Tuesday, July 1, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 316



নীলফড়িং পর্ব-০৪

0

#ফারহানা_হাওলাদার_প্রকৃতি
#নীলফড়িং
#পর্ব ৪
.
.
এভাবেই দিন গুলো চলতে লাগল, দিন যায় রাত যায়, আজকাল আর রাবীত নামক অমানুষকে দেখতে হয় না। খুব ভালো করেই জীবন এগোতে লাগল। আজ আমার জন্মদিন ছিল। যেই থেকে বুঝতে শুরু করেছি সেই থেকে কখনো বার্থডে উৎযাপন করি নি। জন্মদিনের দিন, নিজের হাতে রান্না করে বাচ্চাদের খাওয়াতে বেশ লাগে আমার কাছে। এই কয়েক বছর যাবত আমি নিজের হাতে রান্না করে এতিম বাচ্চাদের বাড়িতে এনে খাওয়াই। আব্বু মা দুজনেই আমাকে এই বিষয়ে প্রচুর Help করেন। আজও তার ব্যাতিক্রম কিছু হলো না। আগের দিন আব্বু মাদ্রাসায় দাওয়াত দিয়ে আসল। আজ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে আমি মায়ের সাথে মিলে সব গোছাতে লাগলাম।

সব গুছানো শেষ করে রান্না চড়ালাম। রোস্ট, পোলাও, গরুর মাংস, একটা কেক। কেক তো আগেই বানিয়ে রেখে দিয়ে ছিলাম শুধু ডেকোরেশন বাকি। তাই বাকি রান্না গুলো এক এক করে সেরে নিলাম। মা প্রচুর সাহায্য করল।

আমি রান্না শেষ করে ১২:৩০ মিনিট এর দিকে ফ্রেশ হয়ে কেক ডেকোরেশন নিয়ে বসে পড়লাম।

কেক ডেকোরেশন শেষ করতে করতে বাচ্চারা সব এসে পড়ল। আব্বু ওদের ড্রইং রুমে শীতল পাটির উপর সুন্দর করে বিছানা বিছিয়ে সেখানে বসিয়ে দিলেন। আব্বু আর দারোয়ান আঙ্কেল দুজনে মিলে খাবার সার্ফ করল। সাথে একজন হুজুরও এসেছেন, যেহেতু বাচ্চা গুলো খুব ছোট ছোট তাই ওদের একা ছাড়ে না মাদ্রাসা থেকে।

ওরা খাবার শেষ করে বসলো। আমি কেক কেটে পিস পিস করে প্লেটে তুলে দিলাম। আব্বু এসে নিয়ে গেল। খুব ভালো লাগছে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম মা আর আমি। মনের মাঝে প্রচুর ভালো লাগা কাজ করছে। মাঝে মাঝেই এমন কিছু আমি করে ফেলি, কখনো শুক্রবার রান্নাঘরে যাই, নিজেদের জন্য রান্না করতে গিয়ে একটু বেশি করেই রান্না করে ফেলি। পড়ে বক্স ভরে নিয়ে চলে যাই, পথের পাশে অসহায় বাচ্চাদের, বা বুড়ো মানুষদের হাতে তুলে দেই সে খাবার। ইচ্ছে তো করে রোজই করি এমন কিছু না কিছু, কিন্তু কী করব? সব সময় সামর্থ থাকে না যে। কিন্তু যখনই মনে হয় কিছু করে ফেলি।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে হসপিটালে চলে এলাম। সন্ধ্যার দিকে বসে ছিলাম কিছু কাজ করছিলাম। ঠিক তখনই একজন লোক এসে বলে উঠলেন।

…….পুস্পিতা কে?

…..জ্বি আমি।

…….আপনাকে ফাইয়াজ স্যার তার ক্যাবিনে ডেকেছেন।

…….জ্বি আপনি যান আমি আসছি।

সে চলে গেল, আমি উঠে ফোনটা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলাম। ফাইয়াজ স্যারের ক্যাবিনের সামনে এসে দেখলাম অনেক পেশেন্ট বসে রয়েছে, কেউ আবার দাঁড়িয়ে আছে। আমি ক্যাবিনের সামনে গিয়ে স্যারের এসিস্ট্যান্ট কে জিজ্ঞেস করলাম।

……স্যার কী ফ্রী আছে এখন? আমাকে ডেকেছিল।

……এক মিনিট আমি জিজ্ঞেস করে দেখছি।

সে দরজা ঠেলে জিজ্ঞেস করল। এরপর এসে বলে উঠল।

……আপনাকে একটু অপেক্ষা করতে বলেছেন স্যার।

……ওকে।

আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম বারবার। এর মধ্যে এসিস্ট্যান্ট এগিয়ে এসে বলল।

…….স্যার আপনাকে ভেতরে ডেকেছেন।

আমি দরজা ঠেলে ভেতরে যেতে নিয়ে বলে উঠলাম।

……আসবো স্যার?

……হ্যা এসো।

আমি ভেতরে যেতেই স্যার বলে উঠলেন।

……..তুমি প্রচুর কিপ্টে।

…….এই কথা কেনো বলছেন স্যার?

……বসো। আমি সেই কবে তোমার কাছে এক কাপ কফি খেতে চেয়েছিলাম, বাট আজ পর্যন্ত তুমি মুখ ফুটে একদিন জিজ্ঞেস করেও দেখলে না।

…….ক্ষমা করবেন স্যার।

…….ক্ষমা চেয়ে আর কী হবে? এখন যদি আমি অফার করি যাবে তো?

…….বাট স্যার অনেক পেশেন্ট রয়েছে সিরিয়ালে।

…….হ্যা পেশেন্ট তো রোজই থাকে, তাই বলে কী কফি খাওয়া নিষেধ নাকি?

……না তা কেনো হবে? বাট এখন গেলে সবাই কী ভাববে? তার থেকে বরং কাল, কাল তো আমার ডিউটি সকালে পড়েছে, বাসায় ফেরার পথে।

…….হুম বুঝতে পারছি ইগনোর করছ?

…….নো স্যার বাট…….?

…….ওকে তবে (একটা চকলেট বক্স বের করে সামনে দিয়ে) আমি জানতাম তুমি যাবে না, তাই এটা তোমার জন্য। and happy birthday. আর এটা তো নিতেই পারো তাই-না?

…….জ্বি স্যার ধন্যবাদ।

…….আর ধন্যবাদ দিয়ে কী হবে? আচ্ছা তবে যাও।

……Sorry স্যার।

……আরে Sorry বলতে হবে না, আমি জাস্ট ফান করছিলাম। এখন বাহিরে যাওয়াটা আমার জন্যেও সহজ নয়। কারণ সত্যি অনেক পেশেন্ট রয়েছে।

…….ওকে স্যার এখন আসছি?

…….হুম যাও।

আমি স্যারের ক্যাবিন থেকে বের হয়ে চলে এলাম।

ডিউটি শেষ করে যখন বাড়ি ফিরবো হসপিটালের সামনে এসে দাঁড়াতেই দেখলাম আব্বু দাঁড়িয়ে আছেন আমার জন্য, আমাকে দেখে হাসি মুখে এগিয়ে এলেন। আব্বুর সাথে গাড়ীতে উঠে বাড়িতে চলে এলাম।

বাড়িতে এসে ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে গিয়ে বসে পড়লাম, খাবার খেতে খেতে মা বলে উঠলেন।

……তোর নামে সন্ধ্যায় একটা পার্সেল এসেছে।

…….তাই? কে পাঠিয়েছে?

……কী জানি নাম যা লেখা ছিল মনে হচ্ছে না। তোর রুমে রাখা আছে দেখে নিস।

……ওকে।

রুমে গিয়ে দেখলাম একটা লাল গোলাপ ফুলের তোরা রাখা তার সাথে একটা বক্স আমি এগিয়ে গিয়ে ফুলের মাঝ থেকে একটা খাম বের করে ছিড়ে দেখলাম, সেখানে লেখা রয়েছে।

……শুভ হোক আপনার জন্মদিন। ভালো কাটুক আগামীর পথ চলা। সব দুঃখ হারিয়ে যাক, ভালোবাসা গুলো চির স্থায়ী হোক। এই শুভ কামনাই রইলো, আপনার প্রতিটি দিন গুলোতে।

ইতি
আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী

খুব ভালো লাগছে এমন একটা শুভাকাঙ্ক্ষী পেয়ে। বাট তারপরও যে প্রচুর ভয় কাজ করছে মনে, আবার যদি কোনো ভুল কিছুকে ভালো মনে করে আপন ভেবে নেই তাই। বক্সটা হাতে নিয়ে খুলে দেখলাম, সেখানে এক জোরা নুপুর রাখা আছে খুব সুন্দর ছিল নুপুর দুটো। বিছানায় শুয়ে নুপুর জোরা দেখতে দেখতেই এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরদিন ডিউটি শেষ করে বের হতেই দেখলাম স্যার গাড়ীতে উঠতে নিয়ে যখন চোখ পড়ল আমার দিকে থেমে গেল। আমি তার সামনে গিয়ে থেমে যেতেই সে বলে উঠলেন।

…….কী ম্যাডাম আজ কী বলবেন?

……কফি চলবে?

স্যার হেঁসে দিয়ে মাথা নাড়াল। আমি গাড়ীতে উঠে বসে পড়লাম। ভাবছি স্যার এত করে বলছেন না গেলে খারাপ দেখা যায় তাই বললাম।

……আজ তবে আমার উপর দয়াটা হয়েই গেল?

……না ওই আসলে।

……ঠিক আছে সমস্যা নেই। বলেছ যে এটাই অনেক।

একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে দুজনে কফি অর্ডার করে বসে পড়লাম।

…….তা তোমার সামনে কী প্লান রয়েছে?

……আমার তেমন কোনো প্লান নেই তবে হ্যা ভাবছি বাহিরে গিয়ে পড়াশোনা কমপ্লিট করব। আমি চাই কয়েক জন নয় আমাকে লক্ষাধিক মানুষ চিনবে। তাই খুব বড় না হতে পারি ভালো একজন ডক্টর যাতে হতে পারি এই স্বপ্ন নিয়েই আমার বাকিটা পথ চলা।

…….খুব ভালো আমিও চাই যাতে তুমি তোমার স্বপ্ন গুলো কে পূরণ করতে পারো। আমার পক্ষ থেকে প্রচুর শুভকামনা রইল তোমার জন্য।

…….ধন্যবাদ স্যার।

কফি চলে এলো। দুজনে কফি শেষ করে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে আসলাম।

এভাবেই দিন গুলো চলতে শুরু করল। সময় যে কীভাবে যাচ্ছে তা বোঝার ক্ষমতা আমাদের অন্তত পক্ষে নেই। ধীরে ধীরে অনেকটা সময় পারি দিয়ে এলাম, আস্তে আস্তে কেটে গেল দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর। বাহিরে যাবার সময়’টাও খুব কাছে ঘনিয়ে এলো। সব রেডি হয়ে গেছে দু-দিন পরেই আমি রহণা দেবো। তাই আত্মীয়স্বজনরা এসে দেখা করে যাচ্ছে, আবার আমিও গিয়ে অনেকের সাথে দেখা করে আসছি।

দুপুর দিকে খাবার খেয়ে না ঘুমিয়ে ছাদের এক পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। কান্না পাচ্ছে সবাইকে ছেড়ে চলে যাবো এতদিনের জন্য? মা আব্বু কে একা রেখে পারি জমাব অচিন দেশের মাটিতে? ভয় হয় তবুও তো যেতে হবে। এমন সময় কেউ পেছন থেকে বলে উঠল।

…….চলে যাচ্ছ সবাইকে ফেলে?

আমি চোখ মুছে পেছনে তাকিয়ে দেখলাম স্যার দাঁড়িয়ে আছে, তাকে দেখে কিছুই বলতে পারছিলাম না, সে আবারও প্রশ্ন করল।

…….কী হলো কথাও বলার ইচ্ছে নেই নাকি?

……(আমি অপর দিকে ঘুরে গিয়ে) আপনিও তো গিয়েছিলেন।

……হুম গিয়েছিলাম। আমি কী বারণ করেছি তোমাকে যেতে? শুধু জিজ্ঞেস করছি। আমি কিন্তু এতটাও খারাপ নই যে তোমাকে যেতে বারণ করব। তুমি যাও আর কেউ চায় বা না চায় আমি চাই তুমি সফল হয়ে আসো। তুমি একজন ভালো ডক্টর হয়ে ফিরে আসো। তোমার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা রইল আমার পক্ষ থেকে। তোমার যেকোনো সমস্যায় আমাকে একটু স্বরণ করলেই হবে, ইন’শা’আল্লাহ আমি চেষ্টা করব তোমার পাশে থাকতে। এটা মনে রাখবে সব সময় আমি কিন্তু সেইম দেশেই ছিলাম, ওখানের অনেক কিছু সম্পর্কে আমার ধারণা রয়েছে। তাই তোমার যখন ইচ্ছে তুমি আমাকে জানাতে পারবে, আমি তোমার যথাসম্ভব সাহায্য করার চেষ্টা করব ইন’শা’আল্লাহ।

…….ধন্যবাদ স্যার, অসংখ্য ধন্যবাদ আমার সাহস বাড়ানোর জন্য। আসলে আমি নিজের উদ্দেশ্য থেকে নড়ে যাচ্ছি, আপনার কথায় কিছুটা হলেও সাহস পাচ্ছি। আর সব থেকে বড় কথা মা, আব্বু কে দেখার জন্য তো আমি ছাড়া কেউ নেই। তাদের একা রেখে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছে।

…….আচ্ছা আমি কী তোমার সেই ভরসার হাত হতে পারি?

…….জ্বি স্যার?

…….আমি যদি তোমার অ-বর্তমানে আন্টি আঙ্কেলের খেয়াল রাখি তবে কী কিছুটা হলেও তোমার কষ্ট কম হবে?

…….একটু না স্যার অনেক কম হবে। বাট আপনি এত ব্যস্ত মানুষ, তার মধ্যে আমার জন্য এত কেনো করবেন?

…….প্রথমত আমাকে একজন বন্ধু ভাবতে পারো। দ্বিতীয়ত আঙ্কেল আমাকে খুব স্নেহ করে। তাই হয়ত আমি তোমাদের জন্য এতটুকু করতে পারলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করব। আর যেহেতু আমরা একি এলাকার বাসিন্দা তাই এতটুকু তো করাই যায় একজন অন্য জনার জন্য।

আমি চোখের পানি মুছে একটু হাঁসলাম।

…….তবে ওখানে গিয়ে আবার আমাদের ভুলে যেওনা কিন্তু।

……ইন’শা’আল্লাহ স্যার আপনি আমার জন্য অনেক করেছেন, এবং করছেন, আপনাকে ভুলে যাওয়া কী আর এতটা সহজ হবে?

স্যার তার পকেট থেকে একটা ছোট বক্স বের করে আমার সামনে ধরল।

…….এটা তোমার জন্য, এটা তোমাকে সব সময় সাহস যোগাবে। যখনই তুমি নিজেকে একা মনে করবে, এটা চোখের সামনে ধরবে, দেখবে নিজেকে আর একা মনে হবে না।

…….ধন্যবাদ স্যার।

আমি স্যারের থেকে গিফট নিলাম। স্যার কে উদ্দেশ্য করে বললাম।

…….স্যার একটু অপেক্ষা করবেন, আমি এখনি আসছি।

…….ওকে আছি আমি।

আমি ছুটে গিয়ে রুম থেকে একটা শপিং ব্যাগ নিয়ে আবার ছুটে আসলাম। এসে দেখলাম স্যার এখনো দাঁড়িয়ে আছেন। আমি স্যারের সামনে ব্যাগটা ধরে বলে উঠলাম।

…….স্যার এটা আপনার জন্য আমি নিয়ে ছিলাম বাট দিতে সাহস পাচ্ছিলাম না, যদি আপনি না নেন তাই। প্লিজ স্যার।

…… নেবো না কেনো? তুমি খুশি হয়ে আমাকে একটা গিফট দিচ্ছ আর আমি তা নেবো না এটা কেমন হয় বলো? নিশ্চয়ই নেবো।

…….ধন্যবাদ স্যার।

আরও কিছুক্ষণ কথা বলে স্যার চলে গেলেন। আমিও নিচে এসে আমার রুমে গিয়ে স্যারের দেওয়া গিফট ব্যাগে রেখে দিলাম না দেখেই। কারণ ওখানে বসে যখন মন খারাপ হবে তখন দেখব এটা এই ভেবে।

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠলাম, আজ আমি মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে ছিলাম। কারণ আর যদি এই সময় গুলো ফিরে না পাই? কখনো যদি হারিয়ে যায় এই সময় গুলো আমার হাত থেকে, তখন এই স্মৃতি গুলো মনে করে একটু তো শান্তি পাবো।

ব্রেকফাস্ট করে ড্রইং রুমে গিয়ে বসলাম, হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠল। আমি গিয়ে দরজা খুলে দেখলাম একজন লোক পার্সেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

…….জ্বি?

…….পুস্পিতা কে?

……জ্বি আমি। কিন্তু কেনো?

……আপনার জন্য পার্সেল আছে। এখানে একটা সিগনেচার করেন।

আমি সিগনেচার করে দিতেই সে আমার হাতে একটা পার্সেল ধরিয়ে দিল। সে চলে গেল। আমি দরজা আঁটকে ভেতরে এসে ছোপায় বসে পার্সেলটা খুলতে শুরু করলাম।

পার্সেলটা খুলে আমি অবাক কারণ পার্সেল-টা সেই শুভাকাঙ্ক্ষী পাঠিয়েছেন। আমি বের করে দেখলাম, বেশি কিছু নয় শুধু একটা লাল গোলাপ, সাথে একটা ডায়েরি ছিল। ডায়েরির সাথে কসটেপ দিয়ে গোলাপ ফুলটা লাগানো ছিল। ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠা উল্টাতেই একটা গান বেজে উঠল। গানটা ছিল।

♪ ♬ ♩ ♪ ♬ বিদেশ গিয়া বন্ধু তুমি আমায় ভুইলো না চিঠি দিও পত্র দিও জানাই ও ঠিকানা। ♩ ♪ ♬ ♩ ♪ ♬

দ্বিতীয় পৃষ্ঠা উল্টাতেই দেখলাম লেখা রয়েছে।

ভুলনা আমায়।

ইতি
তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী

একটু হাঁসলাম। মাঝে মধ্যে মনে হয় স্যারের কথাই ঠিক আমি একটু কিপটে, কারণ হাসির মাঝেও আমি সব সময় কিপ্টেমি করে ফেলি।



চলবে………..।

নীলফড়িং পর্ব-০৩

0

#ফারহানা_হাওলাদার_প্রকৃতি
#নীলফড়িং
#পর্ব ৩
.
.
সকাল সকাল তারাহুরো করে হসপিটাল থেকে বেড় হচ্ছিলাম। হঠাৎ কারো সাথে সজোরে একটা থাক্কা খেলাম হাতের জিনিস গুলো সব মাটিতে পড়ে গেলো। নিজেকে সামলে তাকিয়ে দেখলাম, একটা ইয়াং বয়সী ছেলে।

……সরি মিস, আমি আসলে খেয়াল করিনি।

এই বলে ছেলেটা তারাহুরো করে আমার পড়ে যাওয়া জিনিস গুলো তুলে আমার হাতে দিয়ে হসপিটালের ভেতর ছুটে চলে গেলো। ছেলেটাকে দেখে মনে হচ্ছে কোনো কারণে চিন্তিত হয়ে আছে। হসপিটাল, হতেই পারে কোনো সমস্যা। আমি আবার এগোতে লাগলাম। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই একটা বাচ্চা এসে হাত ধরে নিলো। আমি তাকে দেখে তার সামনে বসে পড়ে,

……জ্বি কিছু বলবে?

……হ আমি না কাইল থেক্কা কিছু খাই নাই।

…….ক্ষুধা পেয়েছে।

…….হুম।

……তোমার মা কোথায়?

……(আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল) উই যে মায়।

বাচ্চাটাকে দেখে খুব মায়া লাগল। এত ছোট বাচ্চা এভাবে বললে খারাপ না লেগে কী পারে? হয়ত বেশি হলে ৬ কী ৭ বছর হবে। চারিদিকে তাকিয়ে আমার চোখ পড়ল হসপিটালের পাশের রেস্টুরেন্টের দিকে, আমি বাচ্চাটাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাবার দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

……কী খাবে?

…….(ভেবে নিয়ে) ভাত।

আমি ওয়েটার-কে বলে খাবার প্যাক করে নিয়ে, বাচ্চাটাকে নিয়ে এগিয়ে এসে ওর মায়ের হাতে খাবার গুলো দিয়ে, একটা রিকশা ডেকে উঠতে যাবো ঠিক সেই সময় কেউ পেছন থেকে বলে উঠল।

…….পুস্পিতা।

……আমি তাকিয়ে দেখলাম রাবীত ছিল।

……প্লিজ পুস্পিতা আমাকে নিজের হয়ে কিছু তো বলতে দাও। এভাবে সব না জেনে আমাকে শাস্তি দিও না। প্লিজ।

……দ্যাখেন আমার কিছু শোনার ইচ্ছে নেই, আপনার যা কিছু বলার থাকতে পারে। বাট আমার শোনার মতো কিছুই নেই। আমার দেরি হচ্ছে এসব কথা শোনার সময় আমার নেই।

এই বলে আমি রিকশায় উঠে বসে পড়লাম।

……পুস্পিতা প্লিজ আমার কথা শোনো। শুধু একটা চান্স দাও আমাকে, আমার কথা গুলো বলার জন্য।

অটোরিকশা যেহেতু, চালিয়ে সেখান থেকে চলে আসতে সময় লাগল না। আমি আর পেছন ফিরে তাকালাম না।

বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে, সবার সাথে ব্রেকফাস্ট করে নিজের রুমে গিয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। সারারাত যেহেতু একটুও ঘুম হলো না তাই খুব ক্লান্ত লাগছে।

……পুস্পিতা, পুস্পিতা, ওঠ।

…….মা আর একটু ঘুমাতে দাও এত জলদি কেনো ডাকছ?

……এত জলদি কোথায়, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দ্যাখ, ১:০০ বেজে গেলো।

আমি মায়ের কথায় ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখলাম হ্যা সত্যি বলছেন আমার মা জননী।

……..হুম উঠে গেছি। যাও আসছি।

আমি বিছানা থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং রুমে গিয়ে খাবার টেবিলে বসে পড়লাম। মা খাবার সব গুছিয়ে নিজেও বসে পড়ল। দুজনে খাওয়া দাওয়া শেষ করলাম।

ড্রইং রুমে গিয়ে ছোপার উপর পা উঠিয়ে বসে পড়লাম। মা সব গুছিয়ে এসে আমার পাশে বসে পড়ে বলে উঠলেন।

……তোর জন্য একটা সমন্ধ এসেছে। ছেলে খুব ভালো, দেখতেও অনেক সুন্দর।

……মা এসব কথা রাখো। আমি এখন কোনো ভাবেই বিয়ে করব না।

……তবে কী বুড়ী হয়ে বিয়ে করবি?

…….মা সব কিছুর আগে আমি নিজের একটা সুন্দর কেরিয়ার গড়তে চাই। তারপর এসব নিয়ে ভাবব।

…….তোর ভাবতে ভাবতে সময় চলে যাবে। এরপর হারিকেন নিয়ে ছেলে খুঁজতে বেড় হতে হবে।

……মা ছেলে তোমার খুঁজতে হবে না। যদি আমি নিজের কেরিয়ার গড়তে পারি। তবে দেখবে তোমার হারিকেন নিয়ে খুঁজতে বেড় হতে হবে না, তোমাকে খুঁজতে আসবে সবাই হারিকেন হাতে নিয়ে ইন’শা’আল্লাহ।

…….আর যদি না আসে?

…….তবে সমস্যা নেই, তোমার মেয়ে নিজের খেয়াল ইন’শা’আল্লাহ রাখতে পারবে। আর তোমরা তো আছো আমার পাশে নাকি?

…….আমরা আর কয়দিন? বয়স হয়েছে, আজকাল মানুষ হঠাৎ করে যেভাবে মরে যাচ্ছে, তাতে কোনো বিশ্বাস নেই কে কবে শেষ বিদায় নেই।

…….মা ভালো ভালো ভাবো, দেখবে সব ভালো হবে। আর তুমি যেমন-টা বলছ, তাতে তো আমিও মরে যেতে পারি? তবে কারও জীবন কেনো আমার এই অল্প সময়ের সাথে জড়াব?

…….হুম তোর সাথে কথা বলে লাব নেই। তুই সব সময় এসব কথা বলেই আমাকে চুপ করিয়ে দিস। তাই আমি আর কিছু বলব না, তোর যা ইচ্ছে তাই কর গিয়ে।

এই বলে মা রেগে চলে গেলেন। আমি রিমোট হাতে চ্যানেল চেঞ্জ করতে লাগলাম।

রাত প্রায় ৩টা, একটু ঘুমের মতো পড়ে ছিলাম। এমন সময় হসপিটালে একটা বাচ্চা মেয়ে এসে হঠাৎ বলে উঠল,

…..আফু আফু।

……হ্যা বলো?

……আমার সাথে এক্ষনি আইবেন আমার মা কানতে আছে।

…….কেনো কী হয়েছে তোমার মায়ের?

……জানি না মায় কয় তার মাথায় ব্যথা করতেছে।

……আচ্ছা চলো।

আমি মেয়েটার সাথে যেতে নিলাম। মেয়েটা আমার ওয়ার্ড থেকে বেড় হতে নিলো।

……এদিকে কোথায় যাচ্ছ?

……আফু আমার মায়ের কাছে যাই।

……কিন্তু ওই পাশে তো অন্য ডাক্তার আছে। তুমি তাদের না ডেকে আমাকে কেনো ডাকলে?

……হেরা তো সবাই ঘুমাইছে, এখন হেগো ডাকলে হেরা ঝামটা দিবে, হেইতে আপনারে ডাকছি।

……ওকে।

মেয়েটার সাথে কিছুদূর এগিয়ে যেতেই জনশূন্য স্থানে চলে এলাম। যেখানে পেশেন্ট বা অন্য কেউ নেই। এবার আমার একটু ভয় ভয় লাগছে আমি এখানে এসে কোনো ভুল করে ফেললাম না তো? একটু এদিক সেদিক তাকাতেই হঠাৎ দেখলাম মেয়েটা গায়েব হয়ে গেলো। এবার আমার সন্দেহ সত্যি মনে হচ্ছে। আমি পেছনে ঘুরে চলে আসতে যাবো ঠিক তখনই কেউ পেছন থেকে আমার মুখ চেপে ধরল, আমাকে জোর করে টেনে নিয়ে এলো একটা রুমের ভেতর। আমাকে রুমের ভেতর ধাক্কা মেরে সে দরজা বন্ধ করে দিল। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে ঠিক করে দাঁড়িয়ে গেলাম। সামনে তাকিয়ে দেখলাম রাবীত দাঁড়িয়ে আছে।

…….আপনি?

…….হ্যা আমি।

……আপনি আমাকে এখানে কেনো নিয়ে এসেছেন?

……ছোট একটা কারণে Sweet heart.

…….কী কারণে?

……বলছি বেবি।

সে আমার দিকে এগোতে এগোতে নিজের গায়ের থেকে শার্ট-এর বুতাম খুলতে লাগল। আমি হয়ত বুঝতে পারছি এই লোকটা কী করতে চাইছে আমার সাথে, আমি বুঝতে পারছিলাম না কী করবো? হঠাৎ মনে হলো, চিৎকার তো দিতেই পারি।

………Help প্লিজ কে আছেন প্লিজ বাঁচান আমাকে……..।

এইটুকু বলতেই সে ছুটে এসে আমার মুখ চেপে ধরল,

……একটু সাউন্ডও করবে না। আর সমস্যা নেই এই রুমের আসেপাশেও এখন কেউ নেই চারিদিকে সবাই ঘুমিয়ে আছে। তোমাকে সাহায্য করার মতো কেউ নেই প্রিয়তমা।

এই বলে আমার মুখের সামনে থেকে তার হাত সরিয়ে নিলো। আমি তাকে ধাক্কা মেরে সরে আসতে নিলাম। বাট সে আমার হাত ধরে টান দিয়ে একটা বেডের উপর ফেলে দিল। আমি বেড থেকে উঠতে যাবো সে আমার উপর লাফিয়ে পড়ল। একটা হিংস্র পশুর মতো। আমি তাকে আবার ধাক্কা মেরে কোনো রকম সরিয়ে দিয়ে বেড থেকে উঠে ছুটে আসতে নিলাম, সে আমার ওড়না ধরে টান দিল। আমি কোনো রকম ওড়না ছেড়ে দিয়ে, আমার ওড়নাটা তার হাতেই রয়ে গেলো , আমি এগিয়ে গেলাম দরজার কাছে দরজার খিল তুলে দরজা খুলতেই সে আবার আমার হাত ধরে টান দিয়ে দেয়ালের সাথে ঠেসে ধরল আমাকে। সে আমার খুব কাছে আসার চেষ্টা করছিল, বাট আমি হাত দিয়ে তাকে আঁটকে রাখার চেষ্টা করছিলাম। বাট বেশিক্ষণ তাকে আঁটকে রাখতে পারলাম না, সে আমার খুব কাছে চলে এলো। আমি তার সাথে শক্তিতে পারছিলাম না তাই এবার খুব জোরেই চিৎকার দিলাম নিজের মাঝে যতটা শক্তি ছিল, সব দিয়ে।

…….help help plz.

সে আমার কাছে আসার আপ্যায়ন চেষ্টা করে যাচ্ছে। হঠাৎ মনে হলো সে আমার থেকে একটু একটু করে সরে যাচ্ছে। সে আমার কাছ থেকে সরে যেতেই আমি সামনে তাকালাম তাকিয়ে দেখলাম, ফাইয়াজ স্যার ছিল। স্যারকে দেখে আমি অনেকটা শক্তি কুড়িয়ে নিলাম। ভেবে ছিলাম আজ হয়ত আমি আর বাঁচতে পারবো না, কিন্তু কথায় আছে না রাখে আল্লাহ মারে কে? সেটাই আজ আবার প্রমাণ হয়ে গেলো। আমি নিজের চোখ মুছে দাঁড়িয়ে রইলাম, স্যার রাবীতকে মারতে শুরু করলো। মারতে মারতে এক পর্যায় পুলিশ-কে ফোন দিয়ে বলল।

…….হ্যালো আমি কী থানায় ফোন করেছি?

…….🤫

…….জ্বি আসলে আমি ডাক্তার আবরার ফাইয়াজ বলছি, একজন ইন্টার্নি ডাক্তার নেশা করা অবস্থায় হসপিটালে ডিউটি করছিল তাই আমি তাকে আপনাদের হাতে দিতে চাচ্ছি।

……🤫

…….জ্বি ওনার কাছে কিছু নেশা যুক্ত জিনিসও রয়েছে। ওকে।

এই বলে সে ফোনটা রেখে দিয়ে রাবীতের ঘাড় ধরে ফ্লোর থেকে ওর শার্ট তুলে নিয়ে, রুম থেকে বেড় হয়ে এগিয়ে গেলো বলতে বলতে।

…….পুস্পিতা তুমি এখনি তোমার ওয়ার্ডে যাও। আমি ওঁকে দেখে নিচ্ছি।

…….জ্বি স্যার।

…….চল তোকে আজ বোঝাচ্ছি, মেয়েদের দিকে খারাপ নজরে তাকানোর শাস্তি কী হয়।

আমি সেখান থেকে নিজের ওয়ার্ডে চলে এলাম, ওয়াশ রুমে গিয়ে চুল গুলো ঠিক করে নাকে মুখে পানির ছিটা দিয়ে, বেশ কিছুক্ষণ নিজেকে আয়নায় দেখলাম। খুব খারাপ লাগছে, একটা মানুষ আর কতটা নিচে নামতে পারে? আর কতটা খারাপ হতে পারে? বেশ কিছুক্ষণ পরে আমি ওয়াশ রুম থেকে বেড়িয়ে আসলাম। বেড়িয়ে আসতেই দেখলাম আমার ফোন বাজছে, ফোন হাতে নিয়ে স্কিনে তাকিয়ে দেখলাম ফাইয়াজ স্যার ফোন দিয়েছে সাথে সাথে রিসিভ করলাম

……হ্যালো স্যার।

…….পুস্পিতা তোমার চিন্তার কিছু নেই, রাবীত কে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে, যেই জন্য ধরে নিয়ে গেছে তাতে কম হলেও ৬ মাস জেল, তাই তুমি নিশ্চিন্তায় থাকতে পারো। আর শোনো এই বিষয় কারো সাথে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। এতে সমস্যা হবে তোমার।

…….অনেক অনেক ধন্যবাদ স্যার আপনাকে। আপনি তখন না আসলে, ভাবতেই পারছি না কী হতো?

…….ইটস ওকে পুস্পিতা, তুমি নিজেকে শান্ত করো, আর সাবধানে থেকো একটু কেমন?

…….জ্বি স্যার।

ফোন রেখে দিল স্যার। সত্যি আজ স্যার না আসলে কী যে হতো কে জানে?

সকাল তখন ৮:০০ আমি হসপিটাল থেকে বেড় হতেই দেখলাম স্যার গাড়ী নিয়ে হসপিটালের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে, গাড়ীর সাথে ঠেস দিয়ে। আমাকে দেখে সে মুচকি হেঁসে গাড়ীর দরজা খুলে দিল, আমি তার কাছে গিয়ে।

……..স্যার ধন্যবাদ বাট আমি চলে যাবো।

…….হুম নিশ্চয়ই বাট আজ যখন ডিউটি এক সাথে শেষ হয়েছে তবে কেননা এক সাথেই যাই, তোমার এই রিকশার ভাড়া জমিয়ে একদিন না হয় আমাকে এক কাপ কফিই খাইয়ে দিও।

স্যারের কথায় হেঁসে উঠলাম। স্যারও হাঁসল। আমি গাড়ীতে উঠে বসে পড়লাম স্যারও গিয়ে বসে পড়ল। দুজনেই চুপ কোনো কথা বলার মতো ভাষা নেই হয়ত দুজনার মাঝে।

গাড়ী এসে থেমে যেতেই আমি গাড়ী থেকে নামার আগ মূহুর্তে স্যারের উদ্দেশ্যে বললাম।

……স্যার বাড়ির ভেতরে চলেন।

…….আজ না অন্য একদিন। তোমার বলতে হবে না আমি নিজেই আসবো। বাট আজ প্রচুর টায়ার্ড ফিল করছি, তাই আজ নয়।

…….ওকে স্যার।

আমি গাড়ী থেকে নেমে বাড়ির গেট খুলে বাড়ির ভেতরে এগিয়ে গেলাম। দরজায় নক করতেই দরজা খুলে আব্বু বলে উঠল।

…….এসে গেছিস?

……জ্বি আব্বু।

……রিকশায় করে এসেছিস?

……না ফাইয়াজ স্যার এগিয়ে দিয়ে গেলো।

……ওহ আচ্ছা। তবে তাকে ভেতরে আসতে বলবি তো?

……বলেছিলাম বাট সে প্রচুর টায়ার্ড ফিল করছে তাই আসল না।

……ওহ আচ্ছা অনেক দিন হয়েছে দেখা হয়নি ফাইয়াজের সাথে। তাই বলছিলাম। আচ্ছা যা ফ্রেশ হয়ে আয় গিয়ে।

……জ্বি আব্বু।

আমি ফ্রেশ হতে চলে এলাম। ফ্রেশ হতে গিয়ে চোখ যখন আয়নায় পড়ল, তখন দেখলাম ঘাড়ের কাছে লাল হয়ে আছে। মনে পড়ল সেই বিষাক্ত ঘটনা, হয়ত যখন ওড়না টান দিয়েছিল ঠিক তখনই লেগেছিল। আয়না থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে, ফ্রেশ হয়ে ওড়নাটা গলার সাথে লাগিয়ে নিয়ে রুম থেকে বেড় হয়ে এলাম। ব্রেকফাস্ট টেবিলে গিয়ে দেখলাম আব্বু মা বসে আছেন আমার অপেক্ষায়। আমি গিয়ে বসে পড়তেই মা খাবার সার্ফ করল। খাবার খেতে খেতে আব্বু বলে উঠল।

…….তোর পড়াশোনা কেমন চলছে?

…….জ্বি আব্বু আলহামদুলিল্লাহ ভালো।

…….পড়াশোনা, ডিউটি পালন করতে গিয়ে নিজের খেয়াল রাখার কথা ভুলে যাস না।

আব্বুর কথা শুনে মৃদু হাঁসলাম।

খাওয়া শেষ করে রুমে এসে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু আজ আর ঘুম চোখে আসছে না, আজ শুধু বারবার সেই বিষে ভরা বিষাক্ত মূহুর্তের কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে। ওহ গড কী হতো যদি তখন আমার চিৎকার শুনে স্যার না আসতো? আমি ভুলতে চেয়েও যে ভুলে যেতে পারছি না।

বিকেল দিকে মা জোর করে শপিংয়ে নিয়ে এলো। মা কিছু নতুন ড্রেস কিনে দিল। মা আর আমি বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে বাসায় চলে এলাম। বাসায় এসে শপিংয়ের জিনিস গুলো দেখছিলাম, এমন সময় মা বলে উঠলেন।

…….পুস্পিতা তোর ঘাড়ে অমন দাগ পড়েছে কীভাবে?

আমি নিজের হাত সেই দাগের কাছে দিয়ে, ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম, কারণ মা বা আব্বু যদি জানতে পারে এমন কিছু হয়েছে তবে আর আমাকে হসপিটালে যেতে দিবেন না। তাতে যা হয়ে যাক না কেনো। আমি আমতা আমতা করে বলে উঠলাম।

……মা ওই আসলে চেইনে টান পড়ে হয়েছে হয়ত।

……এমন ভাবে টান লাগল কীভাবে?

…….মা ওই আসলে চেঞ্জ করার সময় লেগেছে।

……ওহ আচ্ছা।

মা চা নিয়ে এলো আমার হাতে দিয়ে, নিজেও এক কাপ হাতে নিয়ে বসে পড়ল। ভাগ্যিস মা আর কিছু জিজ্ঞেস করেন নাই। তবে কী বলতাম জানা নেই আমার।

আমি খুব ক্লান্ত, শারিরিক ভাবে নয় মানষিক ভাবে, ভেঙে যাচ্ছি আস্তে আস্তে। সব কিছু ভুলতে চেয়েও না পারি আজ ভুলিতে। চেয়েছিলাম একটা মানুষ, পেয়ে গেলাম একটা অমানুষ।
সন্ধ্যায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে এই কথা গুলোই ভাবছিলাম আর চোখের পানি ফেল ছিলাম। হটাৎ মা ডেকে উঠলেন, তাই চোখ মুছে রুম থেকে বেড়িয়ে এলাম।

রান্নাঘরে এসে দেখলাম মা একা একা রাতের খাবার তৈরি করছিল, তাই মায়ের সাথে হাতে হাতে কাজ করে দিতে লাগলাম।



চলবে…………..।

নীলফড়িং পর্ব-০২

0

#ফারহানা_হাওলাদার_প্রকৃতি
#নীলফড়িং
#পর্ব ২
.
বিকেল দিকে চায়ের কাপে চুমুক দিলাম ছাদের এক পাশে দাঁড়িয়ে। সূর্যটা দেখা যাচ্ছে রেন্ডি গাছের ফাঁকা দিয়ে খুব সুন্দর ভাবেই দেখা যাচ্ছে। দেখতে মন মুগ্ধকর একটি দৃশ্য, দেখে মনে হচ্ছে আকাশ টিপ পড়েছে। এমনি সময় হলে নির্ঘাৎ কয়েকটা ছবি তুলে ফেইসবুকে আপলোড দিয়ে দিতাম, বাট আজ সেই ইচ্ছেটাই যে নেই। মনের মধ্যে উতালপাতাল ঝড় বইছে। কখন জানো বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পড়বে জমিনে।

এমন সময় মনে হচ্ছে কেউ আমাকে দেখছে। চোখ মুছে পেছনে তাকিয়ে দেখলাম ফাইয়াজ স্যার দাঁড়িয়ে আছে কিছুটা দূরে তাদের ছাদে, সেও চায়ের কাপে চুমুক বসিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। আমিও হাসলাম। এরপর আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ছাদ থেকে নেমে এলাম।

সন্ধ্যায় বই নিয়ে বসে ছিলাম, পড়া মাথায় ঢুকছে না শুধু রাবীতের কথাই ভাবছিলাম। এর মধ্যে ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো তাকিয়ে দেখলাম রাবীত ছিলো। না চাইতেও চোখের পানি মুছে ফোনটা হাতে নিলাম।

…….হ্যালো।

……My sweet heart কেমন আছো?

……আলহামদুলিল্লাহ ভালো, আপনি?

……নাহ আমি মোটেও ভালো নেই, তোমার কথা ভেবে ভেবে একদম পাগল পাগল হয়ে যাচ্ছি।

……কেনো আমার কথা এত ভাবার কী আছে?

……তোমার কথা না ভাবলে কার কথা ভাববো? আমার কী আরও কয়েকটা গার্লফ্রেন্ড আছে নাকি? যে তাদের কথা ভাববো?

……থাকতেও তো পারে, তা আমি কীভাবে জানবো?

……(থমথম খেয়ে) কীহ বলছো? তুমি পাগল হয়ে গেছো নাকি? এটা কিন্তু একদম সত্যি নয়। আমি শুধু আমার জান-কেই ভালোবাসি।

…….হ্যা তাই তো, এখন জীবন+জান মানুষের একটাই হয়। বাট যদি আপনি প্রেমিকা+জান বলেন, তবে যে কটা ইচ্ছে বানিয়ে নিতে পারেন। এখানে সন্দেহর কিছু নেই।

…….আচ্ছা পুস্পিতা, তুমি কী আমার উপর কোনো ভাবে রেগে আছো?

……আমি যতটুকু জানি রাগ তো খুব কাছের মানুষ-দের সাথে করা যায়।

…….তাহলে আমি কী তোমার কাছের মানুষ নই?

…….তা তো জানি না। তবে চাইলেই কী আর কাছের মানুষ হওয়া যায়?

……আসলে আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে তুমি রেগে আছো আমার উপরে। প্লিজ জান আমাকে সমস্যা-টা খুলে বলো। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার এমন আচরণে। আমি মেনে নিতে পারছি না, তোমার এমন রুট ব্যবহার।

……ওহ আচ্ছা। হ্যা মা আসছি। সরি আর কথা বলতে পারছি না আসলে মা ডাকছেন।

……আচ্ছা শোনো।

……হ্যা বলেন?

……কাল তোমার ডিউটি কখন পড়েছে?

……ওহ আসলে কাল আমি ছুটি নিয়েছি।

……হঠাৎ ছুটি?

……হ্যা আসলে দু-দিনের জন্য আমি আমার খালার বাসায় যাচ্ছি তাই।

…….কীহ এটা তুমি আমাকে এখন বলছো?

