Wednesday, July 2, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 319



গোলকধাঁধা পর্ব-০৪

0

#গোলকধাঁধা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৪

প্রত্যয় ওকে একপলক লক্ষ্য করে শয়’তানি হাসি
দিয়ে বলল, ‘শাড়িতে তো ভালোই মানায়।’
সিরাত ভস্ম করা দৃষ্টি উপহার দিয়ে বলল, ‘নজর খারাপ তা তো জানতাম না।’
‘আস্তে-ধীরে সবই জানবে। এখন মনোযোগ দিয়ে পা টেপো।’
সিরাতের ইচ্ছে করলো পা দুটো ভেঙ্গে দিতে। বহু
কষ্টে নিজের ইচ্ছেকে সংবরণ করলো সে।

সকালে নাস্তার টেবিলে আমির চৌধুরী সিরাতকে অনেক কিছুই বুঝালেন। বিয়ে যেহেতু হয়েই গেছে সেহেতু সংসারে মনোনিবেশ করা উচিৎ ওর। মন দিয়ে সংসার করতে। কোনো অসুবিধা বা সমস্যা হলে তাকে জানাতে। মানুষটাকে প্রথমে অহংকারী মনে হলেও সিরাত বুঝলো খানিকটা মনুষ্যত্ব আছে৷ এদিকে মুশফিকা চৌধুরী বরাবরের মতোই মুখ ফুলিয়ে বসে রইলেন। সিরাত সেটা কেয়ার না করে আমির সাহেবের উদ্দেশ্যে বলল, ‘আমি একটা কথা বলতে চাই আংকেল।’
‘বলো।’
‘আসলে একটু বাড়ি যেতে চাচ্ছিলাম। বাবা-মা
আমাকে দেখতে চাইছেন। তাছাড়া মেয়ের শরীরটাও ভালো না, ওকে একটু দেখতে ইচ্ছে করছিলো।’
আমির সাহেব চা খাচ্ছিলেন। আচমকা এমন একটা কথা শুনে চমকে ওঠলেন। ফলে গায়ে খানিকটা চা ছলকে পড়লো। ছেলে মিডেল ক্লাস মেয়ে বিয়ে করতে চেয়েছে, তাতে তিনি আপত্তি করেন নি। কিন্তু মেয়ে যে বিবাহিত এবং তার বাচ্চাও আছে সেই খবর তো তিনি পান নি৷ এই অধপতন তো তিনি কিছুতেই মেনে নেবেন না। গরম চোখে একবার প্রত্যয়ের দিকে তারপর
আবার সিরাতের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে
জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার মেয়ে? মানে কি? তুমি
কি বিবাহিত ছিলে নাকি?’
সিরাত বুঝলো এভাবে বলাটা উচিৎ হয়নি। খানিকটা ইতস্তত করে বলল, ‘ও আসলে আমার বড় আপার
মেয়ে। আপার মৃত্যুর পর ওকে আমি আর মা মিলেই বড় করছি। আমাকেই মা বলে জানে ও!’
আমির সাহেব শীতল চোখে তাকালেন, ‘ওর বাবা কোথায়?’
সিরাত অকপটে বলল, ‘ওনি দ্বিতীয় বিয়ে করে
সংসার করছেন। আমরাই সোহাকে সেখানে পাঠাইনি।’
‘বয়স কত?’
‘দেড় বছর।’
আমির সাহেব দুঃখ পেলেন। তিনিও জন্মের সময় মা হারা হয়েছিলেন। যদিও বাবার টাকাপয়সার অভাব ছিলো না তবুও মায়ের আদর ছাড়া বড় হতে অনেক কষ্টই হয়েছে তার। বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠলো ক্ষণিকের জন্য। ক্ষীণ স্বরে বললেন, ‘যেও।
মাঝেমধ্যে নিয়ে এসো বাচ্চাটাকে।’
সিরাত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। মুশফিকা চৌধুরী বিরক্ত হয়ে স্বামীর দিকে তাকাতেই তিনি চোখ রাঙালেন। অগত্যা তার আর কিছুই বলার রইলো না। প্রত্যয় এতক্ষণ বসে বাবার কান্ড দেখছিলো।
আলাপের শেষপর্যায়ে ফুঁসে ওঠে দাঁড়ালো, ‘কোথাও যাওয়া চলবে না।’
‘তুমি বেয়াদবি করো না প্রত্যয়। আর এখানে
সমস্যাটা কোথায়?’
প্রত্যয় রেগে বলল, ‘তুমি ওকে চেনো না বাবা। ও অতি ধুরন্ধর মেয়ে। আবারও কিছু মতলব আঁটছে নিশ্চয়ই!’
আমির সাহেব পুত্রের উদ্দেশ্য বললেন, ‘এখানে রাগারাগির প্রয়োজন দেখছি না। শান্ত হও।’
প্রত্যয় সিরাতের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাবা তোমাকে অনুমতি দিলেও আমি দেবো না। দেখি স্বামীর অনুমতি ছাড়া তুমি কীভাবে যাও।’
বলে গটগটিয়ে হেঁটে চলে গেলো। সিরাত হুমকি শুনে থমকে রইলো। মেজাজ খারাপ হলো প্রচুর। আমির সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ছেলেটাকে বেশি আদরে বাঁদর বানালাম। বাপের কথা শুনতেই চায় না।’
সিরাত শুনলো তা। এ লোকটাকে হাড়েমজ্জায় চেনা হয়েছে ওর। কত খারাপ তা ওর চেয়ে ভালো আর কে জানে? প্রত্যাশা মিটিমিটি করে হেসে বিড়বিড় করে সিরাতকে বলল, ‘আব্বু ই ভাইয়াকে মাথায় ওঠিয়েছে। এখন আব্বুর কথাই শোনে না। আর মা তো কখনো শাসনই করেনি। সবসময় আহ্লাদ দিয়ে মুড়িয়ে রেখেছে। এ কারণেই ভাইয়ার আজ এ অবস্থা। বুঝলে?’
বলে নিজের নাস্তাটুকু শেষ করে কলেজের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো প্রত্যাশা। সিরাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে
তাকিয়ে রইলো ওর যাওয়ার পানে। কি যে করবে
ও কিছুই বুঝতে পারছে না।

ঘরে এসে দেখলো প্রত্যয় ভার্সিটিতে যাওয়ার
উদ্দেশ্যে তৈরি হচ্ছে। সিরাতকে দেখে শক্ত গলায় বলল, ‘তোমার সবকিছুর অনুমতি আমার থেকে নেবে, বাবার থেকে নয়।’
‘নিজের ফ্যামিলিকে কেয়ার করেন না। বাবা-মা’কেও আপনি সম্মান করেন না? আপনি তো খারাপের চূড়ান্ত লেভেলে পৌঁছে গেছেন।’
সিরাতের কথা শুনে প্রত্যয় এসে ওর গাল চেপে ধরে
বলল, ‘আমার ফ্যামিলির জন্য কি করবো না করবো, কার কথা শুনে চলবো এসবে মাথা নষ্ট না করলেই ভালো। আর কে বলেছে আমি সম্মান করি না? আমি ওদের জন্য সব করতে পারি।’
সিরাত গালে ব্যথা পাচ্ছে। প্রত্যয় ওকে ছেড়ে
দিতেই ও তাচ্ছিল্যভরে হাসলো, ‘নিচে তার নমুনা দেখতেই পেলাম।’
প্রত্যয় ভাষাহীন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বলল, ‘ভার্সিটি যেতে চাইলে তৈরি হও। পাঁচ মিনিট টাইম দিলাম। আমি গাড়িতে ওয়েট
করছি।’
সিরাত বলল, ‘আমি আপনার গাড়িতে করে যাবো না।’
প্রত্যয় তাতে পাত্তা না দিয়ে হাতঘড়ি চেক করে
বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘মাইন্ড ইট, অনলি ফাইভ মিনিটস।’

অগত্যা তড়িঘড়ি করে তৈরি হলো সিরাত। লাইট পিংক কালারের সালোয়ার-কামিজ পরে, কোনোমতে চুলটা আঁচড়ে প্রত্যয়ের সাথেই ভার্সিটিতে যেতে বাধ্য হলো সিরাত! মন ভীষণ খারাপ হলো ওর। বন্ধুবান্ধবরাও ওকে দেখে অবাক। তিনদিন যাবৎ ওকে কল, টেক্সট করে পাওয়া যাচ্ছিলো না। তাই ক্লাসে ঢুকতেই সবাই ওকে দেখে হুড়মুড়িয়ে এগিয়ে এলো। নানান প্রশ্নে জর্জরিত করলো। সিরাত একটু সময় নিয়ে মনমরা
হয়ে সবকিছু খুলে বলতেই নিশা অবাক হয়ে বলল, ‘তার মানে প্রত্যয় চৌধুরী এখন তোর বর? আর আমাদের দুলাভাই?’
পাশ থেকে অনল ওর মাথায় গাট্টা মেরে বলল, ‘তা নয়তো কি গাধী? আমাদের সিরাতের বড় শত্রুই এখন ওর বর। কি যে হলো এটা!’
রাহী গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘খুব খারাপ হলো। সিরাত যে কিভাবে সহ্য করবে লোকটাকে! আমার তো ভাবতেই কেমন লাগছে। নিশ্চয়ই ওকে একফোঁটা শান্তিও দেয়নি।’
বন্ধুদের কথা শুনে সিরাত কেঁদে ফেললো। সবাই ওকে সান্ত্বনা দিলো। অনল চিন্তিত হয়ে বলল, ‘ডিভোর্স নিয়ে নে সিরাত।’
সিরাত ব্যহত গলায় বলল, ‘তুই চিনিস না লোকটাকে? নিজে থেকে ছাড়তে না চাইলে কোনোভাবেই সম্ভব না।’
রাহী অনলকে ধমকে ওঠলো, ‘ডিভোর্স যদি দিতেই হতো, তাহলে বিয়ে করতো না রে। ওকে শাস্তি দেবে বলেই বিয়ে করেছে।’
নিশা বলল, ‘কেন যে ওনার বিরুদ্ধে মানববন্ধনটা করতে গেলাম আমরা!’
সিরাত চোখ রাঙালো, ‘এখানে তো আমাদের কোনো ভুল নেই। লোকটার চেলা প্যালা কতটা ক্ষমতা দেখায় জানিস না? ওদের জন্য কেউ ভার্সিটিতে শান্তি পায় কিছু করতে?’
রাহী চিন্তিত হয়ে বলল, ‘তা তো ঠিক। কিন্তু তুই
কীভাবে থাকবি ওনার সাথে?’
সিরাত চোখমুখ মুছে বলল, ‘চিন্তা করিস না। বিয়েই তো করেছে, মেরে তো ফেলেনি। যতক্ষণ প্রাণ আছে ততক্ষণ ওনার অন্যায়গুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে যাবো।’
সবাই ওর কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ক্লাসগুলো মনোযোগ দিয়ে করার চেষ্টা করলো সিরাত। নোটস কালেক্ট করে নিলো। এমন সময় হৈ হৈ রব শুনে করিডোরে গিয়ে দেখলো সবাই বলাবলি করছে
ফার্স্ট ইয়ারের একটা ছেলেকে প্রত্যয় চৌধুরীর চেলা মাহিন ডেকে নিয়ে গেছে। শুনেই সিরাত ছুটে গেলো ভার্সিটি ক্যান্টিনে। পেছন পেছন অনল, নিশা আর রাহীও ছুটে গেলো। ওরা গিয়ে দেখলো পুরো ক্যান্টিন খালি। কেউ নেই৷ এদিকওদিক খোঁজ নিয়ে
একপর্যায়ে লেকের পাড়ে এসে দেখলো সেখানেই ছেলেটাকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। ছেলেটা অনুনয় করে বলছে আর কখনোই সে সিগারেট খাবে না। কিন্তু প্রত্যয়ের চেলারা তা শুনছে না৷ হাতে-পায়ে আঘাত করছে ডাল দিয়ে। প্রত্যয় সামনে বসে তা দেখছে। ছেলেটার আর্তনাদ সহ্য করতে না পেরে সিরাত
গিয়ে ওর সামনে দাঁড়াতেই মাহিন থেমে গেলো।
সিরাত কটমট করে বলল, ‘আর একবারও আঘাত করবে না, ভালো হবে না।’
ইতোমধ্যে প্রত্যয়ের সাঙ্গপাঙ্গরা জেনে গেছে সিরাত ওদের ভাবী। সেজন্য মাহিন প্রত্যয়ের দিকে তাকিয়ে জোরে বলল, ‘ভাবী মারতে মানা করে ভাই। কি করুম?’
প্রত্যয় শ্লেষাত্মক হেসে সিরাতকে বলল, ‘আমাকে
ছেড়ে থাকতেই পারো না দেখছি! ক্যান্টিন থেকে এখানে এলাম। অথচ আমার গন্ধ ঠিকই খুঁজে পেয়ে গেলে।’
সিরাত রেগে বলল, ‘বাজে বকা বন্ধ করুন। ওকে
যেতে দিন। বলেছে তো আর কখনো ধূমপান করবে না।’
‘তুমি নিজের কাজে যাও। অন্যের জন্য মাথা না
ঘামিয়ে নিজের কাজ করো।’
‘আগে আপনি ওকে যেতে দিন।’
সিরাত ভালোভাবেই বললো। প্রত্যয় রেগে গেল,
‘ওর শাস্তি মাত্র শুরু, এখনো শেষ হয়নি।’
সিরাত জানে ছেলেটাকে এমনি এমনি ছাড়বে না প্রত্যয়। ভীষণ জেদী সে। আর সিরাত ব্যাপারটাতে ইন্টারফেয়ার করায় আরও ক্ষেপে গেছে ও! প্রত্যয় ছেলেটাকে লেকের পানিতে ততক্ষণ পর্যন্ত ডুব দেওয়ার আদেশ দিলো যতক্ষণ না ওকে থামতে বলবে! তাহলেই শাস্তি মওকুফ করা হবে। অনল, নিশি, রাহী হতভম্ব হয়ে আৎকে ওঠলো। প্রত্যয়ের চেলারা মজা নিলো। সিরাত কঠোর গলায় বলল, ‘পাগল হয়েছেন? এসব কি বলছেন আপনি? এটা ভার্সিটি, কোনো বিনোদন
কেন্দ্র বা আপনার গড়া প্রতিষ্ঠান না যে শিক্ষার্থীরা আপনার কথায় পুতুলের মতো নাচবে।’
প্রত্যয় ভীষণ বিরক্ত হলো। রাগে চোখ জ্বলতে লাগলো ধিকধিক। ইচ্ছে করছে এক থাপ্পড়ে সেদিনের মতো অজ্ঞান করে দিতে। এতকিছু করলো সিরাতকে ভয় দেখানোর জন্য, বিয়ে পর্যন্ত! এরপরও মেয়েটা দাপট দেখিয়ে যাচ্ছে। একটুও ভয় পাচ্ছে না। ভাবতেই রাগে আগুন জ্বলতে লাগলো বুকে। মুহূর্তেই কুটিল বুদ্ধি খেলে গেলো মাথায়। মুচকি হেসে শান্ত স্বরে
বলল, ‘এক শর্তে ছাড়বো একে।’
ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেটা ভয়ে কাঁপছে তখন। সিরাতের বেশ মায়া লাগলো। দৃঢ় স্বরে বলল, ‘কি শর্ত?’
‘ওর বদলে তোমাকে টাস্ক পূরণ করতে হবে। এতই যখন দরদ হচ্ছে তোমার। মমতার মাতা যে! তাহলেই ওর মুক্তি।’
প্রত্যয়ের কথা শুনে অনল, নিশা, রাহী প্রতিবাদ করলো। প্রত্যয় একটি বাক্যও ব্যয় করলো না। সিরাতও অনুনয় করলো না। মেনে নিলো ওর শর্ত। ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেটা অবাক হয়ে সিরাতের কাছে এসে বলল, ‘থ্যাংকস আপু। কিন্তু আমার জন্য
অহেতুক কষ্ট করবেন না। না হয় শাস্তি ভোগ করবো।’
সিরাত মলিন হেসে বলল, ‘তুমি নিজেকে একদম দোষ দেবে না। শর্তটা আমিই পূরণ করবো। তুমি এই কাজ করবে না। তাহলে আমি হেরে যাবো। আমি কিছুতেই ওনার কাছে হারতে চাই না।’
এরপরও ছেলেটা মানতে নারাজ। সিরাতও নিজ সিদ্ধান্তে অটল দেখে সে বাক্যহীন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালেও ভীষণ খারাপ লাগলো ওর। সামান্য সিগারেট খেলে যে এতকিছু হয়ে যাবে জানলে সে কখনোই এ কাজ করতো না। মনে মনে তওবা করলো। এ জীবনে কোনোদিন সিগারেট খাবে না সে। মাহিন প্রত্যয়ের কাছে এসে বলল, ‘শত হইলেও ভাবী লাগে অহন আমাদের। এইটা কি ঠিক?’
প্রত্যয় চোখ রাঙালো, ‘এত দরদ?’
‘না মানে…!’
‘সর সামনে থেকে।’
প্রত্যয়ের ধমক খেয়ে সরে এলো মাহিন। নিজের জিনিসপত্র সব রাহীর কাছে রেখে লেকের সিঁড়ি বেয়ে হাঁটু জল অবধি নামতেই ভয় লাগলো সিরাতের। এত বড় লেক, সাঁতারেও পারদর্শী না তেমন। ভেবেছিলো যতই হোক, বউ বলে খানিকটা মায়া দেখাবে প্রত্যয়, কিন্তু না। পশুটা নিজের সিদ্ধান্তেই অটল। সিরাতেরও জেদ হলো ভীষণ। প্রত্যয় হাতের ইশারা করতেই সূরা পড়তে পড়তে ডুব দিলো সিরাত। এক, দুই, তিন থামলো না। সিরাত দাঁতে দাঁত চেপে
একের পর এক ডুব দিতেই থাকলো। কানে নিলো না প্রত্যয়ের ডাক, রাহী-ইশার চেঁচামেচি। এদিকে চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে প্রত্যয়ের। আশেপাশের সব সাঙ্গপাঙ্গদের বিকট ধমকে বিদায় করলো সে। তারা নতমুখে, লজ্জায় প্রস্থান করলো। ফার্স্ট
ইয়ারের ছেলেটাকেও ওয়ার্নিং দিয়ে ছেড়ে দিলো। এরপর নিজেই লেকের পানিতে নেমে জোর করে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে এলো সিরাতকে। ওর কিল-ঘুষি গ্রাহ্যই করলো না প্রত্যয়। চিবিয়ে চিবিয়ে
বলল, ‘শরীর প্রদর্শন করতে ভালোই মজা
লাগে তাইনা?’
সিরাত কেঁদে বলল, ‘বউকে সকলের সামনে অসম্মান করতে বুক কাঁপেনি আপনার? অমানুষ, নির্দয়, জানো’য়ার!’

প্রত্যয় ধমকে ওঠলো। গাড়ি করে বাড়ি ফিরলো সিরাতকে নিয়ে। ও পুরো রাস্তা ভেজা জামাকাপড় নিয়েই বসে রইলো চুপটি করে। বাড়ি ফিরে সিরাত অবাক হয়ে দেখলো ওর বাবা-মা এসেছে। ও খুশিতে দৌড়ে গিয়ে সোহাকে কোলে নিয়ে চোখেমুখে চুমু খেলো। সোহাও আধো আধো স্বরে ওকে মাম্মা বলে ডেকে ওঠলো। মুশফিকা চৌধুরী ওকে ভেজা অবস্থায় দেখে অবাক হয়ে বললেন, ‘তোমার এ অবস্থা কেন?’
সবাই-ই প্রশ্নের উত্তর জানতে ওর দিকে তাকালো।
‘আপনার ছেলে আমাকে শাস্তি দিয়েছে।’
বলেই সোহাকে মায়ের কোলে দিয়ে সিরাত রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে নিলো। ওয়াশরুম থেকে বেরুতেই প্রত্যয় কটমট করে বলল, ‘আমার নামে নালিশ করলে
কেন? শাস্তি তো তুমি মাথা পেতে নিয়েছো।’
সিরাত বলল, ‘আমি তো নালিশ দিইনি, সত্যটাই বলেছি।’

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]
চলবে…

গোলকধাঁধা পর্ব-০৩

0

#গোলকধাঁধা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩

বলে সিরাতকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। এরপর বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। এদিকে সত্যিই পুরো রাতটা নির্ঘুম কাটলো সিরাতের। তবে ভোরের দিকে ক্লান্ত চোখদুটো কিছুতেই খোলা রাখা গেলো না।

এলার্মের জোরালো শব্দ। প্রতিদিনের মতো আজও ঘুম ভাঙলো প্রত্যয়ের। ঘুমন্ত অবস্থায়ই হাত বাড়িয়ে এলার্ম বন্ধ করে ওঠলো ও। আড়মোড়া ভেঙে এদিকওদিক চাইতেই চমকে ওঠলো সে৷ মেঝেতে বসে বিছানায় হাতের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে সিরাত। প্রত্যয় নিজের হতচকিত ভাব কাটিয়ে দেখলো ওকে। ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠলো হাসি। ভেতরে ভেতরে প্রচুর শান্তি পাচ্ছে ও। মুডটাই ভালো হয়ে গেলো সকাল সকাল। সিরাতকে এরকম অসহায় অবস্থায় দেখে ওর এতদিনের রাগ-ক্রোধেরা যেন একটু হলেও শান্তি পাচ্ছে। ইস! কতদিন সে অপেক্ষা করেছে ভালোমানুষির মমতাময়ী মাতা সিরাত আঞ্জুমকে এভাবে দেখার! চোখের শান্তি! হাই
সাউন্ডে মিউজিক ছেড়ে লাগোয়া ব্যলকনিতে
ব্যায়াম করতে গেলো সে। এত জোরে মিউজিক শুনে সিরাত লাফ দিয়ে ওঠে বসে চোখ খুললো। মাথার ভেতর সব ঘোলাটে হয়ে আছে৷ গতদিনের সব
ঘটনা মনে পড়তেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো ও। নিজের দিকে তাকিয়ে অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। নিজের শত্রুর সাথে একঘরে রাত কাটিয়েছে সে। জামাকাপড় ঠিক করে ওঠে দাঁড়াতেই বারান্দা থেকে প্রত্যয়ের
গলা শোনা গেলো,
‘ভালোমানুষির দেবীর ঘুম
ভেঙেছে তাহলে?’

সিরাত শুনেও উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলো। কি বলবে বা করবে ভেবে ওঠতে পারলো না। প্রত্যয় গলায় তোয়ালে ঝুলিয়ে ঘরে ঢুকে মিউজিক অফ
করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। বুকের ওপর আড়াআড়ি হাত ভাঁজ করে রেখে ভ্রু উঁচিয়ে বলল, ‘কথা বলার ইচ্ছে নেই জানি। তবে আমার কথা না শোনে কিছু করতেও পারবে না। মমতার মাতার এ কি হাল!’
‘চুপ করুন, স্ক্রাউন্ডেল কোথাকার।’
সিরাত রাগে চেঁচিয়ে ওঠলো৷ চোখের কোণে বোধহয় জলও জমেছে৷ প্রত্যয় কথা না বাড়িয়ে বলল,
‘ওদিকে ওয়াশরুম। আর আমি প্রত্যাশাকে পাঠাচ্ছি ওকে বলতে পারো কিছু প্রয়োজন হলে।’
সিরাত তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল, ‘আমি বাড়ি ফিরতে চাই।’
প্রত্যয় চোখমুখ শক্ত করে বলল, ‘বাড়িতে বসে আরাম করার জন্য তো তোমায় বিয়ে করিনি। তোমার আরাম হারাম করার জন্যই তো এতসব আয়োজন।’
‘ঘৃণা করি আপনার মতো কাপুরুষকে।’
প্রত্যয়ের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘তাতে আমার কিছু যায় আসে না। বাট তুমি এ বাড়িতেই থাকবে, আমার চোখের সামনে। কোথাও যাওয়া চলবে না।’
সিরাত চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘আপনি কি বুঝতে পারছেন না আপনার এসব প্রতিশোধের নেশায় অহেতুক আমার বাবা-মা’কে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করছেন? এতটা পশু কীভাবে হতে পারেন?’

প্রত্যয় ওর কথায় তেমন গা করলো না। বরংচ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে পকেট থেকে ফোন বের করে ডায়াল করলো কোনো নাম্বারে। ওপাশ থেকে সাড়া পেয়ে হাসিমুখ করার চেষ্টা করে কুশল বিনিময় করে কিছুক্ষণ কথা বললো। সিরাত অমন নরম স্বরে কথা বলা
প্রত্যয়কে দেখে মনে মনে গালি দিলো। ব্যাপারটা হয়তো ধরতে পারলো ও। সেজন্যই ফোন লাউড স্পিকারে দিয়ে বলল, ‘আঙ্কেল সিরাত ভয় পাচ্ছে আপনাদের সাথে কন্ট্রাক্ট করতে। বলুন তো আমি কি করবো?’
ওপাশ থেকে সিরাতের বাবা শিমুল সাহেবের গলা শোনা গেলো। ওনি বিনয়ী গলায় বললেন, ‘ভয়ের কিছু নেই। ওকে বলে দাও আমরা রাগারাগি করবো না একদম।’

কাহিনী দেখে সিরাত থ! এতক্ষণ ওর বাবার সাথে কথা বলছিলো এই গুন্ডা? আর এতোটা ব্রেইন ওয়াশ করলো ওর বাবার? যে এত ভালোভাবে কথা বলছে? তার মানে কাল বাবা-ই ভিডিও কলে সোহাকে দেখিয়েছিলো? সিরাত জ্বলন্ত চোখে তাকাতেই
প্র‍ত্যয় ওর দিকে ফোন এগিয়ে দিলো। দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় ও ফোন কানে ঠেকাতেই প্রত্যয় বাঁকা হেসে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। সিরাত ফোন কানে ধরে খানিকটা নত সুরে বলল, ‘বাবা আমি আসলে…’

শিমুল সাহেব রুক্ষ স্বরে বললেন, ‘তুই আমাকে আগে বলবি না? বললে কি আমরা বাঁধা দিতাম? তোর পছন্দই সব আমাদের কাছে। পালিয়ে না গেলেও পারতি! যাইহোক, ছেলেটা ভালো। কতশত নাম
শুনেছি ওর। ভালো পরিবারের ছেলে। বিয়ের আগে এসে আমাকে এমনভাবে ধরলো যে মত দিতে বাধ্য হয়েছি।’
সিরাত হতাশ নিঃশ্বাস ফেললো। ভালোই বোকা বানিয়েছে ওর বাবাকে। ও ছোট্ট করে বলল, ‘স্যরি।’
শিমুল সাহেব বললেন,
‘একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। তোকে আর বিয়ের জন্য জোরাজোরি কর‍তে হবে না। কত প্রস্তাব ফিরিয়েছিস তুই!’
সিরাত এড়িয়ে গিয়ে বলল, ‘তোমরা ঠিক আছো? মা, নীরু কোথায়? সোহা ভালো আছে তো?’
‘আমাদের কি হবে? ভালোই আছি। তোর মা মুখভার করে আছে একটু, চিন্তা করিস না আমি বুঝিয়ে বলবো। নীরু স্কুলে। সোহা ভালো আছে, একদম
চিন্তা করবি না ওর জন্য। এবার একটু নিজের সংসারে মন দে! খানদানি পরিবার একটু মানিয়ে-গুছিয়ে চলবি মা।’
সিরাতের গলা ভার হয়ে এলো। কোনোমতে বলল, ‘সোহার খেয়াল রেখো, মেয়েটার গায়ে জ্বর আছে কিন্তু।’
‘চিন্তা করিস না মা। ডাক্তার দেখে গেছে ওকে। জামাই বাবাজিই তো সব ব্যবস্থা করে দিলো। বড় ভালো ছেলে। তুই যে কেন পালাতে গেলি!’
শিমুল সাহেবের কথা শুনে সিরাতের চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। নাটকবাজ প্রত্যয় এত সম্মান পাওয়ার যোগ্য নয় এটা সিরাতের থেকে ভালো কে জানে? সবই আই ওয়াশ। ও জিজ্ঞেস করল, ‘মাকে দাও একটু কথা বলি?’
‘রান্না বসিয়েছে। পরে কথা বলিয়ে দেবো। এখন তবে রাখি।’
সিরাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আচ্ছা।’

ফোন রাখতেই চশমা পরিহিত প্রত্যাশা এলো। দেখতে সুন্দর মেয়েটির আচরণ মিশুক প্রকৃতির। কাল দেখেই বুঝেছিলো সিরাত; প্রত্যয়ের মতো নয় তার এ বোনটি! সিরাতকে ভীষণ সমীহ করেছে। এ বাড়িতে একমাত্র ওকেই ভালো কেউ বলে বিবেচনা করেছে ওর মস্তিষ্ক। প্রত্যাশা চোখের চশমা ঠিক করে আলতো হেসে বলল, ‘তোমাকে ভাবী বলে ডাকি? যেভবেই হোক না কেন, ভাবী তো সম্পর্কে?’
সিরাতের রাগ হলেও মলিন হেসে বলল, ‘তোমার ইচ্ছে।’
‘আমি সবসময় তোমার মতো মিষ্টি কাউকেই ভাবী হিসেবে কল্পনা করেছি। ভাইয়ার কাজে আমি লজ্জিত তবুও বলছি, তোমাকে আমার দারুণ পছন্দ হয়েছে।’
সিরাত হাসলো। তাতে যেন কোনো প্রাণ নেই। প্রত্যাশা ওর মনোভাব বুঝে কাল মায়ের রেখে যাওয়া শাড়ি, জামাকাপড়ের প্যাকেট হতে মিষ্টি রঙের একটা শাড়ি বের করে বলল,
‘আজ শাড়িই পরো। নতুন বউ যেহেতু। মেহমান আছে কিছু।’
সিরাত মানা করলো না। প্রত্যাশা নিজে থেকেই বলল,
‘মায়ের কাজগুলো আমি করছি! আসলে মা চেয়েছিলো তার বোনের মেয়ে লিয়ানা আপুর সাথে ভাইয়ার বিয়ে দিতে। সেজন্যই এরকম করছে। মায়ের পক্ষ থেকে আমি দুঃখিত।’
‘ইট’স ওকে।’
‘ফ্রেশ হয়ে আসো। আট’টা বাজতে চললো। নাস্তা করতে হবে, কাল তো কিছুই মুখে তুললে না৷ অবশ্য সেরকম পরিস্থিতিই ছিলো না।’

সিরাত কথা না বাড়িয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। নতুন জায়গা, নতুন বাড়ি, নতুন সম্পর্ক। অথচ নিজের অপারগতার জন্য প্রত্যয়ের বন্দিনী মনে হচ্ছে নিজেকে। আভিজাত্যপূর্ণ এ বাড়িতে থাকতে ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে। বেশিক্ষণ সময় নিলো না ফ্রেশ হতে। শাড়িটা কোনোরকমে পরে রুমে ঢুকে দেখলো প্রত্যাশা তখনো ওর জন্য অপেক্ষা করছে। ওকে দেখে কাছে এসে শাড়ির বেহাল দশা দেখে বলল, ‘শাড়ি পর‍তে জানো না বুঝি?’
‘জানি, তবে আনাড়ি এখনো। মা সাহায্য করতো সবসময়।’
প্রত্যাশা হেসে কুচি ঠিক করে দিতে দিতে বলল,
‘আমি কিন্তু ভালোই পারি।’
‘কীসে পড়ো তুমি?’
‘এইচএসসি দেবো।’
‘তুমি বেশ ভালো, প্রত্যয় চৌধুরীর মতো খারাপ নও।’
প্রত্যাশা ঠোঁটে আলতো হাসি ঝুলিয়ে বলল,
‘কি জানি!’

বলে সেফটিফিন খুলে ভালো করে শাড়ি ঠিক করতে নিলো। কয়েক সেকেন্ড পর দরজার বাইরে থেকে পায়ের শব্দ পাওয়া গেলো। সিরাত আতংকিত চোখে তাকালো। প্র‍ত্যাশা চিল্লিয়ে বলল, ‘এসো না ভাইয়া।’
প্রত্যয় দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বোনের চিৎকার শুনে হতভম্ব হয়ে বলল, ‘আমার ঘরে আমি আসতে পারবো না? বেশি সাহস? এখন পারমিশন নিতে হবে তোর কাছ থেকে?’
‘ভাবীকে শাড়ি পরাচ্ছি ভাইয়া। প্লিজ যাও।’
প্রত্যয় ধমকে ওঠলো, ‘কে ভাবী?’
‘সিরাত আঞ্জুম।’

বোনের কথা শুনে প্রত্যয় থমকালো। এরপর বিরক্তি নিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেলো সেখান থেকে।

নাস্তার টেবিলে মুশফিকা চৌধুরী খাবার সাজাচ্ছেন। আমির সাহেব বসে পত্রিকা পড়ছেন। প্রত্যাশা সিরাতকে নিয়ে আসতেই তিনি পত্রিকা থেকে চোখ সরিয়ে দেখলেন ওকে। এরপর আবারও পড়ায় মন দিলেন। সিরাত ইতস্তত করে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম।’
আমির চৌধুরী গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলেন, ‘ওয়ালাইকুমুস সালাম। কেমন আছো?’
‘জি, ভালো।’
‘বসো। কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?’
‘না।’
সিরাত চেয়ারে বসলো। মনে মনে বংশ উদ্ধার করলো তাদের। কিন্তু মুখে কুলুপ এঁটে চুপ করে রইলো। খানিকক্ষণ বাদে প্রত্যয়ও এসে যোগ দিলো নাস্তায়। সিরাতকে দেখে ঠাট্টার চাহনি দিয়ে কফির মগে
চুমুক দিলো ও। সিরাত মুখ বুজে সব সহ্য করলো। প্রত্যাশা নাস্তা সার্ভ করে দিলো ওকে। মুশফিকা চৌধুরী ফিরেও তাকালেন না। তিনি স্বামী-ছেলেকে নাস্তা দিয়ে নিজের খাবারে মন দিলেন। আমির চৌধুরী বসে সব লক্ষ্য করলেন। গতকাল সিরাতের বিয়ে ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় রেগে গেলেও এখন বুঝলেন মেয়েটার আদব-লেহাজ আছে। ছেলে যখন আব্দার করলো সিরাতকে বিয়ে করার, তখন তিনি খোঁজ নিয়ে দেখেছিলেন এই মেয়েটি কোনো বিত্তশালী পরিবারের নয়। ছেলেকে অনেক
বোঝালেন তিনি এ নিয়ে। কিন্তু প্রত্যয়ের এক কথা, একেই বিয়ে করবে। কি যেন হিসাব-নিকাশের কথা আওড়েছিলো সেদিন। সন্দেহ হওয়ায় তিনি খোঁজ নিয়ে দেখলেন এ মেয়ের জন্য ভার্সিটিতে বেশ নাকানিচুাবানি খেয়েছে তার ছেলে। ছাত্রনেতা
প্রত্যয় চৌধুরীর বিরুদ্ধে মানববন্ধন কর্মসূচির
নেতৃত্ব পর্যন্ত দিয়েছে এই মেয়ে। সেখান থেকেই বোধহয় একটা চাপা রাগ ছিলো সিরাতের প্রতি আমির সাহেবের। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি
খাবারে মন দিলেন। সিরাত বেশিকিছুই খেতে
পারলো না।

________

প্রত্যয় ভার্সিটি যাওয়ার উদ্দেশ্যে রেডি হচ্ছে।
চিরচেনা সেই স্টাইলে। পাঞ্জাবি-পাজামা পরে
একদম ছাত্রনেতা ভাব নিয়ে। একটু পর পরই ওর ফোন আসছে। অমুক, তমুক, চেলা প্যালা ফোন দিয়ে মাথা খাচ্ছে। দ্রুত যেতে বলছে। আজ নাকি ওদের দলের গুরুত্বপূর্ণ মিটিং। সিরাত মলিন মুখে চুপ হয়ে বসে এসব দেখছে। মনে মনে ভাবছে এই গুন্ডা
কি এখন ওর ভার্সিটি যাওয়াও বন্ধ করে দেবে?
প্রত্যয় ওকে আনমনা দেখে তা ভালোই আন্দাজ করে নিলো। সিরাতের মুখের ওপর ভেজা তোয়ালে
ছুঁড়ে মারলো। এরপর ওকে আদেশের সুরে বলল, ‘আমার কাপড়গুলো ধুয়ে সুন্দর করে ইস্ত্রি করে রাখবে, এসে যেন দেখি।’
‘আমি আপনার চাকর নই।
প্রত্যয় কটাক্ষ করে বলল,
‘জানি আমার বউ। বারবার মনে করানোর প্রয়োজন নেই।’
সিরাত চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘বউ হতে বয়েই গেছে।’
প্রত্যয় শুনেও না শোনার ভান করলো। বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘আমার কথা মেনে চললে ভার্সিটিতে যেতে পারবে। নয়তো ঘরে বসে শুধুই বউয়ের দায়িত্ব পালন করতে হবে। কাপড় যেন চকচক করে। মাইন্ড ইট!’

সিরাত হতবাক হয়ে ওর যাওয়া দেখলো। লোকটা
এত ধুরন্ধর! এভাবেই ব্ল্যাকমেইল করে সব কাজ করাবে নাকি? একটু পরই দরজায় টোকা পড়লো। সিরাত দরজা খুলে দেখলো হাতে বালতি নিয়ে বিশ-বাইশ বছরের একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সিরাতকে দেখে সে বিস্ময় নিয়ে বলল, ‘আফনেই নতুন ভাবী?’
সিরাত মৃদু কন্ঠে বলল, ‘হ্যাঁ।’
‘কেমুন আছুইন?’
‘ভালো। তুমি কে?’
মেয়টি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে চোখমুখ কুঁচকে বলল,
‘নাম দুখু। আমি এ বাড়ির বা’ন্দী। আফনেরে দেইখা বড়ই ভালা লাগতাছে। দুইজনরে মানাইসে ভালা।’
সিরাত হকচকালো। দুখু আবার কেমন নাম? ও অস্বস্তি নিয়ে বলল,’ইয়ে মানে কিছু প্রয়োজন?’
‘ভাইজানের কাপড় ধুইতে নিয়া যামু। কি কি ধুইতে হইবো দেন নিয়া যাই।’
সিরাত অস্ফুটস্বরে বলল, ‘জানি না।’
দুখু অবাক হলো না। নতুন বউ কেমন জানবে? ও ঘরে ঢুকতে ঢুকতে লন্ড্রি ঝুড়িতে রাখা কাপড়গুলো দেখিয়ে বলল, ‘এইখানে আধোয়া কাপড় রাহে ভাইজানে। আমি নিয়া যাই তাইলে।’
‘কোথায় নেবে?’
‘ধোপার দোকানে। ইংলিশে কি কয় জানিনা।’
‘লন্ড্রি?’
‘হ। প্রতি রবিবার বাড়ির হগলের কাপড় ধুইতে দেয়।’
সিরাত ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘তোমার ভাইজানেরও?’
‘এ বাড়ির হগল কাপড়ই তো দেয়। ভাইজানে বাদ যাইবো নাকি? আজিব কতা।’
সিরাত প্রত্যয়ের পরিকল্পনা বুঝতে পারলো। এর মানে
ওকে নাস্তানাবুদ করার জন্যই এতগুলো কাপড় ধুতে বলে গেছে? বাজে লোক কোথাকার! ও দুখুর হাত থেকে কাপড়গুলো নিয়ে বলল, ‘তুমি যাও।’
দুখু অবাক গলায় বলল,
‘কিন্তু কাপড়?’
‘আমি ধুয়ে দেবো।’
সিরাত উত্তর দিলো। দুখু ওর কথা শুনে মিটিমিটি হেসে চলে গেলো। সিরাতের রাগে-দুঃখে চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করলো। একরাশ বিরক্তি নিয়ে প্রত্যয়ের কাপড়গুলো ধুয়ে দিলো পা দিয়ে পেরে।

রাতে বাড়ি ফিরে এ দৃশ্য দেখে প্রত্যয় ভীষণ
প্রশান্তি অনুভব করলো। অথচ জানতেই পারলো না সিরাত কী ভীষণ ঝড় চালিয়েছে ওর প্রিয় কাপড়গুলোর ওপর! সিরাত ব্যলকনিতে। প্রত্যয়ের সামনে থাকতে ওর অস্বস্তি হয়। শত হলেও
লোকটা তার স্বামী। কিন্তু দেখলেই রাগ হয়।
প্রত্যয় গলা ফাটিয়ে ওকে ডাকতেই
হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলো সিরাত৷ পাছে যদি আবার ভার্সিটিতে যেতে না দেয়? এই অমানুষকে তো
বিশ্বাস নেই। প্রত্যয় বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে আয়েশি ভঙ্গিতে। ওকে দেখেই বলল, ‘পা টিপে দাও।’
সিরাত মুখ অন্ধকার করে বলল, ‘পারবো না।’
প্রত্যয় ধমকে ওঠলো, ‘স্বামীর আদেশ অমান্য
করা? জানো তো এর ফল?’
অগত্যা বাধ্য হয়ে সিরাত ওর পা টিপে দিতে রাজি হলো। বিনিময়ে প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল, ‘কাল ভার্সিটিতে যাবে, আমার সঙ্গে করে। কিন্তু যদি বাড়াবাড়ি করো, পরশু থেকে আবারও বন্ধ।’

সিরাত বহুকষ্টে নিজের গালি আটকালো। প্রত্যয়
ওকে একপলক লক্ষ্য করে শয়’তানি হাসি দিয়ে
বলল, ‘শাড়িতে তো ভালোই মানায়।’
সিরাত ভস্ম করা দৃষ্টি উপহার দিয়ে বলল, ‘নজর খারাপ তা তো জানতাম না।’
‘আস্তে-ধীরে সবই জানবে। এখন মনোযোগ দিয়ে পা টেপো।’
সিরাতের ইচ্ছে করলো পা দুটো ভেঙ্গে দিতে। বহু
কষ্টে নিজের ইচ্ছে সংবরণ করলো সে।

.

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]

চলবে…

গোলকধাঁধা পর্ব-০২

0

#গোলকধাঁধা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২

হতভম্ব হয়ে গালে হাত দিয়ে মায়ের দিকে তাকালো প্রত্যয়। আমির চৌধুরী রেগে তাকালেন স্ত্রীর দিকে। উপস্থিত সকলে মজা নিয়ে নাটক উপভোগ করতে লাগলেন! আমির চৌধুরী প্রত্যয়ের বন্ধুদের ইশারা করতেই অন্তু আর মুহিব এসে এটাসেটা বুঝিয়ে তাদের সেখান থেকে সরানোর চেষ্টা করতে লাগলো। এদিকে প্রত্যয় মায়ের ব্যবহারে ক্ষুদ্ধ হয়ে সেখান থেকে গটগটিয়ে হেঁটে উপরে চলে গেলো। আজ সকাল থেকে ও সবার সামনে অপদস্ত হচ্ছে। প্রথমে ওই সিরাত পালিয়ে গিয়ে সিনক্রিয়েট করলো। এখন মা এসে চড় মেরে হাসির পাত্র বানাচ্ছে ওকে সবার সামনে। মুশফিকা চৌধুরীও জোর কদমে পেছন পেছন চললেন। রাগে নিজেকে উন্মাদ লাগছে তার। এরকম একটা মেয়েকে তার ছেলে কিভাবে বিয়ে করতে পারে তা তিনি ভেবেই পাচ্ছেন না। যায় নাকি তাদের সাথে? মিডেলক্লাস মেয়ে কোথাকার! ঘরে ঢুকেই তিনি প্রত্যয়ের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘জোর করে বিয়ে করলে। তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে? আমার কত স্বপ্ন ছিলো তোমার ছেলের বিয়ে নিয়ে। তুমি সব শেষ করে দিলে।’
মায়ের কথায় প্রত্যয় চোখমুখ শক্ত বানিয়ে বলল, ‘কেন? তোমার বোনের মেয়েকে বিয়ে করিনি বলে রাগ হচ্ছে তোমার?’
মুশফিকা চৌধুরী থতমত খেলেন। আমতা আমতা করে বললেন, ‘আমি তোমার মা। তুমি একবারও আমার পছন্দ-অপছন্দ জানতে চাইবে না? লিয়ানা কি খারাপ ছিলো? তাদের স্ট্যান্ডার্ড দেখছো তুমি?’
প্রত্যয় রোষপূর্ণ গলায় বলল, ‘আমি দেখতে চাই না৷ আর এ বিষয়ে কোনো কথা শুনতেও চাইনা। নিচে তুমি যেটা করলে সেটা একদম ঠিক করলে না।’
‘আমি কখনো এই মেয়েকে তোমার বউ হিসেবে মানবো না।’
‘আই ডোন্ট কেয়ার।’

প্রত্যয়ের কাটখোট্টা জবাবে মুশফিকা চৌধুরী রাগে ভাষা হারিয়ে ঘর থেকে চলে গেলেন। প্রত্যয় পরণের শার্ট খুলে বিছানায় ছুঁড়ে মারলো। হাঁকডাক ছেড়ে সে একমাত্র বোন প্রত্যাশাকে ডাকলো। সিরাতের কাছে বসেছিলো এতক্ষণ। আপডেট জানতে হবে। ওই শকুনি কি কি করেছে তা না জানা অব্ধি ওর শান্তি হচ্ছে না। ভাইয়ের ডাক শুনেই প্রত্যয়ের ঘর থেকে ছুটে এলো প্রত্যাশা, ‘বলো ভাইয়া।’
প্রত্যয় গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘সিরাত কি আবারও কোনো সিনক্রিয়েট করছে?’
‘কাঁদছিলো অনেক। এখন চুপচাপ বসে আছে।’
‘কিছু বলেছে?’
‘বলেছে তার মেয়ের ক্ষতি হলে তোমাকে খু’ন করবে।’
প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল, ‘এত সাহস?’
প্রত্যাশা মিনমিন করে বলল, ‘তুমি কেন এরকম একটা কাজ করলে ভাইয়া? সিরাতের ওপর প্রতিশোধ নেবে৷ সেটা অন্যভাবে নিলেই তো হতো। বিয়ে করার কি দরকার ছিলো? এখন তো সে তোমার শত্রুর বদলে বউ হয়ে গেলো!’
প্রত্যয় চমকে ওঠে বোনের মুখপানে চাইলো। আসলেই তো! কিন্তু পরক্ষণেই সিরাতের সব কার্যক্রম মনে করে সে বলল, ‘বউ না ছাই। আমার বিরুদ্ধে স্পাইগিরি করা, সবাইকে উস্কে তোলা, আমার রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়া মেয়ে আর যাই হোক না কেন আমার শত্রুই হবে। একে উচিৎ শাস্তি দেবো আমি।’
‘পারবে না। ও খুব মিষ্টি মেয়ে। তাছাড়া তুমি অতোও ভালো মানুষ নও।’
প্রত্যাশার দিকে চোখ গরম করে তাকালো প্রত্যয়। ধমকে বলল, ‘আদিক্ষেতা না দেখিয়ে যা এখান থেকে।’
প্রত্যাশা যাবার আগে চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করলো, ‘যদি আবার সোহার কথা জিজ্ঞেস করে? কি বলবো?’
প্রত্যয় ফোনে মনোযোগ দিতে দিতে উত্তর দিলো, ‘আমি এমনিই ওকে ঢপ দিয়েছি। সোহার কিছুই হয়নি।’
প্রত্যাশা ভাইয়ের মুখ থেকে এ কথা শুনে হা হয়ে গেলো। তার এই চালবাজ ভাই এতো ভালো চাল জানে যে সিরাতের মতো মেয়েকেও ঢপ খাইয়ে বিয়েতে রাজি করিয়ে নিলো? ও একটু বিরক্তি নিয়ে বলল,
‘আমি পারবো না। তুমিই গিয়ে বলো।’
বলেই প্রত্যাশা ধুপধাপ পা ফেলে বেরিয়ে গেলো।
প্রত্যয় অন্তুকে ফোন দিয়ে বললো মেহমানদের বিদেয় করে দিতে। এমনিতেও এসব মেহমান লোক দেখানো। এনেছিলো সিরাতকে ঘাবড়ে দিবে বলে। কিন্তু এই মেয়েটাই পালিয়ে গিয়ে ওর মুখে চুনকালি মেখে দিলো। প্রত্যয় বিছানায় শুয়ে দু’চোখ বন্ধ করলো। সিরাতকে এরপর কীভাবে অপদস্ত করবে সেটা ভাবতে লাগলো। এই মেয়েকে সে কেয়ার করবে না একদম।

সিরাত ঘরে বসে নিঃশব্দে কাঁদছে। জীবনটার শেষের শুরু হলো বোধহয়! ফোনটাও কোথায় যে হারালো ধস্তাধস্তির সময়! সোহার অবস্থা ভেবে ভেবে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে ওর। ওই গুন্ডা তার ছোট্ট মেয়েটাকে কি অবস্থায় রেখেছে কে জানে! এ সমস্ত ভাবনার মধ্যেই ঘরে ঢুকলো প্রত্যয়। পরণে ট্রাউজার আর টি-শার্ট। সিরাতকে একপলক দেখে কৌতুকপূর্ণ কন্ঠে বলল, ‘তেজ কমেছে?’
সিরাত ওঠে গিয়ে কলার চেপে ধরলো ওর। কটমট করে বলল, ‘আমার সোহা কোথায়? বিয়ে তো করেছি!’
প্রত্যয় সিরাতের রাগান্বিত চেহারা দেখে খুব মজা পেলো৷ একটা ফু দিয়ে মুখের সামনে পড়ে থাকা এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ বাড়িতে ঘুমাচ্ছে।’
সিরাত কেঁপে ওঠলো। হাত আলগা হয়ে এলো ওর। ধাক্কা দিয়ে প্রত্যয়কে সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি বোকা না। নিশ্চয়ই ওর কোনো ক্ষতি করে… ‘
‘জানি তুমি খুব চালাক। আর এ চালাকির শাস্তি পেলে আজকে।’
সিরাত আশেপাশে তাকিয়ে ড্রেসিং টেবিলের ওপরে রাখা একটা কাচের ফুলদানি তুলে ধরে বলল,
‘আমি সোহাকে সুস্থ-স্বাভাবিক দেখতে চাই। এক্ষুণি, এ মুহূর্তে।’
প্রত্যয় আশা করেনি এরকম কিছুর। তেজ মোটেও কমেনি। ও সিরাতের দিকে এক পা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই ও চিৎকার করে বলল, ‘আমার মেয়ের কিছু হলে আজ তোকে খু’ন করে লা’শ বানাবো বলে দিলাম।’
প্রত্যয় বিরক্ত হলো। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে ফোন করলো কাউকে। ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হতেই ভিডিওতে দেখা গেলো সোহাকে। প্রত্যয় ফোনের স্ক্রিনটা সিরাতের মুখের সামনে ধরলো। আধো আধো ভাঙ্গা বুলি শুনে স্ক্রিনে দেখলো হতচকিত, তৃষ্ণার্ত চোখে দেখলো ছোট্ট সোহাকে। বাড়িতেই আছে বাচ্চাটা, বিছানায় শুয়ে খেলছে। প্রত্যয় ফোন সরিয়ে নিতেই সরু চোখে তাকালো সিরাত। মানে কি এসবের? এত লুকোচুরি কেন? ওকে ভাবনায় রেখে প্রত্যয় ঘর কাঁপিয়ে হো হো করে হাসতে হাসতে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘বোকা সিরাত।’

ধরণীতে রাত নেমে এসেছে। চারিদিক নীরব, নি:স্তব্ধ। সিরাতকে প্রত্যাশা এসে খাবার দিয়ে গেলো। কিন্তু ও সেসব ছুঁয়েও দেখলো না। খানিকক্ষণ পর মুশফিকা চৌধুরী ঘরে এলেন। তার মুখ কালো হয়ে আছে। সিরাত খাবার ছোঁয় নি দেখে তার গা আরো জ্বলে গেলো। মেয়েটাকে সহ্য হচ্ছে না মোটেও। লিয়ানার জায়গা দখল করেছে মেয়েটা। ওকে পুত্রবধূ করার স্বপ্নটা মাঠে মারা গেলো একেবারে। তিনি কিছু শাড়ি, জামাকাপড় নিয়ে এসেছেন। আমির সাহেব জোরাজুরি করলেন বলেই শ্বাশুড়ির দায়িত্ব পালন করতে এসেছেন। নয়তো তার বয়েই গেছে এসব করতে। বিছানার ওপর শাড়িগুলো রেখে সিরাতের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তোমাকে আমার একটুও পছন্দ না।’
সিরাত উত্তর দিলো না। ওর কোনো ইচ্ছেও নেই। মুশফিকা চৌধুরী আবারও বললেন, ‘তোমার কোনো যোগ্যতা নেই আমার ছেলের বউ হওয়ার। ওর পাশে দাঁড়ানোর। লোভী মেয়ে।’
সিরাত তীক্ষ্ণ স্বরে জবাবে বলল, ‘আপনার ছেলেই ছলছাতুরীর আশ্রয় নিয়ে আমায় বিয়ে করেছে। ওনার বউ হওয়ার চেয়ে নদীতে ডুবে ম’রা ভালো৷ আমাকে কথা না শুনিয়ে নিজের ছেলেকে মানুষ বানান!’

মুশফিকা চৌধুরী ক্ষিপ্ত হয়ে চলে গেলেন। সত্যিই মেয়েটা বেয়াদব। সিরাত চুপচাপ মেঝেতে বসে রইলো। মনে হাজারো প্রশ্ন! সোহা যদি বাড়িতেই থাকে তাহলে তখন প্রত্যয়ের ভিডিও কল রিসিভ করলো কে? বাবা-মা? কিন্তু ওরাই বা কল ধরবে কেন? প্রত্যয়কে চেনে নাকি ওরা? অবশ্য চিনতেই পারে। ওদের ভার্সিটির জনপ্রিয় ছাত্রনেতা প্রত্যয় চৌধুরী। যে মুখোশ পরে ভালো মানুষ সেজে থাকে। এসব হাজারো ভাবনা মাথায় ঘুরতেই দেখলো প্রত্যয় ঘরে এসেছে। সিরাত চেঁচিয়ে বলল,
‘কি করেছেন আমার ফ্যামিলিকে?’
‘কিছুই করিনি।’
‘নর্দমার কিট আপনি। একটা কথাও বিশ্বাস করিনা।’
প্রত্যয় মুচকি হাসলো, ‘তোমার বাবা তো আমার খুব
বড় ভক্ত। আমাকে দেখেই
চা-মিষ্টির ব্যবস্থা করলো। তোমার ভার্সিটির সিনিয়র বলে খুব নম্র ব্যবহার করলো।’
সিরাত অবাক হয়ে বলল, ‘আপনি আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন? কেন? নিশ্চয়ই ভয় দেখিয়েছেন?’
প্রত্যয় মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘উহু। বলেছি তুমি আমাকে ভালোবাসো, বিয়ে করতে চাও। এসব বলেই তোমার বাবাকে পটালাম। তুমি এত চালাক হলে
কি করে বলো তো? তোমার পুরো ফ্যামিলিটাই
হাঁদারাম টাইপের।’
সিরাত ফুঁসে ওঠলো, ‘আমার পরিবারকে নিয়ে আর একটা কথাও নয়। লজ্জা করে না সরলসোজা মানুষগুলোকে নিয়ে মজা করতে? মিথ্যেবাদী কোথাকার?’
‘না করে না। আমি তোমাকে বিয়ে করবো শুনেই তো নাচতে নাচতে মত দিয়ে দিলো তোমার বাবা-মা। শতবছর তপস্যা করেও এমন মেয়েজামাই পাবে নাকি?’
প্রত্যয় গা জ্বালানো হাসি দিলো। চোখেমুখে গর্ব। সিরাত তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল, ‘ওরা তো জনপ্রিয় ছাত্রনেতা প্রত্যয় চৌধুরীর কুৎসিত রুপটা জানে না। জানে না তো আপনি নিরীহ ছাত্র-ছাত্রীদের কি পরিমাণ টর্চার করেন। আপনার জন্য কতজন সুই’সাইড পর্যন্ত করেছে। আমার মতো নিরীহ মেয়েকে কিডন্যাপ করেন। জানলে ঝাটাপেটা করে বাড়ি থেকে তাড়াতো!’
বলে ঘৃণায় চোখ সরিয়ে নিলো। প্রত্যয়ের রাগ হলো খানিকটা। ওর গাল চেপে ধরে বলল, ‘তোমার জন্য যতগুলো রাত নির্ঘুম কাটিয়েছি প্রত্যেকটার হিসাব সুদে-আসলে পাবে তুমি। তোমার অশান্তিই আমার শান্তির ঘুম এনে দেবে।’

বলে সিরাতকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। এরপর বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। এদিকে সত্যিই পুরো রাতটা নির্ঘুম কাটলো সিরাতের।

[ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ওকে?]

চলবে…

গোলকধাঁধা পর্ব-০১

0

#গোলকধাঁধা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব- ১

বিয়ের আসর থেকে কনে পালিয়েছে। এ নিয়ে উপস্থিত সকলের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। চারিদিকে শোরগোল, হট্টগোল আরম্ভ হয়েছে। মেহমানদের মধ্যে অনেকেই হাসি – তামাশায় ব্যস্ত। কেউ কেউ কটুক্তি শুরু করে দিয়েছে। চৌধুরী বাড়ির এ হালে তারা যেন বেশ আনন্দ পাচ্ছে। এ যেন হওয়ারই ছিলো। সিরাতের মতো ভদ্র, সভ্য মেয়ে প্রত্যয় চৌধুরীর মতো একটা লোককে বিয়ে করবে কেন? যার মনে দয়া-মায়া, ভালোবাসার লেশমাত্র নেই, তাকে নিয়ে সারাজীবন কাটানো সম্ভব নয় কোনো আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মেয়ের। এসব নিয়েই আলোচনা চলছিলো সকলের মধ্যে। কিন্তু তৎক্ষনাৎ গমগমে এক স্বরে কেঁপে ওঠলো আশেপাশের সকলেই৷ পিছু ফিরে চাইতেই দেখলো আমির চৌধুরী স্টেজে দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় দম্ভ নিয়ে বলছে, ‘যারা যারা বিয়ে খেতে এসেছেন, আপনারা সবাই খেয়ে যাবেন। আমার ছেলের বিয়ে বলে কথা, ক্ষিধে নিয়ে কেউ বাড়ি ফিরবেন না।’

এরমধ্যে একজন কটুক্তি করে বলল, ‘কনে তো পালিয়েছে শুনলাম, আপনাদের তো বদনাম হয়ে গেলো। কত করে বলেছিলাম আমার মেয়ের সাথে বিয়েটা দিন, বিজনেসটা আরও এগিয়ে যাক। সেতো শুনলেনই না। যাইহোক, অবশেষে কি-না প্রত্যয় চৌধুরী রিজেক্ট হলো সামান্য একটা মেয়ের কাছে?’

বলে মাঝবয়েসী একজন টাক মাথার লোক হাসতে লাগলো। আমির চৌধুরী এতক্ষণ নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলেও এবার যেন আগুনে ঘি ঢালার কাজটা করে দিলো। সত্যিই তো, ওই মেয়ের এত সাহস তার ছেলেকে রিজেক্ট করার? ভরা বিয়ের আসরে এভাবে অপমান করার সাহস করলো কি করে ওই দু’টাকার মেয়ে? তিনি ক্রোধপূর্ণ গলায় কিছু বলতে যাবে তার আগেই হলঘরের দরজা থেকে কেউ বলে ওঠলো,
‘প্রত্যয় চৌধুরীকে রিজেক্ট করার সাহস এ শহরের কারোর নেই। স্বচক্ষে আমার বিয়েটা দেখে যান আঙ্কেল৷ আশা করি আপনার মন্দ লাগবে না। প্রমিজ!’

টাক মাথার লোক রাগটা গিলে খেলো প্রত্যয়কে দেখে। বাকি সকলেই হতভম্ব হয়ে গেলো বর-কনেকে দেখে। ফর্মাল শার্ট পরিহিত প্রত্যয়ের কোলে সালোয়ার-কামিজ পরিহিত সিরাত লেপ্টে আছে। কনের সাজের লেশমাত্র নেই। ঘুমিয়ে আছে নাকি জ্ঞানহীন তা বোঝা যাচ্ছে না৷ সকলের অবাক ভঙ্গির মধ্যেই প্রত্যয় সিরাতকে নিয়ে চলে গেলো নিজের ঘরে। শুইয়ে দিলো বিছানায়। একপলক জ্ঞানহীন সিরাতের দিকে তাকালো। ভালোই হলো অজ্ঞান হওয়ায়। তখনকার থাপ্পড়টা কাজে দিয়েছে। গাল লাল হয়ে আছে। কোনোমতে বিয়েটা শেষ হোক, এরপর দেখে নেবে এই মেয়েকে। বিয়ে বাড়ি থেকে পালানোর শাস্তি বিয়ে করেই দিতে হবে ওকে। ওর জারিজুরি সব বের করে দিবে। সিরাত আঞ্জুমের অহংকার ঘুচিয়ে না দিতে পারলে প্রত্যয় চৌধুরী নিজের নাম পালটে ফেলবে। একটা বাঁকা হাসি দিয়ে গলা উঁচিয়ে ডাকলো সে অন্তুকে। মুহূর্তেই দরজায় হাজির হলো অন্তু। সিরাতকে এ অবস্থায় দেখে অবাক হয়ে বলল, ‘কোথায় পেলি ওকে?’

প্রত্যেয় রোষপূর্ণ গলায় বলল, ‘বেশিদূর যেতে পারেনি, স্কুলের পাশের গলিতে পেয়েছি। শরীরে নেই দু-ফোটা শক্তি, আমাকে দেখেই বিয়ে করবে না বলে লাঠি নিয়ে মারতে এলো। এক থাপ্পড় খেয়েই দেখ এখন মরার মতো পরে আছে।
‘অজ্ঞান নাকি?’
‘হ্যাঁ। কাউকে বল পানি আনতে, কুইক। জ্ঞান ফেরাতে হবে, নয়তো বিয়েটা হবে না।’
অন্তু ব্যহত গলায় বলল, ‘ছেড়ে দে না দোস্ত। এভাবে জোর করে বিয়ে হয় না। সিরাত খুব ভালো মেয়ে।’
প্রত্যয় রেগে তাকালো, ‘ভালো মেয়েরা মাথানিচু করে সব কাজ করে। অযথা কারো সাথে লাগতে আসে না।কিন্তু এই মেয়ে তা নয়, সেটা তুই ভালো করেই জানিস।’
‘তাই বলে এরকম করবি?’
‘কিছুই তো করিনি। এতো বেশি কথা না বলে কাজ কর, না পারলে বেরিয়ে যা…’

অন্তু আর কথা বাড়ালো না। বন্ধুকে সে ভালো করেই চেনে। সিরাতের জন্য খুব খারাপ লাগছে। মেয়েটা কেন যে প্রত্যয়ের কাজে নাক গলাতে গেলো! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়ির কাজের লোককে পানি আনতে বললো সে।

চোখেমুখে পানির ছিঁটে পড়তেই মিটিমিটি করে চোখ খুললো সিরাত। মাথাটা ভীষণ ভার লাগছে। কেমন অদ্ভুত লাগছে সবকিছু।
টিউশন শেষে ফেরার পথে ওকে কিডন্যাপ করে এনেছে প্রত্যয় চৌধুরীর গুন্ডা বাহিনী। জোর করে বিয়েতে রাজি করাতে চেয়েছিলো। কিন্তু সুযোগ বুঝে
পালিয়ে গিয়েও ধরা পড়েছিলো প্র‍ত্যয়ের কাছে৷ এখন কোথায় তবে সে? চোখ খুলে তাকাতেই সামনে বসে থাকা প্রত্যয়ের চেহারা দেখেই রক্তশূণ্য হয়ে গেলো ওর মুখ।

সবকিছু মনে পড়তেই লাফিয়ে ওঠে বসলো। গায়ের ওড়না ঠিক করতে করতে চেঁচিয়ে ওঠলো, ‘আমাকে এখানে এনেছেন কেন? আপনার মতো শ’য়তানকে বিয়ে করবো না আমি। কিছুতেই না। আবারও পালিয়ে যাবো।’
প্রত্যয় চেয়ারে বসে হো হো করে হেসে ওঠলো,
‘মজা পেলাম।’
সিরাত চোখ গরম করে তাকালো। সহ্য হচ্ছে না এই লোকটাকে একবিন্দুও। চেহারা দেখেই গা ঘিনঘিন করছে, ‘আমি আপনাকে মজার কথা বলেছি?
‘অবশ্যই। বাঘের খাঁচায় ঢুকে বেরুনোর কথা বললে হাসি ছাড়া আর কিচ্ছু পাবে কি মিস.সিরাত? স্যরি মিসেস চৌধুরী?’
সিরাত তেতে ওঠলো,
‘মুখ সামলে কথা বলুন। আপনার মতো কুলাঙ্গারের মিসেস হওয়ার চেয়ে বি’ষ খেয়ে নিজেকে শেষ করে দেওয়া ঢের ভালো।’

প্রত্যয় গম্ভীরমুখে এগিয়ে এলো সিরাতের দিকে। ও ঘৃণাভরে তাকালো প্রত্যয়ের দিকে। প্রত্যয় তা দেখে বিচলিত হলো না৷ কাষ্ঠ হেসে বলল, ‘মরবে তো অবশ্যই, তবে তা আমার হাতে। ধীরে, আস্তে। আমার কাজে নাক গলানোর খেসারত দিয়েই ম’রতে হবে।’

‘তবে এক্ষুণি মেরে ফেলছেন না কেন? আমাকে বিয়ে করে লাভ কি আপনার?’

‘লাভ-ক্ষতির হিসেবটা আমাকেই না হয় বুঝতে দাও। আপাতত আমি রেগে যাওয়ার আগে বিয়েতে রাজি হয়ে যাও, তোমার কারণে কারো জীবন হয়তো প্রদীপ ধীরে ধীরে নিভে আসছে।’

সিরাত আঁৎকে ওঠলো। বোবা বনে গেলো সে। প্রত্যয় আগের মতোই গা জ্বালানো হাসি দিয়ে কাউকে ফোন লাগালো। সিরাতের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে সে ওপাশের কাউকে জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন আছে আমার হবু সোনাটা? মা’কে বুঝি মিস করছে? দাঁড়া মায়ের সাথে সাক্ষাৎ করাচ্ছি ওকে।’

ওপাশ থেকে কি বললো সিরাত শুনলো না। প্রত্যয় ভিডিও কল এনে ওর সামনে ধরে তীক্ষ্ণ হেসে বলল, ‘ ‘ছোট্ট সোনাটা কাঁদছে সিরাত। মা হিসেবে তুমি কিভাবে সহ্য করছো বলো তো? দয়া নেই তোমার?’

সিরাত হতভম্ব হয়ে ওর হাত থেকে ফোন কেড়ে নিলো। ওর প্রাণ, ওর জীবনকে এভাবে প্রত্যয়ের লোকেদের কাছে দেখে হতবাক হয়ে গেলো। মা-বাবা কোথায়? নীরু কোথায়? ছোট্ট সোহা এদের কাছে কি করছে? এতসব প্রশ্ন যেন ওর মস্তিষ্ক নিতে পারলো না। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠলো। বলল,
‘ও একটা ছোট্ট বাচ্চা৷ কি ক্ষতি করেছে ও? ছেড়ে দিন ওকে।’

‘দেবো। তার আগে বিয়েটা হোক। নয়তো কে জানে রাতে ডাস্টবিনে শেয়াল-কুকুরের খাদ্য বানাতে হবে কিনা!’

কথা শুনেই সিরাতের দম আটকে এলো। এতটা নির্দয়-পাষাণ কিভাবে হতে পারে মানুষ? নাহ! এ মানুষ না ; অমানুষ! সিরাত কাঁদতে কাঁদতে প্রত্যয়ের বুকে কিল-ঘুষি দিতে দিতে বলল,
‘তুই পশুদের থেকেও অধম। জীবনেও ভালো হবে না তোর।’

প্রত্যয় ওর হাত দুটো ধরে বলল, ‘তুই তুকারি একদম না।’

‘বিয়ে করবো আমি। আমার বাচ্চাকে চাই।’

সিরাত কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বললো। প্রত্যয় সামান্য হাসলো। আজকের পর থেকে এভাবেই আর্তনাদ করবে সিরাত প্রতিটা দিন। তবেই ও শান্তি পাবে। তবে এত ছোট্ট বাচ্চাকে পরিকল্পনার অংশে ঢোকাতে রাজি ছিলো না। কিন্তু বাধ্য হয়েই করতে হলো এটা। সিরাতের সবচেয়ে দুর্বল জায়গায় আঘাত না হানলে ও কখনোই এ বিয়েতে রাজি হতো না। ও ওঠে ঘরের বাইরে যেতে যেতে বাঁকা হেসে বলল, ‘অতিরিক্ত সাহসিকতার ফল কখনো ভালো হয় না হবু মিসেস।’

সিরাতের কান্না বন্ধ হয়ে গেলো। ঘৃণাভরে দেখলো সে প্রত্যয়কে। তার জীবনের অভিশাপ এই লোক৷ এখন কিনা একে বিয়ে করে নিজের জীবনটাকে মাঝনদীতে ফেলে দিতে হবে? ছোট্ট সোহাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে বিয়ে করার জঘন্য কাজটা অবশ্য এই লোকটার থেকেই আশা করা যায়। সোহার কান্নারত মুখটা মনে পড়তেই কলিজা মুচড়ে ওঠলো ওর। বড়বোন সিমিনের শেষচিহ্ন সোহা। সোহাকে জন্ম দিতে গিয়ে বোনের মৃত্যু শয্যায় কথা দিয়েছিলো সিরাত, ওকে আগলে রাখবে। কিন্তু আজ নিজের জন্য সোহার এ অবস্থা যেন সিরাতকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দিয়েছে। বমি পাচ্ছে ওর, প্রত্যয়ের প্রতি ঘৃণায় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে। অভিশাপ একটা সিরাতের জীবনে।

আধঘন্টাও পার হলো না, এরমধ্যে প্রত্যয় চৌধুরীর সাথে সিরাতের বিয়েটা হয়ে গেলো। উপস্থিত মেহমানগণ এই প্রথম দেখলো সামান্য সালোয়ার-কামিজ, আর ফর্মাল শার্ট পরে বর-কনের বিয়ে। এত বিত্তশালীদের বিয়ের পোশাক এত সাদামাটা দেখে সকলেই মনে মনে হাসলো। ভেতরের খবর না জানলেও উড়ন্তভাবে তাদের কানে এসেছে প্রত্যয় চৌধুরী এ বিয়েটা জোর করেই করেছে সিরাত নামক মেয়েটিকে। আর এতে সম্পূর্ণ সায় দিয়েছে আমির চৌধুরী। বিয়ের শেষ মুহূর্তে আচমকা এক ঘটনা ঘটলো। প্রত্যয়ের মা মুশফিকা চৌধুরী এসে ঠাস করে থাপ্পড় বসালেন ছেলের গালে। হতভম্ব হয়ে গালে হাত দিয়ে মায়ের দিকে তাকালো প্রত্যয়। আমির চৌধুরী রেগে তাকালেন স্ত্রীর দিকে।
উপস্থিত সকলে মজা নিয়ে নাটক উপভোগ করতে লাগলেন!

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]

অন্যরকম তুমিময় হৃদয়াঙ্গণ পর্ব-৩২ এবং অন্তিম পর্ব শেষ অংশ

0

#অন্যরকম_তুমিময়_হৃদয়াঙ্গণ
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_৩২( সমাপ্তির দ্বিতীয়াংশ)

তাবাসসুম পাগল পাগল হয়ে গেল। পায়চারী করে একের পর এক রুম চেক করছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিগণকে পেলো না। মনে হচ্ছে পুরো বাসা খালি। হিয়া দেয়ান বুঝতে পেরেছে ফাহিম পরিবারের সবাই তাদের ধোঁকা দিয়েছে। তিনি মেয়ের দিকে ক্ষোভ-মিশ্রিত দৃষ্টিতে চেয়ে বলেন,

“আমার মনে হচ্ছে তারা আমাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে রিসোর্টে চলে গেছে। এখনি আমাদের বের হওয়া উচিৎ চল।”

দাঁতে দাঁত চেপে তৎক্ষণাৎ মা-কে নিয়ে বাসার থেকে বেরিয়ে যায় তাবাসসুম। তাদের কান্ড আড়াল থেকে নিশ্চুপে পরখ করছিল রাফি। মা-বেটিকে যেতে দেখে নিজের মালিককে রিমাইন্ডার দিয়ে দেয়। এক ভ্যানের মধ্যে পুরো পরিবার বসে আছে। রিসোর্টের প্রায় কাছেই চলে এসেছে তারা। পরিকল্পনা করে সবাই রিসোর্টের জন্য বেরিয়েছে। রাফির রিমাইন্ডার পেয়ে বাঁকা হাসল আফরাজ। নাজীবা জানালার বাহিরে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার বিশ্বাস হচ্ছে না এতো বড় রিসোর্টে তারা থাকবে। বীচ-সাইড রিসোর্ট। নিজের কেবিনের জানালা থেকে ভ্যান গাড়ি ঢুকতে দেখে নাদিম উত্তেজিত হলো। তার বোন-কে কত বছর পর বুকে নিতে পারবে। সেই আশায় তার বুক ধড়ফড় করছে। নাদিমের এরূপ দশা দেখে তার পিএ কাজল ভ্রু কুঁচকাল। মুখ বাঁকিয়ে বিরবিরিয়ে বলে,’লুচ্চু ছেলে খালি মেয়েদের দিকে তাকাবে। আমার মত সুন্দরী-রে কি তোর চোখে পড়ে না? নাকি আমার মুখে কালি মাখা আছে। ধুর তোর চোখেই ছানা পড়ছে। হা’রা’মজা’দা বস একখানা।’
নাদিম ফিসফিস শুনে বিরক্ত চোখে একপলক কাজলের দিকে তাকিয়ে বলে,’দেখো তোমার ফিসফাস করতে মন চাইলে এ কেবিন থেকে বের হও। শুধু শুধু আমার মাথার পোকা কে রাগিও না। নাহলে পরের বার তোমার ঠোঁটের উপর অত্যাচার চালাবো। আগেরবার প্রথম ছিল বলে চোখের উপর ঠোঁট বসিয়ে ছিলাম।’

কথাগুলো বলে বাঁকা হাসল। বসের কথায় কাজল জমে যায়। আমতা আমতা করে রুমের থেকে বেরিয়ে গেলো। নাদিম তার লজ্জাবতীর লাজ দেখে তৃপ্তি পেলো। এইতো এক রমণী যাকে ছাড়া তার জীবনে আর কেউ ছিল না। সেদিন পথের ফকির হয়ে ঘুরার বদলে এই রমণীর একজোড়া হাতের মুঠোয় নিজের হাত রাখতেই পুরোটা জীবন তার সঙ্গে পারাপার হওয়া। কখনো ভাবেওনি নাদিম তার মনের জগতে এই রমণী এতটা জায়গা করে নেবে। তাইত প্রতিমুহূর্তে এই রমণীকে তার চাই,চাই মানে চাইই। নাদিম দরজার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে পুনরায় বাহিরের দিকে তাকায়। ঐ যে তার বোন,কত বড় হয়ে গেলো মেয়েটা। সে তো নিজ হাতে পুতুল এনে দিতো। এখনো মনে হয় ভাইকে দেখলেই এসে বায়না ধরবে ভাইয়া আজকে কিন্তু তুমি চকলেট আনোনি। আমি খুব লাগ করছি। ছোট বোনটার তোতলা কথা শুনে সে কতই না হেসে বায়নাগুলো পূর্ণ করতো। ছোটবেলার কথা মনে পড়ায় তার চোখের কোণে কবে পানি জমালো টেরও পেলো না। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)চোখ মুছে পরণে কোট জড়িয়ে নেয়। নিজস্ব সত্তাকে স্বাভাবিক রাখার প্রচেষ্টা মাত্র। তখন ফোনে কল আসার শব্দে নিজেকে ধাতস্থ করে ফোনটি রিসিভ করে। অপরপাশ থেকে ‘শা’লা’ কথাটি শুনে মৃদু হাসল।
‘শা’লা’ আমার বউয়ের দিকে কু’নজর দেওয়া বন্ধ কর। নাহলে তোর একদিন কি আমার একদিন।’
‘জনাব আপনি হয়ত ভুলে যাচ্ছেন। যাহাকে আপনি বউ বলিয়াছেন তাহা আমার রক্তের বোন লাগিয়াছে। আমি বলিলেই আমার বোন আমার কাছে থাকার জন্য মরিয়া হয়ে উঠিবে। তাই সাবধানে কথা বলিবেন।’
‘তুই তো শা’লা সুবিধার না। আমার বউকে ভাগিয়ে নিজের কাছে রাখার প্ল্যান করছিস। তোর পরিচয় গোপন রাখব। বলতাম না আমার কোনো শা’লা টা’লা আছে। তুই তোর বউয়ের আঁচলের নিচে গিয়ে মর। আমার বউয়ের আঁচল ধরে আমি ঘাপ্টে মে’রে বসে থাকব। দেখি কোন বাপের সাহস কত বড়? আমার বউকে ভাগানোর হুহ্।’
‘চুপ ব্যাডা নিচে থাক আমি আসতেছি।’

নাদিম ফোন রেখে আবেগী মনকে নিয়ন্ত্রণ করে নিলো। কেবিনের দরজা পেরিয়ে নিচের ফ্লোরে এগিয়ে গেলো। সানন্দের সহিতে ফাহিম পরিবারের সদস্যদের আপ্যয়ন করা হচ্ছে। কাজল একের পর এক ফুল বিতরণ করছে। নাজীবা-র বিষয়টা বেশ আনন্দের লাগল। ফুলটা শুঁকে আফরাজ এর গালে কামড়ে দেয়। যা দেখে আফরাজ চোখ সরু করে তাকালো। নাজীবা পোচ দেওয়ার মত মুখ করে তার ফোনের ক্যামেরায় ক্যাপচার করে নিলো। আকবর তো তার বউকে নকশার কারুকাজ করা স্থানে দাঁড় করিয়ে একেক এঙ্গেলে ছবি তুলছে। জনাব ইসমাইল আর মিসেস ফেরদৌসী পরিবেশটা উপভোগ করছেন। রিসোর্ট এর ঠিক বিপরীতে রয়েছে নেভাল বীচ। আজ রাত বেশি হয়ে যাওয়ায় নেভাল বীচের দিকে যাবে না বলে ভেবে রাখলো। হঠাৎ কারো আগমনে তাদের সকলের দৃষ্টি সেই মানুষটির দিকে পড়ে। কাজল বসকে দেখেই সকলের দৃষ্টিকার্ষণে ডেকে উঠে। আফরাজ আর আকবর ব্যতীত সকলের চোখে মানুষটি নতুন। তার চেয়ে বড় কথা পরিচয় হলো এই রিসোর্টটি তার। ‘টুরিস্ট অফ নেভাল’ রিসোর্টটি দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি চোখ ধাঁধানো পরিবেশের মুগ্ধতা বিরাজ করে।
কাজল পরিচয় করিয়ে দেয়। এতেও নাজীবার ভ্রুক্ষেপ নেই। তার চোখের দৃষ্টি স্থির। শরীরটা ঝংকার দিয়ে উঠেছে বোধহয়। ঢোক গিলে আফরাজ এর হাতের উপর থেকে হাত সরিয়ে নাকিব মুনসিফ নামক লোকটির নিকট এগিয়ে গেলো। নাকিব মুনসিফ নামটা অন্যরকম হলেও নাদিম তো তার আসল নাম। নাদিম এর ইচ্ছে করছে তার বোনটাকে ঝাপ্টে ধরতে‌। কিন্তু ফাজিলের হাড্ডি ফাজিল আফরাজ তার ব্যাপারে কোনো কথাও তুলছে না। রা’গ পেলেও আফরাজ এর লুকানো শ’য়’তানি হাসি দেখে মনেমন কয়েকটা গা’লি ছুঁড়ে মা’রল। মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে রাখা তার পক্ষে কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে পড়ছে। নাজীবা অচেনা মানুষটির মুখোমুখি হলো। তার মুখের আদলে সে কিছু একটা খোঁজে চলেছে। এমন আচরণ তো সে একজনের সাথেই করতো। কাঁপা হাতে চোখ বুজে তার হাতের স্পর্শ নাকিব নামক লোকটির গালে ছুঁয়ে দেয়‌। জনাব ইসমাইল, মিসেস ফেরদৌসী আর কুসুমা অবাক চোখে চেয়ে আছে। তাদের কাছে দৃষ্টিকটু মনে হলেও আফরাজ আর আকবর ভাবলেশহীন। দু’জনের মতিগতি দেখে তারাও প্রশ্ন করার সাহস পাচ্ছে না। নাজীবা-র গলা পাকিয়ে কান্না আসছে। চোখ বুজে থাকা অবস্থায় চোখের কোণা দিয়ে পানি পড়ছে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে নাদিম চট করে নাজীবাকে বুকে আগলে নেয়। কাজলের দৃষ্টিদ্বয় শীতল হয়ে গেলো। তার বুকের মধ্যে অজানা হারানোর বেদনা গ্রাস করছে। নাকিব কেনো এই মেয়েকে জড়িয়ে ধরলো? সে তো অন্যের স্ত্রী। তবে কি তার প্রাক্তন প্রেমিকা? কথাটা মাথায় আসতেই তার শরীর-মন ক্রোধে কেঁপে উঠে। বাক্যহীন তৎক্ষণাৎ নাদিম এর শরীর থেকে হিচড়ে টান দিয়ে দূরে ধাক্কা দেয় নাজীবা-কে। ভাগ্য ভালো বিধেয় আফরাজ কিছুটা আঁচ করতে পেরে তৎক্ষণাৎ তার বিবিজান কে আগলে নেয়। নাদিম এর মেজাজ তুঙ্গে উঠলো। মেয়েটা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। নাজীবা-র স্থানে অন্য নারী হলে এ কাজ করলে সে মেনে নিতো‌। কিন্তু তার বোন-কে এভাবে আলাদা করা। মানতে পারল না মোটেও। দাঁত চেপে কাজলের বাহু চেপে নিজের দিকে ফিরিয়ে জোরেসরে চ’ড় বসালো। চ’ড়ের প্রতিঘাতে কাজল ব্যালেন্স হারিয়ে ফ্লোরের উপর পড়ে যায়। নাদিম চিৎকার করে বলে উঠে।

“তোর সাহস কেমনে হলো আমার বোন-কে আমার বুকের ভেতর থেকে দূরে সরানোর? খুব বাড়াবাড়ি করে ফেলছিস না। শোন কালকে থেকে যেনো তোকে অফিসের ধারেকাছেও না দেখি। লো ক্লাস গার্ল লো ক্লাস পজিশনেই থাকবি।”

নিজের মেয়ের উপর ঘাত হওয়া দেখে জনাব কাশেম এর চোখে পানি চলে এলো। তিনি তৎক্ষণাৎ তার মালিকের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইলো। কাশেম মিয়াকে দেখে নিজের রা’গ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল নাদিম। কপালে হাত রেখে মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে বলে,’আপনি আপনার মেয়ে কে আমার চোখের সামনে থেকে নিয়ে যান। তাকে আমি এমুহুর্তে আর চোখের সামনে দেখতে চাইছি না।’
কাজলের গাল ব্যথায় কাতরাচ্ছে। তবুও টু শব্দ অব্দি করল না। একটু নাহয় বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। তার মানে এই নয় সকলের চোখের সামনে তাকে অপদস্থ করবে। তার আত্মসম্মান বলতে কিছু তো আছে। চোখ মুছে বাবার হাত ধরে বলে,’থ্যাংকিউ স্যার আমার রাস্তা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যে।’
বাবাকে নিয়ে আর অপেক্ষা করল না। রাতের আঁধারে বেরিয়ে যায়। রাত হলেও রিসোর্টের আশপাশ জুড়ে হৈচৈ লাইটিং করা। তাই তারা নিশ্চিন্তে বাড়ি চলে যেতে পারবে। এতটুকু ধারণা করে তপ্ত-শ্বাস ফেলল নাদিম। তার রা’গ নিয়ন্ত্রণ থাকত কিন্তু কাজল অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করায় সে হাত উঠিয়ে ফেলেছে। নাজীবা বোবার মত চেয়ে রইল। আফরাজ আমতা আমতা করে নাদিম এর পিঠে চা’প’ড় মে’রে বলে,

“সরি রে দোস্ত আমার উচিৎ ছিল সবাইকে তোর সত্য পরিচয় জানানো। নাহলে আজ এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। তুইও কম কিসে মামা? হবু ভাবী গার্লফ্রেন্ড জুটিয়ে বসে আছিস। আগে বললে তোর ভাগেরটারেও জানিয়ে দিতাম। এই না বলার ভুলটা কিন্তু তোর মামা। এই দোষ মোটেও আমি আমার মাথায় নেবো না নেভার এভার।”

“ব’দমা’ই’শ ব্যাডা ফাঁদে ফেলে এখন শান্ত্বনা না দিয়ে উল্টো টিটকারী মারছিস। ভুলে যাস না বোনটা কিন্তু আমার।”

“তো তাতে কি নিয়ে যাহ। বোনের ভাই নিয়ে যেতেই পারিস। আমি কি তাতে মানা করবো নাকি?”

নাদিম চোখ রাঙালে আফরাজ হাত উঁচিয়ে বুঝছি বোঝায়। সকলের দিকে তাকিয়ে বিশেষত নাজীবা কে উদ্দেশ্য করে বলে,

“এই হলো নাদিম মুসাররাত মোবারক আলী আর মেহজাবিন সিরাত এর বড় পুত্র আর আমার বিবিজান এর পরম মিত্র ভাই। এক বোনের স্পর্শের মর্ম এক বোনই বুঝে কেননা ভাই তো তারই।”

কথাটা বলার পরপর নাজীবা পুনরায় নাদিম-কে জড়িয়ে ধরে নিশ্চুপ কান্না করতে লাগে। নাদিম ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বোনটা বড় হলে কি হবে এখনো ছোট রয়ে গেলো! বোনকে সোফায় বসিয়ে চোখজোড়া মুছে দিয়ে টিটকারী-র সুরে বলে,’দোস্ত বোন তো আমার বাচ্চা রয়ে গেলো। তুই ওর সাথে উল্টাপাল্টা কিছু ভুলেও করবি না। নাহলে আমি তোর এপারওপার করে দেবো।’

আফরাজ মুখ বাঁকিয়ে বলে,’এ্যাহ আসলো আমার কোথাকার কোন মেলায় হারিয়ে যাওয়া শা’লা। তোর বোন আমার বিবিজান। শুধু উল্টাপাল্টা করব না বরং তোর কোলে উল্টা নয়-দশটা বাচ্চা দিয়ে পূর্ণ করে দেবো দেখিস।’
খুব ভাব নিলো কথাটা বলে। নাজীবার তো কান্না বন্ধ হয়ে গেল কিন্তু আফরাজ এর কথায় বিড়ম্বনায় পড়ে গেল। নাদিম গলা ঝেড়ে অন্যদিক চোখের দৃষ্টি ফেলল। নাজীবা মুখ ফুলিয়ে চোখ রাঙায়। এতে বিন্দুমাত্র পাত্তা দিল না আফরাজ। নাদিম সেসবে খেয়াল না দিয়ে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

“তোর কোনো কষ্ট হচ্ছে না তো আফরাজদের সাথে? আমার সাথে তোর খুব অভিমান তাই না? আমাকে মাফ করে দিস-রে বোন। তোর খারাপ সময়ে তোকে সামলানোর জন্য আমিও ততটা সবল ছিলাম না । তাইত আমাদের উপরে আল্লাহ মেহেরবান হয়েছিলেন। তোকে তোর নিজের আসল স্থানে পাঠিয়ে দিলেন। তোর কাছে অটুট বন্ধন রক্ষাকারী একজন এলো‌। আফরাজ তোকে খুশি সুখি রাখবে আমি জানি। রাগারাগী হবে স্বাভাবিক আর আমি জানি তুই মানিয়ে নিবি। এই ভাইটার কাছেও কয়েকদিন পারলে থেকে শ্বশুরবাড়ি যাইস। জানিস তোর জন্য আমি তোর পছন্দমত রুম সাজিয়েছি। আমার বড় বাংলো আছে।”

“ভাইয়া ব্যস করো। আমি থাকব তোমার এখানে। আমি রাগও আর রাখিনি মনে। কিন্তু একটা বিষয়ে খারাপ লাগছে। আমার কারণে তুমি মেয়েটার সাথে খুব খারাপ আচরণ করে ফেললে। এতটা রাগ হওয়া তোমার উচিৎ হয়নি। তুমি চাইলেই পারতে বুঝিয়ে বলতে। তা না করে হাত উঠিয়ে পুরুষত্বদেখালে? আমি এতে খুব খারাপ বোধ করছি। মেয়েটার চোখে তোমার প্রতি ভালোবাসা দেখেছি আমি।”

কথার পিঠে কি বলল নাজীবা বুঝতে পেরে থ বনে গেলো। চোখ পাকিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,’ওয়েট ভালোবাসা আচ্ছা তাহলে এই কাহিনী! বলো কাহিনী কি হুম?’
নাদিম মাথা চুলকে বলে,’অনেক বড় কাহিনী। তোর বাচ্চা হলে তখন মামা হিসেবে কাহিনীটা শোনাবো। আপাতত তোকে সারাংশটা জানিয়ে দেয়। তোদের ছেড়ে পথের মিসকিন হওয়ার পর ঐ মেয়েটাই ছিল আমার একমাত্র আশ্রয়। তার বাবা আমার এই রিসোর্টের দারোয়ান। আমি লুকিয়ে আমাদের বাবার কাছ থেকে পেয়ে ছিলাম ব্যবসার দলিলপত্র। তার তদারকি করতে নিজের নাম বদলে নাকিব মুনসিফ রেখে ব্যবসা চালু করি। তাইত দাহাব এহসান আমাকে ঘুণাক্ষরেও চিনতে পারেনি। বরং তার কাছে আমাকে সোনার হাঁস মনে হয়ে ছিল। আমিও তার মুখে টাকা ছুঁড়ে বাবার জমির টাকায় ব্যবসা চালাতে পেরেছিলাম। ঐ মেয়েটা আমার মনের ক্ষুধার্ত জীবনের একমাত্র চিহ্ন। আজকে একটু বাড়তি রা’গ দেখিয়েছি। বাট ডোন্ট ওয়ারি তোর ভাই প্রেমিক হিসেবে বেশ রোমান্টিক। দেখবি কালকেই তোর হবু ভাবীকে সামনে হাজির করে দেবো।’

দু’ভাইবোন আপনাআপনি হেসে ফেলল। আফরাজ দূরে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি দেখে চোখ মুছল। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)তারও তো একটা বোন থাকার কথা ছিল। কিন্তু আল্লাহর ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে ছেড়েই চলে গেল। ‘আফরিন’ নামটা মায়ের মুখে আর এলবাম-এ কয়েকবার ছবি দেখে ছিল। বোন নামক মানুষটির সাথে তারও খুব লাঘব থাকার কথা ছিল! হায় আফসোস! জীবনটা বড়ই অদ্ভুত।মিসেস ফেরদৌসী ছেলের মনোভাব বুঝতে পেরে ছেলের নিকট এগিয়ে যান। আফরাজ মা-কে দেখে বোনের ব্যাপার মাথা থেকে ঝেড়ে মা-কে জড়িয়ে ধরে। জনাব ইসমাইল খুশি হলেন অনাথ মেয়েটার বর্তমান পরিচয় বহনকারী একজন পেলো। তারা তো আছেই। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির চেয়ে বাপের বাড়ির মায়া মমতা এক মেয়ে কখনো ভুলতে পারেনা। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। স্ত্রী-সন্তানের দিকে চেয়ে তিনি মনেমন দোয়া পাঠ করলেন। যেনো কোনো কুনজর তাদের পরিবারের উপর না পড়ে।

চলবে…….

#অন্যরকম_তুমিময়_হৃদয়াঙ্গণ
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#অন্তিম_পর্ব

“খুব হাসা হচ্ছে সকলের। আমিও চলে এসেছি। দেখবো কতদিন আর হাসতে পারিস তোরা।”
তাবাসসুম সকলের হাসিমাখা চেহারা দেখে হাত মুঠোবদ্ধ করে আছে। সেও তার মায়ের হাত ধরে ভেতরে প্রবেশ করে। আকস্মিক কারো আগমনে আফরাজ সমেত সকলে পিছু মোড়ে। তাবাসসুম সকলকে বিড়ম্বনায় ফেলতে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,

“আমাকেও বলতে আমিও আসতাম। আফটার অল সেকেন্ড ওয়াইফ আফরাজ এর।”

এ কথায় যেনো কেউ পাত্তা দিলো না এমন ভান করলো। তাবাসসুম সেদিক চোখ দিয়ে মনেমন গা’লি ছুঁড়ে দেয়। আফরাজ এর নিকটে যেতে নিলে নাজীবা সপথে হাজির হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। ভান ধরল যেনো সে তার স্বামীর পাশে কাউকেই সহ্য করতে পারবে না। মুখ ঘুরিয়ে তাবাসসুম এর দিকে তাকিয়ে বলে,

“খবরদার আর এক কদম বাড়ালে তোর পা আর পা থাকবে না। যেখানে আছিস সেখান থেকে সোজা উল্টো পায়ে ফিরিয়ে যাহ্। এই ঘরপরিবারে তোর হক নেই বললেই চলে।”

নাদিম হাত তালি দিয়ে সামনের দিক ইশারা করে। তাবাসসুম চোখ ঘুরিয়ে মা-কে ধরে রুমের দিকে এগালো। নাজীবা ফিক করে হেসে দেয়। নাদিম পরিবারের সকলের সাথে কথাবার্তা বলে আফরাজ কে সঙ্গে নিয়ে কেবিনে ঢুকে পড়ে। যে যার রুমে বিশ্রাম নিচ্ছে। আফরাজ বলে,
“কালকের পার্টিতে গেস্ট হিসেবে সতর্ক থাকিস। তাবাসসুম এর বিশ্বাস নেই। নাজীবা-র ক্ষতি করে দিতে পারে। আমি চাইছি কালকে শরীয়ত মোতাবেক তাবাসসুম এর মুখের উপর তালাক বলে দিতে! শোন সিরিঞ্জ এনেছিস না?”

নাদিম মাথা নেড়ে সিরিঞ্জ-টা এগিয়ে দেয়। আফরাজ পকেটে ভরে রাখল। দু’জনে একে অপরকে আশ্বাস দিয়ে যে যার মত চলে যায়। দিনে কাজটি সম্পন্ন করার জন্য আফরাজ রুমের যাওয়ার সময় এক স্টাফকে ভাড়া করে রাখল। তখনি তার নজরে অচেনা এক মেয়ের চেহারা সামনে এলো। চেহারাটা এখানকার নয় তা মেয়ের গড়ন বলে দিচ্ছে। মেয়েটার নজর বুঝিয়ে দিচ্ছে সে চোরামি করে এসেছে। তার যাওয়ার পথ কোনদিকে তা অনুসরণ করার সময় রইল না আফরাজ এর। রুমে নাজীবা একলা হওয়ায় রুমের দিকেই অগ্রসর হয়। কিন্তু মাঝপথে বিষয়টি নাদিম-কে জানিয়ে রাখার কথা ভাবল। ফোন বের করে নাদিমকে মেসেজ করে দিলো। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
সকাল ১১টায় ফাংশন শুরু হলো। একের পর এক টুরিস্ট গেস্ট আসছে। তাদের মাঝে ফাহিম পরিবারের সদস্যগণ উপস্থিত। নাজীবা-কে কোনোভাবেও হাতছাড়া করছে না আফরাজ। সর্বক্ষণে নজরে রেখেছে। স্বামীর মাত্রাতিরিক্ত ফোকাস নিয়ে নাজীবা বিরক্তবোধ করছে। হঠাৎ মনে হলো তার ওয়াশরুমে যেতে হবে। বিনা সংকোচে স্বামীর হাতায় গুঁতো মে’রে বলে,
“আমি ওয়াশরুমে যেতে চাই।”
আফরাজ ‘চলো’ বলে টেনে নিয়ে যায়। নাজীবা হা করে তাকিয়ে স্বামীর সঙ্গেই গেলো। তাবাসসুম বুঝতে পারছে আফরাজ তার কারণে নাজীবার সঙ্গ ছাড়ছে না‌। তবে তা কতক্ষণ? এই ভেবে শ’য়’তানি হাসি দেয় আপনমনে তাবাসসুম। তার ভাড়া করা পুষ্প নামের মেয়েটিকে চোখের ইশারায় সিরিঞ্জ-টা এগিয়ে দেয়। আফরাজ এর পেছনের যেতে ইশারা করল। সিরিঞ্জ-টা হলো এক রোগীর এইচআইভি ভাইরাসের রক্তের। সে সংগ্রহ করেছে তার সতীনকে তীব্র কষ্টে মৃত্যুর মুখে ফেলার জন্য। পুষ্প মুখে কাপড় পেঁচিয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগালো। তাবাসসুম প্রশান্তির শ্বাস ছেড়ে হিয়া দেয়ান এর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু হিয়া দেয়ান কেনো যেনো নিজের ভারসাম্য ধরে রাখতে পারছেন না। তিনি আলতো হাতে মেয়েকে ধরে বসে পড়লেন। মায়ের অবস্থা দেখে ভ্রু কুঁচকে ‘কি হলো মম’ বলে উঠে। হিয়া দেয়ান মাথা নেড়ে ‘কিছু না’ বোঝায়। মনেমন তিনি নিজেও শরীরের অবস্থার অবনতি নিয়ে চিন্তিত।

আধাঘণ্টা পর এওয়ার্ড পর্ব শুরুর ঘোষণা করা হলো। আফরাজ এর সঙ্গে তাবাসসুম দাঁড়িয়ে যেতে এগোলেও কদম পেরুতে পারে না। কিংবদন্তি হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে থাকে। নাজীবার সুস্থ শরীর দেখে তার মাথার মধ্যে অজস্র প্রশ্নের ঘুরপাক খায়। তৎক্ষণাৎ পুষ্প কে ফোন লাগাল। ফোন ধরল না মেয়েটা। হঠাৎ একজন-কে পাশে এসে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে তাবাসসুম নিজে-কে স্বাভাবিক করে নেয়। নাকিব ওরফে নাদিম এসে বলে,

“যাকে খুঁজছো সে আর ফিরে আসবে না। সাবধানে থেকো তার কাছে দেওয়া সিরিঞ্জের ব্লাড যেনো আবার তোমার শরীরে না যায়?”

তাবাসসুম পাল্টা প্রশ্ন করার পূর্বেই সেখান থেকে নাদিম ভীড়ের মধ্যে মিলিয়ে যায়। আফরাজ বিবিজান এর সঙ্গে এওয়ার্ড রিসিভ করে সকলের সামনে বলে,’এই অংশটা কখনো পেতাম না আমার বিবিজান কে ছাড়া। সে আছে বলেই আমি পরিপূর্ণ। থ্যাংকিউ ফর কামিং মাই লাইফ বিবিজান।’
নাজীবার হিজাবের উপর চুমু এঁকে দেয়। মাস্কের আড়ালে লাজুক হাসে। কাজল আমতা আমতা করে নাদিম এর পাশে এসে দাঁড়ায়। সে পুরো রাত কান্না না করে ভেবেছে। সে যেমন বুঝতে না পেরে বাড়াবাড়ি করল তেমনি নাদিমের মাত্রাতিরিক্ত রা’গ দেখানো উচিৎ হয়নি।
দু’জনেই মৌনব্রত পালন করছে। কিন্তু নাদিমের এই মৌনতা পছন্দ হলো না। সে আক্ষেপের গলায় বলে,’বিয়ে করে আমার অর্ধাঙ্গিণী হতে চাও? একটা ভুলকে মাফ করে এই তোমার পথের ফকিরকে জীবনের বড় অংশ বানাতে দিবে? তোমার মনের মত সম্পদশালী না হলেও আমার হৃদয়ের ছোট আঙ্গিনায় যত্নে গড়া ভালোবাসা লুকিয়ে আছে। সেখানে তুমি আরামে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিতে পারবে। কোনো অভিযোগ হলে নির্দ্বিধায় বলে দেবে,কোনো প্রকার মৌনতা আমি আমাদের মাঝে চাইছি না। আরেকটা কথা পরনারীর প্রতি রা’গ থেকে আমায় নিয়ন্ত্রণ করে যেও তবুও বোনের প্রতি আমার ভালোবাসার নিখুঁতটার পরীক্ষা করতে চেও না।’

নাদিম এর প্রতিটি কথা শুনে মুখ চেপে কান্না নিবারণ করতে লাগে কাজল। কিঞ্চিৎ মুহূর্ত পর তাকে বুকে জড়িয়ে নেয়। কাজল পরম প্রিয়তমের আশ্রয় পেয়ে আহ্লাদী গলায়,’বিয়েতে আমি রাজি’ বলে দেয়। শুনে দুষ্টুমির হেসে নাদিম বলে,’তবে একটু অসভ্যতামি করা উচিৎ কি বলো?’
লজ্জা পেয়ে কাজল মিইয়ে গেল। নাজীবা ভাই-হবু ভাবীর এরূপ দৃশ্য দেখে চোখের উপর হাত রেখে বলে,

“ওপস আমি কিছু দেখিনী সরি।”

দু’জনে হকচকিয়ে গেলো। নাদিম মাথা চুলকে তখনই সরে যায়। কাজল পড়ল বিপাকে। পালিয়ে যেতে নিলে নাজীবা দিলো না। বরং তাকে ধরে আবদারের ঝুলি নিয়ে বসে পড়ল। তাবাসসুম এর মাথা ঘুরছে। সে হিয়া দেয়ান এর পাশে বসে পড়ল। আফরাজ ,আকবর,নাদিম আর জনাব ইসমাইল সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তাদের স্ত্রীগণ রিসোর্টের ভেতরের রুমে আছে। আফরাজ বুকের উপর হাত ভাঁজ করে বলে,

“আজ পরিবারের সবাইকে সাক্ষী মেনে তোমাকে তিন তালাক দিচ্ছি। এক তালাক আমার বিবিজান-কে অপদস্থ আর ভাইরাস আক্রান্ত করার প্রচেষ্টা করায়, দুই তালাক মা-মেয়ে মিলে জঘণ্য পরিকল্পনা করার জন্য আর তিন তালাক আমার জীবন থেকে সরে যাওয়ার জন্য। আলবিদা।”

নিজের কথা ব্যক্ত করে রাফিকে কল দিয়ে ডাকে। তাবাসসুম এর মুখে কোনো কথা নেই। কেনো না প্রথম তালাকের কারণ শুনে বুঝে গিয়েছে তার শরীরে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে। বোবার মত মায়ের দিকে তাকায়। তার মায়ের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে। হাত-পা অজান্তেই বেঁকে যাচ্ছে। প্যারালাইজের লক্ষণ বলা চলে। রাফি লেডি গার্ডস নিয়ে তাবাসসুম আর তার মা-কে ধরে উঠালো। তাবাসসুম আড়চোখে আফরাজ এর দিকে তাকায়। বোবার মুখে কথার বুলি না থাকলেও হৃদয়ের মাঝে অগ্নি ঠিকই জ্বলছে। হুংকার ছেড়ে তৎক্ষণাৎ হাতের ব্যাগ থেকে ছোট আতরের বোতল নিয়ে বোতলের মুখ খোলে নেয়। কেউ কিছু বোঝার পূর্বেই চিৎকার করে উঠে নাদিম। তিনজন হতভম্ব হয়ে গেল। আফরাজ এর হাতের উপর এসিড পড়তে গিয়েও পড়ল না। নাদিম এসে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। একারণে তার হাতে এসিড লেগে যায়। লেডি গার্ডস গু’লিবিদ্ধ করে দেয় তাবাসসুম এর শরীরকে। মুহুর্তেই তাবাসসুম এর শরীর র’ক্তা’ক্ত হয়ে গেলো। তবুও তার মুখে তৃপ্তির হাসি। সে নাজীবা-কে মৃত্যু দিতে না পারলেও তার ভাইকে পুড়াতে পেরেছে। এই যেনো তার জীবনের সার্থকতা। হিয়া দেয়ান মেয়ের নিথর শরীরের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলতে লাগেন। কথা বলার জো নেই। রাফি তাবাসসুম এর লা’শ কে নিয়ে তদন্তহীন ঝামেলা মেটাতে গেলো। নাদিমের গার্ডস এর মাঝে হৈচৈ লেগে গিয়েছে। গার্ডস নিয়ে তৎক্ষণাৎ নাদিম-কে হসপিটালাইজ করে। আফরাজ চিন্তিত। নাজীবা স্বামীকে ধরে চোখের পানি ঝরাচ্ছে। গতরাতেও ভাইকে পেয়ে সুখের পানি ঝরিয়ে ছিল। অথচ এক রাতের ব্যবধানে এমুহুর্তে চোখের থেকে বেদনার পানি ঝরাছে। মিসেস ফেরদৌসী বউমা কে টেনে বসিয়ে দেন। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)ছেলেকে ইশারায় নাদিম এর খোঁজ নিতে ইঙ্গিত দেন। অপারেশন কেবিন থেকে মাস্ক খুলে ডক্টর বের হলেন। সকলে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায়।
ডক্টর বলেন,
“আইম সরি টু সে এসিড বাজেভাবে লেগেছে মিস্টার নাদিমের বাম হাতে। কয়েকমাস পর বাম হাতটা নাড়াচাড়া করতে পারবেন তার আগে নয়। কিন্তু ওষুধের উপর রাখতে হবে যেনো হাতটা অচল না হয়ে পড়ে। আর দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে এসিডের দাগটা আজীবন রয়ে যাবে। ভারী কাজ করতে হলে হেল্পিং হ্যান্ড লাগবে। নাউ পেশেন্ট ইজ রেস্টিং। আফটার হাফ আওয়ার উই শিফট হিম ইন দ্যা কেবিন।”

নামাজ রুম থেকে বের হয়ে অপারেশন রুমের দিকে আসছিল কাজল। এসেই ডক্টরের কথা শুনে ফেলে। চোখ-মুখের বেহাল দশা বানিয়েছে। কাজলের বাবা ডক্টরের কথা শুনে মনেমন মেয়ের ভালোবাসার সিদ্ধান্ত নিয়ে আপত্তি জানান। অনড় কাজল। বাবার মুখের দিকে চেয়ে বলে,

“যাকে ভালোবাসি তাকে কখনো পরিস্থিতির খাতিরে ফেলে চলে যাবো না আমি। আমার নাদিম অচল হলেও তাকে আমি স্বামী রুপে মেনে নেবো। তবে তাকে ছাড়া অন্য কেউ নয়!”

মেয়ের কথায় কাজলের বাবা খুশি হলেন। এবার নাদিম এর জাগ্রত হওয়ার অপেক্ষা শুধু।
ঘুম ভাঙে নাদিমের। পাশে কান্নাময় চেহারা নিয়ে বোন-কে বসে থাকতে দেখল। বোনের হাত ধরতে ডান হাত উঠাতে নিলে নাজীবা নিজে ভাইয়ের হাত ধরল। নাদিম বলে,

“তোর সুখকে বাঁচিয়েছি বিনিময়ে আমার খুশিকে প্রাধান্য দিস।”

ভাইয়ের কথার অর্থ বুঝতে পেরে নাজীবা মাথা নাড়ল। নাদিম সকলের সাথে টুকটাক কথা সারলেও তার চোখজোড়া এক রমণীর উপস্থিতি খুব করে অনুভব করছে। জানে না মেয়েটা নিজের কি হাল করেছে? আদৌ সুস্থ আছে কিনা বুঝতে পারছে না। লজ্জায় বোনের শ্বশুরবাড়ির কাউকেও জিজ্ঞেস করছে না। বোন কি ভাববে তা ভেবে মৌন রইল। অথচ নাজীবা ভাইয়ের অস্থিরতা ঠিকি ধরতে পেরেছে। কেশে সকলকে নিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। তখন দীমি পায়ে প্রবেশ করে কাজল। তার দিকে শীতল নয়ন ফেলল নাদিম। মেয়েটার চোখের কোণে পানি চকচক করছে। পুনরায় রাতের কথাটি তুলে বলে,

“আমাকে কি আর বিয়ে করবে কাজল্লতা? আমি কি আর তোমার স্বামীর যোগ্য রয়েছি? নাকি আমার এই এসিড পোড়ানো হাত দেখে অযোগ্য হয়ে পড়লাম। তুমি নিসংকোচে বলতে পারো‌। আমি নিজ হাতে আমার কাজল্লতার বিয়ে অন্যপারে দেবো। আমি অযোগ্য হলেও আমার হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা কখনো মিথ্যা হবে না।”

“ব্যস চুপ করুন। এতো কথা বলতে বলেছি আমি? ব’দ’মাই’শ হা’রা’মজা’দা কু’ত্তা।”
গা’লি ছুঁড়ে কোনো দিকবেদিক না মেনে নাদিমের নিকট ছুটে গিয়ে ওষ্ঠজোড়া মিলিয়ে দেয়। নাদিম এর চোখজোড়া বড় বড় হয়ে গেলো। তার হবু অর্ধাঙ্গিণী এতো ফাস্ট জানা ছিল না তার! কাজল পরম আবেশে নাদিম এর পাশে খানিক স্থান জুড়ে বসে দুজোড়ার শুকনো ওষ্ঠদ্বয় ভিজিয়ে নিচ্ছে। আফরাজ তার শা’লকের প্রাইভেসির জন্য সকলকে নিয়ে রিসেপশনে চলে যায়। আকবব,রাফি,জনাব ইসমাইল থাকল হাসপাতালে। আফরাজ মহিলাগণ কে রিসোর্ট এ না রেখে বাসায় ছেড়ে হসপিটালে ফিরে আসল।

পাঁচ মাস তিন সপ্তাহ পর…..
নাজীবার দম ফেলার অবকাশ পাচ্ছে না। নিজ হাতে নাদিম ভাইয়ের বিয়ের আয়োজন করছে। কুসুমার ভারী পেট নিয়ে কাজ করা অসম্ভব। অসহায়ের মত তাকিয়ে আছে। তারও ইচ্ছা করছে বিয়ের আনন্দ উপভোগ করতে। সবার ভালোবাসার কাছে পরাজয় হয়ে বসে আছে। নতুন মাসের প্রথম সপ্তাহেও সুখবর শোনা যেতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন ডক্টর।
আফরাজ পায়জামা-পাঞ্জাবী পরে গোমড়া মুখে বসে আছে। কেমন পাষাণ নারী সে! তার আর্দশ ভাইয়ের বিয়ে বলে সে আর কুসুমা ভাবী রাতের আঁধারেই বাসায় চলে গেল। ফোনের দিকে বারংবার চোখের দৃষ্টি ফেলছে। কোনো ফোন কল অব্দি দিলো না পাষাণ নারীটি। মিসেস ফেরদৌসী ছেলের রুমে এসে তাড়া দিলেন। আফরাজ বিরক্তিকর গলায় বলে,

“যাবো না আমি। যান আপনারা।” ছেলের কথা শুনে মিসেস ফেরদৌসী মৃদু হেসে চলে যান। আফরাজ পাত্তা না পেয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে ঘাপটি মে’রে বসে রইল।
মিসেস ফেরদৌসী-রা আকবর-কে কে নিয়ে গাড়িতে উঠে গেলেন। জনাব ইসমাইল ছেলের রুমের জানালার দিকে তাকিয়ে উচ্চ গলায় বলেন,

“ব্যাটা মেয়েদের মত মুখ না ফুলিয়ে চলে আয়।”

আফরাজ পা দিয়ে পা’রা দিচ্ছে। হঠাৎ ফোনে নোটিফিকেশন এলো। মেসেজ রেকর্ড বোধ হয়। রেকর্ডিং চালু করতেই নাজীবার কণ্ঠ শুনতে পায়। আক্ষেপের সুরে জলদি আসার জন্য বলছে। আফরাজ ফোন পকেটে ভরে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
বিয়ের মঞ্চে শেরওয়ানি পরিহিত বর জনাব নাদিম মুসসারাত অস্থীর হয়ে বসে আছে। নতুন জীবন শুরুর অনুভূতি তাকে উদগ্রীব বানিয়ে দিচ্ছে। তার হবু স্ত্রীর অপেক্ষায় কাতরাচ্ছে। নাজীবাও আজ ভাইয়ের বিয়ে বলে সৌন্দর্যে মোড়ানো সাজ দিয়েছে। তার বোরকায় স্টোন এটার্চ করা।
গাড়ির হর্ন শুনে নাদিম উৎসুক দৃষ্টিতে চাইল। আফরাজদের দেখে খুশি হলো বটে। মঞ্চের উপর উঠে আফরাজ পরিবার সমেত কোলাকুলি করল। জনাব ইসমাইল আর মিসেস ফেরদৌসী দোয়া দিলেন নতুন বরকে। আফরাজ উৎসুক দৃষ্টি দিয়ে বিবিজান কে খোঁজে চলেছে। দেখা পাচ্ছে না বলে মনেমন রা’গ ঝারছে মেয়েটার উপরে। হাতে গ্লাস ভর্তি শরবত নিয়ে মঞ্চের দিকে আসছিল নাজীবা। জিভে কামড় লাগায় বুঝতে পারল কোনো এক শ’য়’তান খুব করে বকেছে। আফরাজ এর অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। নাজীবা হাসিমাখা মুখশ্রী নিয়ে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন কে শরবত দিয়ে আপ্যায়ন করল। স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে বাহুডোরে হাত পেঁচিয়ে বলে,

“জানেন কোনো এক কু’ত্তা বিলাই আমাকে গা’লি দিছে। আমার জিভে জোরে কামড় খাইছি। ব্যাটা কী ব্যাটি যেই গা’লি ছুঁড়ছে তারে আমি পেলে পঁচা নালায় ডুবাবো।”

বিবিজান এর কথা শুনে ঢোক গিলল আফরাজ। মনেমন আর কখনো গা’লি বা বকা দিবে না বলে নিজের কাছে শপথ করে।
নাদিম কে আর অস্থিরতায় ভোগালো না মেয়েপক্ষ। কাজলের কাজিনরা বিয়ের মঞ্চে উঠালো। নাদিম বউয়ের হাত ধরে পাশে বসায়। মিটমিটে হাসির শব্দ বুনল। কাজীও চলে এলেন। কাবিননামা দেনমোহর ধার্য করে দুজনের বিয়ে পড়ানো হলো। সকলে ‘আলহামদুল্লিল্লাহ্’ বলে দোয়া পাঠ করে। কাজল কে ভাবী ডেকে নাজীবা আর কুসুমা দুষ্টুমি করতে লেগে পড়ে।
খাওয়ার পর্ব শেষে অতিথিবৃন্দ বেরিয়ে যায়। কাজলকে ভাইয়ের রুমে বসিয়ে নাজীবা অধীর আগ্রহে টাকা হাতানোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। নাদিমকে আকবর আর আফরাজ টিজ করতে করতে রুমের কাছে আনলো। বিবিজান কে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলে,

“বিয়ে হয়েছে তোমার ভাইয়ের। পথের থেকে সরে ঢুকতে দাও তারে। জানো না আজ রাতে তোমার ভাই বিলাই মা’র’বে।”

লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়ে গেলো নাদিম। নাজীবা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে,

“হাতের মধ্যে কচকচে দশটা হাজারের নোট রাখো। নাহলে রুমে প্রবেশ করার কথা তো ভুলেই যাও।”

নাজীবার পক্ষ নিতে কাজলের কিছু কাজিনও হাজির হয়ে যায়। যা দেখে আকবর মিইয়ে যাওয়া গলায় বলে,

“ভাই দিয়ে দেহ্। নাহলে আমাদের মত অবলা জোয়ান পুরুষদের হরণ করে নেবে এই মাইয়াগণ। সবগুলোই টাকার ক্ষুধার্ত। টাকা না পেলে আজ রাত আমাদের অন্তিম রাত হয়ে যাবে।”

নাদিম টাকা দিয়ে দেয়। মেয়েরা টাকা পেয়ে ছু’মন্তুর হয়ে যায়। আফরাজ এর নজর তখনও নাজীবার দিকে। আজ মেয়েটা তারে পাগল বানিয়ে ছেড়েছে। নাদিম ভেতরে ঢুকে পড়লে আফরাজ হাই তুলে বলে,

“যাহ্ ব্যাটা ভাবীর কাছে যাহ্। হবু বাচ্চাকে আগলে নিয়ে আদর কর। আমিও গিয়ে আরেকবার বাসর ছাড়ি। আজ নাহয় বাচ্চার প্রসেসিং চালু করব।”

“বকরচকর ব্যাটা। যাহ্ ভাগ এখান থেকে।”

বন্ধুকে লা’থ মা’রতে নিলে আফরাজ তৎক্ষণাৎ দূরে সরে যায়। চোখ টিপ দিয়ে বিবিজান এর কাছে গেল। রুমে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে না পেয়ে বিরক্ত হলো। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)মেয়েটা খালি খাপছাড়া ভাব নিয়ে পালিয়ে বেড়ায়। কোথায় তুই জামাইকে পেয়ে আদর করবি তা না উল্টা টইটই করে ঘুরে বেড়াস। ড্রয়িং রুম থেকে হৈচৈ এর শব্দ শুনে আফরাজ উঁকি মেরে দেখল। কাজিনপক্ষ এর সাথে নাজীবা আড্ডা দিচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে লাঠি একখান হাতে নিলো। তাদের মাঝে গিয়ে বলে,

“সবার টাকা ভাগাভাগি শেষ। একেকটা ডান্ডার বা’রি খেতে না চাইলে যে তার রুমে পালাও।”

তাদের আর পায় কে? হুডমুড় করে নাজীবাকে রেখে পালিয়ে যায়। লাঠিটা রেখে বুকের উপর হাত গুজল আফরাজ। স্বামীর নীরব মেজাজ দেখে আমতা আমতা করে বলে,

“আ আমি আজকে ভাবীর কাছে থাকি কেমন?”

কথা বলার অজুহাত না পেয়ে এটুকু বলে পালাতে নিলে আফরাজ পাঁজাকোলা করে নেয়। নাজীবা ভীতি গলায় বলে,

“দেখেন উল্টাপাল্টা কিছু করলে ভাইকে বলে দেবো।”

“দাও দেখি। আজ আমার শা’লাও বাপ হওয়ার প্রসেসিং নেবে। এদিকে আমি? একবছরের মত হচ্ছে বিয়ে করেছি। বাপ ডাক আর কত দেরিতে শুনবো। আজ আমিও চক্কা মা’র’ব। গেট রেডি বিবিজান।”

নাজীবা মাথা নেড়ে ‘না না’ করছে। ছাড় পেল না। রুমে গিয়ে বিবিজান কে আপন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আফরাজ। মন-মস্তিষ্কে শুধুই এখন তার বিবিজান। সুখের মুহূর্তে আফরাজ ফিসফিসিয়ে বলে,”আমার বিবিজান কে আমি #হৃদয়াঙ্গণ এ আগলে নিচ্ছি।”
পরম আবেশে নাজীবা আঁকড়ে ধরল তার আফরাজ কে।

দু’বছর পর……

কুসুমা তার দু’বছরের বাচ্চা আজিম কে কোলে নিয়ে চিন্তিত মুখে নাজীবার পাশে বসে রইল। আজিম কে বিছানায় শুয়ে দেয়। আজিম তার বড়’মাকে খুব পছন্দ করে। কারণ কুসুমা অসুস্থ অবস্থায় নাজীবা মায়ের মমতায় পালন করতো। হামাগুড়ি দিয়ে নাজীবার কোলে মাথা রাখে। আফরাজ তিনমাস হলো দেশের বাহিরে গিয়েছে। তার সাথে কন্টাক্টও করা যাচ্ছে না। ছেলেটা এমন কেনো? কুসুমা বুঝে না। তার বউত চিন্তায় চোখের নিচে কালি বসিয়ে ফেলেছে। বউ-মার আকস্মিক মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ায় মিসেস ফেরদৌসী বেশ ভয় পেয়েছেন। জনাব ইসমাইল চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন।

“আমাদের বউমা ঠিক আছে তো ডক্টর? আপনি কিছু বলছেন না যে?”

“কি বলবো? আপনাদের খুব সর্তক হওয়া উচিৎ। আপনাদের বাড়ির বউ যে তিনমাসের গর্ভবতী সে খবর রেখেছেন?”

ডক্টরের হাস্যজ্জ্বল মুখশ্রী থেকে কথাগুলো শুনে সকলের মুখে হাসি ফুটল। জনাব ইসমাইল ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বললেন। তৎক্ষণাৎ আকবরকে মিষ্টির জোগান দিতে বলেন। সেও চাচা হওয়ার খুশিতে আফরাজ কে মেসেজ করে দেয়। অন্যথায়, আফরাজ মিটিং এ ব্যস্ত ছিল। প্রেজেন্টেশন দিচ্ছিল। তার ফোনে মেসেজ আসায় চোখের দৃষ্টি সেদিক দিতে পারল না। বিদেশে আসার পর থেকেই মিটিং,কাজের চাপে বাসার কারো সাথে কথা বলতে পারছিল না। ফোন দেখার সময় অব্দী পেতো না। আকবর একটু আধটু বাসার খবর সম্পর্কে রেকর্ড পাঠাতো। নাজীবার মেসেজ কল দেখেও রিপ্লাই করতো না। কারণ তারও মন জ্বলত। কাজের চাপে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতো। কাজ যত জলদি শেষ করবে তত জলদি সে বাসায় ফিরতে পারবে।
আড়াইঘণ্টা পরে কেবিনে ফিরে এসে বসল আফরাজ। ফোন হাতে নিয়ে আকবর এর পাঠানো মেসেজটা পড়ল। ‘আমি চাচা হতে যাচ্ছি।’ আফরাজ বুঝল না। পাত্তাহীন রেখে দিল। পরক্ষণে টনক নড়ে। আকবর চাচা হচ্ছে মানে? কথাটা তার মস্তিষ্কে জোয়ার তুলল। ফোন হাতে নিয়ে পুনরায় মেসেজটা পড়ে। হঠাৎ খুশিতে চিল্লিয়ে উঠে। তৎক্ষণাৎ বিবিজান কে কল দেয়। স্বামীর কল পেয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয় নাজীবা। এরোপ্ল্যান মোড অন করে রেখে দেয় ফোন। আফরাজ বিবিজান এর অভিমান বুঝতে পারল। কালকেই শেষ প্রেজেন্টেশনটা রেডি করে ফেলবে। এরপর বিবিজান এর অভিমান ভাঙ্গাতে ফিরে যাবে।
পরের রাত প্রায় তিনটা নাগাদ….
তাহাজ্জুদ এর নামাজ আদায়ে বসেছে নাজীবা। মিনিট খানেক পর সালাম ফেরানো শেষে তার চোখজোড়া খুলে। পাশে আফরাজ কে দেখে স্তদ্ধ হলো। পরমুহূর্তে খিলখিলিয়ে হেসে স্বামীকে বুকের উপর লুটে পড়ে। রাত দুইটার সময় দেশের মধ্যে পৌঁছেছে আফরাজ।নাজীবা ব্যতীত সকলের আফরাজ এর আগমন বার্তা জানা। জনাব ইসমাইল,আকবর আর নাদিম এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছিল। আফরাজ এর উতলা মন বিবিজান কে দেখার জন্য ছটপট করছে। নাদিম এর সাথে মজামাস্তির মাঝে মোবারকবাত দিলো। কেনো না নাদিম বাবা হয়েছে সপ্তাহ খানেক হবে। তার কন্যা সন্তানের ছবি দেখেছিল ফোনে। নাম ‘কণিকা মেহজাবিন’ রেখেছে। নাদিম হেসে বলে, ‘তুইও কম কিসে? মাশাআল্লাহ অবশেষে বাচ্চার বাপ হতে চলেছিস।’

আফরাজ হাসল। দু’বছর অপেক্ষার পর তাদের কোলজুড়ে সন্তান আসতে চলেছে। দু’বছর আগেও নাজীবার প্রেগন্যান্সি নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিলো। মেয়েটা গর্ভধারণ করতে না পারার কষ্টে নেতিয়ে পড়েছিল। ডক্টর দেখিয়েও লাভ হয়নি‌। রিপোর্টে সব শুদ্ধ পাওয়া যেতো। বিঘ্নিত মনে নাজীবাও দূরত্ব বাড়ায়। কিন্তু আফরাজ অসীম ধৈর্য্য দ্বারা বিবাহ সম্পর্ককে অটুট রাখে। প্রতিসময় আল্লাহর কাছে মানত করত। সবচেয়ে বড় ব্যাপার আফরাজ তাবাসসুম এর মায়ের সুস্থতা কামনা করে ভালো আশ্রমে রেখেছে। সব হারিয়ে হিয়া দেয়ান এর মাঝে কোনো প্রতিহিংসা নেই। তিনিও মনেমন আফরাজ আর নাজীবার জন্য দোয়া করেন। প্রশান্তির শ্বাস ছেড়ে আফরাজ গাড়ি থেকে নামে।
তড়ফড়িয়ে বিবিজান এর দর্শন পেতে রুমে চলে যায়। সেখানে নামাজরত বিবিজান কে দেখে সেও পরিপাটি হয়ে নামাজে বসে পড়ে। স্বামী-কে পেয়ে নাজীবা আহ্লাদী গলায় বলে,

“আর কিন্তু কষ্ট দিবেন না। নাহলে আমি আমাদের বাবুকে নালিশ দেবো।”
“তাহলে তো আমার বাবুর আম্মুর খুব যত্ন নিতে হবে। নাহয় পুচকা বা পুচকি এসে চ’ড় মা’র’বে।”

কথাটা বলে বিবিজান এর পেটে আলতো হাত ছুঁয়ে চুম্বন দেয় আফরাজ। বিবিজান এর গালে এক হাত রেখে বলে,

“আজীবন আমার হয়ে থেকো বিবিজান , শুধুই আমার হৃদয়ের আঙিনায় #অন্যরকম_তুমিময়_হৃদয়াঙ্গণ রূপে থেকো।”
স্বামীর হাত আঁকড়ে ধরে মিহি গলায় বলে,”ইন শা আল্লাহ থাকব।”
আফরাজ বিবিজান কে বুকে আগলে রেখে জানালার বাহিরে আকাশের মধ্যে লুকোচুরি করা মেঘের দিকে চেয়ে থেকে আদুরীয় কন্ঠে কথার ঝুলি খোলে বসে। একফালি চাঁদ এর রশ্নিতে তারা নিজেদের মনভাব প্রকাশ করছে।

সমাপ্ত……

(অতএব, গল্পের সমাপ্তি ঘটলো। ভুলগুলো ক্ষমা করবেন আর গল্পটা নিয়ে আপনাদের মন্তব্য চাই। আশা করি আপনারা মন্তব্য করবেন। কোনো একসময় ইন শা আল্লাহ আবারো নতুন গল্প নিয়ে হাজির হবো। আপনাদের এই লেখিকাকে ভুলবেন না। ফিরব কোনো একদিন ইন শা আল্লাহ। ততদিন ভালো থাকবেন। দোয়া করবেন আমার জন্য। আল্লাহ হাফেজ)

তোমাতে বিলীন হবো পর্ব-৪৪ এবং শেষ পর্ব

0

#তোমাতে_বিলীন_হবো
#Tahsina_Arini
#পর্ব_৪৪ (শেষ পর্ব – প্রথম অংশ)
(অনুমতি ব্যতীত কপি নিষিদ্ধ)

রাতে তননের উশখুশ করা দেখে তাহসী ফিসফিস করে বলে উঠলো,
-“কি হয়েছে?”

অন্ধকারের মধ্যেই তাহসীর চোখের দিকে তাকিয়ে তনন বললো,
-“বুঝো না!”

তাহসী চোখ নামিয়ে নিল। তনন তাহসীকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসলো। তাহসীর ঠোঁটে ঠোঁট মিশিয়ে দিল। তাহসী চোখ বন্ধ করে তননের কাঁধ আকড়ে ধরলো।
কিছুক্ষণ পর পায়ে হাঁটার শব্দ পেয়ে তনন তাহসীকে ছেড়ে দিল। সম্ভবত সেলিনা শেখ বা তনু ঘুম থেকে উঠেছে ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য। ওনারা রুমে আর তাহসী,তনন ডাইনিং রুমে ঘুমিয়েছে।

তাহসী তননের দিকে তাকালো। তনন তাহসীর দিকে তাকিয়ে ছিল। কিছুক্ষণ পর তাহসী ফিসফিস করে বললো,
-“ঘুমিয়ে পড়ো।”

-“হু।”
তাহসীর বুকে মাথা রেখে তাহসীকে জড়িয়ে ধরলো তনন। তাহসী তননের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।

🍁🍁🍁🍁
কেটে গেছে দুই বছর। দুই বছরে অনেক কিছু পাল্টিয়েছে।‌ তনন, তাহসী পড়াশোনার দিক থেকে এক ধাপ এগিয়ে গেছে। তাহসী মাস্টার্স এ ভর্তি হয়েছে। তনন আপাতত একটা কম্পানি তে জয়েন করেছে। দুইটা টিউশনি করায় আর বিসিএস এর প্রস্তুতি নিচ্ছে।‌ সরকারি চাকরির জন্য পরীক্ষা ও দিচ্ছে।
নাহিদ আর মিথিলার ছোট্ট এক ছেলে বাচ্চা হয়েছে যার বয়স মাত্র চার মাস। নাঈম আর শশীর মেয়ে বয়স এক বছর নয় মাস। ডাক নাম বিনি। অল্প অল্প কথা বলতে পারে আর হাঁটতেও পারে।
শশী এইচএসসি পরীক্ষা দিবে। আর নাঈম দ্বিতীয় বর্ষে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ছে।

ঈদ উপলক্ষে ছুটি পেয়েছে তনন পাঁচদিন। তাহসী মুখ ফুলিয়ে বারান্দায় যেয়ে বসে আছে। আগের বাসাতেই থাকে তারা। ভাড়া আগের চেয়ে দুই হাজার বেড়েছে। বেড়েছে বলতে চাকরি পাওয়ার পর তনন নিজ থেকেই দুই হাজার টাকা বেশি দেয়।

তনন কফি বানিয়ে নিয়ে যেয়ে তাহসীর পাশে দাঁড়ালো। তাহসী সেদিকে তাকালো না। তনন কফিতে চুমুক দিয়ে বললো,
-“কি করবো বলো? ছুটি কি আমার হাতে?”

-“ছয়মাস বাসায় যাই না তনন! এত কম ছুটি! ঈদের জন্য অপেক্ষা করে আছি। স্কুল লাইফ ই ভালো ছিল। রোজার এক মাস ছুটি।”

তনন হাসলো। বললো,
-“তা তো ভালো ছিলই। এত এত দায়িত্ব ছিল না। কি আর করার! আমি যাই দেখি বাসে দুপুরের টিকিট কেটে আসি। ব্যাগ গুছিয়ে ফেলো। এখন নয়টা বাজে।”

-“আমি পারবো না এত তাড়াতাড়ি আসতে।”

-“আমিও একা থাকতে পারবো না।”

-“ভীতু!”

-“কে বলেছে হ্যা? তোমাকে ছাড়া একা থাকতে পারবো না।”
এক হাতে তাহসীর কোমর জড়িয়ে ধরে বললো তনন।

তাহসী তননের দিকে তাকালো। এই দুই বছরে তননের সৌন্দর্য আরো বেড়েছে।‌
-“তাহলে ছুটি বাড়িয়ে দিতে বলতে হবে। না দিলে ছুটি নিয়ে নাও‌।”

কফির মগ পাশে রেখে তাহসীর গালে হাত রেখে তনন বললো,
-“এটা বেসরকারি কোম্পানি বেবি! এত সহজ না। ঘুষ ছাড়া চাকরি পেয়েছি এটাই তো কত।”

-“কি জন্য আবার! আল্লাহ ভাগ্যে রেখেছিলেন তাই বন্ধুর বাবার কম্পানি তে জব হয়ে গেল। ঘুষ লাগলো না।”

-“যাইহোক বাদ দাও। একটু হেসে ব্যাগ গোছাও প্লিজ। দেরি হয়ে যাবে।”
তাহসীর কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে তনন বেরিয়ে গেল। তাহসী দরজা আটকে ব্যাগ গোছাতে গেল।
কতদিন পর বাসায় যাবে তাহসীর আর ভালো লাগছে না অপেক্ষা করতে। সেই কবে থেকে তনন কে জ্বালিয়ে মারছে বাসায় যাওয়ার জন্য। শশীর পিচ্চি টা কে খুব কাছ থেকে দেখতে মন চাচ্ছে।

সন্ধ্যার দিকে গ্রামে পৌঁছে গেল তনন, তাহসী। তাহসীকে তার বাড়ি নামিয়ে দিয়ে তনন নিজের বাড়ি যাবে। এটা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। দুজন দুজনের বাড়ি যাবে। ঈদের দিন তাহসী তননের বাড়িতে যাবে। তনন কিছু বলিনি। মেনে নিয়েছে। তাহসী অনেকদিন থেকে আসার কথা বলছে। তার জন্যেই আসতে পারে না। বাসাতে তাহসীকে ছাড়া ভালো লাগে না তননের। আড়াই বছর একসাথে থাকতে থাকতে দুজন দুজনের অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। ভালোবাসা বেড়েছে কয়েক গুণ।

তাহসী বিনি সোনা বলে ডাক দিতেই বিনি দাঁত বের করে হাসতে হাসতে মূল দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ভিডিও কলে কথা বলায় চিনতে কোনো অসুবিধা হয়নি। বিনি তাহসীদের বাড়িতেই ছিল। নাঈম বাড়িতে থাকলে শশী এই বাড়িতে থাকে। চলে গেলে আবার নিজের বাড়িতে চলে যায়। আবার নাঈম ও মাঝে মাঝে যায় ওখানে। কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। এখন বেশ সুখেই আছে শশী। শিমুল রহমান আগের মতো খারাপ ব্যবহার করে না। এই কয় বছরে সবাই ভুলেই গেছে ওদের ঘটনা।
বিনি নানী,দাদি দুজনের কাছেই থাকে। শশী নিজের মতো পড়াশোনাতে ব্যস্ত। বিনি মাকে জ্বালায় না তেমন।

তাহসী কোলে তুলে নিল বিনিকে। নাতাশা রহমান শুধু তাহসী কে দেখে বললেন,
-“তনন কোথায়?”

-“চলে গেছে।”

-“চলে গেছে মানে!”

তাহসী কে বাড়ির কাছে দিয়েই তনন আগেভাগে চলে গেছে। ভালো করে জানে তাকে দেখলে এখন আর যেতে দিবে না এই বাড়ির মানুষ।

তাহসী ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
-“ওর বাড়ি যাচ্ছে। ভিতরে আসলো না। রাতে যেতে দিবানা তাই।”

-“তো তুই ওকে আনবি না?”

-“ঢাকা থেকে ঠিক করে আসা ও ওর বাড়িতে যাবে, আমি আমার বাড়িতে আসবো।”

নাতাশা রহমান আর কিছু বললেন না। হাজব্যান্ড ওয়াইফ এর ব্যাপারে নাক গলাতে চান না। একে একে ড্রয়িং রুম থেকে সবাই এগিয়ে আসলো। নাহিদ ও গ্রামে এসেছে। তাহসী মিথিলা কে দেখলো না। নাহিদ জানালো মিথিলা রুমে বাচ্চা কে ঘুম পাড়াচ্ছে। তাহসী বললো ঘরে যেয়ে দেখা করে নিবে।

তাহসী বিনিকে নিয়ে রুমে গেল। প্রশ্ন করলো,
-“আমাকে মনে আছে তোমার? বলোতো কে?”

-“ফোনে কথা বল। ফুপিইইই।”

-“এইতো সোনা বাবুটা আমাকে মনে রেখেছে।”
তাহসী ব্যাগ খুলে খেলনা এগিয়ে দিল ওর দিকে।

বিনি নতুন খেলনার দিকে চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে বললো,
-“আমাল জননো (জন্য)?

-“হ্যা।”

-“বাবা লাগ (রাগ) কলবে না!”
ভ্রু কুঁচকে বললো ছোট্ট বিনি।

-“না, তো। আমি তো ফুপি তোমার।”

-“তুমি জানো পাশেল (পাশের) গলে(ঘরে) একটা বাবু আছে, ওল (ওর) সাথে কেলবো এটা নিয়ে?”

-“যা খুশি তাই করতে পারবে। তবে ও তো এখনো ছোট। খেলতে পারবে না। ওর জন্য অন্য খেলনা এনেছি।”

শশী ও রুমে এসেছে। শশী কে দেখে তাহসী বললো,
-“তুমি মামুনির সাথে থাকো। আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।”

বিনি চোখ তুলে তাকালো। শশীকে দেখে ওর কোলে উঠে পড়লো। গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
-“এটা তো আম্মু!”

-“আচ্ছা, আম্মুর কাছে থাকো।”

তাহসী শশীর সাথে হাসি বিনিময় করে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। শশী বিনিকে নিয়ে বিছানার উপর বসলো। বিনি মাকে নতুন খেলনা দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

চলবে ইনশাআল্লাহ;

#তোমাতে_বিলীন_হবো
#Tahsina_Arini
#পর্ব_৪৫(শেষ পর্ব- শেষ অংশ)
(অনুমতি ব্যতীত কপি নিষিদ্ধ)

তাহসী ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে টাওয়েল দিয়ে হাত মুখ মুছতে মুছতে শশীর সামনে বসলো। বিনি তখন মায়ের কাছে বসে নতুন খেলনা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে ব্যস্ত।

তাহসী হেসে শশীর উদ্দেশ্যে বললো,
-“কেমন যাচ্ছে দিনকাল?”

বিনির চুল নেড়ে দিতে দিতে শশী বললো,
-“এই তো বেশ যাচ্ছে। আলহামদুলিল্লাহ।”

দুজনে আরো কথা বললো। শশী কথার ঝুলি নিয়ে বসলো। তাহসীর ভালো লাগলো মেয়েটা এতকিছুর পরও পাল্টায়নি দেখে।

🍁🍁🍁
অনেকদিন পর এই কয়দিন পরিবারের সাথে অনেক ভালো সময় কাটলো তাহসীর।
তননের সাথে বাড়ি এসে দেখা নেই। শুধু মেসেজে কথা হয়েছে।
তনন,তাহসীর দেখা হলো একবারে ঈদের দিন সকালে। ঈদের দিন তননের পরিবারকে তৌহিদ হোসেন দাওয়াত দিয়েছেন। তনন মা-বোনকে সকাল এগারোটার দিকে এসেছে এখানে। তবে এখনো তাহসীর দেখা পাইনি।

তাহসী তখন গোসল করতে ব্যস্ত। ঈদের দিন সকালেই গোসল করতো। কিন্তু শীতের কারণে হয়নি। তুলনামূলক শীত বেশি ঈদের দিন।

তাহসী ওয়াশরুম থেকে বের হতেই চোখ পড়লো বারান্দার দিকে। দেখে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ভ্রু কুঁচকে একটু কাছে যেয়ে উঁকি দিয়ে দেখলো তনন দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছে।
তনন ও এদিকে আসলো ওয়াশরুমের ছিটকিনির আওয়াজ পেয়ে।

-“আসসালামু আলাইকুম।”

-“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কি ব্যাপার? ঈদের দিন সকালে পায়েস বাদ দিয়ে কফি!”
তাহসী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বললো।

বিছানায় বসে তনন উত্তর করলো,
-“পায়েস খেয়ে নামাজ পড়তে গেছিলাম। এখানে এসে আম্মা অফার করলো, তাই না আর করিনি।”

-“আচ্ছা!”

-“নিউজ আছে একটা!”
কফির মগ ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে বললো তনন।

তাহসী চুল মুছে টাওয়েল রাখতে গেলে তনন তাহসীকে টেনে বিছানার উপর বসালো। মাথার নিচের দিকের চুল মুছে দিতে দিতে বললো,
-“চুল ভেজা এখনো! ঠান্ডা লাগবে না?”

তাহসী টাওয়েল মাথায় পেঁচিয়ে রাখে। কিছুক্ষণ থাকার পর খুলে ফেলে। এতে পানি পরে না আর। চুল না মুছে এমনিতেই যখন চুলের পানি চলে যাচ্ছে, তাহসীর কাছে এটাই বেটার অপশন মনে হয়। আজ ঈদের কারণে সাথে সাথে খুলে ফেলেছে। মাথায় টাওয়েল পেঁচিয়ে রাখতে মন চাচ্ছে না আজ।
তাহসী সেই কথায় গেল না। বললো,
-“কি নিউজ এই দুই আড়াই ঘন্টায়? সকালেও তো কথা বললাম।”

-“নিউজ টা অবশ্য এক দিনের পুরোনো। ভাবলাম সামনাসামনি বলি!”

তাহসী কিছু বলার আগেই শশী দরজায় টোকা দিয়ে বললো,
-“আসবো কি?”

-“আয়।”
তাহসী বললো।

তনন চুল মোছা শেষ করে টাওয়েল বারান্দায় দিয়ে আসতে গেল। শশী তাহসীর কাছে যেয়ে বললো,
-“হাউ রোমান্টিক! তোমাদের নিচে ডাকছে।”

-“চল যাচ্ছি।”
বলে উঠে দাঁড়িয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে তাহসী চিরুনি তুলে নিল।

তনন চলে গেল ওদের রেখে। তননের চলে যাওয়া দেখে শশী আর গেল না। তাহসীর চুল আঁচড়ানো শেষে দু’জন একসাথে নামলো।

__________
সন্ধ্যার সময় তননের বাড়িতে ফিরলো তনু, তাহসী আর তনন। সেলিনা শেখ আগেই চলে আসছিলেন। ওরা ঘোরাঘুরি শেষে এসেছে।

সেলিনা শেখ মাংস আর লুচি রাখলেন ওদের সামনে। তনু ও তননের রুমেই কথা বলছিল। তনন বিছানার উপরেই বসে গেল খাবার নিয়ে। ডাইনিং টেবিল যেহেতু বারান্দায়। শীতের রাতে বারান্দায় খাওয়া হয় না।

তাহসী এসব দেখে বললো,
-“এসবের কি দরকার ছিল মামুনি! বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি।”

সেলিনা শেখ মুচকি হেসে বললেন,
-“পিছনে তাকিয়ে দেখো। কি দরকার!”

তনন মুখের খাবার গিলে বললো,
-“এখন আমাকে খাবারের খোঁটা দেওয়া হচ্ছে!”

তনু, তাহসী ঠোঁট চেপে হাসলো। সেলিনা শেখ ও ওদের সাথে বসে নাস্তা করলেন।

সেলিনা শেখ সবার খাওয়া শেষে প্লেট গুছিয়ে নিয়ে চলে গেলেন। তাহসী ও পিছু পিছু গেল সাহায্য করতে।

রাতে তনু তাহসী, তননের সাথেই গল্প করছিল। তনু প্রচুর খুশি এবার। তনন মোবাইল ফোন নিয়ে এসেছে তার জন্য।
এগারোটার দিকে ঘুমানোর জন্য তনু গুড নাইট বলে চলে গেল ওদের রুম থেকে। তনন যেয়ে দরজা দিয়ে আসলো। তাহসী ও ঘুমানোর জন্য ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হলো।

তনন তাহসীর কাছে এগিয়ে যেয়ে জড়িয়ে ধরলো ওকে। তাহসী অবাক হয়ে তননের পিঠে হাত রেখে বললো,
-“হঠাৎ!”

-“কোথায় হঠাৎ? তিন চারদিন কোনো দেখা যায়।”
তাহসীর কাঁধের উপর মাথা রেখে বললো তনন।

তাহসী ও চুপ থাকলো। কিছুক্ষণ পর তনন ই সরে আসলো। বিছানায় তাহসীকে নিজের পাশে বসিয়ে বললো,
-“সুযোগ-ই পাই না আমি তোমার সাথে কথা বলার!”

তাহসী মুচকি হাসলো। তাহসীর গালে হাত রেখে তনন বললো,
-“খুব হাসি পাচ্ছে না? কিছুদিন পর আমাকে প্রচন্ড মিস করবে, তখন বুঝবে!”

তাহসী তননের হাতের উপর হাত রেখে ভ্রু কুঁচকে বলল,
-“কি বলো এসব!”

-“ইয়েস, জব হয়ে গেছে! সরকারি চাকরি হয়ে গেছে। তাও আইটি অফিসার পদে!”
বিছানার উপর শুয়ে পড়ে বললো তনন।

তাহসী ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“কঙগ্রেটস!”

-“বাদ দাও!”

-“হোয়াই? খুশি নও? ওই রবির কম্পানি তে চাকরি করতে ভালো লাগে?”

-“আমি কি শখে ঢুকছিলাম? একটু এক্সপেরিয়েন্স হলো। তারপর বেকার বসে থাকার চেয়ে এটাই ভালো ছিল।”

তাহসী ও তননের পাশে শুয়ে পড়লো।
-“তাহলে খুশি না কেন?”

তনন একটু উঁচু হয়ে তাহসীর দিকে ঝুঁকলো। তাহসীর গালে ঠোট স্পর্শ করে বললো,
-“নারায়ণগঞ্জ পোস্টিং!”

-“সিরিয়াসলি?”
একটু মন খারাপ করে বললো তাহসী।

-“হুম।”

দুজনেই নীরবতা পালন করলো কিছুক্ষণ। তনন তাহসীর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
-“কি দিয়ে কি করবো বুঝছি না কিছু! তোমার সাথে থাকতে একটুও ভালো লাগবে না।”

তাহসী অন্য হাত দিয়ে তননের চুল এলোমেলো করে দিল।
-” কাল জেনেছো এইটা?”

-“হ্যা, মেইল আসলো। ভাবলাম সামনাসামনি বলি। তাই আর কাল জানাইনি।”

-“তো কি করতে চাচ্ছো এখন?”

-“বুঝছি না। একবার মনে হচ্ছে বিসিএস প্রিপারেশন বাদ দিয়ে এদিকে চলে আসি। আবার মনে হচ্ছে। ঢাকায় হলে ভালো হতো। ওখানে কি করবো একা একা!”

তনন তাহসীর হাতের পিঠে চুমু খেয়ে পুনরায় বললো,
-“তুমি কি বলো?”

-“তোমার ইচ্ছে তনন। মামুনি কি বলছে?”

-“তোমার মতোই আমার উপর ছেড়ে দিছে।”

-“তাহলে আল্লাহ তায়ালার কাছে নামাজ পড়ে সাহায্য চাও। তোমার ইচ্ছে যেখানে,সেখানে করো।”

তনন মৌন রইলো। তাহসী তননকে পর্যবেক্ষণ করে বলল,
-“এখন চাচ্ছো কি? বিসিএস নাকি এই জব?”

-“জব যেহেতু হয়ে গেছে তাই বিসিএস আর দিতে চাচ্ছি না। ইঞ্জিনিয়ারিং ই তো উদ্দেশ্য ছিল আমার। কিন্তু আমি ভাবিনি ঢাকার বাইরেও হতে পারে। ব্যাপারটা মাথাতেই আসেনি।”

-“জায়গা নিয়ে সমস্যা?”

-“হুম।”
তাহসীর চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তর করলো তনন।

-“তাহলে জয়েন করে ফেলো। আপাতত ছয়মাস কন্টিনিউ করে ঢাকায় আসার চেষ্টা করো।”

-“হু। এমনটাই ভাবছিলাম। মিস করবো অনেক। এভাবে থাকা যায়?”
তাহসীর গলায় মুখ গুজে বললো তনন।

প্রথমবারের মতো তাহসী ও ফিসফিস করে বললো,
-“আমিও মিস করবো।”

-“সত্যি?”
তনন মাথা তুলে তাহসীর দিকে তাকালো।

-“তো? করবো না? ওয়েট! আমি একা থাকবো বাসায়? নাকি আবার আঁখির ওখানে?”

-“তুমি একা থাকতে পারবে? আর আঁখির ওখানে থাকলে আমি মিট‌ করবো কিভাবে? ছুটি পেলেই টাকা চলে যাবো।”
তনন ঘনিষ্ঠ হতে চাইলো।

তাহসী তননের বাহু ধরে বাঁধা দিয়ে বললো,
-“তাহলে?”

-“জানিনা। এত ভাবতে ভালো লাগছে না।”

-“বাচ্চাদের মতো কথা বলছো তুমি তনন!”

-“যখন কাছে থাকবো না, তখন বুঝো!”

-“নিজে তো ঠিক করে নিলে! আমি একা থাকবো ফ্ল্যাটে?”

-“বলছি তো জানিনা। আর আমি কি ঠিক করেছি? নারায়ণগঞ্জ কেমন জায়গা সেইটাই তো জানা নেই।”

-“হু। সবারই সমস্যা!”

-“তা তো বটেই।”

-“এখন যেইটা করছো, বাদ দিয়েছো?”

-“ঢাকা যাই আগে। কথা বলি এদের সাথে। তারপর। তবে কিছুদিন গ্রামে থাকছি। আমার ফ্রেন্ড কে জানিয়েছি এই ব্যাপারে।”

-“ভালো হলো।”

তনন তাহসীর ঠোঁটে ঠোঁট মিশিয়ে দিল। তাহসী এবার আর বাঁধা দিল না। সে-ও সায় জানালো।

————————— সমাপ্ত ————————-

তোমাতে বিলীন হবো পর্ব-৪২+৪৩

0

#তোমাতে_বিলীন_হবো
#Tahsina_Arini
#পর্ব_৪২
(অনুমতি ব্যতীত কপি নিষিদ্ধ)

তাহসী পরের দিনের বাসের টিকিট কেটে রওনা দিল খুলনার উদ্দেশ্যে। সেলিনা শেখ ও বললেন ঘুরে আসতে। তাহসী ও খুশি হয়ে রাজি হয়ে গেল।
তবে তাহসী কাউকে বলেনি যাওয়ার কথা।

গ্রামের বাড়িতে পৌঁছাতেই বাবা দিলেন এক ধমক। সে কেন একা একা আসতে গেছে। আগের থেকে জানালে বাইক নিয়ে যেতেন।
নাতাশা রহমান তৌহিদ হোসেন এর গলা শুনে বাইরে এসে তাহসী কে দেখে অনেক খুশি হলেন। তৌহিদ হোসেন আর কিছু না বলে ভিতরে চলে গেলেন। তাহসী হাসিমুখে মায়ের সাথে ভিতরে গেল।

তখন দুপুর তিনটা বাজে। সবাই নিজেদের ঘরে রেস্ট নিচ্ছে। নাতাশা রহমান তাহসী কে ফ্রেশ হয়ে আসতে বললেন। এরপর তাহসী ফ্রেশ হয়ে আসলে নাতাশা রহমান খাবার দিলেন।
-“তনন আসলো না?”
তাহসীর পাশের চেয়ারে বসে প্রশ্ন করলেন নাতাশা রহমান।

-“তননের এক্সাম সামনে। আর মামুনি গেছে। তাই সুযোগ পেয়ে চলে আসলাম।”
খেতে খেতে উত্তর দিল তাহসী।

-“আলাদা বাসা নিয়েছিস নাহিদ বললো। তোর বাবা শুনে রাগ করেছে।”

খাওয়া থামিয়ে তাহসী মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আমি কোনদিকে যাবো বলো?”

-“এসব এখন থাক। খেয়ে নে। পরে আর কিছু বলিনি। খেয়ে রুমে যেয়ে রেস্ট কর।”

তাহসী কিছু না বলে খাওয়া শেষ করে রুমে চলে আসলো। ফোন দিয়ে তননকে ফোন দিল। আসার সময় তনন অলরেডি দুইবার ফোন দিয়েছে।
তনন ফোন ধরেই বললো,
-“পৌঁছিয়েছো?”

-“হ্যা, বেশ আগেই। লাঞ্চ করে আসলাম।”

-“ভালো করেছো। মিস করবো।”
শেষের কথাটা ফিসফিস করে বললো তনন।

তাহসী লাজুক হাসলো। কিছু না বলে চুপ থাকলো। তনন পুনরায় বললো,
-“রেস্ট করো। রাতে কথা হবে।”
-“টেক কেয়ার। আল্লাহ হাফেজ।”
-“আল্লাহ হাফেজ।”

তাহসী শুয়ে শুয়ে তননের কথা ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো।
কিন্তু ঘুম বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। আধঘন্টার মাঝেই ভেঙ্গে গেল শব্দে।

-“এটা আমি ঠিক দেখছি! নাঈম!”
শশী অবাক হয়ে বলে উঠলো। শেষ টাই নাঈমের নাম ধরে উচ্চস্বরে ডাকলো।

নাঈম প্রায় ছুটে এসে বললো,
-“কি হয়েছে?”
সামনের দিকে চোখ যেতেই পুনরায় বললো,
-“আপু কখন আসলো!”

তাহসী চোখ ডলে উঠে বসলো। হাই তুলে বললো,
-“এক ঘন্টা আগে। ভাবলাম বিকালেই কথা বলি একবারে। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম দেখছি।”

শশী তাহসীর পাশে বসে বললো,
-“আমি তোমার রুমের দরজা খোলা দেখে এসেছি ভিতরে। ইশ্ ঘুমটা ভেঙ্গে দিলাম। শুয়ে পড়ো আবার। তুমি তো আছোই, পরে কথা বলতে পারবো।”

-“না,ঘুমাবো না। থাক এখানে।”
শশীর গাল টেনে দিল তাহসী।

নাঈম চলে গেল রুম থেকে। তাহসী,শশীর কথা চলতে থাকলো।
-“বেশ মোটা হয়ে গেছিস দেখছি।”

-“বাজে লাগছে দেখতে তাই না?”
মুখ শুকনো করে‌ বললো শশী।

-“না, তবে অন্যরকম লাগছে এই যা। অন্যরকম সুন্দর আরকি।”

-“এখনো সনো করেই দেখতে পারলাম না!”
দুঃখ করে বললো শশী।

-“তাহলে কাল আমার সাথে চল। দেখিয়ে আনবো।”

-“সিরিয়াসলি আপু?”

-“হ্যা। চিন্তা করতে হবে না। মেনেজ করে নিবো।”

-“মেজো চাচী শুধু বাজে বাজে কথা বলে।”

-“ওসব কানে নেওয়া যাবে না।”

-“স্কুলের ফ্রেন্ড রা মিশে না।”
মনখারাপ করে বললো শশী।

তাহসী কঠিন কথা বলতে যেয়েও থেমে গেল। এখন আর কি দরকার মেয়েটার মন খারাপ বাড়িয়ে দেওয়া। তাহসী বললো,
-“চল বাইরে যাই।”

শশী‌ হাসি মুখ করে তাহসীর পিছু পিছু গেল।

_______________
সন্ধ্যার পরে মাগরিবের নামাজ পড়ে নাঈম‌ পড়তে বসেছে। শশী রুমে ছিল না। হঠাৎ রুমে নাঈমের কাছে যেয়ে বিছানায় বসলো। বিছানার পাশেই নাঈমের রিডিং টেবিল। নাঈম পড়া থামিয়ে শশীর দিকে তাকালো। বললো,
-“খুশি খুশি লাগছে যে!”

-“আপু বলেছে কাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে।”

-“মানে আপু একদিন বাড়িতে এসেছে আর তাকে নিয়ে যাওয়া লাগবে? কেন আমি নিয়ে যেতে পারি না?”
নাঈম ভ্রু কুঁচকে বললো।

শশীর মন খারাপ হলো এমন ব্যবহারে। আর মন খারাপ হবে নাই বা কার!
তবুও মুখ ফুটে শশী উত্তর করলো,
-“তোমার ব্যস্ততায় তো শেষ হয় না। তুমি তো কাল ই চলে যাবে। বাড়ি থাকো কয়দিন?আমি বলিনি এর আগে?”

-“কেন! আমি তোমার থেকে শুনিনি যে আমি বাইরে থেকে পড়বো কি-না। এখন কেন বলো এমন। এর আগে বলেছিলে তখন নিয়ে যাওয়া যায়? সবাই কত মাস জানতো তখন? আর টাকা লাগে তুমি বুঝো না?”

শশীর হাসি মুখ শুকনো হয়ে গেল। ছলছল করা চোখ নিচের দিকে নামিয়ে নিল। কোনোরকমে বললো,
-“স্যরি।”

-“আর দুইমাস আছে এডমিশন এর। অন্তত কোথাও চান্স পেলে তখন একটা টিউশনি তো করতে পারবো। বাবার কাছে তো হাত পেতে চাইতে পারিনা।”

শশী চুপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। নাঈম বই বন্ধ করে বারান্দায় যেয়ে দাঁড়ালো।
নিচে তাকিয়ে দেখলো তাহসী,মিথিলা দোলনায় বসে আছে। পিছন থেকে নাহিদ দোল দিচ্ছে। বাড়ি তৈরির সময় তাদের বাড়ির একপাশে দোলনা বানিয়ে নিয়েছিল তাহসী।

নাঈম দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমের ভিতরে এসে দরজা চাপিয়ে দিল। ঠান্ডা বাতাস আসছে।‌ শশীর পাশে বসে চুলের গোড়ায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
-“আচ্ছা বেশ। কাল যাবো। এভাবে বলার জন্য স্যরি। বাবা আমাকে মাসে মাসে বেশি করেই টাকা দেয়। আমার খরচ বাদ দিয়ে বেচে থাকে। গুছিয়ে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম এবার নিয়ে যাবো, কিন্তু কথাটা কিভাবে তুলবো সবার সামনে বুঝতে পারিনি। আপু যদি কাল কথাটা তোলে, ভালোই হবে।”

শশী মুখ না ঘুরিয়ে বললো,
-“কথাটা ভালোভাবেও বলা যেত।”

-“আপু বললো রাজি হয়ে গেলে এইজন্য রাগ লাগছিল। আর আমাকে আবার বলতে পারতে এইটা। স্যরি। যাও নিচে যাও। দেখো দোলনায় সব।”

-“ওখান থেকেই এসেছি। ভালো লাগছে না তাই চলে এসেছি।”

-“ভালো লাগছে না কেন? এখানে আসার পর তো হাসিখুশি দেখলাম।”

-“আমি কি দোলনায় চড়তে পারবো? চলে এসেছি তাই।”

-“আচ্ছা। তাহলে শুয়ে রেস্ট করো। আমি পড়তে বসলাম।”

-“আচ্ছা।”

______________
রাত এগারোটার দিকে তননের কল আসলো। তাহসী তখনও ভাই বোনের সাথে গল্প করছে। তননের কল দেখে শশী বলে উঠলো,
-“আহা! ভাইয়া তোমাকে মিস করছে আপু।”

তাহসী চোখ রাঙিয়ে কল রিসিভ করলো। পরে কথা বলবে বলে রেখে দিল। তনন এত তাড়াতাড়ি ঘুমাবে না। পরে কথা বলা যাবে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই শশী শুয়ে পড়লো বিছানায়। ওরা সবাই নাঈমের রুমেই ছিল।
-“তোমরা গল্প করো। আমি শুনি। ক্লান্ত লাগছে, শুয়ে পড়লাম।”

-” সমস্যা নেই। শুয়ে থাকো।”
মিথিলা বলে উঠলো।

তাহসী হাই তুলতে তুলতে বললো,
-“ঘুম পাচ্ছে। আমিও যাই।”

-“আপু থাকো আমার সমস্যা হচ্ছে না।”
শশী বলে উঠলো।

-“আরে তোর জন্য না। আসলেই ঘুম পাচ্ছে।”
একে একে ওরা চলে গেলে নাঈম দরজা আটকে আসলো।
-“ঘুম পেলে ঘুমিয়ে পড়ো শশী। আমার জন্য জাগবে না। শেষে তোমার ঘুম আসে না। তখন কষ্ট টা তোমার ই হয়।”

নাঈম বাড়িতে থাকলে রাত জেগে পড়ে। এদিকে শশী একসাথে ঘুমানোর জন্য জেগে থাকে নাঈমের অপেক্ষায়। শেষে যেয়ে তার ঘুমের ভাব কেটে যেয়ে ঘুম আসতে চাই না। তখন এপাশ ওপাশ করা লাগে।

শশী বললো,
-“কল ই তো চলে যাবে। কাল থেকে ঘুমিয়ে পড়বো।”

নাঈম বই গুছিয়ে রাখলো। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে লাইট অফ করে দিল। শশী বললো,
-“কি হলো?”

-“ঘুমাবো।”
শশীর পাশে শুয়ে বললো নাঈম।

শশী নাঈমের গলা জড়িয়ে ধরলো। নাঈম শশীর গাল টিপে বললো,
-“ভালোবাসি।”

-“আমিও।”

-“কাল তো চলেই যাবো। তাই আজ বরং তোমার দিকটা ভাবি।”

শশী অনেক খুশি হলো নাঈমের কাজে। বাচ্চা নিয়ে গল্প করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো। নাঈমের তখনও ঘুম আসেনি। এখন পড়তে বসতে চাইলে পড়তে পারে। তবুও সে আর উঠলো না। শশীকে জড়িয়ে নিয়ে শুয়ে থাকলো।

চলবে ইনশাআল্লাহ;

#তোমাতে_বিলীন_হবো
#Tahsina_Arini
#পর্ব_৪৩
(অনুমতি ব্যতীত কপি নিষিদ্ধ)

তাহসী বিছানায় যেয়ে শুয়ে পড়ে কল দিল তননের নাম্বারে। তনন প্রায় সাথে সাথেই রিসিভ করলো।
-“কেমন যাচ্ছে সময়?”
তনন প্রশ্ন করলো।

-“আলহামদুলিল্লাহ। তোমার?”

-“ভালো। তবে মিস করছি তোমাকে।”

তাহসী ও মিস করছে তননকে। এই কয়দিন আলাদা রুটিন হয়ে গেছিল তননের সাথে। তবে মুখে বললো না। লজ্জা চেপে কথা ঘোরানোর জন্য বললো,
-“খেয়েছো?”

-“হুম। তুমি?”

-“আমিও।”

-“তখন কি করছিলে?”

-“নাঈমের রুমে ছিলাম। গল্প করছিলাম।”
দুজনে মিলে আরো বকবক করলো কিছুক্ষণ ধরে। তনন গুড নাইট বলে রেখে দিল।

তাহসী ঘুমানোর চেষ্টা করলো। তননের সাথে ঘুমাতে ঘুমাতে এতদিন অভ্যেস হয়ে গেছে একটা।

__________
পরেরদিন টা অনেক ভালো কাটলো তাহসীর। এবার বাড়ি এসে আর যেতে মন চাচ্ছে না।

সকালে খাওয়ার পর শশীকে ডাক্তার দেখানোর কথা তুললো তাহসী। তৌহিদ হোসেন অনুমতি দিলেন। কথা হলো তাহসী,নাঈম আর শশী যাবে। তৌহিদ হোসেন যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার হঠাৎ একটা কাজ পড়ে গেছে। তাহসী বললো কারো যাওয়া লাগবে না। আর শশীর বাবা তো চাকরিতে ব্যস্ত। তৌহিদ হোসেন একটা অটো ঠিক করে দিলেন। এই অটো তে করে ওরা খুলনা যাবে,আবার ফিরেও আসবে।

আল্ট্রাসনো করার সময় শশী ভয়ে ভয়ে তাহসীর হাত চেপে ধরলো। তাহসী আশ্বস্ত করে বললো,
-“ভয় নেই। ভিতরে যা।”

নাঈম তখন ওদের জন্য হালকা নাস্তা আনতে গেছে। শশী আল্লাহ তায়ালার নাম নিয়ে ভিতরে গেল।

সবশেষ হলে নাঈম বললো,
-“রক্তের রিপোর্ট তো বিকালে দিতে চেয়েছে। আমি বরং নিয়ে নিবো। এখন বাসায় চলো। ওয়েট করে কাজ নেই। তারপর সব রিপোর্ট একবারে ডাক্তারকে দেখিয়ে নিবো।”

তাহসী সায় দিল। ডাক্তার বলেছে মেয়ে হবে। সেই থেকে শশীর খুশি আর ধরছে না। নাঈম আর শশী মিলে অনেক আগেই ছেলে মেয়ের নাম ঠিক করে রেখেছে। তাহসী বললো,
-“তাহলে তুই মেসে চলে যা। আমরা বাড়ি যাচ্ছি।”

-“তোমাদের বাড়ি দিয়ে আসি।”

-“তার কোনো দরকার নেই। শশীকে ধরে নিয়ে যাবো। নো টেনশন।”

শশী ও আস্তে করে বললো,
-“তুমি থাকো। বারবার আশা যাওয়া কষ্ট হবে।”

নাঈম কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
-“আচ্ছা। সাবধানে যেও আর সাবধানে থেকো। নিজের যত্ন……”
আরো বেশ কথা বললো দুজনে। তাহসী দূরে সরে যেয়ে দাঁড়ানোর জন্য শুনতে পেল না। মোট কথা কিছু সময়ের জন্য ওদের আলাদা ছেড়ে দিল।

বাড়ি এসেই শশীর সময় যাচ্ছে না। নাঈম থাকলে নাঈমের পিছু পিছু ঘুরে বেড়াতো। নতুন কলেজে ওঠার কারণে ক্লাস করছে না। ভালোই হয়েছে তার এদিক দিয়ে। এখন মিস গেলে তেমন কোনো সমস্যা হবে না।

তাহসী দুপুরে খাওয়ার পর শুয়ে ছিল নিজের রুমে। ঢাকার তুলনায় এখানে বেশ ভালোই শীত। কম্বলের মধ্যে শুয়ে থাকতে‌ ভালো লাগে তাহসীর।

শশী এসে তাহসীর পাশে বসলো। তাহসী মুখ ঘুরিয়ে শশীর দিকে তাকালো। শশী বললো,
-“আপু তেঁতুল খাবে? তোমার না পছন্দের। তাই নিয়ে আসলাম।”

তাহসী উঠে বসলো। শশীর হাতে কাঁচা তেঁতুল বেশ অনেক গুলো।
-“কোথায় পেয়েছিস?”

-“নাঈম দিয়ে গেছে ওর বন্ধুর বাড়ি থেকে এনে।”

-“তাহলে নিজে না খেয়ে এখানে নিয়ে এসেছিস যে?”

-“আমি কি এতো খেতে পারবো? তুমি নাও।”

-“কয়েকদিন মিলে শেষ করবি।”

-“উফ, আপু তুমি নাও তো। আরো কিছু আছে। একা একা খেতে ভালো লাগছে না। এর আগে তোমার সাথেই তো খেতাম।”

তাহসী হেসে তেঁতুল হাতে নিল। বললো,
-“পোড়াতে পারলে ভালো হতো।”

-“চলো। দুপুরে মাটির চুলাতে না রান্না হলো! এখনো আগুন আছে মনে হয়।”

মিথিলা রুমে প্রবেশ করতে করতে বললো,
-“দু’জনের কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”

শশী উত্তর দিল,
-“তেঁতুল পুড়াতে যাবো ভাবী। চাইলে তুমিও আসতে পারো।”

তাহসী আর শশী নিচে নেমে গেল। মিথিলাও তাদের পিছু পিছু চললো।

🍁🍁🍁
মোট তিনদিন গ্রামে থেকে তাহসী ঢাকায় চলে আসলো। বাসায় যেয়ে তননের সাথে দেখা হলো না। তনুর থেকে জানতে পারলো তনন ক্লাসে গেছে। এখনো আসেনি। সেলিনা শেখ দুইবার কল দিয়েছে, রিসিভ করেনি।

তাহসী গোসল করে নিল। সকালে রওনা দেওয়ার কারণে দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে গেছে। মিথিলা আর নাহিদ ও ঢাকায় আসলো আজ। তাহসী ওদের সাথেই এসেছে।

তাহসী গোসল করে বের হতেই তননের দেখান পেল। তাহসীকে দেখে হেসে তনন ওয়াশরুমে চলে গেল। হাতে টাওয়েল দেখে তাহসী বুঝলো তনন ও গোসল করবে। একটা ওয়াশরুম হওয়ার কারণে মোটামুটি অসুবিধায় হয় বাসায় কেউ আসলে। তাহসী নামাজ পড়ে নিল।
সেলিনা শেখ ওদের খাবার গুছিয়ে দিলেন। তননকে বললেন,
-“ফোন ধরলি না কেন?”

-“ক্লাসে ছিলাম আম্মু। পরে দেখে ভাবলাম একবারে বাসায় যেয়েই কথা বলি।”

তনু বললো,
-“ভাবী তোমাকে মিস করেছি। তুমি থাকলে ঘুরতে বের হতে পারতাম। ভাইয়া কে আম্মু বের হতে দেয় না। শুধু একদিন গিয়েছি।”

সেলিনা শেখ তনুর দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙালেন। তাহসী কতদিন পর বাড়িতে যেতে পেরেছিল, তনু এভাবে বলাটা খারাপ দেখায়।

তাহসী মুখের ভাত শেষ করে বললো,
-“আজ নিয়ে যাবো তোমাকে। বলো কোথায় যেতে চাও।”

সেলিনা শেখ বলে উঠলেন ,
-“ওর কথায় কান দিও না তাহসী।”
এরপর তনুর দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে বললেন,
-“তাহসী আজ এতো জার্নি করে আসলো। আর তুই!”

-“মামুনি ওকে রাগ করো না। আমার জার্নিতে কোনো সমস্যা হয় না।আর বের হবো।”

সেলিনা শেখ কিছু বললেন না আর। তনু হাসলো তাহসীর দিকে তাকিয়ে।

বিকালের দিকে তাহসী আর তনু ই বের হলো বাইরে। সেলিনা শেখ কে তাহসী বললো যাওয়ার জন্য কিন্তু তিনি গেলেন না। তননকেও যেতে দিলেন না।

তনু প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে চাইলো। তাহসী ওকে নিয়ে টিএসসির ওখানে গেল। এরপর জাদুঘরে নিয়ে গেল। সবশেষে রমনার পার্ক দেখে বাসায় ফিরলো ওরা।
তাহসী সর্বক্ষণ তনুর হাত ধরে রেখেছিল।

রাতে সেলিনা শেখ তাহসী, তননের সামনে বললেন,
-“তনন টিকিট কেটে ফেল। আমাদের এবার যাওয়া উচিত।”

তনুর মন খারাপ হয়ে গেল এটা শুনে। তবে যেতে তো হবে। তাহসী বললো,
-“এত তাড়াতাড়ি ছাড়ছি না।”

-“বাড়ি একা ফেলে আসছি অনেকদিন হলো। আবার এসে থাকবো।”

-“আরও দুই একদিন থাকতে হবে।”

তনন ও সায় জানালো তাহসীর কথায়।
-“আর দুইদিন থাকো আম্মু।”

তনু ও ভয়ে ভয়ে বললো,
-“দুইটা দিন ই তো‌। কলেজ শুরু হলে কি আবার আসতে পারবো?”

সেলিনা শেখ চোখ রাঙিয়ে তাকালেন ওর দিকে। কিছুক্ষণ পর বললেন,
-“দুই দিনের বেশি না। আর কেউ জোর করতে পারবে না কিন্তু।”

তনু মাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
-“থ্যাঙ্ক ইউ আম্মু।”

ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলে সেলিনা শেখ বললেন,
-“তনন তোরা ইজ রুমে থাক। আমরা এখানে থাকি।”

তননের আগেই তাহসী উত্তর দিল,
-“আপনারা ভিতরে থাকেন। আমার সমস্যা হবে না।”

এতদিন ওনারা বেড রুমেই ঘুমাচ্ছিলেন। তনন ডাইনাং রুমে ঘুমাতো। তাহসী আসার কারণে নতুন করে কথা উঠেছে এটা ভালো মতোই বুঝলো তাহসী।
সেলিনা শেখ রাজি হলেন না। তাহসী ও শুনলো না তার কথা।
-“মামুনি খাট প্রায় সমান ই। আর দুই রাত কোনো ব্যাপার হলো? আপনারা রুমে ঘুমান তো।”

শেষে তাহসীর কথা মেনে নিল সেলিনা শেখ।

চলবে ইনশাআল্লাহ;

তোমাতে বিলীন হবো পর্ব-৪০+৪১

0

#তোমাতে_বিলীন_হবো
#Tahsina_Arini
#পর্ব_৪০
(অনুমতি ব্যতীত কপি নিষিদ্ধ)

তনন নিজেকে শান্ত করে ফিরে আসলো। তাহসীকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বললো,
-“পানি খেয়ে পড়াতে মনোযোগ দাও। এভাবে বলার জন্য স্যরি। আমি বুঝতে পেরেছি কেন বলেছো।”

তাহসী চুপ করে পানি পান করলো। তনন বিছানার উপর বসে পা সোজা করে রেখে বললো,
-“তোমার কথাটাই হয়তো ঠিক তাহসী। এখানে এসে সময় নষ্ট হচ্ছে বা হবে। তবে তখন আমি অন্যকিছু ভেবেছিলাম। থাক,বাদ দাও।”

-“ওহ্।”

কিছুক্ষণ বাদেই তনন বলে উঠলো,
-“চলো খেতে যাই। পড়া হয়েছে?”

তাহসী নড়েচড়ে বসলো। সে এতক্ষণ ভেবেই যাচ্ছে। পড়া আর হয়নি।‌ তননের কথা তে উঠে বসলো। খাবার নিয়ে এসে তাহসীর পড়ার টেবিলেই রাখলো। তাহসীর বইগুলো সরিয়ে রাখলো এক পাশে। তননের পড়ার চেয়ার টেনে এনে তনন কে ডাকলো। খাবারের প্যাকেট থেকে প্লেটে ঢেলে দিল তাহসী।
-“আমার পছন্দের বিরিয়ানি আনার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু তোমার টেবিলের উপর অন্য একটা প্যাকেট ছিল…..”

তাহসী কথা শেষ করার আগেই তনন বলে উঠলো,
-“দেখেছো?”

-“না। না জিজ্ঞেস করে কারো জিনিস দেখার বাজে স্বভাব আমার নেই।”

তনন এগিয়ে এসে ঠোঁট কামড়ে বললো,
-“আমাকে মিন করলে?”

-“তোমাকে মানে? তুমি তো কিছু করোনি এমন।”

-“এইযে তোমার ডায়েরি দেখেছি।”

-“ওহ্। বইগুলো পেয়ে অনেক অনেক খুশি হয়েছি তনন। আর আমি এইটা মিন করিনি তো। ইভেন মনেই ছিল না। কিছু সামনে পেলে অনেকেই না বলে অন্য কারো জিনিস খুলে দেখে,তাই বললাম এই স্বভাব আমার নেই।”

-“ওহ্, আচ্ছা। খুবই ভালো ব্যাপার। তবে দেখাচ্ছি ওটা খাওয়ার পরে।”
চেয়ারে বসে বললো তনন।

তাহসী ও ঠিক আছে বলে খাওয়া শুরু করলো।

খাওয়া শেষে তাহসীর পিছু পিছু তনন-ও গেল। দুজনেই নিজেদের প্লেট ধুয়ে রাখলো। তাহসী ও খুশি হলো, তনন তার উপর কখনোই কাজ চাপিয়ে দেয় না। ফ্রেন্ড দের সাথে থাকতে এসব কাজ বুয়া এসে করে দিয়ে যেত।

তননের আরো ভালো ভালো দিক আছে। সে সিগারেট খায় না, খারাপ বন্ধুদের সাথে মিশে না, মেয়েদের সাথে যতটুকু দরকার তার বেশি মিশে না। এসবই রুমে এসে ভাবছিল তাহসী মনে মনে।
তনন তাকে স্পর্শ করতেই ভাবনার জগত থেকে বেড়িয়ে আসলো তাহসী।

-“কি হয়েছে?”

-“এই নাও খুলো এবার প্যাকেট টা।”

তাহসী সময় নিয়ে খুললো। বের করে দেখে আসমানী রঙের নেটের শাড়ি একটা, সাথে আর একটা হালকা গোলাপি রঙের জামদানি শাড়ি। সাথে মেলানো ক্রপ টপ, ছায়া-ও আছে।

তাহসী অবাক হয়ে গেছে। শাড়ি দেখতে দেখতে তাহসী বিস্ময় নিয়ে বললো,
-“তোমার চয়েস এত সুন্দর। আগে জানতাম না। কিন্তু আমি তো তেমন শাড়ি ই পরি না।”

-“প্রতিদিন পরতে বলছে কে? মাঝে মাঝে পরো। রাতের বেলা।”
বলেই তাহসীর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিল তনন।

তাহসী লজ্জায় মাথা নত করলো। তনন সেদিকে তাকিয়ে গাল টিপে দিয়ে বললো,
-“লজ্জা না পেয়ে এখন পরে আসেন।”

-“এখন!”

-“তো? এই আকাশী রঙের টা পরো। যাও।”

-“ব্লাউজ আছে আমার এই রঙের? না! ক্রপ টপ একটুও ভালো লাগে না। আমি পরি না এইগুলো।”

-“আমি কি করবো। শাড়ি তো পচ্ছন্দ করেছি। বাকিগুলো শপার দিয়ে দিছে। একদিন ই তো। পরে বানিয়ে নিও।”

-“ওকে।রুম থেকে বের হও। ওয়াশরুমে পারবো না।”

-“চোখ বুজে আছি।”

-“না,যাও। বারান্দায় অথবা ডাইনিং এ।”

তনন এক পলক তাকিয়ে বিড়বিড় করতে করতে চলে গেল। তাহসী ঠিক শুনলো। বলতে বলতে গেল,
-“আমি দেখিনি কিছু মনে হয়!”

তাহসী পাত্তা দিল না। এসব কথা না বাড়ানোই ভালো। কোনোরকমে শাড়ি পরে ফেললো ধীরে ধীরে। এমনিতে পারে না শাড়ি পরতে। শেষ যেদিন শাড়ি পরেছে, সেলিনা শেখ শাড়ি পরিয়ে দিয়েছিল তাও ছয়,সাত মাস আগে। তাহসী কখনো একা একা শাড়ি পরে দেখেনি। সেলিনা শেখ কে যেভাবে দেখছিল এখন ওইরকম করার চেষ্টা করছে। কিন্তু পিছলা হওয়াতে বারবার কুঁচি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত চারবারের সময় ঠিক হলো। আঁচল ঠিক করে তাহসী গলা উঁচিয়ে বললো,
-“এবার আসতে পারো।”

তনন বারান্দা থেকে এগিয়ে আসলো। তাহসী তার ছোট আয়না বের করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শাড়ি দেখতে ব্যস্ত।তনন এগিয়ে এসে ফোনের ক্যামেরা অন করে সেলফি স্টাইল করে নিয়ে তাহসীর দিকে ধরলো। বললো,
-“নাও এবার ঠিকমতো দেখো।”

তাহসী হালকা চোখ তুলে ঠিকমতো দেখে নিল। তনন তাহসীকে বারান্দায় যেয়ে দাঁড়াতে বলে নতুন শার্ট, প্যান্ট গায়ে জড়িয়ে নিল। তাহসী এই সেট ভার্সিটি শেষে কিনে এনেছিল।

তনন বারান্দায় যেয়ে তাহসীর পিছনে দাঁড়াল। আড়চোখে তননকে দেখে নিল। তনন তাহলে ড্রেস ম্যাচিং করে এই রঙের শাড়ি এনেছে। জিন্সের প্যান্টের সাথে আসমানী রঙের শার্ট টা দারুন মানিয়েছে তননের গায়ে। শার্টের হাতা অর্ধেক গুটিয়ে রাখার কারণে তননকে দেখতে আরো সুন্দর লাগছে।

তাহসী মুচকি হেসে চোখ সরিয়ে নিল। একবার মনে হয় দুজনে একসাথে থেকে ভালোই করছে। আবার মনে হয় স্টাডি তে খারাপ প্রভাব ফেলছে।
তনন তাহসীর পিঠ ঘেষে দাঁড়ালো। পরপর ক্লিক করে কয়েকটা সেলফি তুলে নিল।
তাহসী চোখ উঁচিয়ে তননের দিকে তাকালো।
-“এটা কি হলো! আমাকে বলবা তো পিক তুলবে।”

তনন ফটো গুলো চেক করতে করতে হেসে বলল,
-“এমন করে হাসি দিতা আবার?”

-“ফাজিল।”
তাহসী মিটমিট করে গোপনে হাসছে এটা ছবি তে ঠিক বোঝা যাচ্ছে।

এই সুন্দর মুহূর্ত তনন আরো কয়েকটা সেলফি তে বন্দি করে নিল। এরপর বারান্দার ফ্লোরে বসে পড়লো। তাহসী শাড়ি সামলিয়ে পাশে বসলো। তনন ফটো গুলো দেখতে ব্যস্ত।
ফটো দেখতে দেখতে তনন তাহসীর দিকে না তাকিয়েই বলল,
-“শাড়ি পরা কবে শেখা হলো?”

-“আজ ফার্স্ট ট্রাই করলাম।”

-“ভালোই হয়েছে। সুন্দর লাগছে।”

তাহসী মৌন রইলো। তনন ফটো গুলো এডিট করে ঠিক করতে ব্যস্ত। তাহসী বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। তনন এক হাত দিয়ে তাহসীকে জড়িয়ে ধরে আরো কাছে নিয়ে আসলো।
-“পরিবেশ টা সুন্দর না?”
তনন বলে উঠলো।

-“সুন্দর।”

তনন একটা মুভি চালু করলো। তাহসী উশখুশ করে বললো,
-“এখন মুভি দেখবে?”

তনন তাহসীর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“হ্যা। কোনো সমস্যা?”

-“না, তবে এখানে তো অন্ধকারের মতোই। রুমে চলো।”

-“আচ্ছা।”

তনন তাহসীর হাতে ফোন দিয়ে ওকে কোলে তুলতে গেলে তাহসী বাঁধা দিল। দূরে সরে যেয়ে বললো,
-“পায়ের উপর চাপ পড়বে না? চুপচাপ হাঁট।”

অগত্যা তনন তাহসীকে না নিয়ে একাই বিছানার উপর যেয়ে বসলো। তাহসী পাশে বসে মিনমিন করে বললো,
-“শাড়ি পরে কতক্ষণ থাকবো আর?”

-“থাকো কিছুক্ষণ।”

মুভি কখনো দেখা হয় না তাহসীর। এই ব্যাপারে আগ্রহ-ও নেই। মুভি দেখার চেয়ে বই পড়তেই বেশি ভালো লাগে। অনেক বছর পর একটা মুভি দেখতে বসলো‌। তাও আবার হরর। তনন আবার এসব দেখে।

-“হরর?”

-“হু। কেন? রোমা’ন্টিক চাই?”
ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চাইলো তনন।

-“তোমার মাথায় এসব ঘোরে। আমার মাথায় না। ভয় লাগে।”

-“আমি তো আছি পাশে। নাকি?”

-“আমি পারছি না এসব দেখতে।”

-“তাহলে কি দেখবে দাও।”
ফোন এগিয়ে দিয়ে বললো তনন।

-“আমার আইডিয়া নেই।”

-“রোমা’ন্টিক ই দিতাম!”

-“জি না।”

দুজনে পাশাপাশি হেলান দিয়ে বসে আছে। তনন তাহসীকে ছেড়ে শরীর এলিয়ে দিয়ে বললো,
-“যেকোনো একটা চয়েস করো।”

-“না, অন্যকিছু।”

তনন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে অনেক খুঁজে একটা মুভি দিয়ে বললো,
-“দেখো, মিস্ট্রি টাইপ। এই টাইপের বই পড় না তুমি?”

-“এটাও খেয়াল করেছো?”
অবাক হয়ে বললো তাহসী।

-“করেছি।”

সেই নয়টার সময় মুভি দেখতে বসেছিল। শেষ হতে হতে রাত বারোটার বেশি বেজে গেল। তাহসী ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
-“দেখেছো কত সময় চলে গেল! কাল সকালে আর ওঠা হবে না।”

-“ওতো টাও সময় যায়নি।”
ফোন বন্ধ করে একপাশে রেখে তাহসীকে নিজের উপর নিয়ে আসলো তনন।

-“কি করছো?”

তাহসীর ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে তনন বললো,
-“চুপ। কোনো কথা নয়।”

তননের উদ্দেশ্য ভালো করেই বুঝলো তাহসী। চুপ করে গেল‌। পেটে তননের হাতের ছোঁয়া পেয়ে শিউরে উঠলো।

চলবে ইনশাআল্লাহ;

#তোমাতে_বিলীন_হবো
#Tahsina_Arini
#পর্ব_৪১
(অনুমতি ব্যতীত কপি নিষিদ্ধ)

সকালে তাহসীর ঘুম ভাঙ্গল বেশ বেলা করে। চোখ খুলে ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখলো আটটা বাজে। তাহসীর নড়াচড়া তে তননের ঘুম ভেঙ্গে গেল।
তনন তাহসীকে নিজের সাথে আরো জড়িয়ে নিয়ে ঘুম ঘুম কন্ঠে বললো,
-“নড়ছো কেন? ঘুমাও।

তাহসী তননের হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,
-“সকাল আটটা বাজে। আজ একটুও টের পাইনি। ফজরের নামাজ মিস গেল।”

তনন ও চোখ ডলে তাকালো। হাই তুলে বললো,
-“কি বলো!”

তাহসী উঠতে যেয়ে বুঝতে পারলো শরীরের উপর কম্বল ছাড়া আর কিছু নেই। তাড়াতাড়ি করে কম্বলের মধ্যে ঢুকে যেয়ে পাশে তাকালো। শাড়ি দেখতে পেয়ে কোনোরকমে পেঁচিয়ে নিতে গেলে তনন টান দিয়ে ধরলো। তাহসী চোখ পাকিয়ে তাকালো,
-“মজা করো!”

-“মাত্র ঘুম ভাঙ্গল। কিছুক্ষণ থাকো।”

-“ক্লাস আছে। তার উপর তোমার জন্য ফজরের নামাজ পড়া হলো না। রাতে কখন ঘুমালাম মনেই পরছে না।”

-“তুমি ঘুমাও এগারোটার দিকে। সেখানে ঘুমাতে‌ ঘুমাতে রাত একটা। এইজন্যই ঘুমিয়ে পড়েছিলে। তখন আমি আর ডাকিনি।সকালে আমিও টের পাইনি।”

-“তাই বলে ডাকবে না! এটলিস্ট গোসল করে তো ঘুমাতাম!”

-“এখন করো যাও। নাকি আমি আগে যাবো শাওয়ার নিতে?”

তাহসী শাড়ি তননের থেকে টেনে নিয়ে পেঁচিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। আজ নিশ্চিত ভার্সিটির প্রথম দুই ক্লাস মিস যাবে।

তাহসী রেডি হয়ে ব্যাগ গুছাতে গুছাতে বললো,
-“ক্লাস করবা কবে থেকে?”

-“চেয়েছিলাম তো আজ থেকেই। কিন্তু সময় চলে গেছে,আজ হচ্ছে না। আর আজ আম্মু আসবে। দুই একদিন পরেই যাবো।”

-“আচ্ছা। আমি রেডি। শার্ট পরে আমার সাথে নিচে চলো। পাউরুটি,কলা নিয়ে এসে ব্রেকফাস্ট সেরে নাও।”

তনন শার্ট পরে নিল। তাহসীর সাথে নিচে নামলো। তাহসী বলে গেল দুপুরের পর পর ই চলে আসবে। তারপর তননকে নিয়ে লাঞ্চ করে একটা খাট কিনতে যাবে। তনন তাড়াহুড়ো না করতে বলে উপরে উঠে গেল।

___________
বিকেলবেলা তনন রেল স্টেশন এ যেয়ে সেলিনা শেখ আর তনু কে নিয়ে আসলো। সেলিনা শেখ রাগ করলেন তনন যাওয়ার জন্য। কিন্তু তনন গায়ে মাখলো না। শুধু বলেছে সারপ্রাইজ আছে।

বাসায় যেয়ে তনন কলিং বেল বাজানোর পর তনু বললো,
-“আম্মু আগের থেকে অন্য রকম লাগছে না?”

তাহসী দরজা খুলে সালাম দিল। কুশল বিনিময় করে সেলিনা শেখ আর তনু কে ভিতরে নিয়ে গেল। সেলিনা শেখ বললেন,
-“তনন এটা কোন বাসা?”

-“কি ব্যাপার! মামুনি আপনাকে তনন কিছু বলেনি?”
তাহসী অবাক হয়ে বলে উঠলো।

তনন মাথা চুলকে উত্তর দিল,
-“এটাই সারপ্রাইজ। এটা আমাদের দুজনের বাসা আম্মু।”

সেলিনা শেখ তননের কান টেনে ধরলো।
-“এতো পাকনামো কে করতে বলেছে?”

তাহসী আর তনু হেসে উঠলো। ঠোঁট কামড়ে হেসে তাহসী ওদের ফ্রেশ হতে বলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল শরবত আনতে।

-“আম্মু কি করো!”
চোখ মুখ কুঁচকে তনন বলে উঠলো।

সেলিনা শেখ কান ছেড়ে দিয়ে বললেন,
-“হঠাৎ বাসা নিয়েছিস যে?”

-“কেন? ভুল করেছি? আর কতদিন থাকতাম নাহিদ ভাইয়ার বাসায়?”

-“তা ঠিক‌ ভুল করেছিস, আবার করিস ও নি।”

তাহসী সেলিনা শেখ,তনুর হাতে শরবতের গ্লাস দুটি দিয়ে বললো,
-“শরবত খেয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।”

তনন বলে উঠলো,
-“সব কথা পরে হবে। আগে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নাও।”

তাহসী রুমে চলে গেল। তনন তাহসীর পিছু পিছু যেয়ে বললো,
-“শীতকালে মানুষ বাসায় আসলে শরবত কে দেয়!”

-“চা দিতাম ?”
একটু ভেবে বললো তাহসী।

-“হ্যা।”

-“আমি তো শরবত পেলেই বেশি খুশি হবো।”

-“কারণ চা আপনি খান না! যাইহোক রান্না কেমন কি? আমি মাংস রান্না করতে জানিনা। আম্মুকে বলতাম রান্নার জন্য?”

-“মামুনির থেকে শুনে শুনে মশলা পাতি মেশানো যাবে। এটা ম্যাটার না। ম্যাটার হচ্ছে আমরা রুমে থাকবো, আর ওদের ডাইনিং রুমে শুতে দিবো?”

-“উল্টো টাও হতে পারে যদি তুমি চাও।আর শোনো আম্মু কে রেখে দিবো কিছুদিন। তুমি চাইলে কাল যেতে পারো গ্রামে। কাল কিন্তু ফ্রাইডে!”

-“সিরিয়াসলি?”
খুশিতে তননের গলা জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো তাহসী।
পরক্ষণেই কি করেছে বুঝতে পেরে জিহ্বা কেটে হাত সরিয়ে নিতে গেলে তনন বাঁধা দিল। তনন তাহসীর হাত নিজের কাঁধে রেখে তাহসীর কোমড় আঁকড়ে ধরলো।
তাহসী লজ্জা পেয়ে নিচের দিকে তাকালো।
-“ছাড়ো। ওদিকে যাই।”

তনন ঠোঁট এগিয়ে দিয়ে তনুর ডাকে তাহসী কে ছেড়ে দিল। তাহসী মৃদু হেসে বেরিয়ে গেল।

-“একটাই রুম?”
সেলিনা শেখ বলে উঠলেন।

-“হ্যা।”

রেস্ট নেওয়ার পরিবর্তে সেলিনা শেখ ঘুরে ঘুরে সব দেখলেন।
সেলিনা শেখ বললেন,
-“সুন্দর আছে। তোমাদের থাকার জন্য পারফেক্ট। ফ্ল্যাট ও তো ভালোই সাজিয়েছো।”

-“ওই টুকটাক।”

সেলিনা শেখ প্রশ্ন করতে চাচ্ছেন যে সবকিছু কে কিনেছে। কিন্তু সরাসরি প্রশ্ন করতে পারছেন না। এটা অবশ্যই ভালো দেখায় না। শেষ পর্যন্ত বললেন,
-“ফ্রিজ কত নিছে?”

-“ভাইয়া কিনছে এইটা। তাই জানিনা।”
বিব্রত বোধ করে উত্তর দিল তাহসী।

-“ওহ্ আচ্ছা।”

তারপর দুজনেই চুপ। তনু ছাদের কথা বলাতে তনন ওকে নিয়ে ছাদে গিয়েছে। সেলিনা শেখ পুনরায় বললেন,
-“আচ্ছা বাসা কবে নিলে বলোতো? আমাকে বলবা না একবার। তুমি কি তোমার ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়েছো? মানে ফ্রেন্ড দের সাথে থাকতে যেখানে।”

-“এই মাসের শুরুতে উঠেছে। তনন আপনাকে জানায়নি আমি জানতাম না। আর আমি ছেড়ে দিয়েছি ফ্ল্যাট। সব এখানে নিয়ে এসেছি।”

-“আচ্ছা। তাই বলো। আমি ভাবছি পড়ার টেবিল,আলমারি,খাট এসব কিনেছিল বুঝি।”

-“রুমের গুলো আমার। আর এখানের এই টেবিল তননের। আর এখন যে বিছানায় বসে আছি। এটা আজ কিনে আনছি। ভাইয়া শুধু ফ্রিজ ই দিয়েছে। সব আমার কেনা।”
দ্বিধা নিয়ে বললো তাহসী। তার মনে হচ্ছে শুধু ফ্রিজ দিয়েছে শুনে মাইন্ড করে কিনা। এদিকে তার তো ফ্রিজ নেওয়ার ইচ্ছাও ছিল না। নাহিদ নিয়ে এসেছিল তাই নেওয়া।

-“বুঝলাম। তবে তনন নিছে তোমার ভাইয়ার দেওয়া গিফট, এটা বিশ্বাস হচ্ছিল না। কিছু মনে করো না। তবে তোমার ভাইয়ার কি দরকার ছিল এসব আনার। যাইহোক ভালোই গুছিয়েছো, সুন্দর লাগছে।”

তাহসী হাসলো একটু। হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে সেলিনা শেখ বলে উঠলো,
-“তননের জন্য রান্না করে নিয়ে এসেছিলাম একটু। দেখেছো ভুলে গেছি একদম। অবশ্য শীতের সময় নষ্ট হবে না হয়তো। তবুও ফ্রিজে রাখো।”

সেলিনা শেখ মাছ, মাংস রান্না করে নিয়ে এসেছেন। দুধ,ডিম ও নিয়ে এসেছেন সাথে করে। তাহসী মনে মনে ভাবলো আজ রান্না করতে হবে না। পরক্ষণেই ভাবলো তারপরেও কিছু একটা রান্না করবে।

চলবে ইনশাআল্লাহ;

তোমাতে বিলীন হবো পর্ব-৩৮+৩৯

0

#তোমাতে_বিলীন_হবো
#Tahsina_Arini
#পর্ব_৩৮
(অনুমতি ব্যতীত কপি নিষিদ্ধ)

নাঈম ধরতে গেলেই শশী ফোন বিছানার উপর ছুড়ে ফেলে দৌড়ে পালাতে গেল। নাঈম দাঁড়িয়ে যেয়ে বললো,
-“থাম শশী। ধরছি না।”

শশী উল্টা ঘুরে দেখতে যেয়ে বেঁধে গেল নিজের মায়ের সাথে। শিমুল রহমান শশীকে কাঁধ ধরে দাঁড় করিয়ে বললেন,
-“থাপ্পড় দিই দুইটা?”

শশী ভয়ে চুপ করে গেল। নাঈম এগিয়ে এসে বললো,
-“দাও চাচী। তাহলে যদি এর ছোটাছুটি বন্ধ হয়!”

শিমুল রহমান শশীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
-“পরে গেলে কি হতো? বাচ্চার চিন্তা আছে? না আছে পড়াশোনার চিন্তা,না আছে বাচ্চার চান। কোন কাজ করিস, বলবি?”

এবার সত্যি সত্যিই শশীর মন খারাপ হয় গেল। সবাই তাকে বকছে। তার মা তো ভালো ব্যবহার ই করে না তার সাথে। নাঈম ও বললো মা*রের কথা! এটা ভেবে অভিমান হলো শশীর।

শিমুল রহমান নাঈমের উদ্দেশ্যে বললো,
-“নাঈম রাতে আমাদের বাসায় খাবি আজ।”
এই বলে শিমুল রহমান চলে গেলেন।

শশী ও আস্তে আস্তে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। নাঈম যেয়ে হাত টেনে ধরে রুমে নিয়ে আসলো। বিছানার উপর বসিয়া শশীর গালে দুই হাত রেখে বললো,
-“স্যরি।”

-“লাগবে না।”
অভিমানী স্বরে বলে উঠলো শশী।

নাঈম হেসে জড়িয়ে ধরে বললো,
-“বাড়িতে এসে থাকি দুই তিন দিন। সেখানে যদি রাগ করতে করতেই অর্ধেক সময় চলে যায়। তাহলে হবে?”

নাঈম বর্তমানে এডমিশনের কোচিং করছে। ইচ্ছা ছিল ঢাকায় করার। কিন্তু শশীর কারণে খুলনা তে করে। প্রতি সপ্তাহে এসে দুইদিন থেকে যায়।

শশী কিছু বললো না, নাঈমের বুকে মাথা ঠেকিয়ে রাখলো। নাঈম আবারও বলে উঠলো,
-“চাচীর কথায় কষ্ট পাবি না, বুঝেছিস? আর এইরকম দৌড়াদৌড়ি করবি না প্লিজ। আর দুইমাস আছে আমার এডমিশনের। আমাকে কোনো টেনশন দিবি না প্লিজ।”

-“হু।”

দু’জনের মধ্যে আরো কথা চলতে থাকলো।

_________
নাহিদ আর মিথিলা চলে গেছে রাতে ডিনার করে। মিথিলা চারজনের জন্য রান্না করে নিয়ে আসছিল। সেই খাবার ই খেয়েছে সবাই।

ওরা চলে যেতেই তনন বই নিয়ে বসলো। এই কয়েকদিন কিছু্ই পড়া হচ্ছে না। তৌহিদ হোসেন ফোন দিয়ে তাহসী,তননকে যেতে বললেন। এটাও বললেন তননের যদি সমস্যা হয়, তাহলে আসার দরকার নেই। কিন্তু তাহসীর মন চাচ্ছে যেতে। কতদিন দেখা হয় না। এখানে সব কাজ নিজে করে নিতে হবে ভাবতেই কষ্ট লাগছে।

তনন পড়ার মাঝে আড়চোখে তাহসীর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“কি ভাবছো? পড়াশোনা করো যাও। সেমিস্টার ফাইনাল কবে?”

তাহসী ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে এলো। খোলা চুল বাঁধতে বাঁধতে বলল,
-“ডেট দিইনি। এমনিতে মাস তিনেক পরে হতে পারে।”

তনন বলল,
-” ও তাহলে তো টেনশন নেই। একটু আগে সিহান মেসেঞ্জারে বললো দেড় মাস মত পরেই আমাদের এক্সাম”

-“ওহ্।”

-“টেনশনে মাথা যাচ্ছে। আমি কাল থেকে দুইটা করে ক্লাস করবো।”

-“কিন্তু পা ব্যথা করলে চলে আসতে হবে।”

-“জানি আমি। এক্সামের আগে সুস্থ হয়ে যেতে পারলে আলহামদুলিল্লাহ। তার জন্য মেনে চলতে হবে। আর মানুষ আসলে নাস্তা দিতে হয়,জানো না?”

-“রিলেটিভ আসলে! আপন ভাই তো আর পর না। আর এসব মনে থাকে না আমার।”

-“তোমাকে নিয়ে আর পারবো না। আস্তে আস্তে হয়ে যাবে।”

তাহসী কিছু বললো না। তার তো তননের সাথে মেসেজে কথা বলতে ভালো লাগে, প্রতিদিন বিকেলে ঘুরতে যেতে ভালো লাগে, মাঝে মাঝে তননের আ’দর পেতে ভালো লাগে। কিন্তু এইসব সংসার ভালো লাগে না। মনে হয় একঘেঁয়েমিতা চলে আসবে। তার আর প্রেম করা হলো না বুঝি!

তনন ও পড়াই মন দিল। তাহসী ফোন নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। ভিডিও কল দিল শশীর ফোনে।
শাফিন তখন গেইম খেলছে শশীর ফোন নিয়ে। শশী ফোন কেড়ে নিয়ে বললো,
-“তাহসী আপু ফোন দিছে। এখন ফোন দিতে পারবো না।”
শাফিন কান্না শুরু করে দিলেই বকা শুনবে শশী।

-“তাহলে নাঈম ভাইয়ার ফোন দাও।”

নাঈম ও শাফিনের পাশেই বসে ছিল। ফোন এগিয়ে দিল ওর দিকে। শাফিন গেইম না পেয়ে ঝামেলা শুরু করলো। শশীর রাগ হয়ে গেল।
-“আম্মুর ফোন নে, যা।”

-“আম্মু ফোনে কথা বলছে।”

-“আব্বু ও বাসায় নাই। ধুর! যত ঝামেলা আমার।”
শশী তাহসীর ফোন কেটে দিয়ে নাঈমের ফোন দিয়ে কল দিল।

তাহসী ফোন ধরলে বললো,
-“আমার ফোন শাফিনের কাছে আপু।”

-“সমস্যা নেই। কিন্তু এত শুকিয়ে গেছিস যে!”

নাঈম পাশের থেকে বললো,
-“কিছুই খায় না।”

শশী রেগে গেল। টোকা দিয়ে বললো,
-“মিথ্যা বলবা না একদম।”

তাহসী দুজনের খুনসুটি দেখে হাসলো।
শশী বললো,
-“তোমাকেও ক্লান্ত দেখাচ্ছে আপু। আর আসবে তো কাল?”

-“কাল হবে না। তবে শীঘ্রই আসবো ইনশাআল্লাহ।”

-“কাল তো বুধবার। শুক্রবারে আসো। তনন ভাইয়া কি আসবে?”

-“এই ব্যাপারে পরে জানাবো। যাওয়া হবে না সম্ভবত। এখন কত মাস চলে? ছয়?”

-“হ্যা,সাড়ে ছয়। কিন্তু এমনিতে পাঁচ মানে সবাই জানে আরকি। তাই আর আল্টাসনোগ্রাম করতে পারছি না।”

তাহসীর মনে পড়লো তখনকার কথা। যখন জানালো হলো শশীর প্রেগন্যান্সির কথা, সবাই বাঁকা চোখে তাকাচ্ছিল। অনেকে অনেক কথায় বলেছিল। সেই ছোট মেয়েটা যে ছোটবেলায় তাহসীর পিছন পিছন ঘুরে বেড়াত, সে কিনা এখন মা হবে ভাবতেই তাহসীর বিস্ময় লাগলো। দিন এত তাড়াতাড়ি যায়। কবে আমাদের মৃত্যু ঘনিয়ে আসবে, আর আমরা চিন্তাও করি না মৃত্যুর পরবর্তী জীবন সম্পর্কে।
নাঈমের কথায় তাহসী আবার বাস্তব জগতে ফিরে আসলো।
-“আপু ভাইয়া কে নিয়ে চলে আসো ট্রেনে। এটা সেইফ হবে।”

-“দেখি। ইচ্ছা তো ছিল। ওর আবার এক্সামের ডেইট দিছে।”
আস্তে করে বললো তাহসী যেন তনন শুনতে না পায়। কিন্তু তনন শুনতে পেয়ে গেছে, তাহসী যাবে কি না এইটা জিজ্ঞেস করার জন্য এদিকে আসছিল সে। পরক্ষণেই আবার বিছানায় যেয়ে বসলো। তাহসী আসলেই জিজ্ঞেস করা যাবে।

তাহসী প্রশ্ন করলো,
-“পড়াশোনা কেমন চলছে দুইজনের?”

-“আমার তো ভালোই চলছে। কিন্তু শশীর তেমন হয় না।”

তাহসী আরো অনেক কথা বললো। কথা শেষ করে রুমে এসে দেখে তনন শুয়ে পড়েছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে এগারোটা বাজে।
-“কি ব্যপার? আর পড়বে না।”

-“পায়ে একটু মালিশ করে দিবে?”

তাহসী ফোন রেখে তেল গরম করে নিয়ে এসে তননের পায়ের কাছে বসে বললো,
-“এবার একটু খেয়াল রাখো।”

-“তুমি এত কিছু গোছাতে পারতে একা? আমি এমন বসে বসে দেখতে পারি না।”

-“আমার ক্ষমতা নেই বলছো?”

-“তা না। বসে বসে দেখতে পারি না আমি। আমার কথা বাদ দাও। তুমি কি যাবে বাড়িতে?”

তাহসী উত্তর দেওয়ার মতো কিছু পেল না। তনন পুনরায় বললো,
-“আমাকে প্লিজ যেতে বলবা না।”

তাহসী মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো।

তাহসী বই দেখে রাত এগারোটা পঞ্চান্ন এর দিকে ঘুমাতে গেল। তনন কে তাকিয়ে থাকতে দেখে তাহসী বললো,
-“ঘুম আসছে না! এইজন্যই বলি পায়ের উপর চাপ দিয়ে কিছু না করতে। ভালো করে হাঁটা শিখলো না,কাজ করতে চায়!”

তনন মুচকি হেসে তাহসীর দিকে তাকালো। কোনো প্রতিত্তর করলো না। বারোটা বাজতেই তনন তাহসীর কানে কানে বললো,

চলবে ইনশাআল্লাহ;

#তোমাতে_বিলীন_হবো
#Tahsina_Arini
#পর্ব_৩৯
(অনুমতি ব্যতীত কপি নিষিদ্ধ)

তনন মুচকি হেসে তাহসীর দিকে তাকালো। কোনো প্রতিত্তর করলো না। বারোটা বাজতেই তনন তাহসীর কানে কানে বললো,
-“হ্যাপি অ্যানিভার্সেরি টু মাই সুইটহার্ট!”

তননের এরূপ সম্বোধনে তাহসী লজ্জা পেল। এই প্রথম তনন বললো এভাবে।
তাহসী মৃদু স্বরে বললো,
-“হ্যাপি অ্যানিভার্সেরি! মনে আছে দেখছি!”

-“ভুলবো কেন?”

-“না,কিছু না।”

-“কাল আমাদের কোথাও ঘুরতে যাওনা উচিত,তাই না?”

-“তুলে রাখো। কাল যাওয়া লাগবে না।”

-“বললেই হলো?”

-“তো?”

তাহসী চুপ করেই থাকলো। তনন পুনরায় বললো,
-“বিয়ের মধ্যে পরীক্ষা ছিল। আর এইবার দেখো অসুস্থ!”

-“বাদ দাও। অন্য আরেক দিন সারাটা দিন ঘোরাঘুরি করা যাবে। এখন ঘুমাও।”
হাই তুলতে তুলতে বললো তাহসী।

তনন তাহসীর পিঠের নিচে হাত দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসলো।
তাহসীর গালে স্লাইড করতে করতে বললো,
-“এখন ঘুমানো হবে না! ফার্স্ট নাইট ছেড়ে দিছি। কিন্তু আজ কোনো ছা’ড়া’ছা’ড়ি নাই।”

তনন তাহসীকে সুরসুরি দিলে তাহসী হাসতে হাসতে নিজেকে ছাড়াতে চাইলো। তাহসী তননকে থামাতে না পেরে নিজেই তনন কে সুরসুরি দিতে লাগলো। তনন হেসে ছেড়ে দিল। তাহসীর কপালে চুমু খেয়ে তাহসীর কপালে নিজের কপাল ঠেকালো।
-“ভালোবাসি।”

তাহসীর ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো।

🍁🍁🍁
পরেরদিন তাহসীর খুশি বেড়ে গেল। বিকালে কুরিয়ারের লোক এসে প্যাকেট দিয়ে গেল । প্যাকেট খুলে দেখে বই। তাহসী ভেবেছে ড্রেস হবে, বই দেখে মন ভরে গেল। তাহসী টাকা দেখে পেমেন্ট করে দিল। তনন তার জন্য বই অর্ডার দিয়েছে ভাবতেই ভালো লাগলো। যেখানে তাহসীকে এসব গল্প, উপন্যাসের বই পড়া দেখে তনন সময় নষ্ট বলে সেখান থেকে সরে যায়,সেখানে তনন তাকে দশ দশটা টা বই কিনে দিয়েছে। বুঝতে পারলো ক্যাশ অন এ নিয়েছিল, কিন্তু তনন তো বাইরে এখন। কিন্তু উইশলিস্টের বইগুলো তনন জানতে পারলো কিভাবে! ফোন এর গ্যালারি তে সেভ করা,আর নোটবুক এ লিখে রাখা। তাহসী বুঝলো না তনন কোনটা থেকে দেখেছে।

তনন বিকেলে জোর করেই বাইরে গিয়েছে। উদ্দেশ্য খাবার কিনে আনা। তাহসী বলেছিল কি কি লাগবে বলতে সে ভার্সিটি থেকে ফেরার সময় নিয়ে আসবে, তনন বলেনি।

তনন ফিরতেই তাহসী বললো,
-“এত টাকা নষ্টের প্রয়োজন ছিল না।”

-“কেন? রান্না করতে? বেশি কিছু আনিনি। রাতে এতো রিচ ফুড খেয়ে কাজ নেই।”

-“বই এর কথা বলেছি!”

তননের হঠাৎ মনে পড়লো। বিছানার উপর বসে তাহসীর দেওয়া পানি শেষ করে বললো,
-“একদম ভুলে গেছি।”

কিছুক্ষণ বাদেই বললো,
-“টাকা তুমি দিছো? ওয়েট। এ কেমন গিফট!”
নিজে বলে নিজেই হেসে ফেললো তনন। তাহসী ও হাসলো। যার গিফট সেই টাকা পেই করছে।

তনন টাকা বের করে তাহসীকে দিতে গেলে তাহসী বললো,
-“আলমারি থেকে বের করে সেই আলমারি তেই তো আবার ঢুকবে।”

-“দেখো তাহসী! এটা গিফট। যদিও তোমার মতো ওতো টাকা খরচ করতে পারলাম না।”

-“মানে?”
টাকা নিয়ে আলমারি তে নিজের জায়গায় রাখতে রাখতে বললো তাহসী।

-“বাইক!”
বিছানার উপর শাট হয়ে শুয়ে পড়ে বললো তনন।

-“এখনো ওইটা নিয়ে পরে আছো? একটা কথা বলার ছিল। বাইক টা না হয় সেল দিয়ে দাও। তোমার আর কাজ নেই বাইক চালিয়ে।”

-“উহু। সেদিন তো তাড়াহুড়া করছিলাম…”

-“তাড়াহুড়ো আবার করবে না এটার কি কোনো গ্যারান্টি আছে?”

-“অন্য গাড়িতেও এটা হতে পারে। যদি কারো ভাগ্যে থাকে। তোমার কাছ থেকে এমন করা আশা করা যায় না তাহসী।”

-“সেরকম কিছু বিষয় না। আমি এইটা নিজেও জানি যে ভাগ্যে থাকলে হবে কিন্তু তোমার এক্সিডেন্ট এর দিন মামুনি তো বলেছিল বাইক কেন চালাও এত বড় শহরে,বাইক চালানোর কি দরকার।”

বলতে বলতে তাহসী বিছানার উপর যেয়ে বসলো। তনন উঠে এসে তাহসীর কোলে মাথা রাখলো। তাহসী অবাক হয়ে তাকালো। সাধারণত তনন এমন করেনা। এটা অপ্রত্যাশিত ছিল!

তাহসীর হাত নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে তনন উত্তর করলো,
-“মায়েরা একটু বলবেই ওমন। বাদ দাও। আর শোনো আম্মু ফোন দিয়েছিল, আমি বাইরে থাকতে। আম্মু বলছে যে তনুর কিছুদিন স্কুল ছুটি তাই আসতে চাচ্ছে। আমি বলেছি আসার কথা।”

তাহসী কে চুপ করে বসে থাকতে দেখে তনন চোখ বন্ধ করে বললো,
-“উফ্,চুল তো টেনে দিতে পারো!”

তাহসী তননের মাথায় হাত রাখলো।
-“মাথা ব্যথা করছে?”

-“না, শান্তি লাগে।”

-“ভালো করেছো আসার কথা বলে। কিন্তু থাকবে কোথায়?”

-“কথাটা আমি ভাবিনি যে তা না! আমি ভাবছিলাম তোমার যে তোশক টা আছে সেইটা ডাইনিং স্পেসে পারার কথা।”

-“ওভাবে থাকতে দেওয়া যায় কাউকে! মাথা গেছে পুরা।”
শেষ কথাটা বলার সময় তাহসী জোরে চুল টেনে দিল।

-“ব্যথা লাগে তো নাকি! তোমাকেও বলতে পারি না, ওখানে যায়। মাকেও বলতে পারবো না ওখানে থাকো।”

-“তোমাকে বললাম যে আমার খাট টা বড়। ওখানে আমাদের হয়ে যাবে। তা না কথা শুনলে না!”

-“তুমি যে বিছানায় একা ঘুমাও। তার মধ্যে আমি থাকলে অস্বস্তি বোধ করবে না?”

এসব ভাবনা শুনে তাহসীর খুবই ভালো লাগলো। ভালোবাসার দিক দিয়ে জীবন টা স্বার্থক হলো তনন কে পেয়ে। পরকালেও দুজনে একসাথে থাকতে চাই তাহসী।
তননের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
-“ওতো টাও আমার খাট ছোট না যে তুমি আটবে না! নাকি নিজেকে মোটা মনে করো?”
বলেই ঠোঁট চেপে হাসলো তাহসী।

তনন চোখ খুলে দেখে তাহসীর হাঁসি মুখ।
-“ইনডিরেক্টলি আমাকে মোটা বললা!”

-“তোমার কথা ধরে বলেছি!”
মুখ বাঁকিয়ে বললো তাহসী।

-“হিসেব টা তোলা থাকলো। আচ্ছা এখানে শুধু তোমার বেড রাখবো। কিন্তু আমার বেড এ তো আর তনু আর আম্মুর হবে না।”

-“সেল দিয়ে একটা নতুন বেড আনায় যায়!”

-“তা তো যায়-ই।”

তননকে চুপ মেরে যেতে দেখে তাহসী বললো,
-“আমি কিনতেই পারি,তাই না?”

-“পারো। কিন্তু এটা আমার ধার!”

-“ওকে।”
বলে হাসলো তাহসী। মনে মনে ভাবলো দুজন যে কবে সহজ হবে সম্পূর্ণ ভাবে।

সন্ধ্যাবেলা মাগরিবের নামাজ পড়ার পর তনন তাহসী কে টেনে এনে বারান্দায় দাড় করালো। তাহসী বলে উঠলো,
-“কি হয়েছে?”

-“দেখো রাতের শহর। সব ঠিক থাকলে তোমাকে বাইকে নিয়ে বের হতাম।”

-“বাইক চালাবে অন্তত এক বছর পর। রাতে তো নয় ই।”

তনন হাসলো। বললো,
-“আমার নিয়ে এতো চিন্তা?”

তাহসীর মুখ লজ্জায় নত হলো। কিছুক্ষণ বাদে প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বললো,
-“বই সম্পর্কে জানলে কিভাবে? আমার ফোন নাকি ডায়েরি থেকে? আমাকে না বলেই পার্সোনাল জিনিসে হাত দিলে?”

-“তুমি কবে যেন ফোন দেখে ডায়েরি তে বইয়ের নাম লিখছিলে সেদিন তোমার পিছন থেকে একটা ফটো তুলে নিয়েছিলাম।”

-“অনেক দিন ধরেই প্লান করছিলে নাকি!”

আরও দুই একটা কথা বলে তাহসী এসে পড়তে বসলো। পড়ার ফাঁকে তননকে না পড়তে দেখে বললো,
-“কি ভাবছো এতো? পড়াতে মন দাও। সেমিস্টার ফাইনাল তো চলে এলো।”

-“সুযোগ পেয়ে আমার বলতে এসেছো? পড়তে মন চাচ্ছে না আজ।”
তনন প্রায়ই তাহসী কে পড়তে বসার কথা বলে। তাহসী সময় নষ্ট করে অনেকটা। গল্প উপন্যাসের বই,ফোন নিয়ে অনেকটা সময় কেটে যায় তার।

-“এইজন্যই এখনই একসাথে থাকতে চাইনি। সেমিস্টার ফাইনাল টা শেষ হলে….”

তনন এমনিতেই টিউশন পড়া নিয়ে চিন্তিত। আজ সকালের দিকে আগের টিউশন গুলোতে ফোন দিয়েছিল। সবাই না করে দিয়েছে। তারা নতুন টিচার নিয়ে নিছে। শুধু একজন বলেছে তনন গেলে যেতে পারে। পরীক্ষার সময় নতুন টিউশন নিবে কিনা বুঝতে পারছে না। এতো এতো টেনশনের মধ্যে তাহসীর এই কথা শোনাতে তননের আজ রাগ উঠে গেল। বলেই বসলো,
-“একসাথে থাকা নিয়ে এত সমস্যা…। একদিন দেখবে আলাদা হয়ে গেছি!”

তাহসী এভাবে বলতে চায়নি কথাটা। তননের এমন কথাতে মন খারাপ হয়ে গেছে। এইযে পড়ছে না। এখন তো তননের ক্ষতি হচ্ছে। তারও আগের মতো পড়া হয়না। অথচ এই ইয়ার টাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
-“স্যরি। আমি এভাবে বলতে‌ চাইনি।”

তনন কিছু বললো না, বারান্দায় চলে গেল। তাহসী বইয়ের পাতা উল্টাতে লাগলো। তার আর পড়ায় মন বসলো না।
তনন নিজেকে শান্ত করে ফিরে আসলো। তাহসীকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বললো,
-“পানি খেয়ে পড়াতে মনোযোগ দাও। এভাবে বলার জন্য স্যরি। আমি বুঝতে পেরেছি কেন বলেছো।”

চলবে ইনশাআল্লাহ;

তোমাতে বিলীন হবো পর্ব-৩৬+৩৭

0

#তোমাতে_বিলীন_হবো
#Tahsina_Arini
#পর্ব_৩৬
(অনুমতি ব্যতীত কপি নিষিদ্ধ)

তাহসী তননের জোড়াজুড়ি তে নতুন বাসা তে উঠেছে। নাহিদ শেষে কিছু বলেনি। ভাইয়ার মন খারাপ এটা তাহসী ভালোভাবে বুঝতে পেরেছে। ভাবী ও তাকে অনুরোধ করেছিল থাকার জন্য। তার দুলাভাই এসে এমন করবে সে বুঝতে পারেনি।
তনন চলে এসেছে শেষ পর্যন্ত। নাহিদ কে বাসা দেখে যেতে বলেছিল নাহিদ আসেনি। শুধু এসে তননের বাইক রেখে গেছে। উপরে আসেনি। তখন থেকে আরো বেশি খারাপ লাগছে তাহসীর। বাইকের যে সমস্যা হয়েছিল, আগেই ঠিক করে রেখেছিল নাহিদ।

তননের আপাতত এসব নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। সকালের দিকে বাসায় এসেছে। নাহিদ চলে যাওয়ার সময় রিকশা নিয়েছিল। তননের বাইক নিয়ে এসেছিল আসার সময়। তাহসী ও দৌড়ে যেয়ে ভাইয়ের সাথে রিকশা তে করে চলে গেছে ভার্সিটি তে। নাহিদ নামিয়ে দিয়ে গেছে। বাসা ভার্সিটির কাছে হওয়ায় সুবিধা হয়েছে।
তাহসী নেমে যাওয়ার সময় নাহিদ হেসে বলেছিল,
-“সুবিধা হলো তোর। হেঁটেও আসা যাওয়া করতে পারবি।আসি। আল্লাহ হাফেজ।”

তাহসী মাথা নিচু করে চলে গেছে। কিছুই বলতে পারেনি তখন। এত খারাপ লাগছিল তার। ভাই ভাবীর তো দোষ নেই। আশপাশে এমন মানুষ থাকেই অকারণে মানুষ কে খোচানো। যেমন মিথিলার বোন, দুলাভাই।

তনন বাসায় একা। পুরো ফ্ল্যাট ফাঁকা। কোনো জিনিস পত্র নেই। তনন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তাহসী রাগ করে চলে গেছে। তনন লিফটে করে নিচ তলায় নামলো। তিনতলায় বাসা নিয়েছে। পুরো নিচতলা গ্যারেজ, শুধু দারোয়ান এর জন্য ছোট এক রুমের ফ্ল্যাট। গ্যারেজের মধ্যে দিয়ে আসার সময় বাইকের দিকে নজর গেল। তনন আলতো করে ছুয়ে দিল। ডাক্তার অন্তত ছয় মাস বাইক চালাতে নিষেধ করেছে।

তনন বের হয়ে রাস্তার উপরেই দাঁড়ালো। জোর করে হেঁটে তারই সমস্যা হবে। রিকশা আসতেই উঠে বসলো। ফ্রেন্ডস গ্রুপে হেল্প চাইলো, গ্রুপে মেসেজ দেওয়া এইজন্যই সবাই তো ক্লাসে থাকবে। যদি কেউ ক্লাসে না থাকে, তাহলে সঙ্গী বানানো তাকে।
অবশেষে একজন কে পাওয়া গেল।

তনন ওকে সাথে নিয়ে রান্নাঘরের কিছু জিনিসপত্র, তরকারি, বিস্কিট, কয়েক কেজি চাল কিনলো। এরপর আরো কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনলো। এরপর মেস এ যেয়ে দুইটা রিকশা ভাড়া করে তার জিনিসপত্র নিয়ে বাসায় রাখলো। এরপর তননের বন্ধু তাকে রেখে চলে গেল।

মেসে তননের সিঙ্গেল বেড ছিল সেইটা লম্বা করে দেয়ালের সাথে রেখে দিল তনন। এই বেডে তাদের দুজনের হবে না। তোশকের দিকে তাকিয়ে তনন ভাবনায় পড়ে গেল। বেডে যদি না হয় এই তোশকের উপর তো তাদের হবে না। এখন মনে হলো তোশক টা দোকানে দিয়ে নতুন বড় তোশক আনা উচিত ছিল।
ভাবলো কাল আবার যাবে। এখন আর বের হওয়া যাবে না। পায়ের ব্যথা যদি প্রতিদিন এমন বেড়ে যায় তাহলে পায়ের অবস্থা আরো খারাপ হবে। তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে পারবে না। ভাবছে যদি কোনোরকম একটু সুস্থ হতে পারে তাহলে অন্তত একটা টিউশন নিয়ে নিবে। আজকের জিনিস গুলো কিনেছে তার অল্প অল্প করে জমানো টাকা থেকে।
বাসা ভাড়া তো এই মাসের টা হয়ে গেছে। কিন্তু আগামী মাসের টা তো দিতে হবে। তাহসীর উপর ফেলে রাখতে পারবে না এইসব। শুধু কি বাসা ভাড়া! খাওয়া, লেখাপড়ার খরচ আরো কত কি। তননের মনে হচ্ছে এটা বোকামি হয়ে গেল কি-না।

দুপুরে তখন কিনে আনা বিরিয়ানি খেল তনন। আসার পথে দুই প্যাকেট বিরিয়ানি কিনে এনেছিল। এক প্যাকেট ফ্রেন্ড কে জোর করে দিয়েছে। এক প্যাকেট দিয়ে এখন খেল। বিরিয়ানি খাওয়া শেষে মনে পড়লো বাসায় পানি নেই। মাথায় হাত পড়লো তননের। ব্যাগ থেকে পানির পট বের করে নিয়ে নিচে গেল আবার। এই বাসার পাশে একটা টিউবওয়েল আছে, সেদিন বাড়িওয়ালার কাছ থেকে শুনেছিল পানি খাওয়া যায়। আশেপাশের মানুষ এখান থেকে পানি নিয়ে খায়।

তনন পানি ভরে পিছনে তাকাতেই দেখলো তাহসী কাঁধে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে। তনন হাসতে হাসতে এগিয়ে গেল,
-“ওমা,এতো তাড়াতাড়ি শেষ আজ।”

তাহসী হাসি মিলিয়ে একটু মুখ ভাঙালো।
-“রাতে দেখবো এই হাসি কয় যায়!”

তনন চুপ করে গেল। দুজন একসাথে লিফটে করে বাসায় ঢুকলো। তাহসী রুমে যেয়ে বললো,
-“তোশক কার? বাইরে গেছিলা?”

তোশকের উপর বসে তনন বললো,
-“গেছিলাম। মেস থেকে সব নিয়ে আসছি।”

-“মানে কি? পরে সিট পাবা মেসে?”

-“মেসে যাবো কোন দুঃখে?”
পানি খেয়ে জিজ্ঞেস করলো তনন।

-“মানে এখানে পার্মানেন্ট!!”
অবাক হয়ে বললো তাহসী।

-“তো? তুমি চাও না?”
তনন ভ্রু কুঁচকে বলল।

-“আমি ভেবেছি দুই মাস।”
ব্যাগ থেকে খাবারের প্যাকেট বের করলো তাহসী। সেও বসলো তোশকের উপর। তননের দিকে প্যাকেট এগিয়ে দিল।

-“বাব্বাহ! খাবার এনেছো? আমি তো আবার ভাবলাম রেগেমেগে তোমার ফ্ল্যাটে ফিরে যাও কি-না!’

তাহসী আড়চোখে তাকালো সেদিকে। ব্যাগ মেঝের ওপর রেখে তার ছোট্ট আয়না বের করে ব্যাগের উপর হেলান দিয়ে রাখলো। এরপর হেজাবের পিন খুলতে লাগলো।

তাহসীকে দেখতে দেখতে তনন বললো,
-“বিরিয়ানি নিয়ে এসেছিলাম। খেয়ে নিয়েছি। পানি নিতে নিচে গেছিলাম।”

তাহসী এবারেও কিছু বললো না। হেজাব খোলা শেষে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসলো। তননের জন্য ক্লাস মিস দিয়ে চলে আসলো। ভাবলো না খেয়ে থাকবে। অথচ দেখো আরামে আছে এখানে।
তোশকের উপর বসে তাহসী বললো,
-“রাতে কি খাবো? খাবার ও তো এক প্যাকেট আনছি। বাইরের খাবার দিয়ে কতদিন চলবে?”

-“টুকটাক বাজার করেছি।চাল, ডিম, আলু আর দুই একটা সবজি, মরিচ, পেঁয়াজ,রসুন, জিরা আর তেল।”

-“রান্না হবে কিসে? আমি কিন্তু রান্না করতে জানি না।”

নিজের কাছে তাহসী কে টেনে নিল তনন। জড়িয়ে ধরে বললো,
-“এত ভেবে কাজ নেই। টুকটাক করে নিবো। পাতিল,কড়াই এনেছি । তবে প্লিজ আমাকে পার্মানেন্ট রাঁধুনি ভেবো না আর বানিয়ে নিও না!”

তাহসী হেসে উঠলো তননের কথায়।
-“তাহলে মেনে নিচ্ছো?”

তননের কথায় তাহসী থেমে গেল। কেমন যেন লাগছে তার। তার ইচ্ছা ছিল অন্তত অনার্স শেষ করে একসাথে থাকার। কিন্তু তনন আগেই করে নিল সব। রান্না, ঘরের কাজ মিলিয়ে কি আদেও পরিপূর্ণ ভাবে পড়াশোনা করে ওঠা সম্ভব?

_________
পরদিন তাহসী আর ভার্সিটি গেল না। তনন অবশ্য চলে যেতে বলেছিল। অনেক ক্লাস মিস যাচ্ছে তাহসীর। তাহসীর এক স্যার কাল সন্ধ্যায় ফোন দিয়েছিল। তাহসীর মন খারাপ। এই শেষ ইয়ারে এসে মনে হয় এবার আর প্রথম তিনজনের মধ্যে থাকা হবে না? তনন তো একবার বলেই ফেললো বাসা ছেড়ে দেওয়ার কথা।

তাহসী আজ জোর করে যায়নি। তননের উপর এভাবে একা ফেলানো যাচ্ছে না। তোশকের কেনার সাথে সাথে তাহসী নিজের ফ্ল্যাটের সব জিনিস নিয়ে এসেছে। তনন আর তাফসীর বেড পাশাপাশি একসাথে রেখে বড় বেড বানিয়ে নিয়েছে।
তাহসীর ছোট আলমিরা তে দুজনের কাপড় গুছিয়ে নিয়েছে। আঁখি আজ তাহসীর সঙ্গ দিয়েছে। সে ও ক্লাস মিস দিছে আজ। দুপুরে সেই রান্না করলো তিনজনের জন্য। সকালে পাউরুটি,জেলি এনে খেয়েছিল তাহসী।

তাহসীর পড়ার টেবিল রেখেছে রুমের মধ্যে। আর তননের পড়ার টেবিল ডাইনিং রুমে রেখেছে। যেন দুজনের পড়ার কোনো সমস্যা নেই।
আঁখি বলেই ফেললো,
-“তোদের দেখে আমার এখন মনে চাচ্ছে আমিও একটা বিয়ে করে ফেলি।”

দু’জনেই হেসে উঠলো। তাহসী বললো,
-“আপাতত অনার্স টা কমপ্লিট করে নে।”

কথাটার মানে বুঝতে পেরে ও তনন কিছু বললো না। সত্য কথার পিঠে আর কি বলার থাকে। দুপুরে খাওয়ার পরে আঁখি চলে গেল।

চলবে ইনশাআল্লাহ;

#তোমাতে_বিলীন_হবো
#Tahsina_Arini
#পর্ব_৩৭
(অনুমতি ব্যতীত কপি নিষিদ্ধ)

বিকেলবেলা নাহিদ আসলো মিথিলা কে নিয়ে। তাহসী ওদের দেখে খুশি হয়েছে। সাথে মনে মনে হাফ ছেড়ে বাঁচলো। অন্তত থাকার মতো রুমটা করতে পেরেছে। নাহিদ যদি দেখে ফেলতো ফ্লোরে বিছানা! সেদিক দিয়ে বেঁচে গেছে।

নাহিদ কে ভিতরে ঢুকতে বললে উল্টো নাহিদ আরেকজন কে ভিতরে ঢুকতে বললো। মিথিলা আগেই ভিতরে ঢুকেছে। তাহসী তাই জিজ্ঞেস করলো,
-“কে এসেছে আর?”

ফ্রিজ নিয়ে এক জনকে ভিতরে ঢুকতে দেখে তনন বিস্ময় নিয়ে বলে উঠলো,
-“ভাইয়া এসব কি?”

-“গিফট! তোমার কথা মেনে এখানে থাকতে দিয়েছি। এটা নিতেই হবে।”

কিছু না বলে মিথিলা কে নিয়ে সোজা বারান্দায় চলে গেল তাহসী। মিথিলা হেসে বলল,
-“বাব্বাহ! বারান্দাও আছে দেখছি।”

-“হ্যা। বারান্দা ছাড়া বাসা ভাল্লাগে না।”

-“হুম। গ্রামে তোমার রুম দেখেই বুঝেছি। ওহ শোনো কাল গ্রামে যাচ্ছি।”

-“হঠাৎ? ভাইয়ার ছুটি পড়েছে নাকি এমনিতেই?”

-“অনেকদিন যাওয়া হয় না। ছুটি নিতে চাচ্ছিল কিছুদিন ধরে। তো বাবা বললেন…”

তাহসী কথা শেষ না করতে দিয়েই বললো,
-“ওহ্, আচ্ছা! বাবা বলেছে। দেখেছো ভাইয়া কে বলছে। আমাকে বলেনি!”

-“তাহলে বলবে হয়তো। আমরা তো ভাবলাম একসাথে যাবো তোমাদের নিয়ে। বাবা বললেন সবাই আসবে।”
চিন্তিত হয়ে বললো মিথিলা।

তাহসী হেসে বলল,
-“আমি এমনিতেই ওভাবে বললাম। মজা করেছি।”

তনন দরজা থেকে ইশারা করলো তাহসী কে। তাহসী বুঝতে না পেরে বললো,
-“কি?”

মিথিলাও পিছু ঘুরে তাকালো। তনন হাসি দিয়ে চলে গেল। নাহিদের সাথে রুমে কথা বলছিল এতক্ষণ তনন। তাহসী বুঝলো না ব্যাপারটা।

নাহিদকে বসতে বলে তনন চলে গেল রুম থেকে। নাহিদ সেদিকে খেয়াল করেনি। সে তাহসীর কাছে চলে গেছে। তাহসীর পিছনে দাঁড়িয়ে বললো,
-“এতক্ষণে তো মনে হয় তোর ভাবী গুড নিউজ গুলো দিয়ে দিছে।”

-“কিসের গুড নিউজ? একটাই শুনিনি আবার গুলো!”
অবাক হয়ে বললো তাহসী।

-“তোমার ভাইয়া এইবার বিসিএসে টিকে গেছে। আর নাঈম…..”
মিথিলা কে থামিয়ে দিয়ে নাহিদ বলল,
-“নাঈমের টা নাঈম ই বলবে।”

তাহসী হাসিমুখে বললো,
-“আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ। নাঈমের আবার কি?”

-“আলহামদুলিল্লাহ। এইবার লাস্ট বার ছিল আমার বিসিএস। হয়ে গেছে আলহামদুলিল্লাহ।”
নাহিদ বললো।
পুনরায় বলে উঠলো,
-“নাঈমের সাথে নাকি তোর কথা বন্ধ? ফোন দিলে ধরিস না!”

-“ওই আরকি।”
তাহসী এই ব্যাপারে কথা বলতে না চেয়ে অন্য কথায় চলে গেল।

নাহিদ বলে উঠলো,
-“বাসা তো ভালোই গুছিয়েছিস! আমি তো ভাবছিলাম দুই মাসের জন্য বোধ হয় বাসা। কিন্তু তোর সব নিয়ে এসেছিস মানে ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়েছিস তুই! বাবা জানলে রাগারাগী করবে, এটা ভেবেছিস?”

তাহসীর মুখ চুপসে গেল। আরো কথা হলো ওদের মধ্যে। তনন রুম থেকে ডাক দেওয়ায় তিনজন ওখানে গেল। তনন বললো,
-“হালকা নাস্তা করেন। এর থেকে বেশি কিছু করতে পারলাম না।”

নাহিদ এগিয়ে যেয়ে বললো,
-“এইসব করতে গেছো কেন? আমরা কি তোমাদের আত্মীয়? নিজের ভাই ভাবো না দেখছি এখন!”

-“ভাইয়া এমন কিছু না। একটু চেক করে দেখেন। ভালো করে করতে পারিনি।”
তাহসীর দিকে তাকিয়ে বললো তনন।

নাহিদ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বললো,
-“তাহসী এসব বুঝে না তনন। ওর হচ্ছে বাচ্চাদের মতো মন। আর এগুলো করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। বরং তুমি নাস্তা বানিয়ে এনেছো বলে মাইন্ড করলাম।”

তনন মিথিলার দিকে বাটি এগিয়ে দিয়ে বললো,
-“ভাবী আপনি নিন তো। তারপর বলেন নুডলস্ টা কেমন হয়েছে।”

তাহসী মুখ ফুলিয়ে রাখলো। নাহিদ এগিয়ে নিয়ে দুই চামচ মুখে দিয়ে বললো,
-“অনেক ভালো হয়েছে। এত ঝটপট বানালে কিভাবে তাই ভাবছি! আর শোনো, জার্নি করতে পারবে?”

-“কেন ভাইয়া? পারবো মেইবি। ভাবছি আগামী সপ্তাহের মধ্যেই ক্লাস শুরু করবো এক দুইটা।”

-“আমরা কালকেই বাড়িতে যাচ্ছি। তুমি সুস্থ যেতে পারবে কি-না তাই বাবা এখনো তোমাদের বলেনি। এমনিতে একদিন ভালো রান্নাবান্নার আয়োজন করবে বাবা এই আরকি।”

-“কি উপলক্ষে?”

সবার কথাবার্তার মাঝেই তাহসীর ফোনে কল আসলো। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। নাঈমের কল দেখে তাহসী ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলো। তনন পাশেই বসে ছিল। আড়চোখে তাকিয়ে বললো,
-“এবার অন্তত মেনে নাও।”

তাহসী ফোন দিয়ে উঠে গেল। তনন নাহিদ আর মিথিলার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“নাঈম ফোন দিয়েছে।”

কল রিসিভ করে তাহসী চুপ করে থাকলো। ওপাশে থেকে ভেসে এলো নাঈমের কন্ঠস্বর,
-“আপু!”

-“হু।”

-“কথা বলবে না?”

-“কল রিসিভ করেছি তো।”
এতদিন পর কি কথা বলবে ভেবে পেল না তাহসী। নাঈমের কি গুড নিউজ এটা জানার জন্য তাহসীর মন কৌতুহলী হয়ে উঠলো। ব্যাপারটা সে ভুলেই গিয়েছিল।

নাঈমের কাছে থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে শশী বললো,
-“কেমন আছো আপু? তুমি আমাদের উপর এতো রাগ করেছো? একটু কথা বললে কি হয়? কাল তুমি আসবে আপু? জানো তোমার ভাই তোমার কথা ভেবে চোখের পানি ফেলে কত? আজকে তার রেজাল্ট বেরিয়েছে….”
এক নাগাড়ে অনেক কথা বলে থামলো শশী। নাঈম তাকে ধমক দিয়েছে এই পাশ থেকে তাহসী শুনতে পেল।

শশীর বকবকানিতে তাহসীর মন থেকে সমস্ত রাগ চলে গেল। হেসে উঠলো সে। এতদিন নাঈম,শশী কল দিলেও তাহসী ফোন ধরতো না। বাড়ির সবাই স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিলেও ব্যাপারটা কি আসলেও স্বাভাবিক ছিল? একটু শিক্ষা দেওয়ার জন্যই এমন করেছে তাহসী। অবশ্য দুই মাস বাড়িতে যাওয়া হয় না তননের এক্সিডেন্ট এর জন্য। যে সপ্তাহে বাড়ি যেতে চেয়েছিল,সে সপ্তাহেই তননের এক্সিডেন্ট।
ওই পাশ চুপ করে গেলে তাহসী বললো,
-“আহ নাঈম। ভালো লাগছে শুনতে।”

শশী আবারও কথা বলতে শুরু করল। আবদার করে বলল উঠলো,
-“আপু তুমি আসবে তো কাল? আমাকে সব কিছুতেই বকা দেয়। তুমি আসো প্লিজ!”

-“কাল কি? এটাই তো জানলাম না। আজ এইচএসসি রেজাল্ট ছিল একদম ভুলে গেছি। কাল ও মনে ছিল। আজ ভুলে গেছি। নাঈমের রেজাল্ট কি?”

-“উপজেলাতে ফার্স্ট হয়েছে। কাল নাহিদ ভাইয়া আর ওর জন্য বড় চাচু একটু খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করেছে বাড়িতে। এই আরকি। নাঈম বলেছে সে নিজে তোমাকে রেজাল্ট বলতে চাই। তাই চাচু এখনো ফোন দেয়নি। কিন্তু আমি বলে দিয়েছি। হিহিহি।”

-“এই, রাতে ভিডিও কল দিবো হ্যা? এখন রাখি? প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।”

-“ওকে, নো প্রবলেম। তবে ভুলে যেও না।”

তাহসী সায় জানিয়ে মিষ্টি হেসে কল কাটলো। নাহিদ আর মিথিলার সাথে কথা বলা যাক এখন‌।

নাঈম মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকলো। ধমক দিয়ে বললো,
-“নিজের বাড়ি যান আপনি। সবকিছুতে পাকনামো! এখানে কি?”

শশী পেটে হাত রেখে অসহায় মুখ করে বললো,
-“দেখ আমার অসহায় দিন। তোর ফুফি যা-ও একটু ফোন ধরলো আবার কেটে দিল। আর তোর বাবা আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে!”

নাঈম ধরতে গেলেই শশী ফোন বিছানার উপর ছুড়ে মেলে দৌড়ে পালাতে গেল। নাঈম দাঁড়িয়ে যেয়ে বললো,
-“থাম শশী। ধরছি না।”

শশী উল্টা ঘুরে দেখতে যেয়ে বেঁধে গেল……

চলবে ইনশাআল্লাহ;