Monday, June 30, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 311



এক মুঠো প্রণয় ২ পর্ব-০৭

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#সিজন_টু
#পর্ব_০৭
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

সাঈদের সাথে মেহুর সংসার বাঁধা হবে না এই বিষয়টা মেহু মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল ক্ষনে ক্ষনে। চেষ্টা করল ঐ মানুষটাকে ভুলে যেতে।কিন্তু আসলেই কি তা সম্ভব? হয়তো সম্ভব নয়। তাই তো বেহায়ার মতো আবারও কথা বলতে চাইল সাঈদের সাথে। লাগাতার কল দিল সাঈদের নাম্বারে। ছটফট করা হৃদয় নিয়ে অপেক্ষায় থাকল সে মানুষটার কন্ঠ শোনার জন্য। সাঈদ অবশ্য প্রথমেই কল তুলল না। যখন কল তুলল ততক্ষনে মেহু আর কান্না আটকাতে পারল না। ধরা গলায় ঠোঁট কাঁমড়ে কোনরকমে বলল,

“সাঈদ ভাইয়া? আপনি না বাসলেও, আমি আপনাকে ভালোবাসি৷ একবার কি হ্যাঁ বলা যায় না সাঈদ ভাইয়া?একবার কি রাজি হওয়া যায় না?মিথ্যে করে হলে ও একবার বলবেন ভালোবাসি?”

সাঈদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল।কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে শান্তস্বরে উত্তর দিল,

“ যায় না মেহু। আমার মতে তুমি অনেক ভালো মেয়ে মেহু৷ কোনকালে নিজের আশপাশে ছেলেদের সঙ্গ দাওনি। সে জায়গায় আমি অসংখ্য মেয়েকে সঙ্গ দিয়েছি। প্রেম প্রেম কথা বলেছি।তোমার মনে হয় না তুমি ভুল মানুষকে ভালোবেসেছো? ”

মেহু ফের কাঁদল। কান্নারত স্বরে উত্তর দিল,

“ ভুল হলেও আমার মন সে ভুলকেই আঁকড়ে ধরতে চাইছে।অন্তত একটিবার? একটিবার ভাবুন না আমার কথা।প্লিজ। ”

সাঈদ বারকয়েক শ্বাস ফেলল। আবারও কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে উত্তর দিল,

“ মেহু শোনো, আমার কাছে এসব প্রেম ভালোবাসার কোন স্থান নেই।খুব বেশি হলে আমি মেয়েদের শরীরের প্রতি এট্রাক্টশন ফিল করি, তাদের সাথে এসব প্রেম প্রেম অভিনয় করে মজা নিই। কিন্তু সিরিয়াসলি আমি এসবে কোনকালেই বিশ্বাসী ছিলাম না।তুমি বলো, তোমায় কখনো ভালোবাসি বলেছিলাম?কিংবা প্রোপোজ করেছিলাম?বাকি সবার মতোই তোমার সাথেও প্রেম প্রেম কথা বলেছি, প্রেম প্রেম নজরে তাকিয়েছি। সেসবকে তুমি অন্য কিছু ভেবে থাকলে তো আমার দোষ কি? ”

শেষের কথা গুলো শুনেই নিজেকে খুব বেহায়া অনুভব হলো মেহুর। গলা শক্ত হয়ে আসল৷ পরপরই কান্না থামিয়ে দৃঢ় গলায় উত্তর দিল,

“ আমি আপনাকে আর কখনোই কল করব না।”

কথাটা বলেই কল কেঁটে দিল মেহু৷ সাঈদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই প্রথম মনে হচ্ছে তার কান্না পাচ্ছে। কিন্তু পুরুষ মানুষের যে কান্না করা মানা। সাঈদ চোখ বুঝল। একহাতে কপালে হাত বুলাতে বুলাতে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে উষ্ণ শ্বাস টানল। ঠিক তখনই তার ঘরে ডুকলেন এক মধ্যবয়স্কা মহিলা।সাঈদের কপালে হাত ছুঁয়ে কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করল,

“ কি হয়েছে বাবা? ক্লান্ত তুমি? ”

সাঈদের মেজাজ খারাপ হলো। গত এক সপ্তাহ ধরেই মেজাজ চরম রকমে খারাপ তার৷ সম্মুখ মহিলার গলা শুনেই যেন সে মেজাজ খারাপটা তড় তড় করে বাড়ল। উঠে দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল,

“জাস্ট শাটাপ,বাবা বলছেন কাকে?কেন বললেন? ”

ভদ্রমহিলা সে রাগ দেখে বিস্মিত হলেন। আলতো হাতে ছেলের গালে হাত রেখে বললেন,

“এতোটা রাগ? এতোটা রাগ কেউ করে মায়ের উপর? ”

সাঈদ এক ঝটকায় গাল থেকে হাত সরাল। গলা উঁচিয়ে বলতে লাগল,

“ আমি আপনাকে সহ্য করতে পারি না।ঘৃণা করি । আর কয়বার বলতে হবে?আপনাকে দেখলেই আমার গা ঘিনঘিন করে। চলে যান৷ চলে যান প্লিজ এখান থেকে। কেন এসে পড়ে আছেন এখানে?নতুন কি প্ল্যান আপনার?কি প্ল্যান?আব্বুকে খুন করবেন এবারে?”

মহিলা এবারে হাসলেন। উত্তরে বললেন,

“তোমার আব্বু আমায় অন্ধের মতো ভালোবাসত সাঈদ। সে অন্ধচোখে এখন দৃষ্টি এলেও সত্যিটা কি জানো সাঈদ?সে এখনও আমায় ভালোবাসে৷ তাই তো এখনও আমি যখন আসি, থাকি এ বাসায় সে দুর্ব্যবহার করতে পারে না।করে ও না। ”

সাঈদের রাগ এবারে চূড়ায় পৌঁছাল। শুধাল,

“ কিন্তু আমি আমার আব্বুর মতো অতোটা নরম মনের নয়৷ আমি কখনো নারীর ছলনায় অন্ধ হই না।সেজন্যই এতকাল আমি আপনার মাতৃস্নেহ দেখেও গলতে পারিনি৷ শুধুমাত্র আপনার জন্যই আমি নারীজাতিকে আর বিশ্বাস করতে পারিনা৷ কাউকেই না!”

শেষের কথাটা অনেকটা রাসমেতই দাঁতে দাঁত চেপে বলল সাঈদ। পরপরই এক ধাক্কায় দরজার সামনে থাকা ফুলদানিটা ফেলে ভেঙ্গে ফেলল। আর এক মুহুর্তও না দাঁড়িয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেল রুম ছেড়ে। ভদ্রমহিলা দীর্ঘশ্বাস টানলেন। জীবনে সবসময় যৌবনেন ছোঁয়া না থাকলেও যৌবনে করা ভুলের শাস্তি তাকে আজীবনই বয়ে নিতে হবে। এই যেমন এখনও বয়ে যাচ্ছে। নিজেরই একমাত্র ছেলের চোখে তারই জন্য ঘৃণার পাহাড়। এর থেকে বড় শাস্তি হয় কোন মায়ের জন্য?

.

বিলাসবহুল রেস্টুরেন্ট।জ্যোতি সাধারনত এমন রেস্টুরেন্টে আসে না।তবে আজ আসতে হলো সাঈদের জন্যই। সাঈদকে কল করে যখন কথা বলতে চাইল, দেখা করতে চাইল তখন সাঈদ এই ঠিকানাটাই দিয়েছিল। জ্যোতি সময় মেনে চলে। নির্দিষ্ট সময়ে এসেই বসে থাকল অনেকটা সময়। কিন্তু সাঈদ ঠিক সময়ে এল না।এল আরো মিনিট বিশেক পর।জ্যোতি সম্মুখে সোজাসুজি হয়ে বসেই ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলে উঠল,

“ বাহ!শুরু থেকেই কেন জানি আমি তোমার সাথে ফ্লার্ট করে উঠতে পারিনি জ্যোতি। তোমার গম্ভীর আর একাকী চলনে কেন জানি ফ্লাটিংটা আসেনা আমার বুঝলে?তো, কি অর্ডার করব বলো?”

“ কথা বলার প্রয়োজন ছিল সাঈদ ভাইই।কোনকিছুই অর্ডার করতে হবে না।”

“তা বললে হয় নাকি? ”

সাঈদ ওয়েটারকে ডেকে অর্ডার করল স্বল্প খাবার। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল,

“ কি দরকারে ডাকলে জ্যোতি? ”

জ্যোতি মৃদু হাসল। উত্তরে বলল,

“ সাঈদ ভাই, আমি আপনাকে ভাই ডাকি। আপনার ছোটবোন থাকলে সে নিশ্চয় আমার বয়সীও হতে পারত৷ তাই না?তো এই বোনের একটা প্রশ্নের উত্তর দিবেন? সঠিক উত্তরই দিবেন কিন্তু।”

সাঈদ হাসল এইবারে।বলল,

“ উহ টিচার টিচার মনে হচ্ছে তোমায় হঠাৎ।বলো, বলো,সত্যিটা জানলে অবশ্যই উত্তর দিব। ”

জ্যোতি এবারে হাসল না। সোজাসুজি হয়ে বসে তাকাল সাঈদের মুখে। স্পষ্ট স্বরে জিজ্ঞেস করল,

“মেহু আপুকে কি সত্যিই ভালোবাসতেন না?সত্যিই কোন অনুভূতি নেই আপুর জন্য?”

সাঈদের হাসি হাসি মুখে হঠাৎই হাসি মিলিয়ে গেল। কি আশ্চর্য!এইখানেও একই প্রশ্ন? তপ্তশ্বাস ফেলে গম্ভীর গলায় শুধাল,

“ নেই।”

জ্যোতির দৃষ্টি এবার অসহায় হলো। বলল,

“ আপনাকে ভাই সম্বোধন করেছি সাঈদ ভাই। বোন ভেবে সঠিকটা বলবেন না?”

সাঈদ মৃদু হাসল। মুহুর্তেই দক্ষতার সাথে একটা মিথ্যে বলে দিল,

“সঠিকটাই বললাম যে বোন, ওর প্রতি কোন অনুভূতি নেই।”

“কেন নেই?আপু যথেষ্ট সুন্দরী, ম্যাচিউরড, শিক্ষিত। তো?”

সাঈদ এবারে হাসিটা বিস্তৃত করল। মজার ভান করে বলল,

“পৃথিবীতে সুন্দরী, শিক্ষিত, ম্যাচিউরড মেয়ের কি অভাব পড়েছে জ্যোতি? ”

জ্যোতির গম্ভীর গলা,

“ আপু আপনাকে ভালোবাসে।পৃথিবীতে সুন্দরী, শিক্ষিতা হাজারটা মেয়ে থাকলেও তার মতো ভালোবাসবে কেউ?”

“ যে ভালোবাসা মানুষকে প্রতিনিয়ত মরন যন্ত্রনা দেয়, যে ভালোবাসার কলঙ্ক সারাজীবন বয়ে নিয়ে একটা মানুষকে নিঃশেষ হতে হয় সে ভালোবাসা আমার জীবনে না আসুক জ্যোতি !”

জ্যোতির এবারে ফের আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। কথা বাড়িয়ে লাভ নেই ভেবেই উঠে দাঁড়াল। বলল,

“ আসছি সাঈদ ভাই। ”

সাঈদ উঠে দাঁড়াল। জ্যোতির দিকে তাকিয়েই বলল,

“ চলো,রিক্সায় উঠিয়ে দিয়ে আসি। ”

পরমুহুর্তে বিল পে করে বেরিয়ে আসল দুইজনে। রিক্সা ডেকে জ্যোতিকে উঠিয়ে দিবে ঠিক তখনই মেহেরাজের দেখা মিলল। সাঈদ দাঁত কেলিয়ে হাসল ওকে দেখামাত্রই। ঘাড়ে চাপড় বসিয়ে শুধাল,

“ বাহ!পার্ফেক্ট টাইম। এতোটা সময় মেনে কি করে চলিস তুই?”

মেহেরাজ ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল। বিরক্তির সুরে বলল,

“ফোনে যেভাবে গম্ভীর গলায় ডেকে পাঠালি ঠিক সময়ে না এসে তুই আহাম্মকের মতো দেরি করে আসাতে লাভ হতো?এবার বল, মন খারাপ কেন? ”

সাঈদ হাসল৷ ছেলেটা সত্যিই বন্ধু হিসেবে উত্তম। কি করে বুঝল তার মন খারাপ? আলতো হাসতেই মেহেরাজ তীক্ষ্ণ চোখে চাইল। ভ্রু নাচিয়ে শুধাল,

“কি? ”

কথাটা বলার পরপরই চোখে পড়ল জ্যোতিকে। সাঈদের পেঁছনেই দাঁড়ানো। মুহুর্তেই যেন কপালে ভাজ পড়ল। ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়ে জ্যোতির উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ল,

“ তুই? তুই এখানে কেন সাঈদের সাথে ? ”

জ্যোতি নির্লিপ্ত স্বরে উত্তর দিল,

“ সাঈদ ভাইয়ের সাথে কিছু প্রয়োজন ছিল তাই৷ ”

ফের প্রশ্ন,

“ কি প্রয়োজন? ”

“ওটা ব্যাক্তিগত বিষয় মেহেরাজ ভাই। ”

কথাটা বলেই দ্রুত রিক্সায় উঠল জ্যোতি। মেহেরাজ বিরক্ত হলো। একটা ছেলের সাথে একটা মেয়ের ব্যাক্তিগত বিষয় কি থাকতে পারে?কেনই বা থাকবে যেখানে মেয়েটা জ্যোতিই? ভ্রু নাচিয়ে সাঈদের দিকে তাকাল এবার। সাঈদও উত্তর দিল না। উত্তর কিই বা দিবে? তারই বোন সাঈদকে ভালোবাসে, আর সে বিষয়টা নিয়েই কথা বলতে এসেছিল জ্যোতি এটা বলার চেয়ে বোধহয় ঘটনাটা চেপে যাওয়াই ভালো। তাইতো বাঁকা হেসে শুধাল,

“ সিক্রেট ব্রো!”

মেহেরাজের মেজাজ খারাপ হলো। দুইজনেরই সিক্রেট বিষয় কি থাকবে?দাঁতে দাঁত চেপে শুধাল,

“ তুই আবার অন্যদের মতো ওর সাথেও রিলেশন করে মজা নিচ্ছিস না তো?”

সাঈদ অসহায়ের মতো তাকাল। নিরস গলায় বলল,

“উহ, সত্যি বলছি দোস্ত !আমি ওর সাথে শুরু থেকে ফ্লার্টিং বয়কট করেছি। জিজ্ঞেস করতে পারিস। ”

মেহেরাজ গম্ভীর স্বরে শুধাল,

“তোকে বিশ্বাস নেই। তুই দুনিয়ার সব মেয়ের সাথেই যা ইচ্ছে করতে পারিস।”

.

মেহু মেহেরাজের থেকেই মেঘের নাম্বার নিল। কল দিবে ভেবেও দেওয়া হয়নি সারাদিন। অবশেষে কল দিয়েই দিল। ওপাশ থেকে রিসিভড হতেই বলে উঠল,

“আমি মেহু মেঘ। আপনাকে কিছু কথা বলার ছিল। বলব?”

উত্তর এল,

“ অবশ্যই, বলো।”

মেহু ছোট শ্বাস ফেলল। বলল,

“আমি আপনাকে ভালোবাসি না মেঘ।ভালোবাসতে পারব কিনা তাও জানা নেই।কারণ অন্য কাউকে ভালোবাসি আমি।অন্য কাউকে ভালোবাসি জানার পর কি আপনি আমায় বিয়ে করতে চাইবেন? বিয়েটা না করাই উত্তম না?”

মেঘের গলা হঠাৎই থেমে গেল। ভয়টা যেন সত্যি হয়ে গেল এইবার। হৃদয় দুমড়ে মুঁছড়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। উহ!যাকে এতকাল ভালোবেসেছে, এতকাল যাকে নিয়ে স্বপ্ন সাঁজাল সে তাকে ভালোবাসে না। বরং অন্য কাউকে ভালোবাসে। এর চেয়ে কষ্টময় কিছু হয়? হয় না। এর চেয়ে যন্ত্রনা আর কোনকিছুতে নেই। একমুহুর্তের জন্য মনে হলো সবটা মিথ্যে। অস্ফুট স্বরে বলল,

“সত্যিই ভালোবাসো অন্য কাউকে?”

“হ্যাঁ।”

মেঘের দম আটকে আসল। হঠাৎ অনুভব করল সে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। হাত পা কাঁপছে কেন জানি। বুকের ভেতর কি ভীষণ যন্ত্রনা! দুমড়ে মুঁছড়ে যাওয়া যন্ত্রনা। সে যন্ত্রনা নিয়েই আহত স্বরে বলল,

“তোমার সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ তোমার বাবা মা মারা যাওয়ার পরই মেহু। বারো, তেরো বছর বয়সী একটা মেয়ে ছিলে।নিরবে চোখের পানি ফেলছিলে। আমি জানি না সে বয়সে আমার কি হলো। তোমার সে কান্নাভেজা চোখ দেখেই আমার মায়া হলো। কিশোর মনে কোথাও অস্থিরতা অনুভব হলো। সে থেকে আমার এক সাংঘাতিক অসুখ করেছে। অসুখটার নাম হলো মেহু!ঘুমাতে পারি না, খেতে পারিনা, সর্বক্ষন তোমার ভাবনায় ঘিরে থাকে আমায়। আমার তো দোষ ছিল না। দোষ ছিল কোন?এই বারোটা বছর আমি তোমায় নিয়ে স্বপ্ন সাজালাম, একপাক্ষিক অনুভূতি পুষলাম, দূর থেকে ভালোবেসে গেলাম সব তবে ভুলে যেতে বলছো?জানো মেহু? ভালোবাসার মানুষ ভালো না বাসলেও অতোটা কষ্ট হয়না, যতোটা কষ্ট হয় যখন জানতে পারি ভালোবাসার মানুষটাই অন্য কাউকে ভালোবাসে। বিধাতা আমার ভাগ্যেও তো কিছু ভালোবাসা লিখতে পারত। ”

মেহু বিনিময়ে উত্তর দিতে পারল না।মেঘ ফের বলল করুণ স্বরে,

“মেহু? আমাকে কি এইটুকু ভালোবাসারও সম্ভাবনা নেই? এইটুকু ভালোবাসাও কি যায়না মেহু? আমার কেমন দমবন্ধ হয়ে আসছে। ইচ্ছে হচ্ছে মারা যাই। অবশ্য এর চেয়ে বোধহয় মৃত্যুই উত্তম!”

“ আমি আপনার মৃত্যু চাই না।”

“ অথচ তুমি এই মুহুর্তে আমায় মৃত্যুযন্ত্রনাটাই উপহার দিলে৷কি সাংঘাতিক বিষাদময় যন্ত্রনা।বিধাতার কি অদ্ভুত নিয়ম দেখো মেহু। যে ভালোবাসাটা আমি এতোটা সময় ভালোবেসেও, এতোটা প্রার্থনা করেও পেলাম না সে ভালোবাসাটাই অন্য কেউ কতোটা সহজে পেয়ে গেল। বিধাতা বড়ই নিষ্ঠুর! ”

#চলবে…

[ কেমন হয়েছে জানাবেন। ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।]

এক মুঠো প্রণয় ২ পর্ব-০৬

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#সিজন_টু
#পর্ব_০৬
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

তৃতীয় বারের মতো মোহেরাজের স্পর্শ!চিকন হাতের কৃষ্ণরঙ্গা ত্বকের কাঁটা স্থানটাতেই পুরুষালি হাতের আলতো হাতের ছোঁয়া। জ্যোতি হাত সরাল দ্রুত।বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল মুহুর্তেই। মনে পড়ল গ্রামেও মেহেরাজ তার হাত ধরেছিল দুই দুইবার।একবার মালা গাঁথার দিন, আরেকবার সাঈদের মোবাইল দেওয়ার দিন!তাকে গায়ে পড়া মেয়ের সম্বোধন দিয়ে এখন ব্যাক্তিত্ববান মেহেরাজ ভাই এভাবে বারবার তার হাত ধরবেই বা কেন?মুহুর্তেই বিরক্ত হলো সে। যে মেহেরাজের ব্যাক্তিত্বে মুগ্ধ হতো, সম্মান করত সেই মেহেরাজেরই এহেন কান্ডে কপালে ভাজ ফেলল চরম বিরক্তিতে। বলল,

“ কি আশ্চর্য! হাত ধরার জন্য বসতে বলেছিলেন আপনি? ”

মেহেরাজ পুরু ঠোঁটজোড়া চেপে শ্বাস ফেলল। মেয়েটার প্রতি ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হলো প্রচুর। এত ভাব কেন এই মেয়ের? কথায় কথায় ত্যাড়া জবাব! অসন্তুষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধাল,

“ তুই কি আমায় টিপিক্যাল ছেলেদের মতো ভাবিস যে মেয়ে দেখলেই সুযোগ নিতে চাইব,হাত ধরতে চাইব? ”

জ্যোতির থমথমে উত্তর,

“ এটিপিকাল ভাবার মতোও তো কোন কারণ নেই মেহেরাজ ভাই।আর পাঁচ-দশটটা ছেলের মতোই তো সেদিনও আমার হাত ধরেছিলেন, আজও। তো?”

মেহেরাজ ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিল। মুখ টানটান করে প্রশ্ন ছুড়ল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে,

“তার মানে আর পাঁচ-দশটা ছেলেও তোর হাত ধরেছিল? ”

“ যেখানে এইসব হাত ধরাধরি পছন্দই করিনা সেখানে হাত ধরার সুযোগটা দিব কেন আমি তাদের?”

উত্তরটা গম্ভির, শক্ত গলায় আসলেও মেহেরাজ মনে মনে খুশি অনুভব করল। আর যায় হোক সে ব্যাতীত তো কেউ ছোঁয়েনি এই ঘাড়ত্যাড়া মেয়েকে। এটুকুতেই শান্তি! কিন্তু সে শান্তিরূপ বাহিরে প্রকাশ না করেই গম্ভীর মুখে তাকাল জ্যোতির দিকে। ভ্রু উঁচিয়ে ত্যাড়া গলায় শুধাল,

“তোর সাথে প্রেম করার উদ্দেশ্যে হাত ধরিনি নিশ্চয় ? ”

জ্যোতি তাকাল। কাঠকাঠ গলায় উত্তর দিল,

“ যে উদ্দেশ্যেই হাত ধরুন।আমি নিশ্চয়ই আপনি আমার হাত ধরেছেন বলে খুশিতে আনন্দহারা হয়ে যাবো না মেহেরাজ ভাই। ”

মেহেরাজ এবারে আড়ালে চাপা হাসল। বিড়বিড় করে বলল,

“ কোন একদিন ঠিকই খুশতে আনন্দহারা হবি। ”

জ্যোতি শুনল না৷ কপাল কুঁচকে শুধাল,

“ কি?”

“ কিছু না, বসে যা চুপচাপ। চতুর্থবারের মতো তোর হাত ধরব এবারে। ”

মেহেরাজের গম্ভীর গলায় সরাসরি এমন কথা শুনে ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিল জ্যোতি৷ যে হাত ধরা নিয়ে এতক্ষন এত কথা বলল, অথচ সেই হাত ধরার কথাই কেমন আদেশের স্বরে শোনাচ্ছে এই লোক। তপ্তশ্বাস ফেলল জ্যোতি। পা বাড়িয়ে অন্যদিকে ঘুরতে নেওয়ার আগেই মেহেরাজ ফের তার হাত স্পর্শ করল। পাশ থেকে ফার্স্ট এইড বক্স থেকে ঔষুধ নিয়ে ধীর হাতে লাগাল জ্যোতির হাতের কাঁটাস্থানটায়। পরপরই হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।পকেটে হাত গুঁজে জ্যোতির দিকে কিছুটা ঝুঁকে নিচু গলায় বলল,

“ চোখের সামনে আহত প্রাণী দেখলে সেবা করতে হয়। আম্মুই শিখিয়েছিল ছোটবেলাতে। বুঝলি? ”

কথাটা বলেই জ্যোতিকে পাশ কাঁটিয়ে চলে গেল। জ্যোতি একনজর সেদিক পানে তাকিয়ে আরেক নজর চাইল নিজের কাঁটা জায়গাটায়। তবে এই কারণেই হাত ধরেছিল মেহেরাজ ভাই? মনে মনে এবারে লজ্জ্বিত হলে না জেনে দোষারোপ করার জন্য। অস্বস্তিও ঘিরে ধরল কিঞ্চিৎ৷ ততক্ষনে মেহেরাজ গিয়ে দাঁড়িয়েছে মেহুর ঘরের সামনে। দরজায় টোকা দিয়ে বলে উঠল

“মেহু?এই মেহু?দরজাটা খোল।জ্যোতি এসেছে তোর সাথে দেখা করতে। ”

মেহু বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে ছিল। এতোটা সময় কান্নার দাপটে চোখমুখের বেহাল দশা তার।ফোলা চোখ, লালচে নাক,এমনকি মুখেও ফোলা ফোলা ভাব স্পষ্ট!তবুও চোখের পানি মুঁছে দরজা খুলল। বলল,

“কোথায় জ্যোতি?

মেহেরাজ উত্তর দিল না। বোনের দিকে তাকিয়েই উদাসীন হয়ে গেল এক মুহুর্তেই। মুখের এই অবস্থা? যা বুঝার বুঝা হয়ে গেল। উদ্গ্রীব গলায় জিজ্ঞেস করতে লাগল,

“ কেঁদেছিস মেহু? তোর চোখমুখ এমন হয়ে আছে কেন?কি হয়েছে মেহু? বল ভাইয়াকে। ”

মেহেরাজের আহ্লাদি গলা শুনেই মেহুর গলা ধরে আসল। ইচ্ছে হলো ভাইকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে। আহাজারি করে বলতে তার প্রিয়তম বন্ধুকে তারই একমাত্র বোন কতোটা ভালোবাসে। অথচ সেই বন্ধুই কি ভয়ানক ভাবে তার বোনকে বলে দিয়েছে, সে ভালোবাসে না। একটুও ভালোবাসে না মেহুকে। তাদের মাঝে নাকি কিছুই নেই। মেহুর চোখ ফের টলমল করল। ধরে আসা গলায় শুধাল,

“ কিছু হয়নি ভাইয়া৷ ”

মেহেরাজ মানল না সে কথা। ফের বলল,

“ কথা লুকাতে শিখেছিস মেহু? বল কি হয়েছে। ”

“সত্যিই কিছু হয়নি ভাইয়া। এমনিই কান্না পাচ্ছিল তাই। ”

মেহেরাজ কিছুক্ষন চুপ থাকল। উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল বোনের দিকে। পরমুহুর্তেই চোখজোড়া জ্বলে উঠল। যেন কিছু একটা মনে পড়েছে।সঙ্গে সঙ্গেই জিজ্ঞেস করল,

“ কালকের বিষয়টা নিয়েই কি কান্না করেছিস মেহু?স্যরি,
ভাইয়া স্যরি হুহ?আমি আর এই বিষয়টা নিয়ে একটুও এগোব না। একটুও না। বলে দেব বিয়েটা সম্ভব না।ভাইয়াকে ক্ষমা করে দে। ”

মেহু হাসল এবারে কিঞ্চিৎ। অলস পায়ে জ্যোতির দিকে যেতে যেতেই বলল,

“ উহ, ভাইয়া। তুমি শুধু শুধুই চিন্তিত হচ্ছো, তেমন কিছু না। তুমি যাও। ”

মেহেরাজ এবারেও দম মানল। মিনমিনে চোখে চেয়ে বলল,

“ ভাইয়াকে বলা যায় না সত্যিটা মেহু ? এতোটা দূরত্ব তৈরি করে নিয়েছিস? ”

মেহুর নিভু নিভু দৃষ্টি। মুখে হাসি নিয়ে শুধাল,

“ এই পৃথিবীতে কেউ যদি আমার সবচেয়ে বেশি ভালো চেয়ে থাকে সেটা তুমি ভাইয়া। কেউ যদি আমায় সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে সেটাও তুমি।আর সে মানুষটার সাথেই দূরত্ব তৈরি করব যে আমার মা-বাবা দুইজনেরই ভূমিকা পালন করে আসছে এতকাল?এতোটা বোকা আমি? ”

মেহেরাজের দৃষ্টব এবারেও মিনমিনে। মেহু এবারও হাসল। জ্যোতির হাত ধরে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

“তুমি ঘরে যাও ভাইয়া।জ্যোতির সাথে কিছু কথা ছিল বলেই ডেকেছিলাম। বলে নিই? ”

মেহেরাজের দৃষ্টি অসহায়৷ তবুও বোনের কথাতে সাই দিয়ে নিজ ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল। যাওয়ার পথে একবার আড়চোখে তাকাল জ্যোতির পানেও। মেয়েটার দৃষ্টি হয়তো তার দিকেই স্থির ছিল। নজর মিলতেই দৃষ্টি সরাল। মনে মনে মুগ্ধ হলো ভাই বোনের এই মুহুর্তটায়। সত্যিই ভাই হিসেবে কতোটা ভালোবাসলে এভাবে বোনের দুঃখ জানার জন্য উদ্গ্রীব হয়? আসলেই বোনের প্রতি কতোটা যত্নশীল এই মানুষটা!

.

মেহু ঘরে গিয়ে সবটাই খুলে বলল জ্যোতিকে। টলমল করা পানি গুলো ততক্ষনে গড়িয়ে পড়েছে গাল বেয়ে। জ্যোতি অবাক হলো। বিস্ময়ের স্বরে বলল,

“ সাঈদ ভাই সত্যিই ভালোবাসেন না তোমায়?কথাটা ঠিক আমার বিশ্বাস হলো না আপু। উনার মাঝে একটু হলেও তো কিছু ছি..”

কথাটা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই অন্যমনস্ত মেহু উত্তর দিল,

” নেই, কিছুই নেই। উনি নিজ মুখেই বলেছেন সেটা। ”

“কিন্তু কেন বলেছে? সত্যিটা স্বীকার করার সাহস নেই বলেই? ”

মেহু তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসল এইবারে। জবাব দিল,

“ উনি অতোটাও ভীতু নয় জ্যোতি। বলার হলে সবকিছু সরাসরিই বলতেন। ”

“ কিন্তু তুমি? ”

এবারে চাপা দীর্ঘশ্বাস মুক্ত করল মেহু। নরম গলায় উত্তর দিল,

“মানিয়ে নিব।আমার মৃত বাবা মায়ের ও তাই ইচ্ছে ছিল জ্যোতি। মেয়ে হিসেবে কি দায়িত্ব না আমার তাদের এই ইচ্ছেটা পূরণ করা? তাছাড়া বাবা,মা, চাচা, চাচী, ভাইয়া সবাই মিলে যাকে পছন্দ করেছে সে নিশ্চয়ই আমার জন্য খারাপ হবে না।আর সাঈদ ভাইয়ার কথাটা কাউকে বলিস না জ্যোতি। দয়া করে বলিস না।”

জ্যোতি ঠোঁটে ঠোঁট চাপল। মেহুর দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল

“বলব না,কিন্তু তোমার পছন্দ? ”

উত্তর এল,

“ আমি ছোটবেলা থেকেই খুব নরম মনের মেয়ে মেহু। আমার মনে কারোর জায়গা হওয়াটা খুব একটা কঠিন না।মেঘের জায়গাও হয়ে যাবে বল?তাছাড়া দীর্ঘদিন কোন কুকুর বিড়াল পুষলেও তো আমরা তাদের মায়ায় পড়ি। আর আস্ত একটা মানুষের সাথে সংসার করে মায়ায় পরব না? ”

জ্যোতির কান্না পেল এবারে। তবুও কাঁদল না। নিষ্প্রভ গলায় বলল,

“ আপু জানো? ছোটবেলা থেকে মা বাবার সংসারের এমন দশা দেখার পর থেকে আমি ভালোবাসায় বিশ্বাসী ছিলাম না। মনে হতো ভালোবাসা বলতে কিছু হয়না। কিন্তু আজ সত্যিই আমার কষ্ট হচ্ছে।”

জ্যোতির এমন কথা শুনেই মেহুর কান্নার বেগ দ্বিগুণ হলো। ঝাপটে জড়িয়ে ধরল জ্যোতিকে। জ্যোতি লম্বা শ্বাস ফেলল। মেহুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

“আর কান্না করো না আপু। দেখবে যা হবে ভালো হবে। ঠিক হবে! সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা তোমার পরিকল্পনার চেয়েও উত্তম আপু! ”

.

সে রাতটা মেহুদের বাসাতেই কাঁটল জ্যোতির। সকাল হতেই চোখে পড়ল বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা মেহুকে। জ্যোতি একপলক চাইল।মুহুর্তেই মন খারাপ হলো। বাস্তবতা এতো নিষ্ঠুর কেন? কি হতো মেহুর মতো নরম মনের মেয়ে এই আঘাতটা না পেলে? কি হতো সাঈদ ভাই এই মেয়েটাকে ভালোবাসলে? কি হতো এই দুইজনের মিল হলে? ক্ষতি হতো? খুব বেশি ক্ষতি হতো? কথাগুলো ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পরমুহুর্তে মনে পড়ল তার ক্লাস আছে।ভার্সিটিতে যেতে হবে। তার আগে হোস্টেলে যেতে হবে। তাই ঘুমন্ত মেহুকে না ডেকেই চুল বেঁধে, তৈরি হয়ে ঘর ছেড়ে বের হলো। বাইরে দেখা মিলল মেহেরাজের সাথে। জিজ্ঞেস করল,

“ মেহু উঠেছে?”

“ উঠেনি, ঘুমাক। ডাকবেন না আপুকে। আর ঘুম থেকে উঠলে বলবেন আমার ক্লাস ছিল বলেই চলে গিয়েছি। ”

এই বলেই জ্যোতি পা বাড়াল দরজার দিকে। মেহেরাজও পিছু পিছু এসে প্রশ্ন করল,

“ এখন কোথায় যাচ্ছিস? ”

“ হোস্টেলে,তারপর ভার্সিটিতে যাব।”

কথাটা বলেই দরজা পার হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। মেহেরাজ দাঁতে দাঁত চাপল। যাচ্ছে এটা তাকে বলার মতো নূন্যতম ভদ্রতাটুকুও নেই এই মেয়ের মাঝে?পরমুহুর্তেই জ্যোতির সাথে সাথে নামল মেহেরাজও।বাসার বাইরে এসে রিক্সা ডেকে দিয়ে বলল,

“ রিক্সায় উঠে বস। ”

জ্যোতি কথা না বাড়িয়ে উঠে বসল। কিন্তু পরমুহুর্তেই মেহেরাজকেও উঠে বসতে দেখে বলে উঠল,

“ আপনি উঠলেন কেন?”

গম্ভীর গলায় উত্তর আসল,

“তোকে পৌঁছে দিয়ে আসব। ”

সে প্রস্তাব নাকোচ করে জ্যোতি বলল,

“ আপনার যাওয়ার প্রয়োজন নেই মেহেরাজ ভাই৷ নেমে যান। ”

“ আমার প্রয়োজন আছে বলেই যাচ্ছি। ”

“ ঠিক আছে তাহলে আপনি যান, আমি নেমে পড়ছি। ”

কথাটা বলে বিরক্তি নিয়ে কপাল কুঁচকাল জ্যোতি। রিক্সা থেকে নেমে পড়তে নিতেই মেহেরাজ শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে বলে উঠল,

“নামবি না, দরকারটা তোর সাথেই। ”

জ্যোতি ফিরে চাইল এবারে।ততক্ষনে রিক্সা চলতে শুরু হয়েছে।জিজ্ঞেস করল,

“ কি দরকার?”

“মেহু কেন কান্না করেছে? কি কারণে? তোকে বলেছে নিশ্চয় ও? ”

“বলেছে। ”

“আমায় বল তাহলে। ”

”বলব না। ”

মেহেরাজ দাঁতে দাঁত চাপল। প্রশ্ন ছুড়ল,

“কেন বলবি না? ”

“আপনাকে বলার অনুমতি নেই তাই। ”

“মেহু বলেছে এমনটা? ”

“না, বলেনি। তবে কাউকে জানাতেও বলেনি মেহেরাজ ভাই।”

মেহেরাজ তপ্তশ্বাস ফেলল।পরমুহুর্তেি মাঝপথে হঠাৎ রিক্সা থামাতে বলে নেমে পড়ল রিক্সা থেকে। ভাড়া মিটিয়ে ফের চালককে রিক্সা চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিল। জ্যোতি অবাক হলো কিঞ্চিৎ। আশ্চর্য!

.

মেহুর ঘুম যখন ভাঙ্গল তখন বেলা বারোটা। অলস গতিতে বিছানা ছেড়ে মোবাইল নিতেই ফের সে অচেনা লোকের ম্যাসেজ পেয়ে অবাক হলো। স্ক্রিনে ভেসে উঠল,

“ আপনার অজান্তেই আপনাকে ভালোবেসে গিয়েছিলাম এতকাল। আপনার অনুমতি না নিয়েই প্রেম পড়েছিলাম আপনার।স্বপ্ন সাঁজিয়েছিলাম আপনার-আমার সংসারের।কিন্তু আজ হঠাৎই শঙ্কিত হচ্ছি আমি, ভীত হচ্ছি আপনাকে হারানোর ভয়ে। আপনি আমার হবেন তো? আমার আগেই অন্য কেউ জায়গা করে নেয়নি তো আপনার মনে? তাহলেও নাহয় এইটুকু জায়গা আমায় দিয়েন?প্লিজ!আমি সে অল্পটুকুতেই খুশি হবো। ”

#চলবে….

[ ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। কেমন হয়েছে জানাবেন। ]

এক মুঠো প্রণয় ২ পর্ব-০৫

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#সিজন_টু
#পর্ব_০৫
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

যাকে ভালোবাসে তাকে স্বামী হিসেবে পাওয়া যেমনটা বাঁধহারা সুখের বিষয় ঠিক তেমনই যাকে ভালোবাসে তাকে স্বামী হিসেবে না পাওয়ার বেদনাটাও আকাশসম। মেহু দীর্ঘশ্বাস ফেলল৷ সেদিন সাঈদের জম্মদিন ছিল বলেই সে, নাবিলা, নুসাইবা, সামান্তা সহ সাঈদের জম্মদিনের আয়োজন করেছিল বাড়ির ছাদে। কিন্তু কে জানত সে ঘটনার জন্য সাঈদ সেদিন রেগে যাবে। পুরোপুরি নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে সেদিনের পর।কল,ম্যাসেজ, সোশাইল সাইট সব থেকেই উধাও হয়ে গেল ছেলেটা হঠাৎ। অস্বস্তিতে মেহেরাজকেও জিজ্ঞেস করতে পারেনি সাঈদের কথা। এমনটা নয় যে সাঈদ আর মেহুর মাঝে পাকাপোক্তভাবে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। এমনটা ও নয় যে তারা কখনো কাউকে মুখ ফুটো ভালোবাসার কথা বলেছিল। তবুও কোথাও কি কিছুই ছিল না? সাঈদ এভাবে ভুলে বসল মেহুকে? বেদনায় মুখ কালো হয়ে উঠল মেহুর। কিন্তু তার চেয়েও যন্ত্রনার বিষয় হলো অন্য একটা পুরুষকে বিয়ে করা, তার সাথে সংসার করাটা।কে জানত এমন একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে তাকে৷ কে জানত গ্রাম ছেড়ে আসার পর নিজ বাসায় উঠার পর তার জন্য এমন কোন বিস্ময় অপেক্ষা করছে?কল্পনায় ভাবল গতকাল বিকালের ঘটনা,

বিকাল হতেই পরিচিত কয়েকটা মুখের দেখা পেল মেহু।তার বাবার সবচেয়ে কাছের বন্ধু এবং বন্ধুর স্ত্রী।বাকিরা তার চাচা-চাচীরা। এর আগেও অসংখ্যবার মেহুদের বাসায় এসেছেন উনারা। মেহু সালাম দিল।বসতে বলে কিয়ৎক্ষন আলাপও করল। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে ব্যস্ত হলো নাস্তা বানাতে। মেহেরাজ রান্না ভালো পারে। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর সেই রান্না করত সবসময়। অন্যদিকে মেহু রান্নায় কাঁচা। ভাইকে পাশে থেকে সাহায্য করা পর্যন্তই তার দৌড়। আজ মেহেরাজ বাসায় উপস্থিত না থাকাতেই তাকে রান্না করতে বেগ পেতে হলো। তড়িঘড়ি করে কাঁচা হাতে কিছু তৈরি করতেই হঠাৎ এক সুন্দর, মুগ্ধময় কন্ঠ ভেসে আসল কানে,

“ একি মিস!রান্নাও পারেন? আমার জানামতে তো পারতেন না আগে।”

মেহু পিঁছু ফিরে চাইল। ছেলেটার মুখটা চেনাচেনা ঠেকল ঠিক তবে চিনে উঠল না তখনই। পরমুহুর্তেই যেন চিনতে পারল। বিড়বিড় করে শুধাল,

“ আপনি? ”

“জ্বী, আমিই!আপনার না হওয়া বর।”

মেহু ছেলেটাকে চেনে। তার বাবার সবচেয়ে কাছের বন্ধুরই ছোট ছেলে।নাম মেঘ।শেষবারের মতো সেই বছর চারেক আগে দেখা হয়েছিল।তখনকার চেনা পরিচিত ছিল বলেই কথাটা মজা হিসেবেই নিল। বলল,

“এতকাল কোথায় ছিলেন? দেখা পাইনি যে আপনার। ”

মেঘ এবার ভ্রু উঁচাল। উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“কেন কেন?ভীষণ মিস করেছিলে বুঝি আমায়? ”

মেহু অল্প হাসল। উত্তরে বলল,

“ আরেহ না, আমি ছেলেদের মিস টিস করি না। এতকাল পর দেখা হলো তাই জিজ্ঞেস করলাম। ”

মেঘ এগিয়ে এল। মেহুর দিকে তাকিয়ে শুধাল,

“চিন্তা নেই।এখন থেকে রোজ রোজ দেখা হবে মিস মেহু। ”

“ কেন? রোজ রোজ কেন দেখা হবে? ”

“ কেন? দেখা হলে সমস্যা হবে তোমার? ”

মেহু মিনমিনে চোখে তাকাল। কিছু বলবে সে মুহুর্তেই মেহেরাজ উপস্থিত হলো। মেহুর দিকে তাকিয়েই ব্যস্ত গলায় বলল,

“ একি কি করছিস তুই এখানে? হাত পুড়ে যেত যদি? সর।”

মেহু সরে আসল বাধ্য মেয়ের মতো৷ ভাইয়ের দিকে তাকিয়েই বলল,

“ তুমি তো বাসার বাইরে ছিলে ভাইয়া। হঠাৎ বাসায় এলে যে? ”

মেহেরাজ ব্যস্ত কন্ঠে বলল,

“ তোর সাথে কিছু কথা বলব মেহু। খুব মনোযোগ নিয়ে শুনবি। আর জানবি ভাইয়া তোকে ভালোবাসে। তোর খারাপ চায় না সে। ”

মেহু জানে মেহেরাজ তার খারাপ চায় না। তবে হঠাৎ এই কথা কেন বলল?কিই বা বলবে? মাথা নাড়িয়ে বলল,

“হ্যাঁ বলো, ভাইয়া।”

“ তুই রুমে যা। আমি ততক্ষনে সবার জন্য নাস্তা নিয়ে রেডি করছি। তারপর বলব৷ ”

মেহু এবারেও বাধ্য মেয়ের মতোই মাথা নাড়াল। দ্রুত চলে গেল নিজের ঘরে। ঠিক তখনই মেহেরাজ লম্বাশ্বাস ফেলল। গম্ভীর গলায় শুধাল,

“ ইন্টার্নি শেষে অন্য দেশে চলে যাবে শুনলাম? তুমি ছেলে হিসেবে পার্ফেক্ট হলেও এই দূরত্বের বিষয়টা ভাবাচ্ছে আমায়। ভালো রাখবে তো আমার বোনকে? ও খুব চাপা আর নরম মনের মেয়ে মেঘ।”

মেঘ ঠোঁট এলিয়ে হাসল। আশ্বাস দিয়ে বলল,

“ এটুকু বলব যে আপনার বোনকে খারাপ থাকতে দিব না ভাইয়া। ওর সকল খারাপ আমার হোক এটাই চাইব আমি।”

মেহেরাজ তাকাল। গম্ভীর অথচ শান্ত গলায় শুধাল,

“ ভালোবাসার সংজ্ঞা কি জানোতো মেঘ?যাকে ভালোবাসবে তাকে অবশ্যই ভালো রাখার দায়িত্বটুকুও নিতে হবে। তুমি ভালোবাসো আমার বোনকে এটা আমি অনেক আগেই জানতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমার বোন যদি ভালো না থাকে সেক্ষেত্রে কিন্তু আমি অবশ্যই মত পাল্টাব। ”

মেঘ মাথা নাড়াল। বলল,

“আমি আপনাকে শ্রদ্ধা করি, জানি আপনার সিদ্ধান্ত ভুল হবে না। ”

কথাটা বলেই মেঘ চলে গেল। মেহেরাজও নিজ কাজে ব্যস্ত হলো। কিয়ৎক্ষন পর কাজ সেরে মেহুর ঘরে গেল। ততক্ষনে অবশ্য মেহুর কাছে সবটা জানা। কিছুটা সময় আগেই চাচী এসে বলে গিয়েছেন সবটা। ছোটবেলাতেই নাকি তার বাবা মা তার আর মেঘের বিয়ের বিষয়টা ঠিক করে রেখেছিলেন। দুই পরিবারই সে সিদ্ধান্তে অনেকটা খুশি ছিল। ঠিক করেছিলেন বড় হলেই সবটা জানাবেন ছেলেমেয়েদের। কিন্তু তার আগেই তো মেহেরাজের বাবা-মা একটা এক্সিডেন্টে মারা গেল।কিন্তু এতবছর পরও সবাই চাইছে সে সিদ্ধান্তটাই বাস্তবে পরিপূর্ণ হোক। চাচা-চাচীদের সবাইই রাজি, মেহেরাজের নাকি ছেলেকে খুব পছন্দ হয়েছে। শুধু মেহুর মতটাই নেওয়া বাকি।মেহু কি আসলেই অমত করতে পারবে? বাবা মায়ের পর যে চাচা চাচীরা তাদের অভিভাবক ছিলেন তাদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু বলতে পারবে? যে ভাই তাকে বাবা মা মারা যাওয়ার পর থেকে দুই হাতে আগলে রেখেছে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অমত করবে? মেহু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। টলমল চোখে বলল,

“ তুমি সবটা জানতে ভাইয়া ? ”

মেহেরাজ ক্লান্তির শ্বাস নিল। এগিয়ে এসেই বোনের দুইহাত হাতে নিয়ে কোমল স্বরে বলল,

“ জানতাম মেহু।বিষয়টা চাচাদের কাছেই শুনেছিলাম কিছুবছর আগে। এমন নয় যে মেঘ ছেলে হিসেবে খারাপ। ছেলেটা তোকে ভালোবাসে। আমার বিশ্বাস সে তোকে ভালো রাখবে। তবে আজ এভাবে হঠাৎ উনারা আসবেন জানা ছিল না আমার। হঠাৎই এভাবে বিয়ের প্রস্তাব
নিয়ে আসাটা কেমন অযৌক্তিক বোধ হলো। আমি তোকে সেদিন এই কারণেই জিজ্ঞেস করেছিলাম কাউকে ভালোবাসিস কিনা, বা পছন্দ আছে কিনা। তুই বলেছিলি কোন পছন্দ নেই। সে হিসেবেই আমি উনাদের প্রস্তাবে মত দিতে চেয়েছি।বাকিটা তুই যা বলবি তাই, তুই না বললে আমি এক পা ও সামনে যাব না মেহু। ”

মেহুর মনে পড়ল সেদিন বাড়ি থেকে ফেরার পর মেহেরাজ জিজ্ঞেস করেছিল সে কাউকে ভালোবাসে কিনা। সংকোচে আসল উত্তরটা না দিয়েই বলেছিল কাউকে ভালোবাসে না সে। কিন্তু বিষয়টা যে এই কারণেই জিজ্ঞেস করেছিল জানা ছিল না তার। অস্ফুট স্বরে বলল,

“কিন্তু..

বাক্যটা শেষ হওয়ার আগেই মেহেরাজ ফের বলল,

“ কাউকে ভালোবাসিস বোন? আবারও জিজ্ঞেস করছি, ভালোবাসিস কাউকে? ”

মেহু বলে দিতে চাইল সাঈদের প্রতি তার অনুভূতিটা। পরমুহুর্তেই আবার চুপ হয়ে গেল। তাদের মাঝে যে সম্পর্কটা পাকাপোক্ত প্রেমের নয়। হতেই পারে সাঈদ বাকি সবার মতোই তার সাথে ফ্লার্ট করেছিল।তাই সত্যটা চাপা রাখল তখনও। ধরা গলায় বলল,

” আমাকে কি কিছুটা সময় দেওয়া যাবে ভাইয়া? আমি কিছু বুঝে উঠছিনা। কিছুই না।অন্তত একটা দিন সময় দাও।”

মেহেরাজে নরম চাহনীতে চাইল। উঠে গিয়ে মেহুর মাথায় হাত রেখে আশ্বাস দিয়ে শুধাল,

“ যত ইচ্ছে সময় নে মেহু।আমি তোকে জোর করছি না একবারও। তোর মত যা হবে সিদ্ধান্তটা তাই হবে।”

মেহেরাজ এই বলেই বোনের মাথায় হাত রেখে আশ্বস্ত করল। পরমহুর্তেই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। অপরদিকে মেহুর চাহনি নিষ্প্রভ। সেই নিষ্প্রভ চাহনি নিয়েই তাকিয়ে রইল ভাইয়ের যাওয়ার দিকে।

.

মেহু গতকাল বিকালের কথাগুলো কল্পনায় ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল।গতকাল থেকে টানা কল দিয়ে যাচ্ছে সাঈদকে। অথচ ছেলেটা কল তুলেনি। কি হলো ছেলেটার? মেহু চিন্তিতি হলো।দীর্ঘশ্বাস টেনে তাকিয়ে রইল আঁধারে ঘেরা রাতের আকাশের দিকে।আজ কি আকাশেরও মন খারাপ? নয়তো এতো আঁধার কেন? মনের কোণে প্রশ্নগুলো জাগতেই মোবাইলে কল এল।অনেকটা চমকেই গেল সে স্ক্রিনে তাকিয়ে। সাঈদের কল!দেরি করল না সে। দ্রুত কল তুলতেই শোনা গেল সাঈদের গলা,

“ শুভকামনা মেহু। নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা ”

মেহু ভ্রু কুঁচকাল। বলল,

“নতুন জীবন?সাঈদ ভাইয়া? একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”

“ করো। ”

“আমায় বিয়ে করবেন? ”

মেহু গম্ভীর স্বরে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করলেও সাঈদ উত্তরটা দিল মজার সহিতই। বলল,

“ ধুরর!আমার মতো ছেলেকে বিয়ে করে করবেটা কি? ”

মেহু ফের গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল,

“আমাদের মাঝে কি কিছুই ছিল না সাঈদ ভাইয়া?”

সাঈদের গলা এবার সিরিয়াস হলো। উত্তর এল,

“ কি থাকবে?ছিল না, কিছুই না ছিল না। আমার মতো ছেলেদের কারো সাথে কিছু থাকতে পারে না মেহু ”

মেহু বিস্মিত হলো। ঠান্ডা গলায় আবারও জিজ্ঞেস করল,

“ আপনি আমায় ভালোবাসতেন না? ”

সাঈদ লম্বা শ্বাস ফেলল।উত্তরে বলল,

“ না, আমার দ্বারা কোন মেয়েকে ভালোবাসা সম্ভব নয় মেহু। ”

“ কেন? ”

সোজাসাপ্টা জবাব এল,

“ ঘৃণা করি মেয়েজাতিকে। ”

“কিন্তু আমি তো আপনাকে..”

বাকি কথাটা সম্পূর্ণ করতে দিল না সাঈদ। যে সত্য জানলে নিষিদ্ধ মানুষের প্রতি দুর্বলতা বাড়ে সে সত্য না জানাই বোধহয় উত্তম।যে সত্য প্রকাশ করলে নিষিদ্ধ কারোর সাথে জড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে সে সত্য না জানানোই উচিত। তাই সাঈদ সত্যটা প্রকাশও করল না, সত্যটা জানাতেও দিল না। কথার মাঝপথেই বলল,

“ হুরর! কিছু না, ছেলেটা ভালো। অনেকটা ভালো! তোমায় ভালো রাখবে। সবচেয়ে বড় কথা আমার মতো ছন্নছাড়া নয়।বেশ গোছাল আর শান্ত। রাজের মতোই! আমি নিজেই খোঁজ নিয়ে দেখেছি। তার সাথে সুখী হবে তুমি মেহু। বিয়েটা করে নাও। ”

মেহুর গলা আটকে আসল৷ কান্নারা যেন দলা পাকিয়ে আছে। কাল থেকে মেঘের সাথে বিয়ের বিষয়টা নিয়ে যতোটা না কষ্ট হয়েছে তার চেয়েও বেশি কষ্ট হচ্ছে সাঈদ তাকে ভালোবাসে না ভেবে, সাঈদকে স্বামীরূপে পাবে না বলে, সাঈদ জীবনসঙ্গী হবে না বলে। সবটাই তাহলে একতরফা ছিল? মেহুর কান্না পেল। তবুও ধরে আসা গলায় জিজ্ঞেস করল,

“ আপনার কষ্ট হচ্ছে না?”

সাঈদ বলতে পারল না তারও কষ্ট হচ্ছেে।যন্ত্রনা হচ্ছে বুকের ভেতর! উত্তপ্ত লাভার ন্যায় এই যন্ত্রনাটা ছারখার করে দিচ্ছে তার ভেতরটা! তবুও বলা হলোনা। হাসি নিয়ে বলল,

“ধুররর!কষ্ট কেন হবে? তোমার বিয়েতে জমিয়ে খাবার খেতে হবে না? ”

“এভাবে তো বিয়ে হয় না। ”

“এটা কিন্তু তোমার মৃত বাবা মায়ের ইচ্ছে ছিল মেহু।মেয়ে হিসেবে কি তোমার দায়িত্ব না বিয়েটা করা?আশা রাখি বিয়েটা হবে৷ আর আমি খুবই আনন্দের সহিত অপেক্ষা করছি তোমার বিয়েটা খাওয়ার জন্য। ”

কথাগুলো বলেই কল রাখল সাঈদ। মেহু থমকে গেল। চোখ বেয়ে বয়ে গেল কান্নার স্রোত। সত্যিই ভালোবাসত না? কিছুই ছিল না তাদের মাঝে?সবটাই একতরফা ছিল? মেহুর কষ্ট হলো। কান্না পেল। দমবন্ধ হয়ে আসল যেন। ঠিক তখনই মনে পড়ল জ্যোতির কথা৷মোবাইলে উদ্ভ্রান্তের মতো জ্যোতির নাম্বার টা খুঁজে নিয়েই কল লাগাল। ওপাশ থেকে জ্যোতি কল তুলা মাত্রই হুহু করে কেঁদে উঠল নিঃশব্দে। জ্যোতি প্রথম দফায় অবাক হলো। দ্বিতীয় দফায় জিজ্ঞেস করল,

“ মেহু আপু? এই মেহু আপু।তুমি ঠিক আছো? কাঁদছো কেন? ”

মেহু উত্তর দিল না। এবারে শব্দ করেই কেঁদে ফেলল। কাতর স্বরে বলল,

“ একটু সময় হবে তোর জ্যোতি? আমার কেউ একজনকে চাই মনের কথাগুলো খুলে বলার জন্য।দমবন্ধ লাগছে আমার। কাউকে কিছু শেয়ার করতে পারছি না। প্লিজ,প্লিজ, একটু সময় দে!”

জ্যোতি এবারেও অবাক হলো।এসাইনমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত থাকা স্বত্তেও বলল,

“ হবে না কেন সময়? বলো মেহু আপু, কি হয়েছে?কেউ কিছু বলেছে তোমায়? ”

“ এভাবে যে পারব না বলতে৷ একবার আসবি আমাদের বাসায়? দমবন্ধ লাগছে জ্যোতি। কান্না থামাতে পারছি না আমি। ”

জ্যোতি থমকাল।ঘড়িতে সময় দেখে বুঝল রাত আটটা। এইসময়ে এভাবে মেহুদের বাসায় ছুটে যাওয়াটা কতোটা যুক্তিযুক্ত? তাও যেখানে মেহেরাজ ভাইয়ের উপস্থিতি আছে! মেহেরাজ যদি আবারও গায়ে পড়া মেয়ে বলে তাকে? আনমনে সেসব একবার ভাবলেও পরমুহুর্তে পাত্তা দিল না। আপাতত মেহুর কান্নাটাই জরুরী বিষয়। মুদু আওয়াজে বলল,

“ আমি তো যাইনি কখনো তোমাদের বাসায়। ঠিকানাটা বলো আপু।”

মেহু ঠিকানা বলল। জ্যোতিও তৈরি হয়ে বের হলো।মাথায় ঘুরছে অনেকগুলো চিন্তা।বিকালে দাদীর কাছে শুনেছিল তার আব্বার নাকি বুকে ব্যাথা উঠেছে।যে সে ব্যাথা নয়। গুরুতর বুকে ব্যাথা।প্রায় সময়ই নাকি এমন বুকে ব্যাথা হয় । তবুও ডাক্তারের কাছে যেতে নারাজ তিনি। কিন্তু বুকে ব্যাথাকে এভাবে অবহেলা করাও তো উচিত নয়।আবার অপরদিকে মেয়ে হিসেবে জোর করারও যে অধিকার নেই তার। দীর্ঘশ্বাস ফেলল জ্যোতি। জীবনের সমীকরণগুলো বড্ড কঠিন। কেমন রুক্ষ জীবন তার!এসব ভাবতেই ভাবতেই রিক্সা পেয়ে গেল। অন্যমনস্ক হয়ে সঙ্গে সঙ্গে রিক্সায় উঠে বসতে নিতেই ঘটল বিপত্তি। পাশের লোহাটার সাথে টান খেয়ে হাত কেঁটে গেল খানিকটা। অন্ধকারে অবশ্য বোঝা গেল না তা। তবে ব্যাথাটা স্পষ্টই টের পেল জ্যোতি। তবুও বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখাল না ব্যাথা পেযে। চুপচাপ বসে থাকল।কিয়ৎক্ষন পর ঠিকানা অনুযায়ী মেহুদের এলাকায় পৌঁছেও গেল।পরে অবশ্য দুয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে নির্ধারিত বিল্ডিংয়ের সামনে গিয়ে পৌঁছাল। গেইট পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়েই হঠাৎ দেখা মিলল পরিচিত যুবকের।লম্বা চওড়া শরীরে কালো রংয়ের শার্ট আর কালো জিন্স প্যান্ট৷একনজর তাকায়িই নজর সরাল সে।মেহেরাজকে পাশ কাঁটিয়ে যেতে নিতেই কানে এল গম্ভীর গলা,

“ তুই? তুই এখানে? ”

জ্যোতি নিভুনিভু চোখে তাকাল। পরমুহুর্তেই মেহেরাজে দৃষ্টি দেখে কি যেন অনুভূত হলো। শিহরন বইল কি হৃদয় জুড়ে? নাকি পরিপক্ব জ্যোতি হঠাৎই নড়বড়ে অনুভব করল নিজের মাঝে? বুঝল না সে। তবে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে উত্তর দিল,

“ আপনাদের বাসাটা দোতালায় না মেহেরাজ ভাই? ”

মেহেরাজ সে প্রশ্নের উত্তর দিল না। বরং গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করল,

“ কেন এসেছিস এখানে?”

জ্যোতি এবারে অপমানিত বোধ করল। কারো বাসায় আসলে এভাবে কেউ যদি কেন এসেছে জিজ্ঞেস করে তাহলে অপমানিত বোধ করারই কথা বোধহয়। তাই অপমানে মুখ থমথমে করে পা বাড়াল সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার উদ্দেশ্যে৷ ঠিক তখনই ফের শান্ত গলায় বলল মেহেরাজ,

“ দাঁড়া এখানে। ”

জ্যোতি ভ্রু কুঁচকাল। স্পষ্ট স্বরে প্রশ্ন শুধাল,

“ কেন?”

“ কয়েক মিনিটের মধ্যে আসছি আমি৷ ”

জ্যোতি থমথমে গলায় জবাব দিল,

“ আমি তো আপনার জন্য আসিনি এখানে মেহেরাজ ভাই।”

মেহেরাজ দাঁতে দাঁত চাপল। শ্বাস টেনে বলল,

“কিন্তু তোর গন্তব্যটা আমাদের বাসাতেই? তাই না? ”

“ তো? ”

“ বল আমাদের বাসা কোনটা?কোন ফ্লোরে?”

জ্যোতি মুখ কালো করল। সে জানে না উত্তর।মেহুর থেকে কেবল ঠিকানাটাই নিয়েছিল। কত তালায় কিংবা কোন বাসাটা জিজ্ঞেস করেনি সে । তাই ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে নিতে নিতেই বলল,

“ মেহু আপুকে কল দিয়ে জেনে নিব। আপনাকে প্রয়োজন পড়বে না।”

“যদি মেহু কল না তুলে? ”

“ তাহলে নাবিলা, সামান্তা আপু কাউকে ফোন করে জিজ্ঞেস করব। ”

মেহেরাজ ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“ কেউই না বললে? ”

জ্যোতি এবারে বিরক্ত।চরম বিরক্ত নিয়ে শুধাল,

“ তাহলে দরজায় দরজায় নক দিয়ে দেখব কোনটা কার বাসা। ”

“গুড আইডিয়া!যা জিজ্ঞেস কর গিয়ে। ”

কথাটা বলেই গাছাড়া ভাব নিয়ে পা এগুলো মেহেরাজ।জ্যোতি থমথমে মুখে চাইল। গেইটের দিকে পা এগিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়েই কিয়ৎক্ষন থামল। মেহুকে কল করল। আশ্চর্য! মেহু কল তুলল না। একবার, দুইবার, তিনবার কল দিয়েও লাভ হলো না। পরমুহুর্তেই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে নিতেই কোথায় থেকে জানি মেহেরাজ আবারও এসে উপস্থিত হলো। কপাল কুঁচকে বিরক্তির স্বরে বলল,

” এখনও দাঁড়িয়ে আছিস যে এভাবে? আমাকে না জিজ্ঞেস করেও ফলো করে করে আমাদের বাসায় চলে যাবি বলে? ”

জ্যোতি এবারও বিরক্ত হলো। যে মেহেরাজ ভাইয়ের ব্যাক্তিত্বে সে মুগ্ধ ছিল সে মেহেরাজ ভাইয়েরই অতিরিক্ত অহংকার দেখে বিরক্ত হচ্ছে বারবার। সে কি এতোটাই বেহায়া? মেহেরাজ ভাই বারবার তাকে এমনটাই ইঙ্গিত করেন কেন? সেদিনকার চিরকুটটার জন্যই কি? মনে মনে কথাগুলো ভাবলেও উত্তর দিল,

“ না, আপুকে কল দিচ্ছিলাম। ”

“ তো ঠিকাছে,তাহলে আমাকে ফলো না করেই বাসায় পৌঁছাবি। যদি দেখি পেঁছন পেছন আসছিস তাহলে..”

মেহেরাজ বাকিটা বলার আগেই জ্যোতি কাঠকাঠ গলায় বলে উঠল,

“ জানি। তাহলে বলবেন আমি ছেলেদের পেছনে পেঁছনে ঘুরে বেড়াই, ছেলেদের ফলো করি। তাইতো?চিন্তা নেই আমি আপনাকে ফলো করব না।”

কথাটা বলে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল কিয়ৎক্ষন। মেহেরাজ এভাবে জবাব দিল না। জ্যোতিকে রেখেই পা বাড়িয়ে চলে গেল দ্রুত

.

জ্যোতি মেহুদের বাসায় পৌঁছাল আরো মিনট পাঁচ পরে। কলে নাবিলার থেকে জেনেই এসেছে। কলিং বেল বাঁজাতেই দরজা খুলল মেহেরাজ। যেন তার অপেক্ষাতেই দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। জ্যোতি তাকাল না এবারে। এড়িয়ে পা বাড়াতে নিতেই মেহেরাজ বলে উঠল,

“ কি হয়েছে তোর হাতে? ”

জ্যোতি ভ্রু কুঁচকাল। জিজ্ঞেস করল,

“ কি হবে ? ”

মেহেরাজ দাঁতে দাঁত চেপে শুধাল,

“ নাটক করছিস তুই? কেঁটে গিয়েছে তাই জিজ্ঞেস করছি।”

জ্যোতি হাতের দিকে তাকাল। সত্যিই কেঁটে গিয়েছে।বোধহয় রিক্সার সাথে লেগেই কেঁটেছিল।অবশ্য এইটুকু কাঁটা আর কিই? তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,

“ ওসব কিছু না মেহেরাজ ভাই। মেহু আপু কোথায় ?আপুর কি হয়েছে? ”

“ কেন? ও কি কিছু বলেছে তোকে? ”

জ্যোতি কিছু বলতে নিয়েও বলল না। উত্তর দিল,

“ উনার ঘরটা কোথায়? ”

মেহেরাজ ছোটশ্বাস ফেলল। প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শান্ত গলায় বলল,

“ বলব, সোফায় বস আগে। ”

জ্যোতি ভ্রু জোড়া কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

“কেন? ”

“মুখে মুখে কথা বলিস খুব তুই।পছন্দ হয় না।”

জ্যোতি ছোট্ট শ্বাস টানল। যেখানে তার আস্ত জীবনটাই তার কাছে অপছন্দের সেখানে কারো কাছে তার কোন একটা অভ্যাস অপছন্দের হলে খারাপ লাগার কথা নয়। বরং ঠোঁট নাড়িয়ে উত্তর দিল,

“জীবনে সবকিছু পছন্দসই হয়না মেহেরাজ ভাই। না চাইলেও আমাদের জীবনে অনেককিছুই অপছন্দ-সই বয়ে বেড়াতে হয়। সারাজীবনই ! ”

মেহেরাজ উত্তর দিল না। নিজ ঘরে যেতে যেতে বাঁকা হাসল। বিড়বিড় করে আপনমনে বলল,

“ ক্ষতি কি? অপছন্দটাই নাহয় সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হোক আমায়। এবং এবং এবং অবশ্যই তোকেও! ”

কথাটা বলেই আনমনে হাসল সে। পরমুহুর্তেই নিজের এহেন কথার জন্য বিস্মিত হলো। তার মতো ব্যাক্তিত্ববান ব্যাক্তি বুঝি শেষ পর্যন্ত এভাবে হ্যাংলার মতো ব্যবহার করছে? ছিঃ ছিঃ ! সব দোষ এই মেয়েটার। শুধুই এই মেয়েটার!

#চলবে…

এক মুঠো প্রণয় ২ পর্ব-০৪

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#সিজন_টু
#পর্ব_০৪
লেখনীতেঃএকান্তিকা নাথ

মেহেরাজ তখন সবেই ঘুম ছেড়ে উঠেছে।চুলগুলো অগোছাল হয়ে কপালে পড়ে আছে। চোখে সদ্য ঘুম ছেড়ে উঠার রেশ৷পরনের শার্টটার বোতাম লাগানো নেই। এক হাতে হাতা গুঁটিয়ে বোতাম গুলো লাগাতে লাগাতেই ছাদে উঠার উদ্দেশ্যে সিঁড়ির সব ধাপ শেষ করল। পরমুহুর্তেই বিরক্ত হলো যেন। ছাদ আগে থেকেই মেয়েদের দখলে।পাশে অবশ্য সাঈদও বসে আছে। ব্যস্ত হয়ে সবাই কথা বলছে,আড্ডা জমাচ্ছে। ঠিক তার মধ্যেই শোনা গেল সামান্তার রিনরিনে কন্ঠ। প্রায় ফিঁসফিঁসিয়েই বলে উঠল সে,

“ উফফফ!আমার বুক ধড়ফড় করছে। কেমন একটা জানি লাগছে। ”

মেহু, নাবিলা সহ প্রত্যেকটা মেয়েই অবাক হয়ে তাকাল মুহুর্তেই। পরমুহুর্তেই আবার ওর দৃষ্টি অনুসরন করে মেহেরাজের দিকে তাকাল সকলে। নাবিলা মৃদুস্বরে জিজ্ঞেসও করল,

“ রাজ ভাইয়াকে দেখেই তোমার বুক ধড়ফড় করছে আপু? ”

সামান্তা মাথা দুলাল। সঙ্গে সঙ্গেই মেয়েলি কন্ঠগুলোতে হাসির ঝংকার উঠল। সে হাসি শুনেই মেহেরাজ ফিরে চাইল এদিক পানে। কি আশ্চর্য!তাকে কি জোকারের মতো লাগছে? হাসল কেন সবাই তার দিকে তাকিয়ে? ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি ছুড়ে মারতেই মিথি বলে উঠল,

“ মেহেরাজ ভাই? এদিকে আসো তো। আমার জানামতে তো ভূতপ্রেত দেখলেই বুক ধড়পড় করে। এদিকে আসো,তোমায় ভূতপ্রেতের মতো দেখাচ্ছে কিনা সামনে থেকে পরখ করি। ”

মেহেরাজ ফের বিরক্ত হলো। পাত্তা না দিয়ে পকেটে হাত গুঁজে ফের চলে যেতে উদ্যত হতেই সাঈদ বলে উঠল,

“ শালা তুই বেলা এগারোটায় ঘুম থেকে উঠে অগোছাল চুল নিয়া মেয়েদের সামনে আসার কি দরকার ছিল। আমার তো বউ কমে যাচ্ছে এইবারে।”

“ তোর বউয়ের অভাব আছে? ”

“ তো?তুই যে রূপ দেখিয়ে আমার বউ কেড়ে নিচ্ছিস কমে যাচ্ছে না? ”

মেহেরাজ সরু চোখে চাইল। হাত দিয়ে চুলগুলো পেছনে ঠেলে বলল,

“ হুরর!অন্যের বউ কেড়ে নেওয়ার মতো ব্যাক্তিত্বহীন নই আমি।”

সাঈদ মুখ বাঁকাল। বলল,

“ তো আমি কি ব্যাক্তিত্বহীন?”

মেহেরাজ মৃদু হাসল এবারে।ছাদ ছেড়ে যেতে যেতে বলে উঠল,

“তুই তো সাক্ষাৎ চরিত্রহীন। ”

মুহুর্তেই হাসির রোল পড়ল। সাঈদ মুখ কালো করল।নিরস মুখে বলল,

“ ও আমায় চরিত্রহীন বলে চলে গেল? তোমরা কেউ কিছু না বলে হাসছো?”

মিথি মাথা নাড়িয়ে বলে উঠল,

“ আমি কিন্তু মেহেরাজ ভাইয়ের সব কথাকেই সম্মান করি, বিশ্বাস করি। সে হিসেবে মেহেরাজ ভাই যখন বলেছে তার মানে অবশ্যই আপনি চরিত্রহীন ভেড়াসাহেব। ”

সাঈদ কপাল কুঁচকে চাইল। বলে উঠল,

“ এই পিচ্চি, তুমি চুপ করো। চরিত্রের কি বুঝো তুমি হুহ? ”

মিথি ফুঁসে উঠল এইবারে। জবাবে বলল,

“ আর কিছু বুঝি বা না বুঝি তবে এইটুকু বুঝি যে সারাক্ষন মেয়েদের সাথে চিপকে থাকা আর মেয়েদের পেঁছন পেঁছন ঘুরা ছেলেকে চরিত্রবান বলা যায় না। ”

ভ্রু কুঁচকে এল সাঈদের। মুখ বাঁকিয়ে বলল,

“ আমি মেয়েদের সাথে চিপকে থাকি? মেয়েদের পেঁছন পেঁছন ঘুরি? ছিঃ!”

“ অস্বীকার করতে পারবেন? ছিঃ হলেও এই ছিঃ মার্কা কাজটা আপনিই করেন। ”

সাঈদ পাত্তা দিল না এবারে।মহান একটা ভাব নিয়ে বলল,

“ হুরর, আমি শুধু ফ্লার্ট করি। ওটা মহান থেকেও মহানতম কাজ!এসব চিপকাচিপকির মধ্যে আমি নেই। ”

মুখ ভেঙ্গচাল মিথি। বিড়বিড় করে বলল,

“ যে না মহান ব্যাক্তি, সে না তার মহান কাজ!”

সাঈদ ফের কিছু বলার জন্য উদ্যত হচ্ছিল।এতক্ষন ওদের ঝগড়ার নিরব দর্শক হয়ে থাকলেও এতক্ষনে মেহু রাগ নিয়ে বলে উঠল,

“ কি আশ্চর্য সাঈদ ভাইয়া!আপনি ওর থেকে বয়সে এত বড় হয়ে ওর সাথে ঝগড়া করছেন? আশ্চর্য।”

.

বেলা বারোটা বাঁজে। জ্যোতি তখন উনুনে রান্না করছিল। হুট করেই উঠোনের মাঝে চোখে পড়ল নিজের আব্বাকে। ছুটিতে বাড়ি আসার পর এই প্রথমই দেখা হলো। কিন্তু কথা বলা হলো না। নিজের মতো করেই রান্নায় আবার ব্যস্ত হয়ে গেল সে। ঠিক তখনই শোনা গেল আব্বার গম্ভীর স্বর,

“ শহরে গিয়ে এতোটা বেয়াদব হয়ে গেছিস যে আব্বাকে দেখলে সালাম দিতে হয় তাও ভুলে গেছিস? এমন বেয়াদব হওয়ার জন্য তোকে শহরে পাঠিয়ে পড়াচ্ছি? ”

জ্যোতি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আব্বা সবসময় এমন কড়া ভাষায় কথা বলেন কেন? সবসময় কেন তাদেরই দোষ দেখেন? আর দশটা বাবার মতো কি জ্যোতির বাবাও আদুরে, নরম গলায় কথা বলতে পারত না? কেন বলে না?সব দোষ কি তাদের? জ্যোতির চোখ টলমল করল।তবুও কান্না করল না। উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠল,

“ আপনি তো সবসময় আমাদের সাথে কথা বলে খুশি হননা আব্বা। যেচে গিয়ে কারোর অখুশির কারণ হতে চাইনি বলেই সালাম দিইনি। কেমন আছেন? ”

ফের তেজ নিয়ে বলে উঠলেন তিনি,

“ কেমন আছি জানার হলে এই কয়েকদিনে জিজ্ঞেস করে আসতে পারতি।বাবার প্রতি নূন্যতম এই ভদ্রতাটুকুও নেই।বাহ!”

জ্যোতি তাচ্ছিল্য মেখে হাসল। উত্তরে বলল,

“ যে ঘরে ছোটবেলা থেকে আমাদের স্থান হয়নি সে ঘরে গিয়ে কি করে জিজ্ঞেস করে আসতাম? তাই ভদ্রতাটুকু দেখাতে পারিনি।”

“ দোষ চাপাচ্ছিস?আমি কি তোদের ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলাম?একবারও বলেছিলাম ও ঘরে না থাকতে?”

“ বলেননি,বেরও করেননি। কিন্তু এটাতো ঠিক যে ওভাবে ও ঘরে ছোট আম্মা আর আপনার মার খেয়ে পড়ে থাকলে কোন বাচ্চাই সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে উঠতে পারত না। আমি আর মিথিও হয়তো সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারতাম না আব্বা।এখনও কি খুব সুস্থভাবেই বেঁচে আছি?যাদের আব্বা-আম্মা থেকেও থাকে না তারা সুস্থভাবে বাঁচেই বা কি করে বলুন?”

জ্যোতির বাবা মুখ টানটান করলেন। তেজী গলায় বললেন,

“ সবসময় আমিই দোষী! আমিই দোষী!কি করছিনা আমি তোদের জন্য ? ”

জ্যোতির হাসল। বলতে ইচ্ছে হলো, “ বাবার ভালোবাসা দেননি আব্বা, স্নেহ দেননি, নরম গলায় মেয়ের মতো করে কথা বলেননি কখনো। কখনো মাথায় হাত বুলিয়ে দেননি।অসুস্থ হলে কখনো খোঁজ নেননি। তারপরও বলবেন সব করেছেন?শুধু টাকা দিয়েই কি বাবার দায়িত্ব পালন করা হয়ে যায়? ছোটবেলায় যখন মা ছেড়ে গেল আমাদের তখন তো আমাদের মা নেই ভেবে আমাদের প্রতি আপনার দ্বিগুণ ভালোবাসা দেখানো উচিত ছিল আব্বা। যাতে করে আমরা আপনার থেকে মা বাবা দুইজনের ভালোবাসা পেয়ে মায়ের কথা ভুলে যেতাম। কিন্তু আপনি কি করলেন আব্বা? দিনের পর দিন রাগ দেখিয়েছেন, জেদ দেখিয়েছেন, সেই ছোট্ট নিষ্পাপ বাচ্চা মেয়ে দুটোর গালে রাগের বশে থাপ্পড় দিয়েছেন।তবুও বলব সব করেছেন? ” কিন্তু বলা হলো না। গলায় এসে আটকে গেল যেন। টলমল করল চোখজোড়া। নিস্তেজ গলায় বলল,

“ সবই করেছেন। সব!”
জ্যোতির বাবা আর দাঁড়িয়ে থাকলেন না। মুখেচোখে তেজ নিয়ে দ্রুত ছেড়ে গেলে জায়গাটা। জ্যোতি সেদিক পানে তাকিয়েই বিড়বিড় করে বলল,

“ বাবার মতো কিছু করেননি, কিছুই করেননি আব্বা। ”

বিড়বিড় করে কথাটা বলার মাঝখানেই সেখানে এসে হাজির হলো মিনার। একপলক জ্যোতির দিকে তাকিয়েই নরম স্বরে বলে উঠল,

“ এই? কি বিড়বিড় করছিস জ্যোতি?”

জ্যোতি মুহুর্তেই ফিরে চাইল। মিনারকে দেখে বলে উঠল,

“ কিছু না। ”

মিনার অবাক হলো। সে স্পষ্ট শুনেছে৷ অথচ জ্যোতি বলছে কিছু না?পরমুহুর্তেই দৃষ্টি জ্যোতির মুখে পড়তেই অবাক হলো মিনার।চোখ লাল হয়ে আছে, যেন জল গড়িয়ে পড়বে। অথচ সে জানে এই মেয়েটা এখনই চোখের জল গড়াতে দিবে না।মেয়েটা আড়ালে কাঁদে। হতাশ হলো সে। গলাটা আরো নরম করে বলল,

“ মামা কিছু বলেছেন জ্যোতি? চোখ এত লাল কেন?কষ্ট হচ্ছে?কান্না আসছে তোর?”

জ্যোতি মৃদু হাসল। মিনারের দিকে তাকিয়ে বলল,

“ মিনার ভাই,তুমি অনেক ভালো। এতোটা ভালো কেন তুমি?”

মিনার হাসল। উত্তর দিল,

“ এবার বল, মন খারাপ কেন? ”

“ মন খারাপ না।রান্নার সময় কিজানি চোখে পড়ল তাই। ”

“লুকিয়ে যাচ্ছিস? ”

জ্যোতি নিরবে শ্বাস ফেলল।কথা ঘুরাতে বলে উঠল,

“একদমই না। মিথিকে দেখেছো?দাদী আসলে ওকে না দেখলে আবার বকা দেবে। একটু ডেকে দাও।”

মিনার পুনরায় হতাশ হলে। জ্যোতি যে কথা টাকে ঘুরানোর চেষ্টা করছে তা বুঝে নিয়েই মাথা নাড়াল। পা চালিয়ে মিথিকে খোঁজার উদ্দেশ্যে চলে গেল মুহুর্তেই।

.

রান্না শেষ হতেই গোসল সারল জ্যোতি। তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুল জড়িয়ে উঠোনে আসতেই শোনা গেল দাদীর গলা,

“ মিথি কই?দুপুর হইছে খাইব না ওই?সারাদিন তো ঐ বাড়িতেই পইরা থাকে এহন দেহি। পড়ালেখা তো কিচ্ছু নাই ওর। আজ আইলে কয়ডা কথা শুনাইতই হইব। ”

জ্যোতি তাকাল। মিথিটা বড্ড আদরের তার। তাই তো বকা খাওয়া থেকে বাঁচাতেই বলে উঠল,

“ দুদিন পর তো সবাই চলে যাবেই দাদী। থাক না মজা করছে, করুক। ”

“ বছরের সব কয়ডা দিনই তার লাইগা মজারই। এত বড় মাইয়া হইয়াও খালি ঘুমায় আর টো টো কইরা ঘুরে বেড়ায়।”

“ আমি ডেকে আনছি। বকা দিও না, কষ্ট পাবে ও। ছোট মানুষ, ছেড়ে দাও না। ”

“ তা কি তোর থেইকা পরামর্শ নিমু? ”

জ্যোতির মুখ থমথমে হয়ে এল। সময় দেখে বুঝল দুপুর দেড়টা বেঁজেছে৷ ধীর পায়ে পা এগুলো মেহুদের বাড়ির দিকে। পথেই চোখে পড়ল এদিকে এগিয়ে আসা শুভ্র পাঞ্জাবী পরনে থাকা মেহেরাজকে। বোধহয় মা বাবার কবরেই গিয়েছিল,নয়তো গ্রামের মসজিদে। জ্যোতি সঙ্গে সঙ্গেই নজর সরাল যাতে তার দৃষ্টিটা মেহেরাজের চোখে না পড়ে। বাকিটা পথ অবশ্য সে আর একবারও তাকাল না মেহেরাজের দিকে। কিন্তু তবুও মুক্তি মিলল না। আরো কিছুটা পথ এগিয়ে মেহেরাজকে অতিক্রম করে যেতেই কানে এল গম্ভির রাশভারী গলা,

“ জ্যোতি শোন,”

জ্যোতি মনে মনে তপ্তশ্বাস ফেলল।মেহেরাজের দিকে না তাকিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করল পরবর্তী কথার। কিন্তু ফের কথা আসল না। বরং মানুষটাই সশরীরে এগিয়ে আসল।পরখ করে দেখল সামনের মেয়েটাকে।মাথায় জড়ানো ওড়নাটা ভেজা চুলের কারণেই বোধহয় ভিজে উঠল কিঞ্চিৎ। কৃষ্ণবর্ণীয় মুখটা স্নিগ্ধ দেখাল। বুঝা গেল সদ্য গোসল সেরেই এসেছে।একপলক তাকিয়ে নজর সরিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,

“ কেউ ডাকলে সাড়া দিতে হয়। এটুকু ভদ্রতাও নেই তোর মধ্যে? ”

জ্যোতির মনে পড়ল কিছু সময় আগের বাবার বলা কথাগুলো। বাবাও বলেছে সে অভদ্র, বেয়াদব!মুহুর্তেই মুখ টানটান হলো। স্পষ্ট স্বরে বলল,

“ না নেই,আমি অভদ্র। ”

মেহেরাজ বিরক্তে কপাল কুঁচকে নিল। রাশভারী আওয়াজে বলল,

“ বড়দের মুখে মুখে কথা বলছিস তুই?এতোটা বেয়াদব তুই?”

বাবার থেকে পাওয়া সবগুলো সম্বোধন ফের মেহেরাজে মুখে শুনে মুখের ভাব পাল্টাল জ্যোতির। বলল,

“ হ্যাঁ আমি বেয়াদব, অভদ্র,গায়ে পড়া মেয়ে! আর কিছু বলবেন মেহেরাজ ভাই?”

” বেয়াদবির চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছিস দেখছি।”

জ্যোতি এবারেও তাকাল না মেহেরাজের দিকে। বরং কথাগুলো শুনে মুখ টানটান করে মেহেরাজকে এড়িয়ে চলার জন্য পা বাড়াল। মুহুর্তেই হাতে টান অনুভব হলো। ফিরে চাইতে চোখে পড়ল মেহেরাজ তার হাত চেপে ধরেছে। দাঁতে দাঁত চেপে শীতল গলায় বলে উঠল,

“ এড়িয়ে চলে যাচ্ছিস কোন সাহসে?ডেকেছি না?”

জ্যোতি এবারে তাকাল মেহেরাজের দিকে।নিষ্প্রভ গলায় বলল,

“ তো গায়ে পড়া মেয়েদের মতো গায়ে পড়ে থাকলে খুশি হবেন? ”

মেহেরাজ দাঁতে দাঁত চাপল। শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় শুধাল,

“ বড়দের সাথে এভাবে কথা বলিস তুই?অভদ্রতার চূড়ায় উঠে গেছিস দেখছি।”

জ্যোতি হাতের দিকে তাকিয়েই মৃদু আওয়াজে বলল,

“ হাত ছাড়ুন মেহেরাজ ভাই। এভাবে গায়ে পড়া ছেলেদের মতো হাত ধরেছেন কেন? ”

মেহেরাজ অপমানে মুখ টানটান করল। চোয়াল শক্ত হয়ে এল যেন। সম্মুখের মেয়েটার গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলে নিশ্চয়ই অপরাধ হবে না এখন। তবুও নিজেকে শান্ত রাখল।হাত ছেড়ে দিয়ে শুধাল,

” ও বাড়ি যাচ্ছিস না?”

জ্যোতি উত্তর দিল শক্ত গলায়,

“ হ্যাঁ। ”

মেহেরাজ শ্বাস ফেলল।পকেট থেকে একটা মোবাইল বের করে হাত বাড়িয়ে ধরল জ্যোতির সামনে। বলল,

“ মোবাইলটা সাঈদের। দিয়ে দিস। ও বাড়িতেই আছে। ”

জ্যোতি কথা বাড়াল না। মোবাইলটা হাত বাড়িয়ে নিয়েই বলল,

” আচ্ছা। ”

কথাটা বলেই দ্রুত পা বাড়াল জ্যোতি। মেহুদের বাড়িতে গিয়ে মিথিকে ডেকে নিয়েই খুঁজল সাঈদকে। আশ্চর্যজনকভাবে সাঈদের দেখা মিলল না।অবশেষে মিথিকেই জিজ্ঞেস করল,

“সাঈদ ভাই কোথায়? দেখেছিস?”

মিথি উত্তর দিল,

“ জানি না। কিন্তু তোর কি কাজ ঐ ভেড়ার সাথে?”

“ উনার মোবাইলটা মেহেরাজ ভাইয়ের কাছে ছিল। মেহেরাজ ভাই আসার সময় মোবাইলটা হাতে দিয়ে বললেন সাঈদ ভাইকে দিতে। খুঁজে দেখি উনি নেই। উনাকে খুঁজে মোবাইলটা দিয়ে আসতে পারবি মিথি?”

“ আমি কেন দিব?তুই দিয়ে আয়।”

জ্যোতি নিষ্প্রভ গলায় বলল,

“ দিয়ে এলে কি হবে?আমি তোকে ডাকতে এলাম না এতদূর?”

মিথি মাথা নাড়াল। জ্যোতির মুখচোখ ক্লান্ত, নিষ্প্রভ।গলাটাও মলিন। সে বুঝে এমনটার মানে।তাই কিছু বলতে নিয়েও আর বলল না। হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা নিয়েই দৌড়ে গেল সাঈদকে খুঁজতে। ছাদ, উঠোন সব খুঁজে অবশেষে মেহুর কাছে জানতে পারল মেহেরাজের ঘরে আছে সাঈদ। তাই আর দেরি না করে দ্রুত হুড়মুড়িয়ে ডুকল মেহেরাজের রুমে। মুহুর্তেই চোখে পড়ল সদ্য গোসল করা সাঈদকে।পরনে কেবল একটা সাদা তোয়ালে।ভেজা চুল বেয়ে টপাটপ পানি গড়িয়ে আসছে কপালে। উম্মুক্ত ফর্সা বক্ষে ও ফোঁটা ফোঁটা পানি লেগে আছে। মিথি চোখ খিচে নিল মুহুর্তেই। সেও কি বাদবাকি বেহায়া মেয়েদের মতো এই অভদ্র লোকের রূপ পরখ করছিল? ছিঃ ছিঃ! নিজেকে মনে মনে কয়েকটা বকাঝকা দিয়ে হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা ধরল।বাধ্য মেয়ের মতো বলে উঠল,

“ আপনার মোবাইল। মেহেরাজ ভাই দিতে বলেছেন আপনাকে। ”

সাঈদ এতোটা সময় মিথিকে খেয়াল না করলেও এখন খেয়াল করল। এগিয়ে এসে মোবাইলটা হাতে নিল।ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসেই ভ্রু উঁচিয়ে বলে উঠল,

“ একি মেয়ে! তোমার গলা আজ এত ঠান্ডা?তুমিই তো এটা?”

“ না, আমার ভূত। ”

কথাটা বলতেই সাঈদের ফোন বেঁজে উঠল। মিথি অবশ্য আর দাঁড়াল না। পা বাড়িয়ে রুম ছেড়ে যেতে যেতেই কানে এল সাঈদের কিছু অশ্রবণীয় ভাষা।শুনেই বুঝা গেল প্রচন্ড রাগ, ক্ষোভ নিয়েই কথাগুলো বলে ফেলেছে সে। মিথি সেসব শুনেই কপাল কুঁচকাল। ফের রুমের দরজায় এসে উঁকি দিতেই দেখল সাঈদ কল তুলল। কানের কাছে মোবাইল ধরে দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত কন্ঠে বলল,

“ আপনাকে কতবার বলব আমায় কল দিবেন না। কেন কল দিয়েছেন? কেন?আমি আপনাকে সহ্য করতে পারি না। মেজাজ খারাপ হয়ে যায় আমার। অবশ্য আপনার মতো চরিত্রহীনা মহিলাদের কি করেই বা সহ্য করা যায় বলুন?আমি আপনাকে ঘৃণা করি।শুধু এবং শুধুই ঘৃণা করি। ফের আবার কল দিবেন না।”

মিথি কথাগুলো শুনে শুকনো ঢোক গিলল। সদাসর্বদা হাসিখুশি থাকা ছেলেটাও এভাবে রেগে যেতে পারে কিংবা এভাবে রেগে কথা বলতে পারে তার ধারণাতেই ছিল না। পরমুহুর্তেই আবার মনে পড়ল চরিত্রহীনা শব্দটা। বাবার মুখে শতসহস্রবার মায়ের সম্বন্ধে এই শব্দটা শুনেছে সে। যদিও বা মায়ের মুখ তার মনে নেই,মা কেমন ছিল তা ও সে জানে না। তবুও শব্দটা শুনে সর্বপ্রথম তার মায়ের কথাই মনে পড়ল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাঈদের রাগে টানটান হওয়া মুখের দিকে তাকাতেই ফের কানে আসল,

“ জম্মদিন?জম্মদিন মাই ফুট!আমার কোন জম্মদিন নেই। আর এই বিষাক্ত দিনে আপনি উইশ করে যতোটা না আমার জীবনটা সুন্দর করবেন তার চেয়েও বেশি অসুন্দর, অসহনীয়, বিষাক্ত করে তুলেন। ফের আর কল দিবেন না দয়া করে।আমি আপনার থেকে মুক্তি চাইছি।”

কথাটা বলেই কল কাঁটল সাঈদ।ছুড়ে ফেলে রাখল মোবাইলটা বিছানাতে। চুল গুলো হাত দিয়ে খামচে ধরে বসে পড়ল বিছানাতে। দাঁতে দাঁতে চেপে বিড়বিড় করে বলল আরো কিছু অশ্রবণীয় ভাষা।মিথি অবাক হয়ে চেয়ে থাকল। পাশে থাকা মোবাইলটা আবারও বাঁজল। একবার, দুইবার অনেকবার বাঁজতে লাগল। কিন্তু সাঈদ কল তুলল না। অদ্ভুত ভাবে রাগ নিয়ন্ত্রন করতে না পেরে মোবাইলটা হঠাৎ ই ছুড়ে মারল ফ্লোরে। পরপরই মাথা তুলে তাকাতে চোখে পড়ল দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মিথিকে৷লালাভ রাঙ্গা চোখে তাকিয়েই শক্ত গলায় শুধাল,

“ কি এখানে?”

মিথি কেঁপে উঠল হঠাৎ। ঠোঁটে ঠোঁটে চেপে সরে যাওয়ার আগেই সাঈদ এগিয়ে আসল। মুখের উপর দরজাটা লাগিয়ে দিল আওয়াজ করে। মিথি অবাকের চূড়ায় পৌঁছাল।হঠাৎ এত রেগে গেল কেন সাঈদ ? কেই বা কল করল?

#চলবে….

এক মুঠো প্রণয় ২ পর্ব-০৩

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#সিজন_টু
#পর্ব_০৩
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

“ শুনেছি মেয়ের মা মেয়েদের ছোটবেলাতেই ছেড়ে গিয়ে পরপুরুষের সঙ্গে পালিয়ে গেছেন?কথাটা কি সত্যিই? ”

বাক্যটা পাত্রপক্ষের মধ্যে মধ্যবয়স্কা মহিলাটাই বলে উঠলেন৷ মুখে কেমন একটা হাসি ঝুলিয়ে রেখেছেন। যেন কথাটা বলেই বেশ মজা পেলেন ভদ্রমহিলা। জ্যোতি একপলক তাকাল মহিলাটার দিকে।পাত্রপক্ষের সামনে এই প্রথমই বসেছে সে৷ তাও দাদীর আদেশে৷ কিন্তু এইখানে যে নিজের জীবনের চরম সত্য কথাটারই সম্মুখীন হবে ফের তা যেন মাথাতেই ছিল না। চোখ বুঝে একবার মায়ের প্রতিচ্ছবি মনে করার চেষ্টা করল। উহ! বুকের ভেতর জ্বলন অনুভব হলো। ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলতে নিবে তার আগেই দাদীর ঝংকার তোলা গলায় উত্তর এল,

“ হ, সইত্যই। ক্যান ? ”

মহিলাটা কেমন করে যেন চাইল। সম্ভবত পাত্রের ফুফু বা খালা হবে।জ্যোতির দাদীর দিকে একপলা তাকিয়েই বললেন,

“ খোঁজখবর নিব না খালা ? আমাদের এমন একটা সুপুত্রের বিয়ে কি যেথায় সেথায় দিয়ে দিব নাকি?তাই জিজ্ঞেস করেছি৷ তা শুনলাম মেয়েদের বাবার দ্বিতীয় সংসারেও নাকি মেয়েদের জায়গা হয়নি? ওদের আপনিই বড় করেছেন শুনেছি। তা মেয়ের বাবার সাথে মেয়ের সম্পর্ক নেই ? কোথাও মেয়ের বাবাকে দেখতে পেলাম না তো।”

জ্যোতি আবারো তাকাল মহিলাটার দিকে। কেন জানি না ভদ্রমহিলার বলা কথাগুলো তার ভালো লাগল না৷ এটা সত্য যে জ্যোতির বাবার সাথে খুব একটা ভালো সম্পর্কে নেই তার। বলা চলে বাবার সাথে জ্যোতি মিথি উভয়েরই সম্পর্কটা খুবই জঘন্য। ছোটবেলা থেকেই তাদের বাবা তাদের মায়ের প্রতি সমস্ত ঘৃণাটা উগড়ে দিয়েছেন তাদের উপরই।কোথাও গিয়ে সে ঘৃণাটাই পাহাড়সম হয়ে দূরত্ব বাড়িয়েছে বাবা আর মেয়েদের মধ্যে। সেই দূরত্বটা অবশ্য কোনদিন কমেনি বরং বেড়েছেই।বেড়ে চলেছেই। কিন্তু তাই বলে এভাবে কথা শুনতেও যে ভালো লাগবে তা তো নয়। জ্যোতি নিঃশ্বাস ফেলে একবার দাদীর দিকে চাইল। ততক্ষনে দাদী বলে উঠলেন,

“ হে স্কুলে।এইহানে খুব দরকার নাই বইলাই ছুটি লইয়া বাড়িতে থাকতে কইনাই। ”

“ আসার সময় আপনার ছোট নাতনিকেও দেখলাম উঠোনে। ছোট নাতনির থেকে বড় নাতনির গায়ের রংটা চাপা না? তবে আমাদের ছেলের গায়ের রং কিন্তু অতোটাও চাপা নয় খালা। কি বলেন?”

মিথির গায়ের রং ধবধবে ফর্সা।অপরদিকে জ্যোতির গায়ের রং কৃষ্ণবর্ণের। দুইজনের চেহারার সাথে তাদের দাদীর চেহারার অনেক মিল রয়েছে। চোখজোড়া, ঠোঁট, হাসিসহ অনেকাংশেই সাদৃশ্যতা আছে দুইজনের মধ্যে৷ শুধু বৈসাদৃশ্যটা হলো গায়ের রংটা।জ্যোতি হাঁসফাঁস করল ভদ্রমহিলার কথা শুনে৷ মনে মনে বোধহয় কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো। আর যায় হোক যেখানে যোগ্যতার প্রশ্ন আসে সেখানে উপস্থিত থাকাটা কতোটা উচিত?মস্তিষ্ক মুহুর্তেই বলে উঠল, “ উচিত নয়। একদমই উচিত নয়। ”মস্তিষ্কের পাঠানো উত্তরটা পেয়েও সেই স্থান ত্যাগ করা হয়ে উঠল না জ্যোতির। দাদীর নির্দেশে আরো কিয়ৎক্ষন বসে থাকতে হলো তাকে। অবশেষে যখন মুক্তি মিলল তখনই উপস্থিত হলো মিথি। ড্যাবড্যাব করে কিছুক্ষন চেয়ে থাকল জ্যোতির দিকে। লাল টকটকে শাড়ি, চোখজোড়ায় কালো কাজল আর খুলে রাখা চুল। কি অপূর্ব বোধ হলো নিজের বোনকে।তার বোন তেমন সাজে না। তাই বোনকে আজ এই অল্প সাজে দেখেও বেশ খুশ হলো। বাচ্চাদের মতো বলল,

“জ্যোতি?তোকে কেমন বউ বউ লাগছেরে আজ।কিন্তু তোকে একদমই দেবরবিহীন সংসারে বিয়ে দিব না আমি জ্যোতি। বুঝলি?”

জ্যোতি দ্বিধান্বিত চাহনিতে তাকাল। বলল,

“ বুঝলাম না।”

মিথি বিরক্ত হলে। বলতে লাগল,

“ উহ!আজ যে ছেলেটা এসেছিল, তাকিয়ে দেখেছিস তুই?একদম যেন মায়ের আঁচলে লুকিয়ে থাকা পাঁচ বছরের বাচ্চা।ব্যাক্তিত্ববিহীন! ”

জ্যোতি ভ্রু কুঁচকে তাকাল। এতক্ষন পাত্রপক্ষের সামনে বসে থাকলেও সে কিন্তু একবারও ছেলেটার দিকে চোখ তুলে তাকায়নি। এত সময় পর মিথির কাছে ছেলের বিবরণ শুনে কি বলবে বুঝে উঠল না ঠোক। সে তো তাকায়ইনি ছেলেটার দিকে। মিথি ফের আবারো বলল,

“ সবচেয়ে বড় কথা ছেলের আরো দুটো ভাই আছে। কিন্তু দুইজনই বিবাহিত!শুধু বিবাহিতই নয়, দুই তিনটা বাচ্চাকাচ্চাও আছে। তাহলে কি করে হবে বল? ”

জ্যোতির চোখে দ্বিধা যেন বাড়ল। মিথির দিকে সে দ্বিধা নিয়ে তাকাতেই মিথি দ্বিগুণ বিরক্ত হলো। শুধাল,

“ বুঝিস নি? উহ তোর দেবর থাকলে তাকে নাহয় পটিয়ে বিয়ে করা যেত। তারপর তুই আর আমি একসাথে কোমড়ে আঁচল গুঁজে সংসার করতাম। সুন্দর হতো না? কিন্তু এইক্ষেত্রে তো তোর দেবর নেই।”

জ্যোতি মিনমিনে চোখে তাকাল। মিথির মাথায় আলতো হাতে চাটি মেরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল,

“ একটু বেশিই পেঁকে গিয়েছিস মিথি! ”

মিথি মাথায় হাত দিয়ে দূরে সরে গেল৷ কপাল কুঁচকে উত্তর দিল,

“উহ!মারলি কেন জ্যোতি? তোর কি ছেলেটাকে পছন্দ হয়েছে? ছেলেটার তাকানো ও সুন্দর নেই।আমি খেয়াল করেছি বুঝলি?তোকে এই ছেলের কাছে জীবনেও বিয়ে দেওয়া যাবে না।”

.
আর কিছুটা সময় পরই বোধহয় বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নামবে। জ্যোতির হুট করেই ছোটবেলার কথা মনে পড়ল৷ যখন তার মা ছিল! আর পাঁচটা পরিবারের মতো তাদেরও সুখী পরিবার ছিল। কিন্তু তিক্ত হলেও এটাই সত্যি যে এখন তাদের পরিবার নেই, মা -বাবা থেকেও নেই। এসব ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আনমনে হেঁটে পুকুরপাড়ে গেল। পরনে তখনও লাল টকটকে শাড়িটা। চোখের গাঢ় কালো কাজল ফ্যাকাসে হয়েছে। কৃষ্ণকালো লম্বা চুলগুলো ছড়িয়ে আছে পিঠে। মৃদু বাতাসে অল্প নড়চড় বয়ে গেল চুলগুলোতে। এরমাঝেই কানে এল মেহেরাজের গম্ভীর গলা,

“ চোখে দেখিস না তুই ? নাকি চোখ কপালে তুলে হেঁটে বেড়াস? ”

জ্যোতি অবাক হলো। পেঁছন ঘুরে দ্রুত চাইতেই মেহেরাজ ফের চাপা ধমকে বলল,

“ ফুলগুলো তুই মাড়িয়ে গেলি কেন?

জ্যোতি এবারে ভ্রু কুঁচকাল।পুকুরপাড়ের সাথেই শিউলি ফুল গাছ৷ নিচে পড়ে আছে সে গাছেরই সুগন্ধী ফুলগুলো।সেখান থেকেই বোধহয় কিছু ফুল কুড়িয়ে রেখেছিল মেহেরাজ৷ জ্যোতি নিচে তাকিয়ে বুঝতে পারল তা।কিন্তু আপসোসের বিষয় হচ্ছে ফুলগুলো সে মাড়িয়ে এসেছে। ছোট ছোট চোখ করে তাকাতেই মেহেরাজ ফের বলল,

“ এগুলা শিউলি ফুল,কষ্ট করে কুড়িয়ে নিয়েছি। আর তুই ফুলগুলোাে মাড়িয়ে দিয়ে চলে গিয়ে মহান কাজ করে ফেলেছিস ভাবছিস? ”

জ্যোতি এবারে লম্বা শ্বাস ফেলল।মৃদু গলায় শুধাল,

“ দুঃখিত মেহেরাজ ভাই। খেয়ালে ছিল না। ”

কথাটা বলেই মেহেরাজকে এড়িয়ে চলে যাওয়ার জন্যই পা বাড়াল। মুহুর্তেই আবারো মেহেরাজের গমগমে স্বর কানে আসল,

“ এই তুই তোর এই জঘন্য অপরাধকে এড়িয়ে কোথায় চলে যাচ্ছিস? এক্ষুনি ফুল এনে দিবি। যেভাবেই হোক। ”

জ্যোতি নিস্তেজ চোখে তাকাল। জিজ্ঞেস করল,

“ ফুল দিয়ে কি করবেন আপনি? ”

“ফুলের মালা বানাব। ”

জ্যোতি ভ্রু কুঁচকাল। ফুলের মালা? কি বলে এই লোক! ফের জিজ্ঞেস করে,

“ ফুলের মালা? ”

মেহেরাজ ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠল,

“হ্যাঁ, তো?”

জ্যোতি কিয়ৎক্ষন ভাবল। পরমুহুর্তেই মনে পড়ল সামান্তা সেদিন বলেছিল, মেহেরাজ সামান্তার জন্য ছাদে অপেক্ষা করছে। আবার মেহেরাজের ভাষ্যমতে সামান্তা যে চিঠিটা দিয়েছিল তার মধ্যে প্রেমময়ী কথাবার্তা ছিল। ব্যস! আর ভাবতে হলো না। জ্যোতি বুঝে গেল মেহেরাজ আর সামান্তার মাঝে প্রেম বা ভালোবাসাবাসির কোন বিষয় আছে। আর সে কারণেই বোধহয় নিজের প্রিয়তমার জন্য ফুলের মালা বানাচ্ছেন। আহা! এত ব্যাক্তিত্ববান ছেলেও নিজের প্রিয়তমার ভালোবাসার জন্য কি না কি করতে পারে। জ্যোতি মনে মনে মেহেরাজের আরো এক রূপে মুগ্ধ হলো। সে মুগ্ধতার মাঝেই আবারো মেহেরাজ বলল,

“ এতক্ষনে আমি মালা গেঁথে নিতাম। তোর কারণেই দেরি হলো আমার। এখনই তুইই মালা গেঁথে দিবি৷ এটাই শাস্তি তোর। ”

“শাস্তি? ”

“ ভুল করেছিস। শাস্তি তো পাবিই। ”

জ্যোতি এক পলক তাকিয়ে দেখল। পরপর পা বাড়িয়ে চলে গেল ফুল গাছের নিচে। মেহেরাজ সেদিক পানে তাকিয়ে রইল। কেন জানি না আজ তার দৃষ্টি সরাতে ইচ্ছে হচ্ছে না৷ উহ! কি সাংঘাতিক অনুভুতি হচ্ছে। মনে হলো সে ফেঁসে যাচ্ছে।খুব জঘন্যভাবে ফেঁসে যাচ্ছে। অস্ফুট স্বরে বলল,

“ এই ভুলটা তো সামান্য! কিন্তু যে ভয়াবহ ভুলটা তোর দ্বারা হয়ে যাচ্ছে তার শাস্তি কতোটা ভয়বহ হবে ভাবতেও পারবি না জ্যোতি। ”

কথাটা বলেই বার কয়েক জোরে জোরে শ্বাস ফেলল। ততক্ষনে জ্যোতি ফুল হাতে করে গাছের নিচ থেকে ফের এগিয়ে আসছে। মেহেরাজ ততক্ষনে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে জ্যোতির দিক থেকে। বিড়বিড় করে বলল,

“ চোখের দৃষ্টিতেও এতোটা মায়া থাকে?উহ ফেঁসে যাচ্ছিস মেহেরাজ,তাকালেই ফেঁসে যাচ্ছিস। দৃষ্টিটা সাংঘাতিক!নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে।মায়াটা আরো বেশিই সাংঘাতিক!”

জ্যোতি ততক্ষনে ফুলগুলো এনে সিঁড়ির উপর রাখল। অতোটা সতেজ দেখাচ্ছে না ফুলগুলোকে। কেমন নিস্তেজ বোধ হলো। বোধহয় গাছ থেকে ঝরে গিয়েছে বলেই। হাতে দিয়ে সেই নিস্তেজ ফুলগুলো রাখতে রাখতেই মেহেরাজের বিড়বিড় বলা কথাগুলোতে কেবল মায়া শব্দটাই বোধগম্য হলো। উঠে দাঁড়িয়ে সুঁই সুতোর জন্য বাড়ির দিকে পা বাড়াতে নিয়েই জিজ্ঞেস করল,

“ মায়াটা মানে? কি বিড়বিড় করছিলেন মেহেরাজ ভাই? ”

মেহেরাজ চমকাল অল্প। কিন্তু তা বাইরে প্রকাশ করল না একটুও। বরং বিষয়টাকে দামাচাপা দিতে গম্ভীর স্বরে মুখ টানটান করে বলে উঠল,

“ ফুলগুলো পিষে ফেলতে মায়া হয়নি তোর? ”

জ্যোতি মুখ কালো করল। সে কি ইচ্ছে করেই মাড়িয়েছে ফুলগুলো? একবার তো দুঃখিত বলেছে৷কিন্তু এবারে আর কিছু বলল না। দ্রুত পায়ে বাড়ি গিয়ে সুঁই সুতো আনল। মিনিট কয়েকের মধ্যে মালা গেঁথে মেহেরাজে সামনে ধরে স্পষ্ট স্বরে বলল,

” হয়ে গেল শাস্তি পাওয়া।নিন আপনার ফুলের মালা মেহেরাজ ভাই।”

মেহেরাজ মুখচোখ কুঁচকে তাকাল মালাটার দিকে।তীব্র অসন্তুষ্টি নিয়ে বলে উঠল,

“ মালা ও বানাকে পারিস না?বিচ্ছিরি হয়েছে মালাটা। এই বিচ্ছিরি মালাটা দিয়ে কি করব আমি? ”

“ যাকে দেওয়ার কথা তাকেই দিবেন।বিচ্ছিরি তো খুব একটা লাগছে না। ”

“ এই বিচ্ছিরি মালা দেখলে সে সন্তুষ্ট না হয়ে উল্টে অসন্তুষ্ট হয়ে যাবে।”

কথাটা বলতে বলতেই জ্যোতির হাতটা টেনে নিল মেহেরাজ। চিকন হাতে মালাটা পেঁচিয়ে দিতেই জ্যোতি জিজ্ঞেস করল,

“ মানে?”

মেহেরাজ মুখে তীব্র বিরক্তির রেশ ফুটাল। একপলক তাকিয়ে শান্ত গলায় শুধাল,

“তোর হাতে পরিয়ে ট্রাই করলাম বিচ্ছিরি কিনা। এখন দেখছি সত্যিই বিচ্ছিরি লাগছে।তোর মালা বরং তুইই রাখ।”

.

সবার হাতে তখন ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপ। সন্ধ্যে নেমেছে বেশিক্ষন হলো না।সুবিশাল আকাশে চাঁদ নেই আজ।গুঁটিকয়েক তারারই দেখা মিলল কেবল। সেদিক পানে তাকিয়েই মন খারাপ হলো মেহুর। ছোটবেলায় মা বলতো মানুষরা পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার পর আকাশের তারা হয়ে যায়। আজ বড্ড জানতে ইচ্ছে করছে, তার বাবা-মাও কি আকাশের তারা হয়ে গেছেন? মিটমিটিয়ে উজ্জ্বল তারা হয়ে তাদের দেখছেন? কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই চোখ টলমল করল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কান্না চেপে চুমুক দিল চায়ের কাপে। ঠিক তখনই কানে এল সাঈদের গলা,

“ গ্রামে এসেছি তিনদিন হলো। অথচ আমি এখনও একটা মেয়ে পটাতে পারলাম না। কি ভীষণ ব্যর্থতা আমার!”

মুহুর্তেই হাসির রোল পড়ল। মেহু ফোঁসফাঁস শ্বাস ফেলল।মন খারাপ ভুলে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,

“ এই চরম ব্যর্থতার জন্য তো আপনার এক্ষুনিই গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত সাঈদ ভাইয়া।যাচ্ছেন না কেন?”

সাঈদ ফের ঠোঁট বাঁকিয়ে শুধাল,

“পরে যদি তোমাদের গ্রামের মেয়েরা আমার মতো হীরের টুকরো ছেলে হারানোর জন্য আপসোস করে?আপসোস করতে করতে যদি এ্যাটাক ফ্যাটাক করে মরে যায়? তার দায় কে নেবে শুনি?”

মেহু তীক্ষ্ণ চাহনিতে চাইল।উত্তরে বলল,

“ এই যে এখানে আমি, জ্যোতি, মিথি, নাবিলা, সামান্তা সবাই কিন্তু এইগ্রামেরই মেয়ে। আমরা কেউ আপসোস করছি আপনার জন্য? করছি না। তাই চিন্তা করবেন না সে নিয়ে।”

সাঈদ মুখ ভেঙ্গাল। ব্যাথিত সুরে বলল,

“তোমরা তো আসল রত্ন চেনো না। নয়তো এমন অমূল্য রতন পেয়ে কেউ হাতছাড়া করে? ”

নাবিলা পক্ষ নিল সাঈদের। মিষ্টি হেসে উত্তর দিল,

“ অবশ্যই না। সবাই কি আর সব রত্ন চেনে? আপনি একদম আপসোস করবেন না ভাইয়া।আমি অবশ্যই আপনার সাথে একমত!”

সাঈদ খুশি হলো। উচ্ছাস্বিত স্বরে শুধাল,

“ তুমিই বুঝো আমায় নাবিলা।তুমিই আসল প্রেমিকা আমার।”

“ কিন্তু আপনি তো সবার প্রেমিক হয়েই থেকে গেলেন ভাইয়া।”

“কে বলল? প্রেমিক তো তোমার।এই যে এইক্ষন থেকে আমি কেবল মাত্র তোমারই জান। প্রমিজ!”

সবাই হেসে উঠল তৎক্ষনাৎ। কেবল মেহুই হাসল। গম্ভীর চাহনিতে তাকিয়ে একবার দেখল সাঈদকে।ঠিক তখনই মোবাইলের ম্যাসেজ টোন বাঁজল। হাত টেনে স্ক্রিনে তাকাতেই চোখে ভেসে উঠল,

“ অপেক্ষার স্থায়িত্বটা ক্রমশ দীর্ঘ করছো তুমি মেহু।এদিকে যে একটা যুবক সে অপেক্ষা সইতে না পেরে মৃতযন্ত্রনাসম যন্ত্রনা অনুভব করছে সে খেয়াল রেখেছেন মিস? দ্রুত অপেক্ষার অবসান ঘটান।”

মেহু অবাক হলো। নাম্বারটা সেদিনকার সে নাম্বারটাই। কে এই লোক? কেনই বা এভাবে পরিচয় গোপণ রাখছে?

#চলবে…

এক মুঠো প্রণয় ২ পর্ব-০২

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
#সিজন_টু
#পর্ব_০২
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

বিকাল পেরিয়ে সন্ধ্যে হলো।জ্যোতি তখনও মেহুদের বাড়িতেই। অবশেষে আরো কিয়ৎক্ষন সময় মেহুর সাথে কাঁটিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়াল। বাইরে অন্ধকারের রেশ। কিছুটা দূর যেতেই হঠাৎ মনে হলো তার পেছনে কেউ আসছে। জ্যোতি মুহুর্তেই পিঁছু ঘুরল। অদ্ভুতভাবে কারোরই দেখা মিলল না৷ হতাশ হয়ে পুণরায় পথ চলায় মনোযোগী হতেই আবারও মনে হলো পেছনে কেউ আছে।কেউ অনুসরন করছে তাকে। এবার একদম সময় না নিয়েই পেছন ঘুরল। মুহুর্তেই এক পুরুষালি ছায়া চোখে পড়ল। এদিকেই এগিয়ে আসছে। জ্যোতি ক্ষীণ চোখে চাইল এবারে। মৃদুস্বরে বলে উঠল,

“ কে? ”

পুরুষালি অবয়বটা উত্তর না দিয়েই আরো কয়েক কদম এগিয়ে আসল। জ্যোতি মোবাইলের আলোটা ফেলে ভালোভাবে খেয়াল করল। মুহুর্তেই বলে ফেলল,

“ মেহেরাজ ভাই আপনি?

মেহেরাজ এতক্ষনে তাকাল জ্যোতির দিকে।ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে ডান ভ্রুটা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“হ্যাঁ, আমি। তো?

জ্যোতি সরাসরিই প্রশ্ন করল,

“আমার পিছু পিছু আসছেন যে? ”

মেহেরাজের কপালে ভাজ পড়ল। চরম বিরক্তি নিয়ে উত্তর দিল,

“তুই কি আমার প্রেমিকা যে তোর পিছুপিছু যাবো চোরের মতো?”

“এদিকে তো আপনার এখন কোন কাজ থাকার কথা নয় মেহেরাজ ভাই৷ তাই জিজ্ঞেস করেছি, দুঃখিত।”

ফের ত্যাড়া স্বরে উত্তর দিল মেহেরাজ,

“কাজ না থাকলে রাস্তা দিয়ে চলা যায় না? নাকি রাস্তাটা তোর কেনা?আশ্চর্য!”

জ্যোতি থমথমে স্বরে বলে উঠল,

“ তা কখন বললাম? ”

মেহেরাজ ব্যাপক বিরক্ত এমন একটা ভান ধরেই ঠান্ডা গলায় উত্তর দিল,

“ তা না বললে তোর পিছু পিছু আসছি কিনা জিজ্ঞেস করলি কেন?আমি কি তোর মতো?নাকি তুই ইচ্ছে করেই আমার সাথে কথা বলার জন্য অযুহাত খুঁজছিলি? ”

“ মানে? ”

এবারের উত্তরটা ব্যাপক অপমানজনক হয়েই আসল। শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় শীতল ক্রোধ নিয়ে বলে উঠল মেহেরাজ,

“ মানে এই যে গায়ে পড়া মেয়েদের মতো একটা ছেলের সাথে যেচে নিজ থেকে কথা বলাটা, মিথ্যে দোষারোপ করে প্রশ্ন করাটা? এগুলা কোন ধরণের মেয়েরা করে?”

মুহুর্তেই অপমানে থমথমে হয়ে গেল জ্যোতির মুখ।“আমি কি তোর মতো?” বাক্যটা দ্বারা যে তাকে এক আত্মসম্মানহীন, ছ্যাঁচড়া মেয়ের সাথে তুলনা করে ফেলেছে মেহেরাজ তা বুঝতে পেরেই রাগে জেদে মুখ টানটান হলো। স্পষ্টস্বরে কিছু কথা বলতে মন চাইলেও পরমুহুর্তে চুপ থাকার সিদ্ধান্ত নিল।এভাবে গ্রামের রাস্তায় একটা মেয়ের একটা ছেলের সাথে তর্কে জড়ানোটা শোভনীয় নয় বলেই সেখানে আর না দাঁড়িয়ে পেছন ঘুরে সোজা হাঁটা ধরল৷পেছন পেছন টের পেল মেহেরাজের উপস্থিতি ও।তবে বেশিক্ষন নয়। বাড়ির ভেতর ডুকতেই মিলিয়ে গেল যেন সেই উপস্থিতি।

.

আরও একটা ভোর। মেহু তখনও ঘুমে মগ্ন। ঠিক তখনই তার মোবাইলটা বেজে উঠল তুমুল আওয়াজ তুলে। মেহু কপাল কুঁচকাল। না চাওয়া সত্ত্বেও চোখজোড়া কিঞ্চিৎ মেলে মোবাইলের স্ক্রিনে তাকাল। নাম্বারটা সে চেনে না। আননোন নম্বর।কিন্তু একবার কল করেই ক্ষান্ত হলো না আননোন নাম্বারের মালিকটি। পরপর আরো দুইবার কল আসাতেই মেহু কল তুলল।মোবাইলটা কানে নিয়েই বলে উঠল,

“ সকাল সকাল কল দিয়ে মানুষের ঘুম নষ্ট করছেন কেন ভাই?কে আপনি?”

ওপাশের মানুষটা বোধহয় কিঞ্চিৎ হাসল কথাটা শুনে। কেমন একটা হিশহিশ আওয়াজ হলো হাসার। মেহু বিরক্ত হলো। চোখমুখ কুঁচকে বিরক্তির স্বরে বলে উঠল,

“ কি আশ্চর্য! হাসছেন? হাসছেন কোন আক্কেলে আপনি?”

লোকটা হাসি থামাল এবারে। কিয়ৎক্ষন পরই চমৎকার কন্ঠে বলে উঠল,

“ হাসতে আক্কেল লাগে নাকি? ”

মেহুর মনে হলো কন্ঠটা সত্যিই চমৎকার। সুন্দর!তবুও প্রশ্নের যথাযথ উত্তর না দিয়েই পুণরায় একই প্রশ্ন ছুড়ল,

“ আপনি কে? ”

“ জানাটা তো বাধ্যতামূলক নয় মিস মেহু।”

মেহু শক্ত কন্ঠে বলল,

“ অবশ্যই বাধ্যতামূলক! আমি অপরিচিত মানুষদের সাথে কথা বলি না। ”

লোকটা অমায়িক স্বরে শুধাল,

“চিন্তা নেই, আমি আপনার পরিচিতই! নির্দ্বিধায় কথা বলতে পারেন।”

মেহু এবারে খুব বেশিই বিরক্ত হলে। একে তো সকাল সকাল কল দিয়ে ঘুম ভাঙ্গাল, বিরক্ত করল তার উপর পরিচয় দিচ্ছে না। এমন লোকের সাথে এই সাতসকালে মিঠে আলাপ জমানোর কোন মানেই হয় না। তাই তো মুহুর্তেই কল রেখে দিয়ে চোখ বুঝে নিল। ওপাশ থেকে ফিরতি কল এল। একবার, দুইবার,তিনবার!ঠিক তিনবারের সময়ই ফের কল তুলল মেহু। তপ্তশ্বাস ফেলে শুধাল,

“ কে আপনি ভাই? এভাবে বিরক্ত করার মানেই বা কি?”

ওপাশ থেকে ফের হাসার শব্দ শোনা গেল। বলল,

“ আমার ভাগ্যটা খারাপ মেহু। এতকাল যার থেকে দূরত্ব রেখে ছটফট করলাম, প্রেমযন্ত্রনায় ক্ষনে ক্ষনে দগ্ধ হলাম। আজ এতকাল পর তার জন্যই এতদূর ছুটে এসেও তার দেখা পেলাম না। কি ভীষণ যন্ত্রনা!অপেক্ষা নামক শব্দটাই যন্ত্রনার! ”

মেহু বোকা বনে গেল। লোকটার কথার শুরু থেকে শেষ কিছুই যেন বোধগম্য হলো না। বোকার মতো বলেই ফেলল তাই,

“ কিছুই বুঝলাম না। কিসব বলছেন? আমার নামও তো জানেন দেখছি আপনি।কিভাবে জানেন?আমায় চেনেন আপনি?আমার কন্ট্যাক্ট নম্বরই বা কোথায় থেকে পেয়েছেন? ”

একদম শীতল গলায় এবারে ওপাশ থেকে উত্তর আসল,

“ সেসব গুরুত্বপূর্ণ নয়।যার জন্য এতকাল যন্ত্রনায় ছটফট করে মরলাম তাকেই যন্ত্রনায় আবদ্ধ করতে ছুটে এলাম এতদূর।তার কাছে তো যেভাবেই হোক পৌঁছাতে হতোই আমায়,যেভাবেই হোক যোগাযোগ করতে হতো।তাই না?”

মেহু এবারেও বুঝল না কিছু। বিরক্তি নিয়ে বলল,

“আপনার এসব উদ্ভট কথাবার্তা শোনার জন্য সকালের ঘুম মিস দেওয়ার কোন মানেই হয় না।কিন্তু আসলেই কে আপনি ? চিনতে পারিনি।”

ওপাশের লোকটা আবারো হাসল। বলল,

“ আমি কে জানার জন্য একটু বেশিই আগ্রহী দেখছি আপনি মিস!শোনো মেয়ে,সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনায় প্রতিমুহুর্তেই তোমাকে চাওয়া এক অভাগা প্রেমিক আমি। অপেক্ষায় থাকলাম এই অভাগার জীবনে তোমার আগমণের, তোমার-আমার ফের সাক্ষাৎয়ের। ”

কথাগুলো বলেই কল রাখল লোকটা। মেহু অবাক হলো। কে হতে পারে লোকটা? তার পরিচিত কেউ? নাকি সাঈদ?

.

সন্ধ্যায় মেহেরাজদের ছাদে আড্ডা জমল। জ্যোতি, মিথি,মেহু, সামান্তা,নাবিলা, নুসাইবা, সাঈদ, মেহেরাজ সবাই ছাদে উপস্থিত। মেহেরাজ অবশ্য কিছুটা সময় আগেই এল ছাদে। বাদবাকি সবাই আড্ডায় মশগুল। তবে সামান্তা ব্যস্ত আপন মনে মেহেরাজকে দেখতেই।মনে মনে কয়েকবার ভাবল ও, “একটা পুরুষ এতোটা সুন্দর কি করে হয়?কেন এতটা সুন্দর?”তার সে ভাবনার মাঝেই মেহু,নাবিলা, জ্যোতি তাকে ন্ নিয়েই নিচে গিয়ে কাজে লেগে গেল। কড়াইয়ে মেহেরাজের রান্না করে রাখা নুডুলসগুলো প্লেটে পরিবেশন করে একে একে সব প্লেট নিয়ে হাজির হলো ছাদে। সবাইকে দেওয়া শেষেই আবারো বসে পড়ল তিনজনে। মিথি চামচ দিয়ে মুখে খাবার তুলেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বলে উঠল সঙ্গে সঙ্গে,

“ মেহু আপু?সবাইতো ছাদেই ছিলাম আমরা। তোমরা এই কমসময়ে গিয়ে কি করে রান্না করলে? ”

জ্যোতিও তাকাল। সত্যিই তো। রান্নাটা করল কে? মেহু উত্তরে হেসে বলল,

“আমরা রান্না করিনি তো এখন গিয়ে। শুধু প্লেটে করে নিয়ে এসেছি।”

মিথি বোকাবোকা চোখে তাকাল। বলল,

“ গরমই আছে এখনো, তার মানে রান্নাটা কিছুটা সময় আগেই হয়েছিল। তাই না? ”

” ভাইয়া করেছে রান্নাটা। এতক্ষন তো ভাইয়া ছাদে ছিল না, তখনই রান্না করেছে।”

মিথি তাকাল মেহেরাজের দিকে। মোবাইলের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে।বাহবা দিয়ে বলে উঠল মিথি,

“বাহ!বাহ!মেহেরাজ ভাই তো খুব ভালোই রান্না করে।বিয়ে করলে মেহেরাজ ভাইয়ের মতোই একটা জামাইকেই বিয়ে করব। রান্নাও করবে, কাজও করবে, ভালোও বাসবে। আহা!সুখ আর সুখ!”

মিথির কথাতে সবাইই হুহা করে হেসে উঠল তৎক্ষনাৎ। কেবল জ্যোতিই হাসল না।মাত্রই খাবারের প্লেট হাতে নিয়েছিল। মেহেরাজ রান্না করেছে শুনে ফের আবারো রেখে দিল প্লেটটা। আবার যদি মেহেরাজ বলে,“ গায়ে পড়া মেয়েদের মতো যেচে আমার রান্না করা খাবার খেতে এসেছিস কেন?”জ্যোতি উঠে দাঁড়াল৷ ঠিক তখনই ফোন বাঁজল ওর। স্ক্রিনের উপরই “ মিনার ভাই ” নামটা দেখেই মনে প্রশান্তি জাগল। ছোটবেলা থেকেই এই মানুষটা তার বড্ড আপন।বাড়ি এসে সে আপন মানুষটার দেখা মেলেনি অবশ্য। দাদীর কাছে শুনেছিল কোথাও একটা গিয়েছে মিনার৷ তবে এই যে মাত্র কল এল? এর বার্তা হলো মিনার বাড়ি ফিরেছে। নিশ্চয় জ্যোতির আসার খবর পেয়েই কল দিয়েছে।জ্যোতি প্রথমবারে কল না তুলল না। মেহুকে উদ্দেশ্য করে বলল,

” আপু?বাড়ি যাব একটু এখনই। তাছাড়া দাদীও তাড়াতাড়িই ফিরতে বলেছিল আমায়৷ যাই এখন? ”

মেহু মুখ কালো করল।নিরস গলায় বলল,

“এখনই যেতে হবে?খেয়ে তারপর যা।”

বিনিময়ে জ্যোতি কিছু বলার আগেই পুণরায় ফোন বেঁজে উঠল। জ্যোতি কল তুলল। মোবাইলটা কানে নিয়েই সালাম দিয়ে বলে উঠল,

“কেমন আছো মিনার ভাই? ”

মেহেরাজের দৃষ্টি ফোনে হলেও জ্যোতির এতক্ষনকার সব কথায় মনোযোগ দিয়ে শুনল সে।তবে এবারের কথাটা শুনেই কেন জানি মুখভঙ্গি পাল্টে এল তার। স্থির চাহনিতেও যেন নিরব, অদৃশ্য এবং সূক্ষ রাগ এসে ভীড় করল। মনের ভেতরে কোথাও জানান হলো এই যে এতক্ষন এত আড্ডা, এত কথোপকোতন! এতোটা সময়ে জ্যোতি তার দিকে চোখ তুলেও তাকায়ওনি। এমন কি তার রান্না করা বলে না খেয়েই রেখে দিল। এতোটা জেদ? অপমানটা কি বেশি হয়ে গিয়েছে? আনমনে প্রশ্নটা করেই অবাক হলো মেহেরাজ। গা ছাড়া ভাব নিয়ে উঠে দাঁড়ায় সঙ্গে সঙ্গেই। মুহুর্তেই জ্যোতি ফোনের ওপাশের ব্যাক্তিতে উদ্দেশ্য করে বলল,

“ তুমি বাড়ি এসেছো মিনার ভাই?”

ফের কিয়ৎক্ষন পর আবারো জ্যোতি বলল,

“ ফিরছি।বাড়ি এসেছো শুনে খুশি হলাম।”

মেহেরাজ নীরবে সবটাই শুনল। কেন জানি না সে আর দাঁড়িয়ে থাকল না সেখানে। খুব দ্রুতই পা এগিয়ে নিচে নামল।

.

সাঈদ নাবিলাদের কাছ থেকেই জেনে নিল মিথির সম্পর্কে সবটা। মাত্র ষোলো বছর বয়স মেয়েটার। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে সবে কলেজে পা রেখেছে।নিঃসন্দেহে বয়সে তার চেয়ে অনেক ছোট।অথচ এই ছোট মেয়েটার কথাই কি সাংঘাতিক!এই যে এতক্ষনের আড্ডায় কিন্তু মেয়েটা অনেক কথাতেই তাকে জব্দ করেছে।বলা যায় অপমান করেছে! সাঈদ সে অপমানে নিরস হলো। মনে মনে এই মেয়েটাকে জব্দ করার বুদ্ধি নিয়েই কিছুটা দূরে একা দাঁড়িয়ে থাকা মিথির দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,

“ এইযে অন্ধ মেয়ে,শুনছো?”

মিথি একবার তাকাল। জিজ্ঞেস করল,

”কে অন্ধ মেয়ে? কাকে বলছেন? ”

“ কেন? তোমায়। অন্ধ নাহলে কেউ এত সুন্দর একটা ছেলেকে ভেড়া বলতে পারে? অবশ্যই তুমি অন্ধ!”

মিথি ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল। বলল,

“ উহ! এখনো পুরো দুনিয়া দেখা বাকি। এখনই অন্ধ হতে যাবো কেন? আপনার ব্যাখ্যা ভুল।”

সাঈদ ছাদের রেলিং ঘেষে দাঁড়াল। মিথির কথাটার বিনিময়ে ফের কোন যুক্তি না দেখিয়ে বলে উঠল,

“ সবাই ছাদের আরেক কোণে। ধরো এই সুযোগে তোমাকে তুলে নিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দিলে কেমন হবে?ফেলে দেই এক্ষুনি? ”

সাঈদ ভেবেছিল মেয়েটা ভয় পাবে কথাটা শুনে। এইটুকু মেয়ে!ভয় পাওয়া তো স্বাভাবিক।কিন্তু তাকে হতাশ করে দিয়ে মিথি হু হা করে হেসে উঠল। মেয়েটার হাসি সত্যিই সুন্দর। ফর্সা ধবধবে গালে বিমুগ্ধকর টোল! সাঈদ একপলক তাকিয়েই নিজের ফ্লার্ট করার দক্ষতা প্রকাশ করে বুকে হাত রাখল। ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল,

“ ওভাবে হাসলে তো পাগল হয়ে যাব। এভাবে হাসে না যে!বুকে ব্যাথা ধরে। ”

মিথি ফের হেসে বলে উঠল,

“ আপনি এমনিতেও বদ্ধ পাগল ভেড়াসাহেব। স্যরি স্যরি ভেড়াসাহেব বলতে চাইনি। কি যেন নাম আপনার? ”

সাঈদ মুখ কালো করল।উত্তরে বলল,

“ সাঈদ। ভেড়াসাহেব ডাকবে না বলে দিলাম৷ ”

মিথি উপরনিচ মাথা দুলিয়ে বলল,

“ সাঈদ? সুন্দর নাম তো। ভেড়ার মতো দেখতে একটা মানুষের এতো সুন্দর নাম রেখে কে উদ্ধার করল আপনাকে? নিশ্চয় সে মানুষটা অতি সুন্দর মনের বলুন?”

সাঈদ ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলতে নিল যেন। পরমুহুর্তেই আবার কি বুঝে চুপ হয়ে গেল। চোয়াল শক্ত করে চোখ বুঝে নিল মুহুর্তেই।মুখ যেন কেমন টানটান হলো।চোয়াল শক্ত হলো। দৃশ্যমান হলো কপালে ফুলে উঠা রগটাও। মিথি অবাক হলো। ছোটবেলা থেকে তার আব্বাকে অসংখ্যবার রেগে যেতে দেখেছে সে। কোথাও যেন আব্বার সে রাগী মুখটার সাথে সাঈদের এই মুখটার মিল পেল। অবাক হয়ে বলল,

“ একি!আপনি রেগে গেলেন নাকি? ”

সাঈদ বারকয়েক শ্বাস টানল। নিজেকে স্বাভাবিক করেই ঠোঁট বাকিয়ে চমৎকার করে হাসল। ফিচেল স্বরে বলল,

“ উহ!সাঈদ সুন্দরী মেয়েদের উপর রেগে থাকতে পারে না।”

মিথি সন্দেহি চোখে তাকাল। জিজ্ঞেস করল,

” তো হঠাৎ এমন মুখচোখ শক্ত করে ফেললেন যে সাঈদ ভাই?”

সাঈদ হতাশ হয়ে চাইল। সেই হতাশ দৃষ্টি খেয়াল করেই মিথি জিজ্ঞেস করল,

“ কি হলো? সুন্দর নামেই ডেকেছি এবারে আপনাকে।খুশি হননি?”

সাঈদ মুখ ফুলাল।হতাশ গলায় শুধাল,

“ না হই নি।ভাই কেন ডাকবে? এমন সুন্দরী মেয়ের মুখে ভাই ডাক শুনলে বুক ব্যাথা করে আমার। ”

মিথি এবারে ঠোঁট চওড়া করে হাসল। অবস্থানরত স্থানটা ছেড়ে চলে যেতে যেতে বলল,

“ আপনার ফ্লার্ট আমার উপর ফলবে না সাঈদ ভাই।তবে উপভোগ করেছি আপনার ফ্লার্টিংস্কিলটা।দারুণ!”

.

আড্ডায়, আনন্দে কেটে গেল তিন তিনটে দিন। মেহেরাজ সোফায় গা এলিয়ে চোখ বুঝে আছে।পাশেই সাঈদ আবোল তাবোল বকবক করে যাচ্ছে গ্রামের মেয়েদের সম্বন্ধে। প্রথমে কিছুটা বিরক্ত হলেও এখন নিশ্চুপে সেসব শুনে যাচ্ছে মেহেরাজ। তার মধ্যেই হঠাৎ কানে এল মিথির চঞ্চল গলা,

“ একি! মেহেরাজ ভাই কি সোফায় বসে বসেই এভাবে ঘুমিয়ে যান?”

কথাটা বলেই হেসে উঠল মিথি। মেহেরাজ তৎক্ষনাৎই চোখ মেলে চাইল৷ চোখে পড়ল মিথির পাশে দাড়িয়ে থাকা জ্যোতি,নাবিলা আর মেহুকেও। একপলক চেয়েই নজর সরাল তৎক্ষনাৎ।মিথি আর নাবিলা দাঁড়ালেও জ্যোতি আর মেহু অবশ্য দাঁড়িয়ে থাকল না সেথায়। দ্রুত পা চালিয়ে চলে গেল। মেহেরাজ এই তিনদিনে এইটুকু খেয়াল করেছে যে জ্যোতি তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে পুরোপুরি ভাবে।এই তিনদিনে যতবারই এ বাড়ি এসেছে, বা সম্মুখীন হয়েছে মেয়েটা যেচে কথা বলা তো দূর, তার দিকে চোখ তুলেও তাকায়নি ৷ মেহেরাজের দাম্ভিক মনে কোথাও না কোথাও এই এড়িয়ে চলাটাই সহ্য হলো না যেন। সে সহ্য না হওয়ার নীরব যন্ত্রনায় আরো খানিকটা যন্ত্রনা বাড়াতেই বেধহয় নাবিলার উচ্ছাসিত কন্ঠে শোনা গেল,

“ ভাইয়া জানো? আজ বিকালে জ্যোতিকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে।সব ঠিক হলে আজই বিয়ে পড়িয়ে দিবে।আমার তো ব্যাপক হাসি পাচ্ছে। এই বয়সেই ওর বিয়ে হয়ে যাবে ব্যাপারটা হাস্যকর না?

নাবিলার সে কথাটার ঘোর বিরুদ্ধে গিয়ে মিথি বলে উঠল,

“ এ্যাঁ হাস্যকর! আমার অনেক বান্ধবীরই মাধ্যমিক পাশ করেই বিয়ে হয়ে গিয়েছে। আপসোস! আমার বিয়েটাই দিল না এখনো দাদী। ”

মেহেরাজ অবশ্য শুনল না মিথির বলা কথাটা। কেবল নাবিলার বলা কথাটাই ভাবল কিয়ৎক্ষন।পরপরই গা ছাড়া ভাব নিয়ে উঠে চলে গেল নিজের ঘরে। মনে মনে বলল,“ কি আশ্চর্য! জ্যোতির বিয়ে হলে হবে। আমার কি? আমি কেন ভাবছি এত? ”

#চলবে…

এক মুঠো প্রণয় ২ পর্ব-০১

0

#এক_মুঠো_প্রণয়
লেখনীতেঃএকান্তিকা নাথ
#সিজন_টু
#সূচনা_পর্ব

গ্রামের সবার কাছে সুশিক্ষিত,সভ্য,সুদর্শন, অতিভদ্র খ্যাত মেহেরাজ নামের ছেলেটাই যে চরম অভদ্রের মতো এই কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে পেঁছন থেকে জ্যোতির ওড়না টেনে ধরবে তা যেন জ্যোতির ভাবনার বাইরেই ছিল।মুহুর্তেই রাগে শরীর ঘিনঘিন করে উঠল তার।দাঁতে দাঁত পিষে সঙ্গে সঙ্গেই পেঁছন ফিরে শুধাল,

“ পেছন থেকে মেয়েদের ওড়না টেনে ধরাটা কি অসভ্যতার পরিচয় নয় মেহেরাজ ভাই? ”

মেহেরাজ ভ্রু জোড়া কুঁচকাল মুহুর্তেই।শীতকালীন অবসরে গ্রামে ঘুরতে এসে এত বড় একটা অপবাদ পাওয়া হবে তা যেন মস্তিষ্ক মেনে নিতে পারল না।রাগে, জেদে, বিস্ময়ে ঠোঁটজোড়া কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে শুধু একটা শব্দই বের হয়ে আসল,

“হোয়াট!”

শব্দটা বলে পরপরই জ্যোতির বলে ফেলা বাক্যটা বার কয়েক মাথায় ঘুরপাক খেয়ে আসতেই বোধ হলো জ্যোতির ওড়নাটা তার পাশেই ঝোপের সাথে আটকে আছে।অবশ্য ততক্ষনে জ্যোতির চোখেও তা দৃশ্যমান হলো। ব্যস্তহাতে ঝোপ থেকে নিজের ওড়নাটা ছাড়ানোর চেষ্টা চালাল সে। মেহেরাজ খেয়াল করল সমস্তটাই।চোয়াল শক্ত করে মিনমিনে চোখে তাকাল জ্যোতির দিকে।ভেতরে ভেতরে তীব্র ইচ্ছে হলো মেয়েটার গালে ঠাটিয়ে কয়েকটা চড় বসাতে।কিন্তু এই মুহুর্তে সম্ভব হলো না তা৷ হাত মুঠো করে রাগ দমানোর চেষ্টা চালিয়েই গম্ভীর অথচ শান্ত কন্ঠে শুধাল শুধু,

“ না জেনেশুনে অন্যের উপর দোষ চাপানোটা বুঝি খুব একটা সভ্যতার পরিচয়?”

কথাটা বলেই জ্যোতিকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল মেহেরাজ৷ কন্ঠটা এতবেশি শীতল শোনাল যেন শরীরের লোমকূপ পর্যন্ত টের পেল মেহেরাজের ভেতরকার রাগের আভাস। জ্যোতি হতবিহ্বল চোখে চেয়ে রইল কেবল। সত্যিই না জেনে শুনে এভাবে বলে ফেলাটা উচিত হয়নি। আর যায় হোক যে মানুষটাকে সে সম্মান করে, শ্রদ্ধা করে তাকে এভাবে হুট করেই না বুঝে অপমান করে ফেলাটা অনুচিত। আর এই অনুচিত কাজটা করার জন্যই অস্বস্তিতে এই তীব্র শীতেও তার হাত ঘেমে উঠল। মনে মনে নিজেকেই কিয়ৎক্ষন দোষারোপ করল যাচ্ছেতাই ভাবে। তবুও অবশ্য মন থেকে অস্বস্তির প্রভাবটা মিলিয়ে গেল না।অবশেষে অনেকক্ষন পর নিজের অস্বস্তিভাব আর অনুশোচনাগুলো নির্লিপ্ত করে নিজেকে স্থির করল। ওড়নাটা ভালো করে টেনে শরীরে জড়িয়ে নিয়ে মাথায় ঘোমটা টানল৷ তারপরই গ্রামের সরু মাটির রাস্তাটা ধরে হাঁটা ধরল বাড়ির দিকে।

.

শীতকালিন অবসরে বাড়িতে ঘুরতে আসার প্রথম আবদারটা মেহুরই ছিল। কারণটা অবশ্য জ্যোতি। মেহু আর জ্যোতি একই ভার্সিটিতেই পড়ে। মেহু স্নাতক চতুর্থ বর্ষে, আর জ্যোতি স্নাতক প্রথম বর্ষে। এতবড় শহরে জ্যোতিকে একা ছাড়তে প্রথমে রাজি ছিলেন না জ্যোতির দাদী। পরে যখন মেহুর কথা শুনল তখনই রাজি হলেন। তাই মেহুর উপর ভরসা করেই জ্যোতিকে পড়তে পাঠালেন গ্রাম ছেড়ে শহরে৷ ভার্সিটির হলে সিট পাবে না জেনেই মেহু যে গার্ল হোস্টেলে থাকে সেখানেই উঠল জ্যোতি। দুইজন এক রুমে এতগুলো মাস একসাথে থাকাতে দুইজনের মেলামেশা, বোঝাপড়া এই কয়েকমাসেই খুব গভীর হয়েছে।যেন দুইবোন! তাই তো ছুটিতে জ্যোতি গ্রামে চলে আসাতে ব্যাপক মন খারাপ হলো মেহুর। পরমুহুর্তেই মেহেরাজকে রাজি করিয়ে মেহেরাজসহ পাড়ি দিল গ্রামের দিকে। সঙ্গে অবশ্য মেহেরাজের ঐ মেয়েপাগল বন্ধু সাঈদও আসল।এসেই তার কার্য উদ্ধারে দায়িত্ববান ছেলের মতোই লেগে পড়েছে। নাবিলা, নুসাইবা, সামান্তার সাথে মিথ্যে প্রেমালাপের অভিনয়।আর ওরাও কিছুক্ষন পরপর সেই প্রেমালাপ শুনে হেসে উঠছে খিলখিলিয়ে।মেহু বিরক্ত হলো।ওরাও যে বাড়ি এসেছে দুদিন আগেই তা জানলে অবশ্য কখনোই বাড়ি আসার নাম করত না মেহু। কে জানত এসে থেকেই এদের সাথে সাঈদের এই মাখোমাখো প্রেমের বাণী শুনতে হবে? উহ যন্ত্রনা!মেহু উঠে গেল। জ্যোতির দাদী সকাল সকালই পিঠা খাওয়ার জন্য বলে গিয়েছিলেন সবাইকে। সেই বিষয়টা মাথায় নিয়েই সবাইকে তাড়া দিল জ্যোতিদের বাড়িতে যেতে৷ মুহুর্তেই সবাই হুড়মুড়িয়ে উঠল। কিয়ৎক্ষনের মধ্যে পৌঁছেও গেল জ্যোতিদের বাড়িতে।টিনের ঘরের সামনেই ছোট চালার নিচে মাটির উনুনে পিঠা বানাচ্ছেন জ্যোতির দাদী। বয়স হয়েছে ভদ্রমহিলার, তবুও মুখে চোখে আলাদা তেজ আছে। তাইতো এখনো তার নাতনিরা তাকে যমের মতোই ভয় পায়। তার এক চোখ রাঙ্গানিতেই জ্যোতি, মিথি সব আদেশ মানতে এক পায়ে রাজি। মেহু মনে মনে হাসল বিষয়টা ভেবে।একপলক তাকাল জ্যোতির দিকে। উনুনের ধারে বসে দাদীকে সাহায্য করতে ব্যস্ত।পরনে কোন শাল বা শীতের পোশাক নেই।দৃষ্টি পড়ল অযত্নে পাশে রেখে দেওয়া শালটার দিকে। মেহু অবাক হলো। ঠান্ডায় তার হাত-পা শীতল হয়ে আছে এখনো। অথচ জ্যোতির শীত করছে না?প্রশ্নটা মন থেকে মুখে এনে বলেই ফেলল,

“ তুই শীতের পোশাক পরিস নি কেন?”

জ্যোতি পেঁছন ঘুরে তাকাল সঙ্গে সঙ্গে। মুহুর্তেই ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে আসল। বেতের মোড়া এগিয়ে দিয়ে সবাইকে বসতে বলল। পেছন থেকে জ্যোতির দাদী ততক্ষনে বলে উঠলেন,

“ একি!রাজ আহে নাই? আইব না ওই?”

সাঈদ হাসল। দু পা বাড়িয়ে উনুনের ধারে একদম দাদীর পাশে গিয়ে বেতের মোড়ায় বসল। অনুমতিবিহীন এক হাতে মুহুর্তেই একটা ভাপা পিঠা এগিয়ে নিয়ে কাঁমড় বসাল। ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বলে উঠল,

“ উহ!সে তো এখন প্রেমিকার সাথে প্রেমালাপ করতে গেছে দাদী৷ এখন বোধহয় পাবা না তাকে আর। ”

জ্যোতির দাদী মুখ কুঁচকালেন।সাঈদের রসালো হাসিযুক্ত কথার বিনিময়ে বিরস গলায় বললেন,

“ প্রেম করতে গেলে বাপ মায়ের কবরে ক্যান যাইব কেউ? এই জ্যোতি যা তো রাজকে ডাইকা আন। আমি একটু আগেই ওরে দেইখা আসছি ওর বাপ মায়ের কবরের সামনে।এহন হয়তো রাস্তায়ই আছে।”

জ্যোতির চোখজোড়ার দৃষ্টি মিনমিনে হলো। এতগুলো মানুষ থাকতে তাকেই কেন ডাকতে যেতে হবে?কিশোরী বয়সের পর থেকেই তো এই লোকটাকে সে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। এই লোকটার সামনে যতো কম পড়া যায় ততোই যেন ভালো ওর জন্য৷ নাহলে যদি সে মানুষটার প্রতি তার দুর্বলতা বাড়ে?মানুষটা যদি তার দুর্বলতার কিছুটা হলেও বুঝে যায়?ছিঃ ছিঃ!কি বিচ্ছিরি কান্ড হবে৷ তাই তো আজও বাঁধ সাধল৷ নরম গলায় শুধাল,

“ আমি তো এখানে কাজ করছি দাদী। মিথিকে ঘুম থেকে ডেকে পাঠাই?”

মুহুর্তে দাদীর তীক্ষ্ণ স্বরে কথা আসল,

“ ও এহনো ঘুমায়। উঠব না। তুই ডাইকা আনলে কি হইব?”

জ্যোতি মিইয়ে গেল। দাদীর এই তীক্ষ্ণ স্বরের আদেশ সম্বন্ধে জানে বলেই ফের আর কিছু বলল না। গায়ের ওড়নাটা ভালোভাবে মাথায় টেনে নিয়েই ছোট ছোট পা ফেলে চলে গেল মেহেরাজকে ডাকতে। অবশেষে কুয়াশায় আচ্ছন্ন সকালে গিয়ে মেহেরাজের সম্মুখীন হয়ে দাঁড়াল ও রাস্তার মাঝখানে। দাদী পিঠা খাওয়ার জন্য ডেকেছে বলেও দিল স্পষ্টভাবে। কিন্তু বিপত্তিটা ঘটল ফেরার জন্য উদ্যত হতেই। কে জানত ওড়নাটা ঐ ঝোপের সাথে আটকাবে?

জ্যোতি তপ্তশ্বাস ফেলল।কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই উঠোনে এসে দাঁড়াল। অবশেষে ভাবনার ধ্যান ভাঙ্গল মেহুর ডাকে। মুহুর্তেই সচেতন চোখে মেহুর দিকে তাকাতেই মেহু বলে উঠল,

“ এতোটা সময় কি করছিলি জ্যোতি? ”

জ্যোতি মৃদু স্বরে বলতে নিল,

“মেহেরাজ ভাইকে ডাক…”

বাকিটা বলা হলোনা তার। চোখে পড়ল কিছুটা সামনেই বসা মেহেরাজকে। শান্ত চোখের শীতল দৃষ্টি যেন একপলক তাকেই দেখে নিল। জ্যোতি শুকনো ঢোক গিলল।দৃষ্টিটা এতোটাই শীতল বোধ হলো যেন এই শীতলতার আড়ালে ভয়ানক এক আভা টের পেল সে। আবারও অপরাধবোধে ইতস্থত বোধ করল সে। মেহু তাড়া দেখিয়ে জ্যোতিকে বসতে বলেই বলল,

“ভাইয়াতো আরো কয়েক মিনিট আগেই চলে এসেছে।আমি আরো তোকে খুঁজছিলাম।”

জ্যোতি বসল। বলল,

“ কেন আপু? কোন দরকার? ”

“ উহ তাড়াহুড়োই গায়ের শালটাতো নিয়ে যাসনি। শীত করছে না?তখনও দেখলাম শীতের পোশাক না পরে দিব্যি বসে ছিলি।”

জ্যোতি এবার কিঞ্চিৎ হাসল।উত্তর দিল,

“ তখন উনুনের ধারে থাকার কারণে উনুনের তাপে শীত করেনি আপু।সেজন্য আর শাল পরিনি। তবে এখন অবশ্যই শীত লাগছে।”

সাঈদ ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে এগিয়ে এল। মেহুর পাশাপাশি বসে বল উঠল,

“ তোমার আপুও শীতল, তুমিও শীতল। দুই শীতলতা একসাথে থাকলে তো শীত করবেই জ্যোতি। তাই উষ্ণতা দিতে স্বয়ং আমি চলেই আসলাম।”

জ্যোতি কিঞ্চিৎ হেসে মেহুর দিকে চাইল।এই দুইজনের সম্পর্কটা তার ভালোই লাগে। এই কয়েকমাসে এইটুকু অন্তত জানে যে এদের দুইজনের মাঝে কিছু একটা আছে। তবে মেহু তা কোনকালেই স্বীকার করে না।কেন যে করে না কে জানে!জ্যোতির হাসিটা দেখে মেহু ততক্ষনে রেগে তাকাল সাঈদের দিকে। ফোঁসফাঁস শ্বাস ছেড়ে বলে উঠল,

“ সাঈদ ভাইয়া, আপনার মতো আগুন হলেও সমস্যা কিন্তু। ”

সাঈদ চোখ টিপল। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,

“ আমি যে আগুন তা স্বীকার করছো তাহলে? তোমার হৃদয় জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাঁই করতে পেরেছি তাহলে বলো? ”

মেহু তীক্ষ্ণ চাহনি ফেলল এবারে। দৃঢ় গলায় শুধাল,

“ তা অতো সহজ না সাঈদ ভাইয়া।”

সাঈদ মিটমিটিয়ে হাসল। মেহুর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,

“সমস্যা নেই, সহজ করে নিব। শীতলতাকে আগুনের স্পর্ষে এনে উষ্ণ করে তুলব। ”

মেহু এবারে আর কিছু বলতে পারল না। সহসা লজ্জ্বায় লালাভ হয়ে উঠল তার মুখ।কানজোড়া যেন উষ্ণ অনুভব হলো । মুহুর্তেই মুখের সে লজ্জ্বারাঙ্গা রং লুকাতে অন্যপাশে ফিরল মেয়েটা। নম্রভাবে মাথা নুইয়ে রাখল নিচের দিকে। সাঈদ তা দেখে বাঁকা হাসল। কানের কাছে ফের ফিসফিসিয়ে বলল,

“ এত লজ্জ্বা? উহ!”

মেহু জানে এই লোককে সুযোগ দেওয়া মানেই লজ্জ্বার সাগরে এই লোক ডুবিয়ে মারবে। তাই নিজের লজ্জ্বা যথাসম্ভব লুকানোর চেষ্টা চালিয়েই শক্ত গলায় বলল,

“ আপনি একটু বেশিই কথা বলেন সাঈদ ভাইয়া। আপনার মতো কেউ এভাবে বকবক করছে না কিন্তু এখানে। ”

ফের বাঁকা হেসে বলল সাঈদ,

“কিন্তু তুমি তো সেসব বকবক শুনতে ইচ্ছুক। ইচ্ছুক নও বলো? ”

মেহু দাঁতে দাঁত চাপল। ফোঁসফাঁস শ্বাস ছেড়ে বলল,

” ইচ্ছুক নই। ”

.