……হ্যা কিন্তু কেনো?

…….ওহ গড আমি তোমাকে না দেখে দু-দিন কীভাবে থাকবো?

…….ওহ আচ্ছা? যেভাবে এখন আছেন সেভাবেই।

…….এটা তুমি কোনো কথা বললে?

……সরি আমি আর কথা বলতে পারছি না মা আমাকে ডাকছেন।

এই বলে ফোন কেঁটে দিলাম। খুব জেদ হচ্ছিল নিজের উপরে এমন একটা মিথ্যাবাদীর ফাঁদে আমি কীভাবে পা দিলাম। যে কিনা এত বছর কোনো ছেলের সাথে ঠিক করে তেমন একটা কথাও বললাম না সে আজ, এমন একটা খারাপ মানুষের সাথে জড়িয়ে পড়লাম। নিজের উপর প্রচুর ঘৃণা হচ্ছে।

রাত তখন ১২ টা ঘুম নেই চোখের পাতায়। তাই ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কীভাবে সময় চলছে তার গতিতে তাই অনুভব করছিলাম। হঠাৎ ফোনে টুং করে শব্দ হলো, তাকিয়ে দেখলাম সেই ফেক আইডি থেকে ম্যাসেজ।

…….কার জন্য ঘুমহীন চোখে বসে আছো? সে কী তোমার জন্য এতটাই গুরুত্বপূর্ণ। যে জন্য নিজের খেয়াল রাখাটাও ভুলে যাচ্ছ?

…….কী বলতে চাইছে আপনি?

……রাত ১২ বেজে গেছে এখনো সেই মানুষ-টার কথা ভেবে জেগে আছো, যে কিনা এখন হয়ত অন্য কারো সাথে বিছানা শেয়ার করছে।

…….প্লিজ বন্ধ করুণ এ-সব কথা বলা, আমি আর সহ্য করতে পারছি না।

…….কেনো তার জন্য কষ্ট পাচ্ছ? যে তোমাকে ছাড়া বেশ আছে? বাট তুমি তাকে ছাড়া মোটেই ভালো নেই। তুমি তো তাকে জিতিয়ে দিচ্ছ তার চক্রান্তে, সে যা ভেবে ছিলো তাই হচ্ছে, ভালো নেই তুমি তাকে ছাড়া, তুমি তাহাতেই বিভোর, তাকে ছাড়া তুমি অচল পয়শার মতো হয়ে গেছো। তুমি হয়ত তাকে ছাড়া বাঁচতেই পারবে না।

…….কে বলেছে আমি তাকে ছাড়া ভালো নেই। কে বলেছে আমি তাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না? আমি বেশ আছি তাকে ছাড়া, আমি একদম কাঁদছি না। আমি অনেক ভালো আছি। আমি তাহাতে কোনো ভাবেই বিভোর নই। আমি শুধু আমাকে ভালোবাসি। আমি শুধু আমার পরিবারকে ভালোবাসি অন্য কাউকে নয়, বুঝতে পেরেছেন আপনি?

…….না পারিনি, কারণ তুমি এখনো জেগে আছো, এটাই হলো সব চেয়ে বড় প্রমাণ, তুমি ভালো নেই তাকে ছাড়া।

…….আমি ভালো আছি তাকে ছাড়া, আমি এখনি ঘুমাবো, আমি কারো কথা ভাবতে চাই না, কারো কথা নয়।

আমি ফোন রেখে রুমের আলো নিভিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু চোখের সামনে সেই দৃশ্য ভেসে উঠলো, ওদের দু’জনের সেই মূহুর্ত। না আমি ভাববো না তার কথা। কিন্তু এই ভাবনা কেনো চলে আসছে বারবার আমার স্বরনে? আমার মনে হচ্ছে ওরা দু’জন খুব জোরে জোরে হাসছে। খুব বিরক্তি লাগছে আমার। আমি উঠে বসে কান চেপে ধরলাম। অনেক ক্ষণ পড়ে কান ছেড়ে দিতেই কানে গিটারের শব্দ এলো কেউ খুব সুন্দর করে গিটারে সুর তুলেছে, আমি আস্তে করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। দু-হাত গালের নিচে দিয়ে খুব নিখুঁত ভাবে শুনতে লাগলাম। কেনো জানি গিটারের টুংটাং শব্দে সব ভুলে গেলাম। ভালো লাগছে সুরটা সে সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গান ধরলো।

♩ ♪ ♬ বড় সাধ জাগে এক বার তোমায় দেখি। কত কাল দেখিনি তোমায় একবার তোমায় দেখি। ♬ ♩ ♪ ♬

তার কন্ঠ-টা এতই সুন্দর ছিলো যে, আমি গানের মাঝেই হারিয়ে গেলাম। গান শুনতে শুনতে এক পর্যায় ঘুমিয়ে গেলাম।

সকাল সকাল মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙলো। তাই উঠে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং রুমে চলে গেলাম।

……গুড মনিং আব্বু।

……গুড মনিং মামণি।

আমি ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে পড়লাম আব্বু পত্রিকা রেখে ব্রেকফাস্ট করতে নিলো। সবাই খাবার শেষ করলাম।

……মামণি তোমার ডিউটি কখন?

……আজ নাইট ডিউটি পড়েছে আব্বু।

……সব যেমন তেমন এই নাইট ডিউটির জন্য ভালো লাগে না মামণি।

……আব্বু কষ্ট না করলে সামনে এগিয়ে যাবো কী করে?

……হুম।

আব্বু রেডি হয়ে বের হয়ে গেলো। আমি রুমের বারান্দায় গিয়ে উঁকি দিলাম। হটাৎ মনে হলো রাতের সেই মন-মুগ্ধকর গানের কথা, ইশ অনেক সুন্দর ছিলো। ভাবতেই ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির রেখা ফুঁটে উঠলো। আমি হাসি দিয়ে চুল গুলো নাড়া দিয়ে ঘুরে যেতেই দেখলাম ফাইয়াজ স্যার দাঁড়িয়ে আছে ঠোঁটে মৃদু হাসি। তার রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। ইশ রে কতটা লজ্জা পেলাম। আমি নিচের ঠোঁটে দাঁত বসিয়ে দিয়ে ছুটে রুমে চলে এলাম। এই একটা মানুষ যার মুখে অল টাইম হাসি থাকে, আর তার হাঁসিটাও খুব সুন্দর, হাসলে গালে হালকা টোল পড়ে যায়, বাট লজ্জাটাও অনেক পেয়েছি। দরজা লাগিয়ে দিয়ে মুচকি মুচকি হাসছিলাম। এর ভেতর রুমে মা এসে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো।

…….কী ব্যাপার? এভাবে হাসছিস কেনো?

…….আরে মা তেমন কিছু নয়, ওই ফেসবুকে একটা কৌতুক দেখলাম তাই।

…….হুম তাই জেনো হয়। আচ্ছা তোর যে কাপড় গুলো পরিষ্কার করতে হবে ওগুলো দে, বুয়া এসেছে ধুয়ে দেবে।

……জ্বি মা।

আমি তারাহুরো করে মা কে ড্রেস গুলো বের করে দিলাম। সে তা নিয়ে চলে গেলো। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। মাকে প্রচুর ভয় পাই, আব্বু ততটাও কড়া নয়, কিন্তু আমার মা? সে তো প্রচুর রাগী। তাই তাকে অনেকটা ভয় পাই।

ভাবছি আজ রাতে হসপিটালে যাবো কী যাবো না। রাবীত-কে তো বলে দিলাম। আজ যাচ্ছি না। ভাবছি স্যার-কে বলে আমার ডিউটির ওয়ার্ড চেঞ্জ করাবো। যদি ৩ তালা থেকে অন্য কোনো ফ্লোরে যাওয়া যায় ভালো হবে। তাই স্যারকে ফোন দিলাম।

…….আসসালামু আলাইকুম স্যার আমার একটু সাহায্য লাগতো।

……ওয়ালাইকুম আসসালাম। হ্যা পুস্পিতা বলো, আমি যথার্থ চেষ্টা করবো তোমার সাহায্য করার।

…….স্যার আমার ডিউটির রুমটা যদি একটু চেঞ্জ করে দিতেন।

……তাই কিন্তু হঠাৎ করে কেনো?

…….নাহ এমনই থাক প্রয়োজন নেই। আমি রাখছি স্যার।

আমি ফোনটা কেটে দিলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে স্যার নিজেই ফোন দিলো।

……হ্যালো আসসালামু আলাইকুম স্যার।

……হ্যা পুস্পিতা, তোমার ৫তালার সেকেন্ড ফ্লোরে নাইট শিফট পড়েছে।

……Thank u স্যার

স্যার ফোন রেখে দিলো, আমি হালকা হেঁসে ফোনটা বিছানায় রেখে, রুম থেকে বেড় হয়ে পড়লাম। ভবছি আজ মায়ের সাথে সারাদিন কাজ করে কাটিয়ে দেবো।

রাতে আব্বু গিয়ে হসপিটালের সামনে নামিয়ে দিয়ে আসলো, আমি, ৫ তালার সেকেন্ড ফ্লোরে চলে এলাম।

প্রায় রাত ২টা বাজে চোখে একটু ঘুম ঘুম এসেছিল, হঠাৎ ফোনটা টুং করে উঠলো, ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখলাম, লেখা আছে।

……৩ তালার মিটিং রুমে চলে যান, নিশ্চয়ই সেখানে কিছু পেয়ে যাবেন।

আমি বসা থেকে উঠে ফোনটা হাতে নিয়ে জোর পায়ে হেঁটে ৩ তালায় চলে এলাম। মিটিং রুমের সামনে যেতেই পা থেমে আসতে শুরু করলো। অজানা একটি ভয় এসে বারবার ছুঁয়ে যেতে শুরু করলো। আমি কী দেখতে যাচ্ছি, নিজেকে সামলাতে পারবো তো? অনেক কষ্টে পা ফেলে সামনে এগিয়ে গেলাম। মিটিং রুমের দরজা ঠেলে ভেতরে গেলাম। সেখানে গিয়ে চোখ পড়লো সরাসরি সামনেই বসে থাকা মানুষ দুটির উপর, রাবীত আর চৈতী ছিলো তারা একে অপরের সাথে খুবই ঘনিষ্ট ভাবে বসে ছিলো, খুবই কাছাকাছি, তারা আমাকে দেখে সাথে সাথে দুজনেই উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। যা দেখে আমি নিজেকে শান্ত রাখতে পারছিলাম না, তারপরও নিজেকে শান্ত করে হাতে তালি বাজিয়ে বলে উঠলাম।

…..বাহ বাহ বেশ ভালো, আমি আরও ভাবছিলাম আপনি কীভাবে এই দুই-দিন আমাকে ছাড়া থাকবেন? বাট আপনার তো সমস্যাই হলো না, আপনি নতুন কাউকে খুঁজে নিলেন। আর খুঁজেও নিলেন কিনা এমন কাউকে যে আমারই বেষ্ট ফ্রেন্ড। খুব ভালো, কিন্তু এমন একটা সারপ্রাইজ আজ পাবো জানা ছিলো না। জানলে সাথে করে কাজি সাহেবকে নিয়েই আসতাম।

……পুস্পিতা তুমি ভুল ভাবছো।

……ওহ হ্যা আমি তো ভুল ভাবছি, আপনি নিশ্চয়ই বিয়ে করতে চাইছেন না চৈতীকে? হয়ত এভাবেই সময় পাস করতে চাইছেন তাই-না?

……দ্যাখো পুস্পিতা আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলছি। (কাছে এসে)

……(ঠাশ করে থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে) বুঝানোর আরও কিছু বাকি আছে? যদি থাকে তবে আমাকে না, চৈতীকে বুঝান। আমি আর আপনার চক্রান্তে লিপ্ত হচ্ছিনা।

এই বলে আমি চলে আসতে নিলাম। রাবীত আমার হাত ধরে বলে উঠলো।

……প্লিজ পুস্পিতা তুমি এভাবে যেওনা আমাকে ছেড়ে।

…….আমার হাত ধরার সাহস পেলেন কীভাবে? হাত ছাড়ুন।

এই বলে খুব জোরে একটা ঝাড়া দিলাম রাবীতের হাত ছিটকে গেলো আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আমি চলে এলাম সেখান থেকে। এসে সোজা ৫তালার ওয়াশ রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম দরজার সাথে মাথা ঠেকিয়ে। চোখ থেকে অনবরত অশ্রুজ্বল গড়িয়ে পড়ছিল, প্রায় অনেক সময় এভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম। এরপর ভাবলাম।

….পুস্পিতা তুই কার জন্য কাঁদছিস? কে সে? যার জন্য এত মূল্যবান চোখের পানি তুই ঝাড়াচ্ছিস? সে কী এই চোখের পানির মূল্য দিতে পেরেছে? সে কী তোর ভালোবাসার মূল্য দিতে পেরেছে? তবে তুই কেনো কাঁদছিস? তোকে শক্ত হতে হবে, এতটা ভেঙে পড়লে চলবে না। তুই ওই মানুষ-টার জন্য কাঁদছিস? যে কিনা তোর ভালোবাসার যোগ্যই নয়। নাহ আমি আর কাঁদবো না তাও ওই মানুষ-টার জন্য, যে আমাকে এতবড় ধোঁকা দিয়েছে। আমি তাকে দেখিয়ে দেবো, তার জন্য আমার জীবনে কোনো রকম প্রভাবই পড়ে নাই। আমি তার সব রকম চেষ্টা বৃথা করে দেবো।



চলবে……..।

নীলফড়িং পর্ব-০১

0

#ফারহানা_হাওলাদার_প্রকৃতি
#নীলফড়িং
#সূচনা_পর্ব

কারো ঘনিষ্ট মূহুর্তের একটি ভিডিও দেখে, চোখ সরাতে পারলাম না। শোয়া থেকে উঠে বসে পড়লাম। এমন কিছু দেখবো আশা করি নি। ফেসবুক চালাচ্ছিলাম হঠাৎ টুং করে একটা ম্যাসেজ রিকোয়েস্ট এলো ম্যাসেঞ্জারে, সেন্ট করে দেখলাম একটি ভিডিও অন করতেই দেখলাম কারো ঘনিষ্ট মূহুর্তের ভিডিও। এমন ভিডিও দেখে তার থেকে তারাহুরো করে বেড় হতে যাবো, এর মধ্যে চোখ পড়লো মানুষ দুটোর দিকে, আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। কারণ সেই মানুষ দু’জন আমার খুব পরিচিত ব্যক্তি। একজন আমারই বয়ফ্রেন্ড রাবীত, অন্য জন আমারই ফ্রেন্ড চৈতী। যাদের দু’জনকেই আমি প্রচুর বিশ্বাস করি। তাদের এভাবে দেখবো আশা করি নি। ভিডিও থেকে বেড় হয়ে দেখলাম একটি ফেক আইডি থেকে ম্যাসেজটা এসেছে। ফোনটা রেখে মাথা বেডের রেলিং এর সাথে ঠেকিয়ে চুপ করে বসে ছিলাম, চোখ থেকে অঝর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। এভাবেও যে কেউ কারো বিশ্বাস ভাঙতে পারে আমার জানা ছিলো না।

রাবীতের সাথে আমি রিলেশনে জড়িয়েছি মাত্র ২ মাস হলো, সম্পর্ক-টা যে শুধু দু-মাসের তা কিন্তু নয়। রাবীত প্রায় ৪ মাস ধরে আমাকে। ইমপ্রেস করার অনেক চেষ্টা করেছে, আমি এসব প্রেম ভালোবাসায় কখনোই বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু রাবীত এমন একটা মানুষ ছিলো যে আমাকে প্রেমে বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছে। আর আজ সেই মানুষ-টাই আমাকে এত্ত বড় ধোকা দিয়েছে ভাবতেই কষ্ট গুলো আরও দ্বিগুণ বেড়ে যাচ্ছে।

আমি মেডিকেল স্টুডেন্ট, ইন্টার ডাক্তার হিসাবে ভর্তি হলাম মাত্র ৬মাস হয়েছে। রাবীত আমার সেইম ব্যাচে রয়েছে। যেদিন আমি প্রথম হসপিটালে গেলাম, সেদিন থেকেই রাবীত আমাকে ইমপ্রেস করতে ব্যস্ত, কখনো কথা বলার জন্য তার প্রচুর চেষ্টা, কখনো চিঠি, কখনো কারো হাতে ফুল পাঠানো, এভাবেই সে চেষ্টা করতে থাকে, কখনো প্রচুর রিকোয়েস্ট। একদিন হঠাৎ আমার বাড়ীর সামনে গিয়ে সারারাত বৃষ্টিতে ভিজে দাঁড়িয়ে ছিলো, তার পাগলামো গুলো আস্তে আস্তে আমাকে বাধ্য করে তোলে তার পাগলামী মেনে নিতে, তার ভালোবাসা দেখে বুঝেছি কেউ কাউকে পাওয়ার জন্য কতটা কষ্ট করতে পারে? তার এমন ভালোবাসার কাছে হার না মেনে আমি থাকতে পারিনি বেশিদিন। তার প্রেমে পড়েছি তার প্রতিটি পাগলামীতে। আজ দু-মাস তার সাথে প্রেম করছি, সে কখনো আমাকে বুঝতেই দেয়নি সে এতটা খারাপ চরিত্রের মানুষ।

আর চৈতী সে তো আমার কলেজ ফ্রেন্ড, তার সাথে তো একদম বোনের মতো সম্পর্ক ছিলো। মনের কথা সব সময় তার সাথে শেয়ার করতাম, সে যে এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করবে কখনো বুঝতেই পারিনি।

আজ সারারাত আর ঘুম হলো না। চোখ মেলেই সারারাত কাঁটিয়ে দিলাম। ঘুমহীন চোখ দুটো থেকে বারবার অশ্রু গুলো গড়িয়ে পড়ছিল।

সকালে বিছানা থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। আজ ইচ্ছে করছে না বাড়ী থেকে বেড় হতে। বলতে গেলে ভয় হচ্ছে ওদের সামনে যেতে, এমন নোংরা মনের মানুষদের চেহারা দেখতেও ইচ্ছে করছে না।

ডাইনিং টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছিলাম। এমন সময়, স্যার ফোন দিয়ে এখনি হসপিটালে যেতে বলল। আব্বু বলে উঠলো।

…..কীরে আজ তুই হসপিটালে কখন যাচ্ছিস?

…..এত তো আব্বু এখনই যাবো।

…….ওহ আচ্ছা।

……ওকে আব্বু আমি রেডি হয়ে নিচ্ছি তবে।

……হ্যা তুই রেডি হয়ে আয় আমি তোকে যাওয়ার পথে নামিয়ে দিয়ে যাবো।

…..ওকে আব্বু।

রেডি হয়ে এসে দেখলাম আব্বু দাঁড়িয়ে আছে, তাই মাকে বায় বলে দুজনেই বেড়িয়ে পড়লাম। আব্বু আমাকে হসপিটালের সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। আমিও তাই হসপিটালের ভেতরে চলে গেলাম।

আমি ইন্টার ডাক্তার-দের ক্যাবিনে যেতেই দেখলাম যাদের ডিউটি চলছিল তারা উঠে দাঁড়িয়ে গেলো।

……পুস্পিতা তুমি এসে গেছো খুব ভালো হয়েছে আসলে আমাদের একটু জরুরি কাজ ছিলো। তুমি একা কী একটু সামলে নিতে পারবে?

…….হ্যা সমস্যা নেই। তোমরা যেতে পারো বাকিরাও তো চলে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে।

……হ্যা ঠিক আছে।

ওরা চলে গেলো। আমি চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। একটা বই হাতে পড়তে নিলাম কিন্তু বইরের পাতায় মন বসছে না। বারবার রাবীতের কথা মনে করে চোখ ভিজে যাচ্ছে, হঠাৎ একজন দরজা নক করে বলে উঠলো।

…….ম্যাডাম আসতে পারি?

……ইয়েস।

একজন পুরুষ আসলো রুমে। যাকে দেখে আমি প্রশ্ন করে উঠলাম।

……জ্বি বলেন।

……ম্যাডাম আমার ওয়াইফের একটু সমস্যা হচ্ছে যদি একটু আসতেন।

……কী সমস্যা হচ্ছে?

…….ওর পেটে ব্যথা করছে।

…….সিট নাম্বার কত?

…….জ্বি ১০২

…….ওকে আপনি যান আমি আসছি।

…….জ্বি ম্যাডাম।

লোকটা চলে গেলো, আমি ফোনটা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলাম। ১০২ নাম্বার সিটে গিয়ে দেখলাম লোকটা দাঁড়িয়ে আছে, নার্সদের বললাম।

……ফাইল দাও।

……জ্বি ম্যাডাম, আপনাদের রিপোর্ট গুলো দিন।

রিপোর্ট গুলো তাদের থেকে নিয়ে নার্স আমার হাতে দিলো। আমি ওষুধ গুলো, সাথে রিপোর্ট গুলো চেক করে, মহিলাকে ভালো ভাবে দেখলাম। একটা ওষুধের নাম বলে নার্সকে, বাকি রুগীদের চেক করতে শুরু করলাম, সবার রিপোর্ট চেক করলাম। এক আন্টির কাছে গেলাম।

……আন্টি কেমন আছেন আপনি?

……হ মা ভালো।

……আন্টি কোনো সমস্যা আছে আপনার?

…….হ ওই হাতটায় ব্যথা রইছে, সারারাত ঘুমাইতে পারি নাই মাগো।

…….(প্রেশার মেপে) আন্টি প্রেশার তো একটু বেশি আছে ওষুধ খেয়েছেন?

……ওই তো নার্স দিয়েছে।

…….তুমি ওষুধ দিয়েছ ঠিক করে?

……জ্বি ম্যাডাম।

……কোনটা কোনটা দিয়েছো?

…….এই যে ম্যাডাম লেখা আছে।

…….আচ্ছা বিসলল ৪০ ওটা মিসিং কেনো?

……ওহ সরি ম্যাডাম খেয়াল করিনি।

নার্স-এর কথা শুনে মাথাটা গরম হয়ে গেলো, আগেই তো অনেকটা গরম ছিলো। তাই তার হাত ধরে এক পাশে নিয়ে গিয়ে বললাম।

…….এটা কোনো কথা বললে তুমি? এনারা এখানে আমাদের ভরসায় আসে, আর আমরাই যদি ভুল করি তবে কীভাবে হবে? তোমার জন্য যদি ওনার কোনো সমস্যা হয়, তবে সেই রিক্স কে নিবে?

…….সরি ম্যাডাম।

…….সরি বললেই কী সব ভুলের ক্ষমা হয়ে যায়? ওনাকে ওষুধ দাও গিয়ে যাও।

……জ্বি ম্যাডাম।

আন্টির ওষুধ দিয়ে বাকি পেশেন্ট গুলো দেখতে শুরু করলাম। একটা বাচ্চার কাছে গেলাম।

……মিষ্টি আন্টি তুমি কেমন আছো?

……জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো তুমি কেমন আছো?

……একদম ভালো না।

…….কেনো?

……তোমাকে তো পাওয়াই যায়না। আমি কতবার তোমাকে খুঁজতে লোক পাঠিয়েছি।

……তাই বুঝি? কিন্তু কেনো?

……তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে, অন্য সবাই পচা, জানো তো রাতে একটা পচা আন্টি আমাকে বকে দিয়েছিল।

……তাই কিন্তু কেনো?

……আমি আইসক্রিম খেয়েছিলাম তো তাই।

…….কিন্তু আইসক্রিম কেনো খেয়েছিলে তোমার তো আইসক্রিম খাওয়া নিষেধ তাই না?

…….হুম কিন্তু আমি তো লুকিয়ে লুকিয়ে একটু খেয়েছিলাম, আর ওই পচা আন্টি আমাকে এসে ধরে ফেলেছিল।

……হুম এরপর কিন্তু আর খাবে না ঠিক আছে।

……হুম।

আমি সব পেশেন্ট দেখে ক্যাবিনে চলে এলাম, সেখানে এসে দেখলাম বাকিরাও চলে এসেছে ঘড়িতে তখন ৮;৩০ মিনিট, সবাই বসে কথা বলছে আমি বই মেলে বসে পড়লাম, ভালো লাগছে না কারো সাথে কথা বলতে। একটু পড়ে চৈতীও চলে এলো।

……কী রে পুস্পিতা, কখন এলি?

……যখন আসার কথা তখনই এসেছি। তা তোর এত লেট কেনো হলো?

…….ওই আসলে বাসায় একটু কাজ ছিলো, রাবীত আশে নি এখনো?

……তা আমি কী জানি? আমি এতক্ষণ রানিংয়ে ছিলাম।

……ওহ আচ্ছা।

আমি আবার বইয়ের পাতায় মুখ গুজে দিলাম ওর সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছেই নেই কিন্তু কী করবো? ওদের বুঝতে দিলে হবে না আমি সব জানি, ওদের হাতে না হাতে ধরতে হবে।

কিছুক্ষণ পরে রাবীত এলো। আমি সেদিকে খেয়াল না দিয়ে পড়ায় মন বসালাম। রাবীত কথা বলতে চাইছে বাট সবাই রুমের ভেতর তাই কথা বলতে পারছে না। শুধু জিজ্ঞেস করলো।

……কী খবর মিস পুস্পিতা, কেমন আছেন?

…….জ্বি আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ ভালোই রাখছেন।

আমি নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। রাবীতের সঙ্গে আর কথা বললাম না। আমি তো আমার ডিউটি শেষ করে এলাম। যতটুকু ওয়ার্ডে ছিলো তা সম্পূর্ণ করে এলাম। এবার ওদের সবার ডিউটি ওরা পালন করতে গেলো। আমি বসে রইলাম। টুং করে একটা ম্যাসেজ এলো, তাকিয়ে দেখলাম সেই ফেক আইডি থেকে,

💌সরি মন খারাপ করার জন্য, বাট আপনার জানাটা অতি জরুরি ছিলো আপনি কাদের বিশ্বাস করছেন। 💌

💬 কে আপনি💬

💌হয়ত আপনার কোনো এক শুভাকাঙ্ক্ষী 💌

💬বাট সেই শুভাকাঙ্ক্ষী টা কে আমার তা তো জানার ইচ্ছে থাকতেই পারে আমার।💬

💌সময় হলে জেনে যাবেন, হয়ত হটাৎ করেই একদিন চলে আসবো সামনে💌

💬বাট আজ কেনো নয়?💬

💌আজ সময় হয়নি তাই💌

সে আর কিছু না বলে অফ লাইনে চলে গেলো। আমিও ফোন রেখে বসে রইলাম।

রাবীত অনেক চেষ্টা করলো, আমার সাথে কথা বলার ম্যাসেজ দিলো, ইশারা করলো বাট আমি তার দিকে তাকালাম না।

১২টায় ডিউটি শেষ করে বের হতে নিলাম। রাবীত বাইক নিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলো।

……চলো এগিয়ে দিয়ে আশি।

……নাহ প্রয়োজন নেই, আমি চলে যাবো।

……আচ্ছা কোনো কারণে রেগে আছো নাকি?

……কেনো রাগার মতো কিছু করেছেন নাকি?

…….আমার তো মনে হচ্ছে না। তারপরও হয়ত অজান্তেই কিছু ভুল করে ফেলতেই পারি।

…… না আমার জানা মতে ভুল করেন নি। যা করেছেন জেনে শুনেই করেছেন। আচ্ছা রাবীত আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে এখন আশি হ্যা (ঘড়ির দিকে তাকিয়ে)

……আরে বললাম তো আমি এগিয়ে দিয়ে আশি।

…….নাহ আসলে কেউ আমাকে আপনার সাথে দেখে ফেললে সমস্যা হবে। তাই আমি একাই যাচ্ছি।

…….পুস্পিতা শোনো?

তাকিয়ে দেখলাম সিনিয়র ডক্টর আবরার ফাইয়াজ স্যার। তাই সেদিকে এগিয়ে গেলাম স্যার প্রাইভেট কার থেকে উঁকি দিয়ে আমাকে ডাকলেন।

……আসসালামু আলাইকুম জ্বি স্যার?

……ওয়ালাইকুম আসসালাম। পুস্পিতা তুমি নিশ্চয়ই বাসায় যাচ্ছ?

…….জ্বি স্যার।

…….আমি কী লিফট দিতে পারি তোমাকে?

…….নো স্যার আমি চলে যাবো। আপনি শুধু শুধু কেনো কষ্ট করবেন?

……আরে না না আমার কোনো সমস্যা নেই। এক এলাকায়ই তো যাচ্ছি, তাই তুমি কিছু মনে না করলে যেতে পারো আমার সাথে।

স্যার এত করে বলছে না গেলেও খারাপ দেখা যায় ওদিকে রাবীত এখনো দাঁড়িয়ে, তাই তাকে দেখানোর জন্য হলেও স্যারের গাড়ীতে উঠে বসলাম।

স্যার গাড়ী ড্রাইভ করতে করতে বলে উঠলো।

……কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি?

……জ্বি স্যার বলেন।

……রাবীত নামের ছেলেটা আমার কাছে তেমন সুবিধার মনে হচ্ছে না। তুমি যদি পারো ওর থেকে একটু দূরেই থেকো।

…….জ্বি ঠ্যাংস স্যার।

ডক্টর ফাইয়াজ আমাকে আমার বাড়ীর সামনে নামিয়ে দিলো। আমি গাড়ী থেকে নামার আগ মূহুর্তে স্যারকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলাম।

…….স্যার Thanks.

স্যার একটু মুচকি হেঁসে গাড়ী চালিয়ে তার বাড়ীর ভেতরে চলে গেলো। আমি গেইট খুলে বাড়ীর ভেতরে চলে এলাম। আমাদের পাশের বাড়ী-টা ফাইয়াজ স্যার-দের, এজন্য মাঝে মাঝেই স্যার লিফট দিয়ে দেয় যখন সামনে পড়ে যাই।



চলবে……….।

লজ্জাবতী পর্ব-১৪ এবং শেষ পর্ব

0

#লজ্জাবতী
#লেখা_Bobita_Ray
শেষপর্ব

বেশকিছুদিন ধরে অনুপম, মাধুর সাথে অস্বাভাবিক আচরণ করে। অনুপমের হঠাৎ বদলে যাওয়া আচরণ দেখে, মাধুর খুব কষ্ট হয়। প্রচণ্ড কান্না পায়। অনুপম সামান্য বিষয়ে কথা কাটাকাটি হলেও রেগে গিয়ে বলে,
-‘আমার সংসার ভাল না লাগলে তুমি চলে যেতে পারো।
এই মানুষটাকে ছেড়ে কোথায় যাবে মাধু? মানুষটা কেমন চোখের সামনে একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে। আবার রাগ পড়ে গেলে অনুপম, মাধুকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো আদর করে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোলের মাঝে নিয়ে বসে থাকে। আদরে আদরে মাধুও, অনুপমের করা তিক্ত ব্যবহার ভুলে যায়। মলিন কণ্ঠে বলে,
-‘কী হয়েছে তোমার? তুমি এমন করছো কেন?
অনুপম উত্তরে কিছুই বলে না। বাচ্চা দুটোকে বুকের মাঝে আগলে ধরে ঘুমায়। ইদানীং অনুপমের মুড মেজাজ প্রায় সময় খিটখিটে থাকে। ভাল কথাও গায়ে সয় না। বুকের ব্যথাটা বেড়েছে। কাশিও সারছে না। হাতে টাকা হলে একবার বড় ডাক্তার দেখাতে হবে।
অভির স্কুল বন্ধ। ছেলে বায়না ধরেছে। সে তার দাদু, ঠাম্মার কাছে বেড়াতে যাবে। মাধুও হাঁপিয়ে উঠেছে। কয়দিন দুরত্ব বজায় থাকলে স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা বাড়ে, তিক্ততা কমে। অনুপমকে বলতেই সে একবাক্যে রাজি হয়ে গেল। বলল,
-‘আমার তো হাতে ছুটি নেই। আগামী বৃহস্পতিবার তোমাদের রেখে আসব কেমন?
-‘ আচ্ছা।
মাধু যেদিন এই বাসা ছেড়ে চলে গেল। অদ্ভুত কারণে সেদিন চলে যেতে মাধুর যেন কেমন লাগল। বড় শখের নিজের হাতে তিলে তিলে গড়া সংসার মাধুর। এই মায়ায় জড়ানো সংসার, ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে দূরে কোথাও গিয়েও যে বেশিদিন মন টিকে না। সারাক্ষণ মাথায় কুটকুট করে। অনুপম একা একা কী করছে, কী খাচ্ছে, মানুষটা সুস্থ আছে তো! বাচ্চাদের জ্বালায় একান্তে ফোনে বেশিক্ষণ কথাও বলা যায় না। দুজন ফোন টানাটানি করে। কে আগে বাবার সাথে কথা বলবে! মাঝে মাঝে মাধুর এত বিরক্ত লাগে।
এবার গ্রামে এসে অনুপম খুব প্রাণবন্ত হয়ে গেল। বন্ধুবান্ধবদের সাথে পাল্লা দিয়ে সাঁতার কাটা, মাছ ধরা, মাধুকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো৷ বাচ্চাদের সাথে ছোটাছুটি করা। যাওয়ার দিন রাতে মাধুকে দুচোখ জুড়িয়ে, মন ভরে দেখে নিল। মাধু লজ্জা পেয়ে বলল,
-‘এভাবে তাকিয়ে থেকো না তো। লজ্জা লাগে।
অনুপম ঘোর লাগা কণ্ঠে বলল,
-‘লাগুক। বলেই মাধুর চিবুকে চুমু খেলো। মাধু, অনুপমের বুকে মাথা রাখল। অনুপম, শান্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আবেগী কণ্ঠে বলল,
-‘তোমার ছেড়ে আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। চলো না মাধুসোনা কাল আমার সাথে?
-‘অভি রাজি হবে না। দ্যাখো না ছেলেটা গ্রামে এলে একদম যেতে চায় না।
-‘অভি তাহলে থাকুক। তুমি মেয়েকে নিয়ে চলো?
-‘লোকে কী বলবে?
অনুপম বলল,
-‘তোমার মনে আছে মাধু। বিয়ের রাতে তুমি কী কান্ডটাই না করেছিলে। আমাদের প্রথম কাছে আসার রাতটাও আমি খুব খুব উপভোগ করেছি। মাঝে মাঝেই সেই সুন্দর রাতটার কথা মনে পড়ে আমার। অনুপম একটু বিরতি নিয়ে আবারও বলল,
-‘আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া তুমি মাধুসোনা। তুমি ইহজনমে শুধু আমার হয়েই থেকো কেমন?’
-‘আমি তো তোমারই।’
গভীর রাতে অনুপম আকুল ভাবে নিজের করে পেতে চাইল মাধুকে। মাধুও আপত্তি করল না। দূরে সরে গেল না। অনুপমের ভালোবাসার মোহময় ডাকে সারা দিল মাধু। নিজের সবটুকু উজার করে ভালোবাসল অনুপমকে। ইশ, তীব্র সুখের সময়টা যদি এখানেই চিরদিনের মতো আটকে দেওয়া যেত। তাহলে বোধহয় মন্দ হতো না।
বিকেলের দিকে অনুপম চলে গেল। যাওয়ার আগে মাধুকে অনেকক্ষণ বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে রইল। ঠোঁটে ঠোঁট রাখল। গভীর চুমু এঁকে দিল। তারপর কী মনে করে মাধুর শাড়ির আঁচল সরিয়ে বুকের একটু গভীরে এত জোরে কামড় বসিয়ে দিল। ব্যথায় মাধু চিৎকার করে উঠল। চোখ দিয়ে জল পরছে। অনুপম হেসে দিয়ে বলল,
-‘ভালোবাসার চিহ্ন রেখে গেলাম মাধুসোনা। আমার অনুপস্থিতিতে এই চিহ্নটা তোমাকে সবসময় আমার কথা মনে করাবে। মাধু কেঁদে দিয়ে বলল,
-‘ইশ, মনে হয় সারা জীবনের জন্য আমাকে রেখে চলে যাচ্ছ? তুমি এত পাষাণ। এভাবে কেউ কামড় দেয়? দেখছ, এখনো রক্ত পরছে? এই দাগটা হয়ত সারাজীবনেও মিশবে না।
-‘কিছু কিছু দাগ সারাজীবন থাকায় শ্রেয়।
অভি, অনু দৌঁড়ে এলো। অনুপম হাঁটু মুড়ে বসে ছেলেমেয়ে দুটোকে খুব খুব আদর করে দিল। রেণুবালাকে ডেকে বলল,
-‘ওদের দেখে রেখো মা।
-‘রাখব বাবা।
-‘অনিকেত এইমাসে বাড়ি আসবে না?
রেণুবালা ব্যঙ্গ করে বলল,
-‘সে এখন সাহেব হয়েছে। বউ, জেঠু, জেঠী নিয়ে শহরে থাকছে। তাদের তো আপন মা-বাপ ভাল লাগে না।
-‘ওভাবে বলো না মা। জেঠু কত বড় চাকুরী পাইয়ে দিয়েছে ওকে। ও তো বাড়িতেও তোমাদের জন্য টাকা পাঠায়।
-‘সেই! তোমরা দুইভাই টাকা পাঠিয়েই বাপ-মায়ের সব দায়িত্ব শেষ করো।
-‘তোমার খুব ইচ্ছে করে..তাই না মা সবাইকে আগের মতো একসাথে নিয়ে থাকতে?
-‘সে করবে না? সারাজীবন একান্নবর্তী পরিবারে কাটিয়ে এসেছি। বুড়ো বয়সে একা একা ভাল লাগে না কী?
-‘একদিন তোমার মনের আশা পূরণ হবে মা।
-‘আর কবে পূরণ হবে! এক পা চিতেই তুলে দিয়ে রেখেছি!
-‘ওভাবে বলো না মা। শুনতে ভাল লাগে না। আসি কেমন? দেরি হয়ে যাচ্ছে।
বাবা অনুপমকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে এলো। রাতে পৌঁছে গিয়ে ফোন দিল।
মাধু বলল,
-‘ভালো মতো পৌঁছেছো?
-‘হ্যাঁ।’
-‘খাবারগুলো গরম করে খেয়ে নাও?
-‘তুমি খেয়েছো?
মাধু বলল,
-‘তোমাকে রেখে আমি কখনো খেয়েছি?
-‘এই বদঅভ্যাস গুলো ছাড়ো মাধুসোনা। আমি যখন থাকব না। তখন খুব কষ্ট হবে।
-‘ওমা…এ কী অলক্ষুণে কথা?
-‘না মানে আমার বয়স বেশি। হিসেব মতো তোমার থেকে আগে তো আমারই মরার কথা।
-‘ছিঃ ছিঃ চুপ করো। রোজ ভগবানের কাছে বলি, আমি যেন শাঁখা, সিঁদুর নিয়ে মরতে পারি।
-‘এত ভালোবাসো আমায়?
-‘জানি না।”
-‘বলো না? কখনো তো ভালোবাসার কথা তোমার মুখ থেকে শোনা হলো না।
-‘ধেৎ..এগুলো আবার বলতে হয় না কী?
-‘একটিবার বলো প্লিজ?
অভি ঘরে এসে বলল,
-‘আমাকে ফোনটা দাও না মা? আমি বাবার সাথে কথা বলব?
মাধু ফোনটা ছেলেকে দিয়ে দিল। ছেলে বাপের সাথে কতক্ষণ গল্পগুজব করে ফোন রেখে দিল। মাধুর আর বলা হয়ে উঠল না। সে কতটা ভালোবাসে অনুপমকে। সদ্য কামড় দেওয়া বুকে মাধু হাত বুলাল। এত বয়স হলো। অথচ এখনো মানুষটার পাগলামি একবিন্দুও কমেনি।

পরদিন সকালের জলখাবার বানিয়ে, শ্বশুর শাশুড়িকে খেতে দিয়ে বাবুদেরও খেতে দিল। নিজেও এক ফাঁকে চট করে খেয়ে নিল। দুপুরের রান্নাটা সেরে পুকুরপাড় থেকে স্নান সেরে আসল মাধু। সবার দুপুরের খাওয়া হয়ে গেছে। শুধু মাধু বাদে। মাধু ভেজা কাপড় পাল্টে, মাথা ভর্তি সিঁদুর পরল। পায়ে আলতা পরার সময় আচমকা নীচ থেকে এত জোড়ে কান্নার শব্দ ভেসে এলো। মাধুর বুকের ভেতর ধক করে উঠল। ছেলেমেয়ে দুটো সাঁতার জানে না। ওদের কিছু হলো না তো? দূর আকাশে দুটো কাক কা..কা.. করতে করতে উঁড়ে গেল। মাধু তাড়াহুড়ো করে উঠতে গেল। পা লেগে আলতার শিশিখানা ভেঙে গেল। হাত ফস্কে সিঁদুরের কৌটাটা মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল। সিঁদুরের উপর দিয়ে পায়ের ছাপ ফেলে মাধু দৌঁড়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় শাড়ির আঁচল লুটিয়ে পরল। ঐ ওতটুকু পথ যেন ফুরায় না। দৌঁড়ে উঠানে গিয়ে দেখল। রেণুবালা চিৎকার করে কাঁদছে, বাড়িতে কত মানুষ জমে গেছে। মাধু, রেণুবালার মুখোমুখি দাঁড়াল। জলে চোখদুটো টলমল করছে। সবাই মাধুর দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে। খোলা চুল, মাথায় কাপড় নেই, সিঁথি ভর্তি সিঁদুর। পায়ে আলতা৷ এ যেন সাক্ষাৎ লক্ষ্মীপ্রতিমা। রেণুবালা আচমকা মাধুকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরল। মাধুর গালে, কপালে পাগলের মতো চুমু খেলো। কান্নার জন্য কোন কথাই বলতে পারল না। মাধুও ভয় পেয়ে ছেলেমেয়ে দুটোকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল। রেণুবালা হেঁচকি তুলে সবচেয়ে ভয়ংকর খবরটা দিল। বলল,
-‘আমার বড়খোকা আর বেঁচে নেই গো বড়বৌমা…
মাধুর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। মনে হয় কেউ বুকের ভেতরের আত্মাটা কামড়ে ধরেছে। এত ব্যথা করছে। মাধুর বিশ্বাসই হচ্ছে না। কাল রাতেও তো মানুষটার সাথে ফোনে কথা হলো। মাধু কী করবে বুঝতেই পারল না। অনুভূতি শূণ্যে হয়ে কত কষ্টে যে দমটা ছাড়ল! রেণুবালা, মাধুর সিঁথিতে হাত বুলিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলল,
-‘আজকের পর থেকে এই সিঁথিতে আমার বড়খোকার নামে আর কোনদিনও সিঁদুর উঠবে না বড়বৌমা। এই সিঁথিটা ধবধবে সাদাই রয়ে যাবে চিরকাল। মাধু স্তব্ধ হয়ে ধপ করে মাটিতে বসে পরল। হাত-পা অসম্ভব কাঁপছে। বুকের ভেতর তীব্র ব্যথায় ভেঙে আসছে। এভাবে কতক্ষণ কাটল কে জানে। এ্যাম্বুলেন্সটা যখন লোহার গেইট পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকলো। তখন আর মাধুকে কিছুতেই ধরে রাখা গেল না। সদ্য স্বামী হারানো এক নারীর আত্মচিৎকারে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে গেল। মাধুকে কিছুতেই ধরে রাখা গেল না। মাধু, অনুপমকে হন্ন হয়ে খুঁজছে আর চিৎকার করে বলছে,
-‘কী হয়েছে আমার স্বামীর? আরে তোমরা কেউ কিছু বলছ না কেন?
শীতলপাটি বিছিয়ে উঠানে অনুপমের মরাদেহখানা নামানো হলো। সাদা কাপড় দিয়ে শরীর ঢাকা, গলায় সাদা ফুলের মালা, বুকে গীতা, চোখে তুলসি, কপালে তিলকের ফোঁটা। মাধু, অনুপমের প্রাণহীন রক্তশূণ্য মুখখানায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিল। চোখ দিয়ে অনবরত জল পরছে। বিড়বিড় করে বলল,
-‘এরকম তো কথা ছিল না? তুমি আমায় কেন ফাঁকি দিয়ে চলে গেলে? আমি এখন কী নিয়ে থাকব? শেষের কথাগুলো অনুপমের মরাদেহ জড়িয়ে ধরে বলল মাধু। সারা মুখ চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিল। কেউ টেনে হিঁচড়েও মাধুকে, অনুপমের উপর থেকে সরাতে পারছে না। মাধু কেমন পাগলামি করছে। অনুপমে গালে হাত রেখে বলল,
-‘এ্যাই তুমি উঠছ না কেন? উঠো বলছি? আমাদের ফাঁকি দিয়ে কোথায় যাবে তুমি? এবারও আমার কথা ভাববে না? বাচ্চাগুলোর কথা ভাববে না? তোমাকে ছাড়া আমি একা একা কী করে থাকব? আমাদের কার কাছে রেখে গেলা তুমি?
তোমাকে ছাড়া আমি কিন্তু একদম থাকতে পারব না। আমার কেমন দম বন্ধ হয়ে আসছে! বুকের ভেতর জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। নিশ্বাস নিতে পারছি না।

খবর পেয়ে সব আত্মীয়-স্বজন একে একে আসতে শুরু করেছে। বড়দি এসে মাধুকে জাপ্টে ধরে হু হু করে কেঁদে দিল। মাধু কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-‘ও বড়দি…বড়দিরে মানুষটাকে উঠতে বল না? তোর কথা তো শুনে। ওকে এইভাবে শুয়ে থাকতে দেখে আমার কিন্তু একটুও ভাল লাগছে না বড়দি।
বড়দি কী বলবে? তার ছোট বোনের জীবনে এতবড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে। ভেবেই শিউরে উঠল। ঝর্ণারানী কাঁদতে কাঁদতে নাতনীকে কোলে তুলে নিল। ছোট অভিও বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাপুস নয়নে কাঁদছে। অনিকেত উঠানে গড়াগড়ি পেড়ে কাঁদছে। নিখিলেশবাবু খুব ভেঙে পরেছে। জয়ন্ত খবর পেয়ে রিধীকাকেও নিয়ে এসেছে। রিধীকা বড়দাভাইয়ের মরাদেহ দেখে ভয়ে গুটিয়ে গেল। জয়ন্ত জড়িয়ে ধরতেই কেঁদে বুক ভাসালো। এত কান্না, এত আহাজারি, এত হাহাকার যে মানুষটাকে কেন্দ্র করে। সেই মানুষটা আজ ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। শত ডাকলে বা মাথা ঠুকে মরে গেলেও মানুষটা আর সারা দেবে না, ফিরে আসবে না। অনুপমের অফিস কলিগদের কাছে এগিয়ে গেল জয়ন্ত। বলল,
-‘বড়দার কী হয়েছিল?
-‘সঠিক জানি না। তবে ওনার রিপোর্ট দেখে জানতে পেরেছি ওনি ফুসফুসে ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিল। ক্যান্সার পুরো মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়েছিল। আজ অফিসে গিয়েও বেশ কয়েকবার বমি করেছে। অনুপমের না কী প্রচণ্ড মাথাব্যথা করছিল। হঠাৎ খিঁচুনি শুরু হয়। করুণ কণ্ঠে বলে, -‘আমার বাসার টেবিলের ড্রয়ারে রিপোর্টগুলো আছে। আমার যদি কিছু হয়ে যায়। ওগুলো আমার বাড়ির লোকদের দিয়ে দিয়েন। বলতে বলতে রাস্তায়ই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
জয়ন্ত বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই মাটির দেহখানা নিয়ে আমরা কত অহংকার করি, গর্ববোধ করি, অথচ দেহ থেকে দমটা ফুরিয়ে গেলেই সবশেষ।
জয়ন্ত, অনিকেতকে বলল,
-‘সবাই তো এসে পড়েছে। বড়দার মরাদেহ এভাবে তো ফেলে রাখা যাবে না। শ্মশাণে নিয়ে যেতে হবে।
অনিকেত চোখ মুছে উঠে পরল। কেন যে সুর করে দুটো লাইন বিড়বিড় করে গেয়ে উঠল,

“কাঁচা বাঁশের পালকিটা আজ সাজারে তোরা”
”এই রাত পোহালে হয়ে যাবে বাঁশি মরা”
”যতই ডাকো নাম ধরিয়া আর দেবে না সারা”
”এই রাত পোহালে হয়ে যাবে বাঁশি মরা”

একদিকে অনুপমের মরাদেহ জলন্ত আগুনে মটমটিয়ে পুড়ছে। অভি প্রথম বাবার মুখে নিয়ম মেনে আগুন দিল। তারপর অনুপমের শীতল হাত-পা ভেঙে দিতেই পুরো শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে কয়েকজন বিধবা মহিলা মিলে মাধুর শাঁখা, পলা, সিঁথির সিঁদুর মুছে দিল। পায়ের আলতা ঘষে ঘষে উঠিয়ে দিল। ঠান্ডা জলে জোর করে চেপে ধরে একডুব দেওয়াল। তারপর গা থেকে রঙিন শাড়ি খুলে সাদা শাড়ি পরিয়ে দিল। মাত্র সাতাশ বছর বয়সে মাধু বৈধব্য বরণ করে নিল। রেণুবালাও মনে মনে পণ করল, ‘আজকের পর থেকে সে আর কোনদিনও মাধুর সামনে সিঁথিতে সিঁদুর পরবে না। চোখের সামনে সদ্য স্বামী হারানো বিধবা বউটা ঘুরে বেড়াবে আর সে তার সামনে মাথাভর্তি সিঁদুর পরে ঘুরবে। খারাপ শাশুড়ী হলেও এতটা খারাপ মা তিনি এখনো হতে পারেননি। পনেরোদিন পর অনুপমের শ্রাদ্ধ করে মাধুকে মাধুর বাবা-মা নিয়ে যেতে চাইল। মাধু স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিল। সে এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না। বাকিটা জীবন অনুপমের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে, বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ীর সাথে ছেলেমেয়েদুটোকে নিয়ে এই বাড়িতেই কাটিয়ে দেবে। মাধু যে মানুষটাকে কথা দিয়েছিল, ইহজনম মাধু শুধু ঐ পাষাণ, হৃদয়হীন, নিষ্ঠুর মানুষটার হয়েই থাকবে।’

(সমাপ্ত)

লজ্জাবতী পর্ব-১৩

0

#লজ্জাবতী
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব-১৩

নিখিলেশবাবু খবর পেয়ে অন্দরমহলে ছুটে এলেন। স্ত্রী’র স্বভাব তার বেশ জানা আছে। অনিকেতকে নীচু অথচ শীতল কণ্ঠে বলল,
-‘এই মেয়েটাকে নিয়ে তোর রুমে যা। বাড়িটা ফাঁকা হোক। তারপর এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করব আমরা। রেণুবালাও রাগে কাঁপতে কাঁপতে অনিকেতের পিছু পিছু ওদের ঘরে ঢুকে গেল। তার আসলে মাথা কাজ করছে না। কেমন পাগল পাগল লাগছে। একবার মনে হচ্ছে অনিকেতকে ইচ্ছেমতো পিটাতে তো আরকবার মনে হচ্ছে এই মেয়েটার চুলের মুঠি ধরে ঘুরাতে। অনিটার বয়স কম, পড়াশোনা শেষ হয়নি, ইনকাম করে না। মেয়েগুলোও যাতা অবস্থা। কী দেখে যে এই সব কম বয়সী বেকার ছেলেপুলের হাত ধরে ঘর ছাড়ে কে জানে! তবে রেণুবালা এই বিয়ে কিছুতেই মেনে নেবে না। রেণুবালা খাটে হেলান দিয়ে বসল। মেয়েটা ঘরের এক কোণে জুবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একদম পুতুল পুতুল টাইপ সুন্দর চেহারা। সাধারণত এত সুন্দর মানুষ সচরাচর এই গ্রামে দেখা যায় না। পশ্চিম আকাশের লাল রঙা সূর্যটা জানালার ফাঁক গলে মেয়েটার সারামুখে লুটিয়ে পড়েছে। সিঁদুর রাঙা সিঁথি দেখতে কী যে ভাল লাগছে। অনিকেত মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে তার সদ্য বিয়ে করা বউয়ের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হাত-পা একটু একটু কাঁপছে।

রাতে অনিকেতের ঘরে বিশাল বৈঠক বসল। নিখিলেশবাবু, অনিকেতের মুখোমুখি বসল। বলল,
-‘মেয়েটার নাম কী?
-‘পরী।
-‘কতদিনের চেনাজানা?
-‘দেড় বছর।
-‘কী এমন হয়েছিল। যে বলা নেই কওয়া নেই। তুই বিয়ে করে সরাসরি বাড়িতে এনে উঠালি?
-‘আজ রাতে পরীর বিয়ে ছিল। তাই আমি আর রিস্ক নেইনি।
রেণুবালা উত্তেজিত হয়ে ঠাস ঠাস করে অনিকেতের গালে দুটো থাপ্পড় মারল। চিৎকার করে বলল,
-‘অসভ্য, জানোয়ার, তোর বিয়ের বয়স হইছে? তুই তো নিজেই বাপ, ভাইয়ের টাকায় ফুটানি করে চলিস। তোর বউকে খাওয়াবি কী? আজকের পর থেকে তোর সমস্ত হাতখরচা দেওয়া বন্ধ। আমিও দেখব, এই লুতুপুতু বিয়ে বিয়ে নাটক কতদিন টিকে।
নিখিলেশবাবু বিরক্ত হয়ে বলল,
-‘আহ্ রেণু আমি কথা বলছি তো?
-‘তুমি আর কী বলবা? ঝাড়ু দিয়ে পিটিয়ে দুইটাকে বাড়িছাড়া করব আমি।
-‘চুপ…মহিলা।
নিখিলেশবাবু এত জোরে ধমক দিল। রেণুবালা কেঁপে উঠল। আঁচলে মুখ গুঁজে শব্দ করে কাঁদতে লাগল।
নিখিলেশবাবু, মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘তোমার বাবার জাতি ব্যবসা কী?
মেয়েটা মাথা নীচু করে সরল মনে বলল,
-‘মলমূত্র পরিষ্কার করা।
নিখিলেশবাবু চমকে উঠল। রেণুবালার মাথা ঘুরে উঠল। অস্ফুট স্বরে বলল,
-‘তুমি মেথরের মেয়ে? ছিঃ ছিঃ অনি শেষে কী না তুই আমাদের বংশের মান ডুবালি? এত নীচু জাতের মেয়ে কেউ বিয়ে করে? আমার তো ভাবতেই গা গুলিয়ে উঠছে। এই মেয়ে সরে দাঁড়াও। তোমার গা থেকে গু গু গন্ধ বের হচ্ছে। ওয়াক..ছিঃ
মেয়েটি এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার আর চুপ থাকতে পারল না। বলল,
-‘মাফ করবেন। আমরা নীচু জাত হতে পারি। তবে অমানুষ না। আপনি আমাকে দেখে এমন করছেন কেন? তাকিয়ে দেখুন আমার গায়ের রঙ আপনার থেকেও ফর্সা। আর আমার গা দিয়ে গু’র গন্ধ না বরং আপনার গা থেকে জর্দার বাজে গন্ধ আসছে!
রেণুবালা রেগে গেল। বলল,
-‘এই মেয়ে কী বললি তুই? দুইদিনের ছুড়ি। নাক টিপলে দুধ পরে। এই বয়সে না*ঙ ধরা শিখে গেছো।
অনিকেত ইশারায় পরীকে চুপ থাকতে বলল। এই ছটফটে মেয়েটা সে কথা শুনলে তো! দু’পা এগিয়ে গিয়ে রেণুবালার মুখোমুখি দাঁড়াল। বলল,
-‘বেশ তো আমার নাক টিপে দুধ বের করুণ আপনি? আমিও দেখি কত কেজি দুধ বের হয়।
রেণুবালার জ্ঞান হারানোর জোগাড় হয়েছে। অনিকেতকে বলল,
-‘এই নীচু জাতের মেয়েকে নিয়ে এক্ষুনি এই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাবি তুই।
পরী বলল,
-‘কেন যাব আমরা? এটা যেমন আপনার স্বামীর ঘর। তেমন আমারও স্বামীর ঘর। আপনি যদি আমাকে বেশি জ্বালান তাহলে আমি থানায় গিয়ে বধূ নির্যাতনের মামলা ঠুকে দেব।
-‘এই মেয়ে তোমার বয়স কত? তোমার এত বড় সাহস তুমি আমাকে পুলিশের ভয় দেখাও?
-‘আমার বয়স চব্বিশ বছর। আপনার ছেলের থেকে গুনে গুনে দুই বছরের বড়।
রেণুবালা আবারও অনিকেতের গালে থাপ্পড় মারল। চেঁচিয়ে বলল,
-‘শেষে কী না তুই এই নীচু জাতের পাকনা মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে আসলি?
অনিকেত পইপই করে পরীকে বারণ করেছে। ভুলেও তোমার বয়স বেশি এই বাড়ির কাউকে বলবে না। এই মাথামোটা মেয়েটা সে কথা কানেই নেয়নি।
নিখিলেশবাবু হতাশ বোধ করলেন। একে তো তার ছেলে পরের মেয়ে বের করে নিয়ে এসেছে। তার উপর মেয়েটার নীচু বংশ। কী যে লজ্জা লাগছে তার। তিনি যে এখন কী করবেন ভেবেই পেল না। অনুপম এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিল। বাবাকে চুপ থাকতে দেখে, নীচু কণ্ঠে বলল,
-‘কী ভাবছ বাবা?
-‘এখন কী করব বড়খোকা? মাথা কাজ করছে না।
-‘অনিটা ছোট বাবা৷ একটা ভুল নাহয় করেই ফেলেছে। ওকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া ঠিক হবে না।
-‘তাহলে মেয়েটার কী হবে?
-‘ওর বাড়ির লোকজনকে খবর দেওয়া হোক। তারা আসুক। কথা বলে দেখা যাক। কী হয়!
পরীকে বিভিন্ন ভাবে ভয় দেখিকে পরীর বাবার নাম্বার নেওয়া হলো। অনুপম নিজের পরিচয় দিতেই লোকটা অনুপমকে একগাদা কটুকথা শুনিয়ে যা তা ভাষায় অপমান করে ফোন রেখে দিল। পরী নামের না কী তার কোন মেয়ে নেই। একটা মেয়ে ছিল আজ থেকে মৃত। অনুপম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবাকে সবটা জানাল। রেণুবালা আগেই জানিয়ে দিয়েছে অনিকেতের বউকে নিয়ে সে কিছুতেই খাবে না। বাবা, অনিকেতকে বলল,
-‘তোর বউকে নিয়ে সংসার করবি আমার কোন সমস্যা নেই। তুই এই বাড়িতেই থাকবি তবে আজ থেকে আমাদের হাঁড়ি আলাদা। পারলে রোজগার করতে শিখ। বিয়ে যখন একা একা করেছিস। বউয়ের চাহিদা, সংসার খরচ নিজের টাকায় করতে শিখ। আমার পক্ষে দুটো সংসার টানা সম্ভব না।
হঠাৎ অনিকেতের জ্যাঠা বলে উঠল।
-‘আজ থেকে অনিকেত বউকে নিয়ে আমাদের সাথে খাবে। আমরাও ওদের দুইজনকে নিয়ে আলাদা সংসার পাতব। এবং আমার যাবতীয় টাকাপয়সা আমি অনিকেতের নামে রেখে যাব। বুড়ো বয়সে আর যাযাবর হয়ে আমাদের বুড়ো, বুড়ির ঘুরে বেড়াতে ভাল লাগছে না। আমরা এক জায়গায় থিতু হতে চাই।
-‘দাদা..?
-“হ্যাঁ নিখিলেশ তোর বউ অসুস্থ। আমাদের দুজনের জন্য বাড়তি রান্না করতে তারও কষ্ট হয়। এদিকে তোর বৌদি কোন কাজই করতে পারে না এখন আর। সবকিছু বিবেচনা করেই আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অনিকেত পড়তেছে পড়ুক। আমি ওকে ঠিকই একটা না একটা সরকারি চাকুরী পাইয়ে দেব দেখিস। এখন থেকে ওদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করার দায়িত্ব আমাদের।
অনিকেত হাফ ছেড়ে বাঁচল। এই কথার পর আর কারো কোন কথাই থাকে না।

এই তো সেদিন মাথা ভর্তি সিঁদুর পরে, আলতা রাঙা পায়ের ছাপ ফেলে, মাধু এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিল। আজ তাদের বিয়ের একযুগ বেড়িয়ে গেল। প্রাপ্তির খাতায় আরও একজন নতুন মুখ যোগ হয়েছে। হ্যাঁ মাধু অনুপমের আরও একটি ফুটফুটে মেয়েবাবু হয়েছে। মেয়েটার সবে মুখে বুলি ফুটেছে। গুটিগুটি পায়ে সারাবাড়ি হেঁটে বেড়ায়। আর ছেলেটার গেছে মাসে এগারো বছর পূর্ণ হলো। আজ অনুপম, মাধুর বারো বছরের ‘বিবাহবার্ষিকী’। সেই উপলক্ষে অনুপম বিশাল আয়োজন করেছে। অনুপমের অফিস কলিগরা ভরপেট খেয়েদেয়ে বিদায় নিতেই অনুপম মাধুকে পেছন থেকে জাপ্টে ধরল। মাধু ছটফটিয়ে উঠল। অনুপম মাধুর গালে গাল ঘষে বলল,
-‘তোমাকে এখনো স্পর্শ করলে সেই প্রথম দিনের মতো অনুভূতি হয় মাধুসোনা।
মাধু, অনুপমের একটু একটু ভুঁড়ি উঁকি দেওয়া পেটে গুতো দিয়ে বলল,
-‘ইশ, বুড়োর ঢঙ দেখে বাঁচি না। ছাড়ো তো! বাচ্চাগুলো ঐ ঘরে কী করছে। দেখে আসি!
অনুপম আর একটু শক্ত করে মাধুকে চেপে ধরল। মাধুর গালে নাক ঘষে বলল,
-‘আজ রাত শুধু তোমার আমার। বাচ্চাগুলোকে তাড়াতাড়ি ঘুম পাড়িয়ে দাও। তারপর শুধু তুমি আর আমি…
-‘উফ, ছাড়ো তো। এই বয়সেও এত প্রেম কোত্থেকে আসে তোমার?
অনুপম, মাধুর হাতটা নিজের বুকের মাঝে রেখে বলল,
-‘এখান থেকে মাধুসোনা।
মাধু, অনুপমের কাছ থেকে নিজেকে জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে লাজুক হেসে চলে গেল।
দিনগুলো যখন দুষ্টু, মিষ্টি ঝগড়া, খুনসুটি, মান-অভিমান, ভালোবাসায় কেটে যাচ্ছিল।
তখনই সেই ভয়াবহ খবরটা এলো। একটা ফোনকল, একটা চিরসত্য। একদম সবাইকেই ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিল। এমনটা কী আদৌও হওয়ার কথা ছিল? হয়ত ছিল। হয়ত ছিল না।

(চলবে)

লজ্জাবতী পর্ব-১২

0

#লজ্জাবতী
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব-১২

মাধু, শাশুড়ীর চাউনি দেখে, কুণ্ঠিত বোধ করল। মুখে হাসি টেনে বলল,
-‘আন্টির কাছে আছে। আমি নিয়ে আসছি!
মাধু চলে যেতেই রেণুবালা, অনুপমকে বলল,
-‘এ কেমন কথা বড়খোকা? বলি, তোর বউয়ের বোধবুদ্ধি এখনো হলো না। ওতটুকু বাচ্চাকে কেউ আরেকবাড়ি দিয়ে রাখে? যদি বদনজর লেগে যায়?
-‘আরে কিছুই হবে না মা। আন্টি খুব ভাল মানুষ।
-‘ভাল হলেই ভাল।
রেণুবালা পুরো বাসা ঘুরে ঘুরে দেখল। এত জিনিসপত্র দেখে ভেতরে ভেতরে জ্বলে গেল। মাধু বাবুকে এনে মায়ের কোলে তুলে দিল। রেণুবালা কোলে নিয়ে নাতীর কপালে চুমু খেল। খুশিমনে বলল,
-‘একদম আমার বড়খোকার মতো দেখতে হয়েছে।
মাধুকে বলল,
-‘এত বাড়তি জিনিসপত্র কিনে, শুধু শুধু এত টাকা নষ্ট করেছ কেন বড়বৌমা? আমার ছেলের কষ্টের রোজকার। একটু হিসেব করে চলতে শিখো।
মাধু বুঝতেই পারল না। বাড়তি কী এমন জিনিস কেনা হয়েছে! তবে মুখে কিছু বলার সাহস পেল না৷ বলল,
-‘মা হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নিবেন, চলুন?
মাছের বড় মাথা, মুরগির রান রেণুবালার পাতে তুলে দিল মাধু। রেণুবালা খুব তৃপ্তি করে খাচ্ছে। হঠাৎ অনুপমের, মাধুকে নিজের থালা থেকে তুলে জোর করে খাইয়ে দেওয়ার দৃশ্য দেখে, রেণুবালার মনটা তিক্ততায় ভরে গেল। দুজনের আদিখ্যেতা দেখে, রাগে শরীর চিড়বিড়িয়ে উঠল। খাওয়ার রুচি চলে গেল। শুকনো কণ্ঠে বলল,
-‘এভাবে খাইয়ে দিলে নিজের পেট ভরে না কী? তুই খেয়ে নে। বড়বৌমা পরে খাবেক্ষণ।
-‘একদম খেতে চায় না মা। তোমার বৌমার না খেতে খেতে দেখেছ, শরীরের অবস্থা কী করেছে? মাধু হা করো তো?
শাশুড়ীর সামনে এভাবে খেতে মাধুর খুব লজ্জা লাগছে। এই ঘাড়ত্যাড়া ছেলেটা সে কথা বুঝতে তো।
বিয়ের এত বছরেও অনুপমের বাবা এভাবে রেণুবালাকে সাথে নিয়ে খায়নি। নিজের অপ্রাপ্তি গুলো একে একে চোখের পাতায় ভেসে উঠতেই মনটা বিষণ্নতায় ভরে গেল।
অনুপম খেয়েদেয়ে সবার এঁটো থালাবাসন চট করে গুছিয়ে ফেলল। মাধু সোফায় বসে বাবুকে ব্রেস্টফিডিং করাচ্ছে। রেণুবালা ছিঃ ছিঃ করে উঠল। বলল,
-‘এসব কী বড়খোকা? আর কত অধঃপতন দেখব এই চোখে? ব্যাটাছেলে হয়ে তুই এগুলো করছিস কেন?
অনুপম থালাবাসন মাজতে মাজতে বলল,
-‘মা তুমি ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও। এগুলো তোমাকে দেখতে হবে না। বাবুর ঠাণ্ডা লাগবে। এই ভয়ে, আমি যতক্ষণ বাসায় থাকি। মাধুকে আমি জলের কোন কাজই করতে দেই না। মাধু এতটুকু ডিজার্ভ করে মা।
রেণুবালা, মাধুর পাশে গিয়ে বসল। চাপা কণ্ঠে বলল,
-‘আমার ছেলেটাকে ভালোই বশ করেছ! এই দিনও দেখার বাকি ছিল আমার? তোমাকে বাচ্চা নিতে কে বলেছে? একটা বাচ্চা পালতে গিয়ে আমার ছেলেটাকে পুরো নাজেহাল করে ফেলেছো। আর আমরা চার-পাঁচটা বাচ্চা নিয়েও সংসারের সব কাজ নিজের হাতে করেছি। আমাদের সময় বাচ্চা নিয়ে, এত ঢঙ করার সময় ছিল না বাপু।

রাতে মাধু বাবুকে ঘুম পাড়িয়ে উঠে বসতেই। অনুপম একহাত দিয়ে নিজের কাছে টেনে নিল মাধুকে। মাধুকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে চুলে মুখ ডুবিয়ে আবেশে দুচোখ বুজে ফেলল অনুপম। মাধু মলিন কণ্ঠে বলল,
-‘মা যতদিন থাকবে। তুমি আর একটাও কাজ করবা না। কষ্ট হলেও আমিই করে নেব কেমন?
অনুপম, মাধুকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে, গালে হাত রেখে বলল,
-‘কেন মা তোমাকে কিছু বলেছে?
-‘না। বলতে কতক্ষণ?
-‘বোকার মতো কথা বলো না মাধু্। মায়ের ভয়ে আমি তোমাকে হেল্প করব না? মা সেকেলে মানুষ। যাই বলুক, তার কথা ধরে কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই। তাছাড়া আমি অফিসে চলে গেলে সব কাজ একহাতে তো তোমাকেই করতে হয়।
মাধু, অনুপমের বুকে মাথা রেখে হু..হা করে গেল। আজ সারাদিনে খুব ধকল গেছে। ক্লান্তিতে পুরো শরীর ম্যাচম্যাচ করছে। ঘুমে দু’চোখ বুজে আসছে।

ছেলে অফিস চলে গেছে। অথচ বউয়ের এখনো ঘুম থেকে ওঠার নাম নেই। সে বাবুকে বুকের মাঝে নিয়ে কী আরামেই না ঘুমাচ্ছে। রেণুবালার সহ্য হলো না। মাধুর ঘরে এসে চিৎকার করে মাধুকে ডাকল। কাঁচা ঘুম ভাঙতেই মাধু ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। পুরো মাথা ফাঁকা। মাধু ঘুম ঘুম চোখে শাশুড়ির রক্তলাল চোখের পানে তাকাল। আঁৎকে উঠে বলল,
-‘কী হয়েছে মা?
-‘কী হয়নি তাই বলো? আমার ছেলেটাকে তো ঘোড়া বানিয়ে রেখেছ! বলি, তুমি কোন নবাবের বেডি গো? যে এত বেলা পর্যন্ত পরে পরে ঘুমাও? ছেলেটা বাঁশি মুখে সক্কাল সক্কাল বের হয়েছে।
-‘আসলে মা। ছেলেটা রাতে এত জ্বালায়। তারউপর একটু পর পর উঠে ব্রেস্টফিডিং করানো লাগে।
-‘আমাকে কোন অজুহাত দেখিও না বৌমা। ভুলে যেও না। আমরাও বাচ্চা পেলেপুষে বড় করে তবেই এই পর্যন্ত এসেছি। নাতীকে আমি দেখতেছি। অভি দাদুভাই আসো আমার কাছে। অভি কোল বাছে না। হাসিমুখে রেণুবালার কোলে গেল। মাধু সকালের বাঁশি কাজকর্ম সেরে শাশুড়ীকে কলা, রুটি, ডিমসেদ্ধ খেতে দিল। শাশুড়ী শুকনো মুখে খেতে খেতে বলল,
-‘তোমার এখানে তো সারাজীবন পরে থাকব না আমি। ডাক্তার দেখিয়েই চলে যাব। বলি, যে দুটোদিন আছি। আমার পাতে গরম গরম নুচি আর ডাল দিও বড়বৌমা। এসব সাহেবী খাবার আমার মুখে রোচে না গো।
মাধু, রেণুবালার তিক্তবাক্যে শুকনো ঢোকের সাথে হজম করে নিল। মানুষটা এক বিন্দুও পরিবর্তন হয়নি। অভিকে একটু কোলে নিয়েই কোমড় ব্যথার অজুহাতে মেঝেতে নামিয়ে দিল রেণুবালা। ছেলেটা আপনমনে হামাগুড়ি দিয়ে খেলছে। মাধু রান্নার ফাঁকে এসে দেখল। অভি মেঝেতে বসে আছে। মাধু বলল,
-‘মা ওকে দোলনায় শুইয়ে দিন। কেবলই ঠাণ্ডা, জ্বর থেকে উঠল ছেলেটা।
-‘আমাকে এত জ্ঞান দিতে এসো না বড়বৌমা। তোমার থেকে এই বিষয়ে আমার একটু হলেও অভিজ্ঞতা বেশি। এত পুতুপুতু করো দেখেই বাচ্চার অসুখ সাড়ে না।
বেশি বুঝদার মানুষের সাথে তর্ক করা বৃথা। মাধু আর কিছু না বলে, অভিকে কোলে তুলে নিল। তারপর দোলনায় শুইয়ে দিয়ে বাকি রান্নাটা সেরে ফেলল। রেণুবালা কড়া কন্ঠে বলল,
-‘দুপুরে বড়খোকা খেতে এলে আবার নির্লজ্জের মতো সাথে বসে যেও না। তোমাকেই তো সব খাবার খাইয়ে দেয়। হয়ত আমার ছেলেটার পেটই ভরে না।

অনুপম দুপুরে খেতে এসে। মাধুকে খাওয়া নিয়ে জোর করল। মাধু বিরক্ত হয়ে ওদের খাবার বেড়ে দিয়ে সরে গেল। একজন ভালোবাসা দেখাবে, আরেকজন কথা শোনাবে। মাধুর ঢের শিক্ষা হয়েছে। অনুপম খেয়েদেয়ে উঠে বলল,
-‘মা বিকালে রেডি থেকো। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। সিরিয়াল দিয়ে এসেছি।আর মাধু তোমরাও রেডি থেকো আমরা মাকে ডাক্তার দেখিয়ে ঘুরতে যাব।

অনুপম মাকে ডাক্তার দেখিয়ে সিএনজি ভাড়া করে, চারজন মিলে শিশুপার্কে ঘুরতে গেল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুসকা, চটপটি, বাদাম, আইসক্রিম খেল। সারাটা রাস্তা অভি, অনুপমের কোলে চড়ে ঘুরে বেড়াল। ভুলেও মা বা মাধুর কাছে দিল না অনুপম। রেণুবালা মনে মনে বেজায় খুশি। মশলা দেওয়া পানের খিলি মুখে পুরে ছেলে, বউ, নাতীর সাথে মনের সুখে ঘুরে বেড়াল। দুই যুগেরও বেশি সময় খাঁচায় বন্দী জীবন কাটিয়ে দেওয়া মানুষটা।

রেণুবালা যাওয়ার দিন বলল,
-‘আমি ঠাকুরের কাছে মানথ করেছি। নাতীর মুখেভাতের অনুষ্ঠান বাড়িতেই করো কেমন?
-‘আচ্ছা।
-‘দিন তো চলে এলো বলে, কত মানুষকে নেমন্তন্ন করতে হবে। কত কাজ। বৌমা তুমি বরং আমার সাথে চলো?
অনুপম বলল,
-‘না মা। মাধুকে আমিই সাথে করে নিয়ে যাব। প্রয়োজনে বেশি করে ছুটি নিয়ে নেব।
-‘আমার কোমড়ের হাড়ে ক্ষয় ধরেছে। সে খেয়াল তো তোর নেই। এই বয়সে আমাদের সেবা যত্ন কে করবে? আর কতদিন বউকে নিজের কাছে রাখবি। আমরা আর বাঁচব কয়দিন। নাতী নিয়ে বড়বৌমা বাড়িতে থাকলে কী এমন ক্ষতি হবে?
-‘প্রয়োজনে আর একজন কাজের লোক রেখে দেব মা। তোমাকে আর কষ্ট করে রান্না করতে হবে না।
-‘তাও তুই বউকে রেখে আসবি না?
-‘না।
-‘আমাদের শখ করে না নাতীর সাথে সময় কাটাতে?
-‘বেশ তো তাহলে আর কিছুদিন থেকে যাও? দরকার হলে, আমি ছুটি পেলেই ওদের নিয়ে বাড়িতে বেড়াতে যাব।
-‘ভালোই বশ করেছে।
-‘মা…
-‘একদম চোখ রাঙাবি না বড়খোকা। আমাদের সংসারে কী ঝগড়া লাগত না। কত শাশুড়ীর হাতে মাইর খেয়েছি, কটুবাক্যে শুনেছি। কখনো কী আলাদা সংসার করার কথা স্বপ্নেও ভেবেছিলুম? আর এখন কী যুগ এলো। একটুকিছু হলেই তোরা কত সহজে আলাদা সংসার পেতে বসিস। শেষের কথাগুলো বলে রেণুবালা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অনুপমেরও খারাপ লাগছে। তবে কিছুই করার নেই। বউ, বাচ্চা ছাড়া থাকা এখন অনুপমের ক্ষেত্রে অসম্ভব। ওরা বেড়াতে গেলেই তো অনুপমের একা বাসায় দম বন্ধ.. দম বন্ধ অনুভূতি হয়।

‘অভির’ মুখেভাতের অনুষ্ঠানে শ্যাওলা পরা, মরিচা ধরা দু’তলা পুরোনো বাড়িটা আবারও রব রব সাজে মেতে উঠেছে। মাধুর বাবার বাড়ির দিকের আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে অনুপমের মামা, মাসি, পিসি সবাই এসেছে। শুধু আসেনি রিধীকা। অনুপম নিজে গিয়েছিল বোনের বাড়ি নেমন্তন্ন করে বোনকে নিয়ে আসতে। কিন্তু জয়ন্ত কোন আগ্রহ দেখায়নি। ফলে অনুপম নিরাশ হয়ে ফিরে এসেছে।
নিখিলেশবাবু সাদা, ধুতী, পাঞ্জাবি পরে নাতীকে কোলে নিয়ে প্রথম মুখে ভাত দিল। উলুধ্বনির আওয়াজে চারপাশ মুখরিত। উঠানে পুরো গ্রামের মানুষকে নেমন্তন্ন করে পাত পেড়ে খাওয়ানো হচ্ছে।
এর মাঝেই বাড়িতে বিশাল এক কাণ্ড ঘটল। একটি অল্পবয়সী মেয়ে, শুধু মাথা ভর্তি সিঁদুর পরে, অনিকেতের হাত ধরে বাড়িতে এসে উঠল। রেণুবালা বড় বড় চোখ করে বলল,
-‘মেয়েটা কে অনি?
অনিকেত মাথা নীচু করে বলল,
-‘আমরা বিয়ে করেছি মা।

(চলবে)

লজ্জাবতী পর্ব-১১

0

#লজ্জাবতী
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব-১১

অনুপমের রুমমেট তৌহিদ আর দিপু কোচিং শেষ করে আপনমনে এ’গল্পে, সে’গল্পে বাসায় ফিরছিল। অনুপমদের নতুন ফ্ল্যাটের মেইন দরজার সামনে, মাধুকে ওইভাবে পরে থাকতে দেখে, ওরা এগিয়ে গেল।
মাধুকে নীচু কণ্ঠে বার কয়েক ডাকল।
-‘বৌদি..? কী হয়েছে? মাধুর কোন হেলদোল নেই। সাড়াশব্দ না পেয়ে ওরা ভয় পেল। তাড়াহুড়ো করে পকেট থেকে ফোন বের করে, অনুপমকে সংক্ষেপে মাধুর বর্তমান অবস্থা জানাল। অনুপম বেসামাল হয়ে গেল। অজানা ভয়ে শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। ফোন রেখে ছেলেদুটো ওভাবে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারল না। পাশের ফ্ল্যাটের দুজন মহিলার সাহায্যে মাধুকে গাড়িতে তুলে, নিয়ে গেল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। একজন মহিলা মাধুর হাত-পা ঘষে দিচ্ছে। আরেকজন চোখে, মুখে জলের ছিটা দিয়ে মাধুকে মৃদু কণ্ঠে ডাকছে। ধীরে ধীরে মাধুর জ্ঞান ফিরতেই আবারও পেটের চিড়বিড়ে ব্যথাটা ফিরে এলো। মাধু পেট চেপে ধরে শব্দ করে কেঁদে দিল। বাচ্চার মাথা দেখা যাচ্ছে। একবার উঁকি দিচ্ছে তো আরেকবার ডুবে যাচ্ছে। তীব্র ব্যথায় মাধুর সুন্দর মুখখানা শুকিয়ে লাল হয়ে গেছে। মুখ দিয়ে গোঙানির শব্দ শোনা যাচ্ছে। এ যাবৎ কাল পর্যন্ত ছোট, বড় যত ব্যথা পেয়েছে মাধু্। মাতৃত্বের ব্যথা সব ব্যথার উর্ধ্বে। মাধুর মনে হচ্ছে এরচেয়ে মরণ যন্ত্রণাও ঢের ভাল। হাসপাতালের ও.টি তে নিতে নিতে মাধুর বাচ্চা নরমালেই হয়ে গেল। বাচ্চার মাথা পুরোপুরি বেড়িয়ে গেছে। নার্সরা দিক দিশা না পেয়ে একটা রুমে নিয়ে নরমাল ডেলিভারি করে ফেলল। বাচ্চার কান্নার শব্দে চারপাশ মুখরিত। তারপরও নার্স বাচ্চার পিঠে আলতো হাতে থাপ্পড় দিল। বাবুটা তারস্বরে আরও বেশি শব্দ করে কেঁদে দিল। তারপর মাধুর বুকের উপরে বাবুকে শুইয়ে দিল। মায়ের বুকের ওম পেয়ে বাবুর কান্না ধীরে ধীরে থেমে গেল। ক্লান্তিতে মাধুরও ঘুমে দু’চোখ বুজে এলো।
অনুপম খবর পেয়ে ছুটে এলো। ছেলেটার ঘেমে-নেয়ে একাকার অবস্থা। দুই হাঁটুর উপর হাতদুটো রেখে হাঁপাচ্ছে। নার্স বলল,
-‘আপনি পেশেন্টের কী হন?
-‘আমার ওয়াইফ।
-‘আপনার ছেলেবাবু হয়েছে।
খুশিতে অনুপমের চোখের কোণে জল জমেছে। মুখে হাসি টেনে মাধুর মাথায়, মুখে হাত বুলিয়ে দিল। নার্সকে বলল,
-‘বাবুকে কোলে নেব?
-‘এখন না। বাবু মায়ের বুকের ওম নিচ্ছে। থাকুক আর একটু মায়ের বুকে।
মাধুর হাতে স্যালাইন চলছে। অনুপম মা, ছেলের পাশে অনেক অনেকক্ষণ একভাবেই বসে রইল। মহিলা দুজন অনুপমকে বলে বাসায় চলে গেছে। ছেলে দুটো একগাদা ফল, কলা, রুটি, কিনে নিয়ে এলো। দরজায় দাঁড়িয়ে বলল,
-‘দাদা আসব?
-‘আয় ভেতরে আয়।
ওরা এসে ফলমূল, বাসার চাবি অনুপমের হাতে দিয়েই চলে যেতে চাইল। অনুপম পিছু ডেকে বলল,
-‘ভাই কত খরচ হয়েছে। আমি তো জানি না। এই মূহুর্তে এত টাকাও আমার কাছে নেই। তোদের টাকাটা আমি বাসায় গিয়ে পরিশোধ করে দেব, কেমন?
ওরা লজ্জা পেল। বলল,
-‘আচ্ছা তোমার যখন খুশি তুমি তখন দিয়ো তো।
মাধুর বাবা, মা, বড়দি, অনুপমের বাবা খবর পেয়ে রওনা দিয়েছে।
নার্স এসে বাবুকে বেশ কায়দা করে ধরে মায়ের বুকে শালদুধ খাইয়ে দিল। অনুপমকে বলল,
-‘আজ বিকালেই নিয়ে যেতে পারবেন। মা-বাচ্চা দুজনই সুস্থ আছে। তবে অনেক আগে মল ভেঙে গিয়েছিল। আরও দেরি করে এলে, হয়ত নরমালে হওয়ার কোন চান্স থাকত না।
অনুপম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মাধুর স্যালাইন শেষ হতেই অনুপম মাধুকে ধরে উঠিয়ে বালিশে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল। মাধুর এলোমেলো চুলগুলো হাত খোঁপা করে দিল। তারপর বাবুকে নিজের কোলে তুলে নিল। দুজনের কপালে চুমু খেয়ে বলল,
-‘একটু রুটি,কলা খেয়ে নাও।
মাধু মলিন হেসে বলল,
-‘আপনি খুশি তো?
-‘আমাকে খুশি করতে গিয়ে তুমি কত কষ্ট সহ্য করলে। আমি খুব স্যরি মাধুসোনা!
মাধু, অনুপমের হাতখানা নিজের গালে রেখে বলল,
-‘মন খারাপ করবেন না। বাবুটা আর একটু বড় হোক। তখন আমরা আবারও বাবু নেব কেমন? তখন মেয়েবাবু হবে। দেইখেন?
অনুপম হেসে দিল। বলল,
-‘একটাতে শখ মিটেনি তোমার?
-‘না মানে আপনার তো মেয়েবাবু পছন্দ।
অনুপম, মাধুর মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে নাক টেনে দিল। বলল,
-‘ধুর বোকা। আমি তো এমনিই মজা করে বলেছিলাম। ছেলে হলেও আমার বাচ্চা। মেয়ে হলেও আমারই বাচ্চা। একটাই আগে পেলেপুষে বড় করো না।
মাধুও মিষ্টি করে একটুখানি হাসল। বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে নতুুন এক সুখ সুখ অনুভূতির সাথে পরিচয় হলো মাধু। মনটা আত্মতৃপ্তিতে ভরে গেল। এই পুতুল পুতুল ছেলেটা মাধুর? ইশ, ভাবতেই তো একরাশ আনন্দ হচ্ছে।
অনুপম, মাধুকে নিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে উঠল। ঝর্ণারানীরা সবাই রাতের ট্রেনে এলো। ঝর্ণারানী এসেই স্নান সেরে নাতীকে কোলে তুলে নিল। বড়দি রাতের রান্না চাপাতে গেল। রাতে প্রদীপ জ্বেলে সর্ষের তেল গরম করে নাতীর সারা শরীরে মালিশ করে দিল। গ্রামের মানুষ বাচ্চা হলে বাচ্চাকে একমাস না গেলে ধরে না। একঘরে থাকে না। ঝর্ণারানীও সেই প্রচলিত নিয়মের বাইরে না। মাধুকে বলল, একমাস অন্যঘরে আর যাবি না। এইঘরেই থাকবি। অনুপম বলল,
-‘মা এইসব কুসংস্কার আমি মানি না। মাধু সারাবাসা ঘুরে বেড়াবে। ওর যা খুশি তাই করবে। আপনি প্লিজ বাঁধা দিবেন না। যেখানে স্বয়ং জামাই মানে না। সেখানে আর কিছু বলার থাকে না। রাতে অনুপম লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে বড়দিকে বলল,
-‘মাধু বরং আমার সাথে ঘুমাক?
বড়দি মুখ টিপে হেসে দিল। বলল,
-‘একটু ধৈর্য ধরো ভাই। এত তাড়া কিসের?
-‘না মানে মাধুর খুব হাত-পা চাবায়। টিপে না দিলে একদম ঘুমাতে পারে না।
-‘তারজন্য আমরা আছি তো ভাই। এই একমাস তুমি তো বউকে কাছে পাবে না। মা থাকবে মাধুর সাথে।
অনুপম অবাক হয়ে বলল,
-‘কেন, আমার বউ আমি নিয়ে ঘুমাতে পারব না কেন? কোন আইনে লেখা, বাচ্চা হলে বউকে তার মায়ের সাথে ঘুমাতে হয়? এই নিয়ম আমি মানি না।
বড়দি খুব মজা পেল। বলল,
-‘না মানে আমরা দুএকদিন থেকেই মাধুকে নিয়ে যাব তো।
অনুপম আঁৎকে উঠল। বলল,
-‘অসম্ভব। আমার বউ, বাচ্চা আমি দেব না।
-‘তা বললে তো হবে না ভাই। তখন তো তুমিই বলেছিলে!
-‘তখন তো কথার কথা বলেছিলাম।
বড়দি শব্দ করে হেসে দিল। বলল,
-‘ইশ, কী প্রেমরে বাবাহ্। শোন, বউকে যেতে দাও আর না দাও রাতে বউ পাবে না। কারণ মাধু যে ঘুমকাতুরে। ও একবার ঘুমালে বাচ্চা সারারাত খিদেয় কান্না করলেও ঠিক পাবে না। মা একটু পর পর ওকে ডেকে তুলে ব্রেস্টফিডিং করিয়ে দেবে। তাছাড়া অনেক মেয়েলী ব্যপার আছে। ও তুমি বুঝবে না।
অনুপমের খুব মন খারাপ হলো। এটা কোন কথা হলো? অনুপম বিড়বিড় করে বলল,
-‘বউ আমার, বাচ্চা আমার। অথচ আমিই না কী একমাস ওদের সাথে রাতে ঘুমাতে পারব না। ধেৎ ভাল্লাগে না।

বাবুটা দিনভর পরে পরে ঘুমালেও রাতে শুরু হয় কান্নাকাটি। রাত একটা/দেড়টা পর্যন্ত তাকে কোলে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করা লাগে। একটু বসলেও কেঁদেকেটে অস্থির। মাঝে মাঝে মাধুর এত বিরক্ত লাগে। প্রায় সময়ই মায়ের কাছে থাকে। তারপরও রাত জাগলেই মাধুর মাথা গরম হয়ে যায়। মন মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে। ঝর্ণারানী মেয়েকে চোখ রাঙানী দেয়। বলে,
-‘তুই তো তাও সুখেই আছিস। আমি আছি, অনুপম আছে। আর আমাদের বেলায় সাথে কেউ থাকত না। অসুস্থ শরীরে সারাদিন, রাত বাচ্চা নিয়ে একা একা পরে থাকতাম।
বৃহস্পতিবার অফিস ছুটির পর অনুপম বাসায় না ঢুকে সরাসরি ছাদে গেল। মাধু একা একা বাবুর শুকনো কাপড় তুলছিল। অনুপম আচমকা পেছন থেকে মাধুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। মাধু ভয়ে এক চিৎকার দিতেই অনুপম তাড়াহুড়ো করে মুখ চেপে ধরল। অনুপম বিষণ্ণ গলায় বলল,
-‘আজকাল আমার স্পর্শও চেনো না তুমি?
-‘এভাবে জড়িয়ে ধরলে ভয় পাব না?
-‘তোমার মা কবে যাবে মাধু?
-‘এ আবার কেমন কথা?
-‘তো আর কী বলব? নিজের বাসায় নিজের বউয়ের সাথে আজ আঠারোদিন যাবৎ রাতে যোগাযোগ বিছিন্ন। তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমার একটুও ভাল লাগছে না। বলি, তুমি রাতের বেলাও তো একটু চুপিচুপি আমার ঘরে আসতে পারো।
-‘কীভাবে আসব? আপনার গুনধর ছেলে তো গভীর রাত জেগে গোটা বিল্ডিং পাহারা দেয়। মা জেগে থাকে। মায়ের সামনে দিয়ে আপনার ঘরে যেতে লজ্জা করে না বুঝি?
-‘ইশ, ‘আমার লজ্জাবতী লাজুকলতা’। আজকাল আমিও যে তুমি বিহীন একদম ঘুমাতে পারছি না। সে খবর কী তুমি রাখো?
অনুপম, মাধুর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-‘আজ রাতে হবে না কী একবার?
-‘ধুর..ধুর…ধুর। সরুণ তো আপনি!
অনুপম ব্যকুল হয়ে বলল,
-‘আজ রাতে তোমাকে একবার আসতেই হবে। নাহয় আমিই তোমার রুমে চলে যাব। এটা কোন জীবন হলো?
মাধু লজ্জায় গুটিয়ে গেল। এই মানুষটার আজকাল কিছুই মুখে আটকায় না। দিনদিন কেমন বেহায়া হয়ে যাচ্ছে। মাধু কাপড়চোপড় নিয়ে নেমে যেতে লাগল। অনুপম পথ আটকাল। চোখে চোখ রাখল। মাধু তিরতির করে কাঁপছে। অনুপম কী মনে করে মাধুর ঠোঁটে ঠোঁট রাখল। মাধু ছটফটিয়ে উঠল। সরে যেতে চাইল। অনুপম আর একটু নিবিড় ভাবে নিজের কাছে টেনে নিল। এভাবে কতক্ষণ কাটল কেন জানে! অনুপমের হাত আলগা হতেই মাধু চলে যেতে নিল। অনুপম পেছন থেকে মাধুর শাড়ির আঁচল টেনে ধরল। তারপর সময় লাগিয়ে নিজের মুখটা আঁচল দিয়ে মুছে নিয়ে মাধুকে ছেড়ে দিল। মাধু লাজুক হেসে চলে গেল। অনুপম মাথা চুলকে কতক্ষণ ছাদে হাঁটাহাঁটি করল। ফুলের রেণুতে হাত বুলিয়ে দিল। তারপর সেও নীচে নেমে গেল।
মা যতদিন কাছে ছিল। মাধু একদম বুঝেনি। ছোট বাচ্চা একা একা পালা কী যে কষ্টকর। বাসায় থাকলে অনুপম হাতে হাতে মাধুর সবকাজ করে দেয়। সে অফিস চলে গেলেই মাধু খুব অসহায় বোধ করে। বাবুকে একা রেখে বাথরুমে যেতে পারে না। কোন কাজ ঠিক ভাবে করতে পারে না। খেতে বসলেও বাবু পট্টি করে দেয়। মাধু জাস্ট পাগল পাগল হয়ে গেছে। এই নিয়ে প্রায়ই অনুপমের সাথে ঝগড়া লাগে। যদিও সব সময় ঝগড়াটা মাধু একাই করে। অনুপম, মাধুর সব অভিযোগ মন দিয়ে শুনে। তারপর গভীর ভাবে মাধুকে বুকে টেনে নেয়। যতক্ষণ না মাধুর রাগ পরে ওভাবেই জাপ্টে ধরে রাখে। ওদের দিনগুলো দুষ্টুমিষ্টি ভালোবাসায় কেটে যাচ্ছিল। অনুপম প্রায়ই ছুটি পেলে গ্রামের বাড়িতে ঘুরে আসে। মাধু সবার জন্য অনেককিছু কিনে অনুপমের সাথে দিয়ে দেয়।
এবার না কী রেণুবালাও অনুপমের সাথে ঢাকা আসছে। শাশুড়ী এই প্রথম আসবে। মাধু বাবুকে আন্টির কাছে রেখে এসে, রান্না করছে। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে ঘরটাও গুছিয়ে ফেলল। কলিংবেল বাজছে। তারা বোধহয় এসে পরেছে। মাধু দরজা খুলে দিয়ে শাশুড়ীমায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। মাধুকে দেখে, রেণুবালা চোখ, মুখ কুচকে ফেলল। বলল, -‘আমার নাতী কোথায়?’

(চলবে)

লজ্জাবতী পর্ব-১০

0

#লজ্জাবতী
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব-১০

রিধীকা চোখের জল মুছে মায়ের মুখোমুখি দাঁড়াল। মাথার চুল এলোমেলো। শাড়ির আঁচল মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। রিধীকা আচমকা মায়ের হাতখানা চেপে ধরে হিম শীতল কণ্ঠে বলল,
-‘আমার সংসারটা ভেঙে দিয়ে এবার শান্তি হয়েছে মা তোমার? এখন চুপ করে আছো কেন মা? বলো…? রিধীকার চিৎকার শুনে রেণুবালা কেঁপে উঠল। তিনিও কম যান না। হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে, দ্বিগুণ স্বরে চেঁচিয়ে বলল,
-‘আমি তোর সংসার ভাঙব কোন দুঃখে? তুই নিজের দোষে সংসার খুঁড়িয়েছিস মুখপুরী। স্বামীর মন জুগিয়ে চলতে পারিস না?
-‘বিয়ের পর থেকে সারাক্ষণ তুমি আমাকে বুদ্ধি দিতে কীভাবে স্বামীর মন পেতে হবে। কীভাবে আমার বয়স্ক বিধবা শাশুড়ীর সাথে টক্কর দিতে হবে। কীভাবে রান্নার সময় ভাল ভাল খাবার গুলো লুকিয়ে ফেলতে হবে। পরে ঘরের দরজা বন্ধ করে চুপিচুপি খেতে হবে। কীভাবে স্বামীর কানে তার মায়ের নামে বিষ ঢেলে ঢেলে তার স্বচ্ছ মনটা অস্বচ্ছতায় ভরিয়ে দিতে হবে। কীভাবে সামান্য বিষয় নিয়ে সংসারে অ’শান্তি করতে হবে। সবই তো তোমার শিখানো মা। তারপরও আমি বিয়ের ছয়মাস না ঘুরতেই সংসারটা কেন করতে পারলাম না মা? ওই ঘৃণ্য কাজটা তুমি আমাকে কেন করতে বললে? শুধুমাত্র তোমার কূটবুদ্ধি শুনে আমার শাশুড়ীর স্নানের জায়গায় শ্যাম্পু ঢেলে রেখেছিলাম। ওই বুড়ো মানুষটা আছাড় খেয়ে কোমড় ভেঙে হাসপাতালে ভর্তি মা। পা দুটোরও যাতা অবস্থা। কী জানি আর কোনদিন হাঁটতে পারবে না কী! আমার খুব অনুশোচনা হচ্ছে। মানুষটা এতটাও খারাপ ছিল না মা। তুমি শুধু শুধু তার নামে আমার কাছে বদনাম করতে। আমি যদি কখনো মন খারাপ করে ফোনে তোমাকে তার ব্যপারে তিল পরিমাণ বলতাম। তুমি তাল বানিয়ে ফেলতে। তার নামে একগাদা বিষ ঢালতে আমার কানে। আসলে তুমি নিজে খারাপ, দজ্জাল মহিলা। সারাক্ষণ বৌদিমণির সাথে খিটমিট করতে। তাই ভাবতে তোমার মতো সবাই খারাপ। আমি আর জীবনেও তোমাদের জামাইয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বড় গলায় দুটো কথা বলতে পারব না। চোখে চোখ রাখতে পারব না। হয়ত সে আমাকে কোনদিন আর ফিরিয়ে নিতেই আসবে না। কেন আমার সংসারে নাক গলাতে, দিনের পর দিন মা তুমি? আমিই বা কেমন পাগল। অন্যায় হচ্ছে জেনেও তোমার প্রতিটা কথা বেদবাক্য মনে করে মেনে নিয়েছি। আমি যদি সংসার না করতে পারি। তবে মনে রেখ, তোমার সংসারেও আমি আগুন লাগিয়ে দেব।
কথাগুলো বলেই দৌঁড়ে গিয়ে টেবিলের সমস্ত থালাবাসন ফেলে দিল রিধীকা। তারপর কাঁদতে কাঁদতে নিজের ঘরে চলে গেল, অভাগী মেয়েটা।

ভোররাতে অনুপমরা বাসায় পৌঁছে গেল। মাধু ঘুমে ঢুলুঢুলু করছিল। অনুপম চাবি দিয়ে তালা খুলে বলল,
-‘এক মিনিট তুমি একটু দাঁড়াও মাধুসোনা? আমি আসছি। অনুপম ব্যাচেলর বাসায় ঢুকে গেল। তিনজন ছাত্র আর দুইজন চাকুরীজীবি ছেলে মিলে তিনতলায় দুইরুম নিয়ে ভাড়া থাকে অনুপমরা। অনুপম প্রদীপ জ্বেলে নিয়ে দরজায় এলো। প্রদীপের আলোতে মাধুর মায়াবী মুখ দেখে, মাথায় চুমু খেয়ে বলল,
-‘আমার লক্ষ্মীবউ। এই প্রথম আমার গৃহে প্রবেশ করলে। একটু বরণ না করলে হয়? মাধু লজ্জা পেল। অনুপমের হাত ধরে ঘরে প্রবেশ করল। বাড়িওয়ালা আন্টিকে খবর দেওয়া হয়েছে। তিনি খুব বিনয়ী। খবর পেয়ে ছুটে এলেন। মাধুকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। মুখে হাত রেখে, চুমু খেয়ে বললেন,
-‘ইশ, কী লক্ষ্মীমন্ত বউ।
ততক্ষণে সবাই জেগে গেছে। মাধুর সাথে কুশলাদি করছে। আন্টি, অনুপমকে ডেকে বলল,
-‘এভাবে তো বউ নিয়ে থাকতে পারবা না। দোতলার রুম খালি হয়েছে। বউ নিয়ে উঠে যাও। যতক্ষণ থাকার মতো জিনিসপত্র না কেনা হয়। বৌমা বরং আমার সাথে থাকবে। কেমন?
অনুপম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সত্যিই কারো জন্য কিছুই ঠেকে থাকে না। সৃষ্টিকর্তা একটা না একটা ব্যবস্থা ঠিকই করে দেন।
সকালে অনুপম অফিসে চলে গেল। ছুটি নিয়ে আসবাবপত্রর দোকানে ঢুকল। একটা খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, সহ প্রয়োজনীয় অনেককিছু কিনে ছোট গাড়ি ভরে বাসায় নিয়ে এলো। দুই তিনদিন সময় লাগিয়ে মাধুর নতুন সংসার একটু একটু করে নিজের হাতে বেশ উচ্ছ্বাস নিয়ে গোছাল মাধু।
ছুটির দিন ভোরে উঠে, অনুপম এক গাদা বাজার করে নিয়ে এলো। আজ নিজের সংসারে প্রথম রান্না করবে মাধু। এই তিনদিন বাড়িওয়ালা আন্টি নিয়ম করে খাবার দিয়ে যেত। আজ এক ফাঁকে মাধুও তাদের দুপুরে খাওয়ার জন্য নেমন্তন্ন করে এসেছে। অনুপম, মাধুর হাতে হাতে সবজি, মাছ, মাংস কেটে বেছে দিল। মাধু কোমড়ে আঁচল গুঁজে মনের সুখে রান্না করছে। এই রকম একটা সংসারের স্বপ্ন প্রতিটা বাঙালী মেয়েই দেখে। কেউ খুব দ্রুত পায়। কেউবা দেরিতে পায়।
অনুপম দ্রুত হাতে টেবিল গুছিয়ে ফেলল। সেই সকাল থেকে মেয়েটা এত পদ রাঁধতে রাঁধতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। রীতিমতো হাঁপাচ্ছে। অনুপম বকে,ধমকে মাধুকে রান্না ঘর থেকে ঠেলে পাঠাল। বলল,
-‘বিশ্রাম নিয়ে স্নান সেরে নাও। যা রেঁধেছ এই অনেক। এত খাবার কে খাবে? মাধু হাসিমুখে ঘরে চলে গেল। নতুন বাসায় এসে, অনুপমের আশেপাশে থাকতে মাধুর খুব ভাল লাগে। মনটা আনন্দে ভরে যায়।এত সুখও মাধুর ভাগ্যে লেখা ছিল বুঝি?

আংকেল, আন্টির সব গুলো ছেলেমেয়ে প্রবাসী। তারা শুধু দুজন কাজের লোক নিয়ে এক ইউনিটে থাকে। আর সবগুলো ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া। ছেলেমেয়েরা তাদের প্রায়ই নিয়ে যেতে চায়। তবে তারা শেকড় ছেড়ে যাবে না। জীবনের অন্তীম সময়ে, বুড়ো, বুড়ির একসাথে দেশেই কাটিয়ে
দেওয়ার ইচ্ছে। দুপুরে তারা দুজন খেতে এসে মাধুর রান্নার খুব প্রশংসা করল। নিজের রান্নার প্রশংসা শুনতে কার না ভাল লাগে? মাধুর মনটাও আনন্দে ভরে গেল। তারা খেয়েদেয়ে চলে যেতেই অনুপম, মাধুকে নিয়ে খেতে বসল। বড় কাতলা মাছের মাথাটা মাধুর পাতে তুলে দিল। অতি সুখে মাধুর চোখের কোণে জল জমেছে। এত বড় মাথাটা দুজন ভাগাভাগি করে খেলো। মুরগীর দুটো রান দুজন খুব তৃপ্তি করে খেলো।
রাতে, মাধুর চোখদুটো চেপে ধরে অনুপম শোবার ঘরে নিয়ে গেল। চোখের উপর থেকে আস্তে করে হাতটা সরাতেই মাধু অবাক বিস্ময়ে মুখে হাত দিল। অনুপম রীতিমতো ফুল, মোমবাতি, বেলুন দিয়ে বাসরঘর সাজিয়েছে। মাধু, অনুপমের বুকে মুখ লুকাল। অনুপম নীচু কণ্ঠে দুষ্টুমি করে বলল,
-‘ দুপুরে নতুন বউয়ের হাতের খাবার খেলাম। রাতে ফুলসজ্জা করব না?
মাধু, অনুপমের বুকে মৃদু কিল মেরে বলল,
-‘ধেৎ..
অনুপম হাঁটু মুড়ে মাধুর সামনে বসল। মাধুর পেটের উপর কান পেতে, হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-‘কী অবস্থা আমার নতুন মায়ের?
মাধু বলল,
-‘ইশ, মেয়ে হবে না। আমার একদম আপনার মতো ছেলে হবে দেইখেন!
অনুপম, মাধুর নাক চেপে ধরে বলল,
-‘না আমার কণ্যা হবে।
-‘সে দেখা যাবেক্ষণ।

দিনগুলো দেখতে দেখতে হাসি, মজা, আনন্দ, দুষ্ট মিষ্টি ঝগড়া, নীরব রাগ-অভিমানে স্বপ্নের মতো কেটে গেল। মাধুর হওয়ার ডেইট ঘনিয়ে এসেছে। পেট ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। এর মাঝে একদিন সবাই এই বাসায় এসে, ঘটা করে মাধুর স্বাধের অনুষ্ঠান করে গেছে। শুধু রেণুবালা আর রিধীকা আসেনি। ঝর্ণারানী, মাধুকে সাথে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। মাধু, অনুপমকে ছেড়ে যেতে রাজি হয়নি। অনুপম বলেছে,
-‘এখানে যেহেতু যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল। মাধু, আমার কাছেই থাকুক। বাচ্চা হওয়ার পর নাহয় আপনি এসে মাধুর কাছে থাকবেন। কিংবা আমি ওকে আপনার কাছে রেখে আসব।
ফলে তারা আর অমত করেনি। খুশি মনেই মাধুকে রেখে গেছে।

এই বাড়িতে কোন কিছুর অভাব নেই মাধুর। আবদার করার আগেই অনুপম নিজের সাধ্যমতো সবকিছু এনে দেয়। তবুও রিধীকার কথা ভেবে দিনগুলো কী এক বিষণ্ণতায় কাটে। মাঝে মাঝেই রিধীকা ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করে। নিজের মাকে শাপশাপান্ত করে। মাধু বলেছে, তুমি বরং এখানে এসে কিছুদিন থেকে যাও ছোটদি? ভাল লাগবে। রিধীকা বিরস মুখে বলে,
-‘আমার আর ভাল লাগা। পাঁচ মাস হয়ে গেল। মানুষটা না একটু ফোনে কথা বলে, আর না একটু দেখতে এসেছে আমায়। মানুষটার আদরের চিহ্ন এখনো আমাকে শরীরে আছে, জানো বৌদিমণি? আমি কিছুতেই মানুষটাকে ভুলতে পারি না। রাতের আঁধারে বড্ড বেশি মানুষটাকে মনে পড়ে। আমি নাহয় একটা মস্তবড় ভুল করেই ফেলেছি। মানুষটা কী পাষাণ তাই না? আমি ফোন দিলেও রিসিভ করে না। আমার এই একাকীত্বের দহন আর ভাল লাগে না বৌদিমণি। আমি তার সাথে সংসার করতে চাই! বড়দাভাইকে বলে, তার সাথে আমার সংসার করার ব্যবস্থা করে দাও না বৌদিমণি?
অনুপম, রিধীকার বর জয়ন্তর সাথে কথা বলেছিল। লোকটা, অনুপমকেও ভদ্রভাবে অপমান করে ফোন রেখে দিয়েছে।

রেণুবালা রাঁধতেছিল। আজকাল শরীর আর সায় দেয় না। পরের মেয়ে ঘরে আসার পর সুখের মুখ দেখেছিল রেণুবালা। সংসারে কার কূ’নজর লেগেছিল কেন জানে! বউ নিয়েও বেশিদিন খেতে পারল না। এখনকার মেয়েটা খুব বেয়াদব। মুখ বুজে সহ্য করে না। একটু কিছু হলেই বরের হাত ধরে ড্যাঙড্যাঙ করে নতুন সংসার পাতে। কী এমন ক্ষতি হতো? মাধু, রেণুবালার পা’দুটো জড়িয়ে ধরে যদি বলত, -‘মা আমি কোথাও যাব না। আপনার সংসারের এক কোণে পরে থাকতে চাই! তাহলেই তো রেণুবালা মাপ করে দিত৷ রিধীকাটাও একটা কাজ করে না। সারাক্ষণ দরজা বন্ধ করে, ঘরে শুয়ে বসে থাকে। খাওয়ার সময় হলে গাণ্ডেপিণ্ডে গিলে, নিজের ঘরে চলে যায়। মায়ের যে বয়স হয়েছে। সে খেয়াল কারো নেই। এত মানুষ মরে, বলি আমার কেন মরণ হয় না! নিজের রাগ কার সাথে দেখাবে রেণুবালা বুঝতে পারল না। রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে থালাবাসন ঠাস ঠাস করে ফেলছে।

সূর্যটা পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। রিধীকা মন খারাপ করে, ছাদে বসে ছিল। বেখেয়ালে বাড়ির গেইটে চোখ পড়তেই দেখল। জয়ন্ত আসছে। রিধীকার মনের ভেতর একশো পাওয়ারের বাল্ব জ্বেলে উঠল। দৌঁড়ে ছাদ থেকে নেমে গেল। ব্যস্ত হাতে এলোমেলো শাড়ি ঠিক করে পরল। চুল পরিপাটি করে মাথা ভর্তি সিঁদুর পরল। চোখে মোটা করে কাজল টানল। এলোমেলো ঘরটা গোছানোর চেষ্টা করছে। এতদিন পর প্রিয় মুখটা দেখে, উত্তেজনায় কোন কাজই এগোচ্ছে না। সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
জয়ন্তকে দেখে, রেণুবালা হাসিমুখে এগিয়ে গেল। তবে জয়ন্ত রেণুবালার সাথে একটা কথাও বলল না। অনিকেতকে ডেকে বলল,
-‘তোমার বোন কোথায়?
-‘রিধী ঘরেই আছে। আপনি যান।
জয়ন্ত সিঁড়ি দিয়ে উঠে রিধীকার ঘরে চলে গেল। এতদিন পর মানুষটার আসার সময় হলো? রিধীকা অভিমানে মাথা নীচু করে রইল। জয়ন্ত পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে দেখল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-‘কেমন আছো রিধী?
তীব্র অভিমানে এই এতটুকু মায়াময় কথায় ঠোঁট উল্টে কেঁদে দিল রিধীকা। জয়ন্ত দু’পা এগিয়ে এলো। জয়ন্তর গরম নিঃশ্বাসে রিধীকার বুকের ভেতর মৃদু কাঁপন ধরেছে। কাঁদতে কাঁদতে জয়ন্তর পাদু’টো জড়িয়ে ধরে বসে পরল মেয়েটা। বলল,
-‘আমাকে মারুন, কাটুন, যা খুশি তাই করুণ। তবুও দয়া করে আমাকে আপনার সাথে নিয়ে যান। আমার আর এই একাকীত্ব একদম সহ্য হচ্ছে না। এবার যদি আমাকে ফেলে রেখে যান। ভগবানের দিব্যি, আমি বিষ খাব।
-‘রিধীকা…
জয়ন্তও মনে মনে দূর্বল হয়ে পড়েছে। না তাকে নরম হলে চলবে না। শক্ত হতে হবে। শীতল কণ্ঠে বলল,
-‘তুমি যে অন্যায় করেছ, তারপরও আমার সাথে যেতে চাও?
রিধীকার গলা ভেঙে এলো। শুকনো কণ্ঠে বলল,
-‘আমায় ক্ষমা করে দিন।
জয়ন্ত মলিন হাসল। বলল,
-‘যাবে আমার সাথে?
-‘হ্যাঁ যাব।
-‘তাহলে যে শর্ত মেনে যেতে হবে?
-‘আপনার সব শর্ত মানতে রাজি আমি। তবুও আমায় নিয়ে যান।
-‘আজ আমার হাত ধরে এই বাড়ি ছাড়লে, এই বাড়ির কারো সাথে আর জীবনেও যোগাযোগ রাখতে পারবে না তুমি। আমার কথা মতো তোমাকে চলতে হবে।
আর আমি যদি কখনো শুনি আমার মাকে তুমি অন্যায় ভাবে কষ্ট দিয়েছ। সেদিনই হবে আমার সাথে সংসার করা তোমার শেষ দিন। আজ এখানে আমি কিছুতেই তোমাকে নিতে আসতাম না। আমার মায়ের রিকুয়েষ্টে শুধু তোমাকে শেষ একটা সুযোগ দিতে এসেছি।
রিধীকা খুশিমনে ঝটপট ব্যাগ গুছিয়ে ফেলল। এই নরকপুরী থেকে যত তাড়াতাড়ি মুক্ত হবে ততই মঙ্গল। একবার যে ভুল রিধীকা করেছে। সেই ভুল আর জীবনেও রিধীকা করবে না। পাঁচ মাসে বাপের বাড়ি পরে থেকে সারাক্ষণ মায়ের খোঁটা, অভিশাপ, পাড়াপ্রতিবেশিদের রিধীকাকে নিয়ে তিক্তবাণ, ব্যঙ্গ, লাঞ্ছনা শুনতে শুনতে কান পঁচে গেছে। রিধীকার বেশ শিক্ষে হয়েছে। আসলে যতই বিয়ের আগে মেয়েদের মা-বাবা আদর করুক। ভালোবেসে মাথায় তুলে রাখুক। ভাগ্যেক্রমে স্বামীর সংসার না করতে পারলে, বোঝা যায় তাদের আসল রঙ, রুপ।
জয়ন্ত’র হাত ধরে, বাবার বাড়ির সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে রিধীকা সারাজীবনের জন্য চলে গেল। আজও পাশের বাড়ির ছাদ থেকে একজোড়া তৃষ্ণার্ত, ভেজা চোখ রিধীকাকে মনের আঁশ মিটিয়ে দেখে নিল।

অনুপম ভোরে উঠে, নাস্তা তৈরি করে নিজে খেয়েদেয়ে ঘুমন্ত মাধুর কপালে ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দিয়ে, অফিসে চলে গেল। মাধুর পেট অসম্ভব বড় হয়েছে। সারারাত জেগে ছটফট করে মেয়েটা। একদম ভোরের দিকে ঘুমায়। তাই অনুপম আর সকালে মাধুকে ডাকে না।
বেলা দশটার দিকে মাধুর ঘুম ভাঙল। উঠে দেখে, তলপেটে চিনচিনে ব্যথা। কাপড় ভেজা। সময় গড়ায়।একটু একটু করে ব্যথা বাড়ে। মাধু বাথরুমে ফ্রেশ হতে গিয়ে রক্ত দেখে ভয় পেল। পেটে আলতো করে হাত চেপে ধরে কেঁদে দিল। অসহ্য ব্যথায় মাধু বেসামাল হয়ে গেল। তাড়াহুড়ো করে ফোন হাতে নিল। দূর্ভাগ্যক্রমে ফোনে চার্জ নেই। বাসায় কারেন্ট নেই। এদিকে বাড়িওয়ালী আন্টিও আজ দুদিন যাবৎ বাসায় নেই। তার বোনের বাসায় বেড়াতে গেছে। অতিরিক্ত পেট ব্যথায় নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে মাধুর। এদিকে মল ভেঙে গেছে। পরনের কাপড় ভেজা। মাধু ঘরের মেইন দরজা খুলে, ওখানেই মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে বসে পরল। অতিরিক্ত ব্যথা, ভয়, আতঙ্কে ধীরে ধীরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল মেয়েটা।

(চলবে)

লজ্জাবতী পর্ব-০৯

0

#লজ্জাবতী
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব-০৯

মাধু সেই যে মন খারাপ করে, ছাদে গিয়ে চুপটি করে বসে আছে। অনুপম ছাত্র জীবনে শখের বশে বিভিন্ন ফুল গাছের ছোট ছোট চাঁড়া কিনে এনে, ছাদ বাগান করেছিল। অনুপমের অনুপস্থিতিতে অনিকেত বাগানের দেখাশোনা করে। গাছে নিয়ম করে দুবেলা জল দেয়। আবার শখ করে কিছু সাদা রঙের পায়রা পুষে। পায়রাগুলি ফুলগাছের ডালে বসে মনের সুখে ডানা ঝাঁপটায়। খিদে পেলে, চিকুন ঠোঁট দিয়ে কুট কুট করে গম খায়। মাধু বাগানের বাহারি রঙের ফুলের দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো অনুভূতি শূণ্যে হয়ে তাকিয়ে আছে। মাধুকে খুঁজতে খুঁজতে বড়দি ছাদে এলো। বলল,
-‘মাধু ঘরে চল। অনুপম এসে গেছে।
মাধুর বুকের ভেতর চাপা কষ্টে ধুকপুক করে উঠল। মনটা বিষণ্ণতায় ভরে গেল। কী জানি! মানুষটা আবার মাধুকে ভুল বুঝে, দূরে না ঠেলে দেয়। মাধু বসা থেকে উঠে পরল। বড়দি বলল,
-‘যাই হয়ে যাক। তুই কিন্তু ভেঙে পড়বি না। মাধু, বড়দির হাত ধরে গুটিগুটি পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল। আজ বাড়িতে সারাদিনেও উনুন জ্বালানো হয়নি। নিখিলেশবাবু বাইরে থেকে খাবার কিনে এনেছে। সবাই অল্প কিছু খেলেও শুধু রেণুবালাকে কেউ খাওয়াতে পারেনি।
অনুপম বাড়িতে ঢুকেই প্রথমে শ্বশুরের সাথে কুশলাদি বিনিময় করল। মাধুর সাথে একটু চোখাচোখি হলো। মাধু লজ্জায় বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না। অনুপম হাসার চেষ্টা করে বলল,
-‘আপনারা গল্প করুণ। আমি একটু মায়ের ঘর থেকে ঘুরে আসি।
রেণুবালা শুয়ে ছিল। অনুপমকে দেখে, আবারও উঠে বিলাপ শুরু করল। অনুপম ঘরে ঢুকে মাকে একহাতে জড়িয়ে ধরল। চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল,
-‘মা.. মা দয়া করে কান্না বন্ধ করো। তোমার মাধুকে নিয়ে কী কী অভিযোগ আছে। বলো? আমি শুনব। তার আগে কিছু খেয়ে নাও। বিন্দুমাসি খাবার এনে দিল। অনুপম নিজে হাতে মাকে খাইয়ে দিল।
রেণুবালা ভরপেট খেয়ে, চোখের জল মুছে সত্যি, মিথ্যা মিলিয়ে মাধুর নামে একগাদা অভিযোগ করল। অনুপম সব শুনে বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
-‘তোমার বলা শেষ? না আরও কিছু বলার আছে মা?
-‘ আমি আর ঐ হতচ্ছাড়ি মেয়েমানুষ নিয়ে কিছুতেই সংসার করব না বড়খোকা। হয় এই বাড়িতে তোর বউ থাকবে আর নাহয় আমি থাকব। তুই একবার চিন্তা কর! ওর কত বড় কলিজা। ও ওর বাপ, বোনকে খবর দিয়ে, বাড়ি বয়ে নিয়ে এসে আমার নামে মিথ্যে অপবাদ দেয়। আমি না কী তোর বউকে খেতে দেই না। এটা কোন কথা? শুধু যা খেলে বাচ্চার ক্ষতি হবে। সেসব খাবার খেতে যা একটু বারণ করি। ওর ভালোর জন্যই তো বলি।
অনুপম বলল,
-‘মা.. মাধুর গর্ভে আমার সন্তান আসার পর থেকে আমি সংসারে টাকা দেওয়া বাড়িয়ে দিয়েছি। বলো দেইনি?
-‘হ্যাঁ দিয়েছিস।
-‘তারপরও তুমি কেন মাধুকে খাওয়ার কষ্ট দিয়েছ?
রেণুবালা বিষম খেল। বলল,
-‘বড়খোকা? বুঝেছি বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই তোর বউ আমার নামে তোর কানও ভারী করেছে। সেই.. এখন বউই আপন। মা পর।
অনুপম নিজের গলায় দুটো আঙুল দাবিয়ে বলল,
-‘মা..ভগবানের দিব্যি কেটে বলছি, মাধুর সাথে এই বিষয়ে একটা কথাও হয়নি আমার। আমি শুরু থেকেই জানি মা। তুমি মাধুকে খাওয়ার কষ্ট দাও। ইনিয়েবিনিয়ে কটু কথা শোনাও। ওর সব কাজেই খুঁত ধরো। এতক্ষণ ধরে যে মেয়েটার নামে তুমি আমার কাছে একগাদা নিন্দে করলে, ওই মেয়েটা শুধুমাত্র তুমি কষ্ট পাবে বলে, এই বিষয়ে আমাকে এতদিন কিছুই বলতে দেয়নি। সত্যিই নারীরা কত বিচিত্র হয়। তাই না মা?
রেণুবালা কিছুই বলল না। অনুপম একটু বিরতি নিয়ে আবারও বলল,
-‘তারমানে তুমি আমার বউ নিয়ে ভাত খাবে না এই তো?
-‘না খাব না।
-‘বেশ। এবার চলো আমার সাথে?
বসার রুমে এসে সবাই জড়ো হয়েছে। থমথমে পরিবেশ। মাধু এক কোণে ভয়ে গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। অনুপম মাধুর বড়দি আর বাবার অভিযোগও মন দিয়ে শুনলো। তারপর মাধুকে ডেকে বলল,
-‘এখানে আসো?
মাধু মাথা নীচু করে এগিয়ে এলো। বুকের ভেতর মৃদু ব্যথা। অনুপম বলল,
-‘তুমি কী চাও মাধু? বাবার সাথে ওই বাড়িতে গিয়ে থাকতে চাও? না এই বাড়িতে থাকতে চাও? আর না আমার সংসার করতে চাও?
রেণুবালা মাঝখানে ফোড়ন কেটে বলল,
-‘ও, এই বাড়িতে থাকলে কিন্তু আমি থাকব না বড়খোকা।
মাধু আঁতকে উঠল। কিছু বলার সাহস পেল না। অনুপম দীর্ঘশ্বাস ফেলে, মাধুর দিকে একহাত বাড়িয়ে দিল। বলল,
-‘কোন শ্বশুরবাড়ি না। কোন বাবার বাড়ি না। তোমাকে কোথাও কারো বোঝা হয়ে থাকতে হবে না। তুমি কী আমার সাথে যাবে মাধু?
মাধুর জানে প্রাণ ফিরে এলো। মনটা সুখ সুখ অনুভূতিতে ভরে গেল। রেণুবালা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। বলল,
-‘এই মেয়েমানুষ নিয়ে তুই সংসার করবি?
-‘মা এখন যুগ পাল্টেছে। সত্যি, মিথ্যা যাচাই না করে মায়ের একবাক্যে আমি বউ ছেড়ে দেব না। একদিকে তুমি যেমন আমার জন্মদাত্রী মা। অন্যদিকে মাধু আমার নবাগত সন্তানের মা হতে চলেছে। এই মূহুর্তে ওর হাত ছেড়ে দেওয়া নয় বরং ওকে বেশি বেশি সময় দেওয়া দরকার আমার। মা আমি এতটাও অক্ষম হয়ে যাইনি। আমার অনাগত সন্তানের মাকে খাওয়ার অভাবে মাসের পর মাস তার বাপের বাড়ি ফেলে রাখব। হ্যাঁ মাধু যাবে। তবে নিয়ম মেনে সাত মাসের অনুষ্ঠান শেষে তার মায়ের কাছে যাবে। যদি ও মন থেকে যেতে চায় তবেই। মাধু ব্যাগ গুছিয়ে নাও। আসার পর ফিরতি দুটো ট্রেনের টিকিট কেটে এসেছি।
বড়দি মনে মনে খুব খুশি হলো। বিড়বিড় করে বলল,
-‘সাব্বাশ.. এই না হলে পুরুষ মানুষ। একদম মহিলার উচিৎ শিক্ষা হয়েছে। ভগবান মুখ তুলে চেয়েছে। এতদিন পর যদি আমার বোনটা একটু সুখের মুখ দেখে! মাধুর বাবাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
মাধু শ্বশুরের দিকে এক পলক মুখ তুলে তাকাল। তিনি ইশারায় মন ভরে আশীর্বাদ করলেন। মাধুকে, অনুপমের সাথে চলে যেতে বললেন। এইসব অনাচার দেখতে দেখতে তার আর ভাল লাগে না।

বাবা আর বড়দিকে বিদায় দিয়ে, মাধু মনের সুখে ব্যাগ গুছাচ্ছে। অনুপম পাশে বসে মুগ্ধ চোখে মাধুকে দেখছে। এই মেয়েটার চঞ্চল চাউনি, ছটফটে স্বভাবের প্রেমেই তো অনুপম প্রথম পড়েছিল। দুরুদুরু বুকে, দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে, স্বামীর হাত ধরে, মাধু হাসিমুখে বেড়িয়ে গেল। গাড়িতে উঠে একটুখানি বাড়িটার দিকে মায়া মায়া চোখে তাকাল মাধু। মন ভরে, দুচোখ জুড়িয়ে দেখে নিল। এই বাড়িতে মাধুর তিক্ত কিছু সময় কাটলেও অনুপমকে ঘিরে কত যে সুখের, ভালোবাসার চরম মূহুর্ত কেটেছে। সেসব ভেবেই মনটা আত্মতৃপ্তিতে ভরে গেল। মাধু জানে না। ‘স্বামী’ নামক এই মানুষটা মাধুকে কোথায় নিয়ে যাবে, রাখবে কোথায়, খাওয়াবে কী? শুধু জানে আজকের পর থেকে মাধুকে আর মানুষটার কথা ভেবে, মন খারাপ করে, কেঁদেকেটে বালিশ ভেজাতে হবে না। রোজ রাতে মানুষটার মুখ দেখে মাধু ঘুমাবে আবার রোজ সকালে প্রিয় মানুষটার মুখ দেখেই মাধুর জীবনে নতুন সকাল আসবে। মাধুর ছোট্ট জীবনে এতটুকুই তো চাওয়া ছিল।
অনুপম, মাধুকে নিয়ে ট্রেনের কেবিনে উঠল। ফোনটা অফ করে দিয়ে মাধুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে গেল।

মাধুরা চলে যেতেই বাড়িতে আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটল। রাতেই আঁধারে কাউকে কিছু না বলে রিধীকা একা একা চলে এসেছে। শাড়ি এলোমেলো, হাতে, পিঠে, পেটে মাইরের দাগ। কপাল ফেঁটে রক্ত পরছে। বাড়িতে ঢুকেই রিধীকা গা কাঁপিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে। রিধীকার অস্বাভাবিক আচরণ দেখে, সবাই খুব ভয় পেল। মেয়েটার বিয়ের ছয়মাসও ঘুরেনি। কী এমন হলো! যে এভাবে কাঁদছে? নিখিলেশবাবু মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। অনিকেত পাগলের মতো অনুপমের নাম্বারে ফোন দিল। ফোন বন্ধ বলছে। রেণুবালাও মেয়ের কান্না দেখে ভয় পেয়ে কেঁদে দিল। হঠাৎ রিধীকার শ্বশুরবাড়ি থেকে ফোন এলো। ফোনটা করেছে রিধীকার বর। নিখিলেশবাবু ফোন রিসিভ করতেই ভদ্রলোক চাপা কণ্ঠে বলল,
-‘আমার বাড়ির দরজা আপনার মেয়ের জন্য সারাজীবনের জন্য বন্ধ। ভুলেও ওই অলক্ষ্মী মেয়েকে আর আমার সংসারে পাঠাবেন না। আমি খুব শীঘ্রই এই বিষয়ে উকিলের সাথে কথা বলব। কী হয়েছে! আপনার মেয়ের কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে নেবেন। শুধু জেনে রাখেন, আপনার সো কল্ড স্ত্রী’র কূটবুদ্ধির জন্যই আজ আমাদের সংসারটা ভেঙে গেল।
নিখিলেশবাবু ফোন রেখেই রেণুবালার দিকে আগুন চোখে তাকাল। চিৎকার করে বলল,
-‘রিধীকা কেন এভাবে চলে এলো, বলো আমাকে?
রেণুবালা শুকনো ঢোক চিপল। সোফায় বসে, রিধীকা মুখ ঢেকে হাপুস নয়নে কাঁদছে। কেন যে রিধীকা মায়ের বুদ্ধি শুনতে গিয়েছিল। মায়ের কূ’বুদ্ধি শুনে একে একে সব হারাতে বসেছে রিধীকা।

(চলবে)

(সবাই গল্পে রেসপন্স করবেন।)