গোলকধাঁধা পর্ব-০১

0
345

#গোলকধাঁধা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব- ১

বিয়ের আসর থেকে কনে পালিয়েছে। এ নিয়ে উপস্থিত সকলের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। চারিদিকে শোরগোল, হট্টগোল আরম্ভ হয়েছে। মেহমানদের মধ্যে অনেকেই হাসি – তামাশায় ব্যস্ত। কেউ কেউ কটুক্তি শুরু করে দিয়েছে। চৌধুরী বাড়ির এ হালে তারা যেন বেশ আনন্দ পাচ্ছে। এ যেন হওয়ারই ছিলো। সিরাতের মতো ভদ্র, সভ্য মেয়ে প্রত্যয় চৌধুরীর মতো একটা লোককে বিয়ে করবে কেন? যার মনে দয়া-মায়া, ভালোবাসার লেশমাত্র নেই, তাকে নিয়ে সারাজীবন কাটানো সম্ভব নয় কোনো আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মেয়ের। এসব নিয়েই আলোচনা চলছিলো সকলের মধ্যে। কিন্তু তৎক্ষনাৎ গমগমে এক স্বরে কেঁপে ওঠলো আশেপাশের সকলেই৷ পিছু ফিরে চাইতেই দেখলো আমির চৌধুরী স্টেজে দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় দম্ভ নিয়ে বলছে, ‘যারা যারা বিয়ে খেতে এসেছেন, আপনারা সবাই খেয়ে যাবেন। আমার ছেলের বিয়ে বলে কথা, ক্ষিধে নিয়ে কেউ বাড়ি ফিরবেন না।’

এরমধ্যে একজন কটুক্তি করে বলল, ‘কনে তো পালিয়েছে শুনলাম, আপনাদের তো বদনাম হয়ে গেলো। কত করে বলেছিলাম আমার মেয়ের সাথে বিয়েটা দিন, বিজনেসটা আরও এগিয়ে যাক। সেতো শুনলেনই না। যাইহোক, অবশেষে কি-না প্রত্যয় চৌধুরী রিজেক্ট হলো সামান্য একটা মেয়ের কাছে?’

বলে মাঝবয়েসী একজন টাক মাথার লোক হাসতে লাগলো। আমির চৌধুরী এতক্ষণ নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলেও এবার যেন আগুনে ঘি ঢালার কাজটা করে দিলো। সত্যিই তো, ওই মেয়ের এত সাহস তার ছেলেকে রিজেক্ট করার? ভরা বিয়ের আসরে এভাবে অপমান করার সাহস করলো কি করে ওই দু’টাকার মেয়ে? তিনি ক্রোধপূর্ণ গলায় কিছু বলতে যাবে তার আগেই হলঘরের দরজা থেকে কেউ বলে ওঠলো,
‘প্রত্যয় চৌধুরীকে রিজেক্ট করার সাহস এ শহরের কারোর নেই। স্বচক্ষে আমার বিয়েটা দেখে যান আঙ্কেল৷ আশা করি আপনার মন্দ লাগবে না। প্রমিজ!’

টাক মাথার লোক রাগটা গিলে খেলো প্রত্যয়কে দেখে। বাকি সকলেই হতভম্ব হয়ে গেলো বর-কনেকে দেখে। ফর্মাল শার্ট পরিহিত প্রত্যয়ের কোলে সালোয়ার-কামিজ পরিহিত সিরাত লেপ্টে আছে। কনের সাজের লেশমাত্র নেই। ঘুমিয়ে আছে নাকি জ্ঞানহীন তা বোঝা যাচ্ছে না৷ সকলের অবাক ভঙ্গির মধ্যেই প্রত্যয় সিরাতকে নিয়ে চলে গেলো নিজের ঘরে। শুইয়ে দিলো বিছানায়। একপলক জ্ঞানহীন সিরাতের দিকে তাকালো। ভালোই হলো অজ্ঞান হওয়ায়। তখনকার থাপ্পড়টা কাজে দিয়েছে। গাল লাল হয়ে আছে। কোনোমতে বিয়েটা শেষ হোক, এরপর দেখে নেবে এই মেয়েকে। বিয়ে বাড়ি থেকে পালানোর শাস্তি বিয়ে করেই দিতে হবে ওকে। ওর জারিজুরি সব বের করে দিবে। সিরাত আঞ্জুমের অহংকার ঘুচিয়ে না দিতে পারলে প্রত্যয় চৌধুরী নিজের নাম পালটে ফেলবে। একটা বাঁকা হাসি দিয়ে গলা উঁচিয়ে ডাকলো সে অন্তুকে। মুহূর্তেই দরজায় হাজির হলো অন্তু। সিরাতকে এ অবস্থায় দেখে অবাক হয়ে বলল, ‘কোথায় পেলি ওকে?’

প্রত্যেয় রোষপূর্ণ গলায় বলল, ‘বেশিদূর যেতে পারেনি, স্কুলের পাশের গলিতে পেয়েছি। শরীরে নেই দু-ফোটা শক্তি, আমাকে দেখেই বিয়ে করবে না বলে লাঠি নিয়ে মারতে এলো। এক থাপ্পড় খেয়েই দেখ এখন মরার মতো পরে আছে।
‘অজ্ঞান নাকি?’
‘হ্যাঁ। কাউকে বল পানি আনতে, কুইক। জ্ঞান ফেরাতে হবে, নয়তো বিয়েটা হবে না।’
অন্তু ব্যহত গলায় বলল, ‘ছেড়ে দে না দোস্ত। এভাবে জোর করে বিয়ে হয় না। সিরাত খুব ভালো মেয়ে।’
প্রত্যয় রেগে তাকালো, ‘ভালো মেয়েরা মাথানিচু করে সব কাজ করে। অযথা কারো সাথে লাগতে আসে না।কিন্তু এই মেয়ে তা নয়, সেটা তুই ভালো করেই জানিস।’
‘তাই বলে এরকম করবি?’
‘কিছুই তো করিনি। এতো বেশি কথা না বলে কাজ কর, না পারলে বেরিয়ে যা…’

অন্তু আর কথা বাড়ালো না। বন্ধুকে সে ভালো করেই চেনে। সিরাতের জন্য খুব খারাপ লাগছে। মেয়েটা কেন যে প্রত্যয়ের কাজে নাক গলাতে গেলো! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়ির কাজের লোককে পানি আনতে বললো সে।

চোখেমুখে পানির ছিঁটে পড়তেই মিটিমিটি করে চোখ খুললো সিরাত। মাথাটা ভীষণ ভার লাগছে। কেমন অদ্ভুত লাগছে সবকিছু।
টিউশন শেষে ফেরার পথে ওকে কিডন্যাপ করে এনেছে প্রত্যয় চৌধুরীর গুন্ডা বাহিনী। জোর করে বিয়েতে রাজি করাতে চেয়েছিলো। কিন্তু সুযোগ বুঝে
পালিয়ে গিয়েও ধরা পড়েছিলো প্র‍ত্যয়ের কাছে৷ এখন কোথায় তবে সে? চোখ খুলে তাকাতেই সামনে বসে থাকা প্রত্যয়ের চেহারা দেখেই রক্তশূণ্য হয়ে গেলো ওর মুখ।

সবকিছু মনে পড়তেই লাফিয়ে ওঠে বসলো। গায়ের ওড়না ঠিক করতে করতে চেঁচিয়ে ওঠলো, ‘আমাকে এখানে এনেছেন কেন? আপনার মতো শ’য়তানকে বিয়ে করবো না আমি। কিছুতেই না। আবারও পালিয়ে যাবো।’
প্রত্যয় চেয়ারে বসে হো হো করে হেসে ওঠলো,
‘মজা পেলাম।’
সিরাত চোখ গরম করে তাকালো। সহ্য হচ্ছে না এই লোকটাকে একবিন্দুও। চেহারা দেখেই গা ঘিনঘিন করছে, ‘আমি আপনাকে মজার কথা বলেছি?
‘অবশ্যই। বাঘের খাঁচায় ঢুকে বেরুনোর কথা বললে হাসি ছাড়া আর কিচ্ছু পাবে কি মিস.সিরাত? স্যরি মিসেস চৌধুরী?’
সিরাত তেতে ওঠলো,
‘মুখ সামলে কথা বলুন। আপনার মতো কুলাঙ্গারের মিসেস হওয়ার চেয়ে বি’ষ খেয়ে নিজেকে শেষ করে দেওয়া ঢের ভালো।’

প্রত্যয় গম্ভীরমুখে এগিয়ে এলো সিরাতের দিকে। ও ঘৃণাভরে তাকালো প্রত্যয়ের দিকে। প্রত্যয় তা দেখে বিচলিত হলো না৷ কাষ্ঠ হেসে বলল, ‘মরবে তো অবশ্যই, তবে তা আমার হাতে। ধীরে, আস্তে। আমার কাজে নাক গলানোর খেসারত দিয়েই ম’রতে হবে।’

‘তবে এক্ষুণি মেরে ফেলছেন না কেন? আমাকে বিয়ে করে লাভ কি আপনার?’

‘লাভ-ক্ষতির হিসেবটা আমাকেই না হয় বুঝতে দাও। আপাতত আমি রেগে যাওয়ার আগে বিয়েতে রাজি হয়ে যাও, তোমার কারণে কারো জীবন হয়তো প্রদীপ ধীরে ধীরে নিভে আসছে।’

সিরাত আঁৎকে ওঠলো। বোবা বনে গেলো সে। প্রত্যয় আগের মতোই গা জ্বালানো হাসি দিয়ে কাউকে ফোন লাগালো। সিরাতের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে সে ওপাশের কাউকে জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন আছে আমার হবু সোনাটা? মা’কে বুঝি মিস করছে? দাঁড়া মায়ের সাথে সাক্ষাৎ করাচ্ছি ওকে।’

ওপাশ থেকে কি বললো সিরাত শুনলো না। প্রত্যয় ভিডিও কল এনে ওর সামনে ধরে তীক্ষ্ণ হেসে বলল, ‘ ‘ছোট্ট সোনাটা কাঁদছে সিরাত। মা হিসেবে তুমি কিভাবে সহ্য করছো বলো তো? দয়া নেই তোমার?’

সিরাত হতভম্ব হয়ে ওর হাত থেকে ফোন কেড়ে নিলো। ওর প্রাণ, ওর জীবনকে এভাবে প্রত্যয়ের লোকেদের কাছে দেখে হতবাক হয়ে গেলো। মা-বাবা কোথায়? নীরু কোথায়? ছোট্ট সোহা এদের কাছে কি করছে? এতসব প্রশ্ন যেন ওর মস্তিষ্ক নিতে পারলো না। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠলো। বলল,
‘ও একটা ছোট্ট বাচ্চা৷ কি ক্ষতি করেছে ও? ছেড়ে দিন ওকে।’

‘দেবো। তার আগে বিয়েটা হোক। নয়তো কে জানে রাতে ডাস্টবিনে শেয়াল-কুকুরের খাদ্য বানাতে হবে কিনা!’

কথা শুনেই সিরাতের দম আটকে এলো। এতটা নির্দয়-পাষাণ কিভাবে হতে পারে মানুষ? নাহ! এ মানুষ না ; অমানুষ! সিরাত কাঁদতে কাঁদতে প্রত্যয়ের বুকে কিল-ঘুষি দিতে দিতে বলল,
‘তুই পশুদের থেকেও অধম। জীবনেও ভালো হবে না তোর।’

প্রত্যয় ওর হাত দুটো ধরে বলল, ‘তুই তুকারি একদম না।’

‘বিয়ে করবো আমি। আমার বাচ্চাকে চাই।’

সিরাত কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বললো। প্রত্যয় সামান্য হাসলো। আজকের পর থেকে এভাবেই আর্তনাদ করবে সিরাত প্রতিটা দিন। তবেই ও শান্তি পাবে। তবে এত ছোট্ট বাচ্চাকে পরিকল্পনার অংশে ঢোকাতে রাজি ছিলো না। কিন্তু বাধ্য হয়েই করতে হলো এটা। সিরাতের সবচেয়ে দুর্বল জায়গায় আঘাত না হানলে ও কখনোই এ বিয়েতে রাজি হতো না। ও ওঠে ঘরের বাইরে যেতে যেতে বাঁকা হেসে বলল, ‘অতিরিক্ত সাহসিকতার ফল কখনো ভালো হয় না হবু মিসেস।’

সিরাতের কান্না বন্ধ হয়ে গেলো। ঘৃণাভরে দেখলো সে প্রত্যয়কে। তার জীবনের অভিশাপ এই লোক৷ এখন কিনা একে বিয়ে করে নিজের জীবনটাকে মাঝনদীতে ফেলে দিতে হবে? ছোট্ট সোহাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে বিয়ে করার জঘন্য কাজটা অবশ্য এই লোকটার থেকেই আশা করা যায়। সোহার কান্নারত মুখটা মনে পড়তেই কলিজা মুচড়ে ওঠলো ওর। বড়বোন সিমিনের শেষচিহ্ন সোহা। সোহাকে জন্ম দিতে গিয়ে বোনের মৃত্যু শয্যায় কথা দিয়েছিলো সিরাত, ওকে আগলে রাখবে। কিন্তু আজ নিজের জন্য সোহার এ অবস্থা যেন সিরাতকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দিয়েছে। বমি পাচ্ছে ওর, প্রত্যয়ের প্রতি ঘৃণায় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে। অভিশাপ একটা সিরাতের জীবনে।

আধঘন্টাও পার হলো না, এরমধ্যে প্রত্যয় চৌধুরীর সাথে সিরাতের বিয়েটা হয়ে গেলো। উপস্থিত মেহমানগণ এই প্রথম দেখলো সামান্য সালোয়ার-কামিজ, আর ফর্মাল শার্ট পরে বর-কনের বিয়ে। এত বিত্তশালীদের বিয়ের পোশাক এত সাদামাটা দেখে সকলেই মনে মনে হাসলো। ভেতরের খবর না জানলেও উড়ন্তভাবে তাদের কানে এসেছে প্রত্যয় চৌধুরী এ বিয়েটা জোর করেই করেছে সিরাত নামক মেয়েটিকে। আর এতে সম্পূর্ণ সায় দিয়েছে আমির চৌধুরী। বিয়ের শেষ মুহূর্তে আচমকা এক ঘটনা ঘটলো। প্রত্যয়ের মা মুশফিকা চৌধুরী এসে ঠাস করে থাপ্পড় বসালেন ছেলের গালে। হতভম্ব হয়ে গালে হাত দিয়ে মায়ের দিকে তাকালো প্রত্যয়। আমির চৌধুরী রেগে তাকালেন স্ত্রীর দিকে।
উপস্থিত সকলে মজা নিয়ে নাটক উপভোগ করতে লাগলেন!

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে