Wednesday, July 2, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 318



গোলকধাঁধা পর্ব-১৪

0

#গোলকধাঁধা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৪

সিরাত নাকমুখ মুছে বলল,
‘কথা বলো না তো। বাড়ি চলো।’
‘তোর মতিগতি ভালো না। কি হয়েছে তোর?
মায়ের কথা শুনে সিরাত তেলেবেগুনে জ্বলে
ওঠলো,
‘হা হা আমিই খারাপ। আর সবাই ভালো।’
মিনারা বিস্মিত হলেন। এই মেয়ের মাথায় কি গন্ডগোল আছে নাকি? আগে তো এমন ছিলো না। কথায় কথায় এখন চোখের জল ফেলে। তিনি চিন্তিত মুখে বসে রইলেন। ঘাটালেন না মেয়েকে। বেশি কান্নাকাটি করলেও বাচ্চার সমস্যা হবে। সিরাত কিছুক্ষণ পর চুপ হয়ে গেলো আপনাআপনি। ওড়নার কোণা দিয়ে চোখমুখ মুছে রিকশার একপাশ চেপে ধরে বসলো। লোকটা কিভাবে ওকে এতগুলো কথা শোনাতে পারলো? সব দোষ কি সিরাতের? ও নিজে যে এত কান্ড করলো, ক্ষমতার অপব্যবহার করলো, ওকে তুলে এনে বিয়ে করলো, ষড়যন্ত্র করলো, কষ্ট দিলো সেসব কি ভালো কাজ? যে এসে ক্ষমা চাইলেই হয়ে গেলো?
রিকশা থেমে যাওয়ায় সিরাত বাস্তবে ফিরে এলো।
বাড়ি এসে গেছে তারা। মিনারা মেয়েকে সাবধানে নামতে বলে রিকশা ভাড়া মিটিয়ে দিলেন। আমির চৌধুরী গাড়ি করে পৌঁছিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সিরাত রাজি হয়নি। এতবড় গাড়ি তাদের গলিতে ঢুকবে না। তাছাড়া সিরাতের কাছে কেমন যেন বেমানান লাগে!

এক সপ্তাহ হাসপাতালে কাটানোর পর প্রত্যয়
খানিকটা সুস্থ হলে ওকে বাড়ি নিয়ে আসা হলো। এর মধ্যে সিরাত আর ওকে দেখতে আসেনি। তবে প্রত্যাশার কাছে নিয়ম করে ফোন করে খবর
নিয়েছে, মাঝেমধ্যে প্রত্যয় ঘুমিয়ে থাকলে তখন চুপিচুপি ভিডিও কল করে দেখেছে।
সুস্থ হওয়ার পর এসব জেনে প্রত্যয় যারপরনাই রেগে গেলো। দরকার নেই ওর এমন বেয়াদ্দব বউয়ের, স্বামী মরতে বসেছিলো আর ওনি নাকি ভিডিও কলে দেখেছে! বোনের ওপর কিছুক্ষণ চেঁচালো প্রত্যয়। প্রত্যাশা রেগে নিজের ঘরে চলে গেলো। মুশফিকা চৌধুরী মাত্রই ছেলের দুপুরের খাবার নিয়ে এসেছেন। ঘরে ঢোকার মুখে দুই ভাইবোনের চেঁচামেচি
শুনে তিনি এসে বললেন,
‘তোমার আর সিরাত! দু’জনের মধ্যে সমস্যাটা কী? অনেকদিন ধরেই খেয়াল করছি, কিন্তু জানতে চাইনি। বলো তো ঘটনা কি?’
প্রত্যয় ফোন ঘাটার ভান করে ব্যস্ত স্বরে বলল,
‘কিসের সমস্যা? কোনো সমস্যা নেই।’
‘তাহলে প্রত্যাশাকে ওভাবে বললে কেন?’
প্রত্যয় ছোট করে বলল,
‘এমনি। সামান্য মনোমালিন্য চলছে। ঠিক হয়ে যাবে।’
মুশফিকা তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
‘বলো কি? এ সময় ঝগড়াবিবাদ করা ঠিক না। মায়ের কিছু হলে সেটা কিন্তু বাচ্চার ওপরও প্রভাব ফেলে।’
প্রত্যয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘তেমন কিছু সিরিয়াস না৷’
‘আমি সিরাতের সাথে কথা বলবো। আজই ওকে বাড়ি নিয়ে আসবো। কম দিন তো হলো না।’
প্রত্যয় গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘না ও থাকুক। যখন আসতে ইচ্ছে করবে তখন
আসবে। অহেতুক জোরাজুরি করো না।’
‘তাও ঠিক।’
মুশফিকা দু’পাশে মাথা নাড়িয়ে সায় জানালেন।
এরপর ছেলের বারণ স্বত্তেও নিজ হাতে তুলে খাইয়ে দিলেন। খাওয়ানো শেষে এটা-সেটা বলে চলে গেলেন।

গ্রাম থেকে সিরাতের দাদী মুমিনা বেগম এসেছেন বাড়িতে। কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হলেও দাদী বেশ মজার মানুষ। নাতনি মা হতে যাচ্ছে শুনে তার খুশির অন্ত নেই। সিরাতের পছন্দের সব খাবার, আচার পোটলা করে নিয়ে এসেছেন সাথে করে। এমনকি কাঁথাও সেলাই করে এনেছে। সেগুলো দেখে ভালো লাগলো আবার অকারণেই লজ্জাও পেলো সিরাত। ওর খেতে ইচ্ছে করছিলো বলে মিনারা হাঁসের মাংস রান্না করেছে। সারাদিন অরুচি হওয়া মুখে হাঁসের মাংস দিয়ে ভাত খেতে ভালোই লাগছে ওর। ওকে আয়েশ করে এসব খেতে দেখে দাদী আঁৎকে ওঠে বললেন,
‘কি লো বুবু, ছাইপাশ কি গিলতাছোস?’
সিরাত হেসে বলল,
‘হাঁসের মাংস।’
দাদী চিৎকার করলেন,
‘অক্ষুনি ফেল এইসব বুবু, অক্ষুনি ফেল। কি অলক্ষুণে কারবার, বউয়ে কি বিবেকবুদ্ধি হারাইছে নি?’
সিরাত ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘কেন কি হয়েছে?’
‘হাঁসের মাংস খাইলে তোর পেটের বাইচ্চার গলাও ফ্যাসফ্যাসে অইবো লো বুবু। খাইস না ইতা।’
সিরাত হেসে ফেললো। মিনারাও শ্বাশুড়ির চেঁচামেচি শুনে ছুটে এলেন। ঘটনা শুনে দু’জনে মিলেই বোঝাতে লাগলেন এসব কথা ভিত্তিহীন বলে। তবে সেসব
কানেই নিলেন না মুমিনা বেগম,
‘অ আ ক খ পইড়াই বিজ্ঞ হইয়া গেছু তাইনা? অহন আর মুরুব্বিগো কথা হুনবা কেমনে? বাইচ্চা যহন হাঁসের লাগান কথা কইবো তহন এই মুমিনার কতাই মনে অইবো।’
অগত্যা সিরাত আর মুখে তুললো না সেসব খাবার।
এমনভাবে ভয় দেখালে তো মনের ভেতর সন্দেহ ঢুকে পড়ে। তাছাড়া দাদীর কথাও ফেলতে পারলো না। অন্য তরকারি দিয়ে ভাতগুলো শেষ করে ঘরে আসতেই দেখলো সোহা নীরুর চুল টেনে ধরেছে। ব্যথা পেয়ে নীরু চিৎকার করছে, তবুও ছাড়ছে না। ইদানীং সোহা
বেশ দুষ্ট হয়েছে। কামড় দেয়, খামচি দেয়, চুল-দাঁড়ি টেনে ধরে। মুমিনা বেগম বলেছেন এই মেয়ে বড় হলে তাকে এক হাটে বেচে অন্য হাট থেকে কিনে
আসার ক্ষমতা রাখবে এই মেয়ে। সিরাত দ্রুত গিয়ে নীরুকে ছাড়িয়ে নিয়ে ওকে ধমক দিতেই ঠোঁট
ফুলিয়ে কান্না করে বলল,
‘সব্বাই ফচা।’
সিরাত ওকে জোর করে টেনে নিজের কাছে এনে আদর দিয়ে বলল,
‘এইতো আদর দিলাম। আমিও পচা?’
‘সব্বাই।’
‘কি হয়েছে?’
‘বলব না।’
সিরাত মন খারাপ করার ভান করতেই সোহা
ওর গালে চুমু দিয়ে বলল,
‘না না তুমি সুদু বালো মা।’
সিরাত হেসে কাছে টেনে চুমু খেলো ওকে। সোহা ওর কোলে মাথা রেখে খেলতে লাগলো। ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে ভাবলো সোহা বড় হলে দারুণ সুন্দত দেখতে হবে। ঠিক মা সিমিনের মতো। আচমকা হুট করেই ওর মনে হলো ওর বাচ্চা দেখতে কার মতো হবে। বাবা নাকি মা? সিরাত মনে মনে চাইলো প্রত্যয়ের
মতো দেখতে হলেই ভালো, কারণ সিরাত নিজেকে আহামরি সুন্দরী মনে করে না।

রাতে ফোন এলো রাহীর। ফোর্থ ইয়ারের ফাইনাল এক্সাম এ মাসেই। বেশিদিন বাকি নেই। শুনে সিরাতের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। পড়া তেমন কিছুই হয়নি, ক্লাসও ঠিকঠাক অ্যাটেন্ড করতে পারেনি। কিভাবে সব গুছিয়ে ওঠবে তা নিয়ে পড়লো চিন্তায়।
তবে শিমুল সাহেব এসে বললেন এত চাপ না নেওয়ার জন্য। যতটুকু পারবে ততটুকুই যাতে কমপ্লিট করে।সিরাত বইটই খুঁজে এনে প্রিপারেশন শুরু করলো পরদিন থেকেই। মুশফিকা চৌধুরী শুনে বললেন রেজাল্ট খারাপ হলে সমস্যা নেই, ও যাতে নিজের যত্ন নিতে না ভুলে। সিরাত তাকে আশ্বস্ত করলো সে নিজের এবং বাচ্চার খেয়াল ভালোভাবেই রাখবে। ইদানীং বাচ্চার অস্তিত্ব, নড়চড় টের পায় সেটা শ্বাশুড়িকে জানাতেও ভুললো না সে।

এভাবেই দিন কয়েক কেটে গেলো। প্রত্যয় ফোন এবার সিরাত আর কেটে দেয় না। শুধু ’ভালো আছি’ জবাব দিয়ে ত্রিশ সেকেন্ডের ভেতর কেটে দেয়। তবে প্রত্যয়ও এরবেশি কোনো কথা বলে না। রাগ, অভিমান ভালোই জেঁকে ধরেছে ওর। দিনটা মেঘলা। তবে বৃষ্টি নেই। একঝাঁক পাখি ওড়ছে আকাশে। মৃদুমন্দ হাওয়ায় দুলছে পথের ধারে লাগানো বাগানবিলাস গুলো। প্রতিমন্ত্রীর অফিস থেকে মিটিং সেরে মাত্র বেরিয়েছে সে। সঙ্গে আছে মাহিন। সে অনবরত বকবক করে এতদিনের জমানো কাজের ফিরিস্তি দিচ্ছে। প্রত্যয় আনমনা হয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘তোর ভাবীর খবর কি?’
‘ভাবীর তো ফোর্থ ইয়ারের এক্সাম চলে। পরশু
থেইকা শুরু হইছে।’
প্রত্যয় চট করে তাকালো মাহিনের দিকে,
‘আমাকে জানাসনি তো তুই।’
মাহিন মাথা চুলকে বলল,
‘এত কাজের চাপে মনে ছিলো না ভাই।’
‘কার সাথে আসে ও?’
মাহিন অকপটে জানালো,
‘তালুই মশাই নিয়া আসে। যাইবার সময় বান্ধবীর সাথে যায়। ওই রাহী আছে না? ওর সাথে।’
প্রত্যয় আরকিছু বললো না। এই অবস্থায় কি করে চলাফেরা করে মেয়েটা? কতবার মা’কে দিয়ে বলে পাঠিয়েছে গাড়ি করে যেতে, নিজেও বলেছে। কিন্তু এই মেয়ের নাকি গাড়ি করে যেতে ইচ্ছে করে না। প্রত্যয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতঘড়ি চেক করলো। পাঁচটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট। তার মানে ইতোমধ্যে পরীক্ষা শেষ। ড্রাইভারকে বললো গাড়িটা ভার্সিটির দিকে নিয়ে যেতে। সিরাতকে পাবে কি-না সন্দেহ, তবুও একবার দেখে আসতে চায়। কিন্তু গিয়ে লাভ হলো না। কোথাও খুঁজে পেলো না। একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো পরীক্ষা শেষে রাহীর সাথে রিকশা করে চলে গেছে সিরাত। মেজাজ চরম খারাপ হবার মতো খবর শুনে বিরক্তিবোধ জেঁকে ধরলো প্রত্যয়ের। ছ’মাসে পড়েছে এবার, ও যে অন্তঃস্বত্তা সেটা কি ভুলে গেছে?
এত ছোট রিকশা করে যাওয়া কি ঠিক? ওদের বাড়ির ওদিকের রাস্তাগুলোও তেমন ভালো না। ইচ্ছে করছে থাপড়ে ওর গাল লাল করে দিতে।

পরদিন সিরাত পরীক্ষা শেষে বের হয়ে দেখলো মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। বাড়ি ফেরা নিয়ে ওর চিন্তা হলো। রাহীর সাথে মলিন মুখ করে বৃষ্টি থামার
অপেক্ষা করতে লাগলো ও। খানিকক্ষণ পর ঝাপসা চোখে সিরাত দেখলো কালো রঙের পাজেরো
গাড়িটা গেইটের সামনে দাঁড়িয়েছে। আর ভেতর থেকে একটা কালো ছাতা নিয়ে বেরিয়ে এসেছে প্রত্যয়। সাবধানে পা ফেলে দ্রুত হেঁটে এসে দাঁড়ালো
সিরাতদের সামনে। ছাতা নামিয়ে চুল হালকা ঝেড়ে ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
‘দ্রুত চলো।’
সিরাত শক্ত গলায় বলল,
‘বৃষ্টি এক্ষুনি থামবে। আমরা যেতে পারবো। আপনি যান।’
রাহী বিস্ময় ভাব নিয়ে ওকে দেখলো। প্রত্যয়ের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। রাহী পরিস্থিতি বুঝতে পেরে বলল,
‘পাগল নাকি তুই? বৃষ্টি মনে হয় না আজ থামবে। এই অবস্থায়ও তোর জেদ গেলো না! যা তো ভাইয়ার
সাথে। আমি যাই।’
প্রত্যয় রাহীকে বলল,
‘তুমিও চলো। বৃষ্টিতে কীভাবে যাবে?’
‘রিকশা করে। সমস্যা হবে না। এতক্ষণ তো সিরাতের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম। এখন আপনি এসে গেছেন
আমি তাহলে যাই।’
প্রত্যয় বলল,
‘একদম না। আমি নামিয়ে দেবো। চলো আর তোমার গাধী বান্ধবীকেও নিয়ে আসো। নয়তো জোর করে
তুলে নিয়ে যাবো।’
রাহী হাত ধরে টানতে লাগলে অগত্যা বাধ্য হয়েই পেছনের সিটে গিয়ে বসে পড়লো। প্রত্যয় এসে
ড্রাইভিং সিটে বসলো। বৃষ্টিভেজা রাস্তায় গাড়ি চলতে শুরু করলো। রাহীকে ওর মেসের সামনে নামিয়ে
দিয়ে আবারও চলতে শুরু করলো। এরমধ্যে বৃষ্টির তেজ কমে এলো। লুকিং গ্লাস দিয়ে সিরাতকে দেখে প্রত্যয় গলা খাকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘কেমন আছো?’
‘ভালো।’
সাথে সাথেই জবাব দিলো সিরাত। এরপর চুপ করে গেল। প্রত্যয় একটু পর গাড়িটা রাস্তার একধারে থামালো। সিরাত একটু ঘাবড়ালো। প্রত্যয়
স্টিয়ারিং ধরে ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলল,
‘বাচ্চার বাবা ভালো নেই।’
সিরাত চুপ করে থাকায় মেজাজ বিগড়ে গেল
প্রত্যয়ের। চট করে দরজা খুলে পেছনে এসে বসতেই সিরাত আৎকে ওঠলো। ব্যাপারটা বুঝতে না দিয়ে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলো। প্রত্যয় ওর পাশে বসে পূর্ণ দৃষ্টিতে বউকে দেখতে লাগলো, কতদিন দেখে না! অমন চাহনি দেখে খানিকটা শিউরে ওঠলো সিরাত। প্রত্যয় বিষন্ন গলায় বলল,
‘তোমাকে ছাড়া আমার আর ভালো লাগে না। বাড়ি ফিরে তোমার মুখ না দেখে কতদিন কাটিয়ে দিলাম বলো তো!’
সিরাত নির্লিপ্ত স্বরে বলল,
‘দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমাকে ফিরতে হবে। চিন্তা করবে সবাই।’
প্রত্যয় বলল,
‘না করবে না।’
সিরাত বুঝলো বাড়িতে জানে। তবুও বিরক্তি নিয়ে বলল,
‘আমি ক্লান্ত, দেখতে পাচ্ছেন না? এক্ষুনি যেতে চাই।’
প্রত্যয় ওকে জড়িয়ে ধরলো। হুট করে এমন করায় চেঁচিয়ে ওঠলো সিরাত। প্রত্যয় না ছেড়ে আরো শক্ত করে ধরে ডানহাতটা আস্তে করে নিয়ে কামিজের নিচ দিয়ে সিরাতের হালকা উঁচু হওয়া উদরে রেখে বলল,
‘আমি ওকে অনুভব করতে চাই সিরাত। তুমি কেন বুঝো না? আমাকে মাফ করো আর না করো এখন আর কিছু যায় আসে না, তবে তোমাকে আমি কখনো ক্ষমা করবো না, আমাকে এত কষ্ট দেওয়ার জন্য!’
সিরাত কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলো। প্রত্যয় ওকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো। ওর দিকে দৃষ্টি রেখেই বলল,
‘আমার কতগুলো স্বপ্ন, ইচ্ছে তুমি মাটি করে দিচ্ছো জানো তুমি? আমি কি বারবার বাবা হবো যে সব অনুভূতি একাই নিয়ে নিচ্ছো আমাকে ভুল বুঝে?’

সিরাত হাসি চাপতে পারলো না। প্রত্যয় অবাক হয়ে গেলো। হাসির প্রতিটা শব্দ ওর বুকে তীর গেঁথে
দিচ্ছে। যেন ওর ছটফটানি মৃ’ত্যুতে উল্লাস করছে এই মেয়ে। এক ঝটকায় কাছে টেনে চুমু খেলো ঠোঁটে। হতভম্ব হয়ে চুপ করে যাওয়া সিরাতকে এরপর রাগ
রাগ কন্ঠে বলল,
‘জানি, আমাকে এখন আর ভালোবাসো না তুমি। আচ্ছা বাসতে হবে না। তুমি আমার পথের সঙ্গী না হতে চাইলেও সত্যি বলছি, আমি তোমার পথের ধুলো হতে চাই। আমাকে মাঝ রাস্তায় ফেলে চলে যেও না প্লিজ!’

কি যে হলো! সিরাতের মনটা যেন বরফের ন্যায়
গলে একদম পানি হয়ে গেলো। কথাগুলো নাটকীয় মনে হলেও প্রত্যয়ের চোখের দৃষ্টিতে সে মিথ্যে কিছু
দেখলো না। বরংচ খুঁজে পেলো আকুলতা!

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ]

চলবে….

