নিয়ে। এসেই জিজ্ঞেস করলো,
“এই, কী করছিস তোরা এখানে?”
মেয়েটা এক মুহুর্তও না ভেবে গড়গড় করে বলে দিল,
“চো’র ধরেছি দাদু। এ তোমার বাগানের আম চু/রি করছিল। এর মধ্যেই এখান থেকে তিন বস্তা আম পা’চার করেছে নিজের বন্ধুদের নিয়ে। আমি দেখে ফেলেছি বলে আমাকেও ঘুষ দিতে চাইছিল।”
মেয়েটা এক নিঃশ্বাসে সব বলে গেল। আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কী সাংঘাতিক মেয়েরে বাবা! এক বস্তার অর্ধেকও আম ভরেনি আর এ বলে কি না তিন বস্তা! বাগানের মালিকের দিকে তাকাতেই দেখি সে রক্তবর্ণ দুটো চোখ নিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। পালানো ছাড়া আর উপায় নেই। তাই আমিও দিলাম ভোঁ দৌঁড়।”
বলা শেষ হতেই দুজনেই হেসে উঠলেন। অর্ণব বললেন,
“আমি ভুল না হলে আপনার সকল কবিতা এই মেয়েটার উদ্দেশ্যেই লেখা।”
“তুমি ভুল নও। ঠিকই ধরেছো।”
“এই একটা দিক দিয়েই হয়তো আমরা একই। দুজনেই প্রেমে ব্যর্থ।”
“উহু। ভুল বললে। তুমি নিজের জন্য তোমার প্রেমিকাকে ছেড়েছো। আর আমি তার কথায়, তার ভালোর জন্য তাকে ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। আমি ব্যর্থ নই। আমি এখনো তাকে আগের মতোই ভালোবাসি। সে একবার ডাকলে তার কাছে ফিরে যেতে রাজি। আমি নিজ হাতে তাকে বিয়ের মণ্ডপ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলাম। সবকিছু ঠিকই যাচ্ছিল। ততক্ষণ পর্যন্তই যতক্ষণ না আমি বুঝতে পেরেছিলাম বিয়ের দিন তার চোখে জল নিজের জন্য নয়, বরং আমার জন্য ছিল। কিন্তু আমি বুঝতে অনেক দেরি করে ফেলেছিলাম। এরপর আর তার বাড়ির সামনে গিয়ে তাকে এক নজর দেখার অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না আমার হাতে।”
“আপনার প্রেয়সীর নাম বলবেন না কাউকে কোনোদিন?”
রুদ্র অর্ণবের পরিচয় জেনে আগেই বুঝে গিয়েছিলেন সে কে। তবে তা প্রকাশ করেননি। অর্ণবের প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন,
খুব ক্লান্ত লাগছিল মোহিনীর। সে সাথে ঘুমও পাচ্ছিলো। তাই বালিশে মুখ গুজে ঘুমানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ডাকটা শোনা মাত্রই যেন সব ঘুম উড়ে গেল তার। তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।
“তুই!”
পদ্মাবতী এগিয়ে এসে তার হাতে থাকা জিনিসগুলো একপাশে রাখলেন। বললেন,
“ওমা! এটা আবার কেমন প্রশ্ন? কতমাস হয়ে গেছে তোকে দেখিনি। তোকে দেখতে ইচ্ছে করলো তাই এসেছি। জানিস এখানে আসার জন্য বাড়িতে কত মিথ্যে কথা বলে বেরোতে হয়েছে! অনেক কথা বানিয়ে বানিয়ে বলার পর একা আসতে পেরেছি। নয় কেউ তো আমাকে এসময় একা ছাড়তেই চাচ্ছিলো না। বাড়িতেও সবসময় আমার সাথে কেউ না কেউ থাকেই।”
নিজের পেটে হাত বোলাতে বোলাতে কথাগুলো বলছিলেন পদ্মাবতী। মোহিনীর নজর যতবার পদ্মাবতীর পেটের দিকে পড়ছে ততবারই অর্ণবের করা প্রতারণার কথা মনে পড়ছে। আর মনটা বিষিয়ে যাচ্ছে।
“এখান থেকে চলে যা পদ্মা।”
“যাবো কি রে? সবে তো এলাম। দেখ আমি তোর জন্য কতকিছু নিয়ে এসেছি। শোনপাপড়ি, হাওয়াইমিঠাই, সন্দেশ। তোর এগুলো খুব পছন্দ তাই না? সেদিন শেফালীর সাধ এর অনুষ্ঠান হলো। আমি থাকতে পারিনি। আমার বেলায়ও ও থাকতে পারেনি। তোর কথা খুব মনে পড়েছিল তখন।”
মোহিনী জবাব দিলেন না। পদ্মাবতী মন খারাপ করে বললেন,
“ঠিকাছে। তুই যদি চাস তো আমি চলে যাবো। কিন্তু তার আগে তোকে কিছু কথা বলতে চাই।”
“কী কথা?”