মিথির ঘুম ভাঙ্গল ঘরের বাইরে কোন ছেলে কন্ঠের গান শুনে।চোখজোড়া বন্ধ রেখেই ভাবার চেষ্টা করল কন্ঠটা কার।মিনার ভাই?কিন্তু মিনার ভাইয়ের গানের গলা নিশ্চয় এমন ভেড়ার মতো হবে না? তাহলে? উহ!গানের গলাটা এই মুহুর্তে সত্যিই তার কাছে ভেড়ার গলাই বোধ হলো। তাই তো বিরক্তে কপাল কুঁচকে একপলক জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই চোখে পড়ল চেনাপরিচিত কিছু মুখ। মুহুর্তেই শোয়া ছেড়ে উঠে বসল। দ্রুত পায়ে ঘর ছেড়ে বাইরে এসেই ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“ কি আশ্চর্য!এভাবে ভেড়ার গলায় গান গাইছে কে? ”

সাঈদের গান থামল সঙ্গে সঙ্গেই।সে গান গাইতে পারে না এটা পুরোনো কথা।তার গলায় গান মানায় এটাও ঠিক। কিন্তু তাই বলে তার গলাকে সোজা ভেড়ার গলার সাথে তুলনা করে দিল? কি আশ্চর্য! কে এই মেয়ে! ঘাড় বাঁকিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই চোখে পড়ল মুখ চোখ কুঁচকে রাখা সেই ষোড়শী মেয়েকে। চোখে মুখে কি ভীষণ বিরক্তি তার।মেয়েটা নির্ঘাত তার থেকে নয়-দশ বছরের ছোট হবে। এত ছোট পিচ্চি একটা মেয়ের কাছে এমনভাবে সাংঘাতিক অপমানিত হয়ে মুখ থমথমে হয়ে এল যেন। বিরস গলায় শুধাল,

“ কে তুমি রমণী? গানের গলা সম্বন্ধে তোমার কিই বা ধারণা আছে যে তুমি এই চমৎকার কন্ঠের মানুষটিকে ভেড়ার সাথে তুলনা করলে? ”

মুহুর্তেই হাসির রোল পড়ল আশপাশে। মেহু মিথির পক্ষ নিয়ে শুধাল,

“সত্যিই গলাটা ভেড়ার মতোই। আমি মিথির সাথে একমত!”

আহা!মিথি কথাটা শুনেই মনেপ্রাণে খুশি হয়ে গেল।লোকটাকে সে যদিও চিনে না। তবুও অচেনা মানুষের কাছে ঝগড়ায় হেরে যাওয়াটা অপমানজনক। সে যেভাবেই হোক অপমানিত হতে চায় না কারোর কাছে।দুই পা এগিয়ে লোকটাকে ভালোভাবে খেয়াল করল এবারে। নিঃসন্দেহে লোকটা সুদর্শন। বলা চলে মেহেরাজ, মিনার সবার থেকেই সুদর্শন। কিন্তু গায়ের রংটা যেন একটু বেশিই ফর্সা। মুহুর্তেই মুখ কুঁচকে বলে ফেলল সে,

“ লোকটা তো দেখতেও ভেড়ার মতোই। ভেড়ার মতো দেখতে লোকের ভেড়ার মতো গলা বেমানান নয়। তবে আপনার ভেড়ার মতো গলায় এই মুহুর্তে গান শুনতে বেমানান লাগছে ভেড়াসাহেব!”

সাঈদের মুখটা এবার চুপসে যেতে যেতেও চুপসে গেল না। যে রূপ দেখে সব মেয়ে প্রেমের স্বপ্ন দেখে সেই রূপই ভেড়ার মতো বলে দিল এই মেয়ে? রাগ জমল সাঈদের। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“ এই মেয়ে, ভেড়া চেনো তুমি?দেখেছো কখনো?আমার তো সন্দেহ হচ্ছে তুমি ঠিকঠাক চোখে দেখতে পাও কিনা। ”

মিথি ফুঁসে উঠল। বলল,

“ অবশ্যই ঠিকঠাক দেখতে পাই। মেহু আপু তোমরা এই ভেড়াকে কোথায় থেকে আমদানি করেছো?”

মেহু হাসল৷ উত্তরে মৃদু স্বরে বলল,

“ভাইয়ার বন্ধু উনি। ”

মিথির বিশ্বাস হলো না।সন্দিহান গলায় বলে উঠল,

“ মেহেরাজ ভাইয়ের বন্ধু?মেহেরাজ ভাই?তোমার বন্ধু এ?সত্যি?”

শেষের কথাটা মেহেরাজে দিকে তাকিয়ে মেহেরাজকে উদ্দেশ্য করেই বলল। মেহেরাজ এবারে চাপা হাসল। ভরাট গলায় উত্তর দিল,

“ সত্যিই।”

মিথি অবিশ্বাস্য চোখে একবার মেহেরাজ তো একবার সাঈদের দিকে তাকাল।ঠোঁট বাঁকিয়ে শুধাল,

“ অসম্ভব। তুমি কত ভালো। ”

সাঈদ ফোঁড়ন কেঁটে বলে উঠল,

“ আমি কি খারাপ? ”

“ অবশ্যই খারাপ!”

কথাটা বলেই হনহন করেই আবারো ঘরে ডুকে গেল মিথি। সাঈদ ফোঁসফাঁস শ্বাস ফেলল৷ মনে মনে এই মেয়ের প্রতি অদৃশ্য এক রাগ জম্মাল কেন জানি। এইটুকু মেয়ে তাকে এভাবে অপমান করে চলে গেল? মেনে নেওয়া যায়?

.

বিকালের দিকে মেহুর কথাতেই জ্যোতি মেহুদের বাড়িতে এল। পা বাড়িয়ে মেহুর ঘরের দিকে যাবে ঠিক তখনই সামনে এসে উপস্থিত হলো সামান্তা। হাতে ছোট্ট একটা কাগজ।জ্যোতির দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,

” জ্যোতি? একটা সাহায্য করে দিবে আপুর? ”

জ্যোতি উপরনিচ মাথা দুলিয়ে মুহুর্তেই উত্তর দিল,

“ হ্যাঁ আপু, অবশ্যই।”

সামান্তা হাসল।ব্যস্তহাতে কাগজটা জ্যোতির হাতে দিয়ে মৃদুস্বরে বলল,

“মেহেরাজ ভাই ছাদে অপেক্ষা করছেন আমার জন্য। এই কাগজটা সরাসরি দিলে উনার কি প্রতিক্রিয়া হবে জানা নেই আমার।আমার হয়ে উনকে এই কাগজটা দিয়ে আসতে পারবে?বলে দিও আমি দিয়েছি এটা।”

জ্যোতি তপ্তশ্বাস ফেলল।যে লোকের সম্মুখীন হতে চায় না বারবার সে লোকের সামনেই কেন যেতে হবে তাকে? উহ!পরমুহুর্তেই আবার ভেবে নিল সকালের ঘটনার জন্য স্যরিও বলা হয়ে যাবে। বিষয়টা ভেবে নিয়েই কাগজ নিয়ে মৃদু পায়ে পা বাড়াল। ছাদের এককোণে এসেই দেখা মিলল মেহেরাজের। মৃদুস্বরর প্রথমেই বলে নিল,

“ মেহেরাজ ভাই? সকালের ঘটনার জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত।না বুঝেই বলে ফেলেছিলাম।”

মেহেরাজ পেঁছন ফিরে তাকাল। একনজর দেখে নিল জ্যোতিকে। পরমুহুর্তেই সকালের ঘটনা মনে করে ত্যাড়াকন্ঠে জবাব দিল,

“ তো তুই কি দুইবছরের বাচ্চা মেয়ে যে না বুঝেই বলে ফেলেছিস?”

জ্যোতি সরু চোখে চাইল। বিষয়টা নিয়ে কথা বাড়ালে কথা বাড়তেই থাকবে বুঝে নিয়ে হাতের কাগজটা মেহেরাজের দিকে এগিয়ে থমথমে স্বরে বলল,

“ আমি সত্যিই দুঃখিত। এবার বাকিটা আপনার বিষয়। আর এই কাগজটা আপনার জন্য দি…”

জ্যোতির বাকিটা বলা হয়ে উঠল না। তার আগেই সম্মুখের মানুষটি ভ্রু উঁচিয়ে তাচ্ছিল্যের স্বরে জিজ্ঞেস করল,

“ প্রেমপত্র নাকি?”

জ্যোতির মুখ কালো হলো।সরাসরি মেহেরাজের দিকে তাকিয়ে স্পষ্টকন্ঠে জানাল,

“ আপনি কাগজটা দেখলেই তো বুঝতে পারবেন। আমি জানি না ঠিক কিসের কাগজ।”

মেহেরাজ ততক্ষনে কাগজটা নিয়ে নিয়েছে। বিনিময়ে উত্তর না দিয়ে কাগজটা মেলে ধরে ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিল। কপালে ভাজ তুলে বিরক্তির সুরে বলল,

“বয়স কত তোর? ”

জ্যোতি ইতস্থত বোধ করল এবারে। হঠাৎ বয়স জিজ্ঞেস করল কেন? উত্তরে বলল,

“ বিশ। কেন? ”

“ তোর বয়সটা প্রেমের বয়স সে নাহয় বুঝলাম। কিন্তু তোকে তো প্রেমে পিঁছলে পড়া মেয়ে হিসেবে জানতাম না৷ ভালো হিসেবেই জানতাম এতকাল আমি।”

জ্যোতি কিছুই বুঝল না। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

“ মানে? ”

মেহেরাজ চোয়াল শক্ত করল। গম্ভীর কন্ঠে অদৃশ্য, অপ্রকাশিত ক্রোধ ঢেলে বলে উঠল,

” এভাবে প্রেমপত্র লিখে ছেলেদের মন জয় করার চেষ্টা করাটা কি সভ্যতার পরিচয়? তোকে এসব সভ্যতা কে শিখিয়েছে? তোর এসব ছ্যাঁছড়ার মতো অসভ্যতার কথা তোর দাদীকে বলব আমি?

জ্যোতি চোখ ছোট ছোট করে চাইল। বিনিময়ে কিছু বলার আগেই মেহেরাজ দ্রুত তাকে এড়িয়ে চলে গেল।উহ! সকালে মেহেরাজকে করা অপমানের থেকেও যেন এই অপমানটা ঢের জঘন্য। কাগজটা যে সে দেয়নি, সামান্তা আপু দিয়েছে তা তো বলা হলো না। এইমাত্র যে মেহেরাজ এতগুলো কথা বলে গেল এগুলো কি সব জেনেবুঝেই বলে গিয়েছে? এখন সে যদি ফের বলে, “আপনি কি দুইবছরের বাচ্চা ছেলে যে না জেনেই কথাগুলো বলে ফেলেছেন? ”

#চলবে…..…?

এক_মুঠো_প্রণয় সিজন-০১ পড়তে লেখাটি উপর ক্লিক করুন

গোধূলি লগ্নে হলো দেখা পর্ব-০৮ এবং শেষ পর্ব

0

#গোধূলি_লগ্নে_হলো_দেখা
#Last_Part
#ইয়াসমিন_খন্দকার

“আপনিই ইচ্ছা করে আমায় চিংড়ি খাইয়েছেন তাই না? কেন করলেন এমন?”

মান্যতার প্রশ্নের সামনে জুবুথুবু হয়ে যায় ম্যানিলা। কি বলবে কিছু খুঁজে পায় না। সে যে এভাবে ধরা পড়ে যাবে সেটা কখনোই ভাবতে পারে নি। ম্যানিলা আমতা আমতা করে বলে,”আমি কিছু করিনি। তুমি বিশ্বাস করো আমায়।”

“চুপ, একদম চুপ। আপনি যে এমন করেছেন তার সব প্রমাণ আছে আমার কাছে। ”

“প্র.প্রমাণ মানে? কিসের প্রমাণ আছে তোমার কাছে?”

“আপনি কি ডিস অর্ডার করেছিলেন সেটা আমার স্পষ্ট মনে আছে। আর আমি অনলাইনে সার্চ দিয়ে দেখেছি সেই খাবারে চিংড়ি থাকে। এছাড়াও কি আপনার আর কোন প্রমাণের দরকার আছে?”

“হ্যাঁ, আমিই ইচ্ছাকৃত ভাবে তোমায় চিংড়ি মেশানো খাবার খাইয়েছিলাম। এবার যা করবে করো যাও।”

“আপনি কেন এমন করলেন?”

“কারণ আমি ভালোবাসি অনুরাগকে। ওর পাশে আমার কাউকে সহ্য হয়না, কাউকে না।”

“তাই বলে আপনি একজনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবেন?”

“হ্যাঁ, প্রয়োজনে তাই করব। তোমার তাতে কি?”

“আপনার এই সব ব্যাপারে আমি অনুরাগকে জানাব তারপর অনুরাগই আপনার শাস্তির ব্যবস্থা করবে।”

“তোমার কি মনে হয় অনুরাগ তোমায় বিশ্বাস করবে? দুই দিনের একটা মেয়ে হয়ে তোমার এত পাওয়ার? অনুরাগ আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ও আমায় অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। ও আমাকে অবিশ্বাস করবে না।”

“তোমাকে বিশ্বাস করাই আমার জীবনের সব থেকে বড় ভুল ছিল ম্যানিলা।”

“অনুরাগ তু..তুমি।”

“হ্যাঁ, আমি। তোমার সব কথা আমি শুনেছি। ছি! ম্যানিলা ছি! তোমাকে নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড ভাবতেও আমার লজ্জা লাগছে।”

ম্যানিলা অনুরাগের কাছে গিয়ে বলতে থাকে, “বিশ্বাস করো অনুরাগ এই সব মিথ্যা। এই মেয়েটা আমার নামে মিথ্যা এলিগেশন দিয়েছে।”

“বিশ্বাস আর তোমাকে? কখনোই না। তুমি আমার বিশ্বাস ভঙ করেছ। তোমাকে আর কোনমতেই বিশ্বাস করা যায়না। এক্ষুনি বেরিয়ে যাও এখান থেকে। তুমি আমার বন্ধু জন্য তোমাকে এযাত্রায় ছেড়ে দিলাম। নাহলে তোমায় আমি পুলিশে সোপর্দ করতাম।”

“অনুরাগ..”

“চুপ আর একটা কথাও না। বেরিয়ে যাও নাহলে তোমায় আমি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেব।”

ম্যানিলা কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে যেতে থাকে। যাওয়ার আগে মান্যতার দিকে তাকিয়ে মনে মনে থাকে,”তোমাকে আমি কিছুতেই অনুরাগের সাথে সুখে থাকতে দেব না মান্যতা। এর শেষ আমি দেখেই ছাড়ব। অনুরাগ যদি আমার না হয় তাহলে আমি ওকে কারো হতে দেবো না কারোই না।”

~~~~
মান্যতা ইদানীং অনুরাগের সাথে বেশ মানিয়ে নিয়েছে। অনুরাগের তার প্রতি কেয়ার, ভালোবাসা এসব দেখে সে ভিনচেঞ্জোকে ভুলে অনুরাগকে ভালোবাসতে শুরু করেছে।

মান্যতার এই পরিবর্তন অনেকটা সুপ্ত ভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। এরমধ্যে আরেকটা সুখবর হলো আগামী মাসেই তাদের শুভ পরিণয় অর্থ্যাৎ তাদের বিয়ে।

মান্যতার দিন গুলো চলে যাচ্ছে ভীষণ আনন্দ ও উদ্দীপনায়। আজ অনুরাগ তাকে বলেছে সে মান্যতাকে নিয়ে ঘুরতে যেতে চায়। মান্যতাকে নাকি কি সারপ্রাইজ দেবে। মান্যতাও অনুরাগের সাথে যেতে রাজি হয়েছে।

মান্যতাকে নিয়ে আজ ভেনিস শহরে এলো অনুরাগ। ভেনিস শহরের সৌন্দর্য মান্যতাকে মুগ্ধ করল ভীষণভাবে। মান্যতা হারিয়ে গেল ভেনিসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যেই। এরমধ্যে গোধূলি এসে কড়া নাড়ছিল প্রকৃতির বুকে। অনুরাগ হঠাৎ করে মান্যতার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,”আজ কেন আমি তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি জানো?”

“না, কেন?”

“কারণ আজ আমার জীবনে একটি বিশেষ দিন। আজকের দিনেই আমি তোমাকে প্রথম দেখেছি?”

“কি আমাদের দেখা গোধূলি লগ্নে হয়েছিল?”

“হুম। এরকমই এক গোধূলি লগ্নে।”

“আমার তো সেটা মনে নেই।”

“তোমার মনে নাই থাকার কথা। আসলে এটা দুই বছর আগের কথা।”

“কিন্তু আপনার সাথে তো আমার ৫ মাস আগে প্রথম দেখা হয়।”

“উহুম। তুমি ভুল জানো সেটা। আমি তোমায় প্রথম দেখি আজ থেকে দুই বছর আগে। সেবার কিছু জরুরি কাজে বাংলাদেশে গিয়েছিলাম আমি। সেদিন গোধূলি লগ্নে তুমি স্কুল থেকে কাধে ব্যাগ নিয়ে ফিরছেলে। ষড়োষী এক রূপসী তরুণী। যার রূপ লাবণ্য আমার মনে অদ্ভুত ঢেউ তুলেছিল। তারপর না ঠিকমতো খেতে পেরেছি আর না ঘুমাতে। সর্বক্ষণ শুধু তোমার কথা মনে পড়ত। আমি তোমায় অনেক খুঁজেছি কিন্তু কে জানত যে তুমি আমার নিজেরই খালাতো বোন! ভাগ্যিস আম্মু আমায় তোমার ছবি দেখিয়েছিল। নাহলে তো আমি তোমায় আজও খুঁজে পেতাম না।”

“তার মানে..”

“হুম, আমি তোমায় ভালোবাসি। আরো অনেক আগে থেকে।”

মান্যতার মুখে লাল আভায় ছেয়ে যায়। হঠাৎ তার মনে হয় এবার তার সত্যি বলা উচিৎ। তাই সে অনুরাগকে বলে,”আমারও আপনাকে একটা সত্য বলার ছিল।”

“জানি তুমি কি বলবে ভিনচেঞ্জোর কথা তাই তো?”

“আপনি জানেন এটা?”

“অনেক আগে থেকেই জানি। তোমার জ্ঞাতার্থে এটাও জানিয়ে রাখি আমিই ভিনচেঞ্জো।”

“কি!”

হতবাক হয়ে বলে মান্যতা।

“কেন বিশ্বাস হচ্ছে না? দাঁড়াও আমি প্রমাণ দিচ্ছি।”

বলেই একটি ভিডিও রেকর্ড চালু করে। যেখানে অনুরাগ গান গাইছে। এসব দেখে তো মান্যতা বিশ্বাসই করতে পারছে না। তারমানে অনুরাগই তার প্রিয় ভিনচেঞ্জো। যাকে সে এতদিন গোপনে ভালোবেসে গেছে। মান্যতা আবেগাপ্লুত হয়ে অনুরাগকে জড়িয়ে ধরে।

অনুরাগ আর নিজেকে সামলে রাখতে পারছিল না। তাই সে মান্যতার অধরে অধর মিলিয়ে দেয়৷ অতঃপর তাকে কোলে তুলে নেয়। ভেনিসের একটি স্থানীয় মসজিদে গিয়ে অনুরাগ ও মান্যতা বিয়ে করে নেয়। মান্যতাকে নিয়ে এরপর অনুরাগ পৌঁছে যায় ভেনিসের একটি হোস্টেলে। সেখানেই তারা সেদিন রাত্রি অতিবাহিত করে। রচিত করে ভালোবাসার এক অমর কাব্য।

~~~~
আজ অবশেষে সেই শুভ দিন চলেই এলো! আজ অনুরাগ ও মান্যতার চার হাত এক হওয়ার দিন। আনুষ্ঠানিক ভাবে তাদের বিয়ে হবে। সকাল থেকেই অনুরাগের বাড়ির লোকজন তাই সবাই নিজেদের কাজে ব্যস্ত। মান্যতার মা-বাবাও এসে পড়েছে।

মান্যতা অনুরাগের রুমে গিয়ে তাকে আলিঙ্গন করে। অনুরাগ মান্যতাকে বলে,”তোমাকে এত মনমরা লাগছে কেন সুইটহার্ট?”

“কেন জানি আমার মনে হচ্ছে আজ খুব খারাপ কিছু হতে চলেছে।”

“কিছু হবে না সুইটহার্ট। তুমি চিন্তা করো না।”

মান্যতার মন কেন জানি মানছিল না৷ তার বারবার মনে হচ্ছিল কিছুতো খাবার একটা হবেই।

এরইমধ্যে বিয়ের আগে সে চলে যায় পার্লারে সাজগোজ করতে। পার্লার থেকে তৈরি হয়ে মান্যতা চলে যায় একটি স্থানীয় হসপিটালে। অনেক দিন থেকেই তার মন খুঁত খুঁত করছিল। তাই সে আজ সত্যটা নিশ্চিত করতেই এখানে এসেছে।

মান্যতা চেক আপের পর বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে রওনা দেয়। সে যেটা ভেবেছিল সেটাই হয়েছে রিপোর্ট পজেটিভ এসেছে। মান্যতা ফোন লাগায় অনুরাগকে। অনুরাগ ফোন রিসিভ করা মাত্রই সে বলে,”আপনাকে একটা জরুরি কথা বলার ছিল।”

“হ্যাঁ, বলো। এসে জানাচ্ছি।”

বলেই ফোন রেখে দেয় মান্যতা। এরইমধ্যে সে লক্ষ্য করে গাড়িটা অন্য দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মান্যতা ড্রাইভারকে বলতে থাকে,”আপনি আমায় এদিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? রাস্তা তো ঐদিকে।”

“এদিকে শর্টকার্ট।”

“ওহ।”

মান্যতা আর কথা বাড়ায় না। গাড়িটা তাকে নিয়ে একটি নির্জন স্থানে পৌঁছে যায়। সেখানেই গাড়িটি থামে। মান্যতা বলে,”এটা আপনি আমায় কই নিয়ে এলেন?”

ড্রাইভার নিরুত্তর। এরমধ্যে ম্যানিলা এসে গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে পড়ে। তাকে দেখে মান্যতা ঘাবড়ে গিয়ে বলে,”আপনি..!”

“হ্যাঁ, আমি। কিছু হিসাব বাকি ছিল যে সেটাই পূরণ করতে এলাম।”

মান্যতা কি করবে বুঝতে পারে না। এরমধ্যে তার ফোন বেজে উঠলে মান্যতা সেটা রিসিভ করে নেয়। কিন্তু ম্যানিলা ফোন কেড়ে নিয়ে অনুরাগকে বলে,”তোমার মান্যতা এখন আমার কব্জায়। আমি তোমাকে লোকেশন পাঠিয়ে দিচ্ছি পারলে চলে আসো। এসে বাঁচিয়ে নেও তোমার মান্যতাকে!”

বলেই অট্টহাসিতে মেতে ওঠে। মান্যতাকে টেনে হিচড়ে গাড়ি থেকে নামায় ম্যানিলা। তার সাথে চার-পাঁচজন গুন্ডাও ছিল। ম্যানিলা মান্যতার চু**লের মুঠি ধরে তাকে চ*ড় থাপ্পড় মা*রতে থাকে। মান্যতাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য একটি ব্লেড দিয়ে মান্যতার মুখে চোখে ইচ্ছা মতো আঁচড় দিতে থকে। মান্যতার আর্তনাদে সব কেপে ওঠে। ম্যানিলা যেন সা*ইকো হয়ে ওঠে। এতেও সে শান্তি পায়না। একটা কলম হাতে নিয়ে মান্যতার ডান চোখে আঘা**ত করে চোখ আউলে দেয়। তারপর মান্যতার পায়ে ভারি কিছু একটা দিয়ে আঘাত করে। মান্যতা কাতড়াতে থাকে। মান্যতা অনুনয় বিনয় করে বলে,”প্লিজ আমায় মে**রো না।। আমি অনুরাগের সন্তানের মা হতে চলেছি। আমার বাচ্চার জন্য হলেও আমায় বাঁচতে দাও।”

এই কথা ম্যানিলাকে আরও ক্ষিপ্ত করে তোলে। ম্যানিলা হাতে একটি রড তুলে নিয়ে মান্যতার পেটে ঢু**কিয়ে দেয়। মান্যতার মুখ দিয়ে এক দলা রক্ত বের হয়ে। ম্যানিলা এতেও ক্ষান্ত হয়না এক এক করে দশবার মান্যতার পেটে র*-ড ঢুকিয়ে দেয়। মান্যতা ততক্ষণে নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। তার পরাণপাখি উড়াল দিয়েছে। তাও ম্যানিলা থামছে না।

অনেকক্ষণ পর গিয়ে ম্যানিলা থামে। ততক্ষণে অনুরাগও পুলিশকে নিয়ে সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছে। সকলে এই ভয়াবহ হ**ত্যা**যজ্ঞ দেখে থমকে গেছে। অনুরাগ মান্যতার কাছে যেতে নিলে পুলিশ তাকে বাঁধা দেয়। অনুরাগ আকাশ বাতাস কাপিয়ে কাঁদতে থাকে। চিৎকার করে ম্যানিলার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”এটা কি করলে তুমি? কেন করলে? তোমায় ক্ষমা করে দেওয়াই আমার জীবনের সবথেকে বড় ভুল ছিল। যার জন্য আমার মান্যতা…আমি তোমাকে এর শাস্তি দেবোই।”

“তোমায় শাস্তি দিতে হবে না। আমি নিজেই নিজেকে শাস্তি দেব। আমি তো এটাতেই খুশি যে মান্যতা তোমার হয়নি।”

বলেই একটা ব**ন্দুক বের করে নিজের কপালে চালিয়ে দেয়। সাথে সাথেই মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে সে। অনুরাগ মান্যতার নিথর দেহর দিয়ে তাকিয়ে কাঁদতে থাকে। পুলিশ তাকে তার মান্যতার কাছে যেতে বাধা দিচ্ছে। কিন্তু অনুরাগ জানে সে ডাকলে তার মান্যতা আর সাড়া না দিয়ে থাকতে পারবে না…পুলিশ অনুরাগকে মান্যতার পাশেই যেতে দিলো না। মান্যতার দেহটা নিয়ে চলে গেল। অনুরাগ সেখানেই পড়ে রইল। হঠাৎ করে তার সামনে একটি কাগজ উড়ে এলো। মান্যতা কাগজটা কুড়িয়ে দেখে এটা প্রেগ্ন্যাসি টেস্টের রিপোর্ট। রিপোর্ট পজেটিভ। তাহলে কিন্তু মান্যতা তাকে এটাই জানাতে চেয়েছিল। অনুরাগ আরো বেশি কষ্ট পেতে লাগল। তার মান্যতা, তার অনাগত সন্তান দুজনকেই সে হারিয়ে ফেলল নিজের একটা ভুলের জন্য…ম্যানিলাকে ক্ষমা না করে দিলে হয়তো তাকে আর এই দিন দেখতে হতো না…

POV~~ক্ষমা একটি মহৎ গুণ হতে পারে কিন্তু সবাইকে ক্ষমা করতে নেই। কিছু কিছু মানুষকে ক্ষমা করে দিলে পরবর্তীতে তারা আপনার জীবনে এমন অপূরণীয় ক্ষতি করে দিয়ে যাবে যা আর কখনোই পূরণ হবার নয়।

The End

গোধূলি লগ্নে হলো দেখা পর্ব-০৭

0

#গোধূলি_লগ্নে_হলো_দেখা
#Part_7
#ইয়াসমিন_খন্দকার

ম্যানিলা দৌড়ে ছুটে এসে অনুরাগকে আলিঙ্গন করে। মিহি কন্ঠে বলে,”আমাকে ভুলে গেলে এনি? আমাকে না জানিয়েই এভাবে এনগেজমেন্ট করে নিচ্ছ।”

অনুরাগ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে মান্যতার দিকে তাকায়। মান্যতা কিচ্ছু বুঝতে না পেরে থতমত খেয়ে তাকিয়ে আছে। অনুরাগ ম্যানিলাকে বলে,”তুমি আসবে আগে জানালে না তো! নিউইয়র্ক থেকে কবে ফিরলে?”

“আজকেই ফিরলাম। এসেই সোজা তোমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য এখানে চলে এলাম। এখানে এসে তো আমিই সারপ্রাইজড হয়ে গেলাম।”

কথাটা বলেই অনুরাগকে ছেড়ে দেয় ম্যানিলা। অনুরাগ স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়। যদিও বিদেশে এটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা৷ এভাবে ছেলে-মেয়ে বন্ধুরা একে অপরকে আলিঙ্গন করতেই পারে। কিন্তু মান্যতা ব্যাপারটাকে কেমন ভাবে নেয় সেটা নিয়েই ধন্দে ছিল অনুরাগ। তাই কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে মান্যতার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলে,”ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ম্যানিলা। ও নিউইয়র্কে একজন ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে কাজ করে। ও অনেক ব্যস্ত মানুষ তো তাই ওকে আমি এ ব্যাপারে কিছু জানাই নি৷ ভেবেছিলাম বিয়ের ইনভিটেইশন কার্ড একবারে ধরিয়ে দেব কিন্তু….”

“কিন্তু আমি আগেই চলে এলাম অনুরাগ। যাইহোক, এখন যখন আমি এসে গেছি তখন আর কোন সমস্যা হবে না। তোমরা এনগেজমেন্ট কান্টিনিউ করো।”

অনুরাগ মান্যতার হাতে এনগেজমেন্ট রিং পড়িয়ে দেয়। বাইরে নিজেকে হাসিখুশি প্রকাশ করলেও এই দৃশ্য দেখে ম্যানিলার অর্ন্তদহন শুরু হয়৷ সে দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করে। মনে মনে বলে,”আমি ছাড়া তুমি আর কারো হবে না অনুরাগ কারো না। তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি অনেক কিছু করেছি, অনেক নিচে নেমেছি। এবার নাহয় আরো নিচে নামব!”

~~~
মহিউদ্দিন ও রাহেলা বেগমের মধ্যে বচসা লেগে গেছে। বিতর্কের কারণ ম্যানিলা। মহিউদ্দিন বলে চলেছেন,”তোমার বোনের ছেলের ঐ বান্ধবীকে আমার মোটেই সুবিধার লাগছে না। এইজন্য আমি এই বিয়েতে রাজি হতে চাইনি। আমার তো এখন অনুরাগের চরিত্র নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে। তুমি না ওর খুব প্রশংসা করো যে বিদেশে থেকেও নিজের সংস্কৃতি ভোলে নি তাহলে এসব কি? এভাবে একটা মেয়েকে জড়িয়ে ধরল তাও আবার এনগেজমেন্টের দিন।”

“তুমি ভুল ভাবছ। অনুরাগ মোটেই ঐ মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে নি। ঐ মেয়েটাই তো…তাছাড়া এখানে এসব স্বাভাবিক ব্যাপার। এটা তো আর বাংলাদেশ নয়।”

“ঠিক আছে, তুমি যখন আমার কথায় কোন গুরুত্ব দিচ্ছ না তখন নিজের যা ভালো মনে হয় করো। কিন্তু আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি, পরবর্তীতে যদি আমাদের মেয়েকে কোনভাবে এসবের জন্য সাফার করতে হয় তাহলে আমি কিন্তু তোমায় ছেড়ে কথা বলব না।”

~~~~~
মান্যতা কানে হেডফোন লাগিয়ে ভিনচেঞ্জোর গান শুনছিল। এমন সময় তার রুমে আসে অনুরাগ। সে এসেই বলে,”মান্যতা আমি আর ম্যানিলা আজ একটু বাইরে ঘুরতে যাচ্ছি তুমিও চলো আমাদের সাথে।”

মান্যতা কান থেকে হেডফোন নামিয়ে বলে,”কি বললেন?”

অনুরাগ আবারো নিজের কথার পুনরাবৃত্তি করে। মান্যতা উত্তরে বলে,”আপনারা যান ঘুরে আসুন। আমি যেতে ইচ্ছুক নই।”

অনুরাগ তবুও জোর করতে থাকে। কারণ সে চায়না ম্যানিলাকে নিয়ে মান্যতার মনে কোন সন্দেহ তৈরি হোক। অনুরাগের জেদের কাছে অবশেষে নতি স্বীকার করে নেয় মান্যতা। যেতে রাজি হয় অনুরাগ ও ম্যানিলার সাথে।

ম্যানিলা বাইরে দাঁড়িয়ে অনুরাগের জন্য অপেক্ষা করছিল। অনুরাগকে মান্যতার সাথে আসতে দেখে ভীষণ রেগে যায় ম্যানিলা। বিড়বিড় করে বলে,”উফ, এই ঝামেলাটা আবার কেন এসেছে! এই ঝামেলাকে আমায় দূর করতে হবে। নাহলে আমি অনুরাগকে কিছুতেই পাবো না।”

অনুরাগ ম্যানিলার সামনে এসে বলে,”মান্যতাও যাবে আমাদের সাথে।”

ম্যানিলা জোরপূর্বক হেসে বলে,”ভালোই তো। ও আমাদের সাথে রোম শহর ঘুরে দেখুক।”

`~~
তিনজনে মিলে রোমের কলোসিয়ামে এসে হাজির হয়৷ মান্যতার এসবে তেমন আগ্রহ নেই তাই সে চুপচাপ ছিল। অনুরাগকে বেশ আগ্রহী দেখাচ্ছিল৷ অন্যদিকে ম্যানিলার মনে জ্বলছিল আ*গুন। সে শুধু মান্যতাকে কিভাবে তাদের মাঝ থেকে দূর করা যায় সেটাই ভাবছিল।

কলোসিয়াম ঘোরা শেষ করে তারা সবাই গাড়িতে করে রওনা দেয়। মাঝপথে একটা ইটালিয়ান রেস্টুরেন্টে নামে তারা৷ অনুরাগের একটা জরুরি ফোনকল আসলে সে কথা বলতে একটু বাইরে যায়। এই মুহুর্তে ম্যানিলা মান্যতাকে জিজ্ঞেস করে,”বলো কি খাবে? আমি অর্ডার করে দিচ্ছি।”

“যা ইচ্ছা অর্ডার করুন। শুধু দেখবেন তাতে যেত চিংড়ি না থাকে। আসলে আমার চিংড়ি মাছে এলার্জি। এটা খেলে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়।”

ম্যানিলা যেন নিজের হাতে অস্ত্র পেয়ে যায়। মনে মনে বলে,”তাহলে তো তোমার খারাপ অবস্থা করার ব্যবস্থাই করতে হবে।”

ম্যানিলা একজন ওয়েটারকে দেখে এমন খাবার অর্ডার দেয় যেটা চিংড়ি দিয়ে বানানো। কিন্তু চিংড়িটা এমন ভাবে সুপ্ত অবস্থায় থাকে যে বোঝার উপায় নেই। তন্মধ্যে অনুরাগও চলে আসে। ওয়েটার এসে খাবার দিয়ে যায়। সবাই খাওয়া শুরু করে। মান্যতাও খেতে শুরু করে। ম্যানিলা কাউন্টডাউন শুরু করে দেয়,”১,২,৩”

তার কাউন্টডাউন শেষ হতে না হতেই মান্যতা কাশতে শুরু করে। অতঃপর হাত চুলকাতে শুরু করে দেয়। অনুরাগ মান্যতার দিকে পানি বাড়িয়ে দিয়ে বলে,”কি হয়েছে? কোন সমস্যা? এই নাও পানি খাও।”

মান্যতা পানিটা খেয়ে নেয়৷ কিন্তু তার অবস্থার উন্নতি হয় না। কাশতে কাশতে তার শ্বাসকষ্ট বন্ধ হওয়ার উপক্রম। অনুরাগ এসব দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। ম্যানিলাও উদ্বিগ্ন হওয়ার নাটক করে বলে,”আমার মনে হয় ওর কোন সমস্যা হয়েছে। তুই ওকে জলদি হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা কর।”

অনুরাগ মান্যতাকে নিয়ে গাড়িতে তোলে। ম্যানিলাও যায় তার সাথে হাসপাতালে। হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় মান্যতাকে। ডাক্তার মান্যতাকে চেক করে বলে,”ওনার তো ভয়াবহ রকমের এলার্জি হয়েছে। উনি অনেক ঝুঁকির মধ্যে আছেন এখন।”

অনুরাগ ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে খুশির ঝলক দেখা যায় ম্যানিলার মুখে। ম্যানিলা মনে মনে বলতে থাকে,”তুমি মরে যাও মান্যতা। মরে গিয়ে আমার আর অনুরাগের মধ্যে থেকে চলে যাও। অনুরাগের পাশে অন্য কাউকে যে আমার সহ্য হয়না। এর আগেও একজনকে সরিয়েছি। এবার নাহয় তোমাকে সরালাম।”

~~~~~~
চিকিৎসার পর মান্যতা এখন অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত। তার জ্ঞানও ফিরেছে। এই ঘটনার কথা পৌঁছে গেছে অনুরাগ ও ম্যানিলার কাছেও। দুজনেই ছুটে এসেছে। দুজনই ভীষণ উদ্বিগ্ন তবে তার উদ্বিগ্নতার কারণ ভিন্ন। অনুরাগ মান্যতার অবস্থা জানতে ছুটে আসছে আর ম্যানিলা নিজের কুকীর্তি ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে। ম্যানিলা সেখানে এসেই হাতজোড় করে বলতে প্রার্থনা করে বলতে লাগল,”গড, তুমি দেখো। এই মেয়ে আবার না সব সত্য বলে দেয়। তাহলে তো আমি অনুরাগের চোখে ছোট হয়ে যাব।”

~~~~~~“““““~~~~~~~
মান্যতার সাথে কথা বলে অনুরাগ বাইরে এসে ম্যানিলার মুখোমুখি হয়। ম্যানিলা ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেও শান্ত থাকে। অনুরাগ ম্যানিলাকে বলে,”তোমাকে নাকি মান্যতা বলেছিল যে ওর চিংড়িতে এলার্জি। তারপরেও তুমি চিংড়ি মেশানো খাবার অর্ডার করলে কেন?”

“অনুরাগ…আমি…বিশ্বাস করো আমি এই ব্যাপারে কিছু জানি না। আমি অন্য খাবার অর্ডার করেছিলাম। ওরাই হয়তো ভুল করে দিয়েছে।”

“কাম ডাউন ম্যানিলা। আমি জানি, তুমি এমন কিছু করবে না। আমি তোমায় বিশ্বাস করি৷ তুমি আমার বেস্টফ্রেন্ড, তুমি কেন আমার উডবি ওয়াইফের ক্ষতি চাইবে।”

ম্যানিলা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। আর মনে মনে বলে,”আমি জানি তুমি আমায় অন্ধের মতো বিশ্বাস করো অনুরাগ। তাহলে আমায় ভালোবাসা কেন? তুমি আমায় ভালো বাসলে তো আমায় এত নিচে নামতে হতো না। তবে কোন ব্যাপার না। আমি তোমাকে নিজের করে নেবোই। আর সেটা খুব শীঘ্রই। এবার সরাতে পারিনি তো কি হয়েছে খুব শীঘ্রই আমি ঐ মান্যতা নামের গারবেজকে তোমার জীবন থেকে সরিয়ে দেব।”

To be continue

গোধূলি লগ্নে হলো দেখা পর্ব-০৬

0

#গোধূলি_লগ্নে_হলো_দেখা
#Part_6
#ইয়াসমিন_খন্দকার

মান্যতাকে কাঁদতে দেখে হচকচিয়ে তাকিয়ে রইল ভেনাস। নিজের ম্যানেজারের উদ্দ্যেশ্যে বলল,”ও এভাবে কাঁদছে কেন? ও কি এখানে নিজের ইচ্ছায় এসেছে না তুমি ওকে জোর করে নিয়ে এসেছ?”

“আমি জোর করিনি স্যার৷ উনি নিজের ইচ্ছাতেই এসেছেন এখানে?”

“তাহলে উনি কাঁদছেন কেন?”

মান্যতা বলে,”আমাকে ঠকিয়ে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। আমি ভিনচেঞ্জোর কনসার্টে ছিলাম। সেখান থেকে একজন লোক আমার সাথে ভিনচেঞ্জোর দেখা করিয়ে দেবার কথা বলে এখানে নিয়ে এসেছে। আমাকে দয়া করে এখান থেকে যেতে দিন। আপনি তো আমার ভাইয়ের মতোই। নিজের বোনের কোন ক্ষতি করবেন না প্লিজ।”

বোনের কথা শুনেই ভেনাস আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। তার মনে পড়ে যায় নিজের বোনের কথা। তারও তো একটা সুন্দর পরিবার ছিল। মা-বাবা, বোন সবাই ছিল। কিন্তু হঠাৎ আসা এক ঝড়ে তার পুরো জীবনই যেন বদলে যায়। অতীত থেকে বেরিয়ে এসে ভেনাস রাগী চোখে তার ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমাকে এইজন্য রেখেছি আমি? এভাবে প্রতারণা করে মেয়েদের ধরে আনছ কেন তুমি? তোমাকে না আমি একবারেই বলেছি যেসব মেয়েরা স্বেচ্ছায় টাকার বিনিময়ে আসতে রাজি হবে তাদের নিয়ে আসবে। তাহলে এসব কি?”

“আমি কিছু জানি না স্যার। এরিয়েল এই মেয়েটাকে নিয়ে এসেছে। ও তো বলল মেয়েটা স্বেচ্ছায় এসেছে আর তাছাড়া মেয়েটার ব্যবহার দেখেও তো আমার মনে হয়েছিল যে ও জেনে বুঝেই এখানে এসেছে।”

মান্যতা কাঁদতে কাঁদতে বলে,”আমি তো ভেবেছিলাম এখানে এসে ভিনচেঞ্জোর সাথে দেখা করব। তাই তো এত স্বাভাবিক ছিলাম।”

ভেনাস তার ম্যানেজারকে আদেশের সুরে বলল,”এই মেয়েটাকে সসম্মানে ওর বাড়িতে পৌঁছে দাও।”

অতঃপর মান্যতার দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমি আমায় ভাই বলেছ, তাই আমিও তোমাকে নিজের বোন মনে করেই একটা পরামর্শ দিচ্ছি। এভাবে অচেনা কাউকে বিশ্বাস করো না। পৃথিবীটা অনেক জটিল যায়গা। এখানে তো আপনজনদেরই বিশ্বাস করা যায়না সেখানে অচেনা মানুষ তো দূর। আজ যদি ঐ এরিয়েল তোমায় আমার কাছে না এনে অন্য কোথাও নিয়ে যেত তাহলে কি হতো একবার ভেবে দেখেছ? যাইহোক তুমি এখন সাবধানে নিজের বাড়ি যাও।”

মান্যতা কৃতজ্ঞতা সূচক দৃষ্টিতে ভেনাসের দিকে তাকায়। বলে,”আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি সত্যি একজন ভালো মানুষ। আমি আপনাকে নিজের ভাইয়ের মতোই দেখব।”

“আমি মোটেই ভালো মানুষ নই। তবে তোমার ভাই হতে কোন আপত্তি নেই। আমারও একটা বোন ছিল ঠিক তোমারই মতো।”

“ছিল মানে? এখন আর নেই?”

মান্যতার মুখে এমন প্রশ্ন শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে ভেনাস। নিজের ম্যানেজারের দিকে তাকায় ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে। ভেনাসের ম্যানেজার মান্যতাকে বলে,”দ্রুত আমার সাথে চলো। স্যার, রেগে যাচ্ছে।”

মান্যতা চলে যেতে থাকে। ভেনাস চোখ বন্ধ করে বলে ওঠে,”আমার সব ছিল, সব। সব হয়তো আজও ঠিক থাকতো যদি আমি ভুল মানুষকে ভালো না বাসতাম।”

`~~~
ভেনাসের ম্যানেজার মান্যতাকে অনুরাগদের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। মান্যতা অনুরাগদের বাড়িতে প্রবেশ করে। মান্যতাকে দেখেই এগিয়ে আসেন অনিতা খান। তিনি এসেই বলেন,”তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে মান্যতা? অনুরাগ বললো কনসার্টে গিয়ে তুমি নাকি হারিয়ে গেছ। ছেলেটা চারিদিকে পাগলের মতো তোমায় খুঁজছে।”

“আমি আসলে অনেক লোকের মাঝে হারিয়ে গিয়েছিলাম খালা। তারপর কয়েকজন মানুষের সাহায্য নিয়ে এখানে ফিরলাম।”

“তোমার ফোন কোথায়? তোমাকে নাকি অনুরাগ ফোন করেছিল।”

“তখন ভিড়ের মধ্যে ফোন রিসিভ করতেই পারিনি। আর পরে ফোনে চার্জও ছিলনা।”

‘ওহ। আচ্ছা, তুমি নিজের রুমে যাও। আমি অনুরাগকে তোমার ফেরার সংবাদটা দেই। না জানি ছেলেটা তোমায় কোথায় কোথায় খুঁজে চলেছে।”

মান্যতা মনে মনে বলে,”এই মিথ্যা বলা ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না৷ সত্য বললে সবাই খুব চিন্তা করত। বাড়িতে এসব জানাজানি হলে আব্বু আমায় আবার দেশে ফিরিয়ে নিতে চাইত। তাহলে তো ভিনচেঞ্জোকে পাওয়ার শেষ আশাও আমার নস্যাৎ হয়ে যেত।”

“““`
হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে ফিরে অনুরাগ। বাড়িতে এসে সোজা চলে যায় মান্যতার রুমে। মান্যতা সবে ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে নিজের রুমে প্রবেশ আসল। অনুরাগ রুমে এসেই মান্যতাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”কোথায় চলে গিয়েছিলে তুমি? জানো আমি কতটা ভয় পেয়ে গেছিলাম!”

“আপনি শান্ত হোন। আমি একদম ঠিক আছি।”

“সব দোষ আমারই। আমার উচিৎ হয়নি তোমাকে তখন এভাবে একা ছেড়ে যাওয়া।”

“আপনি নিজের দোষ দেবেন না।”

“এখন থেকে তোমাকে আমি এক মুহুর্তের জন্যেও একা ছাড়ব না মান্যতা। খুব শীঘ্রই তোমাকে নিজের করে নেব সুইটহার্ট।”

~~~`
বেশ কয়েকদিন পর,
সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফাস্ট করতে নিচে নামতেই চরম পর্যায়ের অবাক হলো মান্যতা। তার মা-বাবা ইটালিতে! মান্যতা তাদের সামনে গিয়ে হতবাক গলায় বলে,”তোমরা!”

মহিউদ্দিন বলেন,”কি চমকে দিলাম তো?”

“আম্মু-আব্বু তোমরা আসবে আমাকে জানাও নি তো?!”

রাহেলা বেগম বলে ওঠেন,”আগে থেকে জানালে কি তোমাকে এভাবে সারপ্রাইজ দিতে পারতাম!”

“ওহ, তোমরা তার মানে আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য এভাবে চলে এসেছ?”

অনুরাগ পিছন থেকে বলে ওঠে,”এর থেকে বড় সারপ্রাইজ আজ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।”

“সারপ্রাইজ?! আর কি সারপ্রাইজ?”

“সেটা আজ সন্ধ্যাতেই জানতে পারবে।”

অনুরাগের কথায় ধন্দে পড়ে যায় মান্যতা। অনিতা খান বলে ওঠেন,”মেয়েটাকে আর চিন্তার মধ্যে রেখো না অনুরাগ। ওকে সত্যিটা বলে দাও। মান্যতা আজ সন্ধ্যায় তোমার আর অনুরাগের এনগেজমেন্ট।”

“কি?! এনগেজমেন্ট!”

“হুম। কি খুশি হও নি তুমি?”

মান্যতা ভীষণই চমকে যায়।

““
“ভিনচেঞ্জো ছাড়া আমি আর কারো সাথে নিজের এনগেজমেন্ট হতে দিতে পারি না। আমি ভিনচেঞ্জো ছাড়া আর কারো নই। এই এনগেজমেন্ট টা আমায় আটকাতেই হবে।”

নিজের রুমে বসে এসবই বিড়বিড় করছিল মান্যতা। এমন সময় অনুরাগ তার দরজায় টোকা দিয়ে বলে,”ভেতরে আসতে পারি।”

“হ্যাঁ, আসুন।”

অনুরাগ রুমে এসে মান্যতার দিকে একটা শপিং ব্যাগ তুলে দিয়ে বলে,”এটা খুলে দেখো। তোমার জন্য অনেক সুন্দর একটা গিফট আছে।”

মান্যতা শপিং ব্যাগটা খুলে লাল রঙের খুব সুন্দর একটা গাউন দেখতে পায়। অনুরাগ জিজ্ঞেস করে,”পছন্দ হয়েছে?”

মান্যতা মাথা নাড়ায়।

“তাহলে আজ এনগেজমেন্টে এটাই পড়ে এসো। তোমাকে অনেক সুন্দর লাগবে এটা পড়ে। অপেক্ষায় থাকবো।”

বলেই স্মিত হেসে চলে যায় অনুরাগ। মান্যতা গাউনটা সাইডে রেখে বলে,”এখন কি আর এই এনগেজমেন্ট আটকানোর কোন উপায় নেই? উফ কি করব কিছু বুঝতে পারছি না৷ এখন সবকিছু আল্লাহর হাতে। আল্লাহ তুমি আমায় অনেক সাহায্য করেছ আর একটু সাহায্য করে দাও। এমন কিছু করো যাতে এই এনগেজমেন্ট টা আজ বাতিল হয়ে যায়। আমি মন থেকে এই এনগেজমেন্টটা মানতে পারব না। কারণ আমি যে অন্য কাউকে ভালোবাসি। তার জন্যই তো এত কিছু করা।”

~~~
একে একে অনেক গেস্ট এসে হাজির হয়েছে। আজকের সন্ধ্যাটা খুব স্পেশাল। আজ অনুরাগ ও মান্যতার এনগেজমেন্ট। অনুরাগ আজ কালো রঙের ফরমাল কোর্ট আর জিন্সের প্যান্ট পড়েছে। সে কিছু সময় পর পরই সিঁড়ির দিকে তাকাচ্ছে। তার মন উসখুস করছে কখন নিজের প্রেয়সীকে দেখতে পারবে। তার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে মান্যতাকে তার দেওয়া লাল গাউন পড়িয়ে নিচে নিয়ে আসে অনিতা খান৷ মান্যতার দিকে মুগ্ধদৃষ্টিতে অপলক তাকিয়ে থাকে অনুরাগ। যেন এক যাদুতে মুগ্ধ সে। মান্যতা এগিয়ে আসে। এনগেজমেন্টের কার্যক্রম শুরু হয়। মান্যতাকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও সব করতে হচ্ছে। মান্যতাকে পড়ানোর জন্য একটা রিং হাতে তুলে নেয় অনুরাগ। মান্যতা অনিচ্ছাকৃত হাত বাড়িয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলে,”এছাড়া আমার আর কোন উপায় নেই। এবার মনে হয় এনগেজমেন্টটা হয়েই যাবে।”

অনুপম মান্যতাকে রিং পড়াতে যাবে এমন সময় সেখানে হাজির হয় এক ভিনদেশী তরুণী৷ পরনে তার খুব ছোট একটা স্কার্ট। চুলে লাল রঙ করানো। মেয়েটি এসেই বাকা হেসে বলে,”দাঁড়াও এনি। আমাকে ছাড়া তোমার এনগেজমেন্ট কিভাবে হতে পারে?”

অনুপমের মনোযোগ সরে যায়। সে তরুণীটির দিকে তাকিয়ে অবাক কন্ঠে বলে,”ম্যানিলা তুমি!”

To be continue