Tuesday, July 1, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 317



লজ্জাবতী পর্ব-০৮

0

#লজ্জাবতী
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব-০৮

মালা বদল করে, সাত পাঁক ঘুরে, সিঁথি ভর্তি বরের দেওয়া সিঁদুর পরে, রিধীকার বিয়ে হয়ে গেল। দেবু আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। পোড়া মন, হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ভেজা চোখ, মুছতে মুছতে চলে গেল।
একমাত্র ননদের বিয়ে। মাধু খুব ছোটাছুটি করছিল। কাজের যেন শেষ নেই মেয়েটার। একটা কাজ শেষ হতেই রেণুবালা আরেকটা কাজ ধরিয়ে দেয়। গভীর রাত হয়ে যায়। অথচ মাধুর এখনো ঘরে আসার নাম নেই। অনুপম অধৈর্য হয়ে গেল। মাধুকে খুঁজতে খুঁজতে ছাদে পেল। মাধু, নতুন বর, বউয়ের খাওয়া এঁটো থালাবাসন গুচ্ছাছিল। অনুপম চাপা কণ্ঠে বলল,
-‘তুমি এতরাতে এগুলো করছো কেন? ঘরে চলো?
-‘আপনি যান। আমার প্রায় হয়ে গেছে।
অনুপম, মাধুর হাতদুটো টেনে ধরে, নীচু কণ্ঠে বলল,
-‘আমি একা ঘরে চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করছি। আমার ইমোশনের কোন দাম নেই তোমার কাছে? মাধু আমার হাতে ছুটি কম। আমাকে দুদিন পর চলে যেতে হবে। দিনে না হোক। রাতে তো অন্তত তুমি আমাকে সময় দেবে?
মাধু লজ্জা পেল। দৃষ্টি মাটির দিকে রেখে, বসা থেকে উঠে পরল। বিয়ের ছয়মাস হতে চলল। অথচ এখনো অনুপমের আবেগময় কথায় মাধুর হৃদয়ে কাঁপন ধরে। মাধুর জন্য এত অস্থির মানুষটা? শুনতে বেশ লাগে। অনুপম, মাধুকে কোলে তুলে নিল। মাধু ছটফটিয়ে উঠল। অনুরোধ করে বলল,
-‘দয়া করে, আমাকে নামিয়ে দেন? কেউ দেখলে কেলেংকারী হয়ে যাবে।
অনুপম মুচকি হেসে, মাধুকে আর একটু শক্ত করে চেপে ধরল। মাধু, অনুপমের বুকে লজ্জায় মুখ লুকাল। অনুপম, মাধুকে চিলেকোঠার ঘরে নিয়ে গেল। খাটের মাঝখানে বসিয়ে দিল। নিজেও হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে, মাধুর দুইহাত আলতো করে ধরল। চোখে চোখ রেখে গাঢ় কণ্ঠে বলল,
-‘আজকের এই মায়াবী রাত, আকাশে শুক্লপক্ষের চাঁদ, অদূরে ঝিঁঝি পোকার মায়াময় ডাক আর আমার চোখে দেখা, পৃথিবীর সবচেয়ে লক্ষ্মীমন্ত, লজ্জাবতী রমনী।’ আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, আজকের রাতটা আমাদের জীবনে খুব স্পেশাল স্মরণীয় রাত হয়ে থাকবে। এই সুন্দর রাতকে ঘিরে, আমাদের দুজনের সুখ সুখ অনুভূতিকে আমরা জীবনেও ভুলব না। প্রমিস করো লক্ষ্মী?
মাধুর কাজল কালো চোখের কোণে জল জমেছে, কাঁপা কাঁপা হাত অনুপমের বাড়িয়ে রাখা হাতে রাখল। অনুপম, মাধুর চিবুকে ঠোঁট ছোঁয়াল।
অনুপমের তীব্র ভালোবাসার উষ্ণ স্পর্শে মাধুর শরীরে বসন্তের শিমুল ফুলের মতো আগুন লেগেছে। মায়া, ভালোবাসা, একে অপরকে ঘিরে সুখ সুখ অনুভূতিতে একটু করে কেটে গেল, রাতের আঁধার।
দিনের আলো ফুটতেই মাধু ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। আয়নায় নিজেকে দেখে আঁতকে উঠল। চোখে কাজল লেপ্টে গেছে, ঠোঁটের চারপাশে লিপস্টিকে মাখামাখি, সিঁথিতে সিঁদুর লেপ্টে গেছে, ভারী শাড়ি এলোমেলো। বিয়ে বাড়ি। এতক্ষণে বাড়ির অনেক মানুষই উঠে গেছে। মাধুর খুব কান্না পেল। এই বেশে মানুষের সামনে কী করে যাবে মাধু? পাশে অনুপম গভীর ঘুমে মগ্ন। মাধু আস্তে আস্তে ডাকাডাকি করল। অনুপম উঠল না। ঘুমে ব্যঘাত ঘটায় বিরক্ত হয়ে পাশ ফিরে শুলো। মাধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে গেল। মাথায় বড় ঘোমটা টেনে গুটিগুটি পায়ে, ছাদ থেকে নেমে গেল। সিঁড়ির শেষ মাথায় এসে রেণুবালার সাথে দেখা হলো। রেণুবালা মাধুর এই বেশ দেখে, ছিঃ ছিঃ করল। রাগী অথচ চাপা কণ্ঠে বলল,
-‘বাড়িতে তোমার ননদের বিয়ে উপলক্ষে বাড়ি ভর্তি মানুষজন গিজগিজ করছে। দুদিন অন্তত তোমাদের এই বেহায়াপনা না করলে হতো না বড়বৌমা? মুখের কী অবস্থা করেছ? গুরুজনদের সামনে একটু লজ্জা নিয়ে চলতে শিখো?
মাধু মাথা নীচু করে, হাত মোচড়াচ্ছে। শাশুড়ীর তীব্র বাক্যবাণ শুনে চোখদুটো ছলছল করে উঠল। রেণুবালা ধমকে উঠল।
-‘আমার সামনে একদম ন্যাঁকা কান্না কাঁদবে না। দেখতে খুব বিরক্ত লাগে।
-‘কী হয়েছে মাওইমা? মাধুকে ধমকাচ্ছেন কেন?
মাধুর বড়দি এগিয়ে এলো। রেণুবালা শুকনো হাসার চেষ্টা করল। মুখ বলল,
-‘না কিছু না। ওই আরকি?
-‘আপনি আমার গুরুজন। কিছু মনে করবেন না মাওইমা। আমি আপনাদের কথা কিছুটা শুনে ফেলেছি। আমার বোনের এই অবস্থা একা একা হয়নি। এতে যতটা ওর দোষ। ঠিক ততটাই আপনার ছেলের দোষ। তাছাড়া ওরা বিবাহিত দম্পতি। ওরা কখন কী করবে, না করবে সেইটা ওরাই ভাল বুঝবে। এখানে ওকে বকা বা শাষণ করার কিছুই নেই। আপনার দেখতে এতই যখন দৃষ্টিকটু লাগে। আপনার ছেলেকে সরাসরি বলবেন। বউয়ের সাথে রাতে থাকবি না।
মাধু চল আমার সাথে স্নান করবি! বড়দি কথাগুলো বলেই মাধুকে নিয়ে চলে গেল। নেহাৎ বিয়েবাড়ি। না হলে দুই দিনের ছুড়ি রেণুবালাকে অপমান করে? এতক্ষণে রেণুবালা লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে নিত। মাধু পুকুরে পাড়ে গিয়ে সাবান দিয়ে মুখ ধুলো। বড়দি সিঁড়িতে আনমনা হয়ে বসে ছিল। মাধু বলল,
-‘শুধু শুধু ওনাকে এতগুলো কথা শুনালি বড়দি?
-‘তুই কিছু বলিস না দেখেই তোর মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খায়, এই মহিলা। কেন মাধু অন্যায় দেখেও চুপ থাকিস? তুই তো এমন ছিলি না?
-‘আমার চুপ থাকায় যদি সংসারে শান্তি বজায় থাকে। তাহলে চুপ থাকতে মন্দ কী! একসাথেই যখন থাকতে হবে। তখন ঝগড়া, অশান্তি, বিবাদ করে কী লাভ? বলুক না ওনি যা খুশি। এতে আমার শরীর খয়ে যাবে না।
-‘অনুপমকেও তো বলতে পারিস?
-‘ও ওর মাকে খুব ভালোবাসে। একই সঙ্গে আমাকেও প্রচণ্ড ভালোবাসে। একজন ভালোবাসার নারীর মুখ থেকে আরেকজন ভালোবাসার নারীর বদনাম শুনতে ওর একটুও ভাল লাগবে না বড়দি।
-‘আমাদের সেই ছোট্ট মাধু কবে এতটা বড় হয়ে গেল রে?
উত্তরে মাধু একটুখানি হাসল।

বিদায়বেলা রিধীকা খুব কাঁদল। রেণুবালা মেয়েকে বুকে আগলে ধরে বিলাপ করছে। মায়ের বুক থেকে জোর করে রিধীকাকে ছাড়িয়ে নিয়ে গাড়িতে বসানো হলো। ঐ দূরের ছাদ থেকে আরেক জোড়া তৃষ্ণার্ত চোখ, চাতকপাখির মতো তাকিয়ে আছে।
ভালোবাসার মানুষটা পুরোপুরি অন্যের হয়ে যাওয়ার সময় যে ভালোবাসা মনে উদয় হয়। সেই ভয়ংকর, সর্বনেশে ভালোবাসা কারো জীবনে না আসুক।

মেয়ের বিয়ের পর বাড়িতে যে কী পরিমাণ কাজ জমে যায়। মাধু, বিন্দুমাসি পুরো বাড়ি ছাড়ু দিয়ে প্রায় অর্ধেক বেলা লাগিয়ে মুছলো। দুজন কাজের মানুষ নিয়ে থালাবাস ধুয়ে ঘর গুছিয়ে নিল। কাল আবার বৌভাত। ওই বাড়িতে যেতে হবে। ওনারা নেমন্তন্ন করে গেছে।
বিকালে ঘরে এসে দেখল, অনুপম মন খারাপ করে বসে আছে। মাধু পাশে বসল। অনুপম, মাধুর ঘাড়ে মাথা রাখল। বলল,
-‘মা তোমার সাথে এত খারাপ ব্যবহার করে, কখনো আমাকে বলোনি কেন মাধু?
-‘কে বলল আপনাকে এসব কথা?
-‘মা তোমাকে দিনের পর দিন ভাল মাছ দিয়ে খেতে দেয় না। মাঝে মাঝে ভাত ফুরিয়ে গেলে শুধু মুড়ি খেয়ে থাকো। রাতে তোমার খিদের জ্বালায় ভাল ঘুম হয় না। তুমি ছটফট করো, কাঁদো। সকালে কান্না লুকিয়ে মেকি হাসিমুখে সবার সব ফরমায়েশ করে দাও। এই কথাগুলো আমাকে কেন অন্য মানুষের মুখ থেকে শুনতে হবে? তোমার বর হয়ে, এই কথা গুলো কী তোমার মুখ থেকে শোনার অধিকার রাখি না আমি?
মাধুর কণ্ঠে ভেঙে এলো। বলল,
-‘আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।
অনুপম দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
-‘আমার বাবা ওই বয়সে সংসারের প্রতি উদাসীন ছিলেন। বুঝ হবার পর থেকেই দেখে এসেছি। আমার মা এই সংসারে এসে খাওয়া, পরা নিয়ে অনেক কষ্ট করেছে। কাজে একটু ভুল হলে কখনো কখনো আমার কর্তামা মায়ের গায়েও হাত তুলল। কর্তামায়ের কথায় পুরো সংসার চলত। সবসময় ভাল ভাল খাবার কর্তামা, বাবা, জেঠুদের পাতেই পড়ত। আমরা ছেলে বলে, ভাল খাবার পেতাম। তবে আমাদের মা, জেঠিকে গাধা খাটুনি খাটিয়ে দিনশেষে দুবেলা মেপে মেপে খেতে দিত। আমরা যদি নিজেদের ভাগের খাবার মায়ের পাতে তুলে দিতাম। তাহলে পরদিন আর আমাদের ভাগে ভাল খাবার জুটত না। তখন ছোট ছিলাম। ভাল খাবারের লোভে মাকে আর নিজের খাবার থেকে ভাগ দিতাম না। বছরের পর বছর মায়ের সাথে অমানবিক অত্যাচার করে, আমায় মায়ের সুন্দর মনটা অস্বচ্ছতায় ভরে দিয়েছে আমার কর্তামা। হয়ত সেখান থেকে মা এখনো বের হতে পারেনি। যুগ পাল্টেছে। তার মনোভাব এখনো সেকেলে রয়ে গেছে। সে ভাবে আমি এই সংসারে এসে এত কষ্ট সহ্য করেছি। এখন আমার সুখের সময়। আমার বৌমাকেও এই একই কষ্ট সহ্য করতে হবে। শুধুমাত্র এই মনোভাবের জন্যই শাশুড়ীরা খারাপ হয় জানো?
মাধু মাথা নাড়ল। তার বলার কিছুই নেই। এই বাড়িতে এসে মাধু খাওয়া নিয়ে খুব কষ্ট করে। মাধুর বাবা-মা কখনো মাধুদের দুবোনকে বৈষম্য করে বড় করেনি। তাই খিদের কষ্টটা মাধু মেনে নিতে পারে না। মাঝে মাঝেই বড়দিকে বলে। বড়দি মাকে জানানোর পর থেকেই মা, বাবার সাথে খুব রাগারাগি করেছে। অনুপমকে জানাতে চেয়েছে। মাধুর রিকুয়েষ্টে কিংবা মেয়ের সুখের কথা ভেবে জানানো হয়নি। বড়দিটা মাধুর একটা কথাও শুনে না। শেষমেশ ঠিকই অনুপমকে জানিয়ে দিল। মানুষটা খুব কষ্ট পেয়েছে। মানুষটা সামান্য কষ্ট পেলেও মাধুর ভাল লাগে না। বুকের ভেতর ভেঙেচুরে যায়।

মাধু ইদানীং কিছুই খেতে পারে না। যা খায়, সাথে সাথে বমি হয়ে যায়। মাছ, মাংস’র গন্ধও সহ্য হয় না। অল্প কাজকর্ম করেও হাপিয়ে যায়। শরীর সায় দেয় না। অনুপম জোর করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ডাক্তার টেস্ট দিল। রিপোর্টে জানা গেল। মাধু আড়াই মাসের গর্ভবতী। অনুপমের খুশি যেন ধরে না। রেণুবালা শুনেও বেশ খুশি। তার বংশে প্রথম নাতী-নাতনী আসতে চলেছে। ছেলের সামনে মাধুকে খুব আদর করে রেঁধে বেড়ে খাওয়াল। অনুপম কর্মক্ষেত্রে চলে যেতেই, আবারও শুরু হলো মাধুর সাথে খাওয়া নিয়ে শারীরিক অত্যাচার। মাধু যাই খেতে যায়। রেণুবালা তাতেই ফোড়ন কাটে। শুধু ভাত ছাড়া অন্যকিছু খেতে দিতে চায় না। শুধু ভয় দেখায়। এটা খাওয়া যাবে না, ওটা খাওয়া যাবে না। বাচ্চার ক্ষতি হবে। পেটের ভেতর বাচ্চা বড় হয়ে যাবে। মাধুর এত বিরক্ত লাগে। মাঝে মাঝে মাধুর ভয়ংকর সব ইচ্ছে করে। দিন গুলো যে কী দূর্বিসহ ভাবে কাটছে, বলার মতো না। গর্ভবতীকালীন সব সময় ভাত খেতে ভাল লাগে না। কত বাহারি পদের খাবারই যে খেতে ইচ্ছে করে। অভুক্ত থাকতে থাকতে মেয়েটার শরীর ভেঙে গেছে। চোখ মুখ গর্তে বসে গেছে। একদিন না জানিয়ে বড়দি আর বাবা মাধুকে দেখতে এলো। মাধুর এই অবস্থা দেখে, বাবার মনটা কষ্টে নীল হয়ে গেল। তখন মাধুর প্রেগন্যান্সির চারমাস চলছিল। বাবা, নিখিলেশ বাবুকে ডেকে বলল,
-‘কিছু মনে করবেন না। আমার মেয়ে আমি নিয়ে যাব। এই সময়টা ও বরং ওর মায়ের কাছে থাকুক। নিখিলেশবাবু খুব লজ্জা পেল। বড়দি বলল,
-‘তুই ব্যাগ গুছিয়ে নে মাধু।
রেণুবালা বলল,
-‘আমাদের বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী সাতমাসে অনুষ্ঠান করে মেয়েকে নিয়ে যেতে হয়।
-‘এখনই যে আমার বোনের অবস্থা হয়েছে। সাতমাস পর এসে হয়ত ওকে আমরা জীবিতই পাব না।
-‘কী বলতে চাইছ? তোমার বোনকে আমরা খেতে দেই না?
বড়দি বলল,
-‘সে তো আপনারাই ভাল জানেন।
রেণুবালা বলল,
-‘আমার বাড়ির বউকে আমি এইভাবে নিয়ে যেতে দেব না।
-‘তবে কী আমরা ওর মরাদেহ নিয়ে যাবার জন্য অপেক্ষা করব?
রেণুবালা রেগে গেল। বলল,
-‘কী শিক্ষে দিয়েছেন? বিয়াইমশাই আপনার বড় মেয়েকে? গুরুজন মানে না। মুখে মুখে তর্ক করে। আমার পেটের মেয়ে হলে না চাপকে সোজা করে দিতাম।
-‘ভাগ্যিস আমি আপনার পেটের মেয়ে হইনি। যে মহিলা নিজের পুত্রবধূকে খেতে দেয় না। সারাক্ষণ খাওয়া নিয়ে খোঁটা দেয়, কটুকথা শোনায়। স্বামীর সাথে একান্ত সময় কাটালে যার সহ্য হয় না। এরকম মা আমার না হওয়াই শ্রেয়।
রেণুবালা বলল,
-‘বেয়াদব মেয়ে কোথাকার। দেখি কী করে আমার পুত্রবধূকে নিয়ে যাও। বড়বৌমা..?
মাধু এতক্ষণ মাথা নীচু করে ছিল। শাশুড়ীর ডাকে চমকে উঠল। রেণুবালা আবারও বলল,
-‘আজ যদি তুমি তোমার বাবার সাথে নিয়ম ভঙ্গ করে চলে যাও। তবে মনে রেখ, এই যাওয়াই তোমার শেষ যাওয়া। আমার ঘরের দরজা তোমার জন্য সারাজীবনের মতো বন্ধ।
নিপেনবাবু এবার মুখ খুললেন। বললেন,
-‘কিছু মনে করবেন না বেয়ান। আমি তো আপনাকে দেখে, আমার মেয়ে বিয়ে দেইনি। আপনি একটু আগে যে কথাগুলো বললেন। এই একই কথা আপনার ছেলেকে বলতে হবে। আমার মেয়েরা আমার কাছে কিন্তু অভিশাপ না বরং আশীর্বাদ। পেলেপুষে বড় যখন করতে পেরেছি। একভাবে না একভাবে ওদের ভরণপোষণও জোটাতে পারব। আর যাই হোক। বাপের ঘরে না খেয়ে দিন পার করতে হবে না।
রেণুবালা বলল,
-‘ও… এই ব্যাপার? তারমানে আপনার ছোটমেয়েও কম যায় না। আমার নামে আপনাদের কাছে কান ভারী করেছে?
-‘ও তো মিথ্যে কিছু বলেনি? আপনিই বলুন তো এই যুগে কোন শাশুড়ী আছে? যে পুত্রবধূ গর্ভবতী হলে খেতে দেয় না?
-‘ছিঃ ছিঃ আমি খেতে দেই না? বড়বৌমা এতবড় মিথ্যে অপবাদ আমার নামে দিতে পারলে?
মাধু কী করবে, কী বলবে কিছুই বুঝতে পারল না। পরিবেশ খুব বেশি জটিল হয়ে গেছে। মাধু তো তার মা আর বড়দিকে খিদের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে শুধু বলেছিল। তারা যে না বলেকয়ে মাধুকে নিতে আসবে। কে জানত?
রেণুবালা বিলাপ করে কাঁদছে। বড়দি আর বাবা মাধুর ঘরে শুকনো মুখে বসে আছে। অনুপমকে খবর দেওয়া হয়েছে। রাতের ট্রেনে আসবে। অনুপম এলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে রেণুবালা মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে বসলেন। তিনি আর এই বউ নিয়ে কিছুতেই খাবেন না। হয় এই বাড়িতে মাধু থাকবে, আর নাহয় সে থাকবে।

(চলবে)

লজ্জাবতী পর্ব-০৭

0

#লজ্জাবতী
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব-০৭

বাড়িতে দুটো ফোন। একটা বাবার, আরেকটা জেঠুর কাছে থাকে। রাতে ঢাকা পৌঁছে অনুপম বাবার নাম্বারে ফোন দিল। ফোনটা অনিকেতের কাছে ছিল। রিসিভ করে অনিকেত বলল,
-‘ বড়দাভাই ভাল ভাবে পৌঁছে গেছিস তুই?
-‘হ্যাঁ। সবাই কী ঘুমিয়ে গেছে অনি?
-‘জানি না। তবে মা-বাবার ঘর থেকে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। মনে হয়, ঝগড়া লেগেছে।
-‘আজ আবার কী নিয়ে লাগল?
-‘কী জানি বাবা।
-‘অনি এক কাজ কর?
-‘কী?
অনুপম গাল চুলকে ইতঃস্তত করে বলল,
-‘তুই বরং ফোনটা তোর বৌদিমণির কাছে দিয়ে আয়!
-‘দাঁড়া দিচ্ছি।
অনুপম ফোনের ওপাশে অপেক্ষা করছে। অনিকেত বই খাতা বন্ধ করে উঠে গেল।

রাতে ওই ঘটনার পর থেকে মাধু মানসিক ভাবে খুব ভেঙে পড়েছে। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে শুয়ে কাঁদছে মেয়েটা। যতটা না অনুপমের অনুপস্থিতিতে খারাপ লাগছে, তার থেকেও বেশি খারাপ লাগছে, শাশুড়ীর তিক্ত ব্যবহারে! মানুষটা তখন মাধুকে রাক্ষসী বলল? ইশ, এই কষ্ট কোথায় লুকাবে মাধু?
-‘বৌদিমণি…?
কে ডাকে? মাধু চট করে চোখের জল মুছে নিল। মাথায় ঘোমটা টেনে উঠে বসল। অনিকেত ঘরে এসে, মাধুর হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-‘লাইনে বড়দাভাই আছে। কথা বলো?
মাধু ফোন হাতে নিল। একটু কেশে কণ্ঠ স্বাভাবিক করে নিল। অনিকেত চলে যেতেই মাধু বলল,
-‘কেমন আছেন? যেতে কোন অসুবিধে হয়নি তো?
-‘তোমার কণ্ঠ এমন লাগছে কেন মাধুসোনা?
-‘কই না তো।
-‘না..না। কেমন যেন কণ্ঠ বসে গেছে। তোমার কী কোন কারণে খুব মন খারাপ মাধুসোনা? কিংবা খুব কেঁদেছ?
অনুপমের আবেগী কথা শুনে, মাধু মুখ চেপে কান্না আটকাল। শরীর ফুলে ফুলে উঠছে। মন বলছে, রাতের ঘটনা বলে দেই! মস্তিষ্ক বিদ্রোহ করছে। ছোটবেলা থেকেই মাধু দেখে এসেছে, মাধুর বাবা দূরে কোথাও গেলে , সংসারে যতই ঝগড়াঝাটি, ঝামেলা হোক। মাধুর মা ভুলেও স্বামীকে বলত না। মানুষটা দূরে আছে। কী দরকার শুধু শুধু মানুষটাকে পারিবারিক অ’শান্তির কথা জানিয়ে, মন খারাপ করে দেওয়া বা চিন্তায় ফেলা। তাছাড়া মাধুর বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকেই ঝর্ণারানী, মাধুর মাথায় হাত বুলিয়ে খুব বোঝাত। তোমার শাশুড়ীমা যাই বলুক। হয়ত তার সব কথা তোমার ভাল লাগবে না। তাই বলে, কখনো বরের কাছে তার মায়ের নামে বদনাম করবে না। এক সংসারে ঘটি,বাটি থাকলেও তো ঠোকাঠুকি লাগে। সেখানে তো আমরা মেয়েজাতি।
-‘কোথায় হারিয়ে গেলে, ‘মাধুসোনা’?
এই মানুষটা গাঢ় কণ্ঠে ‘মাধুসোনা’ বলে ডাকলে প্রশান্তিতে মাধুর কলিজা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। একটু একটু পেটও কাঁপে। মাধু হেসে দিল। মন ভাল করা হাসি। বলল,
-‘খেয়েছেন?
-‘না। এখন খেতে ইচ্ছে করছে না।
-‘সেকি! না খেলে শরীর খারাপ করবে তো।
-‘তোমার মন খারাপের কারণটা কী কোন ভাবে ‘আমি’ মাধুসোনা?
মাধু ঠোঁট নেড়ে বিড়বিড় করে বলল,
-‘আপনি বুঝেন না?’
অনুপম শুনতে পেল না। বলল,
-‘বলো না বউ?
-‘কী বলব?
অনুপম মন কেমন করা গলায় বলল,
-‘আমার না একটুও ভাল লাগছে না। ইচ্ছে করে সবকিছু ফেলে, একছুটে তোমার কাছে চলে যেতে। বিয়ে করে নতুন বউকে যদি কাছেই না পাই…অনুপম আর কথা বলতে পারল না। চাপা কষ্টে গলা বুঁজে এলো। মাধুর বুকের ভেতরও কাঁপন ধরেছে।
অনুপম আনমনে বলল,
-‘আমরা কেউ কাউকে কিছুদিন আগেও চিনতাম না, জানতাম না। অথচ এখন ছেড়ে থাকতেও খুব কষ্ট হচ্ছে। ভগবান, স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র সম্পর্কে কী এক অপার মায়া দিয়েই না বেঁধে রেখেছে। আচ্ছা মাধু তুমি কী আমাকে ‘ভালোবাসো?’
-‘জানি না।
-‘আমি বোধহয় তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। চোখ বুজলেও তোমাকে দেখছি, চোখ খুললেও তোমাকেই দেখছি।

নতুন কপোত-কপোতী প্রায় অর্ধরাত জেগে ফোনে কথা বলে কাটিয়ে দিল। কত না বলা গল্প, কত সুখ, দুঃখের গল্প যে দু’জনের মনের ভেতর জমেছিল!
একে তো অভ্যাস নেই। তারউপর রাত জাগার কারণে মাধুর মাথাব্যথা করছে। তবুও ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে গেল। বাড়িটা কেমন নীরব, নিস্তব্ধ। মনে হয় রেণুবালা এখনো ঘুম থেকে উঠেনি। শুধু কলতলায় বিন্দুমাসির বাসনকোসন মাজার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
টুলু ঘুম ঘুম চোখে হাতে কাঁচি নিয়ে মাঠে যাচ্ছিল। মাধুর সামনে পড়তেই মাধু বোকা টুলুদাদাকে ক্ষ্যাপানোর জন্য, আঙুল নাচিয়ে নাচিয়ে, সুর করে বলল,

টুলু, টুলটুলিয়ে যায়।
টুলু হালকা দুদু খায়
টুলুর গলায় মাদুলি
টুলু, টুলটুকিয়ে যায়, টু….

টুলু ক্ষেপে ফেলে। রাগী চোখে তাকাল। মায়ের কাছে গিয়ে নালিশ দিল। বিন্দুমাসি হেসেই উড়িয়ে দিল। টুলু কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল,
-‘বৌদিমণি খুব খুব পঁচা।

মাধুর দিনগুলো এভাবেই কাটছিল। হাসি, মজা কখনো শাশুড়ী মায়ের কটু কথা শুনে, তীব্র মন খারাপ। অনুপম মাঝে মাঝে আসে দু’রাত থেকেই চলে যায়। বাবা কথায় কথায় একবার অনুপমকে বলেছিল, মাধুকে সাথে নিয়ে যেতে। মা যেন বাড়িতে লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে নিয়েছিল।
রীতিমতো কেঁদেকেটে, না খেয়েদেয়ে অনশনে গিয়েছিল। সে এই সংসারের জন্য অনেক কষ্ট করেছে। আজ যখন একটু সুখের মুখ দেখেছে। পরের মেয়ে ঘরে এসে যখন দুটো ভাত রেঁধে খাওয়ায়। তখনই অনুপমকে বাবা-মায়ের কথা না ভেবে বউ নিয়ে যেতে হবে? রেণুবালা সারাদিন মাধুকে শাপশাপান্ত করত। পরে ভয় পেয়ে মাধুই আর অনুপমের সাথে যাওয়ার সাহস পায়নি।
ঘটা করে ছেলে দেখা হচ্ছে। ছেলে, ছেলের বাড়িঘর দেখে, সবার পছন্দ হয়েছে৷ খুব শীঘ্রই রিধীকার বিয়ে। দিনক্ষণ দেখে, ছেলেকে স্বর্ণের চেইন দিয়ে আশীর্বাদ করে এসেছে। ছেলে সরকারি চাকুরী করে। মাইনে ভাল। বেশ মোটা দাগের যৌতুক দিতে হবে। তাতে কী! মেয়েটা সুখী হলেই হয়।
রিধীকার গতকাল মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আজ বিয়ে।

নরমালি আমি কোন বিয়ে বাড়ি-টারি যাই না। তবে আমাদের পাড়ায় আজ, বিশাল ধুমধাম করে, রিধীকার বিয়ে হচ্ছে। ওদের বাড়ির চারপাশ ঘিরে, ডেকোরেশনের লোকেরা কী সুন্দর করে সাজিয়েছে। সন্ধ্যার পর থেকে পড়ার টেবিলে বসে কিংবা ছাদে গিয়ে, গাছ-গাছালির ফাঁকফোকর দিয়ে, রিধীকাদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। সানাই বাজছে। বাঁশির করুণ সুর আমার ঘরের জানালা ভেদ করে মস্তিষ্কে আলোড়ন সৃষ্টি করছে। পোলাও, ইলিশ মাছ, রোস্টের গন্ধ্যে চারপাশ ম ম করছে। রিধীকা আর আমি সেই ছোটবেলা থেকে একসাথে পুতুল খেলে, বড় হয়েছি। যদিও আমি ওর থেকে গুনে গুনে চার বছরের বড়। তবুও ও আমাকে তুই, মুই বলে ডাকে। যদিও আমার নামের শেষে ‘দা’ যোগ করে দেয়। কাকিমা মানে রিধীকার মা বার বার আমাকে বিয়েতে যেতে বলেছে।
দিনে যেতে একটু একটু লজ্জা লাগলেও রাতে যখন ফুল দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজানো বরের গাড়ি এসে ওদের গেইটের সামনে থামল। তখন আমি ঘর থেকে বের হলাম। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে ওদের ‘জামাইবরণ’ উৎসব দেখতে লাগলাম। রিধীকার বৌদিমণি, দিদিরা লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পরে নতুন জামাইবরণ করতে এসেছে। রিধীকার বর সাদা ধুতি, খয়েরী রঙের পাঞ্জাবি পরেছে, হাতে কালো ঘড়ি, কপালে চন্দনের ফোঁটা, মাথায় টোপর পরেছে। দেখতে খুব একটা মন্দ লাগছে না। বরযাত্রীরা গেইট দিয়ে ঢুকেই বউ দেখে, খাবারের টেবিলে চলে গেল। ভাবটা এমন! যেন তারা গাণ্ডেপিণ্ডে গিলতেই এসেছে। আমি নতুন বউকে যে ঘরে বসানো হয়েছে। সেই ঘরে গিয়ে খাটের এক কোণায় চুপটি করে বসলাম। রিধীকাকে মা দূর্গার মতো দেখতে, সুন্দর লাগছে। লাল টুকটুকে বেনারসি শাড়ি পরেছে। গা ভর্তি সোনার গহনা। মাথায় টিকলি, নাকে নথ, কপালের মাঝখানে বড় লাল টিপের চারপাশে তিলকের নকশা আঁকা। চিকুন সরু ঠোঁটে খুব যত্ন করে লাল রঙা লিপস্টিক আঁকা। বড় বড় মায়াবী দু’চোখে মোটা করে কাজল টেনেছে। মাথায় বড় করে বউ ঘোমটা দেওয়া। হাতে শাঁখা, পলা। রিধীকাকে এই নতুন রুপে দেখে, বার কয়েক শুকনো ঢোক চিপলাম আমি। মনের ভেতর উত্তাল ঢেউ, বুকের ভেতর অসম্ভব কাঁপা-কাঁপি। কই আগে তো, ওর জন্য আমার এই রকম অনুভূতি হয়নি? রিধীকা আমাকে দেখে, একটুখানি মিষ্টি করে হাসল। দুষ্টুমি করে বলল,
-‘কী রে দেবুদা? তুই পড়ার টেবিল ছেড়ে এখানে কী করিস?
আমি লজ্জা পেয়ে চোখদুটো নামিয়ে নিলাম। পায়ে পা ঘষছি। ভাবখানা এমন। যেন আমার খুব শীত লাগছে! ভাল ছাত্র হওয়ার জন্য এলাকার মা, কাকিমাদের কাছে যেমন সুনাম আছে। তেমন কেউ পড়া না পারলে, আমাকে, আমার সমবয়সী সবার সাথে তুলনা দেয় দেখে, ওরা আড়ালে আমার বদনামও করে খুব। তাদের দলে রিধীকাও আছে।
ওর দাদারা রিধীকাকে আলপনা আঁকা পিঁড়িতে বসিয়ে, পান পাতা দিয়ে মুখ ঢেকে, বিয়ের আসরে নিয়ে গেল। আমিও পিছু পিছু গেলাম। পৌরোহিত মশাই মন্ত্র যপ করছে। রিধীকার বাবা কণ্যা সম্পদান করে উঠে গেল। রিধীকা যখন ওই লোকটার সাথে মালা বদল করল, তখন আমার বুকের ভেতর একটু একটু করে ভেঙে এলো। আমার এত কান্না পাচ্ছে। আর একটু হলেই জোরে কেঁদে দিতাম। কত কষ্টে যে নিজের আবেগ লুকিয়েছি! এখন মনে হচ্ছে বিয়েতে না এলেই ভাল হতো। এই মেয়েটাকে আমি কবে এতটা ভালোবেসে ফেলেছি?

(চলবে)

লজ্জাবতী পর্ব-০৬

0

#লজ্জাবতী
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব-০৬

মাধু সারা বাড়িতে ধূপগন্ধী দেখিয়ে, রাতের রান্না সেরে, ঘরে যেতে যেতে রাত আটটা বেজে গেল। মাধু কোমড়ে আঁচল গুজে, ব্যাগ থেকে শাড়িগুলো নামাতে নামাতে বলল,
-‘মা খেতে ডাকে। তুমি চট করে খেয়ে আসো। আমি বরং এই দিকটা গুছিয়ে ফেলি।
অনুপম পেছন থেকে মাধুকে আলতো করে জড়িয়ে ধরল। মাধুর ঘাড়ে মুখখানা রেখে বলল,
-‘ এত দেরি করলে কেন, মাধুসোনা? তুমি চোখের আড়াল হলে, আমার আকুল হৃদয় বড্ড ছটফট করে যে!
মাধু মুখ টিপে বলল,
-‘ঢঙ।’

রাতে অনুপম ভরপেট খেয়েদেয়ে, ফুলবাবু সেজে, পাড়ার গলিতে, ব্যাডমিন্টন খেলতে গেল।
প্রায় ঘন্টাদুই যাবৎ অনুপম চোখের আড়াল হয়েছে। ওই ওতটুকু সময়ে, একা ঘরে মাধু কেঁদেকেটে একাকার অবস্থা। এই মানুষটা চোখের আড়াল হলেই মাধুর কেমন দম বন্ধ হয়ে আসে। কিছুই ভাল লাগে না। মাধু কত করে মানা করল। কাল তো চলেই যাবেন! আজ আর কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। অবাধ্য মানুষটা মাধুর কথা শুনলে তো! এতটুকু সময়ে অনুপম দৃষ্টির অগোচরে গেলে সহ্য হচ্ছে না। অনুপম চলে গেলে, একা ঘরে কী করে থাকবে মাধু? মানুষটা তিনদিনে কী এমন জাদু করল মাধুকে?
রাতে ঘামার্ত শরীরে ঘরে ঢুকল অনুপম। জামা, জুতা টেনে টেনে খুলল। মাধু শুয়ে ছিল। অনুপমকে দেখে, ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। আড়চোখে অনুপমের খালি শরীরের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল। ইশ, মানুষটা কেমন ঘেমে-নেয়ে একাকার অবস্থা। অনুপম, হাতমুখ ধুয়ে এসে মাধুর শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছল। মাধুর খুব অভিমান হলো। একদিকে যেমন অনুপমকে এত কাছে পেয়ে ভাল লাগছে। অন্যদিকে আগামীকাল চলে যাবে ভেবে, খুব কান্না পাচ্ছে। অনুপম, মাধুর হাতদুটো চেপে ধরতেই মাধু মোচড়ামুচড়ি করে ছাড়িয়ে নিয়ে পাশ ফিরে শুলো। অনুপম, মাধুর মুখের উপর ঝুঁকে পড়ল। মাধুর গালে ঠাণ্ডা হাত রেখে, গাঢ় কণ্ঠে বলল,
-‘কী হয়েছে মাধু?
মাধুর কী যে কান্না পেল। অভিমান করে বলল,
-‘ছাড়ুন। আমি ঘুমাব।
অনুপম, মাধুর গালে নাক ঘষে বলল,
-‘উহুম..ছাড়ব না। বলো আগে, কী হয়েছে?
-‘কী হবে?
-‘বলো না মাধুসোনা?
-‘কাল তো চলেই যাবেন। এত করে মানা করলাম। আমার কথা উপেক্ষা করে, এতরাতে চলে গেলেন!
-‘রাগ করে না মাধুসোনা। এইতো আমি এসে গেছি।
মাধু চোখের কোণ মুছে বলল,
-‘সেই! আপনার প্রয়োজনে আপনি শুধু আমার কাছে আসেন।
-মাধু…তাকাও আমার দিকে?
মাধু পদ্মপুকুরের মতো মায়া কাড়া চোখ মেলে তাকাল। কারেন্ট নেই। মেঝেতে মোমবাতি জ্বলছে। মোম বাতির উষ্ণ আলোতে অনুপমের সুন্দর মুখপানে তাকিয়ে থাকতে কী যে ভাল লাগছে মাধুর। এই মানুষটা চোখের সামনে থাকলেই মাধুর সব অবসাদ, ক্লান্তি ম্যাজিকের মতে দূর হয়ে যায়। মাধু বিড়বিড় করে বলল,
-‘হে ভগবান.. আমার সবটুকু আয়ু দিয়ে এই মানুষটাকে বাঁচিয়ে রেখো তুমি।
কিশোরী মন। প্রথম প্রেম। সারাক্ষণ অনুপমকে নিয়ে কতকিছু ভেবে যায় মাধু।
ভাবনাতেও যেন সুখ সুখ অনুভূতি লুকিয়ে আছে।
রাতে খুব গভীর ভাবে মাধুকে নিজের করে পেতে চাইল অনুপম। স্বামী নামক মানুষটার সাথে যতই রাগ, অভিমান থাকুক। এত আকুল ভাবে ডাকলে, সারা না দিয়ে থাকা যায়? মাধুও নিজের বোকা বোকা রাগ, জেদের কাছে হেরে গিয়ে, অনুপমের ডাকে ধরা দিল, অন্যরুপে। গভীর ভালোবাসা ও কিশোরীর আকুতি ভরা অভিমান মিলেমিশে কেটে গেল দীর্ঘ রজনী।

পরদিন ঘুম থেকে উঠতে, মাধুর বেশ বেলা হয়ে গেল। একে তো অনুপমের ভালোবাসার তীব্র অনলে জ্বলতে জ্বলতে গভীর রাতে ঘুমিয়েছিল মাধু। তার উপর অনুপম কিছুতেই ভোরবেলা মাধুকে ছাড়তে চাইল না। মাধুকে পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে, মাধুর চুলে মুখ ডুবিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে আছে অনুপম। মাধু নড়াচড়া করতেই অনুপম বিরক্ত হয়ে বলল,
-‘এত ছটফট করো না মাধুসোনা। আজ চলেই তো যাব। একটু বেশি সময়, আমার কাছে থাকো নাহয়!
এই কথার পর, আর কোন কথা চলে না।

মাধু খুব ভয়ে ভয়ে পা টিপে টিপে ঘরের দরজা খুলে নীচে নামল। রেণুবালা, মাধুর জন্যই মনে হয়, উঠোনে বসে অপেক্ষা করছিল। মাধুকে দেখে, ছুটে এলো। ছিঃ ছিঃ করতে করতে বলল,
-‘তুমি কেমন ধারা মেয়েমানুষ গো? আকাশে রোদ উঠে গেছে, অথচ তোমার বরের বিছানা ছাড়তে মনে চায় না। বেহায়া মেয়েমানুষ কোথাকার! আমার শাশুড়ী আমাদের সূর্য উঠার আগেই ঘুম থেকে তুলে দিত। একটু দেরি হলেই মুখে যা আসত, তাই বলত। বলি, এতবেলা করে, বরের কাছে শুয়ে থাকলে, বরের অমঙ্গল হয়। সে শিক্ষা দেয়নি? তোমার মা তোমাকে? ছিঃ ছিঃ তোমার বেহায়াপনা দেখে, আমারই নজ্জা (লজ্জা) করছে। যাও শিগগিরই স্নান সেরে রন্ধনঘরে যাও। বিন্দু বলে দেবেক্ষণ। কী কী রাঁধতে হবে।
রেণুবালা কথাগুলো কড়া কণ্ঠে বলেই পাড়া বেড়াতে চলে গেল। মাধুর খুব মন খারাপ হলো। লজ্জায় শাশুড়ীমায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেও সাহস পায়নি। মানুষটা কেন যে মাধুকে চোখ পেতে দেখতে পারে না। কে জানে!

অনুপম যাওয়ার সময়, মাধুকে সবার অগোচরে জড়িয়ে ধরেতেই, মাধু অনেকক্ষণ কাঁদল। অনুপমেরও মাধুকে ছেড়ে যেতে খুব খারাপ লাগছে। মাধুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-‘এই পাগলী এভাবে কাঁদে কেউ? আমি ছুটিতে আবার আসব তো! তখন তোমাকে নিয়ে হানিমুনে যাব।
-‘আমার কোথাও যাওয়া লাগবে না। শুধু আপনি পাশে থাকলেই হবে।
-‘আমার মনটা তো তোমার কাছেই রেখে যাচ্ছি মাধুসোনা।
অনুপম নীচু হয়ে গাল বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
-‘এখানে একটা ফাস্ট ক্লাস চুমু খাও তো মাধুসোনা..?
মাধু লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নিল। বলল,
-‘ধেৎ,
-‘তুমি বিয়ের পর থেকে, এখন পর্যন্ত নিজে থেকে একবারও আমাকে আদর করোনি মাধুসোনা। আমি চলে গেলে কিন্তু খুব আফসোস করবা!
-‘উফ, চুপ করুণ তো আপনি।
-‘তাহলে আমার কথা রাখো?
-‘ না।
-‘বেশ তবে চলে গেলাম।
মাধুর বুকের ভেতর চাপা ব্যথায় মোচড় দিয়ে উঠল। অনুপমের শার্টের কোণা টেনে ধরল। অনুপম মুচকি হাসল। আবারও গাল বাড়িয়ে দিল। মাধু লজ্জাবতী পাতার মতো টলে গেল। ফিসফিস করে বলল,
-“চোখ বুজুন?
-‘ওকে মহারাণী।
অনুপম চোখ বুজতেই মাধু আলতো করে চুমু এঁকে দিল। অনুপম শক্ত করে মাধুকে জড়িয়ে ধরল। কপালে চুমু খেয়ে বলল,
-‘আসি বউ..?
মাধু, অনুপমের পিছুপিছু বাড়ির গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেল। অনুপম বাবা-মাকে প্রমাণ করে সিএনজিতে উঠে বসল। মাধুর চোখদুটো ছলছল করছে। চোখের ঘন কালো পাপড়ি গুলো ভিজে উঠেছে। অনুপম চোখের আড়াল হতেই কী এক শূণ্যতা অনুভব করল মাধু। এই কষ্ট একজন নতুন বউই বুঝে। ভাঙা মন, মাথায় ভোতা অনুভূতি নিয়ে ঘরে ফিরল।
মাধু শুয়ে ছিল। রেণুবালা, মাধুর ঘরে এসে বলল,
-‘পরে পরে শুধু ঘুমালেই হবে বড়বৌমা? কত কাজ পরে আছে। বলি, সে খেয়াল আছে?
মাধুর এই মানুষটাকে দেখতেই ইদানীং খুব বিরক্ত লাগে আবার ভয়ও লাগে। মুখে কিছু বলল না। রেণুবালা বলল,
-‘নীচে গিয়ে সবাইকে খেতে দিয়ে দাও। তারপর আমার পা দুটোতে একটু তেল মালিশ করে দেবে।
মাধু মাথা নেড়ে উঠে গেল। মাথায় ঘোমটা টেনে বাবা, জেঠু, অনিকেত, রিধীকাকে খেতে দিল। দুদিন যাবৎ জেঠিমা বাবার বাড়ি বেড়াতে গেছে। জেঠুর এক ছেলে, বউ বাচ্চা নিয়ে বিদেশে থাকে। জেঠু সরকারি চাকুরীজীবি ছিলেন। অনেকবছর দেশের বিভিন্ন জেলা ঘুরে চাকুরী করেছে।
রিটায়ার্ড হওয়ার পর, মাস ছয়েক পৈতৃক ভিটায় এসে জেঠিকে নিয়ে থাকছে।

মাধু একহাতে সবার খাবার বেড়ে দিলেও নিজের খাবার বেড়ে খাওয়ার ভাগ্য হলো না। সবাই চলে যেতেই, রেণুবালা মাধুকে নিয়ে খেতে বসল। মাছের বড় মাথাটা গামলায় জ্বলজ্বল করছে। মাধুর খুব লোভ হলো। জিহবা ভিজে উঠেছে। রেণুবালা কেবলই মাথাটা নিজের পাতে তুলে নিতে যাবে। মাধু লজ্জামাখা কণ্ঠে বলল,
-‘মা.. মাথাটা আমায় দিবেন?
রেণুবালা ঠাস করে মাছের মাথা পাত্রে রাখল। মাধুর দিকে বড় বড় চোখ করে তাকাল। রাগে চিড়বিড়িয়ে বলল,
-‘মাছের মাথা খাবে কেন? এক কাজ করো, তুমি বরং আমার মাথাটাই খেয়ে ফেলো। তুমি এত লোভী ছিঃ.. তোমার মা তোমাকে ভালমন্দ খেতে দেয়নি কোনদিন? শ্বশুরবাড়িতে আসার আগে নিজের লোভী নোলাটা কেটে রেখে আসতে হয়।
মাধু অতিরিক্ত লজ্জায়, অপমানে একটা ভাতও আর খেতে পারল না। টপটপ করে ভাতের উপরে চোখের জল পরছে। এদিকে খাওয়া ফেলে উঠে যাওয়ারও সাহস পাচ্ছে না। আজ এই মুহূর্তে রেণুবালার তিক্ত কথাগুলো এতটাই আলোড়ন তুলল কিশোরী মনে। মনে মনে শপথ করল,
-‘ভগবানের দিব্যি, আর জীবনেও মাধু মাছের মাথা খেতে চাইবে না।
রেণুবালা, মাধুর সামনে বসে, বড় বড় হাঁ তুলে মনের সুখে মাছের মাথাখানা চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে।
মাধু ডাল বেগুন ভাজা আর ছোট একপিস মাছ দিয়ে কয়েক লোকমা ভাত বহুকষ্টে জল দিয়ে গিলে খেলো।
নিখিলেশবাবু মনের ভুলে খাবার ঘরের টেবিলে চশমাটা ফেলে গিয়েছিল। নিতে এসে দেখল। মাধুরা বউ, শাশুড়ী একসাথে বসে খাচ্ছে। হাসিমুখে এগিয়ে এসে দেখল, নিজের গিন্নী বড় মাছের মাথা ও একপিস মাছ নিয়ে গাপুসগুপুস খাচ্ছে। আর মাধু ছোট একপিস মাছ দিয়ে ভাত খাচ্ছে। খাচ্ছে কম নাড়াচাড়া করছে বেশি। নিখিলেশের মনটা তিতা বিষে ভরে গেল। বলল,
-‘বৌমাকে এত ছোট একপিস মাছ দিয়েছ কেন রেণু? বড় একপিস মাছ দাও?
রেণুবালা থমথমে গলায় বলল,
-‘কী বড়বৌমা দেব না কী আর এক পিস?
-‘না মা।
-‘দেখেছ তো ও খাবে না। আমি তোমার মায়ের মতো না। যে বাড়ির বউকে মাছ খেতে দেব না। আজ তো খুব খবরদারি করছ? যখন দিনের পর দিন আমরা মাছ ছাড়া ভাত খেতাম। কত রাত, ভাত ফুরিয়ে গেছে, বউদের জন্য আবার উনুন জ্বালা হবে না কী! এই অজুহাতে ভরপেট জল খেয়ে পার করতে হতো। তখন কোথায় ছিলে তুমি? কোনদিন তো তোমার মায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে দেখিনি। আজ তবে তোমার ছেলের বউয়ের জন্য এত দরদ উথলে উঠছে কেন? ওর তো তাও ভাগ্য ভাল। কপালে মাছ জুটেছে। আর আমরা! রেণুবালা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল।নিখিনেশবাবু উত্তরে কিছু বলতে চাইল! মাধু হাত জোর করে, কিছু না বলার জন্য অনুরোধ করল।
আজ বাড়িতে যে মাধুর জন্য দুজনের মাঝে বিশাল ঝগড়া লাগবে। বেশ বোঝা যাচ্ছে। রেণুবালা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-‘এক রাক্ষসী মরতে না মরতেই আমার সোনার সংসারখানা, নিজের হাতের মুঠোয় নেওয়ার জন্য আরেক রাক্ষসী উদয় হয়েছে।

(চলবে)

লজ্জাবতী পর্ব-০৫

0

#লজ্জাবতী
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব-০৫

মাধু, অনুপমের কাঁটা হাতখানা টেনে নিল। তাতে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিল। ‘ইশ কতোখানি কেটে গেছে!’ মাধুর মায়াবী চোখদুটো ছলছল করে উঠল। ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না আটকাল। অনুপম এতক্ষণ গভীর দৃষ্টি মেলে মাধুকেই দেখছিল! ঠোঁট নেড়ে দুটো লাইন গেয়ে উঠল।
”মধুর কিছু সময় যে জীবনে আসে”
গুন গুন করে ওঠে মন কত আবেশে”

ইশ, মাধু লজ্জায় শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখখানি ঢেকে ফেলল। অনুপম শোয়া থেকে উঠে বসল। কিছুক্ষণ পিনপতন নীরবতা। আস্তে করে মাধুর মুখের উপর থেকে শাড়ির আঁচল খানা সরিয়ে দিল অনুপম। তারপর ডান হাতের একটা আঙুল দিয়ে ধীরে ধীরে মাধুর গালে আঁকিবুঁকি করল। অজানা উত্তপ্ত শিহরণে মাধুর সারা অঙ্গ জ্বলে গেল। মুখটা হেমন্তের ধান পাতার মতো আবেশে তিরতির করে কেঁপে উঠল। অতিরিক্ত লজ্জায় মাধুর দু’গাল ফুলে লাল টুকটুকে হয়ে গেল। অনুপম, মাধুর গালে ঠোঁট রেখে দীর্ঘ চুমু খেল। মাধু ছটফটিয়ে সরে যেতে চাইল। মাধুর যে ইদানীং কী এক অসুখ হয়েছে। এই মানুষটা দূরে গেলেও জ্বালা। আবার এত কাছে এলেও জ্বালা। মাধু, দিকদিশা না পেয়ে অনুপমকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে, ‘ওর’ পুরুষালি বুকে মুখ ডুবিয়ে, নিশ্বাসে টেনে নিল সেই মন কেমন করা বুনো ঘ্রাণ। অনুপম, ওই ভাবেই মাধুকে টেনে নিয়ে শুয়ে পরল। হাত বাড়িয়ে লাইটটা বন্ধ করে দিল। মাধুর কানের কাছে মুখ নিয়ে আবেগী কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,
-‘আজ তোমাকে নতুন এক ভালোবাসার গোপন অধ্যায়ের সাথে পরিচয় করাব মাধু। প্রত্যেকটা স্বামী-স্ত্রী’র জীবনে এই অধ্যায়টা খুব স্পেশাল। এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও পালন করে। আশা করি, আমার উপর পূর্ণ বিশ্বাস রেখে, আমার ভালোবাসার মর্যাদা দেবে তুমি। আজ যদি তুমি আমার সাথে গতকাল রাতের মতো বা বিয়ের রাতের মতো সিনক্রিয়েট করো, বাজে ব্যবহার করো। ভগবানের দিব্যি কেটে বলছি, আমি এই ভাবেই চলে যাব। আর জীবনেও এমুখো হবো না। মাধু মাথা নীচু করে রইল। খুব অনুশোচনা হচ্ছে! এই মানুষটা চলে গেলে, মাধু যে অর্ধপাগল হয়ে যাবে। সে খবর কী মানুষটা রাখে? রাখে না বোধহয়। রাখলে মাধুকে এত কঠিন কঠিন কথা বলতে পারত না। অনুপম আর সময় নিল না। মাধুকে পরিচয় করাল, নতুন এক ভালোবাসার গোপন অধ্যায়ের সাথে। এত স্বামী সুখও বুঝি মাধুর কপালে লেখা ছিল? ছিল তো। এই যেমন, অনুপমের অসহ্য ভালোবাসার আবেশে কিংবা তীব্র নীল ব্যথার মিশেলে মাধু নিঃশব্দ কাঁদছে।

খুব ভোরে মাধুর গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো। মাধু অর্ধচেতন হয়ে বিছানায় পরে আছে। অনুপম খুব ভয় পেল। কাউকে ডাকারও সাহস পাচ্ছে না বেচারা। এদিকে বিছানায় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ লেগে আছে। অনুপম নীচু কণ্ঠে বলল,
-‘এ্যাঁই মাধু..? খুব বেশি কী খারাপ লাগছে তোমার? তুমি না ভোরে উঠে যাও? এভাবে শুয়ে থেকে, আমার ভয় আর বাড়িও না বউ?
মাধু চোখ পিটপিট করে তাকাল। অতিরিক্ত লজ্জায় অনুপমের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না বেচারি। লাজুক হেসে বলল,
-‘বিয়ে করলে এত কষ্ট পেতে হয় জানলে, জীবনেও বিয়ে করতাম না। পুরো শরীর ব্যথায় নীল হয়ে গেছে।
অনুপম ফিসফিস করে বলল,
-‘জীবনে প্রথমবার তো। তাই এমন লাগছে। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।
উত্তরে মাধু কিছু বলল না। শুয়েই রইল।
অনুপম কিছুক্ষণ মাধুর পাশে বসে থেকে, দরজা খুলে চলে গেল। খানিকবাদে বড়দি এলো। মাধুর কপালে হাত রেখে, বলল,
-‘প্রথম রাতেই জ্বর বাধিয়ে নিলি?
মাধু অভিমান করে বলল,
-‘তোর জন্যই তো। আমার এতবড় সর্বনাশ হয়ে গেল।
বড়দি রিনরিনে কণ্ঠে খিলখিলিয়ে হেসে দিল। বলল,
-‘কিছুদিন যাক। তারপর বুঝবি। এই পিরিতি কতটা মধুর।
-‘বড়দি….?
-‘বল?
-‘আগে মনে হতো, ওকে ছাড়া আমি থাকতেই পারব না। এখন মনে হচ্ছে, ও যত তাড়াতাড়ি ঢাকা চলে যাবে। ততই আমার জন্য ভাল।
-‘আহা..স্বামী কাছে না থাকলে কেমন শূণ্যতা যে লাগে বুনু। স্বামী কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার পরেই বুঝবা। কতরাত যে ঘুমবিহীন জেগে জেগে, চোখের জল ফেলে কাটিয়ে দিতে হবে। তার কোন হিসেব নেই।
-‘ধেৎ. তুই একটু বেশি বেশি বলিস।
-‘নে এবার উঠে পর। জল গরম দিয়েছি। তুই স্নান সেরে নে। আমি চট করে চাদরটা ধুয়ে দেই। ততক্ষণে তুই কিছু খেয়ে, জ্বরের ও ব্যথার ঔষধ খেয়ে নে।
-‘আচ্ছা।

বড়দি চাদর ধুয়ে এসে মাধুকে জলখাবার দেওয়ার পর, এক গ্লাস গরম দুধ খেতে দিল। তারপর নিজে হাতে ঔষধ খাইয়ে দিয়ে বলল,
-‘তুই বরং একটু ঘুমিয়ে নে। আমি একবাটি আঙুর ফল ধুয়ে দিচ্ছি।

নিয়ম অনুযায়ী, অনুপমের আজ জামাই বাজার করার কথা। তবে অনুপম সে ঝামেলায় গেল না। মাধুর হাতে হাজার বিশেক টাকা তুলে দিল। মাধু সেই টাকা নিয়ে বাবার হাতে তুলে দিল। বাবা নিতে চাইল না। বলল, -‘ তোর কাছে রেখে দে মা।’ মাধু জোর করে বাবার পকেটে টাকা গুলো গুঁজে দিল। মাধুর মা আশেপাশের সবগুলো বাড়ি দুপুরে জামাই বাজার খাওয়ার জন্য নেমন্তন্ন দিয়ে এলো।
রিধীকা, ঝর্ণারানীর পাশে বসে গল্প করছে। অনুপম উঠানে চেয়ারে বসে রোদ পোহাচ্ছে। টুলু বাবার সাথে বাজারে গেছে। আর মাধু বড়দির কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। পাশে বড়দির ছোটবাবুটা মৃদু নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।
বাবা বাজার থেকে অনেককিছু কিনে নিয়ে এলো। বড় বড় কাতলামাছ, দেশী ছোট মাছ, ইলিশমাছ, খাসির মাংস, সাতটা আস্ত মুরগী কেটে এনেছে, সব ধরনের সবজি, দুধ, গুড়। আর কতকিছু।
দুপুরে সবাই জমিয়ে খাওয়া-দাওয়া করল।
বিকালে মাধুর বান্ধবীরা সব দলবল বেঁধে গল্প করতে এলো। মাধুকে সুন্দর শাড়ি, গহনা পরে রাণীর মতো সেজেগুজে থাকতে দেখে বলল,
-‘মাধু বিয়ের পর তুই অনেক পাল্টে গেছিস রে!
মাধু চোখ বড় বড় করে বলল,
-‘মোটেও পাল্টে যাইনি আমি।
-‘নারে মাধু.. তুই সত্যিই পাল্টে গেছিস। বিয়ের পর সবাই কেন পাল্টে যায় বলত?
-‘বললাম তো আমি পাল্টে যাইনি রে বাবা।
-‘তাহলে প্রমান দে?
-‘ কী প্রমাণ চাই, তোদের বল?
-‘ওই বড় মাঠে গিয়ে আমাদের সাথে লাফঝাঁপ খেলবি।
মাধু, অনুপমের দিকে এক পলক তাকাল। অনুপম ইশারায় খেলতে মানা করল। মাধু মলিন হেসে বলল,
-‘অন্য একদিন খেলব কেমন?
-‘ঠিক ধরেছিলাম। তুইও বাকি সবার মতো পাল্টে গেছিস। আচ্ছা এসব কথা ছাড়। তুই সুখে আছিস তো মাধু?
মাধু মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলতে চাইল! হঠাৎই রেণুবালার কথা মনে পড়ে গেল। মানুষটা হয়ত সবার সামনে মাধুকে কিছুই বলে না। তবে সবার অগোচরে অনেক কটুকথা শোনায়, ভালমন্দ রান্না হলেও খেতে দেয় মেপে মেপে। রেণুবালার করা ব্যবহারে মাধু খুব কষ্ট পায়। তবে লজ্জা বা ভয়ে কাউকে কিছু বলার সাহস পায় না।
মুখে বলল,
-‘আমি অনেক সুখে আছি রে।
সন্ধ্যা পর্যন্ত আড্ডা চলল। তারপর যে যার বাড়ি চলে গেল।

আজ রাতে আর মাধুকে জোর করা লাগল না। মাধু নিজে থেকেই অনুপমের ডাকে সারা দিল। দুটো সত্যার প্রেম বিনিময় হলো গভীর ভাবে। স্বর্গ সুখ কিংবা সুখের সাগর বুঝি একেই বলে। দুজনের মনেই উষ্ণতার আবেশের রেশ থেকে যায় অনেক, অনেকক্ষণ।

মাধুরা আজ চলে যাবে। ঝর্ণারানী রান্নাবান্নার চাপে দুদণ্ড মেয়েকে সময় দিতে পারেনি। সকাল থেকেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে চোখ মুছছে। মাধুটা সারাক্ষণ হৈ হৈ করে বাড়ি মাতিয়ে রাখত। মেয়েটা চলে যাওয়ার পর থেকেই ঝর্ণারানীর কিছুই ভাল লাগে না। মাধু পেছন থেকে আচমকা মাকে জড়িয়ে ধরল। ধরে রইল অনেকক্ষণ। ঝর্ণারানী চোখ মুছে বলল,
-‘দেখি সর..?
-‘না।
-‘মাধু..?
-‘শাশুড়ীরা কখনো মা হয় না। তাই না মা?
ঝর্ণারানী চিন্তিত মুখে বলল,
-‘হঠাৎ একথা বলছিস কেন? কিছু কী হয়েছে?
-‘না মা। এমনিই বললাম।
-‘মাধু.. কিছু হয়ে থাকলে আমাকে বল?
-‘কী হবে?
-‘কিছু তো অবশ্যই হয়েছে।
-‘ আরেহ্.. তুমি যা ভাবছ তা নয়। ওই আমি কাজ না পারলে একটু বকাঝকা করে।
-‘ওহ.. এই ব্যপার! সে তো আমিও করতাম।
-‘তুমি আমাকে বকলে আমার একটুও খারাপ লাগত না। কিন্তু ওনি আমাকে অল্প একটু বকলেও আমার খুব খারাপ লাগে। কান্না পায়।
-“নারী জাতটা হলো, জলের মতো তরল পদার্থ মা। তাকে যখন যে পাত্রে রাখা হয়। সে তখন সেই রুপ ধারণ করে।” তারাই এখন তোমার আপনজন। তাদের মন থেকে আপন করে নে। দেখবি আর খারাপ লাগবে না।
মাধু আনমনে সম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকাল।

আজও মাধু বিদায়বেলা প্রচুর কাঁদল। ঝর্ণারানী চোখের জলে মেয়েকে বিদায় দিল। এই চেনা পথঘাট, চেনা নদী, চেনা বাড়িঘর গুলো একটু একটু করে চোখের আড়াল হতেই মাধুর কিশোরী অবুঝ মনটা বিষণ্ণতায় ভরে গেল। অনুপম সারাটা পথ মাধুর একহাত শক্ত করে ধরে রইল।

বাড়িতে এসে যে যার ঘরে চলে গেল। মাধু একটু বিশ্রাম নিয়ে নীচে নামতেই রেণুবালা বলল,
-‘খুব তো বেড়ালে মা। এবার সন্ধ্যে নামার আগে আগে রাতের রান্নাটা সেরে ফেলো তো বাপু!
অনুপম, মাধুকে খুঁজতে খুঁজতে নীচে এসে বলল,
-‘মাধু তুমি এখানে কী করছ? আমি কাল ঢাকা ফিরব। শিগগিরই ব্যাগ থেকে তোমার শাড়িগুলো নামিয়ে ফেলো। আমি জামা-কাপড় গোছাব।
রেণুবালা একগাল হেসে বলল,
-‘আর বলিস না। কত করে বললাম, বড়বৌমা সবে এলে একটু বিশ্রাম নাও। না সে না কী এখন রাঁধবে! তোর বউকে নিয়ে আমি আর পারি না বাপু। যাও.. যাও.. সোয়ামী ডাকলে হাতের কাজ ফেলে জলদি যেতে হয়। আমার আবার কোমড়ের ব্যথাটা বেড়েছে।
অনুপম বলল,
-‘আচ্ছা তুমি তাহলে রাতে আমাকে ব্যাগ গুছিয়ে দিও। এখন মায়ের হাতে হাতে রান্নাটা সেরে নাও।

(চলবে)

লজ্জাবতী পর্ব-০৪

0

#লজ্জাবতী
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব-০৪

অনুপম, মাধুকে নিজের ঘরে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক বোঝাল, হাত টানাটানি করল। মাধু কিছুতেই অনুপমের সাথে যাওয়ার সাহস পেল না। অনুপম চট করেই মাধুকে কোলে তুলে নিল। কণ্ঠে রাগ ঢেলে বলল,
-‘ বেশি ছটফট করলে এক আছাড় মেরে ফেলে দেব কিন্তু?
মাধু পদ্মপুকুরের মতো স্বচ্ছ টলমলে চোখে, অনুপমের মুখপানে তাকাল। ঘোর লাগা দৃষ্টিতে একরাশ মুগ্ধতা।
অনুপম নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে, ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। মাধু আঁতকে উঠল। আবারও অনুপমকে এত কাছে পেয়ে, সেই চিড়বিড়ে শরীর কাঁপানো শিহরণে মাধুর মস্তিষ্ক বিবশ হয়ে গেল। কই, আগে তো কারো জন্য মাধুর এত অস্থির লাগেনি? মাধুর পনেরো বছরের জীবনে, এই প্রথম নতুন সুখ সুখ অনুভূতির সাথে পরিচিত হলো মাধু। কে জানে এর শেষ কোথায়?
অনুপম আলমারি খুলে কী যেন বের করল। তারপর হাত দুটো পেছনে লুকিয়ে মাধুর খুব কাছে চলে এলো। যতটা কাছে এলে, একে অপরের গরম নিঃশ্বাসের আবেশে মাতাল হওয়া যায়। ঠিক ততটা কাছে। মাধু হাত দিয়ে শাড়ি মুঠো করে চেপে ধরল। দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। অনুপম, মাধুর মুখে আলতো করে ফুঁ দিল। মাধু আবেশে চোখদুটো বুঁজে ফেলল। অনুপম ফিসফিস করে বলল,
-‘আমি না বলা পর্যন্ত চোখদুটো খুলবে না, প্লিজ?
মাধু ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা ঝাকাল। খোলা জানালার ভেতর দিয়ে এক ঝাপটা বাতাস এসে মাধুর চোখেমুখে উপচে পরল। মাধুর চোখের পাঁপড়ি তিরতির করে কেঁপে উঠল বোধহয়। রীতিমতো অতিরিক্ত লজ্জায় মাধুর ভেতরে ভুমিকম্প শুরু হয়েছে।
কোত্থেকে একঝাঁক রঙিন প্রজাপ্রতি মাধুর কানে কানে বলে গেল।
”অনুপমের তীব্র ভালোবাসার স্বর্গসুখে তুই মরেই যাবি রে মুখপুরী।”
অনুপম প্রথমে মাধুর ডামহাত টেনে নিল। তারপর মধ্যেমা আঙুলে একটা স্বর্ণের আংটি পরিয়ে দিয়ে তাতে গভীর চুমু এঁকে দিল। মাধুর দুইহাতে দু’মুঠো লাল টুকটুকে রেশমি চুড়ি পরিয়ে দিল। হাত ছেড়ে দিয়ে, হাঁটু মুড়ে মেঝেতে বসে পরল। মাধুর এক পা নিজের হাঁটুর উপরে রাখল। মাধু একচোখ খুলে খুব সাবধানে তাকাল। অনুপম দেখার আগে আবারও চোখদুটো শক্ত করে বুঁজে ফেলল। অনুপম, মাধুর দু’পায়ের আঙুলে রুপোর দুটো আংটি পরিয়ে দিল। এক পায়ের পাতায় চুমু খেতেই, মাধু তাড়াহুড়ো করে পা সরিয়ে নিল। মুখে হাত চেপে ধরে বলল,
-‘ছিঃ ছিঃ কী করছেন? আমার পাপ হবে তো?
অনুপম মাছি তাড়ানোর মতো মাধুর কথা হেসেই উড়িয়ে দিল। বলল,
-‘ধেৎ, এগুলো কুসংস্কার বউ। কোথাও শুনেছ, স্বামীর আদর সোহাগে বউয়ের পাপ হয়?
উত্তরে মাধু কিছু বলতে চাইল! অনুপমের বলার ধরণে লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল।
অনুপম খাটে আরাম করে বসল। মাধুকে একটানে নিজের কোলের মাঝে বসিয়ে দিয়ে দু’হাতে শক্ত করে কোমর জড়িয়ে ধরল। মাধুর ঘাড়ে মুখ রেখে বলল,
-‘হাতে ছুটি কম। কালই আমরা অষ্টমঙ্গলায় শ্বশুরবাড়ি যাব। এখানে তো তোমাকে শত ডাকাডাকি করেও কাছে পাওয়া যায় না। আমাদের জীবনের এত মূল্যবাণ সময় আমি হেলায় ফেলায় শেষ করতে চাই না।
-‘আপনার মাকে বলেছেন?
-‘বাবাকে বলেছি।

বাবার বাড়ি যাবে। সেই আনন্দে সারারাত মাধুর ঘুম হলো না। দুদিন মাধু বাড়ি ছাড়া। অথচ মনে হচ্ছে, দুইযুগ পেরিয়ে গেছে। অনুপম গভীর রাতে মাধুকে কাছে টানল। অনুপমের তীব্র ভালোবাসার প্রতিফলণ দেখে, মাধু খুব ভয় পেল। সরে যেতে চাইল। অনুপম আর একটু শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরল। মাধু দিক-দিশা না পেয়ে অনুপমের ঘাড়ে, হাতে, জোরে কামড় বসিয়ে দিল। এত জোরে কামড় দেওয়াই রীতিমতো হাত কেটে রক্ত পরছে। মাধু শব্দ করে কেঁদে দিল। অনুপম অভিমান করে মাধুকে ছেড়ে দিল। কাঁটা জায়গা হাত বুলিয়ে পাশ ফিরে শুলো। মাধু আর অনুপমকে ডাকার সাহস পেল না। ইশ,মানুষটার কতোখানি হাত কেটে গেছে। মাধুই বা কী করবে? এত জোরে চেপে ধরায় মাধুর দম বন্ধ হয়ে আসছিল। মাধু টিভিতে দেখেছে, মুভিতে ভিলেনরা এইভাবে নায়িকার সাথে ধস্তাধস্তি করে। নায়িকার শাড়ি খুলে লজ্জা হরণ করে। অনুপম, মাধুর ‘বর’ হয়ে কেন মাধুর সাথে এত খারাপ আচরণ করবে? কাল বাড়ি গিয়ে এই বিষয়ে বড়দিকে বলতে হবে। এত কিছুর পরও মানুষটা মাধুর থেকে আঘাত পেল। কেন যেন একটুও ভাল লাগছে না। খুব কান্না পাচ্ছে।
আজও খুব ভোরে মাধুর ঘুম ভাঙল। ঘুম থেকে উঠেই একা একা পুকুরপাড়ে গিয়ে স্নান সারল। অনুপম যদিও গতকাল মানা করেছিল! বুঝ হওয়ার পর থেকেই পুকুরে স্নান করার অভ্যাস মাধুর। তোলা জলে স্নান করতে ইচ্ছে করল না। মাধু যখন ভেজা কাপড়ে চুপিচুপি বাড়ি ঢুকল। বিন্দুমাসি কলতলায় বাসনপত্র মাজাঘষা করছিল। মাধুকে দেখে লজ্জামাখা হাসি দিল। মাধুও একটু হাসি বিমিময় করে। স্নানঘরে গিয়ে কাপড় পাল্টে নিল।
অনুপমদের পুরোনো আমলের দুইতলা বাড়িটা গ্রামে ঢোকার মুখেই পরে। বাড়ির সামনে বিভিন্ন ফুল, ফলের বাগান। বাগানের মাঝখান দিয়ে একটু হেঁটে গেলেই বড় গেইট। গেইটের সামনে ইট বিছানো রাস্তা। বাড়ির পেছনে বিশাল খেত। খেতে সব ধরনের ফসল ফলে। বর্ষায় জোয়ারের পানি এসে যদিও খেতগুলো সব ডুবে যায়। পানি শুকিয়ে পলিমাটি জমলে কৃষকরা মনের সুখে বিভিন্ন শস্যর বীপ বপন করে।
বাড়ির অনেকখানি উঠোন জুড়ে পাঁকা করা। বিকালে সব মেয়ে বউরা দলবল বেঁধে গল্প করতে আসে। ধান, সরিষা শুকাতে আসে। মাধু তার সাজার সরঞ্জাম নিয়ে গিয়ে পা’দুটো মেলে রোদে বসল। মুখে ক্রীম মেখে, মাথা ভর্তি সিঁদুর পরল, কপালের মাঝখানে লাল টিপ পরে, খোঁপা খুলে লম্বা চুলগুলো রোদে শুকাতে দিয়ে, পায়ে সময় নিয়ে আলতা পরল।
রেণুবালা উঠোনে এসে বলল,
-‘শুধু পটের বিবি সাজলেই হবে বড়বৌমা? রন্ধনঘরে কতকাজ পরে আছে। সে খেয়াল আছে?
-” কী করতে হবে মা?
-‘বলে বলে তোমাকে কয়টা কাজ করাব মা? সকালে ডাল, নুচি (লুচি) করতে হবে। ডাল রেঁধে নুচি ভেজে ফেলো। আর হ্যাঁ আজ তো তোমরা অষ্টমঙ্গলায় যাবা। উনুন নিভিয়ে দিও না। একটু ফুলকপি দিয়ে রুইমাছের পাতলা ঝোল, চালতা দিয়ে টকডাল, আর ছোট মাছের চচ্চড়িটাও রেঁধে ফেলো তো বাপু। যদিও তোমার রাঁন্ধা খুব একটা ভাল হয় না। তবে খাওয়া চলে! আমার আবার কোমড়ের ব্যথাটা খুব বেড়েছে। নাহলে এ আর এমন কী কাজ! আমিই করে নিতুম!
-‘বিন্দু..?
-‘গিন্নীমা আমারে ডাকিয়াছেন?
-‘তুই বরং উনুন জ্বেলে দে! বৌমাকে কী কী রাঁধতে হবে, বলে দিয়েছি। তুই সব কেটেকুটে রেডি করে দে। এই ফাঁকে আমি একটু পাড়া বেড়িয়ে আসি।
বিন্দু বিড়বিড় করে বলল,
-‘ইতিহাসের পূর্ণাবৃত্তি হইতেছে।

শীতেরদিন, ছোট বেলা। এতকিছু রাঁধতে রাঁধতে বেলা বারোটা বেজে গেল। ভাগ্যিস মা সেই ছোটবেলা থেকে সবকাজ মাধুকে হাতে ধরে শিখিয়েছিল। তাছাড়া মাধুর গায়ের গড়ন সুন্দর। ওর যে এতকম বয়স বোঝা যায় না। তবে বোধ-বুদ্ধিতেই যা একটু পিছিয়ে।
অনুপমের সাথে রাতের পর আর কথা হয়নি। সকালে খেতে এসে এক’দুবার চোখাচোখি হয়েছিল। মাধু তাকাতেই অনুপম চোখ নামিয়ে নিয়েছিল। মানুষটার মুখটাও কেমন শুঁকনো। খাওয়ার সময় মাধুর খাওয়া হয়েছে না কী একবারও খোঁজ নেয়নি। মাধুও জেদ করে সকালের জলখাবার খেলো না। দুপুরে বউ, শাশুড়ী মিলে সবাইকে খেতে দিয়ে, মাধুরা তিনজন শেষে খেতে বসল। মাধু, রেণুবালা আর বিন্দুমাসি। আজকে অবশ্য মাধুর ভাগ্যে মাছ জুটেছে। তবে লেজের আগের ছোট পিস। মাধু ক্ষুধার্ত পেটে তাই দিয়ে সোনামুখ করে খেয়ে নিল। কোণা চোখে একবার শাশুড়ী মায়ের থালার দিকে তাকাল। মাছের বড় লেজটা আর একপিস মাছ নিয়ে কী তৃপ্তি করেই না খাচ্ছে মানুষটা। মাধুর প্রচণ্ড লোভ হলো। ইশ, এভাবে বড় বড় দু’পিছ মাছ নিয়ে, যদি মাধুও খেতে পারত! মাধুর আজও খুব মন খারাপ হলো। মা সব সময় বলত,
‘শাশুড়ীরা মায়ের মতো হয়। তাদের সব সময় সম্মান দিয়ে কথা বলবি। তারা যা-ই বলুক! বিনাবাক্যব্যয়ে মেনে নিবি। কখনো মুখে মুখে তর্ক করবি না। কখনো যদি শ্বশুরবাড়ি থেকে তোর নামে নালিশ আসে। তোর বাবা কিন্তু জীবনেও ওমুখো হবে না।” শাশুড়ীরা যদি সত্যিই মায়ের মতো হয়! তাহলে কেন সে কখনো মাধুকে ভাল খাবার খেতে দেয় না? সব সময় বৈষম্য করে। কাল বিকালে মাধুকে ঘর মুছতে দিয়েছিল। মাধু পরিষ্কার করে মুছতে পারেনি দেখে, বলল,
-‘তুমি এত নোংরা কেন বড়বৌমা? তোমার মা কিছু শিখায়নি? মাধু একটাও কথা বলেনি। মাথা নীচু করে তার অভিযোগ গুলো শুনেছে। মাধুর সেই চঞ্চল, ছটফটে সত্যাটাও যেন ধীরে ধীরে কোথায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
রেডি হয়ে বের হতে হতে বিকাল গড়িয়ে গেল। মাধুর সাথে অনুপম, রিধীকা, আর টুলু গেল। অনুপমের ছোট ভাই অনিকেত এবার ইন্টার ফাস্ট ইয়ারের পরীক্ষা দিচ্ছে। ইচ্ছে থাকা স্বত্ত্বেও সাথে যাওয়া হলো না। রিধীকা পড়ে ক্লাস টেনে আর টুলু ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ে, পড়াশোনা বাদ দিয়েছে। ওর না কী পড়তে একটুও ভাল লাগে না। একটু সহজসরল তবে লাজুক। যে যা বলে চট করেই বিশ্বাস করে নেয়। বয়স আনুমানিক সতেরো বছর। অনুপমের বাবা অনেক ফল মিষ্টি কিনে টুলুর হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। একটা সিএনজিতে করে ওরা সবাই মাধুদের বাড়ি যাচ্ছে।

অনুপম গাড়ি ভাড়া মিটিয়ে যখন মাধুদের উঠানে দাঁড়াল। তখন মাধুর সব বান্ধুবী, কাকাতো, জ্যাঠাতো ভাই, বোনেরা অনুপমকে ঘিরে ধরল। হাসিমুখে বলল,
-‘নতুন জামাইকে তো খালি হাতে ঘরে ঢুকতে দেওয়া যাবে না।
অনুপমও মজা করে বলল,
-‘আমি কিন্তু কোন টাকা দিতে পারব না শালীরা..!
-‘সেক্ষেত্রে দুটো অপশন আছে।
-‘দ্বিতীয় অপশনটা তাহলে বলুন, শুনি?
-‘আগে এখানে বসুন তো!
সুন্দর নঁকশা আঁকা পিঁড়িতে মাধু, অনুপম বসল। উঠানেও খুব সুন্দর করে আলপনা দেওয়া হয়েছে। বরণডালা, ফল মিষ্টি সবই আছে। মাধুর মা, কাকীমা জামাইকে ধান, দূর্বা দিয়ে বরণ করে, নবদম্পতিকে মন ভরে আশীর্বাদ করল। মুরুব্বিরা সরে যেতেই আবারও মাধুর বোনেরা ঘিরে ধরল অনুপমকে। একটা বেগুন অনুপমের সামনে রেখে বলল,
-‘এই বেগুনটা এক কোপে তিন টুকরো করলেই আর কোন টাকা দিতে হবে না। বউকে কোলে নিয়ে তড়তড়িয়ে শ্বশুরবাড়ি ঢুকে যাবেন। অনুপম ভেবে ভেবে অস্থির। এক কোপে কীভাবে বেগুন তিন টুকরো করা যায়। অনুপমের কেন যে একটা বড়বোন নেই। জামাইবাবুরা এই ব্যপার গুলো খুব ভাল বুঝে। অনুপম তার বন্ধুদের বিয়েতে গিয়ে দেখেছে, জামাইবাবুরা চট করেই একটা সমাধান দিয়ে দেই। অনুপম অনেক ভেবেও যখন ঠাহর করতে পারল না। তখন ভাবাভাবিই ছেড়ে দিয়ে। চুপচাপ বসে বসে দুটো মিষ্টি খেলো। মাধু, অনুপমের পেটে গুতো দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-‘সামান্য কয়টা টাকাই তো চেয়েছে। দিয়ে দেন না। এভাবে বসে থাকতে পা ব্যথা করছে।
-‘ওকে। আমার বউ যখন বলেছে, তখন দিতেই হয়। তবে এক শর্তে!
সবাই একসাথে চিল্লিয়ে বলে উঠল।
-‘কী শর্ত জামাইবাবু?
-‘এই বেগুনটা তোমরা এক কোপে তিনটুকরো করে দেখাও। তবেই টাকা দেবো।
মিতালি এগিয়ে এলো। একটা স্টিলের গ্লাস নিয়ে বেগুনের মাঝখানে চেপে ধরল। খুব সহজেই বেগুনটা তিনটুকরো হয়ে গেল।
অনুপম বিড়বিড় করে বলল,
-‘ডেঞ্জারাস। কেবল তো শুরু। কে জানে সামনে আরও কী কী অপেক্ষা করছে।

বাড়িতে প্রথম নতুন জামাই এসেছে। সেই উপলক্ষে মাধুর মা ঝর্ণারানী কতকিছু যে রান্না করেছে তার কোন হিসেব নেই। প্রথমে পাঁচ পদের পিঠা, পায়েস, দই মিষ্টি খেতে দিল। এগুলো খেতেই তো অনুপমদের পেট ভরে গেল। ভাত খাবে কী! শ্বশুরবাড়িতে এসে অনুপম, মাধুকে নিয়ে এক থালায় খাচ্ছে। অথচ নিজের বাড়িতে মাধু কী খেল না খেলো খোঁজও নেয় না অনুপম। মাধুও মায়ের হাতের বানানো পিঠেপুলি খুব তৃপ্তি করে খেলো। রাতে ভাত খেতে বসে মনে হলো, কতগুলো দিনপর মাধু মাছের বড় টুকরো দিয়ে ভাত খাচ্ছে। মাত্র দুইদিন ছয়বেলা মাধুকে, রেণুবালা খেতে দিয়েছে। তাতেই এমন অনুভূতি হচ্ছে।
মাধুরা দুইবোন। কোন ভাই নেই। বাবা একজন স্কুল শিক্ষক। মাধু ছোটবেলা থেকেই কখনো খাওয়া, পড়ার অভাব বুঝেছি। হয়ত অনুপমদের মতো অতবড় বাড়ি নেই, অত টাকাও নেই মাধুদের। তবে মা-বাবা খুব আদর করে দুবোনকে পেলেপুষে বড় করেছে। বড়দিরও বছর পাঁচেক আগে বিয়ে হয়েছে। এক বছরের একটা ছেলেবাবুও আছে। জামাইবাবু বিয়েতে থাকলেও অষ্টমঙ্গলায় থাকতে পারেনি। ছুটি নেই দেখে বড়দিকে রেখে চলে গেছে। জামাইবাবু বিজিবিতে আছে। বড়দি শ্বশুরবাড়িতে বাচ্চা নিয়ে থাকে।
মাধু বড়দির কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। কালরাতে অনুপম, মাধুর সাথে কী কী করেছে। সব খুলে বলল। অনুপমকে নিয়ে তার মনোভাব কী তাও বলল। সব শুনে বড়দি হেসে দিয়ে বলল,
-‘তুই কী পাগল মাধু? এভাবে বরের হাত কামড়ে কেউ রক্তাক্ত করে দেয়? তোর বর কী তোকে ফুলদানিতে সাজিয়ে রেখে, তিনবেলা পূজা করার জন্য, বিয়ে করেছে? তারও তো তোকে ঘিরে কিছু চাওয়া পাওয়া আছে। পুরুষ মানুষের মন ঘুরে যাওয়ার আগেই পুরুষ মানুষকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করতে হয় রে মুখপুরী। তার মন ঘুরে গেলে, পরে কেঁদেও কূল পাবি না। সে তোকে ভালোবেসেই কাছে টেনেছিল। তার ভালোবাসাকে তুই কেন পায়ে ঠেলে দিলি?
-‘আমিই বা কী করব? ওমন করে কাছে আসলে ভয় করে। খুব লজ্জাও করে।
-‘আর সুখ?
মাধু আনমনে বলল,
-‘তাকে দেখলেই তো আমার দু’চোখ জুড়িয়ে যায়। সব সময় তার আশেপাশে থাকলে সুখ সুখ অনুভূতি হয়।
বড়দি বলল,
-‘আর এই ভুল করিস না। অনুপম তোকে যেভাবে, যে রুপে চাইবে। তুই তাকে সেই ভাবে, সেই রুপেই ধরা দিবি। স্বামীকে নিজের সবটা উজার করে দেওয়ার মাঝেই তো মেয়েদের প্রকৃত সুখ লুকিয়ে আছে।

মাধুকে, বড়দি খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিল। ঘরে গিয়ে দেখল, অনুপম চোখের উপরে একহাত রেখে শুয়ে আছে। মাধু পায়ে ছন্দ তুলে সারাঘর হাঁটল। রিনিঝিনি নূপুরের শব্দে অনুপমের তন্দ্রা ভাব ছুটে গেল। মাধুর দিকে এক পলক পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাল। মাধুকে এই রুপে দেখে, অনুপমের মাথা ঝিমঝিম করছে। চোখ ফেরানো দায়। মাধু, অনুপমের গা ঘেঁষে বসল। মুখে মিষ্টি হাসি টেনে বলল,
-‘আমাকে কেমন লাগছে? প্রশান্তিতে
অনুপমের দু’চোখ জুড়িয়ে গেল, মন ভরে গেল। বুক দুরুদুরু করছে। ধেৎ পুরুষ মানুষের আবার বুক ধুকপুক করে না কী? অনুপমের করছে তো! ঠোঁট নেড়ে বিড়বিড় করে বলল,
-‘এত অস্থির ভাবে বধূসাজে কেউ?’

(চলবে)

লজ্জাবতী পর্ব-০৩

0

#লজ্জাবতী
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব-০৩

নতুন বউ আঁধমাথা ঘোমটা টেনে, খাটের কিনারায় চুপটি করে বসে আছে। প্রতিবেশীরা একটু পর পর মাধুকে দেখতে আসছে! সকালে সবার খাওয়া হলেও এখনো মাধুকে কেউ খেতে ডাকেনি। পেটের ভেতর খিদেয় চু চু করছে। মাধুকে এতক্ষণ অভুক্ত রাখা? নিজের বাড়ি হলে, সারা পাড়া চিল্লিয়ে মাথায় করে ফেলত। তারপর মা পিছুপিছু ভাতের থালা নিয়ে ঘুরত। মাধু প্রথমে একটু রাগ দেখাত, গাল ফুলিয়ে অভিমান করত। তারপর মায়ের মন ভোলানো কথায় লক্ষ্মী মেয়ের মতো খেয়ে নিত। এখানে তো কেউ ভুলেও মাধুর খাওয়ার কথা বলল না? অনুপম বা রিধীকাও আশেপাশে নেই। যে ডেকে একটু ভাত চাইবে! না কী শ্বশুরবাড়িতে কেউ খেতে দেয় না? কী জানি বাবা! এটাও বোধহয় একটা নিয়ম হবে হয়ত! এমনিতেই বিয়ের দুদিন উপোস ছিল মাধু। যদিও বড়দি লুকিয়ে চুকিয়ে এটা-সেটা খেতে দিয়েছিল!
সকাল পেরিয়ে বেলা গড়িয়ে গেছে। তখন মাধুর খাওয়ার জন্য ডাক পরল। ততক্ষণে পেটের অতিরিক্ত খিদেটাও মরে গেছে।
রন্ধনঘরে মাধুকে পিঁড়ি পেতে বসতে দেওয়া হলো। মাধুর আশেপাশে বাড়ির সব মহিলারাও খাওয়ার জন্য গোল হয়ে বসে গেল। এই বাড়িতে চেয়ার-টেবিলের ব্যবস্থা আছে। তবে বোধহয় মেয়ে বউরা সেখানে বসে খায় না। মাটিতে পিঁড়ি পেতে বসে খায়। সকালে লুচি, ছোট ছোট মাংস পিছ করে বুটের ডাল ও সবজি রান্না হয়েছে।
বুটের ডাল সবার পাতে একহাতা.. একহাতা করে পড়লেও মাধুকে দেওয়ার আগেই শেষ হয়ে গেল। মাধুর এত পছন্দের একটা খাবার, একটুও ভাগে পেল না মাধু। ভাবতেই খুব কান্না পেল। কান্না গিলে ফেলে, শুধু সবজি আর বাঁশি পায়েস দিয়ে দুটো লুচি খেল মাধু। রেণুবালা একপলক মাধুর দিকে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাল। হয়ত বেখেয়ালে নিজের তিক্ত অতীত মনে পড়ে গেল। খেতে খেতে মাধুকে শুনিয়ে শুনিয়ে জা’দের উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘আমাদের শাশুড়ীমা বলত, “বউকালে জ্বালা, শাশুড়ীকালে সুখের ডালা।” কত সকাল বা রাত আমরা শুধু এক’দু মুঠো শুকনো মুড়ি আর ভরপেট জল খেয়ে কাটিয়ে দিয়েছি তাই না দিদি?

খাওয়া-দাওয়া শেষ হতেই বিন্দুমাসি সব এঁটো থালাবাসন কলতলায় ধুঁতে নিয়ে গেল। রেণুবালা মাধুকে বলল,
-‘বড়বৌমা?
মাধু চোখ মেলে তাকাল। রেণুবালা বলল,
-‘আজ দুপুরের পর, সব অতিথিরা চলে যাবে। আজ সবাই তোমার হাতের রান্না খেতে চেয়েছে! সব পদ রান্নার দরকার নেই। এক দুই পদ রাঁধো!
মাধু শুকনো ঢোক গিলল। কম করে হলেও পঁচিশ, ত্রিশ জনের রান্না। এত রান্নায় কতটুকু তেল, মশলা দিতে হয়। তাইতো মাধুর জানা নেই। মাধু যে রান্না করতে পারে না। তা কিন্তু নয়। তবে এতগুলো মানুষের রান্না মাধু পারে না। মাধু তাও সাহস করে বলল,
-‘আমাকে মশলা পরিমাণ করে দেখায় দিলেই পারব মা।
রেণুবালা কটমটিয়ে তাকাল। চাপা কণ্ঠে বলল,
-‘ঘটকমশাই যে বিয়ের আগে বলেছিল, মেয়ে রুপে লক্ষ্মী, গুনে সরস্বতী। মেয়ের এত প্রংশসা শুনেই তো ছেলে বিয়ে দিলুম। সারাজীবন তো হাত পুড়িয়ে রান্না করেই খেলুম। এবার তো আমাকে ক্ষমা দাও। তোমাকে যদি আমার রান্না শিখিয়ে দেওয়া লাগে তাহলে তো রান্নাটা আমিই করতে পারি বাপু। বিন্দু উনুন জ্বেলে ভাত, বেগুন ভাজা, শাঁক ভাজা রান্না করে নিবেক্ষণ। তুমি বরং শুধু ইলিশ ভাঁপা, খাসির মাংসকষা আর মাছের মাথা দিয়ে ঘন মুগডালটা করে নিবে। ব্যস। আমার কোমড়ের ব্যথাটা বেড়ে গেছে। আমি একটু বিশ্রাম নেবো। কথাগুলো একদমে বলেই চাবিরতোড়া খানা হাতে নিয়ে, গালভর্তি পান চিবুতে চিবুতে রেণুবালা চলে গেল। এখন মাধুরও খুব ইচ্ছে করছে। একছুটে নিজের বাড়ি চলে যেতে। এত মানুষের রান্না কী করে রাঁধবে মাধু?
অনুপমের ছোটমামী মাধুর পাশে বসল। বলল,
-‘নতুন বউয়ের মন খারাপ?
-” না। তবে খুব টেনশন হচ্ছে।
-‘চলো আমি, তোমাকে হেল্প করে দেই!
মাধু একলাফে উঠে দাঁড়াল। খুশি হয়ে বলল,
-‘সত্যি?
-‘তিন সত্যি। আসলে অনুপমের মা। মানে আমার বড় ননাসটা একটু সেকেলে টাইপ, চড়া মেজাজী। ওনার কথায় তুমি কিছু মনে করো না নতুনবৌ।
মাধু জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল।
এতবড় কড়াইয়ে হাতা নাড়তে, চাড়তে মাধুর খুব কষ্ট হচ্ছে। এই শীতেও ঘেমে-নেয়ে একাকার অবস্থা। মামী পরিমাপ করে মশলা, তেল দিয়ে দিলি। রান্নায় খুব সুন্দর কালার ও স্মেইল এসেছে! ইলিশ ভাঁপা, ডাল রান্না শেষ। মাংসকষাও হয়ে এলো বলে। মামী বলল,
-‘এখন আমি যাই। স্নান করব। তুমি বরং গরম মশলা বাঁটা দিয়ে, মাংসটা নামিয়ে নিও।
-‘আচ্ছা মামী।
মাধু সকালের পারা বরই দিয়ে, একটা টকের আইটেমও রেঁধে ফেলল।
দুপুরে সবাই খুব তৃপ্তি নিয়ে চেটেপুটে খেলো। সবাই মাধুর রান্নার খুব প্রংশসা করল। অনুপম একটু দরকারে হাঁটে গিয়েছিল। মাধু রান্না করেছে শুনে, এসেই হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসল।
এই বাড়ির নিয়ম বউ, মেয়েরা সব ব্যাটাছেলেদের খাওয়ার শেষে খায়। অনুপম ইচ্ছে করে পাতে অনেকগুলো মাংস তুলে নিল। কিছু খেয়ে কিছু মাধুর জন্য রেখে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে উঠে পরল। কলতলায় যাওয়ার আগে , মাধুকে ডেকে জোরে জোরে বলল,
-‘তুমি বরং আমার এঁটো পাতে খেয়ে নিও মাধু। না হলে এতগুলো মাংস শুধু শুধু নষ্ট হবে। মাধু মাথা ঝাঁকাল।
রেণুবালা ছেলের চালাকি চট করেই ধরে ফেলল। নিমিষেই অশান্ত মনটা তিতা বিষে ভরে গেল। কই কখনো অনুপমের বাবা তো তার জন্য পাতে মাংস রেখে খাওয়া ছেড়ে উঠে যায়নি?
নিজে হাতে এত ভালমন্দ রান্না করলেও নতুন বউ থাকতে, তার ভাগে ভাল মাছ, মাংস কিছুই জুটত না। কত যে ভালমন্দ না খেতে পেরে লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছে। তার হিসেব কেউ রাখেনি। তাহলে এখন রেণুবালা কেন রাখবে?
সবাই চলে যেতেই অনুপমের এঁটো থালায় রেণুবালা ভাত বেড়ে নিয়ে গপাগপ খেতে লাগল। মাধুকে বলল,
-‘তুমি নতুন বউ। তোমাকে এঁটো খাবার খেতে হবে না। বিন্দু, বড়বৌমাকে ভাত বেড়ে দে?
এখনও মাধুর খেতে বসে প্রচণ্ড কান্না পেল। কড়াইয়ের তলায় একটা হাড্ডি আর ছোট ছোট দুটো গলা মাংস পরে আছে। ইলিশ ভাঁপা ফুরিয়ে গেছে। বহুকষ্টে একটু ডাল আর ওই ওতটুকু মাংসকষা দিয়ে মাধু খেয়ে উঠল। অথচ বাড়িতে মাধুকে সবসময় বেছে বেছে বড় মাছ, মাংস দিয়ে ভাত খেতে দিত মা। বাবাও খাওয়ার সময় মাধুকে নিজের পাত থেকে এটা-সেটা তুলে দিত।
সব আত্মীয়-স্বজন দুপুরে খেয়ে-দেয়ে চলে গেছে। এখন বাড়িতে মাধুরা জনা দশেক মানুষ আছে। মাধুর শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদ-স্বামী, জ্যাঠাশ্বশুর-জেঠীশাশুড়ী, বিন্দুমাসি আর টুলুদাদা। বিন্দুমাসি এই বাড়ির সব ফরমায়েশ খাঁটে আর বিন্দুমাসির ছেলে দেখতে বোকাসোকা টুলুদাদা হাঁট-বাজার করে দেয়, খেতে শাঁক-সবজির আবাদ করে।
অনুপম দুইবার এসে মাধুকে ডেকে গেছে।
রেণুবালা, মাধুকে দিনের বেলা ঘরে যেতে দিল না। বলল,
-‘দিনের বেলা লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে, স্বামী-স্ত্রী একঘরে থাকবা। এটা কেমন দেখায়? যাও একবারে রাতে ঘরে যাবা। রিধীকার ঘরে গিয়ে একটু ভাতঘুম দাওগে!
মাধু হাতে শাড়ির আঁচল পেঁচিয়ে মন খারাপ করে রিধীকার ঘরে চলে এলো। অনুপমকে এক পলক দেখার জন্য মনটা আঁকুপাঁকু করছে।
অনুপম, মাধুকে খুঁজতে খুঁজতে রিধীকার ঘরে এসে পেলো। বিষন্ন গলায় বলল,
-‘আমি এত ডাকাডাকি করলাম। তারপরও আমার ঘরে গেলে না মাধু? আমাকে এত অপছন্দ করো?
মাধুর বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। অনুপমের সুন্দর মুখখানি দেখে, হৃদয়ে সুখের দোলা দিল। তবে মুখে কিছু বলতে পারল না। অনুপম আবারও বলল,
-‘আমি আর তিনদিন পরই ঢাকা চলে যাব। বাড়িতে যেকটা দিন আছি। আমার কী ইচ্ছে করে না। আমার বউয়ের সাথে একান্ত সময় কাটাতে?
‘অনুপম চলে যাবে?’ মাধু আঁতকে উঠল।
মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল! ইচ্ছে করছে, অনুপমের বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে। লজ্জায় কাছে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। অনুপম, মাধুর একহাত ধরে বলল,
-‘ ঘরে চলো?
মাধুর পুরো শরীরে বিদ্যুৎ বয়ে গেল। এই স্পর্শর তীব্রতা এত গভীর কেন? অনুভবেও সুখ লুকিয়ে আছে। শুকনো ঢোক গিলে বহুকষ্টে মুখে বলল,
-‘না’
-‘বেশ..
অনুপম জানালার ভারী পর্দা টেনে দিল। দরজা চাপিয়ে দিয়ে। মাধুকে একটানে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরল। ভাললাগার আবেশে মাধু বোধহয় একটু একটু বেহুশ হয়ে যাচ্ছে। অনুপম, মাধুর ঢেউ খেলানো সুন্দর চুলের মাঝে মুখ ডুবিয়ে দিল। আবেগী কণ্ঠে বিড়বিড় করে বলল,
-‘আমার অস্থিরতা বুঝো না তুমি?

(চলবে)

লজ্জাবতী পর্ব-০২

0

#লজ্জাবতী
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব-০২

কুয়াশাচ্ছন্ন সুন্দর সকাল। জানালার পর্দা ভেদ করে, মিঠা রোদ আমার সারা মুখে লুটোপুটি খাচ্ছে। ভেবেছিলাম ঘুম জড়ানো চোখ মেলে, প্রথমেই আমার নতুন বউয়ের কোমল মুখখানি দেখব! কিন্তু না মহারানী ঘরে নেই। কী জানি কোথায় গেল! নতুন বউ একা একা, টো টো করে সারাবাড়ি ঘুরে বেড়ালে, লোকে মন্দ বলবে! সেই বোধটাই আমার বউয়ের মাথায় নেই। কাল প্রায় অর্ধেক রাত জেগে, এই বাড়ির মানুষজন কে কেমন, কোথায় কোন কথা বলতে হবে, খুব সংক্ষেপে ধারণা দিয়েছি। তখন তো খুব পণ্ডিতের মতো মাথা ঝাঁকাল। ভোর হতেই ঘুমের সাথে সব ভুলে গুলে খেয়েছে।
বাইরের উঠান থেকে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমি ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলাম। পরনের পাঞ্জাবি খুলে একটা হাফহাতা ছাপার গেঞ্জি গায়ে জড়িয়ে নিলাম। আয়নার একপলক নিজেকে দেখে, তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলাম।

অনুপমদের উঠানের একপাশে, পাঁকা শানবাঁধানো পুকুরের পাড় ঘেঁষে, বিশাল বরইগাছ। সবগুলো বরই পেঁকে পুকুরের জলে টপটপিয়ে ঝরে পরে। সেই গাছের মগডালে মাধু বসে বসে, মনের সুখে পাঁকা বরই ছিঁড়ে শাড়ির আঁচলে ভরছে। নীচে অনুপমের মা, বোন, কাকীমা, মামী, সবাই একজোট হয়ে মাধুকে গাছ থেকে নামতে বলছে। তাদের চেঁচামেচির শব্দে এতক্ষণে বাড়ির সব মানুষ, আত্মীয়- স্বজন পুকুরপাড়ে এসে জড়ো হয়েছে। সবাই অদ্ভুত চোখে, মাধুকে দেখছে! কেউ কেউ ফিসফাস করছে। একসাথে এত মানুষ দেখে, মাধু খুব ভয় পেয়ে গেছে। গাছ থেকে নামার সাহস পাচ্ছে না। অনুপমের মা রেণুবালা দেবী ছেলেকে দেখে এগিয়ে গেল। রাগী অথচ চাপা কণ্ঠে বলল,
-‘তোরা বাপ-ছেলে মিলে এ’কাকে বাড়ির বউ করে নিয়ে আসলি, বড়খোকা? নতুন বউ। বিয়ের দুদিনও পার হয়নি। লোক-লজ্জার মাথা খেয়ে, ব্যাটা ছেলেদের মতো তড়তড়িয়ে গাছে উঠে বরই পাড়ছে। লোকে তোর বউয়ের কাণ্ড দেখে, হাসছে। ছিঃ..
আমার মাথা গরম হওয়ার আগে তোর বউকে গাছ থেকে নামতে বল?
অনুপম শুকনো ঢোক গিলল। মাকে দেখে, সেই ছোটবেলা থেকেই অনুপম ভয় পায়। বলতে লজ্জা নেই, এখনো অনুপমের ছোট ভাই-বোন ভুল করলে, মা ঠাস ঠাস চড় মেরে দেয় গালে, পিঠে।
রিধীকা , অনুপমের পাশে এসে দাঁড়াল। অনুপম নীচু কণ্ঠে বলল,
-‘ঘটনা কী বলতো? মাধু সাত-সকালে বরই গাছে উঠেছে কেন?
রিধীকা ফিসফিস করে বলল,
-‘বৌদিমণি ঘুম থেকে উঠেই রান্নাঘরে ঢুকেছিল। তার না কী খুব জল তৃষ্ণা পেয়েছে। মা এক ধমকে বৌদিমণিকে রান্নাঘর থেকে বের করে দিয়েছে। বলেছে,
-‘তোমার লজ্জা করে না বড়বৌমা। সকাল বেলা স্নান না করে, বাঁশি কাপড়ে রান্নাঘরে ঢুকতে? যাও এক্ষুণি পুকুরপাড় থেকে স্নান সেরে আসো।
তারপর মা আমাকে ডেকে বৌদিমণির সাথে পাঠাল। বৌদিমণি বরই গাছ দেখে, এক লাফে, তড়তড়িয়ে গাছে উঠে গেল। আমি কত মানা করলাম! শুনল না। উল্টো ইশারায় আমাকে চুপ থাকলে বলে, তাড়াহুড়ো করে বরই ছিঁড়তে লাগল। বৌদিমণির গাছে উঠে বরই ছিঁড়ার দৃশ্য বিন্দুমাসি দেখে ফেলল, রামো…রামো, এ আমি কী দেখিলাম? বলেই মাকে খবরখানা দিতে গেল।
অনুপম বলল,
-‘তুই শিগগিরই গিয়ে বাবাকে ডেকে নিয়ে আয়! পরিস্থিতি জটিল হয়ে গেছে। একমাত্র বাবা ছাড়া এখন কাউকেই সামাল দিতে পারব না। বাবা যে বেছে বেছে এই ঝাঁঝের রাণীকেই কেন বিয়ে করেছিল, কে জানে! সব সময় ছোট ব্যপার গুলো চিৎকার চেঁচামেচি করে বড় করে ফেলে।
অনুপমের বাবা নিখিলেশ চ্যাটার্জী এসেই দশ মিনিটের ভেতর, সবাইকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে অন্দরমহলে নিয়ে গেল। এই পাশটা ফাঁকা হতেই অনুপম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মাধু তখনো ভয়ে গুটিশুটি মেরে গাছের মগডালে চুপটি করে বসে আছে। অনুপম আদুরে কণ্ঠে আস্তে করে বলল,
-‘মাধু…? ধীরে ধীরে গাছ থেকে নেমে আসো?
মাধু উঁচু ডাল থেকে লাফ দিয়ে নামল। বরই কাঁটার ঘঁষায় হাতের বেশকিছু জায়গা ছিঁলে গেছে। অনুপম, মাধুর কাঁটা জায়গায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-‘এটা বাবার বাড়ি না মাধু। এখানে তথাকথিত নিয়মের বাইরে চললেই তেমাকে কটুকথা শুনতে হবে। কী দরকার ছিল, সাত-সকালে বরই গাছে উঠার?
-‘ধেৎ চুপ করুণ তো। আমার মাও সারাক্ষণ আমার সাথে রাগারাগি করে, কথা না শুনলে গায়ে হাত তোলে। এগুলো এত ধরলে হয় না। একটাই তো জীবন আমাদের। সবার সব কথা শুনে শুনে একজীবন পাড় করে দেব না কী? মাঝে মাঝে নিজের মনের কথাও শুনতে হয়।
অনুপম বিড়বিড় করে বলল,
-‘বয়স কম হলে কী হবে! বেশ বোধ-বুদ্ধিও আছে দেখছি!
রিধীকা বলল,
-‘বড়দাভাই.. তোরা দুজন বরং স্নান সেরে নে। আমি প্রাইভেট পড়তে যাব। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
-‘ঠিকাছে। তুই বরং আমার লুঙ্গি, গামছা আর সাবানটা দিয়ে যাস।
রিধীকা যেতে যেতে বলল,
-‘সে দেবক্ষণ!

মাধবীলতা নূপুর পরা পায়ে, রিমিঝিমি শব্দ তুলে, সিঁড়ি দিয়ে হাঁটু জলে নেমে গেল। অনুপম গায়ের গেঞ্জিটা একটানে খুলে ফেলল। মাধবীলতা সাঁতার কাটতে কাটতে বেখেয়ালে অনুপমের দিকে তাকাল।
অনুপম দেখতে বেশ লম্বাচওড়া, ফর্সা বুকে ছোট ছোট কালো লোম, মেদহীন পেটানো শরীর, মাথার ঘন কালো চুলগুলো স্টাইল করে ছেটে রাখা, ফর্সা গালের বামপাশে একটা গর্তমতো কাঁটা দাগ, সুন্দর চোখ, মুখ। একমুঠ মিঠারোদ অনুপমের গায়ে লুটোপুটি খাচ্ছে। সম্পূর্ণ খালি গায়ে অনুপমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, মাধবীলতার কেমন যেন লাগল। চোখ নামিয়ে নিল। বেহায়া দু’চোখ বেশিক্ষণ সামলে রাখতে পারল কই? আবারও খুব সাবধানে অনুপমের সারাশরীর ঘুরে এলো। কিশোরীর বাঁধভাঙা প্রথম প্রেম বুঝি এসেই গেল! মাধু চোখ ফিরিয়ে নিল। আনমনে সাঁতার কাটতে কাটতে শাড়ি পেঁচিয়ে গেল। ব্লাউজের সাথে কানের দুলের আংটা আটকে গেল।
মাধুকে গলা জলে ছটফট করতে দেখে,
অনুপম জলে নেমে একহাত বাড়িয়ে দিল। মাধু মাথা নীচু করে ফেলল। অনুপমের হাতে মৃদু কাঁপা হাত রাখল। অনুপম, মাধুর খুব কাছে চলে এলো। মাধুর ঘাড়ে অনুপমের উত্তপ্ত একেকটা গরম নিঃশ্বাস জোয়ারের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পরছে। অজানা সুখ সুখ অনুভূতিতে মাধুর দেহ, মন একটু একটু করে বিবশ হয়ে এলো। অনুপম, মাধুর কানের দুলের আংটা খুব যত্ন করে ছাড়িয়ে দিল। অনুপমের পুরুষালি স্পর্শে মাধু তিরতির করে কাঁপছে। অনুপম ঘোর লাগা দৃষ্টি মেলে, তার ‘প্রিয়তমার’ দিকে বড় আগ্রহ নিয়ে তাকাল। আবেগী কণ্ঠে বলল,
-‘এই ভেঁজা কাপড়ে তোমাকে দেখতে, একটু বেশিই সুন্দর লাগছে মাধু। আজ থেকে, তোমার স্নান করার জন্য এই পুকুর নিষিদ্ধ। আমি চাই না, আমার মাধুকে আমি ব্যতীত, অন্যপুরুষ দেখুক।
মাধু দু’হাতে লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেলল।
‘ইশ’…
বুকের ভেতর বালিকার প্রথম প্রেমের দোলা দিয়ে, একঝাঁক রঙীন প্রজাপ্রতি মনের সুখে উঁড়ছে।

(চলবে)

লজ্জাবতী পর্ব-০১

0

#লজ্জাবতী
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব_১

-‘বিয়ের রাতে শুধু আমি একটু ‘ওর’ হাত ধরেছিলাম।’
-‘তারপর..তারপর? বন্ধুরা খুব কৌতূহল নিয়ে অনুপমের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। অনুপম হুইস্কির গ্লাসে শেষ চুমুক দিয়ে বলল,
-‘ ও হাতটা আস্তে করে ছাড়িয়ে নিয়ে, ভয়ে গুটিশুটি মেরে সরে শুলো। আমার আর একটু সাহস বেড়ে গেল। আমি কম্বলের তলায় ওর হাতটা টেনে নিয়ে, আঁকিবুঁকি করতে লাগলাম।
-‘দোস্ত, আমার খুব এক্সাইটেড লাগতেছে। তারপর বৌদির সাথে কী করলি? সিধু মুখে হাত দিয়ে লাজুক হেসে বলল।
-‘তারপর আমি কিছু করিনি। যা করার ‘ও’ করছে!
রবি বলল,
-‘ও মাই গড। বৌদি এত রোমান্টিক? দোস্ত তোর তো কপাল খুলে গেছে।
সিধু বিরক্ত হয়ে বলল,
-‘চুপ করবি শালা! আগে অনুপমকে পুরো কথাটা শেষ করতে দে!
অনুপম কাঁচের গ্লাসে আঁকিবুঁকি করতে করতে বলল,
‘মাধবীলতা হঠাৎ চিৎকার করে উঠল। একে একে ঘরের সবগুলো লাইট জ্বেলে দিল। ওর মা, বড়বোনকে পাশের ঘর থেকে টেনে নিয়ে এলো। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল,
-‘বড়দি এই ব্যাটা মাঝরাতে ঘুম বাদ দিয়ে, আমার হাত টানাটানি করছে। এত কাতুকুতু দিয়ে ঘুম ধরে, তোমরাই বলো?
সবগুলো বন্ধু একসাথে খিলখিলিয়ে হেসে দিল। সেকি দম ফাঁটা হাসি। সিধু বলল,
-‘ইশ,
অনুপম লাজুক হেসে, মাথা চুলকে বলল,
-‘শাশুড়ীমা তার মাথামোটা মেয়ের কথা শুনে, লজ্জায় আঁধমাথা ঘোমটা টেনে তড়িঘড়ি করে চলে গেল। এদিকে আমারও খুব লজ্জা লাগছিল। আমি কম্বল মুড়ি দিয়ে, ঘুমের ভাণ ধরে ঘাপটি মেরে পরে রইলাম।
ওর বড়দি ওকে কতকিছু বুঝাল। কিছুতেই কাজ হলো না। সে আর আমার সাথে শুবেই না। তার ঘুরেফিরে একটাই কথা। ‘এই লোকের মতলব ভাল না।’ তাকায়ও যেন কেমন কেমন করে।

-‘এই বড়দা কত রাত হলো! তুই এখনো ছাদে বসে আছিস? নতুন বৌদিকে নিয়ে কাকিমা, মামী তোর ঘরে বসে আছে। তোকে এখন যেতে হবে।
-‘ তুই যা.. আমি আসছি!
রিধীকা চলে যেতেই, অনুপম উঠে দাঁড়াল। সিধু পিছু ডেকে, চোখ টিপে বলল,
-‘দোস্ত ফুলসজ্জা একটু বুঝেশুনে করো! তোমার যে বউরে বাবা! শেষে দেখা যাবে, পুরো পাড়া চিল্লিয়ে মাথায় করে ফেলেছে।
অনুপম চিন্তিত ভঙ্গীতে মাথা নাড়ল। বলল,
-‘বাবা-মায়ের কথা শুনে, এত অল্পবয়সী মেয়ে বিয়ে করা ঠিক হয়নি।
-‘দোস্ত একটা বুদ্ধি দেই?
-‘বল?
-‘তুই বরং বৌদিকে দুধের সাথে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে খাওয়া! কিচ্ছু ঠিক পাবে না।
অনুপম, সিধুর মাথায় চাট্টি মেরে বলল,
-‘শালা..মাধু আমার প্রেমিকা না বউ। এত তাড়া কিসের?
অনুপম বিয়ের সমস্ত নিয়ম-নীতি মেনে যখন শুতে এলো। দেখল, মাধু ঘরে নেই। অনুপম বেশ অবাক হলো। কাউকে লজ্জায় বলতেও পারছে না। মাধু কোথায়? অনুপম জানালা খুলে দিল। পাশেই বিশাল সরষেখেত! ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। মাধু খাটের তলা থেকে বেড়িয়ে এলো। শাড়ি এলোমেলো। গয়নাগাটিও জায়গারটা জায়গায় নেই। কপালের টিকলি কানের পাশে এসে গেছে, বাঁধা চুলের ফাঁকফোকর দিয়ে কিছু খোলা চুল বেড়িয়ে এসেছে, চোখদুটো পদ্মপুকুরের মতো টলমলে স্বচ্ছ মায়া কাড়া, ফর্সা গোলগাল মুখ, চেহারায় অল্পবয়সী ছাপ স্পষ্ট ফুঁটে উঠেছে।
অনুপম বিষম খেয়ে বলল,
-‘তুমি খাটের তলায় কী করছিলে?
মাধবীলতা সর্তক দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। ব্যস্ত ভঙ্গীতে বলল,
-‘একটা ইঁদুর দৌঁড়ে আপনার খাটের তলায় এসে ঢুকেছে। খুঁজে পাচ্ছি না। একটু দেখুন তো, পাঁজি ইঁদুরটা কোথায় গেল?
অনুপম বিড়বিড় করে বলল,
-‘অন্য মানুষের বউরা বাসর ঘরে বিড়াল মারে আর আমার বউ ইঁদুর মারছে। বাহ্ বেশ ইন্টারেস্টিং তো!
-‘কিছু বললেন?
-‘না তো।
অনুপম পূর্ণ দৃষ্টি মেলে মাধবীলতার দিকে একপলক তাকাল। হাতে শাঁখা-পলা, সিঁথিতে সিঁদুর, আলতা রাঙা নূপুর পরা সুন্দর পা, চোখে মোটা করে কাজল টানা। কপালের মাঝখানে বড় একটা লাল টিপ তার চারপাশে তিলক দিয়ে সুন্দর নঁকশা আঁকা। অনুপম বার কয়েক শুকনো ঢোক গিলল। বুকের ভেতর শিরশির করছে। আস্তে করে ঘরের দরজার ছিটকানি তুলে দিল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
-‘শুতে আসো?
মাধু শাড়ির আঁচলের গিট থেকে একটা কচকচে পেয়ারা বের করল। তাতে কামড় বসিয়ে মনের সুখে চিবুতে লাগল, তারপর বড় আরাম করে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসল। অনুপম পাশে বসে মাধুর একহাত চেপে ধরল। চোখে চোখ রাখল। মাধু বড় বড় করে তাকাল। হাত কচলাতে থাকল। শেষে অনুপমের পুরুষালি শক্তির সাথে না পেরে , ঠোঁট উল্টে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে বাচ্চাদের মতো কেঁদে দিল। অনুপম চাপা শব্দে ধমক দিল। বলল,
-এ্যাঁই মাধু তুমি কাঁদছ কেন?
-‘আপনাকে দেখলেই আমার খুব ভয় লাগে।
-‘কেন আমি বাঘ না ভাল্লুক?
মাধু নাক টেনে লজ্জিত ভঙ্গিতে ফিসফিস করে বলল,
-‘আমার বান্ধবীরা বলেছে আপনি কাছে আসলেই আমার বাচ্চা হবে। আমি এখন কিছুতেই বাচ্চা চাই না।
অনুপম শুকনো ঢোক গিলল। ফিসফিস করে বলল,
-‘তোমার বান্ধবীরা আর কী কী বলেছে?
-‘কাউকে বলবেন না তো?
-‘না..
মাধু নীচু কণ্ঠে বলল,
-‘ওরা বলেছে, আপনি একবার কাছে আসলে একটা বাচ্চা হবে, দুইবার কাছে আসলে দুটো বাচ্চা হবে। আমার তো এখন বাচ্চাই চাই না। আপনি কাছে আসলে ভয় করবে না বলুন?

অনুপম হাসবে না কাঁদবে! বুঝতে পারছে না। এই মেয়েটার বয়স পনেরো বছর। আর অনুপমের বয়স সাতাশ বছর। এই মেয়েটার থেকে গুনে গুনে বারো বছরের বড় অনুপম। বাবাকে কত করে বোঝাল অনুপম। সে কিছুতেই এত কমবয়সী, ইমম্যাচিউর মেয়ে বিয়ে করবে না। কিন্তু অনুপমের অশিক্ষিত, সহজ-সরল বাবা সে কথা বুঝলে তো! অনুপম শহরে চাকুরী পাওয়ার পর, বাবা আর দেরি করল না। রীতিমতো ঘটক ধরে, মাধুর সাথে বিয়ে দিয়ে দিল। যেদিন অনুপমরা, মাধুকে দেখতে গিয়েছিল। সেদিন দেখল, মাধু আমবাগানে বান্ধুবীদের সাথে দলবল বেঁধে জুতাজোর খেলছে। মাথায় দুটো বেণী বাঁধা, কোমড়ে ওড়না গুঁজা। নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে।
বাবা, মাধুকে ডেকে জিজ্ঞেস করল,
-‘মা, নিপেনবাবুর বাড়ি কোথায়?
খেলায় ব্যঘাত ঘটায় মাধু বোধহয় একটু বিরক্ত হলো। খেলা বিরতি দিয়ে বাবার হাত টেনে ধরে, নিপেনবাবুর বাড়িটা কোনরকমে দেখিয়ে দিয়ে একছুটে খেলতে চলে এলো। মাধুর মা আর বড়দি দুজন মিলে, খেলা ভঙ্গ করে মাধুকে আমাদের অগোচরে নিয়ে গিয়ে তৈরি করে দিল। মাধুকে যখন সাজিয়ে গুছিয়ে আমাদের সামনে আনা হলো। মাধু বাবাকে দেখে, একগাল হেসে দিয়ে বলল,
-‘কাকু আপনারা, আমাকে দেখতে এসেছেন?
দেখতে, সহজ-সরল, সুন্দরী গায়ের গড়নের মাধুকে আমার বাবার চট করেই পছন্দ হয়ে গেল। আমার যে খুব একটা খারাপ লাগছিল তা কিন্তু নয়।

একটু আগে মাধু আমাকে যে কথা শোনাল। আমার আর মাধুকে ছোঁয়ার সাহস হলো না। আমি কপালের উপর হাত রেখে টানটান হয়ে শুয়ে পরলাম। আমার দেখাদেখি মাধুও আমার পাশে এসে শুয়ে পরল। আকাশে থালার মতো বড় চাঁদ উঠেছে, বিছানা গোলাপ, গাঁদাফুল দিয়ে সাজানো, পাশে জীবন্ত নারী শরীর। সব মিলিয়ে মোহময় পরিবেশ। আমার নিজের মাঝের লুকানো কামুক পুরুষকে এখন খুব ভয় লাগছে। আমি চোখ মেলে তাকালাম। মাধু আমার গা ঘেঁষে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে। মাথার চুল এলোমেলো, সিঁথির সিঁদুর লেপ্টে গেছে, লিপস্টিক আঁকা সুন্দর ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে নালা পরছে। আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে মাধুকে দেখছি। এই চাঁদের মতো সুন্দর পুতুল বউটা এখন শুধুই আমার। ভাবতেই একরাশ ভাললাগায় মনটা ভরে গেল। আমি খুব গোপনে মাধুর কপালে চুমু এঁকে দিলাম। আমার অস্থিরতা বেড়ে গেল। সাহস করে, মাধুর কপালের এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে গালে একটা চুমু খেলাম।
আমাকে ওর মুখের উপর ঝুঁকে পড়তে দেখে, মাধু বড় বড় চোখ করে তাকাল। ভয়ে এক চিৎকার দেওয়ার আগেই আমি ওর মুখটা শক্ত করে চেপে ধরলাম। ও ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এলো। আমি ওর কানের সাথে মুখ লাগিয়ে ফিসফিস করে বললাম,
-‘বিয়ের পর নতুন বউকে চুমু খেতে হয়। এটা নিয়ম।
মাধু খুব লজ্জা পেল। চোখ নামিয়ে নিয়ে, সন্দিহান গলায় বলল,
-‘সত্যি তো?

(চলবে)

গোলকধাঁধা পর্ব-১৬ এবং শেষ পর্ব

0

#গোলকধাঁধা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-(অন্তিম)

কিছু কথা মুখে বলতে হয় না। মুখ দেখে বা অপর মানুষটির আচরণেই বোঝা যায়। প্রত্যয়ও দরজায় দাঁড়িয়ে সেরকম সিরাতকে দেখছে, ওর মন পড়ার
চেষ্টা করছে। মুখফুটে না বললেও প্রত্যয় জানে সিরাতের রাগটাগ সব গলে পানি! ও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল আঁচড়ানো সিরাতের দিকে এগিয়ে গিয়ে তোয়ালে দিয়ে চুলগুলো মুছে দিতে দিতে বলল,
‘রাত জেগো না। শুয়ে পড়ো।’
সিরাত ছোট্ট করে বলল,
‘আপনিও।’
‘রাগ কমেছে?’
ভালোবাসার মানুষটি যখন নিজের মনোভাব প্রকাশ করে ফেলে, বারবার ছুটে আসে তখন মনে সৃষ্টি হয় চঞ্চলতা, উদ্বিগ্নতা। হৃদয় হয়ে ওঠে ব্যাকুল। মান-অভিমানের পাল্লা তখন চাইলেও আর দীর্ঘ করা যায় না। সিরাত দু’পাশে মাথা নাড়লো,
‘হুঁ।’
প্রত্যয় এবার ভাবুক হলো। তার বউয়ের মুড সুইংটা
সে ঠিকঠাক বুঝে ওঠতে পারছে না। তবুও বুকের ভেতর সে এক অদ্ভুত প্রশান্তি! ছোটখাটো দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে নিজের নাক ঘঁষলো সিরাতের নাকে। অস্ফুটস্বরে বলল,
‘যাক অবশেষে এই অধম নিস্তার পেলো তবে।’

________________________

এরমধ্যে কেটে গেলো কয়েক মাস!
আজ বসন্তের প্রথম দিন। ফাল্গুনী হাওয়া গায়ে
লাগিয়ে গাছগাছালি সেজেছে নতুন সাজে। সেইসাথে আনন্দের সাথে বসন্তকে বরণ করছে সকলে। প্রত্যাশা তৈরি হচ্ছিলো তার ভার্সিটি প্রোগ্রামে যাওয়ার জন্য! সিরাত তাকে সাজিয়ে দিচ্ছে। তার ভারী শরীর। পেট আগের থেকে কিছুটা উঁচু হয়েছে। হাঁটাচলা করতে হয় সাবধানে। এরমধ্যে একগ্লাস পানি খেলো সিরাত। কিন্তু পানিটা খাওয়ার কিছু মুহূর্ত পরই কেমন অদ্ভুত এক যন্ত্রণা অনুভব করলো। তেমন একটা পাত্তা দিলো না। সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে দিলো প্রত্যাশাকে। কুচি ঠিক করে দেওয়ার জন্য খানিকটা ঝুঁকতেই যন্ত্রণাটা আচমকাই প্রকট হয়ে গেলো। মৃদু চিৎকার দিয়ে নেতিয়ে পড়তে নিলেই প্রত্যাশা ধরে ফেললো। চেঁচিয়ে মা’কে ডাকলো৷ মুশফিকা চৌধুরী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। খানিকটা বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে পড়ে দ্রুত স্বামী-ছেলেকে ফোন করলেন। এরপর ড্রাইভারকে বললেন গাড়ি বের করতে।

প্রত্যয় গুরুত্বপূর্ণ এক সমাবেশে যোগ দিতে মাহিনকে নিয়ে শহরের বাইরে তখন! ফোন ছিলো মাহিনের কাছে, রিসিভও করলো সে। ঘটনা শুনে তড়িঘড়ি
করে খবরটা দিতেই প্রত্যয় বিস্ময়ের সীমা রইলো না। আজই হতে হলো এসব কান্ড? সমাবেশের আয়োজকদের ব্যাপারটা বুঝিয়ে সেখান থেকে একভাবে বেরিয়ে এলো ওরা। এদিকে গাড়িতে বসেই প্রচন্ড ঘামতে শুরু করলো, উদ্বিগ্ন হয়ে বারবার ঘড়ি দেখছে প্রত্যয়। এত বছরের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে কখনো কোনো সমস্যায় এহেন দুর্বল প্রত্যয়কে কখনো দেখেনি মাহিন। রাস্তায় তখন ভীষণ যানজট।
গাড়ি আগানো যাচ্ছে না।বিরক্তিতে তেতো হয়ে
ওঠলো মন। ট্রাফিক পুলিশের থেকে জানা গেলো এ যানজট ছুটতে ঘন্টা লেগে যাবে। উত্তেজনা, চিন্তার মধ্যেই ফোন এলো প্রত্যয়ের,
মাহিন সেটা রিসিভ করলো। এরপর কলটা
কেটে প্রত্যয়ের দিকে পানির বোতল এগিয়ে
দিতে দিতে ঢোক গিলে বলল,
‘ভাই, আমাদের ভাতিজি মানে আপনের
মাইয়া হইসে।’
প্রত্যয় বেমালুম পানি খাওয়া ভুলে অবিশ্বাস্য
দৃষ্টিতে মাহিনকে দেখলো। গলা ধরে এলো ওর। কোনোমতে বলল,
‘যানজট কি ছাড়বে না? চল হেঁটে চলে যাই।’
মাহিন বলল,
‘হেঁটে গেলেও কয়েক ঘন্টা ভাই। আর একটু অপেক্ষা করে দেখি, নয়তো অন্য চিন্তা করা যাবে।’
প্রত্যয় আরকিছু ভাবতে পারলোনা!

_____________

আমির সাহেবের আত্মীয়স্বজন বেশি। কিছু একটা হলেই দলবেঁধে সকলে ছুটে আসে কি হয়েছে না হয়েছে দেখতে! কিন্তু অনাগত নাতিনাতনি আসার খবরটি তিনি এখনি সবাইকে জানালেন না। শহরের সবচেয়ে বড় এই প্রাইভেট হসপিটালটি বড্ড আধুনিক। এখানে পেশেন্টদের স্বার্থেই জনসমাগম কম রাখার নির্দেশ আছে। সেজন্য আমির সাহেব শুধুমাত্র নিজের আর সিরাতের পরিবার ব্যতীত কাউকেই ডাকেন নি। মুশফিকা চৌধুরী করিডোরের ওয়েটিং রুমে বসে মিনারার সাথে কথা চিন্তিত মুখ করে বসে আছেন। কি হয় না হয়, কে জানে! তবে সকলের একটাই চাওয়া
মা-বাচ্চা যাতে ঠিক থাকে। একটু পরই একজন নার্স এলেন আকাঙ্ক্ষিত শিশুটিকে নিয়ে। মুশফিকা চৌধুরীর চোখেমুখে জল, ঠোঁটে উপচে পড়া হাসি। গদগদ ভঙ্গিতে আমির সাহেব আর শিমুল সাহেব কোলাকুলি করলেন। তোয়ালেতে মুড়িয়ে থাকা শিশুটিকে দেখে দুই পরিবারের সকলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সকলের চোখেমুখে উপচে পড়া আনন্দ! এর কোলে, ওর কোলে নিতে নিতে কন্যা শিশুটি দেখতে কার মতো হয়েছে তা নিয়েই চলছে আলোচনা, গবেষণা, হাসিঠাট্টা! সকলের আদর করা শেষ হলে প্রত্যাশা কোলে নিলো। কোলাহলে একপ্রকার বিরক্ত হয়েই একটুখানি মনোযোগ দিয়ে বাচ্চাটিকে দেখার আশায় প্রত্যাশা ওয়েটিং রুম থেকে বেরিয়ে করিডোরে চলে এলো। বসার জায়গা ফাঁকা পেয়ে বসে মুগ্ধ দৃষ্টিতে ভাতিজিকে দেখলো। চুমু খেলো হাতে-পায়ে, চোখে-মুখে। বরাবরই বাচ্চা তার ভীষণ পছন্দের! অমনি পেছন থেকে পুরুষালি কন্ঠস্বর ভেসে এলো,
‘একি! নিউ বর্ন বেবি আপনার কাছে কেন? কি
সব ডিজগাস্টিং কাজকর্ম করছেন? নূন্যতম
সেন্স নেই?’
প্রত্যাশা ভয় পেয়ে কেঁপে ওঠলেও নিজেকে
সামলে নিয়ে বলল,
‘কি করেছি?’
ডাক্তারটি রাগী সুরে বলল,
‘আপনার গবেট মাথায় এসব ঢুকবে না।’
‘মানে?’
ডাক্তারটি ওকে তেমন পাত্তাই দিলো না। যেন ভীষণ বিরক্ত ওর ওপর! হাঁকডাক ছাড়তেই দু’জন
নার্স ছুটে এলো। ডাক্তার শাফায়াত প্রচন্ড জোরে
ধমকে ওঠলেন,
‘কোথায় ছিলেন? নিউ বর্ন বেবি এতক্ষণ যাবৎ এখানে আর আপনারা কি করছিলেন? নিজের দায়িত্ব ভুলে গেলে মনে না পড়া পর্যন্ত কাজে যোগ দেবেন না৷
ওকে? আপনাদের জন্য হসপিটালের দুর্নাম হচ্ছে দিনদিন।’
নার্সরা ধমক শুনে কেঁপে ওঠলো। নিজেদের গাফিলতির জন্য মাথা নিচু করে রইলো। ক্ষমা চেয়ে প্রত্যাশার কোল থেকে বাচ্চাটিকে নিয়ে দ্রুত বেবি কেয়ারে নিয়ে গেলো। ডাক্তার শাখাওয়াত সেদিকে তাকিয়ে ফিরতেই দেখলেন বাসন্তী রঙের শাড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা মানবীটির দিকে। তার দিকে কেমন
রাগ নিয়ে তাকিয়ে আছে। মানবীটি কটমট করে ওর মুখের ওপর বলে দিলো,
‘রাস্কেল ডাক্তার!’
বলে চলে যেতে উদ্যত হতেই পেছন থেকে
শাখাওয়াত বলল,
‘এক্সমিউজ মি, কথাটা কি আমাকে বললেন?’
‘হু, আপনাকেই মিস্টার।’
‘কারণটা কি?’
‘বলতে বাধ্য নই।’
শাফায়াত চোয়াল শক্ত করে এগিয়ে এলো। স্টেথোস্কোপটা হাতে নিয়ে জোর গলায় বলল,
‘কথাটা যেহেতু আমাকে বলেছেন তাহলে আপনি অবশ্যই বাধ্য। কারণ না দর্শিয়ে আপনি এখান থেকে যেতে পারবেন না।’
প্রত্যাশা নিজের চোখের চশমাটা ঠেলে নিলো। খোলা চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অকপটে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
‘কারণ দর্শাবো না। কি করবেন আপনি?’
ডাক্তার শাখাওয়াত আচমকা উচ্চস্বরে হেসে
ফেললেন। এরপর আচমকা থেমে গিয়ে নিচু
গলায় বললেন,
‘না আর কারণ দর্শিয়ে লাভ নেই। আপনি যেতে পারেন।’
প্রত্যাশার রাগে গা জ্বলছে ডাক্তারটার একটু
আগের করা ব্যবহারে। শক্ত গলায় তাই বলল,
‘মেয়েমানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করবেন।
আপনি উচ্চপদে আছেন বলে নিচু পদস্থদের
অসম্মান করবেন সেটা কোনো শিক্ষিতদের মধ্যে
পড়ে না।’
বলে চলে এলো। আসার পথে পেছন তাকাতেই দেখলো ডাক্তারটি করিডোরের দেয়াল ঘেঁষে
দাঁড়িয়ে ওর যাওয়া দেখছে। ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত হাসি। প্রত্যাশার কাছে হাসিটা বেশ রহস্যময়
ঠেকলো৷ করিডোর পেরিয়ে নিচের ক্যান্টিনে নামতেই দেখলো বাইরের বড় স্ক্রিনে তখনকার খটোমটো ডাক্তারটির হাস্যোজ্জ্বল চেহারা , নাম, পরিচয় দেখাচ্ছে। ও বিরক্ত হয়ে সেখান থেকে চলে এলো,
এই লোকের চেহারা সে দেখতে চায় না। ব্যাগে ফোন বাজছে। প্রত্যাশা ধরলো না। বসন্ত বরণ অনুষ্ঠানে
সব বান্ধবীরা একসাথে ঘুরবে বলে
ঠিক করেছিলো। কিন্তু ভাবির এই অবস্থা আর
ভাইঝির প্রতি অসীম মমতা ছেড়ে প্রত্যাশা কোথাও যেতে রাজি না। বসন্তের এই উষ্ণ দিনে এতবড় উপহার ওর সব আনন্দ যেন বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে!

____________

হসপিটালে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা সাতটা
বেজে গেলো প্রত্যয়ের। ছোট্ট তোয়ালেতে মোড়া
শিশুটি হাত-পা নেড়ে চিৎকার করে কাঁদছে। পুরো পৃথিবীকে জানান দিচ্ছে যেন তার আগমন। প্রত্যয়কে দেখেই মুশফিকা চৌধুরী পুত্রকে কাছে ডাকলেন। এগিয়ে ধরলেন নাতনিকে। কম্পিত হাতে বাচ্চাটিকে কোলে নিতেই কেমন কেঁপে ওঠলো প্রত্যয়। এক
অদ্ভুত অনুভূতিতে হৃদযন্ত্রটা থমকে গেছে যেন।
মেয়েটা কার মতো দেখতে হয়েছে সেটা ঠিক বুঝতে পারছে না। নিজের মতো নাকি সিরাতের মতো? মুশফিকা চৌধুরীছেলেকে বললেন নাতনি তার
ছেলের মতোই হয়েছে! প্রত্যয় শুনে ভ্রু কুঁচকালো,
মেয়ে মায়ের মতো হলেই তো ভালো ছিলো! দুটোকে দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যেতো! প্রত্যাশা এসে ছোট্ট তোয়ালেতে মুড়ানো বাচ্চাটাকে ছো মেরে নিয়ে
নার্সের কোলে দিয়ে ভাইকে বলল,
‘ভাইয়া, তুমি গিয়ে বেডে শুয়ে থাকো। হার্ট-অ্যাটাক করে ফেলবে মনে হয়।’
প্রত্যয় চোখ রাঙালো বোনকে। কিন্তু এরপরই মেয়ের দিকে তাকাতেই নিজেকে শান্ত করে নিলো সে। বাবা হয়ে গেছে সে৷ এখন আর আগের মতো কিছু করা
যাবে না। নিজেকে সংযত করে প্রত্যয় ঢোক গিলে বলল,
‘সিরাতের অবস্থা কী? সুস্থ তো?’
‘সি-সেকশনের প্রয়োজন হয়নি, কালকেই বাড়ি
যেতে পারবে।’
প্রত্যয় ত্রস্ত পায়ে কেবিনের দিকে এগিয়ে গেলো। মৃদু আলোয় দেখলো সিরাত ঘুমিয়ে। চোখেমুখে ক্লান্তি লেপ্টে আছে। প্রত্যয় ওর মাথার কাছে টুল টেনে গিয়ে বসলো। চুমু খেলো ঘুমন্ত চোখের পাতায়! নড়েচড়ে ওঠে চোখ খুললো সিরাত। ওকে চোখের সামনে দেখেই তখুনি কেঁদে ওঠলো,
‘এতদিন তো বাচ্চাকে প্রথম আপনি কোলে নেবেন
বলে কত নাটকই না করলেন! আর আজ এতক্ষণে আপনার আসার সময় হয়েছে? বাচ্চার বয়স তো আট ঘন্টা পেরিয়ে গেলো! সবাই কোলে নিয়েছে, আপনি ছাড়া!’
প্রত্যয় ওর অভিযোগ শুনে হেসে ফেললো,
‘ফার্স্ট হতে গিয়ে লাস্ট হয়েছি। আফসোসটা রয়েই গেলো। যাইহোক, পরেরবার আর ভুল হবে না….’
প্রত্যয় চোখ টিপলো। সিরাত ক্ষুদ্ধ নয়নে
তাকাতেই বলল,
‘আমাকে বাবা বানিয়ে দেওয়ার জন্য এক
আকাশ ভালোবাসা মানবতার মাতা!’
সিরাতের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠলো! তখনি কেবিনের দরজার ফাঁক দিয়ে গাল ফুলিয়ে
তাকিয়ে থাকা সোহাকে দেখা গেলো। প্রত্যয় গিয়ে
ওকে কোলে তুলে নিতেই দেখলো বাচ্চাটার গাল ভেজা। অবাক হয়ে সে প্রশ্ন করলো,
‘কে বকেছে?’
সোহা দু-হাত দিয়ে চোখ মুছে বলল,
‘কেউ না।’
সিরাত হয়তো ওর মনোভাব বুঝতে পারলো। সেজন্য কাছে ডেকে বলল,
‘মায়ের কাছে আসো।’
সোহা এবার কেঁদে ফুঁপিয়ে ওঠল,
‘তোমাল বাবু আচে৷ আমাকে আদল কলবে না আর। তাইনা? আমি জানি!’
প্রত্যয় ওর গালে চুমু খেলো,
‘সবার আগে সোহাবাচ্চা আদর পাবে, এরপর বাকিসবাই? ঠিক আছে সোনা?’
সিরাতও হেসে ওকে নিজের কাছে বসিয়ে
মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘ওটা তো বোন হয় তোমার। বোন তোমার আদর চায়, ভালোবাসা চায়। দিবে না তুমি?’
সোহা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এরপর গালে হাত রেখে ভাবুক গলায় বলল,
‘দিবো। তোমলা আমাকে আদল দিলে আমি বুনকে আদল দিবো। টিক আছে?’
সিরাত আর প্রত্যয় একসাথে হেসে ফেললো,
‘জো হুকুম!’

________________

রাত এগারো টা। প্রত্যয় ঘরে এসে দেখলো
সিরাতের দু-পাশে তার দু’মেয়ে ঘুমাচ্ছে। তিনজনের ঘুমন্ত চেহারাই নিষ্পাপ! সোহা এখন এখানেই
থাকে। প্রত্যয়ই নিয়ে এসেছে ওকে।
মৃদু হলদেটে আলোয় বেশ সুন্দর দেখাচ্ছিলো। কিছুক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে দৃশ্যটুকু অবলোকন করার পর প্রত্যয়ের হঠাৎ মন বিষন্ন হয়ে গেলো। এই দুই মেয়ের চক্করে বউকে সে কাছে পায় না। তবে আজ এক বুদ্ধি খেলে গেলো মাথায়। দুই মেয়েকে একপাশে সরিয়ে দিলো সাবধানে। এরপর নিজে এসে শুয়ে পড়লো বউয়ের পাশে। পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘোর লাগা কন্ঠে বলল,
‘এতদিনে আমার ঘরটা পূর্ণ হলো।’
সিরাত ওঠে গেলো। প্রত্যয়ের কান্ড দেখে
হতবাক হয়ে বলল,
‘বোধবুদ্ধি লোপ পেয়েছে? আপনি এখানে কি করেন?’
প্রত্যয় অভিমানী গলায় বলল,
‘পেয়েছে। আমাকে সবসময় দূরে রাখো কেন?
ওদের মতো আমিও তোমায় বুকে নিয়ে ঘুমাতে চাই, বুঝো না কেন?’
সিরাত কটাক্ষ করে বলল,
‘বুইড়া বয়সে ভিমরতি ধরেছে নাকি? সরুন তো! ছোটটার ঘুম ভাঙলে শেষ! চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করবে!’
প্রত্যয় শুনেই শক্ত করে ওকে জাপ্টে ধরলো,
‘করুক। আমিও আজ তোমাকে নিয়েই ঘুমাবো।’
‘আরে কি বাচ্চামো শুরু করেছেন?’
প্রত্যয় অন্যরকম স্বরে বলল,
‘স্বামীর জন্য দয়ামায়া নেই? অভুক্ত, তৃষ্ণার্ত,
পিপার্সাত, পানিপ্রার্থী আমি। একটু তো বুঝো। কাছে আসো মেয়ে!’
সিরাত লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। ওর মুখ চেপে
ধরে কম্পিত কণ্ঠে শুধালো,
‘বাচ্চাগুলো ওঠে যাবে।’
‘ওঠবে না।’
প্রত্যয় নিচু কন্ঠে বলতেই লাজুকলতা মুখ
গুঁজলো ওর বুকে। কেঁপে ওঠে হৃদযন্ত্র, নিঃশ্বাসের গাঢ় অনুভূতি মিলিয়ে যায় নিঃস্তব্ধ রাত্রিতে!
এরপর, এরপর! সীমাহীন প্রেম আর ভালোবাসায় কেটে যেতে লাগলো সময়, দিন, মাস, বছর!

[ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]

_______সমাপ্ত___

গোলকধাঁধা পর্ব-১৫

0

#গোলকধাঁধা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৫

কি যদি হলো! সিরাতের রাগটাগ গলে একদম পানি হয়ে গেলো। কথাগুলো নাটকীয় মনে হলেও প্রত্যয়ের চোখের দৃষ্টিতে সে মিথ্যে কিছু দেখলো না। বরংচ খুঁজে পেলো আকুলতা!

সিরাত বারান্দায় দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি দূরে। আকাশে আজ রোদ নেই। চারদিকে কেমন বিষন্ন ভাব। তেমনি সিরাতেরও! হাজারো চিন্তায় মশগুল মস্তিষ্কটা যেন
খুব ক্লান্ত। আজ খুব করে বাইরে যেতে মন চাচ্ছে, ঘুরাফেরা করতে ইচ্ছে করছে। ইতস্তত করে
মিনারাকে গিয়ে জানালো নিজের ইচ্ছের কথা।
কিন্তু মা-দাদীর থেকে মুখ ঝামটা ছাড়া আরকিছুই পেলো না। দাদী ধমকের সুরে বলল,
‘এই ঝড়বৃষ্টির দিনে অত গুরাগুরি কি লো? কু-বাতাস লাগবো শরীলও। বইয়া থাক ঘরে দরজা-বাড়ি
লাগায়া। পোয়াতি মাইয়াগো অহন অত রঙ করনের সময় না।’
মিনারাও শ্বাশুড়ির কথায় সায় জানালেন। বাবার দিকে আশা নিয়ে তাকিয়েও লাভ হলো না। শিমুল সাহেব পত্রিকাতে চোখ বুলাতে বুলাতে বললেন,
‘জেদ করিস না মা। এখন যাওয়ার কোনো সময় না।’
দাদী বললেন,
‘নাতজামাইয়ের অনুমতি ছাড়া পোয়াতি মাইয়া কই যাবি তুই? কিছু হইলে তো আমাগো ছাড়বো না তোর নেতা জামাই।’
সিরাতের ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে করলো। বেজার মুখ করে ঘরে চলে এলো। কোথাও শান্তি পাচ্ছে না। মন খারাপ করে বসে রইলো অনেকক্ষণ। ঘোর ভাঙলো আচমকা একটি কান্ডে। ঠোঁটের হাসিটাও চওড়া হলো তখুনি। পেটের ভিতর নড়চড় করা অস্তিত্বটা যেন ওর ভাবনাগুলোকে পালটে দিলো এক লহমায়। আসলেই তো! এত সুন্দর বাবা হওয়ার অনুভূতিগুলো থেকে সে সত্যিই বঞ্চিত করছে প্রত্যয়কে! কিছু মুহূর্ত গভীর চিন্তায় ডুব দিয়ে ফোনটা হাতে নিলো। আনব্লক করলো সে প্রত্যয়কে। সেদিন মানুষটার আকুলতা টের পেলেও ‘হা’ ‘না’ কিছুই বলে নি। কিন্তু এখন মা – দাদীর মুখ ঝামটা খেয়ে একমাত্র নিজের আপন বলতে ওই মানুষটাকেই মনে হলো ওর! সিরাত কল করলো ওর ভালোবাসার পুরুষটিকে, যাকে সে দিনের পর দিন অভিমান করে দূরে সরিয়ে রেখেছে! মন শক্ত করে কল করলো ও প্রত্যয়কে। দু’বারের মাথায় রিসিভ হলো। তবে ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ইতস্তত করে ক্ষীণ স্বরে বলল,
‘আমার বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে। এখুনি, এই
মুহূর্তে।’
ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রত্যয়ের চমকিত
স্বর শোনা গেলো,
‘আমি আসছি এক্ষুনি।’
‘বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে!’
‘আমার বউ তার ইচ্ছে আমাকে জানিয়েছে,
বৃষ্টিকে ভয় পাই না-কি আমি? উহু, তা নয়। আজ যত ঝড়বৃষ্টিই হোক না কেন ঘরণির মনের ইচ্ছে অবশ্যই পূরণ করবে তার বর।’
প্রত্যয়ের বলা কথাগুলো ঝড়ো হাওয়ার বেগে হৃদয়ে নাড়া দিলো। সিরাতের কপালের ভাঁজ নরম হয়ে এলো। মন খারাপ ভাবটা নিমিষেই হারিয়ে গেলো ধোঁয়াশায়!এই পুরুষটি কীভাবে ওর মন ভালো করে দিতে পারলো দু-তিনটা শব্দতে? নিজের পুরুষ বলেই কি?
সিরাত তৈরি হলো, তবে আয়নায় অপলক নিজের দিকে তাকিয়েই রইলো। ইদানীং একটু মেদ বেড়েছে, দেখতে কেমন অচেনা মনে হয় নিজের কাছে নিজেকেই! ওর লজ্জা লাগলো কেমন যেন তাই সাজগোজটা একদমই করলো না। ঘন্টাখানিক পর ম্যাসেজ এলো ফোনে,
“এই বউ! দ্রুত কিন্তু সাবধানে আসবে।
নিচে আছি।”
সিরাত হেসে ফেললো। এই লোকটা আজকাল প্রায়ই তাকে “বউ” বলে ডাকে। ব্যাগটা নিয়ে ঘর থেকে বেরুতেই মিনারা অবাক হয়ে বললেন,
‘কই যাস এখন?’
সিরাত গায়ে মাখলো না কথা। মা-বাবা, দাদীর ওপর অভিমানে গাল ভারী হয়ে আছে ওর। কিছুটা
অন্যরকম সুরেই বলল,
‘আমি আমার বরের সাথে ঘুরতে যাচ্ছি। আশা করি এবার আর তোমাদের সমস্যা হবার কথা নয়।’
মিনারা অবাক হয়ে বললেন,
‘পাগল হলি? একটা চড় মারবো বেয়াদব! জামাই এসেছে নাকি?’
‘হুম, নিচে অপেক্ষা করছে। আমাকে নিয়ে
বাইরে যাবে।’
মিনারা শাসনের সুরে বললেন,
‘নিশ্চয়ই তুই জেদ করেছিস! আরে বাইরে
আকাশের কি অবস্থা দেখছিস না? জামাইকে বল
ঘরে আসতে। কত সময় পরে আছে ঘুরাফেরার,
এখনি যাওয়ার কি আছে?’
সিরাত মুখ গোঁজ করে বলল,
‘কারণ আমার এখুনি ইচ্ছে করছে, পরে না!’
মিনারা আটকাতে চাইলেও শিমুল সাহেব ইশারায় তাকে বারণ করলেন। ইদানীং বড্ড জেদ করছে মেয়েটা। সিরাত নামতেই দেখলো প্রত্যয় গাড়ির
সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কানে ফোন। ওকে দেখে ফোন কেটে এগিয়ে এসে বলল,
‘কোথায় যাবে?’
সিরাত জানে না সে কোথায় যাবে। চিন্তাও করেনি। শুধু এই অদ্ভুত সুন্দর বিকেলটা ঘরে কাটাতে ইচ্ছে করছিলো না বলেই বাইরে বেরুনো। খানিকটা রুষ্ট গলায় ও বলল,
‘জানি না।’
প্রত্যয় এহেন কথা শোনে নি আর। নিজেই বললো যেতে চায়, এখন বলছে জানে না? অদ্ভুত! এক মুহূর্ত চেয়ে থেকে এরপর ভ্রু কুঁচকালো,
‘তাহলে?’
সিরাত ভড়কে যাওয়া কন্ঠে বলল,
‘আপনি এত প্রশ্ন করছেন কেন? ডেকে
অপরাধ করে ফেললাম নাকি? এমনি এমনি
কোথাও যেতে চাই।’
প্রত্যয় ওর বোকামি বুঝে হেসে ফেললো। সিরাত গম্ভীর মুখভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে ওকে দেখে মুখ ভেঙচালো। প্রত্যয় সরু গলায় বলল,
‘চলো।’
সিরাত বিস্ময় প্রকাশ করলো,
‘কোথায়?’
‘এমনি এমনি জায়গায়, চলো নিয়ে যাই।’
প্রত্যয়ের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি। সিরাত গাড়িতে এসে বসলো। প্রত্যয় গাড়ি স্টার্ট করলো। সিরাতের কান্ড কীর্তি ওর মজা লাগছে। আনমনে বলে ফেললো,
‘প্রেগন্যান্ট মায়েদের যে অমন অদ্ভুত অদ্ভুত ইচ্ছে হয়, তা দেখার জন্য হলেও প্রতি বছর তোমার প্রেগন্যান্ট হওয়া উচিৎ!’
সিরাতের লজ্জায়, বিস্ময়ে, রাগে চোখ ফেটে জল
গড়িয়ে পড়লো দু-ফোঁটা। প্রত্যয় ওর অদ্ভুত আচরণে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! কি এমন বললো সে? মজা করেই তো কথাটা বলেছে, তার বউ এসব ছোটখাটো মজা কবে থেকে সিরিয়াসলি নেওয়া শুরু করেছে? ও এবার গাড়ি থামালো। গলা ঝাড়া দিয়ে বলল,
‘আমি মজা করে বলেছি।’
সিরাত রেগে বলল,
‘আমাকে অপমান করেই তো মজা পান। আমি ভুল ছিলাম। সত্যিই আপনি আগের মতোই আছেন,
একটুও বদলান নি!’
‘আরে বাবা, মজাও করতে পারবো না?’
‘না। যারা বউকে অপমান করে সুখ পায়, তাদের মজা করার অধিকার নেই।’
প্রত্যয় ওর হাতদুটো নিজের মুঠোয় নিলো।
এরপর ব্যাকুল স্বরে বলল,
‘অপমানও করিনি, সুখও পাইনি। আমার বউ কাঁদবে আমি এরকম কোনোকিছুই ইন্টেনশনালি করতে চাইনি। আচ্ছা আর কখনো এরকম বলবো না। তুমি মানো না তবে আমাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তোমাকে অপমান করা মানেই তো আমার অপমান। আর নিজেকে নিজে কে অপমানিত করে? বোকারা! আমি কি বোকা?’
সিরাত নিশ্চুপ। রাগ কমেছে। পেটের মধ্যে
কেমন ছুঁচো দৌঁড়াচ্ছে!প্রত্যয় একবার দেখে ওর
গাল মুছে দিয়ে এরপর বলল,
‘এই মেয়ে, কাঁদবে না। দেখো তোমার কান্না দেখে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে।’
‘হোক।’
‘তবে আমাকে ডাকলে কেন?’
সিরাত নাক টানলো। কান্নাকাটি বন্ধ করে বলল,
‘স্বামী হন যে তাই।’
প্রত্যয় টুপ করে গালে চুমু খেলো। সিরাত অবাক হয়ে বলল,
‘আপনি ইদানীং মুভি-টুভি বেশি দেখছেন তাইনা?’
প্রত্যয় হতাশ হয়ে বলল,
‘কি আর করবো বলো? রাতটা কাটাতে হবে তো! মুভি-সিরিজ ছাড়া আর কি আছে বলো? প্রেমিকা তো নেই যে, প্রেম করবো! আর বউ তো দূরদূর করে কবেই তাড়িয়ে দিয়েছে।’
সিরাত চোখ পাকিয়ে তাকালো,
‘এই আপনি কিসব দেখেন বলুন তো? একটু বেশি আদর-আহ্লাদ দেখাচ্ছেন! কোথা থেকে শিখলেন!’
প্রত্যয় বউয়ের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে ফেললো।
অতঃপর কথার মানেটা বুঝতে পেরে ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দিয়ে জোরালো শব্দে হেসে ওঠলো,
‘ওহ নো!’
সিরাত সেই হাসির শব্দে কেঁপে ওঠলো। সেইসাথে রাগও হলো ওর। কত নির্লজ্জ এই মানুষটা! আর
কথাই বলবে না সে। বাইরে তখন সন্ধ্যে নেমেছে। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি ঝরছে টুপটাপ। পিচঢালা রাস্তা ভিজে গাঢ় কালচে রঙ ধারণ করেছে। মৃদুমন্দ ঠান্ডা বাতাস। মানুষজন কম। দোকানপাট, রেস্টুরেন্টেও তেমন ভিড় নেই। সিরাতের পেট ক্ষিধেয় চো চো করছে। কিন্তু বলতে পারছে না সে প্রত্যয়কে। এদিকে বউয়ের মান-অভিমান ভাঙানোর চক্করে অন্যদিকে মনোযোগ নেই ওর। শুধু ব্যাকুল গলায় নিজের মনের
কথাগুলো বলে চলেছে। সিরাত একটা সময় ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
‘কিছু খাবো।’
প্রত্যয় বোকার মতো তাকিয়ে রইলো। কথাটা বুঝতেই সময় লাগলো একটু। এতক্ষণ যাবৎ বউটা বাইরে, না খেয়ে আছে আর ও কি-না খেয়ালই করেনি? আহাম্মক সে! তবে মনেমনে একটু খুশিও হলো প্রত্যয়, সিরাত স্বাভাবিকভাবেই ওর কাছে নিজের
ক্ষিধের কথা জানিয়েছে বলে। রাস্তার ওপাশে বিশাল এক চাইনিজ রেস্তোরাঁর লটে গাড়ি থামালো
প্রত্যয়। জিজ্ঞেস করলো ওখানে যেতে চায় কি-না সিরাত। কিন্তু ও যেতে চাইলো না। প্রত্যয় ছাতা হাতে বেরিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘কি খেতে চাও? বলো আমায়।’
সিরাত চারপাশের পরিস্থিতি এবং আবহাওয়া দেখে ভাবলো বৃষ্টিভেজা পরিবেশে গরম গরম চা-বিস্কুট খাওয়ার মজাই আলাদা। সেজন্য বলল,
‘চা-বিস্কুট।’
প্রত্যয় অবাক গলায় বলল,
‘এসব কোনো খাবার হলো? পেট ভরবে নাকি? অন্যকিছু বলো, ভারী খাবার।’
সিরাত বিরক্ত হলো,
‘আনতে হবে না। আমাকে বাড়ি দিয়ে আসুন।’
‘এক্ষুণি যাচ্ছি।’
বলে দ্রুত পায়ে চলে গেলো কাছের একটা ক্যাফে’তে।
সিরাত ওর যাওয়া দেখলো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এলো। সিরাত দরজা খুলে দিতেই ভেতরে এসে বসলো। হাতে চায়ের ফ্ল্যাক্স আর দু-তিন রকমের কুকিজের প্যাকেট। সিরাত বিস্মিত হলো,
‘একি! চা খাবো বলেছি, এতোটাও নয় যে ফ্ল্যাক্সে
করে আনতে হবে।’
প্রত্যয় ধমকে ওঠলো,
‘তোমাকে এত ভাবতে হবে না। খেতে চেয়েছো এনে দিয়েছি, আবার কথা কীসের?’
‘আপনি আসলেই একটা যা-তা।’
প্রত্যয় কানে তুললো না ওর কথা। ওয়ান টাইম
কাপে চা ঢেলে এগিয়ে দিলো সিরাতের দিকে। প্যাকেট থেকে কুকিজ বের করে বলল,
‘নাও।’
সিরাত কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল,
‘আপনি খান।’
‘নিজেরটা খাও, পরে বাকিসব।’
এরপরই ওর খাওয়া দেখে কৌতূহলী গলায় জিজ্ঞেস করলো,
‘আচ্ছা, শুনো! ইয়ে মানে…’
‘কী?’
প্রত্যয় ইতস্তত করলো একটু,
‘মানে আমার বাচ্চাটা তোমার চায়ে ভাগ বসালে তোমার রাগ হবে না?’
বোকার মতো প্রশ্ন শুনে সিরাত চোখ রাঙালো,
‘শুধু চা না, আমার সবকিছুতেই আপনার বাচ্চা ভাগ বসায়। আমি আর কি করবো! বাচ্চার বাপকে…’
প্রত্যয়ের মুখে আঁধার নেমে এলো,
‘গালাগাল দিয়ে উদ্ধার করো!’
‘ঠিক তাই।’
সিরাত মুখ শক্ত করে বললো। প্রত্যয় গাড়ি ঘুরিয়ে
নিলো। এরপর ফোন দিলো কাউকে। সিরাত দেখলো ওকে; কথা শুনে মনে হলো মায়ের সাথে কথা বলছে। সিরাত খানিকটা বিস্মিত হলো যখন শুনলো ও
এখন শ্বশুরবাড়ি যাবে! ও আঁৎকে ওঠল,
‘এ মা! আমি ওখানে যাবো না। বাড়ি দিয়ে আসুন প্লিজ।’
প্রত্যয় ফোন রেখে বলল,
‘তা আর হচ্ছে না আমার ঘরণি। এই গুল্টুমুল্টু বউ
ছাড়া আর একদিনও চলবে না আমার। নির্ঘাৎ মৃত্যু হবে বউ-বাচ্চার অনাহারে থাকতে থাকতে।’
সিরাত অনুনয় করলো,
‘না আমি যাবো না। লজ্জা করে আমার। এভাবে ওনাদের সামনে ঘুরাঘুরি করতে…’
প্রত্যয় এহেন কথায় বড্ড হাসলো,
‘করুক লজ্জা।’
‘আপনি কিন্তু ঠিক করছেন না।’
প্রত্যয় এবার কঠিন হলো। ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যেই সে কিছু অবান্তর কথা বলল,
‘সতীন আনলে ঠিক হবে তাইনা? শ’য়তান এমনিই আমাদের মাঝে ঢুকে বসে আছে। সুযোগ পেলেই মাথায় চড়বে। যেমন এখন তোমার মাথায় চড়ে আছে। আস্কারা দিলেই দেখবে তোমার স্বামী বিয়ে করে মাসনা নিয়ে এসেছে।’

সিরাত হতবাক হয়ে গেলো। খারাপ হোক, ভালো হোক তবুও স্বামীই তো। সতীনের সাথে স্বামীর ভাগাভাগি করার মতো এতটা দয়ালুও সে নয়। এমনিতেই নেতা পেতার আশেপাশে মেয়ের অভাব হয় না, দারুণ সুন্দরীও বটে তারা! তুলনা করলে এরমধ্যে সিরাত আর এহেন কি সুন্দরী? স্বামী যাতে পরনারীতে আসক্ত না হওয়ার সুযোগ পায় সেজন্যই সিরাত আর কথা বাড়ালো না। শ্বশুরবাড়িতে ফিরে এলো। মুশফিকা চৌধুরী বেশ আয়েশ করে বৌমাকে বরণ করলেন। খুশি যেন তার আর ধরে না! সিরাতকে নিয়ে ওর ঘরে এলেন, হাতের কাছে প্রয়োজনীয় সব গুছিয়ে দিলেন। অনাগত নাতিনাতনির জন্য কি কি শপিং করেছেন সব দেখাচ্ছে উৎফুল্ল মনে। সিরাত অবাক হলো। এরকম ভালোবাসা যেন ও নতুন পাচ্ছে। প্রত্যাশাও তাল মিলিয়ে ভাবীকে এতদিনের গল্পসল্প করছে। সংসারের মানেটা যেন হুট করে দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল হয়ে ওঠলো সিরাতের মন-মস্তিষ্কে।

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ]

চলবে….