গোলকধাঁধা পর্ব-১২

0
254

#গোলকধাঁধা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১২

প্রত্যয়ের গলায় মিষ্টি আটকে গেলো বোনের কথা
শুনে। চোখ কপালে ওঠলো ওর। সবাই কি মজা
করছে ওর সাথে? কাশতে থাকলো সে। মুশফিকা চৌধুরী হন্তদন্ত হয়ে পুত্রকে পানি খাইয়ে দিলেন। প্রত্যয়ের গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুচ্ছে না উত্তেজনায়। কোনোমতে মুশফিকা চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করলো,
‘মা আমার বউ কই?’
‘আমার ঘরে বসে আছে। ভাবির বোধহয় লজ্জা
লাগছে সামনে আসতে।’
প্রত্যাশা হেসে ভাইকে বললো। প্রত্যয় ভ্রু কুঁচকে
গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘এখানে লজ্জার কি আছে? কই আমি তো পাচ্ছি না। উল্টে আমার তো বুকের ভেতর শব্দ হচ্ছে। তোমরা কি কিছু শুনতে পাচ্ছো না? আব্বু আমার মনে হচ্ছে হার্ট-অ্যাটাক হয়ে যাবে।’
আমির সাহেব মাথা নেড়ে হেসে বললেন,
‘বাবা হওয়ার খবর শুনে আমারও এমন হয়েছিলো।
আমি তো সব কাজ ফেলে তোর মাকে সামনে বসিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম দু’দিন।’
প্রত্যাশা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকালো,
‘এটা অসম্ভব আব্বু।’
আমির সাহেব মেয়েকে বললেন,
‘তুমি বুঝবে না মা এই অনুভূতি!’
প্রত্যয়ও বোনকে ধমকে বলল,
‘আসলেই তুই বুঝতে পারছিস না, আমারও
ঠিক এমনই ইচ্ছে করছে।’
আমির সাহেব হাসতে লাগলেন পুত্রের কান্ড দেখে। মুশফিকা চৌধুরীও ভীষণ আনন্দিত! তিনি দাদী হতে যাচ্ছেন। অবশেষে বাড়িতে একটা বাচ্চা আসতে চলেছে যে সোহার মতো গুটিগুটি পায়ে হাঁটবে, আধো আধো স্বরে দাদীমা বলে ডাকবে। পুত্রের উচ্ছ্বাস দেখে তিনি হেসে বললেন,
‘ওকে ক্লিনিকে নিয়ে যেও। আমি এপয়েনমেন্ট নিয়ে রেখেছি ডাঃ শাহানার।’
প্রত্যয় মাথা নেড়ে মায়ের কথায় সায় জানালো। আর কোনো অভিযোগ করতে দেবে না সিরাতকে। মন দিয়ে এবার সে বউ-বাচ্চার খেয়াল রাখবে। রাজনীতিতে এত সাকসেস, প্রথমবারেই নির্বাচনে আশার বাইরে জনগণের এত সাড়া পাওয়ার পর যতটুকু আনন্দ হয়েছিলো এর চেয়েও হাজারগুণ বেশি আনন্দ হচ্ছে বাবা হবে বলে। একমুহূর্ত কিছু ভেবে নিজে না গিয়ে প্রত্যাশাকে পাঠালো সিরাতকে ডাকতে। প্রত্যাশা গিয়েই ফিরে এলো। এসে জানালো ও ডেকেছে শুনে সিরাত আসেনি। ওর সাথে ক্লিনিকে যেতেও রাজি হলো না। মুশফিকা চৌধুরী জানেন না দু’জনের মাঝে কি
হয়েছে। তবে আজ আর সেদিকে বেশি নজর দিলেন না। সিরাতের আচরণে বিস্মিত হলেও রাগ করলেন
না। নিজেই বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিয়ে গেলেন ক্লিনিকে। প্রত্যয়ের নিজেরও ভীষণ রাগ হলো সিরাতের এমন আচরণে। মেয়েটা চোখের দেখা পর্যন্ত দিলো না ওকে। এত রাগ? এত জেদ ওর? রাগ করে সে নির্বাচনী প্রচারণায় যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলো।
কিন্তু মনটা পড়ে রইলো সিরাতের কাছে!

বাড়ি ফিরে খাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে দেশের সমসাময়িক বিভিন্ন খবর নিয়ে রিসার্চ করছিলো প্রত্যয়। নির্বাচনী প্রচারণায় বেশ সাড়া পেলেও ভোটে কে হারবে কে জিতবে এটা নিয়ে ওর কোনো মাথাব্যথা নেই। তবে জনগণের এত ভালোবাসা পেয়ে ওদের
জন্য কিছু করার তাগিদ হচ্ছে ওর এমনিতেই।
সেজন্য সমস্যাগুলো নোট করে রাখছে। একবার
এমপি পদ পেয়ে গেলে জনগণের চাহিদা মাথায় রেখে কোথা থেকে কাজ শুরু করলে উন্নয়ন হবে তা ঠিক করছিলো। এসব নিয়ে সামান্য চিন্তাভাবনা করছিলো ও। এমন সময়ই সিরাতকে দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে দেখলো। ভ্রু কুঁচকালো প্রত্যয়। সারাদিন পর
মহারাণীর এখন দেখা দেওয়ার সময় হলো! তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ও কোনো শব্দ করলো না। ফোন ঘাটার ভান করে আড়চোখে বারবার সিরাতকে দেখতে থাকলো। মেয়েটার মুখে হাসির লেশমাত্র
নেই, মেঘ জমিয়ে রেখেছে।
সিরাত একপলক প্রত্যয়কে দেখে বারান্দায় গিয়ে
বসলো চুপচাপ। রেশমী হাওয়া। রাতের আকাশে অনেক তারা। মেঘমুক্ত আকাশে মস্ত চাঁদ ঝলমলে আলো ছড়াচ্ছে। দূরের বাড়িঘর গুলো কেমন
অন্ধকার! সিরাত এই অকৃত্রিম সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে পেটে হাত রেখে ভাবনায় মত্ত হলো। এই প্রত্যয় লোকটাকে নিয়ে আর মন খারাপ করবে না সে। এতদিন মনটা বিষন্ন, গুমোট লাগলেও আজ প্রতিটি মুহূর্ত সে অনুভব করছে সব উদ্ভট ভাবনা বাদ দিয়ে।
এ কারণেই বোধহয় কথিত আছে, মা হওয়ার আনন্দটাই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সুখ এনে দেয়।

আবহাওয়া শীতল। এর মধ্যে সিরাত বারান্দায় বসে আছে দেখে প্রত্যয় একটু পর ওঠে গেলো। জানে যে সিরাত ওর কথা শুনবে না সেজন্য একপ্রকার জোর করেই পাঁজাকোলা করে ঘরে নিয়ে এলো ওকে।
সিরাত ছুটার জন্য ছটফট শুরু করায় সাবধানে
ওকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল,
‘আমার সাথে রাগ করেছো তাহলে আমার বাচ্চাকে
কষ্ট দিচ্ছো কেন? আরেকবার নড়চড় করলে
একটা চড় বসিয়ে দেবো।’
সিরাত শক্ত গলায় বলল,
‘ছাড়ুন। ধরেন কেন আমাকে? আপনি ছুঁলে আমার নিজেকে জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। বাজে লোক।’
‘হুঁ, আমি বাজে। সেজন্যই ছাড়বো না, শক্ত করে
ধরে রাখবো।’
প্রত্যয়ের কথা শুনে ওর মেজাজটা বিগড়ে গেলো ওর।
কথা না বাড়িয়ে ফোঁসফোঁস করতে করতে শুয়ে পড়লো। প্রত্যয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে চাদর টেনে দিলো ওর গায়ে। ডাঃ শাহানার সাথে ওর কথা হয়েছে। এ সময়টা বেশ যত্ন নিতে হবে সিরাতের। মন-মেজাজের যত্ন নিতে হবে, মানসিক সাপোর্ট দিতে হবে। কিন্তু এরকম আচরণই যদি করে তাহলে প্রত্যয় কিভাবে কি করবে?
ও আলো নিভিয়ে নিজেও শুয়ে পড়লো।