গোলকধাঁধা পর্ব-১৩

0

#গোলকধাঁধা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৩

সিরাত সান্ত্বনা দিয়ে ওকে বলল,
‘চোর ধরতে আসবে মা, তোমাকে না।’
প্রত্যয়ের মনে হলো কথাটা ওকেই উদ্দেশ্য করে
বলেছে সিরাত। অপমানে থমথমে হয়ে ওঠলো মুখ।
রেগে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে। এদিকওদিক
কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে সোহার জন্য কিছু কিনে রাত দশটায় ফিরে এলো। খাবারের পর্ব সেরে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়লো। পরদিন খুব সকালেই বেরিয়ে গেলো আবার, নাস্তা করতে পারলো না। মিনারা বারবার করে বলে দিলেন কাজ সেরে চলে আসতে। প্রত্যয়ও আর না করতে পারলো না।

গোধূলির রঙচঙে আকাশ। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে। সিরাতদের বাড়িটা বেশ পুরোনো, তেমন একটা বড়ও নয়। শ্যাওলা পড়া ছাদে একটুখানি হেঁটে ঢিবির ওপর এসে বসলো সিরাত। হাঁপাচ্ছে ও। আজকাল হাঁটাহাঁটি, ভারী কাজ করতে ভালো লাগে না ওর। ইনফেক্ট কিছুই করতে ইচ্ছে করে না। খাওয়া আর ঘুম ছাড়া নড়াচড়া করতেও অলস লাগে। তবুও ঘরে আর কত বসে থাকা যায়! মিনারা নীরুকে সঙ্গে করে ঠেলে ঠুলে ওকে ছাদে পাঠিয়েছেন কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করতে। নীরু ফুলগাছগুলোতে পানি দিচ্ছে।
একটু পর প্রত্যয় এসে উপস্থিত হলো। সকালে বেরিয়ে ছিলো, কাজ শেষে মাত্রই এসেছে। ঘরে সিরাতকে না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে এখানে উপস্থিত হয়েছে সে। সিরাতকে দেখে হাঁফ ছেড়ে এসে ওর পাশে বসলো। তৎক্ষনাৎ সিরাত বসা থেকে ওঠে পড়লো। নীরু মাথা নিচু করে নিচে চলে গেলো। প্রত্যয় নিজেও ওঠে কিছুক্ষণ আশপাশটা ঘুরে সামনে এসে দাঁড়ালো সিরাতের। এরপর শান্ত স্বরে বলল,
‘তোমার সাথে কথা আছে।’
‘কোনো কথা নেই।’
বলে সিরাত চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। পেছন থেকে প্রত্যয় ধৈর্য্যহীন হয়ে চেঁচিয়ে ওঠলো,
‘তুমি আমার কথা শুনতে চাও না। তাহলে কিভাবে সমস্যার সমাধান হবে? নিজেকে জাস্টিফাই করার সুযোগ তো দাও। ক্ষমা কিভাবে চাইলে তুমি সন্তুষ্ট হবে বলো, আমি ঠিক তাই করবো। সেদিন আমি যা বলেছিলাম সেগুলো ঠিক নয়।’
সিরাতের পা থেমে গেলো। ঘুরে না তাকিয়েই
রুক্ষ স্বরে বলল,
‘সেদিন আপনি যা বলেছিলেন সেটাই সত্যি।’
প্রত্যয় এগিয়ে এসে একদম ওর সামনে পথরোধ
করে দাঁড়ালো। দৃঢ় গলায় বলল,
‘না সেটা নয়। আমার উদ্দেশ্য এটা থাকলেও আমি
পরে সেগুলো থেকে সরে আসি, শুধু তোমার জন্য।আমি নিজের অনুশোচনা থেকে সবকিছু স্বীকার করেছিলাম, মনের ভার কমাতে। ভাবিনি তুমি
এরকম রিয়েক্ট করবে। তাহলে কখনোই বলতাম
না তোমায়।’
সিরাত তাচ্ছিল্যভরে হাসলো,
‘এটা সিনেমা নয়, বাস্তব। আপনার কথা আমি বিশ্বাস করি না। আমাকে যেতে দিন, কানের কাছে ঘ্যানরঘ্যানর করবেন না।’
প্রত্যয় চটে গেল,
‘আমি ঘ্যানরঘ্যানর করি?’
‘জি করেন। আপনি বুঝতে পারেন না আমি বিরক্ত
হই আপনার এসবে?’
প্রত্যয় হুট করে জাপ্টে ধরলো ওকে,
‘এই মেয়ে, এই! তুমি আমার সাথে এমন করছো কেন?
আমার বুকটাতে আগুন জ্বলে, কষ্ট হয় বুঝো না?’
সিরাত রেগে বলল,
‘বুঝতে চাই না। কারণ সব আপনার নাটক। আর
ভুলছি না এসবে।’
প্রত্যয়ের রাগে গা জ্বলে গেলো। ধৈর্য্য ধরে রাখা
কঠিন। তবুও শান্ত স্বরে বলল,
‘আমাদের বাচ্চা কি খুব ভালো থাকবে যখন সে
শুনবে তার মা তার বাবাকে বিশ্বাস করে না? মাফ
করে দাও আমাকে এসবের জন্য।’
সিরাত কটাক্ষ করে বলল,
‘অমানুষ, জানোয়ার! বাচ্চার জন্য দরদ উতলে পড়ছে তাইনা? আপনি আমাদের থেকে দূরে থাকুন। কখন আবার আমার বাচ্চাটাকে লা’শ বানানোর ইচ্ছে জাগবে বলা যায় না।’
প্রত্যয় বাক্যহারা হয়ে গেলো। এ এটা কিভাবে বলতে পারলো সিরাত? একটুও বিশ্বাস করে না? নিজের বাচ্চার ক্ষতি করার কথা কীভাবে ভাবতে পারে প্রত্যয়?
ও ধীরপায়ে ছাদ থেকে নেমে এলো। শিমুল সাহেব চা খাচ্ছেন। মিনারা নাস্তা বানাচ্ছে। নীরু ওকে
দেখে বলল,
‘দুলাভাই বসেন। খালাম্মা আপনার জন্য পায়েস
রান্না করছে।’
প্রত্যয় ভদ্রতার খাতিরে দু’চামচ পায়েস মুখে দিলো। এরপর জরুরি কাজের বাহানা দেখিয়ে বিদায় নিয়ে চলে এলো। মিনারা বেগম ওর মুখ দেখেই বুঝলেন মেয়ে হয়তো আবারও কিছু বলেছে ছেলেটাকে। তিনি সিরাতকে অনেক বকাঝকা করলেন। মায়ের বকবক শুনে সিরাত বিরক্ত হলো। ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকলো। অমানুষটা এত নাটক জানে যে, এখন সিরাতের বাবা-মাও ওকে
দোষ দেয়! অথচ সত্যি ঘটনাটা শুনলে তারা
নিজেরাই ছাড়িয়ে আনতে চাইবে প্রত্যয়ের কাছ থেকে।
কিন্তু একটা কারণেই সিরাত তা করছে না। তার অনাগত বাচ্চাটার প্রতি প্রত্যয় আর ওর পরিবার ভীষণ দুর্বল। বাচ্চাটাকে কোনোভাবেই ছাড়বে না, নিশ্চয়ই নিজেদের কাছে নিয়ে নেবে। তারা ক্ষমতাধর ব্যক্তিবর্গ! সিরাত চাইলেও পারবে না কিছু করতে। আর নিজের সন্তানকে হারাতে হবে ভাবলেই বুক কেঁপে ওঠে ওর!

সপ্তাহ খানিক পর শিমুল সাহেব স্কুল থেকে ফিরে জানালেন প্রত্যয়ের জ্বর হয়েছে। যে সে জ্বর না, একদম ডেঙ্গুজ্বর। অবস্থা বেশ খারাপ, হসপিটালে এডমিট। ক’দিন আগে ডেঙ্গু প্রতিরোধী কর্মসূচি আয়োজন করেছিলো সে, আর নিজেই এখন এতে আক্রান্ত বলে শিমুল সাহেবের আফসোসের শেষ রইলো না। সিরাত শুনে বাইরে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। মিনারা বেগম তাদের সাথে একপ্রকার জোর করে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন সিরাতকে। প্রত্যয়ের দলের চেলা পেলা, ভাই-বন্ধুসহ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পরিচিত লোক দিয়ে ওর কেবিন ভরা। ডাক্তারদের বিধিনিষেধ কেউ মানছেই না। বাইরে দরজার কাছে দু’জন চেলা দাঁড়িয়ে প্রটেকশন দিচ্ছে। সিরাত মনে মনে তাচ্ছিল্য করলো। ওকে দেখেই সবাই ভাবি ভাবি করে আদিক্ষেতা শুরু করলো। না চাইতেও হাসি হাসি মুখ করে সবার সাথে কুশল বিনিময়ে করলো। ভাইয়ের ‘বউ’ এসেছে শুনে প্রায় সবাই কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে এলো। সিরাতরা ভেতরে ঢুকে দেখলো মুশফিকা চৌধুরী ছেলের কাছে বসে আছেন। আর জ্ঞানহীনের ন্যায় চোখ বন্ধ করে হাতে স্যালাইন লাগিয়ে মশারির ভেতর শুয়ে আছে দীর্ঘদেহী প্রত্যয়। মুশফিকা চৌধুরী জোর করে টুকরো করা আপেল খাওয়াচ্ছেন ছেলেকে। প্রত্যাশা দুধের গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু এসব খাওয়ার রুচি হারিয়েছে প্রত্যয়। চোখমুখের বেহাল দশা, উষ্কুখুস্কু চুল। দেখে ভালো লাগলো না
সিরাতের। চোখ ছলছল করে ওঠলো। মুশফিকা চৌধুরী সিরাতকে দেখে ডুকরে কেঁদে ওঠলেন,
‘তুমি বাড়ি গিয়ে বসে আছো। আমার ছেলেটার নিজের প্রতি একটুও খেয়াল নেই তা তো জানতে। দেখো কি অবস্থা করেছে নিজের। এত জ্বর, গা ব্যথা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। কাউকে বলেও নি। কি বিপদ বাঁধিয়ে বসে আছে।’
মিনারা বেগম আঁৎকে ওঠলেন,
‘কি বলেন আপা? বুঝলেন কিভাবে?’
ফুঁপিয়ে ওঠলেন মুশফিকা চৌধুরী,
‘জ্ঞান ছিলো না। মাহিন ফোন করে খবর দিলো। ওরাই তো ধরাধরি করে হাসপাতালে এনেছে। এরপর এসে
জানতে পারলাম ডেঙ্গু।’
হায় হায় করে ওঠলেন মিনারা বেগম। মেয়ের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালেন। শ্বাশুড়ি আর মায়ের সামনে চুপসে গেলো সিরাত। মুখ ছোট হয়ে গেলো ওর। মিনমিন করে বলল,
‘আপনার ছেলে আমাকেও বলেনি মা। না বললে
আমি কিভাবে জানবো? চেনেন তো ওনাকে। যোগাযোগ রাখেনা, ফোন করেনা, ঘাড়ত্যাড়া লোক।’
একটু পর প্রত্যয় নড়ে ওঠলো। এরপর দুর্বল
চোখ খুলে তাকালো। ওর অস্ফুট গলার স্বর শোনা গেল। কেউ তেমন কিছু বুঝলো না।
প্রত্যাশা বলল,
‘ভাইয়া সবাইকে যেতে বলেছে। ভাবী তুমি না হয়
একটু থাকো।’
মুশফিকা চৌধুরী আপত্তি জানালেন৷ কিন্তু পরে
ছেলের কথা শুনে বেরিয়ে এলেন। সবাই বেরিয়ে যেতেই প্রত্যয় ডাকলো সিরাতকে,
‘এই মেয়ে, ওখানে দাঁড়িয়ে কাঁদছো কেন? বাড়ি
গিয়ে ঘুমিয়ে থাকো। আর আসবে না এখানে।’
সিরাত মিনমিন করে বলল,
‘আপনি ঠিক করে দেওয়ার কে? শুনবো না আপনার কথা।’
প্রত্যয় কড়া চোখে তাকালো,
‘খুব তো সাধু সাজা হচ্ছে। এসব লোকদেখানো নাটক বন্ধ করে বাড়ি যান। আমার বাচ্চার কিছু হলে আস্ত রাখবো না।’
‘আমি লোকদেখানো নাটক করছি?’
প্রত্যয় কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
‘করেন নি? ওহ আচ্ছা! আমি আপনাকে ফোন
করিনা, যোগাযোগ রাখিনা, কিছু বলি না, ঘাড়ত্যাড়া লোক তাই তো? তাহলে কে যেন আমার নাম্বার ব্লকলিস্টে ফেলে রেখেছে? কে যেন আমার গলা শুনলেই ফোন কেটে দেয়? বাড়ি গেলে অপমান করে তাড়িয়ে দেয়?’
সিরাতের গলা শুকিয়ে গেলো। গুন্ডাটা এই মরমর দশায়ও ঠিক কান খোলা রেখেছে। সব শুনে
নিয়েছে। তবুও জোর গলায় বলল,
‘বেশ করি। ড্রামাবাজ, বিশ্বাসঘাতকের সাথে এমনই করা উচিৎ।’
প্রত্যয় ধমক দিলো,
‘এত এত উপাধি যে দিচ্ছো। তুমি তো প্রথম থেকেই জানতে আমি তোমাকে শাস্তি দেওয়ার জন্যই বিয়ে করেছি। তাহলে কেন আমার প্রেমে পড়লে? ভালোবাসলে? আমার ক্ষমতা, প্রতিপত্তি দেখে নাকি আমার রুপ-যৌবন দেখে?’
সিরাতের রাগে-দুঃখে চোখ ফেটে জল চলে এলো।
‘ছিঃ! আমার এখানে আসাটাই ভুল হয়েছে। আর আসবো না। বেশ হয়েছে ডেঙ্গু হয়েছে। আমার সাথে ঠকবাজি করার ফল এসব।’
প্রত্যয়ের মাথা গরম হয়ে গেলো অবান্তর কথাবার্তা শুনে। তেড়েমেরে ওঠে বলল,
‘যা যা ছলনাময়ী কোথাকার! ভালোবেসে আমাকে উদ্ধার করে ফেলেছে। আমি ছুঁলে তার গা জ্বলে, যা আমাকে মেরে এরপর আবার গিয়ে বিয়ে কর ভালোমানুষ দেখে। আমি মরে গেলেও দেখতে আসবি না আর বেয়াদব মেয়েমানুষ কোথাকার।’
সিরাতের গায়ে যেন আগুন জ্বলে ওঠলো এসব শুনে। বাইরে সবাই আছে সেজন্য কথা বাড়ালো না। দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। প্রত্যয় পেছন থেকে গজগজ
করে বলল,
‘নির্দয় মেয়ে।’
মুশফিকা চৌধুরী সিরাতকে কাহিল দেখে বাড়ি
পাঠিয়ে দিলেন। শিমুল সাহেব রয়ে গেলো। তিনি পরে ফিরবেন৷ রিকশায় বসে সিরাত কেঁদে দিলো।
মিনারা ঝাড়ি মেরে বললেন,
‘এখন কাঁদিস কেন? বাড়ি এলে দূরছাই করিস
আবার কেঁদে বুক ভাসাচ্ছিস।’
সিরাত নাকমুখ মুছে বলল,
‘কথা বলো না তো। বাড়ি চলো।’
‘তোর মতিগতি ভালো না। কি হয়েছে তোর?
মায়ের কথা শুনে সিরাত তেলেবেগুনে জ্বলে
ওঠলো,
‘হা হা আমিই খারাপ। আর সবাই ভালো।’

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ]

চলবে…

গোলকধাঁধা পর্ব-১২

0

#গোলকধাঁধা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১২

প্রত্যয়ের গলায় মিষ্টি আটকে গেলো বোনের কথা
শুনে। চোখ কপালে ওঠলো ওর। সবাই কি মজা
করছে ওর সাথে? কাশতে থাকলো সে। মুশফিকা চৌধুরী হন্তদন্ত হয়ে পুত্রকে পানি খাইয়ে দিলেন। প্রত্যয়ের গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুচ্ছে না উত্তেজনায়। কোনোমতে মুশফিকা চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করলো,
‘মা আমার বউ কই?’
‘আমার ঘরে বসে আছে। ভাবির বোধহয় লজ্জা
লাগছে সামনে আসতে।’
প্রত্যাশা হেসে ভাইকে বললো। প্রত্যয় ভ্রু কুঁচকে
গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘এখানে লজ্জার কি আছে? কই আমি তো পাচ্ছি না। উল্টে আমার তো বুকের ভেতর শব্দ হচ্ছে। তোমরা কি কিছু শুনতে পাচ্ছো না? আব্বু আমার মনে হচ্ছে হার্ট-অ্যাটাক হয়ে যাবে।’
আমির সাহেব মাথা নেড়ে হেসে বললেন,
‘বাবা হওয়ার খবর শুনে আমারও এমন হয়েছিলো।
আমি তো সব কাজ ফেলে তোর মাকে সামনে বসিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম দু’দিন।’
প্রত্যাশা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকালো,
‘এটা অসম্ভব আব্বু।’
আমির সাহেব মেয়েকে বললেন,
‘তুমি বুঝবে না মা এই অনুভূতি!’
প্রত্যয়ও বোনকে ধমকে বলল,
‘আসলেই তুই বুঝতে পারছিস না, আমারও
ঠিক এমনই ইচ্ছে করছে।’
আমির সাহেব হাসতে লাগলেন পুত্রের কান্ড দেখে। মুশফিকা চৌধুরীও ভীষণ আনন্দিত! তিনি দাদী হতে যাচ্ছেন। অবশেষে বাড়িতে একটা বাচ্চা আসতে চলেছে যে সোহার মতো গুটিগুটি পায়ে হাঁটবে, আধো আধো স্বরে দাদীমা বলে ডাকবে। পুত্রের উচ্ছ্বাস দেখে তিনি হেসে বললেন,
‘ওকে ক্লিনিকে নিয়ে যেও। আমি এপয়েনমেন্ট নিয়ে রেখেছি ডাঃ শাহানার।’
প্রত্যয় মাথা নেড়ে মায়ের কথায় সায় জানালো। আর কোনো অভিযোগ করতে দেবে না সিরাতকে। মন দিয়ে এবার সে বউ-বাচ্চার খেয়াল রাখবে। রাজনীতিতে এত সাকসেস, প্রথমবারেই নির্বাচনে আশার বাইরে জনগণের এত সাড়া পাওয়ার পর যতটুকু আনন্দ হয়েছিলো এর চেয়েও হাজারগুণ বেশি আনন্দ হচ্ছে বাবা হবে বলে। একমুহূর্ত কিছু ভেবে নিজে না গিয়ে প্রত্যাশাকে পাঠালো সিরাতকে ডাকতে। প্রত্যাশা গিয়েই ফিরে এলো। এসে জানালো ও ডেকেছে শুনে সিরাত আসেনি। ওর সাথে ক্লিনিকে যেতেও রাজি হলো না। মুশফিকা চৌধুরী জানেন না দু’জনের মাঝে কি
হয়েছে। তবে আজ আর সেদিকে বেশি নজর দিলেন না। সিরাতের আচরণে বিস্মিত হলেও রাগ করলেন
না। নিজেই বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিয়ে গেলেন ক্লিনিকে। প্রত্যয়ের নিজেরও ভীষণ রাগ হলো সিরাতের এমন আচরণে। মেয়েটা চোখের দেখা পর্যন্ত দিলো না ওকে। এত রাগ? এত জেদ ওর? রাগ করে সে নির্বাচনী প্রচারণায় যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলো।
কিন্তু মনটা পড়ে রইলো সিরাতের কাছে!

বাড়ি ফিরে খাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে দেশের সমসাময়িক বিভিন্ন খবর নিয়ে রিসার্চ করছিলো প্রত্যয়। নির্বাচনী প্রচারণায় বেশ সাড়া পেলেও ভোটে কে হারবে কে জিতবে এটা নিয়ে ওর কোনো মাথাব্যথা নেই। তবে জনগণের এত ভালোবাসা পেয়ে ওদের
জন্য কিছু করার তাগিদ হচ্ছে ওর এমনিতেই।
সেজন্য সমস্যাগুলো নোট করে রাখছে। একবার
এমপি পদ পেয়ে গেলে জনগণের চাহিদা মাথায় রেখে কোথা থেকে কাজ শুরু করলে উন্নয়ন হবে তা ঠিক করছিলো। এসব নিয়ে সামান্য চিন্তাভাবনা করছিলো ও। এমন সময়ই সিরাতকে দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে দেখলো। ভ্রু কুঁচকালো প্রত্যয়। সারাদিন পর
মহারাণীর এখন দেখা দেওয়ার সময় হলো! তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ও কোনো শব্দ করলো না। ফোন ঘাটার ভান করে আড়চোখে বারবার সিরাতকে দেখতে থাকলো। মেয়েটার মুখে হাসির লেশমাত্র
নেই, মেঘ জমিয়ে রেখেছে।
সিরাত একপলক প্রত্যয়কে দেখে বারান্দায় গিয়ে
বসলো চুপচাপ। রেশমী হাওয়া। রাতের আকাশে অনেক তারা। মেঘমুক্ত আকাশে মস্ত চাঁদ ঝলমলে আলো ছড়াচ্ছে। দূরের বাড়িঘর গুলো কেমন
অন্ধকার! সিরাত এই অকৃত্রিম সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে পেটে হাত রেখে ভাবনায় মত্ত হলো। এই প্রত্যয় লোকটাকে নিয়ে আর মন খারাপ করবে না সে। এতদিন মনটা বিষন্ন, গুমোট লাগলেও আজ প্রতিটি মুহূর্ত সে অনুভব করছে সব উদ্ভট ভাবনা বাদ দিয়ে।
এ কারণেই বোধহয় কথিত আছে, মা হওয়ার আনন্দটাই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সুখ এনে দেয়।

আবহাওয়া শীতল। এর মধ্যে সিরাত বারান্দায় বসে আছে দেখে প্রত্যয় একটু পর ওঠে গেলো। জানে যে সিরাত ওর কথা শুনবে না সেজন্য একপ্রকার জোর করেই পাঁজাকোলা করে ঘরে নিয়ে এলো ওকে।
সিরাত ছুটার জন্য ছটফট শুরু করায় সাবধানে
ওকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল,
‘আমার সাথে রাগ করেছো তাহলে আমার বাচ্চাকে
কষ্ট দিচ্ছো কেন? আরেকবার নড়চড় করলে
একটা চড় বসিয়ে দেবো।’
সিরাত শক্ত গলায় বলল,
‘ছাড়ুন। ধরেন কেন আমাকে? আপনি ছুঁলে আমার নিজেকে জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। বাজে লোক।’
‘হুঁ, আমি বাজে। সেজন্যই ছাড়বো না, শক্ত করে
ধরে রাখবো।’
প্রত্যয়ের কথা শুনে ওর মেজাজটা বিগড়ে গেলো ওর।
কথা না বাড়িয়ে ফোঁসফোঁস করতে করতে শুয়ে পড়লো। প্রত্যয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে চাদর টেনে দিলো ওর গায়ে। ডাঃ শাহানার সাথে ওর কথা হয়েছে। এ সময়টা বেশ যত্ন নিতে হবে সিরাতের। মন-মেজাজের যত্ন নিতে হবে, মানসিক সাপোর্ট দিতে হবে। কিন্তু এরকম আচরণই যদি করে তাহলে প্রত্যয় কিভাবে কি করবে?
ও আলো নিভিয়ে নিজেও শুয়ে পড়লো।

দিনদিন যেন মানসিক অবস্থার অবনতি ঘটছে সিরাতের। মাঝেমধ্যে বিরক্ত লাগে, কখনো কান্না
পায়। প্রত্যয়ের কথা শুনলেই চেঁচিয়ে ওঠতে ইচ্ছে
করে শুধু মনে হয় লোকটা ওকে ঠকিয়েছে। মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমাতে ইচ্ছা করে। কারো সাথে কথা বলতেও ইচ্ছে করে না কখনো। সবাই-ই ওর পরিবর্তন টের পাচ্ছিলো। এ সময় এসব স্বাভাবিক,
আবহাওয়া পরিবর্তন দরকার। এই সময়টা অনেক মেয়েই নিজের মায়ের কাছে থাকতে চায়। শ্বশুর-শ্বাশুড়ি নিজে থেকেই অনুমতি দিলেন
সিরাতকে, সে কোথায় যেতে চায়? সিরাত জানালো
বাড়ি যেতে চায়। মুশফিকা চৌধুরী নিজে এসে দিয়ে গেলেন ওকে, এছাড়াও চারবেলা নিয়ম করে খোঁজ নেন ওর। ঔষধ খেয়েছে কি-না, শরীর খারাপ হলো কি-না এসব নিয়ে তিনি প্রচুর চিন্তিত! শ্বাশুড়ির এই আমূল পরিবর্তন দেখেও সিরাতের
ভালো-মন্দ কিছুই অনুভব হয় না। তবে বাড়িতে ওর দিনকাল ভালোই কাটে মা, নীরু, সোহার সাথে হৈ-হল্লা করে। এভাবেই বেশ কিছুদিন কেটে গেলো।

ভোটের দিন চলে এলো। প্রতিপক্ষকে বেশ বড় ব্যবধানে হারিয়ে জিতে গেলো প্রত্যয়। নামের আগে যোগ হলো এমপি। তার দলের কর্মীরা উল্লাসে ব্যস্ত। তবে এসব কিছুই ছুঁতে পারছে না প্রত্যয়কে। সিরাত
ওর ফোন ধরে না বাবার বাড়ি যাওয়ার পর থেকে, নাম্বার ব্লক করে রেখেছে। এর,ওর ফোন দিয়ে কল দিলেও কথা বলে না। এইযে, ভোটে সে জয় পেয়েছে খবরটা নিজের মুখে দিতে চেয়েছে সিরাতকে। কিন্তু মেয়েটা একবার গলা শুনেই কল কেটে দিয়েছে। এর মধ্যে শুনতে পেলো কিছু ভোটকেন্দ্রে গন্ডগোল বাঁধিয়েছে ওর বিরোধী প্রার্থীর লোকেরা। পুলিশ
আসায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে ওর দলের কিছু ছেলেকে থানায় ধরে নিয়ে গেছে৷ প্রত্যয় মাহিন আর অন্তুকে নিয়ে ছুটে গেলো সেখানে। পথে যেতে যেতে দেখলো বিভিন্ন জায়গায় ওর জয় নিয়ে আনন্দ মিছিল বের করছে সাধারণ জনগণ। প্রত্যয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে হাসলো, বউটাই একমাত্র ওকে
দেখতে পারে না!

নির্বাচনী কার্যক্রম সামলে প্রত্যয় এক দুপুরে এক গাড়ি ভর্তি বাজারসদাই করে গেল শ্বশুরবাড়ি। মূলত শিমুল সাহেবই মেয়ে জামাইকে দাওয়াত করেছেন তার সফলতার জন্য। কাজে ব্যস্ত প্রত্যয় এ সুযোগে বউকে দেখার লোভটা সামলাতে না পেরে সব রেখেই ছুটে গেলো। দরজা খুলে দিলো সিরাতের খালার মেয়ে নীরু। এবার ক্লাস নাইনে উঠেছে সে। গ্রামে থেকে ভালো পড়াশোনা হয় না বলে গত তিনবছর যাবৎ
শহরে খালার বাসায় থেকেই পড়াশোনা করছে নীরু। সিরাত ফোন না ধরায় নীরুর কাছ থেকেই ওর সব খোঁজ নেয় প্রত্যয়। ওকে দেখেই নীরু উৎফুল্ল
গলায় বলল,
‘ভালো আছেন দুলাভাই?’
প্রত্যয় হেসে বলল,
‘হ্যাঁ, তোমরা কেমন আছো?’
নীরু হেসে বলল,
‘আলহামদুলিল্লাহ। আপাও ভালোই আছে।’
‘কোথায় সে?’
‘ঘুমায়।’
প্রত্যয় ভ্রু কুঁচকালো,
‘এই অসময়ে?’
‘হা। আপার দিনদুপুরের ঠিক নাই। সারাদিন ঘুমায়।’
প্রত্যয় হেসে ফেললো। শিমুল সাহেব এসে বললেন,
‘দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে আসো বাবা। এই নীরু
শরবতের ব্যবস্থা কর। খালাম্মারে খবর দে গিয়ে।’
‘আচ্ছা যাই।’
বলে নীরু ছুটে গেলো। প্রত্যয় এতসব বাজার-সদাই করে এনেছে দেখে শিমুল সাহেব হতবাক। এই ছেলে যতবার আসে এতসব সঙ্গে নিয়ে আসে। কি একটা অবস্থা! মিনারা এসে লাজুক স্বরে বারবার আফসোস করতে লাগলেন। দুপুরের ভূরিভূজন সেরে সিরাত ঘুমিয়ে আছে দেখে বিরক্ত করলো না প্রত্যয়।
পড়ার ঘরে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিলো। ঘুম ভাঙলো মাগরিবের আজান শুনে।
শিমুল সাহেবের সঙ্গে মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে
বাড়ি এসে দেখলো টেবিলে বসে সবজি কাটছে
সিরাত। প্রত্যয় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে বউকে দেখে নিজের চোখের তৃষ্ণা মেটালো। পাশেই সোহা মাটিতে বসে খেলছে। প্রত্যয়ের চোখেমুখে প্রশান্তি নেমে এলো। হাসিমুখে এগিয়ে যেতেই সোহা দু-হাত বাড়িয়ে
‘আ আ’ করে ওর কোলে আসতে চাইলো। ওকে
নিয়ে পায়চারি করতে থাকলো
প্রত্যয়। সোহা মিষ্টি হেসে বারবার ছড়ার মতো
বলতে লাগলো,
‘প্রত্তু, প্রত্তু, প্রত্তু…’
প্রত্যয় নিজের নামের দফারফা অবস্থা দেখে
বিনিময়ে মুচকি হাসলো। সিরাতকে একপলক
দেখে এরপর বলল,
‘প্রত্তুকে এখন আর ভালো লাগে না, তাইনা?’
সিরাত শুনতে পেলো কথাটা। ইচ্ছে করেই যে ওকে এসব শুনাচ্ছে তা বুঝতে পারলো। সোহা গো গো শব্দ করে হেসে প্রত্যয়ের গালে সদ্য বেড়ে ওঠা খোঁচা
খোঁচা দাঁড়ি ধরে টান মারলো। প্রত্যয় ‘আহ’ বলে চেঁচিয়ে ওঠলো। সিরাত টেবিলেই বসে শসা
কাটছিলো। দেখেও এগিয়ে এলো না। বরংচ বিরক্তি ভঙ্গিতে কাজে মন দিলো। প্রত্যয় মুখভার করে সিরাতকে শুনিয়ে শুনিয়ে সোহাকে বলল,
‘তোমার মা আমার সাথে কথা বলে না জান। বলো
তো কি করি?’
সোহা দু-হাত এক করে তালি দিয়ে দিয়ে বলল,
‘মালো মালো।’
প্রত্যয় অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
‘মারলে তো পুলিশ নিয়ে যাবে আমায়। তখন কি
হবে?’
পুলিশের কথা শুনেই সোহা ভয় পেয়ে কেঁদে দিলো। প্রত্যয় বোকা বনে গেলো। সিরাত এসে ছোঁ মেরে
ওকে নিয়ে গেলো। কান্না থামানোর জন্য
টেবিলের ওপর বসিয়ে আহ্লাদী সুরে এটাওটা বলতে লাগলো। সোহা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে মা’কে বিচার দিলো,
‘পুলিস আসচে মামুনি…’
সিরাত সান্ত্বনা দিয়ে ওকে বলল,
‘চোর ধরতে আসবে মা, তোমাকে না।’
প্রত্যয়ের মনে হলো কথাটা ওকেই উদ্দেশ্য করে
বলেছে সিরাত। অপমানে থমথমে হয়ে ওঠলো মুখ।
রেগে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে।

[৯নং পর্বতে ডিটেইলস লিখিনি, কিন্তু হিন্টস তো ছিলো প্রেগন্যান্সির! যাইহোক, না বোঝাতে পারার জন্য সত্যিই দুঃখিত। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]

চলবে…

গোলকধাঁধা পর্ব-১১

0

#গোলকধাঁধা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১১

সিরাত নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে
ভাবলো এই লোকটা পাগল; জীবনেও শোধরানোর নয়। সেইসাথে প্রচন্ড হাসিও পেলো ওর। লোকটা
এত অদ্ভুত কথা বলে মাঝেমধ্যে যে ও দ্বিধায়
পড়ে যায়। কখনো ভয়ও হয়! ও হাসার প্রচেষ্টা
করে বলল,
‘এসব আবার কেমন প্রতিজ্ঞা আপনার? এরকম
কেউ বলে?’
‘আমি বলি। কারণ আমার লক্ষ্য তো এটাই, তোমার জীবন উলটপালট করে দেওয়া। কেন,
তুমি বুঝি জানতে না?’
সিরাত আলতো হেসে বলল,
‘মানে? বুঝিনি কি বলতে চাচ্ছেন।’
প্রত্যয় গমগমে কন্ঠে বলল,
‘সিরাত, ইদানীং বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়েছে তোমার। ব্যাপারটা কী?’
‘কিছু না। আসলে আমি কনফিউজড হয়ে গেছি
একেক সময় একেক কথা বলছেন।’
প্রত্যয় ওর গাল টেনে ধরলো,
‘প্রেমে পড়ে গেছেন মিসেস?’
সিরাত লাল হলো। নতমুখে আওড়ালো,
‘এটাই কি স্বাভাবিক নয়? ভালোবাসা আসবে এটা
তো হওয়ারই।’
প্রত্যয় ওকে ছেড়ে দিলো৷ এরপর অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ওকে ঘাবড়ে দিতে হো হো
করে হেসে বলল,
‘আমি তোমাকে সত্যিই সবার থেকে আলাদা ভেবেছিলাম সিরাত। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তুমিও সব মেয়েদের মতো।’
সিরাত ভীষণ বিস্মিত হলো,
‘আমি বুঝতে পারছি না আপনি এত অবাক
হচ্ছেন কেন? এতদিন ধরে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে আমরা আছি। অন্য সবার মতো স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের সম্পর্ক এগিয়ে গেছে। এখন আপনি বলছেন আমি অন্য সবার মতো? মানে কি?’
প্রত্যয় শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেললো। গা এলিয়ে দিলো হেডবোর্ডে। একটু সময় চুপ থেকে এরপর ভ্রু
সোজা করে বলল,
‘তোমাকে আজ কিছু বলি, হুঁ! রাজনীতি করা আমার স্বপ্ন ছিলো। কত ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে ক্যারিয়ারটা গুছিয়েছি সেটা তুমি চিন্তাও করতে পারবে না। অথচ সেটা তোমার জন্য নষ্ট হতে বসেছিলো। আমার জীবনে তোমার জন্য সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয়েছে সেটা কি জানো তুমি? এত এত সমস্যা যে, একটা সময় আমার মনে হতো তোমার লা’শ ফেলে দিই।’
সিরাত আঁৎকে ওঠলো। নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। ভালোই তো এতক্ষণ কথা বলছিলো দু’জন। তাহলে এখন এসব উদ্ভট কথা বলছে কেন লোকটা?
প্রত্যয় কপালে হাত ঘষে আবারও বলল,
‘তবে সেটা করিনি। নেহাৎই তুমি মেয়েমানুষ, তাই।
কিন্তু ব্যাপারটা একসময় এত এত বাড়াবাড়ি পর্যায়ে নিয়ে গেলে যে তোমাকে চরম একটা শিক্ষা না দেওয়া অবধি শান্তি পাচ্ছিলাম না। একটা কথা কি জানো, তোমাকে হাতে মেরে কাপুরুষের তকমা পেতে চাইনি। সেজন্য সহজভাবে এগিয়েছি। তোমাকে দুর্বল জায়গায় আঘাতটা করতে চেয়েছি। আই মিন পরিবার, বিয়ে,স্বামী, ভালোবাসা এসব জিনিসকেই অস্ত্র
হিসেবে নিয়েছি। শারীরিক ভাবে নয় আমি তোমাকে মানসিকভাবে ভাঙতে চেয়েছি। আর দেখো এটা কিন্তু ম্যাজিকের মতো কাজ করেছে।’
প্রত্যয় এটুকু বলে থামলো। সিরাতের চোখ জ্বলজ্বল করছে। কি হলো এটা? প্রত্যয় প্রথম প্রথম ওকে কষ্ট দেওয়ার চেষ্টা করলেও একটা পর্যায়ে নিজের ভুলগুলো শুধরে নিয়েছিলো। তাহলে এতদিন কি ও অভিনয় করে গেছে? আর অপেক্ষা করেছে সিরাত কবে দুর্বল হবে ওর ওপর? এটাই ওর ইচ্ছে ছিলো। আজ যেই মনের কথাটা সাহস করে বলে দিলো তখনি সিরাতের অনুভূতিকে মিথ্যে প্রমাণ করে দিতে চাইছে? ওর মাথা যেন ভার হয়ে এলো। মস্তিষ্ক ফাঁকা লাগছে।
সময় নিলো একটু। অভিনয় নাকি বাস্তব বোঝা কঠিন। তবুও ও আড়ষ্ট হেসে বলল,
‘সত্যিই আপনি আমাকে ভেতর থেকে ভেঙে
দিয়েছেন।’
প্রত্যয় চোখমুখ শক্ত করে বসে রইলো। কেমন অদ্ভুত লাগছে এসব স্বীকার করে। বলল,
‘অবশেষে নিজের কার্যে সফল হয়েছি
তাহলে?’
সিরাত নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল,
‘অবশ্যই মিস্টার প্রত্যয়। তবে আমারও কিছু বলার আছে।’
প্রত্যয় ক্ষীণ স্বরে বলল,
‘শুনছি।’
‘আসলে আমি ভেবেছিলাম যেমনই হোক আপনি তো আমার স্বামী। কোনো বিপদ হোক বা খারাপ কিছু ঘটুক তা চাইনি। সবসময় যাতে ভালো কাজ করেন, ভালো থাকতে পারেন তাই চেয়েছি। আমি আপনার সাথে সুখী হতে চেয়েছিলাম। এর বেশিকিছু নয়।’
প্রত্যয় চোখেমুখে অনুশোচনার রেশ ফুটে ওঠলো।
ছোট গলায় সে বলল,
‘এত সহজে? আমি তো শত্রু ছিলাম।’
সিরাত মলিন হাসলো। এরপর বলল,
‘এগুলো তো সম্পূর্ণই মনের ব্যাপার। মন যখন-তখন প্রেমে পড়ে যেতে পারে। হোক সে শত্রু বা মিত্র! কিন্তু
চমকপ্রদ ব্যাপারটা কি জানেন? আপনি আমাকে মেরে কাপুরুষের তকমা পেতে চান নি। কিন্তু যা করেছেন তা কাপুরুষের থেকেও অধম! আমি সবকিছু ভুলে যাকে আপন করতে চাইলাম সে-ই আমায় পর করে দেবে ভাবিনি। মন ভাঙার কষ্টটা তবে আমি সামলে নিতে পারবো আশা করি। কিন্তু আর কখনোই বিশ্বাস
করবো না।’

সিরাত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। প্রত্যয় ভেতরে ভেতরে চমকালো। সিরাত এত ঠান্ডা আচরণ করবে সে ভাবেনি। ধারণা করেছিলো ও বেশ হুলস্থুল করবে, চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় করে সিনক্রিয়েট করবে। কিন্তু না! মেয়েটা এত শান্তভাবে কথাগুলো বলে
দিলো যে এখন ওর নিজেরই অস্বস্তি হচ্ছে।
প্রত্যয় বিমূর্ত ভঙ্গিতে বিছানায় বসে ছটফট করতে লাগলো। নিজেকে কেমন ছোট মনের মনে হচ্ছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো দেড়টা বাজে। সিরাত এখনো ঘরে আসেনি। ওর তো আরও কিছু বলার আছে, সেগুলো শুনবে না সিরাত? আচ্ছা, রাগ করে আবার বেরিয়ে গেছে নাকি বাড়ি থেকে? আশঙ্কা বাড়লো ওর। হতচকিত হয়ে ছুটে গেলো। সারাবাড়ি ঘুমে ডুবে আছে, কোথাও কেউ নেই। গেলো কোথায় মেয়েটা? হন্তদন্ত হয়ে দারোয়ানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারলো সিরাত বাইরে যায়নি। প্রত্যয় ভালো করে খোঁজ নিয়ে
দেখলো সিরাত প্রত্যাশার ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
ও মুখভার করে দাঁড়িয়ে থাকলো বাইরে। এতগুলো দিন একসাথে থেকেও কখনো একে-অপরকে বলা হয়নি ভালোবাসি। কিন্তু প্রত্যয় জানে এতদিনে সে নিজেও সিরাতের প্রতি দুর্বল এবং নির্ভরশীল। ওকে ছাড়া ওর রাতে ঘুম হয় না, অস্থির লাগে, জীবন দুর্বিষহ মনে হয়। এগুলো যে ভালোবাসার অন্য রুপ সেটা সে জানে। ধরা দিতে চায় না সিরাতকে। কিন্তু আজ তো ভালো মনেই ও নিজের কুরুচিপূর্ণ দিকটা তুলে ধরেছিলো সিরাতকে, যাতে নিজের মনের ভার কমে যায়। কিন্তু ভার কমার বদলে দূরত্ব বাড়িয়ে দেবে তা তো ভাবেনি। প্রত্যয়ের ইচ্ছে করলো ট্রেনের নিচে মাথা দিয়ে ম’রে যেতে। সবসময় সব সত্যি জানাতে নেই।

এরপর সিরাত কেমন পাল্টে গেলো। প্রত্যয়কে এড়িয়ে চলতে শুরু করলো। ওর কোনো কাজ গোছগাছ করে দিতো না, কোনোভাবেই ওর সামনে পড়তে চাইতো না। নির্বাচনের কাজে ব্যস্ত প্রত্যয় সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে বাড়ি এসে দেখতো সিরাত আগেভাগেই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে নিজের মতো করে। অথচ মেয়েটা এতদিন ওকে একা করে কখনোই খেতো না। এরমধ্যে মাস দেড়েক কেটে গেলো। বাড়ি ফিরে অন্যদিনের মতোই আচরণ পেলো সিরাতের থেকে। প্রত্যয় এতদিন সব মেনে নিলেও আজ কেন যেন ব্যাপারগুলো হজম করতে পারলো না। কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো বহুক্ষণ। এরপর সিরাতকে টেনে এনে বুকে জড়িয়ে শুয়ে পড়লো। ঘুম ভেঙে গেলো সিরাতের। ধরফড়িয়ে ওঠে বসে অগ্নিময় চোখে তাকালো। প্রত্যয় কথা বলার চেষ্টা করলেও সিরাত দূরে সরে গেলো। বিরক্তি নিয়ে দু-হাত জড়ো করে বলল,
‘সব প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে গেলে আপনি অতি শ্রীঘ্রই তালাকের ব্যবস্থা করুন। এক খাটে কোনো কাপুরুষের সাথে ঘুমাতে হয় ভাবলেই আমার বমি পাচ্ছে। সরুন তো।’
চোখমুখ কুঁচকে দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো সিরাত। এরপর বের হয়ে ওড়নায় হাতমুখ মুছেই বালিশ নিয়ে ডিভানে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। প্রত্যয় হতভম্ব হয়ে বসে থাকলো। নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। কপাল দোষে আজ তার এই দশা। কেন সে ওসব স্বীকার করতে গেছিলো? এমনিতেই তো ভালো
ছিলো সবকিছু!

________________________

নতুন দিনের সূচনা। রাতে বোধহয় বৃষ্টি নেমেছিলো। চারদিকে কেমন উদাসী ঠান্ডা হাওয়া বইছে। রোদ নেই। ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙলো প্রত্যয়ের। বিরক্তি নিয়ে রিসিভ করে সব বুঝিয়ে দিলো ওপাশের ব্যক্তিটিকে। ফোন রেখে ঘাড় ফেরাতেই সিরাতকে ডিভানে বসে থাকতে দেখলো। ভাবলেশহীন ভাবে চা খাচ্ছে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবীর কোথাও অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটতে চলেছে। প্রত্যয় ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। এরপর দু’বার ডাকলো ওকে, সাড়া পেলো না। সিরাত বেরিয়ে গেলো। হতাশ প্রত্যয় ওঠে ফ্রেশ হয়ে নিলো। পাঞ্জাবি বের করে রেডি হতে হতে ভাবলো কিভাবে, কি করলে মহারানীর মন পাবে সে! আর তো এই বিরহ সহ্য করা যাচ্ছে না। বউয়ের মন জয় করার চেয়ে নির্বাচনে জয় পাওয়া সহজ।

বাইরে হালকা বৃষ্টি নেমেছে। প্রত্যয় ড্রাইভারকে তাড়া দিলো গাড়ি বের করতে। একেবারে রেডি হয়ে দোতলা থেকে নামার সময় সে দেখলো সিরাত ছাড়া বাড়ির সকলে ডাইনিং এ অপেক্ষা করছে ওর জন্য। সবার মুখ জ্বলজ্বল করছে। মুশফিকা চৌধুরী ছেলেকে দেখে আহ্লদে ফেটে পড়ে বললেন,
‘আব্বা, আমার আব্বা এদিকে আসো।’
প্রত্যয় বুঝলো না কিছুই। আমির সাহেব গমগমে স্বরে হেসে ওঠলেন,
‘এসো এসো, মিষ্টিমুখ করো।’
প্রত্যাশার চেহারাও খুশি খুশি। যেটা সচরাচর থাকে না। প্রত্যয়ের চোখ এতক্ষণে টেবিলের দিকে পড়লো। নানা পদের মিষ্টান্ন রাখা ওখানে, যেন দোকান বসেছে। কাজের লোকগুলো পর্যন্ত খুশি। কিন্তু কোথাও সিরাতের টিকিটিও নেই। প্রত্যয় কিছুই ধরতে পারছে না। ভ্রু কুঁচকে মা’কে সে জিজ্ঞেস করলো,
‘ব্যাপার কি? নির্বাচন তো আরও সাতদিন পরে। এখনও তো জয়লাভ করি নি, তাহলে এত আনন্দ-উৎসব কোন হিসেবে?’
আমির সাহেব উচ্চস্বরে হেসে ওঠলেন,
‘আমার গাধা ছেলে কি বলে শুনলে?’
মুশফিকা চৌধুরী হাসতে লাগলেন। পুত্রকে দ্বিধান্বিত দেখে তিনি বেশ মজা পাচ্ছেন। প্রত্যাশা ঢুস করে ভাইয়ের মুখে মিষ্টি ঠেসে দিয়ে হাসিমুখে বলল,
‘তুমি বাবা হতে চলেছো ভাইয়া। এই নাও মিষ্টি খাও!’
প্রত্যয়ের গলায় মিষ্টি আটকে গেলো বোনের কথা শুনে। চোখ কপালে ওঠলো ওর। সবাই কি মজা করছে ওর সাথে? কাশতে থাকলো সে। মুশফিকা চৌধুরী হন্তদন্ত হয়ে পুত্রকে পানি খাইয়ে দিলেন। প্রত্যয়ের গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুচ্ছে না উত্তেজনায়। কোনোমতে মুশফিকা চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করলো,
‘মা আমার বউ কই?’

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]

চলবে…

গোলকধাঁধা পর্ব-১০

0

#গোলকধাঁধা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১০

ইদানীং কাজের চাপে পরিবারকে সময় দেওয়াটা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রত্যয়ের জন্য। মা-বাবা, সিরাত যে ওর ওপর রেগে আগুন তা সে ভালোই বুঝতে পারে। তাছাড়া নিজেও ফুরসত পাচ্ছে না। সারাদিন কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান শুনতে শুনতে ও ক্লান্ত। এই কাজ, সেই কাজ, এর-ওর অপরাধের বিচার, প্রতিপক্ষের সাথে লড়াই সব মিলিয়ে মাঝেমধ্যে মন বিষিয়ে ওঠে ওর। ইচ্ছে করে সব ছেড়ে ছুড়ে চলে যেতে, কিন্তু তা সম্ভব হয় না। কাগজে একের পর এক সাইন করারত
অবস্থায় হঠাৎ ফোন বেজে ওঠলো ওর। চোখ সরিয়ে দেখলো প্রত্যাশার নাম্বার থেকে এসেছে।
রিসিভ করলো প্রত্যয়। ধরেই ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
‘প্রচন্ড ব্যস্ত, কি বলবি দশ সেকেন্ডে বল।’
প্রত্যাশা শক্ত গলায় বলল,
‘আসলে সোহা এসেছে। প্রত্তু প্রত্তু করে পায়ে-পায়ে
ঘুরে বেড়াচ্ছে। আচ্ছা তুমি যখন ব্যস্ত কি আর করার! রাখছি, কাজ করো।’
এটুকু বলে ফোন কেটে দিলো প্রত্যাশা। কিছুক্ষণ চেয়ারে ‘থ’ হয়ে বসে রইলো প্রত্যয়। সোহাকে দেখে
না আজ প্রায় তিন সপ্তাহ হতে চললো। গুণে দেখলো সে। এত আদুরে বাচ্চাটা যে ভালো না বেসে থাকতে পারে নি সে। এই মুহূর্তে ভীষণ লোভ জন্মালো মনে, পালিয়ে যাওয়ার লোভ! মস্তিষ্ক জ্যাম করা বিষন্ন, একঘেয়ে কাজকর্ম ফেলে ছোট্ট সোহাকে কোলে নিয়ে ছাদে ঘুরতে ইচ্ছে হলো ওর। তাই মিনিটেই নিজের সিদ্ধান্ত বদলে ফেললো ও। মাহিনকে ডেকে সব কাজকর্ম ওর ওপর চাপিয়ে দিয়ে সন্ধ্যা নামতেই
বাড়ির উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলো সে। এদিকে কাজের চাপে মাহিনের মুখ ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো। গার্লফ্রেন্ড অধরার সাথে ডিনারে যাওয়ার কথা আজ। এই কথা সে বলতেও পারবে না প্রত্যয়কে। বললেই তার চাকরি নট, এদিকে যেতে না পারলেও অধরার থেকে কানের নিচে দু-চারটে খেতে হবে। কিন্তু সব বিবেচনা করে কাজটাকেই গুরুত্ব দিলো সে, অধরাকে লম্বা একটা টেক্সট পাঠিয়ে প্রত্যয়ের দিয়ে যাওয়া কাজে মন দিলো।
বাড়ি ফিরে প্রত্যয় ফ্রেশ হয়ে প্রথমেই সোহাকে নিয়ে সারা বাড়িময় ঘুরে বেড়ালো, খেললো। সোহা ওকে প্রত্তু বলে ডাকে আর সে ‘হা’ হয়ে, মুগ্ধ চোখে দেখে। এত কিউট লাগে সোহাকে যে দু’হাতে গাল টেনে দেয় ওর। এদিকে প্রত্যাশা বেশ মজা পাচ্ছে ভাইয়ের কান্ড দেখে।
মুশফিকা চৌধুরী ময়দা মাখতে মাখতে সিরাতকে
ডেকে বললেন,
‘দেখো, একটা ছেলেমেয়ে আসলে তবেই ছেলেটা ঘরমুখো হবে।’
সিরাত বললো,
‘যে ঘরে থাকতে চায় না, তাকে ঘরমুখো করে কি
লাভ? এত এত এক্সিডেন্ট হলো, আপনার অসুস্থতা, বাবার ধমকি কিছুই তো ওনি গণ্য করেনি। তাহলে একটা বাচ্চা কিভাবে ওনাকে আটকে রাখবে ঘরে?
তাছাড়া শুধু আমাকে বললেই তো হবে না মা,
ওনার ও তো বুঝতে হবে তাইনা? ওনি তো আমার
কথা শুনেনই না।’
মুশফিকা চৌধুরী ওর কথাটা তেমন পছন্দ করলেন
না। তার মতে সিরাত একটা বেয়াদব আর স্বার্থপর মেয়ে। খামখেয়ালিপনা করে বেশি, তার ছেলের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা নেই ওর। তিনি বেশ কাঠখোট্টা গলায়ই বললেন,
‘তুমি ভারী বেয়াদব মেয়ে। মুখে মুখে তর্ক করার স্বভাবটা পাল্টাও।’
‘দুঃখিত। তবে আমার মনে হয় না আমি ভুল কিছু বলেছি!’
‘এত কথা জানি না, কাজে যাও।’

সিরাত চলে এলো সেখান থেকে। ভীষণ বিরক্ত আর অপমান বোধ হচ্ছে। শ্বাশুড়ি বিচ্ছুর মতো তার পিছু পড়ে আছে, আজব! এতবড় দামড়া ছেলের সাথে না পেরে এখন ওকে চাপ দিতে এসেছে। রাতের খাবার পর্ব শেষ করে সব কাজ গুছিয়ে বাকিটা বুয়াকে বুঝিয়ে দিয়ে একটু ফুরসত পেলো সিরাত। ড্রইংরুমে গিয়ে দেখলো প্রত্যয়ের কোলে ওঠে সোহা ওর গালে খামচি দিচ্ছে আর প্রত্যয় ছাড়ানোর চেষ্টা করলেই চিৎকার দিচ্ছে। ও ছুটে গিয়ে সোহাকে ছাড়িয়ে নিলো। এরপর বকাঝকা করতে করতে ঘরে চলে এলো ওকে নিয়ে। প্রত্যয়ও এলো পেছন পেছন। ধমকে বলল,
‘এভাবে বকছো কোন সাহসে? দাও ওকে আমার কাছে।’
সিরাত কঠোর গলায় বলল,
‘আপনি এই সময়ে এখানে কেন? অফিসে যান। এত আদিক্ষেতা কেন দেখাতে এসেছেন?’
প্র‍ত্যয় অবাক হলো,
‘মানে?’
‘ও কি আপনার বাচ্চা? এত আদর দিয়ে মাথায় তুলছেন যে? লাগবে না আপনার এত ভালোবাসা। নিজের মুরগীর খবর নেই, আরেকজনের বাচ্চা নিয়ে আদিক্ষেতা যত্তসব।’
সিরাতের ভাষা দেখে প্রত্যয় বিস্মিত হলো। এই মেয়ে এসব ভাষাও জানে নাকি? পরক্ষণেই রেগে বলল,
‘শাট আপ বেয়াদব।’
সিরাত তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
‘হু আমি তাই।’
বলে সোহাকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। প্রত্যয় ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। নিজেও গিয়ে শুলো। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করল,
‘কি হয়েছে আমার বাঘিনীর? এমন করছে কেন?’
রাগের মাথায় সিরাত হঠাৎই বলে বসলো,
‘ছোট্ট বাঘ ছানার জন্য হাপ্যিতেশ করছে সবাই।’
প্রত্যয় ঝট করে মুখ তুলে চাইলো। অবাক চোখে তাকালো,
‘কি?’
সিরাত লজ্জা পেয়ে গেলো। একি বললো সে? কথা এড়ানোর জন্য বলল,
‘কিছুনা। আচ্ছা আপনার কাজ নেই?’
প্রত্যয় ক্লান্ত গলায় বলল,
‘অনেক কাজ।’
সিরাত মুখ গোঁজ করে বলল,
‘আপনি প্লিজ কিছুদিন বেকার থাকুন।’
‘কেন?’
‘বাড়িতে সময় দিন। মায়ের প্রেসারটা ঠিক নেই
ইদানীং, মেজাজও তিরিক্ষি। খাওয়াদাওয়া করছেন
না ঠিকঠাক। আমার মনে হয় আপনার চিন্তায় ওনি একদিন ঠিক পাগল হয়ে যাবেন।’
প্রত্যয় ওর ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলল,
‘আর তুমি?’
‘আমি কি?’
‘বেকার স্বামীর চিন্তায় তুমি কি হবে?’
‘কিছু হবো না, কিন্তু আপনাকে ভালো রান্না করে খাওয়াবো।’
‘তাই নাকি? কিন্তু এত খাওয়ালে তো আমি ভুড়িওয়ালা হয়ে যাবো।’
সিরাত হেসে বলল,
‘ভালোই মানাবে আপনাকে। ভুড়িওয়ালা বেকার মোরগ।’
প্রত্যয় নাকমুখ কুঁচকে বলল,
‘ইডিয়ট। ভুড়িওয়ালা মোরগ আমি হতে চাই না।’
সিরাত হেসে ফেললো। গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
‘কতদিন পর আপনার সাথে দুটো কথা বলার সুযোগ হলো বলুন তো!’
‘সেটাও সোহার জন্য!’
সিরাত রেগে ওর গলা ছেলে দিলো,
‘আমার জন্য কখন সময় বের করবেন আপনি?’
প্রত্যয় অপরাধী গলায় বলল,
‘আমি চেষ্টা করছি, হয়ে ওঠছে না।’
সিরাত কঠোর গলায় বলল,
‘বুঝেছি সত্যিই ছানাপোনা হলে আপনার
সময় হয়ে ওঠবে।’
প্রত্যয় নির্বিকার চেয়ে থেকে কিছু একটা ভাবলো। এরপর আচমকা কিছু না জানার ভান করে সরু
কন্ঠে বলল,
‘আমি সঠিক জানি না। কিন্তু ফোলা পেটে তোমাকে কেমন লাগবে সেটা ভেবেই আমার হাসি পাচ্ছে।
আমি হয়তো তোমার মতো সুন্দরী মুরগীকে এইভাবে দেখার লোভে আর অফিসেই যাবো না। ওমন প্রতিবাদী, মানবদরদী সিরাত কীভাবে শত্রুর প্রেমে পড়ে তার ছানাপোনার মা হতে যাচ্ছে সেটা উপভোগ করার আনন্দ পৃথিবীর সব আনন্দের ঊর্ধ্বে
হবে তখন! আমি এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত হতে
চাই না।’
সিরাত ভীষণ রেগে গেলো। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে
বললো,
‘ইতর লোক।’
প্রত্যয় বাঁকা হাসলো,
‘আসো মুরগী, তোমাকে আমার ছানা-পোনা’র মা
বানিয়ে দিই।’
সিরাত কানে হাত চেপে কটমট করে বলল,
‘আপনার নির্লজ্জ কথাবার্তা বন্ধ করুন প্লিজ।’
প্রত্যয় হাসতে হাসতে চুপ করে সময়টা উপভোগ
করতে লাগলো। সিরাতের লাজুক চেহারাটা হৃদয়ে লাগে যেন। এই মেয়ের জীবনের প্রতিটা সময় কান্নায় মুড়িয়ে দিতে এনে সে নিজেই জড়িয়ে গেছে আনমনে। ওর যত্ন, ভালোবাসাকে প্রত্যয় অবহেলা করতে পারেনি। সিরাতকে দু’হাতে কাছে টেনে কপালে চুমু বসালো সে; কতদিন সুন্দর সময় কাটানো হয় না দু’জনের!

________________

সোহানের মেজাজ তিরিক্ষি। সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না আফজাল সাহেব তাকে এভাবে ঠকাবে। সামনের নির্বাচনে ওকে নমিনেশন না দিয়ে প্রত্যয়কে নমিটেড করেছে তার পার্টি; এটা ভাবতেই ওর সারা গায়ে আগুন জ্বলে ওঠলো। প্রত্যয়ের দল ভারী। তরুণ নেতা হিসেবে সকলের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে।
তবুও আফজাল সাহেব সোহানকে ভরসা দিয়েছিলো সেই এবার নির্বাচনে লড়াই করবে এবং জিতবে। সোহান সেটা বিশ্বাসও করে নিয়েছিলো। কিন্তু এতবড় বিট্রে হবে নিজের সাথে তা ভাবতে পারে নি।
এমনিতেই প্রত্যয় সবখানে নিজের আধিপত্য বিস্তার করেছে, যার কারণে সোহানের ক্ষতি হয়েছে। তবুও এই নির্বাচন এবং পদের লোভে সে এতদিন চুপচাপ সব মেনে নিয়েছে। কিন্তু এভাবে আফজাল সাহেব পেছন থেকে ছুরি বসিয়ে সর্বোচ্চ ক্ষতিটা করে দেবে তা ঘূর্ণাক্ষরেও টের পায়নি। আর এ সবকিছুর জন্যে দায়ী প্রত্যয়, অবশ্যই সে। প্রত্যয় এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করলে আফজাল সাহেব নিশ্চয়ই এ কাজ করার সাহস পেতো না। সোহানের সব রাগ, হিংসা-বিদ্বেষ সব গিয়ে প্রত্যয়ের ওপর পড়লো!
প্রতিশোধ একটা নিতেই হবে, নয়তো ওর বুকের জ্বালা কমবে না। সোহান ফোন করলো প্রত্যয়কে।

প্রত্যয় প্রেসক্লাবে এসেছিলো গুরুত্বপূর্ণ কাজে। কাজ শেষে বেরুনোর সময়ই এলো ফোন। নাম্বারটা তার চেনা। বাঁকা হেসে ফোন ধরলো সে। কিছু বলার আগেই সোহান চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
‘কত টাকা দিয়ে কিনেছিস আফজাল কুত্তাকে?’
প্রত্যয় হেসে বলল,
‘তুই যত দিয়েছিস তার একগুণও না। তবে ছোট্ট একটা ট্রিকস খাটিয়েছি, সেটাই কাজে দিয়েছে। এটাই রাজনীতি, বুঝলি? এখানে একবার বোকামি করলে সারাজীবন পস্তাতে হবে। যেমন তুই পস্তাচ্ছিস!’
‘তোর মরণ আমার হাতে। আমি শেষ হলে তুইও শেষ।’
প্রত্যয় ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
‘তাই?’
সোহান রোষপূর্ণ গলায় বলল,
‘আমাকে পাত্তা দিচ্ছিস না তাইতো? কাজেকর্মে করে দেখাবো অতি শ্রীঘ্রই। তোকে সহ তোর বউ, পরিবারকে জ্যান্ত কবর না দিলে আমার নামও সোহান নয়। লিখে রাখ, আগামী ২৪ঘন্টার মধ্যে তুই শেষ। কাকপক্ষীতেও টের পাবে না কিছু।’
প্রত্যয়ের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। এরপর আচমকাই থেমে গেলো। গম্ভীর, ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে বলল,
‘তোর কি ধারণা আমি বোকা? কাঁচা খেলা খেলি?
এখনও এত বোকা র‍য়ে গেলি। এর আগেও তুই
আমার অনেক ক্ষতি করেছিস। সিরাতকে উষ্কে দিয়েছিস আমার নামে যা-তা বলে, ওর ক্ষতি করার চেষ্টা করেছিস! এমনকি আমার বাবাকেও উল্টাপাল্টা কথা বলেছিস আমার ক্যারিয়ার নষ্ট করার জন্য।
এসব আমি জানি না ভেবে ভুল করেছিস। আমি
তোকে চরম শিক্ষা দেওয়ার জন্য বসে ছিলাম
এতদিন।’
সোহান ভড়কে গেলো। এসব প্রত্যয় জানলো কিভাবে? ওর তো এসব জানার কথা নয়! এই চিড়িয়াটাকে সে এখনো ঠিকঠাক বুঝে ওঠতে পারেনি। এতকিছু বলেও ভয় দেখানো গেলো না, উল্টো ওকেই হুমকি দিচ্ছে? দম আছে বলতে হয় এর। ও নিজের ভড়কানো ভাব লুকিয়ে বলল,
‘মানে? কি বলতে চাইছিস তুই?’
প্রত্যয় শান্ত স্বরে বলল,
‘সব তো শুনলিই। তাছাড়া আরও একটা কথা শুনে নে, এই যে তুই, এতক্ষণ যা যা বললি সব কলরেকর্ড হয়ে আছে। অডিও রেকর্ডটা কিছুক্ষণ পর সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরাফেরা করবে। ভাইরাল হতে আর কতক্ষণ? এরপর বাকিটা তুই নিজেই দেখে নিস।
তোর মতো কিছু আসবে যাবে। ছুঁচো মেরে হাত নোংরা করছে না আর প্রত্যয়। গুড লাক বন্ধু।’

মুখের ওপর ফোন কেটে দিলো প্রত্যয়। সোহান ভেবেই পেলো না এতবড় বোকামি কি করে করতে পারলো সে! চিন্তা, অস্থিরতা, ভয় গ্রাস করে নিলো ওকে। কি করবে বুঝে ওঠতে পারলো না। কিছু মুহূর্তেই ওর অডিও রেকর্ড সহ বিভিন্ন কুকর্মের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লো। সোহান দিশেহারা হয়ে একে-ওকে ফোন করতে লাগলো, কিন্তু কেউই ওর প্রতি সদয়
হলো না। পরবর্তীতে এই নিয়ে বেশ হুলস্থুল কান্ড পরে গেলো চারদিকে। প্রত্যয়ও ছোট্ট একটা মামলাও করে দিলো ওর নামে, এতে করে পুলিশ নিজেদের হেফাজতে নিয়ে নিলো সোহানকে। আর আরও একটা সত্যি জানতে পারলো সে, ওর বিশ্বস্ত কর্মী মকবুলই ওর সব কার্যক্রম প্রত্যয়কে জানাতো। মূলত সে প্রত্যয়ের দলেরই লোক ছিলো। এতকিছু জানতে পেরেও কপাল চাপড়ানো ছাড়া ওর আর কিছুই করার রইলো না সোহানের, বিপদে দলের কাউকে পাশে পেলো না সে।

___________

ঘরে ঢুকে প্রত্যয় দেখলো সিরাত ঘুমে ঢুসছে চেয়ারে বসে। প্রত্যয় ওর ঘুম না ভাঙিয়ে কপালে চুমু খেতেই ধরফড়িয়ে ওঠলো সিরাত। প্রত্যয়কে দেখেই ফুস
করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘ডাকবেন তো! ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন।’
প্রত্যয় শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলল,
‘এখানে বসে ঢুলছো কেন? বিছানায় গিয়ে ঘুমাও।’
সিরাত বাস্তবে ফিরে এলো। ওর গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
‘আপনি ঠিক আছেন তো? কতকিছু ঘটে গেলো আজ। সোহান লোকটা আসলেই সব খারাপ করেছে। খারাপ জানতাম, এত বড় বদমাশ জানতাম না।’
প্রত্যয় হেসে বলল,
‘তাই? আর আমি?’
সিরাত ওর গলা ছেড়ে দিলো। এরপর কাপড় বের
করে দিতে দিতে বিড়বিড় করে বলল,
‘মোটামুটি চলে। বেশি ভালো বলবো না। ভেতরের
খবর তো সব আমি জানি না।’
‘মানে?’
‘ইয়ে যদি আপনার খুব গায়ে লাগে আরকি, তাই
বলতে চাচ্ছি না!’
প্রত্যয় সামান্য হাসার প্রচেষ্টা করে বলল,
‘বলো যা মনে আছে, আমি এত গায়ে মাখি না।’
সিরাত ঠোঁট উল্টে বলল,
‘আসলে যারা রাজনীতি করে তাদের নীতিটাই
তো খারাপ। গুটিকয়েক পাবেন ভালো। তাছাড়া সবই নষ্ট চরিত্রের অধিকারী। যেমন ধরুন, বউ রেখে সুন্দরীদের নিয়ে ফষ্টিনষ্টি করা ছাড়া আরও কত কি! জীবনে কোনো অন্যায়, অবিচার করেনি এরকম
কথা কোনো নেতা, পাতি নেতা বুকে হাত দিয়ে স্বীকার করতে পারবে না। ন্যায় বলতে কিছু আছে তারা সেটা জানেই না।’
প্রত্যয়ের হাসিমাখা মুখটা মুহূর্তেই কালো হয়ে এলো।একদৃষ্টে চুপ করে তাকিয়ে থাকলো সিরাতের দিকে। কিন্তু রাগে ধিকধিক করে জ্বলতে থাকা চোখ দুটো সিরাতের নজর এড়াতে ব্যর্থ হলো। সিরাত বিড়বিড় করে বলল,
‘পড়লো কথা হাটের মাঝে, যার কথা তার গায়ে
লাগে।’
প্রত্যয় শুনতে পেলো কথাটা। জ্বলন্ত চোখে তাকালো সিরাতের দিকে। ও পালাতে গেলেই একহাত চেপে ধরে আটকে ফেললো। এরপর অন্যহাতে নিজের বুকে হাত রেখে বলল,
‘আমি প্রত্যয় চৌধুরী, বুকে হাত রেখে স্বীকার করছি
এই জীবনে করা আমার সবচেয়ে ন্যায়পূর্ণ কাজ হলো আমার শত্রু সিরাত আঞ্জুমকে বিবাহ করা। বিবাহ করে ওর প্রতিটা দিন উলটপালট করে দেওয়াটাই আমার জীবনের সবচেয়ে ন্যায়ের কাজ। এও স্বীকার করছি, আগামী দিনগুলোতে ওর সাথে আরো উল্টাপাল্টা কাজ করে ন্যায়ের পথে এগিয়ে যাবো। কেউ ঠেকাতে পারবে না।’

সিরাত নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে
ভাবলো এই লোকটা জীবনেও শোধরানোর নয়। সেইসাথে প্রচন্ড হাসিও পেলো ওর।

_________

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ]

চলবে…

গোলকধাঁধা পর্ব-০৯

0

#গোলকধাঁধা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব -৯

পরদিন সিরাতদের বাড়ি থেকেই প্রত্যয় ভার্সিটিতে চলে গেলো। এরপর চেলাপালা, ছাত্র-ছাত্রীদের সকলকে ডেকে বললো আজ থেকে হট্টগোল, মারধর এগুলো ভার্সিটি এরিয়াতে বন্ধ। তবে নিজের কর্মকাণ্ডের জন্য একটুও অনুতপ্ত না ও। কেননা প্রত্যয়ের মতে ও কোনো ভুল করেনি। উল্টো যারা ভুল করেছে তাদের শাস্তি দিয়েছে৷ তবে একেবারেই যে ওর প্রভাব কমে যাবে তা নয়, অকাজ করলে অবশ্যই তাকে শাসন করা হবে। কিন্তু যেটাই হোক, শিক্ষার্থীরা বেশ অবাক হলেও স্বস্তি পেলো, দুশ্চিন্তামুক্ত হলো। এত নাটকীয়কতা করেও যে এসব করা থেকে বিরত থাকেনি, তার হঠাৎ আজ কি হলো! তবে সবকিছু ছাপিয়ে অনেকেরই প্রশংসায় ভরিয়ে দিলো
প্রত্যয়কে। ব্যাপারগুলো উপভোগ করলো ও।
এতদিন সকলের চোখে কেমন আতঙ্ক লেগে থাকতো ওকে দেখলেই, কিন্তু আজ সেটা নেই। সবার দৃষ্টিতেই কেমন নমনীয়তা মিশে আছে। অন্তু আর মুহিব বন্ধুর ওপর মজাও করলো কিছুক্ষণ! প্রত্যয় বিনিময়ে মুচকি হাসলো। ওর মনের মধ্যে শুধুমাত্র সিরাতের মুখটাই উঁকি দিচ্ছে! মেয়েটার প্রতি দিনদিন কেমন ভালো
লাগা অনুভব করছে সে, ওর কথাগুলো ফেলতে পারছে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিন্তার জগৎ থেকে
বেরিয়ে সে বয়রাকে ডেকে বললো গরম এক কাপ
চা দিতে। চা’য়ে চুমুক বসাতে বসাতে সে আবারও হারিয়ে গেলো ভাবনার জগতে!

রাহী ফোন করে সিরাতকে বলল,
‘তোর জামাই’য়ের কি হইসে বল তো? এত বদলাই গেসে হঠাৎ! কাহিনী কি?’
সিরাত ঘুমিয়ে ছিলো। ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙলো।
মস্তিষ্ক ফাঁকা। প্রত্যয়ের ব্যাপারে কথা শুনে কান খাড়া করে জিজ্ঞেস করলো,
‘কি হয়েছে? আবার কি করেছে?’
‘কেন তুই জানিস না?’
সিরাতের মেজাজ খারাপ হলো,
‘দেখ, ভনিতা না করে বল আবার কি করেছে?
আমাকে মনে হয় কোনোদিন আর শান্তি দেবে না এই লোক। জীবন শেষ আমার…’
ওপাশ থেকে রাহী হেসে বলল,
‘ধুর! তোর জামাই আই মিন দুলাভাই তো বিরাট কান্ড করসে। সব্বাইরে ডাইকা বইলা দিসে এই প্রাঙ্গণে হট্টগোল, মারধর করবেন না। তবে ভুল করলে অবশ্যই বড় ভাই হিসেবে শাসন করবেন।’
সিরাত অবাক হলো,
‘বলিস কী!’
‘এটাই তো ঘটেছে।’
‘আমার বিশ্বাস হয় না।’
‘ডিয়ার! এটাই তো হয়েছে। আমার কি মনে হয় জানিস?
‘কি?’
রাহী মজা করে বলল,
‘তুই কালকে ব্যথা পেলি না! সেজন্যই বোধহয়
ওনার খারাপ লেগেছে। শত হলেও বউ বলে কথা!
মনে হয় তোরে মনে মনে পছন্দ করে।’
সিরাত ধমক দিয়ে বলল,
‘মজা পেলাম।’
রাহী বলল,
‘এখন তো এসবই বলবা! তুমি নিজেও যে ফিদা
সেটাও বোঝা যায়।’
সিরাত থতমত খেয়ে বলল,
‘মানে? কেমনে বোঝা যায়?’
‘এমনে এমনেই। তোমার হাবভাবেই বোঝা যায়। এতদিন হইসে বিয়ের, আমরা বুঝি না ভাবছো? কি দিয়ে দুলাভাইকে বশ করলা বলো তো?’
‘ছি ছি। ফোন রাখ।’
রাহী হাসতে হাসতে বলল,
‘হ হ। এখন গর্তে মুখ লুকাই বইসা থাকো।
আমরা কচি খুকি না। জামাইর নামে আন্দোলন
কইরা এখন তার প্রেমে কেমনে হাবুডুবু খাও, সবই স্বচক্ষে দেখা যায়।’
সিরাত ফোন কেটে দিলো। অজানা কারণেই লজ্জায় আচ্ছন্ন হলো মন। সত্যিই কি ওর মুখ দেখে বোঝা যায় নাকি? এমন সময় মিনারার ডাক শোনা গেলো দরজা থেকে। নাস্তা করতে ডাকছেন। সিরাত কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে নাস্তা করার জন্য ওঠলো। সারাটা
দিন একপ্রকার ঘোরে ঘোরেই কেটে গেলো। ভাবেনি প্রত্যয় সত্যিকার অর্থেই নিজের কথা রাখবে। এতদিন এতকিছু করেও যার এসব কাজ বন্ধ করা গেলো না, সেখানে সিরাতের ঘৃণিত চাহনি নিতে না পেরে প্রত্যয় চৌধুরী তার অত্যাচার বন্ধ করে দেবে। এটা ওর কাছে প্রচন্ড বিস্ময়ের ব্যাপার হয়ে রইলো! তবে মনে
মনে খুশি হলো, স্বস্তি পেলো।

প্রত্যয় রাতে এলো ওদের বাড়ি । মিনারা মেয়ে জামাইয়ের জন্য নিজের হাতে নানা পদের খাবার তৈরি করলেন। খাবার খেতে খেতে শিমুল সাহেবের সাথে বসে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করলো কিছুক্ষণ। সিরাত আশেপাশে ঘুরঘুর করছে, কিন্তু কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে না। অনেকক্ষণ আড্ডা দেওয়া শেষে ক্লান্ত হয়ে রুমে এলো প্রত্যয়। সিরাত পানির গ্লাস এগিয়ে দিলে তা ঢকঢক করে খেলো। নিজের কথা রাখার জন্য ধন্যবাদ জানালো। ওর সব কাজ সিরাত উৎফুল্ল মনে করে দিলো। প্রত্যয় বসে বসে শুধু দেখছে। মাঝেমধ্যে বিরক্তও হচ্ছে সিরাতের কান্ড দেখে। এত ঢঙের কি আছে সেটাই বুঝতে পারছে না! একপর্যায়ে ধমক দিয়ে বলল,
‘এত আদিক্ষেতার কারণ নেই। আহ্লাদীপনা বন্ধ করো। বাড়ি ফিরলে না কেন? আমি তো সকালেই বলে গেছিলাম!’
সিরাত অবাক হয়ে বলল,
‘ওমা! এতদিন পর বাড়ি এসে দু’দিনও থাকবো না? তা হয় নাকি? তাছাড়া আপনিও জামাই আদর পাননি। সময়টা উপভোগ করুন।’
‘তুমি জানো না আমার নিজের বিছানা ছাড়া ঘুম
হয় না?’
সিরাত ব্যস্ত গলায় বলল,
‘জানি। কিন্তু সবসময়, সব পরিস্থিতিতে তো আপনার বিছানা আপনার সঙ্গী হবে না। তাই যে সঙ্গী হবে তার ভালো-মন্দেও এবার একটু গুরুত্ব দিন।’
প্রত্যয় ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো। মুচকি হেসে এক টানে কাছে এনে নিজের নাক ঘষলো ওর গলায়।
অস্ফুটস্বরে বলল,
‘দিচ্ছি বলেই তো এখানে এসেছি।’
সিরাত ভড়কে গেলো। ইতস্তত করে বলল,
‘কীভাবে?’
‘বিছানা-সঙ্গী কোনোটা ছাড়াই ঘুম আসে না।
সেজন্যই তো হাত-পা ব্যথা নিয়েও পড়ে আছি
এখানে। নাও, পা-গুলো মালিশ করে দাও।’
বলে ঠাস করে ছেড়ে দিলো ওকে। সিরাত মেঝেতে পড়ে গেলো। আচমকা এমন কান্ডে রাগ হলো ওর।
ওঠে কাপড় ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,
‘ভেবেছিলাম ভালো হয়ে গেছেন…’
প্রত্যয় ভ্রু উঁচিয়ে হাসলো,
‘ভালো হলে কি হতো?’
‘ছাই হতো।’
প্রত্যয় গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘কাল কিন্তু সকালেই বেরুবো, তোমায় বাড়ি দিয়ে
আমি কাজে যাবো।’
‘আপনার কাজ মানে কতগুলো উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলেপেলে দু’পাশে নিয়ে দাপিয়ে বেড়া। যত্তসব…!’
সিরাত রাগে গজগজ করতে করতে ঘর থেকে
বেরিয়ে গেলো। প্রত্যয় বিছানায় শুয়ে হাসতে
লাগলো। মেয়েটাকে রাগাতে ওর বড্ড শান্তি লাগে। চোখ রাঙিয়ে তাকালে ইচ্ছে করে চোখের পাতায়
চুমু খেতে। সিরাত ঘরে ফিরলো বেশ কিছুক্ষণ পর।
গোমড়া মুখ করে কিছু না বলে বিছানায় অন্যদিকে
মুখ করে শুয়ে পড়লো। প্রত্যয় পেছন থেকে ভ্রু
কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর সিরাত নিজের উদরে ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেলো। তৎক্ষনাৎ শিরদাঁড়া বেয়ে শিহরণ বয়ে গেলো। গলা শুকিয়ে এলো।
মিনমিন করে বলল,
‘অসভ্য!’
প্রত্যয় ওর গালে চুমু খেয়ে নাক ঘষতে
ঘষতে ফিসফিস করে বলল,
‘সভ্য হতে চাই…’
সিরাত স্তম্ভিত! শরীর কাঁপছে ওর। মস্তিষ্কে জেঁকে বসলো নানান কিছু। প্রত্যয় বিবশ চোখে চেয়ে রইলো। মনের মধ্যে কেমন এক ঝড় উল্টেপাল্টে দিতে লাগলো। সবকিছু ভীষণ অচেনা, তবুও যেন মনোমুগ্ধকর! এই শান্ত বাতাস,
এই রজনী, এই মুহূর্ত সবকিছুই যেন ভালো-লাগার উদ্বেগ বহন করে। দোটানা মনে ঠাঁই না দিয়ে এক
নতুন অনুভূতির সাথে যেন পরিচিত হলো দু’জনেই!
ভাবে নি, এই অনুভূতি ধীরে ধীরে দু’জনের মধ্যে
সৃষ্টি করে দেবে ভালোবাসা!

_______________________________

শীত শেষে আরেক হেমন্তের শুরু। হলদেটে একটা ভাব মিশে থাকে প্রকৃতিতে। নীলাভ আকাশের বুকে ওড়ে চলা সাদাটে মেঘ মন ভালো করে দেয়। গাছপালা বাতাসে দোলে অন্যরকম সৌন্দর্য তৈরি করে চারপাশে। সিরাত জানালার গ্রিল ধরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষায় আছে তার মনে জায়গা দখল করা গুন্ডা’টির। জানে সে এত দ্রুত বাড়ি ফিরবে না, তবুও সে অপেক্ষমাণ! যে মানুষটাকে না দেখে থাকা যায় না, যার দূরে যাওয়া ব্যাকুল করে দেয় হৃদপিন্ড, যার চিন্তায় সর্বক্ষণ বিভোর হয়ে থাকে মস্তিষ্ক, যে না থাকলে চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার লাগে, বিষন্নতায় ছটফট করে মন! সেই মানুষটির জন্য সিরাত অনুভব করে ভালোবাসা। যেটা শুরু হয় তিক্ততা দিয়ে, সেটা একসময় ভালোলাগা হয়ে রুপ নেয় ভালোবাসায়। কখনো ভাবে নি এই মানুষটার প্রতি ওর এমন
অনুভূতি জাগ্রত হবে। এইযে এতকিছু করলো, এত
এত কাহিনী! সব জেনেও ওর মনটা প্রত্যয়ের মাঝেই কেমন করে আটকে গেছে। সেদিনের পর তো আরও!
স্বামী-স্ত্রী’র সম্পর্কে বাঁধা পড়লে শত্রু ও যে কাছের মানুষ হতে পারে ও কল্পনা করেনি কখনো!
তবে ইদানীং ওর অভিমান হয় মানুষটার ওপর। সামনে নির্বাচন, তাতে প্রচন্ড ব্যস্ত সে। রাতে এত দেরি করে বাড়ি ফেরায় ইচ্ছে হয় কটু কথা শোনাতে। কিন্তু সেই সুযোগ আর হয় না। প্রত্যয় ফিরতে ফিরতে সিরাত ঘুমের দেশে তলিয়ে যায়। সকালে ওঠে যা একটু চোখের সামনে পায় তখন আর মন খুলে কিছু বলা
যায় না, নাস্তা করা, কাজ গোছানো, ভার্সিটি বা বাইরে যাওয়ার তাড়া থাকে। প্রত্যয়ের এমন অবহেলা সিরাত মনে জমিয়ে রাখে। যাওয়ার সময় লোকটা যখন কপালে বা গালে চুমু খেয়ে যায় তখন সেও কামড় বসায় ওর হাতে! তাতেও লোকটার কোনো হেলদোল নেই, হাসি-ঠাট্টা করে ওকে আধপাগল তকমা দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সেজন্য সিরাত সারাদিন মুখ
গোমড়া করে থাকে।

রাতের রান্না হচ্ছে। সিরাত তরকারিতে মশলা
দিচ্ছিলো, নুনের বদলে চিনির কৌটা ওর হাতে। মুশফিকা চৌধুরী সন্দেহী দৃষ্টিতে ওকে দেখে। শ্বাশুড়িকে ওমনভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে থতমত খেলো ও।
‘কি দিচ্ছো খেয়াল আছে? তরকারিতে আমরা লবণ খাই, চিনি না।’
সিরাত জিভ কাটলো। কৌটা রেখে লবণের পাত্র বের করতে করতে বলল,
‘খেয়াল ছিলো না।’
কটাক্ষ করলেন মুশফিকা চৌধুরী,
‘থাকবে কি করে? নিজেকে নিয়ে ভেবেই তো কুল পাও না। স্বামী-শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কথা ভাবতে যাবে কেন?’
সিরাত বিস্মিত হয়ে বলল,
‘এসব কি বলছেন মা? আমি শুধু নিজের কথা ভাবি আপনার তাই মনে হয়? এতোটা স্বার্থপরও নই।’
মুশফিকা চৌধুরী তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন,
‘এসব জানি না বাপু। তবে আমাদের কথা যদি এতোই ভাবো তাহলে নাতিপুতির মুখ তো এখনো দেখালে না! বিয়ের তো কম দিন হয়নি। আমার ছেলেটা সারাদিন বাইরে বাইরে পড়ে থাকে, বাড়িতে একটা বাচ্চা এলে তবেই তো ওর মনটা টিকবে এখানে। এসবও কি আমাদের বলে দিতে হবে?’
সিরাত অপ্রস্তুত হলো,
‘এখনি বাচ্চা মানে..’
মুশফিকা চৌধুরী বললেন,
‘বিয়ে হয়েছে কত মাস?’
‘ইয়ে মানে… নয় মাস!’
মুশফিকা নির্লিপ্ত কন্ঠে বললেন,
‘এট কি কম? এখনই প্ল্যানিং করার সময়। আজ
এলে বলবে আমার ছেলেকে। খবরদার আমি বলেছি এটা বলবে না। সেঁকেলে ভাবনা বলে উড়িয়ে দেবে। কি? মনে থাকবে?’
সিরাত আড়ষ্ট কন্ঠে বলল,
‘জি জি।’
‘দেখা যাবে। মনের মতো ছেলের বউ পাইনি,
অন্তত নাতিনাতনি তো দাও!’
এসব বলতে বলতে তিনি বেরিয়ে গেলেন। সিরাত জানে কেন মুশফিকা চৌধুরী ওর সাথে এমন করেন। তার বোনের মেয়ে লিয়ানা বেশ ঘরোয়া, চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে। দেখতেও আগুন সুন্দরী। বংশ, প্রতিপত্তি কম নেই। বাবার আদরের রাজকন্যা। তাই প্রত্যয়ের সাথে বিয়ে দেবে বলে ভেবে রেখেছিলো দু’বোন মিলে। কিন্তু সেই ইচ্ছে পূরণ না হওয়ায় মাঝেমধ্যেই আবোলতাবোল অনেককিছু বলে ফেলেন
সিরাতকে। সেজন্য ও এসবে এতো মাথা ঘামায় না।
সোহা একটু বড় হয়েছে। এ বাড়ি এলেই মুশফিকা চৌধুরীর কাছে থাকে বেশিরভাগ সময়। তিনিও বেশ আদর করেন ওকে। প্র‍ত্যয়কে সোহা বাবাই বলে
ডাকে, তাতে কেমন স্নেহবোধ জেগে ওঠে ওর, সময় দেয় ওকে। মাঝেমধ্যে মিটিং, মিছিলও ক্যান্সেল করেছে প্রত্যয়। একজন বাবার মতোই সে মাঝেমধ্যে সোহার আবদার পূরণ করে ও। সেখান থেকেই
হয়তো মুশফিকা চৌধুরীর মনে নাতিপুতির ভাবনাটা এসেছে। কিন্তু এখন শ্বাশুড়ি যে সুযোগ পেয়ে অপমানের মাধ্যমে নিজের ইচ্ছে চাপিয়ে দিয়ে
গেলেন সেটা ভালোই বুঝলো সিরাত। নাতিপুতি
চাইলে ছেলেকে গিয়ে বলুক, ওর কাছে কি! জীবনেও প্রত্যয়কে এসব বলতে পারবে না সিরাত।

চলবে…

গোলকধাঁধা পর্ব-০৮

0

#গোলকধাঁধা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৮

প্রত্যয় শক্ত গলায় বলল,
‘আমি তো সেবাই ভাবছি অন্যকিছু কেন ভাবতে
যাবো বউ?’
ওর চোখেমুখে কুটিল হাসি। সিরাতের
ভেতরটা কেমন কেঁপে ওঠলো। এই লোকের মতলব ওর কাছে একদম ভালো ঠেকছে না। সব কাজ শেষ করে খাবার নিয়ে আবারও ফিরে গেলো। সেখানেও প্রত্যয় ওকে ছাড় দিলো না। হাত ভালো হয়ে যাওয়া স্বত্তেও সিরাতকেই খাইয়ে দিতে হলো ওকে। সবটা যে ইচ্ছে করে করছে তা বেশ জানে ও!
____________

শীতের আগমন ঘটেছে প্রকৃতিতে। চারদিকে ঠান্ডা বাতাস আর কুয়াশার ঘনঘটা। নরম রোদে ঝলমল করে সবকিছু। এ সময়টা সিরাতের বেশ প্রিয়। খুব উপভোগ করে সে, নিজের মতো একলা থাকতে ভালোবাসে। কিন্তু এবার সময় ভিন্ন। পুরোপুরি অন্য একটা পরিবারে এসে চাইলেও নিজের মতো কিছু করা যায় না। মানুষগুলোর মধ্যে ধীরেধীরে নিজেকে মানিয়ে
নেওয়ার চেষ্টা করলেও মিশিয়ে নিতে পারবে না এটা
ও নিশ্চিত। বিকেলে অলস সময় কাটাচ্ছিলো বারান্দার ফুল গাছ গুলোর যত্ন নেওয়ার মাধ্যমে। এমন সময় ফোন এলো। ঘরে গিয়ে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মায়ের গলা শোনা গেলো, ‘কেমন আছিস?’
‘ভালো। তোমরা কেমন আছো?’
‘আমরা ভালোই আছি। জামাইয়ের শরীরটা এখন কেমন?’
সিরাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিলো,
‘হাঁটাচলা করতে পারে এখন, ভালো আছে।’
‘যাক আলহামদুলিল্লাহ, দে না একটু কথা বলি?’
সিরাত তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
‘বাড়ি নেই। বেরিয়েছে।’
মিনারা বেগম অবাক গলায় বললেন,
‘শরীরের এই অবস্থায় বাইরে যেতে দিলি কেন?’
সিরাত কিছুটা রুক্ষ গলায় বলল,
‘হুহ, আমি যেতে দেওয়ার কে? মা-বাবার কথাই শোনে না সেখানে আমি কি করে আটকাবো? বাদ দাও!’
মিনারা বেগম ধমকে বললেন,
‘তুই ওর স্ত্রী। জামাইকে কিভাবে বেঁধে রাখতে হয় সেটাও বুঝিস না যে এই অসুস্থ শরীরে বেরিয়ে যেতে দিলি! গাধী। নারীর বাঁধনে যে পুরুষ একবার পরে সে কিভাবে কথা না শোনে থাকে?’
সিরাত লজ্জায় উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দিলো।
মা এসব কি বললো? ইশ, এই লোকটার জন্য ওকে আর কত অপদস্ত হতে হবে কে জানে! আজ আসুক, হেস্তনেস্ত একটা করেই ছাড়বে!
কিন্তু হেস্তনেস্ত আর করা হলো না। প্রত্যয় বাড়ি
ফিরলো কারো ওপর রেগে। ফোন কলে কিছুক্ষণ চোটপাট চালালো। এরপর কল কেটে রাগ রাগ
ভঙ্গিতেই কিছুক্ষণ পায়চারি করলো ঘরের এ মাথা, ও মাথা। গায়ের পাঞ্জাবি খুলে ফ্রেশ হয়ে হতে গেলো। বারান্দায় বসে ওলের সোয়েটার বুনছিলো সিরাত। প্রত্যয়ের কান্ডগুলো সবটাই দেখেছে সে। সময় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে তোয়ালে পরে ওয়াশরুম থেকে বেরুলো প্রত্যয়। হাঁক-ডাক ছেড়ে সিরাতকে ডেকে বললো ওর কাপড় বের করে দিতে। ও বারান্দা থেকে এসে কাপড় বের করে দিলো। কিন্তু প্রত্যয় বললো সে এসব পরবে না। অগত্যা সিরাত অন্য একসেট বের করলো, প্রত্যয় আগের মতো এটাও রিজেক্ট করলো। বারবার এমন করায় সিরাত বলেই ফেললো, ‘নিজের কাজ
নিজেই করুন তাহলে। অযথা আমাকে খাটাচ্ছেন কেন?’
প্রত্যয় শক্ত মুখে জবাব দিলো,
‘পারবো না।’
সিরাত বলল,
‘শুনুন, আমি আপনার চাকর নই আমি। পারবো না আপনার এসব কাজ করতে। আপনার অত্যাচার মেনে নেওয়া যাচ্ছে না আর।’
‘কেন? কি করবে তুমি? ডমেস্টিক
ভায়ো’লেন্সের মামলা?’
বিরক্তিতে সিরাতের মাথা ধরে এলো,
‘আপনি আসলেই একটা যা-তা। কথা বলাই বেকার।’
বলে ড্রয়ারের সব কাপড় বের করে দিলো। প্রত্যয় সেসব না ছুঁয়ে প্রথমে বের করা ট্রাউজার আর টি-শার্টটাই পরলো। সিরাত এবার হতভম্ব হয়ে বলল,
‘এটাই যখন পরবেন তখন এত নাটক করলেন কেন?’
প্রত্যয় বিছানায় শুয়ে পড়লো। গমগমে স্বরে বলল,
‘বাইরে থেকে এসে তোমাকে সামনে যেন দেখি
এরপর থেকে। লুকিয়ে-চুরিয়ে থাকলে এমনই হবে।’
সিরাত অবাক হয়ে বলল,
‘লুকালাম কোথায়? আমি তো বারান্দায় ছিলাম।’
‘ভালো করেছো। এখন সব গুছাও বসে বসে।’
প্রত্যয় কটাক্ষ করে জবাব দিলো। এরপর পাশ
ফিরে ঘুমিয়ে পড়লো। সিরাত রাগ নিয়ে সব গুছাতে লাগলো। এই লোকটা ওকে এক ফোঁটা শান্তিও দিচ্ছে না। পা ভাঙ্গার পরও শান্তি দেয়নি, এখন সুস্থ হওয়ার পরও দিচ্ছে না। কোন কুক্ষণে যে লোকটার সাথে
ওর দেখা হয়েছিলো ভাবতেই ওর চোখের কোণে জল জমে গেলো।

__________

সিরাতের মনটা আজ খুব ভালো। বহুদিন পর শান্তিমতো কলেজে এসেছে সে। ক্যান্টিনে বসে
বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলো ও। তখুনি সেখানে প্রত্যয়ের প্রতিপক্ষ দলের লিডার সোহান আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা এসে বসলো। সিগারেটে ফুঁ ধোঁয়া ওড়িয়ে সে বয়রা’কে চা-সিঙ্গারা দিতে বললো। পাশের টেবিলে
সিরাতকে দেখতে পেয়েই দাঁত বের করে হেসে
জিজ্ঞেস করলো,
‘কি ব্যাপার ভাবী সাহেবা? কেমন আছেন?’
সিরাত বিব্রত হলো। এই লোকটাকে তার একটুও সুবিধার মনে হয় না। কেমন অশালীন চাহনি।
ও শক্ত গলায় বলল,
‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো!’
সোহান শব্দ করে বিশ্রি ভঙ্গিতে হাসলো,
‘ভালো তো থাকবেনই। যার বিরুদ্ধে এত নাটক,
সিনেমা করলেন শেষমেশ তার গলায়ই ঝুইলা পড়লেন? কিসের অফার করছিলো আপনারে যে
লোভ সামলাতে পারলেন না?’
অনল, রাহী প্রতিবাদ করতে গেলে সিরাত ওদের থামিয়ে দিলো। কথা বাড়ালেই ঝামেলা শুরু করবে অহেতুক। বন্ধুদের ইশারা করলো সেখান থেকে ওঠে যেতে। সোহানের এক চেলা বলল, ‘আরেকটারে ধইরা নিয়া গেছে ভাই। গাছতলায় উত্তম-মধ্যম দিতাছে।’
সোহান সিরাতকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আগে তো প্র‍্ত্যয় চৌধুরীর নামে কতকিছুই করতেন, এবার তাইলে স্বামীর বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেবেন ভাবীজান? আমরাও শুনি!’
বলে সকলে মিলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।
সিরাতের রাগে গা কাঁপতে লাগলো। ছুটে গেলো
দ্রুত। গিয়ে একজনের কাছে থেকে জানতে পারলো এক মেয়েকে উত্যক্ত করছিলো এই ছেলে, দিয়েছিলো বাজে প্রস্তাবও। সেই মেয়ে এসে বিচার দিয়েছে প্রত্যয়কে। সেইজন্যই ওকে এনে উত্তম-মধ্যম
দেওয়া হচ্ছে। সিরাত বেশ বিরক্ত
হলো এবার নিজের জীবনের ওপর। দ্রুত পায়ে
এগিয়ে গেলো সেদিকে।
প্রত্যয়ের মারধর পর্ব চলছে। আশেপাশে খেয়াল নেই ওর। কিন্তু তক্ষুনি আচমকা মারামারির মাঝখানে কেউ এসে পড়ায় ও ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় তাকে। তাল সামলাতে না পেরে গাছের ডালে বারি খেয়ে প্রচন্ড
ব্যথা পেয়েছে কপালে সিরাত। কেটেও গেছে বেশ খানিকটা জায়গা। হাত-পা ছুঁলে গেছে। রাগের মাথায় প্রত্যয়ের মাথা কাজ করছিলো না, খেয়াল করেনি ধাক্কাটা সে কাকে দিচ্ছে! কিন্তু যখন মাহিন আর অন্যান্য ছেলেরা হায় হায় করে ওঠলো তখুনি ওর
টনক নড়লো। সিরাত নিজেও স্তব্ধ! কপালে হাত
দিতেই ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠলো। প্রত্যয় হতভম্ব হয়ে ওর দিকে দ্রুত এগিয়ে গেলে সিরাত ঘৃণা মিশ্রিত চাহনি নিক্ষেপ করে সেখান থেকে দৌড়ে চলে গেলো। বাকিটা সঙ্গীদের সামলাতে বলে প্রত্যয় নিজেও সেখান থেকে চলে এলো। কিন্তু সিরাতকে আর খুঁজে পেলো না সে কোথাও। তড়িঘড়ি করে বাড়ি চলে এলো, এসে দেখে সিরাত নেই। ফোনও বন্ধ। প্রত্যাশা আর মুশফিকা চৌধুরী ঘাবড়ে গেলেন পুত্রের অস্থিরতা দেখে। প্রত্যয় কাউকে কিছু না জানিয়ে আবারও বেরিয়ে ফোন করলো কাউকে।

এদিকে খুব বেশি আঘাত না লাগলেও কপাল ফুলে গেছে সিরাতের। হালকা কাটাযুক্ত স্থানটা ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে ডিসপেনসারি থেকে। আপাতত
ব্যথানাশক ঔষধ খেয়ে বিছানায় ঘুমিয়ে আছে সোহাকে নিয়ে। বহুদিন পর মেয়ে বাড়ি আসায় শিমুল সাহেব বাজার করেছেন বেশ। বড় মাছ, মাংস এনেছেন তিনি। এদিকে মিনারা বেজায় খুশি। তবে মেয়েকে এভাবে বিধস্ত অবস্থায় দেখে তারা বেশ চিন্তিত ছিলেন। সিরাত জানালো বাড়ি আসার পথে রিকশা থেকে পড়ে ব্যথা পেয়েছে। যাইহোক, মেয়ের জন্য মিনারা ওর পছন্দের ভুনা খিচুড়ি আর মাংস রান্না করছেন।
রাত নয়টা। চার-পাঁচ ঘন্টা পর ঘুম ভেঙেছে সিরাতের।
তবে এমনি এমনি ওর ঘুম ভাঙেনি। পরিচিত এক পারফিউমের সুবাস নাকে ধাক্কা খাচ্ছে বারবার। চোখ কচলে তাকিয়ে দেখলো সোহা নেই। হয়তো মা নিয়ে গেছে ভেবে ওঠে বসার চেষ্টা করতেই ‘আহ’ শব্দ করে ওঠলো। বেশ ব্যথা করছে জায়গাটা। এমন সময়
গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘আমাকে না বলে এখানে এসে একদম ঠিক কাজ
করো নি।’
সিরাত জানে কন্ঠটা কার। তবুও সে চমকে ওঠলো।
পাশ ফিরতেই আধশোয়া অবস্থায় প্রত্যয়কে দেখে
নির্বিকার কন্ঠে বলল,
‘এখানে কেন এসেছেন?’
‘তোমার কি বেশি লেগেছে? চলো ডাক্তারের কাছে যাবে।’
সিরাত উত্তরে বলল,
‘আমি ঠিক আছি। ডাক্তার-ফাক্তারের নাটক করতে হবে না। শুনুন, এসেছেন যখন খেয়েদেয়ে যাবেন।
আর একটা কথা, আমি আপনার সাথে কোনো কথা বলতে চাই না।’
বলে ওঠে চলে গেলো। প্রত্যয় সেদিকে তাকিয়ে থেকে আনমনে বললো, ‘রাগ করে কি হবে! আমি তো ইচ্ছে করে করি নি!’

মায়ের কাছ থেকে সিরাত জানলো আধঘন্টা আগে এসেছে প্রত্যয়। সঙ্গে এনেছে এত এত ফল, মিষ্টি।
সিরাতের কাজিন নীরু তো দুলাভাইয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু সিরাত এই লোকের নাটকের ওপর চরম বিরক্ত হলো। সোহাকে নিয়ে সে খাবার খেয়ে নিলো। এরপর মাকে গিয়ে বললো সোহাকে নিয়ে সে পড়ার ঘরে থাকবে। প্রত্যয় থাকতে চাইলে যাতে ওর বিছানাপত্র করে দেয়। এরপর ও সোহাকে নিয়ে পড়ার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। প্রত্যয় এসব দেখে মনে মনে ভীষণ রেগে যায়। তবুও সে শান্ত থাকে। একবার বাড়ি যাক, এরপর একে সে দেখে নেবে। শিমুল সাহেব খাওয়ার জন্য ডাকতে এলে ও
জানিয়ে দেয় বাইরে থেকে খেয়ে এসেছে, ক্ষিধে নেই। সিরাতের মা-বাবা লজ্জায় পড়ে যান এবার। কান্ড
দেখে দুজনেই বুঝতে পারেন নিশ্চয়ই ঝামেলা হয়েছে। মিনারা নিজের মেয়ের কান্ডজ্ঞানের অভাব দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে কথা শোনাতে থাকেন। শিমুল সাহেব তাকে এ ব্যপারে নাক গলাতে মানা করেন। সিরাত ঘরে বসে সবই শুনছিলো। তবুও তেমন পাত্তা দিলো না ব্যাপারটাতে। প্রত্যয়ের আজকের কর্মকাণ্ডে বেশ হার্ট হয়েছে ও। সোহাকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়ানি কবিতা পড়তে লাগলো।
তবে ঘন্টা পেরুতেই ও আর শান্ত থাকতে পারলো না। মন খচখচ করতে লাগলো। এই লোক তো ক্ষিধে নিয়ে থাকতেই পারে না, এ নিয়ে কত জ্বালায় ওকে! এতদিনে এসব ওর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। দরজা খুলে বেরিয়ে এসে দেখলো সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। রান্নাঘরে গিয়ে প্লেটে খাবার নিলো। নিজের ঘরের দরজা ঠেলতেই খুলে গেলো। দেখলো প্রত্যয় উল্টো হয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে নেই বুঝে সিরাত শক্ত গলায় বলল,
‘ওঠুন, খেয়ে নিন।’
প্রত্যয় চোখ খুললো,
‘খাইয়ে দাও।’
সিরাত তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল,
‘পারবো না। খেলে খান না খেলে আমি যাই।’
প্রত্যয় ওঠে বসলো। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘আমার হাত কেটে গেছে।’
সিরাত সাথে সাথেই বলল,
‘উচিৎ বিচার হয়েছে।
প্রত্যয় ভ্রু কুঁচকে দেখলো ওকে। এরপর গোমড়া
মুখে বলল,
‘আমার ক্ষিধে পেয়েছে।’
হাসি চেপে সিরাত ওকে খাইয়ে দিতে লাগলো।
জানতো গুন্ডা’টা এমন নাটক করবে, তাই ও
আগেই হাত ধুয়ে এসেছে। খাইয়ে দিতে দিতে প্রশ্ন করলো,
‘এসব কাজকর্ম কি আপনি কোনোভাবেই বন্ধ
করবেন না? কি পান এসব করে?’
‘তোমার ঘৃণা।’
সিরাত ভ্রু কুঁচকালো,
‘আমার ঘৃণা আপনার এতো ভালো লাগে?’
‘না তো।’
‘তাহলে করেন কেন?’
প্রত্যয় পানি খেতে খেতে বলল,
‘আচ্ছা, আর করবো না।’

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]

চলবে….

গোলকধাঁধা পর্ব-০৭

0

#গোলকধাঁধা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৭

প্রত্যয় ফোঁস ফোঁস করতে করতে বললো,
‘দু-ফোঁটা চোখের জলও তো ফেললে না। বাকি সবাই আমার জন্য চিন্তিত, কান্নাকাটি, হুলস্থুল করেছে। এদিকে আমার বউ হয়ে তুমি কি করলে? শুধু এন্টিসেপটিক আর তুলো দিয়ে সেবা? আমার মনের সেবা কে করবে?’
সিরাত বাক্যহারা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো!
বিস্ময় ভাব কাটিয়ে হালকা কেশে অস্ফুটস্বরে
জিজ্ঞেস করল,
‘আপনার মনের সেবা? সেটা কীভাবে করতে পারি? অবশ্য আমাকে হেনস্তা করলেই তো আপনার শান্তি অনুভব হয়। তো আজ কীভাবে হেনস্তা করবেন বলে ভেবেছেন?’
‘মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। যাও গিয়ে আমার জন্য কফি করে নিয়ে আসো। তারপর মাথাটা টিপে দাও।’
প্রত্যয় মাথা ধরার ভান করে বললো। সিরাত সেটা বুঝতে পেরে বলল, ‘এই অসময়ে আমি আপনার জন্য কফি করবো? মাথা খারাপ? ঘুমে আমার চোখ বুজে আসছে। পারবো না এসব করতে।’
প্রত্যয় রুক্ষ স্বরে বলল, ‘তাহলে এ বাড়ি থেকে
বেরুনো বন্ধ।’
সিরাত রাগে গজগজ করতে করতে কফি করে নিয়ে এলো। ডিভানে মাথা এলিয়ে চোখ বুজে কফির মগে চুমুক বসাতে বসাতে মাথা টিপে দিতে ইশারা করলো। ভীষণ রাগে গা জ্বলছে সিরাতের। ইচ্ছে করলো চুল ছিঁড়ে ফেলতে। করলোও তাই। আচমকা চুলে টান পড়ায় গমগমে স্বরে প্রত্যয় বলল, ‘চুল ছিঁড়ে
ফেলবে নাকি?’
সিরাত কিছু না জানার ভান করে বলল, ‘দুঃখিত জনাব।’
‘অসহ্যকর মেয়ে। সরো।’
বলে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। সিরাতও হাফ ছেড়ে বাঁচলো। নিজেও গিয়ে শুয়ে পড়লো। মুহূর্তেই ক্লান্ত-শ্রান্ত চোখ দুটিতে জেঁকে বসলো ঘুম। পরদিন ঘুম থেকে ওঠে প্রত্যয়কে দেখতে পেলো না সিরাত। নিচে গিয়ে জানলো প্রত্যয় বেরিয়ে গেছে। আজ ওদের দলের সমাবেশ। সেখানে অনেক কাজ। তাই বাবা-মায়ের বারণ স্বত্তেও সে ওখানে গেছে। সেইজন্য মুশফিকা চৌধুরী কাঁদতে কাঁদতে মূর্ছা যাবার জোগাড়। রাগ করে আমির সাহেবও না খেয়ে অফিসে চলে গেছেন। সিরাত থমথমে পরিস্থিতি দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এই লোক এমন ঘাড়ত্যাড়া হলো কেন? মা-বাবার কথারও কোনো দাম নেই? বেয়াদব লোক!
প্রত্যাশা এসে ওকে বললো খেয়ে নিতে। কিন্তু সিরাত খেলো না। ঘরে এসে ফোন করলো প্রত্যয়কে। প্রথমবারেই রিসিভ হলো, ‘বলো।’
‘আপনি এত খারাপ কেন?’
‘আবার কি করলাম? আজ তো ভালোই ঘুম দিয়েছো, আমি তো ডির্স্টার্বও করি নি। তো?’
সিরাত রেগে বলল, মা-বাবা’কে চিন্তায় রেখে
কি পান? একটা কথাও শোনেন না তাদের। বাজে লোক।’
প্রত্যয়ের বিরক্তি টের পাওয়া গেলো,
‘তুমি কি আমাকে এসব বলার জন্য ফোন করেছো?’
‘ফিরুন এখুনি। ওসব সমাবেশের চেয়ে পরিবার বেশি ইম্পোর্টেন্ট।’
সিরাত কটমট করে বললো। প্রত্যয় ব্যস্ত স্বরে বলল,
‘আমি সমাবেশে আছি। অনেক ঝামেলা। এখুনি আমাকে ভাষণ দেওয়ার জন্য যেতে হবে। তুমি ফোন রাখো।’
‘অসভ্য, নির্দয় লোক।’
প্রত্যয় এসব শুনে বলল,
‘তোমার কি চিন্তা হচ্ছে আমার জন্য? বলো, বলে ফেলো।’
‘কচু হচ্ছে।’
বলে মুখের ওপর ফোন কেটে দিলো। এরপর
মনে মনে বংশ উদ্ধার করলো প্রত্যয়ের। খাবার খাওয়ার কোনো ইচ্ছেই হলো না। কিছুক্ষণ ফোন
স্ক্রল করলো, বাড়িতে কথা বললো, সোহাকে ভিডিও কলে দেখলো। কিন্তু বিরক্তি যেন কাটছেই না। প্রত্যাশার ঘরে গিয়ে কিছুক্ষণ গল্প করে এলো।
কিন্তু মেয়েটার ক’দিন পরই ফাইনাল এক্সাম শুরু
হবে, সিরাত তাই বেশি বিরক্ত করলো না৷ ওকে।
এভাবেই সারাদিন আর সন্ধ্যা কেটে গেলো।
রাতে এক অভাবনীয় কান্ড হলো। সমাবেশের রেশ ধরেই প্রতিপক্ষের লোকেদের সাথে আজও বিরাট গন্ডগোল, সংঘর্ষ বেঁধেছে। দু-পক্ষের লোকেরাই
আহত হয়েছে বেশ। গন্ডগোলে মারামারি করতে গিয়ে প্রত্যয়েরও আঘাত লেগেছে। সেজন্য ও এখন হসপিটালে ভর্তি। সবাই স্তব্ধ। অন্তুর কাছ থেকে এ খবর শুনে তড়িঘড়ি করে সকলে হসপিটালের উদ্দেশ্য রওয়ানা হলো। ডাক্তার জানালো এখন ঠিক আছে, তবে হাতে চোট পেয়েছে, পা ভেঙ্গে গেছে। ঠিক হতে বেশ সময় লাগবে। তিন সপ্তাহের বেড রেস্ট দিয়েছে। সবাই প্রত্যয়ের সাথে দেখা করে আসার পর সিরাত কেবিনে গেলো। গিয়ে শক্ত গলায় বলল, ‘এখন কেমন লাগছে?’
প্রত্যয় গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলো, ‘ভালো না।
আমার পা ভেঙ্গে গেছে।’
‘ওই প্রবাদটা জানেন তো! পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে। বাবা-মায়ের কথা তো একদম শুনেন না।’
সিরাত রেগে বললো। প্রত্যয় ভ্রু কুঁচকে ওকে দেখে বলল, ‘তোমার খুব আনন্দ হচ্ছে বুঝি?’
‘অবশ্যই।’
‘কাঁদছিলে নাকি?’
প্রত্যয়ের ভ্রু কুঁচকে কথাটা বলতেই তা শুনে
হকচকিয়ে গেলো সিরাত।
থতমত খেয়ে বলল, ‘চোখটাও গেছে আপনার।’
বলে সেখান থেকে একপ্রকার পালিয়েই এলো।
ধুর! কান্নাকাটির বিষয়টাও এ গুন্ডাটা বুঝে ফেলেছে।
কখন আর কেন যে কান্না এসে গেছিলো তখন!
সিরাতের মা-বাবা এসেছে মেয়ে জামাইয়ের এ
অবস্থার কথা শুনে। সোহাকে কোলে নিয়ে সিরাত চুপচাপ বসে রইলো। তিনদিন পর খানিকটা স্টেবল হওয়ার পর প্রত্যয়কে বাড়ি নিয়ে আসা হলো।
হাঁটাচলা বারণ। মুশফিকা চৌধুরী ছেলের চিন্তায় বিপি লো করে ফেললেন। সিরাতই প্রত্যয়ের দেখাশোনা করতে লাগলো দিনরাত এক করে। তবে ফোন নিয়ে ড্রয়ারে তালা মেরে রেখে দিলো মুশফিকা চৌধুরীর নির্দেশে। কোনোভাবেই যাতে আবার ঝামেলায় জড়িয়ে না পড়ে। সেজন্য প্রত্যয়ও প্রতিশোধ নিচ্ছে ওর উপর। এই বাহানা, সেই বাহানা মেটাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে ও। এই সিরাত কফি দাও, চা দাও, পানি দাও, ঔষধ নেবো না, এটা খাবো না, ওটা খাবো, বিরিয়ানি করে নিয়ে এসো, মলম লাগিয়ে দাও, গা ধুয়ে দাও, চুল আঠা হয়ে গেছে শ্যাম্পু করে দাও! ঘুমাতে গেলেও শান্তি নেই। মাথা ব্যথা, গা ব্যথা, চুল টেনে দাও! এসব করে করে জ্বালিয়ে মারছে এতদিন। সিরাতের মনে হচ্ছে প্রত্যয়ের অত্যাচারে আর বেশিদিন বাঁচবে না ও। গুন্ডাটা সব প্রতিশোধ বুঝি এভাবেই নেবে। না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ওর চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে এই ক’দিনেই। তবুও
প্রত্যয়ের সেবা করে যাচ্ছে ওর জ্বালাযন্ত্রণা সহ্য
করে। না ভালো না খারাপ। করতে কি চায় গুন্ডাটা
ওর সাথে? গোলকধাঁধায় পড়ে গেছে মনে হচ্ছে ওর!

রাত সাড়ে এগারোটা। প্রত্যয় টিভিতে খবর দেখছে। নিজের সব কাজ গুছিয়ে গোসল সেরেছে সবেমাত্র ঘরে এসেছে সিরাত। প্রত্যয় টিভি না দেখে আড়চোখে ওকে দেখতে লাগলো একমনে। তোয়ালেতে চুল মুছতে মুছতে প্রত্যয়কে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার কিছু প্রয়োজন? রাতে ওঠে প্লিজ আমাকে জ্বালাতন করবেন না। আপনার যন্ত্রণায় মনে হচ্ছে বেশিদিন আর বাঁচবো না। কি খাবেন বলুন?’
প্রত্যয় উত্তর না দিয়ে বলল,
‘এদিকে এসো।’
সিরাত সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো। গেলো না। পরক্ষনেই ওকে ধমকে ওঠলো প্রত্যয়। সিরাত চোখমুখ কালো করে এগুলো ওর দিকে। দূরত্ব বজায় রেখে জিজ্ঞেস করল,
‘কী?’
প্রত্যয় একটানে ওকে বিছানায় বসিয়ে দিলো। এরপর ওর মুখের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে
আকস্মিক কাছে টেনে কপালে চুমু খেলো,
গালেও। সিরাত বাকহারা হয়ে গেলো। অনেক কষ্টে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওর ঠোঁট দখল করে নিলো প্রত্যয়। বেশ কিছু মুহূর্ত পর ছেড়ে দিয়ে বলল,
‘জ্বালাবো না।’
সিরাতের এলোমেলো মস্তিষ্ক। ঠোঁট মুছতে মুছতে বলল, ‘ক কি করলেন এটা?’
‘ঘুমাও। প্রশ্ন করবে না একদম।’
সময় নিয়ে বাক্য সাজালো সিরাত। তেজ নিয়ে বলল,
‘আ আপনি খুব খারাপ লোক।’
‘জানি বউ। ঘুমাও।’
‘না। আপনি আগে বলুন কেন এমন করলেন?’
সিরাত কঠোর গলায় জিজ্ঞেস করলো। প্রত্যয় এবার বিরক্ত হলো, ‘বেশি কথা বললে বেশিকিছু করে ফেলবো।’
কথা শেষ হতে দেরি সিরাতের লাপাত্তা হতে দেরি নেই। একছুটে পালিয়ে গেলো ঘর থেকে। প্রত্যয় সেদিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থেকে কাঠের স্বরে বললো, ‘সহ্য হচ্ছিলো না তোমায়। জ্বলেপুড়ে যাচ্ছিলো যে!’

এদিকে সিরাত প্রত্যাশার ঘরে গিয়ে বসে রইলো। অনেক রাত পর্যন্ত বসে রইলো সেখানে। প্রত্যাশা কিছু হয়েছে কি-না জিজ্ঞেস করলে শুধু বলেছে ছোটখাটো ঝগড়া হয়েছে ওদের। এমনি করেই অনেক সময় কেটে যাওয়ার পর ধীরপায়ে ঘরে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো প্রত্যয়কে ঘুমন্ত দেখে। এমনিতেই প্রত্যয়ের কান্ড ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এমন না যে ও কিছু বুঝতে পারে নি। আবার গুন্ডাটার ধূর্ত, কুটিল স্বভাবের কথা ও জানে। ও আসলে কি চায়? কিন্তু প্রত্যয় যদি সত্যি সত্যি ওর কাছে আসে তাহলে ও কি করবে? সিরাত ভয়ভয় চোখে প্রত্যয়কে দেখে বিড়বিড় করে দোয়া পড়তে পড়তে তড়িঘড়ি করে ওযু করতে চলে গেলো। ফজরের আযান পড়ে গেছে ততক্ষণে!

পরদিন বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙলো প্রত্যয়ের।
সূর্যের আলো মেঝেতে লুটোপুটি খাচ্ছে। চোখ ডলে ওঠে বসতেই ‘আহ’ শব্দে ছোট্ট করে চেঁচালো। জ্বলছে কাঁটাছেড়া জায়গাগুলো। সিরাতকে ঘরে দেখতে পেলো না ও। বিরক্তি ভঙ্গিতে খানিকক্ষণ সময় নিয়ে বিছানা থেকে নেমে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে ওয়াশরুমে গেলো। ফ্রেশ হয়ে ঘরে এসেই হাঁকডাক ছেড়ে সিরাতকে না দেখতে পেয়ে ডাকতে লাগলো। রান্নাঘরে মুশফিকা চৌধুরী দুপুরের রান্না বসিয়েছেন। সিরাত হাতে হাতে তাকে সাহায্য করছে। ও জানে শ্বাশুড়ি এখনো মনে মনে তাকে অপছন্দ করে।
কিন্তু তাতে ওর কিছু আসে যায় না। ও নিজে থেকেই দায়িত্বগুলো পালন করে। পাছে শ্বাশুড়ি নিন্দে করুক ও কোনোমতেই সেই সু্যোগ দেবে না। সেদ্ধ আলুর খোসা ছাড়াচ্ছিলো মনোযোগ দিয়ে। ওপর থেকে আসা প্রত্যয়ের হাঁকডাক কানে পৌঁছালো না ওর৷ মুশফিকা চৌধুরী লক্ষ্য করলেন ব্যাপারটা। বিরক্তি নিয়ে ওর কাছে এসে ডাকলেন, ‘এই মেয়ে!’
সিরাত হকচকিয়ে ওঠলো, ‘জি?’
‘শুনতে পাচ্ছো না আমার ছেলে ডাকছে? ও অসুস্থ! তোমার কি একটুও খেয়াল নেই ওর প্রতি? যাও এক্ষুনি। দেখো গিয়ে ওর কি প্রয়োজন। কেন ডাকছে! আমার ছেলের প্রতি কোনো মনোযোগ নেই!’
মুশফিকা চৌধুরী রাগান্বিত হয়ে কথা শোনালেন ওকে।
সিরাত হতবাক হয়ে গেলো। সুযোগ পেলে কথা শোনাতে ভুলেন না এই মহিলা।
ও ছোট্ট করে বলল, ‘যাচ্ছি।
বলে হাত ধুয়ে দ্রুত পায়ে ঘরে এলো। প্রত্যয় খালি
গায়ে বসে আছে। ওকে দেখে বলল, ‘এই
মেয়ে, এতক্ষণে আসার সময় হয়েছে?’
‘কেন?’
‘অসুস্থ স্বামীকে ফেলে কোথায় ছিলে এতক্ষণ?
আমার ডাক তোমার কানে যায় না? বেয়াদব মেয়ে।’
সিরাতের কাল রাতের কথা মনে পড়লো। লজ্জা লাগছে কেন জানি! তবু্ও অকপটে উত্তর দিলো, ‘শুনতে পাইনি। কি প্রয়োজন বলুন।’
প্রত্যয় তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, ‘তোমাকে।’
সিরাত সন্দিগ্ধ চোখে তাকালো। প্রত্যয় ওর বোকা চাহনি দেখে মনে মনে হেসে খু’ন। কিন্তু ওপরে নিজের গাম্ভীর্যতা ধরে রেখে বলল,
‘মলম নিয়ে এসো।’
সিরাত হাফ ছাড়লো। তড়িঘড়ি থেকে ড্রয়ার থেকে মলম নিয়ে এলো। ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে প্রত্যয়ের সামনে দাঁড়ালো। প্রত্যয়ের তীক্ষ্ণ চাহনিতে ভেতরটা অস্বস্তিতে মিইয়ে যাচ্ছে। কোথা থেকে কি শুরু করবে বুঝতে পারছে না। এতদিন মলম লাগানোর সময় ওর এতকিছু মনে হয়নি। কিন্তু এখন অস্বস্তি হচ্ছে। গলা শুকিয়ে আসছে। প্রত্যয় ধমক দিয়ে বলল, ‘স্বামীর চেহারা দেখে মন ভরে গেলে এবার একটু মানবসেবা করুন। জ্বলে যাচ্ছে সবকিছু।’
সিরাত দম আটকে বলল, ‘না মানে কোথা থেকে শুরু করবো?’
প্রত্যয়ের ধৈর্যের বাঁধ ফুরিয়ে আসছে, ‘মাথা থেকে।’
সিরাত ওর কঠোর স্বর শুনে সব জড়তা কাটিয়ে মলম লাগাতে শুরু করলো বুকে-পিঠে, হাতে, কপালে। ওর নরম হাতের আলতো ছোঁয়ায় প্রত্যয়ের কেমন অদ্ভুত অনুভূতির সাথে পরিচিত হলো। কেমন! সেটা সে নিজেও বুঝতে পারছিলো না। তবে ভীষণ অদ্ভুত! ভীষণ ভালো! সিরাত বেশি সময় নিলো না। মলম মেখে, ঔষধ দিয়ে প্রত্যয়কে জিজ্ঞেস করলো, ‘খাবার আনবো?’
‘হুঁ।’
‘কষা মাংস আর পোলাও রান্না হয়েছে। আপনার
নাকি খুব পছন্দ?’
প্র‍ত্যয় বিস্মিত হবার ভান করে হো হো করে হাসলো,
‘এতকিছুতে নজর! বাহ! বেশ ভালো।’
সিরাত কটমট করে বলল, ‘আনবো কি-না বলুন।
আমি শুধু আপনার সেবা করছি। অন্যকিছু না।’
প্রত্যয় শক্ত গলায় বলল,
‘আমি তো সেবাই ভাবছি অন্যকিছু কেন ভাবতে
যাবো বউ?’
ওর চোখেমুখে কুটিল হাসি। সিরাতের
ভেতরটা কেমন কেঁপে ওঠলো। এই লোকের মতলব ওর কাছে একদম ভালো ঠেকছে না।

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]

#চলবে…

গোলকধাঁধা পর্ব-০৬

0

#গোলকধাঁধা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৬

বুকের ওপর ভারী কিছু অনুভব করায় প্রত্যয়ের ঘুম ভেঙে গেলো। চোখ খুলে তাকিয়ে সে চমকে ওঠলো। সোহা ওর বুকের ওপর বসে নিজের ইচ্ছেমতো খেলা করছে। প্রত্যয় খানিকক্ষণ ওকে দেখে হতবিহ্বল হয়ে পাশে তাকিয়ে দেখলো সিরাত এখনো গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। ও ধীরগতিতে সোহাকে নামানোর চেষ্টা করতেই বাচ্চাটা শব্দ করে কেঁদে ওঠলো। সেই শব্দে কানে তালা লেগে যাওয়ার যোগাড়, সিরাতের ঘুম ভাঙলো। সোহাকে প্রত্যয়ের কাছে দেখে ধরফড়িয়ে ওঠে বসে দূরে সরিয়ে নিলো। মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল,
‘বাচ্চাটাকে কাঁদাচ্ছিলেন কেন?’
প্রত্যয় নিজেও ওঠে বসলো, ‘মাথার সব প্রোটিন
কি নিঃশেষ হয়ে গেছে যে উল্টোপাল্টা বকছো? আমি কখন ওকে কাঁদালাম?’
‘তাহলে ও কাঁদলো কেন?’
‘আমাকে গিনিপিগ বানিয়ে খেলছিলো তোমার মেয়ে, নামাতে চেয়েছি সেজন্য চিৎকার করেছে। ঠিক
তোমার মতো।’
প্রত্যয়ের কথা বিশ্বাস না করে সিরাত বলল,
‘আপনাকে আমার তো চেনার বাকি নেই। আপনার
সব হুমকি আমার স্পষ্ট মনে আছে। যেই সুযোগ পেয়েছেন তেমনি সোহার ওপর শোধ নিচ্ছেন।’
প্রত্যয় বিরক্তি ওঠে যেতে যেতে নিজেকেই
বলল, ‘পাগলের প্রলাপ কানে
নিস না।’
সিরাত আগুন চোখে তাকালো, ‘আমি পাগল!’
‘নিজের অস্তিত্ব অস্বীকার করো নি বলে খুশি হলাম।’
সিরাত বোকার মতো তাকিয়ে রইলো। আর প্রত্যয় হাসতে হাসতে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো!
সিরাতও ওঠলো। সোহা কে ফ্রেশ করিয়ে, খাইয়ে নিজের সব কাজকর্ম সেরে নিলো। ভার্সিটির জন্য
তৈরি হয়ে রইলো। না চাইতেও প্রত্যয়ের সঙ্গে ওকে বেরুতে হলো। পথিমধ্যে সোহাকে বাড়ি নামিয়ে দিয়ে যাবে। গাড়িতে বসে সোহা ভীষণ খুশি। বারবার এটা-ওটা ধরছে, হাসছে দু’পাটি দাঁত বের করে। আর সিরাত আদুরে কথা বিনিময়ে ওর সাথে সঙ্গ দিয়ে খেলছে। প্রত্যয় লুকিং গ্লাসে এসব দেখে গলা খাকারি দিলো। সিরাত বিরক্ত চোখে তাকাতেই বলল, ‘এসে গেছি!’

সিরাত দেখলো ওর বাড়ির সামনে গাড়ি থেমেছে। ও সোহাকে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। প্রত্যয় খানিকটা ইতস্তত করে ডাকলো ওকে, ‘এই মেয়ে, শুনো!’
সিরাত ঘুরে তাকালো, ‘কী?’
‘এটা নিয়ে যাও, সোহার জন্য!’
সিরাত দেখলো একটা বড় বক্স। তাতে বাচ্চাদের
টয়েস, চকলেট সহ নানা হাবিজাবি জিনিস। এসব কখন এনেছে গুন্ডাটা? আর সোহাকেই বা দিচ্ছে কেন? ও সন্দেহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এসব কেন?’
‘এমনি!’
‘লাগবে না। আপনার জিনিস আপনি রাখুন।’
‘একবার যখন বলেছি দ্বিতীয়বার আর বলবো না।’
ঠান্ডা হুমকি। সিরাত হকচকিয়ে গেলো। গুন্ডা’টা
হয়তো আবার রেগে কিছু একটা করে বসবে।
সেজন্য বাধ্য হয়েই গিফট বক্সটা নিলো সে। তাচ্ছিল্য করে বলল,
‘আপনার যে কয়টা মুখোশ আমি ভেবেই পাচ্ছি না।’
‘অন্যের বিষয়ে না ভেবে নিজেকে নিয়ে ভাবো। ওকে দিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে আসো। লেইট হয়ে যাচ্ছে।’
প্রত্যয় গম্ভীর কণ্ঠে বললো। সিরাত আর দাঁড়ালো না। সোহাকে মা’য়ের কাছে দিয়ে এলো। বারবার করে বলে এলো খেয়াল রাখতে। এরপর দ্রুতই ফিরে
এলো। প্রত্যয় গাড়ি স্টার্ট করে ভার্সিটির দিকে
রওয়ানা হলো। সিরাত একটু পর বলল, ‘আমার ফোনটা কি পেতে পারি?’
প্রত্যয় ড্রাইভ করতে করতে ভ্রু উঁচিয়ে গমগমে স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
‘কী করবে? স্বামীর নামে উল্টাপাল্টা পোস্ট লেখবে সোশ্যাল মিডিয়ায়?’
সিরাত চেহারা কালো করে বলল, ‘সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।’
প্রত্যয় ছোট্ট করে বলল, ‘ওহ! আই সী!’
‘পাবো তো?’
‘ভেবে দেখবো।’
সিরাত একটু বিরক্ত হলো, ‘আমার জিনিস ফেরত দেবেন সেখানে এত নাটকীয়তার কি আছে? নাকি
ভয় পাচ্ছেন আমাকে?’
প্রত্যয় হাসলো, ‘আমাকে ইঁদুর ভাবলে ভুল করবে।’
সিরাত টিপ্পনী কাটলো,
‘জানি তো আপনি বেড়াল।’
‘উহু, বাঘ।’
‘জোক্স অফ দ্যা ইয়ার।’
সিরাত উচ্চস্বরে হেসে ওঠলো। প্রত্যয় নির্বিকার
ভঙ্গিতে গাড়ি চালাচ্ছে। হেলদোল হলো না সিরাতের তাচ্ছিল্যতায়। তবে সিরাতের উচ্চ স্বরে হাসিটা ওর ভেতরে আগুন জ্বালিয়ে দিলো। কিন্তু ব্যাপারটা
একটুও বুঝতে দিলো না ওকে। শান্ত হয়ে বাকি
পথটুকু পাড়ি দিলো সে। ভার্সিটির সামনে গাড়ি থামাতেই সিরাত নামলো। পেছন থেকে গমগমে
স্বরে প্রত্যয় ডেকে বলল, ‘নাও।’
পেছনে ফিরতেই খুশিতে চকচক করে ওঠলো
সিরাতের চোখ। দ্রুত নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে খুশিতেই বলে ফেললো, ‘থ্যাংক্স পাওয়ার যোগ্য
না আপনি, তাই দিলাম না।’

ভার্সিটিতে বাকি সময়টা বেশ ভালোই কাটলো সিরাতের। তবুও তক্কেতক্কে রইলো। কিন্তু আজ আর উল্টোপাল্টা কিছু ঘটার খবর পেলো না সে। বাড়ি ফেরার সময় ও ক্যান্টিনের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলো প্রত্যয়ের জন্য। কিন্তু ওর বদলে এলো মাহিন। এসেই চওড়া হাসি দিয়ে বলল, ‘ভাই পাঠাইসে। সে দলের ঝামেলায় ব্যস্ত, আসতে পারে নাই। আসেন আফনেরে দিয়া আসি।’.
সিরাত বুঝতে পারলো কেন আজ গন্ডগোল বাঁধেনি। গুন্ডাটা ঝামেলায় ব্যস্ত, ভালোই হয়েছে! ও বলল, ‘লাগবে না। আমি একাই পারবো।’
মাহিন নাছোড়বান্দা, ‘একলা যাইতে মানা
করছে ভাই। চলেন ভাবী।’
সিরাত জানে প্রত্যয়কে। তবে মাহিনের ব্যবহার দেখে আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলল, ‘কি ব্যাপার মাহিন ভাই, এত সম্মান দিয়ে কথা বলছেন যে? আগে তো তুমি করে বলতেন।’
মাহিন লজ্জা পেলো, ‘এহন তো ভাবী লাগেন!
আগের কথা মনে কইরেন না আর।’
সিরাত বলল,
‘এখনো সময় আছে, ভালো মানুষির পথে আসুন।’
মাহিন দাঁত বের করে হাসলো, ‘ওই আরকি! চলেন।’

___________

দিন কয়েক পরের কথা। রাতে সিরাত বসে বসে ফোন স্ক্রল করছিলো, প্রত্যয় তখনো ফেরেনি। এমন সময় ফোন এলো অনলের। সিরাত রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে অনলের ব্যস্ত গলা শোনা গেলো, ‘কি খবর?’
সিরাত হেসে বললো, ‘ভালো। কিন্তু মতলব কি?
এই অসময়ে ফোন যে?’
‘আজ দুই পক্ষের আবারও সংঘর্ষ, হাতাহাতি হইসে। অনেক পোলাপান আহত, একজন নিহত হইসে। খবর জানোস কিছু?’
সিরাত ভড়কে গেলো। হাসি হাসি মুখে মেদুর ছায়া পড়লো। বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘বলিস কি! আমি তো কিছুই জানি না।’
‘সে কী! তোর জামাই আই মিন প্রত্যয় ভাই কই?’
সিরাত চিন্তিত হয়ে উত্তর দিলো,
‘জ জানি না। এখনো ফেরে নি।’
অনল বুঝলো সিরাত এই ব্যাপারে কিছুই জানে না। আর হঠাৎ এই খবর শুনে ভড়কে গেছে। সেজন্য ও শান্ত গলায় হেসে বলল, ‘আরে টেনশন নিস না। আমি খোঁজ নিচ্ছি। খবর পেলেই জানাবো তোকে। ওকে?’
সিরাত ব্যস্ত গলায় বলল, ‘আমার টেনশন হচ্ছে।’
‘রিল্যাক্স দোস্ত। খবর পেলেই জানাবো।’

ফোন কেটে হতভম্ব হয়ে বসে রইলো সিরাত। কি করবে বুঝতে পারলো না। ঘড়িতে রাত দশটা বেজে পনেরো মিনিট। অন্যদিন সাড়ে নয়টাতেই বাড়ি ফেরে প্রত্যয়। আজ এত দেরি কেন হচ্ছে! প্রত্যয়কে কল করলো, ওপাশ থেকে বন্ধ এলো৷ সিরাতের এবার আশঙ্কা হলো। বাড়ির কেউ-ই এই ব্যাপারে জানে না। সবাইকে জানানো উচিৎ হবে কি-না একবার ভাবলো। ঠিক করলো জানানোটাই ঠিক। দরজা খুলে দ্রুতপদে ছুটে গেলো শ্বাশুড়ির ঘরে। এই ঘরে হাতে গোনা দু’বার এসেছে সে। মুশফিকা চৌধুরীর সাথে ওর একদম জমে না বলতে গেলে। তবুও ইতস্তত করে কড়া নাড়তেই মুশফিকা চৌধুরীর গলা শোনা গেল,
‘খোলা আছে।’
সিরাত ঢুকলো। ওকে দেখে অবাক হলো মুশফিকা চৌধুরী। সিরাত উৎকন্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘বাবা কোথায়?’
মুশফিকা চৌধুরী কাঠ গলায় উত্তর দিলেন,
‘ওয়াশরুমে। বসো।’
সিরাত বসলো। কিন্তু ভীষণ উত্তেজিত সে। মুশফিকা চৌধুরীকে কিছু বললো না ও। আমির সাহেব ফ্রেশ হয়ে বেরুলে তাকেই সিরাত সবকিছু খুলে বললো। এসব শুনে তিনি ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। প্রত্যয়ের ফোন অসংখ্য কল দিলেন, সুইচড অফ বলছে। আমির সাহেব দিশেহারা হয়ে একে-ওকে ফোন দিয়ে ছেলের খোঁজ নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এভাবেই আরও একঘন্টা কেটে গেলো। কিন্তু খোঁজ পেলো না। সিরাতের হুট করেই মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো।

রাত বারোটার দিকে অন্তু, মুহিব, মাহিনকে সঙ্গে নিয়ে হাতে-পায়ে অসংখ্য চোট পেয়ে বাড়ি ফিরলো প্রত্যয়। কিন্তু সেদিকে ওর খেয়াল নেই। ফোনে কাউকে প্রচন্ড ধমকাচ্ছে ও। এদিকে আমির সাহেব রাগ সামলাতে না পেরে পুত্রের গালে সশব্দে
চড় বসালেন, ‘তোর বাপ কি মরে গেছে যে এসবে
যাস? আজকের পর থেকে তোর এসব নেতাগিরি বন্ধ।’
প্রত্যয় গালে হাত দিয়ে অবাক চোখে তাকালো,
‘তুমি আমাকে মারলে?’
‘আরো আগে যদি মারতাম তাহলে এই দিন দেখতে
হতো না।’
প্রত্যয় কাহিনী ধরতে না পেরে আবারও জিজ্ঞেস করলো, ‘হয়েছেটা কি তোমাদের?’
আমির সাহেব গমগমে স্বরে বললেন, ‘নিজের অবস্থা দেখেছো? হাত-পা কেটে রক্ত ঝরছে আবার জিজ্ঞেস করছো কি হয়েছে? তোমাকে এই অবস্থায় দেখার জন্য বড় করেছিলাম?’
এতক্ষণে বিষয়টা পরিষ্কার হলো প্র‍ত্যয়ের কাছে।
ও বিরক্ত হলো। বাড়িতে এই খবর কে দিয়েছে? তাদের তো জানার কথা নয়! আমির চৌধুরী আবারও গর্জে ওঠলেন, ‘মায়ের অবস্থা দেখে এসো। বেয়াদব ছেলে।’
প্রত্যয় আশেপাশে নজর বুলিয়ে দেখলো সিরাত
সিঁড়ির মাথায় থমথমে চেহারা বানিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যাশার চেহারাও শুকনো। ও তাকাতেই সিরাত আর প্রত্যাশা গটগটিয়ে হেঁটে সেখান থেকে চলে গেলো। প্রত্যয় এক গ্লাস পানি খেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের
ঘরে গিয়ে দেখলো মুশফিকা চৌধুরী বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে বিছানায়। হাত-পায়ে মালিশ করছে
প্রত্যাশা। সিরাত মাথায় পানি ঢালছে। এসব দেখে প্রত্যয় হতভম্ব হয়ে গেলো। বাড়ির পরিবেশ অনুকূলে নয় দেখে মুহিব, অন্তুদের সে বিদায় দিয়ে দিলো।
জ্ঞান ফেরার পর ছেলেকে দেখে যেন প্রাণ ফিরে পেলেন মুশফিকা চৌধুরী। কেঁদেকেটে অস্থির হলেন। প্রত্যয় মা’কে ভুজুংভাজুং বুঝ দিয়ে শান্ত করলো।

তখন ভোর চারটে। প্রত্যয় আপাতত পরিস্থিতি সামলে ক্লান্ত হয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ালো। কাটা ক্ষত গুলো জ্বলছে ভীষণ! ঘরে এসে দেখলো সিরাত ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে বসে আছে। ওকে দেখেই এগিয়ে এসে আদেশের সুরে বলল, ‘বসুন।’
সিরাতের থমথমে চেহারা দেখে বাধ্য ছেলের মতো বসলো প্রত্যয়। এন্টিসেপটিক, তুলা বের করে কপাল, মুখ, হাতে কেটে যাওয়া ক্ষত পরিষ্কার করতে করতে সিরাত শক্ত গলায় বলল, ‘পাঞ্জাবি খুলুন।’
‘লাগবে না, ওখানে কাটেনি।’
প্রত্যয় মানা করলো। কিন্তু পরক্ষণেই সিরাতের ভস্ম করা দৃষ্টি দেখে ভড়কে গিয়ে একটানে পরণের পাঞ্জাবি খুলে ফেললো। সিরাত তুলা দিয়ে বুকের ক্ষত পরিষ্কার করতে গিয়ে চেপে ধরতেই প্রত্যয় ‘আহ’ বলল চেঁচিয়ে ওঠলো। সিরাত ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কি হলো?’
‘মানবতার মাতা নার্সগিরিটা রয়েসয়ে করুন।’
সিরাত অবাক হওয়ার ভান করে বলল, ‘সে কী! আপনার তো ব্যথা পেলেও অনুভব করার কথা নয়। যেভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের শাস্তি দেন, মজাই তো মনে হয় আপনার কাছে!’
কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিঁটাটা বেশ ভালোই বুঝতে পারলো প্রত্যয়। নিচে তাকিয়ে মৃদু হেসে আচমকা কোমড়
চেপে ধরে অনেকটা কাছে টেনে আনলো। আকস্মিক এমন কান্ডে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো ও। রেগে বলল, ‘ভালো হচ্ছে না কিন্তু!’
‘এ কথাটা আগে তোমার ভাবা উচিৎ ছিলো
আমার ঘরনি!’
বলে আরো শক্ত করে ধরলো। সিরাত নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে ব্যর্থ হলো। প্রত্যয় বাঁকা হাসতেই অজানা আশঙ্কায় শিওরে ওঠলো ও। ছটফট করতে করতে রাগী গলায় বলল,
‘মার খেয়েও স্বভাব বদলায়নি।’
প্রত্যয় সেভাবেই ফিসফিস করে বলল,
‘বদলাবেও না।’
‘ছাড়ুন আমাকে!’
প্রত্যয় ওর ঘাড়ে এবার দাঁত বসালো। সিরাত আর্তনাদ
করে ধাক্কা দিয়ে ওকে দূরে সরিয়ে দিলো। ব্যথিত
গলায় বলল, ‘আপনি কি ভালো হবেন না? কি
করলেন এটা?’
‘প্রতি’শোধ নিলাম।’
‘মানে? কীসের প্রতি’শোধ?’
প্রত্যয় রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে বললো,
‘দু-ফোঁটা চোখের জলও তো ফেললে না। বাকি সবাই আমার জন্য চিন্তিত, কান্নাকাটি, হুলস্থুল করেছে। এদিকে আমার বউ হয়ে তুমি কি করলে? শুধু এন্টিসেপটিক আর তুলো দিয়ে সেবা? আমার মনের সেবা কে করবে?’
সিরাত বিস্ময়ে বাক্যহারা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো!

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]

চলবে…

গোলকধাঁধা পর্ব-০৫

0

#গোলকধাঁধা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৫

ওয়াশরুম থেকে বেরুতেই প্রত্যয় কটমট করে বলল, ‘আমার নামে নালিশ করলে
কেন? শাস্তি তো তুমি মাথা পেতে নিয়েছো।’
সিরাত বলল, ‘আমি তো নালিশ দিইনি, সত্যটাই বলেছি।’
‘আমি তো ভুলেই গেছিলাম তুমি সত্যবাদী যুধিষ্ঠি।’
প্রত্যয় চটে গেল। সিরাত রাগী গলায় বলল,
‘একদম আজেবাজে কথা বলবেন না। আপনি আসলে বড্ড ইনসিকিউরড, তাইনা?’
‘কে বললো তোমায়?’
সিরাত তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল,
‘চেহারা দেখেই বুঝেছি। আমার বাবা-মায়ের সামনে নিজের ফেইস লসটা ঠিক মানতে পারেন নি। তাই এখন আমার সাথে ঝামেলা করতে এসেছেন।
তাইনা?’
প্রত্যয় কটমট করে বলল, ‘জানো আমি কত করে নিচে সবটা সামলে এসেছি? অন্যের শাস্তি মাথা পেতে নিয়ে আমাকে ফাঁসানোই তোমার ইচ্ছে ছিলো। তাইনা? রাবিশ!’
‘জি, ঠিক আপনার মতো।’
সিরাতের মুখে মুখে তর্ক শুনে রাগ জেঁকে ধরলো প্রত্যয়কে। ওর হাতের কবজি চেপে ধরে কাছে টেনে বলল, ‘মুখ সেলাই করতে আমার হাত একটুও
কাঁপবে না মেয়ে।’
সিরাত ভয় পেলো না। উল্টো হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল, ‘জানি। যে পাবলিক প্লেসে নিজের বউকে অসম্মান করতে পারে তার দ্বারা সবকিছু সম্ভব। আর আপনার বেলায় তো সন্দেহের অবকাশ নেই।’
প্রত্যয় ওর হাত আরও শক্ত করে চেপে ধরতেই ব্যথায় মৃদু আর্তনাদ করলো সিরাত। প্রত্যয় বাঁকা হেসে বলল,
‘এত বউ বউ করছো যে? নিজেকে সত্যিই আমার বউ ভাবছো নাকি?’
সিরাত চোখমুখে ঘৃণা ফুটিয়ে বলল,
‘না ভাবার তো কিছু নেই। আমরা না মেনে নিলেও
সত্য তো পাল্টাবে না। আর এটা স্বীকার করার সাহস আমার আছে, বরংচ আপনি কাপুরুষ। আচ্ছা,
সকলের ছোটখাটো অপরাধে আপনি তাদের যেভাবে শাস্তি দেন, আপনি যে আমার সাথে অন্যায় করছেন তার বিচার কে করবে? বউ পিটিয়ে আর কতদূর!’
প্রত্যয় বিস্ময় নিয়ে ওর হাত ছেড়ে দিলো। দূরে সরে শক্ত গলায় বলল, ‘আমি বউ পেটাই?’
‘সামনে থেকে সরুন তো! আপনার মুখদর্শন করতে অসহ্য লাগছে আমার!’
তীব্র ঘৃণা মেশানো বাক্য। সিরাতের চোখমুখ ভেজা। প্রত্যয় চোয়াল শক্ত করে ওর আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করছে। এই মেয়ে কোন ধাতুতে গড়া কে জানে। এতকিছু করেও ভয় দেখাতে পারলো না, উল্টে কথায় কথায় ওর সাথে বিবাদে জড়াচ্ছে। প্রত্যয় হতবিহ্বল ভঙ্গিতে ওর ভেজা গাল দেখে আনমনেই হাত
বাড়াতে গেলো, ঠিক তখনি দরজায় টোকা পড়লো। প্রত্যাশা চেঁচিয়ে বলল,
‘নিচে সবাই বসে আছে। ভাবী এসো।’
সিরাত চোখমুখ মুছে উত্তর দিলো, ‘আসছি!’

বলে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো নিচে। প্রত্যয় ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে মনে মনে ফুঁসে ওঠলো। কেন যেন সবকিছু অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। সিরাতকে
যেভাবে শাস্তি দেবে বলে ভেবেছিলো তার কিছুই করতে পারছে সে না ঠিকঠাক।
রাতে খাবার টেবিলে দুই পরিবারের সবাই একসঙ্গে খেতে বসলেন। মুশফিকা চৌধুরী থমথমে চেহারায় আপ্যায়ন করছেন সিরাতের বাবা-মাকে। তবে ছোট্ট সোহার উপর মুখ কালো করে থাকতে পারলেন না বেশিক্ষণ। আসার পর থেকেই বাচ্চাটা যেন
সকলের মনেই জায়গা করে নিয়েছে।
দেড় বছরের ছোট্ট মেয়েটা আধো আধো স্বরে মুশফিকা চৌধুরীকে দিদা, আমির সাহেবকে দাদা বলে সম্বোধন করছে। প্রত্যাশাই শিখিয়ে দিয়েছে ওকে! আমির সাহেব সহাস্যে ওকে কোলে তুলে আদর করছে। এসব দেখে সিরাতের মা মিনারা খাতুন মেয়েকে বললেন, ‘বড়লোক দেইখা তো ভাবছিলাম অহংকারী। এখন তো মানসিকতা দেখি ভালোই।’
সিরাত হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘দুটোই।’
‘জামাই বাবাজি কেমন? অবশ্য আমাদের বাড়িতে যেদিন গিয়েছিলো সেদিন খারাপ মনে
হয় নাই! বড্ড সরল, ভালো!’
সিরাত খানিকটা বিরক্ত হলো, ‘বড্ড ভালো? তাহলে ছেলে বানিয়ে নিয়ে যাও! কিন্তু ওই শয়’তানের কথা আমায় জিজ্ঞেস করবে না।’
মিনারা খাতুন সরল মানুষ। মেয়ের কথার মানে বুঝতে না পেরে চোখ রাঙালেন, ‘এসব কি কথা? পালিয়ে
বিয়ে করেছিস আবার বড় গলা করিস, বেত্তমিজ কোনখানের! একটুর জন্য আমাদের মুখে চুনকালি লেপে নাই।’
সিরাত চুপ রইলো। উত্তর দেওয়ার ভাষা নেই ওর। মিনারা খাতুন এরপর শান্ত গলায় আবারও বললেন,
‘জানিস, তোর বাবা যখন অস্বস্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো ওদের কি কি চাহিদা, শুনে তো ছেলের রাগ! অহেতুক খরচা না করে শুধু দোয়া করতে বললো। এত ভালো ছেলে যে আমাদের কোনো আয়োজন পর্যন্ত করতে দিলো না, উলটে বাবাকে পাঠিয়ে আমাদের দাওয়াত করে আসতে বললো। আজকাল এমন ছেলে পাওয়া যায় নাকি?’
সিরাত এসব শুনে হতাশ হয়ে মিনমিন করে বলল, ‘তোমরা সত্যিই বড্ড বোকা!’
এমন সময় শিমুল সাহেব এলেন। তিনিও এমন অনেক কথাই বললেন। বাবা-মায়ের সাথে অনেক কথা হলো সিরাতের। তবে রাত হয়ে যাওয়ায় শিমুল সাহেব এবার বাড়ি ফিরতে চাইলেন। বিদায় মুহূর্তে সোহা ভীষণ চিৎকারে বাড়ি মাথায় তুলতে লাগলো। সে কিছুতেই সিরাতকে ছেড়ে যাবে না, ওর কোল ছেড়ে নামবে না। আমির সাহেবের ভীষণ মায়া হলো। তিনি অনুরোধ করে বললেন অন্তত আজ রাতটা থেকে যেতে। শুনে সিরাতের বাবা লজ্জায় পড়ে গেলেন। একদমই রাজি হলেন না তিনি এ প্রস্তাব। এ কি কান্ড! মেয়ের বাড়িতে প্রথমদিন এসেই থেকে যাওয়াটা বড্ড লজ্জাজনক ব্যাপার তার কাছে।
অগত্যা সিরাত বাধ্য হয়ে বলল, ‘সোহা থাকুক,
কাল এসে নিয়ে যেও!’
সবাই-ই এ কথায় সহমত জানালো। ওর কথা শুনে প্রত্যয় শিমুল সাহেবকে ভরসা দিয়ে বলল,
‘টেনশন নিবেন না। আমি কাল ওকে পৌঁছে দিয়ে আসবো।’
শিমুল সাহেব মাথা নাড়ালেন। প্রত্যয়কে বললেন, ‘ভালো থেকো। সুখী হও। আমার মেয়েটাকেও সুখে রেখো।’
প্রত্যয় একপলক সিরাতকে দেখলো ও তাচ্ছিল্যভরে হাসছে। কেউ না বুঝলেও ওর দৃষ্টি এড়াতে পারলো না তা। আচমকাই ভীষণ রাগে বুকটা জর্জরিত হয়ে গেলো যেন!

_______

রাতে শুতে গিয়ে হলো ঝামেলা! সোহা কান্না করছিলো, বেশ জ্বালাচ্ছিলো। বহুকষ্টে ঘুম পাড়ানো হয়েছে ওকে। প্রত্যয় শব্দ করে দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করতেই সিরাত ধড়ফড়িয়ে ওঠলো। কখন যে চোখ লেগে এসেছিলো বুঝেনি! প্রত্যয়কে শব্দ করে কাজ করতে দেখে ভস্ম করা দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলল, ‘আওয়াজ করছেন কেন? দেখছেন না বাচ্চাটা ঘুমিয়েছে?’
প্রত্যয় ভাবলেশহীন গলায় আলমারি বন্ধ করতে
করতে বলল, ‘তাতে আমার কি?’
‘অসহ্যকর!’
বিরক্তিকর শব্দ করে আবারও ঘুমিয়ে পড়লো সিরাত। প্রত্যয় ল্যাপটপ নিয়ে বসলো। মাঝেমধ্যে আড়চোখে সিরাতকে লক্ষ্য করলো। সোহাকে বুকে আগলে
ঘুমিয়ে আছে। লম্বা চুলগুলো মেঝেতে লুটোপুটি খাচ্ছে। দৃশ্যটা সুন্দর! প্রত্যয় সোজা হয়ে বসে অনেকক্ষণ মনোযোগ দিয়ে দেখলো। কেমন বাবা
বাবা একটা অনুভূতি হচ্ছে ওর। সোহার মায়াভরা মুখটায় তাকিয়ে দেখলো অনেকক্ষণ।
মা সন্তানকে আগলে ঘুমিয়ে আছে এর থেকে সুন্দর দৃশ্য পৃথিবীতে বোধহয় কমই আছে। প্রত্যয় মনে মনে বলল, ‘সুন্দর!’

বড়লোক বাবা-মায়ের ছেলে প্রত্যয় চৌধুরী। ভার্সিটিতে টপ স্টুডেন্টদের মধ্যে একজন। সুদর্শন চেহারা, পড়াশোনাসহ অন্যান্য কার্যক্রম সব কিছুতে অন্য সবার চেয়ে ছিলো এগিয়ে। সেই সাথে অনেকের স্বপ্নপুরুষও ছিলো। কিন্তু এসবের প্রতি ওর আগ্রহ ছিলো নিতান্তই কম। পড়াশোনা শেষে হঠাৎ করেই একসময় জড়িয়ে পড়ে রাজনীতিতে। আচরণেও আসে পরিবর্তন।
ভার্সিটিতে কেউ যদি উল্টাপাল্টা কিছু করে তাহলে
তার আর রক্ষে নেই। অমানবিক, নিষ্ঠুর শাস্তি দেয় সবাইকে ওর দলের সদস্যরা। ওদের আচরণে সকলেই একসময় ভয়ে অতিষ্ঠ, তটস্থ হয়ে পড়ে। কেউ খোলাখুলি প্রেম করুক, সিগারেট খাক তো বা কিছু করুক, সেদিন বুঝি আর তার রক্ষে নেই। ভার্সিটি কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানালেও তারা এ বিষয়টাতে তেমন মাথা ঘামায় না। বরংচ এসব আরো বেড়ে যায়। ক্ষমতার জোরে দেখিয়ে এসব অন্যায় চালাতে থাকে সে। কিন্তু একদিন দুজন শিক্ষার্থীর রুম ডেইটে হাতেনাতে ধরে প্রত্যয়ের চেলারা ভীষণ অপমান করে তাদের। এর মধ্যে মেয়েটি এসব নিতে না পেরে সুইসাইড করে। এরপর আরো একজন! তবুও এমন র‍্যাগিং বা শাস্তি থামেনি! এদিকে সিরাত সবসময়ই
শান্ত প্রকৃতির মেয়ে ছিলো। পড়াশোনায়ও ভালো। প্রত্যয়ের এসব কর্মকান্ড ফার্স্ট ইয়ার থেকে দেখে আসছিলো সে। রাগ হলেও মাথা ঘামায়নি বা সাহস হতো না ওর। কিন্তু পরপর দুজন সুই’সাইড করার পর ওর ভীষণ খারাপ লাগে। দুঃখ হয়।
কিন্তু একদিন ওর চোখের সামনে একজনকে
বেরধড়ক পিটিয়ে রক্তা’ক্ত করে প্রত্যয়ের চেলারা। সেদিন আর চুপ থাকতে পারেনি। প্রতিবাদ করেছিলো। সেখান থেকেই ঝামেলার শুরু ওদের। বন্ধুদের
সাহায্য নিয়ে রক্তা’ক্ত ছাত্রটাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলো। প্রত্যয় এসব শুনে রেগে জিজ্ঞেস করেছিলো মাহিনকে, ‘কে ও? খোঁজ নে!’
মাহিন খোঁজ নিয়ে বলল, ‘থার্ড ইয়ারে পরে
ভাইজান। ডাইকা আনমু নাকি? কন খালি একবার।’
‘আন!’
প্রত্যয়ের আদেশে সিরাতকে ডাকা হলো। হুমকি-ধমকি, ভয়ভীতি দেখানো হলো। কিন্তু কোনোটাতেই কাজ হলো না। উলটো প্রতিবাদ জানালো। প্রত্যয় সেদিন ক্রোধে জর্জরিত হয়ে ফেটে পড়ছিলো। এরপর থেকে ওর এসব কাজে সিরাত ও তার বন্ধুরা বাঁধা দিতে লাগলো। ছাত্রছাত্রীদের মনও খানিকটা পেলো। এমনকি মানববন্ধন পর্যন্ত করলো, সিরাত দিলো নেতৃত্ব! এ কারণে প্রত্যয়ের প্রতিপক্ষও ওর নামে বদনাম, কুৎসা রটানো শুরু করলো। সবাইকে উস্কে দিতে লাগলো। ব্যাপারটা একপর্যায়ে হাতাহাতির পর্যায়েও চলে গিয়েছিলো। দুই পক্ষের সংঘর্ষে
ভার্সিটির পরিবেশ হয়ে ওঠলো উত্তপ্ত। সেদিনই প্রত্যয় মনে মনে সিরাতকে উচিৎ শিক্ষা দেবে বলে ঠিক করেছিলো। পায়ের তলায় জুতো বানিয়ে রাখবে ভেবেছিলো! কিন্তু পায়ের তলায় জুতোর বদলে
এখন সবটাই ঘেটে কেমন ‘ঘ’ হয়ে যাচ্ছে!
এসব ভেবে প্রত্যয় দীর্ঘশ্বাস ফেললো। দমকা ঠান্ডা বাতাস ঠেলে ঘরে ঢুকছে। সোহার ঠান্ডা লাগতে পারে চিন্তা করে প্রত্যয় ওঠে ব্লাঙ্কেট এনে জড়িয়ে দিলো সোহা, সিরাতকে। সবটা মানবিকতার খাতিরে ভেবে নিলো সে!

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]

#চলবে….