পদ্মাবতী মোহিনীর আরও কাছে এসে বললেন,
“তুই অর্ণবকে খুব ভালোবাসিস না? কিন্তু তোর থেকেও যে আমি বেশি ভালোবেসেছি তাকে। তাই তো নিজের করে নিতে পেরেছি। আর এখন তার সন্তানের মাও হবো আমি।”
“তো? আমি কী করবো তাতে? তুই আমার ঘরে এলি কী করে? কেউ আঁটকালো না তোকে?”
“অনেক দূরে কোথায় চলে যা। যেখানে তোকে কেউ চিনবে না। তোর আসল পরিচয় জানবে না। সম্মানের সাথে বেঁচে থাকতে পারবি। তুই বল কোথায় যাবি। আমি নিজে দিয়ে আসবো তোকে। টাকা পয়সার কোনো অভাব থাকবে না তোর। সব দেব আমি।”
মোহিনী এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন,
“পাগল হয়ে গেছিস তুই?”
“এখন না হলেও একদিন ঠিকই হয়ে যাবো রে। এভাবে বেশিদিন বাঁচতে পারবো না আমি।”
“এসব নাটক বন্ধ কর পদ্মা। অর্ণবের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আর রাখতেও চাই না।”
মুহূর্তের মধ্যেই চেহারা পাল্টে গেল পদ্মাবতীর। ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। সেই সাথে রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন,
“মিথ্যে বলছিস। তোর সাথে সম্পর্ক না থাকলে উনি এখন আমার কাছে থাকতেন। আমার খোঁজ নিতেন। তাহলে নেন না কেন?”
মোহিনী তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,
“কারণ উনি তোকে ভালোবাসেন না। একটু আগেই তো বললি যে অর্ণব এখনো আমাকে ভালোবাসেন। তাহলে তোকে কী করে ভালোবাসবেন? একসাথে কখনো দু’জনকে ভালোবাসা যায় নাকি? ইশ! তোর জন্য বড্ড কষ্ট লাগেরে পদ্মা। এতো চেষ্টা করেও অর্ণবের ভালোবাসা পেলি না। নামে মাত্র তার স্ত্রী হয়েই রইলি। অর্ণব শুধু আমাকে ভালোবেসেছেন। তুই আজ এসব কথা বলে তার প্রতি আমার বিশ্বাস আবার ফিরিয়ে দিলিরে পদ্মা। ভেবে দেখলাম। আমি এখন আর তাকে ছেড়ে কোত্থাও যাবো না।”
সারা গা যেন জ্বলে গেল পদ্মাবতীর। উঁচু স্বরে বললেন,
“শেষ পর্যন্ত নিজের অবস্থান দেখিয়েই দিলি তুই? এর চেয়ে বেশি আর কিইবা করতে পারিস। যতই হোক, সামান্য একটা বাইজী বলে কথা। অন্যের স্বামীকে নিজের মায়ার জ্বালে ফাঁসিয়ে অন্যের সংসার ভাঙা ছাড়া আর কিইবা করতে পারিস তোরা? ঘরে বউ থাকতেও পুরুষ যখন অন্য নারীকে নিয়ে আসে তখন তাকে কী বলে জানিস? র/ক্ষি/তা। তুই সারাজীবন অর্ণবের র/ক্ষি/তা হয়েই থাকবি। বউ হতে পারবি না কোনোদিন। তোর তো বাপ-মায়েরও কোনো হদিস নেই। কে জানে তোর মা কী করেছিল। কার সংসার নষ্ট করেছিল যে তোর বাবাও তোকে কোনোদিন খুঁজতে এলো না। তোর মতো মেয়ের সাথে যে আমার এতো বছরের বন্ধুত্ব ছিল এটা ভাবতেও এখন ঘেন্না লাগছে আমার। গা গুলিয়ে উঠছে।”
বলেই পেছন ঘুরে হাঁটা দিলেন পদ্মাবতী। এসব কী বলে গেলেন তিনি! একদম সহ্য করতে পারলেন না মোহিনী। দৌঁড়ে বাইরে এলেন পদ্মাবতীর পেছন পেছন। সিড়ির কাছে আসতেই এক ধাক্কায় পদ্মাবতীকে ফেলে দিলেন। পদ্মাবতীর দেহটা সিড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়লো। নিচে পড়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন তিনি। মোহিনী নিজের কান্ডে নিজেই হতভম্ব হয়ে গেলেন। মাথায় হাত দিয়ে সিড়ি ধরে সেখানেই ধপ করে বসে পড়লেন তিনি। সবার আগেই ছুটে এলেন তারানা। মোহিনীকে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতে আর পদ্মাবতীকে নিচে পড়ে থাকতে দেখে সবকিছু বুঝতে এক মুহুর্তও লাগলো না তার। মোহিনীর উদ্দেশ্যে বললেন উঠলেন,
“এটা তুই কী করলি মেহের?”
আরও কিছু মেয়ে আসতেই সকলে মিলে পদ্মাবতীকে ধরাধরি করে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে নিয়ে গেলেন। চরণকে পাঠালেন অর্ণবদের বাড়িতে খবর পাঠাতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চরণ এসে এ-বাড়ির চৌকাঠে দাঁড়ালেন। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন,
“ও বিবিজি, আপকি বহু সিড়িওছে নিচে গির গায়্যি হ্যে। আম্মাজিনে উসকো আসপাতাল লেকার গায়্যি হ্যে।”
“এমনিই জিজ্ঞেস করছিলাম। ও তো ফিরেছে গ্রামে। দেখা করলো না যে?”
“তুমি কি আজকাল নে/শা টেশা করছো নাকি তারামা? উনি আমার সাথে কেন দেখা করতে যাবেন? এতোকিছুর পরও? এসব উল্টাপাল্টা কথাবার্তা না বলে ঠিক করে বলো তো তুমি কী বলার চেষ্টা করছো?”
“আমি আবার কী বলার চেষ্টা করবো? যা বলছি তাই-ই তো।”
“তোমার কথাবার্তা যেন কেমন অদ্ভুত লাগছে।”
“আমার মনে হয় না সেদিনের ব্যাপারে ও-বাড়িতে কেউ কিছু জানে।”
“পদ্মা এখনো চুপ থাকবে ভেবেছো?”
“ও যদি চুপ নাই থাকতো তো তুই এখন এখানে থাকতিস না। জে/লে থাকতে হতো।”
“ওহ। তুমি তাহলে এই নিয়ে চিন্তায় আছো? এতো চিন্তা করো না। কিছু হলে এতোদিনে হয়ে যেত।”
“চিন্তা করবো না মানে? তোর জন্য আমার কতটা চিন্তা হয় তা যদি বুঝতিস। আমি বুঝি না তুই এতো নিশ্চিন্তে কীভাবে আছিস।”
“ওর কিছু হলে নাহয় চিন্তা হতো। কিন্তু কোনো ক্ষতি তো হয়নি তেমন। আর তুমি থাকতে আমার কে কী করতে পারবে তারামা? এখন আরেকটা কচুরি দাও তো।”
তারানা মোহিনীর থালায় আরেকটা কচুরি দিতে দিতে বললেন,
“পদ্মাবতীর নাকি ফুটফুটে একটা ছেলে হয়েছে। অর্ণবও চলে এলো খবর পেয়ে। এবার মনে হয় ওদের সম্পর্কটা ঠিক হয়েই যাবে।”
“সম্পর্ক ঠিক হয়ে যাবে এটা কী করে বলছো?”
“কেন?”
“অর্ণব পদ্মার জন্য নয়, নিজের ছেলের জন্য ফিরেছেন।”
“সে যাই হোক।”
“তারামা, ও এতো উঁচু থেকে পড়ার পরও ম/র/লো না কেন বলো তো?”
“তোর মুখে যতসব অলক্ষুণে কথা। ওর কিছু হলে তুইও এখানে শান্তিতে থাকতে পারতি না। জেলে পঁচে ম/র/তে হতো।”
মোহিনী তাচ্ছিল্যপূর্ণ হেসে বললেন,
“তাও শান্তি পেতাম।”
মোহিনীর কথায় তারানা চুপ করে রইলেন। মোহিনী বললেন,
“তারামা, আমি বলছিলাম কী, আমি ও-বাড়িতে একবার যাবো। পদ্মার ছেলেকে দেখতে।”
“কী! তুই যাবি ও-বাড়িতে।”
“হুম। দেখবো ওর ছেলে দেখতে কেমন হয়েছে। অর্ণবের মতো হয়েছে নিশ্চয়ই।”
“আজই যাবি?”
“উঁহু। ওর ছেলের নামকরণের অনুষ্ঠানে।”
“কিন্তু….।”
তারানা কিছু বলতে গিয়েও আবার থেমে গেলেন। মোহিনী বললেন,
“ঠিকাছে। আজই যাবো তাহলে। আমার মায়ের সব জিনিসপত্র কোথায় আছে তারামা?”
“আমার ঘরে। কেন?”
“লাগবে কিছু।”
মোহিনী উঠে হাত ধুয়ে নিলেন। এরপর তারানার ঘরে এসে খাটের নিচ থেকে একটা ট্রাংক বের করলেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর যেন পছন্দ মতো কিছু একটা পেলেন তিনি। ছোট্ট একটা বাক্সে একটা গলার চেইন। মোহিনী আর ওটা বের করলেন না। বাক্স বন্ধ করে ওভাবেই নিয়ে গেলেন। নিজের ঘরে এসে আলমারি থেকে আরও একটা জিনিস নিলেন। মোহিনীর এমন কাজে তারানা মোটেও সন্তুষ্ট নন। সেদিন মোহিনী কিছুক্ষণের জন্য ঘাবড়ে গেলেও তারপর থেকেই আবার স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিলেন। তার ভয় যেন একদম কেটে গিয়েছে। কিন্তু এতোদিন পর এখনো তারানা নিজের ভয় কাটাতে পারেননি। তার চিন্তা যেন আরও বেড়েই চলেছে। যতই হোক, মোহিনীকে তিনি নিজের মেয়ে বলেই মনে করেন। তা নাহলে এতো ছাড় তিনি কাউকেই দেননি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সেই মেয়েকেই তার হারাতে হবে। মনের মধ্যে ভয়গুলো আরও বেশি করে গেঁথে যাচ্ছে। তবে প্রার্থনা করা ছাড়া এখন আর উপায়ই বা কী তার!
.
.
বাড়িতে আসা সব লোকজন চলে যাওয়ার পর মোহিনী ভেতরে প্রবেশ করলেন। আজ এ-বাড়িতে প্রবেশ করতে কেউ তাকে আটকায়নি। কেউ দেখেনি এমন নয়। দেখেছে, তবুও আটকায়নি। আটকানোর কোনো প্রয়োজন মনে হয়নি। মোহিনীকে সদর দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখেই উপস্থিত সকলেই একদম স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। পদ্মাবতী নিজের ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে ছিলেন। মোহিনী অন্যকারও দিকে খেয়াল না করে সোজা পদ্মাবতীর কাছে চলে গেলেন। তার কোলের বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ঠিক বলেছিলাম আমি। একদম বাবার মতোই হয়েছে। আমি কোলে নিতে পারবো ওকে? নাকি আমার কোলে দিতে আপত্তি আছে?”
পদ্মাবতী জবাব দিলেন না। পাশে থেকে শেফালী আস্তে করে বললেন,
“অরণ্য।”
“ভালো তো। শেফালী, ওকে এটা পরিয়ে দে।”
বলেই শেফালীর হাতে ছোট্ট একটা বাক্স দিলেন মোহিনী। বললেন,
“ওর জন্য ছোট্ট একটা উপহার এনেছি। আমি নিজেও এটা ছুঁইনি। তাই এতে কোনো নর্তকীর স্পর্শও নেই। আশা করি ওকে এটা পরাতে কারও আপত্তি থাকবে না।”
শেফালী চেইনটা বাচ্চাটার গলায় পরিয়ে দিলেন। মোহিনী বাচ্চাটাকে কোল থেকে নামিয়ে আবার পদ্মাবতীর কাছে দিয়ে দিলেন। তার উপস্থিতিটা এখানে কেউ-ই যে পছন্দ করছেন না তা বেশ বুঝতে পারছেন তিনি। তার নিজেরও এখানে থাকতে কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। তাই দ্রুত ফিরে যাওয়াটাই নিজের জন্য ভালো মনে করলেন। কিন্তু যাওয়ার আগে মোহিনীর চোখজোড়া অন্য কাউকে খুঁজতে লাগলো। কোণায় অর্ণবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন তিনি। এগিয়ে গিয়ে তার সামনে দাঁড়ালেন। শকুন্তলা কিছু বলতে যাবেন কিন্তু শুধু শুধু কথা বাড়বে বলে আম্রপালি তাকে থামিয়ে দিলেন। মোহিনী কিছুটা তাচ্ছিল্য করে অর্ণবের উদ্দেশ্যে বললেন,
“কেমন আছেন অর্ণব?”
মোহিনীকে দেখে অর্ণবের ভাবের কোনো পরিবর্তন হলো না। তিনি নির্লিপ্তভাবে জবাব দিলেন,
“ভালো। আপনি?”
“যেমনটা ছেড়ে গিয়েছিলেন। শুধু একটা জিনিস পরিবর্তন হয়েছে আমার জীবনে। আবারও নাচতে শুরু করেছি।”
অর্ণব কোনো জবাব দিলেন না। মোহিনী আবার বললেন,
“আপনাকে আবার এভাবে দেখবো ভাবিনি। সে যাই হোক, আপনার পরিবারের একটা জিনিস আমার কাছে রয়ে গেছে। সেটাও ফিরিয়ে দিতে এসেছি।”
“কোন জিনিস?”
অর্ণবের হাতে বালাটা দিয়ে মোহিনী বললেন,
“এটা।”
“ওহ।”
“কাল সন্ধ্যায় আমাদের জলসায় আপনার আমন্ত্রণ রইলো।”
আর কিছু বললেন না মোহিনী। শোনারও অপেক্ষা করলেন না। চলে গেলেন। তার যাওয়ার পর সবাই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। গোটা পরিবারের কাছে তিনি একটা আতংক ছাড়া যেন কিছুই নন। শান্তি দেবী অর্ণবের সামনে এসে বললেন,
“বালাটা তো আমি তোর বউকে দিতে বলেছিলাম। তুই মোহিনীকে দিয়েছিলি কেন?”
শান্তি দেবী মাঝেমাঝে যেমন সব ভুলে যান আবার তেমনই মাঝেমাঝে তার সবকিছু কীভাবে মনে থাকে এটা ভেবে পাননা অর্ণব। তবে তিনি যে রেগে যাননি তা কথা শুনে বুঝতে পারছেন। কিন্তু তার প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারলেন না অর্ণব।
.
.
.
বিছানায় শুয়ে শুধু এপাশ ওপাশ করছেন পদ্মাবতী। কিছুতেই ঘুম আসছে না। মোহিনী চলে যেতে যেতেও তাকে কী একটা দুশ্চিন্তায় ফেলে গেলেন। অর্ণবকে কাল সন্ধ্যার জলসায় আমন্ত্রণ জানালেন। অর্ণব কি সত্যিই যাবেন সেখানে? না, অর্ণব যাবেন না। অর্ণব যে সেখানে আর যেতে পারেন না এব্যাপারে নিশ্চিত পদ্মাবতী। এই কয়দিনে তিনি খুব ভালোভাবেই বুঝে গেছেন মোহিনী নামক দুশ্চিন্তাটা তার জীবন থেকে চিরদিনের মতো চলে গেছে। এখন তার আর অর্ণবের সম্পর্কটা আর বাকি পাঁচটা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মতোই ভালোবাসায় ভরপুর। অর্ণব এখন আর মোহিনীকে ভালোবাসেন না। শুধু তাকেই ভালোবাসেন। অনেক চেষ্টার পর এটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে নিতে পেরেছেন পদ্মাবতী। এসব ভাবতেই তার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। খাটের পাশেই দোলনাটায় নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে অরণ্য। ওই ভালো। আশেপাশে কী হচ্ছে না হচ্ছে সেসবে ওর কিচ্ছু যায় আসে না। ওরই এখন যত সুখের দিন। ঘরে হ্যারিকেন এর টিমটিম আলো জ্বলছে। বারান্দার দরজা দিয়ে হুহু করে শরীর হিম করা শীতল হাওয়া আসছে। যা গরম পড়েছে! হাতপাখায় আর কুলোয় না। এখন এই হাওয়াটাই ভরসা। পদ্মাবতী উঠে বারান্দায় এলেন। অর্ণব একটা সিগার হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। পদ্মাবতী পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। তার পিঠে মাথা রেখে চোখ বুজে রইলেন। বাইরে প্রচন্ড জোরে বাতাস বইছে। সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। এরমধ্যে বিদ্যুৎ চমকে প্রথম বাজটা পড়লো। অর্ণব সিগার শেষ করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঘরের ভেতরে চলে এলেন। পদ্মাবতীর মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। তিনি সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন। একটু পরপর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই সাথে চারপাশের পরিবেশটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে উঠছে। পদ্মাবতী দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখতে দেখতে ভাবতে লাগলেন,
“আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চারজন। বড়মা, অর্ণব, আমার সন্তান আর মোহিনী। মোহিনী, যাকে আমি ভালোওবাসি আবার ঘৃণাও করি। যার সাথে বন্ধুত্বের মতো একটা পবিত্র সম্পর্ক আমি নিজের হাতে নষ্ট করেছি। যার ভালোবাসার পরিবর্তে আমি তাকে দিয়েছিলাম বিশ্বাসঘাতকতা। পৃথিবীতে যার কাছে আমি সারাটা জীবন দোষী হয়ে থাকবো। কিন্তু আমাকে তো না চাইতেও এসব করতে হয়েছে। নিজের স্বার্থের জন্য। কারণ আমি সবচেয়ে বেশি ঘৃণাও তাকেই করি। আর ঘৃণার পরিমাণটা হয়তো ভালোবাসার চেয়ে বেশিই ছিল। তাইতো কত ক্ষতি করার চেষ্টা করেছি আমি ওর। মে/রেও ফেলতে চেয়েছি। আবার নিজেই নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়েছি। কিন্তু আমার কর্মের শাস্তি যে আমাকে এভাবে পেতে হবে তা কোনোদিন ভাবতেও পারিনি। অন্যের ক্ষতি করতে গিয়ে আমি নিজেই নিজের সবচেয়ে বড় ক্ষতি করে ফেলেছি। যা আর কোনোদিন পূরণ হবার নয়। কোনোদিনও নয়। আমার সাথে যা যা হয়েছে তার জন্য আমি কোনোদিনও মোহিনীকে দ্বায়ী করবো না। এসবের জন্য দ্বায়ী আমি নিজেই। আমার সন্তান…”
আর ভাবতে পারলেন না পদ্মাবতী। তার আগেই ভেতর থেকে অর্ণবের ডাক এলো।
“ভেতরে এসো পদ্মাবতী। অরণ্য ঘুমের মধ্যে ভয় পাচ্ছে।”
ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো তার। ভেতরে এসে বারান্দার দরজা লাগিয়ে অরণ্যর কাছে এলেন। বাজ পড়ার শব্দে ঘুমের মধ্যেই কেঁপে কেঁপে উঠছে বেচারা। অর্ণব ইতোমধ্যেই উল্টো দিকে ঘুরে শুয়ে পড়েছেন। পদ্মাবতী সাবধানে অরণ্যকে কোলে তুলে নিলেন। বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকালেই তার সমস্ত দুশ্চিন্তা, হতাশা দূর হয়ে যায়। তার ভাগ্য থেকে দুঃখ দুরাশা দূর করতেই যে বাচ্চাটা এসেছে এটা বেশ ভালোই বুঝতে পারেন তিনি। অর্ণবের পাশে বাচ্চাটাকে বুকে নিয়ে বালিশে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে রইলেন পদ্মাবতী।