দিনদিন যেন মানসিক অবস্থার অবনতি ঘটছে সিরাতের। মাঝেমধ্যে বিরক্ত লাগে, কখনো কান্না
পায়। প্রত্যয়ের কথা শুনলেই চেঁচিয়ে ওঠতে ইচ্ছে
করে শুধু মনে হয় লোকটা ওকে ঠকিয়েছে। মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমাতে ইচ্ছা করে। কারো সাথে কথা বলতেও ইচ্ছে করে না কখনো। সবাই-ই ওর পরিবর্তন টের পাচ্ছিলো। এ সময় এসব স্বাভাবিক,
আবহাওয়া পরিবর্তন দরকার। এই সময়টা অনেক মেয়েই নিজের মায়ের কাছে থাকতে চায়। শ্বশুর-শ্বাশুড়ি নিজে থেকেই অনুমতি দিলেন
সিরাতকে, সে কোথায় যেতে চায়? সিরাত জানালো
বাড়ি যেতে চায়। মুশফিকা চৌধুরী নিজে এসে দিয়ে গেলেন ওকে, এছাড়াও চারবেলা নিয়ম করে খোঁজ নেন ওর। ঔষধ খেয়েছে কি-না, শরীর খারাপ হলো কি-না এসব নিয়ে তিনি প্রচুর চিন্তিত! শ্বাশুড়ির এই আমূল পরিবর্তন দেখেও সিরাতের
ভালো-মন্দ কিছুই অনুভব হয় না। তবে বাড়িতে ওর দিনকাল ভালোই কাটে মা, নীরু, সোহার সাথে হৈ-হল্লা করে। এভাবেই বেশ কিছুদিন কেটে গেলো।

ভোটের দিন চলে এলো। প্রতিপক্ষকে বেশ বড় ব্যবধানে হারিয়ে জিতে গেলো প্রত্যয়। নামের আগে যোগ হলো এমপি। তার দলের কর্মীরা উল্লাসে ব্যস্ত। তবে এসব কিছুই ছুঁতে পারছে না প্রত্যয়কে। সিরাত
ওর ফোন ধরে না বাবার বাড়ি যাওয়ার পর থেকে, নাম্বার ব্লক করে রেখেছে। এর,ওর ফোন দিয়ে কল দিলেও কথা বলে না। এইযে, ভোটে সে জয় পেয়েছে খবরটা নিজের মুখে দিতে চেয়েছে সিরাতকে। কিন্তু মেয়েটা একবার গলা শুনেই কল কেটে দিয়েছে। এর মধ্যে শুনতে পেলো কিছু ভোটকেন্দ্রে গন্ডগোল বাঁধিয়েছে ওর বিরোধী প্রার্থীর লোকেরা। পুলিশ
আসায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে ওর দলের কিছু ছেলেকে থানায় ধরে নিয়ে গেছে৷ প্রত্যয় মাহিন আর অন্তুকে নিয়ে ছুটে গেলো সেখানে। পথে যেতে যেতে দেখলো বিভিন্ন জায়গায় ওর জয় নিয়ে আনন্দ মিছিল বের করছে সাধারণ জনগণ। প্রত্যয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে হাসলো, বউটাই একমাত্র ওকে
দেখতে পারে না!

নির্বাচনী কার্যক্রম সামলে প্রত্যয় এক দুপুরে এক গাড়ি ভর্তি বাজারসদাই করে গেল শ্বশুরবাড়ি। মূলত শিমুল সাহেবই মেয়ে জামাইকে দাওয়াত করেছেন তার সফলতার জন্য। কাজে ব্যস্ত প্রত্যয় এ সুযোগে বউকে দেখার লোভটা সামলাতে না পেরে সব রেখেই ছুটে গেলো। দরজা খুলে দিলো সিরাতের খালার মেয়ে নীরু। এবার ক্লাস নাইনে উঠেছে সে। গ্রামে থেকে ভালো পড়াশোনা হয় না বলে গত তিনবছর যাবৎ
শহরে খালার বাসায় থেকেই পড়াশোনা করছে নীরু। সিরাত ফোন না ধরায় নীরুর কাছ থেকেই ওর সব খোঁজ নেয় প্রত্যয়। ওকে দেখেই নীরু উৎফুল্ল
গলায় বলল,
‘ভালো আছেন দুলাভাই?’
প্রত্যয় হেসে বলল,
‘হ্যাঁ, তোমরা কেমন আছো?’
নীরু হেসে বলল,
‘আলহামদুলিল্লাহ। আপাও ভালোই আছে।’
‘কোথায় সে?’
‘ঘুমায়।’
প্রত্যয় ভ্রু কুঁচকালো,
‘এই অসময়ে?’
‘হা। আপার দিনদুপুরের ঠিক নাই। সারাদিন ঘুমায়।’
প্রত্যয় হেসে ফেললো। শিমুল সাহেব এসে বললেন,
‘দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে আসো বাবা। এই নীরু
শরবতের ব্যবস্থা কর। খালাম্মারে খবর দে গিয়ে।’
‘আচ্ছা যাই।’
বলে নীরু ছুটে গেলো। প্রত্যয় এতসব বাজার-সদাই করে এনেছে দেখে শিমুল সাহেব হতবাক। এই ছেলে যতবার আসে এতসব সঙ্গে নিয়ে আসে। কি একটা অবস্থা! মিনারা এসে লাজুক স্বরে বারবার আফসোস করতে লাগলেন। দুপুরের ভূরিভূজন সেরে সিরাত ঘুমিয়ে আছে দেখে বিরক্ত করলো না প্রত্যয়।
পড়ার ঘরে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিলো। ঘুম ভাঙলো মাগরিবের আজান শুনে।
শিমুল সাহেবের সঙ্গে মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে
বাড়ি এসে দেখলো টেবিলে বসে সবজি কাটছে
সিরাত। প্রত্যয় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে বউকে দেখে নিজের চোখের তৃষ্ণা মেটালো। পাশেই সোহা মাটিতে বসে খেলছে। প্রত্যয়ের চোখেমুখে প্রশান্তি নেমে এলো। হাসিমুখে এগিয়ে যেতেই সোহা দু-হাত বাড়িয়ে
‘আ আ’ করে ওর কোলে আসতে চাইলো। ওকে
নিয়ে পায়চারি করতে থাকলো
প্রত্যয়। সোহা মিষ্টি হেসে বারবার ছড়ার মতো
বলতে লাগলো,
‘প্রত্তু, প্রত্তু, প্রত্তু…’
প্রত্যয় নিজের নামের দফারফা অবস্থা দেখে
বিনিময়ে মুচকি হাসলো। সিরাতকে একপলক
দেখে এরপর বলল,
‘প্রত্তুকে এখন আর ভালো লাগে না, তাইনা?’
সিরাত শুনতে পেলো কথাটা। ইচ্ছে করেই যে ওকে এসব শুনাচ্ছে তা বুঝতে পারলো। সোহা গো গো শব্দ করে হেসে প্রত্যয়ের গালে সদ্য বেড়ে ওঠা খোঁচা
খোঁচা দাঁড়ি ধরে টান মারলো। প্রত্যয় ‘আহ’ বলে চেঁচিয়ে ওঠলো। সিরাত টেবিলেই বসে শসা
কাটছিলো। দেখেও এগিয়ে এলো না। বরংচ বিরক্তি ভঙ্গিতে কাজে মন দিলো। প্রত্যয় মুখভার করে সিরাতকে শুনিয়ে শুনিয়ে সোহাকে বলল,
‘তোমার মা আমার সাথে কথা বলে না জান। বলো
তো কি করি?’
সোহা দু-হাত এক করে তালি দিয়ে দিয়ে বলল,
‘মালো মালো।’
প্রত্যয় অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
‘মারলে তো পুলিশ নিয়ে যাবে আমায়। তখন কি
হবে?’
পুলিশের কথা শুনেই সোহা ভয় পেয়ে কেঁদে দিলো। প্রত্যয় বোকা বনে গেলো। সিরাত এসে ছোঁ মেরে
ওকে নিয়ে গেলো। কান্না থামানোর জন্য
টেবিলের ওপর বসিয়ে আহ্লাদী সুরে এটাওটা বলতে লাগলো। সোহা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে মা’কে বিচার দিলো,
‘পুলিস আসচে মামুনি…’
সিরাত সান্ত্বনা দিয়ে ওকে বলল,
‘চোর ধরতে আসবে মা, তোমাকে না।’
প্রত্যয়ের মনে হলো কথাটা ওকেই উদ্দেশ্য করে
বলেছে সিরাত। অপমানে থমথমে হয়ে ওঠলো মুখ।
রেগে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে।

[৯নং পর্বতে ডিটেইলস লিখিনি, কিন্তু হিন্টস তো ছিলো প্রেগন্যান্সির! যাইহোক, না বোঝাতে পারার জন্য সত্যিই দুঃখিত। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে