লজ্জাবতী পর্ব-০২

0
265

#লজ্জাবতী
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব-০২

কুয়াশাচ্ছন্ন সুন্দর সকাল। জানালার পর্দা ভেদ করে, মিঠা রোদ আমার সারা মুখে লুটোপুটি খাচ্ছে। ভেবেছিলাম ঘুম জড়ানো চোখ মেলে, প্রথমেই আমার নতুন বউয়ের কোমল মুখখানি দেখব! কিন্তু না মহারানী ঘরে নেই। কী জানি কোথায় গেল! নতুন বউ একা একা, টো টো করে সারাবাড়ি ঘুরে বেড়ালে, লোকে মন্দ বলবে! সেই বোধটাই আমার বউয়ের মাথায় নেই। কাল প্রায় অর্ধেক রাত জেগে, এই বাড়ির মানুষজন কে কেমন, কোথায় কোন কথা বলতে হবে, খুব সংক্ষেপে ধারণা দিয়েছি। তখন তো খুব পণ্ডিতের মতো মাথা ঝাঁকাল। ভোর হতেই ঘুমের সাথে সব ভুলে গুলে খেয়েছে।
বাইরের উঠান থেকে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমি ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলাম। পরনের পাঞ্জাবি খুলে একটা হাফহাতা ছাপার গেঞ্জি গায়ে জড়িয়ে নিলাম। আয়নার একপলক নিজেকে দেখে, তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলাম।

অনুপমদের উঠানের একপাশে, পাঁকা শানবাঁধানো পুকুরের পাড় ঘেঁষে, বিশাল বরইগাছ। সবগুলো বরই পেঁকে পুকুরের জলে টপটপিয়ে ঝরে পরে। সেই গাছের মগডালে মাধু বসে বসে, মনের সুখে পাঁকা বরই ছিঁড়ে শাড়ির আঁচলে ভরছে। নীচে অনুপমের মা, বোন, কাকীমা, মামী, সবাই একজোট হয়ে মাধুকে গাছ থেকে নামতে বলছে। তাদের চেঁচামেচির শব্দে এতক্ষণে বাড়ির সব মানুষ, আত্মীয়- স্বজন পুকুরপাড়ে এসে জড়ো হয়েছে। সবাই অদ্ভুত চোখে, মাধুকে দেখছে! কেউ কেউ ফিসফাস করছে। একসাথে এত মানুষ দেখে, মাধু খুব ভয় পেয়ে গেছে। গাছ থেকে নামার সাহস পাচ্ছে না। অনুপমের মা রেণুবালা দেবী ছেলেকে দেখে এগিয়ে গেল। রাগী অথচ চাপা কণ্ঠে বলল,
-‘তোরা বাপ-ছেলে মিলে এ’কাকে বাড়ির বউ করে নিয়ে আসলি, বড়খোকা? নতুন বউ। বিয়ের দুদিনও পার হয়নি। লোক-লজ্জার মাথা খেয়ে, ব্যাটা ছেলেদের মতো তড়তড়িয়ে গাছে উঠে বরই পাড়ছে। লোকে তোর বউয়ের কাণ্ড দেখে, হাসছে। ছিঃ..
আমার মাথা গরম হওয়ার আগে তোর বউকে গাছ থেকে নামতে বল?
অনুপম শুকনো ঢোক গিলল। মাকে দেখে, সেই ছোটবেলা থেকেই অনুপম ভয় পায়। বলতে লজ্জা নেই, এখনো অনুপমের ছোট ভাই-বোন ভুল করলে, মা ঠাস ঠাস চড় মেরে দেয় গালে, পিঠে।
রিধীকা , অনুপমের পাশে এসে দাঁড়াল। অনুপম নীচু কণ্ঠে বলল,
-‘ঘটনা কী বলতো? মাধু সাত-সকালে বরই গাছে উঠেছে কেন?
রিধীকা ফিসফিস করে বলল,
-‘বৌদিমণি ঘুম থেকে উঠেই রান্নাঘরে ঢুকেছিল। তার না কী খুব জল তৃষ্ণা পেয়েছে। মা এক ধমকে বৌদিমণিকে রান্নাঘর থেকে বের করে দিয়েছে। বলেছে,
-‘তোমার লজ্জা করে না বড়বৌমা। সকাল বেলা স্নান না করে, বাঁশি কাপড়ে রান্নাঘরে ঢুকতে? যাও এক্ষুণি পুকুরপাড় থেকে স্নান সেরে আসো।
তারপর মা আমাকে ডেকে বৌদিমণির সাথে পাঠাল। বৌদিমণি বরই গাছ দেখে, এক লাফে, তড়তড়িয়ে গাছে উঠে গেল। আমি কত মানা করলাম! শুনল না। উল্টো ইশারায় আমাকে চুপ থাকলে বলে, তাড়াহুড়ো করে বরই ছিঁড়তে লাগল। বৌদিমণির গাছে উঠে বরই ছিঁড়ার দৃশ্য বিন্দুমাসি দেখে ফেলল, রামো…রামো, এ আমি কী দেখিলাম? বলেই মাকে খবরখানা দিতে গেল।
অনুপম বলল,
-‘তুই শিগগিরই গিয়ে বাবাকে ডেকে নিয়ে আয়! পরিস্থিতি জটিল হয়ে গেছে। একমাত্র বাবা ছাড়া এখন কাউকেই সামাল দিতে পারব না। বাবা যে বেছে বেছে এই ঝাঁঝের রাণীকেই কেন বিয়ে করেছিল, কে জানে! সব সময় ছোট ব্যপার গুলো চিৎকার চেঁচামেচি করে বড় করে ফেলে।
অনুপমের বাবা নিখিলেশ চ্যাটার্জী এসেই দশ মিনিটের ভেতর, সবাইকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে অন্দরমহলে নিয়ে গেল। এই পাশটা ফাঁকা হতেই অনুপম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মাধু তখনো ভয়ে গুটিশুটি মেরে গাছের মগডালে চুপটি করে বসে আছে। অনুপম আদুরে কণ্ঠে আস্তে করে বলল,
-‘মাধু…? ধীরে ধীরে গাছ থেকে নেমে আসো?
মাধু উঁচু ডাল থেকে লাফ দিয়ে নামল। বরই কাঁটার ঘঁষায় হাতের বেশকিছু জায়গা ছিঁলে গেছে। অনুপম, মাধুর কাঁটা জায়গায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-‘এটা বাবার বাড়ি না মাধু। এখানে তথাকথিত নিয়মের বাইরে চললেই তেমাকে কটুকথা শুনতে হবে। কী দরকার ছিল, সাত-সকালে বরই গাছে উঠার?
-‘ধেৎ চুপ করুণ তো। আমার মাও সারাক্ষণ আমার সাথে রাগারাগি করে, কথা না শুনলে গায়ে হাত তোলে। এগুলো এত ধরলে হয় না। একটাই তো জীবন আমাদের। সবার সব কথা শুনে শুনে একজীবন পাড় করে দেব না কী? মাঝে মাঝে নিজের মনের কথাও শুনতে হয়।
অনুপম বিড়বিড় করে বলল,
-‘বয়স কম হলে কী হবে! বেশ বোধ-বুদ্ধিও আছে দেখছি!
রিধীকা বলল,
-‘বড়দাভাই.. তোরা দুজন বরং স্নান সেরে নে। আমি প্রাইভেট পড়তে যাব। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
-‘ঠিকাছে। তুই বরং আমার লুঙ্গি, গামছা আর সাবানটা দিয়ে যাস।
রিধীকা যেতে যেতে বলল,
-‘সে দেবক্ষণ!

মাধবীলতা নূপুর পরা পায়ে, রিমিঝিমি শব্দ তুলে, সিঁড়ি দিয়ে হাঁটু জলে নেমে গেল। অনুপম গায়ের গেঞ্জিটা একটানে খুলে ফেলল। মাধবীলতা সাঁতার কাটতে কাটতে বেখেয়ালে অনুপমের দিকে তাকাল।
অনুপম দেখতে বেশ লম্বাচওড়া, ফর্সা বুকে ছোট ছোট কালো লোম, মেদহীন পেটানো শরীর, মাথার ঘন কালো চুলগুলো স্টাইল করে ছেটে রাখা, ফর্সা গালের বামপাশে একটা গর্তমতো কাঁটা দাগ, সুন্দর চোখ, মুখ। একমুঠ মিঠারোদ অনুপমের গায়ে লুটোপুটি খাচ্ছে। সম্পূর্ণ খালি গায়ে অনুপমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, মাধবীলতার কেমন যেন লাগল। চোখ নামিয়ে নিল। বেহায়া দু’চোখ বেশিক্ষণ সামলে রাখতে পারল কই? আবারও খুব সাবধানে অনুপমের সারাশরীর ঘুরে এলো। কিশোরীর বাঁধভাঙা প্রথম প্রেম বুঝি এসেই গেল! মাধু চোখ ফিরিয়ে নিল। আনমনে সাঁতার কাটতে কাটতে শাড়ি পেঁচিয়ে গেল। ব্লাউজের সাথে কানের দুলের আংটা আটকে গেল।
মাধুকে গলা জলে ছটফট করতে দেখে,
অনুপম জলে নেমে একহাত বাড়িয়ে দিল। মাধু মাথা নীচু করে ফেলল। অনুপমের হাতে মৃদু কাঁপা হাত রাখল। অনুপম, মাধুর খুব কাছে চলে এলো। মাধুর ঘাড়ে অনুপমের উত্তপ্ত একেকটা গরম নিঃশ্বাস জোয়ারের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পরছে। অজানা সুখ সুখ অনুভূতিতে মাধুর দেহ, মন একটু একটু করে বিবশ হয়ে এলো। অনুপম, মাধুর কানের দুলের আংটা খুব যত্ন করে ছাড়িয়ে দিল। অনুপমের পুরুষালি স্পর্শে মাধু তিরতির করে কাঁপছে। অনুপম ঘোর লাগা দৃষ্টি মেলে, তার ‘প্রিয়তমার’ দিকে বড় আগ্রহ নিয়ে তাকাল। আবেগী কণ্ঠে বলল,
-‘এই ভেঁজা কাপড়ে তোমাকে দেখতে, একটু বেশিই সুন্দর লাগছে মাধু। আজ থেকে, তোমার স্নান করার জন্য এই পুকুর নিষিদ্ধ। আমি চাই না, আমার মাধুকে আমি ব্যতীত, অন্যপুরুষ দেখুক।
মাধু দু’হাতে লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেলল।
‘ইশ’…
বুকের ভেতর বালিকার প্রথম প্রেমের দোলা দিয়ে, একঝাঁক রঙীন প্রজাপ্রতি মনের সুখে উঁড়ছে।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে